hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ঈসা মসীহ ইসলামের এক নবী চার্চের বিকৃতির এক ঐতিহাসিক আলেখ্য

লেখকঃ মুহাম্মাদ আতাউর- রহীম

১৩
অষ্টম অধ্যায়: একালে খৃষ্টধর্ম
একালে খৃষ্টধর্মের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে দু’টি বিষয় মনে রাখা জরুরি। তা হলো পর্যবেক্ষণ ও অনুমান লব্ধ জ্ঞান ও মানুষের নিকট প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য। নতুন নতুন পর্যবেক্ষণ ও নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনুমান লব্ধ জ্ঞানের পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং এ জ্ঞান সন্দেহাতীত নয়। প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত দিক, অন্যটি হলো বাস্তুব দিক। অধিবিদ্যাগত জ্ঞান এক ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। অন্যদিকে বাস্তব জ্ঞান শিক্ষা দেয় আচরণবিধি। প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞান সর্বদা একজন বার্তা বাহক বা দূত কর্তৃক বহন করে আনা হয়েছে যিনি তার বাস্তব রূপ। তিনি যে পন্থায় জীবন-যাপন করেছেন সেটাই বাণী। একজন দূত বা বাণী বাহকের ন্যায় আচরণ করার জন্য সে বাণী সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। আর এ জ্ঞান হলো সন্দেহাতীত। বলা হয়, প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞানই হলো একালের খৃষ্টান ধর্মের ভিত্তি। কিন্তু কোনো বাইবেলেই যীশুর বাণী অবিকৃত অবস্থায় অর্থাৎ তার কাছে যেভাবে প্রত্যাদেশ হয়েছিল সেই আদিরূপ নেই। তার আচরণবিধির কোনো লিখিত বিবরণ কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। নিউটেষ্টামেন্টের কোনো গ্রন্থেই তার বাণী ও কর্মকান্ডের ব্যাপারে প্রত্যক্ষদর্শীর কোনো বিবরণ নেই। সেগুলো এমন লোকদের দ্বারা লিখিত হয়েছে যারা যীশুকে স্বচক্ষে দেখেননি, তাঁকে দেখছেন এমন ব্যক্তিদের কাছে শুনে তারা লিখেছেন। এসব বিবরণ সমন্বিত বা উপলব্ধিযোগ্য নয়। যীশু যা বলেছেন ও করেছেন অথচ লিপিবদ্ধ হয় নি তার সবই চিরকালের মত বিলুপ্ত হয়েছে।

নিউ টেস্টামেণ্টে বিধৃত বিষয়সমূহ যারা যাচাই করতে চান, তারা দাবি করেন যে, একটি কোনোক্রমেই সমন্বিত না হলেও ন্যূনতম পক্ষে নির্ভুল। যা হোক, একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় সবসময় মনে রাখতে হবে যে, বাইবেলের বর্তমান অনুবাদগুলো যেখান থেকে উদ্ভূত, সেই নিউ টেস্টামেণ্টের প্রাচীনতম টিকে থাকা পাণ্ডুলিপিগুলোও নিসিয়ার কাউন্সিলের পর রচিত। সাইনাইটিকাসের (Codex Sinaiticus) পুঁথি ও ভ্যাটিকানাসের (Codes Vaticanus) পুঁথির রচনাকালে চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিক। অন্যদিকে আলেকজান্দ্রিয়াসের পুঁথির (Codes Alexandrius) রচনাকাল পঞ্চম শতাব্দী। নিসিয়ার কাউন্সিলের পর যীশুর জীবনের বিবরণ সংবলিত প্রায় ৩শ’ পাণ্ডুলিপি, যার মধ্যে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণও ছিল, পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়। নিসিয়ার কাউন্সিলের ঘটনাবলী এ ইঙ্গিত দেয় যে, পলীয় চার্চ তখনও টিকে থাকা চারটি গসপেলের পরিবর্তন সাধন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এটা সুস্পষ্ট যে, নিসিয়ার কাউন্সিলের পর লিখিত নিউ টেস্টামেন্টের পাণ্ডুলিপিগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ নয় মরু সাগর পুঁথিগুলোর এমন অংশগুলোর প্রকাশের ব্যবস্থা করা হলেও পরবর্তীতে উক্ত অংশের প্রকাশনা বন্ধ করা হয়।

গসপেলগুলোর অবাস্তবতা চার্চ নিজেও স্বীকার করেছে বলেই মনে হয়। খৃষ্টধর্মের অধ্যাত্ম দর্শন আজ এমনকি গসপেল ভিত্তিকও নয়। আদি পাপ, প্রায়শ্চিত্ত ও পাপস্খালন, যীশুর ঈশ্বরত্ব, পবিত্র আত্মার ঈশ্বরত্ব ও ত্রিত্ববাদী মতবাদের ওপর ভিত্তি করে চার্চ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু গসপেলগুলোতে এসব মতবাদের কোনোটিই খুঁজে পাওয়া যায় না। যীশু সেগুলো শিক্ষা প্রদান করেন নি। এর সবই পলের আবিষ্কার এবং গ্রীক সংস্কৃতি ও দর্শনের প্রভাবের ফল। পল কখনোই যীশুর সাহচর্য লাভ করেন নি কিংবা তার কাছ থেকে সরাসরি কোনো জ্ঞান আহরণও করেন নি। তিনি ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের আগে যীশুর অনুসারীদের ওপর কঠোর নিপীড়ন চালিয়েছেন এবং যীশুর অন্তর্ধানের পর তিনি যখন খৃষ্টান ধর্মকে গ্রীসের অ-ইয়াহুদীদেরও অন্যদের কাছে নিয়ে যান, তখন যীশুর আচরণ বিধি বিপুলভাবে পরিত্যাগের জন্য তিনি দায়ী। “খৃষ্টের” রূপে যে ব্যক্তি তাকে তার নয়া মতবাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন বলে তিনি দাবি করেন তা ছিল কল্পিত। তার শিক্ষা যা কিনা যীশুর কল্পিত মৃত্যু ও পুনরুত্থান নির্ভর এমন এক ঘটনা তা বাস্তবে কখনো ঘটে নি।

মূল সম্পর্কে সন্দেহপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এসব মতবাদ “খৃষ্টান ধর্ম শিক্ষাকারী” যে কোনো ব্যক্তির জন্য অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পালনযোগ্য। যদিও অনেকেই এসব মতবাদ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু তারপরও যারা এতে বিশ্বাস স্থাপন করে তারা এই কুখ্যাত যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয় যে, “চার্চের বাইরে কোনো মুক্তি নেই।” চার্চের অধ্যাত্ম দর্শনের কাঠামো হলো: প্রায়শ্চিত্ত ও পাপ মুক্তির মতবাদ বলে যে, ঈশ্বরদের একজন খৃষ্ট মানুষের রূপ গ্রহণ করেন, তিনি যীশু নামে পরিচিত হন, অতঃপর তিনি মানবজাতির সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে মৃত্যুবরণ করেন। চার্চ বিচারের দিনে “খৃষ্টে” বিশ্বাসী সকল মানুষ ও যারা চার্চের নির্দেশনা অনুসরণ করে তাদের সকলের পাপের ক্ষমা ও মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়। উপরন্তু আরো বিশ্বাস করা হয় যে, জগতের বিলুপ্তি না ঘটা পর্যন্ত সকল মানুষের ক্ষেত্রে এই চুক্তি কার্যকর। এ বিশ্বাসের স্বাভাবিক পরিণতি এরূপ:

প্রথমত: এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী নয় এবং মৃত্যুর পর সেগুলোর জন্য সে দায়ী হবে না। কারণ সে যাই করুক না কেন তার বিশ্বাস যে, “খৃষ্টের আত্মত্যাগের” কারণে সে মুক্তি লাভ করবে। যাহোক, এর অর্থ এই নয় যে, পৃথিবীতে তার জীবন আনন্দে পরিপূর্ণ হবে। আদি পাপের মতবাদে তার বিশ্বাসের (যাতে বলা হয়েছে যে, আদমের ভুলের কারণে সকল মানুষই পাপী হয়ে জন্ম নেয়) অর্থ হলো এই যে, সে যতক্ষণ জীবিত থাকে তার অবস্থা থাকে অযোগ্যতা ও অপূর্ণতারই একটি দৃষ্টান্ত। জীবনের এই দুঃখজনক দৃষ্টিভঙ্গি জে. জি. ভস (J. G VOS) নামক একজন খৃষ্টানের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে। এতে তিনি ইসলাম ও খৃষ্টধর্মের তুলনা করেছেন:

ইসলাম এমন কিছু সেই যে, কোনো মানুষ বলবে “কি হতভাগ্য আমি মৃত্যুর পর কে আমাকে উদ্ধার করবে?” অথবা “ আমি জানি, আমি অর্থাৎ আমার এই শরীর কোনো ভালো কাজ করে নি।” যুক্তিসংগত অভীষ্ট লাভের উদ্দেশ্য সংবলিত একটি ধর্ম পাপীকে অপরাধী বিবেকের যন্ত্রণা ভোগ বা একটি সম্পূর্ণ নৈতিক মানসম্মত জীবন- যাপনে সাফল্য লাভ না করার হতাশা প্রদান করে না। সংক্ষেপে, ইসলাম একজন মানুষের মনে উত্তম অনুভূতি সৃষ্টি করে, পক্ষান্তরে খৃষ্টধর্ম অনিবার্যভাবে সৃষ্টি করে খারাপ অনুভূতি। ভগ্নহৃদয় লোকদের ধর্ম হলো খৃষ্টধর্ম, ইসলাম নয়।১

দ্বিতীয়ত: প্রায়শ্চিত্ত ও মুক্তি লাভ মতবাদে বিশ্বাস এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে যখন একজন খৃষ্টান অন্য মানুষের কাছে ঈশ্বরের প্রত্যাদিষ্ট অন্যান্য ধর্মের সাথে তার ধর্মের একটি সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে। এর অর্থ এই যে, ‘খৃষ্টের আত্মত্যাগ’ ও “বাণী” অতুলনীয় ও চূড়ান্ত এবং তিনি অন্য নবীদের শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেন না। একই সাথে তিনি সেগুলোর মধ্যে যে, সত্য খুঁজে পান তাও অস্বীকার করতে পারেন না। এভাবে একজন খৃষ্টান ইয়াহূদীধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে, আবার গ্রহণ করে ওল্ড টেস্টামেন্ট যা ইয়াহূদীদের কাছে আনীত মূসার আলাইহিস সালাম শিক্ষা থেকে উদ্ভূত। সে নিজেকে যুগপৎভাবে দু’টি পরস্পর বিরোধী বিশ্বাস গ্রহণ করার এক অসম্ভব অবস্থানে নিজেকে স্থাপিত করে। নিম্নোদ্ধৃত অংশে এর প্রমাণ মেলে: অ-খৃষ্টান ধর্মগুলোতে আপেক্ষিক ভালো উপাদান রয়েছে। মিথ্যা ধর্ম থেকে দূরে থাকার আহ্বানটি নিশ্চিতরূপেই বাইবেলের অন্যদিকে ধর্মগ্রন্থগুলোতে পৌত্তলিক ধর্মের অপদেবতাদের শিক্ষাও প্রদান করা হয়েছে... এ কথাও সত্য যে, সীমিত আপেক্ষিক ভালোর উপাদানগুলো এসব ধর্মেও রয়েছে। একথা যেমন সত্য যে, সেগুলো অপদেবতার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, একথাও আবার সত্য যে, সেগুলোর মানুষের কাছে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশের মানুষের কৃত বিকৃত ব্যাখ্যারই সৃষ্টি। যদিও সেগুলো শয়তানের কর্ম হতে পারে, তবে তা অংশিত ঈশ্বরের সাধারণ অনুগ্রহের এবং অংশিত পাপী মানুষ কর্তৃক ঈশ্বরের প্রত্যাদেশের অপব্যবহারের ফসলও বটে।২

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, ভস বাইবেল যেসব বিকৃতির শিকার হয়েছে তার সবগুলোর উল্লেখ করেন নি।

অ-খৃষ্টান ধর্ম বিশ্বাসের যুগপৎ গ্রহণ ও বর্জনের এই সমস্যা পরিহারের প্রচেষ্টা এ যুক্তিতে শুরু হলো যে, কিছু খৃষ্টান “নিজেদের মধ্যে ‘ঈশ্বরের খৃষ্টে’র প্রভাব উপলব্ধি করছে যিনি চিরন্তন বিশ্ব নিয়ন্ত্রক অথবা ঈশ্বর হিসেবে হচ্ছেন “আলো যিনি প্রতিটি মানুষকে আলোকিত করেন।” উইলিয়াম টেম্পল (W. Temple) এই মত সমর্থন করে লিখেছেন- “ঈশ্বরের বাণী, বলতে গেলে যীশুখৃষ্ট, যিশাইয় (Isaiah) ও প্লাটো, যরথ্রুষ্ট্র (Zoroastor) বুদ্ধ ও কনফুসিয়াস সে সত্যই লিখেছেন ও বলেছেন যা তারা ঘোষণা করেছেন। ঐশ্বরিক আলো একটাই এবং প্রতিটি মানুষই তার নিজ নিজ পরিমাপ অনুযায়ী তা দ্বারা আলোকিত হয়েছে।”৩ এই বক্তব্যে যে দু’টি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো “এক ঐশ্বরিক আলো” এবং “খৃষ্ট”। এ দু’টি আসলে একই বিষয়। যেহেতু খৃষ্ট ‘কল্পনার’ বিষয়, তাই এ মতবাদ ব্যর্থ এবং সমস্যা বিরাজ করছে। জর্জ অরওয়েলের “দ্বৈত চিন্তা”র শরণাপন্ন হলেই শুধু তা পরিহার করা যেতে পারে। তিনি একে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন:

‘দ্বৈত চিন্তা’র অর্থ হলো যুগপৎভাবে দু’টি পরস্পর বিরোধী শক্তিকে ধারণ করা এবং তাদের উভয়কেই গ্রহণ করা। দলীয় বুদ্ধিজীবী জানেন যে, তিনি বাস্তবের সাথে ভাঁওতাবাজি করছেন, কিন্তু দ্বৈত চিন্তার প্রয়োগ দ্বারা তিনি নিজেকে সন্তুষ্টও করছেন যে বাস্তবতা লংঘিত হচ্ছে না।৪

খৃষ্টই ঈশ্বর- একজন খৃষ্টানের এই মৌলিক ধারণার মূলে রয়েছে ‘দ্বৈত চিন্তা’র অবস্থান। যীশুর দু’টি প্রকৃতির বৈপরীত্য থেকে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, দ্বৈত চিন্তা তাকে বেষ্টন করে আছে। এক মুহূর্তে তিনি মানুষ। অন্য মুহূর্তে তিনি ঈশ্বর। প্রথমে তিনি যীশু, তার পরে তিনি খৃষ্ট। একজন মানুষ যুগপৎভাবে দু’টি পরস্পর বিরোধী বিশ্বাস ধারণ করতে পারে। এটা শুধু দ্বৈত চিন্তার প্রয়োগেই সম্ভব। একমাত্র দ্বৈত চিন্তার দ্বারাই ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন ও তা বজায় রাখা যায়।

চার্চ অব ইংল্যান্ডের ৩৯ টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৭ম অনুচ্ছেদ শুরু হয়েছে এভাবে:

“ওল্ড টেস্টামেন্ট নতুনটির বিরোধী নয়....” মিল্টন স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, ওল্ড টেস্টামেন্টের বহু অংশে ঈশ্বরের একত্বের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হয়েছে। সেখানে এমন একটি অংশও নেই যেখানে ঐশ্বরিক সত্যকে ত্রিত্ববাদের রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট ও গসপেলগুলোতে একত্ববাদের প্রতি সমর্থন এবং একই সময়ে ত্রিত্ববাদের প্রতি সমর্থন সম্ভবত আজকের খৃষ্টান ধর্মের মধ্যে দ্বৈত চিন্তার প্রভাবের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। এভাবে যীশু যা শিক্ষা দেন নি, সেই মতবাদ ভিত্তিক চার্চের অধিবিদ্যার যুক্তি শুধু যীশুর মর্যাদাকেই ম্লান করে নি, ঈশ্বরের একত্বকেও ক্ষুণ্ণ করেছেন। আজকের খৃষ্টান ধর্মের যে অধ্যাত্ম দর্শন তা যীশুর আনীত অধ্যাত্ম দর্শনের সম্পূর্ণ বিরোধী। যীশুর শিক্ষার বাস্তব দিকগুলো অর্থাৎ তার আচরণ বিধি আজ চিরতরের জন্য বিলুপ্ত। যীশুর জীবন-যাপন অনুযায়ী জীবন যাপন করার মাধ্যমেই তার বাণী উপলব্ধি করা সম্ভব, কিন্তু যীশুর আচরণের কোনো বিবরণ এখন কার্যত আর টিকে নেই। এ সম্পর্কে যৎসামান্য যা জানা যায়, তাও আজ উপেক্ষিত। যীশুর সবচাইতে মৌলিক কাজ ছিল স্রষ্টার উপাসনা- যে উদ্দেশ্যেই শুধু মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, যীশু যে উপাসনা করতেন, কোনো খৃষ্টানই এখন সে উপাসনার কাজ করে না। যীশু সাধারণ সিনাগগে উপাসনা করতেন। তিনি প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে উপাসনা করতেন- সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায়। তার উপাসনার প্রকৃত বিবরণ আজ আর পাওয়া যায় না। তবে জানা যায় যে, মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি যে রকম উপাসনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তাই ছিল তার উপাসনার ভিত্তি। যীশু বলতেন, তিনি বিধি-বিধানকে সমুন্নত রাখার জন্যই এসেছেন। সেগুলোর বিন্দুমাত্র ধ্বংস সাধন বা ক্ষতি করার জন্য নয়। যীশুকে ১২ বছর বয়স থেকেই জেরুজালেমে সিনাগগে শিক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। তিনি সিনাগগকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন। কোনো খৃষ্টানকেই এখন এ ধরনের কাজ করতে দেখা যায় না। যীশুর মত করে ক’জন খৃষ্টান খতনা করিয়েছেন? আজ চার্চে যে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয় তার প্রচলন শুরু হয় যীশুর অন্তর্ধান ঘটার বহুকাল পর। তার অনেকগুলোই সরাসরি এসেছে পৌত্তলিক গ্রেকো- রোমান (Graeco-Roman) পৌরাণিক রীতি-নীতি থেকে। এখন তারা যে প্রার্থনা বাক্য পাঠ করে, তা যীশুর প্রার্থনা বাক্য নয়। তারা যে স্তোত্র গেয়ে থাকে তা যীশুর গাওয়া স্তোত্র নয়। পল ও তাদের অনুসারীদের মস্তিষ্ক প্রসূত মতবাদের কারণে কোনো জিনিস খাওয়া হারাম আর কোনোটি নয়- সে ব্যাপারে কোনো প্রত্যাদেশজনিত শিক্ষা নেই। এখন যারা খৃষ্টান হয়, তারা যা খুশি খেতে পারে। যীশু ও তার অনুসারীরা শুধু হালাল গোশত খেতেন, তাদের শূকরের মাংস আহার করা নিষিদ্ধ ছিল। অন্তর্ধানের পূর্বে যীশু সর্বশেষ যে আহার করেন তা ধর্মীয় উৎসব (Passover meal) উপলক্ষে প্রস্তুত খাদ্য। কোনো খৃষ্টানই আজ দীর্ঘকালের এই ইয়াহূদী ঐতিহ্যটি পালন করে না যা যীশু অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পালন করেছিলেন। আজ আরো জানা যায় না যে, যীশু কীভাবে আহার ও পান করতেন, তিনি কার সাথে আহার করতেন এবং কার সাথে আহার করতেন না, কোথায় তিনি আহার করতেন এবং কোথায় করতেন না, কখন আহার করতেন এবং কখন আহার করতেন না। যীশু উপবাস করতেন, কিন্তু কীভাবে কোথায় এবং কখন উপবাস করতেন, তাও জানা যায় না। তার উপবাসের নিয়ম- কানুন আজ হারিয়ে গেছে। তিনি কোনো খাবার বিশেষ পছন্দ করতেন এবং কোনো খাবারের প্রতি তার বিশেষ কোনো দুর্বলতা ছিল না, তাও জানা যায় না। যীশু যতদিন পৃথিবীতে ছিলেন তিনি বিবাহ করেন নি, কিন্তু তিনি নিষিদ্ধও করেন নি। গসপেলে এমন কোনো অংশ নেই যেখানে তার একজন সহচরেরও কৌমার্য পালনের শপথ গ্রহণের কথা আছে। আবার মঠ বা আশ্রমের মতো পুরুষ অধ্যুষিত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রমাণও কোথাও নেই যদিও তাদের উৎসের সাথে সম্পর্কিত এরকম দু’একটি সম্প্রদায় তখন ছিল। যেমন প্রসেনীরা। যীশুর আদি অনুসারীদের মধ্যে যারা বিবাহ করেছিলেন তারা অবশ্যই মূসার আলাইহিস সালাম প্রচারিত ধর্মের নিয়ম- কানুন অনুসারেই তা করেছিলেন। তাদের দৃষ্টান্ত আজ আর অনুসরণ করা হয় না।

পাশ্চাত্যে পারিবারিক কাঠামোর ভাঙ্গন থেকে দেখা যায় যে, একজন পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের সাথে কি আচরণ করবে বা একজন মহিলা একজন পুরুষের সাথে কী ধরনের আচরণ করবে- এ ব্যাপারে খৃষ্টান বিবাহের মধ্যে কোনো কার্যকর নির্দেশনা নেই। গসপেল থেকে নৈতিক নীতি আহরণ করে তার সাহায্যে জীবন যাপনের চেষ্টা আর যীশু কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনো নির্দিষ্টভাবে কাজ করেছেন বলে জ্ঞাত হয়ে সেভাবে কাজ করা এক কথা নয়। কারণ প্রথমটা হলো সিদ্ধান্তমূলক জ্ঞানের ফল, আর দ্বিতীয়টি হলো প্রত্যাদেশ লব্ধ জ্ঞানের বাস্তবায়ন।

যীশু কীভাবে হাঁটতেন, কীভাবে বসতেন, কীভাবে দাঁড়াতেন, কীভাবে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন, কীভাবে ঘুমাতে যেতেন, কীভাবে জেগে উঠতেন, কীভাবে মানুষকে শুভেচ্ছা জানাতেন, বৃদ্ধ লোকদের সাথে কি রকম ব্যবহার করতেন, অল্পবয়স্ক লোকদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল, বৃদ্ধা মহিলাদের সাথে তিনি কেমন ব্যবহার করতেন, তরুণী-যুবতীদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল, আগন্তুকদের কাছে তিনি কেমন ছিলেন, অতিথিদের সাথে কেমন ব্যবহার করতেন, শত্রুদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল, কীভাবে ভ্রমণ করতেন, তিনি কি করার অনুমোদন প্রাপ্ত ছিলেন এবং তিনি কি করার অনুমতি প্রাপ্ত ছিলেন না- এ সবের কোনো বিবরণই নেই।

যীশুর কাছে ঈশ্বর কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট বাণীর যে বিবরণ পাওয়া যায় তা অপূর্ণ ও অ-যথার্থ। আজকের খৃষ্টান ধর্ম যে মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এসব বিবরণের মধ্যে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। যীশুর কর্মকান্ডের বিবরণ প্রায় সম্পূর্ণই অনুপস্থিত, যৎসামান্য যাও বা আছে তাও কার্যত উপেক্ষিত। অবশ্য চার্চ যে রূপেই হোক না, সর্বদাই যীশুর বাণীর ব্যাখ্যাতা ও অভিভাবক হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। যীশু কিন্তু চার্চ প্রতিষ্ঠা করে যাননি। তিনি ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য কোনো পুরোহিত বা যাজকমণ্ডলী প্রতিষ্ঠা করে যাননি। তা সত্ত্বেও সেই প্রথমাবস্থা থেকেই প্রতিষ্ঠিত পলীয় চার্চ সর্বদাই খৃষ্টানদের এই শিক্ষা দিয়ে আসছে যে, তাদের মুক্তি নিশ্চয়তা তখনই দেওয়া যাবে যদি তারা চার্চ যা বলে তা করে ও বিশ্বাস স্থাপন করে। চার্চ কোথা থেকে এ কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা পেয়েছে?

এই চরমপন্থী কর্তৃত্বের দাবি দেখা যায় রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপদের অভ্রান্ত বলে দাবিকৃত মতবাদের মধ্যে। কার্ডিনাল হীনান (Heenan) এভাবে এর বর্ণনা দিয়েছেন:

আমাদের চার্চের মধ্যে এই আশ্চর্য ঐক্যের গোপন রহস্য হলো খৃষ্টের সেই অঙ্গীকার যাতে তিনি বলেছিলেন চার্চ কখনো সত্য শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হবে না। আমরা জানি যে, চার্চ যে শিক্ষা দেয় আমরা তা গ্রহণ করি। আমরা জানি যে এটা অবশ্যই সত্য হবে... সকল ক্যাথলিক যাজকই একই মতবাদ শিক্ষা দান করেন যেহেতু তারা সকলেই খৃষ্টের প্রতিনিধিত্ব মান্য করেন।

‘প্রতিনিধিত্ব’ কথাটির অর্থ হলো “সেই ব্যক্তি যিনি অন্যের স্থান গ্রহণ করেন।” পোপ হলেন খৃষ্টের প্রতিনিধি, কেননা, তিনি পৃথিবীতে চার্চের প্রধান। চার্চ একই থাকে যেহেতু তার সকল সদস্যই একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী। তারা চার্চ বিশ্বাস করে, কেননা চার্চ মিথ্যা কোনো কিছু শিক্ষা দিতে পারে না। আমরা যখন বলি যে, চার্চ অভ্রান্ত, তার মধ্য দিয়ে আমরা এ কথাই বুঝাতে চাই। খৃষ্ট তার চার্চকে পরিচালিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি যেসব পন্থা মনোনীত করেছেন তার একটি হলো তার কথা বলার জন্য পৃথিবীতে তার প্রতিনিধিত্ব রেখে যাওয়া। সে কারণেই আমরা পোপকে অভ্রান্ত বলে থাকি। তিনি হচ্ছে অভ্রান্ত চার্চের প্রধান। ঈশ্বর তাকে ভ্রান্তিতে নিপতিত হতে দিতে পারেন না।৫

এখানে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো যে, কার্ডিনাল হীনান শুধু খৃষ্টের কথাই বলেছেন, যীশুর কথা নয়। তিনি তার বক্তব্যের সমর্থনে গসপেলের উল্লেখ করেন নি।

এই মতবাদ প্রায়শই অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, যদি সকল পোপই অভ্রান্ত হন, তাহলে কেন পোপ অনারিয়াসকে (Honorius) গীর্জার অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল? সাম্প্রতিককালে পোপের উত্তরসূরি যীশুর কথিত ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার জন্য ইয়াহূদীরা দায়ী ছিল না বলে মত ব্যক্ত করেছেন, তার অর্থ কি এই যে, পূর্বের সকল পোপই মোটেই অভ্রান্ত ছিলেন না? “চার্চ কখনোই সত্য শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হবে না বলে খৃষ্টের প্রতিশ্রুতি’র বৈধতা একালের বহু রোমান ক্যাথলিকই প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোনো গসপেলেও অবশ্য এ বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। চার্চের শিক্ষা ও রীতি- নীতির মধ্যে যে বিশাল ফাঁক তা সিনসিনাটির আর্চ বিশপ জোসেফ এল, বার্নাডিন (Josheph. L. Bernadin)-কে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। ইউ.এস. ক্যাথলিক- এ এক সাক্ষাৎকারের বার্ণাডিন বলেন, “বহু লোকই নিজেদেরকে উত্তম ক্যাথলিক বলে বিবেচনা করে যদিও তাদের বিশ্বাস ও আচার-আচরণের সাথে চার্চের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিরোধ দেখা যায়। একালে একজন ভালো ক্যাথলিক হওয়ার অর্থই প্রায় নতুন রূপ ধারণ করেছে.... যখন (১৯৬৬) শুক্রবারে গোশত খাওয়া বৈধ হলো, তখন যে কেউই পোপের কর্তৃত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পালন, যাজকবৃত্তি ত্যাগ এবং বিবাহ করা অথবা যার যা খুশি করতে পারে।” গ্রীলি (Greely) লিখেছেন, “শুক্রবারে গোশত আহার থেকে বিরত থাকার অর্থ যীশুর উপবাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং যে দিনটিতে তিনি ক্রুশবিদ্ধ হন, সে দিনটির স্মৃতি পালন করা। শেষ পর্যন্ত তা চার্চের এক বিধানে পরিণত হয় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ তা এক ধরনের রোমান ক্যাথলিক পরিচয় চি‎হ্ন হিসেবে কাজ করে।”

লেখক ডোরিস গ্রুমবাখ (Doris Grumbach) ক্রিটিক- এ লিখেছিলেন: ভ্যাটিকান ২ (১৯৬২ খৃস্টাব্দে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিল) আমাকে অভিভূত করেছিল। কারণ বিবর্ণ জীবন, জ্ঞান ও আচরণের একান্ত যে ভুবন- তার বাইরে আরো কিছু ব্যাপারে তা একের অধিক জবাবের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু নিয়ম- কানুন ও শাসনের মানবিক অভিজ্ঞতার সকল ক্ষেত্রের ন্যায় যখন জানালা খুলে যায়, প্রত্যেকটি বিষয়ই তখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। কোনো চিরন্তনতা, কোনো পূর্ণাঙ্গতা তখন অবশিষ্ট থাকে না। এ সময় চার্চ আমার কাছে একটি বিতর্কযোগ্য প্রশ্ন হয়ে উঠে। আমি এখনও আমার জীবনের কেন্দ্রশক্তি হিসেবে গসপল, খৃষ্ট এবং তার কিছু শিষ্যকে আঁকড়ে ধরে রয়েছি, কিন্তু চার্চ আমার কাছে আর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নয়। আমি আর এর মধ্যে থাকতে পারি না।৬

সম্পূর্ণ অভ্রান্ত না হওয়া সত্ত্বেও চার্চের কর্তৃত্ব এখনও বিদ্যমান। যেসব চার্চ তাদের ওপর পোপের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেছে, সেসব চার্চের মধ্যেও এর শিকড় ছড়ানো। যা হোক, আজ এই কর্তৃত্বের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে এবং এমন পর্যায়ে তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে যা পূর্বে কখনো হয় নি। জর্জ হ্যারিসনের ভাষায়:

আপনি যখন তরুণ ছিলেন তখন আপনার পিতা- মাতা কর্তৃক আপনি চার্চে নীত হয়েছিলেন এবং স্কুলে আপনাকে ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেগুলো আপনার মনে কিছু রেখাপাত করার চেষ্টা করছে। এর কারণ এই যে, কেউই চার্চে যায় না এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। কেন? কারণ তারা বাইবেলকে সেভাবে ব্যাখ্যা করে নি যেভাবে তা করা উচিৎ ছিল। আমি আসলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনি, কারণ আমাকে সেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে শুধু বিশ্বাস লাভের জন্য, আপনার সে জন্য দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই, আমরা আপনাকে যা বলছি, আপনি শুধু তা বিশ্বাস করুন।৭

যীশুর বানীর অভিভাবকত্বের ব্যাপারে চার্চের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ গ্রহণ ও সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের দু’টি মেরুর মধ্যে একজন খৃষ্টান হওয়ার ব্যাপারে সকল মতামতের ছায়াপাত ঘটেছে। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিত লিখেছেন:

আজকের খৃষ্টান চার্চের মধ্যে এত বেশি বৈপরীত্য ও সংঘাত, এত বেশি গোলযোগ যে খৃষ্টীয় সত্যের ঐক্যবদ্ধ অথবা পদ্ধতিগত পুরোনো আদর্শ বিদায় নিয়েছে। সে কারণে যাজক সম্প্রদায়ের ঐক্য আন্দোলনে অত্যন্ত দেরি হয়ে গেছে। যা ঘটেছে তা হলো খৃষ্টান জগৎ বিকল্প সুযোগের খোলাখুলি বৈচিত্র্যময় পরিস্থিতির দিকে এগিয়েছে। মনে হয়, কারো পক্ষে আর এটা সম্ভব হবে না যে, তাকে আনুষ্ঠানিক ও সামগ্রিকভাবে খৃষ্টান হওয়ার কথা বলা হবে অথবা বলার কল্পনা করা হবে। তার নিজের জন্য তাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।৮

এ সিদ্ধান্ত থেকে এটাই বুঝা যায় যে, আজ যত খৃষ্টান আছে, খৃষ্টান ধর্মের তত রূপও আছে এবং যীশুর বাণীর অভিভাবক যে চার্চ, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেই চার্চের ভূমিকা এখন বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে। ইউ, সি. এল. এ (U. C. L. A)-এর একজন স্নাতক ছাত্রের প্রশ্ন: “যদি আমার জ্ঞানের ওপরই সবকিছু নির্ভর করে তাহলে চার্চের প্রয়োজনটা কি?”৯

যা হোক, চার্চ আজ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই বিদ্যমান এবং এ দুয়ের মধ্যকার সম্পর্ক এক কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়।

বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্যে বিপুল পরিমাণ সাহিত্য রচিত হয়েছে। এর মধ্যে বহু গ্রন্থই মানুষের যখন তার জীবন- যাপন ও জীবনোপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞানের নিশ্চয়তা থাকে না তখন সে যা খুঁজে ফেরে, সেই মানুষের মনের চিন্তার সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রের একটি চিত্র তুলে ধরে। কিছু কিছু লেখক যেমন পাসকাল (Pascal) উপলব্ধি করেছেন যে, মন একটি সীমাবদ্ধ যন্ত্র এবং হৃদয় হলো মানুষের সত্ত্বার কেন্দ্র এবং প্রকৃত জ্ঞানের আধার:

হৃদয়ের নিজস্ব যুক্তি আছে যা যুক্তির কাছে অপরিচিত। হৃদয়ই ঈশ্বর সম্পর্কে সচেতন, যুক্তি নয়। এটা হলো তাই, যাকে বিশ্বাস বলা হয়। ঈশ্বর হৃদয় দ্বারা উপলব্ধ হন, যুক্তি দ্বারা নয়।১০

হৃদয়ে প্রবেশ লাভের চেষ্টায় অনেকেই খৃষ্টান ধর্মকে প্রত্যাখ্যান এবং অন্য পন্থা নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেছেন:

অধ্যাত্মবাদী অভিজ্ঞতা বিশ্বজগৎ সম্পর্কে “সত্যের” প্রকৃত জ্ঞান লাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই সত্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, বরং তা উপলব্ধির বিষয়। এক্ষেত্রে মাধ্যম হতে পারে সংগীত, মাদক, ধ্যান....।১১

সত্য উপলব্ধির এই বিকল্প পন্থা পাশ্চাত্যে ব্যাপকভাবে জনগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে, প্রায়শই আত্মতুষ্টির পন্থা হিসেবে।

পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির এই নয়া ধারার সাথে চার্চ ব্যাপকভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। চার্চকে জনাকীর্ণ রাখতে কিছু যাজক তাদের কর্মসূচীতে পোপ গ্রুপ ও ডিসকোথেককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন যাতে তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করা যায়। কনসার্ট, প্রদর্শনী এবং রক্ষণশীলদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় পুরোনো মালের সস্তা দরে বিক্রয়ের। দাতব্য সংস্থাগুলো চার্চগুলোর সাথে জড়িতদের জন্য একটি উদ্দেশ্য সাধনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। চার্চকে “আধুনিকায়ন” করার এবং তাকে যুগোপযোগী রাখার নিরন্তর উদ্যোগ যে কোনো পন্থায় আপোস করার পলীয় চার্চের দীর্ঘকালের ঐতিহ্যেরই পরিচয় বহন করে। চার্চ যদি যীশুর বাণী প্রচার করতে নাও পারে, ন্যূনতম পক্ষে একটি প্রয়োজনীয় সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজক অবশ্যই হতে পারে।

এই আপোস প্রক্রিয়ার ফল হয়েছে বিশেষ করে গত দশকে সংস্কৃতিতে চার্চের অব্যাহত আত্মীকরণ এবং চার্চের পরিবর্তনশীল কাঠামোতে সংস্কৃতির পুনঃআত্মীকরণ। এটি হলো একটি দ্বি-মুখী প্রক্রিয়া যা পল ও তার অনুসারীগণ কর্তৃক শুরু হওয়ার পর থেকে সীমাহীনভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। সংগীত, মাদক ও ধ্যানের অভিজ্ঞতার ফলে বহু লোকই খৃষ্টান ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছে। তাদের প্রবণতা হলো হয় এসব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান ও খৃষ্টানধর্মের গোঁড়া রূপটি গ্রহণ অথবা তাদের নতুন জীবন ধারাকে খৃষ্টানধর্মের তাদের নিজস্ব আধুনিকীকৃত রূপে অন্তর্ভুক্ত করা। এই উভয়ধারাই যীশুর নবীত্বকে ঢেকে ফেলেছে। তিনি হয় ঈশ্বর হিসেবে উন্নীত হয়েছেন অথবা অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়েছেন। তিনি উত্তম ছিলেন, তবে তাকে ভুল বুঝা হয়েছে।

পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে চার্চের সম্পর্কের বিষয়টি একালে লোকেরা কীভাবে জীবন- যাপন করে তা লক্ষ্য করে দেখলেই সুষ্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। যারা ঈশ্বরকে স্মরণ করার জন্য মঠ ও আশ্রমগুলোতে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে তাদের ছাড়া যারা নিজেদের খৃষ্টান বলে আখ্যায়িত করে, তাদের জীবন যাত্রার সাথে যারা নিজেদের অজ্ঞবাদী (Agnostic), মানবতাবাদী বা নাস্তিক বলে দাবি করে, তাদের জীবন যাত্রার সাদৃশ্য রয়েছে। তাদের ধর্ম বিশ্বাসের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তাদের সাধারণ ব্যবহার বা আচরণে কোনো পার্থক্য নেই।

পাশ্চাত্যের খৃষ্টান দেশগুলোতে যে আইন বিদ্যমান, যেমন জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কিত আইন, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন, বিবাহিত জীবন ও বিবাহ জীবনের বাইরে সম্পত্তির অধিকার অথবা বিবাহ বিচ্ছেদ ও মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনা, দত্তক গ্রহণ ও অভিভাবকত্ব, বাণিজ্য ও শিল্প সংক্রান্ত আইন এসবের কোনোটিই গসপেলগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের কাছে যেসব আইন প্রত্যাদিষ্ট হয়েছে, এগুলো সে আইন নয়। এগুলো হলো সিদ্ধান্তমূলক জ্ঞানের ফল। এগুলো হয় রোমান আইন ব্যবস্থা থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে এসেছে অথবা দীর্ঘকাল ধরে লোকের সাধারণ আচার- আচরণ তার ভিত্তি অথবা প্রাচীন গ্রীকদের প্রণীত বিধি যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংস্কার ও সংশোধন করা হয়েছে। একালের কোনো আদালতে কেউই কোনো লোকের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকালে উৎস হিসেবে গসপেলের কথা উল্লেখ করতে বা তা গ্রহণ করতে পারে না।

আজকের খৃষ্টান ধর্ম পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি থেকে অবিভাজ্য। খৃষ্টান চার্চ ও রাষ্ট্র এক। এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব ব্যক্তি কাজ করেন তারা যীশুর ন্যায় জীবন- যাপন করেন না। খৃষ্টান ধর্মের সামগ্রিক অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে বলা যায় যে, আজকের দিনের খৃষ্টানদের মধ্যে সামাজিক আচরণ- জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং এই অভাব তাদেরকে এই জীবনে সদ্গুণ বর্জিত করেছে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ঘটনার জন্য তাদের প্রস্তুত করে রেখেছে। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিত লিখেছেন:

‘খৃষ্টান ধর্মকে সত্য ধর্ম বলা কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য নয়। একটিই মাত্র প্রশ্ন তাৎপর্যপূর্ণ যা ঈশ্বর অথবা আমাকে অথবা আমার প্রতিবেশীকে নিয়ে- আর তা হলো: আমার খৃষ্টান ধর্ম সত্য নাকি আপনারটি সত্য। এই প্রশ্নের ব্যাপারে, যা সত্যই এক বিশ্বজনীন প্রশ্ন, আমার কাছে এর একমাত্র বৈধ উত্তরটি হলো- খুব একটা না. ।১২

এতক্ষণের এই আলোচনার পর যে বিস্ময়কর ঘটনাটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো, বিশ্বের চার্চগুলো ক্রমশ: শূন্য হয়ে পড়েছে- আর ইসলাম ধর্মের মসজিদগুলো ক্রমশ: পূর্ণ হয়ে উঠছে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন