HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
মুসলিম নারীর অধিকার ও দায়িত্ব ইসলামের ইশতিহার ও সনদ
লেখকঃ ফায়সাল বিন খালেদ
৪
দ্বিতীয়ত: নারীর অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের মূলনীতিইসলামী ইতিহাসের দেড় হাজার বছরের দীর্ঘ জীবনে কখনোই, তার শক্তি ও বিজয় বা দুর্বলতা ও পরাজয়, কোন পর্বেই, মুসলিম সমাজে এমন কোন সংকট দেখা দেয় নি যার নাম ‘নারী ইস্যু’। কিন্তু পশ্চিম ও পশ্চিমা-ভাবাপন্ন পশ্চিমের মিত্ররা যখন তাদের অসুস্থতা ও সংকটগুলো নিয়ে ইতিহাসে আবির্ভূত হল, যাতে আন্যদের সাথে সাথে আক্রান্ত হল মুসলমানরাও - তখনই উদ্ভূত হল সেই কল্পিত সংকট, যার নাম ‘নারী ইস্যু’। ইসলামী সমাজে ও ডিসকোর্সে এটা কোন সংকট নয়, তাই ইস্যুও, নয়। যে মুসলিম সমাজ ও ডিসকোর্সগুলোতে এই বিষয়টি আলোচিত হয়, তার অধিকাংশই মূলত বিষয়টিকে গ্রহণ করেছে ধর্মহীন পাশ্চিমা অর্থে।
সুতরাং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা নির্ধারণ করা জরুরী। এখানে আমরা নারীর অধিকার ও ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের মূলনীতিগুলো আলোচনা করছি :
১. মূল যে দুই অংশ দ্বারা গড়ে উঠেছে মানব প্রজাতি, নারী তার একটি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন যুগল : পুরুষ ও নারী’- সূরা নাজম (৪৫)। দুই অঙ্গে গড়া নফসের একটি অঙ্গ নারী। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘হে মানুষ তোমরা তোমাদের রবের তাক্বওয়া অবলম্বন কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গীকে’- সূরা নিছা (১)। সুতরাং আদি সৃষ্টি, মাঝের জীবৎকালের দায়িত্ব এবং পরিণতি, সর্ব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমমানের সঙ্গি। জীবন, সমাজ জগৎ বিনির্মাণে তারা উভয়েই অংশ গ্রহণ করে এবং আপন আপন বৈশিষ্ট অনুসারে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস, সাওয়াব, আযাব, কোন ক্ষেত্রেই, এবং শরীয়তে দেওয়া অধিকার ও দায়িত্ব, কোন এলাকাতেই পুরুষ ও নারীর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ তায়ালা
এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘মোমেন পুরুষ অথবা নারী সৎ কর্ম করলে আমি তাকে উত্তম জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের থেকে উত্তম বিনিময় দান করব’- সূরা নাহাল (৯৭)। আবু দাউদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেছেন :
إنما النساء شقائق الرجال
অর্থাৎ ‘নারীরা পুরুষের অর্ধাঙ্গ’ - আবু দাউদ। এই সাম্য চেতনার কারণেই ইসলাম নিছক লিঙ্গের ভিত্তিতে কারো মর্যাদা নির্ধারণ করে নি বরং ইসলামের নিকট মর্যাদার পরিমাপক তাক্বওয়া। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি সে যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মুত্তাকি’- সূরা হুজরাত (১৩)। নারী ও পুরুষের অর্থবহ কোন সমতা-ভাবনা প্রকাশ করার জন্য ‘তোমরা একে অপরের অংশ’। এর থেকে সূক্ষ্ম ও অর্থবোধক কোন ভাষিক প্রকাশ থাকতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তখন তাদের রব তাদের ডাকে সাড়া দিলেন যে, আমি তোমাদের নারী-পুরুষ কারো কোন আমল ব্যর্থ করব না, তোমরা একে অপরের অংশ’- সূরা আলে ইমরান (১৯৫)। সুতরাং মানবিকতায়, ধর্ম ও শরীয়তের বিধান মালায়, এবং আল্লাহর নিকট মর্যাদার বিচারে নারী-পুরুষ সমান।
বিশেষ এক হিকমতে আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি ও শারীরিক গঠন দান করেছেন। শারীরিক গঠনের তারতম্যের কারণে নারী ও পুরুষের শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি ও স্বভাব এক নয়। উভয়ের মধ্যে তারতম্য আছে। শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবে নারী-পুরুষ অভিন্ন নয়। আল্লাহ তায়ালা পুরুষ সম্পর্কে বলেছেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘পুরুষ তো নারীর মত নয়’- সূরা আলে ইমরান (৩৬)। এবং নারী সম্পর্কে বলেছেন:
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যে অলংকারের মাঝে লালিত হয় এবং যে তর্কে অস্পষ্ট ’- সূরা যুখরুফ (১৪)।
শরীয়তের কিছু বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই গঠনগত ও প্রকৃতিগত ব্যবধানের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে ,নারী ও পুরুষের জন্য, তাদের নিজস্ব গঠন ও প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বিধান ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। শরীয়তের বিধানদাতা আল্লাহ তায়ালা তার হিকমাত সর্বজ্ঞানী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালার অমোঘ হিকমাতের দাবি অনুযায়ী তা করা হয়েছে। কোরআনের এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(আরবি)
অর্থাৎ জেনে রাখ, সৃজন ও আদেশ তারই, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ বরকতময়’- সূরা আ’রাফ (৪৫)। ওটা হল আল্লাহ তায়ালার মহাবৈশ্বয়িক সৃষ্টি, নির্মাণ, নির্ধারণ বিষয়ক ইচ্ছা, আর এটা হল নির্দেশ, বিচার, বিধান প্রণয়নে আল্লাহ তায়ালার দ্বীন ও শরীয়ত বিষয়ক ইচ্ছা। নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে- সৃষ্টিজগতের স্বার্থ, পৃথিবীর নির্মাণ-কর্ষণ, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সৃঙ্খলা বিধান এসবের আলোকে- এ উভয় ইচ্ছা একত্রিত হয়েছে।
২. এই অনড় বাস্তবতার উপর ভিত্তি করেই বিন্যস্ত হয়েছে ইসলামী শরীয়তের অনেকগুলো বিধান, যার অন্যতম পরিবার বিষয়ক বিধানাবলী। ইসলামের ভাবনায় পরিবার সমাজ সংগঠনের একক। পরিবারের সুসম বিন্যাস, শক্তি ও টিকে থাকার উপরই নির্ভর করে সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্ত্বা। পরিবার তার সদস্যদের মধ্যে প্রশান্তি, ভালবাসা ও সহমর্মিতার পরস্পর বিনিময় নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই দায়িত্ব পালনের লক্ষ্য স্থির করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তার অন্যতম নিদর্শন : তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন সঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও। এবং তিনি তোমাদের মাঝে দিয়েছেন ভালবাসা ও দয়া’- সূরা রূম (২১)।
সমকালের পশ্চিমা জাহেলিয়্যাত নির্বোধের মত নারীর পারিবারিক ভূমিকাকে হালকা করে দেখে, তুচ্ছ মনে করে নারীর পারিবারিক এই দায়িত্বকে। যে কোন সুস্থ সমাজকে অবশ্যই এই চিন্তা মোকাবেলা করতে হবে। ইসলাম তো মনে করে পরিবার ও পরিবার সংক্রান্ত দায়িত্বগুলোই হচ্ছে মুসলিম নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নারী যদি এই দায়িত্ব পালন করে তাহলে তাই হবে সমাজের জন্য, সবার জন্য, মঙ্গলকর।
সামাজিক দায়িত্ব বন্টনে ইসলামী শরীয়ত, অপর দিকে, পুরুষকে দিয়েছে পরিবারের তত্বাবধান ও অবিভাকত্বের দায়িত্বগুলো। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘পুরুষ নারীর দায়িত্বশীল। কারণ আল্লাহ তাদের একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ-কারণেও যে পুরুষরা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে ’- সূরা নিছা (৩৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘নারীর উপর পুরুষের যেমন তেমনি, নীতি অনুযায়ী, পুরুষের উপরও নারীরও অধিকার রয়েছে। তবে নারীদের উপর রয়েছে পুরুষদের একস্তর শ্রেষ্ঠত্ব ’ - সূরা বাক্বারা (২২৮) ‘কিওয়ামাহ’ বা পারিবারিক অবিভাকত্বের মানে ক্ষুদ্র সমাজের অর্থাৎ পরিবাবের নেতৃত্ব দেওয়া-পরিচালনা করা। স্বেচ্ছাচারিতা ও অধিপত্যকামী মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষকে নেতৃত্বের এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব আদায়ের মাধ্যমে পুরুষ, নারী এবং পরিবারের কল্যাণে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন পুরুষ পরিবারের আর্থিক ব্যয়ভার বহন করে, তার নিরাপত্বার দায়িত্ব নেয়, পরিবারের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। সুতরাং নেতৃত্বমূলক কোন দায়িত্ব স্বার্থকভাবে পালন করার জন্য নেতার প্রতি যতটুকো আনুগত্য জরুরী স্বাভাবিক পুরুষ তা পাবে। তবে আনুগত্য হবে কল্যাণ কাজে। ইসলাম নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দেয় নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
إنما الطاعة في المعروف
অর্থাৎ ‘আনুগত্য হবে কল্যাণ কাজে কিংবা সঠিক বিচার অনুসারে ’- বোখারী ও মুসলিম।
৩. নারীর আর্থিক ব্যায়ভার গ্রহণ করা পুরুষের দায়িত্ব। পুরুষের সম্পত্তির একটি ভাগ, এই অধিকার বলে, নারীর প্রাপ্য। এই দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হলে পুরুষ কখনোই তা এড়াতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করনে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘স্বচ্ছল ব্যক্তি যেন তার সচ্ছলতা অনুসারে খরচ করে। আর যার সক্ষমতা সীমিত সে যেন, আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন, তা থেকেই খরচ করে। আল্লাহ কোন ব্যক্তির উপর তাকে যতটুকো সাধ্য দিয়েছেন তার বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। অচিরেই আল্লাহ অসচ্ছলতার পর সচ্ছলতা দান করবেন’- সূরা তালাক (৭)। স্বামীর পক্ষ থেকে আর্থিক ব্যয় লাভ নারীর অধিকার। এবং তার নিজস্ব সম্পত্তির মালিকানা ও ব্যবহারের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। নিজস্ব সম্পত্তির মালিকানা এবং তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মত স্বাধীন, অভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্তও পশ্চিমা জাহেলিয়্যাত নারীকে স্বাধীন উপার্জন এবং নিজস্ব মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার দেয় নি। রোমান আইনে নারীকে এই অধিকার দেওয়া হয় নি। উপার্জন, সম্পদের মালিকানা এবং তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। এই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কোন ফারাক নেই।
ইসলাম নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং তাদের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব নির্ধারণ ও বন্টন করেছে সম্পূরুক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ নারী তার নির্ধারিত দায়িত্ব আদায়ের মাধ্যমে পুরুষকে সম্পূর্ণতা দান করবে অনুরূপ পুরুষ সম্পূর্ণতা দান করবে নারীকে। এই সম্পূরক কর্তব্য বন্টনের অন্যতম লক্ষ্য নারীর সান্নিধ্যে পুরুষের ‘ছাকান’ বা প্রশান্তি লাভ এবং উভয়ের মাঝে ভালবাসা ও সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তার নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে তিনি তোমাদের নফস থেকেই তোমাদের সঙ্গিনীদের তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি পেতে পার। এবং তোমাদের দিয়েছেন ভালবাসা ও দয়া’- সূরা রূম (২১)। এখানে ব্যবহৃত ‘সাকান’ শব্দটি খুবই ব্যাপক অর্থবোধক। এই ক্ষেত্রে, এই অর্থ উৎপাদনের জন্য আরবীতে- সম্ভবত অন্য কোনো ভাষাতেও- এর চেয়ে ভাল আর কোন শব্দ নেই। শব্দটির মাঝে অনেকগুলো অর্থ একত্রিত হয়েছে, উদাহরণত নিরাপত্বা, শান্তি, প্রশান্তি, আপনত্বের অনুভূতি ইত্যাদি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে যদি এই গুণগুলো বিকশিত হয় তাহলে এর সুফল ভোগ করে, সর্বপ্রথম স্বামী-স্ত্রী নিজেই, এরপর সন্তানরা এভাবে গোটা সমাজ।
আমরা আগেই দেখিয়েছি নারী-পুরুষ সৃষ্টিগতভাবেই এক নয়। তাদের মাঝে শারীরিক ও মানসিক অনেক ফারাক আছে। নারী-পুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখেছে এবং তাদের নিজ নিজ প্রাকৃতিক-জৈব বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতার সাথে সঙ্গতি রেখে সম্পূরক পদ্ধতিতে তাদের দায়িত্ব বন্টন ও অধিকার নির্ধারণ করেছে। মানবিক সম্পর্ক বিনির্মাণে ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের যে ভিত্তি দিয়েছে এটা তারই ফল।
যার যে স্বাভাবিক দায়িত্ব, সম্পূরক সমাজিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে, তাকে তার থেকে বেশী দায়িত্ব দেওয়া হলে বা স্বেচ্ছায় তার থেকে বেশী দায়িত্ব নিলে অনেক সময় তার দ্বারা সমাজ উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কারণ তার ফলে সামাজিক সংগঠন ব্যাহত হয়। তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া নারীর উপর পুরুষের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, এক প্রকার জুলুম। এটা দায়িত্ব বন্টন ও অধিকারের সুসঙ্গতাকে নষ্ট করে। এর মাধ্যমে নারীর সম্মান বিদীর্ণ করা হয়। নারীর নারীত্বকে অপদস্থ করা হয়।
৫. ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন এবং ব্যাপকভাবে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নারীর দায়িত্ব কি, তা স্পষ্ট করা এবং সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যে বিষয়টি অনিবার্য পূর্বশর্ত তা হল -শিক্ষা। তাই আমরা মনে করি, যা ছাড়া মানুষ তার রবের এবাদত পূর্ণাঙ্গরূপে আদায় করতে পারবে না-যেমন বিশ্বাস ও অনুশীলনের অনিবার্য বিষয়গুলো- সেই সব বিষয়ে শিক্ষাদান একটি অনিবার্য শরীয়তী নির্দেশ এবং সেই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোন ফারাক নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
طلب العلم فريضة علي كل مسلم
অর্থাৎ ‘জ্ঞান অন্বেষণ প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ’- ইবনে মাজা। ইসলামের এই মৌলিক বিধানগুলোর বাইরের অন্যান্য বিধানের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যে নিজ নিজ ভূমিকা ও দায়িত্ব সে অনুসারে জ্ঞান অর্জন করবে। এর বাইরের যে জ্ঞান চর্চা তা নফল, তা আদায় করতে গিয়ে পার্থিব ও অপার্থিব ফরজ আমলগুলো ব্যহত করা যাবে না।
৬. ইসলাম নরীর অধিকারগুলো নির্ধারণ করেছে তার জৈব ও প্রাকৃতিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গতি রেখে। পক্ষান্তরে জাতীসংঘ মানুষের অধিকারের যে সনদ পেশ করেছে তাতে নারীর অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে একটি অনুরূপ সাম্যতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। ইসলাম নারীকে যে সব অধিকার দেয় এবং জাতিসংঘের এই অধিকার সনদে নারীর জন্য যে সব অধিকারের কথা বলা হয়েছেত এই দুয়ের তুলনামূলক পাঠ নিলে দেখা যাবে ইসলাম নারীকে যে সব সামাজিক অধিকার দিয়েছে তা জাতিসংঘের দেওয়া অধিকারগুলো থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই অধিকারগুলো সম্পর্কে পশ্চিমা জাহেলিয়াত উদাসীন। তাই কোনরূপ দ্বিধা না করে সে এইগুলো এড়িয়ে যায়, অকার্যকর করে দিতে চায়। উদাহরণত বিয়ে, মাতৃত্ব, গৃহ পরিচালনা এবং পারিবারিক অবকাঠামোর মধ্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো অনুশীলন ও বিকশিত করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত নারীকে যে অধিকার দিয়েছে, আধুনিক জাহেলিয়াতের বিধান-সনদে তা নেই।
ইসলাম নরীকে স্বামী নির্বাচনের অধিকার দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে রাসূল স্বামীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দিয়ে তার সাহায্যে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিয়েছে নারীকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
إذا أتاكم من ترضون خلقه ودينه فزوجوه
অর্থাৎ ‘যার চরিত্র ও দ্বীনদারি তোমরা পছন্দ কর , তোমাদের নিকট যদি এমন কেউ আসে তাহলে তার নিকট বিয়ে দাও’-ইবনে মাজা। কোন কারণে দাম্পত্য জীবন যদি সংকটের মুখে পড়ে তাহলে শরীয়ত নারীকে স্বামীর সাথে না থাকার অধিকার দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে কোরআনে অনেক আয়াত ও সহীহ ও স্পষ্ট হাদীস আছে। এই বিষয়ে যে কোন বিধান সেগুলোর সাপেক্ষেই নির্ধারিত হওয়া উচিত।
নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষা ইসলামী শরীয়তের একটি বিধান। যে পাঁচটি বিষয় শরীয়তের সামাজিক বিধান গুলোর মূল, অর্থাৎ দ্বীন, মর্যাদা, আক্বল, মাল, নারীর মর্যাদা রক্ষা তার অন্যতম। কোন ভাবে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা মানে শরীয়তের বিরুদ্ধে যাওয়া, নারী-পুরুষ, পরিবার ও সমাজের অধিকার লংঘন করা। এবং তা মোমেনদের মাঝে অশ্লিলতা ছাড়ানোর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে, যার সম্পর্কে কোরআনে এসেছে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যারা মোমেনদের মাঝে অশ্লিলতা ছড়াতে চায় তাদের জন্য দুনিয়া আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাকর শাস্তি। আল্লাহ জানেন তোমরা জান না’- সূরা নূর (১৯)। ইসলামের সমাজ ভাবনা ও বিধানে এটি মৌলিক একটি বিষয়। এই মৌলিক বিষয়টিকে রক্ষা করার জন্য ইসলাম অনেকগুলো বিধান দিয়েছে। যেমন ইসলাম অনেক গুরুত্বের সাথে বিয়ের বিধান দিয়েছে এবং বিয়ের চুক্তিকে বলেছে ‘কঠিন প্রতিশ্রুতি’। যেমন কোরআনে এসেছে:
(আরবি)
অর্থাৎ ‘আমি তোমাদের কাছ থেকে নিয়েছি কঠিন প্রতিশ্রুতি’- সূরা নিছা (২১)। এই মূল বিষয়টি যেন ব্যহত না হয় তাই ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়ের উপর সমভাবে যিনা হারাম করেছে। কোরআনে এসেছে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তোমরা যিনার নিকটেও যেও না। কারণ তা অশ্লীল এবং খুবই খারাপ পথ’- সূরা ইছরা (৩২)। যে সব বিষয় ব্যক্তি ও সমাজকে ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যায় ইসলাম তা বন্ধ করে দিয়েছে। বিবাহ বন্ধন হারাম নয় এমন নারীর সাথে নির্জন ও ঘনিষ্ট মেলামেশা-কথাবার্তা নিষিদ্ধ। সমাজে যে কোন ধরনের অশ্লীলতা ছড়ানোকে কঠিনভাবে বাঁধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং গুরুত্বের সাথে প্রণয়ন করছে হিজাব ও এই সংক্রান্ত বিধানগুলো। এবং যারা এই বিষয়টি ক্ষুণ্ণ করে তাদের জন্য ইসলাম দিয়েছে শাস্তির বিধান । এই উদ্দেশ্যেই ইসলামে যিনার কঠিন শাস্তি-বিধানগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে ইসলাম নারীর সম্ভ্রব ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টিকে নানাভাবে গুরুত্ব দিয়েছে।
সম্ভ্রম ও শালীনতা রক্ষা এবং অশ্লীলতার বিস্তার রোধের জন্য ইসলামী শরীয়ত যে কয়টি সামাজিক দূর্গ নির্মাণ করেছে তার অন্যতম হল হিজাব। কেবল তাই নয় বরং হিজাব নারী ও পুরুষের সম্ভ্রম-মর্যাদার প্রতি যত্নবান শরীয়তের অন্যতম প্রতীক।
হিজাব কোন নফল বিধান নয়। কিংবা হিজাব ঐচ্ছিক প্রতীকী কোন অনুশীলন নয় যে, কারো মনে চাইলে তা পালন করবে বা করবে না। বরং নারীর মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার একটি উপায় হিসেবে আল্লাহ নারীদের উপর হিজাব ফরজ করেছেন। এর ফলে কাম ও প্রবৃত্তির অনুসারী দুষ্টরা তাদের উত্তক্ত করতে পারবে না। এটি অবশ্যপালনীয় ফরজ বিধান। নারীদের আদর্শ ‘উম্মাহাতুল মোমেনীন’ এর উপরও তা ফরজ ছিল। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘হে নবী আপনি আপনার স্ত্রী ও কন্যা এবং মোমেন নারীদের বলুন তারা যেন হিজাব দিয়ে ঢেকে থাকে। তাহলে তাদের চিনা যাবে না এবং তাদেরকে কেউ উত্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল দায়ালু’- সূরা আহযাব (৫৯)।
ইসলামের শত্রুরা এবং প্রবৃত্তির অনুসারী ও মানুষের কামুক বৃত্তিগুলো ভাঙ্গিয়ে যারা বাণিজ্য করে তারা ইসলামী হিজাবকে খুবই নগ্নভাবে হামলা করে থাকে। আবার অনেক সমাজ ও ডিসকোর্স হিজাব গ্রহণ করে নেয়। তবে অন্তসার ও লক্ষ্যশূন্য জাতীগত একটি প্রথা হিসেবে। বাহ্যত হিজাব পালন করলেও এরা হিজাবের মিত্র নয়। হিজাবকে সরাসরি অস্বীকারের সাথে এর মৌলিক কোন তফাত নেই। দুটিই ইসলামী শরীয়ত ও হিজাবের শত্রু।
কিন্তু শরীয়ার বিধান হিসেবে তো অবশ্যই, হিজাব এবং তার সাথে সম্পৃক্ত মূল্যবোধ- আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি- যে কোন মাবনীয় সমাজের সুস্থ্য জীবনের জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে হিজাবের প্রতি এত বিদ্বেষ কেন ? উদাহরণত পশ্চিম, বিস্ময়করভাবে, হিজাবের ক্ষেত্রে খুবই সংকীর্ণ আচরণ করে। হিজাব নিয়ে তারা খুবই শংকিত ও বিব্রত বোধ করে। আর কোন ধর্ম-সম্প্রদায় বা মাবন-গোষ্ঠীর পোষাক নিয়ে পশ্চিমকে এমন সংকীর্ণ আচরণ করতে দেখা যায় না। পশ্চিমের দেশগুলো এবং পশ্চিম আক্রান্ত ধর্ম নিরপেক্ষ মুসলিম দেশগুলোতেও আইন ও বাস্তব আচরণ, উভয় উপায়ে হিজাবকে নানাভাবে আক্রমন করা হচ্ছে। এর কারণ কি ? - তা নিয়ে ভাবলে আমাদের নিকট অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।
হিজাব, পূর্বে আমরা প্রমাণ করেছি, ইসলামী শরীয়তের একটি মৌলিক ফরজ। ইসলাম এই বিধান দিয়েছে নারী ও সমাজের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য, নারীর সম্ভ্রমকে সমর্থন করার জন্য। শরীয়তের অপর যে বিধানটি এই লক্ষ্যের সাথে জড়িত এবং তাকে শক্তি যোগায় তা বহু বিবাহ। তবে বিকৃত প্রচারণা এবং ভুল অনুশীলন-চর্চার ফলে এই বিধান তার মূল জায়গা থেকে সরে গিয়েছে। তার আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। বাস্তবতার পাঠ নিলে দেখা যাবে যে সমাজ, এমনকি যে সব অমুসলিম সমাজ এই প্রথার চর্চা করে তাতে নারীর মর্যাদা ও মূল্য তুলনামূলক ভাল। যাতে এই প্রথার অনুশীলন ও প্রচলন আছে এবং যা এই বিধানকে অবৈধ ও অপরাধমূলক মনে করে, এই দুই সমাজের তুলনামূলক পাঠ নিলেই এই সত্য উন্মোচিত হয়ে যাবে। দেখা যাবে দ্বিতীয় সমাজেই নারী তুলনামূলক কম মূল্য পাচ্ছে।
তাই বহু বিবাহ ইসলামী শরীয়তের একটি স্বীকৃত বিধান। ক্ষুণ্ণ নয়, এই বিধান নারীর মর্যাদাকে আরো নিশ্চিত করে। বৈধব্য, তালাক, পৌড়ত্ব/বিবাহহীনতার কারণে মেয়েদের আইবুড়ো হয়ে উঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদার সাথে বিয়ের যে সংকট দেখা দেয় বহু বিবাহ বিধান সে সংকটের সহজ সমাধান করতে পারে। বহু বিবাহ প্রথা আরো অনেক সমাজিক সংকটের তুলনামূলক সহজ ও কার্যকরী সমাধান। যেমন বন্ধাত্ব, অসুস্থতা, পেশা-প্রকৃতি কিংবা জাতীয়তার মত আইনগত সংকট। এই সব ক্ষেত্রে বহু বিবাহ ছাড়া অন্য যে সমাধানটি আছে তা তালাক, ইসলামের ভাবনায় তা নিকৃষ্টতম বৈধ বিধান, যা ইসলামের দাম্পত্য বিধানের মূল স্পিরিট- পরস্পর ভালবাসা, মায়া-তার বিরোধী। অনেক ক্ষেত্রে বহু বিবাহ শিশুর অভিভাবকহীনতার সমাধান হয়ে থাকে। যেমন বাবা মারা-যাওয়া শিশু, বা বাবা-নিখোঁজ শিশুর ক্ষেত্রে বিকল্প পিতা-অভিভাবক তৈরি করে বহু বিবাহ প্রথা শিশুকে অনাথ এতীমী জীবন থেকে উদ্ধার করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘আর যদি আশংকা কর যে, এতীমদের ক্ষেত্রে ইনসাফ করতে পারবে না তাহলে পছন্দমত দুই তিন বা চার নারী বিয়ে কর। যদি আশংকা হয় যে, ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না তাহলে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এটাই অন্যায় পক্ষপাতে আক্রান্ত না হওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায়’- সূরা নিছা (৩)। এভাবে বিয়ের বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী, পুরুষ তথা গোটা সমাজের কল্যাণের প্রতি সযত্ন মনযোগ দিয়েছে। এমন বিধান দিয়েছে যা উভয় পক্ষের জন্য দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্যকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত করে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদা পুর্ণ করে।
সুতরাং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা নির্ধারণ করা জরুরী। এখানে আমরা নারীর অধিকার ও ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের মূলনীতিগুলো আলোচনা করছি :
১. মূল যে দুই অংশ দ্বারা গড়ে উঠেছে মানব প্রজাতি, নারী তার একটি। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন যুগল : পুরুষ ও নারী’- সূরা নাজম (৪৫)। দুই অঙ্গে গড়া নফসের একটি অঙ্গ নারী। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘হে মানুষ তোমরা তোমাদের রবের তাক্বওয়া অবলম্বন কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গীকে’- সূরা নিছা (১)। সুতরাং আদি সৃষ্টি, মাঝের জীবৎকালের দায়িত্ব এবং পরিণতি, সর্ব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমমানের সঙ্গি। জীবন, সমাজ জগৎ বিনির্মাণে তারা উভয়েই অংশ গ্রহণ করে এবং আপন আপন বৈশিষ্ট অনুসারে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। ধর্মের ক্ষেত্রে বিশ্বাস, সাওয়াব, আযাব, কোন ক্ষেত্রেই, এবং শরীয়তে দেওয়া অধিকার ও দায়িত্ব, কোন এলাকাতেই পুরুষ ও নারীর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহ তায়ালা
এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘মোমেন পুরুষ অথবা নারী সৎ কর্ম করলে আমি তাকে উত্তম জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের থেকে উত্তম বিনিময় দান করব’- সূরা নাহাল (৯৭)। আবু দাউদ ও তিরমিযীতে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেছেন :
إنما النساء شقائق الرجال
অর্থাৎ ‘নারীরা পুরুষের অর্ধাঙ্গ’ - আবু দাউদ। এই সাম্য চেতনার কারণেই ইসলাম নিছক লিঙ্গের ভিত্তিতে কারো মর্যাদা নির্ধারণ করে নি বরং ইসলামের নিকট মর্যাদার পরিমাপক তাক্বওয়া। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি সে যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মুত্তাকি’- সূরা হুজরাত (১৩)। নারী ও পুরুষের অর্থবহ কোন সমতা-ভাবনা প্রকাশ করার জন্য ‘তোমরা একে অপরের অংশ’। এর থেকে সূক্ষ্ম ও অর্থবোধক কোন ভাষিক প্রকাশ থাকতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তখন তাদের রব তাদের ডাকে সাড়া দিলেন যে, আমি তোমাদের নারী-পুরুষ কারো কোন আমল ব্যর্থ করব না, তোমরা একে অপরের অংশ’- সূরা আলে ইমরান (১৯৫)। সুতরাং মানবিকতায়, ধর্ম ও শরীয়তের বিধান মালায়, এবং আল্লাহর নিকট মর্যাদার বিচারে নারী-পুরুষ সমান।
বিশেষ এক হিকমতে আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি ও শারীরিক গঠন দান করেছেন। শারীরিক গঠনের তারতম্যের কারণে নারী ও পুরুষের শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি ও স্বভাব এক নয়। উভয়ের মধ্যে তারতম্য আছে। শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবে নারী-পুরুষ অভিন্ন নয়। আল্লাহ তায়ালা পুরুষ সম্পর্কে বলেছেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘পুরুষ তো নারীর মত নয়’- সূরা আলে ইমরান (৩৬)। এবং নারী সম্পর্কে বলেছেন:
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যে অলংকারের মাঝে লালিত হয় এবং যে তর্কে অস্পষ্ট ’- সূরা যুখরুফ (১৪)।
শরীয়তের কিছু বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই গঠনগত ও প্রকৃতিগত ব্যবধানের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে ,নারী ও পুরুষের জন্য, তাদের নিজস্ব গঠন ও প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বিধান ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। শরীয়তের বিধানদাতা আল্লাহ তায়ালা তার হিকমাত সর্বজ্ঞানী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তায়ালার অমোঘ হিকমাতের দাবি অনুযায়ী তা করা হয়েছে। কোরআনের এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(আরবি)
অর্থাৎ জেনে রাখ, সৃজন ও আদেশ তারই, জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ বরকতময়’- সূরা আ’রাফ (৪৫)। ওটা হল আল্লাহ তায়ালার মহাবৈশ্বয়িক সৃষ্টি, নির্মাণ, নির্ধারণ বিষয়ক ইচ্ছা, আর এটা হল নির্দেশ, বিচার, বিধান প্রণয়নে আল্লাহ তায়ালার দ্বীন ও শরীয়ত বিষয়ক ইচ্ছা। নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে- সৃষ্টিজগতের স্বার্থ, পৃথিবীর নির্মাণ-কর্ষণ, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সৃঙ্খলা বিধান এসবের আলোকে- এ উভয় ইচ্ছা একত্রিত হয়েছে।
২. এই অনড় বাস্তবতার উপর ভিত্তি করেই বিন্যস্ত হয়েছে ইসলামী শরীয়তের অনেকগুলো বিধান, যার অন্যতম পরিবার বিষয়ক বিধানাবলী। ইসলামের ভাবনায় পরিবার সমাজ সংগঠনের একক। পরিবারের সুসম বিন্যাস, শক্তি ও টিকে থাকার উপরই নির্ভর করে সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্ত্বা। পরিবার তার সদস্যদের মধ্যে প্রশান্তি, ভালবাসা ও সহমর্মিতার পরস্পর বিনিময় নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই দায়িত্ব পালনের লক্ষ্য স্থির করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তার অন্যতম নিদর্শন : তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন সঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও। এবং তিনি তোমাদের মাঝে দিয়েছেন ভালবাসা ও দয়া’- সূরা রূম (২১)।
সমকালের পশ্চিমা জাহেলিয়্যাত নির্বোধের মত নারীর পারিবারিক ভূমিকাকে হালকা করে দেখে, তুচ্ছ মনে করে নারীর পারিবারিক এই দায়িত্বকে। যে কোন সুস্থ সমাজকে অবশ্যই এই চিন্তা মোকাবেলা করতে হবে। ইসলাম তো মনে করে পরিবার ও পরিবার সংক্রান্ত দায়িত্বগুলোই হচ্ছে মুসলিম নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নারী যদি এই দায়িত্ব পালন করে তাহলে তাই হবে সমাজের জন্য, সবার জন্য, মঙ্গলকর।
সামাজিক দায়িত্ব বন্টনে ইসলামী শরীয়ত, অপর দিকে, পুরুষকে দিয়েছে পরিবারের তত্বাবধান ও অবিভাকত্বের দায়িত্বগুলো। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘পুরুষ নারীর দায়িত্বশীল। কারণ আল্লাহ তাদের একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ-কারণেও যে পুরুষরা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে ’- সূরা নিছা (৩৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘নারীর উপর পুরুষের যেমন তেমনি, নীতি অনুযায়ী, পুরুষের উপরও নারীরও অধিকার রয়েছে। তবে নারীদের উপর রয়েছে পুরুষদের একস্তর শ্রেষ্ঠত্ব ’ - সূরা বাক্বারা (২২৮) ‘কিওয়ামাহ’ বা পারিবারিক অবিভাকত্বের মানে ক্ষুদ্র সমাজের অর্থাৎ পরিবাবের নেতৃত্ব দেওয়া-পরিচালনা করা। স্বেচ্ছাচারিতা ও অধিপত্যকামী মনোভাব থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষকে নেতৃত্বের এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব আদায়ের মাধ্যমে পুরুষ, নারী এবং পরিবারের কল্যাণে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন পুরুষ পরিবারের আর্থিক ব্যয়ভার বহন করে, তার নিরাপত্বার দায়িত্ব নেয়, পরিবারের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। সুতরাং নেতৃত্বমূলক কোন দায়িত্ব স্বার্থকভাবে পালন করার জন্য নেতার প্রতি যতটুকো আনুগত্য জরুরী স্বাভাবিক পুরুষ তা পাবে। তবে আনুগত্য হবে কল্যাণ কাজে। ইসলাম নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দেয় নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
إنما الطاعة في المعروف
অর্থাৎ ‘আনুগত্য হবে কল্যাণ কাজে কিংবা সঠিক বিচার অনুসারে ’- বোখারী ও মুসলিম।
৩. নারীর আর্থিক ব্যায়ভার গ্রহণ করা পুরুষের দায়িত্ব। পুরুষের সম্পত্তির একটি ভাগ, এই অধিকার বলে, নারীর প্রাপ্য। এই দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হলে পুরুষ কখনোই তা এড়াতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করনে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘স্বচ্ছল ব্যক্তি যেন তার সচ্ছলতা অনুসারে খরচ করে। আর যার সক্ষমতা সীমিত সে যেন, আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন, তা থেকেই খরচ করে। আল্লাহ কোন ব্যক্তির উপর তাকে যতটুকো সাধ্য দিয়েছেন তার বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। অচিরেই আল্লাহ অসচ্ছলতার পর সচ্ছলতা দান করবেন’- সূরা তালাক (৭)। স্বামীর পক্ষ থেকে আর্থিক ব্যয় লাভ নারীর অধিকার। এবং তার নিজস্ব সম্পত্তির মালিকানা ও ব্যবহারের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। নিজস্ব সম্পত্তির মালিকানা এবং তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মত স্বাধীন, অভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্তও পশ্চিমা জাহেলিয়্যাত নারীকে স্বাধীন উপার্জন এবং নিজস্ব মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার দেয় নি। রোমান আইনে নারীকে এই অধিকার দেওয়া হয় নি। উপার্জন, সম্পদের মালিকানা এবং তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। এই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে কোন ফারাক নেই।
ইসলাম নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং তাদের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব নির্ধারণ ও বন্টন করেছে সম্পূরুক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ নারী তার নির্ধারিত দায়িত্ব আদায়ের মাধ্যমে পুরুষকে সম্পূর্ণতা দান করবে অনুরূপ পুরুষ সম্পূর্ণতা দান করবে নারীকে। এই সম্পূরক কর্তব্য বন্টনের অন্যতম লক্ষ্য নারীর সান্নিধ্যে পুরুষের ‘ছাকান’ বা প্রশান্তি লাভ এবং উভয়ের মাঝে ভালবাসা ও সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তার নিদর্শনসমূহের অন্যতম হচ্ছে তিনি তোমাদের নফস থেকেই তোমাদের সঙ্গিনীদের তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি পেতে পার। এবং তোমাদের দিয়েছেন ভালবাসা ও দয়া’- সূরা রূম (২১)। এখানে ব্যবহৃত ‘সাকান’ শব্দটি খুবই ব্যাপক অর্থবোধক। এই ক্ষেত্রে, এই অর্থ উৎপাদনের জন্য আরবীতে- সম্ভবত অন্য কোনো ভাষাতেও- এর চেয়ে ভাল আর কোন শব্দ নেই। শব্দটির মাঝে অনেকগুলো অর্থ একত্রিত হয়েছে, উদাহরণত নিরাপত্বা, শান্তি, প্রশান্তি, আপনত্বের অনুভূতি ইত্যাদি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে যদি এই গুণগুলো বিকশিত হয় তাহলে এর সুফল ভোগ করে, সর্বপ্রথম স্বামী-স্ত্রী নিজেই, এরপর সন্তানরা এভাবে গোটা সমাজ।
আমরা আগেই দেখিয়েছি নারী-পুরুষ সৃষ্টিগতভাবেই এক নয়। তাদের মাঝে শারীরিক ও মানসিক অনেক ফারাক আছে। নারী-পুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখেছে এবং তাদের নিজ নিজ প্রাকৃতিক-জৈব বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতার সাথে সঙ্গতি রেখে সম্পূরক পদ্ধতিতে তাদের দায়িত্ব বন্টন ও অধিকার নির্ধারণ করেছে। মানবিক সম্পর্ক বিনির্মাণে ইসলাম ন্যায় ও ইনসাফের যে ভিত্তি দিয়েছে এটা তারই ফল।
যার যে স্বাভাবিক দায়িত্ব, সম্পূরক সমাজিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে, তাকে তার থেকে বেশী দায়িত্ব দেওয়া হলে বা স্বেচ্ছায় তার থেকে বেশী দায়িত্ব নিলে অনেক সময় তার দ্বারা সমাজ উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কারণ তার ফলে সামাজিক সংগঠন ব্যাহত হয়। তাই ব্যক্তিগত ও সামাজিক কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া নারীর উপর পুরুষের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, এক প্রকার জুলুম। এটা দায়িত্ব বন্টন ও অধিকারের সুসঙ্গতাকে নষ্ট করে। এর মাধ্যমে নারীর সম্মান বিদীর্ণ করা হয়। নারীর নারীত্বকে অপদস্থ করা হয়।
৫. ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন এবং ব্যাপকভাবে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নারীর দায়িত্ব কি, তা স্পষ্ট করা এবং সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যে বিষয়টি অনিবার্য পূর্বশর্ত তা হল -শিক্ষা। তাই আমরা মনে করি, যা ছাড়া মানুষ তার রবের এবাদত পূর্ণাঙ্গরূপে আদায় করতে পারবে না-যেমন বিশ্বাস ও অনুশীলনের অনিবার্য বিষয়গুলো- সেই সব বিষয়ে শিক্ষাদান একটি অনিবার্য শরীয়তী নির্দেশ এবং সেই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোন ফারাক নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
طلب العلم فريضة علي كل مسلم
অর্থাৎ ‘জ্ঞান অন্বেষণ প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরজ’- ইবনে মাজা। ইসলামের এই মৌলিক বিধানগুলোর বাইরের অন্যান্য বিধানের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যে নিজ নিজ ভূমিকা ও দায়িত্ব সে অনুসারে জ্ঞান অর্জন করবে। এর বাইরের যে জ্ঞান চর্চা তা নফল, তা আদায় করতে গিয়ে পার্থিব ও অপার্থিব ফরজ আমলগুলো ব্যহত করা যাবে না।
৬. ইসলাম নরীর অধিকারগুলো নির্ধারণ করেছে তার জৈব ও প্রাকৃতিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গতি রেখে। পক্ষান্তরে জাতীসংঘ মানুষের অধিকারের যে সনদ পেশ করেছে তাতে নারীর অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে একটি অনুরূপ সাম্যতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। ইসলাম নারীকে যে সব অধিকার দেয় এবং জাতিসংঘের এই অধিকার সনদে নারীর জন্য যে সব অধিকারের কথা বলা হয়েছেত এই দুয়ের তুলনামূলক পাঠ নিলে দেখা যাবে ইসলাম নারীকে যে সব সামাজিক অধিকার দিয়েছে তা জাতিসংঘের দেওয়া অধিকারগুলো থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই অধিকারগুলো সম্পর্কে পশ্চিমা জাহেলিয়াত উদাসীন। তাই কোনরূপ দ্বিধা না করে সে এইগুলো এড়িয়ে যায়, অকার্যকর করে দিতে চায়। উদাহরণত বিয়ে, মাতৃত্ব, গৃহ পরিচালনা এবং পারিবারিক অবকাঠামোর মধ্যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো অনুশীলন ও বিকশিত করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত নারীকে যে অধিকার দিয়েছে, আধুনিক জাহেলিয়াতের বিধান-সনদে তা নেই।
ইসলাম নরীকে স্বামী নির্বাচনের অধিকার দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে রাসূল স্বামীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দিয়ে তার সাহায্যে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিয়েছে নারীকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
إذا أتاكم من ترضون خلقه ودينه فزوجوه
অর্থাৎ ‘যার চরিত্র ও দ্বীনদারি তোমরা পছন্দ কর , তোমাদের নিকট যদি এমন কেউ আসে তাহলে তার নিকট বিয়ে দাও’-ইবনে মাজা। কোন কারণে দাম্পত্য জীবন যদি সংকটের মুখে পড়ে তাহলে শরীয়ত নারীকে স্বামীর সাথে না থাকার অধিকার দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে কোরআনে অনেক আয়াত ও সহীহ ও স্পষ্ট হাদীস আছে। এই বিষয়ে যে কোন বিধান সেগুলোর সাপেক্ষেই নির্ধারিত হওয়া উচিত।
নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষা ইসলামী শরীয়তের একটি বিধান। যে পাঁচটি বিষয় শরীয়তের সামাজিক বিধান গুলোর মূল, অর্থাৎ দ্বীন, মর্যাদা, আক্বল, মাল, নারীর মর্যাদা রক্ষা তার অন্যতম। কোন ভাবে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা মানে শরীয়তের বিরুদ্ধে যাওয়া, নারী-পুরুষ, পরিবার ও সমাজের অধিকার লংঘন করা। এবং তা মোমেনদের মাঝে অশ্লিলতা ছাড়ানোর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে, যার সম্পর্কে কোরআনে এসেছে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যারা মোমেনদের মাঝে অশ্লিলতা ছড়াতে চায় তাদের জন্য দুনিয়া আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাকর শাস্তি। আল্লাহ জানেন তোমরা জান না’- সূরা নূর (১৯)। ইসলামের সমাজ ভাবনা ও বিধানে এটি মৌলিক একটি বিষয়। এই মৌলিক বিষয়টিকে রক্ষা করার জন্য ইসলাম অনেকগুলো বিধান দিয়েছে। যেমন ইসলাম অনেক গুরুত্বের সাথে বিয়ের বিধান দিয়েছে এবং বিয়ের চুক্তিকে বলেছে ‘কঠিন প্রতিশ্রুতি’। যেমন কোরআনে এসেছে:
(আরবি)
অর্থাৎ ‘আমি তোমাদের কাছ থেকে নিয়েছি কঠিন প্রতিশ্রুতি’- সূরা নিছা (২১)। এই মূল বিষয়টি যেন ব্যহত না হয় তাই ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়ের উপর সমভাবে যিনা হারাম করেছে। কোরআনে এসেছে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তোমরা যিনার নিকটেও যেও না। কারণ তা অশ্লীল এবং খুবই খারাপ পথ’- সূরা ইছরা (৩২)। যে সব বিষয় ব্যক্তি ও সমাজকে ব্যভিচারের দিকে নিয়ে যায় ইসলাম তা বন্ধ করে দিয়েছে। বিবাহ বন্ধন হারাম নয় এমন নারীর সাথে নির্জন ও ঘনিষ্ট মেলামেশা-কথাবার্তা নিষিদ্ধ। সমাজে যে কোন ধরনের অশ্লীলতা ছড়ানোকে কঠিনভাবে বাঁধা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং গুরুত্বের সাথে প্রণয়ন করছে হিজাব ও এই সংক্রান্ত বিধানগুলো। এবং যারা এই বিষয়টি ক্ষুণ্ণ করে তাদের জন্য ইসলাম দিয়েছে শাস্তির বিধান । এই উদ্দেশ্যেই ইসলামে যিনার কঠিন শাস্তি-বিধানগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। এভাবে ইসলাম নারীর সম্ভ্রব ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টিকে নানাভাবে গুরুত্ব দিয়েছে।
সম্ভ্রম ও শালীনতা রক্ষা এবং অশ্লীলতার বিস্তার রোধের জন্য ইসলামী শরীয়ত যে কয়টি সামাজিক দূর্গ নির্মাণ করেছে তার অন্যতম হল হিজাব। কেবল তাই নয় বরং হিজাব নারী ও পুরুষের সম্ভ্রম-মর্যাদার প্রতি যত্নবান শরীয়তের অন্যতম প্রতীক।
হিজাব কোন নফল বিধান নয়। কিংবা হিজাব ঐচ্ছিক প্রতীকী কোন অনুশীলন নয় যে, কারো মনে চাইলে তা পালন করবে বা করবে না। বরং নারীর মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার একটি উপায় হিসেবে আল্লাহ নারীদের উপর হিজাব ফরজ করেছেন। এর ফলে কাম ও প্রবৃত্তির অনুসারী দুষ্টরা তাদের উত্তক্ত করতে পারবে না। এটি অবশ্যপালনীয় ফরজ বিধান। নারীদের আদর্শ ‘উম্মাহাতুল মোমেনীন’ এর উপরও তা ফরজ ছিল। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘হে নবী আপনি আপনার স্ত্রী ও কন্যা এবং মোমেন নারীদের বলুন তারা যেন হিজাব দিয়ে ঢেকে থাকে। তাহলে তাদের চিনা যাবে না এবং তাদেরকে কেউ উত্ত্যক্ত করবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল দায়ালু’- সূরা আহযাব (৫৯)।
ইসলামের শত্রুরা এবং প্রবৃত্তির অনুসারী ও মানুষের কামুক বৃত্তিগুলো ভাঙ্গিয়ে যারা বাণিজ্য করে তারা ইসলামী হিজাবকে খুবই নগ্নভাবে হামলা করে থাকে। আবার অনেক সমাজ ও ডিসকোর্স হিজাব গ্রহণ করে নেয়। তবে অন্তসার ও লক্ষ্যশূন্য জাতীগত একটি প্রথা হিসেবে। বাহ্যত হিজাব পালন করলেও এরা হিজাবের মিত্র নয়। হিজাবকে সরাসরি অস্বীকারের সাথে এর মৌলিক কোন তফাত নেই। দুটিই ইসলামী শরীয়ত ও হিজাবের শত্রু।
কিন্তু শরীয়ার বিধান হিসেবে তো অবশ্যই, হিজাব এবং তার সাথে সম্পৃক্ত মূল্যবোধ- আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি- যে কোন মাবনীয় সমাজের সুস্থ্য জীবনের জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে হিজাবের প্রতি এত বিদ্বেষ কেন ? উদাহরণত পশ্চিম, বিস্ময়করভাবে, হিজাবের ক্ষেত্রে খুবই সংকীর্ণ আচরণ করে। হিজাব নিয়ে তারা খুবই শংকিত ও বিব্রত বোধ করে। আর কোন ধর্ম-সম্প্রদায় বা মাবন-গোষ্ঠীর পোষাক নিয়ে পশ্চিমকে এমন সংকীর্ণ আচরণ করতে দেখা যায় না। পশ্চিমের দেশগুলো এবং পশ্চিম আক্রান্ত ধর্ম নিরপেক্ষ মুসলিম দেশগুলোতেও আইন ও বাস্তব আচরণ, উভয় উপায়ে হিজাবকে নানাভাবে আক্রমন করা হচ্ছে। এর কারণ কি ? - তা নিয়ে ভাবলে আমাদের নিকট অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।
হিজাব, পূর্বে আমরা প্রমাণ করেছি, ইসলামী শরীয়তের একটি মৌলিক ফরজ। ইসলাম এই বিধান দিয়েছে নারী ও সমাজের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য, নারীর সম্ভ্রমকে সমর্থন করার জন্য। শরীয়তের অপর যে বিধানটি এই লক্ষ্যের সাথে জড়িত এবং তাকে শক্তি যোগায় তা বহু বিবাহ। তবে বিকৃত প্রচারণা এবং ভুল অনুশীলন-চর্চার ফলে এই বিধান তার মূল জায়গা থেকে সরে গিয়েছে। তার আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। বাস্তবতার পাঠ নিলে দেখা যাবে যে সমাজ, এমনকি যে সব অমুসলিম সমাজ এই প্রথার চর্চা করে তাতে নারীর মর্যাদা ও মূল্য তুলনামূলক ভাল। যাতে এই প্রথার অনুশীলন ও প্রচলন আছে এবং যা এই বিধানকে অবৈধ ও অপরাধমূলক মনে করে, এই দুই সমাজের তুলনামূলক পাঠ নিলেই এই সত্য উন্মোচিত হয়ে যাবে। দেখা যাবে দ্বিতীয় সমাজেই নারী তুলনামূলক কম মূল্য পাচ্ছে।
তাই বহু বিবাহ ইসলামী শরীয়তের একটি স্বীকৃত বিধান। ক্ষুণ্ণ নয়, এই বিধান নারীর মর্যাদাকে আরো নিশ্চিত করে। বৈধব্য, তালাক, পৌড়ত্ব/বিবাহহীনতার কারণে মেয়েদের আইবুড়ো হয়ে উঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদার সাথে বিয়ের যে সংকট দেখা দেয় বহু বিবাহ বিধান সে সংকটের সহজ সমাধান করতে পারে। বহু বিবাহ প্রথা আরো অনেক সমাজিক সংকটের তুলনামূলক সহজ ও কার্যকরী সমাধান। যেমন বন্ধাত্ব, অসুস্থতা, পেশা-প্রকৃতি কিংবা জাতীয়তার মত আইনগত সংকট। এই সব ক্ষেত্রে বহু বিবাহ ছাড়া অন্য যে সমাধানটি আছে তা তালাক, ইসলামের ভাবনায় তা নিকৃষ্টতম বৈধ বিধান, যা ইসলামের দাম্পত্য বিধানের মূল স্পিরিট- পরস্পর ভালবাসা, মায়া-তার বিরোধী। অনেক ক্ষেত্রে বহু বিবাহ শিশুর অভিভাবকহীনতার সমাধান হয়ে থাকে। যেমন বাবা মারা-যাওয়া শিশু, বা বাবা-নিখোঁজ শিশুর ক্ষেত্রে বিকল্প পিতা-অভিভাবক তৈরি করে বহু বিবাহ প্রথা শিশুকে অনাথ এতীমী জীবন থেকে উদ্ধার করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘আর যদি আশংকা কর যে, এতীমদের ক্ষেত্রে ইনসাফ করতে পারবে না তাহলে পছন্দমত দুই তিন বা চার নারী বিয়ে কর। যদি আশংকা হয় যে, ইনসাফ রক্ষা করতে পারবে না তাহলে একজনকে অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকে। এটাই অন্যায় পক্ষপাতে আক্রান্ত না হওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায়’- সূরা নিছা (৩)। এভাবে বিয়ের বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলাম নারী, পুরুষ তথা গোটা সমাজের কল্যাণের প্রতি সযত্ন মনযোগ দিয়েছে। এমন বিধান দিয়েছে যা উভয় পক্ষের জন্য দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্যকে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত করে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাহিদা পুর্ণ করে।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন