HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
মুসলিম নারীর অধিকার ও দায়িত্ব ইসলামের ইশতিহার ও সনদ
লেখকঃ ফায়সাল বিন খালেদ
৫
তৃতীয়ত: সনদের অভিমত১. মানুষ হিসেবে মানুষের যে সম্মান প্রাপ্য এবং যে অধিকারগুলো মানুষের মানবিক অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত সে ক্ষেত্রে এবং ব্যাপকভাবে ধর্ম ও শরীয়তের বিধানাবলীর ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের সমতা-অভিন্নতার কথা বলেছে এবং সাম্যমূলক বিধান দিয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক ও জন্মগতভাবেই নারী পুরুষ অনুরূপ ও অভিন্ন নয়। নারী-পুরুষের মাঝে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও জৈব এবং শারীরিক পার্থক্য রয়েছে। তার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণের সময় যার যার প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে ভিন্ন ভিন্ন বিধান দিয়েছে, যাতে উভয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে। নারীবাদী ডিসকোর্স ও আন্তর্জাতিক নারী সংগঠনগুলো এবং মুসলিম দেশগুলোতে তাদের অনুসারীরা নারীর সমান অধিকার নিয়ে যে হৈ চৈ করে, নারী-পুরুষের অভিন্ন সাম্যের শ্লোগান দেয়, তা কাল্পনিক, অপ্রাকৃতিক এবং খুবই অবাস্তব।
মৌল মানবিক ক্ষেত্রগুলোয় সমতা ও সমান অধিকার খুবই প্রাকৃতিক এবং ন্যায্য দাবি। কারণ নারী-পুরুষ হচ্ছে সেই দুই অঙ্গ যার মাধ্যমে মনুষ্যঅস্তিত্ব পূর্ণতা লাভ করে। ইসলাম সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে এই অধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু জীবনের যাবতীয় দায়িত্ব ও আদায়ের পদ্ধতির ক্ষেত্রে সমতা রক্ষার দাবি কি স্বাভাবিক?, তা বাস্তবায়ন কি সম্ভব ? নারী আন্দোলন, সংগঠন এবং নারীবাদীরা কি, সভা সেমিনার, তার শিল্প ও বিজ্ঞানসম্মত বক্তৃতা ও লেখালেখি দ্বারা বদলে দিতে পারেন বস্ত্তর ধর্ম-প্রকৃতি, মানুষের মৌল স্বভাব ? ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তা একটি বাস্তব সম্মত ধর্ম ও বিধান। তার স্বভাব অনুসারে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রেও ইসলাম বাস্তবতা এবং তাদের মৌল বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই বিধান দিয়েছে। সমতা যেখানে মৌল স্বভাবের দাবি সেখানে সমতা রক্ষা করেছে আর যেখানে ফারাক করাই বাস্তবতা, ফিতরাত বা মৌল স্বভাবের দাবি সেখানে ফারাক করেছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না ? তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত’- সূরা মুলক (১৪)।
সমাজের প্রকৃতি এবং মানুষের মৌল স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে পরিচালিত যে কোন আন্দোলন ও তৎপরতার একমাত্র পরিণতির নাম করুণ ব্যর্থতা। দীর্ঘ দেড় যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও, এমনকি পশ্চাত্য সমাজেও যে নারীবাদী আন্দোলনগুলো তাদের প্রত্যাশা পূরণে সফল হয় নি এটিই তার কারণ, এই দাবি-প্রত্যাশা প্রকৃতিবিরোধী। এ থেকেই আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি মুখরোচক এত শ্লোগান থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য সমাজে নারীবাদ বিরোধী নানা সংগঠন-আন্দোলন কেন গড়ে উঠছে, যারা নারীবাদের ধ্বংসাত্মক ফলাফলগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে। তার প্রতিরোধ করছে। সুতরাং ইসলামী সমাজগুলোর জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে পাশ্চাত্য সমাজের এই পরিণতি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা এবং তারা যেখানে শেষ করেছে সেখান থেকে শুরু করা, যেখান থেকে তারা শুরু করেছিল সেখান থেকে নয়। ইসলাম নারীর ক্ষেত্রে যে বিধান দিয়েছে তাই যে হিকমতপূর্ণ, মুসলিম সমাজগুলো পাশ্চাত্যের নারীবাদের এই পরিণতি থেকে সেই অনুভূতিকে শক্তিশালী করতে পারে। এই ইতিহাস হতে পারে তার একটি বাস্তব প্রমাণ।
যা নারীর অধিকারকে ব্যাহত করে বা তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, ইসলামী শরীয়ত নারীর বিরুদ্ধে এমন যে কোন পক্ষপাতমূলক আচরণ ও ধারণাকে হারাম মনে করে। নারীর বিপক্ষে এবং পুরুষের স্বপক্ষে অন্যায় কোন পক্ষপাত ইসলামী চিন্তা পদ্ধতি ও বিধানাবলীতে নেই। এগুলো মানসিকভাবে পরাজিত বা ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের ভুল ধারণা। যারা নারী পুরুষের প্রকৃতি ও জৈব পার্থক্যগুলো জানে না এবং তার ভিত্তিতে ইসলাম কোন কোন শরীয়তী বিধান এবং জীবনের কোন কোন দায়িত্ব ও অধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে ফারাক করেছে, তা বুঝতে পারে না তারাই এই ধরনের বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়। এর বাইরে নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষপাতের যে কোন দাবি- তা করতে পারে সচেতন শত্রু বা অজ্ঞ বন্ধু- মূলত অজ্ঞতা বা ভ্রান্ত যুক্তি নির্ভর।
নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের অন্যায় পক্ষপাতের নানা উদাহরণ দেওয়া হয়। তার অন্যতম : মিরাসের ক্ষেত্রে, মিরাসের উৎসের সাথে অভিন্ন আত্মীয়তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর জন্য পুরুষের অর্ধেক মিরাস নির্ধারণ। এই চিন্তা নারী-পুরুষের অনুরূপ সাম্যের পশ্চিমা ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং যে সুসম ইনসাফ ধারণার উপর ইসলাম মানবিক সম্পর্কগুলো সাজিয়েছে তা বুঝতে অক্ষম। এই ইনসাফ-ভাবনার দাবি, নারী ও পুরুষের অধিকার নির্ধারণ করা হবে নারী-পুরুষ উভয়ের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিবেচনা মনে রেখে। ইসলাম পুরুষকে নারীর আর্থিক ব্যয়ভার বহন করার অনিবার্য দায়িত্ব দিয়েছে, নারীর মহর আদায় করা পুরুষের উপর ওয়াজিব করেছে। মিরাস বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম যদি এই সব বিষয় বিবেচনায় এনে থাকে এবং পুরুষকে তুলনামূলক বেশী মিরাস দিয়ে থকে তাহলে সেটা কি ইনসাফপূর্ণ হবে না ? মূলত ইসলামী শরীয়তের খন্ডিত পাঠের ফলে এই ধরনের বিভিন্ন বিভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়।
নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের অন্যায় পক্ষপাতের দ্বিতীয় যে উদাহরণটি দেওয়া হয় তা, ইসলাম দুই নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অনুরূপ গণ্য করেছে। এই ভ্রান্তির ভিত্তি নারীর সৃষ্টিগত স্বভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা। আল্লাহ- বিশেষ এক হেকমতে- নারীকে বিশেষ এক স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই স্বভাব নারীকে অনেক সময় হাক্বিকত-সত্য অবধারণে বিপথে নিয়ে যায়। ফলে সঠিক সত্য অবধারণ ও আদায়ের জন্য সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে তার সহযোগী হিসেবে অপর একজন নারী থাকা জরুরী। অন্যথায় আইন অন্যায়-ফায়সালায় আক্রান্ত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যাতে তাদের একজন ভুলে গেলে অন্যজন স্মরণ করিয়ে দেয়’- সূরা বাক্বারা (২৪২)। তবে মনে রাখা উচিত নারীর একান্ত ও ঘনিষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে -যেমন দুগ্ধ দান, কুমারিত্ব, গোপন রমণীয় রোগগুলো- ইসলামী শরীয়ত একজন নারীর সাক্ষ্যকে গ্রহণযোগ্য মনে করে।
ইসলাম নারীর বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করেছে এই দাবির পক্ষে আরেকটি যুক্তি এই যে : ইসলামী বিধানে নারীর দিয়ত পুরুষের দিয়তের অর্ধেক। এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে যে জিনিসটি বুঝতে হবে তা হল, দিয়তের সম্পদ ব্যবহার করে তার দ্বারা উপকৃত হয় কি মৃত ব্যক্তি ? মৃত ব্যক্তি, সে পুরুষ হোক বা নারী, নয়, দিয়ত সম্পদ পায় কিন্তু তার ওয়ারিসরা। যে কোন বিধানের ক্ষতির বিনিময় বিধানের ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করা হয় ক্ষতির পরিমাণ অনুসারে। এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকাটি মাথায় রেখে এবার সিদ্ধান্ত নিন : যার উপর তাদের আর্থিক ব্যায়ভারের দায়িত্ব আরোপিত, যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ হয়ে থাকে , বৈষয়িক বিচারে সে মারা গেলে ওয়ারিসরা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে নাকি যার উপর তাদের এই সব বৈষয়িক দায় দায়িত্ব নেই সে মারা গেলে ? সুতরাং পুরুষ নিহত হলেই তার পরিবারের ওয়ারিসরা বৈষয়িকভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ক্ষতির বৈষয়িক ক্ষতিপুরণ অর্থাৎ দিয়তের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। এবং নারীর তুলনায় পুরুষের দিয়ত অধিক নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কারণেই আংশিক দিয়তের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে কোন ফারাক করা হয় নি। যেমন অঙ্গের দিয়তের ক্ষেত্রে। যদি কোন অঙ্গহানি ঘটে এবং যার অঙ্গহানি ঘটেছে সে জীবিত থাকে এই ধরনের ঘটনায় দিয়তের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তে নারী-পুরুষের মাঝে কোন ফারাক করা হয় নি।
এই আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি : যে সব ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত নারী-পুরুষের মাঝে ফারাক করেছে এবং নারী বিরোধী পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতের আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করা হয়, সেখানে মূলত ফারাক করাই ছিল ইনসাফের দাবি। সেটাই স্বাভাবিক এবং মানুষের বিধান নির্মাণের ইসলামী স্পিরিট ও পদ্ধতি তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
৩. শরীর, ভাবনা এবং আবেগের ক্ষেত্রে নারীর যে বিশেষ কাঠামো, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এইগুলো মূলত নারীকে একটি বিশেষ ও মৌলিক দায়িত্বের জন্য প্রস্ত্তত করে। সেই দায়িত্বটি মাতৃত্ব। নারী যদি এই দায়িত্ব পালন না করে তাহলে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে গড়া একটি জৈব-প্রাকৃতিক শক্তিকে অপচিত ও নষ্ট করা হবে। সুতরাং মাতৃত্ব ও তার সাথে সম্পর্কিত দায়িত্বগুলো পালন করাই নারীর প্রধান কর্তব্য। তবে যদি কোন ব্যক্তিগত বা সামাজিক কারণে নারীকে অন্য কাজ করতে, উপার্জনমূলক কোন পেশায় জড়াতে হয়, তাহলে তাতে ইসলামের কোন আপত্তি নেই। আর নারী যদি, তার পর যা হবার হোক, এমন ভাবনা থেকে অবাধ ভোগের জন্য স্বনির্ভর ও উপার্জনশীল হতে চায় এবং নানা ধরনের গৃহবহিরস্থ কাজ করে তাহলে ইসলাম তা অনুমোদন করবে না। নারী বিনা প্রয়োজনে কিংবা নির্বোধ কোন আবেগ তাড়িত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নানা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে শুরু করলে মানব প্রজন্মের জন্য তার ফলাফল খুব সুখকর হবে না। তাকে তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মাশুল দিতে হবে। এই ধরনের সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের ঐতিহাসিক অস্তিত্বকেই বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। কারণ সমাজ ও মানবিক ইতিহাস ও গঠন তার ধারাবাহিকতায় নারী-পুরুষ সম্পূরক উপাদানের মত কাজ করে। যে যার দায়িত্ব যদি পালন না করে তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য।
নারী একই সাথে শিশুর মা এবং কোন মনিবের মজুর হতে পারে না। এই অবস্থায় সে কোন দায়িত্বই সঠিক ও পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করতে পারে না। শিশুসদনের কর্মীরা শিশু পালনের বিষয়টি শামাল দিতে পারে, এম্পেরিসিজম-বাস্তব তথ্যনির্ভর পর্যবেক্ষণ এই দাবিকে সমর্থন করে না। তাছাড়া সে ক্ষেত্রে, যে জন্য দাম্পত্য জীবন, যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন ‘যাতে তোমরা তার নিকট প্রশান্তি পেতে পার’ এই পদ্ধতি তাকে ব্যহত করে নিশ্চিত। নারীকে ঘর পরিবার ও মাতৃত্বের দায়িত্ব থেকে বাইরে বের করে আনলে যদি বৈষয়িক উৎপাদন বাড়েও তাতে মানুষের কি আসে যায় যদি তার কারণে মানবিক উৎপাদন-জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
মানুষের স্বভাব এবং সমাজের প্রয়োজন উভয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেই ইসলাম নারীকে তার মূল দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহিত করেছে এবং একে এবাদতের মর্যাদা দিয়েছে, যার জন্য তার সৃষ্টি। তাকে এই কাজ করার প্রতিভা দান করেছে। নির্বিঘ্নে সে যেন এই দায়িত্ব আদায় করতে পারে সে জন্য শরীয়ত নানা ব্যবস্থা করেছে। যেমন পুরুষকে তার আর্থিক ব্যায়ভার গ্রহণের দায়িত্ব দিয়েছে, যাতে মনযোগ দিয়ে, নিশ্চিন্তে সে মানবিক উৎপাদনে নিয়োজিত থাকতে পারে, স্বামী-সন্তানের প্রশান্তি পূর্ণ করতে পারে। এবং সমাজকে নারীর তত্বাবধান গ্রহণ এবং সম্মাননায় উৎসাহিত করে। যেমন স্বামীর প্রতি কোরআনের আদেশ :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তোমরা তাদের সাথে উত্তম আচরণ কর’- সূরা নিছা (১৯)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: خيركم خيركم لأهلكم
অর্থাৎ ‘যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি’- তিরমিযী। রাসূল আরো এরশাদ করেন :
إستوصوا بالنساء خيرا
অর্থাৎ ‘তোমরা নারীদের হিতাকাংখী হও’- মুসলিম। এবং ইসলাম সন্তানকে মায়ের সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতি উৎসাহিত করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, কে আমার উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশী হক্বদার ? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা।
৪. মুসলামানকে, নারী ও পুরুষ উভয়কেই, যে কোন ধারণা ও শব্দকে বিচার করতে হবে তার ইসলামী অর্থের মধ্যে থেকে। ভ্রান্ত ও অন্য চিন্তা থেকে আমদানী করা কোন অর্থ বা ব্যাখ্যা দ্বারা নয়। সুতরাং ‘কাজ’ বা ‘পেশা, তার সদর্থকতা ও অর্থহীনতা বিচার করতে হবে তার ইসলামী ব্যাখ্যা দ্বারাই। নারীর কোন পেশা নেই। মুসলিম সমাজে নারী কাজ করতে পারে না । এই প্রকৃতির নেতিবাচক যে কথাগুলো সাধারণত বলা হয়, তা কাজের অনৈসলামী ব্যাখ্যা দ্বারা আক্রান্ত। আমরা মনে করি আদর্শ মুসলিম সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ করে। পুরুষ ‘কাজ’ করছে রিজিক বা অর্থ উপার্জন এবং সমাজ গড়ার জন্য তেমনি নারীও ‘কাজ’ করছে তার বাড়িতে, সমাজের মূলভিত্তি অর্থাৎ পরিবার নির্মাণে।
‘কাজ’ এর ব্যাখ্যা ও অর্থের ক্ষেত্রে অধিকাংশের চিন্তা বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত। নারীবাদীরা যখন নারীর কাজের কথা বলেন, নারীকে কাজ দেওয়ার দাবি জানান তখন ‘কাজ’ বলতে তারা মজুর-কর্মকে বুঝান অর্থাৎ এমন কাজ যার বিনিময় বা মজুরী থাকে, নারী কাজ করবে এমন কোন ব্যক্তির অধীনে যার সাথে তার সম্পর্ক হবে বিশুদ্ধ বৈষয়িক। সুতরাং এই চিন্তা, নারী তার বাড়িতে যে সব কাজ করে- উদাহরণত সন্তান প্রতিপালন, বাবা মায়ের সেবা, ঘরাকন্না করা, রান্না-বান্না করা- সেগুলোকে ‘কাজ’ মনে করে না। কারণ এই কাজে নারী কোন মজুরী পায় না। এই চিন্তা অ-মজুর নারীকে মনে করে অক্রিয়। তাদের ধারণা নারীকে যদি ঘর থেকে বের করে ‘কাজের বাজারে’ না আনা যায় তাহলে সমাজের অর্ধেক অক্রিয় হয়ে যাবে। এগুলো ভুল চিন্তা। তবে এই ধরনের ভাবনা শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবাইকে আক্রান্ত করেছে। এমনকি, নারী ঘরে থেকে সন্তান প্রতিপালন ও ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করবে নাকি ঘরের বাইরের কোন পেশায় নিয়োজিত হবে, এই সিদ্ধান্ত নারীর সামনে হাজির হয়েছে এই ভাষায় : তুমি স্বাধীন শ্রমিক হবে না অক্রিয় ঘরকুনো ? অথচ সঠিক ভাষায় বললে এই সিদ্ধান্তের ভাষা এমন হওয়া উচিৎ : তুমি অন্যের অধিনস্থ মজুর হবে না স্বাধীনভাবে তোমার নির্ধারিত প্রাকৃতিক দায়িত্ব পালন করবে ?
কাজ সম্পর্কে এই ভুল ধারণা পরিবার সমাজ এবং ব্যক্তি নারীকে, ঘরের স্বাধীন শ্রমিক না হয়ে, বাইরের অধীন মজুর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এর ফলে নারী অনেক গুলো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সে নিজের উপর জুলুম করে, স্বামী ও সন্তানদের পারিবারিক দায়িত্ব পালনের তার যে প্রাকৃতিক ভূমিকা তাতে অবহেলা করে, পুরুষের কর্ম সুযোগ সংকুচিত করে দেয়। এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তাতে নিরাপত্বা, অর্থনীতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর কারণে বিয়ে সংকট দেখা দেয় এবং বিবাহহীন আইবুড়ো নারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এইভাবে একটি প্রতারণামূলক লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে গিয়ে একটি সংকটময় পরিস্থিতির জন্ম দিতে বাধ্য হয় নারী। আশীর দশকে জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে ... ‘নারী বাইরের পেশায় জড়িত হওয়ার ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে/রাজস্বে ৪০% ভাগ চাপ বৃদ্ধি পায়’। সুতরাং, নারী উপার্জনশীল কাজে অংশগ্রহণ করলে অর্থনৈতিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, এই দাবী. জাতীসংঘের এই রিপোর্ট অনুসারেই, সঠিক নয়। এই রিপোর্টেই অন্য আরেক জায়গায় বলা হয়েছে : ঘরের কাজের জন্য যদি নারীকে মজুরী দেওয়া হয় তাহলে তা হবে প্রতিটি জাতির রাজস্ব ব্যায়ের অর্ধেক পরিমাণ’।
ব্যক্তিগত বা সামাজিক কোন প্রয়োজনে কোন নারী যদি, শরীয়তের সীমায় থেকে, তার স্বভাব-প্রকৃতির উপযোগী কোন পেশা গ্রহণ করে তাহলে শরীয়ত তাকে না-জায়েয বলবে না। কারণ সামাজিক ও ব্যক্তিক প্রয়োজনে কোন নারীর পেশা গ্রহণের তাগিদ পুরুষের কর্মক্ষেত্রে নারীর জোর প্রবেশের প্রমান হিসেবে অথবা নারী তার মূল কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসার দলিল হিসেবে দাঁড় করানো যায় না।
এই প্রয়োজন দূর করতে এবং তার পরিধি সংকীর্ণ করতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উদযোগী হতে হবে। এটা বড়ই অন্যায় হবে যে চাকুরির ক্ষেত্রে কর্ম প্রকার, কর্ম এলাকা, কর্ম সময়, ছুটি-অবকাশ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সাথে আচরণ হবে পুরুষের সমমান। বরং যেখানে নারীকে কাজ করতে হয় সেখানে নারীর বিশেষ স্বভাব ও শারীরিক কাঠামোর সাথে সংগতি রেখে এবং তার যে পারিবারিক মৌলিক দায়িত্ব রয়েছে তার কথা মনে রেখে নারী কর্মীদের জন্য কর্ম নির্বাচন বিষয়ে রাষ্ট্রকে দৃঢ়ভাবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সমস্যা সমূলে উৎপাটনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দারিদ্র্য মুক্ত করা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য নারীকে তার স্বভাবের অনুপযোগী কাজ গ্রহণ করতে বাধ্য করে।
৫. মুসলিম সমাজগুলোর প্রচলিত শিক্ষা এবং তার পদ্ধতি কৌশল নিয়ে নতুনভাবে ভাবা উচিৎ। নারী এবং তার কর্ম সংক্রান্ত সংকটের সাথেও শিক্ষা বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে যা সমাজকে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে প্রস্ত্তত করে। যে কাজ তার প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক দায়িত্ব , যা একান্ত তার সাথে সম্পৃক্ত সে ছাড়া আর কেউ তা পালন করতে পারে না, যে শিক্ষা নারীকে সে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত এবং প্রস্ত্তত করে তোলে। মুসলিম সমাজে নতুন সংস্কিৃত এবং এমন শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে যা নিন্মোক্ত মৌলিক লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে :
ক. এমন নারী বের করা যে তার রবের ইবাদত করবে সুন্দরভাবে।
খ. স্বামীর সাথে আচরণে হবে নান্দনিক।
গ. সন্তানদের প্রতিপালনে হবে আদর্শ মা।
ঘ. সংসার পরিচালনায় হবে আদর্শ ঘরণী।
ঙ. সমাজ বিনির্মাণে হবে আদর্শ রমণী।
নারী ও পুরুষের অনুরূপ শিক্ষাপদ্ধতি মূলত নারী বিরোধী এবং নারীর জন্য অবমাননাকর শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ এই শিক্ষা ব্যবস্থা নারীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনযোগ না দিয়ে নারী ও পুরুষকে একই সিলেবাস ও পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয় এবং নারী ও পুরুষকে একই দায়িত্ব ও পেশার জন্য প্রস্ত্তত করে। মেয়েদের বিবাহহীনতা, তালাক্ব, মানসিক হতাশা, ইত্যাদি সামাজিক সংকটের পিছনে, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো প্রমাণ করছে, এই তথাকথিত সম শিক্ষার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
সুতরাং সমাজের, বিশেষত সমাজের চিন্তাশীল সদস্যদের দায়িত্ব, যা শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষার লক্ষ্য, সব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অভিন্ন ব্যবস্থার কথা বলে, এমন যে কোন দাবি, সিদ্ধান্ত ও তৎপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং শরীয়তসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের চেষ্টা করা, যা কল্যাণের বিস্তার ঘটাবে, ফাসাদ দূর করবে, সামাজিক জীবনকে সুস্থ-স্থীর করবে, সমাজের প্রতিটি সদস্যকে তার উপযোগী অধিকার দান করবে এবং সমাজকে সম শিক্ষার অভিশাপ-অনিষ্ট - তা যে অনিষ্টকর, বাস্তব অভিজ্ঞতা তা প্রমাণ করেছে- থেকে মুক্তি দেবে।
৬. আল্লাহ তায়ালা জুলুম হারাম করেছেন। বান্দাদের মাঝে কোন ধরনের অবিচার করা যাবে না। এক হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন :
يا عبادي إني حرمت الظلم علي نفسي وجعلته بينكم محرما فلا تظالموا
অর্থাৎ ‘হে আমার বান্দারা আমি নিজের উপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের মাঝেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর অবিচার করো না’- মুসলিম। সুতরাং মুসলানদের অন্যতম দায়িত্ব ,সামাজিক ইনসাফ নিশ্চিত করা এবং সমাজকে জুলুমমুক্ত রাখা। সবচেয়ে নিকৃষ্ট সামাজিক জুলুম নারীর বিরুদ্ধে জুলুম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম এরশাদ করেছেন : ‘হে আল্লাহ ! আমি এতীম ও নারী এই দুই দুর্বলের হক্বের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছি’- নাছাঈ। নারীর বিরুদ্ধে জুলুম হতে পারে নানাভাবে। উদাহরণত নারীকে, সে মা বা স্ত্রী বা মেয়ে হোক, তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা, তার দুর্বলতা ও নারীত্বের সুযোগ নেওয়া। আল্লাহ তায়ালার দেওয়া জীবন পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যাওয়া, শরীয়ত বিরোধী নানা চিন্তা ও অনুশীলনের অনুসরণ এবং নারী-জুলুম বিরোধী কোন ধর্মীয় ও নৈতিক তৎপরতা না থাকার ফলে আজ সমাজে এই সব নারী-জুলুম ব্যাপক বিস্তার পেয়েছে। মুসলিম সমাজগুলো পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও জীবন পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে পাশ্চাত্য সমাজের সংকট ও অসুস্থতাগুলোয় আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিম সমাজগুলোও। উদাহরণত পারিবারিক বিবাদ, লৈঙ্গিক দ্বন্দ্ব, দাম্পত্য বিশ্বাসঘাতকতা মুসলিম সমাজে ইত্যাদি নেতিবাচক সামাজিক প্রবঞ্চগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। অনুরূপ ইনসাফহীন দাম্পত্য জীবন, নারীর উপর বলপ্রয়োগ, অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ আত্মসাৎ, তাদের অর্থনৈতিক তত্বাবধানে অবহেলা, তালাকের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা ও অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এই সব সামাজিক ও নারী-বিরোধী অপরাধে আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিম সমাজ। বাবা অনেক ক্ষেত্রে, তাদের প্রতিপালনে অবহেলা করে, আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পুত্রদের প্রতি অন্যায় পক্ষপাৎ করে কিংবা অপাত্রে বিয়ে বা বিয়ে বিলম্ব করে, জুলুম করছে মেয়ের উপর। এর কোনটিকেই শরীয়ত সমর্থন করে না। বরং এগুলো পবিত্র ইসলামী শরীয়ত থেকে দূরে সরারই অনিবার্য প্রাকৃতিক পরিণতি।
এই জুলুম দূর করা কিংবা সম্ভাব্য পরিমাণে তাকে লাঘব করা একটি শরয়ী দায়িত্ব। শুধু অনিবার্য শরয়ী দায়িত্ব হিসেবেই মুসলিম সমাজকে কাজ করে যেতে হবে : যে সব কারণ ও প্রথার ফলে এই জুলুম অন্যায় হচ্ছে তা সরাতে হবে অথবা সংস্কার করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও আইনী ব্যবস্থা ও তৎপরতাগুলো সহজ করতে হবে, যাতে এই জুলুমগুলোকে সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই রোধ করা যায় বা কোথাও সংঘটিত হয়ে গেলে তা বন্ধ করা যায়। মৌলিকভাবে এই ধরনের অন্যায়-অবিচার রোধকল্পে, সামাজিক পর্যায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক সচেতনা তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি ও সমাজের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনে অর্থবহ সংস্কার আনতে হবে, শরীয়ত আশ্রিত অধিকার ও বিধানাবলী এবং তা পালনের বৈধ উপায়গুলো সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। মুসলিম সমাজকে সতর্ক করতে হবে তারা যেন পশ্চিমা ভাবধারা, আচার-অনুশীলণ এবং তার অধিকার-চিন্তা ও তা বাস্তবায়ন পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই ক্ষেত্রে শরীয়তী বিধানের ব্যাপারে উদাসীন না হয়ে পড়ে।
৭. পশ্চিমের যে নির্দিষ্ট নারী ভাবনা ও অনুশীলন তার নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে পশ্চিম তার নিজস্ব নানা সংকট থেকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং পশ্চিমের নিজস্ব ভূ-ভাগ, পরিবেশ ও সমাজে, যদিওবা এই সিদ্ধান্তগুলোর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু পশ্চিম ছাড়া অন্য কোন ভূ-অঞ্চল ও সমাজ বিশেষত ইসলামী সমাজে এই চিন্তার অনুশীলনের কোন যুক্তি নেই। বরং অন্য পরিবেশ ও সমাজে তার প্রভাব অবশ্যই নেতিবাচক হতে বাধ্য। পশ্চিমের নির্দিষ্ট এই নারী ভাবনা ও অনুশীলনের মূল কারণ তিনটি : প্রথমত, পশ্চিমের আইন ও বিধান নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের পক্ষপাতপুষ্ট, ও তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও অধিকারগত ঐতিহাসিক বিবাদনির্ভর। আর এটাকেই বিশ্বায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও এ ভূ-খন্ডের সাংস্কৃতিক ও আইনি তফাত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বিস্তর। দ্বিতীয়ত : পশ্চিমের লোকদের পুজিবাদী-মুনাফাকামী মানসিকতা এর আরেকটি কারণ। পশ্চিমের দেশগুলোতে বস্ত্তকেন্দ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বস্ত্তস্বার্থ নিয়ন্ত্রণকারী কোন চারিত্রিক ও মূল্যবোধিক ধারাকে আদৌ মূল্যায়ন করা হয়না। তৃতীয়ত : যাবতীয় নীতি নৈতিকতা, মূল্যবোধ এড়িয়ে মুনাফাকামী মানসিকতাই ক্রিয়াশীল থাকে পশ্চিমাদের মাঝে। কাছাকাছি বসবাস, অথবা পরিসংখ্যান-গবেষণা, ও বস্ত্তনিষ্ঠ রিপোর্টসমূহের পাঠ থেকে এ বিষয়টি উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ে। এই যাতনাদায়ক সামাজিক অবস্থাই- যা বিশ্বায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে- পাশ্চত্য সমাজের প্রকৃত চেহারা। যদিও তা সংবাদ মাধ্যমের প্রবঞ্চক পর্দায়, অধিকার বিষয়ক মিথ্যা মোড়কে, ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। কেননা সেখানে পারিবারিক হিংস্ত্রতা, শ্লীলতাহানী, যৌন বিড়ম্বনা-এমনকি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিকদের ক্ষেত্রেও - ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অনুরূপ জীবীকা অর্জনের উদ্দেশ্যেও বেড়ে চলেছে নারীর যাতনা। এক অভিবাবক সম্পন্ন অথবা আদৌ অভিভাবক নেই এ ধরনের বাচ্চাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমেই। এই সব নানা কারণে পশ্চিম, সামাজিক ও আইনগত প্রসেসের মধ্য দিয়ে, বিবাহ বহির্ভূত নারী-পুরুষের এক সাথে জীবনযাপন, পরিবারের বিকল্প হিসেবে হাজির করেছে। বিস্তার ঘটেছে জেন্ডার ধারণার। ফ্রান্সের পারলামেন্টে উপস্থাপিত একটি বাৎসরিক সরকারী রিপের্টে পশ্চিমা সমাজের পরিবার, বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে নারী সংকটের একটি ভয়াবহ চিত্র খোঁজে পাই। তাতে বলা হয়েছে : ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সোভিয়েতের পর, ফ্রান্স দ্রুত সেই পরিণতির দিকে যাচ্ছে, যেখানে বিয়ের হার দ্রুত কমছে, বিয়েপ্রথা হারিয়ে যাচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে নারী-পুরুষের বিয়েহীন স্বাধীন দাম্পত্যজীবন। বৎসরে ৪৫০.০০০ নারী-পুরুষ যুগল এই ধরনের স্বাধীন সম্পর্ক গড়ছে। তেমনি বাড়ছে সমকামীদের- গ্যে ও লেসবিয়ান- কোন যুক্তিহীন স্বাধীন দাম্পত্যজীবন। বর্তমানে এই ধরনের সম্পর্কের বাৎসরিক হার ৩০.০০০।
৮. মুসলিম সমাজে আইন প্রণয়ন পদ্ধতির দৈত্ব , এবং সামাজিক ও নৈতিকতা নির্দেশক উৎসের দৈত্ব, মূলত মুসলমানদেরকে দ্বীন সম্পর্কে বিভ্রান্ত করছে, দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে এমন এক অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে সব ধরনের আলো থেকে বঞ্চিত হতে হয় মানুষকে। ফলে তারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না। সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, নৈতিকতা, ইত্যাদি নানা প্রকৃতির ইটের সমন্বিত গাথুনিতেই গড়ে উঠে একটি সমাজ। ফলে এর কোন একটিতে যদি সংকট দেখা দেয় তাহলে তা অন্যান্য অঙ্গকেও আক্রান্ত করে। তাই সমাজ সংস্কারের ব্যাপারটি আমাদের ভাবতে হবে ব্যাপকভাবে। সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, নৈতিকতা, সব ক্ষেত্রেই ইসলামী শরীয়তকে মূল মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, পশ্চিমা ধর্ম-নিরপেক্ষতাকে তাড়াতে হবে আইনসহ সমাজের সকল জায়গা থেকে। সব কিছুর ভিত্তি হবে আল্লাহ প্রদত্ব প্রত্যাদেশ। যার আগে-পিছে কোন অসত্য আসতে পারে না। পবিত্র কোরআনে এসেছে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘সামনে, পিছনে কোন দিক থেকে তার নিকট বাতিল আসতে পারে না। তা অবতীর্ণ প্রশংসিত প্রজ্ঞাবানের কাছ থেকে’ -সূরা ফুসসিলাত (৪২)। সাথে সাথে মানবতাকে দিতে হবে মানবাধিকারের সত্যিকার বাস্তবায়িত রূপ। নারীকে দিতে হবে শরীয়ত নির্ধারিত ইনসাফের আওতায় স্বাধীনতা ভোগের পূর্ণ ইখতিয়ার। ধর্ম ও মূল্যবোধে আরোপিত নারীকে রক্ষা করতে হবে সকল প্রকার জুলুম অন্যায় থেকে। চাই তা পাঠশালায় হোক অথবা পরিবার গঠনের ইচ্ছাপোষণ কালে , অথবা প্রয়োজনের সময় রিজিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে।
মৌল মানবিক ক্ষেত্রগুলোয় সমতা ও সমান অধিকার খুবই প্রাকৃতিক এবং ন্যায্য দাবি। কারণ নারী-পুরুষ হচ্ছে সেই দুই অঙ্গ যার মাধ্যমে মনুষ্যঅস্তিত্ব পূর্ণতা লাভ করে। ইসলাম সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে এই অধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু জীবনের যাবতীয় দায়িত্ব ও আদায়ের পদ্ধতির ক্ষেত্রে সমতা রক্ষার দাবি কি স্বাভাবিক?, তা বাস্তবায়ন কি সম্ভব ? নারী আন্দোলন, সংগঠন এবং নারীবাদীরা কি, সভা সেমিনার, তার শিল্প ও বিজ্ঞানসম্মত বক্তৃতা ও লেখালেখি দ্বারা বদলে দিতে পারেন বস্ত্তর ধর্ম-প্রকৃতি, মানুষের মৌল স্বভাব ? ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তা একটি বাস্তব সম্মত ধর্ম ও বিধান। তার স্বভাব অনুসারে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রেও ইসলাম বাস্তবতা এবং তাদের মৌল বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখেই বিধান দিয়েছে। সমতা যেখানে মৌল স্বভাবের দাবি সেখানে সমতা রক্ষা করেছে আর যেখানে ফারাক করাই বাস্তবতা, ফিতরাত বা মৌল স্বভাবের দাবি সেখানে ফারাক করেছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না ? তিনিই সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত’- সূরা মুলক (১৪)।
সমাজের প্রকৃতি এবং মানুষের মৌল স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে পরিচালিত যে কোন আন্দোলন ও তৎপরতার একমাত্র পরিণতির নাম করুণ ব্যর্থতা। দীর্ঘ দেড় যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরও, এমনকি পশ্চাত্য সমাজেও যে নারীবাদী আন্দোলনগুলো তাদের প্রত্যাশা পূরণে সফল হয় নি এটিই তার কারণ, এই দাবি-প্রত্যাশা প্রকৃতিবিরোধী। এ থেকেই আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি মুখরোচক এত শ্লোগান থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য সমাজে নারীবাদ বিরোধী নানা সংগঠন-আন্দোলন কেন গড়ে উঠছে, যারা নারীবাদের ধ্বংসাত্মক ফলাফলগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে। তার প্রতিরোধ করছে। সুতরাং ইসলামী সমাজগুলোর জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে পাশ্চাত্য সমাজের এই পরিণতি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা এবং তারা যেখানে শেষ করেছে সেখান থেকে শুরু করা, যেখান থেকে তারা শুরু করেছিল সেখান থেকে নয়। ইসলাম নারীর ক্ষেত্রে যে বিধান দিয়েছে তাই যে হিকমতপূর্ণ, মুসলিম সমাজগুলো পাশ্চাত্যের নারীবাদের এই পরিণতি থেকে সেই অনুভূতিকে শক্তিশালী করতে পারে। এই ইতিহাস হতে পারে তার একটি বাস্তব প্রমাণ।
যা নারীর অধিকারকে ব্যাহত করে বা তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে, ইসলামী শরীয়ত নারীর বিরুদ্ধে এমন যে কোন পক্ষপাতমূলক আচরণ ও ধারণাকে হারাম মনে করে। নারীর বিপক্ষে এবং পুরুষের স্বপক্ষে অন্যায় কোন পক্ষপাত ইসলামী চিন্তা পদ্ধতি ও বিধানাবলীতে নেই। এগুলো মানসিকভাবে পরাজিত বা ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের ভুল ধারণা। যারা নারী পুরুষের প্রকৃতি ও জৈব পার্থক্যগুলো জানে না এবং তার ভিত্তিতে ইসলাম কোন কোন শরীয়তী বিধান এবং জীবনের কোন কোন দায়িত্ব ও অধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে ফারাক করেছে, তা বুঝতে পারে না তারাই এই ধরনের বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হয়। এর বাইরে নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষপাতের যে কোন দাবি- তা করতে পারে সচেতন শত্রু বা অজ্ঞ বন্ধু- মূলত অজ্ঞতা বা ভ্রান্ত যুক্তি নির্ভর।
নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের অন্যায় পক্ষপাতের নানা উদাহরণ দেওয়া হয়। তার অন্যতম : মিরাসের ক্ষেত্রে, মিরাসের উৎসের সাথে অভিন্ন আত্মীয়তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর জন্য পুরুষের অর্ধেক মিরাস নির্ধারণ। এই চিন্তা নারী-পুরুষের অনুরূপ সাম্যের পশ্চিমা ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং যে সুসম ইনসাফ ধারণার উপর ইসলাম মানবিক সম্পর্কগুলো সাজিয়েছে তা বুঝতে অক্ষম। এই ইনসাফ-ভাবনার দাবি, নারী ও পুরুষের অধিকার নির্ধারণ করা হবে নারী-পুরুষ উভয়ের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিবেচনা মনে রেখে। ইসলাম পুরুষকে নারীর আর্থিক ব্যয়ভার বহন করার অনিবার্য দায়িত্ব দিয়েছে, নারীর মহর আদায় করা পুরুষের উপর ওয়াজিব করেছে। মিরাস বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম যদি এই সব বিষয় বিবেচনায় এনে থাকে এবং পুরুষকে তুলনামূলক বেশী মিরাস দিয়ে থকে তাহলে সেটা কি ইনসাফপূর্ণ হবে না ? মূলত ইসলামী শরীয়তের খন্ডিত পাঠের ফলে এই ধরনের বিভিন্ন বিভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়।
নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের অন্যায় পক্ষপাতের দ্বিতীয় যে উদাহরণটি দেওয়া হয় তা, ইসলাম দুই নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অনুরূপ গণ্য করেছে। এই ভ্রান্তির ভিত্তি নারীর সৃষ্টিগত স্বভাব সম্পর্কে অজ্ঞতা। আল্লাহ- বিশেষ এক হেকমতে- নারীকে বিশেষ এক স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই স্বভাব নারীকে অনেক সময় হাক্বিকত-সত্য অবধারণে বিপথে নিয়ে যায়। ফলে সঠিক সত্য অবধারণ ও আদায়ের জন্য সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে তার সহযোগী হিসেবে অপর একজন নারী থাকা জরুরী। অন্যথায় আইন অন্যায়-ফায়সালায় আক্রান্ত হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘যাতে তাদের একজন ভুলে গেলে অন্যজন স্মরণ করিয়ে দেয়’- সূরা বাক্বারা (২৪২)। তবে মনে রাখা উচিত নারীর একান্ত ও ঘনিষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে -যেমন দুগ্ধ দান, কুমারিত্ব, গোপন রমণীয় রোগগুলো- ইসলামী শরীয়ত একজন নারীর সাক্ষ্যকে গ্রহণযোগ্য মনে করে।
ইসলাম নারীর বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করেছে এই দাবির পক্ষে আরেকটি যুক্তি এই যে : ইসলামী বিধানে নারীর দিয়ত পুরুষের দিয়তের অর্ধেক। এই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে যে জিনিসটি বুঝতে হবে তা হল, দিয়তের সম্পদ ব্যবহার করে তার দ্বারা উপকৃত হয় কি মৃত ব্যক্তি ? মৃত ব্যক্তি, সে পুরুষ হোক বা নারী, নয়, দিয়ত সম্পদ পায় কিন্তু তার ওয়ারিসরা। যে কোন বিধানের ক্ষতির বিনিময় বিধানের ক্ষেত্রে তা নির্ধারণ করা হয় ক্ষতির পরিমাণ অনুসারে। এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকাটি মাথায় রেখে এবার সিদ্ধান্ত নিন : যার উপর তাদের আর্থিক ব্যায়ভারের দায়িত্ব আরোপিত, যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ হয়ে থাকে , বৈষয়িক বিচারে সে মারা গেলে ওয়ারিসরা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে নাকি যার উপর তাদের এই সব বৈষয়িক দায় দায়িত্ব নেই সে মারা গেলে ? সুতরাং পুরুষ নিহত হলেই তার পরিবারের ওয়ারিসরা বৈষয়িকভাবে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ক্ষতির বৈষয়িক ক্ষতিপুরণ অর্থাৎ দিয়তের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। এবং নারীর তুলনায় পুরুষের দিয়ত অধিক নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কারণেই আংশিক দিয়তের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে কোন ফারাক করা হয় নি। যেমন অঙ্গের দিয়তের ক্ষেত্রে। যদি কোন অঙ্গহানি ঘটে এবং যার অঙ্গহানি ঘটেছে সে জীবিত থাকে এই ধরনের ঘটনায় দিয়তের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তে নারী-পুরুষের মাঝে কোন ফারাক করা হয় নি।
এই আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি : যে সব ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়ত নারী-পুরুষের মাঝে ফারাক করেছে এবং নারী বিরোধী পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতের আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করা হয়, সেখানে মূলত ফারাক করাই ছিল ইনসাফের দাবি। সেটাই স্বাভাবিক এবং মানুষের বিধান নির্মাণের ইসলামী স্পিরিট ও পদ্ধতি তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
৩. শরীর, ভাবনা এবং আবেগের ক্ষেত্রে নারীর যে বিশেষ কাঠামো, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এইগুলো মূলত নারীকে একটি বিশেষ ও মৌলিক দায়িত্বের জন্য প্রস্ত্তত করে। সেই দায়িত্বটি মাতৃত্ব। নারী যদি এই দায়িত্ব পালন না করে তাহলে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে গড়া একটি জৈব-প্রাকৃতিক শক্তিকে অপচিত ও নষ্ট করা হবে। সুতরাং মাতৃত্ব ও তার সাথে সম্পর্কিত দায়িত্বগুলো পালন করাই নারীর প্রধান কর্তব্য। তবে যদি কোন ব্যক্তিগত বা সামাজিক কারণে নারীকে অন্য কাজ করতে, উপার্জনমূলক কোন পেশায় জড়াতে হয়, তাহলে তাতে ইসলামের কোন আপত্তি নেই। আর নারী যদি, তার পর যা হবার হোক, এমন ভাবনা থেকে অবাধ ভোগের জন্য স্বনির্ভর ও উপার্জনশীল হতে চায় এবং নানা ধরনের গৃহবহিরস্থ কাজ করে তাহলে ইসলাম তা অনুমোদন করবে না। নারী বিনা প্রয়োজনে কিংবা নির্বোধ কোন আবেগ তাড়িত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে নানা পেশায় আত্মনিয়োগ করতে শুরু করলে মানব প্রজন্মের জন্য তার ফলাফল খুব সুখকর হবে না। তাকে তার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মাশুল দিতে হবে। এই ধরনের সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের ঐতিহাসিক অস্তিত্বকেই বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। কারণ সমাজ ও মানবিক ইতিহাস ও গঠন তার ধারাবাহিকতায় নারী-পুরুষ সম্পূরক উপাদানের মত কাজ করে। যে যার দায়িত্ব যদি পালন না করে তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য।
নারী একই সাথে শিশুর মা এবং কোন মনিবের মজুর হতে পারে না। এই অবস্থায় সে কোন দায়িত্বই সঠিক ও পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করতে পারে না। শিশুসদনের কর্মীরা শিশু পালনের বিষয়টি শামাল দিতে পারে, এম্পেরিসিজম-বাস্তব তথ্যনির্ভর পর্যবেক্ষণ এই দাবিকে সমর্থন করে না। তাছাড়া সে ক্ষেত্রে, যে জন্য দাম্পত্য জীবন, যার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন ‘যাতে তোমরা তার নিকট প্রশান্তি পেতে পার’ এই পদ্ধতি তাকে ব্যহত করে নিশ্চিত। নারীকে ঘর পরিবার ও মাতৃত্বের দায়িত্ব থেকে বাইরে বের করে আনলে যদি বৈষয়িক উৎপাদন বাড়েও তাতে মানুষের কি আসে যায় যদি তার কারণে মানবিক উৎপাদন-জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
মানুষের স্বভাব এবং সমাজের প্রয়োজন উভয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেই ইসলাম নারীকে তার মূল দায়িত্ব পালন করতে উৎসাহিত করেছে এবং একে এবাদতের মর্যাদা দিয়েছে, যার জন্য তার সৃষ্টি। তাকে এই কাজ করার প্রতিভা দান করেছে। নির্বিঘ্নে সে যেন এই দায়িত্ব আদায় করতে পারে সে জন্য শরীয়ত নানা ব্যবস্থা করেছে। যেমন পুরুষকে তার আর্থিক ব্যায়ভার গ্রহণের দায়িত্ব দিয়েছে, যাতে মনযোগ দিয়ে, নিশ্চিন্তে সে মানবিক উৎপাদনে নিয়োজিত থাকতে পারে, স্বামী-সন্তানের প্রশান্তি পূর্ণ করতে পারে। এবং সমাজকে নারীর তত্বাবধান গ্রহণ এবং সম্মাননায় উৎসাহিত করে। যেমন স্বামীর প্রতি কোরআনের আদেশ :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘তোমরা তাদের সাথে উত্তম আচরণ কর’- সূরা নিছা (১৯)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: خيركم خيركم لأهلكم
অর্থাৎ ‘যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম সেই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি’- তিরমিযী। রাসূল আরো এরশাদ করেন :
إستوصوا بالنساء خيرا
অর্থাৎ ‘তোমরা নারীদের হিতাকাংখী হও’- মুসলিম। এবং ইসলাম সন্তানকে মায়ের সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতি উৎসাহিত করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, কে আমার উত্তম ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশী হক্বদার ? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা।
৪. মুসলামানকে, নারী ও পুরুষ উভয়কেই, যে কোন ধারণা ও শব্দকে বিচার করতে হবে তার ইসলামী অর্থের মধ্যে থেকে। ভ্রান্ত ও অন্য চিন্তা থেকে আমদানী করা কোন অর্থ বা ব্যাখ্যা দ্বারা নয়। সুতরাং ‘কাজ’ বা ‘পেশা, তার সদর্থকতা ও অর্থহীনতা বিচার করতে হবে তার ইসলামী ব্যাখ্যা দ্বারাই। নারীর কোন পেশা নেই। মুসলিম সমাজে নারী কাজ করতে পারে না । এই প্রকৃতির নেতিবাচক যে কথাগুলো সাধারণত বলা হয়, তা কাজের অনৈসলামী ব্যাখ্যা দ্বারা আক্রান্ত। আমরা মনে করি আদর্শ মুসলিম সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ করে। পুরুষ ‘কাজ’ করছে রিজিক বা অর্থ উপার্জন এবং সমাজ গড়ার জন্য তেমনি নারীও ‘কাজ’ করছে তার বাড়িতে, সমাজের মূলভিত্তি অর্থাৎ পরিবার নির্মাণে।
‘কাজ’ এর ব্যাখ্যা ও অর্থের ক্ষেত্রে অধিকাংশের চিন্তা বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত। নারীবাদীরা যখন নারীর কাজের কথা বলেন, নারীকে কাজ দেওয়ার দাবি জানান তখন ‘কাজ’ বলতে তারা মজুর-কর্মকে বুঝান অর্থাৎ এমন কাজ যার বিনিময় বা মজুরী থাকে, নারী কাজ করবে এমন কোন ব্যক্তির অধীনে যার সাথে তার সম্পর্ক হবে বিশুদ্ধ বৈষয়িক। সুতরাং এই চিন্তা, নারী তার বাড়িতে যে সব কাজ করে- উদাহরণত সন্তান প্রতিপালন, বাবা মায়ের সেবা, ঘরাকন্না করা, রান্না-বান্না করা- সেগুলোকে ‘কাজ’ মনে করে না। কারণ এই কাজে নারী কোন মজুরী পায় না। এই চিন্তা অ-মজুর নারীকে মনে করে অক্রিয়। তাদের ধারণা নারীকে যদি ঘর থেকে বের করে ‘কাজের বাজারে’ না আনা যায় তাহলে সমাজের অর্ধেক অক্রিয় হয়ে যাবে। এগুলো ভুল চিন্তা। তবে এই ধরনের ভাবনা শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবাইকে আক্রান্ত করেছে। এমনকি, নারী ঘরে থেকে সন্তান প্রতিপালন ও ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করবে নাকি ঘরের বাইরের কোন পেশায় নিয়োজিত হবে, এই সিদ্ধান্ত নারীর সামনে হাজির হয়েছে এই ভাষায় : তুমি স্বাধীন শ্রমিক হবে না অক্রিয় ঘরকুনো ? অথচ সঠিক ভাষায় বললে এই সিদ্ধান্তের ভাষা এমন হওয়া উচিৎ : তুমি অন্যের অধিনস্থ মজুর হবে না স্বাধীনভাবে তোমার নির্ধারিত প্রাকৃতিক দায়িত্ব পালন করবে ?
কাজ সম্পর্কে এই ভুল ধারণা পরিবার সমাজ এবং ব্যক্তি নারীকে, ঘরের স্বাধীন শ্রমিক না হয়ে, বাইরের অধীন মজুর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। এর ফলে নারী অনেক গুলো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সে নিজের উপর জুলুম করে, স্বামী ও সন্তানদের পারিবারিক দায়িত্ব পালনের তার যে প্রাকৃতিক ভূমিকা তাতে অবহেলা করে, পুরুষের কর্ম সুযোগ সংকুচিত করে দেয়। এর ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তাতে নিরাপত্বা, অর্থনীতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর কারণে বিয়ে সংকট দেখা দেয় এবং বিবাহহীন আইবুড়ো নারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এইভাবে একটি প্রতারণামূলক লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে গিয়ে একটি সংকটময় পরিস্থিতির জন্ম দিতে বাধ্য হয় নারী। আশীর দশকে জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে ... ‘নারী বাইরের পেশায় জড়িত হওয়ার ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে/রাজস্বে ৪০% ভাগ চাপ বৃদ্ধি পায়’। সুতরাং, নারী উপার্জনশীল কাজে অংশগ্রহণ করলে অর্থনৈতিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, এই দাবী. জাতীসংঘের এই রিপোর্ট অনুসারেই, সঠিক নয়। এই রিপোর্টেই অন্য আরেক জায়গায় বলা হয়েছে : ঘরের কাজের জন্য যদি নারীকে মজুরী দেওয়া হয় তাহলে তা হবে প্রতিটি জাতির রাজস্ব ব্যায়ের অর্ধেক পরিমাণ’।
ব্যক্তিগত বা সামাজিক কোন প্রয়োজনে কোন নারী যদি, শরীয়তের সীমায় থেকে, তার স্বভাব-প্রকৃতির উপযোগী কোন পেশা গ্রহণ করে তাহলে শরীয়ত তাকে না-জায়েয বলবে না। কারণ সামাজিক ও ব্যক্তিক প্রয়োজনে কোন নারীর পেশা গ্রহণের তাগিদ পুরুষের কর্মক্ষেত্রে নারীর জোর প্রবেশের প্রমান হিসেবে অথবা নারী তার মূল কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসার দলিল হিসেবে দাঁড় করানো যায় না।
এই প্রয়োজন দূর করতে এবং তার পরিধি সংকীর্ণ করতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উদযোগী হতে হবে। এটা বড়ই অন্যায় হবে যে চাকুরির ক্ষেত্রে কর্ম প্রকার, কর্ম এলাকা, কর্ম সময়, ছুটি-অবকাশ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সাথে আচরণ হবে পুরুষের সমমান। বরং যেখানে নারীকে কাজ করতে হয় সেখানে নারীর বিশেষ স্বভাব ও শারীরিক কাঠামোর সাথে সংগতি রেখে এবং তার যে পারিবারিক মৌলিক দায়িত্ব রয়েছে তার কথা মনে রেখে নারী কর্মীদের জন্য কর্ম নির্বাচন বিষয়ে রাষ্ট্রকে দৃঢ়ভাবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সমস্যা সমূলে উৎপাটনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে দারিদ্র্য মুক্ত করা। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য নারীকে তার স্বভাবের অনুপযোগী কাজ গ্রহণ করতে বাধ্য করে।
৫. মুসলিম সমাজগুলোর প্রচলিত শিক্ষা এবং তার পদ্ধতি কৌশল নিয়ে নতুনভাবে ভাবা উচিৎ। নারী এবং তার কর্ম সংক্রান্ত সংকটের সাথেও শিক্ষা বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে যা সমাজকে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে প্রস্ত্তত করে। যে কাজ তার প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক দায়িত্ব , যা একান্ত তার সাথে সম্পৃক্ত সে ছাড়া আর কেউ তা পালন করতে পারে না, যে শিক্ষা নারীকে সে দায়িত্ব পালনের জন্য উপযুক্ত এবং প্রস্ত্তত করে তোলে। মুসলিম সমাজে নতুন সংস্কিৃত এবং এমন শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে যা নিন্মোক্ত মৌলিক লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে :
ক. এমন নারী বের করা যে তার রবের ইবাদত করবে সুন্দরভাবে।
খ. স্বামীর সাথে আচরণে হবে নান্দনিক।
গ. সন্তানদের প্রতিপালনে হবে আদর্শ মা।
ঘ. সংসার পরিচালনায় হবে আদর্শ ঘরণী।
ঙ. সমাজ বিনির্মাণে হবে আদর্শ রমণী।
নারী ও পুরুষের অনুরূপ শিক্ষাপদ্ধতি মূলত নারী বিরোধী এবং নারীর জন্য অবমাননাকর শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ এই শিক্ষা ব্যবস্থা নারীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনযোগ না দিয়ে নারী ও পুরুষকে একই সিলেবাস ও পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয় এবং নারী ও পুরুষকে একই দায়িত্ব ও পেশার জন্য প্রস্ত্তত করে। মেয়েদের বিবাহহীনতা, তালাক্ব, মানসিক হতাশা, ইত্যাদি সামাজিক সংকটের পিছনে, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো প্রমাণ করছে, এই তথাকথিত সম শিক্ষার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
সুতরাং সমাজের, বিশেষত সমাজের চিন্তাশীল সদস্যদের দায়িত্ব, যা শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষার লক্ষ্য, সব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের অভিন্ন ব্যবস্থার কথা বলে, এমন যে কোন দাবি, সিদ্ধান্ত ও তৎপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং শরীয়তসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের চেষ্টা করা, যা কল্যাণের বিস্তার ঘটাবে, ফাসাদ দূর করবে, সামাজিক জীবনকে সুস্থ-স্থীর করবে, সমাজের প্রতিটি সদস্যকে তার উপযোগী অধিকার দান করবে এবং সমাজকে সম শিক্ষার অভিশাপ-অনিষ্ট - তা যে অনিষ্টকর, বাস্তব অভিজ্ঞতা তা প্রমাণ করেছে- থেকে মুক্তি দেবে।
৬. আল্লাহ তায়ালা জুলুম হারাম করেছেন। বান্দাদের মাঝে কোন ধরনের অবিচার করা যাবে না। এক হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন :
يا عبادي إني حرمت الظلم علي نفسي وجعلته بينكم محرما فلا تظالموا
অর্থাৎ ‘হে আমার বান্দারা আমি নিজের উপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের মাঝেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর অবিচার করো না’- মুসলিম। সুতরাং মুসলানদের অন্যতম দায়িত্ব ,সামাজিক ইনসাফ নিশ্চিত করা এবং সমাজকে জুলুমমুক্ত রাখা। সবচেয়ে নিকৃষ্ট সামাজিক জুলুম নারীর বিরুদ্ধে জুলুম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম এরশাদ করেছেন : ‘হে আল্লাহ ! আমি এতীম ও নারী এই দুই দুর্বলের হক্বের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছি’- নাছাঈ। নারীর বিরুদ্ধে জুলুম হতে পারে নানাভাবে। উদাহরণত নারীকে, সে মা বা স্ত্রী বা মেয়ে হোক, তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা, তার দুর্বলতা ও নারীত্বের সুযোগ নেওয়া। আল্লাহ তায়ালার দেওয়া জীবন পদ্ধতি থেকে দূরে সরে যাওয়া, শরীয়ত বিরোধী নানা চিন্তা ও অনুশীলনের অনুসরণ এবং নারী-জুলুম বিরোধী কোন ধর্মীয় ও নৈতিক তৎপরতা না থাকার ফলে আজ সমাজে এই সব নারী-জুলুম ব্যাপক বিস্তার পেয়েছে। মুসলিম সমাজগুলো পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও জীবন পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে পাশ্চাত্য সমাজের সংকট ও অসুস্থতাগুলোয় আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিম সমাজগুলোও। উদাহরণত পারিবারিক বিবাদ, লৈঙ্গিক দ্বন্দ্ব, দাম্পত্য বিশ্বাসঘাতকতা মুসলিম সমাজে ইত্যাদি নেতিবাচক সামাজিক প্রবঞ্চগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। অনুরূপ ইনসাফহীন দাম্পত্য জীবন, নারীর উপর বলপ্রয়োগ, অন্যায়ভাবে তাদের সম্পদ আত্মসাৎ, তাদের অর্থনৈতিক তত্বাবধানে অবহেলা, তালাকের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা ও অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এই সব সামাজিক ও নারী-বিরোধী অপরাধে আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিম সমাজ। বাবা অনেক ক্ষেত্রে, তাদের প্রতিপালনে অবহেলা করে, আর্থিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পুত্রদের প্রতি অন্যায় পক্ষপাৎ করে কিংবা অপাত্রে বিয়ে বা বিয়ে বিলম্ব করে, জুলুম করছে মেয়ের উপর। এর কোনটিকেই শরীয়ত সমর্থন করে না। বরং এগুলো পবিত্র ইসলামী শরীয়ত থেকে দূরে সরারই অনিবার্য প্রাকৃতিক পরিণতি।
এই জুলুম দূর করা কিংবা সম্ভাব্য পরিমাণে তাকে লাঘব করা একটি শরয়ী দায়িত্ব। শুধু অনিবার্য শরয়ী দায়িত্ব হিসেবেই মুসলিম সমাজকে কাজ করে যেতে হবে : যে সব কারণ ও প্রথার ফলে এই জুলুম অন্যায় হচ্ছে তা সরাতে হবে অথবা সংস্কার করতে হবে। এই ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও আইনী ব্যবস্থা ও তৎপরতাগুলো সহজ করতে হবে, যাতে এই জুলুমগুলোকে সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই রোধ করা যায় বা কোথাও সংঘটিত হয়ে গেলে তা বন্ধ করা যায়। মৌলিকভাবে এই ধরনের অন্যায়-অবিচার রোধকল্পে, সামাজিক পর্যায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক সচেতনা তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি ও সমাজের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনে অর্থবহ সংস্কার আনতে হবে, শরীয়ত আশ্রিত অধিকার ও বিধানাবলী এবং তা পালনের বৈধ উপায়গুলো সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। মুসলিম সমাজকে সতর্ক করতে হবে তারা যেন পশ্চিমা ভাবধারা, আচার-অনুশীলণ এবং তার অধিকার-চিন্তা ও তা বাস্তবায়ন পদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই ক্ষেত্রে শরীয়তী বিধানের ব্যাপারে উদাসীন না হয়ে পড়ে।
৭. পশ্চিমের যে নির্দিষ্ট নারী ভাবনা ও অনুশীলন তার নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে পশ্চিম তার নিজস্ব নানা সংকট থেকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং পশ্চিমের নিজস্ব ভূ-ভাগ, পরিবেশ ও সমাজে, যদিওবা এই সিদ্ধান্তগুলোর একটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু পশ্চিম ছাড়া অন্য কোন ভূ-অঞ্চল ও সমাজ বিশেষত ইসলামী সমাজে এই চিন্তার অনুশীলনের কোন যুক্তি নেই। বরং অন্য পরিবেশ ও সমাজে তার প্রভাব অবশ্যই নেতিবাচক হতে বাধ্য। পশ্চিমের নির্দিষ্ট এই নারী ভাবনা ও অনুশীলনের মূল কারণ তিনটি : প্রথমত, পশ্চিমের আইন ও বিধান নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের পক্ষপাতপুষ্ট, ও তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও অধিকারগত ঐতিহাসিক বিবাদনির্ভর। আর এটাকেই বিশ্বায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও এ ভূ-খন্ডের সাংস্কৃতিক ও আইনি তফাত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বিস্তর। দ্বিতীয়ত : পশ্চিমের লোকদের পুজিবাদী-মুনাফাকামী মানসিকতা এর আরেকটি কারণ। পশ্চিমের দেশগুলোতে বস্ত্তকেন্দ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বস্ত্তস্বার্থ নিয়ন্ত্রণকারী কোন চারিত্রিক ও মূল্যবোধিক ধারাকে আদৌ মূল্যায়ন করা হয়না। তৃতীয়ত : যাবতীয় নীতি নৈতিকতা, মূল্যবোধ এড়িয়ে মুনাফাকামী মানসিকতাই ক্রিয়াশীল থাকে পশ্চিমাদের মাঝে। কাছাকাছি বসবাস, অথবা পরিসংখ্যান-গবেষণা, ও বস্ত্তনিষ্ঠ রিপোর্টসমূহের পাঠ থেকে এ বিষয়টি উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ে। এই যাতনাদায়ক সামাজিক অবস্থাই- যা বিশ্বায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে- পাশ্চত্য সমাজের প্রকৃত চেহারা। যদিও তা সংবাদ মাধ্যমের প্রবঞ্চক পর্দায়, অধিকার বিষয়ক মিথ্যা মোড়কে, ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। কেননা সেখানে পারিবারিক হিংস্ত্রতা, শ্লীলতাহানী, যৌন বিড়ম্বনা-এমনকি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিকদের ক্ষেত্রেও - ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অনুরূপ জীবীকা অর্জনের উদ্দেশ্যেও বেড়ে চলেছে নারীর যাতনা। এক অভিবাবক সম্পন্ন অথবা আদৌ অভিভাবক নেই এ ধরনের বাচ্চাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ক্রমেই। এই সব নানা কারণে পশ্চিম, সামাজিক ও আইনগত প্রসেসের মধ্য দিয়ে, বিবাহ বহির্ভূত নারী-পুরুষের এক সাথে জীবনযাপন, পরিবারের বিকল্প হিসেবে হাজির করেছে। বিস্তার ঘটেছে জেন্ডার ধারণার। ফ্রান্সের পারলামেন্টে উপস্থাপিত একটি বাৎসরিক সরকারী রিপের্টে পশ্চিমা সমাজের পরিবার, বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে নারী সংকটের একটি ভয়াবহ চিত্র খোঁজে পাই। তাতে বলা হয়েছে : ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সোভিয়েতের পর, ফ্রান্স দ্রুত সেই পরিণতির দিকে যাচ্ছে, যেখানে বিয়ের হার দ্রুত কমছে, বিয়েপ্রথা হারিয়ে যাচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে নারী-পুরুষের বিয়েহীন স্বাধীন দাম্পত্যজীবন। বৎসরে ৪৫০.০০০ নারী-পুরুষ যুগল এই ধরনের স্বাধীন সম্পর্ক গড়ছে। তেমনি বাড়ছে সমকামীদের- গ্যে ও লেসবিয়ান- কোন যুক্তিহীন স্বাধীন দাম্পত্যজীবন। বর্তমানে এই ধরনের সম্পর্কের বাৎসরিক হার ৩০.০০০।
৮. মুসলিম সমাজে আইন প্রণয়ন পদ্ধতির দৈত্ব , এবং সামাজিক ও নৈতিকতা নির্দেশক উৎসের দৈত্ব, মূলত মুসলমানদেরকে দ্বীন সম্পর্কে বিভ্রান্ত করছে, দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে এমন এক অন্ধকার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে সব ধরনের আলো থেকে বঞ্চিত হতে হয় মানুষকে। ফলে তারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না। সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, নৈতিকতা, ইত্যাদি নানা প্রকৃতির ইটের সমন্বিত গাথুনিতেই গড়ে উঠে একটি সমাজ। ফলে এর কোন একটিতে যদি সংকট দেখা দেয় তাহলে তা অন্যান্য অঙ্গকেও আক্রান্ত করে। তাই সমাজ সংস্কারের ব্যাপারটি আমাদের ভাবতে হবে ব্যাপকভাবে। সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, নৈতিকতা, সব ক্ষেত্রেই ইসলামী শরীয়তকে মূল মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, পশ্চিমা ধর্ম-নিরপেক্ষতাকে তাড়াতে হবে আইনসহ সমাজের সকল জায়গা থেকে। সব কিছুর ভিত্তি হবে আল্লাহ প্রদত্ব প্রত্যাদেশ। যার আগে-পিছে কোন অসত্য আসতে পারে না। পবিত্র কোরআনে এসেছে :
(আরবি)
অর্থাৎ ‘সামনে, পিছনে কোন দিক থেকে তার নিকট বাতিল আসতে পারে না। তা অবতীর্ণ প্রশংসিত প্রজ্ঞাবানের কাছ থেকে’ -সূরা ফুসসিলাত (৪২)। সাথে সাথে মানবতাকে দিতে হবে মানবাধিকারের সত্যিকার বাস্তবায়িত রূপ। নারীকে দিতে হবে শরীয়ত নির্ধারিত ইনসাফের আওতায় স্বাধীনতা ভোগের পূর্ণ ইখতিয়ার। ধর্ম ও মূল্যবোধে আরোপিত নারীকে রক্ষা করতে হবে সকল প্রকার জুলুম অন্যায় থেকে। চাই তা পাঠশালায় হোক অথবা পরিবার গঠনের ইচ্ছাপোষণ কালে , অথবা প্রয়োজনের সময় রিজিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন