HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

প্রতিপক্ষের মতামত খন্ডনে ইসলামি শিষ্টাচার

লেখকঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
প্রতিপক্ষের মতামত খন্ডনে ইসলামি শিষ্টাচার

আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সম্পাদনা : আলী হাসান তাইয়েব

প্রতিপক্ষের মতামত খন্ডনে ইসলামি শিষ্টাচার
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখা একটি বই পড়ছিলাম। বইটি আমাদের দেশে প্রচলিত শবে বরাতের পক্ষে লেখা। লিখেছেন বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ একজন শ্রদ্ধেয় মুফতি সাহেব। যারা শবে বরাত পালন করতে চান না, শবে বরাতকে ইসলামি সংস্কৃতি হিসাবে স্বীকার করেন না স্বভাবত তারা তার এ বইয়ে প্রতিপক্ষ। দেখলাম তিনি তার প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কোথাও বলেছেন, ‘তারা বিভ্রান্ত’ আবার কোথাও বলেছেন, ‘তারা গোমরাহ’ আবার বলেছেন, ‘তারা একদম মূর্খ’ কোখাও বলেছেন, ‘কুরআন হাদিস সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান নেই’ ইত্যাদি সব বিশেষণ ব্যবহার করেছেন তার প্রতিপক্ষদের সম্পর্কে। আমার প্রশ্ন হল, যখন আমার দাবির স্বপক্ষে আমার প্রমাণাদি মজবুত থাকে তাহলে প্রতিপক্ষকে গালাগালি করার প্রয়োজন থাকে কোথায়? আরো প্রশ্ন হল, প্রতিপক্ষের যুক্তি ও দাবি খন্ডনে তাদের গালি দেয়া কি ইসলাম সম্মত? এ সম্পর্কে কি ইসলামের কোনো দিক-নির্দেশনা নেই? বা প্রতিপক্ষকে যা ইচ্ছা তা বলা জায়েয?

প্রতিপক্ষ যদি ইহুদি বা খৃস্টান হয় তবুওতো তাদের সাথে তর্কে বা তাদের দাবি খন্ডনে গালাগালির আশ্রয় নেয়া জায়েয নয়। আর যদি আপনার প্রতিপক্ষ হয় মুসলিম, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত তাহলে তাদের গালি দেয়া কতখানি ইসলাম অনুমোদিত, সেটা বলার জন্য আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। একজন সম্মানিত ইমাম সাহেব আমাকে ঘটনাটি বলেছেন। তার কাছে একটি লোক এসে একটি বিষয় জানতে চাইল। ইমাম সাহেব যা উত্তর দিলেন লোকটি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারল না। বিতর্ক জুড়ে দিল। ইমাম সাহেব বিতর্কের এক পর্যায়ে তাকে বললেন, আপনি দাড়ি মুন্ডন করেন। প্রতিদিন রাসূলের সুন্নাতের ওপর ক্ষুর চালান। আপনি ফাসেক। তাই আপনার স্বাক্ষীও ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি যখন একটি মস্তবড় সুন্নাত তরক করছেন তখন একটি মুস্তাহাব আমল নিয়ে আপনার এত মাথা ব্যথা কেন? আপনি চবিবশ ঘণ্টা কবিরা গুনাহতে লিপ্ত, সে খবর নেই। আর একটি মুস্তাহাব আমল নিয়ে আমার সাথে বহস করতে এসেছেন?- এ কথা বলার পর লোকটি একেবারে চুপ হয়ে গেল। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সোজা চলে গেল।

ইমাম সাহেব এ ঘটনাটি তার এক বিরল কৃতিত্ব হিসাবে অনেকের কাছেই বলে বেড়ান। তিনি বিতর্কে জয়ী হয়েছেন বলে গর্ব করেন।

প্রতিপক্ষকে জব্দ করার একটি কৌশল বটে। এ ধরনের কৌশল কি ইসলাম পছন্দ করে? বা এ কৌশল কি কোনো ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে? না, বরং এর কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ইমাম সাহেবের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হল। এমন শত্রুতা যে, ইমাম সাহেব কোনো হক কথা বললেও সে মানতে চাইবে না। সে মরিয়া হয়ে চাইবে ইমাম সাহেবের ওপর এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে। আসলে কি তিনি সঠিক কাজ করছেন ? যা করেছেন তা কি ইসলামি আদব-শিষ্টাচারে উত্তীর্ণ? না ইমাম সাহেব বলে কথা ? ইসলামে কি এ বিষয়ে কোনো দিক-নির্দেশনা নেই ?

হ্যাঁ, প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্ক কিভাবে করতে হবে সে সম্পর্কেও ইসলামি শরিয়াহ বিধি-বিধান দিয়েছে। রয়েছে এ ব্যাপারে আমাদের সম্মুখে আল্লাহ তাআলার কালাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর হাদিস ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, আজ দেখা যায় যারা ইসলাম সম্পর্কে তেমন জানে না বা জানলেও মানে না। তারা যখন প্রতিপক্ষের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে তখন বলে ‘আমার প্রতিপক্ষের বন্ধুদের কাছে সবিনয় নিবেদন করছি .......।’ ইত্যাদি; কিন্তু ইসলামের দাওয়াতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ যখন ইসলামের কোনো বিষয় নিয়ে তার প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনা করেন বা তার মতামত খন্ডন করেন, তখন এ ধরনের কথাই শোনা যায়- ‘সে ভন্ড, গোমরাহ, পথভ্রষ্ট, কুরআন-হাদিস সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ, খারেজি, ওহাবি, বেদআতি, সে নাস্তিক, সে মুরতাদ’ ইত্যাদি।

ইসলাম অনুসারীরা যদি ইসলামি আচরণবিধি অনুসরণ না করেন, তাহলে কারা তা অনুসরণ করবে? এ বিষয়ে ইসলামি দাওয়াত-কর্মী, ইমাম, আলেম-উলামা ও গবেষকদের সচেতন করার লক্ষ্যেই এ লেখা।

প্রতিপক্ষ বলতে আমরা কী বুঝি?
একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি অথবা সংগঠনের প্রতিপক্ষ থাকে, থাকাটাই স্বাভাবিক। থাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষ, সামাজিক কর্তৃত্বের প্রতিপক্ষ। বলতে গেলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের প্রতিপক্ষ থাকে। এমনিভাবে থাকে নিকট প্রতিপক্ষ, থাকে দূর প্রতিপক্ষ। বক্ষমাণ নিবদ্ধে আমরা ইসলামের প্রসার ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের আচার-আচরণ নিয়ে আলোচনা করব। উদ্দেশ্য কিন্তু এটা নয় যে, এখানের বিতর্ক ও মতামত খন্ডনের যে আদব-কায়দাগুলো আলোচনা করা হবে তা শুধু প্রয়োগ করা হবে ইসলাম সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনায়। বরং সকল প্রকার প্রতিপক্ষের সাথেই আলোচনা, বিতর্কে ও মতামত খন্ডনে এ শিষ্টাচারগুলো প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এতে সমাজে শান্তি-শৃংখলা বিঘ্নিত হবে না। পরস্পরের মধ্যে মতের ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে বৈরিতাও সৃষ্টি হবে না। হানাহানী থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র অনেকাংশেই রেহাই পাবে। পথ ও মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেবও সকলের মাঝে বজায় থাকবে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য ।

ইসলাম সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষ বলতে কী বুঝায় ?
ইসলাম সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষকে আমরা দুভাবে ভাগ করতে পারি। এক. দূর প্রতিপক্ষ। তারা হল- (ক) নাস্তিক (খ) আস্তিক তবে মুসলমান নয় যেমন- ইহুদি, খৃস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইত্যাদি (গ) মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী, অর্থাৎ যারা জন্ম সূত্রে মুসলিম হয়েও ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে। বা জন্ম সূত্রে অমুসলিম ছিল কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করে আবার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দুই. নিকট প্রতিপক্ষ। যারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দেয়। যেমন মুসলিম পরিচয় দানকারী ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শে বিশ্বাসী। এমনিভাবে শিয়া, খারেজি, কাদিয়ানি, বেরেলভি ও অন্যান্য বিদআতি গোষ্ঠি ও ব্যক্তি। বা হতে পারে যে কোনো মুসলিম, যে কোনো একটি বিদআত বা ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত।

এরা সকলেই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের (আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামাআত হলো, যারা ইসলাম অনুসরণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লা্ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর সুন্নাহ ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের ভিত্তিতে।) প্রতিপক্ষ।

প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনা ও বিতর্কের গুরুত্ব
আল্লাহ রাববুল আলামিন যত নবী-রাসূলকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাদের সকলেই আপন দাওয়াতের প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। এ বিতর্কের ও তাদের মতামত খন্ডনের অনেকগুলো ঘটনা আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে বর্ণনা করেছেন। নূহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জাতির সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ ﴿২৫﴾ أَنْ لَا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ أَلِيمٍ ﴿২৬﴾ فَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ مَا نَرَاكَ إِلَّا بَشَرًا مِثْلَنَا وَمَا نَرَاكَ اتَّبَعَكَ إِلَّا الَّذِينَ هُمْ أَرَاذِلُنَا بَادِيَ الرَّأْيِ وَمَا نَرَى لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ بَلْ نَظُنُّكُمْ كَاذِبِينَ ﴿২৭﴾ قَالَ يَا قَوْمِ أَرَأَيْتُمْ إِنْ كُنْتُ عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّي وَآَتَانِي رَحْمَةً مِنْ عِنْدِهِ فَعُمِّيَتْ عَلَيْكُمْ أَنُلْزِمُكُمُوهَا وَأَنْتُمْ لَهَا كَارِهُونَ ﴿২৮﴾ وَيَا قَوْمِ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مَالًا إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَمَا أَنَا بِطَارِدِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَلَكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ ﴿২৯﴾ وَيَا قَوْمِ مَنْ يَنْصُرُنِي مِنَ اللَّهِ إِنْ طَرَدْتُهُمْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ﴿৩০﴾ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ إِنِّي مَلَكٌ وَلَا أَقُولُ لِلَّذِينَ تَزْدَرِي أَعْيُنُكُمْ لَنْ يُؤْتِيَهُمُ اللَّهُ خَيْرًا اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا فِي أَنْفُسِهِمْ إِنِّي إِذًا لَمِنَ الظَّالِمِينَ ﴿৩১﴾ قَالُوا يَا نُوحُ قَدْ جَادَلْتَنَا فَأَكْثَرْتَ جِدَالَنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ ﴿৩২﴾ قَالَ إِنَّمَا يَأْتِيكُمْ بِهِ اللَّهُ إِنْ شَاءَ وَمَا أَنْتُمْ بِمُعْجِزِينَ ﴿৩৩﴾ وَلَا يَنْفَعُكُمْ نُصْحِي إِنْ أَرَدْتُ أَنْ أَنْصَحَ لَكُمْ إِنْ كَانَ اللَّهُ يُرِيدُ أَنْ يُغْوِيَكُمْ هُوَ رَبُّكُمْ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ ﴿৩৪﴾ ( سورة هود : ২৫-৩৪)

‘আর অবশ্যই আমি নূহকে প্রেরণ করেছিলাম তার জাতির কাছে (এই বার্তা দিয়ে) যে, ‘আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী। যেন তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না কর। নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক দিবসের আযাবের ভয় করছি। অতঃপর তার জাতির নেতৃস্থানীয়রা, যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, ‘আমরা তো তোমাকে আমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখছি না এবং আমরা দেখছি যে, কেবল আমাদের নীচু শ্রেণীর লোকেরাই বিবেচনাহীনভাবে তোমার অনুসরণ করেছে। আর আমাদের উপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব আমরা দেখছি না; বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করছি। সে বলল, ‘হে আমার জাতি, তোমরা কি মনে কর, যদি আমি আমার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত হই এবং তিনি আমাকে তাঁর পক্ষ থেকে রহমত দিয়ে থাকেন, আর তা তোমাদের কাছে গোপন রাখা হয়, তবে কি আমি তোমাদের উপর তোমাদের অপছন্দ হওয়া সত্বেও তা চাপিয়ে দেব? আর হে আমার জাতি, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ চাই না। আমার প্রতিদান শুধু আল্লাহর কাছে। যারা ঈমান এনেছে, আমি তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না। নিশ্চয় তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। কিন্তু আমি তো দেখছি তোমরা এমন এক জাতি যারা অজ্ঞ থাকতে চায়। হে আমার জাতি, যদি আমি তাদেরকে তাড়িয়ে দেই, তবে আল্লাহর আযাব থেকে কে আমাকে সাহায্য করবে? এরপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? আর আমি তোমাদের বলছি না যে, ‘আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডারসমূহ আছে। এবং আমি গায়েব জানি না, আর আমি এও বলছি না যে, ‘আমি ফেরেশতা।’ তোমাদের চোখে যারা হীন, তাদের সম্পর্কে আমি বলছি না যে, ‘আল্লাহ তাদেরকে কখনো কোনো কল্যাণ দান করবেন না।’ তাদের অন্তরে যা আছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ অধিক অবগত। (যদি এরূপ উক্তি করি) তাহলে নিশ্চয় আমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হব। তারা বলল, ‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে বিতর্ক করছ এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিতর্ক করেছ। অতএব যার প্রতিশ্রুতি তুমি আমাদেরকে দিচ্ছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে আস, যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও। সে বলল, ‘আল্লাহই তো তোমাদের কাছে তা হাজির করবেন, যদি তিনি চান। আর তোমরা তাকে অক্ষম করতে পারবে না। ‘আর আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিতে চাইলেও আমার উপদেশ তোমাদের কোনো উপকারে আসবে না, যদি আল্লাহ তোমাদের বিভ্রান্ত করতে চান। তিনি তোমাদের রব এবং তাঁর কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ (হুদ : ২৫-৩৪)

এ আয়াতগুলোতে নূহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে, কী ভাষা প্রয়োগ করে তাঁর প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্ক করেছেন আমরা তা দেখতে পেলাম। তাঁর সম্প্রদায়ের কথা, ‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে বিতর্ক করছ এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিতর্ক করেছ।’ দ্বারা আমরা জানতে পারলাম যে, আল্লাহর রাসূল নূহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কওমের সাথে গুরুত্ব ও দৃঢ়তার সাথে বিতর্ক করেছেন।

ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম নমরুূদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। যেমন : ইরশাদ হয়েছে -

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آَتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ ﴿سورة البقرة :২৫৮﴾

‘তুমি কি সে ব্যক্তিকে দেখনি, যে ইবরাহিমের সাথে তার রবের ব্যাপারে বিতর্ক করেছে যে, আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছেন? যখন ইবরাহিম বলল, ‘আমার রব তিনিই’ যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, ‘আমিই জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই।’ ইবরাহিম বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পূর্ব দিক থেকে সূর্য আনেন। অতএব তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে আন।’ ফলে কাফির ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।’ (বাকারা : ২৫৮)

এমনিভাবে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের মতামত খন্ডন করেছেন। এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে সূরা আম্বিয়া (আয়াত ৫১-৬৭) ও আরও কয়েক স্থানে।

মুসা ও হারুন আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফেরআউনের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে বিনম্র্ ভাষায় বিতর্ক করতে আদেশ করেছেন। (ত্বাহা : ৪৩-৬২)

নবী সালেহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের ক্ষমতাসীনদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। (দেখুন সূরা হুদ : ৬১-৬৩)

নবী শুআইব আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। (দেখুন সূরা হুদ : ৮৪- ৯৩)

আল্লাহ রাববুল আলামিন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্ক করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে -

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ( النحل : ১২৫)

‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত দাও এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর।’ (নাহাল : ১২৫)

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল র.-কে প্রশ্ন করা হল, ‘এক ব্যক্তি নফল নামাজ পড়ে, নফল রোজা রাখে এবং ইতেকাফ করে। সে আপনার কাছে প্রিয় না কি ওই ব্যক্তি যে বিদআতে লিপ্তদের সাথে বিতর্ক করে।’ তিনি বললেন, ‘যে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, ইতেকাফ করে সে তো তা নিজের জন্য করে। কিন্তু যে বিদআতপন্থীদের সাথে কথা বলে, বিতর্ক করে সে তা মুসলমানদের জন্য করে থাকে। আমার নিকট এ ব্যক্তিই প্রিয়তম ও শ্রেষ্ঠ।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ইবনে তাইমিয়া, ২৮/২৩১)

আমর ইবনে সালামা আল-হামদানি বলেন, আমরা কয়েকজন লোক জোহর নামাজের পূর্বে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.- এর দরজায় তিনি বের হলে আমরা তাঁর সাথে মসজিদের দিকে যাব এ অপেক্ষায় বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে আবু মুসা আল-আশআরি রা. আসলেন। তিনি বললেন, আবু আব্দুর রহমান (আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ) কি বের হয়েছেন? আমরা বললাম, ‘না।’ তিনিও আমাদের সাথে বসলেন তাঁর বের হওয়ার অপেক্ষায়। যখন তিনি বের হলেন আমরা সকলে রওনা হওয়ার জন্য দাঁড়ালাম। আবু মুসা রা. তাকে বললেন, ‘হে আব্দুর রহমানের পিতা, আমি মসজিদে কিছুক্ষণ পূর্বে একটি বিষয় প্রত্যক্ষ করলাম। আমার দেখে ভাল লাগেনি। তবে আল্লাহর প্রশংসা- আমি এতে খারাপ কিছু দেখিনি। ইবনে মাসউদ রা. বললেন, বিষয় কী? তিনি বললেন, ‘যদি আপনি বেঁচে থাকেন তাহলে নিজ চোখে দেখবেন।’ অতপর আমরা মসজিদে গিয়ে দেখলাম, কতগুলো মানুষ বৃত্তাকারে মসজিদে বসে আছে নামাজের অপেক্ষায়। প্রত্যেকের হাতে আছে পাথরের দানা। একজন বলছে, একশত বার আল্লাহ আকবর পড়ুন। সকলে তাই করছে। আবার বলছে, একশত বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ুন, তারা তাই পড়ছে। আবার বলল, একশত বার আল-হামদুলিল্লাহ পড়ুন। তারা তাই পড়ছে। আবার বলছে, একশত বার ছুবহানাল্লাহ পড়ুন! তারা তাই পড়ছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবু মূসা আল-আশআরি রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তাদের কী বলছেন?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি কিছু বলিনি। আপনার অপেক্ষায় আছি।’ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, আপনি তাদের বলতে পারতেন, ‘তোমরা তোমাদের পাপগুলোকে গণনা কর। তাহলে তোমাদের পুণ্যগুলো যেন বরবাদ না হয়ে যায় আমি সে নিশ্চয়তা দেব।’ তারপর তিনি (আমরাও তার সাথে ছিলাম) তাদের কাছে আসলেন। তাদের কাছে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এ কী করছ ? আমি কী দেখছি ?’

তারা বলল, ‘হে আবু আব্দুর রহমান, আমরা পাথরের দানা দিয়ে তাকবির, তাসবিহ, তাহলিল ও তাহমিদ গণনা করে পড়ছি।’ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ‘তোমরা তোমাদের পাপগুলোকে গণনা কর। তাহলে আমি তোমাদের পুণ্যগুলো যেন বিনষ্ট না হয় সে নিশ্চয়তা দেব। হে উম্মাতে মুহাম্মদি, ধিক তোমাদের! এত তাড়াতাড়ি তোমরা ধ্বংসের পথ ধরলে? এই যে তোমাদের সামনে এখনো তোমাদের নবীর অনেক সাহাবি উপস্থিত। তাঁদের পোশাকগুলো এখনো পুরাতন হয়নি। তাঁদের বর্তনগুলো এখনো ভেঙ্গে যায়নি। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, তোমরা কি উম্মাতে মুহাম্মাদির মধ্যে সবচেয়ে বেশি হেদায়েতের অধিকারী হয়ে গেলে ? না তোমরা একটি ভ্রান্ত পথ খুলতে বসেছ ?’

তারা বলল, ‘হে আবু আব্দুর রহমান, আল্লাহর শপথ! আমরা ভাল উদ্দেশ্যেই এ কাজ করছি।’ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ‘ভাল উদ্দেশ্যে কাজ করছে এমন কত লোক আছে, কিন্তু তারা সঠিক পথে পৌঁছতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এমন সম্প্রদায় আসবে যারা কুরআন পাঠ করবে কিন্তু তা তাদের কণ্ঠ অতিক্রম করে ভেতরে যাবে না। তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন তীর তার ধনুক থেকে বের হয়ে যায়।’ আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় তাদের অধিকাংশ তোমাদের থেকে হবে।’ এ কথা বলে ইবনে মাসউদ রা. তাদের থেকে চলে গেলেন। আমি তাদের অধিকাংশকে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের দলে দেখতে পেলাম। (সুনানে দারেমি : ১/৭৯। হাদিসটি সহিহ। দেখুন সিলসিলাতুস সাহিহা লিল-আলবানি : ২০০৫)

এ হাদিস থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানতে পারলাম-

এক. সাহাবায়ে কেরাম যা বুঝেছেন সেটাই সঠিক। ইবনে মাসউদের সাথে অন্যান্য সাহাবি যারা ছিলেন তাদের বক্তব্যও ইবনে মাসউদের মতামতের অনুরূপ ছিল। কেউ ওই কাজটিকে সমর্থন করেননি। তাঁরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর সুন্নাহ সম্পর্কে বেশি জ্ঞাত ছিলেন, তেমনি সুন্নাহ পালনে ছিলেন অন্য সকলের চেয়ে অগ্রগামী। তাঁরা আল-কুরআন নাজিল প্রত্যক্ষ করেছেন। উম্মতের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর হাদিস পৌঁছিয়েছেন। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেন নি। তাঁর সাহাবায়ে কেরাম করেন নি তা কখনো দীন ইসলামের অংশ নয়। দীনের কাজ হিসাবে স্বীকৃত নয়। এর উদ্দেশ্য যতই ভাল থাক।

দুই. বেদআতের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর সাহাবিগণ অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন।

তিন. যারা বিভিন্ন বেদআতি কাজ করেন সন্দেহ নেই তারা ভাল ও সুন্দর উদ্দেশ্যে কাজটি সম্পাদন করেন। কিন্তু কথা হল, কাজের উদ্দেশ্য ও নিয়্যত ভাল হলেই কাজটি ভাল হয় না। কাজটি কুরআন বা সুন্নাহ দ্বারা সঠিক পদ্ধতিতে অনুমোদিত হতে হয়। যেমন : ইবনে মাসউদ রা. হাদিস উল্লেখ করে সে সব মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যারা কুরআন তেলাওয়াত করবে কিন্তু তাদের কুরআন হৃদয়ে প্রবেশ করবে না.....। তাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই ভাল থাকবে কিন্তু সুন্নাহ মোতাবেক তাদের আমল হবে না।

চার. বেদআত যখন শুরু হয় তখন তার ব্যাপ্তি থাকে কম। আস্তে আস্তে এর ব্যাপ্তি বেড়ে যায়। শুরুতে এর পরিমাণ অর্ধ হাত হলে তা সামান্য সময়ের মধ্যেই এক হাত হয়ে যায়। যেমন এ হাদিসে দেখা গেল ‘তারা পাথর দিয়ে তাসবিহ পাঠের বেদআতে লিপ্ত হল। পরে তারা খারেজিদের সাথে যোগ দিয়ে মুসলিম উম্মাহ তথা আহলে সুন্নাহর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করল। তাদের হত্যা করতে শুরু করল।

পাঁচ. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বেদআতি কাজে লিপ্তদের সাথে বিতর্ক করলেন। কিন্তু তিনি তাদের গালি দিলেন না। অভিশাপ দিলেন না। তাদের আঘাত করে কোনো কথা বললেন না।

এ সকল আয়াত ও হাদিস দিয়ে আমরা ইসলামের প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্ক করার গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে পারি।

অবশ্য যে সকল হাদিসে বিতর্ক না করতে উৎসাহিত করা হয়েছে সে সকল হাদিস বৈষয়িক বিষয়ে বিতর্ক পরিহার করা সম্পর্কে এসেছে। ইসলামি বিষয়ে যখন হক ও বাতিলের প্রসঙ্গ আসবে তখন অবশ্যই বিতর্ক করতে হবে।

বিতর্ক করার আদব-শিষ্টাচার (ক) সুন্দর পন্থায় বিতর্ক করা
আল্লাহ রাববুল আলামিন মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বিতর্ক করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাথে সাথে তাঁকে সুন্দরতম পদ্ধতিতে বিতর্ক করতে বলেছেন। যেখানেই তিনি বিতর্ক করার কথা বলেছেন, সেখানেই তিনি উত্তম পন্থায় বিতর্ক করতে আদেশ দিয়েছেন। যেমন :

ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ( النحل : ১২৫)

‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত দাও এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর।’ (নাহল : ১২৫)

আল্লাহ তাআলা সকল মুসলিমের উদ্দেশে আরও ইরশাদ করেন-

وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ

‘আর তোমরা সুন্দরতম পন্থা ছাড়া আহলে কিতাব (ইহুদি ও খৃস্টানদের) সাথে বিতর্ক করো না।’ (আনকাবুত : ৪৬)

আল্লাহ রাববুল আলামিন ইহুদি ও খৃস্টান প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্ক কালে সুন্দরতম পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। যদি প্রতিপক্ষ এদের চেয়ে শ্রেষ্ট হয়, অর্থাৎ বিতর্কের প্রতিপক্ষ যদি মুসলিম হয় তখন কেমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে? সুন্দরের চেয়েও সুন্দরতম পন্থা-পদ্ধতিতে তাদের সাথে বিতর্ক করতে হবে। এটা আল্লাহর নির্দেশ। ইহুদি, খৃস্টানদের সাথে মুসলমানের সম্পর্কের চেয়ে মুসলমানের পারস্পারিক সম্পর্কের গুরুত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার আমরা ধর্মীয় বিষয়ে যখন মুসলিম আলেম-উলামাদের সাথে অন্য মুসলিম ভাইদের বিতর্ক করতে দেখি তখন গাল-মন্দ জাতীয় শব্দ প্রয়োগ করতে দেখি বেশি।

(খ) প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান ও দয়া মমতা
বিতর্ক করা হবে সত্য প্রকাশ ও মানুষের প্রতি দয়া-মমতার জন্য। যেমন শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া র. বিতর্কের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত অনুসারীরা বাতিল পন্থীদের সাথে বিতর্ক করে তবে তাদের উদ্দেশ্য হল,

يظهر الحق ويرحم الخلق

‘তারা সত্য প্রকাশ করেন ও সৃষ্টি জীবের প্রতি দয়া করেন।’

সাহাবি আবু উমামা আল-বাহেলি যখন দেখলেন, খারেজি মতাদর্শের প্রায় সত্তর জন লোককে মৃত্যুদন্ড দিয়ে তাদের মাথা দামেশকের মসজিদের সম্মুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তখন তিনি বললেন, শয়তান এদেরকে কোথায় নিয়ে গেল! এরপর তিনি কাঁদলেন। অন্য লোকেরা বলল, আপনি এদের মত মানুষের জন্য কাঁদছেন? তখন তিনি বললেন, ‘কেন কাঁদব না? তারাতো ইসলামের অনুসারী ছিল।’ (আল-ইতেসাম, ইমাম শাতেবি র.)

বিতর্কে একপক্ষ অপর পক্ষকে মূর্খ বা অজ্ঞ বলে থাকে। কিন্তু প্রতিপক্ষ যদি মূর্খও হয় তবুও তাকে তা বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং না বলাটাই ইসলামের শিক্ষা।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا

‘আর রাহমানের বান্দা তারাই যারা যমীনে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের সম্বোধন করে তখন বলে ‘সালাম।’ (ফুরকান : ৬৩)

যখন মূর্খদেরকে সালাম বলতে বলা হয়েছে, তখন আপনার প্রতিপক্ষ যারা আসলে মূর্খ নয়, অজ্ঞ নয় তাদেরকে উক্ত বিশেষণে সম্বোধন করা তো আরো জঘন্য। তারা যদি আসলেই মূর্খ বা অজ্ঞ হত তাহলে তো আপনি তাদের সাথে আলোচনা বিতর্কে বসতেন না।

(গ) গালিগালাজ, অবমাননাকর উক্তি ও হুমকি প্রদান না করা
আল্লাহ রাববুল আলামিন যেখানে ইহুদি খৃস্টানদের সাথে বিতর্কে অশোভন কথা বলতে নিষেধ করেছেন। সুন্দর ও মার্জিত কথা বলতে আদেশ করেছেন, সেখানে মুসলিম প্রতিপক্ষের সাথে বিতর্কে অশোভন কথা-বার্তা, অবমাননাকর উক্তি বা হুমকি প্রদানের বিষয়তো কল্পনাই করা যায় না। উপরোন্তু স্বভাবগুলো কাফেরদের। আমরা দেখি কাফেররা যখন নবী বা রাসূলদের সাথে বিতর্ক করতো তখন তাদের গালিগালাজ করত ও হুমকি দিত।

কুরআন থেকে কয়েকটি উদাহরণ দেখুন-

قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَكَ مِنْ قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ

‘তার কওম থেকে যে নেতারা অহঙ্কার করেছিল তারা বলল, ‘হে শুআইব, আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ সে বলল, ‘যদিও আমরা অপছন্দ করি তবুও?’ (আরাফ : ৮৮)

এ আয়াতে আমরা দেখলাম শুআইব আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর জাতির নেতারা তার সাথে বিতর্ক করার এ পর্যায়ে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দিয়েছিল।

قَالُوا يَا شُعَيْبُ مَا نَفْقَهُ كَثِيرًا مِمَّا تَقُولُ وَإِنَّا لَنَرَاكَ فِينَا ضَعِيفًا وَلَوْلَا رَهْطُكَ لَرَجَمْنَاكَ وَمَا أَنْتَ عَلَيْنَا بِعَزِيزٍ

‘তারা বলল, ‘হে শুআইব, তুমি যা বল, তার অনেক কিছুই আমরা বুঝি না। আর তোমাকে তো আমরা আমাদের মধ্যে দুর্বলই দেখতে পাচ্ছি। যদি তোমার আত্মীয়-স্বজন না থাকত, তবে আমরা তোমাকে অবশ্যই পাথর মেরে হত্যা করতাম। আর আমাদের উপর তুমি শক্তিশালী নও।’ (হুদ : ৯১)

এ আয়াতেও আমরা দেখি বিতর্কের এক পর্যায়ে নবী শুআইব আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে পাথর মেরে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে -

قَالُوا رَبُّنَا يَعْلَمُ إِنَّا إِلَيْكُمْ لَمُرْسَلُونَ ﴿১৬﴾ وَمَا عَلَيْنَا إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ ﴿১৭﴾ قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُمْ مِنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿১৮﴾

‘তারা বলল, ‘আমাদের রব জানেন, অবশ্যই আমরা তোমাদের কাছে প্রেরিত রাসূল। আর সুস্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব। তারা বলল, ‘আমরা তো তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ মনে করি। তোমরা যদি বিরত না হও তাহলে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব স্পর্শ করবে।’ (ইয়াসিন : ১৬-১৮)

এ আয়াতে আমরা দেখতে পাই, সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষেরা বিতর্কের এক পর্যায়ে এসে রাসূলদেরকে অমঙ্গলের কারণ বলে গালি দিয়েছে ও তাদের যন্ত্রণাদায়ক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে।

আল-কুরআনে এ ধরনের বহু দৃষ্টান্ত আছে যেখানে সত্যের প্রতিপক্ষ লোকেরা সত্যানুসারীদের সাথে বিতর্ক করার সময় গালাগালি করেছে, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে, নির্যাতন, হত্যার হুমকি দিয়েছে। এ স্বভাবগুলো মূলত যারা সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাদেরই। সত্যানুসারী তার্কিকগণ কখনো এ ধরনের স্বভাবের অধিকারী হতে পারেন না। হওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না।

(ঘ) বিতর্কের বিষয় সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞান অর্জন করে নেয়া
বিতর্কের বিষয়টি সম্পর্কে ভালভাবে পড়াশুনা করে জেনে বুঝে বিতর্ক করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইহুদি ও খৃস্টানদের উদ্দেশ্য করে বলেনঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تُحَاجُّونَ فِي إِبْرَاهِيمَ وَمَا أُنْزِلَتِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ إِلَّا مِنْ بَعْدِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ﴿৬৫﴾ هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ﴿৬৬﴾

‘হে কিতাবীগণ, (ইহুদি ও খৃস্টান) তোমরা ইবরাহিমের ব্যাপারে কেন বিতর্ক কর? অথচ তাওরাত ও ইনজিল তো তারপরই অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমরা কি বুঝবে না?

সাবধান! তোমরা তো সেসব লোক, বিতর্ক করলে এমন বিষয়ে, যার জ্ঞান তোমাদের রয়েছে। তবে কেন তোমরা বিতর্ক করছ সে বিষয়ে যার জ্ঞান তোমাদের নেই? আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’ (ইমরান : ৬৫-৬৬)

ইহুদি ও খৃস্টানেরা বিতর্ক করত যে, ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদি ছিল না খৃস্টান। ইহুদিরা দাবি করত ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদি ছিলেন আর খৃস্টনেরা দাবি করত ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম খৃস্টান ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাদের এ বিতর্ক দেখে বলেন, এ বিতর্ক কী করে সম্ভব ? ইহুদি ও খৃস্টানের জন্ম হয়েছে তাওরাত ও ইনজিল নাজিল হওয়ার পরে। আর ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম গত হয়ে গেছেন এর অনেক পূর্বে। তখন ইহুদি ও খৃস্টানের জন্মই হয়নি। কাজেই তার ইহুদি বা খৃস্টান হওয়ার কল্পনা আসে কিভাবে ? এ ধরনের অসার বিতর্ক তোমরা কেন করছ? এখন কথা হল তার আদর্শ নিয়ে। তার আদর্শ ইহুদিবাদ ছিল না খৃস্টবাদ? আর এ বিষয়ে তোমাদের দু’দলের কারো কাছে কোনো জ্ঞান নেই। এর জ্ঞান আছে আল্লাহ তাআলার কাছে। যে সম্পর্কে জ্ঞান নেই সে সম্পর্কে বিতর্ক করাই তোমাদের কাজ ?

১০
(ঙ) কোনো অবস্থায় আলেমদের অবমাননা করা যাবে না
বিতর্কের প্রতিপক্ষ যদি আলেমে দীন হয়ে থাকেন তাহলে তার সাথে বিতর্কে আরো বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিতর্ক করতে যেয়ে তাকে যেন অবমাননা বা অসম্মানকর কিছু করা না হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঈমানী বিষয়। এ বিষয়টিতে আমি দীর্ঘ আলোচনা না করে শুধু আল-কুরআন থেকে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরব। বিষয়টির গুরুত্ব উপলদ্ধি করার জন্য এতটুকু যথেষ্ট বলে আমার কাছে মনে হয়।

তাবুক যুদ্ধের সময় কিছু সংখ্যক মানুষ আলেম ও কারী সাহাবিদের সমালোচনা করে বলল, ‘আমাদের আলেম ও কারীগণ খাওয়া-দাওয়ার বেলায় পেটুক আর লড়াইয়ে কাপুরুষ।’

এ সমালোচনার বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- জানতে পারলে যারা সমালোচনা করেছে তিনি তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, ‘আমরা হাসি-তামাশাচ্ছলে কথাগুলো বলেছি মাত্র।’

সাথে সাথে আল্লাহ এ সম্পর্কে আয়াত নাজিল হল-

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ ﴿৬৫﴾ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ ﴿৬৬﴾

‘আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বল, ‘আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের সাথে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে? তোমরা অজুহাত পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফরি করেছ। যদি আমি তোমাদের থেকে একটি দলকে ক্ষমা করে দেই, তবে অপর দলকে আযাব দেব। কারণ, তারা হচ্ছে অপরাধী।’ (তাওবা : ৬৫-৬৬)

আল্লাহর এ বাণীতে আমরা দেখি যে, তিনি আলেমদের অবমাননাকর সমালোচনা, তাদের বিদ্রুপ করাকে আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও রাসূলের বিদ্রুপ বলে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি এ কাজটিকে ঈমান আনার পর কুফরি বলে ঘোষণা করেছেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকে বহু আলেম অন্য আলেমদের সমালোচনা করতে যেয়ে এ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখেন না।

আর আলেম ব্যতীত অনেক মানুষ এমনকি বহু ইসলামি চিন্তাবিদ (প্রতিষ্ঠানিক আলেম নন) অহরহ আলেমদের সম্পর্কে কটুক্তি করে থাকেন। কথায় কথায় তাদের অবমাননা করে থাকেন। এটা একটি মারাত্মক ব্যধি। এমনি মারাত্মক যাকে আল্লাহ কুফরি বলে অভিহিত করেছেন।

আমাদের সমাজের আলেমগণ মানুষ। তারা ফেরেশ্তা নন। এ প্রত্যাশা করা ঠিক নয় যে, আলেমগণ হবেন ফেরেশ্তা। কাফের ও পৌত্তলিকরা দাবি করত যে, নবী-রাসূলগণ মানুষ হবেন কেন? তারা হবেন ফেরেশতা। আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনের বহু স্থানে তাদের এ দাবিকে খন্ডন করেছেন।

আমাদের সমাজে আধুনিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত অনেক মানুষ আছেন যারা ইসলাম সম্পর্কে প্রচুর পড়াশুনা ও গবেষণা করে ইসলামি চিন্তাবিদ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। সমাজে ইসলামের প্রসারে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তাদের নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু দেখা যায়, তারা অনেক সময় আলেমদের সম্পর্কে কটুক্তি করেন। ঢালাওভাবে সমালোচনা করেন। কিন্তু এটা যে একটা ঈমানি সমস্যা, এ বিষয়টি তাদের চিন্তা ও গবেষণায় ধরা পড়ে না।

তারাও ইসলামের বাহক আর আলেমগণও ইসলামের বাহক। কিন্তু এ দু’দলের মধ্যে পার্থক্য হল আকাশ-পাতাল। আলেমগণ সর্বদা ‘আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর রাসূল বলেছেন’ এ রকম বাণী প্রচার করে যাচ্ছেন সারা জীবন। নিন্দুকের নিন্দার প্রতি কোনো কর্ণপাত নেই তাদের। ইসলামের জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে সর্বদা প্রস্ত্তত। নিজেদের জীবনের সকল সুখ-শান্তি, অর্থ-বিত্ত, সমাজে প্রতিষ্ঠা সবকিছুই ত্যাগ করেছেন ইসলামের জন্য। আল্লাহর এ দীনের জন্যই তারা দারিদ্রতা, হীনতা, অপমান, লাঞ্ছনা, অভাব-অনটন, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবমূল্যায়ন, সাম্রাজ্যবাদীদের চোখ রাঙ্গানি বেছে নিয়েছেন। এতে সন্তুষ্ট থেকেছেন। ইসলামের ধারক-বাহক হিসাবে আর কে তাদের সম-মর্যাদার অধিকারী হতে পারে? আল্লাহ রাববুল আলামিনের কাছে তারা প্রিয় হবে না কেন? এ কারণে আল্লাহ তাদের অবমাননা ও অসম্মানকে কুফরি বলে অভিহিত করেছেন। যা ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়। তাদের বিদ্রুপ করাকে নিজের সাথে বিদ্রুপ বলে অভিহিত করেছেন।

আপনি একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। সমাজে আপনার অবদান আছে অনেক। সাথে সাথে আপনি ইসলাম নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন। সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু আপনি কি আলেমদের মত ইসলামের জন্য ঝুঁকি নিতে পেরেছেন? ভবিষ্যতে কি পারবেন? ইসলামের যা কিছু বিজ্ঞানের সাথে মানানসই তা আপনি প্রচার করেন বুক ফুলিয়ে। ইসলামকে কিভাবে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত তরিকায় প্রচার করা যায় সে পরিকল্পনা আপনার মানসিকতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু ইসলামের যা কিছু আপাতত বিজ্ঞানের সাথে খাপ খায় না, তা বলতে আপনার মুখ শুকিয়ে যায়। বুকটা ধরফর করে। লোকে কী বলবে ভাবনা জাগে। ইসলামের সব কিছু প্রচার করলে আবার কেহ আমাকে মৌলবাদী তালিকায় নাম লিখে দেয় এ দুঃচিন্তা আপনাকে তাড়া করে।

অতএব এ সত্যটুকু উপলদ্ধি করুন আপনি কখনো সে সকল আলেমদের সমকক্ষ হতে পারবেন না কোনো দিন, যারা ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তাদের দেখতে যত খারাপ লাগুক, তাদের কথা যতই অগোছালো হোক, ভাষা তাদের যতই গ্রাম্য হোক, দুনিয়াদারী সম্পর্কে যত বে-খবর হোক। ইসলামের প্রচারক হিসাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে তারাই গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয়। তাদের মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলা ইসলামকে টিকিয়ে রেখেছেন দেড় হাজার বছর ধরে। কেয়ামত পর্যন্ত ইসলাম টিকে থাকবে তাদের মাধ্যমেই।

১১
বিতর্কের লক্ষ্য উদ্দেশ্য স্থির করা (ক) ইখলাছ ও বিশুদ্ধ নিয়্যত
ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় বিতর্ক করা অবশ্যই একটি নেক আমল। কোনো নেক আমল আল্লাহর কাছে কবুল হবে না, যদি তাতে ইখলাছ তথা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়্যত না থাকে। এটা সকলে কাছে পরিস্কার। এতে কারো দ্বিমত নেই। (দেখুন সূরা বাইয়েনা : ০৫, সূরা কাহাফ : ১১০ ও বুখারি ০১)

এ ছাড়া এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

من طلب العلم ليجادل به العلماء أو ليماري به السفهاء أو يصرف به وجوه الناس إليه أدخله النار .

‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণ করবে এ উদ্দেশ্যে যে, সে আলেমদের সাথে বিতর্ক করবে অথবা মূর্খদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে কিংবা মানুষদেরকে তার দিকে আকৃষ্ট করবে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’ (তিরমিজি : ৭/৪১৪)

বিতর্ক করার লক্ষ্য উদ্দেশ্য যদি নিজের ইলম জাহির করা হয়ে থাকে। কিংবা এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পরিচিত ও প্রভাব বিস্তার করার নিয়্যত করা হয়ে থাকে তাহলে তার পরিণাম সম্পর্কে এ হাদিসটি যথেষ্ট।

১২
(খ) শুধু সংস্কার ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে বিতর্ক করা
নবী শুআইব আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের সাথে বিতর্কে বলেছিলেন-

إِنْ أُرِيدُ إِلَّا الْإِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ

‘আমি চাই সংশোধন ও সংস্কার করতে আমার সাধ্যমত। আল্লাহর দেয়া সামর্থ ব্যতীত আমার তাওফিক নেই। আমি তাঁরই ওপর তাওয়াক্কুল করি এবং তার কাছেই ফিরে যাই।’(হুদ :...)

১৩
(গ) কোনো অজুহাত সৃষ্টির জন্য বিতর্ক না করা
এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা কোনো কাজ বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রয়াসী হলে কর্তৃপক্ষের সাথে এ উদ্দেশ্যে বিতর্ক জুড়ে দেন যেন কাজটি করা না হয়। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। কারণ কাজটি বাস্তবায়িত হলে তার ব্যক্তি স্বার্থ ব্যহত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এটা হল অজুহাত সৃষ্টি করার জন্য বিতর্ক। আল্লাহ রাববুল আলামিন সে সকল মানুষ সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন যারা উহুদ যুদ্ধে অংশ না পনয়ার জন্য বিতর্ক জুড়ে দিয়েছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে। উদ্দেশ্য ছিল অজুহাত সৃষ্টি করে অভিযান পরিচালনা না করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। ইরশাদ হয়েছে-

يُجَادِلُونَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَمَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنْظُرُونَ .

‘তারা তোমার সাথে সত্য সম্পর্কে বিতর্ক করছে তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর। যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হচেছ, আর তারা তা দেখছে।’ (আনফাল : ০৬)

তারা মৃত্যুর ভয়ে যুদ্ধ না করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিতর্ক করেছিল। যেন একটি অজুহাত দাঁড় করিয়ে জিহাদে বের হওয়ার পথ বন্ধ করা যায়। আল্লাহ তাআলা এ ধরণের অসৎ উদ্দেশ্যে বিতর্কের নিন্দা করেছেন এ আয়াতে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাঁর পছন্দমত সত্যের পথে বিতর্ক করার এবং যথাযথভাবে মানুষকে তাঁর দিকে আহবান করার তাওফিক দিন। আমিন।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন