HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
গুরুত্বপূর্ণ বিশটি হাদিসের ভাষ্য
লেখকঃ গবেষণা পরিষদ: আল-মুনতাদা আল-ইসলামী
بسم الله الرحمن الرحيم
نحمده و نصلي علي رسوله الكريم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামগ্রিক জীবন ধারা, অভ্যাস-আচরণ, দিক-নির্দেশনা ও মানবতার ইহ-পারলৌকিক কল্যাণের উদ্দেশে ত্যাগ-ধৈর্য বিশদভাবে ব্যাঞ্জনা পেয়েছে, খুবই যত্নে বর্ণিত হয়েছে, হাদিসসমগ্রে। হাদিসের অধ্যয়ন-অনুধাবন-চর্চা একজন মানুষকে, পারলৌকিক সফলতা তো অবশ্যই, পোঁছে দিতে পারে, বরং, পার্থিব সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায়। জীবন পরিচালনার সঠিকতম দৃষ্টিকোণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বস্ত্তনিষ্ঠতা ও গভীর বিবেচনা, এবং ফলে, জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা অর্জনের বিস্তারিত কড়চা খুবই উজ্জ্বলভাবে স্থান করে আছে মহানবীর হাদিস সমগ্রে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সীমিত শব্দে ব্যাপক অর্থ ও বোধের বিচ্ছুরণ ঘটাতেন। সে হিসেবে প্রায় প্রতিটি হাদিসেই, মূর্ত অথবা বিমূর্ত আকারে, সন্বিবেশিত রয়েছে একাধিক ভাব-ধারণা-আদর্শ, যা সামান্য মনযোগ প্রয়োগেই বেরিয়ে আসে বিশ্লিষ্ট আকারে।
বক্ষ্যমাণ বইটি এ ধরণেরই একটি সফল প্রয়াস বলা চলে। বইটিতে উল্লেখিত বিশটি হাদিসের প্রত্যেকটির সরল ব্যাখ্যা, কঠিন শব্দগুলোর অর্থ-উদ্ধারসহ প্রতিটি হাদিসের সন্বিবেশিত ভাব ও আদর্শ উপস্থাপনে গবেষকবৃন্দ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। অনুবাদকর্মেও যত্নের ছোঁয়া রাখতে পেরেছেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন সিরাজুল ইসলাম আলী আকবর, শিহাবুদ্দিন হোসাইন আহমদ, সানাউল্লাহ নযির আহমদ। সম্পাদনায় প্রাজ্ঞ শরীয়তবিদ নুমান বিন আবুল বাশার, আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান ও কাউসার বিন খালেদ এবং আবহাসের সকল কর্মকর্তার শ্রম ও ঐকান্তিকতা পশংসার দাবি রাখে। আল্লাহ সবাইকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।
মুহাম্মদ শামছুল হক সিদ্দিক
মহাপরিচালক
আবহাস এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি
বাড়ি: ১৪, রোড: ১৫, সেক্টর: ৪, উত্তরা, ঢাকা ১২৩০
ফোন : ৮৯৫৩৫৬৬ মোবাইল : ০১৬৭৮-১৩৪৫২৪
نحمده و نصلي علي رسوله الكريم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামগ্রিক জীবন ধারা, অভ্যাস-আচরণ, দিক-নির্দেশনা ও মানবতার ইহ-পারলৌকিক কল্যাণের উদ্দেশে ত্যাগ-ধৈর্য বিশদভাবে ব্যাঞ্জনা পেয়েছে, খুবই যত্নে বর্ণিত হয়েছে, হাদিসসমগ্রে। হাদিসের অধ্যয়ন-অনুধাবন-চর্চা একজন মানুষকে, পারলৌকিক সফলতা তো অবশ্যই, পোঁছে দিতে পারে, বরং, পার্থিব সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায়। জীবন পরিচালনার সঠিকতম দৃষ্টিকোণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বস্ত্তনিষ্ঠতা ও গভীর বিবেচনা, এবং ফলে, জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বিক সফলতা অর্জনের বিস্তারিত কড়চা খুবই উজ্জ্বলভাবে স্থান করে আছে মহানবীর হাদিস সমগ্রে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সীমিত শব্দে ব্যাপক অর্থ ও বোধের বিচ্ছুরণ ঘটাতেন। সে হিসেবে প্রায় প্রতিটি হাদিসেই, মূর্ত অথবা বিমূর্ত আকারে, সন্বিবেশিত রয়েছে একাধিক ভাব-ধারণা-আদর্শ, যা সামান্য মনযোগ প্রয়োগেই বেরিয়ে আসে বিশ্লিষ্ট আকারে।
বক্ষ্যমাণ বইটি এ ধরণেরই একটি সফল প্রয়াস বলা চলে। বইটিতে উল্লেখিত বিশটি হাদিসের প্রত্যেকটির সরল ব্যাখ্যা, কঠিন শব্দগুলোর অর্থ-উদ্ধারসহ প্রতিটি হাদিসের সন্বিবেশিত ভাব ও আদর্শ উপস্থাপনে গবেষকবৃন্দ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। অনুবাদকর্মেও যত্নের ছোঁয়া রাখতে পেরেছেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন সিরাজুল ইসলাম আলী আকবর, শিহাবুদ্দিন হোসাইন আহমদ, সানাউল্লাহ নযির আহমদ। সম্পাদনায় প্রাজ্ঞ শরীয়তবিদ নুমান বিন আবুল বাশার, আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান ও কাউসার বিন খালেদ এবং আবহাসের সকল কর্মকর্তার শ্রম ও ঐকান্তিকতা পশংসার দাবি রাখে। আল্লাহ সবাইকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।
মুহাম্মদ শামছুল হক সিদ্দিক
মহাপরিচালক
আবহাস এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি
বাড়ি: ১৪, রোড: ১৫, সেক্টর: ৪, উত্তরা, ঢাকা ১২৩০
ফোন : ৮৯৫৩৫৬৬ মোবাইল : ০১৬৭৮-১৩৪৫২৪
عَنْ عُمَرَ بْنِ اْلَخطَّابِ رَضيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ يَقُوْلُ : إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَ رَ سُوْلِهِ فَهِجْرَتٌهُ إِلَى اللهِ وَ رَسُوْلِهِ، وَ مَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيا يُصِيْبُهَا أَوِامْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ .
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : কর্ম মাত্রই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। এবং প্রত্যেকের প্রাপ্য-ফল হবে তাই, যা সে নিয়ত করেছে। অতএব, কারো হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে হলে বস্ত্তত তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া-প্রাপ্তি অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত তারই প্রতি হয়েছে বলে গণ্য হবে। [বোখারি, মুসলিম।]
হাদিস বর্ণনাকারী : খলিফা, আমিরুল মোমিনীন আবু হাফস উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনে নুফায়েল ইবনে আব্দুল উজ্জা আল-কোরাইশী আল-আদাবী। তিনি জন্ম লাভ করেন নবুয়্যতের ত্রিশ বৎসর পূর্বে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের প্রতি ছিলেন কঠোর মনোভাব পোষণকারী। অত:পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় ও মুক্তির দুয়ার খুলে যায়। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ র. বলেন :—
وما عبدنا الله جهرة حتى أسلم عمر .
উমর ইসলাম আনার পূর্বে আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহর এবাদত করিনি। [যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৫]
তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়, বিশাল অবয়ব ও রক্তিম বর্ণের অধিকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফারুক (পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা তার ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। তিনি হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সমস্ত যুদ্ধেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৩ হিজরিতে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মনোনয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা নিযুক্ত হন। তাঁর খেলাফতকালেই সিরিয়া, মিশর, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ইরাক বিজিত হয়। হিজরি সন প্রবর্তন করেন তিনিই। নথি তৈরির রীতিও তারই মাধ্যমে চালু হয়। এমনিভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের প্রচলন সর্বপ্রথম তিনিই করেছেন। মুসলিম উম্মার প্রতি তার দরদ ছিল অগাধ ; ব্যক্তিগতভাবে তিনি সকলের প্রয়োজনের প্রতি সদা দৃষ্টি রাখতেন, খুঁজে খুঁজে তাদের প্রয়োজন পূরণে তৎপর থাকতেন। সত্য ও সততায় তিনি ছিলেন কঠোর। যে পথ বেয়ে চলতেন তিনি, শয়তান তা থেকে পালিয়ে ভিন্ন পথে পলায়ন করত। দীর্ঘ দশ বছর ব্যাপী তিনি মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শাহাদাত বরণ করেন ২৩ হি: সনে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
* শাব্দিক আলোচনা :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ : এখানে আমল-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কর্ম ও কথন। বাক্যটির গঠন ও শৈলী ‘সীমাবদ্ধকরণ’ অর্থের প্রতি নির্দেশ করে। অর্থাৎ নিয়ত ব্যতীত কোন কর্মফল নেই। نية -النيات এর বহুবচন ; আভিধানিক অর্থ : এরাদা, ইচ্ছা।
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ দুটি :—
এক : কর্মের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য নিরূপণ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান। অর্থাৎ, কর্মের উদ্দেশ্য কি লা-শরিক এক আল্লাহর সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অপর কারো সন্তুষ্টি, অথবা আল্লাহর সাথে সাথে ভিন্ন কেউ?—এভাবে পার্থক্য নিরূপণ। উদাহরণত: সালাত আদায়। নিয়তের মাধ্যমে সহজে আমরা পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হই যে, বান্দা তা কি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নির্দেশ পালনার্থে, তাকে ভালোবেসে, করুণা প্রাপ্তির আশায়, তার শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে সালাত আদায় করেছে, না তার আদায়ের পিছনে কাজ করেছে লোক-দেখানো, বা যশ-খ্যাতি প্রাপ্তির মত হীন উদ্দেশ্য।
দুই : এবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা। যেমন : জোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা। এবং রমজান মাসের রোজাকে অন্য মাসের রোজা থেকে পৃথক করা। অথবা এবাদতকে অভ্যাসগত নিত্য-কর্ম থেকে ভিন্ন করে নেয়া। যেমন অপবিত্রতার গোসলকে পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা।
امرئ অর্থ পুরুষ। তবে এখানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত। ইসলামি শরিয়ার প্রচলিত সম্বোধন ধারা অনুসারে অর্থাৎ ইসলামি শরিয়া কোন ক্ষেত্রে মহিলার উল্লেখ ব্যতীত শুধু পুরুষের উল্লেখ করে বিধি-নিষেধ বর্ণনা করলে, সেখানে আদৌ এ উদ্দেশ্য করা হয় না যে, বর্ণিত বিধানটি শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য, মহিলার জন্য আলাদা বিধান রয়েছে। হ্যাঁ, মহিলার জন্য আলাদা বিধান প্রমাণ করে এমন কোন দলিল যদি থাকে, তাহলে তা স্বতন্ত্র। তা উক্ত সম্বোধন ধারার আওতাভুক্ত নয়।
الهجر- هِجْرَتُهُ থেকে গৃহীত। শব্দটির আদি অর্থ—ত্যাগ বা বর্জন ; এর বিপরীত শব্দ মিলন বা সংযোগ। পরবর্তীতে এর ব্যবহার প্রাধান্য পেতে থাকে এক স্থান ত্যাগ করে ভিন্ন স্থানে গমনের ক্ষেত্রে। শরিয়তের পরিভাষায় হিজরত হল—
مفارقة دار الكفر إلى دار الإسلام خوف الفتنة، وطلبا لإقامة الدين .
দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ফেতনা হতে আত্মরক্ষার মহতী ব্রত নিয়ে দারুল কুফর ত্যাগ করে দারুল ইসলামে গমন। [বিনা বাধায় ইসলাম পালন করা যায় যে ভূমিতে, তাকে বলে দারুল ইসলাম ; অপরদিকে ইসলাম যেখানে অবাধ নয়, নানা প্রতিকুলতায় সীমাবদ্ধ, তাকে বলে দারুল কুফুর।]
دنيا দাল অক্ষরটি পেশ বা যের যুক্ত। তবে পেশ-যুক্তই অধিক প্রসিদ্ধ। অর্থ নিকটতর। পার্থিব জগৎকে দুনিয়া নামে অবহিত করা হয়েছে, কারণ, তা ধ্বংসের খুবই নিকটতর, কিংবা পরজগতের পূর্বে এই জগতের আবির্ভাব হয়েছে বিধায় তার ‘দুনিয়া’ নামকরণ করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য পার্থিব জগতের ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য-খ্যাতি ও পদবী—ইত্যাদি।
يُصِيْبُهَا অর্থাৎ তা লাভ করবে।
বিধান ও ফায়দা :—
অর্থ, মর্ম ও ব্যাপ্তির বিচারে হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ব্যাপক। নি:সন্দেহে তা দ্বীনের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। এ কারণে অনেক সালাফে সালিহীন (উত্তম পূর্ব-সুরী) এর গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন—
وبه صدر البخاري كتابه الصحييح، وأقامه مقام الخطبة له، إشارة منه إلى أن كل عمل لايراد به وجه الله فهو باطل لا ثمرة له في الدنيا ولا في الآخرة .
ইমাম বোখারি র. তাঁর কিতাব সহিহ বোখারির প্রারম্ভে ভূমিকা স্বরূপ হাদিসটির অবতারণা করে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়—এমন সকল আমল বাতিল হিসেবে পরিত্যাজ্য, এ ধরনের আমল দুনিয়া ও আখেরাতে চূড়ান্তভাবে প্রতিফলশূন্য। [বোখারি] ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেছেন :—
هذا الحديث ثلث العلم، ويدخل في سبعين بابا من الفقه .
এ হাদিস দ্বীনের যাবতীয় উলুমের এক তৃতীয়াংশ, এবং ফিকাহ শাস্ত্রের সত্তুরটি অনুচ্ছেদে (প্রমাণ, প্রতিপাদ্য বা অন্য যে কোনভাবে) উল্লেখিত। [যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬] ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন :—
أصول الإسلام على ثلاثة أحاديث :
ইসলামের ভিত্তি তিনটি হাদিসের উপর স্থাপিত।
এক : উমর রহ. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস— إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ অর্থ : সকল আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।
দুই : আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত হাদিস :—
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
অর্থ : যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে অন্তর্ভুক্ত নয়—এমন নতুন কিছু আবিষ্কার বা সংযোজন করবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিন : নোমান ইবনে বশীর কর্তৃক বর্ণিত হাদিস : الحلال بين والحرام بين অর্থ : হালাল বিষয়ও সুস্পষ্ট, হারাম বিষয়ও সুস্পষ্ট। [মুসলিম]
মাসায়েল ও উপকারিতা :
এক : ইসলামি শরিয়তে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমল গ্রহণযোগ্য হয় না বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সকল এবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন:—
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর তাঁরই জন্য এবাদতকে বিশুদ্ধ করে। [সূরা যুমার : ২] তিনি আরো বলেছেন :—
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
‘তাদের শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে খাঁটি নিয়তে আল্লাহরই এবাদত করে।’ [সূরা বায়্যিনাহ : ৫]
কাজেই বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। যার সালাতের লক্ষ্য গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টি, তার নামাজ গ্রহণযোগ্য নয় কোনভাবে। অনুরূপভাবে, যার জাকাত দানের পেছনে লোক দেখানোর মত কপটাচার-কুমতলব লুকিয়ে থাকে তার সেই জাকাত আদৌ কবুল করা হবে না। এমনিভাবে কোন আমল সহিহ নিয়ত ছাড়া গৃহীত হয় না।
দুই : সালাফে সালিহীন রহ. নিয়ত বিষয়টির প্রতি অতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা তার প্রতি রাখতেন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সজাগ দৃষ্টি। গুরুত্ব ও সতর্কতা প্রমাণ করে তাদের এমন কিছু উক্তি নিম্নে পেশ করা হচ্ছে :—উমর রা. বলেছেন—
لا عمل لمن لا نية له، ولا أجر لمن لا حسبة له .
যার নিয়ত নেই, তার কোন আমল নেই। [যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬]
অর্থাৎ যার কোন সওয়াবের উদ্দেশ্য নেই, তার কোন পুরস্কার নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত—
لا ينفع قول إلا بعمل، ولا عمل إلا بنية، ولا ينفع قول ولا عمل ولا نية إلا بما وافق السنة .
কর্ম ব্যতীত বাকোয়াজিতে কোন ফল নেই, আর নিয়ত ব্যতীত কর্ম অসার। কর্ম, কথা ও নিয়ত কোন কাজে আসবে না, যতক্ষণ না তা রাসূলের সুন্নতের অনুসারে করা হবে। [প্রাগুক্ত : ৬] দাউদ তাঈ রহ. বলেন :—
رأيت الخير كله إنما يجمعه حسن النية .
আমি দেখেছি, কল্যাণের সুসন্বিবেশ হয় পরিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে। [প্রাগুক্ত : ৬] ইবনে মোবারক রহ. বলেন—
رب عمل صغير تعظمه النية، ورب عمل كبير تصغره النية .
নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে, অনেক বৃহৎ আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়। [প্রাগুক্ত : ৬]
তিন : উক্ত হাদিস থেকে এ বিষয়টি সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি, সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা—প্রভৃতির ন্যায় যে কর্মগুলো স্বীয় অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে, সে সব কর্ম ও সদিচ্ছাও সৎ নিয়তের বদৌলতে পুণ্যময় কর্মে পরিণত হতে পারে। পারে পুরস্কার বয়ে আনতে এরই মধ্য দিয়ে। সুতরাং কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এবাদতের শক্তি-ক্ষমতা লাভের এরাদাও যদি করে নেয়, তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই পুরস্কৃত হবে। এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোন সু-স্বাদু বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা বন্দেগিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন, আবু যর কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকা বিষয়ক আলাপকালে বলেছেন :—
وفي بضع أحدكم صدقة، قالوا يا رسول الله أيأتي أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر ؟ قال : نعم، أرأيتم لو وضعها في حرام يكون عليها وزر ؟ قالوا : نعم، فكذلك إذا وضعها في حلال فله فيها أجر .
তোমাদের প্রত্যেকের লজ্জাস্থানে (স্ত্রী সম্ভোগে) সদকার সওয়াব রয়েছে। তখন উপস্থিত সাহাবিগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের কেউ যদি স্বীয় স্ত্রীর নিকট যেŠন-চাহিদা পূরণের জন্য গমন করে তাহলে এতেও কি তার জন্য পুরস্কার আছে ? তিনি উত্তর বললেন : হাঁ, তোমরা কী মনে কর, সে যদি কোন হারাম পাত্রে তার যৌন-চাহিদা পূরণ করে তবে এতে তার পাপ হবে ? তারা জবাব দিলেন, হাঁ ! তখন তিনি বললেন, ঠিক তদ্রুপ সে যদি কোন হালাল পাত্রে নিজের যৌন-চাহিদা মেটায় তাহলে তার জন্য তাতে পুরস্কার থাকবে। [মুসলিম-১০০৬]
সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন :—
إنك لن تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله إلا أجرت بها، حتى ما تجعله في فيّ امرأتك .
নি:সন্দেহে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে তোমার যে কোন ব্যয়ের পরিবর্তে তুমি পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। এমনকি, পানাহার হিসাবে যা-ই তুমি নিজের স্ত্রীর মুখে দেবে তার জন্যও তুমি পুরস্কৃত হবে। [বোখারি-৫৬]
চার : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
‘সমস্ত আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং নিয়ত অনুযায়ীই প্রত্যেকের কর্মফল বিবেচিত হয়।’ [বোখারি ও মুসলিম] এই হাদিসটি প্রমাণ করে, বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য শুধু মৌখিক স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়, বরং হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাসও একান্ত আবশ্যক। কেননা, ঈমান মৌখিক স্বীকৃতি, আত্মার বিশ্বাস এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের সমন্বয়ে গঠিত, যা আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা বৃদ্ধি এবং তার নাফরমানি দ্বারা হ্রাস পায়।
পাঁচ : উক্ত হাদিস থেকে এই ভয়ানক হুমকিও প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে যার লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়, তবে তার কৃত-কর্ম না পুরস্কার যোগ্য, না গ্রহণযোগ্য। যেমন : কেউ লোক প্রদর্শনের নিয়তে জিহাদে যোগদান করল অথবা কেউ সুনাম-সুখ্যাতি কুড়ানোর মানসে ধন-দৌলত ব্যয় করল, অথবা ‘আলেম’ উপাধি লাভের লোভে জ্ঞানার্জন করল, অথবা ‘তার কোরআন পাঠ কতই না সুন্দর’—এই প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা করল। অনুরূপভাবে তাদের ন্যায়, যাদের কর্ম-কান্ডের নেপথ্যে কুমতলব কিংবা কু-নিয়ত কার্যকর থাকবে, তাদের সকলের পুনরুত্থান ঘটবে নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ীই। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ ﴿15﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই বরবাদগ্রস্ত এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সব বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। [সূরা হুদ ১৫-১৬]
যে সকল মুসল্লিদের সালাতের নেপথ্যে লুক্কায়িত থাকে লোক-দেখানো ও যশ-খ্যাতির মনোভাব, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :—
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿4﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿5﴾ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ ﴿6﴾ وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ ﴿7﴾
‘অতএব, দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে। এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্ত অন্যকে দেয় না।’ [সূরা মাউন ৪-৬]
ছয় : দারুল ইসলাম (ইসলামিক অঞ্চল)-এর উদ্দেশ্যে দারুল কুফর (কুফর অধ্যুষিত এলাকা) ত্যাগ একটি মহৎ কর্ম। যেহেতু দ্বীনের সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা বিষয়টির সাথে জড়িত, সেহেতু ইসলাম তার প্রতি দিয়েছে অনুপ্রেরণা, দিয়েছে জোর তাগিদ। সুতরাং হিজরতকারী যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দেয়া পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তাহলে সে উক্ত সৎকর্মের জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। আর যদি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিয়ে-শাদি, ধন-দৌলতের ন্যায় পার্থিব বস্ত্ত হয়, তবে এমন হিজরতের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হবে না। বৈষয়িক বস্ত্তই হবে তার একমাত্র প্রাপ্তি।
সাত : ছোট, বড় সর্ব প্রকার পাপাচার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করাও মহান হিজরতের অন্যতম মর্ম এবং এটাই প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এভাবে তা পরিহার করতে পারলে তা তার জন্য বয়ে আনবে উত্তম বদলা। কেননা, ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু পরিহার করলে তিনি তাকে এর জন্য মহা পুরস্কার দান করেন।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : কর্ম মাত্রই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। এবং প্রত্যেকের প্রাপ্য-ফল হবে তাই, যা সে নিয়ত করেছে। অতএব, কারো হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে হলে বস্ত্তত তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া-প্রাপ্তি অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত তারই প্রতি হয়েছে বলে গণ্য হবে। [বোখারি, মুসলিম।]
হাদিস বর্ণনাকারী : খলিফা, আমিরুল মোমিনীন আবু হাফস উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনে নুফায়েল ইবনে আব্দুল উজ্জা আল-কোরাইশী আল-আদাবী। তিনি জন্ম লাভ করেন নবুয়্যতের ত্রিশ বৎসর পূর্বে। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের প্রতি ছিলেন কঠোর মনোভাব পোষণকারী। অত:পর ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় ও মুক্তির দুয়ার খুলে যায়। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ র. বলেন :—
وما عبدنا الله جهرة حتى أسلم عمر .
উমর ইসলাম আনার পূর্বে আমরা প্রকাশ্যে আল্লাহর এবাদত করিনি। [যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৫]
তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়, বিশাল অবয়ব ও রক্তিম বর্ণের অধিকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ফারুক (পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা তার ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে দিয়েছিলেন। তিনি হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সমস্ত যুদ্ধেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৩ হিজরিতে আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর মনোনয়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা নিযুক্ত হন। তাঁর খেলাফতকালেই সিরিয়া, মিশর, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ইরাক বিজিত হয়। হিজরি সন প্রবর্তন করেন তিনিই। নথি তৈরির রীতিও তারই মাধ্যমে চালু হয়। এমনিভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের প্রচলন সর্বপ্রথম তিনিই করেছেন। মুসলিম উম্মার প্রতি তার দরদ ছিল অগাধ ; ব্যক্তিগতভাবে তিনি সকলের প্রয়োজনের প্রতি সদা দৃষ্টি রাখতেন, খুঁজে খুঁজে তাদের প্রয়োজন পূরণে তৎপর থাকতেন। সত্য ও সততায় তিনি ছিলেন কঠোর। যে পথ বেয়ে চলতেন তিনি, শয়তান তা থেকে পালিয়ে ভিন্ন পথে পলায়ন করত। দীর্ঘ দশ বছর ব্যাপী তিনি মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শাহাদাত বরণ করেন ২৩ হি: সনে, তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।
* শাব্দিক আলোচনা :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ : এখানে আমল-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কর্ম ও কথন। বাক্যটির গঠন ও শৈলী ‘সীমাবদ্ধকরণ’ অর্থের প্রতি নির্দেশ করে। অর্থাৎ নিয়ত ব্যতীত কোন কর্মফল নেই। نية -النيات এর বহুবচন ; আভিধানিক অর্থ : এরাদা, ইচ্ছা।
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ
নিয়তের পারিভাষিক অর্থ দুটি :—
এক : কর্মের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য নিরূপণ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রদান। অর্থাৎ, কর্মের উদ্দেশ্য কি লা-শরিক এক আল্লাহর সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অপর কারো সন্তুষ্টি, অথবা আল্লাহর সাথে সাথে ভিন্ন কেউ?—এভাবে পার্থক্য নিরূপণ। উদাহরণত: সালাত আদায়। নিয়তের মাধ্যমে সহজে আমরা পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হই যে, বান্দা তা কি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে, তার নির্দেশ পালনার্থে, তাকে ভালোবেসে, করুণা প্রাপ্তির আশায়, তার শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে সালাত আদায় করেছে, না তার আদায়ের পিছনে কাজ করেছে লোক-দেখানো, বা যশ-খ্যাতি প্রাপ্তির মত হীন উদ্দেশ্য।
দুই : এবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা। যেমন : জোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা। এবং রমজান মাসের রোজাকে অন্য মাসের রোজা থেকে পৃথক করা। অথবা এবাদতকে অভ্যাসগত নিত্য-কর্ম থেকে ভিন্ন করে নেয়া। যেমন অপবিত্রতার গোসলকে পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা।
امرئ অর্থ পুরুষ। তবে এখানে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত। ইসলামি শরিয়ার প্রচলিত সম্বোধন ধারা অনুসারে অর্থাৎ ইসলামি শরিয়া কোন ক্ষেত্রে মহিলার উল্লেখ ব্যতীত শুধু পুরুষের উল্লেখ করে বিধি-নিষেধ বর্ণনা করলে, সেখানে আদৌ এ উদ্দেশ্য করা হয় না যে, বর্ণিত বিধানটি শুধু পুরুষের জন্য প্রযোজ্য, মহিলার জন্য আলাদা বিধান রয়েছে। হ্যাঁ, মহিলার জন্য আলাদা বিধান প্রমাণ করে এমন কোন দলিল যদি থাকে, তাহলে তা স্বতন্ত্র। তা উক্ত সম্বোধন ধারার আওতাভুক্ত নয়।
الهجر- هِجْرَتُهُ থেকে গৃহীত। শব্দটির আদি অর্থ—ত্যাগ বা বর্জন ; এর বিপরীত শব্দ মিলন বা সংযোগ। পরবর্তীতে এর ব্যবহার প্রাধান্য পেতে থাকে এক স্থান ত্যাগ করে ভিন্ন স্থানে গমনের ক্ষেত্রে। শরিয়তের পরিভাষায় হিজরত হল—
مفارقة دار الكفر إلى دار الإسلام خوف الفتنة، وطلبا لإقامة الدين .
দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ফেতনা হতে আত্মরক্ষার মহতী ব্রত নিয়ে দারুল কুফর ত্যাগ করে দারুল ইসলামে গমন। [বিনা বাধায় ইসলাম পালন করা যায় যে ভূমিতে, তাকে বলে দারুল ইসলাম ; অপরদিকে ইসলাম যেখানে অবাধ নয়, নানা প্রতিকুলতায় সীমাবদ্ধ, তাকে বলে দারুল কুফুর।]
دنيا দাল অক্ষরটি পেশ বা যের যুক্ত। তবে পেশ-যুক্তই অধিক প্রসিদ্ধ। অর্থ নিকটতর। পার্থিব জগৎকে দুনিয়া নামে অবহিত করা হয়েছে, কারণ, তা ধ্বংসের খুবই নিকটতর, কিংবা পরজগতের পূর্বে এই জগতের আবির্ভাব হয়েছে বিধায় তার ‘দুনিয়া’ নামকরণ করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য পার্থিব জগতের ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য-খ্যাতি ও পদবী—ইত্যাদি।
يُصِيْبُهَا অর্থাৎ তা লাভ করবে।
বিধান ও ফায়দা :—
অর্থ, মর্ম ও ব্যাপ্তির বিচারে হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মহিমান্বিত ও ব্যাপক। নি:সন্দেহে তা দ্বীনের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। এ কারণে অনেক সালাফে সালিহীন (উত্তম পূর্ব-সুরী) এর গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন—
وبه صدر البخاري كتابه الصحييح، وأقامه مقام الخطبة له، إشارة منه إلى أن كل عمل لايراد به وجه الله فهو باطل لا ثمرة له في الدنيا ولا في الآخرة .
ইমাম বোখারি র. তাঁর কিতাব সহিহ বোখারির প্রারম্ভে ভূমিকা স্বরূপ হাদিসটির অবতারণা করে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়—এমন সকল আমল বাতিল হিসেবে পরিত্যাজ্য, এ ধরনের আমল দুনিয়া ও আখেরাতে চূড়ান্তভাবে প্রতিফলশূন্য। [বোখারি] ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেছেন :—
هذا الحديث ثلث العلم، ويدخل في سبعين بابا من الفقه .
এ হাদিস দ্বীনের যাবতীয় উলুমের এক তৃতীয়াংশ, এবং ফিকাহ শাস্ত্রের সত্তুরটি অনুচ্ছেদে (প্রমাণ, প্রতিপাদ্য বা অন্য যে কোনভাবে) উল্লেখিত। [যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬] ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন :—
أصول الإسلام على ثلاثة أحاديث :
ইসলামের ভিত্তি তিনটি হাদিসের উপর স্থাপিত।
এক : উমর রহ. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস— إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ অর্থ : সকল আমলের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।
দুই : আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত হাদিস :—
من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد
অর্থ : যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে অন্তর্ভুক্ত নয়—এমন নতুন কিছু আবিষ্কার বা সংযোজন করবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
তিন : নোমান ইবনে বশীর কর্তৃক বর্ণিত হাদিস : الحلال بين والحرام بين অর্থ : হালাল বিষয়ও সুস্পষ্ট, হারাম বিষয়ও সুস্পষ্ট। [মুসলিম]
মাসায়েল ও উপকারিতা :
এক : ইসলামি শরিয়তে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমল গ্রহণযোগ্য হয় না বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সকল এবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ তাআলা বলেছেন:—
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ
‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর তাঁরই জন্য এবাদতকে বিশুদ্ধ করে। [সূরা যুমার : ২] তিনি আরো বলেছেন :—
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
‘তাদের শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে খাঁটি নিয়তে আল্লাহরই এবাদত করে।’ [সূরা বায়্যিনাহ : ৫]
কাজেই বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। যার সালাতের লক্ষ্য গায়রুল্লাহর সন্তুষ্টি, তার নামাজ গ্রহণযোগ্য নয় কোনভাবে। অনুরূপভাবে, যার জাকাত দানের পেছনে লোক দেখানোর মত কপটাচার-কুমতলব লুকিয়ে থাকে তার সেই জাকাত আদৌ কবুল করা হবে না। এমনিভাবে কোন আমল সহিহ নিয়ত ছাড়া গৃহীত হয় না।
দুই : সালাফে সালিহীন রহ. নিয়ত বিষয়টির প্রতি অতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা তার প্রতি রাখতেন সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সজাগ দৃষ্টি। গুরুত্ব ও সতর্কতা প্রমাণ করে তাদের এমন কিছু উক্তি নিম্নে পেশ করা হচ্ছে :—উমর রা. বলেছেন—
لا عمل لمن لا نية له، ولا أجر لمن لا حسبة له .
যার নিয়ত নেই, তার কোন আমল নেই। [যাদুদ দায়িয়াহ : পৃষ্ঠা : ৬]
অর্থাৎ যার কোন সওয়াবের উদ্দেশ্য নেই, তার কোন পুরস্কার নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত—
لا ينفع قول إلا بعمل، ولا عمل إلا بنية، ولا ينفع قول ولا عمل ولا نية إلا بما وافق السنة .
কর্ম ব্যতীত বাকোয়াজিতে কোন ফল নেই, আর নিয়ত ব্যতীত কর্ম অসার। কর্ম, কথা ও নিয়ত কোন কাজে আসবে না, যতক্ষণ না তা রাসূলের সুন্নতের অনুসারে করা হবে। [প্রাগুক্ত : ৬] দাউদ তাঈ রহ. বলেন :—
رأيت الخير كله إنما يجمعه حسن النية .
আমি দেখেছি, কল্যাণের সুসন্বিবেশ হয় পরিশুদ্ধ নিয়তের মাধ্যমে। [প্রাগুক্ত : ৬] ইবনে মোবারক রহ. বলেন—
رب عمل صغير تعظمه النية، ورب عمل كبير تصغره النية .
নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। পক্ষান্তরে, অনেক বৃহৎ আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়। [প্রাগুক্ত : ৬]
তিন : উক্ত হাদিস থেকে এ বিষয়টি সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি, সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা—প্রভৃতির ন্যায় যে কর্মগুলো স্বীয় অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে, সে সব কর্ম ও সদিচ্ছাও সৎ নিয়তের বদৌলতে পুণ্যময় কর্মে পরিণত হতে পারে। পারে পুরস্কার বয়ে আনতে এরই মধ্য দিয়ে। সুতরাং কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এবাদতের শক্তি-ক্ষমতা লাভের এরাদাও যদি করে নেয়, তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই পুরস্কৃত হবে। এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোন সু-স্বাদু বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা বন্দেগিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন, আবু যর কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকা বিষয়ক আলাপকালে বলেছেন :—
وفي بضع أحدكم صدقة، قالوا يا رسول الله أيأتي أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر ؟ قال : نعم، أرأيتم لو وضعها في حرام يكون عليها وزر ؟ قالوا : نعم، فكذلك إذا وضعها في حلال فله فيها أجر .
তোমাদের প্রত্যেকের লজ্জাস্থানে (স্ত্রী সম্ভোগে) সদকার সওয়াব রয়েছে। তখন উপস্থিত সাহাবিগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের কেউ যদি স্বীয় স্ত্রীর নিকট যেŠন-চাহিদা পূরণের জন্য গমন করে তাহলে এতেও কি তার জন্য পুরস্কার আছে ? তিনি উত্তর বললেন : হাঁ, তোমরা কী মনে কর, সে যদি কোন হারাম পাত্রে তার যৌন-চাহিদা পূরণ করে তবে এতে তার পাপ হবে ? তারা জবাব দিলেন, হাঁ ! তখন তিনি বললেন, ঠিক তদ্রুপ সে যদি কোন হালাল পাত্রে নিজের যৌন-চাহিদা মেটায় তাহলে তার জন্য তাতে পুরস্কার থাকবে। [মুসলিম-১০০৬]
সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন :—
إنك لن تنفق نفقة تبتغي بها وجه الله إلا أجرت بها، حتى ما تجعله في فيّ امرأتك .
নি:সন্দেহে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে তোমার যে কোন ব্যয়ের পরিবর্তে তুমি পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। এমনকি, পানাহার হিসাবে যা-ই তুমি নিজের স্ত্রীর মুখে দেবে তার জন্যও তুমি পুরস্কৃত হবে। [বোখারি-৫৬]
চার : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :—
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَ إِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
‘সমস্ত আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং নিয়ত অনুযায়ীই প্রত্যেকের কর্মফল বিবেচিত হয়।’ [বোখারি ও মুসলিম] এই হাদিসটি প্রমাণ করে, বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য শুধু মৌখিক স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়, বরং হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাসও একান্ত আবশ্যক। কেননা, ঈমান মৌখিক স্বীকৃতি, আত্মার বিশ্বাস এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের সমন্বয়ে গঠিত, যা আল্লাহর আনুগত্য দ্বারা বৃদ্ধি এবং তার নাফরমানি দ্বারা হ্রাস পায়।
পাঁচ : উক্ত হাদিস থেকে এই ভয়ানক হুমকিও প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে যার লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি নয়, তবে তার কৃত-কর্ম না পুরস্কার যোগ্য, না গ্রহণযোগ্য। যেমন : কেউ লোক প্রদর্শনের নিয়তে জিহাদে যোগদান করল অথবা কেউ সুনাম-সুখ্যাতি কুড়ানোর মানসে ধন-দৌলত ব্যয় করল, অথবা ‘আলেম’ উপাধি লাভের লোভে জ্ঞানার্জন করল, অথবা ‘তার কোরআন পাঠ কতই না সুন্দর’—এই প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা শিক্ষা করল। অনুরূপভাবে তাদের ন্যায়, যাদের কর্ম-কান্ডের নেপথ্যে কুমতলব কিংবা কু-নিয়ত কার্যকর থাকবে, তাদের সকলের পুনরুত্থান ঘটবে নিজ নিজ নিয়ত অনুযায়ীই। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ ﴿15﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই বরবাদগ্রস্ত এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সব বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে। [সূরা হুদ ১৫-১৬]
যে সকল মুসল্লিদের সালাতের নেপথ্যে লুক্কায়িত থাকে লোক-দেখানো ও যশ-খ্যাতির মনোভাব, তাদের সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :—
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ﴿4﴾ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ ﴿5﴾ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ ﴿6﴾ وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ ﴿7﴾
‘অতএব, দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে। এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্ত অন্যকে দেয় না।’ [সূরা মাউন ৪-৬]
ছয় : দারুল ইসলাম (ইসলামিক অঞ্চল)-এর উদ্দেশ্যে দারুল কুফর (কুফর অধ্যুষিত এলাকা) ত্যাগ একটি মহৎ কর্ম। যেহেতু দ্বীনের সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠা বিষয়টির সাথে জড়িত, সেহেতু ইসলাম তার প্রতি দিয়েছে অনুপ্রেরণা, দিয়েছে জোর তাগিদ। সুতরাং হিজরতকারী যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর দেয়া পুরস্কার গ্রহণের উদ্দেশ্যে হিজরত করে, তাহলে সে উক্ত সৎকর্মের জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। আর যদি তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বিয়ে-শাদি, ধন-দৌলতের ন্যায় পার্থিব বস্ত্ত হয়, তবে এমন হিজরতের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হবে না। বৈষয়িক বস্ত্তই হবে তার একমাত্র প্রাপ্তি।
সাত : ছোট, বড় সর্ব প্রকার পাপাচার সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করাও মহান হিজরতের অন্যতম মর্ম এবং এটাই প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এভাবে তা পরিহার করতে পারলে তা তার জন্য বয়ে আনবে উত্তম বদলা। কেননা, ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কিছু পরিহার করলে তিনি তাকে এর জন্য মহা পুরস্কার দান করেন।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ - رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ : قَالَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيْهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الإِيْمانِ : أَنْ يَّكُوْنَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ أحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا ও وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءُ لَا يُحِبُّهُ إلَّا ِللهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَّعُوْدَ فِيْ الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُّقْذَفَ فِيْ النَّارِ .
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : যে ব্যক্তি তিনটি সৎ স্বভাব (গুণ)-এর অধিকারী হবে সে ঈমানের স্বাদ উপভোগ করবে—(এক) তার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স. সব চাইতে প্রিয় হবে। (দুই) কোনো ব্যক্তিকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসবে। (তিন) আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেরূপ অপছন্দ করে, কুফরিতে ফিরে যাওয়াকেও ঠিক সে-রূপ অপছন্দ করবে। [বোখারি- ১৬, মুসলিম-৪৩।]
হাদিস বর্ণনাকারী : মহান সাহাবি আবু হামজা আনাস ইবনে মালেক ইবনে নছর নাজ্জারী খাযরাজী ; যিনি ইমাম, কারী, মুফতি ও মুহাদ্দিস এবং ইসলামের অন্যতম মহান রাবী ও রাসূলুল্লাহ স.-এর বিশিষ্ট খাদেম। আল্লামা যাহাবী রহ. বলেন :—
صحب النبي صلى الله عليه وسلم أتم الصحبة، ولازمه أكمل الملازمة، منذ أن هاجر إلى أن مات، وغزا معه غير مرة، وبايع تحت الشجرة .
তিনি রাসূল সা.-এর পরিপূর্ণ সাহচর্য-লাভে ধন্য হয়েছেন। মহানবীর হিজরতের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর সেবা যত্নে অব্যাহতভাবে নিরত ছিলেন। একাধিক ‘গাযওয়ায়’ (ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে) তিনি ছিলেন রাসূলের একান্ত সহযোগী। (বাবলা) বৃক্ষের নীচে বায়আত গ্রহণকারী ভাগ্যবানদের তিনি ছিলেন অন্যতম। [আল-ইসাবা ফি তামঈযিস সাহাবা] তিনি স্বয়ং বলেন :—
خدمت النبي صلى الله عليه وسلم عشر سنين، فما ضربني، ولا سبني، ولا عبس في وجهي .
আমি এক নাগাড়ে দশ বছর রাসূলের খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো আমাকে (ত্রুটি সত্ত্বেও) প্রহার করেননি, কটু কথা বলেননি কখনো, কিংবা কোন কারণে তার ভ্রূ কুঞ্চিত হতে দেখিনি। [যাদুদ দায়িয়াহ : ৮]
রাসূল সা. তার জন্য দোয়া করেছিলেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্যের জন্য। তার দোয়া কবুল হয়, এবং মৃত্যুর পূর্বে তার সন্তান-সন্ততির সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিকে। ৯১ হিজরিতে, কিংবা বলা হয় আরো পরে, তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তিনি ছিলেন বসরায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবি। তার মৃত্যুতে মানুষের মাঝে এক অভূতপূর্ব শোকের ছায়া নেমে আসে। এমনকি, তখন মানুষের মাঝে বলাবলি হচ্ছিল যে—
قد ذهب نصف العلم .
‘জ্ঞানের অর্ধেক বিদায় নিয়েছে।’
শাব্দিক আলোচনা :—
ثَلَاثٌ অর্থাৎ তিনটি স্বভাব বা গুণ।
مَنْ كُنَّ فِيْهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الإِيْمانِ — كن দ্বারা উদ্দেশ্য ‘অর্জিত হল’। সুতরাং এ كان টি হল পূর্ণাঙ্গ ক্রিয়া। বাক্যটির অর্থ এই যে, এ গুণত্রয় যার অর্জিত হবে, সে ঈমানের মাধুর্যপ্রাপ্ত হবে। ঈমানের মাধুর্য হল : আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের মাধ্যমে অতুলনীয় আস্বাদ লাভ, অন্তরের প্রশান্তি ও উন্মোচন।
ঈমানের হালাওয়াত (মাধুর্য) কি ?
এবাদতগুজার ব্যক্তি বন্দেগি-গুজরানকালে যে আত্মতৃপ্তি ও আন্তরিক প্রশান্তি উপভোগ করে, তাকেই ঈমানের হালাওয়াত বা ঈমানের মধুরতা-মাধুর্য বলে।
আল্লামা ইবনে হাজর রহ. শায়খ আবু মুহাম্মদ ইবনে আবু জামরার বরাত দিয়ে বলেন :—
إنما عبر بالحلاوة لأن الله شبه الإيمان بالشجرة في قوله تعالى : ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ ( إبراهيم : ২৪) فالكلمة هي كلمة الإخلاص، والشجرة أصل الإيمان، وأغصانها اتباع الأمر واجتناب النهي، وورقها ما يهتم به المؤمن من الخير، وثمرها عمل الطاعات، وحلاوة الثمر جني الثمرة، وغاية كماله تناهي نضج الثمرة، وبه تظهر حلاوتها .
মানুষের আত্মার এই আস্বাদ ও প্রশান্তির মধুর অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘হালাওয়াত’ শব্দের অবতারণার কারণ এই যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঈমানকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন ; কোরআনে এসেছে—
‘আল্লাহ তাআলা উপমা বর্ণনা করেছেন : পবিত্র বাক্য হল পবিত্র বৃক্ষের মতো।’ [ইবরাহীম : ২৪] [যাদুদ দায়িয়াহ :]
উল্লেখিত আয়াতে ‘কালেমা’ দ্বারা উদ্দেশ্য কালেমায়ে এখলাস (কালেমায়ে তায়্যিবা)। বৃক্ষ হল ঈমানের মূল কান্ড, আদেশের অনুবর্তন ও নিষেধের পরিহার, তার শাখা-প্রশাখা ; মোমিনগণ ব্রতী হন যে কল্যাণ-কর্মে, তা তার পত্র-পল্লব। মোমিনের অনুগত কর্মতৎপরতা হল এ বৃক্ষের ফল, ফলের আহরণ ফলের সুমিষ্ট স্বাদ। ফল পরিপূর্ণ পরিপক্ব হওয়া এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সুখময়-সফল পরিণতি—এভাবেই, সার্বিক পরম্পরায় প্রকাশ পায় এর ‘হালাওয়াত’ বা মাধুর্য।
وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءُ لَا يُحِبُّهُ إلَّا للهِ এর মর্মার্থ এই যে, মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কের একক ভিত্তি হবে আল্লাহর প্রতি সর্বান্ত বিশ্বাস, সৎকর্ম—ইত্যাদি। আল্লাহর জন্য অপরকে ভালোবাসা তখনই প্রমাণিত হবে, যখন তাৎক্ষণিক পারস্পরিক সম্প্রীতি বা মনোমালিন্যের দরুন দু’জন মুসলিমের মাঝে আল্লাহ ও তার প্রতি বিশ্বাস কেন্দ্রিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না।
وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَّعُوْدَ فِيْ الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُّقْذَفَ فِيْ النَّارِ অর্থ হল : কুফরে প্রত্যাবর্তনে ততখানি ঘৃণা ও আতঙ্ক বোধ করবে, যতটা আতঙ্ক ও অনীহা বোধ করে মানুষ আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে। ভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে :—
وحتى أن يقذف في النار أحب إليه أن يرجع إلي الكفر بعد إذ أنقذه الله منه
অর্থাৎ—যতক্ষণ যে কুফর থেকে আল্লাহ তাআলা মানুষকে রক্ষা করেছেন, সে কুফরে প্রত্যাবর্তনের তুলনায় অধিক প্রিয় জ্ঞান করবে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। [বোখারি : ৫৫৮১] উপরোক্ত বর্ণনার তুলনায় এ বর্ণনাটি অধিক অলংকারপূর্ণ। কারণ, প্রথমোক্ত রেওয়াতে কুফরে প্রত্যাবর্তন ও আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে একই পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এ রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, কুফরে প্রত্যাবর্তনের তুলনায় আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অধিক শ্রেয়।
বিধি-বিধান ও উপকারিতা :
১। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের রয়েছে এক অভূতপূর্ব, অপরিমেয় ও তৃপ্তিকর আস্বাদ, যা গ্রহণ করতে সক্ষম কেবল সত্যবাদী মোমিনগণ, যাদের ক্রমাগত অধ্যবসায় সৃষ্টি করে এ আস্বাদ লাভের উপযোগী গুণাবলী—তাদের আত্মায়, কর্মে ও নিত্য তৎপরতায়। ঈমানের দাবিদার মাত্রই এ আস্বাদ গ্রহণে সক্ষম—এমন নয়।
২। আল্লাহ তাআলাকে মহববত করা এবং তারই ফলশ্রুতিতে তার রাসূলকেও ভালোবাসা। এ এমন এক গুণ যা সেসব সৌভাগ্যশালী সুমহান ব্যক্তি-বর্গের গুণাগুণের মাঝে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, যারা ঈমানের তৃপ্তি-স্বাদ গ্রহণে সফল হতে পেরেছেন। বস্ত্তত: কোন মহববতই আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূলের মহববতের চেয়ে অগ্রণী হতে পারে না। বরং মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসাই মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, সমগ্র মানুষ, এমনকি নিজের সত্তাসহ সকল কিছুর চেয়ে অগ্রগণ্য হতে হবে। এটাই ঈমানের দাবি। উল্লেখ্য, উমর রা. মহানবীকে বলেছিলেন:—
يا رسول الله لأنت أحب إلي من كل شيء إلا من نفسي، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : لا والذي نفسي بيده حتى أكون أحب إليك من نفسك، فقال عمر : فإنه الآن والله لأنت أحب إلي من نفسي، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : الآن يا عمر، ( أى كمل إيمانك ).
হে আল্লাহর রাসূল স.! আপনি আমার নিকট আমি ছাড়া অপরাপর সবকিছুর চেয়ে অধিকতর প্রিয়। তখন তিনি স. বললেন : না, (এরূপ হতে পারে না) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার সত্তার চাইতেও প্রিয়তর হই। (এবার) উমর রা. বললেন : আল্লাহর শপথ ! এ মুহূর্ত থেকে অবশ্যই আপনি আমার কাছে আমার আপন সত্তার চেয়েও প্রিয়। মহানবী (এবার) বললেন : হে উমর ! এক্ষণে (তোমার ঈমান পূর্ণতা পেল)। [বোখারি- ৬৬৩২]
আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :—
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين .
তোমাদের মাঝে কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান, এবং সকল মানব-মানবীর চেয়ে প্রিয়তর হব। [বোখারি-১৫, মুসলিম-৪৫]
মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ভালোবাসার যে চিত্র উক্ত পরিসরে তুলে ধরা হল তার একটি অনিবার্য প্রভাব তথা অলৌকিক প্রতিক্রিয়া ও ফলশ্রুতি রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ও তার রাসূল স.-এর সে-রূপ মহববত পোষণকারী বান্দারা ঐশী আদেশ-নিষেধের প্রতি যথাযোগ্য আত্মতুষ্টি আর আত্মস্বীকৃতির বিকাশ ঘটিয়ে সেসব বিধি-নিষেধ বা আদেশ-নিষেধের অকপট অনুকরণে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রাখতে সদাই সক্রিয় হন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :—
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ ( آل عمران : ৩১)
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে তোমরা আমাকে অনুসরণ কর, তবে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন। [আল- ইমরান: ৩১]
৩। ফরজ কর্মের পর যে সমস্ত বিষয় আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা মানুষের অন্তরে জাগ্রত করে,—ইবনে কায়্যিম (রহ.)-এর মতে—তা নিম্নরূপ :—
(ক) আত্ম-সমাহিতি, নিমগ্নতা ও সক্রিয় চিন্তাবৃত্তির মাধ্যমে কোরআন তেলাওয়াতে ব্রতী হওয়া।
(খ) নফল এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য হাসিলে প্রয়াসী হওয়া।
(গ) রসনা, আত্মা ও নেক আমলের মাধ্যমে সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে সক্রিয় থাকা।
(ঘ) আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় বিষয়াদিকে প্রবৃত্তির শোভনীয় বস্ত্তসমূহের উপর প্রাধান্য দেয়া।
(ঙ) আল্লাহর প্রতি মহববত পোষণকারী সত্যবাদী নেককারদের সংস্রবে আত্মনিয়োগ করা।
(চ) মহান আল্লাহ ও অন্তরাত্মার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়—এমন সব উপায়-উপকরণের সাথে যথা-সম্ভব দূর সম্পর্কও না রাখা।
৪। আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার ফলশ্রুতিতে তাঁর রাসূলকেও ভালোবাসা এবং উক্ত পবিত্রতম মহববতকে সৃষ্টিকুলের মহববতের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া। আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে মহানবীকে ভালোবাসার কতিপয় লক্ষণ নিম্নরূপ :—
(ক) এ কথার প্রতি সুদৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস পোষণ করা যে, তিনি স. হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল। আল্লাহ তাআলা তাকে সকল মানুষের জন্য সু-সংবাদ দানকারী, সতর্ককারী এবং তার আনীত একমাত্র সত্য-ধর্ম ইসলামের প্রতি আহবানকারী এবং তিমিরনাশী মশাল ও আলোকিত দিশারি রূপে প্রেরণ করেছেন।
(খ) তার দর্শন-সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষার লালন এবং এ আকাঙ্ক্ষা মনে জাগ্রত না হলে মনঃকষ্টের উদ্রেক হওয়া।
(গ) তার যাবতীয় আদেশের অনুবর্তন এবং নিষেধের পরিহার ও বর্জন। কারণ, প্রকৃত মহববত পোষণকারী মাহবুবের অনুসারী হয়। এটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় যে, তুমি এক দিকে তার ভালোবাসার দাবি করবে এবং অন্যদিকে তার নির্দেশাবলীর বিরোধিতা এবং নিষিদ্ধ বিষয়াদির সীমা লঙ্ঘন করবে।
(ঘ) সুন্নতের অতুলনীয়তা ও অনুপম আদর্শের আলোয় জীবন সমুজ্জ্বল করা। তার অনুকুল ও পক্ষ মতের অনুসারী যারা, তাদের সাহায্য করা, এবং যারা তার ঘোরতর বিরোধিতায় লিপ্ত, মনে-প্রাণে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা। তার মতামত ও আদর্শ প্রচারে অবদান রাখা। সর্বোপরি, এসব পথে নিরলস চেষ্টা সাধনায় কোনরূপ কার্পণ্য না করা।
(ঙ) তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ।
(চ) তাঁর নৈতিকতা ও চরিত্রে চরিত্রবান এবং শিষ্টাচারে পরিমার্জিত হওয়া।
(ছ) তাঁর সাহাবিদের ভালোবাসা এবং তাদের পক্ষ হয়ে প্রতিরোধ করা।
(জ) তাঁর জীবন বৃত্তান্ত ও সমুদয় সংবাদ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করা।
৫। মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতির ভিত্তি হবে আল্লাহ তাআলার জন্য ও তার সন্তুষ্টির উপর ভিত্তি করে। এ সৌহার্দ্যের রয়েছে অতুলনীয় ফজিলত ও সওয়াব। এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন হাদিস। আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন :—
سبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله ... وذكرمنهم ورجلان تحابا في الله، اجتمعا عليه وافترقا عليه .
‘যেদিন আল্লাহ তাআলার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে তার ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন...(তাদের মাঝে তিনি উল্লেখ করেন)...এমন দুই ব্যক্তি, যারা একে-অপরকে ভালোবেসেছে একমাত্র আল্লাহর জন্য—তারা একত্রিত বা পৃথক হয়েছে তারই উদ্দেশ্যে, তারই নিমিত্তে। [বোখারি ও মুসলিম]
৬। আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে ভালোবাসার কতিপয় অধিকারসমূহ :—
(ক) প্রয়োজনের সময় সহায়তার জন্য পাশে দাঁড়ানো। যেমন হাদিসে এসেছে:
خير الناس أنفعهم للناس .
যে মানুষের সর্বাধিক উপকারে আসে, সে-ই তাদের মাঝে সর্বোত্তম। [তাবারানী, হাদিসটি হাসান]
(খ) স্বীয় মুসলিম ভাই-এর দোষচর্চা থেকে নীরব থাকা। তার ভুল-ত্রুটিকে কোন না কোন অজুহাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। তুমি যেরূপ তোমার দোষ-ত্রুটিকে ঢেকে রাখা পছন্দ কর, তার জন্যেও তা পছন্দ করবে।
(গ) তোমার দ্বীনি ভাই আল্লাহ কর্তৃক কোন নেয়ামত প্রাপ্ত হলে তুমি তার প্রতি কিছুতেই হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হবে না।
(ঘ) তোমার সে ভাই জীবিত হোক কিংবা মৃত, তার জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করা। কারণ, এরূপ দোয়া আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় এবং প্রার্থনাকারীও তার অনুরূপ দয়াপ্রাপ্ত হয়।
(ঙ) মুসলিম ভাইকে অভিবাদন ও সালাম দানে অগ্রণী থাকা। তার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া, বা জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং তার প্রতি অহংকার ও প্রতারণামূলক আচার-আচরণ মোটেও না করা।
(চ) যে কোন মুসলিম ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়া।
কুফরি আল্লাহর নিকট একটি জঘন্য বিষয়। কাজেই মোমিনের নিকট জ্বলন্ত অগ্নিতে নিপতিত হওয়া যত অপছন্দনীয়, তার কাছে কুফরি শুধু ততটা অপছন্দনীয়—তাই নয়, বরং তার চেয়েও তীব্রতর ও অশুভ হওয়া একান্ত কাম্য। অনুরূপভাবে, কাফের আল্লাহর নিকট ঘৃণিত, তাই ঈমানদার ব্যক্তিকেও তাকে সেই কুফরির জন্য—যা জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে নিক্ষিপ্ত করে তাতে—ঘৃণা করা একান্তভাবে জরুরি।
বস্ত্তত: কাফেরদের সঙ্গ অবলম্বন ও মৈত্রী আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির কারণ। কাফেরদের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ মৈত্রীর নানাবিধ ধরন বা বিবিধ পদ্ধতি রয়েছে। যথা : তাদের ভালোবাসা, মোমিনদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। তাদের খোশামোদ-তোষামোদপূর্ণ সঙ্গ ও বন্ধুত্ব অবলম্বনে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িত হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً .
ঈমানদারগণ মোমিন ব্যতীত কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে না। যারা এরূপ করে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর (তবে তাদের সঙ্গে সাবধানতার সাথে থাকবে)। [আলে-ইমরান, ২৮]
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : যে ব্যক্তি তিনটি সৎ স্বভাব (গুণ)-এর অধিকারী হবে সে ঈমানের স্বাদ উপভোগ করবে—(এক) তার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রাসূল স. সব চাইতে প্রিয় হবে। (দুই) কোনো ব্যক্তিকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসবে। (তিন) আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে যেরূপ অপছন্দ করে, কুফরিতে ফিরে যাওয়াকেও ঠিক সে-রূপ অপছন্দ করবে। [বোখারি- ১৬, মুসলিম-৪৩।]
হাদিস বর্ণনাকারী : মহান সাহাবি আবু হামজা আনাস ইবনে মালেক ইবনে নছর নাজ্জারী খাযরাজী ; যিনি ইমাম, কারী, মুফতি ও মুহাদ্দিস এবং ইসলামের অন্যতম মহান রাবী ও রাসূলুল্লাহ স.-এর বিশিষ্ট খাদেম। আল্লামা যাহাবী রহ. বলেন :—
صحب النبي صلى الله عليه وسلم أتم الصحبة، ولازمه أكمل الملازمة، منذ أن هاجر إلى أن مات، وغزا معه غير مرة، وبايع تحت الشجرة .
তিনি রাসূল সা.-এর পরিপূর্ণ সাহচর্য-লাভে ধন্য হয়েছেন। মহানবীর হিজরতের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর সেবা যত্নে অব্যাহতভাবে নিরত ছিলেন। একাধিক ‘গাযওয়ায়’ (ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে) তিনি ছিলেন রাসূলের একান্ত সহযোগী। (বাবলা) বৃক্ষের নীচে বায়আত গ্রহণকারী ভাগ্যবানদের তিনি ছিলেন অন্যতম। [আল-ইসাবা ফি তামঈযিস সাহাবা] তিনি স্বয়ং বলেন :—
خدمت النبي صلى الله عليه وسلم عشر سنين، فما ضربني، ولا سبني، ولا عبس في وجهي .
আমি এক নাগাড়ে দশ বছর রাসূলের খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনো আমাকে (ত্রুটি সত্ত্বেও) প্রহার করেননি, কটু কথা বলেননি কখনো, কিংবা কোন কারণে তার ভ্রূ কুঞ্চিত হতে দেখিনি। [যাদুদ দায়িয়াহ : ৮]
রাসূল সা. তার জন্য দোয়া করেছিলেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্যের জন্য। তার দোয়া কবুল হয়, এবং মৃত্যুর পূর্বে তার সন্তান-সন্ততির সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিকে। ৯১ হিজরিতে, কিংবা বলা হয় আরো পরে, তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তিনি ছিলেন বসরায় মৃত্যুবরণকারী সর্বশেষ সাহাবি। তার মৃত্যুতে মানুষের মাঝে এক অভূতপূর্ব শোকের ছায়া নেমে আসে। এমনকি, তখন মানুষের মাঝে বলাবলি হচ্ছিল যে—
قد ذهب نصف العلم .
‘জ্ঞানের অর্ধেক বিদায় নিয়েছে।’
শাব্দিক আলোচনা :—
ثَلَاثٌ অর্থাৎ তিনটি স্বভাব বা গুণ।
مَنْ كُنَّ فِيْهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الإِيْمانِ — كن দ্বারা উদ্দেশ্য ‘অর্জিত হল’। সুতরাং এ كان টি হল পূর্ণাঙ্গ ক্রিয়া। বাক্যটির অর্থ এই যে, এ গুণত্রয় যার অর্জিত হবে, সে ঈমানের মাধুর্যপ্রাপ্ত হবে। ঈমানের মাধুর্য হল : আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের মাধ্যমে অতুলনীয় আস্বাদ লাভ, অন্তরের প্রশান্তি ও উন্মোচন।
ঈমানের হালাওয়াত (মাধুর্য) কি ?
এবাদতগুজার ব্যক্তি বন্দেগি-গুজরানকালে যে আত্মতৃপ্তি ও আন্তরিক প্রশান্তি উপভোগ করে, তাকেই ঈমানের হালাওয়াত বা ঈমানের মধুরতা-মাধুর্য বলে।
আল্লামা ইবনে হাজর রহ. শায়খ আবু মুহাম্মদ ইবনে আবু জামরার বরাত দিয়ে বলেন :—
إنما عبر بالحلاوة لأن الله شبه الإيمان بالشجرة في قوله تعالى : ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ ( إبراهيم : ২৪) فالكلمة هي كلمة الإخلاص، والشجرة أصل الإيمان، وأغصانها اتباع الأمر واجتناب النهي، وورقها ما يهتم به المؤمن من الخير، وثمرها عمل الطاعات، وحلاوة الثمر جني الثمرة، وغاية كماله تناهي نضج الثمرة، وبه تظهر حلاوتها .
মানুষের আত্মার এই আস্বাদ ও প্রশান্তির মধুর অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘হালাওয়াত’ শব্দের অবতারণার কারণ এই যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঈমানকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করেছেন ; কোরআনে এসেছে—
‘আল্লাহ তাআলা উপমা বর্ণনা করেছেন : পবিত্র বাক্য হল পবিত্র বৃক্ষের মতো।’ [ইবরাহীম : ২৪] [যাদুদ দায়িয়াহ :]
উল্লেখিত আয়াতে ‘কালেমা’ দ্বারা উদ্দেশ্য কালেমায়ে এখলাস (কালেমায়ে তায়্যিবা)। বৃক্ষ হল ঈমানের মূল কান্ড, আদেশের অনুবর্তন ও নিষেধের পরিহার, তার শাখা-প্রশাখা ; মোমিনগণ ব্রতী হন যে কল্যাণ-কর্মে, তা তার পত্র-পল্লব। মোমিনের অনুগত কর্মতৎপরতা হল এ বৃক্ষের ফল, ফলের আহরণ ফলের সুমিষ্ট স্বাদ। ফল পরিপূর্ণ পরিপক্ব হওয়া এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সুখময়-সফল পরিণতি—এভাবেই, সার্বিক পরম্পরায় প্রকাশ পায় এর ‘হালাওয়াত’ বা মাধুর্য।
وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءُ لَا يُحِبُّهُ إلَّا للهِ এর মর্মার্থ এই যে, মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কের একক ভিত্তি হবে আল্লাহর প্রতি সর্বান্ত বিশ্বাস, সৎকর্ম—ইত্যাদি। আল্লাহর জন্য অপরকে ভালোবাসা তখনই প্রমাণিত হবে, যখন তাৎক্ষণিক পারস্পরিক সম্প্রীতি বা মনোমালিন্যের দরুন দু’জন মুসলিমের মাঝে আল্লাহ ও তার প্রতি বিশ্বাস কেন্দ্রিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না।
وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَّعُوْدَ فِيْ الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُّقْذَفَ فِيْ النَّارِ অর্থ হল : কুফরে প্রত্যাবর্তনে ততখানি ঘৃণা ও আতঙ্ক বোধ করবে, যতটা আতঙ্ক ও অনীহা বোধ করে মানুষ আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে। ভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে :—
وحتى أن يقذف في النار أحب إليه أن يرجع إلي الكفر بعد إذ أنقذه الله منه
অর্থাৎ—যতক্ষণ যে কুফর থেকে আল্লাহ তাআলা মানুষকে রক্ষা করেছেন, সে কুফরে প্রত্যাবর্তনের তুলনায় অধিক প্রিয় জ্ঞান করবে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে। [বোখারি : ৫৫৮১] উপরোক্ত বর্ণনার তুলনায় এ বর্ণনাটি অধিক অলংকারপূর্ণ। কারণ, প্রথমোক্ত রেওয়াতে কুফরে প্রত্যাবর্তন ও আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে একই পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এ রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, কুফরে প্রত্যাবর্তনের তুলনায় আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অধিক শ্রেয়।
বিধি-বিধান ও উপকারিতা :
১। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের রয়েছে এক অভূতপূর্ব, অপরিমেয় ও তৃপ্তিকর আস্বাদ, যা গ্রহণ করতে সক্ষম কেবল সত্যবাদী মোমিনগণ, যাদের ক্রমাগত অধ্যবসায় সৃষ্টি করে এ আস্বাদ লাভের উপযোগী গুণাবলী—তাদের আত্মায়, কর্মে ও নিত্য তৎপরতায়। ঈমানের দাবিদার মাত্রই এ আস্বাদ গ্রহণে সক্ষম—এমন নয়।
২। আল্লাহ তাআলাকে মহববত করা এবং তারই ফলশ্রুতিতে তার রাসূলকেও ভালোবাসা। এ এমন এক গুণ যা সেসব সৌভাগ্যশালী সুমহান ব্যক্তি-বর্গের গুণাগুণের মাঝে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, যারা ঈমানের তৃপ্তি-স্বাদ গ্রহণে সফল হতে পেরেছেন। বস্ত্তত: কোন মহববতই আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূলের মহববতের চেয়ে অগ্রণী হতে পারে না। বরং মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসাই মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, সমগ্র মানুষ, এমনকি নিজের সত্তাসহ সকল কিছুর চেয়ে অগ্রগণ্য হতে হবে। এটাই ঈমানের দাবি। উল্লেখ্য, উমর রা. মহানবীকে বলেছিলেন:—
يا رسول الله لأنت أحب إلي من كل شيء إلا من نفسي، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : لا والذي نفسي بيده حتى أكون أحب إليك من نفسك، فقال عمر : فإنه الآن والله لأنت أحب إلي من نفسي، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : الآن يا عمر، ( أى كمل إيمانك ).
হে আল্লাহর রাসূল স.! আপনি আমার নিকট আমি ছাড়া অপরাপর সবকিছুর চেয়ে অধিকতর প্রিয়। তখন তিনি স. বললেন : না, (এরূপ হতে পারে না) যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার সত্তার চাইতেও প্রিয়তর হই। (এবার) উমর রা. বললেন : আল্লাহর শপথ ! এ মুহূর্ত থেকে অবশ্যই আপনি আমার কাছে আমার আপন সত্তার চেয়েও প্রিয়। মহানবী (এবার) বললেন : হে উমর ! এক্ষণে (তোমার ঈমান পূর্ণতা পেল)। [বোখারি- ৬৬৩২]
আনাস রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :—
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين .
তোমাদের মাঝে কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান, এবং সকল মানব-মানবীর চেয়ে প্রিয়তর হব। [বোখারি-১৫, মুসলিম-৪৫]
মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ভালোবাসার যে চিত্র উক্ত পরিসরে তুলে ধরা হল তার একটি অনিবার্য প্রভাব তথা অলৌকিক প্রতিক্রিয়া ও ফলশ্রুতি রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ও তার রাসূল স.-এর সে-রূপ মহববত পোষণকারী বান্দারা ঐশী আদেশ-নিষেধের প্রতি যথাযোগ্য আত্মতুষ্টি আর আত্মস্বীকৃতির বিকাশ ঘটিয়ে সেসব বিধি-নিষেধ বা আদেশ-নিষেধের অকপট অনুকরণে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রাখতে সদাই সক্রিয় হন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :—
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ ( آل عمران : ৩১)
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে তোমরা আমাকে অনুসরণ কর, তবে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন। [আল- ইমরান: ৩১]
৩। ফরজ কর্মের পর যে সমস্ত বিষয় আল্লাহ তাআলার ভালোবাসা মানুষের অন্তরে জাগ্রত করে,—ইবনে কায়্যিম (রহ.)-এর মতে—তা নিম্নরূপ :—
(ক) আত্ম-সমাহিতি, নিমগ্নতা ও সক্রিয় চিন্তাবৃত্তির মাধ্যমে কোরআন তেলাওয়াতে ব্রতী হওয়া।
(খ) নফল এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য হাসিলে প্রয়াসী হওয়া।
(গ) রসনা, আত্মা ও নেক আমলের মাধ্যমে সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে সক্রিয় থাকা।
(ঘ) আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় বিষয়াদিকে প্রবৃত্তির শোভনীয় বস্ত্তসমূহের উপর প্রাধান্য দেয়া।
(ঙ) আল্লাহর প্রতি মহববত পোষণকারী সত্যবাদী নেককারদের সংস্রবে আত্মনিয়োগ করা।
(চ) মহান আল্লাহ ও অন্তরাত্মার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়—এমন সব উপায়-উপকরণের সাথে যথা-সম্ভব দূর সম্পর্কও না রাখা।
৪। আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার ফলশ্রুতিতে তাঁর রাসূলকেও ভালোবাসা এবং উক্ত পবিত্রতম মহববতকে সৃষ্টিকুলের মহববতের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া। আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে মহানবীকে ভালোবাসার কতিপয় লক্ষণ নিম্নরূপ :—
(ক) এ কথার প্রতি সুদৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস পোষণ করা যে, তিনি স. হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ রাসূল। আল্লাহ তাআলা তাকে সকল মানুষের জন্য সু-সংবাদ দানকারী, সতর্ককারী এবং তার আনীত একমাত্র সত্য-ধর্ম ইসলামের প্রতি আহবানকারী এবং তিমিরনাশী মশাল ও আলোকিত দিশারি রূপে প্রেরণ করেছেন।
(খ) তার দর্শন-সাক্ষাতের প্রবল আকাঙ্ক্ষার লালন এবং এ আকাঙ্ক্ষা মনে জাগ্রত না হলে মনঃকষ্টের উদ্রেক হওয়া।
(গ) তার যাবতীয় আদেশের অনুবর্তন এবং নিষেধের পরিহার ও বর্জন। কারণ, প্রকৃত মহববত পোষণকারী মাহবুবের অনুসারী হয়। এটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয় যে, তুমি এক দিকে তার ভালোবাসার দাবি করবে এবং অন্যদিকে তার নির্দেশাবলীর বিরোধিতা এবং নিষিদ্ধ বিষয়াদির সীমা লঙ্ঘন করবে।
(ঘ) সুন্নতের অতুলনীয়তা ও অনুপম আদর্শের আলোয় জীবন সমুজ্জ্বল করা। তার অনুকুল ও পক্ষ মতের অনুসারী যারা, তাদের সাহায্য করা, এবং যারা তার ঘোরতর বিরোধিতায় লিপ্ত, মনে-প্রাণে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা। তার মতামত ও আদর্শ প্রচারে অবদান রাখা। সর্বোপরি, এসব পথে নিরলস চেষ্টা সাধনায় কোনরূপ কার্পণ্য না করা।
(ঙ) তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ।
(চ) তাঁর নৈতিকতা ও চরিত্রে চরিত্রবান এবং শিষ্টাচারে পরিমার্জিত হওয়া।
(ছ) তাঁর সাহাবিদের ভালোবাসা এবং তাদের পক্ষ হয়ে প্রতিরোধ করা।
(জ) তাঁর জীবন বৃত্তান্ত ও সমুদয় সংবাদ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করা।
৫। মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতির ভিত্তি হবে আল্লাহ তাআলার জন্য ও তার সন্তুষ্টির উপর ভিত্তি করে। এ সৌহার্দ্যের রয়েছে অতুলনীয় ফজিলত ও সওয়াব। এ ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন হাদিস। আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন :—
سبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله ... وذكرمنهم ورجلان تحابا في الله، اجتمعا عليه وافترقا عليه .
‘যেদিন আল্লাহ তাআলার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে তার ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন...(তাদের মাঝে তিনি উল্লেখ করেন)...এমন দুই ব্যক্তি, যারা একে-অপরকে ভালোবেসেছে একমাত্র আল্লাহর জন্য—তারা একত্রিত বা পৃথক হয়েছে তারই উদ্দেশ্যে, তারই নিমিত্তে। [বোখারি ও মুসলিম]
৬। আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে ভালোবাসার কতিপয় অধিকারসমূহ :—
(ক) প্রয়োজনের সময় সহায়তার জন্য পাশে দাঁড়ানো। যেমন হাদিসে এসেছে:
خير الناس أنفعهم للناس .
যে মানুষের সর্বাধিক উপকারে আসে, সে-ই তাদের মাঝে সর্বোত্তম। [তাবারানী, হাদিসটি হাসান]
(খ) স্বীয় মুসলিম ভাই-এর দোষচর্চা থেকে নীরব থাকা। তার ভুল-ত্রুটিকে কোন না কোন অজুহাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। তুমি যেরূপ তোমার দোষ-ত্রুটিকে ঢেকে রাখা পছন্দ কর, তার জন্যেও তা পছন্দ করবে।
(গ) তোমার দ্বীনি ভাই আল্লাহ কর্তৃক কোন নেয়ামত প্রাপ্ত হলে তুমি তার প্রতি কিছুতেই হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হবে না।
(ঘ) তোমার সে ভাই জীবিত হোক কিংবা মৃত, তার জন্য তার অনুপস্থিতিতে দোয়া করা। কারণ, এরূপ দোয়া আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয় এবং প্রার্থনাকারীও তার অনুরূপ দয়াপ্রাপ্ত হয়।
(ঙ) মুসলিম ভাইকে অভিবাদন ও সালাম দানে অগ্রণী থাকা। তার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া, বা জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং তার প্রতি অহংকার ও প্রতারণামূলক আচার-আচরণ মোটেও না করা।
(চ) যে কোন মুসলিম ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়া।
কুফরি আল্লাহর নিকট একটি জঘন্য বিষয়। কাজেই মোমিনের নিকট জ্বলন্ত অগ্নিতে নিপতিত হওয়া যত অপছন্দনীয়, তার কাছে কুফরি শুধু ততটা অপছন্দনীয়—তাই নয়, বরং তার চেয়েও তীব্রতর ও অশুভ হওয়া একান্ত কাম্য। অনুরূপভাবে, কাফের আল্লাহর নিকট ঘৃণিত, তাই ঈমানদার ব্যক্তিকেও তাকে সেই কুফরির জন্য—যা জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে নিক্ষিপ্ত করে তাতে—ঘৃণা করা একান্তভাবে জরুরি।
বস্ত্তত: কাফেরদের সঙ্গ অবলম্বন ও মৈত্রী আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির কারণ। কাফেরদের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ মৈত্রীর নানাবিধ ধরন বা বিবিধ পদ্ধতি রয়েছে। যথা : তাদের ভালোবাসা, মোমিনদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। তাদের খোশামোদ-তোষামোদপূর্ণ সঙ্গ ও বন্ধুত্ব অবলম্বনে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িত হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً .
ঈমানদারগণ মোমিন ব্যতীত কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে না। যারা এরূপ করে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর (তবে তাদের সঙ্গে সাবধানতার সাথে থাকবে)। [আলে-ইমরান, ২৮]
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا- أنَّهُ قَالَ : كُنْتُ خَلْفَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهَ وَسَلَّمَ يَوْمًا، فَقَالَ : يَا غُلاَمُ، إنِّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ : اِحْفَظِ اللهَ يَحْفَظُكَ، اِحْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ، إذَا سَألْتَ فَاسْألِ اللهَ، وَإذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِا للهِ، وَاعْلَمْ أنَّ الأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَّنْفَعُوْكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوْكَ إلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ الله لَكَ، وَلَوِ اجْتَمَعُوْا عَلَى أَنْ يَّضُرُّوُكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوْكَ إلَّا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ، رُفِعَتِ الأقْلَامُ وَجُفَّتِ الصُحُفُ . ( رواه الترمذي وقال حديث حسن صحيح )
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি একদা রাসূলুল্লাহ স.-এর পশ্চাতে বসা ছিলাম। তিনি বললেন : হে বালক ! আমি তোমাকে কিছু কথা শিখাচ্ছি—শোন ! তুমি আল্লাহ (আল্লাহর বিধি-বিধান)-কে সংরক্ষণ কর, তাহলে তিনি তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আল্লাহর বিধি-বিধানের সুরক্ষায় সচেষ্ট হও, তাহলে তুমি তাকে তোমার কাছে পাবে। যদি তুমি কিছু প্রার্থনা কর, তাহলে আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা কর। আর তুমি সাহায্য প্রার্থনা করলে আল্লাহর নিকটই প্রার্থনা কর এবং জেনে রেখো, কোন বিষয়ে তোমার উপকারার্থে যদি সমগ্র মানব জাতি একত্রিত হয়, তবে তারা তোমার কোন-রূপ উপকার করতে সক্ষম হবে না। কেবল তাই হবে, যা আল্লাহ তাআলা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এবং যদি তারা সবাই কোন বিষয়ে তোমার অপকারকল্পে সমবেত হয়, তাহলেও তারা তোমার অপকার করতে পারবে না। তবে তা অবশ্যই ঘটবে, যা আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, শুকিয়ে গেছে লিপিকা (সুতরাং, কিছুই পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই)। [ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদিসটি হাসান ও সহিহ।]
হাদিস বর্ণনাকারী—হাদিসটি বর্ণনা করেছেন মহান সাহাবি, উম্মাহর জ্ঞান তাপস ও তাফসির শাস্ত্রের অন্যতম পুরোধা রাসূল সা.-এর চাচা আববাস বিন আ. মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহ, তিনি ছিলেন কোরাইশী গোত্রের হাশেমী শাখার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। হিজরতের তিন বছর পূর্বে জন্মলাভ করেন। হিজরতের বছর পিতা-মাতার সাথে হিজরতের পুণ্যভূমি মদিনায় গমন করেন। দ্বীনের জ্ঞানের প্রশস্ততা ও গভীরতার জন্য রাসূল তাকে দোয়া করেন। ইমাম বোখারি রহ. তার থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম স. একবার ইস্তেঞ্জায় প্রবেশ করেন। আমি তাঁর জন্য ওজুর পানি রেখে দিলাম। তিনি তা দেখে বললেন : কে রেখে দিল এটা ? তাকে অবহিত করা হলে তিনি এ বলে দোয়া করেন যে—
اللهم فقهه في الدين . وفي رواية : اللهم علمه الكتاب . وفي رواية أنه قال : اللهم فقهه في الدين وعلمه التأويل .
হে আল্লাহ, তাকে দ্বীনের জ্ঞান-প্রজ্ঞা দান করুন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হে আল্লাহ ! তাকে কোরআন কারীমের জ্ঞান দান করুন। অপর রেওয়ায়েতে আছে, হে আল্লাহ ! তাকে ইসলাম ধর্মের জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং কোরআন ব্যাখ্যা করার মতো ব্যুৎপত্তি দান করুন। [বোখারি- ১৪৩ মুসলিম -২৪৭৭] মাসরুক র. বলেন :—
كنت إذا رأيت ابن عباس قلت : أجمل الناس، فإذا نطق قلت : أفصح الناس، فإذا تحدث قلت : أعلم الناس .
ইবনে আববাসকে দেখামাত্র আমার মনে যে ভাবনার উদয় হত, তা এই যে, মানুষের মাঝে তিনি অবয়বে-গঠনে সুন্দরতম ব্যক্তি। আর যখন তিনি কথোপকথন ও খুতবায় ব্যাপৃত হতেন, মনে হত, তিনি মানুষের মাঝে বিশুদ্ধতম বচন ও বর্ণনা-ভঙ্গির অধিকারী, অসাধারণ বাগ্মী। যখন দ্বীনের আলোচনায় মগ্ন হতেন, আমার মনে হত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তিনিই শীর্ষস্থানীয়। [যাদুদ দায়িয়াহ : ১১]
হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয় সাহাবিদের অন্যতম। তাফসীর শাস্ত্র ও দ্বীনের অন্যান্য শাখায় সূক্ষ্ম জ্ঞানের অবতারণায় তার ছিল অগাধ পান্ডিত্য। তিনি ইন্তেকাল করেন ৬৮ হিজরিতে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
শাব্দিক আলোচনা :—
* يَا غُلاَمُ- غلام শব্দের অর্থ নিতান্ত বালক, ছোট ছেলে, ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে যৌবন অবধি যে কোন বয়সী ব্যক্তির জন্য তা সমানভাবে ব্যবহৃত।
*: اِحْفَظِ اللهَ আল্লাহকে রক্ষা কর, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক সুনির্ধারিত শরয়ি সীমাসমূহ লঙ্ঘন না করা, এবং তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার যথাযথভাবে আদায়ে অব্যাহতভাবে প্রয়াসী ও সক্রিয় হওয়া। যাবতীয় আদেশ-নিষেধের কোন ব্যত্যয় বা অন্যথা যাতে না ঘটে, বরং যথাযথভাবে তা পালিত হয়—সে ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সচেষ্ট থাকা।
* يَحْفَظُكَ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তার হেফাজতকারী বান্দাদের শারীরিক, পারিবারিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা শুধু নয়, বরং তার সকল স্বার্থ পূরণের সু-ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আকিদা এমনরূপে সংরক্ষণ করেন যে, যে সমস্ত বিষয়ে সত্য-মিথ্যা ও হালাল-হারামের মিশ্রণ রয়েছে এরূপ বিভ্রান্তিকর সকল কিছু থেকে তাদের বিরত রাখেন। এমনিভাবে প্রবৃত্তির যে সমস্ত অবৈধ ও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা রয়েছে তা থেকে তাদেরকে অনুগ্রহপূর্বক নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখেন। উপরন্তু, তারা আল্লাহ তাআলার অপার কৃপায় মৃত্যু-ক্ষণের মতো ভয়ংকর সময়ে সত্য-বিচ্যুতি ও বিপথগামিতা থেকে সুরক্ষা পায় এবং পর-জীবনে ভয়াবহতম জাহান্নামের শাস্তি থেকে অনায়াসে বেঁচে যায়।
* تَجِدْهُ تُجَاهَكَ তাকে তোমার কাছে পাবে, এর গূঢ় অর্থ : সর্বাবস্থায় তুমি তাকে সহায় এবং যাবতীয় বিষয়ের তওফিকদাতা হিসেবে তোমার সামনে পাবে।
* إذَا سَألْتَ فَاسْألِ اللهَ، وَإذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِا للهِ অর্থ : যদি কিছু প্রার্থনা কর, আল্লাহর কাছে কর। সাহায্য প্রার্থনা করলে তাঁরই নিকট প্রার্থনা কর। আমরা প্রতিদিন সালাতে নিত্য যে প্রার্থনা করি, এ দোয়াটি অবিকল তারই মত—দোয়াটি এই— إياك نعبد وإياك نستعين ( الفاتحة : ৪) ‘আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’
বিধি-মালা ও উপকারিতা :
উক্ত হাদিসটি, নি:সন্দেহে বলা যায় একটি আকর হাদিস ; উম্মাহর জন্য তাতে একই সাথে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও দ্বীনের ক্ষেত্রে খুবই প্রণিধানযোগ্য মৌলিক সার্বিক নীতিমালা। জনৈক আলেম হাদিসটি প্রসঙ্গে বলেন :
تدبرت هذا الحديث فأدهشني، وكدت أطيش، فوا أسفا من الجهل بهذا الحديث وقلة الفهم لمعناه .
আমি যখনই হাদিসটি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছি, আমাকে তা বাকশূন্য করে দিয়েছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি ভেবেছি—হাদিসটির ব্যাপারে অজ্ঞতা ও তার মর্ম উপলব্ধি করতে না পারা আমাদের জন্য খুবই আফসোসের কারণ হবে। [প্রাগুক্ত : ১২]
হাদিসটি প্রমাণ করে, নবী সা. উম্মাহর প্রতি ছিলেন সদা নিবেদিত ; তার চিন্তার সবটুকু জুড়ে ছিল উম্মার সাফল্য-পরিণতি, তিনি সচেষ্ট ছিলেন তাদের মাঝে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের সঞ্চারে, চারত্রিক গুণাবলির বিস্তার ও সত্য-সঠিক পথের অনুসরণের উদ্যম গড়ে তোলায়। তাই, নিতান্ত বালক ইবনে আববাস যখন একই উটের পিঠে তার পশ্চাতে আরোহণ করলেন,—আমরা দেখতে পাই, তিনি তাকে শিক্ষা দিচ্ছেন সংক্ষিপ্ত শব্দ অথচ ব্যাপক অর্থময় কিছু বচন, যা তার ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে খুবই প্রভাব বিস্তার করবে।
পিতা, দায়ী, শিক্ষক—যে-ই মুরবিব-অভিভাবক হন, সে তাঁর গুরু-দায়িত্ব আদায়ে উপযুক্ত সময়-সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। অধিকন্তু, দিক-নির্দেশনামূলক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে শ্রোতৃমন্ডলীর দৃষ্টি তথা মনোযোগ আকর্ষণের যে বিবিধ প্রারম্ভিক পদ্ধতি রয়েছে, তা অবশ্যই প্রয়োগ করবে। হাদিসটি এ ব্যাপারে আমাদের জন্য উত্তম দিক-নির্দেশক।
প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির উপর বিরাট দায়িত্ব রয়েছে, যা তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে এই ঐহিক জীবনে। তা এই যে, সে আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করবে। বর্জন করবে নিষিদ্ধ সমস্ত বিষয়। তাঁর নির্ধারিত শরয়ি সীমাসমূহ রক্ষা করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল সা. নির্দেশিত পন্থাকে আমৃত্যু অনুসরণ করে চলবে।
ইসলামি শরিয়ায় কিছু সুনির্দিষ্ট কর্ম রয়েছে যেগুলোর প্রতি যত্নবান হতে আল্লাহ কখনো নির্দেশ প্রদান করেছেন, কখনো দিয়েছেন উৎসাহ, সঞ্চার করেছেন উদ্দীপনা। যথা :—
(ক) নামাজ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :—
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ ( البقرة : ২৩৮)
‘সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের (আসর) ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সঙ্গে দাঁড়াও। [সূরা বাকারা : ২৩৮]
(খ) পাক-পবিত্রতা ও ওজু। এ বিষয়ে সাওবান রা. থেকে বর্ণিত—
وعن ثوبان رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلي الله عليه وسلم : استقيموا ولن تحصوه، واعلموا أن خير أعمالكم الصلاة، ولن يحافظ علي الوضوء إلا مؤمن .
তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : তোমরা দ্বীনের উপর অবিচল থাক, এবং তা গণনা কর না। (আমল যতই অব্যাহত থাকুক, এবং সংখ্যায় বিপুল হোক, তা গণনার আশ্রয় নিও না) আর জেনে রেখো ! তোমাদের আমল সমূহের মাঝে সর্বোত্তম আমল হলো সালাত। মোমিন মাত্রই ওজুর প্রতি যত্নবান। [ইবনে মাজা : ২৭৩]
(গ) শপথ : যথা আল্লাহ তাআলা বলেন : وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ ‘তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর’ অর্থাৎ, শপথ ভঙ্গ করো না।
(ঘ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজত। যথা : জিহবা ও গুপ্তাঙ্গের হেফাজত।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন—
من حفظ ما بين لحييه، وما بين رجليه، أضمن له الجنة .
যে ব্যক্তি জিহবা ও গুপ্তাঙ্গের হেফাজত করবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হয়ে যাব। [বোখারি- ৬৪৭৪, মুসলিম- ৬৪]
হাদিসটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের প্রতি যত্নশীল হবে, পালন করবে তার বিধি-বিধান জীবনের যাবতীয় অনুসঙ্গে, আল্লাহ তাআলা তার পার্থিব যাবতীয় বিষয়ের রক্ষা করবেন—দৈহিক, পারিবারিক ও বিষয়-সম্পত্তি—সর্বক্ষেত্রে তার রক্ষাণাবেক্ষণ বিস্তৃত থাকবে। এমননিভাবে, যে তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের দুর্দান্ত সময়গুলোতে আল্লাহর দ্বীন ও হুকুম-আহকামের প্রতি যত্ন নিবে, বার্ধক্যের বিষণ্ণ-ভঙ্গুর দিনগুলোতে আল্লাহ তার পাশে থাকবেন, সতেজ রাখবেন তাকে শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে। এমনিভাবে, তাকে রক্ষা করবেন দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর সংশয় থেকে—যা বান্দাকে সঠিক-শুদ্ধ পথ থেকে হটিয়ে নিপতিত করে বিভ্রান্ত পথের ঘোর অমানিশায়। শয়তান নিষিদ্ধ প্রবৃত্তির যে সৌন্দর্য বিস্তার ঘটায়, প্রতিমুহূর্তে তৎপর থাকে বান্দাকে তাতে আপতিত করতে—সে ব্যাপারেও আল্লাহ হবেন তার উত্তম রক্ষাকারী।
দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক বান্দার হেফাজতের অন্যতম ফলশ্রুতি এই যে, মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাকে মৃত্যুকালে সত্য-ভ্রষ্টতার ধ্বংসাত্মক থাবা থেকে সুরক্ষা করেন। ফলে তার মৃত্যু-ক্ষণে এই শাশ্বত মহা-সত্যের সাক্ষ্য দানের পরম ও চরম সৌভাগ্য নসিব হয় যে—
لا اله إلا الله محمد رسول الله
‘আল্লাহ ছাড়া এবাদতের উপযুক্ত আর কোন ইলাহ নেই ; মোহাম্মদ সা. আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।’
এ মহান সৌভাগ্য যে অর্জন করে, তার সর্বশেষ আবাস ও পরিণতি জান্নাত। যেমন রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :—
ما من عبد قال : لا إله إلا الله ثم مات علي ذالك إلا دخل الجنة .
‘যে কোন বান্দা এই কথার সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন মাবুদ নেই, অত:পর এই প্রদত্ত সাক্ষ্যের উপর মৃত্যুবরণ করবে, নি:সন্দেহে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [বোখারি- ৬৫০২]
অনুরূপভাবে, দ্বীনের হেফাজতকারী বান্দা কবর, হাশরসহ পর জীবনের সর্বত্র ভয়ানক মুহূর্তে মহান আল্লাহর হেফাজতে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করবে। অতএব, আল্লাহর দ্বীনকে হেফাজতকারী হও, তবে তিনি তোমার হেফাজত করবেন। তুমি তার দ্বীন ও বিধানের যথাযোগ্য সংরক্ষণ কর, তাহলে তাঁকে কঠিন মুহূর্তে সামনে পাবে সহায় হিসেবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ غَيْرَ بَعِيدٍ . هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِكُلِّ أَوَّابٍ حَفِيظٍ . (ق: ৩১-৩২)
‘জান্নাতকে উপস্থিত করা হবে আল্লাহভীরুদের অদূরে। তোমাদের প্রত্যেক অনুরাগী ও স্মরণকারীকে এরই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।’ [ক্বাফ : ৩১-৩২]
আল্লাহর হেফাজতের আরেক সুফল হলো : দুনিয়া-আখেরাতের সব ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা লাভ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :—
الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ . ( الأنعام :82)
‘যারা ঈমান-বিশ্বাসকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তাঁরাই সুপথগামী।’ [আনআম : ৮২]
আল্লাহ তাআলা মূসা ও হারুন আ.-কে লক্ষ করে বলেছেন :—
َ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ( طه : ৪৬)
‘তোমরা ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, আমি দেখি ও শুনি।’ [ত্বোয়া-হা : ৪৬]
এমনিভাবে নবী করিম সা. আবু বকর রা.-কে বললেন : যখন উভয়ে মদিনা অভিমুখে হিজরতকালে সাওর গুহায় অবস্থান করছিলেন :—
ما ظنك باثنين الله ثالثهما، لا تحزن إن الله معنا .
দু ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা কি যাদের তৃতীয় জন হলেন আল্লাহ ? তুমি ভয় করো না আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। [বোখারি : ৪২৯৫]
পার্থিব জীবনে মানুষ সর্বদা একই অবস্থায় যাপন করে না ; নানা পরিস্থিতি ও অবস্থায় তার আবর্তন ঘটে প্রতি মুহূর্তে, প্রতিক্ষণে। কখনো সে সুখী, কখনো দু:খী ; কখনো আর্থিক প্রাচুর্য ঘিরে থাকে তাকে, সীমাহীন ভোগ-বিলাসের সামর্থ্য যেন লুটিয়ে পড়ে তার পদতলে। কখনো সে আক্রান্ত হয় দারিদ্রে্যর বিপুল যন্ত্রণায়, বিদ্ধ হয় নানাবিধ সংকটের তীরে। কখনো সতেজ সু-স্বাস্থ্যবান, কখনো দুর্বল-রুগ্ন। দীর্ঘ একটা সময় যৌবনের দৃপ্ততায় কাটানোর পর সে ম্রিয়মান হয় বার্ধক্যের কষাঘাতে। তুমি তোমার প্রাচুর্যে, সুস্বাস্থ্যে, যৌবনের দুর্দান্ত শক্তিময়তায় আল্লাহর সাথে থাক,—দারিদ্র্য, অসুস্থতা ও বার্ধক্যের দৌর্বল্যে তিনি তোমার পাশে থাকবেন।
আল্লাহ তাআলার হেফাজত লাভের কতিপয় উপকরণ :—
(ক) বাধ্যতামূলক বিধি-নিষেধগুলোকে পরিপূর্ণ রূপে মেনে চলা। যথা: মসজিদে এসে জামাতসহ সঠিক ওয়াক্তে নামাজ আদায় করা।
(খ) নফল বা ঐচ্ছিক এবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভে এগিয়ে আসা। যেমন : সুন্নতে মুয়াক্কাদা, বিতর, এবং শরিয়ত-সিদ্ধ মাসিক ও বার্ষিক রোজা পালনে যত্নবান হওয়া।
(গ) দ্বীন ও দুনিয়া সংশ্লিষ্ট সার্বক্ষণিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দিন-রাত দোয়া ও প্রার্থনা করা।
(ঘ) এরূপ নেককারগণের সংস্পর্শ বা সংশ্রব লাভ করা যারা তোমাকে তোমার মাওলা আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। তোমাকে বন্দেগীময় জীবন যাপনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে এবং তোমার দ্বীন- ইসলামের হেফাজতের গুরু দায়িত্ব-ভার গ্রহণ করবে।
(ঙ) এমন উপকারী জ্ঞান অন্বেষণে আত্মনিমগ্ন হওয়া যা তোমাকে প্রভু, স্রষ্টা, সম্বন্ধে জ্ঞান দানের পাশাপাশি তার আদেশ-নিষেধাবলীর পরিচয় তুলে ধরবে।
(১১) উপরোক্ত হাদিসের অন্যতম শিক্ষা এই যে, দোয়া একটি প্রণিধানযোগ্য মৌলিক এবাদত। আল্লাহ তাআলা নিম্নোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে আহবান জানিয়েছেন—
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ .( غافر : ৬০)
‘এবং তোমার প্রভু বলেন : তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। [সূরা গাফের : আয়াত ৬০] তিনি আরো বলেন :—
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ . ( البقرة : ৮৬)
‘আর আমার বানদারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, বস্ত্তত: আমি রয়েছি সন্নিকটে। আমি প্রার্থীর প্রার্থনা কবুল করি, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। [বাক্বারা : ৮৬]
আল্লাহর নিকট প্রার্থনার কতিপয় শুভ ফলাফল :
(ক) স্বীয় লাঞ্ছনা, অবমাননা, ও চরম মুখাপেক্ষিতার বহি:প্রকাশ।
(খ) উপকার সাধন ও অপকার অপসারণের মতো পরম চাওয়া-পাওয়া।
(গ) এতে রয়েছে বিপুল প্রতিদান ও পুরস্কার। এর মাধ্যমে মার্জিত হয় পাপাচার ও অনাচার।
(ঘ) নিরাপত্তা ও অনুকম্পাসহ আল্লাহ তার সাথেই আছেন—এরূপ একটি সঙ্গবোধ অন্তরের গভীরে জাগ্রত হয় এর মাধ্যমে।
(ঙ) আল্লাহ তাআলার নিম্ন উদ্ধৃত আয়াতকে বাস্তবে রূপ দান করা হয়। তিনি বলেন :—
إياك نعبد وإياك نستعين ( الفاتحة : ৪)
‘শুধু তোমারই এবাদত করি এবং তোমারই নিকট প্রার্থনা জানাই।’ [সূরা ফাতেহা : আয়াত ৪]
(চ) আল্লাহ তাআলার ক্রোধ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার এটিও অন্যতম উত্তম পথ ও পন্থা। যেমন : নবী করিম সা. বলেছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দোয়া করে না তার উপর তাঁর ক্রোধ নিপতিত হয়।
(১২) এ মহান হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়টিও পরিস্ফুটিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে এমন বিষয়ে—যা তিনি ব্যতীত আর কেউ পারে না—সাহায্য, আশ্রয়সহ কিছুই চাওয়া যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যেই হোক না কেন কারোরই জন্যে কোন প্রকার এবাদত করা যাবে না। এই ঐকান্তিক ও নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদতের পথ ব্যতীত এবাদতের গ্রহণযোগ্যতা ও দ্বীন-দুনিয়ার সফলতা বা মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন আদৌ সম্ভব নয়।
(১৩) অত্র অধ্যায়ে আলোচ্য হাদিস থেকে এ বিষয়টিও সাব্যস্ত হয় যে, বান্দা এই জড় জগতে ভাল-মন্দ, লাভ-লোকসান যাই প্রাপ্ত হোক না কেন তা সবই তার পূর্ব লিখিত ও নিরূপিত ভাগ্য অনুযায়ীই হয়ে থাকে। সৃষ্টিকুলের সমগ্র সৃষ্টিই যদি একযোগে কোন বিষয়ে প্রভূত চেষ্টা তদবির চালিয়ে যায়, তবে পরিণাম তাই হয় যা পূর্বে লিখিত ও নির্ধারিত। বিন্দু বা অনু পরিমাণও তার বিপরীত ঘটে না এবং ঘটতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا . ( التوبة :৫১)
‘আপনি বলুন আমাদের কিছুই পৌঁছোবে না কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে রেখেছেন।’ [আত-তাওবাহ : আয়াত ৫৮] তিনি আরো বলেন :—
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا . ( الحديد : ২২)
‘পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না কিন্তু (যা আসে) তা জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।’ [আল হাদীদ : ২২]
(১৪) আল্লাহ তাআলার ফয়সালা ও নির্ধারিত ভাগ্য-লিপির প্রতি বিশ্বাস, এর শেকড় দৃঢ়ভাবে আত্মস্থ করাও ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। এর উদ্দেশ্য আদৌ এ নয় যে, কেউ আমল ছেড়ে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে। কেননা, যিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও ভাগ্যলিপির প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান করেছেন, তিনিই তো আবার সুফল বয়ে আনে এমন কর্মতৎপরতার প্রয়াস-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকারও আদেশ করেছেন। যেমন : ইমাম মুসলিম রহ. তার কিতাব মুসলিম শরীফে বর্ণনা করেন—
اعملوا فكل ميسر لما خلق له .
‘তোমরা কর্ম করে যাও। কারণ, প্রত্যেককে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তা সহজ করে দেয়া হয়েছে।’ [বোখারি : ৬৯৯৬]
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি একদা রাসূলুল্লাহ স.-এর পশ্চাতে বসা ছিলাম। তিনি বললেন : হে বালক ! আমি তোমাকে কিছু কথা শিখাচ্ছি—শোন ! তুমি আল্লাহ (আল্লাহর বিধি-বিধান)-কে সংরক্ষণ কর, তাহলে তিনি তোমার রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আল্লাহর বিধি-বিধানের সুরক্ষায় সচেষ্ট হও, তাহলে তুমি তাকে তোমার কাছে পাবে। যদি তুমি কিছু প্রার্থনা কর, তাহলে আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা কর। আর তুমি সাহায্য প্রার্থনা করলে আল্লাহর নিকটই প্রার্থনা কর এবং জেনে রেখো, কোন বিষয়ে তোমার উপকারার্থে যদি সমগ্র মানব জাতি একত্রিত হয়, তবে তারা তোমার কোন-রূপ উপকার করতে সক্ষম হবে না। কেবল তাই হবে, যা আল্লাহ তাআলা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এবং যদি তারা সবাই কোন বিষয়ে তোমার অপকারকল্পে সমবেত হয়, তাহলেও তারা তোমার অপকার করতে পারবে না। তবে তা অবশ্যই ঘটবে, যা আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, শুকিয়ে গেছে লিপিকা (সুতরাং, কিছুই পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই)। [ইমাম তিরমিজি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদিসটি হাসান ও সহিহ।]
হাদিস বর্ণনাকারী—হাদিসটি বর্ণনা করেছেন মহান সাহাবি, উম্মাহর জ্ঞান তাপস ও তাফসির শাস্ত্রের অন্যতম পুরোধা রাসূল সা.-এর চাচা আববাস বিন আ. মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহ, তিনি ছিলেন কোরাইশী গোত্রের হাশেমী শাখার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। হিজরতের তিন বছর পূর্বে জন্মলাভ করেন। হিজরতের বছর পিতা-মাতার সাথে হিজরতের পুণ্যভূমি মদিনায় গমন করেন। দ্বীনের জ্ঞানের প্রশস্ততা ও গভীরতার জন্য রাসূল তাকে দোয়া করেন। ইমাম বোখারি রহ. তার থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী করিম স. একবার ইস্তেঞ্জায় প্রবেশ করেন। আমি তাঁর জন্য ওজুর পানি রেখে দিলাম। তিনি তা দেখে বললেন : কে রেখে দিল এটা ? তাকে অবহিত করা হলে তিনি এ বলে দোয়া করেন যে—
اللهم فقهه في الدين . وفي رواية : اللهم علمه الكتاب . وفي رواية أنه قال : اللهم فقهه في الدين وعلمه التأويل .
হে আল্লাহ, তাকে দ্বীনের জ্ঞান-প্রজ্ঞা দান করুন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হে আল্লাহ ! তাকে কোরআন কারীমের জ্ঞান দান করুন। অপর রেওয়ায়েতে আছে, হে আল্লাহ ! তাকে ইসলাম ধর্মের জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং কোরআন ব্যাখ্যা করার মতো ব্যুৎপত্তি দান করুন। [বোখারি- ১৪৩ মুসলিম -২৪৭৭] মাসরুক র. বলেন :—
كنت إذا رأيت ابن عباس قلت : أجمل الناس، فإذا نطق قلت : أفصح الناس، فإذا تحدث قلت : أعلم الناس .
ইবনে আববাসকে দেখামাত্র আমার মনে যে ভাবনার উদয় হত, তা এই যে, মানুষের মাঝে তিনি অবয়বে-গঠনে সুন্দরতম ব্যক্তি। আর যখন তিনি কথোপকথন ও খুতবায় ব্যাপৃত হতেন, মনে হত, তিনি মানুষের মাঝে বিশুদ্ধতম বচন ও বর্ণনা-ভঙ্গির অধিকারী, অসাধারণ বাগ্মী। যখন দ্বীনের আলোচনায় মগ্ন হতেন, আমার মনে হত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তিনিই শীর্ষস্থানীয়। [যাদুদ দায়িয়াহ : ১১]
হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয় সাহাবিদের অন্যতম। তাফসীর শাস্ত্র ও দ্বীনের অন্যান্য শাখায় সূক্ষ্ম জ্ঞানের অবতারণায় তার ছিল অগাধ পান্ডিত্য। তিনি ইন্তেকাল করেন ৬৮ হিজরিতে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
শাব্দিক আলোচনা :—
* يَا غُلاَمُ- غلام শব্দের অর্থ নিতান্ত বালক, ছোট ছেলে, ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে যৌবন অবধি যে কোন বয়সী ব্যক্তির জন্য তা সমানভাবে ব্যবহৃত।
*: اِحْفَظِ اللهَ আল্লাহকে রক্ষা কর, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক সুনির্ধারিত শরয়ি সীমাসমূহ লঙ্ঘন না করা, এবং তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার যথাযথভাবে আদায়ে অব্যাহতভাবে প্রয়াসী ও সক্রিয় হওয়া। যাবতীয় আদেশ-নিষেধের কোন ব্যত্যয় বা অন্যথা যাতে না ঘটে, বরং যথাযথভাবে তা পালিত হয়—সে ব্যাপারে সদা সতর্ক ও সচেষ্ট থাকা।
* يَحْفَظُكَ অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তার হেফাজতকারী বান্দাদের শারীরিক, পারিবারিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা শুধু নয়, বরং তার সকল স্বার্থ পূরণের সু-ব্যবস্থা করেন এবং তাদের দ্বীন-ধর্ম ও ঈমান-আকিদা এমনরূপে সংরক্ষণ করেন যে, যে সমস্ত বিষয়ে সত্য-মিথ্যা ও হালাল-হারামের মিশ্রণ রয়েছে এরূপ বিভ্রান্তিকর সকল কিছু থেকে তাদের বিরত রাখেন। এমনিভাবে প্রবৃত্তির যে সমস্ত অবৈধ ও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা রয়েছে তা থেকে তাদেরকে অনুগ্রহপূর্বক নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখেন। উপরন্তু, তারা আল্লাহ তাআলার অপার কৃপায় মৃত্যু-ক্ষণের মতো ভয়ংকর সময়ে সত্য-বিচ্যুতি ও বিপথগামিতা থেকে সুরক্ষা পায় এবং পর-জীবনে ভয়াবহতম জাহান্নামের শাস্তি থেকে অনায়াসে বেঁচে যায়।
* تَجِدْهُ تُجَاهَكَ তাকে তোমার কাছে পাবে, এর গূঢ় অর্থ : সর্বাবস্থায় তুমি তাকে সহায় এবং যাবতীয় বিষয়ের তওফিকদাতা হিসেবে তোমার সামনে পাবে।
* إذَا سَألْتَ فَاسْألِ اللهَ، وَإذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِا للهِ অর্থ : যদি কিছু প্রার্থনা কর, আল্লাহর কাছে কর। সাহায্য প্রার্থনা করলে তাঁরই নিকট প্রার্থনা কর। আমরা প্রতিদিন সালাতে নিত্য যে প্রার্থনা করি, এ দোয়াটি অবিকল তারই মত—দোয়াটি এই— إياك نعبد وإياك نستعين ( الفاتحة : ৪) ‘আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।’
বিধি-মালা ও উপকারিতা :
উক্ত হাদিসটি, নি:সন্দেহে বলা যায় একটি আকর হাদিস ; উম্মাহর জন্য তাতে একই সাথে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও দ্বীনের ক্ষেত্রে খুবই প্রণিধানযোগ্য মৌলিক সার্বিক নীতিমালা। জনৈক আলেম হাদিসটি প্রসঙ্গে বলেন :
تدبرت هذا الحديث فأدهشني، وكدت أطيش، فوا أسفا من الجهل بهذا الحديث وقلة الفهم لمعناه .
আমি যখনই হাদিসটি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছি, আমাকে তা বাকশূন্য করে দিয়েছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি ভেবেছি—হাদিসটির ব্যাপারে অজ্ঞতা ও তার মর্ম উপলব্ধি করতে না পারা আমাদের জন্য খুবই আফসোসের কারণ হবে। [প্রাগুক্ত : ১২]
হাদিসটি প্রমাণ করে, নবী সা. উম্মাহর প্রতি ছিলেন সদা নিবেদিত ; তার চিন্তার সবটুকু জুড়ে ছিল উম্মার সাফল্য-পরিণতি, তিনি সচেষ্ট ছিলেন তাদের মাঝে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের সঞ্চারে, চারত্রিক গুণাবলির বিস্তার ও সত্য-সঠিক পথের অনুসরণের উদ্যম গড়ে তোলায়। তাই, নিতান্ত বালক ইবনে আববাস যখন একই উটের পিঠে তার পশ্চাতে আরোহণ করলেন,—আমরা দেখতে পাই, তিনি তাকে শিক্ষা দিচ্ছেন সংক্ষিপ্ত শব্দ অথচ ব্যাপক অর্থময় কিছু বচন, যা তার ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে খুবই প্রভাব বিস্তার করবে।
পিতা, দায়ী, শিক্ষক—যে-ই মুরবিব-অভিভাবক হন, সে তাঁর গুরু-দায়িত্ব আদায়ে উপযুক্ত সময়-সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। অধিকন্তু, দিক-নির্দেশনামূলক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে শ্রোতৃমন্ডলীর দৃষ্টি তথা মনোযোগ আকর্ষণের যে বিবিধ প্রারম্ভিক পদ্ধতি রয়েছে, তা অবশ্যই প্রয়োগ করবে। হাদিসটি এ ব্যাপারে আমাদের জন্য উত্তম দিক-নির্দেশক।
প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির উপর বিরাট দায়িত্ব রয়েছে, যা তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে এই ঐহিক জীবনে। তা এই যে, সে আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করবে। বর্জন করবে নিষিদ্ধ সমস্ত বিষয়। তাঁর নির্ধারিত শরয়ি সীমাসমূহ রক্ষা করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল সা. নির্দেশিত পন্থাকে আমৃত্যু অনুসরণ করে চলবে।
ইসলামি শরিয়ায় কিছু সুনির্দিষ্ট কর্ম রয়েছে যেগুলোর প্রতি যত্নবান হতে আল্লাহ কখনো নির্দেশ প্রদান করেছেন, কখনো দিয়েছেন উৎসাহ, সঞ্চার করেছেন উদ্দীপনা। যথা :—
(ক) নামাজ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন :—
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ ( البقرة : ২৩৮)
‘সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের (আসর) ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সঙ্গে দাঁড়াও। [সূরা বাকারা : ২৩৮]
(খ) পাক-পবিত্রতা ও ওজু। এ বিষয়ে সাওবান রা. থেকে বর্ণিত—
وعن ثوبان رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلي الله عليه وسلم : استقيموا ولن تحصوه، واعلموا أن خير أعمالكم الصلاة، ولن يحافظ علي الوضوء إلا مؤمن .
তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : তোমরা দ্বীনের উপর অবিচল থাক, এবং তা গণনা কর না। (আমল যতই অব্যাহত থাকুক, এবং সংখ্যায় বিপুল হোক, তা গণনার আশ্রয় নিও না) আর জেনে রেখো ! তোমাদের আমল সমূহের মাঝে সর্বোত্তম আমল হলো সালাত। মোমিন মাত্রই ওজুর প্রতি যত্নবান। [ইবনে মাজা : ২৭৩]
(গ) শপথ : যথা আল্লাহ তাআলা বলেন : وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ ‘তোমরা স্বীয় শপথসমূহ রক্ষা কর’ অর্থাৎ, শপথ ভঙ্গ করো না।
(ঘ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হেফাজত। যথা : জিহবা ও গুপ্তাঙ্গের হেফাজত।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন—
من حفظ ما بين لحييه، وما بين رجليه، أضمن له الجنة .
যে ব্যক্তি জিহবা ও গুপ্তাঙ্গের হেফাজত করবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হয়ে যাব। [বোখারি- ৬৪৭৪, মুসলিম- ৬৪]
হাদিসটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের প্রতি যত্নশীল হবে, পালন করবে তার বিধি-বিধান জীবনের যাবতীয় অনুসঙ্গে, আল্লাহ তাআলা তার পার্থিব যাবতীয় বিষয়ের রক্ষা করবেন—দৈহিক, পারিবারিক ও বিষয়-সম্পত্তি—সর্বক্ষেত্রে তার রক্ষাণাবেক্ষণ বিস্তৃত থাকবে। এমননিভাবে, যে তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের দুর্দান্ত সময়গুলোতে আল্লাহর দ্বীন ও হুকুম-আহকামের প্রতি যত্ন নিবে, বার্ধক্যের বিষণ্ণ-ভঙ্গুর দিনগুলোতে আল্লাহ তার পাশে থাকবেন, সতেজ রাখবেন তাকে শারীরিক ও মানসিক শক্তিতে। এমনিভাবে, তাকে রক্ষা করবেন দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর সংশয় থেকে—যা বান্দাকে সঠিক-শুদ্ধ পথ থেকে হটিয়ে নিপতিত করে বিভ্রান্ত পথের ঘোর অমানিশায়। শয়তান নিষিদ্ধ প্রবৃত্তির যে সৌন্দর্য বিস্তার ঘটায়, প্রতিমুহূর্তে তৎপর থাকে বান্দাকে তাতে আপতিত করতে—সে ব্যাপারেও আল্লাহ হবেন তার উত্তম রক্ষাকারী।
দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক বান্দার হেফাজতের অন্যতম ফলশ্রুতি এই যে, মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাকে মৃত্যুকালে সত্য-ভ্রষ্টতার ধ্বংসাত্মক থাবা থেকে সুরক্ষা করেন। ফলে তার মৃত্যু-ক্ষণে এই শাশ্বত মহা-সত্যের সাক্ষ্য দানের পরম ও চরম সৌভাগ্য নসিব হয় যে—
لا اله إلا الله محمد رسول الله
‘আল্লাহ ছাড়া এবাদতের উপযুক্ত আর কোন ইলাহ নেই ; মোহাম্মদ সা. আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।’
এ মহান সৌভাগ্য যে অর্জন করে, তার সর্বশেষ আবাস ও পরিণতি জান্নাত। যেমন রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন :—
ما من عبد قال : لا إله إلا الله ثم مات علي ذالك إلا دخل الجنة .
‘যে কোন বান্দা এই কথার সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন মাবুদ নেই, অত:পর এই প্রদত্ত সাক্ষ্যের উপর মৃত্যুবরণ করবে, নি:সন্দেহে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ [বোখারি- ৬৫০২]
অনুরূপভাবে, দ্বীনের হেফাজতকারী বান্দা কবর, হাশরসহ পর জীবনের সর্বত্র ভয়ানক মুহূর্তে মহান আল্লাহর হেফাজতে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করবে। অতএব, আল্লাহর দ্বীনকে হেফাজতকারী হও, তবে তিনি তোমার হেফাজত করবেন। তুমি তার দ্বীন ও বিধানের যথাযোগ্য সংরক্ষণ কর, তাহলে তাঁকে কঠিন মুহূর্তে সামনে পাবে সহায় হিসেবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ غَيْرَ بَعِيدٍ . هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِكُلِّ أَوَّابٍ حَفِيظٍ . (ق: ৩১-৩২)
‘জান্নাতকে উপস্থিত করা হবে আল্লাহভীরুদের অদূরে। তোমাদের প্রত্যেক অনুরাগী ও স্মরণকারীকে এরই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।’ [ক্বাফ : ৩১-৩২]
আল্লাহর হেফাজতের আরেক সুফল হলো : দুনিয়া-আখেরাতের সব ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা লাভ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :—
الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ . ( الأنعام :82)
‘যারা ঈমান-বিশ্বাসকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তাঁরাই সুপথগামী।’ [আনআম : ৮২]
আল্লাহ তাআলা মূসা ও হারুন আ.-কে লক্ষ করে বলেছেন :—
َ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ( طه : ৪৬)
‘তোমরা ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, আমি দেখি ও শুনি।’ [ত্বোয়া-হা : ৪৬]
এমনিভাবে নবী করিম সা. আবু বকর রা.-কে বললেন : যখন উভয়ে মদিনা অভিমুখে হিজরতকালে সাওর গুহায় অবস্থান করছিলেন :—
ما ظنك باثنين الله ثالثهما، لا تحزن إن الله معنا .
দু ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার ধারণা কি যাদের তৃতীয় জন হলেন আল্লাহ ? তুমি ভয় করো না আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। [বোখারি : ৪২৯৫]
পার্থিব জীবনে মানুষ সর্বদা একই অবস্থায় যাপন করে না ; নানা পরিস্থিতি ও অবস্থায় তার আবর্তন ঘটে প্রতি মুহূর্তে, প্রতিক্ষণে। কখনো সে সুখী, কখনো দু:খী ; কখনো আর্থিক প্রাচুর্য ঘিরে থাকে তাকে, সীমাহীন ভোগ-বিলাসের সামর্থ্য যেন লুটিয়ে পড়ে তার পদতলে। কখনো সে আক্রান্ত হয় দারিদ্রে্যর বিপুল যন্ত্রণায়, বিদ্ধ হয় নানাবিধ সংকটের তীরে। কখনো সতেজ সু-স্বাস্থ্যবান, কখনো দুর্বল-রুগ্ন। দীর্ঘ একটা সময় যৌবনের দৃপ্ততায় কাটানোর পর সে ম্রিয়মান হয় বার্ধক্যের কষাঘাতে। তুমি তোমার প্রাচুর্যে, সুস্বাস্থ্যে, যৌবনের দুর্দান্ত শক্তিময়তায় আল্লাহর সাথে থাক,—দারিদ্র্য, অসুস্থতা ও বার্ধক্যের দৌর্বল্যে তিনি তোমার পাশে থাকবেন।
আল্লাহ তাআলার হেফাজত লাভের কতিপয় উপকরণ :—
(ক) বাধ্যতামূলক বিধি-নিষেধগুলোকে পরিপূর্ণ রূপে মেনে চলা। যথা: মসজিদে এসে জামাতসহ সঠিক ওয়াক্তে নামাজ আদায় করা।
(খ) নফল বা ঐচ্ছিক এবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভে এগিয়ে আসা। যেমন : সুন্নতে মুয়াক্কাদা, বিতর, এবং শরিয়ত-সিদ্ধ মাসিক ও বার্ষিক রোজা পালনে যত্নবান হওয়া।
(গ) দ্বীন ও দুনিয়া সংশ্লিষ্ট সার্বক্ষণিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দিন-রাত দোয়া ও প্রার্থনা করা।
(ঘ) এরূপ নেককারগণের সংস্পর্শ বা সংশ্রব লাভ করা যারা তোমাকে তোমার মাওলা আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। তোমাকে বন্দেগীময় জীবন যাপনে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে এবং তোমার দ্বীন- ইসলামের হেফাজতের গুরু দায়িত্ব-ভার গ্রহণ করবে।
(ঙ) এমন উপকারী জ্ঞান অন্বেষণে আত্মনিমগ্ন হওয়া যা তোমাকে প্রভু, স্রষ্টা, সম্বন্ধে জ্ঞান দানের পাশাপাশি তার আদেশ-নিষেধাবলীর পরিচয় তুলে ধরবে।
(১১) উপরোক্ত হাদিসের অন্যতম শিক্ষা এই যে, দোয়া একটি প্রণিধানযোগ্য মৌলিক এবাদত। আল্লাহ তাআলা নিম্নোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে আহবান জানিয়েছেন—
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ .( غافر : ৬০)
‘এবং তোমার প্রভু বলেন : তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। [সূরা গাফের : আয়াত ৬০] তিনি আরো বলেন :—
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ . ( البقرة : ৮৬)
‘আর আমার বানদারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে, বস্ত্তত: আমি রয়েছি সন্নিকটে। আমি প্রার্থীর প্রার্থনা কবুল করি, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। [বাক্বারা : ৮৬]
আল্লাহর নিকট প্রার্থনার কতিপয় শুভ ফলাফল :
(ক) স্বীয় লাঞ্ছনা, অবমাননা, ও চরম মুখাপেক্ষিতার বহি:প্রকাশ।
(খ) উপকার সাধন ও অপকার অপসারণের মতো পরম চাওয়া-পাওয়া।
(গ) এতে রয়েছে বিপুল প্রতিদান ও পুরস্কার। এর মাধ্যমে মার্জিত হয় পাপাচার ও অনাচার।
(ঘ) নিরাপত্তা ও অনুকম্পাসহ আল্লাহ তার সাথেই আছেন—এরূপ একটি সঙ্গবোধ অন্তরের গভীরে জাগ্রত হয় এর মাধ্যমে।
(ঙ) আল্লাহ তাআলার নিম্ন উদ্ধৃত আয়াতকে বাস্তবে রূপ দান করা হয়। তিনি বলেন :—
إياك نعبد وإياك نستعين ( الفاتحة : ৪)
‘শুধু তোমারই এবাদত করি এবং তোমারই নিকট প্রার্থনা জানাই।’ [সূরা ফাতেহা : আয়াত ৪]
(চ) আল্লাহ তাআলার ক্রোধ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার এটিও অন্যতম উত্তম পথ ও পন্থা। যেমন : নবী করিম সা. বলেছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দোয়া করে না তার উপর তাঁর ক্রোধ নিপতিত হয়।
(১২) এ মহান হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়টিও পরিস্ফুটিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে এমন বিষয়ে—যা তিনি ব্যতীত আর কেউ পারে না—সাহায্য, আশ্রয়সহ কিছুই চাওয়া যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যেই হোক না কেন কারোরই জন্যে কোন প্রকার এবাদত করা যাবে না। এই ঐকান্তিক ও নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদতের পথ ব্যতীত এবাদতের গ্রহণযোগ্যতা ও দ্বীন-দুনিয়ার সফলতা বা মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন আদৌ সম্ভব নয়।
(১৩) অত্র অধ্যায়ে আলোচ্য হাদিস থেকে এ বিষয়টিও সাব্যস্ত হয় যে, বান্দা এই জড় জগতে ভাল-মন্দ, লাভ-লোকসান যাই প্রাপ্ত হোক না কেন তা সবই তার পূর্ব লিখিত ও নিরূপিত ভাগ্য অনুযায়ীই হয়ে থাকে। সৃষ্টিকুলের সমগ্র সৃষ্টিই যদি একযোগে কোন বিষয়ে প্রভূত চেষ্টা তদবির চালিয়ে যায়, তবে পরিণাম তাই হয় যা পূর্বে লিখিত ও নির্ধারিত। বিন্দু বা অনু পরিমাণও তার বিপরীত ঘটে না এবং ঘটতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا . ( التوبة :৫১)
‘আপনি বলুন আমাদের কিছুই পৌঁছোবে না কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে রেখেছেন।’ [আত-তাওবাহ : আয়াত ৫৮] তিনি আরো বলেন :—
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا . ( الحديد : ২২)
‘পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না কিন্তু (যা আসে) তা জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।’ [আল হাদীদ : ২২]
(১৪) আল্লাহ তাআলার ফয়সালা ও নির্ধারিত ভাগ্য-লিপির প্রতি বিশ্বাস, এর শেকড় দৃঢ়ভাবে আত্মস্থ করাও ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। এর উদ্দেশ্য আদৌ এ নয় যে, কেউ আমল ছেড়ে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে। কেননা, যিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও ভাগ্যলিপির প্রতি ঈমান আনয়নের নির্দেশ প্রদান করেছেন, তিনিই তো আবার সুফল বয়ে আনে এমন কর্মতৎপরতার প্রয়াস-প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকারও আদেশ করেছেন। যেমন : ইমাম মুসলিম রহ. তার কিতাব মুসলিম শরীফে বর্ণনা করেন—
اعملوا فكل ميسر لما خلق له .
‘তোমরা কর্ম করে যাও। কারণ, প্রত্যেককে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তা সহজ করে দেয়া হয়েছে।’ [বোখারি : ৬৯৯৬]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمّ : إنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ : مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحََرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُهُ عَلَيْهِ، وَلَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتّى أُحِبَّهُ، فَإذَا أحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعُهُ الّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرُهُ الّذِي يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِيْ يُبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلُهُ الَّتِيْ يَمْشِيْ بِهَا، وَلَئِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنّهُ، وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ . ( رَوَاهُ البُخَارِيْ )
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : আল্লাহ তাআলা বলেন—যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে কোনো প্রকার শত্রুতা পোষণ করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেই। আমার বান্দা যে এবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আমার সান্নিধ্য লাভ করে সে সবের মাঝে তার প্রতি আরোপিত ফরজ কাজই আমার নিকট অধিকতর প্রিয় এবং আমার বান্দা নফল কার্যাবলীর মাধ্যমে অব্যাহত ভাবে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, এক সময় সে আমার ভালোবাসা লাভে সক্ষম হয়। আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি হয়ে যাই তার কর্ণ, যার মাধ্যমে সে শ্রবণ করে। এবং হয়ে যাই তার চক্ষু, যার মাধ্যমে সে দর্শন করে, এবং তার হস্ত, যার দ্বারা সে হস্তগত করে, এবং তার চরণ হয়ে যাই যা দিয়ে বিচরণ করে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায় আমি তাকে অবশ্যই তা প্রদান করি। যদি আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দান করি। [বোখারি-৬৫০২]
হাদিস বর্ণনাকারী : হাদিসটি বর্ণনাকারী আবু হুরাইরা রা., তিনি ছিলেন হাদিস কণ্ঠস্থকারী সাহাবিদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়। তার ও তার পিতার নাম বিষয়ে বিজ্ঞ উলামা মহলে রয়েছে মতদ্বৈধতা। তবে প্রসিদ্ধ মতানুসারে তার এবং তার পিতার নাম হলো আব্দুর রহমান, ইবনে ছখর, আদ দাওসী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন খায়বার যুদ্ধের বছরে, সপ্তম হিজরির প্রারম্ভে। ইমাম জাহাবী বলেন :—
حمل عن النبي صلى الله عليه وسلم علما طيبا كثيرا مباركا فيه، لم يلحق فى كثرته .
রাসূলুল্লাহ সা. হতে তিনি প্রভূত, বরকতময় জ্ঞান বহন করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। [আল-ইসাবা] রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিরবচ্ছিন্ন সংস্রবের বরকতে পবিত্র হাদিসের বর্ণনায় তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাবী। যে কারণে তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা পাঁচ হাজার তিন শত চুয়াত্তর (৫,৩৭৪)-এ পৌঁছেছে। ইমাম বোখারি রহ. আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে—তিনি বলেছেন :—
إنكم تقولون : إن أبا هريرة يكثر الحديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم، وتقولون : ما بال المهاجرين والأنصار لا يحدثون عن رسول الله- صلى الله عليه وسلم- بمثل حديث أبي هريرة ؟ وإن إخوتي من المهاجرين كان يشغلهم الصفق بالأسواق، وكنت ألزم رسول الله صلى الله عليه وسلم على ملء بطني، فأشهد إذا غابوا، وأحفظ إذا نسوا، وكان يشغل إخوتي من الأنصار عمل أموالهم، وكنت امرأ مسكينا من مساكين الصفة، أعي حين ينسون .
‘তোমরা পরস্পর বলাবলি কর যে, আবু হুরাইরা রাসূল সা. হতে অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেন এবং তোমাদের পারস্পরিক মন্তব্য হচ্ছে যে, মুহাজির ও আনসারগণ আবু হুরাইরার মত হাদিস বর্ণনায় অংশ নেন না কেন ? আমার মুহাজির ভাইরা বাজারে ব্যবসায় নিয়োজিত থাকত। আর আমি উদরপূর্তির চিন্তা বাদ দিয়ে রাসূলের সঙ্গ যাপনেই বেশি গুরুত্ব প্রদান করতাম। যখন তারা চলে যেত, তখন আমি উপস্থিত থাকতাম, আর তারা বিস্মৃত হলে আমি ব্যাপৃত হতাম কণ্ঠস্থ করণে। আমার আনসার ভাইদের ব্যস্ত রাখত সহায়-সম্পত্তির ব্যস্ততা। আমি ছিলাম সুফ্ফার অসহায় কপর্দকশূন্য একজন। তারা বিস্মৃত হলে আমি মনে রাখতাম।’ [আল-ইসাবা]
একদিন রাসূল স. হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন :—
إنه لن يبسط أحد ثوبه حتى أقضي جميع مقالتي هذه ثم يجمع إليه ثوبه إلا وعى ما أقول . فبسطت نمرة علي ّ، حتى إذا قضى رسول الله صلى الله عليه وسلم مقالته جمعتها إلى صدري، فما نسيت من مقالة رسول الله صلى الله عليه وسلم تلك من شيء .
‘আমি যতক্ষণ না আমার যাবতীয় কথা শেষ করছি ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ যদি তার কাপড় বিছিয়ে রেখে দেয় এবং কথা শেষ হলে তা নিজের দিকে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে, তাহলে আমার উপস্থাপিত সব কথাই তার মনে থাকবে।’—তৎক্ষণাৎ আমি আমার সাদা-কালো দাগযুক্ত পশমি চাদর পেতে দিলাম এবং যখন তিনি যাবতীয় কথা বলে শেষ করলেন, তখনি আমি আমার পাতা চাদরটি টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তাই, রাসূলের বলা সেই কথাগুলোর কিছুই আমি ভুলিনি। [বোখারি : ১৯০৬]
সাতান্ন হিজরিতে তিনি পরলোক গমন করেন।
শাব্দিক আলোচনা :
إنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ হাদিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এ ধরণের বাক্যরূপ প্রমাণ করে হাদিসটি ‘হাদিসে কুদসী’। হাদিসে কুদসী হল :—
هو ما أضيف إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم وأسنده إلى ربه عز وجل .
রাসূল স. যা নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট করে বর্ণনা করেন, কিন্তু বরাত দেন আল্লাহ তাআলার কালাম হিসেবে।
مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا (যে আমার কোনো ওলি (বন্ধু)-এর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করল) ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে :—
من أهان لي وليّا فقد بارزني بالمحاربة
যে আমার কোনো প্রিয় বান্দাকে অপমাণিত করল সে আমার সঙ্গে লড়াইয়ের ঘোষণা দিল। [যাদুদ দায়িয়াহ : ১৫] ‘ওয়ালিয়্যুন’ শব্দটি ‘মুওয়ালাত’ থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ নৈকট্য। ওলি কাকে বলে ?—
الولي : هو القريب من الله بعمل الطاعات والكف عن المعاصي
ওলি তাকেই বলে যে যথার্থ এবাদত বন্দেগি ও সর্বপ্রকার পাপাচার পরিহারে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখে মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্যে উপনীত হতে সক্ষম ও সফল হয়েছে। [প্রাগুক্ত : ১৫]
فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحََرْبِ অর্থাৎ, যেহেতু আমার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে সেহেতু আমিও তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম।
وَمَا تَقَرَّبَ إلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُهُ عَلَيْهِ ‘আমার বন্ধুদের সাথে শত্রুতা প্রকারান্তরে আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষণারই অনুরূপ’—এ আলোচনার অবতারণার পর আল্লাহ তাআলা তার বন্ধুদের গুণ বর্ণনা করেছেন, যাদের সাথে শত্রুতা নিষিদ্ধ, এবং যাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আল্লাহর কাম্য। আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারাই, যারা নৈকট্যদানকারী বিষয়কে অবলম্বন করে, বলাবাহুল্য এর শীর্ষে অবস্থান করে শরিয়তের অবশ্য পালনীয় বিধান বা ফরজ সমূহ।
فَإذَا أحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعُهُ الّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرُهُ الّذِي يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِيْ يُبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلُهُ الَّتِيْ يَمْشِيْ بِهَا বাক্যাংশের উদ্দেশ্য এই যে, প্রথমত: ফরজ, দ্বিতীয়ত: নফল-ইত্যাদির মাধ্যমে সে নিরত হবে আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভের অধ্যবসায়, আল্লাহ তাকে আপন করে নিবেন, ঈমানের স্তর হতে তাকে উন্নীত করবেন এহসানের স্তরে। ফলে সে এমনভাবে আল্লাহ পাকের এবাদতে লিপ্ত হবে—যেন সে আল্লাহর দর্শন লাভ করছে, তার হৃদয় পূর্ণ হবে আল্লাহর মারেফাতে, তার মহববত ও মহত্ত্বে। তার আত্মা কম্পিত হবে আল্লাহর ভীতি ও মাহাত্ম্যে। তার হৃদয়কোন্দর বিগলিত হবে তার সংশ্লিষ্টতা ও তার প্রতি প্রবল ব্যগ্রতায়। এক সময় তার মনে হবে, অন্তরদৃষ্টি দ্বারা সে আল্লাহকে দর্শন করছে—তার কথন হবে আল্লাহর কথন, শ্রবণ হবে তারই শ্রবণ, দৃষ্টি হবে তারই দৃষ্টি।
وَلَئِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنّهُ، وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ . অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাকের সে-রূপ নৈকট্যশালী সৌভাগ্যবান বান্দার বিশিষ্ট মর্যাদা রয়েছে তাঁর সমীপে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সে যদি তাঁর সকাশে কিছু চায় তবে তিনি তাকে তা দিয়ে দেন। কোনো বিষয় থেকে আশ্রয় কামনা করলে তিনি তা থেকে তাকে আশ্রয় দেন। তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। অতএব আল্লাহ পাকের সকাশে তার এহেন সম্মান থাকায় সে الدَّعْوَةِ مُسْتَجَابُ (যার দোয়া কবুল করা হয়) বান্দায় পরিণত হয়।
বিধান ও উপকারিতা :
ওয়াজিব-মোস্তাহাব, বা আবশ্যক-অনাবশ্যক সর্বস্তরের এবাদত বন্দেগির অভ্যন্তরে বিচরণ, এবং ছোট বড় সর্বশ্রেণীর পাপাচার অনাচারের ভয়ংকর বৃত্ত থেকে সম্পূর্ণ ভাবে আত্মরক্ষা—এ দু’টি বিষয়ই মানব-মানবীর ভিতরে অলিত্বের প্রতিভা সৃষ্টি করে। শামিল করে তাদের সেই শ্রেষ্ঠ অলিদের কাতারে যারা মহববত করে আল্লাহকে। আল্লাহ পাকও তাদের মহববত করেন—কেবল তাই নয়, বরং যারা তাদের মহববত করে তিনি তাদেরকেও ভালোবাসেন। অধিকন্তু, যে সমস্ত লোক আল্লাহ তাআলার এমন বন্ধুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে, অথবা তাদের কষ্ট দেয়, কিংবা ঘৃণা করে, অথবা তাদের সাথে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা মূলক দুরাচার, অথবা কোনোরূপ অনিষ্ট ও ক্ষতি সাধনের কুটিল মতলব নিয়ে তাদের পিছু নেয়, তিনি সে সমস্ত দুষ্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা তাদের সাহায্য সহযোগিতার জিম্মাদার হন। বিধায় তিনি তাদের সহায়তা করেন।
আল্লাহর বন্ধুদের প্রতি মহববত পোষণ আবশ্যক, অপরদিকে তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ অবৈধ সর্বৈবে। এমনিভাবে, যারা তার সাথে শত্রুতায় লিপ্ত তাদের সাথে শত্রুতার মনোভাব ও তাদের বন্ধুত্ব বর্জন আবশ্যক।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ
যারা আমার ও তোমাদের শত্রু, তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। [আল মুমতাহিনা : ১]
অপর এক স্থানে তিনি বলেন—
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ . ( المائدة : ৫৬)
যারা আল্লাহ, তার রাসূল ও মোমিনদের সাথে বন্ধুতা করে, তারাই আল্লাহর দল, আর আল্লাহর দলই বিজয়ী। [সূরা মায়েদা : ৫৬]
আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, তারা মোমিনদের প্রতি সদয় এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।
হাদিসটি প্রমাণ করে, আল্লাহর বন্ধু দু শ্রেণীতে বিভক্ত।
প্রথমত: যারা ফরজ আদায়ের মাধ্যমে তার নৈকট্য হাসিল করে। এরা আসহাবে ইয়ামিন বা মধ্যপন্থী। ফরজ আদায়, নি:সন্দেহ, সর্বোত্তম এবাদত, যেমন বলেছেন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.
أفضل الأعمال أداء ما افترض الله، والورع عما حرم الله، وصدق النية فيما عند الله .
‘সর্বোত্তম এবাদত হল যা আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন, অত:পর আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার এবং যা আল্লাহর কাছে রক্ষিত, তা লাভের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ নিয়ত।’ [যাদুদ দায়িয়াহ : ১৬]
দ্বিতীয়ত: ফরজ আদায়ের পর যারা নফল এবাদত, মাকরূহ বিষয়াদি পরিহার—ইত্যাদির অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করে। আল্লাহ তাদের প্রতি ভালোবাসা আবশ্যক করে নেন। উল্লেখিত হাদিসে এ দ্বিতীয় প্রকার অলিদের প্রতি বিশেষ আলোকপাত করে বলা হয়েছে—
وَلَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتّى أُحِبَّهُ
নফল এবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে আমার বান্দা আমার নৈকট্য লাভ অব্যাহত রাখে এমনকি এ পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবাসি। [বোখারি- ৬৫০২]
আল্লাহ তাআলা যে বান্দাকে ভালোবাসেন, সে বান্দার হৃদয়ে তার বাস্তব ভালোবাসা জাগিয়ে তোলেন এবং স্মরণ ও এবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিমগ্ন থাকতে পারে—এরূপ শক্তি-সামর্থ্য ও হিম্মত তাকে দান করেন। তদুপরি, আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য ও নৈকট্য বয়ে আনে এমন ধর্মকর্ম বা ধর্ম-পরায়ণতায় সে তার অন্তরঙ্গতা ও নিবিড় আন্তরিকতা খুঁজে পায়। ফলে ওই সব সু-কর্ম নিশ্চিত করে মহান আল্লাহর নিকটবর্তিতা এবং সাব্যস্ত করে ওই সংরক্ষিত অনন্ত নেয়ামতরাজি যা তাঁরই সকাশে সংরক্ষিত। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ( المائدة :৫৪)
হে মোমিনগণ, তোমাদের মধ্য থেকে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-বিনম্র হবে, এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে, এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ। [মায়েদা : ৫৪]
বান্দার জন্য আল্লাহর মহববত অন্যতম মুখ্য বিষয়। যে ব্যক্তি তা প্রাপ্ত হবে, প্রাপ্ত হবে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও সৌভাগ্য। প্রকৃত মোমিন সেই, যে আল্লাহর অলি হওয়ার আকাঙ্খায় ব্যাগ্র-কাতর হবে। এ লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত করবে চূড়ান্ত অধ্যবসায়। আল্লাহর অলি হওয়ার লক্ষ্য অর্জিত হয় নানাভাবে—
(ক) যা পালন আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য ফরজ করেছেন, তা সুচারুরূপে পালন করা। হাদিসে এসেছে—
وَمَا تَقَرَّبَ إلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُهُ عَلَيْهِ
আমার বান্দা যে সমস্ত উপায়ে আমার নৈকট্য পায়, তন্মধ্যে তার প্রতি আমার আরোপিত ফরজ কর্ম সমূহই আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়।
কিছু ফরজ কর্মের উদাহরণ নিম্নরূপ :—
তাওহীদ বা একত্ববাদের বাস্তবিক রূপায়ণ, ফরজ সালাত আদায়, জাকাত প্রদান, এবং মাহে-রমজানের সিয়াম পালন, ও বায়তুল্লাহর হজ পালন, এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার ও আত্মীয়ের হক আদায়। তদুপরি সততা, নিষ্ঠা, উদারতা, সহানুভূতি, অনুনয়-বিনয় এবং উৎকৃষ্ট কথন-বলন ও উত্তম ব্যবহার—প্রভৃতির ন্যায় শ্রেষ্ঠ চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া।
(খ) ছোট বড় সকল হারাম বস্ত্ত সহ মাকরূহ বা অপছন্দনীয় বিষয়াদি থেকে যথা সাধ্য দূরত্ব বজায় রাখা।
(গ) নানাবিধ নফল সালাত, সদকা, সিয়াম, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, সৎ কর্মের আদেশ, অসৎ কর্মের নিষেধসহ ইত্যাদি নফল বা ঐচ্ছিক নেক কর্মে নিয়োজিত হয়ে মহান আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য অর্জনে ব্রতী হওয়া।
উল্লেখযোগ্য কিছু নফল-কর্ম :
এক : অনুধাবন ও চিন্তা-গবেষণাসহ কোরআন তেলাওয়াত, এবং সে অনুসারে চিন্তা-ভাবনা করে তা শ্রবণ, যথাসাধ্য তার মুখস্থ এবং কণ্ঠস্থকৃত অংশগুলোর বারংবার পুনরাবৃত্তি এবং উক্ত আবৃত্তির মাধ্যমে আন্তরিক প্রশান্তি উপভোগ করা। কেননা মাহবুবের কথন-বলন ও শ্রবণে যে মধুরতা নিহিত, মহববত পোষণকারী মহলে তার চেয়ে তীব্রতর মধুরতা ও মিষ্টতা আর কিছুই নেই। খুঁজে পায় সেখানে তারা চরম ও পরম তৃপ্তি। কোরআন কারীমের পাঠ সংক্রান্ত উক্ত স্বাদ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে—এমন কিছু উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
এক—উক্ত বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প করা।
দুই—উক্ত বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
তিন—উক্ত বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ।
চার—উপরোক্ত তিনটি কাজ শেষ করার পর যে মূল কর্মটি হাতে নিতে হবে তা হলো দৈনন্দিন কোরআন করীমের একটি পারার তেলাওয়াত নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালিয়ে যাবে এবং যথাসাধ্য উক্ত নিয়মানুবর্তিতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলবে। কিছুতেই তা ভঙ্গ করবে না।
দুই : আত্মিক ও মৌখিকভাবে আল্লাহর স্মরণে অধিকহারে ব্যাপৃত হওয়া। বিশুদ্ধ হাদিসে কুদসীতে এসেছে যে—
يقول الله تعالي : أنا عند ظن عبدى بى، وأنا معه حين يذكرني، فان ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي، وان ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منهم .
আল্লাহ তাআলা বলেন : আমার প্রতি আমার বান্দা যেরূপ ধারণা পোষণ করে আমি তার সে-রূপ ধারণা অনুযায়ী কাজ করি। আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমায় স্মরণ করে। অতএব সে যদি আমাকে নির্জনে স্মরণ করে আমি তাকে নির্জনে স্মরণ করি। আর যদি সে আমাকে ভরা মজলিসে স্মরণ করে তবে আমি তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। [বোখারি , মুসলিম] এবং আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ ( البقرة : ১৫২)
তোমরা আমার স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব। [সুরা বাক্বারা : ১৫২]
তিন : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার পরম বন্ধুদের ভালোবাসা। পাশাপাশি উক্ত উদ্দেশ্যে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা। উমর রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন : নবী করীম স. বলেছেন :—
إن من عباد الله لأناسا ما هم بأنبياء ولا شهداء، يغبطهم الأنبياء والشهداء يوم القيامة بمكانهم من الله تعالى، يوم القيامة بمكانهم من الله تعالي، قالوا : يا رسول الله، تخبرنا من هم ؟ قال : هم قوم تحابوا بروح الله علي غير أرحام بينهم، ولا أموال يتعاطونها، فوالله إن وجوههم لنور، وإنهم علي منابر من نور لا يخافون إذا خاف الناس، ولا يحزنون إذا حزن الناس، وقرأ هذه الآية : أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [ يونس : ৬২]
আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা নবী কিংবা শহীদ নয়। আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত বিশেষ মর্যাদার কারণে নবী ও শহীদগণ কেয়ামত দিবসে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন। তারা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল সা. তারা কারা, আপনি আমাদের তা অবহিত করবেন কী ? তিনি বললেন : তারা হল সে সমস্ত লোক যারা একে অপরকে ভালো বেসেছিল শুধু আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নে, কোন আত্মীয়তার বন্ধনের তাগিদে নয়, কিংবা তাদের পারস্পরিক সম্পদের আদান-প্রদানের কারণেও নয়। আল্লাহর শপথ ! নিশ্চয় তাদের মুখমন্ডল হবে আলোময় (ঝলমলে) তারা উপবিষ্ট থাকবে জ্যোতির তৈরি মিম্বার (মঞ্চ) সমূহে। লোকেরা যখন শঙ্কায় কাতর হবে, তখন তারা হবে নি:শঙ্কচিত্ত। মানুষ যখন শোকে কাতর হবে, তখন তারা হবে আনন্দচিত্ত। [আবু দাউদ : ৩০৬০]
অত:পর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন :—
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [ يونس : ৬২]
আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয়-ভীতি কিংবা শোক-দু:খ নেই। [ইউনুস : ৬২]
পাঁচ : হাদিসটি প্রমাণ করে—রাসূল সা.-এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার আনুগত্য ও বন্ধুত্বের যে বিধান দিয়েছেন, তা ব্যতীত ভিন্ন কোন পথ-পদ্ধতির মাধ্যমে তা লাভের দাবি খুবই অসাড়, মিথ্যা—তাই সর্বার্থে বর্জনীয়। মুশরিকরা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের ভিন্ন উপায় হিসেবে গায়রুল্লাহর এবাদত করত কোরআনে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে আল্লাহ তাআলা বলেন—
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى ( الزمر 3)
আমরা তাদের উপাসনা শুধু এ জন্যই করি যাতে তারা আমাদের আল্লাহর নিকটস্থ করে দেয়। [যুমার : ৩]
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা ইহুদি খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে তাদের উক্তি তুলে ধরে বলেন :—
نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ ( المائدة : 17)
আমরা আল্লাহর পুত্র ও তাঁর বন্ধু। [মায়েদা : ১৭]
অথচ তারা সমস্ত রাসূলদেরই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে উদ্ধতভাবে এবং তাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য ও ফরজ-কর্মসমূহ পরিহারে তারা থাকে অটল ও অনড়।
ছয় : মুসলমানমাত্র আশা রাখে যে তার দোয়া কবুল করা হবে, গ্রহণ করা হবে তার কর্মগুলো, দান করা হবে তাকে তার প্রার্থিত বিষয়। যা থেকে সে পরিত্রান প্রার্থনা করবে, তা থেকে তাকে পরিত্রান দেয়া হবে। এগুলো মানুষের খুবই আন্তরিক ও আত্মিক বাসনা, যার সঠিক সন্ধান দিতে পারে একমাত্র ওলায়াত বা বন্ধুত্বের পথ। যে পথের পুরোটাই জুড়ে থাকবে ফরজ ও শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত-সমর্থিত নফল এবাদত—যার পিছনে কাজ করবে বিশুদ্ধ নিয়ত ও রাসূলের আনুসরণ এবং তার নির্দেশিত পথের অনুবর্তন।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : আল্লাহ তাআলা বলেন—যে ব্যক্তি আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে কোনো প্রকার শত্রুতা পোষণ করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেই। আমার বান্দা যে এবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আমার সান্নিধ্য লাভ করে সে সবের মাঝে তার প্রতি আরোপিত ফরজ কাজই আমার নিকট অধিকতর প্রিয় এবং আমার বান্দা নফল কার্যাবলীর মাধ্যমে অব্যাহত ভাবে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে, এক সময় সে আমার ভালোবাসা লাভে সক্ষম হয়। আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি হয়ে যাই তার কর্ণ, যার মাধ্যমে সে শ্রবণ করে। এবং হয়ে যাই তার চক্ষু, যার মাধ্যমে সে দর্শন করে, এবং তার হস্ত, যার দ্বারা সে হস্তগত করে, এবং তার চরণ হয়ে যাই যা দিয়ে বিচরণ করে। সে যদি আমার কাছে কিছু চায় আমি তাকে অবশ্যই তা প্রদান করি। যদি আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দান করি। [বোখারি-৬৫০২]
হাদিস বর্ণনাকারী : হাদিসটি বর্ণনাকারী আবু হুরাইরা রা., তিনি ছিলেন হাদিস কণ্ঠস্থকারী সাহাবিদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়। তার ও তার পিতার নাম বিষয়ে বিজ্ঞ উলামা মহলে রয়েছে মতদ্বৈধতা। তবে প্রসিদ্ধ মতানুসারে তার এবং তার পিতার নাম হলো আব্দুর রহমান, ইবনে ছখর, আদ দাওসী। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন খায়বার যুদ্ধের বছরে, সপ্তম হিজরির প্রারম্ভে। ইমাম জাহাবী বলেন :—
حمل عن النبي صلى الله عليه وسلم علما طيبا كثيرا مباركا فيه، لم يلحق فى كثرته .
রাসূলুল্লাহ সা. হতে তিনি প্রভূত, বরকতময় জ্ঞান বহন করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। [আল-ইসাবা] রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিরবচ্ছিন্ন সংস্রবের বরকতে পবিত্র হাদিসের বর্ণনায় তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাবী। যে কারণে তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা পাঁচ হাজার তিন শত চুয়াত্তর (৫,৩৭৪)-এ পৌঁছেছে। ইমাম বোখারি রহ. আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে—তিনি বলেছেন :—
إنكم تقولون : إن أبا هريرة يكثر الحديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم، وتقولون : ما بال المهاجرين والأنصار لا يحدثون عن رسول الله- صلى الله عليه وسلم- بمثل حديث أبي هريرة ؟ وإن إخوتي من المهاجرين كان يشغلهم الصفق بالأسواق، وكنت ألزم رسول الله صلى الله عليه وسلم على ملء بطني، فأشهد إذا غابوا، وأحفظ إذا نسوا، وكان يشغل إخوتي من الأنصار عمل أموالهم، وكنت امرأ مسكينا من مساكين الصفة، أعي حين ينسون .
‘তোমরা পরস্পর বলাবলি কর যে, আবু হুরাইরা রাসূল সা. হতে অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেন এবং তোমাদের পারস্পরিক মন্তব্য হচ্ছে যে, মুহাজির ও আনসারগণ আবু হুরাইরার মত হাদিস বর্ণনায় অংশ নেন না কেন ? আমার মুহাজির ভাইরা বাজারে ব্যবসায় নিয়োজিত থাকত। আর আমি উদরপূর্তির চিন্তা বাদ দিয়ে রাসূলের সঙ্গ যাপনেই বেশি গুরুত্ব প্রদান করতাম। যখন তারা চলে যেত, তখন আমি উপস্থিত থাকতাম, আর তারা বিস্মৃত হলে আমি ব্যাপৃত হতাম কণ্ঠস্থ করণে। আমার আনসার ভাইদের ব্যস্ত রাখত সহায়-সম্পত্তির ব্যস্ততা। আমি ছিলাম সুফ্ফার অসহায় কপর্দকশূন্য একজন। তারা বিস্মৃত হলে আমি মনে রাখতাম।’ [আল-ইসাবা]
একদিন রাসূল স. হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন :—
إنه لن يبسط أحد ثوبه حتى أقضي جميع مقالتي هذه ثم يجمع إليه ثوبه إلا وعى ما أقول . فبسطت نمرة علي ّ، حتى إذا قضى رسول الله صلى الله عليه وسلم مقالته جمعتها إلى صدري، فما نسيت من مقالة رسول الله صلى الله عليه وسلم تلك من شيء .
‘আমি যতক্ষণ না আমার যাবতীয় কথা শেষ করছি ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ যদি তার কাপড় বিছিয়ে রেখে দেয় এবং কথা শেষ হলে তা নিজের দিকে টেনে এনে জড়িয়ে ধরে, তাহলে আমার উপস্থাপিত সব কথাই তার মনে থাকবে।’—তৎক্ষণাৎ আমি আমার সাদা-কালো দাগযুক্ত পশমি চাদর পেতে দিলাম এবং যখন তিনি যাবতীয় কথা বলে শেষ করলেন, তখনি আমি আমার পাতা চাদরটি টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তাই, রাসূলের বলা সেই কথাগুলোর কিছুই আমি ভুলিনি। [বোখারি : ১৯০৬]
সাতান্ন হিজরিতে তিনি পরলোক গমন করেন।
শাব্দিক আলোচনা :
إنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ হাদিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এ ধরণের বাক্যরূপ প্রমাণ করে হাদিসটি ‘হাদিসে কুদসী’। হাদিসে কুদসী হল :—
هو ما أضيف إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم وأسنده إلى ربه عز وجل .
রাসূল স. যা নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট করে বর্ণনা করেন, কিন্তু বরাত দেন আল্লাহ তাআলার কালাম হিসেবে।
مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا (যে আমার কোনো ওলি (বন্ধু)-এর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করল) ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে :—
من أهان لي وليّا فقد بارزني بالمحاربة
যে আমার কোনো প্রিয় বান্দাকে অপমাণিত করল সে আমার সঙ্গে লড়াইয়ের ঘোষণা দিল। [যাদুদ দায়িয়াহ : ১৫] ‘ওয়ালিয়্যুন’ শব্দটি ‘মুওয়ালাত’ থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ নৈকট্য। ওলি কাকে বলে ?—
الولي : هو القريب من الله بعمل الطاعات والكف عن المعاصي
ওলি তাকেই বলে যে যথার্থ এবাদত বন্দেগি ও সর্বপ্রকার পাপাচার পরিহারে দৃঢ়তার স্বাক্ষর রেখে মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্যে উপনীত হতে সক্ষম ও সফল হয়েছে। [প্রাগুক্ত : ১৫]
فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحََرْبِ অর্থাৎ, যেহেতু আমার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে সেহেতু আমিও তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম।
وَمَا تَقَرَّبَ إلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُهُ عَلَيْهِ ‘আমার বন্ধুদের সাথে শত্রুতা প্রকারান্তরে আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষণারই অনুরূপ’—এ আলোচনার অবতারণার পর আল্লাহ তাআলা তার বন্ধুদের গুণ বর্ণনা করেছেন, যাদের সাথে শত্রুতা নিষিদ্ধ, এবং যাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আল্লাহর কাম্য। আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারাই, যারা নৈকট্যদানকারী বিষয়কে অবলম্বন করে, বলাবাহুল্য এর শীর্ষে অবস্থান করে শরিয়তের অবশ্য পালনীয় বিধান বা ফরজ সমূহ।
فَإذَا أحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعُهُ الّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرُهُ الّذِي يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِيْ يُبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلُهُ الَّتِيْ يَمْشِيْ بِهَا বাক্যাংশের উদ্দেশ্য এই যে, প্রথমত: ফরজ, দ্বিতীয়ত: নফল-ইত্যাদির মাধ্যমে সে নিরত হবে আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভের অধ্যবসায়, আল্লাহ তাকে আপন করে নিবেন, ঈমানের স্তর হতে তাকে উন্নীত করবেন এহসানের স্তরে। ফলে সে এমনভাবে আল্লাহ পাকের এবাদতে লিপ্ত হবে—যেন সে আল্লাহর দর্শন লাভ করছে, তার হৃদয় পূর্ণ হবে আল্লাহর মারেফাতে, তার মহববত ও মহত্ত্বে। তার আত্মা কম্পিত হবে আল্লাহর ভীতি ও মাহাত্ম্যে। তার হৃদয়কোন্দর বিগলিত হবে তার সংশ্লিষ্টতা ও তার প্রতি প্রবল ব্যগ্রতায়। এক সময় তার মনে হবে, অন্তরদৃষ্টি দ্বারা সে আল্লাহকে দর্শন করছে—তার কথন হবে আল্লাহর কথন, শ্রবণ হবে তারই শ্রবণ, দৃষ্টি হবে তারই দৃষ্টি।
وَلَئِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنّهُ، وَلَئِنْ اسْتَعَاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ . অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাকের সে-রূপ নৈকট্যশালী সৌভাগ্যবান বান্দার বিশিষ্ট মর্যাদা রয়েছে তাঁর সমীপে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সে যদি তাঁর সকাশে কিছু চায় তবে তিনি তাকে তা দিয়ে দেন। কোনো বিষয় থেকে আশ্রয় কামনা করলে তিনি তা থেকে তাকে আশ্রয় দেন। তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। অতএব আল্লাহ পাকের সকাশে তার এহেন সম্মান থাকায় সে الدَّعْوَةِ مُسْتَجَابُ (যার দোয়া কবুল করা হয়) বান্দায় পরিণত হয়।
বিধান ও উপকারিতা :
ওয়াজিব-মোস্তাহাব, বা আবশ্যক-অনাবশ্যক সর্বস্তরের এবাদত বন্দেগির অভ্যন্তরে বিচরণ, এবং ছোট বড় সর্বশ্রেণীর পাপাচার অনাচারের ভয়ংকর বৃত্ত থেকে সম্পূর্ণ ভাবে আত্মরক্ষা—এ দু’টি বিষয়ই মানব-মানবীর ভিতরে অলিত্বের প্রতিভা সৃষ্টি করে। শামিল করে তাদের সেই শ্রেষ্ঠ অলিদের কাতারে যারা মহববত করে আল্লাহকে। আল্লাহ পাকও তাদের মহববত করেন—কেবল তাই নয়, বরং যারা তাদের মহববত করে তিনি তাদেরকেও ভালোবাসেন। অধিকন্তু, যে সমস্ত লোক আল্লাহ তাআলার এমন বন্ধুদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে, অথবা তাদের কষ্ট দেয়, কিংবা ঘৃণা করে, অথবা তাদের সাথে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা মূলক দুরাচার, অথবা কোনোরূপ অনিষ্ট ও ক্ষতি সাধনের কুটিল মতলব নিয়ে তাদের পিছু নেয়, তিনি সে সমস্ত দুষ্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা তাদের সাহায্য সহযোগিতার জিম্মাদার হন। বিধায় তিনি তাদের সহায়তা করেন।
আল্লাহর বন্ধুদের প্রতি মহববত পোষণ আবশ্যক, অপরদিকে তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ অবৈধ সর্বৈবে। এমনিভাবে, যারা তার সাথে শত্রুতায় লিপ্ত তাদের সাথে শত্রুতার মনোভাব ও তাদের বন্ধুত্ব বর্জন আবশ্যক।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ
যারা আমার ও তোমাদের শত্রু, তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। [আল মুমতাহিনা : ১]
অপর এক স্থানে তিনি বলেন—
وَمَنْ يَتَوَلَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْغَالِبُونَ . ( المائدة : ৫৬)
যারা আল্লাহ, তার রাসূল ও মোমিনদের সাথে বন্ধুতা করে, তারাই আল্লাহর দল, আর আল্লাহর দলই বিজয়ী। [সূরা মায়েদা : ৫৬]
আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, তারা মোমিনদের প্রতি সদয় এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর।
হাদিসটি প্রমাণ করে, আল্লাহর বন্ধু দু শ্রেণীতে বিভক্ত।
প্রথমত: যারা ফরজ আদায়ের মাধ্যমে তার নৈকট্য হাসিল করে। এরা আসহাবে ইয়ামিন বা মধ্যপন্থী। ফরজ আদায়, নি:সন্দেহ, সর্বোত্তম এবাদত, যেমন বলেছেন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.
أفضل الأعمال أداء ما افترض الله، والورع عما حرم الله، وصدق النية فيما عند الله .
‘সর্বোত্তম এবাদত হল যা আল্লাহ তাআলা ফরজ করেছেন, অত:পর আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার এবং যা আল্লাহর কাছে রক্ষিত, তা লাভের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ নিয়ত।’ [যাদুদ দায়িয়াহ : ১৬]
দ্বিতীয়ত: ফরজ আদায়ের পর যারা নফল এবাদত, মাকরূহ বিষয়াদি পরিহার—ইত্যাদির অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করে। আল্লাহ তাদের প্রতি ভালোবাসা আবশ্যক করে নেন। উল্লেখিত হাদিসে এ দ্বিতীয় প্রকার অলিদের প্রতি বিশেষ আলোকপাত করে বলা হয়েছে—
وَلَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتّى أُحِبَّهُ
নফল এবাদত বন্দেগির মধ্য দিয়ে আমার বান্দা আমার নৈকট্য লাভ অব্যাহত রাখে এমনকি এ পর্যায়ে আমি তাকে ভালোবাসি। [বোখারি- ৬৫০২]
আল্লাহ তাআলা যে বান্দাকে ভালোবাসেন, সে বান্দার হৃদয়ে তার বাস্তব ভালোবাসা জাগিয়ে তোলেন এবং স্মরণ ও এবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিমগ্ন থাকতে পারে—এরূপ শক্তি-সামর্থ্য ও হিম্মত তাকে দান করেন। তদুপরি, আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য ও নৈকট্য বয়ে আনে এমন ধর্মকর্ম বা ধর্ম-পরায়ণতায় সে তার অন্তরঙ্গতা ও নিবিড় আন্তরিকতা খুঁজে পায়। ফলে ওই সব সু-কর্ম নিশ্চিত করে মহান আল্লাহর নিকটবর্তিতা এবং সাব্যস্ত করে ওই সংরক্ষিত অনন্ত নেয়ামতরাজি যা তাঁরই সকাশে সংরক্ষিত। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ( المائدة :৫৪)
হে মোমিনগণ, তোমাদের মধ্য থেকে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-বিনম্র হবে, এবং কাফেরদের প্রতি হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে, এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ। [মায়েদা : ৫৪]
বান্দার জন্য আল্লাহর মহববত অন্যতম মুখ্য বিষয়। যে ব্যক্তি তা প্রাপ্ত হবে, প্রাপ্ত হবে দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ ও সৌভাগ্য। প্রকৃত মোমিন সেই, যে আল্লাহর অলি হওয়ার আকাঙ্খায় ব্যাগ্র-কাতর হবে। এ লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত করবে চূড়ান্ত অধ্যবসায়। আল্লাহর অলি হওয়ার লক্ষ্য অর্জিত হয় নানাভাবে—
(ক) যা পালন আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য ফরজ করেছেন, তা সুচারুরূপে পালন করা। হাদিসে এসেছে—
وَمَا تَقَرَّبَ إلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُهُ عَلَيْهِ
আমার বান্দা যে সমস্ত উপায়ে আমার নৈকট্য পায়, তন্মধ্যে তার প্রতি আমার আরোপিত ফরজ কর্ম সমূহই আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়।
কিছু ফরজ কর্মের উদাহরণ নিম্নরূপ :—
তাওহীদ বা একত্ববাদের বাস্তবিক রূপায়ণ, ফরজ সালাত আদায়, জাকাত প্রদান, এবং মাহে-রমজানের সিয়াম পালন, ও বায়তুল্লাহর হজ পালন, এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার ও আত্মীয়ের হক আদায়। তদুপরি সততা, নিষ্ঠা, উদারতা, সহানুভূতি, অনুনয়-বিনয় এবং উৎকৃষ্ট কথন-বলন ও উত্তম ব্যবহার—প্রভৃতির ন্যায় শ্রেষ্ঠ চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া।
(খ) ছোট বড় সকল হারাম বস্ত্ত সহ মাকরূহ বা অপছন্দনীয় বিষয়াদি থেকে যথা সাধ্য দূরত্ব বজায় রাখা।
(গ) নানাবিধ নফল সালাত, সদকা, সিয়াম, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, সৎ কর্মের আদেশ, অসৎ কর্মের নিষেধসহ ইত্যাদি নফল বা ঐচ্ছিক নেক কর্মে নিয়োজিত হয়ে মহান আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য অর্জনে ব্রতী হওয়া।
উল্লেখযোগ্য কিছু নফল-কর্ম :
এক : অনুধাবন ও চিন্তা-গবেষণাসহ কোরআন তেলাওয়াত, এবং সে অনুসারে চিন্তা-ভাবনা করে তা শ্রবণ, যথাসাধ্য তার মুখস্থ এবং কণ্ঠস্থকৃত অংশগুলোর বারংবার পুনরাবৃত্তি এবং উক্ত আবৃত্তির মাধ্যমে আন্তরিক প্রশান্তি উপভোগ করা। কেননা মাহবুবের কথন-বলন ও শ্রবণে যে মধুরতা নিহিত, মহববত পোষণকারী মহলে তার চেয়ে তীব্রতর মধুরতা ও মিষ্টতা আর কিছুই নেই। খুঁজে পায় সেখানে তারা চরম ও পরম তৃপ্তি। কোরআন কারীমের পাঠ সংক্রান্ত উক্ত স্বাদ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে—এমন কিছু উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
এক—উক্ত বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প করা।
দুই—উক্ত বিষয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
তিন—উক্ত বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ।
চার—উপরোক্ত তিনটি কাজ শেষ করার পর যে মূল কর্মটি হাতে নিতে হবে তা হলো দৈনন্দিন কোরআন করীমের একটি পারার তেলাওয়াত নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালিয়ে যাবে এবং যথাসাধ্য উক্ত নিয়মানুবর্তিতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলবে। কিছুতেই তা ভঙ্গ করবে না।
দুই : আত্মিক ও মৌখিকভাবে আল্লাহর স্মরণে অধিকহারে ব্যাপৃত হওয়া। বিশুদ্ধ হাদিসে কুদসীতে এসেছে যে—
يقول الله تعالي : أنا عند ظن عبدى بى، وأنا معه حين يذكرني، فان ذكرني في نفسه ذكرته في نفسي، وان ذكرني في ملأ ذكرته في ملأ خير منهم .
আল্লাহ তাআলা বলেন : আমার প্রতি আমার বান্দা যেরূপ ধারণা পোষণ করে আমি তার সে-রূপ ধারণা অনুযায়ী কাজ করি। আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমায় স্মরণ করে। অতএব সে যদি আমাকে নির্জনে স্মরণ করে আমি তাকে নির্জনে স্মরণ করি। আর যদি সে আমাকে ভরা মজলিসে স্মরণ করে তবে আমি তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। [বোখারি , মুসলিম] এবং আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ ( البقرة : ১৫২)
তোমরা আমার স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব। [সুরা বাক্বারা : ১৫২]
তিন : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার পরম বন্ধুদের ভালোবাসা। পাশাপাশি উক্ত উদ্দেশ্যে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা। উমর রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন : নবী করীম স. বলেছেন :—
إن من عباد الله لأناسا ما هم بأنبياء ولا شهداء، يغبطهم الأنبياء والشهداء يوم القيامة بمكانهم من الله تعالى، يوم القيامة بمكانهم من الله تعالي، قالوا : يا رسول الله، تخبرنا من هم ؟ قال : هم قوم تحابوا بروح الله علي غير أرحام بينهم، ولا أموال يتعاطونها، فوالله إن وجوههم لنور، وإنهم علي منابر من نور لا يخافون إذا خاف الناس، ولا يحزنون إذا حزن الناس، وقرأ هذه الآية : أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [ يونس : ৬২]
আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা নবী কিংবা শহীদ নয়। আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত বিশেষ মর্যাদার কারণে নবী ও শহীদগণ কেয়ামত দিবসে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন। তারা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল সা. তারা কারা, আপনি আমাদের তা অবহিত করবেন কী ? তিনি বললেন : তারা হল সে সমস্ত লোক যারা একে অপরকে ভালো বেসেছিল শুধু আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নে, কোন আত্মীয়তার বন্ধনের তাগিদে নয়, কিংবা তাদের পারস্পরিক সম্পদের আদান-প্রদানের কারণেও নয়। আল্লাহর শপথ ! নিশ্চয় তাদের মুখমন্ডল হবে আলোময় (ঝলমলে) তারা উপবিষ্ট থাকবে জ্যোতির তৈরি মিম্বার (মঞ্চ) সমূহে। লোকেরা যখন শঙ্কায় কাতর হবে, তখন তারা হবে নি:শঙ্কচিত্ত। মানুষ যখন শোকে কাতর হবে, তখন তারা হবে আনন্দচিত্ত। [আবু দাউদ : ৩০৬০]
অত:পর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন :—
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ [ يونس : ৬২]
আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয়-ভীতি কিংবা শোক-দু:খ নেই। [ইউনুস : ৬২]
পাঁচ : হাদিসটি প্রমাণ করে—রাসূল সা.-এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার আনুগত্য ও বন্ধুত্বের যে বিধান দিয়েছেন, তা ব্যতীত ভিন্ন কোন পথ-পদ্ধতির মাধ্যমে তা লাভের দাবি খুবই অসাড়, মিথ্যা—তাই সর্বার্থে বর্জনীয়। মুশরিকরা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের ভিন্ন উপায় হিসেবে গায়রুল্লাহর এবাদত করত কোরআনে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে আল্লাহ তাআলা বলেন—
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى ( الزمر 3)
আমরা তাদের উপাসনা শুধু এ জন্যই করি যাতে তারা আমাদের আল্লাহর নিকটস্থ করে দেয়। [যুমার : ৩]
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা ইহুদি খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে তাদের উক্তি তুলে ধরে বলেন :—
نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ ( المائدة : 17)
আমরা আল্লাহর পুত্র ও তাঁর বন্ধু। [মায়েদা : ১৭]
অথচ তারা সমস্ত রাসূলদেরই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে উদ্ধতভাবে এবং তাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য ও ফরজ-কর্মসমূহ পরিহারে তারা থাকে অটল ও অনড়।
ছয় : মুসলমানমাত্র আশা রাখে যে তার দোয়া কবুল করা হবে, গ্রহণ করা হবে তার কর্মগুলো, দান করা হবে তাকে তার প্রার্থিত বিষয়। যা থেকে সে পরিত্রান প্রার্থনা করবে, তা থেকে তাকে পরিত্রান দেয়া হবে। এগুলো মানুষের খুবই আন্তরিক ও আত্মিক বাসনা, যার সঠিক সন্ধান দিতে পারে একমাত্র ওলায়াত বা বন্ধুত্বের পথ। যে পথের পুরোটাই জুড়ে থাকবে ফরজ ও শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত-সমর্থিত নফল এবাদত—যার পিছনে কাজ করবে বিশুদ্ধ নিয়ত ও রাসূলের আনুসরণ এবং তার নির্দেশিত পথের অনুবর্তন।
عَنْ أبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ دَخَلَ المَسْجِدَ، فَدَخَلَ رَجُلٌ فَصَلَّى، ثُمَّ جَاءَ فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلّيْهِ وَسَلَّمَ، فَرَدَّ النَّبِيُّ صَلَى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ السَّلَامَ، فَقَالَ : ( اِرْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ ) فَصَلَّى، ثُمَّ جَاءَ فَسَلَّمَ عَلَى النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ : ( اِرْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ ) ثَلَاثًا .
َقالَ : وَالَّذِيْ بَعثَكَ بِالَحقِّ مَا أحْسَنَ غَيْرُهُ، فَعَلِّمْنِيْ، قَالَ : ( إذَا أقَمْتَ الصَّلَاةَ فَكَبِّرْ، ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ القُرْآنِ، ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ جَالِسًا، ثُمَّ اسْجُدْ
حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمَّ افْعَلْ ذَلِكَ فِيْ صَلَاتِكَ كُلِّهَا ) متفق عليه .
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করল। অত:পর রাসূলের নিকটে এসে তাকে সালাম করলে রাসূল তার সালামের উত্তর দিলেন এবং বললেন :—
তুমি ফিরে যাও, এবং পুনরায় সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার সালাত হয়নি। অত:পর লোকটি সালাত আদায় করল। সালাত শেষে রাসূলের কাছে এসে তাকে সালাম জানাল। রাসূল সা. এবারও বললেন, তুমি আবার ফিরে যাও, এবং সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার সালাত হয়নি। এভাবে তিনি তিনবার বললেন।
লোকটি বলল, যে সত্তা আপনাকে সত্য দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ ! আমি এর চেয়ে উত্তমরূপে আদায় করতে সক্ষম নই। সুতরাং আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি এরশাদ করলেন, যখন তুমি সালাতে দন্ডায়মান হবে, প্রথমে তাকবীর দেবে।
অত:পর কোরআন থেকে তোমার জন্য সহজ—এমন কিছু পাঠ করবে। এরপর ধীরস্থিরভাবে রুকু করবে, এবং সোজা হয়ে দন্ডায়মান হবে। তারপর সেজদারত হবে মগ্ন হয়ে, এবং সোজা হয়ে বসবে। পুনরায় সেজদায় গমন করবে, পূর্বের মত ধীরস্থিরভাবে। এভাবে তুমি তোমার সালাত সমাপ্ত করবে। [বোখারি-৭৫৭ ও মুসলিম-৩৯৭]
হাদিসের শব্দ প্রসঙ্গে :
فَدَخَلَ رَجُلٌ ব্যক্তিটি ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবি খাল্লাদ বিন রাফে রা.।
فَصَلَّى তার আদায়কৃত সালাত ছিল تحية المسجد হিসেবে।
اِرْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ অর্থাৎ, পুনরায় সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার আদায় করা সালাত তোমার জন্য যথেষ্ট নয়।
ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ القُرْآنِ আহলে ইলমের অধিকাংশের মত এই যে, হাদিসের এ অংশের দ্বারা উদ্দেশ্য হল সূরা ফাতেহা। হাদিসটির বর্ণিত ভিন্ন রেওয়ায়েত বিষয়টিকে আরো জোড়াল করে। অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে—
ثم اقرأ بأم القرآن وبما شاء অত:পর তুমি কোরআনের মূল (সূরা ফাতেহা) এবং সাথে যা ইচ্ছা তা পাঠ কর।
আহকাম ও ফায়দা :
হাদিসবেত্তাগণ একে حديث المسيء في صلاته (নামাজে যে ভুল করেছে তার সম্পর্কিত হাদিস) নামে নামকরণ করেছেন। কারণ, হাদিসটিতে বর্ণিত আছে যে, লোকটি বারবার সালাতে ভুল করছিল, এবং রাসূল তাকে পুনরায় আদায় করতে আদেশ দিচ্ছিলেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে যে, সালাতে প্রতি রাকাতে ক্বেরাত পাঠ ওয়াজিব। [বোখারি-৭৫৭ ও মুসলিম-৩৯৭] উবাদা বিন ছামেত রা. কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস বিষয়টিকে আরো দৃঢ় করে। বর্ণিত আছে, রাসূল সা. এরশাদ করেন—
لا صلاة لمن لا يقرأ بفاتحة الكتاب .
কোরআনের সূরা ফাতেহা যে পাঠ না করবে, তার সালাত হবে না। [বোখারি-৭৫৬]
ধীরস্থিরতা সালাতের অন্যতম রুকুন, ধীরস্থিরতা ব্যতীত সালাত শুদ্ধ হতে পারে না কোনভাবে। এ কারণেই রাসূল সা. লোকটিকে পুনরায় সালাত আদায়ের আদেশ দিচ্ছিলেন। সে বারংবার এ বিষয়টিতে ভুল করছিল। ধীরস্থিরতা দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসা এবং সালাতে ওয়াজিব দোয়া পাঠ করা। কিবয়াম, রুকু, রুকু হতে উঠা, সেজদা, সেজদা হতে উঠা, তাশাহ্হুদের জন্য বসা—ইত্যাদি সালাতের যাবতীয় কর্মে এই ধীরস্থিরতা আবশ্যক, অন্যথায় সালাত বাতিল বলে গণ্য হবে। [বোখারি-৭৫৭ ও মুসলিম-৩৯৭]
উক্ত হাদিসে যে সমস্ত রুকুনের উল্লেখ পাওয়া যায়, সালাতের প্রতি রাকাতে সমভাবে তা ওয়াজিব। তবে তাকবীরে তাহরীমা এর ব্যতিক্রম। কারণ, তা কেবল প্রথম রাকাতের রোকন।
যে জানে না, বুঝে না, অথবা গাফেল—তাকে শিক্ষা প্রদানের জন্য হাদিসটিতে উৎসাহব্যঞ্জক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। তবে, শর্ত এই যে, শিক্ষাপ্রদান হতে হবে বিনয়-বিনম্রতার সাথে, স্পষ্টভাবে ; কঠোরতা ও জোরজবরদস্তি ব্যতীত।
হাদিসের মাধ্যমে আমরা ছাত্র ও শিক্ষার্থীর যে সমস্ত গুণ ও আদবের পরিচয় পাই, তা এই যে—
শিক্ষকের প্রতি পরিপূর্ণ উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে মনোসংযোগ স্থাপন, যাতে শিক্ষক হতে সর্বোচ্চ উপকারিতা অর্জন সম্ভব হয়। হাদিসে বর্ণিত সাহাবি রাসূল সা.-এর প্রতি নিয়োগ করেছিলেন পরিপূর্ণ মনোসংযোগ, যাতে তার সালাত পূর্ণাঙ্গ ও উৎকর্ষমন্ডিত হওয়ার উপকরণগুলো রাসূলের কাছ থেকে ভালোভাবে শ্রবণ করে নিতে পারে।
যথোপযুক্ত শিষ্টাচার প্রদর্শন ও জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দান—যাতে শিক্ষক তাকে যা শিক্ষা দানে প্রয়াসী ও অভিপ্রায়ী, তা পূর্ণাঙ্গরূপে আয়ত্ব করা সম্ভব হয়।
শিক্ষক যা শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন, শিক্ষার্থীর নিকট যদি তা অস্পষ্ট থাকে, তবে প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা করা। শিক্ষকের উদ্দেশ্য শিক্ষার্থী যখন উপলব্ধি ও আয়ত্ব করতে সক্ষম না হবে—তখনো এ অভ্যাসের গুরুত্ব অতীব। আল্লামা মুজাহিদ রহ. মন্তব্য করেন—
لا يتعلم العلم مستح ولا مستكبر .
মুখচোরা লাজুক কিংবা অহংকারী জ্ঞান হতে বঞ্চিত। [যাদুদ দায়িয়াহ : ২০]
জ্ঞানী বা শিক্ষক তার ছাত্রদের সামনে যা উপস্থাপন করেন, তার মাঝে সবচেয়ে উপকারী ও কল্যাণকর হচ্ছে উপদেশ প্রদান। তবে তা অবশ্যই হতে হবে প্রথম শিক্ষক সা.-এর অনুকরণে, তারই বর্ণিত পথ ও পদ্ধতি অনুসারে।
শিক্ষাদান পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা আরোপ। প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করবে, যা শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে খুবই সমন্বিত ও সমঞ্জস। মানুষের জ্ঞানার্জন ক্ষমতা বিচিত্র ও খুবই স্বতন্ত্রতায় পর্যবসিত।
হাদিসটি দ্বারা তাহিয়্যাতুল মসজিদ-এর শরিয়ত সিদ্ধি প্রমাণিত হয়। হাদিসটিতে আছে যে, সাহাবি মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং দু রাকাত সালাত আদায় করলেন। উত্তমরূপে আদায় হয়নি বলে রাসূল তাকে বারংবার আদায়ের নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
সালাম প্রদান। যদিও একবার সালাম প্রদানের পর দু ব্যক্তির মাঝে সময়ের তারতম্য হয় খুবই সামান্য ও স্বল্প।
সর্বশেষ আলোচ্য ও দ্রষ্টব্য এই যে, হাদিসটি বিধৃত হয়ে আছে রাসূল সা.-এর উত্তম আচরণের বিবিধ বৈচিত্র্য দ্বারা। তার প্রতিটি ছত্রে পরিস্ফূটিত হচ্ছে রাসূলের সুষমামন্ডিত আচার ও সামাজিকতা। তার সাহাবিদের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই সামাজিক আচরণের অনুবর্তী, সহনশীল ও ভালোবাসা-প্রবণ। সুতরাং, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের এ জাতীয় যাবতীয় পরিস্থিতিতে রাসূলের একান্ত অনুসরণ কাম্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,—
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ( الأحزاب ২১)
যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ। [আহযাব : ২১]
َقالَ : وَالَّذِيْ بَعثَكَ بِالَحقِّ مَا أحْسَنَ غَيْرُهُ، فَعَلِّمْنِيْ، قَالَ : ( إذَا أقَمْتَ الصَّلَاةَ فَكَبِّرْ، ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ القُرْآنِ، ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا، ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ جَالِسًا، ثُمَّ اسْجُدْ
حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا، ثُمَّ افْعَلْ ذَلِكَ فِيْ صَلَاتِكَ كُلِّهَا ) متفق عليه .
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন। তখন এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সালাত আদায় করল। অত:পর রাসূলের নিকটে এসে তাকে সালাম করলে রাসূল তার সালামের উত্তর দিলেন এবং বললেন :—
তুমি ফিরে যাও, এবং পুনরায় সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার সালাত হয়নি। অত:পর লোকটি সালাত আদায় করল। সালাত শেষে রাসূলের কাছে এসে তাকে সালাম জানাল। রাসূল সা. এবারও বললেন, তুমি আবার ফিরে যাও, এবং সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার সালাত হয়নি। এভাবে তিনি তিনবার বললেন।
লোকটি বলল, যে সত্তা আপনাকে সত্য দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তার শপথ ! আমি এর চেয়ে উত্তমরূপে আদায় করতে সক্ষম নই। সুতরাং আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন। তিনি এরশাদ করলেন, যখন তুমি সালাতে দন্ডায়মান হবে, প্রথমে তাকবীর দেবে।
অত:পর কোরআন থেকে তোমার জন্য সহজ—এমন কিছু পাঠ করবে। এরপর ধীরস্থিরভাবে রুকু করবে, এবং সোজা হয়ে দন্ডায়মান হবে। তারপর সেজদারত হবে মগ্ন হয়ে, এবং সোজা হয়ে বসবে। পুনরায় সেজদায় গমন করবে, পূর্বের মত ধীরস্থিরভাবে। এভাবে তুমি তোমার সালাত সমাপ্ত করবে। [বোখারি-৭৫৭ ও মুসলিম-৩৯৭]
হাদিসের শব্দ প্রসঙ্গে :
فَدَخَلَ رَجُلٌ ব্যক্তিটি ছিলেন প্রখ্যাত সাহাবি খাল্লাদ বিন রাফে রা.।
فَصَلَّى তার আদায়কৃত সালাত ছিল تحية المسجد হিসেবে।
اِرْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ অর্থাৎ, পুনরায় সালাত আদায় কর, কারণ, তোমার আদায় করা সালাত তোমার জন্য যথেষ্ট নয়।
ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ القُرْآنِ আহলে ইলমের অধিকাংশের মত এই যে, হাদিসের এ অংশের দ্বারা উদ্দেশ্য হল সূরা ফাতেহা। হাদিসটির বর্ণিত ভিন্ন রেওয়ায়েত বিষয়টিকে আরো জোড়াল করে। অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে—
ثم اقرأ بأم القرآن وبما شاء অত:পর তুমি কোরআনের মূল (সূরা ফাতেহা) এবং সাথে যা ইচ্ছা তা পাঠ কর।
আহকাম ও ফায়দা :
হাদিসবেত্তাগণ একে حديث المسيء في صلاته (নামাজে যে ভুল করেছে তার সম্পর্কিত হাদিস) নামে নামকরণ করেছেন। কারণ, হাদিসটিতে বর্ণিত আছে যে, লোকটি বারবার সালাতে ভুল করছিল, এবং রাসূল তাকে পুনরায় আদায় করতে আদেশ দিচ্ছিলেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে যে, সালাতে প্রতি রাকাতে ক্বেরাত পাঠ ওয়াজিব। [বোখারি-৭৫৭ ও মুসলিম-৩৯৭] উবাদা বিন ছামেত রা. কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস বিষয়টিকে আরো দৃঢ় করে। বর্ণিত আছে, রাসূল সা. এরশাদ করেন—
لا صلاة لمن لا يقرأ بفاتحة الكتاب .
কোরআনের সূরা ফাতেহা যে পাঠ না করবে, তার সালাত হবে না। [বোখারি-৭৫৬]
ধীরস্থিরতা সালাতের অন্যতম রুকুন, ধীরস্থিরতা ব্যতীত সালাত শুদ্ধ হতে পারে না কোনভাবে। এ কারণেই রাসূল সা. লোকটিকে পুনরায় সালাত আদায়ের আদেশ দিচ্ছিলেন। সে বারংবার এ বিষয়টিতে ভুল করছিল। ধীরস্থিরতা দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসা এবং সালাতে ওয়াজিব দোয়া পাঠ করা। কিবয়াম, রুকু, রুকু হতে উঠা, সেজদা, সেজদা হতে উঠা, তাশাহ্হুদের জন্য বসা—ইত্যাদি সালাতের যাবতীয় কর্মে এই ধীরস্থিরতা আবশ্যক, অন্যথায় সালাত বাতিল বলে গণ্য হবে। [বোখারি-৭৫৭ ও মুসলিম-৩৯৭]
উক্ত হাদিসে যে সমস্ত রুকুনের উল্লেখ পাওয়া যায়, সালাতের প্রতি রাকাতে সমভাবে তা ওয়াজিব। তবে তাকবীরে তাহরীমা এর ব্যতিক্রম। কারণ, তা কেবল প্রথম রাকাতের রোকন।
যে জানে না, বুঝে না, অথবা গাফেল—তাকে শিক্ষা প্রদানের জন্য হাদিসটিতে উৎসাহব্যঞ্জক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। তবে, শর্ত এই যে, শিক্ষাপ্রদান হতে হবে বিনয়-বিনম্রতার সাথে, স্পষ্টভাবে ; কঠোরতা ও জোরজবরদস্তি ব্যতীত।
হাদিসের মাধ্যমে আমরা ছাত্র ও শিক্ষার্থীর যে সমস্ত গুণ ও আদবের পরিচয় পাই, তা এই যে—
শিক্ষকের প্রতি পরিপূর্ণ উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে মনোসংযোগ স্থাপন, যাতে শিক্ষক হতে সর্বোচ্চ উপকারিতা অর্জন সম্ভব হয়। হাদিসে বর্ণিত সাহাবি রাসূল সা.-এর প্রতি নিয়োগ করেছিলেন পরিপূর্ণ মনোসংযোগ, যাতে তার সালাত পূর্ণাঙ্গ ও উৎকর্ষমন্ডিত হওয়ার উপকরণগুলো রাসূলের কাছ থেকে ভালোভাবে শ্রবণ করে নিতে পারে।
যথোপযুক্ত শিষ্টাচার প্রদর্শন ও জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দান—যাতে শিক্ষক তাকে যা শিক্ষা দানে প্রয়াসী ও অভিপ্রায়ী, তা পূর্ণাঙ্গরূপে আয়ত্ব করা সম্ভব হয়।
শিক্ষক যা শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন, শিক্ষার্থীর নিকট যদি তা অস্পষ্ট থাকে, তবে প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা করা। শিক্ষকের উদ্দেশ্য শিক্ষার্থী যখন উপলব্ধি ও আয়ত্ব করতে সক্ষম না হবে—তখনো এ অভ্যাসের গুরুত্ব অতীব। আল্লামা মুজাহিদ রহ. মন্তব্য করেন—
لا يتعلم العلم مستح ولا مستكبر .
মুখচোরা লাজুক কিংবা অহংকারী জ্ঞান হতে বঞ্চিত। [যাদুদ দায়িয়াহ : ২০]
জ্ঞানী বা শিক্ষক তার ছাত্রদের সামনে যা উপস্থাপন করেন, তার মাঝে সবচেয়ে উপকারী ও কল্যাণকর হচ্ছে উপদেশ প্রদান। তবে তা অবশ্যই হতে হবে প্রথম শিক্ষক সা.-এর অনুকরণে, তারই বর্ণিত পথ ও পদ্ধতি অনুসারে।
শিক্ষাদান পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা আরোপ। প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোচনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করবে, যা শিক্ষাদান পদ্ধতির সাথে খুবই সমন্বিত ও সমঞ্জস। মানুষের জ্ঞানার্জন ক্ষমতা বিচিত্র ও খুবই স্বতন্ত্রতায় পর্যবসিত।
হাদিসটি দ্বারা তাহিয়্যাতুল মসজিদ-এর শরিয়ত সিদ্ধি প্রমাণিত হয়। হাদিসটিতে আছে যে, সাহাবি মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং দু রাকাত সালাত আদায় করলেন। উত্তমরূপে আদায় হয়নি বলে রাসূল তাকে বারংবার আদায়ের নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
সালাম প্রদান। যদিও একবার সালাম প্রদানের পর দু ব্যক্তির মাঝে সময়ের তারতম্য হয় খুবই সামান্য ও স্বল্প।
সর্বশেষ আলোচ্য ও দ্রষ্টব্য এই যে, হাদিসটি বিধৃত হয়ে আছে রাসূল সা.-এর উত্তম আচরণের বিবিধ বৈচিত্র্য দ্বারা। তার প্রতিটি ছত্রে পরিস্ফূটিত হচ্ছে রাসূলের সুষমামন্ডিত আচার ও সামাজিকতা। তার সাহাবিদের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই সামাজিক আচরণের অনুবর্তী, সহনশীল ও ভালোবাসা-প্রবণ। সুতরাং, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের এ জাতীয় যাবতীয় পরিস্থিতিতে রাসূলের একান্ত অনুসরণ কাম্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,—
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا ( الأحزاب ২১)
যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ। [আহযাব : ২১]
عَنْ أبِيْ هُرَيْرَةَ - رَضِيَ اللهُ عَنْهُ - قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إنَّ أثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى المُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ وَ صَلَاةُ الفَجْرِ، وَلَوْ يَعْلَمُوْنَ مَا فِيْهِمَا لَأتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا، وَلَقَدْ هَمَمْتُ أنْ آمُرَ بِالصَّلاةِ فَتُقَامَ، ثُم آمُرَ رَجُلاً فَيُصَلِّي بِالنَّاسِ، ثُمَّ أنْطَلِقُ مَعِيَ بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حَزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إلَى قَوْمٍ لَا يَشْهَدُوْنَ الصَّلَاةَ فَأحْرِقَ عَلَيْهِمْ بُيُوْتَهُمْ بِالنَّارِ . ( متفق عليه )
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—মুনাফিকদের নিকট সর্বাধিক কঠিন ও ভারী সালাত হচ্ছে এশা ও ফজরের সালাত। তাতে কি কল্যাণ ও সওয়াব নিহিত আছে, যদি তারা সে সম্পর্কে জানত, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা তাতে অংশগ্রহণ করত। কখনো কখনো আমার ইচ্ছা জাগে যে আমি সালাত আদায়ের নির্দেশ প্রদান করি, এবং তা কায়েম করা হয়, অত:পর এক ব্যক্তিকে আদেশ প্রদান করি, সে মানুষকে নিয়ে সালাত আদায় করবে ; আমি একদল লোক নিয়ে বের হব, যাদের সাথে থাকবে লাকড়ির বোঝা। আমরা খুঁজে বের করব এমন লোকদের, যারা উপস্থিত হয়নি সালাতে। আমরা তাদেরসহ তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব। [বোখারি৬৫৭, মুসলিম-৬৫১]
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
أثْقَلَ صَلَاةٍ : أثقل : শব্দটি নির্গত الثقل হতে। আধিক্যজ্ঞাপক বিশেষ্য। অর্থ : ভারী, কষ্টকর।
عَلَى المُنَافِقِينَ : অভিধানে নিফাকের মৌলিক অর্থ গোপন করা, ঢাকা। মুনাফিককে এ নামে নামকরণ করার কারণ এই যে, প্রকাশ্যে ঈমান প্রচার করলেও তার অন্তরের আড়ালে থাকে গোপন কুফর ও অবিশ্বাস। এখানে মুনাফিক দ্বারা উদ্দেশ্য—যারা প্রকাশ্যে ইসলামকে আপন ধর্ম হিসেবে প্রচার করে এবং মনে লুকিয়ে রাখে কুফর ও অবিশ্বাস।
وَلَوْ يَعْلَمُوْنَ مَا فِيْهِمَا : অর্থাৎ, এ দুই সালাতের ফজিলত ও প্রাচুর্য বিষয়ে যদি তারা অবগত হত...।
لَأتَوْهُمَا : অর্থাৎ, দু সালাতে উপস্থিত হত। তারা মসজিদে এসে জামাতের সাথে সালাতে অংশগ্রহণ করত।
وَلَوْ حَبْوًا : অর্থাৎ, হাঁটার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে তারা বুকে হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হত। আল্লামা নববী রহ. বলেন, যদি তারা এ উভয় সালাতের ফজিলত ও পরোকালিক পুরস্কারের ব্যাপারে অবগত হত, এবং কোন কারণে হামাগুড়ি ব্যতীত তাতে উপস্থিত হতে অপারগ হত, তবে তারা অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে তাতে উপস্থিত হত এবং জামাত ত্যাগ বরদাশত করত না।
وَلَقَدْ هَمَمْتُ : الهم মানে প্রত্যয়, দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ। কেউ কেউ বলেন, এর মানে দৃঢ় ইচ্ছার তুলনায় কিছুটা নিম্নস্তরের ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ করা।
আহকাম ও ফায়দা :
ফরজ সালাত মসজিদে আদায় আবশ্যক হওয়ার মৌলিক প্রমাণ হাদিসটি। কারণ রাসূল সা. উক্ত হাদিসে শরিয়ত সম্মত ওজর ব্যতীত জামাতে সালাত ত্যাগকারীর জন্য আগুনের শাস্তির উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য যে সকল নির্দেশ ও কোরআন-হাদিসের দলিল বিষয়টিকে আরো জোড়াল ও দৃঢ় করে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হল—
عن أبي هريرة -رضي الله عنه- قال أتي النبي صلي الله عليه وسلم رجل أعمى، فقال : يا رسول الله، إنه ليس لي قائد يقودني إلي المسجد، فسأل رسول الله صلي الله عليه وسلم أن يرخص له فيصلي في بيته، فرخص له، فلما ولي دعاه، فقال : هل تسمع النداء بالصلاة ؟ قال : نعم قال : فأجب . رواه مسلم : ১০৪৪
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সা.-এর নিকট এক অন্ধ ব্যক্তি উপস্থিত হল। বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে মসজিদে উপস্থিত করার মত কেউ নেই—এই বলে সে রাসূলের নিকট গৃহে সালাত আদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করল। রাসূল তাকে অনুমতি দিলেন। সে বের হয়ে পড়লে তিনি তাকে ডেকে বললেন, তুমি কি আজান শুনতে পাও ? সে উত্তর দিল, হ্যা। তিনি বললেন, তবে তুমি আজানের ডাকে সাড়া প্রদান করো। [মুসলিম-১০৪৪]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—
لقد رأيتنا وما يتخلف عن الصلاة إلا منافق قد علم نفاقه أو مريض، إن كان المريض ليمشي بين رجلين حتى يأتي الصلاة . رواه مسلم ১০৪৫
আমি আমাদের দেখেছি এমন মুনাফিক ব্যতীত কেউ জামাতে সালাত আদায় বর্জন করত না, যার নেফাক সম্পর্কে সকলে অবগত হয়ে গিয়েছে কিংবা যে অসুস্থ—এমনকি প্রবল অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিও দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে সালাতে উপস্থিত হত। [মুসলিম-১০৪৫]
জামাতে সালাত আদায়ের রয়েছে প্রভূত ফজিলত ও অসংখ্য সওয়াব। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে যে, রাসূল সা. বলেছেন—
صلاة الرجل في الجماعة تضعف علي صلاته في بيته وفي سوقه خمسا وعشرين ضعفا، وذلك أنه إذا توضأ فأحسن الوضوء ثم خرج إلي المسجد لا يخرجه إلا الصلاة لم يخط خطوة إلا رفعت له به درجة، وحط عنه به خطيئة، فإذا صلي لم تزل الملائكة تصلي عليه ما دام في مصلاه، اللهم صل عليه، اللهم ارحمه، ولا يزال أحدكم في صلاة ما انتظر الصلاة . رواه مسلم : ৬১১
ব্যক্তির জামাতে সালাত আদায় তার গৃহে একাকী কিংবা বাজারে সালাত আদায়ের তুলনায় পঁচিশ গুণ বেশি সওয়াব বয়ে আনে। কারণ সে যখন উত্তমরূপে ওজু করে কেবল মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন প্রতি পদক্ষেপে একটি করে তার দরজা (মর্যাদা) বুলন্দ হয়, এবং ক্ষালণ হয় একটি করে পাপ। সালাত শেষে যতক্ষণ সে সালাতের স্থানে অবস্থান করে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকেন—আল্লাহ, তাকে দয়া করুন ; আল্লাহ তাকে রহমতে ভূষিত করুন। তোমাদের সালাতের অপেক্ষাও সালাতের অংশ হিসেবে ধর্তব্য। [মুসলিম-৬১১]
মসজিদে এশা ও ফজরের সালাত আদায়ের রয়েছে প্রভূত সওয়াব ও ফজিলত। রাসূল সা. বিষয়টির গুরুত্ব ও পরোকালে এর মহান পুরস্কারের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যে ব্যক্তি এর ফজিলত বিষয়ে অবগতি লাভ করবে, শিশুর মত হামাগুড়ি দিয়ে হলেও সে তাতে অংশগ্রহণে সচেষ্ট হবে। এশা ও ফজরের সালাত জামাতভুক্তিতে আদায়ের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণ করে ভিন্ন একটি হাদিস, যা উসমান বিন আফফান রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছেন—
من صلي العشاء في جماعة فكأنما قام نصف الليل، ومن صلى الصبح في جماعة فكأنما صلى الليل كله .
যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল সে যেন অর্ধ রাত্রি এবাদতে কাটিয়ে দিল। আর যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করল সে যেন পুরো রাত্রিই সালাতে যাপন করল। [মুসলিম- ৬৫৬]
ফজরের সালাত আদায়কারীর পুরস্কার বর্ণনা প্রসঙ্গে জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—
من صلي الصبح فهو في ذمة الله، فلا يطلبنكم الله من ذمته بشيء، فإنه من يطلبه من ذمته بشئ يدركه، ثم يكبه علي وجهه في نار جهنم .
যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল, সে আল্লাহর জিম্মায়। আল্লাহ যেন নিজের জিম্মা বিষয়ে তোমাদের থেকে কিছু তলব না করেন। কারণ, এ ব্যাপারে তিনি যার কাছ থেকে তলব করেন, তাকে তিনি পাকড়াও করেন, অত:পর জাহান্নামের আগুনের তাকে উপুর করে নিক্ষেপ করেন। [মুসলিম- ২৬১, তিরমিজি-৩৯৪৬]
ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায়ের ক্ষেত্রে যা ব্যক্তির জন্য সহায়ক :
সালাত আদায়ের জন্য ভোরে নিদ্রা হতে জাগরণের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়।
এ ব্যাপারে সহায়তার জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন।
রাতের প্রথম ভাগে দ্রুত নিদ্রায় গমন, যাতে শরীর উৎফুল্ল ও সতেজ থাকে।
ঘুমানো ও ঘুম হতে জাগরণকালীন দোয়া নিয়মিত আদায় করা।
সহায়ক অন্যান্য উপায় অবলম্বন। যেমন : এলার্ম ইত্যাদির সহায়তা গ্রহণ, যাতে সঠিক সময়ে নিদ্রা হতে জাগতে পারে।
শরয়ি বৈধ কোন কারণ ব্যতীত যে ব্যক্তি জামাতে এশা ও ফজরের সালাত আদায় বর্জন করল, সে নিজেকে ঠেলে দিল এক ভয়াবহ বিপদ ও পাপের মুখে। দলভুক্ত হল মুনাফিকদের। এ দু সালাত ত্যাগকারীদের ব্যাপারে রাসূল সা. ছিলেন অত্যন্ত ক্রোধান্বিত। তিনি ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন এদের ঘরবাড়িসহ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার।
নিফাক খুবই মন্দ স্বভাব ও ভয়াবহ চারিত্রিক বিপদের কারণ। এমন কোন ব্যক্তি বা দল নেই, এ মন্দতায় আক্রান্ত হওয়ার পরও আল্লাহ যাদের ধ্বংস করেননি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ
‘নিশ্চয় মুনাফিকগণ জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থান করবে।’ [সূরা নিসা : আয়াত ১৪৫]
মুনাফিকদের দোষগুলো কী কী—নিম্নে সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা হবে—
অন্তরে কুফরকে স্থান দিলেও প্রকাশ্যে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় প্রদান করা।
এবাদত পালন খুব ভারী বোঝা মনে হওয়া—বিশেষত: এশা ও ফজর সালাতের ক্ষেত্রে। কারণ, এ সময় শয়তান ক্রমাগত মন্ত্রণা দেয় তা বর্জন করার জন্য। তা ছাড়া এশা হচ্ছে প্রশান্তি ও বিশ্রামের সময়, ফজরের সময়ে নিদ্রার স্বাদ অতুলনীয়।
মুনাফিকরা তাদের যে কোন ধর্মীয় কর্ম পালন করে প্রশংসা কুড়ানো ও লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে। তারা যাকে উত্তম মনে করে তাকে আরো উত্তম হিসেবে লোকসমাজে প্রকাশের জন্য লালায়িত হয়। লোক-সমাবেশের স্থলে তারা হাজির হয়, সকলের সামনে নিজেকে প্রদর্শনীয় করে উত্থাপন করে। যখন কেউ দেখে না, তিরোহিত হয় বিন্দুমাত্র প্রশংসা প্রাপ্তির সম্ভাবনা—তখন তারা অন্তর্হিত হয়।
পার্থিব উপার্জনের জন্য তারা প্রবলভাবে হয় লালায়িত—যদিও তা হয় এবাদত পালনের মাধ্যমে। এক রেওয়ায়েতে এসেছে—
والذي نفسي بيده لو يعلم أحدهم أنه يجد عرقا سمينا أو مرماتين حسنتين لشهد العشاء . رواه البخاري
ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ ! তাদের কেউ যদি জানত যে, মসজিদে এলে গোশত ভর্তি উটের হাড় পাওয়া যাবে, কিংবা পাওয়া যাবে বকরির ক্ষুর-দ্বয়ের মধ্যবর্তী উৎকৃষ্ট মাংস, তবে সে অবশ্যই এশার সালাতে উপস্থিত হত। [বোখারি]
কল্যাণ সাধনের তুলনায় অকল্যাণ রোধ প্রথমে আবশ্যক—শরিয়তের এ এক মৌলিক নীতি। রাসূল সা. তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে দেননি কেবল এ কারণেই যে, এর ফলে অসহায় নারী-শিশুরা আক্রান্ত হবে, যারা এ হুকুমের আওতাভুক্ত নয়।
ইসলাম—নি:সন্দেহে, মুসলমানদের জন্য প্রণীত একটি পূর্ণাঙ্গ মৌলিক পদ্ধতি, জীবনের প্রতিটি অনুসঙ্গে মুসলমানগণ যাকে আঁকড়ে ও লালন করে জীবনযাপন করবে। এ পদ্ধতির সূচনাতেই যার অবস্থান, তা হচ্ছে এবাদত—যার মাধ্যমে বান্দা মাওলার নৈকট্যের পরম স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হয়। এ পদ্ধতির অন্যতম অংশ হচ্ছে দিবস ও রজনির সালাতগুলো সঠিক সময়ে, নিয়মবদ্ধরূপে জামাতের সাথে আদায় করা। শরয়ি কোন কারণ ব্যতীত তা বর্জনের দু:সাহস না করা।
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—মুনাফিকদের নিকট সর্বাধিক কঠিন ও ভারী সালাত হচ্ছে এশা ও ফজরের সালাত। তাতে কি কল্যাণ ও সওয়াব নিহিত আছে, যদি তারা সে সম্পর্কে জানত, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা তাতে অংশগ্রহণ করত। কখনো কখনো আমার ইচ্ছা জাগে যে আমি সালাত আদায়ের নির্দেশ প্রদান করি, এবং তা কায়েম করা হয়, অত:পর এক ব্যক্তিকে আদেশ প্রদান করি, সে মানুষকে নিয়ে সালাত আদায় করবে ; আমি একদল লোক নিয়ে বের হব, যাদের সাথে থাকবে লাকড়ির বোঝা। আমরা খুঁজে বের করব এমন লোকদের, যারা উপস্থিত হয়নি সালাতে। আমরা তাদেরসহ তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব। [বোখারি৬৫৭, মুসলিম-৬৫১]
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
أثْقَلَ صَلَاةٍ : أثقل : শব্দটি নির্গত الثقل হতে। আধিক্যজ্ঞাপক বিশেষ্য। অর্থ : ভারী, কষ্টকর।
عَلَى المُنَافِقِينَ : অভিধানে নিফাকের মৌলিক অর্থ গোপন করা, ঢাকা। মুনাফিককে এ নামে নামকরণ করার কারণ এই যে, প্রকাশ্যে ঈমান প্রচার করলেও তার অন্তরের আড়ালে থাকে গোপন কুফর ও অবিশ্বাস। এখানে মুনাফিক দ্বারা উদ্দেশ্য—যারা প্রকাশ্যে ইসলামকে আপন ধর্ম হিসেবে প্রচার করে এবং মনে লুকিয়ে রাখে কুফর ও অবিশ্বাস।
وَلَوْ يَعْلَمُوْنَ مَا فِيْهِمَا : অর্থাৎ, এ দুই সালাতের ফজিলত ও প্রাচুর্য বিষয়ে যদি তারা অবগত হত...।
لَأتَوْهُمَا : অর্থাৎ, দু সালাতে উপস্থিত হত। তারা মসজিদে এসে জামাতের সাথে সালাতে অংশগ্রহণ করত।
وَلَوْ حَبْوًا : অর্থাৎ, হাঁটার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে তারা বুকে হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হত। আল্লামা নববী রহ. বলেন, যদি তারা এ উভয় সালাতের ফজিলত ও পরোকালিক পুরস্কারের ব্যাপারে অবগত হত, এবং কোন কারণে হামাগুড়ি ব্যতীত তাতে উপস্থিত হতে অপারগ হত, তবে তারা অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে তাতে উপস্থিত হত এবং জামাত ত্যাগ বরদাশত করত না।
وَلَقَدْ هَمَمْتُ : الهم মানে প্রত্যয়, দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ। কেউ কেউ বলেন, এর মানে দৃঢ় ইচ্ছার তুলনায় কিছুটা নিম্নস্তরের ইচ্ছাশক্তি প্রকাশ করা।
আহকাম ও ফায়দা :
ফরজ সালাত মসজিদে আদায় আবশ্যক হওয়ার মৌলিক প্রমাণ হাদিসটি। কারণ রাসূল সা. উক্ত হাদিসে শরিয়ত সম্মত ওজর ব্যতীত জামাতে সালাত ত্যাগকারীর জন্য আগুনের শাস্তির উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য যে সকল নির্দেশ ও কোরআন-হাদিসের দলিল বিষয়টিকে আরো জোড়াল ও দৃঢ় করে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হল—
عن أبي هريرة -رضي الله عنه- قال أتي النبي صلي الله عليه وسلم رجل أعمى، فقال : يا رسول الله، إنه ليس لي قائد يقودني إلي المسجد، فسأل رسول الله صلي الله عليه وسلم أن يرخص له فيصلي في بيته، فرخص له، فلما ولي دعاه، فقال : هل تسمع النداء بالصلاة ؟ قال : نعم قال : فأجب . رواه مسلم : ১০৪৪
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূল সা.-এর নিকট এক অন্ধ ব্যক্তি উপস্থিত হল। বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে মসজিদে উপস্থিত করার মত কেউ নেই—এই বলে সে রাসূলের নিকট গৃহে সালাত আদায়ের অনুমতি প্রার্থনা করল। রাসূল তাকে অনুমতি দিলেন। সে বের হয়ে পড়লে তিনি তাকে ডেকে বললেন, তুমি কি আজান শুনতে পাও ? সে উত্তর দিল, হ্যা। তিনি বললেন, তবে তুমি আজানের ডাকে সাড়া প্রদান করো। [মুসলিম-১০৪৪]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—
لقد رأيتنا وما يتخلف عن الصلاة إلا منافق قد علم نفاقه أو مريض، إن كان المريض ليمشي بين رجلين حتى يأتي الصلاة . رواه مسلم ১০৪৫
আমি আমাদের দেখেছি এমন মুনাফিক ব্যতীত কেউ জামাতে সালাত আদায় বর্জন করত না, যার নেফাক সম্পর্কে সকলে অবগত হয়ে গিয়েছে কিংবা যে অসুস্থ—এমনকি প্রবল অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিও দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে সালাতে উপস্থিত হত। [মুসলিম-১০৪৫]
জামাতে সালাত আদায়ের রয়েছে প্রভূত ফজিলত ও অসংখ্য সওয়াব। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে যে, রাসূল সা. বলেছেন—
صلاة الرجل في الجماعة تضعف علي صلاته في بيته وفي سوقه خمسا وعشرين ضعفا، وذلك أنه إذا توضأ فأحسن الوضوء ثم خرج إلي المسجد لا يخرجه إلا الصلاة لم يخط خطوة إلا رفعت له به درجة، وحط عنه به خطيئة، فإذا صلي لم تزل الملائكة تصلي عليه ما دام في مصلاه، اللهم صل عليه، اللهم ارحمه، ولا يزال أحدكم في صلاة ما انتظر الصلاة . رواه مسلم : ৬১১
ব্যক্তির জামাতে সালাত আদায় তার গৃহে একাকী কিংবা বাজারে সালাত আদায়ের তুলনায় পঁচিশ গুণ বেশি সওয়াব বয়ে আনে। কারণ সে যখন উত্তমরূপে ওজু করে কেবল মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন প্রতি পদক্ষেপে একটি করে তার দরজা (মর্যাদা) বুলন্দ হয়, এবং ক্ষালণ হয় একটি করে পাপ। সালাত শেষে যতক্ষণ সে সালাতের স্থানে অবস্থান করে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকেন—আল্লাহ, তাকে দয়া করুন ; আল্লাহ তাকে রহমতে ভূষিত করুন। তোমাদের সালাতের অপেক্ষাও সালাতের অংশ হিসেবে ধর্তব্য। [মুসলিম-৬১১]
মসজিদে এশা ও ফজরের সালাত আদায়ের রয়েছে প্রভূত সওয়াব ও ফজিলত। রাসূল সা. বিষয়টির গুরুত্ব ও পরোকালে এর মহান পুরস্কারের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যে ব্যক্তি এর ফজিলত বিষয়ে অবগতি লাভ করবে, শিশুর মত হামাগুড়ি দিয়ে হলেও সে তাতে অংশগ্রহণে সচেষ্ট হবে। এশা ও ফজরের সালাত জামাতভুক্তিতে আদায়ের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণ করে ভিন্ন একটি হাদিস, যা উসমান বিন আফফান রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলছেন—
من صلي العشاء في جماعة فكأنما قام نصف الليل، ومن صلى الصبح في جماعة فكأنما صلى الليل كله .
যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল সে যেন অর্ধ রাত্রি এবাদতে কাটিয়ে দিল। আর যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করল সে যেন পুরো রাত্রিই সালাতে যাপন করল। [মুসলিম- ৬৫৬]
ফজরের সালাত আদায়কারীর পুরস্কার বর্ণনা প্রসঙ্গে জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—
من صلي الصبح فهو في ذمة الله، فلا يطلبنكم الله من ذمته بشيء، فإنه من يطلبه من ذمته بشئ يدركه، ثم يكبه علي وجهه في نار جهنم .
যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল, সে আল্লাহর জিম্মায়। আল্লাহ যেন নিজের জিম্মা বিষয়ে তোমাদের থেকে কিছু তলব না করেন। কারণ, এ ব্যাপারে তিনি যার কাছ থেকে তলব করেন, তাকে তিনি পাকড়াও করেন, অত:পর জাহান্নামের আগুনের তাকে উপুর করে নিক্ষেপ করেন। [মুসলিম- ২৬১, তিরমিজি-৩৯৪৬]
ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায়ের ক্ষেত্রে যা ব্যক্তির জন্য সহায়ক :
সালাত আদায়ের জন্য ভোরে নিদ্রা হতে জাগরণের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়।
এ ব্যাপারে সহায়তার জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জ্ঞাপন।
রাতের প্রথম ভাগে দ্রুত নিদ্রায় গমন, যাতে শরীর উৎফুল্ল ও সতেজ থাকে।
ঘুমানো ও ঘুম হতে জাগরণকালীন দোয়া নিয়মিত আদায় করা।
সহায়ক অন্যান্য উপায় অবলম্বন। যেমন : এলার্ম ইত্যাদির সহায়তা গ্রহণ, যাতে সঠিক সময়ে নিদ্রা হতে জাগতে পারে।
শরয়ি বৈধ কোন কারণ ব্যতীত যে ব্যক্তি জামাতে এশা ও ফজরের সালাত আদায় বর্জন করল, সে নিজেকে ঠেলে দিল এক ভয়াবহ বিপদ ও পাপের মুখে। দলভুক্ত হল মুনাফিকদের। এ দু সালাত ত্যাগকারীদের ব্যাপারে রাসূল সা. ছিলেন অত্যন্ত ক্রোধান্বিত। তিনি ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন এদের ঘরবাড়িসহ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার।
নিফাক খুবই মন্দ স্বভাব ও ভয়াবহ চারিত্রিক বিপদের কারণ। এমন কোন ব্যক্তি বা দল নেই, এ মন্দতায় আক্রান্ত হওয়ার পরও আল্লাহ যাদের ধ্বংস করেননি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ
‘নিশ্চয় মুনাফিকগণ জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে অবস্থান করবে।’ [সূরা নিসা : আয়াত ১৪৫]
মুনাফিকদের দোষগুলো কী কী—নিম্নে সে ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা হবে—
অন্তরে কুফরকে স্থান দিলেও প্রকাশ্যে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় প্রদান করা।
এবাদত পালন খুব ভারী বোঝা মনে হওয়া—বিশেষত: এশা ও ফজর সালাতের ক্ষেত্রে। কারণ, এ সময় শয়তান ক্রমাগত মন্ত্রণা দেয় তা বর্জন করার জন্য। তা ছাড়া এশা হচ্ছে প্রশান্তি ও বিশ্রামের সময়, ফজরের সময়ে নিদ্রার স্বাদ অতুলনীয়।
মুনাফিকরা তাদের যে কোন ধর্মীয় কর্ম পালন করে প্রশংসা কুড়ানো ও লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে। তারা যাকে উত্তম মনে করে তাকে আরো উত্তম হিসেবে লোকসমাজে প্রকাশের জন্য লালায়িত হয়। লোক-সমাবেশের স্থলে তারা হাজির হয়, সকলের সামনে নিজেকে প্রদর্শনীয় করে উত্থাপন করে। যখন কেউ দেখে না, তিরোহিত হয় বিন্দুমাত্র প্রশংসা প্রাপ্তির সম্ভাবনা—তখন তারা অন্তর্হিত হয়।
পার্থিব উপার্জনের জন্য তারা প্রবলভাবে হয় লালায়িত—যদিও তা হয় এবাদত পালনের মাধ্যমে। এক রেওয়ায়েতে এসেছে—
والذي نفسي بيده لو يعلم أحدهم أنه يجد عرقا سمينا أو مرماتين حسنتين لشهد العشاء . رواه البخاري
ঐ সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ ! তাদের কেউ যদি জানত যে, মসজিদে এলে গোশত ভর্তি উটের হাড় পাওয়া যাবে, কিংবা পাওয়া যাবে বকরির ক্ষুর-দ্বয়ের মধ্যবর্তী উৎকৃষ্ট মাংস, তবে সে অবশ্যই এশার সালাতে উপস্থিত হত। [বোখারি]
কল্যাণ সাধনের তুলনায় অকল্যাণ রোধ প্রথমে আবশ্যক—শরিয়তের এ এক মৌলিক নীতি। রাসূল সা. তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে দেননি কেবল এ কারণেই যে, এর ফলে অসহায় নারী-শিশুরা আক্রান্ত হবে, যারা এ হুকুমের আওতাভুক্ত নয়।
ইসলাম—নি:সন্দেহে, মুসলমানদের জন্য প্রণীত একটি পূর্ণাঙ্গ মৌলিক পদ্ধতি, জীবনের প্রতিটি অনুসঙ্গে মুসলমানগণ যাকে আঁকড়ে ও লালন করে জীবনযাপন করবে। এ পদ্ধতির সূচনাতেই যার অবস্থান, তা হচ্ছে এবাদত—যার মাধ্যমে বান্দা মাওলার নৈকট্যের পরম স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হয়। এ পদ্ধতির অন্যতম অংশ হচ্ছে দিবস ও রজনির সালাতগুলো সঠিক সময়ে, নিয়মবদ্ধরূপে জামাতের সাথে আদায় করা। শরয়ি কোন কারণ ব্যতীত তা বর্জনের দু:সাহস না করা।
عَنِ بْنِ عَبَّاسٍ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا- عَنِ النَّبِيِّ- صَلَى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فِيْمَا يَرْوِيْ عَنْ رَّبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ، قَالَ : إنَّ اللهَ كَتَبَ الَحسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ، ثُمَّ بَيْنَ ذَلِكَ، فَمَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإنْ هُوَ هَمَّ بِهِ فَعَمِلَهِا كَتَبَهَا اللهُ عِنْدَهُ عَشَرَ حَسَنَاتٍ إلَى سَبْعِمِائةِ ضِعْفٍ، إلَى أضْعَافٍ كَثِيْرَةٍ، وَمَنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلَةً، فَإنْ هُوَ هَمَّ بِهَا فَعَمِلَهَا كَتَبَهَا اللهُ لَهُ سَيِّئَةً وَاحِدَةً . ( متفق عليه )
ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. এক হাদিসে কুদসীতে এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, তিনি যাবতীয় ভালো ও গর্হিত কাজ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। অত:পর তিনি তা বিশদভাবে বর্ণনা করে বলেন—যে ব্যক্তি মনে মনে একটি ভালো কাজের ইচ্ছা পোষণ করল, কিন্তু তা কর্মে পরিণত করল না, আল্লাহ তার নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দেন। আর যদি সে ইচ্ছা পোষণ করার সাথে তা কর্মেও পরিণত করে, তবে তিনি তার নামে দশ হতে সাত শত গুণ অবধি—কিংবা তারও বেশি—সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দেন। আর যে ব্যক্তি অসৎ-কর্মের ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করার পরও তা কর্মে পরিণত না করে, আল্লাহ তার জন্য একটি সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দেন। আর যদি ইচ্ছা করার সাথে সাথে তা কর্মে পরিণত করে, তবে তার নামে কেবল একটি মন্দ-কর্ম লিপিবদ্ধ করেন।
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
- فِيْمَا يَرْوِيْ عَنْ رَّبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ : (যা তিনি বর্ণনা করেন নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে) হাদিসে কুদসি বর্ণনার একটি পদ্ধতি।
إنَّ اللهَ كَتَبَ الَحسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ : হতে পারে এটি আল্লাহর কালামেরই একটি অংশ। তখন ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন’—বাক্যাংশটিকে বাক্যের অনুক্ত অংশ ধরা হবে। কিংবা হতে পারে এটি রাসূল সা.-এর কথন, যাতে তিনি আল্লাহ তাআলার একটি কর্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
كَتَبَ : আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে লিপিবদ্ধ করণে নির্দেশ প্রদান করলেন। কেউ কেউ বলেন, এখানে একটি অনুল্লেখ্য ঊহ্য অংশ রয়েছে—‘ফেরেশতাদের মধ্য হতে লিপিকারদের সে ব্যাপারে জ্ঞাত করালেন’—সেই ঊহ্য অংশ।
ثُمَّ بَيْنَ ذَلِكَ : অর্থাৎ আল্লাহ তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করলেন। এবং পরবর্তী বক্তব্যের মাধ্যমে তা বিশদ করে দিয়েছেন।
فَمَنْ هَمَّ : الهم অর্থ ইচ্ছাকে কর্মে রূপদানের কামনা ত্বরান্বিত করা। هممت بكذا অর্থাৎ ইচ্ছার মাধ্যমে কাজটি করার দৃঢ় অবস্থানে উন্নীত হয়েছি। অস্থায়ী ও খুবই সাময়িক ইচ্ছার তুলনায় এটি কিছুটা দৃঢ় ও কর্মে পরিণত করার সংকল্পে অনড়। কেউ কেউ বলেন, বাক্যাংশটির স্বাভাবিক অর্থই গৃহীত হবে ; অর্থ : إذا أراد (যখন সে ইচ্ছা করল)।
فَلَمْ يَعْمَلْهَا : অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা অন্তরের মাধ্যমে সে তাকে কর্মে পরিণতি দান করেনি।
আহকাম ও ফায়দা :
হাদিসের মূল আলোচ্য বিষয় আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব, ফজিলত ও মহানুভবতা। তিনি বান্দাকে এই সম্মানে ভূষিত করেছেন যে, কেবল কর্মের ইচ্ছার কারণেই তিনি বান্দার নামে সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দিচ্ছেন। আর যখন তা কর্মে পরিণত হয়,—হোক তা আত্মিক বা শারীরিক কর্ম—তখন তিনি তা বৃদ্ধি করে দেন দশ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত। কিংবা অবস্থার তারতম্যে আরো বেশি বাড়িয়ে দেন।
তাত্ত্বিকদের মত এই যে, সাত শত গুণ কিংবা তারও বেশিতে সৎকর্ম রূপান্তরিত হওয়ার কারণ হল, সৎকর্ম সম্পাদনকালীন বান্দার এখলাস ও আন্তরিকতা কখনো কখনো স্বাভাবিকতার তুলনায় বৃদ্ধি পায়, জন্ম নেয় তার মাঝে অটল দৃঢ়তা, অন্তরের যাবতীয় সজাগ অনুভূতিগুলো কেন্দ্রীভূত হয় সেই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে—কিংবা সে যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার কল্যাণ ও উপকারিতা অব্যাহত থাকে দীর্ঘ দিন, ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক—যেমন সদকায়ে জারিয়া, জ্ঞানের উৎসারণ, সুন্নতে হাসানা—ইত্যাদি। এর ফলে আল্লাহ তাআলা তার সৎকর্মের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে, মোমিনদের অন্তরে পাপের যে চিন্তা হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তৎক্ষণাৎ দূরীভূত হয়, তা কর্মে পরিণত করার ইচ্ছা পোষণ করে না দৃঢ়ভাবে, কিংবা চিন্তাটি তার মাঝে স্থায়িত্ব লাভ করে না,—এর ব্যাপারে আল্লাহ তাদের পাকড়াও করবেন না। অন্তরে ইচ্ছার উদয়ের পরও যদি তারা তা হতে বিরত থাকে, তবে তাদের নামে একটি সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করা হবে। আর যদি কর্মে পরিণত করে, তবে তাদের নামে একটি অপকর্মই কেবল লিপিবদ্ধ করা হবে। সৎকর্মের অনুরূপ একে বৃদ্ধি করা হবে না। বিষয়টিকে জোড়াল করে আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত একটি হাদিস, যাতে রাসূল সা. এরশাদ করেছেন—
إن الله تجاوز لأمتي ما حدثت به أنفسها مالم يتكلموا أو يعملوا به .
আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের অন্তরে যে পাপের চিন্তার উদয় হয়, তা ক্ষমা করে দেন—যতক্ষণ না তারা সে বিষয়ে আলোচনা করে, কিংবা কর্মে পরিণত করে। [মুসলিম : ১৮১]
বান্দা এ পার্থিব জগতে যে কর্মেই অংশ নেয়—ছোট হোক কিংবা বড়, সূক্ষ্ম হোক কিংবা স্থূল,—আল্লাহ তা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে—
وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآَثَارَهُمْ
অর্থাৎ, আমি তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করে রাখি। [সূরা ইয়াছিন ১২]
অপর এক স্থানে উল্লেখ হয়েছে যে—
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا ( الكهف ৪৯)
আর আমলনামা সামনে রাখা হবে, তাতে যা আছে তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে : হায় আফসোস ! এ কেমন আমলনামা ! এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি—সবই এতে রয়েছে ! তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি জুলুম করবেন না। [কাহাফ : ৪৯]
তিনি আরো এরশাদ করেন—-
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ ﴿7﴾ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ ﴿8﴾ ( الزلزلة )
যে ব্যক্তি অংশ নিবে অনু পরিমাণ সৎকর্মে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে অংশ নিবে অনু পরিমাণ অসৎকর্মে, সেও তা দেখতে পাবে। [সূরা যিলযাল : ৭-৮]
মুসলমানের কর্তব্য এই যে, সে সদা সতর্ক থাকবে যেন সৎকর্ম ব্যতীত তার লিপিকায় অন্য কিছুই স্থান না পায়। যখন তার অন্তর সৎকর্মচ্যুত হবে, কিংবা উদ্রেক হবে পাপ-চিন্তার, তৎক্ষণাৎ সে তওবা, ইস্তেগফার ও অনুশোচনার মাধ্যমে নিজেকে শুধরে নিবে।
মানুষ কখনো কখনো ভাবে যে, তার প্রবৃত্তি ও মনোবাসনার আস্বাদগুলো নিহিত আছে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ পাপকর্মে। যখন বান্দা তার প্রভুর কারণে, তার প্রতিদান প্রাপ্তির আশায়, শাস্তির ভয়ে তা ত্যাগ করবে—নিশ্চয় এর ফলে সে পুরস্কার প্রাপ্ত হবে, তাকে দান করা হবে অশেষ সওয়াব।
হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, বৈধ কাজের কারণে মানুষের জন্য কোন সওয়াব বা শাস্তির বিধান দেওয়া হয় না, যতক্ষণ না এর পিছনে কাজ করে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ নিয়ত। বৈধ কাজগুলো শুদ্ধ বা অশুদ্ধ নিয়তের ফলে সৎ বা অসৎকর্মে পরিণত হয়।
বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার অশেষ মহানুভবতা এই যে, মানুষের সৎকর্মের ইচ্ছাগুলোকে তিনি পরিপূর্ণ সৎকর্মের স্থান দান করেছেন—যদিও সে তা কর্মে পরিণত না করে। এমনিভাবে মানুষ যখন সৎকর্ম আরম্ভ করার পর কোন প্রকার বাধা-প্রাপ্তির ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়—সে ক্ষেত্রেও একই হুকুম। উদাহরণত: কেউ রাত জেগে এবাদতের ইচ্ছা করল, অত:পর নিদ্রাকাতর হয়ে পড়ল কিংবা আক্রান্ত হল অসুস্থতায়—এ সকল অবস্থায় কর্মটি সমাপ্ত না হলেও তার নামে সৎকর্মটি লিপিবদ্ধ করা হবে।
আল্লাহ তাআলার এ মহান মহানুভবতার—সৎকর্ম সাত শত গুণ বা তারও বেশি বৃদ্ধি, পাপের ইচ্ছা উদয় হওয়ার পরও তা লিপিবদ্ধ না করা,—আরেকটি দিক এই যে, তিনি সৎকর্মের মাধ্যমে অসৎকর্মগুলো মুছে দেন। পবিত্র কোরআনে তিনি এরশাদ করেন—
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ ( هود : 114)
দিনের দুই প্রান্তেই সালাত কায়েম করবে এবং রাতের প্রান্ত-ভাগে। পুণ্য কর্ম অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়। [হুদ : ১১৪]
আবু যরকে সম্বোধন করে রাসূল সা. এরশাদ করেছেন—
اتق الله حيثما كنت، وأتبع السيئة الحسنة تمحها، وخالق الناس بخلق حسن .
যেখানেই অবস্থান করো, আল্লাহকে ভয় কর। পাপের পর সৎকর্ম করো, যা তাকে মুছে দেবে। মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করো। [তিরমিজী ১৯১০]
ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. এক হাদিসে কুদসীতে এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, তিনি যাবতীয় ভালো ও গর্হিত কাজ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। অত:পর তিনি তা বিশদভাবে বর্ণনা করে বলেন—যে ব্যক্তি মনে মনে একটি ভালো কাজের ইচ্ছা পোষণ করল, কিন্তু তা কর্মে পরিণত করল না, আল্লাহ তার নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দেন। আর যদি সে ইচ্ছা পোষণ করার সাথে তা কর্মেও পরিণত করে, তবে তিনি তার নামে দশ হতে সাত শত গুণ অবধি—কিংবা তারও বেশি—সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দেন। আর যে ব্যক্তি অসৎ-কর্মের ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করার পরও তা কর্মে পরিণত না করে, আল্লাহ তার জন্য একটি সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দেন। আর যদি ইচ্ছা করার সাথে সাথে তা কর্মে পরিণত করে, তবে তার নামে কেবল একটি মন্দ-কর্ম লিপিবদ্ধ করেন।
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
- فِيْمَا يَرْوِيْ عَنْ رَّبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ : (যা তিনি বর্ণনা করেন নিজ প্রতিপালকের পক্ষ হতে) হাদিসে কুদসি বর্ণনার একটি পদ্ধতি।
إنَّ اللهَ كَتَبَ الَحسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ : হতে পারে এটি আল্লাহর কালামেরই একটি অংশ। তখন ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন’—বাক্যাংশটিকে বাক্যের অনুক্ত অংশ ধরা হবে। কিংবা হতে পারে এটি রাসূল সা.-এর কথন, যাতে তিনি আল্লাহ তাআলার একটি কর্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
كَتَبَ : আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে লিপিবদ্ধ করণে নির্দেশ প্রদান করলেন। কেউ কেউ বলেন, এখানে একটি অনুল্লেখ্য ঊহ্য অংশ রয়েছে—‘ফেরেশতাদের মধ্য হতে লিপিকারদের সে ব্যাপারে জ্ঞাত করালেন’—সেই ঊহ্য অংশ।
ثُمَّ بَيْنَ ذَلِكَ : অর্থাৎ আল্লাহ তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করলেন। এবং পরবর্তী বক্তব্যের মাধ্যমে তা বিশদ করে দিয়েছেন।
فَمَنْ هَمَّ : الهم অর্থ ইচ্ছাকে কর্মে রূপদানের কামনা ত্বরান্বিত করা। هممت بكذا অর্থাৎ ইচ্ছার মাধ্যমে কাজটি করার দৃঢ় অবস্থানে উন্নীত হয়েছি। অস্থায়ী ও খুবই সাময়িক ইচ্ছার তুলনায় এটি কিছুটা দৃঢ় ও কর্মে পরিণত করার সংকল্পে অনড়। কেউ কেউ বলেন, বাক্যাংশটির স্বাভাবিক অর্থই গৃহীত হবে ; অর্থ : إذا أراد (যখন সে ইচ্ছা করল)।
فَلَمْ يَعْمَلْهَا : অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা অন্তরের মাধ্যমে সে তাকে কর্মে পরিণতি দান করেনি।
আহকাম ও ফায়দা :
হাদিসের মূল আলোচ্য বিষয় আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব, ফজিলত ও মহানুভবতা। তিনি বান্দাকে এই সম্মানে ভূষিত করেছেন যে, কেবল কর্মের ইচ্ছার কারণেই তিনি বান্দার নামে সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করে দিচ্ছেন। আর যখন তা কর্মে পরিণত হয়,—হোক তা আত্মিক বা শারীরিক কর্ম—তখন তিনি তা বৃদ্ধি করে দেন দশ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত। কিংবা অবস্থার তারতম্যে আরো বেশি বাড়িয়ে দেন।
তাত্ত্বিকদের মত এই যে, সাত শত গুণ কিংবা তারও বেশিতে সৎকর্ম রূপান্তরিত হওয়ার কারণ হল, সৎকর্ম সম্পাদনকালীন বান্দার এখলাস ও আন্তরিকতা কখনো কখনো স্বাভাবিকতার তুলনায় বৃদ্ধি পায়, জন্ম নেয় তার মাঝে অটল দৃঢ়তা, অন্তরের যাবতীয় সজাগ অনুভূতিগুলো কেন্দ্রীভূত হয় সেই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে—কিংবা সে যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, তার কল্যাণ ও উপকারিতা অব্যাহত থাকে দীর্ঘ দিন, ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক—যেমন সদকায়ে জারিয়া, জ্ঞানের উৎসারণ, সুন্নতে হাসানা—ইত্যাদি। এর ফলে আল্লাহ তাআলা তার সৎকর্মের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে, মোমিনদের অন্তরে পাপের যে চিন্তা হঠাৎ উপস্থিত হয়ে তৎক্ষণাৎ দূরীভূত হয়, তা কর্মে পরিণত করার ইচ্ছা পোষণ করে না দৃঢ়ভাবে, কিংবা চিন্তাটি তার মাঝে স্থায়িত্ব লাভ করে না,—এর ব্যাপারে আল্লাহ তাদের পাকড়াও করবেন না। অন্তরে ইচ্ছার উদয়ের পরও যদি তারা তা হতে বিরত থাকে, তবে তাদের নামে একটি সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করা হবে। আর যদি কর্মে পরিণত করে, তবে তাদের নামে একটি অপকর্মই কেবল লিপিবদ্ধ করা হবে। সৎকর্মের অনুরূপ একে বৃদ্ধি করা হবে না। বিষয়টিকে জোড়াল করে আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত একটি হাদিস, যাতে রাসূল সা. এরশাদ করেছেন—
إن الله تجاوز لأمتي ما حدثت به أنفسها مالم يتكلموا أو يعملوا به .
আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের অন্তরে যে পাপের চিন্তার উদয় হয়, তা ক্ষমা করে দেন—যতক্ষণ না তারা সে বিষয়ে আলোচনা করে, কিংবা কর্মে পরিণত করে। [মুসলিম : ১৮১]
বান্দা এ পার্থিব জগতে যে কর্মেই অংশ নেয়—ছোট হোক কিংবা বড়, সূক্ষ্ম হোক কিংবা স্থূল,—আল্লাহ তা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে—
وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآَثَارَهُمْ
অর্থাৎ, আমি তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করে রাখি। [সূরা ইয়াছিন ১২]
অপর এক স্থানে উল্লেখ হয়েছে যে—
وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يَا وَيْلَتَنَا مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لَا يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً إِلَّا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا ( الكهف ৪৯)
আর আমলনামা সামনে রাখা হবে, তাতে যা আছে তার কারণে আপনি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন। তারা বলবে : হায় আফসোস ! এ কেমন আমলনামা ! এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি—সবই এতে রয়েছে ! তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো প্রতি জুলুম করবেন না। [কাহাফ : ৪৯]
তিনি আরো এরশাদ করেন—-
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ ﴿7﴾ وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ ﴿8﴾ ( الزلزلة )
যে ব্যক্তি অংশ নিবে অনু পরিমাণ সৎকর্মে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে অংশ নিবে অনু পরিমাণ অসৎকর্মে, সেও তা দেখতে পাবে। [সূরা যিলযাল : ৭-৮]
মুসলমানের কর্তব্য এই যে, সে সদা সতর্ক থাকবে যেন সৎকর্ম ব্যতীত তার লিপিকায় অন্য কিছুই স্থান না পায়। যখন তার অন্তর সৎকর্মচ্যুত হবে, কিংবা উদ্রেক হবে পাপ-চিন্তার, তৎক্ষণাৎ সে তওবা, ইস্তেগফার ও অনুশোচনার মাধ্যমে নিজেকে শুধরে নিবে।
মানুষ কখনো কখনো ভাবে যে, তার প্রবৃত্তি ও মনোবাসনার আস্বাদগুলো নিহিত আছে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ পাপকর্মে। যখন বান্দা তার প্রভুর কারণে, তার প্রতিদান প্রাপ্তির আশায়, শাস্তির ভয়ে তা ত্যাগ করবে—নিশ্চয় এর ফলে সে পুরস্কার প্রাপ্ত হবে, তাকে দান করা হবে অশেষ সওয়াব।
হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, বৈধ কাজের কারণে মানুষের জন্য কোন সওয়াব বা শাস্তির বিধান দেওয়া হয় না, যতক্ষণ না এর পিছনে কাজ করে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ নিয়ত। বৈধ কাজগুলো শুদ্ধ বা অশুদ্ধ নিয়তের ফলে সৎ বা অসৎকর্মে পরিণত হয়।
বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার অশেষ মহানুভবতা এই যে, মানুষের সৎকর্মের ইচ্ছাগুলোকে তিনি পরিপূর্ণ সৎকর্মের স্থান দান করেছেন—যদিও সে তা কর্মে পরিণত না করে। এমনিভাবে মানুষ যখন সৎকর্ম আরম্ভ করার পর কোন প্রকার বাধা-প্রাপ্তির ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়—সে ক্ষেত্রেও একই হুকুম। উদাহরণত: কেউ রাত জেগে এবাদতের ইচ্ছা করল, অত:পর নিদ্রাকাতর হয়ে পড়ল কিংবা আক্রান্ত হল অসুস্থতায়—এ সকল অবস্থায় কর্মটি সমাপ্ত না হলেও তার নামে সৎকর্মটি লিপিবদ্ধ করা হবে।
আল্লাহ তাআলার এ মহান মহানুভবতার—সৎকর্ম সাত শত গুণ বা তারও বেশি বৃদ্ধি, পাপের ইচ্ছা উদয় হওয়ার পরও তা লিপিবদ্ধ না করা,—আরেকটি দিক এই যে, তিনি সৎকর্মের মাধ্যমে অসৎকর্মগুলো মুছে দেন। পবিত্র কোরআনে তিনি এরশাদ করেন—
وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ ( هود : 114)
দিনের দুই প্রান্তেই সালাত কায়েম করবে এবং রাতের প্রান্ত-ভাগে। পুণ্য কর্ম অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়। [হুদ : ১১৪]
আবু যরকে সম্বোধন করে রাসূল সা. এরশাদ করেছেন—
اتق الله حيثما كنت، وأتبع السيئة الحسنة تمحها، وخالق الناس بخلق حسن .
যেখানেই অবস্থান করো, আল্লাহকে ভয় কর। পাপের পর সৎকর্ম করো, যা তাকে মুছে দেবে। মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করো। [তিরমিজী ১৯১০]
عَنْ أبِيْ هُرَيْرَةَ -رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سِلَّمَ- بَدَأَ الِإسْلَامُ غَرِيْبًا، وَ سَيَعُوْدُ كَمَا بَدَأَ غَرِيْبًا، فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءَ . رواه مسلم .
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, ইসলামের সূচনা হয়েছে অপরিচিত নির্বাসিতের মত। পুনরায় একদিন তা নির্বাসিতে পরিণত হবে। নির্বাসিতদের জন্য সু-সংবাদ। [মুসলিম-১৪৬]
আভিধানিক আলোচনা :
غَرِيْبًا : নির্বাসন দু প্রকার : একটি হচ্ছে বাহ্যিক বা অনুভবনীয়—যেমন নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে একাকী জীবন-যাপন। অপরটি হচ্ছে আদর্শিক। আদর্শের দিক দিয়ে সে যেন নির্বাসিত, অপরিচিত, সমাজে তার আদর্শ তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আলোচ্য হাদিসে দ্বিতীয়টিই উদ্দেশ্য। অর্থ হচ্ছে—কোন মানুষ তার অবস্থান, এবাদত-বন্দেগি, ধর্ম পরায়ণতা, পাপাচার হতে মুক্ত থাকার দরুন আদর্শিকভাবে সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন ও নির্বাসিত হয়ে পড়া।
এ নির্বাসন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা খুবই আপেক্ষিক ব্যাপার : সময় ও অবস্থান-ভেদে নির্বাসনের অনুভূতি মানুষের মাঝে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
بَدَأَ الِإسْلَامُ غَرِيْبًا : প্রাথমিকভাবে ইসলাম বীজ আকারে ছড়িয়ে ছিল ব্যক্তিদের মাঝে। অত:পর ধীরে ধীরে তা নৈর্ব্যক্তিক ও সামাজিক রূপ লাভ করে। কিন্তু ক্রমে তাকে আক্রান্ত করে বিভিন্ন অপভ্রংশ, ফলে সূচনাকালের মত আজ তা কেবল ব্যক্তিক রূপে ফিরে এসেছে, হারিয়েছে তার সামাজিক যাবতীয় মূল্য।
فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءَ : অতএব নির্বাসিতদের জন্য শুভ সংবাদ। এ বাক্যটির অর্থ নির্ধারণে আলেমদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তূবা-এর অর্থ আনন্দ, দৃষ্টির শীতলতা। কেউ বলেন, বাক্যটির অর্থ হচ্ছে—তাদের কী সৌভাগ্য ! কিংবা—তাদের কী ঈর্ষণীয় সাফল্য ! কারো মত এই যে, এর অর্থ—কল্যাণ ও মহানুভবতা তাদেরই। কেউ বলেন, তূবা অর্থ জান্নাত, অথবা জান্নাতের একটি বৃক্ষ। উল্লেখিত হাদিসে এর যে কোন একটি অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে।
আহকাম ও ফায়দা :
সাহাবিদের মহত্ত্ব ও মহানুভবতার প্রমাণ বহন করে হাদিসটি। কারণ, নবুয়্যতি জ্ঞান ধারার সূচনাকালেই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন—এর ফলে, পুরোপুরি বৈরী একটি সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে লড়াই করে টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল তাদের আকিদা ও বিশ্বাস। আক্ষরিক অর্থে নয়, তাদের এ নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতা ছিল মানসিক ও আদর্শিক। শিরক ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হয়েছিলেন স্বজাতির বিরোধিতায়।
আল্লাহর দ্বীনকে আকড়ে থাকা, তাতে দৃঢ় ও অটল থাকা, সর্বান্তঃকরণে নবী মোহাম্মদ সা.-এর অনুসরণে আত্মনিয়োগ করা—এগুলো হচ্ছে সেই প্রকৃত মোমিনের চারিত্রিক ভূষণ ও বৈশিষ্ট্য, যারা আদর্শিক নির্বাসনের পুন্যলাভে প্রয়াসী—যদিও সমাজের বৃহৎ একটি শ্রেণি তার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষ কি মতামত পোষণ করছে—তাকে ভিত্তি করে নয় ; মূলত: ফলাফল নিরূপিত হবে সত্যকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে থাকার বিবেচনায়। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ [ الأنعام : ১১৬]
আর আপনি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। [আনআম : ১১৬]
হাদিসটি আদর্শিক ও সামাজিক নির্বাসিতদের মহান প্রাপ্তি ও তাদের উচ্চ মর্যাদার ঘোষণা দিচ্ছে। নির্বাসিত দ্বারা এখানে ধর্মের কারণে নির্বাসিত হওয়া উদ্দেশ্য। যারা জাগতিক কারণে স্বদেশ হতে নির্বাসিত, তারা কোনভাবেই উদ্দেশ্য নয়।
কয়েকটি হাদিসে উক্ত নির্বাসিতদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—
الذين يَصلحون إذا فسد الناس .
যারা মানুষের বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খল থাকে। [তিরমিজি] কিংবা—
هم الذين يُصلحون ما أفسد الناس .
যারা মানুষের বিশৃঙ্খলতাকে শৃঙ্খলা দান করে। বা কলুষিত সমাজকে যারা সংস্কার করে। [আহমদ]
এ উক্তিগুলো প্রমাণ করে যে, কেবল ব্যক্তি-শুদ্ধি একজন প্রকৃত মোমিনের জন্য যথেষ্ট নয় ; বরং প্রজ্ঞা, বিনয়-বিনম্র আচরণের মাধ্যমে যারা বিপথে চালিত, তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবেই একজন মোমিন উক্ত হাদিসে বর্ণিত নির্বাসিতের গুণ অর্জনে সক্ষম হবে।
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, ইসলামের সূচনা হয়েছে অপরিচিত নির্বাসিতের মত। পুনরায় একদিন তা নির্বাসিতে পরিণত হবে। নির্বাসিতদের জন্য সু-সংবাদ। [মুসলিম-১৪৬]
আভিধানিক আলোচনা :
غَرِيْبًا : নির্বাসন দু প্রকার : একটি হচ্ছে বাহ্যিক বা অনুভবনীয়—যেমন নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে একাকী জীবন-যাপন। অপরটি হচ্ছে আদর্শিক। আদর্শের দিক দিয়ে সে যেন নির্বাসিত, অপরিচিত, সমাজে তার আদর্শ তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আলোচ্য হাদিসে দ্বিতীয়টিই উদ্দেশ্য। অর্থ হচ্ছে—কোন মানুষ তার অবস্থান, এবাদত-বন্দেগি, ধর্ম পরায়ণতা, পাপাচার হতে মুক্ত থাকার দরুন আদর্শিকভাবে সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন ও নির্বাসিত হয়ে পড়া।
এ নির্বাসন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা খুবই আপেক্ষিক ব্যাপার : সময় ও অবস্থান-ভেদে নির্বাসনের অনুভূতি মানুষের মাঝে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
بَدَأَ الِإسْلَامُ غَرِيْبًا : প্রাথমিকভাবে ইসলাম বীজ আকারে ছড়িয়ে ছিল ব্যক্তিদের মাঝে। অত:পর ধীরে ধীরে তা নৈর্ব্যক্তিক ও সামাজিক রূপ লাভ করে। কিন্তু ক্রমে তাকে আক্রান্ত করে বিভিন্ন অপভ্রংশ, ফলে সূচনাকালের মত আজ তা কেবল ব্যক্তিক রূপে ফিরে এসেছে, হারিয়েছে তার সামাজিক যাবতীয় মূল্য।
فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءَ : অতএব নির্বাসিতদের জন্য শুভ সংবাদ। এ বাক্যটির অর্থ নির্ধারণে আলেমদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তূবা-এর অর্থ আনন্দ, দৃষ্টির শীতলতা। কেউ বলেন, বাক্যটির অর্থ হচ্ছে—তাদের কী সৌভাগ্য ! কিংবা—তাদের কী ঈর্ষণীয় সাফল্য ! কারো মত এই যে, এর অর্থ—কল্যাণ ও মহানুভবতা তাদেরই। কেউ বলেন, তূবা অর্থ জান্নাত, অথবা জান্নাতের একটি বৃক্ষ। উল্লেখিত হাদিসে এর যে কোন একটি অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে।
আহকাম ও ফায়দা :
সাহাবিদের মহত্ত্ব ও মহানুভবতার প্রমাণ বহন করে হাদিসটি। কারণ, নবুয়্যতি জ্ঞান ধারার সূচনাকালেই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন—এর ফলে, পুরোপুরি বৈরী একটি সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে লড়াই করে টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল তাদের আকিদা ও বিশ্বাস। আক্ষরিক অর্থে নয়, তাদের এ নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতা ছিল মানসিক ও আদর্শিক। শিরক ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হয়েছিলেন স্বজাতির বিরোধিতায়।
আল্লাহর দ্বীনকে আকড়ে থাকা, তাতে দৃঢ় ও অটল থাকা, সর্বান্তঃকরণে নবী মোহাম্মদ সা.-এর অনুসরণে আত্মনিয়োগ করা—এগুলো হচ্ছে সেই প্রকৃত মোমিনের চারিত্রিক ভূষণ ও বৈশিষ্ট্য, যারা আদর্শিক নির্বাসনের পুন্যলাভে প্রয়াসী—যদিও সমাজের বৃহৎ একটি শ্রেণি তার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষ কি মতামত পোষণ করছে—তাকে ভিত্তি করে নয় ; মূলত: ফলাফল নিরূপিত হবে সত্যকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে থাকার বিবেচনায়। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ [ الأنعام : ১১৬]
আর আপনি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। [আনআম : ১১৬]
হাদিসটি আদর্শিক ও সামাজিক নির্বাসিতদের মহান প্রাপ্তি ও তাদের উচ্চ মর্যাদার ঘোষণা দিচ্ছে। নির্বাসিত দ্বারা এখানে ধর্মের কারণে নির্বাসিত হওয়া উদ্দেশ্য। যারা জাগতিক কারণে স্বদেশ হতে নির্বাসিত, তারা কোনভাবেই উদ্দেশ্য নয়।
কয়েকটি হাদিসে উক্ত নির্বাসিতদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—
الذين يَصلحون إذا فسد الناس .
যারা মানুষের বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খল থাকে। [তিরমিজি] কিংবা—
هم الذين يُصلحون ما أفسد الناس .
যারা মানুষের বিশৃঙ্খলতাকে শৃঙ্খলা দান করে। বা কলুষিত সমাজকে যারা সংস্কার করে। [আহমদ]
এ উক্তিগুলো প্রমাণ করে যে, কেবল ব্যক্তি-শুদ্ধি একজন প্রকৃত মোমিনের জন্য যথেষ্ট নয় ; বরং প্রজ্ঞা, বিনয়-বিনম্র আচরণের মাধ্যমে যারা বিপথে চালিত, তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবেই একজন মোমিন উক্ত হাদিসে বর্ণিত নির্বাসিতের গুণ অর্জনে সক্ষম হবে।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ -رَضيَ اللهُ عَنْهُمَا- قَالَ : شَهِدْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- الصَّلَاةَ يَوْمَ العِيْدِ، فَبَدَأ بِالصَّلاةِ قَبْـــلَ الخُطْبَةِ بِغَيِر أذَانٍ وَلَا إقَامَةٍ، ثُمَّ قَامَ مُتَوَكِّئًا عَلَى بِلَالٍ، فَأَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ، وَحَثَّ عَلَى طَاعَتِهِ، وَوَعَظَ النَّاسَ وَذَكَرَهُمْ،
ثُمَّ مَضَى حَتَّى أَتَى النِّسَاءَ فَوَعَظَهُمْ وِذَكَرَهُنَّ، فَقَالَ : تَصَدَّقْنَ فَإنَّ أكْثَرَكُنَّ حَطَبُ جَهَنَّمَ، فَقَامَتْ مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ، سُفَعَاءَ الخَدَّيْنِ، فَقَالَتْ : لِمَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ : لِأَنَّكُنَّ تُكْثِرنَ الشَّكَاةَ، وَتَكْفُرْنَ العَشِيْرَ، قَالَ : فَجَعَلْنَ يَتَصَدَّقْنَ مِنْ حُلِيِّهِنَّ، يَلْقِيْنَ فِيْ ثَوْبِ بِلَالٍ مِنْ أقْرُطَتِهِنَّ وَخَوَاتِمِهِنَّ . ( متفق عليه )
জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—আমি রাসূল সা.-এর সাথে একবার ঈদের জামাতে অংশ গ্রহণ করলাম। আজান-একামত ব্যতীত তিনি খুতবার পূর্বেই সালাত আরম্ভ করলেন। সালাত শেষে বেলাল রা.-এর কাঁধে ভর দিয়ে দন্ডায়মান হলেন। সকলকে আল্লাহর তাকওয়ার আদেশ দিলেন, তার আনুগত্যের উৎসাহ প্রদান করলেন। মানুষকে ওয়াজ-নসিহত করলেন।
অত:পর নারীদের নিকট গমন করে তাদের উদ্দেশ্যে নসিহত করে বললেন : তোমরা সদকা কর, তোমাদের অধিকাংশই হবে জাহান্নামের ইন্ধন। বিবর্ণ-ফ্যাকাশে মুখমন্ডল নিয়ে নারীদের মধ্য হতে একজন দাঁড়িয়ে বলল, কেন, হে আল্লাহর রাসূল? রাসূল বললেন, কারণ তোমরা অধিক অভিযোগ কর, স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও।
জাবের বলেন, অত:পর তারা তাদের অলংকারাদি সদকা করতে আরম্ভ করল। তাদের কানের দুল ও আংটি বেলালের বিছানো কাপড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। [বোখারি-৯৭৮, মুসলিম-৮৮৫]
হাদিসের বর্ণনাকারি :
প্রখ্যাত আনসারি সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন হারাম। তিনি ও তার পিতা উভয়ে রাসূলের সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনে সক্ষম হন। শেষ আকাবার বায়আতে তিনি তার পিতার সঙ্গী ছিলেন। তার পিতা ছিলেন রাসূলের নিয়োগকৃত দলপতিদের অন্যতম। অনেকগুলো যুদ্ধে তিনি রাসূল সা.-এর সঙ্গী হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন—এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি রাসূলের সাথে উনিশটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। হাদিস বর্ণনার সংখ্যায় তিনি রাবীদের মাঝে অন্যতম। মসজিদে নববীতে তার একটি ক্লাস ছিল, তার সান্নিধ্যে বিদ্যার্জনের জন্য মানুষের বিপুল সমাগম হত সেখানে। তিনি ছিলেন দীর্ঘজীবী—মদীনায় মৃত্যুবরণ কারী সর্বশেষ সাহাবিদের তিনি ছিলেন একজন। ৯৪ বছর বয়সে, ৭৮ হিজরি সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
يَوْمَ العِيْدِ : দিনটি ছিল ঈদুল ফিতরের দিন।
مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ : س শব্দে যের ط শব্দে যবর হবে। অর্থ : মধ্যবর্তী স্থান। নারীদের মধ্যে অবস্থানকারী একজন মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। কেউ কেউ বলেন, سطة النساء দ্বারা উদ্দেশ্য নারীদের মাঝে যিনি মাননীয়া, তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তবে, এ মতটি পূর্বেরটির তুলনায় অগ্রহণযোগ্য।
سُفَعَاءَ الخَدَّيْنِ : অর্থাৎ, দু:খ, ভয় ও হতাশার ফলে তার গন্ড-দ্বয়ের তবক বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল।
تُكْثِرنَ الشَّكَاةَ : অর্থাৎ, তোমরা অধিক-হারে অভিযোগ কর।
وَتَكْفُرْنَ العَشِيْرَ : আভিধানিক অর্থে العشير হচ্ছে মিশুক। অধিকাংশ আলেম উক্ত হাদিসে একে স্বামী অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ বিবেক-শূন্যতা ও জ্ঞানের দুর্বলতার দরুন অধিকাংশ স্ত্রী তার স্বামীর এহসানকে অস্বীকার করে।
حُلِيِّهِنَّ : হাত ইত্যাদিতে নারীরা যে সমস্ত অলংকারাদি পরিধান করে।
أقْرُطَتِهِنَّ : قرط শব্দের বহুবচন। স্বর্ণের হোক কিংবা অন্য কিছুর—কানে পরিধান করার অলংকার।
আহকাম ও ফায়দা :
১-হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈদের সালাতের আহকামের বর্ণনা রয়েছে এতে। যথা : —
হাদিসটি প্রমাণ করে যে, ঈদের সালাতের আজান কিংবা একামত নেই।
জুমার খুতবায় আলোচ্য বিষয় হবে আল্লাহ-ভীতি, আল্লাহর আনুগত্যের উৎসাহ এবং নসীহত—ইত্যাদি।
ঈদের সালাতের খুতবার সময় হচ্ছে সালাতের পর, জুমার মত পূর্বে নয়। জুমা এবং ঈদের সালাত—উভয় ক্ষেত্রেই খুতবা দুটি ; কিন্তু ঈদের ক্ষেত্রে তার নির্ধারিত সময় নামাজের পর। এভাবেই রাসূল সা. ও খোলাফায়ে রাশিদীন পালন করেছেন।
দুই ঈদের সালাত, বিশুদ্ধতম মতানুসারে, ওয়াজিব। সুতরাং, মুসলমানের উচিত গুরুত্ব সহকারে তা আদায় করা, এবং উপস্থিত হয়ে খুতবা শ্রবণ করা। যাতে সে প্রভূত সওয়াবের অধিকারী হতে পারে, এবং ইমামের খুতবা হতে শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
২-ইসলাম নারীর বিষয়টিতে অশেষ গুরুত্বারোপ করেছে, ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে তার জন্য নির্ধারণ করেছে উঁচু ও সম্মানীয় স্থান। এ হাদিসে নারী সংক্রান্ত বিভিন্ন আহকাম ও দৃষ্টিকোণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যথা :—
রাসূল সা. ঈদের জামাতের শেষে নারীদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে খুতবা প্রদান করেছিলেন। এর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, ঈদের জামাতে ইমামের উচিত নারী মুসল্লিদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে খুতবা প্রদান করা, যাতে তিনি একান্তভাবে তাদের নিজস্ব বিষয়গুলো সম্বন্ধে ওয়াজ-নসিহত ও দিক-নির্দেশনা প্রদান করবেন। তবে, সাধারণ সকলের জন্য প্রদত্ত খুতবা যদি তারা শ্রবণে সক্ষম না হন, তবে এই হুকুম। অন্যথায় ইমাম তার খুতবার একাংশে একান্তভাবে তাদের জন্য বয়ান রাখবেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে, পুরুষদের সাথে স্বাভাবিক মেলামেশাও নারীদের জন্য হারাম। হোক তা মসজিদ বা অন্য কোথাও। তারা তাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে অবস্থান করবেন। ফেতনা ও হারাম বিষয়ের উদ্রেককারী যাবতীয় বিষয়কে এড়ানোর জন্যই এই হুকুম প্রদান করা হয়েছে। নারীদের বিষয়ে ইসলামের এ হুকুম নারী ও তার অভিভাবকদের অনুধাবন করা কর্তব্য—এর উপর নির্ভর করে নানা সামাজিক উপকারিতা।
নারী হোক কিংবা পুরুষ—শিক্ষার্জন সকলের অধিকার। ধর্মীয় জ্ঞানাহরণের ব্যাপারে তাই নারীদের আগ্রহ ও আকর্ষণ থাকা আবশ্যক। এর একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে—বিজ্ঞ আলেমের নসিহত শ্রবণ ও সে বিষয়ে প্রশ্নোত্তর—হাদিসটি যেমন প্রমাণ করে।
হাদিসটিতে নারীদের যে সকল দোষের উল্লেখ রয়েছে, তা এই যে—অধিক অভিযোগ করা, স্বামীদের প্রতি অকৃতজ্ঞ থাকা। এ খুবই গর্হিত অভ্যাস, যা নারীকে জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। সুতরাং, নারীদের উচিত এ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা।
মুসলিম নারীর পরিচয় হল—সে সতত কল্যাণের প্রতি ধাবিত হবে, ঈমানের যে কোন প্রকার আহবানে সাড়া দেবে।
সম্পত্তির মালিকানা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সিদ্ধ। এ ব্যাপারে ব্যয়ের অধিকারও তাদের উভয়ের জন্যই সংরক্ষিত। তাই, সাহাবি নারীগণ তাদের স্বামীদের অনুমতি ব্যতীতই সদকা করতে তৎপর হয়েছেন। স্বাধীনভাবে নারী ব্যয় করতে পারবে, স্বামীর অনুমতি ব্যতীতও সদকা করতে পারবে। রাসূল উক্ত হাদিসে নারীদের এ ব্যয়কে সমর্থন করেছেন।
৩- খতিব ও ওয়ায়েজের রয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আল্লাহর পক্ষ হতে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন হালাল-হারামের বিধান। হাদিসটি প্রমাণ করে, এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ খতিব ও ওয়ায়েজের কর্তব্য। মানুষ যা জানে, তা পালনে তিনি তাদের উদ্বুদ্ধ করবেন, যা সম্পর্কে অজ্ঞ, তা জ্ঞাত করাবেন। কল্যাণ ও ভালো কাজের ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করবেন। সতর্ক করবেন মন্দ-কর্মে।
৪-সদকার রয়েছে বিবিধ উপকারিতা ও কল্যাণ। ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে তার নানা সুফল রয়েছে। জাহান্নামের আগুন হতে বান্দাকে তা রক্ষা করে—রাসূলের একটি হাদিস বিষয়টিকে আরো জোড়াল করে, তিনি মন্তব্য করেছেন—
اتقوا النار و لو بشق تمرة .
একটি খেজুরের অর্ধেক দান করে হলেও তোমরা আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর। [বোখারি-১৪১৩ ও মুসলিম-১০১৬]
৫-অন্যের সাথে সুস্থ আচার-আচরণের প্রতি ইসলাম মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে—এমনকি, যদি তা হয় একেবারে নিকটাত্মীয়ের সাথেও। ইসলাম শিক্ষা দেয়—সম্মানিতদের প্রতি জ্ঞাপন করবে পরিপূর্ণ সম্মান, স্বীকার করে নিবে হকদারদের হক। সম্পত্তির ব্যাপারে কার্পণ্য করবে না, মানুষের জন্য যা অকল্যাণকর, তা এড়িয়ে যাবে সযত্নে। অশ্লীল কথোপকথন পরিহার করবে, অপরের প্রতি অকৃতজ্ঞ হবে না।
৬- ইলম অর্জনে প্রয়াসী সর্বদা তার জ্ঞানকে বৃদ্ধি করার প্রতি মনোনিবেশ করবে। যা জটিল ও দুর্বোধ্য, সে ব্যাপারে তার শিক্ষককে প্রশ্ন করে জেনে নিবে। তবে, প্রশ্ন করার ব্যাপারে শিক্ষকের প্রতি প্রদর্শন করবে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা।
ثُمَّ مَضَى حَتَّى أَتَى النِّسَاءَ فَوَعَظَهُمْ وِذَكَرَهُنَّ، فَقَالَ : تَصَدَّقْنَ فَإنَّ أكْثَرَكُنَّ حَطَبُ جَهَنَّمَ، فَقَامَتْ مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ، سُفَعَاءَ الخَدَّيْنِ، فَقَالَتْ : لِمَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ : لِأَنَّكُنَّ تُكْثِرنَ الشَّكَاةَ، وَتَكْفُرْنَ العَشِيْرَ، قَالَ : فَجَعَلْنَ يَتَصَدَّقْنَ مِنْ حُلِيِّهِنَّ، يَلْقِيْنَ فِيْ ثَوْبِ بِلَالٍ مِنْ أقْرُطَتِهِنَّ وَخَوَاتِمِهِنَّ . ( متفق عليه )
জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—আমি রাসূল সা.-এর সাথে একবার ঈদের জামাতে অংশ গ্রহণ করলাম। আজান-একামত ব্যতীত তিনি খুতবার পূর্বেই সালাত আরম্ভ করলেন। সালাত শেষে বেলাল রা.-এর কাঁধে ভর দিয়ে দন্ডায়মান হলেন। সকলকে আল্লাহর তাকওয়ার আদেশ দিলেন, তার আনুগত্যের উৎসাহ প্রদান করলেন। মানুষকে ওয়াজ-নসিহত করলেন।
অত:পর নারীদের নিকট গমন করে তাদের উদ্দেশ্যে নসিহত করে বললেন : তোমরা সদকা কর, তোমাদের অধিকাংশই হবে জাহান্নামের ইন্ধন। বিবর্ণ-ফ্যাকাশে মুখমন্ডল নিয়ে নারীদের মধ্য হতে একজন দাঁড়িয়ে বলল, কেন, হে আল্লাহর রাসূল? রাসূল বললেন, কারণ তোমরা অধিক অভিযোগ কর, স্বামীর অকৃতজ্ঞ হও।
জাবের বলেন, অত:পর তারা তাদের অলংকারাদি সদকা করতে আরম্ভ করল। তাদের কানের দুল ও আংটি বেলালের বিছানো কাপড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। [বোখারি-৯৭৮, মুসলিম-৮৮৫]
হাদিসের বর্ণনাকারি :
প্রখ্যাত আনসারি সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন হারাম। তিনি ও তার পিতা উভয়ে রাসূলের সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনে সক্ষম হন। শেষ আকাবার বায়আতে তিনি তার পিতার সঙ্গী ছিলেন। তার পিতা ছিলেন রাসূলের নিয়োগকৃত দলপতিদের অন্যতম। অনেকগুলো যুদ্ধে তিনি রাসূল সা.-এর সঙ্গী হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন—এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি রাসূলের সাথে উনিশটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। হাদিস বর্ণনার সংখ্যায় তিনি রাবীদের মাঝে অন্যতম। মসজিদে নববীতে তার একটি ক্লাস ছিল, তার সান্নিধ্যে বিদ্যার্জনের জন্য মানুষের বিপুল সমাগম হত সেখানে। তিনি ছিলেন দীর্ঘজীবী—মদীনায় মৃত্যুবরণ কারী সর্বশেষ সাহাবিদের তিনি ছিলেন একজন। ৯৪ বছর বয়সে, ৭৮ হিজরি সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
يَوْمَ العِيْدِ : দিনটি ছিল ঈদুল ফিতরের দিন।
مِنْ سِطَةِ النِّسَاءِ : س শব্দে যের ط শব্দে যবর হবে। অর্থ : মধ্যবর্তী স্থান। নারীদের মধ্যে অবস্থানকারী একজন মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। কেউ কেউ বলেন, سطة النساء দ্বারা উদ্দেশ্য নারীদের মাঝে যিনি মাননীয়া, তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তবে, এ মতটি পূর্বেরটির তুলনায় অগ্রহণযোগ্য।
سُفَعَاءَ الخَدَّيْنِ : অর্থাৎ, দু:খ, ভয় ও হতাশার ফলে তার গন্ড-দ্বয়ের তবক বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল।
تُكْثِرنَ الشَّكَاةَ : অর্থাৎ, তোমরা অধিক-হারে অভিযোগ কর।
وَتَكْفُرْنَ العَشِيْرَ : আভিধানিক অর্থে العشير হচ্ছে মিশুক। অধিকাংশ আলেম উক্ত হাদিসে একে স্বামী অর্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ বিবেক-শূন্যতা ও জ্ঞানের দুর্বলতার দরুন অধিকাংশ স্ত্রী তার স্বামীর এহসানকে অস্বীকার করে।
حُلِيِّهِنَّ : হাত ইত্যাদিতে নারীরা যে সমস্ত অলংকারাদি পরিধান করে।
أقْرُطَتِهِنَّ : قرط শব্দের বহুবচন। স্বর্ণের হোক কিংবা অন্য কিছুর—কানে পরিধান করার অলংকার।
আহকাম ও ফায়দা :
১-হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈদের সালাতের আহকামের বর্ণনা রয়েছে এতে। যথা : —
হাদিসটি প্রমাণ করে যে, ঈদের সালাতের আজান কিংবা একামত নেই।
জুমার খুতবায় আলোচ্য বিষয় হবে আল্লাহ-ভীতি, আল্লাহর আনুগত্যের উৎসাহ এবং নসীহত—ইত্যাদি।
ঈদের সালাতের খুতবার সময় হচ্ছে সালাতের পর, জুমার মত পূর্বে নয়। জুমা এবং ঈদের সালাত—উভয় ক্ষেত্রেই খুতবা দুটি ; কিন্তু ঈদের ক্ষেত্রে তার নির্ধারিত সময় নামাজের পর। এভাবেই রাসূল সা. ও খোলাফায়ে রাশিদীন পালন করেছেন।
দুই ঈদের সালাত, বিশুদ্ধতম মতানুসারে, ওয়াজিব। সুতরাং, মুসলমানের উচিত গুরুত্ব সহকারে তা আদায় করা, এবং উপস্থিত হয়ে খুতবা শ্রবণ করা। যাতে সে প্রভূত সওয়াবের অধিকারী হতে পারে, এবং ইমামের খুতবা হতে শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
২-ইসলাম নারীর বিষয়টিতে অশেষ গুরুত্বারোপ করেছে, ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে তার জন্য নির্ধারণ করেছে উঁচু ও সম্মানীয় স্থান। এ হাদিসে নারী সংক্রান্ত বিভিন্ন আহকাম ও দৃষ্টিকোণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যথা :—
রাসূল সা. ঈদের জামাতের শেষে নারীদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে খুতবা প্রদান করেছিলেন। এর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, ঈদের জামাতে ইমামের উচিত নারী মুসল্লিদের জন্য স্বতন্ত্রভাবে খুতবা প্রদান করা, যাতে তিনি একান্তভাবে তাদের নিজস্ব বিষয়গুলো সম্বন্ধে ওয়াজ-নসিহত ও দিক-নির্দেশনা প্রদান করবেন। তবে, সাধারণ সকলের জন্য প্রদত্ত খুতবা যদি তারা শ্রবণে সক্ষম না হন, তবে এই হুকুম। অন্যথায় ইমাম তার খুতবার একাংশে একান্তভাবে তাদের জন্য বয়ান রাখবেন।
হাদিসটি প্রমাণ করে, পুরুষদের সাথে স্বাভাবিক মেলামেশাও নারীদের জন্য হারাম। হোক তা মসজিদ বা অন্য কোথাও। তারা তাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে অবস্থান করবেন। ফেতনা ও হারাম বিষয়ের উদ্রেককারী যাবতীয় বিষয়কে এড়ানোর জন্যই এই হুকুম প্রদান করা হয়েছে। নারীদের বিষয়ে ইসলামের এ হুকুম নারী ও তার অভিভাবকদের অনুধাবন করা কর্তব্য—এর উপর নির্ভর করে নানা সামাজিক উপকারিতা।
নারী হোক কিংবা পুরুষ—শিক্ষার্জন সকলের অধিকার। ধর্মীয় জ্ঞানাহরণের ব্যাপারে তাই নারীদের আগ্রহ ও আকর্ষণ থাকা আবশ্যক। এর একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে—বিজ্ঞ আলেমের নসিহত শ্রবণ ও সে বিষয়ে প্রশ্নোত্তর—হাদিসটি যেমন প্রমাণ করে।
হাদিসটিতে নারীদের যে সকল দোষের উল্লেখ রয়েছে, তা এই যে—অধিক অভিযোগ করা, স্বামীদের প্রতি অকৃতজ্ঞ থাকা। এ খুবই গর্হিত অভ্যাস, যা নারীকে জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়। সুতরাং, নারীদের উচিত এ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা।
মুসলিম নারীর পরিচয় হল—সে সতত কল্যাণের প্রতি ধাবিত হবে, ঈমানের যে কোন প্রকার আহবানে সাড়া দেবে।
সম্পত্তির মালিকানা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সিদ্ধ। এ ব্যাপারে ব্যয়ের অধিকারও তাদের উভয়ের জন্যই সংরক্ষিত। তাই, সাহাবি নারীগণ তাদের স্বামীদের অনুমতি ব্যতীতই সদকা করতে তৎপর হয়েছেন। স্বাধীনভাবে নারী ব্যয় করতে পারবে, স্বামীর অনুমতি ব্যতীতও সদকা করতে পারবে। রাসূল উক্ত হাদিসে নারীদের এ ব্যয়কে সমর্থন করেছেন।
৩- খতিব ও ওয়ায়েজের রয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আল্লাহর পক্ষ হতে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন হালাল-হারামের বিধান। হাদিসটি প্রমাণ করে, এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ খতিব ও ওয়ায়েজের কর্তব্য। মানুষ যা জানে, তা পালনে তিনি তাদের উদ্বুদ্ধ করবেন, যা সম্পর্কে অজ্ঞ, তা জ্ঞাত করাবেন। কল্যাণ ও ভালো কাজের ব্যাপারে তাদের উৎসাহিত করবেন। সতর্ক করবেন মন্দ-কর্মে।
৪-সদকার রয়েছে বিবিধ উপকারিতা ও কল্যাণ। ঐহিক ও পারত্রিক জীবনে তার নানা সুফল রয়েছে। জাহান্নামের আগুন হতে বান্দাকে তা রক্ষা করে—রাসূলের একটি হাদিস বিষয়টিকে আরো জোড়াল করে, তিনি মন্তব্য করেছেন—
اتقوا النار و لو بشق تمرة .
একটি খেজুরের অর্ধেক দান করে হলেও তোমরা আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর। [বোখারি-১৪১৩ ও মুসলিম-১০১৬]
৫-অন্যের সাথে সুস্থ আচার-আচরণের প্রতি ইসলাম মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে—এমনকি, যদি তা হয় একেবারে নিকটাত্মীয়ের সাথেও। ইসলাম শিক্ষা দেয়—সম্মানিতদের প্রতি জ্ঞাপন করবে পরিপূর্ণ সম্মান, স্বীকার করে নিবে হকদারদের হক। সম্পত্তির ব্যাপারে কার্পণ্য করবে না, মানুষের জন্য যা অকল্যাণকর, তা এড়িয়ে যাবে সযত্নে। অশ্লীল কথোপকথন পরিহার করবে, অপরের প্রতি অকৃতজ্ঞ হবে না।
৬- ইলম অর্জনে প্রয়াসী সর্বদা তার জ্ঞানকে বৃদ্ধি করার প্রতি মনোনিবেশ করবে। যা জটিল ও দুর্বোধ্য, সে ব্যাপারে তার শিক্ষককে প্রশ্ন করে জেনে নিবে। তবে, প্রশ্ন করার ব্যাপারে শিক্ষকের প্রতি প্রদর্শন করবে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা।
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ - عَنِ النَّبِيِّ- صَلَّى الله ُعَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَالَ : سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إلَّا ظِلُّهُ : إمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِيْ عِبَادَةِ اللهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِيْ المَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِيْ اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتَ مَنْصَبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ : إنِّي أخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِيْنُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ ) متفق عليه (
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন—কেয়ামত দিবসে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোন ছায়া থাকবে না—ন্যয়পরায়ন বাদশাহ ; এমন যুবক, যে তার যৌবন ব্যয় করেছে আল্লাহর এবাদতে ; ঐ ব্যক্তি যার হৃদয় সর্বদা সংশ্লিষ্ট থাকে মসজিদের সাথে ; এমন দু ব্যক্তি, যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছে, এবং বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারই জন্য ; এমন ব্যক্তি, যাকে কোন সুন্দরী নেতৃস্থানীয়া রমণী আহবান করল অশ্লীল কর্মের প্রতি, এবং প্রত্যাখ্যান করে সে বলল, আমি আল্লাহকে ভয় করি ; এমন ব্যক্তি, যে এরূপ গোপনে দান করে যে, তার বাম হাত ডান হাতের দান সম্পর্কে অবগত হয় না। আর এমন ব্যক্তি, নির্জনে যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু-চোখ বেয়ে বয়ে যায় অশ্রুধারা। [বোখারি-৬৬০, মুসলিম-১০৩১।]
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
سَبْعَةٌ : অর্থ সাত, সংখ্যাটি এখানে সীমাবদ্ধ করণের জন্য উল্লেখ করা হয়নি, কারণ, অন্যান্য হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, এ সাত শ্রেণি ব্যতীত অন্যান্যরাও কেয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে স্থান লাভ করবে।
يُظِلُّهُمُ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ : আল্লাহর ছায়া দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য তার আরশের ছায়া। ভিন্ন এক রেওয়ায়েত এর প্রমাণ—যেখানে স্পষ্টভাবে ‘তার আরশ’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلاَّ ظِلَّهُ : উদ্দেশ্য কেয়ামত দিবস।
إِمَامٌ عَادِلٌ : আভিধানিক অর্থে ইমাম হলেন—যার নেতৃত্ব মেনে নেওয়া হয় এমন দলপতি। পরিভাষায়—শাসক ও বিচারক, যাদের কাঁধে মুসলমানদের কল্যাণের দায়িত্ব-ভার অর্পণ করা হয়েছে। ন্যায় প্রয়োগের মাধ্যমে যিনি শাসন করেন, তাকে আদেল ( عادِل ) বলা হয়।
شَابٌٌّ نَشَأَ فِيْ عِبَادَةِ اللهِ : বিশেষভাবে যুব শ্রেণির উল্লেখের কারণ এই যে, যুবক বয়সেই প্রবৃত্তি নানাভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনায় হানা দেয়, প্রলুব্ধ করে নানা অপকর্মে-অধর্মে। সুতরাং যুবক বয়সে এবাদতে নিমগ্ন হওয়া অন্য যে কোন সময়ে এবাদতে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে শ্রেয় ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
اِجْتَمَعَا عَلَيْهِ : অর্থাৎ, আল্লাহর ভালোবাসার ভিত্তিতেই তারা একে অপরকে ভালোবেসেছে, এবং বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারই জন্য। আল্লাহর ভালোবাসাই তাদের উভয়ের মাঝে গড়ে দিয়েছে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব, পার্থিব কোন প্রতিবন্ধকতা এ ব্যাপারে তাদের মাঝে আড়াল তৈরি করতে পারেনি। মৃত্যু পর্যন্ত তাদের উভয়ের মাঝে বন্ধনের একমাত্র সূত্র হল আল্লাহর মহববত।
وَ رَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتَ مَنْصَبٍ وَ جَمَالٍ : অর্থাৎ সুন্দরী নেতৃস্থানীয়া রমণী তাকে মন্দ কর্মের প্রতি আহবান জানাল।
وَ رَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ : সদকা হল : মানুষ আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য যে সম্পদ বিলিয়ে দেয়—হোক তা জাকাতের মত ফরজ কিংবা নফল দান। তবে, সদকা শব্দের ব্যবহার এক সময় ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায় কেবল নফল দানের ক্ষেত্রে।
فَأَخَفَاهَا حَتّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُه مَا تُنْفِقُ يَمِيْنُهُ : বাক্যটি দ্বারা দানের গোপনীয়তা বুঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যদি বাম হাত ডান হাতের কর্ম সম্পর্কে অবগতি লাভে সক্ষম হত, অধিক গোপনীয়তার কারণে সেও তার দানের ব্যাপারে অবগতি লাভ করতে পারত না।
خَالِيًا : নির্জনে, যেখানে কেউ নেই। বিশেষভাবে এ অবস্থাটি উল্লেখের কারণ হল, নির্জনের এবাদত রিয়া বা লোক দেখানো ভাবনা হতে মুক্ত থাকে, লোক-দেখানো প্রবৃত্তির সম্ভাবনা স্বভাবতই থাকে না।
فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ : আল্লাহর ভয়ে তার দু-চোখে অশ্রু বয়ে গেল।
আহকাম ও ফায়দা :
আল্লাহ তাআলার মহানুভবতা এই যে, কিছু কিছু কর্মকে তিনি বান্দার জন্য বিশেষ ফলদায়ক নির্ধারণ করে দিয়েছেন, উক্ত কর্মের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে অনেকের তুলনায় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে উঠে। এভাবে তিনি বান্দাদের মাঝে কল্যাণ-কর্মের উদ্দীপনা ও উৎসাহ সঞ্চার করেন।
বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে উঠা সাত শ্রেণির লোকদের কথা রাসূল সা. উক্ত হাদিসে উল্লেখ করেছেন। এ সাত শ্রেণি ব্যতীতও, অন্য কয়েকটি শ্রেণির কথা রাসূল ভিন্ন হাদিসে উল্লেখ করেছেন। উদাহরণত: আল্লাহর পথে গাজি ; অভাবীর সাহায্যকারী ; ঋণগ্রস্তকে সাহায্যদাতা ; এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মসজিদে গমনকারী—ইত্যাদি। অন্য হাদিসের এ রেওয়ায়াতের ফলে হাদিসবেত্তাগণ মত দিয়েছেন যে, সাত সংখ্যাটি এখানে বিশেষ কোন অর্থ বহন করে না। তাই সাতের মাঝেই তা সীমাবদ্ধ নয়।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী উক্ত গুণ অনুসন্ধান করেছেন এবং তার রচিত معرفة الخصال الموصلة إلى الظلال নামক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
হাদিসটিতে কেবল পুরুষের উল্লেখও কোন সীমাবদ্ধকরণের নির্দেশ করে না। দুটি স্থান ব্যতীত যা যা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে নারীরাও সমান অংশীদার। স্থান দুটি হচ্ছে—
সর্বোচ্চ নেতৃস্থান ও শাসন ব্যবস্থা। নারীরা মুসলমানদের সাধারণ নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম নয়, এবং সক্ষম নয় তারা বিচারক হতে। তবে যে সকল ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব বৈধ—যেমন স্কুলের প্রধান হওয়া—সে সকল ক্ষেত্রে নারীদের ন্যয়পরায়নতা বিবেচ্য।
দ্বিতীয়ত: নারীদের ক্ষেত্রে মসজিদে গমন করা বাধ্যতামূলক হওয়ার বিষয়টি বিবেচ্য নয়, কারণ, তাদের জন্য গৃহে সালাত আদায়ই উত্তম। অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীরাও সমানভাবে অংশীদার।
শরিয়ত ন্যয়পরায়নতার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে,—হোক তা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কিংবা তার তুলনায় কিছুটা নিম্নস্তরে ; এমনকি ব্যক্তির পারিবারিক জীবনও এর আওতাভুক্ত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন—
وَقُلْ آَمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ ( الشورى : 15)
আপনি বলুন, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, আমি তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, এবং তোমাদের মাঝে ন্যয় প্রতিষ্ঠার আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি। [সূরা শূরা : ১৫]
অন্যত্র তিনি বলেন—
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ ( النحل : 90)
নিশ্চয় আল্লাহ আদেশ করেন ন্যয়পরায়নতা ও এহসানের। [সূরা নহল : ৯০]
রাসূল সা. বলেছেন—
اتقوا الله واعدلوا بين أولادكم .
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, এবং তোমাদের সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান কর। [বোখারি : ২৩৯৮] অন্যত্র বলেছেন—
إن المقسطين عند الله على منابر من نورعن يمين الرحمن عز وجل، وكلتا يديه يمين، الذين يعدلون في حكمهم وأهليهم وما ولوا .
সুবিচারকগণ আল্লাহর ডান পাশে নূরের মিম্বর সমূহে অবস্থান করবে—তার উভয় হাতই ডান ; যারা তাদের শাসন, পরিবার ও দায়িত্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ন্যয় প্রতিষ্ঠা করবে। [মুসলিম : ৩৪০৬] উক্ত হাদিসে রাসূল ন্যায়পরায়ণ শাসকের উল্লেখ সর্বপ্রথমে করেছেন, কারণ, নেতৃত্ব ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা খুবই কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের জীবনে যৌবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়, তাতে দৃঢ়তা থাকে প্রচন্ড, মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকে প্রখর—উদ্দম ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর একটি সময় মানুষের যৌবন। সুতরাং, যে ব্যক্তি যৌবনে আল্লাহ প্রবর্তিত পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করবে, দমন করবে প্রবৃত্তি ও চাহিদা—হাদিসে বর্ণিত সেই মহান স্তর তারই প্রাপ্য। যে বিষয়গুলো যৌবনে মানুষকে তা অর্জনে সাহায্য করে, তা নিম্নরূপ—
জ্ঞানান্বেষণ, ও তাতে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ।
বিভিন্ন ভালো কাজের মাধ্যমে সর্বদা সময় কাজে লাগানোর অভ্যাস গড়ে তোলা।
আল্লাহর পথের মহান অনুসারীদের সাথে সংস্পর্শ যাপন।
যুবক বয়সে পবিত্র কোরআনের পুরোটা কিংবা তার অংশ বিশেষ মুখস্থ করার প্রচেষ্টা চালান।
৭. মসজিদ আল্লাহর ঘর, তাতে ফরজ ও নফল এবাদতসমূহ পালন করা হয়। চর্চা করা হয় নানা ধর্মীয় বিদ্যা। ধর্মের আলোচনা ও নসিহত হয় সর্বদা। দ্বীনের ক্ষেত্রে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যারা মসজিদের সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত, তারা কেয়ামত দিবসে সেই মহান সওয়াব লাভ করবে। এছাড়া, যে মসজিদের সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত, সে দূরে থাকে পাপ, এমনকি, পাপের দর্শন থেকে। অবস্থান করে আল্লাহর রহমতের স্বর্গীয় সান্নিধ্যে। এভাবে তার অন্তর পরিচ্ছন্নতা লাভ করে, স্বচ্ছ হয় তার চিন্তা-চেতনা। ক্রমান্বয়ে ক্ষালন হতে থাকে তার পাপসমূহ, বাড়তে থাকে সৎ ও সুফলদায়ক কর্মগুলো। মসজিদের সাথে সম্পৃক্ততার অর্থ এ নয় যে, সর্বদা স্বশরীরে মসজিদে অবস্থান করতে হবে। এর অর্থ এই যে, মসজিদ হতে বের হওয়ার পরও তার মন কেবল তাতে ফিরে যেতে উৎসুক হয়ে উঠবে, যখন তাতে অবস্থান করবে, স্থানটিকে তার খুবই আপন মনে হবে, লাভ করবে পরম স্বস্তি ও প্রশান্তি।
৮. সম্পর্কের নানা রকম পার্থিব ভিত্তি মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি করে—কখনো আত্মীয়তা, অর্থনৈতিক যূথবদ্ধতা, চারিত্রিক ও আচরণীয় সম্পৃক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে পালন করে থাকে মৌলিক ভূমিকা। পক্ষান্তরে, ইসলাম মানুষকে উৎসাহী করে এমন শক্তিকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরিতে, যার পুরোটাই নির্ভর করে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার উপর। কোরআন ও সুন্নাহও এ দিকটির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে—আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন—
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
মোমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। [সূরা হুজুরাত : ১০] অন্যত্র এসেছে—
الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ ﴿ الزخرف :67﴾
মোত্তাকি ব্যতীত সে দিন বন্ধুরা হবে পরস্পর পরস্পরের শত্রু। [সূরা যুখরুফ : ৬৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে এরশাদ করেন—
أوثق عرى الإيمان الحب في الله والبغض في الله .
ঈমানের মজবুতম বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, এবং তার জন্য ঘৃণা করা। [আহমদ ২৮৬/৪, বায়হাকী, হাদিসটি সহিহ]
৯. মানুষের প্রবৃত্তির রয়েছে নানা আকর্ষণ ও ইচ্ছা। ইসলাম এগুলো সুস্থ ও বৈধভাবে পূরণ করার ব্যবস্থা করেছে। শয়তান সর্বদা এ ফন্দিতে ব্যস্ত থাকে যে, কীভাবে সে মানুষকে আক্রান্ত করবে প্রবৃত্তির ফাঁদে, ভ্রষ্ট করবে সত্য পথ হতে। নারী-পুরুষ সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে শয়তান মানুষের সামনে খুবই মোহনীয় করে তুলে ধরে। নারী যদি হয় সুন্দরী, সম্মানিতা ও মর্যাদার অধিকারী, তবে পুরুষ তার প্রতি আসক্ত হয় প্রবল মোহে। যে ঈমানদার, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী, এ সকল পরিস্থিতিতে পাপে তার ঈমান বাধা প্রদান করে, সতর্ক করে দেয় ; ফলে তার অনুভূতি জাগ্রত হয় যে—আমি আল্লাহকে ভয় করি—মৌখিক এ স্বীকৃতির পর সে যখন বাস্তবেও এর অনুসরণ করে, লাভ করে হাদিসে বর্ণিত মহান সৌভাগ্য ও মর্যাদা। ইসলাম তার মৌলিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে নারী ও পুরুষকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তুলতে চায়—যে তার প্রতি কর্মে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহকে ধ্যানে উপস্থিত রাখবে। কবি বলেন—
و إذا خلوت بريبة في ظلمة و النفس داعية إلي الطغيان
فاستقم من نظر الإله و قل لها إن الذي خلق الظلام يراني
নির্জন অন্ধকারে যখন একান্ত হবে সংশয়ে (রমনীর সাথে)
আর তোমার প্রবৃত্তি আহবান জানাবে অন্যায়ের প্রতি
তখন তুমি আল্লাহর দৃষ্টির সম্মুখে লজ্জাশীল হও
তাকে বল, এ অন্ধকারের যিনি স্রষ্টা, তিনি তো আমাকে দেখছেন।
১০. সদকা এক মহান কর্ম। এর ফজিলত প্রভূত। অজস্র এর ফলাফল। এর ফজিলত ও সওয়াব বর্ণনায় অসংখ্য আয়াত ও হাদিস নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন—
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ( البقرة : 261)
আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ ব্যয়কারীদের দৃষ্টান্ত একটি বীজের মত, যা হতে উৎপন্ন হয়েছে সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশত শস্যদানা। যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ তাআলা আরো বাড়িয়ে দেন, আল্লাহ প্রশস্ত, সর্বজ্ঞ। [সূরা বাকারা : ২৬১]
প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য—উভয় প্রকার সদকাই ফজিলতপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ( البقرة : 271)
তোমরা যদি সদকা প্রকাশ কর, তবে তা উত্তম। আর যদি তা গোপন করে দরিদ্রদের মাঝে তা বিতরণ করে দাও, তবে তাও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তা তোমাদের পাপ ক্ষালন করবে ; তোমরা যা কর, সে ব্যাপারে আল্লাহ জ্ঞাত।’ [সূরা বাকারা : ২৭১]
অবস্থাভেদে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সদকার মাঝে উত্তম-অনুত্তম নির্ধারণ করা হয়। যদি তা প্রকাশ্যে পালন করার ব্যাপারে কোন কল্যাণ থাকে, তবে তাই উত্তম। অন্যথায়, ফরজ ও নফল—উভয় ক্ষেত্রে গোপনে পালন করা উত্তম।
১২. সর্বোত্তম আমলগুলোর মাঝে জিকির অন্যতম। সন্দেহ নেই, এটি তার সহজতরগুলোর মাঝেও অন্যতম। এতে আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা করা হয়, প্রশংসা করা হয়, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয় তার প্রতি, পেশ করা হয় সশঙ্ক আকুতি। যখন এ জিকির পালিত হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে, এবং আল্লাহর ভয়ে জিকিরকারী বান্দার দু-চোখ ভরে যায় অশ্রুধারায়, আল্লাহ তাকে মহান সওয়াবে ভূষিত করেন—তিনি তাকে ছায়া দান করেন কেয়ামতের কঠিন দিবসে, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোন ছায়া থাকবে না।
১৩. হাদিসটি প্রমাণ করে, এখলাসশূন্য এবাদত কোন কাজে আসে না। উল্লেখিত আমলগুলোর মাঝে একক যে গুণটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে এবাদতের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ এখলাস আনয়ন, এবং পার্থিব যাবতীয় উদ্দেশ্য হতে তাকে মুক্ত রাখা।
১৪. এ গুণগুলোর মাঝে যে কয়টি একক গুণ পাওয়া যায়—তা হচ্ছে, সবর, সহিষ্ণুতা। সন্দেহ নেই, আল্লাহর আনুগত্য ও তার নির্দেশ পালনের জন্য প্রয়োজন সবর ও ধৈর্য। কারণ, তার প্রতি পদে বাধা হয়ে দাঁড়াবে শয়তান, গাফেল আত্মা ও প্রবৃত্তি। বান্দা যখন এর বিরুদ্ধে অংশ নিবে আত্মিক জেহাদে, বিজয় অর্জন করবে এর বিরুদ্ধে—নিশ্চয় উত্তম পুরস্কারে ভূষিত হবে।
১৫. হাদিসটি আমাদেরকে এ হেদায়েত প্রদান করে যে, মোমিনের উচিত গোপনে সৎকর্মে অংশগ্রহণ করা। যাতে এবাদতে রিয়ার (লোক দেখানো ভাবনা) বিন্দুমাত্র সংশয় তৈরি না হয়, এবং গড়ে উঠে এখলাসের অভ্যাস।
আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন—কেয়ামত দিবসে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোন ছায়া থাকবে না—ন্যয়পরায়ন বাদশাহ ; এমন যুবক, যে তার যৌবন ব্যয় করেছে আল্লাহর এবাদতে ; ঐ ব্যক্তি যার হৃদয় সর্বদা সংশ্লিষ্ট থাকে মসজিদের সাথে ; এমন দু ব্যক্তি, যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবেসেছে, এবং বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারই জন্য ; এমন ব্যক্তি, যাকে কোন সুন্দরী নেতৃস্থানীয়া রমণী আহবান করল অশ্লীল কর্মের প্রতি, এবং প্রত্যাখ্যান করে সে বলল, আমি আল্লাহকে ভয় করি ; এমন ব্যক্তি, যে এরূপ গোপনে দান করে যে, তার বাম হাত ডান হাতের দান সম্পর্কে অবগত হয় না। আর এমন ব্যক্তি, নির্জনে যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু-চোখ বেয়ে বয়ে যায় অশ্রুধারা। [বোখারি-৬৬০, মুসলিম-১০৩১।]
শব্দ প্রসঙ্গে আলোচনা :
سَبْعَةٌ : অর্থ সাত, সংখ্যাটি এখানে সীমাবদ্ধ করণের জন্য উল্লেখ করা হয়নি, কারণ, অন্যান্য হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, এ সাত শ্রেণি ব্যতীত অন্যান্যরাও কেয়ামত দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে স্থান লাভ করবে।
يُظِلُّهُمُ اللهُ فِيْ ظِلِّهِ : আল্লাহর ছায়া দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য তার আরশের ছায়া। ভিন্ন এক রেওয়ায়েত এর প্রমাণ—যেখানে স্পষ্টভাবে ‘তার আরশ’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلاَّ ظِلَّهُ : উদ্দেশ্য কেয়ামত দিবস।
إِمَامٌ عَادِلٌ : আভিধানিক অর্থে ইমাম হলেন—যার নেতৃত্ব মেনে নেওয়া হয় এমন দলপতি। পরিভাষায়—শাসক ও বিচারক, যাদের কাঁধে মুসলমানদের কল্যাণের দায়িত্ব-ভার অর্পণ করা হয়েছে। ন্যায় প্রয়োগের মাধ্যমে যিনি শাসন করেন, তাকে আদেল ( عادِل ) বলা হয়।
شَابٌٌّ نَشَأَ فِيْ عِبَادَةِ اللهِ : বিশেষভাবে যুব শ্রেণির উল্লেখের কারণ এই যে, যুবক বয়সেই প্রবৃত্তি নানাভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনায় হানা দেয়, প্রলুব্ধ করে নানা অপকর্মে-অধর্মে। সুতরাং যুবক বয়সে এবাদতে নিমগ্ন হওয়া অন্য যে কোন সময়ে এবাদতে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে শ্রেয় ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
اِجْتَمَعَا عَلَيْهِ : অর্থাৎ, আল্লাহর ভালোবাসার ভিত্তিতেই তারা একে অপরকে ভালোবেসেছে, এবং বিচ্ছিন্ন হয়েছে তারই জন্য। আল্লাহর ভালোবাসাই তাদের উভয়ের মাঝে গড়ে দিয়েছে সখ্যতা ও বন্ধুত্ব, পার্থিব কোন প্রতিবন্ধকতা এ ব্যাপারে তাদের মাঝে আড়াল তৈরি করতে পারেনি। মৃত্যু পর্যন্ত তাদের উভয়ের মাঝে বন্ধনের একমাত্র সূত্র হল আল্লাহর মহববত।
وَ رَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتَ مَنْصَبٍ وَ جَمَالٍ : অর্থাৎ সুন্দরী নেতৃস্থানীয়া রমণী তাকে মন্দ কর্মের প্রতি আহবান জানাল।
وَ رَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ : সদকা হল : মানুষ আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য যে সম্পদ বিলিয়ে দেয়—হোক তা জাকাতের মত ফরজ কিংবা নফল দান। তবে, সদকা শব্দের ব্যবহার এক সময় ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায় কেবল নফল দানের ক্ষেত্রে।
فَأَخَفَاهَا حَتّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُه مَا تُنْفِقُ يَمِيْنُهُ : বাক্যটি দ্বারা দানের গোপনীয়তা বুঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যদি বাম হাত ডান হাতের কর্ম সম্পর্কে অবগতি লাভে সক্ষম হত, অধিক গোপনীয়তার কারণে সেও তার দানের ব্যাপারে অবগতি লাভ করতে পারত না।
خَالِيًا : নির্জনে, যেখানে কেউ নেই। বিশেষভাবে এ অবস্থাটি উল্লেখের কারণ হল, নির্জনের এবাদত রিয়া বা লোক দেখানো ভাবনা হতে মুক্ত থাকে, লোক-দেখানো প্রবৃত্তির সম্ভাবনা স্বভাবতই থাকে না।
فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ : আল্লাহর ভয়ে তার দু-চোখে অশ্রু বয়ে গেল।
আহকাম ও ফায়দা :
আল্লাহ তাআলার মহানুভবতা এই যে, কিছু কিছু কর্মকে তিনি বান্দার জন্য বিশেষ ফলদায়ক নির্ধারণ করে দিয়েছেন, উক্ত কর্মের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে অনেকের তুলনায় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে উঠে। এভাবে তিনি বান্দাদের মাঝে কল্যাণ-কর্মের উদ্দীপনা ও উৎসাহ সঞ্চার করেন।
বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে উঠা সাত শ্রেণির লোকদের কথা রাসূল সা. উক্ত হাদিসে উল্লেখ করেছেন। এ সাত শ্রেণি ব্যতীতও, অন্য কয়েকটি শ্রেণির কথা রাসূল ভিন্ন হাদিসে উল্লেখ করেছেন। উদাহরণত: আল্লাহর পথে গাজি ; অভাবীর সাহায্যকারী ; ঋণগ্রস্তকে সাহায্যদাতা ; এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মসজিদে গমনকারী—ইত্যাদি। অন্য হাদিসের এ রেওয়ায়াতের ফলে হাদিসবেত্তাগণ মত দিয়েছেন যে, সাত সংখ্যাটি এখানে বিশেষ কোন অর্থ বহন করে না। তাই সাতের মাঝেই তা সীমাবদ্ধ নয়।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী উক্ত গুণ অনুসন্ধান করেছেন এবং তার রচিত معرفة الخصال الموصلة إلى الظلال নামক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
হাদিসটিতে কেবল পুরুষের উল্লেখও কোন সীমাবদ্ধকরণের নির্দেশ করে না। দুটি স্থান ব্যতীত যা যা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে নারীরাও সমান অংশীদার। স্থান দুটি হচ্ছে—
সর্বোচ্চ নেতৃস্থান ও শাসন ব্যবস্থা। নারীরা মুসলমানদের সাধারণ নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম নয়, এবং সক্ষম নয় তারা বিচারক হতে। তবে যে সকল ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব বৈধ—যেমন স্কুলের প্রধান হওয়া—সে সকল ক্ষেত্রে নারীদের ন্যয়পরায়নতা বিবেচ্য।
দ্বিতীয়ত: নারীদের ক্ষেত্রে মসজিদে গমন করা বাধ্যতামূলক হওয়ার বিষয়টি বিবেচ্য নয়, কারণ, তাদের জন্য গৃহে সালাত আদায়ই উত্তম। অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষের সাথে সাথে নারীরাও সমানভাবে অংশীদার।
শরিয়ত ন্যয়পরায়নতার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেছে,—হোক তা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কিংবা তার তুলনায় কিছুটা নিম্নস্তরে ; এমনকি ব্যক্তির পারিবারিক জীবনও এর আওতাভুক্ত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন—
وَقُلْ آَمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ ( الشورى : 15)
আপনি বলুন, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, আমি তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি, এবং তোমাদের মাঝে ন্যয় প্রতিষ্ঠার আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি। [সূরা শূরা : ১৫]
অন্যত্র তিনি বলেন—
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ ( النحل : 90)
নিশ্চয় আল্লাহ আদেশ করেন ন্যয়পরায়নতা ও এহসানের। [সূরা নহল : ৯০]
রাসূল সা. বলেছেন—
اتقوا الله واعدلوا بين أولادكم .
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, এবং তোমাদের সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান কর। [বোখারি : ২৩৯৮] অন্যত্র বলেছেন—
إن المقسطين عند الله على منابر من نورعن يمين الرحمن عز وجل، وكلتا يديه يمين، الذين يعدلون في حكمهم وأهليهم وما ولوا .
সুবিচারকগণ আল্লাহর ডান পাশে নূরের মিম্বর সমূহে অবস্থান করবে—তার উভয় হাতই ডান ; যারা তাদের শাসন, পরিবার ও দায়িত্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ন্যয় প্রতিষ্ঠা করবে। [মুসলিম : ৩৪০৬] উক্ত হাদিসে রাসূল ন্যায়পরায়ণ শাসকের উল্লেখ সর্বপ্রথমে করেছেন, কারণ, নেতৃত্ব ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা খুবই কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের জীবনে যৌবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়, তাতে দৃঢ়তা থাকে প্রচন্ড, মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকে প্রখর—উদ্দম ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর একটি সময় মানুষের যৌবন। সুতরাং, যে ব্যক্তি যৌবনে আল্লাহ প্রবর্তিত পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করবে, দমন করবে প্রবৃত্তি ও চাহিদা—হাদিসে বর্ণিত সেই মহান স্তর তারই প্রাপ্য। যে বিষয়গুলো যৌবনে মানুষকে তা অর্জনে সাহায্য করে, তা নিম্নরূপ—
জ্ঞানান্বেষণ, ও তাতে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ।
বিভিন্ন ভালো কাজের মাধ্যমে সর্বদা সময় কাজে লাগানোর অভ্যাস গড়ে তোলা।
আল্লাহর পথের মহান অনুসারীদের সাথে সংস্পর্শ যাপন।
যুবক বয়সে পবিত্র কোরআনের পুরোটা কিংবা তার অংশ বিশেষ মুখস্থ করার প্রচেষ্টা চালান।
৭. মসজিদ আল্লাহর ঘর, তাতে ফরজ ও নফল এবাদতসমূহ পালন করা হয়। চর্চা করা হয় নানা ধর্মীয় বিদ্যা। ধর্মের আলোচনা ও নসিহত হয় সর্বদা। দ্বীনের ক্ষেত্রে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যারা মসজিদের সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত, তারা কেয়ামত দিবসে সেই মহান সওয়াব লাভ করবে। এছাড়া, যে মসজিদের সাথে সর্বদা সম্পৃক্ত, সে দূরে থাকে পাপ, এমনকি, পাপের দর্শন থেকে। অবস্থান করে আল্লাহর রহমতের স্বর্গীয় সান্নিধ্যে। এভাবে তার অন্তর পরিচ্ছন্নতা লাভ করে, স্বচ্ছ হয় তার চিন্তা-চেতনা। ক্রমান্বয়ে ক্ষালন হতে থাকে তার পাপসমূহ, বাড়তে থাকে সৎ ও সুফলদায়ক কর্মগুলো। মসজিদের সাথে সম্পৃক্ততার অর্থ এ নয় যে, সর্বদা স্বশরীরে মসজিদে অবস্থান করতে হবে। এর অর্থ এই যে, মসজিদ হতে বের হওয়ার পরও তার মন কেবল তাতে ফিরে যেতে উৎসুক হয়ে উঠবে, যখন তাতে অবস্থান করবে, স্থানটিকে তার খুবই আপন মনে হবে, লাভ করবে পরম স্বস্তি ও প্রশান্তি।
৮. সম্পর্কের নানা রকম পার্থিব ভিত্তি মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি করে—কখনো আত্মীয়তা, অর্থনৈতিক যূথবদ্ধতা, চারিত্রিক ও আচরণীয় সম্পৃক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে পালন করে থাকে মৌলিক ভূমিকা। পক্ষান্তরে, ইসলাম মানুষকে উৎসাহী করে এমন শক্তিকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরিতে, যার পুরোটাই নির্ভর করে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার উপর। কোরআন ও সুন্নাহও এ দিকটির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে—আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন—
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
মোমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। [সূরা হুজুরাত : ১০] অন্যত্র এসেছে—
الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ ﴿ الزخرف :67﴾
মোত্তাকি ব্যতীত সে দিন বন্ধুরা হবে পরস্পর পরস্পরের শত্রু। [সূরা যুখরুফ : ৬৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে এরশাদ করেন—
أوثق عرى الإيمان الحب في الله والبغض في الله .
ঈমানের মজবুতম বন্ধন হচ্ছে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, এবং তার জন্য ঘৃণা করা। [আহমদ ২৮৬/৪, বায়হাকী, হাদিসটি সহিহ]
৯. মানুষের প্রবৃত্তির রয়েছে নানা আকর্ষণ ও ইচ্ছা। ইসলাম এগুলো সুস্থ ও বৈধভাবে পূরণ করার ব্যবস্থা করেছে। শয়তান সর্বদা এ ফন্দিতে ব্যস্ত থাকে যে, কীভাবে সে মানুষকে আক্রান্ত করবে প্রবৃত্তির ফাঁদে, ভ্রষ্ট করবে সত্য পথ হতে। নারী-পুরুষ সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে শয়তান মানুষের সামনে খুবই মোহনীয় করে তুলে ধরে। নারী যদি হয় সুন্দরী, সম্মানিতা ও মর্যাদার অধিকারী, তবে পুরুষ তার প্রতি আসক্ত হয় প্রবল মোহে। যে ঈমানদার, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী, এ সকল পরিস্থিতিতে পাপে তার ঈমান বাধা প্রদান করে, সতর্ক করে দেয় ; ফলে তার অনুভূতি জাগ্রত হয় যে—আমি আল্লাহকে ভয় করি—মৌখিক এ স্বীকৃতির পর সে যখন বাস্তবেও এর অনুসরণ করে, লাভ করে হাদিসে বর্ণিত মহান সৌভাগ্য ও মর্যাদা। ইসলাম তার মৌলিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে নারী ও পুরুষকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তুলতে চায়—যে তার প্রতি কর্মে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহকে ধ্যানে উপস্থিত রাখবে। কবি বলেন—
و إذا خلوت بريبة في ظلمة و النفس داعية إلي الطغيان
فاستقم من نظر الإله و قل لها إن الذي خلق الظلام يراني
নির্জন অন্ধকারে যখন একান্ত হবে সংশয়ে (রমনীর সাথে)
আর তোমার প্রবৃত্তি আহবান জানাবে অন্যায়ের প্রতি
তখন তুমি আল্লাহর দৃষ্টির সম্মুখে লজ্জাশীল হও
তাকে বল, এ অন্ধকারের যিনি স্রষ্টা, তিনি তো আমাকে দেখছেন।
১০. সদকা এক মহান কর্ম। এর ফজিলত প্রভূত। অজস্র এর ফলাফল। এর ফজিলত ও সওয়াব বর্ণনায় অসংখ্য আয়াত ও হাদিস নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন—
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ ( البقرة : 261)
আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ ব্যয়কারীদের দৃষ্টান্ত একটি বীজের মত, যা হতে উৎপন্ন হয়েছে সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশত শস্যদানা। যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ তাআলা আরো বাড়িয়ে দেন, আল্লাহ প্রশস্ত, সর্বজ্ঞ। [সূরা বাকারা : ২৬১]
প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য—উভয় প্রকার সদকাই ফজিলতপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন—
إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ( البقرة : 271)
তোমরা যদি সদকা প্রকাশ কর, তবে তা উত্তম। আর যদি তা গোপন করে দরিদ্রদের মাঝে তা বিতরণ করে দাও, তবে তাও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তা তোমাদের পাপ ক্ষালন করবে ; তোমরা যা কর, সে ব্যাপারে আল্লাহ জ্ঞাত।’ [সূরা বাকারা : ২৭১]
অবস্থাভেদে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সদকার মাঝে উত্তম-অনুত্তম নির্ধারণ করা হয়। যদি তা প্রকাশ্যে পালন করার ব্যাপারে কোন কল্যাণ থাকে, তবে তাই উত্তম। অন্যথায়, ফরজ ও নফল—উভয় ক্ষেত্রে গোপনে পালন করা উত্তম।
১২. সর্বোত্তম আমলগুলোর মাঝে জিকির অন্যতম। সন্দেহ নেই, এটি তার সহজতরগুলোর মাঝেও অন্যতম। এতে আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা করা হয়, প্রশংসা করা হয়, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয় তার প্রতি, পেশ করা হয় সশঙ্ক আকুতি। যখন এ জিকির পালিত হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে, এবং আল্লাহর ভয়ে জিকিরকারী বান্দার দু-চোখ ভরে যায় অশ্রুধারায়, আল্লাহ তাকে মহান সওয়াবে ভূষিত করেন—তিনি তাকে ছায়া দান করেন কেয়ামতের কঠিন দিবসে, যেদিন তার ছায়া ব্যতীত ভিন্ন কোন ছায়া থাকবে না।
১৩. হাদিসটি প্রমাণ করে, এখলাসশূন্য এবাদত কোন কাজে আসে না। উল্লেখিত আমলগুলোর মাঝে একক যে গুণটি পাওয়া যায়, তা হচ্ছে এবাদতের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ এখলাস আনয়ন, এবং পার্থিব যাবতীয় উদ্দেশ্য হতে তাকে মুক্ত রাখা।
১৪. এ গুণগুলোর মাঝে যে কয়টি একক গুণ পাওয়া যায়—তা হচ্ছে, সবর, সহিষ্ণুতা। সন্দেহ নেই, আল্লাহর আনুগত্য ও তার নির্দেশ পালনের জন্য প্রয়োজন সবর ও ধৈর্য। কারণ, তার প্রতি পদে বাধা হয়ে দাঁড়াবে শয়তান, গাফেল আত্মা ও প্রবৃত্তি। বান্দা যখন এর বিরুদ্ধে অংশ নিবে আত্মিক জেহাদে, বিজয় অর্জন করবে এর বিরুদ্ধে—নিশ্চয় উত্তম পুরস্কারে ভূষিত হবে।
১৫. হাদিসটি আমাদেরকে এ হেদায়েত প্রদান করে যে, মোমিনের উচিত গোপনে সৎকর্মে অংশগ্রহণ করা। যাতে এবাদতে রিয়ার (লোক দেখানো ভাবনা) বিন্দুমাত্র সংশয় তৈরি না হয়, এবং গড়ে উঠে এখলাসের অভ্যাস।
عَنْ أبَي هُرَيْرَةَ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلّمَ- أيُّهَا النَّاسُ إنّ اللهَ طَيِّبٌ لا يَقْبَلُ إلَّا طَيِّبًا، وَ إنَّ اللهَ أمَرَ المُؤْمِنِيْنَ بِمَا أمَرَ بِهِ المُرْسَلِيْنَ، فَقَالَ : يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ ( المؤمنون : 51) وَ قَالَ : يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَاشْكُرُوا لِلَّهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ( البقرة : 172) ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ أشْعَثَ أغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، و مَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَ مَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَ مَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَ غُذِيَ بِالْحََرامِ، فَأنَّى يُسْتَجَابُ لِذلِكَ . رَوَاهُ مُسْلِمٌ .
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোক সকল ! আল্লাহ তাআলা পবিত্র এবং তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা মোমিনদেরকে ঐ সকল নির্দেশই দিয়েছেন, যা তিনি দিয়েছেন তার প্রেরিত রাসূলগণকে। আর রাসূলদের প্রতি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ছিল এই যে, হে রাসুলগণ ! পবিত্র বস্ত্ত আহার কর এবং সৎকাজ কর। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি পরিজ্ঞাত। [সুরা মুমিন ৫১]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন : হে ইমানদারগণ তোমরা পবিত্র বস্ত্ত আহার কর যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুজি হিসেবে দান করেছি, এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। যদি তোমরা তারই এবাদত করে থাক। [সুরা বাক্বারা ১৭২]
অত:পর রাসূল সা. সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ধুলোবালি মিশ্রিত অবস্থায় এলোমেলো চুল নিয়ে দুই হাত আকাশের দিকে উঁচু করে বলতে থাকে : হে আমার রব ! হে আমার রব ! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, এবং বস্ত্র হারাম, এমতাবস্থায় তার দোয়া কেমন করে কবুল হবে ! [মুসলিম]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
طيب শব্দের অর্থ পবিত্র। এখানে উদ্দেশ্য—আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিষ্কলুষ-বিমুক্ত।
لا يَقْبَلُ إلَّا طَيِّبًا আল্লাহ শুধু ঐ দানই গ্রহণ করেন যা হালাল ও পবিত্র। কেউ কেউ বলেছেন, এখানে দান-খয়রাতসহ সব আমলই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমলের মাঝে আল্লাহর নিকট ঐ আমলই গ্রহণযোগ্য যা লোক দেখানো মানসিকতা এবং অহংকার মুক্ত হয়। আর দানের মাঝে গ্রহণযোগ্য যা পবিত্র ও হালাল মাল দ্বারা আদায় করা হয়। এ ব্যাখ্যাকারীদের যুক্তি হল এই যে, পবিত্রতার গুণ সর্বপ্রকার কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম ও আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
وَ إنَّ اللهَ أمَرَ المُؤْمِنِيْنَ بِمَا أمَرَ بِهِ المُرْسَلِيْنَ .অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নবীগণ ও তাদের উম্মতকে হালাল আহার গ্রহণ ও নেক আমল করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
أشْعَثَ أغْبَرَ অর্থাৎ—পোশাক-পরিচ্ছদ ও আকার-আকৃতিতে ধুলোময় ও এলোচুলের ব্যক্তি।
غُذِيَ শব্দে غ বর্ণে পেশ হবে। ذ বর্ণে যের হবে। উদ্দেশ্য হল হারাম বস্ত্ত দ্বারা প্রতিপালিত।
فَأنَّى يُسْتَجَابُ কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে ! এখানে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে এহেন ব্যক্তির দোয়া কেমন করে কবুল হবে ! অর্থাৎ তার দোয়া কবুল হবে না।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। তাঁর জন্য রয়েছে সর্ব উৎকৃষ্ট নাম ও গুণসমূহ।
আল্লাহ স্বয়ং পূত-পবিত্র, এবং তার অভিপ্রায় হল, বান্দাগণ কথা ও কাজে, আকিদা ও বিশ্বাসে সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হবে। আল্লাহ বলেন إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ তার দিকে আরোহণ করে সৎ বাক্য এবং সৎ কর্ম তাকে তুলে নেয়। [সূরা ফাতির : ১০।] মহান রাববুল আলামিন রাসূলের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে যে গুণটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তাহল, রাসূল উম্মতের জন্য পবিত্র বস্ত্ত হালাল করেন,—কোরআনে এসেছে— وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ অর্থ : তিনি মোমিনদের জন্য উত্তম বস্ত্ত হালাল করেন। [সূরা আরাফ : ১৫৭।] এবং মোমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেছেন— الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ অর্থাৎ ফেরেশতারা যাদের রূহ পবিত্র থাকা অবস্থায় কবজ করে (তাদের প্রতি শুভ সংবাদ)। [সূরা নহল : ৩২] মোমিন দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান—সর্বাবস্থায় হবে সম্পূর্ণ পবিত্র। তার অন্তরে ঈমান আছে, তাই তার অন্তর পবিত্র। এমনিভাবে মুখে সদা আল্লাহর জিকির গুঞ্জরিত, তাই তার মুখও পবিত্র। এমনিভাবে তার অন্যান্য অঙ্গের দ্বারা আল্লাহর বিভিন্ন এবাদত হচ্ছে, তাই তার অন্য সব অঙ্গও পবিত্র। আবু হুরাইরা রা.-কে সম্বোধন করে রাসূল বলেন—
سبحان الله إن المسلم لا ينجس .
সুবহানাল্লাহ ! নিশ্চয় মুসলিম কখনো অপবিত্র হয় না। [বোখারি : ৬৭২] পক্ষান্তরে কাফেরদের সম্পর্কে বলেছেন,
إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ
wনশ্চয় মুশরিকগণ অপবিত্র। [সূরা তওবা : ২৮।]
মোমিন বান্দাগণ সার্বিকভাবে পবিত্র হওয়া যেমন আল্লাহর অভিপ্রায়, তেমনিভাবে তারা অপবিত্র ও আবর্জনা যুক্ত হওয়া তার খুবই অপছন্দনীয়। হোক না সে অপবিত্রতা কথায়, কাজে কিংবা আকিদা ও বিশ্বাসে। আল্লাহ এই মর্মে রাসূলের প্রশংসা করেছেন যে, তিনি পূত-পবিত্র বস্ত্ত উম্মতের জন্য হালাল করেন। আর হারাম করেন অপবিত্র ও আবর্জনাযুক্ত বস্ত্ত। আল্লাহ বলেন—
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ .
এবং আল্লাহ তাদের জন্য পবিত্র বস্ত্ত হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্ত্ত হারাম করেন। [সূরা আরাফ :১৫৭]
আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, অর্থ উপার্জন শুধু হালাল ও বৈধভাবেই হতে হবে, হারাম বা অবৈধ ভাবে কখনো হতে পারবে না। সুতরাং হারাম পদ্ধতিতে উপার্জিত সম্পদ থেকে দান-খয়রাতও গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এমন একটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন, মুমিনগণ ও নবিগণ উভয়ের মাঝে যা দৃশ্যমান-বিস্তৃত। আর তা এই যে, তারা হালাল বস্ত্তই আহার হিসেবে গ্রহণ করে। কোরআন ও হাদিসের বহু উদ্ধৃতি হালাল উপার্জন ও আহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ এবং হারাম উপার্জন ও ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا
হে মানবমন্ডলী ! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী ভক্ষণ কর। [বাকারা : ১৬৮।]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
হে ইমানদারগণ ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, কেবল মাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। [নিসা : ২৯।] (অন্যের মাল যা ব্যবসার মাধ্যমে হস্তগত হয় তা বৈধ)
আল্লাহ আরো এরশাদ করেন—
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ
তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোন গোনাহ নেই। [বাকারা : ১৯৮।]
ইমাম বোখারি আবু হুরায়রার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يأتي على الناس زمان لا يبالي المرأ ما أخذ، أ من الحلال أم من الحرام .
মানুষের নিকট এমন এক সময় আগত হবে, যখন তারা শুধু সম্পদ সঞ্চয়ের চিন্তায় বিভোর থাকবে। আর তা কি হালাল উপায়ে আসছে না হারাম উপায়ে—এ ব্যাপারে চিন্তা করবে না বিন্দুমাত্র। [বোখারি : ১৯৩০]
মেকদাম রা. বর্ণনা করেন—রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
ما أكل أحد طعاما قط خيرا من أن يأكل من عمل يده، وإن نبى الله داود كان يأكل من عمل يده .
মানুষ স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্য থেকে উত্তম খাদ্য কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাউদ আ. হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
لأن يحتطب أحدكم حزمة على ظهره خير من أن يسأل أحدا فيعطيه أو يمنعه .
লাকড়ির বোঝা পিঠে বহন করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের নিকট ভিক্ষা করার চেয়ে উত্তম—যা কখনো প্রদান করে আবার কখনো প্রদান করে না।
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হালাল ও পবিত্র সম্পদ ব্যতীত আল্লাহ তাআলা দান হিসেবে গ্রহণ করবেন না। সুতরাং, হারাম সম্পদ থেকে দান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لا يقبل صلاة بغير طهور و لا صدقة من غلول .
পবিত্রতা ব্যতীত নামাজ গ্রহণযোগ্য না। আর غلول থেকে দান গ্রহণযোগ্য না। [মুসলিম শরিফ : ৩২৯]
غلول বলা হয়, যুদ্ধলব্ধ মালে আত্মসাত করা। তবে, এখানে উদ্দেশ্য হল অসৎ উপায়ে উপার্জিত যে কোন বস্ত্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ما تصدق عبد بصدقة من مال طيب ولا يقبل الله إلا الطيب إلا أخذها الرحمن بيمينه . رواه البخاري ومسلم
আল্লাহ তাআলা হালাল বস্ত্ত ব্যতীত গ্রহণ করেন না। যদি কোন ব্যক্তি তার হালাল সম্পদ থেকে দান করে তবে আল্লাহ তার ডান হাত দিয়ে তা গ্রহণ করেন। [২ বোখারি ১৩২১]
৬. হারাম সম্পদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ, পান, বা পরিধান বা অন্য কোন উপায়ে ভোগ করা দোয়া কবুল হবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যদিও দোয়া কবুল হওয়ার যাবতীয় উপকরণ উপস্থিত থাকে। যথা—দীর্ঘ পথ অতিক্রম, দান খয়রাত, কাকুতি-মিনতি, হাত উত্তোলন, ও দোয়ার আধিক্য—ইত্যাদি।
৭. আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর থেকে উভয় জগতের কল্যাণ কামনা, ও সফলতা অর্জনে দোয়া হল সর্বোত্তম মাধ্যম। যে ব্যক্তি দোয়া কবুল থেকে বঞ্চিত, সে উভয় জগতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
৮. এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়ার কতিপয় আদব শিক্ষা দিয়েছেন যা দোয়া কবুলের জন্য সহায়ক।
ক) সফর তথা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা। সফর—সন্দেহ নেই, দোয়া কবুলের দাবি রাখে। যেমন আবু হুরাইরা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
ثلاث دعوات مستجابات لا شك فيهن : دعوة المظلوم، ودعوة المسافر، ودعوة الوالد لولده .
তিন ব্যক্তির দোয়া অবশ্যই কবুল হয়।
(১) অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া, (২) মুসাফিরের দোয়া, (৩) সন্তানের জন্য পিতার দোয়া। [বোখারি : আল-আদাবুল মুফরাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজা, সহিহ আল জামে, হাদিস নং ৩০৩২]
আর যদি সফর অতিশয় লম্বা হয়, তখন দোয়া কবুলের সম্ভাবনা আরো বেশি হয়ে দেখা দেয়। কেননা, দীর্ঘ পথ সফরে সাধারণত: অধিক কষ্ট, সাহায্য ও বাসস্থান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করাতে দেহ-মনে ভগ্নতা সৃষ্টি হয়। ভগ্ন হৃদয়ের দোয়া খুব দ্রুত কবুল হয়।
এ হাদিস অনেক ক্ষেত্রে দোয়ায় হাত উঠানোর প্রমাণ বহন করে। সালমান রা. এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إن الله تعالى حي كريم يستحي إذا رفع الرجل إليه يديه أن يردهما صفرا خائبتين .
নিশ্চয় মহান আল্লাহ দয়ালু, জীবন্ত, মানুষ যখন হাত উত্তোলন করে তাঁর নিকট দোয়া করে তখন তাকে বঞ্চিত অবস্থায় খালি হাতে ফেরত দিতে তিনি লজ্জা বোধ করেন। [২ তিরমিজি, আবু দাউদ]
يا رب يا رب অর্থ হে প্রভু ! হে প্রভু !—বলে যখন স্রষ্টার সৃষ্টির অধিক পরিমাণে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে দোয়া করা হয়, তখন তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোক সকল ! আল্লাহ তাআলা পবিত্র এবং তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা মোমিনদেরকে ঐ সকল নির্দেশই দিয়েছেন, যা তিনি দিয়েছেন তার প্রেরিত রাসূলগণকে। আর রাসূলদের প্রতি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ছিল এই যে, হে রাসুলগণ ! পবিত্র বস্ত্ত আহার কর এবং সৎকাজ কর। তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি পরিজ্ঞাত। [সুরা মুমিন ৫১]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন : হে ইমানদারগণ তোমরা পবিত্র বস্ত্ত আহার কর যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুজি হিসেবে দান করেছি, এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। যদি তোমরা তারই এবাদত করে থাক। [সুরা বাক্বারা ১৭২]
অত:পর রাসূল সা. সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ধুলোবালি মিশ্রিত অবস্থায় এলোমেলো চুল নিয়ে দুই হাত আকাশের দিকে উঁচু করে বলতে থাকে : হে আমার রব ! হে আমার রব ! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, এবং বস্ত্র হারাম, এমতাবস্থায় তার দোয়া কেমন করে কবুল হবে ! [মুসলিম]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
طيب শব্দের অর্থ পবিত্র। এখানে উদ্দেশ্য—আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি হতে নিষ্কলুষ-বিমুক্ত।
لا يَقْبَلُ إلَّا طَيِّبًا আল্লাহ শুধু ঐ দানই গ্রহণ করেন যা হালাল ও পবিত্র। কেউ কেউ বলেছেন, এখানে দান-খয়রাতসহ সব আমলই উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমলের মাঝে আল্লাহর নিকট ঐ আমলই গ্রহণযোগ্য যা লোক দেখানো মানসিকতা এবং অহংকার মুক্ত হয়। আর দানের মাঝে গ্রহণযোগ্য যা পবিত্র ও হালাল মাল দ্বারা আদায় করা হয়। এ ব্যাখ্যাকারীদের যুক্তি হল এই যে, পবিত্রতার গুণ সর্বপ্রকার কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম ও আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
وَ إنَّ اللهَ أمَرَ المُؤْمِنِيْنَ بِمَا أمَرَ بِهِ المُرْسَلِيْنَ .অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নবীগণ ও তাদের উম্মতকে হালাল আহার গ্রহণ ও নেক আমল করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
أشْعَثَ أغْبَرَ অর্থাৎ—পোশাক-পরিচ্ছদ ও আকার-আকৃতিতে ধুলোময় ও এলোচুলের ব্যক্তি।
غُذِيَ শব্দে غ বর্ণে পেশ হবে। ذ বর্ণে যের হবে। উদ্দেশ্য হল হারাম বস্ত্ত দ্বারা প্রতিপালিত।
فَأنَّى يُسْتَجَابُ কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে ! এখানে বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে এহেন ব্যক্তির দোয়া কেমন করে কবুল হবে ! অর্থাৎ তার দোয়া কবুল হবে না।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। তাঁর জন্য রয়েছে সর্ব উৎকৃষ্ট নাম ও গুণসমূহ।
আল্লাহ স্বয়ং পূত-পবিত্র, এবং তার অভিপ্রায় হল, বান্দাগণ কথা ও কাজে, আকিদা ও বিশ্বাসে সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হবে। আল্লাহ বলেন إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ তার দিকে আরোহণ করে সৎ বাক্য এবং সৎ কর্ম তাকে তুলে নেয়। [সূরা ফাতির : ১০।] মহান রাববুল আলামিন রাসূলের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে যে গুণটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন তাহল, রাসূল উম্মতের জন্য পবিত্র বস্ত্ত হালাল করেন,—কোরআনে এসেছে— وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ অর্থ : তিনি মোমিনদের জন্য উত্তম বস্ত্ত হালাল করেন। [সূরা আরাফ : ১৫৭।] এবং মোমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেছেন— الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ অর্থাৎ ফেরেশতারা যাদের রূহ পবিত্র থাকা অবস্থায় কবজ করে (তাদের প্রতি শুভ সংবাদ)। [সূরা নহল : ৩২] মোমিন দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান—সর্বাবস্থায় হবে সম্পূর্ণ পবিত্র। তার অন্তরে ঈমান আছে, তাই তার অন্তর পবিত্র। এমনিভাবে মুখে সদা আল্লাহর জিকির গুঞ্জরিত, তাই তার মুখও পবিত্র। এমনিভাবে তার অন্যান্য অঙ্গের দ্বারা আল্লাহর বিভিন্ন এবাদত হচ্ছে, তাই তার অন্য সব অঙ্গও পবিত্র। আবু হুরাইরা রা.-কে সম্বোধন করে রাসূল বলেন—
سبحان الله إن المسلم لا ينجس .
সুবহানাল্লাহ ! নিশ্চয় মুসলিম কখনো অপবিত্র হয় না। [বোখারি : ৬৭২] পক্ষান্তরে কাফেরদের সম্পর্কে বলেছেন,
إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ
wনশ্চয় মুশরিকগণ অপবিত্র। [সূরা তওবা : ২৮।]
মোমিন বান্দাগণ সার্বিকভাবে পবিত্র হওয়া যেমন আল্লাহর অভিপ্রায়, তেমনিভাবে তারা অপবিত্র ও আবর্জনা যুক্ত হওয়া তার খুবই অপছন্দনীয়। হোক না সে অপবিত্রতা কথায়, কাজে কিংবা আকিদা ও বিশ্বাসে। আল্লাহ এই মর্মে রাসূলের প্রশংসা করেছেন যে, তিনি পূত-পবিত্র বস্ত্ত উম্মতের জন্য হালাল করেন। আর হারাম করেন অপবিত্র ও আবর্জনাযুক্ত বস্ত্ত। আল্লাহ বলেন—
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ .
এবং আল্লাহ তাদের জন্য পবিত্র বস্ত্ত হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্ত্ত হারাম করেন। [সূরা আরাফ :১৫৭]
আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, অর্থ উপার্জন শুধু হালাল ও বৈধভাবেই হতে হবে, হারাম বা অবৈধ ভাবে কখনো হতে পারবে না। সুতরাং হারাম পদ্ধতিতে উপার্জিত সম্পদ থেকে দান-খয়রাতও গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এমন একটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন, মুমিনগণ ও নবিগণ উভয়ের মাঝে যা দৃশ্যমান-বিস্তৃত। আর তা এই যে, তারা হালাল বস্ত্তই আহার হিসেবে গ্রহণ করে। কোরআন ও হাদিসের বহু উদ্ধৃতি হালাল উপার্জন ও আহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ এবং হারাম উপার্জন ও ভক্ষণের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا
হে মানবমন্ডলী ! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী ভক্ষণ কর। [বাকারা : ১৬৮।]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
হে ইমানদারগণ ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, কেবল মাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। [নিসা : ২৯।] (অন্যের মাল যা ব্যবসার মাধ্যমে হস্তগত হয় তা বৈধ)
আল্লাহ আরো এরশাদ করেন—
لَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ
তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করায় কোন গোনাহ নেই। [বাকারা : ১৯৮।]
ইমাম বোখারি আবু হুরায়রার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يأتي على الناس زمان لا يبالي المرأ ما أخذ، أ من الحلال أم من الحرام .
মানুষের নিকট এমন এক সময় আগত হবে, যখন তারা শুধু সম্পদ সঞ্চয়ের চিন্তায় বিভোর থাকবে। আর তা কি হালাল উপায়ে আসছে না হারাম উপায়ে—এ ব্যাপারে চিন্তা করবে না বিন্দুমাত্র। [বোখারি : ১৯৩০]
মেকদাম রা. বর্ণনা করেন—রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
ما أكل أحد طعاما قط خيرا من أن يأكل من عمل يده، وإن نبى الله داود كان يأكل من عمل يده .
মানুষ স্বহস্তে উপার্জিত খাদ্য থেকে উত্তম খাদ্য কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাউদ আ. হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
لأن يحتطب أحدكم حزمة على ظهره خير من أن يسأل أحدا فيعطيه أو يمنعه .
লাকড়ির বোঝা পিঠে বহন করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের নিকট ভিক্ষা করার চেয়ে উত্তম—যা কখনো প্রদান করে আবার কখনো প্রদান করে না।
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হালাল ও পবিত্র সম্পদ ব্যতীত আল্লাহ তাআলা দান হিসেবে গ্রহণ করবেন না। সুতরাং, হারাম সম্পদ থেকে দান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لا يقبل صلاة بغير طهور و لا صدقة من غلول .
পবিত্রতা ব্যতীত নামাজ গ্রহণযোগ্য না। আর غلول থেকে দান গ্রহণযোগ্য না। [মুসলিম শরিফ : ৩২৯]
غلول বলা হয়, যুদ্ধলব্ধ মালে আত্মসাত করা। তবে, এখানে উদ্দেশ্য হল অসৎ উপায়ে উপার্জিত যে কোন বস্ত্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ما تصدق عبد بصدقة من مال طيب ولا يقبل الله إلا الطيب إلا أخذها الرحمن بيمينه . رواه البخاري ومسلم
আল্লাহ তাআলা হালাল বস্ত্ত ব্যতীত গ্রহণ করেন না। যদি কোন ব্যক্তি তার হালাল সম্পদ থেকে দান করে তবে আল্লাহ তার ডান হাত দিয়ে তা গ্রহণ করেন। [২ বোখারি ১৩২১]
৬. হারাম সম্পদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ, পান, বা পরিধান বা অন্য কোন উপায়ে ভোগ করা দোয়া কবুল হবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যদিও দোয়া কবুল হওয়ার যাবতীয় উপকরণ উপস্থিত থাকে। যথা—দীর্ঘ পথ অতিক্রম, দান খয়রাত, কাকুতি-মিনতি, হাত উত্তোলন, ও দোয়ার আধিক্য—ইত্যাদি।
৭. আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর থেকে উভয় জগতের কল্যাণ কামনা, ও সফলতা অর্জনে দোয়া হল সর্বোত্তম মাধ্যম। যে ব্যক্তি দোয়া কবুল থেকে বঞ্চিত, সে উভয় জগতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
৮. এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়ার কতিপয় আদব শিক্ষা দিয়েছেন যা দোয়া কবুলের জন্য সহায়ক।
ক) সফর তথা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা। সফর—সন্দেহ নেই, দোয়া কবুলের দাবি রাখে। যেমন আবু হুরাইরা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
ثلاث دعوات مستجابات لا شك فيهن : دعوة المظلوم، ودعوة المسافر، ودعوة الوالد لولده .
তিন ব্যক্তির দোয়া অবশ্যই কবুল হয়।
(১) অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া, (২) মুসাফিরের দোয়া, (৩) সন্তানের জন্য পিতার দোয়া। [বোখারি : আল-আদাবুল মুফরাদ, আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজা, সহিহ আল জামে, হাদিস নং ৩০৩২]
আর যদি সফর অতিশয় লম্বা হয়, তখন দোয়া কবুলের সম্ভাবনা আরো বেশি হয়ে দেখা দেয়। কেননা, দীর্ঘ পথ সফরে সাধারণত: অধিক কষ্ট, সাহায্য ও বাসস্থান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করাতে দেহ-মনে ভগ্নতা সৃষ্টি হয়। ভগ্ন হৃদয়ের দোয়া খুব দ্রুত কবুল হয়।
এ হাদিস অনেক ক্ষেত্রে দোয়ায় হাত উঠানোর প্রমাণ বহন করে। সালমান রা. এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إن الله تعالى حي كريم يستحي إذا رفع الرجل إليه يديه أن يردهما صفرا خائبتين .
নিশ্চয় মহান আল্লাহ দয়ালু, জীবন্ত, মানুষ যখন হাত উত্তোলন করে তাঁর নিকট দোয়া করে তখন তাকে বঞ্চিত অবস্থায় খালি হাতে ফেরত দিতে তিনি লজ্জা বোধ করেন। [২ তিরমিজি, আবু দাউদ]
يا رب يا رب অর্থ হে প্রভু ! হে প্রভু !—বলে যখন স্রষ্টার সৃষ্টির অধিক পরিমাণে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে দোয়া করা হয়, তখন তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।
عَنْ جَابِرٍ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ كَانَ النَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- يُعَلِّمُنَا الْاِسْتِخَارَةَ فِي الْأُمُوْرِ كُلِّهَا، كَالسُّوْرَةِ مِنَ الْقُرْآنِ : ( إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالْأَمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الْفَرِيْضَةِ، ثُمَّ يَقُوْلُ : اللّهُمَّ إنِّيْ أسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ، وَ أسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَ أسْألُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ، فَإنَّكَ تَقْدِرُ وَ لآ أقْدِرُ، وَ تَعْلَمُ وَ لآ أعْلَمُ، وَ أنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوْبِ، اللّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هذَا الْأمْرَ خَيْرٌ لِّيْ فِيْ دِيْنِيْ وَ مَعَاشِيْ وَ عَاقِبَةِ أمْرِيْ- أوْ قَالَ : فِيْ عَاجِلِ أمْرِيْ وَآجِلِه- فَاقْدُرْهُ لِيْ، وَ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هذَا الْأمْرَ شَرٌّ لِّيْ فِيْ دِيْنِيْ وَ مَعَاشِيْ وَ عَاقِبَةِ أمْرِيْ- أوْ قَالَ : فِيْ عَاجِلِ أمْرِيْ وَ آجِلِه- فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَ اصْرِفْنِيْ عَنْهُ، وَ اقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ رَضِّنِيْ بِه . ( وَ يُسَمِّيْ حَاجَتَه .) رَوَاهُ الْبُخَاِريْ .
জাবের রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে কোন কাজ করার পূর্বে ইসতেখারার নির্দেশ দিতেন। তাই ইসতেখারার দোয়া এরূপ গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ করাতেন যেরূপ গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ করাতেন কোরআনের সূরা।
ইসতেখারার নিয়ম এই যে, প্রথমে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে উলেখিত দোয়া পাঠ করবে—যার অর্থ: হে আল্লাহ ! আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি। এবং আপনার মহা অনুগ্রহ কামনা করছি। কেননা আপনি শক্তিধর, আমি শক্তিহীন, আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন। এবং আপনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী। হে আল্লাহ ! এই কাজটি (এখানে উদ্দিষ্ট কাজ বা বিষয়টি উলেখ করবে) আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দ্বীন, আমার জীবিকা এবং আমার পরিণতির ক্ষেত্রে অথবা ইহলোক ও পরলোকে কল্যাণকর হয়, তবে তাতে আমাকে সামর্থ্য দিন। পক্ষান্তরে এই কাজটি আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দ্বীন, জীবিকা, ও পরিণতির দিক দিয়ে অথবা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং আমাকেও তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং কল্যাণ যেখানেই থাকুক, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। অত:পর তাতেই আমাকে পরিতুষ্ট রাখুন। (অত:পর সে তার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে।) [বোখারি]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
خير থ الْاِسْتِخَارَةَ বা خيرة দ্বারা অর্থ আল্লাহ থেকে কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। উদ্দেশ্য হল অপরিহার্য দুই বস্ত্ত ভালটি কামনা করা।
فِي الْأُمُوْرِ كُلِّهَا প্রতিটি কাজে ইসতেখারা করা। كل শব্দটা ব্যাপক অর্থবোধক। তবে এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়নি। কেননা, ফরজ, ওয়াজিব কাজ করার জন্য আর হারাম, মাকরূহ কাজ না করার জন্য ইসতেখারা হয় না। সুতরাং, ইসতেখারা শুধু মুবাহ বা জায়েজ কাজ করা না করা আর মোস্তাহাব বা উত্তম—দ্বি-অবকাশমুখী কাজের মাঝে কোনটি করবে তা নির্ণয়ের জন্য হয়ে থাকে।
كَالسُّوْرَةِ مِنَ الْقُرْآنِ ইসতেখারার দোয়া শিক্ষাকে কোরআন শিক্ষার সাথে তুলনা করার কারণ হল কোরআন যেমন সর্বপ্রকার নামাজে প্রয়োজন তেমনিভাবে সর্বপ্রকার কাজে ইসতেখারাও প্রয়োজন। কোন কোন আলেম বলেছেন, এখানে শাব্দিক উদাহরণ উদ্দেশ্য ; অর্থাৎ কোরআন মজিদের প্রতিটি হরফ মুখস্থ করা ও গুরুত্ব সহকারে তা সংরক্ষণের ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব দিতেন তেমনিই গুরুত্ব দিতেন ইসতেখারার দোয়া মুখস্থ ও সংরক্ষণের ব্যাপারে।
إِذَا هَمَّ অর্থাৎ যখন কোন কাজের ইচ্ছা করে। কমপক্ষে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। যদি কেউ ইচ্ছা করে তবে বেশিও পড়তে পারবে। তবে প্রতি দুই রাকাত এক সালামে হতে হবে। দুই এর অধিক রাকাত এক সালামে এই ক্ষেত্রে শুদ্ধ হবে না।
أسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ আপনার সর্বময় জ্ঞানের আলোকে যা কল্যাণকর আমি তা চাচ্ছি, যেহেতু আপনিই ভাল-মন্দ সব জানেন।
وَ أسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ আপনার নিকট সে কাজ করার সক্ষমতা প্রার্থনা করছি।
وَ أسْألُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ এ বাক্য দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোন কাজে সফল হওয়া আল্লাহ তাআলার অনুকম্পা ও অনুগ্রহ ব্যতীত সম্ভব নয়।
أوْ قَالَ : فِيْ عَاجِلِ أمْرِيْ وَ آجِلِه হাদিস বর্ণনাকারী এখানে সন্দেহ পোষণ করছেন, যে রাসূল সা. اللّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هذَا الْأمْرَ خَيْرٌ لِّيْ এবং وَ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هذَا الْأمْرَ شَرٌّ لِّيْ এর পরে হয়তো فِيْ دِيْنِيْ وَ مَعَاشِيْ وَ عَاقِبَةِ أمْرِيْ - বলেছেন কিংবা فِيْ عَاجِلِ أمْرِيْ وَآجِلِه - বলেছেন।
فَاقْدُرْهُ لِيْ : الدال বর্ণে পেশ ও জবর উভয় হতে পারে। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত কাজ বিষয় আমার সাধ্য দিন ও সহজ করে দিন।
وَ اصْرِفْنِيْ عَنْهُ যে কাজ আমার জন্য অমঙ্গলজনক আমাকে সে কাজ হতে বিরত রাখার সাথে সাথে অন্তরকেও সে কাজের আগ্রহ থেকে ফিরিয়ে রাখুন।
ইসতেখারার হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
উম্মতের প্রতি রাসূলের অগাধ ভালোবাসা ও দয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যে, তিনি উম্মতকে শিক্ষা দিলেন প্রত্যেক কাজের ভাল-মন্দ আল্লাহ তাআলা থেকে চেয়ে নাও এবং সম্পর্ক আল্লাহর সাথে রাখ।
ইসতেখারার দোয়া এ শিক্ষা দেয় যে, কোন মানুষ তার ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তথা নির্ভুল পদক্ষেপ, সুউচ্চ জ্ঞান বৃদ্ধি, অর্থ সম্পদ, বংশ-মর্যাদা ও আধিপত্যের দ্বারা মন্দ কাজ থেকে বেঁচে গেলে ভাল-কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মহান আল্লাহ যাকে চান সেই শুধু ভাল কাজ করতে পারে ও মন্দ কাজ থেকে বাঁচতে পারে। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا حول و لا قوة إلا بالله বেহেশতের গুপ্ত ধনসমূহের একটি ধন।
ইসতেখারা সর্ব কাজের সফলতার সর্বোত্তম উপায়। কেননা, এতে নম্রতা ও বিনয়ের সাথে মহান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের আকাঙ্ক্ষা ও অভাবনীয় শাস্তি থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানানো হয়। যেহেতু তিনিই সর্ব কাজের অধিকারী, তাই তিনিই জানেন, প্রতিটি কাজের পরিণাম ফল কী হবে। তাই মানুষ ইসতেখারার মাধ্যমে তারই শরণাপন্ন হয়, যাতে সফলতার দিক নির্দেশনা পায়। মহান আল্লাহ বলেছেন ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে ও সংগোপনে। [সূরা আরাফ : ৫৫]
ইসতেখারা নামাজ ও দোয়ার সমন্বয়। সৌভাগ্যবান সে যে ইসতেখারা করে আর হতভাগা সে যে ইসতেখারা করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :—
من سعادة ابن آدم استخارته الله، من سعادة ابن آدم رضاه بما قضاه الله، و من شقوة ابن آدم تركه استخارته الله، و من شقوة ابن آدم سخطه بما قضى الله عز و جل .
আদম সন্তানের সৌভাগ্যের বিষয়সমূহ থেকে একটি হল ইসতেখারা করা ও আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। আর মানুষের দুর্ভাগ্য হল ইসতেখারা না করা ও আল্লাহর ফয়সালার উপর অসন্তুষ্ট থাকা। [আহমদ : ১৩৬৭]
এ হাদিস প্রমাণ করে যে, ইসতেখারা শরিয়ত স্বীকৃত একটি এবাদত। এ আমল সে করবে যে শরিয়ত অনুমোদিত কোন মুবাহ বা হালাল কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে।—অথবা যে দ্বি-অবকাশমুখী মোস্তাহাবের উত্তমটি নির্ণয়ের ইচ্ছা করে। কেননা দ্বি-অবকাশমুখী মোস্তাহাব এবং ওয়াজিব কাজ আদায়ে হারাম ও মাকরূহ কাজ পরিহারে ইসতেখারা হয় না। হ্যা যদি কোন মাকরূহ পরিহার করাতে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সে মাকরূহ ছাড়া না ছাড়ার ব্যাপারে ইসতেখারা হতে পারে। যে সব কাজে ইসতেখারা হয় তন্মধ্যে—যেমন সফর, চাকুরি, বিয়ে ঘর বা দোকান ভাড়া ইত্যাদি।
ইসতেখারার নামাজ কমপক্ষে দুই রাকাত এবং তা নফল। হ্যাঁ, যদি তাহিয়্যাতুল মসজিদের সাথে সাথে (যা মসজিদের প্রবেশের পর পর পড়া হয়) ইসতেখারার নিয়ত করলে এক সাথে উভয়টা আদায় হয়ে যাবে।
হাদিসের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে যে ইসতেখারার দোয়া নামাজের পরে হবে। কিন্তু কিছু সংখ্যক ওলামা বলেছেন নামাজের মধ্যেও হতে পারে। যেমন সেজদারত অবস্থায় ও শেষ বৈঠকে তাশাহুদ ও দরুদ শরীফের পর। হাদিসের বর্ণনায় বুঝা যাচ্ছে যে আগে নামাজ অত:পর দোয়া। তার কারণ, ইসতেখারা করার অর্থই হল ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। আর আল্লাহর রহমতের দরজা খোলার জন্য নামাজতুল্য কোন এবাদত নেই। কেননা নামাজই একমাত্র এবাদত যাতে অনেক এবাদতের সমষ্টি রয়েছে। আল্লাহর প্রশংসা তার বড়ত্ব ও মহত্ত্ব ও সর্ব শ্রেণির লোকের সর্বাবস্থায় মুখাপেক্ষীর উজ্জ্বল প্রমাণ।
যে ব্যক্তি ইসতেখারা করবে সে অবশ্যই দোয়ার মাঝে তার প্রত্যাশিত বিষয় উলেখ করবে।
বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, ইসতেখারা করার পর তার মন যে দিকে ধাবিত হবে সে দিকেই যাবে। আর যদি কোন দিকে ধাবিত না হয় তা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন দিক নির্দেশনা না পাবে, বা কোন দিকে মন ধাবিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসতেখারা করতে থাকবে।
এ হাদিসে আল্লাহর দুটি সিফাত বা গুণ প্রমাণিত হল। এক : এলেম বা জ্ঞানের সিফাত। দুই : কুদরত বা ক্ষমতার সিফাত। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হল যে, আল্লাহর নাম বা গুণের উসিলায় দোয়া করা শরিয়ত স্বীকৃত।
জাবের রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে কোন কাজ করার পূর্বে ইসতেখারার নির্দেশ দিতেন। তাই ইসতেখারার দোয়া এরূপ গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ করাতেন যেরূপ গুরুত্ব দিয়ে মুখস্থ করাতেন কোরআনের সূরা।
ইসতেখারার নিয়ম এই যে, প্রথমে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে উলেখিত দোয়া পাঠ করবে—যার অর্থ: হে আল্লাহ ! আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি। এবং আপনার মহা অনুগ্রহ কামনা করছি। কেননা আপনি শক্তিধর, আমি শক্তিহীন, আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন। এবং আপনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী। হে আল্লাহ ! এই কাজটি (এখানে উদ্দিষ্ট কাজ বা বিষয়টি উলেখ করবে) আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দ্বীন, আমার জীবিকা এবং আমার পরিণতির ক্ষেত্রে অথবা ইহলোক ও পরলোকে কল্যাণকর হয়, তবে তাতে আমাকে সামর্থ্য দিন। পক্ষান্তরে এই কাজটি আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দ্বীন, জীবিকা, ও পরিণতির দিক দিয়ে অথবা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং আমাকেও তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং কল্যাণ যেখানেই থাকুক, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। অত:পর তাতেই আমাকে পরিতুষ্ট রাখুন। (অত:পর সে তার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে।) [বোখারি]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
خير থ الْاِسْتِخَارَةَ বা خيرة দ্বারা অর্থ আল্লাহ থেকে কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। উদ্দেশ্য হল অপরিহার্য দুই বস্ত্ত ভালটি কামনা করা।
فِي الْأُمُوْرِ كُلِّهَا প্রতিটি কাজে ইসতেখারা করা। كل শব্দটা ব্যাপক অর্থবোধক। তবে এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়নি। কেননা, ফরজ, ওয়াজিব কাজ করার জন্য আর হারাম, মাকরূহ কাজ না করার জন্য ইসতেখারা হয় না। সুতরাং, ইসতেখারা শুধু মুবাহ বা জায়েজ কাজ করা না করা আর মোস্তাহাব বা উত্তম—দ্বি-অবকাশমুখী কাজের মাঝে কোনটি করবে তা নির্ণয়ের জন্য হয়ে থাকে।
كَالسُّوْرَةِ مِنَ الْقُرْآنِ ইসতেখারার দোয়া শিক্ষাকে কোরআন শিক্ষার সাথে তুলনা করার কারণ হল কোরআন যেমন সর্বপ্রকার নামাজে প্রয়োজন তেমনিভাবে সর্বপ্রকার কাজে ইসতেখারাও প্রয়োজন। কোন কোন আলেম বলেছেন, এখানে শাব্দিক উদাহরণ উদ্দেশ্য ; অর্থাৎ কোরআন মজিদের প্রতিটি হরফ মুখস্থ করা ও গুরুত্ব সহকারে তা সংরক্ষণের ব্যাপারে যেমন গুরুত্ব দিতেন তেমনিই গুরুত্ব দিতেন ইসতেখারার দোয়া মুখস্থ ও সংরক্ষণের ব্যাপারে।
إِذَا هَمَّ অর্থাৎ যখন কোন কাজের ইচ্ছা করে। কমপক্ষে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। যদি কেউ ইচ্ছা করে তবে বেশিও পড়তে পারবে। তবে প্রতি দুই রাকাত এক সালামে হতে হবে। দুই এর অধিক রাকাত এক সালামে এই ক্ষেত্রে শুদ্ধ হবে না।
أسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ আপনার সর্বময় জ্ঞানের আলোকে যা কল্যাণকর আমি তা চাচ্ছি, যেহেতু আপনিই ভাল-মন্দ সব জানেন।
وَ أسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ আপনার নিকট সে কাজ করার সক্ষমতা প্রার্থনা করছি।
وَ أسْألُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيْمِ এ বাক্য দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোন কাজে সফল হওয়া আল্লাহ তাআলার অনুকম্পা ও অনুগ্রহ ব্যতীত সম্ভব নয়।
أوْ قَالَ : فِيْ عَاجِلِ أمْرِيْ وَ آجِلِه হাদিস বর্ণনাকারী এখানে সন্দেহ পোষণ করছেন, যে রাসূল সা. اللّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هذَا الْأمْرَ خَيْرٌ لِّيْ এবং وَ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أنَّ هذَا الْأمْرَ شَرٌّ لِّيْ এর পরে হয়তো فِيْ دِيْنِيْ وَ مَعَاشِيْ وَ عَاقِبَةِ أمْرِيْ - বলেছেন কিংবা فِيْ عَاجِلِ أمْرِيْ وَآجِلِه - বলেছেন।
فَاقْدُرْهُ لِيْ : الدال বর্ণে পেশ ও জবর উভয় হতে পারে। অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত কাজ বিষয় আমার সাধ্য দিন ও সহজ করে দিন।
وَ اصْرِفْنِيْ عَنْهُ যে কাজ আমার জন্য অমঙ্গলজনক আমাকে সে কাজ হতে বিরত রাখার সাথে সাথে অন্তরকেও সে কাজের আগ্রহ থেকে ফিরিয়ে রাখুন।
ইসতেখারার হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
উম্মতের প্রতি রাসূলের অগাধ ভালোবাসা ও দয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ এই যে, তিনি উম্মতকে শিক্ষা দিলেন প্রত্যেক কাজের ভাল-মন্দ আল্লাহ তাআলা থেকে চেয়ে নাও এবং সম্পর্ক আল্লাহর সাথে রাখ।
ইসতেখারার দোয়া এ শিক্ষা দেয় যে, কোন মানুষ তার ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তথা নির্ভুল পদক্ষেপ, সুউচ্চ জ্ঞান বৃদ্ধি, অর্থ সম্পদ, বংশ-মর্যাদা ও আধিপত্যের দ্বারা মন্দ কাজ থেকে বেঁচে গেলে ভাল-কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মহান আল্লাহ যাকে চান সেই শুধু ভাল কাজ করতে পারে ও মন্দ কাজ থেকে বাঁচতে পারে। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا حول و لا قوة إلا بالله বেহেশতের গুপ্ত ধনসমূহের একটি ধন।
ইসতেখারা সর্ব কাজের সফলতার সর্বোত্তম উপায়। কেননা, এতে নম্রতা ও বিনয়ের সাথে মহান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের আকাঙ্ক্ষা ও অভাবনীয় শাস্তি থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানানো হয়। যেহেতু তিনিই সর্ব কাজের অধিকারী, তাই তিনিই জানেন, প্রতিটি কাজের পরিণাম ফল কী হবে। তাই মানুষ ইসতেখারার মাধ্যমে তারই শরণাপন্ন হয়, যাতে সফলতার দিক নির্দেশনা পায়। মহান আল্লাহ বলেছেন ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে ও সংগোপনে। [সূরা আরাফ : ৫৫]
ইসতেখারা নামাজ ও দোয়ার সমন্বয়। সৌভাগ্যবান সে যে ইসতেখারা করে আর হতভাগা সে যে ইসতেখারা করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :—
من سعادة ابن آدم استخارته الله، من سعادة ابن آدم رضاه بما قضاه الله، و من شقوة ابن آدم تركه استخارته الله، و من شقوة ابن آدم سخطه بما قضى الله عز و جل .
আদম সন্তানের সৌভাগ্যের বিষয়সমূহ থেকে একটি হল ইসতেখারা করা ও আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। আর মানুষের দুর্ভাগ্য হল ইসতেখারা না করা ও আল্লাহর ফয়সালার উপর অসন্তুষ্ট থাকা। [আহমদ : ১৩৬৭]
এ হাদিস প্রমাণ করে যে, ইসতেখারা শরিয়ত স্বীকৃত একটি এবাদত। এ আমল সে করবে যে শরিয়ত অনুমোদিত কোন মুবাহ বা হালাল কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে।—অথবা যে দ্বি-অবকাশমুখী মোস্তাহাবের উত্তমটি নির্ণয়ের ইচ্ছা করে। কেননা দ্বি-অবকাশমুখী মোস্তাহাব এবং ওয়াজিব কাজ আদায়ে হারাম ও মাকরূহ কাজ পরিহারে ইসতেখারা হয় না। হ্যা যদি কোন মাকরূহ পরিহার করাতে অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সে মাকরূহ ছাড়া না ছাড়ার ব্যাপারে ইসতেখারা হতে পারে। যে সব কাজে ইসতেখারা হয় তন্মধ্যে—যেমন সফর, চাকুরি, বিয়ে ঘর বা দোকান ভাড়া ইত্যাদি।
ইসতেখারার নামাজ কমপক্ষে দুই রাকাত এবং তা নফল। হ্যাঁ, যদি তাহিয়্যাতুল মসজিদের সাথে সাথে (যা মসজিদের প্রবেশের পর পর পড়া হয়) ইসতেখারার নিয়ত করলে এক সাথে উভয়টা আদায় হয়ে যাবে।
হাদিসের বাহ্যিক দৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে যে ইসতেখারার দোয়া নামাজের পরে হবে। কিন্তু কিছু সংখ্যক ওলামা বলেছেন নামাজের মধ্যেও হতে পারে। যেমন সেজদারত অবস্থায় ও শেষ বৈঠকে তাশাহুদ ও দরুদ শরীফের পর। হাদিসের বর্ণনায় বুঝা যাচ্ছে যে আগে নামাজ অত:পর দোয়া। তার কারণ, ইসতেখারা করার অর্থই হল ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের কল্যাণ চেয়ে নেওয়া। আর আল্লাহর রহমতের দরজা খোলার জন্য নামাজতুল্য কোন এবাদত নেই। কেননা নামাজই একমাত্র এবাদত যাতে অনেক এবাদতের সমষ্টি রয়েছে। আল্লাহর প্রশংসা তার বড়ত্ব ও মহত্ত্ব ও সর্ব শ্রেণির লোকের সর্বাবস্থায় মুখাপেক্ষীর উজ্জ্বল প্রমাণ।
যে ব্যক্তি ইসতেখারা করবে সে অবশ্যই দোয়ার মাঝে তার প্রত্যাশিত বিষয় উলেখ করবে।
বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন, ইসতেখারা করার পর তার মন যে দিকে ধাবিত হবে সে দিকেই যাবে। আর যদি কোন দিকে ধাবিত না হয় তা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত কোন দিক নির্দেশনা না পাবে, বা কোন দিকে মন ধাবিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ইসতেখারা করতে থাকবে।
এ হাদিসে আল্লাহর দুটি সিফাত বা গুণ প্রমাণিত হল। এক : এলেম বা জ্ঞানের সিফাত। দুই : কুদরত বা ক্ষমতার সিফাত। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হল যে, আল্লাহর নাম বা গুণের উসিলায় দোয়া করা শরিয়ত স্বীকৃত।
عن أبي هريرة- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ – قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ، قِيْلَ : مَا هُنَّ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ إذَا لَقِيْتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَ إذَا دَعَاكَ فَأجِبْهُ، وَ إذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وَ إذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللهَ فَشَمِّتْهُ، وَ إذَا مَرِضَ فَعُدْهُ، وَ إذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ . رَوَاهُ مُسْلِمٌ (৪০২৩)
আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল ! সেগুলো কি কি ? বললেন, (এক) সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করা, (দুই) আমন্ত্রণ করলে গ্রহণ করা, (তিন) উপদেশ চাইলে উপদেশ দেওয়া, (চার) হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা, (পাঁচ) অসুস্থ হলে সাক্ষাত করে খোঁজ খবর নেয়া (ছয়) মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় উপস্থিত থাকা। [মুসলিম-৪০২৩]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
حَقُّ : হক বলতে ঐ সব কাজ বুঝানো হয়, যা পালন করা অপরিহার্য। যথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মোয়াক্কাদা—ইত্যাদি।
سِتٌّ : এ হাদিসে মুসলমানের ছয়টি হকের কথা বলা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে মুসলমানের হক ছয়টির মাঝেই সীমাবদ্ধ। বরং উদ্দেশ্য হল, মুসলমানের হকসমূহের অন্যতম ছয়টি এই...। অন্যথায় বিশুদ্ধ হাদিসে আলোচিত হক ছাড়াও অন্য হকের কথা বলা হয়েছে।
إذَا لَقِيْتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ : যদি মুসলমানের সাথে সাক্ষাৎ হয়, অথবা তার ঘরে প্রবেশের প্রয়োজন হয়। তাহলে তাকে বল— السلام عليكم و رحمة الله و بركاته
و السلام : এটা আল্লাহর গুণবাচক নাম। অর্থাৎ, হে মোমিন তুমি আল্লাহর আশ্রয়ে থাক। কোন কোন আলেম বলেছেন, السلام অর্থাৎ নিরাপত্তা। তখন পূর্ণ অর্থ হবে—হে মোমিন ! তোমার জন্য আল্লাহর নিরাপত্তা অনিবার্য হোক।
وَ إذَا دَعَاكَ অর্থাৎ শরিয়ত সম্মত কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে তা গ্রহণ কর। যেমন অলিমা বা বউভাত—ইত্যাদি।
وَ إذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ : অর্থাৎ যদি কেউ উপদেশ চায় তাহলে উপদেশ দাও। হাদিসের বাহ্যিক অর্থে প্রতীয়মান হয় যে, উপদেশপ্রার্থীকে উপদেশ প্রদান করা ফরজ। আর যে প্রার্থী নয়, তাকে উপদেশ প্রদান মানদুব তথা নফল। যেহেতু তা ভাল কাজের পথ প্রদর্শনের অন্তর্গত।
فَشَمِّتْهُ কোন কোন বর্ণনায় الشين এর স্থলে السين দ্বারা বলা হয়েছে। অর্থাৎ হাঁচি দেয়া ব্যক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা।
فَعُدْهُ অর্থাৎ অসুস্থ মুসলমানের সাথে সাক্ষাত করে খোঁজ খবর গ্রহণ কর।
وَ إذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ মুসলমানের মৃত্যুর সংবাদ পেলে তার নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ কর। এখানে আল্লাহর রাসূল উম্মতকে নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
সমস্ত মুসলমান ইটের গাঁথুনির প্রাচীরের ন্যায়। যার একাংশ অন্যাংশকে শক্তিশালী করে। সমস্ত মুসলমান ভাই ভাই। মুসলমানদের সমাজ ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু হক বাতলে দিয়েছেন, যেগুলোর মাঝে সকলেই অংশীদার। যাতে সর্ব শ্রেণির মুসলমান সংঘবদ্ধভাবে ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যের বলে বলীয়ান হতে পারে।
যে সকল হক সমস্ত মুসলমানের মাঝে বিস্তৃত তার প্রথম হল সালাম। যাতে নিহিত আছে সালাম প্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ, রহমত, শান্তি ও নিরাপত্তার দোয়া।
সালামের কতিপয় আদব তথা নিয়মাবলি
(ক) সালাম করা সুন্নতে মোয়াক্কাদা। আর সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন—
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
আর তোমাদেরকে যদি কেউ দোয়া করে তাহলে তোমরাও তার জন্য দোয়া কর, তার চেয়ে উত্তম দোয়া কর অথবা তারই মত বল। [সূরা নিসা : আয়াত ৮৬]
(খ) সংক্ষিপ্ত সালাম হল السلام عليكم আর পরিপূর্ণ সালাম হল
السلام عليكم و رحمة الله و بركاته
(গ) সালাম যারা করেন তারা যদি একাধিক হন তখন সবার পক্ষ থেকে একজনের সালামই যথেষ্ট। এমনিভাবে যারা সালাম গ্রহণ করছেন, তারা যদি একাধিক হন, তখন সবার পক্ষ থেকে একজন গ্রহণ করলেই যথেষ্ট।
কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
يجزئ عن الجماعة إذا مروا أن يسلم أحدهم، و يجزئ عن الجماعة أن يرد أحدهم . أبو داود (৪৫৩৪)
অর্থাৎ অনেক লোকের পক্ষ থেকে একজনের সালাম যথেষ্ট। আর অনেক লোকের পক্ষ থেকে একজনের উত্তর যথেষ্ট। [আবু দাউদ-৪৫৩৪]
(ঙ) সালাম দু বার সুন্নত। প্রথমত: সাক্ষাতে, দ্বিতীয়ত: প্রস্থানে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إذا انتهى أحدكم إلى مجلس فليسلم، فإن بدا له أن يجلس فليجلس ،ثم إذا قام فليسلم، فليست الأولى بأحق من الآخرة . رواه الترمذي (২৬২০)
তোমাদের মাঝে কেউ যখন জনসভায় গমন করবে, তখন উপস্থিত লোকদের সালাম করবে। যদি সেখানে অবস্থান করার ইচ্ছা থাকে, বসে পড়বে। অত:পর যখন সেখান থেকে বিদায় নিবে, তখনও তাদেরকে সালাম করবে। কেননা বিদায়ের সালাম কোন অংশে সাক্ষাতের সালাম থেকে কম গুরুত্বের নয়। [তিরমিজি- ২৬২০]
(ছ) সালামের আদব সমূহ থেকে এটাও একটি যে ছোট বড়কে সালাম করবে, আগমনকারী অবস্থানকারীকে, কমসংখ্যক অধিক সংখ্যককে, আরোহী পথচারীকে সালাম করবে।
(ঝ) হাদিস থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, সালাম শুধু মুসলমানকেই দেবে। অমুসলিমকে আগে সালাম দেওয়া যাবে না। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
رواه الترمذي ১৫২৮ لا تبدأوا اليهود و النصاري بالسلام .... অর্থাৎ তোমরা ইহুদি ও নাসারাদেরকে প্রথমে সালাম করবে না। যদি তারা সালাম করে তাহলে উত্তরে বলবে—
و عليكم ‘তোমার উপরও।’ [তিরমিজি-১৫২৮]
(ঞ) সালামের পরিবর্তে অন্য কোন শব্দ ব্যবহারে সালামের সুন্নত আদায় হবে না। যেমন শুভ সকাল কিংবা শুভ সন্ধ্যা—ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার। কেননা, মুসলমানের শান্তি ও নিরাপত্তা কোন সময়ে সাথে নির্দিষ্ট নয়। বরং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা ইহকাল ও পরকাল—সবসময় বিস্তৃত। মহান আল্লাহ বলেন—
وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ
অর্থাৎ, জান্নাতের মাঝে মোমিনদের অভিবাদন হবে সালাম।
মুসলমানদের মাঝে সালামের প্রচলন খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কারণ, এর মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়। এতে মানুষের অন্তর নিস্কলুষ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
ألأ أدلكم على شيء إذا فعلتموه تحاببتم، أفشوا السلام بينكم . رواه البخاري (৮১)
আমি তোমাদের এমন কিছুর সন্ধান দেব না, যা তোমরা পালন করলে তোমাদের পারস্পরিক প্রীতি সৃষ্টি হবে ? তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের প্রচলন কর। [বোখারি - ৮১]
(৩) মুসলমানদের দ্বিতীয় হক হবে দাওয়াত কবুল করা। মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আছে, যেগুলোতে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস স্পন্দিত হয়। যেমন—বিয়ে-শাদি, সন্তান লাভ ও কর্মে সফলতা—ইত্যাদি। তখন আনন্দিত ব্যক্তি অন্যান্যকেও এতে সম্পৃক্ত করতে চায়। তাই ওলিমা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যদের আমন্ত্রণ জানায় এবং আনন্দিত মেহমানদের শুভাগমনে সেই ব্যক্তি খুবই খুশি হয়। সুতরাং, এহেন কাজে অংশগ্রহণ করে মুসলমানকে খুশি করা তার হক। হা, যদি উক্ত অনুষ্ঠানে শরিয়ত পরিপন্থী কোন কাজ হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তি তা প্রতিহত করার ক্ষমতা না রাখে তাহলে সে অনুষ্ঠানে না আসাই ভাল।
ওলিমা ছাড়া যত দাওয়াত আছে সেগুলোতে অংশগ্রহণ মোস্তাহাব। শুধু ওলিমার দাওয়াতে অংশগ্রহণ সম্বন্ধে অনেক ওলামায়ে কেরাম ওয়াজিব বলেছেন। কেননা, রাসূল সা. বলেছেন—
إذا دعي أحدكم إلي وليمة فليأتها . رواه مسلم (২৫৭৬)
যখন তোমাদেরকে কোন ওলিমায় আমন্ত্রণ করা হয় তখন অবশ্যই আসবে। [মুসলিম - ২৫৭৬]
মুসলমানদের তৃতীয় হক হচ্ছে, সৎ উপদেশ প্রদান। সৎ উপদেশ ইসলামের মৌলিক নীতিমালা সমূহের অন্যতম একটি মূলনীতি। কোরআনের বহু আয়াত ও রাসূলের অনেক হাদিস এর প্রমাণ বহন করে।
নসিহত বা উপদেশের কতিপয় আদব
(ক) আদিষ্ট ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে যে, আদিষ্ট ব্যক্তি পাওনাদার। সুতরাং, সঠিক উপদেশে কোন প্রকার ধোঁকা-বাজি করবে না। এবং পরিপূর্ণ উপদেশ দানে কোন প্রকার ত্রুটি করবে না।
(খ) উপদেশ প্রার্থীকে উপদেশে দান ওয়াজিব। আর যে প্রার্থী নয়, তাকে উপদেশ দান মোস্তাহাব।
(গ) নসিহতের আরো এক অর্থ হল কল্যাণ কামনা। এই কল্যাণ কামনায় খলিফাতুল মুসলিমীন, সরকার প্রধান, প্রশাসক ও উলামায়ে কেরাম তথা সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্য হতে পারে। খলিফাতুল মুসলিমীনের প্রতি কল্যাণ কামনার অর্থ হল তার আনুগত্য স্বীকার করা, তার বিরুদ্ধাচরণ না করা। এবং ভাল কাজে তার সমর্থন করা, উৎসাহিত করা। আর সাধারণ মুসলমানদের প্রতি কল্যাণ কামনা—যেমন পথহারা মানুষকে পথের সন্ধান দান, হারিয়ে যাওয়া বস্ত্ত মালিকের নিকট পৌঁছে দেওয়া, মূর্খ লোকদের শিক্ষা দেওয়া—ইত্যাদি।
(ঙ) আজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি একা হয় তখন উপদেশ হবে গোপনে। বুদ্ধিমত্তার আলোকে, উত্তম পদ্ধতিতে, অত্যন্ত কোমল ও আন্তরিকতার সাথে। কেননা, প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উপদেশ দানের অর্থ হল তাকে অপমান করা। এবং উপদেশের ক্ষেত্রে কঠোরতা বর্জন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ( آل عمران : 159)
আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত। [সূরা আলে ইমরান : ১৫৯]
(ছ) সর্বাবস্থায় সমাজকে উপদেশ দানে সচেষ্ট থাকা। কেননা, উপদেশ যেমনিভাবে সমাজকে রক্ষা করে ধ্বংসের হাত থেকে, তেমনিভাবে সৃষ্টি করে পরস্পর আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য-হৃদ্যতা।
(৫) মুসলমানের চতুর্থ হক হল হাঁচির উত্তর দেওয়া। এটা ইসলামের সুন্দরতম বৈশিষ্ট্য। নিম্নে তার হুকুম বর্ণিত হল—
(ক) মুসলমান যখন হাঁচি দেবে তখন বলবে আলাহামদু লিল্লাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إذا عطس أحدكم فليقل : الَحمْدُ ِللِه، وليقل له أخوه أو صاحبه : يَرْحَمُكَ اللهُ، وليقل هو : يَهْدِيْكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ . رواه البخاري (5756)
তোমাদের কেউ যখন হাঁচি দেবে তখন বলবে আল-হামদুলিল্লাহ ; আর শ্রোতা বলবে ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন) অত:পর যে ব্যক্তি হাঁচি দিয়েছে, সে বলবে, ইয়াহদিকুমুল্লাহু ওয়া ইয়ুছলিহু বালাকুম (আল্লাহ আপনাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন ও আপনার সকল বিষয় গুছিয়ে দিন)। এখানে হাঁচি দেওয়ার পর আল হামদুলিল্লাহ বলার রহস্য এই যে, হাঁচির দ্বারা মস্তিষ্কে লুক্কায়িত ক্ষতিকর বাষ্প নির্গত হয়। সুতরাং হাঁচি আল্লাহর বিশেষ একটি নেয়ামত। তাই হাঁচির পর আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়।
(৬) মুসলমানদের পঞ্চম হক—অপর মুসলমান অসুস্থ হলে তাকে দেখতে গিয়ে সমবেদনা জানানো। এক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে—
(ক) অসুস্থ ব্যক্তির সাক্ষাৎ মুসলমানদের হক সমূহের অন্যতম হক। কেননা, সে শারীরিক দুর্বলতার কারণে স্বীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে যায়। তখন তার এমন কিছুর প্রয়োজন যা তাকে সুস্থতার আশ্বাসের মাধ্যমে শক্তি-সাহস বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সাহায্য করবে। এবং তার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবে।
(খ) অসুস্থ ব্যক্তির সাক্ষাতে রোগী যেমন উপকৃত হয়, তেমনি উপকৃত হয় সাক্ষাৎকারী। রোগীর উপকার যেমন—তার মনে প্রশান্তি আসে, ক্লান্তি দূর হয় ইত্যাদি। সাক্ষাৎকারীর উপকার যেমন তার পুণ্য লাভ হয়। তার নিজের সুস্থতার কথা স্মরণ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
(গ) অসুস্থ ব্যক্তির সাক্ষাতের আদব সমূহের একটি হল, তার জন্য হাদিসে বর্ণিত দোয়া পড়া। যেমন
الّلهُمَّ رَبَّ النَاسِ، أَذْهِبِ البَأْسَ، وَاشْفِ اَنْتَ الشَّافِيْ، لاَ شِفَاءَ اِلاَّ شِفَاؤُكَ، شِفَاءٌ لاَ يِغَادِرُ سَقَما . رواه البخاري (৫২৪৩)
হে মানুষের প্রভু ! সমস্যা দূর করে দাও। এবং (এই ব্যক্তিকে) শেফা (সুস্থতা) দান কর। নিশ্চয় তুমি একমাত্র শেফাদানকারী। আপনার শেফা ছাড়া কোন শেফা নেই । এমন শেফা দাও, যে শেফা কোন রোগকে ছেড়ে দেয় না। [বোখারি : ৫২৪৩]
(ঙ) সাক্ষাৎকারীদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তাদের সাক্ষাৎ যেন রোগীর কষ্টের কারণ না হয়। তাই উপযুক্ত সময়ে সাক্ষাৎ করবে ও ডাক্তারদের সাজেশন মেনে চলবে।
(৭) মুসলমানদের ষষ্ঠ হক হল নামাজে জানাজা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করা। মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে অবধারিত সত্য। যা প্রত্যেক প্রাণীর দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে পরকালের জীবনের সূচনা করে। এবং এতে মানুষের আমলের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই মৃত ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা বেশি অসহায়। সুতরাং ইসলাম নামাজে জানাজাকে মুসলমানদের হক বলে আখ্যায়িত করেছে। যেন অন্য মুসলমান মৃত ব্যক্তির জন্য রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের জন্য নামাজে জানাজার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দোয়া করে। আর এ কাজে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য আল্লাহ এতে অনেক পুণ্য রেখেছেন। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
من شهد الجنازة فله قيراط، ومن شهدها حتى تدفن فله قيراطان، قيل : وما القيراطان ؟ قال : مثل الجبلين العظيمين . رواه البخاري (১২৪০)
যে ব্যক্তি জানাজায় অংশগ্রহণ করল সে এক কিরাত পরিমাণ নেকি পেল। আর যে জানাজা ও দাফন—উভয় কাজে অংশগ্রহণ করবে সে দু কিরাত পরিমাণ নেকি পাবে। প্রশ্ন করা হল, দু কিরাত কি ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দু কিরাত হল দুই বড় পর্বত সদৃশ।
আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজন মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল ! সেগুলো কি কি ? বললেন, (এক) সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করা, (দুই) আমন্ত্রণ করলে গ্রহণ করা, (তিন) উপদেশ চাইলে উপদেশ দেওয়া, (চার) হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা, (পাঁচ) অসুস্থ হলে সাক্ষাত করে খোঁজ খবর নেয়া (ছয়) মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় উপস্থিত থাকা। [মুসলিম-৪০২৩]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
حَقُّ : হক বলতে ঐ সব কাজ বুঝানো হয়, যা পালন করা অপরিহার্য। যথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতে মোয়াক্কাদা—ইত্যাদি।
سِتٌّ : এ হাদিসে মুসলমানের ছয়টি হকের কথা বলা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে মুসলমানের হক ছয়টির মাঝেই সীমাবদ্ধ। বরং উদ্দেশ্য হল, মুসলমানের হকসমূহের অন্যতম ছয়টি এই...। অন্যথায় বিশুদ্ধ হাদিসে আলোচিত হক ছাড়াও অন্য হকের কথা বলা হয়েছে।
إذَا لَقِيْتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ : যদি মুসলমানের সাথে সাক্ষাৎ হয়, অথবা তার ঘরে প্রবেশের প্রয়োজন হয়। তাহলে তাকে বল— السلام عليكم و رحمة الله و بركاته
و السلام : এটা আল্লাহর গুণবাচক নাম। অর্থাৎ, হে মোমিন তুমি আল্লাহর আশ্রয়ে থাক। কোন কোন আলেম বলেছেন, السلام অর্থাৎ নিরাপত্তা। তখন পূর্ণ অর্থ হবে—হে মোমিন ! তোমার জন্য আল্লাহর নিরাপত্তা অনিবার্য হোক।
وَ إذَا دَعَاكَ অর্থাৎ শরিয়ত সম্মত কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালে তা গ্রহণ কর। যেমন অলিমা বা বউভাত—ইত্যাদি।
وَ إذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ : অর্থাৎ যদি কেউ উপদেশ চায় তাহলে উপদেশ দাও। হাদিসের বাহ্যিক অর্থে প্রতীয়মান হয় যে, উপদেশপ্রার্থীকে উপদেশ প্রদান করা ফরজ। আর যে প্রার্থী নয়, তাকে উপদেশ প্রদান মানদুব তথা নফল। যেহেতু তা ভাল কাজের পথ প্রদর্শনের অন্তর্গত।
فَشَمِّتْهُ কোন কোন বর্ণনায় الشين এর স্থলে السين দ্বারা বলা হয়েছে। অর্থাৎ হাঁচি দেয়া ব্যক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করা।
فَعُدْهُ অর্থাৎ অসুস্থ মুসলমানের সাথে সাক্ষাত করে খোঁজ খবর গ্রহণ কর।
وَ إذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ মুসলমানের মৃত্যুর সংবাদ পেলে তার নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ কর। এখানে আল্লাহর রাসূল উম্মতকে নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করেছেন।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
সমস্ত মুসলমান ইটের গাঁথুনির প্রাচীরের ন্যায়। যার একাংশ অন্যাংশকে শক্তিশালী করে। সমস্ত মুসলমান ভাই ভাই। মুসলমানদের সমাজ ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু হক বাতলে দিয়েছেন, যেগুলোর মাঝে সকলেই অংশীদার। যাতে সর্ব শ্রেণির মুসলমান সংঘবদ্ধভাবে ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যের বলে বলীয়ান হতে পারে।
যে সকল হক সমস্ত মুসলমানের মাঝে বিস্তৃত তার প্রথম হল সালাম। যাতে নিহিত আছে সালাম প্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ, রহমত, শান্তি ও নিরাপত্তার দোয়া।
সালামের কতিপয় আদব তথা নিয়মাবলি
(ক) সালাম করা সুন্নতে মোয়াক্কাদা। আর সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন—
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
আর তোমাদেরকে যদি কেউ দোয়া করে তাহলে তোমরাও তার জন্য দোয়া কর, তার চেয়ে উত্তম দোয়া কর অথবা তারই মত বল। [সূরা নিসা : আয়াত ৮৬]
(খ) সংক্ষিপ্ত সালাম হল السلام عليكم আর পরিপূর্ণ সালাম হল
السلام عليكم و رحمة الله و بركاته
(গ) সালাম যারা করেন তারা যদি একাধিক হন তখন সবার পক্ষ থেকে একজনের সালামই যথেষ্ট। এমনিভাবে যারা সালাম গ্রহণ করছেন, তারা যদি একাধিক হন, তখন সবার পক্ষ থেকে একজন গ্রহণ করলেই যথেষ্ট।
কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
يجزئ عن الجماعة إذا مروا أن يسلم أحدهم، و يجزئ عن الجماعة أن يرد أحدهم . أبو داود (৪৫৩৪)
অর্থাৎ অনেক লোকের পক্ষ থেকে একজনের সালাম যথেষ্ট। আর অনেক লোকের পক্ষ থেকে একজনের উত্তর যথেষ্ট। [আবু দাউদ-৪৫৩৪]
(ঙ) সালাম দু বার সুন্নত। প্রথমত: সাক্ষাতে, দ্বিতীয়ত: প্রস্থানে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إذا انتهى أحدكم إلى مجلس فليسلم، فإن بدا له أن يجلس فليجلس ،ثم إذا قام فليسلم، فليست الأولى بأحق من الآخرة . رواه الترمذي (২৬২০)
তোমাদের মাঝে কেউ যখন জনসভায় গমন করবে, তখন উপস্থিত লোকদের সালাম করবে। যদি সেখানে অবস্থান করার ইচ্ছা থাকে, বসে পড়বে। অত:পর যখন সেখান থেকে বিদায় নিবে, তখনও তাদেরকে সালাম করবে। কেননা বিদায়ের সালাম কোন অংশে সাক্ষাতের সালাম থেকে কম গুরুত্বের নয়। [তিরমিজি- ২৬২০]
(ছ) সালামের আদব সমূহ থেকে এটাও একটি যে ছোট বড়কে সালাম করবে, আগমনকারী অবস্থানকারীকে, কমসংখ্যক অধিক সংখ্যককে, আরোহী পথচারীকে সালাম করবে।
(ঝ) হাদিস থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, সালাম শুধু মুসলমানকেই দেবে। অমুসলিমকে আগে সালাম দেওয়া যাবে না। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
رواه الترمذي ১৫২৮ لا تبدأوا اليهود و النصاري بالسلام .... অর্থাৎ তোমরা ইহুদি ও নাসারাদেরকে প্রথমে সালাম করবে না। যদি তারা সালাম করে তাহলে উত্তরে বলবে—
و عليكم ‘তোমার উপরও।’ [তিরমিজি-১৫২৮]
(ঞ) সালামের পরিবর্তে অন্য কোন শব্দ ব্যবহারে সালামের সুন্নত আদায় হবে না। যেমন শুভ সকাল কিংবা শুভ সন্ধ্যা—ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার। কেননা, মুসলমানের শান্তি ও নিরাপত্তা কোন সময়ে সাথে নির্দিষ্ট নয়। বরং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা ইহকাল ও পরকাল—সবসময় বিস্তৃত। মহান আল্লাহ বলেন—
وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ
অর্থাৎ, জান্নাতের মাঝে মোমিনদের অভিবাদন হবে সালাম।
মুসলমানদের মাঝে সালামের প্রচলন খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কারণ, এর মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য সৃষ্টি হয়। এতে মানুষের অন্তর নিস্কলুষ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—
ألأ أدلكم على شيء إذا فعلتموه تحاببتم، أفشوا السلام بينكم . رواه البخاري (৮১)
আমি তোমাদের এমন কিছুর সন্ধান দেব না, যা তোমরা পালন করলে তোমাদের পারস্পরিক প্রীতি সৃষ্টি হবে ? তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের প্রচলন কর। [বোখারি - ৮১]
(৩) মুসলমানদের দ্বিতীয় হক হবে দাওয়াত কবুল করা। মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আছে, যেগুলোতে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস স্পন্দিত হয়। যেমন—বিয়ে-শাদি, সন্তান লাভ ও কর্মে সফলতা—ইত্যাদি। তখন আনন্দিত ব্যক্তি অন্যান্যকেও এতে সম্পৃক্ত করতে চায়। তাই ওলিমা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যদের আমন্ত্রণ জানায় এবং আনন্দিত মেহমানদের শুভাগমনে সেই ব্যক্তি খুবই খুশি হয়। সুতরাং, এহেন কাজে অংশগ্রহণ করে মুসলমানকে খুশি করা তার হক। হা, যদি উক্ত অনুষ্ঠানে শরিয়ত পরিপন্থী কোন কাজ হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তি তা প্রতিহত করার ক্ষমতা না রাখে তাহলে সে অনুষ্ঠানে না আসাই ভাল।
ওলিমা ছাড়া যত দাওয়াত আছে সেগুলোতে অংশগ্রহণ মোস্তাহাব। শুধু ওলিমার দাওয়াতে অংশগ্রহণ সম্বন্ধে অনেক ওলামায়ে কেরাম ওয়াজিব বলেছেন। কেননা, রাসূল সা. বলেছেন—
إذا دعي أحدكم إلي وليمة فليأتها . رواه مسلم (২৫৭৬)
যখন তোমাদেরকে কোন ওলিমায় আমন্ত্রণ করা হয় তখন অবশ্যই আসবে। [মুসলিম - ২৫৭৬]
মুসলমানদের তৃতীয় হক হচ্ছে, সৎ উপদেশ প্রদান। সৎ উপদেশ ইসলামের মৌলিক নীতিমালা সমূহের অন্যতম একটি মূলনীতি। কোরআনের বহু আয়াত ও রাসূলের অনেক হাদিস এর প্রমাণ বহন করে।
নসিহত বা উপদেশের কতিপয় আদব
(ক) আদিষ্ট ব্যক্তিকে মনে রাখতে হবে যে, আদিষ্ট ব্যক্তি পাওনাদার। সুতরাং, সঠিক উপদেশে কোন প্রকার ধোঁকা-বাজি করবে না। এবং পরিপূর্ণ উপদেশ দানে কোন প্রকার ত্রুটি করবে না।
(খ) উপদেশ প্রার্থীকে উপদেশে দান ওয়াজিব। আর যে প্রার্থী নয়, তাকে উপদেশ দান মোস্তাহাব।
(গ) নসিহতের আরো এক অর্থ হল কল্যাণ কামনা। এই কল্যাণ কামনায় খলিফাতুল মুসলিমীন, সরকার প্রধান, প্রশাসক ও উলামায়ে কেরাম তথা সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্য হতে পারে। খলিফাতুল মুসলিমীনের প্রতি কল্যাণ কামনার অর্থ হল তার আনুগত্য স্বীকার করা, তার বিরুদ্ধাচরণ না করা। এবং ভাল কাজে তার সমর্থন করা, উৎসাহিত করা। আর সাধারণ মুসলমানদের প্রতি কল্যাণ কামনা—যেমন পথহারা মানুষকে পথের সন্ধান দান, হারিয়ে যাওয়া বস্ত্ত মালিকের নিকট পৌঁছে দেওয়া, মূর্খ লোকদের শিক্ষা দেওয়া—ইত্যাদি।
(ঙ) আজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি একা হয় তখন উপদেশ হবে গোপনে। বুদ্ধিমত্তার আলোকে, উত্তম পদ্ধতিতে, অত্যন্ত কোমল ও আন্তরিকতার সাথে। কেননা, প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উপদেশ দানের অর্থ হল তাকে অপমান করা। এবং উপদেশের ক্ষেত্রে কঠোরতা বর্জন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ( آل عمران : 159)
আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত। [সূরা আলে ইমরান : ১৫৯]
(ছ) সর্বাবস্থায় সমাজকে উপদেশ দানে সচেষ্ট থাকা। কেননা, উপদেশ যেমনিভাবে সমাজকে রক্ষা করে ধ্বংসের হাত থেকে, তেমনিভাবে সৃষ্টি করে পরস্পর আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য-হৃদ্যতা।
(৫) মুসলমানের চতুর্থ হক হল হাঁচির উত্তর দেওয়া। এটা ইসলামের সুন্দরতম বৈশিষ্ট্য। নিম্নে তার হুকুম বর্ণিত হল—
(ক) মুসলমান যখন হাঁচি দেবে তখন বলবে আলাহামদু লিল্লাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
إذا عطس أحدكم فليقل : الَحمْدُ ِللِه، وليقل له أخوه أو صاحبه : يَرْحَمُكَ اللهُ، وليقل هو : يَهْدِيْكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ . رواه البخاري (5756)
তোমাদের কেউ যখন হাঁচি দেবে তখন বলবে আল-হামদুলিল্লাহ ; আর শ্রোতা বলবে ইয়ারহামুকাল্লাহ (আল্লাহ আপনার প্রতি দয়া করুন) অত:পর যে ব্যক্তি হাঁচি দিয়েছে, সে বলবে, ইয়াহদিকুমুল্লাহু ওয়া ইয়ুছলিহু বালাকুম (আল্লাহ আপনাকে সৎপথ প্রদর্শন করুন ও আপনার সকল বিষয় গুছিয়ে দিন)। এখানে হাঁচি দেওয়ার পর আল হামদুলিল্লাহ বলার রহস্য এই যে, হাঁচির দ্বারা মস্তিষ্কে লুক্কায়িত ক্ষতিকর বাষ্প নির্গত হয়। সুতরাং হাঁচি আল্লাহর বিশেষ একটি নেয়ামত। তাই হাঁচির পর আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়।
(৬) মুসলমানদের পঞ্চম হক—অপর মুসলমান অসুস্থ হলে তাকে দেখতে গিয়ে সমবেদনা জানানো। এক্ষেত্রে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে—
(ক) অসুস্থ ব্যক্তির সাক্ষাৎ মুসলমানদের হক সমূহের অন্যতম হক। কেননা, সে শারীরিক দুর্বলতার কারণে স্বীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে যায়। তখন তার এমন কিছুর প্রয়োজন যা তাকে সুস্থতার আশ্বাসের মাধ্যমে শক্তি-সাহস বৃদ্ধি করার ব্যাপারে সাহায্য করবে। এবং তার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবে।
(খ) অসুস্থ ব্যক্তির সাক্ষাতে রোগী যেমন উপকৃত হয়, তেমনি উপকৃত হয় সাক্ষাৎকারী। রোগীর উপকার যেমন—তার মনে প্রশান্তি আসে, ক্লান্তি দূর হয় ইত্যাদি। সাক্ষাৎকারীর উপকার যেমন তার পুণ্য লাভ হয়। তার নিজের সুস্থতার কথা স্মরণ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
(গ) অসুস্থ ব্যক্তির সাক্ষাতের আদব সমূহের একটি হল, তার জন্য হাদিসে বর্ণিত দোয়া পড়া। যেমন
الّلهُمَّ رَبَّ النَاسِ، أَذْهِبِ البَأْسَ، وَاشْفِ اَنْتَ الشَّافِيْ، لاَ شِفَاءَ اِلاَّ شِفَاؤُكَ، شِفَاءٌ لاَ يِغَادِرُ سَقَما . رواه البخاري (৫২৪৩)
হে মানুষের প্রভু ! সমস্যা দূর করে দাও। এবং (এই ব্যক্তিকে) শেফা (সুস্থতা) দান কর। নিশ্চয় তুমি একমাত্র শেফাদানকারী। আপনার শেফা ছাড়া কোন শেফা নেই । এমন শেফা দাও, যে শেফা কোন রোগকে ছেড়ে দেয় না। [বোখারি : ৫২৪৩]
(ঙ) সাক্ষাৎকারীদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তাদের সাক্ষাৎ যেন রোগীর কষ্টের কারণ না হয়। তাই উপযুক্ত সময়ে সাক্ষাৎ করবে ও ডাক্তারদের সাজেশন মেনে চলবে।
(৭) মুসলমানদের ষষ্ঠ হক হল নামাজে জানাজা ও দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করা। মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে অবধারিত সত্য। যা প্রত্যেক প্রাণীর দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে পরকালের জীবনের সূচনা করে। এবং এতে মানুষের আমলের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই মৃত ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা বেশি অসহায়। সুতরাং ইসলাম নামাজে জানাজাকে মুসলমানদের হক বলে আখ্যায়িত করেছে। যেন অন্য মুসলমান মৃত ব্যক্তির জন্য রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের জন্য নামাজে জানাজার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দোয়া করে। আর এ কাজে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য আল্লাহ এতে অনেক পুণ্য রেখেছেন। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
من شهد الجنازة فله قيراط، ومن شهدها حتى تدفن فله قيراطان، قيل : وما القيراطان ؟ قال : مثل الجبلين العظيمين . رواه البخاري (১২৪০)
যে ব্যক্তি জানাজায় অংশগ্রহণ করল সে এক কিরাত পরিমাণ নেকি পেল। আর যে জানাজা ও দাফন—উভয় কাজে অংশগ্রহণ করবে সে দু কিরাত পরিমাণ নেকি পাবে। প্রশ্ন করা হল, দু কিরাত কি ? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দু কিরাত হল দুই বড় পর্বত সদৃশ।
عن أبي سعيد الخدري- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أنَّ النَّبِيَّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- قَالَ : إيَّاكُمْ وَ الْجُلُوْسَ فِي الطُّرُقَاتِ، فَقَالُوْا : يَا رَسُوْلَ اللهِ، مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدٌّ نَتَحَدَّثُ فِيْهَا، فَقَالَ : فَإذَا أبَيْتُمْ إلاَّ الْمَجْلِسَ فَأعْطُوا الطَّرِيْقَ حَقَّهُ . قَالُوْا : وَمَا حَقُّ الطَّرِيْقِ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ : غَضُّ الْبَصَرِ، و كَفُّ الأذى، وَ رَدُّ السَّلاَمِ، وَ الْأمْرُ بِالْمَعْرُوْفِ وَ النَّهْيُ عَنِ الْمُنْكَرِ . ( متفق عليه )
আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সা. বলেন, তোমরা রাস্তায় বসে থাকা থেকে বিরত থাক। সাহাবিগণ রা. আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য রাস্তায় বসার বিকল্প নেই। রাসূল সা. বললেন, যদি তোমাদের একান্ত বসতেই হয়, তাহলে রাস্তার হক আদায় কর। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ! রাস্তার হক কি ? তিনি বললেন, চক্ষু অবনত করা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর প্রদান করা, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা। [বোখারি-৬২২৯, মুসলিম-১৪।]
হাদিস বর্ণনাকারী—
তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট সাহাবি সা’দ, উপনাম আবু সাঈদ। পিতা মালেক। পিতামহ সানান। তিনি ছিলেন আনসার অন্তর্গত খুদুর গ্রামের অধিবাসী। মদিনার আনসারদের একটি গ্রামের নাম হল খুদুর। সেই গ্রামেই তার জন্ম, সে জন্য তাকে বলা হয় খুদরী। পিতা মালেক রা. উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক খন্দক তথা পরিখার যুদ্ধে ও বাইআতে রিজওয়ানে অংশগ্রহণ করেছেন। রাসূল থেকে এক হাজার একশ সত্তুরটি হাদিস বর্ণনা করেছেন তিনি। ফিকাহ বিশারদ হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। ৭৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আভিধানিক ব্যাখ্যা—
إيَّاكُمْ তোমরা বেঁচে থাক। ভীতি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার হয়। উদ্দেশ্য তোমরা রাস্তায় বসা পরিহার কর।
وَ الْجُلُوْسَ فِي الطُّرُقَاتِ এখানে س বর্ণে জবর হবে। অর্থাৎ, রাস্তায় বসাকে ভয় কর। উদ্দেশ্য হল রাস্তায় বসা থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি।
الطرقات শব্দটি طرق - এর বহুবচন। আর طرق শব্দটি طريق শব্দের বহুবচন। হাদিসে যদিও طريق শব্দ ব্যবহার হয়েছে, উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যাপক। অর্থাৎ মানুষের সমস্ত গমনাগমন স্থান যেমন হাটবাজার, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে—হাদিস বর্ণনাকারী বলেন, كنا جلوسا بالأفنية অর্থাৎ আমরা যখন বাড়ির সামনে বসে ছিলাম। তখন রাসূল আমাদের বললেন, إياكم و الجلوس في الطرقات অর্থাৎ তোমরা রাস্তায় বসা পরিহার কর। এতে বুঝা গেল, রাস্তা মূল উদ্দেশ্য নয়, কেননা, তারা রাস্তায় বসে ছিলেন না। বরং উদ্দেশ্য হল, মানুষের গমনাগমনের পথ।
مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدٌّ এখানে د বর্ণে পেশ ও তাশদীদ হবে। অর্থ : আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য রাস্তায় বসার বিকল্প নেই।
فَإذَا أبَيْتُمْ إلاَّ الْمَجْلِسَ অর্থ যদি তোমাদের এই সমস্ত জায়গায় বসার একান্ত প্রয়োজনই হয়...।
فَأعْطُوا الطَّرِيْقَ حَقَّهُ কোন কোন বর্ণনায় حقها এসেছে। طريق শব্দটি উভয় লিঙ্গে ব্যবহার হয়। সে জন্য حقه ও حقها উভয়টি ব্যবহার বিধি-সম্মত। অর্থ, যদি তোমরা অপরাগ হয়ে বস, তবে রাস্তার হকগুলো আদায় কর।
غَضُّ الْبَصَرِ শাব্দিক অর্থ হল চোখের দুই পাতাকে এমন ভাবে মিলিয়ে নেওয়া যাতে কিছুই দেখা না যায়। এখানে উদ্দেশ্য, চোখকে হারাম দৃষ্টি থেকে হেফাজত করা।
كَفُّ الأذى অর্থ পথচারীদেরকে উপহাস বা অশালীন কথা বা কাজের দ্বারা কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। পথচারীর কষ্ট হয় এমন সকল কাজ থেকে বিরত থাকা।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
ইসলামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে কুরুচিপূর্ণ আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড থেকে নিষ্কলুষ করে সৎ-চরিত্র ও আদর্শবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে বিরাজ করে পারস্পরিক মায়া-মমতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি। মনে হবে, যেন তারা একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ইসলাম সর্বাঙ্গ সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। নীতিমালা নির্ধারণ ও অন্যের হক সংরক্ষণ ইত্যাদিতে তা পরিপূর্ণ ও অনন্য। যা অন্য কোন ধর্মে কিংবা মতাদর্শে বিরল—নেই বললেই চলে।
এই হাদিস প্রমাণ করে, রাস্তাঘাট তথা মানুষের গমনাগমনের স্থানসমূহ প্রকৃত পক্ষে বসার আসন বা এ কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। অন্যথায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—
অন্যায় ও অসামাজিক এবং অশীল কাজের বিস্তার ঘটা
আকার ইঙ্গিত ও গালি মন্দের দ্বারা পথচারীকে কষ্ট দেয়া
অনর্থক মানুষের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করা
অযথা সময়ের অপচয়
এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাস্তার কয়েকটি আদবের কথা বলেছেন। যথা :
চক্ষুদ্বয়কে হারাম দৃষ্টি থেকে সংযত রাখা। রাস্তায় যেহেতু নারী সম্প্রদায়কে তাদের প্রয়োজনের তাগিদে আসতেই হয় এবং এর কোন বিকল্প নেই, সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি স্বেচ্ছায় না তাকাতে বলা হয়েছে। কেননা, স্বেচ্ছায় কোন পর নারীর দিকে তাকানোকে ইসলাম হারাম করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ
মুসলিমদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে, এবং হেফাজত করে তাদের যৌনাঙ্গের। এতে তাদের জন্য রয়েছে অতিশয় পবিত্রতা। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। [সূরা নূর : ৩০]
পথচারীদেরকে যে কোন প্রকার কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। যেমন গালমন্দ ঠাট্টা তিরস্কার ইত্যাদি। এমনিভাবে যে কোন উপায়ে মুসলমানকে কষ্ট দেয়া,—যেমন কারো ঘরে উঁকি দিয়ে দেখা বা কারো বাড়ির পার্শ্বে বল খেলা ইত্যাদি—থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। সব ধরনের কষ্টই হারাম ও পরিত্যাজ্য।
সালামের উত্তর দেওয়া। এর উপর সমস্ত আলেমগণ একমত যে সালামের উত্তর ওয়াজিব। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
আর যদি তোমাদেরকে সালাম পেশ করে তবে তোমরাও তার জন্য এর চেয়ে উত্তম সালাম পেশ কর অথবা তার সমপরিমাণ কর। [সূরা নিসা : ৮৬।]
তবে হ্যাঁ, সালাম দেয়া ওয়াজিব নয়। বরং সুন্নত, পুণ্যের কাজ। কেননা, তা মুসলমানের জন্য রহমত, বরকত, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। সাধারণত: রাস্তা ঘাটে অন্যায় বা অসৎ কাজের আধিক্য ঘটে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসৎ কাজের নিষেধ রাস্তার হক হিসাবে উলেখ করেছেন। এবং এই কাজ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ এই যে, কোরআনের বহু আয়াত আর রাসূলের বহু হাদিস এ প্রসঙ্গে বিবৃত। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
তোমাদের এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে। এক সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। [সূরা আলে ইমরান : ১০৪]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان .
তোমাদের কেউ যখন কোন মন্দ কাজ দেখবে, তখন সামর্থ্য থাকলে শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত কর। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে কথার দ্বারা তার প্রতিবাদ কর। তাও যদি না পার তাহলে অন্তরে ঘৃণা করত: তা প্রতিহতের চিন্তা ভাবনা করতে থাক। আর এ হল ঈমানের সর্বশেষ দাবি বা স্তর। [মুসলিম-৪৯, তিরমিজি, ইবনে মাজা, নাসায়ী]
(ছ) অন্যান্য বর্ণনায় উপরে উলেখিত হক ব্যতীত আরো কিছু হকের কথা বলা হয়েছে। যেমন—
(ক) মার্জিত ভাষায় কথা বলা
(খ) হাঁচির উত্তর প্রদান
(গ) বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করা
(ঘ) অক্ষমের সহযোগিতা করা
(ঙ) সন্দিহান ব্যক্তিকে সত্যের সন্ধান প্রদান
(চ) পথহারা ব্যক্তিকে পথের সন্ধান দান
(ছ) অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিহত করা
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে হাজর র. রাস্তার আদব সমূহ বিভিন্ন হাদিস থেকে ছন্দ আকারে একত্রে উলেখ করেছেন, যার অর্থ :
جمعت آداب من رام الجلوس على
الطريق من قول خير الخلق إنسانا
أفش السلام، وأحسن في الكلام
وشمت عاطسا، ردّ إحسانا
في الحمل عاون، ومظلوما أعن
وأغث لهفان، اهد سبيلا، واهد حيرانا
بالعرف مر، وانه عن نكر، وكف أذى
وغض طرفا، وكثر ذكر مولانا
সংকলিত করেছি আমি রাস্তায় বসার নিয়মাবলি,
মহামানবের উক্তি থেকে বিস্তারিত শুনে নাও
সালামের প্রচলন কর, মার্জনীয় মন্তব্য কর,
হাঁচিদাতার উত্তর প্রদান কর সালাম দিলে
উত্তমরূপে উত্তর দাও, বোঝা বহনকারীর সহযোগী হও
নিপীড়িতকে সহযোগিতা কর, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য কর
পথহারাকে পথ দেখাও, হতভম্বকে দিশা দাও
ভাল কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে বাধা দাও
কষ্ট দেয়া থেকে দূরে থাক, চক্ষু দ্বয় সংযত রাখ
মাওলা পাকের জিকির কর, (হৃদয়টাকে সতেজ কর)
আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সা. বলেন, তোমরা রাস্তায় বসে থাকা থেকে বিরত থাক। সাহাবিগণ রা. আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য রাস্তায় বসার বিকল্প নেই। রাসূল সা. বললেন, যদি তোমাদের একান্ত বসতেই হয়, তাহলে রাস্তার হক আদায় কর। তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ! রাস্তার হক কি ? তিনি বললেন, চক্ষু অবনত করা, কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, সালামের উত্তর প্রদান করা, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করা। [বোখারি-৬২২৯, মুসলিম-১৪।]
হাদিস বর্ণনাকারী—
তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট সাহাবি সা’দ, উপনাম আবু সাঈদ। পিতা মালেক। পিতামহ সানান। তিনি ছিলেন আনসার অন্তর্গত খুদুর গ্রামের অধিবাসী। মদিনার আনসারদের একটি গ্রামের নাম হল খুদুর। সেই গ্রামেই তার জন্ম, সে জন্য তাকে বলা হয় খুদরী। পিতা মালেক রা. উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক খন্দক তথা পরিখার যুদ্ধে ও বাইআতে রিজওয়ানে অংশগ্রহণ করেছেন। রাসূল থেকে এক হাজার একশ সত্তুরটি হাদিস বর্ণনা করেছেন তিনি। ফিকাহ বিশারদ হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। ৭৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আভিধানিক ব্যাখ্যা—
إيَّاكُمْ তোমরা বেঁচে থাক। ভীতি প্রদর্শনের জন্য ব্যবহার হয়। উদ্দেশ্য তোমরা রাস্তায় বসা পরিহার কর।
وَ الْجُلُوْسَ فِي الطُّرُقَاتِ এখানে س বর্ণে জবর হবে। অর্থাৎ, রাস্তায় বসাকে ভয় কর। উদ্দেশ্য হল রাস্তায় বসা থেকে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি।
الطرقات শব্দটি طرق - এর বহুবচন। আর طرق শব্দটি طريق শব্দের বহুবচন। হাদিসে যদিও طريق শব্দ ব্যবহার হয়েছে, উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যাপক। অর্থাৎ মানুষের সমস্ত গমনাগমন স্থান যেমন হাটবাজার, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে—হাদিস বর্ণনাকারী বলেন, كنا جلوسا بالأفنية অর্থাৎ আমরা যখন বাড়ির সামনে বসে ছিলাম। তখন রাসূল আমাদের বললেন, إياكم و الجلوس في الطرقات অর্থাৎ তোমরা রাস্তায় বসা পরিহার কর। এতে বুঝা গেল, রাস্তা মূল উদ্দেশ্য নয়, কেননা, তারা রাস্তায় বসে ছিলেন না। বরং উদ্দেশ্য হল, মানুষের গমনাগমনের পথ।
مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدٌّ এখানে د বর্ণে পেশ ও তাশদীদ হবে। অর্থ : আমাদের প্রয়োজনীয় কথার জন্য রাস্তায় বসার বিকল্প নেই।
فَإذَا أبَيْتُمْ إلاَّ الْمَجْلِسَ অর্থ যদি তোমাদের এই সমস্ত জায়গায় বসার একান্ত প্রয়োজনই হয়...।
فَأعْطُوا الطَّرِيْقَ حَقَّهُ কোন কোন বর্ণনায় حقها এসেছে। طريق শব্দটি উভয় লিঙ্গে ব্যবহার হয়। সে জন্য حقه ও حقها উভয়টি ব্যবহার বিধি-সম্মত। অর্থ, যদি তোমরা অপরাগ হয়ে বস, তবে রাস্তার হকগুলো আদায় কর।
غَضُّ الْبَصَرِ শাব্দিক অর্থ হল চোখের দুই পাতাকে এমন ভাবে মিলিয়ে নেওয়া যাতে কিছুই দেখা না যায়। এখানে উদ্দেশ্য, চোখকে হারাম দৃষ্টি থেকে হেফাজত করা।
كَفُّ الأذى অর্থ পথচারীদেরকে উপহাস বা অশালীন কথা বা কাজের দ্বারা কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। পথচারীর কষ্ট হয় এমন সকল কাজ থেকে বিরত থাকা।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ
ইসলামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হল সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিকে কুরুচিপূর্ণ আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড থেকে নিষ্কলুষ করে সৎ-চরিত্র ও আদর্শবান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে বিরাজ করে পারস্পরিক মায়া-মমতা ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি। মনে হবে, যেন তারা একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ইসলাম সর্বাঙ্গ সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। নীতিমালা নির্ধারণ ও অন্যের হক সংরক্ষণ ইত্যাদিতে তা পরিপূর্ণ ও অনন্য। যা অন্য কোন ধর্মে কিংবা মতাদর্শে বিরল—নেই বললেই চলে।
এই হাদিস প্রমাণ করে, রাস্তাঘাট তথা মানুষের গমনাগমনের স্থানসমূহ প্রকৃত পক্ষে বসার আসন বা এ কাজে ব্যবহারের জন্য নয়। অন্যথায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—
অন্যায় ও অসামাজিক এবং অশীল কাজের বিস্তার ঘটা
আকার ইঙ্গিত ও গালি মন্দের দ্বারা পথচারীকে কষ্ট দেয়া
অনর্থক মানুষের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করা
অযথা সময়ের অপচয়
এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাস্তার কয়েকটি আদবের কথা বলেছেন। যথা :
চক্ষুদ্বয়কে হারাম দৃষ্টি থেকে সংযত রাখা। রাস্তায় যেহেতু নারী সম্প্রদায়কে তাদের প্রয়োজনের তাগিদে আসতেই হয় এবং এর কোন বিকল্প নেই, সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি স্বেচ্ছায় না তাকাতে বলা হয়েছে। কেননা, স্বেচ্ছায় কোন পর নারীর দিকে তাকানোকে ইসলাম হারাম করেছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ
মুসলিমদেরকে বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে, এবং হেফাজত করে তাদের যৌনাঙ্গের। এতে তাদের জন্য রয়েছে অতিশয় পবিত্রতা। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। [সূরা নূর : ৩০]
পথচারীদেরকে যে কোন প্রকার কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। যেমন গালমন্দ ঠাট্টা তিরস্কার ইত্যাদি। এমনিভাবে যে কোন উপায়ে মুসলমানকে কষ্ট দেয়া,—যেমন কারো ঘরে উঁকি দিয়ে দেখা বা কারো বাড়ির পার্শ্বে বল খেলা ইত্যাদি—থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। সব ধরনের কষ্টই হারাম ও পরিত্যাজ্য।
সালামের উত্তর দেওয়া। এর উপর সমস্ত আলেমগণ একমত যে সালামের উত্তর ওয়াজিব। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا
আর যদি তোমাদেরকে সালাম পেশ করে তবে তোমরাও তার জন্য এর চেয়ে উত্তম সালাম পেশ কর অথবা তার সমপরিমাণ কর। [সূরা নিসা : ৮৬।]
তবে হ্যাঁ, সালাম দেয়া ওয়াজিব নয়। বরং সুন্নত, পুণ্যের কাজ। কেননা, তা মুসলমানের জন্য রহমত, বরকত, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। সাধারণত: রাস্তা ঘাটে অন্যায় বা অসৎ কাজের আধিক্য ঘটে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসৎ কাজের নিষেধ রাস্তার হক হিসাবে উলেখ করেছেন। এবং এই কাজ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ এই যে, কোরআনের বহু আয়াত আর রাসূলের বহু হাদিস এ প্রসঙ্গে বিবৃত। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ
তোমাদের এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে। এক সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। [সূরা আলে ইমরান : ১০৪]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان .
তোমাদের কেউ যখন কোন মন্দ কাজ দেখবে, তখন সামর্থ্য থাকলে শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত কর। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে কথার দ্বারা তার প্রতিবাদ কর। তাও যদি না পার তাহলে অন্তরে ঘৃণা করত: তা প্রতিহতের চিন্তা ভাবনা করতে থাক। আর এ হল ঈমানের সর্বশেষ দাবি বা স্তর। [মুসলিম-৪৯, তিরমিজি, ইবনে মাজা, নাসায়ী]
(ছ) অন্যান্য বর্ণনায় উপরে উলেখিত হক ব্যতীত আরো কিছু হকের কথা বলা হয়েছে। যেমন—
(ক) মার্জিত ভাষায় কথা বলা
(খ) হাঁচির উত্তর প্রদান
(গ) বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করা
(ঘ) অক্ষমের সহযোগিতা করা
(ঙ) সন্দিহান ব্যক্তিকে সত্যের সন্ধান প্রদান
(চ) পথহারা ব্যক্তিকে পথের সন্ধান দান
(ছ) অত্যাচারীর অত্যাচার প্রতিহত করা
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে হাজর র. রাস্তার আদব সমূহ বিভিন্ন হাদিস থেকে ছন্দ আকারে একত্রে উলেখ করেছেন, যার অর্থ :
جمعت آداب من رام الجلوس على
الطريق من قول خير الخلق إنسانا
أفش السلام، وأحسن في الكلام
وشمت عاطسا، ردّ إحسانا
في الحمل عاون، ومظلوما أعن
وأغث لهفان، اهد سبيلا، واهد حيرانا
بالعرف مر، وانه عن نكر، وكف أذى
وغض طرفا، وكثر ذكر مولانا
সংকলিত করেছি আমি রাস্তায় বসার নিয়মাবলি,
মহামানবের উক্তি থেকে বিস্তারিত শুনে নাও
সালামের প্রচলন কর, মার্জনীয় মন্তব্য কর,
হাঁচিদাতার উত্তর প্রদান কর সালাম দিলে
উত্তমরূপে উত্তর দাও, বোঝা বহনকারীর সহযোগী হও
নিপীড়িতকে সহযোগিতা কর, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য কর
পথহারাকে পথ দেখাও, হতভম্বকে দিশা দাও
ভাল কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে বাধা দাও
কষ্ট দেয়া থেকে দূরে থাক, চক্ষু দ্বয় সংযত রাখ
মাওলা পাকের জিকির কর, (হৃদয়টাকে সতেজ কর)
عن أمامة الباهلي- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ - قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- أنَا زَعِيْمٌ بِبَيْتٍ فِيْ رَبَضِ الْجَنَّةِ، لِمَنْ تَرَكَ الْمِرَاءَ، وَ إنْ كَانَ مُحِقًّا، وَ بِبَيْتٍ فِيْ وَسْطِ الْجَنَّةِ، لِمَنْ تَرَكَ الْكِذْبَ، وَ إنْ كَانَ مَازِحًا، وَ بِبَيْتٍ فِيْ أعْلَى الْجَنَّةِ، لِمَنْ حَسُنَ خُلُقُهُ . رواه أبوداود (৪১৬৭)
আবু উমামা আল বাহেলী রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের তৃতীয় শ্রেণিতে একটি বাড়ির জিম্মাদার যে কলহ বিবাদ পরিত্যাগ করে। যদিও সত্য তার পক্ষেই হয়। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের দ্বিতীয় শ্রেণিতে একটি বাড়ির জিম্মাদার, যে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে। যদিও তা হাসি-তামাশাচ্ছলে হয়। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের প্রথম শ্রেণিতে একটি বাড়ির জিম্মাদার, যে সৎ চরিত্র ও আদর্শবান। [আবু দাউদ, সনদটি হাসান।]
হাদিস বর্ণনাকারী—
বর্ণনাকারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশিষ্ট সাহাবি। নাম সাদি বিন আজলান আল-বাহেলি। উপাধি, আবু উমামা। পিতার নাম আজলান, বাহেল নামক স্থানের অধিবাসী হওয়ার ফলে তাকে বাহেলী বলা হয়। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার সংগ্রহ করেছিলেন। ৮১ মতান্তরে ৮৬ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আভিধানিক ব্যাখ্যা
- زَعِيْمٌ জিম্মাদার, দায়িত্বভার বহনকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَأَنَا بِهِ زَعِيمٌ এবং আমি তার জিম্মাদার। [সুরা ইউসুফ ৭২]
بِبَيْتٍ বালাখানা, জান্নাতের প্রাসাদ।
رَبَضِ الْجَنَّةِ - ر ও ب বর্ণে জবর হবে। অর্থ : নীচের স্তরের বা তৃতীয় শ্রেণির।
الْمِرَاءَ - م বর্ণে যের হবে। অর্থ কলহ বিবাদ।
مُحِقًّا - অর্থ, তার ধারণা সে হকের উপর রয়েছে।
الْكِذْبَ - মিথ্যা, তথা বাস্তবের বিপরীত।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
সফল আহবায়ক ও অভিভাবক সেই ব্যক্তি যে তার কথাগুলো এমন কৌশলে শ্রোতাদের নিকট উপস্থাপন করে যে, শ্রোতাবৃন্দ তার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করে। যেমন এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু গুণের প্রতি এ বলে অনুপ্রাণিত করেছেন যে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার।
জান্নাত হল প্রত্যাশীদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা এবং প্রতিযোগীদের সর্বাধিক প্রতিযোগিতার বিষয়। সফলকাম সে যে জান্নাত লাভের জন্য সচেষ্ট হয়। ভাগ্যবান সে যে তা অর্জনের জন্য অধিক পরিমাণে নেক আমল করে। জান্নাত অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ, তা অর্জন করা শুধু তার জন্যই সহজ হয়, যার জন্য ঐশীভাবে বিষয়টি সহজ করা হয়।
জান্নাত—যা আল্লাহ তাআলা মোমিন বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন—বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। বর্ণিত হাদিসে সে সব লোকদের জন্য জান্নাতের শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছে, যারা তিনটি গুণের যে কোন একটি দ্বারা অলংকৃত হয়েছে।
(ক) অনর্থক কলহ বিবাদ থেকে দূরে থাকা। এরূপ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের তৃতীয় শ্রেণি বরাদ্দ। কেননা কলহ বিবাদ মানুষকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে ও পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ফলে তাকে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে অক্ষম করে দেয়। সুতরাং, প্রকৃত মুসলমান সব ধরনের কলহ বিবাদ পরিহার করে চলে।
(খ) মিথ্যা থেকে দূরে থাকা—হোক তা উপহাস মূলক। এ গুণে অলংকৃত ব্যক্তির জন্য জান্নাতের দ্বিতীয় শ্রেণির বাড়ির শুভ সংবাদ রয়েছে। এ ব্যক্তি এহেন সম্মানে ভূষিত হওয়ার কারণ এই যে, সে কথা ও কাজে মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সর্বদা সত্য ও বাস্তবের উপর স্থির থাকে। যখন কথা বলে তখন সত্যই বলে। আর যখন কোন সংবাদ প্রচার করে তখন সত্য সংবাদই প্রচার করে। মিথ্যা একটি জঘন্য অপরাধ। তাই মিথ্যা কপটতার লক্ষণসমূহের মাঝে অন্যতম। যেমন আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
آية المنافق ثلاث : إذا حدث كذب، وإذا وعد أخلف، وإذا أؤتمن خان . رواه البخاري (৩২)
কপটের লক্ষণ তিনটি: (১) মিথ্যা বলা, (২) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ও (৩) আমানতের খেয়ানত করা বা গচ্ছিত বস্ত্ততে অনধিকার হস্তক্ষেপ করা। [বোখারি -৩২]
মিথ্যা বড় বড় গোনাহ সমূহের অন্যতম। মিথ্যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিরাট ক্ষতির উদ্রেককারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
وإياكم والكذب، فإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وما يزال الرجل يكذب ويتحرى الكذب ، حتى يكتب عند الله كذابا . رواه مسلم (৪৭২১)
তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কেননা মিথ্যা অপকর্মের উদগাতা। আর অপকর্মের পরিণাম ফল জাহান্নাম। পৃথিবীতে কিছু লোক আছে, যারা খুব মিথ্যা বলে। মিথ্যা বলায় সদা সচেষ্ট থাকে। পরিশেষে আল্লাহর নিকট মিথ্যুক বলে লিখিত হয়ে যায়।
এ মস্ত বড় সতর্ক বাণী, যা প্রতিটি মিথ্যুকের জন্য প্রযোজ্য। যদিও এ মিথ্যা শুধু মজাক করার জন্য বলা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
ويل للذي يحدث بالحديث ليضحك به القوم، ويل له، ويل له .
ধ্বংস সে ব্যক্তির জন্য, লোক হাসানোর জন্য যে মিথ্যা বলে, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস ।
সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা কথা হল, আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের উপর মিথ্যা বলা। এমনিভাবে সম্পদের জন্য মিথ্যা কথা বলা।
সৎ চরিত্র ও উত্তম আদর্শ ব্যক্তির জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ গুণে অলংকৃত ব্যক্তির জন্য রয়েছে জান্নাতের প্রথম শ্রেণির বাড়ির শুভ সংবাদ। যেহেতু এই ব্যক্তি এক মহৎ গুণের অধিকারী, আর তা হল সৎ চরিত্র ও উত্তম আদর্শ, যা ছিল নবীকুল শিরোমণি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ গুণ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। [সূরা কলম : ৪] এই মহান চরিত্রই হল সর্ব উৎকৃষ্ট গুণ, যা মুসলমানদের জন্য জগতবাসীর কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ও পরকালে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
ما من شيء أثقل في ميزان المؤمن يوم القيامة من خلق حسن، وإن الله ليبغض الفاحش البذيء . رواه الترمذي : ১৯২৫
কেয়ামতের দিন যে সব আমল ওজন করা হবে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি ওজনী আমল হবে সৎ চরিত্র বা উত্তম আদর্শ। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির উপর অসন্তুষ্ট যে অশালীন ও অসৎ চরিত্রবান। [তিরমিজি - ১৯২৫]
ইসলামের দাবি হল মুসলিম সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে বিরাজ করবে মায়া-মমতা, আন্তরিকতা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের সুসম্পর্ক। যেখানে থাকবে না কোন প্রকার হিংসা বিদ্বেষ ও কুরুচিকর কর্মকান্ড।
ইসলামের মূলনীতির অন্যতম হল ভাল বস্ত্তর উপকার দ্বারা উপকৃত হওয়ার চেয়ে মন্দের অপকারিতা থেকে বাঁচার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা। সুতরাং যে কলহ বিবাদ মানুষকে সমস্যার সম্মুখীন করবে, তা হতে দূরে থাকাই উচিত।
আবু উমামা আল বাহেলী রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের তৃতীয় শ্রেণিতে একটি বাড়ির জিম্মাদার যে কলহ বিবাদ পরিত্যাগ করে। যদিও সত্য তার পক্ষেই হয়। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের দ্বিতীয় শ্রেণিতে একটি বাড়ির জিম্মাদার, যে মিথ্যাকে পরিত্যাগ করে। যদিও তা হাসি-তামাশাচ্ছলে হয়। আর ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের প্রথম শ্রেণিতে একটি বাড়ির জিম্মাদার, যে সৎ চরিত্র ও আদর্শবান। [আবু দাউদ, সনদটি হাসান।]
হাদিস বর্ণনাকারী—
বর্ণনাকারী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশিষ্ট সাহাবি। নাম সাদি বিন আজলান আল-বাহেলি। উপাধি, আবু উমামা। পিতার নাম আজলান, বাহেল নামক স্থানের অধিবাসী হওয়ার ফলে তাকে বাহেলী বলা হয়। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার সংগ্রহ করেছিলেন। ৮১ মতান্তরে ৮৬ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আভিধানিক ব্যাখ্যা
- زَعِيْمٌ জিম্মাদার, দায়িত্বভার বহনকারী। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَأَنَا بِهِ زَعِيمٌ এবং আমি তার জিম্মাদার। [সুরা ইউসুফ ৭২]
بِبَيْتٍ বালাখানা, জান্নাতের প্রাসাদ।
رَبَضِ الْجَنَّةِ - ر ও ب বর্ণে জবর হবে। অর্থ : নীচের স্তরের বা তৃতীয় শ্রেণির।
الْمِرَاءَ - م বর্ণে যের হবে। অর্থ কলহ বিবাদ।
مُحِقًّا - অর্থ, তার ধারণা সে হকের উপর রয়েছে।
الْكِذْبَ - মিথ্যা, তথা বাস্তবের বিপরীত।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
সফল আহবায়ক ও অভিভাবক সেই ব্যক্তি যে তার কথাগুলো এমন কৌশলে শ্রোতাদের নিকট উপস্থাপন করে যে, শ্রোতাবৃন্দ তার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করে। যেমন এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু গুণের প্রতি এ বলে অনুপ্রাণিত করেছেন যে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার।
জান্নাত হল প্রত্যাশীদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা এবং প্রতিযোগীদের সর্বাধিক প্রতিযোগিতার বিষয়। সফলকাম সে যে জান্নাত লাভের জন্য সচেষ্ট হয়। ভাগ্যবান সে যে তা অর্জনের জন্য অধিক পরিমাণে নেক আমল করে। জান্নাত অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ, তা অর্জন করা শুধু তার জন্যই সহজ হয়, যার জন্য ঐশীভাবে বিষয়টি সহজ করা হয়।
জান্নাত—যা আল্লাহ তাআলা মোমিন বান্দাদের জন্য তৈরি করেছেন—বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। বর্ণিত হাদিসে সে সব লোকদের জন্য জান্নাতের শুভ সংবাদ দেয়া হয়েছে, যারা তিনটি গুণের যে কোন একটি দ্বারা অলংকৃত হয়েছে।
(ক) অনর্থক কলহ বিবাদ থেকে দূরে থাকা। এরূপ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের তৃতীয় শ্রেণি বরাদ্দ। কেননা কলহ বিবাদ মানুষকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে ও পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ফলে তাকে মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে অক্ষম করে দেয়। সুতরাং, প্রকৃত মুসলমান সব ধরনের কলহ বিবাদ পরিহার করে চলে।
(খ) মিথ্যা থেকে দূরে থাকা—হোক তা উপহাস মূলক। এ গুণে অলংকৃত ব্যক্তির জন্য জান্নাতের দ্বিতীয় শ্রেণির বাড়ির শুভ সংবাদ রয়েছে। এ ব্যক্তি এহেন সম্মানে ভূষিত হওয়ার কারণ এই যে, সে কথা ও কাজে মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সর্বদা সত্য ও বাস্তবের উপর স্থির থাকে। যখন কথা বলে তখন সত্যই বলে। আর যখন কোন সংবাদ প্রচার করে তখন সত্য সংবাদই প্রচার করে। মিথ্যা একটি জঘন্য অপরাধ। তাই মিথ্যা কপটতার লক্ষণসমূহের মাঝে অন্যতম। যেমন আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
آية المنافق ثلاث : إذا حدث كذب، وإذا وعد أخلف، وإذا أؤتمن خان . رواه البخاري (৩২)
কপটের লক্ষণ তিনটি: (১) মিথ্যা বলা, (২) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ও (৩) আমানতের খেয়ানত করা বা গচ্ছিত বস্ত্ততে অনধিকার হস্তক্ষেপ করা। [বোখারি -৩২]
মিথ্যা বড় বড় গোনাহ সমূহের অন্যতম। মিথ্যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিরাট ক্ষতির উদ্রেককারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
وإياكم والكذب، فإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وما يزال الرجل يكذب ويتحرى الكذب ، حتى يكتب عند الله كذابا . رواه مسلم (৪৭২১)
তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাক। কেননা মিথ্যা অপকর্মের উদগাতা। আর অপকর্মের পরিণাম ফল জাহান্নাম। পৃথিবীতে কিছু লোক আছে, যারা খুব মিথ্যা বলে। মিথ্যা বলায় সদা সচেষ্ট থাকে। পরিশেষে আল্লাহর নিকট মিথ্যুক বলে লিখিত হয়ে যায়।
এ মস্ত বড় সতর্ক বাণী, যা প্রতিটি মিথ্যুকের জন্য প্রযোজ্য। যদিও এ মিথ্যা শুধু মজাক করার জন্য বলা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
ويل للذي يحدث بالحديث ليضحك به القوم، ويل له، ويل له .
ধ্বংস সে ব্যক্তির জন্য, লোক হাসানোর জন্য যে মিথ্যা বলে, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস ।
সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা কথা হল, আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের উপর মিথ্যা বলা। এমনিভাবে সম্পদের জন্য মিথ্যা কথা বলা।
সৎ চরিত্র ও উত্তম আদর্শ ব্যক্তির জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ গুণে অলংকৃত ব্যক্তির জন্য রয়েছে জান্নাতের প্রথম শ্রেণির বাড়ির শুভ সংবাদ। যেহেতু এই ব্যক্তি এক মহৎ গুণের অধিকারী, আর তা হল সৎ চরিত্র ও উত্তম আদর্শ, যা ছিল নবীকুল শিরোমণি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ গুণ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। [সূরা কলম : ৪] এই মহান চরিত্রই হল সর্ব উৎকৃষ্ট গুণ, যা মুসলমানদের জন্য জগতবাসীর কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ও পরকালে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
ما من شيء أثقل في ميزان المؤمن يوم القيامة من خلق حسن، وإن الله ليبغض الفاحش البذيء . رواه الترمذي : ১৯২৫
কেয়ামতের দিন যে সব আমল ওজন করা হবে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি ওজনী আমল হবে সৎ চরিত্র বা উত্তম আদর্শ। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির উপর অসন্তুষ্ট যে অশালীন ও অসৎ চরিত্রবান। [তিরমিজি - ১৯২৫]
ইসলামের দাবি হল মুসলিম সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে বিরাজ করবে মায়া-মমতা, আন্তরিকতা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের সুসম্পর্ক। যেখানে থাকবে না কোন প্রকার হিংসা বিদ্বেষ ও কুরুচিকর কর্মকান্ড।
ইসলামের মূলনীতির অন্যতম হল ভাল বস্ত্তর উপকার দ্বারা উপকৃত হওয়ার চেয়ে মন্দের অপকারিতা থেকে বাঁচার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা। সুতরাং যে কলহ বিবাদ মানুষকে সমস্যার সম্মুখীন করবে, তা হতে দূরে থাকাই উচিত।
عن أبي هريرة- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : أوْصِنِيْ قَالَ : لَا تَغْضَبْ، فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ : لَا تَغْضَبْ . رواه البخاري (৫৬৫১)
আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রাসূল বললেন, ক্রুদ্ধ হয়ো না। সে ব্যক্তি বারংবার উপদেশ চাইলে রাসূল (একই উত্তর দিয়ে) তাকে বললেন, ক্রদ্ধ হয়ো না। [বোখারি-৫৬৫১]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
أَنَّ رَجُلاً তিনি ছিলেন রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবি জারিয়া বিন কুদামাহ রা.।
لَا تَغْضَبْ অর্থাৎ, যে সকল কারণে রাগ আসে সেগুলো থেকে দূরে থাক।
، فَرَدَّدَ مِرَارًا সে ব্যক্তি বারংবার প্রশ্ন করে এ প্রত্যাশা করছিলেন যে, আরো অধিক উপকারী ও ব্যাপক কোন বিষয় রাসূল তাকে জ্ঞাত করাবেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কিছু না বলে একটি উপদেশের উপরেই ক্ষান্ত রইলেন।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
উলেখিত হাদিসটি রাসূলের ‘জামিউল কালাম’- এর মধ্য থেকে অন্যতম। সংক্ষিপ্ত শব্দে যাতে ব্যাপক অর্থময় মর্মের বিস্তার করা হয়। বিজ্ঞ আলেমগণ এ হাদিসের সুদীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেননা এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, সূক্ষ্মতা ও গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা অনুসরণ ও জীবনে পূর্ণ বাস্তাবায়ন করা।
ক্রোধ হল মানুষ্য চরিত্রের এক অস্বাভাবিক অবস্থা। যা সুনির্দিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। এই ক্রোধের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ক্রোধ বিষয়ে মানুষের যেমন বিভিন্ন অবস্থান রয়েছে, তেমনিভাবে এ বিষয়ে ইসলামেরও দিক নির্দেশনা দিয়েছে নানাভাবে। মানুষের উচিত এ গুলোকে ভালোভাবে অবলোকন করা, এবং সঠিক ও যথাযথ উপায়ে প্রয়োগ করা।
ক্রোধের প্রকার
ক্রোধ বিভিন্ন প্রকার। নিম্নে তার সার বর্ণনা করা হল।
(ক) প্রশংসনীয় ক্রোধ : যেমন আল্লাহর প্রতি মহববত পোষণকারী কোন মুসলিম যখন আল্লাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট পুরস্কৃত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ
এটাই বিধান। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম। [সূরা হজ : ৩০]
(খ) নিন্দনীয় ক্রোধ। এ এমন ক্রোধ যা হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এ প্রকারের ক্রোধান্ধ ব্যক্তি আল্লাহর নিকট ঘৃণিত।
(গ) স্বভাবগত ক্রোধ। যেমন কারো স্ত্রী তার কথা অমান্য করলে সে ক্রুদ্ধ হয়, এই প্রকারের ক্রোধ হালাল, কিন্তু এর কু-পরিণামের কারণে এই ক্রোধ থেকেও বারণ করা হয়েছে। একে রাসূলের নিষিদ্ধ ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ক্রোধের কতিপয় কারণ
(ক) স্বভাবগত ক্রোধ
(খ) অহংকারের ফলে উদ্ভূত ক্রোধ
(গ) ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের লালসা জনিত ক্রোধ
(ঘ) অনর্থক কলহ বশত: ক্রোধ
(ঙ) অত্যধিক হাসি মজাক ও ঠাট্টা বিদ্রূপ জনিত ক্রোধ
ক্রোধের পরিণাম খুবই অমঙ্গলজনক
(ক) ক্রোধ বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধি নির্ভুলভাবে প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে অন্যায়ের নির্দেশ প্রদান করে। অত:পর যখন ক্রোধ থেমে যায়, তখন এর জন্য লজ্জিত হয়। যেমন কেউ ক্রোধে অস্থির হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল। বা নিজ সন্তানকে অথবা আপনজনকে এমন প্রহার করল যে, সে রক্তাক্ত হয়ে গেল। এহেন ক্রোধের কারণে নিশ্চয় পরবর্তীতে সে লজ্জিত হবে।
(খ) ক্রোধান্ধ ব্যক্তি থেকে মানুষ পলায়ন করে, বর্জন করে তার আশপাশ। ফলে সে কখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না, বঞ্চিত হয় মানুষের সু-দৃষ্টি হতে। বরং সব সময় মানুষের নিকট সে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
(গ) ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে।
(ঘ) ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।
(ঙ) ক্রোধ সমাজে বিরাজমান পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অমানবিকতা সৃষ্টি করে।
(চ) ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্ক—যা সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক—এর উপর আঘাত হানে। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের বায়ুচাপ, ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।
(জ) ক্রোধের পরিণামফল হল, নিজের সম্পদ ধ্বংস করা ও মানুষের রোষানলে পতিত হওয়া।
এই ক্ষতিকর ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের উপায়
(ক) যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা।
(খ) মুখ ও অন্তর দ্বারা আল্লাহর জিকির করা। কেননা, ক্রোধ হল শয়তানের কু-প্রভাবের বিষক্রিয়া।
তাই যখন মানুষ আল্লাহর জিকির করে তখন শয়তানের প্রভাব মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন—
الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে , জেনে রাখ আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। [রা’দ : ২৮]
(গ) ক্রোধ পরিত্যাগ ও মানুষকে ক্ষমার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন—
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ . الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ . ﴿آل عمران : 133-134﴾
তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে, আসমান জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সম্বরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্ত্তত: আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। [আলে ইমরান : ১৩৩, ১৩৪]
রাসূল বলেন—
لا تغضب و لك الجنة .
ক্রুদ্ধ হয়ো না, প্রতিদানে তোমার জন্য জান্নাত। [যাদুদ দায়িয়াহ : ৪৯]
(ঘ) ক্রোধের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। ক্রোধান্ধ ব্যক্তি যদি ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজ অশোভণীয় বিকৃত আকৃতি দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি ক্ষান্ত হয়ে যেত।
(চ) ক্রুদ্ধ ব্যক্তির অবস্থার পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় ছিল তার পরিবর্তে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা।
(ছ) ওজু করা, তা এই জন্য যে ক্রোধ হল শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন পানি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলের সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে।
(জ) যখন ক্রোধ আসবে, তখন أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিবে। কেননা মানুষ শয়তানের প্রভাবে ক্রোধাক্রান্ত হয়, যখন সে উক্ত বাক্য পাঠ করে তখন শয়তান পিছু হটে যায়, যেমন হাদিসে আছে—
أن رجلان استبا عند النَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- وأحدهما يسب صاحبه، قد احمر وجهه، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : إني لأعلم كلمة لو قالها لذهب عنه ما يجد، لوقال أعوذ بالله من الشيطان الرجيم . رواه البخاري (৫৬৫০)
দু্ই ব্যক্তি রসুলের সামনে একে অন্যকে কটু বাক্য বলছিল। তাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এমন বাণী সম্পর্কে অবগত, যদি সে তা পাঠ করত, তবে তার ক্রোধ দূরীভূত হত। যদি সে আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম বলত, তবে তার ক্রোধ দূর হয়ে যেত। [বোখারি : ৫৬৫০]
(৭) মোমিনের বিশেষ গুণ হল সে সব সময় উভয় জগতের মঙ্গলজনক কাজে সচেষ্ট থাকে, যেমন হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তি উপদেশের জন্য রাসূলের উপস্থিতিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে রাসূল থেকে বারংবার উপদেশ চাচ্ছিলেন, যা তার জীবনের পাথেয় হবে। বর্তমান যুগে আল্লাহর পথে আহবায়ক ও আলেম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করে তাদের শিক্ষা, আদেশ ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।
আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রাসূল বললেন, ক্রুদ্ধ হয়ো না। সে ব্যক্তি বারংবার উপদেশ চাইলে রাসূল (একই উত্তর দিয়ে) তাকে বললেন, ক্রদ্ধ হয়ো না। [বোখারি-৫৬৫১]
আভিধানিক ব্যাখ্যা
أَنَّ رَجُلاً তিনি ছিলেন রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবি জারিয়া বিন কুদামাহ রা.।
لَا تَغْضَبْ অর্থাৎ, যে সকল কারণে রাগ আসে সেগুলো থেকে দূরে থাক।
، فَرَدَّدَ مِرَارًا সে ব্যক্তি বারংবার প্রশ্ন করে এ প্রত্যাশা করছিলেন যে, আরো অধিক উপকারী ও ব্যাপক কোন বিষয় রাসূল তাকে জ্ঞাত করাবেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কিছু না বলে একটি উপদেশের উপরেই ক্ষান্ত রইলেন।
হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়
উলেখিত হাদিসটি রাসূলের ‘জামিউল কালাম’- এর মধ্য থেকে অন্যতম। সংক্ষিপ্ত শব্দে যাতে ব্যাপক অর্থময় মর্মের বিস্তার করা হয়। বিজ্ঞ আলেমগণ এ হাদিসের সুদীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেননা এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, সূক্ষ্মতা ও গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা অনুসরণ ও জীবনে পূর্ণ বাস্তাবায়ন করা।
ক্রোধ হল মানুষ্য চরিত্রের এক অস্বাভাবিক অবস্থা। যা সুনির্দিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। এই ক্রোধের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ক্রোধ বিষয়ে মানুষের যেমন বিভিন্ন অবস্থান রয়েছে, তেমনিভাবে এ বিষয়ে ইসলামেরও দিক নির্দেশনা দিয়েছে নানাভাবে। মানুষের উচিত এ গুলোকে ভালোভাবে অবলোকন করা, এবং সঠিক ও যথাযথ উপায়ে প্রয়োগ করা।
ক্রোধের প্রকার
ক্রোধ বিভিন্ন প্রকার। নিম্নে তার সার বর্ণনা করা হল।
(ক) প্রশংসনীয় ক্রোধ : যেমন আল্লাহর প্রতি মহববত পোষণকারী কোন মুসলিম যখন আল্লাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট পুরস্কৃত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ
এটাই বিধান। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম। [সূরা হজ : ৩০]
(খ) নিন্দনীয় ক্রোধ। এ এমন ক্রোধ যা হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এ প্রকারের ক্রোধান্ধ ব্যক্তি আল্লাহর নিকট ঘৃণিত।
(গ) স্বভাবগত ক্রোধ। যেমন কারো স্ত্রী তার কথা অমান্য করলে সে ক্রুদ্ধ হয়, এই প্রকারের ক্রোধ হালাল, কিন্তু এর কু-পরিণামের কারণে এই ক্রোধ থেকেও বারণ করা হয়েছে। একে রাসূলের নিষিদ্ধ ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ক্রোধের কতিপয় কারণ
(ক) স্বভাবগত ক্রোধ
(খ) অহংকারের ফলে উদ্ভূত ক্রোধ
(গ) ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের লালসা জনিত ক্রোধ
(ঘ) অনর্থক কলহ বশত: ক্রোধ
(ঙ) অত্যধিক হাসি মজাক ও ঠাট্টা বিদ্রূপ জনিত ক্রোধ
ক্রোধের পরিণাম খুবই অমঙ্গলজনক
(ক) ক্রোধ বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধি নির্ভুলভাবে প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে অন্যায়ের নির্দেশ প্রদান করে। অত:পর যখন ক্রোধ থেমে যায়, তখন এর জন্য লজ্জিত হয়। যেমন কেউ ক্রোধে অস্থির হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল। বা নিজ সন্তানকে অথবা আপনজনকে এমন প্রহার করল যে, সে রক্তাক্ত হয়ে গেল। এহেন ক্রোধের কারণে নিশ্চয় পরবর্তীতে সে লজ্জিত হবে।
(খ) ক্রোধান্ধ ব্যক্তি থেকে মানুষ পলায়ন করে, বর্জন করে তার আশপাশ। ফলে সে কখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না, বঞ্চিত হয় মানুষের সু-দৃষ্টি হতে। বরং সব সময় মানুষের নিকট সে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
(গ) ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে।
(ঘ) ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।
(ঙ) ক্রোধ সমাজে বিরাজমান পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অমানবিকতা সৃষ্টি করে।
(চ) ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্ক—যা সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক—এর উপর আঘাত হানে। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের বায়ুচাপ, ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।
(জ) ক্রোধের পরিণামফল হল, নিজের সম্পদ ধ্বংস করা ও মানুষের রোষানলে পতিত হওয়া।
এই ক্ষতিকর ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের উপায়
(ক) যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা।
(খ) মুখ ও অন্তর দ্বারা আল্লাহর জিকির করা। কেননা, ক্রোধ হল শয়তানের কু-প্রভাবের বিষক্রিয়া।
তাই যখন মানুষ আল্লাহর জিকির করে তখন শয়তানের প্রভাব মুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন—
الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللَّهِ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে , জেনে রাখ আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। [রা’দ : ২৮]
(গ) ক্রোধ পরিত্যাগ ও মানুষকে ক্ষমার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন—
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ . الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ . ﴿آل عمران : 133-134﴾
তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে, আসমান জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সম্বরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্ত্তত: আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। [আলে ইমরান : ১৩৩, ১৩৪]
রাসূল বলেন—
لا تغضب و لك الجنة .
ক্রুদ্ধ হয়ো না, প্রতিদানে তোমার জন্য জান্নাত। [যাদুদ দায়িয়াহ : ৪৯]
(ঘ) ক্রোধের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। ক্রোধান্ধ ব্যক্তি যদি ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজ অশোভণীয় বিকৃত আকৃতি দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি ক্ষান্ত হয়ে যেত।
(চ) ক্রুদ্ধ ব্যক্তির অবস্থার পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় ছিল তার পরিবর্তে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা।
(ছ) ওজু করা, তা এই জন্য যে ক্রোধ হল শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন পানি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলের সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে।
(জ) যখন ক্রোধ আসবে, তখন أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিবে। কেননা মানুষ শয়তানের প্রভাবে ক্রোধাক্রান্ত হয়, যখন সে উক্ত বাক্য পাঠ করে তখন শয়তান পিছু হটে যায়, যেমন হাদিসে আছে—
أن رجلان استبا عند النَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- وأحدهما يسب صاحبه، قد احمر وجهه، فقال النبي صلى الله عليه وسلم : إني لأعلم كلمة لو قالها لذهب عنه ما يجد، لوقال أعوذ بالله من الشيطان الرجيم . رواه البخاري (৫৬৫০)
দু্ই ব্যক্তি রসুলের সামনে একে অন্যকে কটু বাক্য বলছিল। তাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এমন বাণী সম্পর্কে অবগত, যদি সে তা পাঠ করত, তবে তার ক্রোধ দূরীভূত হত। যদি সে আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম বলত, তবে তার ক্রোধ দূর হয়ে যেত। [বোখারি : ৫৬৫০]
(৭) মোমিনের বিশেষ গুণ হল সে সব সময় উভয় জগতের মঙ্গলজনক কাজে সচেষ্ট থাকে, যেমন হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তি উপদেশের জন্য রাসূলের উপস্থিতিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে রাসূল থেকে বারংবার উপদেশ চাচ্ছিলেন, যা তার জীবনের পাথেয় হবে। বর্তমান যুগে আল্লাহর পথে আহবায়ক ও আলেম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করে তাদের শিক্ষা, আদেশ ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا- قَالَ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ- يَقُوْلُ : اِنْطَلَقَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكَمُ ْحَتّى أوَوا الْمَبِيْتَ إلى غَارٍ فَدَخَلُوْهُ، فَانْحَدَرَتْ صَخْرَةٌ مِنَ الْجَبَلِ، فَسَدَّتْ عَلَيْهِمُ الْغَارَ، فَقَالُوْا : إنَّه لَايُنْجِيْكُمْ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةَِ إلَّا أنْ تَدْعُوا اللهَ بِصَالِحِ أعْمَالِكُمْ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنْهُمْ : اللّهُمَّ كَانَ لِيْ أبْوَانِ شَيْخَانِ كَبِيْرَانِ وَكُنْتُ لَا أغْبِقُ قَبْلَهُمَا أهْلًا ولَا مَالًا، فَنَأى بِيْ فَيْ طَلَبِ شَيْئٍ يَوْمًا، فَلَمْ أرِحْ عَلَيْهِمَا حَتَّى نَامَا : فَحَلَبْتُ لَهُمَا غَبُوْقَهُمَا، فَوَجَدتُّهُمَا نَائِمَيْنِ، وَكَرِهْتُ أنْ أغْبِقَ قَبْلَهُمَا أهْلًا أوْ مَالًا، فًلَبِثْتُ - وَالْقَدْحُ عَلَى يَدِيْ- أنْتَظِرُ اِسْتِيْقَاظَهُمَا حَتّى بَرِقَ الْفَجْرُ، فَاسْتَيْقَظَا فَشَرِبَا غَبُوْقَهُمَا، اللّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَفَرِّجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ مِنْ هذِهِ الصَّخْرَةِ، فَانْفَجَرَتْ شَيْئًا لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ الْخُرُوْجَ .
قال النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : وقال الآخَرُ : اللَّهُمَّ كَانَتْ لِيْ بِنْتُ عَمٍّ، كَانَتْ أحَبَ النَّاسِ إلَيَِّ، فَأرَدتُّهَا عَنْ نَفْسِهَا، فَامْتَنَعَتْ مِنِّيْ حَتَّى ألَّمَتْ بِهَا سَنَةٌ مِنَ السِّنِيْنَ، فَجَائتْنِيْ فَأعْطَيْتُهَا عِشْرِيْنَ وَمِائةَ دِيْنَارٍ عَلَى إن تُخَلِّيَ بَيْنِيْ وَبَيْنَ نَفْسِهَا، فَفَعَلَتْ، حَتَّى إذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا، قَالَتْ : لَا أحِلُّ لَكَ أنْ تَفُضَّ الْخَاتَمَ إلَّا بِحَقَّهِ، فَتَحَرَّجْتُ مِنَ الْوُقُوْعِ عَلَيْهَا، فَانْصَرَفْتُ عَنْهَا وَهِيَ أحَبُّ النَّاسِ إلَيَّ، وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِيِ أعْطَيْتُهَا، اللّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ، فَانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، غَيْرَ أنَّهُمْ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ الْخُرُوْجَ مِنْهَا .
قال النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : وقَالَ الثَّالِثُ : اللّهُمَّ إنِّيْ اسْتَأجَرْتُ أجَرَاءَ، فَأعْطَيْتُهُمْ أجْرَهُمْ غَيْرَ رَجُلٍ وَاحِدٍ تَرَكَ الَّذِيْ لَهُ وَذَهَبَ، فَثَمَّرْتُ أجْرَهُ حَتّى كَثُرَتْ مِنْهُ الْأمْوَالُ فَجَاءَنِيْ بَعْدَ حِيْنٍ فَقَالَ : يَا عَبْدَ اللهِ، أدِّ إلَيَّ أجْرِيْ، فَقُلْتُ لَهُ : كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أجْرِكَ، مِنَ الْإبِلِ، وَالْبَقَرِ، وَالْغَنَمِ، وَالرَّقِيْقِ، فَقَالَ : يَا عَبْدَ اللهِ، لَاتَسْتَهْزِئْ بِيْ، فَقُلْتُ : إنِّيْ لَا أسْتَهْزِئُ بِكَ فَأخَذَهُ كُلَّهُ فَاسْتَاقَهْ فَلَمْ يَتْرُكْ مِنْهُ شَيْئًا، اللَّهُمَّ فَإنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ، فَانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، فَخَرَجُوْا يَمْشُوْنَ . رواه البخاري (2111)
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের পূর্বের যুগে তিন ব্যক্তির একটি দল কোথাও যাত্রা করেছিল, যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহাতে তারা আগমন করে এবং তাতে প্রবেশ করে। অকস্মাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে এবং বন্ধ করে দেয় তাদের উপর গুহামুখ। এমন অসহায় অবস্থায় তারা বলাবলি করছিল, তোমাদেরকে এ পাথর হতে মুক্ত করতে পারবে—এমন কিছুই হয়ত নেই। তবে যদি তোমরা নিজ নিজ নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া কর—নাজাত পেতে পার।
তাদের একজন বলল : হে আল্লাহ ! আমার বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন, আমি তাদেরকে দেওয়ার পূর্বে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য—স্ত্রী-সন্তান ও গোলাম-পরিচারকদের কাউকে রাতের খাবার—দুগ্ধ—পেশ করতাম না। একদিনের ঘটনা : ঘাসাচ্ছাদিত চারণভূমির অনুসন্ধানে বের হয়ে বহু দূরে চলে গেলাম। আমার ফেরার পূর্বেই তারা ঘুমিয়ে পরেছিলেন। আমি তাদের জন্য—রাতের খাবার—দুগ্ধ দোহন করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম তারা ঘুমাচ্ছেন। তাদের আগে পরিবারের কাউকে- স্ত্রী-সন্তান বা মালিকানাধীন গোলাম-পরিচারকদের দুধ দেয়াকে অপছন্দ করলাম। আমি—পেয়ালা হাতে—তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, এতেই সকাল হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন এবং তাদের—রাতের খাবার—দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ ! আমি এ খেদমত যদি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে এ পাথরের মুসিবত হতে আমাদের মুক্তি দিন। তার এই দোয়ার ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।
নবী সা. বলেন—অপর ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহ ! আমার একজন চাচাতো বোন ছিল, সে ছিল আমার নিকট সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয়। আমি তাকে পাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমার থেকে দূরে সরে থাকল। পরে কোন এক সময় দুর্ভিক্ষ তাড়িত, অভাবগ্রস্ত হয়ে আমার কাছে ঋণের জন্য আসে, আমি তাকে একশত বিশ দিরহাম দেই, এ শর্তে যে—আমার এবং তার মাঝখানের বাধা দূর করে দেবে। সে তাতেও রাজি হল। আমি যখন তার উপর সক্ষম হলাম, সে বলল : অবৈধ ভাবে সতীচ্ছেদ করার অনুমতি দিচ্ছি না—তবে বৈধভাবে হলে ভিন্ন কথা। আমি তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম। অথচ তখনও সে আমার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। যে স্বর্ণ-মুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি, তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল—তবে এখনও তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হল না।
রাসূল বলেন—তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ ! আমি কয়েকজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম, অতঃপর তাদের পাওনা তাদের দিয়ে দেই। তবে এক ব্যক্তি ব্যতীত—সে নিজের মজুরি পরিত্যাগ করে চলে যায়। আমি তার মজুরি বার বার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। যার ফলে সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পায়। অনেক দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে, হে আব্দুল্লাহ, আমার মজুরি পরিশোধ কর। আমি তাকে বললাম, তুমি যা কিছু দেখছ—উট-গরু-বকরি-গোলাম—সব তোমার মজুরি। সে বলল : হে আব্দুল্লাহ ! তুমি আমার সাথে উপহাস করো না। আমি বললাম, উপহাস করছি না। অতঃপর সে সবগুলো গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল। তারা সকলে নিরাপদে হেঁটে বের হয়ে আসল। ঘটনাটি ইমাম বোখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। [বোখারি : ২১১১]
হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি—বিশিষ্ট সাহাবি আবু আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন উমর ইবনুল খাত্তাব বিন নোফাইল আল-কোরাইশী আল ‘আদাওয়ী আল-মাক্কী আল-মাদানী। তিনি ছিলেন বরণীয়, অনুসরণীয় একজন পথিকৃৎ ইমাম। শৈশবে ইসলাম গ্রহণ করেন। পিতার সাথে হিজরত করেন—তখনও তিনি সাবালক হননি। বয়স কম থাকার কারণে ওহুদের যুদ্ধে তাকে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। তার প্রথম যুদ্ধ খন্দক। আল-কোরআনে বর্ণিত গাছের নীচে যারা বায়আত গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। রাসূল সা. এবং খোলাফায়ে রাশেদীন হতে অনেক হাদিস বর্ণনা করেন তিনি। ৭৩ হি. সনে ইন্তেকাল করেন।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
অত্র হাদিসটি অনেক উপদেশ এবং বহু তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নে কতিপয় উলেখ করা হল :—
১. পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনায় অনেক উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এ সমস্ত ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করা এবং দৈনন্দিন জীবনে এ থেকে উপকৃত হওয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে পূর্ববর্তী রাসূল সা. ও অন্যান্য লোকের অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্যে একটাই যাতে পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদের থেকে উপকৃত হয়। উপদেশ গ্রহণ করে ও শিক্ষা অর্জন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَى وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ . ﴿يوسف : ১১১﴾
‘তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন।’ [ইউসুফ : ১১১]
২. ঘটনা মূলক বর্ণনা পদ্ধতি মূল বিষয় বস্ত্ত আত্মস্থ করতে শ্রোতা ও পাঠকগণকে খুব দ্রুত আকৃষ্ট করে। ফলে সহজেই গ্রহণ করে এবং তার উপর আমল করে। এ জন্য রাসূল সা. অনেক সময় সাহাবায়ে কেরামদের জন্য ঘটনা মূলক উদাহরণ পেশ করতেন। খতিব বা বক্তাগণ যখন মানুষের সামনে খুতবা পেশ করেন, তাদের উচিত সুযোগ মত এ পদ্ধতি অবলম্বন করা। কারণ, মানুষের বিচার-বুদ্ধি, প্রকৃতি ও স্বভাবের উপর এর সফল প্রভাব পরে।
৩. খাঁটি বিশ্বাস ও খালেস তওহিদ সবচেয়ে বড় আমল যা মানুষকে ইহকালীন মুসিবত ও পরকালীন শাস্তি হতে নাজাত প্রদান করে। ঘটনায় বর্ণিত তিন জন লোক স্বীয় দৃষ্টিতে পূর্ণ আন্তরিকতা (এখলাছ) সহ সম্পাদনকৃত সর্বোত্তম আমল-এর ওসিলা দিয়ে দোয়া করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। যার দ্রুত ফল তারা দুনিয়াতেই পেয়ে গেছে।
৪. আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত নেক আমলের বরাত দিয়ে দোয়া করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া অন্য কোন জিনিস যেমন—গাছ, কবর, মাজার ও পীর-আউলিয়াদের ওসিলা কিংবা বরাত দিয়ে দোয়া করা বা তাদের আহবান করা, শিরকে আকবর—যা দ্বীন থেকে বের করে দেয়। যার প্রমাণ আল্লাহ তাআলার বাণী—
إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ . ﴿الأعراف : ১৯৪﴾
‘আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা সবাই তোমাদের মতই বান্দা।’ [আল-আরাফ : ১৯৪]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :—
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ . وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ . ﴿سبا : ২২-২৩﴾
‘বলুন, তোমরা তাদেরকে আহবান কর, যাদের উপাস্য মনে করতে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত। তারা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের অণুপরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়, এতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহ তাআলার সহায়কও নয়। যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্য ব্যতীত আল্লাহ তাআলার কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।’ [সাবা : ২২-২৩]
৫. দোয়া সর্বোত্তম এবাদত। মোমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম মাধ্যম। কারণ দোয়াতে বান্দা আল্লাহ তালার প্রতি সর্বাঙ্গে ধাবিত হয়। এতে নিজের দারিদ্র্য, হীনতা, অপারগতা ও সামর্থহীনতাকে প্রকট ভাবে উপলব্ধি করে। উপরোক্ত তিন জন লোক—সব কিছু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে—দোয়ার মাধ্যমে এবং নেক আমলের ওসিলা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়েছে—যাতে তিনি তাদেরকে আক্রান্ত মুসিবত হতে মুক্ত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ . ﴿الغافر / المؤمن : ৬০﴾
‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ [আল-গাফের : ৬০]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :—
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ . ﴿البقرة : ১৮৬﴾
‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্ত্তত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস রাখা তাদের কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ [আল-বাক্বারা : ১৮৬]
৬. অত্র হাদিস দ্বারা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, আনুগত্য, তাদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়া, তাদের খেদমত আঞ্জাম দেয়া এবং তাদের জন্য পরিশ্রম ও কষ্ট করার ফজিলত প্রমাণিত হয়।
পিতা-মাতার কতিপয় উলেখযোগ্য অধিকার
ক. তাদের নির্দেশ পালন করা, যদি তাতে আল্লাহ তাআলার নাফরমানি না হয়। বৈষয়িক বিষয়গুলো পূর্ণ করা। শক্তি ও অর্থের মাধ্যমে সাহায্য করা। নরম ভাষায় সম্বোধন করা। বিরুদ্ধাচরণ না করা। তাদের জন্য দোয়া করা।
খ. তাদের জন্য বেশী করে দোয়া করা। তাদের পক্ষ হতে সদকা করা। তারা যে ওসিয়ত করেছেন, তা পূর্ণ করা। তাদের সাথে সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা। বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا . وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا . ﴿الإسراء : ২৩-২৪﴾
‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহু’ শব্দটিও বলো না, এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল : হে পালনকর্তা ! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ [আল-ইসরা : ২৩-২৪]
৭. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার দুনিয়ার সমস্যার সমাধান এবং আখেরাতের শাস্তি হতে নাজাতের ওসিলা। পিতা-মাতার আজ্ঞাবহ আলোচিত ব্যক্তির সদ্ব্যবহার তাদের সকলের উপর থেকে পাথর হটে যাওয়ার একটি কারণ ছিল। আবু দারদাহ রা. বর্ণনা করেন রাসূল সা. বলেছেন —
الوالد أوسط أبواب الجنة، فإن شئت فحافظ على الباب أو ضيع .
‘পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা, তোমার ইচ্ছা—এ দরজাকে সংরক্ষণ কর অথবা নষ্ট কর।’ [তিরমিজি : ১৯০০, আহমদ : ৬/৪৪৫]
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার যেমন জান্নাত লাভের ওসিলা ; তদ্রুপ তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের জন্য শাস্তি যোগ্য অপরাধ। রাসূল সা. বলেন—
ثلاثة لايدخلون الجنة : العاق لوالديه، والديوث و رجلة النساء .
‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না—পিতা-মাতার বিরুদ্ধাচরণকারী; অসতী স্ত্রীর স্বামী; পুরুষের আকৃতি ধারণকারী নারী।’ [নাসায়ি : ২৫১৫]
৮. ইসলাম বাহ্যিক পবিত্রতা, অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। এর উপর ভিত্তি করে দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক উত্তম প্রতিদানের হিসাব কষেছে। আমরা লক্ষ্য করি মেয়েটি যখন আলোচ্য লোকটিকে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, লোকটি সাথে সাথে অশীলতা হতে বিরত থাকে। যার কারণে তারা পাথর হতে মুক্তি পেয়েছে। এটা তাদের নগদ প্রতিদান। এছাড়া আল্লাহ তাআলার নিকট যা রক্ষিত আছে তা আরো উত্তম ও চিরস্থায়ী।
৯. প্রকৃত মোমিন অশীলতা ও গর্হিত বিষয় হতে দূরে থাকে। গুনাহ ও পাপ-পঙ্কিলতার নিকটবর্তী হয় না। সে এ নিষ্পাপ অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেষ্টা করে।
১০. আমানত এক গুরুত্বপূর্ণ মহান দায়িত্ব। এর মর্যাদা আল্লাহ তাআলা এবং মানুষের কাছে অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন ও পাহাড়ের উপর আমানত পেশ করে ছিলেন, তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে, শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু দুর্বল মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এখন সে এ আমানত যথাযথ আদায় করলে দুনিয়া-আখেরাতে এর প্রতিদান পাবে। অন্যথায় তার শাস্তির কারণ হবে।
বিশেষ কয়েকটি আমানত :
ক. আল্লাহ তাআলার তওহিদকে আঁকড়ে ধরা।
খ.সব ধরনের নেক কাজ সম্পাদন করা।
গ.ব্যাপকভাবে সকলের অধিকার বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে গচ্ছিত সম্পদ, জামানত ও অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশোধ করা।
১১.সব ধরনের নেক আমল দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক জটিল ও কঠিন সংকটের উত্তরণ সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا . وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ . ﴿الطلاق : ২-৩﴾
‘আর যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ [তালাক : ২-৩]
قال النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : وقال الآخَرُ : اللَّهُمَّ كَانَتْ لِيْ بِنْتُ عَمٍّ، كَانَتْ أحَبَ النَّاسِ إلَيَِّ، فَأرَدتُّهَا عَنْ نَفْسِهَا، فَامْتَنَعَتْ مِنِّيْ حَتَّى ألَّمَتْ بِهَا سَنَةٌ مِنَ السِّنِيْنَ، فَجَائتْنِيْ فَأعْطَيْتُهَا عِشْرِيْنَ وَمِائةَ دِيْنَارٍ عَلَى إن تُخَلِّيَ بَيْنِيْ وَبَيْنَ نَفْسِهَا، فَفَعَلَتْ، حَتَّى إذَا قَدَرْتُ عَلَيْهَا، قَالَتْ : لَا أحِلُّ لَكَ أنْ تَفُضَّ الْخَاتَمَ إلَّا بِحَقَّهِ، فَتَحَرَّجْتُ مِنَ الْوُقُوْعِ عَلَيْهَا، فَانْصَرَفْتُ عَنْهَا وَهِيَ أحَبُّ النَّاسِ إلَيَّ، وَتَرَكْتُ الذَّهَبَ الَّذِيِ أعْطَيْتُهَا، اللّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ، فَانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، غَيْرَ أنَّهُمْ لَا يَسْتَطِيْعُوْنَ الْخُرُوْجَ مِنْهَا .
قال النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : وقَالَ الثَّالِثُ : اللّهُمَّ إنِّيْ اسْتَأجَرْتُ أجَرَاءَ، فَأعْطَيْتُهُمْ أجْرَهُمْ غَيْرَ رَجُلٍ وَاحِدٍ تَرَكَ الَّذِيْ لَهُ وَذَهَبَ، فَثَمَّرْتُ أجْرَهُ حَتّى كَثُرَتْ مِنْهُ الْأمْوَالُ فَجَاءَنِيْ بَعْدَ حِيْنٍ فَقَالَ : يَا عَبْدَ اللهِ، أدِّ إلَيَّ أجْرِيْ، فَقُلْتُ لَهُ : كُلُّ مَا تَرَى مِنْ أجْرِكَ، مِنَ الْإبِلِ، وَالْبَقَرِ، وَالْغَنَمِ، وَالرَّقِيْقِ، فَقَالَ : يَا عَبْدَ اللهِ، لَاتَسْتَهْزِئْ بِيْ، فَقُلْتُ : إنِّيْ لَا أسْتَهْزِئُ بِكَ فَأخَذَهُ كُلَّهُ فَاسْتَاقَهْ فَلَمْ يَتْرُكْ مِنْهُ شَيْئًا، اللَّهُمَّ فَإنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فِيْهِ، فَانْفَرَجَتِ الصَّخْرَةُ، فَخَرَجُوْا يَمْشُوْنَ . رواه البخاري (2111)
আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের পূর্বের যুগে তিন ব্যক্তির একটি দল কোথাও যাত্রা করেছিল, যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহাতে তারা আগমন করে এবং তাতে প্রবেশ করে। অকস্মাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে এবং বন্ধ করে দেয় তাদের উপর গুহামুখ। এমন অসহায় অবস্থায় তারা বলাবলি করছিল, তোমাদেরকে এ পাথর হতে মুক্ত করতে পারবে—এমন কিছুই হয়ত নেই। তবে যদি তোমরা নিজ নিজ নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া কর—নাজাত পেতে পার।
তাদের একজন বলল : হে আল্লাহ ! আমার বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন, আমি তাদেরকে দেওয়ার পূর্বে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য—স্ত্রী-সন্তান ও গোলাম-পরিচারকদের কাউকে রাতের খাবার—দুগ্ধ—পেশ করতাম না। একদিনের ঘটনা : ঘাসাচ্ছাদিত চারণভূমির অনুসন্ধানে বের হয়ে বহু দূরে চলে গেলাম। আমার ফেরার পূর্বেই তারা ঘুমিয়ে পরেছিলেন। আমি তাদের জন্য—রাতের খাবার—দুগ্ধ দোহন করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম তারা ঘুমাচ্ছেন। তাদের আগে পরিবারের কাউকে- স্ত্রী-সন্তান বা মালিকানাধীন গোলাম-পরিচারকদের দুধ দেয়াকে অপছন্দ করলাম। আমি—পেয়ালা হাতে—তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, এতেই সকাল হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন এবং তাদের—রাতের খাবার—দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ ! আমি এ খেদমত যদি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে এ পাথরের মুসিবত হতে আমাদের মুক্তি দিন। তার এই দোয়ার ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।
নবী সা. বলেন—অপর ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহ ! আমার একজন চাচাতো বোন ছিল, সে ছিল আমার নিকট সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয়। আমি তাকে পাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমার থেকে দূরে সরে থাকল। পরে কোন এক সময় দুর্ভিক্ষ তাড়িত, অভাবগ্রস্ত হয়ে আমার কাছে ঋণের জন্য আসে, আমি তাকে একশত বিশ দিরহাম দেই, এ শর্তে যে—আমার এবং তার মাঝখানের বাধা দূর করে দেবে। সে তাতেও রাজি হল। আমি যখন তার উপর সক্ষম হলাম, সে বলল : অবৈধ ভাবে সতীচ্ছেদ করার অনুমতি দিচ্ছি না—তবে বৈধভাবে হলে ভিন্ন কথা। আমি তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম। অথচ তখনও সে আমার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। যে স্বর্ণ-মুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি, তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল—তবে এখনও তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হল না।
রাসূল বলেন—তৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ ! আমি কয়েকজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম, অতঃপর তাদের পাওনা তাদের দিয়ে দেই। তবে এক ব্যক্তি ব্যতীত—সে নিজের মজুরি পরিত্যাগ করে চলে যায়। আমি তার মজুরি বার বার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। যার ফলে সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পায়। অনেক দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে, হে আব্দুল্লাহ, আমার মজুরি পরিশোধ কর। আমি তাকে বললাম, তুমি যা কিছু দেখছ—উট-গরু-বকরি-গোলাম—সব তোমার মজুরি। সে বলল : হে আব্দুল্লাহ ! তুমি আমার সাথে উপহাস করো না। আমি বললাম, উপহাস করছি না। অতঃপর সে সবগুলো গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল। তারা সকলে নিরাপদে হেঁটে বের হয়ে আসল। ঘটনাটি ইমাম বোখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। [বোখারি : ২১১১]
হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি—বিশিষ্ট সাহাবি আবু আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন উমর ইবনুল খাত্তাব বিন নোফাইল আল-কোরাইশী আল ‘আদাওয়ী আল-মাক্কী আল-মাদানী। তিনি ছিলেন বরণীয়, অনুসরণীয় একজন পথিকৃৎ ইমাম। শৈশবে ইসলাম গ্রহণ করেন। পিতার সাথে হিজরত করেন—তখনও তিনি সাবালক হননি। বয়স কম থাকার কারণে ওহুদের যুদ্ধে তাকে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। তার প্রথম যুদ্ধ খন্দক। আল-কোরআনে বর্ণিত গাছের নীচে যারা বায়আত গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। রাসূল সা. এবং খোলাফায়ে রাশেদীন হতে অনেক হাদিস বর্ণনা করেন তিনি। ৭৩ হি. সনে ইন্তেকাল করেন।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
অত্র হাদিসটি অনেক উপদেশ এবং বহু তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নে কতিপয় উলেখ করা হল :—
১. পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনায় অনেক উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এ সমস্ত ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করা এবং দৈনন্দিন জীবনে এ থেকে উপকৃত হওয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে পূর্ববর্তী রাসূল সা. ও অন্যান্য লোকের অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্যে একটাই যাতে পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদের থেকে উপকৃত হয়। উপদেশ গ্রহণ করে ও শিক্ষা অর্জন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَى وَلَكِنْ تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ . ﴿يوسف : ১১১﴾
‘তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন।’ [ইউসুফ : ১১১]
২. ঘটনা মূলক বর্ণনা পদ্ধতি মূল বিষয় বস্ত্ত আত্মস্থ করতে শ্রোতা ও পাঠকগণকে খুব দ্রুত আকৃষ্ট করে। ফলে সহজেই গ্রহণ করে এবং তার উপর আমল করে। এ জন্য রাসূল সা. অনেক সময় সাহাবায়ে কেরামদের জন্য ঘটনা মূলক উদাহরণ পেশ করতেন। খতিব বা বক্তাগণ যখন মানুষের সামনে খুতবা পেশ করেন, তাদের উচিত সুযোগ মত এ পদ্ধতি অবলম্বন করা। কারণ, মানুষের বিচার-বুদ্ধি, প্রকৃতি ও স্বভাবের উপর এর সফল প্রভাব পরে।
৩. খাঁটি বিশ্বাস ও খালেস তওহিদ সবচেয়ে বড় আমল যা মানুষকে ইহকালীন মুসিবত ও পরকালীন শাস্তি হতে নাজাত প্রদান করে। ঘটনায় বর্ণিত তিন জন লোক স্বীয় দৃষ্টিতে পূর্ণ আন্তরিকতা (এখলাছ) সহ সম্পাদনকৃত সর্বোত্তম আমল-এর ওসিলা দিয়ে দোয়া করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। যার দ্রুত ফল তারা দুনিয়াতেই পেয়ে গেছে।
৪. আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত নেক আমলের বরাত দিয়ে দোয়া করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া অন্য কোন জিনিস যেমন—গাছ, কবর, মাজার ও পীর-আউলিয়াদের ওসিলা কিংবা বরাত দিয়ে দোয়া করা বা তাদের আহবান করা, শিরকে আকবর—যা দ্বীন থেকে বের করে দেয়। যার প্রমাণ আল্লাহ তাআলার বাণী—
إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ . ﴿الأعراف : ১৯৪﴾
‘আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা সবাই তোমাদের মতই বান্দা।’ [আল-আরাফ : ১৯৪]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :—
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ . وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ . ﴿سبا : ২২-২৩﴾
‘বলুন, তোমরা তাদেরকে আহবান কর, যাদের উপাস্য মনে করতে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত। তারা নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের অণুপরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়, এতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহ তাআলার সহায়কও নয়। যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্য ব্যতীত আল্লাহ তাআলার কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।’ [সাবা : ২২-২৩]
৫. দোয়া সর্বোত্তম এবাদত। মোমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম মাধ্যম। কারণ দোয়াতে বান্দা আল্লাহ তালার প্রতি সর্বাঙ্গে ধাবিত হয়। এতে নিজের দারিদ্র্য, হীনতা, অপারগতা ও সামর্থহীনতাকে প্রকট ভাবে উপলব্ধি করে। উপরোক্ত তিন জন লোক—সব কিছু হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে—দোয়ার মাধ্যমে এবং নেক আমলের ওসিলা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়েছে—যাতে তিনি তাদেরকে আক্রান্ত মুসিবত হতে মুক্ত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ . ﴿الغافر / المؤمن : ৬০﴾
‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ [আল-গাফের : ৬০]
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন :—
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ . ﴿البقرة : ১৮৬﴾
‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্ত্তত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস রাখা তাদের কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ [আল-বাক্বারা : ১৮৬]
৬. অত্র হাদিস দ্বারা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, আনুগত্য, তাদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়া, তাদের খেদমত আঞ্জাম দেয়া এবং তাদের জন্য পরিশ্রম ও কষ্ট করার ফজিলত প্রমাণিত হয়।
পিতা-মাতার কতিপয় উলেখযোগ্য অধিকার
ক. তাদের নির্দেশ পালন করা, যদি তাতে আল্লাহ তাআলার নাফরমানি না হয়। বৈষয়িক বিষয়গুলো পূর্ণ করা। শক্তি ও অর্থের মাধ্যমে সাহায্য করা। নরম ভাষায় সম্বোধন করা। বিরুদ্ধাচরণ না করা। তাদের জন্য দোয়া করা।
খ. তাদের জন্য বেশী করে দোয়া করা। তাদের পক্ষ হতে সদকা করা। তারা যে ওসিয়ত করেছেন, তা পূর্ণ করা। তাদের সাথে সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা। বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا . وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا . ﴿الإسراء : ২৩-২৪﴾
‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহু’ শব্দটিও বলো না, এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল : হে পালনকর্তা ! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ [আল-ইসরা : ২৩-২৪]
৭. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার দুনিয়ার সমস্যার সমাধান এবং আখেরাতের শাস্তি হতে নাজাতের ওসিলা। পিতা-মাতার আজ্ঞাবহ আলোচিত ব্যক্তির সদ্ব্যবহার তাদের সকলের উপর থেকে পাথর হটে যাওয়ার একটি কারণ ছিল। আবু দারদাহ রা. বর্ণনা করেন রাসূল সা. বলেছেন —
الوالد أوسط أبواب الجنة، فإن شئت فحافظ على الباب أو ضيع .
‘পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা, তোমার ইচ্ছা—এ দরজাকে সংরক্ষণ কর অথবা নষ্ট কর।’ [তিরমিজি : ১৯০০, আহমদ : ৬/৪৪৫]
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার যেমন জান্নাত লাভের ওসিলা ; তদ্রুপ তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের জন্য শাস্তি যোগ্য অপরাধ। রাসূল সা. বলেন—
ثلاثة لايدخلون الجنة : العاق لوالديه، والديوث و رجلة النساء .
‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না—পিতা-মাতার বিরুদ্ধাচরণকারী; অসতী স্ত্রীর স্বামী; পুরুষের আকৃতি ধারণকারী নারী।’ [নাসায়ি : ২৫১৫]
৮. ইসলাম বাহ্যিক পবিত্রতা, অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। এর উপর ভিত্তি করে দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক উত্তম প্রতিদানের হিসাব কষেছে। আমরা লক্ষ্য করি মেয়েটি যখন আলোচ্য লোকটিকে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, লোকটি সাথে সাথে অশীলতা হতে বিরত থাকে। যার কারণে তারা পাথর হতে মুক্তি পেয়েছে। এটা তাদের নগদ প্রতিদান। এছাড়া আল্লাহ তাআলার নিকট যা রক্ষিত আছে তা আরো উত্তম ও চিরস্থায়ী।
৯. প্রকৃত মোমিন অশীলতা ও গর্হিত বিষয় হতে দূরে থাকে। গুনাহ ও পাপ-পঙ্কিলতার নিকটবর্তী হয় না। সে এ নিষ্পাপ অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেষ্টা করে।
১০. আমানত এক গুরুত্বপূর্ণ মহান দায়িত্ব। এর মর্যাদা আল্লাহ তাআলা এবং মানুষের কাছে অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন ও পাহাড়ের উপর আমানত পেশ করে ছিলেন, তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে, শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু দুর্বল মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এখন সে এ আমানত যথাযথ আদায় করলে দুনিয়া-আখেরাতে এর প্রতিদান পাবে। অন্যথায় তার শাস্তির কারণ হবে।
বিশেষ কয়েকটি আমানত :
ক. আল্লাহ তাআলার তওহিদকে আঁকড়ে ধরা।
খ.সব ধরনের নেক কাজ সম্পাদন করা।
গ.ব্যাপকভাবে সকলের অধিকার বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে গচ্ছিত সম্পদ, জামানত ও অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশোধ করা।
১১.সব ধরনের নেক আমল দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক জটিল ও কঠিন সংকটের উত্তরণ সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا . وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ . ﴿الطلاق : ২-৩﴾
‘আর যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ [তালাক : ২-৩]
عَنْ أبِيْ بَكْرَةَ-َ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : مَامِنْ ذَنْبٍ أجْدَرُ أن يُّعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوْبَةَ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُهُ لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيْعَةِ الرِّحْمِ . رواه الترمذي وقال : حسن صحيح .
‘সাহাবি আবু বাকরাহ রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরণ ছাড়া এমন কোনো গুনাহ নেই যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখেরাতে জমা করে রাখার সাথে সাথে দুনিয়াতেও নগদ প্রদান করেন।’ (ইমাম তিরমিজি রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদিসটি হাসান, সহিহ।) [হাদিসটি তিরমিজি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন ‘হাসান ও সহিহ’]
হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি : বিশিষ্ট সাহাবি আবু বাকরাহ নুফাই ইবনে আল হারেস, রাসূল সা.-এর মুক্ত গোলাম। অষ্টম হিজরিতে হুনাইনের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। আবু বাকরাহসহ হাওয়াযেন ও সাক্বীফের কয়েক জন যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করে তায়েফের দুর্গে আশ্রয় নেয়। রাসূল সা. তাদের পিছু নেন, তায়েফের দুর্গ ঘেরাও করেন। বিভিন্ন মতানুসারে চলিশ দিন, বিশ দিনের কিছু বেশি, তবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী দশ দিনের কিছু বেশি সময় ঘেরাও করে রাখেন। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। অত:পর রাসূল সা. ঘোষণা দেন, যে দুর্গ হতে বের হয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে—সে মুক্ত। এ ঘোষণা শুনে বেশ কয়েকজন লোক পালিয়ে চলে আসে। যাদের সংখ্যা দশের বেশি ছিল। আবু বাকরাহ পানি উত্তোলনকারী গোলাকার চরকি দ্বারা দেয়ালে চড়েন—যার আরবি নাম বাকরাহ—দেয়াল টপকে রাসূল সা.-এর কাছে চলে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। সেখান থেকে রাসূল সা. তার নামকরণ করেন ‘আবু বাকরাহ’। তিনি রাসূল সা.-কে বলেন ‘আমি গোলাম’। রাসূল সা. তাকে মুক্ত করে দেন। তিনি অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন ফিক্বাহবিদ অন্যতম একজন সাহাবি। মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের খেলাফত-যুগে বসরাতে ইন্তেকাল করেন। হাসান বলেন, ইমরান বিন হুসাইন ও আবু বাকরাহ হতে উত্তম কোন সাহাবি বসরাতে বসতি স্থাপন করেননি।
প্রয়োজনীয় শব্দের অর্থ :—
صلة الرحم : অর্থাৎ, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা। অর্থাৎ নিকট আত্মীয়, যেমন—চাচা, মামা, এবং তাদের সন্তানাদির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, যোগাযোগ রক্ষা করা, সালাম আদান প্রদান করা।
قطيعة الرحم : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদ করা। অর্থাৎ তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখা। যোগাযোগ বা যাওয়া আসা না করা। সালাম আদান-প্রদান না করা।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা :
১.জুলুম বা অত্যাচারের বাস্তবরূপ ঘোর অন্ধকার। অত্যাচারী ব্যক্তি দুনিয়াতে নগদ শাস্তির উপযুক্ত। অনেকাংশে মৃত্যুর পূর্বে সে এর ভুক্তভোগী হয়ে যায়। কোরআনের অনেক আয়াত, রাসূল সা.-এর বহু হাদিসে জুলুম-অত্যাচারের ব্যাপারে কঠোর বার্তা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ . ﴿الغافر / المؤمن : ১৮﴾
‘জালিমদের কোন বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই।’ [আল-গাফের : ১৮]
অন্যত্র বলেন :—
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ . ﴿إبراهيم : ৪২﴾
‘জালেমরা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাকে কখনো বে-খবর মনে করো না।’ [ইবরাহিম : ৪২]
অন্যত্র বলেন :—
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا . ﴿الفرقان : ২৭﴾
‘জালেম সে দিন আপন হস্ত-দ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস ! আমি যদি রাসূল-এর সাথে একই পথ অবলম্বন করতাম।’ [আল-ফোরকান : ২৭]
আবু মূসা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন—
إن الله ليملي للظالم . فإذا أخذه لم يفلت . رواه البخاري ومسلم .
‘আল্লাহ তাআলা জালিমদের অবকাশ দেন ; কিন্তু যখন পাকড়াও করেন, তখন আর রেহাই দেন না। অত:পর রাসূল সা. আল কোরআনের নিম্ন আয়াতটি পাঠ করেন—
وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ . ﴿هود : ১০২﴾
‘আর তোমার পরওয়ারদেগার যখন কোন পাপপূর্ণ জনপদকে পাকড়াও করেন, তখন এমনিভাবেই ধরে থাকেন, নিশ্চয় তার পাকড়াও খুবই মারাত্মক, বড়ই কঠোর।’ [হুদ : ১০২]
২. জুলুমের অনেক প্রকার রয়েছে
ক. সবচে’ বড় জুলুম—আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করা। আল্লাহ তাআলার ভাষায় লোকমানের উপদেশ :—
يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ . ﴿لقمان : ১৩﴾
‘হে বৎস ! আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করা মহা অন্যায়।’ [লোকমান : ১৩]
খ. পরিবার ও সন্তানদের প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা না দেয়া জুলুম।
গ. সাধারণ মানুষের উপর জুলুম করা। যেমন—অত্যাচার করা, তাদের অধিকার নষ্ট করা, তাদের ইজ্জত-সম্মানে আঘাত করা।
ঘ. জনকল্যাণ মূলক কাজে অবহেলা করা জুলুম। যেমন—শর্তানুসারে কাজের চাহিদা পুরণ না করা ; অথবা জনকল্যাণমূলক কাজ বিলম্ব করা।
ঙ. কর্মচারী ও মজুরদের উপর জুলুম করা। তাদের প্রাপ্য কম দেয়া। অথবা তাদের সাধ্যের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়া।
৩. আল্লাহ তাআলার দ্বীনে জরায়ু তথা রক্তের সম্পর্কের অনেক গুরুত্ব রয়েছে, যা বজায় রাখা ওয়াজিব, ছিন্ন করা হারাম। যার প্রমাণ রাসূল সা. এর হাদিস—
إن الله خلق الخلق , حتى إذا فرغ قامت الرحم فقالت : هذا مقام العائذ بك من القطيعة، قال : نعم، أما ترضين أن أصل من وصلك، وأقطع من قطعك، قالت : بلى، قال : فذلك لك . رواه مسلم (৪৬৩৪)
‘আল্লাহ তাআলা সমস্ত সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন। যখন শেষ পর্যায়ে পোঁছেন, জরায়ুর সম্পর্ক তখন উঠে দাঁড়াল, এবং বলল : এ জায়গা তোমার নিকট সম্পর্ক ছেদন হতে পানাহ চাওয়ার। আল্লাহ তাআলা বলেন, হ্যাঁ। তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নয় যে তোমাকে রক্ষা করবে আমি তাকে রক্ষা করব, যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তাকে ছিন্ন করব ? সে বলল, অবশ্যই। আল্লাহ তাআলা বলেন, এটাই তোমাকে প্রদান করা হল। অতঃপর রাসূল সা. বলেন তোমরা প্রমাণ চাইলে নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত কর :—
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ . أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ . ﴿محمد : ২২-২৩﴾
‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত: তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করেন। অতঃপর তাদের বোধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন।’ [মোহাম্মদ : ২২-২৩]
৪. জরায়ুর সম্পর্ক বা রক্তের বন্ধন অক্ষত রাখার কিছু উপায় :
তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, খোঁজ খবর নেয়া, নিকট আত্মীয়দের উপর আস্থা রাখা, নরম ভাষায় সম্বোধন করা। তদ্রুপ উপযুক্ত উপহার সামগ্রী পেশ করা, ভাল কিছু অর্জিত হলে অভিবাদন জানানো, গরিব-ঋণগ্রস্তকে ঋণ আদায়ে সাহায্য করা, দান-সদকা করা, প্রয়োজন পুর্ণ করা, সব সময় কল্যাণ ও সফলতার জন্য দোয়া করা—ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন থাকে।
৫. জরায়ুর সম্পর্ক অটুট রাখলে বয়স বাড়ে, বরকতময় হয়। সম্পদ বর্ধিত হয় এবং তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। অধিকন্তু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের ভিতর গুনাহ মোচন হতে থাকে এবং নেকি বাড়তে থাকে। আনাস রা. হতে ইমাম বোখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন—
من أحب أن يبسط له في رزقه، وينسأ له في أثره فليصل رحمه . رواه البخاري ( ৫৫২৭)
‘যে ব্যক্তি রিজিক প্রশস্ত ও হায়াত বাড়াতে চায়, সে যেন আত্মীয়তার (জরায়ুর) সম্পর্ক রক্ষা করে।’ [বোখারি : ৫৫২৭]
৬. প্রকৃত মুসলমান নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপরের জন্যও তা পছন্দ করে। তাদের অধিকার আদায় করে। তাদের উপর জুলুম করে না, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে বা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাদের সাথে অহমিকা প্রদর্শন করে না, ধৃষ্টতা দেখায় না।
৭. আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য অপরাধের বিপরীতে যে শাস্তি নির্ধারণ করেছেন, তা কখনো কখনো দুনিয়াতে নগদ প্রদান করেন। আবার কখনো পরকালের জন্য জমা রাখেন। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। গোনাহের শাস্তি দুনিয়াতে না দেখে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানি ও অবাধ্যতার সামান্যতম জিনিসকেও গৌণ মনে করবে না।
‘সাহাবি আবু বাকরাহ রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকরণ ছাড়া এমন কোনো গুনাহ নেই যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখেরাতে জমা করে রাখার সাথে সাথে দুনিয়াতেও নগদ প্রদান করেন।’ (ইমাম তিরমিজি রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদিসটি হাসান, সহিহ।) [হাদিসটি তিরমিজি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন ‘হাসান ও সহিহ’]
হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি : বিশিষ্ট সাহাবি আবু বাকরাহ নুফাই ইবনে আল হারেস, রাসূল সা.-এর মুক্ত গোলাম। অষ্টম হিজরিতে হুনাইনের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। আবু বাকরাহসহ হাওয়াযেন ও সাক্বীফের কয়েক জন যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করে তায়েফের দুর্গে আশ্রয় নেয়। রাসূল সা. তাদের পিছু নেন, তায়েফের দুর্গ ঘেরাও করেন। বিভিন্ন মতানুসারে চলিশ দিন, বিশ দিনের কিছু বেশি, তবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী দশ দিনের কিছু বেশি সময় ঘেরাও করে রাখেন। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই চলে। অত:পর রাসূল সা. ঘোষণা দেন, যে দুর্গ হতে বের হয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে—সে মুক্ত। এ ঘোষণা শুনে বেশ কয়েকজন লোক পালিয়ে চলে আসে। যাদের সংখ্যা দশের বেশি ছিল। আবু বাকরাহ পানি উত্তোলনকারী গোলাকার চরকি দ্বারা দেয়ালে চড়েন—যার আরবি নাম বাকরাহ—দেয়াল টপকে রাসূল সা.-এর কাছে চলে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। সেখান থেকে রাসূল সা. তার নামকরণ করেন ‘আবু বাকরাহ’। তিনি রাসূল সা.-কে বলেন ‘আমি গোলাম’। রাসূল সা. তাকে মুক্ত করে দেন। তিনি অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন ফিক্বাহবিদ অন্যতম একজন সাহাবি। মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের খেলাফত-যুগে বসরাতে ইন্তেকাল করেন। হাসান বলেন, ইমরান বিন হুসাইন ও আবু বাকরাহ হতে উত্তম কোন সাহাবি বসরাতে বসতি স্থাপন করেননি।
প্রয়োজনীয় শব্দের অর্থ :—
صلة الرحم : অর্থাৎ, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা। অর্থাৎ নিকট আত্মীয়, যেমন—চাচা, মামা, এবং তাদের সন্তানাদির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, যোগাযোগ রক্ষা করা, সালাম আদান প্রদান করা।
قطيعة الرحم : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদ করা। অর্থাৎ তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখা। যোগাযোগ বা যাওয়া আসা না করা। সালাম আদান-প্রদান না করা।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা :
১.জুলুম বা অত্যাচারের বাস্তবরূপ ঘোর অন্ধকার। অত্যাচারী ব্যক্তি দুনিয়াতে নগদ শাস্তির উপযুক্ত। অনেকাংশে মৃত্যুর পূর্বে সে এর ভুক্তভোগী হয়ে যায়। কোরআনের অনেক আয়াত, রাসূল সা.-এর বহু হাদিসে জুলুম-অত্যাচারের ব্যাপারে কঠোর বার্তা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ . ﴿الغافر / المؤمن : ১৮﴾
‘জালিমদের কোন বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই।’ [আল-গাফের : ১৮]
অন্যত্র বলেন :—
وَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ غَافِلًا عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ . ﴿إبراهيم : ৪২﴾
‘জালেমরা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাকে কখনো বে-খবর মনে করো না।’ [ইবরাহিম : ৪২]
অন্যত্র বলেন :—
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا . ﴿الفرقان : ২৭﴾
‘জালেম সে দিন আপন হস্ত-দ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস ! আমি যদি রাসূল-এর সাথে একই পথ অবলম্বন করতাম।’ [আল-ফোরকান : ২৭]
আবু মূসা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন—
إن الله ليملي للظالم . فإذا أخذه لم يفلت . رواه البخاري ومسلم .
‘আল্লাহ তাআলা জালিমদের অবকাশ দেন ; কিন্তু যখন পাকড়াও করেন, তখন আর রেহাই দেন না। অত:পর রাসূল সা. আল কোরআনের নিম্ন আয়াতটি পাঠ করেন—
وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ . ﴿هود : ১০২﴾
‘আর তোমার পরওয়ারদেগার যখন কোন পাপপূর্ণ জনপদকে পাকড়াও করেন, তখন এমনিভাবেই ধরে থাকেন, নিশ্চয় তার পাকড়াও খুবই মারাত্মক, বড়ই কঠোর।’ [হুদ : ১০২]
২. জুলুমের অনেক প্রকার রয়েছে
ক. সবচে’ বড় জুলুম—আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করা। আল্লাহ তাআলার ভাষায় লোকমানের উপদেশ :—
يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ . ﴿لقمان : ১৩﴾
‘হে বৎস ! আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার সাথে শরিক করা মহা অন্যায়।’ [লোকমান : ১৩]
খ. পরিবার ও সন্তানদের প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা না দেয়া জুলুম।
গ. সাধারণ মানুষের উপর জুলুম করা। যেমন—অত্যাচার করা, তাদের অধিকার নষ্ট করা, তাদের ইজ্জত-সম্মানে আঘাত করা।
ঘ. জনকল্যাণ মূলক কাজে অবহেলা করা জুলুম। যেমন—শর্তানুসারে কাজের চাহিদা পুরণ না করা ; অথবা জনকল্যাণমূলক কাজ বিলম্ব করা।
ঙ. কর্মচারী ও মজুরদের উপর জুলুম করা। তাদের প্রাপ্য কম দেয়া। অথবা তাদের সাধ্যের উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয়া।
৩. আল্লাহ তাআলার দ্বীনে জরায়ু তথা রক্তের সম্পর্কের অনেক গুরুত্ব রয়েছে, যা বজায় রাখা ওয়াজিব, ছিন্ন করা হারাম। যার প্রমাণ রাসূল সা. এর হাদিস—
إن الله خلق الخلق , حتى إذا فرغ قامت الرحم فقالت : هذا مقام العائذ بك من القطيعة، قال : نعم، أما ترضين أن أصل من وصلك، وأقطع من قطعك، قالت : بلى، قال : فذلك لك . رواه مسلم (৪৬৩৪)
‘আল্লাহ তাআলা সমস্ত সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন। যখন শেষ পর্যায়ে পোঁছেন, জরায়ুর সম্পর্ক তখন উঠে দাঁড়াল, এবং বলল : এ জায়গা তোমার নিকট সম্পর্ক ছেদন হতে পানাহ চাওয়ার। আল্লাহ তাআলা বলেন, হ্যাঁ। তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নয় যে তোমাকে রক্ষা করবে আমি তাকে রক্ষা করব, যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তাকে ছিন্ন করব ? সে বলল, অবশ্যই। আল্লাহ তাআলা বলেন, এটাই তোমাকে প্রদান করা হল। অতঃপর রাসূল সা. বলেন তোমরা প্রমাণ চাইলে নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত কর :—
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ . أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ . ﴿محمد : ২২-২৩﴾
‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত: তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহ তাআলা অভিসম্পাত করেন। অতঃপর তাদের বোধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন।’ [মোহাম্মদ : ২২-২৩]
৪. জরায়ুর সম্পর্ক বা রক্তের বন্ধন অক্ষত রাখার কিছু উপায় :
তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, খোঁজ খবর নেয়া, নিকট আত্মীয়দের উপর আস্থা রাখা, নরম ভাষায় সম্বোধন করা। তদ্রুপ উপযুক্ত উপহার সামগ্রী পেশ করা, ভাল কিছু অর্জিত হলে অভিবাদন জানানো, গরিব-ঋণগ্রস্তকে ঋণ আদায়ে সাহায্য করা, দান-সদকা করা, প্রয়োজন পুর্ণ করা, সব সময় কল্যাণ ও সফলতার জন্য দোয়া করা—ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন থাকে।
৫. জরায়ুর সম্পর্ক অটুট রাখলে বয়স বাড়ে, বরকতময় হয়। সম্পদ বর্ধিত হয় এবং তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। অধিকন্তু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের ভিতর গুনাহ মোচন হতে থাকে এবং নেকি বাড়তে থাকে। আনাস রা. হতে ইমাম বোখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন—
من أحب أن يبسط له في رزقه، وينسأ له في أثره فليصل رحمه . رواه البخاري ( ৫৫২৭)
‘যে ব্যক্তি রিজিক প্রশস্ত ও হায়াত বাড়াতে চায়, সে যেন আত্মীয়তার (জরায়ুর) সম্পর্ক রক্ষা করে।’ [বোখারি : ৫৫২৭]
৬. প্রকৃত মুসলমান নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপরের জন্যও তা পছন্দ করে। তাদের অধিকার আদায় করে। তাদের উপর জুলুম করে না, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে বা ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাদের সাথে অহমিকা প্রদর্শন করে না, ধৃষ্টতা দেখায় না।
৭. আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য অপরাধের বিপরীতে যে শাস্তি নির্ধারণ করেছেন, তা কখনো কখনো দুনিয়াতে নগদ প্রদান করেন। আবার কখনো পরকালের জন্য জমা রাখেন। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। গোনাহের শাস্তি দুনিয়াতে না দেখে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানি ও অবাধ্যতার সামান্যতম জিনিসকেও গৌণ মনে করবে না।
عَنْ أبِيْ هُرَيْرَةَ- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : كُلُّ سُلامى مِنَ النَّاسِ عَلَيْهِ صَدَقَةٌ، كُلُّ يَوْمٍ تَطْلُعُ فِيْهِ الشَّمْسُ تَعْدِلُ بَيْنَ الْاِثْنَيْنِ صَدَقَةٌ، وَتُعِيْنُ الرَّجُلَ فِيْ دَابَّتِهِ فَتَحْمِلُهُ عَلَيْهَا أوْ تَرْفَعُ لَهُ عَلَيْهِا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ، وَالْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ، وَكُلُّ خُطْوَةٍ تَمْشِيْهَا إلَى الصَّلَاةِ صَدَقَةٌ، وَتُمِيْطُ الْأذى عَنِ الطَّرِيْقِ صَدَقَةٌ . رواه البخاري (২৫০৮) ومسلم (১৬৭৭)
‘আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন—মানব জাতির প্রতিটি হাড়ের মোকাবেলায় সদকা ধার্য করা আছে। প্রতিদিন, যাতে সূর্য উদিত হয়, দুজনের মাঝে সুষ্ঠু মীমাংসা করা সদকা। যানবাহনে আরোহণকালীন কাউকে সাহায্য করা সদকা—যেমন কাউকে যানবাহনে উঠিয়ে দেয়া বা কোন জিনিস যানবাহনে উঠাতে সাহায্য করা। কল্যাণ মূলক কথা বলা সদকা। নামাজে আসতে প্রতিটি কদমে কদমে সদকা। রাস্তা হতে কষ্টদায়ক কোনো জিনিস হটানো সদকা।’ [বোখারি : ২৫০৮, মুসলিম : ১৬৭৭]
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
১. আমাদের উপর রয়েছে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য ও বে-হিসাব নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা আমাদের অস্তিত্ব দান করেছেন। সুচারুরূপে সুবিন্যস্ত করেছেন আমাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সৃষ্টি করেছেন আমাদের সুন্দরতম আকৃতিতে—এগুলো সন্দেহ নেই, এক বড় নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ . ﴿النحل : ৫৩﴾
‘যে সমস্ত নেয়ামত তোমাদের নিকট আছে সব আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে।’ [নাহল : ৫৩]
অন্যত্র বলেন—
يَا أَيُّهَا الْإِنْسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ . الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ . فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ . ﴿الإنفطار : ৬-৮﴾
‘হে মানব ! কীসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করল ? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন, এবং তিনিই তোমাকে তার ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করেছেন’। [আল-ইনফেতার : ৫-৮]
২. রাসূল সা. আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন—অস্থিসমূহের সুবিন্যস্ততা এবং ত্রুটি মুক্ত হওয়া আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। তাই প্রতি হাড়ের জন্য আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া স্বরূপ মানুষের সদকা করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন—
قُلْ هُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ . ﴿الملك : ২৩﴾
‘বলুন, তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ [আল-মুলক : ২৩]
আরো বলেন—
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ . ﴿النحل : ৭৮﴾
‘আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ করেছেন। তোমরা কিছুই অবগত ছিলে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু অন্তর প্রদান করেছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ [আন-নাহাল : ৭৮]
৩. অত্র হাদিসে রাসূল সা. বর্ণনা করেছেন—বনী আদমের কর্তব্য সদকার মাধ্যমে স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনিময়ে প্রত্যহ আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা। হাদিসে বর্ণিত উদাহরণসমূহের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন।
৪. ওলামায়ে কেরাম বলেছেন—আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের দুটি স্তর রয়েছে।
ক. ওয়াজিব তথা অবশ্য কর্তব্য শুকরিয়া। অর্থাৎ ওয়াজিব আমলগুলো পালন করা, হারাম হতে বিরত থাকা।
খ. মোস্তাহাব তথা ঐচ্ছিক শুকরিয়া। অর্থাৎ ফরজ আদায় করে, হারাম হতে বিরত থাকার পর নফল এবাদত করা।
৫. মানুষের মাঝে মীমাংসা করা, ভালোবাসা, মহববত ও সুসম্পর্ক স্থাপন করা, পরস্পর বিরোধিতা, হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা—এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় ও অধিক ছাওয়াব অর্জিত হয়।
৬. মানুষের সেবা করা এবং তাদের প্রয়োজন পুর্ণ করা, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা করা, ঋণগ্রস্ত অভাবী ব্যক্তিদের সুযোগ দেয়া। এ ধরনের আরো খেদমত আঞ্জাম দেয়া যার দ্বারা অপর ব্যক্তি উপকৃত হয়—অধিক সওয়াবের এবং উত্তম আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاةِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا . ﴿النساء : ১১৪﴾
‘তাদের অধিকাংশ সলা-পরামর্শ ভাল নয়। কিন্তু যে সলা-পরামর্শ দান খয়রাত করতে কিংবা সৎকাজ করতে, কিংবা দুজনের মাঝে সন্ধি-স্থাপন কল্পে করা হয়, তা স্বতন্ত্র। যে এ কাজ করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে, আমি তাকে বিরাট সওয়াব দান করব।’ [আন নিসা : ১১৪।]
আল্লাহ তাআলা অনেক অনেক নেয়ামত আমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তার মাঝে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যতম ; যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন জৈবিক চাহিদা পূরণ করি। তবে এর ভিতর একমাত্র জিহবা কথা বলতে সক্ষম, আমরা যদি একে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালনা করি—সন্দেহ নেই বিপুল সওয়াব পাব। রাসূল সা. হাদিসে বলেছেন, الكلمة الطيبة صدقة . ‘ভাল কথা সদকা।’ যেমন—ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়া, কোরআন পড়ানো, আল্লাহ তাআলার দিকে আহবান করা, সৎকাজের আদেশ প্রদান, অসৎ কাজ হতে বাধা প্রদান, হারানো ব্যক্তিকে পথ দেখানো, সালাম দেয়া এবং সালামের উত্তর দেয়া, হাঁচি দাতার الحمد لله -এর উত্তরে يرحمك الله বলা—ইত্যাদি।
৮. নামাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাশীল ও শরিয়তের ভিতর উঁচুমানের একটি এবাদত—বিধায় নামাজি ব্যক্তি নামাজের জন্যে যে পথে চলে তার প্রতিটি কদমে কদমে সওয়াব দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রতি কদমে সে সদকার সওয়াব লাভ করে।
৯. মুসলমান নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে। সে তার ভাইকে খুশি করতে চেষ্টা করে, তার অবর্তমানে শারীরিক বা মানসিক পীড়াদায়ক জিনিস প্রতিহত করে। যেমন—তার রাস্তা হতে পাথর, কাচ, ময়লা, পেরেক ও কলার ছিলকা জাতীয় কষ্টদায়ক জিনিস দূর করে। তদুপরি আল্লাহ তাআলার রাসূল সা. এ কাজকে ঈমানের শাখার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন—
الإيمان بضع وسبعون شعبة، أعلاها قول لاإله إلا الله، وأدناها إماطة الأذى عن الطريق . رواه مسلم ( ৫১)
‘ঈমানের সত্তুরের উপরে শাখা রয়েছে, সর্বোত্তম শাখা হল لاإله إلا الله -এর বাণী। সর্ব নিম্ন শাখা হল إماطة الأذى عن الطريق -অর্থাৎ রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্ত্ত হটানো।’
১০. অত্র হাদিসে বর্ণিত প্রতিটি আমলকে খুব গুরুত্ব দেয়া, আল্লাহ তাআলার শুকরিয়ার জন্য এ গুলোকে সম্পাদন করা—বলা বাহুল্য, একান্ত জরুরি। এ হাদিসের অন্য বর্ণনায় আরো কিছু নেক আমলের কথা উলেখ রয়েছে। যেমন— ذكر الله আল্লাহর জিকির। الحمد لله আল-হামদুলিল্লাহ। سبحان الله সুবহানাল্লাহ। لا إله إلا الله লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। الله أكبر আল্লাহু আকবার—ইত্যাদি তাসবীহ পাঠ করা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ-কাজের নিষেধ করা ; অভাবী দুঃখ-ভারাক্রান্তদের সাহায্য করা ; দুর্বলদের উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা করা ; অন্ধদের রাস্তা দেখানো—ইত্যাদি।
১১. সহি মুসলিম এর বর্ণনায় অত্র হাদিসের শেষে আছে—
عن أبي ذر- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ - : ويجزي من ذلك كله ركعتان يركعهما من الضحى . رواه مسلم (১১৮১)
‘সাহাবি আবু যর রা. বলেন. প্রথম প্রহরের দুই রাকাত নামাজ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুকরিয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।’ [মুসলিম : ১১৮১।]
এ হাদিস সাধারণভাবে সব নামাজ এবং বিশেষ করে প্রথম প্রহরের নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণ করে। ওলামায়ে কেরাম বলেছেন দুই রাকাত নামাজ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুকরিয়ার জন্য যথেষ্ট হবে, কারণ নামাজের ভিতর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ তাআলার এবাদত ও তার আনুগত্যে ব্যবহার হয়। সুতরাং দুই রাকাত নামাজ প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনিময়ে সদকার জন্য যথেষ্ট হবে।
‘আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন—মানব জাতির প্রতিটি হাড়ের মোকাবেলায় সদকা ধার্য করা আছে। প্রতিদিন, যাতে সূর্য উদিত হয়, দুজনের মাঝে সুষ্ঠু মীমাংসা করা সদকা। যানবাহনে আরোহণকালীন কাউকে সাহায্য করা সদকা—যেমন কাউকে যানবাহনে উঠিয়ে দেয়া বা কোন জিনিস যানবাহনে উঠাতে সাহায্য করা। কল্যাণ মূলক কথা বলা সদকা। নামাজে আসতে প্রতিটি কদমে কদমে সদকা। রাস্তা হতে কষ্টদায়ক কোনো জিনিস হটানো সদকা।’ [বোখারি : ২৫০৮, মুসলিম : ১৬৭৭]
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
১. আমাদের উপর রয়েছে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য ও বে-হিসাব নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা আমাদের অস্তিত্ব দান করেছেন। সুচারুরূপে সুবিন্যস্ত করেছেন আমাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সৃষ্টি করেছেন আমাদের সুন্দরতম আকৃতিতে—এগুলো সন্দেহ নেই, এক বড় নেয়ামত। আল্লাহ তাআলা বলেন :—
وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ . ﴿النحل : ৫৩﴾
‘যে সমস্ত নেয়ামত তোমাদের নিকট আছে সব আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে।’ [নাহল : ৫৩]
অন্যত্র বলেন—
يَا أَيُّهَا الْإِنْسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ . الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ . فِي أَيِّ صُورَةٍ مَا شَاءَ رَكَّبَكَ . ﴿الإنفطار : ৬-৮﴾
‘হে মানব ! কীসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করল ? যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন, এবং তিনিই তোমাকে তার ইচ্ছামত আকৃতিতে গঠন করেছেন’। [আল-ইনফেতার : ৫-৮]
২. রাসূল সা. আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন—অস্থিসমূহের সুবিন্যস্ততা এবং ত্রুটি মুক্ত হওয়া আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। তাই প্রতি হাড়ের জন্য আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া স্বরূপ মানুষের সদকা করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন—
قُلْ هُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ . ﴿الملك : ২৩﴾
‘বলুন, তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ [আল-মুলক : ২৩]
আরো বলেন—
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ . ﴿النحل : ৭৮﴾
‘আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ করেছেন। তোমরা কিছুই অবগত ছিলে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু অন্তর প্রদান করেছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ [আন-নাহাল : ৭৮]
৩. অত্র হাদিসে রাসূল সা. বর্ণনা করেছেন—বনী আদমের কর্তব্য সদকার মাধ্যমে স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনিময়ে প্রত্যহ আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা। হাদিসে বর্ণিত উদাহরণসমূহের মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন।
৪. ওলামায়ে কেরাম বলেছেন—আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের দুটি স্তর রয়েছে।
ক. ওয়াজিব তথা অবশ্য কর্তব্য শুকরিয়া। অর্থাৎ ওয়াজিব আমলগুলো পালন করা, হারাম হতে বিরত থাকা।
খ. মোস্তাহাব তথা ঐচ্ছিক শুকরিয়া। অর্থাৎ ফরজ আদায় করে, হারাম হতে বিরত থাকার পর নফল এবাদত করা।
৫. মানুষের মাঝে মীমাংসা করা, ভালোবাসা, মহববত ও সুসম্পর্ক স্থাপন করা, পরস্পর বিরোধিতা, হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা—এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় ও অধিক ছাওয়াব অর্জিত হয়।
৬. মানুষের সেবা করা এবং তাদের প্রয়োজন পুর্ণ করা, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা করা, ঋণগ্রস্ত অভাবী ব্যক্তিদের সুযোগ দেয়া। এ ধরনের আরো খেদমত আঞ্জাম দেয়া যার দ্বারা অপর ব্যক্তি উপকৃত হয়—অধিক সওয়াবের এবং উত্তম আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন—
لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاةِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا . ﴿النساء : ১১৪﴾
‘তাদের অধিকাংশ সলা-পরামর্শ ভাল নয়। কিন্তু যে সলা-পরামর্শ দান খয়রাত করতে কিংবা সৎকাজ করতে, কিংবা দুজনের মাঝে সন্ধি-স্থাপন কল্পে করা হয়, তা স্বতন্ত্র। যে এ কাজ করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যে, আমি তাকে বিরাট সওয়াব দান করব।’ [আন নিসা : ১১৪।]
আল্লাহ তাআলা অনেক অনেক নেয়ামত আমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তার মাঝে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যতম ; যার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন জৈবিক চাহিদা পূরণ করি। তবে এর ভিতর একমাত্র জিহবা কথা বলতে সক্ষম, আমরা যদি একে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালনা করি—সন্দেহ নেই বিপুল সওয়াব পাব। রাসূল সা. হাদিসে বলেছেন, الكلمة الطيبة صدقة . ‘ভাল কথা সদকা।’ যেমন—ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়া, কোরআন পড়ানো, আল্লাহ তাআলার দিকে আহবান করা, সৎকাজের আদেশ প্রদান, অসৎ কাজ হতে বাধা প্রদান, হারানো ব্যক্তিকে পথ দেখানো, সালাম দেয়া এবং সালামের উত্তর দেয়া, হাঁচি দাতার الحمد لله -এর উত্তরে يرحمك الله বলা—ইত্যাদি।
৮. নামাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাশীল ও শরিয়তের ভিতর উঁচুমানের একটি এবাদত—বিধায় নামাজি ব্যক্তি নামাজের জন্যে যে পথে চলে তার প্রতিটি কদমে কদমে সওয়াব দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রতি কদমে সে সদকার সওয়াব লাভ করে।
৯. মুসলমান নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করে। সে তার ভাইকে খুশি করতে চেষ্টা করে, তার অবর্তমানে শারীরিক বা মানসিক পীড়াদায়ক জিনিস প্রতিহত করে। যেমন—তার রাস্তা হতে পাথর, কাচ, ময়লা, পেরেক ও কলার ছিলকা জাতীয় কষ্টদায়ক জিনিস দূর করে। তদুপরি আল্লাহ তাআলার রাসূল সা. এ কাজকে ঈমানের শাখার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেন—
الإيمان بضع وسبعون شعبة، أعلاها قول لاإله إلا الله، وأدناها إماطة الأذى عن الطريق . رواه مسلم ( ৫১)
‘ঈমানের সত্তুরের উপরে শাখা রয়েছে, সর্বোত্তম শাখা হল لاإله إلا الله -এর বাণী। সর্ব নিম্ন শাখা হল إماطة الأذى عن الطريق -অর্থাৎ রাস্তা হতে কষ্টদায়ক বস্ত্ত হটানো।’
১০. অত্র হাদিসে বর্ণিত প্রতিটি আমলকে খুব গুরুত্ব দেয়া, আল্লাহ তাআলার শুকরিয়ার জন্য এ গুলোকে সম্পাদন করা—বলা বাহুল্য, একান্ত জরুরি। এ হাদিসের অন্য বর্ণনায় আরো কিছু নেক আমলের কথা উলেখ রয়েছে। যেমন— ذكر الله আল্লাহর জিকির। الحمد لله আল-হামদুলিল্লাহ। سبحان الله সুবহানাল্লাহ। لا إله إلا الله লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু। الله أكبر আল্লাহু আকবার—ইত্যাদি তাসবীহ পাঠ করা। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ-কাজের নিষেধ করা ; অভাবী দুঃখ-ভারাক্রান্তদের সাহায্য করা ; দুর্বলদের উৎসাহ প্রদান ও সহযোগিতা করা ; অন্ধদের রাস্তা দেখানো—ইত্যাদি।
১১. সহি মুসলিম এর বর্ণনায় অত্র হাদিসের শেষে আছে—
عن أبي ذر- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ - : ويجزي من ذلك كله ركعتان يركعهما من الضحى . رواه مسلم (১১৮১)
‘সাহাবি আবু যর রা. বলেন. প্রথম প্রহরের দুই রাকাত নামাজ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুকরিয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।’ [মুসলিম : ১১৮১।]
এ হাদিস সাধারণভাবে সব নামাজ এবং বিশেষ করে প্রথম প্রহরের নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণ করে। ওলামায়ে কেরাম বলেছেন দুই রাকাত নামাজ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুকরিয়ার জন্য যথেষ্ট হবে, কারণ নামাজের ভিতর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ তাআলার এবাদত ও তার আনুগত্যে ব্যবহার হয়। সুতরাং দুই রাকাত নামাজ প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনিময়ে সদকার জন্য যথেষ্ট হবে।
عَنْ عَائِشَةَ- رَضِيَ اللهُ عَنْهَا- قَالَتْ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ : عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ : قَصُّ الشَّارِبِ، وإعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكِ، وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ، وَقَصُّ الْأظْفَارِ، وَعَمَلُ الْبَرَاجِمِ، وَنَتْفُ الْإبِطِ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ، وَانْتَقَاصُ الْمَاءِ، قال مُصْعَبْ- أحَدٌ مِّنَ الرُّوَاةِ : وَنَسِيْتُ الْعَاشِرَةَ، إلَّا أنْ تَكُوْنَ الْمَضْمَضَةُ . رواه مسلم (৩৮৪)
‘আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, মানুষের দশটি প্রকৃতিগত স্বভাব, যথা—
১. মোচ কর্তন
২. দাঁড়ি বড় হতে দেয়া বা ছেড়ে দেয়া
৩. মেসওয়াক
৪. নাকের ভিতর শ্বাসের সাথে পানি নেয়া
৫. নখ কাটা
৬. আঙুলের গিরা ধৌত করা
৭. বগলের পশম উপড়ানো
৮. নাভির নিম্নদেশে ক্ষৌরকর্ম
৯. পায়খানা বা পেশাবের পর পানি ব্যবহার
১০. (সম্ভবত) কুলি করা।
হাদিসটি ইমাম মুসলিম রহ. তার উস্তাদ কুতাইবা ইবনে সাঈদ, আবু বকর ইবনে শাইবাহ ও যুহাইর ইবনে হারব প্রমুখগণ হতে শিক্ষা লাভ করেছেন, তারা সকলে ওয়াকী হতে, সে জাকারিয়া বিন আবু যায়েদা হতে, সে মুস‘আব বিন শাইবা হতে, সে তালক্ব বিন হাবীব হতে, সে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের হতে, সে স্বীয় খালা আয়েশা সিদ্দিকা রা. হতে, আয়েশা রা. বলেন আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি...আল হাদিস।
মুসআব বিন শাইবাহ তার ছাত্র জাকারিয়া বিন আবু যায়েদাকে বলেন, আমি দশমটি ভুলে গেছি, তবে তা কুলি করা হতে পারে।
আয়াজ রহ. বলেন—খুব সম্ভব দশমটি খতনা করা। এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, যে সমস্ত হাদিসের ভিতর পাঁচটি স্বভাবের কথা উলেখ করা হয়েছে, সেখানে খতনার কথাও উলেখ রয়েছে।
হাদিসের শব্দ প্রসঙ্গে :
الْفِطْرَةِ : বিশেষজ্ঞ আলেমগণ শব্দটির নানা অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। খাত্তাবী বলেছেন—অধিকাংশ ওলামাদের মতে, এর অর্থ (মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন সুস্থ মানুষের) স্বভাব বা আভিধানিক সুন্নত। অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম বলেছেন— الفطرة অর্থ নবীগণের সুন্নত। আর কেউ কেউ বলেছেন এর অর্থ দ্বীন বা ধর্ম।
জ্ঞাতব্য যে, হাদিসে বর্ণিত সবগুলো স্বভাব ওলামাদের মতে ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য নয়। কয়েকটির ব্যাপারে ওয়াজিব হওয়া না-হওয়া নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। যেমন-খতনা করা, কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া।
আরেকটি বিধান জানা প্রয়োজন : এক, নির্দেশের ভিতর আবশ্যক-অনাবশ্যক দু ধরনের হুকুম থাকতে পারে, যেমন—কোরআনে আছে—
كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ . ﴿الأنعام : ১৪১﴾
‘এগুলোর ফল তোমরা খাও, যখন ফলন্ত হয় এবং হক দান কর কর্তনের সময়।’ [আল আনআম : ১৪১।]
অত্র আয়াতে প্রদানের নির্দেশ ওয়াজিব করা হয়েছে, খাওয়ার নির্দেশ নয়। অথচ একই নির্দেশে এবং একই শব্দের মাধ্যমে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে।
قَصُّ الشَّارِبِ : মোচ কর্তন করা বা ছোট করা ; যাতে ঠোঁটের উপরের অংশ বের হয়ে যায়। বেড বা ক্ষুর জাতীয় জিনিসের মাধ্যমে মোচ কর্তন করা বা চাছাকে কেউ কেউ মাকরূহ বলেছেন।
اللِّحْيَةِ : উভয় গাল ও থুতনিতে গজানো লোমকে দাড়ি বলে।
السِّوَاكِ : লাকড়ি বা লাকড়ি জাতীয় কোন জিনিসকে মুখ ও দাঁতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহার করা।
وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ : নাকের ভিতর শ্বাসের সাথে পানি টেনে নেয়া।
الْبَرَاجِمِ : হাতের আঙুলের পৃষ্ঠদেশের গিরা।
الْعَانَةِ : ঐ সমস্ত লোম যা পুরুষাঙ্গের উপর ও তার দু’পাশে গজায়। তদ্রুপ নারীর যোনি বা গুপ্তাঙ্গেরে দু’পাশে যে লোম গজায়।
وَانْتَقَاصُ الْمَاءِ : প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা :
১. ইসলাম পবিত্রতার ধর্ম। বাহ্যিক-অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার ধর্ম। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য পরিচ্ছন্নতার ধর্ম। এ জন্যই রাসূল সা. উলেখিত স্বভাবসমূহ সুন্নত বা দ্বীনেরে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর কিছু আছে ওয়াজিব-অবশ্য পালনীয়। আর কিছু আছে মোস্তাহাব- যা করলে সওয়াব হবে।
২. মোচ কাটা বা ছাটা এবং দাড়িকে যত্ন করা ও লম্বা করা বা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। এর মাধ্যমে মুসলমান অন্যদের থেকে স্বতন্ত্রতা লাভ করে, যার প্রমাণ ইবনে উমর রা.-এর হাদিস। রাসূল সা. বলেছেন—
خالفوا المشركين، وفروا اللحلى، واحفوا الشوارب . رواه البخاري ( ৫৪২২)
‘মুশরিকদের বিরোধিতা করো : দাড়ি লম্বা কর, মোচ ছোট কর।’ [বোখারি : ৫৪২২]
ইবনে উমর রা. এর আরেকটি হাদিসে আছে—
أنهكوا الشوارب وأعفوا اللحى . رواه البخاري ( ৫৪২২)
‘রাসূল সা. বলেছেন, মোচ নিঃশেষ কর এবং দাড়ি বড় কর।’ তাই, দাড়ি চাছা বা ছোট করা হারাম। মোচ মূল হতে উপড়ানো মকরুহ।
৩. মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি ও অবশ্য কর্তব্য সুন্নত হলো মেসওয়াক করা। অর্থাৎ লাকড়ি বা এ জাতীয় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য দাঁত ঘর্ষণ করা। অনেক হাদিসের ভিতর এ জন্য উৎসাহ প্রধান করা হয়েছে। যেমন—আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—
لو لا أن اشق على أمتي لأمرتهم بالسواك عند كل صلاة . و في رواية عند وضوء . رواه مسلم (৩৭০)
‘যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্ট না হতো, আমি প্রতি নামাজের সময় মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম। অন্য বর্ণনায় আছে—প্রতি ওজুর সময়।’ [মুসলিম : ৩৭০]
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—
السواك مطهرة للفم . ومرضاة للرب . رواه النسائي (৫)
‘মেসওয়াক মুখের পবিত্রতা ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।’ [নাসায়ী : ৫]
যে সমস্ত জিনিসের মাধ্যমে মেসওয়াকের কাজ আদায় হয়, তা এর অন্তর্ভুক্ত। কিছু কিছু সময় মেসওয়াক করা অতীব জরুরি। বিশেষ করে ওজুর সময়, নামাজের সময়, বাড়িতে প্রবেশ করার সময়, কোরআন তিলাওয়াত করার সময়, ঘুম হতে উঠার পর, মুখের স্বাদ বিকৃত হলে—ইত্যাদি।
৪. অত্র হাদিসে নাকে পানি দেয়াকে সুন্নত উলেখ করা হয়েছে। ওজু-গোসলে তা ওয়াজিব, কারণ নাক চেহারার অন্তর্ভুক্ত। অপর দিকে যারাই রাসূল সা. এর ওজু বর্ণনা করেছেন—নাকে পানি দেয়াকে উলেখ করেছেন।
৫. নখ ছোট করা বা কাটা পবিত্রতার অন্তর্ভুক্ত। কারণ এতে ময়লা জমে অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা হয়ে যায়। কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ওজুতে পানি পৌঁছানো আবশ্যক—এমন অংশে পানি পৌঁছোতে বাধার সৃষ্টি করে। আবার আমরা সবাই বাঁ হাতকে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করি, সে ক্ষেত্রে নখ বড় থাকলে ময়লা লেগে হাত নষ্ট হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে।
৬. মানুষের শরীরে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলো যত্ন সহকারে পরিষ্কার রাখতে হয়। যেমন হাতের পৃষ্ঠদেশে আঙুলের গিরা, সেখানে ময়লা জমে থাকার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং এগুলোকে ভাল করে ধৌত করা ও পরিষ্কার করা জরুরি।
৭. আরো পবিত্রতার অন্তর্ভুক্ত : নাভির নীচের পশম মুন্ডানো ও বগলের নীচের পশম উপড়ানো। এর ভিতর হিকমত হলো এর দুর্গন্ধ হতে সৃষ্ট অনুভূতিগুলো নিঃশেষ করা বা হালকা করা। যাতে মুসলমানদের শরীরের ঘ্রাণ তার স্বভাবের মত পবিত্র তাকে। এখানে জেনে রাখা ভাল, বগলের পশম উপড়ানো জরুরি নয় বরং যে কোন জিনিসের মাধ্যমে দূর করাই যথেষ্ট।
৮. মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য পানির মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা। যাতে মলদ্বার ও পেশাবের স্থানে কোন ধরনের ময়লা না থাকে। কারণ পরিষ্কার ব্যতীত রেখে দিলে শরীর নাপাক হতে পারে। যার ফলে তার নামাজ বিশুদ্ধ না হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
৯. ইসলামি শিষ্টচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, অপরকে সম্মান করা, ইজ্জত দেয়া, দুর্গন্ধের মাধ্যমে তাদের কষ্ট না দেয়া। সুতরাং, মুসলমানদের উচিত শরীরের ভাল সুগন্ধি ব্যবহার করা। শরীর পরিষ্কার রাখা। তদুপরি শরীরকে দুর্গন্ধের মত বিরক্তিকর জিনিস হতে সংরক্ষণ করা—বন্ধু-বান্ধব ও সাথি-সঙ্গীদের সাথে সদ্ব্যবহারের শামিল। এ জন্য ইসলাম এ স্বভাবগুলোকে প্রকৃতিগত সুন্নতের স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
১০. মুসলমান স্বীয় অবয়ব, বাহ্যিক পোশাক-আশাক এবং ভিতরে-বাহিরে এক অনন্য স্বতন্ত্রতা লালন করে। যেমন—সে বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার এবং মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে ইসলামকে পারংগমতার সাথে অনুসরণকারী, তদ্রূপ সে বাহ্যিক শশ্রুধারী, পরিমিত মোচ বিশিষ্ট ইসলামি আদর্শ বহনকারী। এর ভিত্তিতেই সে ইহুদি-নাসারা ও অগ্নিপূজকদের আদর্শের বিরুদ্ধবাদী তথা প্রতিবাদী ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী বলে গণ্য হবে।
১১. আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ . ﴿التغابن : ৩﴾
‘তিনি তোমাদের আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি।’ [তাগাবুন : ৩]
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করেছেন এবং বলে দিয়েছেন, সে যেন এতে বিকৃতি আরোপ করে কুৎসিত না করে এবং এর সৌন্দর্য রক্ষায় যত্নবান হয়। বস্ত্তত এগুলো রক্ষা করা রুচিবোধের পরিচয়। কারণ, মানুষ যখন মার্জিত বেশ ভুষায় আত্মপ্রকাশ করে, অন্যান্য সকলে তার প্রতি সন্তুষ্টচিত্ত ও প্রফুল থাকে। তার কথা গ্রহণ করে। এর বিপরীত হলে ফলাফলও বিপরীত হবে।
১২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ডান দিক প্রাধান্য দেয়া সুন্নত। সুতরাং নখ কাটার সময় ডান দিক থেকে আরম্ভ করবে। মোচ ছোট করার সময় ডান পাশকে প্রাধান্য দেবে। এভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করবে।
১৩. ওলামায়ে কেরাম উলেখ করেছেন, প্রয়োজন মোতাবেক নখ কাটবে, মোচ ছোট করে ছাঁটবে, নাভির নিচের পশম মুন্ডাবে ও বগলের পশম ওপড়াবে। নখ, মোচ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত রেখে দিবে না-যাতে লম্বা হতেই থাকে। কেউ কেউ প্রতি জুমআতে এ সমস্ত আমল সম্পাদন করা মোস্তাহাব বলেছেন। কারণ, জুমআর দিন গোসল করা ও পবিত্রতা অর্জন কার মোস্তাহাব।
‘আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, মানুষের দশটি প্রকৃতিগত স্বভাব, যথা—
১. মোচ কর্তন
২. দাঁড়ি বড় হতে দেয়া বা ছেড়ে দেয়া
৩. মেসওয়াক
৪. নাকের ভিতর শ্বাসের সাথে পানি নেয়া
৫. নখ কাটা
৬. আঙুলের গিরা ধৌত করা
৭. বগলের পশম উপড়ানো
৮. নাভির নিম্নদেশে ক্ষৌরকর্ম
৯. পায়খানা বা পেশাবের পর পানি ব্যবহার
১০. (সম্ভবত) কুলি করা।
হাদিসটি ইমাম মুসলিম রহ. তার উস্তাদ কুতাইবা ইবনে সাঈদ, আবু বকর ইবনে শাইবাহ ও যুহাইর ইবনে হারব প্রমুখগণ হতে শিক্ষা লাভ করেছেন, তারা সকলে ওয়াকী হতে, সে জাকারিয়া বিন আবু যায়েদা হতে, সে মুস‘আব বিন শাইবা হতে, সে তালক্ব বিন হাবীব হতে, সে আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের হতে, সে স্বীয় খালা আয়েশা সিদ্দিকা রা. হতে, আয়েশা রা. বলেন আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি...আল হাদিস।
মুসআব বিন শাইবাহ তার ছাত্র জাকারিয়া বিন আবু যায়েদাকে বলেন, আমি দশমটি ভুলে গেছি, তবে তা কুলি করা হতে পারে।
আয়াজ রহ. বলেন—খুব সম্ভব দশমটি খতনা করা। এটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, যে সমস্ত হাদিসের ভিতর পাঁচটি স্বভাবের কথা উলেখ করা হয়েছে, সেখানে খতনার কথাও উলেখ রয়েছে।
হাদিসের শব্দ প্রসঙ্গে :
الْفِطْرَةِ : বিশেষজ্ঞ আলেমগণ শব্দটির নানা অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। খাত্তাবী বলেছেন—অধিকাংশ ওলামাদের মতে, এর অর্থ (মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন সুস্থ মানুষের) স্বভাব বা আভিধানিক সুন্নত। অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম বলেছেন— الفطرة অর্থ নবীগণের সুন্নত। আর কেউ কেউ বলেছেন এর অর্থ দ্বীন বা ধর্ম।
জ্ঞাতব্য যে, হাদিসে বর্ণিত সবগুলো স্বভাব ওলামাদের মতে ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য নয়। কয়েকটির ব্যাপারে ওয়াজিব হওয়া না-হওয়া নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। যেমন-খতনা করা, কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া।
আরেকটি বিধান জানা প্রয়োজন : এক, নির্দেশের ভিতর আবশ্যক-অনাবশ্যক দু ধরনের হুকুম থাকতে পারে, যেমন—কোরআনে আছে—
كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ . ﴿الأنعام : ১৪১﴾
‘এগুলোর ফল তোমরা খাও, যখন ফলন্ত হয় এবং হক দান কর কর্তনের সময়।’ [আল আনআম : ১৪১।]
অত্র আয়াতে প্রদানের নির্দেশ ওয়াজিব করা হয়েছে, খাওয়ার নির্দেশ নয়। অথচ একই নির্দেশে এবং একই শব্দের মাধ্যমে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে।
قَصُّ الشَّارِبِ : মোচ কর্তন করা বা ছোট করা ; যাতে ঠোঁটের উপরের অংশ বের হয়ে যায়। বেড বা ক্ষুর জাতীয় জিনিসের মাধ্যমে মোচ কর্তন করা বা চাছাকে কেউ কেউ মাকরূহ বলেছেন।
اللِّحْيَةِ : উভয় গাল ও থুতনিতে গজানো লোমকে দাড়ি বলে।
السِّوَاكِ : লাকড়ি বা লাকড়ি জাতীয় কোন জিনিসকে মুখ ও দাঁতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহার করা।
وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ : নাকের ভিতর শ্বাসের সাথে পানি টেনে নেয়া।
الْبَرَاجِمِ : হাতের আঙুলের পৃষ্ঠদেশের গিরা।
الْعَانَةِ : ঐ সমস্ত লোম যা পুরুষাঙ্গের উপর ও তার দু’পাশে গজায়। তদ্রুপ নারীর যোনি বা গুপ্তাঙ্গেরে দু’পাশে যে লোম গজায়।
وَانْتَقَاصُ الْمَاءِ : প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা :
১. ইসলাম পবিত্রতার ধর্ম। বাহ্যিক-অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার ধর্ম। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য পরিচ্ছন্নতার ধর্ম। এ জন্যই রাসূল সা. উলেখিত স্বভাবসমূহ সুন্নত বা দ্বীনেরে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর কিছু আছে ওয়াজিব-অবশ্য পালনীয়। আর কিছু আছে মোস্তাহাব- যা করলে সওয়াব হবে।
২. মোচ কাটা বা ছাটা এবং দাড়িকে যত্ন করা ও লম্বা করা বা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। এর মাধ্যমে মুসলমান অন্যদের থেকে স্বতন্ত্রতা লাভ করে, যার প্রমাণ ইবনে উমর রা.-এর হাদিস। রাসূল সা. বলেছেন—
خالفوا المشركين، وفروا اللحلى، واحفوا الشوارب . رواه البخاري ( ৫৪২২)
‘মুশরিকদের বিরোধিতা করো : দাড়ি লম্বা কর, মোচ ছোট কর।’ [বোখারি : ৫৪২২]
ইবনে উমর রা. এর আরেকটি হাদিসে আছে—
أنهكوا الشوارب وأعفوا اللحى . رواه البخاري ( ৫৪২২)
‘রাসূল সা. বলেছেন, মোচ নিঃশেষ কর এবং দাড়ি বড় কর।’ তাই, দাড়ি চাছা বা ছোট করা হারাম। মোচ মূল হতে উপড়ানো মকরুহ।
৩. মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি ও অবশ্য কর্তব্য সুন্নত হলো মেসওয়াক করা। অর্থাৎ লাকড়ি বা এ জাতীয় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য দাঁত ঘর্ষণ করা। অনেক হাদিসের ভিতর এ জন্য উৎসাহ প্রধান করা হয়েছে। যেমন—আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—
لو لا أن اشق على أمتي لأمرتهم بالسواك عند كل صلاة . و في رواية عند وضوء . رواه مسلم (৩৭০)
‘যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্ট না হতো, আমি প্রতি নামাজের সময় মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম। অন্য বর্ণনায় আছে—প্রতি ওজুর সময়।’ [মুসলিম : ৩৭০]
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন—
السواك مطهرة للفم . ومرضاة للرب . رواه النسائي (৫)
‘মেসওয়াক মুখের পবিত্রতা ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।’ [নাসায়ী : ৫]
যে সমস্ত জিনিসের মাধ্যমে মেসওয়াকের কাজ আদায় হয়, তা এর অন্তর্ভুক্ত। কিছু কিছু সময় মেসওয়াক করা অতীব জরুরি। বিশেষ করে ওজুর সময়, নামাজের সময়, বাড়িতে প্রবেশ করার সময়, কোরআন তিলাওয়াত করার সময়, ঘুম হতে উঠার পর, মুখের স্বাদ বিকৃত হলে—ইত্যাদি।
৪. অত্র হাদিসে নাকে পানি দেয়াকে সুন্নত উলেখ করা হয়েছে। ওজু-গোসলে তা ওয়াজিব, কারণ নাক চেহারার অন্তর্ভুক্ত। অপর দিকে যারাই রাসূল সা. এর ওজু বর্ণনা করেছেন—নাকে পানি দেয়াকে উলেখ করেছেন।
৫. নখ ছোট করা বা কাটা পবিত্রতার অন্তর্ভুক্ত। কারণ এতে ময়লা জমে অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা হয়ে যায়। কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ওজুতে পানি পৌঁছানো আবশ্যক—এমন অংশে পানি পৌঁছোতে বাধার সৃষ্টি করে। আবার আমরা সবাই বাঁ হাতকে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করি, সে ক্ষেত্রে নখ বড় থাকলে ময়লা লেগে হাত নষ্ট হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে।
৬. মানুষের শরীরে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলো যত্ন সহকারে পরিষ্কার রাখতে হয়। যেমন হাতের পৃষ্ঠদেশে আঙুলের গিরা, সেখানে ময়লা জমে থাকার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং এগুলোকে ভাল করে ধৌত করা ও পরিষ্কার করা জরুরি।
৭. আরো পবিত্রতার অন্তর্ভুক্ত : নাভির নীচের পশম মুন্ডানো ও বগলের নীচের পশম উপড়ানো। এর ভিতর হিকমত হলো এর দুর্গন্ধ হতে সৃষ্ট অনুভূতিগুলো নিঃশেষ করা বা হালকা করা। যাতে মুসলমানদের শরীরের ঘ্রাণ তার স্বভাবের মত পবিত্র তাকে। এখানে জেনে রাখা ভাল, বগলের পশম উপড়ানো জরুরি নয় বরং যে কোন জিনিসের মাধ্যমে দূর করাই যথেষ্ট।
৮. মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য পানির মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা। যাতে মলদ্বার ও পেশাবের স্থানে কোন ধরনের ময়লা না থাকে। কারণ পরিষ্কার ব্যতীত রেখে দিলে শরীর নাপাক হতে পারে। যার ফলে তার নামাজ বিশুদ্ধ না হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে।
৯. ইসলামি শিষ্টচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, অপরকে সম্মান করা, ইজ্জত দেয়া, দুর্গন্ধের মাধ্যমে তাদের কষ্ট না দেয়া। সুতরাং, মুসলমানদের উচিত শরীরের ভাল সুগন্ধি ব্যবহার করা। শরীর পরিষ্কার রাখা। তদুপরি শরীরকে দুর্গন্ধের মত বিরক্তিকর জিনিস হতে সংরক্ষণ করা—বন্ধু-বান্ধব ও সাথি-সঙ্গীদের সাথে সদ্ব্যবহারের শামিল। এ জন্য ইসলাম এ স্বভাবগুলোকে প্রকৃতিগত সুন্নতের স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
১০. মুসলমান স্বীয় অবয়ব, বাহ্যিক পোশাক-আশাক এবং ভিতরে-বাহিরে এক অনন্য স্বতন্ত্রতা লালন করে। যেমন—সে বিশ্বাস, আচার-ব্যবহার এবং মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে ইসলামকে পারংগমতার সাথে অনুসরণকারী, তদ্রূপ সে বাহ্যিক শশ্রুধারী, পরিমিত মোচ বিশিষ্ট ইসলামি আদর্শ বহনকারী। এর ভিত্তিতেই সে ইহুদি-নাসারা ও অগ্নিপূজকদের আদর্শের বিরুদ্ধবাদী তথা প্রতিবাদী ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারী বলে গণ্য হবে।
১১. আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ . ﴿التغابن : ৩﴾
‘তিনি তোমাদের আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি।’ [তাগাবুন : ৩]
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করেছেন এবং বলে দিয়েছেন, সে যেন এতে বিকৃতি আরোপ করে কুৎসিত না করে এবং এর সৌন্দর্য রক্ষায় যত্নবান হয়। বস্ত্তত এগুলো রক্ষা করা রুচিবোধের পরিচয়। কারণ, মানুষ যখন মার্জিত বেশ ভুষায় আত্মপ্রকাশ করে, অন্যান্য সকলে তার প্রতি সন্তুষ্টচিত্ত ও প্রফুল থাকে। তার কথা গ্রহণ করে। এর বিপরীত হলে ফলাফলও বিপরীত হবে।
১২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ডান দিক প্রাধান্য দেয়া সুন্নত। সুতরাং নখ কাটার সময় ডান দিক থেকে আরম্ভ করবে। মোচ ছোট করার সময় ডান পাশকে প্রাধান্য দেবে। এভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করবে।
১৩. ওলামায়ে কেরাম উলেখ করেছেন, প্রয়োজন মোতাবেক নখ কাটবে, মোচ ছোট করে ছাঁটবে, নাভির নিচের পশম মুন্ডাবে ও বগলের পশম ওপড়াবে। নখ, মোচ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত রেখে দিবে না-যাতে লম্বা হতেই থাকে। কেউ কেউ প্রতি জুমআতে এ সমস্ত আমল সম্পাদন করা মোস্তাহাব বলেছেন। কারণ, জুমআর দিন গোসল করা ও পবিত্রতা অর্জন কার মোস্তাহাব।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন