HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য
লেখকঃ আব্দুর রাযযাক ইব্ন আব্দুল মুহসিন আল-বাদ্র
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা ভিক্ষা করি। আমরা আমাদের আত্মার অনিষ্ট থেকে এবং মন্দ কর্ম থেকে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। পক্ষান্তরে তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করে, তাকে কেউ সঠিক পথ দেখাতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, শরীকবিহীন এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন হক্ব মা‘বূদ নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি এবং তাঁর সকল সাহাবীর প্রতি অসংখ্য দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।
ছোট্ট এই পুস্তিকার শিরোনাম হচ্ছে, ‘সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য’। সত্যিই আমাদের উপর অর্পিত এ কর্তব্য মহান। সেজন্য আমাদের উচিৎ, এবিষয়টির প্রতি যারপর নেই গুরুত্ব প্রদান করা এবং সর্বোচ্চ যত্নশীল হওয়া।
সম্মানিত পাঠকের জানা যরূরী যে, সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য যেন-তেন কোন বিষয় নয়। এটি দ্বীন ইসলামের প্রতি আমাদের কর্তব্যেরই একটি অংশ, যে দ্বীনকে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং যা ব্যতীত তিনি তাদের নিকট থেকে অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করেন না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ﴾ [ آل عمران : ١٩ ]
‘নিশ্চয় আল্লাহ্র নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’ (আলে-ইমরান ১৯)।
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥ ﴾ [ آل عمران : ٨٥ ]
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত (আলে-ইমরান ৮৫)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [ المائدة : ٣ ]
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম’ (আল-মায়েদাহ ৩)।
অতএব, এই সরল-সোজা পথ এবং সত্য দ্বীনই হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীন। এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বস্ত প্রচারক, বিচক্ষণ উপদেষ্টা এবং সম্মানিত রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নির্বাচন করেন। তিনি এই দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিতে এবং আল্লাহ নির্দেশিত বিষয়সমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে কোন প্রকার ত্রুটি করেন নি। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ ﴾ [ المائدة : ٦٧ ]
‘হে রাসূল! আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা পৌঁছে দিন’ (আল-মায়েদাহ ৬৭)। আল্লাহ্র এই নির্দেশ মোতাবেক তিনি আমরণ রিসালাতের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করেছেন, তাঁর উম্মতকে সঠিক নছীহত করে গেছেন এবং আল্লাহ্র রাহে সত্যিকার জিহাদ করেছেন। কল্যাণের এমন কোন দিক নেই, যা তিনি তাঁর উম্মতকে বলে যান নি। পক্ষান্তরে অকল্যাণের এমন কোন দিক নেই, যা থেকে তিনি তার উম্মতকে সতর্ক করে যান নি। মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢﴾ [ الجمعة : ٢ ]
‘তিনিই নিরক্ষরদের নিকট তাঁদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত’ (আল-জুমু‘আহ ২)।
আমি আবারও বলছি, আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র দ্বীনের প্রচার ও প্রসার যথার্থভাবে করে গেছেন। তিনি তাঁর উম্মতকে নছীহত করতে কোন প্রকার ত্রুটি করেননি; বরং তিনি তাদের জন্য তাদের লক্ষ্যস্থল স্পষ্টভাবে বাতলে দিয়ে গেছেন।
মহান আল্লাহ সম্মানিত এই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য সম্মানিত সাহাবায়ে কেরামকে মনোনীত করেন। তাঁরা তাঁকে এবং আল্লাহ্র দ্বীনকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তাঁরা ছিলেন ভূ-পৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির শ্রেষ্ঠতম সহচর। তাঁরা ছিলেন তাঁর সৎ সঙ্গী, মহৎ সহকর্মী এবং শক্তিশালী সাহায্যকারী। আল্লাহ্র দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তাঁরা সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
তাঁরা কতই না নিবেদিতপ্রাণ এবং মহৎ ছিলেন! কতই না সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তাঁরা! আল্লাহ্র দ্বীনের সহযোগিতার জন্য তাঁরা কি অসাধারণ প্রচেষ্টাই না করেছেন!
মহান আল্লাহ বিশেষ তাৎপর্যকে সামনে রেখেই তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য উত্তম ও ন্যায়পরায়ণ এসকল সাহাবীকে মনোনীত করেন। স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাক্ষ্যানুযায়ী নবী ও রাসূলগণ (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর পরে তাঁরাই ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ﴾ [ آل عمران : ١١٠ ]
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে’ (আলে-ইমরান ১১০)। অগ্রবর্তিতার ভিত্তিতে এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবীগণই সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ্র এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার আওতাভুক্ত হবেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ»
‘আমার যুগের মানুষই সর্বোত্তম মানুষ। অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ, অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ’। [. সহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩। হাদীসটি ইবনে মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন।]
বুঝা গেল, সাহাবীগণের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দিলেন স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সত্যিই তাঁরা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বস্ত এবং সুদৃঢ় দিক-নির্দেশক।
অতএব, আমাদের ভালোভাবে জানা উচিৎ যে, সাহাবীগণ ও তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্য শীর্ষক আলোচনা দ্বীন, ইসলামী আক্বীদা এবং ঈমানেরই একটি অংশ। কেননা অতীত ও বর্তমানে সালাফে ছালেহীন কর্তৃক প্রণীত আক্বীদা বিষয়ক এমন কোন বই আপনি পাবেন না, যাতে সাহাবীগণের প্রতি মুসলিম আক্বীদার বিষদ বিবরণ নেই।
কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন উঠেঃ সাহাবীবর্গের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা কেন দ্বীনের প্রতি আমাদের কর্তব্যের একটি অংশ হিসাবে বিবেচিত হল?
জবাবে বলব, সাহাবীগণ হলেন এই দ্বীনের ধারক এবং বাহক। তাঁরা কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি এই দ্বীনের বার্তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে শ্রবণের মহান গৌরর অর্জন করেছেন। তাঁরা সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। অতঃপর পূর্ণ আমানতদারিতার সহিত উক্ত হাদীসসমূহকে সংরক্ষণ করতঃ মুসলিম উম্মাহ্র উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদীসও কি এমন পাওয়া যাবে যে, তা সাহাবায়ে কেরাম ছাড়া অন্য কারো সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে?!
যখন আপনি বুখারী, মুসলিম, সুনান [. যেসব হাদীস গ্রন্থ ফিক্বহী অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজানো হয়, সেগুলিকে ‘সুনান’ ( السنن ) বলে। এসব হাদীস গ্রন্থে মারফূ‘ হাদীস ব্যতীত মাক্বতু‘ বা মাওক্বূফ হাদীস থাকে না বললেই চলে। যেমনঃ সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ ইত্যাদি। –অনুবাদক।], মাসানীদ [. যেসক হাদীস গ্রন্থে প্রত্যেক সাহাবীর সহীহ, হাসান ও যঈফ হাদীসকে পৃথকভাবে সাজানো হয়, অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাদীস উল্লেখ করা হয় না, সেসব হাদীস গ্রন্থকে ‘মাসানীদ’ ( المسانيد )বলে। যেমনঃ মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে বায্যার ইত্যাদি।আবার কখনও যে গ্রন্থে বেশকিছু হাদীস একত্রিত করা হয়, তবে সেটার হাদীসগুলিকে সাহাবীর নামানুসারে না সাজিয়ে অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজানো হয়, তাকেও মুসনাদ বলে। যেমনঃ মুসনাদে বাক্বী ইবনে মাখলাদ আল-আন্দালুসী। –অনুবাদক।], মাজামী‘ [. যেসব গ্রন্থে হাদীছের বিভিন্ন মূল গ্রন্থ থেকে হাদীস জমা করা হয় এবং একত্রিত হাদীসগুলিকে মূল গ্রন্থসমূহের বিন্যাশ অনুযায়ী সাজানো হয়, সেগুলিকে ‘মাজামী’ ( المجاميع ) বলে। যেমনঃ ছাগানী প্রণীত ‘আল-জাম্‘উ বায়নাছ্-ছহীহাইন’, সুয়ূত্বী প্রণীত ‘আল-জামে‘ আল-কাবীর’ ইত্যাদি। এসব হাদীস গ্রন্থের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, এগুলিতে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত একই বিষয়ের অনেকগুলি হাদীস একত্রে পাওয়া যায়। –অনুবাদক।], আজ্যা [. হাদীছের যেসব ছোট্ট গ্রন্থে লেখকগণ বেশকিছু হাদীস একত্রিত করেন এবং হাদীসগুলি সাধারণতঃ বিষয়বস্তু, বর্ণনাকারী অথবা মতন বা সনদের বৈশিষ্ট্যের দিক বিবেচনায় একই হয়, তাকে ‘আজ্যা হাদীছিইয়্যাহ’ ( الأجزاء الحديثية ) বলে। যেমনঃ ইমাম বুখারী প্রণীত ‘জুয্উ রফইল ইয়াদায়েন ফিছ্-ছালাহ’। –অনুবাদক।] বা হাদীছের অন্য কোন গ্রন্থ খুলবেন, তখন দেখবেন, গ্রন্থকার থেকে হাদীছের সনদ শুরু হয়ে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে। অতঃপর সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সেজন্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত প্রত্যেকটি হাদীছের সূত্রে কোন না কোন বিশিষ্ট সাহাবী অবশ্যই রয়েছেন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর কাছেই ক্ষমা ভিক্ষা করি। আমরা আমাদের আত্মার অনিষ্ট থেকে এবং মন্দ কর্ম থেকে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। পক্ষান্তরে তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করে, তাকে কেউ সঠিক পথ দেখাতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, শরীকবিহীন এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন হক্ব মা‘বূদ নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি এবং তাঁর সকল সাহাবীর প্রতি অসংখ্য দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন।
ছোট্ট এই পুস্তিকার শিরোনাম হচ্ছে, ‘সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য’। সত্যিই আমাদের উপর অর্পিত এ কর্তব্য মহান। সেজন্য আমাদের উচিৎ, এবিষয়টির প্রতি যারপর নেই গুরুত্ব প্রদান করা এবং সর্বোচ্চ যত্নশীল হওয়া।
সম্মানিত পাঠকের জানা যরূরী যে, সাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য যেন-তেন কোন বিষয় নয়। এটি দ্বীন ইসলামের প্রতি আমাদের কর্তব্যেরই একটি অংশ, যে দ্বীনকে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং যা ব্যতীত তিনি তাদের নিকট থেকে অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করেন না। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ﴾ [ آل عمران : ١٩ ]
‘নিশ্চয় আল্লাহ্র নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’ (আলে-ইমরান ১৯)।
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥ ﴾ [ آل عمران : ٨٥ ]
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা তার পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত (আলে-ইমরান ৮৫)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [ المائدة : ٣ ]
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম’ (আল-মায়েদাহ ৩)।
অতএব, এই সরল-সোজা পথ এবং সত্য দ্বীনই হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীন। এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বস্ত প্রচারক, বিচক্ষণ উপদেষ্টা এবং সম্মানিত রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নির্বাচন করেন। তিনি এই দ্বীনকে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিতে এবং আল্লাহ নির্দেশিত বিষয়সমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে কোন প্রকার ত্রুটি করেন নি। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿۞يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ ﴾ [ المائدة : ٦٧ ]
‘হে রাসূল! আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা পৌঁছে দিন’ (আল-মায়েদাহ ৬৭)। আল্লাহ্র এই নির্দেশ মোতাবেক তিনি আমরণ রিসালাতের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করেছেন, তাঁর উম্মতকে সঠিক নছীহত করে গেছেন এবং আল্লাহ্র রাহে সত্যিকার জিহাদ করেছেন। কল্যাণের এমন কোন দিক নেই, যা তিনি তাঁর উম্মতকে বলে যান নি। পক্ষান্তরে অকল্যাণের এমন কোন দিক নেই, যা থেকে তিনি তার উম্মতকে সতর্ক করে যান নি। মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদেরকে তাঁর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢﴾ [ الجمعة : ٢ ]
‘তিনিই নিরক্ষরদের নিকট তাঁদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত’ (আল-জুমু‘আহ ২)।
আমি আবারও বলছি, আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র দ্বীনের প্রচার ও প্রসার যথার্থভাবে করে গেছেন। তিনি তাঁর উম্মতকে নছীহত করতে কোন প্রকার ত্রুটি করেননি; বরং তিনি তাদের জন্য তাদের লক্ষ্যস্থল স্পষ্টভাবে বাতলে দিয়ে গেছেন।
মহান আল্লাহ সম্মানিত এই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য সম্মানিত সাহাবায়ে কেরামকে মনোনীত করেন। তাঁরা তাঁকে এবং আল্লাহ্র দ্বীনকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তাঁরা ছিলেন ভূ-পৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির শ্রেষ্ঠতম সহচর। তাঁরা ছিলেন তাঁর সৎ সঙ্গী, মহৎ সহকর্মী এবং শক্তিশালী সাহায্যকারী। আল্লাহ্র দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তাঁরা সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
তাঁরা কতই না নিবেদিতপ্রাণ এবং মহৎ ছিলেন! কতই না সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন তাঁরা! আল্লাহ্র দ্বীনের সহযোগিতার জন্য তাঁরা কি অসাধারণ প্রচেষ্টাই না করেছেন!
মহান আল্লাহ বিশেষ তাৎপর্যকে সামনে রেখেই তাঁর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য উত্তম ও ন্যায়পরায়ণ এসকল সাহাবীকে মনোনীত করেন। স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাক্ষ্যানুযায়ী নবী ও রাসূলগণ (আলাইহিমুস্ সালাম)-এর পরে তাঁরাই ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ﴾ [ آل عمران : ١١٠ ]
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে’ (আলে-ইমরান ১১০)। অগ্রবর্তিতার ভিত্তিতে এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবীগণই সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ্র এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণার আওতাভুক্ত হবেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ»
‘আমার যুগের মানুষই সর্বোত্তম মানুষ। অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ, অতঃপর তার পরের যুগের মানুষ’। [. সহীহ বুখারী, হা/২৬৫২; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩। হাদীসটি ইবনে মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন।]
বুঝা গেল, সাহাবীগণের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দিলেন স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সত্যিই তাঁরা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, বিশ্বস্ত এবং সুদৃঢ় দিক-নির্দেশক।
অতএব, আমাদের ভালোভাবে জানা উচিৎ যে, সাহাবীগণ ও তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্য শীর্ষক আলোচনা দ্বীন, ইসলামী আক্বীদা এবং ঈমানেরই একটি অংশ। কেননা অতীত ও বর্তমানে সালাফে ছালেহীন কর্তৃক প্রণীত আক্বীদা বিষয়ক এমন কোন বই আপনি পাবেন না, যাতে সাহাবীগণের প্রতি মুসলিম আক্বীদার বিষদ বিবরণ নেই।
কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন উঠেঃ সাহাবীবর্গের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য, তা কেন দ্বীনের প্রতি আমাদের কর্তব্যের একটি অংশ হিসাবে বিবেচিত হল?
জবাবে বলব, সাহাবীগণ হলেন এই দ্বীনের ধারক এবং বাহক। তাঁরা কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি এই দ্বীনের বার্তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে শ্রবণের মহান গৌরর অর্জন করেছেন। তাঁরা সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। অতঃপর পূর্ণ আমানতদারিতার সহিত উক্ত হাদীসসমূহকে সংরক্ষণ করতঃ মুসলিম উম্মাহ্র উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদীসও কি এমন পাওয়া যাবে যে, তা সাহাবায়ে কেরাম ছাড়া অন্য কারো সূত্রে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে?!
যখন আপনি বুখারী, মুসলিম, সুনান [. যেসব হাদীস গ্রন্থ ফিক্বহী অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজানো হয়, সেগুলিকে ‘সুনান’ ( السنن ) বলে। এসব হাদীস গ্রন্থে মারফূ‘ হাদীস ব্যতীত মাক্বতু‘ বা মাওক্বূফ হাদীস থাকে না বললেই চলে। যেমনঃ সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ ইত্যাদি। –অনুবাদক।], মাসানীদ [. যেসক হাদীস গ্রন্থে প্রত্যেক সাহাবীর সহীহ, হাসান ও যঈফ হাদীসকে পৃথকভাবে সাজানো হয়, অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাদীস উল্লেখ করা হয় না, সেসব হাদীস গ্রন্থকে ‘মাসানীদ’ ( المسانيد )বলে। যেমনঃ মুসনাদে আহমাদ, মুসনাদে বায্যার ইত্যাদি।আবার কখনও যে গ্রন্থে বেশকিছু হাদীস একত্রিত করা হয়, তবে সেটার হাদীসগুলিকে সাহাবীর নামানুসারে না সাজিয়ে অধ্যায় বা অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজানো হয়, তাকেও মুসনাদ বলে। যেমনঃ মুসনাদে বাক্বী ইবনে মাখলাদ আল-আন্দালুসী। –অনুবাদক।], মাজামী‘ [. যেসব গ্রন্থে হাদীছের বিভিন্ন মূল গ্রন্থ থেকে হাদীস জমা করা হয় এবং একত্রিত হাদীসগুলিকে মূল গ্রন্থসমূহের বিন্যাশ অনুযায়ী সাজানো হয়, সেগুলিকে ‘মাজামী’ ( المجاميع ) বলে। যেমনঃ ছাগানী প্রণীত ‘আল-জাম্‘উ বায়নাছ্-ছহীহাইন’, সুয়ূত্বী প্রণীত ‘আল-জামে‘ আল-কাবীর’ ইত্যাদি। এসব হাদীস গ্রন্থের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, এগুলিতে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত একই বিষয়ের অনেকগুলি হাদীস একত্রে পাওয়া যায়। –অনুবাদক।], আজ্যা [. হাদীছের যেসব ছোট্ট গ্রন্থে লেখকগণ বেশকিছু হাদীস একত্রিত করেন এবং হাদীসগুলি সাধারণতঃ বিষয়বস্তু, বর্ণনাকারী অথবা মতন বা সনদের বৈশিষ্ট্যের দিক বিবেচনায় একই হয়, তাকে ‘আজ্যা হাদীছিইয়্যাহ’ ( الأجزاء الحديثية ) বলে। যেমনঃ ইমাম বুখারী প্রণীত ‘জুয্উ রফইল ইয়াদায়েন ফিছ্-ছালাহ’। –অনুবাদক।] বা হাদীছের অন্য কোন গ্রন্থ খুলবেন, তখন দেখবেন, গ্রন্থকার থেকে হাদীছের সনদ শুরু হয়ে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে। অতঃপর সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সেজন্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত প্রত্যেকটি হাদীছের সূত্রে কোন না কোন বিশিষ্ট সাহাবী অবশ্যই রয়েছেন।
সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রত্যেকেই ন্যায়পরায়ণ। স্বয়ং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন। সেজন্য দেখা গেছে, মুহাদ্দিছগণ হাদীস বর্ণনাকারীগণের ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। সনদের কোন্ বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত আর কে যঈফ, তা তাঁরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন। কিন্তু সনদের ধারাবাহিকতা যখন সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছত, তখন তাঁরা আর কোন বিশ্লেষণই করতেন না। কেননা তাঁরা নিশ্চিত জানতেন যে, সকল সাহাবী ন্যায়পরায়ণ এবং বিশ্বস্ত। সে কারণে আপনি যখন ‘রিজাল শাস্ত্র’ [. যে শাস্ত্র হাদীছের বর্ণনাকারীগণের অবস্থা বিশ্লেষণ করে, তাকে ‘রিজাল শাস্ত্র’ বলে। –অনুবাদক।]-এর গ্রন্থসমূহ পড়বেন, তখন সেখানে দেখবেন, গ্রন্থকারগণ তাবেঈন থেকে শুরু করে সকলের অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, অমুক বিশ্বস্ত, অমুক হাফেয, অমুক যঈফ, অমুক এমন...। কিন্তু সাহাবীগণ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কি ন্যায়পরায়ণ নাকি ন্যায়পরায়ণ নন, তাঁরা কি বিশ্বস্ত নাকি বিশ্বস্ত নন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা কোন আলোচনাই আনেন নি।
এর মূল কারণ হল, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সবাই ন্যায়পরায়ণ। মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এবং অসংখ্য হাদীছে তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
এর মূল কারণ হল, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সবাই ন্যায়পরায়ণ। মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এবং অসংখ্য হাদীছে তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
সাহাবীগণ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে এই দ্বীন শ্রবণ করেছেন এবং যেভাবে শুনেছেন, ঠিক সেভাবেই সংরক্ষণ করতঃ আমানতদারিতা ও বিশ্বস্ততার সহিত উম্মতের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৃত নিম্নোক্ত দো‘আটির পূর্ণ হিস্সা লাভে ধন্য হয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ»
‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির মুখোজ্জ্বল করুন, যে আমাদের কাছ থেকে হাদীস শুনল এবং তা সংরক্ষণ করতঃ মানুষের নিকট পৌঁছে দিল’। [. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৬২; তিরমিযী, হা/২৬৫৬; ইবনু মাজাহ, হা/২৩০। প্রখ্যাত সাহাবী যায়েদ ইব্ন ছাবেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হ’তে হাদীসটি বর্ণিত। হাদীসটি বিভিন্ন শব্দে কিন্তু একই অর্থে আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং শায়খ আলবানী সহীহ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ/৪০৪)।] সাহাবায়ে কেরাম যেমন এই দো‘আর পূর্ণ হিস্সা লাভে ধন্য হয়েছেন, উম্মতে মুহাম্মাদীর আর কেউ তেমনটি অর্জন করতে পেরেছেন বলে কি আপনাদের জানা আছে?
আমি আবারো বলছি, তাঁরা দ্বীন ইসলামের বাণী ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসসমূহ শ্রবণ করেছেন এবং পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণভাবে আমানতদারিতা, বিশ্বস্ততা ও যত্নসহকারে তা উম্মতের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁর সাথে সর্বদা থাকতেন, তাঁর বৈঠকসমূহে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে হাদীস শ্রবণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তেন। এভাবে তাঁরা হাদীস সংরক্ষণ করতঃ মুসলিম উম্মাহ্র নিকট তা পৌঁছে দিতেন।
সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৃত নিম্নোক্ত দো‘আটির পূর্ণ হিস্সা লাভে ধন্য হয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ»
‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির মুখোজ্জ্বল করুন, যে আমাদের কাছ থেকে হাদীস শুনল এবং তা সংরক্ষণ করতঃ মানুষের নিকট পৌঁছে দিল’। [. আবূ দাঊদ, হা/৩৬৬২; তিরমিযী, হা/২৬৫৬; ইবনু মাজাহ, হা/২৩০। প্রখ্যাত সাহাবী যায়েদ ইব্ন ছাবেত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হ’তে হাদীসটি বর্ণিত। হাদীসটি বিভিন্ন শব্দে কিন্তু একই অর্থে আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং শায়খ আলবানী সহীহ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ/৪০৪)।] সাহাবায়ে কেরাম যেমন এই দো‘আর পূর্ণ হিস্সা লাভে ধন্য হয়েছেন, উম্মতে মুহাম্মাদীর আর কেউ তেমনটি অর্জন করতে পেরেছেন বলে কি আপনাদের জানা আছে?
আমি আবারো বলছি, তাঁরা দ্বীন ইসলামের বাণী ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসসমূহ শ্রবণ করেছেন এবং পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণভাবে আমানতদারিতা, বিশ্বস্ততা ও যত্নসহকারে তা উম্মতের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁর সাথে সর্বদা থাকতেন, তাঁর বৈঠকসমূহে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে হাদীস শ্রবণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তেন। এভাবে তাঁরা হাদীস সংরক্ষণ করতঃ মুসলিম উম্মাহ্র নিকট তা পৌঁছে দিতেন।
দ্বীন ইসলামের ধারক-বাহক এমন সুমহান মর্যাদার অধিকারী সাহাবীগণ সম্পর্কে আলোচনা কি দ্বীন সম্পর্কে আলোচনার একটি অংশ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না? যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত প্রত্যেকটি হাদীছের সূত্রেই কোন না কোন সাহাবী রয়েছেন, সেহেতু তাঁদের সম্পর্কে আলোচনা দ্বীন সম্পর্কে আলোচনারই একটি অংশ।
পক্ষান্তরে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে নিন্দা করাই হল দ্বীনকে নিন্দা করা। কারণ আলেমগণ বলছেন, ‘কোন কিছুর বর্ণনাকারীকে নিন্দা করার অর্থই হচ্ছে বর্ণিত বিষয়কে নিন্দা করা’। অতএব, যাঁরা আমাদের নিকট দ্বীন পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁরা যদি হন নিন্দিত, ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রে সমালোচিত, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতার ক্ষেত্রে কলংকিত, তাহলে সেই দ্বীনের অবস্থা কি হতে পারে? নিশ্চয়ই সেই দ্বীনও হবে নিন্দিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ। সেজন্য ইমাম আবু যুর‘আহ আর-রাযী (রহঃ) বলেন,
إِذَا رَأَيْتَ الرَّجُلَ يَنْتَقِصُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم , فَاعْلَمُوْا أَنَّهُ زِنْدِيقٌ؛ وذَلِكَ أَنَّ الرَّسُولَ صلى الله عليه وسلم عِنْدَنَا حَقٌّ، وَالْقُرْآنَ حَقٌّ، وَإِنَّمَا أَدَّى إِلَيْنَا هَذَا الْقُرْآنَ وَالسُّنَنَ أَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، وَإِنَّمَا يُرِيدُونَ أَنْ يَجْرَحُوا شُهُوْدَنَا لِيُبْطِلُوْا الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ، وَالْجَرْحُ بِهِمْ أَوْلَى، وَهُمْ زَنَادِقَةٌ .
‘তোমরা কাউকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদার হানি করতে দেখলে জানবে যে, সে ‘যিনদ্বীক’ [. ‘যিনদীক্ব’ ফারসী শব্দ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর যুগে শব্দটি প্রসিদ্ধ ছিল না; আব্বাসীয় যুগে শব্দটির ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। ইবনু ক্বুদামাহ (রহঃ) একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে ইসলামের কথা বলে এবং গোপনে কুফরী জিইয়ে রাখে, সে-ই হচ্ছে ‘যিনদীক্ব’। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে এই শ্রেণীর লোককে ‘মুনাফিক্ব’ বলা হত, বর্তমান এদেরকে ‘যিনদীক্ব’ বলা হয়’ (আল-মুগনী, ৬/৩৭০)। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ্র প্রতি এবং আখেরাতে উত্থানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না এমন বস্তুবাদী নাস্তিককে ‘যিনদীক্ব’ বলে। আবার কেউ কেউ বলেন, যে কোন দ্বীনকে বিশ্বাস করে না, তাকে ‘যিনদীক্ব’ বলে। তবে, ফক্বীহগণ এমর্মে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, ‘যিনদীক্ব’ হচ্ছে কাফের এবং পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে মুনাফিক্বের যেসব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলিই ‘যিনদীক্ব’-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। –অনুবাদক।]। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট হক্ব, কুরআন আমাদের নিকট হক্ব। আর এই কুরআন এবং হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। মূলতঃ শত্রুরা কুরআন ও হাদীসকে বাতিল করার হীন উদ্দেশ্যেই আমাদের প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে আঘাত করতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বস্তুতঃ তারাই নিন্দার উপযুক্ত এবং তারাই হচ্ছে যিনদীক্ব’। [. খত্বীব বাগদাদী, ‘আল-কিফায়াহ ফী ইল্মির রিওয়া-ইয়াহ’/৪৯।]
সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) যদি বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ না হন, তাহলে যে দ্বীনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্র ইবাদত করি, সে দ্বীনের অস্তিত্ব কোথায় যাবে?!
একদল লোক পথভ্রষ্টতার অতল গভীরে নিমজ্জিত হয়ে হাতেগোণা কয়েকজন সাহাবী ব্যতীত সকল সাহাবীকে নিন্দা করে থাকে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, অবস্থা যদি তা-ই হয়, তাহলে দ্বীন কোথায়?! আল্লাহ্র দ্বীনকে কিভাবে জানতে হবে?! কিভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করা সম্ভব হবে?! কিভাবে আল্লাহ্র তরে নামায আদায় করতে হবে এবং সেজদা করতে হবে?! কিভাবে আল্লাহ্র ফরযসমূহ আদায় করতে হবে?! কিভাবে হজ্জ্ব করতে হবে?! কিভাবেই বা আল্লাহ্র আনুগত্য করতে হবে?!
সেজন্য আমাদের খুব ভালভাবে জানতে হবে, দ্বীনের ধারক-বাহক সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে নিন্দা করার অর্থই হল সরাসরি দ্বীনকে নিন্দা করা। আমাদের আরো জানতে হবে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য মূলতঃ দ্বীনের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যেরই একটি অংশ। কেননা তাঁরাই এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। সুতরাং তাঁদেরকে নিন্দা করা হলে দ্বীনও নিন্দিত হবে।
إِذَا رَأَيْتَ الرَّجُلَ يَنْتَقِصُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبيِّ صلى الله عليه وسلم , فَاعْلَمُوْا أَنَّهُ زِنْدِيقٌ؛ وذَلِكَ أَنَّ الرَّسُولَ صلى الله عليه وسلم عِنْدَنَا حَقٌّ، وَالْقُرْآنَ حَقٌّ، وَإِنَّمَا أَدَّى إِلَيْنَا هَذَا الْقُرْآنَ وَالسُّنَنَ أَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، وَإِنَّمَا يُرِيدُونَ أَنْ يَجْرَحُوا شُهُوْدَنَا لِيُبْطِلُوْا الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ، وَالْجَرْحُ بِهِمْ أَوْلَى، وَهُمْ زَنَادِقَةٌ .
‘তোমরা কাউকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদার হানি করতে দেখলে জানবে যে, সে ‘যিনদ্বীক’ [. ‘যিনদীক্ব’ ফারসী শব্দ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর যুগে শব্দটি প্রসিদ্ধ ছিল না; আব্বাসীয় যুগে শব্দটির ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। ইবনু ক্বুদামাহ (রহঃ) একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে ইসলামের কথা বলে এবং গোপনে কুফরী জিইয়ে রাখে, সে-ই হচ্ছে ‘যিনদীক্ব’। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে এই শ্রেণীর লোককে ‘মুনাফিক্ব’ বলা হত, বর্তমান এদেরকে ‘যিনদীক্ব’ বলা হয়’ (আল-মুগনী, ৬/৩৭০)। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহ্র প্রতি এবং আখেরাতে উত্থানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না এমন বস্তুবাদী নাস্তিককে ‘যিনদীক্ব’ বলে। আবার কেউ কেউ বলেন, যে কোন দ্বীনকে বিশ্বাস করে না, তাকে ‘যিনদীক্ব’ বলে। তবে, ফক্বীহগণ এমর্মে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, ‘যিনদীক্ব’ হচ্ছে কাফের এবং পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে মুনাফিক্বের যেসব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলিই ‘যিনদীক্ব’-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। –অনুবাদক।]। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট হক্ব, কুরআন আমাদের নিকট হক্ব। আর এই কুরআন এবং হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। মূলতঃ শত্রুরা কুরআন ও হাদীসকে বাতিল করার হীন উদ্দেশ্যেই আমাদের প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে আঘাত করতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বস্তুতঃ তারাই নিন্দার উপযুক্ত এবং তারাই হচ্ছে যিনদীক্ব’। [. খত্বীব বাগদাদী, ‘আল-কিফায়াহ ফী ইল্মির রিওয়া-ইয়াহ’/৪৯।]
সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) যদি বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ না হন, তাহলে যে দ্বীনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্র ইবাদত করি, সে দ্বীনের অস্তিত্ব কোথায় যাবে?!
একদল লোক পথভ্রষ্টতার অতল গভীরে নিমজ্জিত হয়ে হাতেগোণা কয়েকজন সাহাবী ব্যতীত সকল সাহাবীকে নিন্দা করে থাকে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করি, অবস্থা যদি তা-ই হয়, তাহলে দ্বীন কোথায়?! আল্লাহ্র দ্বীনকে কিভাবে জানতে হবে?! কিভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করা সম্ভব হবে?! কিভাবে আল্লাহ্র তরে নামায আদায় করতে হবে এবং সেজদা করতে হবে?! কিভাবে আল্লাহ্র ফরযসমূহ আদায় করতে হবে?! কিভাবে হজ্জ্ব করতে হবে?! কিভাবেই বা আল্লাহ্র আনুগত্য করতে হবে?!
সেজন্য আমাদের খুব ভালভাবে জানতে হবে, দ্বীনের ধারক-বাহক সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে নিন্দা করার অর্থই হল সরাসরি দ্বীনকে নিন্দা করা। আমাদের আরো জানতে হবে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য মূলতঃ দ্বীনের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যেরই একটি অংশ। কেননা তাঁরাই এই দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। সুতরাং তাঁদেরকে নিন্দা করা হলে দ্বীনও নিন্দিত হবে।
যাঁদেরকে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে ন্যায়পরায়ণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন; বরং স্বয়ং আল্লাহ যাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, সেসকল সাহাবীকে কিভাবে নিন্দা করা যেতে পারে! মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ﴾ [ التوبة : ١٠٠ ]
‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে অগ্রবর্তী সাহাবীগণ এবং কল্যাণকর্মের মাধ্যমে তাঁদের অনুসারীগণের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন’ (আত-তাওবাহ ১০০)।
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তা‘আলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, তিনি তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট। দ্বীনের ধারক-বাহক হিসাবে বিশ্বস্ত নন এমন কারো প্রতি আল্লাহ কি কখনও সন্তুষ্ট হতে পারেন?! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অমিয় বাণী প্রচারে খেয়ানতকারী কারো প্রতি কি তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন?! অসম্ভব! এমনটি কখনই হতে পারে না। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ তাঁরা বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ, তাঁরা সর্বোত্তম আদর্শ এবং আল্লাহ্র দ্বীনের একনিষ্ঠ প্রচারক। আল্লাহ বলেন,
﴿رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ ﴾ [ البينة : ٨ ]
‘আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরাও আল্লাহ্র প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন’।
তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿لَّقَدۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ﴾ [ الفتح : ١٨ ]
‘আল্লাহ মুমিনগণের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তাঁরা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করেছেন’ (আল-ফাত্হ ১৮)।
বায়‘আতকারী এসকল সাহাবীর সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশী এবং তাঁদের সকলের প্রতিই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ সম্পর্কে বলেন,
«وَمَا يُدْرِيكَ؟ لَعَلَّ اللَّهَ أَنْ يَكُونَ قَدْ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ»
‘[হে ওমর!] তুমি কিভাবে জানলে [যে, হাত্বেব মুনাফিক্ব হয়ে গেছে]? [মনে রেখ], আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ সম্পর্কে জানেন। সেজন্যই তিনি বলেছেন, তোমরা যা ইচ্ছা, তাই কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’। [. সহীহ বুখারী, হা/৩০০৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৪৯৪। হাদীসটি আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন।] এগুলি পবিত্র কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত তাঁদের প্রশংসার কয়েকটি নমুনা মাত্র। সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসায় বর্ণিত আয়াত ও হাদীস হিসাব করাই কষ্টকর। সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর গুণ-গান শুধুমাত্র পবিত্র কুরআনেই আসে নি; বরং তাঁদের সৃষ্টির আগেই তাওরাত ও ইঞ্জীলে তাঁদের প্রশংসার কথা বিঘোষিত হয়েছে। সূরা আল-ফাত্হের শেষ আয়াতে মহান আল্লাহ সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে বলেন,
﴿مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ﴾ [ الفتح : ٢٩ ]
‘মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন’ (আয়াত ২৯)। তাহলে দেখা গেল, স্বয়ং প্রতিপালক সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা করলেন। কিন্তু তাঁদের এই প্রশংসা বাণী কোথায় এবং কোন্ কিতাবে ঘোষিত হয়েছে? আল্লাহ বলেন,
﴿ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطَۡٔهُۥ فََٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا ٢٩ ﴾ [ الفتح : ٢٩ ]
‘তাওরাতে তাঁদের উদাহরণ এরূপ। আর ইঞ্জিলে তাঁদের উদাহরণ হচ্ছে একটি শস্যবীজের মত, যা থেকে উদ্গত হয় অঙ্কুর, অতঃপর তা শক্ত ও মজবূত হয় এবং কাণ্ডের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়; ইহা চাষীদেরকে আনন্দে অভিভূত করে কিন্তু আল্লাহ তাঁদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাঁদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাঁদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন’ (আল-ফাত্হ ২৯)।
সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রতি সুবাসিত এই প্রশংসা ও গুণগান উল্লেখিত হয়েছে তাওরাত ও ইঞ্জীলে।
প্রিয় মুসলিম ভাই! উক্ত আয়াতে কারীমা আপনাকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, মহামহিম প্রতিপালক তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি তাঁদের প্রশংসা করেছেন তাঁদের সৃষ্টির পূর্বে মূসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত অবতীর্ণের সময় এবং ঈসা (আঃ)-এর উপর ইঞ্জীল অবতীর্ণের সময়। অতঃপর তাঁদের জীবদ্দশায় তিনি আবার তাঁদের প্রশংসা করলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে।
মহান আল্লাহ কর্তৃক সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা সম্বলিত সূরা আল-হাশরের আরো কিছু আয়াত আমরা তেলাওয়াত করব। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لِلۡفُقَرَآءِ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأَمۡوَٰلِهِمۡ يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ٨ ﴾ [ الحشر : ٨ ]
‘এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্য, যাঁরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। বস্তুতঃ তাঁরাই সত্যবাদী’ (আল-হাশর ৮)।
এখানে আল্লাহ তাঁদেরকে সত্যবাদী হিসাবে বিশেষিত করলেন। তিনি বললেন, ﴿أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ﴾ ‘তাঁরাই হচ্ছেন সত্যবাদী’।
অতঃপর মহান আল্লাহ আনছার সাহাবীগণ সম্পর্কে বললেন,
﴿وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٩﴾ [ الحشر : ٩ ]
‘যাঁরা মুহাজিরগণের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসতি গড়ে তুলেছিলেন এবং ধর্মবিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁরা মুহাজিরগণকে ভালবাসেন। আর মুহাজিরগণকে যা দেয়া হয়েছে, সে কারণে তাঁরা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করেন না; বরং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার প্রদান করেন। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম (আল-হাশর ৯)।
উক্ত আয়াতদ্বয়ে মুহাজির ও আনছার সাহাবীগণের প্রশংসা করা হল। আর একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, সকল সাহাবী এই দুই প্রকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মুজাজিরগণ হলেন মক্কার অধিবাসী সাহাবীবর্গ, যাঁরা তাঁদের ধন-সম্পদ এবং ভিটে-বাড়ী ত্যাগ করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। আল্লাহ বলেন,
﴿يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ﴾ [ الحشر : 8]
‘তাঁরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে’ (আল-হাশর ৮)। তাঁরা জীবনের সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে শুধুমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সহযোগিতা করার জন্য মদীনায় আগমন করেন। তাই তো আল্লাহ তাঁদের সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁরাই হচ্ছেন সত্যবাদী’। অর্থাৎ ঈমান, সাহচর্য, আনুগত্য এবং আল্লাহ্র দ্বীনের অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরা সত্যবাদী। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ رِجَالٞ صَدَقُواْ مَا عَٰهَدُواْ ٱللَّهَ عَلَيۡهِۖ فَمِنۡهُم مَّن قَضَىٰ نَحۡبَهُۥ وَمِنۡهُم مَّن يَنتَظِرُۖ وَمَا بَدَّلُواْ تَبۡدِيلٗا ٢٣﴾ [ الاحزاب : ٢٣ ]
‘মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহ্র সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি’ (আল-আহযাব ২৩)। তাঁরাই হলেন সাহাবী, প্রতিপালক যাঁদের এমন সুবাসিত প্রশংসা করলেন।
তিনি মুহাজিরগণের যেমন প্রশংসা করলেন, তেমনি প্রশংসা করলেন আনছার সাহাবীগণেরও। তিনি বললেন, ﴿وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ﴾ ‘যাঁরা মদীনায় বসতি গড়ে তুলেছিলেন’। এখানে الدَّارَ অর্থঃ মদীনা। সুতরাং আনছার সাহাবীগণ মুহাজির সাহাবীগণের আগমনের পূর্বেই মদীনাকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, মুহাজিরগণের খেদমতে আনছার সাহাবীগণ কি এমন করেছিলেন? জবাবে বলব, আনছার সাহাবীগণ নিজেদের সম্পদে মুহাজিরগণকে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আনছার সাহাবী মুহাজির সাহাবীকে তাঁর বাড়ী ও সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের উপরে অন্য মুসলিম ভাইকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই মহৎ গুণের কারণে মহান আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করে বলেন, ﴿وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ﴾ ‘তাঁরা নিজেরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদেরকে (মুহাজিরগণ) নিজেদের উপর প্রাধান্য দেন’। আনছার এবং মুহাজিরগণ আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্যার্থে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা করেছিলেন। তাই তো তাঁরা সবাই আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্যকারী। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا بَدَّلُواْ تَبۡدِيلٗا ٢٣﴾
‘তাঁরা তাঁদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেন নি’।
﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ﴾ [ التوبة : ١٠٠ ]
‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে অগ্রবর্তী সাহাবীগণ এবং কল্যাণকর্মের মাধ্যমে তাঁদের অনুসারীগণের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন’ (আত-তাওবাহ ১০০)।
উক্ত আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তা‘আলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন, তিনি তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট। দ্বীনের ধারক-বাহক হিসাবে বিশ্বস্ত নন এমন কারো প্রতি আল্লাহ কি কখনও সন্তুষ্ট হতে পারেন?! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অমিয় বাণী প্রচারে খেয়ানতকারী কারো প্রতি কি তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন?! অসম্ভব! এমনটি কখনই হতে পারে না। আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ তাঁরা বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ, তাঁরা সর্বোত্তম আদর্শ এবং আল্লাহ্র দ্বীনের একনিষ্ঠ প্রচারক। আল্লাহ বলেন,
﴿رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُۚ ﴾ [ البينة : ٨ ]
‘আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরাও আল্লাহ্র প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন’।
তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿لَّقَدۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ﴾ [ الفتح : ١٨ ]
‘আল্লাহ মুমিনগণের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তাঁরা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করেছেন’ (আল-ফাত্হ ১৮)।
বায়‘আতকারী এসকল সাহাবীর সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশী এবং তাঁদের সকলের প্রতিই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ সম্পর্কে বলেন,
«وَمَا يُدْرِيكَ؟ لَعَلَّ اللَّهَ أَنْ يَكُونَ قَدْ اطَّلَعَ عَلَى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ»
‘[হে ওমর!] তুমি কিভাবে জানলে [যে, হাত্বেব মুনাফিক্ব হয়ে গেছে]? [মনে রেখ], আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ সম্পর্কে জানেন। সেজন্যই তিনি বলেছেন, তোমরা যা ইচ্ছা, তাই কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি’। [. সহীহ বুখারী, হা/৩০০৭; সহীহ মুসলিম, হা/২৪৯৪। হাদীসটি আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন।] এগুলি পবিত্র কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত তাঁদের প্রশংসার কয়েকটি নমুনা মাত্র। সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসায় বর্ণিত আয়াত ও হাদীস হিসাব করাই কষ্টকর। সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর গুণ-গান শুধুমাত্র পবিত্র কুরআনেই আসে নি; বরং তাঁদের সৃষ্টির আগেই তাওরাত ও ইঞ্জীলে তাঁদের প্রশংসার কথা বিঘোষিত হয়েছে। সূরা আল-ফাত্হের শেষ আয়াতে মহান আল্লাহ সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে বলেন,
﴿مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ﴾ [ الفتح : ٢٩ ]
‘মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন’ (আয়াত ২৯)। তাহলে দেখা গেল, স্বয়ং প্রতিপালক সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা করলেন। কিন্তু তাঁদের এই প্রশংসা বাণী কোথায় এবং কোন্ কিতাবে ঘোষিত হয়েছে? আল্লাহ বলেন,
﴿ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطَۡٔهُۥ فََٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا ٢٩ ﴾ [ الفتح : ٢٩ ]
‘তাওরাতে তাঁদের উদাহরণ এরূপ। আর ইঞ্জিলে তাঁদের উদাহরণ হচ্ছে একটি শস্যবীজের মত, যা থেকে উদ্গত হয় অঙ্কুর, অতঃপর তা শক্ত ও মজবূত হয় এবং কাণ্ডের উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়; ইহা চাষীদেরকে আনন্দে অভিভূত করে কিন্তু আল্লাহ তাঁদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাঁদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাঁদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন’ (আল-ফাত্হ ২৯)।
সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রতি সুবাসিত এই প্রশংসা ও গুণগান উল্লেখিত হয়েছে তাওরাত ও ইঞ্জীলে।
প্রিয় মুসলিম ভাই! উক্ত আয়াতে কারীমা আপনাকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, মহামহিম প্রতিপালক তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদেরকে ন্যায়পরায়ণ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি তাঁদের প্রশংসা করেছেন তাঁদের সৃষ্টির পূর্বে মূসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত অবতীর্ণের সময় এবং ঈসা (আঃ)-এর উপর ইঞ্জীল অবতীর্ণের সময়। অতঃপর তাঁদের জীবদ্দশায় তিনি আবার তাঁদের প্রশংসা করলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে।
মহান আল্লাহ কর্তৃক সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা সম্বলিত সূরা আল-হাশরের আরো কিছু আয়াত আমরা তেলাওয়াত করব। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿لِلۡفُقَرَآءِ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأَمۡوَٰلِهِمۡ يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ٨ ﴾ [ الحشر : ٨ ]
‘এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্য, যাঁরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। বস্তুতঃ তাঁরাই সত্যবাদী’ (আল-হাশর ৮)।
এখানে আল্লাহ তাঁদেরকে সত্যবাদী হিসাবে বিশেষিত করলেন। তিনি বললেন, ﴿أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ﴾ ‘তাঁরাই হচ্ছেন সত্যবাদী’।
অতঃপর মহান আল্লাহ আনছার সাহাবীগণ সম্পর্কে বললেন,
﴿وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٩﴾ [ الحشر : ٩ ]
‘যাঁরা মুহাজিরগণের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসতি গড়ে তুলেছিলেন এবং ধর্মবিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁরা মুহাজিরগণকে ভালবাসেন। আর মুহাজিরগণকে যা দেয়া হয়েছে, সে কারণে তাঁরা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করেন না; বরং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার প্রদান করেন। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম (আল-হাশর ৯)।
উক্ত আয়াতদ্বয়ে মুহাজির ও আনছার সাহাবীগণের প্রশংসা করা হল। আর একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, সকল সাহাবী এই দুই প্রকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মুজাজিরগণ হলেন মক্কার অধিবাসী সাহাবীবর্গ, যাঁরা তাঁদের ধন-সম্পদ এবং ভিটে-বাড়ী ত্যাগ করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। আল্লাহ বলেন,
﴿يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ﴾ [ الحشر : 8]
‘তাঁরা আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে’ (আল-হাশর ৮)। তাঁরা জীবনের সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে শুধুমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সহযোগিতা করার জন্য মদীনায় আগমন করেন। তাই তো আল্লাহ তাঁদের সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁরাই হচ্ছেন সত্যবাদী’। অর্থাৎ ঈমান, সাহচর্য, আনুগত্য এবং আল্লাহ্র দ্বীনের অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরা সত্যবাদী। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ رِجَالٞ صَدَقُواْ مَا عَٰهَدُواْ ٱللَّهَ عَلَيۡهِۖ فَمِنۡهُم مَّن قَضَىٰ نَحۡبَهُۥ وَمِنۡهُم مَّن يَنتَظِرُۖ وَمَا بَدَّلُواْ تَبۡدِيلٗا ٢٣﴾ [ الاحزاب : ٢٣ ]
‘মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহ্র সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি’ (আল-আহযাব ২৩)। তাঁরাই হলেন সাহাবী, প্রতিপালক যাঁদের এমন সুবাসিত প্রশংসা করলেন।
তিনি মুহাজিরগণের যেমন প্রশংসা করলেন, তেমনি প্রশংসা করলেন আনছার সাহাবীগণেরও। তিনি বললেন, ﴿وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ﴾ ‘যাঁরা মদীনায় বসতি গড়ে তুলেছিলেন’। এখানে الدَّارَ অর্থঃ মদীনা। সুতরাং আনছার সাহাবীগণ মুহাজির সাহাবীগণের আগমনের পূর্বেই মদীনাকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, মুহাজিরগণের খেদমতে আনছার সাহাবীগণ কি এমন করেছিলেন? জবাবে বলব, আনছার সাহাবীগণ নিজেদের সম্পদে মুহাজিরগণকে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আনছার সাহাবী মুহাজির সাহাবীকে তাঁর বাড়ী ও সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের উপরে অন্য মুসলিম ভাইকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই মহৎ গুণের কারণে মহান আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করে বলেন, ﴿وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ﴾ ‘তাঁরা নিজেরা অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদেরকে (মুহাজিরগণ) নিজেদের উপর প্রাধান্য দেন’। আনছার এবং মুহাজিরগণ আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্যার্থে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা করেছিলেন। তাই তো তাঁরা সবাই আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্যকারী। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا بَدَّلُواْ تَبۡدِيلٗا ٢٣﴾
‘তাঁরা তাঁদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেন নি’।
এই যাঁদের অবদান, তাঁদের প্রতি তাঁদের উত্তরসূরীদের কি কর্তব্য হতে পারে?
আমাদেরকে এর জবাব অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। মুহাজির এবং আনছার সাহাবীগণের ক্ষেত্রে একজন মুমিনের ভূমিকা কি হবে, তা আল্লাহ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [ الحشر : ١٠ ]
‘আর এই সম্পদ তাদের জন্য, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ আপনি রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়’ (আল-হাশর ১০)।
এখানে ‘তাদের পরে যারা এসেছে’ বলতে আনছার ও মুহাজিরগণের পরে যারা এসেছে, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।
সাহাবীগণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি মুমিনের যে ভূমিকা হওয়া উচিৎ, তা উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
এই দায়িত্ব ও কর্তব্য নিম্নোক্ত দু’টি পয়েন্টে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রিয় পাঠক! পয়েন্ট দু’টির প্রতি ভালভাবে খেয়াল করবেন, আল্লাহ আপনাকে এতদুভয়ের বিনিময়ে উপকৃত করবেন।
প্রথমতঃ সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে আমাদের অন্তঃকরণকে নিষ্কলুষ রাখতে হবে। তাঁদের প্রতি হৃদয়ে কোন হিংসা-বিদ্বেষ বা ঘৃণা থাকবে না; থাকবে না কোন প্রকার শত্রুতা। বরং হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পাবে শুধু ভালবাসা, অনুগ্রহ আর সহানুভূতি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপনি ঈমানদারগণের প্রতি আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না’। অর্থাৎ আমাদের পূর্বে যাঁরা ঈমানের সহিত গত হয়ে গেছেন, আপনি তাঁদের ব্যাপারে আমাদের হৃদয়সমূহকে নিষ্কলুষ করে দিন। তাঁরা আমাদের ভাই শুধু নয়; বরং তাঁরা আমাদের সর্বোত্তম ভাই। সেজন্য মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর এই সম্পদ তাদের জন্য, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন’। অতএব, তাঁরা আমাদের ভাই। তাঁদের আরেকটি মহৎ বৈশিষ্ট্য হল, ‘তাঁরা ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী’। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে অগ্রবর্তী সাহাবীগণ’ (আত-তাওবাহ ১০০)। এই বিশেষ মর্যাদায় আল্লাহ তাঁদেরকে মর্যাদাবান করেছেন।
আমরা হিজরী সাল অনুযায়ী বর্তমান চতুর্দশ শতাব্দীতে অবস্থান করছি। তাঁদের মাঝে এবং আমাদের মাঝে অনেকগুলি শতাব্দী গত হয়ে গেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই তাঁরা তাঁর সাথে ছিলেন। সর্বদা তাঁরা তাঁকে সঙ্গ দিতেন এবং তাঁকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তাহলে, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে আমাদের কি কোন তুলনা চলে?!
তাঁরা ঈমান আনয়ন, দ্বীনের সহযোগিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদেরকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহচর্য লাভের সুযোগ দিয়ে আল্লাহ্ তাঁদেরকে যে সম্মানিত করেছেন, সেক্ষেত্রেও তাঁরা আমাদেরকে ছাড়িয়ে গেছেন।
অতএব, আপনি তাঁদের জন্য দো‘আ করার সময় তাঁদের অগ্রবর্তিতার কথা স্মরণ করবেন। আয়াতে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন’।
এই অগ্রবর্তিতার কারণে আপনার প্রতি তাঁদের অধিকার রয়েছে। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা উপলব্ধির উদ্দেশ্যে আপনি তাঁদের অগ্রবর্তিতার কথা স্মরণ করুন। কারণ এই অগ্রবর্তিতার কারণে আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘যাঁরা ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী হয়েছেন’।
যাহোক, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে হৃদয়কে নিষ্কলুষ রাখার অপরিহার্যতা হল প্রথম পয়েন্ট। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি ঈমানদারগণের প্রতি আমাদের হৃদয়ে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না’।
দ্বিতীয়তঃ তাঁদের ক্ষেত্রে জিহ্বাকে মুক্ত রাখতে হবে। গালি-গালাজ, অশ্লীল কথা-বার্তা, অভিশাপ, নিন্দা ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। পক্ষান্তরে তাঁদের জন্য শুধু প্রাণখোলা দো‘আ করতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাঁরা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন’। মুমিনগণ কি তাঁদেরকে গালি দিবে?! তাঁদেরকে ভর্ৎসনা করবে?! তাঁরা কি তাঁদেরকে নিন্দা করবে?! তাঁদের মান-সম্মানে আঘাত করবে?! কখনই না, আদৌ এমনটি কোন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না; বরং পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের বৈশিষ্ট্য হবে নিম্নরূপঃ ‘আর এই সম্পদ তাদের জন্য, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ আপনি রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়’ (আল-হাশর ১০)।
সেজন্য সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে ঈমানদারগণের ভূমিকা আমি আবারও পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইঃ
১. হৃদয়কে কলুষমুক্ত করতে হবে।
২. জিহ্বাকে গালি-গালাজ, নিন্দা ইত্যাদি থেকে মুক্ত করতে হবে। সত্যিই সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন হৃদয় এবং মার্জিত যবান।
আমাদেরকে এর জবাব অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। মুহাজির এবং আনছার সাহাবীগণের ক্ষেত্রে একজন মুমিনের ভূমিকা কি হবে, তা আল্লাহ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [ الحشر : ١٠ ]
‘আর এই সম্পদ তাদের জন্য, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ আপনি রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়’ (আল-হাশর ১০)।
এখানে ‘তাদের পরে যারা এসেছে’ বলতে আনছার ও মুহাজিরগণের পরে যারা এসেছে, তাদেরকে বুঝানো হয়েছে।
সাহাবীগণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি মুমিনের যে ভূমিকা হওয়া উচিৎ, তা উক্ত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
এই দায়িত্ব ও কর্তব্য নিম্নোক্ত দু’টি পয়েন্টে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রিয় পাঠক! পয়েন্ট দু’টির প্রতি ভালভাবে খেয়াল করবেন, আল্লাহ আপনাকে এতদুভয়ের বিনিময়ে উপকৃত করবেন।
প্রথমতঃ সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে আমাদের অন্তঃকরণকে নিষ্কলুষ রাখতে হবে। তাঁদের প্রতি হৃদয়ে কোন হিংসা-বিদ্বেষ বা ঘৃণা থাকবে না; থাকবে না কোন প্রকার শত্রুতা। বরং হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পাবে শুধু ভালবাসা, অনুগ্রহ আর সহানুভূতি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপনি ঈমানদারগণের প্রতি আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না’। অর্থাৎ আমাদের পূর্বে যাঁরা ঈমানের সহিত গত হয়ে গেছেন, আপনি তাঁদের ব্যাপারে আমাদের হৃদয়সমূহকে নিষ্কলুষ করে দিন। তাঁরা আমাদের ভাই শুধু নয়; বরং তাঁরা আমাদের সর্বোত্তম ভাই। সেজন্য মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর এই সম্পদ তাদের জন্য, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন’। অতএব, তাঁরা আমাদের ভাই। তাঁদের আরেকটি মহৎ বৈশিষ্ট্য হল, ‘তাঁরা ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী’। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে অগ্রবর্তী সাহাবীগণ’ (আত-তাওবাহ ১০০)। এই বিশেষ মর্যাদায় আল্লাহ তাঁদেরকে মর্যাদাবান করেছেন।
আমরা হিজরী সাল অনুযায়ী বর্তমান চতুর্দশ শতাব্দীতে অবস্থান করছি। তাঁদের মাঝে এবং আমাদের মাঝে অনেকগুলি শতাব্দী গত হয়ে গেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুঅত প্রাপ্তির পর থেকেই তাঁরা তাঁর সাথে ছিলেন। সর্বদা তাঁরা তাঁকে সঙ্গ দিতেন এবং তাঁকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তাহলে, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে তাঁদের সাথে আমাদের কি কোন তুলনা চলে?!
তাঁরা ঈমান আনয়ন, দ্বীনের সহযোগিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদেরকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহচর্য লাভের সুযোগ দিয়ে আল্লাহ্ তাঁদেরকে যে সম্মানিত করেছেন, সেক্ষেত্রেও তাঁরা আমাদেরকে ছাড়িয়ে গেছেন।
অতএব, আপনি তাঁদের জন্য দো‘আ করার সময় তাঁদের অগ্রবর্তিতার কথা স্মরণ করবেন। আয়াতে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন’।
এই অগ্রবর্তিতার কারণে আপনার প্রতি তাঁদের অধিকার রয়েছে। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা উপলব্ধির উদ্দেশ্যে আপনি তাঁদের অগ্রবর্তিতার কথা স্মরণ করুন। কারণ এই অগ্রবর্তিতার কারণে আল্লাহ তাঁদের প্রশংসা করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘যাঁরা ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী হয়েছেন’।
যাহোক, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে হৃদয়কে নিষ্কলুষ রাখার অপরিহার্যতা হল প্রথম পয়েন্ট। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি ঈমানদারগণের প্রতি আমাদের হৃদয়ে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না’।
দ্বিতীয়তঃ তাঁদের ক্ষেত্রে জিহ্বাকে মুক্ত রাখতে হবে। গালি-গালাজ, অশ্লীল কথা-বার্তা, অভিশাপ, নিন্দা ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। পক্ষান্তরে তাঁদের জন্য শুধু প্রাণখোলা দো‘আ করতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাঁরা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন’। মুমিনগণ কি তাঁদেরকে গালি দিবে?! তাঁদেরকে ভর্ৎসনা করবে?! তাঁরা কি তাঁদেরকে নিন্দা করবে?! তাঁদের মান-সম্মানে আঘাত করবে?! কখনই না, আদৌ এমনটি কোন মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না; বরং পবিত্র কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের বৈশিষ্ট্য হবে নিম্নরূপঃ ‘আর এই সম্পদ তাদের জন্য, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ আপনি রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়’ (আল-হাশর ১০)।
সেজন্য সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে ঈমানদারগণের ভূমিকা আমি আবারও পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইঃ
১. হৃদয়কে কলুষমুক্ত করতে হবে।
২. জিহ্বাকে গালি-গালাজ, নিন্দা ইত্যাদি থেকে মুক্ত করতে হবে। সত্যিই সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন হৃদয় এবং মার্জিত যবান।
বুখারী ও মুসলিমের একটি হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালমন্দ করা থেকে তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন এবং একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্যে সাহাবীগণের মর্যাদার কথা তুলে ধরেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ»
‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিওনা। যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই মহান সত্ত্বার কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করে, তথাপিও সে তাঁদের কোন একজনের পূর্ণ এক মুদ্দ [. ‘মুদ্দ’ হল এক ‘ছা’-এর চার ভাগের এক ভাগ । অর্থাৎ চার মুদ্দে হয় এক ‘ছা’। গ্রামের হিসাবে প্রায় ৬২৫ গ্রাম। -অনুবাদক।] বা অর্ধ মুদ্দ দান সমপরিমাণ পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না’। [. ইমাম বুখারী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন (সহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৩); ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে (সহীহ মুসলিম, হা/২৫৪০)।]
কোন একজন সাহাবী যদি একজন মিসকীনকে এক মুদ্দ পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য দান করে আর আপনি এক উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করেন, তথাপিও আপনি ঐ সাহাবীর এক মুদ্দ পরিমাণ দানের ধারে কাছেও যেতে পারবেন না। যদিও এটি সম্ভব নয় যে, আমাদের কারো উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ হবে এবং সে তা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করবে। এত বেশী পরিমাণ সম্পদ যদি কারো হয়ও, তবুও হয়তো এই সম্পদ তার জন্য ফেৎনার কারণ হবে এবং সে কৃপণ হয়ে যাবে। ধরা যাক, আমাদের কারো উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ হল এবং সে তা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করল, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে একজন সাহাবীর এক মুদ্দ খাদ্য দ্রব্য দানের নেকী পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে, সাহাবীগণের সম্মান ও মর্যাদা কত বেশী।
‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিওনা’- এ নির্দেশ স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর; ইহা সাধারণ কোন মানুষ বা আলেমের উক্তি নয়। এখানে তিনি তাঁর উম্মতকে নছীহত করেছেন এবং কোন সাহাবীর সামান্যতম মানহানিকর কোন কার্যক্রম থেকে তাদেরকে সতর্ক করেছেন। সাথে সাথে তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কেও উম্মতকে সজাগ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমর্মে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলিতে তিনি তাঁর উম্মতের উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সম্মান ও মর্যাদা তুলে ধরেছেন। এমনকি কতিপয় আলেম সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদা বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন; কিন্তু এককভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা সম্বলিত হাদীস অনেক বেশী হওয়ার কারণে এক খণ্ডে তা সমাপ্ত করতে সক্ষম হন নি। বরং কয়েক খণ্ডে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন পড়েছে।
লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ! কি মহা তাঁদের সম্মান! কি উঁচু তাঁদের মর্যাদা! তাঁদের প্রতি একজন মুসলিমের কর্তব্যই না কত বড়!
মহান আল্লাহ ঈমানদারগণকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ করেছেন এবং সত্যিকার মুমিনগণ তার বাস্তবায়নও করেছেন। কিন্তু কতিপয় লোক কুরআন ও হাদীস নির্দেশিত এই পথ প্রত্যাখ্যান করে চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে তারা তাঁদেরকে দিয়েছে গালি এবং প্রশংসার পরিবর্তে করেছে নিন্দা। সহীহ মুসলিমে এসেছে, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) উরওয়া ইব্ন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বলেন, يَا ابْنَ أُخْتِيْ أُمِرُوْا أَنْ يَسْتَغْفِرُوْا لأَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَسَبُّوْهُمْ . ‘হে ভাগ্নে! ওদেরকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা দিয়েছে গালি’। [. সহীহ মুসলিম, হা/৩০২২।]
তবে এর পেছনে আল্লাহ্র বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ইবনুল আছীর (রহঃ) তাঁর প্রণীত ‘জামেউল উছূল’ ( جامع الأصول ) [. হা/৬৩৬৬, কিন্তু কোন্ মুহাদ্দিছ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তা ইবনুল আছীর উল্লেখ করেন নি। তবে ইবনু আসাকের তাঁর জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারীখু দিমাশ্ক্ব (৪৪/৩৮৭)’-এ হাদীসটি সনদসহ উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে খত্বীব বাগদাদী তাঁর ‘তারীখু বাগদাদ (৫/১৪৭)’-এ হাদীসটি নিয়ে এসেছেন।] গ্রন্থে উল্লেখ করেন, জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণনা করেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘কিছু মানুষ সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম), এমনকি আবু বকর ও ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এরও নিন্দা-সমালোচনা করে থাকে, (তাদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি)? তিনি বলেছিলেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের নেক আমল বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন, তাঁদের নেকীর পথ যেন বন্ধ না হয়ে যায়’।
এটা কিভাবে সম্ভব? হাদীস থেকে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি, যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে কারো নিন্দা-সমালোচনা করবে, ক্বিয়ামত দিবসে ঐ নিন্দাকারীর নেকী বিনা অপরাধে নিন্দিত ব্যক্তিটিকে দেওয়া হবে। হাদীছে এসেছে, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে বললেন,
«أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟ قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ . فَقَالَ : إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ .»
‘তোমরা কি জান, দরিদ্র কে?’ তাঁরা বললেন, যার অর্থকড়ি নেই, সেই তো আমাদের মধ্যে দরিদ্র। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তবে আমার উম্মতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি দরিদ্র, যে ক্বিয়ামত দিবসে নামায, রোযা, যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে; কিন্তু সাথে এমন কিছু মানুষকে নিয়ে আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছিল, কাউকে যেনার অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল, আবার কাউকে প্রহার করেছিল। অতঃপর তাদেরকে তার নেকী থেকে দেওয়া হবে। কিন্তু তার উপর চাপানো দেনাপাওনা শেষ হওয়ার আগেই যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহলে ঐ লোকগুলির পাপ নিয়ে তার আমলনামায় দেওয়া হবে। অবশেষে এক পর্যায়ে তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে’। [. ইমাম মুসলিম আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, হা/২৫৮১।] জাহান্নামের আগুন থেকে আমরা আল্লাহ্র কাছে মুক্তি প্রার্থনা করি।
একজন সাধারণ মুসলিমকে গালি দেওয়ার ফল যদি এমন হয়, তাহলে যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালি দেয়, তার অবস্থা কি হবে?! ক্বিয়ামত দিবসে যখন তার নেকী সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে দিয়ে দেওয়া হবে, তখন কি ভয়াবহ হবে ঐ ব্যক্তির দশা?! অতঃপর গালিদাতার নেকী শেষ হয়ে গেলে যাঁকে সে নিন্দা করেছে, তাঁর মন্দ আমল থেকে তাকে দেওয়া হবে। অতঃপর ঐ গালিদাতাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ। যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালমন্দ করবে, বিপদাপদের কি ঘনঘটাই না নেমে আসবে তার পারলৌকিক জীবনে?! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নেকী নিয়ে নিবেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নেকী নিয়ে নিবেন, উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নেকী নিয়ে নিবেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণ তার নেকী নিয়ে নিবেন। এমনিভাবে অন্যান্য সাহাবীও তার নেকী নিয়ে নিবেন।
আশ্চর্য হলেও সত্য যে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)ও তাদের নিন্দা থেকে নিষ্কৃতি পাননি। অথচ ইফ্কের ঘটনায় তাঁকে যেনার অপবাদে অপবাদকারীদের অপবাদ থেকে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাঁকে নিষ্কলুষ ঘোষণা করেছেন এবং সূরা নূরে এ প্রসঙ্গে অনেকগুলি আয়াতও অবতীর্ণ করেছেন, যেগুলি ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুসলিমদের মাঝে তেলাওয়াত করা হবে। এতদ্সত্ত্বে আজও কিছু মানুষ তাঁকে নিন্দা করে থাকে; তাহলে ক্বিয়ামত দিবসে মা আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর ভাগ্য কি সুপ্রসন্ন হবে। তিনি বিরাট ছওয়াবের ভাগীদার হবেন। কিন্তু এই হতভাগা নিন্দাকারী ক্বিয়ামতের দিন নিঃস্ব হয়ে উঠবে। কারণ সে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালি দেওয়ার মত ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, কিছু লোক সকাল-সন্ধ্যা সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালি দিয়ে থাকে; ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের সময় এই হতভাগার দশা কি হবে!
এমনকি তাদের কারো কারো বাড়াবাড়ি এমন চরমসীমায় পৌঁছেছে যে, তারা আবু বকর ও ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মত মহান ব্যক্তিত্বকে অশ্লীল ও অকথ্য ভাষায় গালি দিতেও পিছপা হয়নি। তাদের গালির নোংরা ভাষা এরূপঃ ‘হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশ বংশের দুই মূর্তি, দুই আল্লাহদ্রোহী, দুই ক্বিবত্বী এবং দুই কন্যা আবু বকর ও ওমরের উপর অভিশাপ বর্ষণ কর’। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন সম্পর্কে বলেন, ‘নিন্দুক, অভিশাপকারী ও অশ্লীল বাক্যালাপকারী মুমিন নয়’। [. মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৯৪৯; বুখারী, ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’, হা/৩১২; তিরমিযী, হা/১৯৭৭; হাকেম, ১/১২। সবাই ইবনে মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘হাদীসটি হাসান-গারীব’, ইমাম হাকেম বলেন, ‘ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি সহীহ’, হাফেয যাহাবী হাকেমের এই মতকে সমর্থন করেছেন। শায়খ আলবানী হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩১২)।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একবার বলা হয়েছিল, হে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি মুশরিকদের উপর বদদো‘আ করুন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘বদদো‘আ ও অভিশাপকারী হিসাবে আমি প্রেরিত হই নি’। [. ইমাম মুসলিম হাদীসটি আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, হা/২৫৯৯।] এতকিছুর পরেও একশ্রেণীর পরিত্যক্ত মানুষ উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলিকে লা‘নত করার জন্য বেছে নিয়েছে!
«لَا تَسُبُّوا أَصْحَابِي فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيفَهُ»
‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিওনা। যাঁর হাতে আমার প্রাণ, সেই মহান সত্ত্বার কসম করে বলছি, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করে, তথাপিও সে তাঁদের কোন একজনের পূর্ণ এক মুদ্দ [. ‘মুদ্দ’ হল এক ‘ছা’-এর চার ভাগের এক ভাগ । অর্থাৎ চার মুদ্দে হয় এক ‘ছা’। গ্রামের হিসাবে প্রায় ৬২৫ গ্রাম। -অনুবাদক।] বা অর্ধ মুদ্দ দান সমপরিমাণ পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না’। [. ইমাম বুখারী আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন (সহীহ বুখারী, হা/৩৬৭৩); ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে (সহীহ মুসলিম, হা/২৫৪০)।]
কোন একজন সাহাবী যদি একজন মিসকীনকে এক মুদ্দ পরিমাণ খাদ্য দ্রব্য দান করে আর আপনি এক উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করেন, তথাপিও আপনি ঐ সাহাবীর এক মুদ্দ পরিমাণ দানের ধারে কাছেও যেতে পারবেন না। যদিও এটি সম্ভব নয় যে, আমাদের কারো উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ হবে এবং সে তা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করবে। এত বেশী পরিমাণ সম্পদ যদি কারো হয়ও, তবুও হয়তো এই সম্পদ তার জন্য ফেৎনার কারণ হবে এবং সে কৃপণ হয়ে যাবে। ধরা যাক, আমাদের কারো উহুদ পরিমাণ স্বর্ণ হল এবং সে তা আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করল, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে একজন সাহাবীর এক মুদ্দ খাদ্য দ্রব্য দানের নেকী পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে, সাহাবীগণের সম্মান ও মর্যাদা কত বেশী।
‘তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিওনা’- এ নির্দেশ স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর; ইহা সাধারণ কোন মানুষ বা আলেমের উক্তি নয়। এখানে তিনি তাঁর উম্মতকে নছীহত করেছেন এবং কোন সাহাবীর সামান্যতম মানহানিকর কোন কার্যক্রম থেকে তাদেরকে সতর্ক করেছেন। সাথে সাথে তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কেও উম্মতকে সজাগ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমর্মে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেগুলিতে তিনি তাঁর উম্মতের উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সম্মান ও মর্যাদা তুলে ধরেছেন। এমনকি কতিপয় আলেম সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদা বিষয়ে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন; কিন্তু এককভাবে অথবা সমষ্টিগতভাবে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর প্রশংসা সম্বলিত হাদীস অনেক বেশী হওয়ার কারণে এক খণ্ডে তা সমাপ্ত করতে সক্ষম হন নি। বরং কয়েক খণ্ডে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন পড়েছে।
লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ! কি মহা তাঁদের সম্মান! কি উঁচু তাঁদের মর্যাদা! তাঁদের প্রতি একজন মুসলিমের কর্তব্যই না কত বড়!
মহান আল্লাহ ঈমানদারগণকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ করেছেন এবং সত্যিকার মুমিনগণ তার বাস্তবায়নও করেছেন। কিন্তু কতিপয় লোক কুরআন ও হাদীস নির্দেশিত এই পথ প্রত্যাখ্যান করে চরম ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে। ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে তারা তাঁদেরকে দিয়েছে গালি এবং প্রশংসার পরিবর্তে করেছে নিন্দা। সহীহ মুসলিমে এসেছে, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) উরওয়া ইব্ন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বলেন, يَا ابْنَ أُخْتِيْ أُمِرُوْا أَنْ يَسْتَغْفِرُوْا لأَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَسَبُّوْهُمْ . ‘হে ভাগ্নে! ওদেরকে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা দিয়েছে গালি’। [. সহীহ মুসলিম, হা/৩০২২।]
তবে এর পেছনে আল্লাহ্র বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ইবনুল আছীর (রহঃ) তাঁর প্রণীত ‘জামেউল উছূল’ ( جامع الأصول ) [. হা/৬৩৬৬, কিন্তু কোন্ মুহাদ্দিছ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তা ইবনুল আছীর উল্লেখ করেন নি। তবে ইবনু আসাকের তাঁর জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তারীখু দিমাশ্ক্ব (৪৪/৩৮৭)’-এ হাদীসটি সনদসহ উল্লেখ করেছেন। অনুরূপভাবে খত্বীব বাগদাদী তাঁর ‘তারীখু বাগদাদ (৫/১৪৭)’-এ হাদীসটি নিয়ে এসেছেন।] গ্রন্থে উল্লেখ করেন, জাবের ইব্ন আব্দুল্লাহ আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণনা করেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘কিছু মানুষ সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম), এমনকি আবু বকর ও ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এরও নিন্দা-সমালোচনা করে থাকে, (তাদের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি)? তিনি বলেছিলেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের নেক আমল বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন, তাঁদের নেকীর পথ যেন বন্ধ না হয়ে যায়’।
এটা কিভাবে সম্ভব? হাদীস থেকে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি, যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে কারো নিন্দা-সমালোচনা করবে, ক্বিয়ামত দিবসে ঐ নিন্দাকারীর নেকী বিনা অপরাধে নিন্দিত ব্যক্তিটিকে দেওয়া হবে। হাদীছে এসেছে, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে বললেন,
«أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟ قَالُوا الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ وَلاَ مَتَاعَ . فَقَالَ : إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِى يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَةٍ وَصِيَامٍ وَزَكَاةٍ وَيَأْتِى قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا وَأَكَلَ مَالَ هَذَا وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِى النَّارِ .»
‘তোমরা কি জান, দরিদ্র কে?’ তাঁরা বললেন, যার অর্থকড়ি নেই, সেই তো আমাদের মধ্যে দরিদ্র। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তবে আমার উম্মতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি দরিদ্র, যে ক্বিয়ামত দিবসে নামায, রোযা, যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে; কিন্তু সাথে এমন কিছু মানুষকে নিয়ে আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছিল, কাউকে যেনার অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল, আবার কাউকে প্রহার করেছিল। অতঃপর তাদেরকে তার নেকী থেকে দেওয়া হবে। কিন্তু তার উপর চাপানো দেনাপাওনা শেষ হওয়ার আগেই যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহলে ঐ লোকগুলির পাপ নিয়ে তার আমলনামায় দেওয়া হবে। অবশেষে এক পর্যায়ে তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে’। [. ইমাম মুসলিম আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, হা/২৫৮১।] জাহান্নামের আগুন থেকে আমরা আল্লাহ্র কাছে মুক্তি প্রার্থনা করি।
একজন সাধারণ মুসলিমকে গালি দেওয়ার ফল যদি এমন হয়, তাহলে যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালি দেয়, তার অবস্থা কি হবে?! ক্বিয়ামত দিবসে যখন তার নেকী সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে দিয়ে দেওয়া হবে, তখন কি ভয়াবহ হবে ঐ ব্যক্তির দশা?! অতঃপর গালিদাতার নেকী শেষ হয়ে গেলে যাঁকে সে নিন্দা করেছে, তাঁর মন্দ আমল থেকে তাকে দেওয়া হবে। অতঃপর ঐ গালিদাতাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ। যে ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালমন্দ করবে, বিপদাপদের কি ঘনঘটাই না নেমে আসবে তার পারলৌকিক জীবনে?! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নেকী নিয়ে নিবেন, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নেকী নিয়ে নিবেন, উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহু তার নেকী নিয়ে নিবেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণ তার নেকী নিয়ে নিবেন। এমনিভাবে অন্যান্য সাহাবীও তার নেকী নিয়ে নিবেন।
আশ্চর্য হলেও সত্য যে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)ও তাদের নিন্দা থেকে নিষ্কৃতি পাননি। অথচ ইফ্কের ঘটনায় তাঁকে যেনার অপবাদে অপবাদকারীদের অপবাদ থেকে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাঁকে নিষ্কলুষ ঘোষণা করেছেন এবং সূরা নূরে এ প্রসঙ্গে অনেকগুলি আয়াতও অবতীর্ণ করেছেন, যেগুলি ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুসলিমদের মাঝে তেলাওয়াত করা হবে। এতদ্সত্ত্বে আজও কিছু মানুষ তাঁকে নিন্দা করে থাকে; তাহলে ক্বিয়ামত দিবসে মা আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর ভাগ্য কি সুপ্রসন্ন হবে। তিনি বিরাট ছওয়াবের ভাগীদার হবেন। কিন্তু এই হতভাগা নিন্দাকারী ক্বিয়ামতের দিন নিঃস্ব হয়ে উঠবে। কারণ সে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালি দেওয়ার মত ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, কিছু লোক সকাল-সন্ধ্যা সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালি দিয়ে থাকে; ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের সময় এই হতভাগার দশা কি হবে!
এমনকি তাদের কারো কারো বাড়াবাড়ি এমন চরমসীমায় পৌঁছেছে যে, তারা আবু বকর ও ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মত মহান ব্যক্তিত্বকে অশ্লীল ও অকথ্য ভাষায় গালি দিতেও পিছপা হয়নি। তাদের গালির নোংরা ভাষা এরূপঃ ‘হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশ বংশের দুই মূর্তি, দুই আল্লাহদ্রোহী, দুই ক্বিবত্বী এবং দুই কন্যা আবু বকর ও ওমরের উপর অভিশাপ বর্ষণ কর’। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন সম্পর্কে বলেন, ‘নিন্দুক, অভিশাপকারী ও অশ্লীল বাক্যালাপকারী মুমিন নয়’। [. মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৯৪৯; বুখারী, ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’, হা/৩১২; তিরমিযী, হা/১৯৭৭; হাকেম, ১/১২। সবাই ইবনে মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী বলেন, ‘হাদীসটি হাসান-গারীব’, ইমাম হাকেম বলেন, ‘ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি সহীহ’, হাফেয যাহাবী হাকেমের এই মতকে সমর্থন করেছেন। শায়খ আলবানী হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩১২)।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একবার বলা হয়েছিল, হে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি মুশরিকদের উপর বদদো‘আ করুন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘বদদো‘আ ও অভিশাপকারী হিসাবে আমি প্রেরিত হই নি’। [. ইমাম মুসলিম হাদীসটি আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, হা/২৫৯৯।] এতকিছুর পরেও একশ্রেণীর পরিত্যক্ত মানুষ উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলিকে লা‘নত করার জন্য বেছে নিয়েছে!
আলী ইব্ন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আবু বকর ও ওমর নবী-রাসূলগণ ব্যতীত পরিণত বয়সী সকল জান্নাতবাসীর সরদার’। [. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬০২; তিরমিযী, হা/৩৬৬৬; ইবনে মাজাহ, হা/৯৫। এই হাদীসটি আরো কয়েকজন সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং সবগুলি সনদের উপর ভিত্তি করে শায়খ আলবানী হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৮২৪)।] অতএব, নবী-রাসূলগণ (আঃ)-এর পরে তাঁরা দু’জন যেমন জান্নাতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, তেমনি দুনিয়াতেও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
সহীহ বুখারীতে [. হা/৩৬৫৫।] এসেছে, ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে কে বেশী উত্তম, তা বিশ্লেষণ করতাম। আমরা সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসাবে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে জানতাম, অতঃপর ওমর ইব্ন আল-খাত্ত্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে, অতঃপর উছমান ইব্ন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু কে। সহীহ বুখারী ছাড়া অন্যান্য কয়েকটি হাদীস গ্রন্থে এসেছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এমর্মে খবর পৌঁছলে তিনি তা অপছন্দ করতেন না’। [. ইবনু আবী ‘আছেম, ‘আস-সুন্নাহ’, হা/৯৯৩; আবু ইয়া‘লা, ‘আল-মুসনাদ’, হা/৫৬০৪; ত্ববারানী, ‘মুসনাদুশ্-শামিইয়্যিন’, হা/১৭৬৪। হাদীছের অতিরিক্ত এই অংশটুকু ‘সহীহ’, শায়খ আলবানী ‘যিলালুল জান্নাহ’ গ্রন্তে ইহাকে ‘সহীহ’ বলেছেন, হা/১১৯৩।]
সহীহ বুখারীতে এসেছে, মুহাম্মাদ ইব্ন আল-হানাফিইয়্যাহ বলেন, আমি আমার পিতা আলী ইব্ন আবু ত্বালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আবু বকর। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, ওমর। আমি ভাবলাম, এবার হয়তো উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নাম বলবেন। সেজন্য বললাম, তারপর কি আপনি! তিনি বললেন, আমি সাধারণ একজন মুসলিম বৈ আর কেউ নই। [. সহীহ বুখারী, হা/৩৬৭১।]
ইবনু আবী ‘আছেম প্রণীত ‘আস-সুন্নাহ’ [. হা/১২১৯, ইমাম আহমাদ ‘ফাযায়েলুস্ সাহাবাহ’-তে হাদীসটি নিয়ে এসেছেন (৪৯)।] নামক গ্রন্থে এসেছে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«لاَ يَبْلُغُنِيْ عَنْ أَحَدٍ يُفَضِّلُنِي عَلَىٰ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ إِلاَّ جَلَدْتُهُ حَدَّ الْمُفْتَرِيْ»
‘কারো পক্ষ থেকে যদি আমার কাছে এমর্মে খবর আসে যে, সে আমাকে আবু বকর ও ওমরের উপর প্রাধান্য দিচ্ছে, তাহলে আমি মিথ্যা অপবাদকারীর হদ্দ স্বরূপ তাকে বেত্রাঘাত করব’। ইহা স্বয়ং আমীরুল মুমিনীন আলী ইব্ন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উক্তি।
আমাদেরকে জানতে হবে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের তুলনামূলক তারতম্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্যেরই একটি অংশ। আর এই জ্ঞান থাকলে আমরা তাঁদের প্রত্যেককে তাঁর যথাযথ হক্ব প্রদান করতে পারব। মহান আল্লাহ কি পবিত্র কুরআনে বলেন নি,
﴿لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ١٠﴾ [ الحديد : ١٠ ]
‘তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যাদা তাদের চেয়ে বেশী, যারা পরে ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত’ (আল-হাদীদ ১০)।
এখানে ‘আল-হুসনা’ ( الْحُسْنَىٰ ) অর্থঃ জান্নাত এবং ‘আল-ফাত্হ’ ( الْفَتْح ) অর্থঃ মক্কা বিজয় বা হুদায়বিয়ার সন্ধি। আয়াতে বলা হল, যাঁরা হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে গাছের নীচে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে হাত রেখে বায়‘আত করেছিলেন আর যাঁরা এ সন্ধির পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং আল্লাহ্র রাস্তায় লড়াই করেছিলেন, তাঁরা সবাই ঈমান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে সমান নন। বরং উভয় গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে; যদিও তাঁরা সবাই সাহাবী, সবাই ঈমানদার এবং সবাই জান্নাতী।
বুঝা গেল, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মর্যাদার ক্ষেত্রে সবাই সমান নন। সেজন্য হুদায়বিয়ার দিনে গাছের নীচে বায়‘আতকারী সাহাবীগণ হলেন সর্বোত্তম। এরপর বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ। কিন্তু তাঁদের সবার মধ্যে উত্তম হলেন, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বৈঠকে ঐ দশজন সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন। ইমাম তিরমিযী ও ইমাম আহমাদ প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুর রহমান ইব্ন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, ‘আবু বকর জান্নাতী, ওমর জান্নাতী, উছমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী, ত্বালহা জান্নাতী, যুবায়ের জান্নাতী, আব্দুর রহমান ইব্ন আওফ জান্নাতী, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্বাছ জান্নাতী, সাঈদ ইব্ন যায়েদ ইব্ন আমর ইব্ন নুফাইল জান্নাতী এবং আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ জান্নাতী’। [. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৭৫; তিরমিযী, হা/৩৭৪৭; নাসাঈ, ‘সুনানে কুবরা’, হা/৮১৯৪। দুজনই হাদীসটিকে আব্দুর রহমান ইব্ন আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী ‘ছহীহুল জামে’-তে হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন (৫০)।] উল্লেখিত দশজন সাহাবীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বৈঠকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। তাঁরা ভূ-পৃষ্ঠে চলাফেরা করতেন অথচ জানতেন, তাঁরা নিশ্চিত জান্নাতে যাবেন। কি মহা সৌভাগ্যের অধিকারী তাঁরা! দুনিয়ার মাটিতে চলাফেরা করছেন, অথচ জানছেন যে, তাঁরা ক্বিয়ামত দিবসে নিশ্চিত জান্নাতের অধিবাসী।
আবার এই দশজনের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন চার খলীফা এবং চার খলীফার মধ্যে সর্বোত্তম হলেন আবু বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। কিন্তু সকল সাহাবীর মধ্যে সর্বোত্তম হলেন আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহু।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সাহচর্যের কথা সরাসরি পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
﴿إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ ﴾ [ التوبة : ٤٠ ]
‘তখন তিনি তাঁর সঙ্গীকে বললেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ (আত-তাওবাহ ৪০)।
তিনি ব্যতীত দ্বিতীয় আর কোন সাহাবীর সাহচর্যের কথা পবিত্র কুরআনে আসেনি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে তাঁকে যা-ই বলা হত, তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা বিশ্বাস করে নিতেন। মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুশরিকদেরকে বললেন যে, রাতে তাঁকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনি বুরাক্ব-এ চড়েছিলেন; তখন তারা তা বিশ্বাস করতে না পেরে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকটে আসল এবং বলল, তোমার সঙ্গী কি বলছে জানো? সে এমন এমন বলছে...। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তিনি যদি একথা বলে থাকেন, তাহলে সত্যই বলেছেন। [. হাকেম, ৩/৬৫; আবু নু‘আইম, ‘মারেফাতুস্ সাহাবাহ’, ১/৮২; বায়হাক্বী, ‘দালায়েলুন নুবুওয়াহ’, ২/৩৬১। তাঁরা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন এবং হাফেয যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম আলবানীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩০৬)।] সেজন্য তাঁকে এই উম্মতের ‘সিদ্দীক্ব’ বা সত্যবাদী বলা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সবকিছুকে বিনা বাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করার মত এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে আর কেউ পৌঁছতে পারে নি। আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصِّدِّيقُونَۖ ٩﴾ [ الحديد : ١٩ ]
‘আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তারাই তাদের পালনকর্তার নিকট সিদ্দীক্ব বলে বিবেচিত’ (আল-হাদীদ ১৯)।
আয়াতে উল্লেখিত এই সম্মান এবং বিশেষণে বিশেষিত হওয়ার যোগ্য সর্বপ্রথম ব্যক্তিত্ব হলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
নীচের ঘটনাটি মনোযোগ দিয়ে শুনুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা আবু বকর ও ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর অনুপস্থিতিতে ঘটনাটি বর্ণনা করছিলেন। ঘটনাটি ছিল এরূপঃ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামায শেষে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর দিকে মুখ করে বসলেন। অতঃপর বললেন, (বনী ইসরাঈলের) এক ব্যক্তি একদিন এক গরুর পিঠে আরোহণ করল এবং তাকে প্রহার করল। গরুটি বলল, আমাদেরকে আরোহণ করার কাজে সৃষ্টি করা হয়নি; বরং চাষাবাদের জন্য আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তখন উপস্থিতিগণ বলে উঠলেন, সুবহা-নাল্লাহ! গরু কথা বলে!! এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি, আবু বকর এবং ওমর এতে বিশ্বাস করি। হাদীসটির বর্ণনাকারী বলেন, ঐদিন তাঁরা দু’জন অনুপস্থিত ছিলেন।
(বনী ইসরাঈলের) আরেক ব্যক্তি ছাগল চরাচ্ছিল, এমতাবস্থায় বাঘ এসে একটি ছাগল নিয়ে গেল। লোকটি পিছু ধাওয়া করে বাঘের হাত থেকে ছাগলটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হল। তখন বাঘটি তাকে বলল, এই লোক! ছাগলটিকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলে? যেদিন আমি ছাড়া ওর আর কোন রাখাল থাকবে না, সেদিন ওকে কে রক্ষা করবে? উপস্থিতিগণ বলে উঠলেন, সুবহা-নাল্লাহ! বাঘ কথা বলে!! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি, আবু বকর এবং ওমর ইহা বিশ্বাস করি। বর্ণনাকারী বলছেন, ঐদিন তাঁরা দু’জন অনুপস্থিত ছিলেন। [. সহীহ বুখারী, হা/৩৪৭১।]
এখানে সিদ্দীক্ব এবং তাঁর ঈমানী দৃঢ়তার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর পূর্ণ হেদায়েতের প্রাপ্তির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যদি কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে আবু বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মর্যাদার উপর আলোচনা করতে যাই, তাহলে ২/১টি বক্তব্যে তা শেষ করা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ ব্যতীত যেহেতু আর কোন হক্ব মা‘বুদ নেই, সেহেতু তাঁর সুন্দরতম নামসমূহ এবং সুমহান গুণাবলীর মাধ্যমে আমরা তাঁরই নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন কোন সাহাবীর প্রতি অথবা অন্য কোন মুমিনের প্রতি আমাদের হৃদয়সমূহে সামান্যতম বিদ্বেষ না দেন। তিনি আমাদেরকে এবং আমাদের যেসব ভাই ঈমানের সহিত গত হয়ে গেছেন, তাদেরকে যেন ক্ষমা করেন। আমরা আল্লাহ্র সুন্দরতম নামসমূহ এবং সুমহান গুণাবলীর মাধ্যমে তাঁর নিকট আরো প্রার্থনা করি, তিনি যেন ক্বিয়ামত দিবসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীবর্গের সাথে আমাদেরকে হাশর-নাশর করান। আরও প্রার্থনা করি, ক্বিয়ামত দিবসে তিনি যেন আমাদেরকে আবু বকর, ওমর, উছমান, আলী এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণের সাথে হাশর-নাশর করান। মহা সম্মান এবং মর্যাদার অধিকারী সকল সাহাবীর সাথে যেন তিনি আমাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন হাশর-নাশর করান।
সহীহ বুখারীতে [. হা/৩৬৫৫।] এসেছে, ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে কে বেশী উত্তম, তা বিশ্লেষণ করতাম। আমরা সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসাবে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে জানতাম, অতঃপর ওমর ইব্ন আল-খাত্ত্বাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে, অতঃপর উছমান ইব্ন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু কে। সহীহ বুখারী ছাড়া অন্যান্য কয়েকটি হাদীস গ্রন্থে এসেছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এমর্মে খবর পৌঁছলে তিনি তা অপছন্দ করতেন না’। [. ইবনু আবী ‘আছেম, ‘আস-সুন্নাহ’, হা/৯৯৩; আবু ইয়া‘লা, ‘আল-মুসনাদ’, হা/৫৬০৪; ত্ববারানী, ‘মুসনাদুশ্-শামিইয়্যিন’, হা/১৭৬৪। হাদীছের অতিরিক্ত এই অংশটুকু ‘সহীহ’, শায়খ আলবানী ‘যিলালুল জান্নাহ’ গ্রন্তে ইহাকে ‘সহীহ’ বলেছেন, হা/১১৯৩।]
সহীহ বুখারীতে এসেছে, মুহাম্মাদ ইব্ন আল-হানাফিইয়্যাহ বলেন, আমি আমার পিতা আলী ইব্ন আবু ত্বালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আবু বকর। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, ওমর। আমি ভাবলাম, এবার হয়তো উছমান রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নাম বলবেন। সেজন্য বললাম, তারপর কি আপনি! তিনি বললেন, আমি সাধারণ একজন মুসলিম বৈ আর কেউ নই। [. সহীহ বুখারী, হা/৩৬৭১।]
ইবনু আবী ‘আছেম প্রণীত ‘আস-সুন্নাহ’ [. হা/১২১৯, ইমাম আহমাদ ‘ফাযায়েলুস্ সাহাবাহ’-তে হাদীসটি নিয়ে এসেছেন (৪৯)।] নামক গ্রন্থে এসেছে, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«لاَ يَبْلُغُنِيْ عَنْ أَحَدٍ يُفَضِّلُنِي عَلَىٰ أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ إِلاَّ جَلَدْتُهُ حَدَّ الْمُفْتَرِيْ»
‘কারো পক্ষ থেকে যদি আমার কাছে এমর্মে খবর আসে যে, সে আমাকে আবু বকর ও ওমরের উপর প্রাধান্য দিচ্ছে, তাহলে আমি মিথ্যা অপবাদকারীর হদ্দ স্বরূপ তাকে বেত্রাঘাত করব’। ইহা স্বয়ং আমীরুল মুমিনীন আলী ইব্ন আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উক্তি।
আমাদেরকে জানতে হবে, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের তুলনামূলক তারতম্য সম্পর্কে জ্ঞান থাকা তাঁদের প্রতি আমাদের কর্তব্যেরই একটি অংশ। আর এই জ্ঞান থাকলে আমরা তাঁদের প্রত্যেককে তাঁর যথাযথ হক্ব প্রদান করতে পারব। মহান আল্লাহ কি পবিত্র কুরআনে বলেন নি,
﴿لَا يَسۡتَوِي مِنكُم مَّنۡ أَنفَقَ مِن قَبۡلِ ٱلۡفَتۡحِ وَقَٰتَلَۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡظَمُ دَرَجَةٗ مِّنَ ٱلَّذِينَ أَنفَقُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَقَٰتَلُواْۚ وَكُلّٗا وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٞ ١٠﴾ [ الحديد : ١٠ ]
‘তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যাদা তাদের চেয়ে বেশী, যারা পরে ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত’ (আল-হাদীদ ১০)।
এখানে ‘আল-হুসনা’ ( الْحُسْنَىٰ ) অর্থঃ জান্নাত এবং ‘আল-ফাত্হ’ ( الْفَتْح ) অর্থঃ মক্কা বিজয় বা হুদায়বিয়ার সন্ধি। আয়াতে বলা হল, যাঁরা হুদায়বিয়ার সন্ধির দিনে গাছের নীচে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে হাত রেখে বায়‘আত করেছিলেন আর যাঁরা এ সন্ধির পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং আল্লাহ্র রাস্তায় লড়াই করেছিলেন, তাঁরা সবাই ঈমান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে সমান নন। বরং উভয় গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে; যদিও তাঁরা সবাই সাহাবী, সবাই ঈমানদার এবং সবাই জান্নাতী।
বুঝা গেল, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মর্যাদার ক্ষেত্রে সবাই সমান নন। সেজন্য হুদায়বিয়ার দিনে গাছের নীচে বায়‘আতকারী সাহাবীগণ হলেন সর্বোত্তম। এরপর বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ। কিন্তু তাঁদের সবার মধ্যে উত্তম হলেন, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বৈঠকে ঐ দশজন সাহাবীকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন। ইমাম তিরমিযী ও ইমাম আহমাদ প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুর রহমান ইব্ন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, ‘আবু বকর জান্নাতী, ওমর জান্নাতী, উছমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী, ত্বালহা জান্নাতী, যুবায়ের জান্নাতী, আব্দুর রহমান ইব্ন আওফ জান্নাতী, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্বাছ জান্নাতী, সাঈদ ইব্ন যায়েদ ইব্ন আমর ইব্ন নুফাইল জান্নাতী এবং আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ জান্নাতী’। [. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৭৫; তিরমিযী, হা/৩৭৪৭; নাসাঈ, ‘সুনানে কুবরা’, হা/৮১৯৪। দুজনই হাদীসটিকে আব্দুর রহমান ইব্ন আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী ‘ছহীহুল জামে’-তে হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন (৫০)।] উল্লেখিত দশজন সাহাবীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বৈঠকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন। তাঁরা ভূ-পৃষ্ঠে চলাফেরা করতেন অথচ জানতেন, তাঁরা নিশ্চিত জান্নাতে যাবেন। কি মহা সৌভাগ্যের অধিকারী তাঁরা! দুনিয়ার মাটিতে চলাফেরা করছেন, অথচ জানছেন যে, তাঁরা ক্বিয়ামত দিবসে নিশ্চিত জান্নাতের অধিবাসী।
আবার এই দশজনের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন চার খলীফা এবং চার খলীফার মধ্যে সর্বোত্তম হলেন আবু বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। কিন্তু সকল সাহাবীর মধ্যে সর্বোত্তম হলেন আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদিয়াল্লাহু আনহু।
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সাহচর্যের কথা সরাসরি পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
﴿إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ ﴾ [ التوبة : ٤٠ ]
‘তখন তিনি তাঁর সঙ্গীকে বললেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ (আত-তাওবাহ ৪০)।
তিনি ব্যতীত দ্বিতীয় আর কোন সাহাবীর সাহচর্যের কথা পবিত্র কুরআনে আসেনি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে তাঁকে যা-ই বলা হত, তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা বিশ্বাস করে নিতেন। মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মুশরিকদেরকে বললেন যে, রাতে তাঁকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনি বুরাক্ব-এ চড়েছিলেন; তখন তারা তা বিশ্বাস করতে না পেরে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকটে আসল এবং বলল, তোমার সঙ্গী কি বলছে জানো? সে এমন এমন বলছে...। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তিনি যদি একথা বলে থাকেন, তাহলে সত্যই বলেছেন। [. হাকেম, ৩/৬৫; আবু নু‘আইম, ‘মারেফাতুস্ সাহাবাহ’, ১/৮২; বায়হাক্বী, ‘দালায়েলুন নুবুওয়াহ’, ২/৩৬১। তাঁরা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন এবং হাফেয যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম আলবানীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩০৬)।] সেজন্য তাঁকে এই উম্মতের ‘সিদ্দীক্ব’ বা সত্যবাদী বলা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সবকিছুকে বিনা বাক্য ব্যয়ে বিশ্বাস করার মত এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে আর কেউ পৌঁছতে পারে নি। আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصِّدِّيقُونَۖ ٩﴾ [ الحديد : ١٩ ]
‘আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তারাই তাদের পালনকর্তার নিকট সিদ্দীক্ব বলে বিবেচিত’ (আল-হাদীদ ১৯)।
আয়াতে উল্লেখিত এই সম্মান এবং বিশেষণে বিশেষিত হওয়ার যোগ্য সর্বপ্রথম ব্যক্তিত্ব হলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
নীচের ঘটনাটি মনোযোগ দিয়ে শুনুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা আবু বকর ও ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর অনুপস্থিতিতে ঘটনাটি বর্ণনা করছিলেন। ঘটনাটি ছিল এরূপঃ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামায শেষে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর দিকে মুখ করে বসলেন। অতঃপর বললেন, (বনী ইসরাঈলের) এক ব্যক্তি একদিন এক গরুর পিঠে আরোহণ করল এবং তাকে প্রহার করল। গরুটি বলল, আমাদেরকে আরোহণ করার কাজে সৃষ্টি করা হয়নি; বরং চাষাবাদের জন্য আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তখন উপস্থিতিগণ বলে উঠলেন, সুবহা-নাল্লাহ! গরু কথা বলে!! এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি, আবু বকর এবং ওমর এতে বিশ্বাস করি। হাদীসটির বর্ণনাকারী বলেন, ঐদিন তাঁরা দু’জন অনুপস্থিত ছিলেন।
(বনী ইসরাঈলের) আরেক ব্যক্তি ছাগল চরাচ্ছিল, এমতাবস্থায় বাঘ এসে একটি ছাগল নিয়ে গেল। লোকটি পিছু ধাওয়া করে বাঘের হাত থেকে ছাগলটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হল। তখন বাঘটি তাকে বলল, এই লোক! ছাগলটিকে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলে? যেদিন আমি ছাড়া ওর আর কোন রাখাল থাকবে না, সেদিন ওকে কে রক্ষা করবে? উপস্থিতিগণ বলে উঠলেন, সুবহা-নাল্লাহ! বাঘ কথা বলে!! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি, আবু বকর এবং ওমর ইহা বিশ্বাস করি। বর্ণনাকারী বলছেন, ঐদিন তাঁরা দু’জন অনুপস্থিত ছিলেন। [. সহীহ বুখারী, হা/৩৪৭১।]
এখানে সিদ্দীক্ব এবং তাঁর ঈমানী দৃঢ়তার বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর পূর্ণ হেদায়েতের প্রাপ্তির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যদি কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে আবু বকর ও ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মর্যাদার উপর আলোচনা করতে যাই, তাহলে ২/১টি বক্তব্যে তা শেষ করা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ ব্যতীত যেহেতু আর কোন হক্ব মা‘বুদ নেই, সেহেতু তাঁর সুন্দরতম নামসমূহ এবং সুমহান গুণাবলীর মাধ্যমে আমরা তাঁরই নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন কোন সাহাবীর প্রতি অথবা অন্য কোন মুমিনের প্রতি আমাদের হৃদয়সমূহে সামান্যতম বিদ্বেষ না দেন। তিনি আমাদেরকে এবং আমাদের যেসব ভাই ঈমানের সহিত গত হয়ে গেছেন, তাদেরকে যেন ক্ষমা করেন। আমরা আল্লাহ্র সুন্দরতম নামসমূহ এবং সুমহান গুণাবলীর মাধ্যমে তাঁর নিকট আরো প্রার্থনা করি, তিনি যেন ক্বিয়ামত দিবসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীবর্গের সাথে আমাদেরকে হাশর-নাশর করান। আরও প্রার্থনা করি, ক্বিয়ামত দিবসে তিনি যেন আমাদেরকে আবু বকর, ওমর, উছমান, আলী এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণের সাথে হাশর-নাশর করান। মহা সম্মান এবং মর্যাদার অধিকারী সকল সাহাবীর সাথে যেন তিনি আমাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন হাশর-নাশর করান।
প্রিয় মুসলিম ভাই! আমাদের উচিৎ, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর জীবনী, তাঁদের সম্মান, মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশুনা করা। এক্ষেত্রে কুরআন মাজীদ দিয়ে শুরু করতে হবে। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস পড়তে হবে। তারপর সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আরবা‘আহ, মাসানীদ, মা‘আজিম [. মা‘আজিম মাসানীদের মত (মাসানীদ-এর অর্থ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে)। তবে উভয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য হল, মা‘আজিম গ্রন্থসমূহে সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর নামসমূহকে শুধুমাত্র আরবী বর্ণের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সাজানো হয় এবং কখনও কখনও একই বৈঠকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর হাদীস সমূহকে সর্বপ্রথম নিয়ে আসা হয়। কিন্তু মাসানীদে সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) কে সাজানোর কয়েকটি ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। –অনুবাদক।], আজ্যা ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত আছার এবং ওলামায়ে কেরামের উক্তি পড়তে হবে। সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর ফযীলত বিষয়ে পৃথকভাবে প্রণীত গ্রন্থসমূহও পড়তে হবে। কারণ, এই অধ্যয়ন থেকে আমরা অনেক উপকার লাভে ধন্য হব। তন্মধ্যেঃ-
এক. সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জীবনী পড়লে তাঁদের প্রতি আমাদের ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। তাঁদের প্রশংসা, তাঁদের জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনার পথ প্রশস্ত হবে। তাঁদের সম্পর্কে সবসময় ভাল আলোচনার বিষয়টি সহজ হবে।
দুই. সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জীবনচরিত পড়লে তাঁদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনের প্রতি আপনি যত্নশীল হতে পারবেন। আর আপনি জীবন চলার পথে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সাথে যতবেশী সাদৃশ্য বজায় রাখতে পারবেন, কল্যাণের ততবেশী কাছাকাছি থাকতে পারবেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ﴾ [ ال عمران : ١١٠ ]
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে (আলে-ইমরান ১১০)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ হলেন আমার যুগের মানুষ’। [. সহীহ বুখারী, হা/২৬৫২, ৩৬৫১, ৬৪২৯; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩। হাদীসটি তাঁরা ইবনে মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।] যেহেতু আল্লাহ এবং তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন, সেহেতু যতবেশী তাঁদের সাথে সাদৃশ্য বজায় রাখা যাবে, যতবেশী কল্যাণের কাছাকাছি থাকা সম্ভব হবে।
তিন. সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালমন্দ করা, তাঁদেরকে নিন্দা-সমালোচনা করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট কাজ থেকে আপনি সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করতে পারবেন। সাহাবীগণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাঁদের প্রশংসা করা, তাঁদেরকে সম্মান করা, তাঁদেরকে ভালবাসা এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার নির্দেশ আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আর তাঁদের জীবনী অধ্যয়ন আপনাকে উপরোক্ত নির্দেশাবলী পালনে উৎসাহিত করে তুলবে।
এক. সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জীবনী পড়লে তাঁদের প্রতি আমাদের ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে। তাঁদের প্রশংসা, তাঁদের জন্য দো‘আ এবং ক্ষমা প্রার্থনার পথ প্রশস্ত হবে। তাঁদের সম্পর্কে সবসময় ভাল আলোচনার বিষয়টি সহজ হবে।
দুই. সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জীবনচরিত পড়লে তাঁদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনের প্রতি আপনি যত্নশীল হতে পারবেন। আর আপনি জীবন চলার পথে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর সাথে যতবেশী সাদৃশ্য বজায় রাখতে পারবেন, কল্যাণের ততবেশী কাছাকাছি থাকতে পারবেন। কেননা মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ﴾ [ ال عمران : ١١٠ ]
‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে (আলে-ইমরান ১১০)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সর্বোত্তম মানুষ হলেন আমার যুগের মানুষ’। [. সহীহ বুখারী, হা/২৬৫২, ৩৬৫১, ৬৪২৯; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৩। হাদীসটি তাঁরা ইবনে মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।] যেহেতু আল্লাহ এবং তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন, সেহেতু যতবেশী তাঁদের সাথে সাদৃশ্য বজায় রাখা যাবে, যতবেশী কল্যাণের কাছাকাছি থাকা সম্ভব হবে।
তিন. সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কে গালমন্দ করা, তাঁদেরকে নিন্দা-সমালোচনা করা ইত্যাদি নিকৃষ্ট কাজ থেকে আপনি সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করতে পারবেন। সাহাবীগণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাঁদের প্রশংসা করা, তাঁদেরকে সম্মান করা, তাঁদেরকে ভালবাসা এবং তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার নির্দেশ আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আর তাঁদের জীবনী অধ্যয়ন আপনাকে উপরোক্ত নির্দেশাবলী পালনে উৎসাহিত করে তুলবে।
আমাদের আলোচনার এটিই শেষ বিষয়। সাহাবীগণের মধ্যে যেসব মতানৈক্য হয়েছে, তদ্বিষয়ে আমাদের করণীয় কি?
আমাদের সালাফে ছালেহীনের এক ব্যক্তিকে [. ঘটনাটি ওমর ইব্ন আব্দুল আযীয (রহঃ) থেকে বর্ণনা করা হয় (‘হিলইয়াতুল আওলিয়া’, ৯/১১৪; ‘আল-মুজালাসাহ’/১৯৬৫)। এখানে উক্তিটির শব্দগুলি এভাবে এসেছে, تِلْكَ دِمَاءٌ طَهَّرَ اللهُ يَدِي مِنْهَا، فَمَا لي أُخَضِّبُ لِسَانِي فِيْهَا ‘সেটি ছিল রক্তাক্ত ইতিহাস, আল্লাহ তাত্থেকে আমার হাতকে মুক্ত রেখেছেন। তাহলে এবিষয়ে কথা বলে খামাখা কেন আমি আমার জিহ্বাকে রঞ্জিত করব?!’] যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন,
تِلْكَ فِتْنَةٌ طَهَّرَ اللهُ مِنْهَا سُيُوْفَنَا , فَلْنُطَهِّرْ مِنْهَا أَلْسِنَتَنَا .
‘এটি ছিল একটি ফেৎনা। আল্লাহ তাত্থেকে আমাদের তরবারীকে মুক্ত রেখেছেন। অতএব, আমরা তা থেকে আমাদের যবানকেও মুক্ত রাখব’।
আরেকজনকে [. তিনি হলেন ইমাম আহমাদ (খাল্লাল, ‘আস-সুন্নাহ’, ২/৪৮১)।] এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন,
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٣٤﴾ [ البقرة : ١٣٤ ]
‘তারা ছিল এক সম্প্রদায়, যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্য। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না’ (আল-বাক্বারাহ ১৩৪)।
যদি ধরেও নিই যে, কোন একজন সাহাবী ভুল করেছেন; তবে আপনার তাতে মাথা ঘামানোর দরকার কি! ক্বিয়ামতের দিন কি আল্লাহ এই ভুলের জন্য আপনার কাছে হিসাব চাইবেন? আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না’। আপনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর পর্যবেক্ষক নন, তাহলে কেন আপনি তাঁদের মধ্যে বিবাদীয় বিষয়ে নিজেকে জড়াবেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ছিল এক সম্প্রদায়, যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্য। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না’ ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ধরে নিচ্ছি, একজন সাহাবী ভুল করেছেন। কিন্তু তিনি এই ভুলটি সাধ করে করেন নি; বরং ইজতিহাদ করতে গিয়ে ঘটে গেছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ»
‘বিচারক যদি বিচার করতে গিয়ে ইজতিহাদ করেন এবং সঠিক বিচার করতে সক্ষম হন, তাহলে তাঁর জন্য রয়েছে দু’টি নেকী। পক্ষান্তরে যদি তিনি বিচার করতে গিয়ে ইজতিহাদ করেন, কিন্তু ভুল বিচার করে ফেলেন, তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি নেকী’। [. সহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২; মুসলিম, হা/১৭১৬। দুজনই হাদীসটি ‘আমর ইবনুল আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন।] সেজন্য সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে যেসব মতানৈক্য বা ভুলের কথা উল্লখ করা হয়, সেগুলির দু’টি অবস্থাঃ
হয় সেগুলি তাঁদের উপর মিথ্যারোপ। আর তাঁদের সম্পর্কে উল্লেখিত বেশীর ভাগ মতানৈক্য বা ভুল এই শ্রেণীর।
আর নয়তো সেগুলি সঠিক। আর সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত এই ভুলগুলি সম্পর্কে আমরা বলব, তাঁরা ইজতিহাদ করেছেন। যিনি ইজতিহাদ করতে গিয়ে ভুল করেন নি, তাঁর দুই নেকী। আর যিনি ভুল করেছেন, তাঁর এক নেকী এবং তাঁর গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে।
অতএব, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মধ্যে বিবাদীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা কারো উচিৎ নয়। তবে যদি কেউ তাঁদের পক্ষে লড়াই এবং তাঁদের সম্মান-মর্যাদা বর্ণনার উদ্দেশ্যে এসব বিষয়ে কথা বলে, তাহলে কোন সমস্যা নেই।
পরিশেষে, আমি নিম্নোক্ত দো‘আগুলির মাধ্যমে এই পুস্তিকাটির ইতি টানতে চাইঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ , اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ .
‘হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমনিভাবে আপনি ইবরাহীমের উপর এবং ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি মহা প্রশংসিত, মহা সম্মানিত। হে আল্লাহ! আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের উপর, যেমনিভাবে আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীমের উপর এবং ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের উপর। নিশ্চয়ই আপনি মহা প্রশংসিত, মহা সম্মানিত’।
وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ وَالْأَئِمَّةِ الْمَهْدِيِّيْنَ؛ أَبِيْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقِ , وَعُمَرَ الْفَارُوْقِ , وَعُثْمَانَ ذِيْ النُّوْرَيْنِ , وَأَبِيْ الْحَسَنَيْنِ عَلِيٍّ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ بَقِيَّةِ الْعَشَرَةِ الْمُبَشَّرِيْنَ بِالْجَنَّةِ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ زَوْجَاتِ نَبِيِّكَ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ صَحَابَةِ نَبِيِّكَ الَّذِيْنَ شَهِدُوْا بَدْرًا , عَنْ صَحَابَةِ نَبِيِّكَ الَّذِيْنَ شَهِدُوْا بَيْعَةَ الرِّضْوَانِ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ صَحَابَةِ نَبِيِّكَ أَجْمَعِيْنَ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَمَّنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ .
‘হে আল্লাহ! আপনি চার খরীফা আবু বকর, ওমর, উছমান ও আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের মধ্যে অবশিষ্ট ছয়জনের প্রতিও আপনি সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণের উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং বায়‘আতে রিয্ওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল সাহাবীর উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি তাঁদের পথের প্রকৃত অনুসারীদের উপর সন্তুষ্ট হোন’।
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ .
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ আপনি রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়’।
اللَّهُمَّ إِنَّا نَبْرَأُ إِلَيْكَ وَنَعُوْذُ بِكَ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- مِنْ طَرِيْقَةِ مَنْ يَّقَعُ فِيْ أَحَدٍ مِّنْ أَصْحَابِ النِّبيِّ صلى الله عليه وسلم , اللَّهُمَّ إِنَّا نَبْرَأُ إِلَيْكَ مِنْ طَرِيْقَةِ هَؤُلاَءِ , وَنَعُوْذُ بِكَ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- مِنْ مَسْلَكِهِمْ , وَنَسْأَلُكَ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ أَنْ تَعْمُرَ قُلُوْبَنَا بِمَحَبَّةِ أَصْحَابِ نَبِيِّكَ أَجْمَعِيْنَ , وَأَنْ تَحْشُرَنَا مَعَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ -.
‘হে আল্লাহ! যারা সাহাবীগণকে গালি দেয়, তাদের পথাবলম্বন থেকে আমরা আপনার কাছে পরিত্রাণ চাচ্ছি। হে আল্লাহ! তাদের এই নিকৃষ্ট আচরণ থেকে আমরা আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল সাহাবীর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে আপনি আমাদের হৃদয়সমূহকে পূর্ণ করে দিন এবং তাঁদের সাথে আপনি আমাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন একত্রিত করুন।
اللَّهُمَّ وَاغْفِرْ لَنَا أَجْمَعِيْنَ , اللَّهُمَّ وَفِّقْنَا لِمَا تُحِبُّ وَتَرْضَى , وَأَعِنَّا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى .
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যা ভালবাসেন, আমাদেরকে তা-ই করার তাওফীক্ব দান করুন। আপনি আমাদেরকে সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে সহযোগিতা করুন।
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ مُوجِبَاتِ رَحْمَتِكَ , وَعَزَائِمَ مَغْفِرَتِكَ , وَالْغَنِيمَةَ مِنْ كُلِّ بِرٍّ , وَالسَّلَامَةَ مِنْ كُلِّ إِثْمٍ , وَالْفَوْزَ بِالْجَنَّةِ , وَالنَّجَاةَ مِنَ النَّارِ .
‘হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে এমন আমল প্রার্থনা করি, যা আপনার রহমত লাভ নিশ্চিত করবে এবং যা আমার জন্য আপনার ক্ষমা বয়ে আনবে। আমরা আপনার কাছে সবধরণের কল্যাণকর কাজের সুযোগ চাই। আমরা আপনার কাছে সকল পাপ থেকে নিরাপত্তা এবং জান্নাত লাভের সফলতা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করি’।
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لَنَا دِيْنَنَا الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِنَا وَأَصْلِحْ لَنَا دُنْيَانَا الَّتِي فِيهَا مَعَاشُنَا وَأَصْلِحْ لَنَا آخِرَتَنَا الَّتِي فِيهَا مَعَادُنَا وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لَنَا فِي كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لَنَا مِنْ كُلِّ شَرٍّ .
‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের দ্বীনকে সঠিক করে দিন, যা আমাদের সবকিছুর রক্ষাকবচ। আর আপনি আমাদের জন্য আমাদের দুনিয়াকে সঠিক করে দিন, যাতে রয়েছে আমাদের জীবিকা। আমাদের জন্য আমাদের আখেরাতকেও শুদ্ধ করে দিন, যেখানে হবে আমাদের প্রত্যাবর্তন। আপনি আমাদের জীবনকালকে প্রত্যেক কল্যাণকর কাজে বৃদ্ধি করুন এবং আমাদের মৃত্যুকে সকল অনিষ্টতা থেকে প্রশান্তি লাভের উপায় করে দিন’।
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا , وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوْبِنَا , وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ , وَأَخْرِجْنَا مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوْرِ , وَبَارِكْ لَنَا فِيْ أَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا , وَقُوَّاتِنَا أَبَدًا مَا أَحْيَيْتَنَا .
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পরস্পরের দ্বন্দ্ব-কলহ মীমাংসা করে দিন। আপনি আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টি করে দিন। আমাদেরকে আপনি শান্তির পথে পরিচালিত করুন। আপনি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসুন। যতদিন আমরা বেঁচে থাকি, ততদিন আপনি আমাদের শ্রবণ শক্তি, দর্শন শক্তি এবং দৈহিক শক্তিতে বরকত দান করুন’।
اللَّهُمَّ اجْمَعْنَا عَلَى طَاعَتِكَ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- وَمَا يُقَرِّبُ إِلَيْكَ وَثَقِّلْ بِهِ مَوَازِيْنَنَا – يَا حَيُّ ياَ قَيُّوْمُ , يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ -.
‘হে আল্লাহ! যে আমল বান্দাকে আপনার নিকটবর্তী করে দেয়, সেই আমলের ক্ষেত্রে এবং আপনার অনুসরণের ক্ষেত্রে আপনি আমাদেরকে সংঘবদ্ধ করুন। হে চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী! এর বিনিময়ে আপনি আমাদের নেকীর পাল্লা ভারী করে দিন।
اللَّهُمَّ اجْعَلْنَا مِمَّنْ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ , أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ , وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ .
‘হে আল্লাহ! যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে; অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে, আপনি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেছেন এবং তারাই বুদ্ধিমান’।
সবশেষে, আবার মহান রব্বুল আলামীনের প্রশংসা করছি। আল্লাহ তাঁর বান্দা ও রাসূলের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর দরূদ, সালাম ও বরকত নাযিল করুন। [. এই বিষয়বস্তুটি মূলতঃ মদীনার মসজিদে ক্বুবাতে উপস্থাপিত একটি বক্তব্য। ক্যাসেট থেকে বক্তব্যটি আলাদা করা হয়েছে এবং আমি এখানে কিছু সংশোধনীও এনেছি। তবে বক্তব্যটি বক্তব্য আকারে রেখে দেওয়াই ভাল মনে করেছি। মহান আল্লাহ একক তাওফীক্বদাতা।]
আমাদের সালাফে ছালেহীনের এক ব্যক্তিকে [. ঘটনাটি ওমর ইব্ন আব্দুল আযীয (রহঃ) থেকে বর্ণনা করা হয় (‘হিলইয়াতুল আওলিয়া’, ৯/১১৪; ‘আল-মুজালাসাহ’/১৯৬৫)। এখানে উক্তিটির শব্দগুলি এভাবে এসেছে, تِلْكَ دِمَاءٌ طَهَّرَ اللهُ يَدِي مِنْهَا، فَمَا لي أُخَضِّبُ لِسَانِي فِيْهَا ‘সেটি ছিল রক্তাক্ত ইতিহাস, আল্লাহ তাত্থেকে আমার হাতকে মুক্ত রেখেছেন। তাহলে এবিষয়ে কথা বলে খামাখা কেন আমি আমার জিহ্বাকে রঞ্জিত করব?!’] যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন,
تِلْكَ فِتْنَةٌ طَهَّرَ اللهُ مِنْهَا سُيُوْفَنَا , فَلْنُطَهِّرْ مِنْهَا أَلْسِنَتَنَا .
‘এটি ছিল একটি ফেৎনা। আল্লাহ তাত্থেকে আমাদের তরবারীকে মুক্ত রেখেছেন। অতএব, আমরা তা থেকে আমাদের যবানকেও মুক্ত রাখব’।
আরেকজনকে [. তিনি হলেন ইমাম আহমাদ (খাল্লাল, ‘আস-সুন্নাহ’, ২/৪৮১)।] এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন,
﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسَۡٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٣٤﴾ [ البقرة : ١٣٤ ]
‘তারা ছিল এক সম্প্রদায়, যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্য। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না’ (আল-বাক্বারাহ ১৩৪)।
যদি ধরেও নিই যে, কোন একজন সাহাবী ভুল করেছেন; তবে আপনার তাতে মাথা ঘামানোর দরকার কি! ক্বিয়ামতের দিন কি আল্লাহ এই ভুলের জন্য আপনার কাছে হিসাব চাইবেন? আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না’। আপনি সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর পর্যবেক্ষক নন, তাহলে কেন আপনি তাঁদের মধ্যে বিবাদীয় বিষয়ে নিজেকে জড়াবেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারা ছিল এক সম্প্রদায়, যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্য। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না’ ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ধরে নিচ্ছি, একজন সাহাবী ভুল করেছেন। কিন্তু তিনি এই ভুলটি সাধ করে করেন নি; বরং ইজতিহাদ করতে গিয়ে ঘটে গেছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ»
‘বিচারক যদি বিচার করতে গিয়ে ইজতিহাদ করেন এবং সঠিক বিচার করতে সক্ষম হন, তাহলে তাঁর জন্য রয়েছে দু’টি নেকী। পক্ষান্তরে যদি তিনি বিচার করতে গিয়ে ইজতিহাদ করেন, কিন্তু ভুল বিচার করে ফেলেন, তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি নেকী’। [. সহীহ বুখারী, হা/৭৩৫২; মুসলিম, হা/১৭১৬। দুজনই হাদীসটি ‘আমর ইবনুল আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন।] সেজন্য সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সম্পর্কে যেসব মতানৈক্য বা ভুলের কথা উল্লখ করা হয়, সেগুলির দু’টি অবস্থাঃ
হয় সেগুলি তাঁদের উপর মিথ্যারোপ। আর তাঁদের সম্পর্কে উল্লেখিত বেশীর ভাগ মতানৈক্য বা ভুল এই শ্রেণীর।
আর নয়তো সেগুলি সঠিক। আর সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণিত এই ভুলগুলি সম্পর্কে আমরা বলব, তাঁরা ইজতিহাদ করেছেন। যিনি ইজতিহাদ করতে গিয়ে ভুল করেন নি, তাঁর দুই নেকী। আর যিনি ভুল করেছেন, তাঁর এক নেকী এবং তাঁর গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে।
অতএব, সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মধ্যে বিবাদীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা কারো উচিৎ নয়। তবে যদি কেউ তাঁদের পক্ষে লড়াই এবং তাঁদের সম্মান-মর্যাদা বর্ণনার উদ্দেশ্যে এসব বিষয়ে কথা বলে, তাহলে কোন সমস্যা নেই।
পরিশেষে, আমি নিম্নোক্ত দো‘আগুলির মাধ্যমে এই পুস্তিকাটির ইতি টানতে চাইঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ , اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ .
‘হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমনিভাবে আপনি ইবরাহীমের উপর এবং ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের উপর রহমত বর্ষণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি মহা প্রশংসিত, মহা সম্মানিত। হে আল্লাহ! আপনি বরকত নাযিল করুন মুহাম্মাদের উপর এবং মুহাম্মাদের পরিবার-পরিজনের উপর, যেমনিভাবে আপনি বরকত নাযিল করেছিলেন ইবরাহীমের উপর এবং ইবরাহীমের পরিবার-পরিজনের উপর। নিশ্চয়ই আপনি মহা প্রশংসিত, মহা সম্মানিত’।
وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ وَالْأَئِمَّةِ الْمَهْدِيِّيْنَ؛ أَبِيْ بَكْرٍ الصِّدِّيْقِ , وَعُمَرَ الْفَارُوْقِ , وَعُثْمَانَ ذِيْ النُّوْرَيْنِ , وَأَبِيْ الْحَسَنَيْنِ عَلِيٍّ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ بَقِيَّةِ الْعَشَرَةِ الْمُبَشَّرِيْنَ بِالْجَنَّةِ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ زَوْجَاتِ نَبِيِّكَ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ صَحَابَةِ نَبِيِّكَ الَّذِيْنَ شَهِدُوْا بَدْرًا , عَنْ صَحَابَةِ نَبِيِّكَ الَّذِيْنَ شَهِدُوْا بَيْعَةَ الرِّضْوَانِ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنْ صَحَابَةِ نَبِيِّكَ أَجْمَعِيْنَ , وَارْضَ اللَّهُمَّ عَمَّنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ .
‘হে আল্লাহ! আপনি চার খরীফা আবু বকর, ওমর, উছমান ও আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের মধ্যে অবশিষ্ট ছয়জনের প্রতিও আপনি সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণের উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং বায়‘আতে রিয্ওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল সাহাবীর উপর সন্তুষ্ট হোন। হে আল্লাহ! আপনি তাঁদের পথের প্রকৃত অনুসারীদের উপর সন্তুষ্ট হোন’।
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ .
‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রবর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন। ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ আপনি রাখবেন না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আপনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়’।
اللَّهُمَّ إِنَّا نَبْرَأُ إِلَيْكَ وَنَعُوْذُ بِكَ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- مِنْ طَرِيْقَةِ مَنْ يَّقَعُ فِيْ أَحَدٍ مِّنْ أَصْحَابِ النِّبيِّ صلى الله عليه وسلم , اللَّهُمَّ إِنَّا نَبْرَأُ إِلَيْكَ مِنْ طَرِيْقَةِ هَؤُلاَءِ , وَنَعُوْذُ بِكَ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- مِنْ مَسْلَكِهِمْ , وَنَسْأَلُكَ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ أَنْ تَعْمُرَ قُلُوْبَنَا بِمَحَبَّةِ أَصْحَابِ نَبِيِّكَ أَجْمَعِيْنَ , وَأَنْ تَحْشُرَنَا مَعَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ -.
‘হে আল্লাহ! যারা সাহাবীগণকে গালি দেয়, তাদের পথাবলম্বন থেকে আমরা আপনার কাছে পরিত্রাণ চাচ্ছি। হে আল্লাহ! তাদের এই নিকৃষ্ট আচরণ থেকে আমরা আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল সাহাবীর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে আপনি আমাদের হৃদয়সমূহকে পূর্ণ করে দিন এবং তাঁদের সাথে আপনি আমাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন একত্রিত করুন।
اللَّهُمَّ وَاغْفِرْ لَنَا أَجْمَعِيْنَ , اللَّهُمَّ وَفِّقْنَا لِمَا تُحِبُّ وَتَرْضَى , وَأَعِنَّا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى .
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যা ভালবাসেন, আমাদেরকে তা-ই করার তাওফীক্ব দান করুন। আপনি আমাদেরকে সৎ ও তাক্বওয়ার কাজে সহযোগিতা করুন।
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ مُوجِبَاتِ رَحْمَتِكَ , وَعَزَائِمَ مَغْفِرَتِكَ , وَالْغَنِيمَةَ مِنْ كُلِّ بِرٍّ , وَالسَّلَامَةَ مِنْ كُلِّ إِثْمٍ , وَالْفَوْزَ بِالْجَنَّةِ , وَالنَّجَاةَ مِنَ النَّارِ .
‘হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে এমন আমল প্রার্থনা করি, যা আপনার রহমত লাভ নিশ্চিত করবে এবং যা আমার জন্য আপনার ক্ষমা বয়ে আনবে। আমরা আপনার কাছে সবধরণের কল্যাণকর কাজের সুযোগ চাই। আমরা আপনার কাছে সকল পাপ থেকে নিরাপত্তা এবং জান্নাত লাভের সফলতা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করি’।
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لَنَا دِيْنَنَا الَّذِي هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِنَا وَأَصْلِحْ لَنَا دُنْيَانَا الَّتِي فِيهَا مَعَاشُنَا وَأَصْلِحْ لَنَا آخِرَتَنَا الَّتِي فِيهَا مَعَادُنَا وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لَنَا فِي كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لَنَا مِنْ كُلِّ شَرٍّ .
‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের দ্বীনকে সঠিক করে দিন, যা আমাদের সবকিছুর রক্ষাকবচ। আর আপনি আমাদের জন্য আমাদের দুনিয়াকে সঠিক করে দিন, যাতে রয়েছে আমাদের জীবিকা। আমাদের জন্য আমাদের আখেরাতকেও শুদ্ধ করে দিন, যেখানে হবে আমাদের প্রত্যাবর্তন। আপনি আমাদের জীবনকালকে প্রত্যেক কল্যাণকর কাজে বৃদ্ধি করুন এবং আমাদের মৃত্যুকে সকল অনিষ্টতা থেকে প্রশান্তি লাভের উপায় করে দিন’।
اللَّهُمَّ أَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا , وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوْبِنَا , وَاهْدِنَا سُبُلَ السَّلَامِ , وَأَخْرِجْنَا مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّوْرِ , وَبَارِكْ لَنَا فِيْ أَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا , وَقُوَّاتِنَا أَبَدًا مَا أَحْيَيْتَنَا .
‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের পরস্পরের দ্বন্দ্ব-কলহ মীমাংসা করে দিন। আপনি আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টি করে দিন। আমাদেরকে আপনি শান্তির পথে পরিচালিত করুন। আপনি আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসুন। যতদিন আমরা বেঁচে থাকি, ততদিন আপনি আমাদের শ্রবণ শক্তি, দর্শন শক্তি এবং দৈহিক শক্তিতে বরকত দান করুন’।
اللَّهُمَّ اجْمَعْنَا عَلَى طَاعَتِكَ – يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- وَمَا يُقَرِّبُ إِلَيْكَ وَثَقِّلْ بِهِ مَوَازِيْنَنَا – يَا حَيُّ ياَ قَيُّوْمُ , يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ -.
‘হে আল্লাহ! যে আমল বান্দাকে আপনার নিকটবর্তী করে দেয়, সেই আমলের ক্ষেত্রে এবং আপনার অনুসরণের ক্ষেত্রে আপনি আমাদেরকে সংঘবদ্ধ করুন। হে চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী! এর বিনিময়ে আপনি আমাদের নেকীর পাল্লা ভারী করে দিন।
اللَّهُمَّ اجْعَلْنَا مِمَّنْ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ , أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ , وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ .
‘হে আল্লাহ! যারা মনোনিবেশ সহকারে কথা শুনে; অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে, আপনি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেছেন এবং তারাই বুদ্ধিমান’।
সবশেষে, আবার মহান রব্বুল আলামীনের প্রশংসা করছি। আল্লাহ তাঁর বান্দা ও রাসূলের উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর দরূদ, সালাম ও বরকত নাযিল করুন। [. এই বিষয়বস্তুটি মূলতঃ মদীনার মসজিদে ক্বুবাতে উপস্থাপিত একটি বক্তব্য। ক্যাসেট থেকে বক্তব্যটি আলাদা করা হয়েছে এবং আমি এখানে কিছু সংশোধনীও এনেছি। তবে বক্তব্যটি বক্তব্য আকারে রেখে দেওয়াই ভাল মনে করেছি। মহান আল্লাহ একক তাওফীক্বদাতা।]
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন