HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
কাদিয়ানী মতবাদ (পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ)
লেখকঃ এহসান ইলাহী জহীর
বিংশ শতাব্দীতে কাফের সাম্রাজ্যবাদীদের ইঙ্গিত ও ষড়যন্ত্রে দুটি ঘৃণ্য দল সৃষ্টি হয়। এদের উদ্দেশ্য হল, মুসলমানগণকে তাদের কেবলা ও কা’বা এবং তাদের প্রাণপ্রিয় ও আত্মার আবাসস্থল মক্কা মুকাররামা ও মদিনা মুনাওয়ারা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাদেরকে তাদের আবাসভূমি ও স্বদেশে আবদ্ধ রাখা। যাতে, সেই সুদৃঢ় সম্পর্ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যে সম্পর্ক পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত এবং উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষকে গ্রথিত করে রেখেছে। যে সম্পর্কের কারণে নীল নদের উপত্যকায় বসবাসরত লোকের উপর কোন বিপদ পতিত হলে সমর-কন্দ ও বোখারার অধিবাসীরা ব্যথিত হয়ে পড়ে এবং হিমালয় উপত্যকা ও কাশ্মীরের পাহাড়ি এলাকার অধিবাসীদের জন্য হিজাজ প্রান্ত ও নজ্দ মরুভূমির অধিবাসীরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এ দু’টির একটি হল, কাদিয়ানী দল, [২ আফ্রিকা সহ অন্যান্য দেশে কাদিয়ানীরা ‘আহমাদিয়া’ নামে নিজেদের পরিচয় দানের মাধ্যমে মুসলমানদের প্রতারণা ও ভ্রমে ফেলার প্রচেষ্টা করে। প্রকৃত পক্ষে, তাদের সাথে রাসুল সাঃ যাঁর নাম আহমাদও ছিল- এর কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ভন্ডনবির নাম হল গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। পাক-ভারতে এরা কাদিয়ানী নামেই পরিচিত।] যারা ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট এবং দ্বিতীয়টি হল বাহায়ীয়া দল।
এই প্রধান উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয় কাদিয়ানী দল এবং এরা ইসলাম ও মুসলমানদের সেই সব শত্রুর ছায়াতলে লালিত পালিত হয় যারা, উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার উপর বিপদাপদ পতিত হওয়ার আশায় সর্বদা অপেক্ষায় থাকে, তারাই এদেরকে ধন সম্পদ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাহায্য করতে থাকে।
সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকে এ দলটিকে বিরাট অঙ্কের অর্থ সম্পদ, উচ্চ পর্যায়ের বৃত্তি, বড় বড় পদ ও বিশেষ বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। আর, হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মৌখিক ও লেখনীর মাধ্যমে এদের প্রতিরক্ষার চেষ্টা চালান হয়। তেমনি ভাবে ইহুদী সম্প্রদায় কাল্পনিক হলেও নানাবিধ দলীল এবং শূন্য হলেও বিভিন্ন কৃত্রিম তহবিল দ্বারা তাদের সাহায্য করতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদীরা এখনও এ দলটিকে ইসরাইলে প্রতিষ্ঠিত কাদিয়ানী কেন্দ্র ও আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত এর বিভিন্ন কেন্দ্র সমূহের মাধ্যমে সাহায্য করে চলছে। প্রত্যেকটি দল এ মতবাদ প্রচার করার জন্য চূড়ান্ত শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল মুসলমানগণকে মুজাহিদে আজম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তাঁর ইন্তেকালের চৌদ্দ শত বছর পর আজও তাঁর নাম শুনলে কাফেরদের অন্তর ভয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং তাদের স্কন্ধ থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। এখনও তাঁর উম্মত বিদ্বেষ প্রবণ শত্রুদের গলদেশে কাঁটা স্বরূপ বাঁধে আছে। তাদের সজাগ হওয়ার কল্পনা মাত্র নাস্তিক ও মুশরিকদেরকে তাদের বিশ্রামাগার থেকে কাঁপিয়ে তোলে। তারা ভাল করে জানে যে, মহান নেতা মুহাম্মদ আল-আমীন সাঃ এর জীবন্ত ও মৃতদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারকারী শিক্ষাগুলো মুছে না ফেলা পর্যন্ত তাদের জীবনে শান্তি আসবে না; অথবা, এ শিক্ষাকে এমন ভাবে পরিবর্তন ও বিকৃত করে দিতে হবে, যাতে এর জীবনী শক্তি দূর হয়ে যায় এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তারা মনে করে যে, এ উদ্দেশ্য সফল হতে পারে এ ধরনের আন্দোলন ও দাওয়াতকে সমর্থন করারই মাধ্যমে। এইতো সেই বিশিষ্ট হিন্দু লেখক ড: শঙ্কর দাসের একটি ভাষণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বলেন: ‘‘আমাদের দেশ বর্তমানে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন তা হল এই, কীভাবে আমরা মুসলমানদের অন্তরে জাতীয়তাবাদের স্লোগান সৃষ্টি করতে পারি?’’ আমরা তাদের সাথে সকল প্রকার প্রচেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তাদের সাথে বিভিন্ন প্রকার চুক্তি ও অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয়েছি, তথাপি ভারতের মুসলমানদের উপর এর কোন প্রভাব পড়েনি। এখনও তারা কল্পনা করে যে, তারা একটি স্বাধীন জাতি এবং তারা আরবের গান গায়। সম্ভব হলে তারা ভারতকে আরবের একটি অংশে পরিণত করে দিত।
নৈরাশ্যের এ গভীর অন্ধকারের মধ্যে দেশ প্রেমিক ও হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা শুধু একটিমাত্র দিক হতে আলোর ছিটা দেখছে; তা হল কাদিয়ানী সম্প্রদায়। যত বেশি মুসলমান কাদিয়ানী মতবাদের দিক ঝুঁকে পড়বে, তারা মক্কার পরিবর্তে কাদিয়ানকে তাদের কিবলা ও কাবা কল্পনা করবে। আর, এভাবেই তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নিকটবর্তী হয়ে আসবে। কাদিয়ানী মতবাদের উন্নতি ব্যতিরেকে আরবী সভ্যতা ও ইসলামী জাতীয়তাবাদের চেতনাকে দূরীভূত সম্ভব নয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে আমাদের বিবেচনা করা উচিত। সে মতে ভারতের পাঞ্জাব এলাকা থেকে একটি লোক আবির্ভূত হয় এবং মুসলমানগণকে তার অনুসরণ করতে আহবান জানায়। যে তার অনুসরণ করবে সে এককালে শুধু মুসলমান থাকার পর এখন কাদিয়ানী মুসলিম হিসাবে পরিগণিত হবে এবং বিশ্বাস করবে যে:-
১- নিশ্চয়ই আল্লাহ মানব জাতীর হেদায়েত ও পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে রাসূল প্রেরণ করেন।
২- আরব জাতীর অবনতির যুগে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রাসূলরূপে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন।
৩- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আল্লাহ তায়ালা অপর নবীর প্রয়োজন বোধ করেন। তাই, তিনি মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে রাসূলরূপে প্রেরণ করেন। সম্ভবত: আমার স্বজাতি ভাইয়েরা প্রশ্ন করবেন যে, তার এ ধর্ম বিশ্বাস আমাদের কি উপকারে আসবে? উত্তরে আমি বলব- যেমন একজন হিন্দু যদি মুসলমান হয়ে যায়, তবে রাম, কৃষ্ণ, বেদ, গীতা ও রামায়ণ থেকে তার ভালোবাসা কুরআন ও আরবের প্রতি চলে যায়, তদ্রুপ একজন মুসলমান যদি কাদিয়ানী হয়ে যায় তা হলে তার দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন হয়ে পড়বে এবং মুহাম্মদ সা: এর প্রতি তার ভালোবাসা কমে যাবে। আর, তার খিলাফতের কেন্দ্র আরব উপদ্বীপ ও তুর্কিস্থান থেকে কাদিয়ানের দিকে পরিবর্তিত হয়ে পড়বে এবং প্রাচীন এক পবিত্র স্থান হওয়া ছাড়া মক্কার আর কোন গুরুত্ব তার কাছে থাকবে না।
প্রত্যেকটি কাদিয়ানী সে যেখানেই থাকুক না কেন, চাই আরব, তুর্কিস্থান, ইরান অথবা পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলে অবস্থান করুক, সর্বদাই তার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কাদিয়ান অভিমুখে হবে এবং কাদিয়ান তার মুক্তির কেন্দ্রস্থল হবে। আর এতেই ভারতকে পবিত্র মনে করার রহস্য নিহিত। প্রত্যেকটি কাদিয়ানী ভারতকে পবিত্র মনে করবে। কেননা কাদিয়ান ভারতে অবস্থিত এবং গোলাম আহমাদও ভারতীয়। তার খলীফাগণ ও প্রতিনিধিগণ সকলেই ভারতীয়। এ কারণেই ধর্মান্ধ মুসলমানগণ কাদিয়ানী মতবাদকে সন্দেহের চোখে দেখে। কেননা, তাদের ধারণা যে, কাদিয়ানী মতবাদ আরব সভ্যতা ও প্রকৃত ইসলামের শত্রু। এ জন্যই খেলাফত আন্দোলনে [৩ তুরস্কে উছমানী খেলাফতের পতনের সময় ভারতীয় মুসলমানগণ তীব্র প্রতিবাদের ঝড় তুলে খেলাফতের পূনঃ প্রতিষ্ঠা দাবী করে। এই আন্দোলনের নাম ছিল ‘খেলাফত আন্দোলন’। এর প্রতি ইঙ্গিত করে হিন্দু লিখক বলেন যে কাদিয়ানীরা খেলাফত পূনঃপ্রতিষ্ঠার দাবীতে মুসলমানদের সমর্খন করেনি।]
কাদিয়ানীরা মুসলমানদের সমর্থন করেনি। কারণ, তারা আরব ও তুরস্কের পরিবর্তে কাদিয়ানেই খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর এটাই সাধারণ মুসলমানদের উপর, যারা ইসলামী পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখে, একটা বড় আঘাত। অপর পক্ষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্য আনন্দের বিষয়। (ড: শঙ্কর দাস বি, এস, সি; এম, বি, বি, এস এর প্রবন্ধ যা হিন্দুদের পত্রিকা ‘‘বন্দে মাতরমে’’ লিখিত এবং ২২ এপ্রিল ১৯৩২ সালে প্রকাশিত।) প্রকাশ থাকে যে, যখন ইসলাম ও রেসালাতে মুহাম্মাদীর কবি ড: মুহাম্মদ ইকবাল কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখেন, যাতে তিনি ওদের মিথ্যা ও বিভ্রান্তির স্পষ্ট বর্ণনা দেন, তখন সর্ব প্রথম ব্যক্তি যিনি তার প্রতিবাদ করেন এবং কাদিয়ানীদের পক্ষে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন তিনি হলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের নেতা জওহার লাল নেহরু। তিনি ওদের সমর্থনে কতকগুলো প্রবন্ধ লিখলেন। যার ফলে কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমাদ কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে জওহার লাল নেহরুর প্রতি সংবর্ধনা জ্ঞাপনে উৎসাহিত করতে গিয়ে ঘোষণা করেন: সম্মানিত জওহার লাল নেহরু ড: মুহাম্মদ ইকবালের ঐ সকল প্রবন্ধের প্রতিবাদ করেছেন, যেগুলো তিনি এ কথা প্রমাণ করার জন্য রচনা করেছেন যে কাদয়িনীগণ একটি স্বতন্ত্র কাফের দল এবং ইসলামের সাথে ঐ দলের কোন সম্পর্ক নেই। এর প্রতিবাদে জওহার লালই দাঁড়িয়েছেন এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, কাদিয়ানীদের উপর ড: ইকবালের আপত্তিসমূহ একেবারেই অযৌক্তিক। সুতরাং জওহার লাল নেহরুকে আন্তরিকতার সহিত সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা কাদিয়ানীদের কর্তব্য। (জুময়ার খুতবা যা কাদিয়ান নগরে কাদিয়ানী খলীফা প্রদান করেছিল। কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে প্রকাশিত ১৮ই জুন ১৯৩৬ খৃ:) অতপর: ইসলামের কবি নেহরুর পাল্টা জবাব দেন এবং তার কাদিয়ানীদের পক্ষ অবলম্বনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে বলেন: নিশ্চয়ই জওহার লাল নেহরু ও তার জাতীয়তাবাদী সঙ্গী-সাথীরা মুসলমানদের পুনরুত্থান ও উন্নতিতে অস্থির, যেমন কাদিয়ানীরা ঐ একই কারণে অস্থির। তারা অনুভাব করে যে, এ উন্নতি ও আন্দোলন তাদের মূল পরিকল্পনা অর্থাৎ আমাদের প্রাণপ্রিয় মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ভারতীয় মিথ্যা নবুয়তের দাবিদারের জন্য একটি উন্নত উম্মত তৈরি করে দেওয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেবে। এ কারণেই জওহার লাল নেহরু তাদেরকে সমর্থন করেন। নচেৎ ওদের সাথে তার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? ( ড: মুহাম্মদ ইকবালের আল-কাদিয়ানীয়াহ ও আল-ইসলাম নামক প্রবন্ধ যা আল-ইসলাম নামক ইংরেজি ম্যাগাজিনে প্রচারিত, ২২ জানুয়ারি ১৯৩৬ খৃ: প্রকাশিত।)
এ ধরনের আন্দোলন যখন গড়ে উঠেছিল, তখন আশা ছিল যে ইসলাম বিরোধী শক্তি সমূহ তাকে সহায়তা করবে। কার্যত: তাকে সাহায্য করেছে এবং সমর্থনও দিয়েছে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদীরা একে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য লোকজনকে উহার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এদের অধিকাংশই ছিল উপনিবেশবাদী ইংরেজ সরকারের বেতনভোগী আমলা ও জায়গিরদার; যাদের কোন ধর্ম নেই, একমাত্র সরকারের সেবা ও সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া এদের আর কোন দীন-ধর্ম নেই।
নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমাদ নিজেই একথা স্বীকার করেছে। সে বলেছে যে, আমার দলে যারা প্রবেশ করেছে তাদের অধিকাংশ ইংরেজ সরকারের সদস্য বড় বড় চাকুরিজীবী, বা তারা এ দেশের নেতৃস্থানীয় লোক ও ব্যবসায়ী, অথবা তারা উকিল ও ইংরেজি শিক্ষার্থী কিংবা তারা আলেম ফাযেল যারা অতীতে ইংরেজ সরকারের সেবা করেছে বা বর্তমানেও করছে এবং তাদের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব। মোটকথা, এ দলটি তার মুরববী ইংরেজ সরকার দ্বারা গঠিত, তাদের সন্তুষ্টি অর্জনকারী এবং তাদের পুরস্কারে ধন্য। সুতরাং আমি এবং অনুসারী শিক্ষিত সমাজ মানুষের কাছে এ সরকারের অবদান সমূহ বর্ণনা করে আসছি এবং হাজার হাজার লোকের অন্তরে এর আনুগত্য দৃঢ় করছি। (ইংরেজ সরকারের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নরের কাছে গোলাম কাদিয়ানীর চিঠি ‘‘তাবলীগে রিসালত’’ নামক গোলামের ঘোষণা বলীর অন্তর্ভুক্ত, ৭ম খন্ড ১৮ পৃ:, কাসেম কাদিয়ানী কর্তৃক সংকলিত)
অতএব, যখন থেকে এ দলটি গঠিত হয় এবং উহার তৎপরতা আরম্ভ হয়, তখন থেকেই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকে। আমি দ্বীনি মাদ্রাসা সমূহে পাঠ্যরত থাকা কালে এ আন্দোলন সম্পর্কে শেয়খুল ইসলাম ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, সেই যুগের ইমাম শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম শিয়ালকোটি এবং আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা মুহাদ্দিস হাফেজ মুহাম্মদ জলন্দরী প্রমুখ ওলামাদের লিখিত কিতাব সমূহের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করি। তারপর ঘটনা হল এই, যখন আমি ও আমার কিছু সাথী আমার নিজ শহর শিয়াকোটে অবস্থিত বাহায়ীদের মজলিসে এবং খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের সাথে আলোচনা ও বিতর্কের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করছিলাম, তখন কাদিয়ানী মতবাদের কিছু লোক আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাকে তাদের মুবাল্লেগের সহিত আলোচনার জন্য আহবান জানায়। যেহেতু এ ধরনের আলোচনার প্রতি আমার অতি আগ্রহ ও মনোযোগ ছিল। তাই আমি ইতস্ত. না করে শুধু একটি মাত্র শর্তে তাদের আহবান গ্রহণ করলাম। শর্তটি হল, তারা আমাকে গোলাম আহমদের পুস্তক সমূহ ধার দেবে। তারা আমাকে পাঁচটি বই ধার দিল। এ গুলোর নাম আমার এখনও স্মরণ আছে। তা হল:
১- আনজামে আছিম ২- এজালাতুল আওহাম ৩- দুররে ছামীন ৪- হাকীকাতুল ওহী এবং ৫- ছাফিনায়ে নূহ। প্রথম ও তৃতীয় বই দুটিতে বিরক্তিকর ও অর্থহীন বিষয় থাকা সত্ত্বেও আমি একই রাতে পড়ে নিলাম। এভাবে আমি অবশিষ্ট বইগুলি দুই বা তিন দিনের মধ্যে পড়ে শেষ করে নিলাম। প্রতিশ্রুত নির্দিষ্ট দিনে আমরা কয়েকজন সাথী একত্রিত হয়ে কাদিয়ানীদের মসজিদে গমন করলাম। সেখানে তারাও আমাদের অপেক্ষায় ছিল। অল্প কিছু কথা বার্তার পর আমরা আলোচনার বিষয়বস্ত্ত ঠিক করে নিলাম: ‘‘গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ।’’ কেননা, গোলাম তার ভবিষ্যদ্বাণী গুলোকে তার নবুয়তের মাপকাঠি রূপে নির্ধারণ করেছিল। তাই আমি আব্দুল্লাহ আছিমের মৃত্যু সম্পর্কে গোলাম আহমাদের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা প্রথমে তুলে ধরলাম। গোলাম বলেছিল যে, সে পনেরো মাসের শেষ দিকে মারা যাবে। আর, আমি প্রমাণ করে দিলাম যে, সে তার জন্য নির্ধারণকৃত সময়ে মারা যায়নি। সুতরাং তোমাদের মিথ্যা নবীর নবুয়্যত প্রমাণিত হয়নি। অতএব সে তার নবুয়তের দাবিতে সত্যবাদী নয়। কেননা, নবির ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়া অপরিহার্য। [৪ ‘‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী ও তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ’’ নামক প্রবন্ধে এই সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।] তখন আমি দেখতে পাই যে, কাদিয়ানী মুবাল্লেগের মুখ থেকে ফেনা বের হওয়ার পর সে ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে। সে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু এ প্রবল প্রমাণাদির উত্তর দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশেষে সে এ কথা বলতে বাধ্য হল যে, আমি বিতর্কে পারদর্শী নই। তবে, ‘রাবওয়া’ [৫ ‘রাবওয়া’ পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমানে পাকিস্তান) একটি ক্ষুদ্র শহর। কাদিয়ানীরা এই শহর তৈরী করে তাদের কেন্দ্রে পরিণত করে।] থেকে বিতর্ককারী একজন কাদিয়ানী আলেম আসবে। তখন আমরা আপনাদেরকে তার সাথে বাহাছ করার জন্য আহবান করব। আমরা বিজয়ী হয়ে তাদের ওখান থেকে ফিরলাম এবং তাদের কাছ থেকে কাদিয়ানীদের আরও কতকগুলো বই ধার স্বরূপ নিয়ে আসলাম। এভাবেই, আমি কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই এ ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা আরম্ভ করলাম। এরপর থেকে আমি এবং আমার বন্ধু বান্ধবরা বাহায়ীদের মাহফিল, খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠান ও কাদিয়ানীদের কেন্দ্রসমূহে আরও বেশি করে যাতায়াত শুরু করলাম। অবশেষে, আমি তাদের কেন্দ্রস্থল রাবওয়াতে উপস্থিত হই, যেখানে কাদিয়ানীরা ও তাদের বিতর্ককারীরা জড় হয়। তাদের খলীফাও সেখানে বাস করে। তাদের সাথে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলে, আল হামদু লিল্লাহ ফলাফল প্রথম আলোচনার বিপরীত হয় নি ।( অর্থাৎ আমরাই বিজয়ী হই)
অতঃপর, আমি কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে পাকিস্তানের উর্দু ম্যাগাজিনে কতকগুলো প্রবন্ধ লিখি। যখন আমি মদিনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ লাভ করি এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকগণের সাথে মিলিত হই, এবং বাইতুল্লাহ শরীফে ও মসজিদে নববীতে আগত হাজীগণের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের দেশে কাদিয়ানী মতবাদের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে পারি, তখন আমি আরবী ও অন্যান্য ভাষায় কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে পুস্তক লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভাব করি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন উস্তাদ যেমন ফিক্হ শাস্ত্রের অধ্যাপক বিজ্ঞ শেখ আতিয়া মুহাম্মদ সালেম, আরবী ভাষার অধ্যাপক শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম শকরা, ইতিহাসের অধ্যাপক শেখ আব্দুল হক মাহরুছ ও অন্যান্যরা যখন জানতে পারলেন যে, ইতি পূর্বে আমি কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে উর্দু ভাষায় পুস্তক লিখেছি তখন তারা আমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এই ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। আমি আল্লাহর সাহায্য কামনা করি এবং কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে ‘‘কাদিয়ানীরা উপনিবেশবাদীদের এজেন্ট’’ শিরোনামে আমার প্রথম প্রবন্ধটি রচনা করি। আর আমি একথা ঠিক করে নিলাম যে, আমি কোন কথাই উহার উৎস উল্লেখ না করে লিখব না। এ প্রবন্ধটি আমি দামেস্কের বিখ্যাত ‘‘হাদারাতুল ইসলাম’’ নামক ম্যাগাজিনে প্রেরণ করি; যা ইতিপূর্বে আমার আরও কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। ১৩৮৬ হিঃ সনে ‘‘হাজারাতে ইসলামীয়ার’’ তৃতীয় সংখ্যায় আমার এ প্রবন্ধটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু বান্ধবের কাছে তা বিপুলভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয়। আমার সাথী ও উস্তাদগণ বিশেষকরে, পূর্বোল্লিখিত অধ্যাপকগণ এবং শেখ হাবীব হাম্মাদ আনসারী অধ্যাপক হাদীস ও শরীয়া বিভাগ, বিশিষ্ট শেখ আব্দুল কাদের সাইবাতুল হামদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ও উসুলে দ্বীন বিভাগের তাফসীর ও বিভিন্ন ফিরকা ও ধর্মতত্ব বিষয়ের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড: আদীব সালেহ, হাদারাতুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ও দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উলুমুল কুরআনের অধ্যাপক প্রমুখ ব্যক্তিগণ এভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে আমাকে উৎসাহিত করেন। ফলে, পূর্বের ন্যায় ধারাবাহিক লেখা এবং উল্লেখিত ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ পাঠানোর ছিল-ছিলা চলতে থাকে। উক্ত ম্যাগাজিন ও আগ্রহের সাথে তা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এরপর প্রবন্ধগুলো শেষে একত্র করে একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা আমি সমীচীন মনে করলাম। তাই, আমি বিভিন্ন প্রকারের দশটি প্রবন্ধ সংবলিত পুস্তকটি এখন পেশ করছি।
এতে আমি আলোচনা করেছি কাদিয়ানী মতবাদের জন্ম ও তার ইতিহাস এবং ঐ সকল কারণ যা এ মতবাদ গঠনে ও তাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে এর সম্পর্ক, এর মূল আকীদাসমুহ, এর প্রতিষ্ঠাতা ও নবুয়তের দাবিদারের ইতিহাস, তার জীবন বৃত্তান্ত, তার দাবি সমূহ, আল্লাহর নবী রাসূল, আউলিয়ায়ে উম্মত ও সৎ লোকদের অবমাননা ইত্যাদি। সাথে এ ভাবে আমি কাদিয়ানীদের বিশ্বাসগত বক্তব্য এবং তাদের মিথ্যা নবীর বাদী-দাওয়া সমূহ তাদেরই বই পুস্তক ও উদ্ধৃতির দ্বারা বিশ্লেষণ করছি। এ মতবাদের অসারতা ও উহার প্রতিষ্ঠাতার দাবিদাওয়ার অসত্যতা তাদের স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছি। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা আমি প্রয়োজন মনে করি:
১- যেখানেই আমি কোন বক্তব্য উল্লেখ করে কাদিয়ানী পত্রিকা অথবা ম্যাগাজিনের উদ্ধৃতি যা দিয়েছি, তা প্রফেসার মুহাম্মদ ইলিয়াছ বরনীর ‘‘কাদিয়ানী মাজহাব’’ নামক তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ থেকে গৃহীত। গ্রন্থটি সাধারণ অসাধারণ সব লোকের কাছে পাওয়া যায়। ইহা অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে, কিন্তু কোন কাদিয়ানী এর উৎস বা উদ্ধৃতিসমূহকে ভুল প্রতিপন্ন করার সাহস পায়নি। সুতরাং এর উদ্ধৃতিগুলো মুসলমান ও কাদিয়ানী সকলের কাছে নির্ভরযোগ্য।
২- আমার প্রবন্ধসমূহে যে সকল কিতাব ও উহার পৃষ্ঠা উল্লেখ করেছি, তার অধিকাংশ প্রথম সংস্করণের। কারণ, কাদিয়ানীদের অভ্যাস হল যখনই তারা তাদের কিতাবের নতুন সংস্করণ করে, তখনই উহার পৃষ্ঠাগুলো পরিবর্তন করে ফেলে। ইহা ছাপার তারতম্য হেতু নহে, বরং ইহা তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা করে থাকে। যেমন আমি ‘‘কাদিয়ানী মতবাদ ও প্রতিশ্রুত মাসীহের আকীদা’’ প্রবন্ধে নবুয়তের মিথ্যা দ্বাবীদার কাদিয়ানী থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছি যে, ইসা আঃ দাজ্জালকে বাইতুল মুকাদ্দাসের লুধ নামক এক গ্রামের ফটকে পেয়ে হত্যা করবেন। এ উক্তিটি গোলামের ‘‘এজালাতুল আওহাম’’ নামক পুস্তকের প্রথম সংস্করণে ২২০ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। কিন্তু কাদিয়ানীরা তা দ্বিতীয় সংস্করণের ৯১ পৃষ্ঠায় স্থানান্তরিত করে ফেলে। পার্থক্য সুস্পষ্ট। মিথ্যুক কাদিয়ানী অমৃত-সর নিবাসী শাইখুল ইসলাম ছানাউল্লাহকে ‘হে বাতাসের পুত্র’ ‘হে প্রতারক’ বলেও গালি দিয়েছে। আমি এ কথাটি ‘‘ইতিহাসের মানদন্ডে কাদিয়ানী মতবাদের নবী’’ নামক প্রবন্ধে বর্ণনা করেছি। এ গালিটি আমি তার পুস্তক ‘‘এজাজে আহমদী’’ এর প্রথম সংস্করণের ৪৩ পৃষ্ঠায় পেয়েছি, কিন্তু কাদিয়ানীগণ তা দ্বিতীয় সংস্করণের ৭৭ পৃষ্ঠায় স্থানান্তরিত করে দিয়েছে। ঐ একই প্রবন্ধে আমি উল্লেখ করেছি যে, মির্জা গোলাম লিখেছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, উহা কখন হবে? উত্তরে তিনি বললেন: সকল আদম সন্তানের উপর একশত বৎসরের মাথায় কেয়ামত হবে! আমি তার পুস্তক ‘‘এজালাতুল আওহাম’’ এর ২৫৪ পৃষ্ঠা থেকে এ কথার উদ্ধৃতি দিয়েছি। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে তারা একে ১০৪ পৃষ্ঠায় নিয়ে গেছে। অনুরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে।
কাদিয়ানীদের অধিকাংশ পুস্তকের নাম যে গুলোর অর্থ আরবী ভাষায় বুঝা যায় তা স্বীয় অবস্থায় রেখে দিয়েছি। কিন্তু কিছু পুস্তক যে গুলোর অর্থ আরবী ভাষায় বোধগম্য নহে, সে গুলোকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করে দিয়েছি। যথা: ‘‘কিস্তিয়ে নূহ’’ ইহা গোলামের রচিত পুস্তক। উর্দু ভাষার কিস্তিকে আরবীতে ছাফিনা বলা হয়। তাই লেখার সময় আমি ‘‘ছফিনাতু নূহ’’ লিখেছি। এমনি ভাবে তার আর একটি পুস্তক ‘‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’’ আয়নাকে আরবীতে ‘‘মিরআতুন’’ বলে। তাই আমি উহাকে ‘‘মিরআতু কামালাতে ইসলাম’’ লিখেছি। তদ্রুপ গোলামের পুত্র মাহমুদ আহমাদের ‘‘আয়নায়ে ছদাকাত’’ কে ‘‘মিরআতুছ ছিদক’’ গোলামের ‘‘জংগে মুকাদ্দাস’’কে ‘‘আল- হারবুলমুকাদ্দাস’’ এবং ‘‘এক গালতী কা এজালা’’ কে ‘‘এজালাতুল গালতাহ’’ লিখেছি।
৩- আমি এ পুস্তক রচনা কালে মুসলিম ওলামাদের বহু কিতাব থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছি। উদ্ধৃতি গ্রহণের তালিকায় এর বর্ণনা আসবে। এ প্রবন্ধটি ব্যাপক গবেষণার ফলাফলের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং দলীল প্রমাণ দ্বারা সুদৃঢ়। কাজেই কাদিয়ানীরা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা ও উত্তর দিতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং প্রবন্ধটি এ দলকে অসত্য প্রমাণ করতে এবং উহা যে হিংসা প্রসূত ও সাম্রাজ্যবাদীদের লালিত দল তা নির্ধারণে এক অকাট্য ও প্রকৃষ্ট দলীল রূপে পরিগণিত। আমি এই কিতাবের কোথায়ও আলোচনা ও বিতর্কের নীতি বহির্ভূত কোন কথা না বলার প্রতি লক্ষ রেখেছি এবং ভিত্তিহীন কোন দাবির উপর সিদ্ধান্ত না দেওয়ার নীতি অবলম্বন করেছি। অতএব, পাঠক সমস্ত কিতাবের মধ্যে এমন একটি বিষয়ও পাবেন না, যার উদ্ধৃতি কাদিয়ানীদের কাছে নির্ভরযোগ্য উৎস হতে দেয়া হয়নি। এমনি ভাবে কোন মাসআলা বা কোন হুকুম দানের ক্ষেত্রে আমি বিশুদ্ধ ও সহীহ হাদীস ব্যতীত অন্য কোন হাদীস উপস্থাপন করিনি। আল্লাহর কাছেই তওফিক কামনা করছি।
৪- সব কটি প্রবন্ধ যেভাবে আমি লিখেছিলাম কিতাবের মধ্যে ঐ ভাবেই রেখে দিয়েছি। তাতে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করিনি। তাই, পাঠকবৃন্দ মূল বিষয় বস্ত্তর পরিচিতির জন্য প্রত্যেকটি প্রবন্ধের পূর্বে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা দেখতে পাবেন। প্রথম প্রবন্ধ ছাড়া অন্য সকল প্রবন্ধের ভূমিকা কয়েক লাইনের বেশি নহে। তারপর সকল প্রবন্ধকে আমি এক একটি অধ্যায়ের মত সাজিয়েছি। প্রথম প্রবন্ধ, প্রথম অধ্যায়,দ্বিতীয় প্রবন্ধ, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় প্রবন্ধ, তৃতীয় অধ্যায়, অনুরূপ শেষ পর্যন্ত সাজিয়েছি। দশম অধ্যায়কে কিতাবের পরিশিষ্ট করেছি এবং তাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। কেননা, মিথ্যা নবুয়তের দ্বাবীদার ‘‘মুসাইলামাতুল কাজ্জাব’’ থেকে নিয়ে কাদিয়ানী পর্যন্ত সকল দাজ্জালই মুসলমানদের ‘‘আকীদায়ে খতমে নবুয়্যত ও রিসালাত’’ সম্পর্কে অজ্ঞতাকেই তাদের পুঁজি বানিয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহর নবী ও রাসূল ‘‘মুহাম্মদ আস-সাদিকুল আমিন’’ এর উপর নবুয়্যত ও রেসালাত যে সমাপ্ত হয়েছে, তা সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলমান অজ্ঞ। (তাঁর জন্য আমার মাতা-পিতা ও আমার প্রাণ উৎসর্গ।)
৫- হয়তো কেহ বলতে পারেন যে, আমি গোলাম আহমদ কদিয়ানী ও তার অনুসারীদের বেলায় কোন প্রকার আদব ও সম্মান সূচক শব্দ ব্যবহার করিনি। ইহা আহলে হাদীসের অভ্যাসের পরিপন্থী। কেননা, তারা তাদের বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।
উত্তরে আমি বলব, সম্মান ঐ সকল লোকের জন্য জায়েজ বা মুস্তাহাব, বরং ক্ষেত্র বিশেষে ওয়াজিবের পর্যায়ে গণ্য যারা, শুধু মতামত ও চিন্তাধারার বিরুদ্ধবাদী। কিন্তু ঐ সকল লোকদের জন্য সম্মান প্রদর্শন করা জায়েজ নহে, যারা ইসলাম ধর্ম থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে এবং আল্লাহর নবি রাসূলগণের প্রতি বেয়াদবী করে এবং রাসুলুল্লাহর ওয়াজীরগণ, তার দরদী, সন্তান ও সৎ সাহাবীগণকে গালি গালাজ করে। আর, সাইয়েদুল মুরসালীনের মর্যাদা লাভের এবং নবুয়্যত ও রেসালাতের দাবিকরে। এ ধরনের লোকদের সম্মান করা মুসলমানদের জন্য হারাম। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ ধরনের লোকদের সম্বোধন করতেন তখন এরূপ উক্তি দ্বারা সম্বোধন করতেন ‘‘মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহর পক্ষ থেকে মিথ্যাবাদী মুসায়লামার প্রতি।’’ আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। কাউকে গালি-গালাজ করা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমরা কাউকে গালি দেইনি, যদিও সে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মত দাজ্জাল হয়। আমরা নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেই বাণীর উপর আমল করি ‘‘ দোষারোপ ও লানতকারী খাঁটি মুমিন নয়।’’ (ইমাম তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন)
এই হল অত্র কিতাবে সন্নিবেশিত পাঁচটি ব্যতিক্রম, যা অধ্যয়ন শুরু করার পূর্বেই পাঠকের কাছে আমি বর্ণনা করে দিতে চেয়েছি।
পরিশেষে আমি ইসলামী সংগঠনগুলোর প্রতি এবং যাদের কাছে ইসলামী সমস্যাবলির গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে মক্কা ভিত্তিক রাবেতায়ে আলমে ইসলামী, করাচী ইসলামী গবেষণা বোর্ড, কায়রো, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা মুনাওয়ারা প্রভৃতি সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের প্রতি আহবান রাখছি, তারা যেন এ সকল কাফের ও ধর্মান্তরিত লোকের থাবা থেকে মুসলমানগণকে উদ্ধারের জন্য কাজ করেন, সাধারণ ভাবে আরব দেশ ও অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে আফ্রিকা ও ইউরোপে। যেখানে কাদিয়ানীরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের এবং খাঁটি স্বচ্ছ ধর্ম ইসলামের শত্রুদের সহায়তায় বিরাট ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ইসলামের এ সকল শত্রু সম্প্রদায় কাদিয়ানীদেরকে সকল প্রকারে ও বিভিন্ন উপায়ে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য করে চলেছে, যাতে তারা মুসলমানগণকে প্রকৃত ইসলাম থেকে এবং যে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে তারা আছেন তা থেকে ইসলামের নামে ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে দুরে সরিয়ে দিতে পারে। এর কারণ হল, ঐ সব দেশে খাঁটি মুসলিম ওলামার স্বল্পতা, তাদের পদ শূন্যতা, আসল কাদিয়ানী মতবাদের হাকীকত ও তাদের কার্যাবলী সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলমানের অজ্ঞতা এবং আফ্রিকা সম্বন্ধে মুসলিম বিশ্বের উদাসীনতা। যখন কাদিয়ানীরা আফ্রিকায় পাঁচটিরও বেশি উচ্চ মানের ম্যাগাজিন মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি, ষড়যন্ত্র ও কুফরী চিন্তাধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে ইসলামের শত্রুদের সহায়তায় প্রকাশ করে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে সমস্ত আফ্রিকায় মুসলমানদের এমন একটি ম্যাগাজিন পাওয়া যায়নি যা ওদের মুকাবেলা ও তাদের বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি প্রকাশ করতে পারে। উপরন্তু, তারা শত শত কাদিয়ানী মুবাল্লেগ নিযুক্ত করে রাখছে, যারা অন্যান্য মহাদেশসহ আফ্রিকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে তারা সাতচল্লিশটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং দুই শত ষাটটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। তার সাথে রয়েছে অনেক বিশেষ বিশেষ ও সাধারণ লাইব্রেরি, বই পুস্তক পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন ভাষায় কোরান শরীফ অনুবাদের ব্যবস্থা করেছে। ইদানীং তারা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেকগুলো হাসপাতাল ও সমাজ কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তাদের ঘোষণা অনুযায়ী আফ্রিকায় তাদের অনুসারীদের সংখ্যা পনেরো বৎসরের মধ্যেই দুই মিলিয়নের ও বেশি হয়ে গেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল বিভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী এ দলটি সাম্রাজ্যবাদীদের ও ইংরেজ সরকারের সকল প্রকার সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও তাদেরই রাজত্বকালে ভারত উপমহাদেশে যেখানে উহার কেন্দ্র অবস্থিত, গুটি কতেক ব্যক্তি ছাড়া কাউকে তাদের দলে ভিড়াতে পারেনি; যারা সাম্রাজ্যবাদীদের কোলে দীর্ঘ সত্তুর বছর ধরে লালিত পালিত হয়েছে। এদের সংখ্যা কয়েক হাজারের অধিক নহে। এদের মসজিদ কয়েক দশকেরও বেশি হয়নি এবং এদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা নয় এর বেশি নহে। এখানে এদের এমন অবস্থা হওয়ার কারণ এই যে, মুসলমানরা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানতে পেরেছে এবং তাদের তৎপরতা উদ্ঘাটন করে দিয়েছে। আর, আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে ইসলাম প্রচারকদের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। এর কারণ কি? মুসলমানগণ কি এতই দরিদ্র হয়ে পড়েছে যে, ঐ সকল দেশে মুবাল্লেগ প্রেরণ করার মত তাদের সামর্থ্য নেই অথবা এর আর কি কারণ থাকতে পারে?
আমাদের প্রত্যেককে এর উত্তর সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। আমাকে সুযোগ দিলে আমি প্রকাশ্যে বলব- সব কিছুই মুসলমানদের কাছে পর্যাপ্ত রয়েছে বরং পূর্বের চেয়ে বেশি আছে। কিন্তু ইসলামের উন্নতির জন্য চিন্তা ভাবনা করা, ইসলামের বিপর্যয়ে ব্যথিত হওয়া, ইসলামের কাজে প্রস্ত্তত থাকা ও ইহার অসুবিধা গুলে কে দূর করা এবং এর রাস্তায় কুরবাণী করার গুণাবলি আজ আর আমদের মধ্যে নেই। আমরা নিজেদেরকে খুব ভাল অবস্থায় মনে করি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের, আমাদের ভাই বেরাদার ও স্ত্রী পুত্রের এবং পরিবার বর্গের উপর কোন কষ্ট না পৌঁছে। কিন্তু ইসলাম যে বিপদজনক অবস্থায় পতিত হচ্ছে এবং মুসলমানগণ কুফর ও ইরতেদাদ এবং গুমরাহী ও নাস্তিকতার তুফানে যে ভাবে জর্জরিত হচ্ছে, তা যতক্ষণ আমাদের বাড়ি ঘর হতে দূরে থাকে ততক্ষণ আমরা এই বিপদের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না। এটাই হল স্পষ্ট গুমরাহী। অথচ মহান আল্লাহ পাক উম্মতে মুহাম্মাদীকে এই বলে প্রশংসা করেছেন ‘‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি যাদেরকে মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বের করা হয়েছে, তোমরা মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, আর আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে’’। [৬ সুরা আল এমরান-১১০] কিন্তু আমরা এ সম্মান ও মর্যাদাকে উপেক্ষা করে চলছি এবং কল্যাণের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছি।
অতএব হে মুসলমানগণ! জাগ্রত হও এবং সাবধান হয়ে যাও। এর চেয়ে দুঃখের ও অশ্রু বিসর্জনের ব্যাপার আর কি হতে পারে যে, মুসলিম বিশ্বের বহু জনবল এই কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ মুসলমানগণ অতীতে নিজ নিজ দেশে প্রতিটি শত্রুর মোকাবিলায় জাগ্রত এবং প্রতিটি গুমরাহী ও ফাসাদের বিরুদ্ধে ফয়সালা করার জন্য যুদ্ধরত ছিল। এ দায়িত্বটি প্রত্যেকের উপর তার সামর্থ্যনুযায়ী প্রযোজ্য এবং কাদিয়ানীদের মোকাবিলায় তাদের বিপদ ঠেকাবার জন্য কাজ করা এমন একটি বিষয় যা ধর্মীয় রাজনৈতিক এবং দেশাত্মবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে সকলের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য । ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ জন্য যে, কাদিয়ানী তৎপরতা দ্বীনের আকীদা সমূহকে বিকৃত করছে এবং ইসলামের বুনিয়াদকে ধ্বংস করছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ জন্য যে, সাম্রাজ্যবাদীরা যখনই এ দলটিকে তৈরি করেছে এবং তাদের সহযোগিতার চুক্তিতে আবদ্ধ করেছে, তখন থেকেই তারা বিজিত দেশ সমূহে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এদেরকে সেতুরুপে ব্যবহার করে চলেছে। দেশত্ববোধের দৃষ্টিকোণ থেকে কাদিয়ানীদের অস্তিত্ব যে কতটুকু মারাত্মক তা অখন্ড্য ভারতের বিখ্যাত লেখক এবং ইসলামের কবি ড: মুহাম্মদ ইকবাল স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, যখন তিনি জওহার লাল নেহরু কর্তৃক এ দলকে সমর্থন দানের সময় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন।
শেষ কথা এই যে, আমি এই পুস্তকটি যা সম্ভবত: মুসলমান ও কাদিয়ানী উভয় সম্প্রদায়ের পাঠকের কাছে অনুপম পুস্তক হিসেবে সমভাবে গণ্য হবে, মুসলমানদেরকে কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে পরিচয় দান করা এবং সাধারণ কাদিয়ানীদেরকে এ মতবাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য উপস্থাপিত করছি; যাতে মুসলমানগণ এর বিপদ থেকে সতর্ক থাকেন এবং সাধারণ কাদিয়ানী এর হাকিকত অনুধাবন করতে পারে । আমি জনাব আতিয়া মুহাম্মদ সালেমের সঠিক দিক নির্দেশনা ও পরামর্শের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছি না এবং মদিনা মুনাওয়ারার মাকতাবায়ে ইলমীর মালিক শেখ মুহাম্মদ সুলতান নমনুকানীকেও পুস্তকের মুদ্রণ ও প্রচারের দায়িত্ব ভার গ্রহণের জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আল্লাহর কাছে এ কামনা করি, তিনি যেন গ্রন্থটিকে খালেছ ভাবে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কবুল করেন। আর যার হাতে ইহা পৌঁছোবে তার জন্য যেন উপকারী করে দেন এবং এ ময়দানে জেহাদের অগ্রগামীর জন্য পাথেয় করে দেন। আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করছি। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা ও সর্বশেষ নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর এবং তার পরিবার বর্গ ও সাহাবীগণের উপর । হে আল্লাহ, তুমি কবুল কর।
২৭ রমজান ১৩৮৬ হিঃ এহসান এলাহী জহীর
মদিনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়
এই প্রধান উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয় কাদিয়ানী দল এবং এরা ইসলাম ও মুসলমানদের সেই সব শত্রুর ছায়াতলে লালিত পালিত হয় যারা, উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার উপর বিপদাপদ পতিত হওয়ার আশায় সর্বদা অপেক্ষায় থাকে, তারাই এদেরকে ধন সম্পদ ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাহায্য করতে থাকে।
সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকে এ দলটিকে বিরাট অঙ্কের অর্থ সম্পদ, উচ্চ পর্যায়ের বৃত্তি, বড় বড় পদ ও বিশেষ বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়। আর, হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মৌখিক ও লেখনীর মাধ্যমে এদের প্রতিরক্ষার চেষ্টা চালান হয়। তেমনি ভাবে ইহুদী সম্প্রদায় কাল্পনিক হলেও নানাবিধ দলীল এবং শূন্য হলেও বিভিন্ন কৃত্রিম তহবিল দ্বারা তাদের সাহায্য করতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদীরা এখনও এ দলটিকে ইসরাইলে প্রতিষ্ঠিত কাদিয়ানী কেন্দ্র ও আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত এর বিভিন্ন কেন্দ্র সমূহের মাধ্যমে সাহায্য করে চলছে। প্রত্যেকটি দল এ মতবাদ প্রচার করার জন্য চূড়ান্ত শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করছে। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল মুসলমানগণকে মুজাহিদে আজম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। তাঁর ইন্তেকালের চৌদ্দ শত বছর পর আজও তাঁর নাম শুনলে কাফেরদের অন্তর ভয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং তাদের স্কন্ধ থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। এখনও তাঁর উম্মত বিদ্বেষ প্রবণ শত্রুদের গলদেশে কাঁটা স্বরূপ বাঁধে আছে। তাদের সজাগ হওয়ার কল্পনা মাত্র নাস্তিক ও মুশরিকদেরকে তাদের বিশ্রামাগার থেকে কাঁপিয়ে তোলে। তারা ভাল করে জানে যে, মহান নেতা মুহাম্মদ আল-আমীন সাঃ এর জীবন্ত ও মৃতদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারকারী শিক্ষাগুলো মুছে না ফেলা পর্যন্ত তাদের জীবনে শান্তি আসবে না; অথবা, এ শিক্ষাকে এমন ভাবে পরিবর্তন ও বিকৃত করে দিতে হবে, যাতে এর জীবনী শক্তি দূর হয়ে যায় এবং নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তারা মনে করে যে, এ উদ্দেশ্য সফল হতে পারে এ ধরনের আন্দোলন ও দাওয়াতকে সমর্থন করারই মাধ্যমে। এইতো সেই বিশিষ্ট হিন্দু লেখক ড: শঙ্কর দাসের একটি ভাষণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বলেন: ‘‘আমাদের দেশ বর্তমানে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন তা হল এই, কীভাবে আমরা মুসলমানদের অন্তরে জাতীয়তাবাদের স্লোগান সৃষ্টি করতে পারি?’’ আমরা তাদের সাথে সকল প্রকার প্রচেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তাদের সাথে বিভিন্ন প্রকার চুক্তি ও অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয়েছি, তথাপি ভারতের মুসলমানদের উপর এর কোন প্রভাব পড়েনি। এখনও তারা কল্পনা করে যে, তারা একটি স্বাধীন জাতি এবং তারা আরবের গান গায়। সম্ভব হলে তারা ভারতকে আরবের একটি অংশে পরিণত করে দিত।
নৈরাশ্যের এ গভীর অন্ধকারের মধ্যে দেশ প্রেমিক ও হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা শুধু একটিমাত্র দিক হতে আলোর ছিটা দেখছে; তা হল কাদিয়ানী সম্প্রদায়। যত বেশি মুসলমান কাদিয়ানী মতবাদের দিক ঝুঁকে পড়বে, তারা মক্কার পরিবর্তে কাদিয়ানকে তাদের কিবলা ও কাবা কল্পনা করবে। আর, এভাবেই তারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নিকটবর্তী হয়ে আসবে। কাদিয়ানী মতবাদের উন্নতি ব্যতিরেকে আরবী সভ্যতা ও ইসলামী জাতীয়তাবাদের চেতনাকে দূরীভূত সম্ভব নয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে আমাদের বিবেচনা করা উচিত। সে মতে ভারতের পাঞ্জাব এলাকা থেকে একটি লোক আবির্ভূত হয় এবং মুসলমানগণকে তার অনুসরণ করতে আহবান জানায়। যে তার অনুসরণ করবে সে এককালে শুধু মুসলমান থাকার পর এখন কাদিয়ানী মুসলিম হিসাবে পরিগণিত হবে এবং বিশ্বাস করবে যে:-
১- নিশ্চয়ই আল্লাহ মানব জাতীর হেদায়েত ও পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে রাসূল প্রেরণ করেন।
২- আরব জাতীর অবনতির যুগে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রাসূলরূপে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন।
৩- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আল্লাহ তায়ালা অপর নবীর প্রয়োজন বোধ করেন। তাই, তিনি মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে রাসূলরূপে প্রেরণ করেন। সম্ভবত: আমার স্বজাতি ভাইয়েরা প্রশ্ন করবেন যে, তার এ ধর্ম বিশ্বাস আমাদের কি উপকারে আসবে? উত্তরে আমি বলব- যেমন একজন হিন্দু যদি মুসলমান হয়ে যায়, তবে রাম, কৃষ্ণ, বেদ, গীতা ও রামায়ণ থেকে তার ভালোবাসা কুরআন ও আরবের প্রতি চলে যায়, তদ্রুপ একজন মুসলমান যদি কাদিয়ানী হয়ে যায় তা হলে তার দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন হয়ে পড়বে এবং মুহাম্মদ সা: এর প্রতি তার ভালোবাসা কমে যাবে। আর, তার খিলাফতের কেন্দ্র আরব উপদ্বীপ ও তুর্কিস্থান থেকে কাদিয়ানের দিকে পরিবর্তিত হয়ে পড়বে এবং প্রাচীন এক পবিত্র স্থান হওয়া ছাড়া মক্কার আর কোন গুরুত্ব তার কাছে থাকবে না।
প্রত্যেকটি কাদিয়ানী সে যেখানেই থাকুক না কেন, চাই আরব, তুর্কিস্থান, ইরান অথবা পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলে অবস্থান করুক, সর্বদাই তার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কাদিয়ান অভিমুখে হবে এবং কাদিয়ান তার মুক্তির কেন্দ্রস্থল হবে। আর এতেই ভারতকে পবিত্র মনে করার রহস্য নিহিত। প্রত্যেকটি কাদিয়ানী ভারতকে পবিত্র মনে করবে। কেননা কাদিয়ান ভারতে অবস্থিত এবং গোলাম আহমাদও ভারতীয়। তার খলীফাগণ ও প্রতিনিধিগণ সকলেই ভারতীয়। এ কারণেই ধর্মান্ধ মুসলমানগণ কাদিয়ানী মতবাদকে সন্দেহের চোখে দেখে। কেননা, তাদের ধারণা যে, কাদিয়ানী মতবাদ আরব সভ্যতা ও প্রকৃত ইসলামের শত্রু। এ জন্যই খেলাফত আন্দোলনে [৩ তুরস্কে উছমানী খেলাফতের পতনের সময় ভারতীয় মুসলমানগণ তীব্র প্রতিবাদের ঝড় তুলে খেলাফতের পূনঃ প্রতিষ্ঠা দাবী করে। এই আন্দোলনের নাম ছিল ‘খেলাফত আন্দোলন’। এর প্রতি ইঙ্গিত করে হিন্দু লিখক বলেন যে কাদিয়ানীরা খেলাফত পূনঃপ্রতিষ্ঠার দাবীতে মুসলমানদের সমর্খন করেনি।]
কাদিয়ানীরা মুসলমানদের সমর্থন করেনি। কারণ, তারা আরব ও তুরস্কের পরিবর্তে কাদিয়ানেই খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আর এটাই সাধারণ মুসলমানদের উপর, যারা ইসলামী পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখে, একটা বড় আঘাত। অপর পক্ষে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্য আনন্দের বিষয়। (ড: শঙ্কর দাস বি, এস, সি; এম, বি, বি, এস এর প্রবন্ধ যা হিন্দুদের পত্রিকা ‘‘বন্দে মাতরমে’’ লিখিত এবং ২২ এপ্রিল ১৯৩২ সালে প্রকাশিত।) প্রকাশ থাকে যে, যখন ইসলাম ও রেসালাতে মুহাম্মাদীর কবি ড: মুহাম্মদ ইকবাল কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখেন, যাতে তিনি ওদের মিথ্যা ও বিভ্রান্তির স্পষ্ট বর্ণনা দেন, তখন সর্ব প্রথম ব্যক্তি যিনি তার প্রতিবাদ করেন এবং কাদিয়ানীদের পক্ষে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন তিনি হলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের নেতা জওহার লাল নেহরু। তিনি ওদের সমর্থনে কতকগুলো প্রবন্ধ লিখলেন। যার ফলে কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমাদ কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে জওহার লাল নেহরুর প্রতি সংবর্ধনা জ্ঞাপনে উৎসাহিত করতে গিয়ে ঘোষণা করেন: সম্মানিত জওহার লাল নেহরু ড: মুহাম্মদ ইকবালের ঐ সকল প্রবন্ধের প্রতিবাদ করেছেন, যেগুলো তিনি এ কথা প্রমাণ করার জন্য রচনা করেছেন যে কাদয়িনীগণ একটি স্বতন্ত্র কাফের দল এবং ইসলামের সাথে ঐ দলের কোন সম্পর্ক নেই। এর প্রতিবাদে জওহার লালই দাঁড়িয়েছেন এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, কাদিয়ানীদের উপর ড: ইকবালের আপত্তিসমূহ একেবারেই অযৌক্তিক। সুতরাং জওহার লাল নেহরুকে আন্তরিকতার সহিত সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা কাদিয়ানীদের কর্তব্য। (জুময়ার খুতবা যা কাদিয়ান নগরে কাদিয়ানী খলীফা প্রদান করেছিল। কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে প্রকাশিত ১৮ই জুন ১৯৩৬ খৃ:) অতপর: ইসলামের কবি নেহরুর পাল্টা জবাব দেন এবং তার কাদিয়ানীদের পক্ষ অবলম্বনের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে বলেন: নিশ্চয়ই জওহার লাল নেহরু ও তার জাতীয়তাবাদী সঙ্গী-সাথীরা মুসলমানদের পুনরুত্থান ও উন্নতিতে অস্থির, যেমন কাদিয়ানীরা ঐ একই কারণে অস্থির। তারা অনুভাব করে যে, এ উন্নতি ও আন্দোলন তাদের মূল পরিকল্পনা অর্থাৎ আমাদের প্রাণপ্রিয় মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ভারতীয় মিথ্যা নবুয়তের দাবিদারের জন্য একটি উন্নত উম্মত তৈরি করে দেওয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেবে। এ কারণেই জওহার লাল নেহরু তাদেরকে সমর্থন করেন। নচেৎ ওদের সাথে তার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? ( ড: মুহাম্মদ ইকবালের আল-কাদিয়ানীয়াহ ও আল-ইসলাম নামক প্রবন্ধ যা আল-ইসলাম নামক ইংরেজি ম্যাগাজিনে প্রচারিত, ২২ জানুয়ারি ১৯৩৬ খৃ: প্রকাশিত।)
এ ধরনের আন্দোলন যখন গড়ে উঠেছিল, তখন আশা ছিল যে ইসলাম বিরোধী শক্তি সমূহ তাকে সহায়তা করবে। কার্যত: তাকে সাহায্য করেছে এবং সমর্থনও দিয়েছে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদীরা একে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য লোকজনকে উহার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এদের অধিকাংশই ছিল উপনিবেশবাদী ইংরেজ সরকারের বেতনভোগী আমলা ও জায়গিরদার; যাদের কোন ধর্ম নেই, একমাত্র সরকারের সেবা ও সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া এদের আর কোন দীন-ধর্ম নেই।
নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমাদ নিজেই একথা স্বীকার করেছে। সে বলেছে যে, আমার দলে যারা প্রবেশ করেছে তাদের অধিকাংশ ইংরেজ সরকারের সদস্য বড় বড় চাকুরিজীবী, বা তারা এ দেশের নেতৃস্থানীয় লোক ও ব্যবসায়ী, অথবা তারা উকিল ও ইংরেজি শিক্ষার্থী কিংবা তারা আলেম ফাযেল যারা অতীতে ইংরেজ সরকারের সেবা করেছে বা বর্তমানেও করছে এবং তাদের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব। মোটকথা, এ দলটি তার মুরববী ইংরেজ সরকার দ্বারা গঠিত, তাদের সন্তুষ্টি অর্জনকারী এবং তাদের পুরস্কারে ধন্য। সুতরাং আমি এবং অনুসারী শিক্ষিত সমাজ মানুষের কাছে এ সরকারের অবদান সমূহ বর্ণনা করে আসছি এবং হাজার হাজার লোকের অন্তরে এর আনুগত্য দৃঢ় করছি। (ইংরেজ সরকারের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নরের কাছে গোলাম কাদিয়ানীর চিঠি ‘‘তাবলীগে রিসালত’’ নামক গোলামের ঘোষণা বলীর অন্তর্ভুক্ত, ৭ম খন্ড ১৮ পৃ:, কাসেম কাদিয়ানী কর্তৃক সংকলিত)
অতএব, যখন থেকে এ দলটি গঠিত হয় এবং উহার তৎপরতা আরম্ভ হয়, তখন থেকেই তারা ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকে। আমি দ্বীনি মাদ্রাসা সমূহে পাঠ্যরত থাকা কালে এ আন্দোলন সম্পর্কে শেয়খুল ইসলাম ছানাউল্লাহ অমৃতসরী, সেই যুগের ইমাম শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম শিয়ালকোটি এবং আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা মুহাদ্দিস হাফেজ মুহাম্মদ জলন্দরী প্রমুখ ওলামাদের লিখিত কিতাব সমূহের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করি। তারপর ঘটনা হল এই, যখন আমি ও আমার কিছু সাথী আমার নিজ শহর শিয়াকোটে অবস্থিত বাহায়ীদের মজলিসে এবং খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠান সমূহে তাদের সাথে আলোচনা ও বিতর্কের উদ্দেশ্যে যাতায়াত করছিলাম, তখন কাদিয়ানী মতবাদের কিছু লোক আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাকে তাদের মুবাল্লেগের সহিত আলোচনার জন্য আহবান জানায়। যেহেতু এ ধরনের আলোচনার প্রতি আমার অতি আগ্রহ ও মনোযোগ ছিল। তাই আমি ইতস্ত. না করে শুধু একটি মাত্র শর্তে তাদের আহবান গ্রহণ করলাম। শর্তটি হল, তারা আমাকে গোলাম আহমদের পুস্তক সমূহ ধার দেবে। তারা আমাকে পাঁচটি বই ধার দিল। এ গুলোর নাম আমার এখনও স্মরণ আছে। তা হল:
১- আনজামে আছিম ২- এজালাতুল আওহাম ৩- দুররে ছামীন ৪- হাকীকাতুল ওহী এবং ৫- ছাফিনায়ে নূহ। প্রথম ও তৃতীয় বই দুটিতে বিরক্তিকর ও অর্থহীন বিষয় থাকা সত্ত্বেও আমি একই রাতে পড়ে নিলাম। এভাবে আমি অবশিষ্ট বইগুলি দুই বা তিন দিনের মধ্যে পড়ে শেষ করে নিলাম। প্রতিশ্রুত নির্দিষ্ট দিনে আমরা কয়েকজন সাথী একত্রিত হয়ে কাদিয়ানীদের মসজিদে গমন করলাম। সেখানে তারাও আমাদের অপেক্ষায় ছিল। অল্প কিছু কথা বার্তার পর আমরা আলোচনার বিষয়বস্ত্ত ঠিক করে নিলাম: ‘‘গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ।’’ কেননা, গোলাম তার ভবিষ্যদ্বাণী গুলোকে তার নবুয়তের মাপকাঠি রূপে নির্ধারণ করেছিল। তাই আমি আব্দুল্লাহ আছিমের মৃত্যু সম্পর্কে গোলাম আহমাদের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা প্রথমে তুলে ধরলাম। গোলাম বলেছিল যে, সে পনেরো মাসের শেষ দিকে মারা যাবে। আর, আমি প্রমাণ করে দিলাম যে, সে তার জন্য নির্ধারণকৃত সময়ে মারা যায়নি। সুতরাং তোমাদের মিথ্যা নবীর নবুয়্যত প্রমাণিত হয়নি। অতএব সে তার নবুয়তের দাবিতে সত্যবাদী নয়। কেননা, নবির ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়া অপরিহার্য। [৪ ‘‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী ও তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ’’ নামক প্রবন্ধে এই সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি।] তখন আমি দেখতে পাই যে, কাদিয়ানী মুবাল্লেগের মুখ থেকে ফেনা বের হওয়ার পর সে ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছে। সে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু এ প্রবল প্রমাণাদির উত্তর দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশেষে সে এ কথা বলতে বাধ্য হল যে, আমি বিতর্কে পারদর্শী নই। তবে, ‘রাবওয়া’ [৫ ‘রাবওয়া’ পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমানে পাকিস্তান) একটি ক্ষুদ্র শহর। কাদিয়ানীরা এই শহর তৈরী করে তাদের কেন্দ্রে পরিণত করে।] থেকে বিতর্ককারী একজন কাদিয়ানী আলেম আসবে। তখন আমরা আপনাদেরকে তার সাথে বাহাছ করার জন্য আহবান করব। আমরা বিজয়ী হয়ে তাদের ওখান থেকে ফিরলাম এবং তাদের কাছ থেকে কাদিয়ানীদের আরও কতকগুলো বই ধার স্বরূপ নিয়ে আসলাম। এভাবেই, আমি কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই এ ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা আরম্ভ করলাম। এরপর থেকে আমি এবং আমার বন্ধু বান্ধবরা বাহায়ীদের মাহফিল, খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠান ও কাদিয়ানীদের কেন্দ্রসমূহে আরও বেশি করে যাতায়াত শুরু করলাম। অবশেষে, আমি তাদের কেন্দ্রস্থল রাবওয়াতে উপস্থিত হই, যেখানে কাদিয়ানীরা ও তাদের বিতর্ককারীরা জড় হয়। তাদের খলীফাও সেখানে বাস করে। তাদের সাথে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলে, আল হামদু লিল্লাহ ফলাফল প্রথম আলোচনার বিপরীত হয় নি ।( অর্থাৎ আমরাই বিজয়ী হই)
অতঃপর, আমি কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে পাকিস্তানের উর্দু ম্যাগাজিনে কতকগুলো প্রবন্ধ লিখি। যখন আমি মদিনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ লাভ করি এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপকগণের সাথে মিলিত হই, এবং বাইতুল্লাহ শরীফে ও মসজিদে নববীতে আগত হাজীগণের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের দেশে কাদিয়ানী মতবাদের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে পারি, তখন আমি আরবী ও অন্যান্য ভাষায় কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে পুস্তক লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভাব করি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন উস্তাদ যেমন ফিক্হ শাস্ত্রের অধ্যাপক বিজ্ঞ শেখ আতিয়া মুহাম্মদ সালেম, আরবী ভাষার অধ্যাপক শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম শকরা, ইতিহাসের অধ্যাপক শেখ আব্দুল হক মাহরুছ ও অন্যান্যরা যখন জানতে পারলেন যে, ইতি পূর্বে আমি কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে উর্দু ভাষায় পুস্তক লিখেছি তখন তারা আমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এই ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। আমি আল্লাহর সাহায্য কামনা করি এবং কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে ‘‘কাদিয়ানীরা উপনিবেশবাদীদের এজেন্ট’’ শিরোনামে আমার প্রথম প্রবন্ধটি রচনা করি। আর আমি একথা ঠিক করে নিলাম যে, আমি কোন কথাই উহার উৎস উল্লেখ না করে লিখব না। এ প্রবন্ধটি আমি দামেস্কের বিখ্যাত ‘‘হাদারাতুল ইসলাম’’ নামক ম্যাগাজিনে প্রেরণ করি; যা ইতিপূর্বে আমার আরও কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। ১৩৮৬ হিঃ সনে ‘‘হাজারাতে ইসলামীয়ার’’ তৃতীয় সংখ্যায় আমার এ প্রবন্ধটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু বান্ধবের কাছে তা বিপুলভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয়। আমার সাথী ও উস্তাদগণ বিশেষকরে, পূর্বোল্লিখিত অধ্যাপকগণ এবং শেখ হাবীব হাম্মাদ আনসারী অধ্যাপক হাদীস ও শরীয়া বিভাগ, বিশিষ্ট শেখ আব্দুল কাদের সাইবাতুল হামদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ও উসুলে দ্বীন বিভাগের তাফসীর ও বিভিন্ন ফিরকা ও ধর্মতত্ব বিষয়ের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড: আদীব সালেহ, হাদারাতুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ও দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উলুমুল কুরআনের অধ্যাপক প্রমুখ ব্যক্তিগণ এভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে আমাকে উৎসাহিত করেন। ফলে, পূর্বের ন্যায় ধারাবাহিক লেখা এবং উল্লেখিত ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ পাঠানোর ছিল-ছিলা চলতে থাকে। উক্ত ম্যাগাজিন ও আগ্রহের সাথে তা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এরপর প্রবন্ধগুলো শেষে একত্র করে একটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা আমি সমীচীন মনে করলাম। তাই, আমি বিভিন্ন প্রকারের দশটি প্রবন্ধ সংবলিত পুস্তকটি এখন পেশ করছি।
এতে আমি আলোচনা করেছি কাদিয়ানী মতবাদের জন্ম ও তার ইতিহাস এবং ঐ সকল কারণ যা এ মতবাদ গঠনে ও তাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে এর সম্পর্ক, এর মূল আকীদাসমুহ, এর প্রতিষ্ঠাতা ও নবুয়তের দাবিদারের ইতিহাস, তার জীবন বৃত্তান্ত, তার দাবি সমূহ, আল্লাহর নবী রাসূল, আউলিয়ায়ে উম্মত ও সৎ লোকদের অবমাননা ইত্যাদি। সাথে এ ভাবে আমি কাদিয়ানীদের বিশ্বাসগত বক্তব্য এবং তাদের মিথ্যা নবীর বাদী-দাওয়া সমূহ তাদেরই বই পুস্তক ও উদ্ধৃতির দ্বারা বিশ্লেষণ করছি। এ মতবাদের অসারতা ও উহার প্রতিষ্ঠাতার দাবিদাওয়ার অসত্যতা তাদের স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছি। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা আমি প্রয়োজন মনে করি:
১- যেখানেই আমি কোন বক্তব্য উল্লেখ করে কাদিয়ানী পত্রিকা অথবা ম্যাগাজিনের উদ্ধৃতি যা দিয়েছি, তা প্রফেসার মুহাম্মদ ইলিয়াছ বরনীর ‘‘কাদিয়ানী মাজহাব’’ নামক তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ থেকে গৃহীত। গ্রন্থটি সাধারণ অসাধারণ সব লোকের কাছে পাওয়া যায়। ইহা অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে, কিন্তু কোন কাদিয়ানী এর উৎস বা উদ্ধৃতিসমূহকে ভুল প্রতিপন্ন করার সাহস পায়নি। সুতরাং এর উদ্ধৃতিগুলো মুসলমান ও কাদিয়ানী সকলের কাছে নির্ভরযোগ্য।
২- আমার প্রবন্ধসমূহে যে সকল কিতাব ও উহার পৃষ্ঠা উল্লেখ করেছি, তার অধিকাংশ প্রথম সংস্করণের। কারণ, কাদিয়ানীদের অভ্যাস হল যখনই তারা তাদের কিতাবের নতুন সংস্করণ করে, তখনই উহার পৃষ্ঠাগুলো পরিবর্তন করে ফেলে। ইহা ছাপার তারতম্য হেতু নহে, বরং ইহা তাদের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা করে থাকে। যেমন আমি ‘‘কাদিয়ানী মতবাদ ও প্রতিশ্রুত মাসীহের আকীদা’’ প্রবন্ধে নবুয়তের মিথ্যা দ্বাবীদার কাদিয়ানী থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছি যে, ইসা আঃ দাজ্জালকে বাইতুল মুকাদ্দাসের লুধ নামক এক গ্রামের ফটকে পেয়ে হত্যা করবেন। এ উক্তিটি গোলামের ‘‘এজালাতুল আওহাম’’ নামক পুস্তকের প্রথম সংস্করণে ২২০ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। কিন্তু কাদিয়ানীরা তা দ্বিতীয় সংস্করণের ৯১ পৃষ্ঠায় স্থানান্তরিত করে ফেলে। পার্থক্য সুস্পষ্ট। মিথ্যুক কাদিয়ানী অমৃত-সর নিবাসী শাইখুল ইসলাম ছানাউল্লাহকে ‘হে বাতাসের পুত্র’ ‘হে প্রতারক’ বলেও গালি দিয়েছে। আমি এ কথাটি ‘‘ইতিহাসের মানদন্ডে কাদিয়ানী মতবাদের নবী’’ নামক প্রবন্ধে বর্ণনা করেছি। এ গালিটি আমি তার পুস্তক ‘‘এজাজে আহমদী’’ এর প্রথম সংস্করণের ৪৩ পৃষ্ঠায় পেয়েছি, কিন্তু কাদিয়ানীগণ তা দ্বিতীয় সংস্করণের ৭৭ পৃষ্ঠায় স্থানান্তরিত করে দিয়েছে। ঐ একই প্রবন্ধে আমি উল্লেখ করেছি যে, মির্জা গোলাম লিখেছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, উহা কখন হবে? উত্তরে তিনি বললেন: সকল আদম সন্তানের উপর একশত বৎসরের মাথায় কেয়ামত হবে! আমি তার পুস্তক ‘‘এজালাতুল আওহাম’’ এর ২৫৪ পৃষ্ঠা থেকে এ কথার উদ্ধৃতি দিয়েছি। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্করণে তারা একে ১০৪ পৃষ্ঠায় নিয়ে গেছে। অনুরূপ অনেক উদাহরণ রয়েছে।
কাদিয়ানীদের অধিকাংশ পুস্তকের নাম যে গুলোর অর্থ আরবী ভাষায় বুঝা যায় তা স্বীয় অবস্থায় রেখে দিয়েছি। কিন্তু কিছু পুস্তক যে গুলোর অর্থ আরবী ভাষায় বোধগম্য নহে, সে গুলোকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করে দিয়েছি। যথা: ‘‘কিস্তিয়ে নূহ’’ ইহা গোলামের রচিত পুস্তক। উর্দু ভাষার কিস্তিকে আরবীতে ছাফিনা বলা হয়। তাই লেখার সময় আমি ‘‘ছফিনাতু নূহ’’ লিখেছি। এমনি ভাবে তার আর একটি পুস্তক ‘‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’’ আয়নাকে আরবীতে ‘‘মিরআতুন’’ বলে। তাই আমি উহাকে ‘‘মিরআতু কামালাতে ইসলাম’’ লিখেছি। তদ্রুপ গোলামের পুত্র মাহমুদ আহমাদের ‘‘আয়নায়ে ছদাকাত’’ কে ‘‘মিরআতুছ ছিদক’’ গোলামের ‘‘জংগে মুকাদ্দাস’’কে ‘‘আল- হারবুলমুকাদ্দাস’’ এবং ‘‘এক গালতী কা এজালা’’ কে ‘‘এজালাতুল গালতাহ’’ লিখেছি।
৩- আমি এ পুস্তক রচনা কালে মুসলিম ওলামাদের বহু কিতাব থেকে সাহায্য গ্রহণ করেছি। উদ্ধৃতি গ্রহণের তালিকায় এর বর্ণনা আসবে। এ প্রবন্ধটি ব্যাপক গবেষণার ফলাফলের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং দলীল প্রমাণ দ্বারা সুদৃঢ়। কাজেই কাদিয়ানীরা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা ও উত্তর দিতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং প্রবন্ধটি এ দলকে অসত্য প্রমাণ করতে এবং উহা যে হিংসা প্রসূত ও সাম্রাজ্যবাদীদের লালিত দল তা নির্ধারণে এক অকাট্য ও প্রকৃষ্ট দলীল রূপে পরিগণিত। আমি এই কিতাবের কোথায়ও আলোচনা ও বিতর্কের নীতি বহির্ভূত কোন কথা না বলার প্রতি লক্ষ রেখেছি এবং ভিত্তিহীন কোন দাবির উপর সিদ্ধান্ত না দেওয়ার নীতি অবলম্বন করেছি। অতএব, পাঠক সমস্ত কিতাবের মধ্যে এমন একটি বিষয়ও পাবেন না, যার উদ্ধৃতি কাদিয়ানীদের কাছে নির্ভরযোগ্য উৎস হতে দেয়া হয়নি। এমনি ভাবে কোন মাসআলা বা কোন হুকুম দানের ক্ষেত্রে আমি বিশুদ্ধ ও সহীহ হাদীস ব্যতীত অন্য কোন হাদীস উপস্থাপন করিনি। আল্লাহর কাছেই তওফিক কামনা করছি।
৪- সব কটি প্রবন্ধ যেভাবে আমি লিখেছিলাম কিতাবের মধ্যে ঐ ভাবেই রেখে দিয়েছি। তাতে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করিনি। তাই, পাঠকবৃন্দ মূল বিষয় বস্ত্তর পরিচিতির জন্য প্রত্যেকটি প্রবন্ধের পূর্বে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা দেখতে পাবেন। প্রথম প্রবন্ধ ছাড়া অন্য সকল প্রবন্ধের ভূমিকা কয়েক লাইনের বেশি নহে। তারপর সকল প্রবন্ধকে আমি এক একটি অধ্যায়ের মত সাজিয়েছি। প্রথম প্রবন্ধ, প্রথম অধ্যায়,দ্বিতীয় প্রবন্ধ, দ্বিতীয় অধ্যায়, তৃতীয় প্রবন্ধ, তৃতীয় অধ্যায়, অনুরূপ শেষ পর্যন্ত সাজিয়েছি। দশম অধ্যায়কে কিতাবের পরিশিষ্ট করেছি এবং তাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। কেননা, মিথ্যা নবুয়তের দ্বাবীদার ‘‘মুসাইলামাতুল কাজ্জাব’’ থেকে নিয়ে কাদিয়ানী পর্যন্ত সকল দাজ্জালই মুসলমানদের ‘‘আকীদায়ে খতমে নবুয়্যত ও রিসালাত’’ সম্পর্কে অজ্ঞতাকেই তাদের পুঁজি বানিয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহর নবী ও রাসূল ‘‘মুহাম্মদ আস-সাদিকুল আমিন’’ এর উপর নবুয়্যত ও রেসালাত যে সমাপ্ত হয়েছে, তা সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলমান অজ্ঞ। (তাঁর জন্য আমার মাতা-পিতা ও আমার প্রাণ উৎসর্গ।)
৫- হয়তো কেহ বলতে পারেন যে, আমি গোলাম আহমদ কদিয়ানী ও তার অনুসারীদের বেলায় কোন প্রকার আদব ও সম্মান সূচক শব্দ ব্যবহার করিনি। ইহা আহলে হাদীসের অভ্যাসের পরিপন্থী। কেননা, তারা তাদের বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন।
উত্তরে আমি বলব, সম্মান ঐ সকল লোকের জন্য জায়েজ বা মুস্তাহাব, বরং ক্ষেত্র বিশেষে ওয়াজিবের পর্যায়ে গণ্য যারা, শুধু মতামত ও চিন্তাধারার বিরুদ্ধবাদী। কিন্তু ঐ সকল লোকদের জন্য সম্মান প্রদর্শন করা জায়েজ নহে, যারা ইসলাম ধর্ম থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে এবং আল্লাহর নবি রাসূলগণের প্রতি বেয়াদবী করে এবং রাসুলুল্লাহর ওয়াজীরগণ, তার দরদী, সন্তান ও সৎ সাহাবীগণকে গালি গালাজ করে। আর, সাইয়েদুল মুরসালীনের মর্যাদা লাভের এবং নবুয়্যত ও রেসালাতের দাবিকরে। এ ধরনের লোকদের সম্মান করা মুসলমানদের জন্য হারাম। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ ধরনের লোকদের সম্বোধন করতেন তখন এরূপ উক্তি দ্বারা সম্বোধন করতেন ‘‘মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহর পক্ষ থেকে মিথ্যাবাদী মুসায়লামার প্রতি।’’ আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। কাউকে গালি-গালাজ করা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমরা কাউকে গালি দেইনি, যদিও সে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মত দাজ্জাল হয়। আমরা নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেই বাণীর উপর আমল করি ‘‘ দোষারোপ ও লানতকারী খাঁটি মুমিন নয়।’’ (ইমাম তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন)
এই হল অত্র কিতাবে সন্নিবেশিত পাঁচটি ব্যতিক্রম, যা অধ্যয়ন শুরু করার পূর্বেই পাঠকের কাছে আমি বর্ণনা করে দিতে চেয়েছি।
পরিশেষে আমি ইসলামী সংগঠনগুলোর প্রতি এবং যাদের কাছে ইসলামী সমস্যাবলির গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে মক্কা ভিত্তিক রাবেতায়ে আলমে ইসলামী, করাচী ইসলামী গবেষণা বোর্ড, কায়রো, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা মুনাওয়ারা প্রভৃতি সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের প্রতি আহবান রাখছি, তারা যেন এ সকল কাফের ও ধর্মান্তরিত লোকের থাবা থেকে মুসলমানগণকে উদ্ধারের জন্য কাজ করেন, সাধারণ ভাবে আরব দেশ ও অন্যান্য মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে আফ্রিকা ও ইউরোপে। যেখানে কাদিয়ানীরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের এবং খাঁটি স্বচ্ছ ধর্ম ইসলামের শত্রুদের সহায়তায় বিরাট ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ইসলামের এ সকল শত্রু সম্প্রদায় কাদিয়ানীদেরকে সকল প্রকারে ও বিভিন্ন উপায়ে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য করে চলেছে, যাতে তারা মুসলমানগণকে প্রকৃত ইসলাম থেকে এবং যে সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে তারা আছেন তা থেকে ইসলামের নামে ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে দুরে সরিয়ে দিতে পারে। এর কারণ হল, ঐ সব দেশে খাঁটি মুসলিম ওলামার স্বল্পতা, তাদের পদ শূন্যতা, আসল কাদিয়ানী মতবাদের হাকীকত ও তাদের কার্যাবলী সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলমানের অজ্ঞতা এবং আফ্রিকা সম্বন্ধে মুসলিম বিশ্বের উদাসীনতা। যখন কাদিয়ানীরা আফ্রিকায় পাঁচটিরও বেশি উচ্চ মানের ম্যাগাজিন মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি, ষড়যন্ত্র ও কুফরী চিন্তাধারা প্রচারের উদ্দেশ্যে ইসলামের শত্রুদের সহায়তায় প্রকাশ করে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে সমস্ত আফ্রিকায় মুসলমানদের এমন একটি ম্যাগাজিন পাওয়া যায়নি যা ওদের মুকাবেলা ও তাদের বিশ্বাসগত বিভ্রান্তি প্রকাশ করতে পারে। উপরন্তু, তারা শত শত কাদিয়ানী মুবাল্লেগ নিযুক্ত করে রাখছে, যারা অন্যান্য মহাদেশসহ আফ্রিকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে তারা সাতচল্লিশটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং দুই শত ষাটটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। তার সাথে রয়েছে অনেক বিশেষ বিশেষ ও সাধারণ লাইব্রেরি, বই পুস্তক পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন ভাষায় কোরান শরীফ অনুবাদের ব্যবস্থা করেছে। ইদানীং তারা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেকগুলো হাসপাতাল ও সমাজ কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, তাদের ঘোষণা অনুযায়ী আফ্রিকায় তাদের অনুসারীদের সংখ্যা পনেরো বৎসরের মধ্যেই দুই মিলিয়নের ও বেশি হয়ে গেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল বিভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী এ দলটি সাম্রাজ্যবাদীদের ও ইংরেজ সরকারের সকল প্রকার সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও তাদেরই রাজত্বকালে ভারত উপমহাদেশে যেখানে উহার কেন্দ্র অবস্থিত, গুটি কতেক ব্যক্তি ছাড়া কাউকে তাদের দলে ভিড়াতে পারেনি; যারা সাম্রাজ্যবাদীদের কোলে দীর্ঘ সত্তুর বছর ধরে লালিত পালিত হয়েছে। এদের সংখ্যা কয়েক হাজারের অধিক নহে। এদের মসজিদ কয়েক দশকেরও বেশি হয়নি এবং এদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা নয় এর বেশি নহে। এখানে এদের এমন অবস্থা হওয়ার কারণ এই যে, মুসলমানরা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানতে পেরেছে এবং তাদের তৎপরতা উদ্ঘাটন করে দিয়েছে। আর, আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে ইসলাম প্রচারকদের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। এর কারণ কি? মুসলমানগণ কি এতই দরিদ্র হয়ে পড়েছে যে, ঐ সকল দেশে মুবাল্লেগ প্রেরণ করার মত তাদের সামর্থ্য নেই অথবা এর আর কি কারণ থাকতে পারে?
আমাদের প্রত্যেককে এর উত্তর সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। আমাকে সুযোগ দিলে আমি প্রকাশ্যে বলব- সব কিছুই মুসলমানদের কাছে পর্যাপ্ত রয়েছে বরং পূর্বের চেয়ে বেশি আছে। কিন্তু ইসলামের উন্নতির জন্য চিন্তা ভাবনা করা, ইসলামের বিপর্যয়ে ব্যথিত হওয়া, ইসলামের কাজে প্রস্ত্তত থাকা ও ইহার অসুবিধা গুলে কে দূর করা এবং এর রাস্তায় কুরবাণী করার গুণাবলি আজ আর আমদের মধ্যে নেই। আমরা নিজেদেরকে খুব ভাল অবস্থায় মনে করি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের, আমাদের ভাই বেরাদার ও স্ত্রী পুত্রের এবং পরিবার বর্গের উপর কোন কষ্ট না পৌঁছে। কিন্তু ইসলাম যে বিপদজনক অবস্থায় পতিত হচ্ছে এবং মুসলমানগণ কুফর ও ইরতেদাদ এবং গুমরাহী ও নাস্তিকতার তুফানে যে ভাবে জর্জরিত হচ্ছে, তা যতক্ষণ আমাদের বাড়ি ঘর হতে দূরে থাকে ততক্ষণ আমরা এই বিপদের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না। এটাই হল স্পষ্ট গুমরাহী। অথচ মহান আল্লাহ পাক উম্মতে মুহাম্মাদীকে এই বলে প্রশংসা করেছেন ‘‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি যাদেরকে মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে বের করা হয়েছে, তোমরা মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে, আর আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে’’। [৬ সুরা আল এমরান-১১০] কিন্তু আমরা এ সম্মান ও মর্যাদাকে উপেক্ষা করে চলছি এবং কল্যাণের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছি।
অতএব হে মুসলমানগণ! জাগ্রত হও এবং সাবধান হয়ে যাও। এর চেয়ে দুঃখের ও অশ্রু বিসর্জনের ব্যাপার আর কি হতে পারে যে, মুসলিম বিশ্বের বহু জনবল এই কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ মুসলমানগণ অতীতে নিজ নিজ দেশে প্রতিটি শত্রুর মোকাবিলায় জাগ্রত এবং প্রতিটি গুমরাহী ও ফাসাদের বিরুদ্ধে ফয়সালা করার জন্য যুদ্ধরত ছিল। এ দায়িত্বটি প্রত্যেকের উপর তার সামর্থ্যনুযায়ী প্রযোজ্য এবং কাদিয়ানীদের মোকাবিলায় তাদের বিপদ ঠেকাবার জন্য কাজ করা এমন একটি বিষয় যা ধর্মীয় রাজনৈতিক এবং দেশাত্মবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে সকলের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য । ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ জন্য যে, কাদিয়ানী তৎপরতা দ্বীনের আকীদা সমূহকে বিকৃত করছে এবং ইসলামের বুনিয়াদকে ধ্বংস করছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ জন্য যে, সাম্রাজ্যবাদীরা যখনই এ দলটিকে তৈরি করেছে এবং তাদের সহযোগিতার চুক্তিতে আবদ্ধ করেছে, তখন থেকেই তারা বিজিত দেশ সমূহে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এদেরকে সেতুরুপে ব্যবহার করে চলেছে। দেশত্ববোধের দৃষ্টিকোণ থেকে কাদিয়ানীদের অস্তিত্ব যে কতটুকু মারাত্মক তা অখন্ড্য ভারতের বিখ্যাত লেখক এবং ইসলামের কবি ড: মুহাম্মদ ইকবাল স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, যখন তিনি জওহার লাল নেহরু কর্তৃক এ দলকে সমর্থন দানের সময় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন।
শেষ কথা এই যে, আমি এই পুস্তকটি যা সম্ভবত: মুসলমান ও কাদিয়ানী উভয় সম্প্রদায়ের পাঠকের কাছে অনুপম পুস্তক হিসেবে সমভাবে গণ্য হবে, মুসলমানদেরকে কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে পরিচয় দান করা এবং সাধারণ কাদিয়ানীদেরকে এ মতবাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য উপস্থাপিত করছি; যাতে মুসলমানগণ এর বিপদ থেকে সতর্ক থাকেন এবং সাধারণ কাদিয়ানী এর হাকিকত অনুধাবন করতে পারে । আমি জনাব আতিয়া মুহাম্মদ সালেমের সঠিক দিক নির্দেশনা ও পরামর্শের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছি না এবং মদিনা মুনাওয়ারার মাকতাবায়ে ইলমীর মালিক শেখ মুহাম্মদ সুলতান নমনুকানীকেও পুস্তকের মুদ্রণ ও প্রচারের দায়িত্ব ভার গ্রহণের জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আল্লাহর কাছে এ কামনা করি, তিনি যেন গ্রন্থটিকে খালেছ ভাবে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কবুল করেন। আর যার হাতে ইহা পৌঁছোবে তার জন্য যেন উপকারী করে দেন এবং এ ময়দানে জেহাদের অগ্রগামীর জন্য পাথেয় করে দেন। আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করছি। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা ও সর্বশেষ নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর এবং তার পরিবার বর্গ ও সাহাবীগণের উপর । হে আল্লাহ, তুমি কবুল কর।
২৭ রমজান ১৩৮৬ হিঃ এহসান এলাহী জহীর
মদিনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নেতা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ লন্ডনে একত্রিত হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম গবেষণা ও গভীর চিন্তা-ভাবনার পর অত্যন্ত গুরুতর এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কেননা, ইসলাম ব্যতীত বিশ্বে আর কোন শক্তি তাদের মোকাবিলায় বিদ্যমান নেই তাই, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া অপরিহার্য। তবে, এদের সরাসরি আক্রমণ করে নয়, বরং তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক বাতিল ফিরকা বা দল সৃষ্টি করে এ উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। এ দলগুলো নামে মাত্র মুসলমান হবে এবং প্রকৃত পক্ষে তারা ইসলামের বুনিয়াদ ও নীতিমালা মূলোৎপাটনকারী হিসাবে কাজ করবে। এ দলগুলোকে সম্ভাব্য আর্থিকও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। যাতে, তারা ওদের বিপক্ষে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারে এবং মুসলমানদের উপর গোয়েন্দাগিরির চাল চালিয়ে যেতে পারে। সুতরাং সে অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদীদের বিচক্ষণ হাত অত্যন্ত সুন্দর ও সুদৃঢ় এক জাল তৈরি করে। প্রথম পর্যায়ে তারা তাদের অধিকৃত দেশ সমূহে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও বিশ্বাস ঘাতক লোক অনুসন্ধান করার নিমিত্তে বিশেষ বিশেষ দল পাঠাল। যারা ঐ,লোকদের অন্ত-করণ ঈমান, অনুভূতি ও বোধশক্তিকে ক্রয় করে নিতে পারে। এই ঘৃণ্য টিমগুলো বিশ্বাসঘাতক লোকদের অনুসন্ধান করতে লাগল। আর এটাত জানা কথা যে, কোন সম্প্রদায়ই এ ধরনের লোক থেকে মুক্ত নহে। তবে, এদের মধ্যে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সবচেয়ে মারাত্মক এজেন্ট ছিল ভারতের গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং ইরানের বাহাউল্লাহ নামে পরিচিত মির্জা হুসাইন আলী। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি অধিক সাহসী অথচ বোকা ছিল। তাই, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার হিংসা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করে দেয় এবং অতি দু:-সাহসের সাথে বলে ফেলে যে, (ভুল ভ্রান্তিতে ভরপুর) তার কিতাব দ্বারা কোরান করীম রহিত হয়ে গেছে এবং সে হল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরীয়ত রহিতকারী। ফলে তার দ্বারা ইসলামের ক্ষতি কম হয়েছে। তবে, প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ কাদিয়ানী ছিল অধিক পটু ও ধুরন্ধর। এ কারণেই সে তার হিংসা বিদ্বেষকে গোপন রাখে। কখনও সে মুজাদ্দিদ রূপে, আবার কখনও মেহেদি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এর পর লাপ দিয়ে সে নবুয়তের মর্যাদায় পৌঁছে গিয়ে দাবিকরে বসল যে, সে আল্লাহর একজন প্রেরিত নবী, তার কাছে ওহী আসে। কিন্তু সে স্বয়ং সম্পূর্ণ নবী নহে বরং সে একজন অনুগামী নবী। যেমন হারুন আঃ মুসা আঃ এর অনুগামী নবী ছিলেন। সে কোরআন শরীফের অর্থ বিকৃত করে এবং উহার অপ ব্যাখ্যা করে। আর, সে বাতিল চিন্তাধারা প্রচার করতে শুরু করে এবং মুসলমানদের সারিতে থেকে সাম্রাজ্যবাদীদেরও বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকে। কারণ ইসলামের মুখোশ পরে যতটুকু খেদমত করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, ইসলাম থেকে বের হয়ে তা সম্ভব হত না। সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য তার সবচেয়ে বড় এক খেদমত ছিল তার ঐ ফতওয়া ‘‘ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা মুসলমানদের জন্য জায়েজ নহে। কারণ, জেহাদের হুকুম রহিত হয়ে গেছে এবং ইংরেজরা হল এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েজ নয়।’’ এতে সাম্রাজ্যবাদীরা তার উপর অত্যধিক খুশি হল। এবং সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ও অর্থ সম্পদ তার সামনে পেশ করল। এমনকি, তার অনুসরণ ও অনুকরণ করার জন্য তাকে কতগুলো লোক জুটিয়ে দিল। ফলে, যে ব্যক্তি তার দীর্ঘ জীবনে
একসাথে একশত পাউন্ড দেখে নাই সে আজ লক্ষ লক্ষ পাউন্ড নিয়ে খেলতে শুরু করে। সে ছিল মিসকীন, সামান্য বেতনভোগী কর্মচারী, মাসে পাঁচ পাউন্ডের বেশি বেতন পেত না, জীবিকার অন্বেষণে নগরে নগরে এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত; সে আজ বিরাট অট্রালিকা তৈরি করতে লাগল এবং দামী গাড়ি চড়তে লাগল। আর, তার চাকর নোকররা বড় বড় লোকদের চেয়েও বেশি জীবিকা অর্জনের সুযোগ লাভ করতে শুরু করে। ব্রিটেনের রাণীকে ভারতবর্ষে আগমন উপলক্ষে কাদিয়ানী যে মানপত্র প্রদান করেছিল, তাতে সে একথা স্বীকার করেছে। এমনি ভাবে, সাম্রাজ্যবাদীরা এ বৃক্ষটি বাড়িয়ে তোলার জন্য এবং লালন পালন করার জন্য তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করল। তাকে লোকের কাছে পরিচিত করল এবং নিজেদের ছত্রছায়ায় রেখে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করল। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর এবং তাদের শ্রদ্ধাভাজন পূর্বপুরুষ ও ইমামদের উপর আক্রমণের জন্য উৎসাহ দিতে লাগল। এমনকি, সে নবীগণের এবং সাইয়েদুল মুরসালীনের ইজ্জতের উপরও আক্রমণ করতে লাগল। যেমন সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর হাসান হুসাইন, তাঁর খলীফা, দামাদ ও আত্মীয় স্বজন অর্থাৎ আবু বকর উমর, উসমান, আলী ও অন্যান্য সাহাবীদের সম্মানের উপর আক্রমণ করল। সুতরাং উম্মতের সকল আলেমগণ একবাক্যে তাকে কাফের বলে ঘোষণা দেন এবং নবুয়তের বাদী, নবীগণের তিরস্কার, মুসলমানদের গালি গালাজ ও খাঁটি ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদকে অস্বীকার করার কারণে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে ফতওয়া প্রদান করেন। কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভু তার পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করতে থাকে এবং তাকে মুসলমানদের ক্রোধ ও রোষানল থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে, মুসলমানগণ তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন নি। তবে, মুসলিম আলেমগণ তার সাথে বিতর্ক ও মুনাজারা করেন। এভাবে, তারা সত্য প্রকাশ করেন এবং বাতিলকে অসার প্রমাণিত করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিখ্যাত আলেম অমৃত সর নিবাসী শেখ ছানাউল্লাহ। তিনি বার বার বিতর্কে তার উপর জয়ী হন এবং তাকে প্রমাণ দ্বারা জব্দ করেন। পরিশেষে তাকে মুবাহালার জন্য আহবান করেন এই বলে: ‘যে মিথ্যাবাদী সে যেন সত্যবাদীর জিবদ্দশায় অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে’। আবার সত্য প্রকাশ পেল। এ মুবাহালার কিছুদিন পরেই গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এমনভাবে মৃত্যুবরণ করল যা শুনা মাত্র মানুষ ঘৃণা বোধ করে। পরে আমি এ ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করব। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, এ ধর্মান্তরিত দলটি ইসলামের সাথে যার আদৌ সম্পর্ক নেই এবং ইসলাম ও তা থেকে বিচ্ছিন্ন, সে দলটি পুনরায় মুসলমানদের সারিতে প্রবেশ করে এবং তারা প্রকাশ করে, যে ঐ সকল বিষয়ের উপর তারা বিশ্বাস রাখে যার উপর মুসলমানদের বিশ্বাস রয়েছে। ছোটোখাটো অমৌলিক কিছু বিষয় ছাড়া তাদের এবং মুসলমানদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আবার তাদের ঐ পুরাতন প্রভু ইউরোপ ও আফ্রিকায় পত্র পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারণার মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য করে। যেমন, খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি সংগঠন আল-মনজিদ অভিধানের পরিশিষ্টে এ কথা সংযোজন করে যে, ‘কাদিয়ানীরা একটি মুসলিম দল, তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তাদের বিশ্বাস মুসলমানদের উপর জেহাদ ফরজ নয়’। এ কারণেই আমি এ নতুন মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার মনস্থ করলাম। বিশেষ করে কাবা শরীফে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত আমার কিছু বন্ধুর সাথে যখন সাক্ষাৎ হল এবং তারা আমাকে শঙ্কিত করে তুলল যে তাদের দেশে এমন কতকগুলো লোক রয়েছে, যারা কাদিয়ানী মতবাদের প্রতি এই বলে আহবান করে যে, তাদের নেতা উম্মতে মুসলিমার মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক আর, তারা এমন কিছু পাচ্ছেন না যা দিয়ে ওদের মুকাবেলা করতে পারেন। কাদিয়ানী আলেমরা যখন তাদেরকে প্রশ্ন করেন তখন তারা উত্তর দিতে পারেন না। কারণ, তাদের কাছে ওদের কিতাব ও প্রকৃত আকিদা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই, আমি এ প্রথম কিস্তি পেশ করছি, আল্লাহর সঙ্গে এ প্রতিশ্রুতিসহ যে এ মতবাদের প্রকৃত অবস্থার মুখোশ না খোলা পর্যন্ত আমি শান্ত হব না। মহান আল্লাহর দরবারে এর তাওফিক কামনা করছি। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে পাঞ্জাবের অন্তর্গত কাদিয়ান নামক গ্রামে কোন এক পরিবারে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট গোলাম আহমদের জন্ম হয়। তার পিতা ঐ সকল লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এবং মান-সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদকে সাহায্য করেছে। যেমন, স্বয়ং গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার কিতার ‘তোহফায়ে কায়সারিয়ায়’ উল্লেখ করেছে যে, আমার পিতা গোলাম মুরতাজা ঐ সমস্ত লোকদের একজন ছিলেন, ইংরেজ সরকারের সাথে যাদের সুসম্পর্ক ও ভালোবাসার বন্ধন ছিল, এবং রাজ দরবারে তার একটা আসন সংরক্ষিত ছিল। সে ইংরেজ সরকারকে সর্বতভাবে সাহায্য করেছিল যখন তার স্বদেশি ও স্ব ধর্মীয় ভারতবাসীরা ১৮৫১ ইং সালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। (এটা ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একটা প্রসিদ্ধ বিপ্লব) এমনকি সে নিজের পক্ষ থেকে পঞ্চাশজন সৈন্য ও পঞ্চাশটি ঘোড়া দ্বারা তাদের সাহায্য করে এবং সে তার সাধ্যাতীত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেবা করেছে। (উল্লেখিত গ্রন্থ ১৬ পৃ:) সুতরাং এ ধরনের পরিবারে যদি গোলাম আহমদের জন্ম না হয় তবে, আর কার জন্ম হবে? মোটকথা, জন্মের পর লেখাপড়ার বয়সে পৌছলে সে অখ্যাত কিছু শিক্ষকের কাছে কতক গুলো উর্দু ও আরবী পুস্তক পড়ে এবং কিছু আইন বিদ্যাও শিখে। তারপর সে মাসিক মাত্র পনেরো টাকা বেতনে বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত শিয়ালকোট নামক শহরে চাকুরি নেয়। সে একটা মানসিক ভারসাম্যহীন প্রকৃতির লোক ছিল। এমনকি, তার সম্পর্কে বলা হয় যে তাকে ঘর থেকে চিনি আনার কথা বলা হলে সে চিনির বদলে লবণ নিয়ে আসে। একান্ত নির্বুদ্ধিতা ও ভারসাম্যহীনতার কারণে সে পথিমধ্যে উহা খেতে আরম্ভ করে। যখন লবণ তার গলায় পৌঁছে আটকে যায় তখন তার চক্ষু-দ্বয় থেকে অশ্রু নির্গত হয়।(তার পুত্র বশীর আহমদ কর্তৃক লিখিত ‘‘সিরাতুল মাহদী’’ নামক গ্রন্থ) এতদ্ব্যতীত সে এত ভীরু ছিল যে, কখনও যুদ্ধ ও কুস্তিতে অংশ গ্রহণ করেনি। অথচ ঐ সময় ভদ্র পরিবারের সকলেই সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করত। এ কারণেই একদা সে একটা মোরগের বাচ্চা জবাই করতে গিয়ে তার আঙুল কেটে ফেলে এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। ফলে, সে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করে সরে পড়ে। কারণ, সে তার জীবনে কোন প্রাণী জবাই করেনি। (সিরাতে মাহদী ২য় খন্ড ৪থ পৃ:) এ নির্বুদ্ধিতা ও ভীরুতা নিয়ে সে বড় হতে লাগল এবং যৌবনে পদার্পণ করল। এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ সে সর্বদা অসুস্থই থাকত। যৌবনে সে পাগলামি সাদৃশ্য ‘মুরাক’ বা হিষ্ট্রীয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া সে আরো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল। ‘রিভিউ কাদিয়ান’ নামক কাদিয়ানী পত্রিকায় একদা প্রকাশিত হয়েছিল যে, মুরাক রোগটি আমাদের হযরতের বংশগত রোগ ছিল না, বরং উহা বহির্গত কারণে হয়েছিল। অর্থাৎ গোলাম আহমদের পূর্বে তার পরিবারের আর কেহ এ রোগে আক্রান্ত হন নি, বরং মস্তিষ্কের দুর্বলতার কারণে তিনিই প্রথম এ রোগে আক্রান্ত ও প্রভাবিত হন। (আগস্ট সংখ্যা ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দ) এতে, প্রমাণিত হল যে, সে মুরাক বা হিষ্ট্রীয়া রোগে আক্রান্ত ছিল এবং তার পরিবারে আরো অনেক লোক এ রোগে আক্রান্ত ছিল। এদের মধ্যে তার মামাতো ভাই ,কন্যা, এমনকি, তার স্ত্রীও এ রোগে আক্রান্ত ছিল। একথা তার ছেলে তার জীবন চরিতে উল্লেখ করেছে এবং সে নিজেও বলেছে‘‘আমার স্ত্রী মুরাক রোগে আক্রান্ত’’। ডাক্তারদের পরামর্শানুযায়ী সে আমার সঙ্গে কখনও বেড়াতে বের হত।(কাদিয়ানী পত্রিকা আল হিকম এ গোলামের বর্ণনা, যা ১৯০১ সালের ১০ আগস্ট প্রকাশিত) মুরাক রোগটা কি? এখন আমরা তা নিয়ে আলোচনা করব। কেননা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সহিত এর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু আলী সিনা তার ‘আল কানুন’ নামক গ্রন্থে ‘মুরাক’ রোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, মুরাক এমন একটা রোগ যার ফলে ভয়ভীতি ও বিপর্যয়ের আশঙ্কায় মানুষের চিন্তাধারা ও কল্পনাতে পরিবর্তন ঘটে। অভ্যন্তরীণ ভাবে মানসিক শক্তি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং রোগী এর কারণে সর্বদা অস্থির থাকে। আল্লামা বুরহানুদ্দিন মস্তিষ্ক রোগের লক্ষণ ও কারণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, মুরাক এমন একটা রোগ যার কারণে স্বাভাবিক কল্পনা ও চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়ে রোগীর গতিবিধি অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এমনকি, এ অবস্থায় পৌঁছে যায় যে,রোগী নিজেকে মনে করে সে অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে। আর এ ধরনের কোন কোন রোগী মনে করে যে, সে ফেরেস্তা হয়ে গেছে। অমূলক চিন্তাধারা ও কল্পনার মধ্যেই এ মরাকী পাগল কাদিয়ানী যৌবনে পদার্পণ করে দাবি করল যে, সে একজন মুজাদ্দিদ। এরপর সে বলতে লাগে যে, তার উপর উর্ধ জগতের রহস্যাবলীর ইলহাম হয়। এ সুযোগে তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভু তার মাথায় নবুয়তের মুকুট পরিয়ে দেয়। সুতরাং এ নবুয়তের দাবিদার তাদেরই নবীতে পরিণত হয় এবং তারা হল এর মাবুদ। যেমন সে নিজেই ইহা স্বীকার করে বলেছে, বিশ বছরের কম বয়সের একজন ইংরেজ যুবকের আকৃতিতে আমি একজন ফেরেস্তাকে স্বপ্নে দেখেছি সে একটি চেয়ারের উপর বসে আছে এবং তার সামনে একটি টেবিল রয়েছে। আমি তাকে বললাম তুমি অতি সুন্দর। সে উত্তর দিল হাঁ, হাঁ’। (গোলাম কর্তৃক রচিত তাজকিরায়ে অহীয়ে মুকাদ্দাস ৩১ পৃ:) তার পর ইংরেজি ভাষায় ইলহাম হল, (i love you) আমি তোমাকে ভালোবাসি, (i with you) আমি তোমার সাথে আছি , (i shall help you) আমি তোমার সাহায্য করব। সে আরো উল্লেখ করে যে , ‘এরপর আমার শরীর প্রকম্পিত হল এবং ইংরেজি ভাষায় ইলহাম হল: আমি যা ইচ্ছে করি তা করতে পারি। অনন্তর আমি তার ভাষা উচ্চারণ বুঝতে পারলাম যেন একজন ইংরেজ আমার মাথার কাছে বসে কথা বলছেন’। (গোলাম আহমদ কর্তৃক রচিত‘‘বারাহীনে আহমদী’’ ৪৮০ পৃ:) এরপর আর কি? সে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং নিজের গোলামকে সাহায্য করে। কাজেই তার অবশ্য কর্তব্য হল তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। বিশেষ করে ভারত সম্রাজ্ঞী মহান রাণীকে আল্লাহ তাআলা পাঠালেন এবং তিনি শান্ত-না ও সাহস প্রদানের জন্য অনুগ্রহ পূর্বক তার ঘরে আগমন করলেন। সে নিজেই এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে আমি কাশফের মাধ্যমে ভারত সম্রাজ্ঞী মহান রাণীকে দেখতে পেলাম, তিনি আমার ঘরে আগমন করেছেন। তখন আমি আমার সঙ্গী সাথীদের একজনকে বললাম যে, মহান রাণী তার পরিপূর্ণ স্নেহ মমতা ও ভালোবাসা দ্বারা আমাদের কে সম্মানিত করেছেন। আর ,আমাদের ঘরে দু দিন অবস্থান করেছে। তাই, আমাদের কর্তব্য হল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। (মঞ্জুর কাদিয়ানির লিখিত ‘মুকাশিফাতে গোলাম’ ১৭পৃষ্ঠা)
কার্যত: সাম্রাজ্যবাদের ভালোবাসা এবং উহার প্রতি তার বিশ্বস্ততার ঘোষণা স্বরূপ এবং মুসলমানদের ছিদ্রানুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সে তার কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। এমনকি যখন কোন এক ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী একটা পুস্তক রচনা করে উহাতে উম্মাহাতুল মুমেনিন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানের উপর আঘাত হানে। তখন ভারত বর্ষের মুসলমানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে, আর যখন এ পুস্তকের কারণে তাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ সরকারের কাছে পৌছাল। তখন সে মুসলমানদের সাথে সহযোগিতার বদলে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল। কারণ তার মতে মহান ব্রিটিশ সরকার যারা এ পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া স্বরূপ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ করার অধিকার মুসলমানদের নেই। সাম্রাজ্যবাদের সাহায্য সহযোগিতা এমনকি উহার প্রতি তার অহবান এবং মুসলমানদের ছিদ্রানুসন্ধান করার কারণে যখন তার উপর আক্রমণ চলতে থাকে, তখন সে তার কোন একটি পুস্তকে লিখেছিল যে, আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী সরকারের জন্য আমরা সকল প্রকার বিপদ সহ্য করছি এবং ভবিষ্যতেও করব। কেননা তার করুণা ও দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ব্রিটিশ সরকারের জন্য আমরা আমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ উৎসর্গ করব। আর, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে উহার মর্যাদা ও উন্নতির জন্য আমরা সর্বদা প্রার্থনা করব। (গোলামের ‘‘আরিয়া ধর্ম’’ ৭৯ ও ৮০ পৃষ্ঠা)
জানি না, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননা গ্রহণ করে, সে ধরনের লোক কি নবুয়্যত ও তাজদীদের (সংস্কার) দাবিকরতে পারে? বরঞ্চ সে ঐ সকল লোকের প্রশংসা করছে যারা হুজুরের অবমাননা করেছে এবং ঐ সব লোকের বিরোধিতা করছে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণ ও দেহকে উৎসর্গ করেছেন। সে তার অনুসারী ও ভক্তগণকে উৎসাহিত করে, তারা যেন তাদের মহাপ্রভু ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যে সম্পদ ও প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্ত্তত থাকে। কারণ তার ধর্ম তাকে শিক্ষা দেয়, আল্লাহর আদেশ পালন করতে এবং ঐ সরকারের আনুগত্য করতে যে দেশকে নিরাপত্তা দান করেছে এবং তাদেরকে নিজ ছায়াতলে জালিমদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) হাত থেকে রক্ষা করেছে।
এ সরকার ব্রিটিশ সরকার ছাড়া আর কেহ নহে। অধিকন্তু, এ সরকারের অবাধ্যতা ইসলাম এবং আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের অবাধ্যতার শামিল।( সরকারের লক্ষণ নামক পুস্তিকায় উল্লেখিত গোলামের ভাষণ) তার দুটি পুস্তক ‘‘জরুরতুল ইমাম’’ পৃষ্ঠা ২৩ এবং ‘‘তুহফায়ে কায়সারিয়া’’ পৃ: ২৭ এ সে বলেছে আমি মহান আল্লাহর শুকরিয়া এজন্য আদায় করছি যে, তিনি আমাকে ব্রিটিশের এমন করুণার ছায়াতলে থেকে আমি কাজ করতে পারছি এবং ওয়াজ-নসিহতও করতে পারছি। সুতরাং এ অনুগ্রহশীল সরকারের প্রজাদের কর্তব্য হল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, বিশেষ করে, আমার কর্তব্য হল এ সরকারের অধিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কেননা, বর্তমান ভারত সম্রাট ছাড়া আর কারো অধীনে থেকে আমার মহান উদ্দেশ্য সফল করতে পারতাম না। সে এও বলেছে যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতা ও বিপর্যয় কামনা করে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ এবং ঐ ব্যক্তির উপরও যে নেতার অনুগতা স্বীকার করে না। অথচ আল্লাহপাক বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের এবং নেতাদের অনুগত থাক। এখানে উলিল আমর বা নেতা বলতে বর্তমান সম্রাটকে বুঝায়। এজন্য আমি আমার ভক্তবৃন্দ ও অনুসারীগণকে উপদেশ দিয়ে থাকি তারা যেন ইংরেজকে উলুল আমর এর অন্তর্ভূত করে নেয় এবং অন্তর থেকে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত না হয়। (তার নিজ ভাষা) তারা যে ইংরেজদের আনুগত্য করবে এতে আশ্চর্যের কিছু নয়; কেননা, তারা ওদেরই সন্তান, হাতের বানান বস্ত্ত এবং ওদের লাগান গাছের ফল। ভারত বর্ষের ইতিহাস বেত্তা দেখতে পেল তাদের লাগান গাছ পরিপক্ব ও ফলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, তখন তারা কাদিয়ানীদের বেতনের মাধ্যমে ও বেতন ছাড়া বিশেষ বিশেষ সুযোগ দান করতে লাগল, কাদিয়ানী ছাত্রদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য ইউরোপে পাঠাতে লাগল। আর , ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প কারখানা ইত্যাদি সমুদয় কর্মক্ষেত্রে তাদেরকে বিশেষ অধিকার দিতে লাগল। এমনিভাবে ইংরেজ সরকারকে এ দলের চিন্তা ধারাকে প্রচার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে নেয়। কেননা, এসব চিন্তাধারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ও তাদের স্বার্থেই ছিল। আর তাদের উৎসাহ প্রদান ও উত্তেজিত করার কারণে অনেক মূর্খ ও দুর্বল ইমানের অনেক লোক এ জালে আটকা পড়ে। কারণ, তারা ইহা অর্জনও করতে লাগল। এভাবে এ মুরতাদ দলটি ক্রমশ: বিস্তৃতি লাভ করে এবং দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর মুসলমানগণকে ইসলাম থেকে সরিয়ে রাখা ব্রিটিশের দাসত্বের নিকটবর্তী করার জন্য অনেক পুস্তিকা প্রচার করে। মুসলমানদের ক্রোধ ও রোষানল থেকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী মুরবিবরা সর্বদা তাদেরকে হেফাযত করত। যখনই কোন সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসক তাদের প্রতি অমনোযোগী হত, তখনই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রতিবাদ উত্থাপিত হত যে, অমুক অন্যান্য দলকে আমাদের সমমর্যাদা দান করে। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি ভীতি প্রদর্শন ও সতর্ক বাণী এসে পড়ত। যেমন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ভারতে নিযুক্ত ভইসরয়ের কাছে এমন কতকগুলো শব্দ ও পদ্ধতি ব্যবহার করে দরখাস্ত পেশ করল, যা কোন মর্যাদা সম্পন্ন লোকের পক্ষে শোভা পায় না। আর, আল্লাহর নবিতো এ থেকে কত ঊর্ধ্বে। (তার মূল বর্ণনা) আমার অনুসারীদের নাম সংবলিত যে আবেদন পত্রটি আপনার সমীপে পেশ করছি, এর উদ্দেশ্য হল এই যে, আমি ও আমার পূর্ব পুরুষেরা আপনাদের জন্য যে বিরাট খেদমত করেছি উহার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। আমি মহান সরকারের কাছে আরো আশা রাখি যে সরকার ঐ পরিবারের প্রতি লক্ষ্য রাখবে যে দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর যাবৎ পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সহিত প্রমাণ করেছে যে, এ পরিবার সরকারের প্রতি সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠাবান। মহান সরকারের শাসকবর্গ এ পরিবারের ভালোবাসার স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং এ পরিবারের জন্য অঙ্গীকার পত্র ও সনদপত্র দান করেছে যে, ইহা একটি সেবক ও নিঃস্বার্থ পরিবার। এ জন্য আমি আপনাদের নিকট আশা রাখি যে, আপনার অধীনস্থ প্রশাসকদেরকে লিখবেন যাতে তারা ঐ বৃক্ষের প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করে; যা আপনারাই রোপণ করেছেন। আরো আশা করি, তারা যেন আমার অনুসারীদের প্রতি বিশেষ স্নেহের দৃষ্টি রাখে। কেননা অতীতে কখনও আমরা আপনাদের জন্য প্রাণ ও রক্ত উৎসর্গ করতে পিছিয়ে থাকিনি, আর ভবিষ্যতেও পিছিয়ে থাকব না। এ মহান অবদানের প্রেক্ষিতে আমরা মহান সরকারের কাছে সাহায্য সহযোগিতা দাবি করার অধিকার রাখি, যাতে কেহ আমাদের উপর আক্রমণের সাহস না পায়। (ভারতবর্ষের প্রতি গোলাম আহমদের পত্র যা কাসেম কাদিয়ানীর লিখিত ‘‘তাবলীগে রিসালাত’’ নামক পুস্তকের ৭ম খন্ডে উল্লেখিত।) পুনরায় সে তাদের বিরাট বিরাট সেবার কথা উল্লেখ করে বলেছে যে, ইংরেজদের প্রশংসায় আমার রচিত পুস্তকাবলী দ্বারা আমি গ্রন্থাগার পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। বিশেষ করে, সরকারের প্রতি এটাই আমার বড় অবদান। আমি আশা করি যে আমাকে এর উত্তম বিনিময় প্রদান করা হবে। কার্যত: এটাই ছিল তার অন্যতম বড় খেদমত। কেননা, সাম্রাজ্যবাদীরা খ্রিস্টান হোক আর অখৃষ্টান হোক , তারা মুসলমানদের জেহাদের অনুভূতিকে যতটুকু ভয় করে, অন্য কিছুকে তারা ততটুকু ভয় করে না। সুতরাং সে এর বিনিময় পেল। আর এর চেয়ে বড় বিনিময় কি হতে পারে যে, একজন মুরাক (হিষ্ট্রিয়া) রোগাক্রান্ত ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যার কাছে একদিনের খাবার ছিল না, সে আজ নবুয়তের সিংহাসনে সমাসীন হয়ে বসেছে এবং তার চতুর পার্শ্বে নজর ও নেওয়াজের ধারা বয়ে চলেছে। লোকেরা তার কাছে দৌড়ে ছুটছে এবং এবং তখনকার বিশ্বের সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্র তাকে সহায়তা করছে। এর ফলশ্রুতিতে তার পাগলামি আরো বৃদ্ধি পায় এবং তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ইনশাআল্লাহ, আমি উহা বিশেষ প্রবন্ধে উল্লেখ করব। এ আলোচনার সঙ্গে গোলাম আহমদের ছেলে, তার দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক ব্যক্ত স্বীকারোক্তি ‘‘কাদিয়ানী ধর্ম সাম্রাজ্যবাদীদের ফসল ছাড়া আর কিছু নয়’’। যোগ করছি সে বলছে আমাদের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের অনেক অবদান রয়েছে। আমরা পূর্ণ শান্তি ও আরামের সহিত আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করছি এবং বিভিন্ন দেশে প্রচারের উদ্দেশ্যে আমরা যেতে পারছি। ব্রিটিশ সরকার এখানেও আমাদের সাহায্য করছে। এটা হল আমাদের উপর তাদের পূর্ণ করুণা ও দয়া। (মাহমুদ আহমদ রচিত ‘‘বারাকাতুল খেলাফত’’ নামক গ্রন্থ ৬৫ পৃষ্ঠা) এ কারণেই গোলাম আহমদ সর্বদা তার ভক্তগণকে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা অর্জনে সচেষ্ট হওয়ার জন্য উৎসাহিত করত। শুধু তাই নহে বরং এর জন্য আত্মোৎসর্গ করতে এবং এর আহবায়ক হতে, আর মানুষের মনে এ কথা বদ্ধ মূল করতে অনুপ্রেরণা দিত যে, পৃথিবীতে এ সরকারের চেয়ে অধিক ন্যায় পরায়ণ ও উত্তম আর কেহ নেই। যার ফলে, এ আহবানের দরুন মানুষের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করবে। কেননা যখন এ কথাটি বার বার শ্রুত হতে থাকে তখন এ করুণাময় সরকারের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান সুদৃঢ় হওয়া স্বাভাবিক। আর উহা শুধু ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং আমাদের কেহ অন্য দেশে গেলে সেখানেও এ কর্মধারা চালিয়ে যাবে। কারণ, আমাদের স্বার্থ ও লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। ( আর তাদের এই অভিন্ন লক্ষ্য হলো ইসলামের প্রকৃতিকে ধ্বংস করা এবং সঠিক ধর্মকে মুছে ফেলা) যখন এ সরকারের ন্যায়পরায়ণতার কথা অন্যান্য দেশবাসীরা জানতে পারবে তখন তারা আগ্রহ করবে যেন এ বরকতময় সরকারের পা তাদের দেশেও পৌঁছে যায়।
বস্ত্তত তাদের উদ্দেশ্যাবলী ছিল অভিন্ন। যেমন এক কাদিয়ানী ধর্মপ্রচারক ১৯২৩ সনে রাশিয়া হতে প্রত্যাবর্তন করে সংবাদ দিয়ে বলল যে, আমি ব্রিটিশের গুপ্তচর হওয়ার অপবাদে কয়েকবার ধৃত হয়েছি’ সে গর্ব করে আরো বলে যে, আমি রাশিয়াতে শুধু কাদিয়ানী ধর্ম প্রচারের জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু কাদিয়ানীদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যের সাথে জড়িত, তাই আমি ব্রিটিশ সরকারের সেবা করতে এবং আমার উপর তার অর্পিত কর্তব্য সম্পাদন করতে বাধ্য ছিলাম। (কাদিয়ানীদের মুবাল্লিগ মুহাম্মদ আমিনের লিখিত এবং আল ফজলুল কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রচারিত ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খৃ:) এভাবেই তাদের কার্যক্রম চলতে থাকল। এ অপবিত্র দলটি লাঞ্ছনা ও অপদস্ততার সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে। এমন হল যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একের পর এক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে পতনের কারণে তারা আনন্দ উল্লাস করতে থাকে এবং বড় বড় সাধারণ সভা অনুষ্ঠান শুরু করে আর মুসলিম নিধনের জন্য যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বড় অঙ্কের টাকা প্রেরণ করতে থাকে। যখন গোলামের পুত্র ও তার খলিফা এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলে, মুসলিম ওলামারা আমাদেরকে ইংরেজ সরকারের সহযোগিতার অপবাদ দেয়, আর উহার বিজয় সমূহে আমাদের আনন্দ উল্লাসের কারণে আমাদেরকে দোষারোপ করে। আমরা প্রশ্ন করি, কেন আমরা উহাতে সন্তুষ্ট ও আনন্দিত হব না? অথচ আমাদের ইমাম এ কথা বলেছেন, ‘আমি মেহদী এবং ব্রিটিশ সরকার আমার তরবারি’। সুতরাং আমরা এর বিজয়ে আনন্দিত হবই এবং আমরা দেখতে চাই যে, এ তরবারির আলো যেন ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে উদ্ভাসিত হচ্ছে। সে আরো বলে, আল্লাহ তায়ালা এ সরকারের সাহায্য করার জন্য ফেরেস্তা প্রেরণ করেছেন।(আল-ফজল পত্রিকা ৭ই ডিসেম্বর ১৯১৮ ইং) তদুপরি তার বক্তব্য হল যে, শত শত কাদিয়ানী ইরাক বিজয়ের জন্য ইংরেজ বাহিনীতে যোগদান করেছে এবং এ জন্য তাদের (অপবিত্র) রক্ত ঝরিয়েছে। (আল-ফজল পত্রিকা ৩১ শে আগস্ট ১৯২৩ খৃ:) অনুরূপ ভাবে সে আনন্দ প্রকাশ করে যখন সাম্রাজ্যবাদী বাহিনী আল-কুদসে প্রবেশ করে। সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে সে একটি প্রবন্ধও লিখেছে। তার এ কাজের ও উসমানী সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রীর সেক্রেটারি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আল-ফজল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিজয়ের জন্য আমরা আল্লাহর হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। এটা একটা আনন্দ উল্লাসের কারণ। কেননা আমাদের নেতা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার অনুসারীদেরকে এর জন্য দোয়া করতে উপদেশ দিতেন। ইতিপূর্বে কাদিয়ানী ধর্মের যে দাওয়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার পথ আবার খুলে দেয়া হল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার ফলেই আমাদের এ সকল সুযোগ-সুবিধা লাভ হয় । (আল-ফজল ২৩ নভেম্বর ১৯১৮ খৃ:) এমনি ভাবে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি সফল করার জন্য এ দলটিকে লালন-পালন করে। যেহেতু, এরা ইংরেজদের এজেন্ট, তাই জার্মান সরকার তার মন্ত্রী-বর্গকে এদের মাহফিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে নিষেধ করে। আল-ফজল ১লা নভেম্বর ১৯৩৪ খৃ: আরো উল্লেখ্য যে , আফগান ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে যখন এ দলের দু’ব্যক্তি আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল, তখন আফগান সরকার এদেরকে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে হত্যা করে। আফগান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, এদের কাছে এমন প্রমাণ ও চিঠিপত্র পাওয়া গেছে যদ্বারা এটাই সাব্যস্ত হয় যে, এরা আমাদের শত্রুর এজেন্ট। কিন্তু এর বিপরীত কাদিয়ানী খলীফা এ দু’জনের অপরাধ নিয়ে গর্ব করে বলে যে, যদি আমাদের লোকেরা আফগানিস্থানে চুপ থাকত আর জিহাদ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসকে প্রকাশ না করত তবে তাদের উপর কোন বিপদ আসত না। কিন্তু তারা ব্রিটিশ সরকারের ভালোবাসাকে গোপন করতে পারেনি, যা আমাদের কাছ থেকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই তারা মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। (ইবনে গোলামের জুমার খোতবা যা আল-ফজল পত্রিকায় প্রকাশিত ১৬ ই আগস্ট ১৯৩৫ খৃ:) এটা কারো কাছে অস্পষ্ট নয় যে, সাম্রাজ্যবাদীরা সর্বদাই গুপ্তচর বৃত্তির জন্য ধর্ম এবং ধর্মপ্রচারের সুযোগ গ্রহণ করে। যেমন ড: উমর ফররুখ তার পুস্তক ‘‘আত-তাবসীর অল-ইস্তিমার’’ এর মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন এবং আমরাও তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এখন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শক্তি সুদৃঢ় করার জন্য এবং তাদের সার্থ রক্ষার তাগিদে আফ্রিকায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে সন্দেহের সৃষ্টি এবং ইসলামকে কুলষিত করতে ও গুপ্তচর বৃত্তি চালাতে শুরু করেছে। এরা ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং ওদের সাহায্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলামের নাম ব্যবহার করছে। পরিশেষে, কাদিয়ানীদের মুখপাত্র আল-ফজল পত্রিকায় যা প্রচারিত হয়েছে, তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘‘ব্রিটিশ সরকার আমাদের জন্য ঢাল স্বরূপ।যার ছত্রছায়ায় আমরা কেবল সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যদি এ ঢাল সরিয়ে নেয়া হয়, তা হলে আমরা শত্রুর আক্রমণে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। সুতরাং এজন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছি যে, ব্রিটিশের উন্নতি অর্থ আমাদের উন্নতি এবং ওদের ধ্বংস অর্থ আমাদের ধ্বংস। (আল-ফজল ১৯শে অক্টোবর ১৯১৫ খৃ:) এটাই হল এ ধর্মান্তরিত দলের বাস্তব রূপ। যারা সাম্রজ্যবাদের কাছে তাদের আকিদা বিশ্বাসকে বিক্রি করে দিয়েছে। সর্বশক্তি দিয়ে তাদের খেদমত করেছে, আজও করে যাচ্ছে। ‘‘মহান আল্লাহর তওফীক ছাড়া গুনাহ থেকে বিরত থাকা এবং সৎকাজ সম্পাদন করার শক্তি-সামর্থ্য আমাদের কারো নেই’’
একসাথে একশত পাউন্ড দেখে নাই সে আজ লক্ষ লক্ষ পাউন্ড নিয়ে খেলতে শুরু করে। সে ছিল মিসকীন, সামান্য বেতনভোগী কর্মচারী, মাসে পাঁচ পাউন্ডের বেশি বেতন পেত না, জীবিকার অন্বেষণে নগরে নগরে এবং গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত; সে আজ বিরাট অট্রালিকা তৈরি করতে লাগল এবং দামী গাড়ি চড়তে লাগল। আর, তার চাকর নোকররা বড় বড় লোকদের চেয়েও বেশি জীবিকা অর্জনের সুযোগ লাভ করতে শুরু করে। ব্রিটেনের রাণীকে ভারতবর্ষে আগমন উপলক্ষে কাদিয়ানী যে মানপত্র প্রদান করেছিল, তাতে সে একথা স্বীকার করেছে। এমনি ভাবে, সাম্রাজ্যবাদীরা এ বৃক্ষটি বাড়িয়ে তোলার জন্য এবং লালন পালন করার জন্য তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োজিত করল। তাকে লোকের কাছে পরিচিত করল এবং নিজেদের ছত্রছায়ায় রেখে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করল। ইসলাম ও মুসলমানদের উপর এবং তাদের শ্রদ্ধাভাজন পূর্বপুরুষ ও ইমামদের উপর আক্রমণের জন্য উৎসাহ দিতে লাগল। এমনকি, সে নবীগণের এবং সাইয়েদুল মুরসালীনের ইজ্জতের উপরও আক্রমণ করতে লাগল। যেমন সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর হাসান হুসাইন, তাঁর খলীফা, দামাদ ও আত্মীয় স্বজন অর্থাৎ আবু বকর উমর, উসমান, আলী ও অন্যান্য সাহাবীদের সম্মানের উপর আক্রমণ করল। সুতরাং উম্মতের সকল আলেমগণ একবাক্যে তাকে কাফের বলে ঘোষণা দেন এবং নবুয়তের বাদী, নবীগণের তিরস্কার, মুসলমানদের গালি গালাজ ও খাঁটি ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদকে অস্বীকার করার কারণে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে ফতওয়া প্রদান করেন। কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভু তার পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করতে থাকে এবং তাকে মুসলমানদের ক্রোধ ও রোষানল থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে, মুসলমানগণ তার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেন নি। তবে, মুসলিম আলেমগণ তার সাথে বিতর্ক ও মুনাজারা করেন। এভাবে, তারা সত্য প্রকাশ করেন এবং বাতিলকে অসার প্রমাণিত করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিখ্যাত আলেম অমৃত সর নিবাসী শেখ ছানাউল্লাহ। তিনি বার বার বিতর্কে তার উপর জয়ী হন এবং তাকে প্রমাণ দ্বারা জব্দ করেন। পরিশেষে তাকে মুবাহালার জন্য আহবান করেন এই বলে: ‘যে মিথ্যাবাদী সে যেন সত্যবাদীর জিবদ্দশায় অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে’। আবার সত্য প্রকাশ পেল। এ মুবাহালার কিছুদিন পরেই গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এমনভাবে মৃত্যুবরণ করল যা শুনা মাত্র মানুষ ঘৃণা বোধ করে। পরে আমি এ ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করব। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, এ ধর্মান্তরিত দলটি ইসলামের সাথে যার আদৌ সম্পর্ক নেই এবং ইসলাম ও তা থেকে বিচ্ছিন্ন, সে দলটি পুনরায় মুসলমানদের সারিতে প্রবেশ করে এবং তারা প্রকাশ করে, যে ঐ সকল বিষয়ের উপর তারা বিশ্বাস রাখে যার উপর মুসলমানদের বিশ্বাস রয়েছে। ছোটোখাটো অমৌলিক কিছু বিষয় ছাড়া তাদের এবং মুসলমানদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আবার তাদের ঐ পুরাতন প্রভু ইউরোপ ও আফ্রিকায় পত্র পত্রিকা ও অন্যান্য প্রচারণার মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য করে। যেমন, খ্রিস্টান মিশনারিদের একটি সংগঠন আল-মনজিদ অভিধানের পরিশিষ্টে এ কথা সংযোজন করে যে, ‘কাদিয়ানীরা একটি মুসলিম দল, তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তাদের বিশ্বাস মুসলমানদের উপর জেহাদ ফরজ নয়’। এ কারণেই আমি এ নতুন মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার মনস্থ করলাম। বিশেষ করে কাবা শরীফে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত আমার কিছু বন্ধুর সাথে যখন সাক্ষাৎ হল এবং তারা আমাকে শঙ্কিত করে তুলল যে তাদের দেশে এমন কতকগুলো লোক রয়েছে, যারা কাদিয়ানী মতবাদের প্রতি এই বলে আহবান করে যে, তাদের নেতা উম্মতে মুসলিমার মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক আর, তারা এমন কিছু পাচ্ছেন না যা দিয়ে ওদের মুকাবেলা করতে পারেন। কাদিয়ানী আলেমরা যখন তাদেরকে প্রশ্ন করেন তখন তারা উত্তর দিতে পারেন না। কারণ, তাদের কাছে ওদের কিতাব ও প্রকৃত আকিদা সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই, আমি এ প্রথম কিস্তি পেশ করছি, আল্লাহর সঙ্গে এ প্রতিশ্রুতিসহ যে এ মতবাদের প্রকৃত অবস্থার মুখোশ না খোলা পর্যন্ত আমি শান্ত হব না। মহান আল্লাহর দরবারে এর তাওফিক কামনা করছি। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে পাঞ্জাবের অন্তর্গত কাদিয়ান নামক গ্রামে কোন এক পরিবারে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট গোলাম আহমদের জন্ম হয়। তার পিতা ঐ সকল লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এবং মান-সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদকে সাহায্য করেছে। যেমন, স্বয়ং গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার কিতার ‘তোহফায়ে কায়সারিয়ায়’ উল্লেখ করেছে যে, আমার পিতা গোলাম মুরতাজা ঐ সমস্ত লোকদের একজন ছিলেন, ইংরেজ সরকারের সাথে যাদের সুসম্পর্ক ও ভালোবাসার বন্ধন ছিল, এবং রাজ দরবারে তার একটা আসন সংরক্ষিত ছিল। সে ইংরেজ সরকারকে সর্বতভাবে সাহায্য করেছিল যখন তার স্বদেশি ও স্ব ধর্মীয় ভারতবাসীরা ১৮৫১ ইং সালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। (এটা ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একটা প্রসিদ্ধ বিপ্লব) এমনকি সে নিজের পক্ষ থেকে পঞ্চাশজন সৈন্য ও পঞ্চাশটি ঘোড়া দ্বারা তাদের সাহায্য করে এবং সে তার সাধ্যাতীত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সেবা করেছে। (উল্লেখিত গ্রন্থ ১৬ পৃ:) সুতরাং এ ধরনের পরিবারে যদি গোলাম আহমদের জন্ম না হয় তবে, আর কার জন্ম হবে? মোটকথা, জন্মের পর লেখাপড়ার বয়সে পৌছলে সে অখ্যাত কিছু শিক্ষকের কাছে কতক গুলো উর্দু ও আরবী পুস্তক পড়ে এবং কিছু আইন বিদ্যাও শিখে। তারপর সে মাসিক মাত্র পনেরো টাকা বেতনে বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত শিয়ালকোট নামক শহরে চাকুরি নেয়। সে একটা মানসিক ভারসাম্যহীন প্রকৃতির লোক ছিল। এমনকি, তার সম্পর্কে বলা হয় যে তাকে ঘর থেকে চিনি আনার কথা বলা হলে সে চিনির বদলে লবণ নিয়ে আসে। একান্ত নির্বুদ্ধিতা ও ভারসাম্যহীনতার কারণে সে পথিমধ্যে উহা খেতে আরম্ভ করে। যখন লবণ তার গলায় পৌঁছে আটকে যায় তখন তার চক্ষু-দ্বয় থেকে অশ্রু নির্গত হয়।(তার পুত্র বশীর আহমদ কর্তৃক লিখিত ‘‘সিরাতুল মাহদী’’ নামক গ্রন্থ) এতদ্ব্যতীত সে এত ভীরু ছিল যে, কখনও যুদ্ধ ও কুস্তিতে অংশ গ্রহণ করেনি। অথচ ঐ সময় ভদ্র পরিবারের সকলেই সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করত। এ কারণেই একদা সে একটা মোরগের বাচ্চা জবাই করতে গিয়ে তার আঙুল কেটে ফেলে এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। ফলে, সে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করে সরে পড়ে। কারণ, সে তার জীবনে কোন প্রাণী জবাই করেনি। (সিরাতে মাহদী ২য় খন্ড ৪থ পৃ:) এ নির্বুদ্ধিতা ও ভীরুতা নিয়ে সে বড় হতে লাগল এবং যৌবনে পদার্পণ করল। এর অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ সে সর্বদা অসুস্থই থাকত। যৌবনে সে পাগলামি সাদৃশ্য ‘মুরাক’ বা হিষ্ট্রীয়া রোগে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া সে আরো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিল। ‘রিভিউ কাদিয়ান’ নামক কাদিয়ানী পত্রিকায় একদা প্রকাশিত হয়েছিল যে, মুরাক রোগটি আমাদের হযরতের বংশগত রোগ ছিল না, বরং উহা বহির্গত কারণে হয়েছিল। অর্থাৎ গোলাম আহমদের পূর্বে তার পরিবারের আর কেহ এ রোগে আক্রান্ত হন নি, বরং মস্তিষ্কের দুর্বলতার কারণে তিনিই প্রথম এ রোগে আক্রান্ত ও প্রভাবিত হন। (আগস্ট সংখ্যা ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দ) এতে, প্রমাণিত হল যে, সে মুরাক বা হিষ্ট্রীয়া রোগে আক্রান্ত ছিল এবং তার পরিবারে আরো অনেক লোক এ রোগে আক্রান্ত ছিল। এদের মধ্যে তার মামাতো ভাই ,কন্যা, এমনকি, তার স্ত্রীও এ রোগে আক্রান্ত ছিল। একথা তার ছেলে তার জীবন চরিতে উল্লেখ করেছে এবং সে নিজেও বলেছে‘‘আমার স্ত্রী মুরাক রোগে আক্রান্ত’’। ডাক্তারদের পরামর্শানুযায়ী সে আমার সঙ্গে কখনও বেড়াতে বের হত।(কাদিয়ানী পত্রিকা আল হিকম এ গোলামের বর্ণনা, যা ১৯০১ সালের ১০ আগস্ট প্রকাশিত) মুরাক রোগটা কি? এখন আমরা তা নিয়ে আলোচনা করব। কেননা আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সহিত এর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু আলী সিনা তার ‘আল কানুন’ নামক গ্রন্থে ‘মুরাক’ রোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, মুরাক এমন একটা রোগ যার ফলে ভয়ভীতি ও বিপর্যয়ের আশঙ্কায় মানুষের চিন্তাধারা ও কল্পনাতে পরিবর্তন ঘটে। অভ্যন্তরীণ ভাবে মানসিক শক্তি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং রোগী এর কারণে সর্বদা অস্থির থাকে। আল্লামা বুরহানুদ্দিন মস্তিষ্ক রোগের লক্ষণ ও কারণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, মুরাক এমন একটা রোগ যার কারণে স্বাভাবিক কল্পনা ও চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়ে রোগীর গতিবিধি অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। এমনকি, এ অবস্থায় পৌঁছে যায় যে,রোগী নিজেকে মনে করে সে অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে। আর এ ধরনের কোন কোন রোগী মনে করে যে, সে ফেরেস্তা হয়ে গেছে। অমূলক চিন্তাধারা ও কল্পনার মধ্যেই এ মরাকী পাগল কাদিয়ানী যৌবনে পদার্পণ করে দাবি করল যে, সে একজন মুজাদ্দিদ। এরপর সে বলতে লাগে যে, তার উপর উর্ধ জগতের রহস্যাবলীর ইলহাম হয়। এ সুযোগে তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভু তার মাথায় নবুয়তের মুকুট পরিয়ে দেয়। সুতরাং এ নবুয়তের দাবিদার তাদেরই নবীতে পরিণত হয় এবং তারা হল এর মাবুদ। যেমন সে নিজেই ইহা স্বীকার করে বলেছে, বিশ বছরের কম বয়সের একজন ইংরেজ যুবকের আকৃতিতে আমি একজন ফেরেস্তাকে স্বপ্নে দেখেছি সে একটি চেয়ারের উপর বসে আছে এবং তার সামনে একটি টেবিল রয়েছে। আমি তাকে বললাম তুমি অতি সুন্দর। সে উত্তর দিল হাঁ, হাঁ’। (গোলাম কর্তৃক রচিত তাজকিরায়ে অহীয়ে মুকাদ্দাস ৩১ পৃ:) তার পর ইংরেজি ভাষায় ইলহাম হল, (i love you) আমি তোমাকে ভালোবাসি, (i with you) আমি তোমার সাথে আছি , (i shall help you) আমি তোমার সাহায্য করব। সে আরো উল্লেখ করে যে , ‘এরপর আমার শরীর প্রকম্পিত হল এবং ইংরেজি ভাষায় ইলহাম হল: আমি যা ইচ্ছে করি তা করতে পারি। অনন্তর আমি তার ভাষা উচ্চারণ বুঝতে পারলাম যেন একজন ইংরেজ আমার মাথার কাছে বসে কথা বলছেন’। (গোলাম আহমদ কর্তৃক রচিত‘‘বারাহীনে আহমদী’’ ৪৮০ পৃ:) এরপর আর কি? সে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং নিজের গোলামকে সাহায্য করে। কাজেই তার অবশ্য কর্তব্য হল তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। বিশেষ করে ভারত সম্রাজ্ঞী মহান রাণীকে আল্লাহ তাআলা পাঠালেন এবং তিনি শান্ত-না ও সাহস প্রদানের জন্য অনুগ্রহ পূর্বক তার ঘরে আগমন করলেন। সে নিজেই এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে আমি কাশফের মাধ্যমে ভারত সম্রাজ্ঞী মহান রাণীকে দেখতে পেলাম, তিনি আমার ঘরে আগমন করেছেন। তখন আমি আমার সঙ্গী সাথীদের একজনকে বললাম যে, মহান রাণী তার পরিপূর্ণ স্নেহ মমতা ও ভালোবাসা দ্বারা আমাদের কে সম্মানিত করেছেন। আর ,আমাদের ঘরে দু দিন অবস্থান করেছে। তাই, আমাদের কর্তব্য হল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। (মঞ্জুর কাদিয়ানির লিখিত ‘মুকাশিফাতে গোলাম’ ১৭পৃষ্ঠা)
কার্যত: সাম্রাজ্যবাদের ভালোবাসা এবং উহার প্রতি তার বিশ্বস্ততার ঘোষণা স্বরূপ এবং মুসলমানদের ছিদ্রানুসন্ধানের উদ্দেশ্যে সে তার কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। এমনকি যখন কোন এক ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী একটা পুস্তক রচনা করে উহাতে উম্মাহাতুল মুমেনিন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানের উপর আঘাত হানে। তখন ভারত বর্ষের মুসলমানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে, আর যখন এ পুস্তকের কারণে তাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ সরকারের কাছে পৌছাল। তখন সে মুসলমানদের সাথে সহযোগিতার বদলে তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল। কারণ তার মতে মহান ব্রিটিশ সরকার যারা এ পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া স্বরূপ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ করার অধিকার মুসলমানদের নেই। সাম্রাজ্যবাদের সাহায্য সহযোগিতা এমনকি উহার প্রতি তার অহবান এবং মুসলমানদের ছিদ্রানুসন্ধান করার কারণে যখন তার উপর আক্রমণ চলতে থাকে, তখন সে তার কোন একটি পুস্তকে লিখেছিল যে, আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী সরকারের জন্য আমরা সকল প্রকার বিপদ সহ্য করছি এবং ভবিষ্যতেও করব। কেননা তার করুণা ও দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ব্রিটিশ সরকারের জন্য আমরা আমাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ উৎসর্গ করব। আর, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে উহার মর্যাদা ও উন্নতির জন্য আমরা সর্বদা প্রার্থনা করব। (গোলামের ‘‘আরিয়া ধর্ম’’ ৭৯ ও ৮০ পৃষ্ঠা)
জানি না, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননা গ্রহণ করে, সে ধরনের লোক কি নবুয়্যত ও তাজদীদের (সংস্কার) দাবিকরতে পারে? বরঞ্চ সে ঐ সকল লোকের প্রশংসা করছে যারা হুজুরের অবমাননা করেছে এবং ঐ সব লোকের বিরোধিতা করছে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণ ও দেহকে উৎসর্গ করেছেন। সে তার অনুসারী ও ভক্তগণকে উৎসাহিত করে, তারা যেন তাদের মহাপ্রভু ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যে সম্পদ ও প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্ত্তত থাকে। কারণ তার ধর্ম তাকে শিক্ষা দেয়, আল্লাহর আদেশ পালন করতে এবং ঐ সরকারের আনুগত্য করতে যে দেশকে নিরাপত্তা দান করেছে এবং তাদেরকে নিজ ছায়াতলে জালিমদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) হাত থেকে রক্ষা করেছে।
এ সরকার ব্রিটিশ সরকার ছাড়া আর কেহ নহে। অধিকন্তু, এ সরকারের অবাধ্যতা ইসলাম এবং আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের অবাধ্যতার শামিল।( সরকারের লক্ষণ নামক পুস্তিকায় উল্লেখিত গোলামের ভাষণ) তার দুটি পুস্তক ‘‘জরুরতুল ইমাম’’ পৃষ্ঠা ২৩ এবং ‘‘তুহফায়ে কায়সারিয়া’’ পৃ: ২৭ এ সে বলেছে আমি মহান আল্লাহর শুকরিয়া এজন্য আদায় করছি যে, তিনি আমাকে ব্রিটিশের এমন করুণার ছায়াতলে থেকে আমি কাজ করতে পারছি এবং ওয়াজ-নসিহতও করতে পারছি। সুতরাং এ অনুগ্রহশীল সরকারের প্রজাদের কর্তব্য হল তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, বিশেষ করে, আমার কর্তব্য হল এ সরকারের অধিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কেননা, বর্তমান ভারত সম্রাট ছাড়া আর কারো অধীনে থেকে আমার মহান উদ্দেশ্য সফল করতে পারতাম না। সে এও বলেছে যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতা ও বিপর্যয় কামনা করে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ এবং ঐ ব্যক্তির উপরও যে নেতার অনুগতা স্বীকার করে না। অথচ আল্লাহপাক বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের এবং নেতাদের অনুগত থাক। এখানে উলিল আমর বা নেতা বলতে বর্তমান সম্রাটকে বুঝায়। এজন্য আমি আমার ভক্তবৃন্দ ও অনুসারীগণকে উপদেশ দিয়ে থাকি তারা যেন ইংরেজকে উলুল আমর এর অন্তর্ভূত করে নেয় এবং অন্তর থেকে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত না হয়। (তার নিজ ভাষা) তারা যে ইংরেজদের আনুগত্য করবে এতে আশ্চর্যের কিছু নয়; কেননা, তারা ওদেরই সন্তান, হাতের বানান বস্ত্ত এবং ওদের লাগান গাছের ফল। ভারত বর্ষের ইতিহাস বেত্তা দেখতে পেল তাদের লাগান গাছ পরিপক্ব ও ফলে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে, তখন তারা কাদিয়ানীদের বেতনের মাধ্যমে ও বেতন ছাড়া বিশেষ বিশেষ সুযোগ দান করতে লাগল, কাদিয়ানী ছাত্রদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য ইউরোপে পাঠাতে লাগল। আর , ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প কারখানা ইত্যাদি সমুদয় কর্মক্ষেত্রে তাদেরকে বিশেষ অধিকার দিতে লাগল। এমনিভাবে ইংরেজ সরকারকে এ দলের চিন্তা ধারাকে প্রচার করার দায়িত্ব গ্রহণ করে নেয়। কেননা, এসব চিন্তাধারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ও তাদের স্বার্থেই ছিল। আর তাদের উৎসাহ প্রদান ও উত্তেজিত করার কারণে অনেক মূর্খ ও দুর্বল ইমানের অনেক লোক এ জালে আটকা পড়ে। কারণ, তারা ইহা অর্জনও করতে লাগল। এভাবে এ মুরতাদ দলটি ক্রমশ: বিস্তৃতি লাভ করে এবং দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর মুসলমানগণকে ইসলাম থেকে সরিয়ে রাখা ব্রিটিশের দাসত্বের নিকটবর্তী করার জন্য অনেক পুস্তিকা প্রচার করে। মুসলমানদের ক্রোধ ও রোষানল থেকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী মুরবিবরা সর্বদা তাদেরকে হেফাযত করত। যখনই কোন সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসক তাদের প্রতি অমনোযোগী হত, তখনই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রতিবাদ উত্থাপিত হত যে, অমুক অন্যান্য দলকে আমাদের সমমর্যাদা দান করে। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি ভীতি প্রদর্শন ও সতর্ক বাণী এসে পড়ত। যেমন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ভারতে নিযুক্ত ভইসরয়ের কাছে এমন কতকগুলো শব্দ ও পদ্ধতি ব্যবহার করে দরখাস্ত পেশ করল, যা কোন মর্যাদা সম্পন্ন লোকের পক্ষে শোভা পায় না। আর, আল্লাহর নবিতো এ থেকে কত ঊর্ধ্বে। (তার মূল বর্ণনা) আমার অনুসারীদের নাম সংবলিত যে আবেদন পত্রটি আপনার সমীপে পেশ করছি, এর উদ্দেশ্য হল এই যে, আমি ও আমার পূর্ব পুরুষেরা আপনাদের জন্য যে বিরাট খেদমত করেছি উহার প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। আমি মহান সরকারের কাছে আরো আশা রাখি যে সরকার ঐ পরিবারের প্রতি লক্ষ্য রাখবে যে দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসর যাবৎ পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার সহিত প্রমাণ করেছে যে, এ পরিবার সরকারের প্রতি সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠাবান। মহান সরকারের শাসকবর্গ এ পরিবারের ভালোবাসার স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং এ পরিবারের জন্য অঙ্গীকার পত্র ও সনদপত্র দান করেছে যে, ইহা একটি সেবক ও নিঃস্বার্থ পরিবার। এ জন্য আমি আপনাদের নিকট আশা রাখি যে, আপনার অধীনস্থ প্রশাসকদেরকে লিখবেন যাতে তারা ঐ বৃক্ষের প্রতি লক্ষ্য রাখে এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ করে; যা আপনারাই রোপণ করেছেন। আরো আশা করি, তারা যেন আমার অনুসারীদের প্রতি বিশেষ স্নেহের দৃষ্টি রাখে। কেননা অতীতে কখনও আমরা আপনাদের জন্য প্রাণ ও রক্ত উৎসর্গ করতে পিছিয়ে থাকিনি, আর ভবিষ্যতেও পিছিয়ে থাকব না। এ মহান অবদানের প্রেক্ষিতে আমরা মহান সরকারের কাছে সাহায্য সহযোগিতা দাবি করার অধিকার রাখি, যাতে কেহ আমাদের উপর আক্রমণের সাহস না পায়। (ভারতবর্ষের প্রতি গোলাম আহমদের পত্র যা কাসেম কাদিয়ানীর লিখিত ‘‘তাবলীগে রিসালাত’’ নামক পুস্তকের ৭ম খন্ডে উল্লেখিত।) পুনরায় সে তাদের বিরাট বিরাট সেবার কথা উল্লেখ করে বলেছে যে, ইংরেজদের প্রশংসায় আমার রচিত পুস্তকাবলী দ্বারা আমি গ্রন্থাগার পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। বিশেষ করে, সরকারের প্রতি এটাই আমার বড় অবদান। আমি আশা করি যে আমাকে এর উত্তম বিনিময় প্রদান করা হবে। কার্যত: এটাই ছিল তার অন্যতম বড় খেদমত। কেননা, সাম্রাজ্যবাদীরা খ্রিস্টান হোক আর অখৃষ্টান হোক , তারা মুসলমানদের জেহাদের অনুভূতিকে যতটুকু ভয় করে, অন্য কিছুকে তারা ততটুকু ভয় করে না। সুতরাং সে এর বিনিময় পেল। আর এর চেয়ে বড় বিনিময় কি হতে পারে যে, একজন মুরাক (হিষ্ট্রিয়া) রোগাক্রান্ত ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যার কাছে একদিনের খাবার ছিল না, সে আজ নবুয়তের সিংহাসনে সমাসীন হয়ে বসেছে এবং তার চতুর পার্শ্বে নজর ও নেওয়াজের ধারা বয়ে চলেছে। লোকেরা তার কাছে দৌড়ে ছুটছে এবং এবং তখনকার বিশ্বের সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্র তাকে সহায়তা করছে। এর ফলশ্রুতিতে তার পাগলামি আরো বৃদ্ধি পায় এবং তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ইনশাআল্লাহ, আমি উহা বিশেষ প্রবন্ধে উল্লেখ করব। এ আলোচনার সঙ্গে গোলাম আহমদের ছেলে, তার দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক ব্যক্ত স্বীকারোক্তি ‘‘কাদিয়ানী ধর্ম সাম্রাজ্যবাদীদের ফসল ছাড়া আর কিছু নয়’’। যোগ করছি সে বলছে আমাদের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের অনেক অবদান রয়েছে। আমরা পূর্ণ শান্তি ও আরামের সহিত আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করছি এবং বিভিন্ন দেশে প্রচারের উদ্দেশ্যে আমরা যেতে পারছি। ব্রিটিশ সরকার এখানেও আমাদের সাহায্য করছে। এটা হল আমাদের উপর তাদের পূর্ণ করুণা ও দয়া। (মাহমুদ আহমদ রচিত ‘‘বারাকাতুল খেলাফত’’ নামক গ্রন্থ ৬৫ পৃষ্ঠা) এ কারণেই গোলাম আহমদ সর্বদা তার ভক্তগণকে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা অর্জনে সচেষ্ট হওয়ার জন্য উৎসাহিত করত। শুধু তাই নহে বরং এর জন্য আত্মোৎসর্গ করতে এবং এর আহবায়ক হতে, আর মানুষের মনে এ কথা বদ্ধ মূল করতে অনুপ্রেরণা দিত যে, পৃথিবীতে এ সরকারের চেয়ে অধিক ন্যায় পরায়ণ ও উত্তম আর কেহ নেই। যার ফলে, এ আহবানের দরুন মানুষের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করবে। কেননা যখন এ কথাটি বার বার শ্রুত হতে থাকে তখন এ করুণাময় সরকারের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান সুদৃঢ় হওয়া স্বাভাবিক। আর উহা শুধু ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং আমাদের কেহ অন্য দেশে গেলে সেখানেও এ কর্মধারা চালিয়ে যাবে। কারণ, আমাদের স্বার্থ ও লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। ( আর তাদের এই অভিন্ন লক্ষ্য হলো ইসলামের প্রকৃতিকে ধ্বংস করা এবং সঠিক ধর্মকে মুছে ফেলা) যখন এ সরকারের ন্যায়পরায়ণতার কথা অন্যান্য দেশবাসীরা জানতে পারবে তখন তারা আগ্রহ করবে যেন এ বরকতময় সরকারের পা তাদের দেশেও পৌঁছে যায়।
বস্ত্তত তাদের উদ্দেশ্যাবলী ছিল অভিন্ন। যেমন এক কাদিয়ানী ধর্মপ্রচারক ১৯২৩ সনে রাশিয়া হতে প্রত্যাবর্তন করে সংবাদ দিয়ে বলল যে, আমি ব্রিটিশের গুপ্তচর হওয়ার অপবাদে কয়েকবার ধৃত হয়েছি’ সে গর্ব করে আরো বলে যে, আমি রাশিয়াতে শুধু কাদিয়ানী ধর্ম প্রচারের জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু কাদিয়ানীদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্যের সাথে জড়িত, তাই আমি ব্রিটিশ সরকারের সেবা করতে এবং আমার উপর তার অর্পিত কর্তব্য সম্পাদন করতে বাধ্য ছিলাম। (কাদিয়ানীদের মুবাল্লিগ মুহাম্মদ আমিনের লিখিত এবং আল ফজলুল কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রচারিত ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ খৃ:) এভাবেই তাদের কার্যক্রম চলতে থাকল। এ অপবিত্র দলটি লাঞ্ছনা ও অপদস্ততার সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে। এমন হল যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একের পর এক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে পতনের কারণে তারা আনন্দ উল্লাস করতে থাকে এবং বড় বড় সাধারণ সভা অনুষ্ঠান শুরু করে আর মুসলিম নিধনের জন্য যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বড় অঙ্কের টাকা প্রেরণ করতে থাকে। যখন গোলামের পুত্র ও তার খলিফা এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত একটি সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলে, মুসলিম ওলামারা আমাদেরকে ইংরেজ সরকারের সহযোগিতার অপবাদ দেয়, আর উহার বিজয় সমূহে আমাদের আনন্দ উল্লাসের কারণে আমাদেরকে দোষারোপ করে। আমরা প্রশ্ন করি, কেন আমরা উহাতে সন্তুষ্ট ও আনন্দিত হব না? অথচ আমাদের ইমাম এ কথা বলেছেন, ‘আমি মেহদী এবং ব্রিটিশ সরকার আমার তরবারি’। সুতরাং আমরা এর বিজয়ে আনন্দিত হবই এবং আমরা দেখতে চাই যে, এ তরবারির আলো যেন ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে উদ্ভাসিত হচ্ছে। সে আরো বলে, আল্লাহ তায়ালা এ সরকারের সাহায্য করার জন্য ফেরেস্তা প্রেরণ করেছেন।(আল-ফজল পত্রিকা ৭ই ডিসেম্বর ১৯১৮ ইং) তদুপরি তার বক্তব্য হল যে, শত শত কাদিয়ানী ইরাক বিজয়ের জন্য ইংরেজ বাহিনীতে যোগদান করেছে এবং এ জন্য তাদের (অপবিত্র) রক্ত ঝরিয়েছে। (আল-ফজল পত্রিকা ৩১ শে আগস্ট ১৯২৩ খৃ:) অনুরূপ ভাবে সে আনন্দ প্রকাশ করে যখন সাম্রাজ্যবাদী বাহিনী আল-কুদসে প্রবেশ করে। সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনে সে একটি প্রবন্ধও লিখেছে। তার এ কাজের ও উসমানী সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রীর সেক্রেটারি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আল-ফজল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিজয়ের জন্য আমরা আল্লাহর হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। এটা একটা আনন্দ উল্লাসের কারণ। কেননা আমাদের নেতা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার অনুসারীদেরকে এর জন্য দোয়া করতে উপদেশ দিতেন। ইতিপূর্বে কাদিয়ানী ধর্মের যে দাওয়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার পথ আবার খুলে দেয়া হল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার ফলেই আমাদের এ সকল সুযোগ-সুবিধা লাভ হয় । (আল-ফজল ২৩ নভেম্বর ১৯১৮ খৃ:) এমনি ভাবে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি সফল করার জন্য এ দলটিকে লালন-পালন করে। যেহেতু, এরা ইংরেজদের এজেন্ট, তাই জার্মান সরকার তার মন্ত্রী-বর্গকে এদের মাহফিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে নিষেধ করে। আল-ফজল ১লা নভেম্বর ১৯৩৪ খৃ: আরো উল্লেখ্য যে , আফগান ও ইংরেজদের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে যখন এ দলের দু’ব্যক্তি আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল, তখন আফগান সরকার এদেরকে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে হত্যা করে। আফগান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, এদের কাছে এমন প্রমাণ ও চিঠিপত্র পাওয়া গেছে যদ্বারা এটাই সাব্যস্ত হয় যে, এরা আমাদের শত্রুর এজেন্ট। কিন্তু এর বিপরীত কাদিয়ানী খলীফা এ দু’জনের অপরাধ নিয়ে গর্ব করে বলে যে, যদি আমাদের লোকেরা আফগানিস্থানে চুপ থাকত আর জিহাদ সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসকে প্রকাশ না করত তবে তাদের উপর কোন বিপদ আসত না। কিন্তু তারা ব্রিটিশ সরকারের ভালোবাসাকে গোপন করতে পারেনি, যা আমাদের কাছ থেকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই তারা মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। (ইবনে গোলামের জুমার খোতবা যা আল-ফজল পত্রিকায় প্রকাশিত ১৬ ই আগস্ট ১৯৩৫ খৃ:) এটা কারো কাছে অস্পষ্ট নয় যে, সাম্রাজ্যবাদীরা সর্বদাই গুপ্তচর বৃত্তির জন্য ধর্ম এবং ধর্মপ্রচারের সুযোগ গ্রহণ করে। যেমন ড: উমর ফররুখ তার পুস্তক ‘‘আত-তাবসীর অল-ইস্তিমার’’ এর মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন এবং আমরাও তা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এখন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শক্তি সুদৃঢ় করার জন্য এবং তাদের সার্থ রক্ষার তাগিদে আফ্রিকায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে সন্দেহের সৃষ্টি এবং ইসলামকে কুলষিত করতে ও গুপ্তচর বৃত্তি চালাতে শুরু করেছে। এরা ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং ওদের সাহায্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলামের নাম ব্যবহার করছে। পরিশেষে, কাদিয়ানীদের মুখপাত্র আল-ফজল পত্রিকায় যা প্রচারিত হয়েছে, তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘‘ব্রিটিশ সরকার আমাদের জন্য ঢাল স্বরূপ।যার ছত্রছায়ায় আমরা কেবল সম্মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যদি এ ঢাল সরিয়ে নেয়া হয়, তা হলে আমরা শত্রুর আক্রমণে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। সুতরাং এজন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছি যে, ব্রিটিশের উন্নতি অর্থ আমাদের উন্নতি এবং ওদের ধ্বংস অর্থ আমাদের ধ্বংস। (আল-ফজল ১৯শে অক্টোবর ১৯১৫ খৃ:) এটাই হল এ ধর্মান্তরিত দলের বাস্তব রূপ। যারা সাম্রজ্যবাদের কাছে তাদের আকিদা বিশ্বাসকে বিক্রি করে দিয়েছে। সর্বশক্তি দিয়ে তাদের খেদমত করেছে, আজও করে যাচ্ছে। ‘‘মহান আল্লাহর তওফীক ছাড়া গুনাহ থেকে বিরত থাকা এবং সৎকাজ সম্পাদন করার শক্তি-সামর্থ্য আমাদের কারো নেই’’
অনেক লোক মনে করে যে, কাদিয়ানীরা মুসলমানদের বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি দল। তবে, তারা কতগুলো শাখা প্রশাখায় ভিন্ন মত পোষণ করে। এ ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন তফাত নেই। আমরা এ প্রবন্ধে মুসলমানগণ ও তাদের ধর্মের মোকাবিলায় কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করব। যাতে, এটা যে, কত বড় বিভ্রান্তি তা পাঠক সহজে অনুধাবন করতে পারেন। আর এটাও বুঝতে পারেন যে, ইসলাম ধর্মের সাথে উহার বিন্দু মাত্র সম্পর্ক নেই। অথচ তারা জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করছে এবং ইসলাম নামের পিছনে আত্মগোপন করে আছেন। প্রকৃতপক্ষে, তারা ইহুদ নাছারার ন্যায় ইসলাম থেকে বহু দুরে অবস্থান করছে। এ আবরণের দ্বারা নিজ স্বার্থরক্ষা ও সুযোগ লাভ করাই তাদের উদ্দেশ্য। অন্যথায় তাদের কিতাব সমূহে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, কোন মুসলিম মারা গেলে জানাজার নামাজ পড়া যাবে না, এবং তাদের গোরস্থানেও কবর দেয়া যাবে না। কোন মুসলমানের সাথে বিবাহ শাদি চলবে না এবং কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও যোগদান করা যাবে না। বরং তাদের মতে সে কাফের। মিথ্যা নবীর দ্বাবীদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বলেছে, ‘যে ব্যক্তি আমাকে বিশ্বাস করে না সে আল্লাহ ও রাসূলকে বিশ্বাস করে না’। (গোলাম আহমদের হাকিকাতুল অহী পৃষ্ঠা ১৬৩) তার ছেলে ও দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ লিখেছে: ‘‘এক ব্যক্তি লক্ষ্মী শহরে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করল যে, জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেছে যে যারা কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করে নাই তাদেরকে আপনারা কাফের বলেন, একথা কি সত্য? আমি তাকে বললাম, হাঁ, সত্য। এতে কোন সন্দেহ নেই, আমরা তোমাদেরকে কাফের বলি। লোকটি আমার কথাকে অদ্ভুত মনে করল এবং আশ্চর্যান্বিত হল। (আনওরে খিলাফত ৯২ পৃ:) সে আরো বলে: আমাদেরই প্রশ্ন অকাদিয়ানীদেরে আমরা কাফের বলব না কেন? অথচ তা কুরআন দ্বারা স্পষ্ট। কেননা আল্লাহ পাক পরিষ্কার ভাবে বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন রাসূলকে অস্বীকার করবে সে কাফের, আর যে ব্যক্তি কুরআন কে অস্বীকার করবে সে কাফের। এমতাবস্থায় যে ব্যক্তি গোলাম আহমদকে নবী ও রাসূল বলতে অস্বীকার করবে সে কুরআনের ভাষায় কাফের। এজন্যই আমরা মুসলমানগণকে কাফের বলি। কেননা তারা রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করছে। কারো উপর ইমান রাখে, আবার কাউকে অস্বীকার করে। ফলে, এ প্রেক্ষিতে তারা কাফের।(আল-ফজল কাদিয়ানী পত্রিকা যা ২৬ মে জুন ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত) তার দ্বিতীয় পুত্র বশীর আহমদ স্পষ্ট ভাষায় নির্লজ্জ ভাবে লিখেছে: যে ব্যক্তি মুসা আলাইহিস সালাম প্রতি ইমান আনে এবং ঈসার আলাইহিস সালাম প্রতি ইমান আনে না অথবা ঈসার প্রতি ইমান আনে কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ইমান আনে না সে কাফের। অনুরূপ ভাবে যে ব্যক্তি গোলাম আহমদের উপর ইমান আনে না সেও কাফির এবং ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত। এ কথা আমরা নিজ থেকে বলছি না, বরং আল্লাহর কিতাব থেকে বলছি ‘‘তারাই হল সত্যিকারের কাফের।’’ (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের কালিমাতুল ফাছল’ নামক গ্রন্থ)
জনৈক কাদিয়ানী আলেম তার ‘‘আন-নবুয়্যত ফিল ইলহাম’ গ্রন্থে লিখেছে: আল্লাহ তায়ালা গোলাম আহমদকে বললেন ‘‘যে ব্যক্তি আমাকে ভাল-বাসে ও আমার আনুগত্য স্বীকার করে তার কর্তব্য হল তোমার অনুসরণ করা এবং তোমার উপর ইমান আনা। অন্যথায়, সে আমার বন্ধু নয় বরং সে আমার শত্রু। আর তোমার অস্বীকারকারীরা যদি তা গ্রহণ না করে বরং তোমাকে অবিশ্বাস করে ও কষ্ট দেয়, তবে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিব এবং এ সকল কাফেরদের জন্য কারাগার হিসাবে জাহান্নামকে তৈরি করে রেখেছি।’’ অতএব আল্লাহ তায়ালা এ ইলহামে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি গোলাম আহমদকে অমান্য করবে, সে কাফির এবং তার শাস্তি জাহান্নাম। (মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানীর ‘আন-নবুয়্যত ফিল ইলহাম’ নামক পুস্তক ৪০ পৃষ্ঠা)
কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীনের উদ্ধৃতি দিয়ে গোলাম পুত্র বলেছে যে, অকাদিয়ানী মুসলমানরা আল্লাহ তায়ালার ঐ বাণীর অন্তর্ভুক্ত ‘‘এরাই হল সত্যিকারের কাফের’’। এই প্রসঙ্গে সে আরো বলেছে ‘একথা কেমন করে সম্ভব যে, মুসার আলাইহিস সালাম অস্বীকারকারী কাফের ও অভিশপ্ত হবে এবং ঈসার আলাইহিস সালাম অস্বীকারকারীরা কাফের হবে, আর গোলাম আহমদের অস্বীকারকরীরা কাফের হবে না, মুমেনদের আকিদা হল এই- ‘‘আমরা রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করি না’’ অথচ এরা রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করছে।
সুতরাং গোলাম আহমদকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি কাফের হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং সে আল্লাহর ঐ বাণীর অন্তর্ভুক্ত- ‘‘এরাই প্রকৃত কাফের’’ (বশীর আহমদ কর্তৃক লিখিত কালিমাতুল ফাছল ১২০ ও ১৪৭ পৃষ্ঠা এবং ‘‘রিভিউ অব রিলি-জিওন্স’’ মাসিক পত্রিকায় সন্নিবেশিত।
এই হল তাদের মতবাদ এবং তাদের ভাষায় এটাই তাদের ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের স্বরূপ। কিন্তু তারা মুসলমানদের সারির পেছনে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য লুকিয়ে আছে। কখনও তারা সাধারণ মুসলমানগণকে প্রতারণা করে, বিশেষ করে পাক ভারত ব্যতীত অন্যান্য দেশে মুসলমানদের সাথে এবং তাদের ইমামের পিছনে প্রতারণা মূলক নামাজ পড়ে। কেননা আমরা পূর্বেই বলেছি যে, তারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুয়্যত অস্বীকারকারীকে কাফের বলে। সুতরাং কেমন করে তারা কাফেরদের পেছনে এবং তাদের সারিতে নামাজ পড়ার অনুমতি দিতে পারে? যদি তারা নামাজ পড়ে থাকে তবে উহা কপটতার নামাজ। অতঃপর তারা এ নামাজগুলোকে নিজ গৃহে পুনরায় পড়ে নেয়। অকাদিয়ানীদের পিছনে নামাজ পড়া সম্পর্কে এদের মতামত বর্ণনার পর আমরা তাদের এ দুরভিসন্ধি বিস্তারিত উল্লেখ করব। নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী বলে- ‘এটাই আমার সুপরিচিত ধম মত যে, অকাদিয়ানী ব্যক্তি যেখানেই হোক , যে কেউই হোক , লোকেরা তার যতই প্রশংসা করুক, তার পিছনে তোমাদের নামাজ পড়া জায়েজ নহে। এটা আল্লাহর নির্দেশ ও আল্লাহর ইচ্ছা। আর, এতে যে সন্দেহ পোষণ করে বা ইতস্তত: করে সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। তোমাদের এবং ওদের মধ্যে আল্লাহ পার্থক্য করে দিতে চান। (গোলামের মালফুজাত যা আল-হিকম নামক কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রচারিত প্রবন্ধ, ১০ ডিসেম্বর ১৯০৪ খৃ:)
গোলাম আহমদ তার ‘‘আরবাঈন’’ নামক পুস্তিকার ৩৪ও ৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছে- আল্লাহ আমাকে অবগত করেছেন যে, যে ব্যক্তি আমাকে অবিশ্বাস করে এবং আমার আনুগত্য স্বীকার করতে ইতস্তত: করে, তার পিছনে তোমাদের নামাজ পড়া অকাট্য হারাম। বরং তোমাদের কোন এক ইমামের পেছনে নামাজ পড়া তোমাদের কর্তব্য। হাদীসে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, ‘‘তোমাদের ইমাম তোমাদের মধ্য থেকেই হবে’’। অর্থাৎ যখন মাসীহ অবতরণ করবেন তখন তোমাদের কর্তব্য হবে ইসলামের দাবিদার সকল দলকে বর্জন করা। তোমাদের মধ্য হতে ইমাম নিযুক্ত করে নিবে। তোমাদের যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে তদনুযায়ী কাজ কর। তোমরা কি চাও যে, তোমাদের অজান্তে তোমাদের আমল সমূহ নষ্ট হয়ে যাক? এটাই গোলামের উক্তি। আর, তার ছেলের উক্তি হল এই- অকাদিয়ানী কোন ব্যক্তির পেছনে কারো নামাজ পড়া বৈধ নহে। লোকেরা বারংবার এ প্রশ্ন করছে যে অকাদিয়ানীদের পেছনে নামাজ বৈধ কি না? আমি বলি যখনই তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন করবে তখনই আমি বলব, জায়েজ নহে, জায়েজ নহে, জায়েজ নহে, (আনওরে খেলাফত, ৮৯ পৃ:)
তারা এ ব্যাপারে এতই কঠোর যে, তাদের দলের করো জন্য কোন ইমামের পেছনে নামাজ পড়া বৈধ নহে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিশ্চিত না হবে যে এ ইমাম কাদিয়ানী। মনজুর কাদিয়ানীর ‘‘মালফুজাতে আহমদিয়া’’ নামক গ্রন্থের ৪থ খন্ডে ১৪৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি গোলাম আহমদকে জিজ্ঞেস করল- কোন ব্যক্তির পক্ষে ঐ ইমামের পেছনে নামাজ পড়া বৈধ আছে কি না যার ধর্ম সম্পর্কে সে অবহিত নহে। উত্তরে সে বলল: না, তার ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে অবহিত না হয়ে তার পেছনে নামাজ পড়া বৈধ হবে না। যদি সে আমাকে বিশ্বাস করে, তবে বৈধ হবে, অবিশ্বাস করলে বৈধ হবে না। আর যদি বিশ্বাস অবিশ্বাস কিছুই না করে তবুও বৈধ হবে না, কেননা, সে মুনাফেক। আর কোন কোন সময় তারা মুসলমানদের মসজিদে এবং মুসলিম ইমামের পেছনে নামাজ পড়ে থাকে উহার হাকীকত আমি কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলীফা গোলামের পুত্র মাহমুদ আহমদের বাচনিক বর্ণনা করছি। সে তার হজের সফরের উল্লেখ করে বলে- ‘আমি ১৯১২ সালে মিসর গেলাম। আর, সেখান থেকে হজে গেলাম। জিদ্দায় আমার মাতামহ আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। এরপর সরাসরি আমরা মক্কায় চলে গেলাম। প্রথম দিন আমরা যখন তওয়াফে রত ছিলাম, তখন নামাজের সময় হয়ে গেল। আমি ফিরে যাবার ইচ্ছা করলাম, কিন্তু ভিড়ের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল এবং নামাজ শুরু হয়ে গেল। এমনি অবস্থায় আমার নানা আমাকে নামাজ পড়তে আদেশ করলেন। তাতে আমরা নামাজ পড়ে নিলাম। অতঃপর যখন আমরা ঘরে পড়তে প্রস্ত্ততি নিলাম যা অকাদিয়ানীদের পিছনে আদায় ও গ্রহণযোগ্য নহে। আমরা দাঁড়িয়ে সে নামাজ পড়ে নিলাম। আমরা এরূপই করতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ঘরেই নামাজ পড়তাম এবং কখনও জামাতের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করতাম। তারপর দাঁড়িয়ে আমাদের জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতাম। কোন কোন সময় আমাদের সাথে অকাদিয়ানীরা শরীক হয়ে যেত। (কেননা তারা জানত না যে, এরা বিদ্রোহী ও ধর্মান্তরিত দল)
অতঃপর বলে- যখন আমরা হজের সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করলাম, তখন কোন একজন আমাদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীনকে জিজ্ঞেস করল একজন কাদিয়ানী অকাদিয়ানীর পেছনে নামাজের ব্যাপারে কি করবে? উত্তরে খলীফা বললেন, যদি অকাদিয়ানীর পেছনে নামাজ পড়া সংগত মনে করে তবে তার পেছনে নামাজ পড়ে নিবে। তবে পুনরায় উহা পড়ে নিবে। (মাহমুদ আহমদ লিখিত আয়নায়ে ছাদাকাত, ৯১পৃঃ) এটাই হল তাদের নামাজের স্বরূপ, যা কখনও কখনও তারা সাধারণ মুসলমানদের সাথে প্রতারণার উদ্দেশ্যে পড়ে থাকে। শুধু এ পর্যন্তই নহে, বরং কাদিয়ানীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা যেন সাধারণ ভাবে মুসলমানদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারা যেন মুসলমানদের অনুষ্ঠানে এবং তাদের সুখে দুঃখে অংশগ্রহণ না করে। কেননা, কাদিয়ানীরা পবিত্র আর মুসলমানরা অপবিত্র। কাজেই অপবিত্রের সাথে পবিত্র এবং কাফেরের সাথে মোমিনের মিলিত হওয়া সমীচীন নহে। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে: এ সম্পর্ক যে আমরা ছিন্ন করেছি তা আমাদের পক্ষ থেকে করিনি বরং আল্লাহর নির্দেশে করেছি। (স্বভাবতই তিনি হবেন কাদিয়ানীদের আল্লাহ, জগৎবাসীর আল্লাহ নহেন) সে আরো বলে- আমার নবুয়তের অস্বীকার করা অবস্থায় এদের সাথে সম্পর্ক রাখার উদাহরণ হল এই যে, খাঁটি দুধকে দুর্গন্ধময় বিকৃত দুধের সাথে মিশিয়ে রাখা। (আমি জানি না, সে খাঁটি দুধ বলে কাদেরে উদ্দেশ্য করেছে) এ কারণেই আমরা এ সব সম্পর্কের প্রয়োজন বোধ করি না। (গোলামের উক্তি যা ‘‘তাশহীদুল আজহান’’ নামক গ্রন্থে ৮ম খন্ড ৪থ নম্বর ৩১১ পৃ: উল্লেখিত।) সে আরো বলেছে: তোমরা বিবাহ শাদী ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে মুসলমানদের সাথে অংশগ্রহণ করবে না এবং তাদের জানাজার নামাজও পড়বে না। কেননা, তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। যখন এদের সাথে আমাদের সকল সম্পর্ক ও নামাজ বিচ্ছিন্ন এবং এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের কাছে কোনই গুরুত্ব রাখে না। তখন এদের মৃতের উপর আমাদের নামাজ আদায় করার অবকাশ আর কোথায় থাকে? (ইমামের বাণী যা আল ফজল পত্রিকায় ১৮ই জুন ১৯১৬ সালে প্রকাশিত) এ জন্যেই, যখন আমাদের কোন একজন দ্বিতীয় খলীফাকে জিজ্ঞেস করল- মুসলমান শিশুর উপর জানাজার নামাজ পড়া কি বৈধ? কেননা সে নিষ্পাপ এবং ভবিষ্যতে বেঁচে থাকলে সে কাদিয়ানী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তরে দ্বিতীয় খলীফা বললেন তার জানাজার নামাজ পড়া যবে না। যেমন খ্রিস্টান শিশুদের নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও জানাজার নামাজ পড়া যায় না। (মাহমুদ আহমদের ডায়রী যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে ২৩ অক্টোবর ১৯২২ খৃ: প্রচারিত হয়েছে) তার আনওয়ারুল খেলাফত নামক পুস্তিকার ৯৩ পৃ: সে লিখেছে- ‘একটি প্রশ্ন রয়ে গেল যে মুসলমানদের শিশুদের উপর জানাজার নামাজ পড়া কি জায়েজ? আমি বলব, জায়েজ নহে, যেমন হিন্দু ও খ্রিস্টান শিশুদের উপর জানাজার নামাজ জায়েজ নহে। কেননা, শিশুর ধর্ম তার মাতা-পিতারই ধর্ম, সে তার মাতা-পিতার অনুগামী’। এইতো ছিল মুসলিম শিশুদের ব্যাপার। আর, স্বয়ং বয়স্ক মুসলমানদের উপর জানাযার নামাজের হুকুম কি হতে পারে? নিশ্চয়ই তাদের মতে এটা বৈধ হবে না। কেননা, কাফেরগণ মুসলমানদের জানাজার নামাজ পড়ে না। তাই, অন্যদের তুলনায় এরা চরম কাফের হওয়া সত্ত্বে কেমন করে পড়তে পারে? প্রকাশ থাকে যে, গোলাম আহমদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীন বলেছে: মুসলমানদের উপর জানাজার নামাজ পড়া বৈধ নহে। তবে, মাসীহ (গোলাম আহমদ) মুসলমানদের উপর যে জানাজার নামাজ পড়তেন, উহা দাওয়াতের প্রাথমিক যুগে ছিল। যেমন নবী করীম ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেরদের উপর জানাজার নামাজ পড়তেন। (আল ফজল ২৯শে এপ্রিল ১৯১৬ খৃ:) এমনকি, নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী তার নিজ পুত্রের জানাজার নামাজ পড়েনি, শুধু এ কারণেই যে, সে তার উপর ঈমান আনে নি এবং মুসলমান অবস্থায় মারা গিয়েছে। সে তার অপরাপর ভাইয়ের ন্যায় ধর্মান্তরিত হয়নি। (আনওয়ারুল খেলাফত ৯১ পৃ:) এ ব্যাপারে তারা আরও কঠোরতা অবলম্বন করে এত নিম্নে পৌঁছে গেছে যে, যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানীর নাম শুনেনি এবং তার ভ্রান্ত দাওয়াতের কথা শুনেনি তারও জানাজার নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে। যেমন, কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ৬মে ১৯১৫ খৃ: সংখ্যায় প্রকাশ করেছে যে, ‘যদি ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয় যে, এমন স্থানে মারা গিয়েছে যেখানে কাদিয়ানী দাওয়াত পৌঁছেনি, তার ব্যাপারে কি করতে হবে? অতঃপর সেখানে কোন এক কাদিয়ানী পৌঁছোল, সে কি তার জানাজার নামাজ পড়বে? উত্তরে আমরা বলি, জাহের ব্যতীত আমরা কিছু জানি না। আর , তার ব্যাপারে জাহের হল এই যে, সে এমন অবস্থায় মারা গিয়েছে যে সে আল্লাহর রাসূল ও নবীকে চিনে নি। কাজেই আমরা তার জানাজার নামাজ পড়ব না। এমন কি যে ব্যক্তি কাদিয়ানী হয়ে ও মুসলমানদের পিছনে নামাজ পড়ে এবং তাদের সাথে কাজ কারবার করে তার জানাজার নামাজও পড়া যাবে না । কেননা, এ ব্যক্তিও তার কার্যকলাপের দ্বারা কাদিয়ানী ধর্মের বহির্ভূত হয়ে গেছে। (গোলামের পুত্র ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদের পত্র যা ১৯৩৬ সালে ১৩ এপ্রিল আল ফজল পত্রিকায় প্রকাশিত।) তদুপরি মুসলমানদের জন্য রহমতের দোয়া করা যাবে না। যেমন দুজন কাদিয়ানী মুফতীকে যখন জিজ্ঞেস করা হল: কোন অকাদিয়ানী মারা গেলে কাদিয়ানী ব্যক্তি ‘রাহিমাহুল্লাহ’ ও ‘আদখালাহুল জান্নাহ’ বলতে পারে কি? উত্তরে তারা বলল না। কেননা, তাদের কুফুরী প্রকাশ্য। তাই, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। (ফতওয়া রওশন আলী ও মুহাম্মদ সরওর, আল ফজল পত্রিকা ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ খৃ:) এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও তাদের বেহেস্তে প্রবেশ করা কাদিয়ানীদের দোয়ার উপর নির্ভর করে। যদি তারা মুসলমানদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করে তবে মুসলমানদের জন্য বেহেস্তের দরজা খোলা হবে না । জানি না এত কিছুর পরও কেন তারা ইসলামের দাবির উপর অটল থাকছে এবং মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করছে। বরং বীরত্বের দাবি হল এই যে, তারা যেন এ কথা ঘোষণা করে দেয় যে, তারা মুসলমান নহে, মুসলমানদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এবং ইসলাম ধর্মের আড়ালে যেন তারা আত্মগোপন না করে। বরং তাদের স্বতন্ত্র দ্বীন ও নতুন ধর্মের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দেয়। যেমন তাদের ভাতৃবৃন্দ বাহায়ী সম্প্রদায় করেছে। যারা বর্তমান সকল ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটাই তাদের জন্য ঠিক ও শ্রেয়: হত। কিন্তু ‘‘কাদিয়ানীরা হল সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট’’ নামক প্রবন্ধে যেমন আমরা উল্লেখ করেছি এদের উদ্দেশ্য হল ইসলামের প্রকৃত রূপ পরিবর্তন এবং মুসলমানদের মধ্যে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করা, টাকা, পয়সা উপার্জন, সাম্রাজ্যবাদীদের সেবা, ইসলামের ছদ্মাবরণে আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে বাতিল দাওয়াতের প্রসার এবং সাধারণ মুসলমানদিগকে প্রতারিত করা। অন্যথায়, তাদের আকীদা হল এই যে, তারা মুসলমানদের পিছনে নামাজ পড়া এবং মুসলমানদের উপর জানাজা পড়াকে জায়েজ মনে করে না। সম্ভবত: ইহা পাঠকদের কাছে নতুন কোন ব্যাপার নহে। কারণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ভারত উপমহাদেশে মুসলিম মিল্লাতের হিতৈষী কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন) যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাফর উল্লাহ খান কাদিয়ানী তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেনি। ইহার কারণ সুস্পষ্ট যে, কায়েদে আজম তার মতে কাফের ছিলেন। যেহেতু তিনি মুহহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসারী ছিলেন এবং তার উম্মতগণকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। অথচ সেই জাফরুল্লাহ ছিল মুরতাদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট ও তার ইমাম গোলাম কাদিয়ানী বলেছে: আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর ইলহাম করেছেন যে, যে ব্যক্তি তোমার অনুসরণ করবে না আর তোমার বিরোধিতা করবে সে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধী এবং দোজখে প্রবেশকারী। (মে‘ইয়ারুল আখইয়ার ৮ম পৃ:) আর তার ইমামের পুত্র ও প্রতিনিধি বলেছে, যে ব্যক্তি গোলাম আহমদ কে বিশ্বাস করবে না সে কাফের, যদিও তার কাছে কাদিয়ানীদের দাওয়াত না পৌঁছে থাকে। এজন্যই তারা মুসলমানদের সাথে বিবাহ-শাদি বৈধ মনে করে না’। মাহমুদ আহমদ তার কিতাব ‘বরকতে খেলাফত’ এর ৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তার ভাষণে ঘোষণা দিয়েছে যে, কোন কাদিয়ানীর পক্ষে তার মেয়েকে অকাদিয়ানীর কাছে বিবাহ দেয়া বৈধ নহে। কারণ এটা প্রতিশ্রুত মাসীহের (গোলাম আহমদ) কঠোর নির্দেশ। সে আরো উল্লেখ করেছে: যে ব্যক্তি তার মেয়েকে অকাদিয়ানীর কাছে বিবাহ দেবে সে আমাদের জামাতের অন্তর্ভুক্ত নহে, যতই সে কাদিয়ানী ধর্মের দাবিদার হোক। এমনকি, আমাদের অনুসারীর জন্য উচিত নহে এ ধরনের কোন বিবাহ-শাদীর অনুষ্ঠানে যোগদান করা’ (আল-ফজল ২৩শে মে ১৯৩১খৃঃ)।
অধিকন্তু, কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল হিকমে’ প্রকাশিত হয়েছে যে, মুসলমানদের সাথে বিবাহ-শাদীর বেলায় একথা লক্ষ রাখতে হবে যে, তাদের কাছে কোন মেয়ে বিবাহ দেয়া যাবে না। তবে তাদের মেয়ে বিবাহ করা যেতে পারে। কেননা, তারা আহলে কিতাবের অনুরূপ। সুতরাং আমরা আমাদের মেয়ে দেব না বরং তাদের মেয়ে আমরা গ্রহণ করব। যেরূপ ব্যবহার আহলে কিতাবের সাথে করা হয়। আমাদের ইমাম বর্ণনা দিয়েছেন যে, অকাদিয়ানী মুসলমানরা হল আহলে কিতাব। আমাদের মেয়ে তাদেরকে দান করা বৈধ নহে কিন্তু আমাদের পক্ষে তাদের মেয়ে গ্রহণ করা বৈধ হবে। এতে আমাদের লাভও রয়েছে যে, আমাদের জামাতে একজন লোক বৃদ্ধি পেল। (আল-হিকম ১৪ই এপ্রিল ১৯২০খৃঃ) মাহমুদ আহমদ বলে, ‘মুসলমান, হিন্দু ও শিখ মেয়ে গ্রহণ করা জায়েজ, কিন্তু তাদেরকে মেয়ে দান করা বৈধ নহে’। (আল-ফজল ১৮ফেব্রূয়ারী ১৯৩০খৃঃ) সে আরো বলেছে: কোন কাদিয়ানী তার মেয়েকে অকাদিয়ানীর কাছে বিবাহ দেবে না। যদি দেয় তার উদাহরণ হল, যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে ‘‘কোন জেনাকারী যখন সে জেনা করে তখন সে মুমিন থাকে না’’। (আল-ফজল ২৬ জুলাই ১৯২২খৃঃ) সে আরো বলেছে, যে ব্যক্তি মুসলমানদের কাছে মেয়ে বিবাহ দেবে, তাকে জামাত থেকে বহিষ্কার করা হবে, এবং তাকে কাফের ঘোষণা দেয়া হবে’। ( আল ফজল ৪ই মে ১৯২২খৃঃ) ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে ১৯৩৪ খৃ: আল ফজল পত্রিকায় পাঁচজন লোককে জামাত থেকে এ অপরাধের কারণে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাদের অপরাধ ছিল তারা মুসলমানদের কাছে তাদের মেয়ে বিবাহ দিয়েছিল। ঘোষণার বর্ণনা ছিল এই, ‘‘আল-মাসীহের দ্বিতীয় খলীফা আমিরুল মুমেনীনের নির্দেশ অনুসারে উল্লেখিত নামের লোক দিগকে জামাত থেকে বহিষ্কার করা হল এবং এদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেয়া গেল’’। এমনকি, বশীর আহমদ স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছে- ‘আমাদের নামাজ পৃথক করে দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মেয়ে বিবাহ দেয়া হারাম করা হয়েছে এবং তাদের জানাজায় শরীক হতে নিষেধ করা হয়েছে’। অতঃপর আর কি অবশিষ্ট রইল যে আমরা তাদের সাথে কাজ কারবারে যোগদান করব। সম্পর্ক দু‘ভাগে বিভক্ত: দ্বীনি ও দুনিয়াবী। তবে, দ্বীনি সম্পর্কের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল এবাদত এবং দুনিয়াবী সম্পর্কের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল এ বিবাহ শাদির সম্পর্ক। অতএব তাদের সাথে এবাদত করা এবং বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়া আমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে। যদি প্রশ্ন করেন যে, আপনারা কীভাবে তাদের মেয়ে গ্রহণ করার অনুমতি দেন? উত্তরে বলব যেমন আমরা খ্রিস্টানদের মেয়ে গ্রহণ করার অনুমতি দেই, আর যদি প্রশ্ন করেন- কেন আপনারা তাদেরকে সালাম করেন? উত্তরে বলব- রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদীগণকে সালাম দিতেন। সারকথা হল এই যে, আমাদের ইমাম তাদের এবং আমাদের মধ্যে সবদিক থেকে পার্থক্য করে দিয়েছেন। (বশীর আহমদের কালিমাতুর ফাছল যা রিভিউ অব রিলিজিওনে সন্নিবেশিত)
হে কাপুরুষেরা! তোমরা কেন এ কপটতা অবলম্বন করছ? আর সাধারণ জনমতের সম্মুখে ইসলামের মুখোশ পরে আছ? এবং কেন তোমাদের অসৎ পূর্ববর্তীদের ন্যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তোমাদের হিংসা বিদ্বেষ প্রকাশ করছ না? কেমন করে তোমরা বড় চোরের পরামর্শানুযায়ী পর্দার অন্তরালে থেকে জগৎবাসীকে প্রতারণা করছ? সে বলেছিল ‘‘তোমার স্বর্ণ, তোমার গমনাগমন ও তোমার ধর্মকে গোপন রাখ।’’ এটা তারা করেছিল অপদস্ততা ও লাঞ্ছনার ভয়ে। [৭ বাহায়ী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও নবুওতের ভন্ডদাবীদার বাহাউল্লাহর ইলহামাত।] তোমরা কি এই ধোঁকায় পড়ে আছ যে, জগদ্বাসী তোমাদের গোপন রহস্য, তোমাদের নির্লজ্জতা, তোমাদের বই পুস্তক ও মতামত জানতে পারবে না? আর তোমরা- ওহে আল্লাহ ও ইসলামের শত্রুরা,মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতের শত্রুরা! ভারত উপমহাদেশে তোমাদের বিষয়ের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার কারণে তোমরা বিকল হয়ে পড়েছে। এখন তোমরা তোমাদের প্রচেষ্টাকে আফ্রিকা ও আরব বিশ্বে কেন্দ্রীভূত করেছ। তোমাদের পূর্ববর্তী মনিবের পরিকল্পনা অনুযায়ী গুপ্তচরবৃত্তি ও ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে । অথচ অতীতে তোমাদের খলীফা প্রকাশ করেছে যে, সে মুসলমানদের শত্রু। সে তার দলকে সম্বোধন করে একদা বলছে- আমরা ভারতবর্ষে আদম শুমারী অনুযায়ী পঁচাত্তর হাজার লোক আছি। কিন্তু এত সত্ত্বেও মুসলমানদের তুলনায় আমাদের স্বল্পতা কোন গুরুত্ব রাখে না। কেননা, আমাদের একজন নিষ্ঠাবান মুমিন এক হাজার মুসলমানের উপর বিজয়ী হবে। (হায়রে বীরত্ব) আর, সমস্ত বিশ্বের মুসলমানের সংখ্যা পঁচাত্তর মিলিয়নের বেশি নহে। (হায়রে হিসাব! হায়রে মিথ্যাচার) তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, সমুদয় মুসলমান আমাদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী নহে। তারা আমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না, বরং আমরাই তাদের উপর বিজয়ী হব’। (অর্থাৎ মহান ইংরেজ সরকারের করুণায়।) আল-ফজল পত্রিকা ২১শে জুন ১৯৩৪ খৃ:।
মুসলমানদের প্রতি তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ নিহিত রয়েছে, একথাগুলো উহার একটি চিত্র তুলে ধরছে। ইতিপূর্বে যখন তুর্কি মুসলিম শক্তির সহিত পঞ্চম জর্জের অর্থাৎ কাফের শক্তির সংঘর্ষ বেঁধেছিল, তখন তাদের দ্বিতীয় খলীফা বলেছিল- ‘আমরা পঞ্চম জর্জের সাথে আছি’। কেননা, তিনি বর্তমান খলীফা। (আল- ফজল পত্রিকা ২৬ শে জুলাই ১৯৩০ খৃ:) ব্রিটিশরা যখন প্যালেষ্টাইনে প্রবেশ করে, তখন তাদের প্রশংসায় সে একটি প্রবন্ধও লিখেছিল। বর্তমানে ইসরাইলীরা সমগ্র ইসলাম জগতের প্রধান শত্রু। আর এই ইসরাইলের সাথেই কাদিয়ানীদের হৃদ্যতাপূর্ণ ও সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এটা শুধু এ কারণেই যে, তারা উভয়ই দ‘টি বিষয়ে একমত। একটা হল ইসলামের বিরোধিতা ও এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ এবং অপরটি হল সাম্রাজ্যবাদের দালালি। এ সম্পর্কে এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার দানে তাদেরকে সম্মানিত করেন। আর, এ সকল সাক্ষাৎকারে কি যে ষড়যন্ত্র রয়েছে তা সকলেরই বোধগম্য। ক্ষুদ্র ইসরাইল রাষ্ট্রের নেতা কাকে সম্মান দিতে পারে? ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ কেন ওদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা প্রদান করল? ইসরাইল কি কোন দলকে কেন্দ্র খোলার অনুমতি দিতে পারে, যদি তাদের উদ্দেশ্যাবলী ওদের উদ্দেশাবলীর সহিত যুক্ত না হয়? ইসরাইল বিনা মূল্যে কি আর্থিক সাহায্য করতে পারে? আর এটা কি অসম্ভব কথা যে, ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে গুপ্তচর বৃত্তির মূল্য ওদের থেকে আদায় করে নেয়? প্রথমত: তারা সবচেয়ে বড় যে খেদমত আদায় করছে তা, হল তারা মুহাম্মদ আরবী থেকে আরবদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তাদের বহির্বিশ্বের ভাইদেরকে সম্পৃক্ত করে উহা ছিন্ন করছে এবং জেহাদের চেতনা তাদের অন্তর থেকে বের করে দিচ্ছে। (‘‘আমাদের মতে জেহাদ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ’’ কাদিয়ানী পত্রিকা: রিভিউ অব রিলিজিওন্স ১৯০২ খৃ:)
এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, ইসরাইলের মধ্যে শুধু অধিকৃত প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্রের কেন্দ্র নহে, বরং সমুদয় আরব রাষ্ট্রের কেন্দ্র সেখানে রয়েছে। সেখান থেকে তাদের প্রচারপত্র সকল আরব দেশগুলোতে প্রেরণ করা হয়। যেমন, কাদিয়ানীরা নিজেরাই তা স্বীকার করেছে। সময় সময় সেখানকার কাদিয়ানীদের তৎপরতার সংবাদ ইসরাইল বেতারযন্ত্র থেকে প্রচার করা হয়। কাদিয়ানীরা তাদের ‘‘মারকাযুনা ফিল খারেজ’’ নামক গ্রন্থে যা প্রচার করেছে, তার সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি আমরা বর্ণনা করছি। ‘‘আলমারকাজুল ইসরাইলী’’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাদিয়ানী কেন্দ্র হায়ফার সাউন্ট কারমালে অবস্থিত। ঐ খানে আমরা একটা মসজিদ, কেন্দ্রের জন্য একটা ঘর, সাধারণ পাঠকদের জন্য একটা লাইব্রেরি, বই বিক্রির জন্য একটা লাইব্রেরি ও একটি বিদ্যালয়ের মালিক। কেন্দ্র ‘‘বুশরা’’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে। ত্রিশটি আরব দেশে এ পত্রিকা প্রচার করা হয়। প্রতিশ্রুত মাসীহ (গোলাম) এর অধিকাংশ পুস্তক সমূহ এ কেন্দ্রের সাহায্যে আরবীতে অনুবাদ করা হয়। এই কাদিয়ানী কেন্দ্রটি প্যালেষ্টাইন বিভক্তির কারণে নানাভাবে প্রভাবন্বিত হয়েছে, যেসব মুসলমান ইসরাইলে রয়ে গিয়েছিল তারা এই কেন্দ্র থেকে অত্যধিক উপকৃত হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রটি এদের খেদমতের কোন সুযোগই নষ্ট করে নি। কিছুদিন পূর্বে এই কেন্দ্রের একটি প্রতিনিধি দল হাইফা কর্পোরেশনের মেয়রের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তার সাথে অনেক বিষয়ে মতবিনিময় করে। হাইফার মেয়র আমাদের জন্য ‘কাবাবীর’ নামক স্থানে যেখানে অনেক কাদিয়ানী বসবাস করে একটি বিদ্যালয় স্থাপনে তার প্রস্ত্ততির কথা জানালেন । কাবাবীরে আমাদের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎকারের প্রতিশ্রুতি দিলেন। এরপর কথানুযায়ী তিনি এমন চার ব্যক্তিকে নিয়ে আসলেন, যারা হাইফাতে আমাদের পরিচিত। আমাদের জামাত ও বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল এবং তাদেরকে সংবর্ধনার জন্য একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত করল। ফেরার পূর্বে তারা সাক্ষাৎকার রেজিস্ট্রিতে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। ইসরাইল রাষ্ট্রে আমাদের যে মর্যাদা রয়েছে তা ছোট একটি বিষয় দ্বারা পাঠক বর্গ অনুধাবন করতে পারবেন। আমাদের একজন মুবাল্লেগ চৌধুরী মুহাম্মদ শরীফ ১৯৫৬ সালে ইসরাইল থেকে পাকিস্তান ফেরার ইচ্ছা করলে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রধান তার কাছে দূত পাঠালেন যেন তিনি ইসরাইল রাষ্ট্র ত্যাগ করার পূর্বে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সুতরাং মুবাল্লেগ এ সুযোগকে একটি গনিমত মনে করল এবং জার্মানি ভাষায় অনুদিত একখন্ড কুরআন তাকে উপহার দিল। তিনি উহা অতি আনন্দের সহিত গ্রহণ করলেন। ইসরাইলী পত্রিকাসমূহে এ সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা হয় এবং রেডিও মারফত উহা প্রচার করা হয়। (উল্লেখিত পুস্তক ৭৯ পৃষ্ঠা)
এটাই হল মুসলমানদের সাথে এদের সম্পর্কের ও মুসলমানদের চরম শত্রুদের সাথে এই মুরতাদ সম্প্রদায়ের ভালোবাসার প্রকৃত রূপ। তারা দখলকৃত ভূমি এবং কট্টর ইহুদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র কে মুসলমানদের ধ্বংস ও বিনাশ সাধনের জন্য কেন্দ্র নির্বাচন করে তাদের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কেননা, এইভাবে তারা মুসলমানদের পরম শত্রু ও কঠোর বিদ্বেষী লোকদের কাছ থেকে শক্তির জোগান লাভ করতে পারে।
এখান থেকেই পাঠক ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি এই দলের শত্রুতার মাত্রা দু‘দিক দিয়ে অনুধাবন করতে পারবে। একটি হল ধর্মীয় দিক, যা তাদের পুস্তকের মূল উদ্ধৃতিসহ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরটি রাজনৈতিক দিক, যা উল্লেখিত বক্তব্যের দ্বারা আরো স্পষ্ট প্রমাণিত হল। আল্লাহ পাক বিদ্বেষী দুষ্টদের হাত থেকে তাঁর দ্বীনকে রক্ষা করুন।
জনৈক কাদিয়ানী আলেম তার ‘‘আন-নবুয়্যত ফিল ইলহাম’ গ্রন্থে লিখেছে: আল্লাহ তায়ালা গোলাম আহমদকে বললেন ‘‘যে ব্যক্তি আমাকে ভাল-বাসে ও আমার আনুগত্য স্বীকার করে তার কর্তব্য হল তোমার অনুসরণ করা এবং তোমার উপর ইমান আনা। অন্যথায়, সে আমার বন্ধু নয় বরং সে আমার শত্রু। আর তোমার অস্বীকারকারীরা যদি তা গ্রহণ না করে বরং তোমাকে অবিশ্বাস করে ও কষ্ট দেয়, তবে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিব এবং এ সকল কাফেরদের জন্য কারাগার হিসাবে জাহান্নামকে তৈরি করে রেখেছি।’’ অতএব আল্লাহ তায়ালা এ ইলহামে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি গোলাম আহমদকে অমান্য করবে, সে কাফির এবং তার শাস্তি জাহান্নাম। (মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানীর ‘আন-নবুয়্যত ফিল ইলহাম’ নামক পুস্তক ৪০ পৃষ্ঠা)
কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীনের উদ্ধৃতি দিয়ে গোলাম পুত্র বলেছে যে, অকাদিয়ানী মুসলমানরা আল্লাহ তায়ালার ঐ বাণীর অন্তর্ভুক্ত ‘‘এরাই হল সত্যিকারের কাফের’’। এই প্রসঙ্গে সে আরো বলেছে ‘একথা কেমন করে সম্ভব যে, মুসার আলাইহিস সালাম অস্বীকারকারী কাফের ও অভিশপ্ত হবে এবং ঈসার আলাইহিস সালাম অস্বীকারকারীরা কাফের হবে, আর গোলাম আহমদের অস্বীকারকরীরা কাফের হবে না, মুমেনদের আকিদা হল এই- ‘‘আমরা রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করি না’’ অথচ এরা রাসূলগণের মধ্যে পার্থক্য করছে।
সুতরাং গোলাম আহমদকে অস্বীকারকারী ব্যক্তি কাফের হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং সে আল্লাহর ঐ বাণীর অন্তর্ভুক্ত- ‘‘এরাই প্রকৃত কাফের’’ (বশীর আহমদ কর্তৃক লিখিত কালিমাতুল ফাছল ১২০ ও ১৪৭ পৃষ্ঠা এবং ‘‘রিভিউ অব রিলি-জিওন্স’’ মাসিক পত্রিকায় সন্নিবেশিত।
এই হল তাদের মতবাদ এবং তাদের ভাষায় এটাই তাদের ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের স্বরূপ। কিন্তু তারা মুসলমানদের সারির পেছনে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য লুকিয়ে আছে। কখনও তারা সাধারণ মুসলমানগণকে প্রতারণা করে, বিশেষ করে পাক ভারত ব্যতীত অন্যান্য দেশে মুসলমানদের সাথে এবং তাদের ইমামের পিছনে প্রতারণা মূলক নামাজ পড়ে। কেননা আমরা পূর্বেই বলেছি যে, তারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুয়্যত অস্বীকারকারীকে কাফের বলে। সুতরাং কেমন করে তারা কাফেরদের পেছনে এবং তাদের সারিতে নামাজ পড়ার অনুমতি দিতে পারে? যদি তারা নামাজ পড়ে থাকে তবে উহা কপটতার নামাজ। অতঃপর তারা এ নামাজগুলোকে নিজ গৃহে পুনরায় পড়ে নেয়। অকাদিয়ানীদের পিছনে নামাজ পড়া সম্পর্কে এদের মতামত বর্ণনার পর আমরা তাদের এ দুরভিসন্ধি বিস্তারিত উল্লেখ করব। নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী বলে- ‘এটাই আমার সুপরিচিত ধম মত যে, অকাদিয়ানী ব্যক্তি যেখানেই হোক , যে কেউই হোক , লোকেরা তার যতই প্রশংসা করুক, তার পিছনে তোমাদের নামাজ পড়া জায়েজ নহে। এটা আল্লাহর নির্দেশ ও আল্লাহর ইচ্ছা। আর, এতে যে সন্দেহ পোষণ করে বা ইতস্তত: করে সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। তোমাদের এবং ওদের মধ্যে আল্লাহ পার্থক্য করে দিতে চান। (গোলামের মালফুজাত যা আল-হিকম নামক কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রচারিত প্রবন্ধ, ১০ ডিসেম্বর ১৯০৪ খৃ:)
গোলাম আহমদ তার ‘‘আরবাঈন’’ নামক পুস্তিকার ৩৪ও ৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছে- আল্লাহ আমাকে অবগত করেছেন যে, যে ব্যক্তি আমাকে অবিশ্বাস করে এবং আমার আনুগত্য স্বীকার করতে ইতস্তত: করে, তার পিছনে তোমাদের নামাজ পড়া অকাট্য হারাম। বরং তোমাদের কোন এক ইমামের পেছনে নামাজ পড়া তোমাদের কর্তব্য। হাদীসে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, ‘‘তোমাদের ইমাম তোমাদের মধ্য থেকেই হবে’’। অর্থাৎ যখন মাসীহ অবতরণ করবেন তখন তোমাদের কর্তব্য হবে ইসলামের দাবিদার সকল দলকে বর্জন করা। তোমাদের মধ্য হতে ইমাম নিযুক্ত করে নিবে। তোমাদের যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে তদনুযায়ী কাজ কর। তোমরা কি চাও যে, তোমাদের অজান্তে তোমাদের আমল সমূহ নষ্ট হয়ে যাক? এটাই গোলামের উক্তি। আর, তার ছেলের উক্তি হল এই- অকাদিয়ানী কোন ব্যক্তির পেছনে কারো নামাজ পড়া বৈধ নহে। লোকেরা বারংবার এ প্রশ্ন করছে যে অকাদিয়ানীদের পেছনে নামাজ বৈধ কি না? আমি বলি যখনই তোমরা আমার কাছে প্রশ্ন করবে তখনই আমি বলব, জায়েজ নহে, জায়েজ নহে, জায়েজ নহে, (আনওরে খেলাফত, ৮৯ পৃ:)
তারা এ ব্যাপারে এতই কঠোর যে, তাদের দলের করো জন্য কোন ইমামের পেছনে নামাজ পড়া বৈধ নহে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিশ্চিত না হবে যে এ ইমাম কাদিয়ানী। মনজুর কাদিয়ানীর ‘‘মালফুজাতে আহমদিয়া’’ নামক গ্রন্থের ৪থ খন্ডে ১৪৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি গোলাম আহমদকে জিজ্ঞেস করল- কোন ব্যক্তির পক্ষে ঐ ইমামের পেছনে নামাজ পড়া বৈধ আছে কি না যার ধর্ম সম্পর্কে সে অবহিত নহে। উত্তরে সে বলল: না, তার ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে অবহিত না হয়ে তার পেছনে নামাজ পড়া বৈধ হবে না। যদি সে আমাকে বিশ্বাস করে, তবে বৈধ হবে, অবিশ্বাস করলে বৈধ হবে না। আর যদি বিশ্বাস অবিশ্বাস কিছুই না করে তবুও বৈধ হবে না, কেননা, সে মুনাফেক। আর কোন কোন সময় তারা মুসলমানদের মসজিদে এবং মুসলিম ইমামের পেছনে নামাজ পড়ে থাকে উহার হাকীকত আমি কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলীফা গোলামের পুত্র মাহমুদ আহমদের বাচনিক বর্ণনা করছি। সে তার হজের সফরের উল্লেখ করে বলে- ‘আমি ১৯১২ সালে মিসর গেলাম। আর, সেখান থেকে হজে গেলাম। জিদ্দায় আমার মাতামহ আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। এরপর সরাসরি আমরা মক্কায় চলে গেলাম। প্রথম দিন আমরা যখন তওয়াফে রত ছিলাম, তখন নামাজের সময় হয়ে গেল। আমি ফিরে যাবার ইচ্ছা করলাম, কিন্তু ভিড়ের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল এবং নামাজ শুরু হয়ে গেল। এমনি অবস্থায় আমার নানা আমাকে নামাজ পড়তে আদেশ করলেন। তাতে আমরা নামাজ পড়ে নিলাম। অতঃপর যখন আমরা ঘরে পড়তে প্রস্ত্ততি নিলাম যা অকাদিয়ানীদের পিছনে আদায় ও গ্রহণযোগ্য নহে। আমরা দাঁড়িয়ে সে নামাজ পড়ে নিলাম। আমরা এরূপই করতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ঘরেই নামাজ পড়তাম এবং কখনও জামাতের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করতাম। তারপর দাঁড়িয়ে আমাদের জামাতের সাথে নামাজ আদায় করতাম। কোন কোন সময় আমাদের সাথে অকাদিয়ানীরা শরীক হয়ে যেত। (কেননা তারা জানত না যে, এরা বিদ্রোহী ও ধর্মান্তরিত দল)
অতঃপর বলে- যখন আমরা হজের সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করলাম, তখন কোন একজন আমাদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীনকে জিজ্ঞেস করল একজন কাদিয়ানী অকাদিয়ানীর পেছনে নামাজের ব্যাপারে কি করবে? উত্তরে খলীফা বললেন, যদি অকাদিয়ানীর পেছনে নামাজ পড়া সংগত মনে করে তবে তার পেছনে নামাজ পড়ে নিবে। তবে পুনরায় উহা পড়ে নিবে। (মাহমুদ আহমদ লিখিত আয়নায়ে ছাদাকাত, ৯১পৃঃ) এটাই হল তাদের নামাজের স্বরূপ, যা কখনও কখনও তারা সাধারণ মুসলমানদের সাথে প্রতারণার উদ্দেশ্যে পড়ে থাকে। শুধু এ পর্যন্তই নহে, বরং কাদিয়ানীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা যেন সাধারণ ভাবে মুসলমানদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারা যেন মুসলমানদের অনুষ্ঠানে এবং তাদের সুখে দুঃখে অংশগ্রহণ না করে। কেননা, কাদিয়ানীরা পবিত্র আর মুসলমানরা অপবিত্র। কাজেই অপবিত্রের সাথে পবিত্র এবং কাফেরের সাথে মোমিনের মিলিত হওয়া সমীচীন নহে। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে: এ সম্পর্ক যে আমরা ছিন্ন করেছি তা আমাদের পক্ষ থেকে করিনি বরং আল্লাহর নির্দেশে করেছি। (স্বভাবতই তিনি হবেন কাদিয়ানীদের আল্লাহ, জগৎবাসীর আল্লাহ নহেন) সে আরো বলে- আমার নবুয়তের অস্বীকার করা অবস্থায় এদের সাথে সম্পর্ক রাখার উদাহরণ হল এই যে, খাঁটি দুধকে দুর্গন্ধময় বিকৃত দুধের সাথে মিশিয়ে রাখা। (আমি জানি না, সে খাঁটি দুধ বলে কাদেরে উদ্দেশ্য করেছে) এ কারণেই আমরা এ সব সম্পর্কের প্রয়োজন বোধ করি না। (গোলামের উক্তি যা ‘‘তাশহীদুল আজহান’’ নামক গ্রন্থে ৮ম খন্ড ৪থ নম্বর ৩১১ পৃ: উল্লেখিত।) সে আরো বলেছে: তোমরা বিবাহ শাদী ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে মুসলমানদের সাথে অংশগ্রহণ করবে না এবং তাদের জানাজার নামাজও পড়বে না। কেননা, তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। যখন এদের সাথে আমাদের সকল সম্পর্ক ও নামাজ বিচ্ছিন্ন এবং এদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের কাছে কোনই গুরুত্ব রাখে না। তখন এদের মৃতের উপর আমাদের নামাজ আদায় করার অবকাশ আর কোথায় থাকে? (ইমামের বাণী যা আল ফজল পত্রিকায় ১৮ই জুন ১৯১৬ সালে প্রকাশিত) এ জন্যেই, যখন আমাদের কোন একজন দ্বিতীয় খলীফাকে জিজ্ঞেস করল- মুসলমান শিশুর উপর জানাজার নামাজ পড়া কি বৈধ? কেননা সে নিষ্পাপ এবং ভবিষ্যতে বেঁচে থাকলে সে কাদিয়ানী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তরে দ্বিতীয় খলীফা বললেন তার জানাজার নামাজ পড়া যবে না। যেমন খ্রিস্টান শিশুদের নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও জানাজার নামাজ পড়া যায় না। (মাহমুদ আহমদের ডায়রী যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে ২৩ অক্টোবর ১৯২২ খৃ: প্রচারিত হয়েছে) তার আনওয়ারুল খেলাফত নামক পুস্তিকার ৯৩ পৃ: সে লিখেছে- ‘একটি প্রশ্ন রয়ে গেল যে মুসলমানদের শিশুদের উপর জানাজার নামাজ পড়া কি জায়েজ? আমি বলব, জায়েজ নহে, যেমন হিন্দু ও খ্রিস্টান শিশুদের উপর জানাজার নামাজ জায়েজ নহে। কেননা, শিশুর ধর্ম তার মাতা-পিতারই ধর্ম, সে তার মাতা-পিতার অনুগামী’। এইতো ছিল মুসলিম শিশুদের ব্যাপার। আর, স্বয়ং বয়স্ক মুসলমানদের উপর জানাযার নামাজের হুকুম কি হতে পারে? নিশ্চয়ই তাদের মতে এটা বৈধ হবে না। কেননা, কাফেরগণ মুসলমানদের জানাজার নামাজ পড়ে না। তাই, অন্যদের তুলনায় এরা চরম কাফের হওয়া সত্ত্বে কেমন করে পড়তে পারে? প্রকাশ থাকে যে, গোলাম আহমদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীন বলেছে: মুসলমানদের উপর জানাজার নামাজ পড়া বৈধ নহে। তবে, মাসীহ (গোলাম আহমদ) মুসলমানদের উপর যে জানাজার নামাজ পড়তেন, উহা দাওয়াতের প্রাথমিক যুগে ছিল। যেমন নবী করীম ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেরদের উপর জানাজার নামাজ পড়তেন। (আল ফজল ২৯শে এপ্রিল ১৯১৬ খৃ:) এমনকি, নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী তার নিজ পুত্রের জানাজার নামাজ পড়েনি, শুধু এ কারণেই যে, সে তার উপর ঈমান আনে নি এবং মুসলমান অবস্থায় মারা গিয়েছে। সে তার অপরাপর ভাইয়ের ন্যায় ধর্মান্তরিত হয়নি। (আনওয়ারুল খেলাফত ৯১ পৃ:) এ ব্যাপারে তারা আরও কঠোরতা অবলম্বন করে এত নিম্নে পৌঁছে গেছে যে, যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানীর নাম শুনেনি এবং তার ভ্রান্ত দাওয়াতের কথা শুনেনি তারও জানাজার নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে। যেমন, কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ৬মে ১৯১৫ খৃ: সংখ্যায় প্রকাশ করেছে যে, ‘যদি ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয় যে, এমন স্থানে মারা গিয়েছে যেখানে কাদিয়ানী দাওয়াত পৌঁছেনি, তার ব্যাপারে কি করতে হবে? অতঃপর সেখানে কোন এক কাদিয়ানী পৌঁছোল, সে কি তার জানাজার নামাজ পড়বে? উত্তরে আমরা বলি, জাহের ব্যতীত আমরা কিছু জানি না। আর , তার ব্যাপারে জাহের হল এই যে, সে এমন অবস্থায় মারা গিয়েছে যে সে আল্লাহর রাসূল ও নবীকে চিনে নি। কাজেই আমরা তার জানাজার নামাজ পড়ব না। এমন কি যে ব্যক্তি কাদিয়ানী হয়ে ও মুসলমানদের পিছনে নামাজ পড়ে এবং তাদের সাথে কাজ কারবার করে তার জানাজার নামাজও পড়া যাবে না । কেননা, এ ব্যক্তিও তার কার্যকলাপের দ্বারা কাদিয়ানী ধর্মের বহির্ভূত হয়ে গেছে। (গোলামের পুত্র ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদের পত্র যা ১৯৩৬ সালে ১৩ এপ্রিল আল ফজল পত্রিকায় প্রকাশিত।) তদুপরি মুসলমানদের জন্য রহমতের দোয়া করা যাবে না। যেমন দুজন কাদিয়ানী মুফতীকে যখন জিজ্ঞেস করা হল: কোন অকাদিয়ানী মারা গেলে কাদিয়ানী ব্যক্তি ‘রাহিমাহুল্লাহ’ ও ‘আদখালাহুল জান্নাহ’ বলতে পারে কি? উত্তরে তারা বলল না। কেননা, তাদের কুফুরী প্রকাশ্য। তাই, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। (ফতওয়া রওশন আলী ও মুহাম্মদ সরওর, আল ফজল পত্রিকা ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ খৃ:) এ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও তাদের বেহেস্তে প্রবেশ করা কাদিয়ানীদের দোয়ার উপর নির্ভর করে। যদি তারা মুসলমানদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা না করে তবে মুসলমানদের জন্য বেহেস্তের দরজা খোলা হবে না । জানি না এত কিছুর পরও কেন তারা ইসলামের দাবির উপর অটল থাকছে এবং মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করছে। বরং বীরত্বের দাবি হল এই যে, তারা যেন এ কথা ঘোষণা করে দেয় যে, তারা মুসলমান নহে, মুসলমানদের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এবং ইসলাম ধর্মের আড়ালে যেন তারা আত্মগোপন না করে। বরং তাদের স্বতন্ত্র দ্বীন ও নতুন ধর্মের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দেয়। যেমন তাদের ভাতৃবৃন্দ বাহায়ী সম্প্রদায় করেছে। যারা বর্তমান সকল ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটাই তাদের জন্য ঠিক ও শ্রেয়: হত। কিন্তু ‘‘কাদিয়ানীরা হল সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট’’ নামক প্রবন্ধে যেমন আমরা উল্লেখ করেছি এদের উদ্দেশ্য হল ইসলামের প্রকৃত রূপ পরিবর্তন এবং মুসলমানদের মধ্যে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করা, টাকা, পয়সা উপার্জন, সাম্রাজ্যবাদীদের সেবা, ইসলামের ছদ্মাবরণে আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশে বাতিল দাওয়াতের প্রসার এবং সাধারণ মুসলমানদিগকে প্রতারিত করা। অন্যথায়, তাদের আকীদা হল এই যে, তারা মুসলমানদের পিছনে নামাজ পড়া এবং মুসলমানদের উপর জানাজা পড়াকে জায়েজ মনে করে না। সম্ভবত: ইহা পাঠকদের কাছে নতুন কোন ব্যাপার নহে। কারণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ভারত উপমহাদেশে মুসলিম মিল্লাতের হিতৈষী কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন) যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাফর উল্লাহ খান কাদিয়ানী তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেনি। ইহার কারণ সুস্পষ্ট যে, কায়েদে আজম তার মতে কাফের ছিলেন। যেহেতু তিনি মুহহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসারী ছিলেন এবং তার উম্মতগণকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। অথচ সেই জাফরুল্লাহ ছিল মুরতাদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের এজেন্ট ও তার ইমাম গোলাম কাদিয়ানী বলেছে: আল্লাহ তা‘আলা আমার উপর ইলহাম করেছেন যে, যে ব্যক্তি তোমার অনুসরণ করবে না আর তোমার বিরোধিতা করবে সে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধী এবং দোজখে প্রবেশকারী। (মে‘ইয়ারুল আখইয়ার ৮ম পৃ:) আর তার ইমামের পুত্র ও প্রতিনিধি বলেছে, যে ব্যক্তি গোলাম আহমদ কে বিশ্বাস করবে না সে কাফের, যদিও তার কাছে কাদিয়ানীদের দাওয়াত না পৌঁছে থাকে। এজন্যই তারা মুসলমানদের সাথে বিবাহ-শাদি বৈধ মনে করে না’। মাহমুদ আহমদ তার কিতাব ‘বরকতে খেলাফত’ এর ৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত তার ভাষণে ঘোষণা দিয়েছে যে, কোন কাদিয়ানীর পক্ষে তার মেয়েকে অকাদিয়ানীর কাছে বিবাহ দেয়া বৈধ নহে। কারণ এটা প্রতিশ্রুত মাসীহের (গোলাম আহমদ) কঠোর নির্দেশ। সে আরো উল্লেখ করেছে: যে ব্যক্তি তার মেয়েকে অকাদিয়ানীর কাছে বিবাহ দেবে সে আমাদের জামাতের অন্তর্ভুক্ত নহে, যতই সে কাদিয়ানী ধর্মের দাবিদার হোক। এমনকি, আমাদের অনুসারীর জন্য উচিত নহে এ ধরনের কোন বিবাহ-শাদীর অনুষ্ঠানে যোগদান করা’ (আল-ফজল ২৩শে মে ১৯৩১খৃঃ)।
অধিকন্তু, কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল হিকমে’ প্রকাশিত হয়েছে যে, মুসলমানদের সাথে বিবাহ-শাদীর বেলায় একথা লক্ষ রাখতে হবে যে, তাদের কাছে কোন মেয়ে বিবাহ দেয়া যাবে না। তবে তাদের মেয়ে বিবাহ করা যেতে পারে। কেননা, তারা আহলে কিতাবের অনুরূপ। সুতরাং আমরা আমাদের মেয়ে দেব না বরং তাদের মেয়ে আমরা গ্রহণ করব। যেরূপ ব্যবহার আহলে কিতাবের সাথে করা হয়। আমাদের ইমাম বর্ণনা দিয়েছেন যে, অকাদিয়ানী মুসলমানরা হল আহলে কিতাব। আমাদের মেয়ে তাদেরকে দান করা বৈধ নহে কিন্তু আমাদের পক্ষে তাদের মেয়ে গ্রহণ করা বৈধ হবে। এতে আমাদের লাভও রয়েছে যে, আমাদের জামাতে একজন লোক বৃদ্ধি পেল। (আল-হিকম ১৪ই এপ্রিল ১৯২০খৃঃ) মাহমুদ আহমদ বলে, ‘মুসলমান, হিন্দু ও শিখ মেয়ে গ্রহণ করা জায়েজ, কিন্তু তাদেরকে মেয়ে দান করা বৈধ নহে’। (আল-ফজল ১৮ফেব্রূয়ারী ১৯৩০খৃঃ) সে আরো বলেছে: কোন কাদিয়ানী তার মেয়েকে অকাদিয়ানীর কাছে বিবাহ দেবে না। যদি দেয় তার উদাহরণ হল, যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে ‘‘কোন জেনাকারী যখন সে জেনা করে তখন সে মুমিন থাকে না’’। (আল-ফজল ২৬ জুলাই ১৯২২খৃঃ) সে আরো বলেছে, যে ব্যক্তি মুসলমানদের কাছে মেয়ে বিবাহ দেবে, তাকে জামাত থেকে বহিষ্কার করা হবে, এবং তাকে কাফের ঘোষণা দেয়া হবে’। ( আল ফজল ৪ই মে ১৯২২খৃঃ) ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে ১৯৩৪ খৃ: আল ফজল পত্রিকায় পাঁচজন লোককে জামাত থেকে এ অপরাধের কারণে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাদের অপরাধ ছিল তারা মুসলমানদের কাছে তাদের মেয়ে বিবাহ দিয়েছিল। ঘোষণার বর্ণনা ছিল এই, ‘‘আল-মাসীহের দ্বিতীয় খলীফা আমিরুল মুমেনীনের নির্দেশ অনুসারে উল্লেখিত নামের লোক দিগকে জামাত থেকে বহিষ্কার করা হল এবং এদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেয়া গেল’’। এমনকি, বশীর আহমদ স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছে- ‘আমাদের নামাজ পৃথক করে দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে মেয়ে বিবাহ দেয়া হারাম করা হয়েছে এবং তাদের জানাজায় শরীক হতে নিষেধ করা হয়েছে’। অতঃপর আর কি অবশিষ্ট রইল যে আমরা তাদের সাথে কাজ কারবারে যোগদান করব। সম্পর্ক দু‘ভাগে বিভক্ত: দ্বীনি ও দুনিয়াবী। তবে, দ্বীনি সম্পর্কের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল এবাদত এবং দুনিয়াবী সম্পর্কের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল এ বিবাহ শাদির সম্পর্ক। অতএব তাদের সাথে এবাদত করা এবং বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়া আমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে। যদি প্রশ্ন করেন যে, আপনারা কীভাবে তাদের মেয়ে গ্রহণ করার অনুমতি দেন? উত্তরে বলব যেমন আমরা খ্রিস্টানদের মেয়ে গ্রহণ করার অনুমতি দেই, আর যদি প্রশ্ন করেন- কেন আপনারা তাদেরকে সালাম করেন? উত্তরে বলব- রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদীগণকে সালাম দিতেন। সারকথা হল এই যে, আমাদের ইমাম তাদের এবং আমাদের মধ্যে সবদিক থেকে পার্থক্য করে দিয়েছেন। (বশীর আহমদের কালিমাতুর ফাছল যা রিভিউ অব রিলিজিওনে সন্নিবেশিত)
হে কাপুরুষেরা! তোমরা কেন এ কপটতা অবলম্বন করছ? আর সাধারণ জনমতের সম্মুখে ইসলামের মুখোশ পরে আছ? এবং কেন তোমাদের অসৎ পূর্ববর্তীদের ন্যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তোমাদের হিংসা বিদ্বেষ প্রকাশ করছ না? কেমন করে তোমরা বড় চোরের পরামর্শানুযায়ী পর্দার অন্তরালে থেকে জগৎবাসীকে প্রতারণা করছ? সে বলেছিল ‘‘তোমার স্বর্ণ, তোমার গমনাগমন ও তোমার ধর্মকে গোপন রাখ।’’ এটা তারা করেছিল অপদস্ততা ও লাঞ্ছনার ভয়ে। [৭ বাহায়ী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও নবুওতের ভন্ডদাবীদার বাহাউল্লাহর ইলহামাত।] তোমরা কি এই ধোঁকায় পড়ে আছ যে, জগদ্বাসী তোমাদের গোপন রহস্য, তোমাদের নির্লজ্জতা, তোমাদের বই পুস্তক ও মতামত জানতে পারবে না? আর তোমরা- ওহে আল্লাহ ও ইসলামের শত্রুরা,মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতের শত্রুরা! ভারত উপমহাদেশে তোমাদের বিষয়ের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার কারণে তোমরা বিকল হয়ে পড়েছে। এখন তোমরা তোমাদের প্রচেষ্টাকে আফ্রিকা ও আরব বিশ্বে কেন্দ্রীভূত করেছ। তোমাদের পূর্ববর্তী মনিবের পরিকল্পনা অনুযায়ী গুপ্তচরবৃত্তি ও ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে । অথচ অতীতে তোমাদের খলীফা প্রকাশ করেছে যে, সে মুসলমানদের শত্রু। সে তার দলকে সম্বোধন করে একদা বলছে- আমরা ভারতবর্ষে আদম শুমারী অনুযায়ী পঁচাত্তর হাজার লোক আছি। কিন্তু এত সত্ত্বেও মুসলমানদের তুলনায় আমাদের স্বল্পতা কোন গুরুত্ব রাখে না। কেননা, আমাদের একজন নিষ্ঠাবান মুমিন এক হাজার মুসলমানের উপর বিজয়ী হবে। (হায়রে বীরত্ব) আর, সমস্ত বিশ্বের মুসলমানের সংখ্যা পঁচাত্তর মিলিয়নের বেশি নহে। (হায়রে হিসাব! হায়রে মিথ্যাচার) তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, সমুদয় মুসলমান আমাদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী নহে। তারা আমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না, বরং আমরাই তাদের উপর বিজয়ী হব’। (অর্থাৎ মহান ইংরেজ সরকারের করুণায়।) আল-ফজল পত্রিকা ২১শে জুন ১৯৩৪ খৃ:।
মুসলমানদের প্রতি তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ও হিংসা-বিদ্বেষ নিহিত রয়েছে, একথাগুলো উহার একটি চিত্র তুলে ধরছে। ইতিপূর্বে যখন তুর্কি মুসলিম শক্তির সহিত পঞ্চম জর্জের অর্থাৎ কাফের শক্তির সংঘর্ষ বেঁধেছিল, তখন তাদের দ্বিতীয় খলীফা বলেছিল- ‘আমরা পঞ্চম জর্জের সাথে আছি’। কেননা, তিনি বর্তমান খলীফা। (আল- ফজল পত্রিকা ২৬ শে জুলাই ১৯৩০ খৃ:) ব্রিটিশরা যখন প্যালেষ্টাইনে প্রবেশ করে, তখন তাদের প্রশংসায় সে একটি প্রবন্ধও লিখেছিল। বর্তমানে ইসরাইলীরা সমগ্র ইসলাম জগতের প্রধান শত্রু। আর এই ইসরাইলের সাথেই কাদিয়ানীদের হৃদ্যতাপূর্ণ ও সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এটা শুধু এ কারণেই যে, তারা উভয়ই দ‘টি বিষয়ে একমত। একটা হল ইসলামের বিরোধিতা ও এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ এবং অপরটি হল সাম্রাজ্যবাদের দালালি। এ সম্পর্কে এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার দানে তাদেরকে সম্মানিত করেন। আর, এ সকল সাক্ষাৎকারে কি যে ষড়যন্ত্র রয়েছে তা সকলেরই বোধগম্য। ক্ষুদ্র ইসরাইল রাষ্ট্রের নেতা কাকে সম্মান দিতে পারে? ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ কেন ওদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা প্রদান করল? ইসরাইল কি কোন দলকে কেন্দ্র খোলার অনুমতি দিতে পারে, যদি তাদের উদ্দেশ্যাবলী ওদের উদ্দেশাবলীর সহিত যুক্ত না হয়? ইসরাইল বিনা মূল্যে কি আর্থিক সাহায্য করতে পারে? আর এটা কি অসম্ভব কথা যে, ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে গুপ্তচর বৃত্তির মূল্য ওদের থেকে আদায় করে নেয়? প্রথমত: তারা সবচেয়ে বড় যে খেদমত আদায় করছে তা, হল তারা মুহাম্মদ আরবী থেকে আরবদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তাদের বহির্বিশ্বের ভাইদেরকে সম্পৃক্ত করে উহা ছিন্ন করছে এবং জেহাদের চেতনা তাদের অন্তর থেকে বের করে দিচ্ছে। (‘‘আমাদের মতে জেহাদ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ’’ কাদিয়ানী পত্রিকা: রিভিউ অব রিলিজিওন্স ১৯০২ খৃ:)
এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, ইসরাইলের মধ্যে শুধু অধিকৃত প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্রের কেন্দ্র নহে, বরং সমুদয় আরব রাষ্ট্রের কেন্দ্র সেখানে রয়েছে। সেখান থেকে তাদের প্রচারপত্র সকল আরব দেশগুলোতে প্রেরণ করা হয়। যেমন, কাদিয়ানীরা নিজেরাই তা স্বীকার করেছে। সময় সময় সেখানকার কাদিয়ানীদের তৎপরতার সংবাদ ইসরাইল বেতারযন্ত্র থেকে প্রচার করা হয়। কাদিয়ানীরা তাদের ‘‘মারকাযুনা ফিল খারেজ’’ নামক গ্রন্থে যা প্রচার করেছে, তার সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি আমরা বর্ণনা করছি। ‘‘আলমারকাজুল ইসরাইলী’’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কাদিয়ানী কেন্দ্র হায়ফার সাউন্ট কারমালে অবস্থিত। ঐ খানে আমরা একটা মসজিদ, কেন্দ্রের জন্য একটা ঘর, সাধারণ পাঠকদের জন্য একটা লাইব্রেরি, বই বিক্রির জন্য একটা লাইব্রেরি ও একটি বিদ্যালয়ের মালিক। কেন্দ্র ‘‘বুশরা’’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে। ত্রিশটি আরব দেশে এ পত্রিকা প্রচার করা হয়। প্রতিশ্রুত মাসীহ (গোলাম) এর অধিকাংশ পুস্তক সমূহ এ কেন্দ্রের সাহায্যে আরবীতে অনুবাদ করা হয়। এই কাদিয়ানী কেন্দ্রটি প্যালেষ্টাইন বিভক্তির কারণে নানাভাবে প্রভাবন্বিত হয়েছে, যেসব মুসলমান ইসরাইলে রয়ে গিয়েছিল তারা এই কেন্দ্র থেকে অত্যধিক উপকৃত হয়েছে। আমাদের কেন্দ্রটি এদের খেদমতের কোন সুযোগই নষ্ট করে নি। কিছুদিন পূর্বে এই কেন্দ্রের একটি প্রতিনিধি দল হাইফা কর্পোরেশনের মেয়রের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তার সাথে অনেক বিষয়ে মতবিনিময় করে। হাইফার মেয়র আমাদের জন্য ‘কাবাবীর’ নামক স্থানে যেখানে অনেক কাদিয়ানী বসবাস করে একটি বিদ্যালয় স্থাপনে তার প্রস্ত্ততির কথা জানালেন । কাবাবীরে আমাদের সহিত পুনরায় সাক্ষাৎকারের প্রতিশ্রুতি দিলেন। এরপর কথানুযায়ী তিনি এমন চার ব্যক্তিকে নিয়ে আসলেন, যারা হাইফাতে আমাদের পরিচিত। আমাদের জামাত ও বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল এবং তাদেরকে সংবর্ধনার জন্য একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত করল। ফেরার পূর্বে তারা সাক্ষাৎকার রেজিস্ট্রিতে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল। ইসরাইল রাষ্ট্রে আমাদের যে মর্যাদা রয়েছে তা ছোট একটি বিষয় দ্বারা পাঠক বর্গ অনুধাবন করতে পারবেন। আমাদের একজন মুবাল্লেগ চৌধুরী মুহাম্মদ শরীফ ১৯৫৬ সালে ইসরাইল থেকে পাকিস্তান ফেরার ইচ্ছা করলে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রধান তার কাছে দূত পাঠালেন যেন তিনি ইসরাইল রাষ্ট্র ত্যাগ করার পূর্বে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সুতরাং মুবাল্লেগ এ সুযোগকে একটি গনিমত মনে করল এবং জার্মানি ভাষায় অনুদিত একখন্ড কুরআন তাকে উপহার দিল। তিনি উহা অতি আনন্দের সহিত গ্রহণ করলেন। ইসরাইলী পত্রিকাসমূহে এ সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা হয় এবং রেডিও মারফত উহা প্রচার করা হয়। (উল্লেখিত পুস্তক ৭৯ পৃষ্ঠা)
এটাই হল মুসলমানদের সাথে এদের সম্পর্কের ও মুসলমানদের চরম শত্রুদের সাথে এই মুরতাদ সম্প্রদায়ের ভালোবাসার প্রকৃত রূপ। তারা দখলকৃত ভূমি এবং কট্টর ইহুদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র কে মুসলমানদের ধ্বংস ও বিনাশ সাধনের জন্য কেন্দ্র নির্বাচন করে তাদের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কেননা, এইভাবে তারা মুসলমানদের পরম শত্রু ও কঠোর বিদ্বেষী লোকদের কাছ থেকে শক্তির জোগান লাভ করতে পারে।
এখান থেকেই পাঠক ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি এই দলের শত্রুতার মাত্রা দু‘দিক দিয়ে অনুধাবন করতে পারবে। একটি হল ধর্মীয় দিক, যা তাদের পুস্তকের মূল উদ্ধৃতিসহ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরটি রাজনৈতিক দিক, যা উল্লেখিত বক্তব্যের দ্বারা আরো স্পষ্ট প্রমাণিত হল। আল্লাহ পাক বিদ্বেষী দুষ্টদের হাত থেকে তাঁর দ্বীনকে রক্ষা করুন।
৫
তৃতীয় প্রবন্ধ: নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী কর্তৃক সাহাবায়ে কেরাম ও নবীগণের অবমাননা। [১- এই প্রবন্ধটি ১৩৮৬ হিঃ সনে ‘হাদারাতুল ইসলাম’ ম্যাগাজিনের ৮ম সংখায় প্রকাশিত হয়।]রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘কিয়ামত কায়েম হবে না যে পর্যন্ত না ত্রিশজন দাজ্জাল বের হবে। তারা প্রত্যেকে নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবি করবে’’। আর এক রেওয়ায়েতে আছে, ‘‘আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কোন নবী আসবে না’’। [২- আবু-দাউদ, তিরমিযী থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ কাদিয়ানী এই হদীসকে অস্বীকার করেছে এই বলে যে, হাদীসে যে ত্রিশ দাজ্জালের কথা বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে আমাদের গুলাম আহমদ কাদিয়ানী অন্তর্ভুক্ত নয় ত্রিশ দাজ্জালের আগমণ শেষ হয়ে গেছে। এই অস্বীকৃতির কয়েকটি জবাব রয়েছে এখানে সংক্ষিপ্তাকারে দু‘টির উল্লেখ করছি। প্রথমতঃ আলোচ্য ‘‘আমার পরে আর কোন নবী আসবে না’’ বাক্যে অস্বীকৃতির কোন জো নেই। দ্বিতীয়তঃ হাফিজ ইবনে হাজার ফতহুল বারীতে এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন- এই হাদীসের দ্বারা রাসুলুল্লাহর পর নবুওতের দাবীদার মাত্র উদ্দেশ্য নয়। নবুওতের দাবীদার তো অগণিত, এদের অধিকাংশই বিকৃত মস্তিস্ক ও অপ্রকৃতিস্ত। এই হাদীস দ্বারা এমন ভন্ডনবীদের কথা বলা হয়েছে যারা নবুওতের দাবী করবে এবং মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারবে। (ফাতহুল বারী-৬ম খন্ড ৪৫৫পৃষ্ঠা)] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন। আর, তিনি প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন কথা বলেন না। যা বলেন তা তার প্রতি ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই বলেন। এ সকল দাজ্জালের মধ্যে প্রথম শতাব্দীর প্রধান দাজ্জাল ছিল মুসাইলামাতুল কাজ্জাব। আর, চতুর্দশ শতাব্দীর দাজ্জাল হল গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। উভয়ই নবী ও রাসূল হওয়ার দাবিতে ঐক্যতা প্রকাশ করে। কিন্তু দ্বিতীয়টি তার ভ্রান্তিতে অধিকতর অগ্রসর হয়ে সকল নবী রাসূলের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেছে এবং তাঁদের অবমাননা করে তাঁদের সম্মানের উপর আঘাত হেনেছে। কাউকে গালি দিয়েছে এবং কারো নিন্দা করেছে। অনুরূপ ভাবে সে বেহেস্ত বাসী যুবকদের নেতৃদ্বয় হাসান ও হুসাইনের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহানুভূতিশীল আত্মীয় স্বজন ও ওজীরদ্বয়ের সম্মানের উপর আক্রমণ করেছে। ইসলামের পতাকাবাহী এবং রাসূলের সুন্নতের প্রচারকারী পবিত্র সাহাবীগণ রা. আ‘ইম্মায়ে মুজতাহিদীন, আউলিয়ায়ে উম্মত ও মনোনীত মনিষীগণকে তারা নির্বোধ আখ্যায়িত করেছে। তা সত্ত্বেও কাদিয়ানীরা নিজেদেরকে মুসলমান মনে করে এবং মুসলমানদের সাথী বলে ধারণা করে। আর, মুসলমানরা যে ধর্ম বিশ্বাস রাখে তারাও সে ধর্মে বিশ্বাস রাখে বলে দাবিকরে। মুসলমানদের মধ্যে এমন কে আছে, যে হযরত আবু বকর ,ওমর, ওসমান ও আলী রা. থেকে কাউকে শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করতে পারে? মুসলমানদের এমন কোন ইমাম আছে যিনি বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর দরবারে ইমাম হাসান ও হুসাইনের তুলনায় পরবর্তীদের মধ্যে অন্য কেহ অধিক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হবে? বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে এমন কে আছে, যে, ধারণা করতে পারে যে, এমন কোন ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করেছে যে মানব শ্রেষ্ঠ ও আদম সন্তানের সর্দার হতে অধিক মর্যাদাবান? না, এমন কেহ নেই। সুতরাং কে আছে এমন যে মুসলমান হয়ে এমন উক্তি করতে পারে? আল্লাহর শপথ, যিনি মুহাম্মদকে সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত সৃষ্টির উপর তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, আর, তাঁর সাথীদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, এমন দাবি কেহ করতে পারে না। অতঃপর, মুসলমানদের মধ্যে এমন কে আছে, যে এ কল্পনা করতে পারে যে, মুসলমানদের মধ্যে কোন ব্যক্তি নবী ও রাসূলকে গালি দিতে পারে , তাঁদের নিন্দা করতে পারে? আসুন, এখন আমরা নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানীর আলোচনা করি। সে উম্মতে মুহাম্মদীর ওলীদের উল্লেখ করে বলে, ‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের মধ্যে হাজার হাজার ওলী জন্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু, আমার সমান কেহ নেই। (গোলামের ‘‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’’ ২৯ পৃ:) ইমাম হাসান ও হুসাইনের রা. কথা উল্লেখ করে বলে যে, মুসলমানরা আমার উপর এ জন্য রাগান্বিত যে, আমি নিজেকে ইমাম হুসাইনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেই। অথচ, কুরআনে তাঁর নামের উল্লেখ নেই, বরং যায়েদের নাম আছে। হুসাইন যদি শ্রেষ্ঠ হতেন তবে, কুরআনে তাঁর নামের উল্লেখ থাকত। আর, পিতৃত্বের সম্বন্ধ তো আল্লাহর এ বাণী দ্বারা ছিন্ন হয়ে গেছে, ‘‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্য হতে কোন পুরুষের পিতা নহেন, বরং তিনি আল্লাহর একজন রাসূল।’’ (মালফুজাতে আহমদীয়া ১৯১,৯২ পৃষ্ঠা) সে আরো বলে: মুসলমানরা আমার সমালোচনা করে যে, আমি নিজেকে হাসান ও হুসাইনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। উত্তরে আমি বলি যে, হাঁ, আমি নিজেকে তাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করি। অচিরেই আল্লাহ তা‘আলা এ শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে দিবেন। (গোলাম রচিত পুস্তক ‘‘এজাজে আহমদিয়া’’ ৫৮ পৃ:) অধিকন্তু, গোলামের পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা কাদিয়ানে যে জুম‘আর খুতবা দিয়েছিল এবং কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে ১৯২৬ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছিল, উহাতে সে বলেছে: ‘আমার পিতা বলছেন: একশত হুসাইন আমার পকেটে রয়েছে। মানুষ এর অর্থ এই বুঝে যে তিনি একশত হুসাইনের সমান। কিন্তু আমি আরো অধিক বলি যে, দ্বীনের খেদমতের জন্য আমার পিতার এক ঘন্টার কুরবাণী একশত হুসাইনের কুরবাণীর চেয়ে উত্তম। কাদিয়ানী পত্রিকা আল-হিকমে প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘পুরাতন খিলাফত নিয়ে দ্বন্দ্ব পরিহার কর এবং নতুন খেলাফত গ্রহণ কর। তোমাদের মধ্যে জীবিত আলী বিদ্যমান। তাকে ছেড়ে তোমরা মৃত আলীর অনুসন্ধান করছ’। (মালফুজাতে আহমদিয়া ১ম খন্ড ১৩১ পৃ:) এ জঘন্য মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী আরো অগ্রসর হয়ে নিজেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সবচেয়ে প্রিয় পাত্র ও নবীর পরে সর্বোত্তম ব্যক্তির উপর প্রাধান্য দিয়ে বলে যে, আমি ঐ মাহদী, যার সম্পর্কে ইবনে সীরীনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: তিনি কি আবু বকরের সমমর্যাদা সম্পন্ন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন- তার তুলনায় আবু বকরের অবস্থান কোথায়? বরং তিনি তো কোন কোন নবীর চেয়েও উত্তম । (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘‘মি‘ইয়ারুল আখবার’’ যা তাবলীগে রেসালাতের ৯ম খন্ডের ৩০পৃষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত।) গোলামের পুত্র ও তার খলীফা বলেছে: ‘হযরত আবু বকরের মর্যাদা উম্মতে মুহাম্মদীর শত শত লোক অর্জন করেছে’। (মাহমুদ আহমদ রচিত ‘‘হাকীকতে নবুয়্যত’’ ১৫২ পৃ:) জনৈক কাদিয়ানী লিখেছে যে, সে কোন এক কাদিয়ানী ধর্ম প্রচারক (যে আহলে বাইত অর্থাৎ গোলামের পরিবার ভুক্ত) থেকে এই বলতে শুনেছে যে, সে বলছে, গোলাম আহমদের তুলনায় আবু বকর ও ওমরের অবস্থান কোথায়? এরা তো গোলামের জুতা উঠাবার যোগ্যাতা রাখে না। (এ ধরনের জঘন্য অপরাধ ও দুঃসাহসিকতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করছি।) (মুহাম্মদ হুসাইন আল কাদিয়ানী কর্তৃক রচিত ‘‘আল মাহদী’’ ৩০৪ নম্বর ৫৭ পৃষ্ঠা) অতি আশ্চর্যের বিষয় এই যে, গোলাম আহমদের মত একজন ইতর ব্যক্তি ঐ সকল পবিত্র ব্যক্তিবর্গের সাথে প্রতিযোগিতার দাবি করে যাদেরকে আল্লাহপাক এ পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় বেহেস্তের সুসংবাদ দিয়েছেন। এই হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর, রা. যাদের সম্পর্কে মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ‘‘নবী ও রসুলগণ [১ তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ] ব্যতীত পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে বয়স্ক বেহেস্তবাসীদের সরদার হলেন আবু বকর ও ওমর’’। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন ‘‘ প্রত্যেক নবীরই পৃথিবী বাসীদের মধ্য হতে দ‘জন ওজীর এবং আসমান বাসীদের মধ্য হতে দু‘জন ওজীর থাকেন। পৃথিবী বাসীদের মধ্যে আমার দু‘ওজীর হলেন আবু বকর ও ওমর রা.’’। [২ তিরমিযী] প্রথম ব্যক্তি সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘‘তিনি হলেন সর্ব প্রথম ব্যক্তি যাকে বেহেস্তের সকল দরজা থেকে ডাকা হবে’’। [৩ বুখারী]
তিনি আরো বলেছেন ‘‘সাহচর্য ও সম্পদের দিক দিয়ে সকল লোকের মধ্যে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহশীল হলেন আবু বকর। যদি আমি কাউকে একক আন্তরিক বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তবে আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম। তবে আমাদের মধ্যে রয়েছে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। এ মসজিদে আবু বকরের দরজা ছাড়া আর কারো দরজা খোলা থাকবে না ’’ [৪ বুখারী ,মুসলিম, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে দারমী, মুসনাদে আহমদ।]। দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ‘‘আমার পর যদি কোন নবী হতেন তা হলে তিনি উমরই হতেন’’ [৫ মুসনাদে আহমদ, তিরমিজী।] ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ওমরের মুখে ও অন্তরে সত্য বিদ্যমান রেখেছেন’’ [৬ আবু-দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও আহমদ।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: শয়তান তোমাকে কোন পথে চলতে দেখলে সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে যায়’’। [৭ বুখারী, মুসলিম, ও মুসনাদে আহমদ।] নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘বেহেস্তে তিনি ওমরের প্রসাদের কাছেই নিজেকে দেখেছেন।’’ [৮ বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী ও মুসনাদে আহমদ।] এ সকল পুণ্যবান লোকদের মোকাবেলায় সে (কাদিয়ানী) গর্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এ ব্যক্তিটিই বা কে? নেশাখোর, মদ্যপায়ী ও প্রতারক এক ব্যক্তি । আমি নিজ থেকে তাকে এ সকল গুণ দ্বারা কখনও অভিযুক্ত করছি না, বরং কাদিয়ানীরা তার এ সব গুণ উল্লেখ করেছে। গোলামের পুত্র তার দ্বিতীয় খলীফা বলেছে: ঔষধের মধ্যে আফিম অধিকাংশ ব্যবহার করা হয়। আমার পিতা বলতেন যে, আফিম হল চিকিৎসা ব্যবস্থার অর্ধেক। কাজেই ঔষধরূপে ইহার ব্যবহার বৈধ এবং তাতে কোন দোষ নেই। আমার পিতা আল্লাহর নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে তিরইয়াকে এলাহী নামক একটি ঔষধ তৈরি করছিলেন, যার বড় অংশ ছিল আফিম। ঐ ঔষধ তিনি তার খলীফা নুরুদ্দীনকে দিতেন। তিনি ও বিভিন্ন রোগের জন্য সময় সময় তা ব্যবহার করতেন’। (মাহমুদ আহমদের ‘‘আল- ফজল’’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১৯ জুলাই ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ।) দেখুন, তার স্বীকারোক্তি, প্রতারণা ও ধৃষ্টতা। সে কেমন করে আফিমকে হালাল করতে চায় এবং জন সাধারণকে দিয়ে বলে, সে আল্লাহর নির্দেশে ইহা ব্যবহার করছে। অথচ, মুহাম্মদের রব বলছেন ‘‘হারামের মধ্যে আরোগ্য নেই।’’ আর এটা কীরূপ হারাম? যে হারাম থেকে সাধারণ মানুষও ভয় পায়। এ লোকটি কেমন করে নবুয়তের দাবিকরে এবং ঐসকল লোকদের মোকাবিলায় গর্ব করে যারা এ সকল ঘৃণিত অপবিত্র বস্ত্ত থেকে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র লোক ছিলেন। অপর এক কাদিয়ানী এ ভাবে সাক্ষ্য প্রদান করেছে যে, এ ভন্ডনবী আফিমখোর কি না তা সে জানে না। সে একজন প্রেসের মালিক। সে বলেছে যখন গোলাম প্রথম বারের মত আমার প্রেসে আসল এবং চেয়ারে বসে ঐ পুস্তক সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল যা সে ছাপাতে চায়, তখন তার মোদিত নিদ্রা মগ্ন চক্ষু-দ্বয় দেখে বুঝতে পারলাম যে, সে ভাং অথবা আফিম ব্যবহার করে। যেমন, সে সময়কার বড় লোকেরা ব্যবহার করত। কিন্তু এখন আমি বুঝলাম, যে নেশা তার মধ্যে আমি দেখেছিলাম তা আফিম বা ভাং এর নেশা নহে বরং তা ছিল আল্লাহর মা‘রেফাতের নেশা। (আল-ফজল পত্রিকায় নুর আহমদের বর্ণনা, ২০ আগস্ট ১৯৪৬ খৃ:) আর মদ সম্পর্কে গোলাম আহমদ লাহোরে তার এক মুরিদের কাছে লিখেছিল, বলুমর নামক ব্যক্তির দোকান থেকে ওয়াইন (মদ) কিনে তার কাছে যেন পাঠায়। মুরিদ যখন বলুমরকে জিজ্ঞেস করল ওয়াইন কি? বলুমর উত্তর দিল ইহা এক প্রকার শক্তিশালী নেশাদার মদ যা সীল করা বোতলে ইংলান্ড থেকে আমদানি করা হয়। (কাদিয়ানী ডাক্তার মুহাম্মদ হুসাইনের ‘‘মাকতুবুল ইমাম বিইসমিল গোলাম’’ ৫পৃষ্ঠা এবং ডাক্তার মুহাম্মদ আলী আল-মুসলিমের লিখিত ‘‘জুনুনুল গোলাম’’ ৩৯ পৃষ্ঠা) অপর একজন কাদিয়ানী ডাক্তার বসারত আলী আমাদের কথার সত্যতা স্বীকার করে এবং সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছে যে, গোলাম আহমদ মদ পান করত। সে আরো বলেছে যে, অসুস্থ অবস্থায় ‘বরান্ডি’ ও ‘র্যাম্প’ [১ বরান্ডি ও র্যাম মদের দু‘টি প্রকার।] ব্যবহারে কি অসুবিধা থাকতে পারে এবং রোগের কারণে আমার ইমাম যদি তা ব্যবহার করেন বা কাউকে ব্যবহার করার অনুমতি দেন তবে তাতে দোষ কি? আর এটা সকলের জানা কথা যে, তিনি একজন দুর্বল লোক ছিলেন, তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত। কখনও নাড়ির স্পন্দন লোপ পেয়ে যেত । এ সকল অবস্থায় যদি তিনি মদ্য-পান করেন তবে তা শরীয়ত বিরোধী নহে বরং এটাই শরীয়ত। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘পয়গামে সুন্নাহ’’ ১৩মার্চ ১৯৩৫ খৃ:) আল্লাহ পানাহ, আল্লাহ পানাহ! এ সকল ওজর আপত্তি হতে। তবে, কেন স্পষ্ট বলা হচ্ছে না যে, গোলাম আহমদ আমাদেরকে যে শরীয়ত প্রদান করেছে উহাতে মদ্য-পান বৈধ। নবুয়তের চাদর চুরি, এবং হযরত আবু বকর ও ওমরের সম্মান হরণের মত জঘন্য অপরাধের পর মদ্য-পানের স্বীকারোক্তিতে আর কি দোষ আছে? হাঁ ওমর এমন সম্ভ্রান্তশীল মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন যিনি মদ্য-পান নিষিদ্ধ হওয়ার উপর বার বার জোর দিতেন। অবশেষে, মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করলেন, ‘‘নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা ও লটারির তীর অপবিত্র ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো থেকে বিরত থাক, অবশ্যই তোমরা সফলকাম হবে।’’ [২ সুরা মায়েদা- ৯০] এই সে দালাল ও অপমানিত গোলাম যে তার ভক্তদেরকে বাইয়াত কালে এ শর্তারোপ করত তারা যেন কাফের ইংরেজ সরকারের অনুগত ও সেবক হয়। [১ গোলাম কাদিয়ানীর দামীমা পুস্তকের বারিয়াহ অধ্যায়ের ৯ নং পৃষ্ঠা] সে নিজেকে এমন দু‘জন শহীদ ইমামের উপর প্রাধান্য দেয়, যাদের জন্য স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে অবতরণ করে তাদেরকে উঠিয়ে নিতেন এবং তাদেরকে সম্মুখে রেখে খুতবা দিতেন। [২ তিরমিজী, নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ]
আর যাদের সম্পর্কে নবী করীম বলেছেন ‘‘বেহেস্তবাসী যুবকদের সর্দার হলেন হাসান ও হুসাইন।’’ [৩ তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ।] শুধু তা নহে বরং এ জঘন্য মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী কোন কোন সাহাবীকে বোকা বলত। সে বলত যে, হযরত আবু-হুরাইরা রা. নির্বোধ ছিলেন, তার সঠিক বোধশক্তি ছিল না। (গোলামের ‘‘এজাজে আহমদী’’ ১৮পৃষ্ঠা) সে আরো বলেছে: কোন কোন সাহাবী ছিলেন নির্বোধ। (‘নছরুল হক’ এর পরিশিষ্ট ১৪০ পৃষ্ঠা) প্রকৃতপক্ষে, সে নিজেই ছিল বোকা ও মূর্খ। সে নিজেই তার সম্পর্কে বলেছে, ‘আমার স্মরণ শক্তি খুবই খারাপ’। যে ব্যক্তি কয়েকবার আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছে, তাকেই আমি ভুলে যাই। এ অবস্থা এত দুর পর্যন্ত পৌঁছেছে যা বর্ণনা করা সম্ভব নহে। (মাকতুবাতে আহমদিয়া ৫ম খন্ড ২১পৃষ্ঠা।) কার্যত: তার নির্বোধতা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, সে কাপড় উল্টো পরিধান করত। নীচের অংশ উপরে এবং উপরের অংশ নীচে, ডান পায়ের জুতা বাম এবং বাম পায়ের জুতা ডান পায়ে পরত। তার বোকামী এ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ইস্তেঞ্জার জন্য তার পকেটে রাখা মাটির ঢেলা সে মিষ্টি মনে করে খেয়ে ফেলত। এই তো তাদেরই স্পষ্ট বক্তব্য, তার পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানী বলে যে, ডাঃ মুহাম্মদ ইসমাইল কাদিয়ানী আমাকে বলেছেন: ‘আমাদের ইমাম এতই সাধাসিধে ছিলেন, কথনও কখনও তিনি পাঁয়তারা পরিধান করতে গিয়ে পাঁয়তারার গোড়ালির দিকটাকে পায়ের উপরের দিকে রেখে দিতেন, বোতামকে সোজা ছিদ্রিতে না লাগিয়ে কখনও নীচের বোতামকে উপরের ছিদ্রিতে এবং উপরের বোতামকে নীচের ছিদ্রিতে লাগাতেন। কখনও তার কোন বন্ধু কোন পরিধান বস্ত্র হাদিয়া স্বরূপ নিয়ে আসলে সে উহার ডান বাম বুঝতে পারত না। এ জন্যই সে এমন জুতা পছন্দ করত যার ডান বামে কোন পার্থক্য নেই। খাওয়ার বেলায় ও তার এ অবস্থা ছিল। সে নিজেই বলত যে ‘আমি কি খাচ্ছি তা আমি অনুভব করি না। তবে কোন কঙ্কর বা শক্ত কিছু দাঁতে ঠেকলে তা অনুভব করা যায়। (বশীর আহমদ কাদিয়ানীর ‘‘সীরাতে মাহদী’’ ২য় খন্ড ৫৮ পৃষ্ঠা) তার জনৈক ভক্ত কাদিয়ানী আলেম লিখেছে যে, গোলাম আহমদ গুড় পছন্দ করত এবং সে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত ছিল। সে পকেটে মাটির ঢেলা রাখত যেমন করে গুড়ের চাকা সে পকেটে রাখত; কারণ সে উহাকে খুব পছন্দ করত। তাই কোন কোন সময় সে মাটির ঢেলাকে গুড়ের চাকা মনে করে খেয়ে ফেলত। (বারাহীনে আহমদিয়ার পরিশিষ্টে ‘‘আহ-ওয়ালুল গোলাম বিতারতীবে মে‘রাজুদ্দীন’’ ১ম খন্ড ৬৭ পৃষ্ঠা।) এমন বোকা ও নির্বোধ লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণকে নির্বোধ বলে! শুধু তাই নহে বরং সে নিজেকে শেখাইন আবু বকর ও ওমর রা. ও সকল সাহাবীর উপর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। এখন আমরা তার কিছু ভ্রমাত্মক বক্তব্যের বর্ণনা দিচ্ছি। সে নবী রাসূলগণের উপরও নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে বাদী করে। সে নিজেকে আদম আলাইহিস সালাম এর উপরও প্রাধান্য দিয়ে বলছে ‘আল্লাহ তা‘য়ালা আদম আলাইহিস সালাম কে সৃষ্টি করে অনুসরণীয় সরদার বানিয়েছেন, আর, তাকে প্রত্যেক প্রাণীর উপর প্রধান ও শাসক নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহর বাণী ‘‘আদমকে তোমরা সেজদা কর’’ দ্বারা তা প্রমাণিত। অতঃপর শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করে বেহেস্ত থেকে বের করে ফেলে। তাই, ক্ষমতা শয়তানের কাছে চলে যায়, আর আদম লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়ে পড়েন..........। তারপর শয়তানকে পরাজিত করার জন্য আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। কুরআনে আল্লাহপাক এরই প্রতিশ্রুতি ও দিয়েছেন। (গোলাম রচিত ‘‘মালফরকু ফি আদম ওয়াল মাসীহুল মাওউদ’’।) সে বলে ‘আল্লাহ আমাকে আদম রূপে সৃষ্টি করেছেন। এবং আদমকে যাহা কিছু দিয়েছেন তা আমাকেও দিয়েছেন। কেননা, আদিতে আল্লাহ পাক এমন আদম সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন, যে হবে সর্বশেষ খলীফা। যেমনিভাবে তিনি আদিতে প্রথম খলীফা সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন’। (গোলামের খুতবায়ে ইলহামী ১৬৭ পৃষ্ঠা) মাহমুদ আহমদ এ কথাকে আরো স্পষ্ট করে বলেছে- আল্লাহ তা‘য়ালা ফেরেস্তাগণকে আদমের অনুগত সেবক হতে নির্দেশ দিলেন। প্রথমের জন্য যেহেতু এ নির্দেশ দেয়া হয়, তবে প্রতিশ্রুত মাসীহ দ্বিতীয় আদম যিনি মর্যাদার দিক দিয়ে প্রথম আদম থেকেও শ্রেষ্ঠ তার বেলায় কেন বলা যাবে না যে, এ আগুন তোমার দাস বরং তোমার দাসের দাস হোক। (মাহমুদ আহমদের ‘‘মালাইকাতুল্লাহ’’ ৬৫ পৃষ্ঠা।) আর সে নিজেকে আল্লাহর সেই মহান নূহ আলাইহিস সালাম নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করে, যিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘ সাড়ে নয়শো বছর অবস্থান করেছেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করতেন, উপদেশ দিতেন এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করতেন। (যিনি আল্লাহর পথে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন।) যাকে আল্লাহর পথে অনেক কষ্ট দেয়া হয়েছে এবং কঠিন পরীক্ষা করা হয়েছে। এটা তাঁর ব্যক্তি সার্থে নহে এবং সম্পদ ও সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে নহে, বরং আল্লাহর দ্বীনকে সুমহান করার কাজে তাকে সহ্য করতে হয়েছে। তিনি সেই মনীষী ছিলেন যিনি তার সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‘‘.হে আমার কওম, আমি এ কাজের উপর তোমাদের নিকট থেকে কোন সম্পদ চাচ্ছি না , এর বিনিময় একমাত্র আল্লাহই আমাকে দিবেন।’’ [১ সুরা হুদ-২৯] এমন ব্যক্তির উপর ঐ লোক নিজেকে প্রাধান্য দিচ্ছে যে সাম্রাজ্যবাদীদের সেবা করত এবং ইংরেজের দাসত্ব করত, আর, একেবারে স্পষ্ট ও নির্লজ্জ ভাবে তার সাথে নিজ সেবার বিনিময়ের প্রত্যাশী ছিল। তাইতো দেখা যায়, একদা সে তার বিরাট খেদমতের কথা উল্লেখ করার পর বড়লাটের কাছে তোষামোদ স্বরূপ বলে- আঠারোটি বছর অতিবাহিত হল আমি ঐ সব পুস্তক রচনায় রত ছিলাম, যেগুলো মুসলমানদের অন্তরে তোমাদের প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য ও বন্ধুত্ব ভাব সৃষ্টি করবে, অথচ অধিকাংশ আলেম এ সকল কারণেই আমাকে ঘৃণা করছে এবং এ সকল মতামতের উপর ক্রোধের কারণে তাদের অন্তর জ্বলছে।
কিন্তু আমি জানি যে তারা মূর্খ, তারা এ কথা জানে না যে, যারা মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানে না তারা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং অবদানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সমতুল্য। এটাই হল আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু বড়ই আক্ষেপ, যে সমস্ত পুস্তক সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ উহার প্রতি আমাদের দয়াল সরকার গুরুত্ব সহকারে দৃষ্টিপাত করেন নি। অথচ আমি অনেকবার তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এখন আমি আপনাদেরকে আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আপনারা যেন আমার এ দরখাস্তে উল্লেখিত পুস্তক সমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং উহার চি হ্নত স্থান ও উল্লেখিত পৃষ্ঠাগুলো বিশেষভাবে পাঠ করেন। ইংরেজ সরকারের গুরুত্ব সহকারে ভাবিয়া দেখা উচিত যে, এ সকল অবিরাম চেষ্টা সাধনা যা দীর্ঘ আঠারো বছর যাবৎ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে শুধু ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের প্রতি মুসলমানদের মুখ ফিরিয়ে আনা, তাদের অন্তরে এ সরকারের আনুগত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, এবং বহির্বিশ্বে ইংরেজ সরকারের প্রতি প্রচার চালানোর জন্য। এর কারণ ও লক্ষ কি? আর কি জন্য এ ধরনের পুস্তকাদি প্রচার করা হচ্ছে এবং প্রেরণ করা হচ্ছে ? এবং এর উদ্দেশ্যই বা কি? (ভারতের বড় লাটের প্রতি গোলামের আবেদন পত্র মীর কাসেম আলী রচিত ‘‘তাবলীগে রেসালাত’’ ৭ম খন্ড ১১,১২ও ১৩ পৃষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত।) বলুন, যে ব্যক্তি আল্লাহর এবাদতের প্রতি মানুষকে আহবান করার কাজে নিজের জীবনকে ব্যয় করেছেন, আর, যে ব্যক্তি কাফেরদের সেবায় নিজের জীবনকে ব্যয় করে, এত দু ভয়ের মধ্যে কি কোন সামঞ্জস্য আছে? আর, সেই ব্যক্তি এ কাজের জন্য গর্ব করে যে, সে ইংরেজ সরকারের সেবায় তার জীবনকে ব্যয় করেছে এবং ঐ সকল পুস্তকের রচনায় দীর্ঘ উনিশটি বছর অতিবাহিত করেছে যা মানুষকে এ সরকারের সেবা করা অপরিহার্য বলে উদ্বুদ্ধ করে এবং মুসলমানদের মনে এ কথা সুদৃঢ় করে যে তারা অন্যান্য জাতির তুলনায় এ সরকারের প্রতি অধিক বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান। আর, এ উদ্দেশ্যেই সে কোন কোন পুস্তক আরবী ভাষায় এবং কোনটি ফার্সী ভাষায় রচনা করে দূর-দেশে প্রচার করে। যাতে, সর্বস্থানের মুসলমানগণ ব্রিটিশ সরকারের একেবারে অনুগত হয়ে যায়; আর এ আনুগত্য যেন তাদের অন্তর ও আত্মা হতে উৎসারিত হয়। (গোলাম আহমদ রচিত ‘‘কাশফুল গাতা’’ ৪০৩ পৃষ্ঠা) অপর এক পুস্তকে সে বলে, ‘আমি যে সব পুস্তক প্রচার করছি, তার সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছেছে। আর, আমি এগুলো মক্কা, মদিনা, কন্সান্টিনিপল, সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা, মিসর ও আফগানিস্তান সকল স্থানেই যথা সম্ভব প্রচার করেছি। এ সকল পুস্তকের ফলাফলও প্রকাশ পেয়েছে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান যারা জিহাদে (আল্লাহর পথে যুদ্ধ) বিশ্বাস করত, তারা এ অপবিত্র বিশ্বাসকে যা তাদের অন্তরে বদ্ধ মূল ছিল এবং মূর্খ আলেমগণ তাদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছিলেন তারা এখন বর্জন করেছে। এটা একটি বিরাট অবদান যা আমার কাছ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, এবং এর দ্বারা আমি সমস্ত ভারতীয় মুসলমানদের উপর গর্ব করতে পারি যে, এরূপ অবদানের দৃষ্টান্ত পেশ করতে আর কেহ সক্ষম হবে না। (গোলাম রচিত ‘‘সিতারায়ে কায়সারা’’ ৩ পৃষ্ঠা।)এই সে কাফের সাম্রাজ্যবাদীর সেবার উপর গর্বকারী ব্যক্তি আল্লাহর নবী নূহের (আঃ) উপর নিজেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বলে যে, আল্লাহ ত‘য়ালা আমার দাবির সত্যতায় এত অধিক নিদর্শনা বলী ও দলীল প্রমাণ নাযেল করেছেন; যদি এগুলো নূহের আঃ. উপর নাযেল করা হত তবে তাঁর কওমের কেহই ডুবে মরত না।’’ কিন্তু এ সকল বিরুদ্ধবাদীদের উদাহরণ হল ঐ অন্ধের ন্যায় যে উজ্জ্বল দিবসকে রাত বলে, দিন নহে। (গোলাম রচিত ‘‘তাতিম্মাতু হাকীকাতুল ওহী’’ ১৩৭ পৃষ্ঠা।)এতদ্ব্যতীত সে ঐ নবীর পেছনেও পড়েছে যার সম্মুখে রাজত্ব পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যতক্ষণ না ঐ সকল মহিলারা তার নির্দোষ ও পবিত্রতার জন্য সাক্ষ্য প্রদান করে, যারা নিজ নিজ হাত কেটে ফেলেছিল। তিনি মিসরের শাসকের স্ত্রীর সহিত অবৈধ আচরণের পরিবর্তে কারা বরণ করে নিয়েছিলেন, নবুয়তের দাবিদার মিথ্যুক লোকটি আল্লাহর এ নবীর বিরুদ্ধে লেগেছে, যার পিতাও ছিলেন নবী এবং যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘‘করীম বিন করীম বিন করীম’’ [১ সহীহ বুখারী।] মহান নবীর পুত্র, মহান নবীর পৌত্র আর তারই সম্বন্ধে বিশ্বাস ঘাতকের সন্তান বিশ্বাস ঘাতক বলে যে, ‘সে তার চেয়েও উত্তম ও শ্রেষ্ঠ’। সে এমন ব্যক্তি যে নিজ বংশের এক দরিদ্র মহিলার প্রেমে পড়েছিল এবং তাকে পাওয়ার জন্য তার পিতার দরিদ্রতা ও অভাবের সুযোগ গ্রহণ করেছিল। কখনও তাকে আশা দিত এবং কখনও তাকে ভয় প্রদর্শন করত। পুনরায় তাকে আশা দিত আবার ধমকও দিত। অতঃপর সে তার প্রেম ও ভালোবাসায় পড়ে এতই নিম্ন স্তরে চলে গিয়েছিল যে, তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে তালাক দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। কারণ সে তার প্রেমিকাকে শিকার করতে সহায়তা ও মধ্যস্থতা করেনি। এমনি ভাবে, সে তার পুত্রকেও বর্জন করে, যে তাকে তার ইচ্ছা পূরণে সাহায্য করেনি। সে দ্বিতীয় পুত্রকে তার স্ত্রী তালাক দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। কারণ, তার প্রেমিকার সাথে ঐ মহিলার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এবং সে তার ঐ সম্পর্ক দ্বারা এই মহিলার মাতা-পিতাকে বাধ্য করেনি। কেননা তার মা হলেন ঐ প্রেমিকার ফুফু। যখন তার ছেলে পিছু হটে যায় এবং ইতস্তত: করে, তখন সে তার প্রতি এই বলে সতর্ক বাণী পাঠায় যে, যদি তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক না দাও, তবে তুমি ও তোমার পূর্ববর্তী ভ্রাতার ন্যায় উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। কার্যত এ নিরীহ মেয়েটিকে বিনা অপরাধে তালাক দেয়া হয়। এখানেই সে ক্ষান্ত হয়নি, বরং নির্দ্বিধায় সে আত্মীয়তার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে যে কেহ তার বিরোধিতা করে, তাকে সে এই বলে হুমকি দেয় যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন। কেননা, আকাশের উপরেই প্রেমিকার বিবাহ তার সাথে সম্পন্ন হয়ে গেছে। যদি কেহ এই মহিলাকে বিবাহ করে তবে সে মারা যাবে এবং যে বিবাহ দিয়েছে সেও। এমনি ভাবে সে আরো বলত যে এ মহিলা বিবাহ হয়ে গেলেও বা বিধবা হওয়ার পর হলেও তার কাছে অবশ্যই ফিরে আসবে। কেননা, মহিলার ফিরে আসা এবং আমার সাথে তার বিবাহ আল্লাহর অকাট্য সিদ্ধান্ত। [২ যা বাদ পড়েনা এবং যা সংঘটিত হওয়া অনিবার্য ।] অবশেষে, এ প্রেমিক ভন্ডনবী তার এ অনুতাপ নিয়েই মৃত্যু বরণ করে। অপরদিকে তার প্রেমিকা অন্যত্র বিবাহ বসে ঘর সংসার করে এবং গোলামের অন্তর জ্বালিয়ে ও তাকে বোকা সাজিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বামীর আশ্রয়ে জীবনযাপন করে। এরূপ ব্যক্তি কি নিজেকে ইউসূফ আলাইহিস সালাম এর সাথে তুলনা করতে পারে? শুধু তুলনাই করছে না বরং তার উপর নিজেকে প্রাধান্য দিয়ে বলে, আমি এই উম্মতের ইউসুফ অর্থাৎ আমি অক্ষম ও অধম বনী ইসরাইলের ইউসুফ হতে উত্তম। কারণ, আল্লাহ তা‘য়ালা নিজে এবং অনেক নিদর্শনা বলী দ্বারা আমার পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। অথচ ইউসুফ বিন ইয়াকুব বিন ইছহাক বিন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম নিজের পবিত্রতার জন্য মানুষের সাক্ষীর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়েছেন। (গোলামের বারাহীনে আহমদিয়া।)
একজন দরিদ্র মহিলার জন্য ওহে একজন লাঞ্ছিত ব্যক্তি, ইউসুফ বিন ইয়াকুব বিন ইছহাক বিন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এ সম্মুখে তোর অবস্থান কোথায়? যে ইউসুফ আঃ. আজীজের স্ত্রী এবং শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন। ওহে জালেম ও স্বার্থপর! তুই তোরই বংশের একজন লোক থেকে সুযোগ নিতে উদ্যোগী হয়েছিলে যে তোর কাছে তার কোন ব্যাপারে সাহায্য কামনা করতে এসেছিল এবং তুই তাকে এই ভাষায় উত্তর দিয়েছিলে- ‘শ্রদ্ধেয় ভাই আহমদ বেগ, ‘‘আল্লাহ তাকে নিরাপত্তা দান করুন!’’ আমি এই মাত্র মুরাকাবা শেষ করলাম। অতপর নিদ্রা আমাকে আচ্ছন্ন করে এবং আমি স্বপ্নে দেখি, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাকে এ কথা অবগত করতে ‘‘তুমি যেন তোমার কুমারী মেয়েকে আমার নিকট বিয়ে দিয়ে দাও।’’ তা হলে তুমি আল্লাহর সমূহ মঙ্গল, বরকত, দান ও সম্মানের অধিকারী হবে এবং তোমার সকল বিপদাপদ দূরীভূত হবে। আর, যদি তোমার মেয়েকে আমার কাছে বিবাহ না দাও, তা হলে তুমি তিরস্কার ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর আদেশ তোমার কাছে পোঁছিয়ে দিলাম, যাতে তুমি তাঁর অনুগ্রহ ও সম্মান লাভ করতে পার এবং তাঁর নেয়ামতের ভান্ডার তোমার উপর খুলে যায়। তুমি জান যে, আমি তোমাকে সম্মান করি এবং তোমার সম্মুখে আদব রক্ষা করে চলি। আর আমি তোমাকে একজন খাঁটি ঈমানদার ধর্মপরায়ণ মনে করি এবং তুমি আমার কাছে অতি সম্মানিত। তোমার আদেশ পালনে আমি গর্ববোধ করি এবং তুমি যে অঙ্গীকার পত্র আমার কাছে নিয়ে আসছিলে উহাতে সাক্ষর করতে আমি প্রস্ত্তত আছি। তদুপরি, আমার সম্পূর্ণ সম্পত্তি তোমার জন্য ও আল্লাহর জন্য। আর তোমার ছেলে আজিজ বেগের জন্য পুলিশ বিভাগে চাকুরি লাভের ব্যাপারে সুপারিশ করতে আমি প্রস্ত্তত আছি। অনুরূপ, কোন এক বিত্তশালীর মেয়ের সহিত তাকে বিবাহ দিতেও তৈরি আছি’। (আহমদ বেগের কাছে গোলামের পত্র ‘‘নবীস্তায়ে গায়েব’’ পুস্তকের ১০০ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত।) আহমদ বেগের কাছে অপর এক পত্রে সে লিখেছে ‘যদি তুমি তোমার মেয়েকে আমার সহিত বিবাহ দাও, তবে আমার বাগান ও স্থাবর সম্পত্তির এক বড় অংশ তোমাকে দেব এবং তোমার মেয়েকে আমার সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দান করব। আমি সত্যই বলছি। তুমি যা চাইবে তাই দেব। আমার মত আত্মীয়তা রক্ষাকারী আর কোন লোক তুমি পাবে না’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’’ ৫৭৩ পৃষ্ঠা)
যখন সে দেখল যে, তার এ সকল উৎসাহ ও আগ্রহ দান বাতাসের সহিত মিশে গেছে তখন সে রাগে জ্বলে উঠে এবং তার ছেলের শ্বশুর আলী শের বেগের কাছে লিখল, যিনি আহমদ বেগের ভগ্নীপতি, সম্মানিত আলী শের বেগ, আমি শুনতে পেলাম যে, আহমদ বেগ তার মেয়েকে আমার নিকট বিবাহ দিতে চায় না, বরং আমি ছাড়া অন্য কারো নিকট বিবাহ দিতে ইচ্ছুক। আমি আশা করি, তোমার আত্মীয়তার সুবাদে তুমি এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করবে। আর তাদেরকে আমার কাছে ঐ মহিলাকে বিবাহ দিতে বাধ্য করবে। আমি কি কোন ঝাড়ুদার বা নীচ বংশের লোক, যে কারণে তারা আমাকে ছেড়ে অন্যের কাছে মেয়েটিকে বিবাহ দেবে? ইতিপূর্বে তোমার স্ত্রীর কাছেও একটা রেজিষ্টারী পত্র লিখেছি, সে যেন তার ভাইকে বাধ্য করে। কিন্তু সে আমার পত্রের উত্তর দেয়নি। বরং আমি শুনেছি যে, সে আমার সম্পর্কে বলে: এ ইতর ব্যক্তি মৃত্যুর নিকটবর্তী হয়েও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে। তার জন্য আমরা কিছুই করতে পারব না। (এ সময় তার বয়স ছিল পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে এবং সে বিভিন্ন ব্যাধি যথা হিষ্ট্রিয়া, মস্তিষ্ক বিকৃতি, ডায়বেটিক ও প্যারালাইসেস রোগে আক্রান্ত ছিল।) এখন আমি তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে লিখছি যদি তোমরা আমাকে সাহায্য না কর এবং আহমদ বেগ ঐ মেয়েকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেয়, তবে যে দিন ঐ মেয়ের বিবাহ হবে সে দিনই আমার পুত্র ফজল আহমদের সাথে তোমাদের যে মেয়ের বিবাহ হয়েছে, তার তালাক নামা তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। (আলী শেরের নিকট লিখিত গোলামের পুত্রের সার সংক্ষেপ, ২মে ১৮৯১ খৃ:।) কার্যত: এ মেয়েটির বিবাহ হওয়ার পরপরই শের আলীর মেয়ের তালাক হয়ে যায়। আর তার দ্বিতীয় পুত্র উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়। কেননা এ মহিলার আত্মীয় স্বজনের সাথে তার পিতার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও সে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। যেমনি ভাবে, গোলাম তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে ঐ একই কারণে তালাক দিয়েছিল, যেহেতু সে তার এ কাজে সাহায্য করেনি।(গোলামের পুত্র বশীর আহমদ লিখিত ‘‘সীরাতে মাহদী’’ ১ম খন্ড ২২পৃষ্টা।)
আর আমাদের আলোচ্য এ পাগলটি বিরহ বিচ্ছেদের ময়দানে অস্থির ও হায় হুতাসে পড়ে রইল। ঐ মহিলার স্বামী সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক ছিল, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে সে নিজেকে প্রতারিত করতে লাগল। যেমন, সে তার এক পত্রে লিখছে: ‘আমি আল্লাহর নিকট বিনয় ও আহজারীর সহিত প্রার্থনা করি। তখন আমার কাছে ইলহাম (ঐশী বাণী) হল- ‘অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শন দেখাব, ঐ মেয়েটি বিধবা হয়ে যাবে এবং তার স্বামী ও পিতা তিন বছরের মধ্যে মারা যাবে। আর, ঐ মহিলাটি তোমার কাছে ফিরে আসবে। এটা কেহই বাধা দিয়ে ঠেকাতে পারবে না’’। (ইলহামুল গোলাম ‘‘নবীস্তায়ে গায়েব’’ থেকে উদ্ধৃত।)
আল্লাহর কুদরত যে, তরবারি ও আগুনের ছায়াতলে জীবন যাপনকারী সেই লোকটি মারা যায়নি, যেমনটা ভন্ডনবী আশা করেছিল। বরং এই জ্ঞান-হারা প্রেমিক তার সকল স্বপ্ন ও অমূলক আশা নিয়ে মারা গেল এবং তার সফল প্রতিদ্বন্দ্বী তার মৃত্যুর পর কয়েক দশক পর্যন্ত বেঁচে রইল। এমন এক ব্যক্তি ঐ লোকের সাথে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দাবি করছে যার পবিত্রতা সম্পর্কে শহরের মহিলাগণ সাক্ষ্য প্রদান করছিল। তাদের শীর্ষে ছিলেন আজীজের স্ত্রী। তাদের উক্তি ছিল: ‘‘আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা, আমরা তাঁর সম্পর্কে খারাপ কিছু জানি না ।’’ আজীজের স্ত্রী বললেন, এখন সত্য প্রকাশিত হয়ে গেছে, আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলাম, আর তিনি নিশ্চয়ই সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। [১ সুরা ইউসুফ ৫১] তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তিনি আমার নিষ্ঠাবান বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত।’’ [১ সুরা ইউসুফ ২৪] আর তাকে রাজত্ব ও জ্ঞান [২ সুরা সুরা ইউসুফ ২১ নং আয়াতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।] সহ আল্লাহ তাআলা স্বপ্নের ব্যাখ্যা [৩ সুরা ইউসুফ ২১ নং আয়াতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।] করার যোগ্যতা দান করেছেন এবং বিশ্বস্ত বন্ধু [৪ সুরা ইউসুফের ৪৬ ও ৫৪ নং আয়াতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।] ও আমীন উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
এখন আমি আরও উল্লেখ করছি যে, সে নিজেকে এমন মনীষীর উপর প্রাধান্য দিয়েছে, যার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘‘মরিয়মের পুত্র ঈসাকে আমি স্পষ্ট প্রমাণাদি দান করেছি এবং রুহুল কুদুস অর্থাৎ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি’’ [৫ সুরা বাকারা ৮৭] ‘‘নিশ্চয়ই, মরিয়াম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসূল ও তাঁর বার্তা যা মরিয়মের নিকট পাঠিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর আদিষ্ট রূহ।’’ [৬ সুরা নিসা ১৭১] ঈসার আলাইহিস সালাম ভাষায় আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন- ‘‘আমি আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ আমাকে কিতাব প্রদান করেছেন, এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আর আমি যেখানেই থাকি আমাকে বরকতময় করেছেন। আমাকে নামাজ ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন যে পর্যন্ত আমি জীবিত থাকি এবং আমাকে আমার মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ করেছেন আমাকে অত্যাচারী ও হতভাগা করেন নি। আমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব, আর যেদিন আমাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে’’। [৭ সুরা মরিয়াম ৩০-৩৩] আর এই ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এই তুচ্ছ বান্দা [৮ এই গুণ দ‘টি গোরাম তার নিজের জন্য ব্যবহার করেছে। পূর্বে যেরূপ বর্ণিত হয়েছে।] (কাদিয়ানী) বলে: আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের মধ্যে এমন একজন মাসীহ পাঠিয়েছেন, যার মর্যাদা প্রথম মাসীহ হতে অনেক উচ্চে। আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, যে যুগে আমি জীবন যাপন করছি, সেই যুগে যদি ঈসা আলাইহিস সালাম বর্তমান থাকতেন; তবে, আমি যা করছি তিনি তা করতে পারতেন না।(‘‘আমি যা করছি’’ এর দ্বারা যদি সাম্রাজ্যবাদীদের এবং কাফেরদের দাসত্ব উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে ঠিকই আছে।) এবং আমি যে সকল নিদর্শনা বলী ও ঘটনাবলী প্রকাশ করছি, তা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হত না। ( গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘হাকীকতে ওহী’’ ১৪৮ পৃষ্ঠা।) সে আরো বলেছে: ‘‘মরিয়াম পুত্র ঈসা আমা হতে, আর, আমি আল্লাহ হতে। সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যে আমাকে চিনতে পেরেছে এবং দুর্ভাগা সেই ব্যক্তি যার চক্ষুর আড়ালে আমি রয়েছি’’। (মাকতুবাতে আহমদিয়া ৩য় খন্ড ১১৮ পৃষ্ঠা।) আর, তার পুত্র বলে যে, ‘‘আমার পিতা বলেছেন- ‘তিনি আদম, নূহ ও ঈসা আলাইহিস সালাম থেকে শ্রেষ্ঠ’। কেননা, শয়তান আদমকে বেহেস্ত থেকে বের করে দিয়েছে, আর তিনি আদম সন্তান কে বেহেস্তে প্রবিষ্ট করবেন। ঈসাকে ইহুদীরা শূলবিদ্ধ করেছে এবং তিনি শূল ভাঙবেন। তিনি নূহ আলাইহিস সালাম হতে ও উত্তম। কেননা, তার বড় ছেলে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়েছে; কিন্তু তার পুত্র (গোলামের) হেদায়েতে প্রবেশ করেছে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের বক্তৃতার সার সংক্ষেপ, ‘যা আল ফযল পত্রিকায়’ ১৮ জুলাই ১৯৩১ খৃ: সংকলিত।)
মুহাম্মদ আহসান নামক জনৈক কাদিয়ানী মুবাল্লেগ লিখেছে: পূর্বেকার ‘উলুল আজম’ বা নেতৃস্থানীয় দৃঢ় সংকল্প রাসূলগণের কেহই এমন পর্যায়ের ছিলেন না যিনি আমাদের ইমাম মাসীহে মাওউদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন। হাদীসে ‘‘আছে যদি ঈসা ও মুসা জীবিত থাকতেন তবে আমার অনুসরণ করা ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর থাকত না।’’ [১ এ হাদীসে ঈসা আঃ কে অতিরিক্ত যোগ করা হয়েছে। অথচ হাদীূসের কোন কিতাবেই এরূপ নেই। কাদিয়ানীরা এ হাদীস দিয়ে ঈসা আঃ এর মৃত্যু প্রমানিত করার জন্য দলীল পেশ করে। আঃ] কিন্তু আমি বলি, যদি মুসা ও ঈসা আমাদের ইমামের যুগে জীবিত থাকতেন, তা হলে তার অনুসরণ ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকত না’। (আল-ফজল, ১৮ই মার্চ ১৯১৬খৃঃ)
এ ঘৃণ্য দুঃসাহসিকতার প্রতি লক্ষ্য করুন। কীভাবে নবী রাসূলগণের (তাদের ও আমাদের রাসূলের উপর হাজার হাজার সালাম) অবমাননা ও হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে? কেমন করে একজন দাজ্জাল ও মিথ্যুক নিজের ও আল্লাহর মনোনীত মহাপুরুষগণের মধ্যে তুলনার দাবিকরে? তার শয়তান তাকে এ কথা বলতেও উদ্যত করেছে যে, অনেক নবী আগমন করেছেন কিন্তু কেহই আল্লাহর মা’ রেফাতে আমার অগ্রগামী হতে পারেন নি। সকল নবীগণকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, সম্পুর্নরুপে তা একাই আমাকে দেয়া হয়েছে, । (গোলামের দুরের ছামীন ১৮৭ ও ১৮৮ পৃষ্ঠা।)সে আরো বলে: যে সমস্ত গুণাবলি সকল নবীগণের মধ্যে পাওয়া যেত, রাসুলৃল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে সে সব গুণাবলি বরং এরও অধিক বিদ্যমান ছিল। এরপর এ সকল যোগ্যতা আমাকে প্রদান করা হয়। এ কারণেই আমার নামকরণ করা হয়েছে আদম, ইব্রাহীম, মুসা, নূহ, দাউদ, ইউসুফ, সুলাইমান, ইয়াহইয়া ও ঈসা’। (মালফুজাতে আহমদিয়া ৪থ খন্ড ১৪২ পৃ:) এর চেয়ে অধিক জঘন্য ব্যাপার হল, যেহেতু গোলাম আহমদের মধ্যে সকল প্রকার কুকর্ম ও মন্দ স্বভাব বিদ্যমান ছিল, কাজেই, সে নবী রাসূলগণকে এ সকল কুকর্মের দ্বারা কলুষিত করতে উদ্যত হয়। তার অভ্যাস উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে মদ্যপায়ী ছিল। এ কারণেই, সে আল্লাহর নবী ঈসা আঃ এর উপর এ অপবাদ আরোপ করে বলেছে, ‘‘আমার অভিমত হল মাসীহও মদ্য-পান হতে পবিত্র ছিলেন না।’’ (রিভিউ ১ম খন্ড ১২৩ পৃ: ১৯০২ খৃ:) ‘মাসীহও নিজেকে সৎ বলতে সক্ষম ছিলেন না। কেননা, লোক তাকে মদ্যপায়ী ও ফিতনা সৃষ্টিকারী বলে জানত। (গোলামের ‘‘সৎ ভাজন’’ হাসিয়া ১৭২ পৃষ্ঠা।) আরবী ভাষায় একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে: ‘‘মানুষ নিজের উপর অন্যকে ক্বিয়াস করে’’ তাই , সে বলেছে: ‘মাসীহ মদ্য-পান করতেন। কোন অসুখের কারণে অথবা তার পুরাতন অভ্যাস অনুযায়ী। (গোলামের ‘‘সাফিনায়ে নূহ’’ ৬৫ পৃষ্ঠা।) তার অভ্যাস ছিল, রাতের অন্ধকারে গায়ের মুহাররম রমণীদের সাথে সে মেলামেশা করত। এ চরিত্রের বৈধতা প্রমাণের জন্য সে আল্লাহর নবী ঈসার আলাইহিস সালাম প্রতি অপবাদ আরোপের আশ্রয় নেয়। কাজেই, সে একান্ত নির্লজ্জভাবে বলেছে: ঈসার আলাইহিস সালাম পরিবার এক অদ্ভুত পরিবার। তার তিন মাতামহী ছিলেন দুশ্চরিত্র ব্যভিচারিণী। এ পবিত্র রক্ত? হতে ঈসার সৃষ্টি। হয়তো এ কারণেই ঈসা ব্যভিচারীদের প্রতি আসক্ত ছিলেন। নচেৎ কোন খোদা ভীরু ব্যক্তি ব্যভিচারিণী যুবতীকে তার মাথা স্পর্শ করতে এবং তার অবৈধ সম্পদ দ্বারা আতর লাগাবার অনুমতি দিতে পারে না। অতএব, মানুষের বুঝা উচিত যে, এ মাসীহের চরিত্র কেমন ছিল। (গোলাম রচিত ‘‘আঞ্জামে আথমের’’ পরিশিষ্ট ৭ পৃষ্ঠা।) জানি না, কোথায় লজ্জা ও কোথায় ভদ্রতার অবশিষ্ট অংশ রয়েছে। এটা কি সম্ভব যে কোন ভদ্র ব্যক্তিকে এরূপ অপবাদ দেয়া যায়? বিশেষ করে, যাকে অপবাদ দেয়া হয়েছে তিনি হলেন আল্লাহর এমন নবী যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত ফেরেশতার মাধ্যমে পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছেন ‘‘আমি তোমার প্রভুর দূত, আমি তোমাকে পবিত্র একটি ছেলে দান করতে এসেছি’’। [১ সুরা মারয়াম ১৯] এই যে বিশ্ববাসীর প্রভু সবচেয়ে সত্যবাদী সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিষ্পাপ। অতএব, হে পাপিষ্ঠ! তুই কি করে এ দুঃসাহসিকতা দেখাতে সাহস পেলি যে আল্লাহর কথার বিরোধিতা করছিস। অথচ, তুই তো এমন ব্যক্তি যে পর নারীদের সাথে মেলামেশা করছিস এবং রাতের অন্ধকারে তাদেরকে তোর হাত-পা দাবিয়ে দিতে নির্দেশ দিচ্ছিস।
প্রকাশ থাকে যে, স্বয়ং আল-ফজল পত্রিকা সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং স্বীকার করছে ও বলছে- ‘মাসীহে মওউদ গোলাম আহমদ নবী ছিলেন। তাই, নারীদের সাথে তার মেলামেশা, স্পর্শ করা এবং তার হাত পা দাবিয়ে দিতে আদেশ করাতে কোন দোষ নেই। বরং এটা ছওয়াব, রহমত ও বরকতের কারণ’। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজল’ ২০ মার্চ ১৯২৮ খৃ:) আর. তুমিই বলেছ যে, ‘বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বড়দের উপর দোষারোপ করা, তাদের সমালোচনা করা এবং তাদের নিন্দা করা জঘন্য ও নিকৃষ্ট কাজ’। (গোলামের বারাহীনে আহমদিয়া ১০২ পৃ:) যে সকল নীতি তুমি নিজেই রচনা করেছ এবং যে সকল আইন তুমিই নির্ধারণ করেছ, এর আলোকে তুমি কি হবে? সুতরাং তোমার ব্যাপারে তুমি যা বলেছ, তাছাড়া আমরা আর কিছু বলতে চাই না। কেননা আমরা গালি গালাজ থেকে পবিত্র। যদিও সে দাজ্জাল হয় এবং নবী রাসূলগণকে গালি দেয়। এখন আমরা তোমার কিতাব থেকে, তোমার ভাষ্য হতে, এবং তোমার নিজ শব্দে তোমার কাছে উপহার পেশ করছি- ‘যে ব্যক্তি পবিত্র ও নেককার লোকজনকে গাল মন্দ করে, সে খবীছ, অভিশপ্ত ও ইতর ব্যতীত আর কিছু নহে। (আল-বালাগুল মুবিন ১৯ পৃ:) এর পর সে আরো বড় অপরাধের দিকে অগ্রসর হয়। আর এ সমস্ত বিরাট অপরাধের চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ হল যে, সে এমন ব্যক্তিত্বের উপর আক্রম করেছে, যিনি সমস্ত সৃষ্টির সারাংশ, সকল অস্তিত্বের গৌরব, নবী রাসূলাগণের প্রধান, যার সম্পর্কে সকল রাসূল সুসংবাদ দিয়েছেন। এবং যার জন্য আল্লাহ পাক সকল নবী হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি আল্লাহর রসুল এবং সর্ব শেষ নবী। (আমার প্রাণ ও আমার মাতা-পিতা তার উপর উপর উৎসর্গ। তার উপর দরুদ ও সালাম) এ দাজ্জাল বলে যে , নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিন হাজার অলৌকিক ঘটনা রয়েছে; কিন্তু আমার অলৌকিক ঘটনাবলীর সংখ্যা এক মিলিয়নেরও অধিক’। (গোলামের ‘‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন ৪১ পৃ:) সে অ রো বলে, আমাকে যা দেয়া হয়েছে তা বিশ্ব জগতের আর কাউকে দেয়া হয়নি। (গোলামের হাকীকাতুল ওহীর পরিশিষ্ট।) এতদ্ব্যতীত তার ছেলে ও দ্বিতীয় খলীফা বলেছে- আমাদের ইমামের পয়গাম্বরী জ্ঞান নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জ্ঞান থেকে বহু ঊর্ধ্বে ছিল। (নাউযু বিল্লাহ) কেননা, সভ্যতার দিক দিয়ে বর্তমান যুগ সে কাল হতে বহু উন্নত। আর, এটা হল বিশেষ ক্ষেত্রের প্রাধান্যতা যা গোলাম আহমদ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর লাভ করে। (কাদিয়ানী রিভিউ, মে ১৯৪৯ ইং।) এ বিষয়ের উপর আমি একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লিখব। এখন আমি এ আলোচনাকে তার নিজেরই একটি বক্তব্যের উপর শেষ করছি। যাতে তারই উক্তি তারই বিরুদ্ধে ডিগ্রি প্রদান করে। সে বলেছে: ঐ ব্যক্তি কাফের যে কোন নবীর অবমাননা করে’ এবং ‘যে ব্যক্তি এমন শব্দাবলি ব্যবহার করে যদ্দারা স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ভাবে কোন ধর্মীয় নেতার অবমাননা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাকে আমরা বড় খবীছ ও নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে বিবেচনা করি’। (কাদিয়ানী নবুয়তের দাবিদার গোলামের ‘‘অইনুল মারেফাত’’ ১৮ পৃ: এবং ‘‘বারাহীনে আহমদীয়া’’ ১০৯ পৃ:।) আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে মুসলমানরুপে জীবিত রাখেন এবং মুসলমানরুপে মৃত্যু দান করেন। আমীন।
তিনি আরো বলেছেন ‘‘সাহচর্য ও সম্পদের দিক দিয়ে সকল লোকের মধ্যে আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুগ্রহশীল হলেন আবু বকর। যদি আমি কাউকে একক আন্তরিক বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম তবে আবু বকরকেই গ্রহণ করতাম। তবে আমাদের মধ্যে রয়েছে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। এ মসজিদে আবু বকরের দরজা ছাড়া আর কারো দরজা খোলা থাকবে না ’’ [৪ বুখারী ,মুসলিম, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে দারমী, মুসনাদে আহমদ।]। দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ‘‘আমার পর যদি কোন নবী হতেন তা হলে তিনি উমরই হতেন’’ [৫ মুসনাদে আহমদ, তিরমিজী।] ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ওমরের মুখে ও অন্তরে সত্য বিদ্যমান রেখেছেন’’ [৬ আবু-দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও আহমদ।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: শয়তান তোমাকে কোন পথে চলতে দেখলে সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে যায়’’। [৭ বুখারী, মুসলিম, ও মুসনাদে আহমদ।] নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘বেহেস্তে তিনি ওমরের প্রসাদের কাছেই নিজেকে দেখেছেন।’’ [৮ বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী ও মুসনাদে আহমদ।] এ সকল পুণ্যবান লোকদের মোকাবেলায় সে (কাদিয়ানী) গর্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এ ব্যক্তিটিই বা কে? নেশাখোর, মদ্যপায়ী ও প্রতারক এক ব্যক্তি । আমি নিজ থেকে তাকে এ সকল গুণ দ্বারা কখনও অভিযুক্ত করছি না, বরং কাদিয়ানীরা তার এ সব গুণ উল্লেখ করেছে। গোলামের পুত্র তার দ্বিতীয় খলীফা বলেছে: ঔষধের মধ্যে আফিম অধিকাংশ ব্যবহার করা হয়। আমার পিতা বলতেন যে, আফিম হল চিকিৎসা ব্যবস্থার অর্ধেক। কাজেই ঔষধরূপে ইহার ব্যবহার বৈধ এবং তাতে কোন দোষ নেই। আমার পিতা আল্লাহর নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে তিরইয়াকে এলাহী নামক একটি ঔষধ তৈরি করছিলেন, যার বড় অংশ ছিল আফিম। ঐ ঔষধ তিনি তার খলীফা নুরুদ্দীনকে দিতেন। তিনি ও বিভিন্ন রোগের জন্য সময় সময় তা ব্যবহার করতেন’। (মাহমুদ আহমদের ‘‘আল- ফজল’’ পত্রিকায় প্রকাশিত ১৯ জুলাই ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ।) দেখুন, তার স্বীকারোক্তি, প্রতারণা ও ধৃষ্টতা। সে কেমন করে আফিমকে হালাল করতে চায় এবং জন সাধারণকে দিয়ে বলে, সে আল্লাহর নির্দেশে ইহা ব্যবহার করছে। অথচ, মুহাম্মদের রব বলছেন ‘‘হারামের মধ্যে আরোগ্য নেই।’’ আর এটা কীরূপ হারাম? যে হারাম থেকে সাধারণ মানুষও ভয় পায়। এ লোকটি কেমন করে নবুয়তের দাবিকরে এবং ঐসকল লোকদের মোকাবিলায় গর্ব করে যারা এ সকল ঘৃণিত অপবিত্র বস্ত্ত থেকে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র লোক ছিলেন। অপর এক কাদিয়ানী এ ভাবে সাক্ষ্য প্রদান করেছে যে, এ ভন্ডনবী আফিমখোর কি না তা সে জানে না। সে একজন প্রেসের মালিক। সে বলেছে যখন গোলাম প্রথম বারের মত আমার প্রেসে আসল এবং চেয়ারে বসে ঐ পুস্তক সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল যা সে ছাপাতে চায়, তখন তার মোদিত নিদ্রা মগ্ন চক্ষু-দ্বয় দেখে বুঝতে পারলাম যে, সে ভাং অথবা আফিম ব্যবহার করে। যেমন, সে সময়কার বড় লোকেরা ব্যবহার করত। কিন্তু এখন আমি বুঝলাম, যে নেশা তার মধ্যে আমি দেখেছিলাম তা আফিম বা ভাং এর নেশা নহে বরং তা ছিল আল্লাহর মা‘রেফাতের নেশা। (আল-ফজল পত্রিকায় নুর আহমদের বর্ণনা, ২০ আগস্ট ১৯৪৬ খৃ:) আর মদ সম্পর্কে গোলাম আহমদ লাহোরে তার এক মুরিদের কাছে লিখেছিল, বলুমর নামক ব্যক্তির দোকান থেকে ওয়াইন (মদ) কিনে তার কাছে যেন পাঠায়। মুরিদ যখন বলুমরকে জিজ্ঞেস করল ওয়াইন কি? বলুমর উত্তর দিল ইহা এক প্রকার শক্তিশালী নেশাদার মদ যা সীল করা বোতলে ইংলান্ড থেকে আমদানি করা হয়। (কাদিয়ানী ডাক্তার মুহাম্মদ হুসাইনের ‘‘মাকতুবুল ইমাম বিইসমিল গোলাম’’ ৫পৃষ্ঠা এবং ডাক্তার মুহাম্মদ আলী আল-মুসলিমের লিখিত ‘‘জুনুনুল গোলাম’’ ৩৯ পৃষ্ঠা) অপর একজন কাদিয়ানী ডাক্তার বসারত আলী আমাদের কথার সত্যতা স্বীকার করে এবং সাক্ষ্য প্রদান করে বলেছে যে, গোলাম আহমদ মদ পান করত। সে আরো বলেছে যে, অসুস্থ অবস্থায় ‘বরান্ডি’ ও ‘র্যাম্প’ [১ বরান্ডি ও র্যাম মদের দু‘টি প্রকার।] ব্যবহারে কি অসুবিধা থাকতে পারে এবং রোগের কারণে আমার ইমাম যদি তা ব্যবহার করেন বা কাউকে ব্যবহার করার অনুমতি দেন তবে তাতে দোষ কি? আর এটা সকলের জানা কথা যে, তিনি একজন দুর্বল লোক ছিলেন, তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত। কখনও নাড়ির স্পন্দন লোপ পেয়ে যেত । এ সকল অবস্থায় যদি তিনি মদ্য-পান করেন তবে তা শরীয়ত বিরোধী নহে বরং এটাই শরীয়ত। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘পয়গামে সুন্নাহ’’ ১৩মার্চ ১৯৩৫ খৃ:) আল্লাহ পানাহ, আল্লাহ পানাহ! এ সকল ওজর আপত্তি হতে। তবে, কেন স্পষ্ট বলা হচ্ছে না যে, গোলাম আহমদ আমাদেরকে যে শরীয়ত প্রদান করেছে উহাতে মদ্য-পান বৈধ। নবুয়তের চাদর চুরি, এবং হযরত আবু বকর ও ওমরের সম্মান হরণের মত জঘন্য অপরাধের পর মদ্য-পানের স্বীকারোক্তিতে আর কি দোষ আছে? হাঁ ওমর এমন সম্ভ্রান্তশীল মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন যিনি মদ্য-পান নিষিদ্ধ হওয়ার উপর বার বার জোর দিতেন। অবশেষে, মহান আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করলেন, ‘‘নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজা ও লটারির তীর অপবিত্র ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা এগুলো থেকে বিরত থাক, অবশ্যই তোমরা সফলকাম হবে।’’ [২ সুরা মায়েদা- ৯০] এই সে দালাল ও অপমানিত গোলাম যে তার ভক্তদেরকে বাইয়াত কালে এ শর্তারোপ করত তারা যেন কাফের ইংরেজ সরকারের অনুগত ও সেবক হয়। [১ গোলাম কাদিয়ানীর দামীমা পুস্তকের বারিয়াহ অধ্যায়ের ৯ নং পৃষ্ঠা] সে নিজেকে এমন দু‘জন শহীদ ইমামের উপর প্রাধান্য দেয়, যাদের জন্য স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে অবতরণ করে তাদেরকে উঠিয়ে নিতেন এবং তাদেরকে সম্মুখে রেখে খুতবা দিতেন। [২ তিরমিজী, নাসায়ী, মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ]
আর যাদের সম্পর্কে নবী করীম বলেছেন ‘‘বেহেস্তবাসী যুবকদের সর্দার হলেন হাসান ও হুসাইন।’’ [৩ তিরমিজী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ।] শুধু তা নহে বরং এ জঘন্য মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী কোন কোন সাহাবীকে বোকা বলত। সে বলত যে, হযরত আবু-হুরাইরা রা. নির্বোধ ছিলেন, তার সঠিক বোধশক্তি ছিল না। (গোলামের ‘‘এজাজে আহমদী’’ ১৮পৃষ্ঠা) সে আরো বলেছে: কোন কোন সাহাবী ছিলেন নির্বোধ। (‘নছরুল হক’ এর পরিশিষ্ট ১৪০ পৃষ্ঠা) প্রকৃতপক্ষে, সে নিজেই ছিল বোকা ও মূর্খ। সে নিজেই তার সম্পর্কে বলেছে, ‘আমার স্মরণ শক্তি খুবই খারাপ’। যে ব্যক্তি কয়েকবার আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছে, তাকেই আমি ভুলে যাই। এ অবস্থা এত দুর পর্যন্ত পৌঁছেছে যা বর্ণনা করা সম্ভব নহে। (মাকতুবাতে আহমদিয়া ৫ম খন্ড ২১পৃষ্ঠা।) কার্যত: তার নির্বোধতা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, সে কাপড় উল্টো পরিধান করত। নীচের অংশ উপরে এবং উপরের অংশ নীচে, ডান পায়ের জুতা বাম এবং বাম পায়ের জুতা ডান পায়ে পরত। তার বোকামী এ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ইস্তেঞ্জার জন্য তার পকেটে রাখা মাটির ঢেলা সে মিষ্টি মনে করে খেয়ে ফেলত। এই তো তাদেরই স্পষ্ট বক্তব্য, তার পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানী বলে যে, ডাঃ মুহাম্মদ ইসমাইল কাদিয়ানী আমাকে বলেছেন: ‘আমাদের ইমাম এতই সাধাসিধে ছিলেন, কথনও কখনও তিনি পাঁয়তারা পরিধান করতে গিয়ে পাঁয়তারার গোড়ালির দিকটাকে পায়ের উপরের দিকে রেখে দিতেন, বোতামকে সোজা ছিদ্রিতে না লাগিয়ে কখনও নীচের বোতামকে উপরের ছিদ্রিতে এবং উপরের বোতামকে নীচের ছিদ্রিতে লাগাতেন। কখনও তার কোন বন্ধু কোন পরিধান বস্ত্র হাদিয়া স্বরূপ নিয়ে আসলে সে উহার ডান বাম বুঝতে পারত না। এ জন্যই সে এমন জুতা পছন্দ করত যার ডান বামে কোন পার্থক্য নেই। খাওয়ার বেলায় ও তার এ অবস্থা ছিল। সে নিজেই বলত যে ‘আমি কি খাচ্ছি তা আমি অনুভব করি না। তবে কোন কঙ্কর বা শক্ত কিছু দাঁতে ঠেকলে তা অনুভব করা যায়। (বশীর আহমদ কাদিয়ানীর ‘‘সীরাতে মাহদী’’ ২য় খন্ড ৫৮ পৃষ্ঠা) তার জনৈক ভক্ত কাদিয়ানী আলেম লিখেছে যে, গোলাম আহমদ গুড় পছন্দ করত এবং সে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত ছিল। সে পকেটে মাটির ঢেলা রাখত যেমন করে গুড়ের চাকা সে পকেটে রাখত; কারণ সে উহাকে খুব পছন্দ করত। তাই কোন কোন সময় সে মাটির ঢেলাকে গুড়ের চাকা মনে করে খেয়ে ফেলত। (বারাহীনে আহমদিয়ার পরিশিষ্টে ‘‘আহ-ওয়ালুল গোলাম বিতারতীবে মে‘রাজুদ্দীন’’ ১ম খন্ড ৬৭ পৃষ্ঠা।) এমন বোকা ও নির্বোধ লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণকে নির্বোধ বলে! শুধু তাই নহে বরং সে নিজেকে শেখাইন আবু বকর ও ওমর রা. ও সকল সাহাবীর উপর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। এখন আমরা তার কিছু ভ্রমাত্মক বক্তব্যের বর্ণনা দিচ্ছি। সে নবী রাসূলগণের উপরও নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে বাদী করে। সে নিজেকে আদম আলাইহিস সালাম এর উপরও প্রাধান্য দিয়ে বলছে ‘আল্লাহ তা‘য়ালা আদম আলাইহিস সালাম কে সৃষ্টি করে অনুসরণীয় সরদার বানিয়েছেন, আর, তাকে প্রত্যেক প্রাণীর উপর প্রধান ও শাসক নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহর বাণী ‘‘আদমকে তোমরা সেজদা কর’’ দ্বারা তা প্রমাণিত। অতঃপর শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করে বেহেস্ত থেকে বের করে ফেলে। তাই, ক্ষমতা শয়তানের কাছে চলে যায়, আর আদম লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়ে পড়েন..........। তারপর শয়তানকে পরাজিত করার জন্য আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। কুরআনে আল্লাহপাক এরই প্রতিশ্রুতি ও দিয়েছেন। (গোলাম রচিত ‘‘মালফরকু ফি আদম ওয়াল মাসীহুল মাওউদ’’।) সে বলে ‘আল্লাহ আমাকে আদম রূপে সৃষ্টি করেছেন। এবং আদমকে যাহা কিছু দিয়েছেন তা আমাকেও দিয়েছেন। কেননা, আদিতে আল্লাহ পাক এমন আদম সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন, যে হবে সর্বশেষ খলীফা। যেমনিভাবে তিনি আদিতে প্রথম খলীফা সৃষ্টি করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন’। (গোলামের খুতবায়ে ইলহামী ১৬৭ পৃষ্ঠা) মাহমুদ আহমদ এ কথাকে আরো স্পষ্ট করে বলেছে- আল্লাহ তা‘য়ালা ফেরেস্তাগণকে আদমের অনুগত সেবক হতে নির্দেশ দিলেন। প্রথমের জন্য যেহেতু এ নির্দেশ দেয়া হয়, তবে প্রতিশ্রুত মাসীহ দ্বিতীয় আদম যিনি মর্যাদার দিক দিয়ে প্রথম আদম থেকেও শ্রেষ্ঠ তার বেলায় কেন বলা যাবে না যে, এ আগুন তোমার দাস বরং তোমার দাসের দাস হোক। (মাহমুদ আহমদের ‘‘মালাইকাতুল্লাহ’’ ৬৫ পৃষ্ঠা।) আর সে নিজেকে আল্লাহর সেই মহান নূহ আলাইহিস সালাম নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করে, যিনি স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘ সাড়ে নয়শো বছর অবস্থান করেছেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করতেন, উপদেশ দিতেন এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করতেন। (যিনি আল্লাহর পথে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন।) যাকে আল্লাহর পথে অনেক কষ্ট দেয়া হয়েছে এবং কঠিন পরীক্ষা করা হয়েছে। এটা তাঁর ব্যক্তি সার্থে নহে এবং সম্পদ ও সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে নহে, বরং আল্লাহর দ্বীনকে সুমহান করার কাজে তাকে সহ্য করতে হয়েছে। তিনি সেই মনীষী ছিলেন যিনি তার সম্প্রদায়কে সম্বোধন করে বলেছিলেন ‘‘.হে আমার কওম, আমি এ কাজের উপর তোমাদের নিকট থেকে কোন সম্পদ চাচ্ছি না , এর বিনিময় একমাত্র আল্লাহই আমাকে দিবেন।’’ [১ সুরা হুদ-২৯] এমন ব্যক্তির উপর ঐ লোক নিজেকে প্রাধান্য দিচ্ছে যে সাম্রাজ্যবাদীদের সেবা করত এবং ইংরেজের দাসত্ব করত, আর, একেবারে স্পষ্ট ও নির্লজ্জ ভাবে তার সাথে নিজ সেবার বিনিময়ের প্রত্যাশী ছিল। তাইতো দেখা যায়, একদা সে তার বিরাট খেদমতের কথা উল্লেখ করার পর বড়লাটের কাছে তোষামোদ স্বরূপ বলে- আঠারোটি বছর অতিবাহিত হল আমি ঐ সব পুস্তক রচনায় রত ছিলাম, যেগুলো মুসলমানদের অন্তরে তোমাদের প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য ও বন্ধুত্ব ভাব সৃষ্টি করবে, অথচ অধিকাংশ আলেম এ সকল কারণেই আমাকে ঘৃণা করছে এবং এ সকল মতামতের উপর ক্রোধের কারণে তাদের অন্তর জ্বলছে।
কিন্তু আমি জানি যে তারা মূর্খ, তারা এ কথা জানে না যে, যারা মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানে না তারা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং অবদানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সমতুল্য। এটাই হল আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু বড়ই আক্ষেপ, যে সমস্ত পুস্তক সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ উহার প্রতি আমাদের দয়াল সরকার গুরুত্ব সহকারে দৃষ্টিপাত করেন নি। অথচ আমি অনেকবার তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এখন আমি আপনাদেরকে আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আপনারা যেন আমার এ দরখাস্তে উল্লেখিত পুস্তক সমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং উহার চি হ্নত স্থান ও উল্লেখিত পৃষ্ঠাগুলো বিশেষভাবে পাঠ করেন। ইংরেজ সরকারের গুরুত্ব সহকারে ভাবিয়া দেখা উচিত যে, এ সকল অবিরাম চেষ্টা সাধনা যা দীর্ঘ আঠারো বছর যাবৎ চালিয়ে যাওয়া হয়েছে শুধু ইংরেজ সরকারের আনুগত্যের প্রতি মুসলমানদের মুখ ফিরিয়ে আনা, তাদের অন্তরে এ সরকারের আনুগত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, এবং বহির্বিশ্বে ইংরেজ সরকারের প্রতি প্রচার চালানোর জন্য। এর কারণ ও লক্ষ কি? আর কি জন্য এ ধরনের পুস্তকাদি প্রচার করা হচ্ছে এবং প্রেরণ করা হচ্ছে ? এবং এর উদ্দেশ্যই বা কি? (ভারতের বড় লাটের প্রতি গোলামের আবেদন পত্র মীর কাসেম আলী রচিত ‘‘তাবলীগে রেসালাত’’ ৭ম খন্ড ১১,১২ও ১৩ পৃষ্ঠার অন্তর্ভুক্ত।) বলুন, যে ব্যক্তি আল্লাহর এবাদতের প্রতি মানুষকে আহবান করার কাজে নিজের জীবনকে ব্যয় করেছেন, আর, যে ব্যক্তি কাফেরদের সেবায় নিজের জীবনকে ব্যয় করে, এত দু ভয়ের মধ্যে কি কোন সামঞ্জস্য আছে? আর, সেই ব্যক্তি এ কাজের জন্য গর্ব করে যে, সে ইংরেজ সরকারের সেবায় তার জীবনকে ব্যয় করেছে এবং ঐ সকল পুস্তকের রচনায় দীর্ঘ উনিশটি বছর অতিবাহিত করেছে যা মানুষকে এ সরকারের সেবা করা অপরিহার্য বলে উদ্বুদ্ধ করে এবং মুসলমানদের মনে এ কথা সুদৃঢ় করে যে তারা অন্যান্য জাতির তুলনায় এ সরকারের প্রতি অধিক বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান। আর, এ উদ্দেশ্যেই সে কোন কোন পুস্তক আরবী ভাষায় এবং কোনটি ফার্সী ভাষায় রচনা করে দূর-দেশে প্রচার করে। যাতে, সর্বস্থানের মুসলমানগণ ব্রিটিশ সরকারের একেবারে অনুগত হয়ে যায়; আর এ আনুগত্য যেন তাদের অন্তর ও আত্মা হতে উৎসারিত হয়। (গোলাম আহমদ রচিত ‘‘কাশফুল গাতা’’ ৪০৩ পৃষ্ঠা) অপর এক পুস্তকে সে বলে, ‘আমি যে সব পুস্তক প্রচার করছি, তার সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছেছে। আর, আমি এগুলো মক্কা, মদিনা, কন্সান্টিনিপল, সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা, মিসর ও আফগানিস্তান সকল স্থানেই যথা সম্ভব প্রচার করেছি। এ সকল পুস্তকের ফলাফলও প্রকাশ পেয়েছে। লক্ষ লক্ষ মুসলমান যারা জিহাদে (আল্লাহর পথে যুদ্ধ) বিশ্বাস করত, তারা এ অপবিত্র বিশ্বাসকে যা তাদের অন্তরে বদ্ধ মূল ছিল এবং মূর্খ আলেমগণ তাদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছিলেন তারা এখন বর্জন করেছে। এটা একটি বিরাট অবদান যা আমার কাছ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, এবং এর দ্বারা আমি সমস্ত ভারতীয় মুসলমানদের উপর গর্ব করতে পারি যে, এরূপ অবদানের দৃষ্টান্ত পেশ করতে আর কেহ সক্ষম হবে না। (গোলাম রচিত ‘‘সিতারায়ে কায়সারা’’ ৩ পৃষ্ঠা।)এই সে কাফের সাম্রাজ্যবাদীর সেবার উপর গর্বকারী ব্যক্তি আল্লাহর নবী নূহের (আঃ) উপর নিজেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বলে যে, আল্লাহ ত‘য়ালা আমার দাবির সত্যতায় এত অধিক নিদর্শনা বলী ও দলীল প্রমাণ নাযেল করেছেন; যদি এগুলো নূহের আঃ. উপর নাযেল করা হত তবে তাঁর কওমের কেহই ডুবে মরত না।’’ কিন্তু এ সকল বিরুদ্ধবাদীদের উদাহরণ হল ঐ অন্ধের ন্যায় যে উজ্জ্বল দিবসকে রাত বলে, দিন নহে। (গোলাম রচিত ‘‘তাতিম্মাতু হাকীকাতুল ওহী’’ ১৩৭ পৃষ্ঠা।)এতদ্ব্যতীত সে ঐ নবীর পেছনেও পড়েছে যার সম্মুখে রাজত্ব পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যতক্ষণ না ঐ সকল মহিলারা তার নির্দোষ ও পবিত্রতার জন্য সাক্ষ্য প্রদান করে, যারা নিজ নিজ হাত কেটে ফেলেছিল। তিনি মিসরের শাসকের স্ত্রীর সহিত অবৈধ আচরণের পরিবর্তে কারা বরণ করে নিয়েছিলেন, নবুয়তের দাবিদার মিথ্যুক লোকটি আল্লাহর এ নবীর বিরুদ্ধে লেগেছে, যার পিতাও ছিলেন নবী এবং যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘‘করীম বিন করীম বিন করীম’’ [১ সহীহ বুখারী।] মহান নবীর পুত্র, মহান নবীর পৌত্র আর তারই সম্বন্ধে বিশ্বাস ঘাতকের সন্তান বিশ্বাস ঘাতক বলে যে, ‘সে তার চেয়েও উত্তম ও শ্রেষ্ঠ’। সে এমন ব্যক্তি যে নিজ বংশের এক দরিদ্র মহিলার প্রেমে পড়েছিল এবং তাকে পাওয়ার জন্য তার পিতার দরিদ্রতা ও অভাবের সুযোগ গ্রহণ করেছিল। কখনও তাকে আশা দিত এবং কখনও তাকে ভয় প্রদর্শন করত। পুনরায় তাকে আশা দিত আবার ধমকও দিত। অতঃপর সে তার প্রেম ও ভালোবাসায় পড়ে এতই নিম্ন স্তরে চলে গিয়েছিল যে, তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে তালাক দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। কারণ সে তার প্রেমিকাকে শিকার করতে সহায়তা ও মধ্যস্থতা করেনি। এমনি ভাবে, সে তার পুত্রকেও বর্জন করে, যে তাকে তার ইচ্ছা পূরণে সাহায্য করেনি। সে দ্বিতীয় পুত্রকে তার স্ত্রী তালাক দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। কারণ, তার প্রেমিকার সাথে ঐ মহিলার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এবং সে তার ঐ সম্পর্ক দ্বারা এই মহিলার মাতা-পিতাকে বাধ্য করেনি। কেননা তার মা হলেন ঐ প্রেমিকার ফুফু। যখন তার ছেলে পিছু হটে যায় এবং ইতস্তত: করে, তখন সে তার প্রতি এই বলে সতর্ক বাণী পাঠায় যে, যদি তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক না দাও, তবে তুমি ও তোমার পূর্ববর্তী ভ্রাতার ন্যায় উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। কার্যত এ নিরীহ মেয়েটিকে বিনা অপরাধে তালাক দেয়া হয়। এখানেই সে ক্ষান্ত হয়নি, বরং নির্দ্বিধায় সে আত্মীয়তার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে যে কেহ তার বিরোধিতা করে, তাকে সে এই বলে হুমকি দেয় যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন। কেননা, আকাশের উপরেই প্রেমিকার বিবাহ তার সাথে সম্পন্ন হয়ে গেছে। যদি কেহ এই মহিলাকে বিবাহ করে তবে সে মারা যাবে এবং যে বিবাহ দিয়েছে সেও। এমনি ভাবে সে আরো বলত যে এ মহিলা বিবাহ হয়ে গেলেও বা বিধবা হওয়ার পর হলেও তার কাছে অবশ্যই ফিরে আসবে। কেননা, মহিলার ফিরে আসা এবং আমার সাথে তার বিবাহ আল্লাহর অকাট্য সিদ্ধান্ত। [২ যা বাদ পড়েনা এবং যা সংঘটিত হওয়া অনিবার্য ।] অবশেষে, এ প্রেমিক ভন্ডনবী তার এ অনুতাপ নিয়েই মৃত্যু বরণ করে। অপরদিকে তার প্রেমিকা অন্যত্র বিবাহ বসে ঘর সংসার করে এবং গোলামের অন্তর জ্বালিয়ে ও তাকে বোকা সাজিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বামীর আশ্রয়ে জীবনযাপন করে। এরূপ ব্যক্তি কি নিজেকে ইউসূফ আলাইহিস সালাম এর সাথে তুলনা করতে পারে? শুধু তুলনাই করছে না বরং তার উপর নিজেকে প্রাধান্য দিয়ে বলে, আমি এই উম্মতের ইউসুফ অর্থাৎ আমি অক্ষম ও অধম বনী ইসরাইলের ইউসুফ হতে উত্তম। কারণ, আল্লাহ তা‘য়ালা নিজে এবং অনেক নিদর্শনা বলী দ্বারা আমার পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। অথচ ইউসুফ বিন ইয়াকুব বিন ইছহাক বিন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম নিজের পবিত্রতার জন্য মানুষের সাক্ষীর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়েছেন। (গোলামের বারাহীনে আহমদিয়া।)
একজন দরিদ্র মহিলার জন্য ওহে একজন লাঞ্ছিত ব্যক্তি, ইউসুফ বিন ইয়াকুব বিন ইছহাক বিন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এ সম্মুখে তোর অবস্থান কোথায়? যে ইউসুফ আঃ. আজীজের স্ত্রী এবং শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন। ওহে জালেম ও স্বার্থপর! তুই তোরই বংশের একজন লোক থেকে সুযোগ নিতে উদ্যোগী হয়েছিলে যে তোর কাছে তার কোন ব্যাপারে সাহায্য কামনা করতে এসেছিল এবং তুই তাকে এই ভাষায় উত্তর দিয়েছিলে- ‘শ্রদ্ধেয় ভাই আহমদ বেগ, ‘‘আল্লাহ তাকে নিরাপত্তা দান করুন!’’ আমি এই মাত্র মুরাকাবা শেষ করলাম। অতপর নিদ্রা আমাকে আচ্ছন্ন করে এবং আমি স্বপ্নে দেখি, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাকে এ কথা অবগত করতে ‘‘তুমি যেন তোমার কুমারী মেয়েকে আমার নিকট বিয়ে দিয়ে দাও।’’ তা হলে তুমি আল্লাহর সমূহ মঙ্গল, বরকত, দান ও সম্মানের অধিকারী হবে এবং তোমার সকল বিপদাপদ দূরীভূত হবে। আর, যদি তোমার মেয়েকে আমার কাছে বিবাহ না দাও, তা হলে তুমি তিরস্কার ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর আদেশ তোমার কাছে পোঁছিয়ে দিলাম, যাতে তুমি তাঁর অনুগ্রহ ও সম্মান লাভ করতে পার এবং তাঁর নেয়ামতের ভান্ডার তোমার উপর খুলে যায়। তুমি জান যে, আমি তোমাকে সম্মান করি এবং তোমার সম্মুখে আদব রক্ষা করে চলি। আর আমি তোমাকে একজন খাঁটি ঈমানদার ধর্মপরায়ণ মনে করি এবং তুমি আমার কাছে অতি সম্মানিত। তোমার আদেশ পালনে আমি গর্ববোধ করি এবং তুমি যে অঙ্গীকার পত্র আমার কাছে নিয়ে আসছিলে উহাতে সাক্ষর করতে আমি প্রস্ত্তত আছি। তদুপরি, আমার সম্পূর্ণ সম্পত্তি তোমার জন্য ও আল্লাহর জন্য। আর তোমার ছেলে আজিজ বেগের জন্য পুলিশ বিভাগে চাকুরি লাভের ব্যাপারে সুপারিশ করতে আমি প্রস্ত্তত আছি। অনুরূপ, কোন এক বিত্তশালীর মেয়ের সহিত তাকে বিবাহ দিতেও তৈরি আছি’। (আহমদ বেগের কাছে গোলামের পত্র ‘‘নবীস্তায়ে গায়েব’’ পুস্তকের ১০০ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত।) আহমদ বেগের কাছে অপর এক পত্রে সে লিখেছে ‘যদি তুমি তোমার মেয়েকে আমার সহিত বিবাহ দাও, তবে আমার বাগান ও স্থাবর সম্পত্তির এক বড় অংশ তোমাকে দেব এবং তোমার মেয়েকে আমার সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দান করব। আমি সত্যই বলছি। তুমি যা চাইবে তাই দেব। আমার মত আত্মীয়তা রক্ষাকারী আর কোন লোক তুমি পাবে না’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘আয়নায়ে কামালাতে ইসলাম’’ ৫৭৩ পৃষ্ঠা)
যখন সে দেখল যে, তার এ সকল উৎসাহ ও আগ্রহ দান বাতাসের সহিত মিশে গেছে তখন সে রাগে জ্বলে উঠে এবং তার ছেলের শ্বশুর আলী শের বেগের কাছে লিখল, যিনি আহমদ বেগের ভগ্নীপতি, সম্মানিত আলী শের বেগ, আমি শুনতে পেলাম যে, আহমদ বেগ তার মেয়েকে আমার নিকট বিবাহ দিতে চায় না, বরং আমি ছাড়া অন্য কারো নিকট বিবাহ দিতে ইচ্ছুক। আমি আশা করি, তোমার আত্মীয়তার সুবাদে তুমি এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করবে। আর তাদেরকে আমার কাছে ঐ মহিলাকে বিবাহ দিতে বাধ্য করবে। আমি কি কোন ঝাড়ুদার বা নীচ বংশের লোক, যে কারণে তারা আমাকে ছেড়ে অন্যের কাছে মেয়েটিকে বিবাহ দেবে? ইতিপূর্বে তোমার স্ত্রীর কাছেও একটা রেজিষ্টারী পত্র লিখেছি, সে যেন তার ভাইকে বাধ্য করে। কিন্তু সে আমার পত্রের উত্তর দেয়নি। বরং আমি শুনেছি যে, সে আমার সম্পর্কে বলে: এ ইতর ব্যক্তি মৃত্যুর নিকটবর্তী হয়েও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে। তার জন্য আমরা কিছুই করতে পারব না। (এ সময় তার বয়স ছিল পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে এবং সে বিভিন্ন ব্যাধি যথা হিষ্ট্রিয়া, মস্তিষ্ক বিকৃতি, ডায়বেটিক ও প্যারালাইসেস রোগে আক্রান্ত ছিল।) এখন আমি তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে লিখছি যদি তোমরা আমাকে সাহায্য না কর এবং আহমদ বেগ ঐ মেয়েকে অন্য কারো কাছে বিবাহ দেয়, তবে যে দিন ঐ মেয়ের বিবাহ হবে সে দিনই আমার পুত্র ফজল আহমদের সাথে তোমাদের যে মেয়ের বিবাহ হয়েছে, তার তালাক নামা তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। (আলী শেরের নিকট লিখিত গোলামের পুত্রের সার সংক্ষেপ, ২মে ১৮৯১ খৃ:।) কার্যত: এ মেয়েটির বিবাহ হওয়ার পরপরই শের আলীর মেয়ের তালাক হয়ে যায়। আর তার দ্বিতীয় পুত্র উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়। কেননা এ মহিলার আত্মীয় স্বজনের সাথে তার পিতার সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরও সে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। যেমনি ভাবে, গোলাম তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে ঐ একই কারণে তালাক দিয়েছিল, যেহেতু সে তার এ কাজে সাহায্য করেনি।(গোলামের পুত্র বশীর আহমদ লিখিত ‘‘সীরাতে মাহদী’’ ১ম খন্ড ২২পৃষ্টা।)
আর আমাদের আলোচ্য এ পাগলটি বিরহ বিচ্ছেদের ময়দানে অস্থির ও হায় হুতাসে পড়ে রইল। ঐ মহিলার স্বামী সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক ছিল, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে সে নিজেকে প্রতারিত করতে লাগল। যেমন, সে তার এক পত্রে লিখছে: ‘আমি আল্লাহর নিকট বিনয় ও আহজারীর সহিত প্রার্থনা করি। তখন আমার কাছে ইলহাম (ঐশী বাণী) হল- ‘অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শন দেখাব, ঐ মেয়েটি বিধবা হয়ে যাবে এবং তার স্বামী ও পিতা তিন বছরের মধ্যে মারা যাবে। আর, ঐ মহিলাটি তোমার কাছে ফিরে আসবে। এটা কেহই বাধা দিয়ে ঠেকাতে পারবে না’’। (ইলহামুল গোলাম ‘‘নবীস্তায়ে গায়েব’’ থেকে উদ্ধৃত।)
আল্লাহর কুদরত যে, তরবারি ও আগুনের ছায়াতলে জীবন যাপনকারী সেই লোকটি মারা যায়নি, যেমনটা ভন্ডনবী আশা করেছিল। বরং এই জ্ঞান-হারা প্রেমিক তার সকল স্বপ্ন ও অমূলক আশা নিয়ে মারা গেল এবং তার সফল প্রতিদ্বন্দ্বী তার মৃত্যুর পর কয়েক দশক পর্যন্ত বেঁচে রইল। এমন এক ব্যক্তি ঐ লোকের সাথে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দাবি করছে যার পবিত্রতা সম্পর্কে শহরের মহিলাগণ সাক্ষ্য প্রদান করছিল। তাদের শীর্ষে ছিলেন আজীজের স্ত্রী। তাদের উক্তি ছিল: ‘‘আল্লাহর জন্য সকল পবিত্রতা, আমরা তাঁর সম্পর্কে খারাপ কিছু জানি না ।’’ আজীজের স্ত্রী বললেন, এখন সত্য প্রকাশিত হয়ে গেছে, আমিই তাকে ফুসলিয়েছিলাম, আর তিনি নিশ্চয়ই সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। [১ সুরা ইউসুফ ৫১] তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তিনি আমার নিষ্ঠাবান বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত।’’ [১ সুরা ইউসুফ ২৪] আর তাকে রাজত্ব ও জ্ঞান [২ সুরা সুরা ইউসুফ ২১ নং আয়াতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।] সহ আল্লাহ তাআলা স্বপ্নের ব্যাখ্যা [৩ সুরা ইউসুফ ২১ নং আয়াতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।] করার যোগ্যতা দান করেছেন এবং বিশ্বস্ত বন্ধু [৪ সুরা ইউসুফের ৪৬ ও ৫৪ নং আয়াতের দিকে ইংগিত করা হয়েছে।] ও আমীন উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
এখন আমি আরও উল্লেখ করছি যে, সে নিজেকে এমন মনীষীর উপর প্রাধান্য দিয়েছে, যার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘‘মরিয়মের পুত্র ঈসাকে আমি স্পষ্ট প্রমাণাদি দান করেছি এবং রুহুল কুদুস অর্থাৎ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি’’ [৫ সুরা বাকারা ৮৭] ‘‘নিশ্চয়ই, মরিয়াম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসূল ও তাঁর বার্তা যা মরিয়মের নিকট পাঠিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর আদিষ্ট রূহ।’’ [৬ সুরা নিসা ১৭১] ঈসার আলাইহিস সালাম ভাষায় আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন- ‘‘আমি আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ আমাকে কিতাব প্রদান করেছেন, এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন। আর আমি যেখানেই থাকি আমাকে বরকতময় করেছেন। আমাকে নামাজ ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন যে পর্যন্ত আমি জীবিত থাকি এবং আমাকে আমার মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ করেছেন আমাকে অত্যাচারী ও হতভাগা করেন নি। আমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব, আর যেদিন আমাকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে’’। [৭ সুরা মরিয়াম ৩০-৩৩] আর এই ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এই তুচ্ছ বান্দা [৮ এই গুণ দ‘টি গোরাম তার নিজের জন্য ব্যবহার করেছে। পূর্বে যেরূপ বর্ণিত হয়েছে।] (কাদিয়ানী) বলে: আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের মধ্যে এমন একজন মাসীহ পাঠিয়েছেন, যার মর্যাদা প্রথম মাসীহ হতে অনেক উচ্চে। আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, যে যুগে আমি জীবন যাপন করছি, সেই যুগে যদি ঈসা আলাইহিস সালাম বর্তমান থাকতেন; তবে, আমি যা করছি তিনি তা করতে পারতেন না।(‘‘আমি যা করছি’’ এর দ্বারা যদি সাম্রাজ্যবাদীদের এবং কাফেরদের দাসত্ব উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে ঠিকই আছে।) এবং আমি যে সকল নিদর্শনা বলী ও ঘটনাবলী প্রকাশ করছি, তা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হত না। ( গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘হাকীকতে ওহী’’ ১৪৮ পৃষ্ঠা।) সে আরো বলেছে: ‘‘মরিয়াম পুত্র ঈসা আমা হতে, আর, আমি আল্লাহ হতে। সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যে আমাকে চিনতে পেরেছে এবং দুর্ভাগা সেই ব্যক্তি যার চক্ষুর আড়ালে আমি রয়েছি’’। (মাকতুবাতে আহমদিয়া ৩য় খন্ড ১১৮ পৃষ্ঠা।) আর, তার পুত্র বলে যে, ‘‘আমার পিতা বলেছেন- ‘তিনি আদম, নূহ ও ঈসা আলাইহিস সালাম থেকে শ্রেষ্ঠ’। কেননা, শয়তান আদমকে বেহেস্ত থেকে বের করে দিয়েছে, আর তিনি আদম সন্তান কে বেহেস্তে প্রবিষ্ট করবেন। ঈসাকে ইহুদীরা শূলবিদ্ধ করেছে এবং তিনি শূল ভাঙবেন। তিনি নূহ আলাইহিস সালাম হতে ও উত্তম। কেননা, তার বড় ছেলে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়েছে; কিন্তু তার পুত্র (গোলামের) হেদায়েতে প্রবেশ করেছে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের বক্তৃতার সার সংক্ষেপ, ‘যা আল ফযল পত্রিকায়’ ১৮ জুলাই ১৯৩১ খৃ: সংকলিত।)
মুহাম্মদ আহসান নামক জনৈক কাদিয়ানী মুবাল্লেগ লিখেছে: পূর্বেকার ‘উলুল আজম’ বা নেতৃস্থানীয় দৃঢ় সংকল্প রাসূলগণের কেহই এমন পর্যায়ের ছিলেন না যিনি আমাদের ইমাম মাসীহে মাওউদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন। হাদীসে ‘‘আছে যদি ঈসা ও মুসা জীবিত থাকতেন তবে আমার অনুসরণ করা ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর থাকত না।’’ [১ এ হাদীসে ঈসা আঃ কে অতিরিক্ত যোগ করা হয়েছে। অথচ হাদীূসের কোন কিতাবেই এরূপ নেই। কাদিয়ানীরা এ হাদীস দিয়ে ঈসা আঃ এর মৃত্যু প্রমানিত করার জন্য দলীল পেশ করে। আঃ] কিন্তু আমি বলি, যদি মুসা ও ঈসা আমাদের ইমামের যুগে জীবিত থাকতেন, তা হলে তার অনুসরণ ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকত না’। (আল-ফজল, ১৮ই মার্চ ১৯১৬খৃঃ)
এ ঘৃণ্য দুঃসাহসিকতার প্রতি লক্ষ্য করুন। কীভাবে নবী রাসূলগণের (তাদের ও আমাদের রাসূলের উপর হাজার হাজার সালাম) অবমাননা ও হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে? কেমন করে একজন দাজ্জাল ও মিথ্যুক নিজের ও আল্লাহর মনোনীত মহাপুরুষগণের মধ্যে তুলনার দাবিকরে? তার শয়তান তাকে এ কথা বলতেও উদ্যত করেছে যে, অনেক নবী আগমন করেছেন কিন্তু কেহই আল্লাহর মা’ রেফাতে আমার অগ্রগামী হতে পারেন নি। সকল নবীগণকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, সম্পুর্নরুপে তা একাই আমাকে দেয়া হয়েছে, । (গোলামের দুরের ছামীন ১৮৭ ও ১৮৮ পৃষ্ঠা।)সে আরো বলে: যে সমস্ত গুণাবলি সকল নবীগণের মধ্যে পাওয়া যেত, রাসুলৃল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে সে সব গুণাবলি বরং এরও অধিক বিদ্যমান ছিল। এরপর এ সকল যোগ্যতা আমাকে প্রদান করা হয়। এ কারণেই আমার নামকরণ করা হয়েছে আদম, ইব্রাহীম, মুসা, নূহ, দাউদ, ইউসুফ, সুলাইমান, ইয়াহইয়া ও ঈসা’। (মালফুজাতে আহমদিয়া ৪থ খন্ড ১৪২ পৃ:) এর চেয়ে অধিক জঘন্য ব্যাপার হল, যেহেতু গোলাম আহমদের মধ্যে সকল প্রকার কুকর্ম ও মন্দ স্বভাব বিদ্যমান ছিল, কাজেই, সে নবী রাসূলগণকে এ সকল কুকর্মের দ্বারা কলুষিত করতে উদ্যত হয়। তার অভ্যাস উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে মদ্যপায়ী ছিল। এ কারণেই, সে আল্লাহর নবী ঈসা আঃ এর উপর এ অপবাদ আরোপ করে বলেছে, ‘‘আমার অভিমত হল মাসীহও মদ্য-পান হতে পবিত্র ছিলেন না।’’ (রিভিউ ১ম খন্ড ১২৩ পৃ: ১৯০২ খৃ:) ‘মাসীহও নিজেকে সৎ বলতে সক্ষম ছিলেন না। কেননা, লোক তাকে মদ্যপায়ী ও ফিতনা সৃষ্টিকারী বলে জানত। (গোলামের ‘‘সৎ ভাজন’’ হাসিয়া ১৭২ পৃষ্ঠা।) আরবী ভাষায় একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে: ‘‘মানুষ নিজের উপর অন্যকে ক্বিয়াস করে’’ তাই , সে বলেছে: ‘মাসীহ মদ্য-পান করতেন। কোন অসুখের কারণে অথবা তার পুরাতন অভ্যাস অনুযায়ী। (গোলামের ‘‘সাফিনায়ে নূহ’’ ৬৫ পৃষ্ঠা।) তার অভ্যাস ছিল, রাতের অন্ধকারে গায়ের মুহাররম রমণীদের সাথে সে মেলামেশা করত। এ চরিত্রের বৈধতা প্রমাণের জন্য সে আল্লাহর নবী ঈসার আলাইহিস সালাম প্রতি অপবাদ আরোপের আশ্রয় নেয়। কাজেই, সে একান্ত নির্লজ্জভাবে বলেছে: ঈসার আলাইহিস সালাম পরিবার এক অদ্ভুত পরিবার। তার তিন মাতামহী ছিলেন দুশ্চরিত্র ব্যভিচারিণী। এ পবিত্র রক্ত? হতে ঈসার সৃষ্টি। হয়তো এ কারণেই ঈসা ব্যভিচারীদের প্রতি আসক্ত ছিলেন। নচেৎ কোন খোদা ভীরু ব্যক্তি ব্যভিচারিণী যুবতীকে তার মাথা স্পর্শ করতে এবং তার অবৈধ সম্পদ দ্বারা আতর লাগাবার অনুমতি দিতে পারে না। অতএব, মানুষের বুঝা উচিত যে, এ মাসীহের চরিত্র কেমন ছিল। (গোলাম রচিত ‘‘আঞ্জামে আথমের’’ পরিশিষ্ট ৭ পৃষ্ঠা।) জানি না, কোথায় লজ্জা ও কোথায় ভদ্রতার অবশিষ্ট অংশ রয়েছে। এটা কি সম্ভব যে কোন ভদ্র ব্যক্তিকে এরূপ অপবাদ দেয়া যায়? বিশেষ করে, যাকে অপবাদ দেয়া হয়েছে তিনি হলেন আল্লাহর এমন নবী যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা তার প্রেরিত ফেরেশতার মাধ্যমে পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছেন ‘‘আমি তোমার প্রভুর দূত, আমি তোমাকে পবিত্র একটি ছেলে দান করতে এসেছি’’। [১ সুরা মারয়াম ১৯] এই যে বিশ্ববাসীর প্রভু সবচেয়ে সত্যবাদী সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিষ্পাপ। অতএব, হে পাপিষ্ঠ! তুই কি করে এ দুঃসাহসিকতা দেখাতে সাহস পেলি যে আল্লাহর কথার বিরোধিতা করছিস। অথচ, তুই তো এমন ব্যক্তি যে পর নারীদের সাথে মেলামেশা করছিস এবং রাতের অন্ধকারে তাদেরকে তোর হাত-পা দাবিয়ে দিতে নির্দেশ দিচ্ছিস।
প্রকাশ থাকে যে, স্বয়ং আল-ফজল পত্রিকা সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং স্বীকার করছে ও বলছে- ‘মাসীহে মওউদ গোলাম আহমদ নবী ছিলেন। তাই, নারীদের সাথে তার মেলামেশা, স্পর্শ করা এবং তার হাত পা দাবিয়ে দিতে আদেশ করাতে কোন দোষ নেই। বরং এটা ছওয়াব, রহমত ও বরকতের কারণ’। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজল’ ২০ মার্চ ১৯২৮ খৃ:) আর. তুমিই বলেছ যে, ‘বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বড়দের উপর দোষারোপ করা, তাদের সমালোচনা করা এবং তাদের নিন্দা করা জঘন্য ও নিকৃষ্ট কাজ’। (গোলামের বারাহীনে আহমদিয়া ১০২ পৃ:) যে সকল নীতি তুমি নিজেই রচনা করেছ এবং যে সকল আইন তুমিই নির্ধারণ করেছ, এর আলোকে তুমি কি হবে? সুতরাং তোমার ব্যাপারে তুমি যা বলেছ, তাছাড়া আমরা আর কিছু বলতে চাই না। কেননা আমরা গালি গালাজ থেকে পবিত্র। যদিও সে দাজ্জাল হয় এবং নবী রাসূলগণকে গালি দেয়। এখন আমরা তোমার কিতাব থেকে, তোমার ভাষ্য হতে, এবং তোমার নিজ শব্দে তোমার কাছে উপহার পেশ করছি- ‘যে ব্যক্তি পবিত্র ও নেককার লোকজনকে গাল মন্দ করে, সে খবীছ, অভিশপ্ত ও ইতর ব্যতীত আর কিছু নহে। (আল-বালাগুল মুবিন ১৯ পৃ:) এর পর সে আরো বড় অপরাধের দিকে অগ্রসর হয়। আর এ সমস্ত বিরাট অপরাধের চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ হল যে, সে এমন ব্যক্তিত্বের উপর আক্রম করেছে, যিনি সমস্ত সৃষ্টির সারাংশ, সকল অস্তিত্বের গৌরব, নবী রাসূলাগণের প্রধান, যার সম্পর্কে সকল রাসূল সুসংবাদ দিয়েছেন। এবং যার জন্য আল্লাহ পাক সকল নবী হতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি আল্লাহর রসুল এবং সর্ব শেষ নবী। (আমার প্রাণ ও আমার মাতা-পিতা তার উপর উপর উৎসর্গ। তার উপর দরুদ ও সালাম) এ দাজ্জাল বলে যে , নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিন হাজার অলৌকিক ঘটনা রয়েছে; কিন্তু আমার অলৌকিক ঘটনাবলীর সংখ্যা এক মিলিয়নেরও অধিক’। (গোলামের ‘‘তাযকেরাতুশ শাহাদাতাইন ৪১ পৃ:) সে অ রো বলে, আমাকে যা দেয়া হয়েছে তা বিশ্ব জগতের আর কাউকে দেয়া হয়নি। (গোলামের হাকীকাতুল ওহীর পরিশিষ্ট।) এতদ্ব্যতীত তার ছেলে ও দ্বিতীয় খলীফা বলেছে- আমাদের ইমামের পয়গাম্বরী জ্ঞান নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জ্ঞান থেকে বহু ঊর্ধ্বে ছিল। (নাউযু বিল্লাহ) কেননা, সভ্যতার দিক দিয়ে বর্তমান যুগ সে কাল হতে বহু উন্নত। আর, এটা হল বিশেষ ক্ষেত্রের প্রাধান্যতা যা গোলাম আহমদ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর লাভ করে। (কাদিয়ানী রিভিউ, মে ১৯৪৯ ইং।) এ বিষয়ের উপর আমি একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লিখব। এখন আমি এ আলোচনাকে তার নিজেরই একটি বক্তব্যের উপর শেষ করছি। যাতে তারই উক্তি তারই বিরুদ্ধে ডিগ্রি প্রদান করে। সে বলেছে: ঐ ব্যক্তি কাফের যে কোন নবীর অবমাননা করে’ এবং ‘যে ব্যক্তি এমন শব্দাবলি ব্যবহার করে যদ্দারা স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ভাবে কোন ধর্মীয় নেতার অবমাননা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাকে আমরা বড় খবীছ ও নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে বিবেচনা করি’। (কাদিয়ানী নবুয়তের দাবিদার গোলামের ‘‘অইনুল মারেফাত’’ ১৮ পৃ: এবং ‘‘বারাহীনে আহমদীয়া’’ ১০৯ পৃ:।) আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে মুসলমানরুপে জীবিত রাখেন এবং মুসলমানরুপে মৃত্যু দান করেন। আমীন।
৬
চতুর্থ প্রবন্ধ: ‘‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী এবং মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর তার ঔদ্ধত্য প্রকাশ’’ [১ ১৩৮৬ হিজরী সনে ‘হাদারাতুল ইসলাম’ পত্রিকার নবম সংখায় এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।]এ পৃথিবীতে অনেক দুর্ভাগ্যতা, হীনতা, নবুয়তের চাদরচুরী, নবীগণের অবমাননা, রাসূলগণকে গালমন্দ করা, এবং আল্লাহর শানে মিথ্যা আরোপ করার ক্ষেত্রে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার অনুসারীদের সম পর্যায়ের লোক খুব কমই পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন- ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে [২ সুরা আন্আম- ৯৩]পারে’’? গোলাম কাদিয়ানী আল্লাহর উপর মিথ্যা-রোপ করে বলে, সে আল্লাহর নবী ও রসুল। যেমন করে তার পূর্ববর্তী দুই ভ্রাতা মুসায়লামা ও আসওয়াদ আনাসী দাবি করেছিল। তারপর, সে আরো দাবি করেছে যে, সে সকল নবী রাসূলের চেয়েও উত্তম। এ জন্যই তার নাম রাখা হয়েছে আদম, শীষ, নূহ, ইব্রাহীম, ইসহাক, ইসমাইল, ইয়াকুব, ইউসুফ, মুসা, দাউদ ও ঈসা আলাইহিস সালাম। [৩ হাকীকাতুল ওহী এর টিকা, ৭২ পৃষ্ঠা, গোলাম রচিত।]
এর চেয়েও অধিক সে বলে: সমস্ত নবী রাসূলগণকে যা দেওয়া হয়েছে তার সমস্তটাই তাকে দেয়া হয়েছে। [৪ দুরএর ছামীন এর টিকা, পৃষ্ঠা ২৮৭ ও ২৮৮, গোলাম রচিত।] সে এর উপরও সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তার ইংরেজ প্রভুর ইঙ্গিতে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীনের মর্যাদার উপর আক্রমণ করতে, তার সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে এবং তার উপর নিজকে প্রাধান্য দিতে উদ্যত হয়েছে। তাই, সে বলে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিন হাজার মু’ জেজা ছিল, কিন্তু আমার মু’ জেজা সমূহ এক মিলিয়নেরও অধিক। (গোলামের ‘‘তুহফায়ে কুলরা’’ ৪০ পৃষ্ঠা, এবং ‘‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’’ ৪১ পৃষ্ঠা।) হায়! যদি বুঝতে পারতাম, তার মু’ জেজা সমূহ দ্বারা তার কি উদ্দেশ্য? তার মু’ জেজা সমূহ দ্বারা যদি এ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে, সে পুরুষত্ব থেকে বঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও তার সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করেছে; তা হলে এটা তার স্ত্রীর মু’ জেজা হরে, তার মু’ জেজা নহে। লক্ষ্য করুন! সে তার উক্ত মু’ জেজার উল্লেখ করে বলেছে: আমার দ্বিতীয় মু’ জেজা হল, বিবাহ সম্পর্কে যখন পবিত্র ওহী অবতীর্ণ হল, তখন আমি হৃৎপিন্ড, মস্তিষ্ক ও শারীরিক দুর্বলতা, বহু মূত্র, মাথাঘোরা ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ছিলাম। (আল্লাহ, আল্লাহ! একদিকে মারাত্মক রোগ সমূহের আক্রমণ, অপরদিকে বিবাহের অনুরাগ।) এ সকল মারাত্মক রোগসমূহ নিয়ে যখন আমি বিবাহ করলাম তখন কেহ কেহ আক্ষেপ করলেন। কেননা, আমার অবস্থা পুরুষত্ব না থাকার মতই ছিল এবং আমি মৃত্যুমুখী বৃদ্ধের ন্যায় ছিলাম । এজন্য উস্তাদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী আমার কাছে একটি পত্র লিখলেন যে, এ অবস্থায় তোমার বিবাহ করা উচিত ছিল না; যাতে কোন প্রকার বিপদের সম্মুখীন হতে না হয়। কিন্তু এ সকল রোগ ও দুর্বলতা সত্ত্বেও আমি স্বাস্থ্য ফিরে পাই এবং চারটি ছেলে লাভ করি। (গোলামের ‘‘নুযুলুল মাসীহের’’ হাসিয়া, ২০৯ পৃষ্ঠা।) উল্লেখ্য যে, এ বিবাহ গোলামের দ্বিতীয় বিবাহ ছিল। তখন তার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে এবং তার বর্ণনাকৃত রোগ সমূহতো তার সঙ্গে ছিলই। এর চেয়ে অধিক সুক্ষ কথা হল এই যে, তার এ যুবতী স্ত্রীর গর্ভে দশটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। অথচ তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে দীর্ঘকালে মাত্র দ’টি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে প্রথম সন্তানের জন্মের সময় তার বয়স মাত্র পনেরো বা ষোলো বৎসর ছিল , যেমন সে নিজেই এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে: ‘আল্লাহই জানেন যে সন্তানের জন্য আমার কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না। অথচ যখন আমার বয়স পনেরো বা ষোলো, তখন আমি সন্তান লাভ করি’। (‘‘ইরশাদুল গোলাম’’ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল হিকমের’’ অন্তর্ভুক্ত এবং মঞ্জুর কাদিয়ানীর পুস্তক ৩৪৩ পৃষ্ঠা হতে গৃহীত।) সে তার প্রথম খলীফা ও তার সাথী নুরুদ্দীনের কাছে লিখেছে- যখন আমি বিবাহ করি, তখন আমার বিশ্বাস ছিল যে, দীর্ঘ দিন যাবৎ আমার পুরুষত্ব নেই। (তা সত্ত্বেও বিবাহের পরপরই সন্তান জন্ম গ্রহণ করতে থাকে। ‘‘মাকতুবাতে আহমদিয়া’’ ৫ম খন্ড ১৪৫পৃষ্ঠা।)
এটা তার অথবা তার ভক্তগণের কাছে হয়তো মু’ জেজা হতে পারে। কিন্তু আমরা নিষ্ঠাবান মুসলমানগণ একে হাস্যাস্পদ, লাঞ্ছনা ও পরীক্ষা ছাড়া কিছুই মনে করি না। যেমন মহান শেখ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী গোলামের নিকট প্রেরীত তার পত্রে এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ ধরনের মু’ জেজা দ্বারা কি ভন্ডনবী কাদিয়ানী রাসুলে আরাবীর সাথে গর্ব ও অহংকার করতে পারে? যার সম্মানে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল, পাথর ও বৃক্ষ যাকে সালাম জানিয়েছিল, যার আঙুল সমূহের মধ্য হতে পানি প্রবাহিত হয়েছিল এবং যার বিচ্ছেদে খেজুরের কান্ডটি উষ্ট্রীর ন্যায় স্ব-রবে কেঁদেছিল। হযরত আনাছ বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন যে, মক্কা-বাসীরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তাদেরকে একটি মু’ জেজা দেখাবার জন্য আবেদন করল। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে চন্দ্র দু’ভাগে বিভক্ত করে দেখালেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের রা. বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন- আমরা একদা মিনায় ছিলাম, এমন সময় চন্দ্র দু’খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায় , এক খন্ড পাহাড়ের এক পার্শ্বে এবং অপর খন্ড পাহাড়ের অপর পার্শ্বে ছিল। অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন: তোমরা সাক্ষী থাক। [১ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এবং আহমদ ও তায়ালীসী তাদের মসনদদ্বয়ে উদ্ধৃত করেছেন, আর শব্দাবলী মুসলিমের।]
হযরত জাবির বিন সামুরা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন- আমি মক্কার ঐ পাথরটিকে চিনি যে আমাকে নবুয়্যত লাভের পূর্বে সালাম দিত। নিশ্চয়ই আমি এখনও ঐ পাথরটিকে চিনি। [২ মুসলিম মুসনদে আহমদ, তবকাতে ইবনে সা’দ মুসনাদে তায়ালীসী।] অপর বর্ণনায় আছে: ‘‘যখন আমি নবুয়্যত প্রাপ্ত হই।’’ [৩ তিরমিযী।] (একথাটি বর্ণনার সাথে সংযুক্ত রয়েছে) হযরত আলী বিন আবি তালিব রা. বলেন, আমি মক্কায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে ছিলাম। এক সময় তার সঙ্গে মক্কার কোন প্রান্তে বের হলাম, তখন কোন পাহাড় বা বৃক্ষ তাঁর সম্মুখীন হলেই বলত, আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ । [১ মুসনাদে দারামী ও তিরমিযী।] হযরত আনাছ বিন মালিক রা. বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখলাম, তখন আছরের সময় হয়ে গিয়েছিল; লোক জন ওজুর পানি তালাশ করে পেল না। তারপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ওজুর পানি আনা হল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে পাত্রে নিজ হাতে রাখলেন এবং লোকজনকে এ পাত্র হতে ওজু করার নির্দেশ দিলেন। আনাছ রা. বলেন, আমি দেখতে পেলাম যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আঙুল সমূহের নীচ থেকে পানি উৎসারিত হচ্ছে। লোকজন সকলেই ওজু করলেন। আনাছ রা . বলেন, লোকের সংখ্যা প্রায় তিন শত ছিল। [২ ইবনে সা’দ মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে দারমী। তবে শব্দুসলিমের।] আর উষ্ট্রীর ন্যায় খেজুর কান্ডটি যে ক্রন্দন করেছে, সে সম্পর্কে আনাছ বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর কান্ডে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন, পরে সাহাবীগণ তাঁর জন্য একটি মিম্বার তৈরি করলেন। তিনি এর উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতে লাগলেন। তখন খেজুর কান্ডটি উষ্ট্রের ন্যায় কাঁদতে লাগল। রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে এসে তাকে স্পর্শ করলে সে শান্ত হয়। [৩ তিরমিযী] এ হল সত্য ও বিশ্বস্ত নবীর মু’ জেজা সমূহ। এ ছাড়া আরো অনেক মু’ জেজা রয়েছে। এই ভন্ডনবী কাদিয়ানী অন্যত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নিজেকে অধিক মর্যাদাবান দাবিকরে বলেছে:- ‘‘তাঁর (মুহাম্মদের) জন্য চন্দ্র গ্রহণ হয়েছিল এবং আমার জন্য চন্দ্র ও সূর্য উভয়েরই গ্রহণ হয়। তুমি কি ইহা অস্বীকার কর? অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য কেবল চন্দ্র গ্রহণ হয়েছিল , সে স্থলে আমার জন্য চন্দ্র ও সূর্য উভয়ের মধ্যে গ্রহণ লেগেছিল। (গোলামের এজাজে আহমদী ৭১ পৃষ্ঠা।) সে আরো অধিক অগ্রসর হয়ে সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ও নির্বোধের মত বলে: নিশ্চয়ই ইসলাম প্রথম দিকে নব চন্দ্রের মত ছিল, অর্থাৎ একেবারে ছোট। অতঃপর নির্ধারিত হল যে, এ যুগে উহা পূর্ণ চন্দ্রে রূপান্তরিত হবে। এ দিকেই মহান আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন- ‘‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বদর বা পূর্ণ চন্দ্র দ্বারা সাহায্য করেছেন’’ (খুতবায়ে ইলহামিয়া ১৮৪ পৃষ্ঠা।) এমনিভাবে, আল্লাহর এ শত্রু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছে। যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন ‘‘আমি আপনার খ্যাতিকে সুউচ্চ করেছি।’’ মহান আল্লাহর এ বাণীকেও সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে:
(আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসাবে মনোনীত করলাম) [৪ সুরা মায়েদা, আয়াত ৩।] সে ইহুদীদের ন্যায় কুরআনকে পরিবর্তন করার ইচ্ছা করেছে। যেহেতু সে আল্লাহর বাণীর এমন অর্থ গ্রহণ করেছে যা আল্লাহর উদ্দেশ্য নহে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও এদিকে ইঙ্গিত করেন নি। কোন সাহাবী, ইমাম ও তাফসীরকারের মনে এমন কল্পনাও আসেনি। এমনিভাবে এ ঘৃণ্য ব্যক্তিটি সুদৃঢ় পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্রমশ: আউলিয়া, আইম্মা, সাহাবা ও আম্বিয়াদের অবমাননা করার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননার দিকে অগ্রসর হয়। তা সত্ত্বেও কাদিয়ানীরা চায় তাদেরকে যেন ইসলাম ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা না হয় এবং মুসলমানগণ তাদেরকে যেন ঘৃণ্য ধর্মান্তরিত দল বলে অভিহিত না করেন। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের উপর নিজেকে প্রাধান্য দেয় (তার দাবির প্রতি লক্ষ্য না করেও) এবং হুজুরের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে, সে কি মুসলমান? অথবা ইসলামের সহিত তার কি কোন সম্পর্ক আছে? অতঃপর যারা এর উপর তার হাতে বাইআত করে এবং তার কথায় বিশ্বাস করে, তারা কি মুসলমান? শুধু তাই নহে, বরং সে নিজে যা বলে ভক্তরা এর চেয়ে অনেক বেশি অত্যুক্তি করে। অপর এক অভিশপ্ত কাদিয়ানী মুবাল্লেগ ও কবি ভন্ডনবীর প্রশংসায় তারই সম্মুখে কতকগুলো কবিতা আবৃত্তি করে বলে: ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মধ্যে পুনরায় অবতরণ করেছেন: এমতাবস্থায় যে, তার এবারকার মর্যাদা প্রথম বারের চেয়ে অনেক বড়’’। যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পরিপূর্ণ আকৃতিতে দেখতে চায়, সে যেন কাদিয়ানী গোলাম আহমদকে দেখে নেয়। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘বদর’’ হতে উদ্ধৃত, ২৫ অক্টোবর ১৯০২ খৃ:) এ ইতর ব্যক্তিটি লিখেছে যে, গোলাম আহমদ এ কবিতাটি শুনে সন্তুষ্ট হয়েছে। অতএব, আবৃত্তিকারী এবং যার উদ্দেশ্যে আবৃত্তি করা হল, আর যারা উহা স্বীকার করে নিল, তারা কি পর্যায়ের গণ্য হতে পারে? এদের উপর ধ্বংস আসুক! অপর দিকে মহাশক্তি ও মহত্ত্বের অধিকারী আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, যে নবীর সম্মুখে উচ্চস্বরে কথা বলে, তার সকল আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং সকল নেকী ব্যর্থ হবে, অথচ তারা ঈমানদার। আল্লাহ বলেন- হে বিশ্বাসীগণ! নবীর কথার উপর তোমরা পরস্পরের ন্যায় তার সম্মুখে জোরে কথা বলিও না। আশঙ্কা রয়েছে যে , তোমাদের আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তোমরা তা অনুভব করতে পারবে না। [১ সুরা আল-হুজুরাত, ২নং আয়াত] সুতরাং যারা এ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যিনি সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরিত, তার উপর এ দাজ্জাল ও কাজ্জাবকে উচ্চ স্থান দেয়, তাদের পরিণতি কি হবে? এরা মুরতাদ। আর শুধু মুরতাদ হওয়াইতো হত্যাযোগ্য অপরাধ। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি তার ধর্ম পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর’। [২ তিরমিযী] অপর এক হতভাগা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজলে’’ লিখেছে: ‘আমাদের বিশ্বাস যে, গোলাম আহমদের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তাআলা এত নিদর্শনা বলী এবং প্রমাণাদি অবতীর্ণ করেছেন যদি তা এক হাজার নবীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়, তবে তাদের নবুয়্যত প্রমাণিত হওয়ার জন্য এগুলো যথেষ্ট হবে এবং সকল নবীর মধ্যে যে সমস্ত পবিত্র গুণাবলি ছিল, তার সবটাই গোলাম আহমদের মধ্যে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজর’’ ১৬ অক্টোবর ১৯১৭ খৃ:)
জানি না , কোন কোন গুণাবলি দ্বারা কাফেরদের প্রশংসা ও দাসত্ব করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কোন নবীর মধ্যেই এ সকল গুণাবলি ছিল না এবং কোন সত্য নবীর জন্য তা উপযোগীও নহে। আর যদি এ সকল গুণাবলি দ্বারা কাপুরুষতা ও কপটতা উদ্দেশ্য হয়, তবে এ সকল দোষ থেকে নবীগণ পবিত্র ছিলেন। কারো কাছে হাত পাতা ও কাকুতি মিনতি করা আল্লাহর রাসূলগণের অভ্যাস ছিল না; বরং তারা ছিলেন সবচেয়ে সাহসী ও সত্যবাদী। অনুরূপভাবে তারা ছিলেন সবচেয়ে বেশি অমুখাপেক্ষী এবং অপরের কাছে কিছু চাওয়া ও কারো সামনে হাত পাতা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। এইতো আল্লাহর রাসূল মক্কার নেতাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে এবং তাদেরকে কাফের নামে অভিহিত করে আল্লাহর বাণী ঘোষণা করছেন- ‘‘আপনি বলুন, হে কাফেরগণ! তোমরা যার উপাসনা কর, আমি তার উপাসনা কার না। আর তোমরাও উপাসনা কর না আমি যার উপাসনা করি এবং এবং ভবিষ্যতেও আমি তোমাদের মাবুদগণের উপাসনা করব না । আর, তোমরাও আমার মাবুদের উপাসনা করবে না। তোমাদের প্রতিদান তোমরা পাবে এবং আমার প্রতিদান আমরা পাব।’’ [১ সুরা কাফেরূন।] এ দাজ্জাল ও কাজ্জাবের অবস্থান হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, এই কাফের ইংরেজ সরকার সম্পর্কে বলে: আমি এই পরিবারের লোক যার সম্পর্কে ইংরেজ সরকার স্বীকার করে যে, এ পরিবার সরকারের অতি বিশ্বস্ত। প্রশাসকরাও স্বীকৃতি দিয়েছে যে, আমার পিতা ও আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা মনে প্রাণে পূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে সরকারের সেবা করেছে। এ সরকারের তত্ত্বাবধানে আমরা যে সুখ ও শান্তি পাচ্ছি, তজ্জন্য এ দয়াল সরকারের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য আমি কোন ভাষা খোঁজে পাচ্ছি না। এ জন্য আমি আমার পিতা ও আমার ভাই এ সরকারের অবদান ও উপকারসমূহ প্রকাশ করতে ও জনসাধারণকে এ সরকারের আনুগত্যের প্রতি বাধ্য করতে এবং তাদের অন্তরে এটিকে বদ্ধ মূল করতে সর্বদা কঠোর পরিশ্রম করেছি। (তাবলীগে রিসালাত, ৭ম খন্ড, ৮ও ৯ পৃষ্ঠা।) এ সমস্ত গুণাবলিই কি তোমাদের উদ্দেশ্য? নবীগণ শাহাদৎ বরণ করেছেন, অগ্নি দগ্ধ হয়েছেন, নিজ ঘর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন এবং ধন-সম্পদ হতে বঞ্চিত হয়েছেন। তবুও আল্লাহর পথে দাওয়াত ত্যাগ করেন নি এবং আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া কারো আনুগত্য গ্রহণ করেন নি। তারা কোন রাজা বাদশাহর দাসত্ব স্বীকার করেন নি এবং কোন স্বৈরাচার ও ফেরাউনের সম্মুখে মাথা নত করেন নি তারা মহান আল্লাহর এই বাণীর উপর অটল ছিলেন ‘‘তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছে, তা প্রকাশ্যে প্রচার কর, এবং মুশরেকদেরকে উপেক্ষা করে চল। [২ সুরা আল-হিযর, ৯৪ আয়াত।]
ভন্ডনবী কাদিয়ানীর মত তারা মানুষের উপর কাফেরদের আনুগত্য ওয়াজিব করেন নি। যদি এই তাদের লক্ষ্য হত, তবে তাদেরকে প্রেরণ করার কি সার্থকতা ছিল?
গোলাম আহমদ অন্যত্র বলে: আমি আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ইংরেজ সরকারের সাহায্যে এবং জিহাদের বিরোধিতায় ব্যায় করেছি। আর, মুসলমানগণ এই সরকারের প্রতি অনুগত না হওয়া পর্যন্ত আমার এ চেষ্টা চালিয়ে যাব। (গোলামের ‘‘তিরিয়াকুল কুলুব’’ ১৫ পৃষ্ঠা ।) হ্যাঁ, কার্যত: জেহাদের বিরোধিতায় সে তার জীবন সমাপ্ত করেছে। কেননা, জেহাদের স্বাদ অনুভব করতে পারেনি। তাই তার মত দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভীরু ব্যক্তি এই বক্তব্যের ঘোষণাকারীর বীরত্বকে উপলব্ধি করতে পারে- ‘‘অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে ন্যায়ের কথা বলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেহাদ’’ [১ তিরমিযী।] যদি সে জানত তবে একথা বলত না ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কামালাতের তাজাল্লী শেষ প্রান্তে উন্নীত হতে পারে নি, বরং এই তাজাল্লী সমূহ আমার যুগে এবং আমার ব্যক্তিত্বে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে’’। (খুতবায়ে ইলহামিয়া, ১৭৭ পৃষ্ঠা।) অতএব হে দাজ্জাল! তুই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন নগণ্যতম খাদেমদেরও সম পর্যায়ের নহে। অথচ তুই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নিজের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছিস। অতএব, যখন আল্লাহ তাআলা তার হাবীব ও খলীল, আরব ও আজমের সরদার, শেষ নবী ও সাইয়েদুল মুরসালীনের অবমাননা সম্পর্কে তোকে জিজ্ঞাসা করবে তখন তোর অবস্থা কি হবে? হে পাপিষ্ঠ! তুই কেমন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহিত তোর হীন ব্যক্তিত্বকে তুলনা করছিস? আল্লাহই তাঁকে সমস্ত সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তাকে ‘‘রাহমাতুললিল আলামীন’’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি এমন পর্যায়ের দানবীর ও দাতা ছিলেন যে, তার হাতে যা কিছু আসত তা আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতেন এবং রিক্ত হস্তে নিজ গৃহে ফিরতেন। এমতাবস্থায়, যখন উম্মাহাতুল মু’ মেনিন রা. তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কেন নিজের জন্য কিছুটা অবশিষ্ট রাখেন নি? উত্তরে হুজুর বলতেন: ‘‘তোমাদের নিকট যা কিছু আছে তা তো নিঃশেষ হয়ে যাবে, আর আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে তা স্থায়ী থাকবে’’। [২ সুরা নাহল-৯৬] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মীনি ও মুমেনগণের মা আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিরোধানের পূর্ব পর্যন্ত তার পরিবারের লোকেরা একাধারে দু’দিন যবের রুটি পেট ভরে খেতে পারেন নি। ছিমাক ইবনে হরব বলেন, আমি নুমান ইবনে বশিরকে রা. বলতে শুনেছি: তোমরা কি যা চাও তা পানাহার করছ না ? অথচ আমি তোমাদের নবীকে দেখেছি, তিনি এই পরিমাণ মামুলি খেজুরও পেতেন না, যাতে তার পেট ভরতে পারে। [৩ সামায়েলে তিরমিযী।] কিন্তু তোমার (কাদিয়ানীর) অবস্থা হল যে, তুমি
মানুষের পকেট কাটছ। ভক্তদের কাছ থেকে জাকাতের নামে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টনের নামে অবৈধ লুণ্ঠিত সম্পদ এবং ইংরেজদের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা ও এজেন্ট হওয়ার বিনিময়ে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত সম্পদ খাচ্ছ। তুমি ভুনা মুরগি, বক ও কবুতর পাখির গোস্ত খাচ্ছ। বিভিন্ন দূর-দেশ থেকে তোমার বিশেষ দস্তরখানার জন্য আমদানীকৃত খাবার কাবাব, কুফতা, বিরিয়ানী, মিষ্টি-দ্রব্য, বিভিন্ন প্রকার পোলাও , ডিম, মাখন ও মাখনদ্বারা প্রস্ত্তত দ্রব্যাদি ও দুধ ইত্যাদি সংগ্রহ করছ। আর, ফলের মধ্যে আঙ্গুর , ডালিম, কমলা, আপেল ইত্যাদি এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত কেক যা শুকরের চর্বি দ্বারা প্রস্ত্তত, [৪ এভাবে গুলাম পুত্র বশীর আহমদ বলেছে, আমার পিতা কেক খেতেন যদিও লোক এতে সন্দেহ পোষন করতেন যে এটা শুকরের চর্বি দিয়ে তরৈী অথবা চর্বি দিয়ে পাকানো হয়েছে। কিন্তু গোলামের অভিমত ছিল যে, এই কেক কি দিয়ে পাক করা হয়েছে তা নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলে তা খেতে আপত্তি নেই। (বশীর রচিত সীরাতে মাহদী ২য় খন্ড ১৩৫ পৃঃ)] প্রভৃতি সহ আরো অনেক কিছু তুমি খাচ্ছ। [৫ সীরাতে মাহদী ২য় খন্ড ১৩২-১৩৫ পৃষ্ঠা] এগুলো ব্যতীত আরো অনেক শক্তি বর্ধক সামগ্রী যেমন মিশকে আম্বর [১ মাকতুবাতে আহমদীয়া ৫ম খন্ড ২৬ পৃঃ] ও আগর যার ২৫ গ্রাম তখনকার দিনে পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি হত [২ মাকতুবাতে আহমদীয়া ৫ম খন্ড পৃঃ ১২১৩ মাকাতিবুল ইমাম ২য় খন্ড (মাহমুদ হুসাইন কাদিয়ানী)] এবং জাফরান, মারওয়ারীদ, মারজান-ইয়াকুত [] আফিম ও মদ তুমি ব্যবহার করছ। এসব কিছু নবুয়তের নামে এবং নবুয়তের বরকত হিসাবে চালিয়ে যাচ্ছ। অথচ নবুয়তের দাবি করার পূর্বে তোমারই বর্ণনা অনুযায়ী তোমার এ অবস্থা ছিল- ‘আমি একজন দরিদ্র লোক ছিলাম। কেহ আমাকে চিনত না এবং আমার কাছে এমন জীবিকার ব্যবস্থা ছিল না যাদ্দারা আমি আরাম ও স্বচ্ছলতার সহিত জীবন যাপন করতে পারি। আমার পিতা আমার জন্য অতি সামান্য সম্পদ রেখে গিয়েছেন। এরপর আল্লাহ আমার দিকে দুনিয়া ফিরিয়ে দিলেন। তখন আমি যে মাসিক দশ টাকা লাভ করতে পারব তারও আশা করতে পারতাম না। কিন্তু আল্লাহ আমার অবস্থার পরিবর্তন করে দিলেন এবং আমাকে সাহায্য করলেন। এখন আমার নিকট তিন লাখেরও বেশি টাকা আছে। (গোলামের ‘‘হাকীকতে ওহী’’ ২১১ ও ২১২ পৃষ্ঠা) এত অধিক সম্পদ কোত্থেকে আসল? কাদিয়ানী মুফতি সরওর শাহ এর বর্ণনা দিয়ে বলেন যে, এ সম্পদ অজ্ঞাত স্থান হতে আসছে। তিনি আরো বলেন- একজন মুবাল্লেগ আমাকে জানিয়েছেন যে, আমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য কাদিয়ানে প্রচুর পরিমাণ টাকা পাঠাতাম। (কাদিয়ান হল নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদের জন্ম স্থান।) কিন্তু যখন আমরা কাদিয়ানে গেলাম, তখন দেখতে পেলাম এ বিরাট পরিমাণের টাকা গোলাম আহমদের বেগমদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে তারা খুব আরাম ও স্বচ্ছলতার সাথে জীবন যাপন করছে, বাহিরের জীবনে তারা এর দশ ভাগের একভাগও উপভোগ করার সুযোগ পাননি। অথচ এ টাকাগুলো তাদের জন্য প্রেরিত হত না। অতঃপর মুফতি বলেন- তখন আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম এবং তওবা করতাম এই ভয়ে যে আল্লাহ শাস্তি নাযেল করে দিতে পারেন। (কাদিয়ানী মূফতী সরওয়ার শাহ রচিত ‘‘কাশফুল ইখতেলাফ’’ ১৩ পৃষ্ঠা।)
এভাবে এ প্রক্রিয়া ছাড়া অন্যান্য পন্থায় ও এ দরিদ্র ভন্ডনবী বিরাট সম্পদ সঞ্চয় করেছে। ইতিপূর্বে জীবন ধারণের মত সামান্য খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থাও তার কাছে ছিল না। এমন কি, সে শিয়াল কোট শহরে গমন করে মাত্র পনেরো টাকা মাসিক বেতনে একজন নিম্ন মানের কর্মচারীরূপে চাকুরি নিতে বাধ্য হয়। সে মানুষের পায়ের কাছে বসে থাকত। অতএব, তার মত একজন চোর ও অন্যায়ভাবে পরের সম্পদ গ্রাসকারী ব্যক্তি নিজেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তুলনা করে, যিনি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন যে, মৃত্যুকালে তাঁর বর্মটি এক ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল। আর সে বলে, যে ব্যক্তি আমার এবং মুস্তফার মধ্যে পার্থক্য করে, সে আমাকে চিনে নি ও আমাকে দেখিনি। (গোলামের উক্তি যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজলের’’ অন্তর্গত, ১৭ই জুন ১৯১৫ খৃ:) সে আরো অগ্রসর হয়ে বলে, আমি মসীহ আমি কালিমুল্লাহ, আমি মুহাম্মদ ও আহমদ, যাকে আল্লাহ মনোনীত করেছেন। (গোলামের দুররে ছামীন।) সে আরো বলে: যে আমার জামাতে প্রবেশ করবে সে যেন ছাইয়েদুল মুরছালীনের সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (গোলামের খুতবাতুল ইলহামিয়া ১৭১ পৃ:) এরূপ বিশ্বাস ঘাতক মিথ্যাবাদী কি করে এ ধরনের ভ্রান্ত দাবিকরতে পারে যে, ‘‘যে ব্যক্তি তার দলে প্রবেশ করবে সে সাইয়েদুল মুরসালীনের সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’’। অথচ, প্রকৃত পক্ষে এরা তো মুসাইলামাতুল কাজ্জাব ও আসওদ আনাসীর অনুসারীদের সারিতেই প্রবেশ করেছে এবং ঐ মরদুদ শয়তানের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, যে তাদেরকে ও তাদের নেতাকে বিপথগামী করেছে। এ মির্জা আরো বলে, ‘‘ সে অবিকল মুস্তফা!’’ অথচ, মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুনিয়াকে এমনি ভাবে ত্যাগ করেছেন যে, তাঁর বর্মটি জনৈক ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল এবং তাঁর সহধর্মীনিগণ পানি ও খেজুরের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করতেন, তবে তাঁর খাদেমগণ স্বর্ণ রৌপ্য দ্বারা তাঁর ঘর পরিপূর্ণ করে দিতে পারতেন। আমাদের এ কাদিয়ানীর মত ঐাকাত ও সাদা-কাতের নামে নহে, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য । আর এ মহান রাসূলের খলীফা মারা গেলে তাকে পুরাতন কাপড়ে দাফন করা হয়। হাঁ, ইনি হলেন তাঁর প্রথম খলীফা আবু বকর সিদ্দিক রা.। তাঁর দ্বিতীয় খলীফা যিনি কায়সার ও কিসরার রাজত্বের মালিক হওয়া সত্ত্বেও পরিধানের জন্য ছেঁড়া কাপড় ব্যতীত কিছুই পান নি। একদা যখন তিনি নিখুঁত দু’টি চাদর পরিধান করেছিলেন, তখন তাঁর একজন প্রজা দাঁড়িয়ে বলল: আপনি এটা কোত্থেকে পেলেন? উত্তরে তিনি বললেন: ‘একটি আমার এবং অপরটি আমার ছেলে আমাকে দান করেছে’। তাদের অবস্থা এ মিথ্যুকের মত ছিল না। যে পুস্তক মুদ্রণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে। অতঃপর সে পুস্তক না ছাপিয়ে টাকা পয়সাগুলো তার নিজ লোকদের মধ্যে ব্যয় করে ফেলে আর, যখন তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন সে বলে এ সম্পদ আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। কাউকে আমি একটি পয়সা ফেরত দেব না এবং এ ব্যাপারে কাউকে উত্তরও দেব না। যে ব্যক্তি আমার কাছে হিসাব চায় তার জন্য উচিত সে যেন এরপর আমাকে আর কিছুই না দেয়। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল হিকম ২১শে মার্চ ১৯০৫ খৃ:) এতো গেল তার অবস্থা। আর, এর পরও তার খলীফাগণ এমন বিরাট সুউচ্চ অট্রালিকায় বসবাস করছে, যার কল্পনা এর পূর্বে তারা করতে পারেনি। এমনকি স্বপ্নেও না । এ সকল সুবৃহৎ ও বিরাট প্রসাদ পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর নিয়োজিত করা হয়। (আল ফজল ১২ই অক্টোবর, ১৯২৪ খৃ:) তার খলীফা যখন ইংল্যান্ডে ভ্রমণে যায়, তার পিতার ঐ সকল অনুগ্রহকারীদের সাক্ষাতে ধন্য হওয়ার জন্য, যারা তার পিতার মাথায় নবুয়তের মুকুট পরিয়েছিল তখন কেবল মাত্র এ ভ্রমণে ব্যয় করার জন্য চল্লিশ হাজার টাকা সাথে নেয়। (পয়গামে সুলেহ ২৩শে জুলাই, ১৯২৪ খৃ:) এখান থেকে সে প্যারিসে ভ্রমণ করে এবং তথায় আন্তর্জাতিক নৃত্যের আসরে যোগদান করে। আন্তর্জাতিক নৃত্যে নর্তকীরা স্বভাবত: উলঙ্গ কিংবা অর্ধোলঙ্গ থাকে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, যেহেতু আমার দৃষ্টি শক্তি দুর্বল এবং মঞ্চ আমার থেকে দুরে ছিল, তাই আমি নর্তকীদের উলঙ্গপনা দেখিনি। এ ধরনের সহচরদেরকে নিয়ে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার কাদিয়ানী কি গর্ব করে ? এ ব্যক্তি তো শুধু তার সহচরই নহে, বরং সে তার ছেলে এবং দ্বিতীয় খলীফা। এ বিষবৃক্ষ ও তার ফল হতে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি। আবারও আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি। এ সত্ত্বেও বলা হয়, গোলামের আধ্যাত্মিক শক্তি রাসূলুল্লাহ আধ্যাত্মিক শক্তি হতে অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক শক্তিশালী। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের কালিমাতুল ফাছল যা রিভিউ অব রিলিজিওনের অন্তর্ভুক্ত, ১৪৭ পৃ:) সুতরাং এ হল তার আধ্যাত্মিকতা যে , সে আফিম ভক্ষণ করে , মদ্য-পান করে, [১ ইতিপূর্বে তার মদ্যপান, আফিম ভক্ষণ ও নারীপ্রেম সম্পর্কে তৃতীয় প্রবন্ধে ‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী কতৃক নবূগণের অবমাননা’ উৎস ও উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করেছি।] নারীদের প্রতি আশক্ত হয়, ইংরেজের দাসত্ব করে এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়। তার ছেলে নৃত্যের আসরে উপস্থিত হয় এবং বড় বড় অট্টালিকায় বসবাস করে , যে গুলোকে কুকুর পাহারা দেয় । সে এবং তার ভক্তরা কুরআনকে পরিবর্তন করে এবং যে সকল আয়াত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে, উহাকে সে নিজের সহিত সম্পৃক্ত করে । আর, যিনি সমস্ত মানব জাতির উত্তম, তার চেয়েও এ ভন্ডের মর্যাদাকে তারা উচ্চ বলে গণ্য করে।
অপর এক কাদিয়ানীর বৃত্তান্ত শুনুন ! যার মধ্যে সকল প্রকার কুকর্ম ও বদ খাছলত একত্র রয়েছে। প্রথমত: সে কুরআন মজীদ তাহরীফ (বিকৃত) করে এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে। দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননা করে। তৃতীয়ত: এ মিথ্যাবাদী দাজ্জালকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ও সকল নবীর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। সে বলে, আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে যে অঙ্গিকারের কথা রয়েছে- ‘‘আর যখন আল্লাহ তায়ালা নবীগণ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত দিয়েছি, তারপর যদি তোমাদের কাছে কোন রাসূল আসেন যিনি তোমাদের কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করেন, তখন অবশ্যই তোমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা কি ইহা স্বীকার করলে এবং এ কথার উপর আমার অঙ্গীকার গ্রহণ করলে? তাঁরা উত্তর দিল, আমরা স্বীকার করলাম’। তখন আল্লাহ বললেন: ‘‘তোমরা সাক্ষী থাক, আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। এরপর যারা এ অঙ্গীকার থেকে বিমুখ হবে তারাই হল অবাধ্য ফাসেক’’। [২ সুরা আল-ইমরান-৮১ও ৮২] সেই অঙ্গীকার গোলাম আহমদের জন্য, মুহাম্মদের জন্য নহে। আর, যাদের নিকট থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছে, তারা হলেন নূহ, ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসা আঃ। এমনি ভাবে, এ অঙ্গীকার মুহাম্মদ সা: হতেও গ্রহণ করা হয়েছে। অতএব, ধন্যবাদ। কারণ অঙ্গীকারের লক্ষ্য ব্যক্তি এসে গেছেন। সুতরাং মুসলমানগণ দ্রুত এ প্রতিশ্রুতি পালন করে যেন আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে যায়। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল-ফজল’’ ২৬শে ফেব্র: ১৯২৪ খৃ:) এ বক্তব্যটি কুরআন পরিবর্তন করা, মুসলমানগণকে কুরআনের অর্থ অনুধাবন ও মুহাম্মদে আরাবী থেকে দুরে সরিয়ে রাখার কাদিয়ানী পরিকল্পনার একটা চিত্র প্রদান করে। যে পরিকল্পনাটি তারা কাফের সাম্রাজ্যবাদীদের ইঙ্গিতে গ্রহণ করেছিল যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিত্ব ও কুরআনের জীবনী শক্তি সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত। এ কারণেই গোলাম আহমদের নবুয়্যত প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদাকে খাট করা এবং মুসলমানদের অন্তর থেকে তাঁর মহববত ও ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নেওয়া এবং কুরআনের অর্থ ও মর্ম বিকৃত করা । যদিও এর মূল শব্দকে বিকৃত করা সম্ভব নহে। তাই, গোলাম আহমদই প্রথম ব্যক্তি যে ইসলামের নামে কুরআন পরিবর্তন করার ভিত্তি স্থাপন করে। তারপর, তার ভক্ত ও অনুসারীগণ অত্যন্ত ঘৃণিত পন্থায় ও নির্লজ্জ ভাবে কুরআন পরিবর্তনের কাজে তার অনুসরণ করে চলে। এখানে আমরা তার পক্ষ থেকে কুরআনে কারীমের পরিবর্তন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননার কথা এক সঙ্গে উল্লেখ করছি। সে বলে: আল্লাহর বাণী ‘‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, আর তাঁর সাথীরা কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর এবং তারা পরস্পর অতি দয়ালু।’’ [১ সুরা আল-ফাতহ-২৭] এর দ্বারা আমিই উদ্দেশ্য। কেননা , আল্লাহ তাআলা এ ওহীতে আমার নাম রেখেছেন মুহাম্মদ ও রাসূল। এভাবে অপর কয়েক স্থানে আল্লাহ আমাকে এ নামে উল্লেখ করেছেন’। (গোলামের উক্তি যা কাসেম কাদিয়ানীর ‘‘তাবলীগে রেসালাতের’’ অন্তর্ভুক্ত, ১০ম খন্ড ১৪পৃষ্ঠা।) সে বলে, আমাকে অবগত করা হয়েছে যে, কুরআন ও হাদীসে আমার সম্পর্কে খবরাখবর বিদ্যমান আছে। আমাকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে আল্লাহর এ বাণীতে ‘‘আল্লাহ তাআলাই হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে স্বীয় রাসূলকে প্রেরণ করেছেন যাতে এ দ্বীনকে সমুদয় দ্বীনের উপর প্রাধান্য দান করেন। [২ সুরা তাওবা- ৩৩, সুরা আল ফাতহ-২৮ সুরা আল সাফ-৭] (এজাজে আহমদী গোলাম কাদিয়ানীর নুযুলুল মাসীহের পরিশিষ্ট, ৭ পৃ:।) আল্লাহ তাআলার এ বাণীতেও আমাকেই লক্ষ্য করা হয়েছে ‘‘আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্ব জগতের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’’ [৩ সুরা আল-আম্বিয়া-১০৭] (গোলামের ‘আরবাঈন’ ৩ নম্বর ২৫ পৃষ্ঠা।) আমি আল্লাহর ঐ বাণীরও লক্ষ্য বস্ত্ত- ‘‘তোমাকে মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করবেন’’। (গোলামের ‘আরবাঈন’ ১০২ পৃষ্ঠা।)
এর পর তারই পুত্র বশীর আহমদ একই পন্থায় অগ্রসর হয়ে বলে ‘‘রাসূলগণ যার সুসংবাদ দিয়েছেন, তিনি হলেন গোলাম আহমদ, আল্লাহর নবী মুহাম্মদ নহেন। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে তিনিই উদ্দেশ্য ‘(ঈসা) সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, আমার পরে যে রাসূল আসবেন তার নাম আহমদ’। [৪ সুরা আছ ছাফ-৬] কেননা, আল্লাহর আয়াতের উদ্দেশ্য হল মুহাম্মদ ব্যতীত অন্য ব্যক্তি। অতএব, বুঝা গেল যে, এ বাণীর উদ্দেশ্য গোলাম আহমদ, মুহাম্মদ নহেন। (বশীর আহমদের প্রবন্ধের সারাংশ, যা রিভিউ অব রিলিজিওনের অন্তর্ভুক্ত ১৩৯- ১৪১ পৃ: আল-ফজল পত্রিকায় প্রচারিত, ১৯শে আগস্ট ১৯১৬খৃঃ) এর উপরই ভিত্তি করে কাদিয়ানীরা বলে, তাদের কালেমায়ে শাহাদাত অবিকল মুসলমানদের কালিমায়ে শাহাদাত। কেননা, তাদের উদ্দেশ্য হল গোলাম আহমদের রেসালাতের স্বীকৃতি। আর এ উদ্দেশ্য মুসলমানদের কালিমা দ্বারাই সাধিত হয়। কালেমাটি হল এই ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এ কালেমাতে গোলামের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুহাম্মদ’ যেমন আল্লাহর এ বাণীতেও নামকরণ করা হয়েছে: ‘‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, আর যারা তাঁর সাথী------------’’। অতঃপর বলে: ‘‘গোলাম আহমদের নবুয়তের শাহাদাতের জন্য আমরা আমাদের ধর্মে কোন নতুন কালেমার প্রয়োজন বোধ করি না।’’ কেননা, নবী এবং গোলাম আহমদের মধ্যে কোন তফাত নেই। যেমন, গোলাম আহমদ নিজেই বলেছে- ‘আমার অস্তিত্ব তাঁরই অস্তিত্ব এবং যে ব্যক্তি আমার ও মুস্তফার মধ্যে পার্থক্য করে সে আমাকে চিনতে পারে নি’ । সে আরো বলে, আল্লাহ তাআলা পুনরায় ‘খাতামুন নাবীয়্যীন’ কে প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, মসীহে মাওউদ (গোলাম) স্বয়ং সে-ই মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ, যাকে ইসলাম প্রচারের জন্য দ্বিতীয় বারের মত প্রেরণ করা হয়েছে। এ জন্যই আমরা অপর কোন কালেমায়ে শাহাদাতের প্রয়োজন বোধ করি না। অবশ্য যদি প্রেরক ব্যক্তি মুহাম্মদ ব্যতীত অন্য কেহ হত, তাহলে আমাদের নূতন কালেমার প্রয়োজন হত। (কালিমাতুল ফছল’ রিভিউ অব রিলিজিওন্স হতে উদ্ধৃত, ১৫৮ পৃ:, ৪নম্বর ১৪ খৃ:।) কাদিয়ানীরা তাদের বিভ্রান্তিকরও অমূলক কথা বার্তায় আরো অগ্রসর হয়ে কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজলে’’ প্রচার করেছে যে, যে স্থানে গোলাম আহমদ সমাধিস্থ হয়েছে, সেই স্থান ও উহার আশে পাশের স্থানসমূহ বেহেস্তের একটি টুকরা বিশেষ এবং গোলাম আহমদের কবর (নাউজুবিল্লাহ) রাসূলুল্লাহর কবরের মতই। এ পর্যন্তই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং তারা বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই গোলাম আহমদের কবরে সালাম দেন। এ কথা তারা স্পষ্টভাবে বলছে। কাদিয়ানে জনৈক দীক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তি ঘোষণা করে, যে ব্যক্তি দারুল আমান কাদিয়ানে আসে (এ কাদিয়ানকে তারা দারুল আমান নামে আখ্যায়িত করত, উহা হিন্দুদের দখলে চলে গেলে কাদিয়ানীরা সেখানে বেহেস্তের টুকরা ও তাদের রাসূলের কবর ছেড়ে পলায়ন করে। সে স্থান সম্পর্কে বলছে) এবং নূরে ভরপুর মাজারে উপস্থিত হয় না, তার অবস্থা কেমন হবে? তারা কি জানে না যে এ পবিত্র রওজাতে? ঐ মহান ব্যক্তির শবদেহ সমাধিস্থ আছে, যার প্রতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম প্রেরণ করেন। অতএব, তোমরা এ বরকতময় কবরে উপস্থিত হয়ে ঐ সকল বরকত লাভ করতে সক্ষম হবে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজায় নির্ধারিত রয়েছে। সুতরাং, কতই না দুর্ভাগা ঐ ব্যক্তি যে কাদিয়ানে এসে হজ্জে আকবর দ্বারা উপকৃত হয় না। (আল ফজল পত্রিকা যা ১৮ ডিসেম্বর ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত।) নিশ্চয়ই হে দুর্ভাগা সম-প্রদায়! তোমরা সবাই দুর্ভাগ্যে সমান। কারণ, যে ব্যক্তি খতমে নবুয়্যতকে অস্বীকার করে এবং খাতামুন নাবীয়্যীনকে অবিশ্বাস করে , আর গোলাম আহমদের মত একটা দাজ্জালকে নবী বলে বিশ্বাস করে, শুধু নবীই নহে বরং সে মুহাম্মদে আরাবীর সমতুল্য এবং তার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান মনে করে, সে যদি এ দুর্ভাগা না হয়, তবে আর কে হবে? ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি সত্য দ্বীন সহ স্বীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁরই দ্বারা নবুয়্যতকে সমাপ্ত করেছেন। তাঁকে আদম সন্তানের সরদার বানিয়েছেন এবং সমগ্র মানব জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তাঁর আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর অবাধ্যতাকে আল্লাহর অবাধ্যতা [১ বুখারী কতৃক বর্ণিত হাদীছের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ বলেনঃ ‘যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল, আর যে আমার অবাধ্য হল সে আল্লাহর অবাধ্য হল’।] এবং তাঁর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করাকে আল্লাহর কাছে বাইয়াত গ্রহণ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, [২ আল্লাহপাক বলেনঃ ‘‘নিশ্চয়ই যারা তোমার বাইয়াত করেছে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বাইয়াত করেছে’’ সুরা আল-ফাতহ-১১।] সেই আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অভিশপ্ত আর কেহ নহে, যে আল্লাহর রাসূলের অবমাননা করে এবং তাঁর উপর নিজের প্রাধান্য দাবিকরে। এখানে আমি স্বয়ং গোলাম আহমদের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সে বলে- যে ব্যক্তি কোন নবীকে তুচ্ছ মনে করে সে কাফের। (গোলামের আইনুল মা’ রেফাত’’ ১৮পৃঃ) এ বক্তব্যের আলোকে গোলাম ও তার জামাত যারা কাদিয়ানী নামে পরিচিত কি হবে? তার ছেলে ও খলীফা মাহমুদ আহমদের কি হবে? যে এমন ঘৃণ্য কথা বলে, ‘প্রত্যেকের জন্য এটা সম্ভব যে, সে যে মর্যাদায় উন্নতি লাভ করতে বা পৌঁছতে চায়, তা সে পেতে পারে। এমন কি যদি সে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ও সম্মান থেকে অগ্রগামী হতে চায়, তাতেও সে সফলকাম হতে পারে। (কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদের ‘‘ইওমিয়াত’’ যা আল ফজল পত্রিকায় প্রচারিত ১৭ই জুলাই ১৯২২ সনে প্রকাশিত।) এই হল দ্বিতীয় অভিশপ্ত ব্যক্তির বক্তব্য, যে এমন ব্যক্তি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছে, যাকে রাত্রিকালে মসজিদে আকসার ভ্রমণ করান হয় আসমানের দিকে মে’ রাজের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে এবং যার পেছনে সকল নবী নামাজ আদায় করেন। [৩ যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর ফেরেস্তাগণ নবীর উপর দরুদ প্রেরণ’’ সুরা আহযাব।] যার প্রতি আল্লাহ ও ফেরেস্তা এবং মুমিনগণ দরুদ ও সালাম প্রেরণ করেন। [৪ তিরমিজী ও আহহমদ ।] যিনি কেয়ামতের দিন হামদের পতাকাবাহী হবেন [৫ মসনদে আহমদ] এবং সকল নবীর পক্ষ হতে বক্তব্য রাখবেন। যার সম্পর্কে বরকতময় মহান প্রভু বলেছেন: ‘‘যাতে আল্লাহ তাআলা আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেন’’ [৬ সুরা আল ফাতহ- ২] আরো এরশাদ হচ্ছে- ‘‘তিনি হেদায়েত ও সত্য ধর্ম দিয়ে তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ ধর্মকে অন্য সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন’’। [৭ সুরা আল ফাতহ- ২৮৮ সুরা আহযাব-৪৫] আরো বলেন- ‘‘হে নবী আমি তোমাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এবং আল্লাহর নির্দেশে তার প্রতি আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে পাঠিয়েছি’’। [] কিন্তু কাদিয়ানী খলীফা বলে: কেহ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ও সম্মান হতে অগ্রসর হতে চায়, তবে সে অগ্রগামী হতে পারবে। ‘‘আল্লাহ পানাহ! আল্লাহ পানাহ! এ কুকুর হতে বড় কুকুর আর কে হতে পারে? এ ঘৃণ্য কাজ হতে বড় ঘৃণ্য কাজ আর কি হতে পারে? এবং এ নির্লজ্জতা হতে বড় নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? কেমন করে এ সকল পাপিষ্ঠ বদমাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার দুঃসাহস করে ? যদি সমস্ত সৃষ্টিকে পাল্লার একদিকে রাখা হয় এবং তাঁকে অপর দিকে রাখা হয়, তবে , নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহর দিকটাই ভারী হবে। এতদ সত্ত্বেও তারা দাবিকরে যে , মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যেরূপ বিশ্বাস রাখে, তারাও অনুরূপ বিশ্বাস পোষণ করে । তবে কোন মুসলমান কি এরূপ কথা বলতে পারে? যা স্মরণ হওয়া মাত্রই অন্তর কেঁপে ওঠে। মহান আল্লাহ তাআলা সত্যই বলেছেন ‘‘তারা আল্লাহ ও ঈমানদার গণের সাথে প্রতারণা করে, অথচ তারা নিজেদের ছাড়া আর কাউকে প্রতারণা করছে না । তবে তারা এর খবরও রাখে না তাদের অন্তরের মধ্যে রোগ রয়েছে, আল্লাহ সে রোগকে আরো বাড়িয়ে দিলেন। আর, তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি তাদের মিথ্যা উক্তির জন্য।’’ [১ সুরা বাকারা ৯ও ১০] তারা কি মনে করে যে , রাসূলুল্লাহ সা: এর মর্যাদাকে এভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারবে যেভাবে তাদের ঘৃণ্য পূর্ব-পুরুষগণ এ ধারণা ও চেষ্টা করে আসছে? তাদের পূর্ব-পুরুষদের প্রতিবাদে মহান আল্লাহ যা বলেছেন- আমি তাদেরকে তাই বলব: আল্লাহ বলেন ‘‘তারা চায় আল্লাহর নূরকে ফুৎকারে নিভিয়ে দেবে পক্ষান্তরে আল্লাহ স্বীয় নূরকে পরিপূর্ণ না করে ছাড়বেন না ; যদিও কাফেরগণ তা অপছন্দ করে। তিনিই আল্লাহ যিনি স্বীয় রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাকে একে সমূদয় ধর্মের উপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরেকগণ তা অপছন্দ করে।’’ [২ সুরা তাওবা- ৩২-৩৩] কাফের ও মুরতাদগণ ! তোমরা ঘৃণা করতে থাক এবং তোমাদের সকল শক্তি দিয়ে আল্লাহর নূরকে ফুৎকার দিয়ে নির্বাপিত করার জন্য চেষ্টা চালাও । তোমাদের সঙ্গী-সাথী সাহায্যকারী ইংরেজ প্রভু ও অন্যান্যদেরকে এ কাজে আহবান কর। অতঃপর সমবেত চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাও। তবুও তোমরা কিছুই করতে পারবে না । কেননা, আল্লাহ তাআলা স্বীয় নূরকে পরিপূর্ণ করতে চান, যদিও তোমরা তা অপছন্দ কর। তোমরা ও তোমাদের প্রভুদের ভাগ্যে লাঞ্ছনাই লাঞ্ছনা। তোমরা উপনিবেশবাদী কাফের- গণকে ভারত উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখতে পারনি। তারা প্রাচ্য অঞ্চল হতে বের হয়ে যাওয়াতে হতাশ হয়ে পড়েছ। তোমরা মুসলমানদের অন্তর হতে জেহাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছ। তোমরা মুসলমানদের ঘাড়ে ইংরেজদের আনুগত্যের শিকল পরাতে বিফল হয়েছ। এমনি ভাবে তোমরা খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীনের উপর মিথ্যাবাদী দাজ্জাল গোলাম আহমদের প্রাধান্য প্রমাণ করতে পরনি এবং কখনও পারবে না। যখন তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দ্বীনের নামে কাদিয়ানী মতবাদের দাওয়াত প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ, তখন তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান ব্যক্তিত্বকে খাট করার ব্যাপারে তোমাদের অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়েছ। অতএব রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের অন্তরে যে হিংসা ও বিদ্বেষ লুক্কায়িত রয়েছে, তা তোমরা বাহ্যিক ভাবে মুখে উচ্চারণ কর না এবং তোমাদের আসল বিশ্বাস ও প্রকৃত উদ্দেশ্যকে তোমরা প্রকাশ কর না; যাতে তোমাদের আসলরূপ প্রকাশিত না হয় এবং তোমরা সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত না হও। কিন্তু আমরা তোমাদের মুখের ও মূল লক্ষের পর্দা সরিয়ে দেব। এতে এখন পর্যন্ত যারা সতর্ক হয়নি তারা সতর্ক হয়ে যাবে। আমরা তোমাদেরকে তোমাদের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে আহবান জানাচ্ছি। উপনিবেশবাদীদের সেবা করার জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, অথচ উপনিবেশবাদীরা এ উপমহাদেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং তারা এশিয়া ও আফ্রিকায় আবার ফিরে আসা থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। মুসলমানদের জিহাদের বিশ্বাসকে বিকৃত করার জন্য তোমাদের ও তোমাদের নবীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ মুসলমানরা জিহাদ করে যাচ্ছে। অতএব, এখন তোমাদের উচিত, তোমরা তোমাদের কার্যকলাপের উপর লজ্জিত হওয়া এবং ইসলাম ও দ্বীনে মুহাম্মদী এবং শরীয়তে মুহাম্মদীর দিকে তোমাদের ফিরে আসা। তা হলে আশা করা যায় যে পূর্ববর্তী কাজের উপর তোমাদের লজ্জিত হওয়ার কারণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের জন্য সুপারিশ করবেন এবং তার শানে তোমাদের অবমাননা করার অপরাধও ক্ষমা করে দেবেন। কেননা, তাকে জগৎ বাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে।সুতরাং ক্ষমা ও মার্জনা করা তার সুমহান অভ্যাস। তাই, তোমরা তার পথে ফিরে আস। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দানশীল ও দয়াবান। আশা করা যায় , তিনি তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি মক্কা বিজয়ের দিন ঐ সকল লোকদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, যারা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং তাকে তার নিজ আবাস ভূমি ও তার পূর্ব পুরুষ গণের আবাস ভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে বহিষ্কৃত করেছিল এবং তার ও তার সাথীদের সংঙ্গে লড়াই করেছিল, সে দিন তিনি বিজয়ী ও ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী ছিলেন: আজ তোমাদের উপর কোন অভিযোগ করা হবে না, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন; তিনি পরম করুণাময়।’’ অতএব, হে অপরাধীগণ, সে দিন আসার আগেই ‘যে দিন কোন বেচা-কেনা ও সুপারিশ চলবে না, কাফেরগণই হল অন্যায়কারী।’ এবং তোমাদেরকে ঐ কথা বলার পূর্বেই ‘হে পা পিষ্ট গণ আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও’’ তোমরা দ্রুত তওবা কর এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনিই হলেন ঐ মহান রাসূল যিনি বলেছেন: ‘‘ইসলাম তার পুববর্তী সকল অপরাধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং হিজরত তার পূর্ববর্তী সকল অপরাধকে মুছে ফেলে’’। [১ বুখারী ও মুসলিম।] তিনি আরো বলেছেন: ‘‘আল্লাহ তার বান্দার তওবাতে ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন যে বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে তার উট হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ার পর সে তার উট ফিরে পেল’’। [২ বুখারী।] তিনি সেই ব্যক্তি যিনি তার চাচার হত্যাকারীকে যখন সে ইসলাম গ্রহণ ও তওবা করে এসেছিল, ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং যে মহিলা তার চাচার কলিজাকে চিবিয়েছিল, সে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আসলে তাকে তিনি মাফ করে দেন। তোমাদের উপর শাস্তি পতিত হওয়ার আগে তোমরা তাড়াতাড়ি তওবা কর। আল্লাহর কসম! যিনি বিশবজগৎ ও উহার অন্তর্ভুক্ত সকল বস্ত্তকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তওবা করার পূর্বে মারা যাও, তবে তোমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল খুবই খারাপ হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন এবং তোমাদের জন্য ইসলামের পথ উজ্জ্বল করুন। তোমাদেরকে নবুয়তের দাবিদার এ মিথ্যাবাদী থেকে দূরে রাখুন, যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননাকারী, নবুয়তের চাদর চোর, কাফেরদের সেবক। কেবল মাত্র আল্লাহর তওফীক ও ক্ষমতা ব্যতীত গুনাহ থেকে বাঁচার এবং এবাদত করার কোন শক্তি কারো নেই। তিনি উত্তম অভিভাবক ও কার্য সমাধা কারী। দরুদ ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, যিনি সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং তার পরিবার বর্গ, সাহাবায়ে কেরাম ও বন্ধু বান্ধবের উপর।
আমীন।
এর চেয়েও অধিক সে বলে: সমস্ত নবী রাসূলগণকে যা দেওয়া হয়েছে তার সমস্তটাই তাকে দেয়া হয়েছে। [৪ দুরএর ছামীন এর টিকা, পৃষ্ঠা ২৮৭ ও ২৮৮, গোলাম রচিত।] সে এর উপরও সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তার ইংরেজ প্রভুর ইঙ্গিতে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীনের মর্যাদার উপর আক্রমণ করতে, তার সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে এবং তার উপর নিজকে প্রাধান্য দিতে উদ্যত হয়েছে। তাই, সে বলে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিন হাজার মু’ জেজা ছিল, কিন্তু আমার মু’ জেজা সমূহ এক মিলিয়নেরও অধিক। (গোলামের ‘‘তুহফায়ে কুলরা’’ ৪০ পৃষ্ঠা, এবং ‘‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’’ ৪১ পৃষ্ঠা।) হায়! যদি বুঝতে পারতাম, তার মু’ জেজা সমূহ দ্বারা তার কি উদ্দেশ্য? তার মু’ জেজা সমূহ দ্বারা যদি এ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে, সে পুরুষত্ব থেকে বঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও তার সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করেছে; তা হলে এটা তার স্ত্রীর মু’ জেজা হরে, তার মু’ জেজা নহে। লক্ষ্য করুন! সে তার উক্ত মু’ জেজার উল্লেখ করে বলেছে: আমার দ্বিতীয় মু’ জেজা হল, বিবাহ সম্পর্কে যখন পবিত্র ওহী অবতীর্ণ হল, তখন আমি হৃৎপিন্ড, মস্তিষ্ক ও শারীরিক দুর্বলতা, বহু মূত্র, মাথাঘোরা ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ছিলাম। (আল্লাহ, আল্লাহ! একদিকে মারাত্মক রোগ সমূহের আক্রমণ, অপরদিকে বিবাহের অনুরাগ।) এ সকল মারাত্মক রোগসমূহ নিয়ে যখন আমি বিবাহ করলাম তখন কেহ কেহ আক্ষেপ করলেন। কেননা, আমার অবস্থা পুরুষত্ব না থাকার মতই ছিল এবং আমি মৃত্যুমুখী বৃদ্ধের ন্যায় ছিলাম । এজন্য উস্তাদ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী আমার কাছে একটি পত্র লিখলেন যে, এ অবস্থায় তোমার বিবাহ করা উচিত ছিল না; যাতে কোন প্রকার বিপদের সম্মুখীন হতে না হয়। কিন্তু এ সকল রোগ ও দুর্বলতা সত্ত্বেও আমি স্বাস্থ্য ফিরে পাই এবং চারটি ছেলে লাভ করি। (গোলামের ‘‘নুযুলুল মাসীহের’’ হাসিয়া, ২০৯ পৃষ্ঠা।) উল্লেখ্য যে, এ বিবাহ গোলামের দ্বিতীয় বিবাহ ছিল। তখন তার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে এবং তার বর্ণনাকৃত রোগ সমূহতো তার সঙ্গে ছিলই। এর চেয়ে অধিক সুক্ষ কথা হল এই যে, তার এ যুবতী স্ত্রীর গর্ভে দশটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। অথচ তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে দীর্ঘকালে মাত্র দ’টি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে প্রথম সন্তানের জন্মের সময় তার বয়স মাত্র পনেরো বা ষোলো বৎসর ছিল , যেমন সে নিজেই এর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে: ‘আল্লাহই জানেন যে সন্তানের জন্য আমার কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না। অথচ যখন আমার বয়স পনেরো বা ষোলো, তখন আমি সন্তান লাভ করি’। (‘‘ইরশাদুল গোলাম’’ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল হিকমের’’ অন্তর্ভুক্ত এবং মঞ্জুর কাদিয়ানীর পুস্তক ৩৪৩ পৃষ্ঠা হতে গৃহীত।) সে তার প্রথম খলীফা ও তার সাথী নুরুদ্দীনের কাছে লিখেছে- যখন আমি বিবাহ করি, তখন আমার বিশ্বাস ছিল যে, দীর্ঘ দিন যাবৎ আমার পুরুষত্ব নেই। (তা সত্ত্বেও বিবাহের পরপরই সন্তান জন্ম গ্রহণ করতে থাকে। ‘‘মাকতুবাতে আহমদিয়া’’ ৫ম খন্ড ১৪৫পৃষ্ঠা।)
এটা তার অথবা তার ভক্তগণের কাছে হয়তো মু’ জেজা হতে পারে। কিন্তু আমরা নিষ্ঠাবান মুসলমানগণ একে হাস্যাস্পদ, লাঞ্ছনা ও পরীক্ষা ছাড়া কিছুই মনে করি না। যেমন মহান শেখ মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী গোলামের নিকট প্রেরীত তার পত্রে এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ ধরনের মু’ জেজা দ্বারা কি ভন্ডনবী কাদিয়ানী রাসুলে আরাবীর সাথে গর্ব ও অহংকার করতে পারে? যার সম্মানে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল, পাথর ও বৃক্ষ যাকে সালাম জানিয়েছিল, যার আঙুল সমূহের মধ্য হতে পানি প্রবাহিত হয়েছিল এবং যার বিচ্ছেদে খেজুরের কান্ডটি উষ্ট্রীর ন্যায় স্ব-রবে কেঁদেছিল। হযরত আনাছ বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন যে, মক্কা-বাসীরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তাদেরকে একটি মু’ জেজা দেখাবার জন্য আবেদন করল। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে চন্দ্র দু’ভাগে বিভক্ত করে দেখালেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের রা. বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেন- আমরা একদা মিনায় ছিলাম, এমন সময় চন্দ্র দু’খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায় , এক খন্ড পাহাড়ের এক পার্শ্বে এবং অপর খন্ড পাহাড়ের অপর পার্শ্বে ছিল। অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন: তোমরা সাক্ষী থাক। [১ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এবং আহমদ ও তায়ালীসী তাদের মসনদদ্বয়ে উদ্ধৃত করেছেন, আর শব্দাবলী মুসলিমের।]
হযরত জাবির বিন সামুরা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন- আমি মক্কার ঐ পাথরটিকে চিনি যে আমাকে নবুয়্যত লাভের পূর্বে সালাম দিত। নিশ্চয়ই আমি এখনও ঐ পাথরটিকে চিনি। [২ মুসলিম মুসনদে আহমদ, তবকাতে ইবনে সা’দ মুসনাদে তায়ালীসী।] অপর বর্ণনায় আছে: ‘‘যখন আমি নবুয়্যত প্রাপ্ত হই।’’ [৩ তিরমিযী।] (একথাটি বর্ণনার সাথে সংযুক্ত রয়েছে) হযরত আলী বিন আবি তালিব রা. বলেন, আমি মক্কায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে ছিলাম। এক সময় তার সঙ্গে মক্কার কোন প্রান্তে বের হলাম, তখন কোন পাহাড় বা বৃক্ষ তাঁর সম্মুখীন হলেই বলত, আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ । [১ মুসনাদে দারামী ও তিরমিযী।] হযরত আনাছ বিন মালিক রা. বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখলাম, তখন আছরের সময় হয়ে গিয়েছিল; লোক জন ওজুর পানি তালাশ করে পেল না। তারপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ওজুর পানি আনা হল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে পাত্রে নিজ হাতে রাখলেন এবং লোকজনকে এ পাত্র হতে ওজু করার নির্দেশ দিলেন। আনাছ রা. বলেন, আমি দেখতে পেলাম যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আঙুল সমূহের নীচ থেকে পানি উৎসারিত হচ্ছে। লোকজন সকলেই ওজু করলেন। আনাছ রা . বলেন, লোকের সংখ্যা প্রায় তিন শত ছিল। [২ ইবনে সা’দ মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে দারমী। তবে শব্দুসলিমের।] আর উষ্ট্রীর ন্যায় খেজুর কান্ডটি যে ক্রন্দন করেছে, সে সম্পর্কে আনাছ বিন মালিক রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর কান্ডে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন, পরে সাহাবীগণ তাঁর জন্য একটি মিম্বার তৈরি করলেন। তিনি এর উপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতে লাগলেন। তখন খেজুর কান্ডটি উষ্ট্রের ন্যায় কাঁদতে লাগল। রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বার থেকে নেমে এসে তাকে স্পর্শ করলে সে শান্ত হয়। [৩ তিরমিযী] এ হল সত্য ও বিশ্বস্ত নবীর মু’ জেজা সমূহ। এ ছাড়া আরো অনেক মু’ জেজা রয়েছে। এই ভন্ডনবী কাদিয়ানী অন্যত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নিজেকে অধিক মর্যাদাবান দাবিকরে বলেছে:- ‘‘তাঁর (মুহাম্মদের) জন্য চন্দ্র গ্রহণ হয়েছিল এবং আমার জন্য চন্দ্র ও সূর্য উভয়েরই গ্রহণ হয়। তুমি কি ইহা অস্বীকার কর? অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য কেবল চন্দ্র গ্রহণ হয়েছিল , সে স্থলে আমার জন্য চন্দ্র ও সূর্য উভয়ের মধ্যে গ্রহণ লেগেছিল। (গোলামের এজাজে আহমদী ৭১ পৃষ্ঠা।) সে আরো অধিক অগ্রসর হয়ে সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ও নির্বোধের মত বলে: নিশ্চয়ই ইসলাম প্রথম দিকে নব চন্দ্রের মত ছিল, অর্থাৎ একেবারে ছোট। অতঃপর নির্ধারিত হল যে, এ যুগে উহা পূর্ণ চন্দ্রে রূপান্তরিত হবে। এ দিকেই মহান আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন- ‘‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বদর বা পূর্ণ চন্দ্র দ্বারা সাহায্য করেছেন’’ (খুতবায়ে ইলহামিয়া ১৮৪ পৃষ্ঠা।) এমনিভাবে, আল্লাহর এ শত্রু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে চেয়েছে। যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন ‘‘আমি আপনার খ্যাতিকে সুউচ্চ করেছি।’’ মহান আল্লাহর এ বাণীকেও সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে:
(আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসাবে মনোনীত করলাম) [৪ সুরা মায়েদা, আয়াত ৩।] সে ইহুদীদের ন্যায় কুরআনকে পরিবর্তন করার ইচ্ছা করেছে। যেহেতু সে আল্লাহর বাণীর এমন অর্থ গ্রহণ করেছে যা আল্লাহর উদ্দেশ্য নহে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও এদিকে ইঙ্গিত করেন নি। কোন সাহাবী, ইমাম ও তাফসীরকারের মনে এমন কল্পনাও আসেনি। এমনিভাবে এ ঘৃণ্য ব্যক্তিটি সুদৃঢ় পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্রমশ: আউলিয়া, আইম্মা, সাহাবা ও আম্বিয়াদের অবমাননা করার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননার দিকে অগ্রসর হয়। তা সত্ত্বেও কাদিয়ানীরা চায় তাদেরকে যেন ইসলাম ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা না হয় এবং মুসলমানগণ তাদেরকে যেন ঘৃণ্য ধর্মান্তরিত দল বলে অভিহিত না করেন। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের উপর নিজেকে প্রাধান্য দেয় (তার দাবির প্রতি লক্ষ্য না করেও) এবং হুজুরের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে, সে কি মুসলমান? অথবা ইসলামের সহিত তার কি কোন সম্পর্ক আছে? অতঃপর যারা এর উপর তার হাতে বাইআত করে এবং তার কথায় বিশ্বাস করে, তারা কি মুসলমান? শুধু তাই নহে, বরং সে নিজে যা বলে ভক্তরা এর চেয়ে অনেক বেশি অত্যুক্তি করে। অপর এক অভিশপ্ত কাদিয়ানী মুবাল্লেগ ও কবি ভন্ডনবীর প্রশংসায় তারই সম্মুখে কতকগুলো কবিতা আবৃত্তি করে বলে: ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মধ্যে পুনরায় অবতরণ করেছেন: এমতাবস্থায় যে, তার এবারকার মর্যাদা প্রথম বারের চেয়ে অনেক বড়’’। যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পরিপূর্ণ আকৃতিতে দেখতে চায়, সে যেন কাদিয়ানী গোলাম আহমদকে দেখে নেয়। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘বদর’’ হতে উদ্ধৃত, ২৫ অক্টোবর ১৯০২ খৃ:) এ ইতর ব্যক্তিটি লিখেছে যে, গোলাম আহমদ এ কবিতাটি শুনে সন্তুষ্ট হয়েছে। অতএব, আবৃত্তিকারী এবং যার উদ্দেশ্যে আবৃত্তি করা হল, আর যারা উহা স্বীকার করে নিল, তারা কি পর্যায়ের গণ্য হতে পারে? এদের উপর ধ্বংস আসুক! অপর দিকে মহাশক্তি ও মহত্ত্বের অধিকারী আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, যে নবীর সম্মুখে উচ্চস্বরে কথা বলে, তার সকল আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং সকল নেকী ব্যর্থ হবে, অথচ তারা ঈমানদার। আল্লাহ বলেন- হে বিশ্বাসীগণ! নবীর কথার উপর তোমরা পরস্পরের ন্যায় তার সম্মুখে জোরে কথা বলিও না। আশঙ্কা রয়েছে যে , তোমাদের আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তোমরা তা অনুভব করতে পারবে না। [১ সুরা আল-হুজুরাত, ২নং আয়াত] সুতরাং যারা এ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যিনি সমগ্র মানব জাতির প্রতি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরিত, তার উপর এ দাজ্জাল ও কাজ্জাবকে উচ্চ স্থান দেয়, তাদের পরিণতি কি হবে? এরা মুরতাদ। আর শুধু মুরতাদ হওয়াইতো হত্যাযোগ্য অপরাধ। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি তার ধর্ম পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর’। [২ তিরমিযী] অপর এক হতভাগা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজলে’’ লিখেছে: ‘আমাদের বিশ্বাস যে, গোলাম আহমদের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তাআলা এত নিদর্শনা বলী এবং প্রমাণাদি অবতীর্ণ করেছেন যদি তা এক হাজার নবীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়, তবে তাদের নবুয়্যত প্রমাণিত হওয়ার জন্য এগুলো যথেষ্ট হবে এবং সকল নবীর মধ্যে যে সমস্ত পবিত্র গুণাবলি ছিল, তার সবটাই গোলাম আহমদের মধ্যে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজর’’ ১৬ অক্টোবর ১৯১৭ খৃ:)
জানি না , কোন কোন গুণাবলি দ্বারা কাফেরদের প্রশংসা ও দাসত্ব করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কোন নবীর মধ্যেই এ সকল গুণাবলি ছিল না এবং কোন সত্য নবীর জন্য তা উপযোগীও নহে। আর যদি এ সকল গুণাবলি দ্বারা কাপুরুষতা ও কপটতা উদ্দেশ্য হয়, তবে এ সকল দোষ থেকে নবীগণ পবিত্র ছিলেন। কারো কাছে হাত পাতা ও কাকুতি মিনতি করা আল্লাহর রাসূলগণের অভ্যাস ছিল না; বরং তারা ছিলেন সবচেয়ে সাহসী ও সত্যবাদী। অনুরূপভাবে তারা ছিলেন সবচেয়ে বেশি অমুখাপেক্ষী এবং অপরের কাছে কিছু চাওয়া ও কারো সামনে হাত পাতা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। এইতো আল্লাহর রাসূল মক্কার নেতাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে এবং তাদেরকে কাফের নামে অভিহিত করে আল্লাহর বাণী ঘোষণা করছেন- ‘‘আপনি বলুন, হে কাফেরগণ! তোমরা যার উপাসনা কর, আমি তার উপাসনা কার না। আর তোমরাও উপাসনা কর না আমি যার উপাসনা করি এবং এবং ভবিষ্যতেও আমি তোমাদের মাবুদগণের উপাসনা করব না । আর, তোমরাও আমার মাবুদের উপাসনা করবে না। তোমাদের প্রতিদান তোমরা পাবে এবং আমার প্রতিদান আমরা পাব।’’ [১ সুরা কাফেরূন।] এ দাজ্জাল ও কাজ্জাবের অবস্থান হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, এই কাফের ইংরেজ সরকার সম্পর্কে বলে: আমি এই পরিবারের লোক যার সম্পর্কে ইংরেজ সরকার স্বীকার করে যে, এ পরিবার সরকারের অতি বিশ্বস্ত। প্রশাসকরাও স্বীকৃতি দিয়েছে যে, আমার পিতা ও আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা মনে প্রাণে পূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে সরকারের সেবা করেছে। এ সরকারের তত্ত্বাবধানে আমরা যে সুখ ও শান্তি পাচ্ছি, তজ্জন্য এ দয়াল সরকারের কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য আমি কোন ভাষা খোঁজে পাচ্ছি না। এ জন্য আমি আমার পিতা ও আমার ভাই এ সরকারের অবদান ও উপকারসমূহ প্রকাশ করতে ও জনসাধারণকে এ সরকারের আনুগত্যের প্রতি বাধ্য করতে এবং তাদের অন্তরে এটিকে বদ্ধ মূল করতে সর্বদা কঠোর পরিশ্রম করেছি। (তাবলীগে রিসালাত, ৭ম খন্ড, ৮ও ৯ পৃষ্ঠা।) এ সমস্ত গুণাবলিই কি তোমাদের উদ্দেশ্য? নবীগণ শাহাদৎ বরণ করেছেন, অগ্নি দগ্ধ হয়েছেন, নিজ ঘর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন এবং ধন-সম্পদ হতে বঞ্চিত হয়েছেন। তবুও আল্লাহর পথে দাওয়াত ত্যাগ করেন নি এবং আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া কারো আনুগত্য গ্রহণ করেন নি। তারা কোন রাজা বাদশাহর দাসত্ব স্বীকার করেন নি এবং কোন স্বৈরাচার ও ফেরাউনের সম্মুখে মাথা নত করেন নি তারা মহান আল্লাহর এই বাণীর উপর অটল ছিলেন ‘‘তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছে, তা প্রকাশ্যে প্রচার কর, এবং মুশরেকদেরকে উপেক্ষা করে চল। [২ সুরা আল-হিযর, ৯৪ আয়াত।]
ভন্ডনবী কাদিয়ানীর মত তারা মানুষের উপর কাফেরদের আনুগত্য ওয়াজিব করেন নি। যদি এই তাদের লক্ষ্য হত, তবে তাদেরকে প্রেরণ করার কি সার্থকতা ছিল?
গোলাম আহমদ অন্যত্র বলে: আমি আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ইংরেজ সরকারের সাহায্যে এবং জিহাদের বিরোধিতায় ব্যায় করেছি। আর, মুসলমানগণ এই সরকারের প্রতি অনুগত না হওয়া পর্যন্ত আমার এ চেষ্টা চালিয়ে যাব। (গোলামের ‘‘তিরিয়াকুল কুলুব’’ ১৫ পৃষ্ঠা ।) হ্যাঁ, কার্যত: জেহাদের বিরোধিতায় সে তার জীবন সমাপ্ত করেছে। কেননা, জেহাদের স্বাদ অনুভব করতে পারেনি। তাই তার মত দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভীরু ব্যক্তি এই বক্তব্যের ঘোষণাকারীর বীরত্বকে উপলব্ধি করতে পারে- ‘‘অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে ন্যায়ের কথা বলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেহাদ’’ [১ তিরমিযী।] যদি সে জানত তবে একথা বলত না ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কামালাতের তাজাল্লী শেষ প্রান্তে উন্নীত হতে পারে নি, বরং এই তাজাল্লী সমূহ আমার যুগে এবং আমার ব্যক্তিত্বে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে’’। (খুতবায়ে ইলহামিয়া, ১৭৭ পৃষ্ঠা।) অতএব হে দাজ্জাল! তুই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন নগণ্যতম খাদেমদেরও সম পর্যায়ের নহে। অথচ তুই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নিজের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছিস। অতএব, যখন আল্লাহ তাআলা তার হাবীব ও খলীল, আরব ও আজমের সরদার, শেষ নবী ও সাইয়েদুল মুরসালীনের অবমাননা সম্পর্কে তোকে জিজ্ঞাসা করবে তখন তোর অবস্থা কি হবে? হে পাপিষ্ঠ! তুই কেমন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহিত তোর হীন ব্যক্তিত্বকে তুলনা করছিস? আল্লাহই তাঁকে সমস্ত সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তাকে ‘‘রাহমাতুললিল আলামীন’’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি এমন পর্যায়ের দানবীর ও দাতা ছিলেন যে, তার হাতে যা কিছু আসত তা আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতেন এবং রিক্ত হস্তে নিজ গৃহে ফিরতেন। এমতাবস্থায়, যখন উম্মাহাতুল মু’ মেনিন রা. তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কেন নিজের জন্য কিছুটা অবশিষ্ট রাখেন নি? উত্তরে হুজুর বলতেন: ‘‘তোমাদের নিকট যা কিছু আছে তা তো নিঃশেষ হয়ে যাবে, আর আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে তা স্থায়ী থাকবে’’। [২ সুরা নাহল-৯৬] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মীনি ও মুমেনগণের মা আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিরোধানের পূর্ব পর্যন্ত তার পরিবারের লোকেরা একাধারে দু’দিন যবের রুটি পেট ভরে খেতে পারেন নি। ছিমাক ইবনে হরব বলেন, আমি নুমান ইবনে বশিরকে রা. বলতে শুনেছি: তোমরা কি যা চাও তা পানাহার করছ না ? অথচ আমি তোমাদের নবীকে দেখেছি, তিনি এই পরিমাণ মামুলি খেজুরও পেতেন না, যাতে তার পেট ভরতে পারে। [৩ সামায়েলে তিরমিযী।] কিন্তু তোমার (কাদিয়ানীর) অবস্থা হল যে, তুমি
মানুষের পকেট কাটছ। ভক্তদের কাছ থেকে জাকাতের নামে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টনের নামে অবৈধ লুণ্ঠিত সম্পদ এবং ইংরেজদের কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা ও এজেন্ট হওয়ার বিনিময়ে প্রাপ্ত পর্যাপ্ত সম্পদ খাচ্ছ। তুমি ভুনা মুরগি, বক ও কবুতর পাখির গোস্ত খাচ্ছ। বিভিন্ন দূর-দেশ থেকে তোমার বিশেষ দস্তরখানার জন্য আমদানীকৃত খাবার কাবাব, কুফতা, বিরিয়ানী, মিষ্টি-দ্রব্য, বিভিন্ন প্রকার পোলাও , ডিম, মাখন ও মাখনদ্বারা প্রস্ত্তত দ্রব্যাদি ও দুধ ইত্যাদি সংগ্রহ করছ। আর, ফলের মধ্যে আঙ্গুর , ডালিম, কমলা, আপেল ইত্যাদি এবং ইংল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত কেক যা শুকরের চর্বি দ্বারা প্রস্ত্তত, [৪ এভাবে গুলাম পুত্র বশীর আহমদ বলেছে, আমার পিতা কেক খেতেন যদিও লোক এতে সন্দেহ পোষন করতেন যে এটা শুকরের চর্বি দিয়ে তরৈী অথবা চর্বি দিয়ে পাকানো হয়েছে। কিন্তু গোলামের অভিমত ছিল যে, এই কেক কি দিয়ে পাক করা হয়েছে তা নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলে তা খেতে আপত্তি নেই। (বশীর রচিত সীরাতে মাহদী ২য় খন্ড ১৩৫ পৃঃ)] প্রভৃতি সহ আরো অনেক কিছু তুমি খাচ্ছ। [৫ সীরাতে মাহদী ২য় খন্ড ১৩২-১৩৫ পৃষ্ঠা] এগুলো ব্যতীত আরো অনেক শক্তি বর্ধক সামগ্রী যেমন মিশকে আম্বর [১ মাকতুবাতে আহমদীয়া ৫ম খন্ড ২৬ পৃঃ] ও আগর যার ২৫ গ্রাম তখনকার দিনে পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি হত [২ মাকতুবাতে আহমদীয়া ৫ম খন্ড পৃঃ ১২১৩ মাকাতিবুল ইমাম ২য় খন্ড (মাহমুদ হুসাইন কাদিয়ানী)] এবং জাফরান, মারওয়ারীদ, মারজান-ইয়াকুত [] আফিম ও মদ তুমি ব্যবহার করছ। এসব কিছু নবুয়তের নামে এবং নবুয়তের বরকত হিসাবে চালিয়ে যাচ্ছ। অথচ নবুয়তের দাবি করার পূর্বে তোমারই বর্ণনা অনুযায়ী তোমার এ অবস্থা ছিল- ‘আমি একজন দরিদ্র লোক ছিলাম। কেহ আমাকে চিনত না এবং আমার কাছে এমন জীবিকার ব্যবস্থা ছিল না যাদ্দারা আমি আরাম ও স্বচ্ছলতার সহিত জীবন যাপন করতে পারি। আমার পিতা আমার জন্য অতি সামান্য সম্পদ রেখে গিয়েছেন। এরপর আল্লাহ আমার দিকে দুনিয়া ফিরিয়ে দিলেন। তখন আমি যে মাসিক দশ টাকা লাভ করতে পারব তারও আশা করতে পারতাম না। কিন্তু আল্লাহ আমার অবস্থার পরিবর্তন করে দিলেন এবং আমাকে সাহায্য করলেন। এখন আমার নিকট তিন লাখেরও বেশি টাকা আছে। (গোলামের ‘‘হাকীকতে ওহী’’ ২১১ ও ২১২ পৃষ্ঠা) এত অধিক সম্পদ কোত্থেকে আসল? কাদিয়ানী মুফতি সরওর শাহ এর বর্ণনা দিয়ে বলেন যে, এ সম্পদ অজ্ঞাত স্থান হতে আসছে। তিনি আরো বলেন- একজন মুবাল্লেগ আমাকে জানিয়েছেন যে, আমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য কাদিয়ানে প্রচুর পরিমাণ টাকা পাঠাতাম। (কাদিয়ান হল নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার গোলাম আহমদের জন্ম স্থান।) কিন্তু যখন আমরা কাদিয়ানে গেলাম, তখন দেখতে পেলাম এ বিরাট পরিমাণের টাকা গোলাম আহমদের বেগমদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে তারা খুব আরাম ও স্বচ্ছলতার সাথে জীবন যাপন করছে, বাহিরের জীবনে তারা এর দশ ভাগের একভাগও উপভোগ করার সুযোগ পাননি। অথচ এ টাকাগুলো তাদের জন্য প্রেরিত হত না। অতঃপর মুফতি বলেন- তখন আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতাম এবং তওবা করতাম এই ভয়ে যে আল্লাহ শাস্তি নাযেল করে দিতে পারেন। (কাদিয়ানী মূফতী সরওয়ার শাহ রচিত ‘‘কাশফুল ইখতেলাফ’’ ১৩ পৃষ্ঠা।)
এভাবে এ প্রক্রিয়া ছাড়া অন্যান্য পন্থায় ও এ দরিদ্র ভন্ডনবী বিরাট সম্পদ সঞ্চয় করেছে। ইতিপূর্বে জীবন ধারণের মত সামান্য খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থাও তার কাছে ছিল না। এমন কি, সে শিয়াল কোট শহরে গমন করে মাত্র পনেরো টাকা মাসিক বেতনে একজন নিম্ন মানের কর্মচারীরূপে চাকুরি নিতে বাধ্য হয়। সে মানুষের পায়ের কাছে বসে থাকত। অতএব, তার মত একজন চোর ও অন্যায়ভাবে পরের সম্পদ গ্রাসকারী ব্যক্তি নিজেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তুলনা করে, যিনি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন যে, মৃত্যুকালে তাঁর বর্মটি এক ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল। আর সে বলে, যে ব্যক্তি আমার এবং মুস্তফার মধ্যে পার্থক্য করে, সে আমাকে চিনে নি ও আমাকে দেখিনি। (গোলামের উক্তি যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজলের’’ অন্তর্গত, ১৭ই জুন ১৯১৫ খৃ:) সে আরো অগ্রসর হয়ে বলে, আমি মসীহ আমি কালিমুল্লাহ, আমি মুহাম্মদ ও আহমদ, যাকে আল্লাহ মনোনীত করেছেন। (গোলামের দুররে ছামীন।) সে আরো বলে: যে আমার জামাতে প্রবেশ করবে সে যেন ছাইয়েদুল মুরছালীনের সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (গোলামের খুতবাতুল ইলহামিয়া ১৭১ পৃ:) এরূপ বিশ্বাস ঘাতক মিথ্যাবাদী কি করে এ ধরনের ভ্রান্ত দাবিকরতে পারে যে, ‘‘যে ব্যক্তি তার দলে প্রবেশ করবে সে সাইয়েদুল মুরসালীনের সাহাবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’’। অথচ, প্রকৃত পক্ষে এরা তো মুসাইলামাতুল কাজ্জাব ও আসওদ আনাসীর অনুসারীদের সারিতেই প্রবেশ করেছে এবং ঐ মরদুদ শয়তানের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, যে তাদেরকে ও তাদের নেতাকে বিপথগামী করেছে। এ মির্জা আরো বলে, ‘‘ সে অবিকল মুস্তফা!’’ অথচ, মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুনিয়াকে এমনি ভাবে ত্যাগ করেছেন যে, তাঁর বর্মটি জনৈক ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল এবং তাঁর সহধর্মীনিগণ পানি ও খেজুরের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করতেন, তবে তাঁর খাদেমগণ স্বর্ণ রৌপ্য দ্বারা তাঁর ঘর পরিপূর্ণ করে দিতে পারতেন। আমাদের এ কাদিয়ানীর মত ঐাকাত ও সাদা-কাতের নামে নহে, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য । আর এ মহান রাসূলের খলীফা মারা গেলে তাকে পুরাতন কাপড়ে দাফন করা হয়। হাঁ, ইনি হলেন তাঁর প্রথম খলীফা আবু বকর সিদ্দিক রা.। তাঁর দ্বিতীয় খলীফা যিনি কায়সার ও কিসরার রাজত্বের মালিক হওয়া সত্ত্বেও পরিধানের জন্য ছেঁড়া কাপড় ব্যতীত কিছুই পান নি। একদা যখন তিনি নিখুঁত দু’টি চাদর পরিধান করেছিলেন, তখন তাঁর একজন প্রজা দাঁড়িয়ে বলল: আপনি এটা কোত্থেকে পেলেন? উত্তরে তিনি বললেন: ‘একটি আমার এবং অপরটি আমার ছেলে আমাকে দান করেছে’। তাদের অবস্থা এ মিথ্যুকের মত ছিল না। যে পুস্তক মুদ্রণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে। অতঃপর সে পুস্তক না ছাপিয়ে টাকা পয়সাগুলো তার নিজ লোকদের মধ্যে ব্যয় করে ফেলে আর, যখন তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয় তখন সে বলে এ সম্পদ আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। কাউকে আমি একটি পয়সা ফেরত দেব না এবং এ ব্যাপারে কাউকে উত্তরও দেব না। যে ব্যক্তি আমার কাছে হিসাব চায় তার জন্য উচিত সে যেন এরপর আমাকে আর কিছুই না দেয়। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল হিকম ২১শে মার্চ ১৯০৫ খৃ:) এতো গেল তার অবস্থা। আর, এর পরও তার খলীফাগণ এমন বিরাট সুউচ্চ অট্রালিকায় বসবাস করছে, যার কল্পনা এর পূর্বে তারা করতে পারেনি। এমনকি স্বপ্নেও না । এ সকল সুবৃহৎ ও বিরাট প্রসাদ পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর নিয়োজিত করা হয়। (আল ফজল ১২ই অক্টোবর, ১৯২৪ খৃ:) তার খলীফা যখন ইংল্যান্ডে ভ্রমণে যায়, তার পিতার ঐ সকল অনুগ্রহকারীদের সাক্ষাতে ধন্য হওয়ার জন্য, যারা তার পিতার মাথায় নবুয়তের মুকুট পরিয়েছিল তখন কেবল মাত্র এ ভ্রমণে ব্যয় করার জন্য চল্লিশ হাজার টাকা সাথে নেয়। (পয়গামে সুলেহ ২৩শে জুলাই, ১৯২৪ খৃ:) এখান থেকে সে প্যারিসে ভ্রমণ করে এবং তথায় আন্তর্জাতিক নৃত্যের আসরে যোগদান করে। আন্তর্জাতিক নৃত্যে নর্তকীরা স্বভাবত: উলঙ্গ কিংবা অর্ধোলঙ্গ থাকে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে, যেহেতু আমার দৃষ্টি শক্তি দুর্বল এবং মঞ্চ আমার থেকে দুরে ছিল, তাই আমি নর্তকীদের উলঙ্গপনা দেখিনি। এ ধরনের সহচরদেরকে নিয়ে নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার কাদিয়ানী কি গর্ব করে ? এ ব্যক্তি তো শুধু তার সহচরই নহে, বরং সে তার ছেলে এবং দ্বিতীয় খলীফা। এ বিষবৃক্ষ ও তার ফল হতে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি। আবারও আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি। এ সত্ত্বেও বলা হয়, গোলামের আধ্যাত্মিক শক্তি রাসূলুল্লাহ আধ্যাত্মিক শক্তি হতে অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক শক্তিশালী। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের কালিমাতুল ফাছল যা রিভিউ অব রিলিজিওনের অন্তর্ভুক্ত, ১৪৭ পৃ:) সুতরাং এ হল তার আধ্যাত্মিকতা যে , সে আফিম ভক্ষণ করে , মদ্য-পান করে, [১ ইতিপূর্বে তার মদ্যপান, আফিম ভক্ষণ ও নারীপ্রেম সম্পর্কে তৃতীয় প্রবন্ধে ‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী কতৃক নবূগণের অবমাননা’ উৎস ও উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করেছি।] নারীদের প্রতি আশক্ত হয়, ইংরেজের দাসত্ব করে এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়। তার ছেলে নৃত্যের আসরে উপস্থিত হয় এবং বড় বড় অট্টালিকায় বসবাস করে , যে গুলোকে কুকুর পাহারা দেয় । সে এবং তার ভক্তরা কুরআনকে পরিবর্তন করে এবং যে সকল আয়াত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে অবতীর্ণ হয়েছে, উহাকে সে নিজের সহিত সম্পৃক্ত করে । আর, যিনি সমস্ত মানব জাতির উত্তম, তার চেয়েও এ ভন্ডের মর্যাদাকে তারা উচ্চ বলে গণ্য করে।
অপর এক কাদিয়ানীর বৃত্তান্ত শুনুন ! যার মধ্যে সকল প্রকার কুকর্ম ও বদ খাছলত একত্র রয়েছে। প্রথমত: সে কুরআন মজীদ তাহরীফ (বিকৃত) করে এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে। দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননা করে। তৃতীয়ত: এ মিথ্যাবাদী দাজ্জালকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ও সকল নবীর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। সে বলে, আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে যে অঙ্গিকারের কথা রয়েছে- ‘‘আর যখন আল্লাহ তায়ালা নবীগণ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত দিয়েছি, তারপর যদি তোমাদের কাছে কোন রাসূল আসেন যিনি তোমাদের কিতাবের সত্যতা প্রমাণ করেন, তখন অবশ্যই তোমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা কি ইহা স্বীকার করলে এবং এ কথার উপর আমার অঙ্গীকার গ্রহণ করলে? তাঁরা উত্তর দিল, আমরা স্বীকার করলাম’। তখন আল্লাহ বললেন: ‘‘তোমরা সাক্ষী থাক, আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম। এরপর যারা এ অঙ্গীকার থেকে বিমুখ হবে তারাই হল অবাধ্য ফাসেক’’। [২ সুরা আল-ইমরান-৮১ও ৮২] সেই অঙ্গীকার গোলাম আহমদের জন্য, মুহাম্মদের জন্য নহে। আর, যাদের নিকট থেকে এ অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছে, তারা হলেন নূহ, ইব্রাহীম, মুসা ও ঈসা আঃ। এমনি ভাবে, এ অঙ্গীকার মুহাম্মদ সা: হতেও গ্রহণ করা হয়েছে। অতএব, ধন্যবাদ। কারণ অঙ্গীকারের লক্ষ্য ব্যক্তি এসে গেছেন। সুতরাং মুসলমানগণ দ্রুত এ প্রতিশ্রুতি পালন করে যেন আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে যায়। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল-ফজল’’ ২৬শে ফেব্র: ১৯২৪ খৃ:) এ বক্তব্যটি কুরআন পরিবর্তন করা, মুসলমানগণকে কুরআনের অর্থ অনুধাবন ও মুহাম্মদে আরাবী থেকে দুরে সরিয়ে রাখার কাদিয়ানী পরিকল্পনার একটা চিত্র প্রদান করে। যে পরিকল্পনাটি তারা কাফের সাম্রাজ্যবাদীদের ইঙ্গিতে গ্রহণ করেছিল যারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিত্ব ও কুরআনের জীবনী শক্তি সম্পর্কে ভীত সন্ত্রস্ত। এ কারণেই গোলাম আহমদের নবুয়্যত প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদাকে খাট করা এবং মুসলমানদের অন্তর থেকে তাঁর মহববত ও ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নেওয়া এবং কুরআনের অর্থ ও মর্ম বিকৃত করা । যদিও এর মূল শব্দকে বিকৃত করা সম্ভব নহে। তাই, গোলাম আহমদই প্রথম ব্যক্তি যে ইসলামের নামে কুরআন পরিবর্তন করার ভিত্তি স্থাপন করে। তারপর, তার ভক্ত ও অনুসারীগণ অত্যন্ত ঘৃণিত পন্থায় ও নির্লজ্জ ভাবে কুরআন পরিবর্তনের কাজে তার অনুসরণ করে চলে। এখানে আমরা তার পক্ষ থেকে কুরআনে কারীমের পরিবর্তন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননার কথা এক সঙ্গে উল্লেখ করছি। সে বলে: আল্লাহর বাণী ‘‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, আর তাঁর সাথীরা কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর এবং তারা পরস্পর অতি দয়ালু।’’ [১ সুরা আল-ফাতহ-২৭] এর দ্বারা আমিই উদ্দেশ্য। কেননা , আল্লাহ তাআলা এ ওহীতে আমার নাম রেখেছেন মুহাম্মদ ও রাসূল। এভাবে অপর কয়েক স্থানে আল্লাহ আমাকে এ নামে উল্লেখ করেছেন’। (গোলামের উক্তি যা কাসেম কাদিয়ানীর ‘‘তাবলীগে রেসালাতের’’ অন্তর্ভুক্ত, ১০ম খন্ড ১৪পৃষ্ঠা।) সে বলে, আমাকে অবগত করা হয়েছে যে, কুরআন ও হাদীসে আমার সম্পর্কে খবরাখবর বিদ্যমান আছে। আমাকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে আল্লাহর এ বাণীতে ‘‘আল্লাহ তাআলাই হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে স্বীয় রাসূলকে প্রেরণ করেছেন যাতে এ দ্বীনকে সমুদয় দ্বীনের উপর প্রাধান্য দান করেন। [২ সুরা তাওবা- ৩৩, সুরা আল ফাতহ-২৮ সুরা আল সাফ-৭] (এজাজে আহমদী গোলাম কাদিয়ানীর নুযুলুল মাসীহের পরিশিষ্ট, ৭ পৃ:।) আল্লাহ তাআলার এ বাণীতেও আমাকেই লক্ষ্য করা হয়েছে ‘‘আমি আপনাকে সমস্ত বিশ্ব জগতের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’’ [৩ সুরা আল-আম্বিয়া-১০৭] (গোলামের ‘আরবাঈন’ ৩ নম্বর ২৫ পৃষ্ঠা।) আমি আল্লাহর ঐ বাণীরও লক্ষ্য বস্ত্ত- ‘‘তোমাকে মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করবেন’’। (গোলামের ‘আরবাঈন’ ১০২ পৃষ্ঠা।)
এর পর তারই পুত্র বশীর আহমদ একই পন্থায় অগ্রসর হয়ে বলে ‘‘রাসূলগণ যার সুসংবাদ দিয়েছেন, তিনি হলেন গোলাম আহমদ, আল্লাহর নবী মুহাম্মদ নহেন। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীতে তিনিই উদ্দেশ্য ‘(ঈসা) সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, আমার পরে যে রাসূল আসবেন তার নাম আহমদ’। [৪ সুরা আছ ছাফ-৬] কেননা, আল্লাহর আয়াতের উদ্দেশ্য হল মুহাম্মদ ব্যতীত অন্য ব্যক্তি। অতএব, বুঝা গেল যে, এ বাণীর উদ্দেশ্য গোলাম আহমদ, মুহাম্মদ নহেন। (বশীর আহমদের প্রবন্ধের সারাংশ, যা রিভিউ অব রিলিজিওনের অন্তর্ভুক্ত ১৩৯- ১৪১ পৃ: আল-ফজল পত্রিকায় প্রচারিত, ১৯শে আগস্ট ১৯১৬খৃঃ) এর উপরই ভিত্তি করে কাদিয়ানীরা বলে, তাদের কালেমায়ে শাহাদাত অবিকল মুসলমানদের কালিমায়ে শাহাদাত। কেননা, তাদের উদ্দেশ্য হল গোলাম আহমদের রেসালাতের স্বীকৃতি। আর এ উদ্দেশ্য মুসলমানদের কালিমা দ্বারাই সাধিত হয়। কালেমাটি হল এই ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এ কালেমাতে গোলামের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুহাম্মদ’ যেমন আল্লাহর এ বাণীতেও নামকরণ করা হয়েছে: ‘‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, আর যারা তাঁর সাথী------------’’। অতঃপর বলে: ‘‘গোলাম আহমদের নবুয়তের শাহাদাতের জন্য আমরা আমাদের ধর্মে কোন নতুন কালেমার প্রয়োজন বোধ করি না।’’ কেননা, নবী এবং গোলাম আহমদের মধ্যে কোন তফাত নেই। যেমন, গোলাম আহমদ নিজেই বলেছে- ‘আমার অস্তিত্ব তাঁরই অস্তিত্ব এবং যে ব্যক্তি আমার ও মুস্তফার মধ্যে পার্থক্য করে সে আমাকে চিনতে পারে নি’ । সে আরো বলে, আল্লাহ তাআলা পুনরায় ‘খাতামুন নাবীয়্যীন’ কে প্রেরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, মসীহে মাওউদ (গোলাম) স্বয়ং সে-ই মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ, যাকে ইসলাম প্রচারের জন্য দ্বিতীয় বারের মত প্রেরণ করা হয়েছে। এ জন্যই আমরা অপর কোন কালেমায়ে শাহাদাতের প্রয়োজন বোধ করি না। অবশ্য যদি প্রেরক ব্যক্তি মুহাম্মদ ব্যতীত অন্য কেহ হত, তাহলে আমাদের নূতন কালেমার প্রয়োজন হত। (কালিমাতুল ফছল’ রিভিউ অব রিলিজিওন্স হতে উদ্ধৃত, ১৫৮ পৃ:, ৪নম্বর ১৪ খৃ:।) কাদিয়ানীরা তাদের বিভ্রান্তিকরও অমূলক কথা বার্তায় আরো অগ্রসর হয়ে কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল ফজলে’’ প্রচার করেছে যে, যে স্থানে গোলাম আহমদ সমাধিস্থ হয়েছে, সেই স্থান ও উহার আশে পাশের স্থানসমূহ বেহেস্তের একটি টুকরা বিশেষ এবং গোলাম আহমদের কবর (নাউজুবিল্লাহ) রাসূলুল্লাহর কবরের মতই। এ পর্যন্তই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং তারা বলে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই গোলাম আহমদের কবরে সালাম দেন। এ কথা তারা স্পষ্টভাবে বলছে। কাদিয়ানে জনৈক দীক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তি ঘোষণা করে, যে ব্যক্তি দারুল আমান কাদিয়ানে আসে (এ কাদিয়ানকে তারা দারুল আমান নামে আখ্যায়িত করত, উহা হিন্দুদের দখলে চলে গেলে কাদিয়ানীরা সেখানে বেহেস্তের টুকরা ও তাদের রাসূলের কবর ছেড়ে পলায়ন করে। সে স্থান সম্পর্কে বলছে) এবং নূরে ভরপুর মাজারে উপস্থিত হয় না, তার অবস্থা কেমন হবে? তারা কি জানে না যে এ পবিত্র রওজাতে? ঐ মহান ব্যক্তির শবদেহ সমাধিস্থ আছে, যার প্রতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম প্রেরণ করেন। অতএব, তোমরা এ বরকতময় কবরে উপস্থিত হয়ে ঐ সকল বরকত লাভ করতে সক্ষম হবে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজায় নির্ধারিত রয়েছে। সুতরাং, কতই না দুর্ভাগা ঐ ব্যক্তি যে কাদিয়ানে এসে হজ্জে আকবর দ্বারা উপকৃত হয় না। (আল ফজল পত্রিকা যা ১৮ ডিসেম্বর ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত।) নিশ্চয়ই হে দুর্ভাগা সম-প্রদায়! তোমরা সবাই দুর্ভাগ্যে সমান। কারণ, যে ব্যক্তি খতমে নবুয়্যতকে অস্বীকার করে এবং খাতামুন নাবীয়্যীনকে অবিশ্বাস করে , আর গোলাম আহমদের মত একটা দাজ্জালকে নবী বলে বিশ্বাস করে, শুধু নবীই নহে বরং সে মুহাম্মদে আরাবীর সমতুল্য এবং তার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান মনে করে, সে যদি এ দুর্ভাগা না হয়, তবে আর কে হবে? ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি সত্য দ্বীন সহ স্বীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁরই দ্বারা নবুয়্যতকে সমাপ্ত করেছেন। তাঁকে আদম সন্তানের সরদার বানিয়েছেন এবং সমগ্র মানব জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তাঁর আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর অবাধ্যতাকে আল্লাহর অবাধ্যতা [১ বুখারী কতৃক বর্ণিত হাদীছের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ বলেনঃ ‘যে আমার আনুগত্য করল সে আল্লাহর আনুগত্য করল, আর যে আমার অবাধ্য হল সে আল্লাহর অবাধ্য হল’।] এবং তাঁর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করাকে আল্লাহর কাছে বাইয়াত গ্রহণ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, [২ আল্লাহপাক বলেনঃ ‘‘নিশ্চয়ই যারা তোমার বাইয়াত করেছে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বাইয়াত করেছে’’ সুরা আল-ফাতহ-১১।] সেই আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক অভিশপ্ত আর কেহ নহে, যে আল্লাহর রাসূলের অবমাননা করে এবং তাঁর উপর নিজের প্রাধান্য দাবিকরে। এখানে আমি স্বয়ং গোলাম আহমদের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সে বলে- যে ব্যক্তি কোন নবীকে তুচ্ছ মনে করে সে কাফের। (গোলামের আইনুল মা’ রেফাত’’ ১৮পৃঃ) এ বক্তব্যের আলোকে গোলাম ও তার জামাত যারা কাদিয়ানী নামে পরিচিত কি হবে? তার ছেলে ও খলীফা মাহমুদ আহমদের কি হবে? যে এমন ঘৃণ্য কথা বলে, ‘প্রত্যেকের জন্য এটা সম্ভব যে, সে যে মর্যাদায় উন্নতি লাভ করতে বা পৌঁছতে চায়, তা সে পেতে পারে। এমন কি যদি সে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ও সম্মান থেকে অগ্রগামী হতে চায়, তাতেও সে সফলকাম হতে পারে। (কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদের ‘‘ইওমিয়াত’’ যা আল ফজল পত্রিকায় প্রচারিত ১৭ই জুলাই ১৯২২ সনে প্রকাশিত।) এই হল দ্বিতীয় অভিশপ্ত ব্যক্তির বক্তব্য, যে এমন ব্যক্তি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছে, যাকে রাত্রিকালে মসজিদে আকসার ভ্রমণ করান হয় আসমানের দিকে মে’ রাজের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে এবং যার পেছনে সকল নবী নামাজ আদায় করেন। [৩ যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর ফেরেস্তাগণ নবীর উপর দরুদ প্রেরণ’’ সুরা আহযাব।] যার প্রতি আল্লাহ ও ফেরেস্তা এবং মুমিনগণ দরুদ ও সালাম প্রেরণ করেন। [৪ তিরমিজী ও আহহমদ ।] যিনি কেয়ামতের দিন হামদের পতাকাবাহী হবেন [৫ মসনদে আহমদ] এবং সকল নবীর পক্ষ হতে বক্তব্য রাখবেন। যার সম্পর্কে বরকতময় মহান প্রভু বলেছেন: ‘‘যাতে আল্লাহ তাআলা আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেন’’ [৬ সুরা আল ফাতহ- ২] আরো এরশাদ হচ্ছে- ‘‘তিনি হেদায়েত ও সত্য ধর্ম দিয়ে তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ ধর্মকে অন্য সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করেন’’। [৭ সুরা আল ফাতহ- ২৮৮ সুরা আহযাব-৪৫] আরো বলেন- ‘‘হে নবী আমি তোমাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এবং আল্লাহর নির্দেশে তার প্রতি আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে পাঠিয়েছি’’। [] কিন্তু কাদিয়ানী খলীফা বলে: কেহ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ও সম্মান হতে অগ্রসর হতে চায়, তবে সে অগ্রগামী হতে পারবে। ‘‘আল্লাহ পানাহ! আল্লাহ পানাহ! এ কুকুর হতে বড় কুকুর আর কে হতে পারে? এ ঘৃণ্য কাজ হতে বড় ঘৃণ্য কাজ আর কি হতে পারে? এবং এ নির্লজ্জতা হতে বড় নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? কেমন করে এ সকল পাপিষ্ঠ বদমাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার দুঃসাহস করে ? যদি সমস্ত সৃষ্টিকে পাল্লার একদিকে রাখা হয় এবং তাঁকে অপর দিকে রাখা হয়, তবে , নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহর দিকটাই ভারী হবে। এতদ সত্ত্বেও তারা দাবিকরে যে , মুসলমানগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যেরূপ বিশ্বাস রাখে, তারাও অনুরূপ বিশ্বাস পোষণ করে । তবে কোন মুসলমান কি এরূপ কথা বলতে পারে? যা স্মরণ হওয়া মাত্রই অন্তর কেঁপে ওঠে। মহান আল্লাহ তাআলা সত্যই বলেছেন ‘‘তারা আল্লাহ ও ঈমানদার গণের সাথে প্রতারণা করে, অথচ তারা নিজেদের ছাড়া আর কাউকে প্রতারণা করছে না । তবে তারা এর খবরও রাখে না তাদের অন্তরের মধ্যে রোগ রয়েছে, আল্লাহ সে রোগকে আরো বাড়িয়ে দিলেন। আর, তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি তাদের মিথ্যা উক্তির জন্য।’’ [১ সুরা বাকারা ৯ও ১০] তারা কি মনে করে যে , রাসূলুল্লাহ সা: এর মর্যাদাকে এভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারবে যেভাবে তাদের ঘৃণ্য পূর্ব-পুরুষগণ এ ধারণা ও চেষ্টা করে আসছে? তাদের পূর্ব-পুরুষদের প্রতিবাদে মহান আল্লাহ যা বলেছেন- আমি তাদেরকে তাই বলব: আল্লাহ বলেন ‘‘তারা চায় আল্লাহর নূরকে ফুৎকারে নিভিয়ে দেবে পক্ষান্তরে আল্লাহ স্বীয় নূরকে পরিপূর্ণ না করে ছাড়বেন না ; যদিও কাফেরগণ তা অপছন্দ করে। তিনিই আল্লাহ যিনি স্বীয় রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাকে একে সমূদয় ধর্মের উপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরেকগণ তা অপছন্দ করে।’’ [২ সুরা তাওবা- ৩২-৩৩] কাফের ও মুরতাদগণ ! তোমরা ঘৃণা করতে থাক এবং তোমাদের সকল শক্তি দিয়ে আল্লাহর নূরকে ফুৎকার দিয়ে নির্বাপিত করার জন্য চেষ্টা চালাও । তোমাদের সঙ্গী-সাথী সাহায্যকারী ইংরেজ প্রভু ও অন্যান্যদেরকে এ কাজে আহবান কর। অতঃপর সমবেত চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাও। তবুও তোমরা কিছুই করতে পারবে না । কেননা, আল্লাহ তাআলা স্বীয় নূরকে পরিপূর্ণ করতে চান, যদিও তোমরা তা অপছন্দ কর। তোমরা ও তোমাদের প্রভুদের ভাগ্যে লাঞ্ছনাই লাঞ্ছনা। তোমরা উপনিবেশবাদী কাফের- গণকে ভারত উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখতে পারনি। তারা প্রাচ্য অঞ্চল হতে বের হয়ে যাওয়াতে হতাশ হয়ে পড়েছ। তোমরা মুসলমানদের অন্তর হতে জেহাদের শিকড়কে উপড়ে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছ। তোমরা মুসলমানদের ঘাড়ে ইংরেজদের আনুগত্যের শিকল পরাতে বিফল হয়েছ। এমনি ভাবে তোমরা খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীনের উপর মিথ্যাবাদী দাজ্জাল গোলাম আহমদের প্রাধান্য প্রমাণ করতে পরনি এবং কখনও পারবে না। যখন তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দ্বীনের নামে কাদিয়ানী মতবাদের দাওয়াত প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছ, তখন তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান ব্যক্তিত্বকে খাট করার ব্যাপারে তোমাদের অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়েছ। অতএব রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের অন্তরে যে হিংসা ও বিদ্বেষ লুক্কায়িত রয়েছে, তা তোমরা বাহ্যিক ভাবে মুখে উচ্চারণ কর না এবং তোমাদের আসল বিশ্বাস ও প্রকৃত উদ্দেশ্যকে তোমরা প্রকাশ কর না; যাতে তোমাদের আসলরূপ প্রকাশিত না হয় এবং তোমরা সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত না হও। কিন্তু আমরা তোমাদের মুখের ও মূল লক্ষের পর্দা সরিয়ে দেব। এতে এখন পর্যন্ত যারা সতর্ক হয়নি তারা সতর্ক হয়ে যাবে। আমরা তোমাদেরকে তোমাদের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে আহবান জানাচ্ছি। উপনিবেশবাদীদের সেবা করার জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, অথচ উপনিবেশবাদীরা এ উপমহাদেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং তারা এশিয়া ও আফ্রিকায় আবার ফিরে আসা থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। মুসলমানদের জিহাদের বিশ্বাসকে বিকৃত করার জন্য তোমাদের ও তোমাদের নবীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ মুসলমানরা জিহাদ করে যাচ্ছে। অতএব, এখন তোমাদের উচিত, তোমরা তোমাদের কার্যকলাপের উপর লজ্জিত হওয়া এবং ইসলাম ও দ্বীনে মুহাম্মদী এবং শরীয়তে মুহাম্মদীর দিকে তোমাদের ফিরে আসা। তা হলে আশা করা যায় যে পূর্ববর্তী কাজের উপর তোমাদের লজ্জিত হওয়ার কারণে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের জন্য সুপারিশ করবেন এবং তার শানে তোমাদের অবমাননা করার অপরাধও ক্ষমা করে দেবেন। কেননা, তাকে জগৎ বাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে।সুতরাং ক্ষমা ও মার্জনা করা তার সুমহান অভ্যাস। তাই, তোমরা তার পথে ফিরে আস। আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত দানশীল ও দয়াবান। আশা করা যায় , তিনি তোমাদের ক্ষমা করবেন। আর তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি যিনি মক্কা বিজয়ের দিন ঐ সকল লোকদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, যারা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং তাকে তার নিজ আবাস ভূমি ও তার পূর্ব পুরুষ গণের আবাস ভূমি মক্কা মুকাররমা থেকে বহিষ্কৃত করেছিল এবং তার ও তার সাথীদের সংঙ্গে লড়াই করেছিল, সে দিন তিনি বিজয়ী ও ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী ছিলেন: আজ তোমাদের উপর কোন অভিযোগ করা হবে না, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন; তিনি পরম করুণাময়।’’ অতএব, হে অপরাধীগণ, সে দিন আসার আগেই ‘যে দিন কোন বেচা-কেনা ও সুপারিশ চলবে না, কাফেরগণই হল অন্যায়কারী।’ এবং তোমাদেরকে ঐ কথা বলার পূর্বেই ‘হে পা পিষ্ট গণ আজ তোমরা পৃথক হয়ে যাও’’ তোমরা দ্রুত তওবা কর এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনিই হলেন ঐ মহান রাসূল যিনি বলেছেন: ‘‘ইসলাম তার পুববর্তী সকল অপরাধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং হিজরত তার পূর্ববর্তী সকল অপরাধকে মুছে ফেলে’’। [১ বুখারী ও মুসলিম।] তিনি আরো বলেছেন: ‘‘আল্লাহ তার বান্দার তওবাতে ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন যে বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে তার উট হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ার পর সে তার উট ফিরে পেল’’। [২ বুখারী।] তিনি সেই ব্যক্তি যিনি তার চাচার হত্যাকারীকে যখন সে ইসলাম গ্রহণ ও তওবা করে এসেছিল, ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং যে মহিলা তার চাচার কলিজাকে চিবিয়েছিল, সে লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আসলে তাকে তিনি মাফ করে দেন। তোমাদের উপর শাস্তি পতিত হওয়ার আগে তোমরা তাড়াতাড়ি তওবা কর। আল্লাহর কসম! যিনি বিশবজগৎ ও উহার অন্তর্ভুক্ত সকল বস্ত্তকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তওবা করার পূর্বে মারা যাও, তবে তোমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল খুবই খারাপ হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন এবং তোমাদের জন্য ইসলামের পথ উজ্জ্বল করুন। তোমাদেরকে নবুয়তের দাবিদার এ মিথ্যাবাদী থেকে দূরে রাখুন, যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননাকারী, নবুয়তের চাদর চোর, কাফেরদের সেবক। কেবল মাত্র আল্লাহর তওফীক ও ক্ষমতা ব্যতীত গুনাহ থেকে বাঁচার এবং এবাদত করার কোন শক্তি কারো নেই। তিনি উত্তম অভিভাবক ও কার্য সমাধা কারী। দরুদ ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, যিনি সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং তার পরিবার বর্গ, সাহাবায়ে কেরাম ও বন্ধু বান্ধবের উপর।
আমীন।
যে সকল বাতিল মতবাদ ইসলামের শক্তিকে বিচ্ছিন্ন এবং তার অস্তিত্বকে বিনাশ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তন্মধ্যে একটি হল কাদিয়ানী মতবাদ। এমতবাদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হল ইসলামী চিন্তাধারাকে প্রকাশ্যে নহে বরং গোপনীয়ভাবে ধূলিসাৎ করা। কেননা, ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা এ কথা প্রমাণ করেছে যে, যখনই ইসলাম বিরোধী কোন দল বা সম্প্রদায় ইসলামের উপর মুখোমুখী আক্রমণ চালায় এবং তার অস্তিত্বকে মুছে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তখন তারা সে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি, বরং এর ফলে ইসলামের শক্তি ও মুসলমানদের তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পায়। ইহুদ, নাছারা ও মক্কার মুশরেকগণ তাদের সকল শক্তি নিয়ে ইসলামের সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করতে এবং মুসলমানদের সংখ্যা কমিয়ে দিতে ও তাদের উন্নতিকে রোধ করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু তারা এ সকল উদ্যোগের পর ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। যুদ্ধের ক্ষেত্রে তা তো স্পষ্ট। যখন ক্রুসেডের শক্তি পরাভূত হয়, তখন তাদের আধিপত্য চুন-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং ইসলামের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মোকাবিলায় তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানি ভেঙে পড়ে, যেমন করে ইসলামের উষালগ্নে ইসলামের গতি প্রতিরোধে মুশরিক ও ইহুদী সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছিল। এমনিভাবে বাহাছ ও মুনাজারা এবং তর্ক বিতর্কের ক্ষেত্রে এবং উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমেও তারা ইসলামের মোকাবেলায় কখনও সফলতা অর্জন করতে পারেনি। অনন্তর, ইসলাম তাদের সমুদয় অপচেষ্টা সত্ত্বেও প্রচার ও প্রসার লোভী করে চলেছে।এসকল বিপদাপদ ইসলামের উন্নতি, মহত্ত্ব এবং স্থিতিশীলতাই বৃদ্ধি করেছে। তাই, যেমন তারা ইসলামের কোন রূপ ক্ষতিসাধনে ব্যর্থ হয়, তেমনিভাবে তারা ইসলামের জ্যোতি প্রবাহের সম্মুখে বাঁধা সৃষ্টি করতে নিরাশ হয়ে পড়ে্ আরব উপদ্বীপের মুশরেক, ইহুদ ও খ্রিস্টানদের এ অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রবেশ করার যুগে আফগানিস্তান, ইরান ও চীনের হিন্দু, বৌদ্ধ, অগ্নিপূঁজারী ও শিখরাও এর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে যেরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল তাদের বন্ধুগণ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে। উপরন্তু তারা এটাও অনুধাবন করল যে, ইসলামের পাষাণ প্রস্তরটি অতি কঠিন। একে ভেঙে ফেলা বা উহাতে ফাটল বা ছিদ্র করা সম্ভব নহে।
এ তিক্ত অভিজ্ঞতা ইসলামের অনিষ্টকারী শত্রুদেরকে যে নতুন চিন্তা ধারার খোরাক জোগায়, তা হল এই, তাদের উচিত প্রকাশ্যে ইসলামকে প্রতিরোধ করার পদ্ধতি পরিবর্তন করা। কেননা, প্রকাশ্য প্রতিরোধ মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও প্রতিরোধ শক্তিকে আরো বৃদ্ধি করে তোলে। আর, তারা যেন মুসলমান ও ইসলামের উপর আঘাত হানতে প্রতারণা ও কপটতার কৌশল অবলম্বন করে এবং ইসলামের মোকাবিলার জন্য ইসলামের নামে মুসলমানদের মধ্য থেকে পৃথক নতুন ধর্ম তৈরি করে। এভাবে ধীরে ধীরে এর অস্তিত্ব ও চিন্তা ধারাকে মুছে ফেলা যাবে, এমনি ভাবে এবং পরিকল্পিত এই চিন্তা ধারায় কাদিয়ানী মতবাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রথমত: তারা একটি মুসলিম দলরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং তারা ইসলাম বিরোধী বিষাক্ত চিন্তাধারা এমনভাবে প্রচার করতে শুরু করে, যাতে সাধারণ লোক বুঝে উঠতে না পারে। অতঃপর তারা ক্রমশ: গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করতে লাগল। যখন তাদের জালে কিছু অনভিজ্ঞ লোক এমনি ভাবে ফেঁসে যায় যে তাদের পালাবার আর কোন পথ থাকে না, তখন খোলাখুলি ভাবে এদের সম্মুখে তাদের এ ভ্রান্ত আকিদায় বহাল থেকে যায়, আর যাদেরকে হেদায়েত ও মুক্তি দান করা আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, তারা এ ভ্রান্তি থেকে রেহাই পায়। এ চিন্তাধারায় এবং কাফের খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে তারা এ পরিকল্পিত স্তর গুলোকে তাবলীগ ও দাওয়াতের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করে নিল, যাতে তারা মুসলমানদের বিভ্রান্ত এবং ইসলামের প্রকৃত রূপকে কলুষিত করতে পারে। তাই , আমরা এ প্রবন্ধে কাদিয়ানী মতবাদের প্রকৃত আকীদা সমূহ এবং যে উদ্দেশ্যে উহার সৃষ্টি, তা তাদেরই কিতাবসমূহ থেকে উল্লেখ সহ বিশদ বর্ণনা দিব, যাতে পাঠকবৃন্দ এর ব্যাপক ভয়াবহতার ও বিরাট দুরভিসন্ধির কথা জানতে পারেন। অনুরূপভাবে এদের প্রতারণা এবং ইসলামের পোশাক পরিধান করে এদের মোনাফেকী সম্পর্কে তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন।
সকল মুসলমান কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়াই এ কথা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা সকল প্রকার দোষত্রুটি এবং মানবিক উত্তেজনা থেকে মুক্ত। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং জন্ম গ্রহণও করেন নি। আর কেহ তাঁর সমকক্ষ নেই। তিনি সাদৃশ্য ও অবয়ব বিশিষ্ট হওয়া থেকে পবিত্র। এমনি ভাবে , তারা বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী ও রাসূল। তার পর আর কোন নবী নেই। তাঁর উপরই রেসালাতের ধারাবাহিকতা শেষ হয়েছে এবং তাঁর দ্বারাই ওহীর ছিল-ছিলা বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁর কিতাবই শেষ কিতাব, তাঁর উম্মতই শেষ উম্মত এবং তাঁর ধর্মই শেষ ধর্ম। তার পরে যে কেহ নবুয়তের দাবি করবে সে হবে মিথ্যুক এবং আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপকারী। কারণ, মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নহেন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।’’ [১ সুরা আহযাব-৪০]
আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিয়েছি। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মনোনীত করেছি।’’ [২ সুরা মায়েদা-৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আমার এবং অপর নবীগনের দৃষ্টান্ত এক প্রসাদের মত যাকে খুব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু উহাতে একটি ইটের জায়গা খালি রাখা হয়। দর্শকরা এটা প্রত্যক্ষ করে এবং এর সুন্দর নির্মাণে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়, তবে,একটি ইটের জায়গা খালি থাকার কারণে আশ্চার্যবোধ করে। আমার দ্বারা দালানের নির্মাণ কাজ শেষ হল এবং রাসূলগণের আগমনও আমার দ্বারা সমাপ্ত হল,। [৩ বুখারী ও মুসলিম।] অন্য রেওয়ায়েতে আছে- আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী। আর এক বর্ণনায় রয়েছে- ‘আমি শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মত,। [১ ইবনে মাজাহ, ইবনে খুজায়মা ও হাকিম।] হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে আর কোন উম্মত নেই’। [২ মাসনাদে আহমদ] অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘আমার উম্মতের পরে আর কোন উম্মত নেই।’ [৩ তাবারানী ও বায়হাকী]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতগণ এটাও বিশ্বাস করেন যে, জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। এটা একটি উত্তম ইবাদত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি বড় উপায়। সকল শহর ও জনপদের মধ্যে মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওরা উত্তম এবং মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসার মর্যাদা ও সম্মান সকল মসজিদ হতে অধিক। পৃথিবীতে কোন মসজিদই এগুলোর সমমানের নহে। এটা মুসলমানদের বিশ্বাস। কিন্তু, কাদিয়ানীরা বরে- ‘আল্লাহ রোজা থাকেন, নামাজ পড়েন এবং (নাউজুবিল্লাহ) তিনি নিদ্রা যান ও জাগ্রত হন, লিখেন ও স্বাক্ষর করেন, সঠিক সিদ্ধান্ত করেন এবং ভুলও করেন, স্ত্রী সহবাস করেন এবং সন্তান জন্ম দেন, বিভক্ত হন, সাদৃশ্য রাখেন এবং তিনি দেহ বিশিষ্ট’।
এ প্রসঙ্গে কিছু স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে। তথাকথিত কাদিয়ানী নবী গোলাম আহমদ বলে: আল্লাহ আমাকে বলেছেন- আমি নামাজ পড়ি ও রোজা রাখি, জাগ্রত থাকি ও নিদ্রা যাই। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আল-বুশরা’ ২য় খন্ড, ৯৭ পৃ:।) এ হল দাজ্জালের কথা। পক্ষান্তরে, সত্য মাবুদ অললাহ পাক মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যা অবতীর্ণ করেছেন, তা হল এই- ‘‘আল্লাহ তিনি ব্যতীত আর কোন মা’বুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী, তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা কোনটাই স্পর্শ করে না। আকাশ সমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে এ সবের মালিক তিনিই। এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? মানুষের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন। তার ইচ্ছা ব্যতীত তার ইলমের কিছু অংশও কেহ আয়ত্বে আনতে পারে না। তাঁর কুরছি আকাশ সমূহ ও পৃথিবী ব্যাপ্ত করে আছে। এ দু‘টোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর জন্য কঠিন নহে। তিনি সর্ব-উচ্চ ও মহান। [৪ সুরা বাকারা, আয়াতুল কুরসী-২৫৫]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আল্লাহ নিদ্রা যান না এবং নিদ্রা যাওয়া তাঁর জন্য সাজেনা’। [৫ মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও দারামী]
অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:- ‘‘আল্লাহর ইলম সকল বস্ত্তকে বেষ্টন করে রেখেছে।’’ [৬ সুরা তাহরীম- ১২] আরো বলেন:- ‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, কিনি উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখেন।’’ [৭ সুনা হাশর - ২২] আর ফেরেস্তাদের ভাষ্যে বলেন:- ‘‘আমরা আপনার প্রভুর নির্দেশ ব্যতীত অবতরণ করি না, আমাদের সম্মুখে,পিছনে ও এত দু ভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা সব কিছুর মালিক তিনিই। আর তোমার প্রভু কখনও ভুলেন না।’’ [১ সুরা মারয়াম - ৬৪] মুসা আলাইহিস সালাম এর ভাষ্যে বলেন- ‘‘আমার প্রভু পথভ্রষ্ট হন না এবং ভোলেন ও না।’’ কিন্তু কদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ভুলও করেন এবং সঠিকও করেন। এটা জানা কথা যে, ভুলের সহিত অজ্ঞতা ও বিস্মৃত হওয়া অনিবার্য। ভন্ড কাদিয়ানী আরবী ভাষায় নিজ শব্দে বলে: ‘‘আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি রাসূলের পক্ষ হতে উত্তর দেই, আমি ভুলও করি এবং সঠিকও করি। আমি রাসূলকে বেষ্টন করে রেখেছি।’’(আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৭৯ পৃষ্টা।) সে আরো বলে: ‘‘আমি কাশফের দ্বারা দেখছি যে, আমি অনেক গুলি কাগজ আল্লাহ তাআলার কাছে পেশ করছি উহাতে স্বাক্ষর করার জন্য এবং আমি যে সকল দাবি করেছি উহা অনুমোদনের জন্য। অনন্তর, আমি দেখতে পেলাম তিনি উহাতে লাল কালি দ্বারা স্বাক্ষর করেছেন। কাশফের সময় আমার কাছে আব্দুল্লাহ নামে আমার একজন ভক্ত উপস্থিত ছিল। অতঃপর আল্লাহ কলম ঝাড়লেন। এতে লাল কালির ফোটা আমার কাপড়ে ও আমার ভক্ত আব্দুল্লাহর কাপড়ে পড়ল। কাশফ যখন শেষ হল তখন বাস্তবে দেখতে পেলাম আমার ও আব্দুল্লাহর কাপড় সেই লাল রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে গেছে। অথচ আমাদের নিকট কোন লাল রং ছিল না। এখন পর্যন্ত এ কাপড়গুলো আমার মুরীদ আব্দুল্লাহর নিকট মওযুদ আছে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তিরিয়াকুল কুলুব’ এবং ‘হাকীকতুল ওহী’ ২৫৫ পৃ:।)
অন্যত্র এ দাজ্জাল সৃষ্টিকর্তা সুমহান সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী আল্লাহকে ‘অক্টোপাস’ নামক একটা সামুদ্রিক প্রাণীর সহিত তুলনা দিয়েছে। সে বলে: ‘আল্লাহর অস্তিত্বের প্রকৃতিকে আমরা এরূপ ধরে নিতে পারি যে, তাঁর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কোন সীমা নেই। তিনি অক্টোপাস সাদৃশ’। তার অনেক শীরা রয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রসারিত। (গোলামের ‘তাওজীহুল মুরাম’ ৭৫ পৃ:) এমনিভাবে সে আল্লাহর অস্তিত্বকে নিয়ে বিদ্রূপ করেছে, যে আল্লাহর কোন সাদৃশ্য নেই। আর মহান আল্লাহর বাণী ‘‘ তাঁর অনুরূপ কোন বস্ত্ত নেই, তিনি সবকিছু শুনেন ও দেখেন। [২ সুরা শুরা - ১১] একথা সে অস্বীকার করেছে। এতদ্ব্যতীত কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ত‘আলা স্ত্রী সহবাস করেন এবং তাঁর সন্তানাদি জন্ম লাভ করে।’’ তাদের এ বিশ্বাস কিতাবুল্লাহ, সুনণতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সকল আসমানি ধর্মের পরিপন্থী । অতঃপর এর চেয়ে অদ্ভুত বিষয় তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের নবী গোলাম আহমদের সাথে সহবাস করেছেন। শুধু তা-ই নহে বরং এ সহবাসের ফল সে নিজেই। প্রথমত: যার সাথে আল্লাহ সহবাস করেছেন সে হল তাদের নবী গোলাম আহমদ। অতঃপর সে-ই গর্ভ ধারণকারী। দ্বিতীয়ত: সে-ই জন্ম গ্রহণকারী সন্তান। এখন আমাদের শুনা উচিত কাদিয়ানীরা তাদের ভাষায় কি বলে? কাজী ইয়ার মুহাম্মদ কাদিয়ানীর বক্তব্য: ‘‘মসীহ মাওউদ’’ (গোলাম) এক সময় তার নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, তিনি নিজেকে স্বপ্নে দেখেন, তিনি যেন একজন মহিলা। আর, আল্লাহ তাআলা তার মধ্যে নিজের পুরুষত্ব শক্তি প্রকাশ করলেন। (ইয়ার মুহাম্মদ, জাহিয়াতুল ইসলাম ৩৪ পৃ:) ভন্ড কাদিয়ানী নিজে বলে- ‘‘আমার মধ্যে ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে, যেমন মরিয়ামের মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছিল। রূপকভাবে আমি গর্ভ ধারণ করলাম। কয়েক মাস পরই যা দশ মাসের ঊর্ধ্বে নহে মরিয়াম হতে পরিবর্তিত হয়ে ঈসা হয়ে গেলাম। এ পদ্ধতিতে আমি মরিয়ম পুত্র হয়ে গেলাম। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘সফিনায়ে নূহ’ ৪৭ পৃ:) আরো সে বলে- আল্লাহ তাআলা আমাকে মরিয়ম নামে নাম করণ করেছেন, যে, মরিয়ম ঈসা কে গর্ভ ধারণ করেছিলেন। সুরায়ে তাহরীমের মধ্যে আল্লাহর এ বাণীতে আমিই উদ্দেশ্য, ‘‘ইমরানের কন্যা মরিয়ম যিনি তার সতীত্ব রক্ষা করেছেন। অতঃপর আমি উহাতে আমার রূহ ফুঁকে দিলাম’’। অবশ্যই আমি মেই একমাত্র ব্যক্তি যে দাবি করছে ‘আমিই মরিয়ম এবং আমার মধ্যেই ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে’। (গোলামের হাকীকতুল ওহীর হাসিয়া, ৩৩৭ পৃ:) এই ভিত্তিতে কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদকে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে, বরং সেই প্রকৃত আল্লাহ। এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী বলে: ‘আল্লাহ আমাকে বলেছেন- ‘‘তোমার সৃষ্টি আমার পানি থেকে এবং ওদের সৃষ্টি আমার পানি থেকে এবং ওদের সৃষ্টি কাপুরুষত্ব থেকে।’’ (গোলামের ‘‘আনজাসে আতম’’ ৫৫ পৃ:) সে আরো বলে- ‘আল্লাহ আমাকে এই বলে সম্বোধন করেছেন, শুন হে আমার ছেলে!’ (গোলামের ‘‘আল বুশরা ’’ ১ম খন্ড ৪৯ পৃষ্ঠা)
সে আরো বলে- যে, প্রভু আমাকে বলেছেন: তুমি আমা হতে এবং আমি তোমা থেকে, তোমার প্রকাশ আমার প্রকাশ। (গোলামের ‘‘ওহীয়ে মুকাদ্দাস’’ ৬৫০ পৃষ্ঠা) আল্লাহ আরো বলেছেন: হে সূর্য! হে চন্দ্র! তুমি আমা হতে এবং আমি তোমা হতে। (গোলাম রচিত ‘‘হাকীকতুল ওহী’’ ৭৩ পৃ:) সে আরো বলে: আল্লাহ তাআলা আমার মধ্যে অবতরণ করেছেন এবং তাঁর ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আমি হলাম মাধ্যম।’’ (গোলাম রচিত কিতাবুল বারিয়্যা ৭৫ পৃ:) সে আরো বলে: আমার উপর ওহী এসেছে-‘‘আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এমন একটি পুত্রের, যে হবে সত্য ও উচ্চ মর্যাদার প্রতীক, যেন আল্লাহ আকাশ হতে অবতরণ করেছেন।’’ (গোলাম রচিত ‘‘আল ইসতেফতা’’ ৮৫পৃষ্ঠা) এই হল মহান আল্লাহ সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আকীদাসমূহ। তারা আল্লাহর প্রতি যে সকল কথা আরোপ করছে, তা থেকে তিনি পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তাআলা তার সম্মানিত কালামে পাকে বলেন: ‘‘আপনি বলুন! তিনি আল্লাহ এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি সন্তান জন্ম দেননি এবং তিনি জন্ম গ্রহণও করেন নি। তার সমকক্ষ কেহ নেই। [১ সুরা ইখলাছ] আল্লাহ বলেন: ‘‘ঐ সকল লোকেরা কাফের হয়ে গেছে যারা বলে মসীহ ইবনে মরিয়মই হলেন আল্লাহ’’। [২ সুরা মায়েদা- ১৭] তিনি আরো বলেন: ‘‘হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ী কর না এবং আল্লাহর শানে সত্য ব্যতীত আর কিছুই বল না। নিশ্চয়ই মসীহ ঈসা বিন মরিয়ম আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্য কিছু নহেন। তিনি আল্লাহর কালিমা যাকে মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছেন এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আদিষ্ট রূহ। অতএব তোমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তিন খোদা বল না। তোমরা এ থেকে বিরত থাক। এটা তোমাদের জন্য মঙ্গল জনক। আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, সন্তান হওয়া থেকে তিনি পবিত্র। আকাশ সমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক তিনি। কার্য সম্পাদনে আল্লাহই যথেষ্ট’’। [১ সুরা নিসা- ১৭১] আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিস্টানরা বলে’’ মাসীহ আল্লাহর পুত্র, উহা তাদের মুখের কথা। এদের কথা ইতি পূর্বেকার কাফেরদের কথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস করুন। কাদিয়ানীরা যে আকীদা পোষণ করে , এর উপর তাদেরকে মহান আল্লাহ যা বলেছেন তা ছাড়া আমরা আর কিছুই বলব না। তিনি বলেছেন: ‘‘এদের কথা পূর্বেকার কাফেরদের কথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। কেমন করে তারা উল্টো দিকে ফিরে যাচ্ছে’’? আমরা কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় আকীদার দিকে যাওয়ার পূর্বে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করতে চাই যে, কাদিয়ানীরা গোলামকে যে প্রভুর পুত্র বলে দাবিকরে, সে হল ইংরেজ। যেমন, গোলাম আহমদ স্পষ্ট করে বলেছে: ‘আমার প্রতি ইংরেজি ভাষায় কয়েকবার ইলহাম হয়েছে। শেষবারে এ ইলহাম হয়: I can do what I will অর্থাৎ ‘আমি যা চাই, তাই করতে পারি।’ কথার উচ্চারণ ও বাক্য ভঙ্গি থেকে আমি বুঝতে পারলাম যেন একজন ইংরেজ আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। (গোলাম রচিত- ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ ৪৮০ পৃষ্ঠা) এখন আমরা খতমে নবুয়্যত সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আকীদার কথা উল্লেখ করছি। কাদিয়ানীরা এ বিশবাস করে যে, মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম দ্বারা নবুয়্যত শেষ হয়নি বরং নবুয়্যত চলতে থাকবে। গোলাম পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা বলে- ‘আমরা (কাদিয়ানীরা) বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তাআলা প্রয়োজন অনুসারে এ উম্মতের সংশোধন ও হেদায়েতের জন্য নবীগণ প্রেরণ করতে থাকবেন’। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের প্রবন্ধ, যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল-ফজলের, অন্তর্ভুক্ত এবং ১৯২৫ সালের ১৪ই মে তারিখে প্রকাশিত।) সে আরো লিখেছে- ‘‘তারা কি মনে করে আল্লাহর ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে গেছে । তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত। কেননা আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত। কেননা, আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। তা না হলে কোথায় এক নবী, বরং আমি বলি, অচিরেই হাজার হাজার নবীর আগমন ঘটবে’’। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ রচিত ‘আনওয়ারুল খেলাফত’ ৬২ পৃ:) এ কাদিয়ানী খলীফাকে একদা জিজ্ঞাসা করা হল: ভবিষ্যতে নবীগণের আগমন কি সম্ভব? সে উত্তর দিল হ্যাঁ, নবীগণ কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবেন। কারণ, পৃথিবীতে যতক্ষণ পর্যন্ত ফ্যাসাদ বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নবীগণের আগমন অপরিহার্য। (আল-ফজল, ২৭শে ফেব্র:, ১৯২৭ খৃ:।)
এ নির্বোধ বুঝতে পারেনি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম যাবতীয় ফাসাদ ও উহার প্রতিকারের বর্ণনা দিয়ে গেছেন। কাজেই, কোন নতুন নবীর আগমনের প্রয়োজন হতে পারে না। এ দিকেই নবী করীম তাঁর বাণীতে ইঙ্গিত করেছেন: ‘বণী ইসরাইলের তত্ত্বাবধান করতেন নবীগণ। যখনই কোন নবীর তিরোধান ঘটত, তখন অন্য নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। নিশ্চয়ই আমার পরে আর কোন নবী নেই, কাজেই বহু সংখ্যক খলীফা আগমন করবেন’’। [২ বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজা ও আহমদ।] হাদীসের তাৎপর্য হল এই খলীফাগণের কর্তব্য হবে যে তারা ইসলাম প্রচার, খাঁটি ধর্মের প্রসার ও মুসলমানদের সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। যেমনি ভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উত্তরাধিকারী উলামায়ে কেরামগণ এ দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সহীহ বুখারীতে আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:- আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী।’ [১ বুখারী ও তিরমিজী] এর প্রতিই আল্লাহ তাআলা তাঁর কালামে ইঙ্গিত করেছেন: ‘প্রত্যেক বড় সম্প্রদায় হতে এক একটি ছোট দল দ্বীনের জ্ঞান লাভ করার জন্য কেন বের হয় না? যখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবে, তখন তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে।’’ [২ সরা তওবা ১২২] এ আক্বীদাকে তারা শুধু এ জন্যই তৈরি করেছে, যাতে গোলাম আহমদের নবুয়তের দাবিকে শক্তিশালী করা যায়। নচেৎ গোলাম আহমদ কোন ফাসাদের সংস্কার করেছে? বরং সে ই তো ফাঁসাদের একটি উৎস। গোলাম তার পুত্র ও খলীফার ন্যায় কথা বলেছে, ‘‘নিশ্চয়ই নবীগণের আগমন আল্লাহর একটা অনুগ্রহ এবং তাদের ধারাবাহিকতা কথনও বিচ্ছিন্ন হবে না। এটা আল্লাহর বিধান। তোমরা এটাকে ঠেকাতে পারবে না ।’’ (গোলামের ‘কিতাবে শিয়ালকোট’ এর সার সংক্ষেপ, ২২পৃঃ) যখন নবুয়তের আকারে হয়। এ গোলামই সর্বপ্রথম এতে প্রবেশ করে। এ জন্যই কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল। শুধু তাই নহে, বরং সে সকল নবী রাসূলগণ হতে উত্তম। সে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের গৌরব। কাদিয়ানী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও তাদের মিথ্যা নবী গোলাম তার নিজের অবস্থা বর্ণনা করে বলে: ‘আমি ঐ আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ, তিনি আমাকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং নবী নামে অভিহিত করেছেন। আর, আমাকে মসীহে মাওউদ বলে আহবান করেছেন এবং আমার দাবির সমর্থনে তিন হাজার নিদর্শন অবতীর্ণ করেছেন।’’ (গোলাম রচিত হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, ৬৮ পৃ:) সে আরো বলে: তিনিই সত্য প্রভু, যিনি কাদিয়ানী তার রাসূল পাঠিয়েছেন।’ (কাদিয়ান তার আভাস ভূমির নাম)আল্লাহ তাআলা কাদিয়ানকে হিফাজত করবেন এবং প্লেগ রোগ, থেকে রক্ষা করবেন। শক্তিমান পরাক্রমশালী আল্লাহর কুদরত যে, গ্রামকে ভন্ডনবী কাদিয়ানী নিজের অবস্থান ও ভ্রান্ত মতবাদ দিয়ে অপবিত্র করেছে সেই কাদিয়ানে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। যাতে তার দাবি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়, অথচ আশে পাশের শহর-গ্রামে এই রোগ বিস্তৃতি লাভ করেনি। পরে এই গোলাম কাদিয়ানী তার শ্বশুরের কাছে লিখিত একটি পত্রে স্বয়ং এই প্লেগ রোগের কথা স্বীকার করে। সে লিখেছে: এখানে (কাদিয়ানে) প্লেগ রোগ চরমে পৌঁছেছে। মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হলে কয়েক ঘনটার মধ্যেই মারা যায়।(মাকতুবাতে আহমদিয়া ৫ম খন্ড ১১২ পৃ:) উক্ত ব্যক্তির নিকট লেখা অন্য একটি পত্রে সে বলে: প্লেগ রোগ গ্রামে ঢুকে পড়েছে, এমনকি আমাদের ঘরেও ঢুকে পড়েছে। গোছানা আক্রান্ত তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে , যেমন বের করে দিয়েছি জনাব মোহাম্মদ দ্বীনকে। কেননা, সেও আক্রান্ত । আজ দিল্লী থেকে আগত আমাদের এক মেহমান মেয়ে লোক আক্রান্ত হলো। যদিও এর প্রকোপ সত্তুর বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। কেননা, এটা তার রাসূলের বাসস্থান এবং এতে সকল জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (গোলাম রচিত দাফেউল বালা’ ১০ও ১১ পৃ:) সে আরো বলে: আমার রেসালাত প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তাআলা এত বেশি সংখ্যক নিদর্শন প্রেরণ করেছেন, যদি তা এক হাজার নবীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়, তবে এতেই তাদের রেসালত প্রমাণিত হয়ে যাবে। কিন্তু মানব শয়তানরা এটা বিশ্বাস করে না ।(গোলাম রচিত আইনুল মারেফত ৩১৭ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল লিখেছে, যে অর্থে পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণকে নবী রাসূল বলা হত সেই অর্থে গোলাম আহমদও নবী এবং রাসূল। (আল ফজল, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৪খৃঃ) এ পত্রিকাটি ‘মুসলমানদের প্রতি আহবান’ শিরোনামে প্রচার করে: ‘‘হে লোকেরা, যারা ইসলামের দাবিকর, তোমরা প্রকৃত ইসলামের দিকে আস, যা তোমরা মাসীহে মাওউদ (অর্থাৎ গোলাম আহমদ) ব্যতীত আর কারো কাছে পাবে না। তার দ্বারাই তোমাদের পুণ্য ও খোদা ভীতির পথ খুলবে, তার অনুসরণে মানবজাতি সফলতা ও মুক্তি লাভ করবে, এবং গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবে। তিনিই হলেন পূর্ববর্তী পরবর্তীদের গৌরব।(আল-ফজল, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ খৃ:) ভন্ডনবী কাদিয়ানীর পুত্র এবং কাদিয়ানীদের নেতা বশীর আহমদ লিখেছে: এ কথা বাস্তব সত্য যে, গোলাম আহমদ নবী ও রাসূল থেকে উত্তম বলে বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও রয়েছেন এখানে আমরা শুধু এদের দ‘টি উক্তি উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করি। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে, ‘আমাকে যা কিছু আল্লাহ দিয়েছেন, তা জগৎবাসীর মধ্যে আর কাউকে দেননি।’ (গোলাম কাদিয়ানীর- হাকিকতে ওহীর পরিশিষ্ট, ৮৭ পৃ:) সে আরো বলে: সকল নবীগণকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তা একাই আমাকে দেয়া হয়েছে। (গোলামের দুররে ছামীন ২৮৭ পৃ:) কাদিয়ানীদের একটা আকীদা হল এই যে, জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম গোলাম আহমদের নিকট অবতরণ করতেন। অথচ সকল মুসলমান এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, মুহাম্মদের পরে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আর কারো কাছে অবতরণ করেন নি। গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: আমার বয়স যখন নয় বছর, সে সময় আমি এবং আমার সাথী একজন ছাত্র আমাদের বাড়িতে খেলছিলাম। এমনি এক সময় খেলা ধুলার অবসরে আমরা একটি পুস্তক দেখতে পেলাম। আমরা উহা খুললাম যা পড়তেও সক্ষম ছিলাম। কাজেই, আমরা উহার কিছু অংশ পড়লাম। আমাদের পড়ার মধ্যে এ কথাটি ছিল ‘‘নিশ্চয়ই জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এখন অবতরণ করেন না’’। আমি বললাম এটা মিথ্যা কথা। কেননা, জিব্রাঈল আমার পিতার কাছে আগমন করেন। ঐ ছাত্রটি তা অস্বীকার করে বলল: না, কেননা এ পুস্তকে লেখা আছে যে, জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম অবতরণ করেন না। আমরা দ‘জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। তাই আমরা আমার পিতার নিকট গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে তিনি বললেন- কিতাবে যা লেখা আছে তা ভুল। কেননা জিব্রাঈল আঃ. এখনও অবতরণ করেন। (মাহমুদ আহমদের ভাষণ, যা আল ফজল পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত এবং ১০ এপ্রিল ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত) গোলাম নিজেই বলে: জিব্রাঈল আঃ. আগমন করে আমাকে পছন্দ করলেন এবং তার আঙুল ঘুরিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে শত্রুগণ হতে রক্ষা করবেন। (গোলাম রচিত ‘মাওয়াহিবুর রহমান’ ৪৩ পৃষ্ঠা) কাদিয়ানীরা এটাও বিশ্বাস করে যে, গোলামের নিকট ওহী আসে এবং তার উপর আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হয়। শুধু এই নহে, বরং তার ওহী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওহীর সমতুল্য এবং তার এলহামাত কুরআনের মতই। এর উপর ঈমান আনয়ন করা অবশ্যই কর্তব্য। কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানী বলে: গোলাম আহমদ আদিষ্ট হয়েছেন যে, তার কাছে যে ওহী আসে তা তার জামাতকে শুনাবেন। অনুরূপভাবে উহার উপর বিশ্বাস করা কাদিয়ানীদের কর্তব্য। কেননা, আল্লাহর কালাম এ উদ্দেশ্যে পৌঁছে থাকে অর্থাৎ উহাতে বিশ্বাস করা এবং তা কার্যে পরিণত করাই উদ্দেশ্য। এ মর্যাদা নবীগণ ছাড়া আর কারো নেই যে, তাদের ওহীতে ঈমান আনতে হবে। (মুহাম্মদ ইউসুফ রচিত ‘আন নবুয়্যত ফিল ইসলাম ’ ২৮ পৃ:) গোলাম বলে: ‘মহান আল্লাহর শপথ! আমি আমার ওহীতে বিশ্বাস করি, যেমন কুরআন ও অন্যান্য আসমানি কিতাবে বিশ্বাস রাখি। আর, আমি বিশ্বাস করি যে, যে কালাম আমার উপর অবতীর্ণ হয়, উহা আল্লাহর নিকট হতেই অবতীর্ণ হয়। অনুরূপভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।’ (গোলাম কাদিয়ানী রচিত-হাকীকাতুল ওহী’ ২১১ পৃ:) সে আরো বলছে: আমার নিকট যে ইলহামাত অবতীর্ণ হয়, উহাতে আমি এরূপ বিশ্বাস করি যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে বিশ্বাস রাখি। (তাবলীগে রেসালাত’ ৬খন্ড, ৬৪পৃঃ) কাদিয়ানীদের এক প্রধান জালালুদ্দীন সামছ লিখেছে ‘গোলাম আহমদের ওহীর মর্যাদা অবিকল কুরআন, ইঞ্জিল ও তাওরাতের মর্যাদার সমান।’ (জালালুদ্দীন রচিত আকিবাতুল মুনকিরিন খেলাফাহ’ ৪৯ পৃ:) যেহেতু কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদের প্রলাপসমূহকে কুরআনের মতই মনে করে তাই তারা বলে যে, যে সকল হাদীসে গোলাম আহমদের উক্তির বিপরীত হবে, উহা প্রত্যাখ্যাত; যদিও উহা প্রকৃত পক্ষে বিশুদ্ধ হাদীস হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে, যে সকল হাদীস গোলাম আহমদের উক্তির মোতাবেক উহা বিশুদ্ধ। যদিও উহা প্রকৃত পক্ষে মওযু (জাল) বা মিথ্যা হয়ে থাকে। কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: গোলাম আহমদের কথা নির্ভরযোগ্য। এর উপর নির্ভর করা যায়। কিন্তু হাদীস সমূহের অবস্থা এর বিপরীত। কেননা, হাদীস সমূহ তো আমরা রাসূলুল্লাহর মুখ থেকে শুনি নি, আর গোলাম আহমদের কথা আমরা তার মুখ থেকেই শুনেছি। কাজেই হাদীস সহীহ হলে উহা গোলাম আহমদের উক্তির বিপরীত হওয়া সম্ভব নহে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের উক্তি যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে উদ্ধৃত, ২৯ এপ্রিল ১৯১৫ খৃ:) এ পত্রিকাটি আরো প্রচার করেছে- ‘এক বে-আদব লিখেছে, গোলামের যে সকল উক্তি বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীত তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত। এ নির্বোধ! বুঝতে পারেনি যে, এর দ্বারা গোলাম আহমদের সত্য দাবিগুলো অস্বীকার করা অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে। পক্ষান্তরে কোন কোন হাদীস এমনও রয়েছে, যে গুলোকে আলেমগণ দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু আমাদের নবী গোলাম আহমদ বলেন যে, ইহা বিশুদ্ধ। সুতরাং আমরা তার কথা বিশ্বাস করব ওদের কথা নহে। তিনি যে হাদীসকে বিশুদ্ধ বলেন আমরাও উহাকে বিশুদ্ধ বলব। আর যে হাদীসকে তিনি দুর্বল বলেন, আমরাও উহাকে দুর্বল বলব। কেননা, হাদীস সমূহ রাবীদের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। আমরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনিনি। তবে গোলাম আহমদের কথার উপর আমরা এ জন্য নির্ভর করি যে, তিনি আল্লাহর নিকট থেকে অবহিত হওয়ার পর আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। আর তিনি হলেন একজন জ্যান্ত নবী। মোট কথা, যে হাদীস গোলাম আহমদের উক্তির বিপরীত হবে, হয়তো উহা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ অথবা উহা বিশুদ্ধ নহে। (আল- ফজল, ২৯ এপ্রিল, ১৯১৫ খৃ:) কাদিয়ানীদের খলীফা ও তাদের নেতা বলে: ‘মসীহে মাওউদ’ (গোলাম) যে কুরআন পেশ করেছেন উহা ভিন্ন আর কোন কুরআন নেই। যে হাদীস গোলাম আহমদের শিক্ষার আলোকে হবে, উহা ভিন্ন আর কোন হাদীস নেই। এবং গোলাম আহমদের নেতৃত্ব বহির্ভূত কোন নবী নেই। যে ব্যক্তি মুহাম্মদকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে চায়, সে যেন গোলাম আহমদের প্রতিচ্ছবি দেখে নেয়। কেননা, যে ব্যক্তি তার মাধ্যম ছাড়া মুহাম্মদকে দেখতে চায়, তার পক্ষে উহা সম্ভব নহে। অনুরূপভাবে কেহ যদি তার মাধ্যম ছাড়া কুরআন দেখতে চায়, তবে এই কুরআন সেই কুরআন নহে। যাহা যাকে ইচ্ছা তাকে পথ প্রদর্শন করে, বরং উহা সেই কুরআন হবে, যাহা যাকে ইচ্ছা তাকে পথভ্রষ্ট করে। অনুরূপভাবে গোলাম আহমদের ব্যাখ্যা ছাড়া হাদীসের কোন মূল্য নেই। কেননা, প্রত্যেকে এ থেকে যা ইচ্ছা তা বের করতে পারে।’ (জুমার খুতবা যা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ কাদিয়ানে প্রদান করেছিল, উহা ‘আল-ফজল ‘পত্রিকার অন্তর্ভুক্ত, ১৫ জুলাই ১৯২৪ খৃ:) কাদিয়ানীদের আরেকটি আকীদা হল এই যে, গোলাম আহমদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, যেরূপভাবে প্রধান রাসূলগণের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল। তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, উহা অন্যান্য অনেক নবীর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার চেয়েও অধিক। অন্যান্য আসমানি কিতাব যেভাবে তিলাওয়াত করা হয়, অনুরূপভাবে, এ কিতাবটিও তিলাওয়াত করা অপরিহার্য। যে কিতাবটি তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে উহার নাম ‘আল-কিতাবুল মুবিন।’ আরো উল্লেখযোগ্য যে, কাদিয়ানীদের কুরআনে বিশ অংশ রয়েছে। এমনি ভাবে তা বিভিন্ন আয়াতেও বিভক্ত। কাদিয়ানী পত্রিকা লিখছে- গোলাম আহমদের উপর তার প্রভুর কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যে কোন নবীর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার চেয়ে কম নহে। বরং উহা অনেক নবীর চেয়ে বেশি। (আল-ফজল ১৫ ফেব্র: ১৯১৯ খৃ:) মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানী তার পুস্তকে লিখছে- আল্লাহ তাআলা গোলাম আহমদের ইলহামাতের সমষ্টিকে ‘আল কিতাবুল মুবিন’ নামে অভিহিত করেছেন। এক একটা ইলহামের নাম এক একটি আয়াত যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, নবীর জন্য কিতাব লাভ করা অপরিহার্য; তার কর্তব্য হল গোলাম আহমদের নবুয়্যত ও রেসালতকে বিশ্বাস করা। কেননা, আল্লাহ তাআলা তার জন্য একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং ‘আলকিতাবুল মুবিন’ নামে উহার নামকরণ করেছেন। আর এ গুণে তাকে ভূষিত করেছেন।’ যদিও কাফেরগণ তা অপছন্দ করে। (মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানী রচিত ‘আন-নবুয়্যত ফিল ইসলাম’ ৪৩ পৃ:) কাদিয়ানী খলীফা কাদিয়ানে প্রদত্ত তার ঈদের খুতবায় বলেছে: প্রকৃত ঈদ আমাদের জন্য; তবে প্রয়োজনের চাহিদা হল এই যে, মসীহে মাওউদের (গোলামের) উপর আল্লাহর যে কালাম অবতীর্ণ হয়েছে উহা আমাদের পাঠ করা ও অনুধাবন করা উচিত। খুব কম লোক আছে যারা এ কালাম পাঠ করে এবং এর দুধ পান করে। অথচ অপরাপর কিতাব যতই পাঠ করা হোক না কেন উহাতে সে স্বাদ ও আনন্দ নেই যা গোলাম আহমদের উপর অবতীর্ণ কিতাব পাঠ করলে লাভ করা যায়। (আল-ফজল, ৩রা এপ্রিল ১৯২৮ খৃ:) গোলাম আহমদ তার কালামের বর্ণনায় বলে: আমার উপর এত অধিক পরিমাণ আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হয়েছে; যদি উহা একত্রিত করা যায়, তবে বিশ খন্ডের কম হবে না। (গোলাম কদিয়ানীর ‘হাকীকতুল ওহী’ ৩৯১ পৃ:) কাদিয়ানীরা আরো বিশ্বাস করে যে, তারা স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি ধর্মের অধিকারী এবং তাদের শরীয়ত একটা স্বতন্ত্র শরীয়ত। গোলাম আহমদের সঙ্গী সাথী সাহাবাগণের মতই এবং তার উম্মত একটি নতুন উম্মত। কাদিয়ানীদের পত্রিকা একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছে। উহাতে আছে-‘আল্লাহ তাআলা এ রেসালাতকে কাদিয়ান নামক উজাড় বস্তিতে প্রকাশ করেছেন এবং এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য গোলাম আহমদকে নির্বাচিত করেছেন, যিনি পারস্য বংশোদ্ভুত। তাকে বলে দিয়েছেন- ‘‘আমি তোমার নাম পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেব এবং শক্তি দিয়ে তোমাকে সাহায্য করব। তুমি যে ধর্ম নিয়ে আগমন করেছ, উহাকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করব। আর এ বিজয় কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে।’’ (আল-ফজল পত্রিকা ৩রা ফেব্রু: ১৯৫৩ খৃ:) পত্রিকাটি আরো প্রচার করেছে যে, ‘যে ব্যক্তি কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করা অবস্থায় গোলাম আহমদকে দেখেছে, তাকে সাহাবী বলা হবে।’ (আল-ফজল, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ খৃ:) গোলাম আহমদ নিজেই এ মতের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে- যে ব্যক্তি আমার জামাতে প্রবেশ করবে, সে বাস্তবে সাইয়েদুল মুরসালীনের সাহাবাগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (গোলামের ‘খুতবায়ে ইলহামিয়া’ ১৭১ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা এ সূত্র ধরে বলে: ‘গোলাম আহমদের জামাত প্রকৃত পক্ষে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জামাত। তাদের উপর যেমন রাসূলুল্লাহর ফয়েজ ও বরকত সমূহ জারি হয় এমনি ভাবে কোন পার্থক্য ছাড়াই তার জামাতের উপর রাসূলুল্লাহর ফয়েজ ও বরকত জারি হয়। (আল-ফজল ১ম জানুয়ারি ১৯১৪ খৃ:) কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদ তার জামাতকে ঐ সকল লোকের সাথে সাক্ষাতের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছে যে, ‘মসীহে মাওউদের (গোলামের) আসহাবের সহিত তোমাদের সাক্ষাৎ করা উচিত।’ এদের মধ্যে অনেকেই এমন আছে, যাদের চুল এলোমেলো এবং মলিন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাদের প্রশংসা করেছেন। (মাহমুদ আহমদের প্রবন্ধ যা আল-ফজল পত্রিকায় প্রচারিত, ৮জানুয়ারী ১৯৩২ খৃ:)
এখন আমরা স্বয়ং গোলাম আহমদের আলোচনা করছি। সে তার উম্মতের কথা উল্লেখ করে বলে: ‘আমার উম্মত দু’ভাগে বিভক্ত। এক দল খ্রিস্ট ধর্মের রং অবলম্বন করবে ও ধ্বংস হয়ে যাবে। অপর দল মাহদীর রং গ্রহণ করবে। (গোলামের উক্তিসমূহ যা আল-ফজল পত্রিকার অন্তর্ভুক্ত, ২৬ শে জানুয়ারি ১৯১৬ খৃ:) অনুরূপভাবে, এই গোলাম আহমদ তার শরীয়তের উল্লেখ করে বলে: শরীয়ত কি? তা তোমরা বুঝে নাও। আদেশ নিষেধের বর্ণনা করার নাম শরীয়ত। যে ব্যক্তি এ কাজ করবে এবং তার উম্মতের জন্য আইন কানুন নির্ধারণ করবে সেই হল ছাহেবে শরীয়ত। সুতরাং আমিই ছাহেবে শরীয়ত। কেননা, আমার কাছে আদেশ নিষেধ সম্পর্কে ওহী আসে। আর শরীয়তের জন্য এটা জরুরি নহে যে, তা নতুন নতুন আহকাম সংবলিত হবে। কেননা, কুরআনে যে সমস্ত শিক্ষা রয়েছে তাওরাতেও তা বর্তমান। বরকতময় মহান আল্লাহ এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন- ‘নিশ্চয়ই এটা পূর্বেকার সহীফা সমূহের মধ্যে আছে অর্থাৎ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ও মুসার আলাইহিস সালাম সহীফাতে রয়েছে।’’ [১সুরা আল আ’লা ১৮-১৯] (গোলাম রচিত ‘আরবাঈন’ ৪ নম্বর ৭পৃঃ)
কাদিয়ানীরা এ আকীদা ও পোষণ করে যে, কাদিয়ান অর্থাৎ যে জনপদে দাজ্জাল, মিথ্যাবাদী, বিকৃত মস্তিষ্ক গোলাম আহমদ জন্ম গ্রহণ করেছে, উহা মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা সমতুল্য। বরং এ দু’স্থান হতেও উত্তম। আর উহার ভূমি হেরেমের ভূমি এবং উহাতে আল্লাহর অনেক নিদর্শনা বলী রয়েছে। উহাতে এমন একটি অংশ রয়েছে যা বেহেস্তের এক টুকরা। এখানে এমন একটি গোরস্থান রয়েছে, যার উপর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম প্রেরণ করেন এবং কুরআনে এর উল্লেখ রয়েছে। কাদিয়ানের মসজিদ, মসজিদে নববী, মসজিদে হারাম ও মসজিদে আকসার সমতুল্য, বরং স্বয়ং এ মহল্লা মুসলমানদের কিবলা ও কা’বা সাদৃশ্য। কাদিয়ানীদের এক অভিশপ্ত ব্যক্তি ‘আল-ফজল পত্রিকায় লিখছে, যার ভাষ্য হল: ‘কাদিয়ান কি? কাদিয়ান হল আল্লাহর জালালী শান ও কুদরতের একটি প্রকাশ্য নিদর্শন। এমনি ভাবে মসীহে মাওউদ (গোলাম) বলেছেন- ‘ইহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দারুল খেলাফত এবং মাসীহের বাসস্থান, জন্মস্থান ও সমাধিস্থল। এ জনপদেই রয়েছে এমন একটা ঘর যেখানে বসবাস করতেন বিশ্বের মুক্তিদাতা, দাজ্জালের ঘাতক এবং (খ্রিস্টানদের) ক্রসের চূর্ণ বিচূর্ণকারী (স্বপ্ন জগতে) আর ইসলাম ধর্মকে সকল ধর্মের উপর বিজয় দানকারী। (আল-ফজল, ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৩৯ খৃ:) অন্য এক মিথ্যাবাদী লিখছে ‘এটা আল্লাহর নূর সমূহের অবতরণ স্থল, ইহার অলি-গলি ও গৃহ সমূহে কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তার প্রত্যেকটি ইট আল্লাহর এক একটি নিদর্শন। এর মসজিদ সমূহ নুরানী এবং উহার মুয়াজ্জিনের আযান জ্যোতিষ্মান। এ সকল মসজিদের মিনার সমূহ হতে এমন ধ্বনি উচ্চারিত হয় যা আরব উপদ্বীপে চৌদ্দ শতাব্দী পূর্বে উচ্চারিত হয়েছিল। (আল-ফজল ১লা জানুয়ারি ১৯২৯ খৃ:) কাদিয়ানের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: ‘আমি তোমাদেরকে সত্য বলছি, আল্লাহ আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, কাদিয়ানের ভূমি বরকতময়, উহাতে অবিকল ঐ সকল বরকত অবতীর্ণ হয় যা মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের বাণী যা ‘আল-ফজল’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত, ১০ ডিসেম্বর ১৯৩২ খৃ:) সে আরো বলেছে কাদিয়ানী আল্লাহর নেয়ামত ও বরকত সমূহের অবতরণ স্থল। এ সমস্ত বরকত ও ফয়েজ সমূহ যেভাবে কাদিয়ানী অবতীর্ণ হয়, অন্য কোথায়ও তেমনি অবতীর্ণ হয় না। গোলাম আহমদও বলেছে: যে ব্যক্তি কাদিয়ানে আসবে না, আমি তার ঈমানের উপর আশঙ্কা করি।’ (গোলাম পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা কর্তৃক রচিত ‘আনওয়ারুল খেলাফত’ ১১৭ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজল’ প্রচার করেছে; যে মসজিদে আকসার দিকে রাসূলুল্লাহকে রাত্রিবেলা ভ্রমণ করান হয়েছিল, তা হল ঐ মসজিদ যা কাদিয়ানী অবস্থিত। আর মূল বক্তব্য হল এই আল্লাহর বাণী। ‘‘ঐ আল্লাহ পবিত্র যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসার প্রতি ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন, যার চতুর্পাশ্ব আমি বরকতময় করে রেখেছি।’’ [১ সুরা বণী ইসরাইল-১] উহাতে মসজিদে আকসার দ্বারা কাদিয়ানের মসজিদকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কেননা, রাসূলুল্লাহকে রাত্রিকালে ঐ মসজিদের দিকে ভ্রমণ করান হয়েছিল যা কাদিয়ানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং যা গোলাম আহমদের ঐ সকল কামালাত ও বরকতের জ্যান্ত ছবি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দান করেছিলেন। (আল ফজল, ২১ আগস্ট, ১৯৩২ খৃ:) এই কাদিয়ানী দাজ্জাল উক্ত মসজিদকে বাইতুল হারামের সঙ্গে তুলনা করে বলে: কাদিয়ানে অবস্থিত আমার মসজিদের বর্ণনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআনে তাঁর বাণী- ‘‘আর যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করল সে নিরাপদ হয়ে গেল। [২ সুরা আলে ইমরান- ৯৭] অবতীর্ণ করেছেন। (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘‘এজালাতুল আওহাম’’ ৭৫ পৃ:) গোলামের জনৈক ভক্ত আল ফজল পত্রিকায় লিখেছে, ‘আরব ভূমি যদি হেরেম শরীফ দ্বারা গর্ব করতে পারে তবে অনারব ভূমি কাদিয়ান ভূমি দ্বারা গর্ব করতে পারবে।’ (আল-ফজলে, প্রকাশিত ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খৃ:) এ পত্রিকাটিতেই কাদিয়ানের প্রশংসায় জনৈক কাদিয়ানীর রচিত একটি কাসীদা প্রচারিত হয়েছে। এতে আছে, হে কাদিয়ানের ভূমি তোমার উজ্জ্বল পরিবেশকে কি বলব, যদ্দারা বড় বড় চক্ষু বিশিষ্ট হুরগণের চক্ষু আলোকিত হয়। আর আমি তোমাকে কি বলব? তুমিই ক্বিবলা ও কা’বা এবং ফেরেস্তাগণের মসজিদ।’’ (আল-ফজল, ১৮ ই আগস্ট ১৯৩২ খৃ:) কদিয়ানী খলীফা জুমায়ার খুতবা দিতে গিয়ে বলে- কাদিয়ান পৃথিবীর কেন্দ্র স্থল এবং তা সকল জনপদের মূল। এ পবিত্র ভূমি ছাড়া কোন প্রকারের উপকারিতা লাভ করা সম্ভব নহে।(জুমায়ার খুতবা যা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ কাদিয়ানে প্রদান করেছিল এবং আল ফজল পত্রিকায় প্রচারিত ৩রা জানুয়ারি ১৯২৫খৃঃ) সে তার হাকীকতুর রুইয়া. নামক পুস্তকে লিখেছে কাদিয়ান হল সকল জনপদের মূল। যে ব্যক্তি উহা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তাকে টুকরা টুকরা ও ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হবে। তোমরা টুকরা ও ছিন্ন ভিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাক। মক্কা ও মদিনার ফল শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কাদিয়ানের ফল সর্বদা টাটকা থাকবে। (হাকীকতুর রুইয়া ২৫ পৃ:) যেমনি ভাবে এ সকল দাজ্জাল মক্কা ও মদিনার মর্যাদার অবমাননা করতে চেয়েছে। হ্যাঁ, এই মক্কা মুকাররমা, যার শপথ করেছেন মহান ও বরকতময় প্রভু এবং এর নামকরণ করেছেন ‘নিরাপদ শহর’। তিনি বলেন- ‘‘আমি এ শহরের শপথ করছি।’’ [৩ সুরা আল বালাদ ১] আরো বলেন: ‘এ নিরাপদ শহরের শপথ’’। [৪ সুরা তীন ৩] আর ‘‘উম্মুলকুরা’’ (সকল জনপদের মূল) নামে এর নামকরণ করে আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘যাতে আপনি উম্মুল কুরা অর্থাৎ মক্কা ও তার আশে পাশের লোকজনকে ভীতি প্রদর্শন করেন।’’ [৫ সরা আল আনআম ৯৩] আর যেখানে আল্লাহ সম্মানিত ঘর ও হেরেম শরীফ রেখেছেন, যেমন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ কালামের মধ্যে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন- ‘‘সর্ব প্রথম ঘর যা মানব জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে, উহা মক্কায় অবস্থিত, যা অত্যন্ত বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য পথ প্রদর্শক। উহাতে রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শনা বলী। তন্মধ্যে একটি হল মাকামে ইব্রাহীম। যে ব্যক্তি উহাতে প্রবেশ করল সে নিরাপদ হয়ে গেল।’’ [১ সুরা আলে ইমরান- ৯৬-৯৭] আল্লাহ আরো বলেন ‘‘ হে মুহাম্মদ আপনি ঘোষণা করুন: আমি এ সম্মানিত শহরের প্রভুর এবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি।’’ [২ সুরা নমল-৭] আর এ শহর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় তুমি সর্বোত্তম ভূমি এবং আল্লাহর কাছে তাঁর ভূমিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়তম।’’ [৩ তিরমিজী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, আহমদ, হাকিম ও ইবনে হিববান।] আর মদিনা মুনাওরা হল মহান আল্লাহর রাসূলের শহর, ওহীর অবতরণস্থল, নুরের উৎস এবং সাইয়্যেদুল মুরসালীনের হিজরত ও সমাধিস্থল। আল্লাহ এর নাম রেখেছেন ‘ত্বাবাহ’ (পবিত্র শহর) যে ব্যক্তি এখানে মৃত্যুবরণ করবে তাঁর জন্য রাসূলকে সুপারিশকারী বানিয়েছেন, দাজ্জাল ও প্লেগ হতে একে রক্ষা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি ওহীর সাহায্যে কথা বলেন তিনি একে হেরেমের মর্যাদা দান করেছেন। যেমন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হেরেম শরীফ বানিয়েছেন এবং একে ঈমানের কেন্দ্রস্থল সাব্যস্ত করেছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আল্লাহ তাআলা মদিনাকে ‘তাবাহ’ নাম দিয়েছেন [৪ বুখারী ও মুসলিম] এবং বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম হয় , সে যেন এখানে মৃত্যুবরণ করে। কেননা, যে ব্যক্তি এখানে মৃত্যুবরণ করবে আমি তার জন্য সুপারিশ করব। [৫ তিরমিজী ইবমোজাহ ও ইবনে হিববান] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘মদিনার দ্বার সমূহে ফেরেস্তা-গণের পাহারা রয়েছে, সেখানে দাজ্জাল ও প্লেগ প্রবেশ করতে পারবে না।’ [৬ বুখারী মুসলিম মুয়াত্তা ও আহমদ] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হেরেম বানিয়েছেন এবং মদিনার উভয়‘‘লাবা’’ প্রান্তরের মধ্যবর্তী স্থানকে হেরমরুপে নির্ধারিত করছি। [৭ তিরমিজী] হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘নিশ্চয়ই ঈমান সংকুচিত হয়ে মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেমন সর্প সংকুচিত হয়ে তার গর্তে প্রবেশ করে।’ [৮ বুখারী মুসলিম ইবনে মাজাহ ও আহমদ] হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-‘মদিনা মানুষের অপবিত্রতাকে এমনিভাবে দূর করে দেয় যেমনি কর্মকারের চুলা লোহার ময়লাকে দূর করে দেয়।’ [৯ বুখারী মুসলিম তিরমিজী, নাসায়ী, মুয়াত্তা ও আহমদ] এসব হল মক্কা ও মদিনা সম্পর্কে ইসলাম ও মুসলমানদের আকীদা। কিন্তু কাদিফানীরা এ দুটি মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ ও হ্রাস করার প্রয়াস চালায় এবং কাদিয়ানকে মক্কা ও মদিনার সমতুল্য নয় বরং এ দুটির চেয়ে আরো উত্তম বানাতে চায়। এ জন্যই কাদিয়ানী খলীফা বলে- মক্কা-মদিনার ফল নিঃশেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কাদিয়ানের ফল সর্বদাই তাজা থাকবে। সে আরো বলে: কাদিয়ানে আল্লাহর কতকগুলো নিদর্শন রয়েছে। তন্মধ্যে বার্ষিক সম্মেলন স্থল, মসজিদে আল মুবারক, মসজিদে আকসা (আল কাদিয়ানী) মসীহের মিনার [১ ‘মসীহের মিনার’ গুলাম আহমদ এই মিনার বানিয়ে ঘোষণা করে যে এই সেই মিনার যার প্রতি রাসুলুল্লাহ সাঃ. এই বলে ইশারা করেছেন যে, পূর্ব দামেস্কের এই মিনারার উপর ঈসা আঃ অবতরণ করবেন। গুলামের এই দাবীতে তার বোকামীর ভ্রষ্টতা কোথায় দামেস্ক আর কোথায় কাদিয়ান। এরপর কোথায় পূর্ব থেকে তৈরী মিনার আর কোথায়পরে তৈরী মিনার, যেটি নির্মাণ করছে মিথ্যুক ভন্ডনবী। এরপর বলে যে, এরপর বলে যে, এর উপর ঈসা নাজেল হবেন। এর চেয়ে বড় বোকামী আর কি হতে পারে!!] ইত্যাদি। সুতরাং এ সকল পবিত্র স্থানের জিয়ারত করা উচিত। কেননা এগুলো আল্লাহর নিদর্শনা বলী। (মাহমুদ আহমদের ভাষণ, যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজলে অন্তর্ভুক্ত, ৮ই জানুয়ারি ১৯৩৩ খৃ:) তাদের আর একটি আকীদা হল এই ‘কাদিয়ানের বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার নাম হজ।’ গোলাম পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা বলে: আমাদের বার্ষিক সম্মেলনই হল হজ। আল্লাহ তাআলা হজের স্থানরূপে কাদিয়ানকে নির্বাচিত করেছেন এবং এখানে অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ নিষিদ্ধ।’ (মাহমুদ আহমদের ‘‘বারাকাতুল খেলাফত’’ ৫ও ৭ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে ছুলাহ’ তে জনৈক কাদিয়ানী লিখেছে, ‘গোলাম আহমদের উপর ঈমান গ্রহণ ব্যতীত কোন ইসলাম নেই, যেমন কাদিয়ানী সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া ব্যতীত কোন হজ নেই। কেননা, বর্তমান মক্কায় হজের উদ্দেশ্য সমূহ পূর্ণ হয় না। (পয়গামে ছুলাহ, ১৯ এপ্রিল ১৯৩৩ খৃ:) মিথ্যুক গোলাম আহমদ বলে: শুধু কাদিয়ানে অবস্থান করাই নফল হজ হতে উত্তম। (গোলাম রচিত ‘মেরআতু কামালাতিল ইসলাম’ ৩৫২ পৃ:) মাহমুদ আহমদ বলে: আমাকে ইয়াকুব আহমদ কাদিয়ানী বর্ণনা করেছেন যে, গোলাম আহমদ বলেছেন- ‘কাদিয়ানে আগমনই হচ্ছে হজ। (আল ফজল, ৫ জানুয়ারি ১৯৩৩ খৃ:)সারকথা, কাদিয়ানীদের প্রথম আকীদা হল: তাদের একজন মাবুদ আছেন যিনি মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন। তিনি রোজা রাখেন, নামাজ পড়েন, নিদ্রা যান ও জাগ্রত হন, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ভুলও করেন, লিখেন এবং সাক্ষরও করেন, স্ত্রী সহবাস করেন ও সন্তান জন্ম দেন, এবং বিভক্তও হন। দ্বিতীয়: নবী রাসূলগণ কিয়ামত পর্যন্ত আগমন করবেন। তৃতীয়: গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল। চতুর্থ: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সকল নবী রাসূল থেকে তিনি উত্তম। পঞ্চম: গোলামের উপর ওহী অবতীর্ণ হয়। ষষ্ঠ: গোলাম আহমদের কাছে ওহী পৌঁছানোর জন্য যে ফেরেস্তা নিযুক্ত করা হয়েছে তিনি হলেন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম সপ্তম: তাদের ধর্ম অন্য সকল ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র এবং তাদের শরীয়ত স্বয়ং সম্পূর্ণ। আর তারা একটি নতুন উম্মত অর্থাৎ গোলাম আহমদের উম্মত। অষ্টম: তাদের একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ কিতাব আছে, যা সম্মান ও মর্যাদায় কুরআনের সমতুল্য। তার বিশটি খন্ড আছে। উহার নাম ‘আল-কিতাবুল মুবীন’ এবং উহা বিভিন্ন আয়াতে বিভক্ত। উহার একটি আয়াত হল- ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ কাদিয়ানে অবতরণ করেন।’’ (গোলাম রচিত, আল-বুশরা হতে উদ্ধৃত ৫৬ পৃ:) অপর একটি আয়াত ‘আল্লাহ তাআলা আরশ থেকে তোমার প্রশংসা করেন এবং তোমার দিকে চলে আসেন।’’ (গোলাম রচিত, আক্বিবাতুল আছিম’ ৫৫ পৃ:) অপর একটি আয়াত- ‘অমুক ব্যক্তি তোমার হায়েজ বা তোমার মধ্যকার অপর অপবিত্রতা সম্পর্কে অবগত হতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তোমার মধ্যে তার ধারাবাহিক দান সমূহ দেখাবেন। তোমার মধ্যে হায়েজ নেই; বরং তোমার মধ্যে একটা শিশু আছে। হ্যাঁ এই শিশুটি‘‘আতফালুল্লাহ ’’ (আল্লাহ তাআলার শিশুগণ) এর সমতুল্য। (গোলাম রচিত, হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, ১৪২ পৃ:) নবম: সম্মান ও মর্যাদায় কাদিয়ান মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারার সমতুল্য, এমনকি এ দুটি হতেও উত্তম। দশম: কাদিয়ানে বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হওয়াই হল তাদের হজ। এখন আমরা এ সকল নির্দেশাবলীর উল্লেখ করব যা নবুয়তের দ্বাবীদার কাদিয়ানীর উপর তার প্রভু ইংরেজের পক্ষ হতে নাজেল করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শক্তিকে খর্ব করা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মুসলমানদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা, আর, জিহাদ রহিত করা। কেননা, সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামের জিহাদের আকীদাকে সর্বাধিক ভয় করে। কারণ, জিহাদের সহিত মুসলমানদের সম্পর্ক ও আন্তরিকতা সম্বন্ধে তারা অবগত রয়েছে। ক্রুসেডের যুদ্ধ চলাকালে তারা এ আকীদা থেকে নির্গত উক্ত দুটি বিষয় ভালভাবেই আঁচ করতে পেরেছে। এ জন্য ইংরেজ খ্রিস্টান উপনিবেশবাদী তার মিথ্যা নবীকে মুসলমানদের অন্তর হতে এ বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করতে এবং এখন থেকে ইসলামে জিহাদ নেই, এ নতুন আকীদা সৃষ্টি করতে নির্দেশ দেয়। ফলে মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী বলে: ‘আল্লাহ তাআলা ধীরে ধীরে জেহাদের কঠোরতা হ্রাস করে দিয়েছেন। মুসার আলাইহিস সালাম যুগে শিশুদের হত্যা করা হত এবং মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগে শিশু, নারীও বৃদ্ধদেরকে হত্যা করা রহিত করা হয়। অতঃপর আমার যুগে জেহাদের হুকুমকে একেবারে রহিত করে দেয়া হয়।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আরবাঈন’ ৪ নম্বর ১৫ পৃ:) সে আরো বলে: ‘আজ তরবারি দ্বারা জেহাদ রহিত হয়ে গেল, আজকের পর আর জেহাদ নেই।’ অতএব, যে ব্যক্তি কাফেরদের উপর অস্ত্রধারণ করবে এবং নিজেকে গাজী বলে অভিহিত করবে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরোধী বলে গণ্য হবে, যিনি তেরো শতাব্দী পূর্বে ঘোষণা দিয়েছেন যে, মসীহে মাওউদের সময় জেহাদ রহিত হয়ে যাবে। হে আল্লাহর শত্রু! তুমি মিথ্যা বলেছ এবং মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর এমন কথা আরোপ করেছ যা তিনি কখনও বলেন নি।) আর, আমিই মসীহে মাওউদ। এখন আমার প্রকাশ পাওয়ার পর কোন জেহাদ নেই। তাই, আমরা সন্ধি ও নিরাপত্তার পতাকা উত্তোলন করব। (আরবাঈন- ৪৭ পৃ:।) একদা এ বিশ্বাস ঘাতক দালাল ঘোষণা দিল যে, ‘‘তোমরা এখন জেহাদের চিন্তা ছেড়ে দাও। কেননা, ধর্মের জন্য যুদ্ধ করা হারাম করে দেয়া হয়েছে। ইমাম ও মসীহ এসে গেছেন এবং আসমান থেকে আল্লাহর নূর অবতীর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং জেহাদ আর নেই। বরং যে ব্যক্তি এখন আল্লাহর পথে জেহাদ করবে, সে আল্লাহর শত্রু এবং নবীর আদেশ অমান্যকারী। (এখানে আল্লাহর শত্রু বলতে কাদিয়ানীদের প্রভু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শত্রু বুঝায় এবং নবীর অমান্যকারী বলতে কাদিয়ানীদের নবীর অমান্যকারী উদ্দেশ্য।) (গুলামেরে ঘোষণা যা গোলাম রচিত ‘‘তাবলীগে রেসালতের’’ অন্তর্ভুক্ত, ৪থ খন্ড ৪৯পৃঃ) কাদিয়ানী ম্যাগাজিন ‘‘রিভিউ অব রিলিজিউন্স’’ এর সম্পাদক মুহাম্মদ আলী লিখেছে: ইংরেজ সরকারের কর্তব্য হল কাদিয়ানীদের অবস্থা অনুধাবন করা। কেননা, আমাদের ইমাম তার জীবনের বাইশটি বছর লোকজনকে শুধু এ শিক্ষা দিতে ব্যয় করেছেন যে, জিহাদ হারাম এবং অকাট্য হারাম। শুধু ভারতেই তিনি এ শিক্ষা প্রচার করে ক্ষান্ত হননি, বরং তা মুসলিম দেশ সমূহে যথা আরব, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে প্রচার করেছেন। (‘‘রিভিউ অব রিলিজিওন্স’’ ২নম্বর ১৯০৪ খৃ:) ভন্ডনবী দাজ্জাল বলে: নিশ্চয়ই এ কাদিয়ানী সম্প্রদায় মুসলমানদের অন্তর থেকে জিহাদের অপবিত্র আকিদার মূলোৎপাটন করতে দিবারাত্র চেষ্টা চালিয়ে যাবে। (সরকারের প্রতি গোলামের আবেদনপত্র যা ‘‘রিভিউ অব রিরিজিওন্সের’’ অন্তর্ভুক্ত ৫নম্বর ১৯২২ খৃ:) কাদিয়ানীরা যে সমস্ত ঘৃণ্য আকিদা পোষণ করে তন্মধ্যে জিহাদকে রহিত করার ঘৃণিত আকিদা হল অন্যতম। অথচ, বিশ্বস্ত সত্যবাদী আল্লাহর রাসূল বলেন: ‘‘জেহাদ সর্বোত্তম আমল’’। [১ বুখারী মুসলিম আবু দাউদ, তিরমিজী, নাসায়ী, দারেমী ও আহমদ] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘‘মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ মুমিন ব্যক্তি যে তার জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে।’’ [২ বুখারী মুসলিম আবু দাউদ, তিরমিজী, নাসায়ী, দারেমী ও আহমদ ৩ বুখারী মুসলিম নাসায়ী ও আহমদ] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:‘‘বেহেস্তের মধ্যে একশতটি স্তর রয়েছে, যে গুলোকে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাস্তায় জেহাদকারীদের জন্য তৈরি করেছেন’’ [৪ তিরমিজী, বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ,, আহমদ, ত্বায়ালিসী ও দারামী] মুজাহিদ গণের নবী এবং তাদের সরদার ও নেতা, আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে ও তরবারির ছায়াতলে তাঁদের প্রধান (তাঁর উপর আমার মাতা-পিতা ও আমার প্রাণ উৎসর্গ) বলেছেন: ‘‘আল্লাহর পথে এক সকাল বা এক বিকালের জিহাদ পৃথিবী ও উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত হতে উত্তম। বেহেস্তের মধ্যে তোমাদের কারো দুটি ধনুক পরিমাণ জায়গা অথবা তার হাত পরিমাণ জায়গা পৃথিবী ও উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত হতে উত্তম। বেহেস্তের কোন নারী যদি পৃথিবীর দিকে একবার উঁকি দেয়, তবে উহার সকল বস্ত্তকে আলোকিত করে দেবে এবং সুগন্ধময় করে তুলবে। আর তাঁর মাথার ওড়না পৃথিবী ও উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত হতে উত্তম। [৫ বুখারী মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, আহমদ ও ত্বায়ালাসী। উদ্ধৃতি বুখারী।] ‘‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: আল্লাহর পথে কোন বান্দার দু‘টি পা যদি ধুলা মিশ্রিত হয়, তবে একে দোজখের আগুন কখনও স্পর্শ করবে না।’’ [] এগুলো হল ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বানী। আর ঐগুলো হলো কাদিয়ানীদের মিথ্যা নবী দালাল, বিশ্বাস ঘাতক ও কাপুরুষের উক্তি। এগুলো হলো স্বাধীন মুসলমানদের আকিদা আর ঐ গুলো হলো সাম্রাজ্যবাদের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী কাদিয়ানীদের আকিদা। কাদিয়ানীদের অপর একটি আকিদা হল ইংরেজ সরকারের ভালোবাসা ও আনুগত্য। এ সম্পর্কে আমি একটা পৃথক প্রবন্ধ লিখেছি। কিন্তু এখানে আমি ঐসকল বিষয় উল্লেখ করব যা ওখানে উল্লেখ করিনি। আর তা হল, এ কথা প্রমাণ করা যে, উপরোক্ত বিষয় তাদের মূল আকীদার অন্তর্ভুক্ত ও মৌলিক মূলমন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত। এটা জানা কথা যে, বাইয়াতের শর্তাবলি মাযহাবের মৌলিক নীতি এবং ভিত্তি হয়ে থাকে। একথা কাদিয়ানী ভন্ডনবী নিজেই স্বীকার করেছে। তার মূল বক্তব্য হল ‘‘আমি বাইয়াতের শর্তাবলি মুদ্রিত করেছি, যাতে এটা আমার দলের ও আমার অনুগামীদের কর্মসূচীর জন্য নীতি মালারুপে গণ্য হয়।’’ (তাবলীগে রেসালাত’’ মাযমুয়ায়ে কদিয়ানিয়াত. ৭ম খন্ড. ১৬ পৃ:) তাই, স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ সকল শর্ত কাদিয়ানীদের জন্য তাদের নবীর বর্ণনানুসারে মূলনীতি হিসাবে সাব্যস্ত। অতএব এখন আমরা দেখব ঐ সকল শর্তাবলি কি? যা গোলাম আহমদ তাদের জন্য মূলনীতিরূপে নির্ধারণ করেছে। সে বলে: আমি বাইয়াতের শর্তাবলি মুদ্রিত করেছি, যাতে এগুলো আমার দলের ও অনুসারীদের জন্য কর্মসূচী হয়ে থাকে। আর, এর নামকরণ করেছি ‘‘তাকমিলুত তাবলীগ মায়া শুরুতিল বাইয়াত’’ এবং উহার এক কপি সরকারের নিকট প্রেরণ করেছি; যাতে সরকার এ কথা জানতে পারে যে, আমি অনুসারীদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নির্দেশ দিয়েছি যাতে তারা ইংরেজ সরকারের বিশ্বস্ত অনুগত ও থাকে। (ভারতের বড় লাটের কাছে গোলামের প্রেরিত আবেদন যা কাসেম কাদিয়ানী রচিত ‘‘তাবলীগে রেসালতের অন্তর্ভুক্ত, ৭ম খন্ড, ১৬ পৃষ্ঠা) সে এর চেয়েও অধিক স্পষ্ট করে বলছে: দীর্ঘ সতের বছর ধরে আমার অনবরত ভাষণের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আমি মনে প্রাণে ইংরেজ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান। সরকারের আনুগত্য ও মানুষের ভালোবাসা হল আমার বিশ্বাস। এটাই আমার আকীদা, যা আমার অনুসারী ভক্তগণের জন্য বাইয়াতের শর্তাবলির অন্তর্ভুক্ত করেছি। আমি এ আকীদাকে বাইয়াতের শর্তাবলি সম্পর্কীয় পুস্তিকায় চতুর্থ বিষয়ের আওতায় স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি, যা আমার ভক্ত ও অনুসারীগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘কিতাবুল বারিয়ার’’ পরিশিষ্ট, ৯ পৃষ্ঠা) কাদিয়ানীদের খলীফা গোলামপুত্র লিখেছে যে, মসীহে মাওউদ (গোলাম) ইংরেজ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততাকে বাইয়াতের শর্তাবলির অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি সরকারকে অমান্য করবে এবং তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করবে এবং তার নির্দেশাবলী বাস্তবায়িত করবে না, সে আমাদের জামাতের অন্তর্ভুক্ত নহে।(গোলামপুত্র এবং তার দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ রচিত ‘‘তুহফাতুল মুলুক’’ ১২৩ পৃ:) মোটকথা, কাদিয়ানীদের আকীদা হল কাফের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা পোষণ করা। এ বিকৃত আকীদাসমূহের সাথে আমি তাদের আর একটি আকীদা যোগ করব এবং এর উপর প্রবন্ধটি শেষ করব। আর তা হল, কাদিয়ানীরা এ বিশ্বাস পোষণ করে- যে ব্যক্তি গোলাম আহমদের উপর ঈমান আনবে না এবং তার উক্তিকে অমান্য করবে, সে কাফের এবং চিরকাল;দোজখে অবস্থান করবে। যদিও সে মুমিন ও মুসলিম হয়ে থাকে। কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: যে ব্যক্তি গোলাম আহমদকে বিশ্বাস করে না সে কাফেরও দ্বীন বহির্ভূত। যদিও সে মুসলিম হয় এবং কখনও গোলাম আহমদের নামও শুনতে পায়নি। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ‘‘আনওয়ারে সাদাকাত’’ ৩৫ পৃ:) গোলামের দ্বিতীয় পুত্র বশীর আহমদ বলে: যে ব্যক্তি মুসাকে আলাইহিস সালাম বিশ্বাস করে না অথবা ঈসাকে বিশ্বাস করে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কে বিশ্বাস করে না, সে কাফের। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কে বিশ্বাস করে, কিন্তু গোলাম আহমদকে বিশ্বাস করে না, সেও কাফের, তার কাফের হওয়াতে কোন সন্দেহ নেই । (বশীর আহমদের ‘‘কালিমাতুল ফছল’’ যা কাদিয়ানী ম্যগাজিন রিভিউ অব রিলিজিউন্স হতে উদ্ধৃত ৩৫ নম্বর, ১৪ খন্ড, ১১০ পৃ:) মিথ্যাবাদী ভন্ড নবী আরও বলেছে: ‘‘যার কাছে আমার দাওয়াত পৌঁছেছে এবং সে আমাকে বিশ্বাস করেনি, সে কাফের।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর বাণী ‘‘আল-ফজলের’’ অন্তর্ভুক্ত, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৫ খৃ:) সে বলে: ‘‘আমার নিকট ইলহাম হয়েছে যে, আল্লাহ আমাকে বলেছেন- যে ব্যক্তি তোমাকে বিশ্বাস করে না এবং তোমার অনুসরণ করে না, বরং বিরোধিতা করে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধী এবং সে দোজখের আগুনে প্রবেশ করবে। (গোলামের ইলহাম যা কাসেম কাদিয়ানীর ‘‘তাবলীগে রেসালাতের’’ অন্তর্গত, ৯ম খন্ড, ২৭ পৃ:)
এই হল কাদিয়ানীদের আকীদাসমূহ যা তারা গ্রহণ করে নিয়েছে। আমি এগুলোকে তাদের পুস্তক সমূহ থেকে তাদের ভাষায়, এমনকি তাদের শব্দ মালায় উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুক। কেমন করে তারা উল্টো দিকে ফিরে যাচ্ছে?
এ তিক্ত অভিজ্ঞতা ইসলামের অনিষ্টকারী শত্রুদেরকে যে নতুন চিন্তা ধারার খোরাক জোগায়, তা হল এই, তাদের উচিত প্রকাশ্যে ইসলামকে প্রতিরোধ করার পদ্ধতি পরিবর্তন করা। কেননা, প্রকাশ্য প্রতিরোধ মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও প্রতিরোধ শক্তিকে আরো বৃদ্ধি করে তোলে। আর, তারা যেন মুসলমান ও ইসলামের উপর আঘাত হানতে প্রতারণা ও কপটতার কৌশল অবলম্বন করে এবং ইসলামের মোকাবিলার জন্য ইসলামের নামে মুসলমানদের মধ্য থেকে পৃথক নতুন ধর্ম তৈরি করে। এভাবে ধীরে ধীরে এর অস্তিত্ব ও চিন্তা ধারাকে মুছে ফেলা যাবে, এমনি ভাবে এবং পরিকল্পিত এই চিন্তা ধারায় কাদিয়ানী মতবাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রথমত: তারা একটি মুসলিম দলরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং তারা ইসলাম বিরোধী বিষাক্ত চিন্তাধারা এমনভাবে প্রচার করতে শুরু করে, যাতে সাধারণ লোক বুঝে উঠতে না পারে। অতঃপর তারা ক্রমশ: গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করতে লাগল। যখন তাদের জালে কিছু অনভিজ্ঞ লোক এমনি ভাবে ফেঁসে যায় যে তাদের পালাবার আর কোন পথ থাকে না, তখন খোলাখুলি ভাবে এদের সম্মুখে তাদের এ ভ্রান্ত আকিদায় বহাল থেকে যায়, আর যাদেরকে হেদায়েত ও মুক্তি দান করা আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, তারা এ ভ্রান্তি থেকে রেহাই পায়। এ চিন্তাধারায় এবং কাফের খ্রিস্টান সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে তারা এ পরিকল্পিত স্তর গুলোকে তাবলীগ ও দাওয়াতের ভিত্তিরূপে গ্রহণ করে নিল, যাতে তারা মুসলমানদের বিভ্রান্ত এবং ইসলামের প্রকৃত রূপকে কলুষিত করতে পারে। তাই , আমরা এ প্রবন্ধে কাদিয়ানী মতবাদের প্রকৃত আকীদা সমূহ এবং যে উদ্দেশ্যে উহার সৃষ্টি, তা তাদেরই কিতাবসমূহ থেকে উল্লেখ সহ বিশদ বর্ণনা দিব, যাতে পাঠকবৃন্দ এর ব্যাপক ভয়াবহতার ও বিরাট দুরভিসন্ধির কথা জানতে পারেন। অনুরূপভাবে এদের প্রতারণা এবং ইসলামের পোশাক পরিধান করে এদের মোনাফেকী সম্পর্কে তারা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন।
সকল মুসলমান কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়াই এ কথা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা সকল প্রকার দোষত্রুটি এবং মানবিক উত্তেজনা থেকে মুক্ত। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং জন্ম গ্রহণও করেন নি। আর কেহ তাঁর সমকক্ষ নেই। তিনি সাদৃশ্য ও অবয়ব বিশিষ্ট হওয়া থেকে পবিত্র। এমনি ভাবে , তারা বিশ্বাস করেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী ও রাসূল। তার পর আর কোন নবী নেই। তাঁর উপরই রেসালাতের ধারাবাহিকতা শেষ হয়েছে এবং তাঁর দ্বারাই ওহীর ছিল-ছিলা বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁর কিতাবই শেষ কিতাব, তাঁর উম্মতই শেষ উম্মত এবং তাঁর ধর্মই শেষ ধর্ম। তার পরে যে কেহ নবুয়তের দাবি করবে সে হবে মিথ্যুক এবং আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপকারী। কারণ, মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নহেন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।’’ [১ সুরা আহযাব-৪০]
আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিয়েছি। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে ধর্ম হিসাবে মনোনীত করেছি।’’ [২ সুরা মায়েদা-৩] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আমার এবং অপর নবীগনের দৃষ্টান্ত এক প্রসাদের মত যাকে খুব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু উহাতে একটি ইটের জায়গা খালি রাখা হয়। দর্শকরা এটা প্রত্যক্ষ করে এবং এর সুন্দর নির্মাণে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়, তবে,একটি ইটের জায়গা খালি থাকার কারণে আশ্চার্যবোধ করে। আমার দ্বারা দালানের নির্মাণ কাজ শেষ হল এবং রাসূলগণের আগমনও আমার দ্বারা সমাপ্ত হল,। [৩ বুখারী ও মুসলিম।] অন্য রেওয়ায়েতে আছে- আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষ নবী। আর এক বর্ণনায় রয়েছে- ‘আমি শেষ নবী এবং তোমরা শেষ উম্মত,। [১ ইবনে মাজাহ, ইবনে খুজায়মা ও হাকিম।] হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে আর কোন উম্মত নেই’। [২ মাসনাদে আহমদ] অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘আমার উম্মতের পরে আর কোন উম্মত নেই।’ [৩ তাবারানী ও বায়হাকী]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতগণ এটাও বিশ্বাস করেন যে, জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। এটা একটি উত্তম ইবাদত এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি বড় উপায়। সকল শহর ও জনপদের মধ্যে মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওরা উত্তম এবং মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসার মর্যাদা ও সম্মান সকল মসজিদ হতে অধিক। পৃথিবীতে কোন মসজিদই এগুলোর সমমানের নহে। এটা মুসলমানদের বিশ্বাস। কিন্তু, কাদিয়ানীরা বরে- ‘আল্লাহ রোজা থাকেন, নামাজ পড়েন এবং (নাউজুবিল্লাহ) তিনি নিদ্রা যান ও জাগ্রত হন, লিখেন ও স্বাক্ষর করেন, সঠিক সিদ্ধান্ত করেন এবং ভুলও করেন, স্ত্রী সহবাস করেন এবং সন্তান জন্ম দেন, বিভক্ত হন, সাদৃশ্য রাখেন এবং তিনি দেহ বিশিষ্ট’।
এ প্রসঙ্গে কিছু স্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে। তথাকথিত কাদিয়ানী নবী গোলাম আহমদ বলে: আল্লাহ আমাকে বলেছেন- আমি নামাজ পড়ি ও রোজা রাখি, জাগ্রত থাকি ও নিদ্রা যাই। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আল-বুশরা’ ২য় খন্ড, ৯৭ পৃ:।) এ হল দাজ্জালের কথা। পক্ষান্তরে, সত্য মাবুদ অললাহ পাক মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যা অবতীর্ণ করেছেন, তা হল এই- ‘‘আল্লাহ তিনি ব্যতীত আর কোন মা’বুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী, তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা কোনটাই স্পর্শ করে না। আকাশ সমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে এ সবের মালিক তিনিই। এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? মানুষের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন। তার ইচ্ছা ব্যতীত তার ইলমের কিছু অংশও কেহ আয়ত্বে আনতে পারে না। তাঁর কুরছি আকাশ সমূহ ও পৃথিবী ব্যাপ্ত করে আছে। এ দু‘টোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর জন্য কঠিন নহে। তিনি সর্ব-উচ্চ ও মহান। [৪ সুরা বাকারা, আয়াতুল কুরসী-২৫৫]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘আল্লাহ নিদ্রা যান না এবং নিদ্রা যাওয়া তাঁর জন্য সাজেনা’। [৫ মুসলিম, ইবনে মাজাহ ও দারামী]
অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:- ‘‘আল্লাহর ইলম সকল বস্ত্তকে বেষ্টন করে রেখেছে।’’ [৬ সুরা তাহরীম- ১২] আরো বলেন:- ‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, কিনি উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখেন।’’ [৭ সুনা হাশর - ২২] আর ফেরেস্তাদের ভাষ্যে বলেন:- ‘‘আমরা আপনার প্রভুর নির্দেশ ব্যতীত অবতরণ করি না, আমাদের সম্মুখে,পিছনে ও এত দু ভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা সব কিছুর মালিক তিনিই। আর তোমার প্রভু কখনও ভুলেন না।’’ [১ সুরা মারয়াম - ৬৪] মুসা আলাইহিস সালাম এর ভাষ্যে বলেন- ‘‘আমার প্রভু পথভ্রষ্ট হন না এবং ভোলেন ও না।’’ কিন্তু কদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ভুলও করেন এবং সঠিকও করেন। এটা জানা কথা যে, ভুলের সহিত অজ্ঞতা ও বিস্মৃত হওয়া অনিবার্য। ভন্ড কাদিয়ানী আরবী ভাষায় নিজ শব্দে বলে: ‘‘আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি রাসূলের পক্ষ হতে উত্তর দেই, আমি ভুলও করি এবং সঠিকও করি। আমি রাসূলকে বেষ্টন করে রেখেছি।’’(আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৭৯ পৃষ্টা।) সে আরো বলে: ‘‘আমি কাশফের দ্বারা দেখছি যে, আমি অনেক গুলি কাগজ আল্লাহ তাআলার কাছে পেশ করছি উহাতে স্বাক্ষর করার জন্য এবং আমি যে সকল দাবি করেছি উহা অনুমোদনের জন্য। অনন্তর, আমি দেখতে পেলাম তিনি উহাতে লাল কালি দ্বারা স্বাক্ষর করেছেন। কাশফের সময় আমার কাছে আব্দুল্লাহ নামে আমার একজন ভক্ত উপস্থিত ছিল। অতঃপর আল্লাহ কলম ঝাড়লেন। এতে লাল কালির ফোটা আমার কাপড়ে ও আমার ভক্ত আব্দুল্লাহর কাপড়ে পড়ল। কাশফ যখন শেষ হল তখন বাস্তবে দেখতে পেলাম আমার ও আব্দুল্লাহর কাপড় সেই লাল রঙ্গে রঞ্জিত হয়ে গেছে। অথচ আমাদের নিকট কোন লাল রং ছিল না। এখন পর্যন্ত এ কাপড়গুলো আমার মুরীদ আব্দুল্লাহর নিকট মওযুদ আছে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তিরিয়াকুল কুলুব’ এবং ‘হাকীকতুল ওহী’ ২৫৫ পৃ:।)
অন্যত্র এ দাজ্জাল সৃষ্টিকর্তা সুমহান সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী আল্লাহকে ‘অক্টোপাস’ নামক একটা সামুদ্রিক প্রাণীর সহিত তুলনা দিয়েছে। সে বলে: ‘আল্লাহর অস্তিত্বের প্রকৃতিকে আমরা এরূপ ধরে নিতে পারি যে, তাঁর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের কোন সীমা নেই। তিনি অক্টোপাস সাদৃশ’। তার অনেক শীরা রয়েছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সম্প্রসারিত। (গোলামের ‘তাওজীহুল মুরাম’ ৭৫ পৃ:) এমনিভাবে সে আল্লাহর অস্তিত্বকে নিয়ে বিদ্রূপ করেছে, যে আল্লাহর কোন সাদৃশ্য নেই। আর মহান আল্লাহর বাণী ‘‘ তাঁর অনুরূপ কোন বস্ত্ত নেই, তিনি সবকিছু শুনেন ও দেখেন। [২ সুরা শুরা - ১১] একথা সে অস্বীকার করেছে। এতদ্ব্যতীত কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ ত‘আলা স্ত্রী সহবাস করেন এবং তাঁর সন্তানাদি জন্ম লাভ করে।’’ তাদের এ বিশ্বাস কিতাবুল্লাহ, সুনণতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সকল আসমানি ধর্মের পরিপন্থী । অতঃপর এর চেয়ে অদ্ভুত বিষয় তারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের নবী গোলাম আহমদের সাথে সহবাস করেছেন। শুধু তা-ই নহে বরং এ সহবাসের ফল সে নিজেই। প্রথমত: যার সাথে আল্লাহ সহবাস করেছেন সে হল তাদের নবী গোলাম আহমদ। অতঃপর সে-ই গর্ভ ধারণকারী। দ্বিতীয়ত: সে-ই জন্ম গ্রহণকারী সন্তান। এখন আমাদের শুনা উচিত কাদিয়ানীরা তাদের ভাষায় কি বলে? কাজী ইয়ার মুহাম্মদ কাদিয়ানীর বক্তব্য: ‘‘মসীহ মাওউদ’’ (গোলাম) এক সময় তার নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, তিনি নিজেকে স্বপ্নে দেখেন, তিনি যেন একজন মহিলা। আর, আল্লাহ তাআলা তার মধ্যে নিজের পুরুষত্ব শক্তি প্রকাশ করলেন। (ইয়ার মুহাম্মদ, জাহিয়াতুল ইসলাম ৩৪ পৃ:) ভন্ড কাদিয়ানী নিজে বলে- ‘‘আমার মধ্যে ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে, যেমন মরিয়ামের মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছিল। রূপকভাবে আমি গর্ভ ধারণ করলাম। কয়েক মাস পরই যা দশ মাসের ঊর্ধ্বে নহে মরিয়াম হতে পরিবর্তিত হয়ে ঈসা হয়ে গেলাম। এ পদ্ধতিতে আমি মরিয়ম পুত্র হয়ে গেলাম। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘সফিনায়ে নূহ’ ৪৭ পৃ:) আরো সে বলে- আল্লাহ তাআলা আমাকে মরিয়ম নামে নাম করণ করেছেন, যে, মরিয়ম ঈসা কে গর্ভ ধারণ করেছিলেন। সুরায়ে তাহরীমের মধ্যে আল্লাহর এ বাণীতে আমিই উদ্দেশ্য, ‘‘ইমরানের কন্যা মরিয়ম যিনি তার সতীত্ব রক্ষা করেছেন। অতঃপর আমি উহাতে আমার রূহ ফুঁকে দিলাম’’। অবশ্যই আমি মেই একমাত্র ব্যক্তি যে দাবি করছে ‘আমিই মরিয়ম এবং আমার মধ্যেই ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে’। (গোলামের হাকীকতুল ওহীর হাসিয়া, ৩৩৭ পৃ:) এই ভিত্তিতে কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদকে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করে, বরং সেই প্রকৃত আল্লাহ। এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী বলে: ‘আল্লাহ আমাকে বলেছেন- ‘‘তোমার সৃষ্টি আমার পানি থেকে এবং ওদের সৃষ্টি আমার পানি থেকে এবং ওদের সৃষ্টি কাপুরুষত্ব থেকে।’’ (গোলামের ‘‘আনজাসে আতম’’ ৫৫ পৃ:) সে আরো বলে- ‘আল্লাহ আমাকে এই বলে সম্বোধন করেছেন, শুন হে আমার ছেলে!’ (গোলামের ‘‘আল বুশরা ’’ ১ম খন্ড ৪৯ পৃষ্ঠা)
সে আরো বলে- যে, প্রভু আমাকে বলেছেন: তুমি আমা হতে এবং আমি তোমা থেকে, তোমার প্রকাশ আমার প্রকাশ। (গোলামের ‘‘ওহীয়ে মুকাদ্দাস’’ ৬৫০ পৃষ্ঠা) আল্লাহ আরো বলেছেন: হে সূর্য! হে চন্দ্র! তুমি আমা হতে এবং আমি তোমা হতে। (গোলাম রচিত ‘‘হাকীকতুল ওহী’’ ৭৩ পৃ:) সে আরো বলে: আল্লাহ তাআলা আমার মধ্যে অবতরণ করেছেন এবং তাঁর ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আমি হলাম মাধ্যম।’’ (গোলাম রচিত কিতাবুল বারিয়্যা ৭৫ পৃ:) সে আরো বলে: আমার উপর ওহী এসেছে-‘‘আমি তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছি এমন একটি পুত্রের, যে হবে সত্য ও উচ্চ মর্যাদার প্রতীক, যেন আল্লাহ আকাশ হতে অবতরণ করেছেন।’’ (গোলাম রচিত ‘‘আল ইসতেফতা’’ ৮৫পৃষ্ঠা) এই হল মহান আল্লাহ সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আকীদাসমূহ। তারা আল্লাহর প্রতি যে সকল কথা আরোপ করছে, তা থেকে তিনি পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তাআলা তার সম্মানিত কালামে পাকে বলেন: ‘‘আপনি বলুন! তিনি আল্লাহ এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি সন্তান জন্ম দেননি এবং তিনি জন্ম গ্রহণও করেন নি। তার সমকক্ষ কেহ নেই। [১ সুরা ইখলাছ] আল্লাহ বলেন: ‘‘ঐ সকল লোকেরা কাফের হয়ে গেছে যারা বলে মসীহ ইবনে মরিয়মই হলেন আল্লাহ’’। [২ সুরা মায়েদা- ১৭] তিনি আরো বলেন: ‘‘হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ী কর না এবং আল্লাহর শানে সত্য ব্যতীত আর কিছুই বল না। নিশ্চয়ই মসীহ ঈসা বিন মরিয়ম আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্য কিছু নহেন। তিনি আল্লাহর কালিমা যাকে মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছেন এবং তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আদিষ্ট রূহ। অতএব তোমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তিন খোদা বল না। তোমরা এ থেকে বিরত থাক। এটা তোমাদের জন্য মঙ্গল জনক। আল্লাহই একমাত্র উপাস্য, সন্তান হওয়া থেকে তিনি পবিত্র। আকাশ সমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক তিনি। কার্য সম্পাদনে আল্লাহই যথেষ্ট’’। [১ সুরা নিসা- ১৭১] আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিস্টানরা বলে’’ মাসীহ আল্লাহর পুত্র, উহা তাদের মুখের কথা। এদের কথা ইতি পূর্বেকার কাফেরদের কথার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আল্লাহ এদেরকে ধ্বংস করুন। কাদিয়ানীরা যে আকীদা পোষণ করে , এর উপর তাদেরকে মহান আল্লাহ যা বলেছেন তা ছাড়া আমরা আর কিছুই বলব না। তিনি বলেছেন: ‘‘এদের কথা পূর্বেকার কাফেরদের কথার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। কেমন করে তারা উল্টো দিকে ফিরে যাচ্ছে’’? আমরা কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় আকীদার দিকে যাওয়ার পূর্বে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করতে চাই যে, কাদিয়ানীরা গোলামকে যে প্রভুর পুত্র বলে দাবিকরে, সে হল ইংরেজ। যেমন, গোলাম আহমদ স্পষ্ট করে বলেছে: ‘আমার প্রতি ইংরেজি ভাষায় কয়েকবার ইলহাম হয়েছে। শেষবারে এ ইলহাম হয়: I can do what I will অর্থাৎ ‘আমি যা চাই, তাই করতে পারি।’ কথার উচ্চারণ ও বাক্য ভঙ্গি থেকে আমি বুঝতে পারলাম যেন একজন ইংরেজ আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। (গোলাম রচিত- ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ ৪৮০ পৃষ্ঠা) এখন আমরা খতমে নবুয়্যত সম্পর্কে কাদিয়ানীদের আকীদার কথা উল্লেখ করছি। কাদিয়ানীরা এ বিশবাস করে যে, মুহাম্মদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম দ্বারা নবুয়্যত শেষ হয়নি বরং নবুয়্যত চলতে থাকবে। গোলাম পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা বলে- ‘আমরা (কাদিয়ানীরা) বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তাআলা প্রয়োজন অনুসারে এ উম্মতের সংশোধন ও হেদায়েতের জন্য নবীগণ প্রেরণ করতে থাকবেন’। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের প্রবন্ধ, যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল-ফজলের, অন্তর্ভুক্ত এবং ১৯২৫ সালের ১৪ই মে তারিখে প্রকাশিত।) সে আরো লিখেছে- ‘‘তারা কি মনে করে আল্লাহর ভান্ডার নিঃশেষ হয়ে গেছে । তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত। কেননা আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত। কেননা, আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। তা না হলে কোথায় এক নবী, বরং আমি বলি, অচিরেই হাজার হাজার নবীর আগমন ঘটবে’’। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ রচিত ‘আনওয়ারুল খেলাফত’ ৬২ পৃ:) এ কাদিয়ানী খলীফাকে একদা জিজ্ঞাসা করা হল: ভবিষ্যতে নবীগণের আগমন কি সম্ভব? সে উত্তর দিল হ্যাঁ, নবীগণ কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবেন। কারণ, পৃথিবীতে যতক্ষণ পর্যন্ত ফ্যাসাদ বিদ্যমান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নবীগণের আগমন অপরিহার্য। (আল-ফজল, ২৭শে ফেব্র:, ১৯২৭ খৃ:।)
এ নির্বোধ বুঝতে পারেনি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম যাবতীয় ফাসাদ ও উহার প্রতিকারের বর্ণনা দিয়ে গেছেন। কাজেই, কোন নতুন নবীর আগমনের প্রয়োজন হতে পারে না। এ দিকেই নবী করীম তাঁর বাণীতে ইঙ্গিত করেছেন: ‘বণী ইসরাইলের তত্ত্বাবধান করতেন নবীগণ। যখনই কোন নবীর তিরোধান ঘটত, তখন অন্য নবী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন। নিশ্চয়ই আমার পরে আর কোন নবী নেই, কাজেই বহু সংখ্যক খলীফা আগমন করবেন’’। [২ বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজা ও আহমদ।] হাদীসের তাৎপর্য হল এই খলীফাগণের কর্তব্য হবে যে তারা ইসলাম প্রচার, খাঁটি ধর্মের প্রসার ও মুসলমানদের সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। যেমনি ভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উত্তরাধিকারী উলামায়ে কেরামগণ এ দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সহীহ বুখারীতে আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:- আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী।’ [১ বুখারী ও তিরমিজী] এর প্রতিই আল্লাহ তাআলা তাঁর কালামে ইঙ্গিত করেছেন: ‘প্রত্যেক বড় সম্প্রদায় হতে এক একটি ছোট দল দ্বীনের জ্ঞান লাভ করার জন্য কেন বের হয় না? যখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবে, তখন তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে।’’ [২ সরা তওবা ১২২] এ আক্বীদাকে তারা শুধু এ জন্যই তৈরি করেছে, যাতে গোলাম আহমদের নবুয়তের দাবিকে শক্তিশালী করা যায়। নচেৎ গোলাম আহমদ কোন ফাসাদের সংস্কার করেছে? বরং সে ই তো ফাঁসাদের একটি উৎস। গোলাম তার পুত্র ও খলীফার ন্যায় কথা বলেছে, ‘‘নিশ্চয়ই নবীগণের আগমন আল্লাহর একটা অনুগ্রহ এবং তাদের ধারাবাহিকতা কথনও বিচ্ছিন্ন হবে না। এটা আল্লাহর বিধান। তোমরা এটাকে ঠেকাতে পারবে না ।’’ (গোলামের ‘কিতাবে শিয়ালকোট’ এর সার সংক্ষেপ, ২২পৃঃ) যখন নবুয়তের আকারে হয়। এ গোলামই সর্বপ্রথম এতে প্রবেশ করে। এ জন্যই কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল। শুধু তাই নহে, বরং সে সকল নবী রাসূলগণ হতে উত্তম। সে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের গৌরব। কাদিয়ানী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও তাদের মিথ্যা নবী গোলাম তার নিজের অবস্থা বর্ণনা করে বলে: ‘আমি ঐ আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ, তিনি আমাকে রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং নবী নামে অভিহিত করেছেন। আর, আমাকে মসীহে মাওউদ বলে আহবান করেছেন এবং আমার দাবির সমর্থনে তিন হাজার নিদর্শন অবতীর্ণ করেছেন।’’ (গোলাম রচিত হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, ৬৮ পৃ:) সে আরো বলে: তিনিই সত্য প্রভু, যিনি কাদিয়ানী তার রাসূল পাঠিয়েছেন।’ (কাদিয়ান তার আভাস ভূমির নাম)আল্লাহ তাআলা কাদিয়ানকে হিফাজত করবেন এবং প্লেগ রোগ, থেকে রক্ষা করবেন। শক্তিমান পরাক্রমশালী আল্লাহর কুদরত যে, গ্রামকে ভন্ডনবী কাদিয়ানী নিজের অবস্থান ও ভ্রান্ত মতবাদ দিয়ে অপবিত্র করেছে সেই কাদিয়ানে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। যাতে তার দাবি মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়, অথচ আশে পাশের শহর-গ্রামে এই রোগ বিস্তৃতি লাভ করেনি। পরে এই গোলাম কাদিয়ানী তার শ্বশুরের কাছে লিখিত একটি পত্রে স্বয়ং এই প্লেগ রোগের কথা স্বীকার করে। সে লিখেছে: এখানে (কাদিয়ানে) প্লেগ রোগ চরমে পৌঁছেছে। মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হলে কয়েক ঘনটার মধ্যেই মারা যায়।(মাকতুবাতে আহমদিয়া ৫ম খন্ড ১১২ পৃ:) উক্ত ব্যক্তির নিকট লেখা অন্য একটি পত্রে সে বলে: প্লেগ রোগ গ্রামে ঢুকে পড়েছে, এমনকি আমাদের ঘরেও ঢুকে পড়েছে। গোছানা আক্রান্ত তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে , যেমন বের করে দিয়েছি জনাব মোহাম্মদ দ্বীনকে। কেননা, সেও আক্রান্ত । আজ দিল্লী থেকে আগত আমাদের এক মেহমান মেয়ে লোক আক্রান্ত হলো। যদিও এর প্রকোপ সত্তুর বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। কেননা, এটা তার রাসূলের বাসস্থান এবং এতে সকল জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (গোলাম রচিত দাফেউল বালা’ ১০ও ১১ পৃ:) সে আরো বলে: আমার রেসালাত প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তাআলা এত বেশি সংখ্যক নিদর্শন প্রেরণ করেছেন, যদি তা এক হাজার নবীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়, তবে এতেই তাদের রেসালত প্রমাণিত হয়ে যাবে। কিন্তু মানব শয়তানরা এটা বিশ্বাস করে না ।(গোলাম রচিত আইনুল মারেফত ৩১৭ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল লিখেছে, যে অর্থে পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণকে নবী রাসূল বলা হত সেই অর্থে গোলাম আহমদও নবী এবং রাসূল। (আল ফজল, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯১৪খৃঃ) এ পত্রিকাটি ‘মুসলমানদের প্রতি আহবান’ শিরোনামে প্রচার করে: ‘‘হে লোকেরা, যারা ইসলামের দাবিকর, তোমরা প্রকৃত ইসলামের দিকে আস, যা তোমরা মাসীহে মাওউদ (অর্থাৎ গোলাম আহমদ) ব্যতীত আর কারো কাছে পাবে না। তার দ্বারাই তোমাদের পুণ্য ও খোদা ভীতির পথ খুলবে, তার অনুসরণে মানবজাতি সফলতা ও মুক্তি লাভ করবে, এবং গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবে। তিনিই হলেন পূর্ববর্তী পরবর্তীদের গৌরব।(আল-ফজল, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ খৃ:) ভন্ডনবী কাদিয়ানীর পুত্র এবং কাদিয়ানীদের নেতা বশীর আহমদ লিখেছে: এ কথা বাস্তব সত্য যে, গোলাম আহমদ নবী ও রাসূল থেকে উত্তম বলে বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও রয়েছেন এখানে আমরা শুধু এদের দ‘টি উক্তি উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করি। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে, ‘আমাকে যা কিছু আল্লাহ দিয়েছেন, তা জগৎবাসীর মধ্যে আর কাউকে দেননি।’ (গোলাম কাদিয়ানীর- হাকিকতে ওহীর পরিশিষ্ট, ৮৭ পৃ:) সে আরো বলে: সকল নবীগণকে যা কিছু দেয়া হয়েছে, তা একাই আমাকে দেয়া হয়েছে। (গোলামের দুররে ছামীন ২৮৭ পৃ:) কাদিয়ানীদের একটা আকীদা হল এই যে, জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম গোলাম আহমদের নিকট অবতরণ করতেন। অথচ সকল মুসলমান এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, মুহাম্মদের পরে জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আর কারো কাছে অবতরণ করেন নি। গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: আমার বয়স যখন নয় বছর, সে সময় আমি এবং আমার সাথী একজন ছাত্র আমাদের বাড়িতে খেলছিলাম। এমনি এক সময় খেলা ধুলার অবসরে আমরা একটি পুস্তক দেখতে পেলাম। আমরা উহা খুললাম যা পড়তেও সক্ষম ছিলাম। কাজেই, আমরা উহার কিছু অংশ পড়লাম। আমাদের পড়ার মধ্যে এ কথাটি ছিল ‘‘নিশ্চয়ই জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এখন অবতরণ করেন না’’। আমি বললাম এটা মিথ্যা কথা। কেননা, জিব্রাঈল আমার পিতার কাছে আগমন করেন। ঐ ছাত্রটি তা অস্বীকার করে বলল: না, কেননা এ পুস্তকে লেখা আছে যে, জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম অবতরণ করেন না। আমরা দ‘জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল। তাই আমরা আমার পিতার নিকট গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে তিনি বললেন- কিতাবে যা লেখা আছে তা ভুল। কেননা জিব্রাঈল আঃ. এখনও অবতরণ করেন। (মাহমুদ আহমদের ভাষণ, যা আল ফজল পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত এবং ১০ এপ্রিল ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত) গোলাম নিজেই বলে: জিব্রাঈল আঃ. আগমন করে আমাকে পছন্দ করলেন এবং তার আঙুল ঘুরিয়ে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে শত্রুগণ হতে রক্ষা করবেন। (গোলাম রচিত ‘মাওয়াহিবুর রহমান’ ৪৩ পৃষ্ঠা) কাদিয়ানীরা এটাও বিশ্বাস করে যে, গোলামের নিকট ওহী আসে এবং তার উপর আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হয়। শুধু এই নহে, বরং তার ওহী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওহীর সমতুল্য এবং তার এলহামাত কুরআনের মতই। এর উপর ঈমান আনয়ন করা অবশ্যই কর্তব্য। কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানী বলে: গোলাম আহমদ আদিষ্ট হয়েছেন যে, তার কাছে যে ওহী আসে তা তার জামাতকে শুনাবেন। অনুরূপভাবে উহার উপর বিশ্বাস করা কাদিয়ানীদের কর্তব্য। কেননা, আল্লাহর কালাম এ উদ্দেশ্যে পৌঁছে থাকে অর্থাৎ উহাতে বিশ্বাস করা এবং তা কার্যে পরিণত করাই উদ্দেশ্য। এ মর্যাদা নবীগণ ছাড়া আর কারো নেই যে, তাদের ওহীতে ঈমান আনতে হবে। (মুহাম্মদ ইউসুফ রচিত ‘আন নবুয়্যত ফিল ইসলাম ’ ২৮ পৃ:) গোলাম বলে: ‘মহান আল্লাহর শপথ! আমি আমার ওহীতে বিশ্বাস করি, যেমন কুরআন ও অন্যান্য আসমানি কিতাবে বিশ্বাস রাখি। আর, আমি বিশ্বাস করি যে, যে কালাম আমার উপর অবতীর্ণ হয়, উহা আল্লাহর নিকট হতেই অবতীর্ণ হয়। অনুরূপভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, কুরআন আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।’ (গোলাম কাদিয়ানী রচিত-হাকীকাতুল ওহী’ ২১১ পৃ:) সে আরো বলছে: আমার নিকট যে ইলহামাত অবতীর্ণ হয়, উহাতে আমি এরূপ বিশ্বাস করি যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে বিশ্বাস রাখি। (তাবলীগে রেসালাত’ ৬খন্ড, ৬৪পৃঃ) কাদিয়ানীদের এক প্রধান জালালুদ্দীন সামছ লিখেছে ‘গোলাম আহমদের ওহীর মর্যাদা অবিকল কুরআন, ইঞ্জিল ও তাওরাতের মর্যাদার সমান।’ (জালালুদ্দীন রচিত আকিবাতুল মুনকিরিন খেলাফাহ’ ৪৯ পৃ:) যেহেতু কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদের প্রলাপসমূহকে কুরআনের মতই মনে করে তাই তারা বলে যে, যে সকল হাদীসে গোলাম আহমদের উক্তির বিপরীত হবে, উহা প্রত্যাখ্যাত; যদিও উহা প্রকৃত পক্ষে বিশুদ্ধ হাদীস হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে, যে সকল হাদীস গোলাম আহমদের উক্তির মোতাবেক উহা বিশুদ্ধ। যদিও উহা প্রকৃত পক্ষে মওযু (জাল) বা মিথ্যা হয়ে থাকে। কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: গোলাম আহমদের কথা নির্ভরযোগ্য। এর উপর নির্ভর করা যায়। কিন্তু হাদীস সমূহের অবস্থা এর বিপরীত। কেননা, হাদীস সমূহ তো আমরা রাসূলুল্লাহর মুখ থেকে শুনি নি, আর গোলাম আহমদের কথা আমরা তার মুখ থেকেই শুনেছি। কাজেই হাদীস সহীহ হলে উহা গোলাম আহমদের উক্তির বিপরীত হওয়া সম্ভব নহে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের উক্তি যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে উদ্ধৃত, ২৯ এপ্রিল ১৯১৫ খৃ:) এ পত্রিকাটি আরো প্রচার করেছে- ‘এক বে-আদব লিখেছে, গোলামের যে সকল উক্তি বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীত তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত। এ নির্বোধ! বুঝতে পারেনি যে, এর দ্বারা গোলাম আহমদের সত্য দাবিগুলো অস্বীকার করা অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে। পক্ষান্তরে কোন কোন হাদীস এমনও রয়েছে, যে গুলোকে আলেমগণ দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু আমাদের নবী গোলাম আহমদ বলেন যে, ইহা বিশুদ্ধ। সুতরাং আমরা তার কথা বিশ্বাস করব ওদের কথা নহে। তিনি যে হাদীসকে বিশুদ্ধ বলেন আমরাও উহাকে বিশুদ্ধ বলব। আর যে হাদীসকে তিনি দুর্বল বলেন, আমরাও উহাকে দুর্বল বলব। কেননা, হাদীস সমূহ রাবীদের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। আমরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনিনি। তবে গোলাম আহমদের কথার উপর আমরা এ জন্য নির্ভর করি যে, তিনি আল্লাহর নিকট থেকে অবহিত হওয়ার পর আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। আর তিনি হলেন একজন জ্যান্ত নবী। মোট কথা, যে হাদীস গোলাম আহমদের উক্তির বিপরীত হবে, হয়তো উহা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ অথবা উহা বিশুদ্ধ নহে। (আল- ফজল, ২৯ এপ্রিল, ১৯১৫ খৃ:) কাদিয়ানীদের খলীফা ও তাদের নেতা বলে: ‘মসীহে মাওউদ’ (গোলাম) যে কুরআন পেশ করেছেন উহা ভিন্ন আর কোন কুরআন নেই। যে হাদীস গোলাম আহমদের শিক্ষার আলোকে হবে, উহা ভিন্ন আর কোন হাদীস নেই। এবং গোলাম আহমদের নেতৃত্ব বহির্ভূত কোন নবী নেই। যে ব্যক্তি মুহাম্মদকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে চায়, সে যেন গোলাম আহমদের প্রতিচ্ছবি দেখে নেয়। কেননা, যে ব্যক্তি তার মাধ্যম ছাড়া মুহাম্মদকে দেখতে চায়, তার পক্ষে উহা সম্ভব নহে। অনুরূপভাবে কেহ যদি তার মাধ্যম ছাড়া কুরআন দেখতে চায়, তবে এই কুরআন সেই কুরআন নহে। যাহা যাকে ইচ্ছা তাকে পথ প্রদর্শন করে, বরং উহা সেই কুরআন হবে, যাহা যাকে ইচ্ছা তাকে পথভ্রষ্ট করে। অনুরূপভাবে গোলাম আহমদের ব্যাখ্যা ছাড়া হাদীসের কোন মূল্য নেই। কেননা, প্রত্যেকে এ থেকে যা ইচ্ছা তা বের করতে পারে।’ (জুমার খুতবা যা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ কাদিয়ানে প্রদান করেছিল, উহা ‘আল-ফজল ‘পত্রিকার অন্তর্ভুক্ত, ১৫ জুলাই ১৯২৪ খৃ:) কাদিয়ানীদের আরেকটি আকীদা হল এই যে, গোলাম আহমদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, যেরূপভাবে প্রধান রাসূলগণের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল। তার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, উহা অন্যান্য অনেক নবীর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার চেয়েও অধিক। অন্যান্য আসমানি কিতাব যেভাবে তিলাওয়াত করা হয়, অনুরূপভাবে, এ কিতাবটিও তিলাওয়াত করা অপরিহার্য। যে কিতাবটি তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে উহার নাম ‘আল-কিতাবুল মুবিন।’ আরো উল্লেখযোগ্য যে, কাদিয়ানীদের কুরআনে বিশ অংশ রয়েছে। এমনি ভাবে তা বিভিন্ন আয়াতেও বিভক্ত। কাদিয়ানী পত্রিকা লিখছে- গোলাম আহমদের উপর তার প্রভুর কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যে কোন নবীর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার চেয়ে কম নহে। বরং উহা অনেক নবীর চেয়ে বেশি। (আল-ফজল ১৫ ফেব্র: ১৯১৯ খৃ:) মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানী তার পুস্তকে লিখছে- আল্লাহ তাআলা গোলাম আহমদের ইলহামাতের সমষ্টিকে ‘আল কিতাবুল মুবিন’ নামে অভিহিত করেছেন। এক একটা ইলহামের নাম এক একটি আয়াত যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, নবীর জন্য কিতাব লাভ করা অপরিহার্য; তার কর্তব্য হল গোলাম আহমদের নবুয়্যত ও রেসালতকে বিশ্বাস করা। কেননা, আল্লাহ তাআলা তার জন্য একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং ‘আলকিতাবুল মুবিন’ নামে উহার নামকরণ করেছেন। আর এ গুণে তাকে ভূষিত করেছেন।’ যদিও কাফেরগণ তা অপছন্দ করে। (মুহাম্মদ ইউসুফ কাদিয়ানী রচিত ‘আন-নবুয়্যত ফিল ইসলাম’ ৪৩ পৃ:) কাদিয়ানী খলীফা কাদিয়ানে প্রদত্ত তার ঈদের খুতবায় বলেছে: প্রকৃত ঈদ আমাদের জন্য; তবে প্রয়োজনের চাহিদা হল এই যে, মসীহে মাওউদের (গোলামের) উপর আল্লাহর যে কালাম অবতীর্ণ হয়েছে উহা আমাদের পাঠ করা ও অনুধাবন করা উচিত। খুব কম লোক আছে যারা এ কালাম পাঠ করে এবং এর দুধ পান করে। অথচ অপরাপর কিতাব যতই পাঠ করা হোক না কেন উহাতে সে স্বাদ ও আনন্দ নেই যা গোলাম আহমদের উপর অবতীর্ণ কিতাব পাঠ করলে লাভ করা যায়। (আল-ফজল, ৩রা এপ্রিল ১৯২৮ খৃ:) গোলাম আহমদ তার কালামের বর্ণনায় বলে: আমার উপর এত অধিক পরিমাণ আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হয়েছে; যদি উহা একত্রিত করা যায়, তবে বিশ খন্ডের কম হবে না। (গোলাম কদিয়ানীর ‘হাকীকতুল ওহী’ ৩৯১ পৃ:) কাদিয়ানীরা আরো বিশ্বাস করে যে, তারা স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি ধর্মের অধিকারী এবং তাদের শরীয়ত একটা স্বতন্ত্র শরীয়ত। গোলাম আহমদের সঙ্গী সাথী সাহাবাগণের মতই এবং তার উম্মত একটি নতুন উম্মত। কাদিয়ানীদের পত্রিকা একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছে। উহাতে আছে-‘আল্লাহ তাআলা এ রেসালাতকে কাদিয়ান নামক উজাড় বস্তিতে প্রকাশ করেছেন এবং এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য গোলাম আহমদকে নির্বাচিত করেছেন, যিনি পারস্য বংশোদ্ভুত। তাকে বলে দিয়েছেন- ‘‘আমি তোমার নাম পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেব এবং শক্তি দিয়ে তোমাকে সাহায্য করব। তুমি যে ধর্ম নিয়ে আগমন করেছ, উহাকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করব। আর এ বিজয় কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে।’’ (আল-ফজল পত্রিকা ৩রা ফেব্রু: ১৯৫৩ খৃ:) পত্রিকাটি আরো প্রচার করেছে যে, ‘যে ব্যক্তি কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করা অবস্থায় গোলাম আহমদকে দেখেছে, তাকে সাহাবী বলা হবে।’ (আল-ফজল, ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ খৃ:) গোলাম আহমদ নিজেই এ মতের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে- যে ব্যক্তি আমার জামাতে প্রবেশ করবে, সে বাস্তবে সাইয়েদুল মুরসালীনের সাহাবাগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (গোলামের ‘খুতবায়ে ইলহামিয়া’ ১৭১ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা এ সূত্র ধরে বলে: ‘গোলাম আহমদের জামাত প্রকৃত পক্ষে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জামাত। তাদের উপর যেমন রাসূলুল্লাহর ফয়েজ ও বরকত সমূহ জারি হয় এমনি ভাবে কোন পার্থক্য ছাড়াই তার জামাতের উপর রাসূলুল্লাহর ফয়েজ ও বরকত জারি হয়। (আল-ফজল ১ম জানুয়ারি ১৯১৪ খৃ:) কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদ তার জামাতকে ঐ সকল লোকের সাথে সাক্ষাতের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছে যে, ‘মসীহে মাওউদের (গোলামের) আসহাবের সহিত তোমাদের সাক্ষাৎ করা উচিত।’ এদের মধ্যে অনেকেই এমন আছে, যাদের চুল এলোমেলো এবং মলিন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাদের প্রশংসা করেছেন। (মাহমুদ আহমদের প্রবন্ধ যা আল-ফজল পত্রিকায় প্রচারিত, ৮জানুয়ারী ১৯৩২ খৃ:)
এখন আমরা স্বয়ং গোলাম আহমদের আলোচনা করছি। সে তার উম্মতের কথা উল্লেখ করে বলে: ‘আমার উম্মত দু’ভাগে বিভক্ত। এক দল খ্রিস্ট ধর্মের রং অবলম্বন করবে ও ধ্বংস হয়ে যাবে। অপর দল মাহদীর রং গ্রহণ করবে। (গোলামের উক্তিসমূহ যা আল-ফজল পত্রিকার অন্তর্ভুক্ত, ২৬ শে জানুয়ারি ১৯১৬ খৃ:) অনুরূপভাবে, এই গোলাম আহমদ তার শরীয়তের উল্লেখ করে বলে: শরীয়ত কি? তা তোমরা বুঝে নাও। আদেশ নিষেধের বর্ণনা করার নাম শরীয়ত। যে ব্যক্তি এ কাজ করবে এবং তার উম্মতের জন্য আইন কানুন নির্ধারণ করবে সেই হল ছাহেবে শরীয়ত। সুতরাং আমিই ছাহেবে শরীয়ত। কেননা, আমার কাছে আদেশ নিষেধ সম্পর্কে ওহী আসে। আর শরীয়তের জন্য এটা জরুরি নহে যে, তা নতুন নতুন আহকাম সংবলিত হবে। কেননা, কুরআনে যে সমস্ত শিক্ষা রয়েছে তাওরাতেও তা বর্তমান। বরকতময় মহান আল্লাহ এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন- ‘নিশ্চয়ই এটা পূর্বেকার সহীফা সমূহের মধ্যে আছে অর্থাৎ ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ও মুসার আলাইহিস সালাম সহীফাতে রয়েছে।’’ [১সুরা আল আ’লা ১৮-১৯] (গোলাম রচিত ‘আরবাঈন’ ৪ নম্বর ৭পৃঃ)
কাদিয়ানীরা এ আকীদা ও পোষণ করে যে, কাদিয়ান অর্থাৎ যে জনপদে দাজ্জাল, মিথ্যাবাদী, বিকৃত মস্তিষ্ক গোলাম আহমদ জন্ম গ্রহণ করেছে, উহা মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা সমতুল্য। বরং এ দু’স্থান হতেও উত্তম। আর উহার ভূমি হেরেমের ভূমি এবং উহাতে আল্লাহর অনেক নিদর্শনা বলী রয়েছে। উহাতে এমন একটি অংশ রয়েছে যা বেহেস্তের এক টুকরা। এখানে এমন একটি গোরস্থান রয়েছে, যার উপর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম প্রেরণ করেন এবং কুরআনে এর উল্লেখ রয়েছে। কাদিয়ানের মসজিদ, মসজিদে নববী, মসজিদে হারাম ও মসজিদে আকসার সমতুল্য, বরং স্বয়ং এ মহল্লা মুসলমানদের কিবলা ও কা’বা সাদৃশ্য। কাদিয়ানীদের এক অভিশপ্ত ব্যক্তি ‘আল-ফজল পত্রিকায় লিখছে, যার ভাষ্য হল: ‘কাদিয়ান কি? কাদিয়ান হল আল্লাহর জালালী শান ও কুদরতের একটি প্রকাশ্য নিদর্শন। এমনি ভাবে মসীহে মাওউদ (গোলাম) বলেছেন- ‘ইহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দারুল খেলাফত এবং মাসীহের বাসস্থান, জন্মস্থান ও সমাধিস্থল। এ জনপদেই রয়েছে এমন একটা ঘর যেখানে বসবাস করতেন বিশ্বের মুক্তিদাতা, দাজ্জালের ঘাতক এবং (খ্রিস্টানদের) ক্রসের চূর্ণ বিচূর্ণকারী (স্বপ্ন জগতে) আর ইসলাম ধর্মকে সকল ধর্মের উপর বিজয় দানকারী। (আল-ফজল, ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৩৯ খৃ:) অন্য এক মিথ্যাবাদী লিখছে ‘এটা আল্লাহর নূর সমূহের অবতরণ স্থল, ইহার অলি-গলি ও গৃহ সমূহে কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তার প্রত্যেকটি ইট আল্লাহর এক একটি নিদর্শন। এর মসজিদ সমূহ নুরানী এবং উহার মুয়াজ্জিনের আযান জ্যোতিষ্মান। এ সকল মসজিদের মিনার সমূহ হতে এমন ধ্বনি উচ্চারিত হয় যা আরব উপদ্বীপে চৌদ্দ শতাব্দী পূর্বে উচ্চারিত হয়েছিল। (আল-ফজল ১লা জানুয়ারি ১৯২৯ খৃ:) কাদিয়ানের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: ‘আমি তোমাদেরকে সত্য বলছি, আল্লাহ আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, কাদিয়ানের ভূমি বরকতময়, উহাতে অবিকল ঐ সকল বরকত অবতীর্ণ হয় যা মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের বাণী যা ‘আল-ফজল’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত, ১০ ডিসেম্বর ১৯৩২ খৃ:) সে আরো বলেছে কাদিয়ানী আল্লাহর নেয়ামত ও বরকত সমূহের অবতরণ স্থল। এ সমস্ত বরকত ও ফয়েজ সমূহ যেভাবে কাদিয়ানী অবতীর্ণ হয়, অন্য কোথায়ও তেমনি অবতীর্ণ হয় না। গোলাম আহমদও বলেছে: যে ব্যক্তি কাদিয়ানে আসবে না, আমি তার ঈমানের উপর আশঙ্কা করি।’ (গোলাম পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা কর্তৃক রচিত ‘আনওয়ারুল খেলাফত’ ১১৭ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজল’ প্রচার করেছে; যে মসজিদে আকসার দিকে রাসূলুল্লাহকে রাত্রিবেলা ভ্রমণ করান হয়েছিল, তা হল ঐ মসজিদ যা কাদিয়ানী অবস্থিত। আর মূল বক্তব্য হল এই আল্লাহর বাণী। ‘‘ঐ আল্লাহ পবিত্র যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসার প্রতি ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন, যার চতুর্পাশ্ব আমি বরকতময় করে রেখেছি।’’ [১ সুরা বণী ইসরাইল-১] উহাতে মসজিদে আকসার দ্বারা কাদিয়ানের মসজিদকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কেননা, রাসূলুল্লাহকে রাত্রিকালে ঐ মসজিদের দিকে ভ্রমণ করান হয়েছিল যা কাদিয়ানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং যা গোলাম আহমদের ঐ সকল কামালাত ও বরকতের জ্যান্ত ছবি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দান করেছিলেন। (আল ফজল, ২১ আগস্ট, ১৯৩২ খৃ:) এই কাদিয়ানী দাজ্জাল উক্ত মসজিদকে বাইতুল হারামের সঙ্গে তুলনা করে বলে: কাদিয়ানে অবস্থিত আমার মসজিদের বর্ণনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা কুরআনে তাঁর বাণী- ‘‘আর যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করল সে নিরাপদ হয়ে গেল। [২ সুরা আলে ইমরান- ৯৭] অবতীর্ণ করেছেন। (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘‘এজালাতুল আওহাম’’ ৭৫ পৃ:) গোলামের জনৈক ভক্ত আল ফজল পত্রিকায় লিখেছে, ‘আরব ভূমি যদি হেরেম শরীফ দ্বারা গর্ব করতে পারে তবে অনারব ভূমি কাদিয়ান ভূমি দ্বারা গর্ব করতে পারবে।’ (আল-ফজলে, প্রকাশিত ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ খৃ:) এ পত্রিকাটিতেই কাদিয়ানের প্রশংসায় জনৈক কাদিয়ানীর রচিত একটি কাসীদা প্রচারিত হয়েছে। এতে আছে, হে কাদিয়ানের ভূমি তোমার উজ্জ্বল পরিবেশকে কি বলব, যদ্দারা বড় বড় চক্ষু বিশিষ্ট হুরগণের চক্ষু আলোকিত হয়। আর আমি তোমাকে কি বলব? তুমিই ক্বিবলা ও কা’বা এবং ফেরেস্তাগণের মসজিদ।’’ (আল-ফজল, ১৮ ই আগস্ট ১৯৩২ খৃ:) কদিয়ানী খলীফা জুমায়ার খুতবা দিতে গিয়ে বলে- কাদিয়ান পৃথিবীর কেন্দ্র স্থল এবং তা সকল জনপদের মূল। এ পবিত্র ভূমি ছাড়া কোন প্রকারের উপকারিতা লাভ করা সম্ভব নহে।(জুমায়ার খুতবা যা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ কাদিয়ানে প্রদান করেছিল এবং আল ফজল পত্রিকায় প্রচারিত ৩রা জানুয়ারি ১৯২৫খৃঃ) সে তার হাকীকতুর রুইয়া. নামক পুস্তকে লিখেছে কাদিয়ান হল সকল জনপদের মূল। যে ব্যক্তি উহা থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তাকে টুকরা টুকরা ও ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হবে। তোমরা টুকরা ও ছিন্ন ভিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাক। মক্কা ও মদিনার ফল শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কাদিয়ানের ফল সর্বদা টাটকা থাকবে। (হাকীকতুর রুইয়া ২৫ পৃ:) যেমনি ভাবে এ সকল দাজ্জাল মক্কা ও মদিনার মর্যাদার অবমাননা করতে চেয়েছে। হ্যাঁ, এই মক্কা মুকাররমা, যার শপথ করেছেন মহান ও বরকতময় প্রভু এবং এর নামকরণ করেছেন ‘নিরাপদ শহর’। তিনি বলেন- ‘‘আমি এ শহরের শপথ করছি।’’ [৩ সুরা আল বালাদ ১] আরো বলেন: ‘এ নিরাপদ শহরের শপথ’’। [৪ সুরা তীন ৩] আর ‘‘উম্মুলকুরা’’ (সকল জনপদের মূল) নামে এর নামকরণ করে আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘যাতে আপনি উম্মুল কুরা অর্থাৎ মক্কা ও তার আশে পাশের লোকজনকে ভীতি প্রদর্শন করেন।’’ [৫ সরা আল আনআম ৯৩] আর যেখানে আল্লাহ সম্মানিত ঘর ও হেরেম শরীফ রেখেছেন, যেমন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ কালামের মধ্যে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন- ‘‘সর্ব প্রথম ঘর যা মানব জাতির কল্যাণের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে, উহা মক্কায় অবস্থিত, যা অত্যন্ত বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য পথ প্রদর্শক। উহাতে রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শনা বলী। তন্মধ্যে একটি হল মাকামে ইব্রাহীম। যে ব্যক্তি উহাতে প্রবেশ করল সে নিরাপদ হয়ে গেল।’’ [১ সুরা আলে ইমরান- ৯৬-৯৭] আল্লাহ আরো বলেন ‘‘ হে মুহাম্মদ আপনি ঘোষণা করুন: আমি এ সম্মানিত শহরের প্রভুর এবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি।’’ [২ সুরা নমল-৭] আর এ শহর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় তুমি সর্বোত্তম ভূমি এবং আল্লাহর কাছে তাঁর ভূমিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়তম।’’ [৩ তিরমিজী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, আহমদ, হাকিম ও ইবনে হিববান।] আর মদিনা মুনাওরা হল মহান আল্লাহর রাসূলের শহর, ওহীর অবতরণস্থল, নুরের উৎস এবং সাইয়্যেদুল মুরসালীনের হিজরত ও সমাধিস্থল। আল্লাহ এর নাম রেখেছেন ‘ত্বাবাহ’ (পবিত্র শহর) যে ব্যক্তি এখানে মৃত্যুবরণ করবে তাঁর জন্য রাসূলকে সুপারিশকারী বানিয়েছেন, দাজ্জাল ও প্লেগ হতে একে রক্ষা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি ওহীর সাহায্যে কথা বলেন তিনি একে হেরেমের মর্যাদা দান করেছেন। যেমন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হেরেম শরীফ বানিয়েছেন এবং একে ঈমানের কেন্দ্রস্থল সাব্যস্ত করেছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- আল্লাহ তাআলা মদিনাকে ‘তাবাহ’ নাম দিয়েছেন [৪ বুখারী ও মুসলিম] এবং বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম হয় , সে যেন এখানে মৃত্যুবরণ করে। কেননা, যে ব্যক্তি এখানে মৃত্যুবরণ করবে আমি তার জন্য সুপারিশ করব। [৫ তিরমিজী ইবমোজাহ ও ইবনে হিববান] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘মদিনার দ্বার সমূহে ফেরেস্তা-গণের পাহারা রয়েছে, সেখানে দাজ্জাল ও প্লেগ প্রবেশ করতে পারবে না।’ [৬ বুখারী মুসলিম মুয়াত্তা ও আহমদ] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে হেরেম বানিয়েছেন এবং মদিনার উভয়‘‘লাবা’’ প্রান্তরের মধ্যবর্তী স্থানকে হেরমরুপে নির্ধারিত করছি। [৭ তিরমিজী] হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন- ‘নিশ্চয়ই ঈমান সংকুচিত হয়ে মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেমন সর্প সংকুচিত হয়ে তার গর্তে প্রবেশ করে।’ [৮ বুখারী মুসলিম ইবনে মাজাহ ও আহমদ] হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-‘মদিনা মানুষের অপবিত্রতাকে এমনিভাবে দূর করে দেয় যেমনি কর্মকারের চুলা লোহার ময়লাকে দূর করে দেয়।’ [৯ বুখারী মুসলিম তিরমিজী, নাসায়ী, মুয়াত্তা ও আহমদ] এসব হল মক্কা ও মদিনা সম্পর্কে ইসলাম ও মুসলমানদের আকীদা। কিন্তু কাদিফানীরা এ দুটি মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ ও হ্রাস করার প্রয়াস চালায় এবং কাদিয়ানকে মক্কা ও মদিনার সমতুল্য নয় বরং এ দুটির চেয়ে আরো উত্তম বানাতে চায়। এ জন্যই কাদিয়ানী খলীফা বলে- মক্কা-মদিনার ফল নিঃশেষ হয়ে গেছে, কিন্তু কাদিয়ানের ফল সর্বদাই তাজা থাকবে। সে আরো বলে: কাদিয়ানে আল্লাহর কতকগুলো নিদর্শন রয়েছে। তন্মধ্যে বার্ষিক সম্মেলন স্থল, মসজিদে আল মুবারক, মসজিদে আকসা (আল কাদিয়ানী) মসীহের মিনার [১ ‘মসীহের মিনার’ গুলাম আহমদ এই মিনার বানিয়ে ঘোষণা করে যে এই সেই মিনার যার প্রতি রাসুলুল্লাহ সাঃ. এই বলে ইশারা করেছেন যে, পূর্ব দামেস্কের এই মিনারার উপর ঈসা আঃ অবতরণ করবেন। গুলামের এই দাবীতে তার বোকামীর ভ্রষ্টতা কোথায় দামেস্ক আর কোথায় কাদিয়ান। এরপর কোথায় পূর্ব থেকে তৈরী মিনার আর কোথায়পরে তৈরী মিনার, যেটি নির্মাণ করছে মিথ্যুক ভন্ডনবী। এরপর বলে যে, এরপর বলে যে, এর উপর ঈসা নাজেল হবেন। এর চেয়ে বড় বোকামী আর কি হতে পারে!!] ইত্যাদি। সুতরাং এ সকল পবিত্র স্থানের জিয়ারত করা উচিত। কেননা এগুলো আল্লাহর নিদর্শনা বলী। (মাহমুদ আহমদের ভাষণ, যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজলে অন্তর্ভুক্ত, ৮ই জানুয়ারি ১৯৩৩ খৃ:) তাদের আর একটি আকীদা হল এই ‘কাদিয়ানের বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার নাম হজ।’ গোলাম পুত্র ও তার দ্বিতীয় খলীফা বলে: আমাদের বার্ষিক সম্মেলনই হল হজ। আল্লাহ তাআলা হজের স্থানরূপে কাদিয়ানকে নির্বাচিত করেছেন এবং এখানে অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ নিষিদ্ধ।’ (মাহমুদ আহমদের ‘‘বারাকাতুল খেলাফত’’ ৫ও ৭ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে ছুলাহ’ তে জনৈক কাদিয়ানী লিখেছে, ‘গোলাম আহমদের উপর ঈমান গ্রহণ ব্যতীত কোন ইসলাম নেই, যেমন কাদিয়ানী সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া ব্যতীত কোন হজ নেই। কেননা, বর্তমান মক্কায় হজের উদ্দেশ্য সমূহ পূর্ণ হয় না। (পয়গামে ছুলাহ, ১৯ এপ্রিল ১৯৩৩ খৃ:) মিথ্যুক গোলাম আহমদ বলে: শুধু কাদিয়ানে অবস্থান করাই নফল হজ হতে উত্তম। (গোলাম রচিত ‘মেরআতু কামালাতিল ইসলাম’ ৩৫২ পৃ:) মাহমুদ আহমদ বলে: আমাকে ইয়াকুব আহমদ কাদিয়ানী বর্ণনা করেছেন যে, গোলাম আহমদ বলেছেন- ‘কাদিয়ানে আগমনই হচ্ছে হজ। (আল ফজল, ৫ জানুয়ারি ১৯৩৩ খৃ:)সারকথা, কাদিয়ানীদের প্রথম আকীদা হল: তাদের একজন মাবুদ আছেন যিনি মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন। তিনি রোজা রাখেন, নামাজ পড়েন, নিদ্রা যান ও জাগ্রত হন, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ভুলও করেন, লিখেন এবং সাক্ষরও করেন, স্ত্রী সহবাস করেন ও সন্তান জন্ম দেন, এবং বিভক্তও হন। দ্বিতীয়: নবী রাসূলগণ কিয়ামত পর্যন্ত আগমন করবেন। তৃতীয়: গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল। চতুর্থ: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সকল নবী রাসূল থেকে তিনি উত্তম। পঞ্চম: গোলামের উপর ওহী অবতীর্ণ হয়। ষষ্ঠ: গোলাম আহমদের কাছে ওহী পৌঁছানোর জন্য যে ফেরেস্তা নিযুক্ত করা হয়েছে তিনি হলেন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম সপ্তম: তাদের ধর্ম অন্য সকল ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র এবং তাদের শরীয়ত স্বয়ং সম্পূর্ণ। আর তারা একটি নতুন উম্মত অর্থাৎ গোলাম আহমদের উম্মত। অষ্টম: তাদের একটা স্বয়ং সম্পূর্ণ কিতাব আছে, যা সম্মান ও মর্যাদায় কুরআনের সমতুল্য। তার বিশটি খন্ড আছে। উহার নাম ‘আল-কিতাবুল মুবীন’ এবং উহা বিভিন্ন আয়াতে বিভক্ত। উহার একটি আয়াত হল- ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ কাদিয়ানে অবতরণ করেন।’’ (গোলাম রচিত, আল-বুশরা হতে উদ্ধৃত ৫৬ পৃ:) অপর একটি আয়াত ‘আল্লাহ তাআলা আরশ থেকে তোমার প্রশংসা করেন এবং তোমার দিকে চলে আসেন।’’ (গোলাম রচিত, আক্বিবাতুল আছিম’ ৫৫ পৃ:) অপর একটি আয়াত- ‘অমুক ব্যক্তি তোমার হায়েজ বা তোমার মধ্যকার অপর অপবিত্রতা সম্পর্কে অবগত হতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তোমার মধ্যে তার ধারাবাহিক দান সমূহ দেখাবেন। তোমার মধ্যে হায়েজ নেই; বরং তোমার মধ্যে একটা শিশু আছে। হ্যাঁ এই শিশুটি‘‘আতফালুল্লাহ ’’ (আল্লাহ তাআলার শিশুগণ) এর সমতুল্য। (গোলাম রচিত, হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, ১৪২ পৃ:) নবম: সম্মান ও মর্যাদায় কাদিয়ান মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারার সমতুল্য, এমনকি এ দুটি হতেও উত্তম। দশম: কাদিয়ানে বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হওয়াই হল তাদের হজ। এখন আমরা এ সকল নির্দেশাবলীর উল্লেখ করব যা নবুয়তের দ্বাবীদার কাদিয়ানীর উপর তার প্রভু ইংরেজের পক্ষ হতে নাজেল করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শক্তিকে খর্ব করা এবং সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে মুসলমানদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা, আর, জিহাদ রহিত করা। কেননা, সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামের জিহাদের আকীদাকে সর্বাধিক ভয় করে। কারণ, জিহাদের সহিত মুসলমানদের সম্পর্ক ও আন্তরিকতা সম্বন্ধে তারা অবগত রয়েছে। ক্রুসেডের যুদ্ধ চলাকালে তারা এ আকীদা থেকে নির্গত উক্ত দুটি বিষয় ভালভাবেই আঁচ করতে পেরেছে। এ জন্য ইংরেজ খ্রিস্টান উপনিবেশবাদী তার মিথ্যা নবীকে মুসলমানদের অন্তর হতে এ বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করতে এবং এখন থেকে ইসলামে জিহাদ নেই, এ নতুন আকীদা সৃষ্টি করতে নির্দেশ দেয়। ফলে মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী বলে: ‘আল্লাহ তাআলা ধীরে ধীরে জেহাদের কঠোরতা হ্রাস করে দিয়েছেন। মুসার আলাইহিস সালাম যুগে শিশুদের হত্যা করা হত এবং মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগে শিশু, নারীও বৃদ্ধদেরকে হত্যা করা রহিত করা হয়। অতঃপর আমার যুগে জেহাদের হুকুমকে একেবারে রহিত করে দেয়া হয়।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আরবাঈন’ ৪ নম্বর ১৫ পৃ:) সে আরো বলে: ‘আজ তরবারি দ্বারা জেহাদ রহিত হয়ে গেল, আজকের পর আর জেহাদ নেই।’ অতএব, যে ব্যক্তি কাফেরদের উপর অস্ত্রধারণ করবে এবং নিজেকে গাজী বলে অভিহিত করবে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিরোধী বলে গণ্য হবে, যিনি তেরো শতাব্দী পূর্বে ঘোষণা দিয়েছেন যে, মসীহে মাওউদের সময় জেহাদ রহিত হয়ে যাবে। হে আল্লাহর শত্রু! তুমি মিথ্যা বলেছ এবং মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর এমন কথা আরোপ করেছ যা তিনি কখনও বলেন নি।) আর, আমিই মসীহে মাওউদ। এখন আমার প্রকাশ পাওয়ার পর কোন জেহাদ নেই। তাই, আমরা সন্ধি ও নিরাপত্তার পতাকা উত্তোলন করব। (আরবাঈন- ৪৭ পৃ:।) একদা এ বিশ্বাস ঘাতক দালাল ঘোষণা দিল যে, ‘‘তোমরা এখন জেহাদের চিন্তা ছেড়ে দাও। কেননা, ধর্মের জন্য যুদ্ধ করা হারাম করে দেয়া হয়েছে। ইমাম ও মসীহ এসে গেছেন এবং আসমান থেকে আল্লাহর নূর অবতীর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং জেহাদ আর নেই। বরং যে ব্যক্তি এখন আল্লাহর পথে জেহাদ করবে, সে আল্লাহর শত্রু এবং নবীর আদেশ অমান্যকারী। (এখানে আল্লাহর শত্রু বলতে কাদিয়ানীদের প্রভু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শত্রু বুঝায় এবং নবীর অমান্যকারী বলতে কাদিয়ানীদের নবীর অমান্যকারী উদ্দেশ্য।) (গুলামেরে ঘোষণা যা গোলাম রচিত ‘‘তাবলীগে রেসালতের’’ অন্তর্ভুক্ত, ৪থ খন্ড ৪৯পৃঃ) কাদিয়ানী ম্যাগাজিন ‘‘রিভিউ অব রিলিজিউন্স’’ এর সম্পাদক মুহাম্মদ আলী লিখেছে: ইংরেজ সরকারের কর্তব্য হল কাদিয়ানীদের অবস্থা অনুধাবন করা। কেননা, আমাদের ইমাম তার জীবনের বাইশটি বছর লোকজনকে শুধু এ শিক্ষা দিতে ব্যয় করেছেন যে, জিহাদ হারাম এবং অকাট্য হারাম। শুধু ভারতেই তিনি এ শিক্ষা প্রচার করে ক্ষান্ত হননি, বরং তা মুসলিম দেশ সমূহে যথা আরব, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে প্রচার করেছেন। (‘‘রিভিউ অব রিলিজিওন্স’’ ২নম্বর ১৯০৪ খৃ:) ভন্ডনবী দাজ্জাল বলে: নিশ্চয়ই এ কাদিয়ানী সম্প্রদায় মুসলমানদের অন্তর থেকে জিহাদের অপবিত্র আকিদার মূলোৎপাটন করতে দিবারাত্র চেষ্টা চালিয়ে যাবে। (সরকারের প্রতি গোলামের আবেদনপত্র যা ‘‘রিভিউ অব রিরিজিওন্সের’’ অন্তর্ভুক্ত ৫নম্বর ১৯২২ খৃ:) কাদিয়ানীরা যে সমস্ত ঘৃণ্য আকিদা পোষণ করে তন্মধ্যে জিহাদকে রহিত করার ঘৃণিত আকিদা হল অন্যতম। অথচ, বিশ্বস্ত সত্যবাদী আল্লাহর রাসূল বলেন: ‘‘জেহাদ সর্বোত্তম আমল’’। [১ বুখারী মুসলিম আবু দাউদ, তিরমিজী, নাসায়ী, দারেমী ও আহমদ] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘‘মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ মুমিন ব্যক্তি যে তার জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে।’’ [২ বুখারী মুসলিম আবু দাউদ, তিরমিজী, নাসায়ী, দারেমী ও আহমদ ৩ বুখারী মুসলিম নাসায়ী ও আহমদ] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:‘‘বেহেস্তের মধ্যে একশতটি স্তর রয়েছে, যে গুলোকে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাস্তায় জেহাদকারীদের জন্য তৈরি করেছেন’’ [৪ তিরমিজী, বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ,, আহমদ, ত্বায়ালিসী ও দারামী] মুজাহিদ গণের নবী এবং তাদের সরদার ও নেতা, আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে ও তরবারির ছায়াতলে তাঁদের প্রধান (তাঁর উপর আমার মাতা-পিতা ও আমার প্রাণ উৎসর্গ) বলেছেন: ‘‘আল্লাহর পথে এক সকাল বা এক বিকালের জিহাদ পৃথিবী ও উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত হতে উত্তম। বেহেস্তের মধ্যে তোমাদের কারো দুটি ধনুক পরিমাণ জায়গা অথবা তার হাত পরিমাণ জায়গা পৃথিবী ও উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত হতে উত্তম। বেহেস্তের কোন নারী যদি পৃথিবীর দিকে একবার উঁকি দেয়, তবে উহার সকল বস্ত্তকে আলোকিত করে দেবে এবং সুগন্ধময় করে তুলবে। আর তাঁর মাথার ওড়না পৃথিবী ও উহার মধ্যকার সকল বস্ত্ত হতে উত্তম। [৫ বুখারী মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, আহমদ ও ত্বায়ালাসী। উদ্ধৃতি বুখারী।] ‘‘হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: আল্লাহর পথে কোন বান্দার দু‘টি পা যদি ধুলা মিশ্রিত হয়, তবে একে দোজখের আগুন কখনও স্পর্শ করবে না।’’ [] এগুলো হল ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বানী। আর ঐগুলো হলো কাদিয়ানীদের মিথ্যা নবী দালাল, বিশ্বাস ঘাতক ও কাপুরুষের উক্তি। এগুলো হলো স্বাধীন মুসলমানদের আকিদা আর ঐ গুলো হলো সাম্রাজ্যবাদের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী কাদিয়ানীদের আকিদা। কাদিয়ানীদের অপর একটি আকিদা হল ইংরেজ সরকারের ভালোবাসা ও আনুগত্য। এ সম্পর্কে আমি একটা পৃথক প্রবন্ধ লিখেছি। কিন্তু এখানে আমি ঐসকল বিষয় উল্লেখ করব যা ওখানে উল্লেখ করিনি। আর তা হল, এ কথা প্রমাণ করা যে, উপরোক্ত বিষয় তাদের মূল আকীদার অন্তর্ভুক্ত ও মৌলিক মূলমন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত। এটা জানা কথা যে, বাইয়াতের শর্তাবলি মাযহাবের মৌলিক নীতি এবং ভিত্তি হয়ে থাকে। একথা কাদিয়ানী ভন্ডনবী নিজেই স্বীকার করেছে। তার মূল বক্তব্য হল ‘‘আমি বাইয়াতের শর্তাবলি মুদ্রিত করেছি, যাতে এটা আমার দলের ও আমার অনুগামীদের কর্মসূচীর জন্য নীতি মালারুপে গণ্য হয়।’’ (তাবলীগে রেসালাত’’ মাযমুয়ায়ে কদিয়ানিয়াত. ৭ম খন্ড. ১৬ পৃ:) তাই, স্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ সকল শর্ত কাদিয়ানীদের জন্য তাদের নবীর বর্ণনানুসারে মূলনীতি হিসাবে সাব্যস্ত। অতএব এখন আমরা দেখব ঐ সকল শর্তাবলি কি? যা গোলাম আহমদ তাদের জন্য মূলনীতিরূপে নির্ধারণ করেছে। সে বলে: আমি বাইয়াতের শর্তাবলি মুদ্রিত করেছি, যাতে এগুলো আমার দলের ও অনুসারীদের জন্য কর্মসূচী হয়ে থাকে। আর, এর নামকরণ করেছি ‘‘তাকমিলুত তাবলীগ মায়া শুরুতিল বাইয়াত’’ এবং উহার এক কপি সরকারের নিকট প্রেরণ করেছি; যাতে সরকার এ কথা জানতে পারে যে, আমি অনুসারীদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নির্দেশ দিয়েছি যাতে তারা ইংরেজ সরকারের বিশ্বস্ত অনুগত ও থাকে। (ভারতের বড় লাটের কাছে গোলামের প্রেরিত আবেদন যা কাসেম কাদিয়ানী রচিত ‘‘তাবলীগে রেসালতের অন্তর্ভুক্ত, ৭ম খন্ড, ১৬ পৃষ্ঠা) সে এর চেয়েও অধিক স্পষ্ট করে বলছে: দীর্ঘ সতের বছর ধরে আমার অনবরত ভাষণের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আমি মনে প্রাণে ইংরেজ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান। সরকারের আনুগত্য ও মানুষের ভালোবাসা হল আমার বিশ্বাস। এটাই আমার আকীদা, যা আমার অনুসারী ভক্তগণের জন্য বাইয়াতের শর্তাবলির অন্তর্ভুক্ত করেছি। আমি এ আকীদাকে বাইয়াতের শর্তাবলি সম্পর্কীয় পুস্তিকায় চতুর্থ বিষয়ের আওতায় স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি, যা আমার ভক্ত ও অনুসারীগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘কিতাবুল বারিয়ার’’ পরিশিষ্ট, ৯ পৃষ্ঠা) কাদিয়ানীদের খলীফা গোলামপুত্র লিখেছে যে, মসীহে মাওউদ (গোলাম) ইংরেজ সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততাকে বাইয়াতের শর্তাবলির অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বলেছেন, যে ব্যক্তি সরকারকে অমান্য করবে এবং তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ করবে এবং তার নির্দেশাবলী বাস্তবায়িত করবে না, সে আমাদের জামাতের অন্তর্ভুক্ত নহে।(গোলামপুত্র এবং তার দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ রচিত ‘‘তুহফাতুল মুলুক’’ ১২৩ পৃ:) মোটকথা, কাদিয়ানীদের আকীদা হল কাফের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা পোষণ করা। এ বিকৃত আকীদাসমূহের সাথে আমি তাদের আর একটি আকীদা যোগ করব এবং এর উপর প্রবন্ধটি শেষ করব। আর তা হল, কাদিয়ানীরা এ বিশ্বাস পোষণ করে- যে ব্যক্তি গোলাম আহমদের উপর ঈমান আনবে না এবং তার উক্তিকে অমান্য করবে, সে কাফের এবং চিরকাল;দোজখে অবস্থান করবে। যদিও সে মুমিন ও মুসলিম হয়ে থাকে। কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ বলে: যে ব্যক্তি গোলাম আহমদকে বিশ্বাস করে না সে কাফেরও দ্বীন বহির্ভূত। যদিও সে মুসলিম হয় এবং কখনও গোলাম আহমদের নামও শুনতে পায়নি। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ‘‘আনওয়ারে সাদাকাত’’ ৩৫ পৃ:) গোলামের দ্বিতীয় পুত্র বশীর আহমদ বলে: যে ব্যক্তি মুসাকে আলাইহিস সালাম বিশ্বাস করে না অথবা ঈসাকে বিশ্বাস করে এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কে বিশ্বাস করে না, সে কাফের। অনুরূপভাবে, যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কে বিশ্বাস করে, কিন্তু গোলাম আহমদকে বিশ্বাস করে না, সেও কাফের, তার কাফের হওয়াতে কোন সন্দেহ নেই । (বশীর আহমদের ‘‘কালিমাতুল ফছল’’ যা কাদিয়ানী ম্যগাজিন রিভিউ অব রিলিজিউন্স হতে উদ্ধৃত ৩৫ নম্বর, ১৪ খন্ড, ১১০ পৃ:) মিথ্যাবাদী ভন্ড নবী আরও বলেছে: ‘‘যার কাছে আমার দাওয়াত পৌঁছেছে এবং সে আমাকে বিশ্বাস করেনি, সে কাফের।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর বাণী ‘‘আল-ফজলের’’ অন্তর্ভুক্ত, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৩৫ খৃ:) সে বলে: ‘‘আমার নিকট ইলহাম হয়েছে যে, আল্লাহ আমাকে বলেছেন- যে ব্যক্তি তোমাকে বিশ্বাস করে না এবং তোমার অনুসরণ করে না, বরং বিরোধিতা করে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধী এবং সে দোজখের আগুনে প্রবেশ করবে। (গোলামের ইলহাম যা কাসেম কাদিয়ানীর ‘‘তাবলীগে রেসালাতের’’ অন্তর্গত, ৯ম খন্ড, ২৭ পৃ:)
এই হল কাদিয়ানীদের আকীদাসমূহ যা তারা গ্রহণ করে নিয়েছে। আমি এগুলোকে তাদের পুস্তক সমূহ থেকে তাদের ভাষায়, এমনকি তাদের শব্দ মালায় উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুক। কেমন করে তারা উল্টো দিকে ফিরে যাচ্ছে?
কাদিয়ানী মতবাদ উদ্ভাবন করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সাধন, মুসলমানদের অন্তর থেকে আত্মনির্ভরশীল মুহাম্মদী জীবন্ত শিক্ষাকে উৎপাটন এবং ঐ সকল লোকদের মধ্য থেকে ভ্রাতৃত্ব, সমবেদনা, ভালোবাসা ও সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য , যারা এক প্রভু-প্রতিপালকের অনুগত, এক ক্বেবলার দিকে মুখ করে, এক কিতাবে বিশ্বাস করে, যারা আপন সম্পদ , পরিবার-পরিজন, সন্তান ও নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে মুহাম্মদে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এবং তাঁরই কারণে তারা ভালোবাসে প্রতিটি শহরকে যেখানে তিনি বাস করেছেন, প্রতিটি মহল্লাকে যেখানে তিনি অবস্থান করেছেন, প্রতিটি মসজিদকে যেখানে তিনি নামাজ আদায় করেছেন, প্রতিটি সম্প্রদায়কে যারা তাঁর ভাষায় কথা বলে এবং প্রতিটি লোককে যে তাঁর অনুসরণ করে। উপরোক্ত এই সব প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই কাদিয়ানী মতবাদ গঠিত ও সৃষ্টি করা হয় এবং ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের ছত্র ছায়ায় উহা লালিত-পালিত হয়। মুহাম্মদে আরাবীর উম্মতের দুর্দিনের অপেক্ষায় যারা ছিল তাদের জন্য কদিয়ানীরা নিজ নিজ অবস্থান দ্বারা বড় বড় খেদমত সম্পাদন করে। তারা এ ধারণা পোষণ করে যে, তাদের নেতা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আল্লাহর নবী ও তার রাসূল এবং সে সত্যবাদী আল্লাহর নবী ও তার রাসূল এবং সে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সকল নবী ও রাসূলগণ হতে উত্তম। কাদিয়ান গ্রাম যা গোলাম আহমদের বাসস্থান উহা মক্কা মদিনা হতে উত্তম, যে কবরে মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী সমাধিস্থ হয়েছে উহা পৃথিবীর সমুদয় কবর হতে অধিক মর্যাদাবান, মক্কা, আরাফাত ও মিনাতে কোন হজ্জ নেই, আল্লাহর পথে কোন জিহাদ নেই, তাদের নবী যে ইসলাম পেশ করেছেন তা ব্যতীত আর কোন ইসলাম নেই। যে ব্যক্তি তাকে ও তার পবিত্রতাকে বিশ্বাস করে না সে মুসলিম নহে। আমি এ প্রবন্ধে তাদের নবীর জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন চরিত আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি। যাতে তার সম্পর্কে অনুসন্ধানকারীরা জানতে পারবে যে, এ লোকটি কে? তার প্রকৃত রূপ কি? এ ধরনের লোক কি নবী হতে পারে? কোথায় নবুয়্যত? নবী হওয়াতো দূরের কথা? বরং এ ধরনের ব্যক্তিকে কি সৎ ও আল্লাহ ওয়ালা উলামাদের সারিতে গণ্য করা যায়? আমরা এ আলোচনায় যা কিছু বলব তা তাদের পুস্তকাবলী হতেই ও তাদের শব্দের উদ্ধৃতি দ্বারাই উল্লেখ করব। এটাই নিজের উপর বাধ্যতা মূলকভাবে স্থির করে নিয়েছি।
গোলামের বংশ ও জন্মস্থান:
ভন্ডনবী কাদিয়ানী তার বংশ ও জন্ম স্থানের উল্লেখ করে বলে: আমার নাম গোলাম আহমদ , আমার পিতার নাম গোলাম মুরতাজা, আমার দাদার নাম আতা মুহাম্মদ, আমার গোত্র মুঘল বরসাল। সংরক্ষিত দলীল পত্র দ্বারা বুঝা যায়, আমার পূর্ব পুরুষেরা সমর-কন্দ থেকে আগমন করেছেন। (গোলাম আহমদের কিতাবুল বারিয়া, ১৩৪, পৃ:) এটা জানা কথা যে, মুঘল তুর্কি বংশের। অথচ গোলাম বলেছে, সে মুঘল বংশধর। কিন্তু অন্যত্র সে বলে, সে পারস্য বংশোদ্ভুত। যেমন সে উল্লেখ করেছে: ‘‘এটা সুস্পষ্ট যে, আমার গোত্র মুঘল বংশোদ্ভুত কিন্তু এখন আমার কাছে আল্লাহর কালাম হতে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে আমি পারসি বংশোদ্ভুত কিন্তু এখন আমার কাছে আল্লাহর কালাম হতে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে আমি পারসী বংশোদ্ভুত এবং আমি এতে বিশ্বাসী। কেননা, আল্লাহ তাআলা যেভাবে বংশের বাস্তব অবস্থা জানেন, আর কেহ তা জানে না’’ (গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক রচিত আরবাঈনের হাসিয়া, ২ নম্বর ১৭ পৃ:) সে আরো বলেছে, আমি আমার পূর্ব পুরুষগণের জীবন চরিত সম্পর্কে লিখিত কোন কোন পুস্তকে পড়েছি যে, তারা মুঘল বংশের লোক। আমার পিতার কাছ থেকেও আমি এরূপ শুনেছি। কিন্তু আল্লাহ আমার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন যে, তারা তুর্কি বংশোদ্ভুত নহে। বরং পারসী বংশোদ্ভুত। আল্লাহ আমাকে আরো অবহিত করেছেন যে, আমার কোন কোন দাদি ফাতেমী ও রাসূল পরিবারের ছিলেন। (গোলামের ‘‘হাকীকাতুল ওহীর’’পরিশিষ্ট ৭৭ পৃ:) একদা তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, তুমি কেমন করে বল যে, তুমি মুঘল বংশের? তার পর এ থেকে ফিরে গিয়ে দাবিকর যে, তুমি পারসী বংশের? তোমার এ দাবির পিছনে কি প্রমাণ রয়েছে? উত্তরে সে বলে: ‘আমি যে পারসী বংশীয় এ ব্যাপারে আল্লাহর ইলহাম ব্যতীত আমার কাছে আর কোন প্রমাণ ব্যতিরকে পরিবর্তন করে বলে: মুহিউদ্দিন ইবনুল আরবী তার পুস্তক ‘ফুসুলুল হিকমে’ আমার সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে বলেছেন: শেষ জামানায় এমন একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে যে আল্লাহর দিকে লোকদের আহবান জানাবে, তার জন্ম স্থান হবে চীন দেশ এবং তার ভাষা হবে নিজ দেশীয়। আমিই সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি। কেননা, আমি মূলত: চীন বংশীয়। (গোলামের, হাকীকতুল ওহী, মূল পুস্তক ও টীকা, ২০০ পৃ:) শুধু তা-ই নহে, বরং অন্য এক স্থানে সে বলে ‘‘আমি ফাতেমী’’, রাসূল তনয় ফাতেমার রা. বংশধর এবং আমার বংশ ইসহাকের আলাইহিস সালাম উত্তরসূরি। (তুহফায়ে গলড়িয়া’’ ২৯ পৃ:) এটাই হল তার বংশ পরিচয়। যখনই তুমি তার বংশের উলটা পালটা বর্ণনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, সে উত্তরে বলবে, তাকে এভাবেই আল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন। মিথ্যাবাদীর মিথ্যা তার নিজের পরস্পর বিরোধী কথাবার্তাতেই ধরা পড়ে। মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে আসত তাহলে তোমরা এতে অনেক পার্থক্য পেতে’। [১সুরা নিসা-৮২] এরপর সে তার পিতা সম্পর্কে বলে- ‘রাজ দরবারে আমার পিতার জন্য একটা আসন সংরক্ষিত ছিল। তিনি ইংরেজ সরকারের খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। এমনকি তিনি ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহে (ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি বিখ্যাত গণ-আন্দোলন) সরকারকে উত্তম রূপে সাহায্য করেছিলেন। তিনি নিজের পক্ষ থেকে ৫০ জন সৈনিক ও ৫০ টি ঘোড়া সরকারকে জোগান দিয়েছিলেন। এমনি ভাবে, তিনি তার শক্তির ঊর্ধ্বে মহান সরকারের সেবা করেছেন। কিন্তু, এরপর থেকে আমার বংশের পতন ও অবনতি আরম্ভ হল। (সম্ভবত: তা দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা এবং যালেম কাফের উপনিবেশবাদের দালালির কারণে হয়েছিল।) এমনকি আমার পরিবার একটা দরিদ্র কৃষক পরিবারে পরিণত হয়ে যায়। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘তুহফায়ে কায়সারিয়া’’ ১৬ পৃ:) এ ধরনেরই একটি দরিদ্র, বিশ্বাস- ঘাতক, অজ্ঞাত পরিচয় বংশের পরিবারে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী জন্ম গ্রহণ করে। সে বলেছে: ‘আমি ১৯৩৯ বা ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে (পাঞ্জাবে) শিখ রাজত্বের শেষ দিকে জন্ম গ্রহণ করেছি’। (গোলাম কাদিয়ানীর কিতাবুল বারিয়া’’ ১৩৪ পৃ:)
তার শৈশব ও শিক্ষা:
যখন সে বোধশক্তি সম্পন্ন বয়সে পৌঁছে, তখন থেকে সে ছরফ, নাহু, আরবী, ফার্সী ও চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু পুস্তকাদি পড়তে শুরু করে। সে নিজেই উল্লেখ করেছে: যখন আমি বয়ঃপ্রাপ্ত হতে লাগলাম এবং যৌবনে পদার্পণ করলাম, তখন আমি কিছু ফার্সী, কিছু ছরফ, নাহুর পুস্তিকা, অন্যান্য শাস্ত্রের অল্প কিছু পুস্তিকা এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের অল্প কিছু পুস্তক পড়তে লাগলাম। আমার পিতা ছিলেন একজন বিজ্ঞ জ্যোতিষী। এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। এ সম্পর্কে কিছু পুস্তক তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি আমাকে উৎসাহিত করেন-----। তবে হাদীস, উসূল ও ফিকহ শাস্ত্রে আমার গভীর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয় নি। নামমাত্র কিছু পড়াশোনা করেছি। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আত-তাবলীগ ইলা মাশাইখিল হিন্দ’ ৫৯ পৃ:) সে আরো বলেছে আমি উস্তাদ ফজলে ইলাহীর কাছে কুরআন ও ফার্সী কিতাব সমূহ পড়েছি এবং ছরফ, নাহু ও চিকিৎসা শাস্ত্র উস্তাদ ফজলে আহমদের নিকট পড়েছি (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘কিতাবুল বারিয়া’ ১৩৫ পৃ:) তার কোন কোন শিক্ষক ছিলেন ভাং ও আফিমপায়ী। যেমন, তার ছেলে ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদ তার ভাষণে উল্লেখ করেছে, যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল-ফজলে প্রচারিত হয়েছে, ৫ই ফেব্রু: ১৯২৯ খৃ:। ‘তিনি ইংরেজি ভাষার প্রাথমিক পুস্তকগুলি শিয়াল কোটে অবস্থান কালে সরকারী কর্মচারীদের জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয়ে ডা: আমীর শাহকে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। জনাব (গোলাম) এ বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়তে আরম্ভ করলেন এবং সেখানে দু’একটি পুস্তক পড়লেন।’’ (গোলাম পুত্র বশীর রচিত ‘সীরাতুল মাহদী’ ১ম খন্ড ১৩৫পৃঃ) এ হল তার যাবতীয় শিক্ষা ও লেখা পড়ার বিবরণ। এ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় তারি বিভিন্ন প্রবন্ধ ও পুস্তকে। সে শুধু সুক্ষ্ণ জ্ঞানগর্ব বিষয়ে ভূল করেনি বরং সে সহজ ও সর্বজনবিদিত ঐতিহাসিক বিষয়েও ভীষণভাবে ভূল করেছে। যেমন সে বলেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের কিছুদিন পরেই তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘পয়গামে সুলাহ’’ ১৯ পৃ:) অথচ, ইসলামী ইতিহাস অথবা সীরাতের সঙ্গে যার সামান্যতম সম্পর্ক আছে, সে জানে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর পিতা তার জন্মের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘‘আইনুল মা’ রেফাত’’ নামক তার পুস্তকে সে আরো লিখেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এগারো জন পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন এবং সবাই মারা যান। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আইনুল মা’ রেফত ২৮৬ পৃ:) জানি না, সে তা কোত্থেকে গ্রহণ করেছে? কেননা, ইতিহাস এবং সীরাত আমাদের একথা বলে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এগারো জন সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছেন। বরং তাঁর শুধু চারজন ছেলে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন, তারা হলেন: তৈয়ব, তাহির, কাসিম ও ইব্রাহীম। খাদিজাতুল কুবরার রা. গর্ভে তিনজন এবং মারিয়া কিবতিয়ার রা.গর্ভে চতুর্থজন জন্ম গ্রহণ করেন। আর একবার সে লিখেছে, ‘‘প্রতিশ্রুত সন্তান ইসলামী মাসের চতুর্থ মাস অর্থাৎ সফরে জন্ম গ্রহণ করেছেন। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘তিরইয়াকুল কুলুব’’ ৪৩ পৃ:) বালকরা ও জানে যে, সফর মাস ইসলামী মাস সমূহের চতুর্থ মাস নহে, বরং দ্বিতীয় মাস। এরকম তার আরো অনেক ভুল ভ্রান্তি রয়েছে।
শৈশবে তার মধ্যে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল এই প্রথমত: তার কাপুরুষতা, দ্বিতীয়ত: তার বোকামী, তৃতীয়ত: পরের মাল ছিনতাই, চতুর্থত: তার বিভিন্ন প্রকার রোগ। বিখ্যাত কাদিয়ানী লিখক ইয়াকুব আলী কাদিয়ানী গোলামের সীরাতে উল্লেখ করেছে ‘‘ মাসীহ (গোলাম) কোনোরূপ প্রতিপক্ষের সহিত মোকাবিলায় ও কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেন নি, যেমন- তখনকার দিনের ভদ্র পরিবারের সন্তানদের অভ্যাস ছিল। সে সামরিক বিদ্যাও শিখিনি। অথচ লোকেরা এ সকল কাজকে ভদ্রতা ও বীরত্বের প্রতীক রূপে গণ্য করত।’’ (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘হায়াতুন নবী’ ১ম খন্ড১৩৮ পৃ:) আর তার ছেলে বশীর আহমদ তার সীরতে লিখেছে: ‘জনাব (গোলাম) একদা একটা মুরগির বাচ্চা জবাই করতে গিয়ে তার একটা আঙুল কেটে ফেললেন। ফলে হাত থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। তখন তিনি তওবা ইসতেগফার করতে লাগলেন। কেননা, তিনি তার জীবনে কখনও কোন প্রাণী জবাই করেন নি। (সীরাতে মাহদী, ২য় খন্ড, ৪পৃঃ) তার বোকামী সম্পর্কে তার ছেলে যা উল্লেখ করেছে: ‘‘আমার মা আমাকে বলেছেন, জনাব আববা-জান একদা তাঁকে বলেছেন- শৈশবে তাকে কয়েকজন বালক বলল- আমাদের জন্য ঘর থেকে কিছু চিনি নিয়ে আস। আমি ঘরে আসলাম এবং কাইকে কিছু জিজ্ঞেস না করে যেটাকে চিনি মনে করলাম তা গলায় পৌঁছে আটকে গেল তখন অত্যন্ত কষ্ট পেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, যা আমি চিনি মনে করছিলাম তা চিনি নয়, লবণ ছিল। (গোলাম পুত্র বশীরের সীরাতে মাহদী, ১ম খন্ড, ২২৬পৃঃ)তার এই ছেলে আরো যা উল্লেখ করেছে, তাতে এ লোকটির ব্যক্তিত্ব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। সে বলে: আমার মা (গোলামের স্ত্রী) আমাকে বলেছেন, মাসীহে মাওউদ তার যৌবন কালে একদা তার দাদার পেনশনের টাকা উঠাতে গেলেন এবং তার সাথে ‘‘ইমামুদ্দীন’’ নামে জনৈক ব্যক্তি গেলেন। যখন তিনি পেনশন উঠালেন, তখন ইমামুদ্দীন তাকে ফুসলিয়ে কাদিয়ানী বাহিরে নিয়ে গেল এবং তারা দু’জন এখানে ওখানে ঘুরতে লাগলেন। জনাব (গোলাম) যখন তার সব টাকা শেষ করে ফেললেন, তখন ইমামুদ্দীন তাকে একাকী ফেলে অন্যত্র চলে গেল। কিন্তু জনাব মসীহে মাওউদ? তিনি লজ্জা শরমের কারণে বাড়িতে ফিরলেন না, বরং তিনি শিয়ালকোট গিয়ে সামান্য বেতনে (যার পরিমাণ ছিল পনেরো টাকা) চাকুরি করতে লাগলেন। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানীর ‘‘সীরাতুল মাহদী’’ ১ম খন্ড, ২৪ পৃ:)
তার অসুখ বিসুখঃ
তার অসুখ খুব বেশি পরিমাণ ছিল। তার ডান হাত ভাঙ্গা ছিল। গোলাম পুত্র উল্লেখ করেছে: আমার মা আমাকে অবগত করেছেন যে, আমার পিতার (গোলামের) ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল এবং শেষ জীবন পর্যন্ত তার এ হাত দুর্বল ছিল। এ হাত দ্বারা তিনি খাবার উঠাতে পারতেন, কিন্তু পানির পাত্র বা অন্য কোন ভারী জিনিস উঠাতে পারতেন না এমন কি, নামাযের মধ্যে বাম হাতের উপরই ভর করতেন। (সীরাতুল মাহদী, ১ম খন্ড, ১৯৮ পৃষ্ঠা) তাঁর দাঁত সম্পর্কে তার ছেলে বলে: তাঁর দাঁতগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উহাতে পোকা ধরে ফেলেছিল। (সীরাতুল মাহদী, ২য় খন্ড, ১৩৫ পৃ:)
যক্ষ্মা:
ইয়াকুব আহমদ কাদিয়ানী লিখেছে: জনাব (গোলাম) তার পিতার জিবদ্দশায়ই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তার পিতা প্রায় ছয় মাস এর চিকিৎসা করেন। (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘‘হায়াতে আহমদ’’ ১ম খন্ড ৭৯ পৃ:) তার পুত্র বশীর আহমদ লিখেছে: জনাব মাসীহে মাওউদ তার পিতার জিবদ্দশায়ই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। (সীরাতুল মাহদী, ১ম খন্ড, ৪২ পৃ:)
বহুমূত্র এবং মাথা ঘুরানো:
নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী বলে: আমি দু’টি রোগে আক্রান্ত। প্রথম রোগটি আমার শরীরের উপরিভাগে এবং এটা হলো মাথা ঘুরানো। আর দ্বিতীয় রোগটি হলো আমার শরীরের নিম্ন ভাগে এবং সেটা হলো বহুমূত্র (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘হাকীকতুল ওহী’’ ২০৬ পৃ:) গোলাম আহমদের স্ত্রী তার মাথা ঘোরানোর সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে বলেন: ‘একদা জনাব মসীহের মাথা ঘুরানো আরম্ভ হলো, তখন তার দুই ছেলে ‘সুলতান আহমদ ও ফজল আহমদ’ কে ডাকা হয়। তারা দ্রুত ছুটে আসল। সুলতান আহমদ ভীত হয়ে তার খাটের পাশে বসে পড়ল এবং ফজল আহমদের মুখের রং বদলে গেল, সে এখানে ওখানে ছোটা ছুটি করতে শুরু করে। অতঃপর দু’পা তর পাগড়ি দ্বারা বেঁধে রাখে (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘‘সীরতে মাহদী’’ ১ম খন্ড ২২পৃঃ) গোলাম আহমদ নিজেই তাঁর মাথা ঘুরানো সম্পর্কে তার অবস্থা বর্ণনা করে বলে: মাথা ঘুরানোর তীব্রতা দেখা দিলে আমি কখনও কখনও মাটিতে পড়ে যাই এবং হৃৎপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন মন্থর হয়ে পড়ে। এ অবস্থা আমার জন্য খুবই বিপদ জনক ছিল (গোলাম কাদিয়ানীর ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ ৫ম খন্ড ২০১ পৃ:) কোন এক সময়ের কথা উল্লেখ করে তার স্ত্রী বলেছে: ‘একদা গোলাম আহমদ নামাজের জন্য মসজিদে গেলেন এবং নামাজ আরম্ভ করেন। কিছুক্ষণ তিনি দেখলেন যে, কাল কিছু তার চক্ষু-দ্বয় থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। এতে তিনি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তারপর থেকে তিনি ইমামতি করেন নি। (সীরতে মাহদী, ১ম খন্ড ১৩ পৃ:)
এরপর থেকে তার মাথা ঘুরানো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। এ জন্য তিনি তার জীবনের অধিকাংশ রমযান মাসে রোযা থাকতে পারেন নি। যেমন, তার ছেলে তার সীরতে উল্লেখ করেছে। (সীরতে মাহদী ১ম খন্ড ৫১ পৃ:) গোলাম আহমদ তার ১ম খলীফা নুরুদ্দীনের নিকট লিখিত এক পত্রে তার পুরুষত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে: ‘আমি মনে করি আমার মস্তিষ্ক যে পরিমাণ দুর্বল তোমাদের তেমন নহে। আর যখন আমি বিবাহ করি তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি পুরুষ নই’’। (নুরুদ্দীনের কাছে গোলামের পত্র যা তারি পত্রাবলির সমষ্টি ‘মাকাতিবে আহমদীয়া’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড ১৩ নং।) উল্লেখ্য যে, তার বয়স যখন পনেরো বা ষোলো ছিল, তখন তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। (মঞ্জুর কাদিয়ানীর ‘‘মঞ্জুরে ইলাহী’’ ৩৪২ পৃ:)। সে স্নায়ুবিক দুর্বলতায় আক্রান্ত ছিল, যার ফলে তার স্মরণ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ইহা সে বিভিন্ন লোকের কাছে লিখিত পত্রে উল্লেখ করেছে। যেমন- আমি স্নায়ুবিক দুর্বলতায় আক্রান্ত। এজন্য আমি ঠান্ডা ও বৃষ্টি সহ্য করতে পারি না।’’ (গোলামের পত্রাবলি যা ‘মাকতুবাতে আহমদীয়ার অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড, ২ নম্বর।) আমার স্মরণ শক্তি অতিশয় দুর্বল। কোন কোন লোকের সাথে আমার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু কিছু দিন পরই তার সাথে যে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল তা ভুলে যাই। আমার এ অবস্থা অবর্ণনীয় (মাকতুবাতে আহমদীয়া, ৫ম খন্ড ৩ নম্বর)।
তার চোখ দু’টি দুর্বল ও রুগ্ন ছিল। এমনকি সে উহা পুরোপুরি খুলতে পারত না। তার ছেলে লিখেছে: ‘একদা জনাব (গোলাম) তার কোন মুরীদের সঙ্গে ফোটো উঠাতে চাইলেন। তখন ফটোগ্রাফার তাকে একটু চোখ খুলতে বলল, যাতে ফোটোটা ঠিক মত উঠে। জনাব অতি কষ্টে চক্ষু খোলার চেষ্টা করলেন , কিন্তু খুলতে পারলেন না (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘সীরতে মাহদী’ ২য় খন্ড ৭৭ পৃ:)। শেষ বয়সে লোকটি এত অধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, যদি তাকে রোগ সমূহের সমষ্টি বলা হয়, তবে উহা বাস্তবের পরিপন্থী হবে না। তিনি ‘মুরাক; রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং এটা এক প্রকার ‘মালীখুলীয়া’। ডাঃ আল্লামা বুরহানুদ্দীন ‘শরহুল আসবাব অল আলামাত ’ গ্রন্থে মাথার রোগ সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘মুরাক’ রোগটি এক প্রকার ‘মালীখুলীয়া’। (শরহে আসবাব, ১ম খন্ড ৭৪ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে সে মুরাক রোগে আক্রান্ত ছিল। আর তার মূল ভাষ্য হল: ‘জনাব মসীহে মাওউদ মস্তিস্কের দুর্বলতার কারণে মুরাক রোগে আক্রান্ত ছিলেন । (কাদিয়ানী ম্যাগাজিন ‘রিভিউ অব রিলিজিউন্স, আগস্ট, ১৯২৬ খৃ: গোলাম আহমদ নিজেই বলেছে, ‘আমি মুরাক রোগে আক্রান্ত। ’ কাদিয়ানী পত্রিকা আল হিকম’ যা ৩১ শে অক্টোবর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত।)
কাদিয়ানী চিকিৎসক ড: শাহ নেওয়াজ গোলাম আহমদের রোগ সমূহের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: আমাদের হুজুরের রোগ সমূহ যথা-মাথা ঘুরানো, মাথা ব্যথা, স্বল্প নিদ্রা, ক্ষুধা মন্দা, হৃৎপিন্ডের দুর্বলতা, দাস্ত, বহুমূত্র, মুরাক ইত্যাদি এগুলোর একমাত্র কারণ ছিল দুর্বলতা । (ড: শাহ নেওয়াজ কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা রিভিউ ম্যাগাজিনে প্রচারিত, মে, ১৯৩৭ খৃ:)
গোলাম আহমদ বলেছে: ‘আমি চির রোগী’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘নাসীমে দাওয়াত’ ৬৮ পৃ:) সে আরো লিখেছে ‘আমি এ সমস্ত রোগের কারণে অক্ষম হয়ে পড়েছি; এমনকি দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পারি না। কথনও নামায পূর্ণ করার পূর্বেই ভেঙে ফেলি। বর্তমানে এমন হয়ে পড়েছি যে, বসেও নামায পড়তে পারি না। (গোলামের পত্র ‘মাকতুবাতে আহমদীয়ার অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড ৮৮ পৃ:)
উপরন্তু আল্লাহ তা’ আলা তার উপর ‘হিষ্ট্রিয়া’ নামক এক মারাত্মক রোগ চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তার ছেলে বশীর আহমদ বলেছে: ডাঃ মুহাম্মদ ইসমাইল কাদিয়ানী আমাকে বলেছেন যে, জনাব মসীহ ‘হিষ্ট্রিয়া’ রোগে আক্রান্ত। (সীরতে মাহদী ২য় খন্ড ৫৫ পৃ:) এমনি ভাবে বশীর আহমদ তার মার কাছ থেকে বর্ণনা করছে যে, তার মা তাকে অবহিত করেছেন: জনাব (গোলাম) তার পুত্র প্রথম বশীরের মৃত্যুর পর হিষ্ট্রিয়া রোগে আক্রান্ত হন (সীরতে মাহদী ১ম খন্ড, ১৩ পৃ:) মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন: ‘‘নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে পরকালীন শাস্তির পূর্বে দুনিয়ার কিছু শাস্তির স্বাদ ভোগ করাব। যাতে তারা তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসে’। [১ সুরা সিজদা- ২০]
তার খ্যাতি ও দাওয়াতের সূচনা:
প্রথম অবস্থায় গোলাম আহমদ একজন মাযজুব (ধ্যানে আত্মহারা) ও ইসলামের প্রতিরক্ষাকারী রূপে প্রকাশ পায়। সে যখন শিয়াল কোটের চাকুরি ছেড়ে দিল এবং বেকার হয়ে পড়লে, তখন নে হিন্দু এবং খ্রিস্টানদের বই পড়তে শুরু করে, কারণ, তখনকার দিনে ভারত বর্ষে মুসলিম উলামা এবং খ্রিস্টান ধর্মজাযক ও হিন্দু পন্ডিতদের মধ্যে আকীদা বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে বাছ, মুনাযারা ও তর্ক-বিতর্ক চলছিল। সাধারণ মুসলমানগণ উলামা ও মুনাযারা বিশারদগণকে সম্মান দিত এবং নিজের জান-মাল দ্বারা যথাসাধ্য খেদমত করত। অর্ধ শতাব্দী পূর্বে পৃথিবীর সকল অঞ্চলে মুসলমানদের এ অবস্থা ছিল। গোলাম আহমদ এটাকে তার নিজের জন্য সহজ ও সম্মানজনক কাজ মনে করল। আর, যে ধন-সম্পদ চাকুরির দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নহে তা এর দ্বারা অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করল । তাই, সর্ব প্রথম সে হিন্দুদের বিরুদ্ধে একটা ঘোষণা প্রচার করল। পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে কিছু প্রবন্ধ লিখল। এরপর সে ধারাবাহিক হিন্দু ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ঘোষণা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করতে থাকে। এতে মুসলমানগণ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
(তা ১৮৭৭ ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা) তারপর সে ঘোষণা দিল যে, পঞ্চাশ ভলিয়মের একখানি পুস্তক সে রচনা করছে। কাফেরগণ ইসলামের বিরুদ্ধে যে সমস্ত আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করে উহাতে সে তার জবাব দেবে। তাই, যথা সময়ে বইটি ছাপানোর জন্য অগ্রিম মূল্য প্রদান করে এতে অংশ গ্রহণ করা মুসলমানগণের কর্তব্য সুতরাং তার ভ্রান্ত দ্বাবী ও উত্তেজনা মূলক ঘোষণা-বলী দ্বারা সাধারণ মুসলমানগণ এ ধোঁকায় পড়ে যান যে, সত্যই সে পঞ্চাশ ভলিয়মের এমন একটি কিতাব ছাপাবে যাতে ইসলামের ও মুসলমানদের উপর হিন্দু ও খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত সকল অভিযোগ আপত্তি খন্ডন করে ঐ গুলোর উত্তর দেবে? এসময়ে সে তার কেরামত ও মিথ্যা সাজান কাশ্ফ সমূহের ঘোষণা দিতে লাগল। ফলে মূর্খ লোকেরা মনে করল যে, সে মধু একজন আলেমই নহে বরং একজন মজযুব এবং আল্লাহর ওলী । তাই, কিতাবটি ছাপানোর জন্য তারা ওর কাছে প্রচুর পরিমাণ টাকা পাঠাতে লাগল। (গোলামের ঘোষণা বলী দ্রষ্টব্য, যা তাবলীগে রিসালাতের অন্তর্ভুক্ত, যা গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণা বলীর সমষ্টি। ১ম খন্ড ২৫ পৃ: এবং তাবলীগে রিসালত ২য় খন্ড এবং ১ম খন্ড ১৩ পৃ:) অতএব সে ১৮৮০ সনে পুস্তকটির ১ম খন্ড প্রকাশ করে এবং উহার নাম দেয় ‘‘বারাহীনে আহমদীয়া’’ এ খন্ডটি ঘোষণা বলী , প্রচারপত্র, তার কেরামত ও কাশফ দ্বারা পরিপূর্ণ। অতঃপর সে ২য় খন্ড প্রকাশ করে যা প্রথমটির মতই ছিল। এই ভাবে সে ১৮৮২ সনে ৩য় খন্ড এবং ১৮৮৪ সনে ৪থ খন্ড প্রকাশ করে। (বারাহীনে আহমদীয়ার ভূমিকা ১ম ২য় ৩য় ও ৪থ খন্ড, ) লোকের কাছে কিতাবটি পৌঁছার পর সকলেই আশ্চর্যান্বিত হল যে, এতে শত্রু পক্ষের আপত্তি ও সন্দেহাবলীর উল্লেখ করার পরিবর্তে তার নিজস্ব কেরামত ও কাফের উপনিবেশবাদের প্রশংসা পৃষ্ঠাগুলো ভরপুর করে দিয়েছে। এতে উলামা সমাজ বুঝতে পারলেন যে, লোকটি প্রতারক ও লুটেরা ব্যতীত আর কিছু নহে। সে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তার ঘোষণা বলী ও প্রচারপত্র সমূহ দ্বারা মুসলমানদের শোষণ করতে এবং সম্পদ, সম্মান ও খ্যাতি অর্জনকরতে চেয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত এবং তাদের শত্রুর প্রতিরোধ করা তার উদ্দেশ্য নহে। বিশেষ করে যখন তারা ইসলামের বুনিয়াদের বিপরীত তার কিতাবের বর্ণনা-বলীর উপর অবহিত হলেন, তখন অনেক আলেম ভবিষ্যদ্ব্যাণী করলেন যে, ইসলামের নামে দোকান তৈরি করা ছাড়া লোকটির আর কোন উদ্দেশ্য নেই। যদি কেহ তাকে এর চেয়ে অধিক দান করে এবং তার জন্য বড় দোকান তৈরি করে দেয়, তবে সে ইসলামের বিরোধিতা করে হলেও সেই ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়বে। তারা যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন তেমনটিই ঘটেছে কেননা, ইংরেজরা তখন মুসলমানদের বিদ্রোহ এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। তারা মুসলমানদের মধ্যে এমন লোক খুঁজছিল, যাদের মুসলিম সমাজে খ্যাতি রয়েছে। এদেরকে তারা এজেন্ট নিযুক্ত করবে। যখন সাম্রাজ্যবাদীরা এমন পরিবারের একটি লোক পেল, যে তাদের এজেন্ট হিসাবে বিখ্যাত ছিল, তখন তারা এর সুযোগ গ্রহণ করল। এ জন্য গোলাম আহমদ উক্ত কিতাবের তৃতীয় খন্ড ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের প্রশংসায় পরিপূর্ণ করে দেয়। যখন এ ব্যাপারে মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপত্তি উত্থাপন হল, তখন সে বলল- ‘‘কোন কোন মুসলমান আমার কাছে লিখেছে যে, আমি তৃতীয় খন্ডে ইংরেজ সরকারের প্রশংসা এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম কেন? কোন কোন মুসলমান এ প্রশংসার জন্য আমাকে গালমন্দও করেছেন। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য উচিত , আমি কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার অনুসরণে এ সরকারের প্রশংসা করছি (হে আল্লাহর শত্রু! তুই মিথ্যা বলছিস। কেননা, ইসলাম কোন কাফের সাম্রাজ্যবাদী ও জবর দখলকারী সরকারের প্রশংসা করার শিক্ষা দেয় না।) এজন্য আমি বাধ্য হয়ে এ সরকারের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। (গোলামের ঘোষণা যা ‘বারাহীনে আহমদীয়ার চতুর্থ খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।) )
মোটকথা, সাম্রাজ্যবাদ তাকে অস্ত্রস্বরূপ গ্রহণ করেছে এবং সমুদয় উত্তম ও মূল্যবান বস্ত্ত তার নিকট পেশ করেছে। তাই, তার পিতা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে যেমন বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল সেও তেমনি করল। তবে প্রথম বিশ্বাস ঘাতকতা ছিল তার দেশ ও দেশবাসীর প্রতি এবং দ্বিতীয়টি হল তার ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি। ফলে, সে সাম্রাজ্যবাদীদের মতবাদ এবং নির্দেশাবলী পালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৮৮৫ সনে তার প্রথম ঘোষণা ছিল যে, সে একজন মুজাদ্দেদ। ১৮৯১ সনে সে দাবি করল যে, সে প্রতিশ্রুত ‘মাহদী’’ আর ঠিক ঐ বৎসরই সে দাবি করল সে প্রতিশ্রুত ‘‘মাসীহ’’। তবে সে অনুসারী নবী। তারপর সে ১৯০১ সনে ঘোষণা দিল যে, সে স্বয়ং সম্পূর্ণ নবী এবং সকল নবী রাসূলগণের মধ্যে উত্তম। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকেরা তার নবুয়তের দাবির পূর্বেই বুঝে নিয়েছেন যে, সে এটাই চায়। কিন্তু প্রথমে সে কঠোরভাবে ইহা অস্বীকার করে বলে যে, আহলে সুন্নাহর যে আক্বীদা, আমি ও সেই আক্বীদা পোষণ করি। আমি বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এসে শেষ হয়ে গেছে (গোলামের ঘোষণা ২১শে অক্টোবর ১৮৯১ খৃ: যা তাবলীগে রেসালত ২য় খন্ড ২য় পৃ: অন্তর্ভুক্ত)। তারপর সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনায় আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলে- ‘আমি নবী নই, তবে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে নবায়নকারী ‘কালীম’ বানিয়েছেন; যাতে, আমি দ্বীনে মুস্তফার নবায়ন করতে পারি। (গোলাম রচিত ‘মেরাতে কামালাতে ইসলাম’ ৩৮৩ পৃ:) ধীরে ধীরে সে বলতে আরম্ভ করল, ‘আমি নবী নই, তবে আমি ‘মুহদাস’। নবী হওয়ার যোগ্যতা রাখে, তবে কার্যত: সে নবী নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘হামামাতুল বুশরা’’ এর সারাংশ, ৯৯ পৃ:) অতঃপর সে বলে: ‘মুহদাস হল অসম্পূর্ণ নবী । সে যেন নবীগণ ও উম্মতগণের মধ্যে পুলের ন্যয় যোগসূত্র’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘এজালাতুল আওহাম’ ৫২৯ পৃ:) অতঃপর সে বলে আমি ঐ মাসীহ যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়ে গেছেন। (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘এজালাতুল আওহাম’ ৮৩ পৃ:)
পরিশেষে বলে ‘ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তিনিই আমাকে প্রেরণ করেছেন এবং আমাকে নবী নামে অভিহিত করেছেন। আর আমার দাবির সত্যতা প্রমাণে তিন লক্ষ নিদর্শনা বলী প্রকাশ করেছেন’ । (গোলামের হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, ৬৮ পৃ:) অথচ সে নিজেই ইতিপূর্বে বলেছে যে, ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবি করবে সে মুসাইলামা আল কাজ্জাবের ভাই এবং কাফের ও খবীছ’’ (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ ২৮ পৃ:) আরো সে বলেছে- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুয়তের দাবি করবে, তাকে আমরা অভিশাপ দেই। (গোলামের ঘোষণা যা ‘তাবলীগে রেসালাতের’ অন্তর্ভুক্ত, ৬ষ্ট খন্ড ২য় পৃ:) এভাবে নবায়নের দাবি হতে তার প্রচারের সূচনা হয় এবং নবুয়তের দাবিতে গিয়ে সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, যে কিতাবের পঞ্চাশ খন্ড প্রকাশ করার জন্য সে ঘোষণা দিয়েছিল উহার মাত্র পাঁচ খন্ড প্রকাশ করেছে। যখন চাঁদা দাতাদের পক্ষ থেকে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে উত্তর দিল- ‘পাঁচ ও পঞ্চাশের মধ্যে শুধু একটা বিন্দুর পার্থক্য। (গোলামের ‘বারাহীনে আহমদীয়ার’ ভূমিকা, ৫ম খন্ড ৭পৃঃ)
তার চাল-চলন ও চরিত্র:
কাদিয়ানীদের এ নেতা ও ভন্ডনবী চারিত্রিক দৃষ্টি কোন থেকে নজির বিহীন ছিল। এমন কোন গাল-মন্দ নেই যা সে জানে না এবং তার প্রতিপক্ষ ও বিরোধীর প্রতি সে তা ব্যবহার করেনি। একদা সে কোন এক ব্যক্তির নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে সে ব্যক্তি ঐ নির্দিষ্ট সময়ে মারা যায়নি। তখন তাকে কোন কোন আলেম জিজ্ঞাসা করলেন যে, তুমি নবী বলে দাবিকর এবং আল্লাহর ওহী ব্যতীত কথা বল না তবে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না হওয়া কেমন করে সম্ভব হয়? তখন দলীল প্রমাণ সহ তাদের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে সে তাদেরকে এবং সমস্ত মুসলমান আলেমদেরকে গালি দিতে শুরু করে। তার ভাষ্য ছিল এরূপ- ‘পৃথিবীতে শুকর হতে অপবিত্র আর কিছু নেই, কিন্তু ঐ সকল আলেম যারা আমার বিরোধিতা করে তারা শুকর হতেও অপবিত্র। হে আলেমগণ! হে মৃতদেহ ভক্ষণ কারী গণ এবং হে অপবিত্র আত্মার অধিকারীগণ! (গোলামের আঞ্জামে আথম, ২১ পৃ:) সে আরো বলে: ‘হে দুর্ভাগা অপবাদ কারী গণ! জানি না, এ অসভ্য দল লজ্জাবোধ করে না কেন? তাদের চেহারা কাল করে দেয়া হবে’। (গোলাম কাদিয়ানীর আঞ্জামে আথম ৫৮ পৃ:) সে তার বিরুদ্ধবাদীদের এই বলে গালি দেয় যে, ওদের কেহ কেহ কুকুরের ন্যায়, কেহ নেকড়ে বাঘের ন্যায় এবং কেহ শুকরের ন্যায় ।’ (গোলামের ‘খুৎবায়ে ইলহামিয়া’ ১৫০পৃঃ) তার শত্রুদেরকে ব্যাপকভাবে এ সকল গালি দিয়েও সে সন্তুষ্ট হয়নি, বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তাদের নাম উল্লেখ করে গালি দিতে থাকে। যেমন বলেছে- ‘হে আব্দুল হক নামী শয়তানের গোলাম! তোর মৃত্যু হোক।’’ (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ ৫৮ পৃ:) সে আরো বলে: আব্দুল হক আমাদের বিজয় সহ্য করতে পারে নি। কেননা, তার আগ্রহ সে যেন জারজ সন্তানে পরিণত হয়।’ (গোলামের ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ ৩০ পৃ:) তার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে সা’দুল্লাহ নামী এক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সম্মুখে সে তার নিজ চরিত্র প্রকাশ করে বলে ‘হে প্রেত, উতর, পাপিষ্ঠ, শয়তান, অভিশপ্ত আহাম্মকের বীর্য, খবীস, মুফসেদ, মিথ্যাবাদী, হতভাগা ও বেশ্যার পুত্র! (আল্লাহ পানাহ, আল্লাহ পানাহ, কাদিয়ানীদের নবীর এমন উক্তি হতে) (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ ২৮১ পৃ:) প্রসিদ্ধ মুনাযির তর্কবাগিশ শেখ ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে এই বলে সম্বোধন করে- ‘হে কুকুর, হে মৃতদেহ ভক্ষণকারী, ! (আঞ্জামে আথম’ এর টিকা, ২৫ পৃ:) আরো সম্বোধন করে- ‘হে আবু জাহেল হে কাকতাড়ুয়া সন্তান ও বিশ্বাস ঘাতক!’ (গোলামের ‘এজাজে আহমদী’ ৪৩ পৃ:) ভারতবর্ষের জনৈক শাইখে তরী-কতকে সে এই বলে সম্বোধন করে- ‘মিথ্যুক, অপবাদকারী, খবীছ, বিচ্ছু এবং হে কুলরা ভূমির কীট! (যা এই শেখের বাসস্থান) তোর উপর আল্লাহর অভিশাপ! ইবলিসের কারণে তুই অভিশপ্ত হয়েছিস। তুই হল গুমরাহীর শেখ, ও হতভাগা’। (গোলামের ‘নুযুলুল মাসীহ’ ৭৫ও ৭৬ পৃ:)
একটি আরবী কবিতার কলিতে সে তার সকল শত্রুর উল্লেখ করে বলে:-
(সকল শত্রুরা মাঠের শুকর হয়ে গেছে।
আর তাদের নারীগণ তাদের সম্মুখে কুকুরীর ন্যায়।)
(গোলামের ‘নজমুল হুদা’ ১০ পৃ:)
কাদিয়ানী নবী এর চেয়ে অধিক এমন সব গাল মন্দ উচ্চারণ করত যা কান শুনতে চায় না এবং মুখও উচ্চারণ করতে চায় না। বিশেষ করে ঐ সকল গাল-মন্দের ব্যবহার যা ইসলামী আইনে অপবাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং একজন সাধারণ লোকও তা উচ্চারণ করতে ঘৃণাবোধ করে। একদা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ‘তুই জারজ সন্তান’ বলে গালি দিতে শুনে বলল: ওমর রা. এর সময়ে এরূপ গালির উপর অপবাদের শাস্তি হিসাবে কোড়া মারা হত। কিন্তু আজ কাল এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে জারজ সন্তান বলে গালি দিতে শুনেও লোকেরা কোন সাড়া দেয় না, এ গালিটি যেন তাদের কাছে কিছুই নহে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ‘জুমআর খুতবা’ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলের অন্তর্ভুক্ত, ১৩ই ফেব্রু: ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত) অতএব হে গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ! তোমার পিতা সম্পর্কে তুমি কি বল? যখন সে কোন মুসলমান আলেমকে এই বলে গালি দেয় ‘তুমি তোমার অপবিত্রতার দ্বারা আমাকে কষ্ট দিয়েছ। হে নর্তকীর ছেলে! তুই যদি অপদস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ না করিস, তাহলে আমি সত্য নবী নই’। (গোলামের আঞ্জামে আথম ৮৮ পৃ:) তোমার পিতা এবং তোমার নবী, যার তুমি খলীফা, বল তো সে কোড়ার উপযুক্ত হলো কি না?
ভন্ডনবী কাদিয়ানীর ভান্ডারে এরূপ গাল-মন্দ অনেক রয়েছে। সে তার বিরুদ্ধবাদীগণকে প্রায়শ: বলত: ‘অমুক হারামজাদা, অমুক বেশ্যার সন্তান।’ উম্মতের অনেক বিশিষ্ট লোক ও নেতাদেরকে সে এরূপ অশ্লীল গাল-মন্দ দিয়েছে। একদা সে সমস্ত উম্মতকে তার অদ্ভুত শব্দাবলি দ্বারা সম্বোধন করেছে: ‘এ সকল পুস্তকাদির প্রতি সকল মুসলমান ভালোবাসার চোখে দেখবে এবং উহার মারেফত থেকে উপকৃত হবে, আর, আমাকে গ্রহণ করবে এবং আমার দাওয়াত বিশ্বাস করবে, কিন্তু বেশ্যার সন্তানরাই বিশ্বাস করবে না, যাদের অন্তরের উপর আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন’। (গোলামের ‘মেরাতু কামালাতিল ইসলাম’ ৫৪৭ পৃ:) মুসলমানদের একজন শ্রেষ্ঠ আলেমকে সে এই বলে গালি দিয়ে বলে: ‘তুমি ঐ ভাবে নর্তন করছ যেমন নর্তকীরা মঞ্চে নর্তন করে। (গোলামের ‘হুজ্জাতুল্লাহ’ আরবী ৮৭ পৃ:) একজন খ্রিস্টান ব্যক্তিকে সে গালি দিয়ে বলে: ‘এটা হল জারজ সন্তানের লক্ষণ যে, সে সঠিক পথে চলে না।’ (গোলামের ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ ৩০ পৃ:) আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে এই বলে গালি দেয়: ‘তারা জারজ সন্তান এবং হীন স্বভাবের লোক।’ (গোলামের ‘আরিয়া ধর্ম’ ৫৪ পৃ:)
এই হল কাদিয়ানী নবীর চরিত্রের সাধারণ নমুনা। অন্যথায়, সে এ ব্যাপারে সকল সীমা লঙ্ঘন করেছে। এ ব্যাপারে তার কোন জুড়ি নেই। এমন কোন লোক কি পাওয়া যাবে? যে পূর্ণ চারটি পৃষ্ঠা শুধু লা‘নত লিখে কালো করেছে। হ্যাঁ সে-ই ঐ ব্যক্তি! যে তার একটি পুস্তকের পূর্ণ চারটি পৃষ্ঠা ‘লা‘নত’ শব্দ লিখে কালো করেছে। সে তার বিরুদ্ধবাদীদের উপর লানত লানত লানত এ শব্দটিকে এক হাজার বার লিখেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘নুরুল হক’ ১১৮-১২২ পৃ: দেখুন।) খ্রিস্ট ধর্মের একজন লোকের উপর হাজার বার লানত করেছে। (তাবলীগে রেসালত) তার পুস্তকাদিতে এ জাতীয় গাল-মন্দের ব্যবহার অনেক। এমনকি কোন লোক আছে যে, নবীগণকে গালি দেয়? হ্যাঁ! ভন্ডনবী কাদিয়ানীই আল্লাহর নবী ঈসাকে আলাইহিস সালাম গালি দিয়ে বলে: ‘ঈসা তার নিজের ব্যাপারে একথা বলতে পারেনি যে, তিনি সৎ। কেননা, লোকেরা তাকে মদ্যপায়ী এবং বদ চরিত্র বলে জানত। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘চিত্তে ভজনের’ টীকা ১৭২ পৃ:) সে আরো বলে: ঈসা আলাইহি সালাম বেশ্যাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন।’ কেননা, তাঁর মাতামহীগণ বেশ্যা ছিলেন। (আল্লাহ পানাহ) (গুলমের ‘আঞ্জামে আথম’ এ পরিশিষ্টের টিকা, ৭পৃঃ)
আশ্চর্যের বিষয়, এরকম অশালীন ও অভিশপ্তকারী ব্যক্তি দাবিকরে যে, সে নবী। সে নিজেই বলেছে: ‘‘গাল-মন্দ করা ছিদ্দকগণের কাজ নহে । আর, মুমিন ব্যক্তি অভিশপ্তকারী হতে পারে না’’ । (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ৬৬ পৃ: আবার তার ছেলে বলেছে: মানুষ যখন পরাজিত হয়ে যায় এবং তার দাবির সমর্থনে কোন প্রমাণ পায় না, তখনই গালাগালি আরম্ভ করে। আর, যত বেশি সে গালাগালি করবে, তার পরাজয় তত বেশি প্রমাণিত হবে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ‘আনওয়ারুল খেলাফত’ ১৫পৃঃ) ক্রিমিনাল আদালতের দুইজন বিচারক কাদিয়ানী ভন্ডনবীকে দোষী সাব্যস্ত করে বলেছেন যে, সে (গোলাম) অসচ্চরিত্র, অশালীন ভাষা এবং অশ্লীল শব্দ প্রয়োগকারী। তার কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, সে যেন তার বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি পুনরায় এরূপ শব্দাবলি প্রয়োগ না করে । গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে এ অঙ্গীকার করেছে। সে এর উল্লেখ করে বলে: ‘আমি নায়েবে হাকীমের সম্মুখে অঙ্গীকার করেছি যে, আমি এরপর এ ধরনের অশ্লীল শব্দাবলি আর ব্যবহার করব না।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘কিতাবুল বারিয়্যহ’ ভূমিকা, ১৩ পৃ:)
এই হল চারিত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাদিয়ানী নবীর স্বরূপ এবং তার গালিগালাজ। আমরা তার নিজ পুস্তক ও ভাষা হতে এখানে কিছুটা উল্লেখ করলাম।
তার আচার-ব্যবহার:
তার লেন দেনের অবস্থা এই যে, সে একটি ঘোষণা প্রচার করল: ‘আমার সকল অনুসারীদের উপর কর্তব্য হলো তারা যেন প্রত্যেক মাসে তাদের মালের একটা অংশ আমার কাছে পাঠায় । এ ঘোষণার পর আমি তিন মাস অপেক্ষা করব। যে ব্যক্তি এ সময়ের মদ্যে তার কিছু মাল আমার কাছে পাঠাবে না, আমার মুরিদগণের তালিকা হতে তার নাম মুছে ফেলব’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘লাওহুল মাহদী’ ১ম পৃ:) আর একবার সে ঘোষণা দিল: কাদিয়ানী ধর্মের জন্য সকলের কিছু দান করা উচিত। কারণ, টাকা পয়সা ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নহে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে, মুসা আলাইহিস সালাম ঈসা আলাইহিস সালাম এবং অন্য সকল নবীর যুগে এভাবে দানের টাকা একত্রিত করা হয়েছে। তাই এ দিকে আমার জামাতের লক্ষ্য করা কর্তব্য এবং সম্ভাব্য দান সমূহ একত্রিত করা উচিত’। (গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদরে প্রকাশিত’ ৯ই জুলাই, ১৯০৩ খৃ:) ‘‘খেদমতে ইসলাম’’ নাম দেওয়ার কারণে লোকেরা তার কাছে বড় বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু এ টাকা গুলো কোথায় ব্যয় করা হল ? এ প্রশ্নের উত্তরে একজন বিশিষ্ট কাদিয়ানী নেতা বলে: একদা আমি, খাজা কামালুদ্দীন (কাদিয়ানীদের অন্যতম নেতা) ও অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী (লাহোর কাদিয়ানী জামাতের আমীর) চাঁদা আদায় করতে গেলাম। রাস্তায় অধ্যাপক খাজা কামালুদ্দীন আলোচনা করতে লাগলেন যে প্রথম প্রথম আমরা লোকজনকে বলতামঃ আম্বিয়া এবং সাহাবাগণের মত জীবন অবলম্বন করা আমাদের উচিত এবং তারা যেরূপ কাজ করে গেছেন তদ্রুপ আমাদের কাজ করা উচিত। তারা মোটা কাপড় পরিধান করতেন এবং মোটা ভাত খেতেন। আর, আল্লাহর রাস্তায় তাদের ধন সম্পদ ব্যয় করতেন। আমরা এ সকল কথা বলতাম এবং লোকজন থেকে এমনকি আমাদের মহিলাদের থেকেও চাঁদা আদায় করে কাদিয়ানে পাঠাতাম। কিন্তু এর পর যখন আমাদের স্ত্রী গণ ও অন্যান্যদের স্ত্রী গণ কাদিয়ানে গেলেন, তখন তারা ওখানকার অবস্থা দেখে রাগান্বিত হয়ে ফিরে আসলেন এবং বললেন তোমরা বড়ই মিথ্যাবাদী। আমরা নিজ চোখে নবী ও সাহাবীদের জীবন যাপন দেখে এসেছি, তাদের স্ত্রী ও মহিলাদের দেখলাম খুবই প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। বাহিরে এর দশ ভাগের এক ভাগও দেখা যায় না। অথচ টাকা পয়সা তাদের জন্য পাঠান হয় না বরং আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য পাঠান হয়। আমরা চাইলে এ সম্পদ নিজেদের জন্য ব্যয় করতে পারতাম। কেননা, আমাদের এ সম্পদ হালাল উপায়ে আমরাই অর্জন করেছি । সুতরাং এরপর আর কিছুই আমরা দান করব না। (কাদিয়ানী মুফতি ছরওয়ার শাহ লিখিত ‘কাশফুল ইখতিলাফ’ ১৩ পৃ:) গোলাম পুত্র এ বাস্তব সত্যকে কাদিয়ানী প্রদত্ত তার জুম আর খুতবায় স্বীকার করেছে যে, ‘‘লুদিয়ান নিবাসী’’ (ভারতের একটি শহর) এক ব্যক্তি একদা বলেছে আমরা অতি কষ্টে এবং দুরবস্থায় কাদিয়ানে চাঁদা পাঠাই, আর সেখানে এ টাকা গুলো গোলাম আহমদের স্ত্রীর অলংকারাদি এবং পোশাক পরিচ্ছেদে ব্যয় করা হয়। সুতরাং এ সমস্ত চাঁদা দিয়ে লাভ কি? যখন এ সংবাদ মাসীহে মাওউদের কাছে পৌঁছোল তখন সে বলল: এর পর আমাদের কাছে কিছু প্রেরণ করা ঐ ব্যক্তির জন্য হারাম। অতঃপর আমরা দেখব এতে আমাদের কি ক্ষতি হয়। (গোলাম পুত্র ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে’ প্রকাশিত, ৩১ আগস্ট ১৯৩৮ খৃ:) একবার যখন ভন্ডনবী কাদিয়ানীর উপর এ আপত্তি উঠল যে, ধর্মের নামে যে সমস্ত চাঁদা আদায় করা হয়, তা সে তার নিজের ও তার স্ত্রী গণের জন্য ব্যয় করে ফেলে। তাই , লোক সম্মুখে এর হিসাব প্রকাশ করা উচিত। উত্তরে সে বলল- আমি কোন ব্যবসায়ী নই যে, আমার নিকট উহার হিসাব রাখব এবং জমিয়তের কোষাধ্যক্ষও নই যে, উহার হিসাব দিব আমি জমিনে আল্লাহর প্রতিনিধি। তাই, আমার নিকট এ জিজ্ঞাসা করা সম্ভব নয় যে, আমি উহা কোথায় খরচ করেছি এবং কোথায় ব্যয় করেছি। সত্যিকারের ঈমানদার তারাই, যারা তাদের সম্পদ আমাকে দান করার পর তাদের বুঝে আসুক বা না আসুক আমাকে জিজ্ঞাসা করে না । আপত্তি উত্থাপন করা ঈমান চলে যাওয়ার কারণ বলে মনে করি। (গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণার সারাংশ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজলে’ প্রকাশিত, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ খৃ:)
এ সকল অভিযোগ কারী গণ কাদিয়ানীদের বড় বড় নেতা ছিলেন। গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ বর্ণনা দিচ্ছে যে, জনাব গোলাম তার মৃত্যুর পূর্বে বলেছেন অধ্যাপক খাজা কামালুদ্দীন ও শেখ মুহাম্মদ আলী আমার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে এবং আমাকে অপবাদ দেয় যে, আমি অন্যায় ভাবে লোকের সম্পদ ভক্ষণ করি। এটা তাদের জন্য উচিত নহে। এমনকি অদ্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী (কাদিয়ানী নেতা) আমার নিকট একটি পত্র পাঠিয়েছে, যাতে সে বলেছে যে, নিয়মিত খরচতো অল্পই হচ্ছে। তবে অবশিষ্ট সম্পদ যা হাজার হাজার টাকা হবে তা কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে? তারপর অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন: তারা বলে যে, আমরা হারাম ভক্ষণ করছি অথচ এসব টাকা পয়সার সহিত তাদের কোন সম্পর্ক নেই।যদি আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি তবে তাদের কাছে এসব সম্পদ এমনকি একটি পয়সাও আসবে না। (নুরুদ্দীনের নিকট গোলাম পুত্রের লিখিত পত্র যা মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানীর লিখিত ‘হাকীকতুল এখতেলাফ’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত, ৫০ পৃ:)
এসব লেন-দেনের ব্যাপারে সে এতই নীচে নেমেছে যে, একদা সে ঘোষণা দিল, পঞ্চাশ খন্ডের একখানা পুস্তক সে ছাপাতে চায়। যে ব্যক্তি অগ্রিম টাকা পাঠাবে, তার কাছে অর্ধেক মূল্যে কিতাব পাঠান হবে। ফলে, অনেক সাদা সিদে লোক এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে পঞ্চাশ খন্ডের টাকা পাঠিয়ে দিল। কিন্তু তার মৃত্যু পর্যন্ত এ পুস্তকের মাত্র পাঁচ খন্ড ব্যতীত আর ছাপা হয়নি। যখন লোকজন তাকে জিজ্ঞাসা করল যে, আপনি আমাদের কাছে পঞ্চাশ খন্ড ছাপাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এর মূল্যও গ্রহণ করেছেন। উত্তরে সে এমন কথা বলল যা বিবেকবানদের উপদেশ বটে।তার উত্তরের বিবরণ হল এই হ্যাঁ, আমি পঞ্চাশ খন্ড ছাপাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সত্য কিন্তু পাঁচ ও পঞ্চাশের মধ্যে মাত্র একটি বিন্দুর পার্থক্য। কাজেই আমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি। (গোলামের ‘বারাহীনে আহমদীয়ার’ ভূমিকা ৫ম খন্ড ৭পৃঃ)
যখন লোকজন তাদের অবশিষ্ট মূল্য ফেরত চাইল তখন উত্তরে সে বলল: এটা আল্লাহর দেওয়া সম্পদ। এর একটি পয়সাও আমি কাউকে ফেরত দেব না, অনুরূপভাবে আমি কাউকে এ প্রশ্নের জবাবও দেব না। কেহ যদি আমার নিকট এর হিসাব চায় তবে সে যেন এরপর আর আমাকে কিছুই না দেয়। (গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল হিকমে’ প্রচারিত এবং ২১ মার্চ ১৯০৫ ইং প্রকাশিত।) তার পুত্র বশীর আহমদ বলেছে: আমাকে আব্দুল্লাহ আল সিন্নূর কাদিয়ানী বলেছে: এক ব্যক্তি জনাব গোলামের নিকট এসে একটা ফতওয়া চাইল যে, তার ভগ্নী কিছু সম্পদ রেখে গেছে, সে একজন বেশ্যা নারী ছিল, বেশ্যা বৃত্তির দ্বারা সম্পদ উপার্জন করত। হযরত তাকে উত্তর দিলেন: এ যুগে এ সম্পত্তি ইসলামের সেবায় ব্যয় করা যেতে পারে। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের লিখিত সিরাতুল মাহদী, ৩৪০ পৃ:) উল্লেখযোগ্য যে, গোলামের যুগে তার দৃষ্টিতে সে ছাড়া আর কেহই ইসলামের খাদেম ছিল না।
তার মিথ্যাচার সমূহ:
ভন্ডনবী কাদিয়ানী মিথ্যা সম্পর্কে বলে: ‘মিথ্যা হল সকল ঘৃণ্য বস্ত্তর মূল’। (গোলামের উক্তি যা ‘তাবলীগে রেসালাতের’ অন্তর্ভুক্ত ৭ম খন্ড, ২৮ পৃ:) সে আরো বলে: মিথ্যা বলা মুরতাদ (ধর্মান্তরিত) হওয়ার চেয়ে কম অপরাধ নহে।(গোলামের ‘‘আরবাঈনের’’ হাসিয়া, ৩ নম্বর ২৪ পৃ:) কিন্তু সে নিজেই মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত ছিল। তার সবচেয়ে বড় মিথ্যা হল আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করা যে, তিনি তাকে রাসূল বানিয়েছেন এবং তার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি কয়েকটা প্রবন্ধে অনেক আলোচনা করেছি। তাই আমি এখানে আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না ।
অপর একটি প্রধান মিথ্যা হল: কুরআনের নাম নিয়ে এমন কথা বলে যা কুরআনে নেই। সে বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(গোলাম কাদিয়ানীর ‘নুরুল হক’ ১ম খন্ড ৪৬ পৃ:) অথচ কুরআনের কোথাও এ ভাষ্য পাওয়া যায় না। গোলাম এ এবারতের অনেকবার পুনরাবৃত্তি করেছে , কেননা, সে ‘ফরইয়াদ দরদে বালাগ’ নামক তার পুস্তকে এ এবারতকে কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে চারবার উল্লেখ করেছে, ৮,১০,১৭,২৩, পৃ:। তার ঘোষণাবলীতেও তা উল্লেখিত রয়েছে, যা ‘তাবলীগে রেসালতের’ অন্তর্ভুক্ত ৩য় খন্ড ১৯৪ পৃ: এবং ৭ম খন্ড ৩৯পৃঃ)
সে আর এক স্থানে বলেছে: কুরআনে আছে, (গোলাম কাদিয়ানীর ‘হাকীকতুল ওহী’ ১৫৪ পৃ:) আর এটাও কুরআন সম্পর্কে তার একটা স্পষ্ট মিথ্যা। সে তার কিতাব ‘তাজকেরাতুশ শহাদাতাইন’ এ বলেছে: ‘দেখুন, কুরআনে করীমে আল্লাহপাক কি বলেন:
(গোলাম কাদিয়ানীর ‘তাজকেরাতুশ শহাদাতাইন’ ৩৪ পৃ:)এ এবারত সমূহ তার পুস্তকাদিতে এরূপই পাওয়া যায়। অথচ এ গুলো অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে। এর দ্বারা শুধু তার এটাই উদ্দেশ্য যে, মানুষের মনে এ সন্দেহ সৃষ্টি করা যে, কুরআনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কুরআনের উপর যেমন মিথ্যা-রোপ করেছে তদ্রুপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরও মিথ্যা-রোপ করেছে। সে লিখেছে : রাসূলুল্লাহকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? উত্তরে তিনি বললেন: সমস্ত মানব জাতীর উপর আজকের দিন হতে একশত বৎসরের মধ্যে কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘এযালাতুল আওহাম’ ২৫৩ পৃ:) অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও এমন উক্তি করেন নি যে, সমস্ত মানব জাতীর উপর একশত বৎসরের মধ্যে ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। কেহই তা প্রমাণ করতে পারবে না। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরো মিথ্যা আরোপ করে বলেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যখন কোন শহরে বালা-মছিবত অবতীর্ণ হয়, শহরবাসীর জন্য তৎক্ষণাৎ এ শহর ত্যাগ করা উচিত। নচেৎ তারা আল্লাহর সাথে যুদ্ধকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (মুরিদগণের প্রতি গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল-হিকমে’ প্রচারিত, ২৪ আগস্ট, ১৯০৭ খৃ:) এটা রাসূলুল্লাহর নামে একটি মিথ্যা ও জঘন্য অপবাদ।
সে অন্য এক স্থানে এ মিথ্যা উক্তি করেছে: ছহীহ হাদীসে আছে যে, মাসীহে মাওউদ শতাব্দীর প্রান্তে অবতীর্ণ হবেন এবং তিনি চৌদ্দ শতাব্দীর ইমাম হবেন’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘নুসরতুল হকের’ পরিশিষ্ট ১৮৮পৃঃ)
সকল নবীর উপর সে অপবাদ দিয়ে বলেছে: পূর্ববর্তী সকল নবীর ওহী একবাক্যে বলে যে,মাসীহে মাওউদ চৌদ্দ শতাব্দীতে জন্ম গ্রহণ করবেন এবং তিনি পাঞ্জাবেই জন্ম গ্রহণ করবেন। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আরবাঈন’ ২৫ নম্বর,২৩ পৃ:) এটা স্পষ্ট মিথ্যা এবং প্রকাশ্য অপবাদ। কারণ সকল নবীতো দুরের কথা একজন নবীর নিকট ও এ অর্থে কোন ওহী পাওয়া যায় না। আল্লাহর নবী ঈসার আলাইহিস সালাম উপর সে মিথ্যা-রোপ করেছে যে, ‘তিনি গালি গালাজে অভ্যস্ত ও কুচরিত্রবান ছিলেন। ধৈর্য না থাকার কারণে তিনি সাধারণ বিষয়ে রাগান্বিত হয়ে উঠতেন’ আরো সে কটাক্ষ করে বলে: ‘ঈসা আলাইহিস সালাম মিথ্যায় অভ্যস্ত ছিলেন’। (গোলাম কাদিয়ানীর জমীমায়ে আঞ্জামে আথমের টিকা, ৫পৃঃ)
তার উপর আরো মিথ্যা-রোপ করে বলে: ‘ঈসা আলাইহিস সালাম পুরুষত্ব হতে বঞ্চিত ছিলেন, যা মানুষের জন্য অতি উঁচু প্রশংসনীয় গুণ’। (মাকতুবাতে আহমদিয়া, যা গোলাম কাদিয়ানীর চিঠি পত্রের সমষ্টি, ৩য় খন্ড, ২৮পৃঃ।)
ঈসার আলাইহিস সালাম উপর সে আরো মিথ্যা-রোপ করে বলেছে: ঈসা আলাইহিস সালাম যাদুকর ছিলেন যা কিছু তার থেকে প্রকাশ পেয়েছে তা এ যাদুর বলেই প্রকাশ পেয়েছে’। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ৩০৯ পৃ:)
ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর তার মিথ্যাসমূহ পূর্ববর্তী ‘নবুয়তের দাবিদার....... অবমাননা’ শীর্ষক তৃতীয় প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। সে ঈসার আলাইহিস সালাম প্রতি বিদ্বেষ রাখত, বিশেষ করে এ উদ্দেশ্যে যে, সে যেন ঈসার আলাইহিস সালাম চারিত্রিক গুণাবলি ধ্বংস করে দিতে পারে, যাতে লোকজন তার দোষত্রুটির উপর আপত্তি উত্থাপন করতে না পারে।
নবী রাসূলগণের উপর তার মিথ্যাচার আরো অনেক রয়েছে। আমরা এখানে এতটুকুই উল্লেখ করা যথেষ্ট মনে করি।
তার মিথ্যাচারের আরো কয়েকটি নমুনা হল এই: ‘গত কয়েক বছরে আমার হাতে লক্ষাধিক লোক বয়আত করেছে।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তুহফাতুন নদওয়া’) কাদিয়ানী ম্যাগাজিনে গোলামের ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে, এ পর্যন্ত আমার হাতে প্রায় এক লক্ষ লোক তওবা করেছে ।’ (কাদিয়ানী ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিউন্স, সেপ্টেম্বর ১৯০২ খৃ:) এর সাড়ে তিন বৎসর পর সে লিখেছে, ‘আমার হাতে প্রায় ৪লক্ষ লোক তওবা করেছে।’ (তজল্লিয়াতে এলাহিয়া, ৩পৃঃ, ৩রা মার্চ ১৯০৬ খৃ: মুদ্রিত।) একই বক্তব্য তার ‘হাকীকতুল ওহী’ নামক পুস্তকে উল্লেখ করেছে। ‘আমি হাজারো শুকরিয়া আদায় করছি যে, এ পর্যন্ত আমার হাতে চার লাখ লোক কুফুর ও পাপাচার হতে তওবা করেছে’। (গোলামের ‘হাকীকতুল ওহীর’ পরিশিষ্ট ১১৭ পৃ:) তার মৃত্যুর চৌদ্দ বছর পর তার পুত্র ও তার খলীফা ঘোষণা করেছে যে, কাদিয়ানীর সংখ্যা চার পাঁচ লাখে পৌঁছে গেছে। (কাদিআনী পত্রিকা ‘আল-ফজল ২৬ জুন, ১৯২২ খৃ:) কিন্তু সরকারী আদম শুমারী ভন্ডনবী কাদিয়ানী ও তার পুত্রের ভাষ্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেয়। তার ছেলে এই বলে স্বীকার করেছে. ‘সরকারী আদম শুমারী অনুযায়ী পাঞ্জাবে কাদিয়ানীদের সংখ্যা ছাপ্পান্ন হাজার এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে কাদিয়ানীদের সংখ্যা বিশ হাজার বলে অনুমান করা যায়। এমনি ভাবে আমাদের সংখ্যা ছিয়াত্তর হাজারে দাঁড়ায়’। (গোলাম পুত্র এবং কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ অহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলের অন্তর্ভুক্ত, ২১ জুন১৯৩৪ খৃ:)
সুতরাং তার মিথ্যা সুস্পষ্ট। ১৯০৬ সালে গোলাম বলছে যে তার জামাতের লোক সংখ্যা চার-লাখ। কিন্তু আঠারো বৎসর পরের আদম শুমারী বলছে যে, গোলাম পুত্রের উক্তি অনুযায়ী নারী ও শিশু সহ তাদের সংখ্যা ছিয়াত্তর হাজারের অধিক নহে। হায় লজ্জা, হায় শরম। এমনিভাবে ১৮৯৯ সনে সে যে উক্তি করেছে উহাও মিথ্যা। সে বলেছে: ‘আমার তিন হাজারের অধিক ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত ও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ ‘‘হাকীকতুল মাহদী’’ ৮পৃঃ ১৮৯৯ সালে মুদ্রিত। কিন্তু দুই বৎসর পর যে নিজেকে মিথ্যা প্রমাণিত করে লিখেছে: আমি নিজে দেখেছি যে, এ পর্যন্ত আমার একশত পঞ্চাশটি ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে। (এজালাতুল গালতা’ ৭ পৃ: ১৯০১ সালে মুদ্রিত।)
তার অপর একটি মিথ্যাচার হল, সে লিখেছে: ‘‘আমার মোজেজা সমূহ এক মিলিয়নেরও অধিক।’’ (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ ৪১ পৃ:) সুতরাং মিথ্যা ও অপবাদ জনাব গলিম কাদিয়ানীর স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও সে বলে যে, মিথ্যা ধর্মান্তরিত হওয়ার চেয়ে কম অপরাধ নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আরবাঈন’ কিতাবের হাসিয়া ৩৫ নম্বর ২৪ পৃ:।) সে আরো বলে: ‘অপবাদকারীর উপর আল্লাহর লা’নত এবং আল্লাহর কাছে তার কোন মর্যাদা নেই।’ (গোলামের ‘নুসরতুল হক’ ১০ পৃ:)
এইতো হল কাদিয়ানীর কথা। অপর দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘যার মধ্যে এ চারটি স্বভাব রয়েছে সে খাঁটি মুনাফিক, আর যার মধ্যে এর একটি রয়েছে তার মধ্যে নেফাকের একটি চরিত্র রয়েছে, যতক্ষণ না সে তা বর্জন করে:( ১) যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন সে খিয়ানত করে, (২) যখন কথা বলে তখন সে মিথ্যা বলে, (৩) যখন অঙ্গিকার করে তখন ভঙ্গ করে (৪) এবং যখন ঝগড়া করে তখন গালি-গালাজ করে। [১ বুখারী ও মুসলিম।]
ভন্ডনবী কাদিয়ানীর মধ্যে এ সকল চরিত্রের সব গুলোই বর্তমান ছিল। যেমন আমি এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আসলাম।
তার তথাকথিত ইলহাম সমূহ
তার চরিত্রের বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা তার কিছু এলহামের উল্লেখ করতে চাই। যাতে পাঠক জানতে পারবেন যে, এ সমস্ত ওহী কোন ধরনের এবং এর উদ্দেশ্যই বা কি? আল্লাহর কালাম কি অর্থহীন হওয়া যুক্তি সংগত? যেভাবে ভন্ডনবী কাদিয়ানী গোলাম আহমদ এর চিত্র তুলে ধরেছে। গোলাম আহমদ বলে: ‘আমার কাছে ইলহাম আসছে- ১১ ইনশাআল্লাহ’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আল- বুশরা’ ২য় খন্ড,৬৫পৃঃ।) এরপর সে বা তার অন্য কোন অনুসারী এর কোন ব্যাখ্যা দেয় নি যে, ‘১১ ইনশাআল্লাহ’ এর কি অর্থ? সে আরো বলেছে: তার কাছে ইলহাম আসছে- ‘উপযুক্ত ব্যক্তি’ (আল-বুশরা’ ২য় খন্ড, ৮৪ পৃ:) উপযুক্ত ব্যক্তিটি কে? এর কোন পরিচয় নেই। আরো বলেছে: আক্ষেপ অত্যন্ত আক্ষেপ’। (গোলামের ইলহামাতের সমষ্টি ‘আল-বুশরা’ ২য় খন্ড ৫৭ পৃ:) আরো একটি এলহাম: ‘‘চৌধরী রস্তম আলী’’ (আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৮৮পৃঃ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদরের অন্তর্ভুক্ত, ১ম খন্ড, ৩২ গৃঃ) আরো একটি ইলহাম: ‘ফজলুর রহমান দরজা খুলেছে’। (আল- বুশরা, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:) এবং ‘তুমি আমার সন্তানদের সমতুল্য’। (আরবাঈন, হাসিয়া, ২৩ পৃ: ৪ নম্বর।)
এই হল ইলহামাতের নমুনা। জানি না, এ গুলোর অর্থ কি? আরো অদ্ভুত কথা হল, গোলাম আহমদ নিজেই এগুলোর অর্থ জানে না। এরূপ ইলহামাত গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিকট অনেক আছে। বরং অধিকাংশ ইলহামাত এ ধরনেরই।
তার পরিণতি ও মৃত্যু:
গোলামের মৃত্যু তার মিথ্যার উপর মোহর মেরে দিয়েছে। সে আল্লাহর রাসূল, কুরআন ও নবীগণের উপর মিথ্যারোপের কারণে সে নিজের উপর লা’নত টেনে এনেছে। আলেমগণ তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং তাকে সংশোধন করার ও ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনার নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়েছেন। যখন তারা কুফুরের উপর তার জেদ ও দৃঢ়তা, ধর্মান্তরিত হওয়া ও নবুয়তের মিথ্যাবাদীর উপর অনঢ় দেখতে পেলেন, তখন তাকে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং তার সঙ্গে মুনাজারা করলেন। তার মিথ্যা দাবির অসারতা প্রকাশ করেন। দলীল প্রমাণ পেশ করার সকল প্রচেষ্টা সমাপ্ত হওয়ার পর সকলেই ঐক্যমতে তার কুফুর এবং মিথ্যাচারের ফতওয়া প্রদান করলেন। এ সকল আলেমের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় হলেন ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের পক্ষে প্রতিরোধকারী ও ইসলামের তরফ থেকে মুনাজারায় অগ্রগামী মহান শেখ আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। তার এবং গোলাম কাদিয়ানীর মধ্যে অনেকগুলো বিতর্ক এবং লিখিত ও মৌখিক বাহাছ-মুবাহাছা হয়েছে। তবে, বিজয় সর্বদা এই আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তি [১ আল্লামা রশীদ রেজা তার প্রশিদ্ধ ‘আল মানার’ ম্যাগাজিনে শায়খ ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে এই নামে অভিহিত করেছেন।] ও ইসলামের বীর পুরুষের পক্ষেই ছিল। এর ফলে ভন্ডনবী কাদিয়ানী রাগে জ্বলে উঠে এবং ১৯০৭ খৃষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিলে একটি প্রচার পত্র বিলি করে। এতে নিম্নোক্ত কথাগুলো লেখা ছিল: ‘‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি এবং তাঁর সম্মানিত রাসূলের প্রতি দরুদ পড়ি। ‘‘লোকেরা তোমাকে সংবাদ জিজ্ঞাসা করে ইহা কি সত্যি? তুমি বলে দাও, হ্যাঁ, আল্লাহ আমার প্রভু-প্রতিপালকের! নিশ্চয়ই এটা সত্য । [২ সুরা ইউনুস-৫৩]
উস্তাদ ছানাউল্লাহর প্রতি প্রেরিত। যে হেদায়েতের অনুসারী তার উপর ছালাম। আপনাদের ম্যাগাজিন আহলে হাদীসে দীর্ঘদিন যাবৎ আমাকে মিথ্যাবাদী ও ফাসেক বলা হচ্ছে এবং সর্বদা এ ম্যাগাজিনে আমাকে মালাউন, কাজ্জাব, দাজ্জাল ও মুফসেদ নামে অভিহিত করেছেন । বিশ্বে প্রচার করেছেন যে, আমি অপবাদকারী, মিথ্যুক, দাজ্জাল এবং আমার মাসীহিয়তের দাবিতে আমি মিথ্যাবাদী। আমি আপনার কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি এবং ধৈর্য ধারণ করেছি। কিন্তু যখন আমি দেখলাম যে, আমি সত্য প্রচারের জন্য আদিষ্ট, আর আপনি আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিশ্বকে আমার দিকে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করছেন। সুতরাং এখন আমি দোয়া করছি যে, যদি আমি মিথ্যাবাদী ও অপবাদকারী হই, যেমন আপনি আপনার ম্যাগাজিনে প্রচার করছেন, তাহলে যেন আপনার জীবদ্দশাই আমি ধ্বংস হয়ে যাই। কেননা, আমি জানি যে, কোন মিথ্যাবাদী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বেশি দিন বাঁচে না। বরং সে তার শত্রুর জীবদ্দশায়ই লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর, তার মৃত্যুতে আল্লাহর বান্দাগণের উপকার নিহিত রয়েছে। কারণ, সে আর তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আর, যদি আমি মিথ্যাবাদী ও অপবাদকারী না হয়ে থাকি এবং আল্লাহর সাথে কথা বলার মর্যাদা লাভ করে থাকি এবং আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ মর্যাদা লাভ করে থাকি এবং আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ হই, তা হলে আমি দোয়া করছি তুমি যেন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী অবিশ্বাসীদের পরিণাম হতে মুক্তি লাভ না কর। আমি ঘোষণা করছি, যে শাস্তি শুধু আল্লাহর নিকট থেকে হয় যেমন প্লেগ ও কলেরা, উহাদ্বারা যদি তুমি আমার জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ না কর তবে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি না বরং বরকতময় মহান আল্লাহর নিকট থেকে প্রকাশ্য মীমাংসা চেয়েছি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, হে আমার প্রভু, যিনি সবকিছু দেখেন, মহাশক্তি ধর, সর্বজ্ঞানী, যিনি সবকিছুর খবর রাখেন। হে অন্তরের রহস্য জ্ঞাত, আমি যদি তোমার দৃষ্টিতে মিথ্যুক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে থাকি এবং রাত দিন তোমার উপর অপবাদ দিয়ে থাকি, তবে, হে আল্লাহ, উস্তাদ ছানাউল্লাহর জীবনেই আমাকে ধ্বংস করে দাও এবং তাকে ও তার জামাতকে আমার মৃত্যুর দ্বারা আনন্দিত কর। আমীন। হে আল্লাহ! আর আমি যদি সত্য হই এবং ছানাউল্লাহ বাতিল পন্থী ও আমার উপর তার আরোপিত অপবাদ সমূহে মিথ্যাবাদী হয়ে থাকেন, তবে, তাকে আমার জীবিতাবস্থায় ঘাতক ব্যাধি যেমন প্লেগ, কলেরা ইত্যাদি দ্বারা ধ্বংস করে দিন। আমীন। হে প্রভু! আমি বড় কষ্ট পেয়েছি এবং ছবর করেছি। কিন্তু এখন আমি দেখছি যে, তিনি সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন এবং আমাকে চোর, জবর দখলকারী যাদের দ্বারা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের চেয়েও অধিক অপরাধী মনে করেন। আর, আমাকে আল্লাহর সৃষ্টির হেয় ব্যক্তি বলে ধারণা করেন। তিনি দুর-দূরান্তে প্রচার করেছেন যে, আমি বাস্তবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, লুণ্ঠনকারী, লোভী, মিথ্যাবাদী, অপবাদকারী ও ঘৃণ্য ব্যক্তি। যদিও এসব কথার প্রতিক্রিয়া হয়নি। আমি এতে ধৈর্য ধারণ করেছি, কিন্তু আমি দেখছি যে, ছানাউল্লাহ এ সকল অপবাদ দ্বারা আমার দাওয়াতকে এবং আমার নির্মিত ইমারতকে ধ্বংস করতে চায়। তুমিই আমার প্রভু, তুমিই আমাকে প্রেরণ করেছ। এজন্য হে আল্লাহ! তোমার পবিত্রতার আঁচল ধরে তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আপনি আমার ও ছানাউল্লাহর মধ্যে ঠিক ফয়সালা করে দিন। আর, যে মিথ্যাবাদী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী তাকে সত্যবাদীর জীবিতাবস্থায়ই ধ্বংস করে দিন। অথবা, তাকে মৃত্যু সমতুল্য বিপদে পতিত করুন। হে আমার প্রিয় প্রভু, আপনি এটাই করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
‘‘হে আল্লাহ! আপনি আমার ও আমার কওমের মধ্যে সঠিক ফয়সালা করে দিন। আর আপনি হলেন উত্তম ফয়সালাকারী’’। (সুরা আল-আরাফ-৮৯)
পরিশেষে, আমি উস্তাদ ছানাউল্লাহর কাছে আশা করব, তিনি যেন, এ প্রচার পত্রটি তার ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেন। এরপর তার যা ইচ্ছা এর সাথে যুক্ত করতে পারেন। এখন ফয়সালা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। লেখক, আল্লাহুস সামাদ এর বান্দাহ গোলাম আহমদ আল মাসীহুল মাওউদ। আল্লাহ তাকে সুস্থ রাখুন এবং সাহায্য করুন।(গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণা যা ১৫ এপ্রিল ১৯০৭ খৃ: প্রচারিত এবং ‘তাবলীগে রেসালত’ ১০ খন্ড ১২০ পৃ: অন্তর্ভুক্ত, কাসেম কাদিয়ানী কর্তৃক সজ্জিত মাজমুয়াতু এলানাতিল গোলাম’।) এ দোআতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সত্যবাদীর জীবিতাবস্থায় মিথ্যাবাদীর মৃত্যু কামনা করে। অর্থাৎ যদি গোলাম আহমদ সত্যবাদী হয়ে থাকে তবে তার জীবিতাবস্থায় শেখ ছানাউল্লাহ মৃত্যু বরণ করবেন। (আর, যদি শেখ ছানাউল্লাহ গোলাম আহমদকে মিথ্যুক বলার ক্ষেত্রে সত্যবাদী হয়ে থাকেন তা হলে তার জীবদ্দশায় গোলাম আহমদ মারা যাবে।) এ ঘোষণা ও দেয়ার দশ দিন পর গোলাম আহমদ কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রকাশ করল: ‘ছানাউল্লাহ সম্পর্কে য বলা হয়েছে তা আমার নিজের পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে। আজ রাতেই এ দোয়া সম্পর্কে আমার নিকট এলহাম হয়েছে- ‘উজিবু দাওয়াতাদ দায়ী’ এ এলহামের অর্থ হল এই যে, আমার প্রার্থনা গৃহীত হয়ে গেছে’। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদর’ ২৫ এপ্রিল ১৯০৭ খৃ: প্রকাশিত।) কার্যত: তার এ প্রার্থনা গৃহীত হয়ে যায়। এবং তার ও ছানাউল্লাহর মধ্যে সঠিক ফয়সালা হয়ে যায়। গণনা অনুযায়ী তিন মাস দশদিন পর আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও ফয়সালা এমন ভয়ানক আকারে তার কাছে পৌঁছোল, যা সে শ্রদ্ধেয় শেখ ছানাউল্লাহর জন্য আকাঙ্ক্ষা করছিল । হ্যাঁ, ঐ অবস্থায় এবং ঐ রোগেই সে আক্রান্ত হল। এর বিবরণের প্রতি পাঠক মহোদয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করছি: গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের বিশিষ্ট নেতা বশীর আহমদ গোলামের জীবন বৃত্তান্তে লিখছে: আমার মা আমাকে বলেছেন, জনাবের (গোলামের) খাওয়ার পর পরই পায়খানায় যাওয়ার প্রয়োজন হল, এরপর একটু নিদ্রা গেলেন, আবার পায়খানায় যাবার প্রয়োজন হল। অতঃপর আমাকে অবহিত না করেই আরো দু এক বার গেলেন। তারপর আমাকে জাগালেন। তখন আমি দেখতে পেলাম যে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এমনকি, তিনি তার খাট পর্যন্ত হেঁটে যেতে সক্ষম হন নি। এজন্য আমার খাটেই বসে পড়লেন। তখন আমি তার শরীর মলতে ও দাবাতে লাগলাম। একটু পরেই আবার পায়খানার প্রয়োজন অনুভব করলেন, কিন্তু এবার পায়খানায় যেতে না পেরে খাটের নিকটেই প্রয়োজন সেরে নিলেন। প্রয়োজন সেরে একটু বিশ্রাম নিলেন। অতঃপর বমি আসল। বমি করার পর চিৎ হয়ে পড়লেন। খাটের কাঠের সাথে তার মাথার টক্কর লাগে এবং তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘সিরাতে মাহদী’ ১০৯ পৃ:) তার শ্বশুর লিখেছে: যে রাত্রে জনাব (গোলাম) অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সে রাত্রে আমি আমার কামরায় ঘুমিয়েছিলাম। যখন তার রোগের অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করল তখন গৃহের লোকজন আমাকে জাগাল, আমি তার নিকট গিয়ে তার কষ্ট দেখতে পেলাম। আমাকে তিনি এ বলে সম্বোধন করলেন: আমি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। অতঃপর, তিনি আর কোন কথা স্পষ্ট করে বলতে পারেন নি। এমনকি, পরদিন সকাল দশটার পর মারা যান। (গোলাম কাদিয়ানীর শ্বশুরের ‘হায়াতে নাসির’ ১৪ পৃ:।)
তখনকার দিনের ভারতীয় পত্রিকাগুলো প্রচার করেছে. ‘‘ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী
যখন কলেরায় আক্রান্ত হল তখন তার মৃত্যুর পূর্বে তার মুখ দিয়ে পায়খানা নির্গত হচ্ছিল। সে প্রয়োজন সারতে পায়খানায় বসা ছিল, এমতাবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে’’। অনুরূপভাবে মুহাম্মদ ইসমাঈল কাদিয়ানীর বর্ণনা কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রচারিত হয়: ‘‘বিরুদ্ধবাদীরা বলে যে, মৃত্যু কালে মাসীহে মাওউদের মুখ দিয়ে পায়খানা বের হচ্ছিল। (মুহাম্মদ ইসমাঈলকাদিয়ানীর বর্ণনা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে সুলাহ’ এর মধ্যে ৩রা মার্চ ১৯৩৯ খৃ:) মোটকথা, মৃত্যু আসল, কিন্তু কি অবস্থায় আসল? এমন অবস্থা যা শুনলেই প্রাণ শিহরিয়া উঠে। সে ২৬ মে ১৯০৮ খৃ: সকাল সাড়ে দশ ঘটিকায় মারা যায়। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল হিকম’ ২৮ মে ১৯০৮ খৃ: এবং ‘সীরতে মাহদী’ প্রভৃতি কাদিয়ানী পুস্তকাবলী।) মোটকথা, সে মারা যায় এবং ছানাউল্লাহ জীবিতই রইলেন । এমনকি তার মৃত্যুর পর প্রায় চল্লিশ বৎসর জীবিত থেকে কাদিয়ানীদের প্রাসাদ ধূলিসাৎ এবং তাদের মূলোৎপাটন করছিলেন। এমনিভাবে, আল্লাহ তা‘আলা এ মিথ্যাবাদীকে তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও মিথ্যা সাব্যস্ত করেছেন। দুনিয়াতে শাস্তি দিয়েছেন এবং পরকালে রয়েছে তার জন্য আরো কঠোর ও সবল শাস্তি। মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন- ‘‘ওর চেয়ে বড় জালিম আর কে? যে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে অথবা বলে: আমার উপর ওহী এসেছে, অথচ তার কাছে কোন ওহী আসেনি, এবং যে বলে আল্লাহ যেরূপ নাজিল করেছেন আমিও তদ্রুপ নাজিল করতে পারি। যদি আপনি দেখতে পেতেন! এ জালিমরা যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় পতিত হয়, আর, ফেরেস্তারা তাদের হস্ত সম্প্রসারণ করে বলে, তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হবে, কেননা, তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অসত্য কথা বলতে এবং অহংকার ভরে আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করতে’’। [১ সুরা আল আনআম-৯৩]
লক্ষণীয় বিষয়, ভন্ডনবী গোলাম লাহোরে মৃত্যু বরণ করে। তারপর তার লাশ কাদিয়ানে হস্তান্তরিত করা হয়। (‘সীরতুল মাহদী’ ‘হায়াতে নবী’ প্রভৃতি।) এভাবে তার মৃত্যুর পরেও সাব্যস্ত হয় যে, সে নবুয়তের দাবিতে মিথ্যাবাদী। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে সেই স্থানেই মৃত্যুদান করেন, যেখানে তার সমাধিস্থ হওয়া আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। [২ তিরমিজী।]
গোলামের বংশ ও জন্মস্থান:
ভন্ডনবী কাদিয়ানী তার বংশ ও জন্ম স্থানের উল্লেখ করে বলে: আমার নাম গোলাম আহমদ , আমার পিতার নাম গোলাম মুরতাজা, আমার দাদার নাম আতা মুহাম্মদ, আমার গোত্র মুঘল বরসাল। সংরক্ষিত দলীল পত্র দ্বারা বুঝা যায়, আমার পূর্ব পুরুষেরা সমর-কন্দ থেকে আগমন করেছেন। (গোলাম আহমদের কিতাবুল বারিয়া, ১৩৪, পৃ:) এটা জানা কথা যে, মুঘল তুর্কি বংশের। অথচ গোলাম বলেছে, সে মুঘল বংশধর। কিন্তু অন্যত্র সে বলে, সে পারস্য বংশোদ্ভুত। যেমন সে উল্লেখ করেছে: ‘‘এটা সুস্পষ্ট যে, আমার গোত্র মুঘল বংশোদ্ভুত কিন্তু এখন আমার কাছে আল্লাহর কালাম হতে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে আমি পারসি বংশোদ্ভুত কিন্তু এখন আমার কাছে আল্লাহর কালাম হতে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে আমি পারসী বংশোদ্ভুত এবং আমি এতে বিশ্বাসী। কেননা, আল্লাহ তাআলা যেভাবে বংশের বাস্তব অবস্থা জানেন, আর কেহ তা জানে না’’ (গোলাম আহমদ কাদিয়ানী কর্তৃক রচিত আরবাঈনের হাসিয়া, ২ নম্বর ১৭ পৃ:) সে আরো বলেছে, আমি আমার পূর্ব পুরুষগণের জীবন চরিত সম্পর্কে লিখিত কোন কোন পুস্তকে পড়েছি যে, তারা মুঘল বংশের লোক। আমার পিতার কাছ থেকেও আমি এরূপ শুনেছি। কিন্তু আল্লাহ আমার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন যে, তারা তুর্কি বংশোদ্ভুত নহে। বরং পারসী বংশোদ্ভুত। আল্লাহ আমাকে আরো অবহিত করেছেন যে, আমার কোন কোন দাদি ফাতেমী ও রাসূল পরিবারের ছিলেন। (গোলামের ‘‘হাকীকাতুল ওহীর’’পরিশিষ্ট ৭৭ পৃ:) একদা তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, তুমি কেমন করে বল যে, তুমি মুঘল বংশের? তার পর এ থেকে ফিরে গিয়ে দাবিকর যে, তুমি পারসী বংশের? তোমার এ দাবির পিছনে কি প্রমাণ রয়েছে? উত্তরে সে বলে: ‘আমি যে পারসী বংশীয় এ ব্যাপারে আল্লাহর ইলহাম ব্যতীত আমার কাছে আর কোন প্রমাণ ব্যতিরকে পরিবর্তন করে বলে: মুহিউদ্দিন ইবনুল আরবী তার পুস্তক ‘ফুসুলুল হিকমে’ আমার সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে বলেছেন: শেষ জামানায় এমন একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে যে আল্লাহর দিকে লোকদের আহবান জানাবে, তার জন্ম স্থান হবে চীন দেশ এবং তার ভাষা হবে নিজ দেশীয়। আমিই সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি। কেননা, আমি মূলত: চীন বংশীয়। (গোলামের, হাকীকতুল ওহী, মূল পুস্তক ও টীকা, ২০০ পৃ:) শুধু তা-ই নহে, বরং অন্য এক স্থানে সে বলে ‘‘আমি ফাতেমী’’, রাসূল তনয় ফাতেমার রা. বংশধর এবং আমার বংশ ইসহাকের আলাইহিস সালাম উত্তরসূরি। (তুহফায়ে গলড়িয়া’’ ২৯ পৃ:) এটাই হল তার বংশ পরিচয়। যখনই তুমি তার বংশের উলটা পালটা বর্ণনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, সে উত্তরে বলবে, তাকে এভাবেই আল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন। মিথ্যাবাদীর মিথ্যা তার নিজের পরস্পর বিরোধী কথাবার্তাতেই ধরা পড়ে। মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে আসত তাহলে তোমরা এতে অনেক পার্থক্য পেতে’। [১সুরা নিসা-৮২] এরপর সে তার পিতা সম্পর্কে বলে- ‘রাজ দরবারে আমার পিতার জন্য একটা আসন সংরক্ষিত ছিল। তিনি ইংরেজ সরকারের খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। এমনকি তিনি ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহে (ভারত উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি বিখ্যাত গণ-আন্দোলন) সরকারকে উত্তম রূপে সাহায্য করেছিলেন। তিনি নিজের পক্ষ থেকে ৫০ জন সৈনিক ও ৫০ টি ঘোড়া সরকারকে জোগান দিয়েছিলেন। এমনি ভাবে, তিনি তার শক্তির ঊর্ধ্বে মহান সরকারের সেবা করেছেন। কিন্তু, এরপর থেকে আমার বংশের পতন ও অবনতি আরম্ভ হল। (সম্ভবত: তা দেশবাসীর প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা এবং যালেম কাফের উপনিবেশবাদের দালালির কারণে হয়েছিল।) এমনকি আমার পরিবার একটা দরিদ্র কৃষক পরিবারে পরিণত হয়ে যায়। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘তুহফায়ে কায়সারিয়া’’ ১৬ পৃ:) এ ধরনেরই একটি দরিদ্র, বিশ্বাস- ঘাতক, অজ্ঞাত পরিচয় বংশের পরিবারে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী জন্ম গ্রহণ করে। সে বলেছে: ‘আমি ১৯৩৯ বা ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে (পাঞ্জাবে) শিখ রাজত্বের শেষ দিকে জন্ম গ্রহণ করেছি’। (গোলাম কাদিয়ানীর কিতাবুল বারিয়া’’ ১৩৪ পৃ:)
তার শৈশব ও শিক্ষা:
যখন সে বোধশক্তি সম্পন্ন বয়সে পৌঁছে, তখন থেকে সে ছরফ, নাহু, আরবী, ফার্সী ও চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু পুস্তকাদি পড়তে শুরু করে। সে নিজেই উল্লেখ করেছে: যখন আমি বয়ঃপ্রাপ্ত হতে লাগলাম এবং যৌবনে পদার্পণ করলাম, তখন আমি কিছু ফার্সী, কিছু ছরফ, নাহুর পুস্তিকা, অন্যান্য শাস্ত্রের অল্প কিছু পুস্তিকা এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের অল্প কিছু পুস্তক পড়তে লাগলাম। আমার পিতা ছিলেন একজন বিজ্ঞ জ্যোতিষী। এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। এ সম্পর্কে কিছু পুস্তক তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি আমাকে উৎসাহিত করেন-----। তবে হাদীস, উসূল ও ফিকহ শাস্ত্রে আমার গভীর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ হয় নি। নামমাত্র কিছু পড়াশোনা করেছি। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আত-তাবলীগ ইলা মাশাইখিল হিন্দ’ ৫৯ পৃ:) সে আরো বলেছে আমি উস্তাদ ফজলে ইলাহীর কাছে কুরআন ও ফার্সী কিতাব সমূহ পড়েছি এবং ছরফ, নাহু ও চিকিৎসা শাস্ত্র উস্তাদ ফজলে আহমদের নিকট পড়েছি (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘কিতাবুল বারিয়া’ ১৩৫ পৃ:) তার কোন কোন শিক্ষক ছিলেন ভাং ও আফিমপায়ী। যেমন, তার ছেলে ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদ তার ভাষণে উল্লেখ করেছে, যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘‘আল-ফজলে প্রচারিত হয়েছে, ৫ই ফেব্রু: ১৯২৯ খৃ:। ‘তিনি ইংরেজি ভাষার প্রাথমিক পুস্তকগুলি শিয়াল কোটে অবস্থান কালে সরকারী কর্মচারীদের জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয়ে ডা: আমীর শাহকে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। জনাব (গোলাম) এ বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়তে আরম্ভ করলেন এবং সেখানে দু’একটি পুস্তক পড়লেন।’’ (গোলাম পুত্র বশীর রচিত ‘সীরাতুল মাহদী’ ১ম খন্ড ১৩৫পৃঃ) এ হল তার যাবতীয় শিক্ষা ও লেখা পড়ার বিবরণ। এ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় তারি বিভিন্ন প্রবন্ধ ও পুস্তকে। সে শুধু সুক্ষ্ণ জ্ঞানগর্ব বিষয়ে ভূল করেনি বরং সে সহজ ও সর্বজনবিদিত ঐতিহাসিক বিষয়েও ভীষণভাবে ভূল করেছে। যেমন সে বলেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের কিছুদিন পরেই তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘পয়গামে সুলাহ’’ ১৯ পৃ:) অথচ, ইসলামী ইতিহাস অথবা সীরাতের সঙ্গে যার সামান্যতম সম্পর্ক আছে, সে জানে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর পিতা তার জন্মের পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘‘আইনুল মা’ রেফাত’’ নামক তার পুস্তকে সে আরো লিখেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এগারো জন পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন এবং সবাই মারা যান। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আইনুল মা’ রেফত ২৮৬ পৃ:) জানি না, সে তা কোত্থেকে গ্রহণ করেছে? কেননা, ইতিহাস এবং সীরাত আমাদের একথা বলে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এগারো জন সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছেন। বরং তাঁর শুধু চারজন ছেলে জন্ম গ্রহণ করে ছিলেন, তারা হলেন: তৈয়ব, তাহির, কাসিম ও ইব্রাহীম। খাদিজাতুল কুবরার রা. গর্ভে তিনজন এবং মারিয়া কিবতিয়ার রা.গর্ভে চতুর্থজন জন্ম গ্রহণ করেন। আর একবার সে লিখেছে, ‘‘প্রতিশ্রুত সন্তান ইসলামী মাসের চতুর্থ মাস অর্থাৎ সফরে জন্ম গ্রহণ করেছেন। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘তিরইয়াকুল কুলুব’’ ৪৩ পৃ:) বালকরা ও জানে যে, সফর মাস ইসলামী মাস সমূহের চতুর্থ মাস নহে, বরং দ্বিতীয় মাস। এরকম তার আরো অনেক ভুল ভ্রান্তি রয়েছে।
শৈশবে তার মধ্যে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছিল তা হল এই প্রথমত: তার কাপুরুষতা, দ্বিতীয়ত: তার বোকামী, তৃতীয়ত: পরের মাল ছিনতাই, চতুর্থত: তার বিভিন্ন প্রকার রোগ। বিখ্যাত কাদিয়ানী লিখক ইয়াকুব আলী কাদিয়ানী গোলামের সীরাতে উল্লেখ করেছে ‘‘ মাসীহ (গোলাম) কোনোরূপ প্রতিপক্ষের সহিত মোকাবিলায় ও কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেন নি, যেমন- তখনকার দিনের ভদ্র পরিবারের সন্তানদের অভ্যাস ছিল। সে সামরিক বিদ্যাও শিখিনি। অথচ লোকেরা এ সকল কাজকে ভদ্রতা ও বীরত্বের প্রতীক রূপে গণ্য করত।’’ (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘হায়াতুন নবী’ ১ম খন্ড১৩৮ পৃ:) আর তার ছেলে বশীর আহমদ তার সীরতে লিখেছে: ‘জনাব (গোলাম) একদা একটা মুরগির বাচ্চা জবাই করতে গিয়ে তার একটা আঙুল কেটে ফেললেন। ফলে হাত থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়। তখন তিনি তওবা ইসতেগফার করতে লাগলেন। কেননা, তিনি তার জীবনে কখনও কোন প্রাণী জবাই করেন নি। (সীরাতে মাহদী, ২য় খন্ড, ৪পৃঃ) তার বোকামী সম্পর্কে তার ছেলে যা উল্লেখ করেছে: ‘‘আমার মা আমাকে বলেছেন, জনাব আববা-জান একদা তাঁকে বলেছেন- শৈশবে তাকে কয়েকজন বালক বলল- আমাদের জন্য ঘর থেকে কিছু চিনি নিয়ে আস। আমি ঘরে আসলাম এবং কাইকে কিছু জিজ্ঞেস না করে যেটাকে চিনি মনে করলাম তা গলায় পৌঁছে আটকে গেল তখন অত্যন্ত কষ্ট পেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, যা আমি চিনি মনে করছিলাম তা চিনি নয়, লবণ ছিল। (গোলাম পুত্র বশীরের সীরাতে মাহদী, ১ম খন্ড, ২২৬পৃঃ)তার এই ছেলে আরো যা উল্লেখ করেছে, তাতে এ লোকটির ব্যক্তিত্ব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। সে বলে: আমার মা (গোলামের স্ত্রী) আমাকে বলেছেন, মাসীহে মাওউদ তার যৌবন কালে একদা তার দাদার পেনশনের টাকা উঠাতে গেলেন এবং তার সাথে ‘‘ইমামুদ্দীন’’ নামে জনৈক ব্যক্তি গেলেন। যখন তিনি পেনশন উঠালেন, তখন ইমামুদ্দীন তাকে ফুসলিয়ে কাদিয়ানী বাহিরে নিয়ে গেল এবং তারা দু’জন এখানে ওখানে ঘুরতে লাগলেন। জনাব (গোলাম) যখন তার সব টাকা শেষ করে ফেললেন, তখন ইমামুদ্দীন তাকে একাকী ফেলে অন্যত্র চলে গেল। কিন্তু জনাব মসীহে মাওউদ? তিনি লজ্জা শরমের কারণে বাড়িতে ফিরলেন না, বরং তিনি শিয়ালকোট গিয়ে সামান্য বেতনে (যার পরিমাণ ছিল পনেরো টাকা) চাকুরি করতে লাগলেন। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানীর ‘‘সীরাতুল মাহদী’’ ১ম খন্ড, ২৪ পৃ:)
তার অসুখ বিসুখঃ
তার অসুখ খুব বেশি পরিমাণ ছিল। তার ডান হাত ভাঙ্গা ছিল। গোলাম পুত্র উল্লেখ করেছে: আমার মা আমাকে অবগত করেছেন যে, আমার পিতার (গোলামের) ডান হাত ভেঙে গিয়েছিল এবং শেষ জীবন পর্যন্ত তার এ হাত দুর্বল ছিল। এ হাত দ্বারা তিনি খাবার উঠাতে পারতেন, কিন্তু পানির পাত্র বা অন্য কোন ভারী জিনিস উঠাতে পারতেন না এমন কি, নামাযের মধ্যে বাম হাতের উপরই ভর করতেন। (সীরাতুল মাহদী, ১ম খন্ড, ১৯৮ পৃষ্ঠা) তাঁর দাঁত সম্পর্কে তার ছেলে বলে: তাঁর দাঁতগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উহাতে পোকা ধরে ফেলেছিল। (সীরাতুল মাহদী, ২য় খন্ড, ১৩৫ পৃ:)
যক্ষ্মা:
ইয়াকুব আহমদ কাদিয়ানী লিখেছে: জনাব (গোলাম) তার পিতার জিবদ্দশায়ই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তার পিতা প্রায় ছয় মাস এর চিকিৎসা করেন। (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘‘হায়াতে আহমদ’’ ১ম খন্ড ৭৯ পৃ:) তার পুত্র বশীর আহমদ লিখেছে: জনাব মাসীহে মাওউদ তার পিতার জিবদ্দশায়ই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। (সীরাতুল মাহদী, ১ম খন্ড, ৪২ পৃ:)
বহুমূত্র এবং মাথা ঘুরানো:
নবুয়তের দাবিদার কাদিয়ানী বলে: আমি দু’টি রোগে আক্রান্ত। প্রথম রোগটি আমার শরীরের উপরিভাগে এবং এটা হলো মাথা ঘুরানো। আর দ্বিতীয় রোগটি হলো আমার শরীরের নিম্ন ভাগে এবং সেটা হলো বহুমূত্র (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘হাকীকতুল ওহী’’ ২০৬ পৃ:) গোলাম আহমদের স্ত্রী তার মাথা ঘোরানোর সময়কার অবস্থা বর্ণনা করে বলেন: ‘একদা জনাব মসীহের মাথা ঘুরানো আরম্ভ হলো, তখন তার দুই ছেলে ‘সুলতান আহমদ ও ফজল আহমদ’ কে ডাকা হয়। তারা দ্রুত ছুটে আসল। সুলতান আহমদ ভীত হয়ে তার খাটের পাশে বসে পড়ল এবং ফজল আহমদের মুখের রং বদলে গেল, সে এখানে ওখানে ছোটা ছুটি করতে শুরু করে। অতঃপর দু’পা তর পাগড়ি দ্বারা বেঁধে রাখে (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘‘সীরতে মাহদী’’ ১ম খন্ড ২২পৃঃ) গোলাম আহমদ নিজেই তাঁর মাথা ঘুরানো সম্পর্কে তার অবস্থা বর্ণনা করে বলে: মাথা ঘুরানোর তীব্রতা দেখা দিলে আমি কখনও কখনও মাটিতে পড়ে যাই এবং হৃৎপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন মন্থর হয়ে পড়ে। এ অবস্থা আমার জন্য খুবই বিপদ জনক ছিল (গোলাম কাদিয়ানীর ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ ৫ম খন্ড ২০১ পৃ:) কোন এক সময়ের কথা উল্লেখ করে তার স্ত্রী বলেছে: ‘একদা গোলাম আহমদ নামাজের জন্য মসজিদে গেলেন এবং নামাজ আরম্ভ করেন। কিছুক্ষণ তিনি দেখলেন যে, কাল কিছু তার চক্ষু-দ্বয় থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। এতে তিনি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তারপর থেকে তিনি ইমামতি করেন নি। (সীরতে মাহদী, ১ম খন্ড ১৩ পৃ:)
এরপর থেকে তার মাথা ঘুরানো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। এ জন্য তিনি তার জীবনের অধিকাংশ রমযান মাসে রোযা থাকতে পারেন নি। যেমন, তার ছেলে তার সীরতে উল্লেখ করেছে। (সীরতে মাহদী ১ম খন্ড ৫১ পৃ:) গোলাম আহমদ তার ১ম খলীফা নুরুদ্দীনের নিকট লিখিত এক পত্রে তার পুরুষত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করে বলে: ‘আমি মনে করি আমার মস্তিষ্ক যে পরিমাণ দুর্বল তোমাদের তেমন নহে। আর যখন আমি বিবাহ করি তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি পুরুষ নই’’। (নুরুদ্দীনের কাছে গোলামের পত্র যা তারি পত্রাবলির সমষ্টি ‘মাকাতিবে আহমদীয়া’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড ১৩ নং।) উল্লেখ্য যে, তার বয়স যখন পনেরো বা ষোলো ছিল, তখন তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। (মঞ্জুর কাদিয়ানীর ‘‘মঞ্জুরে ইলাহী’’ ৩৪২ পৃ:)। সে স্নায়ুবিক দুর্বলতায় আক্রান্ত ছিল, যার ফলে তার স্মরণ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ইহা সে বিভিন্ন লোকের কাছে লিখিত পত্রে উল্লেখ করেছে। যেমন- আমি স্নায়ুবিক দুর্বলতায় আক্রান্ত। এজন্য আমি ঠান্ডা ও বৃষ্টি সহ্য করতে পারি না।’’ (গোলামের পত্রাবলি যা ‘মাকতুবাতে আহমদীয়ার অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড, ২ নম্বর।) আমার স্মরণ শক্তি অতিশয় দুর্বল। কোন কোন লোকের সাথে আমার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু কিছু দিন পরই তার সাথে যে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল তা ভুলে যাই। আমার এ অবস্থা অবর্ণনীয় (মাকতুবাতে আহমদীয়া, ৫ম খন্ড ৩ নম্বর)।
তার চোখ দু’টি দুর্বল ও রুগ্ন ছিল। এমনকি সে উহা পুরোপুরি খুলতে পারত না। তার ছেলে লিখেছে: ‘একদা জনাব (গোলাম) তার কোন মুরীদের সঙ্গে ফোটো উঠাতে চাইলেন। তখন ফটোগ্রাফার তাকে একটু চোখ খুলতে বলল, যাতে ফোটোটা ঠিক মত উঠে। জনাব অতি কষ্টে চক্ষু খোলার চেষ্টা করলেন , কিন্তু খুলতে পারলেন না (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘সীরতে মাহদী’ ২য় খন্ড ৭৭ পৃ:)। শেষ বয়সে লোকটি এত অধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, যদি তাকে রোগ সমূহের সমষ্টি বলা হয়, তবে উহা বাস্তবের পরিপন্থী হবে না। তিনি ‘মুরাক; রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং এটা এক প্রকার ‘মালীখুলীয়া’। ডাঃ আল্লামা বুরহানুদ্দীন ‘শরহুল আসবাব অল আলামাত ’ গ্রন্থে মাথার রোগ সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘মুরাক’ রোগটি এক প্রকার ‘মালীখুলীয়া’। (শরহে আসবাব, ১ম খন্ড ৭৪ পৃ:) কাদিয়ানী পত্রিকা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে সে মুরাক রোগে আক্রান্ত ছিল। আর তার মূল ভাষ্য হল: ‘জনাব মসীহে মাওউদ মস্তিস্কের দুর্বলতার কারণে মুরাক রোগে আক্রান্ত ছিলেন । (কাদিয়ানী ম্যাগাজিন ‘রিভিউ অব রিলিজিউন্স, আগস্ট, ১৯২৬ খৃ: গোলাম আহমদ নিজেই বলেছে, ‘আমি মুরাক রোগে আক্রান্ত। ’ কাদিয়ানী পত্রিকা আল হিকম’ যা ৩১ শে অক্টোবর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত।)
কাদিয়ানী চিকিৎসক ড: শাহ নেওয়াজ গোলাম আহমদের রোগ সমূহের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন: আমাদের হুজুরের রোগ সমূহ যথা-মাথা ঘুরানো, মাথা ব্যথা, স্বল্প নিদ্রা, ক্ষুধা মন্দা, হৃৎপিন্ডের দুর্বলতা, দাস্ত, বহুমূত্র, মুরাক ইত্যাদি এগুলোর একমাত্র কারণ ছিল দুর্বলতা । (ড: শাহ নেওয়াজ কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা রিভিউ ম্যাগাজিনে প্রচারিত, মে, ১৯৩৭ খৃ:)
গোলাম আহমদ বলেছে: ‘আমি চির রোগী’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘নাসীমে দাওয়াত’ ৬৮ পৃ:) সে আরো লিখেছে ‘আমি এ সমস্ত রোগের কারণে অক্ষম হয়ে পড়েছি; এমনকি দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পারি না। কথনও নামায পূর্ণ করার পূর্বেই ভেঙে ফেলি। বর্তমানে এমন হয়ে পড়েছি যে, বসেও নামায পড়তে পারি না। (গোলামের পত্র ‘মাকতুবাতে আহমদীয়ার অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড ৮৮ পৃ:)
উপরন্তু আল্লাহ তা’ আলা তার উপর ‘হিষ্ট্রিয়া’ নামক এক মারাত্মক রোগ চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তার ছেলে বশীর আহমদ বলেছে: ডাঃ মুহাম্মদ ইসমাইল কাদিয়ানী আমাকে বলেছেন যে, জনাব মসীহ ‘হিষ্ট্রিয়া’ রোগে আক্রান্ত। (সীরতে মাহদী ২য় খন্ড ৫৫ পৃ:) এমনি ভাবে বশীর আহমদ তার মার কাছ থেকে বর্ণনা করছে যে, তার মা তাকে অবহিত করেছেন: জনাব (গোলাম) তার পুত্র প্রথম বশীরের মৃত্যুর পর হিষ্ট্রিয়া রোগে আক্রান্ত হন (সীরতে মাহদী ১ম খন্ড, ১৩ পৃ:) মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন: ‘‘নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে পরকালীন শাস্তির পূর্বে দুনিয়ার কিছু শাস্তির স্বাদ ভোগ করাব। যাতে তারা তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসে’। [১ সুরা সিজদা- ২০]
তার খ্যাতি ও দাওয়াতের সূচনা:
প্রথম অবস্থায় গোলাম আহমদ একজন মাযজুব (ধ্যানে আত্মহারা) ও ইসলামের প্রতিরক্ষাকারী রূপে প্রকাশ পায়। সে যখন শিয়াল কোটের চাকুরি ছেড়ে দিল এবং বেকার হয়ে পড়লে, তখন নে হিন্দু এবং খ্রিস্টানদের বই পড়তে শুরু করে, কারণ, তখনকার দিনে ভারত বর্ষে মুসলিম উলামা এবং খ্রিস্টান ধর্মজাযক ও হিন্দু পন্ডিতদের মধ্যে আকীদা বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে বাছ, মুনাযারা ও তর্ক-বিতর্ক চলছিল। সাধারণ মুসলমানগণ উলামা ও মুনাযারা বিশারদগণকে সম্মান দিত এবং নিজের জান-মাল দ্বারা যথাসাধ্য খেদমত করত। অর্ধ শতাব্দী পূর্বে পৃথিবীর সকল অঞ্চলে মুসলমানদের এ অবস্থা ছিল। গোলাম আহমদ এটাকে তার নিজের জন্য সহজ ও সম্মানজনক কাজ মনে করল। আর, যে ধন-সম্পদ চাকুরির দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নহে তা এর দ্বারা অর্জন করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করল । তাই, সর্ব প্রথম সে হিন্দুদের বিরুদ্ধে একটা ঘোষণা প্রচার করল। পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে কিছু প্রবন্ধ লিখল। এরপর সে ধারাবাহিক হিন্দু ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ঘোষণা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করতে থাকে। এতে মুসলমানগণ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
(তা ১৮৭৭ ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা) তারপর সে ঘোষণা দিল যে, পঞ্চাশ ভলিয়মের একখানি পুস্তক সে রচনা করছে। কাফেরগণ ইসলামের বিরুদ্ধে যে সমস্ত আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করে উহাতে সে তার জবাব দেবে। তাই, যথা সময়ে বইটি ছাপানোর জন্য অগ্রিম মূল্য প্রদান করে এতে অংশ গ্রহণ করা মুসলমানগণের কর্তব্য সুতরাং তার ভ্রান্ত দ্বাবী ও উত্তেজনা মূলক ঘোষণা-বলী দ্বারা সাধারণ মুসলমানগণ এ ধোঁকায় পড়ে যান যে, সত্যই সে পঞ্চাশ ভলিয়মের এমন একটি কিতাব ছাপাবে যাতে ইসলামের ও মুসলমানদের উপর হিন্দু ও খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত সকল অভিযোগ আপত্তি খন্ডন করে ঐ গুলোর উত্তর দেবে? এসময়ে সে তার কেরামত ও মিথ্যা সাজান কাশ্ফ সমূহের ঘোষণা দিতে লাগল। ফলে মূর্খ লোকেরা মনে করল যে, সে মধু একজন আলেমই নহে বরং একজন মজযুব এবং আল্লাহর ওলী । তাই, কিতাবটি ছাপানোর জন্য তারা ওর কাছে প্রচুর পরিমাণ টাকা পাঠাতে লাগল। (গোলামের ঘোষণা বলী দ্রষ্টব্য, যা তাবলীগে রিসালাতের অন্তর্ভুক্ত, যা গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণা বলীর সমষ্টি। ১ম খন্ড ২৫ পৃ: এবং তাবলীগে রিসালত ২য় খন্ড এবং ১ম খন্ড ১৩ পৃ:) অতএব সে ১৮৮০ সনে পুস্তকটির ১ম খন্ড প্রকাশ করে এবং উহার নাম দেয় ‘‘বারাহীনে আহমদীয়া’’ এ খন্ডটি ঘোষণা বলী , প্রচারপত্র, তার কেরামত ও কাশফ দ্বারা পরিপূর্ণ। অতঃপর সে ২য় খন্ড প্রকাশ করে যা প্রথমটির মতই ছিল। এই ভাবে সে ১৮৮২ সনে ৩য় খন্ড এবং ১৮৮৪ সনে ৪থ খন্ড প্রকাশ করে। (বারাহীনে আহমদীয়ার ভূমিকা ১ম ২য় ৩য় ও ৪থ খন্ড, ) লোকের কাছে কিতাবটি পৌঁছার পর সকলেই আশ্চর্যান্বিত হল যে, এতে শত্রু পক্ষের আপত্তি ও সন্দেহাবলীর উল্লেখ করার পরিবর্তে তার নিজস্ব কেরামত ও কাফের উপনিবেশবাদের প্রশংসা পৃষ্ঠাগুলো ভরপুর করে দিয়েছে। এতে উলামা সমাজ বুঝতে পারলেন যে, লোকটি প্রতারক ও লুটেরা ব্যতীত আর কিছু নহে। সে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তার ঘোষণা বলী ও প্রচারপত্র সমূহ দ্বারা মুসলমানদের শোষণ করতে এবং সম্পদ, সম্মান ও খ্যাতি অর্জনকরতে চেয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানদের খেদমত এবং তাদের শত্রুর প্রতিরোধ করা তার উদ্দেশ্য নহে। বিশেষ করে যখন তারা ইসলামের বুনিয়াদের বিপরীত তার কিতাবের বর্ণনা-বলীর উপর অবহিত হলেন, তখন অনেক আলেম ভবিষ্যদ্ব্যাণী করলেন যে, ইসলামের নামে দোকান তৈরি করা ছাড়া লোকটির আর কোন উদ্দেশ্য নেই। যদি কেহ তাকে এর চেয়ে অধিক দান করে এবং তার জন্য বড় দোকান তৈরি করে দেয়, তবে সে ইসলামের বিরোধিতা করে হলেও সেই ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়বে। তারা যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন তেমনটিই ঘটেছে কেননা, ইংরেজরা তখন মুসলমানদের বিদ্রোহ এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। তারা মুসলমানদের মধ্যে এমন লোক খুঁজছিল, যাদের মুসলিম সমাজে খ্যাতি রয়েছে। এদেরকে তারা এজেন্ট নিযুক্ত করবে। যখন সাম্রাজ্যবাদীরা এমন পরিবারের একটি লোক পেল, যে তাদের এজেন্ট হিসাবে বিখ্যাত ছিল, তখন তারা এর সুযোগ গ্রহণ করল। এ জন্য গোলাম আহমদ উক্ত কিতাবের তৃতীয় খন্ড ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের প্রশংসায় পরিপূর্ণ করে দেয়। যখন এ ব্যাপারে মুসলমানদের পক্ষ থেকে আপত্তি উত্থাপন হল, তখন সে বলল- ‘‘কোন কোন মুসলমান আমার কাছে লিখেছে যে, আমি তৃতীয় খন্ডে ইংরেজ সরকারের প্রশংসা এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম কেন? কোন কোন মুসলমান এ প্রশংসার জন্য আমাকে গালমন্দও করেছেন। সুতরাং প্রত্যেকের জন্য উচিত , আমি কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার অনুসরণে এ সরকারের প্রশংসা করছি (হে আল্লাহর শত্রু! তুই মিথ্যা বলছিস। কেননা, ইসলাম কোন কাফের সাম্রাজ্যবাদী ও জবর দখলকারী সরকারের প্রশংসা করার শিক্ষা দেয় না।) এজন্য আমি বাধ্য হয়ে এ সরকারের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। (গোলামের ঘোষণা যা ‘বারাহীনে আহমদীয়ার চতুর্থ খন্ডের অন্তর্ভুক্ত।) )
মোটকথা, সাম্রাজ্যবাদ তাকে অস্ত্রস্বরূপ গ্রহণ করেছে এবং সমুদয় উত্তম ও মূল্যবান বস্ত্ত তার নিকট পেশ করেছে। তাই, তার পিতা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে যেমন বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল সেও তেমনি করল। তবে প্রথম বিশ্বাস ঘাতকতা ছিল তার দেশ ও দেশবাসীর প্রতি এবং দ্বিতীয়টি হল তার ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি। ফলে, সে সাম্রাজ্যবাদীদের মতবাদ এবং নির্দেশাবলী পালন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৮৮৫ সনে তার প্রথম ঘোষণা ছিল যে, সে একজন মুজাদ্দেদ। ১৮৯১ সনে সে দাবি করল যে, সে প্রতিশ্রুত ‘মাহদী’’ আর ঠিক ঐ বৎসরই সে দাবি করল সে প্রতিশ্রুত ‘‘মাসীহ’’। তবে সে অনুসারী নবী। তারপর সে ১৯০১ সনে ঘোষণা দিল যে, সে স্বয়ং সম্পূর্ণ নবী এবং সকল নবী রাসূলগণের মধ্যে উত্তম। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকেরা তার নবুয়তের দাবির পূর্বেই বুঝে নিয়েছেন যে, সে এটাই চায়। কিন্তু প্রথমে সে কঠোরভাবে ইহা অস্বীকার করে বলে যে, আহলে সুন্নাহর যে আক্বীদা, আমি ও সেই আক্বীদা পোষণ করি। আমি বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এসে শেষ হয়ে গেছে (গোলামের ঘোষণা ২১শে অক্টোবর ১৮৯১ খৃ: যা তাবলীগে রেসালত ২য় খন্ড ২য় পৃ: অন্তর্ভুক্ত)। তারপর সাম্রাজ্যবাদের প্ররোচনায় আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলে- ‘আমি নবী নই, তবে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে নবায়নকারী ‘কালীম’ বানিয়েছেন; যাতে, আমি দ্বীনে মুস্তফার নবায়ন করতে পারি। (গোলাম রচিত ‘মেরাতে কামালাতে ইসলাম’ ৩৮৩ পৃ:) ধীরে ধীরে সে বলতে আরম্ভ করল, ‘আমি নবী নই, তবে আমি ‘মুহদাস’। নবী হওয়ার যোগ্যতা রাখে, তবে কার্যত: সে নবী নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘হামামাতুল বুশরা’’ এর সারাংশ, ৯৯ পৃ:) অতঃপর সে বলে: ‘মুহদাস হল অসম্পূর্ণ নবী । সে যেন নবীগণ ও উম্মতগণের মধ্যে পুলের ন্যয় যোগসূত্র’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘এজালাতুল আওহাম’ ৫২৯ পৃ:) অতঃপর সে বলে আমি ঐ মাসীহ যার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়ে গেছেন। (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘এজালাতুল আওহাম’ ৮৩ পৃ:)
পরিশেষে বলে ‘ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, তিনিই আমাকে প্রেরণ করেছেন এবং আমাকে নবী নামে অভিহিত করেছেন। আর আমার দাবির সত্যতা প্রমাণে তিন লক্ষ নিদর্শনা বলী প্রকাশ করেছেন’ । (গোলামের হাকীকতুল ওহীর পরিশিষ্ট, ৬৮ পৃ:) অথচ সে নিজেই ইতিপূর্বে বলেছে যে, ‘‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবি করবে সে মুসাইলামা আল কাজ্জাবের ভাই এবং কাফের ও খবীছ’’ (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ ২৮ পৃ:) আরো সে বলেছে- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুয়তের দাবি করবে, তাকে আমরা অভিশাপ দেই। (গোলামের ঘোষণা যা ‘তাবলীগে রেসালাতের’ অন্তর্ভুক্ত, ৬ষ্ট খন্ড ২য় পৃ:) এভাবে নবায়নের দাবি হতে তার প্রচারের সূচনা হয় এবং নবুয়তের দাবিতে গিয়ে সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, যে কিতাবের পঞ্চাশ খন্ড প্রকাশ করার জন্য সে ঘোষণা দিয়েছিল উহার মাত্র পাঁচ খন্ড প্রকাশ করেছে। যখন চাঁদা দাতাদের পক্ষ থেকে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে উত্তর দিল- ‘পাঁচ ও পঞ্চাশের মধ্যে শুধু একটা বিন্দুর পার্থক্য। (গোলামের ‘বারাহীনে আহমদীয়ার’ ভূমিকা, ৫ম খন্ড ৭পৃঃ)
তার চাল-চলন ও চরিত্র:
কাদিয়ানীদের এ নেতা ও ভন্ডনবী চারিত্রিক দৃষ্টি কোন থেকে নজির বিহীন ছিল। এমন কোন গাল-মন্দ নেই যা সে জানে না এবং তার প্রতিপক্ষ ও বিরোধীর প্রতি সে তা ব্যবহার করেনি। একদা সে কোন এক ব্যক্তির নির্দিষ্ট সময়ে মারা যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে সে ব্যক্তি ঐ নির্দিষ্ট সময়ে মারা যায়নি। তখন তাকে কোন কোন আলেম জিজ্ঞাসা করলেন যে, তুমি নবী বলে দাবিকর এবং আল্লাহর ওহী ব্যতীত কথা বল না তবে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না হওয়া কেমন করে সম্ভব হয়? তখন দলীল প্রমাণ সহ তাদের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে সে তাদেরকে এবং সমস্ত মুসলমান আলেমদেরকে গালি দিতে শুরু করে। তার ভাষ্য ছিল এরূপ- ‘পৃথিবীতে শুকর হতে অপবিত্র আর কিছু নেই, কিন্তু ঐ সকল আলেম যারা আমার বিরোধিতা করে তারা শুকর হতেও অপবিত্র। হে আলেমগণ! হে মৃতদেহ ভক্ষণ কারী গণ এবং হে অপবিত্র আত্মার অধিকারীগণ! (গোলামের আঞ্জামে আথম, ২১ পৃ:) সে আরো বলে: ‘হে দুর্ভাগা অপবাদ কারী গণ! জানি না, এ অসভ্য দল লজ্জাবোধ করে না কেন? তাদের চেহারা কাল করে দেয়া হবে’। (গোলাম কাদিয়ানীর আঞ্জামে আথম ৫৮ পৃ:) সে তার বিরুদ্ধবাদীদের এই বলে গালি দেয় যে, ওদের কেহ কেহ কুকুরের ন্যায়, কেহ নেকড়ে বাঘের ন্যায় এবং কেহ শুকরের ন্যায় ।’ (গোলামের ‘খুৎবায়ে ইলহামিয়া’ ১৫০পৃঃ) তার শত্রুদেরকে ব্যাপকভাবে এ সকল গালি দিয়েও সে সন্তুষ্ট হয়নি, বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তাদের নাম উল্লেখ করে গালি দিতে থাকে। যেমন বলেছে- ‘হে আব্দুল হক নামী শয়তানের গোলাম! তোর মৃত্যু হোক।’’ (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ ৫৮ পৃ:) সে আরো বলে: আব্দুল হক আমাদের বিজয় সহ্য করতে পারে নি। কেননা, তার আগ্রহ সে যেন জারজ সন্তানে পরিণত হয়।’ (গোলামের ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ ৩০ পৃ:) তার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে সা’দুল্লাহ নামী এক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সম্মুখে সে তার নিজ চরিত্র প্রকাশ করে বলে ‘হে প্রেত, উতর, পাপিষ্ঠ, শয়তান, অভিশপ্ত আহাম্মকের বীর্য, খবীস, মুফসেদ, মিথ্যাবাদী, হতভাগা ও বেশ্যার পুত্র! (আল্লাহ পানাহ, আল্লাহ পানাহ, কাদিয়ানীদের নবীর এমন উক্তি হতে) (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ ২৮১ পৃ:) প্রসিদ্ধ মুনাযির তর্কবাগিশ শেখ ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে এই বলে সম্বোধন করে- ‘হে কুকুর, হে মৃতদেহ ভক্ষণকারী, ! (আঞ্জামে আথম’ এর টিকা, ২৫ পৃ:) আরো সম্বোধন করে- ‘হে আবু জাহেল হে কাকতাড়ুয়া সন্তান ও বিশ্বাস ঘাতক!’ (গোলামের ‘এজাজে আহমদী’ ৪৩ পৃ:) ভারতবর্ষের জনৈক শাইখে তরী-কতকে সে এই বলে সম্বোধন করে- ‘মিথ্যুক, অপবাদকারী, খবীছ, বিচ্ছু এবং হে কুলরা ভূমির কীট! (যা এই শেখের বাসস্থান) তোর উপর আল্লাহর অভিশাপ! ইবলিসের কারণে তুই অভিশপ্ত হয়েছিস। তুই হল গুমরাহীর শেখ, ও হতভাগা’। (গোলামের ‘নুযুলুল মাসীহ’ ৭৫ও ৭৬ পৃ:)
একটি আরবী কবিতার কলিতে সে তার সকল শত্রুর উল্লেখ করে বলে:-
(সকল শত্রুরা মাঠের শুকর হয়ে গেছে।
আর তাদের নারীগণ তাদের সম্মুখে কুকুরীর ন্যায়।)
(গোলামের ‘নজমুল হুদা’ ১০ পৃ:)
কাদিয়ানী নবী এর চেয়ে অধিক এমন সব গাল মন্দ উচ্চারণ করত যা কান শুনতে চায় না এবং মুখও উচ্চারণ করতে চায় না। বিশেষ করে ঐ সকল গাল-মন্দের ব্যবহার যা ইসলামী আইনে অপবাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং একজন সাধারণ লোকও তা উচ্চারণ করতে ঘৃণাবোধ করে। একদা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ‘তুই জারজ সন্তান’ বলে গালি দিতে শুনে বলল: ওমর রা. এর সময়ে এরূপ গালির উপর অপবাদের শাস্তি হিসাবে কোড়া মারা হত। কিন্তু আজ কাল এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে জারজ সন্তান বলে গালি দিতে শুনেও লোকেরা কোন সাড়া দেয় না, এ গালিটি যেন তাদের কাছে কিছুই নহে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ‘জুমআর খুতবা’ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলের অন্তর্ভুক্ত, ১৩ই ফেব্রু: ১৯২২ খৃ: প্রকাশিত) অতএব হে গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ! তোমার পিতা সম্পর্কে তুমি কি বল? যখন সে কোন মুসলমান আলেমকে এই বলে গালি দেয় ‘তুমি তোমার অপবিত্রতার দ্বারা আমাকে কষ্ট দিয়েছ। হে নর্তকীর ছেলে! তুই যদি অপদস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ না করিস, তাহলে আমি সত্য নবী নই’। (গোলামের আঞ্জামে আথম ৮৮ পৃ:) তোমার পিতা এবং তোমার নবী, যার তুমি খলীফা, বল তো সে কোড়ার উপযুক্ত হলো কি না?
ভন্ডনবী কাদিয়ানীর ভান্ডারে এরূপ গাল-মন্দ অনেক রয়েছে। সে তার বিরুদ্ধবাদীগণকে প্রায়শ: বলত: ‘অমুক হারামজাদা, অমুক বেশ্যার সন্তান।’ উম্মতের অনেক বিশিষ্ট লোক ও নেতাদেরকে সে এরূপ অশ্লীল গাল-মন্দ দিয়েছে। একদা সে সমস্ত উম্মতকে তার অদ্ভুত শব্দাবলি দ্বারা সম্বোধন করেছে: ‘এ সকল পুস্তকাদির প্রতি সকল মুসলমান ভালোবাসার চোখে দেখবে এবং উহার মারেফত থেকে উপকৃত হবে, আর, আমাকে গ্রহণ করবে এবং আমার দাওয়াত বিশ্বাস করবে, কিন্তু বেশ্যার সন্তানরাই বিশ্বাস করবে না, যাদের অন্তরের উপর আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন’। (গোলামের ‘মেরাতু কামালাতিল ইসলাম’ ৫৪৭ পৃ:) মুসলমানদের একজন শ্রেষ্ঠ আলেমকে সে এই বলে গালি দিয়ে বলে: ‘তুমি ঐ ভাবে নর্তন করছ যেমন নর্তকীরা মঞ্চে নর্তন করে। (গোলামের ‘হুজ্জাতুল্লাহ’ আরবী ৮৭ পৃ:) একজন খ্রিস্টান ব্যক্তিকে সে গালি দিয়ে বলে: ‘এটা হল জারজ সন্তানের লক্ষণ যে, সে সঠিক পথে চলে না।’ (গোলামের ‘আনওয়ারুল ইসলাম’ ৩০ পৃ:) আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে এই বলে গালি দেয়: ‘তারা জারজ সন্তান এবং হীন স্বভাবের লোক।’ (গোলামের ‘আরিয়া ধর্ম’ ৫৪ পৃ:)
এই হল কাদিয়ানী নবীর চরিত্রের সাধারণ নমুনা। অন্যথায়, সে এ ব্যাপারে সকল সীমা লঙ্ঘন করেছে। এ ব্যাপারে তার কোন জুড়ি নেই। এমন কোন লোক কি পাওয়া যাবে? যে পূর্ণ চারটি পৃষ্ঠা শুধু লা‘নত লিখে কালো করেছে। হ্যাঁ সে-ই ঐ ব্যক্তি! যে তার একটি পুস্তকের পূর্ণ চারটি পৃষ্ঠা ‘লা‘নত’ শব্দ লিখে কালো করেছে। সে তার বিরুদ্ধবাদীদের উপর লানত লানত লানত এ শব্দটিকে এক হাজার বার লিখেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘নুরুল হক’ ১১৮-১২২ পৃ: দেখুন।) খ্রিস্ট ধর্মের একজন লোকের উপর হাজার বার লানত করেছে। (তাবলীগে রেসালত) তার পুস্তকাদিতে এ জাতীয় গাল-মন্দের ব্যবহার অনেক। এমনকি কোন লোক আছে যে, নবীগণকে গালি দেয়? হ্যাঁ! ভন্ডনবী কাদিয়ানীই আল্লাহর নবী ঈসাকে আলাইহিস সালাম গালি দিয়ে বলে: ‘ঈসা তার নিজের ব্যাপারে একথা বলতে পারেনি যে, তিনি সৎ। কেননা, লোকেরা তাকে মদ্যপায়ী এবং বদ চরিত্র বলে জানত। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘চিত্তে ভজনের’ টীকা ১৭২ পৃ:) সে আরো বলে: ঈসা আলাইহি সালাম বেশ্যাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন।’ কেননা, তাঁর মাতামহীগণ বেশ্যা ছিলেন। (আল্লাহ পানাহ) (গুলমের ‘আঞ্জামে আথম’ এ পরিশিষ্টের টিকা, ৭পৃঃ)
আশ্চর্যের বিষয়, এরকম অশালীন ও অভিশপ্তকারী ব্যক্তি দাবিকরে যে, সে নবী। সে নিজেই বলেছে: ‘‘গাল-মন্দ করা ছিদ্দকগণের কাজ নহে । আর, মুমিন ব্যক্তি অভিশপ্তকারী হতে পারে না’’ । (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ৬৬ পৃ: আবার তার ছেলে বলেছে: মানুষ যখন পরাজিত হয়ে যায় এবং তার দাবির সমর্থনে কোন প্রমাণ পায় না, তখনই গালাগালি আরম্ভ করে। আর, যত বেশি সে গালাগালি করবে, তার পরাজয় তত বেশি প্রমাণিত হবে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ‘আনওয়ারুল খেলাফত’ ১৫পৃঃ) ক্রিমিনাল আদালতের দুইজন বিচারক কাদিয়ানী ভন্ডনবীকে দোষী সাব্যস্ত করে বলেছেন যে, সে (গোলাম) অসচ্চরিত্র, অশালীন ভাষা এবং অশ্লীল শব্দ প্রয়োগকারী। তার কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন যে, সে যেন তার বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি পুনরায় এরূপ শব্দাবলি প্রয়োগ না করে । গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে এ অঙ্গীকার করেছে। সে এর উল্লেখ করে বলে: ‘আমি নায়েবে হাকীমের সম্মুখে অঙ্গীকার করেছি যে, আমি এরপর এ ধরনের অশ্লীল শব্দাবলি আর ব্যবহার করব না।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘কিতাবুল বারিয়্যহ’ ভূমিকা, ১৩ পৃ:)
এই হল চারিত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাদিয়ানী নবীর স্বরূপ এবং তার গালিগালাজ। আমরা তার নিজ পুস্তক ও ভাষা হতে এখানে কিছুটা উল্লেখ করলাম।
তার আচার-ব্যবহার:
তার লেন দেনের অবস্থা এই যে, সে একটি ঘোষণা প্রচার করল: ‘আমার সকল অনুসারীদের উপর কর্তব্য হলো তারা যেন প্রত্যেক মাসে তাদের মালের একটা অংশ আমার কাছে পাঠায় । এ ঘোষণার পর আমি তিন মাস অপেক্ষা করব। যে ব্যক্তি এ সময়ের মদ্যে তার কিছু মাল আমার কাছে পাঠাবে না, আমার মুরিদগণের তালিকা হতে তার নাম মুছে ফেলব’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘লাওহুল মাহদী’ ১ম পৃ:) আর একবার সে ঘোষণা দিল: কাদিয়ানী ধর্মের জন্য সকলের কিছু দান করা উচিত। কারণ, টাকা পয়সা ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নহে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে, মুসা আলাইহিস সালাম ঈসা আলাইহিস সালাম এবং অন্য সকল নবীর যুগে এভাবে দানের টাকা একত্রিত করা হয়েছে। তাই এ দিকে আমার জামাতের লক্ষ্য করা কর্তব্য এবং সম্ভাব্য দান সমূহ একত্রিত করা উচিত’। (গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদরে প্রকাশিত’ ৯ই জুলাই, ১৯০৩ খৃ:) ‘‘খেদমতে ইসলাম’’ নাম দেওয়ার কারণে লোকেরা তার কাছে বড় বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু এ টাকা গুলো কোথায় ব্যয় করা হল ? এ প্রশ্নের উত্তরে একজন বিশিষ্ট কাদিয়ানী নেতা বলে: একদা আমি, খাজা কামালুদ্দীন (কাদিয়ানীদের অন্যতম নেতা) ও অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী (লাহোর কাদিয়ানী জামাতের আমীর) চাঁদা আদায় করতে গেলাম। রাস্তায় অধ্যাপক খাজা কামালুদ্দীন আলোচনা করতে লাগলেন যে প্রথম প্রথম আমরা লোকজনকে বলতামঃ আম্বিয়া এবং সাহাবাগণের মত জীবন অবলম্বন করা আমাদের উচিত এবং তারা যেরূপ কাজ করে গেছেন তদ্রুপ আমাদের কাজ করা উচিত। তারা মোটা কাপড় পরিধান করতেন এবং মোটা ভাত খেতেন। আর, আল্লাহর রাস্তায় তাদের ধন সম্পদ ব্যয় করতেন। আমরা এ সকল কথা বলতাম এবং লোকজন থেকে এমনকি আমাদের মহিলাদের থেকেও চাঁদা আদায় করে কাদিয়ানে পাঠাতাম। কিন্তু এর পর যখন আমাদের স্ত্রী গণ ও অন্যান্যদের স্ত্রী গণ কাদিয়ানে গেলেন, তখন তারা ওখানকার অবস্থা দেখে রাগান্বিত হয়ে ফিরে আসলেন এবং বললেন তোমরা বড়ই মিথ্যাবাদী। আমরা নিজ চোখে নবী ও সাহাবীদের জীবন যাপন দেখে এসেছি, তাদের স্ত্রী ও মহিলাদের দেখলাম খুবই প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে জীবন যাপন করছেন। বাহিরে এর দশ ভাগের এক ভাগও দেখা যায় না। অথচ টাকা পয়সা তাদের জন্য পাঠান হয় না বরং আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য পাঠান হয়। আমরা চাইলে এ সম্পদ নিজেদের জন্য ব্যয় করতে পারতাম। কেননা, আমাদের এ সম্পদ হালাল উপায়ে আমরাই অর্জন করেছি । সুতরাং এরপর আর কিছুই আমরা দান করব না। (কাদিয়ানী মুফতি ছরওয়ার শাহ লিখিত ‘কাশফুল ইখতিলাফ’ ১৩ পৃ:) গোলাম পুত্র এ বাস্তব সত্যকে কাদিয়ানী প্রদত্ত তার জুম আর খুতবায় স্বীকার করেছে যে, ‘‘লুদিয়ান নিবাসী’’ (ভারতের একটি শহর) এক ব্যক্তি একদা বলেছে আমরা অতি কষ্টে এবং দুরবস্থায় কাদিয়ানে চাঁদা পাঠাই, আর সেখানে এ টাকা গুলো গোলাম আহমদের স্ত্রীর অলংকারাদি এবং পোশাক পরিচ্ছেদে ব্যয় করা হয়। সুতরাং এ সমস্ত চাঁদা দিয়ে লাভ কি? যখন এ সংবাদ মাসীহে মাওউদের কাছে পৌঁছোল তখন সে বলল: এর পর আমাদের কাছে কিছু প্রেরণ করা ঐ ব্যক্তির জন্য হারাম। অতঃপর আমরা দেখব এতে আমাদের কি ক্ষতি হয়। (গোলাম পুত্র ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে’ প্রকাশিত, ৩১ আগস্ট ১৯৩৮ খৃ:) একবার যখন ভন্ডনবী কাদিয়ানীর উপর এ আপত্তি উঠল যে, ধর্মের নামে যে সমস্ত চাঁদা আদায় করা হয়, তা সে তার নিজের ও তার স্ত্রী গণের জন্য ব্যয় করে ফেলে। তাই , লোক সম্মুখে এর হিসাব প্রকাশ করা উচিত। উত্তরে সে বলল- আমি কোন ব্যবসায়ী নই যে, আমার নিকট উহার হিসাব রাখব এবং জমিয়তের কোষাধ্যক্ষও নই যে, উহার হিসাব দিব আমি জমিনে আল্লাহর প্রতিনিধি। তাই, আমার নিকট এ জিজ্ঞাসা করা সম্ভব নয় যে, আমি উহা কোথায় খরচ করেছি এবং কোথায় ব্যয় করেছি। সত্যিকারের ঈমানদার তারাই, যারা তাদের সম্পদ আমাকে দান করার পর তাদের বুঝে আসুক বা না আসুক আমাকে জিজ্ঞাসা করে না । আপত্তি উত্থাপন করা ঈমান চলে যাওয়ার কারণ বলে মনে করি। (গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণার সারাংশ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজলে’ প্রকাশিত, ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ খৃ:)
এ সকল অভিযোগ কারী গণ কাদিয়ানীদের বড় বড় নেতা ছিলেন। গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ বর্ণনা দিচ্ছে যে, জনাব গোলাম তার মৃত্যুর পূর্বে বলেছেন অধ্যাপক খাজা কামালুদ্দীন ও শেখ মুহাম্মদ আলী আমার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে এবং আমাকে অপবাদ দেয় যে, আমি অন্যায় ভাবে লোকের সম্পদ ভক্ষণ করি। এটা তাদের জন্য উচিত নহে। এমনকি অদ্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী (কাদিয়ানী নেতা) আমার নিকট একটি পত্র পাঠিয়েছে, যাতে সে বলেছে যে, নিয়মিত খরচতো অল্পই হচ্ছে। তবে অবশিষ্ট সম্পদ যা হাজার হাজার টাকা হবে তা কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে? তারপর অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন: তারা বলে যে, আমরা হারাম ভক্ষণ করছি অথচ এসব টাকা পয়সার সহিত তাদের কোন সম্পর্ক নেই।যদি আমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি তবে তাদের কাছে এসব সম্পদ এমনকি একটি পয়সাও আসবে না। (নুরুদ্দীনের নিকট গোলাম পুত্রের লিখিত পত্র যা মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানীর লিখিত ‘হাকীকতুল এখতেলাফ’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত, ৫০ পৃ:)
এসব লেন-দেনের ব্যাপারে সে এতই নীচে নেমেছে যে, একদা সে ঘোষণা দিল, পঞ্চাশ খন্ডের একখানা পুস্তক সে ছাপাতে চায়। যে ব্যক্তি অগ্রিম টাকা পাঠাবে, তার কাছে অর্ধেক মূল্যে কিতাব পাঠান হবে। ফলে, অনেক সাদা সিদে লোক এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে পঞ্চাশ খন্ডের টাকা পাঠিয়ে দিল। কিন্তু তার মৃত্যু পর্যন্ত এ পুস্তকের মাত্র পাঁচ খন্ড ব্যতীত আর ছাপা হয়নি। যখন লোকজন তাকে জিজ্ঞাসা করল যে, আপনি আমাদের কাছে পঞ্চাশ খন্ড ছাপাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এর মূল্যও গ্রহণ করেছেন। উত্তরে সে এমন কথা বলল যা বিবেকবানদের উপদেশ বটে।তার উত্তরের বিবরণ হল এই হ্যাঁ, আমি পঞ্চাশ খন্ড ছাপাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সত্য কিন্তু পাঁচ ও পঞ্চাশের মধ্যে মাত্র একটি বিন্দুর পার্থক্য। কাজেই আমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি। (গোলামের ‘বারাহীনে আহমদীয়ার’ ভূমিকা ৫ম খন্ড ৭পৃঃ)
যখন লোকজন তাদের অবশিষ্ট মূল্য ফেরত চাইল তখন উত্তরে সে বলল: এটা আল্লাহর দেওয়া সম্পদ। এর একটি পয়সাও আমি কাউকে ফেরত দেব না, অনুরূপভাবে আমি কাউকে এ প্রশ্নের জবাবও দেব না। কেহ যদি আমার নিকট এর হিসাব চায় তবে সে যেন এরপর আর আমাকে কিছুই না দেয়। (গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল হিকমে’ প্রচারিত এবং ২১ মার্চ ১৯০৫ ইং প্রকাশিত।) তার পুত্র বশীর আহমদ বলেছে: আমাকে আব্দুল্লাহ আল সিন্নূর কাদিয়ানী বলেছে: এক ব্যক্তি জনাব গোলামের নিকট এসে একটা ফতওয়া চাইল যে, তার ভগ্নী কিছু সম্পদ রেখে গেছে, সে একজন বেশ্যা নারী ছিল, বেশ্যা বৃত্তির দ্বারা সম্পদ উপার্জন করত। হযরত তাকে উত্তর দিলেন: এ যুগে এ সম্পত্তি ইসলামের সেবায় ব্যয় করা যেতে পারে। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের লিখিত সিরাতুল মাহদী, ৩৪০ পৃ:) উল্লেখযোগ্য যে, গোলামের যুগে তার দৃষ্টিতে সে ছাড়া আর কেহই ইসলামের খাদেম ছিল না।
তার মিথ্যাচার সমূহ:
ভন্ডনবী কাদিয়ানী মিথ্যা সম্পর্কে বলে: ‘মিথ্যা হল সকল ঘৃণ্য বস্ত্তর মূল’। (গোলামের উক্তি যা ‘তাবলীগে রেসালাতের’ অন্তর্ভুক্ত ৭ম খন্ড, ২৮ পৃ:) সে আরো বলে: মিথ্যা বলা মুরতাদ (ধর্মান্তরিত) হওয়ার চেয়ে কম অপরাধ নহে।(গোলামের ‘‘আরবাঈনের’’ হাসিয়া, ৩ নম্বর ২৪ পৃ:) কিন্তু সে নিজেই মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত ছিল। তার সবচেয়ে বড় মিথ্যা হল আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করা যে, তিনি তাকে রাসূল বানিয়েছেন এবং তার কাছে ওহী পাঠিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি কয়েকটা প্রবন্ধে অনেক আলোচনা করেছি। তাই আমি এখানে আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না ।
অপর একটি প্রধান মিথ্যা হল: কুরআনের নাম নিয়ে এমন কথা বলে যা কুরআনে নেই। সে বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(গোলাম কাদিয়ানীর ‘নুরুল হক’ ১ম খন্ড ৪৬ পৃ:) অথচ কুরআনের কোথাও এ ভাষ্য পাওয়া যায় না। গোলাম এ এবারতের অনেকবার পুনরাবৃত্তি করেছে , কেননা, সে ‘ফরইয়াদ দরদে বালাগ’ নামক তার পুস্তকে এ এবারতকে কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে চারবার উল্লেখ করেছে, ৮,১০,১৭,২৩, পৃ:। তার ঘোষণাবলীতেও তা উল্লেখিত রয়েছে, যা ‘তাবলীগে রেসালতের’ অন্তর্ভুক্ত ৩য় খন্ড ১৯৪ পৃ: এবং ৭ম খন্ড ৩৯পৃঃ)
সে আর এক স্থানে বলেছে: কুরআনে আছে, (গোলাম কাদিয়ানীর ‘হাকীকতুল ওহী’ ১৫৪ পৃ:) আর এটাও কুরআন সম্পর্কে তার একটা স্পষ্ট মিথ্যা। সে তার কিতাব ‘তাজকেরাতুশ শহাদাতাইন’ এ বলেছে: ‘দেখুন, কুরআনে করীমে আল্লাহপাক কি বলেন:
(গোলাম কাদিয়ানীর ‘তাজকেরাতুশ শহাদাতাইন’ ৩৪ পৃ:)এ এবারত সমূহ তার পুস্তকাদিতে এরূপই পাওয়া যায়। অথচ এ গুলো অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে। এর দ্বারা শুধু তার এটাই উদ্দেশ্য যে, মানুষের মনে এ সন্দেহ সৃষ্টি করা যে, কুরআনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কুরআনের উপর যেমন মিথ্যা-রোপ করেছে তদ্রুপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরও মিথ্যা-রোপ করেছে। সে লিখেছে : রাসূলুল্লাহকে কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? উত্তরে তিনি বললেন: সমস্ত মানব জাতীর উপর আজকের দিন হতে একশত বৎসরের মধ্যে কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘এযালাতুল আওহাম’ ২৫৩ পৃ:) অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও এমন উক্তি করেন নি যে, সমস্ত মানব জাতীর উপর একশত বৎসরের মধ্যে ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। কেহই তা প্রমাণ করতে পারবে না। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরো মিথ্যা আরোপ করে বলেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যখন কোন শহরে বালা-মছিবত অবতীর্ণ হয়, শহরবাসীর জন্য তৎক্ষণাৎ এ শহর ত্যাগ করা উচিত। নচেৎ তারা আল্লাহর সাথে যুদ্ধকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (মুরিদগণের প্রতি গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল-হিকমে’ প্রচারিত, ২৪ আগস্ট, ১৯০৭ খৃ:) এটা রাসূলুল্লাহর নামে একটি মিথ্যা ও জঘন্য অপবাদ।
সে অন্য এক স্থানে এ মিথ্যা উক্তি করেছে: ছহীহ হাদীসে আছে যে, মাসীহে মাওউদ শতাব্দীর প্রান্তে অবতীর্ণ হবেন এবং তিনি চৌদ্দ শতাব্দীর ইমাম হবেন’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘নুসরতুল হকের’ পরিশিষ্ট ১৮৮পৃঃ)
সকল নবীর উপর সে অপবাদ দিয়ে বলেছে: পূর্ববর্তী সকল নবীর ওহী একবাক্যে বলে যে,মাসীহে মাওউদ চৌদ্দ শতাব্দীতে জন্ম গ্রহণ করবেন এবং তিনি পাঞ্জাবেই জন্ম গ্রহণ করবেন। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আরবাঈন’ ২৫ নম্বর,২৩ পৃ:) এটা স্পষ্ট মিথ্যা এবং প্রকাশ্য অপবাদ। কারণ সকল নবীতো দুরের কথা একজন নবীর নিকট ও এ অর্থে কোন ওহী পাওয়া যায় না। আল্লাহর নবী ঈসার আলাইহিস সালাম উপর সে মিথ্যা-রোপ করেছে যে, ‘তিনি গালি গালাজে অভ্যস্ত ও কুচরিত্রবান ছিলেন। ধৈর্য না থাকার কারণে তিনি সাধারণ বিষয়ে রাগান্বিত হয়ে উঠতেন’ আরো সে কটাক্ষ করে বলে: ‘ঈসা আলাইহিস সালাম মিথ্যায় অভ্যস্ত ছিলেন’। (গোলাম কাদিয়ানীর জমীমায়ে আঞ্জামে আথমের টিকা, ৫পৃঃ)
তার উপর আরো মিথ্যা-রোপ করে বলে: ‘ঈসা আলাইহিস সালাম পুরুষত্ব হতে বঞ্চিত ছিলেন, যা মানুষের জন্য অতি উঁচু প্রশংসনীয় গুণ’। (মাকতুবাতে আহমদিয়া, যা গোলাম কাদিয়ানীর চিঠি পত্রের সমষ্টি, ৩য় খন্ড, ২৮পৃঃ।)
ঈসার আলাইহিস সালাম উপর সে আরো মিথ্যা-রোপ করে বলেছে: ঈসা আলাইহিস সালাম যাদুকর ছিলেন যা কিছু তার থেকে প্রকাশ পেয়েছে তা এ যাদুর বলেই প্রকাশ পেয়েছে’। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ৩০৯ পৃ:)
ঈসা আলাইহিস সালাম এর উপর তার মিথ্যাসমূহ পূর্ববর্তী ‘নবুয়তের দাবিদার....... অবমাননা’ শীর্ষক তৃতীয় প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। সে ঈসার আলাইহিস সালাম প্রতি বিদ্বেষ রাখত, বিশেষ করে এ উদ্দেশ্যে যে, সে যেন ঈসার আলাইহিস সালাম চারিত্রিক গুণাবলি ধ্বংস করে দিতে পারে, যাতে লোকজন তার দোষত্রুটির উপর আপত্তি উত্থাপন করতে না পারে।
নবী রাসূলগণের উপর তার মিথ্যাচার আরো অনেক রয়েছে। আমরা এখানে এতটুকুই উল্লেখ করা যথেষ্ট মনে করি।
তার মিথ্যাচারের আরো কয়েকটি নমুনা হল এই: ‘গত কয়েক বছরে আমার হাতে লক্ষাধিক লোক বয়আত করেছে।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তুহফাতুন নদওয়া’) কাদিয়ানী ম্যাগাজিনে গোলামের ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে, এ পর্যন্ত আমার হাতে প্রায় এক লক্ষ লোক তওবা করেছে ।’ (কাদিয়ানী ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিউন্স, সেপ্টেম্বর ১৯০২ খৃ:) এর সাড়ে তিন বৎসর পর সে লিখেছে, ‘আমার হাতে প্রায় ৪লক্ষ লোক তওবা করেছে।’ (তজল্লিয়াতে এলাহিয়া, ৩পৃঃ, ৩রা মার্চ ১৯০৬ খৃ: মুদ্রিত।) একই বক্তব্য তার ‘হাকীকতুল ওহী’ নামক পুস্তকে উল্লেখ করেছে। ‘আমি হাজারো শুকরিয়া আদায় করছি যে, এ পর্যন্ত আমার হাতে চার লাখ লোক কুফুর ও পাপাচার হতে তওবা করেছে’। (গোলামের ‘হাকীকতুল ওহীর’ পরিশিষ্ট ১১৭ পৃ:) তার মৃত্যুর চৌদ্দ বছর পর তার পুত্র ও তার খলীফা ঘোষণা করেছে যে, কাদিয়ানীর সংখ্যা চার পাঁচ লাখে পৌঁছে গেছে। (কাদিআনী পত্রিকা ‘আল-ফজল ২৬ জুন, ১৯২২ খৃ:) কিন্তু সরকারী আদম শুমারী ভন্ডনবী কাদিয়ানী ও তার পুত্রের ভাষ্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেয়। তার ছেলে এই বলে স্বীকার করেছে. ‘সরকারী আদম শুমারী অনুযায়ী পাঞ্জাবে কাদিয়ানীদের সংখ্যা ছাপ্পান্ন হাজার এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে কাদিয়ানীদের সংখ্যা বিশ হাজার বলে অনুমান করা যায়। এমনি ভাবে আমাদের সংখ্যা ছিয়াত্তর হাজারে দাঁড়ায়’। (গোলাম পুত্র এবং কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ অহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলের অন্তর্ভুক্ত, ২১ জুন১৯৩৪ খৃ:)
সুতরাং তার মিথ্যা সুস্পষ্ট। ১৯০৬ সালে গোলাম বলছে যে তার জামাতের লোক সংখ্যা চার-লাখ। কিন্তু আঠারো বৎসর পরের আদম শুমারী বলছে যে, গোলাম পুত্রের উক্তি অনুযায়ী নারী ও শিশু সহ তাদের সংখ্যা ছিয়াত্তর হাজারের অধিক নহে। হায় লজ্জা, হায় শরম। এমনিভাবে ১৮৯৯ সনে সে যে উক্তি করেছে উহাও মিথ্যা। সে বলেছে: ‘আমার তিন হাজারের অধিক ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত ও সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’ ‘‘হাকীকতুল মাহদী’’ ৮পৃঃ ১৮৯৯ সালে মুদ্রিত। কিন্তু দুই বৎসর পর যে নিজেকে মিথ্যা প্রমাণিত করে লিখেছে: আমি নিজে দেখেছি যে, এ পর্যন্ত আমার একশত পঞ্চাশটি ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে। (এজালাতুল গালতা’ ৭ পৃ: ১৯০১ সালে মুদ্রিত।)
তার অপর একটি মিথ্যাচার হল, সে লিখেছে: ‘‘আমার মোজেজা সমূহ এক মিলিয়নেরও অধিক।’’ (গোলাম কাদিয়ানী রচিত ‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ ৪১ পৃ:) সুতরাং মিথ্যা ও অপবাদ জনাব গলিম কাদিয়ানীর স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও সে বলে যে, মিথ্যা ধর্মান্তরিত হওয়ার চেয়ে কম অপরাধ নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আরবাঈন’ কিতাবের হাসিয়া ৩৫ নম্বর ২৪ পৃ:।) সে আরো বলে: ‘অপবাদকারীর উপর আল্লাহর লা’নত এবং আল্লাহর কাছে তার কোন মর্যাদা নেই।’ (গোলামের ‘নুসরতুল হক’ ১০ পৃ:)
এইতো হল কাদিয়ানীর কথা। অপর দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘যার মধ্যে এ চারটি স্বভাব রয়েছে সে খাঁটি মুনাফিক, আর যার মধ্যে এর একটি রয়েছে তার মধ্যে নেফাকের একটি চরিত্র রয়েছে, যতক্ষণ না সে তা বর্জন করে:( ১) যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন সে খিয়ানত করে, (২) যখন কথা বলে তখন সে মিথ্যা বলে, (৩) যখন অঙ্গিকার করে তখন ভঙ্গ করে (৪) এবং যখন ঝগড়া করে তখন গালি-গালাজ করে। [১ বুখারী ও মুসলিম।]
ভন্ডনবী কাদিয়ানীর মধ্যে এ সকল চরিত্রের সব গুলোই বর্তমান ছিল। যেমন আমি এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আসলাম।
তার তথাকথিত ইলহাম সমূহ
তার চরিত্রের বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা তার কিছু এলহামের উল্লেখ করতে চাই। যাতে পাঠক জানতে পারবেন যে, এ সমস্ত ওহী কোন ধরনের এবং এর উদ্দেশ্যই বা কি? আল্লাহর কালাম কি অর্থহীন হওয়া যুক্তি সংগত? যেভাবে ভন্ডনবী কাদিয়ানী গোলাম আহমদ এর চিত্র তুলে ধরেছে। গোলাম আহমদ বলে: ‘আমার কাছে ইলহাম আসছে- ১১ ইনশাআল্লাহ’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আল- বুশরা’ ২য় খন্ড,৬৫পৃঃ।) এরপর সে বা তার অন্য কোন অনুসারী এর কোন ব্যাখ্যা দেয় নি যে, ‘১১ ইনশাআল্লাহ’ এর কি অর্থ? সে আরো বলেছে: তার কাছে ইলহাম আসছে- ‘উপযুক্ত ব্যক্তি’ (আল-বুশরা’ ২য় খন্ড, ৮৪ পৃ:) উপযুক্ত ব্যক্তিটি কে? এর কোন পরিচয় নেই। আরো বলেছে: আক্ষেপ অত্যন্ত আক্ষেপ’। (গোলামের ইলহামাতের সমষ্টি ‘আল-বুশরা’ ২য় খন্ড ৫৭ পৃ:) আরো একটি এলহাম: ‘‘চৌধরী রস্তম আলী’’ (আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৮৮পৃঃ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদরের অন্তর্ভুক্ত, ১ম খন্ড, ৩২ গৃঃ) আরো একটি ইলহাম: ‘ফজলুর রহমান দরজা খুলেছে’। (আল- বুশরা, ২য় খন্ড, ৯০ পৃ:) এবং ‘তুমি আমার সন্তানদের সমতুল্য’। (আরবাঈন, হাসিয়া, ২৩ পৃ: ৪ নম্বর।)
এই হল ইলহামাতের নমুনা। জানি না, এ গুলোর অর্থ কি? আরো অদ্ভুত কথা হল, গোলাম আহমদ নিজেই এগুলোর অর্থ জানে না। এরূপ ইলহামাত গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিকট অনেক আছে। বরং অধিকাংশ ইলহামাত এ ধরনেরই।
তার পরিণতি ও মৃত্যু:
গোলামের মৃত্যু তার মিথ্যার উপর মোহর মেরে দিয়েছে। সে আল্লাহর রাসূল, কুরআন ও নবীগণের উপর মিথ্যারোপের কারণে সে নিজের উপর লা’নত টেনে এনেছে। আলেমগণ তার সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং তাকে সংশোধন করার ও ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনার নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়েছেন। যখন তারা কুফুরের উপর তার জেদ ও দৃঢ়তা, ধর্মান্তরিত হওয়া ও নবুয়তের মিথ্যাবাদীর উপর অনঢ় দেখতে পেলেন, তখন তাকে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং তার সঙ্গে মুনাজারা করলেন। তার মিথ্যা দাবির অসারতা প্রকাশ করেন। দলীল প্রমাণ পেশ করার সকল প্রচেষ্টা সমাপ্ত হওয়ার পর সকলেই ঐক্যমতে তার কুফুর এবং মিথ্যাচারের ফতওয়া প্রদান করলেন। এ সকল আলেমের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় হলেন ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের পক্ষে প্রতিরোধকারী ও ইসলামের তরফ থেকে মুনাজারায় অগ্রগামী মহান শেখ আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী। তার এবং গোলাম কাদিয়ানীর মধ্যে অনেকগুলো বিতর্ক এবং লিখিত ও মৌখিক বাহাছ-মুবাহাছা হয়েছে। তবে, বিজয় সর্বদা এই আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তি [১ আল্লামা রশীদ রেজা তার প্রশিদ্ধ ‘আল মানার’ ম্যাগাজিনে শায়খ ছানাউল্লাহ অমৃতসরীকে এই নামে অভিহিত করেছেন।] ও ইসলামের বীর পুরুষের পক্ষেই ছিল। এর ফলে ভন্ডনবী কাদিয়ানী রাগে জ্বলে উঠে এবং ১৯০৭ খৃষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিলে একটি প্রচার পত্র বিলি করে। এতে নিম্নোক্ত কথাগুলো লেখা ছিল: ‘‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি এবং তাঁর সম্মানিত রাসূলের প্রতি দরুদ পড়ি। ‘‘লোকেরা তোমাকে সংবাদ জিজ্ঞাসা করে ইহা কি সত্যি? তুমি বলে দাও, হ্যাঁ, আল্লাহ আমার প্রভু-প্রতিপালকের! নিশ্চয়ই এটা সত্য । [২ সুরা ইউনুস-৫৩]
উস্তাদ ছানাউল্লাহর প্রতি প্রেরিত। যে হেদায়েতের অনুসারী তার উপর ছালাম। আপনাদের ম্যাগাজিন আহলে হাদীসে দীর্ঘদিন যাবৎ আমাকে মিথ্যাবাদী ও ফাসেক বলা হচ্ছে এবং সর্বদা এ ম্যাগাজিনে আমাকে মালাউন, কাজ্জাব, দাজ্জাল ও মুফসেদ নামে অভিহিত করেছেন । বিশ্বে প্রচার করেছেন যে, আমি অপবাদকারী, মিথ্যুক, দাজ্জাল এবং আমার মাসীহিয়তের দাবিতে আমি মিথ্যাবাদী। আমি আপনার কাছ থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছি এবং ধৈর্য ধারণ করেছি। কিন্তু যখন আমি দেখলাম যে, আমি সত্য প্রচারের জন্য আদিষ্ট, আর আপনি আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিশ্বকে আমার দিকে অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করছেন। সুতরাং এখন আমি দোয়া করছি যে, যদি আমি মিথ্যাবাদী ও অপবাদকারী হই, যেমন আপনি আপনার ম্যাগাজিনে প্রচার করছেন, তাহলে যেন আপনার জীবদ্দশাই আমি ধ্বংস হয়ে যাই। কেননা, আমি জানি যে, কোন মিথ্যাবাদী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বেশি দিন বাঁচে না। বরং সে তার শত্রুর জীবদ্দশায়ই লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর, তার মৃত্যুতে আল্লাহর বান্দাগণের উপকার নিহিত রয়েছে। কারণ, সে আর তাদেরকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আর, যদি আমি মিথ্যাবাদী ও অপবাদকারী না হয়ে থাকি এবং আল্লাহর সাথে কথা বলার মর্যাদা লাভ করে থাকি এবং আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ মর্যাদা লাভ করে থাকি এবং আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ হই, তা হলে আমি দোয়া করছি তুমি যেন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী অবিশ্বাসীদের পরিণাম হতে মুক্তি লাভ না কর। আমি ঘোষণা করছি, যে শাস্তি শুধু আল্লাহর নিকট থেকে হয় যেমন প্লেগ ও কলেরা, উহাদ্বারা যদি তুমি আমার জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ না কর তবে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি না বরং বরকতময় মহান আল্লাহর নিকট থেকে প্রকাশ্য মীমাংসা চেয়েছি। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, হে আমার প্রভু, যিনি সবকিছু দেখেন, মহাশক্তি ধর, সর্বজ্ঞানী, যিনি সবকিছুর খবর রাখেন। হে অন্তরের রহস্য জ্ঞাত, আমি যদি তোমার দৃষ্টিতে মিথ্যুক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে থাকি এবং রাত দিন তোমার উপর অপবাদ দিয়ে থাকি, তবে, হে আল্লাহ, উস্তাদ ছানাউল্লাহর জীবনেই আমাকে ধ্বংস করে দাও এবং তাকে ও তার জামাতকে আমার মৃত্যুর দ্বারা আনন্দিত কর। আমীন। হে আল্লাহ! আর আমি যদি সত্য হই এবং ছানাউল্লাহ বাতিল পন্থী ও আমার উপর তার আরোপিত অপবাদ সমূহে মিথ্যাবাদী হয়ে থাকেন, তবে, তাকে আমার জীবিতাবস্থায় ঘাতক ব্যাধি যেমন প্লেগ, কলেরা ইত্যাদি দ্বারা ধ্বংস করে দিন। আমীন। হে প্রভু! আমি বড় কষ্ট পেয়েছি এবং ছবর করেছি। কিন্তু এখন আমি দেখছি যে, তিনি সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন এবং আমাকে চোর, জবর দখলকারী যাদের দ্বারা বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের চেয়েও অধিক অপরাধী মনে করেন। আর, আমাকে আল্লাহর সৃষ্টির হেয় ব্যক্তি বলে ধারণা করেন। তিনি দুর-দূরান্তে প্রচার করেছেন যে, আমি বাস্তবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, লুণ্ঠনকারী, লোভী, মিথ্যাবাদী, অপবাদকারী ও ঘৃণ্য ব্যক্তি। যদিও এসব কথার প্রতিক্রিয়া হয়নি। আমি এতে ধৈর্য ধারণ করেছি, কিন্তু আমি দেখছি যে, ছানাউল্লাহ এ সকল অপবাদ দ্বারা আমার দাওয়াতকে এবং আমার নির্মিত ইমারতকে ধ্বংস করতে চায়। তুমিই আমার প্রভু, তুমিই আমাকে প্রেরণ করেছ। এজন্য হে আল্লাহ! তোমার পবিত্রতার আঁচল ধরে তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আপনি আমার ও ছানাউল্লাহর মধ্যে ঠিক ফয়সালা করে দিন। আর, যে মিথ্যাবাদী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী তাকে সত্যবাদীর জীবিতাবস্থায়ই ধ্বংস করে দিন। অথবা, তাকে মৃত্যু সমতুল্য বিপদে পতিত করুন। হে আমার প্রিয় প্রভু, আপনি এটাই করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
‘‘হে আল্লাহ! আপনি আমার ও আমার কওমের মধ্যে সঠিক ফয়সালা করে দিন। আর আপনি হলেন উত্তম ফয়সালাকারী’’। (সুরা আল-আরাফ-৮৯)
পরিশেষে, আমি উস্তাদ ছানাউল্লাহর কাছে আশা করব, তিনি যেন, এ প্রচার পত্রটি তার ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেন। এরপর তার যা ইচ্ছা এর সাথে যুক্ত করতে পারেন। এখন ফয়সালা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। লেখক, আল্লাহুস সামাদ এর বান্দাহ গোলাম আহমদ আল মাসীহুল মাওউদ। আল্লাহ তাকে সুস্থ রাখুন এবং সাহায্য করুন।(গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণা যা ১৫ এপ্রিল ১৯০৭ খৃ: প্রচারিত এবং ‘তাবলীগে রেসালত’ ১০ খন্ড ১২০ পৃ: অন্তর্ভুক্ত, কাসেম কাদিয়ানী কর্তৃক সজ্জিত মাজমুয়াতু এলানাতিল গোলাম’।) এ দোআতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী সত্যবাদীর জীবিতাবস্থায় মিথ্যাবাদীর মৃত্যু কামনা করে। অর্থাৎ যদি গোলাম আহমদ সত্যবাদী হয়ে থাকে তবে তার জীবিতাবস্থায় শেখ ছানাউল্লাহ মৃত্যু বরণ করবেন। (আর, যদি শেখ ছানাউল্লাহ গোলাম আহমদকে মিথ্যুক বলার ক্ষেত্রে সত্যবাদী হয়ে থাকেন তা হলে তার জীবদ্দশায় গোলাম আহমদ মারা যাবে।) এ ঘোষণা ও দেয়ার দশ দিন পর গোলাম আহমদ কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রকাশ করল: ‘ছানাউল্লাহ সম্পর্কে য বলা হয়েছে তা আমার নিজের পক্ষ থেকে নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে। আজ রাতেই এ দোয়া সম্পর্কে আমার নিকট এলহাম হয়েছে- ‘উজিবু দাওয়াতাদ দায়ী’ এ এলহামের অর্থ হল এই যে, আমার প্রার্থনা গৃহীত হয়ে গেছে’। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদর’ ২৫ এপ্রিল ১৯০৭ খৃ: প্রকাশিত।) কার্যত: তার এ প্রার্থনা গৃহীত হয়ে যায়। এবং তার ও ছানাউল্লাহর মধ্যে সঠিক ফয়সালা হয়ে যায়। গণনা অনুযায়ী তিন মাস দশদিন পর আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও ফয়সালা এমন ভয়ানক আকারে তার কাছে পৌঁছোল, যা সে শ্রদ্ধেয় শেখ ছানাউল্লাহর জন্য আকাঙ্ক্ষা করছিল । হ্যাঁ, ঐ অবস্থায় এবং ঐ রোগেই সে আক্রান্ত হল। এর বিবরণের প্রতি পাঠক মহোদয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করছি: গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের বিশিষ্ট নেতা বশীর আহমদ গোলামের জীবন বৃত্তান্তে লিখছে: আমার মা আমাকে বলেছেন, জনাবের (গোলামের) খাওয়ার পর পরই পায়খানায় যাওয়ার প্রয়োজন হল, এরপর একটু নিদ্রা গেলেন, আবার পায়খানায় যাবার প্রয়োজন হল। অতঃপর আমাকে অবহিত না করেই আরো দু এক বার গেলেন। তারপর আমাকে জাগালেন। তখন আমি দেখতে পেলাম যে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এমনকি, তিনি তার খাট পর্যন্ত হেঁটে যেতে সক্ষম হন নি। এজন্য আমার খাটেই বসে পড়লেন। তখন আমি তার শরীর মলতে ও দাবাতে লাগলাম। একটু পরেই আবার পায়খানার প্রয়োজন অনুভব করলেন, কিন্তু এবার পায়খানায় যেতে না পেরে খাটের নিকটেই প্রয়োজন সেরে নিলেন। প্রয়োজন সেরে একটু বিশ্রাম নিলেন। অতঃপর বমি আসল। বমি করার পর চিৎ হয়ে পড়লেন। খাটের কাঠের সাথে তার মাথার টক্কর লাগে এবং তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘সিরাতে মাহদী’ ১০৯ পৃ:) তার শ্বশুর লিখেছে: যে রাত্রে জনাব (গোলাম) অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সে রাত্রে আমি আমার কামরায় ঘুমিয়েছিলাম। যখন তার রোগের অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করল তখন গৃহের লোকজন আমাকে জাগাল, আমি তার নিকট গিয়ে তার কষ্ট দেখতে পেলাম। আমাকে তিনি এ বলে সম্বোধন করলেন: আমি কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। অতঃপর, তিনি আর কোন কথা স্পষ্ট করে বলতে পারেন নি। এমনকি, পরদিন সকাল দশটার পর মারা যান। (গোলাম কাদিয়ানীর শ্বশুরের ‘হায়াতে নাসির’ ১৪ পৃ:।)
তখনকার দিনের ভারতীয় পত্রিকাগুলো প্রচার করেছে. ‘‘ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী
যখন কলেরায় আক্রান্ত হল তখন তার মৃত্যুর পূর্বে তার মুখ দিয়ে পায়খানা নির্গত হচ্ছিল। সে প্রয়োজন সারতে পায়খানায় বসা ছিল, এমতাবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে’’। অনুরূপভাবে মুহাম্মদ ইসমাঈল কাদিয়ানীর বর্ণনা কাদিয়ানী পত্রিকায় প্রচারিত হয়: ‘‘বিরুদ্ধবাদীরা বলে যে, মৃত্যু কালে মাসীহে মাওউদের মুখ দিয়ে পায়খানা বের হচ্ছিল। (মুহাম্মদ ইসমাঈলকাদিয়ানীর বর্ণনা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে সুলাহ’ এর মধ্যে ৩রা মার্চ ১৯৩৯ খৃ:) মোটকথা, মৃত্যু আসল, কিন্তু কি অবস্থায় আসল? এমন অবস্থা যা শুনলেই প্রাণ শিহরিয়া উঠে। সে ২৬ মে ১৯০৮ খৃ: সকাল সাড়ে দশ ঘটিকায় মারা যায়। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল হিকম’ ২৮ মে ১৯০৮ খৃ: এবং ‘সীরতে মাহদী’ প্রভৃতি কাদিয়ানী পুস্তকাবলী।) মোটকথা, সে মারা যায় এবং ছানাউল্লাহ জীবিতই রইলেন । এমনকি তার মৃত্যুর পর প্রায় চল্লিশ বৎসর জীবিত থেকে কাদিয়ানীদের প্রাসাদ ধূলিসাৎ এবং তাদের মূলোৎপাটন করছিলেন। এমনিভাবে, আল্লাহ তা‘আলা এ মিথ্যাবাদীকে তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও মিথ্যা সাব্যস্ত করেছেন। দুনিয়াতে শাস্তি দিয়েছেন এবং পরকালে রয়েছে তার জন্য আরো কঠোর ও সবল শাস্তি। মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন- ‘‘ওর চেয়ে বড় জালিম আর কে? যে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে অথবা বলে: আমার উপর ওহী এসেছে, অথচ তার কাছে কোন ওহী আসেনি, এবং যে বলে আল্লাহ যেরূপ নাজিল করেছেন আমিও তদ্রুপ নাজিল করতে পারি। যদি আপনি দেখতে পেতেন! এ জালিমরা যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় পতিত হয়, আর, ফেরেস্তারা তাদের হস্ত সম্প্রসারণ করে বলে, তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হবে, কেননা, তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অসত্য কথা বলতে এবং অহংকার ভরে আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করতে’’। [১ সুরা আল আনআম-৯৩]
লক্ষণীয় বিষয়, ভন্ডনবী গোলাম লাহোরে মৃত্যু বরণ করে। তারপর তার লাশ কাদিয়ানে হস্তান্তরিত করা হয়। (‘সীরতুল মাহদী’ ‘হায়াতে নবী’ প্রভৃতি।) এভাবে তার মৃত্যুর পরেও সাব্যস্ত হয় যে, সে নবুয়তের দাবিতে মিথ্যাবাদী। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে সেই স্থানেই মৃত্যুদান করেন, যেখানে তার সমাধিস্থ হওয়া আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়। [২ তিরমিজী।]
নবুয়তের অন্যতম দলীল হল: ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়া অর্থাৎ আল্লাহর ইলহাম দ্বারা গায়েব বা ভবিষ্যতের সংবাদ বাস্তবে পরিণত হওয়া। এর উদাহরণ হল- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যুদ্ধে কাফের বাহিনীর পরাজিত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বদরের যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে তিনি বলেছিলেন: ‘‘অচিরেই দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে ফিরে যাবে’’। [১ সুরা আল- কামার-৪৫]
অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার একদিন পূর্বে প্রতিপক্ষ নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ওমর রা. থেকে আনাছ রা. বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গতকল্য আমাদেরকে মুশরেক নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান দেখিয়ে বলছিলেন: ‘‘ইনশাআল্লাহ আগামীকল্য এটা অমুকের নিহত হওয়ার স্থান এবং ইনশাআল্লাহ আগামীকল্য এটা অমুকের নিহত হওয়ার স্থান’’। ওমর রা. বলেন: ‘সেই সত্তার কসম! যিনি তাঁকে সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন- তারা ঐ সীমা একটুও অতিক্রম করেনি যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন’। (মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ভবিষ্যদ্বাণী হল: রোম ও পারস্য সম্রাটের ধন ভান্ডার সমূহ মুসলমানদের হাতে বিজিত হওয়ার কথা সহ আরো অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন। কেননা, রাসূলগণ নিজের পক্ষ থেকে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করেন না বরং তাঁরা যা বলেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেন। এর প্রতি ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তিনিই হলেন অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত, তাঁর অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত আর কাউকে অবহিত করেন না’’। [২ সুরা জীন- ২৬ ও ২৭]
আল্লাহপাক আরো বলেছেন: ‘‘আপনি কখনও ধারণা করবেন না যে, আল্লাহ তার রাসূলগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন, কেননা, আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী’’। [৩ সুরা হিজর-৪৭]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যা সংগঠিত হবে না এমন কোন বিষয় সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দেয়া রাসূলের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, তা আল্লাহর নীতির পরিপন্থী এবং আল্লাহর বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী, অথচ আল্লাহই সর্বাধিক সত্যবাদী। ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও তার এই উক্তির দ্বারা একথা স্বীকার করছে: তাওরাত ও কুরআন উভয়ই ভবিষ্যদ্বাণী সমূহকে নবুওয়াতের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রমাণ বলে সাব্যস্ত করেছে (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘ইস্তেফতা’ ৩পৃঃ)। সে আরো বলেছে: আল্লাহর এলহাম সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়া অসম্ভব। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘মেরাতুল মারেফাত’ ৮৩ পৃ:) এ ভিত্তিতেই আমরা এ প্রবন্ধে নবুয়্যত ও রেসালাতের দাবিদার গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের আলোচনা করতে চাই। সে দাবিকরে যে, সে আল্লাহর ওহী ও তার সম্বোধন দ্বারা সম্মানিত। সে বলেছে: ‘আমি আমার ওহীতে ঐ রূপ বিশ্বাস করি যেমন তাওরাত ইঞ্জিল ও কুরআনে বিশ্বাস করি ’। (গোলামের ‘‘আরবাঈন’’ ৪ নম্বর ২৫ পৃ:) সে আরো বলেছে: ‘আমি নবী এবং আল্লাহর সম্বোধন ও তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি তা পূরণ করেন এবং তার অদৃশ্য জগতের অনেক কিছু আমার কাছে উদ্ঘাটন করেন। আর, আমাকে বিশ্বের রহস্য-বলী সম্পর্কে অবহিত করেন, যা ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে। এ জন্যই আমাকে নবী বলা হয়। (লাহোরের ‘আম’ নামক পত্রিকায় গোলাম আহমদের প্রেরিত পত্র ২৩ মে, ১৯০৮ খৃ:) এর আলোকে আমরা দেখব, সে কি বাস্তবিকই আল্লাহর সম্বোধন দ্বারা সম্মানিত এবং ভবিষ্যতের রহস্যাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত? অথবা সে আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে? কেননা, সে-ই নিজে এ নিয়ম নির্ধারণ করেছে যে, আমার সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আমার ভবিষ্যৎ বাণী সমূহ থেকে উত্তম ও সুন্দর আর কিছুই নেই। (গোলামের মেরাতুল কামালাত’ ২৩২।)
যে মানদন্ড সে নিজেই নির্ধারণ করেছে আমরা উহা দ্বারা তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে চাই। তার ভবিষ্যদ্বাণীর বিবরণ দেওয়ার পূর্বে তার দেয়া ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা উল্লেখ করা আমি সংগত মনে করি। সে আল্লাহর নবী ঈসাকে আলাইহিস সালাম আক্রমণ করে বলে: ‘এ মিসকিন ইসরাঈলী ব্যক্তির ভবিষ্যদ্বাণী আর কি? ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি।’ এ সকল বিষয়কে ভবিষ্যদ্বাণী এবং গায়েবের সংবাদ কেন বলা হল? তা আমার বোধগম্য নয়। ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষ কি আদি হতে সংঘটিত হচ্ছে না? এবং বিশ্বের কোন না কোন অংশে সর্বদাই যুদ্ধ বিগ্রহ চলছে না? সুতরাং এই আহম্মক (আল্লাহ পানাহ) এ সকল বিষয়কে ভবিষ্যদ্বাণী নাম দিল কেন’’? (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ এর পরিশিষ্ট ৪পৃঃ।) সে আরো বলে: ‘‘নবী ব্যতীত অন্যান্যরাও যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভূমিকম্প ও বিপদাপদ প্রভৃতির সংবাদ দিতে পারে।’’ (গোলাম আহমদের ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ ৪৬৮ পৃ:।) এ দুটি ভাষ্যে ভন্ডনবী কাদিয়ানী আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ অস্বাভাবিক হতে হবে এবং এগুলো সম্পর্কে কোন বিষয়ের বিদ্যমান পূর্বাভাস দ্বারা আনুমানিক সংবাদ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কেননা, এরূপ সংবাদ দেওয়া প্রত্যেক বুদ্ধি সম্পন্ন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। অথচ গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহে এ সকল বস্ত্তকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে, যার বিস্তারিত বিবরণ সম্মুখে আসছে। এখানে এর একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলেছে: আল্লাহ তাআলা আমার কাছে প্রকাশ করেছেন যে, প্রচুর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। যদ্দরুন জনবসতি সমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। তারপর কঠিন ভূমিকম্প হবে। কার্যত:
অত্যধিক বৃষ্টি হয়েই গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ভূমিকম্পের অপেক্ষায় আছি।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘হাকীকতুল ওহী’ ৩০৪ পৃ:)অথচ আদি থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, বিশেষ করে বৃষ্টির মৌসুমে যে কোন ব্যক্তি বৃষ্টি হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। এদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেও আমি গোলাম আহমদের এক একটা ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লেখ করব এবং এগুলোকে তার উক্তি অনুযায়ী তার সত্য মিথ্যার মাপকাঠি হিসেবে উপস্থাপিত করব। বিশেষ করে ঐ সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী যে গুলো সম্বন্ধে সে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে সংঘটিত হওয়ার কথা স্পষ্ট করে বলেছে এবং একথাও বলেছে যে, আল্লাহর কাছ থেকে অবহিত না হয়ে সে সংবাদ দেয়নি। যদি এগুলো বাস্তবায়িত না হয় তাহলে সে এমন এমন হবে এবং তার সাথে এমন এমন ব্যবহার করা হবে। এ প্রসঙ্গে তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী লক্ষ করুন, যা সে অতি শক্তভাবে এ বলে ব্যক্ত করছে: ‘যদি আমার উক্তি অনুসারে ইহা সংঘটিত না হয়, তাহলে আমি সর্বপ্রকার শাস্তি গ্রহণে প্রস্ত্তত আছি। আমার মুখ যেন কাল করা হয়, আমাকে যেন অপমান করা হয় এবং আমার গলায় রশি লাগিয়ে যেন ফাঁসি দেওয়া হয়। আমি মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যা বলছি তা সংঘটিত হওয়া একান্ত অপরিহার্য। আকাশ ও পৃথিবীর পরিবর্তন হওয়া সম্ভব কিন্তু আল্লাহর কথা পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। যদি আমার কথা মিথ্যা হয় তবে আমার জন্য তোমরা শূল তৈরি করে রাখ। শয়তান খবীছও মালউনদের চেয়ে অধিক অভিশাপ আমাকে দাও।’ (গোলাম কাদিয়ানী ‘আল হারবুল মুকাদ্দাস’ ১৮৮ পৃ:) দেখা যাক, ঐ ভবিষ্যদ্বাণীটি কি যা সংঘটিত না হলে সে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলতে প্রস্ত্তত ছিল? এটা তারই ভাষায় আমি ছোট একটি ভূমিকার পর উল্লেখ করব যা পাঠককে সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করতে সাহায্য করবে। এটা নিম্নরূপ:-
১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে ভারতবর্ষের একটি শহর ‘অমৃতসরে ’আব্দুল্লাহ আথম নামে একজন খ্রিস্টানের সহিত গোলাম আহমদের বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। অনেক দীর্ঘ আলোচনার পরও তারা কোন মীমাংসায় পৌঁছতে পারেনি এবং তাদের কেউ প্রতিপক্ষের উপর জয়ী হতে পারে নি। গোলাম আহমদের এ দাবিতেও যে, সে আল্লাহর ওহীর দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত। ফলে সে এমন একটা তামাশা করতে চাইল যদ্দারা সে ঐ অপমানকে মুছে ফেলতে পারে, যা একজন সাধারণ খ্রিস্টানের সাথে পরাজিত হওয়ার কারণে তার উপর আপতিত হয়েছিল। সুতরাং ১৮৯৩ সালের ৫ই জুন তারিখে ভোর হতে না হতে সে ঘোষণা দিল যে, সে আল্লাহর নিকট হতে অবহিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ আথম পনেরো মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৯৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে মারা যাবে। প্রকাশ থাকে যে, উক্ত আব্দুল্লহর বয়স তখন ছেষট্টি বছরের ঊর্ধ্বে ছিল। এখন আমি তার মূল ভাষ্য বর্ণনা করছি। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বলে: ‘আজ রাতে আমার কাছে যা উদ্ঘাটিত হয়েছে তা হল এই- আমি মহান আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত কাকুতি ও বিনয়ের সহিত দোয়া করলাম তিনি যেন এ ব্যাপারে আমাকে একটা মীমাংসা করে দেন। তখন আল্লাহ আমাকে নিদর্শন প্রদান করলেন যে, মিথ্যাবাদী যদি হকের প্রতি প্রত্যাবর্তন না করে তবে সে পনেরো মাসের মধ্যে মৃত্যু বরণ করবে এবং সত্যবাদী সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে। আর, যদি মিথ্যাবাদী ১৮৯৩ সালের ৫মে হতে পনেরো মাসের মধ্যে মৃত্যু বরণ না করে এবং আমার উক্তি বাস্তবায়িত না হয় তবে আমি সকল প্রকার শাস্তি গ্রহণের জন্য প্রস্ত্তত আছি। আমার মুখ যেন কাল করা হয়, আমাকে অপমানিত করা হয় এবং আমার গলায় দড়ি লাগিয়ে আমাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আমি মহান আল্লাহর শপথকরে বলছি যে, আমার উক্তি বাস্তবায়িত হবে এবং উহা বাস্তবায়িত হওয়া অনিবার্য।’ (আল-হরবুল মুকাদ্দাস ১৮৮ পৃ:) কাদিয়ানীরা অত্যন্ত ভয়ংকর পরিবেশে অধৈর্য হয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছিল। এখন আমি এমন কিছুর বর্ণনা দিচ্ছি যদ্দারা ঐ পরিবেশ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে, যে পরিবেশে ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার দল বসবাস করছিল। ভবিষ্যদ্বাণীর মেয়াদ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে গোলাম আহমদ তার জনৈক মুরিদের নিকট পত্র লিখছে, যার নমুনা হল এই, সম্মানিত ভাই রুস্তম আলী, আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ, টিকেট সহ আপনার পত্র পেয়েছি। ভবিষ্যদ্বাণীর নির্দিষ্ট মেয়াদের অল্প কিছুদিন বাকি আছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন তার বান্দাগণকে পরীক্ষা হতে রক্ষা করেন। সেই চিহ্নিত ব্যক্তি আব্দুল্লাহ আথম পিরোজপুরে (ভারতের একটি শহর) নিরাপদ ও সুস্থ দেহে অবস্থান করছে। আল্লাহ তার দুর্বল বান্দাগণকে পরীক্ষা হতে রক্ষা করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন। আমি ভাল আছি। তোমরা শেখের নিকটও পত্র লিখবে যেন তিনিও এ দোয়ায় শরীক থাকেন। (অর্থাৎ আব্দুল্লাহ যেন এ মেয়াদের ভিতরে মৃত্যুবরণ করে।) আস-সালাম’। গোলাম আহমদ, কাদিয়ান হতে।’ (রুস্তম আলীর নিকট গোলাম আহমদের চিঠি যা গোলাম কাদিয়ানীর পত্রাবলির সমষ্টি ‘মাকাতিবে আহমদিয়া’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ৫ম খন্ড, ৩ নম্বর ১২৮ পৃ:) গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানী নেতা বশীর আহমদ লিখেছে: আমাকে আব্দুল্লাহ ছিন্নুরী বলেছেন যে, আব্দুল্লাহ আথমের নির্দিষ্ট মেয়াদের যখন মাত্র একদিন বাকি তখন জনাব মাসীহ আমাকে এবং হামীদ আলীকে নির্দেশ দিলেন যে, মসুর ডালের কিছু দানা নিয়ে উহার উপর কুরআনের কোন একটি সুরা পড়তে। সূরাটির নাম আমি এখন ভুলে গেছি, তবে একথা স্মরণ আছে যে উহা সূরায়ে ফীলের ন্যায় ছোট। আমরা পূর্ণ এক রাত লেগে থেকে অজিফাটি শেষ করলাম। তারপর জনাব মাসীহের (গোলাম) নিকট গেলাম এবং তার সম্মুখে দানাগুলো পেশ করলাম। তিনি আমাদেরকে নিয়ে কাদিয়ানের বাহিরে উত্তর প্রান্তের দিকে বের হলেন এবং বললেন, ‘এখনই আমি এ দানা গুলো পুরাতন একটি কূপে নিক্ষেপ করব। যখন আমি এ দানা গুলো নিক্ষেপ করব তখন তোমরা পিছন ফিরে তাকাবে না এবং দ্রুত ফিরে আসবে।’ আমরা এরূপ করলাম এবং পিছন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত চলে আসলাম। (গোলাম তনয় বশীর আহমদের সীরাতুল মাহদী ১ম খন্ড ১৫৯ পৃ:)
এখন আমরা কাদিয়ানী লেখক ইয়াকুব আলী কদিয়ানীর ‘সীরাতুল মাসীহিল মাওউদ’ নামক পুস্তক হতে নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষ দিনের অবস্থা বর্ণনা করছি। সে বলছে: ‘‘আথমকে দেওয়া নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষ দিন আসল, কাদিয়ানীদের চেহারা হলুদ বর্ণ ধারণ করল এবং তাদের অন্তর অস্থির হয়ে উঠল। আমাদের কেউ কেউ আব্দুল্লাহ আথমের মৃত্যুর উপর বিরুদ্ধবাদীদের সাথে বাজি ধরল। আর, নৈরাশ্য ও অনুতাপ তাদেরকে শ্বাস রুদ্ধ করে দিয়েছিল। তাদের কিছু লোক আল্লাহর কাছে তার মৃত্যুর জন্য দোয়া করে নামাজের মধ্যে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল। তাদের এ চিৎকার ও আর্তনাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেক বিরুদ্ধবাদীরাও তাদের জন্য ব্যথিত হয়ে উঠল। (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘সীরাতুল মাসীহিল মাওউদ’ ৭ পৃ:।) এ সমস্ত কান্নাকাটি ও অজিফা তদবিরের পর কি ঘটল? এ ভবিষ্যদ্বাণী কি বাস্তবায়িত হল এবং আব্দুল্লাহ আথম কি মৃত্যুবরণ করল? এসকল প্রশ্নের উত্তর ভন্ডনবী গোলাম আহমদের শ্বশুর তার নিকট লিখিত একটি পত্রে এভাবে দিচ্ছে: ‘সম্মানিত মাওলানা সাহেব! আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন। আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আজ সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ। ভবিষ্যদ্বাণীর শেষ মেয়াদ ছিল পাঁচ সেপ্টেম্বর। আমি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা নিয়ে আলোচনা করছি না বরং আপনি যে ইলহামের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তা আমার স্মরণ হচ্ছে- ‘যদি পনেরো মাস সময়ের মধ্যে এ মিথ্যাবাদী মৃত্যুবরণ না করে এবং আমার উক্তি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আমি প্রস্ত্তত হব..............। এখন যেহেতু এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হল না এবং আব্দুল্লাহ আথম নিরাপদ, সুস্থ ও জীবিত আছে, মৃত্যুবরণ করেনি। আমার ধারণা যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীর কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নহে...... মুহাম্মদ আলী খান।’ (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিকট মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানীর লিখিত পত্র যা ইয়াকুব আলী কাদিয়ানী রচিত ‘আয়েনায়ে হক্বনুমা’ এর অন্তর্ভুক্ত, ১০০-১০১ পৃ:।) কোন কোন কাদিয়ানী এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিল যে, আব্দুল্লাহ আথম খ্রীষ্টধর্ম থেকে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু আব্দুল্লাহ আথম এদেরকে অপমানিত করে এবং তার ঐ ঘোষণা দ্বারা এদের কোন ব্যাখ্যার অবকাশ রাখেনি, যা সে নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার দশদিন পর ‘‘ওফাদার’’ পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। ইহাতে একথা ছিল ‘গোলাম আহমদ আমার মৃত্যু সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিল উহার প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমি আপনাদেরকে অবহিত করছি যে, আমি আল্লাহর অনুগ্রহে সুস্থ ও নিরাপদ আছি। আমি শুনতে পেলাম যে, গোলাম আহমদ বলছে, আমি খ্রীষ্টধর্ম হতে প্রত্যাবর্তন করেছি। আমি ঘোষণা করছি যে, এটা মিথ্যা, আমি খ্রিস্টান ছিলাম এবং এখনও খ্রিস্টান আছি, যেমন পূর্বে ছিলাম। আল্লাহ যে আমাকে খ্রীষ্টন বানিয়েছেন তার জন্য আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।’ (লাহোরের ওফাদার পত্রিকায় আব্দুল্লাহ আথমের ঘোষণা ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খৃ:) এমনি ভাবে ভন্ড মিথ্যাবাদী এবং আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটনাকারী অপদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়। সে বলেছিল: আকাশ ও পৃথিবী স্থানচ্যুত হওয়া সম্ভব, কিন্তু এ ভবিষ্যদ্বাণী ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব নহে। (আল-হারবুল মুকাদ্দাস ১৮৮ পৃষ্ঠা।) উল্লেখিত আব্দুল্লাহ আথম দীর্ঘদিন জীবিত থাকে এবং এ অভিশপ্ত ভন্ডনবীর মাথা নত হয়। বরং শয়তান খবীছ ও মালউনদের চেয়েও অধিক লানত তার উপর পতিত হয়। সে স্বয়ং তা নিজের জন্য প্রকাশ করেছিল এবং আল্লাহ তা’য়ালা তাকে এ পৃথিবীতে জন সমক্ষে লাঞ্ছিত করেন। ইতিপূর্বে যাদের চক্ষু খুলেনি তাদের চক্ষুও খুলে যায়। যার ভাগ্যে হেদায়েত ছিল সে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। এটাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তার নবী রাসূলগণকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করেন না । তিনিই বলেছেন: ‘আল্লাহর প্রতি এরূপ ধারণা করবেন না যে, তিনি তার রাসূলগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন। [১ সুরা আল-হিজর- ৪৭]
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণী: [২ মূল কিতাবে দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণী লিখা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে দুটি ভবিষ্যদ্বাণী সন্নিবেশিত করা হয়েছে। (অনুবাদক)]
এরপর আমি গোলাম আহমদের দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লেখ করতে চাই। পাঠকের বুঝার সুবিধার জন্য এর একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা প্রদান করছি। তা হল এই, ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আহমদ বেগ নামে একজন আত্মীয় ছিল। সে গোলাম আহমদের সাথে সম্পৃক্ত কোন এক ব্যাপারে গোলাম আহমদের মুখাপেক্ষী হয় এবং তার সাহায্য প্রার্থনা করে। তখন উত্তরে গোলাম আহমদ বলল: ‘আমি তোমাকে এ শর্তে সাহায্য করব যে, তোমার মেয়ে মোহাম্মদী বেগমকে আমার কাছে বিবাহ দিতে হবে।’ এসময় তার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে ছিল এবং সে ছিল বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত; যেমন যক্ষ্মা, বহুমূত্র ও পক্ষাঘাতের অনুরূপ রোগ। আহমদ বেগ এ শর্ত গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। ফলে ভন্ডনবী গোলাম আহমদ পাগলের মত হয়ে যায় এবং তাকে বিভিন্ন রকমের হুমকি দিতে থাকে। এই মেয়ের প্রতি তার আসক্তি এতই প্রবল হয়েছিল যে, সে ভবিষ্যদ্বাণীরূপে ঘোষণা দিল আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ভবিষ্যদ্বাণীরূপে প্রকাশ করেছেন যে, আহমদ বেগের বড় মেয়ের বিবাহ আমার সাথে হবে। তবে, তার পরিবার পরিজন এর বিরোধিতা করবে এবং এতে বাঁধা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমার সাথে তার বিবাহ দেবেন এবং সমুদয় প্রতিবন্ধকতা দূর করবেন। কেহই এর বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘&এজালাতুল আওহাম’’ ৩৯৬ পৃষ্ঠা) সে আরো বলল যে, মুহাম্মদী বেগমের সহিত বিবাহ অবধারিত। আমি আমার প্রভুর শপথ করে বলছি, এটা সত্য এবং তোমরা এর বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন আমি নিজেই তোমার সহিত তার বিবাহ দিয়ে দিলাম এবং কেহই আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করতে পারবে না’। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘‘আল-হুকমুছ্ছামাবী’’ ৪০ পৃ:) মোটকথা, গোলাম এ ব্যপারে উল্লেখ করছে যে, বিশ্ব প্রভু স্বয়ং একে তার সাথে বিবাহ দিয়েছেন এবং তার ফয়সালাকে কেহ ফিরাতে পারবে না। এজন্যই সে এত জোরালোভাবে বলেছে, এ ভাবষ্যদ্বাণী অবশই বাস্তবায়িত হবে এবং এর বাস্তবায়িত হওয়া অবধারিত। অতপর সে বলে: এই ভবিষ্যদ্বাণী অর্থাৎ এ মেয়েটির আমার সাথে বিবাহ হওয়া অখন্ডনীয় ভাগ্যলিপি। যার কোন অবস্থাতেই পরিবর্তন হবে না। কেননা, আমি এলহামের মধ্যে এ বাক্যটি পিছিয়ে ‘‘লা তাবদীলা লি কালিমাতিল্লাহ’’ (আল্লাহর ফায়সালার কোন পরিবর্তন নেই।) এর অর্থ হল, আমার এ ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। কারণ, এটা বাস্তবায়িত না হলে আল্লাহর কালাম অর্থহীন হয়ে পড়বে। (‘‘ইশতেহারুল গোলাম’’ ১৬ অক্টেবর ১৮৯৪ খৃ:) এরও অধিক সে বলেছে- ‘যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হয় তবে আমি অত্যন্ত ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হব। হে নির্বোধেরা (তার বিরুদ্ধবাদীদের সম্বোধন করছে) এটা মানুষের কোন বানান কথা নয় এবং কোন ঘৃণিত ও অপবাদ রটনাকারীর খেলা নহে, বরং এটা আল্লাহর সত্য প্রতিশ্রুতি। তিনি এমন মা’বুদ যার বাণীর পরিবর্তন হয় না এবং এমন প্রভু যার ইচ্ছা পূরণে কেহ বাধা সৃষ্টি করতে পারে না’। (গোলামের আঞ্জামে আথম এর পরিশিষ্ট ৫৪ পৃ:) এ ভবিষ্যদ্বাণীর ফাঁকে সে আহমদ ও তার আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করতে লাগল। কখনও তাদেরকে আশা দেয়, আবার কখনও তাদেরকে হুমকী দেয়, যাতে তার এ আশা পূর্ণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ বাস্তবায়িত হয়ে যায়। সে আহমদ বেগের কাছে পত্র লিখল, যার বক্তব্য হল এই- ‘‘শ্রদ্ধেয় ভাই আহমদ বেগ। আল্লাহ তাআলা আমাকে নিরাপদ রাখুন। আমি এইমাত্র মুরাকাবা শেষ করলাম। সাথে সাথে আমার নিদ্রা আসল। তখন আমি স্বপ্নে দেখলাম, আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আমি তোমাকে এ মর্মে অবহিত করব, তুমি যেন তোমার কুমারী বড় মেয়েটিকে আমার নিকট বিবাহ দিয়ে দাও, যাতে তুমি আল্লাহর মঙ্গল, বরকত, দান ও সম্মানের অধিকারী হতে পার এবং তোমার বিপদাপদ যেন দূর হয়ে যায়। আর, যদি তুমি তোমার মেয়ে আমাকে প্রদান না কর, তা হলে তুমি ভৎর্সনা ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা আমি তোমাকে পৌঁছে দিলাম। যাতে তুমি আল্লাহর পুরস্কার ও সম্মান লাভ করতে পার, এবং তোমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহের ভান্ডার খুলে যায়। তাছাড়া তুমি আমার কাছে যে দরখাস্ত নিয়ে এসেছিলে তাতে আমি স্বাক্ষর দিতে প্রস্ত্তত আছি। উপরন্তু, আমার সমস্ত সম্পত্তি তোমার এবং আল্লাহর। আমি তোমার পুত্র আজিজ বেগের জন্যও সুপারিশ করতে প্রস্ত্তত আছি, যাতে সে পুলিশ বিভাগে চাকুরি লাভ করতে পারে। অনুরূপভাবে, আমি তাকে আমার এক বিরাট ধনী মুরিদের কন্যার সাথে বিবাহ দিয়ে দিব।’’ (আহমদ বেগের কাছে গোলাম কাদিয়ানীর লিখিত পত্র যা ‘নবীস্তায়ে গায়েব’ থেকে গৃহীত ১০০ পৃ:, ফেব্রু: ১৮৮৮ খৃ:।) সে আর একটি পত্র তার কাছে লিখেছে: ‘যদি তুমি আমাকে তোমার মেয়ে দান কর এবং আমার সহিত তার বিবাহ দাও তা হলে আমি তোমাকে আমার স্থাবর সম্পত্তি ও বাগানের একটি বড় অংশ প্রদান করব এবং তোমার মেয়েকে আমার সমুদয় সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দিয়ে দেব। আমি যা বলছি তা সত্য। তুমি যা চাও তা আমি তোমাকে দেব। আমার মত আত্মীয়তা রক্ষাকারী আর কাউকে তুমি খুঁজে পাবে না। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘মেরাতে কামালাতে ইসলাম’ ৫৭৩ পৃ:।) যখন সে দেখল যে এ সকল উৎসাহ ও আগ্রহ দান কোন কাজে আসছে না। তখন সে আহমদ বেগের কাছে নত হয়ে তার করুণা ভিক্ষা করতে লাগল। সে তার নিকট এ মর্মে আরো একটা পত্র লিখল: ‘আমি আপনার কাছে অত্যন্ত আদব ও নম্রতার সাথে আসা করছি যে, আপনি আমার কাছে আপনার মেয়েকে বিবাহ দেয়ার প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন। কেননা, এ বিবাহটি আপনাদের জন্য বরকতের কারণ হবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহের দরজা সমূহ যা আপনারা কল্পনা করতে পারেন না তা আপনাদের জন্য খুলে যাবে। হয়ত আপনারা জানেন, এ ভবিষ্যদ্বাণী হাজার হাজার এমনকি লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে প্রচারিত হয়ে গেছে এবং বিশ্ববাসী এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছে। হাজার হাজার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এ
ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছে, বরং এটা নিয়ে তারা আমাদের বিরুদ্ধে হাসি ঠাট্টা করছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং আমাদিগকে সহায়তা করবেন। এজন্য আমি আপনার কাছে আশা করছি যেন এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেন। (আহমদ বেগের নিকট গোলামের পত্র ১৭ জুলাই ১৮৯২ খৃ: যা ‘কালেমায়ে ফজলে রহমানী’ পুস্তক হতে গৃহীত ১২৩ পৃ:।) যখন এ প্রচেষ্টায়ও সে সফলকাম হতে পারে নি তখন সে তার দু’পুত্র সুলতান আহমদ ও ফজল আহমদের নিকট পত্র লিখল, তারা যেন তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। কারণ, ফজল আহমদ আহমদ বেগের ভাগিনীকে বিবাহ করেছিল। আর আহমদ বেগের মাতৃকুলের সহিত সুলতানের আত্মীয়তা ছিল। অনুরূপভাবে সে তার স্ত্রী সুলতান আহমদের মাতার কাছে পত্র লিখল। তিনি যেন তার অবস্থান দ্বারা এ ব্যাপারে চেষ্টা করেন। আর যদি তারা তাকে সাহায্য না করে, তাহলে সুলতান আহমদ ফজল আহমদ প্রত্যেকে তার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে এবং তাদের মা ত্বালাক প্রাপ্তা হবে।’ আবার, সে একটা সাধারণ ঘোষণা দিল যার বর্ণনা এই- ‘যদি আহমদ বেগের কন্যা আমি ব্যতীত অন্য কারে সঙ্গে বিবাহ বসে তবে ঐ দিনই সুলতান আহমদ আমার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে এবং তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। আর, তার মাও তালাক প্রাপ্তা হয়ে যাবে। আমার পুত্র ফজল আহমদও আমার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে যদি সে তার স্ত্রী আহমদ বেগের ভাগিনীকে তালাক না দেয়। সুলতান আহমদের ন্যায় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। (ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ঘোষণা, ২মে ১৮৯১ খৃ: যা ‘‘তাবলীগে রিসালত’’ এর অন্তর্ভুক্ত ২য় খন্ড ৯পৃঃ) এ সকল ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে এ উদ্যেশ্য ছিল তারা যেন আহমদ বেগকে তার মেয়ে গোলামের কাছে বিবাহ দিতে বাধ্য করে। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করেন। আহমদ বেগের কন্যা মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ সুলতান বেগ নামক জনৈক সৈনিকের সহিত সম্পন্ন হয়ে গেল। আর, এ মিথ্যাবাদী অপবাদ রটনাকারী আক্ষেপ, অনুতাপ ও হতাশার ভিতর জীবন যাপন করতে লাগল এবং নিজের উপর অভিসম্পাত কুড়াতে লাগল যা সে নিজেই নির্ধারণ করেছিল এবং নিজের জন্য প্রয়োগ করেছিল। সে বলেছিল: ‘যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হয়, তবে আমি সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হব।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আঞ্জামে আথম’ এর পরিশিষ্ট ৫৪ পৃ:) তার এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয় নি, যার সম্পর্কে সে বলেছিল. ‘এটা আল্লাহর সত্য প্রতিশ্রুতি এবং আল্লাহর বাণীর কোন ব্যতিক্রম নেই।’ আল্লাহপাক তাকে জন সমক্ষে লাঞ্ছিত করেছেন। কিন্তু সে তার কর্মধারা থেকে বিরত হয়নি এবং সে ঐ কথার উপর অটল রইল যে, যেকোনো অবস্থায় তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ হবে। কেননা, আকাশেই তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ হয়ে গেছে। তবে তার বর্তমান স্বামী অচিরেই মৃত্যুবরণ করবে। তারপর সে বলছে: এটা সত্য যে, আমার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ হয় নি, তবে এটা নিশ্চিত যে, অচিরেই আমার সাথে তার বিবাহ হবে। যেমন ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখ রয়েছে, . ...। এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়ায় লোক আমাকে নিয়ে উপহাস করছে। তবে, এ ভবিষ্যদ্বাণী আমি আমার নিজের পক্ষ হতে দেই নি, বরং আল্লাহর ওহী দ্বারা আমি বলেছি। আমি সত্য বলছি যে, এমন একদিন আসবে যেদিন এ সকল বিদ্রূপকারীদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যাবে..... । আর, মেয়েটি জীবিত অবস্থায় আমার কাছে আসবে এবং আমার সঙ্গে তার বিবাহ হবে। আমি এতে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি। কেননা, আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম হয় না’। (গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণা, যা মঞ্জুর কাদিয়ানঅর ‘মঞ্জুরে এলাহী’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত, ১৪৪ পৃ:) সে আরো লিখেছে: ‘আমি আল্লাহর নিকট কাকুতি মিনতির সহিত প্রার্থনা করলে আমার কাছে এলহাম আসল: ‘অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনা বলী দেখাব, এ মেয়েটি বিধবা হবে এবং তার স্বামী ও পিতা তিন বৎসরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর এই মহিলা আমার নিকট আসবে এবং কেহই এতে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না’ (গোলামের ইলহাম যা ‘নবীস্তায়ে গায়েব’ হতে গৃহীত।) সে আরও বলে: ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সত্য ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন। এটাও বাস্তব যে, আমার সাথে মহিলাটির বিবাহ হবে। এই সংবাদকে আমি আমার সত্য মিথ্যার মানদন্ড নির্ধারণ করছি। আমি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রাপ্তির পরই বলছি। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘আঞ্জামে আথম’ ২২৩ পৃ:)
এদিকে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু মুহাম্মদী বেগমের স্বামী সৈনিক ব্যক্তি অস্ত্র ও গুলীর নীচে জীবন যাপন করেও মৃত্যুবরণ করেনি এবং ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী গোলাম আহমদের নিকট মুহাম্মদী বেগম ফিরে আসেনি। ফলে চতুর্দিক থেকে তার উপর অভিশাপ ও গাল-মন্দ বর্ষিত হতে লাগল। সে দোয়ার মাধ্যমে সর্বশেষ ঘোষণা দিল: পবিত্র ও মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, হে মা’বুদ, সর্ব শক্তিমান ও সর্বজ্ঞ, যদি আহমদ বেগের কন্যার বিবাহের ভবিষ্যদ্বাণী তোমার নিকট হতে হয়ে থাকে, তাহলে তুমি তা বাস্তবে পরিণত কর। যাতে এটা তোমার মখলুকের উপর প্রমাণরূপে গণ্য হয় এবং এর দ্বারা হিংসুক খবীছদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। আর যদি এই ভবিষ্যদ্বাণী তোমার নিকট হতে না হয়ে থাকে, তাহলে হে আল্লাহ! আমাকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করে ধ্বংস করে দিন এবং আপনার দৃষ্টিতে আমাকে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত করুন।’ (গোলাম আহমদের ঘোষণা ২৭ অক্টোবর ১৮৯৪ খৃ: যা কাসিম কাদিয়ানীর ‘তাবলীগে রেসালাতের অন্তর্ভুক্ত, ৩য় খন্ড ১৮৬ পৃ:)
কার্যত: আল্লাহ তাআলা এ অভিশপ্ত ও বিতাড়িত ব্যক্তিকে তার [১ ভন্ডনবী কাদিয়ানী এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হলে উক্ত গুণ দুটো তার নিজের উপর আরোপ করছি। তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়নি।]
দীর্ঘ বাইশ বৎসর যাবৎ এ ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানোর পর অপমানিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত অবস্থায় ধ্বংস করেন। কেননা, সে প্রথম বারের মত ১৮৮৬ সালে এ ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং ১৯০৮ সালে সে মৃত্যুবরণ করে। আর, এ মহিলাটি তার বীর স্বামীর সংসারে থেকে এ ভন্ডনবীর অন্তরকে জ্বালিয়ে এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ ও কৃত্রিম-অমূলক দাবিদাওয়াকে মিথ্যা প্রমাণ করে বেঁচে রইল [২ মুহাম্মদী বেগম প্রায় একশত বছর জীবিত থাকার পর ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেন।]
আর তার স্বামী এই সফল প্রতিযোগী গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর চল্লিশ বৎসরের অধিক কাল জীবিত ছিল। এ আঘাতটি ছিল কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে একটি মরণ আঘাত। এখনও তারা মাথা নত করে আছে এবং এ সংকট থেকে বের হওয়ার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কেননা, তাদের ভন্ডনবী সর্বদা এ ভবিষ্যদ্বাণীকে তার সত্য মিথ্যার মাপকাঠিরূপে গণ্য করেছে। একথা ধর্তব্য ছিল যে, যখন তারা এ লোকটিকে অপবাদ রটনাকারী ও মিথ্যাবাদী জানতে পারবে তখন তারা সঠিক পথে ফিরে আসবে। কেননা, আল্লাহর বাণী ও প্রতিশ্রুতি সমূহের পরিবর্তন অসম্ভব। গোলামও তা স্বীকার করেছে। কিন্তু বক্ষের ভিতর যে অন্তর আছে তা (বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে) অন্ধ হয়ে যায়। তার মিথ্যা প্রকাশ পাওয়ার পরও তারা তার ধর্মত্যাগ করেনি।
চতুর্থ ভবিষ্যদ্বণী:
উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী গোলাম আহমদকে মিথ্যুক ও দাজ্জাল সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কাদিয়ানীদের বিশিষ্ট নেতা ও আমির মুহাম্মদ আলী লাহোরি কাদিয়ানী বলেছে: ‘এটা ঠিক যে, আমাদের ইমাম বলেছেন: মুহাম্মদী বেগমের সহিত তার বিবাহ হবে এবং এটাও ঠিক যে, মুহাম্মাদী বেগমের তার বিবাহ হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বও অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী যা বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে লোকটিকে মিথ্যাবাদী বলা যায় না। (মুহাম্মদ আলীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে সুলাহে’ প্রচারিত ১৬ জানুয়ারি ১৯২১ খৃ:।) প্রথমত: এটা তার ইমাম ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর উক্তির বিপরীত। সে বলেছে: ‘বিরুদ্ধ বাদীরা জেনে রাখ, আমাদের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য এ ভবিষ্যদ্বাণী হতে অধিক সুন্দর ও উপযোগী আর কিছু নেই।’ (গোলামের ‘মিরাতে কামালাতে ইসলাম’ ২৮৮ পৃ:) সুতরাং ভন্ডনবী কাদিয়ানী এ ভবিষ্যদ্বাণীকে বিশেষ করে তার সত্য মিথ্যার মাপকাঠি বানিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত: সে এ ভবিষ্যদ্বাণীকে বিভিন্ন শব্দ দ্বারা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ব্যক্ত করেছে. যেমন, এটা বাস্তবায়িত হওয়া অপরিবর্তনীয় ফয়সালা এবং আসমানে তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে, এবং স্বয়ং আল্লাহ তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ সম্পন্ন করেছেন।’ এ ভবিষ্যদ্বাণী আল্লাহর ঐ সকল বাণীর অন্তর্ভুক্ত যার কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না।’ যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হয় তবে সে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হবে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি.....।
এ সব সত্ত্বেও আমি তার অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীর পরিণতি উল্লেখ করছি, যাতে, এ সত্য আরো অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠে যা পূর্বেই স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং এতে যেন কারো সন্দেহ ও ইতস্তত: করার অবকাশ না থাকে। এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী তার স্ত্রীর গর্ভাবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছে- ঐ আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি আমাকে এ বৃদ্ধাবস্থায় চারটি ছেলে দান করেছেন এবং পঞ্চম ছেলের সুসংবাদ দিয়েছেন।’ (গোলামের মূল বর্ণনা যা তার পুস্তক ‘‘মাওয়াহিবুর রহমান’’ এ উল্লেখিত, ১৩৯ পৃ:।) এ ইলহামটি ১৯০৩ খৃ: এর জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে ছিল এবং ঠিক ঐ মাসের ২৮ তারিখে ১৯০৩ খৃ: ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী গোলাম আহমদের স্ত্রী একটি সন্তান প্রসব করল। তবে এটা কি ছিল? কন্যা? হ্যাঁ, কন্যাই? কিন্তু বেশি দিন বাঁচেনি, বরং কয়েক মাস পরেই সে মারা গেল। আবার তার স্ত্রী গর্ভবতী হল এবং সে ভবিষ্যদ্বাণী করল, ‘‘সম্ভ্রান্ত ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে, সে হবে সুদর্শন সুচতুর সন্তান।’’ (গোলামের আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৯১ পৃ:।) এ ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল, জনসাধারণের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করা যে, ১৯০৩ সালের ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা এ গর্ভই উদ্দেশ্য, ইতি পূর্বেকার গর্ভ নহে। এরপর কি হল? আল্লাহর কুদরত দেখুন! এ অপবাদকারী মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ কীভাবে অপদস্ত করেছেন এবং এ ইলহাম ও ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র এক মাস পর কেমন করে তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেন। ১৯০৪ সালের ২৪ জুন গোলামের স্ত্রী আবার প্রসব করল। তা কি কন্যা? অবশ্যই কন্যা। তার নাম রাখা হল ‘‘আমাতুল হাফিজ।’’ কিন্তু সম্ভ্রান্ত সুচতুর সুদর্শন ছেলে জন্ম গ্রহণ করেনি? অবশ্যই জন্ম গ্রহণ করেনি। তা সত্ত্বেও গোলাম তার জীবনের শেষ পর্যন্ত বার বার একথা বলেছে যে, তার এমন একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে যে তার অপমানকে বিধৌত করবে এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী প্রথম ও দ্বিতীয় গর্ভের জন্য জড়িত ছিল না। পুনরায় সে তার ইলহাম ও বিশেষ সন্তানের ভবিষ্যদ্বাণী ১৯০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করল- ‘আমি তোমাকে একজন ধৈর্যশীল ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা বদর যা ১৯০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এবং আল বুশরা ২য় খন্ড ১৬৩ পৃ:।) অক্টোবর মাসে সে তার দ্বিতীয় ইলহাম ঘোষণা করল: ‘‘অচিরেই আমি তোমাকে একটা ছেলে দান করব। হে প্রভু, আমাকে একটা পবিত্র সন্তান দান কর। আমি তোমাকে এমন ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি যার নাম হবে ইয়াহইয়া। (গোলামের অক্টোবরের ইলহাম যা তার ইলহামের সমষ্টি আল বুশরার অন্তর্ভুক্ত। ২য় খন্ড ১৩৬ পৃ:।) কিন্তু আক্ষেপের বিষয়- ‘পবিত্র ছেলে ও ধৈর্যশীল ছেলে জন্ম গ্রহণ করেনি। কারণ, এই ইলহামের কয়েক মাস পরেই ২৬ শে মে ১৯০৮ সালে গোলাম আহমদ মারা যায়, যাতে সে তার কর্মফল পেতে পারে। আমাতুল হাফিজ নাম্নী যে মেয়েটি ১৯০৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিল, সেই তার শেষ সন্তান। এ আঘাতটি তার জীবনের প্রথম আঘাত ছিল না , বরং ইতিপূর্বে ১৮৮৬ সালে সে এর তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে এতই নির্বোধ ছিল যে, সে এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি।
পঞ্চম ভবিষ্যদ্বাণী:
এ ভবিষ্যদ্বাণী আমি বিস্তারিত বর্ণনা করব। ১৮৮৬ সালের ২০ ফেব্রয়ারী তারিখে যখন গোলাম আহমদের স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, তখন সে ঘোষণা দিল যে, আল্লাহর নিকট থেকে তার কাছে ইলহাম এসেছে। এর বর্ণনা হল এই: ‘‘আল্লাহ করুণাময় দয়ালু যিনি সবকিছু করতে পারেন আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তার একটি নিদর্শন প্রকাশ করবেন, যা রহমতের নিদর্শন.... প্রকাশ্য নিদর্শন..... সুদর্শন, সম্মানিত ও পবিত্র সন্তান......জাহেরী বাতেনী জ্ঞানে পরিপূর্ণ........প্রিয় ছেলে, সৌভাগ্যবান, আউয়াল ও আখেরের এবং হক ও উলার প্রকাশ স্থল, যেন আকাশ থেকে আল্লাহ স্বয়ং অবতরণ করেছেন। (এ সকল তুলনা হতে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি, তারা যা বলছে তা থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্ধ্বে।) এ ছেলেটি খুব তাড়াতাড়ি বড় হবে এবং কায়েদিগণকে মুক্ত করবে এবং বিভিন্ন জাতি তার থেকে বরকত লাভ করবে। (গোলামের ঘোষণা, ২০ ফেব্রঃ ১৮৮৬ সাল, যা কাসিম কাদিয়ানীর ‘তাবলীগে রেসালাত’ এর অন্তর্ভুক্ত, ১ম খন্ড ৫৮ পৃ:।) সে স্পষ্ট করে বলছে যে, এ মহান সন্তানটি বর্তমান গর্ভ থেকেই জন্ম গ্রহণ করবে। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘তাতিম্মতু হাকিকাতুল ওহী, ১৩৫ পৃ:।) অতঃপর গোলামের স্ত্রী এ গুলো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়ার পর এবং আর্তনাদপূর্ণ ইলহামাতের পর এপ্রিল মাসে একটি সন্তান প্রসব করল। কিন্তু ভন্ডনবী মিথ্যাবাদীর দাবি অনুসারে সন্তানটি ছেলে ছিল না, বরং মেয়ে ছিল। তার নাম রাখা হল ‘ইসমত’। তারপর সে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সে ১৮৯১ সালে মারা গেল। কাদিয়ানীরা অধীর আগ্রহে এমন একটি ছেলে সন্তানের অপেক্ষায় রইল, যে হবে সুন্দর, সম্মানিত, মেধাবী, সত্য ও উচ্চ মর্যাদার প্রতীক, বিভিন্ন জাতি তার দ্বারা বরকত লাভ করবে এবং সে বন্দিদের মুক্তি করবে। এ অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত ছিল। যদি এ মিথ্যাবাদীর সামান্যতম বুদ্ধি থাকত তবে সে এ ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পর এ ধরনের আর কোন মিথ্যা ইলহাম রটনা করত না। কিন্তু তার শয়তান তাকে অনেক বার পথভ্রষ্ট করেছে যাতে করে সে লাঞ্ছনা, অপদস্ততা, লানত ও ঐ সকল গাল-মন্দ অর্জন করতে পারে যা সে নিজেই নিজের জন্য নির্ধারিত করেছে। আশ্চর্যের বিষয় যে, এ সত্ত্বেও সে দাবিকরে, প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে সে কোন কথা বলে না, যা বলে তা ওহী ব্যতীত আর কিছু নহে।’ (গোলামের আরবাঈন ৩ নম্বর ৪৩ পৃ:।)
ষষ্ঠ ভবিষ্যদ্বাণী:
এখন আমরা তার ষষ্ঠ ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করব, ১৮৮৬ সনের ২০শে ফেব্রয়ারী তারিখে সে ঘোষণা দিল ‘‘আল্লাহ তাআলা আমাকে এ মর্মে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, বরকতের অধিকারিণী স্ত্রী গণ থেকে আমার অনেক গুলো সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। এদের কাউকে আমি এ এলহামের পরে বিবাহ করব। (তাবলীগে রেসালাতের অন্তর্ভুক্ত গোলামের ইলহাম, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃ:।) এ বক্তব্যকে সে তার নিম্নোক্ত উক্তি দ্বারা আরো স্পষ্ট করেছে- ‘‘আল্লাহর কাছ থেকে ইলহাম পাওয়ার পর ১৮৮৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসে আমি এ ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, এ ঘোষণার পর আল্লাহ তাআলা আমাকে বিবাহের সুসংবাদ দিয়েছেন, অচিরেই আমি বরকতময় রমণীগণকে বিবাহ করব এবং তাদের থেকে আমার সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করবে।’’ (গোলামের ‘মাহাক্কে আখইয়ার ও আসরার’ নামক ঘোষণাপত্র যা তাবলীগে রিসালাতের অন্তর্ভুক্ত ১ম খন্ড ৮৯ পৃ:) অতএব, তার ভবিষ্যদ্বাণী সুস্পষ্ট, কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। তা হল যে, গোলাম কাদিয়ানী ১৮৮৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসের পর কয়েকজন মহিলাকে বিবাহ করবে এবং তাদের থেকে সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করবে। এরপর একটি বিষয় বাকি রয়ে গেল, আর তা হল এই যে, এ ঘোষণার পর সে কয়টি মহিলাকে বিবাহ করেছে এবং তাদের থেকে তার কয়টি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে? বাস্তব অবস্থা এ সম্পর্কে কি বলি? এরপর গোলাম আহমদ অনেক মহিলা তো বিবাহ করেনি বরং একটিও না। আর, সন্তানাদি লাভের তো প্রশ্নই উঠে না।
সপ্তম ভবিষ্যদ্বাণী:
তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের অন্যতম একটি হল এই- ১৮৯৯ সালের ১৪ ই জুন তারিখে তার একটি সন্তান জন্ম লাভ করে এবং তার নাম রাখে ‘মোবারক আহমদ’ তার জন্ম গ্রহণের কয়েকদিন পর সে ভবিষ্যদ্বাণীরূপে ঘোষণা দিল যে, এ সন্তানটি ‘‘আল্লাহর একটি নূর, প্রতিশ্রুত সংস্কারক, মহত্ত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী, মাসীহ সাদৃশ্য আত্মা, রোগ নিরাময় কারী, আল্লাহর বাণী ও সৌভাগ্যবান এ সন্তান বিশ্বের সকল প্রান্তে খ্যাতি লাভ করবে, বন্দি মুক্ত করবে এবং সকল প্রান্তে খ্যাতি লাভ করবে, বন্দি মুক্ত করবে এবং সকল জাতি তার দ্বারা বরকত লাভ করবে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তিরইয়াকুল কুলবি’ ৪৩ পৃ:) অতঃপর এ সন্তানটি তার জন্মের আট বৎসর পর ১৯০৭ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যদ্দরুন গোলাম আহমদ অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠল। কারণ, ইতিপূর্বে সে ঘোষণা দিয়েছিল যে, এ সন্তানটি এমন এমন হবে। সুতরাং যথা সম্ভব সে তার সকল প্রকার চিকিৎসা করল। ১৯০৭ সালের ২৭ শে আগস্ট তারিখে যখন তার রোগ কিছুটা হালকা হল, তখন গোলাম ভবিষ্যদ্বাণী রূপে ঘোষণা দিল ‘আল্লাহ আমার কাছে ইলহাম করেছেন যে, দোয়াটি কবুল হয়ে গেছে এবং রোগ সেরে গেছে। এর অর্থ হল এই যে, আল্লাহ তাআলা দোয়া কবুল করেছেন এবং মুবারক আহমদ আরোগ্য লাভ করবে। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদর’ ২৯ আগস্ট, ১৯০৭ সাল।) ভন্ডনবী কাদিয়ানী আল্লাহর শানে এ মিথ্যা অপবাদ ঘোষণা করার সাথে সাথে রোগটি নতুন করে ফিরে এল এবং ১৯০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে এ প্রতিশ্রুত সংস্কারক সন্তানটি মারা গেল, যে মহত্ত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী, রোগ নিরাময়কারী, মাসীহ সাদৃশ্য, সকল জাতি যার প্রতি অপেক্ষমাণ ছিল, সে বন্দি মুক্ত করবে এবং জনগণের উপর থেকে তাদের কঠিন ও ভারী বোঝা সরিয়ে দেবে। (‘সীরাতে মাহদী’ ৪০ পৃ: এবং কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজল’ ৩০ শে অক্টোবর, ১৯৪০ খৃ:)
অষ্টম ভবিষ্যদ্বাণী:
গোলামের অন্যতম এক ভবিষ্যদ্বাণী হল ‘কাদিয়ান নামক জনপদে যেখানে তার বাসস্থান প্লেগ রোগ দেখা দেবে না।’ সে বলেছে: তিনি সত্য মা’বুদ যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল পাঠিয়েছেন, তিনিই কাদিয়ানকে হেফাজত করবেন এবং প্লেগ রোগ হতে একে রক্ষা করবেন। যদিও এ রোগ সত্ত্বর বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে। কেননা, কাদিয়ান তার রাসূলের আবাস ভূমি এবং এর মধ্যেই (অর্থাৎ কাদিয়ানে প্লেগ প্রবেশ না করাতে) সকল জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘দাফেউল বালা’ ১০ ও ১১ পৃ:) এ ভবিষ্যদ্বাণীতে গোলাম আহমদ দাবি করছে যে, যদিও এদেশে প্লেগ রোগ সত্ত্বর বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে, তবু কখনও উহা কাদিয়ানে প্রবেশ করবে না। কিন্তু দেখা গেল, ঐ কাদিয়ানে প্লেগ রোগ প্রবেশ করেছে, যাকে এ ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার অবস্থান দ্বারা বিখ্যাত করেছিল। এতে তার বাদী মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অথচ সে সময় কাদিয়ানের আশে পাশের গ্রাম ও শহরে প্লেগ ব্যাপক ছিল না এবং এর প্রকোপ স্থায়ী ছিল না। এমনকি এক বৎসর পর্যন্তও স্থায়ী থাকেনি। এখন আমরা গোলাম আহমদের নিজের পক্ষ থেকেই এর প্রমাণ পেশ করব। সে তার শ্বশুর মুহাম্মদ আলী খানের নিকট লিখিত পত্রে কাদিয়ানে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলে: এখানে প্লেগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। লোক আক্রান্ত হয়ে কয়েক ঘনটার মধ্যে মারা যায়। আল্লাহই জানেন যে, এ পরীক্ষা কবে শেষ হবে! আপনারা ‘ফেনাইল ইনফেতলীনের’ একটা বড় বাক্স নিয়ে আসবেন; যার মূল্য প্রায় বিশ টাকা হবে। আর, আপনাদের বাড়িতেও ফেনাইল পাঠাবেন। (মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানীর নিকট পত্র, যা ‘মাকতুবাতে আহমদিয়ার অন্তর্ভুক্ত ৫ম খন্ড ১১২ও ১১৩ পৃ:।) শুধু তাই নহে বরং প্লেগ তার বাড়িতেও ঢুকছে, হ্যাঁ, তার বাড়িতেই যার সম্পর্কে সে বলে ‘আমার বাড়ী নূহ আলাইহিস সালাম এর নৌকার মত; যে এখানে প্রবেশ করবে সে সকল বিপদাপদ হতে রক্ষা পাবে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘সফিনায়ে নূহ’ ৭৬ পৃ:।) ঠিক এ বাড়িতেই প্লেগ প্রবেশ করে এবং যা ঘটবার তা ঘটিয়েছে; ভন্ডনবী কাদিয়ানী উপরোক্ত ব্যক্তির নিকট লিখিত তার অপর এক পত্রে তা স্বীকার করেছে। এতে সে লিখেছে ‘আমাদের পরিবারেই প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছে, এতে গাওছানুল কবীরা নাম্নি মহিলা আক্রান্ত হয়েছে। আমরা তাকে ঘর থকে বের করে দিয়েছি। এমনিভাবে উস্তাদ মুহাম্মদ দ্বীনও আক্রান্ত হয়েছেন, আমরা তাকেও বের করে দিয়েছি। আজ অন্য একজন মহিলা আক্রান্ত হয়েছে, যে দিল্লি হতে এসেছিল এবং আমাদের বাড়িতে অবস্থান করছিল..। আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি। এমন কি আমি ধারণা করতে থাকি যে, আমার ও মৃত্যুর মধ্যে মাত্র কয়েক সেকেন্ড আছে।’ (মুহাম্মদ আলীর নামে গোলামের পত্র, যা ‘মাকতুবাতে আহমদিয়ার অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড, ১১৫ পৃ:)
এই হল কাদিয়ানে প্লেগ রোগ প্রবেশ না করা সম্পর্কে গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী; যার সম্বন্ধে সে বলত যে, ‘এতে জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে। এই হল বাস্তব সত্য এবং মূলত: এতেই রয়েছে জাতির জন্য তার মিথ্যা ও আল্লাহ তাআলার প্রতি তার মিথ্যাচারের নিদর্শন।
নবম ভবিষ্যদ্বাণী:
মঞ্জুর মুহাম্মদ নামে গোলামের একজন মুরিদ ছিল। তার স্ত্রী গর্ভবতী হলে সে গোলাম আহমদের কাছে এসে সংবাদ দিল। তখন ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার অভ্যাস অনুসারে উঠে দাঁড়াল এবং ভবিষ্যদ্বাণীরুপে ঘোষণা দিল ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, মঞ্জুর মুহাম্মদের একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম তার নাম কি হবে? তখন স্বপ্নের অবস্থা ইলহামের অবস্থায় পরিণত হয়ে গেল এবং উত্তরে বলা হল- ‘বশিরুদ্দৌলা’। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে? (গোলামের ইলহাম যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘রিভিই’ এর অন্তর্ভুক্ত, ১৯০৬ সনের মার্চ মাসে প্রকাশিত, ১২২ পৃ:।) একথা স্পষ্ট যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা ঐ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য যে এসে তার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ দিয়েছিল। কিন্তু একে অস্পষ্ট রাখার উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট করে না বলা। বিশেষ করে ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের মধ্যে উল্লেখিত দুটি বিষয়ের স্বাদ গ্রহণ করার পর সে অস্পষ্ট রাখতে চায়। এর তাৎপর্য হল এই যে, যদি তার ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে বলা হবে: তুমিই উদ্দেশ্য ছিলে। আর যদি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে একথা বলতে সহজ হবে যে, অন্য ব্যক্তি উদ্দেশ্য ছিল; স্বয়ং ইলহামে এর স্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই। তারা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহ ও ব্যবস্থা নিলেন। আর, আল্লাহ সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ কারী। তাই আল্লাহ পুনরায় তাকে লাঞ্ছিত করতে ইচ্ছা করলেন। মাত্র চার মাস পর এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী ঘোষণা দিল,- ‘আমার বিশ্বাস যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা এ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য, এবং তার স্ত্রী মুহাম্মদী বেগমের গর্ভে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। (এ মুহাম্মদী বেগম পূর্বোল্লিখিত মুহাম্মদী বেগম নহে) তার নাম হবে বশিরুদ্দৌলা। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে, মঞ্জুর আহমদ দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে? (গোলামের ইলহাম যা কাদিয়ানী পত্রিকা রিভিউ এর অন্তর্ভুক্ত, ১৯০৬ সনের মার্চ মাসে প্রকাশিত, ১২২ পৃ:।) একথা স্পষ্ট যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা ঐ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য যে এসে তার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ দিয়েছিল। কিন্তু একে অস্পষ্ট রাখার উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট করে না বলা। বিশেষ করে ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের মধ্যে উল্লেখিত দুটি বিষয়ের স্বাদ গ্রহণ করার পর সে অস্পষ্ট রাখতে চায়। এর তাৎপর্য হল এই যে, যদি তার ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে বলা হবে: তুমিই উদ্দেশ্য ছিলে । আর যদি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে একথা বলতে সহজ হবে যে, অন্য ব্যক্তি উদ্দেশ্য ছিল; স্বয়ং ইলহামে এর স্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই। তারা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহ ও ব্যবস্থা নিলেন। আর, আল্লাহ সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণকারী। তাই আল্লাহ পুনরায় তাকে লাঞ্ছিত করতে ইচ্ছা করলেন। মাত্র চার মাস পর এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী ঘোষণা দিল,- ‘আমার বিশ্বাস যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা এ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য, এবং তার স্ত্রী মুহাম্মদী বেগমের গর্ভে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। (এ মুহাম্মদী বেগম পূর্বোল্লিখিত মুহাম্মদী বেগম নহে) তার নাম হবে বশিরুদ্দৌলা। এটাও সম্ভব যে, উক্ত সন্তান এ গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করবে না বরং পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম লাভ করবে। কিন্তু তার জন্ম গ্রহণ করা অপরিহার্য। কেননা, সে আল্লাহর নিদর্শন।’ (গোলামের ইলহাম যা ‘রিভিউ অব রিলিজিউন্স’ এর অন্তর্ভুক্ত জুন ১৯০৬ খৃ:।) তার পূর্ববর্তী তিক্ত অভিজ্ঞাতার কারণে এ ভবিষ্যদ্বাণীতে সে তার আত্মরক্ষার পথ রেখেছে। এজন্য বলেছে: আমি জানি না, উক্ত সন্তানটি এ গর্ভ হতে জন্ম গ্রহণ করবে অথবা পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করবে।’ এ সকল সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলেছে, তা হল মুহাম্মদী বেগমের গর্ভে মঞ্জুর মুহাম্মদের একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। তাই সে বলেছে: মঞ্জুর মুহাম্মদের স্ত্রী উক্ত সন্তান জন্ম দান এবং এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করবে না।’ (গোলামের মূল বক্তব্য, যা রিভিউ এর অন্তর্ভুক্ত, জুন ১৯০৭ খৃ:।) ঘটল কি? ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে মঞ্জুর মুহাম্মদের স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান প্রসব করল। তারপর সেই মহিলা আর কোন গর্ভ ধারণ না করে মৃত্যু বরণ করে। কাদিয়ানীরা এই বলে বশিরুদ্দৌলার অপেক্ষায় রইল যে, আল্লাহ জানেন, কখন এবং কেমন করে এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হবে। কেননা, জনাবে মুকাদ্দাস (গোলাম) মুহাম্মদী বেগমের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন। আর, বেচারি তো মৃত্যুবরণ করেছে।’ হায় আফসোস! (গোলামের ইলহামাতের সমষ্টি মঞ্জুর কাদিয়ানী কর্তৃক রচিত ‘আল-বুশরার’ অন্তর্ভুক্ত, ২য় খন্ড, ১১৬ পৃ:।)
দশম ভবিষ্যদ্বাণী:
একদা ভন্ডনবী কাদিয়ানীর সাথে ডা: আব্দুল হাকীম নামী একজন মুসলমানের ঝগড়া বাঁধলে তিনি তাকে মিথ্যাবাদী বলে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং তাকে মাঠে নামার জন্য আহবান জানালেন। কিন্তু গোলাম আহমদ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার পরিবর্তে তাকে শাস্তি, বিপদ, অভিশাপ ও ধ্বংসের হুমকি দিতে লাগল এবং তার স্বভাব অনুযায়ী ঘোষণা দিল- আব্দুল হাকীম আমার জীবদ্দশায় মারা যাবে, কেননা, সে আমার মানহানি ও দুর্নাম করছে। এরূপ ব্যক্তি বেঁচে থাকে না ... এবং.... এবং; কিন্তু ডাঃ আব্দুল হাকীম অন্য ধরনের লোক ছিলেন তাই তিনিও ঘোষণা দিলেন- ‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী আজ থেকে পনেরো মাসের মধ্যে মারা যাবে।’ আর এ ঘোষণাটি ছিল ১৯০৭ সালের ৪ঠা মে তারিখে। এখন এ সম্পর্কে ভন্ডনবী কাদিয়ানীর নিজ মুখের বক্তব্য আমাদের শুনা উচিত। সে লিখেছে- ‘এখন আর এক শত্রু বের হয়েছে- পাটিয়ালার (ভারতের একটি শহর) অধিবাসী ডাঃ আব্দুল হাকীম। সে দাবি করছে যে, আমি তার জীবিতাবস্থায় ১৯০৮ সালের ৪ঠা আগস্টের মধ্যে মারা যাব। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে এর বিপরীত সংবাদ দিয়েছেন, সে আল্লাহর আজাবে আক্রান্ত হবে এবং আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেবেন। পক্ষান্তরে, আমি তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকব। এ ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দৃষ্টিতে সত্য, আল্লাহ তাকেই সাহায্য করবেন।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আইনুল মা‘রেফত, ৩২১ ও ৩২২ পৃ:, ১৯০৮ সালের ২০মে তারিখে প্রচারিত।) সে আরো বলেছে: ‘শত্রু আব্দুল হাকীম যে আমার মৃত্যু কামনা করে , সে অচিরেই আমার চক্ষুর সামনে সমূলে ধ্বংস হবে, যেভাবে হাতিওয়ালাদেরকে সমূলে ধ্বংস করা হয়েছিল’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তাবসেরাহ’)এ ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে সে আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী করল- ‘শত্রুরা আমার মৃত্যু কামনা করে এবং এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণীও করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে আমি আশি বছর বা এরও অধিক কাল বেঁচে থাকব। (গোলামের ‘মাওয়া হিবুর রহমান’ ২১ পৃ:।) সে জোর দিয়ে বলেছে যে, সে ১৯০৮ সালের ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। বরং এরপর আরো দশ বছর সে বেঁচে থাকবে। এটা জানা কথা যে, সে ১৮৩৯ অথবা ১৮৪০ সনে জন্ম গ্রহণ করেছে। সে নিজেই করেছে- আমি ১৮৩৯ বা ১৮৪০ সালে জন্ম গ্রহণ করেছি’ (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়্যাহ’ এর টিকা, ১৪৬ পৃ: এবং কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদর’ ৮ আগস্ট ১৯০৪ খৃ:।) এবং (হায়াতুন নবী প্রথম খন্ড, ৪৯ পৃ: ও কাদিয়ানীদের অন্যান্য পুস্তক) সে আরো লিখেছে- ‘১৮৫৭ সালে আমার বয়স ষোলো বা সতের বছর ছিল। (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়্যর’ টিকা ১৪৬ পৃ:।) এমনিভাবে সে এ ভবিষ্যদ্বাণীতে তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী একত্রিত করল। (১) ভন্ডনবী গোলাম আহমদের জীবিতাবস্থায় আব্দুল হকীম মৃত্যুবরণ করবে। (২) আব্দুল হাকীম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে সে অনুসারে ১৯০৮ সালের ৪ঠা আগস্টের মধ্যে সে মৃত্যুবরণ করবে না। (৩) সে কমপক্ষে ১৯১৯ বা ১৯২০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। এখন আমরা দেখব তার এ সকল ভবিষ্যদ্বাণী কি বাস্তবায়িত হয়েছে? অথচ গোলাম বলেছে নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়া অসম্ভব। (গোলামের ‘সফিনায়ে নূহ’ ৫ম পৃ:) সে আরো বলেছে- আমার সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য আমার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ হতে উত্তম আর কিছু নেই। (গোলামের ‘মেরাতুল কামালাত’ ২৮৮ পৃ:।)
হে পাঠক! হে অনুসন্ধানী! বিবরণ লক্ষ্য করুন! মুহাম্মদ হুসেন কাদিয়ানী লিখেছে, ‘আমাদের ইমাম মাসীহ মাওউদ (গোলাম) ২৫মে পর্যন্ত সুস্থ ছিলেন এবং কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে সুলহ’ এর উদ্দেশ্যে একটি প্রবন্ধ লিখান; কিন্তু মাগরিবের পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন.... এবং ১৯০৮ সালের ২৬শে মে সকাল সাড়ে দশ ঘটিকায় তার রুহ তার সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যায়।’ (মুহাম্মদ হুসাইন কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল
হিকমের’ অন্তর্ভুক্ত, ২৮ মে ১৯০৮ সাল।) গোলাম পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানী লিখেছে- ‘মসীহে মাওউদ ১৯০৮ সালের ২৫মে পর্যন্ত সুস্থ ও উৎফুল্ল ছিলেন। কিন্তু এশার পর আকস্মিক ভাবে আমাদের কাছে তার মৃত্যুমুখী শয্যাশায়ী হওয়ার সংবাদ পৌঁছোল এবং ২৬ মে ১৯০৮ সালে তিনি মারা গেলেন।’ (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘সীরাতে মাহদী’ ৭পৃঃ) এভাবে মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী গোলাম আহমদ এ তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীতে একই সময় তিনটি মিথ্যাকথা বলেছে। প্রথমত: ডা: আব্দুল হাকীম কর্তৃক নির্ধারিত সময়েই সে মৃত্যুবরণ করেছে। এতে এটাই প্রমাণিত হল যে, ডাঃ আঃ হাকীম সত্য এবং সে মিথ্যা। কেননা, সে ইতিপূর্বে বলেছে- ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সাহায্য করেন যে তার দৃষ্টিতে সত্যবাদী। দ্বিতীয়ত: তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তার জীবদ্দশায় আব্দুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেন নি । বরং তার মৃত্যুর পরও তিনি দীর্ঘ দিন বেঁচে ছিলেন। তৃতীয়ত: সে আটষট্টি অথবা উনসত্তুর বৎসর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছে, তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আশি ও তদুর্ধ বৎসর বয়সে নহে। এ বিষয়ে আমি তার সম্পর্কে তা-ই বলব যা সে নিজে বলেছে: যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবিকরে, তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়া তার জন্য বড়ই লাঞ্ছনা ও অপমান জনক।’ (গোলামের ‘তিরয়াকুল কুলুব’ ১০৭ পৃ: এডিশন এক এবং ২৬৮ পৃ: এডিশন ২।) এই কথাটি সে সত্য বলেছে, যদিও অপরাপর অনেক বিষয়ে সে সত্য বলেনি। এ লাঞ্ছনার চেয়ে বড় লাঞ্ছনা এবং অপমানের চেয়ে অপমান আর কি হতে পারে? সে ২০ মে একটি পুস্তক প্রচার করে। যাতে সে তার শত্রুর মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মাত্র ছয়দিন পর সে তার শত্রুর পরিবর্তে নিজেই অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও মিথ্যুক সেজে মৃত্যুবরণ করে। এমনি ভাবে সে আরো কতই না মিথ্যা বলেছে। তার অনেক অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে মাত্র দশটি আমরা এখানে উল্লেখ করেছি, যাতে সে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তার দশম ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে একই সময়ে তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, আমি তা ইতিপূর্বে ব্যক্তি করেছি। এতটুকু বর্ণনা কে আমরা যথেষ্ট মনে করি। যদি আমরা তার মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী সমূহকে ধারাবাহিক বর্ণনা করি তাহলে বড় একটি ভলিউমে উহা সংকুলান করা যাবে না কেননা, এতটুকু বর্ণনাই এ লোকটি এবং তার দ্বাবী দাওয়ার বাস্তব রূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদানে যথেষ্ট। সে নিজেই বলেছে: ‘যদি কেহ একটি বিষয়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয় তবে অন্যান্য বিষয়ে তার উপর বিশ্বাস রাখা যায় না’। (গোলামের ‘আইনুল মারেফাত’ ২২২ পৃ:।) অতএব দু’ একটি বিষয়ে নয়, বরং বারটি ভবিষ্যদ্বাণী বা ঘটনাতে আমরা তার মিথ্যাচারিতা প্রমাণ করেছি।
এ আলোচনার পরিশিষ্টে আমরা কাদিয়ানীদের দাবিদাওয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চাই। ওদের বাদী- ‘যদিও আমাদের সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী সত্য ও বাস্তবায়িত হয়নি, তথাপি কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে।’ ভন্ডনবী কাদিয়ানীর উক্তি যা আমারা এই মাত্র উল্লেখ করেছি, উহার প্রতি দৃষ্টিপাত না করেই বলছি- ‘কোন কোন ভবিষ্যদ্বাণী সত্য ও বাস্তবায়িত হওয়া এটাই প্রমাণ করে যে, ভবিষ্যদ্বাণীর ঘোষণাকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে বলেনি। কেননা, সম্মান ও মহত্ত্বের অধিকারী আল্লাহ কখনও সত্য বলেন এবং কখনও সত্য বলেন না- তা অসম্ভব। বরং তাঁর বাণী সর্বদাই সত্য, এর ব্যতিক্রম সম্ভব নহে। এ ভন্ডনবী যত কথাই বলেছে সবই তার আন্দাজ ও অনুমান দ্বারা বলেছে। কখনও উহা বাস্তবায়িত হয় এবং কখনও উহার ব্যতিক্রম হয়; যেমন জ্যোতিষী ও অনুমানকারীরা কথা বলে থাকে। আর জ্যোতিষীও অনুমানকারীদেরকে নবী ও এলহামের অধিকারী বলা হয় না।
দ্বিতীয়ত: যে সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে কাদিয়ানীরা ঢোল পিটায় এবং বার বার প্রচার করে যে, এটা গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে; তার দুটি অবস্থা রয়েছে:
একটি হল: গোলাম আহমদ আদৌ এ ভবিষ্যদ্বাণী করেনি, বরং এটা সংঘটিত হওয়ার পর সে নিজে অথবা অন্যরা একে তার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এরূপ ঘটনা অনেক যা পরে আমাদের বর্ণনায় আসছে।
দ্বিতীয়টি হল: এর উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না। প্রথমটির উদাহরণ- পন্ডিত দয়ানন্দ নামে জনৈক হিন্দু ব্যক্তি ভন্ডনবী গোলাম আহমদের বিরোধী ছিল। সে স্বাভাবিক ভাবেই মারা গেল। তখন ভন্ডনবী কাদিয়ানী এর সুযোগ গ্রহণ করতে চাইল এবং সে ঘোষণা দিল ‘আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম যে, আমার বিরুদ্ধবাদী পন্ডিত দয়ানন্দ অচিরেই মারা যাবে, এবং তখন সে মারা গেল। এ ভবিষ্যদ্বাণীর উপর শরম বাট নামক একজন হিন্দু সাক্ষী আছে। (আহমদিয়া পকেট বুক) কাদিয়ানীর এ ঘোষণা শুনার সাথে সাথে ‘শরমবাট’ যাকে কাদিয়ানী স্বাক্ষীরূপে গ্রহণ করেছিল ঘোষণা দিল- গোলাম আহমদ মিথ্যুক দাজ্জাল। আমি কখনও তার থেকে এ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিনি। (পন্ডিত লক্ষীরামের ‘কুল্লিয়াত’ এবং তাকজীবে বারাহীনে আহমদিয়া’।) অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল অতিবাহিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোন কাদিয়ানী গোলাম আহমদের কোন বই পুস্তক থেকে এটা প্রমাণ করতে পারেনি যে উল্লেখিত পন্ডিত দয়ানন্দের মৃত্যুর পূর্বে গোলাম আহমদ এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। এমনিভাবে আব্দুল লতীফ ও আব্দুর রহমান নামে কাদিয়ানী দু’ব্যক্তি আফগানিস্তানে ইংরেজের গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে নিহত হল। যখন এ সংবাদ ভন্ডনবী কাদিয়ানীর নিকট পৌঁছোল তখন সে ঘোষণা
দিল। ‘ইতিপূর্বে সে তার পুস্তক বারাহীনে আহমদিয়া ৫১১ পৃষ্ঠায় এ দু’ব্যক্তির নিহত হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং তার ইলহাম ‘‘দু’বকরী জবাই করা হয়েছে।’’ এর প্রতি ইঙ্গিত করেছে। (গোলামের তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন) আর, সে বলেছে এ দু’বকরী দ্বারা এ দু’নিহত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। (উল্লেখিত কিতাব।)
এটা সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা। কেননা, গোলাম এত-দু-ভয়ের হত্যাকান্ডের পূর্বে উক্ত ইলহামের এ মর্মে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। এ কারণেই গোলামের কথিত ইলহাম (দু বকরীর জবাই) দ্বারা তার ভবিষ্যদ্বণীর উপর কাদিয়ানীদের প্রমাণ পেশ করা ভ্রান্ত ও বাতিল। এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে, ইতিপূর্বে গোলাম আহমদ নিজেই ভিন্ন মর্মে এ ইলহামের ব্যাখ্যা দিয়েছে। এখন তার মূল ভাষ্যের প্রতি লক্ষ্য করুন। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে: ‘‘ইলহামে দুই জবেহকৃত বকরী দ্বারা মুহাম্মদী বেগমের স্বামী ও তার পিতাকে বুঝানো হয়েছে। [১ মুহাম্মদী বেগমের স্বামী ও তার পিতার আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে।]
(গোলামের আঞ্জামে আথমের পরিশিষ্ট ৫৭ পৃ:।) তার নিজস্ব এ ব্যাখ্যা থেকে ফিরে যাওয়া প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নহে। এতে লোকটির সুযোগ সন্ধানী ও বহুরূপী হওয়ার একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। কাদিয়ানীরা প্রতারণা মূলক ভাবে যে সমস্ত বিষয়কে তার সাথে সম্পৃক্ত করেছে, তার অপর একটি উদাহরণ হল: তাদের উক্তি ‘‘উস্তাদ মুহাম্মদ ফয়জী, জনাবের (গোলাম) অন্যতম বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। জনাব তার মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। জনাবের এ ভবিষ্যদ্বাণী ‘মাওয়াহিবুর রহমান নামক তার পুস্তকে বিদ্যমান আছে। (আহমদিয়া পকেট বুক।) এটা জঘন্য মিথ্যা ও সুস্পষ্ট প্রতারণা। কেননা, যারা কাদিয়ানী মতবাদের সহিত সম্পৃক্ত তাদের সবাইকে আমরা মাওয়াহিবুর রহমানের প্রথম সংস্করণ থেকে এ ভবিষ্যদ্বাণীটিকে প্রমাণ করতে চ্যালেঞ্জ করেছি। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অদ্যাবধি কেহ জন্ম গ্রহণ করেনি। এমনি ভাবে আরো অনেক উদাহরণ আছে। কোন ঘটনা ঘটলেই গোলাম আহমদ বলত, আমি এটা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই এ সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছি। তার এ পদ্ধতিতে কাদিয়ানীরা তার মৃত্যুর পর তার সাথে এমন সব বিষয় সম্পৃক্ত করে যা সে আদৌ বলেনি বা কখনও তার কল্পনাতে আসেনি।
দ্বিতীয় প্রকার ভবিষ্যদ্বাণীর উদাহরণ সমূহ অর্থাৎ এমন ঘটনাবলীর সংবাদ দেওয়া যার উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রয়োগ হয় না, তাও অনেক। এখানে আমরা এর কিছুটা বর্ণনা পেশ করব। গোলাম আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করল- ‘আমার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে ‘দুই’ নামক এক ব্যক্তি সে আমার সাথে মোবাহালা (পারস্পরিক লা’নত করা) করুক বা নাই করুক সে মারা যাবে। (খাদেম কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক ৩৮৪ পৃ:) অনন্তর কাদিয়ানীরা বলে ‘প্রকৃত পক্ষে ‘দুই’ গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মৃত্যু বরণ করেছে। (উল্লেখিত কিতাব) এটা ও কি একটা ভবিষ্যদ্বাণী? যদি এটা ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে থাকে তা হলে প্রত্যেকের পক্ষে এ জাতীয় ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। কেননা, গোলাম আহমদ এ ব্যক্তির মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করেনি, বরং সে শুধু এ কথা বলেছে দুই মৃত্যুবরণ করবে। কেহ কি চিরকাল বেঁচে থাকবে? ‘‘এ পৃথিবীতে যারাই আছেন সকলই ধ্বংস প্রাপ্ত হবেন এবং একমত আপনার প্রভু যিনি মহান ও মহত্ত্বের অধিকারী তিনিই অবশিষ্ট থাকবেন’’। [২ সুরা আর রহমান ২৬ -২৭]
প্রত্যেকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। [১ সুরা আলে ইমরান ১৮৬ এবং সুরা আল- আম্বিয়া-৩৫]
চাই গোলাম আহমদ বলুক আর নাই বলুক। কাদিয়ানীরা কি এ ধারণা পোষণ করে যে, যদি গোলাম আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী না করত তবে দুই কখনও মৃত্যু বরণ করত না? অন্যথায় আর কি হতে পারে? যার সামান্যতম বুদ্ধি আছে, তার পক্ষে একথা বলা সম্ভব নহে যে এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী। গোলাম আহমদ নিজেই একথা স্বীকার করে আসছে ‘যে বিষয়ে অস্বাভাবিক কিছু নেই তা ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে না’। (গোলামের তিরিয়াকুল কুলুব ১১৫১ পৃ:) তবে ,দুই এর মৃত্যুর মধ্যে অস্বাভাবিক কি আছে? যে কেহই জন্ম গ্রহণ করবে সে মৃত্যুবরণ করবে। গোলাম আহমদ মরেছে, তার সাথীগণ তার প্রথম খলীফা দ্বিতীয় খলিফা, তার ছেলে পেলে, তার বন্ধু বান্ধব, তার স্ত্রী-গণ ও আত্মীয় স্বজন সকলই মৃত্যুবরণ করেছে। হ্যাঁ, যদি ভবিষ্যদ্বাণীতে তার মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ থাকত তা হলে তা যুক্তি সংগত হত, গোলাম আহমদের অধিকাংশ ভবিষ্যদ্বাণী এ পর্যায়েরু অমুক মৃত্যুবরণ করেছে, কেননা, আমি বলেছিলাম যে সে মৃত্যুবরণ করবে। এই প্রকার ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় উদাহরণ হল: তারা যাকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে যে, গোলাম আহমদ ভূমিকম্প ও প্লেগ দেখা দেওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। এ দুটি ব্যাপক আকারে সংঘটিত হয়েছে। আমরা তার মূল বক্তব্য ও উহা বাতিল হওয়ার কথা উল্লেখ করার পূর্বে এদিকে ইঙ্গিত করা সমীচীন মনে করছি যে, ভূমিকম্প ও প্লেগের সংবাদ প্রদানকে ভবিষ্যদ্বণী বলা যায় না এবং এর উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞাও প্রযোজ্য হয় না। এমন কি, গোলাম আহমদের নিকটেও নহে। যেমন, আমরা প্রথম প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। আমরা গোলাম আহমদের আরো কিছু স্পষ্ট বক্তব্য বর্ণনা করব, যা পূর্বে উল্লেখ করিনি। ভন্ডনবী কাদিয়ানী ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের উল্লেখ করে বলে: আমি সমস্ত বিষয়ের ভবিষ্যদাণী করেছি, তা আল্লাহর কুদরত ও তার ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বিগ্রহ ও বিপদাপদ সম্পর্কে জ্যোতিষীদের সংবাদ প্রদানের মত আমার ভবিষ্যদ্বাণী নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ ২৫৫ পৃ:) সে লিখেছে: ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের উদ্দেশ্য হল দলীল প্রমাণের মুখাপেক্ষী থাকে তবে এ ভবিষ্যদ্বাণীর ফল কি? এ জন্যই ভবিষ্যদ্বাণীর স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হওয়া উচিত, যাতে বিশ্ববাসী সরাসরি তা চাক্ষুষ দেখতে পায়। (গোলামের তুহফায়ে কুলরা ১২১ ও ১২২ পৃ:) সে আরো বলেছে- ‘ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি এভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে যে এতে কি এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু আছে যা মানুষের নাগালের বাহিরে অথবা এতে কি এমন কিছু আছে যার সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যা বা ভূতথ্যবিদ্যার সাহায্যে সংবাদ দিতে পারে? প্রথমটি হবে ভবিষ্যদ্বাণী এবং দ্বিতীয়টি হবে বিজ্ঞান।’’ (গোলামের ‘তিরিয়াকুল কুলুব’ ১৫৫ পৃ:) ইঞ্জিলের মধ্যে হজরত ঈসা আঃ. এর সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সে বলে, ভূমিকম্প. যুদ্ধ বিগ্রহ মৃত্যু এবং দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সংবাদ দেওয়াকে ভবিষ্যদ্বাণী বলা যায় না, (গোলামের এজালাতুল আওহাম, ৭ম পৃ:) তার প্রথম খলীফা ও কাদিয়ানীদের বিশিষ্ট নেতা নূরুদ্দীন লিখেছে যে দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, বিপদাপদ প্রভৃতি প্রাকৃতিক বস্ত্ত, এগুলো সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময় করে সংবাদ না দিলে তাকে ভবিষ্যদ্বাণী বলা যায় না।’ নূরুদ্দীনের ‘ফসলুল খেতাব’ প্রবন্ধের প্রারম্ভে গোলামের যে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা আমরা উল্লেখ করছিলাম, পুনরায় উহা উল্লেখ করছি, যাতে আমরা উহাকে আলোচকের বুঝার সুবিধার্থে এই বক্তব্যের সাথে মিলিত করতে পারি। ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী মহান আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম কে বিদ্রূপ করে বলেছে, এই নিঃসহায় ব্যক্তি ঈসার আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণী কি ছিল? ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হবে...। জানি না, এ সমস্ত বিষয়ের সংবাদ দেওয়াকে ভবিষ্যদ্বাণী ও অদৃশ্যের সংবাদ কেন নামকরণ করা হল! আদি হতে কি ভূমিকম্প সংঘটিত হয় নি? পূর্ব থেকেই কি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় নি? বিশ্বের কোন না কোন অঞ্চলে কি অহরহ যুদ্ধ চলছে না? তবে এ নির্বোধ ইসরাঈলী ব্যক্তি ঈসা আলাইহিস সালাম (নাউজুবিল্লাহ) কেন এ বিষয়গুলোর সংবাদ দেওয়াকে ভবিষ্যদ্বাণী নাম দিয়েছে। (গোলামের আঞ্জামে আথম’ এর টীকা, ৪পৃঃ) এসব সত্ত্বেও জানি না কাদিয়ানীরা কোন সাহসে এ উক্তি করে যে, গোলাম আহমদ তার পুস্তক ‘হাকীকতুল ওহী’ ২২০ পৃষ্ঠায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এবং বাস্তবিকই তার ভবিষ্যদানি অনুসারে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে।’ তারা আরো বলে- ‘তিনি তার পুস্তক সিররুল খেলাফতের ৬২ পৃষ্ঠায় তার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার বদ-দোয়া করেছিলেন এবং বাস্তবিকই তা সংঘটিত হয়েছে।’ (আহমদিয়া পকেট বুক)
এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, উপরোল্লিখিত কথাগুলো বলার পর গোলাম আহমদ নিজে কীভাবে এটা বলার দুঃসাহস করে- ‘‘আল্লাহ আমাকে অবহিত করেছেন যে, কিয়ামত সাদৃশ্য একটি কঠিন ভূমিকম্প সংঘটিত হবে....। এ ভবিষ্যদ্বাণীর পর সতর্কতা অবলম্বন করা এবং একে ভয় করা উচিত। এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে আমি ঘরে বসবাস ছেড়ে দিয়েছি এবং তাবু ক্রয় করেছি। আমি উহাতে বসবাস করছি এবং হাজার টাকার মত তাতে ব্যায় করেছি। যে ব্যক্তি এ ভবিষ্যদ্বাণী সংঘটিত হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস রাখে সে ছাড়া আর কে এমন কাজ করবে এবং এ পরিমাণ টাকা ব্যায় করবে?’’ (গোলাম আহমদের ১৯০৫ খৃ: ১১ই মে তারিখে ঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণীর উপর প্রযোজ্য? এ ভবিষ্যদ্বাণী এবং ইতিপূর্বে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী কি হুবহু ঈসার আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণীর মত নহে? অতএব সে স্বয়ং যা করেছে, অনুরূপ আক্রমণ করল কেন? তার এ উক্তিটি অসত্য মিথ্যাবাদীর কথা পরস্পর বিরোধী হওয়া থেকে মুক্ত হতে পারে না।’’ (গোলামের ‘বারাহীনে আহমদিয়ার’ পরিশিষ্ট ৫ম খন্ড ১১২ পৃ:।) সারকথা, এসব সংবাদের উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না এবং এগুলোকে ভবিষ্যদ্বাণী নাম দেওয়া মুর্খতা ও প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নহে। এ সত্ত্বেও আমরা এ সকল সংবাদের আরো কিছু বিষয়াদির আলোচনা করব। প্রথমত: আমরা পেলগের সংবাদটি উল্লেখ করছি। কাদিয়ানীরা বলে-গোলাম আহমদ তার হাকীকাতুল ওহী নামক পুস্তকে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। বাস্তবে তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে প্লেগ দেখা দিয়েছে। ( আহমদিয়া পকেট বুক )
আমরা বলি গোলাম আহমদ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে আদৌ এ সংবাদ দেয়নি, বরং দেশের কোন কোন অঞ্চলে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার পর এ সংবাদ দিয়েছে। সে নিজেও তা স্বীকার করেছে-‘‘ আমার নবুওয়তের একটি নিদর্শন হল-, আমি পাঞ্জাবে ( জেলা ) প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছি, অথচ তখন পাঞ্জাবের একটি এলাকা ছাড়া আর কোথাও প্লেগ বিদ্যমান ছিল না...। বর্তমানে পাঞ্জাবের সকল এলাকায়ই প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে।(গোলাম আহমদের হাকীকাতুল ওহী ২২০ পৃ ) সে আরও বলছে: আমি প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ দিয়েছি যখন পাঞ্জাবের দুটি এলাকা ছাড়া আর কোথাও প্লেগ বিদ্যমান ছিল না। (মালফুজাতে আহমদিয়া ৬ষ্ঠ খন্ড) । এ ব্যাপারটি বুঝতে সামান্যতম চিন্তারও প্রয়োজন হয় না । কেননা , প্লেগ এবং অনুরূপ মহামারী আকারের রোগ সমূহ (আল্লাহ এরূপ না করুন)
যখন কোন এলাকায় দেখা দেয় তখন উহা স্বভাবত: আশে পাশের এলাকা সমূহে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীতে নতুনত্ব কি আছে?
দ্বিতীয় বিষয় হল, ভন্ড নবী গোলাম আহমদ দাবি করত- ‘যখন রোগ ছড়িয়ে পড়বে, তখন তার বসতভূমি কাদিয়ানে প্রবেশ করবে না। অথচ প্লেগ শুধু কাদিয়ানেই ছড়িয়ে পড়েনি বরং উহা ঐ বাড়িতেও প্রবেশ করেছে যার সম্পর্কে সে বলত- উহা নূহের আলাইহিস সালাম নৌকার মত।
আমরা তা পূর্বে সূত্র সমূহের দৃঢ় প্রমাণাদি সহ উল্লেখ করেছি।
তৃতীয় বিষয়টি হল, ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলেছে, ‘আমি বিরুদ্ধবাদীদের জন্য বদ দোয়া করেছি, যাতে তাদের মধ্যে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।’ (গোলামের ছিররুল খিলাফত, ৬২ পৃ:) এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যারা কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করবে না এবং গোলাম আহমদের বিরোধিতা করবে প্লেগ শুধু তাদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে। অন্যত্র সে এর বিশ্লেষণ করে বলেছে: ‘প্লেগ রোগের শাস্তি শুধু অত্যাচারী ও অপরাধীদের জন্য হয়।’ (গোলামের ‘তাফসীরে খাজিনাতুল ইরফান, ১ম খন্ড ১৩১ পৃ:)
কিন্তু ঘটল কি? এ প্লেগ রোগে অনেক কাদিয়ানী তা স্বীকার করেছে। সে বলেছে: ‘‘আমাদের জামাতের কোন কোন লোক প্লেগ রোগে মারা গিয়েছে।’’ (গোলামের ‘হাকীকতুল ওহী’ ১৩১ পৃ:) শুধু তাই নয়, বরং এই জনাব নিজেও এত ভীত ছিল ‘মাসীহে মাওউদ মহামারির সময়ে এতই সতর্ক ছিলেন যে, যদি বাহির থেকে তার নিকট কোন পত্র আসত এবং তিনি তা স্পর্শ করতেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তার দু’হাত ধুয়ে নিতেন।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল-ফজল’ ১৯৩৭ সনের ২৮ শে মে তারিখে প্রকাশিত।) তিনি বকরীর গোস্ত ভক্ষণ ছেড়ে দিয়েছিলেন, কেননা, তিনি বলতেন এতে প্লেগের জীবাণু আছে। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের সীরাতে মাহদী ১ম খন্ড ৩৮ পৃ:) কাদিয়ানীদের মধ্যে প্লেগের কঠোরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন- হে আল্লাহ! আমাদের জামাত থেকে এ মহামারী সরিয়ে দিন।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা বদর ৪ঠা মে ১৯০৫ খৃ:)
এই হল প্লেগ সংক্রান্ত সংবাদের বাস্তব রূপ, যা কাদিয়ানীরা লোকজনকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ভূমিকম্প সম্পর্কে তার সংবাদের বিবরণ হল নিম্নরূপ: ১৯০৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে ভারত বর্ষে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যা জমি উল্টে দিয়েছিল এবং লোকজনকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বসতবাড়িও দালান কোঠা বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। এবং জান মালের অসংখ্য ও অপরিসীম ক্ষতিসাধন হয়েছিল। এ ভূমিকম্প ‘কাংগুরা ভূমিকম্প’ নামে পরিচিত। [১ কাংগুরা ভারতের একটি শহর। এখানে উল্লেখিত ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল। তাই উহার নামানুসারে এ ভূমিকম্পকে ‘কাংগুরা ভূমিকম্প’ বলে।]
অতএব, ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী কাদিয়ানী এ ভূমিকম্পকে তার ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য সুযোগ রূপে গ্রহণ করতে চাইল। কেননা, স্বভাবতই ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর অপরাপর ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই সে এ ভূমিকম্পের চারদিন পর ১৯০৫ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে ঘোষণা দিল- ‘আজ রাত তিন ঘটিকার সময় আমার কাছে ওহী এসেছে যে, কিয়ামতের ন্যায় একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হবে। আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তার নূতন নিদর্শন প্রকাশ করবেন........। এ ভূমিকম্প কখন সংঘটিত হবে? কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েক মাস বা কয়েক বৎসর পর হবে তা আমি সঠিকভাবে জানি না’। (গোলামের সতর্ক বাণী, ৮ই এপ্রিল ১৯০৫ সাল, যা ‘তাবলীগে রেসালাতের’ ১০ম খন্ড ৮০ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত।) এটা গোলাম আহমদের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়া সম্পর্কে প্রথম সংবাদ ছিল। সতর্ক বাণীর সাতদিন পর ১৯০৫ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে দ্বিতীয় সতর্ক বাণী প্রচার করে। তাতে আছে ‘‘অল্প কয়েকদিন পর একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প সংঘটিত হবে যা পৃথিবী উল্টিয়ে দেবে এবং জনপদ সমূহকে ধ্বংস করে দেবে, আর মানুষ, গাছ পালা ও পাথর বিনষ্ট করে দেবে। এটা অল্পক্ষণ চলবে, কিন্তু পৃথিবীর গতি পরিবর্তন করে দেবে। এমনকি জিন ও পক্ষীকুলের উপরও ইহার প্রভাব পড়বে’। (গোলামের ‘নুসরতুল হক’ যা ১৯০৫ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে লিখিত ১৩০ পৃ:) অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু কথিত ভূমিকম্প আর হল না। লোকজন তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল যে, কখন উহা সংঘটিত হবে? কেননা আপনার সকল ভবিষ্যদ্বাণী ব্যাপক, যার কোন সময় সীমা নেই! সে ইঙ্গিতে উত্তর দিল যে, ইহা অতি নিকটে। আল্লাহ তাআলা আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, কিয়ামত সাদৃশ্য একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প সংঘটিত হবে...। এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে আমি ঘরে বসবাস ছেড়ে দিয়েছি এবং তাবু ক্রয় করে উহাতে বসবাস আরম্ভ করেছি। (গোলামের ভবিষ্যদ্বাণী যা ১৯০৫ সালের ১১ই মে তারিখে ঘোষিত এবং ‘তবলীগে রেসালাতের ১০ম খন্ড ৯৬ ও ৯৭ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত।) এ দিন গুলোও অতিবাহিত হল অথচ তার অনুমান ও ধারণা অনুযায়ী ভূমিকম্প সংঘটিত হল না। তার উপর কঠোরভাবে আপত্তি সমূহ উত্থাপিত হতে লাগল। এমনকি, সে ২২শে মে তারিখে আশ্চর্য ধরনের একটি ঘোষণা দিয়ে বলল: আল্লাহর ওহীতে উল্লেখিত ভূমিকম্পের অর্থ বাস্তব ভূমিকম্প হওয়া জরুরি নহে। বরং ভূমিকম্পের অর্থ কঠিন বিপদাপদও হতে পারে। যা হোক, আমার ধারণা যে, ভূমিকম্প তার প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এ জন্যেই আমি ঘর ছেড়ে তাবুতে বসবাস করছি। আমার নিকট আরও ইলহাম হয়েছে যে, ভূমিকম্প বসন্তকালে সংঘটিত হবে। (১৯০৫ সালের ২২ শে মে তারিখে গোলাম আহমদের ঘোষণা যা কাদিয়ানী ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিওন্সের’ ৪থ খন্ডের ৩৪৪ পৃ: সন্নিবেশিত।) পুনরায় সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হল। বসন্তকাল আসল ও চলে গেল কিন্তু ভূমিকম্প সংঘটিত হল না, কিয়ামত সাদৃশ্য ভূমিকম্পও হল না, যার প্রভাব জ্বীন ও পক্ষীকুলের উপর পড়বে তার কোনটাই হল না। তারপরও সে চুপ থাকেনি, বরং লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলল: যে ভূমিকম্প সম্পর্কে আমি সংবাদ দিয়েছি তা আমার দেশে এবং আমার জীবদ্দশায় সংঘটিত অপরিহার্য। যতই তা পিছিয়ে যাক্ না কেন ষোলো বছরের অধিক পিছিয়ে যাবে না। আমার জীবদ্দশায়ই তা সংঘটিত হওয়া অনিবার্য। (গোলামের ‘নুসরতে হক্বের’ পরিশিষ্টের টিকা, ৯৮ পৃ:।)
এরপর কি ঘটল? ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী মৃত্যু বরণ করল, কিন্তু ভূমিকম্প সংঘটিত হল না। কাদিয়ানীরা বাধ্য হয়ে স্বীকার করল যে, এ ভূমিকম্প গোলাম আহমদের জীবদ্দশায় সংঘটিত হয়নি। এদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি হল গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ। সে স্বীকার করেছে- ‘জনাব এ ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন’। (মাহমুদ আহমদের ‘দাওয়াতুল আমীর’ ২৩১ পৃ:।) এখন কোন শহরেই ভূমিকম্প হলে কাদিয়ানীরা বলে- এটা গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে হচ্ছে। তাদেরকে একথা জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, তোমরা কীভাবে তা বলছ? অথচ তোমাদের ইমাম ও তোমাদের মিথ্যুক নবী স্পষ্ট করে বিস্তারিতভাবে বলে গেছে যে, এ ভূমিকম্প তার জীবদ্দশায় তার দেশেই সংঘটিত হবে। গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্বে কি পৃথিবীতে ভূমিকম্প সংঘটিত হত না? আমি মনে করি, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন উক্তি করবে না। ১৯০৫ সালের ৫ই মে এর ভূমিকম্প সম্পর্কে গোলাম আহমদ দাবি করেনি যে, সে এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং তার ভক্তদের মধ্যে কেহ এ কথা প্রমাণ করতে পারবে না যে, সে এটা সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দিয়েছে।
এই হল ঐ সমস্ত সংবাদের বাস্তব রূপ যার জন্য কাদিয়ানীরা ঢাক-ঢোল পিটায়। যদিও এটা সত্য ও বাস্তবায়িত হত, তবুও ইহাতে গোলাম আহমদের নবী, ইলহাম ও ওহী প্রাপ্ত হওয়ার দাবির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ হতে পারে না।
প্রথমত: এ জন্য যে, ভূমিকম্প ও বিপদাপদের সংবাদ দেওয়ার উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না, যেমন পূর্বে এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: কোন কোন সংবাদ সত্য হওয়া এবং কোনটি মিথ্যা হওয়া একথা বুঝায় না যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কেননা, যদি ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে হত তবে কোন একটিরও ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব হত না। এ জন্যেইতো গোলাম আহমদ স্বয়ং বলেছে- ‘যদি সমুদয় ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন না হয় তবে একটিরও বাস্তবায়ন বিশ্বাস যোগ্য নয়। (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়া’ ২১ পৃ:।)
সাধারণত: এটা দৃষ্টিগোচর হয় যে, কোন একটা সাধারণ লোক কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার কারণে তাকে নবী বা আল্লাহর ওলী বলা যায় না। এ কথাই ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বলেছে:- ‘কোন কোন ফাসেক, ফাজের, ব্যভিচারী, চোর, হারাম মাল ভক্ষণকারী, আল্লাহর নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ কারী এমনও আছে যে, কোন কোন সময় তারা সত্য স্বপ্ন দেখে’। (গোলামের ‘হাকীকতে ওহী’ ২য় পৃ:।) সে আরো বলেছে- ‘আরবে অধিক পরিমাণে যে সকল গণক ছিল তারা শয়তানের নিকট হতে ইলহাম প্রাপ্ত হত। যেভাবে তাদের কোন কোন ভবিষ্যদ্বাণীও সত্য হয়ে যেত’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘জহরতুল ইমাম’ ১৭ পৃ:।)
আমরা কাদিয়ানীদের পুস্তকাদি থেকে তাদেরই ভাষায় স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা সাব্যস্ত করেছি যে, যে সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয়, তার একটিও বাস্তবায়িত ও সত্য প্রমাণিত হয় নি। এমনকি যেটির উপর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় নি তাও সত্য প্রমাণিত হয় নি। এটা মিথ্যাবাদী ও অপবাদ রটনাকারীর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি স্বরূপ। কাদিয়ানীরা তাদের পথভ্রষ্টতার মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘোর-পাক খাচ্ছে। কেহ কেহ জেনে শুনে এবং সত্যকে গোপন করে আর কেহ কেহ অজ্ঞতা বশত: এবং বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত না থাকার কারণে। এই হল বাস্তব ও প্রকৃত অবস্থা। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এই যে, তাদেরকে যেন তিনি সত্যকে সত্যরূপে দেখিয়ে দেন এবং তা অনুসরণ করার তওফিক দেন; আর, বাতিলকে বাতিলরূপে দেখিয়ে দেন এবং তা বর্জন করার তাওফিক দান করেন। তিনিই হলেন সর্বোত্তম বন্ধু ও সর্বোত্তম সাহায্যকারী।
অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার একদিন পূর্বে প্রতিপক্ষ নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ওমর রা. থেকে আনাছ রা. বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গতকল্য আমাদেরকে মুশরেক নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান দেখিয়ে বলছিলেন: ‘‘ইনশাআল্লাহ আগামীকল্য এটা অমুকের নিহত হওয়ার স্থান এবং ইনশাআল্লাহ আগামীকল্য এটা অমুকের নিহত হওয়ার স্থান’’। ওমর রা. বলেন: ‘সেই সত্তার কসম! যিনি তাঁকে সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন- তারা ঐ সীমা একটুও অতিক্রম করেনি যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন’। (মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ভবিষ্যদ্বাণী হল: রোম ও পারস্য সম্রাটের ধন ভান্ডার সমূহ মুসলমানদের হাতে বিজিত হওয়ার কথা সহ আরো অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন। কেননা, রাসূলগণ নিজের পক্ষ থেকে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করেন না বরং তাঁরা যা বলেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেন। এর প্রতি ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তিনিই হলেন অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত, তাঁর অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত আর কাউকে অবহিত করেন না’’। [২ সুরা জীন- ২৬ ও ২৭]
আল্লাহপাক আরো বলেছেন: ‘‘আপনি কখনও ধারণা করবেন না যে, আল্লাহ তার রাসূলগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন, কেননা, আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী’’। [৩ সুরা হিজর-৪৭]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যা সংগঠিত হবে না এমন কোন বিষয় সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দেয়া রাসূলের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, তা আল্লাহর নীতির পরিপন্থী এবং আল্লাহর বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী, অথচ আল্লাহই সর্বাধিক সত্যবাদী। ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও তার এই উক্তির দ্বারা একথা স্বীকার করছে: তাওরাত ও কুরআন উভয়ই ভবিষ্যদ্বাণী সমূহকে নবুওয়াতের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রমাণ বলে সাব্যস্ত করেছে (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘ইস্তেফতা’ ৩পৃঃ)। সে আরো বলেছে: আল্লাহর এলহাম সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়া অসম্ভব। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘মেরাতুল মারেফাত’ ৮৩ পৃ:) এ ভিত্তিতেই আমরা এ প্রবন্ধে নবুয়্যত ও রেসালাতের দাবিদার গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের আলোচনা করতে চাই। সে দাবিকরে যে, সে আল্লাহর ওহী ও তার সম্বোধন দ্বারা সম্মানিত। সে বলেছে: ‘আমি আমার ওহীতে ঐ রূপ বিশ্বাস করি যেমন তাওরাত ইঞ্জিল ও কুরআনে বিশ্বাস করি ’। (গোলামের ‘‘আরবাঈন’’ ৪ নম্বর ২৫ পৃ:) সে আরো বলেছে: ‘আমি নবী এবং আল্লাহর সম্বোধন ও তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি তা পূরণ করেন এবং তার অদৃশ্য জগতের অনেক কিছু আমার কাছে উদ্ঘাটন করেন। আর, আমাকে বিশ্বের রহস্য-বলী সম্পর্কে অবহিত করেন, যা ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে। এ জন্যই আমাকে নবী বলা হয়। (লাহোরের ‘আম’ নামক পত্রিকায় গোলাম আহমদের প্রেরিত পত্র ২৩ মে, ১৯০৮ খৃ:) এর আলোকে আমরা দেখব, সে কি বাস্তবিকই আল্লাহর সম্বোধন দ্বারা সম্মানিত এবং ভবিষ্যতের রহস্যাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত? অথবা সে আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে? কেননা, সে-ই নিজে এ নিয়ম নির্ধারণ করেছে যে, আমার সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য আমার ভবিষ্যৎ বাণী সমূহ থেকে উত্তম ও সুন্দর আর কিছুই নেই। (গোলামের মেরাতুল কামালাত’ ২৩২।)
যে মানদন্ড সে নিজেই নির্ধারণ করেছে আমরা উহা দ্বারা তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে চাই। তার ভবিষ্যদ্বাণীর বিবরণ দেওয়ার পূর্বে তার দেয়া ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা উল্লেখ করা আমি সংগত মনে করি। সে আল্লাহর নবী ঈসাকে আলাইহিস সালাম আক্রমণ করে বলে: ‘এ মিসকিন ইসরাঈলী ব্যক্তির ভবিষ্যদ্বাণী আর কি? ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি।’ এ সকল বিষয়কে ভবিষ্যদ্বাণী এবং গায়েবের সংবাদ কেন বলা হল? তা আমার বোধগম্য নয়। ভূমিকম্প ও দুর্ভিক্ষ কি আদি হতে সংঘটিত হচ্ছে না? এবং বিশ্বের কোন না কোন অংশে সর্বদাই যুদ্ধ বিগ্রহ চলছে না? সুতরাং এই আহম্মক (আল্লাহ পানাহ) এ সকল বিষয়কে ভবিষ্যদ্বাণী নাম দিল কেন’’? (গোলামের ‘আঞ্জামে আথম’ এর পরিশিষ্ট ৪পৃঃ।) সে আরো বলে: ‘‘নবী ব্যতীত অন্যান্যরাও যুদ্ধ-বিগ্রহ, ভূমিকম্প ও বিপদাপদ প্রভৃতির সংবাদ দিতে পারে।’’ (গোলাম আহমদের ‘বারাহীনে আহমদীয়া’ ৪৬৮ পৃ:।) এ দুটি ভাষ্যে ভন্ডনবী কাদিয়ানী আমাদেরকে অবহিত করেছে যে, ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ অস্বাভাবিক হতে হবে এবং এগুলো সম্পর্কে কোন বিষয়ের বিদ্যমান পূর্বাভাস দ্বারা আনুমানিক সংবাদ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কেননা, এরূপ সংবাদ দেওয়া প্রত্যেক বুদ্ধি সম্পন্ন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। অথচ গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী সমূহে এ সকল বস্ত্তকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে, যার বিস্তারিত বিবরণ সম্মুখে আসছে। এখানে এর একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলেছে: আল্লাহ তাআলা আমার কাছে প্রকাশ করেছেন যে, প্রচুর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। যদ্দরুন জনবসতি সমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। তারপর কঠিন ভূমিকম্প হবে। কার্যত:
অত্যধিক বৃষ্টি হয়েই গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ভূমিকম্পের অপেক্ষায় আছি।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘হাকীকতুল ওহী’ ৩০৪ পৃ:)অথচ আদি থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, বিশেষ করে বৃষ্টির মৌসুমে যে কোন ব্যক্তি বৃষ্টি হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। এদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেও আমি গোলাম আহমদের এক একটা ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লেখ করব এবং এগুলোকে তার উক্তি অনুযায়ী তার সত্য মিথ্যার মাপকাঠি হিসেবে উপস্থাপিত করব। বিশেষ করে ঐ সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী যে গুলো সম্বন্ধে সে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে সংঘটিত হওয়ার কথা স্পষ্ট করে বলেছে এবং একথাও বলেছে যে, আল্লাহর কাছ থেকে অবহিত না হয়ে সে সংবাদ দেয়নি। যদি এগুলো বাস্তবায়িত না হয় তাহলে সে এমন এমন হবে এবং তার সাথে এমন এমন ব্যবহার করা হবে। এ প্রসঙ্গে তার একটি ভবিষ্যদ্বাণী লক্ষ করুন, যা সে অতি শক্তভাবে এ বলে ব্যক্ত করছে: ‘যদি আমার উক্তি অনুসারে ইহা সংঘটিত না হয়, তাহলে আমি সর্বপ্রকার শাস্তি গ্রহণে প্রস্ত্তত আছি। আমার মুখ যেন কাল করা হয়, আমাকে যেন অপমান করা হয় এবং আমার গলায় রশি লাগিয়ে যেন ফাঁসি দেওয়া হয়। আমি মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যা বলছি তা সংঘটিত হওয়া একান্ত অপরিহার্য। আকাশ ও পৃথিবীর পরিবর্তন হওয়া সম্ভব কিন্তু আল্লাহর কথা পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। যদি আমার কথা মিথ্যা হয় তবে আমার জন্য তোমরা শূল তৈরি করে রাখ। শয়তান খবীছও মালউনদের চেয়ে অধিক অভিশাপ আমাকে দাও।’ (গোলাম কাদিয়ানী ‘আল হারবুল মুকাদ্দাস’ ১৮৮ পৃ:) দেখা যাক, ঐ ভবিষ্যদ্বাণীটি কি যা সংঘটিত না হলে সে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলতে প্রস্ত্তত ছিল? এটা তারই ভাষায় আমি ছোট একটি ভূমিকার পর উল্লেখ করব যা পাঠককে সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করতে সাহায্য করবে। এটা নিম্নরূপ:-
১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে ভারতবর্ষের একটি শহর ‘অমৃতসরে ’আব্দুল্লাহ আথম নামে একজন খ্রিস্টানের সহিত গোলাম আহমদের বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। অনেক দীর্ঘ আলোচনার পরও তারা কোন মীমাংসায় পৌঁছতে পারেনি এবং তাদের কেউ প্রতিপক্ষের উপর জয়ী হতে পারে নি। গোলাম আহমদের এ দাবিতেও যে, সে আল্লাহর ওহীর দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত। ফলে সে এমন একটা তামাশা করতে চাইল যদ্দারা সে ঐ অপমানকে মুছে ফেলতে পারে, যা একজন সাধারণ খ্রিস্টানের সাথে পরাজিত হওয়ার কারণে তার উপর আপতিত হয়েছিল। সুতরাং ১৮৯৩ সালের ৫ই জুন তারিখে ভোর হতে না হতে সে ঘোষণা দিল যে, সে আল্লাহর নিকট হতে অবহিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ আথম পনেরো মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৯৪ সালের ৫ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে মারা যাবে। প্রকাশ থাকে যে, উক্ত আব্দুল্লহর বয়স তখন ছেষট্টি বছরের ঊর্ধ্বে ছিল। এখন আমি তার মূল ভাষ্য বর্ণনা করছি। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বলে: ‘আজ রাতে আমার কাছে যা উদ্ঘাটিত হয়েছে তা হল এই- আমি মহান আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত কাকুতি ও বিনয়ের সহিত দোয়া করলাম তিনি যেন এ ব্যাপারে আমাকে একটা মীমাংসা করে দেন। তখন আল্লাহ আমাকে নিদর্শন প্রদান করলেন যে, মিথ্যাবাদী যদি হকের প্রতি প্রত্যাবর্তন না করে তবে সে পনেরো মাসের মধ্যে মৃত্যু বরণ করবে এবং সত্যবাদী সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে। আর, যদি মিথ্যাবাদী ১৮৯৩ সালের ৫মে হতে পনেরো মাসের মধ্যে মৃত্যু বরণ না করে এবং আমার উক্তি বাস্তবায়িত না হয় তবে আমি সকল প্রকার শাস্তি গ্রহণের জন্য প্রস্ত্তত আছি। আমার মুখ যেন কাল করা হয়, আমাকে অপমানিত করা হয় এবং আমার গলায় দড়ি লাগিয়ে আমাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আমি মহান আল্লাহর শপথকরে বলছি যে, আমার উক্তি বাস্তবায়িত হবে এবং উহা বাস্তবায়িত হওয়া অনিবার্য।’ (আল-হরবুল মুকাদ্দাস ১৮৮ পৃ:) কাদিয়ানীরা অত্যন্ত ভয়ংকর পরিবেশে অধৈর্য হয়ে এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছিল। এখন আমি এমন কিছুর বর্ণনা দিচ্ছি যদ্দারা ঐ পরিবেশ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে, যে পরিবেশে ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার দল বসবাস করছিল। ভবিষ্যদ্বাণীর মেয়াদ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে গোলাম আহমদ তার জনৈক মুরিদের নিকট পত্র লিখছে, যার নমুনা হল এই, সম্মানিত ভাই রুস্তম আলী, আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ, টিকেট সহ আপনার পত্র পেয়েছি। ভবিষ্যদ্বাণীর নির্দিষ্ট মেয়াদের অল্প কিছুদিন বাকি আছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন তার বান্দাগণকে পরীক্ষা হতে রক্ষা করেন। সেই চিহ্নিত ব্যক্তি আব্দুল্লাহ আথম পিরোজপুরে (ভারতের একটি শহর) নিরাপদ ও সুস্থ দেহে অবস্থান করছে। আল্লাহ তার দুর্বল বান্দাগণকে পরীক্ষা হতে রক্ষা করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন। আমি ভাল আছি। তোমরা শেখের নিকটও পত্র লিখবে যেন তিনিও এ দোয়ায় শরীক থাকেন। (অর্থাৎ আব্দুল্লাহ যেন এ মেয়াদের ভিতরে মৃত্যুবরণ করে।) আস-সালাম’। গোলাম আহমদ, কাদিয়ান হতে।’ (রুস্তম আলীর নিকট গোলাম আহমদের চিঠি যা গোলাম কাদিয়ানীর পত্রাবলির সমষ্টি ‘মাকাতিবে আহমদিয়া’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ৫ম খন্ড, ৩ নম্বর ১২৮ পৃ:) গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানী নেতা বশীর আহমদ লিখেছে: আমাকে আব্দুল্লাহ ছিন্নুরী বলেছেন যে, আব্দুল্লাহ আথমের নির্দিষ্ট মেয়াদের যখন মাত্র একদিন বাকি তখন জনাব মাসীহ আমাকে এবং হামীদ আলীকে নির্দেশ দিলেন যে, মসুর ডালের কিছু দানা নিয়ে উহার উপর কুরআনের কোন একটি সুরা পড়তে। সূরাটির নাম আমি এখন ভুলে গেছি, তবে একথা স্মরণ আছে যে উহা সূরায়ে ফীলের ন্যায় ছোট। আমরা পূর্ণ এক রাত লেগে থেকে অজিফাটি শেষ করলাম। তারপর জনাব মাসীহের (গোলাম) নিকট গেলাম এবং তার সম্মুখে দানাগুলো পেশ করলাম। তিনি আমাদেরকে নিয়ে কাদিয়ানের বাহিরে উত্তর প্রান্তের দিকে বের হলেন এবং বললেন, ‘এখনই আমি এ দানা গুলো পুরাতন একটি কূপে নিক্ষেপ করব। যখন আমি এ দানা গুলো নিক্ষেপ করব তখন তোমরা পিছন ফিরে তাকাবে না এবং দ্রুত ফিরে আসবে।’ আমরা এরূপ করলাম এবং পিছন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত চলে আসলাম। (গোলাম তনয় বশীর আহমদের সীরাতুল মাহদী ১ম খন্ড ১৫৯ পৃ:)
এখন আমরা কাদিয়ানী লেখক ইয়াকুব আলী কদিয়ানীর ‘সীরাতুল মাসীহিল মাওউদ’ নামক পুস্তক হতে নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষ দিনের অবস্থা বর্ণনা করছি। সে বলছে: ‘‘আথমকে দেওয়া নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষ দিন আসল, কাদিয়ানীদের চেহারা হলুদ বর্ণ ধারণ করল এবং তাদের অন্তর অস্থির হয়ে উঠল। আমাদের কেউ কেউ আব্দুল্লাহ আথমের মৃত্যুর উপর বিরুদ্ধবাদীদের সাথে বাজি ধরল। আর, নৈরাশ্য ও অনুতাপ তাদেরকে শ্বাস রুদ্ধ করে দিয়েছিল। তাদের কিছু লোক আল্লাহর কাছে তার মৃত্যুর জন্য দোয়া করে নামাজের মধ্যে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল। তাদের এ চিৎকার ও আর্তনাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেক বিরুদ্ধবাদীরাও তাদের জন্য ব্যথিত হয়ে উঠল। (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘সীরাতুল মাসীহিল মাওউদ’ ৭ পৃ:।) এ সমস্ত কান্নাকাটি ও অজিফা তদবিরের পর কি ঘটল? এ ভবিষ্যদ্বাণী কি বাস্তবায়িত হল এবং আব্দুল্লাহ আথম কি মৃত্যুবরণ করল? এসকল প্রশ্নের উত্তর ভন্ডনবী গোলাম আহমদের শ্বশুর তার নিকট লিখিত একটি পত্রে এভাবে দিচ্ছে: ‘সম্মানিত মাওলানা সাহেব! আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন। আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আজ সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ। ভবিষ্যদ্বাণীর শেষ মেয়াদ ছিল পাঁচ সেপ্টেম্বর। আমি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা নিয়ে আলোচনা করছি না বরং আপনি যে ইলহামের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তা আমার স্মরণ হচ্ছে- ‘যদি পনেরো মাস সময়ের মধ্যে এ মিথ্যাবাদী মৃত্যুবরণ না করে এবং আমার উক্তি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আমি প্রস্ত্তত হব..............। এখন যেহেতু এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হল না এবং আব্দুল্লাহ আথম নিরাপদ, সুস্থ ও জীবিত আছে, মৃত্যুবরণ করেনি। আমার ধারণা যে, এ ভবিষ্যদ্বাণীর কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নহে...... মুহাম্মদ আলী খান।’ (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিকট মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানীর লিখিত পত্র যা ইয়াকুব আলী কাদিয়ানী রচিত ‘আয়েনায়ে হক্বনুমা’ এর অন্তর্ভুক্ত, ১০০-১০১ পৃ:।) কোন কোন কাদিয়ানী এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিল যে, আব্দুল্লাহ আথম খ্রীষ্টধর্ম থেকে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু আব্দুল্লাহ আথম এদেরকে অপমানিত করে এবং তার ঐ ঘোষণা দ্বারা এদের কোন ব্যাখ্যার অবকাশ রাখেনি, যা সে নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার দশদিন পর ‘‘ওফাদার’’ পত্রিকায় পাঠিয়েছিল। ইহাতে একথা ছিল ‘গোলাম আহমদ আমার মৃত্যু সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিল উহার প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমি আপনাদেরকে অবহিত করছি যে, আমি আল্লাহর অনুগ্রহে সুস্থ ও নিরাপদ আছি। আমি শুনতে পেলাম যে, গোলাম আহমদ বলছে, আমি খ্রীষ্টধর্ম হতে প্রত্যাবর্তন করেছি। আমি ঘোষণা করছি যে, এটা মিথ্যা, আমি খ্রিস্টান ছিলাম এবং এখনও খ্রিস্টান আছি, যেমন পূর্বে ছিলাম। আল্লাহ যে আমাকে খ্রীষ্টন বানিয়েছেন তার জন্য আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।’ (লাহোরের ওফাদার পত্রিকায় আব্দুল্লাহ আথমের ঘোষণা ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খৃ:) এমনি ভাবে ভন্ড মিথ্যাবাদী এবং আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটনাকারী অপদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়। সে বলেছিল: আকাশ ও পৃথিবী স্থানচ্যুত হওয়া সম্ভব, কিন্তু এ ভবিষ্যদ্বাণী ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব নহে। (আল-হারবুল মুকাদ্দাস ১৮৮ পৃষ্ঠা।) উল্লেখিত আব্দুল্লাহ আথম দীর্ঘদিন জীবিত থাকে এবং এ অভিশপ্ত ভন্ডনবীর মাথা নত হয়। বরং শয়তান খবীছ ও মালউনদের চেয়েও অধিক লানত তার উপর পতিত হয়। সে স্বয়ং তা নিজের জন্য প্রকাশ করেছিল এবং আল্লাহ তা’য়ালা তাকে এ পৃথিবীতে জন সমক্ষে লাঞ্ছিত করেন। ইতিপূর্বে যাদের চক্ষু খুলেনি তাদের চক্ষুও খুলে যায়। যার ভাগ্যে হেদায়েত ছিল সে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। এটাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তার নবী রাসূলগণকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করেন না । তিনিই বলেছেন: ‘আল্লাহর প্রতি এরূপ ধারণা করবেন না যে, তিনি তার রাসূলগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন। [১ সুরা আল-হিজর- ৪৭]
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণী: [২ মূল কিতাবে দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণী লিখা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে দুটি ভবিষ্যদ্বাণী সন্নিবেশিত করা হয়েছে। (অনুবাদক)]
এরপর আমি গোলাম আহমদের দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লেখ করতে চাই। পাঠকের বুঝার সুবিধার জন্য এর একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা প্রদান করছি। তা হল এই, ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আহমদ বেগ নামে একজন আত্মীয় ছিল। সে গোলাম আহমদের সাথে সম্পৃক্ত কোন এক ব্যাপারে গোলাম আহমদের মুখাপেক্ষী হয় এবং তার সাহায্য প্রার্থনা করে। তখন উত্তরে গোলাম আহমদ বলল: ‘আমি তোমাকে এ শর্তে সাহায্য করব যে, তোমার মেয়ে মোহাম্মদী বেগমকে আমার কাছে বিবাহ দিতে হবে।’ এসময় তার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে ছিল এবং সে ছিল বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত; যেমন যক্ষ্মা, বহুমূত্র ও পক্ষাঘাতের অনুরূপ রোগ। আহমদ বেগ এ শর্ত গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। ফলে ভন্ডনবী গোলাম আহমদ পাগলের মত হয়ে যায় এবং তাকে বিভিন্ন রকমের হুমকি দিতে থাকে। এই মেয়ের প্রতি তার আসক্তি এতই প্রবল হয়েছিল যে, সে ভবিষ্যদ্বাণীরূপে ঘোষণা দিল আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ভবিষ্যদ্বাণীরূপে প্রকাশ করেছেন যে, আহমদ বেগের বড় মেয়ের বিবাহ আমার সাথে হবে। তবে, তার পরিবার পরিজন এর বিরোধিতা করবে এবং এতে বাঁধা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমার সাথে তার বিবাহ দেবেন এবং সমুদয় প্রতিবন্ধকতা দূর করবেন। কেহই এর বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘‘&এজালাতুল আওহাম’’ ৩৯৬ পৃষ্ঠা) সে আরো বলল যে, মুহাম্মদী বেগমের সহিত বিবাহ অবধারিত। আমি আমার প্রভুর শপথ করে বলছি, এটা সত্য এবং তোমরা এর বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন আমি নিজেই তোমার সহিত তার বিবাহ দিয়ে দিলাম এবং কেহই আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করতে পারবে না’। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘‘আল-হুকমুছ্ছামাবী’’ ৪০ পৃ:) মোটকথা, গোলাম এ ব্যপারে উল্লেখ করছে যে, বিশ্ব প্রভু স্বয়ং একে তার সাথে বিবাহ দিয়েছেন এবং তার ফয়সালাকে কেহ ফিরাতে পারবে না। এজন্যই সে এত জোরালোভাবে বলেছে, এ ভাবষ্যদ্বাণী অবশই বাস্তবায়িত হবে এবং এর বাস্তবায়িত হওয়া অবধারিত। অতপর সে বলে: এই ভবিষ্যদ্বাণী অর্থাৎ এ মেয়েটির আমার সাথে বিবাহ হওয়া অখন্ডনীয় ভাগ্যলিপি। যার কোন অবস্থাতেই পরিবর্তন হবে না। কেননা, আমি এলহামের মধ্যে এ বাক্যটি পিছিয়ে ‘‘লা তাবদীলা লি কালিমাতিল্লাহ’’ (আল্লাহর ফায়সালার কোন পরিবর্তন নেই।) এর অর্থ হল, আমার এ ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। কারণ, এটা বাস্তবায়িত না হলে আল্লাহর কালাম অর্থহীন হয়ে পড়বে। (‘‘ইশতেহারুল গোলাম’’ ১৬ অক্টেবর ১৮৯৪ খৃ:) এরও অধিক সে বলেছে- ‘যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হয় তবে আমি অত্যন্ত ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হব। হে নির্বোধেরা (তার বিরুদ্ধবাদীদের সম্বোধন করছে) এটা মানুষের কোন বানান কথা নয় এবং কোন ঘৃণিত ও অপবাদ রটনাকারীর খেলা নহে, বরং এটা আল্লাহর সত্য প্রতিশ্রুতি। তিনি এমন মা’বুদ যার বাণীর পরিবর্তন হয় না এবং এমন প্রভু যার ইচ্ছা পূরণে কেহ বাধা সৃষ্টি করতে পারে না’। (গোলামের আঞ্জামে আথম এর পরিশিষ্ট ৫৪ পৃ:) এ ভবিষ্যদ্বাণীর ফাঁকে সে আহমদ ও তার আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করতে লাগল। কখনও তাদেরকে আশা দেয়, আবার কখনও তাদেরকে হুমকী দেয়, যাতে তার এ আশা পূর্ণ এবং ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ বাস্তবায়িত হয়ে যায়। সে আহমদ বেগের কাছে পত্র লিখল, যার বক্তব্য হল এই- ‘‘শ্রদ্ধেয় ভাই আহমদ বেগ। আল্লাহ তাআলা আমাকে নিরাপদ রাখুন। আমি এইমাত্র মুরাকাবা শেষ করলাম। সাথে সাথে আমার নিদ্রা আসল। তখন আমি স্বপ্নে দেখলাম, আল্লাহ্ আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আমি তোমাকে এ মর্মে অবহিত করব, তুমি যেন তোমার কুমারী বড় মেয়েটিকে আমার নিকট বিবাহ দিয়ে দাও, যাতে তুমি আল্লাহর মঙ্গল, বরকত, দান ও সম্মানের অধিকারী হতে পার এবং তোমার বিপদাপদ যেন দূর হয়ে যায়। আর, যদি তুমি তোমার মেয়ে আমাকে প্রদান না কর, তা হলে তুমি ভৎর্সনা ও শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা আমি তোমাকে পৌঁছে দিলাম। যাতে তুমি আল্লাহর পুরস্কার ও সম্মান লাভ করতে পার, এবং তোমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহের ভান্ডার খুলে যায়। তাছাড়া তুমি আমার কাছে যে দরখাস্ত নিয়ে এসেছিলে তাতে আমি স্বাক্ষর দিতে প্রস্ত্তত আছি। উপরন্তু, আমার সমস্ত সম্পত্তি তোমার এবং আল্লাহর। আমি তোমার পুত্র আজিজ বেগের জন্যও সুপারিশ করতে প্রস্ত্তত আছি, যাতে সে পুলিশ বিভাগে চাকুরি লাভ করতে পারে। অনুরূপভাবে, আমি তাকে আমার এক বিরাট ধনী মুরিদের কন্যার সাথে বিবাহ দিয়ে দিব।’’ (আহমদ বেগের কাছে গোলাম কাদিয়ানীর লিখিত পত্র যা ‘নবীস্তায়ে গায়েব’ থেকে গৃহীত ১০০ পৃ:, ফেব্রু: ১৮৮৮ খৃ:।) সে আর একটি পত্র তার কাছে লিখেছে: ‘যদি তুমি আমাকে তোমার মেয়ে দান কর এবং আমার সহিত তার বিবাহ দাও তা হলে আমি তোমাকে আমার স্থাবর সম্পত্তি ও বাগানের একটি বড় অংশ প্রদান করব এবং তোমার মেয়েকে আমার সমুদয় সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দিয়ে দেব। আমি যা বলছি তা সত্য। তুমি যা চাও তা আমি তোমাকে দেব। আমার মত আত্মীয়তা রক্ষাকারী আর কাউকে তুমি খুঁজে পাবে না। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘মেরাতে কামালাতে ইসলাম’ ৫৭৩ পৃ:।) যখন সে দেখল যে এ সকল উৎসাহ ও আগ্রহ দান কোন কাজে আসছে না। তখন সে আহমদ বেগের কাছে নত হয়ে তার করুণা ভিক্ষা করতে লাগল। সে তার নিকট এ মর্মে আরো একটা পত্র লিখল: ‘আমি আপনার কাছে অত্যন্ত আদব ও নম্রতার সাথে আসা করছি যে, আপনি আমার কাছে আপনার মেয়েকে বিবাহ দেয়ার প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন। কেননা, এ বিবাহটি আপনাদের জন্য বরকতের কারণ হবে এবং আল্লাহর অনুগ্রহের দরজা সমূহ যা আপনারা কল্পনা করতে পারেন না তা আপনাদের জন্য খুলে যাবে। হয়ত আপনারা জানেন, এ ভবিষ্যদ্বাণী হাজার হাজার এমনকি লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে প্রচারিত হয়ে গেছে এবং বিশ্ববাসী এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছে। হাজার হাজার খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা এ
ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছে, বরং এটা নিয়ে তারা আমাদের বিরুদ্ধে হাসি ঠাট্টা করছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং আমাদিগকে সহায়তা করবেন। এজন্য আমি আপনার কাছে আশা করছি যেন এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে আমাকে সহযোগিতা করেন। (আহমদ বেগের নিকট গোলামের পত্র ১৭ জুলাই ১৮৯২ খৃ: যা ‘কালেমায়ে ফজলে রহমানী’ পুস্তক হতে গৃহীত ১২৩ পৃ:।) যখন এ প্রচেষ্টায়ও সে সফলকাম হতে পারে নি তখন সে তার দু’পুত্র সুলতান আহমদ ও ফজল আহমদের নিকট পত্র লিখল, তারা যেন তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। কারণ, ফজল আহমদ আহমদ বেগের ভাগিনীকে বিবাহ করেছিল। আর আহমদ বেগের মাতৃকুলের সহিত সুলতানের আত্মীয়তা ছিল। অনুরূপভাবে সে তার স্ত্রী সুলতান আহমদের মাতার কাছে পত্র লিখল। তিনি যেন তার অবস্থান দ্বারা এ ব্যাপারে চেষ্টা করেন। আর যদি তারা তাকে সাহায্য না করে, তাহলে সুলতান আহমদ ফজল আহমদ প্রত্যেকে তার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে এবং তাদের মা ত্বালাক প্রাপ্তা হবে।’ আবার, সে একটা সাধারণ ঘোষণা দিল যার বর্ণনা এই- ‘যদি আহমদ বেগের কন্যা আমি ব্যতীত অন্য কারে সঙ্গে বিবাহ বসে তবে ঐ দিনই সুলতান আহমদ আমার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়ে যাবে এবং তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। আর, তার মাও তালাক প্রাপ্তা হয়ে যাবে। আমার পুত্র ফজল আহমদও আমার সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে যদি সে তার স্ত্রী আহমদ বেগের ভাগিনীকে তালাক না দেয়। সুলতান আহমদের ন্যায় তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। (ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ঘোষণা, ২মে ১৮৯১ খৃ: যা ‘‘তাবলীগে রিসালত’’ এর অন্তর্ভুক্ত ২য় খন্ড ৯পৃঃ) এ সকল ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে এ উদ্যেশ্য ছিল তারা যেন আহমদ বেগকে তার মেয়ে গোলামের কাছে বিবাহ দিতে বাধ্য করে। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করেন। আহমদ বেগের কন্যা মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ সুলতান বেগ নামক জনৈক সৈনিকের সহিত সম্পন্ন হয়ে গেল। আর, এ মিথ্যাবাদী অপবাদ রটনাকারী আক্ষেপ, অনুতাপ ও হতাশার ভিতর জীবন যাপন করতে লাগল এবং নিজের উপর অভিসম্পাত কুড়াতে লাগল যা সে নিজেই নির্ধারণ করেছিল এবং নিজের জন্য প্রয়োগ করেছিল। সে বলেছিল: ‘যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হয়, তবে আমি সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হব।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আঞ্জামে আথম’ এর পরিশিষ্ট ৫৪ পৃ:) তার এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয় নি, যার সম্পর্কে সে বলেছিল. ‘এটা আল্লাহর সত্য প্রতিশ্রুতি এবং আল্লাহর বাণীর কোন ব্যতিক্রম নেই।’ আল্লাহপাক তাকে জন সমক্ষে লাঞ্ছিত করেছেন। কিন্তু সে তার কর্মধারা থেকে বিরত হয়নি এবং সে ঐ কথার উপর অটল রইল যে, যেকোনো অবস্থায় তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ হবে। কেননা, আকাশেই তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ হয়ে গেছে। তবে তার বর্তমান স্বামী অচিরেই মৃত্যুবরণ করবে। তারপর সে বলছে: এটা সত্য যে, আমার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ হয় নি, তবে এটা নিশ্চিত যে, অচিরেই আমার সাথে তার বিবাহ হবে। যেমন ভবিষ্যদ্বাণীতে উল্লেখ রয়েছে, . ...। এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়ায় লোক আমাকে নিয়ে উপহাস করছে। তবে, এ ভবিষ্যদ্বাণী আমি আমার নিজের পক্ষ হতে দেই নি, বরং আল্লাহর ওহী দ্বারা আমি বলেছি। আমি সত্য বলছি যে, এমন একদিন আসবে যেদিন এ সকল বিদ্রূপকারীদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যাবে..... । আর, মেয়েটি জীবিত অবস্থায় আমার কাছে আসবে এবং আমার সঙ্গে তার বিবাহ হবে। আমি এতে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি। কেননা, আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম হয় না’। (গোলাম কাদিয়ানীর ঘোষণা, যা মঞ্জুর কাদিয়ানঅর ‘মঞ্জুরে এলাহী’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত, ১৪৪ পৃ:) সে আরো লিখেছে: ‘আমি আল্লাহর নিকট কাকুতি মিনতির সহিত প্রার্থনা করলে আমার কাছে এলহাম আসল: ‘অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনা বলী দেখাব, এ মেয়েটি বিধবা হবে এবং তার স্বামী ও পিতা তিন বৎসরের মধ্যে মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর এই মহিলা আমার নিকট আসবে এবং কেহই এতে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না’ (গোলামের ইলহাম যা ‘নবীস্তায়ে গায়েব’ হতে গৃহীত।) সে আরও বলে: ঐ আল্লাহর শপথ! যিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সত্য ধর্ম দিয়ে পাঠিয়েছেন। এটাও বাস্তব যে, আমার সাথে মহিলাটির বিবাহ হবে। এই সংবাদকে আমি আমার সত্য মিথ্যার মানদন্ড নির্ধারণ করছি। আমি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ প্রাপ্তির পরই বলছি। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘আঞ্জামে আথম’ ২২৩ পৃ:)
এদিকে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু মুহাম্মদী বেগমের স্বামী সৈনিক ব্যক্তি অস্ত্র ও গুলীর নীচে জীবন যাপন করেও মৃত্যুবরণ করেনি এবং ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী গোলাম আহমদের নিকট মুহাম্মদী বেগম ফিরে আসেনি। ফলে চতুর্দিক থেকে তার উপর অভিশাপ ও গাল-মন্দ বর্ষিত হতে লাগল। সে দোয়ার মাধ্যমে সর্বশেষ ঘোষণা দিল: পবিত্র ও মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, হে মা’বুদ, সর্ব শক্তিমান ও সর্বজ্ঞ, যদি আহমদ বেগের কন্যার বিবাহের ভবিষ্যদ্বাণী তোমার নিকট হতে হয়ে থাকে, তাহলে তুমি তা বাস্তবে পরিণত কর। যাতে এটা তোমার মখলুকের উপর প্রমাণরূপে গণ্য হয় এবং এর দ্বারা হিংসুক খবীছদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। আর যদি এই ভবিষ্যদ্বাণী তোমার নিকট হতে না হয়ে থাকে, তাহলে হে আল্লাহ! আমাকে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত করে ধ্বংস করে দিন এবং আপনার দৃষ্টিতে আমাকে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত করুন।’ (গোলাম আহমদের ঘোষণা ২৭ অক্টোবর ১৮৯৪ খৃ: যা কাসিম কাদিয়ানীর ‘তাবলীগে রেসালাতের অন্তর্ভুক্ত, ৩য় খন্ড ১৮৬ পৃ:)
কার্যত: আল্লাহ তাআলা এ অভিশপ্ত ও বিতাড়িত ব্যক্তিকে তার [১ ভন্ডনবী কাদিয়ানী এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হলে উক্ত গুণ দুটো তার নিজের উপর আরোপ করছি। তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়নি।]
দীর্ঘ বাইশ বৎসর যাবৎ এ ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালানোর পর অপমানিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত অবস্থায় ধ্বংস করেন। কেননা, সে প্রথম বারের মত ১৮৮৬ সালে এ ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং ১৯০৮ সালে সে মৃত্যুবরণ করে। আর, এ মহিলাটি তার বীর স্বামীর সংসারে থেকে এ ভন্ডনবীর অন্তরকে জ্বালিয়ে এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ ও কৃত্রিম-অমূলক দাবিদাওয়াকে মিথ্যা প্রমাণ করে বেঁচে রইল [২ মুহাম্মদী বেগম প্রায় একশত বছর জীবিত থাকার পর ১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেন।]
আর তার স্বামী এই সফল প্রতিযোগী গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর চল্লিশ বৎসরের অধিক কাল জীবিত ছিল। এ আঘাতটি ছিল কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে একটি মরণ আঘাত। এখনও তারা মাথা নত করে আছে এবং এ সংকট থেকে বের হওয়ার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কেননা, তাদের ভন্ডনবী সর্বদা এ ভবিষ্যদ্বাণীকে তার সত্য মিথ্যার মাপকাঠিরূপে গণ্য করেছে। একথা ধর্তব্য ছিল যে, যখন তারা এ লোকটিকে অপবাদ রটনাকারী ও মিথ্যাবাদী জানতে পারবে তখন তারা সঠিক পথে ফিরে আসবে। কেননা, আল্লাহর বাণী ও প্রতিশ্রুতি সমূহের পরিবর্তন অসম্ভব। গোলামও তা স্বীকার করেছে। কিন্তু বক্ষের ভিতর যে অন্তর আছে তা (বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে) অন্ধ হয়ে যায়। তার মিথ্যা প্রকাশ পাওয়ার পরও তারা তার ধর্মত্যাগ করেনি।
চতুর্থ ভবিষ্যদ্বণী:
উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী গোলাম আহমদকে মিথ্যুক ও দাজ্জাল সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কাদিয়ানীদের বিশিষ্ট নেতা ও আমির মুহাম্মদ আলী লাহোরি কাদিয়ানী বলেছে: ‘এটা ঠিক যে, আমাদের ইমাম বলেছেন: মুহাম্মদী বেগমের সহিত তার বিবাহ হবে এবং এটাও ঠিক যে, মুহাম্মাদী বেগমের তার বিবাহ হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বও অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী যা বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে লোকটিকে মিথ্যাবাদী বলা যায় না। (মুহাম্মদ আলীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে সুলাহে’ প্রচারিত ১৬ জানুয়ারি ১৯২১ খৃ:।) প্রথমত: এটা তার ইমাম ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর উক্তির বিপরীত। সে বলেছে: ‘বিরুদ্ধ বাদীরা জেনে রাখ, আমাদের সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য এ ভবিষ্যদ্বাণী হতে অধিক সুন্দর ও উপযোগী আর কিছু নেই।’ (গোলামের ‘মিরাতে কামালাতে ইসলাম’ ২৮৮ পৃ:) সুতরাং ভন্ডনবী কাদিয়ানী এ ভবিষ্যদ্বাণীকে বিশেষ করে তার সত্য মিথ্যার মাপকাঠি বানিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত: সে এ ভবিষ্যদ্বাণীকে বিভিন্ন শব্দ দ্বারা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ব্যক্ত করেছে. যেমন, এটা বাস্তবায়িত হওয়া অপরিবর্তনীয় ফয়সালা এবং আসমানে তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে, এবং স্বয়ং আল্লাহ তার সাথে মুহাম্মদী বেগমের বিবাহ সম্পন্ন করেছেন।’ এ ভবিষ্যদ্বাণী আল্লাহর ঐ সকল বাণীর অন্তর্ভুক্ত যার কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না।’ যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হয় তবে সে অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হবে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি.....।
এ সব সত্ত্বেও আমি তার অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীর পরিণতি উল্লেখ করছি, যাতে, এ সত্য আরো অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠে যা পূর্বেই স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং এতে যেন কারো সন্দেহ ও ইতস্তত: করার অবকাশ না থাকে। এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী তার স্ত্রীর গর্ভাবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছে- ঐ আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি আমাকে এ বৃদ্ধাবস্থায় চারটি ছেলে দান করেছেন এবং পঞ্চম ছেলের সুসংবাদ দিয়েছেন।’ (গোলামের মূল বর্ণনা যা তার পুস্তক ‘‘মাওয়াহিবুর রহমান’’ এ উল্লেখিত, ১৩৯ পৃ:।) এ ইলহামটি ১৯০৩ খৃ: এর জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে ছিল এবং ঠিক ঐ মাসের ২৮ তারিখে ১৯০৩ খৃ: ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী গোলাম আহমদের স্ত্রী একটি সন্তান প্রসব করল। তবে এটা কি ছিল? কন্যা? হ্যাঁ, কন্যাই? কিন্তু বেশি দিন বাঁচেনি, বরং কয়েক মাস পরেই সে মারা গেল। আবার তার স্ত্রী গর্ভবতী হল এবং সে ভবিষ্যদ্বাণী করল, ‘‘সম্ভ্রান্ত ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে, সে হবে সুদর্শন সুচতুর সন্তান।’’ (গোলামের আল-বুশরা ২য় খন্ড, ৯১ পৃ:।) এ ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা তার উদ্দেশ্য ছিল, জনসাধারণের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করা যে, ১৯০৩ সালের ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা এ গর্ভই উদ্দেশ্য, ইতি পূর্বেকার গর্ভ নহে। এরপর কি হল? আল্লাহর কুদরত দেখুন! এ অপবাদকারী মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ কীভাবে অপদস্ত করেছেন এবং এ ইলহাম ও ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র এক মাস পর কেমন করে তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেন। ১৯০৪ সালের ২৪ জুন গোলামের স্ত্রী আবার প্রসব করল। তা কি কন্যা? অবশ্যই কন্যা। তার নাম রাখা হল ‘‘আমাতুল হাফিজ।’’ কিন্তু সম্ভ্রান্ত সুচতুর সুদর্শন ছেলে জন্ম গ্রহণ করেনি? অবশ্যই জন্ম গ্রহণ করেনি। তা সত্ত্বেও গোলাম তার জীবনের শেষ পর্যন্ত বার বার একথা বলেছে যে, তার এমন একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে যে তার অপমানকে বিধৌত করবে এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী প্রথম ও দ্বিতীয় গর্ভের জন্য জড়িত ছিল না। পুনরায় সে তার ইলহাম ও বিশেষ সন্তানের ভবিষ্যদ্বাণী ১৯০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করল- ‘আমি তোমাকে একজন ধৈর্যশীল ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা বদর যা ১৯০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এবং আল বুশরা ২য় খন্ড ১৬৩ পৃ:।) অক্টোবর মাসে সে তার দ্বিতীয় ইলহাম ঘোষণা করল: ‘‘অচিরেই আমি তোমাকে একটা ছেলে দান করব। হে প্রভু, আমাকে একটা পবিত্র সন্তান দান কর। আমি তোমাকে এমন ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি যার নাম হবে ইয়াহইয়া। (গোলামের অক্টোবরের ইলহাম যা তার ইলহামের সমষ্টি আল বুশরার অন্তর্ভুক্ত। ২য় খন্ড ১৩৬ পৃ:।) কিন্তু আক্ষেপের বিষয়- ‘পবিত্র ছেলে ও ধৈর্যশীল ছেলে জন্ম গ্রহণ করেনি। কারণ, এই ইলহামের কয়েক মাস পরেই ২৬ শে মে ১৯০৮ সালে গোলাম আহমদ মারা যায়, যাতে সে তার কর্মফল পেতে পারে। আমাতুল হাফিজ নাম্নী যে মেয়েটি ১৯০৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিল, সেই তার শেষ সন্তান। এ আঘাতটি তার জীবনের প্রথম আঘাত ছিল না , বরং ইতিপূর্বে ১৮৮৬ সালে সে এর তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে এতই নির্বোধ ছিল যে, সে এ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি।
পঞ্চম ভবিষ্যদ্বাণী:
এ ভবিষ্যদ্বাণী আমি বিস্তারিত বর্ণনা করব। ১৮৮৬ সালের ২০ ফেব্রয়ারী তারিখে যখন গোলাম আহমদের স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, তখন সে ঘোষণা দিল যে, আল্লাহর নিকট থেকে তার কাছে ইলহাম এসেছে। এর বর্ণনা হল এই: ‘‘আল্লাহ করুণাময় দয়ালু যিনি সবকিছু করতে পারেন আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তার একটি নিদর্শন প্রকাশ করবেন, যা রহমতের নিদর্শন.... প্রকাশ্য নিদর্শন..... সুদর্শন, সম্মানিত ও পবিত্র সন্তান......জাহেরী বাতেনী জ্ঞানে পরিপূর্ণ........প্রিয় ছেলে, সৌভাগ্যবান, আউয়াল ও আখেরের এবং হক ও উলার প্রকাশ স্থল, যেন আকাশ থেকে আল্লাহ স্বয়ং অবতরণ করেছেন। (এ সকল তুলনা হতে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি, তারা যা বলছে তা থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্ধ্বে।) এ ছেলেটি খুব তাড়াতাড়ি বড় হবে এবং কায়েদিগণকে মুক্ত করবে এবং বিভিন্ন জাতি তার থেকে বরকত লাভ করবে। (গোলামের ঘোষণা, ২০ ফেব্রঃ ১৮৮৬ সাল, যা কাসিম কাদিয়ানীর ‘তাবলীগে রেসালাত’ এর অন্তর্ভুক্ত, ১ম খন্ড ৫৮ পৃ:।) সে স্পষ্ট করে বলছে যে, এ মহান সন্তানটি বর্তমান গর্ভ থেকেই জন্ম গ্রহণ করবে। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘তাতিম্মতু হাকিকাতুল ওহী, ১৩৫ পৃ:।) অতঃপর গোলামের স্ত্রী এ গুলো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়ার পর এবং আর্তনাদপূর্ণ ইলহামাতের পর এপ্রিল মাসে একটি সন্তান প্রসব করল। কিন্তু ভন্ডনবী মিথ্যাবাদীর দাবি অনুসারে সন্তানটি ছেলে ছিল না, বরং মেয়ে ছিল। তার নাম রাখা হল ‘ইসমত’। তারপর সে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সে ১৮৯১ সালে মারা গেল। কাদিয়ানীরা অধীর আগ্রহে এমন একটি ছেলে সন্তানের অপেক্ষায় রইল, যে হবে সুন্দর, সম্মানিত, মেধাবী, সত্য ও উচ্চ মর্যাদার প্রতীক, বিভিন্ন জাতি তার দ্বারা বরকত লাভ করবে এবং সে বন্দিদের মুক্তি করবে। এ অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত ছিল। যদি এ মিথ্যাবাদীর সামান্যতম বুদ্ধি থাকত তবে সে এ ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পর এ ধরনের আর কোন মিথ্যা ইলহাম রটনা করত না। কিন্তু তার শয়তান তাকে অনেক বার পথভ্রষ্ট করেছে যাতে করে সে লাঞ্ছনা, অপদস্ততা, লানত ও ঐ সকল গাল-মন্দ অর্জন করতে পারে যা সে নিজেই নিজের জন্য নির্ধারিত করেছে। আশ্চর্যের বিষয় যে, এ সত্ত্বেও সে দাবিকরে, প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে সে কোন কথা বলে না, যা বলে তা ওহী ব্যতীত আর কিছু নহে।’ (গোলামের আরবাঈন ৩ নম্বর ৪৩ পৃ:।)
ষষ্ঠ ভবিষ্যদ্বাণী:
এখন আমরা তার ষষ্ঠ ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করব, ১৮৮৬ সনের ২০শে ফেব্রয়ারী তারিখে সে ঘোষণা দিল ‘‘আল্লাহ তাআলা আমাকে এ মর্মে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, বরকতের অধিকারিণী স্ত্রী গণ থেকে আমার অনেক গুলো সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। এদের কাউকে আমি এ এলহামের পরে বিবাহ করব। (তাবলীগে রেসালাতের অন্তর্ভুক্ত গোলামের ইলহাম, ১ম খন্ড, ৫৮ পৃ:।) এ বক্তব্যকে সে তার নিম্নোক্ত উক্তি দ্বারা আরো স্পষ্ট করেছে- ‘‘আল্লাহর কাছ থেকে ইলহাম পাওয়ার পর ১৮৮৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসে আমি এ ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, এ ঘোষণার পর আল্লাহ তাআলা আমাকে বিবাহের সুসংবাদ দিয়েছেন, অচিরেই আমি বরকতময় রমণীগণকে বিবাহ করব এবং তাদের থেকে আমার সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করবে।’’ (গোলামের ‘মাহাক্কে আখইয়ার ও আসরার’ নামক ঘোষণাপত্র যা তাবলীগে রিসালাতের অন্তর্ভুক্ত ১ম খন্ড ৮৯ পৃ:) অতএব, তার ভবিষ্যদ্বাণী সুস্পষ্ট, কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। তা হল যে, গোলাম কাদিয়ানী ১৮৮৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসের পর কয়েকজন মহিলাকে বিবাহ করবে এবং তাদের থেকে সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করবে। এরপর একটি বিষয় বাকি রয়ে গেল, আর তা হল এই যে, এ ঘোষণার পর সে কয়টি মহিলাকে বিবাহ করেছে এবং তাদের থেকে তার কয়টি সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে? বাস্তব অবস্থা এ সম্পর্কে কি বলি? এরপর গোলাম আহমদ অনেক মহিলা তো বিবাহ করেনি বরং একটিও না। আর, সন্তানাদি লাভের তো প্রশ্নই উঠে না।
সপ্তম ভবিষ্যদ্বাণী:
তার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের অন্যতম একটি হল এই- ১৮৯৯ সালের ১৪ ই জুন তারিখে তার একটি সন্তান জন্ম লাভ করে এবং তার নাম রাখে ‘মোবারক আহমদ’ তার জন্ম গ্রহণের কয়েকদিন পর সে ভবিষ্যদ্বাণীরূপে ঘোষণা দিল যে, এ সন্তানটি ‘‘আল্লাহর একটি নূর, প্রতিশ্রুত সংস্কারক, মহত্ত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী, মাসীহ সাদৃশ্য আত্মা, রোগ নিরাময় কারী, আল্লাহর বাণী ও সৌভাগ্যবান এ সন্তান বিশ্বের সকল প্রান্তে খ্যাতি লাভ করবে, বন্দি মুক্ত করবে এবং সকল প্রান্তে খ্যাতি লাভ করবে, বন্দি মুক্ত করবে এবং সকল জাতি তার দ্বারা বরকত লাভ করবে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তিরইয়াকুল কুলবি’ ৪৩ পৃ:) অতঃপর এ সন্তানটি তার জন্মের আট বৎসর পর ১৯০৭ সালে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যদ্দরুন গোলাম আহমদ অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠল। কারণ, ইতিপূর্বে সে ঘোষণা দিয়েছিল যে, এ সন্তানটি এমন এমন হবে। সুতরাং যথা সম্ভব সে তার সকল প্রকার চিকিৎসা করল। ১৯০৭ সালের ২৭ শে আগস্ট তারিখে যখন তার রোগ কিছুটা হালকা হল, তখন গোলাম ভবিষ্যদ্বাণী রূপে ঘোষণা দিল ‘আল্লাহ আমার কাছে ইলহাম করেছেন যে, দোয়াটি কবুল হয়ে গেছে এবং রোগ সেরে গেছে। এর অর্থ হল এই যে, আল্লাহ তাআলা দোয়া কবুল করেছেন এবং মুবারক আহমদ আরোগ্য লাভ করবে। (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদর’ ২৯ আগস্ট, ১৯০৭ সাল।) ভন্ডনবী কাদিয়ানী আল্লাহর শানে এ মিথ্যা অপবাদ ঘোষণা করার সাথে সাথে রোগটি নতুন করে ফিরে এল এবং ১৯০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে এ প্রতিশ্রুত সংস্কারক সন্তানটি মারা গেল, যে মহত্ত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী, রোগ নিরাময়কারী, মাসীহ সাদৃশ্য, সকল জাতি যার প্রতি অপেক্ষমাণ ছিল, সে বন্দি মুক্ত করবে এবং জনগণের উপর থেকে তাদের কঠিন ও ভারী বোঝা সরিয়ে দেবে। (‘সীরাতে মাহদী’ ৪০ পৃ: এবং কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজল’ ৩০ শে অক্টোবর, ১৯৪০ খৃ:)
অষ্টম ভবিষ্যদ্বাণী:
গোলামের অন্যতম এক ভবিষ্যদ্বাণী হল ‘কাদিয়ান নামক জনপদে যেখানে তার বাসস্থান প্লেগ রোগ দেখা দেবে না।’ সে বলেছে: তিনি সত্য মা’বুদ যিনি কাদিয়ানে তার রাসূল পাঠিয়েছেন, তিনিই কাদিয়ানকে হেফাজত করবেন এবং প্লেগ রোগ হতে একে রক্ষা করবেন। যদিও এ রোগ সত্ত্বর বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে। কেননা, কাদিয়ান তার রাসূলের আবাস ভূমি এবং এর মধ্যেই (অর্থাৎ কাদিয়ানে প্লেগ প্রবেশ না করাতে) সকল জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘দাফেউল বালা’ ১০ ও ১১ পৃ:) এ ভবিষ্যদ্বাণীতে গোলাম আহমদ দাবি করছে যে, যদিও এদেশে প্লেগ রোগ সত্ত্বর বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে, তবু কখনও উহা কাদিয়ানে প্রবেশ করবে না। কিন্তু দেখা গেল, ঐ কাদিয়ানে প্লেগ রোগ প্রবেশ করেছে, যাকে এ ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার অবস্থান দ্বারা বিখ্যাত করেছিল। এতে তার বাদী মিথ্যা প্রমাণিত হয়। অথচ সে সময় কাদিয়ানের আশে পাশের গ্রাম ও শহরে প্লেগ ব্যাপক ছিল না এবং এর প্রকোপ স্থায়ী ছিল না। এমনকি এক বৎসর পর্যন্তও স্থায়ী থাকেনি। এখন আমরা গোলাম আহমদের নিজের পক্ষ থেকেই এর প্রমাণ পেশ করব। সে তার শ্বশুর মুহাম্মদ আলী খানের নিকট লিখিত পত্রে কাদিয়ানে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলে: এখানে প্লেগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। লোক আক্রান্ত হয়ে কয়েক ঘনটার মধ্যে মারা যায়। আল্লাহই জানেন যে, এ পরীক্ষা কবে শেষ হবে! আপনারা ‘ফেনাইল ইনফেতলীনের’ একটা বড় বাক্স নিয়ে আসবেন; যার মূল্য প্রায় বিশ টাকা হবে। আর, আপনাদের বাড়িতেও ফেনাইল পাঠাবেন। (মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানীর নিকট পত্র, যা ‘মাকতুবাতে আহমদিয়ার অন্তর্ভুক্ত ৫ম খন্ড ১১২ও ১১৩ পৃ:।) শুধু তাই নহে বরং প্লেগ তার বাড়িতেও ঢুকছে, হ্যাঁ, তার বাড়িতেই যার সম্পর্কে সে বলে ‘আমার বাড়ী নূহ আলাইহিস সালাম এর নৌকার মত; যে এখানে প্রবেশ করবে সে সকল বিপদাপদ হতে রক্ষা পাবে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘সফিনায়ে নূহ’ ৭৬ পৃ:।) ঠিক এ বাড়িতেই প্লেগ প্রবেশ করে এবং যা ঘটবার তা ঘটিয়েছে; ভন্ডনবী কাদিয়ানী উপরোক্ত ব্যক্তির নিকট লিখিত তার অপর এক পত্রে তা স্বীকার করেছে। এতে সে লিখেছে ‘আমাদের পরিবারেই প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছে, এতে গাওছানুল কবীরা নাম্নি মহিলা আক্রান্ত হয়েছে। আমরা তাকে ঘর থকে বের করে দিয়েছি। এমনিভাবে উস্তাদ মুহাম্মদ দ্বীনও আক্রান্ত হয়েছেন, আমরা তাকেও বের করে দিয়েছি। আজ অন্য একজন মহিলা আক্রান্ত হয়েছে, যে দিল্লি হতে এসেছিল এবং আমাদের বাড়িতে অবস্থান করছিল..। আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি। এমন কি আমি ধারণা করতে থাকি যে, আমার ও মৃত্যুর মধ্যে মাত্র কয়েক সেকেন্ড আছে।’ (মুহাম্মদ আলীর নামে গোলামের পত্র, যা ‘মাকতুবাতে আহমদিয়ার অন্তর্ভুক্ত, ৫ম খন্ড, ১১৫ পৃ:)
এই হল কাদিয়ানে প্লেগ রোগ প্রবেশ না করা সম্পর্কে গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী; যার সম্বন্ধে সে বলত যে, ‘এতে জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে। এই হল বাস্তব সত্য এবং মূলত: এতেই রয়েছে জাতির জন্য তার মিথ্যা ও আল্লাহ তাআলার প্রতি তার মিথ্যাচারের নিদর্শন।
নবম ভবিষ্যদ্বাণী:
মঞ্জুর মুহাম্মদ নামে গোলামের একজন মুরিদ ছিল। তার স্ত্রী গর্ভবতী হলে সে গোলাম আহমদের কাছে এসে সংবাদ দিল। তখন ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার অভ্যাস অনুসারে উঠে দাঁড়াল এবং ভবিষ্যদ্বাণীরুপে ঘোষণা দিল ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, মঞ্জুর মুহাম্মদের একটি ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম তার নাম কি হবে? তখন স্বপ্নের অবস্থা ইলহামের অবস্থায় পরিণত হয়ে গেল এবং উত্তরে বলা হল- ‘বশিরুদ্দৌলা’। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে? (গোলামের ইলহাম যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘রিভিই’ এর অন্তর্ভুক্ত, ১৯০৬ সনের মার্চ মাসে প্রকাশিত, ১২২ পৃ:।) একথা স্পষ্ট যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা ঐ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য যে এসে তার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ দিয়েছিল। কিন্তু একে অস্পষ্ট রাখার উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট করে না বলা। বিশেষ করে ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের মধ্যে উল্লেখিত দুটি বিষয়ের স্বাদ গ্রহণ করার পর সে অস্পষ্ট রাখতে চায়। এর তাৎপর্য হল এই যে, যদি তার ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে বলা হবে: তুমিই উদ্দেশ্য ছিলে। আর যদি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে একথা বলতে সহজ হবে যে, অন্য ব্যক্তি উদ্দেশ্য ছিল; স্বয়ং ইলহামে এর স্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই। তারা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহ ও ব্যবস্থা নিলেন। আর, আল্লাহ সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ কারী। তাই আল্লাহ পুনরায় তাকে লাঞ্ছিত করতে ইচ্ছা করলেন। মাত্র চার মাস পর এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী ঘোষণা দিল,- ‘আমার বিশ্বাস যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা এ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য, এবং তার স্ত্রী মুহাম্মদী বেগমের গর্ভে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। (এ মুহাম্মদী বেগম পূর্বোল্লিখিত মুহাম্মদী বেগম নহে) তার নাম হবে বশিরুদ্দৌলা। কিন্তু বুঝতে পারছি না যে, মঞ্জুর আহমদ দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে? (গোলামের ইলহাম যা কাদিয়ানী পত্রিকা রিভিউ এর অন্তর্ভুক্ত, ১৯০৬ সনের মার্চ মাসে প্রকাশিত, ১২২ পৃ:।) একথা স্পষ্ট যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা ঐ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য যে এসে তার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ দিয়েছিল। কিন্তু একে অস্পষ্ট রাখার উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট করে না বলা। বিশেষ করে ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের মধ্যে উল্লেখিত দুটি বিষয়ের স্বাদ গ্রহণ করার পর সে অস্পষ্ট রাখতে চায়। এর তাৎপর্য হল এই যে, যদি তার ছেলে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে বলা হবে: তুমিই উদ্দেশ্য ছিলে । আর যদি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, তবে তাকে একথা বলতে সহজ হবে যে, অন্য ব্যক্তি উদ্দেশ্য ছিল; স্বয়ং ইলহামে এর স্পষ্ট কোন বর্ণনা নেই। তারা ষড়যন্ত্র করল এবং আল্লাহ ও ব্যবস্থা নিলেন। আর, আল্লাহ সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণকারী। তাই আল্লাহ পুনরায় তাকে লাঞ্ছিত করতে ইচ্ছা করলেন। মাত্র চার মাস পর এ মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী ঘোষণা দিল,- ‘আমার বিশ্বাস যে, মঞ্জুর মুহাম্মদ দ্বারা এ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য, এবং তার স্ত্রী মুহাম্মদী বেগমের গর্ভে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। (এ মুহাম্মদী বেগম পূর্বোল্লিখিত মুহাম্মদী বেগম নহে) তার নাম হবে বশিরুদ্দৌলা। এটাও সম্ভব যে, উক্ত সন্তান এ গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করবে না বরং পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম লাভ করবে। কিন্তু তার জন্ম গ্রহণ করা অপরিহার্য। কেননা, সে আল্লাহর নিদর্শন।’ (গোলামের ইলহাম যা ‘রিভিউ অব রিলিজিউন্স’ এর অন্তর্ভুক্ত জুন ১৯০৬ খৃ:।) তার পূর্ববর্তী তিক্ত অভিজ্ঞাতার কারণে এ ভবিষ্যদ্বাণীতে সে তার আত্মরক্ষার পথ রেখেছে। এজন্য বলেছে: আমি জানি না, উক্ত সন্তানটি এ গর্ভ হতে জন্ম গ্রহণ করবে অথবা পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করবে।’ এ সকল সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সে একটি বিষয় জোর দিয়ে বলেছে, তা হল মুহাম্মদী বেগমের গর্ভে মঞ্জুর মুহাম্মদের একটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। তাই সে বলেছে: মঞ্জুর মুহাম্মদের স্ত্রী উক্ত সন্তান জন্ম দান এবং এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করবে না।’ (গোলামের মূল বক্তব্য, যা রিভিউ এর অন্তর্ভুক্ত, জুন ১৯০৭ খৃ:।) ঘটল কি? ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে মঞ্জুর মুহাম্মদের স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান প্রসব করল। তারপর সেই মহিলা আর কোন গর্ভ ধারণ না করে মৃত্যু বরণ করে। কাদিয়ানীরা এই বলে বশিরুদ্দৌলার অপেক্ষায় রইল যে, আল্লাহ জানেন, কখন এবং কেমন করে এ ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হবে। কেননা, জনাবে মুকাদ্দাস (গোলাম) মুহাম্মদী বেগমের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন। আর, বেচারি তো মৃত্যুবরণ করেছে।’ হায় আফসোস! (গোলামের ইলহামাতের সমষ্টি মঞ্জুর কাদিয়ানী কর্তৃক রচিত ‘আল-বুশরার’ অন্তর্ভুক্ত, ২য় খন্ড, ১১৬ পৃ:।)
দশম ভবিষ্যদ্বাণী:
একদা ভন্ডনবী কাদিয়ানীর সাথে ডা: আব্দুল হাকীম নামী একজন মুসলমানের ঝগড়া বাঁধলে তিনি তাকে মিথ্যাবাদী বলে চ্যালেঞ্জ করলেন এবং তাকে মাঠে নামার জন্য আহবান জানালেন। কিন্তু গোলাম আহমদ তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার পরিবর্তে তাকে শাস্তি, বিপদ, অভিশাপ ও ধ্বংসের হুমকি দিতে লাগল এবং তার স্বভাব অনুযায়ী ঘোষণা দিল- আব্দুল হাকীম আমার জীবদ্দশায় মারা যাবে, কেননা, সে আমার মানহানি ও দুর্নাম করছে। এরূপ ব্যক্তি বেঁচে থাকে না ... এবং.... এবং; কিন্তু ডাঃ আব্দুল হাকীম অন্য ধরনের লোক ছিলেন তাই তিনিও ঘোষণা দিলেন- ‘ভন্ডনবী কাদিয়ানী আজ থেকে পনেরো মাসের মধ্যে মারা যাবে।’ আর এ ঘোষণাটি ছিল ১৯০৭ সালের ৪ঠা মে তারিখে। এখন এ সম্পর্কে ভন্ডনবী কাদিয়ানীর নিজ মুখের বক্তব্য আমাদের শুনা উচিত। সে লিখেছে- ‘এখন আর এক শত্রু বের হয়েছে- পাটিয়ালার (ভারতের একটি শহর) অধিবাসী ডাঃ আব্দুল হাকীম। সে দাবি করছে যে, আমি তার জীবিতাবস্থায় ১৯০৮ সালের ৪ঠা আগস্টের মধ্যে মারা যাব। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে এর বিপরীত সংবাদ দিয়েছেন, সে আল্লাহর আজাবে আক্রান্ত হবে এবং আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেবেন। পক্ষান্তরে, আমি তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকব। এ ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দৃষ্টিতে সত্য, আল্লাহ তাকেই সাহায্য করবেন।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আইনুল মা‘রেফত, ৩২১ ও ৩২২ পৃ:, ১৯০৮ সালের ২০মে তারিখে প্রচারিত।) সে আরো বলেছে: ‘শত্রু আব্দুল হাকীম যে আমার মৃত্যু কামনা করে , সে অচিরেই আমার চক্ষুর সামনে সমূলে ধ্বংস হবে, যেভাবে হাতিওয়ালাদেরকে সমূলে ধ্বংস করা হয়েছিল’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তাবসেরাহ’)এ ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে সে আরো একটি ভবিষ্যদ্বাণী করল- ‘শত্রুরা আমার মৃত্যু কামনা করে এবং এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণীও করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে আমি আশি বছর বা এরও অধিক কাল বেঁচে থাকব। (গোলামের ‘মাওয়া হিবুর রহমান’ ২১ পৃ:।) সে জোর দিয়ে বলেছে যে, সে ১৯০৮ সালের ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। বরং এরপর আরো দশ বছর সে বেঁচে থাকবে। এটা জানা কথা যে, সে ১৮৩৯ অথবা ১৮৪০ সনে জন্ম গ্রহণ করেছে। সে নিজেই করেছে- আমি ১৮৩৯ বা ১৮৪০ সালে জন্ম গ্রহণ করেছি’ (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়্যাহ’ এর টিকা, ১৪৬ পৃ: এবং কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদর’ ৮ আগস্ট ১৯০৪ খৃ:।) এবং (হায়াতুন নবী প্রথম খন্ড, ৪৯ পৃ: ও কাদিয়ানীদের অন্যান্য পুস্তক) সে আরো লিখেছে- ‘১৮৫৭ সালে আমার বয়স ষোলো বা সতের বছর ছিল। (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়্যর’ টিকা ১৪৬ পৃ:।) এমনিভাবে সে এ ভবিষ্যদ্বাণীতে তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী একত্রিত করল। (১) ভন্ডনবী গোলাম আহমদের জীবিতাবস্থায় আব্দুল হকীম মৃত্যুবরণ করবে। (২) আব্দুল হাকীম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে সে অনুসারে ১৯০৮ সালের ৪ঠা আগস্টের মধ্যে সে মৃত্যুবরণ করবে না। (৩) সে কমপক্ষে ১৯১৯ বা ১৯২০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। এখন আমরা দেখব তার এ সকল ভবিষ্যদ্বাণী কি বাস্তবায়িত হয়েছে? অথচ গোলাম বলেছে নবীগণের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়া অসম্ভব। (গোলামের ‘সফিনায়ে নূহ’ ৫ম পৃ:) সে আরো বলেছে- আমার সত্য মিথ্যা যাচাই করার জন্য আমার ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ হতে উত্তম আর কিছু নেই। (গোলামের ‘মেরাতুল কামালাত’ ২৮৮ পৃ:।)
হে পাঠক! হে অনুসন্ধানী! বিবরণ লক্ষ্য করুন! মুহাম্মদ হুসেন কাদিয়ানী লিখেছে, ‘আমাদের ইমাম মাসীহ মাওউদ (গোলাম) ২৫মে পর্যন্ত সুস্থ ছিলেন এবং কাদিয়ানী পত্রিকা ‘পয়গামে সুলহ’ এর উদ্দেশ্যে একটি প্রবন্ধ লিখান; কিন্তু মাগরিবের পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন.... এবং ১৯০৮ সালের ২৬শে মে সকাল সাড়ে দশ ঘটিকায় তার রুহ তার সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যায়।’ (মুহাম্মদ হুসাইন কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল
হিকমের’ অন্তর্ভুক্ত, ২৮ মে ১৯০৮ সাল।) গোলাম পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানী লিখেছে- ‘মসীহে মাওউদ ১৯০৮ সালের ২৫মে পর্যন্ত সুস্থ ও উৎফুল্ল ছিলেন। কিন্তু এশার পর আকস্মিক ভাবে আমাদের কাছে তার মৃত্যুমুখী শয্যাশায়ী হওয়ার সংবাদ পৌঁছোল এবং ২৬ মে ১৯০৮ সালে তিনি মারা গেলেন।’ (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের ‘সীরাতে মাহদী’ ৭পৃঃ) এভাবে মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী গোলাম আহমদ এ তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীতে একই সময় তিনটি মিথ্যাকথা বলেছে। প্রথমত: ডা: আব্দুল হাকীম কর্তৃক নির্ধারিত সময়েই সে মৃত্যুবরণ করেছে। এতে এটাই প্রমাণিত হল যে, ডাঃ আঃ হাকীম সত্য এবং সে মিথ্যা। কেননা, সে ইতিপূর্বে বলেছে- ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সাহায্য করেন যে তার দৃষ্টিতে সত্যবাদী। দ্বিতীয়ত: তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তার জীবদ্দশায় আব্দুল হাকিম মৃত্যুবরণ করেন নি । বরং তার মৃত্যুর পরও তিনি দীর্ঘ দিন বেঁচে ছিলেন। তৃতীয়ত: সে আটষট্টি অথবা উনসত্তুর বৎসর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছে, তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আশি ও তদুর্ধ বৎসর বয়সে নহে। এ বিষয়ে আমি তার সম্পর্কে তা-ই বলব যা সে নিজে বলেছে: যে ব্যক্তি নবুয়তের দাবিকরে, তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত না হওয়া তার জন্য বড়ই লাঞ্ছনা ও অপমান জনক।’ (গোলামের ‘তিরয়াকুল কুলুব’ ১০৭ পৃ: এডিশন এক এবং ২৬৮ পৃ: এডিশন ২।) এই কথাটি সে সত্য বলেছে, যদিও অপরাপর অনেক বিষয়ে সে সত্য বলেনি। এ লাঞ্ছনার চেয়ে বড় লাঞ্ছনা এবং অপমানের চেয়ে অপমান আর কি হতে পারে? সে ২০ মে একটি পুস্তক প্রচার করে। যাতে সে তার শত্রুর মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মাত্র ছয়দিন পর সে তার শত্রুর পরিবর্তে নিজেই অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও মিথ্যুক সেজে মৃত্যুবরণ করে। এমনি ভাবে সে আরো কতই না মিথ্যা বলেছে। তার অনেক অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে মাত্র দশটি আমরা এখানে উল্লেখ করেছি, যাতে সে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তার দশম ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে একই সময়ে তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, আমি তা ইতিপূর্বে ব্যক্তি করেছি। এতটুকু বর্ণনা কে আমরা যথেষ্ট মনে করি। যদি আমরা তার মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী সমূহকে ধারাবাহিক বর্ণনা করি তাহলে বড় একটি ভলিউমে উহা সংকুলান করা যাবে না কেননা, এতটুকু বর্ণনাই এ লোকটি এবং তার দ্বাবী দাওয়ার বাস্তব রূপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদানে যথেষ্ট। সে নিজেই বলেছে: ‘যদি কেহ একটি বিষয়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয় তবে অন্যান্য বিষয়ে তার উপর বিশ্বাস রাখা যায় না’। (গোলামের ‘আইনুল মারেফাত’ ২২২ পৃ:।) অতএব দু’ একটি বিষয়ে নয়, বরং বারটি ভবিষ্যদ্বাণী বা ঘটনাতে আমরা তার মিথ্যাচারিতা প্রমাণ করেছি।
এ আলোচনার পরিশিষ্টে আমরা কাদিয়ানীদের দাবিদাওয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে চাই। ওদের বাদী- ‘যদিও আমাদের সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী সত্য ও বাস্তবায়িত হয়নি, তথাপি কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে।’ ভন্ডনবী কাদিয়ানীর উক্তি যা আমারা এই মাত্র উল্লেখ করেছি, উহার প্রতি দৃষ্টিপাত না করেই বলছি- ‘কোন কোন ভবিষ্যদ্বাণী সত্য ও বাস্তবায়িত হওয়া এটাই প্রমাণ করে যে, ভবিষ্যদ্বাণীর ঘোষণাকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে বলেনি। কেননা, সম্মান ও মহত্ত্বের অধিকারী আল্লাহ কখনও সত্য বলেন এবং কখনও সত্য বলেন না- তা অসম্ভব। বরং তাঁর বাণী সর্বদাই সত্য, এর ব্যতিক্রম সম্ভব নহে। এ ভন্ডনবী যত কথাই বলেছে সবই তার আন্দাজ ও অনুমান দ্বারা বলেছে। কখনও উহা বাস্তবায়িত হয় এবং কখনও উহার ব্যতিক্রম হয়; যেমন জ্যোতিষী ও অনুমানকারীরা কথা বলে থাকে। আর জ্যোতিষীও অনুমানকারীদেরকে নবী ও এলহামের অধিকারী বলা হয় না।
দ্বিতীয়ত: যে সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে কাদিয়ানীরা ঢোল পিটায় এবং বার বার প্রচার করে যে, এটা গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছে; তার দুটি অবস্থা রয়েছে:
একটি হল: গোলাম আহমদ আদৌ এ ভবিষ্যদ্বাণী করেনি, বরং এটা সংঘটিত হওয়ার পর সে নিজে অথবা অন্যরা একে তার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এরূপ ঘটনা অনেক যা পরে আমাদের বর্ণনায় আসছে।
দ্বিতীয়টি হল: এর উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না। প্রথমটির উদাহরণ- পন্ডিত দয়ানন্দ নামে জনৈক হিন্দু ব্যক্তি ভন্ডনবী গোলাম আহমদের বিরোধী ছিল। সে স্বাভাবিক ভাবেই মারা গেল। তখন ভন্ডনবী কাদিয়ানী এর সুযোগ গ্রহণ করতে চাইল এবং সে ঘোষণা দিল ‘আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম যে, আমার বিরুদ্ধবাদী পন্ডিত দয়ানন্দ অচিরেই মারা যাবে, এবং তখন সে মারা গেল। এ ভবিষ্যদ্বাণীর উপর শরম বাট নামক একজন হিন্দু সাক্ষী আছে। (আহমদিয়া পকেট বুক) কাদিয়ানীর এ ঘোষণা শুনার সাথে সাথে ‘শরমবাট’ যাকে কাদিয়ানী স্বাক্ষীরূপে গ্রহণ করেছিল ঘোষণা দিল- গোলাম আহমদ মিথ্যুক দাজ্জাল। আমি কখনও তার থেকে এ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিনি। (পন্ডিত লক্ষীরামের ‘কুল্লিয়াত’ এবং তাকজীবে বারাহীনে আহমদিয়া’।) অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল অতিবাহিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোন কাদিয়ানী গোলাম আহমদের কোন বই পুস্তক থেকে এটা প্রমাণ করতে পারেনি যে উল্লেখিত পন্ডিত দয়ানন্দের মৃত্যুর পূর্বে গোলাম আহমদ এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। এমনিভাবে আব্দুল লতীফ ও আব্দুর রহমান নামে কাদিয়ানী দু’ব্যক্তি আফগানিস্তানে ইংরেজের গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে নিহত হল। যখন এ সংবাদ ভন্ডনবী কাদিয়ানীর নিকট পৌঁছোল তখন সে ঘোষণা
দিল। ‘ইতিপূর্বে সে তার পুস্তক বারাহীনে আহমদিয়া ৫১১ পৃষ্ঠায় এ দু’ব্যক্তির নিহত হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং তার ইলহাম ‘‘দু’বকরী জবাই করা হয়েছে।’’ এর প্রতি ইঙ্গিত করেছে। (গোলামের তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন) আর, সে বলেছে এ দু’বকরী দ্বারা এ দু’নিহত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। (উল্লেখিত কিতাব।)
এটা সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা। কেননা, গোলাম এত-দু-ভয়ের হত্যাকান্ডের পূর্বে উক্ত ইলহামের এ মর্মে কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। এ কারণেই গোলামের কথিত ইলহাম (দু বকরীর জবাই) দ্বারা তার ভবিষ্যদ্বণীর উপর কাদিয়ানীদের প্রমাণ পেশ করা ভ্রান্ত ও বাতিল। এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে, ইতিপূর্বে গোলাম আহমদ নিজেই ভিন্ন মর্মে এ ইলহামের ব্যাখ্যা দিয়েছে। এখন তার মূল ভাষ্যের প্রতি লক্ষ্য করুন। ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে: ‘‘ইলহামে দুই জবেহকৃত বকরী দ্বারা মুহাম্মদী বেগমের স্বামী ও তার পিতাকে বুঝানো হয়েছে। [১ মুহাম্মদী বেগমের স্বামী ও তার পিতার আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে।]
(গোলামের আঞ্জামে আথমের পরিশিষ্ট ৫৭ পৃ:।) তার নিজস্ব এ ব্যাখ্যা থেকে ফিরে যাওয়া প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নহে। এতে লোকটির সুযোগ সন্ধানী ও বহুরূপী হওয়ার একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। কাদিয়ানীরা প্রতারণা মূলক ভাবে যে সমস্ত বিষয়কে তার সাথে সম্পৃক্ত করেছে, তার অপর একটি উদাহরণ হল: তাদের উক্তি ‘‘উস্তাদ মুহাম্মদ ফয়জী, জনাবের (গোলাম) অন্যতম বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। জনাব তার মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। জনাবের এ ভবিষ্যদ্বাণী ‘মাওয়াহিবুর রহমান নামক তার পুস্তকে বিদ্যমান আছে। (আহমদিয়া পকেট বুক।) এটা জঘন্য মিথ্যা ও সুস্পষ্ট প্রতারণা। কেননা, যারা কাদিয়ানী মতবাদের সহিত সম্পৃক্ত তাদের সবাইকে আমরা মাওয়াহিবুর রহমানের প্রথম সংস্করণ থেকে এ ভবিষ্যদ্বাণীটিকে প্রমাণ করতে চ্যালেঞ্জ করেছি। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অদ্যাবধি কেহ জন্ম গ্রহণ করেনি। এমনি ভাবে আরো অনেক উদাহরণ আছে। কোন ঘটনা ঘটলেই গোলাম আহমদ বলত, আমি এটা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই এ সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছি। তার এ পদ্ধতিতে কাদিয়ানীরা তার মৃত্যুর পর তার সাথে এমন সব বিষয় সম্পৃক্ত করে যা সে আদৌ বলেনি বা কখনও তার কল্পনাতে আসেনি।
দ্বিতীয় প্রকার ভবিষ্যদ্বাণীর উদাহরণ সমূহ অর্থাৎ এমন ঘটনাবলীর সংবাদ দেওয়া যার উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রয়োগ হয় না, তাও অনেক। এখানে আমরা এর কিছুটা বর্ণনা পেশ করব। গোলাম আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করল- ‘আমার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে ‘দুই’ নামক এক ব্যক্তি সে আমার সাথে মোবাহালা (পারস্পরিক লা’নত করা) করুক বা নাই করুক সে মারা যাবে। (খাদেম কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক ৩৮৪ পৃ:) অনন্তর কাদিয়ানীরা বলে ‘প্রকৃত পক্ষে ‘দুই’ গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মৃত্যু বরণ করেছে। (উল্লেখিত কিতাব) এটা ও কি একটা ভবিষ্যদ্বাণী? যদি এটা ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে থাকে তা হলে প্রত্যেকের পক্ষে এ জাতীয় ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। কেননা, গোলাম আহমদ এ ব্যক্তির মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করেনি, বরং সে শুধু এ কথা বলেছে দুই মৃত্যুবরণ করবে। কেহ কি চিরকাল বেঁচে থাকবে? ‘‘এ পৃথিবীতে যারাই আছেন সকলই ধ্বংস প্রাপ্ত হবেন এবং একমত আপনার প্রভু যিনি মহান ও মহত্ত্বের অধিকারী তিনিই অবশিষ্ট থাকবেন’’। [২ সুরা আর রহমান ২৬ -২৭]
প্রত্যেকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। [১ সুরা আলে ইমরান ১৮৬ এবং সুরা আল- আম্বিয়া-৩৫]
চাই গোলাম আহমদ বলুক আর নাই বলুক। কাদিয়ানীরা কি এ ধারণা পোষণ করে যে, যদি গোলাম আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী না করত তবে দুই কখনও মৃত্যু বরণ করত না? অন্যথায় আর কি হতে পারে? যার সামান্যতম বুদ্ধি আছে, তার পক্ষে একথা বলা সম্ভব নহে যে এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী। গোলাম আহমদ নিজেই একথা স্বীকার করে আসছে ‘যে বিষয়ে অস্বাভাবিক কিছু নেই তা ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে না’। (গোলামের তিরিয়াকুল কুলুব ১১৫১ পৃ:) তবে ,দুই এর মৃত্যুর মধ্যে অস্বাভাবিক কি আছে? যে কেহই জন্ম গ্রহণ করবে সে মৃত্যুবরণ করবে। গোলাম আহমদ মরেছে, তার সাথীগণ তার প্রথম খলীফা দ্বিতীয় খলিফা, তার ছেলে পেলে, তার বন্ধু বান্ধব, তার স্ত্রী-গণ ও আত্মীয় স্বজন সকলই মৃত্যুবরণ করেছে। হ্যাঁ, যদি ভবিষ্যদ্বাণীতে তার মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ থাকত তা হলে তা যুক্তি সংগত হত, গোলাম আহমদের অধিকাংশ ভবিষ্যদ্বাণী এ পর্যায়েরু অমুক মৃত্যুবরণ করেছে, কেননা, আমি বলেছিলাম যে সে মৃত্যুবরণ করবে। এই প্রকার ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় উদাহরণ হল: তারা যাকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করে যে, গোলাম আহমদ ভূমিকম্প ও প্লেগ দেখা দেওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। এ দুটি ব্যাপক আকারে সংঘটিত হয়েছে। আমরা তার মূল বক্তব্য ও উহা বাতিল হওয়ার কথা উল্লেখ করার পূর্বে এদিকে ইঙ্গিত করা সমীচীন মনে করছি যে, ভূমিকম্প ও প্লেগের সংবাদ প্রদানকে ভবিষ্যদ্বণী বলা যায় না এবং এর উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞাও প্রযোজ্য হয় না। এমন কি, গোলাম আহমদের নিকটেও নহে। যেমন, আমরা প্রথম প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। আমরা গোলাম আহমদের আরো কিছু স্পষ্ট বক্তব্য বর্ণনা করব, যা পূর্বে উল্লেখ করিনি। ভন্ডনবী কাদিয়ানী ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের উল্লেখ করে বলে: আমি সমস্ত বিষয়ের ভবিষ্যদাণী করেছি, তা আল্লাহর কুদরত ও তার ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বিগ্রহ ও বিপদাপদ সম্পর্কে জ্যোতিষীদের সংবাদ প্রদানের মত আমার ভবিষ্যদ্বাণী নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ ২৫৫ পৃ:) সে লিখেছে: ভবিষ্যদ্বাণী সমূহের উদ্দেশ্য হল দলীল প্রমাণের মুখাপেক্ষী থাকে তবে এ ভবিষ্যদ্বাণীর ফল কি? এ জন্যই ভবিষ্যদ্বাণীর স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হওয়া উচিত, যাতে বিশ্ববাসী সরাসরি তা চাক্ষুষ দেখতে পায়। (গোলামের তুহফায়ে কুলরা ১২১ ও ১২২ পৃ:) সে আরো বলেছে- ‘ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি এভাবে দৃষ্টিপাত করতে হবে যে এতে কি এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু আছে যা মানুষের নাগালের বাহিরে অথবা এতে কি এমন কিছু আছে যার সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যা বা ভূতথ্যবিদ্যার সাহায্যে সংবাদ দিতে পারে? প্রথমটি হবে ভবিষ্যদ্বাণী এবং দ্বিতীয়টি হবে বিজ্ঞান।’’ (গোলামের ‘তিরিয়াকুল কুলুব’ ১৫৫ পৃ:) ইঞ্জিলের মধ্যে হজরত ঈসা আঃ. এর সম্পর্কে সংবাদ দেওয়ার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সে বলে, ভূমিকম্প. যুদ্ধ বিগ্রহ মৃত্যু এবং দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে সংবাদ দেওয়াকে ভবিষ্যদ্বাণী বলা যায় না, (গোলামের এজালাতুল আওহাম, ৭ম পৃ:) তার প্রথম খলীফা ও কাদিয়ানীদের বিশিষ্ট নেতা নূরুদ্দীন লিখেছে যে দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, বিপদাপদ প্রভৃতি প্রাকৃতিক বস্ত্ত, এগুলো সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময় করে সংবাদ না দিলে তাকে ভবিষ্যদ্বাণী বলা যায় না।’ নূরুদ্দীনের ‘ফসলুল খেতাব’ প্রবন্ধের প্রারম্ভে গোলামের যে ভবিষ্যদ্বাণীর কথা আমরা উল্লেখ করছিলাম, পুনরায় উহা উল্লেখ করছি, যাতে আমরা উহাকে আলোচকের বুঝার সুবিধার্থে এই বক্তব্যের সাথে মিলিত করতে পারি। ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী মহান আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম কে বিদ্রূপ করে বলেছে, এই নিঃসহায় ব্যক্তি ঈসার আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণী কি ছিল? ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হবে...। জানি না, এ সমস্ত বিষয়ের সংবাদ দেওয়াকে ভবিষ্যদ্বাণী ও অদৃশ্যের সংবাদ কেন নামকরণ করা হল! আদি হতে কি ভূমিকম্প সংঘটিত হয় নি? পূর্ব থেকেই কি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় নি? বিশ্বের কোন না কোন অঞ্চলে কি অহরহ যুদ্ধ চলছে না? তবে এ নির্বোধ ইসরাঈলী ব্যক্তি ঈসা আলাইহিস সালাম (নাউজুবিল্লাহ) কেন এ বিষয়গুলোর সংবাদ দেওয়াকে ভবিষ্যদ্বাণী নাম দিয়েছে। (গোলামের আঞ্জামে আথম’ এর টীকা, ৪পৃঃ) এসব সত্ত্বেও জানি না কাদিয়ানীরা কোন সাহসে এ উক্তি করে যে, গোলাম আহমদ তার পুস্তক ‘হাকীকতুল ওহী’ ২২০ পৃষ্ঠায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এবং বাস্তবিকই তার ভবিষ্যদানি অনুসারে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে।’ তারা আরো বলে- ‘তিনি তার পুস্তক সিররুল খেলাফতের ৬২ পৃষ্ঠায় তার বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার বদ-দোয়া করেছিলেন এবং বাস্তবিকই তা সংঘটিত হয়েছে।’ (আহমদিয়া পকেট বুক)
এর চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, উপরোল্লিখিত কথাগুলো বলার পর গোলাম আহমদ নিজে কীভাবে এটা বলার দুঃসাহস করে- ‘‘আল্লাহ আমাকে অবহিত করেছেন যে, কিয়ামত সাদৃশ্য একটি কঠিন ভূমিকম্প সংঘটিত হবে....। এ ভবিষ্যদ্বাণীর পর সতর্কতা অবলম্বন করা এবং একে ভয় করা উচিত। এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে আমি ঘরে বসবাস ছেড়ে দিয়েছি এবং তাবু ক্রয় করেছি। আমি উহাতে বসবাস করছি এবং হাজার টাকার মত তাতে ব্যায় করেছি। যে ব্যক্তি এ ভবিষ্যদ্বাণী সংঘটিত হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস রাখে সে ছাড়া আর কে এমন কাজ করবে এবং এ পরিমাণ টাকা ব্যায় করবে?’’ (গোলাম আহমদের ১৯০৫ খৃ: ১১ই মে তারিখে ঘোষিত ভবিষ্যদ্বাণীর উপর প্রযোজ্য? এ ভবিষ্যদ্বাণী এবং ইতিপূর্বে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী কি হুবহু ঈসার আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণীর মত নহে? অতএব সে স্বয়ং যা করেছে, অনুরূপ আক্রমণ করল কেন? তার এ উক্তিটি অসত্য মিথ্যাবাদীর কথা পরস্পর বিরোধী হওয়া থেকে মুক্ত হতে পারে না।’’ (গোলামের ‘বারাহীনে আহমদিয়ার’ পরিশিষ্ট ৫ম খন্ড ১১২ পৃ:।) সারকথা, এসব সংবাদের উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না এবং এগুলোকে ভবিষ্যদ্বাণী নাম দেওয়া মুর্খতা ও প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নহে। এ সত্ত্বেও আমরা এ সকল সংবাদের আরো কিছু বিষয়াদির আলোচনা করব। প্রথমত: আমরা পেলগের সংবাদটি উল্লেখ করছি। কাদিয়ানীরা বলে-গোলাম আহমদ তার হাকীকাতুল ওহী নামক পুস্তকে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। বাস্তবে তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে প্লেগ দেখা দিয়েছে। ( আহমদিয়া পকেট বুক )
আমরা বলি গোলাম আহমদ প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে আদৌ এ সংবাদ দেয়নি, বরং দেশের কোন কোন অঞ্চলে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার পর এ সংবাদ দিয়েছে। সে নিজেও তা স্বীকার করেছে-‘‘ আমার নবুওয়তের একটি নিদর্শন হল-, আমি পাঞ্জাবে ( জেলা ) প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছি, অথচ তখন পাঞ্জাবের একটি এলাকা ছাড়া আর কোথাও প্লেগ বিদ্যমান ছিল না...। বর্তমানে পাঞ্জাবের সকল এলাকায়ই প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে।(গোলাম আহমদের হাকীকাতুল ওহী ২২০ পৃ ) সে আরও বলছে: আমি প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার সংবাদ দিয়েছি যখন পাঞ্জাবের দুটি এলাকা ছাড়া আর কোথাও প্লেগ বিদ্যমান ছিল না। (মালফুজাতে আহমদিয়া ৬ষ্ঠ খন্ড) । এ ব্যাপারটি বুঝতে সামান্যতম চিন্তারও প্রয়োজন হয় না । কেননা , প্লেগ এবং অনুরূপ মহামারী আকারের রোগ সমূহ (আল্লাহ এরূপ না করুন)
যখন কোন এলাকায় দেখা দেয় তখন উহা স্বভাবত: আশে পাশের এলাকা সমূহে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীতে নতুনত্ব কি আছে?
দ্বিতীয় বিষয় হল, ভন্ড নবী গোলাম আহমদ দাবি করত- ‘যখন রোগ ছড়িয়ে পড়বে, তখন তার বসতভূমি কাদিয়ানে প্রবেশ করবে না। অথচ প্লেগ শুধু কাদিয়ানেই ছড়িয়ে পড়েনি বরং উহা ঐ বাড়িতেও প্রবেশ করেছে যার সম্পর্কে সে বলত- উহা নূহের আলাইহিস সালাম নৌকার মত।
আমরা তা পূর্বে সূত্র সমূহের দৃঢ় প্রমাণাদি সহ উল্লেখ করেছি।
তৃতীয় বিষয়টি হল, ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলেছে, ‘আমি বিরুদ্ধবাদীদের জন্য বদ দোয়া করেছি, যাতে তাদের মধ্যে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।’ (গোলামের ছিররুল খিলাফত, ৬২ পৃ:) এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যারা কাদিয়ানী ধর্ম গ্রহণ করবে না এবং গোলাম আহমদের বিরোধিতা করবে প্লেগ শুধু তাদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়বে। অন্যত্র সে এর বিশ্লেষণ করে বলেছে: ‘প্লেগ রোগের শাস্তি শুধু অত্যাচারী ও অপরাধীদের জন্য হয়।’ (গোলামের ‘তাফসীরে খাজিনাতুল ইরফান, ১ম খন্ড ১৩১ পৃ:)
কিন্তু ঘটল কি? এ প্লেগ রোগে অনেক কাদিয়ানী তা স্বীকার করেছে। সে বলেছে: ‘‘আমাদের জামাতের কোন কোন লোক প্লেগ রোগে মারা গিয়েছে।’’ (গোলামের ‘হাকীকতুল ওহী’ ১৩১ পৃ:) শুধু তাই নয়, বরং এই জনাব নিজেও এত ভীত ছিল ‘মাসীহে মাওউদ মহামারির সময়ে এতই সতর্ক ছিলেন যে, যদি বাহির থেকে তার নিকট কোন পত্র আসত এবং তিনি তা স্পর্শ করতেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তার দু’হাত ধুয়ে নিতেন।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল-ফজল’ ১৯৩৭ সনের ২৮ শে মে তারিখে প্রকাশিত।) তিনি বকরীর গোস্ত ভক্ষণ ছেড়ে দিয়েছিলেন, কেননা, তিনি বলতেন এতে প্লেগের জীবাণু আছে। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদের সীরাতে মাহদী ১ম খন্ড ৩৮ পৃ:) কাদিয়ানীদের মধ্যে প্লেগের কঠোরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তিনি আল্লাহর কাছে এই বলে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন- হে আল্লাহ! আমাদের জামাত থেকে এ মহামারী সরিয়ে দিন।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা বদর ৪ঠা মে ১৯০৫ খৃ:)
এই হল প্লেগ সংক্রান্ত সংবাদের বাস্তব রূপ, যা কাদিয়ানীরা লোকজনকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ভূমিকম্প সম্পর্কে তার সংবাদের বিবরণ হল নিম্নরূপ: ১৯০৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল তারিখে ভারত বর্ষে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যা জমি উল্টে দিয়েছিল এবং লোকজনকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বসতবাড়িও দালান কোঠা বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। এবং জান মালের অসংখ্য ও অপরিসীম ক্ষতিসাধন হয়েছিল। এ ভূমিকম্প ‘কাংগুরা ভূমিকম্প’ নামে পরিচিত। [১ কাংগুরা ভারতের একটি শহর। এখানে উল্লেখিত ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল। তাই উহার নামানুসারে এ ভূমিকম্পকে ‘কাংগুরা ভূমিকম্প’ বলে।]
অতএব, ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী কাদিয়ানী এ ভূমিকম্পকে তার ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য সুযোগ রূপে গ্রহণ করতে চাইল। কেননা, স্বভাবতই ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর অপরাপর ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে। তাই সে এ ভূমিকম্পের চারদিন পর ১৯০৫ সালের ৮ই এপ্রিল তারিখে ঘোষণা দিল- ‘আজ রাত তিন ঘটিকার সময় আমার কাছে ওহী এসেছে যে, কিয়ামতের ন্যায় একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হবে। আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তার নূতন নিদর্শন প্রকাশ করবেন........। এ ভূমিকম্প কখন সংঘটিত হবে? কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ অথবা কয়েক মাস বা কয়েক বৎসর পর হবে তা আমি সঠিকভাবে জানি না’। (গোলামের সতর্ক বাণী, ৮ই এপ্রিল ১৯০৫ সাল, যা ‘তাবলীগে রেসালাতের’ ১০ম খন্ড ৮০ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত।) এটা গোলাম আহমদের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়া সম্পর্কে প্রথম সংবাদ ছিল। সতর্ক বাণীর সাতদিন পর ১৯০৫ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে দ্বিতীয় সতর্ক বাণী প্রচার করে। তাতে আছে ‘‘অল্প কয়েকদিন পর একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প সংঘটিত হবে যা পৃথিবী উল্টিয়ে দেবে এবং জনপদ সমূহকে ধ্বংস করে দেবে, আর মানুষ, গাছ পালা ও পাথর বিনষ্ট করে দেবে। এটা অল্পক্ষণ চলবে, কিন্তু পৃথিবীর গতি পরিবর্তন করে দেবে। এমনকি জিন ও পক্ষীকুলের উপরও ইহার প্রভাব পড়বে’। (গোলামের ‘নুসরতুল হক’ যা ১৯০৫ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে লিখিত ১৩০ পৃ:) অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু কথিত ভূমিকম্প আর হল না। লোকজন তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল যে, কখন উহা সংঘটিত হবে? কেননা আপনার সকল ভবিষ্যদ্বাণী ব্যাপক, যার কোন সময় সীমা নেই! সে ইঙ্গিতে উত্তর দিল যে, ইহা অতি নিকটে। আল্লাহ তাআলা আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, কিয়ামত সাদৃশ্য একটি ভয়ংকর ভূমিকম্প সংঘটিত হবে...। এ ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে আমি ঘরে বসবাস ছেড়ে দিয়েছি এবং তাবু ক্রয় করে উহাতে বসবাস আরম্ভ করেছি। (গোলামের ভবিষ্যদ্বাণী যা ১৯০৫ সালের ১১ই মে তারিখে ঘোষিত এবং ‘তবলীগে রেসালাতের ১০ম খন্ড ৯৬ ও ৯৭ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত।) এ দিন গুলোও অতিবাহিত হল অথচ তার অনুমান ও ধারণা অনুযায়ী ভূমিকম্প সংঘটিত হল না। তার উপর কঠোরভাবে আপত্তি সমূহ উত্থাপিত হতে লাগল। এমনকি, সে ২২শে মে তারিখে আশ্চর্য ধরনের একটি ঘোষণা দিয়ে বলল: আল্লাহর ওহীতে উল্লেখিত ভূমিকম্পের অর্থ বাস্তব ভূমিকম্প হওয়া জরুরি নহে। বরং ভূমিকম্পের অর্থ কঠিন বিপদাপদও হতে পারে। যা হোক, আমার ধারণা যে, ভূমিকম্প তার প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এ জন্যেই আমি ঘর ছেড়ে তাবুতে বসবাস করছি। আমার নিকট আরও ইলহাম হয়েছে যে, ভূমিকম্প বসন্তকালে সংঘটিত হবে। (১৯০৫ সালের ২২ শে মে তারিখে গোলাম আহমদের ঘোষণা যা কাদিয়ানী ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিওন্সের’ ৪থ খন্ডের ৩৪৪ পৃ: সন্নিবেশিত।) পুনরায় সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হল। বসন্তকাল আসল ও চলে গেল কিন্তু ভূমিকম্প সংঘটিত হল না, কিয়ামত সাদৃশ্য ভূমিকম্পও হল না, যার প্রভাব জ্বীন ও পক্ষীকুলের উপর পড়বে তার কোনটাই হল না। তারপরও সে চুপ থাকেনি, বরং লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলল: যে ভূমিকম্প সম্পর্কে আমি সংবাদ দিয়েছি তা আমার দেশে এবং আমার জীবদ্দশায় সংঘটিত অপরিহার্য। যতই তা পিছিয়ে যাক্ না কেন ষোলো বছরের অধিক পিছিয়ে যাবে না। আমার জীবদ্দশায়ই তা সংঘটিত হওয়া অনিবার্য। (গোলামের ‘নুসরতে হক্বের’ পরিশিষ্টের টিকা, ৯৮ পৃ:।)
এরপর কি ঘটল? ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী মৃত্যু বরণ করল, কিন্তু ভূমিকম্প সংঘটিত হল না। কাদিয়ানীরা বাধ্য হয়ে স্বীকার করল যে, এ ভূমিকম্প গোলাম আহমদের জীবদ্দশায় সংঘটিত হয়নি। এদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি হল গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ। সে স্বীকার করেছে- ‘জনাব এ ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন’। (মাহমুদ আহমদের ‘দাওয়াতুল আমীর’ ২৩১ পৃ:।) এখন কোন শহরেই ভূমিকম্প হলে কাদিয়ানীরা বলে- এটা গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে হচ্ছে। তাদেরকে একথা জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, তোমরা কীভাবে তা বলছ? অথচ তোমাদের ইমাম ও তোমাদের মিথ্যুক নবী স্পষ্ট করে বিস্তারিতভাবে বলে গেছে যে, এ ভূমিকম্প তার জীবদ্দশায় তার দেশেই সংঘটিত হবে। গোলাম আহমদের ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্বে কি পৃথিবীতে ভূমিকম্প সংঘটিত হত না? আমি মনে করি, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন উক্তি করবে না। ১৯০৫ সালের ৫ই মে এর ভূমিকম্প সম্পর্কে গোলাম আহমদ দাবি করেনি যে, সে এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে এবং তার ভক্তদের মধ্যে কেহ এ কথা প্রমাণ করতে পারবে না যে, সে এটা সংঘটিত হওয়ার সংবাদ দিয়েছে।
এই হল ঐ সমস্ত সংবাদের বাস্তব রূপ যার জন্য কাদিয়ানীরা ঢাক-ঢোল পিটায়। যদিও এটা সত্য ও বাস্তবায়িত হত, তবুও ইহাতে গোলাম আহমদের নবী, ইলহাম ও ওহী প্রাপ্ত হওয়ার দাবির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ হতে পারে না।
প্রথমত: এ জন্য যে, ভূমিকম্প ও বিপদাপদের সংবাদ দেওয়ার উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় না, যেমন পূর্বে এর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: কোন কোন সংবাদ সত্য হওয়া এবং কোনটি মিথ্যা হওয়া একথা বুঝায় না যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কেননা, যদি ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে হত তবে কোন একটিরও ব্যতিক্রম হওয়া সম্ভব হত না। এ জন্যেইতো গোলাম আহমদ স্বয়ং বলেছে- ‘যদি সমুদয় ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন না হয় তবে একটিরও বাস্তবায়ন বিশ্বাস যোগ্য নয়। (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়া’ ২১ পৃ:।)
সাধারণত: এটা দৃষ্টিগোচর হয় যে, কোন একটা সাধারণ লোক কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার কারণে তাকে নবী বা আল্লাহর ওলী বলা যায় না। এ কথাই ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী বলেছে:- ‘কোন কোন ফাসেক, ফাজের, ব্যভিচারী, চোর, হারাম মাল ভক্ষণকারী, আল্লাহর নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ কারী এমনও আছে যে, কোন কোন সময় তারা সত্য স্বপ্ন দেখে’। (গোলামের ‘হাকীকতে ওহী’ ২য় পৃ:।) সে আরো বলেছে- ‘আরবে অধিক পরিমাণে যে সকল গণক ছিল তারা শয়তানের নিকট হতে ইলহাম প্রাপ্ত হত। যেভাবে তাদের কোন কোন ভবিষ্যদ্বাণীও সত্য হয়ে যেত’। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘জহরতুল ইমাম’ ১৭ পৃ:।)
আমরা কাদিয়ানীদের পুস্তকাদি থেকে তাদেরই ভাষায় স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা সাব্যস্ত করেছি যে, যে সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভবিষ্যদ্বাণীর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয়, তার একটিও বাস্তবায়িত ও সত্য প্রমাণিত হয় নি। এমনকি যেটির উপর সংজ্ঞা প্রযোজ্য হয় নি তাও সত্য প্রমাণিত হয় নি। এটা মিথ্যাবাদী ও অপবাদ রটনাকারীর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি স্বরূপ। কাদিয়ানীরা তাদের পথভ্রষ্টতার মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘোর-পাক খাচ্ছে। কেহ কেহ জেনে শুনে এবং সত্যকে গোপন করে আর কেহ কেহ অজ্ঞতা বশত: এবং বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত না থাকার কারণে। এই হল বাস্তব ও প্রকৃত অবস্থা। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এই যে, তাদেরকে যেন তিনি সত্যকে সত্যরূপে দেখিয়ে দেন এবং তা অনুসরণ করার তওফিক দেন; আর, বাতিলকে বাতিলরূপে দেখিয়ে দেন এবং তা বর্জন করার তাওফিক দান করেন। তিনিই হলেন সর্বোত্তম বন্ধু ও সর্বোত্তম সাহায্যকারী।
কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করে যে, শেষ জামানায় যে মাসীহের আগমনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তিনি হলেন গোলাম আহমদ কাদিয়ানী এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংবাদ অনুযায়ী প্রেরিত হয়েছেন। কাজেই সাধারণভাবে সকল মানবজাতি, বিশেষ করে মুসলমানদের কর্তব্য হল তার অনুসরণ করা এবং তার প্রতি বিশ্বাস রাখা। এখন আমাদের দেখা উচিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংবাদ অনুযায়ী কে আসল এবং তার দাবিই বা কি? ভন্ডনবী কাদিয়ানী বলে:- ‘‘আমি ঐ আল্লাহর শপথ করছি যিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন এবং ঐ আল্লাহর শপথ যার উপর অভিশপ্তগণ ব্যতীত আর কেহই অপবাদ রটায় না; তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন এবং আমাকে প্রতিশ্রুত মাসীহ বানিয়েছেন।’’ (গোলামের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালাত এ সন্নিবেশিত, বইটি গোলামের ঘোষণা বলীর সমষ্টি, ১০ম খন্ড, ১৮ পৃ:।) সে বলে: ‘আমার দাবি হল, আমি ঐ প্রতিশ্রুত মাসীহ যার সম্পর্কে সমুদয় আসমানি কিতাবে সংবাদ দেওয়া হয়েছে য, তিনি শেষ জামানায় আত্মপ্রকাশ করবেন।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ‘তুহফায়ে কলরা’ ১৯৫ পৃ:।) সে আরো বলে: ‘বড় বড় ওলীগণের কাশফ এ কথার উপর একমত যে, মাসীহ চতুর্দশ শতাব্দীর পূর্বে অথবা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আত্মপ্রকাশ করবেন। এ সময় অতিক্রান্ত হবে না। (এ কথাটি কে বলেছে? এবং কোথায় বলেছে?) এটা স্পষ্ট কথা যে, চতুর্দশ শতাব্দীতে আমি ব্যতীত আর কেহই এ পদের জন্য ঘোষণা দেয়নি। (আমি বলব: হ্যাঁ এ জন্যই কেহ এ ঘোষণা দেয়নি যে, সব লোক এমন নহে যে দোজখের অগ্নিতে প্রবেশ করার জন্য এ সমস্ত অপবাদ রটানোর দুঃসাহস করতে পারে।) এ জন্য আমিই প্রতিশ্রুত মাসীহ।’’ তার দাবির উপর এটা আশ্চর্য ধরনের প্রমাণ। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘এজালাতুল আওহাম’’ ৬৮৫ পৃ:) কিন্তু পরে সে নিজেই এ দাবি এই বলে প্রত্যাহার করে নেয় ‘আমি এ দাবি করেছি যে, আমি মাসীহ সমতুল্য, অবিকল প্রতিশ্রুত মাসীহ নই। কোন কোন বোকা ধারণা করেছে....। আমি কখনও এ দাবি করিনি যে, আমি মরিয়ম পুত্র মাসীহ। বরং যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে এ কথা বলবে, সে অপবাদ রটনাকারী মিথ্যাবাদী। আমার দাবি হল, আমি মাসীহ সমতুল্য। অর্থাৎ আমার মধ্যে ঈসার আলাইহিস সালাম কোন কোন আধ্যাত্মিক গুণাবলি, স্বভাব ও চরিত্রে সংরক্ষিত করেছেন। (এজালাতুল আওহাম, ২৯৬ পৃ:) পুনরায় সে বলে: ‘আমি এ দা করিনি যে, আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ এবং আমার পরে কোন মাসীহ আসবেন না’ বরং আমি বিশ্বাস করি এবং একথা বার বার বলছি যে, আমার পরে এক মাসীহ নহে বরং হাজার হাজার মাসীহের আগমন ঘটতে পারে। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ২৯৬ পৃ:) অর্থাৎ আমাকে এখন মেনে নাও এবং অন্য কোন ব্যক্তি যদি এ দাবিকরে যে, সে প্রতিশ্রুত মাসীহ, তবে তাকেও মেনে নাও’’। এই হল কাদিয়ানীদের মাসীহ যে মিথ্যাবাদীদের স্বভাব অনুযায়ী তার দাবির মধ্যে অন্ধ উটের ন্যায় দিশেহারা হয়ে বিচরণ করছে। এ ধরনের দিশেহারা আচরণ ও পদস্খলন দ্বারা কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্য হল সরলমনা লোকজনকে যাদের অধিকাংশ মুসলমান, ঈসা আলাইহিস সালাম এর অবতরণ সম্পর্কে তাদের আকীদা বিশ্বাসের সুযোগ গ্রহণ করে প্রতারিত করা। গোলাম আহমদ এমন ব্যক্তি যার অন্তঃসারশূন্য সস্তা দাবিদাওয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকেও সে অনেক নীচে। তার পরস্পর বিরোধী উক্তিসমূহ তার দাবিদাওয়াকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য যথেষ্ট। এ সত্ত্বেও আমরা এ ব্যাপারে তার আনুমানিক, মিথ্যা প্রলাপ ও অমূলক উক্তি সমূহের উল্লেখ করে একটা জ্ঞান সম্মত আলোচনা করতে চাই। যাতে, আমরা প্রত্যেক সন্দেহ পোষণকারী ও সুযোগ সন্ধানী অপেক্ষমাণের মূলোৎপাটন করতে পারি। এতে সন্দেহ নেই যে, মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশ্রুত মাসীহের আগমনের সংবাদ দিয়েছেন এবং তাঁর গুণাবলি ও ব্যক্তিত্বকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছেন। যাতে শয়তান তার অনুসারীদেরকে নিয়ে খেলা করতে না পারে। আবু হুরায়রা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: ‘ঐ আল্লাহর শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! অচিরেই মরিয়ম পুত্র ন্যায় বিচারক শাসকরূপে তোমাদের মধ্যে অবতরণ করবেন, যুদ্ধ রহিত করবেন এবং ধন সম্পদ এত অধিক হবে যে কেহই তা গ্রহণ করবে না। এমন কি তখন একটি মাত্র সেজদা পৃথিবী ও উহাতে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম হবে’। [১ বুখারী ও মুসলিম]
নওয়াস ইবনে সাম’আন রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দাজ্জাল বের হওয়া সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মরিয়ম পুত্র মাসীহকে যখন আল্লাহ তাআলা পাঠাবেন, তখন তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তের সাদা মিনারার নিকট দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে এবং দু’জন ফেরেস্তার ডানার উপর হাত দু’টি রেখে অবতরণ করবেন। যখন মাথা ওঠাবেন তখন উহা থেকে মুক্তা ঝরবে। কোন কাফের তাঁর নিশ্বাসের গন্ধ পেলেই মৃত্যুবরণ করবে। তাঁর দুষ্টি যত দুর পর্যন্ত যায় তত দূর পর্যন্ত তার নিশ্বাসও পৌঁছাবে। তার পর দাজ্জালকে ধাওয়া করে ‘লুদ’ নামক প্রবেশ দ্বারে হত্যা করবেন। [২ মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, ইবনে মাযা, আহমদ ও হাকিম। তবে শব্দাবলী মুসলিমের।] (হাদীসের শেষ পর্যন্ত বর্ণিত)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘ঐ আল্লাহর কসম যার হাতে আমার প্রাণ, ইবনে মরিয়ম ‘রাওহা’ নামক স্থানের পথিমধ্যে হজ অথবা ওমরা কিংবা উভয়টির অবস্থায় নব চন্দ্রের ন্যায় আবির্ভূত হবেন। [৩ মুসলিম]
অন্য রেওয়ায়েতে আছে যে, মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন..... এবং রাওহা নামক [মদিনা হতে সত্তর কিলোমিটার দুরে মক্কার পথে একটি মাঠের নাম।] স্থানে মঞ্জিল করবেন। তারপর সেখান থেকে হজ বা ওমরা অথবা উভয়টি করবেন। [১ মসনদে আহমদ] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম এর অধিকতর নিকটবর্তী। কারণ, তাঁর ও আমার মাঝখানে আর কোন নবী নেই এবং অবশ্যই তিনি অবতরণ করবেন। যখন তোমরা তাঁকে এ সকল লক্ষণ দ্বারা চিনে নিবে; তিনি মধ্যম অবয়ব বিশিষ্ট ও লাল মিশ্রিত সাদা রঙ্গের হবেন। তাঁর মাথা থেকে যেন ফোটা ফোটা হয়ে পানি পড়বে, যদিও তাতে পানি লাগেনি। তিনি ক্রুশ চূর্ণ-বিচূর্ণ করবেন। এবং জনগণকে ইসলামের দিকে আহবান জানাবেন। তাঁর সময়েই আল্লাহ পাক মাসীহ দাজ্জালকে ধ্বংস করবেন। পৃথিবীতে নিরাপত্তা বিরাজ করবে। এমনকি উটের সহিত বাঘ, গরুর সহিত চিতাবাঘ এবং বকরীর সহিত নেকড়ে বাঘ বিচরণ করবে। শিশুরা সাপ নিয়ে খেলা করবে অথচ ওরা তাদের কোন ক্ষতি করবে না। তিনি পৃথিবীতে চল্লিশ বৎসর কাল অবস্থান করবেন। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং মুসলমানগণ তাঁর জানাজার নামাজ পড়ে তাঁকে দাফন করবেন। [২ মসনদে আহমদ ও আব দাউদ। তবে শব্দাবলী মসনদের।]
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন: মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে অবতরণ করবেন, তারপর তিনি বিবাহ করবেন এবং তার সন্তান সন্ততিও হবে। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং আমার সাথে আমার কবরেই তাঁকে দাফন করা হবে। [৩ এ হাদীসটি মিশকাতুল মাসাবীহের গ্রন্থকার ইবনে জাওযীর ‘আল ওফা’ কিতারে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন। হায়ছামীর ‘মাজমাউয জাওয়াইদ’ পুস্তকে অনুরূপ বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি কাদিয়ানীদের মতেও বিশুদাধ পরে এর বর্ণনা আসবে।] এ ছাড়া আরো অনেক হাদীস এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সমস্ত হাদীসে প্রতিশ্রুত মাসীহের গুণাবলি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি কে হবেন? কোথা হতে আসবেন, কোথায় থাকবেন কেমন করে থাকবেন, তাঁর সময় কি কি সংঘটিত হবে, স্বয়ং তিনি কি করবেন, পৃথিবীতে কয়দিন অবস্থান করবেন এবং কোথায় সমাধিস্থ হবেন? এসব বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্তারিত ভাবে ব্যক্ত করে গেছেন:-
১- প্রতিশ্রুত মাসীহ মরিয়ম পুত্র হবেন, অন্য কেহ নহে এবং অন্য কারো পুত্র নহে। আর, তাঁর অনুরূপ ও কেহ নহে।
২- তিনি আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবেন, অর্থাৎ তিনি শুধু প্রেরিতই হবেন না, বরং তাঁর জন্য প্রেরিত ও অবতীর্ণ হওয়া আবশ্যকীয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন।’ আর, এটা জানা কথা যে, অবতরণ করা প্রেরিত হওয়া নহে।
৩- তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তে সাদা মিনারের নিকট আকাশ হতে অবতরণ করবেন এবং তিনি অবতরণ কালে দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিহিত হবেন এবং দু’জন ফেরেস্তার ডানার উপর তাঁর দু’হাত রাখবেন।
৪- তাঁর অবতরণ কালে প্রত্যেক কাফের মৃত্যু বরণ করবে।
৫- তিনি ন্যায় পরায়ণ শাসক হবেন। শাসিত কিংবা অত্যাচারী শাসক হবেন না।
৬- তিনি ক্রস ভেঙে দেবেন। যাতে এরপর তার এবাদত না করা হয়।
৭- শুকর নিধন ও নিঃশেষ করার নির্দেশ দেবেন। এমনকি, তারপর এটা আর ভক্ষণ করা হবে না।
৮- সকল লোক দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে নিবে। এমনকি দ্বীন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন থাকবে না, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়।
৯- ‘লুদ’ নামক প্রবেশ দ্বারে দাজ্জালকে তিনি হত্যা করবেন।
১০- তাঁর যুগে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য হবে, এমনকি জনগণের কাছে ভিক্ষা করার মত কোন ভিক্ষুক থাকবে না। কারণ, তাঁর যুগে অধিক পরিমাণে বরকত ও কল্যাণ অবতীর্ণ হবে।
১১- তাঁর যুগে লোকজন আল্লাহর এবাদতের প্রতি উৎসাহিত হবে এবং প্রত্যেক উৎকৃষ্ট ও আকর্ষণীয় বস্ত্তর উপর উহাকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেবে।
১২- পৃথিবীতে নিরাপত্তা স্থাপিত হবে। এমনকি বাঘ উটের সাথে, গরু চিতাবাঘের সাথে এবং নেকড়ে বাঘ ছাগলের সাথে মাঠে বিচরণ করবে। ছেলে পেলে সাপ নিয়ে খেলবে এবং ওরা তাদের কোন ক্ষতি করবে না।
১৩- অবতরণের পর তিনি হজ্জে এফরাদ বা হজ্জে তামাত্তু অথবা হজ্জে ক্বেরাণ করবেন।
১৪- তিনি পৃথিবীতে চল্লিশ বৎসরকাল অবস্থান করবেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যু ঘটবে।
১৫- মুসলমানগণ তার জানাযার নামাজ পড়বে।
১৬- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মুবারকে তাঁকে দাফন করা হবে।
এই হল প্রতিশ্রুত মাসীহের কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন এবং উল্লেখিত হাদীস সমূহ থেকে আমরা উদ্ধার করেছি। এখন আমরা দুষ্টিপাত করব গোলাম আহমদের দাবির প্রতি, ‘‘সে হল প্রতিশ্রুত মাসীহ, যার সম্বন্ধে সমুদয় আসমানি কিতাবে সংবাদ দেয়া হয়েছে’’। [১ রেফারেন্স পুস্তকের নাম পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।] তার উপর কি এ সমস্ত গুণাবলি প্রযোজ্য হয়?
প্রথমত: সে মরিয়ম পুত্র নহে এবং তার নাম ও ঈসা নহে। বরং তার নাম তারই বর্ণনানুযায়ী ‘আমার নাম গোলাম আহমদ, আমার বাবার নাম গোলাম মুর-তাজা এবং আমার দাদার নাম আতা মুহাম্মদ।’ (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়া’ এর টিকা, ১৩৪ পৃ:।) কেহ যেন এ ধারণা না করেন যে তার মাতার নাম মরিয়ম। মাতার নাম ‘চেরাগ বিবি’। প্রকাশ থাকে যে, জনৈক কাদিয়ানী লেখক তার নাম এই বলে উল্লেখ করেছে. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মা সাইয়েদা আমেনার পর পৃথিবীতে অধিক মর্যাদাবান আর কোন মা নেই মাত্র একজন ব্যতীত, আর তিনি হলেন ‘চেরাগ বিবি’। যিনি পৃথিবীতে একজন মহান সন্তান গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে জন্মদান করেছেন’। (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘হায়াতুন নবী’ ১ম খন্ড, ১৪১ ও ১৪২ পৃ:।) সুতরাং তার নাম গোলাম আহমদ, তার পিতার নাম গোলাম মুরতাজা এবং তার মার নাম চেরাগ বিবি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে মরিয়মপুত্র অবতরণ করবেন’’। [২ বুখারী ও মুসলিম।] সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন: ‘আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। তারপর সে চল্লিশ দিন বা চল্লিশ মাস অথবা চল্লিশ বৎসর অবস্থান করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম কে প্রেরণ করবেন। তিনি ওরওয়া ইবন মাসউদের সাদৃশ্য হবেন। [১ মুসলিম, আহমদ, হাকিম, শব্দ মুসলিমের।] যখন এ সমস্ত সুস্পষ্ট বর্ণনাদি পাওয়া গেল তখন সে দিশে হারার মত প্রলাপ করতে থাকে, যাতে সে নিজেকে মরিয়ম পুত্র প্রমাণ করতে পারে; তা যে কোন প্রকারের নির্বুদ্ধিতা ও বোকামীর আশ্রয় নিয়ে হোক না কেন। সে লিখেছে: ‘আমাকে মরিয়ম বানান হয়েছে এবং দু’বৎসরকাল আমি মরিয়ম রয়েছি। অতঃপর আমার মধ্যে ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে, যেমন মরিয়মের মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছিল। ফলে, আমি গর্ভ-ধারণ করি। অনূর্ধ্ব দশ মাস পর আমি মরিয়ম তে রূপান্তরিত হয়ে ঈসা হয়ে যাই। এভাবে আমি মরিয়ম পুত্র হই।’ (গোলামের ‘সফিনায়ে নূহ’ ১৬ পৃ:।) সে আরো বলেছে: আল্লাহ আমাকে মরিয়ম নাম দিয়েছেন, যিনি ঈসাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সূরা তাহরীমে আল্লাহর এ উক্তিতে আমাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে: (ইমরানের কন্যা মরিয়ম যিনি তাঁর সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন, আমি তাঁর মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছি।) [২ সুরা তাহরীম, ১২।] কেননা, একমাত্র আমিই এ দাবি করেছি যে, আমি মরিয়ম এবং আমার মধ্যে ঈসার আলাইহিস সালাম এর রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে। (গোলামের ‘হাকীকতে ওহী’ এর টিকা, ৩৩৭ পৃ:।) একদা সে এর চেয়ে অধিক নির্বুদ্ধিতা ও বোকামী প্রদর্শন করে বলেছে,- ‘আমি স্বপ্নে আমাকে দেখেছি যেন আমি একজন মহিলা এবং আল্লাহ তাআলা আমার মধ্যে তাঁর পুরুষত্ব প্রকাশ করেছেন’। (ইয়ার মুহাম্মদ কাদিয়ানীর ‘রেওয়ায়েতুল গোলাম’ যা ‘দাহিয়াতুল ইসলামের’ ৩৪ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত।) অতঃপর সে এ কথার গুরুত্ব নিজেই উপলব্ধি করে মাসীহ ঈসা ইবন মরিয়ম সাজার বিভিন্ন কারণ দর্শাতে শুরু করে, যা পূর্বেকার কারণ গুলোর তুলনায় কম হাস্যকর নহে। একবার সে বলে মাসীহ ইবন মরিয়ম হওয়ার উদ্দেশ্য হল তার সাদৃশ্য এমনকি আমি জন্ম গ্রহণেও অদ্ভুত ধরনের। কেননা, যখন আমি জন্ম গ্রহণ করি। এটা মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক গর্ভে একটি সন্তানই জন্ম গ্রহণ করে থাকে। (গোলামের ‘তুহফায়ে কুলরা’ এর টিকা, ১১০ পৃ:) এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে?
আরেকবার সে এর চেয়েও অধিক আশ্চর্য জনক কথা বলেছে- ‘এ উম্মতের মাসীহ ঈসার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর তা হল এই- ‘ঈসা আলাইহিস সালাম সর্ব দিক দিয়ে বনি ইসরাঈল বংশোদ্ভূত ছিলেন না। শুধু মার দিক থেকে ইসরাঈলী ছিলেন। অনুরূপভাবে আমি হাসেমী। কেননা, আমার কোন কোন দাদী সাইয়েদ বংশোদ্ভূত। কিন্তু আমার পিতা সাইয়েদ নহেন।’ (গোলামের শিয়ালকোটের বক্তৃতা, ১৭ নম্বর।) সে আরো বলে- ‘আমি ঈসা আলাইহিস সালাম এর সহিত এই হিসেবে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, আমি কুরাইশ বংশীয় নই। কিন্তু আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়তের ধারাবাহিকতায় চৌদ্দ শতাব্দীতে প্রেরিত হয়েছি। যেমন, ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা না থাকার কারণে ইসরাঈল বংশীয় ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি মুসা আলাইহিস সালাম এর নবুয়তের ধারাবাহিকতায় তাঁর চৌদ্দ শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল হলেন। (গোলামের ‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ ৩৩পৃঃ।) এতেই কি সে ক্ষান্ত হয়েছে? না কখনও না। এতে সে ক্ষান্ত হয়নি হবেও না, বরং সে আবার বলেছে- ‘তোমরা বিশ্বাস কর যে, আমিই ঐ মরিয়ম পুত্র যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আর, আমি কোন আধ্যাত্মিক উস্তাদ পাইনি। এটাই আমার এবং মরিয়ম পুত্র ঈসার মধ্যকার সামঞ্জস্য, যিনি পিতা বিহীন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। যেমন আমি আধ্যাত্মিক পিতা বিহীন জন্ম গ্রহণ করেছি।’’ (‘এজালাতুল আওহাম’ ৬৫৯ পৃ:)
জানি না এত কিছুর পরও কাদিয়ানীরা মুসলমানদের নিকট এ আশা করতে পারে যে, তারা একে প্রতিশ্রুত মাসীহ বলে মেনে নেবে এবং তাকে বিশ্বাস করবে? হায় অসৎ সাহস! হায় স্পষ্ট অপবাদ রটনা! হায় প্রকাশ্য মিথ্যা! সে নিজেই বলেছে= ‘মিথ্যাবাদীর কথায় পরস্পর বিরোধিতা অবশ্যম্ভাবী’। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ পরিশিষ্ট, ৫ম খন্ড, ১১২পৃ)
২- সে আকাশ থেকে অবতরণ করেনি, বরং সে ভারতে পাঞ্জাবের একটি গ্রামে (কাদিয়ানে) জন্ম গ্রহণ করেছে। এই যে কাদিয়ানী পত্রিকা বলেছে- ‘কাদিয়ান মাসীহের জন্মস্থান, বাসস্থান ও সমাধিস্থান। উক্ত গ্রামে ঐ বাড়িটি এখনও রয়েছে যেখানে গোলাম আহমদ জন্ম গ্রহণ করেছে।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজল’ ১৩ ডিসেম্বর ১৯২৯ খৃ:) দেখুন, কাদিয়ানীরা আপত্তি উত্থাপন করে বলতে পারে যে, হাদীসে আকাশ শব্দের উল্লেখ নেই, বুখারীতেও নেই, মুসলিমেও নেই, বরং আকাশের শর্তারোপ তোমাদের পক্ষ হতে করা হয়েছে। আর ‘নুযুলের’ অর্থ হল প্রকাশ পাওয়া।
আমরা উত্তরে বলব: ‘আকাশ শব্দটি আমাদের পক্ষ হতে বাড়ান হয়নি, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং এ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন যা ঐ হাদীসে রয়েছে যে হাদীসটি বায়হাকী ‘কিতাবুল আসমা ওয়াছ ছিফাত’ এ আবু হুরায়রা রা. থেকে উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘‘তোমাদের অবস্থা কেমন হবে, যখন মরিয়ম পুত্র আকাশ থেকে তোমাদের মধ্যে অবতরণ করবেন এবং তোমাদের ইমাম তোমাদের থেকেই হবে।’’ অতএব ‘নুযুল’ বা অবতরণ এর অর্থ ‘যহুর’ বা প্রকাশ পাওয়া গ্রহণ করা সঠিক নহে।
তারা বলে: ‘আকাশ’ শব্দটি বায়হাকীর পক্ষ থেকে বাড়ান হয়েছে। কেননা বায়হাকী এ হাদীসকে বুখারী ও মুসলিমের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। অথচ বুখারী ও মুসলিম এ অতিরিক্ত শব্দ দ্বারা হাদীসটি উল্লেখ করেন নি। তারা আরও বলে: এ হাদীসটিকে ইমাম সুয়ূতী রা. বায়হাকী থেকে ‘আকাশ’ শব্দের উল্লেখ ব্যতিরেকে বর্ণনা করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, ইমাম সুয়ূতী ও এ শব্দটিকে হাদীসের অংশরূপে ধারণা করেন নি।
প্রথমত: আমরা বলব যে, বায়হাকীর কিতাবটি কি, তা আমাদের উপলব্ধি করা উচিত। বায়হাকী এমন একটি কিতাব যা রেওয়ায়েতের ব্যাপারে স্বয়ং সম্পূর্ণ। অর্থাৎ এতে ইমাম বায়হাকী ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি ও ইবনে মাযা প্রমুখ হাদীস বেত্তাদের মত রেওয়ায়েতকে তার সনদ সহকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত উল্লেখ করে থাকেন। ঐ সমস্ত হাদীসের কিতাবের মত নহে যাতে শুধু মতনের উল্লেখ থাকে, সনদের উল্লেখ থাকে না। যেমন মিশকাতুল মাসাবীহ, বুলুগুল মারাম প্রভৃতি কিতাবে হাদীসকে শুধু একত্রিত করা হয়েছে। এ দু’প্রকার হাদীস গ্রন্থের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, প্রথম প্রকার যখন কোন হাদীসকে কোন কিতাবের সাথে সম্পৃক্ত করে তখন তার উদ্দেশ্য শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, মূল হাদীসটি ঐ কিতাবেও বিদ্যমান আছে। দ্বিতীয়টি এর বিপরীত। কেননা, যখন এতে কোন কিতাবের সাথে কোন হাদীসকে সম্পৃক্ত করা হয় তখন ঐ হাদীসের মূল সূত্রটি বর্ণনা করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এ হিসাবে যখন বায়হাকী এ হাদীসটিকে বুখারীর সাথে সম্পৃক্ত করলেন, তাতে তার উদ্দেশ্য এই নহে যে, এ হাদীসের মূল সূত্র হল বুখারী। বরং এ কথার দিকে ইঙ্গিত করাই উদ্দেশ্য যে, মূল হাদীসটি বুখারীও উল্লেখ করেছেন। আর এটা সুস্পষ্ট। তবে, আকাশ শব্দটিকে বায়হাকীর উল্লেখ করা এবং বুখারী ও মুসলিম উল্লেখ না করা, এতে কিছু যায় আসে না। কেননা, এ সমস্ত কিতাবের প্রত্যেকটি স্বয়ং মৌলিকত্বের অধিকারী। আর, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের অতিরিক্ত বিবরণ হাদীস বেত্তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। একথা সর্বসম্মত বলে খতীব বাগদাদী উল্লেখ করেছেন। [১ ১৭তম পরিচ্ছেদ, আল-বাইছুল হাছীছ- ইবনে কাছীর।] একথা স্পষ্ট যে, আকাশ শব্দটি নুযূলের প্রতিকুল নহে; বরং সম্পূর্ণরূপে অনুকুল।
দ্বিতীয়ত: জালালুদ্দীন সুয়ূতীর (সামা) আকাশ শব্দের উল্লেখ না করে এ হাদীসের বর্ণনা করা এ ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না যে, তিনি একে বায়হাকী থেকে উদ্ধৃত করার সময় লক্ষ করেন নি। প্রকৃত পক্ষে বায়হাকী উক্ত হাদীসে ‘সামা’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন এবং তার কিতাবেও তা বিদ্যমান। অথবা তিনি হাদীসটি উদ্ধৃত করার সময় বুখারী ও মুসলিমের শুধু মতনের উপর দৃষ্টি রেখেছেন। উক্ত দুই অবস্থার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব, এর দ্বারা হাদীসে উল্লেখ নেই বলে কোন দলীল উপস্থাপন করা যাবে না। এরূপ হওয়ার দৃষ্টান্ত বহু রয়েছে, যা হাদীস গবেষকদের কাছে অজানা নহে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেই মাসীহের (আঃ) আকাশ হতে অবতরণের কথা স্বীকার করে বলেছে- ‘হাদীসে আছে যে, মাসীহ আলাইহিস সালাম দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন’। (গোলামের ‘ এজালাতুল আওহাম’ ৮১ পৃ:।) এমনিভাবে, তার কিতাব ‘তাশহীজুল আজহানে’ সে বলেছে। কাজেই পালাবার কোন উপাই নেই। কেননা, আমরা সত্যবাদী নবী আল্লাহর রাসূল থেকে প্রমাণ করেছি, তিনি মাসীহের আলাইহিস সালাম একটি গুণ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আকাশ হতে অবতরণ করবেন। যেমন আমরা ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী থেকে তার স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছি যে ঈসা আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। আর এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। এর দ্বারা গোলাম আহমদের মাসীহ হওয়ার দাবি মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যায়।
৩- এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর (মাসীহ) অবতরণ স্থলের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, তিনি হলুদ রংয়ের দু’টি চাদর পরিধান করে দুজন ফেরেস্তার ডানার উপর দু’হাত রেখে পূর্ব দামেস্কর সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন।’ আর জানা কথা যে, গোলাম আহমদ পূর্ব দামেস্কর সাদা মিনারের নিকট কখনও অবতরণ করেনি। বরং সে কাদিয়ানে জন্ম গ্রহণ করেছে। আমরা ইতিপূর্বে তা উল্লেখ করেছি। এমনকি সে তার জীবনে কখনও দামেস্ক দেখেনি। কথিত আছে, ‘যখন তোমার লজ্জা থাকবে না তখন যা ইচ্ছে তা কর’ এই হাদীসটি সে অস্বীকার করতে না পেরে এর বিকৃত ও মেকী ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করল। কখনও সে বলে: আমি মাসীহের আগমনের সম্ভাবনা রয়েছে’। (এজালাতুল আওহাম’ ৭২-৭৩ পৃ:।) সে আরো বলে: ‘আমি অপর একজন মসীহের আগমনের সম্ভাবনা অস্বীকার করি না এবং কখনও অস্বীকার করব না, যার উপর হাদীসে বর্ণিত প্রকাশ্য গুণাবলি প্রযোজ্য হয় আবার তা প্রকাশ্য অর্থে প্রযোজ্য হয় না। (হায় আক্ষেপের বিষয়।) হয়ত বা প্রকৃত পক্ষে মাসীহ দামেস্কে অবতরণ করবেন। (শেখ আব্দুল জববারের নিকট গোলামের লিখিত পত্র যা কাশেম কাদিয়ানীর লিখিত ‘তাবলীগে রেসালতের’ ২য় খন্ড ১৫৯ পৃ: সন্নিবেশিত।) অতঃপর যখন সে বুঝতে পারল যে, এতে কোন ফলোদয় হবে না। তখন সে নতুন পন্থা অবলম্বন করল। কিন্তু এটা প্রথমটি থেকে আরো নিকৃষ্ট। সে বলে- ‘সহীহ মুসলিমে যে কথার উল্লেখ রয়েছে যে, মাসীহ আলাইহিস সালাম পূর্ব দামেস্কের সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন, তা মহাক্কেক আলেমগণকে অস্থির করে তুলেছে। কিন্তু এখন আল্লাহ আমার কাছে এর অর্থ প্রকাশ করেছেন। আর তা হল- দামেস্ক দ্বারা এমন জনপদ উদ্দেশ্য করা হয়েছে যেখানে ইয়াজিদ পন্থীরা বসবাস করে, যারা আল্লাহর শত্রু এবং আল্লাহর রাসূলের শত্রু; যারা তাদের প্রবৃত্তিকে উপাস্য নির্ধারণ করেছে এবং নিজ ‘নফসে আম্মারার’ অনুসরণ করেছে। তা সত্ত্বেও এদের মধ্যেই মাসীহের অবতরণ করা অনিবার্য। আল্লাহ তা,আলা আমার কাছে এ কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন যে, দামেস্ক দ্বারা এমন একটি জনপদ উদ্দেশ্য করা হয়েছে যেখানে দামেস্কের বৈশিষ্টাবলী বিদ্যমান আছে। আর সেটা হল ঐ কাদিয়ান। আল্লাহ আমার কাছে এটা প্রকাশ করেছেন। কেননা, কাদিয়ান দামেস্কের সাথে সামঞ্জস্য রাখে এবং এতে এজিদ পন্থীরা বসবাস করে। আর একথা স্পষ্ট যে উদাহরণে পুরাপুরি সামঞ্জস্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং অনেক সময় দু’বস্ত্তর মধ্যে সামান্যতম সামঞ্জস্য থাকার কারণে এক বস্ত্তর উপর অপর বস্ত্তর নাম ব্যবহার করা হয়। এ সাধারণ নিয়ম অনুসারে আল্লাহ দামেস্কর সহিত কাদিয়ানের তুলনা করেছেন। (গোলামের এজালাতুল আওহাম ৬৩-৭০ পৃ: সার সংক্ষেপ।) বাকি রইল ‘মিনারের’ প্রশ্ন? তার মাসীহিয়্যতের দাবি করার বার বৎসর পর ১৯০৩ সালে কাদিয়ানে একটি মিনার নির্মাণ করে তার নামকরণ করল ‘মানারাতুল মাসীহ’। আর বলল, এটাই সেই মিনার হাদীসে যার উল্লেখ রয়েছে যে এতে মাসীহ অবতরণ করবেন। (গোলামের ঘোষণা যা তার ঘোষণা-বলীর সমষ্টি, কাসেম কাদিয়ানীর ‘তাবলীগে রেসালাতে’ সন্নিবেশিত।) এটা কি বোকামীর পর বোকামী নহে? এ অজ্ঞতার উপর কি আর কোন অজ্ঞতা হতে পারে? ঐ সকল আচ্ছাদিত বুদ্ধিমত্তার জন্য আফসোস যারা একে বিশ্বাস করে এবং এর অনুসরণ করে! ঐ সকল নির্বুদ্ধিতা ও দুর্বল বিষয়াদিকে জেনে শুনেও একে বিশ্বাস করে এবং মেনে চলে। মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন- ‘তাদের অন্তর আছে যদ্দরা তারা অনুধাবন করতে পারে না এবং তাদের চক্ষু আছে যদ্দারা তারা দেখতে পারে না এবং তাদের কান আছে যদ্দরা তারা শুনতে পারে না। ওরা একেবারে উদাসীন। [২ সূরা আ’রাফ, ১৭৯।] এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যের বিষয় হল- যখন হাদীসে একথা উল্লেখ রয়েছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম দু’টিচাদর পরিধান করে অবতরণ করবেন, তখন সে বলল- সহীহ মুসলিমে এর প্রমাণ আছে যে, ঈসা আলাইহি সালাম দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে অবতরণ করবেন এর অর্থ হল, তিনি অবতরণ কালে অসুস্থ থাকবেন। (গোলামের এজালাতুর আওহাম’ ৮১ পৃ:) সে আরো বলে- দুই চাদর দ্বারা উদ্দেশ্য দুটি রোগ। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথার দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, মাসীহ তাঁর অবতরণ কালে দুটি রোগে আক্রান্ত থাকবেন। উল্লেখ্য যে আমি দুটি রোগে আক্রান্ত আছি। একটি বহুমূত্র, অপরটি মাথাঘুরান। (গোলামের প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদরে’ সন্নিবেশিত, ৮ই জুন ১৯০৬ খৃ:।) সে লিখেছে- যখন আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবি করি তখন আমি দুটি রোগে আক্রান্ত হই, একটি বহুমূত্র অপরটি মাথাঘুরান। (গোলামের হকী-কতে ওহী’ ১০৬ও ২০৭ পৃ:) পরিশেষে এই হাদীসে আছে যে, মাসীহ আলাইহিস সালাম দুটি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে অবতরণ করবেন। চাদর দুটি হল আমার মাথা ঘুরান রোগ যার প্রচন্ডতার কারণে আমি কখনও মাটিতে পড়ে যাই এবং আমার বহুমূত্র রোগ, যার কারণে আমি কখনও কখনও রোজ একশতবার প্রস্রাব করে থাকি। (গোলামের বারাহীনে আহমদিয়া’ এর পরিশিষ্ট ৫ম খন্ড, ২০১ পৃ:।)
এটা কি আশ্চর্যের ব্যাপার নহে যে, সত্য মাসীহ আলাইহিস সালাম জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করতেন এবং আল্লাহর নির্দেশে মৃতদের জীবিত করতেন? আর এই মিথ্যা মাসীহ এমন রোগে আক্রান্ত হয় যা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে ফেলে দেয়, এবং এত অধিক পরিমাণ প্রস্রাব করে যে সর্বদা তার পাশে পাত্র রাখতে সে বাধ্য হয়, যাঁর মধ্যে প্রস্রাব করে নিজেই উহা বাহিরে ফেলে দেয়। (কাদিয়ানী মুফতি মুহাম্মদ সাদেকের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে সন্নিবেশিত, ৬ই ডিসেম্বর ১৯২৪ খৃ:) এ সমস্ত অন্তঃ সারশূন্য ব্যাখ্যা দেওয়ার পরও সে মনের দিক থেকে শান্তি লাভ করতে পারেনি। এমনকি, সে বলেছে: ‘অপর একজন মাসীহের অবতরণ সম্ভব যার উপর হাদীসে বর্ণিত গুণাবলি বাহ্যিকভাবে প্রযোজ্য হবে’। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ১৯৯ পৃ:।) সে তার এ বক্তব্যে সত্যই বলেছে যে, পরস্পর বিরোধী দুটি বক্তব্য পাগল বা মুনাফিক ব্যতীত আর কারো কাছ থেকে প্রকাশ পাবে না। (গোলামের ছিত্তে ভজন ৩১ পৃ:।) মোটকথা এ গুণটিও এই জনাবের উপর প্রযোজ্য হয়নি। আর তা হল এই মাসীহ আলাইহিস সালাম দুটি হলদে বর্ণের চাদর পরিধান করে দুজন ফেরেস্তার ডানার উপর ভর করে পূর্ব দামেস্কের সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন। [১ আমি জানি না যে, তারা কিভাবে্এ হাদীসের ব্যাখ্যা করে? অর্থাৎ মাসীহ দুই ফেরেস্তার ডানার উপর দুহাত দিয়ে ভর করে? অর্থাৎ মাসীহ দুই ফেরেস্তার ডানার উপর দুহাত দিয়ে ভর করে অবতরণ করবেন। সম্ভবতঃ কাদিয়ানীর দৃষ্টি এদিকে পড়েনি। অন্যথায় সে একথা বলত না যে, উহা দ্বারা দুটি কাঠ উদ্দেশ্য যার উপর চলাফেরায় অক্ষম ব্যক্তি ভর করে। ওলা হাওলা ওলাওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।] অতএব, প্রমাণিত হল যে, সে তার দাবিতে মিথ্যা..........।
৪- চতুর্থ গুণটি হল যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, তা হল- ‘কাফেরদের মৃত্যু বরণ। তিনি এরশাদ করেছেন- ‘‘কোন কাফের তার নিশ্বাসের গন্ধ পেলেই মৃত্যুবরণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর তাঁর নিশবাস এত দুর পর্যন্ত পৌঁছোবে যত দুর পর্যন্ত তার দৃষ্টি পৌঁছোবে’’। গোলাম আহমদের অবস্থা এর বিপরীত। তার দাবিকালে কাফেরদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কেননা, সে বলেছে যে, আমাকে বিশ্বাস করবে না সে কাফের। (গোলামের হাকীকতে ওহী ১৬৩ পৃ:।) তার উপর মাত্র বিশ হাজার নির্বোধ লোক বিশ্বাস করেছে। অচিরেই আমি এর বিস্তারিত আলোচনা করব যে তার মৃত্যুর বিশ বৎসর পর যখন আদম শুমারি করা হল, তখনও কাদিয়ানীদের সংখ্যা পঁচাত্তর হাজার অতিক্রম করেনি। (আল-ফজল, ২১ জুন ১৯৩৪ খৃ:।) এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, মৃত্যুর দ্বারা কাফেরদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার স্থলে দুই হাজার মিলিয়নেরও অধিক লোক তার আগমনের কারণে কাফের হয়ে গেল...।
৫- মাসীহে মাওউদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হল, ‘‘তিনি ন্যায় বিচারক শাসক হবেন, শাসিত নহে। অত্যাচারী শাসক ও নহে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এই জনাব গোলাম কাদিয়ানী শুধু শাসিতই ছিলেন না, বরং লাঞ্ছিত ও তার জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক এবং কাফের সাম্রাজ্যবাদের দাস ও তার প্রজা হওয়ার দ্বারা গৌরাবান্নিত ছিল। এই তো সে ইংরেজের দাসত্বের কথা সগৌরবে উল্লেখ করে বলছে- ‘আমার পিতা আমরণ ইংরেজ সরকারের নিষ্ঠাবান সেবক ছিলেন। তার পর মহান সরকারের এই খেদমত আমার ভাই গোলাম গোলাম কাদির উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। তিনিও আমরণ ইংরেজ সরকারের ভালোবাসা ও সেবায় আমাদের বাবার পথ অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। অতঃপর আমি তাদের পথ ধরে চলছি এবং যথাযথভাবে তাদের অনুসরণ করছি। কিন্তু আমি কোন ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলাম না। এজন্য আমি আমার হাত ও কলম দ্বারা ইংরেজ সরকারের সেবা করতে উদ্যোগী হলাম। আল্লাহর নামে অঙ্গিকার করলাম যে, আমি এমন কোন পুস্তক লিখব না যাতে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ থাকবে না। (গোলামের নুরুল হক ১ম খন্ড ২৮ পৃ:।) সে আরো বলে: আমি ইংরেজ সরকারের এমন সেবা করেছি যেমন সেবা আর কেউ করতে পারেনি। এমনকি আমার বাপ দাদাও নহে। আর তা হল এই- আমি আরবী ফার্সী ও উর্দু ভাষায় কয়েক দশক পুস্তক এ উদ্দেশ্যে রচনা করেছি, যাতে আমি এ কথা ব্যক্তি করি যে, দয়াবান ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ নহে। সকল মুসলমানের কর্তব্য হল তারা যেন খাঁটি অন্তরে এ সরকারের আনুগত্য করে। এ জন্য আমি আমার বিশ্বস্ত শিষ্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছি যারা ইংরেজ সরকারের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং তার জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্ত্তত’। (গোলাম কাদিয়ানীর ভাষণ যা তাবলীগে রেসালাতে সন্নিবেশিত, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬৫ পৃ:।) সে আরো বলেছে: প্রত্যেক সৌভাগ্যবান মুসলিমের কর্তব্য হল ইংরেজদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য দো’আ করা এবং শত্রুদের উপর তাদের বিজয় কামনা করা। কেননা, এরা একটি অনুগ্রহশীল জাতি এবং আমাদের উপর এ ব্রিটিশ সরকারের বড় বড় অবদান রয়েছে। যে সকল মুসলমান এ সরকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করি তা হলে আমরা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হব।’ (গোলাম কাদিয়ানীর এজালাতুল আওহাম ৯পঃ।) উপরন্তু সে নিজেই স্বীকার করেছে যে, হাদীসের শব্দাবলির বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী প্রতিশ্রুত মাসিহ রাজত্ব ও শাসন ক্ষমতা নিয়ে আসবেন। ‘‘ কিন্তু আমি ফকিরী ও দরবেশি নিয়ে এসেছি’’। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ৩০০ পৃ:।) হায়রে তার অসহায় অবস্থা!
৬- মাসীহ আলাইহিস সালাম এর অপর একটা নিদর্শন হল যে, তিনি ক্রুশকে ভেঙে ফেলবেন। এরপর আর ক্রুশের পূজা হবে না। এটা হল সাইয়েদেনা ঈসার আলাইহিস সালাম বড় বড় অলৌকিক ঘটনাবলীর অন্যতম। তিনি পৃথিবীতে এমন কোন ক্রুশ রাখবেন না যার পূজা করা হবে, এভাবে এমন কোন খ্রিস্টানও রাখবেন না, যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সামনে রুকু, সেজদা করবে। এ কথা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী স্বীকার করে বলেছে: ‘প্রতিশ্রুত মাসীহের আলাইহিস সালাম জন্য যে সকল প্রকাশ্য ও স্পষ্ট নিদর্শনা বলী নির্ধারণ করা হয়েছে তার অন্যতম হল তার হাতে ক্রুশ ভাঙ্গা হবে। (গোলামের আঞ্জামে আথম ৪৬ পৃ:।) এ কথাটি পরবর্তী পৃষ্ঠায় দ্বিতীয়বার উল্লেখ করে বলেছে: ‘হাদীসে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যে, মাসীহের আলাইহিস সালাম সর্ব প্রথম নিদর্শন তার হাতে ক্রুশ চূর্ণ হবে।’ (উল্লেখিত কিতাব ৪৭ পৃ:) এ বখাটেকে সে আরো অধিক স্পষ্ট করে বলেছে: মাসীহের আলাইহিস সালাম অবতরণ উদ্দেশ্য হল, ত্রিত্ববাদের চিন্তাধারাকে মুছে ফেলা এবং একক আল্লাহর মহত্ত্ব প্রকাশ করা। (গোলামের মানারাতুল মাসীহের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালাতে সন্নিবেশিত।) অনুরূপভাবে সে অন্যত্র লিখছে: মাসীহ আলাইহিস সালাম তার সকল প্রচেষ্টা ত্রিত্ববাদের চিন্তাকে মুছে ফেলার জন্য ব্যয় করবেন।’ (গোলামের ‘আইয়ামে সুলহ’ এর টীকা, ৪৪ পৃ:।) একথা স্বীকার করার পর তার মাসীহিয়তের প্রমাণ স্বরূপ বর্ণনা করেছে. ‘এ ক্ষেত্রে (মাসীহিয়াতের ক্ষেত্রে) আমি যে কাজ সম্পন্ন করছি তা হল, ঈসা আলাইহিস সালাম এর এবাদতের স্তম্ভ গুলো আমি, ভেঙে দিচ্ছি। (গোলামের প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা বদরে সন্নিবেশিত, ১৯শে জুলাই, ১৯০৬ খু:)
গোলাম কাদিয়ানীর জন্য তা কি অর্জিত হয়েছে? আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশ্রুত মাসীহের যে সকল গুণাবলি বর্ণনা করেছেন এবং মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী ও যা স্বীকার করেছে, তা কি তার উপর প্রযোজ্য হয়েছে? এখন আমাদের দেখা উচিত, কাদিয়ানী পত্রিকা মাসিহিয়্যাত সম্পর্কে কি বলেছে, তা কি মুছে গেছে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, অথবা বর্ধিত ও উন্নত হয়েছে? ‘পয়গামে সুলাহতে কাদিয়ানীরা প্রচার করেছে যে, মসীহিয়্যাত দিন দিন উন্নতি লাভ করছে। (পয়গামে সুলাহ, ৬ই মার্চ, ১৯২৮ খৃ: প্রকাশিত।) এটাকে কাদিয়ানীরা স্বীকার করে নিয়েছে। আর এটাই হল গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিজ এলাকা ‘গুরদ উসবুরে’ মাসীহিয়্যাত সম্পর্কে আদম শুমারীর ভাষ্য। ১৮৯১ সালে গোলাম আহমদ যখন প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার ঘোষণা দিল তখন গুরদ উসবুরে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার চারশো জন। এটাই নির্ধারিত ছিল যে, গোলাম আহমদ মাসীহিয়্যতের ঘোষণা করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ প্রদান ও গোলাম আহমদের স্বীকৃতি অনুযায়ী একটি খ্রিস্টানও অবশিষ্ট থাকবে না। বিশেষ করে ঐ এলাকায় যেখানে সে বসবাস করে। কিন্তু ঘটল কি? মাত্র দশ বৎসর পর ১৯০১ সালে এদের সংখ্যা ৪৪৭১ জনে পৌঁছোল। যখন এ এলাকার পরবর্তী আদম শুমারী ১৯১১ সালে অনুষ্ঠিত হল তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়াল ২৩৩৬৫ জনে এবং ১৯৩১ সালে ৪৩৩৪৩ জনে। অর্থাৎ গোলামের মাসীহিয়্যতের ঘোষণার পর মাত্র চল্লিশ বৎসরের মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বিশগুণ বেড়ে গেল। আর ইহা ঘটল একটা ছোট এলাকা অর্থাৎ তারই এলাকায়। এটা তার ঐ কথা সত্ত্বেও ঘটল: ‘আমি যদি ইসলামের সাহায্যার্থে এমন কাজ না করে মরে যাই যা মাসীহিয়্যতের সহিত সম্পৃক্ত, তবে তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমি মিথ্যাবাদী। (গোলামের প্রবন্ধ যা ১৯শে জুলাই, ১৯০৬ সালের বদরে সন্নিবেশিত। শেখ আব্দুল্লাহ মেমারের পকেট বুক হতে উদ্ধৃত।)
প্রকাশ থাকে যে, আমরা আদম শুমারী এবং কাদিয়ানীদের স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছি যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের যা কর্তব্য ছিল তা সে করেনি। তবে সে নিজেরই বক্তব্য অনুযায়ী মিথ্যাবাদী ব্যতীত আর কিছুই নহে। তার বক্তব্য অনুযায়ী আমরাও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে সে একটা মস্ত বড় মিথ্যুক।
৭- প্রতিশ্রুত মসীহের সপ্তম বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তিনি শুকর নিধন ও উহা নির্মূল করার নির্দেশ দেবেন। এমনকি, এরপর আদৌ উহা ভক্ষণ করা হবে না। এটা কি গোলাম লাভ করতে পেরেছে? এখন পর্যন্ত কি শুকর ভক্ষণ করা হচ্ছে না, না কি হয়?
৮- প্রতিশ্রুত মাসীহের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তিনি সমুদয় মানব জাতিকে একই ধর্ম ইসলামের উপর একত্রিত করবেন। অপর কোন ধর্ম অবশিষ্ট থাকবে না, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি ‘বরং তিনি যুদ্ধ রহিত করবেন, দ্বারা তা বুঝা যাচ্ছে। সুতরাং কেহ যেন এ ধারণা না করে যে, যুদ্ধ রহিত করার অর্থ জেহাদ উঠিয়ে দেওয়া। না, বরং এর অর্থ হল ইসলাম ব্যতীত অপর কোন ধর্মকে তিনি অবশিষ্ট রাখবেন না যাতে তার যুদ্ধ করতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি ওহীর সাহায্যে কথা বলেন, তিনি এ অর্থটি বিস্তারিত ভাবে অপর হাদীসে বর্ণনা করেছেন, যা আহমদ তাঁর মসনদে এবং আবু দাউদ তার সূনানে উল্লেখ করেছেন: ‘আমি মরিয়ম পুত্রের অধিক নিকটবর্তী, তিনি অবতরণ করবেন। যখন তোমরা তাঁকে দেখবে তখন এমন অবস্থা দ্বারা তাঁকে চিনে নাও যে, তিনি একজন মধ্যম গড়নের লাল সাদা মিশ্রিত রংয়ের লোক হবেন। তাঁর পরনে দুটি হলুদ বর্ণের কাপড় হবে, তাঁর মাথা থেকে যেন পানির ফোটা পড়ছে, যদিও আদ্রতা তাকে আদৌ স্পর্শ করেনি। তিনি ক্রুশ চূর্ণ বিচূর্ণ করবেন, শুকর হত্যা করবেন, কর রহিত করবেন এবং মানব জাতিকে ইসলামের দিকে আহবান করবেন। তার যুগে আল্লাহ তাআলা ইসলাম ব্যতীত সমুদয় ধর্মকে খতম করে দেবেন..। হাদীসের শেষ পর্যন্ত । [১ আহমদ আবু দাউদ।] আবু হুরায়রা রা. এ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন: ইচ্ছে হলে তোমরা পড় [২ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাযা ও আহমদ। কোন কোন আলেম এ রেওয়ায়েতকে মারুফ বলে উল্লেখ করেছেন।]:
وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا ﴿النساء 159﴾
‘‘আহলে কিতাবের সকলেই তার মৃত্যুতে পূর্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাদের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাদের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবেন।’’ [১ সুরা নিসা ১৫৯] ভন্ডনবী কাদিয়ানীও একথা স্বীকার করেছে যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের অন্যতম গুণ হবে ইসলাম প্রচার করা এবং তাঁর যুগের অন্যান্য ধর্মকে মিটিয়ে দেওয়া। এটাই হল তার ভাষ্য ‘এর উপর সবাই একমত যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের যুগে পৃথিবীতে ইসলাম অধিক মাত্রায় প্রসার লাভ করবে এবং অন্যান্য বাতিল ধর্মসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (গোলামের আইয়ামে সুলাহ ১৩৬পৃঃ) সে লিখেছে- আল্লাহর উক্তি: আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম, এর মধ্যে রাজীম শব্দ থেকে প্রকাশ পাচ্ছে যে, এমন একটি যুগ আসবে যখন কোন বাতিল অবশিষ্ট থাকবে না এবং মিথ্যা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর ইসলাম ব্যতীত সকল ধর্ম নির্মূল হয়ে যাবে। (গোলামের এজাজে মাসীহ ৮৩ পৃ:।) সে আরো বলেছে: আল্লাহর ইচ্ছে যে, সমুদয় ধর্মকে এক ধর্মে পরিণত করবেন। আর এ কাজের জন্য একজন প্রতিনিধি নির্ধারিত করে তাঁর নাম রেখেছেন প্রতিশ্রুত মাসীহ’। (গোলামের মেরআতুল মারেফা ৮২ পৃ:।)
এখন প্রশ্ন হল গোলাম আহমদের মাসীহিয়্যাত দাবি করার পর ইসলাম ধর্ম ব্যতীত অপর সকল ধর্ম কি ধ্বংস হয়ে গেছে? এবং এক ধর্ম অর্থাৎ ইসলামের উপর কি সকল লোক একত্রিত হয়েছে? এ প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক, এবং এর উত্তর অতি স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। বরং বহু বাতিল ধর্মের মধ্যে আর একটি ধর্ম বৃদ্ধি পেল। আর তা হল মিথ্যাবাদী কাদিয়ানীর মতবাদ কাদিয়ানী ধর্ম।
৯- মাসীহ আলাইহিস সালাম আর একটি অন্যতম গুণ হল- তিনি ‘লুদ’ দ্বার প্রান্তে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, তিনি লুদ নামক দ্বার প্রান্তে দাজ্জালকে খুঁজে পাবেন এবং তথায় তাকে হত্যা করবেন। ভন্ডনবী কাদিয়ানীও প্রতিশ্রুত মাসীহের এ গুণটি স্বীকার করে বলেছে: অতপর মরিয়ম পুত্র মাসীহ দাজ্জালের অন্বেষণে বের হবেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের লুদ নামক জনপদের দরজার নিকটে তাকে পেয়ে হত্যা করবেন। (গোলাম কাদিয়ানীর এজালাতুল আহাম, ২২০ পৃ:।) গোলাম আহমদ নিজেই প্রতিশ্রুত মাসীহের এ গুণটি স্বীকার পর তার জন্য কি এ গুণ অর্জিত হয়েছে? না, কখনও না। কেহই এ কথা বলে নাই এবং বলতে পারবে না যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী দাজ্জালকে হত্যা করেছে। সে তো এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে যে, বাইতুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত হয়নি এবং তা দেখেও নি।
১০- প্রতিশ্রুত মাসীহের দশম গুণ হল এই যে, তাঁর যুগে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য হবে। এমনকি কোন ভিক্ষুক থাকবে না যে লোকের কাছে ভিক্ষা চেয়ে ফিরে। সত্যবাদী বিশ্বস্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন: ‘‘ধন-সম্পদে অধিক হবে যে, কেহই উহা গ্রহণ করবে না’’। আর, এটা হবে প্রতিশ্রুত মাসীহের বরকত। (তার উপর ও আমাদের নবীর উপর হাজার হাজার সালাম।) প্রতিশ্রুত মাসীহের দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর যুগে কি এমন হয়েছে? সম্পদ কি এত অধিক পরিমাণে হয়েছে যে, কোন ভিক্ষুক অবশিষ্ট থাকে নাই, যে ভিক্ষা চেয়ে ফিরে এবং এমন কোন মিসকিন অবশিষ্ট থাকে নাই, যে মানুষের হাতের দিকে তাকায়? কাদিয়ানী মাসীহ কি লোকজনকে ধন-সম্পদ দান করবেন এবং লোকজনকে তা গ্রহণ করতে আহবান জানাবেন। কিন্তু কেহই তা গ্রহণ করবে না। আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ঈসা আলাইহিস সালাম ন্যায় বিচারক, শাসক এবং ন্যায় পরায়ণ ইমাম রূপে অবতরণ না করেন। তখন তিনি ক্রুশ ভাঙবেন, শুকর হত্যা করবেন এবং কর রহিত করবেন। ধন-সম্পদের এতই প্রাচুর্য হবে যে, উহা কেহই গ্রহণ করবে না।’ [১ ইবনে মাজাহ।] অপর এক বর্ণনায় আছে- লোকজন একে অপরকে ধন-সম্পদ গ্রহণ করার জন্য ডাকবে, কিন্তু কেহই তা গ্রহণ করবে না। [২ মুসনাদে আহমদ] এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘তিনি শুকর হত্যা করবেন, ক্রুশ মুছে ফেলবেন এবং ধন-সম্পদ দান করবেন, কিন্তু কেহই তা গ্রহণ করবে না। [৩ মুসনাদে আহমদ] এর আলোকে যখন আমরা কাদিয়ানীর ইতিহাস ও তার চরিত্র দেখি, তখন আমরা ব্যাপারটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত পাই। ভন্ডনবী কাদিয়ানীকে আমরা ধন-সম্পদ বিতরণকারী ও দাতা হওয়ার পরিবর্তে লোকের নিকট ভিক্ষা করতে ও তাঁদের নিকট স্পষ্ট চাইতে দেখি। সে তার ভক্তগণের নিকট এই বলে সওয়াল করে: যারা আমার অনুসরণকরে তাদের কর্তব্য হল প্রত্যেক মাসে তাদের মালের এক অংশ আমার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া। এ ঘোষণার পর আমি তিন মাস অপেক্ষা করব, যে ব্যক্তি এ তিন মাসের মধ্যে আমার নিকট তার মালের একটি অংশ পাঠাবে না, আমি আমার ভক্তগণের তালিকা হতে তার নাম মুছে ফেলব। (গোলামের লওহুল মাহদী ১পৃঃ।) সে তার ভক্তগণের নিকট আরো লিখেছে লোকজনের কিছু দান-দক্ষিণা করা উচিত। কেননা, কোন কাজই টাকা পয়সা ব্যতীত সম্ভব নহে। আমাদের জামাতের এ দিকে লক্ষ্য করে যথা সম্ভব দান দক্ষিণা জমা করা কর্তব্য। (গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা বদরে সন্নিবেশিত, ৯ই জুলাই ১৯০৩ খৃ:।) শুধু তা-ই নহে বরং সে তার ভক্তগণের জন্য যে দোয়া করত তারও বিনিময় গ্রহণ করত। কাদিয়ানী মুফতি উল্লেখ করেছেন ‘একদা একজন কাদিয়ানী ধনী ব্যক্তির ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের নিকট তার রোগ নিরাময়ের দোয়া চাইল। জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ তার উত্তরে বললেন: এ ধনী ব্যক্তির উচিত যে একটা বড় অঙ্কের টাকা যেন আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়, তা হলে আমি তার পুত্রের জন্য দোয়া করব।’ (কাদিয়ানী মুফতি মুহাম্মদ সাদেকের ভাষণ যা আল ফজর পত্রিকায় সন্নিবেশিত, ২২শে অক্টোবর, ১৯৩৭ খৃ: প্রকাশিত।) ভিক্ষা করতে করতে সে এমন নিম্ন পর্যায়ে নেমে যায় যে তার ভক্তগণের সঙ্গে কবর বেচা কেনা এবং এর দ্বারা ব্যবসা করতে আরম্ভ করে । এ ব্যবসার বিস্তারিত অবস্থা হল এই প্রথমত: সে ঘোষণা দিল আমি এখনই এমন একটা কবরস্থান দেখতে পেলাম, আল্লাহ তাআলা যার নাম রেখেছেন জান্নাতের কবরস্থান। তারপর আমার কাছে এলহাম এসেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত কবরস্থান এ ভূমির সমতুল্য নহে। (মঞ্জুর কাদিয়ানীর লিখিত মুকাশেফাতুল গোলাম’ ৫৯ পৃ:।) অতঃপর তার ভক্তগণকে এই বলে উৎসাহিত করে- আমার প্রভু আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন এবং একটি ভূমির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, এটা এমন একটি ভূমি যার নীচে বেহেস্ত আছে। যে ব্যক্তি এখানে সমাধিস্থ হবে সে বেহেস্ত প্রবেশ করবে এবং তার কোন ভয় ভীতি থাকবে না।’ (গোলামের আল-ইস্তেফতা আরবী ৫১ পৃ:) এরপর, সে তার মূল অবস্থা ধাপ্পা বাজী ও ধন সম্পদ কেড়ে নেওয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করে বলে: কাদিয়ানীদের কবরস্থানের জন্য আর একটি ভূমি সংগ্রহ করেছি এবং আল্লাহ আমাকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, এ ভূমিটি বেহেস্ত এবং বলেছেন যে তিনি সর্ব প্রকার রহমত এতে অবতীর্ণ করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি এ সকল কবরে সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে, তার কর্তব্য হবে সামর্থ্যনুযায়ী তার সম্পদের কিছু অংশ পাঠিয়ে দেওয়া। তার আরো কর্তব্য হবে তার ত্যাজ্য সম্পত্তির এক দশমাংশ কাদিয়ানী তহবিলের জন্য অছিয়ত করে যাওয়া।’’(গোলাম কাদিয়ানীর আল- অছিয়ত’ ১২-১৩ পৃ:।)
অপর দিকে, তার মাসীহিয়্যতের দাবির পিছনে ঐ সম্পদ লাভই উদ্দেশ্য ছিল, যা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা তাকে প্রদান করেছিল এবং যা সরলমনা লোকজন হতে অর্জনের আশা করত। তার পুত্র ও দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ তার মামা হতে বর্ণনা করে বলেছে: মির্জা শের আলী একজন সুদর্শন, সম্মানী এবং সাদা দীর্ঘ দাড়ি বিশিষ্ট লোক ছিলেন। তার বোন প্রতিশ্রুত মাসীহের স্ত্রী ছিলেন তিনি কাদিয়ানের রাস্তায় বসে থাকতেন। যখনই জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের অনুসারীদের মধ্যে কোন নতুন আগন্তুক কাদিয়ানে আসত, তখন তিনি তাকে ডেকে কাছে বসাতেন এবং বলতেন: গোলাম আহমদ মিথ্যুক ও লুটেরা। সে এই দোকান পেতেছে (অর্থাৎ কাদিয়ানী মতবাদের দোকান) যাতে করে সে লোকের সম্পদ হরণ করতে পারে। আমি জনসাধারণকে তা অবগত করছি। কারণ সে আমার আত্মীয়, আর তোমরা তাকে চেন না। আমি জানি, সে একজন দরিদ্র লোক এবং তার আয় অতি নগণ্য। তদুপরি তার ভাই তাকে পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এ জন্যই সে এ দোকান পেতেছে। তোমরা দূর- দূরান্ত থেকে এসে থাক এবং আমরা তার পাশেই বসবাস করি। গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা আল ফজলে সন্নিবেশিত, ১৭ এপ্রিল ১৯৪৬ খৃ:।) আমরা ইতিহাসের আলোকে কাদিয়ানীদের নবী’ নামক প্রবন্ধে জনগণের সম্পদকে অন্যায়ভাবে তার লুঠতরাজের পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। এ ধারাটি তার খলীফা ও সন্তানদের মধ্যে অদ্যাবধি চলে আসছে। প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আর্থিক অবস্থা হল এই। বাকি রইল সাধারণ লোকের অবস্থা। সকলেরই জানা আছে যে এ যুগে কি সম্পদের এতই প্রাচুর্য হয়েছে যে কাউকে দান করলে সে উহা গ্রহণ করবে না? গোলাম আহমদ কি জনগণকে ধন-সম্পদ দান করত? না, সর্ব প্রকার প্রতারণা ও মিথ্যা ছলনার দ্বারা তাদের নিকট থেকে উহা গ্রহণ করত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী থেকে সে কতদূরে? মাসীহের আলাইহিস সালাম যুগে লোক একে অপরকে সম্পদ দিতে চাইলে কেহ তা গ্রহণ করবে না। সম্পদ দেয়া হবে, কিন্তু তা কেহই গ্রহণ করবে না.......।
১১- অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসীহে মাওউদের যুগে জনগণের মধ্যে আল্লাহর এবাদতে আগ্রহ এবং দুনিয়া ও উহার সব কিছুর উপর তা প্রাধান্য দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এটাও গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর যুগে বাস্তবায়িত হয়নি ।কেননা, সে নিজেই স্বীকার করেছে যে তার উপর অল্প সংখ্যক মানুষের একটি দল ছাড়া আর কেহ বিশ্বাস স্থাপন করেনি। তার মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর আদম শুমারীর সময়ে কাদিয়ানীদের সংখ্যা সমস্ত ভারতে পঁচাত্তর হাজারের অধিক হয়নি। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ২১ শে জুন ১৯৩৪ খৃ:।) আমাদের এ বেচারার উপর এ গুণটিও প্রযোজ্য হল না।
১২- মসীহ আলাইহিস সালাম এর অবতরণের অন্যতম নিদর্শন হল পৃথিবীতে নিরাপত্তা স্থাপিত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, সিংহ উটের সহিত, চিতাবাঘ গরুর সহিত বিচরণ করবে। বালকগণ সাপ নিয়ে খেলবে, ওরা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করবে না। এটা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। গোলাম আহমদের যুগেও নহে এবং তার পরেও নহে। এর উপর বড় প্রমাণ হল এই যে, কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদের হজ না করার প্রশ্নে অসুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেছে: গোলাম আহমদ অসুস্থ থাকার কারণে হজ্জ করতে পারে নি। তদুপরি হিজাজের শাসনকর্তা তার বিরোধী। সেখানে গমন করলে তার প্রাণ নাশের আশঙ্কা রয়েছে। (আল ফজল, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ খৃ:।) এই হল গোলাম আহমদের যুগে নিরাপত্তার অবস্থা, যা কাদিয়ানীরা নিজেই স্বীকার করেছে। কোথায় সেই উটের সহিত সিংহের, চিতাবাঘের সহিত গরুর এবং ছাগলের সহিত নেকড়ে বাঘের বিচরণ? কোথায় বালকদের সাপ নিয়ে খেলা ? উল্লেখ্য যে, গোলাম কাদিয়ানী তার শিষ্যদের মাধ্যমে বিরুদ্ধ বাদীগণকে গুপ্ত হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং তাকে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ আদালত তাকে খালাস করে দেয়।
১৩- প্রতিশ্রুত মাসীহ এর আরো একটি গুণ হল তিনি অবতরণের পর হজ্জে এফরাদ, তামাত্তু অথবা ক্বেরান করবেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গোলাম আহমদ হজও করে নি, উমরাহও করেনি। এমনকি পবিত্র স্থান সমূহ দেখার ও তার সুযোগ ঘটেনি। এইতো কাদিয়ানীদের অবস্থা যারা দুর্বল, অন্তঃসারশুণ্য ও সস্তা ব্যাখ্যা দ্বারা তাদের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে: যেমন আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, গোলাম আহমদ অসুস্থ থাকার কারণে তার উপর হজ্জ ফরজ হয়নি এবং হেজাজের প্রশাসকও তার বিরোধী ছিলেন। কেনন, ভারতের আলেমগণ তাকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে ফতওয়া দিয়েছেন। কাজেই সে ওখানে গেলে তার প্রাণ নাশের আশঙ্কা রয়েছে। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ খৃ:।) এ হল তার অবস্থা। অথচ সে দাবি করেছে যে, তার উপর ঐশী বাণী এসেছে, আল্লাহ তোমাকে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করবেন।’ (গোলামের তাজ কেরাতুশ শাহাদাতাইন’ ৪ পৃ:।) মোটকথা, প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হজ্জ করেনি, রোগ, ভয় কিংবা অন্য যে কোন কারণে হোক । অথচ সে নিজেই স্বীকার করেছে যে, বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে ‘‘প্রতিশ্রুত মাসীহ হজ্জ করবেন,। (গোলামের আইয়ামে সুলাহ’ ১৬৯ পৃ:।) যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একথা প্রমাণিত যে হজ্জ করা প্রতিশ্রুত মাসীহের অন্যতম গুণ হেতু তার কোন ওজর আপত্তির অবকাশ থাকবে না। কেননা, প্রকৃত মাসীহের জন্য হজ্জ করার ব্যাপারে যত বাধা বিপত্তি আছে তা সব সরিয়ে ফেলা হবে, যাতে করে তার জন্য এ গুণটি প্রযোজ্য হয় যা এমন নী বর্ণনা করেছেন যিনি ওহী দ্বারা কথা বলেন। এ কথার প্রতি গোলামের স্বীকৃতি রয়েছে যে, হাদীসটি বিশুদ্ধ এবং মাসীহের জন্য হজ্জ সাব্যস্ত।
১৪- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মাসীহ আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে চল্লিশ বৎসর অবস্থান করে মৃত্যুবরণ করবেন। গোলাম কাদিয়ানী ১৮৩৯ বা ১৮৪০ সনে জন্ম গ্রহণ করে [১ গুলামের কিতাবুল বরিয়্যা ১৩৪ পৃঃ] এবং ১৯০৮ সনে মৃত্যুবরণ করে। [২ কাদিয়ানী পত্রিকা আল-হিকম ২৮শে মে , ১৯০৮ সালে প্রকাশিত।] এই হিসাবে তার বয়স ৬৮/৬৯ বৎসর হয়। কিন্তু সে এর ব্যাখ্যা দিয়েছে যে, হাদীসে বর্ণিত বয়স দ্বারা নবুয়তের বয়স উদ্দেশ্য। (গোলামের এজালাতুল আওহাম ৮১ পৃ:।) তার এ দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। কেননা, তার মাসীহ হওয়ার দাবি ছিল ১৮৯১ খৃ:, যেমন তার পুত্র বশীর আহমদ তার সীরতে উল্লেখ করে বলেছে: অর্থাৎ গোলাম ১৮৮২ সনে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি এ উম্মতের সংস্কারক হিসাবে নিয়োজিত এবং ১৮৮৯ সনে ঘোষণা দিলেন যে তিনি মাসীহ মাওউদ। (বশীর আহমদের সীরতে মাহদী ১ম খন্ড ৩১ পৃ:।) এ ভিত্তিতে তার মসীহ হওয়ার দাবির উপর সতের বছরের অধিক কাল অতিবাহিত হয়নি এবং সে চল্লিশ বছর জীবিতও থাকেনি। তাই এ গুণটিও তার মধ্যে পাওয়া গেল না।
১৫- অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- মাসীহ আলাইহিস সালাম মৃত্যুবরণ করার পর মুসলমানগণ তাঁর জানাযার নামাজ আদায় করবেন। কিন্তু গোলাম আহমদের অবস্থা এর বিপরীত। কেননা, একজন মুসলমানও তার জানাযার নামাজ পড়েনি। বরং যারা তার জানাযার নামাজ পড়েছে। তারা সবাই ছিল মুরতাদ ও বিদ্রোহী দলভুক্ত। কাদিয়ানীদের কেহই একথা প্রমাণ করতে পারবে না যে, কোন মুসলিম ব্যক্তি তার জানাযার নামাজ পড়েছে।
১৬- হাদীস শরীফে আছে, যে হাদীসকে ইবনুল জাওযীর উপস্থাপনা অনুযায়ী মিশকাতুল মাসাবীহের গ্রন্থকার বর্ণনা করেছেন যে, প্রতিশ্রুত মাসীহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওজা মুবারকে সমাধিস্থ হবেন। এ হাদীসের সনদ যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, গোলাম আহমদ নিজেই এর স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রতিশ্রুত মাসীহ আমার কবরে সমাধিস্থ হবেন। (গোলাম কাদিয়ানীর সাফিনায়ে নূহ ১৫ পৃ:।) অতএব গোলাম কাদিয়ানীর জন্য এ সম্মান অর্জিত হয়নি, সেত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরও জিয়ারত করতে পারেনি, আর সমাধিস্থ হওয়া তো দূরের কথা? কারণ সে লাহোরে মৃত্যুবরণ করেছে (পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী) পরে তার লাশ কাদিয়ানী এনে তথায় দাফন করা হয়। [৩ আল-হিকম’ ২৮ শে মে, ১৯০৮ খৃঃ।] যখন এ গুণটিও তার বেলায় প্রযোজ্য হয়নি তখন তারা তাদের অভ্যাস অনুযায়ী বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে লাগল যে, কবর দ্বারা প্রকৃত কবর উদ্দেশ্য নহে, বরং আধ্যাত্মিক কবর উদ্দেশ্য। কেননা, যদি প্রকৃত কবর উদ্দেশ্য নহে, বরং আধ্যাত্মিক কবর উদ্দেশ্য। কেননা, যদি প্রকৃত কবর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে তাতে রাসূলুল্লাহ এর অবমাননা হবে। আর তা হল, কবর খুলে তাতে প্রতিশ্রুত মাসীহকে দাফন করা। (খাদিম কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক।) আমরা বলি: আরবগণ কবর শব্দ বলে কবরস্থান অর্থ গ্রহণ করে। এটা তাদের কাছে প্রচলিত। মুছান্নাফে ইবন আবি শাইবার রা. কিতাবুল জানায়িযে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন: ‘আমাকে ওসমান ইবন মাযউনের কবরে অর্থাৎ কবরস্থানে দাফন করিও। (ইবনে আবি শাইবা, কিতাবুল জানায়িয ১৩৪ পৃ: ভারতীয় মুদ্রণ।) একই কিতাবের একই ভাবে মুয়াবিয়া ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি সুফিয়ান থেকে, সুফিয়ান অপর এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, খায়সামা ওসিয়াত করে গেলেন যে, তাকে যেন তার গোত্রীয় দরিদ্রদের মাকবারাতে (কবরস্থানে) দাফন করা হয়। আরবদের নিকট মাকবারার স্থলে কবর এবং কবরের স্থলে মাকবারা ব্যবহার প্রচুর রয়েছে। কাদিয়ানী মুবাল্লেগ খাদেম তার পুস্তকে মুল্লা আলী ক্বারী থেকে বর্ণনা উল্লেখ করেছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে অবস্থানের পর হজ্জ সম্পাদন করবেন এবং ফিরে এসে মক্কা ও মদিনার মধ্যস্থলে মৃত্যুবরণ করবেন। তাঁকে মদিনাতে এনে রওজা শরীফে দাফন করা হবে। (গোলাম কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক ৪৮২ পৃ:।)
এ কথাও অপরিহার্য নয় যে ‘‘মধ্যে’’ অব্যয়টি সর্বদা জরফিয়তের (স্থান-কাল) অর্থে ব্যবহৃত
হবে। কখনও কখনও নিকট অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী এর প্রমাণ,আল্লাহ বলেন: ‘‘ধন্য সে ব্যক্তি, যে আগুনের নিকটবর্তী স্থানে আছে। [১ সুরা নামল, ৮।]
ইমাম রাজী বলেন, এটাই অধিক যুক্তিসংগত। কেননা, নিকটবর্তী বস্ত্তকে বলা হয় এটা উহার মধ্যে আছে। (ইমাম রাজীর তাফসীরে কাবীর ৪৩৬ পৃ:, ৬ষ্ট খন্ড।) অতএব, আমার কবরে দাফন করা হবে এর অর্থ আমার কবরের নিকট দাফন করা হবে। তিরমিজী আব্দুল্লাহ ইবন সালাম রা. থেকে যে রেওয়ায়েত করেছেন তা এ অর্থকে সমর্থন করে। তিনি বলেছেন: তাওরাতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থা এভাবে লিখিত আছে, মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম তার সহিত সমাধিস্থ হবেন।
তিরমিজী এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, এটা হাদীসে হাসান। আর এ হাদীসটি তাবরেজী মিশকাতুল মাসাবীহে উল্লেখ করে বলেছেন: আবু মাওদুদ বলেছেন: (তিনি এ হাদীসের একজন মাদানী রাবী) এ ঘরে একটি কবরের জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে’ উল্লেখ্য যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজে স্বীকার করেছে এ হাদীস (অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম আমার কবরে সমাধিস্থ হবেন।) এর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে অর্থাৎ সম্ভবত: অপর একজন মাসীহ আগমন করবেন, যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা পাকের নিকট দাফন করা হবে।(গোলামের এজালাতুল আওহাম ১৯৬ পৃ:।) অনুরূপ ভাবে কাদিয়ানী বিতর্ক কারিরা ও এ কথার স্বীকার করেছে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। এ সমস্ত অকাট্য প্রমাণাদি ও স্পষ্ট দলীল দস্তাবেজ দ্বারা সাব্যস্ত হল যে, গোলাম আহমদ তার মাসীহ হওয়ার দাবিতে মিথ্যুক। আর তা ঐ সমস্ত গুণাবলির মাপ কাটিতে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, যিনি ওহী ব্যতীত কথা বলেন না, যার সম্পর্কে কল্যাণময় মহান আল্লাহ বলেছেন: তিনি তাঁর প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কথা বলেন না। তিনি যা বলেন তা ওহী ব্যতীত আর কিছু নহে, [১ সুরা নাজম ৪।] সেই মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশ্রুত মাসীহের যে গুণাবলি বর্ণনা করেছেন তার আলোকে গোলাম আহমদ মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত। এমন কি গোলাম তার নিজের স্বীকারোক্তির দ্বারাও মিথ্যুক প্রমাণিত। আমরা সূত্র ব্যতীত কোন কিছুরই উল্লেখ করিনি। এ ব্যাপারে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। কেননা, কাদিয়ানীরা অনেক সময় দুর্বল বুদ্ধি, দুর্বল চিত্ত ও দুর্বল জ্ঞান সম্পন্ন লোকদেরকে এ সকল সন্দেহ সৃষ্টিকারী ও ফন্দি দ্বারা প্রতারিত করে থাকে। তাদের সমুদয় বাঁকা ইমারত গুলি এ বিশ্বাসের উপরই প্রতিষ্ঠিত যে, গোলাম আহমদ প্রতিশ্রুত মাসীহ। তারা দলীল প্রমাণ দ্বারা তাদের এ বিশ্বাস প্রমাণিত করতে অতিশয় দুর্বল।
পাঠকবৃন্দ, নিশ্চয়ই তার দাবি নিরীক্ষণ করেছেন এবং এই সাথে তার দুর্বল প্রমাণাদিও দেখেছেন। এটা কি কোন বুদ্ধিমানের কথা- আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ। তার প্রমাণ? কেননা, তা একমাত্র আমিই এ দাবি করেছি। (গোলামের এজালাতুল আওহাম ৬৮৫ পৃ:।)
পরিশেষে, আমরা আমাদের এ প্রবন্ধ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীস দ্বারা সমাপ্ত করব যার মধ্যে তিনি মাসীহ আলাইহিস সালাম অবতরণের পূর্বে ও পরে পৃথিবীতে কি ঘটবে তা স্পষ্টকরে বর্ণনা করেছেন। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী নওয়াস বিন সাম’আন রা. বলেন: একদা ভোর বেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের আলোচনা করলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে অতি তুচ্ছ ভাষায় উল্লেখ করলেন, আবার তার খুব গুরুত্বও প্রকাশ করলেন। আমাদের নিকটবর্তী ঐ খেজুর বাগানেই আছে। তারপর রাসূলুল্লাহ এর নিকট থেকে আমরা উঠে আসলাম। বিকেলে তাঁর নিকট আবার গেলাম। তিনি আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ভাব অনুভাব করে জিজ্ঞাসা করলেন: তোমাদের কি অবস্থা? আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! ভোরবেলা আপনি দাজ্জালের উল্লেখ করতে গিয়ে কখনও উচ্চ: স্বরে আবার কখনও নিচু স্বরে তার আলোচনা করেন। আমাদের ধারণা হল যেন, দাজ্জাল আমাদের নিকটবর্তী খেজুর বাগানেই আছে। দাজ্জাল আমাদের নিকটবর্তী খেজুর বাগানেই আছে। তখন তিনি বললেন: দাজ্জাল ব্যতীত আমি অন্য বিষয় তোমাদের জন্য বেশি ভয় করি। সে যদি আমার জীবদ্দশায় বের হয় তাহলে তোমাদের রক্ষা করার জন্য আমিই যথেষ্ট। আর আমার অবর্তমানে বের হলে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর নিজকে রক্ষা করার দায়িত্ব থাকবে। আমি সকল মুসলমানের আল্লাহকে রেখে যাব। আর মুসলমানদের সাহায্যের জন্য আল্লাহই থাকবেন। জেনে রাখ, নিশ্চয়ই দাজ্জাল কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট একজন জওয়ান হবে। তার চক্ষু হবে সমতল। আমি তাকে আব্দুল উজ্জা ইবন কুতনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখছি। তার সঙ্গে যার সাক্ষাৎ হবে সে যেন সূরা কাহফের প্রারম্ভিক আয়াতগুলো পাঠ করে। সে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থান থেকে বের হবে। সে তার ডান দিকে বাম দিকে সর্ব অঞ্চলে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। আমরা বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ, সে পৃথিবীতে কতকাল অবস্থান করবে। তিনি বললেন: চল্লিশ দিন। একদিন হবে এক বৎসরের সমান, এক দিন হবে এক মাসের সমান এবং একদিন হবে এক সপ্তাহের সমান। আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! যে দিনটি এক বৎসরের সমান হবে, উহাতে কি আমাদের জন্য এক দিনের নামাজ যথেষ্ট হবে? উত্তরে বললেন: না, এর জন্য তোমরা দিনের পরিমাণ ঠিক করে নিবে। আমরা আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! পৃথিবীতে তার গতি কি রূপ হবে? উত্তরে বললেন: ঐ মেঘমালার ন্যায় যাকে বাতাস পিছন থেকে তাড়া করছে। তারপর সে কোন এক সম্প্রদায়ের নিকট আসবে। তাদের আহবান করবে। তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে তার ডাকে সাড়া দেবে। তার নির্দেশে আকাশ বৃষ্টি বর্ষন করবে এবং জমিন শস্যাদি উৎপাদন করবে। তাদের চতুষ্পদ জন্তু এতে বিচরণ করবে, ফলে এদের কবজাগুলো সুউচ্চ হবে, স্তন গুলো দুধে পরিপূর্ণ হবে এবং কোমরগুলো মোটা তাজা হবে। অতঃপর সে অপর এক সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদেরকে তার প্রতি ঈমান আনার জন্য আহবান করবে, কিন্তু তারা তার কথা প্রত্যাখ্যান করবে। সে তাদের থেকে ফিরে যাবে, তখন এরা একেবারে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তাদের হাতে ধন সম্পদ কিছুই থাকবে না। সে পতিত ভূমি দিয়ে গমন কালে তাকে বলবে: তুমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ বের করে দাও। তাতে সম্পদগুলো মৌমাছিরা যেমন রাণী মৌমাছিকে অনুসরণ করে চলে তেমনি তার পিছে পিছে চলবে। তারপর সে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত একটি যুবককে ডাকবে। তাকে তরবারির আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে উভয় খন্ডকে একটি তীর নিক্ষেপের দুরত্বে ফেলে দেওয়ার পর তাকে ডাকবে। তাতে সে হাসিমুখে উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে তার দিকে আসবে। ইত্যবসরে আল্লাহ তাআলা মরিয়ম পুত্র মাসীহ কে প্রেরণ করবেন। তখন তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তে সাদা মিনারের নিকট দুটি হলদে বর্ণের চাদর পরিহিত অবস্থায় দুজন ফেরেস্তার ডানার উপর ভর করে অবতরণ করবেন। যখন তিনি মাথা নিচু করবেন তখন তার থেকে ফোটা ফোটা করে পানি পড়বে; আর যখন মাথা উঁচু করবেন তখন তার থেকে মুক্তা ঝরবে। কোন কাফের তার নিশ্বাসের গন্ধ পেলেই তৎক্ষণাৎ সে মারা যাবে। তাঁর নিশ্বাস এত দূর পর্যন্ত পুঁছবে যতদূর তাঁর দৃষ্টি পৌঁছোবে। তিনি দাজ্জালকে ধাওয়া করে ‘লুদ’ নামক স্থানের প্রবেশ দ্বারে হত্যা করবেন। তারপর ঈসার আলাইহিস সালাম কাছে এমন একটি দল আসবে যাদেরকে আল্লাহ পাক দাজ্জালের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি তাদের চেহারা মুছে দেবেন এবং তাদেরকে বেহেস্তে তাদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করবেন। ইত্যবসরে আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালাম এর কাছে ওহী পাঠাবেন- ‘আমি আমার কিছু বান্দাকে বের করে দিয়েছি, যাদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই। আপনি আমার এ বান্দাগণকে নিয়ে তুর পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করুন। তখন আল্লাহ পাক ইয়াজুজ মাযুজকে পাঠাবেন। তারা প্রত্যেক উঁচু স্থান হতে নীচের দিকে আসতে থাকবে অর্থাৎ পাহাড় উপত্যকা পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসবে। তাদের প্রথম দল তাবরেস্তানের একটি হ্রদের নিকট দিয়ে গমন করবে এবং উহার সব পানি পান করে ফেলবে। তাদের শেষ দল এর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে। তাদের শেষ দল এর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে: এখানে তো কোন এক সময় পানি ছিল। তখন আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গীগণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বেন। এ অবস্থায় তাদের কাছে একটি গরুর মাথা আজকের দিনের একশত দিনারের চেয়েও বেশি মূল্যবান হবে। তারপর আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে দোয়ায় মগ্ন হবেন। তখন আল্লাহ তাআলা ইয়াযুজ মাযুজের ঘাড়ে মরণ কীট প্রেরণ করবেন। এতে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এক প্রাণের মৃত্যুর ন্যায় সকলে এক সাথে মৃত্যুবরণ করবে। তারপর আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাহাবিগণ পৃথিবীতে অবতরণ করবেন কিন্তু তারা ওদের পঁচা লাশ ও দুর্গন্ধ হতে মুক্ত এক বিঘত জায়গা খুঁজে পাবেন না। এরপর আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সাথীগণ আল্লাহর দরবারে দোয়ায় মশগুল হয়ে পড়বেন। তখন আল্লাহ বুখতী উটের মত লম্বা লম্বা গলা বিশিষ্ট পক্ষী পাঠাবেন। ওরা এদের লাশ উঠিয়ে নিয়ে যেখানে আল্লাহর ইচ্ছা সেখানে নিক্ষেপ করবে। এরপর আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। উহা থেকে কোন কাঁচা ও পাকা ঘর অবশিষ্ট থাকবে না। এই বৃষ্টি পৃথিবীকে ধুয়ে মুছে আয়নার মত স্বচ্ছ করে দেবে। অতঃপর পৃথিবীকে নির্দেশ দেয়া হবে, ফলমূল উৎপন্ন কর এবং তোমার বরকতকে ফিরিয়ে আন। সেদিন একটি ডালিম এক বিরাট দল খাবে এবং উহার ছাল দ্বারা ছায়া গ্রহণ করতে পারবে। আল্লাহ দুধের মধ্যে এমন বরকত দেবেন যে, একটা দুধালো উঁটনী কয়েকজন লোকের জন্য যথেষ্ট হবে, একটি দুধালো গাভি একটি গোত্রের জন্য যথেষ্ট হবে, এবং একটা দুধালো বকরি একটি ছোট দলের জন্য যথেষ্ট হবে। এরপর আল্লাহ তাআলা একটা স্নিগ্ধ বাতাস পাঠাবেন এবং উহা তাদের বগলের নীচ দিয়ে প্রবেশ করে প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের প্রাণ কবজ করে নেবে। আর, থেকে যাবে শুধু দুষ্ট প্রকৃতির লোকগুলো। তারা গাধার ন্যায় প্রকাশ্যে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে’’। [১ মুসলিম. আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ, আহমদ, শব্দ মুসলিমর।] আল্লাহর রাসূল সত্যই বলেছেন। এই হল প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবির সত্যতার মাপকাঠি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, বর্ণনা দিয়েছেন মির্জা গোলামের পূর্বে কি তা ঘটেছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিবরণ দিয়েছেন তার সময়ে কি তা সংঘটিত হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা উল্লেখ করেছেন তা কি তার উপর প্রযোজ্য হয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিবার পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর অনুসারীদের উপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
নওয়াস ইবনে সাম’আন রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দাজ্জাল বের হওয়া সম্পর্কে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মরিয়ম পুত্র মাসীহকে যখন আল্লাহ তাআলা পাঠাবেন, তখন তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তের সাদা মিনারার নিকট দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে এবং দু’জন ফেরেস্তার ডানার উপর হাত দু’টি রেখে অবতরণ করবেন। যখন মাথা ওঠাবেন তখন উহা থেকে মুক্তা ঝরবে। কোন কাফের তাঁর নিশ্বাসের গন্ধ পেলেই মৃত্যুবরণ করবে। তাঁর দুষ্টি যত দুর পর্যন্ত যায় তত দূর পর্যন্ত তার নিশ্বাসও পৌঁছাবে। তার পর দাজ্জালকে ধাওয়া করে ‘লুদ’ নামক প্রবেশ দ্বারে হত্যা করবেন। [২ মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, ইবনে মাযা, আহমদ ও হাকিম। তবে শব্দাবলী মুসলিমের।] (হাদীসের শেষ পর্যন্ত বর্ণিত)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘ঐ আল্লাহর কসম যার হাতে আমার প্রাণ, ইবনে মরিয়ম ‘রাওহা’ নামক স্থানের পথিমধ্যে হজ অথবা ওমরা কিংবা উভয়টির অবস্থায় নব চন্দ্রের ন্যায় আবির্ভূত হবেন। [৩ মুসলিম]
অন্য রেওয়ায়েতে আছে যে, মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন..... এবং রাওহা নামক [মদিনা হতে সত্তর কিলোমিটার দুরে মক্কার পথে একটি মাঠের নাম।] স্থানে মঞ্জিল করবেন। তারপর সেখান থেকে হজ বা ওমরা অথবা উভয়টি করবেন। [১ মসনদে আহমদ] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম এর অধিকতর নিকটবর্তী। কারণ, তাঁর ও আমার মাঝখানে আর কোন নবী নেই এবং অবশ্যই তিনি অবতরণ করবেন। যখন তোমরা তাঁকে এ সকল লক্ষণ দ্বারা চিনে নিবে; তিনি মধ্যম অবয়ব বিশিষ্ট ও লাল মিশ্রিত সাদা রঙ্গের হবেন। তাঁর মাথা থেকে যেন ফোটা ফোটা হয়ে পানি পড়বে, যদিও তাতে পানি লাগেনি। তিনি ক্রুশ চূর্ণ-বিচূর্ণ করবেন। এবং জনগণকে ইসলামের দিকে আহবান জানাবেন। তাঁর সময়েই আল্লাহ পাক মাসীহ দাজ্জালকে ধ্বংস করবেন। পৃথিবীতে নিরাপত্তা বিরাজ করবে। এমনকি উটের সহিত বাঘ, গরুর সহিত চিতাবাঘ এবং বকরীর সহিত নেকড়ে বাঘ বিচরণ করবে। শিশুরা সাপ নিয়ে খেলা করবে অথচ ওরা তাদের কোন ক্ষতি করবে না। তিনি পৃথিবীতে চল্লিশ বৎসর কাল অবস্থান করবেন। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং মুসলমানগণ তাঁর জানাজার নামাজ পড়ে তাঁকে দাফন করবেন। [২ মসনদে আহমদ ও আব দাউদ। তবে শব্দাবলী মসনদের।]
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেছেন: মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে অবতরণ করবেন, তারপর তিনি বিবাহ করবেন এবং তার সন্তান সন্ততিও হবে। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং আমার সাথে আমার কবরেই তাঁকে দাফন করা হবে। [৩ এ হাদীসটি মিশকাতুল মাসাবীহের গ্রন্থকার ইবনে জাওযীর ‘আল ওফা’ কিতারে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন। হায়ছামীর ‘মাজমাউয জাওয়াইদ’ পুস্তকে অনুরূপ বর্ণিত আছে। এ হাদীসটি কাদিয়ানীদের মতেও বিশুদাধ পরে এর বর্ণনা আসবে।] এ ছাড়া আরো অনেক হাদীস এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সমস্ত হাদীসে প্রতিশ্রুত মাসীহের গুণাবলি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি কে হবেন? কোথা হতে আসবেন, কোথায় থাকবেন কেমন করে থাকবেন, তাঁর সময় কি কি সংঘটিত হবে, স্বয়ং তিনি কি করবেন, পৃথিবীতে কয়দিন অবস্থান করবেন এবং কোথায় সমাধিস্থ হবেন? এসব বিষয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্তারিত ভাবে ব্যক্ত করে গেছেন:-
১- প্রতিশ্রুত মাসীহ মরিয়ম পুত্র হবেন, অন্য কেহ নহে এবং অন্য কারো পুত্র নহে। আর, তাঁর অনুরূপ ও কেহ নহে।
২- তিনি আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবেন, অর্থাৎ তিনি শুধু প্রেরিতই হবেন না, বরং তাঁর জন্য প্রেরিত ও অবতীর্ণ হওয়া আবশ্যকীয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন।’ আর, এটা জানা কথা যে, অবতরণ করা প্রেরিত হওয়া নহে।
৩- তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তে সাদা মিনারের নিকট আকাশ হতে অবতরণ করবেন এবং তিনি অবতরণ কালে দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিহিত হবেন এবং দু’জন ফেরেস্তার ডানার উপর তাঁর দু’হাত রাখবেন।
৪- তাঁর অবতরণ কালে প্রত্যেক কাফের মৃত্যু বরণ করবে।
৫- তিনি ন্যায় পরায়ণ শাসক হবেন। শাসিত কিংবা অত্যাচারী শাসক হবেন না।
৬- তিনি ক্রস ভেঙে দেবেন। যাতে এরপর তার এবাদত না করা হয়।
৭- শুকর নিধন ও নিঃশেষ করার নির্দেশ দেবেন। এমনকি, তারপর এটা আর ভক্ষণ করা হবে না।
৮- সকল লোক দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করে নিবে। এমনকি দ্বীন ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন থাকবে না, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়।
৯- ‘লুদ’ নামক প্রবেশ দ্বারে দাজ্জালকে তিনি হত্যা করবেন।
১০- তাঁর যুগে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য হবে, এমনকি জনগণের কাছে ভিক্ষা করার মত কোন ভিক্ষুক থাকবে না। কারণ, তাঁর যুগে অধিক পরিমাণে বরকত ও কল্যাণ অবতীর্ণ হবে।
১১- তাঁর যুগে লোকজন আল্লাহর এবাদতের প্রতি উৎসাহিত হবে এবং প্রত্যেক উৎকৃষ্ট ও আকর্ষণীয় বস্ত্তর উপর উহাকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দেবে।
১২- পৃথিবীতে নিরাপত্তা স্থাপিত হবে। এমনকি বাঘ উটের সাথে, গরু চিতাবাঘের সাথে এবং নেকড়ে বাঘ ছাগলের সাথে মাঠে বিচরণ করবে। ছেলে পেলে সাপ নিয়ে খেলবে এবং ওরা তাদের কোন ক্ষতি করবে না।
১৩- অবতরণের পর তিনি হজ্জে এফরাদ বা হজ্জে তামাত্তু অথবা হজ্জে ক্বেরাণ করবেন।
১৪- তিনি পৃথিবীতে চল্লিশ বৎসরকাল অবস্থান করবেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যু ঘটবে।
১৫- মুসলমানগণ তার জানাযার নামাজ পড়বে।
১৬- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মুবারকে তাঁকে দাফন করা হবে।
এই হল প্রতিশ্রুত মাসীহের কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন এবং উল্লেখিত হাদীস সমূহ থেকে আমরা উদ্ধার করেছি। এখন আমরা দুষ্টিপাত করব গোলাম আহমদের দাবির প্রতি, ‘‘সে হল প্রতিশ্রুত মাসীহ, যার সম্বন্ধে সমুদয় আসমানি কিতাবে সংবাদ দেয়া হয়েছে’’। [১ রেফারেন্স পুস্তকের নাম পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।] তার উপর কি এ সমস্ত গুণাবলি প্রযোজ্য হয়?
প্রথমত: সে মরিয়ম পুত্র নহে এবং তার নাম ও ঈসা নহে। বরং তার নাম তারই বর্ণনানুযায়ী ‘আমার নাম গোলাম আহমদ, আমার বাবার নাম গোলাম মুর-তাজা এবং আমার দাদার নাম আতা মুহাম্মদ।’ (গোলামের ‘কিতাবুল বারিয়া’ এর টিকা, ১৩৪ পৃ:।) কেহ যেন এ ধারণা না করেন যে তার মাতার নাম মরিয়ম। মাতার নাম ‘চেরাগ বিবি’। প্রকাশ থাকে যে, জনৈক কাদিয়ানী লেখক তার নাম এই বলে উল্লেখ করেছে. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মা সাইয়েদা আমেনার পর পৃথিবীতে অধিক মর্যাদাবান আর কোন মা নেই মাত্র একজন ব্যতীত, আর তিনি হলেন ‘চেরাগ বিবি’। যিনি পৃথিবীতে একজন মহান সন্তান গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে জন্মদান করেছেন’। (ইয়াকুব কাদিয়ানীর ‘হায়াতুন নবী’ ১ম খন্ড, ১৪১ ও ১৪২ পৃ:।) সুতরাং তার নাম গোলাম আহমদ, তার পিতার নাম গোলাম মুরতাজা এবং তার মার নাম চেরাগ বিবি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে মরিয়মপুত্র অবতরণ করবেন’’। [২ বুখারী ও মুসলিম।] সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন: ‘আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। তারপর সে চল্লিশ দিন বা চল্লিশ মাস অথবা চল্লিশ বৎসর অবস্থান করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম কে প্রেরণ করবেন। তিনি ওরওয়া ইবন মাসউদের সাদৃশ্য হবেন। [১ মুসলিম, আহমদ, হাকিম, শব্দ মুসলিমের।] যখন এ সমস্ত সুস্পষ্ট বর্ণনাদি পাওয়া গেল তখন সে দিশে হারার মত প্রলাপ করতে থাকে, যাতে সে নিজেকে মরিয়ম পুত্র প্রমাণ করতে পারে; তা যে কোন প্রকারের নির্বুদ্ধিতা ও বোকামীর আশ্রয় নিয়ে হোক না কেন। সে লিখেছে: ‘আমাকে মরিয়ম বানান হয়েছে এবং দু’বৎসরকাল আমি মরিয়ম রয়েছি। অতঃপর আমার মধ্যে ঈসার রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে, যেমন মরিয়মের মধ্যে ফুঁকে দেয়া হয়েছিল। ফলে, আমি গর্ভ-ধারণ করি। অনূর্ধ্ব দশ মাস পর আমি মরিয়ম তে রূপান্তরিত হয়ে ঈসা হয়ে যাই। এভাবে আমি মরিয়ম পুত্র হই।’ (গোলামের ‘সফিনায়ে নূহ’ ১৬ পৃ:।) সে আরো বলেছে: আল্লাহ আমাকে মরিয়ম নাম দিয়েছেন, যিনি ঈসাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। সূরা তাহরীমে আল্লাহর এ উক্তিতে আমাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে: (ইমরানের কন্যা মরিয়ম যিনি তাঁর সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন, আমি তাঁর মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছি।) [২ সুরা তাহরীম, ১২।] কেননা, একমাত্র আমিই এ দাবি করেছি যে, আমি মরিয়ম এবং আমার মধ্যে ঈসার আলাইহিস সালাম এর রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে। (গোলামের ‘হাকীকতে ওহী’ এর টিকা, ৩৩৭ পৃ:।) একদা সে এর চেয়ে অধিক নির্বুদ্ধিতা ও বোকামী প্রদর্শন করে বলেছে,- ‘আমি স্বপ্নে আমাকে দেখেছি যেন আমি একজন মহিলা এবং আল্লাহ তাআলা আমার মধ্যে তাঁর পুরুষত্ব প্রকাশ করেছেন’। (ইয়ার মুহাম্মদ কাদিয়ানীর ‘রেওয়ায়েতুল গোলাম’ যা ‘দাহিয়াতুল ইসলামের’ ৩৪ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত।) অতঃপর সে এ কথার গুরুত্ব নিজেই উপলব্ধি করে মাসীহ ঈসা ইবন মরিয়ম সাজার বিভিন্ন কারণ দর্শাতে শুরু করে, যা পূর্বেকার কারণ গুলোর তুলনায় কম হাস্যকর নহে। একবার সে বলে মাসীহ ইবন মরিয়ম হওয়ার উদ্দেশ্য হল তার সাদৃশ্য এমনকি আমি জন্ম গ্রহণেও অদ্ভুত ধরনের। কেননা, যখন আমি জন্ম গ্রহণ করি। এটা মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক গর্ভে একটি সন্তানই জন্ম গ্রহণ করে থাকে। (গোলামের ‘তুহফায়ে কুলরা’ এর টিকা, ১১০ পৃ:) এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যের বিষয় আর কি হতে পারে?
আরেকবার সে এর চেয়েও অধিক আশ্চর্য জনক কথা বলেছে- ‘এ উম্মতের মাসীহ ঈসার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর তা হল এই- ‘ঈসা আলাইহিস সালাম সর্ব দিক দিয়ে বনি ইসরাঈল বংশোদ্ভূত ছিলেন না। শুধু মার দিক থেকে ইসরাঈলী ছিলেন। অনুরূপভাবে আমি হাসেমী। কেননা, আমার কোন কোন দাদী সাইয়েদ বংশোদ্ভূত। কিন্তু আমার পিতা সাইয়েদ নহেন।’ (গোলামের শিয়ালকোটের বক্তৃতা, ১৭ নম্বর।) সে আরো বলে- ‘আমি ঈসা আলাইহিস সালাম এর সহিত এই হিসেবে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, আমি কুরাইশ বংশীয় নই। কিন্তু আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়তের ধারাবাহিকতায় চৌদ্দ শতাব্দীতে প্রেরিত হয়েছি। যেমন, ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা না থাকার কারণে ইসরাঈল বংশীয় ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি মুসা আলাইহিস সালাম এর নবুয়তের ধারাবাহিকতায় তাঁর চৌদ্দ শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল হলেন। (গোলামের ‘তাজকেরাতুশ শাহাদাতাইন’ ৩৩পৃঃ।) এতেই কি সে ক্ষান্ত হয়েছে? না কখনও না। এতে সে ক্ষান্ত হয়নি হবেও না, বরং সে আবার বলেছে- ‘তোমরা বিশ্বাস কর যে, আমিই ঐ মরিয়ম পুত্র যিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আর, আমি কোন আধ্যাত্মিক উস্তাদ পাইনি। এটাই আমার এবং মরিয়ম পুত্র ঈসার মধ্যকার সামঞ্জস্য, যিনি পিতা বিহীন জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। যেমন আমি আধ্যাত্মিক পিতা বিহীন জন্ম গ্রহণ করেছি।’’ (‘এজালাতুল আওহাম’ ৬৫৯ পৃ:)
জানি না এত কিছুর পরও কাদিয়ানীরা মুসলমানদের নিকট এ আশা করতে পারে যে, তারা একে প্রতিশ্রুত মাসীহ বলে মেনে নেবে এবং তাকে বিশ্বাস করবে? হায় অসৎ সাহস! হায় স্পষ্ট অপবাদ রটনা! হায় প্রকাশ্য মিথ্যা! সে নিজেই বলেছে= ‘মিথ্যাবাদীর কথায় পরস্পর বিরোধিতা অবশ্যম্ভাবী’। (গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর ‘বারাহীনে আহমদিয়া’ পরিশিষ্ট, ৫ম খন্ড, ১১২পৃ)
২- সে আকাশ থেকে অবতরণ করেনি, বরং সে ভারতে পাঞ্জাবের একটি গ্রামে (কাদিয়ানে) জন্ম গ্রহণ করেছে। এই যে কাদিয়ানী পত্রিকা বলেছে- ‘কাদিয়ান মাসীহের জন্মস্থান, বাসস্থান ও সমাধিস্থান। উক্ত গ্রামে ঐ বাড়িটি এখনও রয়েছে যেখানে গোলাম আহমদ জন্ম গ্রহণ করেছে।’ (কাদিয়ানী পত্রিকা ‘আল ফজল’ ১৩ ডিসেম্বর ১৯২৯ খৃ:) দেখুন, কাদিয়ানীরা আপত্তি উত্থাপন করে বলতে পারে যে, হাদীসে আকাশ শব্দের উল্লেখ নেই, বুখারীতেও নেই, মুসলিমেও নেই, বরং আকাশের শর্তারোপ তোমাদের পক্ষ হতে করা হয়েছে। আর ‘নুযুলের’ অর্থ হল প্রকাশ পাওয়া।
আমরা উত্তরে বলব: ‘আকাশ শব্দটি আমাদের পক্ষ হতে বাড়ান হয়নি, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং এ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন যা ঐ হাদীসে রয়েছে যে হাদীসটি বায়হাকী ‘কিতাবুল আসমা ওয়াছ ছিফাত’ এ আবু হুরায়রা রা. থেকে উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘‘তোমাদের অবস্থা কেমন হবে, যখন মরিয়ম পুত্র আকাশ থেকে তোমাদের মধ্যে অবতরণ করবেন এবং তোমাদের ইমাম তোমাদের থেকেই হবে।’’ অতএব ‘নুযুল’ বা অবতরণ এর অর্থ ‘যহুর’ বা প্রকাশ পাওয়া গ্রহণ করা সঠিক নহে।
তারা বলে: ‘আকাশ’ শব্দটি বায়হাকীর পক্ষ থেকে বাড়ান হয়েছে। কেননা বায়হাকী এ হাদীসকে বুখারী ও মুসলিমের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। অথচ বুখারী ও মুসলিম এ অতিরিক্ত শব্দ দ্বারা হাদীসটি উল্লেখ করেন নি। তারা আরও বলে: এ হাদীসটিকে ইমাম সুয়ূতী রা. বায়হাকী থেকে ‘আকাশ’ শব্দের উল্লেখ ব্যতিরেকে বর্ণনা করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, ইমাম সুয়ূতী ও এ শব্দটিকে হাদীসের অংশরূপে ধারণা করেন নি।
প্রথমত: আমরা বলব যে, বায়হাকীর কিতাবটি কি, তা আমাদের উপলব্ধি করা উচিত। বায়হাকী এমন একটি কিতাব যা রেওয়ায়েতের ব্যাপারে স্বয়ং সম্পূর্ণ। অর্থাৎ এতে ইমাম বায়হাকী ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি ও ইবনে মাযা প্রমুখ হাদীস বেত্তাদের মত রেওয়ায়েতকে তার সনদ সহকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত উল্লেখ করে থাকেন। ঐ সমস্ত হাদীসের কিতাবের মত নহে যাতে শুধু মতনের উল্লেখ থাকে, সনদের উল্লেখ থাকে না। যেমন মিশকাতুল মাসাবীহ, বুলুগুল মারাম প্রভৃতি কিতাবে হাদীসকে শুধু একত্রিত করা হয়েছে। এ দু’প্রকার হাদীস গ্রন্থের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, প্রথম প্রকার যখন কোন হাদীসকে কোন কিতাবের সাথে সম্পৃক্ত করে তখন তার উদ্দেশ্য শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, মূল হাদীসটি ঐ কিতাবেও বিদ্যমান আছে। দ্বিতীয়টি এর বিপরীত। কেননা, যখন এতে কোন কিতাবের সাথে কোন হাদীসকে সম্পৃক্ত করা হয় তখন ঐ হাদীসের মূল সূত্রটি বর্ণনা করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এ হিসাবে যখন বায়হাকী এ হাদীসটিকে বুখারীর সাথে সম্পৃক্ত করলেন, তাতে তার উদ্দেশ্য এই নহে যে, এ হাদীসের মূল সূত্র হল বুখারী। বরং এ কথার দিকে ইঙ্গিত করাই উদ্দেশ্য যে, মূল হাদীসটি বুখারীও উল্লেখ করেছেন। আর এটা সুস্পষ্ট। তবে, আকাশ শব্দটিকে বায়হাকীর উল্লেখ করা এবং বুখারী ও মুসলিম উল্লেখ না করা, এতে কিছু যায় আসে না। কেননা, এ সমস্ত কিতাবের প্রত্যেকটি স্বয়ং মৌলিকত্বের অধিকারী। আর, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের অতিরিক্ত বিবরণ হাদীস বেত্তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। একথা সর্বসম্মত বলে খতীব বাগদাদী উল্লেখ করেছেন। [১ ১৭তম পরিচ্ছেদ, আল-বাইছুল হাছীছ- ইবনে কাছীর।] একথা স্পষ্ট যে, আকাশ শব্দটি নুযূলের প্রতিকুল নহে; বরং সম্পূর্ণরূপে অনুকুল।
দ্বিতীয়ত: জালালুদ্দীন সুয়ূতীর (সামা) আকাশ শব্দের উল্লেখ না করে এ হাদীসের বর্ণনা করা এ ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না যে, তিনি একে বায়হাকী থেকে উদ্ধৃত করার সময় লক্ষ করেন নি। প্রকৃত পক্ষে বায়হাকী উক্ত হাদীসে ‘সামা’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন এবং তার কিতাবেও তা বিদ্যমান। অথবা তিনি হাদীসটি উদ্ধৃত করার সময় বুখারী ও মুসলিমের শুধু মতনের উপর দৃষ্টি রেখেছেন। উক্ত দুই অবস্থার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব, এর দ্বারা হাদীসে উল্লেখ নেই বলে কোন দলীল উপস্থাপন করা যাবে না। এরূপ হওয়ার দৃষ্টান্ত বহু রয়েছে, যা হাদীস গবেষকদের কাছে অজানা নহে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেই মাসীহের (আঃ) আকাশ হতে অবতরণের কথা স্বীকার করে বলেছে- ‘হাদীসে আছে যে, মাসীহ আলাইহিস সালাম দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে আকাশ থেকে অবতরণ করবেন’। (গোলামের ‘ এজালাতুল আওহাম’ ৮১ পৃ:।) এমনিভাবে, তার কিতাব ‘তাশহীজুল আজহানে’ সে বলেছে। কাজেই পালাবার কোন উপাই নেই। কেননা, আমরা সত্যবাদী নবী আল্লাহর রাসূল থেকে প্রমাণ করেছি, তিনি মাসীহের আলাইহিস সালাম একটি গুণ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আকাশ হতে অবতরণ করবেন। যেমন আমরা ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী থেকে তার স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছি যে ঈসা আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। আর এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। এর দ্বারা গোলাম আহমদের মাসীহ হওয়ার দাবি মিথ্যা সাব্যস্ত হয়ে যায়।
৩- এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর (মাসীহ) অবতরণ স্থলের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, তিনি হলুদ রংয়ের দু’টি চাদর পরিধান করে দুজন ফেরেস্তার ডানার উপর দু’হাত রেখে পূর্ব দামেস্কর সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন।’ আর জানা কথা যে, গোলাম আহমদ পূর্ব দামেস্কর সাদা মিনারের নিকট কখনও অবতরণ করেনি। বরং সে কাদিয়ানে জন্ম গ্রহণ করেছে। আমরা ইতিপূর্বে তা উল্লেখ করেছি। এমনকি সে তার জীবনে কখনও দামেস্ক দেখেনি। কথিত আছে, ‘যখন তোমার লজ্জা থাকবে না তখন যা ইচ্ছে তা কর’ এই হাদীসটি সে অস্বীকার করতে না পেরে এর বিকৃত ও মেকী ব্যাখ্যা দিতে আরম্ভ করল। কখনও সে বলে: আমি মাসীহের আগমনের সম্ভাবনা রয়েছে’। (এজালাতুল আওহাম’ ৭২-৭৩ পৃ:।) সে আরো বলে: ‘আমি অপর একজন মসীহের আগমনের সম্ভাবনা অস্বীকার করি না এবং কখনও অস্বীকার করব না, যার উপর হাদীসে বর্ণিত প্রকাশ্য গুণাবলি প্রযোজ্য হয় আবার তা প্রকাশ্য অর্থে প্রযোজ্য হয় না। (হায় আক্ষেপের বিষয়।) হয়ত বা প্রকৃত পক্ষে মাসীহ দামেস্কে অবতরণ করবেন। (শেখ আব্দুল জববারের নিকট গোলামের লিখিত পত্র যা কাশেম কাদিয়ানীর লিখিত ‘তাবলীগে রেসালতের’ ২য় খন্ড ১৫৯ পৃ: সন্নিবেশিত।) অতঃপর যখন সে বুঝতে পারল যে, এতে কোন ফলোদয় হবে না। তখন সে নতুন পন্থা অবলম্বন করল। কিন্তু এটা প্রথমটি থেকে আরো নিকৃষ্ট। সে বলে- ‘সহীহ মুসলিমে যে কথার উল্লেখ রয়েছে যে, মাসীহ আলাইহিস সালাম পূর্ব দামেস্কের সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন, তা মহাক্কেক আলেমগণকে অস্থির করে তুলেছে। কিন্তু এখন আল্লাহ আমার কাছে এর অর্থ প্রকাশ করেছেন। আর তা হল- দামেস্ক দ্বারা এমন জনপদ উদ্দেশ্য করা হয়েছে যেখানে ইয়াজিদ পন্থীরা বসবাস করে, যারা আল্লাহর শত্রু এবং আল্লাহর রাসূলের শত্রু; যারা তাদের প্রবৃত্তিকে উপাস্য নির্ধারণ করেছে এবং নিজ ‘নফসে আম্মারার’ অনুসরণ করেছে। তা সত্ত্বেও এদের মধ্যেই মাসীহের অবতরণ করা অনিবার্য। আল্লাহ তা,আলা আমার কাছে এ কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন যে, দামেস্ক দ্বারা এমন একটি জনপদ উদ্দেশ্য করা হয়েছে যেখানে দামেস্কের বৈশিষ্টাবলী বিদ্যমান আছে। আর সেটা হল ঐ কাদিয়ান। আল্লাহ আমার কাছে এটা প্রকাশ করেছেন। কেননা, কাদিয়ান দামেস্কের সাথে সামঞ্জস্য রাখে এবং এতে এজিদ পন্থীরা বসবাস করে। আর একথা স্পষ্ট যে উদাহরণে পুরাপুরি সামঞ্জস্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং অনেক সময় দু’বস্ত্তর মধ্যে সামান্যতম সামঞ্জস্য থাকার কারণে এক বস্ত্তর উপর অপর বস্ত্তর নাম ব্যবহার করা হয়। এ সাধারণ নিয়ম অনুসারে আল্লাহ দামেস্কর সহিত কাদিয়ানের তুলনা করেছেন। (গোলামের এজালাতুল আওহাম ৬৩-৭০ পৃ: সার সংক্ষেপ।) বাকি রইল ‘মিনারের’ প্রশ্ন? তার মাসীহিয়্যতের দাবি করার বার বৎসর পর ১৯০৩ সালে কাদিয়ানে একটি মিনার নির্মাণ করে তার নামকরণ করল ‘মানারাতুল মাসীহ’। আর বলল, এটাই সেই মিনার হাদীসে যার উল্লেখ রয়েছে যে এতে মাসীহ অবতরণ করবেন। (গোলামের ঘোষণা যা তার ঘোষণা-বলীর সমষ্টি, কাসেম কাদিয়ানীর ‘তাবলীগে রেসালাতে’ সন্নিবেশিত।) এটা কি বোকামীর পর বোকামী নহে? এ অজ্ঞতার উপর কি আর কোন অজ্ঞতা হতে পারে? ঐ সকল আচ্ছাদিত বুদ্ধিমত্তার জন্য আফসোস যারা একে বিশ্বাস করে এবং এর অনুসরণ করে! ঐ সকল নির্বুদ্ধিতা ও দুর্বল বিষয়াদিকে জেনে শুনেও একে বিশ্বাস করে এবং মেনে চলে। মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন- ‘তাদের অন্তর আছে যদ্দরা তারা অনুধাবন করতে পারে না এবং তাদের চক্ষু আছে যদ্দারা তারা দেখতে পারে না এবং তাদের কান আছে যদ্দরা তারা শুনতে পারে না। ওরা একেবারে উদাসীন। [২ সূরা আ’রাফ, ১৭৯।] এর চেয়ে অধিক আশ্চর্যের বিষয় হল- যখন হাদীসে একথা উল্লেখ রয়েছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম দু’টিচাদর পরিধান করে অবতরণ করবেন, তখন সে বলল- সহীহ মুসলিমে এর প্রমাণ আছে যে, ঈসা আলাইহি সালাম দু’টি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে অবতরণ করবেন এর অর্থ হল, তিনি অবতরণ কালে অসুস্থ থাকবেন। (গোলামের এজালাতুর আওহাম’ ৮১ পৃ:) সে আরো বলে- দুই চাদর দ্বারা উদ্দেশ্য দুটি রোগ। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথার দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, মাসীহ তাঁর অবতরণ কালে দুটি রোগে আক্রান্ত থাকবেন। উল্লেখ্য যে আমি দুটি রোগে আক্রান্ত আছি। একটি বহুমূত্র, অপরটি মাথাঘুরান। (গোলামের প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা ‘বদরে’ সন্নিবেশিত, ৮ই জুন ১৯০৬ খৃ:।) সে লিখেছে- যখন আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবি করি তখন আমি দুটি রোগে আক্রান্ত হই, একটি বহুমূত্র অপরটি মাথাঘুরান। (গোলামের হকী-কতে ওহী’ ১০৬ও ২০৭ পৃ:) পরিশেষে এই হাদীসে আছে যে, মাসীহ আলাইহিস সালাম দুটি হলুদ বর্ণের চাদর পরিধান করে অবতরণ করবেন। চাদর দুটি হল আমার মাথা ঘুরান রোগ যার প্রচন্ডতার কারণে আমি কখনও মাটিতে পড়ে যাই এবং আমার বহুমূত্র রোগ, যার কারণে আমি কখনও কখনও রোজ একশতবার প্রস্রাব করে থাকি। (গোলামের বারাহীনে আহমদিয়া’ এর পরিশিষ্ট ৫ম খন্ড, ২০১ পৃ:।)
এটা কি আশ্চর্যের ব্যাপার নহে যে, সত্য মাসীহ আলাইহিস সালাম জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করতেন এবং আল্লাহর নির্দেশে মৃতদের জীবিত করতেন? আর এই মিথ্যা মাসীহ এমন রোগে আক্রান্ত হয় যা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে ফেলে দেয়, এবং এত অধিক পরিমাণ প্রস্রাব করে যে সর্বদা তার পাশে পাত্র রাখতে সে বাধ্য হয়, যাঁর মধ্যে প্রস্রাব করে নিজেই উহা বাহিরে ফেলে দেয়। (কাদিয়ানী মুফতি মুহাম্মদ সাদেকের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে সন্নিবেশিত, ৬ই ডিসেম্বর ১৯২৪ খৃ:) এ সমস্ত অন্তঃ সারশূন্য ব্যাখ্যা দেওয়ার পরও সে মনের দিক থেকে শান্তি লাভ করতে পারেনি। এমনকি, সে বলেছে: ‘অপর একজন মাসীহের অবতরণ সম্ভব যার উপর হাদীসে বর্ণিত গুণাবলি বাহ্যিকভাবে প্রযোজ্য হবে’। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ১৯৯ পৃ:।) সে তার এ বক্তব্যে সত্যই বলেছে যে, পরস্পর বিরোধী দুটি বক্তব্য পাগল বা মুনাফিক ব্যতীত আর কারো কাছ থেকে প্রকাশ পাবে না। (গোলামের ছিত্তে ভজন ৩১ পৃ:।) মোটকথা এ গুণটিও এই জনাবের উপর প্রযোজ্য হয়নি। আর তা হল এই মাসীহ আলাইহিস সালাম দুটি হলদে বর্ণের চাদর পরিধান করে দুজন ফেরেস্তার ডানার উপর ভর করে পূর্ব দামেস্কের সাদা মিনারের নিকট অবতরণ করবেন। [১ আমি জানি না যে, তারা কিভাবে্এ হাদীসের ব্যাখ্যা করে? অর্থাৎ মাসীহ দুই ফেরেস্তার ডানার উপর দুহাত দিয়ে ভর করে? অর্থাৎ মাসীহ দুই ফেরেস্তার ডানার উপর দুহাত দিয়ে ভর করে অবতরণ করবেন। সম্ভবতঃ কাদিয়ানীর দৃষ্টি এদিকে পড়েনি। অন্যথায় সে একথা বলত না যে, উহা দ্বারা দুটি কাঠ উদ্দেশ্য যার উপর চলাফেরায় অক্ষম ব্যক্তি ভর করে। ওলা হাওলা ওলাওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।] অতএব, প্রমাণিত হল যে, সে তার দাবিতে মিথ্যা..........।
৪- চতুর্থ গুণটি হল যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, তা হল- ‘কাফেরদের মৃত্যু বরণ। তিনি এরশাদ করেছেন- ‘‘কোন কাফের তার নিশ্বাসের গন্ধ পেলেই মৃত্যুবরণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর তাঁর নিশবাস এত দুর পর্যন্ত পৌঁছোবে যত দুর পর্যন্ত তার দৃষ্টি পৌঁছোবে’’। গোলাম আহমদের অবস্থা এর বিপরীত। তার দাবিকালে কাফেরদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কেননা, সে বলেছে যে, আমাকে বিশ্বাস করবে না সে কাফের। (গোলামের হাকীকতে ওহী ১৬৩ পৃ:।) তার উপর মাত্র বিশ হাজার নির্বোধ লোক বিশ্বাস করেছে। অচিরেই আমি এর বিস্তারিত আলোচনা করব যে তার মৃত্যুর বিশ বৎসর পর যখন আদম শুমারি করা হল, তখনও কাদিয়ানীদের সংখ্যা পঁচাত্তর হাজার অতিক্রম করেনি। (আল-ফজল, ২১ জুন ১৯৩৪ খৃ:।) এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, মৃত্যুর দ্বারা কাফেরদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার স্থলে দুই হাজার মিলিয়নেরও অধিক লোক তার আগমনের কারণে কাফের হয়ে গেল...।
৫- মাসীহে মাওউদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হল, ‘‘তিনি ন্যায় বিচারক শাসক হবেন, শাসিত নহে। অত্যাচারী শাসক ও নহে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এই জনাব গোলাম কাদিয়ানী শুধু শাসিতই ছিলেন না, বরং লাঞ্ছিত ও তার জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক এবং কাফের সাম্রাজ্যবাদের দাস ও তার প্রজা হওয়ার দ্বারা গৌরাবান্নিত ছিল। এই তো সে ইংরেজের দাসত্বের কথা সগৌরবে উল্লেখ করে বলছে- ‘আমার পিতা আমরণ ইংরেজ সরকারের নিষ্ঠাবান সেবক ছিলেন। তার পর মহান সরকারের এই খেদমত আমার ভাই গোলাম গোলাম কাদির উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। তিনিও আমরণ ইংরেজ সরকারের ভালোবাসা ও সেবায় আমাদের বাবার পথ অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। অতঃপর আমি তাদের পথ ধরে চলছি এবং যথাযথভাবে তাদের অনুসরণ করছি। কিন্তু আমি কোন ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলাম না। এজন্য আমি আমার হাত ও কলম দ্বারা ইংরেজ সরকারের সেবা করতে উদ্যোগী হলাম। আল্লাহর নামে অঙ্গিকার করলাম যে, আমি এমন কোন পুস্তক লিখব না যাতে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ থাকবে না। (গোলামের নুরুল হক ১ম খন্ড ২৮ পৃ:।) সে আরো বলে: আমি ইংরেজ সরকারের এমন সেবা করেছি যেমন সেবা আর কেউ করতে পারেনি। এমনকি আমার বাপ দাদাও নহে। আর তা হল এই- আমি আরবী ফার্সী ও উর্দু ভাষায় কয়েক দশক পুস্তক এ উদ্দেশ্যে রচনা করেছি, যাতে আমি এ কথা ব্যক্তি করি যে, দয়াবান ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ নহে। সকল মুসলমানের কর্তব্য হল তারা যেন খাঁটি অন্তরে এ সরকারের আনুগত্য করে। এ জন্য আমি আমার বিশ্বস্ত শিষ্যদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছি যারা ইংরেজ সরকারের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং তার জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্ত্তত’। (গোলাম কাদিয়ানীর ভাষণ যা তাবলীগে রেসালাতে সন্নিবেশিত, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬৫ পৃ:।) সে আরো বলেছে: প্রত্যেক সৌভাগ্যবান মুসলিমের কর্তব্য হল ইংরেজদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য দো’আ করা এবং শত্রুদের উপর তাদের বিজয় কামনা করা। কেননা, এরা একটি অনুগ্রহশীল জাতি এবং আমাদের উপর এ ব্রিটিশ সরকারের বড় বড় অবদান রয়েছে। যে সকল মুসলমান এ সরকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করি তা হলে আমরা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হব।’ (গোলাম কাদিয়ানীর এজালাতুল আওহাম ৯পঃ।) উপরন্তু সে নিজেই স্বীকার করেছে যে, হাদীসের শব্দাবলির বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী প্রতিশ্রুত মাসিহ রাজত্ব ও শাসন ক্ষমতা নিয়ে আসবেন। ‘‘ কিন্তু আমি ফকিরী ও দরবেশি নিয়ে এসেছি’’। (গোলামের ‘এজালাতুল আওহাম’ ৩০০ পৃ:।) হায়রে তার অসহায় অবস্থা!
৬- মাসীহ আলাইহিস সালাম এর অপর একটা নিদর্শন হল যে, তিনি ক্রুশকে ভেঙে ফেলবেন। এরপর আর ক্রুশের পূজা হবে না। এটা হল সাইয়েদেনা ঈসার আলাইহিস সালাম বড় বড় অলৌকিক ঘটনাবলীর অন্যতম। তিনি পৃথিবীতে এমন কোন ক্রুশ রাখবেন না যার পূজা করা হবে, এভাবে এমন কোন খ্রিস্টানও রাখবেন না, যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সামনে রুকু, সেজদা করবে। এ কথা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী স্বীকার করে বলেছে: ‘প্রতিশ্রুত মাসীহের আলাইহিস সালাম জন্য যে সকল প্রকাশ্য ও স্পষ্ট নিদর্শনা বলী নির্ধারণ করা হয়েছে তার অন্যতম হল তার হাতে ক্রুশ ভাঙ্গা হবে। (গোলামের আঞ্জামে আথম ৪৬ পৃ:।) এ কথাটি পরবর্তী পৃষ্ঠায় দ্বিতীয়বার উল্লেখ করে বলেছে: ‘হাদীসে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যে, মাসীহের আলাইহিস সালাম সর্ব প্রথম নিদর্শন তার হাতে ক্রুশ চূর্ণ হবে।’ (উল্লেখিত কিতাব ৪৭ পৃ:) এ বখাটেকে সে আরো অধিক স্পষ্ট করে বলেছে: মাসীহের আলাইহিস সালাম অবতরণ উদ্দেশ্য হল, ত্রিত্ববাদের চিন্তাধারাকে মুছে ফেলা এবং একক আল্লাহর মহত্ত্ব প্রকাশ করা। (গোলামের মানারাতুল মাসীহের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালাতে সন্নিবেশিত।) অনুরূপভাবে সে অন্যত্র লিখছে: মাসীহ আলাইহিস সালাম তার সকল প্রচেষ্টা ত্রিত্ববাদের চিন্তাকে মুছে ফেলার জন্য ব্যয় করবেন।’ (গোলামের ‘আইয়ামে সুলহ’ এর টীকা, ৪৪ পৃ:।) একথা স্বীকার করার পর তার মাসীহিয়তের প্রমাণ স্বরূপ বর্ণনা করেছে. ‘এ ক্ষেত্রে (মাসীহিয়াতের ক্ষেত্রে) আমি যে কাজ সম্পন্ন করছি তা হল, ঈসা আলাইহিস সালাম এর এবাদতের স্তম্ভ গুলো আমি, ভেঙে দিচ্ছি। (গোলামের প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা বদরে সন্নিবেশিত, ১৯শে জুলাই, ১৯০৬ খু:)
গোলাম কাদিয়ানীর জন্য তা কি অর্জিত হয়েছে? আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশ্রুত মাসীহের যে সকল গুণাবলি বর্ণনা করেছেন এবং মিথ্যাবাদী ভন্ডনবী ও যা স্বীকার করেছে, তা কি তার উপর প্রযোজ্য হয়েছে? এখন আমাদের দেখা উচিত, কাদিয়ানী পত্রিকা মাসিহিয়্যাত সম্পর্কে কি বলেছে, তা কি মুছে গেছে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, অথবা বর্ধিত ও উন্নত হয়েছে? ‘পয়গামে সুলাহতে কাদিয়ানীরা প্রচার করেছে যে, মসীহিয়্যাত দিন দিন উন্নতি লাভ করছে। (পয়গামে সুলাহ, ৬ই মার্চ, ১৯২৮ খৃ: প্রকাশিত।) এটাকে কাদিয়ানীরা স্বীকার করে নিয়েছে। আর এটাই হল গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নিজ এলাকা ‘গুরদ উসবুরে’ মাসীহিয়্যাত সম্পর্কে আদম শুমারীর ভাষ্য। ১৮৯১ সালে গোলাম আহমদ যখন প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার ঘোষণা দিল তখন গুরদ উসবুরে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই হাজার চারশো জন। এটাই নির্ধারিত ছিল যে, গোলাম আহমদ মাসীহিয়্যতের ঘোষণা করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ প্রদান ও গোলাম আহমদের স্বীকৃতি অনুযায়ী একটি খ্রিস্টানও অবশিষ্ট থাকবে না। বিশেষ করে ঐ এলাকায় যেখানে সে বসবাস করে। কিন্তু ঘটল কি? মাত্র দশ বৎসর পর ১৯০১ সালে এদের সংখ্যা ৪৪৭১ জনে পৌঁছোল। যখন এ এলাকার পরবর্তী আদম শুমারী ১৯১১ সালে অনুষ্ঠিত হল তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়াল ২৩৩৬৫ জনে এবং ১৯৩১ সালে ৪৩৩৪৩ জনে। অর্থাৎ গোলামের মাসীহিয়্যতের ঘোষণার পর মাত্র চল্লিশ বৎসরের মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বিশগুণ বেড়ে গেল। আর ইহা ঘটল একটা ছোট এলাকা অর্থাৎ তারই এলাকায়। এটা তার ঐ কথা সত্ত্বেও ঘটল: ‘আমি যদি ইসলামের সাহায্যার্থে এমন কাজ না করে মরে যাই যা মাসীহিয়্যতের সহিত সম্পৃক্ত, তবে তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমি মিথ্যাবাদী। (গোলামের প্রবন্ধ যা ১৯শে জুলাই, ১৯০৬ সালের বদরে সন্নিবেশিত। শেখ আব্দুল্লাহ মেমারের পকেট বুক হতে উদ্ধৃত।)
প্রকাশ থাকে যে, আমরা আদম শুমারী এবং কাদিয়ানীদের স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রমাণ করেছি যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের যা কর্তব্য ছিল তা সে করেনি। তবে সে নিজেরই বক্তব্য অনুযায়ী মিথ্যাবাদী ব্যতীত আর কিছুই নহে। তার বক্তব্য অনুযায়ী আমরাও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে সে একটা মস্ত বড় মিথ্যুক।
৭- প্রতিশ্রুত মসীহের সপ্তম বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তিনি শুকর নিধন ও উহা নির্মূল করার নির্দেশ দেবেন। এমনকি, এরপর আদৌ উহা ভক্ষণ করা হবে না। এটা কি গোলাম লাভ করতে পেরেছে? এখন পর্যন্ত কি শুকর ভক্ষণ করা হচ্ছে না, না কি হয়?
৮- প্রতিশ্রুত মাসীহের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তিনি সমুদয় মানব জাতিকে একই ধর্ম ইসলামের উপর একত্রিত করবেন। অপর কোন ধর্ম অবশিষ্ট থাকবে না, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি ‘বরং তিনি যুদ্ধ রহিত করবেন, দ্বারা তা বুঝা যাচ্ছে। সুতরাং কেহ যেন এ ধারণা না করে যে, যুদ্ধ রহিত করার অর্থ জেহাদ উঠিয়ে দেওয়া। না, বরং এর অর্থ হল ইসলাম ব্যতীত অপর কোন ধর্মকে তিনি অবশিষ্ট রাখবেন না যাতে তার যুদ্ধ করতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিনি ওহীর সাহায্যে কথা বলেন, তিনি এ অর্থটি বিস্তারিত ভাবে অপর হাদীসে বর্ণনা করেছেন, যা আহমদ তাঁর মসনদে এবং আবু দাউদ তার সূনানে উল্লেখ করেছেন: ‘আমি মরিয়ম পুত্রের অধিক নিকটবর্তী, তিনি অবতরণ করবেন। যখন তোমরা তাঁকে দেখবে তখন এমন অবস্থা দ্বারা তাঁকে চিনে নাও যে, তিনি একজন মধ্যম গড়নের লাল সাদা মিশ্রিত রংয়ের লোক হবেন। তাঁর পরনে দুটি হলুদ বর্ণের কাপড় হবে, তাঁর মাথা থেকে যেন পানির ফোটা পড়ছে, যদিও আদ্রতা তাকে আদৌ স্পর্শ করেনি। তিনি ক্রুশ চূর্ণ বিচূর্ণ করবেন, শুকর হত্যা করবেন, কর রহিত করবেন এবং মানব জাতিকে ইসলামের দিকে আহবান করবেন। তার যুগে আল্লাহ তাআলা ইসলাম ব্যতীত সমুদয় ধর্মকে খতম করে দেবেন..। হাদীসের শেষ পর্যন্ত । [১ আহমদ আবু দাউদ।] আবু হুরায়রা রা. এ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন: ইচ্ছে হলে তোমরা পড় [২ বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাযা ও আহমদ। কোন কোন আলেম এ রেওয়ায়েতকে মারুফ বলে উল্লেখ করেছেন।]:
وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا ﴿النساء 159﴾
‘‘আহলে কিতাবের সকলেই তার মৃত্যুতে পূর্বে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাদের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাদের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবেন।’’ [১ সুরা নিসা ১৫৯] ভন্ডনবী কাদিয়ানীও একথা স্বীকার করেছে যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের অন্যতম গুণ হবে ইসলাম প্রচার করা এবং তাঁর যুগের অন্যান্য ধর্মকে মিটিয়ে দেওয়া। এটাই হল তার ভাষ্য ‘এর উপর সবাই একমত যে, প্রতিশ্রুত মাসীহের যুগে পৃথিবীতে ইসলাম অধিক মাত্রায় প্রসার লাভ করবে এবং অন্যান্য বাতিল ধর্মসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (গোলামের আইয়ামে সুলাহ ১৩৬পৃঃ) সে লিখেছে- আল্লাহর উক্তি: আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম, এর মধ্যে রাজীম শব্দ থেকে প্রকাশ পাচ্ছে যে, এমন একটি যুগ আসবে যখন কোন বাতিল অবশিষ্ট থাকবে না এবং মিথ্যা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর ইসলাম ব্যতীত সকল ধর্ম নির্মূল হয়ে যাবে। (গোলামের এজাজে মাসীহ ৮৩ পৃ:।) সে আরো বলেছে: আল্লাহর ইচ্ছে যে, সমুদয় ধর্মকে এক ধর্মে পরিণত করবেন। আর এ কাজের জন্য একজন প্রতিনিধি নির্ধারিত করে তাঁর নাম রেখেছেন প্রতিশ্রুত মাসীহ’। (গোলামের মেরআতুল মারেফা ৮২ পৃ:।)
এখন প্রশ্ন হল গোলাম আহমদের মাসীহিয়্যাত দাবি করার পর ইসলাম ধর্ম ব্যতীত অপর সকল ধর্ম কি ধ্বংস হয়ে গেছে? এবং এক ধর্ম অর্থাৎ ইসলামের উপর কি সকল লোক একত্রিত হয়েছে? এ প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক, এবং এর উত্তর অতি স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। বরং বহু বাতিল ধর্মের মধ্যে আর একটি ধর্ম বৃদ্ধি পেল। আর তা হল মিথ্যাবাদী কাদিয়ানীর মতবাদ কাদিয়ানী ধর্ম।
৯- মাসীহ আলাইহিস সালাম আর একটি অন্যতম গুণ হল- তিনি ‘লুদ’ দ্বার প্রান্তে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, তিনি লুদ নামক দ্বার প্রান্তে দাজ্জালকে খুঁজে পাবেন এবং তথায় তাকে হত্যা করবেন। ভন্ডনবী কাদিয়ানীও প্রতিশ্রুত মাসীহের এ গুণটি স্বীকার করে বলেছে: অতপর মরিয়ম পুত্র মাসীহ দাজ্জালের অন্বেষণে বের হবেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের লুদ নামক জনপদের দরজার নিকটে তাকে পেয়ে হত্যা করবেন। (গোলাম কাদিয়ানীর এজালাতুল আহাম, ২২০ পৃ:।) গোলাম আহমদ নিজেই প্রতিশ্রুত মাসীহের এ গুণটি স্বীকার পর তার জন্য কি এ গুণ অর্জিত হয়েছে? না, কখনও না। কেহই এ কথা বলে নাই এবং বলতে পারবে না যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী দাজ্জালকে হত্যা করেছে। সে তো এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে যে, বাইতুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত হয়নি এবং তা দেখেও নি।
১০- প্রতিশ্রুত মাসীহের দশম গুণ হল এই যে, তাঁর যুগে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য হবে। এমনকি কোন ভিক্ষুক থাকবে না যে লোকের কাছে ভিক্ষা চেয়ে ফিরে। সত্যবাদী বিশ্বস্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন: ‘‘ধন-সম্পদে অধিক হবে যে, কেহই উহা গ্রহণ করবে না’’। আর, এটা হবে প্রতিশ্রুত মাসীহের বরকত। (তার উপর ও আমাদের নবীর উপর হাজার হাজার সালাম।) প্রতিশ্রুত মাসীহের দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর যুগে কি এমন হয়েছে? সম্পদ কি এত অধিক পরিমাণে হয়েছে যে, কোন ভিক্ষুক অবশিষ্ট থাকে নাই, যে ভিক্ষা চেয়ে ফিরে এবং এমন কোন মিসকিন অবশিষ্ট থাকে নাই, যে মানুষের হাতের দিকে তাকায়? কাদিয়ানী মাসীহ কি লোকজনকে ধন-সম্পদ দান করবেন এবং লোকজনকে তা গ্রহণ করতে আহবান জানাবেন। কিন্তু কেহই তা গ্রহণ করবে না। আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ঈসা আলাইহিস সালাম ন্যায় বিচারক, শাসক এবং ন্যায় পরায়ণ ইমাম রূপে অবতরণ না করেন। তখন তিনি ক্রুশ ভাঙবেন, শুকর হত্যা করবেন এবং কর রহিত করবেন। ধন-সম্পদের এতই প্রাচুর্য হবে যে, উহা কেহই গ্রহণ করবে না।’ [১ ইবনে মাজাহ।] অপর এক বর্ণনায় আছে- লোকজন একে অপরকে ধন-সম্পদ গ্রহণ করার জন্য ডাকবে, কিন্তু কেহই তা গ্রহণ করবে না। [২ মুসনাদে আহমদ] এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘তিনি শুকর হত্যা করবেন, ক্রুশ মুছে ফেলবেন এবং ধন-সম্পদ দান করবেন, কিন্তু কেহই তা গ্রহণ করবে না। [৩ মুসনাদে আহমদ] এর আলোকে যখন আমরা কাদিয়ানীর ইতিহাস ও তার চরিত্র দেখি, তখন আমরা ব্যাপারটি এর সম্পূর্ণ বিপরীত পাই। ভন্ডনবী কাদিয়ানীকে আমরা ধন-সম্পদ বিতরণকারী ও দাতা হওয়ার পরিবর্তে লোকের নিকট ভিক্ষা করতে ও তাঁদের নিকট স্পষ্ট চাইতে দেখি। সে তার ভক্তগণের নিকট এই বলে সওয়াল করে: যারা আমার অনুসরণকরে তাদের কর্তব্য হল প্রত্যেক মাসে তাদের মালের এক অংশ আমার নিকট পাঠিয়ে দেওয়া। এ ঘোষণার পর আমি তিন মাস অপেক্ষা করব, যে ব্যক্তি এ তিন মাসের মধ্যে আমার নিকট তার মালের একটি অংশ পাঠাবে না, আমি আমার ভক্তগণের তালিকা হতে তার নাম মুছে ফেলব। (গোলামের লওহুল মাহদী ১পৃঃ।) সে তার ভক্তগণের নিকট আরো লিখেছে লোকজনের কিছু দান-দক্ষিণা করা উচিত। কেননা, কোন কাজই টাকা পয়সা ব্যতীত সম্ভব নহে। আমাদের জামাতের এ দিকে লক্ষ্য করে যথা সম্ভব দান দক্ষিণা জমা করা কর্তব্য। (গোলামের ঘোষণা যা কাদিয়ানী পত্রিকা বদরে সন্নিবেশিত, ৯ই জুলাই ১৯০৩ খৃ:।) শুধু তা-ই নহে বরং সে তার ভক্তগণের জন্য যে দোয়া করত তারও বিনিময় গ্রহণ করত। কাদিয়ানী মুফতি উল্লেখ করেছেন ‘একদা একজন কাদিয়ানী ধনী ব্যক্তির ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের নিকট তার রোগ নিরাময়ের দোয়া চাইল। জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ তার উত্তরে বললেন: এ ধনী ব্যক্তির উচিত যে একটা বড় অঙ্কের টাকা যেন আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়, তা হলে আমি তার পুত্রের জন্য দোয়া করব।’ (কাদিয়ানী মুফতি মুহাম্মদ সাদেকের ভাষণ যা আল ফজর পত্রিকায় সন্নিবেশিত, ২২শে অক্টোবর, ১৯৩৭ খৃ: প্রকাশিত।) ভিক্ষা করতে করতে সে এমন নিম্ন পর্যায়ে নেমে যায় যে তার ভক্তগণের সঙ্গে কবর বেচা কেনা এবং এর দ্বারা ব্যবসা করতে আরম্ভ করে । এ ব্যবসার বিস্তারিত অবস্থা হল এই প্রথমত: সে ঘোষণা দিল আমি এখনই এমন একটা কবরস্থান দেখতে পেলাম, আল্লাহ তাআলা যার নাম রেখেছেন জান্নাতের কবরস্থান। তারপর আমার কাছে এলহাম এসেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত কবরস্থান এ ভূমির সমতুল্য নহে। (মঞ্জুর কাদিয়ানীর লিখিত মুকাশেফাতুল গোলাম’ ৫৯ পৃ:।) অতঃপর তার ভক্তগণকে এই বলে উৎসাহিত করে- আমার প্রভু আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন এবং একটি ভূমির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, এটা এমন একটি ভূমি যার নীচে বেহেস্ত আছে। যে ব্যক্তি এখানে সমাধিস্থ হবে সে বেহেস্ত প্রবেশ করবে এবং তার কোন ভয় ভীতি থাকবে না।’ (গোলামের আল-ইস্তেফতা আরবী ৫১ পৃ:) এরপর, সে তার মূল অবস্থা ধাপ্পা বাজী ও ধন সম্পদ কেড়ে নেওয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করে বলে: কাদিয়ানীদের কবরস্থানের জন্য আর একটি ভূমি সংগ্রহ করেছি এবং আল্লাহ আমাকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, এ ভূমিটি বেহেস্ত এবং বলেছেন যে তিনি সর্ব প্রকার রহমত এতে অবতীর্ণ করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি এ সকল কবরে সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবে, তার কর্তব্য হবে সামর্থ্যনুযায়ী তার সম্পদের কিছু অংশ পাঠিয়ে দেওয়া। তার আরো কর্তব্য হবে তার ত্যাজ্য সম্পত্তির এক দশমাংশ কাদিয়ানী তহবিলের জন্য অছিয়ত করে যাওয়া।’’(গোলাম কাদিয়ানীর আল- অছিয়ত’ ১২-১৩ পৃ:।)
অপর দিকে, তার মাসীহিয়্যতের দাবির পিছনে ঐ সম্পদ লাভই উদ্দেশ্য ছিল, যা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা তাকে প্রদান করেছিল এবং যা সরলমনা লোকজন হতে অর্জনের আশা করত। তার পুত্র ও দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ তার মামা হতে বর্ণনা করে বলেছে: মির্জা শের আলী একজন সুদর্শন, সম্মানী এবং সাদা দীর্ঘ দাড়ি বিশিষ্ট লোক ছিলেন। তার বোন প্রতিশ্রুত মাসীহের স্ত্রী ছিলেন তিনি কাদিয়ানের রাস্তায় বসে থাকতেন। যখনই জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের অনুসারীদের মধ্যে কোন নতুন আগন্তুক কাদিয়ানে আসত, তখন তিনি তাকে ডেকে কাছে বসাতেন এবং বলতেন: গোলাম আহমদ মিথ্যুক ও লুটেরা। সে এই দোকান পেতেছে (অর্থাৎ কাদিয়ানী মতবাদের দোকান) যাতে করে সে লোকের সম্পদ হরণ করতে পারে। আমি জনসাধারণকে তা অবগত করছি। কারণ সে আমার আত্মীয়, আর তোমরা তাকে চেন না। আমি জানি, সে একজন দরিদ্র লোক এবং তার আয় অতি নগণ্য। তদুপরি তার ভাই তাকে পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এ জন্যই সে এ দোকান পেতেছে। তোমরা দূর- দূরান্ত থেকে এসে থাক এবং আমরা তার পাশেই বসবাস করি। গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা আল ফজলে সন্নিবেশিত, ১৭ এপ্রিল ১৯৪৬ খৃ:।) আমরা ইতিহাসের আলোকে কাদিয়ানীদের নবী’ নামক প্রবন্ধে জনগণের সম্পদকে অন্যায়ভাবে তার লুঠতরাজের পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছি। এ ধারাটি তার খলীফা ও সন্তানদের মধ্যে অদ্যাবধি চলে আসছে। প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর আর্থিক অবস্থা হল এই। বাকি রইল সাধারণ লোকের অবস্থা। সকলেরই জানা আছে যে এ যুগে কি সম্পদের এতই প্রাচুর্য হয়েছে যে কাউকে দান করলে সে উহা গ্রহণ করবে না? গোলাম আহমদ কি জনগণকে ধন-সম্পদ দান করত? না, সর্ব প্রকার প্রতারণা ও মিথ্যা ছলনার দ্বারা তাদের নিকট থেকে উহা গ্রহণ করত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী থেকে সে কতদূরে? মাসীহের আলাইহিস সালাম যুগে লোক একে অপরকে সম্পদ দিতে চাইলে কেহ তা গ্রহণ করবে না। সম্পদ দেয়া হবে, কিন্তু তা কেহই গ্রহণ করবে না.......।
১১- অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসীহে মাওউদের যুগে জনগণের মধ্যে আল্লাহর এবাদতে আগ্রহ এবং দুনিয়া ও উহার সব কিছুর উপর তা প্রাধান্য দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এটাও গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর যুগে বাস্তবায়িত হয়নি ।কেননা, সে নিজেই স্বীকার করেছে যে তার উপর অল্প সংখ্যক মানুষের একটি দল ছাড়া আর কেহ বিশ্বাস স্থাপন করেনি। তার মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর আদম শুমারীর সময়ে কাদিয়ানীদের সংখ্যা সমস্ত ভারতে পঁচাত্তর হাজারের অধিক হয়নি। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ২১ শে জুন ১৯৩৪ খৃ:।) আমাদের এ বেচারার উপর এ গুণটিও প্রযোজ্য হল না।
১২- মসীহ আলাইহিস সালাম এর অবতরণের অন্যতম নিদর্শন হল পৃথিবীতে নিরাপত্তা স্থাপিত হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, সিংহ উটের সহিত, চিতাবাঘ গরুর সহিত বিচরণ করবে। বালকগণ সাপ নিয়ে খেলবে, ওরা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করবে না। এটা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। গোলাম আহমদের যুগেও নহে এবং তার পরেও নহে। এর উপর বড় প্রমাণ হল এই যে, কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদের হজ না করার প্রশ্নে অসুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেছে: গোলাম আহমদ অসুস্থ থাকার কারণে হজ্জ করতে পারে নি। তদুপরি হিজাজের শাসনকর্তা তার বিরোধী। সেখানে গমন করলে তার প্রাণ নাশের আশঙ্কা রয়েছে। (আল ফজল, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ খৃ:।) এই হল গোলাম আহমদের যুগে নিরাপত্তার অবস্থা, যা কাদিয়ানীরা নিজেই স্বীকার করেছে। কোথায় সেই উটের সহিত সিংহের, চিতাবাঘের সহিত গরুর এবং ছাগলের সহিত নেকড়ে বাঘের বিচরণ? কোথায় বালকদের সাপ নিয়ে খেলা ? উল্লেখ্য যে, গোলাম কাদিয়ানী তার শিষ্যদের মাধ্যমে বিরুদ্ধ বাদীগণকে গুপ্ত হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং তাকে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ আদালত তাকে খালাস করে দেয়।
১৩- প্রতিশ্রুত মাসীহ এর আরো একটি গুণ হল তিনি অবতরণের পর হজ্জে এফরাদ, তামাত্তু অথবা ক্বেরান করবেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গোলাম আহমদ হজও করে নি, উমরাহও করেনি। এমনকি পবিত্র স্থান সমূহ দেখার ও তার সুযোগ ঘটেনি। এইতো কাদিয়ানীদের অবস্থা যারা দুর্বল, অন্তঃসারশুণ্য ও সস্তা ব্যাখ্যা দ্বারা তাদের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে: যেমন আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, গোলাম আহমদ অসুস্থ থাকার কারণে তার উপর হজ্জ ফরজ হয়নি এবং হেজাজের প্রশাসকও তার বিরোধী ছিলেন। কেনন, ভারতের আলেমগণ তাকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে ফতওয়া দিয়েছেন। কাজেই সে ওখানে গেলে তার প্রাণ নাশের আশঙ্কা রয়েছে। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ খৃ:।) এ হল তার অবস্থা। অথচ সে দাবি করেছে যে, তার উপর ঐশী বাণী এসেছে, আল্লাহ তোমাকে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করবেন।’ (গোলামের তাজ কেরাতুশ শাহাদাতাইন’ ৪ পৃ:।) মোটকথা, প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবিদার গোলাম আহমদ কাদিয়ানী হজ্জ করেনি, রোগ, ভয় কিংবা অন্য যে কোন কারণে হোক । অথচ সে নিজেই স্বীকার করেছে যে, বিশুদ্ধ হাদীসে রয়েছে ‘‘প্রতিশ্রুত মাসীহ হজ্জ করবেন,। (গোলামের আইয়ামে সুলাহ’ ১৬৯ পৃ:।) যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একথা প্রমাণিত যে হজ্জ করা প্রতিশ্রুত মাসীহের অন্যতম গুণ হেতু তার কোন ওজর আপত্তির অবকাশ থাকবে না। কেননা, প্রকৃত মাসীহের জন্য হজ্জ করার ব্যাপারে যত বাধা বিপত্তি আছে তা সব সরিয়ে ফেলা হবে, যাতে করে তার জন্য এ গুণটি প্রযোজ্য হয় যা এমন নী বর্ণনা করেছেন যিনি ওহী দ্বারা কথা বলেন। এ কথার প্রতি গোলামের স্বীকৃতি রয়েছে যে, হাদীসটি বিশুদ্ধ এবং মাসীহের জন্য হজ্জ সাব্যস্ত।
১৪- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মাসীহ আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে চল্লিশ বৎসর অবস্থান করে মৃত্যুবরণ করবেন। গোলাম কাদিয়ানী ১৮৩৯ বা ১৮৪০ সনে জন্ম গ্রহণ করে [১ গুলামের কিতাবুল বরিয়্যা ১৩৪ পৃঃ] এবং ১৯০৮ সনে মৃত্যুবরণ করে। [২ কাদিয়ানী পত্রিকা আল-হিকম ২৮শে মে , ১৯০৮ সালে প্রকাশিত।] এই হিসাবে তার বয়স ৬৮/৬৯ বৎসর হয়। কিন্তু সে এর ব্যাখ্যা দিয়েছে যে, হাদীসে বর্ণিত বয়স দ্বারা নবুয়তের বয়স উদ্দেশ্য। (গোলামের এজালাতুল আওহাম ৮১ পৃ:।) তার এ দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। কেননা, তার মাসীহ হওয়ার দাবি ছিল ১৮৯১ খৃ:, যেমন তার পুত্র বশীর আহমদ তার সীরতে উল্লেখ করে বলেছে: অর্থাৎ গোলাম ১৮৮২ সনে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি এ উম্মতের সংস্কারক হিসাবে নিয়োজিত এবং ১৮৮৯ সনে ঘোষণা দিলেন যে তিনি মাসীহ মাওউদ। (বশীর আহমদের সীরতে মাহদী ১ম খন্ড ৩১ পৃ:।) এ ভিত্তিতে তার মসীহ হওয়ার দাবির উপর সতের বছরের অধিক কাল অতিবাহিত হয়নি এবং সে চল্লিশ বছর জীবিতও থাকেনি। তাই এ গুণটিও তার মধ্যে পাওয়া গেল না।
১৫- অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- মাসীহ আলাইহিস সালাম মৃত্যুবরণ করার পর মুসলমানগণ তাঁর জানাযার নামাজ আদায় করবেন। কিন্তু গোলাম আহমদের অবস্থা এর বিপরীত। কেননা, একজন মুসলমানও তার জানাযার নামাজ পড়েনি। বরং যারা তার জানাযার নামাজ পড়েছে। তারা সবাই ছিল মুরতাদ ও বিদ্রোহী দলভুক্ত। কাদিয়ানীদের কেহই একথা প্রমাণ করতে পারবে না যে, কোন মুসলিম ব্যক্তি তার জানাযার নামাজ পড়েছে।
১৬- হাদীস শরীফে আছে, যে হাদীসকে ইবনুল জাওযীর উপস্থাপনা অনুযায়ী মিশকাতুল মাসাবীহের গ্রন্থকার বর্ণনা করেছেন যে, প্রতিশ্রুত মাসীহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রওজা মুবারকে সমাধিস্থ হবেন। এ হাদীসের সনদ যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, গোলাম আহমদ নিজেই এর স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রতিশ্রুত মাসীহ আমার কবরে সমাধিস্থ হবেন। (গোলাম কাদিয়ানীর সাফিনায়ে নূহ ১৫ পৃ:।) অতএব গোলাম কাদিয়ানীর জন্য এ সম্মান অর্জিত হয়নি, সেত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরও জিয়ারত করতে পারেনি, আর সমাধিস্থ হওয়া তো দূরের কথা? কারণ সে লাহোরে মৃত্যুবরণ করেছে (পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী) পরে তার লাশ কাদিয়ানী এনে তথায় দাফন করা হয়। [৩ আল-হিকম’ ২৮ শে মে, ১৯০৮ খৃঃ।] যখন এ গুণটিও তার বেলায় প্রযোজ্য হয়নি তখন তারা তাদের অভ্যাস অনুযায়ী বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে লাগল যে, কবর দ্বারা প্রকৃত কবর উদ্দেশ্য নহে, বরং আধ্যাত্মিক কবর উদ্দেশ্য। কেননা, যদি প্রকৃত কবর উদ্দেশ্য নহে, বরং আধ্যাত্মিক কবর উদ্দেশ্য। কেননা, যদি প্রকৃত কবর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে তাতে রাসূলুল্লাহ এর অবমাননা হবে। আর তা হল, কবর খুলে তাতে প্রতিশ্রুত মাসীহকে দাফন করা। (খাদিম কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক।) আমরা বলি: আরবগণ কবর শব্দ বলে কবরস্থান অর্থ গ্রহণ করে। এটা তাদের কাছে প্রচলিত। মুছান্নাফে ইবন আবি শাইবার রা. কিতাবুল জানায়িযে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন: ‘আমাকে ওসমান ইবন মাযউনের কবরে অর্থাৎ কবরস্থানে দাফন করিও। (ইবনে আবি শাইবা, কিতাবুল জানায়িয ১৩৪ পৃ: ভারতীয় মুদ্রণ।) একই কিতাবের একই ভাবে মুয়াবিয়া ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত আছে, তিনি সুফিয়ান থেকে, সুফিয়ান অপর এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, খায়সামা ওসিয়াত করে গেলেন যে, তাকে যেন তার গোত্রীয় দরিদ্রদের মাকবারাতে (কবরস্থানে) দাফন করা হয়। আরবদের নিকট মাকবারার স্থলে কবর এবং কবরের স্থলে মাকবারা ব্যবহার প্রচুর রয়েছে। কাদিয়ানী মুবাল্লেগ খাদেম তার পুস্তকে মুল্লা আলী ক্বারী থেকে বর্ণনা উল্লেখ করেছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে অবস্থানের পর হজ্জ সম্পাদন করবেন এবং ফিরে এসে মক্কা ও মদিনার মধ্যস্থলে মৃত্যুবরণ করবেন। তাঁকে মদিনাতে এনে রওজা শরীফে দাফন করা হবে। (গোলাম কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক ৪৮২ পৃ:।)
এ কথাও অপরিহার্য নয় যে ‘‘মধ্যে’’ অব্যয়টি সর্বদা জরফিয়তের (স্থান-কাল) অর্থে ব্যবহৃত
হবে। কখনও কখনও নিকট অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী এর প্রমাণ,আল্লাহ বলেন: ‘‘ধন্য সে ব্যক্তি, যে আগুনের নিকটবর্তী স্থানে আছে। [১ সুরা নামল, ৮।]
ইমাম রাজী বলেন, এটাই অধিক যুক্তিসংগত। কেননা, নিকটবর্তী বস্ত্তকে বলা হয় এটা উহার মধ্যে আছে। (ইমাম রাজীর তাফসীরে কাবীর ৪৩৬ পৃ:, ৬ষ্ট খন্ড।) অতএব, আমার কবরে দাফন করা হবে এর অর্থ আমার কবরের নিকট দাফন করা হবে। তিরমিজী আব্দুল্লাহ ইবন সালাম রা. থেকে যে রেওয়ায়েত করেছেন তা এ অর্থকে সমর্থন করে। তিনি বলেছেন: তাওরাতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবস্থা এভাবে লিখিত আছে, মরিয়ম পুত্র ঈসা আলাইহিস সালাম তার সহিত সমাধিস্থ হবেন।
তিরমিজী এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন, এটা হাদীসে হাসান। আর এ হাদীসটি তাবরেজী মিশকাতুল মাসাবীহে উল্লেখ করে বলেছেন: আবু মাওদুদ বলেছেন: (তিনি এ হাদীসের একজন মাদানী রাবী) এ ঘরে একটি কবরের জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে’ উল্লেখ্য যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজে স্বীকার করেছে এ হাদীস (অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম আমার কবরে সমাধিস্থ হবেন।) এর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে অর্থাৎ সম্ভবত: অপর একজন মাসীহ আগমন করবেন, যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা পাকের নিকট দাফন করা হবে।(গোলামের এজালাতুল আওহাম ১৯৬ পৃ:।) অনুরূপ ভাবে কাদিয়ানী বিতর্ক কারিরা ও এ কথার স্বীকার করেছে, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। এ সমস্ত অকাট্য প্রমাণাদি ও স্পষ্ট দলীল দস্তাবেজ দ্বারা সাব্যস্ত হল যে, গোলাম আহমদ তার মাসীহ হওয়ার দাবিতে মিথ্যুক। আর তা ঐ সমস্ত গুণাবলির মাপ কাটিতে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, যিনি ওহী ব্যতীত কথা বলেন না, যার সম্পর্কে কল্যাণময় মহান আল্লাহ বলেছেন: তিনি তাঁর প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কথা বলেন না। তিনি যা বলেন তা ওহী ব্যতীত আর কিছু নহে, [১ সুরা নাজম ৪।] সেই মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশ্রুত মাসীহের যে গুণাবলি বর্ণনা করেছেন তার আলোকে গোলাম আহমদ মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত। এমন কি গোলাম তার নিজের স্বীকারোক্তির দ্বারাও মিথ্যুক প্রমাণিত। আমরা সূত্র ব্যতীত কোন কিছুরই উল্লেখ করিনি। এ ব্যাপারে আমরা দীর্ঘ আলোচনা করেছি। কেননা, কাদিয়ানীরা অনেক সময় দুর্বল বুদ্ধি, দুর্বল চিত্ত ও দুর্বল জ্ঞান সম্পন্ন লোকদেরকে এ সকল সন্দেহ সৃষ্টিকারী ও ফন্দি দ্বারা প্রতারিত করে থাকে। তাদের সমুদয় বাঁকা ইমারত গুলি এ বিশ্বাসের উপরই প্রতিষ্ঠিত যে, গোলাম আহমদ প্রতিশ্রুত মাসীহ। তারা দলীল প্রমাণ দ্বারা তাদের এ বিশ্বাস প্রমাণিত করতে অতিশয় দুর্বল।
পাঠকবৃন্দ, নিশ্চয়ই তার দাবি নিরীক্ষণ করেছেন এবং এই সাথে তার দুর্বল প্রমাণাদিও দেখেছেন। এটা কি কোন বুদ্ধিমানের কথা- আমি প্রতিশ্রুত মাসীহ। তার প্রমাণ? কেননা, তা একমাত্র আমিই এ দাবি করেছি। (গোলামের এজালাতুল আওহাম ৬৮৫ পৃ:।)
পরিশেষে, আমরা আমাদের এ প্রবন্ধ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীস দ্বারা সমাপ্ত করব যার মধ্যে তিনি মাসীহ আলাইহিস সালাম অবতরণের পূর্বে ও পরে পৃথিবীতে কি ঘটবে তা স্পষ্টকরে বর্ণনা করেছেন। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী নওয়াস বিন সাম’আন রা. বলেন: একদা ভোর বেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের আলোচনা করলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে অতি তুচ্ছ ভাষায় উল্লেখ করলেন, আবার তার খুব গুরুত্বও প্রকাশ করলেন। আমাদের নিকটবর্তী ঐ খেজুর বাগানেই আছে। তারপর রাসূলুল্লাহ এর নিকট থেকে আমরা উঠে আসলাম। বিকেলে তাঁর নিকট আবার গেলাম। তিনি আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ভাব অনুভাব করে জিজ্ঞাসা করলেন: তোমাদের কি অবস্থা? আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! ভোরবেলা আপনি দাজ্জালের উল্লেখ করতে গিয়ে কখনও উচ্চ: স্বরে আবার কখনও নিচু স্বরে তার আলোচনা করেন। আমাদের ধারণা হল যেন, দাজ্জাল আমাদের নিকটবর্তী খেজুর বাগানেই আছে। দাজ্জাল আমাদের নিকটবর্তী খেজুর বাগানেই আছে। তখন তিনি বললেন: দাজ্জাল ব্যতীত আমি অন্য বিষয় তোমাদের জন্য বেশি ভয় করি। সে যদি আমার জীবদ্দশায় বের হয় তাহলে তোমাদের রক্ষা করার জন্য আমিই যথেষ্ট। আর আমার অবর্তমানে বের হলে প্রত্যেক ব্যক্তির উপর নিজকে রক্ষা করার দায়িত্ব থাকবে। আমি সকল মুসলমানের আল্লাহকে রেখে যাব। আর মুসলমানদের সাহায্যের জন্য আল্লাহই থাকবেন। জেনে রাখ, নিশ্চয়ই দাজ্জাল কোঁকড়ানো চুল বিশিষ্ট একজন জওয়ান হবে। তার চক্ষু হবে সমতল। আমি তাকে আব্দুল উজ্জা ইবন কুতনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখছি। তার সঙ্গে যার সাক্ষাৎ হবে সে যেন সূরা কাহফের প্রারম্ভিক আয়াতগুলো পাঠ করে। সে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থান থেকে বের হবে। সে তার ডান দিকে বাম দিকে সর্ব অঞ্চলে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। আমরা বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ, সে পৃথিবীতে কতকাল অবস্থান করবে। তিনি বললেন: চল্লিশ দিন। একদিন হবে এক বৎসরের সমান, এক দিন হবে এক মাসের সমান এবং একদিন হবে এক সপ্তাহের সমান। আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! যে দিনটি এক বৎসরের সমান হবে, উহাতে কি আমাদের জন্য এক দিনের নামাজ যথেষ্ট হবে? উত্তরে বললেন: না, এর জন্য তোমরা দিনের পরিমাণ ঠিক করে নিবে। আমরা আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! পৃথিবীতে তার গতি কি রূপ হবে? উত্তরে বললেন: ঐ মেঘমালার ন্যায় যাকে বাতাস পিছন থেকে তাড়া করছে। তারপর সে কোন এক সম্প্রদায়ের নিকট আসবে। তাদের আহবান করবে। তাতে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে তার ডাকে সাড়া দেবে। তার নির্দেশে আকাশ বৃষ্টি বর্ষন করবে এবং জমিন শস্যাদি উৎপাদন করবে। তাদের চতুষ্পদ জন্তু এতে বিচরণ করবে, ফলে এদের কবজাগুলো সুউচ্চ হবে, স্তন গুলো দুধে পরিপূর্ণ হবে এবং কোমরগুলো মোটা তাজা হবে। অতঃপর সে অপর এক সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদেরকে তার প্রতি ঈমান আনার জন্য আহবান করবে, কিন্তু তারা তার কথা প্রত্যাখ্যান করবে। সে তাদের থেকে ফিরে যাবে, তখন এরা একেবারে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তাদের হাতে ধন সম্পদ কিছুই থাকবে না। সে পতিত ভূমি দিয়ে গমন কালে তাকে বলবে: তুমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ বের করে দাও। তাতে সম্পদগুলো মৌমাছিরা যেমন রাণী মৌমাছিকে অনুসরণ করে চলে তেমনি তার পিছে পিছে চলবে। তারপর সে পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত একটি যুবককে ডাকবে। তাকে তরবারির আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে উভয় খন্ডকে একটি তীর নিক্ষেপের দুরত্বে ফেলে দেওয়ার পর তাকে ডাকবে। তাতে সে হাসিমুখে উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে তার দিকে আসবে। ইত্যবসরে আল্লাহ তাআলা মরিয়ম পুত্র মাসীহ কে প্রেরণ করবেন। তখন তিনি দামেস্কের পূর্ব প্রান্তে সাদা মিনারের নিকট দুটি হলদে বর্ণের চাদর পরিহিত অবস্থায় দুজন ফেরেস্তার ডানার উপর ভর করে অবতরণ করবেন। যখন তিনি মাথা নিচু করবেন তখন তার থেকে ফোটা ফোটা করে পানি পড়বে; আর যখন মাথা উঁচু করবেন তখন তার থেকে মুক্তা ঝরবে। কোন কাফের তার নিশ্বাসের গন্ধ পেলেই তৎক্ষণাৎ সে মারা যাবে। তাঁর নিশ্বাস এত দূর পর্যন্ত পুঁছবে যতদূর তাঁর দৃষ্টি পৌঁছোবে। তিনি দাজ্জালকে ধাওয়া করে ‘লুদ’ নামক স্থানের প্রবেশ দ্বারে হত্যা করবেন। তারপর ঈসার আলাইহিস সালাম কাছে এমন একটি দল আসবে যাদেরকে আল্লাহ পাক দাজ্জালের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি তাদের চেহারা মুছে দেবেন এবং তাদেরকে বেহেস্তে তাদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করবেন। ইত্যবসরে আল্লাহ তাআলা ঈসা আলাইহিস সালাম এর কাছে ওহী পাঠাবেন- ‘আমি আমার কিছু বান্দাকে বের করে দিয়েছি, যাদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই। আপনি আমার এ বান্দাগণকে নিয়ে তুর পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করুন। তখন আল্লাহ পাক ইয়াজুজ মাযুজকে পাঠাবেন। তারা প্রত্যেক উঁচু স্থান হতে নীচের দিকে আসতে থাকবে অর্থাৎ পাহাড় উপত্যকা পেরিয়ে তারা এগিয়ে আসবে। তাদের প্রথম দল তাবরেস্তানের একটি হ্রদের নিকট দিয়ে গমন করবে এবং উহার সব পানি পান করে ফেলবে। তাদের শেষ দল এর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে। তাদের শেষ দল এর নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে: এখানে তো কোন এক সময় পানি ছিল। তখন আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গীগণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বেন। এ অবস্থায় তাদের কাছে একটি গরুর মাথা আজকের দিনের একশত দিনারের চেয়েও বেশি মূল্যবান হবে। তারপর আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর কাছে দোয়ায় মগ্ন হবেন। তখন আল্লাহ তাআলা ইয়াযুজ মাযুজের ঘাড়ে মরণ কীট প্রেরণ করবেন। এতে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এক প্রাণের মৃত্যুর ন্যায় সকলে এক সাথে মৃত্যুবরণ করবে। তারপর আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাহাবিগণ পৃথিবীতে অবতরণ করবেন কিন্তু তারা ওদের পঁচা লাশ ও দুর্গন্ধ হতে মুক্ত এক বিঘত জায়গা খুঁজে পাবেন না। এরপর আল্লাহর নবী ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সাথীগণ আল্লাহর দরবারে দোয়ায় মশগুল হয়ে পড়বেন। তখন আল্লাহ বুখতী উটের মত লম্বা লম্বা গলা বিশিষ্ট পক্ষী পাঠাবেন। ওরা এদের লাশ উঠিয়ে নিয়ে যেখানে আল্লাহর ইচ্ছা সেখানে নিক্ষেপ করবে। এরপর আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। উহা থেকে কোন কাঁচা ও পাকা ঘর অবশিষ্ট থাকবে না। এই বৃষ্টি পৃথিবীকে ধুয়ে মুছে আয়নার মত স্বচ্ছ করে দেবে। অতঃপর পৃথিবীকে নির্দেশ দেয়া হবে, ফলমূল উৎপন্ন কর এবং তোমার বরকতকে ফিরিয়ে আন। সেদিন একটি ডালিম এক বিরাট দল খাবে এবং উহার ছাল দ্বারা ছায়া গ্রহণ করতে পারবে। আল্লাহ দুধের মধ্যে এমন বরকত দেবেন যে, একটা দুধালো উঁটনী কয়েকজন লোকের জন্য যথেষ্ট হবে, একটি দুধালো গাভি একটি গোত্রের জন্য যথেষ্ট হবে, এবং একটা দুধালো বকরি একটি ছোট দলের জন্য যথেষ্ট হবে। এরপর আল্লাহ তাআলা একটা স্নিগ্ধ বাতাস পাঠাবেন এবং উহা তাদের বগলের নীচ দিয়ে প্রবেশ করে প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের প্রাণ কবজ করে নেবে। আর, থেকে যাবে শুধু দুষ্ট প্রকৃতির লোকগুলো। তারা গাধার ন্যায় প্রকাশ্যে ব্যভিচারে লিপ্ত হবে’’। [১ মুসলিম. আবু দাউদ, তিরমিজী, ইবনে মাজাহ, আহমদ, শব্দ মুসলিমর।] আল্লাহর রাসূল সত্যই বলেছেন। এই হল প্রতিশ্রুত মাসীহ হওয়ার দাবির সত্যতার মাপকাঠি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে, বর্ণনা দিয়েছেন মির্জা গোলামের পূর্বে কি তা ঘটেছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিবরণ দিয়েছেন তার সময়ে কি তা সংঘটিত হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা উল্লেখ করেছেন তা কি তার উপর প্রযোজ্য হয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পরিবার পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর অনুসারীদের উপর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
ফার্সী ভাষায় কবিতার একটি জ্ঞানপূর্ণ ছন্দ আছে। যার মর্মার্থ হল ‘‘ভিত্তি স্থাপন কালে যদি প্রথম ইটটি বাঁকা অবস্থায় রাখা হয় তা হলে সমস্ত দালানটিই বাঁকা হওয়া অপরিহার্য।’’ এ জ্ঞানপূর্ণ কথাটি সম্পূর্ণরূপে কাদিয়ানীদের উপর প্রযোজ্য।
প্রথমত: গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে সে প্রতিশ্রুত মাসীহ, আল্লাহর নবী ও রাসূল এবং সকল নবী রাসূল হতে উত্তম হওয়ার দাবি করেছে। ইসলামের ভিত্তি ও সর্ব স্বীকৃত মূলনীতি সমূহকে সে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে এবং আল্লাহর নবী রাসূলগণ, ওলীগণ ও তার মনোনীত ব্যক্তিবর্গের অবমাননা করেছে। সে জালিম ইংরেজ উপনিবেশ দাবি প্রভুর ইঙ্গিতে এবং তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তায় সম্পূর্ণরূপে ফিতনার দ্বার সমূহ খুলে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত: তার চতুষ্পার্শ্বে এমন কতকগুলো লোক জড়ো হয়েছে অথবা সে জড়ো করেছে, যারা তার মত বিশ্বাসঘাতক, অতি-লোভী ও ডলার পাউন্ডের বিনিময়ে তাদের অন্তঃকরণকে বিক্রি করে দিয়েছে। এদের কাছে শরীয়তের নীতিমালা ও চারিত্রিক সীমারেখার কোন গুরুত্ব নেই । বরং তারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং নিজস্ব সুবিধা অর্জনের জন্য সবকিছু এমনকি দ্বীন ও ঈমানকে বিক্রি করতে প্রস্ত্তত। তারা কোন প্রকাশ্য ক্ষতি ব্যতিরেকে যা কিছু খরচ করার সামর্থ্য রাখে তার সবটুকু এ পথে ব্যয় করতে থাকে। এরূপ লোকজন দ্বারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ধর্ম তৈরি করেছে। আর যদি অন্যরা বলি, এ সকল লোক দ্বারাই কাদিয়ানী মতবাদ সংগঠিত হয়েছে, তা হলে আমাদের এ প্রকাশ ভঙ্গিটি অধিক উপযোগী ও বিশুদ্ধ হবে। কেননা, এ সমস্ত লোকেরাই গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুয়তের জন্য অর্থ জোগান দিত এবং গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তাদের প্রচারক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তারা তাকে যে কথা প্রচার করার পরামর্শ দিত সে তা-ই প্রচার করত এবং তারা যা বলতে চাইত সেটাই সে বলত। উপরোক্ত কথাগুলো আমি দলীল প্রমাণ ছাড়া বলিনি। বরং স্বয়ং ভন্ডনবী কাদিয়ানী থেকে উহার উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
গোলাম আহমদ একটি পুস্তক রচনার ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা কামনা প্রসঙ্গে লিখেছে ‘আপনার মূল্যবান পত্র পেয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। ইতিপূর্বে ইসলামের কিছু খেদমত করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু আপনার পত্রখানা আমাকে অনেক অনেক সাহস জুগিয়েছে। আপনার কাছে যদি কিছু প্রবন্ধ-বলী থাকে, তবে উহা আমার নিকট পাঠিয়ে দিন।’’ (উস্তাদ চেরাগ আলীর কাছে গোলামের পত্র যা ‘সিওরুল মুছান্নিফিন’ এ সন্নিবেশিত।) সে আরো লিখেছে: দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর এখন পর্যন্ত নবুয়্যত প্রমাণ করা সম্পর্কে আপনার প্রবন্ধটি আমার কাছে পৌঁছেনি। তাই, আপনাকে দ্বিতীয়বার কষ্ট দিচ্ছি যাতে সত্ত্বর আপনার এ প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দেন এবং কুরআনের হকীকত প্রমাণ করে আমার জন্য আর একটি প্রবন্ধ লিখবেন, যাতে উহা আমার পুস্তক বারাহীনে আহমদিয়া তে সন্নিবেশিত করতে পারি। (চেরাগ আলীর নিকট লিখিত গোলামের পত্র এবং ‘সিওরুল মুছান্নিফিনে’ ও তা সন্নিবেশিত।) কদিয়ানীদের অন্যতম নেতা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছে ‘জনাব (গোলাম) প্রতিশ্রুত মাসীহ ও নির্দিষ্ট মাহদী হওয়া সত্ত্বেও আমার নিকট শরীয়তের মাসআলা মাসায়েল জিজ্ঞাসা করতেন এবং এ ব্যাপারে আমার সহিত পরামর্শ করতেন। ( কাদিয়ানী নেতা মুহাম্মদ এহসান আমরুহীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে প্রচারিত এবং ২২ ডিসেম্বর ১৯১৬ খৃ: প্রকাশিত।) গোলাম পুত্র তার পুস্তকে একথা স্বীকার করে বলে: ‘জনাব তার আরবী কিতাব সমূহের পান্ডুলিপি গুলো তার প্রথম খলীফা নুরুদ্দীন ও উস্তাদ মুহাম্মদ আহ-সান আমরুহীর নিকট সংশোধনের জন্য পাঠাতেন। (একজন নবীর কি সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে থাকে?) প্রথম খলীফা যেভাবে উহা গ্রহণ করত ঐ ভাবে তা ফেরত দিয়ে দিত। (কেননা, গোলাম যা লিখত তার অধিকাংশের প্রকৃত লেখক সে ছিল। তাই, উহা পুনরায় দেখার প্রয়োজন মনে করত না।) কিন্তু, উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী উহার সংশোধন ও পরিবর্তনে তার সমুদয় প্রচেষ্টা ব্যয় করতেন। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানীর সীরতে মাহদী ১ম খন্ড ৭৫ পৃ:।)
কাদিয়ানী পত্রিকায় এ কথা প্রচারিত হয় জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ আত-তাবলীগ’ নামক এক খানা কিতাব আরবী ভাষায় রচনা করেছেন যা তার ‘মেরাতু কামালাতে ইসলাম’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। সেই পুস্তক লেখা কালে তিনি এর পান্ডুলিপি হাকিমুল উম্মত নুরুদ্দীনের নিকট পড়ার জন্য পাঠাতেন। তিনি সংশোধন করে দেওয়ার পর উহা উস্তাদ আব্দুল করীমের নিকট ফার্সী ভাষায় রূপান্তরিত করার জন্য পাঠাতেন। (আল-ফজল ১৫ ই জানুয়ারি, ১৯২৯ খৃ:।) মোটকথা কাদিয়ানী নবুয়্যত এমনিভাবে এই সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের যোগসাজশে তৈরি হয়েছে। আমরা ভন্ডনবী কাদিয়ানীর চরিত্রের আলোচনা করতে গেলে এ সকল নেতাদের জীবন আলোচনা করাও আমাদের দায়িত্বে এসে পড়ে। কেননা, শিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্য এতে শিক্ষা রয়েছে এবং এর দ্বারা ওদের প্রকৃত স্বরূপ জনসমক্ষে প্রকাশ পাবে। এছাড়া কাদিয়ানী ধর্মের আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না তাদের ভিতরকার দল উপদলের আলোচনা ব্যতিরেকে, এ প্রবন্ধটি রচনা করি।
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর প্রতি চ্যালেঞ্জ করে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার নিজের জন্য ১৯০৭ সালের ১৫ই এপ্রিল এ বদ দোয়া করেছিল (নিশ্চয়ই যে মিথ্যাবাদী সে সত্যবাদীর জীবদ্দশায় প্লেগ বা কলেরা রোগে মারা যাবে।) এর ফলশ্রুতিতে উক্ত দোয়ার মাত্র এক বৎসর পর ১৯০৮ সালে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর জীবদ্দশায়ই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে পায়খানা গৃহে প্রয়োজন সারতে সারতে সে মারা যায়। [১ গুলাম আহমদের মৃত্যুর পর আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী প্রায় চল্লিশ বৎসর জীবিত ছিলেন।] তাই তার মৃত্যুর পর কাদিয়ানী নেতা ও তার নবুয়তের প্রতিষ্ঠাতাগণ তার ত্যাজ্য সম্পত্তি বণ্টনে এবং একে অন্যের সহিত ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হল। এদের মধ্যে প্রধান ছিল নুরুদ্দীন, মুহম্মদ আলী, গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ, কামাল উদ্দিন, মুহাম্মদ আহসান আমরুহী, ইয়ার মুহাম্মদ, আব্দূল্লাহ টিমাপুরী ও মুহাম্মদ সাদেক। তখনকার সময়ে নুরুদ্দিন ও মুহাম্মদ আলী তাদের শিরোমণি ছিল। এদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি (অর্থাৎ নুরুদ্দীন) সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ছিল যে, গোলাম আহমদের নামে যে সকল পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, সে-ই উহার প্রকৃত রচয়িতা। এই ব্যক্তিই ভন্ডনবী গোলাম আহমদের মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি থেকে নিয়ে নবুয়তের শেষ দাবির সময় পর্যন্ত তার অর্থ জোগান দিত। এটা অযৌক্তিক কথা নয়; কেননা, গোলাম আহমদ স্বয়ং একটা নির্বোধ ও বোকা লোক ছিল। পূর্বের দুটি প্রবন্ধ কদিয়ানীরা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট এবং ইতিহাসের আলোকে কাদিয়ানীদের নবী এর মধ্যে আমরা এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সে তো শরীয়ত সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণও করেনি। বিশেষকরে আরবী ভাষায় বিশেষ কোন জ্ঞান অর্জন করেনি। কিন্তু নুরুদ্দীন ছিল এর বিপরীত। প্রথমত: সে আরবী ভাষায় শিক্ষা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত: সে দীর্ঘ দিন যাবৎ হিজাজে অবস্থান করেছে। তৃতীয়ত: সে কল্পনা প্রবণ ব্যক্তি ছিল। নুরুদ্দীনের প্রতি গোলামের লিখিত পত্রাবলি আমাদের এ উক্তির সমর্থন করে। কেননা, গোলাম সর্বদাই তার সহিত আদব রক্ষা করে চলত এবং তাকে এমন সব উপাধি দ্বারা ভূষিত করে যা উস্তাদ বা শেখ ব্যতীত আর কারো জন্য প্রয়োগ করা হয় না। একদা সে নুরুদ্দীনকে লিখে: ‘‘আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু শেখ হাকীম নুরুদ্দীন! আল্লাহ তাকে নিরাপদে রাখুন! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ও বারাকাতুহু ! আপনার উপকার হয়নি জেনে আশ্চর্য হলাম.....। খাদেম গোলাম আহমদ। (নুরুদ্দীনের নিকট লিখিত গোলামের পত্র যা গোলামের চিঠিপত্র সংকলন ‘‘মাকতুবাতে আহমাদিয়া’’ তে সন্নিবেশিত, ৫ম খন্ড, ১৪ পৃ: ২নং পত্র।) সে আরো লিখেছে: ‘শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত বন্ধু শেখ হাকীম নুরুদ্দীনের প্রতি ....... খাদেম, গোলাম আহমদ’’। (মাকতুবাতে আহমদিয়া ৫ম খন্ড ১৪ নম্বর) নুরুদ্দীনের সহিত এটাই ছিল তার আচরণ। এটা কি যুক্তি সংগত যে, একজন নবী তার শিষ্যদেরকে এরূপ উপাধি দ্বারা সম্বোধন করতে পারে? গোলাম আহমদের মৃত্যুর প্রায় বিশ বৎসর পর ১৯৯২ সালে তারই পুত্র ও দ্বিতীয় খলীফা কাদিয়ানে প্রদত্ত ভাষণে অসাবধানে আমাদের এ কথা স্বীকার করে বলেছে: ‘‘অনেক লোক বলত, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ (গোলাম) উর্দু পর্যন্ত জানেন না। অন্য লোকে আরবী পুস্তক সমূহ লিখে তার সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে। কেহ কেহ এর চেয়ে অধিক বলত: শেখ নুরুদ্দীনই তার জন্য পুস্তক লিখে দেয়। বাস্তব অবস্থা হল জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ এ কথা দাবি করেন নি যে, তিনি কারো কাছ থেকে জাহেরী উলুম শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তিনি বলতেন-, আমার উস্তাদ আফিম ব্যবহার করতেন। [১ সম্ভবতঃ ভন্ডনবী কাদিয়ানী তার এ সকল উস্তাদের ন্যায় আফিমের অভ্যাস্ত ছিল। তার পুত্র মাহমুদ বর্ণনা করেছে, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ ওষধ তৈরী করতেন, যার বড় অংশ ছিল আফিম তিনি এ ওষধ সর্বদা ব্যবহার করতেন। এমনিভাবে নুরদদ্দীনকে উহা ব্যবহার করতে দিতেন।] অনেক সময় তিনি হক্কা পান করতেন এবং অনেক সময় অতিশয় নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে হক্কা মাটিতে পড়ে যেত। এরূপ উস্তাদ কি শিক্ষা দিত? (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে সন্নিবেশিত, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৯ খৃ:) ইতিপূর্বে গোলামের দ্বিতীয় পুত্রের বক্তব্য ও আল-ফজল পত্রিকা থেকে আমরা উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি যে, ভন্ডনবী কাদিয়ানী পান্ডুলিপিগুলো সংশোধনের জন্য নুরুদ্দীনের নিকট পাঠাত। [১ এটা অতি আশ্চর্যের বিষয় যে, কোন নবী কি তার অনুসারীদের কাছে এ কথার মুখাপেক্ষী যে, সে তার কথা বার্তাকে সংশোধন করে দেবে?] সুতরাং এ নুরুদ্দীনই গোলামের মৃত্যুকালে প্রকৃত পক্ষে প্রথম ব্যক্তি ছিল এবং কাদিয়ানীদের কাছে পদে তার পরবর্তী ব্যক্তি ছিল মুহাম্মদ আলী। সে মাস্টার ডিগ্রি এবং কাদিয়ানী সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। এ জন্য গোলাম কাদিয়ানী তাকে একান্ত বিশেষ লোক হিসেবে ‘‘রিভিউ অব রিলিজিউন্সের সম্পাদক নিযুক্ত করে ছিল। অনুরূপভাবে তাকে কাদিয়ানী কয়েকটি কমিটির সভাপতিও নিযুক্ত করেছিল। সে ভন্ডনবী ও তার ইংরেজ প্রভুদের মধ্যে মাধ্যম হিসাবে কাজ করত। কাদিয়ানীদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে এ দু ব্যক্তির সমকক্ষ আর কেহ ছিল না। অবশ্য, তৃতীয় এক ব্যক্তিও ছিল যে গোলামের জীবদ্দশায়ই অত্যন্ত ঘৃণিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। এ আলোচনা পরে আসবে। প্রথমে আমরা নুরুদ্দীনের ও মুহাম্মদ আলীর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করব। পরে কাদিয়ানীদের অন্যান্য বড় বড় লোকের জীবন আলোচনা করব; যাতে পাঠক গোলাম আহমদের সঙ্গী সাথী, খলিফাগণ, কাদিয়ানীদের সর্দার ও নেতাগণের প্রকৃত রূপ জানতে পারে এবং আরো জানতে পারে যে, কোন ধরনের লোকজন নিয়ে এ দলটি গঠিত হয়েছিল। কারণ, এরাই হল কাদিয়ানী ধর্মের ভিত্তি ও বীজ।
নুরুদ্দীন:
কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীন অতিশয় লোভী ও মান-মর্যাদার আকাঙ্ক্ষী ছিল। সূচনা লগ্ন থেকেই তার ব্যক্তিতব বিকাশের প্রবল ইচ্ছা ছিল। তাই, যখন ভারত বর্ষে খোদাদ্রোহী নাস্তিকদের আবির্ভাব ঘটল, তখন সে তাদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করল। এরা খারাপ ও ঘৃণ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও জড় বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিল। আর এ, মিসকীন ব্যক্তির তো সমস্ত পড়া-শুনা মক্তবের ভিতর অথবা প্রাচীন চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে ছিল। এ জন্য সে ওদের কাছে কোন সম্মান লাভ করতে পারে নি। ইত্যবসরে ঘটনাচক্রে গোলাম কাদিয়ানীর সাথে তার পরিচয় হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল যে, এ ব্যক্তিই তার ও তার আশা-আকাঙ্ক্ষার উপযুক্ত। সুতরাং সে তার সাথে মিশে গেল। স্বয়ং গোলাম পুত্র উল্লেখ করেছে- ‘‘জনাব শেখ নূরুদ্দীন নাস্তিকদের চিন্তা ধারায় প্রভাবান্নিত ছিল। কিন্তু জনাব গোলামের সাথে মিশে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে এ প্রভাব দূর হয়ে গেল।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর সীরতে মাহদী’ ১ম খন্ড ১৪১ পৃ:) গোলামের সাথে তার মিশে যাওয়ার পর তাকে ইচ্ছা মাফিক পরিচালনা করতে লাগল এবং তার সমস্ত ভিত্তিহীন ও অমূলক প্রয়োজনে তাকে সবরকমের তথ্য সরবরাহ শুরু করে। যা আমরা এইমাত্র উল্লেখ করেছি। এ দ্বারা তার নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ চরিতার্থ করা উদ্দেশ্য ছিল। আর সে তা গোলামের মৃত্যুর পরই লাভ করে। তখন সে দাবি করল যে, এ জমিনে সে আল্লাহর রাসূল (অর্থাৎ গোলামের নায়েব) যদি তার এ দাবি উদ্দেশ্য না হত তা হল এ সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে তার শক্তির অপচয় করত না। অতএব, সে ঘোষণা দিল: ‘‘আমি মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনিই আমাকে তাঁর খলীফা নির্ধারিত করেছেন। এমন কে আছে যে খেলাফতের এ চাদর আমা থেকে কেড়ে নিতে পারে? আল্লাহ তাঁর পছন্দ ও ইচ্ছায় আমাকে তোমাদের ইমাম ও খলীফা নিযুক্ত করতে চেয়েছেন। সুতরাং তোমরা যা ইচ্ছা তা বলতে থাক। কিন্তু তোমরা আমাকে যে সমস্ত অপবাদ দেবে ও নিন্দা করবে তা আমার নিকট পৌঁছোবে না, বরং পৌঁছোবে আল্লাহর নিকট। কেননা, তিনিই আমাকে খলীফা নিযুক্ত করেছেন।’’ (নুরুদ্দীনের ঘোষণা, যা কাদিয়ানী ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিওন্স এ সন্নিবেশিত, ১৪ খন্ড ৬ নম্বর, ২৩৪ পৃ:) তখন কাদিয়ানীরা তাদের নবীর খলীফা হিসেবে তার হাতে বাইয়াত করল। কারণ গোলাম আহমদের পরিবারের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল এবং তারা জানত যে তাদের ভন্ডনবী তাকে অতিশয় সম্মান করত। বিশেষ করে যখন সাম্রাজ্যবাদী সরকার খেলাফতের মুকুট তার মাথায় রাখতে সম্মতি প্রদান করল। এরপর তার খিলাফতকে সমর্থন করা ছাড়া বিমুখ হওয়ার ক্ষমতা কারো ছিল না। উল্লেখ্য যে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের প্রতি তার ভালোবাসা , নিষ্ঠা ও সেবা এবং মুসলমানদের প্রতি তার বিশ্বাস ঘাতকতার ব্যাপারে পরীক্ষা করেই তার খেলাফত সম্পর্কে সম্মতি দিয়েছিল। ফলে সে কাদিয়ানী সিংহাসনের উপর জমে বসল এবং (নাউযুবিল্লাহ) নিজেকে আবু বকরের রা. সমতুল্য বলে ঘোষণা দিল।
কোথায় এ গান্ধী খবীছের অবস্থান? আর কোথায় আবু বকর রা. এর মত পাক পবিত্র ব্যক্তি? সে তো ঐ ব্যক্তি যে তার নিজ সম্পর্কে বলে: ‘‘আমি জম্মু এলাকায় ছিলাম। তথাকার একজন হিন্দু মহিলা আমাকে ভালোবাসত। যখন আমার দুই পুত্র ফজলে ইলাহি ও হাফিজুর রহমান মারা গেল তখন সে আমার নিকট এসে বলল- আমি এমন এমন দুটি পুত্র তোমাকে দান করব। উত্তরে আমি তাকে বললাম- এমনি ভাবে কি বদলা পাওয়া সম্ভব? (আকবর কাদিয়ানীর মিরাকাতুল ইয়াকীন ফি হায়াতে নুরুদ্দীন’ ১৯৯ পৃ:) কোথায় ঐ ব্যক্তির অবস্থান যে তার দ্বীন ও ঈমান কে তুচ্ছ পার্থিব মান সম্মানের জন্য বিক্রি করেছে এবং কোথায় আবু বকর রা. এর অবস্থান যিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং ঈমান ও দ্বীন ইসলামের জন্য তার নেতৃত্ব ও আধিপত্যকে ত্যাগ করেছেন? এজন্য আল্লাহ তাআলা ঐ বিশ্বাস ঘাতক থেকে ভীষণ অপমানকর প্রতিশোধ নেন। সে দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকে, এমনকি সে তার জ্ঞান ও বাক শক্তি হারিয়ে ফেলে। এমনি ভাবে সে দীর্ঘ দিন আল্লাহর শাস্তিতে কাটানোর পর জঘন্যভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অতঃপর তার যুবক পুত্র কাদিয়ানীদের বিষ প্রয়োগে মারা গেল এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী অন্য এক ব্যক্তির সাথে পলায়ন করে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। স্বয়ং কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল একথা উল্লেখ করে বলেছে যে, নূরুদ্দীনের সেই উক্তি কোথায়? ‘‘জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ আল্লাহর নবী ও রারূল।’’ তার ঐ উক্তিটি যে, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ কুরআনের ঐ আয়াতের লক্ষ্য- ‘‘আমার পরে এক রাসূল আসবেন যার নাম হবে আহমদ। [১ সুরা আছছাফ-৬ (মিথ্যুক কাদিয়ানীরা দাবী করে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম এর ভাষায় কোরআন শরীফে রাসুল সা. এর যে সব গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে এগুলোর উদ্দেশ্য তিনি নন বরং উদ্দেশ্য গুলাম আহমদ কাদিয়ানী।)] শেষের দিকে মাসীহের রেসালতের স্বীকৃতি থেকে নীরব থাকা এবং এর উপর অটল থাকা থেকে বিমুখ হওয়া এবং শাস্তি স্বরূপ ঘোড়ার পিট থেকে পড়ে যাওয়া, অতঃপর মৃত্যুর পূর্বে কথা বন্ধ হওয়া, দরিদ্রতার মধ্যে মৃত্যুবরণ করা তার পুত্র আব্দুল হাই অল্পদিন পর পূর্ণ যৌবনে মৃত্যুবরণ করা, এবং জঘন্য ও নিকৃষ্ট তার স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ সূত্রে অবদ্ধ হওয়ার কারণ কি? এসব বিষয়ে উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য কি কোন উপদেশ নেই? (আল ফজল, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯২২ খৃষ্টাব্দ, রেসালাতে খাজিনাতুস সাদাকাত’ হতে উদ্ধৃত) শুধু এটাই নহে বরং তার কন্যা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের স্ত্রী নিহত হল এবং মাহমুদ আহমদকে এ হত্যা কান্ডের ও তার ভাই আব্দুল হাই এর হত্যা কান্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হল। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ৩রা আগস্ট ১৯৩৭ খৃ:) এমনিভাবে সে যে পার্থিব মান সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করার জন্য মুহাম্মদে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বিশ্বাস-ঘাতকতা করেছিল, তা থেকে সে বঞ্চিত হল। ফলে, সে তার পুত্র ও তার কন্যা যে ভন্ডনবীর পুত্রবধূ ছিল সকলেই মারা গেল। তার দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল মান্নান জীবিত রইল। যখন সে এ সমস্ত অত্যাচারের প্রতিবাদ করল তখন সে মুনাফেকির অভিযোগে দল-চ্যুত হল। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হল। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী। সে ১৩ মার্চ ১৯১৪ সালে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদকে খেলাফতের মুকুট পরান হল। এর আলোচনা করার পূর্বে আমি মুহাম্মদ আলীর জীবন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে চাই, যার স্থান নূরুদ্দীনের পরেই।
লাহোরী কাদিয়ানীদের আমীর মুহাম্মদ আলী:
মুহাম্মদ আলী আধুনিক উচ্চ শিক্ষায় মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে। অতঃপর উপযুক্ত কোন কাজ কর্ম পায়নি। ফলে, সে বেকার অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে। অবশেষে সাম্রাজ্যবাদীরা তাকে শিকার করে নেয় এবং তার দ্বীন ঈমান ক্রয় করে তাদের এজেন্ট বিশ্বাসঘাতক ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী কাদিয়ানীর নিকট সপোর্দ করে, যাতে সে তার সাথে মিলিত হয়ে একসঙ্গে কাজ করে এবং ইসলাম ধর্ম ধ্বংস করতে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে সন্দেহ সৃষ্টি করতে ও তাদের মধ্যে ফিতনার বীজ বপন করতে তাকে সাহায্য করে। তার জন্য বড় অঙ্কের বেতন নির্ধারণ করা হয়। যার পরিমাণ ঐ সময়ে দুই শত টাকার অধিক ছিল তখনকার দিনে কোন ব্যক্তি বেতন রূপে পঞ্চাশ টাকা পেলে তাকে আমীর বলে গণ্য করা হত। উল্লেখ্য যে, গোলাম আহমদ যে মুহাম্মদ আলীর সর্দার ও নেতা ছিল সে তার নবুয়তের দাবির পূর্বে মাসিক মাত্র পনেরো টাকা বেতনরূপে গ্রহণ করত। এত বড় অঙ্কের টাকা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। সুতরাং সে ভন্ডনবী কাদিয়ানীর সহিত মিলিত হয়ে ইসলামের এমারতে ছিদ্র করার কাজে রত হয়ে পড়ল এবং মির্জার প্রয়োজনীয় ভিত্তিহীন ও বাতিল মতবাদ তাকে জোগান দিতে থাকে। এমনি ভাবে তাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের গুপ্তচররূপে তৈরি করা হল। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা অত্যন্ত ধূর্ত ও বিপদজনক লোক ছিল। কেননা, তারা গোলাম আহমদের মাথায় নবুয়তের মুকুট পরানোর পর একথা অনুভব করল যে, তার পাশে আধুনিক ও অন্যান্য শিক্ষায় সুদক্ষ কিছু লোক জড়ো করা প্রয়োজন, যারা সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে ফিতনা ছড়াতে পারে। আর, তাদেরই একজন ছিল মুহাম্মদ আলী। গোলাম আহমদ সাম্রাজ্যবাদীদের ইঙ্গিতে তার জন্য একটি মাসিক ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিউন্স প্রকাশ করল। যার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থী ও আধুনিক সংস্কৃতির অধিকারীদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা প্রচার করা। আর এটা তার হাতেই সপোর্দ করা হল। কোন এক কাদিয়ানী লেখক উল্লেখ করেছে যে, রিভিউ অব রিলিজিওন্স একটি মাসিক ম্যাগাজিন। মুকাদ্দাস (গোলাম) তার চিন্তাধারা ও শিক্ষা দীক্ষা পৃথিবীতে ছড়াবার জন্য এটা প্রকাশ করেছেন। আর উস্তাদ মুহাম্মদ আলীকে এর প্রধান সম্পাদক নিয়োগ করেছেন।’ (মুহাম্মদ ইসমাঈল কাদিয়ানীর ‘আন-নাজবাতু আলা আজবিবাতিত তাহাররিয়াতিস সাবিকা লিমুহাম্মদ আলী’ ৬৪ পৃ:) গোলামের মৃত্যুর পর এ ম্যাগাজিনের শুধু তদারকের দায়িত্ব তার উপর রাখা হয় এবং কাদিয়ানিগণ কর্তৃক বিকৃত কুরআনের অর্থ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করার দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত করা হয়। যাতে সে কাদিয়ানীদের মেকী বিচ্যুতিপূর্ণ আকীদা বিশ্বাসের দ্বারা তা পরিপূর্ণ করতে পারে। প্রথম দিকে কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নূরুদ্দীনের উপর এ অনুবাদ দেখা শুনার দায়িত্ব ছিল।‘‘প্রতিশ্রুত মাসীহের প্রথম খলীফা জনাব নূরুদ্দীন কুরআনের ব্যাখ্যা উস্তাদ মুহাম্মদ আলী দিয়ে লিখাতেন। উস্তাদ মুহাম্মদ আলী এ কাজে নিয়োজিত হয়ে মাসিক দুই শত টাকার বেতন ভোগ করতেন।’’ (আল-ফজল, ২রা জুন ১৯৩১ খৃ: প্রকাশিত।) শের আলী কাদিয়ানী লিখেছে- উস্তাদ মুহাম্মদ আলী অনুবাদের কাজে নিয়োজিত হওয়ার পর তাকে শুধু ম্যাগাজিন দেখা শুনার ভার দেওয়া হল এবং আমাকে এর সম্পাদক নিযুক্ত করা হল। আমি প্রবন্ধাবলি লিখতে লাগলাম এবং ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এগুলো প্রকাশ করার পূর্বে উস্তাদ মুহাম্মদ আলীর নিকট পেশ করতাম। (শের আলী কাদিয়ানীর আত তাবছেরা আলাল আকায়েদেসসাবেকা, উস্তাদ মুহাম্মদ ২৪ পৃ:) যেহেতু সে গোলাম আহমদ ও তার নবুয়তের হাকীকত জানত, তাই সে গোলাম আহমদ ও তার পরিবারের কারো প্রতি ভ্রূক্ষেপ করত না। বরং সে অনেক সময় তার উপর অভিযোগ করত এবং তার জীবদ্দশায়ই তার অবমাননা করত। এমনকি, অনেকবার সে তাকে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণকারী রূপে অপবাদ দিয়েছে। (অর্থাৎ সে একাকী ভোগ করত, অন্য কাউকে এতে অংশীদার করত না।) কিন্তু গোলাম এর কোন প্রতি উত্তর দেয়নি এবং এর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কেমন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? সে তো এ সমস্ত লোকের কাছে ঋণী ছিল। এখানে আমরা গোলাম পুত্র ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সে কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নূরুদ্দীনের নিকট লিখছে ...‘‘উস্তাদ মুহাম্মদ আলী উস্তাদ কামালউদ্দিন সর্বদাই জনাব (গোলাম) এর উপর অভিযোগ করে থাকেন। এমনকি নওয়াব মুহাম্মদ আলী (গোলামের শ্বশুর) আমাকে বলেছেন যে, একবার কামালউদ্দিন ও মুহাম্মদ আলী তাকে বলেছেন যে, গোলাম আহমদের কাছ থেকে হিসাব নিকাশ গ্রহণের সময় এসে গেছে। তাই জনাব (গোলাম) তার মৃত্যুর একদিন পূর্বেও বলেছেন: উস্তাদ মুহাম্মদ আলী ও খাজা কামালউদ্দীন আমার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করেন এবং বলেন যে, আমি অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে থাকি। এটা তাদের জন্য সমীচীন নহে। এরপর গোলাম বলে: আজ আমার নিকট উস্তাদের কাছ থেকে একটি পত্র এসেছে; এতে তিনি বলেছেন যে, পারিবারিক খরচ তো অল্পই হয়ে থাকে। এ হাজার হাজার টাকার অবশিষ্ট সম্পদ কোথায় ব্যয় করা হয়? (হয়ত এর দ্বারা সে সাম্রাজ্যবাদীদের ভন্ডনবীর নিকট তাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি রূপে তার নিজের অংশই উদ্দেশ্য করেছে।) জনাব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন: এ সমস্ত লোক বলে যে, আমরা অবৈধ মাল ভক্ষণ করি। এ সমস্ত সম্পদের সাথে তাদের কি সম্পর্ক? (তাদের সম্পর্ক কেন থাকবে না? তারা কি নবুয়তের অংশীদার নহে?) আমি যদি তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাই তবে এ সম্পদের কিছুই এমনকি একটি পয়সাও তাদের কাছে আসবে না। (এর দ্বারা কি ভক্ষণ করা বৈধ হয়ে যাবে? নূরুদ্দীনের নিকট গোলাম পুত্রের যা লাহোরী কাদিয়ানীদের আমির মুহাম্মাদ আলীর হাকীকতুল ইখতেলাফ কিতাবে সন্নিবেশিত, ৫০ পৃ:) ঠিক এ অর্থই কাদিয়ানী মুফতি সরওয়ার শাহ তার পুস্তক কাশফুল ইখতেলাফে উল্লেখ করেছে- উস্তাদ মুহাম্মদ আলী ও খাজা কামাল উদ্দীন সর্বদাই সম্পদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুত মাসীহের উপর অভিযোগ করতেন এবং সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখতেন।(সরওয়ার কাদিয়ানির কাশফুল ইখতেলাফ) এমনিভাবে তাদের বঞ্চিত রেখে একাকী সম্পদ জড়ো করা ও সঞ্চিত করার ব্যাপারে ভন্ডনবী কাদিয়ানীর সাথে যখন বিরোধ চলছিল, তখন গোলাম মারা গেল এবং কাদিয়ানী খেলাফতের মুকুট নুরুদ্দীনের মাথায় পরানো হল। ফলে, তারা ইংরেজদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং মুরিদগণের কাছ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ বণ্টন করতে লাগল । শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদীরা এক নতুন চিন্তা ভাবনা শুরু করল। তখন কাদিয়ানীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে তাদের কাজ-কর্ম এবং মুসলমানগণকে প্রতারণা করার ব্যাপারটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। কারণ, মুসলিম আলেমগণ জাগ্রত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের শীর্ষে ছিলেন শেখ ফাজেল মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী, ইসলাম ধর্মের তর্ক বিশারদ শেখ ছনাউল্লাহ অমৃতসরী, শেখ জলীল মুহাম্মদ ইব্রাহীম শিয়ালকোটি এবং শেখুল আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জলন্দরী প্রমুখ আলেম-ফাজেলগণ। (তাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক , আর যারা জীবিত আছেন তাদেরকে আল্লাহ হেফাজতে রাখুন।) এদের প্রত্যেকেই কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিবাদে পৃথক পৃথক পুস্তক রচনা করলেন এবং তাদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে দিলেন। তাদের বাস্তব রূপ উদ্ঘাটন করলেন এবং মুসলমানগণকে এদের মিথ্যা নবুয়্যত ও মিথ্যাবাদী নবী থেকে সতর্ক করে দিলেন। ফলে সাম্রাজ্যবাদীরা এ ধর্মান্তরিত দলের পেছনে যে পরিশ্রম করেছিল তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে দেখে ভীত হয়ে পড়ল। তারা তাদের কনিষ্ঠ এজেন্ট মুহাম্মদ আলী যে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য কাদিয়ানীদের বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাকে ইঙ্গিত করল, যাতে সে তার নেতৃত্বে একটি নতুন দল তৈরি করে এবং ঘোষণা দেয় যে, গোলাম আহমদের দাবি নবুয়তের দাবি ছিল না; বরং তার দাবি ছিল যে, সে এ মিল্লাত অর্থাৎ মিল্লাতে ইসলামিয়ার মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক। তা হলে মুসলমানদের মধ্যে যারা ইতিপূর্বে প্রতারিত হয়নি তারা এখন প্রতারিত হবে এবং এভাবে তারা গোলাম আহমদের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। এর ফলে মূল কাদিয়ানী ধর্মে তাদেরকে প্রবেশ করানো সহজ হয়ে যাবে। অথবা কমপক্ষে প্রতিরক্ষাকারী জীবন্ত ইসলাম এবং ইসলামের মুজাহিদ রাসূলের শিক্ষা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। এইভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও মুহাম্মদ আলীর লোভ লালসা অনুসারে এ দলটি সংগঠিত হল, তাদের চিন্তা ধারা ও ধর্ম বিশ্বাসের বিভিন্নতার কারণে নহে। যেমন তারা ধোঁকা ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে তা প্রকাশ করে থাকে। লাহোরে এ দলের কেন্দ্র স্থাপন করা হল। এমনি ভাবে মূল কাদিয়ানী ধর্মের কেন্দ্র কাদিয়ান থেকে গেল। (মুহাম্মদ আলীর তাহরিকে আহমদিয়া ৩০পৃঃ) পূর্ববর্তীরা নিরঙ্কুশ কাদিয়ানী নামে এবং এরা লাহোরী কাদিয়ানী নামে খ্যাতি লাভ করল। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, লাহোরী কাদিয়ানীরা তাদের চিন্তা ধারা ও বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে বিরোধ প্রকাশ করেনি। কেননা, ভিতরে ভিতরে তাদের ধর্ম বিশ্বাস অবিকল কাদিয়ানী ধর্ম বিশ্বাসের মতই ছিল। স্পষ্ট বর্ণনা দেখুন! লাহোরী কাদিয়ানী অর্থাৎ মুহাম্মদ আলী দলের একটি পত্রিকা তাদের মূল ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছে। তাতে রয়েছে আমরা প্রতিশ্রুত মাসীহের প্রাথমিক সেবকগণ। আমাদের বিশ্বাস যে, জনাব আল্লাহর সত্য ও সঠিক রাসূল ছিলেন। এ যুগের জনগণের পথ প্রদর্শন ও হেদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। অনুরূপভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে, তার অনুসরণ ছাড়া কারো মুক্তি পাওয়া সম্ভব নহে। (লাহোরী কাদিয়ানীদের পত্রিকা পয়গামে সুলাহে ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯১৩ সালে প্রকাশিত।) এই মুহাম্মদ আলী নিজেই লিখেছে- আমাদের বিশ্বাস যে ,গোলাম আহমদ প্রতিশ্রুত মাসীহ ও নির্দিষ্ট মাহদী এবং তিনি আল্লাহর নবী ও রাসূল। তিনি তাকে এ মর্যাদায় পৌঁছিয়েছেন যা সে নিজের জন্য বর্ণনা করেছিল। (অর্থাৎ সকল রাসূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।) অনুরূপভাবে আমরা এ বিশ্বাসও করি যে, যে ব্যক্তি তাকে বিশ্বাস করবে না সে মুক্তি পাবে না। (রিভিউ অব রিলিজিওন্স ৩য় খন্ড ১১ নম্বর ৪১১ পৃ:।) সে আরো লিখেছে যদি মুসা আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন এবং ঈসা আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকেন তবে গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল। কেননা, যে সকল নিদর্শনা বলী দ্বারা আমরা আল্লাহর নবীদের পরিচয় পাই, তার সবগুলো গোলাম আহমদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর উপর আমার মাতা-পিতা উৎসর্গ হোক এবং তার উপর সালাত ও সালাম। (রিভিউ অব রিলিজিউনাস ৯ম খন্ড ৭নম্বর ২৪৮ পৃ:।) তার সম্পর্কে এরূপ কথা অনেক। কিন্তু মুহাম্মদ আলী অন্যত্র দাবি করেছে: আমরা বিশ্বাস করি না যে, গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল, বরং আমাদের বিশ্বাস তিনি একজন মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক। (পয়গামে সুলাহ ১৯৩১ খৃ:।) তার এই দাবি বাস্তব বিরোধী ও তার পূর্ববর্তী বিবৃতি-বক্তব্যের পরিপন্থী। কেননা, গোলাম আহমদের দাবিসমূহ যাতে কোন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। সে স্পষ্টভাবে দাবি করেছে যে, আল্লাহর নবী ও রাসূল এবং সকল নবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি সে (নাউজুবিল্লাহ) মুহাম্মদে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও উত্তম আমরা পূর্ববর্তী কয়েকটি প্রবন্ধে এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এমনি ভাবে এখন আমরা মুহাম্মদ আলী ও তার দল সম্পর্কে উল্লেখ করছি যে, তারা মুসলমানদের প্রতারণা করা ও যাদেরকে ইতিপূর্বে প্রতারণা করা সম্ভব হয়নি তাদেরকে শিকার করার জন্য তারা তাদের এ আকীদা প্রকাশ করছে। কার্যত: সরলমনা মুসলমানদের একটি দল তাদের সাথে শামিল হয়ে গেল, যারা গোলাম কাদিয়ানীর দাবিদাওয়া ও এ দলের বাস্তব রূপ সম্পর্কে অবগত ছিল না। যখন তারা জানতে পারল, তখন তারা এ দল এবং মিথ্যাবাদী কাদিয়ানী থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করল।
মোটকথা, মুহাম্মদ আলী ও তার লাহোরী কাদিয়ানী জামাত ঐ আকীদা পোষণ করে যে আকীদার উপর কাদিয়ানী স্থির রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের অন্তরে লুক্কায়িত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাহ্যিকভাবে ঐ আকীদা ত্যাগ করে চলছে। এ উদ্দেশ্যটির সার বিষয় হল নিম্নোক্ত তিনটি:
প্রথমত: কাদিয়ানীদের প্রকৃত প্রভু সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিত ছিল যে, কাদিয়ানীদের এমন একটি দল গঠন করতে হবে যারা সাধারণ মুসলমানদের সাথে সদ্ব্যবহার করে তাদেরকে গোলাম আহমদের নিকটবর্তী করে দেবে। এটা জানা কথা, যে ব্যক্তি গোলামের নিকটবর্তী হবে সে ইসলাম হতে দূরে সরে পড়বে এবং কাদিয়ানীদের প্রকৃত মুরবিব সাম্রাজ্যবাদের নৈকট্য লাভ করবে। লাহোরী কাদিয়ানী পত্রিকা এ দিকে ইঙ্গিত করে বলছে- হায়, যদি কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদকে নবীরূপে প্রকাশ না করত....! যদি তারা এমন করত তা হলে কাদিয়ানী ধর্ম পৃথিবীর সকল প্রান্তে প্রবেশ করত।’ (পয়গাম সুলাহ’ ১৭ই এপ্রিল, ১৯৩৪ খৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মুহাম্মদ আলী নিজেই আমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে মরিসাস দ্বীপে একজন কাদিয়ানী মুবাল্লেগের নিকট লিখেছে ‘তোমাদের উচিত, তোমরা সেখানে এ সব কথা প্রচার করবে না যে, গোলাম আহমদ নবী ছিলেন, মুজাদ্দিদ নয় এবং যে তাকে বিশ্বাস করবে না সে কাফের। কেননা, এ দুটি বিশ্বাস ভারতবর্ষে কাদিয়ানী ধর্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। (লাহোরী কাদিয়ানীদের আমির মুহাম্মদ আলীর মরিসাস দ্বিপে জনৈক কাদিয়ানী মুবাল্লেগের নিকট লিখিত পত্র, যা আত-তাবলীগ পত্রিকায় সন্নিবেশিত ১ম খন্ড, ২১ নম্বর।)
এর অর্থ হল: এ সব কিছু শুধু কাদিয়ানী ধর্মের প্রচলন ও জনসাধারণকে গোলাম আহমদের নিকটবর্তী করে দেওয়ার জন্যই ছিল। এটা কি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে ছিল? মূল বক্তব্য দেখুন! কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজল প্রচার করেছে. ইংরেজ সরকার লাহোরী কাদিয়ানীদেরকে তাদের খেদমতের বিনিময়ে এক হাজার একর জমি দান করেছে। এত বড় পুরস্কার সরকারের প্রতি তাদের বিরাট খেদমতের স্বীকৃতি স্বরূপ দান করা হয়েছে। (আল-ফজল যা প্রচার করেছে তার মূল ভাষ্য, ২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৩০ খৃ:) দ্বিতীয়ত: মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানে সাম্রাজ্যবাদের একজন উচ্চ মর্যাদার প্রতিনিধি ছিল। কারণ, সে গোলাম আহমদের নবুয়্যত প্রচারের জন্য তথ্য জোগান এবং তার দায় দায়িত্বের ভার গ্রহণ করে। এ জন্য সে এ নবুয়তের বাস্তব রূপ এবং এর সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদের সেবা করা এবং মুসলমানগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া। আমরা তা পূর্বে উল্লেখ করেছি। আর এই সেবা একটি নতুন দল গঠনের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সাধিত হতে পারে। এ জন্য সে সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশাবলী দ্রুত বাস্তবায়িত করতে থাকে।
তৃতীয়ত: সে গোলাম আহমদের পরিবারকে রাশি রাশি ধন-সম্পদে তাকে শরীক না করে সঞ্চিত করার জন্য ঘৃণা করত। বিশেষ করে ভন্ডনবীর মৃত্যুর পর। কেননা, তারা এ সমস্ত লোকের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত ছিল না। পক্ষান্তরে ভন্ডনবী নিজে সামান্য হলেও এদের অংশ দিত। কারণ, সে জানত যে এরাই তার নবুয়তের মূল ভিত্তি। আল-ফজল পত্রিকা এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে বলছে: উস্তাদ মুহাম্মদ আলী কয়েকটি কারণে কাদিয়ানী মতবাদ থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। একটি হল: যখন জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ মৃত্যুবরণ করলেন, তখন মুহাম্মদ আলীকে তার (গোলামের) ঘর হতে বের করে দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত: গোলাম কাদিয়ানীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মুহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেন যে, সে জনগণের সম্পদ তার ইমারতে ব্যয় করেছে। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল , ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ খৃ: প্রকাশিত।) এই পত্রিকাই প্রচার করেছে যে, এ দলের (লাহোরী কাদিয়ানী) নেতারা জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের হাতে বায়আত করেছে এবং এদেরকে এ উম্মতের (কাদিয়ানী উম্মত) প্রধান প্রধান লোক বলে গণ্য করা হত। কিন্তু তারা তাদের আধ্যাত্মিক ত্রুটির কারণে সর্বদাই জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের সহিত বেআদবী করত।... আর, তার মৃত্যুর পর ধন-সম্পদ ও পদ মর্যাদার লোভে বশীভূত হয়ে কাদিয়ান কেন্দ্র থেকে তারা পৃথক হয়ে গেল এবং একটি নতুন জামাতের ভিত্তি স্থাপন করল।(আল ফজল ২১ সেপ্টেম্বর ১৯২৮ খৃ:) এ দুটি এবারত আমাদের বক্তব্যের স্পষ্ট সাক্ষ্য। বাকি, ভন্ডনবীর সহিত তাদের বেয়াদবী করা সত্ত্বেও দলের মধ্যে নেতা ও প্রধান হিসেবে বহাল থাকা কোন আশ্চর্যের বিষয় নহে। কেননা, তারা জানত যে, এ নবুয়তের দাবি একটা ব্যবসায়ী কোম্পানি এবং তারা সবাই এর অংশীদার।
মোটকথা, কাদিয়ানীরা দু দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এক দলের প্রধান ছিল নুরুদ্দীন। এদের আকীদা ছিল গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল এবং সে প্রতিশ্রুত মাসীহ ও মাহদী। সে সকল নবী রাসূলের মধ্যে উত্তম এবং যে ব্যক্তি তাতে বিশ্বাস করবে না, সে কাফের, জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। নুরুদ্দীন ব্যতীত এ দলের অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিবর্গ ছিল গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ ও কাদিয়ানীদের মুফতি মুহাম্মদ সাদেক প্রমুখ। এ দলই ছিল ভন্ডনবী কাদিয়ানীর প্রকৃত দল। কেননা, এরাই গোলাম আহমদের শিক্ষাকে খোলাখুলিভাবে প্রচার করত এবং কোন কিছু গোপন করত না।
দ্বিতীয় দল যাদের প্রধান ছিল মুহাম্মদ আলী। তারা প্রকাশ করত যে, গোলাম আহমদ নবী ও রাসূল নহে, বরং মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক। তাকে যে অমান্য করবে সে ফাসেক বিপথগামী। এদের প্রধান প্রধান লোক ছিল খাজা কামালুদ্দীন, মুহা্ম্মদ আহসান আমরুহী প্রমুখ। কিন্তু গোলাম আহমদের শিক্ষা ও বাণী এদের অনুকুলে ছিল না। তা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। মুহাম্মদ আলীর চরিত্রকে পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করার জন্য আমরা আরো কিছু বিষয়ের উল্লেখ করব। যাতে এ ধর্মের মূল উপাদান যে তৈরি করেছে তার পক্ষ থেকে এ ধর্মের প্রকৃত রূপ প্রকাশ করা সম্ভব হয়। মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানী ধর্ম থেকে পৃথক হয়ে কি করল? কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল থেকে আমরা তা শুনে নেই। হয়তো: পাঠকগণ জানেন যে, উস্তাদ মুহাম্মদ আলী যখন কাদিয়ান থেকে বের হয়ে যায়, তখন ইংরেজি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ চুরি করে তার সাথে নিয়ে যায়। যে অনুবাদের জন্য জামাত হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেছিল। একটি বিরাট লাইব্রেরি ও চুরি করে নিয়ে গেল। অনুরূপভাবে একটা ছাপা মেশিনও নিয়ে গেল, যার মূল্য (তখনকার দিনে) সাড়ে তিন শত টাকা ছিল। (আল ফজল, ১লা জুলাই, ১৯১৫ খৃ:।) এটাও জানেন যে, উস্তাদ মুহাম্মদ আলী জামাতের পক্ষ থেকে কুরআনের ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করত। অর্থাৎ সে এ কাজের বিনিময়ে একটা বিরাট পারিশ্রমিক গ্রহণ করত। অতঃপর সে কাদিয়ান থেকে এ অজুহাতে এ বোটা বাদ (বর্তমানে পাকিস্তানের একটি গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান) চলে গেল যে, অবশিষ্ট অনুবাদ সে ওখা নে গিয়ে পূর্ণ করবে। এ কাজের জন্য সে হাজার টাকা অগ্রিম গ্রহণকরে। অনুরূপ ভাব সে কাদিয়ানীদের সাধারণ লাইব্রেরি থেকে হাজার হাজার টাকা মূল্যের পুস্তিকাদি নিয়ে যায়। এই সাথে একটা আধুনিক ছাপা মেশিনও সে নিয়ে গেল, যার মালিক ছিল কাদিয়ানী জামাত। জামাতের নিকট এ সমস্ত জিনিস ফেরত দেওয়ার বদলে সে লাহোরে ঘোষণা দিল- এ সমস্ত জিনিস তার নিজেরই এবং এর সাথে কাদিয়ানীদের কোন সম্পর্ক নেই। অতঃপর সে কুরআনের অনুবাদ [১ অত্যন্ত অনুতাপের বিষয় যে, অনেক মুসলমান ইংরেজী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকৃত তার গ্রন্থটি কিনছেন, তাদের ধারনা যে উহার লেখক একজন মুসলিম ব্যক্তি। এমনিভাবে, তারা ঐ সকল ষড়যন্ত্রের কথাও জানেন না যাকে সে উহার অনুবাদ ও ব্যখ্যার মধ্যে গ্রথিত করেছে। সুতরাং এ তথ্য জানার পর সকলেরই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।] থেকে কাদিয়ানীদের কিছু মাসয়ালা বের করে বিশ্বাসঘাতকতার শীর্ষে পৌঁছে যায়। সে আল্লাহর এ বাণীর প্রতি ভ্রূক্ষেপও করেনি: ‘‘তোমরা জেনে শুনে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং তোমাদের আমানতেও খিয়ানত করো না।’’ আল্লাহ আরো বলেছেন, তিনি বিশ্বাসঘাতকদের পছন্দ করেন না।’ (আল-ফজল, ২রা জুন, ১৯৩১ খৃ:)
মুহাম্মদ আলী জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের চিন্তাধারা চুরি করে কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় সন্নিবেশিত করেছে। কিন্তু উল্লেখ করেনি যে, সে তার নিকট থেকে তা গ্রহণ করেছে। (আল-ফজল’ ৩১ শে জুন ১৯৩১খৃঃ) একদা কাদিয়ানী পত্রিকা প্রকাশ করল- ‘কেবলমাত্র উস্তাদ মুহাম্মদ আলী ইংরেজদের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিয়োজিত নহেন, বরং তার সম্মানিতা স্ত্রীও এই সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। (পয়গামে সুলাহ, যা আল-ফজল, থেকে উদ্ধৃত, ৩রা মার্চ, ১৯৩১ খৃ:)
এই হল কাদিয়ানীদের নেতা এবং লাহোরী কাদিয়ানী জামাতের আমিরের অবস্থা, আর, এই হল লাহোরী কাদিয়ানী জামাতের অবস্থা, ! উল্লেখ্য যে, লাহোরী কাদিয়ানী ধর্ম নুরুদ্দীনের মৃত্যুর পর গোলাম আহমদের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হল। লাহোরী জামাতের প্রধান হল মুহাম্মদ আলী, এর সচিব হল তার ভাই এবং এর কোশাধক্ষ্য হল তার ভাতিজা। সাধারণ ও বিশেষ পাঠাগার সম্পাদক হল তার ভগ্নে। পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও ঘোষণাপত্র বিভাগের প্রধান হল তার শ্বশুর। মেহমানদারী বিভাগের প্রধান হল তার আর এক আত্মীয়। (আল-ফজল যা, ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ খৃ: প্রকাশিত।)
কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ:
১৯১৪ সালে নুরুদ্দীনের মৃত্যুর পর গোলাম কাদিয়ানীর পুত্র জন সমক্ষে এসে নিজেকে খলীফা ঘোষণা দিল। সে শুধূ কাদিয়ানীদের খলীফা নহে, বরং সমগ্র বিশ্বের খলীফা। অনন্তর, সে ঘোষণা দিল: ‘আমি শুধু কাদিয়ানীদের খলীফা নই এবং শুধু ভারতেরও নই, বরং আমি প্রতিশ্রুত মাসীহের খলীফা। তাই, আফগানিস্তান, আরব বিশ্ব, ইরান, চীন, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, সু-মাত্রা, জাভা, এমনকি ব্রিটিশেরও খলীফা। বিশ্বের সকল মহাদেশব্যাপী আমার আধিপত্য রয়েছে।’ (মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা আল-ফজল পত্রিকায় সন্নিবেশিত, ১লা নভেম্বর, ১৯৩১ খৃ:) সেই তার বিকৃত মস্তিষ্ক পিতার যথার্থ সত্যিকার স্থলাভিষিক্ত। কাজেই, সে তার পিতার ন্যায় পাগলামি আরম্ভ করে এবং ঘোষণা দেয়: কুরআনে আমার উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে বর্ণিত লোকমান এবং তদীয় পুত্রের কাহিনী লক্ষ্য করুন! লোকমান কে তা কি জান? এবং তার ছেলেই বা কে? লোকমান হল প্রতিশ্রুত মাসীহ (গোলাম) এবং তার ছেলে হলাম আমি।’ (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে সন্নিবেশিত, ১২ই মার্চ, ১৯২৩ খৃ:) সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বে তার বাবার চরিত্র গ্রহণ করে সে ঘোষণা দিল- ইংরেজ সরকারের দুঃখ আমাদেরই দুঃখ। কাদিয়ানী বাহিনী যারা ফ্রান্স ভূমিতে ব্রিটিশের শত্রুগণের সাথে যুদ্ধরত আছে, তারা যেন এ মর্মটি অনুধাবন করে নেয়। (আল-ফজল’ ২৭শে অক্টোবর, ১৯১৪খৃঃ)
তুরস্ক ও অস্ট্রিয়ায় ইংরেজরা তাদের শত্রু মুসলমানগণকে পরাজিত করার খুশিতে খলীফা মাহমুদ তার অনুসারীদেরকে আনন্দ মাহফিল অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয় এবং যুদ্ধ প্রস্ত্ততিতে কাদিয়ানীদের অংশ গ্রহণের নিমিত্তে সরকারের কাছে পাঁচ হাজার টাকা প্রেরণ করে। এতদ্ব্যতীত ভারত বর্ষে বিশ্বাস ঘাতক সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীকে ধন্যবাদ দিয়ে অনেক অনেক তার বার্তা প্রেরণ করে। (আল-ফজল পত্রিকা দেখুন, ১৬ নভেম্বর, ১৯১৮ সালে প্রকাশিত) আমরা এর জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করব, যাতে পাঠক জানতে পারেন যে, কেমন ব্যক্তিটি কাদিয়ানীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
প্রথমত: সে কাদিয়ানীদের মধ্যে তার কয়েকজন বিরুদ্ধবাদীদের গুপ্ত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। এদের মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রী যে নূরুদ্দীনের কন্যা ছিল এবং তার শ্যালক। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল’ ১৪ই আগস্ট, ১৯৩৭খৃঃ।) কারণ, তারা তার পারিবারিকও দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত খেয়ানতে পরিপূর্ণ। সে যে সকল হারাম ও লজ্জাহীন অশ্লীল কাজে লিপ্ত ছিল তাও তারা জানত। এ সকল ঘটনার একটি হল এই, জনৈক কাদিয়ানী তাকে তার পুত্রবধূ ধর্ষণ করার অভিযোগ দিয়ে বলে- আমি আহমদ দ্বীন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছি যে, আমি একজন কাদিয়ানী এবং আমি বিশ্বাস করি যে, প্রতিশ্রুত মাসীহ আল্লাহর নবী ও রাসূল ছিলেন। আমি জনাব মাসীহের দ্বিতীয় খলীফা তদীয় পুত্র মাহমুদ আহমদের হাতেও বায়আত করেছি। আমার স্ত্রী ও পরিবার পরিজন দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদের বাড়িতে তার পরিবার বর্গ ও মাসীহে মাওউদের পরিবারের সেবা যত্নের উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে যায়। মাহমুদ আহমদ তাকে একাকিনী দেখতে পেয়ে কোন কৌশলে তাকে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং বলে কাউকে তুমি একথা বলিও না। যদি বল, তবে কেহই তোমাকে বিশ্বাস করবে ন, বরং তুমি নিজেই লোকজনের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হবে। অনন্তর, সে কেঁদে কেঁদে বাড়িতে এসে ঘটনাটি বলল। আমি খলীফার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। সে তা অস্বীকার করল। তাকে হলফ করতে বললাম। তাও সে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমাকে মৃত্যু অথবা কাদিয়ান থেকে বিতাড়িত করার হুমকিও দিল, যদি আমি মুখ খুলে কারো কাছে একথা বলি। আমি এ পত্রটি পত্রিকায় এ জন্য পাঠাচ্ছি, যাতে জনগণ এই খলীফার বাস্তব রূপ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে যে তার অপরাধ সমূহ কাদিয়ানী সিলসিলাকে কলুষিত করেছে। যদি সে আমার পুত্রবধূর সাথে ব্যভিচার না করে থাকে তাহলে সে আমার সাথে মোবাহালা করে বলুক- মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ অবতীর্ণ হোক ।’ (আহমদ দ্বীন কাদিয়ানীর পত্র যা দৈনিক জমীনদার লাহোরী পত্রিকায় প্রচারিত।) এ পত্রটি প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে তারা আহমদ দ্বীনকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে বশ করে নিল। শেষ পর্যন্ত সে কাদিয়ানী পত্রিকা আর-ফজলে এ মর্মে ঘোষণা দিল যে, জমীনদার পত্রিকায় আমি যে পত্র প্রচার করেছিলাম তজ্জন্য আমি অনুতপ্ত। কারণ আমার পুত্রবধূ খলীফাতুল মাসীহের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। (এটা কি বুদ্ধিসম্মত কথা যে, কোন একজন বিবাহিত নারী নিজের জন্য এরূপ মিথ্যা অপবাদ রটনা করে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে?) এ জন্য আমরা তাকে ত্বালাক দিয়েছি। তার বিরুদ্ধে আমি মে শপথ আহবান করেছিলাম, তাও আমার পক্ষ থেকে একটি ভুল ছিল। কেননা আমি জানতাম না যে, মোবাহালা এ ধরনের বিষয়াদিতে বৈধ নহে। সুতরাং আমি ঘোষণা দিচ্ছি, হযরতের শপথ ব্যতীত এবং হযরতের সাথে মোবাহালা ব্যতীত আমার বিশ্বাস যে, আমার পুত্রবধূ হযরত (মাহমুদ আহমদ) কে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে।’ (দ্বীন আহমদ কাদিয়ানীর ঘোষণা যা আল-ফজল পত্রিকায় ৩রা জুন ১৯৩০ সালে প্রচারিত।) ঠিক একই অপবাদ তাকে আরো অনেক ব্যক্তি দিয়েছেন, যাদের সংখ্যা বিশের অধিক। তাদের মধ্যে রয়েছেন, আবদুর রহমান কাদিয়ানী, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল করীম, ডাক্তার আব্দুল আজীজ প্রমুখ ব্যক্তিগণ। এদের যারাই তার থেকে শপথ অথবা মোবাহালা দাবি করেছেন সে তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অপবাদ অস্বীকার করেছে। লাহোরী কাদিয়ানী পত্রিকা প্রচার করেছে ১৯২৫ সাল হতে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মাহমুদ আহমদের উপর ব্যভিচারের অপবাদ বিশের অধিক দাঁড়িয়েছে। এ সব অপবাদ ঐ সকল লোকের পক্ষ থেকে আরোপিত হয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজ শহর ও জনপদ ত্যাগ করে হিযরত করেছে। তা সত্ত্বেও খলীফা মাহমুদ একটি মাত্র কথা বলতে সাহস পায়নি, ‘মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ।’ কেননা, সে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। (পায়গামে সুলাহ, ১৬ই নভেম্বর ১৯৪৯ খৃ:।) এদেরই একজন কাদিয়ানের মজলুমগণ নামে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করে উহাতে অপবাদ সমূহের উল্লেখ করার পর বলেছে: আব্দুর রহমান মিসরি কাদিয়ানী এ সকল অপবাদের অনুসন্ধান করার জন্য বিশিষ্ট কাদিয়ানীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার দ্বাবী জানাল, কিন্তু খলীফা তাতে সম্মতি প্রদান করেন নি, বরং তিনি কিছুদিন পর তাকে জামাত থেকে তাড়িয়ে দেন এবং তার যুক্তিসংগত শর্তাবলি গ্রহণ করার পরিবর্তে তাকে কাদিয়ানী ধর্ম হতে বহিষ্কারের ঘোষণা প্রদান করেন। (ফখরুদ্দীন মুলতানী কাদিয়ানীর লিখিত কাদিয়ানের মজলুমগণ।’) এই হল কাদিয়ানী ইমাম ও তাদের খলীফার স্বরূপ, যে সর্বদা এ ধরনের কুৎসিত অপবাদের দ্বারা অভিযুক্ত ছিল। বরং তার মুরিদগণের পক্ষ হতে। আমি ক্রিমিনাল আদালতের রেজিষ্টার হতে নিম্নোক্ত যে ভাষ্যটি উদ্ধৃত করছি তা এ লোকটির মানসিকতার সঠিক চিত্র তুলে ধরছে। মাহমুদ আহমদের কাছে একজন যুবতী সেবিকা ছিল। সে একবার কিছু ঔষধ ক্রয় করার জন্য এহসান আলী কাদিয়ানী তাকে প্রতারিত করে তার ফার্মেসির পেছনে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে তার সাথে ব্যভিচার করে। যখন ছালমা নাম্নি এ সেবিকা বাড়ি প্রত্যাবর্তন করে, তখন কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদের নিকট ঘটনাটির সংবাদ দেয়। খলীফা এহসান আলীকে ডেকে পাঠালেন এবং ছালমাকে বললেন- তাকে (অর্থাৎ এহসান আলীকে) দশটি জুতা মার। সালমা তাকে জুতা মারল, এরপর তাকে ছেড়ে দিলে সে চলে গেল।’ (অমৃতসর জেলা হাকিমের আদলতে ছালমার সাক্ষ্য, ১০ই জুলাই ১৯৩৫ খৃ: যা আল মাযহাবুল কাদিয়ানী অভিধান থেকে উদ্ধৃত।) উক্ত ভাষ্যটি একথা ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না যে, লোকটি এ জঘন্য অপরাধ কে মামুলী বিষয় মনে করত। এরপর ঐ যুবতীকে ব্যভিচারী এহসান আলীর গায়ে হালকাভাবে জুতা দিয়ে প্রহার করার নির্দেশ দেওয়া কি একথা বুঝায় না যে, সে এ সকল অপবাদ দ্বারা অভিযুক্ত হল, তখন সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হতে পারেনি।
আর একবার অমৃতসরের ‘মোবাহালা’ নামক পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে এ বিষয়ের উপর মোবাহালা করতে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, সে ব্যভিচারী নহে। কিন্তু সে এই বলে তাদের প্রতিবাদ করল- এ সমস্ত ব্যাপারে মেবাহালা করা বৈধ নহে। অতপর. উমর উদ্দিন সমলবী কাদিয়ানী বর্ণনা করছে যে, অমৃতসরের মেবাহালা পত্রিকা কর্তৃক কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদ কে এ সকল চ্যালেঞ্জ প্রদান এবং ওগুলো তার প্রত্যাখ্যান করার পর আমি মাহমুদ আহমদের কাছে গেলাম। তখন সে গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল মানসূরিতে অবস্থান করছিল। (মানসুরী ভারতের অন্যতম গ্রীষ্ম কালীন আবাসস্থল।) আমি তাকে বললাম- মুসলমানগণ একে অপরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়ার অবস্থায় মোবাহালা বৈধ হবে না কেন? অথচ প্রতিশ্রুত মাসীহ স্পষ্টভাবে বলে গেছেন যে, এ সমস্ত অবস্থায় মেবাহালা বৈধ। খলীফা মাহমুদ আহমদ আমাকে উত্তর দিল, আমি ইতিপূর্বে এ সমস্ত ব্যাপারে মোবাহালা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুত মাসীহের ফতওয়া সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের ফতওয়া সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর খলীফার কর্তব্য ছিল যে, সে টাল-বাহানা করে মেবাহালা থেকে পিছু হটবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করার জন্য মেবাহালার দিকে অগ্রসর হয়নি। (উমর উদ্দিন সমলাবী কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা পয়গামে সুলাহ এ প্রচারিত এবং ১৯শে জুলাই ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত।) স্বয়ং এই কাদিয়ানী খলীফা যখন ইউরোপ ভ্রমণে গেল তখন সেখানে এমন কতকগুলো কাজে লিপ্ত হল যার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে মানুষ ঘৃণা বোধ করে। এ ভ্রমণ সম্পর্কে অনেক কিছু প্রচারিত হয়েছে। সে প্যারিসে আন্তর্জাতিক ক্লাবে উপস্থিত হয়ে নগ্ন নর্তকীদের নিয়ে আনন্দ উপভোগ করল। এই ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করলে সে উত্তর দেয়: আমি পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপর্যয় সমূহ শুধু পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রবেশ করেছিলাম। এতদ্ব্যতীত সে কাদিয়ান এবং ভারতের বিখ্যাত বিখ্যাত গ্রীষ্মকালীন আবাসভূমি ও নগরে বড় বড় প্রসাদ নির্মাণ করেছে। ভারত বিভক্তির পর সে তার খেলাফতের মুকুট ও সিংহাসন কাদিয়ানে রেখে পাকিস্তানে পলায়ন করে। অতপর: কাদিয়ানীদের জন্য পাকিস্তানে নতুন একটি কেন্দ্রের গোড়াপত্তন করে এর নাম দেয় রাবওয়া। কাদিয়ানীদেরকে ওখানে হিযরত করার নির্দেশ দিল। এখানেও সে তার পুরাতন অভ্যাস সমূহ ত্যাগ করতে পারল না। বরং পুনরায় সে তার কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে এবং আনন্দ উল্লাসে মগ্ন হল। ফলে, তার সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচারিত হতে লাগল এবং তার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গও তাকে চিনে ফেলল। একজন বিশিষ্ট কাদিয়ানী আল ফজল পত্রিকার সম্পাদক ছিল, সে সবকিছু এমন কি কাদিয়ানী ধর্ম ত্যাগ করে রাবওয়া থেকে পলায়ন করার পর তার পুস্তক আমিরুল মাযহাবী লির রাবওয়া তে লিখে তার কলঙ্ক রটিয়ে দিয়েছে।....
পরিশেষে তার উপর পরাক্রমশালী মহান আল্লাহর শান্তি আসল এবং সে কতিপয় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হল; যথা অর্স্ব, বাঁত মাথা ঘুরান, হিষ্ট্রিয়া (এক প্রকার পাগলামী)যক্ষ্মা ও পক্ষাঘাত। সে কয়েক বৎসর যাবৎ বিছানায় পড়ে রইল, না কথা বলতে পারত, না নড়াচড়া করতে পারত। এমতাবস্থায় সে দশ বৎসর যাবৎ উপর্যুপরি এ সকল রোগে আক্রান্ত থেকে ১৯৬৫ সালে মারা যায়। মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন: ‘তাদেরকে আমি বিরাট শাস্তির পূর্বে নিকটবর্তী শাস্তির স্বাদ ভোগ করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।’ [১ সুরা সিজদাহ ২০] তার মৃত্যুর পর তার ছেলে খলীফা নিযুক্ত হল।....
খাজা কামালুদ্দীন:
মুহাম্মদ আলীর অন্যতম প্রধান সাহায্যকারী ছিল খাজা কামালুদ্দীন। সে গোলামের মৃত্যুর পর ঘোষণা দিল, গোলাম আহমদ যা করত সে তাই করবে। কাজেই সেও গোলামের ন্যায় সংশোধনকারী ও মুজাদ্দেদ। (আল ফজল ১০ অক্টোবর, ১৯১৫ খৃ:।) তারপর সে কাদিয়ানীদের কাছ থেকে ইউরোপে কাদিয়ানী ধর্ম প্রচারের নামে একটা বিরাট পরিমাণের টাকা গ্রহণ করল এবং ইংল্যান্ড চলে গেল এবং অকিং এ বসবাস করতে লাগল। সেখানে সে একটি বিরাট বাড়ী ক্রয় করে এবং কোন প্রকার কাজ কর্ম ব্যতীত আমীর উমারাদের ন্যায় জীবন যাপন শুরু করে। [১ আমার কাছে উস্তাদ আব্দুল হক মাহরুছ বর্ণনা করেছেন যে, একদা মিশরে মুদ্রিত আর-রেসালাতে প্রচার করা হল যে, খাজা কামালুদ্দীন ইসলামের একজন বিখ্যাত আহবায়ক। আর তার হাতে বড় বড় ইংরেজ লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে লর্ড হেডলী প্রমুখ ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা আমরা পুর্বে উল্লেখ করেছি যে, সে ইসলামের আহবায়ক ছিল না; বরং কুফুর ও ইরতেদাদের আহবায়ক ছিল। এদের সাথে লর্ড হেডলীর ইসলাম গ্রহণের কোন সম্পর্ক ছিল না। যেমন তিনি নিজেই ইহার ঘোষণা দিয়েছেন।...] যখনই সে কাউকে ইউরোপে ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে শুনত, সাথে সাথে সে এটাকে নিজের কৃতিত্ব বলে দাবি করত। যেমন, সে লর্ড হেডলী, মুহাম্মদ পিকতল, স্যার আরজিন্যাল্ড হিমেলটন, ডাঃ স্যান্ড রেক এবং স্যার ষ্টুয়ার্ড রেঙ্কিন এর বেলায় করেছিল। তবে এদের সকলেই যখন এ অপবাদের কথা জানতে পেরেছেন, সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে, গোলাম আহমদের ধর্ম এবং তার সঙ্গী সাথীদের ধর্মের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। (মাহমুদ আহমদের মেরআতুস সিদক’ ১৫৮ পৃ: এবং তার হাককিতুল ইসলাম ম্যাগাজিন, জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল ও মদিনা পত্রিকা ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সাল।)
ধর্ম প্রচারের নামে যে বিপুল সম্পদ সে গ্রহণ করেছিল তা সে হজম করে নিল এবং তার নিজের প্রতি আহবান করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। স্বয়ং কাদিয়ানী ম্যাগাজিন প্রচার করছে- ‘খাজা কামালুদ্দীন লক্ষ লক্ষ টাকা কোন কাজ না করেই এবং কোন হিসাব না দিয়েই সবটুকু ভক্ষণ করে ফেলেছে। যখন তার কাছে হিসাব চাওয়া হল, তখন উত্তরে বলল-‘জমিয়তে ইসলামিয়া লাহোরের নিকট এর হিসাব আছে। জমিয়ত তার নির্দিষ্ট সময়ে ঘোষণা দিল যে, তাদের নিকট কোন হিসাব নেই। কেননা, খাজা কামালুদ্দীন আহমদের নিকট কোন হিসাব পাঠান নি। (আল ফজল ১৭ আগস্ট, ১৯২৮ খৃ:।) এ বিরাট অঙ্কের টাকা সে কোথায় কীভাবে ব্যায় করল? একজন ভারতীয় পর্যটক যিনি ওয়াকিং গিয়েছিলেন, তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন- মি: কামালুদ্দীন তার জনৈক বন্ধুর সহিত হোটেলে খাবার খাচ্ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আমি হোটেলের বয়কে জিজ্ঞাসা করলাম- এ দুই ভদ্রলোক কি খেলেন? সে অত্যন্ত সরলভাবে উত্তর দিল- উন্নত মানের শুকরের মাংস।’ (আল-ফজল’ ২১ আগস্ট, ১৯২৪ খৃ:।) ইনিই হলেন ভন্ডনবী কাদিয়ানীর মহান সাহাবী ও লাহোরী কাদিয়ানী জামাতের নেতা যিনি বিরাট পরিমাণ সম্পদ পিছনে রেখে মারা যান।
মুহাম্মদ আহসান আমরুহীঃ-
মুহাম্মদ আহসান আমরুহী যার সম্পর্কে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, গোলাম আহমদ তার লিখিত পান্ডুলিপি গুলো সংশোধনের জন্য তার কাছে পাঠিয়ে দিত এবং তার সম্পর্কে লিখেছে যে, জনাব উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী একজন মহান মর্যাদাবান, বিশ্বাসী, মুত্তাকী এবং আল্লাহর পথে নিজের প্রাণ ও অন্তঃকরণ উৎসর্গকারী।’ (গোলামের ভাষণ যা তাবলীগে রেসালাতে সন্নিবেশিত, ২য় খন্ড, ১০৩ পৃ:।) গোলাম পুত্র ও তার খলীফা এ ব্যক্তি সম্পর্কে লিখেছে, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ ও তার খলীফা শেখ সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান আমরুহীকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। আমার পিতা তার ইলম ও ফজলের কারণে তার সামনে আদব রক্ষা করে চলতেন। (মাহমুদ আহমদের মানছাবুল খেলাফত’ ৫৩ পৃ:) শুধু তাই নহে, কাদিয়ানী ভন্ডনবী বিভিন্ন মাসায়েলের ব্যাপারে তারই শরণাপন্ন হতেন। কাদিয়ানী মুফতি মুহাম্মদ সাদিকের বর্ণনার প্রতি লক্ষ করুন- ‘শেখ আব্দুল করীম ইমামতি করছিলেন এবং জনাব গোলাম তার পেছনে নামাজ আদায় করছিলেন। যখন শেখ আব্দুল করীম প্রথম তাশাহুদ হতে দাঁড়ালেন তখন জনাব গোলাম তা বুঝতে না পেরে তাশাহুদেই রয়ে গেলেন। এমনকি শেখ আব্দুল করীম রুকুর জন্য তাকবীর বললেন। (হায়রে ভন্ডনবী মিথ্যাবাদীর উদাসীনতা?) পরে তিনি ক্বিয়াম ছাড়াই রুকুতে গিয়ে মিলিত হলেন। যখন নামাজ সেরে ফেললেন তখন উস্তাদ নুরুদ্দীন ও উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহীকে ডেকে তাদের কাছে মাসআলার অবস্থা পেশ করে তার শরয়ী হুকুম সম্পর্কে ফতওয়া চাইলেন। (কোন নবী শরয়ী মাসায়েল অন্যের নিকট জিজ্ঞাসা করার মুখাপেক্ষী, না তিনিই লোকজনের নিকট মাসায়েল বর্ণনা করবেন? হে আল্লাহর বান্দাগণ একটু ভেবে দেখুন) এ রাকাতকে কি গণনা করবে, না গণনা করবে না? তখন উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী এ ব্যাপারে কয়েকটি সমাধান বর্ণনা করলেন।’ (মুহাম্মদ সাদেকের ভাষণ যা আল-ফজলে সন্নিবেশিত,১৭ই জানুয়ারি ১৯২৫ খৃ:।) এই মহান উস্তাদ, মুত্তাকী, বিশ্বাসী ও কাদিয়ানীদের বিরাট নেতা পরিশেষে কি হলেন? তার সম্পর্কে আল-ফজল পত্রিকা লিখেছে- পয়গামে সুলাহ পত্রিকা এই দুর্ভাগা, কঠোর প্রাণ ও জালুতের একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছে, যে ব্যক্তি শোচনীয় বয়সে পৌঁছেছিলেন এবং তার অনুভূতি শক্তি ও হারিয়ে ফেলেছিলেন অর্থাৎ উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী, তিনি এই প্রবন্ধে বলেন: আমাদের নেতা ও উস্তাদ, দ্বিতীয় খলীফা উমরের সমতুল্য মাহমুদ আহমদ বলেছেন: তিনি ছিলেন একজন সামেরী ও জালুত ব্যক্তি’’। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজল ৯ই নভেম্বর ১৯১৮ খৃ:।) এই হল ভন্ডনবী কাদিয়ানীর বিশিষ্ট সাহাবী তথা তার উস্তাদ। তার সম্পর্কে আল-ফজল এ কথা বলছে এবং গোলাম পুত্র ও তখনকার খলীফা মাহমুদ আহমদের তত্ত্বাবধানে তা প্রচার করছে। সেও একই কথা গোলাম পুত্র কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ সম্পর্কেও বলেছে । আমরা বলি যে, তারা উভয়ই ঠিক বলেছে।
মুহাম্মদ সাদেক- কাদিয়ানীদের মুফতি:
মুহাম্মদ সাদেক সেও আল্লাহর কঠিন শাস্তিতে পতিত হয়েছে। আল-ফজল পত্রিকা প্রচার করেছে যে, সম্মানিত জনাব মুফতি মুহাম্মদ সাদেক জ্বর, কঠিন কাশি ও মূত্র বদ্ধতায় আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করছেন। তার সুস্থতার জন্য দোয়া করা বন্ধু বান্ধবদের কর্তব্য। (আল-ফজল আগস্ট ১৯৪০ খৃ:।)
আশ্চর্যের বিষয়, এ সমস্ত রোগ তার প্রাণনাশ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমতাবস্থায় সে অল্প বয়স্কা এক যুবতীকে বিবাহ করেছে। লক্ষণীয় যে, এ সময় তার বয়স ছিল সত্তুরের ঊর্ধ্বে। লাহোরী কাদিয়ানী পত্রিকা প্রচার করেছে ‘মুফতি মুহাম্মদ সাদেকের বিবাহ সংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অথচ তার বয়স সত্তুর বছর অতিক্রম করেছে। তিনি অল্প বয়স্কা একজন যুবতী বিবাহ করেছেন। এটা জানা কথা যে, উক্ত মুফতি করাচীতে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন। কিন্তু বিবাহের অস্থিরতা তাকে রোগমুক্ত হয়ে কাদিয়ানে যাওয়ার অবকাশ দেয়নি। এজন্য উকিলের মাধ্যমে তিনি বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। (অর্থাৎ স্ত্রী কাদিয়ানে এবং তিনি করাচীতে।) এমনিভাবে কাদিয়ানী মুবাল্লেগ শেখ আব্দুর রহীমের বিবাহের সংবাদও পৌঁছেছে। তার বয়সও সত্তুর বছর অতিক্রম করেছিল। তার কাহিনি হল সে একটি যুবতী মেয়েকে পড়াত এবং আকস্মিকভাবে সে ঘোষণা দিল যে সে মেয়েটিকে বিবাহ করে ফেলেছে। (পয়গামে সুলাহ, ২৮ অক্টোবর, ১৯৪০ খৃ:।)
অতঃপর তার রোগাক্রান্ত অবস্থায় ৯ জানুয়ারি ১৯৪৬ সালে আল-ফজল পত্রিকায় ঘোষণা দেওয়া হল জনাব মুফতি খুবই অসুস্থ। তার মূত্রনালি ফুলে গেছে এবং উহা থেকে রক্ত ঝরছে। তিনি অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছেন। পূর্ণ-রাত অনিদ্রায় কেটে যায়, তিনি বিরতি হীন ভাবে এ রোগ যন্ত্রণায় অস্থির থাকেন।’ (আল-ফজল ৯ই জানুয়ারি ১৯৪৬ খৃ:।) অবশেষে সে এ অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে। শাস্তি এরূপই হয়, আর পরকালের শাস্তিতো আরো ভয়াবহ! যদি তারা উপলব্ধি করত। [১ সুরা কলম ৩৩]
আব্দুল করীম- গোলাম কাদিয়ানীর নামাজের ইমাম:
আমরা কাদিয়ানীদের এ সমস্ত নেতাদের সারিতে আরো একজন কাদিয়ানী নেতার উল্লেখ করা সমীচীন মনে করি, যে গোলাম আহমদের জীবদ্দশায়ই মারা যায়। তার নাম হল আব্দুল করীম। সে গোলাম আহমদের ঘনিষ্ঠ সাথী ও খতিব ছিল। তার সম্পর্কে গোলাম বলেছে, কাদিয়ানীদের মধ্যে এমন কোন তৃতীয় ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেনি যে শেখ নুরুদ্দীন ও শেখ আব্দুল করীমের সমকক্ষ হতে পারে।’ (গোলামের বাণী যা মাহমুদ আহমদের ডায়রীতে সন্নিবেশিত এবং আল-ফজলে প্রচারিত, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ খৃ:।) আমার মওলা আব্দূল করীম শিয়ালকোটি আল্লাহ তাকে নিরাপদে রাখুন! তিনি আমার লিখিত পুস্তক আত-তাবলীগের অনুবাদে সাহায্য করেছেন। এবং তিনি আমার একজন নিষ্ঠাবান বন্ধু’। সে গোলাম আহমদের সাথে মিলিত হবার পূর্বে একজন নাস্তিক ও বেদ্বীন ছিল। (বশীর আহমদের সীরাতুল মাহদী ১ম খন্ড, ১৪১ পৃ:।) সেই প্রথম ব্যক্তি যে গোলাম আহমদকে আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর নবী বলে সম্বোধন করেছিল। (আল-ফজল, ১লা জুলাই, ১৯৩৩ খৃ:।) এমনকি কেহ কেহ বলে থাকেন যে, সে-ই গোলাম আহমদকে নবুয়তের দাবিকরতে সাহস জুগিয়েছিল। কেননা, সর্বদাই সে জুমার খুতবায় তাকে হে নবী! হে রাসূল! বলে সম্বোধন করত। এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে এ পৃথিবীতেই এমন শাস্তি দিয়েছেন, যা শ্রবণ করলে মানুষ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। গোলাম পুত্র বশীর আহমদ তার রোগ সম্পর্কে লিখছে ‘শেখ আব্দুল করীম কারবাঙ্কাল রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তার শরীরে এমন কোন জায়গা অবশিষ্ট ছিল না যেখানে অপারেশন করা হয়নি। সে তার অসুখের সময় এমন চিৎকার করত যা শ্রবণ করাও মানুষ সহ্য করতে পারত না। এ জন্য জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ তার বাসস্থান পরিবর্তন করে দিলেন। কারণ, যেখানে প্রতিশ্রুত মাসীহ বসবাস করতেন ঐ একই বাড়িতে শেখ আব্দুল করীমও বসবাস করত। শেখ আব্দুল করিম চিৎকার করে কান্নাকাটি করত, যাতে জনাব মাসীহ তার সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু জনাব মাসীহ তার শুশ্রূষার জন্য কখনও যান নি। তিনি বলতেন- আমি তো তার কাছে যেতে চাই, কিন্তু আমি তাকে এ অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারব না। কোন কোন সময় শেখ আব্দুল করীম রোগের কঠোরতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলত এবং বলত যে, আমার কাছে সোয়ারী নিয়ে আস, আমি মাসীহের নিকট যাব। কেননা, অনেক দিন যাবৎ আমি তাকে দেখতে পাইনি। তিনি ধারণা করতেন যে, জনাব হতে দূরে কাদিয়ানের বাহিরে কোথাও তিনি অবস্থান করছেন। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদ লিখিত সীরতুল মাহদী ১ম খন্ড, ২৭১ পৃ:।) এভাবে প্রায় দু মাস পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত থেকে সে মারা যায়।
ইয়ার মুহাম্মদ ও আব্দুল্লাহ টিমাপুরী এবং কাদিয়ানীদের তৃতীয় জামাত:
ইয়ার মুহাম্মদ, আব্দুল্লাহ টিমাপুরী ও অন্যান্যরা ভিন্ন ধরনের লোকছিল। যখন তারা এ কৃত্রিম নবুয়্যত দেখতে পেল, যার সংগঠনে তারা অংশগ্রহণ করেছিল; তখন তারা ব্যাপারটি সহজ মনে করে প্রত্যেকেই নবুয়তের দাবিকরে অপর একটি স্বতন্ত্র কাদিয়ানী দল গঠন করে বসল। প্রকৃত পক্ষে এরাই সত্যিকার সেই দল যারা গোলাম আহমদের শিক্ষা দীক্ষাকে কার্যে পরিণত করেছে এবং ভন্ডনবী কাদিয়ানীর প্রস্তাব সমূহ বাস্তবায়িত করেছে।
প্রথমত: ইয়ার মুহাম্মদ নবুয়তের ঘোষণা করে দাবি করল যে, সে জনাব গোলাম আহমদের একজন অনুসারী নবী। এ নতুন ভন্ডনবী গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদের শিক্ষক ছিল। মাহমুদ আহমদ লিখেছে, ইয়ার মুহাম্মদ মাদ্রাসায় আমার শিক্ষক ছিলেন এবং জনাব মাসীহ কে অতি ভালোবাসতেন। শেষ পর্যন্ত তার ধারণা হল যে, সে একজন নবী এবং জনাব মাসীহের (গোলামের সমুদয় এলহামকে তার সহিত সম্পৃক্ত করতে শুরু করে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের প্রবন্ধ যা আল-ফজলে প্রচারিত, ১ম জানুয়ারি ১৯৩৫ খৃ:) এরপর নুর আহমদ কাদিয়ানী এসে ঘোষণা দিল- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আহমদ নূর রাসূলুল্লাহ। আমি আল্লাহর রাসূল। যে আমার আনুগত্য করবে সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে আমার অবাধ্য হবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্য হল। আমি বিশ্ববাসীর প্রতি করুণা স্বরূপ প্রেরিত হয়েছি। আমি সকল নবীর বহি:- প্রকাশ । ( নুর আহমদ কাদিয়ানী লিখিত লিকুল্লি উম্মাতিন আজল’ ১ও ২ পৃ:।) আশ্চর্যের বিষয়, যখনই কেহ নবুয়তের দাবি করত, কাদিয়ানী খলীফা তার সম্পর্কে বলত যে, সে পাগল ও রোগী। এ পার্থক্যের কারণ কি? এটা স্বীকৃত কথা যে, যতদিন তোমরা নবুয়তের দরজা খুলে রাখবে ততদিন পর্যন্ত তোমরা অপরকে বাধা দিতে পারবে না। এখন তোমরা তাদেরকে ঐ কথাই বলছ, যা অপর লোকেরা তোমাদের ভন্ডনবী মিথ্যাবাদীকে বলেছিল। সুতরাং কেন তোমরা ওখানে এটাকে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং এখানে তা প্রত্যাখ্যান করছ? এই তো গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ নতুন ভন্ডনবী নুর আহমদ কাদিয়ানী সম্পর্কে লিখছে: (কেহ কেহ নূর আহমদের কার্যকলাপকে আমাদের সহিত সম্পৃক্ত করে থাকেন।.... তবে প্রত্যেকের জানা উচিত যে, সৈয়দ নূর আহমদ নবুয়তের দাবি করছে। সে একজন অসুস্থ ও অপারগ ব্যক্তি। কাজেই তার সহিত আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আল-ফজল, ১১নভেম্বর ১৯৩৪ খৃ:।) আব্দুল্লাহ টিমাপুরী যিনি গোলাম আহমদের একজন বিশিষ্ট সাহাবী সে এই মর্মে ঘোষণা দিল যে, সে গোলাম আহমদের সুসংবাদ ও ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ অনুসারে একজন নবী সে বলেছে: আমিই হলাম ঐ ব্যক্তি যার সম্বন্ধে জনাব আকদাস প্রতিশ্রুত মাসীহ সুসংবাদ দিয়েছেন যে সে প্রেরিত হবে। অতএব গোলাম আহমদের ফয়েজ ও বরকতে আমি প্রেরিত হয়েছি। অচিরেই, আমার হাতে দুনিয়া বাসীর সম্মুখে জনাব গোলামের সত্যতা প্রকাশ পাবে। (আব্দুল্লাহ টিমাপুরীর তাফসরি সাবআম মিনাল মাসানী’ পৃ: আলিফ।) সে লিখেছে- আল্লাহ ত’আলা আকাশ থেকে আমার উপর একটা সহীফা অবতীর্ণ করেছেন এবং মাখলুকের নিকট তাঁর দাওয়াত পৌঁছে দিতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। বাইশ বৎসর কাল অতিবাহিত হয়েছে, আমি আমার কর্তব্য সম্পাদন করে আসছি।’ (ভন্ডনবী আব্দুল্লাহ টিমাপুরীর উম্মুল ইরফান ৯পৃঃ।)
অপর একজন কাদিয়ানী নবুয়তের সিংহাসনে আরোহণ করে বলল: ‘‘গোলাম আহমদের ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে আমি কদিয়ানীদের জন্য সেই নির্দিষ্ট ও প্রতিশ্রুত ব্যক্তি।’’ (ভন্ডনবী মুহাম্মদ সিদ্দিক কাদিয়ানীর খাদিমু খাতামিন নাবিয়ীন’ ১৮ পৃ:। সে লিখেছে: আমার নিষ্ঠা ও সত্য নিয়তের প্রতি তাকিয়ে দেখুন! আমি নিজে কাদিয়ানে গিয়ে খলীফা মাহমুদ আহমদের হাতে বায়আত করেছি এবং এর উপর অটল রয়েছি। তারপর আমার কাছে প্রকাশ করা হয়েছে যে, আমি কাদিয়ানীদের জন্য অপেক্ষিত ও প্রতিশ্রুত ব্যক্তি এবং আল্লাহ তাআলা আমার জন্য অনেক নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন প্রমাণাদিও অবতীর্ণ করেছেন এবং পূর্ণ ক্ষমতার কামালিয়তকে আমার সঙ্গী করে দিয়েছেন।’ (ভন্ডনবী মুহাম্মদ সিদ্দিক কাদিয়ানীর খাদিম খাতামিন নাবিয়ীন’ ২৫পৃঃ।)
অনুরূপ ভাবে, আরও কয়েক ব্যক্তি তাদের নবুয়তের ঘোষণা দিয়েছে। যেমন, গোলাম মুহাম্মদ কাদিয়ানী, চেরাগ উদ্দিন জমবী কাদিয়ানী ও মুহাম্মদ সাদেক কাদিয়ানী প্রমুখ। তারা কাদিয়ানী ধর্মে আর একটি জামাত গঠন করেছে। তাদের বিশ্বাস, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আল্লাহর নবী ও রাসূল। যে ব্যক্তি গোলাম আহমদের নবুওতে বিশ্বাস করবে না সে মুক্তি পাবে না। এমনিভাবে তাদের নবুয়্যত ও রেসালতে বিশ্বাস করবে না সেও মুক্তি পাবে না। তাদের ও ভন্ডনবী কাদিয়ানীদের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, সে কোন মাধ্যম ছাড়াই নবুয়্যত লাভ করেছে এবং তারা তার মাধ্যমে নবুয়্যত লাভ করেছে। সে তাদের উস্তাদ স্বরূপ এবং তারা হল তার ছাত্র। সত্য কথা হল এই যে, এরাই গোলাম আহমদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ তাদের কে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। (যাতে করে লোকেরা একথা বুঝতে না পারে যে, নবুয়্যত একটা খেলনায় পরিণত হয়ে গেছে।) যেমন, তাদের নেতার সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। ফলে তারা শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। যদিও তারা গোলাম আহমাদের ন্যায় তাদের আশে পাশে কতকগুলো বোকা ও নির্বোধ ব্যক্তিকে জড়ো করতে সামর্থ্য হয়েছিল।
এরাই হল কাদিয়ানীদের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গ। আর এটাই হল তাদের চরিত্র। আর এ গুলো হল কাদিয়ানীদের দল ও উপদল, যারা নিজে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করছে।
প্রথমত: গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে সে প্রতিশ্রুত মাসীহ, আল্লাহর নবী ও রাসূল এবং সকল নবী রাসূল হতে উত্তম হওয়ার দাবি করেছে। ইসলামের ভিত্তি ও সর্ব স্বীকৃত মূলনীতি সমূহকে সে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে এবং আল্লাহর নবী রাসূলগণ, ওলীগণ ও তার মনোনীত ব্যক্তিবর্গের অবমাননা করেছে। সে জালিম ইংরেজ উপনিবেশ দাবি প্রভুর ইঙ্গিতে এবং তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তায় সম্পূর্ণরূপে ফিতনার দ্বার সমূহ খুলে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত: তার চতুষ্পার্শ্বে এমন কতকগুলো লোক জড়ো হয়েছে অথবা সে জড়ো করেছে, যারা তার মত বিশ্বাসঘাতক, অতি-লোভী ও ডলার পাউন্ডের বিনিময়ে তাদের অন্তঃকরণকে বিক্রি করে দিয়েছে। এদের কাছে শরীয়তের নীতিমালা ও চারিত্রিক সীমারেখার কোন গুরুত্ব নেই । বরং তারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং নিজস্ব সুবিধা অর্জনের জন্য সবকিছু এমনকি দ্বীন ও ঈমানকে বিক্রি করতে প্রস্ত্তত। তারা কোন প্রকাশ্য ক্ষতি ব্যতিরেকে যা কিছু খরচ করার সামর্থ্য রাখে তার সবটুকু এ পথে ব্যয় করতে থাকে। এরূপ লোকজন দ্বারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ধর্ম তৈরি করেছে। আর যদি অন্যরা বলি, এ সকল লোক দ্বারাই কাদিয়ানী মতবাদ সংগঠিত হয়েছে, তা হলে আমাদের এ প্রকাশ ভঙ্গিটি অধিক উপযোগী ও বিশুদ্ধ হবে। কেননা, এ সমস্ত লোকেরাই গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুয়তের জন্য অর্থ জোগান দিত এবং গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তাদের প্রচারক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তারা তাকে যে কথা প্রচার করার পরামর্শ দিত সে তা-ই প্রচার করত এবং তারা যা বলতে চাইত সেটাই সে বলত। উপরোক্ত কথাগুলো আমি দলীল প্রমাণ ছাড়া বলিনি। বরং স্বয়ং ভন্ডনবী কাদিয়ানী থেকে উহার উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
গোলাম আহমদ একটি পুস্তক রচনার ব্যাপারে সাহায্য সহযোগিতা কামনা প্রসঙ্গে লিখেছে ‘আপনার মূল্যবান পত্র পেয়ে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। ইতিপূর্বে ইসলামের কিছু খেদমত করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু আপনার পত্রখানা আমাকে অনেক অনেক সাহস জুগিয়েছে। আপনার কাছে যদি কিছু প্রবন্ধ-বলী থাকে, তবে উহা আমার নিকট পাঠিয়ে দিন।’’ (উস্তাদ চেরাগ আলীর কাছে গোলামের পত্র যা ‘সিওরুল মুছান্নিফিন’ এ সন্নিবেশিত।) সে আরো লিখেছে: দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর এখন পর্যন্ত নবুয়্যত প্রমাণ করা সম্পর্কে আপনার প্রবন্ধটি আমার কাছে পৌঁছেনি। তাই, আপনাকে দ্বিতীয়বার কষ্ট দিচ্ছি যাতে সত্ত্বর আপনার এ প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দেন এবং কুরআনের হকীকত প্রমাণ করে আমার জন্য আর একটি প্রবন্ধ লিখবেন, যাতে উহা আমার পুস্তক বারাহীনে আহমদিয়া তে সন্নিবেশিত করতে পারি। (চেরাগ আলীর নিকট লিখিত গোলামের পত্র এবং ‘সিওরুল মুছান্নিফিনে’ ও তা সন্নিবেশিত।) কদিয়ানীদের অন্যতম নেতা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছে ‘জনাব (গোলাম) প্রতিশ্রুত মাসীহ ও নির্দিষ্ট মাহদী হওয়া সত্ত্বেও আমার নিকট শরীয়তের মাসআলা মাসায়েল জিজ্ঞাসা করতেন এবং এ ব্যাপারে আমার সহিত পরামর্শ করতেন। ( কাদিয়ানী নেতা মুহাম্মদ এহসান আমরুহীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে প্রচারিত এবং ২২ ডিসেম্বর ১৯১৬ খৃ: প্রকাশিত।) গোলাম পুত্র তার পুস্তকে একথা স্বীকার করে বলে: ‘জনাব তার আরবী কিতাব সমূহের পান্ডুলিপি গুলো তার প্রথম খলীফা নুরুদ্দীন ও উস্তাদ মুহাম্মদ আহ-সান আমরুহীর নিকট সংশোধনের জন্য পাঠাতেন। (একজন নবীর কি সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে থাকে?) প্রথম খলীফা যেভাবে উহা গ্রহণ করত ঐ ভাবে তা ফেরত দিয়ে দিত। (কেননা, গোলাম যা লিখত তার অধিকাংশের প্রকৃত লেখক সে ছিল। তাই, উহা পুনরায় দেখার প্রয়োজন মনে করত না।) কিন্তু, উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী উহার সংশোধন ও পরিবর্তনে তার সমুদয় প্রচেষ্টা ব্যয় করতেন। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদ কাদিয়ানীর সীরতে মাহদী ১ম খন্ড ৭৫ পৃ:।)
কাদিয়ানী পত্রিকায় এ কথা প্রচারিত হয় জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ আত-তাবলীগ’ নামক এক খানা কিতাব আরবী ভাষায় রচনা করেছেন যা তার ‘মেরাতু কামালাতে ইসলাম’ নামক পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। সেই পুস্তক লেখা কালে তিনি এর পান্ডুলিপি হাকিমুল উম্মত নুরুদ্দীনের নিকট পড়ার জন্য পাঠাতেন। তিনি সংশোধন করে দেওয়ার পর উহা উস্তাদ আব্দুল করীমের নিকট ফার্সী ভাষায় রূপান্তরিত করার জন্য পাঠাতেন। (আল-ফজল ১৫ ই জানুয়ারি, ১৯২৯ খৃ:।) মোটকথা কাদিয়ানী নবুয়্যত এমনিভাবে এই সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের যোগসাজশে তৈরি হয়েছে। আমরা ভন্ডনবী কাদিয়ানীর চরিত্রের আলোচনা করতে গেলে এ সকল নেতাদের জীবন আলোচনা করাও আমাদের দায়িত্বে এসে পড়ে। কেননা, শিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্য এতে শিক্ষা রয়েছে এবং এর দ্বারা ওদের প্রকৃত স্বরূপ জনসমক্ষে প্রকাশ পাবে। এছাড়া কাদিয়ানী ধর্মের আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না তাদের ভিতরকার দল উপদলের আলোচনা ব্যতিরেকে, এ প্রবন্ধটি রচনা করি।
মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর প্রতি চ্যালেঞ্জ করে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার নিজের জন্য ১৯০৭ সালের ১৫ই এপ্রিল এ বদ দোয়া করেছিল (নিশ্চয়ই যে মিথ্যাবাদী সে সত্যবাদীর জীবদ্দশায় প্লেগ বা কলেরা রোগে মারা যাবে।) এর ফলশ্রুতিতে উক্ত দোয়ার মাত্র এক বৎসর পর ১৯০৮ সালে মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর জীবদ্দশায়ই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে পায়খানা গৃহে প্রয়োজন সারতে সারতে সে মারা যায়। [১ গুলাম আহমদের মৃত্যুর পর আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী প্রায় চল্লিশ বৎসর জীবিত ছিলেন।] তাই তার মৃত্যুর পর কাদিয়ানী নেতা ও তার নবুয়তের প্রতিষ্ঠাতাগণ তার ত্যাজ্য সম্পত্তি বণ্টনে এবং একে অন্যের সহিত ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হল। এদের মধ্যে প্রধান ছিল নুরুদ্দীন, মুহম্মদ আলী, গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ, কামাল উদ্দিন, মুহাম্মদ আহসান আমরুহী, ইয়ার মুহাম্মদ, আব্দূল্লাহ টিমাপুরী ও মুহাম্মদ সাদেক। তখনকার সময়ে নুরুদ্দিন ও মুহাম্মদ আলী তাদের শিরোমণি ছিল। এদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি (অর্থাৎ নুরুদ্দীন) সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ছিল যে, গোলাম আহমদের নামে যে সকল পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে, সে-ই উহার প্রকৃত রচয়িতা। এই ব্যক্তিই ভন্ডনবী গোলাম আহমদের মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি থেকে নিয়ে নবুয়তের শেষ দাবির সময় পর্যন্ত তার অর্থ জোগান দিত। এটা অযৌক্তিক কথা নয়; কেননা, গোলাম আহমদ স্বয়ং একটা নির্বোধ ও বোকা লোক ছিল। পূর্বের দুটি প্রবন্ধ কদিয়ানীরা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট এবং ইতিহাসের আলোকে কাদিয়ানীদের নবী এর মধ্যে আমরা এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সে তো শরীয়ত সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণও করেনি। বিশেষকরে আরবী ভাষায় বিশেষ কোন জ্ঞান অর্জন করেনি। কিন্তু নুরুদ্দীন ছিল এর বিপরীত। প্রথমত: সে আরবী ভাষায় শিক্ষা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত: সে দীর্ঘ দিন যাবৎ হিজাজে অবস্থান করেছে। তৃতীয়ত: সে কল্পনা প্রবণ ব্যক্তি ছিল। নুরুদ্দীনের প্রতি গোলামের লিখিত পত্রাবলি আমাদের এ উক্তির সমর্থন করে। কেননা, গোলাম সর্বদাই তার সহিত আদব রক্ষা করে চলত এবং তাকে এমন সব উপাধি দ্বারা ভূষিত করে যা উস্তাদ বা শেখ ব্যতীত আর কারো জন্য প্রয়োগ করা হয় না। একদা সে নুরুদ্দীনকে লিখে: ‘‘আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু শেখ হাকীম নুরুদ্দীন! আল্লাহ তাকে নিরাপদে রাখুন! আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ও বারাকাতুহু ! আপনার উপকার হয়নি জেনে আশ্চর্য হলাম.....। খাদেম গোলাম আহমদ। (নুরুদ্দীনের নিকট লিখিত গোলামের পত্র যা গোলামের চিঠিপত্র সংকলন ‘‘মাকতুবাতে আহমাদিয়া’’ তে সন্নিবেশিত, ৫ম খন্ড, ১৪ পৃ: ২নং পত্র।) সে আরো লিখেছে: ‘শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত বন্ধু শেখ হাকীম নুরুদ্দীনের প্রতি ....... খাদেম, গোলাম আহমদ’’। (মাকতুবাতে আহমদিয়া ৫ম খন্ড ১৪ নম্বর) নুরুদ্দীনের সহিত এটাই ছিল তার আচরণ। এটা কি যুক্তি সংগত যে, একজন নবী তার শিষ্যদেরকে এরূপ উপাধি দ্বারা সম্বোধন করতে পারে? গোলাম আহমদের মৃত্যুর প্রায় বিশ বৎসর পর ১৯৯২ সালে তারই পুত্র ও দ্বিতীয় খলীফা কাদিয়ানে প্রদত্ত ভাষণে অসাবধানে আমাদের এ কথা স্বীকার করে বলেছে: ‘‘অনেক লোক বলত, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ (গোলাম) উর্দু পর্যন্ত জানেন না। অন্য লোকে আরবী পুস্তক সমূহ লিখে তার সাথে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে। কেহ কেহ এর চেয়ে অধিক বলত: শেখ নুরুদ্দীনই তার জন্য পুস্তক লিখে দেয়। বাস্তব অবস্থা হল জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ এ কথা দাবি করেন নি যে, তিনি কারো কাছ থেকে জাহেরী উলুম শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তিনি বলতেন-, আমার উস্তাদ আফিম ব্যবহার করতেন। [১ সম্ভবতঃ ভন্ডনবী কাদিয়ানী তার এ সকল উস্তাদের ন্যায় আফিমের অভ্যাস্ত ছিল। তার পুত্র মাহমুদ বর্ণনা করেছে, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ ওষধ তৈরী করতেন, যার বড় অংশ ছিল আফিম তিনি এ ওষধ সর্বদা ব্যবহার করতেন। এমনিভাবে নুরদদ্দীনকে উহা ব্যবহার করতে দিতেন।] অনেক সময় তিনি হক্কা পান করতেন এবং অনেক সময় অতিশয় নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে হক্কা মাটিতে পড়ে যেত। এরূপ উস্তাদ কি শিক্ষা দিত? (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজলে সন্নিবেশিত, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৯ খৃ:) ইতিপূর্বে গোলামের দ্বিতীয় পুত্রের বক্তব্য ও আল-ফজল পত্রিকা থেকে আমরা উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি যে, ভন্ডনবী কাদিয়ানী পান্ডুলিপিগুলো সংশোধনের জন্য নুরুদ্দীনের নিকট পাঠাত। [১ এটা অতি আশ্চর্যের বিষয় যে, কোন নবী কি তার অনুসারীদের কাছে এ কথার মুখাপেক্ষী যে, সে তার কথা বার্তাকে সংশোধন করে দেবে?] সুতরাং এ নুরুদ্দীনই গোলামের মৃত্যুকালে প্রকৃত পক্ষে প্রথম ব্যক্তি ছিল এবং কাদিয়ানীদের কাছে পদে তার পরবর্তী ব্যক্তি ছিল মুহাম্মদ আলী। সে মাস্টার ডিগ্রি এবং কাদিয়ানী সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে। এ জন্য গোলাম কাদিয়ানী তাকে একান্ত বিশেষ লোক হিসেবে ‘‘রিভিউ অব রিলিজিউন্সের সম্পাদক নিযুক্ত করে ছিল। অনুরূপভাবে তাকে কাদিয়ানী কয়েকটি কমিটির সভাপতিও নিযুক্ত করেছিল। সে ভন্ডনবী ও তার ইংরেজ প্রভুদের মধ্যে মাধ্যম হিসাবে কাজ করত। কাদিয়ানীদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের দিক দিয়ে এ দু ব্যক্তির সমকক্ষ আর কেহ ছিল না। অবশ্য, তৃতীয় এক ব্যক্তিও ছিল যে গোলামের জীবদ্দশায়ই অত্যন্ত ঘৃণিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। এ আলোচনা পরে আসবে। প্রথমে আমরা নুরুদ্দীনের ও মুহাম্মদ আলীর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করব। পরে কাদিয়ানীদের অন্যান্য বড় বড় লোকের জীবন আলোচনা করব; যাতে পাঠক গোলাম আহমদের সঙ্গী সাথী, খলিফাগণ, কাদিয়ানীদের সর্দার ও নেতাগণের প্রকৃত রূপ জানতে পারে এবং আরো জানতে পারে যে, কোন ধরনের লোকজন নিয়ে এ দলটি গঠিত হয়েছিল। কারণ, এরাই হল কাদিয়ানী ধর্মের ভিত্তি ও বীজ।
নুরুদ্দীন:
কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নুরুদ্দীন অতিশয় লোভী ও মান-মর্যাদার আকাঙ্ক্ষী ছিল। সূচনা লগ্ন থেকেই তার ব্যক্তিতব বিকাশের প্রবল ইচ্ছা ছিল। তাই, যখন ভারত বর্ষে খোদাদ্রোহী নাস্তিকদের আবির্ভাব ঘটল, তখন সে তাদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করল। এরা খারাপ ও ঘৃণ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও জড় বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিল। আর এ, মিসকীন ব্যক্তির তো সমস্ত পড়া-শুনা মক্তবের ভিতর অথবা প্রাচীন চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে ছিল। এ জন্য সে ওদের কাছে কোন সম্মান লাভ করতে পারে নি। ইত্যবসরে ঘটনাচক্রে গোলাম কাদিয়ানীর সাথে তার পরিচয় হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল যে, এ ব্যক্তিই তার ও তার আশা-আকাঙ্ক্ষার উপযুক্ত। সুতরাং সে তার সাথে মিশে গেল। স্বয়ং গোলাম পুত্র উল্লেখ করেছে- ‘‘জনাব শেখ নূরুদ্দীন নাস্তিকদের চিন্তা ধারায় প্রভাবান্নিত ছিল। কিন্তু জনাব গোলামের সাথে মিশে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে এ প্রভাব দূর হয়ে গেল।’’ (গোলাম কাদিয়ানীর সীরতে মাহদী’ ১ম খন্ড ১৪১ পৃ:) গোলামের সাথে তার মিশে যাওয়ার পর তাকে ইচ্ছা মাফিক পরিচালনা করতে লাগল এবং তার সমস্ত ভিত্তিহীন ও অমূলক প্রয়োজনে তাকে সবরকমের তথ্য সরবরাহ শুরু করে। যা আমরা এইমাত্র উল্লেখ করেছি। এ দ্বারা তার নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ চরিতার্থ করা উদ্দেশ্য ছিল। আর সে তা গোলামের মৃত্যুর পরই লাভ করে। তখন সে দাবি করল যে, এ জমিনে সে আল্লাহর রাসূল (অর্থাৎ গোলামের নায়েব) যদি তার এ দাবি উদ্দেশ্য না হত তা হল এ সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে তার শক্তির অপচয় করত না। অতএব, সে ঘোষণা দিল: ‘‘আমি মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, তিনিই আমাকে তাঁর খলীফা নির্ধারিত করেছেন। এমন কে আছে যে খেলাফতের এ চাদর আমা থেকে কেড়ে নিতে পারে? আল্লাহ তাঁর পছন্দ ও ইচ্ছায় আমাকে তোমাদের ইমাম ও খলীফা নিযুক্ত করতে চেয়েছেন। সুতরাং তোমরা যা ইচ্ছা তা বলতে থাক। কিন্তু তোমরা আমাকে যে সমস্ত অপবাদ দেবে ও নিন্দা করবে তা আমার নিকট পৌঁছোবে না, বরং পৌঁছোবে আল্লাহর নিকট। কেননা, তিনিই আমাকে খলীফা নিযুক্ত করেছেন।’’ (নুরুদ্দীনের ঘোষণা, যা কাদিয়ানী ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিওন্স এ সন্নিবেশিত, ১৪ খন্ড ৬ নম্বর, ২৩৪ পৃ:) তখন কাদিয়ানীরা তাদের নবীর খলীফা হিসেবে তার হাতে বাইয়াত করল। কারণ গোলাম আহমদের পরিবারের সাথে তার গভীর সম্পর্ক ছিল এবং তারা জানত যে তাদের ভন্ডনবী তাকে অতিশয় সম্মান করত। বিশেষ করে যখন সাম্রাজ্যবাদী সরকার খেলাফতের মুকুট তার মাথায় রাখতে সম্মতি প্রদান করল। এরপর তার খিলাফতকে সমর্থন করা ছাড়া বিমুখ হওয়ার ক্ষমতা কারো ছিল না। উল্লেখ্য যে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের নিজেদের প্রতি তার ভালোবাসা , নিষ্ঠা ও সেবা এবং মুসলমানদের প্রতি তার বিশ্বাস ঘাতকতার ব্যাপারে পরীক্ষা করেই তার খেলাফত সম্পর্কে সম্মতি দিয়েছিল। ফলে সে কাদিয়ানী সিংহাসনের উপর জমে বসল এবং (নাউযুবিল্লাহ) নিজেকে আবু বকরের রা. সমতুল্য বলে ঘোষণা দিল।
কোথায় এ গান্ধী খবীছের অবস্থান? আর কোথায় আবু বকর রা. এর মত পাক পবিত্র ব্যক্তি? সে তো ঐ ব্যক্তি যে তার নিজ সম্পর্কে বলে: ‘‘আমি জম্মু এলাকায় ছিলাম। তথাকার একজন হিন্দু মহিলা আমাকে ভালোবাসত। যখন আমার দুই পুত্র ফজলে ইলাহি ও হাফিজুর রহমান মারা গেল তখন সে আমার নিকট এসে বলল- আমি এমন এমন দুটি পুত্র তোমাকে দান করব। উত্তরে আমি তাকে বললাম- এমনি ভাবে কি বদলা পাওয়া সম্ভব? (আকবর কাদিয়ানীর মিরাকাতুল ইয়াকীন ফি হায়াতে নুরুদ্দীন’ ১৯৯ পৃ:) কোথায় ঐ ব্যক্তির অবস্থান যে তার দ্বীন ও ঈমান কে তুচ্ছ পার্থিব মান সম্মানের জন্য বিক্রি করেছে এবং কোথায় আবু বকর রা. এর অবস্থান যিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং ঈমান ও দ্বীন ইসলামের জন্য তার নেতৃত্ব ও আধিপত্যকে ত্যাগ করেছেন? এজন্য আল্লাহ তাআলা ঐ বিশ্বাস ঘাতক থেকে ভীষণ অপমানকর প্রতিশোধ নেন। সে দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকে, এমনকি সে তার জ্ঞান ও বাক শক্তি হারিয়ে ফেলে। এমনি ভাবে সে দীর্ঘ দিন আল্লাহর শাস্তিতে কাটানোর পর জঘন্যভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অতঃপর তার যুবক পুত্র কাদিয়ানীদের বিষ প্রয়োগে মারা গেল এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী অন্য এক ব্যক্তির সাথে পলায়ন করে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। স্বয়ং কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল একথা উল্লেখ করে বলেছে যে, নূরুদ্দীনের সেই উক্তি কোথায়? ‘‘জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ আল্লাহর নবী ও রারূল।’’ তার ঐ উক্তিটি যে, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ কুরআনের ঐ আয়াতের লক্ষ্য- ‘‘আমার পরে এক রাসূল আসবেন যার নাম হবে আহমদ। [১ সুরা আছছাফ-৬ (মিথ্যুক কাদিয়ানীরা দাবী করে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম এর ভাষায় কোরআন শরীফে রাসুল সা. এর যে সব গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে এগুলোর উদ্দেশ্য তিনি নন বরং উদ্দেশ্য গুলাম আহমদ কাদিয়ানী।)] শেষের দিকে মাসীহের রেসালতের স্বীকৃতি থেকে নীরব থাকা এবং এর উপর অটল থাকা থেকে বিমুখ হওয়া এবং শাস্তি স্বরূপ ঘোড়ার পিট থেকে পড়ে যাওয়া, অতঃপর মৃত্যুর পূর্বে কথা বন্ধ হওয়া, দরিদ্রতার মধ্যে মৃত্যুবরণ করা তার পুত্র আব্দুল হাই অল্পদিন পর পূর্ণ যৌবনে মৃত্যুবরণ করা, এবং জঘন্য ও নিকৃষ্ট তার স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ সূত্রে অবদ্ধ হওয়ার কারণ কি? এসব বিষয়ে উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য কি কোন উপদেশ নেই? (আল ফজল, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯২২ খৃষ্টাব্দ, রেসালাতে খাজিনাতুস সাদাকাত’ হতে উদ্ধৃত) শুধু এটাই নহে বরং তার কন্যা গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের স্ত্রী নিহত হল এবং মাহমুদ আহমদকে এ হত্যা কান্ডের ও তার ভাই আব্দুল হাই এর হত্যা কান্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হল। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল ৩রা আগস্ট ১৯৩৭ খৃ:) এমনিভাবে সে যে পার্থিব মান সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করার জন্য মুহাম্মদে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বিশ্বাস-ঘাতকতা করেছিল, তা থেকে সে বঞ্চিত হল। ফলে, সে তার পুত্র ও তার কন্যা যে ভন্ডনবীর পুত্রবধূ ছিল সকলেই মারা গেল। তার দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল মান্নান জীবিত রইল। যখন সে এ সমস্ত অত্যাচারের প্রতিবাদ করল তখন সে মুনাফেকির অভিযোগে দল-চ্যুত হল। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হল। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী। সে ১৩ মার্চ ১৯১৪ সালে মারা গেল। তার মৃত্যুর পর গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদকে খেলাফতের মুকুট পরান হল। এর আলোচনা করার পূর্বে আমি মুহাম্মদ আলীর জীবন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে চাই, যার স্থান নূরুদ্দীনের পরেই।
লাহোরী কাদিয়ানীদের আমীর মুহাম্মদ আলী:
মুহাম্মদ আলী আধুনিক উচ্চ শিক্ষায় মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে। অতঃপর উপযুক্ত কোন কাজ কর্ম পায়নি। ফলে, সে বেকার অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে। অবশেষে সাম্রাজ্যবাদীরা তাকে শিকার করে নেয় এবং তার দ্বীন ঈমান ক্রয় করে তাদের এজেন্ট বিশ্বাসঘাতক ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী কাদিয়ানীর নিকট সপোর্দ করে, যাতে সে তার সাথে মিলিত হয়ে একসঙ্গে কাজ করে এবং ইসলাম ধর্ম ধ্বংস করতে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসে সন্দেহ সৃষ্টি করতে ও তাদের মধ্যে ফিতনার বীজ বপন করতে তাকে সাহায্য করে। তার জন্য বড় অঙ্কের বেতন নির্ধারণ করা হয়। যার পরিমাণ ঐ সময়ে দুই শত টাকার অধিক ছিল তখনকার দিনে কোন ব্যক্তি বেতন রূপে পঞ্চাশ টাকা পেলে তাকে আমীর বলে গণ্য করা হত। উল্লেখ্য যে, গোলাম আহমদ যে মুহাম্মদ আলীর সর্দার ও নেতা ছিল সে তার নবুয়তের দাবির পূর্বে মাসিক মাত্র পনেরো টাকা বেতনরূপে গ্রহণ করত। এত বড় অঙ্কের টাকা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। সুতরাং সে ভন্ডনবী কাদিয়ানীর সহিত মিলিত হয়ে ইসলামের এমারতে ছিদ্র করার কাজে রত হয়ে পড়ল এবং মির্জার প্রয়োজনীয় ভিত্তিহীন ও বাতিল মতবাদ তাকে জোগান দিতে থাকে। এমনি ভাবে তাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের গুপ্তচররূপে তৈরি করা হল। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা অত্যন্ত ধূর্ত ও বিপদজনক লোক ছিল। কেননা, তারা গোলাম আহমদের মাথায় নবুয়তের মুকুট পরানোর পর একথা অনুভব করল যে, তার পাশে আধুনিক ও অন্যান্য শিক্ষায় সুদক্ষ কিছু লোক জড়ো করা প্রয়োজন, যারা সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে ফিতনা ছড়াতে পারে। আর, তাদেরই একজন ছিল মুহাম্মদ আলী। গোলাম আহমদ সাম্রাজ্যবাদীদের ইঙ্গিতে তার জন্য একটি মাসিক ম্যাগাজিন রিভিউ অব রিলিজিউন্স প্রকাশ করল। যার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থী ও আধুনিক সংস্কৃতির অধিকারীদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা প্রচার করা। আর এটা তার হাতেই সপোর্দ করা হল। কোন এক কাদিয়ানী লেখক উল্লেখ করেছে যে, রিভিউ অব রিলিজিওন্স একটি মাসিক ম্যাগাজিন। মুকাদ্দাস (গোলাম) তার চিন্তাধারা ও শিক্ষা দীক্ষা পৃথিবীতে ছড়াবার জন্য এটা প্রকাশ করেছেন। আর উস্তাদ মুহাম্মদ আলীকে এর প্রধান সম্পাদক নিয়োগ করেছেন।’ (মুহাম্মদ ইসমাঈল কাদিয়ানীর ‘আন-নাজবাতু আলা আজবিবাতিত তাহাররিয়াতিস সাবিকা লিমুহাম্মদ আলী’ ৬৪ পৃ:) গোলামের মৃত্যুর পর এ ম্যাগাজিনের শুধু তদারকের দায়িত্ব তার উপর রাখা হয় এবং কাদিয়ানিগণ কর্তৃক বিকৃত কুরআনের অর্থ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করার দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত করা হয়। যাতে সে কাদিয়ানীদের মেকী বিচ্যুতিপূর্ণ আকীদা বিশ্বাসের দ্বারা তা পরিপূর্ণ করতে পারে। প্রথম দিকে কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নূরুদ্দীনের উপর এ অনুবাদ দেখা শুনার দায়িত্ব ছিল।‘‘প্রতিশ্রুত মাসীহের প্রথম খলীফা জনাব নূরুদ্দীন কুরআনের ব্যাখ্যা উস্তাদ মুহাম্মদ আলী দিয়ে লিখাতেন। উস্তাদ মুহাম্মদ আলী এ কাজে নিয়োজিত হয়ে মাসিক দুই শত টাকার বেতন ভোগ করতেন।’’ (আল-ফজল, ২রা জুন ১৯৩১ খৃ: প্রকাশিত।) শের আলী কাদিয়ানী লিখেছে- উস্তাদ মুহাম্মদ আলী অনুবাদের কাজে নিয়োজিত হওয়ার পর তাকে শুধু ম্যাগাজিন দেখা শুনার ভার দেওয়া হল এবং আমাকে এর সম্পাদক নিযুক্ত করা হল। আমি প্রবন্ধাবলি লিখতে লাগলাম এবং ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এগুলো প্রকাশ করার পূর্বে উস্তাদ মুহাম্মদ আলীর নিকট পেশ করতাম। (শের আলী কাদিয়ানীর আত তাবছেরা আলাল আকায়েদেসসাবেকা, উস্তাদ মুহাম্মদ ২৪ পৃ:) যেহেতু সে গোলাম আহমদ ও তার নবুয়তের হাকীকত জানত, তাই সে গোলাম আহমদ ও তার পরিবারের কারো প্রতি ভ্রূক্ষেপ করত না। বরং সে অনেক সময় তার উপর অভিযোগ করত এবং তার জীবদ্দশায়ই তার অবমাননা করত। এমনকি, অনেকবার সে তাকে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণকারী রূপে অপবাদ দিয়েছে। (অর্থাৎ সে একাকী ভোগ করত, অন্য কাউকে এতে অংশীদার করত না।) কিন্তু গোলাম এর কোন প্রতি উত্তর দেয়নি এবং এর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কেমন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? সে তো এ সমস্ত লোকের কাছে ঋণী ছিল। এখানে আমরা গোলাম পুত্র ও তার খলীফা মাহমুদ আহমদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সে কাদিয়ানীদের প্রথম খলীফা নূরুদ্দীনের নিকট লিখছে ...‘‘উস্তাদ মুহাম্মদ আলী উস্তাদ কামালউদ্দিন সর্বদাই জনাব (গোলাম) এর উপর অভিযোগ করে থাকেন। এমনকি নওয়াব মুহাম্মদ আলী (গোলামের শ্বশুর) আমাকে বলেছেন যে, একবার কামালউদ্দিন ও মুহাম্মদ আলী তাকে বলেছেন যে, গোলাম আহমদের কাছ থেকে হিসাব নিকাশ গ্রহণের সময় এসে গেছে। তাই জনাব (গোলাম) তার মৃত্যুর একদিন পূর্বেও বলেছেন: উস্তাদ মুহাম্মদ আলী ও খাজা কামালউদ্দীন আমার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করেন এবং বলেন যে, আমি অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে থাকি। এটা তাদের জন্য সমীচীন নহে। এরপর গোলাম বলে: আজ আমার নিকট উস্তাদের কাছ থেকে একটি পত্র এসেছে; এতে তিনি বলেছেন যে, পারিবারিক খরচ তো অল্পই হয়ে থাকে। এ হাজার হাজার টাকার অবশিষ্ট সম্পদ কোথায় ব্যয় করা হয়? (হয়ত এর দ্বারা সে সাম্রাজ্যবাদীদের ভন্ডনবীর নিকট তাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি রূপে তার নিজের অংশই উদ্দেশ্য করেছে।) জনাব অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললেন: এ সমস্ত লোক বলে যে, আমরা অবৈধ মাল ভক্ষণ করি। এ সমস্ত সম্পদের সাথে তাদের কি সম্পর্ক? (তাদের সম্পর্ক কেন থাকবে না? তারা কি নবুয়তের অংশীদার নহে?) আমি যদি তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাই তবে এ সম্পদের কিছুই এমনকি একটি পয়সাও তাদের কাছে আসবে না। (এর দ্বারা কি ভক্ষণ করা বৈধ হয়ে যাবে? নূরুদ্দীনের নিকট গোলাম পুত্রের যা লাহোরী কাদিয়ানীদের আমির মুহাম্মাদ আলীর হাকীকতুল ইখতেলাফ কিতাবে সন্নিবেশিত, ৫০ পৃ:) ঠিক এ অর্থই কাদিয়ানী মুফতি সরওয়ার শাহ তার পুস্তক কাশফুল ইখতেলাফে উল্লেখ করেছে- উস্তাদ মুহাম্মদ আলী ও খাজা কামাল উদ্দীন সর্বদাই সম্পদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুত মাসীহের উপর অভিযোগ করতেন এবং সম্পর্কে খারাপ ধারণা রাখতেন।(সরওয়ার কাদিয়ানির কাশফুল ইখতেলাফ) এমনিভাবে তাদের বঞ্চিত রেখে একাকী সম্পদ জড়ো করা ও সঞ্চিত করার ব্যাপারে ভন্ডনবী কাদিয়ানীর সাথে যখন বিরোধ চলছিল, তখন গোলাম মারা গেল এবং কাদিয়ানী খেলাফতের মুকুট নুরুদ্দীনের মাথায় পরানো হল। ফলে, তারা ইংরেজদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং মুরিদগণের কাছ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ বণ্টন করতে লাগল । শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদীরা এক নতুন চিন্তা ভাবনা শুরু করল। তখন কাদিয়ানীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে তাদের কাজ-কর্ম এবং মুসলমানগণকে প্রতারণা করার ব্যাপারটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। কারণ, মুসলিম আলেমগণ জাগ্রত হয়ে পড়েছিলেন। তাদের শীর্ষে ছিলেন শেখ ফাজেল মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী, ইসলাম ধর্মের তর্ক বিশারদ শেখ ছনাউল্লাহ অমৃতসরী, শেখ জলীল মুহাম্মদ ইব্রাহীম শিয়ালকোটি এবং শেখুল আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জলন্দরী প্রমুখ আলেম-ফাজেলগণ। (তাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হোক , আর যারা জীবিত আছেন তাদেরকে আল্লাহ হেফাজতে রাখুন।) এদের প্রত্যেকেই কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিবাদে পৃথক পৃথক পুস্তক রচনা করলেন এবং তাদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে দিলেন। তাদের বাস্তব রূপ উদ্ঘাটন করলেন এবং মুসলমানগণকে এদের মিথ্যা নবুয়্যত ও মিথ্যাবাদী নবী থেকে সতর্ক করে দিলেন। ফলে সাম্রাজ্যবাদীরা এ ধর্মান্তরিত দলের পেছনে যে পরিশ্রম করেছিল তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে দেখে ভীত হয়ে পড়ল। তারা তাদের কনিষ্ঠ এজেন্ট মুহাম্মদ আলী যে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য কাদিয়ানীদের বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তাকে ইঙ্গিত করল, যাতে সে তার নেতৃত্বে একটি নতুন দল তৈরি করে এবং ঘোষণা দেয় যে, গোলাম আহমদের দাবি নবুয়তের দাবি ছিল না; বরং তার দাবি ছিল যে, সে এ মিল্লাত অর্থাৎ মিল্লাতে ইসলামিয়ার মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক। তা হলে মুসলমানদের মধ্যে যারা ইতিপূর্বে প্রতারিত হয়নি তারা এখন প্রতারিত হবে এবং এভাবে তারা গোলাম আহমদের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। এর ফলে মূল কাদিয়ানী ধর্মে তাদেরকে প্রবেশ করানো সহজ হয়ে যাবে। অথবা কমপক্ষে প্রতিরক্ষাকারী জীবন্ত ইসলাম এবং ইসলামের মুজাহিদ রাসূলের শিক্ষা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। এইভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও মুহাম্মদ আলীর লোভ লালসা অনুসারে এ দলটি সংগঠিত হল, তাদের চিন্তা ধারা ও ধর্ম বিশ্বাসের বিভিন্নতার কারণে নহে। যেমন তারা ধোঁকা ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে তা প্রকাশ করে থাকে। লাহোরে এ দলের কেন্দ্র স্থাপন করা হল। এমনি ভাবে মূল কাদিয়ানী ধর্মের কেন্দ্র কাদিয়ান থেকে গেল। (মুহাম্মদ আলীর তাহরিকে আহমদিয়া ৩০পৃঃ) পূর্ববর্তীরা নিরঙ্কুশ কাদিয়ানী নামে এবং এরা লাহোরী কাদিয়ানী নামে খ্যাতি লাভ করল। ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, লাহোরী কাদিয়ানীরা তাদের চিন্তা ধারা ও বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে বিরোধ প্রকাশ করেনি। কেননা, ভিতরে ভিতরে তাদের ধর্ম বিশ্বাস অবিকল কাদিয়ানী ধর্ম বিশ্বাসের মতই ছিল। স্পষ্ট বর্ণনা দেখুন! লাহোরী কাদিয়ানী অর্থাৎ মুহাম্মদ আলী দলের একটি পত্রিকা তাদের মূল ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছে। তাতে রয়েছে আমরা প্রতিশ্রুত মাসীহের প্রাথমিক সেবকগণ। আমাদের বিশ্বাস যে, জনাব আল্লাহর সত্য ও সঠিক রাসূল ছিলেন। এ যুগের জনগণের পথ প্রদর্শন ও হেদায়েতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। অনুরূপভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে, তার অনুসরণ ছাড়া কারো মুক্তি পাওয়া সম্ভব নহে। (লাহোরী কাদিয়ানীদের পত্রিকা পয়গামে সুলাহে ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯১৩ সালে প্রকাশিত।) এই মুহাম্মদ আলী নিজেই লিখেছে- আমাদের বিশ্বাস যে ,গোলাম আহমদ প্রতিশ্রুত মাসীহ ও নির্দিষ্ট মাহদী এবং তিনি আল্লাহর নবী ও রাসূল। তিনি তাকে এ মর্যাদায় পৌঁছিয়েছেন যা সে নিজের জন্য বর্ণনা করেছিল। (অর্থাৎ সকল রাসূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।) অনুরূপভাবে আমরা এ বিশ্বাসও করি যে, যে ব্যক্তি তাকে বিশ্বাস করবে না সে মুক্তি পাবে না। (রিভিউ অব রিলিজিওন্স ৩য় খন্ড ১১ নম্বর ৪১১ পৃ:।) সে আরো লিখেছে যদি মুসা আল্লাহর নবী হয়ে থাকেন এবং ঈসা আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকেন তবে গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল। কেননা, যে সকল নিদর্শনা বলী দ্বারা আমরা আল্লাহর নবীদের পরিচয় পাই, তার সবগুলো গোলাম আহমদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর উপর আমার মাতা-পিতা উৎসর্গ হোক এবং তার উপর সালাত ও সালাম। (রিভিউ অব রিলিজিউনাস ৯ম খন্ড ৭নম্বর ২৪৮ পৃ:।) তার সম্পর্কে এরূপ কথা অনেক। কিন্তু মুহাম্মদ আলী অন্যত্র দাবি করেছে: আমরা বিশ্বাস করি না যে, গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল, বরং আমাদের বিশ্বাস তিনি একজন মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক। (পয়গামে সুলাহ ১৯৩১ খৃ:।) তার এই দাবি বাস্তব বিরোধী ও তার পূর্ববর্তী বিবৃতি-বক্তব্যের পরিপন্থী। কেননা, গোলাম আহমদের দাবিসমূহ যাতে কোন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। সে স্পষ্টভাবে দাবি করেছে যে, আল্লাহর নবী ও রাসূল এবং সকল নবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমনকি সে (নাউজুবিল্লাহ) মুহাম্মদে আরবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেও উত্তম আমরা পূর্ববর্তী কয়েকটি প্রবন্ধে এর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এমনি ভাবে এখন আমরা মুহাম্মদ আলী ও তার দল সম্পর্কে উল্লেখ করছি যে, তারা মুসলমানদের প্রতারণা করা ও যাদেরকে ইতিপূর্বে প্রতারণা করা সম্ভব হয়নি তাদেরকে শিকার করার জন্য তারা তাদের এ আকীদা প্রকাশ করছে। কার্যত: সরলমনা মুসলমানদের একটি দল তাদের সাথে শামিল হয়ে গেল, যারা গোলাম কাদিয়ানীর দাবিদাওয়া ও এ দলের বাস্তব রূপ সম্পর্কে অবগত ছিল না। যখন তারা জানতে পারল, তখন তারা এ দল এবং মিথ্যাবাদী কাদিয়ানী থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করল।
মোটকথা, মুহাম্মদ আলী ও তার লাহোরী কাদিয়ানী জামাত ঐ আকীদা পোষণ করে যে আকীদার উপর কাদিয়ানী স্থির রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের অন্তরে লুক্কায়িত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাহ্যিকভাবে ঐ আকীদা ত্যাগ করে চলছে। এ উদ্দেশ্যটির সার বিষয় হল নিম্নোক্ত তিনটি:
প্রথমত: কাদিয়ানীদের প্রকৃত প্রভু সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিত ছিল যে, কাদিয়ানীদের এমন একটি দল গঠন করতে হবে যারা সাধারণ মুসলমানদের সাথে সদ্ব্যবহার করে তাদেরকে গোলাম আহমদের নিকটবর্তী করে দেবে। এটা জানা কথা, যে ব্যক্তি গোলামের নিকটবর্তী হবে সে ইসলাম হতে দূরে সরে পড়বে এবং কাদিয়ানীদের প্রকৃত মুরবিব সাম্রাজ্যবাদের নৈকট্য লাভ করবে। লাহোরী কাদিয়ানী পত্রিকা এ দিকে ইঙ্গিত করে বলছে- হায়, যদি কাদিয়ানীরা গোলাম আহমদকে নবীরূপে প্রকাশ না করত....! যদি তারা এমন করত তা হলে কাদিয়ানী ধর্ম পৃথিবীর সকল প্রান্তে প্রবেশ করত।’ (পয়গাম সুলাহ’ ১৭ই এপ্রিল, ১৯৩৪ খৃ:)
প্রকাশ থাকে যে, মুহাম্মদ আলী নিজেই আমাদের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে মরিসাস দ্বীপে একজন কাদিয়ানী মুবাল্লেগের নিকট লিখেছে ‘তোমাদের উচিত, তোমরা সেখানে এ সব কথা প্রচার করবে না যে, গোলাম আহমদ নবী ছিলেন, মুজাদ্দিদ নয় এবং যে তাকে বিশ্বাস করবে না সে কাফের। কেননা, এ দুটি বিশ্বাস ভারতবর্ষে কাদিয়ানী ধর্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। (লাহোরী কাদিয়ানীদের আমির মুহাম্মদ আলীর মরিসাস দ্বিপে জনৈক কাদিয়ানী মুবাল্লেগের নিকট লিখিত পত্র, যা আত-তাবলীগ পত্রিকায় সন্নিবেশিত ১ম খন্ড, ২১ নম্বর।)
এর অর্থ হল: এ সব কিছু শুধু কাদিয়ানী ধর্মের প্রচলন ও জনসাধারণকে গোলাম আহমদের নিকটবর্তী করে দেওয়ার জন্যই ছিল। এটা কি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতে ছিল? মূল বক্তব্য দেখুন! কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজল প্রচার করেছে. ইংরেজ সরকার লাহোরী কাদিয়ানীদেরকে তাদের খেদমতের বিনিময়ে এক হাজার একর জমি দান করেছে। এত বড় পুরস্কার সরকারের প্রতি তাদের বিরাট খেদমতের স্বীকৃতি স্বরূপ দান করা হয়েছে। (আল-ফজল যা প্রচার করেছে তার মূল ভাষ্য, ২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৩০ খৃ:) দ্বিতীয়ত: মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানে সাম্রাজ্যবাদের একজন উচ্চ মর্যাদার প্রতিনিধি ছিল। কারণ, সে গোলাম আহমদের নবুয়্যত প্রচারের জন্য তথ্য জোগান এবং তার দায় দায়িত্বের ভার গ্রহণ করে। এ জন্য সে এ নবুয়তের বাস্তব রূপ এবং এর সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদের সেবা করা এবং মুসলমানগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া। আমরা তা পূর্বে উল্লেখ করেছি। আর এই সেবা একটি নতুন দল গঠনের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সাধিত হতে পারে। এ জন্য সে সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশাবলী দ্রুত বাস্তবায়িত করতে থাকে।
তৃতীয়ত: সে গোলাম আহমদের পরিবারকে রাশি রাশি ধন-সম্পদে তাকে শরীক না করে সঞ্চিত করার জন্য ঘৃণা করত। বিশেষ করে ভন্ডনবীর মৃত্যুর পর। কেননা, তারা এ সমস্ত লোকের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত ছিল না। পক্ষান্তরে ভন্ডনবী নিজে সামান্য হলেও এদের অংশ দিত। কারণ, সে জানত যে এরাই তার নবুয়তের মূল ভিত্তি। আল-ফজল পত্রিকা এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে বলছে: উস্তাদ মুহাম্মদ আলী কয়েকটি কারণে কাদিয়ানী মতবাদ থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। একটি হল: যখন জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ মৃত্যুবরণ করলেন, তখন মুহাম্মদ আলীকে তার (গোলামের) ঘর হতে বের করে দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত: গোলাম কাদিয়ানীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মুহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করেন যে, সে জনগণের সম্পদ তার ইমারতে ব্যয় করেছে। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল , ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ খৃ: প্রকাশিত।) এই পত্রিকাই প্রচার করেছে যে, এ দলের (লাহোরী কাদিয়ানী) নেতারা জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের হাতে বায়আত করেছে এবং এদেরকে এ উম্মতের (কাদিয়ানী উম্মত) প্রধান প্রধান লোক বলে গণ্য করা হত। কিন্তু তারা তাদের আধ্যাত্মিক ত্রুটির কারণে সর্বদাই জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের সহিত বেআদবী করত।... আর, তার মৃত্যুর পর ধন-সম্পদ ও পদ মর্যাদার লোভে বশীভূত হয়ে কাদিয়ান কেন্দ্র থেকে তারা পৃথক হয়ে গেল এবং একটি নতুন জামাতের ভিত্তি স্থাপন করল।(আল ফজল ২১ সেপ্টেম্বর ১৯২৮ খৃ:) এ দুটি এবারত আমাদের বক্তব্যের স্পষ্ট সাক্ষ্য। বাকি, ভন্ডনবীর সহিত তাদের বেয়াদবী করা সত্ত্বেও দলের মধ্যে নেতা ও প্রধান হিসেবে বহাল থাকা কোন আশ্চর্যের বিষয় নহে। কেননা, তারা জানত যে, এ নবুয়তের দাবি একটা ব্যবসায়ী কোম্পানি এবং তারা সবাই এর অংশীদার।
মোটকথা, কাদিয়ানীরা দু দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এক দলের প্রধান ছিল নুরুদ্দীন। এদের আকীদা ছিল গোলাম আহমদ আল্লাহর নবী ও রাসূল এবং সে প্রতিশ্রুত মাসীহ ও মাহদী। সে সকল নবী রাসূলের মধ্যে উত্তম এবং যে ব্যক্তি তাতে বিশ্বাস করবে না, সে কাফের, জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে। নুরুদ্দীন ব্যতীত এ দলের অন্যান্য প্রধান ব্যক্তিবর্গ ছিল গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ ও কাদিয়ানীদের মুফতি মুহাম্মদ সাদেক প্রমুখ। এ দলই ছিল ভন্ডনবী কাদিয়ানীর প্রকৃত দল। কেননা, এরাই গোলাম আহমদের শিক্ষাকে খোলাখুলিভাবে প্রচার করত এবং কোন কিছু গোপন করত না।
দ্বিতীয় দল যাদের প্রধান ছিল মুহাম্মদ আলী। তারা প্রকাশ করত যে, গোলাম আহমদ নবী ও রাসূল নহে, বরং মুজাদ্দিদ ও সংস্কারক। তাকে যে অমান্য করবে সে ফাসেক বিপথগামী। এদের প্রধান প্রধান লোক ছিল খাজা কামালুদ্দীন, মুহা্ম্মদ আহসান আমরুহী প্রমুখ। কিন্তু গোলাম আহমদের শিক্ষা ও বাণী এদের অনুকুলে ছিল না। তা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। মুহাম্মদ আলীর চরিত্রকে পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করার জন্য আমরা আরো কিছু বিষয়ের উল্লেখ করব। যাতে এ ধর্মের মূল উপাদান যে তৈরি করেছে তার পক্ষ থেকে এ ধর্মের প্রকৃত রূপ প্রকাশ করা সম্ভব হয়। মুহাম্মদ আলী কাদিয়ানী ধর্ম থেকে পৃথক হয়ে কি করল? কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল থেকে আমরা তা শুনে নেই। হয়তো: পাঠকগণ জানেন যে, উস্তাদ মুহাম্মদ আলী যখন কাদিয়ান থেকে বের হয়ে যায়, তখন ইংরেজি ভাষায় কুরআনের অনুবাদ চুরি করে তার সাথে নিয়ে যায়। যে অনুবাদের জন্য জামাত হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেছিল। একটি বিরাট লাইব্রেরি ও চুরি করে নিয়ে গেল। অনুরূপভাবে একটা ছাপা মেশিনও নিয়ে গেল, যার মূল্য (তখনকার দিনে) সাড়ে তিন শত টাকা ছিল। (আল ফজল, ১লা জুলাই, ১৯১৫ খৃ:।) এটাও জানেন যে, উস্তাদ মুহাম্মদ আলী জামাতের পক্ষ থেকে কুরআনের ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করত। অর্থাৎ সে এ কাজের বিনিময়ে একটা বিরাট পারিশ্রমিক গ্রহণ করত। অতঃপর সে কাদিয়ান থেকে এ অজুহাতে এ বোটা বাদ (বর্তমানে পাকিস্তানের একটি গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান) চলে গেল যে, অবশিষ্ট অনুবাদ সে ওখা নে গিয়ে পূর্ণ করবে। এ কাজের জন্য সে হাজার টাকা অগ্রিম গ্রহণকরে। অনুরূপ ভাব সে কাদিয়ানীদের সাধারণ লাইব্রেরি থেকে হাজার হাজার টাকা মূল্যের পুস্তিকাদি নিয়ে যায়। এই সাথে একটা আধুনিক ছাপা মেশিনও সে নিয়ে গেল, যার মালিক ছিল কাদিয়ানী জামাত। জামাতের নিকট এ সমস্ত জিনিস ফেরত দেওয়ার বদলে সে লাহোরে ঘোষণা দিল- এ সমস্ত জিনিস তার নিজেরই এবং এর সাথে কাদিয়ানীদের কোন সম্পর্ক নেই। অতঃপর সে কুরআনের অনুবাদ [১ অত্যন্ত অনুতাপের বিষয় যে, অনেক মুসলমান ইংরেজী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকৃত তার গ্রন্থটি কিনছেন, তাদের ধারনা যে উহার লেখক একজন মুসলিম ব্যক্তি। এমনিভাবে, তারা ঐ সকল ষড়যন্ত্রের কথাও জানেন না যাকে সে উহার অনুবাদ ও ব্যখ্যার মধ্যে গ্রথিত করেছে। সুতরাং এ তথ্য জানার পর সকলেরই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।] থেকে কাদিয়ানীদের কিছু মাসয়ালা বের করে বিশ্বাসঘাতকতার শীর্ষে পৌঁছে যায়। সে আল্লাহর এ বাণীর প্রতি ভ্রূক্ষেপও করেনি: ‘‘তোমরা জেনে শুনে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং তোমাদের আমানতেও খিয়ানত করো না।’’ আল্লাহ আরো বলেছেন, তিনি বিশ্বাসঘাতকদের পছন্দ করেন না।’ (আল-ফজল, ২রা জুন, ১৯৩১ খৃ:)
মুহাম্মদ আলী জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের চিন্তাধারা চুরি করে কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় সন্নিবেশিত করেছে। কিন্তু উল্লেখ করেনি যে, সে তার নিকট থেকে তা গ্রহণ করেছে। (আল-ফজল’ ৩১ শে জুন ১৯৩১খৃঃ) একদা কাদিয়ানী পত্রিকা প্রকাশ করল- ‘কেবলমাত্র উস্তাদ মুহাম্মদ আলী ইংরেজদের পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিয়োজিত নহেন, বরং তার সম্মানিতা স্ত্রীও এই সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। (পয়গামে সুলাহ, যা আল-ফজল, থেকে উদ্ধৃত, ৩রা মার্চ, ১৯৩১ খৃ:)
এই হল কাদিয়ানীদের নেতা এবং লাহোরী কাদিয়ানী জামাতের আমিরের অবস্থা, আর, এই হল লাহোরী কাদিয়ানী জামাতের অবস্থা, ! উল্লেখ্য যে, লাহোরী কাদিয়ানী ধর্ম নুরুদ্দীনের মৃত্যুর পর গোলাম আহমদের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হল। লাহোরী জামাতের প্রধান হল মুহাম্মদ আলী, এর সচিব হল তার ভাই এবং এর কোশাধক্ষ্য হল তার ভাতিজা। সাধারণ ও বিশেষ পাঠাগার সম্পাদক হল তার ভগ্নে। পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও ঘোষণাপত্র বিভাগের প্রধান হল তার শ্বশুর। মেহমানদারী বিভাগের প্রধান হল তার আর এক আত্মীয়। (আল-ফজল যা, ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ খৃ: প্রকাশিত।)
কাদিয়ানীদের দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদ:
১৯১৪ সালে নুরুদ্দীনের মৃত্যুর পর গোলাম কাদিয়ানীর পুত্র জন সমক্ষে এসে নিজেকে খলীফা ঘোষণা দিল। সে শুধূ কাদিয়ানীদের খলীফা নহে, বরং সমগ্র বিশ্বের খলীফা। অনন্তর, সে ঘোষণা দিল: ‘আমি শুধু কাদিয়ানীদের খলীফা নই এবং শুধু ভারতেরও নই, বরং আমি প্রতিশ্রুত মাসীহের খলীফা। তাই, আফগানিস্তান, আরব বিশ্ব, ইরান, চীন, জাপান, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, সু-মাত্রা, জাভা, এমনকি ব্রিটিশেরও খলীফা। বিশ্বের সকল মহাদেশব্যাপী আমার আধিপত্য রয়েছে।’ (মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা আল-ফজল পত্রিকায় সন্নিবেশিত, ১লা নভেম্বর, ১৯৩১ খৃ:) সেই তার বিকৃত মস্তিষ্ক পিতার যথার্থ সত্যিকার স্থলাভিষিক্ত। কাজেই, সে তার পিতার ন্যায় পাগলামি আরম্ভ করে এবং ঘোষণা দেয়: কুরআনে আমার উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে বর্ণিত লোকমান এবং তদীয় পুত্রের কাহিনী লক্ষ্য করুন! লোকমান কে তা কি জান? এবং তার ছেলেই বা কে? লোকমান হল প্রতিশ্রুত মাসীহ (গোলাম) এবং তার ছেলে হলাম আমি।’ (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের ভাষণ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজলে সন্নিবেশিত, ১২ই মার্চ, ১৯২৩ খৃ:) সাম্রাজ্যবাদের দাসত্বে তার বাবার চরিত্র গ্রহণ করে সে ঘোষণা দিল- ইংরেজ সরকারের দুঃখ আমাদেরই দুঃখ। কাদিয়ানী বাহিনী যারা ফ্রান্স ভূমিতে ব্রিটিশের শত্রুগণের সাথে যুদ্ধরত আছে, তারা যেন এ মর্মটি অনুধাবন করে নেয়। (আল-ফজল’ ২৭শে অক্টোবর, ১৯১৪খৃঃ)
তুরস্ক ও অস্ট্রিয়ায় ইংরেজরা তাদের শত্রু মুসলমানগণকে পরাজিত করার খুশিতে খলীফা মাহমুদ তার অনুসারীদেরকে আনন্দ মাহফিল অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয় এবং যুদ্ধ প্রস্ত্ততিতে কাদিয়ানীদের অংশ গ্রহণের নিমিত্তে সরকারের কাছে পাঁচ হাজার টাকা প্রেরণ করে। এতদ্ব্যতীত ভারত বর্ষে বিশ্বাস ঘাতক সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীকে ধন্যবাদ দিয়ে অনেক অনেক তার বার্তা প্রেরণ করে। (আল-ফজল পত্রিকা দেখুন, ১৬ নভেম্বর, ১৯১৮ সালে প্রকাশিত) আমরা এর জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করব, যাতে পাঠক জানতে পারেন যে, কেমন ব্যক্তিটি কাদিয়ানীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
প্রথমত: সে কাদিয়ানীদের মধ্যে তার কয়েকজন বিরুদ্ধবাদীদের গুপ্ত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। এদের মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রী যে নূরুদ্দীনের কন্যা ছিল এবং তার শ্যালক। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল ফজল’ ১৪ই আগস্ট, ১৯৩৭খৃঃ।) কারণ, তারা তার পারিবারিকও দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত খেয়ানতে পরিপূর্ণ। সে যে সকল হারাম ও লজ্জাহীন অশ্লীল কাজে লিপ্ত ছিল তাও তারা জানত। এ সকল ঘটনার একটি হল এই, জনৈক কাদিয়ানী তাকে তার পুত্রবধূ ধর্ষণ করার অভিযোগ দিয়ে বলে- আমি আহমদ দ্বীন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছি যে, আমি একজন কাদিয়ানী এবং আমি বিশ্বাস করি যে, প্রতিশ্রুত মাসীহ আল্লাহর নবী ও রাসূল ছিলেন। আমি জনাব মাসীহের দ্বিতীয় খলীফা তদীয় পুত্র মাহমুদ আহমদের হাতেও বায়আত করেছি। আমার স্ত্রী ও পরিবার পরিজন দ্বিতীয় খলীফা মাহমুদ আহমদের বাড়িতে তার পরিবার বর্গ ও মাসীহে মাওউদের পরিবারের সেবা যত্নের উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে যায়। মাহমুদ আহমদ তাকে একাকিনী দেখতে পেয়ে কোন কৌশলে তাকে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং বলে কাউকে তুমি একথা বলিও না। যদি বল, তবে কেহই তোমাকে বিশ্বাস করবে ন, বরং তুমি নিজেই লোকজনের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হবে। অনন্তর, সে কেঁদে কেঁদে বাড়িতে এসে ঘটনাটি বলল। আমি খলীফার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। সে তা অস্বীকার করল। তাকে হলফ করতে বললাম। তাও সে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমাকে মৃত্যু অথবা কাদিয়ান থেকে বিতাড়িত করার হুমকিও দিল, যদি আমি মুখ খুলে কারো কাছে একথা বলি। আমি এ পত্রটি পত্রিকায় এ জন্য পাঠাচ্ছি, যাতে জনগণ এই খলীফার বাস্তব রূপ সম্পর্কে অবহিত হতে পারে যে তার অপরাধ সমূহ কাদিয়ানী সিলসিলাকে কলুষিত করেছে। যদি সে আমার পুত্রবধূর সাথে ব্যভিচার না করে থাকে তাহলে সে আমার সাথে মোবাহালা করে বলুক- মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ অবতীর্ণ হোক ।’ (আহমদ দ্বীন কাদিয়ানীর পত্র যা দৈনিক জমীনদার লাহোরী পত্রিকায় প্রচারিত।) এ পত্রটি প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে তারা আহমদ দ্বীনকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে বশ করে নিল। শেষ পর্যন্ত সে কাদিয়ানী পত্রিকা আর-ফজলে এ মর্মে ঘোষণা দিল যে, জমীনদার পত্রিকায় আমি যে পত্র প্রচার করেছিলাম তজ্জন্য আমি অনুতপ্ত। কারণ আমার পুত্রবধূ খলীফাতুল মাসীহের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। (এটা কি বুদ্ধিসম্মত কথা যে, কোন একজন বিবাহিত নারী নিজের জন্য এরূপ মিথ্যা অপবাদ রটনা করে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে?) এ জন্য আমরা তাকে ত্বালাক দিয়েছি। তার বিরুদ্ধে আমি মে শপথ আহবান করেছিলাম, তাও আমার পক্ষ থেকে একটি ভুল ছিল। কেননা আমি জানতাম না যে, মোবাহালা এ ধরনের বিষয়াদিতে বৈধ নহে। সুতরাং আমি ঘোষণা দিচ্ছি, হযরতের শপথ ব্যতীত এবং হযরতের সাথে মোবাহালা ব্যতীত আমার বিশ্বাস যে, আমার পুত্রবধূ হযরত (মাহমুদ আহমদ) কে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে।’ (দ্বীন আহমদ কাদিয়ানীর ঘোষণা যা আল-ফজল পত্রিকায় ৩রা জুন ১৯৩০ সালে প্রচারিত।) ঠিক একই অপবাদ তাকে আরো অনেক ব্যক্তি দিয়েছেন, যাদের সংখ্যা বিশের অধিক। তাদের মধ্যে রয়েছেন, আবদুর রহমান কাদিয়ানী, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল করীম, ডাক্তার আব্দুল আজীজ প্রমুখ ব্যক্তিগণ। এদের যারাই তার থেকে শপথ অথবা মোবাহালা দাবি করেছেন সে তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অপবাদ অস্বীকার করেছে। লাহোরী কাদিয়ানী পত্রিকা প্রচার করেছে ১৯২৫ সাল হতে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মাহমুদ আহমদের উপর ব্যভিচারের অপবাদ বিশের অধিক দাঁড়িয়েছে। এ সব অপবাদ ঐ সকল লোকের পক্ষ থেকে আরোপিত হয়েছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজ শহর ও জনপদ ত্যাগ করে হিযরত করেছে। তা সত্ত্বেও খলীফা মাহমুদ একটি মাত্র কথা বলতে সাহস পায়নি, ‘মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ।’ কেননা, সে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। (পায়গামে সুলাহ, ১৬ই নভেম্বর ১৯৪৯ খৃ:।) এদেরই একজন কাদিয়ানের মজলুমগণ নামে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করে উহাতে অপবাদ সমূহের উল্লেখ করার পর বলেছে: আব্দুর রহমান মিসরি কাদিয়ানী এ সকল অপবাদের অনুসন্ধান করার জন্য বিশিষ্ট কাদিয়ানীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার দ্বাবী জানাল, কিন্তু খলীফা তাতে সম্মতি প্রদান করেন নি, বরং তিনি কিছুদিন পর তাকে জামাত থেকে তাড়িয়ে দেন এবং তার যুক্তিসংগত শর্তাবলি গ্রহণ করার পরিবর্তে তাকে কাদিয়ানী ধর্ম হতে বহিষ্কারের ঘোষণা প্রদান করেন। (ফখরুদ্দীন মুলতানী কাদিয়ানীর লিখিত কাদিয়ানের মজলুমগণ।’) এই হল কাদিয়ানী ইমাম ও তাদের খলীফার স্বরূপ, যে সর্বদা এ ধরনের কুৎসিত অপবাদের দ্বারা অভিযুক্ত ছিল। বরং তার মুরিদগণের পক্ষ হতে। আমি ক্রিমিনাল আদালতের রেজিষ্টার হতে নিম্নোক্ত যে ভাষ্যটি উদ্ধৃত করছি তা এ লোকটির মানসিকতার সঠিক চিত্র তুলে ধরছে। মাহমুদ আহমদের কাছে একজন যুবতী সেবিকা ছিল। সে একবার কিছু ঔষধ ক্রয় করার জন্য এহসান আলী কাদিয়ানী তাকে প্রতারিত করে তার ফার্মেসির পেছনে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে তার সাথে ব্যভিচার করে। যখন ছালমা নাম্নি এ সেবিকা বাড়ি প্রত্যাবর্তন করে, তখন কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদের নিকট ঘটনাটির সংবাদ দেয়। খলীফা এহসান আলীকে ডেকে পাঠালেন এবং ছালমাকে বললেন- তাকে (অর্থাৎ এহসান আলীকে) দশটি জুতা মার। সালমা তাকে জুতা মারল, এরপর তাকে ছেড়ে দিলে সে চলে গেল।’ (অমৃতসর জেলা হাকিমের আদলতে ছালমার সাক্ষ্য, ১০ই জুলাই ১৯৩৫ খৃ: যা আল মাযহাবুল কাদিয়ানী অভিধান থেকে উদ্ধৃত।) উক্ত ভাষ্যটি একথা ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না যে, লোকটি এ জঘন্য অপরাধ কে মামুলী বিষয় মনে করত। এরপর ঐ যুবতীকে ব্যভিচারী এহসান আলীর গায়ে হালকাভাবে জুতা দিয়ে প্রহার করার নির্দেশ দেওয়া কি একথা বুঝায় না যে, সে এ সকল অপবাদ দ্বারা অভিযুক্ত হল, তখন সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হতে পারেনি।
আর একবার অমৃতসরের ‘মোবাহালা’ নামক পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে এ বিষয়ের উপর মোবাহালা করতে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে, সে ব্যভিচারী নহে। কিন্তু সে এই বলে তাদের প্রতিবাদ করল- এ সমস্ত ব্যাপারে মেবাহালা করা বৈধ নহে। অতপর. উমর উদ্দিন সমলবী কাদিয়ানী বর্ণনা করছে যে, অমৃতসরের মেবাহালা পত্রিকা কর্তৃক কাদিয়ানী খলীফা মাহমুদ আহমদ কে এ সকল চ্যালেঞ্জ প্রদান এবং ওগুলো তার প্রত্যাখ্যান করার পর আমি মাহমুদ আহমদের কাছে গেলাম। তখন সে গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল মানসূরিতে অবস্থান করছিল। (মানসুরী ভারতের অন্যতম গ্রীষ্ম কালীন আবাসস্থল।) আমি তাকে বললাম- মুসলমানগণ একে অপরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়ার অবস্থায় মোবাহালা বৈধ হবে না কেন? অথচ প্রতিশ্রুত মাসীহ স্পষ্টভাবে বলে গেছেন যে, এ সমস্ত অবস্থায় মেবাহালা বৈধ। খলীফা মাহমুদ আহমদ আমাকে উত্তর দিল, আমি ইতিপূর্বে এ সমস্ত ব্যাপারে মোবাহালা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুত মাসীহের ফতওয়া সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহের ফতওয়া সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর খলীফার কর্তব্য ছিল যে, সে টাল-বাহানা করে মেবাহালা থেকে পিছু হটবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করার জন্য মেবাহালার দিকে অগ্রসর হয়নি। (উমর উদ্দিন সমলাবী কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা পয়গামে সুলাহ এ প্রচারিত এবং ১৯শে জুলাই ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত।) স্বয়ং এই কাদিয়ানী খলীফা যখন ইউরোপ ভ্রমণে গেল তখন সেখানে এমন কতকগুলো কাজে লিপ্ত হল যার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে মানুষ ঘৃণা বোধ করে। এ ভ্রমণ সম্পর্কে অনেক কিছু প্রচারিত হয়েছে। সে প্যারিসে আন্তর্জাতিক ক্লাবে উপস্থিত হয়ে নগ্ন নর্তকীদের নিয়ে আনন্দ উপভোগ করল। এই ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করলে সে উত্তর দেয়: আমি পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপর্যয় সমূহ শুধু পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রবেশ করেছিলাম। এতদ্ব্যতীত সে কাদিয়ান এবং ভারতের বিখ্যাত বিখ্যাত গ্রীষ্মকালীন আবাসভূমি ও নগরে বড় বড় প্রসাদ নির্মাণ করেছে। ভারত বিভক্তির পর সে তার খেলাফতের মুকুট ও সিংহাসন কাদিয়ানে রেখে পাকিস্তানে পলায়ন করে। অতপর: কাদিয়ানীদের জন্য পাকিস্তানে নতুন একটি কেন্দ্রের গোড়াপত্তন করে এর নাম দেয় রাবওয়া। কাদিয়ানীদেরকে ওখানে হিযরত করার নির্দেশ দিল। এখানেও সে তার পুরাতন অভ্যাস সমূহ ত্যাগ করতে পারল না। বরং পুনরায় সে তার কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে এবং আনন্দ উল্লাসে মগ্ন হল। ফলে, তার সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচারিত হতে লাগল এবং তার অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গও তাকে চিনে ফেলল। একজন বিশিষ্ট কাদিয়ানী আল ফজল পত্রিকার সম্পাদক ছিল, সে সবকিছু এমন কি কাদিয়ানী ধর্ম ত্যাগ করে রাবওয়া থেকে পলায়ন করার পর তার পুস্তক আমিরুল মাযহাবী লির রাবওয়া তে লিখে তার কলঙ্ক রটিয়ে দিয়েছে।....
পরিশেষে তার উপর পরাক্রমশালী মহান আল্লাহর শান্তি আসল এবং সে কতিপয় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হল; যথা অর্স্ব, বাঁত মাথা ঘুরান, হিষ্ট্রিয়া (এক প্রকার পাগলামী)যক্ষ্মা ও পক্ষাঘাত। সে কয়েক বৎসর যাবৎ বিছানায় পড়ে রইল, না কথা বলতে পারত, না নড়াচড়া করতে পারত। এমতাবস্থায় সে দশ বৎসর যাবৎ উপর্যুপরি এ সকল রোগে আক্রান্ত থেকে ১৯৬৫ সালে মারা যায়। মহান আল্লাহ সত্য বলেছেন: ‘তাদেরকে আমি বিরাট শাস্তির পূর্বে নিকটবর্তী শাস্তির স্বাদ ভোগ করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।’ [১ সুরা সিজদাহ ২০] তার মৃত্যুর পর তার ছেলে খলীফা নিযুক্ত হল।....
খাজা কামালুদ্দীন:
মুহাম্মদ আলীর অন্যতম প্রধান সাহায্যকারী ছিল খাজা কামালুদ্দীন। সে গোলামের মৃত্যুর পর ঘোষণা দিল, গোলাম আহমদ যা করত সে তাই করবে। কাজেই সেও গোলামের ন্যায় সংশোধনকারী ও মুজাদ্দেদ। (আল ফজল ১০ অক্টোবর, ১৯১৫ খৃ:।) তারপর সে কাদিয়ানীদের কাছ থেকে ইউরোপে কাদিয়ানী ধর্ম প্রচারের নামে একটা বিরাট পরিমাণের টাকা গ্রহণ করল এবং ইংল্যান্ড চলে গেল এবং অকিং এ বসবাস করতে লাগল। সেখানে সে একটি বিরাট বাড়ী ক্রয় করে এবং কোন প্রকার কাজ কর্ম ব্যতীত আমীর উমারাদের ন্যায় জীবন যাপন শুরু করে। [১ আমার কাছে উস্তাদ আব্দুল হক মাহরুছ বর্ণনা করেছেন যে, একদা মিশরে মুদ্রিত আর-রেসালাতে প্রচার করা হল যে, খাজা কামালুদ্দীন ইসলামের একজন বিখ্যাত আহবায়ক। আর তার হাতে বড় বড় ইংরেজ লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে লর্ড হেডলী প্রমুখ ব্যক্তি রয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা আমরা পুর্বে উল্লেখ করেছি যে, সে ইসলামের আহবায়ক ছিল না; বরং কুফুর ও ইরতেদাদের আহবায়ক ছিল। এদের সাথে লর্ড হেডলীর ইসলাম গ্রহণের কোন সম্পর্ক ছিল না। যেমন তিনি নিজেই ইহার ঘোষণা দিয়েছেন।...] যখনই সে কাউকে ইউরোপে ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে শুনত, সাথে সাথে সে এটাকে নিজের কৃতিত্ব বলে দাবি করত। যেমন, সে লর্ড হেডলী, মুহাম্মদ পিকতল, স্যার আরজিন্যাল্ড হিমেলটন, ডাঃ স্যান্ড রেক এবং স্যার ষ্টুয়ার্ড রেঙ্কিন এর বেলায় করেছিল। তবে এদের সকলেই যখন এ অপবাদের কথা জানতে পেরেছেন, সাথে সাথে এর প্রতিবাদ করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে, গোলাম আহমদের ধর্ম এবং তার সঙ্গী সাথীদের ধর্মের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। (মাহমুদ আহমদের মেরআতুস সিদক’ ১৫৮ পৃ: এবং তার হাককিতুল ইসলাম ম্যাগাজিন, জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল ও মদিনা পত্রিকা ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সাল।)
ধর্ম প্রচারের নামে যে বিপুল সম্পদ সে গ্রহণ করেছিল তা সে হজম করে নিল এবং তার নিজের প্রতি আহবান করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। স্বয়ং কাদিয়ানী ম্যাগাজিন প্রচার করছে- ‘খাজা কামালুদ্দীন লক্ষ লক্ষ টাকা কোন কাজ না করেই এবং কোন হিসাব না দিয়েই সবটুকু ভক্ষণ করে ফেলেছে। যখন তার কাছে হিসাব চাওয়া হল, তখন উত্তরে বলল-‘জমিয়তে ইসলামিয়া লাহোরের নিকট এর হিসাব আছে। জমিয়ত তার নির্দিষ্ট সময়ে ঘোষণা দিল যে, তাদের নিকট কোন হিসাব নেই। কেননা, খাজা কামালুদ্দীন আহমদের নিকট কোন হিসাব পাঠান নি। (আল ফজল ১৭ আগস্ট, ১৯২৮ খৃ:।) এ বিরাট অঙ্কের টাকা সে কোথায় কীভাবে ব্যায় করল? একজন ভারতীয় পর্যটক যিনি ওয়াকিং গিয়েছিলেন, তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন- মি: কামালুদ্দীন তার জনৈক বন্ধুর সহিত হোটেলে খাবার খাচ্ছিল। তারা চলে যাওয়ার পর আমি হোটেলের বয়কে জিজ্ঞাসা করলাম- এ দুই ভদ্রলোক কি খেলেন? সে অত্যন্ত সরলভাবে উত্তর দিল- উন্নত মানের শুকরের মাংস।’ (আল-ফজল’ ২১ আগস্ট, ১৯২৪ খৃ:।) ইনিই হলেন ভন্ডনবী কাদিয়ানীর মহান সাহাবী ও লাহোরী কাদিয়ানী জামাতের নেতা যিনি বিরাট পরিমাণ সম্পদ পিছনে রেখে মারা যান।
মুহাম্মদ আহসান আমরুহীঃ-
মুহাম্মদ আহসান আমরুহী যার সম্পর্কে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, গোলাম আহমদ তার লিখিত পান্ডুলিপি গুলো সংশোধনের জন্য তার কাছে পাঠিয়ে দিত এবং তার সম্পর্কে লিখেছে যে, জনাব উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী একজন মহান মর্যাদাবান, বিশ্বাসী, মুত্তাকী এবং আল্লাহর পথে নিজের প্রাণ ও অন্তঃকরণ উৎসর্গকারী।’ (গোলামের ভাষণ যা তাবলীগে রেসালাতে সন্নিবেশিত, ২য় খন্ড, ১০৩ পৃ:।) গোলাম পুত্র ও তার খলীফা এ ব্যক্তি সম্পর্কে লিখেছে, জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ ও তার খলীফা শেখ সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান আমরুহীকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। আমার পিতা তার ইলম ও ফজলের কারণে তার সামনে আদব রক্ষা করে চলতেন। (মাহমুদ আহমদের মানছাবুল খেলাফত’ ৫৩ পৃ:) শুধু তাই নহে, কাদিয়ানী ভন্ডনবী বিভিন্ন মাসায়েলের ব্যাপারে তারই শরণাপন্ন হতেন। কাদিয়ানী মুফতি মুহাম্মদ সাদিকের বর্ণনার প্রতি লক্ষ করুন- ‘শেখ আব্দুল করীম ইমামতি করছিলেন এবং জনাব গোলাম তার পেছনে নামাজ আদায় করছিলেন। যখন শেখ আব্দুল করীম প্রথম তাশাহুদ হতে দাঁড়ালেন তখন জনাব গোলাম তা বুঝতে না পেরে তাশাহুদেই রয়ে গেলেন। এমনকি শেখ আব্দুল করীম রুকুর জন্য তাকবীর বললেন। (হায়রে ভন্ডনবী মিথ্যাবাদীর উদাসীনতা?) পরে তিনি ক্বিয়াম ছাড়াই রুকুতে গিয়ে মিলিত হলেন। যখন নামাজ সেরে ফেললেন তখন উস্তাদ নুরুদ্দীন ও উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহীকে ডেকে তাদের কাছে মাসআলার অবস্থা পেশ করে তার শরয়ী হুকুম সম্পর্কে ফতওয়া চাইলেন। (কোন নবী শরয়ী মাসায়েল অন্যের নিকট জিজ্ঞাসা করার মুখাপেক্ষী, না তিনিই লোকজনের নিকট মাসায়েল বর্ণনা করবেন? হে আল্লাহর বান্দাগণ একটু ভেবে দেখুন) এ রাকাতকে কি গণনা করবে, না গণনা করবে না? তখন উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী এ ব্যাপারে কয়েকটি সমাধান বর্ণনা করলেন।’ (মুহাম্মদ সাদেকের ভাষণ যা আল-ফজলে সন্নিবেশিত,১৭ই জানুয়ারি ১৯২৫ খৃ:।) এই মহান উস্তাদ, মুত্তাকী, বিশ্বাসী ও কাদিয়ানীদের বিরাট নেতা পরিশেষে কি হলেন? তার সম্পর্কে আল-ফজল পত্রিকা লিখেছে- পয়গামে সুলাহ পত্রিকা এই দুর্ভাগা, কঠোর প্রাণ ও জালুতের একটি প্রবন্ধ প্রচার করেছে, যে ব্যক্তি শোচনীয় বয়সে পৌঁছেছিলেন এবং তার অনুভূতি শক্তি ও হারিয়ে ফেলেছিলেন অর্থাৎ উস্তাদ মুহাম্মদ আহসান আমরুহী, তিনি এই প্রবন্ধে বলেন: আমাদের নেতা ও উস্তাদ, দ্বিতীয় খলীফা উমরের সমতুল্য মাহমুদ আহমদ বলেছেন: তিনি ছিলেন একজন সামেরী ও জালুত ব্যক্তি’’। (কাদিয়ানী পত্রিকা আল-ফজল ৯ই নভেম্বর ১৯১৮ খৃ:।) এই হল ভন্ডনবী কাদিয়ানীর বিশিষ্ট সাহাবী তথা তার উস্তাদ। তার সম্পর্কে আল-ফজল এ কথা বলছে এবং গোলাম পুত্র ও তখনকার খলীফা মাহমুদ আহমদের তত্ত্বাবধানে তা প্রচার করছে। সেও একই কথা গোলাম পুত্র কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদ সম্পর্কেও বলেছে । আমরা বলি যে, তারা উভয়ই ঠিক বলেছে।
মুহাম্মদ সাদেক- কাদিয়ানীদের মুফতি:
মুহাম্মদ সাদেক সেও আল্লাহর কঠিন শাস্তিতে পতিত হয়েছে। আল-ফজল পত্রিকা প্রচার করেছে যে, সম্মানিত জনাব মুফতি মুহাম্মদ সাদেক জ্বর, কঠিন কাশি ও মূত্র বদ্ধতায় আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করছেন। তার সুস্থতার জন্য দোয়া করা বন্ধু বান্ধবদের কর্তব্য। (আল-ফজল আগস্ট ১৯৪০ খৃ:।)
আশ্চর্যের বিষয়, এ সমস্ত রোগ তার প্রাণনাশ করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমতাবস্থায় সে অল্প বয়স্কা এক যুবতীকে বিবাহ করেছে। লক্ষণীয় যে, এ সময় তার বয়স ছিল সত্তুরের ঊর্ধ্বে। লাহোরী কাদিয়ানী পত্রিকা প্রচার করেছে ‘মুফতি মুহাম্মদ সাদেকের বিবাহ সংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছেছে। অথচ তার বয়স সত্তুর বছর অতিক্রম করেছে। তিনি অল্প বয়স্কা একজন যুবতী বিবাহ করেছেন। এটা জানা কথা যে, উক্ত মুফতি করাচীতে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছেন। কিন্তু বিবাহের অস্থিরতা তাকে রোগমুক্ত হয়ে কাদিয়ানে যাওয়ার অবকাশ দেয়নি। এজন্য উকিলের মাধ্যমে তিনি বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। (অর্থাৎ স্ত্রী কাদিয়ানে এবং তিনি করাচীতে।) এমনিভাবে কাদিয়ানী মুবাল্লেগ শেখ আব্দুর রহীমের বিবাহের সংবাদও পৌঁছেছে। তার বয়সও সত্তুর বছর অতিক্রম করেছিল। তার কাহিনি হল সে একটি যুবতী মেয়েকে পড়াত এবং আকস্মিকভাবে সে ঘোষণা দিল যে সে মেয়েটিকে বিবাহ করে ফেলেছে। (পয়গামে সুলাহ, ২৮ অক্টোবর, ১৯৪০ খৃ:।)
অতঃপর তার রোগাক্রান্ত অবস্থায় ৯ জানুয়ারি ১৯৪৬ সালে আল-ফজল পত্রিকায় ঘোষণা দেওয়া হল জনাব মুফতি খুবই অসুস্থ। তার মূত্রনালি ফুলে গেছে এবং উহা থেকে রক্ত ঝরছে। তিনি অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছেন। পূর্ণ-রাত অনিদ্রায় কেটে যায়, তিনি বিরতি হীন ভাবে এ রোগ যন্ত্রণায় অস্থির থাকেন।’ (আল-ফজল ৯ই জানুয়ারি ১৯৪৬ খৃ:।) অবশেষে সে এ অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে। শাস্তি এরূপই হয়, আর পরকালের শাস্তিতো আরো ভয়াবহ! যদি তারা উপলব্ধি করত। [১ সুরা কলম ৩৩]
আব্দুল করীম- গোলাম কাদিয়ানীর নামাজের ইমাম:
আমরা কাদিয়ানীদের এ সমস্ত নেতাদের সারিতে আরো একজন কাদিয়ানী নেতার উল্লেখ করা সমীচীন মনে করি, যে গোলাম আহমদের জীবদ্দশায়ই মারা যায়। তার নাম হল আব্দুল করীম। সে গোলাম আহমদের ঘনিষ্ঠ সাথী ও খতিব ছিল। তার সম্পর্কে গোলাম বলেছে, কাদিয়ানীদের মধ্যে এমন কোন তৃতীয় ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেনি যে শেখ নুরুদ্দীন ও শেখ আব্দুল করীমের সমকক্ষ হতে পারে।’ (গোলামের বাণী যা মাহমুদ আহমদের ডায়রীতে সন্নিবেশিত এবং আল-ফজলে প্রচারিত, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ খৃ:।) আমার মওলা আব্দূল করীম শিয়ালকোটি আল্লাহ তাকে নিরাপদে রাখুন! তিনি আমার লিখিত পুস্তক আত-তাবলীগের অনুবাদে সাহায্য করেছেন। এবং তিনি আমার একজন নিষ্ঠাবান বন্ধু’। সে গোলাম আহমদের সাথে মিলিত হবার পূর্বে একজন নাস্তিক ও বেদ্বীন ছিল। (বশীর আহমদের সীরাতুল মাহদী ১ম খন্ড, ১৪১ পৃ:।) সেই প্রথম ব্যক্তি যে গোলাম আহমদকে আল্লাহর রাসূল ও আল্লাহর নবী বলে সম্বোধন করেছিল। (আল-ফজল, ১লা জুলাই, ১৯৩৩ খৃ:।) এমনকি কেহ কেহ বলে থাকেন যে, সে-ই গোলাম আহমদকে নবুয়তের দাবিকরতে সাহস জুগিয়েছিল। কেননা, সর্বদাই সে জুমার খুতবায় তাকে হে নবী! হে রাসূল! বলে সম্বোধন করত। এর ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে এ পৃথিবীতেই এমন শাস্তি দিয়েছেন, যা শ্রবণ করলে মানুষ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে। গোলাম পুত্র বশীর আহমদ তার রোগ সম্পর্কে লিখছে ‘শেখ আব্দুল করীম কারবাঙ্কাল রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং তার শরীরে এমন কোন জায়গা অবশিষ্ট ছিল না যেখানে অপারেশন করা হয়নি। সে তার অসুখের সময় এমন চিৎকার করত যা শ্রবণ করাও মানুষ সহ্য করতে পারত না। এ জন্য জনাব প্রতিশ্রুত মাসীহ তার বাসস্থান পরিবর্তন করে দিলেন। কারণ, যেখানে প্রতিশ্রুত মাসীহ বসবাস করতেন ঐ একই বাড়িতে শেখ আব্দুল করীমও বসবাস করত। শেখ আব্দুল করিম চিৎকার করে কান্নাকাটি করত, যাতে জনাব মাসীহ তার সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু জনাব মাসীহ তার শুশ্রূষার জন্য কখনও যান নি। তিনি বলতেন- আমি তো তার কাছে যেতে চাই, কিন্তু আমি তাকে এ অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারব না। কোন কোন সময় শেখ আব্দুল করীম রোগের কঠোরতার কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলত এবং বলত যে, আমার কাছে সোয়ারী নিয়ে আস, আমি মাসীহের নিকট যাব। কেননা, অনেক দিন যাবৎ আমি তাকে দেখতে পাইনি। তিনি ধারণা করতেন যে, জনাব হতে দূরে কাদিয়ানের বাহিরে কোথাও তিনি অবস্থান করছেন। (গোলাম পুত্র বশীর আহমদ লিখিত সীরতুল মাহদী ১ম খন্ড, ২৭১ পৃ:।) এভাবে প্রায় দু মাস পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত থেকে সে মারা যায়।
ইয়ার মুহাম্মদ ও আব্দুল্লাহ টিমাপুরী এবং কাদিয়ানীদের তৃতীয় জামাত:
ইয়ার মুহাম্মদ, আব্দুল্লাহ টিমাপুরী ও অন্যান্যরা ভিন্ন ধরনের লোকছিল। যখন তারা এ কৃত্রিম নবুয়্যত দেখতে পেল, যার সংগঠনে তারা অংশগ্রহণ করেছিল; তখন তারা ব্যাপারটি সহজ মনে করে প্রত্যেকেই নবুয়তের দাবিকরে অপর একটি স্বতন্ত্র কাদিয়ানী দল গঠন করে বসল। প্রকৃত পক্ষে এরাই সত্যিকার সেই দল যারা গোলাম আহমদের শিক্ষা দীক্ষাকে কার্যে পরিণত করেছে এবং ভন্ডনবী কাদিয়ানীর প্রস্তাব সমূহ বাস্তবায়িত করেছে।
প্রথমত: ইয়ার মুহাম্মদ নবুয়তের ঘোষণা করে দাবি করল যে, সে জনাব গোলাম আহমদের একজন অনুসারী নবী। এ নতুন ভন্ডনবী গোলাম পুত্র ও কাদিয়ানীদের খলীফা মাহমুদ আহমদের শিক্ষক ছিল। মাহমুদ আহমদ লিখেছে, ইয়ার মুহাম্মদ মাদ্রাসায় আমার শিক্ষক ছিলেন এবং জনাব মাসীহ কে অতি ভালোবাসতেন। শেষ পর্যন্ত তার ধারণা হল যে, সে একজন নবী এবং জনাব মাসীহের (গোলামের সমুদয় এলহামকে তার সহিত সম্পৃক্ত করতে শুরু করে। (গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদের প্রবন্ধ যা আল-ফজলে প্রচারিত, ১ম জানুয়ারি ১৯৩৫ খৃ:) এরপর নুর আহমদ কাদিয়ানী এসে ঘোষণা দিল- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আহমদ নূর রাসূলুল্লাহ। আমি আল্লাহর রাসূল। যে আমার আনুগত্য করবে সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে আমার অবাধ্য হবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্য হল। আমি বিশ্ববাসীর প্রতি করুণা স্বরূপ প্রেরিত হয়েছি। আমি সকল নবীর বহি:- প্রকাশ । ( নুর আহমদ কাদিয়ানী লিখিত লিকুল্লি উম্মাতিন আজল’ ১ও ২ পৃ:।) আশ্চর্যের বিষয়, যখনই কেহ নবুয়তের দাবি করত, কাদিয়ানী খলীফা তার সম্পর্কে বলত যে, সে পাগল ও রোগী। এ পার্থক্যের কারণ কি? এটা স্বীকৃত কথা যে, যতদিন তোমরা নবুয়তের দরজা খুলে রাখবে ততদিন পর্যন্ত তোমরা অপরকে বাধা দিতে পারবে না। এখন তোমরা তাদেরকে ঐ কথাই বলছ, যা অপর লোকেরা তোমাদের ভন্ডনবী মিথ্যাবাদীকে বলেছিল। সুতরাং কেন তোমরা ওখানে এটাকে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং এখানে তা প্রত্যাখ্যান করছ? এই তো গোলাম পুত্র মাহমুদ আহমদ নতুন ভন্ডনবী নুর আহমদ কাদিয়ানী সম্পর্কে লিখছে: (কেহ কেহ নূর আহমদের কার্যকলাপকে আমাদের সহিত সম্পৃক্ত করে থাকেন।.... তবে প্রত্যেকের জানা উচিত যে, সৈয়দ নূর আহমদ নবুয়তের দাবি করছে। সে একজন অসুস্থ ও অপারগ ব্যক্তি। কাজেই তার সহিত আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আল-ফজল, ১১নভেম্বর ১৯৩৪ খৃ:।) আব্দুল্লাহ টিমাপুরী যিনি গোলাম আহমদের একজন বিশিষ্ট সাহাবী সে এই মর্মে ঘোষণা দিল যে, সে গোলাম আহমদের সুসংবাদ ও ভবিষ্যদ্বাণী সমূহ অনুসারে একজন নবী সে বলেছে: আমিই হলাম ঐ ব্যক্তি যার সম্বন্ধে জনাব আকদাস প্রতিশ্রুত মাসীহ সুসংবাদ দিয়েছেন যে সে প্রেরিত হবে। অতএব গোলাম আহমদের ফয়েজ ও বরকতে আমি প্রেরিত হয়েছি। অচিরেই, আমার হাতে দুনিয়া বাসীর সম্মুখে জনাব গোলামের সত্যতা প্রকাশ পাবে। (আব্দুল্লাহ টিমাপুরীর তাফসরি সাবআম মিনাল মাসানী’ পৃ: আলিফ।) সে লিখেছে- আল্লাহ ত’আলা আকাশ থেকে আমার উপর একটা সহীফা অবতীর্ণ করেছেন এবং মাখলুকের নিকট তাঁর দাওয়াত পৌঁছে দিতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। বাইশ বৎসর কাল অতিবাহিত হয়েছে, আমি আমার কর্তব্য সম্পাদন করে আসছি।’ (ভন্ডনবী আব্দুল্লাহ টিমাপুরীর উম্মুল ইরফান ৯পৃঃ।)
অপর একজন কাদিয়ানী নবুয়তের সিংহাসনে আরোহণ করে বলল: ‘‘গোলাম আহমদের ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে আমি কদিয়ানীদের জন্য সেই নির্দিষ্ট ও প্রতিশ্রুত ব্যক্তি।’’ (ভন্ডনবী মুহাম্মদ সিদ্দিক কাদিয়ানীর খাদিমু খাতামিন নাবিয়ীন’ ১৮ পৃ:। সে লিখেছে: আমার নিষ্ঠা ও সত্য নিয়তের প্রতি তাকিয়ে দেখুন! আমি নিজে কাদিয়ানে গিয়ে খলীফা মাহমুদ আহমদের হাতে বায়আত করেছি এবং এর উপর অটল রয়েছি। তারপর আমার কাছে প্রকাশ করা হয়েছে যে, আমি কাদিয়ানীদের জন্য অপেক্ষিত ও প্রতিশ্রুত ব্যক্তি এবং আল্লাহ তাআলা আমার জন্য অনেক নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন প্রমাণাদিও অবতীর্ণ করেছেন এবং পূর্ণ ক্ষমতার কামালিয়তকে আমার সঙ্গী করে দিয়েছেন।’ (ভন্ডনবী মুহাম্মদ সিদ্দিক কাদিয়ানীর খাদিম খাতামিন নাবিয়ীন’ ২৫পৃঃ।)
অনুরূপ ভাবে, আরও কয়েক ব্যক্তি তাদের নবুয়তের ঘোষণা দিয়েছে। যেমন, গোলাম মুহাম্মদ কাদিয়ানী, চেরাগ উদ্দিন জমবী কাদিয়ানী ও মুহাম্মদ সাদেক কাদিয়ানী প্রমুখ। তারা কাদিয়ানী ধর্মে আর একটি জামাত গঠন করেছে। তাদের বিশ্বাস, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী আল্লাহর নবী ও রাসূল। যে ব্যক্তি গোলাম আহমদের নবুওতে বিশ্বাস করবে না সে মুক্তি পাবে না। এমনিভাবে তাদের নবুয়্যত ও রেসালতে বিশ্বাস করবে না সেও মুক্তি পাবে না। তাদের ও ভন্ডনবী কাদিয়ানীদের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, সে কোন মাধ্যম ছাড়াই নবুয়্যত লাভ করেছে এবং তারা তার মাধ্যমে নবুয়্যত লাভ করেছে। সে তাদের উস্তাদ স্বরূপ এবং তারা হল তার ছাত্র। সত্য কথা হল এই যে, এরাই গোলাম আহমদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ তাদের কে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। (যাতে করে লোকেরা একথা বুঝতে না পারে যে, নবুয়্যত একটা খেলনায় পরিণত হয়ে গেছে।) যেমন, তাদের নেতার সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। ফলে তারা শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। যদিও তারা গোলাম আহমাদের ন্যায় তাদের আশে পাশে কতকগুলো বোকা ও নির্বোধ ব্যক্তিকে জড়ো করতে সামর্থ্য হয়েছিল।
এরাই হল কাদিয়ানীদের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গ। আর এটাই হল তাদের চরিত্র। আর এ গুলো হল কাদিয়ানীদের দল ও উপদল, যারা নিজে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করছে।
উম্মতে ইসলামিয়া সম্মিলিত ভাবে এই ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী নেই। তাঁর পর যে কেহ নবুয়তের দাবি করবে, হয় সে মিথ্যাবাদী দাজ্জাল, না হয় বিকৃত মস্তিষ্ক পাগল। এ বিষয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উম্মতের কোন দু’ব্যক্তির মধ্যে মতভেদ নেই। কিন্তু কাফের সাম্রাজ্যবাদী ও উম্মতে মুহাম্মদীয়ার বিরুদ্ধবাদী খ্রিস্টানদের পক্ষ থেকে এমন কতেক দল সৃষ্টি করা হয়েছে, যারা বাহ্যত: ইসলামের নাম ধারণ করলেও, প্রকৃত পক্ষে তারা অন্যের হাতের অস্ত্র স্বরূপ। এরা তাদের অমূলক ধারণা দ্বারা আল্লাহর খালেছ দ্বীনের শত্রুদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করে দাবিকরে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী নহেন এই অর্থে যে, তাঁর পরে আর কোন নবী নেই, বরং তাঁর পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত একাধিক নবীর আগমন সম্ভব। যেমন বাস্তবে তাঁর পরে কোন কোন ভন্ড নবীর আগমন ঘটেছে। তারা কুরআন ও হাদীসের বাক্যকে তার মূল অর্থ থেকে সরিয়ে স্থানচ্যুত করে এবং কুরআন ও হাদীসের বিকৃত, মেকী ও ঘৃণ্য ব্যাখ্যা প্রদান করে। এ সব দলের মধ্যে প্রসিদ্ধ হল কাদিয়ানী সম্প্রদায় যারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর উম্মত এবং বাহায়ী জামাত, যারা হুসাইন আলীর অনুসারী, যার উপাধি হল বাহাউল্লাহ। এ দু’টি ঘৃণ্য দলই ইসলামের দাবিদার হওয়ার কারণে অমূলক অপ ব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া কুরআনের স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। আমরা কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বক্তব্য সমূহ উল্লেখ করব এবং সন্দেহ ও আপত্তি সমূহ উত্থাপন করে যুক্তি সংগত উপায়ে উহার উত্তর প্রদান করব। কোন বিষয় সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘায়িত না করে মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করব, যাতে উহা বিরক্তিকর ও ত্রুটি পূর্ণ না হয়। এইভাবে পাঠকগণ এদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি, প্রতারণা, পথভ্রষ্ট ও বিপথগামী করার কৌশল সম্পর্কে অবগত হতে পারবে।
এটা জানা কথা যে, বাহায়ীরা বিশ্বাস করে, হুসাইন আলী আল্লাহর নবী ও রাসূল। আর, কাদিয়ানীরা বলে: গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবী ও রাসূল। পক্ষান্তরে, আল্লাহ তাআলা বলেন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নহেন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত।’ [সুরা আহযাব-৪১] এ আয়াতটি এ বিষয়ে স্পষ্ট এবং এর অর্থও প্রকাশ্য। কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মুখাপেক্ষী নহে। যার আরবী ভাষা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান আছে সেও এ আয়াত থেকে বুঝতে পারবে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে আর কোন নবী নেই। প্রথমত: খাতাম শব্দের অর্থ শেষ নহে, বরং তার অর্থ হল শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ নবী।’ এর অর্থ এই নহে যে, তার দ্বারা নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত:- খাতাম শব্দের অর্থ মোহর। অর্থাৎ তিনি লোকজনের উপর শীল মোহর করেন এবং তাঁর মোহর দ্বারাই কেহ নবীতে পরিণত হয়।
তৃতীয়তঃ- আন-নাবিয়্যীন দ্বারা শরীয়ত সম্পন্ন নবীগণকে বুঝান হয়েছে। অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ নবীগণের শেষ যারা স্বয়ং সম্পূর্ণ শরীয়ত নিয়ে আগমন করেছেন। এমন অনেক নবী পূর্বে এসেছেন যারা পূর্ববর্তী নবীর শরীয়তের অনুসারী ছিলেন। যেমন, হারুন আলাইহিস সালাম মুসা আলাইহিস সালাম এর অনুগামী নবী।
এই হল উক্ত আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা ও অন্তঃ-সারশূন্য অপ-ব্যাখ্যা মিথ্যাবাদী ভন্ডনবীর নবুওতকে প্রমাণিত করার জন্য তারা যার আশ্রয় নিয়েছে। যে ভন্ডনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন এক সাধারণ খাদেমের স্তরে পৌঁছার যোগ্য নহে, সুতরাং কোথায় সে এবং কোথায় শানে রেসালত ও নবুয়্যত? এ সমস্ত ব্যাখ্যার প্রতি কোন রকমের মনোযোগ ও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, উহাতে এমন দুর্বলতা ও হীনতা রয়েছে যা তাদের নিজের ভাষ্যদ্বারা ফুটে উঠে। কিন্তু যেহেতু তারা এ সমস্ত ব্যাখ্যা দ্বারা নির্বোধ, সরলমনা ও আরবী ভাষা জ্ঞানহীন লোকজনকে প্রতারিত করে, তাই এগুলোর উত্তর আমাদের দিতে হবে।
প্রথম- ‘খাতাম’ শব্দের সর্বশেষ অর্থ ছেড়ে দিয়ে উহার অর্থ শ্রেষ্ঠত্ব গ্রহণ করা আরবী ভাষার অভিধান, তাফসীরকারকদের মতামত, ইজমায়ে উম্মত ও কুরআন হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনার পরিপন্থী। মাজদুদ্দীন ফিরোজাবাদী তার আল-কামুসুল মুহীত নামক অভিধানে বলেন: প্রত্যেক বিষয়ের পিছনের এবং শেষের অংশকে খাতেমা বলা হয় এবং লোকের মধ্যে শেষ ব্যক্তিকেও খাতাম বলে।’ (আল কামুসুল মুহীত, ৪থ খন্ড, ১০২ পৃ: ৪থ সংস্করণ।)
ইবনুল ফারিস বলেন: খাতাম অর্থ বস্ত্তর শেষ পর্যন্ত পৌঁছা এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুল আম্বিয়া, যেহেতু তিনি তাদের শেষে আসছেন।’ (মু’জামুল মাকাঈছুল লুগাত, ২য় খন্ড, ২৪৫ পৃ: ১ম সংস্করণ।)
ইমাম জুবাইদী বলেন: রাসূলুল্লাহ অন্যতম নাম হল খাতিম এবং খাতাম।, আর অর্থ হল ঐ ব্যক্তি যার আগমনে নবুয়্যত সমাপ্ত হয়েছে। (তাজুল আরুছ, ৮ম খন্ড, ২৬৭ পৃ: ১ম সংস্করণ।)
জওহরী তার আস্ সিহাহ’ নামক অভিধানে বলেন: কোন বস্ত্তর খাতেমা তার শেষকে বুঝায়। আর, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীগণের সর্বশেষ। (জওহরী রচিত আস্ সিহাহ।)
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আবুল বাক্কা বলেছেন: আমাদের নবীর খাতামুল আম্বিয়া নমকরণের কারণ হল এই যে, খাতাম হল সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।’ (কুল্লিয়াতে আবুল বাক্কা।’
ইমাম রাগীব ইসফাহানী বলেছেন: খাতামুন নাবিয়্যীন নবুওতকে শেষ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর আগমন দ্বারা তা সম্পূর্ণ করেছেন।’ (আল মুফরাদাত লিল-ইসপাহানী’ ১৪২ পৃ: মিশরীয় সংস্করণ।) সাহেবুল মাজমা বলেন: খাতিম এবং খাতাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম নাম। ‘তা’ বর্ণটি যবরযুক্ত হলে শব্দটি ইসম বা বিশেষ্য হবে অর্থাৎ তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি। আর ‘তা’ বর্ণটি যেরযুক্ত হলে শব্দটি ইসমে ফায়েল হবে অর্থাৎ শেষকারী ব্যক্তি।’ (মাজমাউল বিহার’৩৩০ পৃ:।)
পরিশেষে, ভাষাবিদ ইবন মানজুর আফ্রিকী মিশরী খাতাম শব্দের অন্তর্গত যা কিছু বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করেছেন, আমরা তার আলোচনা করব। তিনি বলেন: প্রত্যেক জিনিসের খাতাম ও খাতেম উহার পরিণাম ও শেষ। ইখতাতামতু শাইআ’ (আমি বিষয়টি শেষ করেছি) । এটা ইফতাতাহতু শাইআ’ (আমি বিষয়টি সূচনা করেছি) এর বিপরীত। সূরার খাতেমা তার শেষ অংশ। খাতিমুল কওম, খিতামুল কওম এবং খাতামুল কওম হল কওমের শেষ ব্যক্তি। ‘লিহইয়ানী’ হতে বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুল আম্বিয়া। আত-তাহজীব থেকে উদ্ধৃত: খাতিম এবং খাতাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম সমূহের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আছে: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের সর্বশেষ। (লিসানুল আরব’ ১২শ খন্ড, ১৬৪ পৃ: বৈরুত সংস্করণ।) এ সমস্ত কথা আরবী ভাষাবিদও পন্ডিতগণ বলেছেন। তাদের আরবী গ্রন্থও অভিধান সমূহ হতে আমরা তা উদ্ধৃত করেছি। তাদের প্রত্যেকেই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, খাতাম অর্থ শেষ। আমি বুঝতে পারি না যে, যারা আরবী ভাষায় কিছুই জানে না তারা কেমন করে দাবিকরে যে, আল্লাহর বাণী:
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ
এর মধ্যে খাতাম শব্দের অর্থ শেষ নহে, বরং শ্রেষ্ঠ। তাফসীর শাস্ত্রের ইমামগণও ঠিক এই শেষ অর্থেই এর ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম ইবন জারীর তাবারী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, خاتم النبيين অর্থাৎ নবীদের সর্বশেষ। (তাফসীরে ইবনে জারীর, ২২খন্ড, ১২পৃঃ ১ম সংস্করণ, মিশর।) খাজেন বলেন: খাতামুন নবিয়্যীনের অর্থ তাঁর দ্বারা আল্লাহ তাআলা নবুওতকে শেষ করেছেন। সুতরাং তাঁর পর আর কোন নবুয়্যত নেই।
وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
এর অর্থ- এ কথাও আল্লাহর ইলমের অন্তর্ভুক্ত যে, তাঁর পর আর নবী নেই। (খাজেনের লুবাবুত তাবীল’ ৩য় খন্ড, ৪৭১ পৃ: ১ম সংস্করণ, মিশর)
নাসাফী বলেছেন: খাতামুন নাবিয়্যীন (‘তা’ বর্ণের যবরযোগে) এর অর্থ হল তিনি হলেন নবীদের সর্বশেষ এবং ‘তা’ বর্ণের যের যোগে এর অর্থ হল তিনি হলেন নবীদের সমাপ্তকারী।’ (তাফসীরে মাদারীকুত তানজীল’ ৩য় খন্ড, ৪৭১ পৃ: ১ম সংস্করণ)
ইমাম কুরতুবী বলেন: একমাত্র ক্বারী আসেমই ‘তা’ বর্ণের যবরযোগে পাঠ করেছেন। অর্থ হল নবীগণকে তাঁর দ্বারাই শেষ করা হয়েছে। আর অধিকাংশ আলেমগণ ‘তা’ বর্ণের যেরযোগে পাঠ করেছেন। অর্থ হল- তিনি তাদের সমাপ্ত করেছেন। কেহ কেহ বলেছেন- খাতাম ও খাতিম দুটো ব্যবহারিক রূপ। অর্থ এক। (তাফসীরে কুরতুবী, ১৪শ খন্ড, ১৯৬ পৃ: ১ম সংস্করণ, মিশর।) ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী বলেন: খাতামুন নাবিয়্যীন এ জন্য যে, যে নবীর পরে অন্য কোন নবী আসবেন যদি সে নবী কোন উপদেশ বা বর্ণনা পরিত্যাগ করে যান, তবে পরবর্তী নবী তা পরিপূর্ণ করবেন। কিন্তু যে নবীর পর আর কোন নবী নেই, তিনি তাঁর উম্মতের জন্য অসীম স্নেহশীল, হেদায়াত দাতা ও উপকারী হয়ে থাকেন। (রাজীর তাফসীরে কবির’।)
ইমাম ইবনে কাছীর
وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ
বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের সর্বশেষ, এ আয়াত সম্পর্কে লিখেছেন। তার মূল ভাষ্য হল এই: এ আয়াতের মধ্যে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যে, তাঁর পর আর কোন নবী নেই। যখন তাঁর পর কোন নবী নেই, তখন কোন রাসূল না থাকাই অনিবার্য। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির বহু হাদীস বর্ণিত আছে। (তাফসীরে ইবন কাসীর, ৩য় খন্ড, ৪৯৩ পৃ:, ৩য় সংস্করণ মিশর)
আল্লাহর রাসূল যিনি ওহী ব্যতীত কথা বলেন না, এ ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা করে বলেছেন-
প্রথম হাদীস- আমিই সর্বশেষ নবী এবং আমার মসজিদ সর্বশেষ মসজিদ। [১ সহীহ মুসলিম।]
দ্বিতীয় হাদীস- অপর এক রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত হাদীসের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেছেন: আমি শেষ নবী এবং আমার মসজিদ নবীগণের সর্বশেষ মসজিদ। [২ দায়লামী এবং বাজ্জার ‘কানজুল উম্মালের উদ্ধৃতি দিয়ে এটা বর্ণনা করেছেন।]
তৃতীয় হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: আমি সর্বশেষ নবী এবং তোমরা সর্বশেষ উম্মত। [ইবন মাযাহ ও হাকিম।]
চতুর্থ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর এক হাদীসে বলেছেন, যে হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম তাদের সহীহ গ্রন্থ দ্বয়ে উদ্ধৃত করেছেন: আমার ও অন্যান্য নবীগণের দৃষ্টান্ত হল- যেমন অতিশয় মনোরম একটি প্রসাদ, যাতে একটি ইটের স্থান ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দর্শকবৃন্দ প্রদক্ষিণ করে তার মনোরম দৃশ্য দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়, কিন্তু একটি ইটের স্থান শুন্য লক্ষ্য করে! সুতরাং আমিই ঐ ইটের শুন্য স্থানটি পূর্ণ করেছি। প্রসাদটি আমার দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে এবং রাসূলগণের আগমনও আমার দ্বারা শেষ হয়েছে। [৪ বুখারী ও মুসলিম।]
এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনিই সর্বশেষ নবী এবং তাঁর উম্মত সর্বশেষ উম্মত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রসাদের হাদীসে ‘খতম’ শব্দের এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যাতে কোন দাজ্জালের জন্য তাঁর পর নবুয়তের দাবি করার অবকাশ রাখেন নি। কেননা, নবুয়তের প্রসাদ পূর্ণতা লাভ করেছে এবং উহার খালি জায়গাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ হাদীসটি অনেক হাদীসবেত্তা বিভিন্ন পন্থায় বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ রা. থেকে এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেছেন যে, নবীগণের মধ্যে আমার দৃষ্টান্ত হল, এক ব্যক্তি একটি সুন্দর ও পরিপূর্ণ ঘর তৈরি করল, কিন্তু উহাতে একটি ইটের স্থান খালি রেখে দিল, সেখানে কোন ইট স্থাপন করেনি। লোকজন এটা প্রদক্ষিণ করে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে- হায়রে, যদি এ ইটের স্থানটুকু পরিপূর্ণ হয়ে যেত! সুতরাং আমিই নবীগণের মধ্যে ঐ ইটের স্থানসম। [১ইবন কাসীরের উদ্ধৃতি দিয়ে আহমদ তাঁর মসনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।] অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, আমি এসে ঐ ইটটি পূর্ণ করে দিয়েছি।
এ সকল হাদীস এটাই প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ সর্বশেষ নবী । আর, কাদিয়ানীর যা বলেছে যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ, শেষ নহে, তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, বিকৃত, অন্তঃসারশূন্য ও দুর্বল, যার কোন ভিত্তি ও প্রমাণ নেই। এইতো ভাষাবিদগণ ও তাফসীরের ইমামগণ স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ নহে, বরং শেষ। মুসলমানদের ইমাম ও মোমিনদের নবী যিনি ওহীর সাহায্যে কথা বলেন, স্বয়ং তিনি স্পষ্টকরে বলেছেন যে, তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁর দ্বারা নবুয়্যতকে সমাপ্ত করা হয়েছে এবং তাঁর দ্বারাই রেসালত বন্ধ হয়ে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তার বিপরীত কিছু বলার সাধ্য কারো নেই। ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী স্বয়ং এ নীতি তার উক্তিতে স্বীকার করেছে. ইলহাম প্রাপ্ত ব্যক্তির (অর্থাৎ রাসূলের) বর্ণনার পর আর কোন ব্যাখ্যা বা তাফসীর গ্রহণযোগ্য নয়। (গোলামের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালতে’ সন্নিবেশিত, ১ম খন্ড, ১২১ পৃ:।) এ জন্যই গোলাম আহমদ তার স্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা সর্বশেষ নবী এবং তাঁর মাধ্যমে রাসূল আগমনের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর আল-ইস্তেফতা’) কাদিয়ানীরা যখন এ সকল গভীর ও স্পষ্ট হাকীকত উপলব্ধি করে তখন তারা তাদের বাতিল ব্যাখ্যা সমূহকে শক্তিশালী করার জন্য এমন কতকগুলো বিষয়ের চেয়ে কম নহে। তাই, কখনও তারা ভিত্তিহীন মওযু (মনগড়া) রেওয়ায়েত দ্বারা, যার কোন আসল নেই, দলীল গ্রহণ করে। আর তা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে বললেন: আমি সর্বশেষ নবী, আর তুমি হে আলী! সর্বশেষ ওলী।’ (নজীর আহমদ কাদিয়ানীর আল কওলুস সরীহ’ ১৭৩ পৃ:।) তারা বলে যে, এর অর্থ হল- আলী রা. সর্বশ্রেষ্ঠ ওলী, এই অর্থ নয় যে, আলীর রা. পরে আর কোন ওলী আসবেন না। আমরা বলি, এ রেওয়ায়েতের কোন আসল বা ভিত্তি নেই। উপরন্তু আমরা সহীহ হাদীস সমূহ দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ নহে, বরং শেষ। আমরা উহা অভিধান ও তাফসীরের কিতাব সমূহ দ্বারা প্রমাণ করেছি। অনুরূপভাবে কোন কোন কাদিয়ানী একটি (বিচ্ছিন্ন) রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। উহাতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবাবাসকে রা. বলেছেন: আনন্দিত হও হে চাচা! নিশ্চয়ই তুমি হলে খাতামুল মুহাজেরীন বা সর্বশেষ মুহাজের। (আব্দুর রহমান কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক।) তাই তারা বলে: এখানে খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ। কারণ, এর অর্থ এই নয় যে, আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হিযরতের পর আর কোন হিযরত নেই।
আমরা বলি: এ রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল গ্রহণ করাও রূগ্ন বুদ্ধি, অন্তরের বক্রতার পরিচয় বহন করে এবং তা দ্বীন ইসলামের মধ্যে পরিবর্তন সাধনের কুমতলব ও বিশ্বস্ত সত্যবাদী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুসলমানগণকে দুরে রাখার একটা কৌশল মাত্র। কেননা, আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, এ রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল গ্রহণ করা ঠিক নহে।
প্রথমত: এ রেওয়ায়েতটি বিচ্ছিন্ন। উহার সনদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত ধারাবাহিক পৌঁছায়নি।
দ্বিতীয়ত: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, নবুয়তের দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং রেসালত শেষ হয়ে গেছে।
তৃতীয়তঃ আমরা ভন্ডনবী কাদিয়ানীর ভাষ্য উল্লেখ করেছি: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনার পর কোন তাফসীর ও ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নহে।
চতুর্থত: যদি আমরা এ রেওয়াতকে সহীহ মেনে নেই তবুও এর দ্বারা দলীল প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, মক্কা বিজয়ের পূর্বে যে সকল মুসলমান মক্কায় অবস্থান করছিলেন, তাদের জন্য মদিনায় হিজরত করা অপরিহার্য ছিল। আর আববাস রা. মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মদিনায় হিযরত করেছিলেন। হাফিজ ইবন হাজার তাঁর আল-ইছাবাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: আববাস রা: মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে হিযরত করেছেন এবং মক্কা বিজয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। [১ সাহাবীগণের পরিচয় সম্পর্কে ইবন হাজারের গ্রন্থ হল আল ইছাবাত।] তিনি যখন মদিনায় পৌঁছেছিলেন, তখন তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন: ‘হে চাচা, তুমি আনন্দিত হও! নিশ্চয়ই তুমি হলে সর্বশেষ মুহাজির। কারণ, মক্কা বিজয়ের সময় অত্যাসন্ন ছিল। মুজাসি ইবন মাসউদ সালমী যখন তার ভাই মুজালিদ ইবন মাসউদকে নিয়ে হিজরতের উপর বায়আত গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে আগমন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: মক্কা বিজয়ের পর হিযরত নেই, তবে ইসলামের উপর বায়আত আছে। [২ বুখারী।]
মোটকথা, এ রেওয়ায়েত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ, শেষ নহে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই পঞ্চম হাদীসকে বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন, যখন আলীকে সম্বোধন করে বলেছিলেন: ‘মুসার আলাইহিস সালাম কাছে হারূণের আলাইহিস সালাম যে মর্যাদা ছিল, ঠিক তেমনি আমার কাছে তোমার মর্যাদা রয়েছে। তবে পার্থক্য হল এতটুকু যে, আমার পরে আর কোন নবী নেই। [৩ বুখারী ও মুসলিম।]
উক্ত হাদীস এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, খাতাম অর্থ শেষ। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরে নবুওতকে অস্বীকার করেছেন। কোন এক কাদিয়ানী জনৈক কবির উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করে বলে, কবিরা খাতাম শব্দকে শ্রেষ্ঠ অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমি বলি: উহা তাদের পক্ষে কোন দলীলরূপে গণ্য হয় না। যেমন, তারা বলে: হাসান ইবন ওহাব আবু তামাম ত্বায়ীর শোক প্রকাশে বলে:
فجع القريص بخاتم الشعراء وغديرروضتها حبيب الطائ
(কুবাইস এলাকাবাসী খাতামুশ শুআরা এর জন্য ব্যথিত, কেননা, প্রকৃত কথা হল, হাবীব ত্বায়ীই ছিল এর বাগানে জলধারা বিশেষ।) এখানে খাতামুশ শুআরা অর্থ শ্রেষ্ঠ কবি, সর্বশেষ কবি নহে। কেননা, কবিগণ সব সময়ই বিদ্যমান আছেন। (কাদিয়ানীদের আল- কাওলুস সারীহ’ ও আহমদিয়া পকেট বুক।’) আমরা এর উত্তরে বলি: এর অর্থ কি আবু তামাম তার পূর্ববর্তী সকল কবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ? এ পর্যন্ত কেহ এমন কথা বলেনি, এবং বলতে পারেও না। আর হাসান ইবন ওহাবেরও ধারণা ছিল না যে, আবু তামাম আরবের সকল কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বরং ইহার অর্থ হল- হাসান ইবন ওহাবের ধারণা অনুযায়ী আবু তামাম ই শেষ কবি, যিনি প্রাচী বিজ্ঞ কবিদের রীতি অনুসরণ করেছিলেন। সুতরাং কবিতার এ পঙ্ক্তি কাদিয়ানীদের পক্ষে দলীল নহে, বরং তাদের বিপক্ষে প্রমাণিত হয়।
দ্বিতীয় কথা- মানুষের কথা দ্বারা আল্লাহর বাণীর অর্থ নির্ধারণের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দিকে, এরপর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং আইম্মায়ে মুজতাহেদীন ও মুফাস্সীরীনের উক্তির দিকে ফিরে যেতে হবে। উপরন্তু এখানে কবির উক্তি অনেক অর্থের সম্ভাবনা রাখে, কোন একটি অর্থ সুস্পষ্ট নহে।
তৃতীয় কথা- কাদিয়ানীরা যখন মানুষের উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করতে চায়, তখন তাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম ও উচিত হবে তারা যেন তাদের নবীর উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করে। প্রকাশ থাকে যে, তাদের ভন্ডনবী কাদিয়ানী ‘খাতাম’ শব্দের অর্থ গ্রহণ করেছে ‘শেষ’ শ্রেষ্ঠ নহে। সে তার জন্ম কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বলে: আমি জন্মগ্রহণ করলাম এবং আমার সাথে একজন মেয়ে জন্মগ্রহণ করল। সে প্রথমে পেট থেকে বের হল, এবং পরে আমি বের হলাম। এরপর আমার মাতা-পিতার আর কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। তাই, আমি হলাম তাদের (খাতাম) সর্বশেষ সন্তান। (তিরিয়াকুল কুলুব, ৩৭৯৯ পৃষ্ঠা)
মির্জা কাদিয়ানীর এ কথাটি কি কাদিয়ানীদের জন্য দলীল হবে? না হাসান ইবনে ওহাবের কথা দলীল হবে? এ ছাড়া ভন্ডনবী কাদিয়ানী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর উল্লেখ করে বলেছে: বনী ইসরাঈলের খাতেম সর্বশেষ নবীর নাম ছিল ঈসা । (বারাহীনে আহমদিয়ার পরিশিষ্ট নুসরাতুল হক’ পৃ: বা।) কোন কাদিয়ানী এ কথা বলতে পারবে না যে, এখানে ‘খাতাম’ এর অর্থ শ্রেষ্ঠ, শেষ নহে। কেননা, ভন্ডনবী অন্যত্র বিশ্লেষণ করে বলেছে:- মুসা আলাইহিস সালাম এর পর সকল নবীই তাঁর শরীআতের খাদেম ছিলেন। (গোলাম কাদিয়ানীর শাহাদাতুল কুরআন’ ২৬ পৃ:।) যদি মানুষের উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করতেই হয়, তবে কাদিয়ানীদের জন্য ভন্ডনবীর উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করা অধিক শ্রেয়। কেননা, সে নিজেই দাবি করছে. সে প্রবৃত্তির তাড়নায় কোন কথা বলে না, সে যা বলে তা ওহীর সাহায্যেই বলে। (গোলাম কাদিয়ানীর আরবাঈন ৩ নম্বর, ৪৩ পৃ:।) সে তো ‘খাতাম’ শব্দকে শেষ অর্থে ব্যবহার করেছে, শ্রেষ্ঠ অর্থে নহে। আর, এ কথা প্রমাণ করাই আমাদের লক্ষ্য। কাদিয়ানীরা বলে যে, খাতাম অর্থ মোহর, অর্থাৎ তিনি লোকদের মোহর লাগান এবং তাঁর মোহরে একজন লোক নবী হতে পারে , ইহা সম্পূর্ণ বাজে কথা। আরবদের কাছে এই অর্থের কোন ব্যবহার নেই। নচেৎ এটা অপরিহার্য হয়ে পড়বে যে, খাতামুল মুহাজেরীনের অর্থ যার মোহরে একজন লোক মুহাজির হয়ে যায় এবং খাতামুল মুজতাহেদীনের অর্থ যে মানুষকে মোহর লাগায় এবং তাদেরকে মুজতাহেদ বানিয়ে দেয়। এ অর্থ আরবরা কখনও শুনেনি এবং এখন পর্যন্ত তাদের ভাষায় ইহার অস্তিত্ব নেই। এমনকি, অন্য কোন ভাষায়ও এরূপ ব্যবহার নেই। অন্যথায়, ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর এ উক্তি উদ্দেশ্য কি হবে: আমি আমার মাতা-পিতার সন্তানের জন্য ‘খাতাম’। সে কি তার মাতা-পিতার সন্তানের মোহর লাগাচ্ছে যাতে তারা তাদের সন্তান হিসেবে পরিগণিত হয়? এ ধরনের নির্বুদ্ধিতার দ্বারা কি কাদিয়ানীরা তাদের মিথ্যাবাদী ভন্ডনবীর নবুওতকে প্রমাণ করতে চায়, না, এর দ্বারা মুসলমানগণকে প্রতারিত করতে চায়?
চতুর্থ কথা- তাদের উক্ত, উক্ত আয়াতে নবীগণ দ্বারা উদ্দেশ্য শরীয়াতের অধিকারী নবগিণ- একথা সম্পূর্ণ বাতিল, এর পক্ষে তাদের কোন দলীল নেই। কারণ, আল্লাহ তাআলা নবীগণের মধ্যে শরীয়ত প্রাপ্ত নহেন এমন কোন পার্থক্য করেননি। বরং আন্নাবিয়্যীন শব্দ আম (ব্যাপক) ও ‘মুতলাক’ (শর্তহীন) রয়েছে। আর, উসুল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ নীতি হল- আমাকে তার উমুম (ব্যাপকতা) এর উপর এবং মুতলাক কে তার এতলাক (শর্তহীনতা) এর উপর বহাল রাখা, যতক্ষণ পর্যন্ত এমন কিছু না পাওয়া যায় যা উহাকে খাস করে অথবা কোন শর্তের সহিত আবদ্ধ করে। এখানে এমন কোন প্রমাণ নেই যদ্দারা বুঝা যায় যে, নবীগণ দ্বারা এক বিশেষ শ্রেণির নবী উদ্দেশ্য। বরং এই অর্থ গ্রহণ করা প্রতিষ্ঠিত স্পষ্ট উদ্ধৃতি সমূহের পরিপন্থী। কারণ এ সকল দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘নাবিয়্যীন’ দ্বারা সাধারণ নবুওতকে বুঝান হয়েছে।
ষষ্ঠ হাদীস- আমরা এখানে আর একটি হাদীসের উল্লেখ করব, যা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুয়তের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (যার জন্য আমার মাতা-পিতা ও আমার প্রাণ কুরবান) এরশাদ করেছেন- বনী ইসরাঈলকে তাদের নবীগণ দেখা শুনা করতেন । যখন কোন নবীর ইন্তেকাল ঘটত, তাঁর পরেই আর এক নবী আগমন করতেন। কিন্তু আমার পর আর কোন নবী নেই। তবে খলীফা আসবেন এবং তাদের সংখ্যা হবে অনেক। [১ বুখারী ইবনে মাযাহ ও আহমদ।] উক্ত হাদীস সুস্পষ্ট ভাবে এ কথাই বোঝাচ্ছে যে, আননাবিয়্যীন অর্থ সাধারণ নবুয়্যত। উহা নতুন কোন শরীয়ত যুক্ত হোক বা না হোক । কেননা, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত হাদীসে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন।
এক:- বণী ইসরাঈলের ভাল-মন্দ নবীগণ দেখাশোনা করতেন। এক নবী ইন্তেকাল করলে অপর নবী আগমন করতেন। কিন্তু কেহই একথা বলেননি যে, বণী ইসরাঈলের সকল নবী স্বতন্ত্র শরীয়তের অধিকারী ছিলেন। স্বয়ং কাদিয়ানীরাও একথা বলেনি। অতঃপর মহান রাসূল এ উক্তি করলেন আমার পরে কোন নবী নেই।
দুই:- তারপর খলীফা হবেন এবং তাঁরা অনেক হবেন।’ এ উক্তিও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, তাঁর পর আর কোন নবী নেই। কারণ তাঁর পর যদি আর কোন নবী থাকত তা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলতেন না যে অচিরেই খলিফাগণ আগমন করবেন এবং তারা অনেক হবেন।
সপ্তম হাদীস- উপরন্তু রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট থেকে ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, অচিরেই এমন কতক গুলো লোক বের হবে যারা অপবাদ রটনাকারী, মিথ্যুক এবং নিজেকে নবী দাবি করবে, আর, আল্লাহর বাণী সমূহকে স্ব স্থান থেকে পরিবর্তন করবে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে কোন প্রকার অস্পষ্টতা ও সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি বলেছেন: অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যুক বের হবে, যাদের প্রত্যেকে আল্লাহর নবী হওয়ার দাবি করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই। অপর রেওয়ায়েতে আছে ক্বিয়ামত কায়েম হবে না যতক্ষণ না ত্রিশজন দাজ্জাল বের হবে, এদের প্রত্যেকেই দাবি করবে যে, সে আল্লাহর রাসূল। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই। [১ আবু দাউদ ও তিরমিজী।] উক্ত হাদীস এদের মিথ্যা, ভ্রান্ত ব্যাখ্যার প্রতি আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে এদের প্রতারণা এবং কুরআন হাদীসের বাণীকে এদের বিকৃতকরণের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরছে। স্বয়ং তাদের ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার মিথ্যা নবুয়্যত দাবি করার পূর্বে স্বীকার করেছে যে, আল্লাহ তাআলার বাণী ‘খাতামুন নবিয়্যীন’ দ্বারা সাধারণ নবুয়্যত বুঝায়। সে তার উক্তি দ্বারা স্পষ্ট করে বলেছে: ‘তুমি কি জান না যে. মহান দয়ালু প্রভু আমাদের নবীর নাম রেখেছেন ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এতে কোন রূপ ব্যতিক্রম নেই। আর আমাদের নবী স্বীয় উক্তি ‘লা নাবিয়্যা বাদী’ দ্বারা সত্যান্বেষীদের জন্য সুস্পষ্ট করে এর ব্যাখ্যা করেছেন।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ইলহামের সমষ্টি হামামাতুল বুশরা ৩৪ পৃ:) সে আরো বলছে: ‘মা কানা মুহাম্মাদুন’ আয়াতটি স্পষ্ট করে প্রমাণ করছে যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর এ পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবেন না।’ (গোলাম কাদিয়ানীর এজালাতুল আওহাম’ ৬১৪ পৃ:।))সে আরো বলেছে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকবার বলেছেন যে, তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না এবং ‘আমার পর কোন নবী নেই’ হাদীসটি অতি প্রসিদ্ধ। এর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কারো আপত্তি করার সাধ্য নেই। কুরআন কারীম , যার প্রতিটি শব্দই অকাট্য আয়াতের উক্তি দ্বারা ইহার সত্যতা প্রমাণ করেছে। সুতরাং নবুয়্যত আমাদের নবীর কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর কিতাবুল বারিয়া’ এর টিকা ১৮৪ পৃ:।) সে এর চেয়েও অধিক বলেছে: আমি ঠিক ঐ ভাবে বিশ্বাস করি যেভাবে মুসলমানগণ ও আহলে সুন্নাহ বিশ্বাস করেন। কুরআন ও হাদীস দ্বারা যা সাব্যস্ত তার সবটুকু আমি সমর্থন করি। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, সর্বশেষ নবী সাইয়েদানা ও মাওলানা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যত ও রেসালতের দাবি করবে সে কাফের ও মিথ্যুক। আমার বিশ্বাস রেসালত আদম ছফিউল্লাহ থেকে আরম্ভ করে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে শেষ হয়েছে। (গোলামের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালতে সন্নিবেশিত, ২য় খন্ড, ২য় পৃ:।)
এ উক্তি গুলো করেছে কাদিয়ানীদের সেই ভন্ডনবী যার দাবি হল যে, সে প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলে না, যা বলে তা ওহী ব্যতীত অন্য কিছু নহে। সুতরাং কাদিয়ানীরা কেমন করে ইজমায়ে উম্মত, মুফাস্সেরীনের মতামত, মহান রাসূলের হাদীস, এমন কি তাদের ভন্ডনবীর উক্তিকে বর্জন করে চলে? সে ভন্ডনবীই তার স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করছে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এর মধ্যে ‘আন নাবিয়্যীন’ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, চাই তারা শরীয়তের অধিকারী হন বা না হন। এমনকি, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ঐ ব্যক্তির দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করছে, যে শরীয়ত বিহীন নবীগণের আগমন এখনও সম্ভব বলে মনে করে। তাই, সে বলছে: ‘মহিউদ্দিন আরবী লিখেছেন, শরীয়ত সম্পন্ন নবুয়্যত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দ্বারা বন্ধ হয়ে গেছে, তবে শরীয়ত বিহীন নবুয়্যত বন্ধ হয়নি।’ কিন্তু আমি গোলাম বিশ্বাস করি যে, সকল প্রকার নবুয়তের দ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-হিকমে প্রচারিত এবং ১০ এপ্রিল ১৯০৩ সালে প্রকাশিত।) আমি জানি না, এত কিছুর পর ভন্ডনবী ও কাদিয়ানীরা কেমন করে এ কথা বলতে দুঃসাহস করে যে, খাতামুন নাবিয়্যীনের অর্থ শরীয়তের অধিকারী নবীগণ। এ ছাড়া আমি কাদিয়ানীদের প্রশ্ন করব যে, তারা আল্লাহ তাআলার এ বাণী সম্পর্কে কি বলে: ‘‘তিনি তোমাদেরকে এ নির্দেশ করছেন না যে তোমরা ফেরেস্তা ও নবীগণকে প্রভুরূপে গ্রহণ কর।’’ [১ সুরা আল ইমরান ৮০।] কাদিয়ানীরা কি এ বিশ্বাস করে যে, স্বতন্ত্র শরীয়ত নিয়ে আসেন নি তাদেরকে প্রভুরূপে গ্রহণ করতে দোষ নেই?
এইভাবে তারা আল্লাহ তাআলার এ বাণীরও কি অর্থ গ্রহণ করে: ‘বরং ঐ ব্যক্তির কাজে প্রকৃত কল্যাণ ও ছওয়াব রয়েছে, যে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেস্তা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস রাখে।’ [২ সুরা বাকারা, ১৭৭।] তারা কি শরীয়ত বিহীন নবীগণের প্রতি ঈমান গ্রহণ না করাকে জায়েজ মনে করে? এতে তো তারা রাজি হবে না। কারণ, তারা বলে যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও একজন শরীয়ত বিহীন নবীগণের প্রতি ঈমান গ্রহণ না করা কে জায়েজ মনে করে? এতে তো তারা রাজি হবে না। কারণ, তারা বলে যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও একজন শরীয়ত বিহীন নবী। তা সত্ত্বেও তার উপর ঈমান আনয়ন করা ফরজ এবং যারা তার মিথ্যা নবুওতকে স্বীকার করবে না তারা কাফের। এ কথাটি আমরা দ্বিতীয় প্রবন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি। বাস্তব কথা হল, তারা আল্লাহর বাণীকে একমাত্র তাদের ঘৃণিত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বিকৃত করে। অন্যথায়, এটা স্পষ্ট যে, গোলাম কাদিয়ানী শরীয়ত বিহীন নবুয়তের দাবি করেনি। বরং স্বতন্ত্র শরীয়ত সম্পন্ন নবুওতেরই দাবি করেছে। পঞ্চম প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছি যে, তার উপর ওহী নাজিলের দাবি করেছে। অনুরূপ ভাবে সে একটা স্বতন্ত্র দ্বীন ও শরীয়তের দাবি করেছে। বরং সে তার ঘৃণিত সত্তাকে সকল নবী রাসূলে উপর প্রাধান্য দিয়েছে। অতএব, তাদের পক্ষ থেকে খাতামুন নাবিয়্যীন এর অর্থ কখনও শরীয়ত সম্পন্ন নবী আর কখনও শরীয়ত বিহীন নবী গ্রহণ করা শুধু মুসলমানের সহিত প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নহে।
‘আন-নাবীয়্যীন দ্বারা কতেক নবী বুঝান হয়েছে’ ইবনে আরবীর এই উক্তি দ্বারা কোন কোন কাদিয়ানীর দলীল গ্রহণ করা সঠিক নহে।
প্রথমত: স্বয়ং তাদের ভন্ডনবী ইবন আরবীর উক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, যা আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। সুতরাং তাদের নবী যা অস্বীকার করেছে উহা দ্বারা তাদের দলীল গ্রহণ করা কেমন করে ঠিক হবে?
দ্বিতীয়ত: কাদিয়ানীরাই ইবন আরবীর উক্তির উদ্ধৃতি প্রদানে ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা করছে। কেননা তারা ভালকরে জানে যে, ইবন আরবী শরীয়ত সম্পন্ন নবী এবং শরীয়ত বিহীন নবী বলে কোন পার্থক্য করেননি। বরং তাঁর মতে নবী মাত্রই শরীয়তের অধিকারী ব্যক্তি। সুতরাং যে ব্যক্তি তাবলীগ করে এবং তাঁর কাছে যে ওহী আসে উহার ঘোষণা দেয়, ইবন আরবীর মতে সে শরিয়তধারী নবী। আর যার কাছে শুধু ইলহাম আসে কিন্তু তিনি ইলহামের কথা প্রচার করেন না, তিনি ওলী। তাকেই ইবন আরবী বাড়িয়ে নবী বলে ফেলেছেন। ‘আল ইয়াওকীত’ গ্রন্থের লেখক বলেছেন: তাদের (প্রকৃত ও রূপক নবীর) মধ্যে পার্থক্য হল- নবী ঐ ব্যক্তি যার কাছে যখন জীবরাঈল ফেরেস্তা কিছু প্রেরণ করেন আর তিনি এটাকে নিজের জন্য খাছ মনে করেন এবং অপরের কাছে প্রচার করাকে হারাম মনে করেন। অতঃপর যদি তাকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, পৌঁছে দাও যা তোমার কাছে অবতীর্ণ করা হয়েছে, তখন এই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে রাসূল বলা হবে। আর, যদি নবী কোন হুকুমকে এমনভাবে নিজের জন্য খাছ না করেন যে, তাহা অন্যের জন্য প্রযোজ্য হবে না, তবে তিনি রাসূল, নবী নন। অর্থাৎ এর দ্বারা শরিয়তধারী নবুয়্যত বুঝায় যা ওলীগণ হাসেল করতে পারে না। (আল-ইয়াওকীত আল-জাওয়াহীর’ যা মুহাম্মদিয়া পকেট বুক থেকে উদ্ধৃত।)
ইবনুল আরবী বলেন: নবী যে গুণের দ্বারা খাছ, ওলীর মধ্যে সে গুণ হতে পারে না, তা হল শরীয়ত সম্পর্কে ওহী লাভ করা । সুতরাং নবী ও রাসূল ব্যতীত কেহ শরীয়ত লাভ করতে পারে না। (ইবন আরবীর ফতুহাতে মক্কিয়া’) মোটকথা, ইবন আরবী প্রমুখ ছুফিগণ এ আক্কিদা রাখেন না যে, প্রকৃত নবুয়্যত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর বিদ্যমান আছে। বরং তারা নবুয়্যত শব্দ দ্বারা এমন বেলায়েত উদ্দেশ্য করেছেন, যার তাবলীগ করা অপরের কাছে হারাম। এ ধরনের নবুয়্যত কি কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্য এবং এ অর্থেই কি তারা গোলাম আহমদের নবুওতে বিশ্বাসী? অথবা অন্য কি অর্থ তারা গ্রহণ করে?
তৃতীয়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এর অর্থ ‘লা নাবিয়্যা বা’দী’ দ্বারা ব্যাখ্যা করার পর কারো জন্য জায়েজ নহে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সুস্পষ্ট বাণীকে ত্যাগ করে মানুষের অস্পষ্ট ও বিভিন্ন অর্থের সম্ভাব্য উক্তি দ্বারা দলীল পেশ করা, যা ইসলামে হুজ্জতও নহে এবং খাঁটি ধর্মের সনদও নহে। এই দেখুন স্বয়ং বিশ্বাসী ও সত্যবাদী রাসূল স্পষ্ট করে বলছেন:- অষ্টম হাদীস- নবুয়্যত ও রেসালত বন্ধ হয়ে গেল। সুতরাং আমার পর আর কোন নবীও নেই এবং কোন রাসূল ও নেই।’ [১ তিরমিজী এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন, আহমদ তাঁর মুসনাদেও এই হাদীস বর্ণনা করেছেন।]
এই হাদীসটিকে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার পুস্তক তুহফায়ে বাগদাদ এর ৭ম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছে এবং এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে: আমাদের নবী যিনি সর্বশেষ নবী তাঁর পরে আল্লাহ তাআলা আর কোন নবী প্রেরণ করবেন না। আর নবুয়তের ধারা বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় নতুন করে উহা চালু করবেন না’ (গোলাম কাদিয়ানীর মেরআতু কামালাতে ইসলাম’ ৩৭৭ পৃ:) কাদিয়ানীরা যে বলে, নবীগণ দ্বারা কতেক নবী উদ্দেশ্য, সকল নবী নহে। দলীলরূপে তারা আল্লাহ তাআলার এই বাণীকে গ্রহণ করে:
وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ( البقرة 61)
তারা নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। [১ সুরা বাকারা, ৬১।] অর্থাৎ ইহুদীরা কতেক নবীকে হত্যা করেছে। এ কথাটিও তাদের মিথ্যাচারিতার প্রমাণ। কারণ, এ স্থানে আন-নাবিয়্যীন এর আলিফ ও লাম হরফ দ্বয় আহ্দী বা নির্দিষ্ট অর্থ জ্ঞাপক, ব্যাপক অর্থবোধক নহে। এ কথাটি বোঝাচ্ছে আল্লাহ তাআলার এই বাণী: তারা নবীগণের এক জামাতকে মিথ্যা বলে আর এক জামাতকে হত্যা করে। [২ সুরা বাকারা, ৮৭।] তাছাড়া কতেক নবী বলতে শরিয়তধারী নবীগণ উদ্দেশ্য নহে। যাতে তারা বলতে পারে যে, ইহুদীরা শুধু শরিয়তধারী নবীগণকে হত্যা করত এবং শরীয়ত বিহীন নবীগণকে হত্যা করত না। এ কথার উপরও কোন দলীল নেই।
বাহায়ীগণ আল্লাহ তাআলার বাণী: ‘‘বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী’’ সম্পর্কে বলে যে, এখানে খাতাম অর্থ সৌন্দর্য। তাই, আয়াতের মর্ম হল এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীগণের জন্য অঙ্গুলির মধ্যে আংটির সৌন্দর্যের মত। বাহায়ীদের অসৎ অনুসারী কাদিয়ানীরা ও এই অপ-ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে। [৩ নজীর কাদিয়ানীর আল-কাউলুস সারীহ-দ্রষ্টব্য।] এ উক্তিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি প্রকাশ্য অবমাননা করা হয়েছে। কেননা, তাঁকে পরিধেয় অলংকারের মালিক ও উহার পরিধানকারীর মোকাবিলায় অলংকারের কোন মূল্য নেই। বরং সেই অলংকার কিনে, পরিধান করে এটাকে খুলে দেয়। সেই অলংকার আঙুলে পরিধান করে সম্মানিত করে, অলংকার তাকে সম্মানিত করে না। সুতরাং এতে মহান রাসূলের জন্য কোন ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয় না। অথচ আল্লাহ তাবারকা ওতাআলা এ শব্দটিকে প্রশংসার স্থলে উল্লেখ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ফযিলত ও সম্মানের কথা স্পষ্টকরে বর্ণনা করেছেন।
নবম হাদীস- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আমাকে ছয়টি গুণের দ্বারা সকল নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। আমাকে এমন ভাষা দান করা হয়েছে, যার শব্দ কম কিন্তু অর্থ ব্যাপক, আমাকে রুউব (সশ্রদ্ধ ভয়) দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করে দেয়া হয়েছে, আমার জন্য সমস্ত জমীনকে মসজিদ এবং পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমার দ্বারা নবীগণের আগমন সমাপ্ত করা হয়েছে। [৪ মুসলিম।]
এ কারণেই সমস্ত মুসলিম জাতি এ কথার উপর ঐক্যবদ্ধ যে, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই সর্বশেষ নবী, তাঁর পরে আর কোন নবী নেই। তাঁর পরে যদি কেহ নবুয়তের দাবিকরে, তবে সে কাফের ও দাজ্জাল। এমনিভাবে যে কেহ এ আকীদা রাখে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা নবুয়্যত শেষ হয়নি, সেও কাফের এবং স্বচ্ছ মুসলিম উম্মত থেকে বহির্ভূত। কাজী আয়াজ ‘ইজমার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- যে ব্যক্তি খাতামুন নাবিয়্যীন এর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে না সে কাফের। তার স্পষ্ট বক্তব্য হল এই: যে, সকল লোক আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে অথবা পরে কারো নবুয়তের দাবিকরে, যেমন ইহুদীদের মধ্যে ঈসায়ী সম্প্রদায় বলে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেসালত আরবের জন্য খাছ, এমনিভাবে, হিজমিয়া সম্প্রদায় বলে যে, রাসূল আগমনের ধারা বিদ্যমান রয়েছে, তবে তারা সকলেই কাফের ও মিথ্যুক। কেননা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়ে গেছেন যে, তিনি সর্বশেষ নবী তাঁর পরে কোন নবী নেই। আর আর আল্লাহ তাআলাও সংবাদ দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ সর্বশেষ নবী এবং সমস্ত মানব জাতির জন্য প্রেরিত। মুসলিম জাতি একমত যে, এ বাক্যটির বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে। কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ব্যতীত এর স্বাভাবিক মর্মই উদ্দেশ্য। সুতরাং অকাট্য দলীল প্রমাণ ও এজমা দ্বারা এদের কাফের সাব্যস্ত হওয়াতে কোন সন্দেহ নেই। (কাজি আয়াজের আশ-শিফা।)
দশম হাদীস উপরোক্ত সব উল্লেখের পর অবশিষ্ট হাদীস গুলোকে আমি বর্ণনা করছি, যাতে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দ্বারা নবুয়্যত শেষ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আমি আল্লাহর কাছে ঐ সময় সর্বশেষ নবীরূপে নির্ধারিত, যখন আদম আলাইহিস সালাম তরল মাটির মধ্যে ছিলেন। [১ শরহে সুন্নাহ ও মসনদে আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে মিশকাতুল মাসাবীহের লীখক হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।]
একাদশ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার অনেক নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মদ , আমি আহমদ, আমি মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ কুফর মিটাবেন। আমি হাসীর, যার পদাঙ্ক অনুসরণে কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে একত্র করা হবে। আমি আ’কিব, যার পরে আর কোন নবী নেই। [২ বুখারী ও মুসলিম।] অপর এক রেওয়ায়েতে আছে- আমি ঐ আ’কিব যে, আমার পর আর কোন নবী নেই। [৩ তিরমিযি।] উক্ত হাদীস স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ‘আমি আ’কিব’। অতঃপর নিজেই এর ব্যাখ্যা করেছেন- ‘আ’কিব ঐ ব্যক্তি যার পর আর কোন নবী নেই’। কিন্তু কাদিয়ানীরা যখন এ স্পষ্ট বক্তব্য দেখতে পেল, তখনই তারা তাদের অসৎ অভ্যাসের আশ্রয় নিল। আর, তা হল কুরআন হাদীসের পরিবর্তন ও বিকৃতি করা । তারা বলে: আ’কিব শব্দের ব্যাখ্যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি। বরং তা কোন বর্ণনাকারী করেছেন।’ (নজীর আহমদ কাদিয়ানীর আল-কাওলুস সারীহ’ ১৮৭ পৃ:।) কাদিয়ানীরা তাদের অজ্ঞতার কারণে তিরমিযীর রেওয়ায়েত সম্পর্কে অবহিত নহে। উহাতে উত্তম পুরুষের ভাষায় ব্যাখ্যা রয়েছে, ‘আমি ঐ শেষ আগমনকারী যে আমার পর আর কোন নবী নেই।’ [৪ তিরমিযি ২য় খন্ড, ১৩৭ পৃঃ। মিশর সংস্করণ ১২৯২ হিঃ।] এ ব্যাখ্যা আদৌ এ কথার সম্ভাবনা রাখে না যে, কোন বর্ণনাকারী উহার ব্যাখ্যা করেছেন। এর ভাষ্য হল: আমিই খাতাম আমার দ্বারা নবুওতকে শেষ করা হয়েছে এবং আমিই আ’কিব সুতরাং আমার পরে আর কোন নবী নেই। [১ ইবন হাযার আসকালানীর আল-ইসাবাত গ্রন্থের হাসিয়া যা ইবন আব্দুল বার আল-ইন্তিখাব নামে রচনা করেছেন। ১ম খন্ড, ৩৭ পৃঃ মিশর সংস্করণ।]
অনুরূপভাবে কাজী আয়াজ উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন- আমিই আ’কিব যে আমার পর আর কোন নবী নেই।’ [২ কাজী আয়াজের আশ-শিফা ১৯১ পৃঃ ইস্তাম্বুল সংস্করণ।]
এসব উদ্ধৃতির পর কাদিয়ানীদের পক্ষে একথা বলার কোন অবকাশ নেই যে, এ ব্যাখ্যা কোন রাবীর পক্ষ থেকে করা হয়েছে এবং উহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষা নহে। কেননা, আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, এ রেওয়ায়েতটি মুতাকাল্লিমের জমীর (উত্তম পুরুষের সর্বনাম) দ্বারা বর্ণিত। আর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে মুতাকাল্লেমের জমীর দ্বারা বর্ণনা করা সম্ভব নহে। হাদীসের বর্ণনা ভঙ্গিও তা বোঝাচ্ছে। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে বলেছেন: আমি মাহী’ অতঃপর এর ব্যাখ্যা করেছেন- যার দ্বারা আল্লাহ কুফরকে মিটাবেন।’ তারপর বলেছেন আমি হাসীর’ এরপর এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন- আমার পদাঙ্ক অনুসরণে সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে।’ অতঃপর বলেছেন আমি আ’কিব এবং এ ক্ষেত্রেও বলেছেন ‘যার পর আর কোন নবী নেই’। এ কথা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, তিনি নিজেই শেষ আগমন কারীর ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন তিনি মাহী’ ও হাসীর’ এর ব্যাখ্যা করেছেন। মোটকথা, যখন আমরা এ ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণ করে দিলাম, তখন এ ব্যাপারে আর কারো পক্ষ থেকে ইতস্তত: করার অবকাশ নেই যে, ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার নবুয়তের দাবিতে সম্পূর্ণ মিথ্যা।
দ্বাদশ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে রা. সম্বোধন করে বলেছেন আমার কাছে তোমার ঐ মর্যাদা রয়েছে, যেমন মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে হারূণ আলাইহিস সালাম এর মর্যাদা ছিল। কিন্তু পার্থক্য শুধু এতটুকু যে আমার পর আর কোন নবী নেই। [৩ বুখারী ও মুসলিম।]
এ হাদীসটি অতি স্পষ্ট করে বোঝাচ্ছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তবুক যুদ্ধের সময় আলী রা. কে যখন তাঁর পিছনে রেখে মদিনাতে যেতে চাইলেন, তখন আলী রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সাথে জিহাদে শরীক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেন। সেই সময় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন, আমি তোমার মর্যাদাকে খাটো করার জন্য কিংবা তোমার সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য তোমাকে পেছনে রেখে যাচ্ছি না, বরং মদিনাতে তোমাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করছি, যেমন মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর সাক্ষাতে তূর পর্বতে গমনকালে তাঁর ভাই হারূণকে আলাইহিস সালাম স্বীয় কওম দেখা শোনার জন্য স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। এ দু টোর মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই শুধু এই কথা যে, হারূণ আলাইহিস সালাম নবী ছিলেন। কারণ, নবুয়তের ধারা তখন খতম হয়নি। কিন্তু তুমি নবী নও। কারণ নবুয়্যত আমার দ্বারা শেষ হয়ে গেছে এবং আমার পর আর কোন নবী নেই । এ অর্থকেই শক্তিশালী করছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আর একটি বাণী, যা হযরত সা’দ ইবন আবি ওক্কাসের রা. রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আমার পর নবুয়্যত নেই’। [১ মুসলিম।]
এই রেওয়ায়েতটি কাফের মুরতাদ সম্প্রদায়ের উপর একটি চরম আঘাত, যারা আল্লাহর বাণীসমূহ ও রাসূলের বাণীসমূহকে ইহুদীদের ন্যায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে। তারা বলে ‘লা নাবিয়া বা’দী’ বাক্যে ‘লা’ অব্যয়টি ‘নফী কামাল’ (পরিপূর্ণতার না বোধক) অর্থে ব্যবহৃত। ‘নফী জিনস’ (মূল নবুয়তের না বোধক) অর্থে ব্যবহৃত নহে। সুতরাং তাদের মতে বাক্যটির অর্থ হয়- আমার পর স্বয়ং সম্পূর্ণ কোন নবী নেই। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে হারূণের আলাইহিস সালাম উল্লেখ করলেন। অতঃপর ‘লা নাবিয়া বা’দী বললেন। এটা জানা কথা যে, হারূণ আলাইহিস সালাম কোন স্বয়ং সম্পূর্ণ নবী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন মুসার আলাইহিস সালাম অনুগামী একজন নবী।
আসল কথা হল- এই এন্টি দলটি শুধু খতমে নবুওতকে অস্বীকার করতে চাচ্ছে না, বরং এর চেয়ে আরো বেশি কিছু তারা চায়। আর, তা হল- আল্লাহ সুবহানাহু অতাআলার অস্তিত্ব সম্পর্কে কুফরীর দ্বার উদ্ঘাটন করা এবং তাওহীদের বুনিয়াদকে ধ্বংস করে দেয়, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং পূর্বেকার সকল রাসূল স্থাপন করে গেছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী ‘লা নবুওতা বা’দী’ এবং ‘লা নাবিয়া বা’দী’ বাক্যে পরিপূর্ণতার না বোধক অর্থ নির্ধারণ করতে চায়। যাতে এ নীতির ভিত্তিতে তাদের কোন একজন অনুরূপ কথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সম্পর্কেও বলতে পারে আমাদের ঐ উদ্ধৃতি এ কথাকেই সমর্থন করছে যা আমরা তাদের থেকে আল্লাহ তাআলার সাথে মানানসই নয় এমন অসমীচীন গুণ সম্পর্কে পঞ্চম প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। মোটকথা, কাদিয়ানী নেতা ও ভন্ডনবী স্বীকার করেছে. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি ‘লা নাবিয়া বা’দী’ এর ‘লা’ অব্যয়টি ব্যাপক নফীর জন্য, ‘নফী কামালের জন্য নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আইয়েমে সুলাহ’ ১৪৬ পৃ:।))কোন কোন কাদিয়ানী এই উক্তি করেছে যে, উক্ত হাদীসে নফী আলী রা. এর জন্য খাছ। এটা আরবী ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সত্যের মোকাবেলায় শুধু হটকারিতা বৈ আর কিছু নয়। কেননা, আরবী ভাষা সম্বন্ধে যার সামান্যতম ধারণা আছে, সে বুঝতে পারে যে, এর দ্বারা সাধারণ ভাবে না বেধক অর্থ উদ্দেশ্য। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- ‘আমার কাছে তোমার ঐ মর্যাদা রয়েছে যে মর্যাদা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে হযরত হারূণ আলাইহিস সালাম এর ছিল, কিন্তু পার্থক্য হল শুধু এতটুকু যে, আমার পর কোন নবী নেই।’ অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘আমার পর নবুয়্যত নেই।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো একথা বলেন নি যে, আমার পর তুমি নবী নও।
ত্রয়োদশ হাদীস- আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন: ‘নবুয়তের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, রয়েছে একমাত্র সুসংবাদ’। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন সুসংবাদ কি? উত্তর দিলেন, ‘সৎ স্বপ্ন’। [২ বুখারী।]
এই হাদীসের অর্থ অতি স্পষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে আর কোন নবী নেই এবং কোন নবুওতও নেই। কাদিয়ানী ও তাদের সাথী মুরতাদ দল দলীল পেশ করে যে, কোন কোন হাদীসের কিতাবে আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যদি ইব্রাহীম জীবিত থাকতেন তা হলে তিনি সত্যবাদী নবী হতেন।’ (আল-কাওলুস সারীহ’ এবং আহমদীয়া পকেট বুক)’ কয়েকটি কারণে তা ঠিক নহে এগুলো আমি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। কেননা, তারা এ রেওয়ায়েতের পাশেই ভ্যান ভ্যান করে ঘুরপাক খাচ্ছে, বিশেষকরে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়তের ধারা এবং রাসূল আগমনের ছিলছিলাকে প্রমাণ করার জন্য। অথচ এতে এমন কোন দলীল ও প্রমাণ লাভের অবকাশ নেই।
প্রথমত: এ হাদীস বিশুদ্ধ নহে। আল্লামা নববী ও অন্যান্যরা এর বিশ্লেষণ করেছেন। কারণ, উক্ত হাদীসের সনদে ইব্রাহীম ইবন উসমান মুহাদ্দিসগণের ঐক্যমত অনুযায়ী দুর্বল। তার সম্পর্কে শু’বা বলেছেন: মিথ্যুক, ইমাম আহমদ বলেছেন: ‘দুর্বল’ ইবন মুঈন বলেছেন: বিশ্বস্ত নহে, এবং নাসায়ী বলেছেন: বর্জিত। [১ ইমাম জাহাবীর মিযানুল এ ’তেদাল।] সুতরাং এ সকল মতামতের পর আর এই হাদীসের দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না।
দ্বিতীয়ত: যদি এ হাদীস ঠিক মেনেও নেওয়া যায় তবুও তা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খতমে নবুয়তের পরিপন্থী নহে। কারণ, এর অর্থ হল ইব্রাহীম যদি বাঁচতেন তা হলে তিনি সত্যবাদী নবী হতেন, কিন্তু তাঁর জন্য বেঁচে থাকা সম্ভব পর ছিল না। কেননা, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খতমে নবুয়্যত তাঁর বাঁচার জন্য প্রতিবন্ধক ছিল। আর এটাই হাফেজ ইবনে হাজার ইমাম আহমদের রেওয়ায়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমদ তাঁর মাসনদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন: ‘যদি ইব্রাহীম জীবিত থাকতেন, তা হলে
নবী হতেন, কিন্তু, তিনি জীবিত থকতে পারেন নি। যেহেতু তোমাদের মধ্যেই রয়েছে সর্বশেষ নবী।’ [২ ফতহুল বারী ইবন হাজার।] এটাকে সমর্থন করছে ঐ হাদীস যা ইমাম বুখারী রা. ইবন মাযা ও অন্যান্যরা ইবন আবু আওফা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন: ইব্রাহীম শিশু অবস্থায় মারা গেলেন। যদি হযরতের পর আর কোন নবী হওয়া সম্ভব হত, তবে তাঁর পুত্র অবশ্যই জীবিত থাকতেন । কিন্তু তাঁর পরে তো কোন নবী নেই।’ [৩ বুখারী ও ইবন মাযা।]
তৃতীয়ত: উক্ত হাদীসে ‘লাও’ অব্যয়টি শর্তের জন্য। আর, শর্তযুক্ত বাক্য প্রথম অংশের বাস্তবায়ন অপরিহার্য করে না। তাই এ উক্তি আল্লাহ তাআলার ঐ বাণীর মতই (যদি আসমান ও জমীনে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ হতেন, তবে উভয়টি বিনষ্ট হয়ে যেত) [৬ সুরা আম্বিয়া ২২।] অর্থাৎ অন্য কোন মাবুদও নেই। কাজেই আসমান ও জমিন বিনষ্টও হবে না এমনিভাবে ইব্রাহীম ও জীবিত থাকবেন না এবং কোন নবীও আসবেন না। মোটকথা, এ হাদীসটিও জোরালোভাবে প্রমাণ করছে যে, নবুয়্যত বিশ্বস্ত সত্যবাদী নবীর উপর শেষ হয়ে গেছে। কাফের মুরতাদগণ যেভাবে ধারণা করছে তা ঠিক নহে। এদিকেই মহান ও সম্মানের অধিকারী আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন- আল্লাহর বাণী: ‘আজকের দিন আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত চূড়ান্ত ভাবে সম্পন্ন করে দিলাম। আর ইসলাম কে তোমাদের দ্বীন রূপে মনোনীত করলাম।’ [১ সুরা মায়েদা ৩।] আল্লাহর বাণী: ‘হে রাসূল, আপনি বলুন, হে মানব জাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর রাসূল।’ [২ সুরা সাবা ২৮ ।] আল্লাহর বাণী: আমি কেবলমাত্র আপনাকে সকল মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শন কারি রূপে প্রেরণ করেছি।’ [৩ সুরা আহযাব।] এরূপ অনেক আয়াত রয়েছে। এজন্যই গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তাকে কাফের সাম্রাজ্যবাদীরা আজ্ঞাবহ করার পূর্বে বলেছিল: আল্লাহ তাআলা স্বীয় উক্তি এর মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে,নবুয়্যত হযরত মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর শেষ হয়ে গেছে এবং তিনিই সর্বশেষ নবী।’ (গোলাম কাদিয়ানীর তোহয়ায়ে গড়লিয়া’ ৮৩ পৃ:।)
চতুর্দশ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: যদি আমার পর কেহ নবী হতেন তা হলে তিনি হতেন ওমর।’ [৪ তিরমিযি।]
এ হাদীসটিও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়্যত শেষ হওয়ার পক্ষে স্পষ্ট দলীল। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় যে দলটি তাদের অনুকরণ ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন পদ্ধতি ছেড়ে দিয়েছে, আর, বিশ্বাস ঘাতক সাম্রাজ্যবাদের আঁচল আঁকড়ে ধরেছে, তারা যখনই কোন সুস্পষ্ট বাণী দেখতে পায় তখনই তা অস্বীকার করে বসে। শুধু অস্বীকারই করে না, ইহুদীদের ন্যায় এটাকে বিকৃত এবং মিথ্যার রূপই দান করে। যদিও নিয়মানুযায়ী তাদের উপকারে আসে না বা অভিধান কিতাবাদী তাদের সহায়তা করে না। তাদের এ ধরনের একটি নিকৃষ্ট ফন্দি হল উক্ত হাদীসকে অস্বীকার করার জন্য তারা বলে: ‘& হাদীসটি গরিব’ উহা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না’। তারা আরো বলে, বা’দী শব্দের বিপরীত নহে। সুতরাং ইহা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর কোন নবী নেই।’ এই কথার দলীল হতে পারে না। (আল কওলুস সারীহ’ ১৮৪ পৃ:।)
এ সমস্ত কথা বলেছে জিন্দিক ও মুরতাদগণ। এদের বক্তব্যের অর্থহীনতার প্রতি লক্ষ করুন । প্রথমত: এদের উক্তি- ‘গরীব হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না’। এটা হাদীস মুহাদ্দীছগণের পরিভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নহে। কেননা, হাদীছ গরীব হওয়াতে উহা অভিযুক্ত হয় না এবং এটাকে দুর্বল করে না। এই সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা দিচ্ছেন হাদীসের ইমাম ও পরিভাষা-বিদ-গণ। যথা: ইমাম ইবন সালাহ, হাকিম, খতীব আসকালানী প্রমুখ, ‘উলুমুল হাদীস, ‘মারেফাতু উলুমুল হাদীস, গরাবাতের সাথে দুর্বলতা ও সবলতার কোন সম্পর্ক নেই। এর উদাহরণ হল বুখারীর প্রথম হাদীসঃ إنما
الأعمال بالنيات
এটা গরিব হাদীস। অথচ এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই যে, উহা বিশুদ্ধ হাদীস, উহা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া তিরমিজি স্বয়ং স্পষ্ট করে বলেছেন যে, এ হাদীসটি হাসান। আর, হাসান মকবুলের অন্তর্ভুক্ত। এইভাবে এদের উক্তি ‘বা’দ (পরে) শব্দটির অর্থ ‘গায়ের’ (ব্যতীত) গ্রহণ করা, এটা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উক্তি ছাড়া আর কিছুই নহে। অন্যথায়, আরবী ভাষার কোন অভিধানে ‘বা’দ’ এর অর্থ গায়ের পাওয়া যায় নি যে, তারা এ শব্দকে ভিন্ন ও বিপরীত অর্থে ব্যবহার করছে। কাদিয়ানীরা আল্লাহ তাআলার বাণী:
فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَ اللَّهِ وَآَيَاتِهِ يُؤْمِنُونَ ﴿6 الجاثية﴾
দ্বারা যে দলীল পেশ করছে যে, উক্ত আয়াতে বা’দ শব্দটি গায়ের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এটা তাদের অজ্ঞতা ও স্বল্প জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। তারা যে আরবী ভাষার জ্ঞান থেকে বহু দূরে, তাই বোঝাচ্ছে। কেননা, আরবরা অধিকাংশ স্থানে (মুজাফইলাইহি) কে লোপ করে উহার স্থানে দ্বিতীয় মুজাফ ইলাইহিকে বসিয়ে থাকে। এটা ঐ সকল ব্যক্তিই বুঝতে পারে, যাদের আরবী ভাষা সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রয়েছে। বা উহার প্রাথমিক বিষয়াদি পড়াশোনা করেছে। এ ধরনেরই একটি বাক্য হল মহান আল্লাহর বাণী:
فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَ اللَّهِ وَآَيَاتِهِ يُؤْمِنُونَ
অর্থাৎ (আল্লাহর বাণী তথা কুরআন ও এর আয়াত সমূহের পর আর কোন কথার প্রতি তারা বিশ্বাস রাখে?) এভাবেই স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন মুফাস্সেরগণের ইমাম ইবন জারীর, ইমাম সয়ূতী, আবুস সুউদ, জমাখশারী ও বায়জাভী প্রমুখ আল্লামাগণ। ঠিক এই অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন খাজেন ও নাসাফী। তাঁরা বা’দ শব্দের পরে কালামুল্লাহ ঊহ্য ধরে বলেছেন:(আল্লাহর পর অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর আয়াতের পর ওরা কোন বাণীর প্রতি বিশ্বাস রাখবে।) [১ সুরা জাছিয়া ৬।] (মায়ালেম ও মাদারেক।) এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরবদের কথা-বার্তায় অনেক। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমের দোয়ায় বলেছেন: أنت الآخر فليس بعدك شيء
(তুমিই শেষ তোমার পর আর কিছু নেই) [২ মুসলিম।] মুল্লা আলী ক্বারী এর অর্থ সম্পর্কে বলেন-অর্থাৎ: أي بعد آخريتك (তোমার শেষত্বের পর আর কিছু নেই।) [৩ মিরকাত. ৩য় খন্ড, ১০৮ পৃঃ।] এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি ‘আমার পর কোন নবুয়্যত নেই। [৪ মুসলিম।] এর অর্থ-.
অর্থাৎ আমার নবুয়তের পর আর কোন নবুয়্যত নেই’।
আমরা অন্যভাবে বলি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ হাদীস নবুয়্যত শেষ হওয়ার উপর অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ, অন্য হাদীস একে শক্তিশালী করছে, যার মধ্যে বা’দ শব্দের উল্লেখ নেই। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘আমি হলাম শেষ নবী।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আরো একটি উক্তি: নবুয়্যত আর অবশিষ্ট নেই কেবলমাত্র সুসংবাদ ব্যতীত। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন-সুসংবাদ কি? উত্তর দিলেন- সৎ স্বপ্ন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অপর একটি উক্তি: রেসালত ও নবুয়্যত শেষ হয়ে গেছে। [১ ইহার আলোচনা পূর্বে চলে গেছে।] এ সকল হাদীস সহ আরো অনেক হাদীস স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, বা’দ এর অর্থ শেষে হওয়া এবং শেষ। এ অর্থ অতি স্পষ্ট।
আর কাদিয়ানীদের উক্তি যে, বা’দ শব্দটি ‘গায়ের’ অর্থে ঐ রেওয়ায়েতের মধ্যে ব্যবহার হয়েছে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করা হয়, তিনি বলেছেন: ‘যদি আমাকে প্রেরণ করা না হত, তা হলে হে ওমর তোমাকে প্রেরণ করা হত।’ (আল- কওলুস সরীহ’ এবং আহমদিয়া পকেট বুক।’) এটা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা, কাদিয়ানীরা এ রেওয়ায়েতকে মিরকাত থেকে উদ্ধৃত করেছে, আর, মিরকাতের লেখক এর সনদ উল্লেখ করেন নি। এ কারণে রেওয়ায়েতটি অজ্ঞাত। ‘শেখ আব্দুল্লাহ মে’মার উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল শব্দে উক্ত রেওয়ায়েতটি হাদীসের কোন কিতাবে পাওয়া যায় না। সম্ভবত: মোল্লা আলী ক্বারী এ রেওয়ায়েতটিকে অপর রেওয়ায়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন যার শব্দাবলি হল- যদি আমাকে প্রেরণ করা না হত, তবে অবশ্যই তোমাদের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করা হত। আর ওমর রা. কেই তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করা হত’। [২ মানাবীর ‘কুনুজুল হক’।] অথবা এটা নিম্নোক্ত রেওয়ায়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন ‘যদি আমি প্রেরিত না হতাম তা হলে আমার পর ওমর রা. কে প্রেরণ করা হত’। [৩ কুনুজুল হক।]
কিন্তু এত সত্ত্বেও উহা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না। কারণ, এ দুটি রেওয়ায়েত দুর্বল এবং বানোয়াট।
প্রথম রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করেছেন ইবনুল জাওযী তাঁর কিতাব ‘মাওযুয়াত’ এর মধ্যে দুটি সনদে। প্রথম সনদের মধ্যে একজন রাবী যার নাম জাকারিয়া ইবন ইয়াহইয়া ওক্কার, সে মিথ্যুক ও হাদীস রচনাকারী। ইবনুল জাওযী বলেছেন: ‘জাকারিয়া মিথ্যুক, সে হাদীস রচনা করে।’ (মাওজুয়াত) জাহবী তাঁর আল-মীজান গ্রন্থে বলেছেন: ইবন আদী বলেছেন: ‘জাকারিয়া হাদীস রচনা করে।’ সালেহ বলেছেন: ‘সে বড় মিথ্যুকদের একজন ছিল।’ [৪ জাহাবীর মীজানুল এতেদাল।] এ রেওয়ায়েতের দ্বিতীয় সনদে একজন রাবীর নাম আ্দুল্লাহ ইবন হেরানী তার সম্পর্কে ইবন জাওযী বলেছেন: ‘সে বর্জিত।’ [৫ মাওজুয়াত।] আর, জাহাবী ইয়াকুব ইবন ইসমাঈল থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, ইবন ওয়াকেদ মিথ্যাবাদী ছিলেন।’ [৬ জাহাবীর মীজানুল এতেদাল।]
এ কারণেই, ইবন জাওযী এ রেওয়ায়েতকে উভয় সনদের দিক থেকে মওযু বলেছেন। আর, দ্বিতীয় রেওয়ায়েত অর্থাৎ ‘যদি আমি প্রেরিত না হতাম তা হলে অবশ্যই আমার পরে ওমরকে রা. প্রেরণ করা হত।’ উহাতে ইসহাক ইবন নুজাইহ মালতী নামে জনৈক রাবী রয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে জাহাবী তাঁর পুস্তক ‘আল-মীজানে’ ইমাম আহমদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন- আহমদ বলেছেন যে, সে লোকজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। ইয়াহইয়া বলেছেন, সে মিথ্যাবাদী ও হাদীস রচনার কাজে প্রসিদ্ধ। [৭ মীজান।] এজন্য ইবন জাওযী বলেছেন: এ রেওয়ায়েতটিও মওযু (বানোয়াট) [১ মওজুয়ত।] মোটকথা, এ উভয় রেওয়ায়েতই মওযু। এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা সঠিক নহে এবং এর দ্বারা হুজ্জতও প্রমাণিত হয় না। তাই বা’দ শব্দের অর্থকে বিকৃত করার মধ্যে তাদের চক্রান্ত নিহিত রয়েছে, যে চক্রান্ত ইহুদীরা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য করে যাচ্ছে।
পঞ্চদশ হাদীস- এরপর আমি আর একটি হাদীস উল্লেখ করব। তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘হে আবু জর! সর্ব প্রথম নবী আদম আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। [২ ইবন হিববান তাঁর সহীহ কিতাবে এবং আবু নাঈম হুলিয়া কিতাবে বর্ণনা করেছেন, আর ইবন হাজার ফতহুল বারী কিতাবে উহাকে সহীহ বলেছন] এ সকল বিশুদ্ধ হাদীস এবং কুরআনে স্পষ্ট ভাষ্য অকাট্য ভাবে প্রমাণ করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। আর, যে ব্যক্তি তার পরে নবুয়তের দাবি করবে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মিথ্যুক ও দাজ্জাল। ইমাম ইবন কাসীর র. বলেছেন: ‘বান্দার প্রতি আল্লাহর অসীম মেহেরবানি যে, তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাদের প্রতি প্রেরণ করেছেন। অতঃপর তাঁকে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে সম্মানিত করেছেন। আর, তাঁরই সম্মানে খাঁটি দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন।’ আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিশুদ্ধ হাদীসে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর পর আর কোন নবী নেই, যাতে সকল মানুষ জানতে পারে যে, যে কেহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর ঐ পদবির দাবি করবে, সে মিথ্যুক, অপবাদদাতা, দাজ্জাল, বিভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী। যদিও তাদের কেহ আগুন দিয়ে খেলে এবং বিভিন্ন প্রকার যাদু মন্ত্র ও ম্যাজিক দেখায়, তবুও বুদ্ধিমান লোকের দৃষ্টিতে এ গুলো প্রতারণা ও ধোঁকা ব্যতীত কিছুই নহে। যেমন করে মহান আল্লাহ ত’আলা ইয়ামেনে আসওদ আনাসীর হাতে এবং ইয়ামামাতে মুসাইলামা কাজ্জাবের হাতে অনেকগুলো বিভ্রান্তিকর অবস্থা ও বাজে উক্তি সমূহ প্রকাশ করান। এ গুলো দেখে প্রত্যেক বুদ্ধিমান, বোধশক্তি সম্পন্ন ও যোগ্য লোক বুঝে নেয় যে, এরা মিথ্যুক। এদের উপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা মিথ্যা নবুয়তের দাবি করবে, তাদের সকলের উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ। সুতরাং এ সকল মিথ্যুকদের কারো কারো কাছে আল্লাহ তাআলা এমন অবস্থা সৃষ্টি করেন যা দেখে আলেমগণ ও মোমিন বান্দাগণ এদের মিথ্যা দাবি অনুধাবন করে নিতে পারেন। [৩ তাফসীরে ইবন কাসীর, ৩য় খন্ড ৪৯৪ পৃঃ মিশর সংস্করণ।] এ সমস্তের পর অর্থাৎ পূর্বে আলোচিত সত্যকে অনুধাবন করার পর এবং কুরআন হাদীস ও আরবী ভাষা নিয়ে কাদিয়ানীদের খেলা করার ব্যাপারে অবহিত হওয়ার পর আর তাদের অমূলক বিকৃতি, সারশূন্য ব্যাখ্যা বলী, নিকৃষ্ট উক্তি ও সস্তা জ্ঞান শূন্য আকীদা বিশ্বাসের পর আমি তাদের আরো কিছু বিকৃতির কথা উল্লেখ করতে চাই, যদ্দারা তারা দলীল গ্রহণ করতে চায় যে, নবুয়তের ধারা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। ফলে এ প্রবন্ধটি ওদের সমস্ত চক্রান্ত এবং বিভ্রান্তির এটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে পারবে এবং পাঠক ওদের স্বভাবগত ঘৃণিত অবস্থা ও গোপন দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে।
কাদিয়ানীরা বলে- আল্লাহ তাআলার বাণী: ‘যারা আল্লাহ ও রাসূলের কথা মেনে চলবে, তারা পরকালে ঐ সকল লোকদের সাথে থাকবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এরা হলেন- নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল লোকগণ। আর, তারা কতই না উত্তম সাথী! [১ সূরা নিসা, ৬৯ আয়াত।]
এই আয়াত প্রমাণ করছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়তের ধারা চালু আছে। (কাদিয়ানী পুস্তক আল-কাওলুস সারীহ’ ১৯৭ পৃ: এবং আহমদিয়া পকেট বুক ৫০০পৃঃ ইত্যাদি।)
আরবী ভাষার সাথে যার সামান্যতম সম্পর্ক আছে অথবা যে উহার শব্দাবলির অর্থ বুঝে, তার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়তের ধারা চালু থাকার উপর দলীল গ্রহণ করা সম্ভব। কারণ, উক্ত আয়াতের মধ্যে এ অর্থের প্রতি সামান্যতমও ইঙ্গিত নেই। কিন্তু কাদিয়ানীরা এবং যারা তাদের সাথে শয়তানের পথ অনুসরণ করে চলেছে, তারা এ পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাতে দুঃসাহস করেছে। এমনকি, তারা তাদের মিথ্যা নবীর নীতি ধরে শয়তানের ওহীর সাহায্যে ইসলামের নামে জনসাধারণকে প্রতারিত করার জন্য পরাক্রমশালী এক আল্লাহর পবিত্র কালাম পরিবর্তন করতে লজ্জাবোধ করেনি।
অতএব, তারা কুরআন ও হাদীসের সকল বাণী এবং আইম্মায়ে তাফসীর ও ভাষাবিদদের মতামতের বিপরীত বলে: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা মেনে চলে সে নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেক্কার গণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।’ হ্যাঁ এ সব কথা বলছে, কুরআনের অস্বীকার কারী আল্লাহর শত্রু ও তাঁর রাসূলের শত্রু এবং ইসলামের শত্রু বিশ্বাসঘাতক সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা, যারা একজন আফিমখোর মদ্যপায়ী ইংরেজদের সেবাদাস ব্যক্তির নবুয়্যত প্রমাণ করতে চায়। অথচ, আয়াতের অর্থ অতি স্পষ্ট। আর তা হল এই ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তারা নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককারগণের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে।’ এ জন্যই আল্লাহ তাআলা এর পরেই বলেছেন: ‘আর তারা কতই না উত্তম সাথী।’ অন্যথায় এদের উক্তি থেকে কতকগুলো বিষয় অপরিহার্য হয়ে পড়ে: প্রথমত:- নবুয়্যত উপার্জন উপযোগী বস্ত্ত, দান গত বস্ত্ত নহে। আর যে কেহ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, সে নবী হতে পারবে। ইহা কুরআনের স্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীত। আল্লাহর বাণী: ‘আল্লাহ ফেরেস্তাদের মধ্যে এবং মানুষের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকেই রাসূল মনোনীত করেন।’ [২ সুরা হাজ্জ।]
দ্বিতীয়ত:- যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবে, তাদের নবী হওয়া অপরিহার্য হবে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ যাদের প্রশংসা করেছেন মহান আল্লাহ স্বীয় কালামে পাকে। কেননা, আজ পর্যন্ত তাদের তুলনায় আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি অধিক অনুগত আর কাইকে পাওয়া যায়নি এবং পাওয়া যাবেও না। তাদের পরেই মর্যাদা ও আনুগত্য লাভ করেছেন তাবেয়ীগণ, অতঃপর তাবে তাবেয়ীগণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের কেহ দাবি করেননি যে, তিনি নবী হয়ে গেছেন। কোন ইমামও একথা বলেন নি যে, তাঁরা নবী ছিলেন। এই নীতিতেই মহান আল্লাহ যখন সত্যিকার মুমিনদের কথা উল্লেখ করেছেন তখন তাদের সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহ উপাধি দান করেছেন। আল্লাহর বাণী: ‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারীগণ এবং যারা আল্লাহর নিকট করযে হাসানা পেশ করে, আল্লাহ তাদের প্রতিদান অনেকগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দেবেন। আর যারা আল্লাহ ও তার রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তাঁরা তাদের প্রভুর কাছে সত্যবাদী ও শহীদরূপে পরিগণিত। [১ সুরা হাদীদ-১৮] আল্লাহর বাণী: ‘যারা ঈমানদার এবং সৎকাজ করে আমি তাদেরকে আমার নেকার বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করব।’ [২ সুরা আনকাবুত-৯] আল্লাহ তা’য়ালা এ কথা বলেন নি যে, আমি তাদের নবীগণের অন্তর্ভুক্ত করব। কেননা, নবুয়্যত অর্জন যোগ্য কোন বস্ত্ত নহে। অন্যথায়, ভন্ডনবী কাদিয়ানী শুধু একাই নবী হবে না, বরং যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসারী হবে, তারা সকলেই কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়াই নবী হবেন। এ কথা স্বয়ং কাদিয়ানীরাও বলে না।
তৃতীয়ত:- আল্লাহ তাআলার বাণী: - وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ
)যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে) উহাতে নারী পুরুষ উভয়ই শামিল। তবে মহিলাদেরকে নবী হওয়া থেকে বঞ্চিত রাখা হবে কেন?
চতুর্থত:- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সঙ্গী হবে। [৩ তিরমিযি, দারমী, দারকুতনী ও শিশকাত।] এর অর্থ কি বিশ্বস্ততার দ্বারা নবী হয়েছেন? উপরোক্ত এ হাদীসটি আয়াতের মতই সুদৃঢ়। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবীগণের সঙ্গী হবেন।’ যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘যে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ নবী ও ছিদ্দীকগণের সঙ্গী হবে।’ এর মর্ম হল সত্যবাদী ব্যবসায়ী ব্যক্তি এ সকল মুকাররব (আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী) বান্দাদের সঙ্গ লাভ করবে।
পঞ্চমত:- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর নিকটবর্তী সময়ে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহগণের সঙ্গ লাভের জন্য প্রার্থনা করতেন। [৪ বুখারী ও মুসলিম।] এর অর্থ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্নেহশীল করুণাময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতেন, তিনি যেন তাঁকে এ দুনিয়া থেকে আপন সান্নিধ্যে নিয়ে যান, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককার বান্দাগণের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন। অনুরূপ আরেকবার বলেছেন- (হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ সাথী!) অন্যথায়, নবী সিদ্দিক ও শহীদ হবার প্রার্থনা দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? অথচ তিনি তো পূর্ব থেকেই নবী।
ষষ্ঠত:- মহান আল্লাহর বাণী:-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ( الأحزاب 40)
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নহেন। বরং তিতি আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী।) আল্লাহর বাণী:-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ( المائدة 3)
(আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার করুণা সু-সম্পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীনরূপে পছন্দ করলাম।)
আল্লাহর বাণী: -وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا ( سبأ 28)
(আমি আপনাকে সমস্ত মানব জাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।) কুরআনে বর্ণিত আরো পবিত্র বাণীসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। অনুরূপভাবে মহান রাসূলের মুতাওয়াতির হাদীস সমূহ এ কথার উপর অকাট্য হুজ্জত যে, তাঁরপর নবুয়তের ধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। সুতরাং এ সকল প্রকাশ্য প্রমাণাদি হুজ্জতের পর কোন বিকৃতকারী ও ইহুদীদের অনুসারীর পক্ষে কোন অধিকার নেই যে, সে মহান আরশের প্রভুর বাণীর সাথে খেলা করে কোন অপবাদ রটনাকারী মিথ্যুকের জন্য নবুয়্যত সাব্যস্ত করবে।
সপ্তমতঃ- কাদিয়ানীরা বলে- আল্লাহর বাণী:
مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ( النساء 69)
এর মধ্যে ‘মাআ’ শব্দটি ‘মিন এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এ কথার কোন দলীল নেই। কারণ, কোন ভাষাবিদ বা কোন তাফসীরকারক এমন কথা কখনও বলেন নি। তাফসীরকারক সকলেই এ কথা সাব্যস্ত করেছেন যে, এ আয়াতে ‘মাআ’ এর অর্থ সঙ্গ ও সাথে থাকা। বিখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে কাছীর এ শব্দ প্রসঙ্গে বলেন: ‘তাকে ওদের সাথী বানিয়ে দেয়।’ ইমাম যমখশারী রহ. বলেন: আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী বান্দা তাঁর সাথী হবেন।’ ইমাম রাজী এর অর্থ করেন, ‘যখন তারা আমার দর্শন ও সাক্ষাৎ লাভ করতে চাইবে, তখন তা পারবে।’ কাদিয়ানীরা এ অর্থ গ্রহণ না করলে আল্লাহ তাআলার এ বাণী সম্পর্কে কি বলতে পারে?-
إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿البقرة 153﴾
(নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।) এর অর্থ কি আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত? তারা আল্লাহ তাআলার এ বাণী সম্পর্কেও কি বলতে পারে?
( النحل ১২৮) إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا
নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। এর অর্থ কি আল্লাহ মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত?))মোটকথা, আল্লাহ তাআলার বাণীতে ‘মাআ’ শব্দটি ‘মায়িআত’ বা সাথী হওয়ার অর্থ প্রদান করছে। অর্থাৎ এ ব্যক্তির ঐ সকল মুকাররব বান্দাদের সঙ্গ হাসেল হবে। স্বয়ং আয়াতের শেষ অংশ এর তাফসীর করছেঃ
وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا ﴿النساء 69﴾
(এরা কতই না উত্তম সাথী।)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঐ বাণীও এর সাক্ষ্য দিচ্ছে- ‘একজন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে হাজির হয়ে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমি এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আমার মালের যাকাত আদায় করি এবং রমযানের রোযা রাখি। উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মারা যাবে সে কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথে এমনভাবে থাকবে, এ কথা বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি অঙ্গুলি একসাথে খাড়া করলেন। [১ আমর ইবন মুররাতাল যুহনীর রেওয়ায়েত থেকে ইমাম আহমদ তার মসনদে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঐ বাণীও একথার সাক্ষ্য দিচ্ছেঃ
من أحبني كان معي في الجنة
(যে আমাকে ভালবাসে সে বেহেশতে আমার সাথে থাকবে।) [২ তিরমিজী।]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হযরত রবিয়া ইবনে কা’বের প্রতি যখন তিনি আবেদন করেছিলেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি বেহেশতে আপনার সঙ্গ কামনা করি’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন- ‘তুমি এ কাজে নিজের জন্য বেশি বেশি সেজদা করে আমাকে সাহায্য কর’। [৩ মুসলিম।] এ সমস্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা এ কথাই প্রকাশ করে যে, ‘মাআ’ শব্দের অর্থ সাথী ও সঙ্গী হওয়া, অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ নহে, এ সকল কাফের ও মুরতাদরা যেমন ধারণা করছে। আমর যুহানীর হাদীস এ ব্যপারে একটি উজ্জ্বল প্রমাণ এবং এ সকল কাফেরদের মাথার উপর একটি কোষমুক্ত তরবারি স্বরূপ। সেই হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন- ‘যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যখন সে এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, যাকাত প্রদান করে ও রমজানের রোজা রাখে সে হবে নবীদের সঙ্গী’। এখানে যদি ‘মাআ’ শব্দকে ‘মিন’ অর্থে ব্যবহার করা হয় তা হলে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নবী হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ জাতীয় বাতিল কথাবার্তা দ্বারা কাদিয়ানীরা কি লোকজনকে পথভ্রষ্ট ও প্রতারিত করতে চায়? অথচ তাদের দলীল প্রমাণাদি মাকড়শার জালের চেয়েও দুর্বল। মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ﴿العنكبوت 41﴾
(‘নিশ্চয়ই মাকড়শার ঘর সবচেয়ে দুর্বল ঘর। হায়, যদি মানুষ তা বুঝতে পারত’।)
দ্বিতীয় আয়াত, যদ্বারা তারা নবুয়তের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করার জন্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করে। আর এ কথা তারা তাদের অসৎ পূর্ব পুরুষ বাহায়ীদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাআলার বাণীর অর্থ বিকৃত করে। আল্লাহর বাণী: (হে আদম সন্তান! যখনই তেমাদের কাছে তোমাদের মধ্য হতে রাসূলগণ আগমন করে, আমার আয়াত বর্ণনা করে, তখন যে কেহ আল্লাহকে ভয় করবে এবং সৎ কাজ করবে তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।) [১ সুরা আরাফ-৩৫।] কাদিয়ানিরা বলে, এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেও নবীগণের আগমন ঘটবে। কেননা, আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে রাসূলগণের আগমন সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। (আল কওলুস সারীহ, ১৯৮ পৃ: ও আহমদিয়া পকেট বুক’ ৫০৩পৃঃ।)
আমরা বলি: এ আয়াত দ্বারা নবুয়্যত চালু থাকার উপর দলীল পেশ করা কতগুলো কারণে বাতিল।
প্রথমত: আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর সন্তানদের প্রতি এ সম্বোধনটি ছিল সৃষ্টির আদিকালে এবং এ প্রতিশ্রুতিটি সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী রাসূলের আগমন দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এই আয়াত প্রসঙ্গে ইমাম ইবনু জারীর বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরকে নিজ হাতে নিয়ে এ কথা দ্বারা সম্বোধন করলেন।’ (তাফসীর ইবনে জারীর) আয়াতের ভাব-ভঙ্গিও একথা বুঝাছে। কেননা, এ আয়াতে আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টি, তাঁর বেহেশতে প্রবেশ, তারপর সেখান থেকে তাঁর বহিস্কৃত হওয়া সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে । দ্বিতীয়ত: আয়াতে إن ‘ইন’ (যদি) শব্দটি বর্ণিত হয়েছে এবং উহার বাস্তবায়ন অপরিহার্য নহে। যেমন- বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তাআলার এ বাণীতেঃ
قُلْ إِنْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ فَأَنَا أَوَّلُ الْعَابِدِينَ ﴿الزخرف 81﴾
(‘যদি আললাহ রহমানের কোন সন্তান থাকত, তাহলে আমিই সর্বপ্রথম তাঁর উপাসনাকারী হতাম’) [২ সুরা ঝুখরুফ ৮১।]
তৃতীয়তঃ ‘ইয়াতীয়ান্না’ শব্দটি فعل مضارع
(বর্তমান বা ভবিষ্যৎকালীন ক্রিয়া) আর المضارع এর ধারাবাহিকতা অপরিহার্য নহে। যেমন রয়েছে আল্লাহর এই বাণীতেঃ
فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا ( مريم 26)
(যদি তুমি কোন মানুষ দেখতে পাও, তবে তাকে বল, আমি রহমানের জন্য রোজার মানত করেছি।) [১ সূরা মরিয়ম, ২৬।] আয়াতের অর্থ এই নয় যে, মরিয়ম অনাধিকাল পর্যন্ত বেচে থাকবেন, এমনকি তিনি মানব জাতিকে সর্বদা ও অবিরত ভাবে দেখতে পাবেন।
সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, আয়াতের মধ্যে সম্বোধনটি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের জন্য নহে। বরং এ সম্বোধনটি মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের পূর্বে সকল আদম সন্তানের জন্য ছিল।
চতুর্থতঃ স্বয়ং কাদিয়ানীর উক্তি নবুয়্যত অর্থাৎ রিসালত শেষ হয়ে গেছে’। ইতিপূর্বে এর আলোচনা হয়ে গেছে।
কাদিয়ানীরা তাদের মিথ্যা নবীর নবুয়্যত প্রমাণ করার জন্য কোন কোন রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল পেশ করেছে। ইতিপূর্বে আমরা যেগুলোর উল্লেখ করিনি, এখন তা উল্লেখ করছি।
প্রথম রেওয়ায়েতঃ হযরত আয়েশা রা. বলেন:
( قولوا خاتم النبيين ولا تقولوا لا نبي بعدي )
(তোমরা খাতামুন নাবিয়্যীন বল, আমার পর কোন নবী নেই এ কথা বল না।) (আল কওলুস সারীহ, যা দূররে মানসুর হতে উদৃত।)
এ রেওয়ায়েতের সনদের আদৌ কোন ভিত্তি নেই। কাদিয়ানীদের এবং তাদের পথের পথিকদের মধ্যে এমন কোন লোক জন্মায়নি যে এ রেওয়ায়েতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে পারে। সুতরাং রেওয়ায়েতটি মওযু। উপরন্তু এটা সৈয়দা হযরত আয়েশার রা. প্রতি একটা অপবাদ। অথচ তিনিই রেওয়ায়েত করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা, বলেছেন: ‘তাঁর পর মুবাশশিরাত ব্যতীত নবুয়তের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সাহাবাগণ আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! মুবাশশিরাত কি? উত্তর দিলেন- সঠিক ও সৎ স্বপ্ন যা মুসলিম দেখতে পায় বা অন্য কেহ তার সম্পর্কে দেখে থাকে। [২ মুসনদে আহমদ।]
দ্বিতীয় রেওয়ায়েতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আববাস রা. কে বলেন: তোমাদের মধ্যেই খেলাফত ও নবুয়্যত হবে।’ (কানজুল উম্মাল, ও হুজ্জুল কারামাহ’।) এ রেওয়েতটিও মাওজু এবং উহার একজন রাবী যার নাম মুহাম্মদ আমির, তিনি সর্ব সম্মতিক্রমে দুর্বল।
দ্বিতীয়ত: এ রেওয়ায়েতের অর্থ যদি এই সাব্যস্ত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আববাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তোমাদের অর্থাৎ বনী হাশেম থেকে নবী আসছেন; যেমন রাজা বাদশাহ ও খলীফাগণ বনী হাসেম থেকে আসবেন। তবে এটাই হল এ রেওয়ায়েতের সঠিক অর্থ। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবীদের আগমনের কোন প্রমাণ নেই। তৃতীয়তঃ এ রেওয়ায়েত থেকে তারা যে অর্থ গ্রহণ করে বাস্তবতা এটাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। কেননা, আববাসী বংশের কেহই এ কথা দাবী করেনি যে, সে নবী। কিন্তু তাদের ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তো মোঘল বংশীয়, যেমনটি সে নিজেই তার জীবন চরিতে উল্লেখ করেছে। [১ ষষ্ঠ প্রবন্ধে এর আলোচনা চলে গেছে।]
এগুলো হল কাদিয়ানীদের দলীল দস্তাবেজ। জানি না তারা কেমন করে বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসসমূহকে বর্জন করে এবং মওযু ও অপ্রমাণিত রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল পেশ করে। এ সমস্ত লোক থেকে এমন আচরণ হওয়া কোন আশ্চর্যের বিষয় নহে। কেননা, যে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বরং তাদের সৃষ্টি করেছে, প্রচলিত নীতি হলো- ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উপায়-উপকরণের ন্যায্যতা প্রতিপালন করে’ কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করার পিছনে তাদের লক্ষ্য হল- ইসলামের আসল সত্য রূপকে বিকৃত করা, মুসলমানগণকে বিপথগামী করা, তাদের ঐক্য বিনষ্ট করা এবং তাদের জামাতকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। এই পথে তারা ঐ সমস্ত উপায় উপকরণ অবলম্বন করে, যা তাদের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে। যেমন বিকৃত করণ, অপব্যাখ্যা, বাতিল বিষয়াদি দ্বারা দলীল পেশ করা। আমাদের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই- এ দলের বাস্তব প্রকৃতি প্রকাশ করা এবং তাদের বাতিল ও ভ্রান্ত বিষয়াদি এবং মেকী দাবির উপর থেকে আবরণ সরিয়ে দেয়া। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে আমরা আমাদের সামর্থানুযায়ী চেষ্টা করছি। আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের এই প্রার্থনা, তিনি যেন সত্যকে তার নির্দেশ দ্বারা সত্য প্রমাণিত করেন এবং সত্যের প্রতি আহবানকারীদের বিজয়ী করেন। আল্লাহ তাআলা রহমত বর্ষণ করুন আমাদের ইমাম ও সর্বশেষ নবী প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সমস্ত সাহাবীগণের উপর।
আল্লাহই আমাদের একমাত্র তাওফীকদাতা।
সমাপ্ত
এটা জানা কথা যে, বাহায়ীরা বিশ্বাস করে, হুসাইন আলী আল্লাহর নবী ও রাসূল। আর, কাদিয়ানীরা বলে: গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নবী ও রাসূল। পক্ষান্তরে, আল্লাহ তাআলা বলেন: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নহেন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত।’ [সুরা আহযাব-৪১] এ আয়াতটি এ বিষয়ে স্পষ্ট এবং এর অর্থও প্রকাশ্য। কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মুখাপেক্ষী নহে। যার আরবী ভাষা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান আছে সেও এ আয়াত থেকে বুঝতে পারবে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে আর কোন নবী নেই। প্রথমত: খাতাম শব্দের অর্থ শেষ নহে, বরং তার অর্থ হল শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারো পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ নবী।’ এর অর্থ এই নহে যে, তার দ্বারা নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত:- খাতাম শব্দের অর্থ মোহর। অর্থাৎ তিনি লোকজনের উপর শীল মোহর করেন এবং তাঁর মোহর দ্বারাই কেহ নবীতে পরিণত হয়।
তৃতীয়তঃ- আন-নাবিয়্যীন দ্বারা শরীয়ত সম্পন্ন নবীগণকে বুঝান হয়েছে। অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ নবীগণের শেষ যারা স্বয়ং সম্পূর্ণ শরীয়ত নিয়ে আগমন করেছেন। এমন অনেক নবী পূর্বে এসেছেন যারা পূর্ববর্তী নবীর শরীয়তের অনুসারী ছিলেন। যেমন, হারুন আলাইহিস সালাম মুসা আলাইহিস সালাম এর অনুগামী নবী।
এই হল উক্ত আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা ও অন্তঃ-সারশূন্য অপ-ব্যাখ্যা মিথ্যাবাদী ভন্ডনবীর নবুওতকে প্রমাণিত করার জন্য তারা যার আশ্রয় নিয়েছে। যে ভন্ডনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন এক সাধারণ খাদেমের স্তরে পৌঁছার যোগ্য নহে, সুতরাং কোথায় সে এবং কোথায় শানে রেসালত ও নবুয়্যত? এ সমস্ত ব্যাখ্যার প্রতি কোন রকমের মনোযোগ ও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, উহাতে এমন দুর্বলতা ও হীনতা রয়েছে যা তাদের নিজের ভাষ্যদ্বারা ফুটে উঠে। কিন্তু যেহেতু তারা এ সমস্ত ব্যাখ্যা দ্বারা নির্বোধ, সরলমনা ও আরবী ভাষা জ্ঞানহীন লোকজনকে প্রতারিত করে, তাই এগুলোর উত্তর আমাদের দিতে হবে।
প্রথম- ‘খাতাম’ শব্দের সর্বশেষ অর্থ ছেড়ে দিয়ে উহার অর্থ শ্রেষ্ঠত্ব গ্রহণ করা আরবী ভাষার অভিধান, তাফসীরকারকদের মতামত, ইজমায়ে উম্মত ও কুরআন হাদীসের স্পষ্ট বর্ণনার পরিপন্থী। মাজদুদ্দীন ফিরোজাবাদী তার আল-কামুসুল মুহীত নামক অভিধানে বলেন: প্রত্যেক বিষয়ের পিছনের এবং শেষের অংশকে খাতেমা বলা হয় এবং লোকের মধ্যে শেষ ব্যক্তিকেও খাতাম বলে।’ (আল কামুসুল মুহীত, ৪থ খন্ড, ১০২ পৃ: ৪থ সংস্করণ।)
ইবনুল ফারিস বলেন: খাতাম অর্থ বস্ত্তর শেষ পর্যন্ত পৌঁছা এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুল আম্বিয়া, যেহেতু তিনি তাদের শেষে আসছেন।’ (মু’জামুল মাকাঈছুল লুগাত, ২য় খন্ড, ২৪৫ পৃ: ১ম সংস্করণ।)
ইমাম জুবাইদী বলেন: রাসূলুল্লাহ অন্যতম নাম হল খাতিম এবং খাতাম।, আর অর্থ হল ঐ ব্যক্তি যার আগমনে নবুয়্যত সমাপ্ত হয়েছে। (তাজুল আরুছ, ৮ম খন্ড, ২৬৭ পৃ: ১ম সংস্করণ।)
জওহরী তার আস্ সিহাহ’ নামক অভিধানে বলেন: কোন বস্ত্তর খাতেমা তার শেষকে বুঝায়। আর, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীগণের সর্বশেষ। (জওহরী রচিত আস্ সিহাহ।)
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আবুল বাক্কা বলেছেন: আমাদের নবীর খাতামুল আম্বিয়া নমকরণের কারণ হল এই যে, খাতাম হল সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তি। আল্লাহ তাআলা বলেছেন- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।’ (কুল্লিয়াতে আবুল বাক্কা।’
ইমাম রাগীব ইসফাহানী বলেছেন: খাতামুন নাবিয়্যীন নবুওতকে শেষ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর আগমন দ্বারা তা সম্পূর্ণ করেছেন।’ (আল মুফরাদাত লিল-ইসপাহানী’ ১৪২ পৃ: মিশরীয় সংস্করণ।) সাহেবুল মাজমা বলেন: খাতিম এবং খাতাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম নাম। ‘তা’ বর্ণটি যবরযুক্ত হলে শব্দটি ইসম বা বিশেষ্য হবে অর্থাৎ তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি। আর ‘তা’ বর্ণটি যেরযুক্ত হলে শব্দটি ইসমে ফায়েল হবে অর্থাৎ শেষকারী ব্যক্তি।’ (মাজমাউল বিহার’৩৩০ পৃ:।)
পরিশেষে, ভাষাবিদ ইবন মানজুর আফ্রিকী মিশরী খাতাম শব্দের অন্তর্গত যা কিছু বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করেছেন, আমরা তার আলোচনা করব। তিনি বলেন: প্রত্যেক জিনিসের খাতাম ও খাতেম উহার পরিণাম ও শেষ। ইখতাতামতু শাইআ’ (আমি বিষয়টি শেষ করেছি) । এটা ইফতাতাহতু শাইআ’ (আমি বিষয়টি সূচনা করেছি) এর বিপরীত। সূরার খাতেমা তার শেষ অংশ। খাতিমুল কওম, খিতামুল কওম এবং খাতামুল কওম হল কওমের শেষ ব্যক্তি। ‘লিহইয়ানী’ হতে বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুল আম্বিয়া। আত-তাহজীব থেকে উদ্ধৃত: খাতিম এবং খাতাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম সমূহের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আছে: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা ছিলেন না, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের সর্বশেষ। (লিসানুল আরব’ ১২শ খন্ড, ১৬৪ পৃ: বৈরুত সংস্করণ।) এ সমস্ত কথা আরবী ভাষাবিদও পন্ডিতগণ বলেছেন। তাদের আরবী গ্রন্থও অভিধান সমূহ হতে আমরা তা উদ্ধৃত করেছি। তাদের প্রত্যেকেই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, খাতাম অর্থ শেষ। আমি বুঝতে পারি না যে, যারা আরবী ভাষায় কিছুই জানে না তারা কেমন করে দাবিকরে যে, আল্লাহর বাণী:
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ
এর মধ্যে খাতাম শব্দের অর্থ শেষ নহে, বরং শ্রেষ্ঠ। তাফসীর শাস্ত্রের ইমামগণও ঠিক এই শেষ অর্থেই এর ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম ইবন জারীর তাবারী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, خاتم النبيين অর্থাৎ নবীদের সর্বশেষ। (তাফসীরে ইবনে জারীর, ২২খন্ড, ১২পৃঃ ১ম সংস্করণ, মিশর।) খাজেন বলেন: খাতামুন নবিয়্যীনের অর্থ তাঁর দ্বারা আল্লাহ তাআলা নবুওতকে শেষ করেছেন। সুতরাং তাঁর পর আর কোন নবুয়্যত নেই।
وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
এর অর্থ- এ কথাও আল্লাহর ইলমের অন্তর্ভুক্ত যে, তাঁর পর আর নবী নেই। (খাজেনের লুবাবুত তাবীল’ ৩য় খন্ড, ৪৭১ পৃ: ১ম সংস্করণ, মিশর)
নাসাফী বলেছেন: খাতামুন নাবিয়্যীন (‘তা’ বর্ণের যবরযোগে) এর অর্থ হল তিনি হলেন নবীদের সর্বশেষ এবং ‘তা’ বর্ণের যের যোগে এর অর্থ হল তিনি হলেন নবীদের সমাপ্তকারী।’ (তাফসীরে মাদারীকুত তানজীল’ ৩য় খন্ড, ৪৭১ পৃ: ১ম সংস্করণ)
ইমাম কুরতুবী বলেন: একমাত্র ক্বারী আসেমই ‘তা’ বর্ণের যবরযোগে পাঠ করেছেন। অর্থ হল নবীগণকে তাঁর দ্বারাই শেষ করা হয়েছে। আর অধিকাংশ আলেমগণ ‘তা’ বর্ণের যেরযোগে পাঠ করেছেন। অর্থ হল- তিনি তাদের সমাপ্ত করেছেন। কেহ কেহ বলেছেন- খাতাম ও খাতিম দুটো ব্যবহারিক রূপ। অর্থ এক। (তাফসীরে কুরতুবী, ১৪শ খন্ড, ১৯৬ পৃ: ১ম সংস্করণ, মিশর।) ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী বলেন: খাতামুন নাবিয়্যীন এ জন্য যে, যে নবীর পরে অন্য কোন নবী আসবেন যদি সে নবী কোন উপদেশ বা বর্ণনা পরিত্যাগ করে যান, তবে পরবর্তী নবী তা পরিপূর্ণ করবেন। কিন্তু যে নবীর পর আর কোন নবী নেই, তিনি তাঁর উম্মতের জন্য অসীম স্নেহশীল, হেদায়াত দাতা ও উপকারী হয়ে থাকেন। (রাজীর তাফসীরে কবির’।)
ইমাম ইবনে কাছীর
وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ
বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের সর্বশেষ, এ আয়াত সম্পর্কে লিখেছেন। তার মূল ভাষ্য হল এই: এ আয়াতের মধ্যে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে যে, তাঁর পর আর কোন নবী নেই। যখন তাঁর পর কোন নবী নেই, তখন কোন রাসূল না থাকাই অনিবার্য। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির বহু হাদীস বর্ণিত আছে। (তাফসীরে ইবন কাসীর, ৩য় খন্ড, ৪৯৩ পৃ:, ৩য় সংস্করণ মিশর)
আল্লাহর রাসূল যিনি ওহী ব্যতীত কথা বলেন না, এ ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা করে বলেছেন-
প্রথম হাদীস- আমিই সর্বশেষ নবী এবং আমার মসজিদ সর্বশেষ মসজিদ। [১ সহীহ মুসলিম।]
দ্বিতীয় হাদীস- অপর এক রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত হাদীসের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেছেন: আমি শেষ নবী এবং আমার মসজিদ নবীগণের সর্বশেষ মসজিদ। [২ দায়লামী এবং বাজ্জার ‘কানজুল উম্মালের উদ্ধৃতি দিয়ে এটা বর্ণনা করেছেন।]
তৃতীয় হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: আমি সর্বশেষ নবী এবং তোমরা সর্বশেষ উম্মত। [ইবন মাযাহ ও হাকিম।]
চতুর্থ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর এক হাদীসে বলেছেন, যে হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম তাদের সহীহ গ্রন্থ দ্বয়ে উদ্ধৃত করেছেন: আমার ও অন্যান্য নবীগণের দৃষ্টান্ত হল- যেমন অতিশয় মনোরম একটি প্রসাদ, যাতে একটি ইটের স্থান ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দর্শকবৃন্দ প্রদক্ষিণ করে তার মনোরম দৃশ্য দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়, কিন্তু একটি ইটের স্থান শুন্য লক্ষ্য করে! সুতরাং আমিই ঐ ইটের শুন্য স্থানটি পূর্ণ করেছি। প্রসাদটি আমার দ্বারা সমাপ্ত হয়েছে এবং রাসূলগণের আগমনও আমার দ্বারা শেষ হয়েছে। [৪ বুখারী ও মুসলিম।]
এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনিই সর্বশেষ নবী এবং তাঁর উম্মত সর্বশেষ উম্মত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রসাদের হাদীসে ‘খতম’ শব্দের এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যাতে কোন দাজ্জালের জন্য তাঁর পর নবুয়তের দাবি করার অবকাশ রাখেন নি। কেননা, নবুয়তের প্রসাদ পূর্ণতা লাভ করেছে এবং উহার খালি জায়গাটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ হাদীসটি অনেক হাদীসবেত্তা বিভিন্ন পন্থায় বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ রা. থেকে এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেছেন যে, নবীগণের মধ্যে আমার দৃষ্টান্ত হল, এক ব্যক্তি একটি সুন্দর ও পরিপূর্ণ ঘর তৈরি করল, কিন্তু উহাতে একটি ইটের স্থান খালি রেখে দিল, সেখানে কোন ইট স্থাপন করেনি। লোকজন এটা প্রদক্ষিণ করে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে- হায়রে, যদি এ ইটের স্থানটুকু পরিপূর্ণ হয়ে যেত! সুতরাং আমিই নবীগণের মধ্যে ঐ ইটের স্থানসম। [১ইবন কাসীরের উদ্ধৃতি দিয়ে আহমদ তাঁর মসনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।] অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, আমি এসে ঐ ইটটি পূর্ণ করে দিয়েছি।
এ সকল হাদীস এটাই প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাতামুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ সর্বশেষ নবী । আর, কাদিয়ানীর যা বলেছে যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ, শেষ নহে, তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, বিকৃত, অন্তঃসারশূন্য ও দুর্বল, যার কোন ভিত্তি ও প্রমাণ নেই। এইতো ভাষাবিদগণ ও তাফসীরের ইমামগণ স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছেন যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ নহে, বরং শেষ। মুসলমানদের ইমাম ও মোমিনদের নবী যিনি ওহীর সাহায্যে কথা বলেন, স্বয়ং তিনি স্পষ্টকরে বলেছেন যে, তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁর দ্বারা নবুয়্যতকে সমাপ্ত করা হয়েছে এবং তাঁর দ্বারাই রেসালত বন্ধ হয়ে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তার বিপরীত কিছু বলার সাধ্য কারো নেই। ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী স্বয়ং এ নীতি তার উক্তিতে স্বীকার করেছে. ইলহাম প্রাপ্ত ব্যক্তির (অর্থাৎ রাসূলের) বর্ণনার পর আর কোন ব্যাখ্যা বা তাফসীর গ্রহণযোগ্য নয়। (গোলামের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালতে’ সন্নিবেশিত, ১ম খন্ড, ১২১ পৃ:।) এ জন্যই গোলাম আহমদ তার স্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা সর্বশেষ নবী এবং তাঁর মাধ্যমে রাসূল আগমনের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর আল-ইস্তেফতা’) কাদিয়ানীরা যখন এ সকল গভীর ও স্পষ্ট হাকীকত উপলব্ধি করে তখন তারা তাদের বাতিল ব্যাখ্যা সমূহকে শক্তিশালী করার জন্য এমন কতকগুলো বিষয়ের চেয়ে কম নহে। তাই, কখনও তারা ভিত্তিহীন মওযু (মনগড়া) রেওয়ায়েত দ্বারা, যার কোন আসল নেই, দলীল গ্রহণ করে। আর তা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে বললেন: আমি সর্বশেষ নবী, আর তুমি হে আলী! সর্বশেষ ওলী।’ (নজীর আহমদ কাদিয়ানীর আল কওলুস সরীহ’ ১৭৩ পৃ:।) তারা বলে যে, এর অর্থ হল- আলী রা. সর্বশ্রেষ্ঠ ওলী, এই অর্থ নয় যে, আলীর রা. পরে আর কোন ওলী আসবেন না। আমরা বলি, এ রেওয়ায়েতের কোন আসল বা ভিত্তি নেই। উপরন্তু আমরা সহীহ হাদীস সমূহ দ্বারা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ নহে, বরং শেষ। আমরা উহা অভিধান ও তাফসীরের কিতাব সমূহ দ্বারা প্রমাণ করেছি। অনুরূপভাবে কোন কোন কাদিয়ানী একটি (বিচ্ছিন্ন) রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। উহাতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবাবাসকে রা. বলেছেন: আনন্দিত হও হে চাচা! নিশ্চয়ই তুমি হলে খাতামুল মুহাজেরীন বা সর্বশেষ মুহাজের। (আব্দুর রহমান কাদিয়ানীর আহমদিয়া পকেট বুক।) তাই তারা বলে: এখানে খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ। কারণ, এর অর্থ এই নয় যে, আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হিযরতের পর আর কোন হিযরত নেই।
আমরা বলি: এ রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল গ্রহণ করাও রূগ্ন বুদ্ধি, অন্তরের বক্রতার পরিচয় বহন করে এবং তা দ্বীন ইসলামের মধ্যে পরিবর্তন সাধনের কুমতলব ও বিশ্বস্ত সত্যবাদী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুসলমানগণকে দুরে রাখার একটা কৌশল মাত্র। কেননা, আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, এ রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল গ্রহণ করা ঠিক নহে।
প্রথমত: এ রেওয়ায়েতটি বিচ্ছিন্ন। উহার সনদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত ধারাবাহিক পৌঁছায়নি।
দ্বিতীয়ত: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ কথা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, নবুয়তের দ্বার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং রেসালত শেষ হয়ে গেছে।
তৃতীয়তঃ আমরা ভন্ডনবী কাদিয়ানীর ভাষ্য উল্লেখ করেছি: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনার পর কোন তাফসীর ও ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নহে।
চতুর্থত: যদি আমরা এ রেওয়াতকে সহীহ মেনে নেই তবুও এর দ্বারা দলীল প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, মক্কা বিজয়ের পূর্বে যে সকল মুসলমান মক্কায় অবস্থান করছিলেন, তাদের জন্য মদিনায় হিজরত করা অপরিহার্য ছিল। আর আববাস রা. মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং মদিনায় হিযরত করেছিলেন। হাফিজ ইবন হাজার তাঁর আল-ইছাবাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: আববাস রা: মক্কা বিজয়ের কিছু পূর্বে হিযরত করেছেন এবং মক্কা বিজয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। [১ সাহাবীগণের পরিচয় সম্পর্কে ইবন হাজারের গ্রন্থ হল আল ইছাবাত।] তিনি যখন মদিনায় পৌঁছেছিলেন, তখন তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন: ‘হে চাচা, তুমি আনন্দিত হও! নিশ্চয়ই তুমি হলে সর্বশেষ মুহাজির। কারণ, মক্কা বিজয়ের সময় অত্যাসন্ন ছিল। মুজাসি ইবন মাসউদ সালমী যখন তার ভাই মুজালিদ ইবন মাসউদকে নিয়ে হিজরতের উপর বায়আত গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে আগমন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: মক্কা বিজয়ের পর হিযরত নেই, তবে ইসলামের উপর বায়আত আছে। [২ বুখারী।]
মোটকথা, এ রেওয়ায়েত দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, খাতাম অর্থ শ্রেষ্ঠ, শেষ নহে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই পঞ্চম হাদীসকে বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন, যখন আলীকে সম্বোধন করে বলেছিলেন: ‘মুসার আলাইহিস সালাম কাছে হারূণের আলাইহিস সালাম যে মর্যাদা ছিল, ঠিক তেমনি আমার কাছে তোমার মর্যাদা রয়েছে। তবে পার্থক্য হল এতটুকু যে, আমার পরে আর কোন নবী নেই। [৩ বুখারী ও মুসলিম।]
উক্ত হাদীস এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, খাতাম অর্থ শেষ। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরে নবুওতকে অস্বীকার করেছেন। কোন এক কাদিয়ানী জনৈক কবির উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করে বলে, কবিরা খাতাম শব্দকে শ্রেষ্ঠ অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমি বলি: উহা তাদের পক্ষে কোন দলীলরূপে গণ্য হয় না। যেমন, তারা বলে: হাসান ইবন ওহাব আবু তামাম ত্বায়ীর শোক প্রকাশে বলে:
فجع القريص بخاتم الشعراء وغديرروضتها حبيب الطائ
(কুবাইস এলাকাবাসী খাতামুশ শুআরা এর জন্য ব্যথিত, কেননা, প্রকৃত কথা হল, হাবীব ত্বায়ীই ছিল এর বাগানে জলধারা বিশেষ।) এখানে খাতামুশ শুআরা অর্থ শ্রেষ্ঠ কবি, সর্বশেষ কবি নহে। কেননা, কবিগণ সব সময়ই বিদ্যমান আছেন। (কাদিয়ানীদের আল- কাওলুস সারীহ’ ও আহমদিয়া পকেট বুক।’) আমরা এর উত্তরে বলি: এর অর্থ কি আবু তামাম তার পূর্ববর্তী সকল কবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ? এ পর্যন্ত কেহ এমন কথা বলেনি, এবং বলতে পারেও না। আর হাসান ইবন ওহাবেরও ধারণা ছিল না যে, আবু তামাম আরবের সকল কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বরং ইহার অর্থ হল- হাসান ইবন ওহাবের ধারণা অনুযায়ী আবু তামাম ই শেষ কবি, যিনি প্রাচী বিজ্ঞ কবিদের রীতি অনুসরণ করেছিলেন। সুতরাং কবিতার এ পঙ্ক্তি কাদিয়ানীদের পক্ষে দলীল নহে, বরং তাদের বিপক্ষে প্রমাণিত হয়।
দ্বিতীয় কথা- মানুষের কথা দ্বারা আল্লাহর বাণীর অর্থ নির্ধারণের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দিকে, এরপর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং আইম্মায়ে মুজতাহেদীন ও মুফাস্সীরীনের উক্তির দিকে ফিরে যেতে হবে। উপরন্তু এখানে কবির উক্তি অনেক অর্থের সম্ভাবনা রাখে, কোন একটি অর্থ সুস্পষ্ট নহে।
তৃতীয় কথা- কাদিয়ানীরা যখন মানুষের উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করতে চায়, তখন তাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম ও উচিত হবে তারা যেন তাদের নবীর উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করে। প্রকাশ থাকে যে, তাদের ভন্ডনবী কাদিয়ানী ‘খাতাম’ শব্দের অর্থ গ্রহণ করেছে ‘শেষ’ শ্রেষ্ঠ নহে। সে তার জন্ম কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে বলে: আমি জন্মগ্রহণ করলাম এবং আমার সাথে একজন মেয়ে জন্মগ্রহণ করল। সে প্রথমে পেট থেকে বের হল, এবং পরে আমি বের হলাম। এরপর আমার মাতা-পিতার আর কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। তাই, আমি হলাম তাদের (খাতাম) সর্বশেষ সন্তান। (তিরিয়াকুল কুলুব, ৩৭৯৯ পৃষ্ঠা)
মির্জা কাদিয়ানীর এ কথাটি কি কাদিয়ানীদের জন্য দলীল হবে? না হাসান ইবনে ওহাবের কথা দলীল হবে? এ ছাড়া ভন্ডনবী কাদিয়ানী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর উল্লেখ করে বলেছে: বনী ইসরাঈলের খাতেম সর্বশেষ নবীর নাম ছিল ঈসা । (বারাহীনে আহমদিয়ার পরিশিষ্ট নুসরাতুল হক’ পৃ: বা।) কোন কাদিয়ানী এ কথা বলতে পারবে না যে, এখানে ‘খাতাম’ এর অর্থ শ্রেষ্ঠ, শেষ নহে। কেননা, ভন্ডনবী অন্যত্র বিশ্লেষণ করে বলেছে:- মুসা আলাইহিস সালাম এর পর সকল নবীই তাঁর শরীআতের খাদেম ছিলেন। (গোলাম কাদিয়ানীর শাহাদাতুল কুরআন’ ২৬ পৃ:।) যদি মানুষের উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করতেই হয়, তবে কাদিয়ানীদের জন্য ভন্ডনবীর উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করা অধিক শ্রেয়। কেননা, সে নিজেই দাবি করছে. সে প্রবৃত্তির তাড়নায় কোন কথা বলে না, সে যা বলে তা ওহীর সাহায্যেই বলে। (গোলাম কাদিয়ানীর আরবাঈন ৩ নম্বর, ৪৩ পৃ:।) সে তো ‘খাতাম’ শব্দকে শেষ অর্থে ব্যবহার করেছে, শ্রেষ্ঠ অর্থে নহে। আর, এ কথা প্রমাণ করাই আমাদের লক্ষ্য। কাদিয়ানীরা বলে যে, খাতাম অর্থ মোহর, অর্থাৎ তিনি লোকদের মোহর লাগান এবং তাঁর মোহরে একজন লোক নবী হতে পারে , ইহা সম্পূর্ণ বাজে কথা। আরবদের কাছে এই অর্থের কোন ব্যবহার নেই। নচেৎ এটা অপরিহার্য হয়ে পড়বে যে, খাতামুল মুহাজেরীনের অর্থ যার মোহরে একজন লোক মুহাজির হয়ে যায় এবং খাতামুল মুজতাহেদীনের অর্থ যে মানুষকে মোহর লাগায় এবং তাদেরকে মুজতাহেদ বানিয়ে দেয়। এ অর্থ আরবরা কখনও শুনেনি এবং এখন পর্যন্ত তাদের ভাষায় ইহার অস্তিত্ব নেই। এমনকি, অন্য কোন ভাষায়ও এরূপ ব্যবহার নেই। অন্যথায়, ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর এ উক্তি উদ্দেশ্য কি হবে: আমি আমার মাতা-পিতার সন্তানের জন্য ‘খাতাম’। সে কি তার মাতা-পিতার সন্তানের মোহর লাগাচ্ছে যাতে তারা তাদের সন্তান হিসেবে পরিগণিত হয়? এ ধরনের নির্বুদ্ধিতার দ্বারা কি কাদিয়ানীরা তাদের মিথ্যাবাদী ভন্ডনবীর নবুওতকে প্রমাণ করতে চায়, না, এর দ্বারা মুসলমানগণকে প্রতারিত করতে চায়?
চতুর্থ কথা- তাদের উক্ত, উক্ত আয়াতে নবীগণ দ্বারা উদ্দেশ্য শরীয়াতের অধিকারী নবগিণ- একথা সম্পূর্ণ বাতিল, এর পক্ষে তাদের কোন দলীল নেই। কারণ, আল্লাহ তাআলা নবীগণের মধ্যে শরীয়ত প্রাপ্ত নহেন এমন কোন পার্থক্য করেননি। বরং আন্নাবিয়্যীন শব্দ আম (ব্যাপক) ও ‘মুতলাক’ (শর্তহীন) রয়েছে। আর, উসুল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ নীতি হল- আমাকে তার উমুম (ব্যাপকতা) এর উপর এবং মুতলাক কে তার এতলাক (শর্তহীনতা) এর উপর বহাল রাখা, যতক্ষণ পর্যন্ত এমন কিছু না পাওয়া যায় যা উহাকে খাস করে অথবা কোন শর্তের সহিত আবদ্ধ করে। এখানে এমন কোন প্রমাণ নেই যদ্দারা বুঝা যায় যে, নবীগণ দ্বারা এক বিশেষ শ্রেণির নবী উদ্দেশ্য। বরং এই অর্থ গ্রহণ করা প্রতিষ্ঠিত স্পষ্ট উদ্ধৃতি সমূহের পরিপন্থী। কারণ এ সকল দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ‘নাবিয়্যীন’ দ্বারা সাধারণ নবুওতকে বুঝান হয়েছে।
ষষ্ঠ হাদীস- আমরা এখানে আর একটি হাদীসের উল্লেখ করব, যা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবুয়তের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (যার জন্য আমার মাতা-পিতা ও আমার প্রাণ কুরবান) এরশাদ করেছেন- বনী ইসরাঈলকে তাদের নবীগণ দেখা শুনা করতেন । যখন কোন নবীর ইন্তেকাল ঘটত, তাঁর পরেই আর এক নবী আগমন করতেন। কিন্তু আমার পর আর কোন নবী নেই। তবে খলীফা আসবেন এবং তাদের সংখ্যা হবে অনেক। [১ বুখারী ইবনে মাযাহ ও আহমদ।] উক্ত হাদীস সুস্পষ্ট ভাবে এ কথাই বোঝাচ্ছে যে, আননাবিয়্যীন অর্থ সাধারণ নবুয়্যত। উহা নতুন কোন শরীয়ত যুক্ত হোক বা না হোক । কেননা, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত হাদীসে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন।
এক:- বণী ইসরাঈলের ভাল-মন্দ নবীগণ দেখাশোনা করতেন। এক নবী ইন্তেকাল করলে অপর নবী আগমন করতেন। কিন্তু কেহই একথা বলেননি যে, বণী ইসরাঈলের সকল নবী স্বতন্ত্র শরীয়তের অধিকারী ছিলেন। স্বয়ং কাদিয়ানীরাও একথা বলেনি। অতঃপর মহান রাসূল এ উক্তি করলেন আমার পরে কোন নবী নেই।
দুই:- তারপর খলীফা হবেন এবং তাঁরা অনেক হবেন।’ এ উক্তিও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, তাঁর পর আর কোন নবী নেই। কারণ তাঁর পর যদি আর কোন নবী থাকত তা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলতেন না যে অচিরেই খলিফাগণ আগমন করবেন এবং তারা অনেক হবেন।
সপ্তম হাদীস- উপরন্তু রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট থেকে ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, অচিরেই এমন কতক গুলো লোক বের হবে যারা অপবাদ রটনাকারী, মিথ্যুক এবং নিজেকে নবী দাবি করবে, আর, আল্লাহর বাণী সমূহকে স্ব স্থান থেকে পরিবর্তন করবে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে কোন প্রকার অস্পষ্টতা ও সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি বলেছেন: অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যুক বের হবে, যাদের প্রত্যেকে আল্লাহর নবী হওয়ার দাবি করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই। অপর রেওয়ায়েতে আছে ক্বিয়ামত কায়েম হবে না যতক্ষণ না ত্রিশজন দাজ্জাল বের হবে, এদের প্রত্যেকেই দাবি করবে যে, সে আল্লাহর রাসূল। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই। [১ আবু দাউদ ও তিরমিজী।] উক্ত হাদীস এদের মিথ্যা, ভ্রান্ত ব্যাখ্যার প্রতি আশ্রয় গ্রহণের মাধ্যমে এদের প্রতারণা এবং কুরআন হাদীসের বাণীকে এদের বিকৃতকরণের বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরছে। স্বয়ং তাদের ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার মিথ্যা নবুয়্যত দাবি করার পূর্বে স্বীকার করেছে যে, আল্লাহ তাআলার বাণী ‘খাতামুন নবিয়্যীন’ দ্বারা সাধারণ নবুয়্যত বুঝায়। সে তার উক্তি দ্বারা স্পষ্ট করে বলেছে: ‘তুমি কি জান না যে. মহান দয়ালু প্রভু আমাদের নবীর নাম রেখেছেন ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এতে কোন রূপ ব্যতিক্রম নেই। আর আমাদের নবী স্বীয় উক্তি ‘লা নাবিয়্যা বাদী’ দ্বারা সত্যান্বেষীদের জন্য সুস্পষ্ট করে এর ব্যাখ্যা করেছেন।’ (গোলাম কাদিয়ানীর ইলহামের সমষ্টি হামামাতুল বুশরা ৩৪ পৃ:) সে আরো বলছে: ‘মা কানা মুহাম্মাদুন’ আয়াতটি স্পষ্ট করে প্রমাণ করছে যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর এ পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবেন না।’ (গোলাম কাদিয়ানীর এজালাতুল আওহাম’ ৬১৪ পৃ:।))সে আরো বলেছে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকবার বলেছেন যে, তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না এবং ‘আমার পর কোন নবী নেই’ হাদীসটি অতি প্রসিদ্ধ। এর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কারো আপত্তি করার সাধ্য নেই। কুরআন কারীম , যার প্রতিটি শব্দই অকাট্য আয়াতের উক্তি দ্বারা ইহার সত্যতা প্রমাণ করেছে। সুতরাং নবুয়্যত আমাদের নবীর কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর কিতাবুল বারিয়া’ এর টিকা ১৮৪ পৃ:।) সে এর চেয়েও অধিক বলেছে: আমি ঠিক ঐ ভাবে বিশ্বাস করি যেভাবে মুসলমানগণ ও আহলে সুন্নাহ বিশ্বাস করেন। কুরআন ও হাদীস দ্বারা যা সাব্যস্ত তার সবটুকু আমি সমর্থন করি। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, সর্বশেষ নবী সাইয়েদানা ও মাওলানা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর যে ব্যক্তি নবুয়্যত ও রেসালতের দাবি করবে সে কাফের ও মিথ্যুক। আমার বিশ্বাস রেসালত আদম ছফিউল্লাহ থেকে আরম্ভ করে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে শেষ হয়েছে। (গোলামের ঘোষণা যা তাবলীগে রেসালতে সন্নিবেশিত, ২য় খন্ড, ২য় পৃ:।)
এ উক্তি গুলো করেছে কাদিয়ানীদের সেই ভন্ডনবী যার দাবি হল যে, সে প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলে না, যা বলে তা ওহী ব্যতীত অন্য কিছু নহে। সুতরাং কাদিয়ানীরা কেমন করে ইজমায়ে উম্মত, মুফাস্সেরীনের মতামত, মহান রাসূলের হাদীস, এমন কি তাদের ভন্ডনবীর উক্তিকে বর্জন করে চলে? সে ভন্ডনবীই তার স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করছে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এর মধ্যে ‘আন নাবিয়্যীন’ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, চাই তারা শরীয়তের অধিকারী হন বা না হন। এমনকি, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ঐ ব্যক্তির দাবিকেও প্রত্যাখ্যান করছে, যে শরীয়ত বিহীন নবীগণের আগমন এখনও সম্ভব বলে মনে করে। তাই, সে বলছে: ‘মহিউদ্দিন আরবী লিখেছেন, শরীয়ত সম্পন্ন নবুয়্যত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দ্বারা বন্ধ হয়ে গেছে, তবে শরীয়ত বিহীন নবুয়্যত বন্ধ হয়নি।’ কিন্তু আমি গোলাম বিশ্বাস করি যে, সকল প্রকার নবুয়তের দ্বার বন্ধ হয়ে গেছে। (গোলাম কাদিয়ানীর প্রবন্ধ যা কাদিয়ানী পত্রিকা আল-হিকমে প্রচারিত এবং ১০ এপ্রিল ১৯০৩ সালে প্রকাশিত।) আমি জানি না, এত কিছুর পর ভন্ডনবী ও কাদিয়ানীরা কেমন করে এ কথা বলতে দুঃসাহস করে যে, খাতামুন নাবিয়্যীনের অর্থ শরীয়তের অধিকারী নবীগণ। এ ছাড়া আমি কাদিয়ানীদের প্রশ্ন করব যে, তারা আল্লাহ তাআলার এ বাণী সম্পর্কে কি বলে: ‘‘তিনি তোমাদেরকে এ নির্দেশ করছেন না যে তোমরা ফেরেস্তা ও নবীগণকে প্রভুরূপে গ্রহণ কর।’’ [১ সুরা আল ইমরান ৮০।] কাদিয়ানীরা কি এ বিশ্বাস করে যে, স্বতন্ত্র শরীয়ত নিয়ে আসেন নি তাদেরকে প্রভুরূপে গ্রহণ করতে দোষ নেই?
এইভাবে তারা আল্লাহ তাআলার এ বাণীরও কি অর্থ গ্রহণ করে: ‘বরং ঐ ব্যক্তির কাজে প্রকৃত কল্যাণ ও ছওয়াব রয়েছে, যে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেস্তা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস রাখে।’ [২ সুরা বাকারা, ১৭৭।] তারা কি শরীয়ত বিহীন নবীগণের প্রতি ঈমান গ্রহণ না করাকে জায়েজ মনে করে? এতে তো তারা রাজি হবে না। কারণ, তারা বলে যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও একজন শরীয়ত বিহীন নবীগণের প্রতি ঈমান গ্রহণ না করা কে জায়েজ মনে করে? এতে তো তারা রাজি হবে না। কারণ, তারা বলে যে, গোলাম আহমদ কাদিয়ানীও একজন শরীয়ত বিহীন নবী। তা সত্ত্বেও তার উপর ঈমান আনয়ন করা ফরজ এবং যারা তার মিথ্যা নবুওতকে স্বীকার করবে না তারা কাফের। এ কথাটি আমরা দ্বিতীয় প্রবন্ধে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি। বাস্তব কথা হল, তারা আল্লাহর বাণীকে একমাত্র তাদের ঘৃণিত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বিকৃত করে। অন্যথায়, এটা স্পষ্ট যে, গোলাম কাদিয়ানী শরীয়ত বিহীন নবুয়তের দাবি করেনি। বরং স্বতন্ত্র শরীয়ত সম্পন্ন নবুওতেরই দাবি করেছে। পঞ্চম প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছি যে, তার উপর ওহী নাজিলের দাবি করেছে। অনুরূপ ভাবে সে একটা স্বতন্ত্র দ্বীন ও শরীয়তের দাবি করেছে। বরং সে তার ঘৃণিত সত্তাকে সকল নবী রাসূলে উপর প্রাধান্য দিয়েছে। অতএব, তাদের পক্ষ থেকে খাতামুন নাবিয়্যীন এর অর্থ কখনও শরীয়ত সম্পন্ন নবী আর কখনও শরীয়ত বিহীন নবী গ্রহণ করা শুধু মুসলমানের সহিত প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছু নহে।
‘আন-নাবীয়্যীন দ্বারা কতেক নবী বুঝান হয়েছে’ ইবনে আরবীর এই উক্তি দ্বারা কোন কোন কাদিয়ানীর দলীল গ্রহণ করা সঠিক নহে।
প্রথমত: স্বয়ং তাদের ভন্ডনবী ইবন আরবীর উক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, যা আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। সুতরাং তাদের নবী যা অস্বীকার করেছে উহা দ্বারা তাদের দলীল গ্রহণ করা কেমন করে ঠিক হবে?
দ্বিতীয়ত: কাদিয়ানীরাই ইবন আরবীর উক্তির উদ্ধৃতি প্রদানে ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা করছে। কেননা তারা ভালকরে জানে যে, ইবন আরবী শরীয়ত সম্পন্ন নবী এবং শরীয়ত বিহীন নবী বলে কোন পার্থক্য করেননি। বরং তাঁর মতে নবী মাত্রই শরীয়তের অধিকারী ব্যক্তি। সুতরাং যে ব্যক্তি তাবলীগ করে এবং তাঁর কাছে যে ওহী আসে উহার ঘোষণা দেয়, ইবন আরবীর মতে সে শরিয়তধারী নবী। আর যার কাছে শুধু ইলহাম আসে কিন্তু তিনি ইলহামের কথা প্রচার করেন না, তিনি ওলী। তাকেই ইবন আরবী বাড়িয়ে নবী বলে ফেলেছেন। ‘আল ইয়াওকীত’ গ্রন্থের লেখক বলেছেন: তাদের (প্রকৃত ও রূপক নবীর) মধ্যে পার্থক্য হল- নবী ঐ ব্যক্তি যার কাছে যখন জীবরাঈল ফেরেস্তা কিছু প্রেরণ করেন আর তিনি এটাকে নিজের জন্য খাছ মনে করেন এবং অপরের কাছে প্রচার করাকে হারাম মনে করেন। অতঃপর যদি তাকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, পৌঁছে দাও যা তোমার কাছে অবতীর্ণ করা হয়েছে, তখন এই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে রাসূল বলা হবে। আর, যদি নবী কোন হুকুমকে এমনভাবে নিজের জন্য খাছ না করেন যে, তাহা অন্যের জন্য প্রযোজ্য হবে না, তবে তিনি রাসূল, নবী নন। অর্থাৎ এর দ্বারা শরিয়তধারী নবুয়্যত বুঝায় যা ওলীগণ হাসেল করতে পারে না। (আল-ইয়াওকীত আল-জাওয়াহীর’ যা মুহাম্মদিয়া পকেট বুক থেকে উদ্ধৃত।)
ইবনুল আরবী বলেন: নবী যে গুণের দ্বারা খাছ, ওলীর মধ্যে সে গুণ হতে পারে না, তা হল শরীয়ত সম্পর্কে ওহী লাভ করা । সুতরাং নবী ও রাসূল ব্যতীত কেহ শরীয়ত লাভ করতে পারে না। (ইবন আরবীর ফতুহাতে মক্কিয়া’) মোটকথা, ইবন আরবী প্রমুখ ছুফিগণ এ আক্কিদা রাখেন না যে, প্রকৃত নবুয়্যত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর বিদ্যমান আছে। বরং তারা নবুয়্যত শব্দ দ্বারা এমন বেলায়েত উদ্দেশ্য করেছেন, যার তাবলীগ করা অপরের কাছে হারাম। এ ধরনের নবুয়্যত কি কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্য এবং এ অর্থেই কি তারা গোলাম আহমদের নবুওতে বিশ্বাসী? অথবা অন্য কি অর্থ তারা গ্রহণ করে?
তৃতীয়: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ এর অর্থ ‘লা নাবিয়্যা বা’দী’ দ্বারা ব্যাখ্যা করার পর কারো জন্য জায়েজ নহে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন সুস্পষ্ট বাণীকে ত্যাগ করে মানুষের অস্পষ্ট ও বিভিন্ন অর্থের সম্ভাব্য উক্তি দ্বারা দলীল পেশ করা, যা ইসলামে হুজ্জতও নহে এবং খাঁটি ধর্মের সনদও নহে। এই দেখুন স্বয়ং বিশ্বাসী ও সত্যবাদী রাসূল স্পষ্ট করে বলছেন:- অষ্টম হাদীস- নবুয়্যত ও রেসালত বন্ধ হয়ে গেল। সুতরাং আমার পর আর কোন নবীও নেই এবং কোন রাসূল ও নেই।’ [১ তিরমিজী এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন, আহমদ তাঁর মুসনাদেও এই হাদীস বর্ণনা করেছেন।]
এই হাদীসটিকে গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার পুস্তক তুহফায়ে বাগদাদ এর ৭ম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছে এবং এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে: আমাদের নবী যিনি সর্বশেষ নবী তাঁর পরে আল্লাহ তাআলা আর কোন নবী প্রেরণ করবেন না। আর নবুয়তের ধারা বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় নতুন করে উহা চালু করবেন না’ (গোলাম কাদিয়ানীর মেরআতু কামালাতে ইসলাম’ ৩৭৭ পৃ:) কাদিয়ানীরা যে বলে, নবীগণ দ্বারা কতেক নবী উদ্দেশ্য, সকল নবী নহে। দলীলরূপে তারা আল্লাহ তাআলার এই বাণীকে গ্রহণ করে:
وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ( البقرة 61)
তারা নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। [১ সুরা বাকারা, ৬১।] অর্থাৎ ইহুদীরা কতেক নবীকে হত্যা করেছে। এ কথাটিও তাদের মিথ্যাচারিতার প্রমাণ। কারণ, এ স্থানে আন-নাবিয়্যীন এর আলিফ ও লাম হরফ দ্বয় আহ্দী বা নির্দিষ্ট অর্থ জ্ঞাপক, ব্যাপক অর্থবোধক নহে। এ কথাটি বোঝাচ্ছে আল্লাহ তাআলার এই বাণী: তারা নবীগণের এক জামাতকে মিথ্যা বলে আর এক জামাতকে হত্যা করে। [২ সুরা বাকারা, ৮৭।] তাছাড়া কতেক নবী বলতে শরিয়তধারী নবীগণ উদ্দেশ্য নহে। যাতে তারা বলতে পারে যে, ইহুদীরা শুধু শরিয়তধারী নবীগণকে হত্যা করত এবং শরীয়ত বিহীন নবীগণকে হত্যা করত না। এ কথার উপরও কোন দলীল নেই।
বাহায়ীগণ আল্লাহ তাআলার বাণী: ‘‘বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী’’ সম্পর্কে বলে যে, এখানে খাতাম অর্থ সৌন্দর্য। তাই, আয়াতের মর্ম হল এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীগণের জন্য অঙ্গুলির মধ্যে আংটির সৌন্দর্যের মত। বাহায়ীদের অসৎ অনুসারী কাদিয়ানীরা ও এই অপ-ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে। [৩ নজীর কাদিয়ানীর আল-কাউলুস সারীহ-দ্রষ্টব্য।] এ উক্তিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি প্রকাশ্য অবমাননা করা হয়েছে। কেননা, তাঁকে পরিধেয় অলংকারের মালিক ও উহার পরিধানকারীর মোকাবিলায় অলংকারের কোন মূল্য নেই। বরং সেই অলংকার কিনে, পরিধান করে এটাকে খুলে দেয়। সেই অলংকার আঙুলে পরিধান করে সম্মানিত করে, অলংকার তাকে সম্মানিত করে না। সুতরাং এতে মহান রাসূলের জন্য কোন ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয় না। অথচ আল্লাহ তাবারকা ওতাআলা এ শব্দটিকে প্রশংসার স্থলে উল্লেখ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ফযিলত ও সম্মানের কথা স্পষ্টকরে বর্ণনা করেছেন।
নবম হাদীস- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আমাকে ছয়টি গুণের দ্বারা সকল নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে। আমাকে এমন ভাষা দান করা হয়েছে, যার শব্দ কম কিন্তু অর্থ ব্যাপক, আমাকে রুউব (সশ্রদ্ধ ভয়) দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, আমার জন্য গনিমতের মাল হালাল করে দেয়া হয়েছে, আমার জন্য সমস্ত জমীনকে মসজিদ এবং পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমার দ্বারা নবীগণের আগমন সমাপ্ত করা হয়েছে। [৪ মুসলিম।]
এ কারণেই সমস্ত মুসলিম জাতি এ কথার উপর ঐক্যবদ্ধ যে, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই সর্বশেষ নবী, তাঁর পরে আর কোন নবী নেই। তাঁর পরে যদি কেহ নবুয়তের দাবিকরে, তবে সে কাফের ও দাজ্জাল। এমনিভাবে যে কেহ এ আকীদা রাখে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা নবুয়্যত শেষ হয়নি, সেও কাফের এবং স্বচ্ছ মুসলিম উম্মত থেকে বহির্ভূত। কাজী আয়াজ ‘ইজমার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- যে ব্যক্তি খাতামুন নাবিয়্যীন এর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে না সে কাফের। তার স্পষ্ট বক্তব্য হল এই: যে, সকল লোক আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে অথবা পরে কারো নবুয়তের দাবিকরে, যেমন ইহুদীদের মধ্যে ঈসায়ী সম্প্রদায় বলে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেসালত আরবের জন্য খাছ, এমনিভাবে, হিজমিয়া সম্প্রদায় বলে যে, রাসূল আগমনের ধারা বিদ্যমান রয়েছে, তবে তারা সকলেই কাফের ও মিথ্যুক। কেননা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ দিয়ে গেছেন যে, তিনি সর্বশেষ নবী তাঁর পরে কোন নবী নেই। আর আর আল্লাহ তাআলাও সংবাদ দিয়েছেন যে, মুহাম্মদ সর্বশেষ নবী এবং সমস্ত মানব জাতির জন্য প্রেরিত। মুসলিম জাতি একমত যে, এ বাক্যটির বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতে হবে। কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ব্যতীত এর স্বাভাবিক মর্মই উদ্দেশ্য। সুতরাং অকাট্য দলীল প্রমাণ ও এজমা দ্বারা এদের কাফের সাব্যস্ত হওয়াতে কোন সন্দেহ নেই। (কাজি আয়াজের আশ-শিফা।)
দশম হাদীস উপরোক্ত সব উল্লেখের পর অবশিষ্ট হাদীস গুলোকে আমি বর্ণনা করছি, যাতে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দ্বারা নবুয়্যত শেষ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আমি আল্লাহর কাছে ঐ সময় সর্বশেষ নবীরূপে নির্ধারিত, যখন আদম আলাইহিস সালাম তরল মাটির মধ্যে ছিলেন। [১ শরহে সুন্নাহ ও মসনদে আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে মিশকাতুল মাসাবীহের লীখক হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।]
একাদশ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার অনেক নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মদ , আমি আহমদ, আমি মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ কুফর মিটাবেন। আমি হাসীর, যার পদাঙ্ক অনুসরণে কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে একত্র করা হবে। আমি আ’কিব, যার পরে আর কোন নবী নেই। [২ বুখারী ও মুসলিম।] অপর এক রেওয়ায়েতে আছে- আমি ঐ আ’কিব যে, আমার পর আর কোন নবী নেই। [৩ তিরমিযি।] উক্ত হাদীস স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ‘আমি আ’কিব’। অতঃপর নিজেই এর ব্যাখ্যা করেছেন- ‘আ’কিব ঐ ব্যক্তি যার পর আর কোন নবী নেই’। কিন্তু কাদিয়ানীরা যখন এ স্পষ্ট বক্তব্য দেখতে পেল, তখনই তারা তাদের অসৎ অভ্যাসের আশ্রয় নিল। আর, তা হল কুরআন হাদীসের পরিবর্তন ও বিকৃতি করা । তারা বলে: আ’কিব শব্দের ব্যাখ্যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি। বরং তা কোন বর্ণনাকারী করেছেন।’ (নজীর আহমদ কাদিয়ানীর আল-কাওলুস সারীহ’ ১৮৭ পৃ:।) কাদিয়ানীরা তাদের অজ্ঞতার কারণে তিরমিযীর রেওয়ায়েত সম্পর্কে অবহিত নহে। উহাতে উত্তম পুরুষের ভাষায় ব্যাখ্যা রয়েছে, ‘আমি ঐ শেষ আগমনকারী যে আমার পর আর কোন নবী নেই।’ [৪ তিরমিযি ২য় খন্ড, ১৩৭ পৃঃ। মিশর সংস্করণ ১২৯২ হিঃ।] এ ব্যাখ্যা আদৌ এ কথার সম্ভাবনা রাখে না যে, কোন বর্ণনাকারী উহার ব্যাখ্যা করেছেন। এর ভাষ্য হল: আমিই খাতাম আমার দ্বারা নবুওতকে শেষ করা হয়েছে এবং আমিই আ’কিব সুতরাং আমার পরে আর কোন নবী নেই। [১ ইবন হাযার আসকালানীর আল-ইসাবাত গ্রন্থের হাসিয়া যা ইবন আব্দুল বার আল-ইন্তিখাব নামে রচনা করেছেন। ১ম খন্ড, ৩৭ পৃঃ মিশর সংস্করণ।]
অনুরূপভাবে কাজী আয়াজ উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন- আমিই আ’কিব যে আমার পর আর কোন নবী নেই।’ [২ কাজী আয়াজের আশ-শিফা ১৯১ পৃঃ ইস্তাম্বুল সংস্করণ।]
এসব উদ্ধৃতির পর কাদিয়ানীদের পক্ষে একথা বলার কোন অবকাশ নেই যে, এ ব্যাখ্যা কোন রাবীর পক্ষ থেকে করা হয়েছে এবং উহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভাষা নহে। কেননা, আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি যে, এ রেওয়ায়েতটি মুতাকাল্লিমের জমীর (উত্তম পুরুষের সর্বনাম) দ্বারা বর্ণিত। আর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে মুতাকাল্লেমের জমীর দ্বারা বর্ণনা করা সম্ভব নহে। হাদীসের বর্ণনা ভঙ্গিও তা বোঝাচ্ছে। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে বলেছেন: আমি মাহী’ অতঃপর এর ব্যাখ্যা করেছেন- যার দ্বারা আল্লাহ কুফরকে মিটাবেন।’ তারপর বলেছেন আমি হাসীর’ এরপর এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন- আমার পদাঙ্ক অনুসরণে সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে।’ অতঃপর বলেছেন আমি আ’কিব এবং এ ক্ষেত্রেও বলেছেন ‘যার পর আর কোন নবী নেই’। এ কথা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, তিনি নিজেই শেষ আগমন কারীর ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন তিনি মাহী’ ও হাসীর’ এর ব্যাখ্যা করেছেন। মোটকথা, যখন আমরা এ ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণ করে দিলাম, তখন এ ব্যাপারে আর কারো পক্ষ থেকে ইতস্তত: করার অবকাশ নেই যে, ভন্ডনবী মিথ্যাবাদী তার নবুয়তের দাবিতে সম্পূর্ণ মিথ্যা।
দ্বাদশ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলীকে রা. সম্বোধন করে বলেছেন আমার কাছে তোমার ঐ মর্যাদা রয়েছে, যেমন মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে হারূণ আলাইহিস সালাম এর মর্যাদা ছিল। কিন্তু পার্থক্য শুধু এতটুকু যে আমার পর আর কোন নবী নেই। [৩ বুখারী ও মুসলিম।]
এ হাদীসটি অতি স্পষ্ট করে বোঝাচ্ছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তবুক যুদ্ধের সময় আলী রা. কে যখন তাঁর পিছনে রেখে মদিনাতে যেতে চাইলেন, তখন আলী রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সাথে জিহাদে শরীক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করলেন। সেই সময় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন, আমি তোমার মর্যাদাকে খাটো করার জন্য কিংবা তোমার সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য তোমাকে পেছনে রেখে যাচ্ছি না, বরং মদিনাতে তোমাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করছি, যেমন মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর সাক্ষাতে তূর পর্বতে গমনকালে তাঁর ভাই হারূণকে আলাইহিস সালাম স্বীয় কওম দেখা শোনার জন্য স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। এ দু টোর মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই শুধু এই কথা যে, হারূণ আলাইহিস সালাম নবী ছিলেন। কারণ, নবুয়তের ধারা তখন খতম হয়নি। কিন্তু তুমি নবী নও। কারণ নবুয়্যত আমার দ্বারা শেষ হয়ে গেছে এবং আমার পর আর কোন নবী নেই । এ অর্থকেই শক্তিশালী করছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আর একটি বাণী, যা হযরত সা’দ ইবন আবি ওক্কাসের রা. রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: আমার পর নবুয়্যত নেই’। [১ মুসলিম।]
এই রেওয়ায়েতটি কাফের মুরতাদ সম্প্রদায়ের উপর একটি চরম আঘাত, যারা আল্লাহর বাণীসমূহ ও রাসূলের বাণীসমূহকে ইহুদীদের ন্যায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে। তারা বলে ‘লা নাবিয়া বা’দী’ বাক্যে ‘লা’ অব্যয়টি ‘নফী কামাল’ (পরিপূর্ণতার না বোধক) অর্থে ব্যবহৃত। ‘নফী জিনস’ (মূল নবুয়তের না বোধক) অর্থে ব্যবহৃত নহে। সুতরাং তাদের মতে বাক্যটির অর্থ হয়- আমার পর স্বয়ং সম্পূর্ণ কোন নবী নেই। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে হারূণের আলাইহিস সালাম উল্লেখ করলেন। অতঃপর ‘লা নাবিয়া বা’দী বললেন। এটা জানা কথা যে, হারূণ আলাইহিস সালাম কোন স্বয়ং সম্পূর্ণ নবী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন মুসার আলাইহিস সালাম অনুগামী একজন নবী।
আসল কথা হল- এই এন্টি দলটি শুধু খতমে নবুওতকে অস্বীকার করতে চাচ্ছে না, বরং এর চেয়ে আরো বেশি কিছু তারা চায়। আর, তা হল- আল্লাহ সুবহানাহু অতাআলার অস্তিত্ব সম্পর্কে কুফরীর দ্বার উদ্ঘাটন করা এবং তাওহীদের বুনিয়াদকে ধ্বংস করে দেয়, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং পূর্বেকার সকল রাসূল স্থাপন করে গেছেন। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী ‘লা নবুওতা বা’দী’ এবং ‘লা নাবিয়া বা’দী’ বাক্যে পরিপূর্ণতার না বোধক অর্থ নির্ধারণ করতে চায়। যাতে এ নীতির ভিত্তিতে তাদের কোন একজন অনুরূপ কথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সম্পর্কেও বলতে পারে আমাদের ঐ উদ্ধৃতি এ কথাকেই সমর্থন করছে যা আমরা তাদের থেকে আল্লাহ তাআলার সাথে মানানসই নয় এমন অসমীচীন গুণ সম্পর্কে পঞ্চম প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি। মোটকথা, কাদিয়ানী নেতা ও ভন্ডনবী স্বীকার করেছে. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি ‘লা নাবিয়া বা’দী’ এর ‘লা’ অব্যয়টি ব্যাপক নফীর জন্য, ‘নফী কামালের জন্য নহে। (গোলাম কাদিয়ানীর ‘আইয়েমে সুলাহ’ ১৪৬ পৃ:।))কোন কোন কাদিয়ানী এই উক্তি করেছে যে, উক্ত হাদীসে নফী আলী রা. এর জন্য খাছ। এটা আরবী ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সত্যের মোকাবেলায় শুধু হটকারিতা বৈ আর কিছু নয়। কেননা, আরবী ভাষা সম্বন্ধে যার সামান্যতম ধারণা আছে, সে বুঝতে পারে যে, এর দ্বারা সাধারণ ভাবে না বেধক অর্থ উদ্দেশ্য। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- ‘আমার কাছে তোমার ঐ মর্যাদা রয়েছে যে মর্যাদা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে হযরত হারূণ আলাইহিস সালাম এর ছিল, কিন্তু পার্থক্য হল শুধু এতটুকু যে, আমার পর কোন নবী নেই।’ অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে- ‘আমার পর নবুয়্যত নেই।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো একথা বলেন নি যে, আমার পর তুমি নবী নও।
ত্রয়োদশ হাদীস- আবু হুরায়রা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন: ‘নবুয়তের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, রয়েছে একমাত্র সুসংবাদ’। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন সুসংবাদ কি? উত্তর দিলেন, ‘সৎ স্বপ্ন’। [২ বুখারী।]
এই হাদীসের অর্থ অতি স্পষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে আর কোন নবী নেই এবং কোন নবুওতও নেই। কাদিয়ানী ও তাদের সাথী মুরতাদ দল দলীল পেশ করে যে, কোন কোন হাদীসের কিতাবে আছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যদি ইব্রাহীম জীবিত থাকতেন তা হলে তিনি সত্যবাদী নবী হতেন।’ (আল-কাওলুস সারীহ’ এবং আহমদীয়া পকেট বুক)’ কয়েকটি কারণে তা ঠিক নহে এগুলো আমি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। কেননা, তারা এ রেওয়ায়েতের পাশেই ভ্যান ভ্যান করে ঘুরপাক খাচ্ছে, বিশেষকরে সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়তের ধারা এবং রাসূল আগমনের ছিলছিলাকে প্রমাণ করার জন্য। অথচ এতে এমন কোন দলীল ও প্রমাণ লাভের অবকাশ নেই।
প্রথমত: এ হাদীস বিশুদ্ধ নহে। আল্লামা নববী ও অন্যান্যরা এর বিশ্লেষণ করেছেন। কারণ, উক্ত হাদীসের সনদে ইব্রাহীম ইবন উসমান মুহাদ্দিসগণের ঐক্যমত অনুযায়ী দুর্বল। তার সম্পর্কে শু’বা বলেছেন: মিথ্যুক, ইমাম আহমদ বলেছেন: ‘দুর্বল’ ইবন মুঈন বলেছেন: বিশ্বস্ত নহে, এবং নাসায়ী বলেছেন: বর্জিত। [১ ইমাম জাহাবীর মিযানুল এ ’তেদাল।] সুতরাং এ সকল মতামতের পর আর এই হাদীসের দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না।
দ্বিতীয়ত: যদি এ হাদীস ঠিক মেনেও নেওয়া যায় তবুও তা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খতমে নবুয়তের পরিপন্থী নহে। কারণ, এর অর্থ হল ইব্রাহীম যদি বাঁচতেন তা হলে তিনি সত্যবাদী নবী হতেন, কিন্তু তাঁর জন্য বেঁচে থাকা সম্ভব পর ছিল না। কেননা, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খতমে নবুয়্যত তাঁর বাঁচার জন্য প্রতিবন্ধক ছিল। আর এটাই হাফেজ ইবনে হাজার ইমাম আহমদের রেওয়ায়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমদ তাঁর মাসনদে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন: ‘যদি ইব্রাহীম জীবিত থাকতেন, তা হলে
নবী হতেন, কিন্তু, তিনি জীবিত থকতে পারেন নি। যেহেতু তোমাদের মধ্যেই রয়েছে সর্বশেষ নবী।’ [২ ফতহুল বারী ইবন হাজার।] এটাকে সমর্থন করছে ঐ হাদীস যা ইমাম বুখারী রা. ইবন মাযা ও অন্যান্যরা ইবন আবু আওফা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন: ইব্রাহীম শিশু অবস্থায় মারা গেলেন। যদি হযরতের পর আর কোন নবী হওয়া সম্ভব হত, তবে তাঁর পুত্র অবশ্যই জীবিত থাকতেন । কিন্তু তাঁর পরে তো কোন নবী নেই।’ [৩ বুখারী ও ইবন মাযা।]
তৃতীয়ত: উক্ত হাদীসে ‘লাও’ অব্যয়টি শর্তের জন্য। আর, শর্তযুক্ত বাক্য প্রথম অংশের বাস্তবায়ন অপরিহার্য করে না। তাই এ উক্তি আল্লাহ তাআলার ঐ বাণীর মতই (যদি আসমান ও জমীনে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ হতেন, তবে উভয়টি বিনষ্ট হয়ে যেত) [৬ সুরা আম্বিয়া ২২।] অর্থাৎ অন্য কোন মাবুদও নেই। কাজেই আসমান ও জমিন বিনষ্টও হবে না এমনিভাবে ইব্রাহীম ও জীবিত থাকবেন না এবং কোন নবীও আসবেন না। মোটকথা, এ হাদীসটিও জোরালোভাবে প্রমাণ করছে যে, নবুয়্যত বিশ্বস্ত সত্যবাদী নবীর উপর শেষ হয়ে গেছে। কাফের মুরতাদগণ যেভাবে ধারণা করছে তা ঠিক নহে। এদিকেই মহান ও সম্মানের অধিকারী আল্লাহ ইঙ্গিত করেছেন- আল্লাহর বাণী: ‘আজকের দিন আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত চূড়ান্ত ভাবে সম্পন্ন করে দিলাম। আর ইসলাম কে তোমাদের দ্বীন রূপে মনোনীত করলাম।’ [১ সুরা মায়েদা ৩।] আল্লাহর বাণী: ‘হে রাসূল, আপনি বলুন, হে মানব জাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর রাসূল।’ [২ সুরা সাবা ২৮ ।] আল্লাহর বাণী: আমি কেবলমাত্র আপনাকে সকল মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শন কারি রূপে প্রেরণ করেছি।’ [৩ সুরা আহযাব।] এরূপ অনেক আয়াত রয়েছে। এজন্যই গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তাকে কাফের সাম্রাজ্যবাদীরা আজ্ঞাবহ করার পূর্বে বলেছিল: আল্লাহ তাআলা স্বীয় উক্তি এর মধ্যে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে,নবুয়্যত হযরত মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর শেষ হয়ে গেছে এবং তিনিই সর্বশেষ নবী।’ (গোলাম কাদিয়ানীর তোহয়ায়ে গড়লিয়া’ ৮৩ পৃ:।)
চতুর্দশ হাদীস- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: যদি আমার পর কেহ নবী হতেন তা হলে তিনি হতেন ওমর।’ [৪ তিরমিযি।]
এ হাদীসটিও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়্যত শেষ হওয়ার পক্ষে স্পষ্ট দলীল। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় যে দলটি তাদের অনুকরণ ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন পদ্ধতি ছেড়ে দিয়েছে, আর, বিশ্বাস ঘাতক সাম্রাজ্যবাদের আঁচল আঁকড়ে ধরেছে, তারা যখনই কোন সুস্পষ্ট বাণী দেখতে পায় তখনই তা অস্বীকার করে বসে। শুধু অস্বীকারই করে না, ইহুদীদের ন্যায় এটাকে বিকৃত এবং মিথ্যার রূপই দান করে। যদিও নিয়মানুযায়ী তাদের উপকারে আসে না বা অভিধান কিতাবাদী তাদের সহায়তা করে না। তাদের এ ধরনের একটি নিকৃষ্ট ফন্দি হল উক্ত হাদীসকে অস্বীকার করার জন্য তারা বলে: ‘& হাদীসটি গরিব’ উহা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না’। তারা আরো বলে, বা’দী শব্দের বিপরীত নহে। সুতরাং ইহা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর কোন নবী নেই।’ এই কথার দলীল হতে পারে না। (আল কওলুস সারীহ’ ১৮৪ পৃ:।)
এ সমস্ত কথা বলেছে জিন্দিক ও মুরতাদগণ। এদের বক্তব্যের অর্থহীনতার প্রতি লক্ষ করুন । প্রথমত: এদের উক্তি- ‘গরীব হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না’। এটা হাদীস মুহাদ্দীছগণের পরিভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নহে। কেননা, হাদীছ গরীব হওয়াতে উহা অভিযুক্ত হয় না এবং এটাকে দুর্বল করে না। এই সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা দিচ্ছেন হাদীসের ইমাম ও পরিভাষা-বিদ-গণ। যথা: ইমাম ইবন সালাহ, হাকিম, খতীব আসকালানী প্রমুখ, ‘উলুমুল হাদীস, ‘মারেফাতু উলুমুল হাদীস, গরাবাতের সাথে দুর্বলতা ও সবলতার কোন সম্পর্ক নেই। এর উদাহরণ হল বুখারীর প্রথম হাদীসঃ إنما
الأعمال بالنيات
এটা গরিব হাদীস। অথচ এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই যে, উহা বিশুদ্ধ হাদীস, উহা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া তিরমিজি স্বয়ং স্পষ্ট করে বলেছেন যে, এ হাদীসটি হাসান। আর, হাসান মকবুলের অন্তর্ভুক্ত। এইভাবে এদের উক্তি ‘বা’দ (পরে) শব্দটির অর্থ ‘গায়ের’ (ব্যতীত) গ্রহণ করা, এটা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উক্তি ছাড়া আর কিছুই নহে। অন্যথায়, আরবী ভাষার কোন অভিধানে ‘বা’দ’ এর অর্থ গায়ের পাওয়া যায় নি যে, তারা এ শব্দকে ভিন্ন ও বিপরীত অর্থে ব্যবহার করছে। কাদিয়ানীরা আল্লাহ তাআলার বাণী:
فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَ اللَّهِ وَآَيَاتِهِ يُؤْمِنُونَ ﴿6 الجاثية﴾
দ্বারা যে দলীল পেশ করছে যে, উক্ত আয়াতে বা’দ শব্দটি গায়ের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এটা তাদের অজ্ঞতা ও স্বল্প জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। তারা যে আরবী ভাষার জ্ঞান থেকে বহু দূরে, তাই বোঝাচ্ছে। কেননা, আরবরা অধিকাংশ স্থানে (মুজাফইলাইহি) কে লোপ করে উহার স্থানে দ্বিতীয় মুজাফ ইলাইহিকে বসিয়ে থাকে। এটা ঐ সকল ব্যক্তিই বুঝতে পারে, যাদের আরবী ভাষা সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রয়েছে। বা উহার প্রাথমিক বিষয়াদি পড়াশোনা করেছে। এ ধরনেরই একটি বাক্য হল মহান আল্লাহর বাণী:
فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَ اللَّهِ وَآَيَاتِهِ يُؤْمِنُونَ
অর্থাৎ (আল্লাহর বাণী তথা কুরআন ও এর আয়াত সমূহের পর আর কোন কথার প্রতি তারা বিশ্বাস রাখে?) এভাবেই স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন মুফাস্সেরগণের ইমাম ইবন জারীর, ইমাম সয়ূতী, আবুস সুউদ, জমাখশারী ও বায়জাভী প্রমুখ আল্লামাগণ। ঠিক এই অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন খাজেন ও নাসাফী। তাঁরা বা’দ শব্দের পরে কালামুল্লাহ ঊহ্য ধরে বলেছেন:(আল্লাহর পর অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর আয়াতের পর ওরা কোন বাণীর প্রতি বিশ্বাস রাখবে।) [১ সুরা জাছিয়া ৬।] (মায়ালেম ও মাদারেক।) এ ধরনের দৃষ্টান্ত আরবদের কথা-বার্তায় অনেক। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমের দোয়ায় বলেছেন: أنت الآخر فليس بعدك شيء
(তুমিই শেষ তোমার পর আর কিছু নেই) [২ মুসলিম।] মুল্লা আলী ক্বারী এর অর্থ সম্পর্কে বলেন-অর্থাৎ: أي بعد آخريتك (তোমার শেষত্বের পর আর কিছু নেই।) [৩ মিরকাত. ৩য় খন্ড, ১০৮ পৃঃ।] এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি ‘আমার পর কোন নবুয়্যত নেই। [৪ মুসলিম।] এর অর্থ-.
অর্থাৎ আমার নবুয়তের পর আর কোন নবুয়্যত নেই’।
আমরা অন্যভাবে বলি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ হাদীস নবুয়্যত শেষ হওয়ার উপর অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ, অন্য হাদীস একে শক্তিশালী করছে, যার মধ্যে বা’দ শব্দের উল্লেখ নেই। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তি যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘আমি হলাম শেষ নবী।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আরো একটি উক্তি: নবুয়্যত আর অবশিষ্ট নেই কেবলমাত্র সুসংবাদ ব্যতীত। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন-সুসংবাদ কি? উত্তর দিলেন- সৎ স্বপ্ন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অপর একটি উক্তি: রেসালত ও নবুয়্যত শেষ হয়ে গেছে। [১ ইহার আলোচনা পূর্বে চলে গেছে।] এ সকল হাদীস সহ আরো অনেক হাদীস স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, বা’দ এর অর্থ শেষে হওয়া এবং শেষ। এ অর্থ অতি স্পষ্ট।
আর কাদিয়ানীদের উক্তি যে, বা’দ শব্দটি ‘গায়ের’ অর্থে ঐ রেওয়ায়েতের মধ্যে ব্যবহার হয়েছে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করা হয়, তিনি বলেছেন: ‘যদি আমাকে প্রেরণ করা না হত, তা হলে হে ওমর তোমাকে প্রেরণ করা হত।’ (আল- কওলুস সরীহ’ এবং আহমদিয়া পকেট বুক।’) এটা সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা, কাদিয়ানীরা এ রেওয়ায়েতকে মিরকাত থেকে উদ্ধৃত করেছে, আর, মিরকাতের লেখক এর সনদ উল্লেখ করেন নি। এ কারণে রেওয়ায়েতটি অজ্ঞাত। ‘শেখ আব্দুল্লাহ মে’মার উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল শব্দে উক্ত রেওয়ায়েতটি হাদীসের কোন কিতাবে পাওয়া যায় না। সম্ভবত: মোল্লা আলী ক্বারী এ রেওয়ায়েতটিকে অপর রেওয়ায়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন যার শব্দাবলি হল- যদি আমাকে প্রেরণ করা না হত, তবে অবশ্যই তোমাদের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করা হত। আর ওমর রা. কেই তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করা হত’। [২ মানাবীর ‘কুনুজুল হক’।] অথবা এটা নিম্নোক্ত রেওয়ায়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন ‘যদি আমি প্রেরিত না হতাম তা হলে আমার পর ওমর রা. কে প্রেরণ করা হত’। [৩ কুনুজুল হক।]
কিন্তু এত সত্ত্বেও উহা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না। কারণ, এ দুটি রেওয়ায়েত দুর্বল এবং বানোয়াট।
প্রথম রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করেছেন ইবনুল জাওযী তাঁর কিতাব ‘মাওযুয়াত’ এর মধ্যে দুটি সনদে। প্রথম সনদের মধ্যে একজন রাবী যার নাম জাকারিয়া ইবন ইয়াহইয়া ওক্কার, সে মিথ্যুক ও হাদীস রচনাকারী। ইবনুল জাওযী বলেছেন: ‘জাকারিয়া মিথ্যুক, সে হাদীস রচনা করে।’ (মাওজুয়াত) জাহবী তাঁর আল-মীজান গ্রন্থে বলেছেন: ইবন আদী বলেছেন: ‘জাকারিয়া হাদীস রচনা করে।’ সালেহ বলেছেন: ‘সে বড় মিথ্যুকদের একজন ছিল।’ [৪ জাহাবীর মীজানুল এতেদাল।] এ রেওয়ায়েতের দ্বিতীয় সনদে একজন রাবীর নাম আ্দুল্লাহ ইবন হেরানী তার সম্পর্কে ইবন জাওযী বলেছেন: ‘সে বর্জিত।’ [৫ মাওজুয়াত।] আর, জাহাবী ইয়াকুব ইবন ইসমাঈল থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, ইবন ওয়াকেদ মিথ্যাবাদী ছিলেন।’ [৬ জাহাবীর মীজানুল এতেদাল।]
এ কারণেই, ইবন জাওযী এ রেওয়ায়েতকে উভয় সনদের দিক থেকে মওযু বলেছেন। আর, দ্বিতীয় রেওয়ায়েত অর্থাৎ ‘যদি আমি প্রেরিত না হতাম তা হলে অবশ্যই আমার পরে ওমরকে রা. প্রেরণ করা হত।’ উহাতে ইসহাক ইবন নুজাইহ মালতী নামে জনৈক রাবী রয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে জাহাবী তাঁর পুস্তক ‘আল-মীজানে’ ইমাম আহমদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন- আহমদ বলেছেন যে, সে লোকজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। ইয়াহইয়া বলেছেন, সে মিথ্যাবাদী ও হাদীস রচনার কাজে প্রসিদ্ধ। [৭ মীজান।] এজন্য ইবন জাওযী বলেছেন: এ রেওয়ায়েতটিও মওযু (বানোয়াট) [১ মওজুয়ত।] মোটকথা, এ উভয় রেওয়ায়েতই মওযু। এর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা সঠিক নহে এবং এর দ্বারা হুজ্জতও প্রমাণিত হয় না। তাই বা’দ শব্দের অর্থকে বিকৃত করার মধ্যে তাদের চক্রান্ত নিহিত রয়েছে, যে চক্রান্ত ইহুদীরা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য করে যাচ্ছে।
পঞ্চদশ হাদীস- এরপর আমি আর একটি হাদীস উল্লেখ করব। তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: ‘হে আবু জর! সর্ব প্রথম নবী আদম আলাইহিস সালাম এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। [২ ইবন হিববান তাঁর সহীহ কিতাবে এবং আবু নাঈম হুলিয়া কিতাবে বর্ণনা করেছেন, আর ইবন হাজার ফতহুল বারী কিতাবে উহাকে সহীহ বলেছন] এ সকল বিশুদ্ধ হাদীস এবং কুরআনে স্পষ্ট ভাষ্য অকাট্য ভাবে প্রমাণ করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। আর, যে ব্যক্তি তার পরে নবুয়তের দাবি করবে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মিথ্যুক ও দাজ্জাল। ইমাম ইবন কাসীর র. বলেছেন: ‘বান্দার প্রতি আল্লাহর অসীম মেহেরবানি যে, তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাদের প্রতি প্রেরণ করেছেন। অতঃপর তাঁকে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে সম্মানিত করেছেন। আর, তাঁরই সম্মানে খাঁটি দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন।’ আল্লাহ তাআলা স্বীয় কিতাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিশুদ্ধ হাদীসে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর পর আর কোন নবী নেই, যাতে সকল মানুষ জানতে পারে যে, যে কেহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর ঐ পদবির দাবি করবে, সে মিথ্যুক, অপবাদদাতা, দাজ্জাল, বিভ্রান্ত ও বিভ্রান্তকারী। যদিও তাদের কেহ আগুন দিয়ে খেলে এবং বিভিন্ন প্রকার যাদু মন্ত্র ও ম্যাজিক দেখায়, তবুও বুদ্ধিমান লোকের দৃষ্টিতে এ গুলো প্রতারণা ও ধোঁকা ব্যতীত কিছুই নহে। যেমন করে মহান আল্লাহ ত’আলা ইয়ামেনে আসওদ আনাসীর হাতে এবং ইয়ামামাতে মুসাইলামা কাজ্জাবের হাতে অনেকগুলো বিভ্রান্তিকর অবস্থা ও বাজে উক্তি সমূহ প্রকাশ করান। এ গুলো দেখে প্রত্যেক বুদ্ধিমান, বোধশক্তি সম্পন্ন ও যোগ্য লোক বুঝে নেয় যে, এরা মিথ্যুক। এদের উপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা মিথ্যা নবুয়তের দাবি করবে, তাদের সকলের উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ। সুতরাং এ সকল মিথ্যুকদের কারো কারো কাছে আল্লাহ তাআলা এমন অবস্থা সৃষ্টি করেন যা দেখে আলেমগণ ও মোমিন বান্দাগণ এদের মিথ্যা দাবি অনুধাবন করে নিতে পারেন। [৩ তাফসীরে ইবন কাসীর, ৩য় খন্ড ৪৯৪ পৃঃ মিশর সংস্করণ।] এ সমস্তের পর অর্থাৎ পূর্বে আলোচিত সত্যকে অনুধাবন করার পর এবং কুরআন হাদীস ও আরবী ভাষা নিয়ে কাদিয়ানীদের খেলা করার ব্যাপারে অবহিত হওয়ার পর আর তাদের অমূলক বিকৃতি, সারশূন্য ব্যাখ্যা বলী, নিকৃষ্ট উক্তি ও সস্তা জ্ঞান শূন্য আকীদা বিশ্বাসের পর আমি তাদের আরো কিছু বিকৃতির কথা উল্লেখ করতে চাই, যদ্দারা তারা দলীল গ্রহণ করতে চায় যে, নবুয়তের ধারা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। ফলে এ প্রবন্ধটি ওদের সমস্ত চক্রান্ত এবং বিভ্রান্তির এটা সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে পারবে এবং পাঠক ওদের স্বভাবগত ঘৃণিত অবস্থা ও গোপন দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে।
কাদিয়ানীরা বলে- আল্লাহ তাআলার বাণী: ‘যারা আল্লাহ ও রাসূলের কথা মেনে চলবে, তারা পরকালে ঐ সকল লোকদের সাথে থাকবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এরা হলেন- নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল লোকগণ। আর, তারা কতই না উত্তম সাথী! [১ সূরা নিসা, ৬৯ আয়াত।]
এই আয়াত প্রমাণ করছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়তের ধারা চালু আছে। (কাদিয়ানী পুস্তক আল-কাওলুস সারীহ’ ১৯৭ পৃ: এবং আহমদিয়া পকেট বুক ৫০০পৃঃ ইত্যাদি।)
আরবী ভাষার সাথে যার সামান্যতম সম্পর্ক আছে অথবা যে উহার শব্দাবলির অর্থ বুঝে, তার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর নবুয়তের ধারা চালু থাকার উপর দলীল গ্রহণ করা সম্ভব। কারণ, উক্ত আয়াতের মধ্যে এ অর্থের প্রতি সামান্যতমও ইঙ্গিত নেই। কিন্তু কাদিয়ানীরা এবং যারা তাদের সাথে শয়তানের পথ অনুসরণ করে চলেছে, তারা এ পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাতে দুঃসাহস করেছে। এমনকি, তারা তাদের মিথ্যা নবীর নীতি ধরে শয়তানের ওহীর সাহায্যে ইসলামের নামে জনসাধারণকে প্রতারিত করার জন্য পরাক্রমশালী এক আল্লাহর পবিত্র কালাম পরিবর্তন করতে লজ্জাবোধ করেনি।
অতএব, তারা কুরআন ও হাদীসের সকল বাণী এবং আইম্মায়ে তাফসীর ও ভাষাবিদদের মতামতের বিপরীত বলে: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা মেনে চলে সে নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেক্কার গণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।’ হ্যাঁ এ সব কথা বলছে, কুরআনের অস্বীকার কারী আল্লাহর শত্রু ও তাঁর রাসূলের শত্রু এবং ইসলামের শত্রু বিশ্বাসঘাতক সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা, যারা একজন আফিমখোর মদ্যপায়ী ইংরেজদের সেবাদাস ব্যক্তির নবুয়্যত প্রমাণ করতে চায়। অথচ, আয়াতের অর্থ অতি স্পষ্ট। আর তা হল এই ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তারা নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককারগণের সান্নিধ্য লাভ করতে পারবে।’ এ জন্যই আল্লাহ তাআলা এর পরেই বলেছেন: ‘আর তারা কতই না উত্তম সাথী।’ অন্যথায় এদের উক্তি থেকে কতকগুলো বিষয় অপরিহার্য হয়ে পড়ে: প্রথমত:- নবুয়্যত উপার্জন উপযোগী বস্ত্ত, দান গত বস্ত্ত নহে। আর যে কেহ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, সে নবী হতে পারবে। ইহা কুরআনের স্পষ্ট ভাষ্যের বিপরীত। আল্লাহর বাণী: ‘আল্লাহ ফেরেস্তাদের মধ্যে এবং মানুষের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকেই রাসূল মনোনীত করেন।’ [২ সুরা হাজ্জ।]
দ্বিতীয়ত:- যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবে, তাদের নবী হওয়া অপরিহার্য হবে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ যাদের প্রশংসা করেছেন মহান আল্লাহ স্বীয় কালামে পাকে। কেননা, আজ পর্যন্ত তাদের তুলনায় আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি অধিক অনুগত আর কাইকে পাওয়া যায়নি এবং পাওয়া যাবেও না। তাদের পরেই মর্যাদা ও আনুগত্য লাভ করেছেন তাবেয়ীগণ, অতঃপর তাবে তাবেয়ীগণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের কেহ দাবি করেননি যে, তিনি নবী হয়ে গেছেন। কোন ইমামও একথা বলেন নি যে, তাঁরা নবী ছিলেন। এই নীতিতেই মহান আল্লাহ যখন সত্যিকার মুমিনদের কথা উল্লেখ করেছেন তখন তাদের সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহ উপাধি দান করেছেন। আল্লাহর বাণী: ‘নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারীগণ এবং যারা আল্লাহর নিকট করযে হাসানা পেশ করে, আল্লাহ তাদের প্রতিদান অনেকগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দেবেন। আর যারা আল্লাহ ও তার রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তাঁরা তাদের প্রভুর কাছে সত্যবাদী ও শহীদরূপে পরিগণিত। [১ সুরা হাদীদ-১৮] আল্লাহর বাণী: ‘যারা ঈমানদার এবং সৎকাজ করে আমি তাদেরকে আমার নেকার বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করব।’ [২ সুরা আনকাবুত-৯] আল্লাহ তা’য়ালা এ কথা বলেন নি যে, আমি তাদের নবীগণের অন্তর্ভুক্ত করব। কেননা, নবুয়্যত অর্জন যোগ্য কোন বস্ত্ত নহে। অন্যথায়, ভন্ডনবী কাদিয়ানী শুধু একাই নবী হবে না, বরং যারাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসারী হবে, তারা সকলেই কোন প্রকার ব্যতিক্রম ছাড়াই নবী হবেন। এ কথা স্বয়ং কাদিয়ানীরাও বলে না।
তৃতীয়ত:- আল্লাহ তাআলার বাণী: - وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ
)যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে) উহাতে নারী পুরুষ উভয়ই শামিল। তবে মহিলাদেরকে নবী হওয়া থেকে বঞ্চিত রাখা হবে কেন?
চতুর্থত:- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সঙ্গী হবে। [৩ তিরমিযি, দারমী, দারকুতনী ও শিশকাত।] এর অর্থ কি বিশ্বস্ততার দ্বারা নবী হয়েছেন? উপরোক্ত এ হাদীসটি আয়াতের মতই সুদৃঢ়। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- ‘সত্যবাদী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবীগণের সঙ্গী হবেন।’ যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘যে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ নবী ও ছিদ্দীকগণের সঙ্গী হবে।’ এর মর্ম হল সত্যবাদী ব্যবসায়ী ব্যক্তি এ সকল মুকাররব (আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী) বান্দাদের সঙ্গ লাভ করবে।
পঞ্চমত:- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর নিকটবর্তী সময়ে আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সালেহগণের সঙ্গ লাভের জন্য প্রার্থনা করতেন। [৪ বুখারী ও মুসলিম।] এর অর্থ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্নেহশীল করুণাময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতেন, তিনি যেন তাঁকে এ দুনিয়া থেকে আপন সান্নিধ্যে নিয়ে যান, যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককার বান্দাগণের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন। অনুরূপ আরেকবার বলেছেন- (হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ সাথী!) অন্যথায়, নবী সিদ্দিক ও শহীদ হবার প্রার্থনা দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? অথচ তিনি তো পূর্ব থেকেই নবী।
ষষ্ঠত:- মহান আল্লাহর বাণী:-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ( الأحزاب 40)
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নহেন। বরং তিতি আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী।) আল্লাহর বাণী:-
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ( المائدة 3)
(আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার করুণা সু-সম্পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীনরূপে পছন্দ করলাম।)
আল্লাহর বাণী: -وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا ( سبأ 28)
(আমি আপনাকে সমস্ত মানব জাতির জন্য সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।) কুরআনে বর্ণিত আরো পবিত্র বাণীসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর আর কোন নবী নেই। অনুরূপভাবে মহান রাসূলের মুতাওয়াতির হাদীস সমূহ এ কথার উপর অকাট্য হুজ্জত যে, তাঁরপর নবুয়তের ধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। সুতরাং এ সকল প্রকাশ্য প্রমাণাদি হুজ্জতের পর কোন বিকৃতকারী ও ইহুদীদের অনুসারীর পক্ষে কোন অধিকার নেই যে, সে মহান আরশের প্রভুর বাণীর সাথে খেলা করে কোন অপবাদ রটনাকারী মিথ্যুকের জন্য নবুয়্যত সাব্যস্ত করবে।
সপ্তমতঃ- কাদিয়ানীরা বলে- আল্লাহর বাণী:
مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ( النساء 69)
এর মধ্যে ‘মাআ’ শব্দটি ‘মিন এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, এ কথার কোন দলীল নেই। কারণ, কোন ভাষাবিদ বা কোন তাফসীরকারক এমন কথা কখনও বলেন নি। তাফসীরকারক সকলেই এ কথা সাব্যস্ত করেছেন যে, এ আয়াতে ‘মাআ’ এর অর্থ সঙ্গ ও সাথে থাকা। বিখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে কাছীর এ শব্দ প্রসঙ্গে বলেন: ‘তাকে ওদের সাথী বানিয়ে দেয়।’ ইমাম যমখশারী রহ. বলেন: আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী বান্দা তাঁর সাথী হবেন।’ ইমাম রাজী এর অর্থ করেন, ‘যখন তারা আমার দর্শন ও সাক্ষাৎ লাভ করতে চাইবে, তখন তা পারবে।’ কাদিয়ানীরা এ অর্থ গ্রহণ না করলে আল্লাহ তাআলার এ বাণী সম্পর্কে কি বলতে পারে?-
إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿البقرة 153﴾
(নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।) এর অর্থ কি আল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত? তারা আল্লাহ তাআলার এ বাণী সম্পর্কেও কি বলতে পারে?
( النحل ১২৮) إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا
নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। এর অর্থ কি আল্লাহ মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত?))মোটকথা, আল্লাহ তাআলার বাণীতে ‘মাআ’ শব্দটি ‘মায়িআত’ বা সাথী হওয়ার অর্থ প্রদান করছে। অর্থাৎ এ ব্যক্তির ঐ সকল মুকাররব বান্দাদের সঙ্গ হাসেল হবে। স্বয়ং আয়াতের শেষ অংশ এর তাফসীর করছেঃ
وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا ﴿النساء 69﴾
(এরা কতই না উত্তম সাথী।)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঐ বাণীও এর সাক্ষ্য দিচ্ছে- ‘একজন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে হাজির হয়ে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আমি এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল। আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আমার মালের যাকাত আদায় করি এবং রমযানের রোযা রাখি। উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মারা যাবে সে কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথে এমনভাবে থাকবে, এ কথা বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি অঙ্গুলি একসাথে খাড়া করলেন। [১ আমর ইবন মুররাতাল যুহনীর রেওয়ায়েত থেকে ইমাম আহমদ তার মসনদে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঐ বাণীও একথার সাক্ষ্য দিচ্ছেঃ
من أحبني كان معي في الجنة
(যে আমাকে ভালবাসে সে বেহেশতে আমার সাথে থাকবে।) [২ তিরমিজী।]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হযরত রবিয়া ইবনে কা’বের প্রতি যখন তিনি আবেদন করেছিলেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি বেহেশতে আপনার সঙ্গ কামনা করি’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন- ‘তুমি এ কাজে নিজের জন্য বেশি বেশি সেজদা করে আমাকে সাহায্য কর’। [৩ মুসলিম।] এ সমস্ত আয়াত ও হাদীস দ্বারা এ কথাই প্রকাশ করে যে, ‘মাআ’ শব্দের অর্থ সাথী ও সঙ্গী হওয়া, অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ নহে, এ সকল কাফের ও মুরতাদরা যেমন ধারণা করছে। আমর যুহানীর হাদীস এ ব্যপারে একটি উজ্জ্বল প্রমাণ এবং এ সকল কাফেরদের মাথার উপর একটি কোষমুক্ত তরবারি স্বরূপ। সেই হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন- ‘যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যখন সে এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, যাকাত প্রদান করে ও রমজানের রোজা রাখে সে হবে নবীদের সঙ্গী’। এখানে যদি ‘মাআ’ শব্দকে ‘মিন’ অর্থে ব্যবহার করা হয় তা হলে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নবী হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ জাতীয় বাতিল কথাবার্তা দ্বারা কাদিয়ানীরা কি লোকজনকে পথভ্রষ্ট ও প্রতারিত করতে চায়? অথচ তাদের দলীল প্রমাণাদি মাকড়শার জালের চেয়েও দুর্বল। মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ ﴿العنكبوت 41﴾
(‘নিশ্চয়ই মাকড়শার ঘর সবচেয়ে দুর্বল ঘর। হায়, যদি মানুষ তা বুঝতে পারত’।)
দ্বিতীয় আয়াত, যদ্বারা তারা নবুয়তের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করার জন্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করে। আর এ কথা তারা তাদের অসৎ পূর্ব পুরুষ বাহায়ীদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাআলার বাণীর অর্থ বিকৃত করে। আল্লাহর বাণী: (হে আদম সন্তান! যখনই তেমাদের কাছে তোমাদের মধ্য হতে রাসূলগণ আগমন করে, আমার আয়াত বর্ণনা করে, তখন যে কেহ আল্লাহকে ভয় করবে এবং সৎ কাজ করবে তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।) [১ সুরা আরাফ-৩৫।] কাদিয়ানিরা বলে, এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরেও নবীগণের আগমন ঘটবে। কেননা, আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে রাসূলগণের আগমন সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। (আল কওলুস সারীহ, ১৯৮ পৃ: ও আহমদিয়া পকেট বুক’ ৫০৩পৃঃ।)
আমরা বলি: এ আয়াত দ্বারা নবুয়্যত চালু থাকার উপর দলীল পেশ করা কতগুলো কারণে বাতিল।
প্রথমত: আদম আলাইহিস সালাম ও তাঁর সন্তানদের প্রতি এ সম্বোধনটি ছিল সৃষ্টির আদিকালে এবং এ প্রতিশ্রুতিটি সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী রাসূলের আগমন দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এই আয়াত প্রসঙ্গে ইমাম ইবনু জারীর বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরকে নিজ হাতে নিয়ে এ কথা দ্বারা সম্বোধন করলেন।’ (তাফসীর ইবনে জারীর) আয়াতের ভাব-ভঙ্গিও একথা বুঝাছে। কেননা, এ আয়াতে আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টি, তাঁর বেহেশতে প্রবেশ, তারপর সেখান থেকে তাঁর বহিস্কৃত হওয়া সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে । দ্বিতীয়ত: আয়াতে إن ‘ইন’ (যদি) শব্দটি বর্ণিত হয়েছে এবং উহার বাস্তবায়ন অপরিহার্য নহে। যেমন- বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তাআলার এ বাণীতেঃ
قُلْ إِنْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ فَأَنَا أَوَّلُ الْعَابِدِينَ ﴿الزخرف 81﴾
(‘যদি আললাহ রহমানের কোন সন্তান থাকত, তাহলে আমিই সর্বপ্রথম তাঁর উপাসনাকারী হতাম’) [২ সুরা ঝুখরুফ ৮১।]
তৃতীয়তঃ ‘ইয়াতীয়ান্না’ শব্দটি فعل مضارع
(বর্তমান বা ভবিষ্যৎকালীন ক্রিয়া) আর المضارع এর ধারাবাহিকতা অপরিহার্য নহে। যেমন রয়েছে আল্লাহর এই বাণীতেঃ
فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِي إِنِّي نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْمًا ( مريم 26)
(যদি তুমি কোন মানুষ দেখতে পাও, তবে তাকে বল, আমি রহমানের জন্য রোজার মানত করেছি।) [১ সূরা মরিয়ম, ২৬।] আয়াতের অর্থ এই নয় যে, মরিয়ম অনাধিকাল পর্যন্ত বেচে থাকবেন, এমনকি তিনি মানব জাতিকে সর্বদা ও অবিরত ভাবে দেখতে পাবেন।
সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, আয়াতের মধ্যে সম্বোধনটি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের জন্য নহে। বরং এ সম্বোধনটি মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের পূর্বে সকল আদম সন্তানের জন্য ছিল।
চতুর্থতঃ স্বয়ং কাদিয়ানীর উক্তি নবুয়্যত অর্থাৎ রিসালত শেষ হয়ে গেছে’। ইতিপূর্বে এর আলোচনা হয়ে গেছে।
কাদিয়ানীরা তাদের মিথ্যা নবীর নবুয়্যত প্রমাণ করার জন্য কোন কোন রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল পেশ করেছে। ইতিপূর্বে আমরা যেগুলোর উল্লেখ করিনি, এখন তা উল্লেখ করছি।
প্রথম রেওয়ায়েতঃ হযরত আয়েশা রা. বলেন:
( قولوا خاتم النبيين ولا تقولوا لا نبي بعدي )
(তোমরা খাতামুন নাবিয়্যীন বল, আমার পর কোন নবী নেই এ কথা বল না।) (আল কওলুস সারীহ, যা দূররে মানসুর হতে উদৃত।)
এ রেওয়ায়েতের সনদের আদৌ কোন ভিত্তি নেই। কাদিয়ানীদের এবং তাদের পথের পথিকদের মধ্যে এমন কোন লোক জন্মায়নি যে এ রেওয়ায়েতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে পারে। সুতরাং রেওয়ায়েতটি মওযু। উপরন্তু এটা সৈয়দা হযরত আয়েশার রা. প্রতি একটা অপবাদ। অথচ তিনিই রেওয়ায়েত করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা, বলেছেন: ‘তাঁর পর মুবাশশিরাত ব্যতীত নবুয়তের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সাহাবাগণ আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! মুবাশশিরাত কি? উত্তর দিলেন- সঠিক ও সৎ স্বপ্ন যা মুসলিম দেখতে পায় বা অন্য কেহ তার সম্পর্কে দেখে থাকে। [২ মুসনদে আহমদ।]
দ্বিতীয় রেওয়ায়েতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আববাস রা. কে বলেন: তোমাদের মধ্যেই খেলাফত ও নবুয়্যত হবে।’ (কানজুল উম্মাল, ও হুজ্জুল কারামাহ’।) এ রেওয়েতটিও মাওজু এবং উহার একজন রাবী যার নাম মুহাম্মদ আমির, তিনি সর্ব সম্মতিক্রমে দুর্বল।
দ্বিতীয়ত: এ রেওয়ায়েতের অর্থ যদি এই সাব্যস্ত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আববাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তোমাদের অর্থাৎ বনী হাশেম থেকে নবী আসছেন; যেমন রাজা বাদশাহ ও খলীফাগণ বনী হাসেম থেকে আসবেন। তবে এটাই হল এ রেওয়ায়েতের সঠিক অর্থ। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে নবীদের আগমনের কোন প্রমাণ নেই। তৃতীয়তঃ এ রেওয়ায়েত থেকে তারা যে অর্থ গ্রহণ করে বাস্তবতা এটাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। কেননা, আববাসী বংশের কেহই এ কথা দাবী করেনি যে, সে নবী। কিন্তু তাদের ভন্ডনবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তো মোঘল বংশীয়, যেমনটি সে নিজেই তার জীবন চরিতে উল্লেখ করেছে। [১ ষষ্ঠ প্রবন্ধে এর আলোচনা চলে গেছে।]
এগুলো হল কাদিয়ানীদের দলীল দস্তাবেজ। জানি না তারা কেমন করে বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসসমূহকে বর্জন করে এবং মওযু ও অপ্রমাণিত রেওয়ায়েত দ্বারা দলীল পেশ করে। এ সমস্ত লোক থেকে এমন আচরণ হওয়া কোন আশ্চর্যের বিষয় নহে। কেননা, যে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বরং তাদের সৃষ্টি করেছে, প্রচলিত নীতি হলো- ‘উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উপায়-উপকরণের ন্যায্যতা প্রতিপালন করে’ কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করার পিছনে তাদের লক্ষ্য হল- ইসলামের আসল সত্য রূপকে বিকৃত করা, মুসলমানগণকে বিপথগামী করা, তাদের ঐক্য বিনষ্ট করা এবং তাদের জামাতকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। এই পথে তারা ঐ সমস্ত উপায় উপকরণ অবলম্বন করে, যা তাদের উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে। যেমন বিকৃত করণ, অপব্যাখ্যা, বাতিল বিষয়াদি দ্বারা দলীল পেশ করা। আমাদের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই- এ দলের বাস্তব প্রকৃতি প্রকাশ করা এবং তাদের বাতিল ও ভ্রান্ত বিষয়াদি এবং মেকী দাবির উপর থেকে আবরণ সরিয়ে দেয়া। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে আমরা আমাদের সামর্থানুযায়ী চেষ্টা করছি। আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের এই প্রার্থনা, তিনি যেন সত্যকে তার নির্দেশ দ্বারা সত্য প্রমাণিত করেন এবং সত্যের প্রতি আহবানকারীদের বিজয়ী করেন। আল্লাহ তাআলা রহমত বর্ষণ করুন আমাদের ইমাম ও সর্বশেষ নবী প্রিয় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সমস্ত সাহাবীগণের উপর।
আল্লাহই আমাদের একমাত্র তাওফীকদাতা।
সমাপ্ত
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন