HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

খাদ্য ও পণ্য-দ্রব্যে ভেজাল ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রতিকার

লেখকঃ ড. মো: আবদুল কাদের

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
খাদ্য ও পণ্য-দ্রব্যে ভেজাল: ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রতিকার

ড. মো: আবদুল কাদের

সম্পাদনা:

আলী হাসান তৈয়ব

খাদ্য ও পণ্য দ্রব্যে ভেজাল: ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রতিকার
মহান আল্লাহ বাণী: ﴿وَأَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا﴾ অর্থাৎ, “মহান আল্লাহ্‌ ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম।” [১. আল-কুরআন : ২:২৭৫।] জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য এক মহতী পেশা। এর মাধ্যমে যেমনি ব্যক্তি পার্থিব জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করে, অনুরূপভাবে পরকালীন জীবনেও মুক্তি ও সফলতা লাভে ধন্য হয়। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তার ব্যবসা নীতিতে কোন প্রকার ধোঁকা, প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয়, শঠতা ও অসৎ উদ্দেশ্য স্থান পেতে পারে না। আর এটাই হল ইসলামের ব্যবসা নীতি। অতএব, ব্যবসার ক্ষেত্রে ইসলামী নীতি অনুসৃত হলে ভেজালমুক্ত খাদ্য ও পণ্যদ্রব্য সরবরাহ সম্ভব এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি-জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমাজ ও রাষ্ট্র সকলেই উপকৃত হবে। ভেজাল নামক ঘাতক থেকে রক্ষা পাবে। নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজালের স্বরূপ ও এর প্রতিকারে ইসলামী নির্দেশনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

ভেজালের স্বরূপ
ভেজাল একটি বহুল প্রচলিত বাংলা শব্দ। এর অর্থ হলো: নিকৃষ্ট, খাঁটি নয় এমন নিকৃষ্ট দ্রব্য মিশ্রণ, গণ্ডগোল, ঝামেলা, বিশৃঙ্খলা। [২. মোসলেম উদ্দিন, আধুনিক বাংলা অভিধান, (ঢাকা: ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ১ জুন, ১৯৮৫), পৃ. ৬৩৯।] নিকৃষ্ট পদার্থ মিশ্রিত, কৃত্রিম মেকি। [৩. শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, (কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, একবিংশতম মুদ্রণ, মে ১৯৯৭), পৃ. ৫৪৯।] এর আরবি প্রতিশব্দ: مزيف، مغشوش এবং غاشة [৪. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, বাংলা-ইংরেজী-আরবী ব্যবহারিক অভিধান, (ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ, ২০০২), পৃ. ৪১৩।] ইংরেজিতে একে adulterant, contaminant, impurity, trouble, tangle, hitch, snag, spurious, corrupt [৫. Editorial board, Bangali English dictionary (Dhaka: Bangla Academy, Tenth reprint, April 1999) P. ৬২১.।] প্রভৃতি শব্দে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। নিকৃষ্ট পদার্থ যা উৎকৃষ্ট পদার্থের সাথে মিশানো হয়। কিংবা নিকৃষ্ট পদার্থ মিশ্রিত খাঁটি বা বিশুদ্ধ নয় এমন যে কোন বস্তুকে ভেজাল বলে। [৬. শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৯।]পবিত্র কুরআনে ভেজালের প্রতিশব্দ خبائث এবং এর বিপরীত শব্দ হিসেবে طيبات এর উল্লেখ রয়েছে। অতএব ভেজাল মানে অপবিত্র, নিকৃষ্ট খাবার-পানীয় যা অকল্যাণকর ও অস্বাস্থ্যকর। [৭. মহান আল্লাহর বাণী: ﴿وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ﴾ অর্থাৎ, “তিনি তাদের জন্য যাবতীয় তাইয়্যেবাত বা পবিত্র ও উৎকৃষ্টকে বৈধ করেন এবং খাবাইস তথা নাপাক-নিকৃষ্ট বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করেন”। (সূরা: আরাফ: ১৫৭)] এ ভেজালের মহাসমারোহ চলছে বিশ্বব্যাপী নানা কৌশলে, মুখরোচক ও দৃষ্টিনন্দন পদ্ধতিতে, তবে বস্তুর তারতম্য ও স্থান, কাল, পাত্রের ব্যবধানে ভেজালেরও বিভিন্ন রূপ লক্ষ্য করা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে পরিচালিত ভেজাল বিরোধী অভিযানে ভেজালের যে বীভৎস চিত্র ধরা পড়েছে, তা দেশবাসীকে একদিকে হতবাক করেছে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত হাজারো অজানা শঙ্কা। এ সব ভেজালের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :

১. খাদ্য-দ্রব্য
ক. বিভিন্ন আড়তে সংরক্ষিত মৃত মুরগী, গরুর গোশত ও পচা ডিম। যা বিভিন্ন ধরণের ফাস্টফুড ও ঝাল জাতীয় খাদ্য দ্রব্যে ব্যবহার করা হয়।

খ. হোটেল রেস্তোরায় সংরক্ষিত অনেক দিনের পচা-বাসি খাবার পরিবেশন।

গ. ফরমালিন জাতীয় বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত মাছ সরবরাহ।

ঘ. নাপাক শুকরের চর্বি হতে প্রাপ্ত তেলে ভাজা মিষ্টদ্রব্য যেমন-সেমাই।

ঙ. বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো ও সংরক্ষিত ফলমূল ও শাক-সবজি।

চ. নির্ধারিত মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ও গুড়ো-দুধসহ শিশুদের খাদ্য দ্রব।

ছ. সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি খাবার।

জ. নিম্নমান কিংবা ক্ষতিকারক উপকরণ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাদ্য।

ঝ. দুধের সাথে পানি মিশ্রণ কিংবা পাউডার ও দুধের মিশ্রণ।

২. পণ্য-দ্রব্য
ক. নিম্নমানের উৎপাদনের তৈরি পণ্য-দ্রব্য।

খ. নিম্নমানের পণ্যদ্রব্য উচ্চ মান সম্পন্ন বলে চালানো, কিংবা অভ্যন্তরে নিম্নমানের পণ্য রেখে বহির্ভাগে উত্তম পণ্য সাজানো।

গ. ওজনে কম-বেশি করা বা পরিমাপে হের-ফের করা।

ঘ. দুগ্ধবতী গাভী বিক্রয়ের পূর্বে দুধ আটকিয়ে রাখা।

মোটকথা: আমাদের খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য পণ্য-সামগ্রীতে ভেজালমুক্ত বস্তু খুঁজে পাওয়া একান্তই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এভাবে ভেজালের সমারোহে আমরা জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খাচ্ছি। [৮. মহান আল্লাহর বাণী: ﴿وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ﴾ অর্থাৎ, “তিনি তাদের জন্য যাবতীয় তাইয়্যেবাত বা পবিত্র ও উৎকৃষ্টকে বৈধ করেন এবং খাবাইস তথা নাপাক-নিকৃষ্ট বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করেন”। (সূরা: আরাফ: ১৫৭)]

ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজাল
ইসলাম কল্যাণকর পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এতে মানুষের জন্য যা হিতকর নয়, অকল্যাণকর ও নিকৃষ্ট সেসব বস্তু, পণ্য ও বিষয় হতে বিরত থাকতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। অতএব ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজাল পণ্যের উৎপাদন, বিপণন ও সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ, অবৈধ। নিম্নে ভেজাল সম্পর্কিত কুরআন ও সুন্নাহ্‌র দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো:

ক. ভেজাল একটি জঘন্যতম প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা
কোন কিছু ক্রয় করার ক্ষেত্রে একজন ক্রেতা বিশ্বস্ত বিক্রেতা অন্বেষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যাতে তার ক্রয়-কৃত পণ্যদ্রব্য সঠিক, গুণগত মান সংরক্ষিত এবং সাশ্রয়ী হয়। কিন্তু পণ্যে ভেজাল থাকলে তা বিক্রেতার প্রতি অবমাননা ও অবমূল্যায়নের শামিল। অতএব এটি একটি বড় ধরনের প্রতারণা। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:" كبرت خيانة أن تحدث أخاك حديثاً وهو لك به مصدق وأنت له به كاذب " “এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে, তুমি এমন ব্যক্তির সাথে মিথ্যার আশ্রয় নেবে যে তোমাকে বিশ্বাস করে।” [৯. ইমাম আবু দাউদ, সুনানু আবি দাউদ, কিতাবুল আদাব। বাবুন ফিল মা’আরীদ (বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৯৫), হাদীস নং ৪৯৭১। তবে হাদীসটি দুর্বল।] অন্য এক হাদিসে এসেছে: " من غشنا فليس منا " “যে আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। [১0. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, (কায়রো: দারুল হাদীস, তৃতীয় প্রকাশনা, ১৯৯৮) হাদীস নং- ১৬৪।] উপরোক্ত হাদিস দ্বয়ের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, ভেজাল ব্যবসায়ী ইসলামী আদর্শের গণ্ডি বহির্ভূত গণ্য হবে।

খ. ‘ভেজাল’ এক প্রকার ঘাতক
পণ্যদ্রব্যের ভেজাল প্রবণতার ফলে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অস্বাস্থ্যকর ও বিভিন্ন রোগের নিয়ামক শক্তিরূপে পরিণত হয়। ফলে এর বিষাক্ত ছোবলে অসংখ্য মানুষ দংশিত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। খাবার হতেই মানুষের ব্লাড বা রক্ত তৈরি হয় এবং তা হতেই সব রোগের উৎপত্তি ঘটে। অতএব, এটি ত্রুটিমুক্ত ও ভেজালমুক্ত না হলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিলে তিলে নিঃশেষিত হয়ে যাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। পবিত্র কুরআন এ ধরনের গুপ্ত হত্যাকে সর্বাধিক জঘন্যতম অন্যায় ও অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইরশাদ হয়েছে:

﴿مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَن قَتَلَ نَفْساً بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعاً﴾

“এ কারণেই বনী ইসরাইলের প্রতি এ বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কর্ম করা, হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল।” [১১. আল-কুরআন : ৫:৩২।]

গ. ভেজাল মানবতা বিধ্বংসী জঘন্য অপরাধ
মানবিক সত্তা মানুষের এক গুরুত্বপূর্ণ সত্তা। এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরস্পরের মাঝে রয়েছে এক সুদৃঢ় বন্ধন, যা অভিন্ন দেহ-সত্তার রূপ পরিগ্রহ করে। [১২. রাসূল (সা.) বলেন: ترى المؤمنين في تراحمهم وتوادهم وتعاطفهم كمثل الجسد إذا اشتكى عضوا تداعى له سائر جسده بالسهر والحمى (দ্র: ইমাম বুখারী, সুহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫০৫৬)] অতএব একজন ব্যক্তি যখন তার দেহের কোন অঙ্গে ব্যথা ও কষ্ট অনুভব হওয়াকে কামনা করে না, তেমনি ভেজাল খাদ্য ও পণ্যদ্রব্য পরিবেশনের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি সাধন মানবতা বিরোধী জঘন্য অন্যায়। এতে শুধু ব্যক্তি অপরের ক্ষতিতে সচেষ্ট হয় না, বরং নিজেও অন্যের ভেজালে আচ্ছাদিত হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কেননা, সে তো এ সমাজেরই একজন সদস্য। অথচ আল্লাহ এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : ﴿وَلاَ تَقْتُلُواْ أَنفُسَكُمْ﴾ অর্থাৎ, "তোমরা তোমাদের নিজেদের হত্যা করো না। [১৩. আল-কুরআন: ৪: ২৯।] তাছাড়াও মহান আল্লাহর রীতি হলো : وَجَزَاء سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا﴾ অর্থাৎ, “মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ” । [১৪. আল-কুরআন: ৪০ : ৪২।]

এ মর্মে হাদিসে এসেছে: " لاضرر ولاضرار " অর্থাৎ,“নিজের কিংবা অন্যের কোন ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না।” [১৫. ইমাম আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মাদ ইবন্ ইয়াযীদ আল-কাযউঈনী, সুনান ইবনু মাজাহ্, তাহকীক: মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী, (বৈরুত: দারুল ফিক্র, তা.বি.) হাদীস নং- ২৩৪০।]

১০
ঘ. ভেজাল মিশ্রিত ব্যবসা জুলুমের নামান্তর
কোন বিক্রেতা যদি তার ব্যবসায় ভেজাল মিশ্রণের প্রবণতা থাকে তাহলে সে পণ্যের মূল্য সাশ্রয় না করে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের ন্যায় তার মূল্য নির্ধারণ করে। এতে করে ক্রেতারা এক প্রকার জুলুমের শিকার হন। এছাড়াও এ ধরনের লেন-দেনে শঠতা, প্রতারণা ও ধোঁকাবাজির সম্ভাবনা থাকে। ফলে এটি অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণের এক অপকৌশল। মহান আল্লাহ বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَأْكُلُواْ أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ﴾

“হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করিও না।” [১৬. আল-কুরআন, ৪: ২৯।]

১১
ঙ. “ভেজাল” ইসলামী নৈতিকতাকে গলা-টিপে হত্যাকারী
মহান আল্লাহ মানুষের সৃষ্টিতে দুটি সত্তার সম্মিলন ঘটিয়েছেন। একটি হলো নৈতিক সত্তা, অপরটি পাশবিক সত্তা। পাশবিক সত্তার প্রাধান্য মানুষকে পশুত্বে পরিণত করে। অপরদিকে নৈতিক সত্তা মানুষকে প্রকৃত মানবে পরিণত করে। খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রিত-কারী নৈতিক গুণাবলী থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আত্মস্বার্থ চিন্তা, অর্থলিপ্সা ও নোংরা মন-মানসিকতা তার নৈতিকতা বোধ ও বিবেককে ধ্বংস করে দেয়। তার যাবতীয় চিন্তা-চেতনা মুনাফাখোরী [১৭. এটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিদেশী শব্দ। (মুনাফা+খোর < খোরী)। মুনাফা শব্দটি আরবী منفعة (মানফা‘আ) থেকে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করেছে। যার অর্থ হচ্ছে, লাভ বা লভ্যাংশ। ইংরেজিতে একে Profit বলে। আর খোর বা খোরী শব্দটি ফারসী ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। যার অর্থ সাধারণত নিন্দার্থে অর্থাৎ যে খায় বা ভোগ করে। যেমন, সুদখোর, ঘুষখোর। অতএব প্রচলিত অর্থে: ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে যে ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে অতিরিক্ত লাভ করে তাকে মুনাফাখোর বলে। আর এ ধরনের কাজ করাকে বলা হয় মুনাফা খোরী। দ্রষ্টব্য: সহজ বাংলা অভিধান, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, ফেব্র“য়ারি, ১৯৯৫), পৃ: ৩৩২।] ও পুঁজিবাদী [১৮. পুঁজিবাদের ইংরেজী প্রতিশব্দ Capitalism, আরবীতে একে رأسمالية ব্যক্তি মালিকানা সীমাহীন অধিকারের ভিত্তিতে অবৈধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইচ্ছেমত সম্পদ উপার্জন ও ভোগের সুযোগ সৃষ্টিকারী ব্যবস্থাই পুঁজিবাদি অর্থ ব্যবস্থা।] অর্থ ব্যবস্থার আবর্তে ঘূর্ণায়মান থাকে। মহান আল্লাহ ও মানুষের কাছে সে একজন প্রতারক, ঘাতক ও জালেম হিসেবে পরিগণিত হয়।

১২
ভেজাল প্রতিরোধে ইসলামী নির্দেশনা ১. তাকওয়ার লালন
একজন ব্যবসায়ীকে ব্যবসা ক্ষেত্রে অবশ্যই আল্লাহর স্মরণে ব্রতী হতে হবে। কেননা ব্যবসা হলো জীবিকা অর্জনের একটি উপলক্ষ মাত্র। এক্ষেত্রে সর্বদা আল্লাহ ভীতি অন্তরে পোষণ করেত হয়। যখনই কোন ব্যক্তির মাঝে এ ধরনের ধারণা লালিত হতে থাকে, তখন তার যাবতীয় কাজ আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা তথা শরী‘আত অনুযায়ী হতে বাধ্য। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণুসহ সকল সৃষ্টি-জীবের কোন কিছুই আল্লাহর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে না। প্রতিটি কথা কর্মের জন্য তাঁর নিকট হিসেব দিতে হবে। অতএব, কোন ব্যক্তিই তখন আর তাঁর অবাধ্য হতে পারে না। কোন ব্যক্তির সাথে অসৎ লেন-দেনও প্রতারণা করতে পারে না। ইসলাম মানুষের অভ্যন্তরে এ ধরনের চিন্তার বীজ বপন করে থাকে এরই নাম ‘তাকওয়া’। এভাবে ব্যক্তি নিজেই নিজের প্রহরী হয়ে যায়। এ মর্মে কুরআনুল কারিমে এসেছে :

﴿وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾

“তোমরা যেখানেই থাকন কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন” [১৯. আল-কুরআন: ৫৭: ৪।] অন্যত্র এসেছে : ﴿يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ﴾ “চক্ষুর অপব্যবহার ও অন্তরে যা গোপন আছে সে সম্বন্ধে তিনি অবহিত”। [২০. আল-কুরআন: ৪০: ১৯।]

১৩
২. আখেরাতে জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন হওয়া
প্রত্যেক মানুষের দুটি জীবন রয়েছে। একটি ইহকালীন, অপরটি পরকালীন। ভেজাল ব্যবসায়ীকে মনে রাখতে হবে যে, ভেজালের মাধ্যমে দুনিয়াতে পার পাওয়া গেলেও পরকালীন প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যম্ভাবী। কেননা আল্লাহর নিকট আসমান ও যমীনের কোন কিছুই গোপন নেই। [২১. আল-কুরআন: ৩: ৫।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

عن أبي هريرة ط أن رسول الله ص قال : أتدرون ما المفلس؟ قالوا المفلس فينا من لا درهم له ولا متاع فقال : إن المفلس من أمتي يأتي يوم القيامة بصلاة وصيام وزكاة ويأتي قد شتم هذا وقذف هذا وأكل مال هذا وسفك دم هذا وضرب هذا فيعطى هذا من حسناته وهذا من حسناته فإن فنيت حسناته قبل أن يقضى ما عليه أخذ من خطاياهم فطرحت عليه ثم طرح في النار .

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: তোমরা কি জান কোন ব্যক্তি নিঃস্ব-গরীব? সাহাবাগণ বললেন: আমাদের মধ্যে গরীব হচ্ছে যার কোন অর্থ-সম্পদ নেই। তিনি বললেন: আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে নিঃস্ব-গরীব ব্যক্তি সে হবে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা, যাকাত ইত্যাদি যাবতীয় ইবাদতসহ আবির্ভূত হবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে মেরেছে (সে এসব গুনাহ সাথে নিয়ে আসবে) এদেরকে তার নেক থেকে আমলগুলো প্রতিদান স্বরূপ দিয়ে দেয়া হবে। উল্লেখিত দাবিসমূহ পূরণ করার পূর্বেই যদি তার নেক আমল শেষ হয়ে যায়, তবে দাবিদারদের গুনাহসমূহ তার ঘাড়ে চাপানো হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [২২. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৫৮১।] অপর এক হাদিসে এসেছে:

لا تزول قدم ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسئل عن خمس : عن عمره فيم أفناه، وعن شبابه فيم أبلاه، وماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه، وماذا عمل فيما علم .

“(কিয়ামতের দিন) বনি আদমের পা একটু ও নড়বে না যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রশ্ন করা হবে তার জীবন এবং যৌবন কিভাবে কাটিয়েছে সে সম্পর্কে। তার ধন সম্পদ কিভাবে আয় করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে এবং যে জ্ঞান অর্জন করেছে সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে সে বিষয়ে।” [২৩. ইমাম তিরমিযী, সুনান আত্তিরমিযী, হাদীস নং - ২৪১৬।]যারা দুনিয়ার জীবনে বিভিন্ন ধোঁকাবাজি প্রতারণা ও অমানবিক কার্যাবলীর মাধ্যমে পণ্যদ্রব্যের ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে অঢেল সহায় সম্পদ ও অট্টালিকার মালিক হবে তাদের বাসস্থান নিছক জাহান্নাম। একজন ব্যবসায়ীর মনে সদা এ বিষয়ে অনুভূতি জাগ্রত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন :

﴿فَأَمَّا مَنْ طَغَى ، وَآَثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا ، فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى﴾

“যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করেছে এবং দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছে, জাহান্নামই হবে তার ঠিকানা।” [২৪. আল-কুরআন ৭৯:৩৭-৪১।]

১৪
৩. ব্যবসা সম্পর্কিত ইসলামী নীতিমালা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ
ইসলাম ব্যবসাকে হালাল করেছে এবং সুদকে হারাম করেছে। পেশা হিসেবে ব্যবসা করার ব্যাপারে ইসলাম মানব জাতিকে বরাবরই উৎসাহিত করে আসছে। শুধু তাই নয়, ইসলামের ধারক ও বাহক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা ক্ষেত্রে তাঁর যে দূরদর্শিতা ছিল সে বিষয়ে একজন মুসলিম ব্যবসায়ী জ্ঞাত হওয়া ও বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো আবশ্যক। ইসলামে ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র পার্থিব জীবনে ভোগ বিলাসে মত্ত হওয়াই নয়, বরং পরকালীন জীবনের সফলতাও এর অন্যতম টার্গেট। এজন্যেই পবিত্র কুরআনে বারবার হুশিয়ার উচ্চারণ করা হয়েছে, যেন পারস্পরিক লেন-দেনের এ উত্তম মাধ্যমটিকে কেউ প্রবৃত্তির অনুসরণে কলুষিত করতে না পারে, এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَأْكُلُواْ أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلاَّ أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ وَلاَ تَقْتُلُواْ أَنفُسَكُمْ إِنَّ اللّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيماً﴾

“হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করিও না। কিন্তু তোমাদের পরস্পর সম্মত হয়ে ব্যবসা করা বৈধ; এবং একে অপরকে হত্যা করিও না; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। আর যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তবে তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি খুবই দয়াশীল।” [২৫. আল-কুরআন: ৪:২৯-৩০।] আল্লাহ তা’আলা অন্যত্রে ঘোষণা করেছেন:

﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ﴾

“কিন্তু যারা কুফরি করে, তারা ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে এবং জন্তু জানোয়ারের মত উদরপূর্তি করে; আর জাহান্নামই তাদের নিবাস।” [২৬. আল-কুরআন: ৪৭:১২।]

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের যে নির্দেশনা রয়েছে তাতে, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা শপথ, শঠতা, অবৈধ পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, ভাল ও খারাপ পণ্যের মিশ্রণ তথা অনৈতিকতা সম্পন্ন কার্যাবলীর কোন স্থান নেই। তাছাড়াও অবৈধ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে কেউ প্রতারণা, ধোঁকাবাজি কিংবা অমানবিক কোন উপায়-উপকরণের আশ্রয় নেয়ার বিষয়ে সবিশেষ ভীতি প্রদর্শন করেছে। মূলত সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতা এ তিনের সমন্বয়ে ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যাবতীয় বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। অতএব,ব্যবসায়ীদেরকে সেসব নীতিমালা ও বিধিবিধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে।

১৫
৪. সৎ ব্যবসায় উদ্বুদ্ধকরণ
ইসলাম মানবজাতিকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং প্রাণী হিসেবে প্রাত্যহিক জীবনের মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণ করেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় ও মৌলিক অধিকার হিসেবে খ্যাত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার পাথেয় অবলম্বনে জীবিকা নির্বাহের বিভিন্ন পেশা গ্রহণে উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরজ ইবাদতসমূহ পালনের পর যমীনে জীবিকার উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছে। ইরশাদ হচ্ছে:

﴿فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾

“সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [২৭. আল-কুরআন: ৬২:১০।] অত্র আয়াতে নামাজ আদায়ের পর ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেরিয়ে পড়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, রিযিক অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমাতেও নির্দেশ রয়েছে। এমনকি, এটাকে জিহাদের মত সুমহান ইবাদতের সম-পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। [২৮. আল-কুরআন: ৭৩:২০। ﴿وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ﴾ এ আয়াতের ব্যখ্যায় ইবনে কাসীর বলেন: أي : مسافرين في الأرض يبتغون من فضل الله في المكاسب والمتاجر অর্থাৎ, “যারা ব্যবসা-বাণিজ্য ও রিযিক উপার্জনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বনে: মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের অন্বেষায় পৃথিবীতে ভ্রমণরত।” দ্রঃ আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবন্ উমর ইবন্ কাসীর আল-কুরাশী, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, তাহকীক: সামী ইবন্ মুহাম্মাদ সাল্লামা, (দারু তাইবা লিন্নাশ্রি ওয়াত্ তাওযী‘, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪২০ হি. - ১৯৯৯ খ্রী.), পৃ. ৮/২৫৮।] যাতে প্রতিটি মুসলমান শ্রম, ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে গভীর অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হতে পারে।

জীবিকা নির্বাহের উত্তম ও অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, তবে এটি অবশ্যই সৎ উপায়ে ইসলামী পন্থায় হতে হবে। এ-মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

عن رافع بن خديج قال : قيل : يا رسول الله أي الكسب أطيب؟ قال : " عمل الرجل بيده وكل بيع مبرور ".

“হযরত রাফে‘ ইবন্ খাদীজ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্ধ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।” [২৯. ইমাম আহমাদ, মুসনাদে আহমাদ, খ. ৪ পৃ. ১৪১।]

ন্যায়পরায়ণ ও সৎ ব্যবসায়ীর সুউচ্চ মর্যাদা ও মাহাত্মের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন:

التاجر الصدوق الأمين مع النبيين والصديقين والشهداء

“সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।” [৩০. ইমাম তিরমিযী, জামে’ আত্তিরমিযী, হাদীস নং- ১২০৯। তবে আল্লামা আলবানী এটাকে ضعيف বলেছেন।]

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যবসা করা সুন্নাত ও সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত এক মহতী কর্ম। তদুপরি, যেসব ব্যবসায় জুলুম, ওজনে ভেজাল, ধোঁকাবাজি, মুনাফাখোরই, মজুদদারি ও কালোবাজারি রয়েছে সেসব ব্যবসা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়াও বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ, নৃত্য ও যৌন শিল্প, মদ-জাত পণ্য, গান-বাদ্য, ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি নির্মাণ শিল্প ওজনে কম বেশি করা, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করে বিক্রি করা, মিথ্যে শপথ করে বিক্রি করা, জুয়া, লটারি, যাদু, জ্যোতিষ গণনা, মদ ও শুকুর প্রভৃতির ব্যবসা হারাম ঘোষণা করেছে। [৩১. ইমাম যাহাবী, কিতাবুল কাবাইর, (বৈরুত: আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ, তা. বি. সংস্করণ) পৃ. ১০২।] শুধু তাই নয়, এসব ব্যবসায়ীদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কেও কুরআন ও সুন্নায় আলোকপাত করা হয়েছে।

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হালাল উপায়ে জীবিকার্জনের প্রতি উৎসাহ এবং হারাম থেকে আত্মরক্ষার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করে বলেন:

أيها الناس ! إن الله طيب لا يقبل إلا طيبا، وإن الله أمر المؤمنين بما أمر به المرسلين فقال : ﴿ يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحاً إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ﴾ وقال : ﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ﴾ . ثم ذكر الرجل يطيل السفر أشعث أغبر يمد يديه إلى السماء : يا رب ! يا رب ! ومطعمه حرام ومشربه حرام وملبسه حرام وغذِّي بالحرام، فأنى يستجاب لذلك؟

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন যে আদেশ তিনি রাসূলগণকে দিয়েছেন। তিনি বলেন: “হে রাসূলগণ! আপনারা পবিত্র বস্তু থেকে খাদ্য গ্রহণ করুন এবং সৎকাজ করুন; আপনারা যা করেন সে সম্পর্কে আমি সবিশেষ অবহিত।” [৩২. আল-কুরআন: ২৩:৫১।] আরও বলেন : “হে মুমিনগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রিযক হিসেবে দান করেছি।” অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহ দরবারে হাত-তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে: হে আমার প্রভু! হে আমার প্রভু। অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?” [৩৩. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৫।]

অসৎ ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে সাবধান করতে গিয়ে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

يا معشر التجار ! إن التجار يبعثون يوم القيامة فجارا إلا من اتقى الله وبر وصدق .

“হে ব্যবসায়ী লোকেরা! কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাপাপী-রূপে হাজির হবে। তবে তারা নয় যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সততা ও বিশ্বস্ততা সহকারে ব্যবসা করবে।” [৩৪. ইমাম তিরমিযী, জামে’ আত্-তিরমিযী, হাদীস নং- ১২১০। তবে হাদীসটি দুর্বল।]

১৬
৫. ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা
ব্যবসায়ীগণ ও ক্রেতাগণের পারস্পরিক সম্পর্ক হলো তারা একে অপরের ভাই। আর ব্যবসা-বাণিজ্য ইসলামের দৃষ্টিতে এক মহান পেশা। কারণ এর মধ্যে নিহিত রয়েছে পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহ করে মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের মহান উদ্যোগ। যা পারস্পারিক সহযোগিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতারই একটি অংশ। আর এসবের মূলে রয়েছে ভাতৃত্ব বোধের চেতনা। একজন ভাই যেমনি অপর ভাইয়ের অকল্যাণ কামনা করতে পারে না, তদ্রুপ ব্যবসায়ীদের মাঝে ভাতৃত্ববোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারলে সম্পর্ক সুদৃঢ় ও মজবুত হবে; উভয়ের সন্তুষ্টির ভিত্তিতে লেন-দেন পরিচালিত হবে। মূলত পাস্পরিক সন্তুষ্টি ও সম্মতির ভিত্তিতেই ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং এটিই ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বৈধ উপায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

لا يحل مال امرئ إلا بطيب نفس منه

“সন্তুষ্টি চিত্তে না দিলে কোন মুসলমানের সম্পদ কারো জন্য হালাল হতে পারে না।” [৩৫. ইমাম আহমদ, মুসনাদ আহমাদ ইবন্ হাম্বল, খ.৫ পৃ.৭৩। তবে হাদীসটির সনদ দূর্বল।]

পবিত্র কুরআনে এসেছে:

﴿إِلاَّ أَن تَكُونَ تِجَارَةً عَن تَرَاضٍ مِّنكُمْ﴾

“কেবলমাত্র পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ।” [৩৬. আল-কুরআন: ৪:২৯।]

১৭
৬. ক্রয়-বিক্রয়ে অসত্য ও মিথ্যা শপথের আশ্রয় না নেয়া
মিথ্যা বলা সাধারণত এক জঘন্য অপরাধ। তদুপরি পণ্য প্রসারে মিথ্যা শপথ অবলম্বন আরও মারাত্মক অন্যায়। ভেজাল, নকল ও নিম্ন মানের পণ্য ক্রেতা সাধারণের হাতে তুলে দেয়ার এটি অন্যতম কৌশল। আর এক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকাসমূহ, রেডিও ও টেলিভিশনকে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কে কত শৈল্পিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে পারবে তার চলছে রীতিমত প্রতিযোগিতা। আর সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানানোর ক্ষেত্রে বড়ই পটু। এ জাতীয় মিথ্যুক ও ভেজাল ব্যবসায়ীদেরকে কুরআনে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। [৩৭. মহান আল্লাহ বলেন: ﴿إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَناً قَلِيلاً أُوْلَـئِكَ لاَ خَلاَقَ لَهُمْ فِي الآخِرَةِ وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللّهُ وَلاَ يَنظُرُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾ “যারা আল্লাহর সাথে কৃতপ্রতিশ্র“তি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে পরকালে তাদের কোন অংশ নেই। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে পরিশ্রদ্ধ করবেন না; তাদের জন্য মমন্তুদ শাস্তি রয়েছে। (আল-কুরআন, ৩:৭৭) এ আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে সহীহ বুখারীতে এসেছে: عن عبد الله بن أبي أوفى رضي الله عنه : أن رجلا أقام سلعة وهو في السوق فحلف بالله لقد أعطى بها ما لم يعط ليوقع فيها رجلا من المسلمين .অর্থাৎ “এক ব্যক্তি বাজারে তার পণ্য বিছিয়ে একজন মুসলমানকে প্রতারিত করার জন্য বলতে থাকে; আল্লাহর কসম! আমি যে মূল্যে দিয়েছি, হে মূল্যে আমি কিনতে পারিনি।” তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়। [ইমাম বুখারী, সহীহ বুখারী, হাদীস নং - ১৯৮২]।] তদুপরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে পণ্য বাজারজাত করা থেকে সতর্ক করেছেন। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخرج إلينا وكنا تجارا وكان يقول : يا معشر التجار إياكم والكذب .

“ওয়াসিলা ইবন আল আশকা‘ বলেন: আমরা যখন ব্যবসা করতাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আমাদের কাছে এসে বলতেন: হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, মিথ্যাচার থেকে সর্তক থাক।” [৩৮. ইমাম তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, খ. ২২, পৃ. ৫৬, হাদীস নং ১৩২।]

আবু যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

ثلاثة لا يكلمهم الله يوم القيامة ولا ينظر إليهم ولا يزكيهم ولهم عذاب أليم . قال : فقرأها رسول الله صلى الله عليه وسلم ثلاث مرار قال أبو ذر : خابوا وخسروا من هم يا رسول الله ؟ قال : " المسبل والمنان والمنفق سلعته بالحلف الكاذب ".

“তিন ব্যক্তির প্রতি আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ তিনি তিনবার এ কথাটি বললেন। আমি বললাম: নিশ্চয়ই এরা ক্ষতিগ্রস্ত ও হতভাগা। কিন্তু তারা কারা, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তিনি বললেন: ‘যে ব্যক্তি অহংকারবশত টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করে; যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয়, আর যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে। [৩৯. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১০৬।]

অপর এক হাদিসে এসেছে, আব্দুর রহমান ইব্‌ন শিবল বলেন :

قال رسول الله ﷺ: إن التجار هم الفجار قال : قيل : يا رسول الله أو ليس قد أحل الله البيع؟ قال : بلى ولكنهم يحدثون فيكذبون، ويحلفون ويأثمون

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ব্যবসায়ীরা পাপিষ্ঠ।’ তখন তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ কি ব্যবসাকে হালাল করেননি? তিনি বললেন: হ্যাঁ, কিন্তু তারা কথা বললে মিথ্যা বলে এবং মিথ্যা শপথ করে ও গুনাহ্‌গার হয়।” []

মিথ্যা শপথে পণ্য বিক্রয়ের অভ্যস্ত ব্যবসায়ীগণ শুধুমাত্র পারলৌকিক জীবনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং দুনিয়ার জীবনেও তাদের এসব উপায় অবলম্বনে যে ব্যবসা হয় তার অশুভ পরিণতি লক্ষ্য করা যায়। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন:

" البيعان بالخيار ما لم يتفرقا " أو قال : " حتى يتفرقا . فإن صدقا وبينا : بورك لهما في بيعهما، وإن كتما وكذبا : محقت بركة بيعهما ".

“যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন না হবে ততক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতার ইখতিয়ার থাকবে। যদি তারা সত্য বলে ও যথাযথ অবস্থা বর্ণনা করে, তবে তাদের ক্রয় বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি পণ্যের প্রকৃত অবস্থা গোপন করে ও মিথ্যা বলে তবে ক্রয় বিক্রয়ের বরকত চলে যাবে।” [৪০. ইমাম আহমাদ, মুসনাদ আহমাদ, খ. ৩ পৃ. ৪২৮।]

এছাড়াও এ ধরনের ব্যবসায়ীর উপর সর্বদা আল্লাহ অভিসম্পাত দিয়ে থাকেন। উপার্জনে বরকত নষ্ট হয়ে যাওয়া তাদের শ্রম পণ্ড হওয়ারই অর্থ বহন করে। অতএব এ ধরনের গর্হিত কাজ থেকে ব্যবসায়ীদের বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য।

১৮
৭. বিক্রির ক্ষেত্রে পণ্যের দোষত্রুটি প্রকাশ করা
পণ্য দ্রব্যের দোষ-ক্রটি গোপন করা ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী কাজ। বিক্রেতাকে অবশ্যই পণ্যের দোষ-ক্রটি ক্রেতার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এতে বরকত হাসিল হয়। পক্ষান্তরে তারা যদি তা গোপন করে ও মিথ্যা কথা বলে তাহলে তাদের ক্রয় বিক্রয়ের বরকত তুলে নেয়া হয়। কোন মুসলমানের জন্য এ ধরনের দোষ গোপন করা সমীচিন নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

المسلم أخو المسلم . ولا يحل لمسلم باع من أخيه بيعا فيه عيب إلا بينه له .

“মুসলমান মুসালমানের ভাই। এটা কোন মুসলমানের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের কাছে এমন কোন বস্তু বিক্রয় করবে যাতে কোন ত্রুটি আছে, অথচ সে তা প্রকাশ করে দেবে না।” [৪১. ইমাম বুখারী, সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ১৩০৩।]

এ ধরনের জঘন্য কাজ কোন মুসলমান তো দূরের কথা, মানুষ নামের কেউই তা করতে পারে না। এ মর্মে উক্‌বা ইবন্ ‘আমের বলেন:

لا يحل لامرئ يبيع سلعة يعلم أن بها داء إلا أخبره

“জেনে-শুনে কোন ত্রুটিযুক্ত পণ্য বিক্রি করা কোন ব্যক্তির জন্যই বৈধ হতে পারে না। যতক্ষণ না এ ব্যাপারে ক্রেতাকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়।” [৪৩. ইমাম বুখারী, সহীহ বুখারী, কিতাবুল বুয়ূ’, বাবু ইযা বাইয়ানাল বা‘য়িয়ানি ওয়ালাম ইয়াক্তুমা ওয়া নাসাহা।]

১৯
৮. দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোনরূপ ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করা
ইসলাম পণ্য দ্রব্যকে তার যথাযথ মালিকের নিকট সোপর্দ করতে বদ্ধ পরিকর। সেক্ষেত্রে যাতে কোন প্রকার সুযোগ সন্ধানী ও শোষণের অবকাশ না থাকে সেদিকেও দৃষ্টি রেখেছে ইসলাম। কারণ, যদি এমনটি হয়, তাহলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের যে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া এগুলো প্রতারণারও অন্তর্ভুক্ত। তাইতো ইসলাম প্রতারণার মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির যাবতীয় পদ্ধতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পদ্ধতিগুলো নিম্নরূপ:

ক) মজুদদারি

ইসলামের পরিভাষায় মজুদদারিকে احتكار ‘ইহতিকার’ বলা হয়। ইমাম ইবন তাইমিয়া রাহেমাহুল্লাহ মজুদদার ( محتكر ) এর সংজ্ঞায় বলেন:

المحتكر هو الذي يعمد إلى شراء ما يحتاج إليه الناس من الطعام فيحبسه عنهم ويريد إغلاءه عليهم وهو ظالم للخلق المشترين .

“মজুদদার সে ব্যক্তি যে মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করে তার মূল্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আটক করে রাখে এবং সে এ কাজে ক্রেতাদের প্রতি জুলুম করে”। [৪৪. ইমাম আহমাদ ইবন্ আব্দুল হালীম ইবন্ তাইমিয়া, মাজমু‘উল ফাতাওয়া, (মদীনা: বাদশাহ্ ফাহাদ্ কুরআন প্রিণ্টিং কম্পে­ক্স, ১৪১৬ হি. - ১৯৯৫ খ্রী.) খ. ২৮ পৃ. ৭৫।]

ইসলামের দৃষ্টিতে মজুদদারি জঘন্য অপরাধ। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

من احتكر طعاما أربعين ليلة فقد برئ من الله تعالى وبرئ الله تعالى منه .

“যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য মজুদ করবে, তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না।” [৪৫. ইমাম আহমাদ, মুসনাদ আহমাদ, খ.২ পৃ.৩৩। শু‘আইব আল-আরনা‘ঊত বলেন: হাদীসটির সনদ দূর্বল।]

মজুদদারের ঘৃণ্য মানসিকতা স্পষ্ট করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

بئس العبد المحتكر إذا رخص الله الأسعار حزن و إذا غلى فرح

“নিকৃষ্ট মানুষ হল মজুদদার। মূল্য হ্রাসের সংবাদ পেলে তার খারাপ লাগে, আর মূল্য চড়া হলে আনন্দিত হয়।” [৪৬. ইমাম বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, সম্পাদনা: মুহাম্মাদ সা‘য়ীদ যাগলুল, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, প্রথম সংস্করণ, ১৪১০ হি.), খ. ৭ পৃ. ৫২৫, হাদীস নং - ১১২১৫।] অন্য হাদিসে এসেছে: المحتكر ملعون والجالب مرزوق অর্থাৎ, “আমদানি-কারক রিযিকগ্রাপ্ত হয়, আর মজুদদার হয় অভিশপ্ত।” [৪৭. ইমাম আব্দুর রায্যাক আস্-সান‘আনী, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক, সম্পাদনা: হাবীবুর রহমান আল-আ‘যামী, (বৈরূত: আল-মাক্তাবুল ইসলামী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৩ হি.), খ. ৮ পৃ. ২০৪।]

খ. তালাক্কী

গ্রাম গঞ্জ হতে কৃষকরা সামগ্রী নিয়ে শহরের বাজারে প্রবেশ করার পূর্বেই তাদের থেকে পাইকারিভাবে সব সামগ্রী খরিদ করে নেয়াকে ‘তালাক্কী’ বলা হয়। গ্রামের কৃষকরা এতে প্রতারিত হতে পারে এবং যথাযথ মূল্য হতে বঞ্চিত হয়। তাই বাজার প্রতিযোগিতা ব্যবস্থা ব্যাহত যেন না হয় এবং ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় বাজার দাম যেন নিয়ন্ত্রিত না হয়, সে লক্ষ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালাক্কী কে নিষেধ করেছেন।” [৪৮. মানছুর বিন ইউনুছ আল-বাঙ্গতী, কাশফুল কিনা ‘আন মাতনিল ইকনা’ (বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৪০২ হি.), খ. ৩, পৃ. ১৮৭।]

গ. দালালি বা নাজাশ

প্রকৃত ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে নকল ক্রেতা সেজে পণ্যের উচ্চ মূল্য হাঁকানোকে নাজাশ বা দালালি বলে। [৪৯. দালালি এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Brokery, brokerage এবং আরবীতে একে عمو لة - سمسرة السمسار বলে আখ্যায়িত করা হয়। দ্রঃ ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, তিন ভাষার পকেট অভিধান, (ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনা, ২০০১) পৃ. ১৯৩। কোন ব্যক্তি স্বীয় আচরণ ও কারসাজির মাধ্যমে পণ্য দ্রব্য বিক্রয়ে যদি কোন মধ্যস্থতা করে, যার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঘটে, তখন তাকে দালালি বলে।] এটি এক ধরনের প্রতারণা।

এর মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। তাই ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লামা তকী ওসমানী এর সংজ্ঞায় বলেন:

هو أن يزيد الرجل في ثمن السلعة لا لرغبة في شوائها، بل ليخدع غيره ليزيد ويشتريها .

“কোন ব্যক্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরকে প্রতারিত করার জন্য এবং অধিক মূল্যে ক্রয়ে প্ররোচিত করা নিমিত্তে গ্রাহক সেজে দ্রব্যের চড়া মূল্য দেয়ার প্রস্তাব করাকে নাজাশ্ বলে। ” [৫০. আল্লামা মোহাম্মদ তকী ওছমানী, তাকমালাতু ফতহিল মুলহিম, (করাচি: দারুল উলূম, ১৯৯২), খ. ১, পৃ. ৩৩০।]

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ করেছেন এবং এটিকে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর বলেছেন। তার ভাষ্য হলো:

نهى النبي صلى الله عليه وسلم عن النجش .

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দালালি থেকে নিষেধ করেছেন।” [৫১. ইমাম বুখারী, সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ২০৩৫।]

প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আবি আওফা বলেন:

الناجش آكل ربا، خائن

“দালাল ব্যক্তি সুদখোর, বিশ্বাসঘাতক।” [৫২. প্রাগুক্ত, হাদীস নং-২০৩৪।] অপর এক হাদিসে এসেছে:

عن أبي هريرة ط أن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى أن يستام الرجل على سوم أخيه .

“হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন: মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ব্যক্তি তার ভাই দর করার সময় দর করতে নিষেধ করেছেন।” [৫৩. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১৫১৫।]

বিক্রেতা ও ভোক্তাদের মাঝে দালাল বা Middle man এর অনুপ্রবেশের কারণে দ্রব্যের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে নিষেধ করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

من دخل في شيء من أسعار المسلمين ليغليه عليهم فان حقا على الله تبارك وتعالى ان يقعده بعظم من النار يوم القيامة .

“কোন ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আগুনের হাড়ের উপর তাকে বসিয়ে শাস্তি দিবেন।” [৫৪. ইমাম আহমাদ, মুসনাদ আহমাদ, খ.৫ পৃ. ২৭।]

ঙ. নকল পণ্য ও ভাল পণ্যের মিশ্রণ

অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে পণ্য-দ্রব্যকে নকল অবস্থায় বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপন করা। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত:

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على صبرة من طعام فأدخل يده فيها فنالت أصابعه بللا فقال يا صاحب الطعام ! ما هذا ؟ قال أصابته السماء يا رسول الله ! قال أفلا جعلته فوق الطعام حتى يراه الناس ؟ ثم قال من غش فليس منا .

“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা একটি খাদ্য স্তূপের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্তূপটির মধ্যে তাঁর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তাতে তাঁর হাত ভিজে গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিক্রেতাকে বললেন: এটা কি হচ্ছে? সে বলল: এগুলোকে বৃষ্টিতে পেয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি কেন ভেজা অংশকে বাহিরে রাখছ না, যাতে লোকেরা তা দেখতে পারে। জেনে রাখ- যারা প্রতারণা করে, তারা আমাদের (মুসলিম মিল্লাতের) অন্তর্ভুক্ত নয়।” [৫৫. ইমাম তিরমিযী, জামে‘ আত-তিরমিযী, হাদীস নং-১৩১৫।]

২০
৯. বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ
ইসলাম মানুষকে হালাল উপায়ে ব্যবসা বাণিজ্য করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে এর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সব ধরণের অসততা, পণ্য দ্রব্যের ভেজাল প্রবণতা রোধ কল্পে “আল- হিসবা” [৫৬. ‘আল-হিসবা’ একটি আরবী শব্দ। পরিভাষায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের দায়িত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করা। আল- আযহাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল ওয়াফা মোহাম্মাদ আবুল ওয়াফা ‘আল- হিসবা’ ব্যাবস্থাপনার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন: الحسبة وظيفة دينية شبه قضائية من باب الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر ويسمى من يقوم بها محتسباً متى عينه ولي الأمر ممن يراه أهلا للقيام بها “এটি একটি কর্মীয় দায়িত্ব, প্রায় বিচার বিভাগীয় দায়িত্বের মত। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ হতে বাধাদান এ ব্যবস্থাপনার মূল কাজ। এ দায়িত্বের নির্বাহী প্রধানকে ‘মুহতাসিব’ বলা হয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত একজন ব্যক্তিকে এ পদে নিয়োগ দান করেন। [ড. আবুল ওয়াফা মোহাম্মদ আবুল ওয়াফা, আল- তাতাউরুল তারিখী লিহিমায়াতিল মালিল আম, সুত্র তারিথিল ইকতিসাদ লিল মুসলেমীন, ১ম খন্ড, পৃ. ৬৬-৬৭]] ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব ইসলামী অর্থনীতিতে রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য যে বিশেষত্ব কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তাকে অলিউল হিসবাহ বলা হয়।

মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রে সর্ব প্রথম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাঈদ ইব্‌ন আল-আসবিন উমাইয়্যাকে মক্কার বাজার দেখাশুনা করার দায়িত্বভার অর্পণ করেছিলেন। [৫৭. আতা শাহওয়ী, আল- হিসবাহ ফিল ইসলাম, দারুল উরুবাহ প্রকাশনী, পৃ. ১৭।] শুধু তাই নয়, স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে যেতেন এবং খাদ্যদ্রব্য পর্যবেক্ষণ করতেন। [৫৮. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১০১।]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরে খুলাফায়ে রাশেদিন এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজেই বাজারে ঘুরে বেড়াতেন এবং এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়িক তৎপরতা রোধে ভূমিকা রাখতেন। এমনকি তিনি নিজে তাদের শাস্তিস্বরূপ প্রহার করতেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি তাদেরকে গাধায় চড়িয়ে শহর ঘুরিয়ে আনতেন এবং তাকে সম্পর্কে সাবধান করে দিতেন। তিনি আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ওতবাহকে বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য নিয়োগ করেছিলেন। [৫৯. আশ-শাহওয়ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪।]

২১
১০. ইসলামী দণ্ডবিধির প্রয়োগ
ইসলাম সহনশীল ও মানবতার ধর্ম। এটা মানুষকে সর্ব প্রথম নৈতিকভাবে উজ্জীবিত করে। যাতে সে আপন ইচ্ছায় অন্যায় অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। তবে এ কথা সত্য যে, উপদেশ-নসীহত সকলের জন্য সবসময় ফলপ্রসূ হয় না। তাই প্রয়োজনে ইসলাম অপরাধ নির্মূলের নিমিত্তে শাস্তির বিধান রেখেছে। এক্ষেত্রে হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর একটি বানী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন :

إن الله ليزع بالسلطان ما لا يزع بالقرآن

“শাসন-দণ্ড দিয়ে মহান আল্লাহ এমন লোকদেরকে উচিত শিক্ষা দেন, কুরআনের উপদেশ-নসীহত যাদের জন্য ফলপ্রসূ হয় না।” ইসলাম শাস্তিযোগ্য অপরাধ সমূহের তিন ধরনের শাস্তির বিধান রেখেছে। এক. হুদুদ, দুই. কিসাস, তিন. তাযীর। [৬০. ১. হুদুদ: যে সব অপরাধের বিধান সরাসরি কুরআন ও সুন্নায় বর্ণিত হয়েছে এবং যা আল্লাহর হকের সাথে সংশ্লিষ্ট তা-ই হুদুদ। যেমন: ব্যভিচার,ব্যভিচারের অপবাদ, চুরি, পৃথিবীতে নৈরাজ্য, ফাসাদ সৃষ্টি, ধর্মত্যাগ ও মদ্য পান প্রভৃতি। ২. কিসাস: যে সব অপরাধে বান্দার হককে শরী‘আতের বিচারে প্রবল ধরা হয়েছে সেগুলোর শাস্তিকে বলা হয়‘ কিসাস’। যথা: প্রাণের বিনিময় প্রাণ ও জখমের বিনিময়ে জখম করা। ৩. ‘তাযীর’: যে সব অপরাধের শাস্তি কুরআন ও সূন্নাহ নির্ধারণ করেনি, বরং বিচারকদের অভিমতের উপর ন্যাস্ত করেছে, এ সব শাস্তিকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘তাযীর’ বলে। এটি কথা দ্বারা হতে পারে, আবার কর্ম দ্বারাও হতে পারে। যেমন – ধমক দেয়া, ভৎসনা করা, নছীহত করা, বেত্রাঘাত, শারীরিক অন্য কোন শাস্তি, বন্দী করে রাখা, নির্বাসন দেয়া, চাকুরি হতে অব্যাহতি দেয়া, জরিমানা ইত্যাদি।]

যেহেতু পণ্যদ্রব্য ও খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল এক প্রকার প্রতারণামূলক ও মানব বিধ্বংসী অপরাধ সেহেতু এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রয়েছে। যাতে এ অপরাধ নির্মূল সহজসাধ্য হয়। এটি মূলত তাযীর জাতীয় একটি অপরাধ। অতএব, ভেজালের পরিমাণ, আকৃতি-প্রকৃতি, পরিমাপের ভয়াবহতাও অন্যান্য পরিবেশ -পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে ভেজাল প্রতিরোধ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করতে হবে। যে সব ভেজাল দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করে মানুষকে ক্রমশ নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা যেতে পারে। পক্ষান্তরে, যার ক্ষয়-ক্ষতি নগণ্য ও সাধারণ তার জন্য সাধারণ পর্যায়ের শাস্তি যেমন, বেত্রাঘাত, জেল ও জরিমানা দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দায়িত্বশীলদের কেউ দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রদর্শন করলে কিংবা দুর্নীতির আশ্রয় নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকতে হবে।

২২
প্রস্তাবনা
ভেজাল একটি প্রতারণামূলক ও ত্রুটিযুক্ত পদ্ধতি যা পণ্য দ্রব্যের গুণগত-মান ধ্বংসের প্রয়াস চালায়। শুধু তাই নয়, অনেক সময় এটি মানুষের জীবন নাশের হুমকিতেও পরিণত হয়। আজ আমাদের দেশের সর্বত্রই ভেজালের ছড়াছড়ি চলছে। ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে মানবতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ইসলামী নৈতিকতার লালনের মাধ্যমে এর প্রতিবিধান সম্ভব। তদুপরি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা নিশ্চিত করতে পারলে ভেজাল প্রতিরোধ সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।

ক. ভেজাল বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি, জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান দান ও উপলব্ধিতে নিয়ে এসে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং তাদের চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কটের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

من رأى منكم منكرا فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه ومن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان

“তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন খারাপ কাজ হতে দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে (শাস্তি প্রয়োগ) বাধা দেয়। এ ক্ষমতা যদি তার না থাকে তাহলে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে (জনমত গঠন করে) তা বন্ধের প্রয়াস চালাবে। আর এ ক্ষমতাও যদি না থাকে, তবে সে অন্তরে এ কর্মকে ঘৃণা করবে আর এটা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল ইমানদারের পরিচয়।” [৬১. . ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৪৯।]

খ. ব্যবসায়ীদের মাঝে ইসলামী নৈতিকতা-বোধ জাগ্রত করা। এজন্য সরকারীভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মাধ্যমে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সভা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। এছাড়া মসজিদের ইমাম সাহেবগণকে এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দান।

গ. ব্যবসায়ী লাইসেন্স প্রদানে সর্তকতা অবলম্বন করা। কোন অসাধু ব্যবসায়ী যেন লাইসেন্স না পায় সে দিকে দৃষ্টি দেয়া অর্থাৎ অসাধু প্রমাণিত হলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা।

ঘ. পণ্য দ্রব্যের গুণগত মান নিরীক্ষার নিমিত্তে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ মনিটরিং সেল গঠন করা। এবং সরকারের কাছে তাদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।

ঙ. ভেজাল নিরূপণের জন্য সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করা। উন্নত বিশ্বে সহজ পদ্ধতিতে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যে ভেজাল নিরূপণের যে নিত্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে তা আমদানি করত আমাদের দেশে চালু করা।

চ. ভেজাল প্রমাণে শাস্তিস্বরূপ ইসলামী দণ্ডবিধির প্রয়োগ নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাদ্য সংশোধন বিল-২০০৫ এর সাথে ইসলামী শরী‘আহ নীতির সংযোজন একান্ত আবশ্যক।

ছ. স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তদারক ও পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ও খাদ্য দ্রব্যের গুদামজাত রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা।

জ. যেহেতু ভেজাল একটি বড় ধরনের প্রতারণা, যাতে খরিদদারকে ধোঁকায় ফেলে বেশি মুনাফা লাভ হয়। সেহেতু এ ধরনের অপরাধীকে প্রতারণা মামলার আওতায় নিয়ে এসে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

উপরোক্ত প্রস্তাবনা ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবায়ন ঘটলে এবং ইসলামী শরী‘আহ নীতি অনুসৃত হলে ভেজাল নামক এ অভিশাপ থেকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই রক্ষা পাবে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন