HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

মদিনা শরিফের ফজিলত জিয়ারত ও অবস্থানকালীন আদব

লেখকঃ আব্দুল মুহসিন বিন হামাদ আল আববাদ আল বদর

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
মদিনা শরিফের ফজিলত

জিয়ারত ও অবস্থানকালীন আদব

লেখক

আব্দুল মুহসিন বিন হামাদ আল আববাদ আল বদর

অনুবাদক

ছানাউল্লাহ নজির আহমদ

অনুবাদকের কথা
প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে, যা তার স্বভাব-প্রকৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন করে। তদ্রূপ নির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান প্রতিটি শহরের। যা তার উত্থান-পতন ও অস্তিত্বের অক্ষয় বিবরণ সংরক্ষণ করে। তবে, পবিত্রতার সৌরভে আর মাধুর্যে সুরভিত-বিধৌত সোনার মদিনা আরো প্রাচুর্যপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। কারণ, এর রয়েছে নিজস্ব ও ধর্মীয় উভয় প্রকার বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। যা সমানভাবে মদিনার স্বকীয়তা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি-কালচারকে সযত্নে ধারণ করে। খুব সম্ভব, এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ ! আমাদের কাছে মদিনাকে প্রিয় করে দিন।’ (বোখারি হা.১৮৮৯)

মদিনার ইতিহাস ইসলামের ইতিহাস। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস। কাল আর ইতিহাসের সাক্ষী-স্তম্ভ হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদে নববী, মসজিদে কুবা ও ওহুদ পাহাড়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ওহুদ পাহাড় আমাদের মহববত করে, আমরা তাকে মহববত করি।’ (বোখারি হা.৭৩৩৩) এখানে সংঘটিত হয়েছে বদর, ওহুদ ও খন্দকের মত মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্বের লড়াই। এখানে অঙ্কুরিত ইসলাম শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লবে শোভা-বিস্তৃতি লাভ করে, অদম্য উদ্দীপনা আর অপরাজেয় গতিতে বিশ্বের বুকে গতিশীল, জীবনমুখী ও যুগোপযোগী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ইসলামের স্বর্ণযুগের আড়ম্বরপূর্ণ খেলাফতের আবির্ভাব ঘটে এ ভূমিতেই—এর ধূসর-রুক্ষ-ধূলিময় প্রান্তরে ইসলামের মহান ঝান্ডা উড়িয়ে। মর্যাদার সুমহান ও শোভাময় যে আসন লাভ করেছিল ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ, তার অবিস্মরণীয় স্মৃতির আধারও মদিনার এ পুণ্যভূমি। এখানে রয়েছে রওযাতুন মিন রিয়াযিল জান্নাহ বা জান্নাতের বাগান। আবু বকর, ওমর ও উসমান সহ হাজারো সাহাবায়ে কেরামের সমাধি। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম জাতির নিকট মদীনা—গৌরবান্বিত, সমাদৃত ও সম্মানিত এক ভূমির নাম। মুসলমানগণ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত হতে আবেগে-উচ্ছলতায় ও মহববতের আকর্ষণে মদিনাতে ছুটে আসেন।

তবে বাস্তব হলো, অনেকেই মদিনার ফজিলত, জিয়ারত ও অবস্থানকালীন আদব না জানার দরুন, বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্তির শিকার হয়ে বহু ফজিলত, প্রভূত কল্যাণ ও অশেষ নেকি হতে বঞ্চিত হয়। কুসংস্কার, বিদ্আত ও শিরকের মত কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়। যার কারণে তার সব সাধনা বিফলে যায়। লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই মদিনার ফজিলত, জিয়ারত ও সেখানে অবস্থানকালীন নিয়ম-কানুন ও আদব নিয়ে রচিত বাংলা বইয়ের অতীব প্রয়োজন অনুভূত হয়। বলাই বাহুল্য, এ বিষয়ে আমাদের দেশে দু’একটি বই যে নেই—তা নয়। তবে তার সিংহ ভাগেরই তথ্য অপ্রতুল, ধারণা নির্ভর, বানোয়াট ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতায় পূর্ণ।

তাই কোরআন, নির্ভরযোগ্য সনদে প্রাপ্ত রাসূলের হাদিস, আদর্শ পূর্বসূরীগণের বাণী ও আমলের আলোকে, বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য আমাদের এ প্রয়াস—আল্লামা আব্দুল মুহ্সিন আল বদরের লিখিত فضل المدينة وآداب سكناها وزيارتها নামক বইটির অনুবাদ। বইটি স্বল্পপরিসরে, ক্ষুদ্র কলেবরে মদিনার ফজিলত, জিয়ারত ও অবস্থানকালীন আদব নিয়ে বিশুদ্ধ ও তথ্য নির্ভর প্রামাণ্য গ্রন্থনা।

শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শামসুল হক সিদ্দিক সাহেব ১৪২৭ হি. সনে হজের প্রায় এক মাস আগে অনুবাদের জন্য বইটি আমার হাতে তুলে দেন, আমি আগ্রহ ভরে গ্রহণ করি। সর্ব সাধারণের প্রতি লক্ষ্য রেখে অনুবাদ সহজ ভাষায় করার চেষ্টা করেছি। হে আল্লাহ ! আমাদের শ্রম কবুল করুন। আমিন।

বিনীত

সানাউল্লাহ্ নজির আহমদ

মদিনা শরিফের ফজিলত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সমস্ত প্রশংসার মালিক আল্লাহ তাআলা। আমরা তার সপ্রশংস আলোচনায় নিয়ত প্রবৃত্ত হই। নুসরাত আর সাহায্য প্রার্থনা করি প্রতি পদক্ষেপে, প্রতি মুহূর্তে। তার নিকট ক্ষমা ও মাগফিরাত প্রার্থনা করি। আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রবৃত্তিজাত অনিষ্ট ও কর্মের কুপ্রভাব হতে আশ্রয় চাই। আল্লাহ তাআলা যাকে হেদায়েত করেন, তার কোন ভ্রষ্টকারী নেই। আর ভ্রষ্ট করেন তিনি যাকে, তার কোন হেদায়েতকারী নেই। সতত আলো শূন্যতা, আর অন্ধকার গহবরের হিতাহিতি নিরন্তর তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি এক, ও এককত্বে মহিমান্বিত, তার কোন শরিক নেই। আর সাক্ষ্য দিচ্ছি, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম তার বান্দা ও রাসূল। প্রকৃত বন্ধু ও সৃষ্টিকুলে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি তাকে কিয়ামতের পূর্বে সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং তারই আদেশক্রমে তার প্রতি আহবানকারী ও আলো প্রদানকারী প্রদীপ রূপে প্রেরণ করেছেন। কল্যাণের আধার তিনি, স্বীয় উম্মতকে কল্যাণের নিদর্শনা দিয়েছেন প্রতি পদে, প্রতি পদক্ষেপে, ও সতর্ক করেছেন অনিষ্ট হতে। হে আল্লাহ ! সালাত, সালাম ও বরকত অবতীর্ণ করুন তার উপর, তার বংশধর ও সাহাবাদের উপর, এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা তার পথে ধাবিত হবে ও তার আদর্শের অনুসরণ করবে—তাদের উপর।

মদিনাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—পবিত্রতায় বিধৌত, শান্তি-স্নিগ্ধতায় মগ্ন এক স্থান। মানবজাতির হেদায়েতের লক্ষ্যে ঐশী কালাম তার আলোকচ্ছটা এখানেই ছড়িয়েছিল, রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হজরত জিব্রাঈল আমিনের আগমনস্থল এ ভূমি। ঈমান তার নিরাপদ আশ্রয়-আবাস খুঁজে পেয়েছিল এর শীতল মরূদ্যানে। রাসূলের পদাঙ্কে উজ্জ্বল মদিনা একাধারে মুহাজির ও আনসারদের মিলনভূমি, মুসলমানদের প্রথম রাজধানী। এখানে উড্ডীন হয়েছিল আল্লাহর পথে জেহাদের ঝান্ডা। একদিন যে আলোর ফোয়ারা উৎসারিত হয়েছিল এ ঊষর ভূমিতে, সিক্ত করেছিল বহুদিনের ক্লেদাক্ততায় মজ্জমান মানবজাতির হৃদয়-কন্দর, কালে তার মাটি ছুঁয়েই ছুটে গিয়েছে সত্যের সেনাদল মানবজাতিকে অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে আসার অভিযানে। এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতভূমি, হিজরতের পর এখানে আগমন করে রাসূল আমৃত্যু এখানেই যাপন করেন। তার মৃত্যু ও সমাহিতি এ ভূমিতেই। এখান থেকেই তিনি পুনরুত্থিত হবেন। তার কবরই হবে প্রথম কবর, যা বিদীর্ণ হবে তার সঙ্গী হতে। তার কবর ব্যতীত অন্য কোন নবীর কবরের স্থান সুনির্ধারিত নয়।

এ হলো বরকতময় মদিনা, বিপুল সম্মান ও মর্যাদায় আল্লাহ যাকে ভূষিত করেছেন, মহিমান্বিত করেছেন নানাভাবে ;—মক্কার পরে এর অবস্থানই পৃথিবীর বুকে উচ্চতম আসনে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী দ্বারা মদিনার তুলনায় মক্কার অধিক ফজিলত প্রমাণিত হয়। যেমন কাফেররা যখন তাকে মক্কা হতে বের করে দেয় এবং তিনি হিজরত উদ্দেশ্যে মদিনায় রওনা হন, তখন মক্কাকে সম্বোধন করে বলেন—

والله إنك لخير أرض الله , وأحب أرض الله إلى الله , ولو لا أني أخرجت منك ما خرجت . ( رواه الترمذي وابن ماجه وهو حديث صحيح )

‘আল্লাহর শপথ! অবশ্যই তুমি আল্লাহর ভূ-খন্ডে সর্বোত্তম এবং আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ভূ-খন্ড। আমি যদি তোমার নিকট থেকে বিতাড়িত না হতাম, বের হতাম না।’ (সহিহ হাদিস। ইমাম তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন।)

তবে যে সমস্ত হাদিস রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করা হয়, এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, মক্কা ছিল রাসূলের প্রিয়, আর মদিনা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রিয়—ফলে তৈরি হয় আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার আপাত, বিভ্রান্তিকর বিরোধ—যেমন হাদিসে পাওয়া যায়—

اللهم إنك أخرجتني من أحب البلاد إلي يعني مكة فأسكني في أحب البلاد إليك يعني المدينة — ( فهو حديث موضوع ومعناه غيرمستقيم )

‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আমার প্রিয় শহর অর্থাৎ মক্কা হতে বের করেছেন। সুতরাং, আপনি আমাকে আপনার প্রিয় শহরে (অর্থাৎ মদিনাতে) বাস করতে দিন।’

সেগুলো সঠিক নয়; বরং খুবই বিভ্রান্তিকর, বানোয়াট ও জাল হাদিস হিসেবে সু-চিহ্নিত, সন্দেহ নেই। কারণ, এ হাদিস প্রমাণ করে, আল্লাহ তাআলার নিকট প্রিয় বস্ত্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রিয় নয়, অপরদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রিয় বস্ত্ত আল্লাহর নিকট প্রিয় নয়। অথচ, এ স্বীকৃত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত আল্লাহর মহববতের অনুগামী, বিপুল স্বতঃস্ফূর্ততায় তিনি সর্বদা চেয়েছেন নিঃশর্তভাবে আল্লাহকে ভালোবাসতে, মানুষকে সে জ্ঞানের আলোকধারায় বেঁচে থাকার শিক্ষায় গড়ে তুলতে। আল্লাহর নিকট প্রিয় বস্ত্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট প্রিয় নয়, এমন উদ্ভট ধারণা যে কোন বিবেচনায় বর্জনীয়।

আমি অত্র পুস্তিকাটি মদিনার ফজিলত, তথায় অবস্থান ও জিয়ারত করার আদব—ইত্যাদি বিষয়ে লেখার মনস্থ করেছি। অতএব আমি এতে মদিনার ফজিলত, তথায় অবস্থানের আদব, এবং মদিনা জিয়ারত করার আদব—ইত্যাদি বর্ণনা করব।

মদিনার ফজিলত
আল্লাহ তাআলা মদিনাকে মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিধানে ভূষিত করেছেন। যেমন মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিধান দিয়েছেন মক্কার ক্ষেত্রে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—

إن إبراهيم حرم مكة , وإني حرمت المدينة . ( رواه مسلم )

‘হজরত ইব্রাহীম আ. মক্কাকে حرام বা পবিত্র করেছেন। আমি মদিনাকে حرام বা পবিত্র করেছি।’ (মুসলিম)

অত্র হাদিসে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইব্রাহীম আ. এর حرام বা পবিত্র করার অর্থ হল, তাদের মাধ্যমে এ নগর দু’টির حرمة বা পবিত্রতা প্রকাশ করা। অন্যথায় حرام বা পবিত্র করা হয়েছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে। একমাত্র তিনিই মক্কা এবং মদিনাকে حرام বা পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা এ দু’টি শহরকে এ বিশেষণ অর্থাৎ الحرمة বা পবিত্রতা দ্বারা বিশেষিত করেছেন;—অন্য কোন শহরকে নয়। মক্কা-মদিনা ব্যতীত অন্য কোন স্থানের حرام বা পবিত্র হওয়ার স্বপক্ষে প্রামাণ্য কোন দলিল নেই। অধিকাংশ লোকমুখে প্রচলিত হয়ে গেছে যে, বায়তুল মাক্বদিস ثالث الحرمين বা তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। এ, নিঃসন্দেহে, প্রচলিত ভুল। কারণ এখানে الحرمين الشريفين বা দু’টি হেরেম শরীফের তৃতীয় হেরেম বলে কিছু নেই, এর উল্লেখও কোথাও পাওয়া যায় না। (সুতরাং, বায়তুল্লাহ শরীফ বা পবিত্র কা’বা ঘরকে ‘আল-হারাম আল-মাক্কী’, ‘আল-মসজিদুল হারাম আল-মাক্কী’ নামে অভিহিত করা যাবে। মসজিদে নববীকে ‘আল-হারাম আল-মাদানী’, আল-হারাম আন-নববী’, আল-মসজিদুল হারাম আল-মাদানী’, আল-মসজিদুল হারাম আন-নববী—ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যাবে। কিন্তু বায়তুল মাক্বদিস বা মসজিদে আক্বসাকে ‘আল-হারাম আল-আক্বসা’, ‘আল-মসজিদুল হারাম আল-আক্বসা’ নামে অভিহিত করা যাবে না। তবে, এভাবে বলা যায়, মসজিদুল আক্বসা ثالث المسجدين বা ‘মসজিদ-দ্বয়ের তৃতীয়’। অর্থাৎ সম্মানিত ও মর্যাদা পূর্ণ মসজিদ-দ্বয়ের তৃতীয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা এসেছে, যা এ তিনটি মসজিদের ফজিলত বহন করে এবং এতে নামাজের জন্য হাজির হতে উৎসাহ প্রদান করে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لاتشد الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد : المسجد الحرام , ومسجدي هذا , والمسجد الأقصى . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘(এবাদতের উদ্দেশ্যে) তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর জন্য সফরের মালপত্র গোছানো যাবে না ; মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ এবং মসজিদুল আক্বসা।’ (বোখারি ও মুসলিম)

মক্কা ও মদিনার হেরেম দ্বারা উদ্দেশ্য
মক্কা ও মদিনার নির্ধারিত সীমানা যে পরিমাণ ভূমি তার আওতাধীন করেছে, তা-ই হেরেম বা পবিত্রতম স্থান। কেবল মসজিদে নববীর দালান কেন্দ্রিক ভূমিকে হেরেম বলে উল্লেখ করার যে রেওয়াজ লোক মুখে চালু হয়েছে, তা প্রচলিত ভুল। কারণ, শুধু এতটুকু হেরেম নয়, বরং আইর হতে সউর পাহাড় ও উভয় লাবার মধ্যবর্তী সম্পূর্ণ মদিনা হেরেম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

المدينة حرم ما بين عير إلى ثور . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘আইর ও সউর পাহাড়-দ্বয়ের মধ্যবতী স্থান মদিনার অংশ হেরেম।’ (বোখারি ও মুসলিম)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

إني حرمت ما بين لابتي المدينة أن يقطع عضاهها , أو يقتل صيدها . ( رواه مسلم .)

‘আমি মদিনার উভয় লাবার মধ্যবর্তী স্থানকে হেরেম করেছি, এ অর্থে যে, এর কোন গাছ কাটা যাবে না এবং এর শিকারযোগ্য কোন প্রাণীকে শিকার করা যাবে না।’ (মুসলিম)

বর্তমান যুগে মদিনার ভূমিগত প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটেছে। ফলে মদিনার কিছু অংশ হেরেমের অংশ ছাড়িয়ে অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে। এ জন্য মদিনার ভিতর বিদ্যমান সকল বাড়ি-ঘরকে হেরেমের অন্তর্ভুক্ত বলা যাবে না। তবে যে স্থান হেরেমের সীমানার ভিতর আছে, তা হেরেম আর যে স্থান হেরেমের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, সে স্থানকে মদিনার অন্তর্ভুক্ত বলা যাবে—হেরেমের অন্তর্ভুক্ত বলা যাবে না।

মদিনার হেরেমের সীমানা
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে মদিনা শরীফের হেরেমের বর্ণনা এভাবে এসেছে—

أن الحرم ما بين اللابتين , أو ما بين الحرتين , أو ما بين الجبلين , أو ما بين عير إلى ثور .

‘উভয় লাবা, উভয় হাররাহ, উভয় পাহাড়, অথবা আইর ও সউর এর মধ্যবর্তী সব স্থান হেরেম।’

শব্দ গুলোর মাঝে কোন বৈপরীত্য বা অমিল নেই। কারণ, ছোট বড়য় বিরাজমান। সুতরাং উভয় লাবা, উভয় হাররাহ এবং আইর ও সউর পাহাড়-দ্বয়ের মধ্যবর্তী যে সব স্থান বিদ্যমান, সব হেরেম। যদি কোন স্থানের ব্যাপারে দ্বিধা কিংবা সংশয়ের সৃষ্টি হয় যে—এ হেরেমের অংশ হতে পারে, হেরেমের অংশ নাও হতে পারে—তাহলে এ ক্ষেত্রে রূপক বা অস্পষ্ট জিনিসের অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয়া সবচেয়ে নিরাপদ। আর রূপক বা অস্পষ্ট জিনিসের ক্ষেত্রে যে পথ ও পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে, তা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিয়েছেন। অর্থাৎ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন নোমান বিন বশীরের হাদিসে আছে—যে হাদিসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সকল হাদিস বিশারদ একমত—নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه , ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام .

‘যে ব্যক্তি রূপক বা অস্পষ্ট জিনিস হতে বেঁচে থাকল, সে তার দ্বীন ও সম্মানের ব্যাপারে নিরাপদ রইল। আর যে ব্যক্তি রূপক বা অস্পষ্ট জিনিসে জড়িত হলো, মূলত সে হারামে লিপ্ত হলো।’

মদিনার ব্যাপারে বর্ণিত আরো কতিপয় ফজিলত
এক: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনাকে ( طيبة ) ‘তাইবাহ’ ও ( طابة ) ‘তাবাহ’ নামে অভিহিত করেছেন। (অর্থ: পবিত্র ও উৎকৃষ্ট) বরং সহিহ মুসলিমে আছে, আল্লাহ তাআলা মদিনাকে ‘তাবাহ’ নামে অভিহিত করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—

إن الله سمى المدينة طابة . ( مسلم )

‘আল্লাহ তাআলা ( طابة ) ‘তাবাহ’ মদিনার নামকরণ করেছেন।’ (মুসলিম)

‘তাইবাহ’ ও ‘তাবাহ’ এ দু’টি শব্দ ( طيب ) ‘তাইয়্যেব’ শব্দ হতে তৈরি হয়েছে (অর্থ: পবিত্র)। এর প্রয়োগও ‘তাইয়্যেব’ বা পবিত্র বস্ত্তর জন্য করা হয়। শব্দ দুটিকে পবিত্র ভূমির জন্য প্রয়োগ যথার্থ প্রয়োগ।

দুই: ঈমান মদিনাতে ফিরে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

إن الإيمان ليأرز إلى المدينة كما تأرز الحية إلى جحرها . ( رواه البخاري ومسلم )

‘অবশ্যই ঈমান মদিনাতে প্রত্যাবর্তিত হবে। যেমন সাপ প্রত্যাবর্তিত হয় তার গর্তে।’ (বোখারি ও মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)

অর্থাৎ ঈমান মদিনাতে ফিরে যাবে, অতঃপর কেবল সে ভূমিই হবে ঈমানশূন্য পৃথিবীর মাঝে একমাত্র ঈমানের আধার, ঈমানের আশ্রয়স্থল। মুসলমানগণ মদিনার প্রতি আবেগাপ্লুত হবে এবং সেখানে সফর করবে। কারণ, ঈমানের মোহনিয়, তীব্র আবেদন, আল্লাহর পক্ষ হতে হারাম ও পবিত্রতার ঘোষণা প্রাপ্ত বরকতময় ভূ-খন্ডের সক্রিয় মহববত তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে, ও উৎসাহ দেবে।

তিন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে মদিনার বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেছেন মদিনা এমন একটি জনপদ যে অন্যান্য জনপদ খেয়ে নিঃশেষ করে তার আওতাভুক্ত করে নিবে। তিনি বলেন -أمرت بقرية تأكل القرى ‘আমাকে এমন এক জনপদের আদেশ দেয়া হয়েছে যে অন্যান্য জনপদ খাবে।’ অর্থাৎ তাকে ঐ জনপদে হিজরতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, জনপদ অন্যান্য জনপদকে আক্রান্ত করবে। يقولون لها يثرب . ‘তারা যে জনপদকে ইয়াসরিব বলে।’ وهي المدينة . ( رواه البخاري ومسلم .) ‘আর তা-ই হল মদিনা।’ (বোখারি ও মুসলিম)

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী تأكل القرى ‘জনপদসমূহ খাবে’—এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মদিনা অন্যান্য জনপদকে জয় করবে, সক্ষম হবে অন্যান্য জনপদকে বশীভূত করতে। আরো বলা হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে প্রাপ্ত গনিমত এখানে নিয়ে আসা হবে এবং স্থানান্তরিত হবে এখান থেকেই। উভয় ব্যাখ্যা কার্যত, আমরা দেখতে পাই, বাস্তব হয়েছে এবং অন্যান্য শহরের উপর এর আধিপত্য বিস্তার লাভও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর সূচনা হয়েছিল, যখন এ ভূমির আশীর্বাদ ধুলো মেখে সংস্কারক, পথপ্রদর্শক, বিজয়ী বীরগণ মানব জাতিকে তাদের প্রভুর ইচ্ছায় অন্ধকার হতে মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে আসার অভিযানে যাত্রা করেন। ফলে তাদের বৃহৎ একটি অংশ, মানবজাতির সফলতম জনগোষ্ঠী হেদায়েতের আলো বিধৌত আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করে। মানবজাতির যেটুকু ভালো, কল্যাণময় এবং হেদায়েতের আলোকশিখায় প্রদীপ্ত, তা একদিন উৎসারিত হয়েছিল এ ভূমি থেকেই। অতএব ‘অন্যান্য জনপদ আক্রান্ত করবে’—এর বাস্তব দেখতে পাই, অন্যান্য জনপদের উপর এর বিজয়ের নিশান উড়তে দেখে। যার উদাহরণ ইসলামের প্রথম কল্যাণ যুগ। মুসলমানদের অগ্র-পথিক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবা ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খলিফাদের যুগ। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং সন্তোষ দান করেছেন তাদের। তদ্রূপ, গনিমতের মাল অর্জন এবং এ স্থানে জড়ো করার সে ভবিষ্যদ্বাণীও বাস্তবে পরিণত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোম-পারস্যের সম্পদের ভান্ডার আল্লাহ তাআলার রাস্তায় ব্যয় হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন—বাস্তবে পরিণত হয়েছে সে উক্তিও। সম্পদের সে ভান্ডার বরকতময় মদিনাতে নিয়ে আসা হয় এবং বণ্টিত হয় হজরত উমরের হাতে।

চার: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার প্রতিকূলতা ও কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, المدينة خير لهم لوكانوا يعلمون . ‘মদিনা তাদের জন্য কল্যাণকর। যদি তারা জানত !’ তিনি এ কথা ঐ সমস্ত লোকদের ব্যাপারে বলেছিলেন, যারা মদিনা ছেড়ে আরাম-আয়েশ, প্রশস্ত রিজিক ও অনেক ধন-সম্পদের জায়গায় চলে যাওয়ার চিন্তা করেছিল। এরশাদ হচ্ছে:—

المدينة خير لهم لوكانوا يعلمون , لايدعها أحد رغبة عنها إلا أبدل الله فيها من هو خير منه , ولايثبت أحد على لأوائها وجهدها إلا كنت له شفيعا أو شهيدا يوم القيامة . ( رواه مسلم .)

‘মদিনা তাদের জন্য কল্যাণকর, (আফসোস !) যদি তারা জানত ! যে আগ্রহ হারিয়ে মদিনা ত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলা তার পরিবর্তে তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তিকে মদিনাতে নিয়ে আসবেন। আর যে প্রতিকূলতা ও কষ্ট সহ্য করে মদিনাতে অবস্থান করবে, আমি কেয়ামতের দিন তার সুপারিশকারী বা সাক্ষী হব।’ (মুসলিম)

অত্র হাদিস মদিনার ফজিলত এবং যে ব্যক্তি মদিনাতে প্রতিকূলতা, কষ্ট ও দুঃখ-ক্লেশের শিকার হবে, তার ধৈর্যের ফজিলত প্রমাণ করে। সুতরাং, এ ধরনের পরিবেশ যেন তাকে মদিনা ছেড়ে আরাম-আয়েশ বা পার্থিব সচ্ছলতার অন্বেষণে অন্য কোথাও যেতে প্রলুব্ধ না করে। বরং, এতে সমস্যার সম্মুখীন হলে ধৈর্যধারণ করবে। এর জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে পুরস্কার ও অনেক সওয়াবের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে।

পাঁচ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার পবিত্রতা ঘোষণা করার সাথে সাথে এর মর্যাদা ও এতে দুষ্কর্মের ভয়াবহ পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন—

المدينة حرم ما بين عير إلى ثور , من أحدث فيها , أو آوى محدثا فعليه لعنة الله والملائكة والناس أجمعين , لايقبل الله منه صرفا ولا عدلا . ( رواه البخاري ومسلم )

‘আইর এবং সউর পর্বত মধ্যবর্তী অংশ মদিনা হারাম। যে এখানে কোন দুষ্কর্ম করবে, অথবা কোন সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেবে তার উপর আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা, এবং সমস্ত মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তাআলা তার ফরজ, নফল কোন ইবাদত কবুল করবেন না।’ (বোখারি ও মুসলিম)

ছয়: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার বরকতের জন্য দোয়া করেছেন। যেমন বলেছেন—

اللهم بارك لنا في ثمرنا , وبارك لنا في مدينتا , وبرك لنا في صاعنا , وبارك لنا في مدنا . ( رواه مسلم )

‘হে আল্লাহ! আমাদের ফলে বরকত দিন, বরকত দিন আমাদের শহরে, আমাদের খাদ্য-শস্যের মাপ-জোকে বরকত দিন।’ (মুসলিম)

সাত: মদিনাতে মহামারি ও দাজ্জাল প্রবেশ করবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

على أنقاب المدينة ملائكة , لايدخلها الطاعون ولاالدجال . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘মদিনার প্রবেশ পথে ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। তাতে মহামারি ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বোখারি ও মুসলিম)

মদিনার ফজিলতের ব্যাপারে হাদিসের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে আমি যা উল্লেখ করেছি, তা মূলতঃ বোখারি-মুসলিম হতে সংগৃহীত এবং তা কার্যত খুবই যৎসামান্য।

মদিনার ফজিলতের ব্যাপারে যত কিতাব লেখা হয়েছে, তার মধ্যে শাইখ ড. সালেহ বিন হামেদ আল-রেফায়ীর কিতাব সবচেয়ে সুন্দর, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, যা রচনা করেছিলেন তিনি জামেয়া ইসলামিয়া, মদিনা হতে পি,এইচ,ডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য। উক্ত অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল— الأحاديث الواردة في فضائل المدينة جمعا ودراسة . ‘ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহ মদিনার ফজিলতের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিস সংকলন’। অনুসন্ধিৎসুদের এ কিতাবটি সংগ্রহ করতে এবং এর থেকে উপকৃত হতে সবিনয় পরামর্শ দিচ্ছি।

মদিনা নগরী যা কিছু অন্তর্ভুক্ত ও নিজের করে নিয়ে পুণ্যময় ও বরকতের আধার হয়েছে, তন্মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ দু’টি মসজিদ উল্লেখযোগ্য। যথা:—

মসজিদে নববী বা রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদ।

মসজিদে কুবা।

মসজিদুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদের ফজিলতের ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

যেমন—রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী—

لاتشد الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد : المسجد الحرام , مسجدي هذا , والمسجد الأقصى . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য (সওয়াবের আশায়) সফর করা যাবে না,—মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ এবং মসজিদুল আক্বসা।’ (বোখারি ও মুসলিম)

সুতরাং, এ মদিনাতেই নবীগণ কর্তৃক নির্মিত সেই ঐতিহ্যপূর্ণ তিনটি মসজিদের একটি অবস্থিত, যে তিনটি মসজিদকে অনন্য এ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে যে, তাদের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোথায় এবাদতের জন্য সফর করা যাবে না, সফর করা হবে শরিয়ত বিরুদ্ধ।

আরো হাদিস আছে, যা এ মসজিদের ফজিলত প্রমাণ করে, যেমন এর ভিতর এক নামাজ এক হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

صلاة في مسجدي هذا أفضل من ألف صلاة فيما سواه إلا المسجد الحرام . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘এই মসজিদের এক নামাজ, অন্যান্য মসজিদের হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম, মসজিদুল হারাম ছাড়া।’ (বোখারি ও মুসলিম)

এ, নিশ্চয়, অনেক বড় ফজিলত, আখেরাতের মৌসুমি বায়ুর সংবাদবাহী, এতে অর্জন বহুগুণ;— দশ বা একশতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং, এর গন্ডি হাজার ছাড়িয়ে অসংখ্যে।

আমরা জানি, পার্থিব মুনাফা লাভে তীব্র আকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ীগণ যখন জানতে পারে, তাদের পণ্য কোন নির্দিষ্ট এক মৌসুমে ভাল বাজার পাবে। তখন তারা সেজন্য তৈরি হয় ও প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে থাকে। লাভ যদিও অর্ধেক বা দ্বিগুণ হয়। সে তুলনায় আমাদের এখানে কি করা উচিত ! এখানে তো আখেরাতের ব্যবসা। দশ গুণ নয়। একশত গুণ নয়। পাঁচ শত গুণ নয়। ছয় শত গুণ নয়। বরং হাজার গুণের চেয়েও বেশি লাভ?!!

বরকতময় এ মসজিদ সম্পর্কে আরো কয়েকটি বিষয় জানা প্রয়োজন:
প্রথমত: এ মসজিদে এক নামাজের সওয়াব হাজার নামাজের চেয়ে বেশি। এ ফজিলত শুধু ফরজের জন্য কিংবা শুধু নফলের জন্য বিশিষ্ট নয়। বরং, উভয় প্রকার নামাজের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম صلاة বা নামাজ শব্দটি ব্যাপক ও উন্মুক্ত রেখেছেন। কাজেই, এক ফরজ, হাজার ফরজের সমান। এক নফল হাজার নফলের ছাওয়াব বয়ে আনবে।

দ্বিতীয়ত: হাদিসে বর্ণিত সওয়াব শুধু ঐ ভূ-খন্ডের সাথে নির্দিষ্ট নয়, যতটুকু ভূ-খন্ড রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মসজিদ হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল। বরং, এ হুকুম ঐ ভূ-খন্ড এবং অতিরিক্ত যতটুকু ভূ-খন্ড মসজিদের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে উভয়ের জন্য। এর দলিল দুই খলিফা হজরত ওমর রা. ও হজরত উসমান রা.-এর আমল। তারা মসজিদকে ইমামের অংশে সম্প্রসারিত করেছেন। আমরা জানি, বর্তমানে ইমামের স্থান, এবং ইমামের পিছনে যে কাতারগুলো সম্প্রসারিত করা হয়েছে, তা রাসূলের যুগে নির্দিষ্ট মসজিদভূমির বাইরে। তদুপরি তাদের যুগে অনেক সাহাবায়ে কেরাম বর্তমান ছিলেন, কেউ তাদের এ কাজে আপত্তি করেননি। এটাই পরিষ্কার দলিল যে বহু গুণ সওয়াব শুধু ঐ ভূ-খন্ডের জন্য বিশিষ্ট নয়, যে ভূ-খন্ড রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মসজিদ হিসেবে নির্দিষ্ট ছিল।

তৃতীয়ত: মসজিদের ভিতর কিছু জায়গা আছে, যার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এটি জান্নাতের একটি বাগান। এরশাদ হচ্ছে—

ما بين بيتي ومنبري روضة من رياض الجنة . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘আমার ঘর এবং মিম্বার এর মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের একটি বাগান।’ (বোখারি ও মুসলিম)

গোটা মসজিদের ভিতর শুধু এ অংশকে এ নামে ভূষিত করার অর্থ হলো অত্র অংশটুকু বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ও আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নফল এবাদত ও জিকির এবং কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে উক্ত ফজিলত অর্জন করা যাবে। শর্ত হল, তথায় যাপন, অবস্থান ও গমনের ব্যাপারে কাউকে যেন কষ্টের সম্মুখীন করা না হয়। মনে রাখতে হবে, ফরজ নামাজ প্রথম কাতারে আদায়ই উত্তম। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

خير صفوف الرجال أولها وشرها آخرها . ( رواه مسلم .)

‘পুরুষদের সর্বোত্তম কাতার প্রথমটি, নিকৃষ্টতম কাতার শেষেরটি।’ (মুসলিম)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন—

لو يعلم الناس ما في النداء والصف الأول , ثم لم يجدوا إلا أن يستهموا عليه لاستهموا عليه . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘মানুষ যদি জানত, আজান দেওয়াতে ও প্রথম কাতারে শামিল হওয়াতে কত খায়ের ও বরকত রয়েছে, এবং লটারি ছাড়া তাতে সুযোগ না পাওয়া যেত, তবে অবশ্যই লটারিতে অংশ গ্রহণ করত।’’ (ইমাম মুসলিম ও ইমাম বোখারি হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।)

চতুর্থত: মুসল্লিদের দ্বারা মসজিদে নববী পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে যে উপস্থিত হবে, সে মসজিদের সামনের অংশ বাদ দিয়ে, তিন দিকে প্রশস্ত রাস্তাতে দাঁড়াবে এবং ইমামের সাথে নামাজ আদায় করবে। এতে জামাতে নামাজ আদায় করার সওয়াব পাবে, তবে হাজারের চেয়ে বহু গুণ বর্ধিত সওয়াব শুধু ঐ ব্যক্তির লাভ হবে, যে মসজিদের ভিতরে নামাজ আদায় করবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

صلاة في مسجدي هذا أفضل من ألف صلاة فيما سواه إلا المسجد الحرام . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘আমার এ মসজিদের ভিতর এক নামাজ অন্যান্য মসজিদের ভিতর হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম, মসজিদুল হারাম ব্যতীত।’ (বোখারি ও মুসলিম)

সে হিসেবে যে রাস্তাতে নামাজ আদায় করল সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মসজিদে নামাজ আদায়কারী হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং, এই বহু বহুগুণে বর্ধিত সওয়াবও তার হাসিল হবে না।

পঞ্চম: বহুল প্রচলিত একটি মত এই যে, মদিনাতে আগমনকারী প্রতিটি ব্যক্তির অবশ্য কর্তব্য হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। কারণ, ইমাম আহমদের ‘মুসনাদে’ হাদিস আছে, হজরত আনাস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন—

من صلى في مسجدي أربعين صلاة لاتفوته صلاة كتبت له براءة من النار ونجاة من العذاب , وبرئ من النفاق . ( وهو حديث ضعيف لاتقوم به الحجة .)

‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, এক ওয়াক্ত নামাজ ও ছুটবে না, তাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি ও শাস্তি হতে নাজাতের সনদ প্রদান করা হবে এবং সে নেফাক হতে মুক্ত হয়ে যাবে।’ (এটি দুর্বল সনদের হাদিস। দলিল হিসেবে পেশ করার অযোগ্য।)

—বরং এক্ষেত্রে হুকুম ব্যাপক। এমন নয়,—যে ব্যক্তি মদিনাতে আসবে তার অবশ্য কর্তব্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদে নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক নামাজ আদায় করা। তবে, নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা অথবা নির্ধারিত কোন নামাজের শর্ত ছাড়াই এতে প্রত্যেক নামাজ হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম।

ষষ্ঠ: ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, আমরা দেখতে পাই, মুসলমানগণ কবরকে কেন্দ্র করে এক ভয়ংকর জাহিলিয়াতে আক্রান্ত হয়ে আছেন—রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর মসজিদে নববীতে অবস্থিত,—এ যুক্তিতে তারা কবরের উপর নির্মাণ করছেন মসজিদ, কিংবা মসজিদে মৃতদের দাফন করছেন নির্দ্বিধায়। তাদের অযৌক্তিক ও খুবই বিভ্রান্তিকর প্রমাণ এই যে, রাসূলকে সমাহিত করা হয়েছে তারই নির্মিত মসজিদে নববীতে। আমরা তাদের এ ভ্রান্তির উত্তর হিসেবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমনোত্তর কালে মসজিদে নববী নির্মাণ করেন, এবং উম্মাহাতুল মোমেনিনদের বসবাসের জন্য তার পাশেই নির্মাণ করেন কয়েকটি ঘর, তার একটি হজরত আয়েশা (রা:)-এর ঘর—ওফাতের পর রাসূলকে যেখানে সমাহিত করা হয়। উম্মাহাতুল মোমেনিনদের ঘরগুলো খোলাফায়ে রাশিদীন, আমিরে মুআবিয়া ও তার পরবর্তী অন্যান্য খলিফাদের আমলে মসজিদের আওতার বাইরে ছিল, পরবর্তীতে, বনু উমাইয়্যা গোষ্ঠীর শাসনামলে, মসজিদে নববীকে সম্প্রসারিত করা হয়, এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমাধি সহ হজরত আয়েশার গৃহটি মসজিদের আওতাভুক্ত করে নেয়া হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনেক সুস্পষ্ট হাদিস বর্ণিত আছে—যা রহিত হওয়াকে কবুল করে না এবং যার দ্বারা কবর সমূহকে মসজিদ রূপে গ্রহণ করা হারাম প্রমাণিত হয়। যেমন—জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ আল বাযালীর রা. এর হাদিস। যে হাদিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তার মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে শুনেছেন। তাতে তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে বলতে শুনেছি—

إني أبرأ إلى الله أن يكون لي منكم خليل , فإن الله اتخذني خليلا كما اتخذ إبراهيم خليلا , ولو كنت متخذا من أمتي خليلا لاتخذت أبابكر خليلا , ألا وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبيائهم وصالحيهم مساجد ألا فلا تتخذواالقبور مساجد فإني أنهاكم عن ذلك . ( رواه مسلم في صحيحه .)

‘তোমাদের কেউ আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু বা খলিল হবে এ থেকে আল্লাহ তাআলার নিকট নিষ্কৃতি চাই। কারণ, আল্লাহ তাআলা আমাকে খলিল নির্বাচন করেছেন। যেভাবে খলিল নির্বাচন করেছেন ইব্রাহীমকে। আমি যদি আমার উম্মত হতে কাউকে খলিল নির্বাচন করতাম, তাহলে অবশ্যই আবু বকরকে খলিল নির্বাচন করতাম। জেনে রেখো ! তোমাদের আগে যারা ছিল, তারা নবীদের এবং নেককার লোকদের কবর সমূহকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করতো। সাবধান ! তোমরা কবর সমূহকে মসজিদ রূপে গ্রহণ করো না। আমি এর থেকে তোমাদের নিষেধ করছি।’ (মুসলিম)

বরং, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রকৃত অবস্থা হলো, মৃত্যুর সায়াহ্নে, এক বেদনা বিধুর পরিবেশেও, তিনি ভোলেন নি এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করতে। কবর সমূহকে মসজিদে রূপান্তর করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। যেমন বোখারি ও মুসলিমে আয়েশা রা. ও ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, তারা বলেছেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট মৃত্যু হাজির হল, একটি চাদর তিনি চেহারার উপর রাখতেন, যখন চিন্তিত হতেন, চেহারা হতে চাদর সরিয়ে নিতেন। এমতাবস্থায় তিনি বলেন—

لعنة الله على اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد .

‘ইয়াহুদ-নাসারাদের উপর আল্লাহ তাআলার লা’নত। তারা তাদের নবীদের কবর সমূহকে মসজিদ বানিয়েছে।’

উম্মতের মাঝে তাদের কর্মের পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে সতর্ক উচ্চারণ করেছিলেন। হজরত আয়েশা রা., ইবনে আববাস এবং হজরত জুনদুব রা. হতে বর্ণিত এ হাদিস গুলো সুস্পষ্ট। কোন অবস্থায় রহিত করণকে স্বীকার করে না। কারণ, হজরত জুনদুব রা. এর হাদিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ জীবনের এবং হজরত আয়েশা রা. ও ইবনে আববাস রা. এর হাদিস দু’টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ মুহূর্তের। সুতরাং, সহিহ ও মুহকাম এ হাদিসগুলো, যা সুনিশ্চয়ভাবে প্রামাণ্য, উমাইয়্যা শাসনামলে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে তার বিরোধিতা করা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। উমাইয়্যাদের সেই সিদ্ধান্তকে ভিত্তি করেই কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ বা মসজিদে দাফনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

মসজিদে কুবা
মদিনার বিশেষ ফজিলত পূর্ণ ও বৈশিষ্ট্য মন্ডিত দু’টি মসজিদের দ্বিতীয়টি হল—মসজিদে কুবা। এর ভিত্তিপ্রস্তরই হয়েছে তাকওয়ার উপর। রাসূলের কর্ম ও উক্তি দ্বারা উক্ত মসজিদে নামাজের বিশেষ ফজিলত প্রমাণিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কর্ম : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন—

كان النبي صلى الله عليه وسلم يأتي قباء كل سبت ماشيا وراكبا فيصلي فيه ركعتين . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি শনিবার পায়ে হেঁটে ও আরোহণ করে মসজিদে কুবাতে আসতেন। অতঃপর তাতে দু’রাকাত নামাজ আদায় করতেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)

উক্তি : হজরত সাহাল বিন হুনাইক রা. হতে প্রমাণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

من تطهر في بيته ثم أتى مسجد قباء فصلى فيه صلاة كان له أجر عمرة . ( رواه ابن ماجه و غيره )

‘যে ব্যক্তি ঘরে পবিত্রতা অর্জন (ওজু) করে, অতঃপর মসজিদে কুবাতে আসে এবং সেখানে কোন নামাজ আদায় করে, সে ওমরার সওয়াব পাবে।’ ( ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।)

এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী فصلى فيه صلاة (অতঃপর সেখানে সে কোন নামাজ আদায় করল) ফরজ-নফল উভয় নামাজকে শামিল করে। মদিনার এ দু’টি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদ সম্পর্কে ফজিলতের বর্ণনা হাদিসে আসেনি।

১০
মদিনায় অবস্থানের আদব
পুণ্যময় এ মদিনায় অবস্থানের সুযোগ আল্লাহ তাআলা যাকে দিয়েছেন, তার কর্তব্য ও পালনীয় হল, এ সুমহান নেয়ামত ও দানের কথা অনুভূতিতে চির জাগরূক রেখে আল্লাহর প্রতি সদা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। এ ফজিলত ও এহসানের কথা স্বীকার করে আল্লাহর প্রশংসা আদায় করবে। মনে রাখবে, দূর-দূরান্তের অসংখ্য এলাকার লোকজন গভীর আগ্রহ ও প্রতীক্ষা নিয়ে মক্কা-মদিনায় পৌঁছার ও কিছুটা সময় তথায় যাপন করার জন্য ব্যাকুল-কাতর হয়ে আছে। কেউ কেউ আছেন, পরিমাণে সামান্য হলেও কিছু কিছু অর্থ জমিয়ে এই আকঙ্খা মেটানোর জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। হিন্দুস্থানের এক আলেম আমাকে জানিয়েছেন, অতীতে, হিন্দুস্থানের হাজিগণ পালতলা নৌকায় করে হজে আগমন করতেন, পথিমধ্যে তাদের দীর্ঘ কাল অতিবাহিত হত লোকালয়-বান্ধব-বর্জিত গভীর সমুদ্রে। অত:পর যখন মক্কা-মদিনার পবিত্র ভূমিতে তাদের নৌকা নোঙ্গর করত, দৃশ্য হত সেই পবিত্র ভূমি, তখন তাদের একটি দল আনন্দের আতিশয্যে, আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপনার্থে নৌকাতেই সিজদায় অবনত হন।

১১
মদিনায় অবস্থানকালীন আদব :
এক : মদিনার বিশেষ ফজিলত এবং তার প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ ভালোবাসার কারণে মদিনাকে মহববত করবে।

ইমাম বোখারি রহ. তার সহিহ কিতাবে হজরত আনাস রা. হতে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফর হতে ফিরতেন এবং যখন মদিনার বাড়ি-ঘরগুলো দৃষ্টি গোচর হত, তখন মদিনার মহববতে স্বীয় উষ্ট্রী জোড়ে হাঁকাতেন। আর ভারবাহী জন্তুর উপর থাকলে তাকে নাড়াতেন।

দুই: এ মদিনাতে আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের উপর অবিচল থাকবে। বেদআত ও গুনাহের কলঙ্ক হতে দূরে অবস্থান করবে। কারণ, মদিনাতে নেকি যেরূপ মর্যাদার, বেদআত ও গুনাহ অনুরূপ ভয়ংকর। কারণ যে ব্যক্তি হেরেমের ভিতর আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করে, তার গুনাহ বড় ও কঠোর হয়—ঐ ব্যক্তির তুলনায়, যে হেরেমের বাইরে আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করে, সংখ্যার দিক দিয়ে গুনাহ বাড়ানো হয় না ঠিক। তবে হারামের সীমানায় সংঘটিত হওয়ার কারণে এর আকার বিরাট ও কঠোর করা হয়।

তিন: মদিনা অবস্থানকালীন আপ্রাণ চেষ্টা করবে, যেন আখেরাতের ব্যবসার বড় একটি অংশ হাসিল হয়। যেখানে লাভ বহু গুণ। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে বর্ণিত সওয়াবের প্রতি উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত হয়ে যত সম্ভব মসজিদে নববীতে বেশি বেশি নামাজ আদায় করবে। এরশাদ হচ্ছে :—

صلاة في مسجدي هذا خير من ألف صلاة فيما سواه إلا المسجد الحرام . ( رواه البخاري ومسلم .)

‘আমার এ মসজিদে এক নামাজ, অন্যান্য মসজিদের ভিতর হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম, মসজিদুল হারাম ব্যতীত।’ (বোখারি ও মুসলিম)

চার: বরকতময় এ মদিনাতে ভাল কথা, কাজ ও কর্মে আদর্শ ও সুন্দর নমুনা হতে চেষ্টা করবে। কারণ, সে এমন এক শহরে, যেখান থেকে নূর বিকশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে, যেখান থেকে কুসংস্কার দূরকারী দ্বীনের দায়ীগণ ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছেছেন। অতএব যে ব্যক্তি মদিনাতে আসবে সে মদিনায় অবস্থানকারীদের উত্তম আদর্শ, মহৎগুণ ও মহান চরিত্রে বিশিষ্ট দেখবে। অতঃপর সে উপকৃত ও প্রভাবন্বিত হয়ে নিজ দেশে ফিরে যাবে। কারণ, সে কল্যাণ, আল্লাহ তাআলার আনুগত্য এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। বস্ত্তত: বরকতময় শহর মদিনাতে আগমনকারীগণ উত্তম আদর্শ দেখে যেরূপ কল্যাণ ও সততা অর্জন করবে, অনুরূপ মদিনার ভিতর কাউকে এর বিপরীত দেখলে ফল পালটে যাবে। তখন সে উপকৃত ও প্রশংসাকারী হওয়ার পরিবর্তে, ক্ষতিগ্রস্ত ও কুৎসা রটনাকারী হবে।

পাঁচ: মদিনাতে অবস্থানকালীন স্মরণ রাখবে, সে এখন অবস্থান করছে পবিত্র ভূ-খন্ডে। যে ভূ-খন্ড একাধারে ওহির অবতরণস্থল, ঈমানের আশ্রয় কেন্দ্র, রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর পদচারণায় বিধৌত-গৌরবময় ঐতিহ্যের ভূমি। তারা এ ভূ-খন্ডে কল্যাণ ও সততার সাথে, হক ও হেদায়াতকে আঁকড়ে ধরে পদচারণা করেছেন। সুতরাং, এতে এমন আচার-আচরণ ও ব্যবহার হতে বিরত থাকবে, যা তাদের নীতি ও আদর্শের বিপরীত। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার অপছন্দনীয় আচার-ব্যবহার—যা তার কাছে নিয়ে আসবে দুনিয়া-আখেরাতের ধ্বংস ও অশুভ পরিণতি।

ছয়: আল্লাহ তাআলা যাকে মদিনাতে থাকার তওফিক দান করেন, সে তথায় কোন অঘটন ঘটানো বা কোন অপরাধীকে আশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকবে। অন্যথায় অভিশাপের সম্মুখীন হবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, তিনি বলেছেন—

المدينة حرم , فمن أحدث فيها أو آوى محدثا فعليه لعنة الله والملائكة والناس أجمعين . لايقبل الله منه يوم القيامة عدلا وصرفا , رواه مسلم من حديث أبي هريرة- رضي الله عنه -( وهو في الصحيحين من حديث علي رضي الله عنه -)

‘মদিনা হেরেম। যে এখানে কোন দুষ্কর্ম করল অথবা কোন অপরাধীকে আশ্রয় দিল, তার উপর আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত। কেয়ামতের দিন তার কোন ফরজ বা নফল কবুল করা হবে না।’ (ইমাম মুসলিম রা. আবু হুরায়রা রা. হতে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। বোখারি ও মুসলিমের অপর স্থানে হাদিসটি হজরত আলী রা. হতে উল্লেখ করা হয়েছে।)

সাত: মদিনার কোন গাছ কাটতে অথবা তার কোন শিকারকে শিকার করতে উদ্বুদ্ধ হবে না। যেহেতু এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনেক হাদিসে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী—

إن إبراهيم حرم مكة وإني حرمت المدينة ما بين لابيتيها , لايقطع عضاهها , ولايصاد صيدها ,.( رواه مسلم من حديث جابر بن عبد الله رضي الله عنهما -)

‘ইব্রাহীম আ. মক্কাকে হেরেম ঘোষণা করেছেন। আমি মদিনার উভয় লাবার মধ্যবর্তী অংশকে হেরেম ঘোষণা করছি। এর কোন গাছ কাটা যাবে না এবং এর কোন শিকারকে শিকার করা যাবে না।’ (ইমাম মুসলিম রহ. জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. এর হাদিস সমগ্র থেকে বর্ণনা করেছেন।)

অধিকন্তু ইমাম মুসলিম রহ. সাদ ইবনে আবি ওয়াক্বাস রা. এর হাদিসও বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—

إني أحرم ما بين لابتي المدينة أن يقطع عضاهها , أو يقتل صيدها ,

‘আমি মদিনার উভয় লাবার মধ্যবর্তী স্থানকে হেরেম ঘোষণা করেছি। এর গাছ কাটা যাবে না, অথবা এর শিকারকে হত্যা করা যাবে না।’

বোখারি ও মুসলিমে আসেম ইবনে সুলাইমান আল-আহওয়াল হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি আনাস রা.কে বলেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি মদিনাকে হারাম ঘোষণা করেছেন? তিনি উত্তর দেন, হ্যাঁ, অমুক জায়গা হতে অমুক জায়গা পর্যন্ত। এর গাছ কাটা যাবে না। যে এতে কোন দুষ্কর্ম করবে তার উপর আল্লাহ তাআলা, ফেরেশতা এবং সমস্ত মানুষের লা’নত।

হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, তিনি বলতেন, আমি যদি মদিনাতে হরিণের পাল চরে বেড়াতে দেখতাম, তাদেরকে উত্ত্যক্ত কিংবা ভীত করতাম না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন , ما بين لابتيها حرام . অর্থ: উভয় লাবার মধ্যবর্তী স্থান হেরেম।

গাছ দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সমস্ত গাছ, যে গুলো আল্লাহ তাআলা গজিয়েছেন। মানুষ যে সমস্ত গাছ রোপণ করেছে, সে গুলো কাটার অনুমতি তাদের রয়েছে।

আট: মদিনার অভাব, মুসিবত ও কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করবে। কারণ আবু হুরায়রা রা. এর হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لايصبر على لأواء المدينة وشدتها أحد من أمتي إلا كنت له شفيعا يوم القيامة أو شهيدا . ( رواه مسلم .)

‘আমার উম্মতের যে কোন ব্যক্তি মদিনার মুসিবত ও কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করবে, কেয়ামতের দিন আমি তার সুপারিশকারী অথবা সাক্ষী হব।’ (মুসলিম)

সহিহ মুসলিমে আরো আছে, মাহরীর আজাদকৃত গোলাম আবু সাঈদ হাররার রাতে (মদিনা ও সিরিয়ার গভর্নরদের মাঝে যুদ্ধের সময়ে) হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা. এর নিকট আসেন। অতঃপর তার নিকট মদিনা ত্যাগ করার ব্যাপারে পরামর্শ চান এবং মদিনার দ্রব্যমূল্য ও নিজের সংসারের অধিক লোক সংখ্যার অভিযোগ করেন। আরো জানান যে, মদিনার অভাব-অনটন ও তার মুসিবত সহ্য করার ধৈর্য তার নেই। তাকে তিনি বলেন, তোমার সর্বনাশ হোক ! এর নির্দেশ আমি তোমাকে দিতে পারি না। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি—

لايصبر أحد على لأوائها فيموت إلا كنت له شفيعا يوم القيامة , إذا كان مسلما .

‘যে ব্যক্তি মদিনার মুসিবতে ধৈর্যধারণ করত: অবশেষে মারা যায়, আমি কেয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী হব, যদি সে মুসলমান হয়।’

নয়: মদিনা বাসীদের কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে। কারণ, যে কোন অবস্থাতে, যে কোন ভূমিতে মুসলমানদের কষ্ট দেয়া হারাম। কিন্তু তা পবিত্র শহরে আরো জঘন্য ও নিকৃষ্ট অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বোখারি রহ. তার সহিহ কিতাবে হজরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি—

لايكد أهل المدينة أحد إلا انماع كما ينماع الملح في الماء .

‘যে মদিনা বাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে। যেমন লবণ পানিতে নিঃশেষ হয়ে যায়।’

ইমাম মুসলিম রহ. তার সহিহ কিতাবে হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণনা করেন—

من أراد أهل هذه البلدة بسوء يعني المدينة- أذابه الله كما يذوب الملح في الماء .

‘যে ব্যক্তি এই শহর অর্থাৎ মদিনা বাসীদের সাথে অনিষ্টের ইচ্ছা করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে নিঃশেষ করে দেবেন। যেমন লবণ পানিতে নিঃশেষ হয়ে যায়।’

দশ: আমি মদিনায় অবস্থান করছি, সুতরাং কল্যাণ ও সৌভাগ্য আমাকে পরিবেষ্টন করে আছে—খবরদার ! এমন ধারণা লালন করে মদিনাবাসী কোনোরূপ প্রবঞ্চনা ও আত্মপ্রতারণার শিকার হবে না। কারণ, তার সাথে যদি নেক আমল, আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবিচ্ছেদ্য আনুগত্য, গুনাহ ও অপরাধ হতে পরহেযগারিতা না থাকে, তবে কেবল মদিনার অবস্থান তার কোনো উপকার করতে পারবে না। বরং, উল্টো তার জন্য বিপদ বয়ে আনবে।

ইমাম মালেকের মুয়াত্তাতে আছে, হজরত সালমান ফারসী রা.—বলেছেন, মাটি কাউকে পবিত্রে রূপান্তরিত করে না। মানুষকে পবিত্র বানায় একমাত্র তার আমল। ইমাম মালেকের বর্ণনার সনদে যদিও কর্তন আছে, তবে হাদিসটি বাস্তব এবং অর্থও ঠিক। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إن أكرمكم عند الله أتقاكم . ( الحجرات : ১৩)

‘তোমাদের ভিতর সর্বাধিক পরহেজগার ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত।’ (সূরা হুজুরাত:১৩)

সর্বজন স্বীকৃত বাস্তবতা এই যে, মদিনাতে বিভিন্ন সময়ে ভাল-মন্দ সব ধরনের লোক বর্তমান ছিল। আমল-ভাল লোকদের উপকার করেছে। খারাপ লোকদের পবিত্র করেনি এবং তাদের অবস্থা হতে উত্তোলন করেনি। এটা বংশের মত। নেক আমল ছাড়া শুধু মানুষের বংশপরস্পরা মানুষকে আল্লাহ তাআলার নিকট উপকৃত করতে পারবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—

ومن بطأ به عمله لم يسرع به نسبه . ( رواه مسلم في صحيحه .)

‘আমল যাকে নিয়ে পিছে পড়ে যাবে, বংশ তাকে নিয়ে অগ্রগামী হতে পারবে না।’ (মুসলিম)

সুতরাং, আমল যে ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করণ মুলতবি করে দেবে, তার বংশ তাকে দ্রুত জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবে না।

এগারো : মদিনাতে অবস্থানকালীন এ উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে, সে এমন এক স্থানে অবস্থান করছে, যেখান থেকে নূর বিকশিত হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়, ইলমে নাফে যেখান থেকে (উপকারী ইলম) পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছেছে, আলো ফেলেছে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার। অতএব, সেই ইলমের শহর খ্যাত মদিনাতে অবস্থানকালীন ইলমে দ্বীন শিখার প্রতি মনোযোগী হবে। যার মাধ্যমে সজ্ঞান উপলব্ধিতে আল্লাহ তাআলা পর্যন্ত পৌঁছোবে। অন্যদেরকে অনুরূপ আল্লাহ তাআলার দিকে আহবান করবে। বিশেষ করে মসজিদে নববীতে ইলমে দ্বীন শিক্ষার প্রতি বেশি যত্নবান হবে। কারণ, হজরত আবু হুরায়রা রা. এর হাদিসে আছে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন,

من دخل مسجدنا هذا يتعلم خيرا أو يعلمه كان كالمجاهد في سبيل الله , ومن دخله لغير ذلك كان كاالناظر إلى ما ليس له . ( رواه أحمد وابن ماجه وغيرهما , وله شاهد عند الطبراني من حديث سهل بن سعد رضي الله عنه -.)

‘যে ব্যক্তি আমাদের এ মসজিদে কল্যাণকর কিছু শিখতে অথবা শিখাতে প্রবেশ করে, সে আল্লাহ তাআলার রাস্তায় জেহাদকারীর ন্যায়। যে অন্য কোন কারণে এতে প্রবেশ করে, সে অন্যের জিনিসে দৃষ্টি নিক্ষেপ কারীর ন্যায়।’ (হাদিসটি আহমদ, ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেছেন। এর স্বপক্ষে তাবরানীতে হজরত সা’দ রা. এর হাদিস বিদ্যমান আছে।)

যেমনিভাবে মদিনায় অবস্থানকালীন আদব রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার জিয়ারতের অনেক আদব। মদিনায় অবস্থানকালীন অধিকাংশ আদব—যার বর্ণনা পূর্বোক্ত আলোচনায় আলোচিত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই মদিনার জিয়ারতকারীকে পালন করতে হবে। অধিকন্তু, তার আরো জানতে হবে, মদিনায় আগমনকারীর জন্য বৈধ হলো, মদিনার উদ্দেশ্যে এই সফর দ্বারা মসজিদে নববীর জিয়ারত এবং শুধু তার জন্যই ভ্রমণের নিয়ত করা। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لاتشد الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد : المسجد الحرام , ومسجدي هذا , والمسجد الأقصى . ( رواه البخاري و مسلم .)

‘তিনটি মসজিদ ব্যতীত (আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে) অন্য কোন দিকে সফর করা যাবে না। মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদুল আক্বসা।’ (বোখারি ও মুসলিম)

এ হাদিস যে কোন মসজিদ বা অন্য বস্ত্ত—যেখানে সে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সফরের নিয়ত করছে, উষ্ট্রী হাঁকাতে নিষেধ করে। কারণ, সুনানে নাসায়ীতে হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি বুসরা বিন আবী বুসরা আল-গেফারী রা. এর সাথে দেখা করেছি। অতঃপর তিনি বলেন, কোথা হতে এসেছেন ? আমি উত্তর দিলাম ‘তুর’ হতে। তিনি বললেন, আপনার সেখানে যাওয়ার আগে যদি আমি আপনার সাথে দেখা করতাম, আপনি সেখানে যেতেন না। আমি তাকে বললাম, কেন ? তিনি বললেন, আমি রাসূল রা.কে বলতে শুনেছি—

لاتعمل المطي إلا إلى ثلاثة مساجد : المسجد الحرام . ومسجدي , ومسجد بيت المقدس . ( وهو حديث صحيح .)

‘আরোহণের পশুকে (আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সফরের কাজে) তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন বস্ত্তর জন্য ব্যবহার করা যাবে না। মসজিদুল হারাম, আমার মসজিদ এবং বায়তুল মাক্বদিসের মসজিদ।’ (এটি সহিহ হাদিস।)

এতে বুসরা বিন আবি বুসরা আল-গেফারী রা. এর দলিল বিদ্যমান আছে, যে এ তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো বস্ত্তর জন্য আরোহণের উষ্ট্রী ব্যবহার করা যাবে না।

১২
যে ব্যক্তি বরকতময় এ মদিনাতে আসে তার জন্য বৈধ ও করণীয় হয়, দু’টি মসজিদ ও তিনটি কবরস্থান জিয়ারত করা।
মসজিদ দু’টি

মসজিদুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

মসজিদে কুবা।

এ দু’টি মসজিদের ভিতর নামাজের ফজিলত সম্পর্কে কিছু দলিল আগে বর্ণিত হয়েছে।

১৩
তিনটি কবরস্থান যেগুলোর জিয়ারত করা শরিয়ত সম্মত
যথা:—

১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর এবং তার দুই সাহাবি আবু বকর রা. ও ওমর রা. এর কবর।

২. জান্নাতুল বাকির কবরস্থান।

৩. ওহুদের শহীদদের কবরস্থান।

জিয়ারতকারী যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর এবং তার দুই সাহাবির কবরের নিকট আসবে, সামনের দিক দিয়ে আসবে এবং কবরগুলোকে সামনে রেখে দাঁড়াবে। শরিয়ত সম্মতভাবে জিয়ারত করবে। বেদআতি জিয়ারত হতে সতর্ক থাকবে। শরিয়ত সম্মত জিয়ারত হলো, আদব ও নিচু আওয়াজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সালাম দেবে। তার জন্য দোয়া করবে এবং বলবে—

السلام عليك يا رسول الله ورحمة الله وبركاته صلى الله وسلم وبارك عليك , وجزاك أفضل ما جزي نبيا عن أمته .

‘আপনার উপর পরিপূর্ণ শান্তি। হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহ তাআলার আরো রহমত ও বরকত। আল্লাহ তাআলা আপনাকে রহমত, বরকত ও শান্তি দান করুন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। সর্বোত্তম প্রতিদান, যা কোন নবীকে তার উম্মতের পক্ষ হতে দেয়া হয়।’

অতঃপর আবু বকর রা.-কে সালাম দেবে এবং তার জন্য দোয়া করবে। হজরত ওমর রা.-কে সালাম দেবে এবং তার জন্য দোয়া করবে। এ দুজন বিশিষ্ট সাহাবি সম্পর্কে যা না জানলেই নয়। কারণ আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে যে সম্মান ও কল্যাণ এ দু’জন মহান ব্যক্তি ও সঠিক পথে পরিচালিত খলিফার অর্জিত হয়েছে, তা অন্য কারো সৌভাগ্য হয়নি।

হজরত আবু বকর রা.: আল্লাহ তাআলা যখন তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্য হেদায়েত সহকারে প্রেরণ করেন, পুরুষদের ভিতর তিনি সর্ব প্রথম তার উপর ঈমান আনেন এবং নবুয়ত প্রাপ্তির পরবর্তী তেরো বছর মক্কাতে সাহচর্যের যাবতীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার সাথে ছায়ার মত অবস্থান করেন। আল্লাহ যখন রাসূলকে মদিনাতে হিজরতের নির্দেশ দেন, মদিনার কঠিন যাত্রায় তিনি তার সাথি হন। সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করেছেন, যা প্রতিদিন শত-সহস্র পাঠকারীর মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, আল্লাহ তাআলার সে পবিত্র বাণী—

إلا تنصروه فقد نصره الله إذ أخرجه الذين كفروا ثاني اثنين إذهما في الغار . إذ يقول لصاحبه لاتحزن إن الله معنا فأنزل الله سكينته عليه وأيده بجنوده لم تروها وجعل كلمة الذين كفروا السفلى وكلمة الله هي العليا والله عزيز حكيم . ( التوبة :৪০)

‘যদি তোমরা তাকে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) সাহায্য না কর, তবে শুনে রেখো! আল্লাহ তাআলা তার সাহায্য করে ছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তার প্রতি স্বীয় সান্ত্বনা নাজিল করেছেন এবং তার সাহায্যে এমন এক বাহিনী পাঠিয়েছেন যা তোমরা দেখনি। বস্ত্তত আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মাথা নিচু করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার কথা-ই সদা সমুন্নত। আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তওবা:৪০)

মদিনায় তার সাথে দশ বছর ছিলেন। তার সাথে সমস্ত জেহাদে শরিক হয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরে খেলাফত গ্রহণ করেন এবং সর্বোত্তমভাবে দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলা তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে সমাধিস্থ করে সম্মানিত করেন। আবার যখন পুনরায় উঠানো হবে, তার সাথে জান্নাতে অবস্থান করবেন। এ হলো আল্লাহ তাআলার মেহেরবানি। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ তাআলা অনেক দয়ালু।

হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. : হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর আগে প্রায় চল্লিশ জন পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি মুসলমানদের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন। যখন আল্লাহ তাআলা তাকে ইসলামের হেদায়েত দান করেন, তখন তার শক্তি ও কঠোরতা কাফেরদের বিরুদ্ধে চলে যায়। তার ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের জন্য সম্মানের কারণ ছিল। যেমন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ বলেন—

مازلنا أعزة منذ أسلم عمر . ( أخرجه البخاري في صحيحه .)

‘যখন থেকে ওমর ইসলাম গ্রহণ করেছেন, আমরা সম্মানের সাথে রয়েছি।’ (বোখারি)

মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্যে অবস্থান করেন। মদিনাতে তার সাথে হিজরত করেন এবং তার সাথে অংশ গ্রহণ করেন সমস্ত জেহাদে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হজরত আবু বকর এর খেলাফতকালীন ছিলেন তার ডান হস্ত। অতঃপর আবু বকর এর ওফাতের পর খেলাফত গ্রহণ করেন। (খেলাফত কালীন দশ বছরের বেশি কাটিয়েছেন।) এতে অনেক বিজয় অর্জিত হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা প্রশস্ত হয়েছে। সে যুগের বৃহৎ দু’টি রাষ্ট্র পারস্য ও রোমকে কুপোকাত করা হয়েছে। চির সত্যবাদী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংবাদ অনুযায়ী, কেসরা ও কায়সারের (রোম-পারস্যের) ধন-ভান্ডার হজরত ফারুক রা.-এর হাতে আল্লাহ তাআলার রাস্তায় খরচ হয়েছে। যখন তিনি ইন্তেকাল করেন, আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে সমাধিস্থ করে সম্মানিত করেন। আবার যখন উত্থিত করা হবে, জান্নাতে তার সাথে থাকবেন। এ হলো আল্লাহ তাআলার দয়া। যাকে ইচ্ছা আল্লাহ তাআলা দান করেন। আল্লাহ তাআলা বড় দয়ালু।

এ রকম দু’জন মহান ব্যক্তি, যাদের এ পরিমাণ সম্মান ও এতো ফজিলত, কোন হিংসুক তাদের হিংসা করতে পারে ? অথবা কোন কুৎসা রটনাকারী তাদের প্রসঙ্গে কুৎসা রটনা করতে পারে ? আল্লাহ তাআলার নিকট অভিশপ্ত হওয়া থেকে পানাহ চাই।

হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে এবং আমাদের ঈমানে অগ্রগামী ভাইদেরকে মাফ কর। ঈমানদারদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসা রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা, তুমি দয়ালু, পরম করুণাময়।

হে আমাদের পালনকর্তা, হেদায়েত দান করার পর আমাদের অন্তরকে পুনরায় ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত করো না। তোমার নিকট হতে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান কর। তুমি-ই সব কিছুর দাতা।

হজরত ইবনে কাসীর রহ. তার তাফসীর গ্রন্থে আল্লাহ তাআলার বাণী ,

إن تجتنبوا كبائر ما تنهون عنه نكفر عنكم سيئاتكم وندخلكم مدخلا كريما . ( النساء : ৩১)

‘যদি তোমরা নিষিদ্ধ বড় গুনাহ হতে বেঁচে থাক, তোমাদের থেকে তোমাদের অপরাধ সমূহ মাফ করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানিত জায়গাতে প্রবেশ করাব।’ (সূরা নিসা:৩১)

এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন, হজরত আবী হাতেম রহ. স্বীয় সূত্রে মুগীরা বিন মিক্বসাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আগে বলা হতো আবু বকর ও ওমর রা.-কে গালমন্দ করা কবিরা গুনাহ। অতঃপর ইবনে কাসীর বলেন, আমি বলছি, আহলে ইলমের বড় একটি জামাত সাহাবাদের গালমন্দকারীকে কাফের বলেছেন। এটা ইমাম মালেক বিন আনাস রা.-এর একটি বর্ণনাও বটে। হজরত মুহম্মাদ বিন সীরীন রহ. বলেছেন, আমি মনে করি না, কোন ব্যক্তি আবু বকর রা.ও ওমর রা. এর সাথে দুশমনি করে এবং সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসে। (ইমাম তিরমিজি বাণীটি উল্লেখ করেছেন।)

১৪
বিদআতি জিয়ারত নিম্নরূপ
এক : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডাকা। তার নিকট সাহায্য চাওয়া। প্রয়োজন পূরণ ও মুসিবত দূর করার আবেদন জানানো। অথবা আরো এমন কিছু জিনিস চাওয়া, যেগুলো একমাত্র আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কারো নিকট প্রার্থনা করা যায় না। কারণ, দোয়া হল ইবাদত। ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

الدعاء هو العبادة . ( وهو حديث صحيح أخرجه أبوداود والترمذي وغيرهما , وقال الترمذي : حديث حسن صحيح .)

‘দোয়াই এবাদত।’ (এটি সহিহ হাদিস। আবু দাউদ, তিরমিজি ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিজি বলেন, হাদিসটি হাসান। সহিহ।)

এবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার হক বা অধিকার। আল্লাহ তাআলার অধিকারের কোন জিনিস আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কাউকে নিবেদিত করা জায়েজ নয়। কারণ, এটা আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক। একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে আবেগাপ্লুত হয়ে কামনা করা যাবে, ডাকা যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য দোয়া করা যাবে, তাকে ডাকা যাবে না। তদ্রূপ, অন্যান্য কবর বাসীদের জন্য দোয়া করা যাবে। তাদেরকে ডাকা যাবে না।

আমরা জানি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কবরে ‘কবরী হায়াত’ নিয়ে জীবিত আছেন, যে হায়াত শহীদদের হায়াতের চেয়ে অবশ্যই পূর্ণ ও উচ্চ-স্তরের। আল্লাহ তাআলা ব্যতীত এ’হায়াতের ধরন কেউ জানে না। এ’হায়াত মৃত্যুর পূর্বের হায়াত, পুনরুত্থান ও প্রত্যাবর্তন পরবর্তী হায়াতের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। সুতরাং, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডাকা, তার কাছে ফরিয়াদ করা জায়েজ নয়। কেননা এটা এবাদত। এবাদত একমাত্র আল্লাহ তাআলার প্রাপ্য। যেমন আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।

দুই : নামাজি ব্যক্তির ন্যায় উভয় হাত বুকের উপর রেখে দাঁড়ানো। এ কাজ না জায়েজ। কেননা, এটা আত্মসমর্পণ ও আল্লাহ তাআলার জন্য উৎসর্গিত অবস্থা। এ কেবল নামাজের ভিতর পালন করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যে মুহূর্তে মুসল্লিগণ দাঁড়িয়ে তাদের রবের সাথে কথোপকথনে মশগুল থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম যখন তার কাছে আসতেন, তখন সালাম করার সময় নিজেদের হাত বুকের উপর রাখতেন না। যদি এটা ভাল হত, আমাদের আগে তারাই পালন করতেন ।

তিন : কবরের পাশের দেয়ালে ও জানালায় হাত বুলান। তদ্রূপ মসজিদ বা অন্য বস্ত্তর কোন স্থানে হাত বুলান। এটা না জায়েজ। কারণ এর পক্ষে কোন হাদিস নেই। আদর্শ পূর্বসূরীগণের আমলও এর প্রতি কোনোরূপ প্রমাণ বহন করে না। এটা এবাদতে শিরক প্রবেশের মাধ্যম বা ওসিলা। যে তা পালন করে সাধারণত সে বলে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহববতে করি। আমরা বলি, প্রত্যেক মোমিনের অন্তরে পিতা-মাতা, সন্তান ও সমস্ত মানুষের মহববতের চেয়ে অধিক মহববত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য থাকা ওয়াজিব। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لايؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين .( رواه البخاري ومسلم .)

‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে পিতা-মাতা ও সমস্ত মানুষ হতে প্রিয় না হব।’ (বোখারি ও মুসলিম)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত আপন জীবনের চেয়ে বেশি থাকা ওয়াজিব। যেমন সহিহ বোখারিতে হজরত ওমরের হাদিসে আছে, নিজের জান, পিতা-মাতা ও সন্তান হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অধিক মহববত থাকা ওয়াজিব। কারণ, যে সমস্ত নেয়ামত আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের দান করেছেন, তার হাতে, তাকে ওসীলা করেই দান করেছেন। যেমন—ইসলামের নেয়ামত, সঠিক ও শুদ্ধ পথ পাওয়ার নেয়ামত। অন্ধকার হতে আলোয় উত্তরণের নেয়ামত। এটা সব চেয়ে বড় ও মূল্যবান নেয়ামত। যার সমতুল্য কোন নেয়ামত হতে পারে না।

কিন্তু এ মহববতের নিদর্শন দেয়ালের উপর ও জানালার উপর হাত বুলান নয়। বরং, তার নিদর্শন হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা ও তার সুন্নতের উপর আমল করা। কারণ ইসলাম ধর্ম বৃহৎ দু’টি নীতির উপর নির্ভরশীল।

প্রথমটি: আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কারো এবাদত করা যাবে না।

দ্বিতীয়টি: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধান নিয়ে এসেছেন, একমাত্র সে অনুসারে আল্লাহ তাআলার এবাদত করতে হবে। আর এটাই لاإله إلا الله এর সাক্ষী ও محمد رسول الله এর সাক্ষীর দাবি।

কোরআনুল কারীমে একটি আয়াত আছে। কতিপয় ওলামায়ে কেরাম যার নাম করণ করেছেন ‘আয়াতুল ইমতিহান’ অর্থাৎ পরীক্ষার আয়াত। সে আয়াতটি হল, আল্লাহ তাআলার বাণী—

قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم . ( آل عمران :৩১)

‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহ তাআলাকে মহববত কর, তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তাআলা তোমাদের মহববত করবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরায়ে আলে ইমরান-৩১)

হাসান বসরী রহ. ও অন্যান্য আদর্শ পূর্বসূরীগণ বলেছেন, কোন এক সম্প্রদায় মনে করেছিল যে, তারা আল্লাহ তাআলাকে মহববত করে। আল্লাহ তাআলা এই আয়াতের মাধ্যমে তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন।

ابتلاهم ‘তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন।’ যাতে মিথ্যাবাদী হতে সত্যবাদী পৃথক ও স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববতের দাবি করে, তার উচিত এ দাবির প্রমাণ পেশ করা। আর সে প্রমাণ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুকরণ।

ইবনে কাসীর রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ আয়াতে কারীমা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি, যে মুহাম্মদের তরীকায় না থেকে আল্লাহ তাআলার মহববতের দাবি করে, তাদের ব্যাপারে মীমাংসাকারী। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত সে সমস্ত কথা ও কাজে শরীয়তে মুহাম্মদী ও নববী দ্বীনের অনুসরণ করবে না, বাস্তবিক পক্ষে সে মিথ্যাবাদী। যেমন বিশুদ্ধ কিতাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত, তিনি বলেন—

من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد . ( رواه مسلم .)

‘যে এমন আমল করবে, যেরূপ সাদৃশ্য আমাদের আমল নেই, সে আমল পরিত্যক্ত।’ (মুসলিম।)

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে,

قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم . ( آل عمران :৩১)

‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহ তাআলাকে মহববত কর, তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তাআলা তোমাদের মহববত করবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন। আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরায়ে আলে ইমরান-৩১)

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার প্রতি মহববতের যে দাবি তোমরা করছ, তার চেয়ে উত্তম জিনিস অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার মহববত তোমাদের জন্য আরো বেশি সৌভাগ্য বয়ে আনবে। এ প্রথমটির তুলনায় বড় ও সম্মানজনক। যেমন প্রজ্ঞাবান কোনো আলেম বলেছেন, সম্মান এতে নয় যে, তুমি মহববত করবে। বরং সম্মান হল তুমি মাহবুব বা মহববতের পাত্র হবে। অতঃপর তিনি হাসান ও অন্যান্য আকাবেরদের বাণী নকল করেছেন।

ইমাম নববী ‘আল-মাজমুউ শরহুল মুহাজ্জাব’-এ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরের দেয়ালে হাত বুলান ও চুমু দেয়ার ব্যাপারে বলেছেন, সাধারণ মানুষের সীমা লঙ্ঘন ও এ ধরনের আমলের কারণে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। কারণ আনুগত্য, আমল একমাত্র হাদিস ও ওলামাদের প্রদর্শিত নির্দেশনা মুতাবিক করতে হবে। সাধারণ জনগণ ও অন্যান্য লোকদের সৃষ্ট আমল এবং তাদের মূর্খতার প্রতি বিন্দু মাত্র ভ্রূক্ষেপ করা যাবে না।

বোখারি ও মুসলিমে হজরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

من أحدث في ديننا هذا ما ليس منه فهو رد .

‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে নতুন কিছুর আবিষ্কার করবে, যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তা পরিত্যাজ্য।’ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় আছে,

من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد .( رواه مسلم .)

‘যে এমন আমল করল যার সাদৃশ্য আমাদের আমলে নেই, তা পরিত্যক্ত।’ (মুসলিম)

হজরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لاتجعلوا قبري عيدا , وصلوا علي , فإن صلاتكم تبلغني حيثما كنتم . ( رواه أبوداود بإسناد صحيح .)

‘তোমরা আমার কবরকে ঈদে পরিণত করো না। তোমরা আমার উপর দরুদ পড়। কারণ তোমরা যেখানে থাক, তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছে।’ (হাদিসটি সহিহ সনদে ইমাম আবু দাউদ রহ. বর্ণনা করেছেন।)

হজরত ফুযায়েল ইবনে আয়ায রহ. প্রসিদ্ধ এক উক্তি করেছেন, যার মর্মার্থ এই যে, তুমি হেদায়েতের পথ অনুসরণ করো। স্মরণ রাখবে ! সত্যপথের কম যাত্রীর কারণে ভেঙে পরবে না বা বিষণ্ণ হবে না। গোমরাহির রাস্তা হতে দূরে থাক, খবরদার ! বিপদগামীদের আধিক্যের দ্বারা প্রভাবন্বিত হবে না, ধোঁকা খাবে না।

যার অন্তরে এ ধারণা আসে যে, হাত বুলান বা এ ধরনের অন্য কোন আমল করা অধিক বরকতের উপায়। এটা তার মূর্খতা ও উদাসীনতার পরিচয়। কারণ, বরকত একমাত্র ঐ সমস্ত জিনিসে যা শরিয়ত অনুযায়ী সম্পাদিত হয়। শরিয়তের বিরোধিতা করে, কীভাবে সম্ভব বরকতের আশা করা ?

চার: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর তওয়াফ করা। এ কাজ হারাম। কারণ আল্লাহ তাআলা একমাত্র মর্যাদা পূর্ণ কাবা শরীফের চার পার্শ্ব ব্যতীত অন্য কোথাও তওয়াফের অনুমোদন দেননি। এরশাদ হচ্ছে,

وليطوفوا بالبيت العتيق . ( الحج :২৯.)

‘তারা যেন সু-সংরক্ষিত ঘরের তওয়াফ করে।’ (সূরা হজ:২৯)

সুতরাং, মর্যাদাপূর্ণ কাবা শরীফের চতুর্পার্শ্ব ব্যতীত অন্য কোথাও তওয়াফ করা যাবে না। যেমন প্রবাদে বলা হয়—‘প্রত্যেক স্থানে আল্লাহ তাআলার অনেক নামাজ আদায় কারী আছেন।’ তদ্রূপ বলা হয় ‘প্রত্যেক স্থানে আল্লাহ তাআলার অনেক দানকারী আছেন।’ প্রত্যেক স্থানে আল্লাহ তাআলার অনেক রোজাদার আছেন।’ প্রত্যেক স্থানে আল্লাহ তাআলার অনেক জিকির কারী আছেন।’ কিন্তু এরূপ বলা হয় না—‘প্রতিটি স্থানে আল্লাহ তাআলার অনেক তওয়াফকারী আছেন। কারণ, তওয়াফ একমাত্র সুসংরক্ষিত ঘর কাবার বৈশিষ্ট্য।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেছেন, মুসলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, বায়তুল মামূর ব্যতীত তওয়াফ করা নিষিদ্ধ। সুতরাং, বায়তুল মাক্বদিসের পাথর তওয়াফ করা, রাসূল এর হুজরা মোবারক তওয়াফ করা, আরাফার ময়দানে অবস্থিত গম্বুজ তওয়াফ করা বা অন্য কিছু তওয়াফ করা অবৈধ বা জায়েজ নয়।

পাঁচ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরের নিকট আওয়াজ উঁচু করা। এর অবকাশ নেই। কারণ, আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় মোমিনদেরকে আদব শিখিয়েছেন। তিনি বলেন—

يا أيها الذبن آمنوا لاترفعوا أصواتكم فوق صوت النبي ولا تجهروا له بالقول كجهر بعضكم لبعض أن تحبط أعمالكم وأنتم لاتشعرون (২) إن الذين يغضون أصواتهم عند رسول الله اولئك الذين امتحن الله قلوبهم للتقوى لهم مغفرة وأجر عظيم .( الحجرات :২-৩)

‘মোমিনগণ ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উচ্চস্বরে কথা বল, তার সাথে সে-রূপ উচ্চস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের আমল বাতিল হয়ে যাবে। তোমরা বুঝতেও পারবে না। যারা আল্লাহ তাআলার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তর সমূহকে তাকওয়ার জন্য যাচাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য ক্ষমাও মহাপুরষ্কার।’ (সুরায়ে হুজুরাত:২-৩)

অতএব জিয়ারতকারীর এ আদব রক্ষা করতে হবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত অবস্থায় যেমন সম্মানের পাত্র, মৃত্যুর পরেও অনুরূপ সম্মানের পাত্র।

ছয়: মসজিদের ভিতর অথবা বাইরে দূর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরকে সামনে রেখে দাঁড়ানো ও সালাম করা। শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রহ. তার ‘মানসাক’ নামক কিতাবে বলেছেন। এ আমল দ্বারা রাসূল এর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতার পরিবর্তে অহমিকার পরিচয় বেশি পাওয়া যায়।

আরো জ্ঞাতব্য যে, মদিনায় আগমনকারী অনেকে আত্মীয়স্বজনের দ্বারা এ ওসীয়তপ্রাপ্ত হন যে, আমার সালাম রাসূলের নিকট পৌঁছে দিয়ো। যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন হাদিসে এর স্বপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাই যার কাছে এ ধরনের দরখাস্ত করা হবে, তার বলা উচিত, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর বেশি বেশি দরুদ পাঠাও, ফেরেশতারা তোমার দরুদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পৌঁছিয়ে দেবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

إن لله ملائكة سياحين يبلغوني عن أمتي السلام . ( وهو حديث صحيح رواه النسائي وغيره .)

‘আল্লাহ তাআলার বিচরণকারী কিছু ফেরেশতা রয়েছেন, যারা আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌঁছিয়ে দেয়।’ (এটি সহিহ হাদিস। ইমাম নাসায়ী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেছেন।)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

لاتجعلوا بيوتكم قبورا , ولا تتخذوا قبري عيدا , وصلوا علي فإن صلاتكم تبلغني حيث كنتم . ( وهو حديث صحيح رواه ابوداود وغيره .)

‘তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করো না এবং আমার কবরকে ঈদ বানিয়ো না। অর্থাৎ উৎসবের স্থান। তোমরা আমার উপর দরুদ পাঠাও। কারণ তোমরা যেখানে থাকো তোমাদের দরুদ আমার নিকট পৌঁছে।’ (এটি সহিহ হাদিস। ইমাম আবু দাউদ রহ. ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বর্ণনা করেছেন।)

আরো জ্ঞাতব্য যে, হজ, ওমরা ও জিয়ারতের মাঝে অঙ্গাঙ্গি কোন সম্পর্ক নেই। যে ব্যক্তি হজ করতে অথবা ওমরা করতে এসেছে, তার মদিনায় আসা ছাড়া নিজ দেশে ফিরে যাওয়া বৈধ। অনুরূপ যে মদিনায় এসেছে, তার হজ অথবা ওমরা করা ছাড়া নিজ দেশে ফিরে যাওয়া বৈধ। আবার একই সফরে হজ-ওমরা ও জিয়ারত সম্পন্ন করা নির্দ্বিধায় বৈধ ও যথার্থ।

যে সমস্ত হাদিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর জিয়ারতের ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন—

من حج ولم يزرني فقد جفاني . ( الحديث .)

‘যে হজ করল কিন্তু আমার জিয়ারত করল না, সে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করল।’ (আল হাদিস।)

من زارني بعد مماتي فكأنما زارني في حياتي .( الحديث .)

‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার জিয়ারত করল, সে প্রায় আমার জীবদ্দশায় জিয়ারত করল।’ (আল হাদিস।)

من زارني وزار أبي إبراهيم في عام واحد ضمنت له على الله الجنة . ( الحديث .)

‘যে ব্যক্তি একই বৎসর আমার এবং আমার পিতা ইব্রাহীমের জিয়ারত করল, আমি আল্লাহ তাআলার নিকট তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হয়ে গেলাম।’ (আল হাদিস।)

من زار قبري وجبت له شفاعتي . ( الحديث .)

‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব।’ (আল হাদিস।)

এ হাদিস ও এর মত অন্যান্য হাদিস দলিলের অযোগ্য। কারণ, এগুলো জাল কিংবা খুবই দুর্বল সনদের হাদিস। হাদিস বিশারদগণ এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। যেমন দারা কুতনী, উকাইলী, বায়হাকী, ইবনে তাইমিয়্যাহ ও ইবনে হাজার রহ. প্রমুখ।

আল্লাহ তাআলার বাণী—

ولو أنهم إذ ظلموا أنفسهم جاءوك فاستغفروا الله واستغفر لهم الرسول لوجدوا الله توابا رحيما . ( النساء :৬৪)

‘সে সব লোক যখন নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছিল, তখন যদি তারা আপনার কাছে আসতো। অতঃপর আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যদি তাদের জন্য ক্ষমার সুপারিশ (ইস্তেগফার) করতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহ তাআলাকে ক্ষমাকারী ও মেহেরবান রূপে পেত।’ (সূরা নিসা-৬৪)

নফ্স জুলুমে আক্রান্ত হলে বা এস্তেগফারের উদ্দেশ্যে রাসূলের কবরের উদ্দেশ্যে জেয়ারত করার কোন দলিল উক্ত আয়াতে পাওয়া জায় না। কেননা, আয়াতের বর্ণনা প্রসঙ্গ মুনাফেকদের ব্যাপারে। দ্বিতীয়ত একমাত্র জীবদ্দশাতেই তার কাছে গমন করা যেতে পারে। কারণ সাহাবায়ে কেরাম রা. ক্ষমা চাওয়ার—ইস্তেগফারের—মুহূর্তে ক্ষমার সুপারিশের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে আসতেন না। এ বিধান মতেই হজরত ওমর রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশার নিয়ম পরিবর্তন করেছেন এবং যখন অনাবৃষ্টির শিকার হয়েছেন, হজরত আববাস রা. এর দোয়ার ওসীলা দিয়ে বলেছেন—

اللهم إنا كنا إذا أجدبنا توسلنا إليك بنبينا فتسقينا , وإنا توسلنا إليك بعم نبينا فاسقنا . قال فيسقون . ( أخرجه البخاري في صحيحه .)

‘হে আল্লাহ ! যখন আমরা অনাবৃষ্টির শিকার হতাম, আমাদের নবীর মাধ্যমে আপনার নিকট দোয়া করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দিতেন। এখানে আমরা আমাদের নবীর চাচার মাধ্যমে আপনার নিকট দোয়া করছি, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করেন। বর্ণনা কারী রাবী বলেন. অতঃপর তাদের বৃষ্টি দেয়া হত।’ (বোখারি)

যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা তার মৃত্যুর পরে দোয়া করানো জায়েজ হত, হজরত ওমর রা. তা পরিত্যাগ করে হজরত আববাস রা.-এর মাধ্যমে দোয়া করাতেন না। ইমাম বোখারি রহ. তার কিতাবে হজরত আয়েশা রা. হতে যে হাদিসটি ‘কিতাবুল মারদাতে’ (অসুস্থ ব্যক্তিদের অধ্যায়ে) বর্ণনা করেছেন, সে হাদিসটিও একথা প্রমাণ করে। হজরত আয়েশা রা. (প্রচন্ড মাথা ব্যথায় ) বলেছেন, ورأساه ! ‘হায় মাথা!’ (বোঝাচ্ছেন তিনি মারা যাবেন) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ذلك لوكان وأنا حي فأستغفر لك وأدعولك ‘যদি এমন হয়ে যায়’ (তুমি মারা যাও) আর আমি জীবিত থাকি, তাহলে তোমার জন্য আমি মাগফিরাত চাইব ও দোয়া করব।’ পরক্ষণই হজরত আয়েশা রা. বলেন, واثكلياه ! ‘হায়! আমি অসহায়!’ (যেহেতু হজরত আয়েশা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথায় কোন সান্ত্বনা পাননি) والله إني لأظنك تحب موتي ....( الحديث ) ‘আল্লাহর শপথ ! আমি মনে করছি, আপনি আমার মৃত্যু পছন্দ করেন।’ সংক্ষিপ্ত হাদিস।

যদি মৃত্যুর পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে দোয়া ও ইস্তেগফার নেয়া যেত, তাহলে এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে হজরত আয়েশা রা.-এর মৃত্যুবরণ করা, অথবা আয়েশা রা.-এর পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু বরণ করার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকত না।

যে সমস্ত হাদিস সাধারণত কবরের জিয়ারত প্রমাণ করে, সেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর জিয়ারতও প্রমাণ করে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী—

زوروا القبور , فإنها تذكرة الآخرة .( أخرجه مسلم في صحيحه .)

‘তোমরা কবর জিয়ারত কর, কেননা, তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেবে।’ (মুসলিম)

তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে লম্বা সময় অবস্থান করা উচিত নয়। বেশি বেশি জিয়ারত করাও উচিত নয়। কারণ, এর দ্বারা সীমা-লঙ্ঘন বা বাড়াবাড়ি হয়। আল্লাহ তাআলা তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, ফেরেশতারা প্রত্যেক স্থান হতে তার নিকট উম্মতের সালাম নিয়ে আসবে। তার কোন উম্মতকে এ বৈশিষ্ট্য প্রদান করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

إن لله ملائكة سياحين يبلغوني عن أمتي السلام .

‘আল্লাহ তাআলার কতিপয় বিচরণকারী ফেরেশতা রয়েছে, যারা আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়।’

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,

لاتجعلوا بيوتكم قبورا , ولاتتخذوا قبري عيدا , وصلوا علي فإن صلاتكم تبلغني حيث كنتم .

‘তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরে পরিণত করো না। আমার কবরকে ঈদ- উৎসবস্থল- বানিয়ো না। তোমরা আমার উপর দরুদ পাঠাও, কারণ তোমরা যেখানে থাক তোমাদের দরুদ আমার নিকট পৌঁছে।’ তিনি যেহেতু স্বীয় কবরকে ঈদ-উৎসবের-জায়গা বানাতে নিষেধ করেছেন, তাই এমন পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, যা ঈদের আদলে হতে পারে। যেমন তিনি বলেছেন—

وصلوا علي فإن صلاتكم تبلغني حيث كنتم .

‘তোমরা আমার উপর সালাম পাঠাও, তোমরা যেখানে থাক তোমাদের সালাম আমার কাছে পৌঁছে। অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে।’

জান্নাতুল বাক্বীর কবর ও উহুদের শহীদদের কবর জিয়ারত করা মোস্তাহাব, যদি শরিয়ত সম্মত পদ্ধতিতে হয়। বেদআতি পদ্ধতিতে হলে হারাম।

শরিয়ত সম্মত জিয়ারত : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে জিয়ারতের ব্যাপারে যে বর্ণনা এসেছে, তা হুবহু যে জেয়ারতে পালন করা হয় এবং যার ভিতর জিয়ারতকারী জীবিত ব্যক্তির কল্যাণ ও জিয়ারতকৃত মৃত ব্যক্তির কল্যাণ নিহিত থাকে, তা-ই শরিয়ত সম্মত জিয়ারত।

১৫
জিয়ারতকারী শরিয়ত সম্মত জিয়ারত দ্বারা তিনটি উপকার লাভ করে।
প্রথমত: জিয়ারত মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যার কারণে জিয়ারতকারী ব্যক্তির নেক আমলের প্রস্ত্ততি স্বাভাবিকভাবে হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

زوروا القبور فإنها تذكركم الآخرة .( رواه مسلم .)

‘তোমরা কবর জিয়ারত কর, কারণ তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (মুসলিম)

দ্বিতীয়ত: জিয়ারত সম্পাদন করা। এটা সুন্নত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আমলের প্রচলন করেছেন। অতএব এ আমলের কারণে তাকে সওয়াব দেয়া হবে।

তৃতীয়ত: মৃত মুসলমান ব্যক্তির জন্য দোয়া করে তাদের উপকার করা। অতএব এ উপকারের প্রতিদান তাকে দেয়া হবে।

জেয়ারতকৃত ব্যক্তির উপকার : জেয়ারতকৃত ব্যক্তি শরিয়ত সম্মত জিয়ারতের মাধ্যমে উপকৃত হয়। সে নিজের জন্য দোয়া পায়। এর দ্বারা সে নিজে উপকৃত হয়। কারণ মৃত ব্যক্তিরা জীবিতদের দোয়ায় উপকৃত হয়।

জিয়ারতকারী ব্যক্তির জন্য মোস্তাহাব এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে জিয়ারতের ব্যাপারে সত্যায়িত দোয়ার মাধ্যমে দোয়া করা। তন্মধ্যে বুরাইদাহ ইবনে আল-হুসাইব এর হাদিস উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, যখন তারা কবর জিয়ারতের জন্য রওয়ানা হতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দোয়া শিক্ষা দিতেন। অতঃপর জিয়ারতের সময় দোয়া পাঠকারীগণ বলতেন,

السلام عليكم أهل الديار من المؤمنين و المسلمين و إنا إن شاء الله بكم للاحقون . أسأل الله لنا ولكم العافية .( مسلم .)

‘হে কবর বাসী মোমিন, মুসলমানগণ, তোমাদের উপর সালাম। আমরা আললাহ তাআলার ইচ্ছানুযায়ী তোমাদের সাথে অবশ্যই মিলিত হব। আল্লাহ তাআলার নিকট আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য সমস্ত মুসিবত হতে নিরাপত্তার প্রার্থনা করি।’ (মুসলিম)

পুরুষদের কবর জিয়ারত করা মোস্তাহাব। মহিলাদের কবর জিয়ারতের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মতপার্থক্য রয়েছে। তাদের কেউ জায়েজ বলেছেন, কেউ বলেছেন না জায়েজ। তবে দু’টি মতের ভিতর বলিষ্ঠ ও যুক্তিযুক্ত হল নিষেধাজ্ঞার মতটি। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিসে আছে—

لعن الله زوارت القبور . ( أخرجه الترمذي وغيره , وقال الترمذي : حديث حسن صحيح .)

‘আল্লাহ তাআলা অধিক কবর জিয়ারতকারী নারীদের লা’নত করেছেন। ইমাম তিরমিজি ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।’ (ইমাম তিরমিজি বলেছেন, হাদিসটি হাসান। সহিহ।)

এ হাদিসের ভিতর زورات শব্দে (যার অর্থ অধিক জিয়ারতকারী নারী) পরিষ্কার যে, এটি সম্পর্কের জন্য। অর্থাৎ জিয়ারতের সম্পর্ক নারীদের সাথে করার জন্য অথবা জিয়ারতকারী নারী বুঝানোর জন্য (এ হিসেবে হাদিসের অর্থ জিয়ারতকারী নারীদের আল্লাহ তাআলা লা’নত করেছেন। জিয়ারতের সংখ্যা কম বা বেশি এ নিয়ে কথা নেই) যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী,

وماربك بظلام للعبيد . ( فصلت :৪৬)

‘আপনার প্রভু বান্দাদের উপর অধিক জুলুমকারী নন।’ (সূরায়ে ফুসসিলাত:৪৬)

অর্থাৎ জুলুমকারী নন বা আল্লাহ তাআলার সাথে জুলুমের সম্পর্ক নেই। (একথা বুঝানোর জন্য ظلام শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ظلام শব্দের অর্থ যদিও অধিক জুলুমকারী। এখানে সবার মতে শুধু জুলুম বুঝানো উদ্দেশ্য। এমন নয় যে আল্লাহ তাআলা অধিক জুলুমকারী নন, কম জুলুমকারী। যেমন বুঝে আসে আভিধানিক অর্থের দ্বারা। আয়াতের অর্থ আপনার প্রভু মোটেই জুলুমকারী নন। কম বা বেশি পরিমাণের কোনো কথা নেই। তদ্রূপ এখানে) زوارت শব্দটি ( আভিধানিক অর্থ) অধিক জিয়ারতকারী নারী বুঝানোর জন্য নয়। (যার ভিতর বুঝে আসে কম জিয়ারতকারী নারী এ লা’নতের বাইরে) যেমন অর্থ উল্লেখ করেছেন নারীদের কবর জিয়ারত জায়েজ ফতওয়া প্রদানকারী কতিপয় ওলামায়ে কেরাম। নিষেধের আরেকটি কারণ, নারীদের ভিতরের দুর্বলতা এবং কান্না-কাটি ও শোরগোল, ধৈর্যহীনতা ইত্যাদি খুবই প্রকটভাবে পাওয়া যায়।

তাছাড়া, নিষেধাজ্ঞার মতটি অধিক এহতেয়াত ও সাবধানতার অবলম্বনের প্রতি নির্দেশ করে। কারণ প্রথম ফতওয়া অনুযায়ী, নারী যদি কবর জিয়ারত ছেড়ে দেয় তার থেকে মাত্র একটি মোস্তাহাব আমল ছুটবে। আর দ্বিতীয় ফতওয়া অনুযায়ী, নারী যদি কবর জিয়ারত সম্পাদন করে, লা’নতের সম্মুখীন হবে।

বিদআতী জিয়ারত: শরিয়তের বিধান ছাড়া যে জিয়ারত করা হয়, তাকে বিদআতী জিয়ারত বলে। যেমন কবর বাসীদের ডাকার জন্য, তাদের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার জন্য, তাদের কাছে জরুরত পূর্ণ হওয়ার দরখাস্ত করার জন্য বা এ ধরনের আরো কারণে কবরে আসার নিয়ত করা। এ ধরনের জিয়ারতের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয় না। উল্টো এর দ্বারা জীবিত ব্যক্তি ক্ষতি গ্রস্ত হয়। হ্যাঁ, জীবিত ব্যক্তি ক্ষতি গ্রস্ত হয়, কারণ সে একটি না জায়েজ কাজ করেছে। যার নাম শিরক। মৃত ব্যক্তিও উপকৃত হয় না। কারণ তার জন্য দোয়া করা হয়নি। বরং গায়রুল্লাহকে ডাকা হয়েছে।

আমাদের মুরুবিব শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রহ. তার ‘মানসাক’ নামক কিতাবে বলেছেন, কবরের নিকট দোয়া করা, কবরের পাশে অবস্থান, মৃত ব্যক্তিদের কাছে প্রয়োজন পূর্ণ করার আবেদন, রোগীদের সুস্থতা, তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া চাওয়া, অথবা তাদের বুজুর্গির বরাত দিয়ে দোয়া করা—ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কবর জিয়ারত করা বেদআত ও গর্হিত। আল্লাহ তাআলা ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জিয়ারতের অনুমোদন দেননি। নেককার আকাবিরগণ এগুলো পালন করেননি। বরং এটা অশ্লীলতার অন্তর্ভুক্ত। যা হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন—

زوروا القبور ولاتقولوا هجرا .

‘তোমরা কবর জিয়ারত কর, বেহুদা কথা-বার্তা বলো না।’

উল্লেখিত আমল নিঃসন্দেহে বেদআতের অন্তর্ভুক্ত। তবে এর স্তর ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, তার কিছু বেদআত, শিরক নয়; উদাহরণত: কবরের নিকট আল্লাহ তাআলাকে ডাকা, মৃত ব্যক্তি ও তার বুজুর্গির বরাত দিয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করা ইত্যাদি। আর কিছু জিনিস আছে শিরকে আকবারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন—মৃত ব্যক্তিদের ডাকা ও তাদের নিকট সাহায্য চাওয়া—ইত্যাদি।

ক্ষুদ্র একটি পুস্তিকা রচনার ইরাদা ও তাড়না আমি বোধ করছিলাম, বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটিই সে ইরাদার মূর্ত ফসল। আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের এবং এ মদিনাতে অবস্থান কারীদের, মদিনার জিয়ারতকারীদের ও সমস্ত মুসলমানদের দুনিয়া ও আখেরাতে ভাল, প্রশংসিত ও উপযুক্ত বিনিময় অর্জন করার তওফীক দান করেন। এ শহরে ভালভাবে ও পূর্ণ আদব রক্ষা করে অবস্থান করার তওফীক দান করেন এবং আমাদের জন্য মৃত্যুকে মঙ্গলজনক করে দেন। আল্লাহ তাআলা তার বান্দা ও রাসূল, আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার বংশধর ও তার সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর উপর মাগফিরাত, রহমত, বরকত নাজিল করুন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন