HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

গল্পে আঁকা ইতিহাস ৪ -দুই ভাইয়ের গল্প

লেখকঃ আলী তানতাভী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
শিশু-কিশোর সিরিজ

গল্পে আঁকা ইতিহাস -৪

দুই ভাইয়ের গল্প

আলী তানতাভী

অনুবাদ

ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী

প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারী ২০০৮ ঈ.

কভার পেইজ থেকে … .. .
বলতে পারো, অতীতের কোন স্মৃতিটা আঁধার মানুষকে সবচে বেশি হাতছানি দিয়ে

ডাকে, ডেকেই চলে অবিরত? জানি না, উত্তরে তুমি কী বলবে। তবে আমার মতে- সে হলো দাদী’র গল্পের আসর! আহা! কী মধুময়। সেই স্মৃতি!! শৈশবকালে দাদীর কাছে গল্প শোনার সেই গাল-ফোলানো ও কপাল-কুঁচকারো বায়নার কথা- কে ভুলতে পারে?..

শিশু হয় কিশোর, তারপর পরিণত যুবক। তখনও সে ভুলতে পারে না চাদনি রাতের মায়াবী জোৎস্নায় দাদী’র গল্পের আসরের। সেই স্মৃতি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে গল্পের প্রতি তার এই ঝোঁক ও আকর্ষণ। তার কেবলই ছুটে যেতে ইচ্ছে করেসেই হারানো শৈশবে, মাদুরপাতা উঠানে, দাদী’র কাছে, চাদনি রাতের সেই গল্পের আসরে!

পাঠক! আমার বড়ো কষ্ট লাগে যখন গল্পের প্রতি শিশু-কিশোরদের এই ঝোঁক ও আকর্ষণকে আমরা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই। আর আমাদের ব্যর্থতায় দুশমনরা আমাদের গল্পপ্রিয় শিশু-কিশোরদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়-গল্প নামের বিষ! আমাদের এই গাফিলতির জন্যে আল্লাহ কি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন? হ্যা পাঠক! এই দায়বোধ থেকেই আমি প্রিয় শিশু-কিশোর বন্ধুদের জন্যে লিখেছি এই গল্প সিরিজ- ইতিহাসের সত্য কাহিনী অবলম্বনে। ইতিহাসকে অবিকৃত ও অক্ষুন্ন রেখে শুধু গল্পের জামাটা পরিয়ে দিয়েছি ইতিহাসের গায়ে।

-আলী তানতাভী ।

দুই ভাইয়ের গল্প
দুই ভাই

উত্তর সিরিয়ার এক শহরের নাম ‘নাসিবাইন’। সেখানে বাস ছিলো মস্ত বড় এক ব্যবসায়ীর। নাম- মুহাম্মদ ইবনে ইমরান। তার ছিলো দুই ছেলে। আহমদ ও খালাফ। মাতৃস্নেহ কী জিনিস- তারা জানে না। শৈশবেই তারা মাকে হারিয়েছিলো। কিন্তু মাতৃস্নেহের অভাব কখনো তাদেরকে কষ্ট দেয় নি, নির্জনে বসে অশ্রু ফেলতে বাধ্য করে নি। কেননা তাদের পিতৃস্নেহ ছিলো অপার ও অতুলনীয়। আদর দিয়ে স্নেহ দিয়ে বাবাই তাদেরকে কোলে-পিঠে করে বড় করেছেন।

আহমদ বড়। হালকা-পাতলা গড়নের এক যুবক। বাবার ভীষণ অনুগত। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য সব কাজে সে বাবাকে সাহায্য করে। বাবার পাশে পাশে থাকে। বিদ্যা-বুদ্ধিও ছিলো তার যথেষ্ট। এক কথায় আহমদ ছিলো বাবার আদর্শ ছেলে। যোগ্য ছেলে। চোখ জোড়ানো মানিক।

কিন্তু খালাফ ছিলো আহমদের একেবারে উল্টো। দেখতে মোটাসোটা এবং গায়ে অশুরীয় শক্তি থাকলেও ইলম-কালাম ও বিদ্যা-বুদ্ধিতে সে ছিলো একেবারেই ফাঁকা। স্বভাব-চরিত্রও ওর ভালো ছিলো না। বাবার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করতো। লঙ্ঘন করতো আল্লাহর হুকুম-আহকামও। বাবা তার আচরণে খুব কষ্ট পেতেন। পাড়ার সব দুষ্ট ও বখাটে ছেলেদের সাথে ছিলো ওর ওঠা-বসা ও সখ্যতা। আর যারা স্বভাব-চরিত্রে সুকুমারবৃত্তির, তাদেরকে সে দু’চোখে দেখতেই পারতো না।

বাবা ও বড় ভাই তাকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করলেন, ফল কিছুই হলো না। খালাফ বুঝলো না- সততার মূল্য, বাবার আনুগত্যের মূল্য। খালাফ মানলো না- সুন্দরের কথা, সত্যের কথা। তার দৃষ্টি ছিলো, তবু সে অন্ধ ছিলো। দৃষ্টি থাকলে মানুষ অন্ধ হয় কী করে? সত্যকে না জানলে, সত্যকে না চিনলে। বড়দের কথা ও নির্দেশ না শুনলে, না মানলে।

পরপারের ডাক এলো
এদিকে বৃদ্ধ বাবা পরপারের ডাক শুনলেন। বুঝতে পারলেন- মৃত্যু তার খুব কাছে। তখন কাছে ডাকলেন তিনি প্রিয় ছেলে আহমদকে। বললেন বিদায়মাখা সুরে, ‘বাবা আহমদ! তুমি আমার বড়ো প্রিয় ছেলে। বড়ো বাধ্য ছেলে। তোমার প্রতি আমি ভীষণ খুশি, খুব সন্তুষ্ট। সব সময় তুমি আমার কাছে কাছে থেকেছো। সব কাজে আমাকে সাহায্য করেছে। আর খালাফটা আমাকে শুধু কষ্টই দিয়েছে। আমি খালাফের প্রতি ভীষণ অখুশী। ও আমার কোনো কথাই শুনে নি। বলেছি ডান দিকে যেতে, ও গিয়েছে বাম দিকে। বলেছি পড়া-লেখা শিখে মানুষ হও, কিন্তু সে মানুষ হলো না। আমার কথা রাখলো না।

বাবা আহমদ! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো! আমি মৃত্যুর ডাক শুনতে পাচ্ছি। এখন আমার শেষ ইচ্ছে আমার সমস্ত সম্পত্তি তোমাকে লিখে দিয়ে যাবো। আমি মনে করি তুমিই আমার সম্পত্তির সত্যিকারের উত্তরাধিকারী। সাক্ষী ডাকো! আমি আর দেরী করতে চাইছি না!”

বাবার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আহমদের মনটা হাহাকার করে উঠলো। ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবার মুখে মৃত্যুর কথা শুনলে আদর্শ ছেলের এমন অবস্থা তো হবেই! কিন্তু বাবার প্রস্তাব মানতে অপারগতা প্রকাশ করে আহমদ বললো, ‘না বাবা! আপনি এমনটি করবেন না। খালাফকে বঞ্চিত করে একা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে যাবেন না। কারণ ইসলাম ধর্মে এটা নাজায়েয। আপনি বরং আমাদের দুজনের মাঝে সমান সমান করে সম্পত্তি বন্টন করে দিয়ে যান।’

বাবা ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ইচ্ছে তো এমনই ছিলো আহমদ! কিন্তু সে যে হবার নয়। আমার মন বলছে, তাকে সম্পত্তি দিয়ে গেলে সে আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠবে। কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের ভাগ উড়িয়ে তোমার ভাগে হাত দেবে। ওকে ভালো করেই চিনি আমি। তোমার মনে নেই ছোট বেলার কথা? তোমাদের জন্যে যখন কিছু কিনে আনতাম, তখন ও নিজের ভাগটা খেয়ে তোমার ভাগেও অসভ্যের মতো হাত দিতো। তুমি কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখলে তাও ও খোঁজে খোঁজে বের করে ফেলতো এবং নিয়ে যেতো। তুমি বাধা দিলে ও তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। আমি তখন তার আক্রমণ থেকে তোমাকে রক্ষা করতাম। চোখে চোখে তোমাকে আগলে রাখতাম। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর কে দেখবে তোমাকে?

সুতরাং আমি সম্পত্তি খালাফকে নয়- তোমাকেই লিখে দিয়ে যাবো। তুমি অমত করো না!’

আহমদ বিনীত কণ্ঠে বললো, ‘কিন্তু বাবা, এমন সিদ্ধান্ত নিলে আল্লাহ যে নারাজ হবেন! আপনি তো জানেন, যে ব্যক্তি তার উত্তরাধীকারীকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

বাবা! আপনি তাকে বঞ্চিত করবেন না। আর আমার জন্যে মোটেই দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভীষণ আস্থা ও গভীর বিশ্বাস রয়েছে। তিনিই আমাকে সকল অনিষ্ট থেকে হিফাযত করবেন। তিনিই আমাকে খালাফের জুলুম থেকে রক্ষা করবেন। ও আমার প্রতি জুলুম করলে আল্লাহ অবশ্যই তার প্রতিশোধ নেবেন।’

বাবা চলে গেলেন!
বাবা চলে গেলেন। সম্পত্তি ভাগ করে যাওয়ার তিনি আর সময় পেলেন না। পিতার মৃত্যুতে আহমদ ছিলো শোক-কাতর। আর খালাফ! আরো বেপরোয়া। পিতার মৃত্যু যেনো তার জন্যে সুযোগ বয়ে এনেছে। দ্রুত সম্পত্তি বন্টনের জন্যে সে আহমদকে চাপ দিতে লাগলো। আহমদ দেরী করলো না, দ্রুত সম্পত্তি বন্টন করে ফেললো। সমান সমান ভাগ করার পর দেখা গেলো, প্রত্যেকের ভাগে পড়েছে তিন লক্ষ দিরহামেরও বেশী।

সত্যের মহিমা এবং অসত্যের মরীচিকা
আহমদ নিজের সম্পত্তি সাথে সাথেই কাজে লাগালো, ব্যবসায় খাটালো। ধীরে ধীরে তার ব্যবসায় উন্নতিও হতে লাগলো। বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হতে লাগলো। বছরে বছরে এখন সে যাকাত আদায় করে। গরীব-দুঃখী ও অসহায়-অভাবীকে হাত খুলে দান করে। এতীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ায়। হারাম কাজে একটি দিরহামও তার নষ্ট হয় না। অন্যায় কাজে একটি পয়সাও তার ব্যয় হয় না। অপচয় তার ভীষণ অপছন্দ। কেননা ‘অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই’।

কিছুদিন পর আহমদ বিবাহ করলো। সুন্দর ও আদর্শবতী এক মেয়ে এলো তার বউ হয়ে। কিছুদিন পর এলো কোল-আলোকিত করা এক সন্তান। সব মিলিয়ে আহমদ বেশ ছিলো। নেই অভাব। নেই অশান্তি। নেই কোনো জুট-ঝামেলা। দুনিয়াতে বসেই সে জান্নাতের সুখ অনুভব করতে লাগলো।

খালাফের দিন-রাত্রি
কিন্তু খালাফ! আহমদের একেবারে উল্টো। নিজের ভাগের সম্পত্তি হাতে পেয়ে সে যেনো পাগল হয়ে গেলো। কোথায় যাবে, কী করবে কার সঙ্গে আড্ডা মারবে- এ সব নিয়েই ছিলো তার ব্যস্ততা। দু’হাতে উড়াতে লাগলো টাকা। হারাম কাজে, অন্যায় কাজে। শুধু তাই নয়; গায়িকা ও নর্তকীদের ঘরে ডেকে এনে খালাফ আসর বসালো। রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছিলো তার এই নৃত্যমাতাল গানের আসরে। অন্যদিকে খালাফের স্বার্থপর ও অসৎ বন্ধুরাও যে যেভাবে পারছিলো খালাফের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছিলো।

আহমদ এ-সব দেখতো আর দুঃখ পেতো। সুযোগ এলেই খালাফকে বোঝাতো। অসৎ পথের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে বলতো। সৎ পথে ফিরে আসার ব্যাকুল আহ্বান জানাতো। কিন্তু খালাফ সে আহ্বানে সাড়া দিতো না। কেননা তার মনের জগত অন্ধকার, শয়তান সেখানে বাসা বেঁধেছিলো। আহমদের কথা শোনা তো দূরের কথা, উপদেশ দেয়ার সময় সে ভাইয়ের দিকে ফিরেও তাকাতো না। চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে বিরক্তি-চিহ্ন। শেষ দিকে তো অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, আহমদ তাকে উপদেশ দিতে গেলে উল্টো তাকেই ছোট ভাইয়ের বকা শুনে ফিরে আসতে হতো। একবার খালাফ সবার সামনে আহমদকে তেড়েই এসেছিলো।

এ-ঘটনার পর থেকে আহমদ খালাফের কাছে যেতো না। শুধু দূর থেকে চোখের পানি ফেলে ফেলে তার জন্যে দু’আ করতো।

এভাবে একে একে কেটে গেলো চারটি বছর। এ-চার বছরে আহমদ যেমন উপরে উঠেছে খালাফ তেমন নীচে নেমেছে। খালাফের লক্ষ লক্ষ দিরহাম শেষ। একেবারে শেষ। যেনো মোমের মতো সব গলে গেছে।

ইস্! তিন লক্ষ দিরহাম। এভাবেই বুঝি সকাল বেলার ধনী সন্ধ্যা বেলায় ফকীর হয়ে যায়? তিন লক্ষ দিরহামের মালিক এখন তিন দিরহামেরও মালিক নয়! এদিকে বুদ্ধি খাটিয়ে ভুল সংশোধন করে নতুন আয়ের একটা উৎস যে খালাফ খুঁজে বের করবে, সে বুদ্ধিবিবেচনাও তার ছিলো না। কেননা, পড়ার সময় সে পড়ে নি, শুধু করেছে বাঁদরামো। ব্যবসা করার শ্রেষ্ঠ সময়ে সে ব্যবসা না করে টাকা উড়িয়েছে অপথে-কুপথে। গানের আসরে, নাচের আসরে।

গুনাহ ডেকে আনে দারিদ্র
তোমরা বেশ অবাক হচ্ছো, না! কীভাবে এতো দিরহাম মাত্র চার বছরেই নেই হয়ে গেলো?! আসলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আসল ব্যাপার কী, জানো? যারা অন্যায় কাজে, হারাম কাজে, অসৎ পথে টাকা-পয়সা খরচ করে, সেই সাথে যাদের নেই কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা এবং যারা মেনে চলে না আল্লার হুকুম-আহকাম, তারা যতো ধনী ও সম্পদশালীই হোক, একদিন তাদের ধন-দৌলত শেষ হয়ে যাবেই। একদিন তারা নিঃস্ব দরিদ্রে পরিণত হবেই। লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হলেও, কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও। কারণ, হারাম পয়সা বা হারাম অর্জন হলো ছোট্ট নালার মতো। নালা সঙ্কীর্ণ হলেও বড় বড় পুকুরের পানিকেও তা গিলে ফেলে। কারণ, পুকুর বড় হলেও আবদ্ধ আর নালা ছোট হলেও অনাবদ্ধ। হারাম পথে থাকলে, গুনাহর পথে থাকলে বিশাল ধনভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়। রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। কারুনের ধন কি কম ছিলো? কেননা তা শেষ হয়ে গেলো? কারণ সে নাফরমানি ও গোনায় লিপ্ত ছিলো। শাদ্দাত কি পেরেছিলো সাধের ‘জান্নাতে’ পা রাখতে? কেন পারেনি? কারণ সে নাফরমানিতে লিপ্ত ছিলো।

তোমাকে জিজ্ঞাসা করি- পৃথিবীতে সবচে’ সহজ কাজটা কী, বলতে পারো? আমিই বলছি! পৃথিবীতে সবচে’ সহজ কাজটা হলো, টাকাপয়সা উড়ানো! বছরের পর বছর শ্রম-সাধনা ব্যয় করে অর্জিত সম্পদ কয়েক মুহূর্তেই শেষ করে দেয়া যায়! টাকা-পয়সা উড়ানোর চেয়ে সহজ কাজ আর একটিও নেই!

ইতিহাসের এক গল্পে আমি পড়েছিলাম ‘এক ধনী লোক ছিলো। ধনে ধনী হলে কী হবে, বুদ্ধিতে ছিলো একেবারে গরীব। ভীষণ বোকা। একবার এই বোকা ধনী- মদ, জুয়া ও হারাম কাজে একরাতে এতো বেশী পরিমাণ টাকা-পয়সা নষ্ট করলো যে, তা দিয়ে কোনো ছিন্নমূল পরিবার নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে এক বছর কাটাতে পারতো।

হ্যাঁ, ইতিহাসে এমন বোকা ধনীদের কোনো অভাব নেই। সব যুগেই এরা কমবেশী ছিলো। এদের পরিণতি হয় খুব খারাপ ও করুণ। কিন্তু অনেকেই এদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয় না। ফলে তাদের পরিণতিও হয় এই এদেরই মতো।

খালাফ এখন কোথায়
খালাফ এখন ভীষণ সঙ্কটে আছে। অর্থ সঙ্কট, বন্ধু সঙ্কট, সব সঙ্কট এক সঙ্গে জমা হয়েছে। আশপাশে কেউ নেই। যতোদিন তার সম্পদ ছিলো, ততোদিন তার বন্ধুও ছিলো। এখন সম্পদ নেই, তাই বন্ধুও নেই। এতোদিন যারা তার পাশে গিজগিজ করেছে, এরা সবাই ছিলো নকল বন্ধু, টাকার বন্ধু, সুদিনের বন্ধু। টাকা শেষ, সুদিন শেষ, তাই নকল বন্ধুদের আনাগোনাও শেষ। দুর্দিন এসেছে সাথে সাথে সব পালিয়েছে।

যে নর্তকী ও গায়িকারা তার জলসাঘরে এসে নাচতে-গাইতো, ভালোবাসা ও অনুরাগ দেখাতো, তারাও লাপাত্তা। হবেই তো লাপাত্তা! এরা এখন কেন পড়ে থাকবে নিঃস্ব খালাফের কাছে? ভালোবাসা ও অনুরাগের টানে? না! কারণ, সে ভালোবাসা ও অনুরাগ ছিলো নকল ভালোবাসা ও অনুরাগ। টাকা হাতানোর ভালোবাসা। সম্পদ চুরি করার অনুরাগ। আর টাকার লোভের নকল ভালোবাসা কখনো স্থায়ী হয় না। টাকা শেষ হয়ে গেলে সে ভালোবাসাও শেষ হয়ে যায়। এ-ভালোবাসা সকাল বেলার শিশিরের মতো। সূর্য ওঠার আগে একটু চিকচিক করে। যে-ই সূর্য উঠে, অমনি তা শুকিয়ে নেই হয়ে যায়। কোনো চিহ্নই আর বাকি থাকে না।

কিন্তু তারা খালাফকে ছেড়ে গেলো কোথায়? তারা এখন অন্য খালাফদের বোকা বানানোর জন্যে তাদের সন্ধানে ছুটোছুটি করছে। নতুন করে সম্পদ চুরি করতে। খালাফের মতো আরো কিছু গাধা পাওয়া তো আর কঠিন না! এ-সব গাধার পিঠে সওয়ার হতে পারলে সহজেই বাণিজ্য করা যায়।

খালাফের পুরোনো বন্ধুরা এমনভাবে উধাও হয়েছে যেনো মাটির সাথে মিশে গেছে। কিছুদিন আগেও যারা খালাফের কথায় উঠতে বসতো, এমন কি ডাকলে রাত-দুপুরেও ছুটে আসতো, তার যে কোনো চাহিদা ও ইচ্ছে পূরণে এক পায়ে খাড়া থাকতো- এরা এখন কোথায় হারিয়ে গেলো সব? আসলে ওরা সব ছিলো স্বার্থপরের দল। স্বার্থও শেষ, বন্ধুত্বও শেষ। আচমকা সেই বন্ধুরা খালাফের সামনে পড়ে গেলে পাশ কেটে চলে যেতো- চোরের মতো। আর মূর্খ ও বোকা খালাফ যখন গায়ে পড়ে ওদের সাথে কথা বলতে যেতো কিংবা ঋণ চাইতে যেতো তখন এমনভাবে তারা খালাফকে ‘না!’ বলে দিতো, যেনো খালাফের সাথে তাদের কখনো কোনো পরিচয়ই ছিলো না। অথচ তার সম্পদ চুষে খেতে এই এরাই তার পেছনে দিন-রাত ঘুরঘুর করেছে। সম্পদ যখন ফুরিয়ে গেলো, ওলান যখন দুধ-শূন্য হয়ে গেলো, তখন নতুন সম্পদ আর নতুন ওলানের সন্ধানে এরা সবাই ছুটে বেড়াতে লাগলো। এখন কেউ নেই নিঃস্ব খালাফের পাশে। খালাফের পৃথিবী এখন ছোট হয়ে এসেছে, ভীষণ ছোট।

খালাফের পৃথিবী এখন বন্ধুহীন- নিঃসঙ্গ পৃথিবী!

খালাফের পৃথিবী এখন সম্পদহীন- নিষ্ঠুর পৃথিবী!

এমনই হয়!

এটাই আল্লাহর বিধান। তিনি সৎ মানুষের সততার বদলা যেমন দেন অসৎ মানুষের অসততার শাস্তিও দেন তেমনি এই দুনিয়াতেই। আর পরকালের শাস্তি তো আছেই।

১০
আহমদ আবার এগিয়ে এলো
বেশ পরের কথা বলছি। আহমদের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন আরো প্রসারিত হয়েছে। সে এখন ‘কারখ’ শহরের মস্ত বড় ব্যবসায়ী। তার মন ছিলো কোমল ও দয়ালু। তাই ভাইয়ের শত দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও সে ভাইকে ভুলে থাকতে পারলো না। তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো। পরিচয় গোপন করে গোপনে তাকে সাহায্য করে যেতে লাগলো। কখনো দশ দিরহাম, কখনো বিশ দিরহাম।

ব্যবসার উদ্দেশ্যে একবার আহমদ বাগদাদ যাওয়ার আয়োজন করলো। বাগদাদের পথে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে সে খালাফকে ডেকে বললো, “তুমি আমার ভাই। আমি নিজের জন্যে যা পছন্দ করি তোমার জন্যে ঠিক তাই পছন্দ করি। তুমি যদি এখন থেকে আমার কথা মেনে চলো, বর্তমান অবস্থা থেকে ফিরে এসো, নিজেকে সংশোধন করো, তাহলে প্রতি মাসে আমি তোমাকে একশ দিনার করে দেবো।’

ভাইয়ের কাছ থেকে অমন অভাবনীয় প্রস্তাব পেয়ে খালাফ মহা খুশি। পেছনের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যে সে সাথে সাথে ক্ষমা চাইলো। অনুশোচনা প্রকাশ করলো। লজ্জিত হলো। ভাইয়ের কাছে প্রতীজ্ঞা করলো- ভবিষ্যতে আর কখনো সে তার অবাধ্য হবে না। অন্যায় পথে চলবে না। নষ্ট বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে না।

খালাফের এই পরিবর্তনে আহমদ বেশ খুশি হলো। ভাবলো ভাইটি তো তার বেশ বদলে গেছে। পেছনের সবকিছু থেকে সরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। আহমদ একশ দিনার প্রদানের ঘোষণা থেকে আরো কয়েক ধাপ সামনে বেড়ে নিজের ব্যবসার সাথেই খালাফকে জড়িত করার চিন্তা করতে লাগলো। নিজের শ্যালিকাকে তার কাছে বিবাহ দেয়ার কথাও ভাবতে লাগলো। শুধু তাই নয়; এ-সব ভাবতে ভাবতে নিঃস্ব খালাফকে নিজের বাসভবনেই থাকার জায়গা করে দিলো। কেননা ততোদিনে খালাফের ঘরে নেমে এসেছিলো জরাজীর্ণ দশা।

১১
খালাফরা এমনই হয়
কিন্তু আহমদ খালাকে চিনতে ভুল করলো। উপরে উপরে খালাফ ভাই-ভক্তি দেখালেও এবং তাওবা করে ভালো হওয়ার ঘোষণা দিলেও আসলে সে বদলায়নি। ভিতরে ভিতরে পাক্কা শয়তানই রয়ে গেছে। আহমদের আশ্রয়ে থেকে, তার নূন খেয়ে তার বিরুদ্ধেই বরং ষড়যন্ত্র শুরু করে দিলো সে। গোপনে গোপনে। আহমদের একেবারে অজান্তে। আর ঘরের মানুষ যখন ঘরের মানুষের বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তখন তা কতোটা ভয়ঙ্কর ও অমানবিক হয়, তা তো জানোই! কারণ, বাইরের শত্রু সম্পর্কে সতর্ক থাকা যায়, ভিতরের শত্রু সম্পর্কে সতর্ক থাকা যায় না, সম্ভব না। কখন যে ভিতরের শত্রু আক্রমণ করে বসে, তা বোঝাই যায় না।

১২
খালাফ! তুমি কি ‘অমানুষ’?
আহমদ কিন্তু তার ভাইকে সাহায্য-সহযোগিতা করেই যাচ্ছিলো। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। ভোলা মনে, স্বচ্ছ মনে, ভ্রাতৃত্বের কোমল অনুভুতিতে আলোড়িত হয়ে। কিন্তু খালাফের মনে কোনো পরিবর্তন এলো না। অমন সোনার ভাইয়ের সম্মানেভক্তিতে তার মাথা নুয়ে এলো না। বরং উল্টো ভাইয়ের বিরুদ্ধে সে চালিয়ে যেতে লাগলো গভীর ষড়যন্ত্র।

বাইরে বাইরে খালাফ আহমদের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ করতো। প্রতিদিনই আহমদের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে আলাপ-আলোচনা করতো। তার কথা মেনে চলার ভান করতো। এমন কি আহমদ কিছু করতে বললে হাসিমুখে সে তা করেও দিতো। ভালো ব্যবহার দেখিয়ে সে আহমদের মন জয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো এবং এ ক্ষেত্রে সে সফলও হলো। কিন্তু মনে মনে সে সুযোগ খুঁজছিলো আহমদের সর্বনাশ করার। তার ধন-সম্পদ দখল করার। এমন কি তাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেয়ার।

একদিন খালাফ আহমদের কাছে এক নতুন প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো। তখন আহমদ এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সফরের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলো। খালাফ সালামের পর বিনয়ভরা কণ্ঠে বললো, ‘ভাইয়া! শুনলাম তুমি সফরে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এ দূরের সফরে তোমার সাথে একজন ভালো পথসঙ্গী থাকা দরকার। তুমি অনুমতি দিলে আমি নিজেই যেতে রাজি আছি।’

আহমদ খালাফের প্রস্তাবে ভীষণ খুশি হলো। বললো, ‘উত্তম প্রস্তাব! তুমি আমার সাথে গেলে তো খুবই ভালো হয়! এতোদিনে বুঝি তোমার সুমতি হলো? হায়! বাবা বেঁচে থাকলে এখন কতো খুশি হতেন!’

আহমদের সফরসঙ্গী হওয়ার সবুজ সঙ্কেত পেয়ে খালাফ ভীষণ খুশি হলো। আহমদের একান্ত বিশ্বস্ত এক কর্মচারী ছিলো। সকল বাণিজ্যিক সফরেই সে আহমদের সঙ্গে থাকতো। খালাফ এবার তাকে দলে ভিড়ানোর কিংবা দল থেকে ভাগানোর উদ্দেশ্যে তার কাছে ছুটে গেলো। প্রথমে চেষ্টা করলো পথের কাঁটাকে ফুল বানাতে, তাকে দলে ভিড়াতে।

খালাফ কর্মচারিটির বিশ্বস্ততার মাত্রা যাচাই করলো। তাকে নিজের পরিকল্পনাটা বললো। কিন্তু ফল হলো উল্টো। খালাফের ষড়যন্ত্রের কথা শুনে কর্মচারিটি রীতিমত আঁতকে উঠলো এবং খালাফের প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করলো।

খালাফ দেখলো- বড়ো ভুল জায়গায় সে হাত দিয়েছে। একে দলভুক্ত করা মোটেই সম্ভব না। আহমদের একেবারে অন্ধ ভক্ত সে। খালাফ ভীষণ বিপাকে পড়ে গেলো। কর্মচারিটি তার আসল মতলব জেনে ফেলেছে। একে শায়েস্তা না করলে এক্ষুণি আহমদের কাছে গিয়ে সব ফাঁস করে দেবে।

খালাফ সময় নষ্ট করলো না। শয়তানদের তো আর শয়তানি বুদ্ধির অভাব হয় না। কর্মচারিটিকে আর ঘাটাঘাটি না করে সে তার কাছ থেকে চোখ লাল করে বেরিয়ে গেলো। ছুটে গেলো আহমদের কাছে। তারপর কর্মচারিটির বিরুদ্ধে ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক মিথ্যা অভিযোগ করলো। বিনা অপরাধেই তাকে মহা অপরাধী হিসাবে তুলে ধরলো।

ভাইয়ের কথা ভাই তো বিশ্বাস করবেই। ভাইয়ের কথায় ভাই তো প্রভাবিত হবেই। ফল যা হবার তাই হলো। বেচারা কর্মচারী কোনো দোষ না করেই দোষী সাব্যস্ত হলো।

আর খালাফ! আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসলো- ‘বিজয়ী’র হাসি! অসৎ হাসি! কুৎসিত হাসি! পাশাপাশি নিজের ষড়যন্ত্রের পথকে কাঁটামুক্ত করতে তার এক নষ্ট বন্ধুকে নিয়ে আহমদের কাছে হাজির করলো, ‘ভাইয়া! এ খুব ভালো। ভীষণ বিশ্বস্ত। একে আমরা নিশ্চিন্তে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি।’

১৩
কাঁটা-বিছানো পথে শুরু হলো পথচলা
একদিন উপযুক্ত একটা দিন দেখে আহমদ এক বাণিজ্য বহরের সাথে সফরে বের হয়ে গেলো। সাথে খালাফ এবং সদ্য নিয়োগ করা কর্মচারিটি। এ-কাফেলায় শরীক ছিলো আরো অনেক নামী দামী ব্যবসায়ী। তাদের সাথে ছিলো বিপুল পণ্য বহর। পণ্যবাহী ঘোড়া, গাধা ও উট ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে।

এ-ধরনের বাণিজ্য কাফেলায় একজন আমীর থাকেন। তার নির্দেশেই কাফেলা সামনে চলে আবার থেমে যায়, যাত্রা বিরতি করে। আরাম-বিশ্রামের পর আবার নতুন করে পথচলা শুরু করে। অর্থাৎ এ সফরের সূচনা ও সমাপ্তি আমীরের পরিচালনা ও পরিকল্পনায় একটা সুন্দর শৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে সম্পন্ন হয়।

খালাফের জন্যে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। কারণ সে ইতিপূর্বে এমন বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে কখনো সফর করে নি। তাই সে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। এ-বিশাল কাফেলায় তার ‘নীলনক্সা’ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? এখানে তো অন্যায় করে পার পাওয়া ভীষণ কঠিন। কাফেলার সরদার কঠোর শাস্তি দেবেন।

এই অবস্থায় এগিয়ে এলো খালাফের ‘বন্ধু’ অর্থাৎ শয়তান! শয়তান তো তার চ্যালাদের সাথেই থাকে! শয়তান এসেই ঢুকিয়ে দিলো খালাফের মাথায় এক দুষ্ট-বুদ্ধি। খালাফ এবার হাসলো- কূটিল হাসি! তারপর আহমদের কানে কানে গিয়ে বললো, ‘ভাইয়া! তুমি কিন্তু একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একদমই ভাবছে না। এই যে বিরাট কাফেলার সাথে আমরা বাগদাদ যাচ্ছি, এটা কিন্তু ভীষণ বোকামী। কারণ এতে আমরা লাভবান হতে পারবো না। এ-কাফেলায় রয়েছে বড় বড় ব্যবসায়ী। বিপুল তাদের পণ্য সামগ্রী। এরা সবাই যখন একসাথে, একই সময়ে বাগদাদ গিয়ে পৌঁছবে, তখন নির্ঘাত বাজারদর পড়ে যাবে। অনেক কম লাভে আমাদেরকে পণ্য বিক্রি করতে হবে। এরচে আমরা যদি এক্ষুণি এ-কাফেলা ত্যাগ করে ভিন্ন পথে একটু দ্রুত পথ চলি, তাহলে আমার মনে হয়, কাফেলার অনেক আগেই আমরা বাগদাদ পৌঁছে যাবো এবং উচ্চ মূল্যে আমাদের পণ্য বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবো।’

আহমদ বললো, ‘কিন্তু এই ভীতিপ্রদ বিজন মরু এলাকায় কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তো ঠিক না! এখানে পদে পদে বিপদের আশঙ্কা।’

খালাফ বললো, ‘ভয়ের কী আছে ভাইয়া? আমরা দু’জন যতক্ষণ জীবিত আছি, ততক্ষণ আপনার কোনো ভয় নেই। আমরা দুজন মিলে দশ পনেরজনের ডাকাত দলকেও কাবু করে ফেলতে পারবো।’

খালাফের কথায় এবারও আহমদ বিভ্রান্ত হলো। মত পরিবর্তন করে কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আমীরকে জানিয়ে একটু পরই ভিন্ন পথে সে যাত্রা করলো। কাফেলার সরদার বারবার ‘না’ করলেন। কিন্তু আহমদ কী ভেবে যেনো মত পরিবর্তনে অপারগতা প্রকাশ করলো।

আহমদ, খালাফ ও কর্মচারিটি এবার বিজন মরুতে আলাদা পথ চলা শুরু করলো। আহমদ একা একটি ঘোড়ায়। খালাফ চড়েছে আরেকটি ঘোড়ায়। তার পেছনে কর্মচারিটি। তাদের সাথে আছে পণ্যবাহী সাতটি গাধা। খালাফ ও তার অনুচরের মুখে হাসি থাকলেও আহমদ ছিলো কিছুটা গম্ভীর। একটা অজানা আশঙ্কার ছায়া তার চোখে-মুখে লেপটে আছে।

১৪
ষড়যন্ত্র যেভাবে শুরু হলো
অবিরাম গতিতে দু’রাত পথ চলার পর ফোরাতের তীরে একটা উঁচু জায়গায় এসে যাত্রাবিরতি করলো তারা। মালামাল খালাসের পর। ঘাস খাওয়ার জন্যে গাধাগুলোকে ছেড়ে দেয়া হলো।

আহমদ সফরের ক্লান্তি দূর করার জন্যে পাঞ্জাবীটা খুলে একটু আরাম করে বসলো। একটু পর খাওয়ার আয়োজন নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আয়োজন শেষে ওদেরকে দস্তরখানে এসে বসতে বললো।

জবাবে খালাফ বললো, ‘ভাইয়া! একটু অপেক্ষা করো! আমি জম্ভগুলোকে একটু পানি খাইয়ে আসছি।’

এরপর খালাফ গাধাগুলো নিয়ে দূরে কোথাও চলে গেলো। সঙ্গে যোগ দিলো কর্মচারিটিও। খালাফ ফিরে এলো বেশ খানিকটা পর। তখন আহমদ বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো।

খালাফ দেখলো, এটাই সুযোগ। সে পা টিপে টিপে আহমদের পেছনে এসে দাঁড়ালো। তারপর আচমকা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আহমদ কিছু বোঝে ওঠার পূর্বেই খালাফ তার নাকে-মুখে কিল-ঘুষি চালাতে লাগলো। অপরদিকে খালাফের সঙ্গীটি এসে আহমদকে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় আহমদ একেবারে আকাশ থেকে পড়লো! এ অস্বাভাবিক আচরণকে বিশ্বাস করতে পারলো না আহমদ। এ কোনো ঠাট্টা নয় তো! কিন্তু ছোট ভাই কি বড় ভাইয়ের সাথে এমন নিষ্ঠুর ঠাট্টায় মেতে উঠতে পারে? তার সঙ্গীটিও কী অমানবিক আক্রোশে তাকে বেঁধে ফেললো! না, অসম্ভব! এ কোনো ঠাট্টা হতে পারে না! তাহলে কি আহমদ খালাফের ষড়যন্ত্রের শিকার?

আহমদ ইন্না লিল্লাহ পড়তে লাগলো। তারপর ওদেরকে বললো, ‘এই! তোমরা এ-সব কী করছো?’ খালাফ তখন আহমদকে ব্যঙ্গ করে বললো, ‘এ-সব কী করছি? বুঝতে পারছেন না বুঝি সাহেব! এ-সব হচ্ছে আপনার উপযুক্ত পুরস্কার! চোরের পুরস্কার!’

আহমদ আহত কণ্ঠে বললো, ‘তুমি আমাকে চোর বলতে পারলে? আমি তোমার কী চুরি করেছি শুনি?’

‘তোমায় চোর বলবো না তো সাধু বলবো নাকি? তুমি আমার বাবার সমস্ত সম্পত্তি লুটে নিয়ে গেছো! আর আমাকে তোমার কর্মচারী করে রেখেছো! আজ এই তোমার উপযুক্ত সাজা!’

আহমদ বললো, ‘খালাফ! আমি অন্যায়ভাবে বাবার কোনো সম্পত্তি নিই নি। বাবা আমাকে সব দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, আমি রাজি হই নি। সমস্ত সম্পত্তি সমান করে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তোমাকে বিন্দুমাত্র ঠকানো হয় নি। বরং আমি কি তোমাকে সব সময় পদে পদে সহযোগিতা করিনি? তোমার মঙ্গল চিন্তায় সব সময় আমি ব্যাকুল থেকেছি। আজ সব ভুলে গিয়ে তুমি আমাকে চোর বলছো! ষড়যন্ত্র করে নির্জন মরুতে আমাকে হত্যা করতে চাইছে! আল্লাহ কিন্তু এঅবিচার সহ্য করবেন না!!’

আহমদের কথায় খালাফের মাঝে কোনো পরিবর্তন এলো না। উল্টো দাঁত বের করে সে হাসলো। শয়তানের মতো অট্টহাসি। তারপর বললো, ‘আহারে! কে বলেছে তোমাকে আমার কল্যাণের কথা ভেবে ভেবে এতো হয়রান পেরেশান হতে? খেয়ে-দেয়ে তোমার কোনো কাজ নেই বুঝি! এই চেয়ে দেখো, তোমাকে খতম করে আমি নিজে নিজেই এখন সমস্ত সম্পত্তির মালিক বনে যাচ্ছি!’

১৫
ভাই যখন ভাইয়ের ‘জানি দুশমন’
আহমদ খালাফের মুখ থেকে এ-সব অশ্রাব্য কথা শুনেও তাকে শত্রু ভাবতে পারছিলো না। বরং এ-আচরণকে এক সাময়িক উত্তেজনা হিসাবে ধরে নিলো। তাই আবার সে খালাফকে স্নেহঝরা কণ্ঠে বললো, ‘খালাফ, তুমি শান্ত হও! তুমি যদি মনে করে থাকো, সম্পত্তিই তোমাকে সুখ ও সৌভাগ্য এনে দেবে, তাহলে বড়ো ভুল করবে তুমি! ধন-সম্পদ মানুষের কোনো কাজেই লাগে না, যদি তা সংরক্ষণের জন্যে উপযুক্ত জ্ঞান-বুদ্ধি না থাকে। শোন, তুমি যদি আল্লাহর হুকুম অমান্য করো, তাহলে কোনোদিন তোমার জীবনে সুখ-শান্তি আসবে না। তোমার কাছে তো ক’বছর আগেও লক্ষ লক্ষ দিরহাম ছিলো! সঠিক জ্ঞান-বুদ্ধির অভাবে তুমি তা নষ্ট করে ফেলেছো, কোনো কাজে লাগাতে পারো নি। তুমি কি ভেবেছো, আমার ক্ষতি করে বিবেকের দংশন থেকে তুমি বাঁচতে পারবে? পারবে না! আল্লাহর প্রতিশোধ থেকে তুমি রেহাই পাবে না!’

খালাফ আহমদের কথায় এবারও কান দিলো না। চীৎকার করে বলে উঠলো, ‘চুপ করো বলছি! এতো বকবক করবে না!’

এরপর খালাফ কী করলো?

এরপর সে গাধার চাবুক দিয়ে মানুষ পেটাতে লাগলো!

কেমন মানুষ?

নিজের আপন ভাই!

কেমন আপন ভাই?

সার্বক্ষণিক হিতাকাংখী!

এরপর কী হলো?

এরপর ভাইয়ের হাতে ভাই রক্তাক্ত হলো।

এ করুণ দৃশ্য দেখে আকাশ কাঁদলো,

বাতাস কাঁদলো,

কাঁদলো মরুভূমির বালুকণারাও বুঝি!

কাঁদলো অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ বাকহীন জন্তুগুলোও বুঝি!

কাঁদলো আকাশের বুকে ভাসমান ঐ মেঘমালারাও বুঝি!

কাঁদলো না শুধু ভাইয়ের মন!

নিষ্ঠুরতায় ঘেরা যে ভাইয়ের মন,

তাকে কি ভাই বলা যায়?

চাবুকের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতে লাগলো আহমদের দেহ। তবু সে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে বাঁধনমুক্ত হওয়ার চিন্তা করলো না। ভাইকে কোনো কটু কথাও বললো না। নিষ্ঠুর ভাইকে নিষ্ঠুরতা দ্বারা বদলা দিলো না। নিষ্ঠুরতা যে তার ধাঁচেই নেই! তার হৃদয় জুড়ে তখনও তোলপাড় করছিলো ভ্রাতৃস্নেহ ও ভ্রাতৃমমতা! ভাই বলে কথা নয়; আহমদ কাউকেই শত্রু মনে করতে পারতো না। একেবারে ছোট্ট বেলা থেকেই সে বেড়ে উঠেছে ন্যায়ের উপর, ভালোবাসার উপর। সত্যের উপর, কল্যাণের উপর। তাই অশ্রুময়-রক্তময় চেহারা নিয়ে তাকালো সে খালাফের দিকে। বললো, ‘ভাই আমার! আল্লাহকে ভয় করো! তুমি কি ভুলে গেছো, আমি তোমার বড় ভাই? রক্তের বন্ধনকে পারবে তুমি অস্বীকার করতে? তা ছাড়া আমরা এক সঙ্গে শৈশব কাটাই নি, খেলি নি, দৌড়াই নি! শৈশবের স্মৃতি-জড়ানো মধুর দিনগুলোর কথা মনে করেও তুমি কি একটু সংযত হবে না? আমার উপর হাত তোলতে একটুও কি লজ্জাবোধ করবে না?

খালাফ! তুমি দিরহাম-দিনার চাও? বিশ্বাস করো, আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারলে যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দেব! তোমার যে কোনো ভালো প্রয়োজন ও সুন্দর ইচ্ছে পূরণে আমি চেষ্টা করবো। সুতরাং তুমি ভুল করো না। জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়ো না!’

খালাফ আরো বেশী উত্তেজিত হয়ে উঠলো। চীৎকার করে বলতে লাগলো, ‘কী! তুমি আমায় দিরহাম-দিনারের লোভ দেখাচ্ছো? বলি, তুমি আমায় দেবার কে? তার আর প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই একা একা সবকিছুর মালিক হয়ে যাচ্ছি। সব আমার বাবার সম্পত্তি। আর এই পণ্য সামগ্রী, এ-সব বিক্রি করে আমি এখন বাড়ি ফিরবো। এতেও তোমার কোনো ভাগ ও অধিকার নেই। তোমার আর বাড়ি ফেরা হবে না! এই গাছের সাথেই তুমি বাঁধা থাকবে। এখানেই তোমার মরণ হবে- হে কুকুর!’

কিন্তু হঠাৎ করে ঝড় উঠলো খালাফের সঙ্গীটির মনে। সে মেনে নিতে পারলো না খালাফের পরিকল্পনা। সে খালাফের কাছে এসে বললো, ‘কী বললে খালাফ? তুমি একা একা সব নিয়ে যাবে? তাহলে আমার ভাগ কোথায় যাবে?’

খালাফ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘তোমার আবার ভাগ কিসের? তুমি তো এসেছো আমার বেতনভোগী কর্মচারী হিসাবে?’

‘অসম্ভব! আমার সাথে তোমার এমন কথা ছিলো না! তুমি আমাকে বলেছিলে- কোনো বিজন মরুতে আহমদকে কতল করে আমরা দু’জন সমান করে তার সমস্ত সম্পদ ভাগ করে নেবো! কী, বলো নি? কয়েকদিনের ব্যবধানেই সব ভুলে গেলে?!’

১৬
এক অপরাধ ডেকে আনে আরেক অপরাধ
কর্মচারিটির মুখে খালাফের অসৎ উদ্দেশ্যের কথা শুনতেই আহমদের অন্তর কেঁপে উঠলো! রক্ত চলাচল যেনো বন্ধ হয়ে গেলো। চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। মৃত্যু-শীতল নীরবতায় মাথাটা বুকের দিকে ঝুঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে সে বসে রইলো।

আহমদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার খালাফ মনোযোগ দিলো তার নতুন শত্রুর দিকে। একটু পরই খালাফ ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। শুরু হলো মল্লযুদ্ধ। একজন আরেকজনকে কাবু করার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। প্রথমে মনে হচ্ছিলো- খালাফ পেরে উঠবে না, হেরেই যাবে। কিন্তু একটু পরই দৃশ্যপট বদলে গেলো। খালাফ এক সুযোগে একটা পাথরখণ্ড কুড়িয়ে ইয়া জোরে কর্মচারীর মাথায় আঘাত করলো। নিমিষেই তার মাথাটা একেবারে থেঁতলে গেলো। লুটিয়ে পড়লো তার বেকাবু দেহটা জমিনে। খালাফ মুহূর্তমাত্র দেরী না করে তাকেও রশি দিয়ে বেঁধে ফেললো এবং সেই গাছটায় আহমদের পাশে বেঁধে রাখলো।

লোকটির আঘাত ছিলো গুরুতর। তীব্র ব্যথায় সে গোঙাচ্ছিলো। আহমদ অবরুদ্ধ অবস্থায় খালাফকে বলে-কয়ে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কে শুনে কার কথা? খালাফ নিবৃত্ত হলো না। তার মুখে তখন খেলা করছিলো বিজয়ের হাসি। পুরোনো ও নতুন দুশমনকে এক সঙ্গে কাবু করে পৈশাচিক উল্লাসে নৃত্য করছিলো তার চোখ-মুখ।

এদিকে মরতে বসা লোকটি আহমদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললো, ‘ভাই, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও! আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত। আমি হলাম সেই অপরাধী ও পাপিষ্ঠ, যে এক জালিমকে জুলুমের কাজে সহযোগিতা করেছে অতঃপর আল্লাহ সেই জালিমকেই তার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন!’

আহমদ বললো, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম! আল্লাহর কাছে তাওবা করো!’

লোকটি বললো, ‘তুমি চেয়েছিলে তোমার ভাইয়ের মঙ্গল ও কল্যাণ আর তোমার ভাই চাইলো তোমার বিনাশ ও ধ্বংস।’

আহমদ বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো, ‘অবশ্যই আল্লাহ এ জন্যে তার কাছ থেকে আমার হয়ে প্রতিশোধ নেবেন এবং তার বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করবেন।’

প্রতিশোধের কথাটা খালাফের কানে গিয়ে বাড়ি খেলো। আবার সে হাসলো- পিশাচের হাসি। বললো, ‘এক্ষুণি দেখবে আল্লাহ কাকে কার বিরুদ্ধে সাহায্য করেন!’

এদিকে খালাফের অলক্ষ্যে লোকটি আহমদের হাতের বাঁধন খুলে ফেলার চেষ্টা করছিলো। প্রায় খুলেই ফেলেছিলো। কিন্তু খালাফ দেখে ফেললো। সাথে সাথে আরেকটা পাথর নিয়ে লোকটির মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলো। থেঁতলানো মাথাটা আরো থেঁতলে গেলো। লোকটি মারা গেলো।

এবার হৃদয়হীন নিষ্ঠুর খালাফ এগিয়ে এলো আহমদের দিকে। হিংস্র জিঘাংসা নিয়ে বসলো তার বুকে। তারপর হাতে নিলো খাপে-ঢাকা একটা ছুরি। তারপর রক্তলাল চোখে বললো, ‘এবার তোমার পালা। দুম্বার মতো তোমাকে জবাই করা হবে! তুমি আস্তো একটা চোর!’

আহমদ নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো। সে সশব্দে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে লাগলো। উচ্চকণ্ঠে খালাফকে বিরত হওয়ার আহ্বান জানাতে লাগলো।

কিন্তু খালাফের মুখে পিশাচের হাসি। খালাফের চোখে দানবের দৃষ্টি। আবার কেঁপে উঠলো আহমদের অন্তরাত্মা। খালাফ বললো, ‘মুখ বন্ধ করো! চীৎকার করে কোনো লাভ নেই। এ বিজন মরুতে আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমার হাতে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত।’

আহমদ কাঁপা কণ্ঠে বললো, ‘আল্লাহ-ই আমাকে বাঁচাবেন। তিনিই হায়াত-মওতের একমাত্র মালিক!’

খালাফ বিদ্রুপমাখা কণ্ঠে বললো, “আচ্ছা! বল তাহলে আল্লাহকে বাঁচাতে!’

‘খালাফ সাবধান! তুমি আল্লাহর সাথে কুফরী করছো!’ আহমদের কণ্ঠে দুঃখ, আফসোস ও বিস্ময়!

‘চুপ করো!’ খালাফের বেপরোয়া উত্তর!

আহমদ আবার কেঁপে উঠলো! চোখ বন্ধ করে আল্লাহর সাহায্য চাইতে লাগলো। পড়তে লাগলো- কালেমা ও ইস্তিগফার। মৃত্যু কি তার খুব কাছে? আল্লাহ, আমার আল্লাহ! সাহায্য করো!!

১৭
গল্প এখানেই শেষ! তবে..
বন্ধু! কাহিনীকার ও গল্প-লেখিয়েদের সাধারণ অভ্যাসটা কী জানো? মাঝ পথে এসে কাহিনী শেষ করে দেয়া! অর্থাৎ কাহিনী বা গল্পের কোনো সফল পরিণতি না টেনে একটা সঙ্কটময় মুহূর্তে এসে ইতি টেনে দেয়া! এ-অভ্যাসটা কিন্তু বড় বিশ্রী ও বিরক্তিকর!

বন্ধু! আমায় ক্ষমা করে দিও!

আজ আমি কাহিনীকারদের এ-বাজে অভ্যাসটাই অনুসরণ করবে এবং এখানেই গল্পের সমাপ্তি টানবো! তবে তোমাদের অতি বিরক্তির কারণ ঘটাবো না। একদম হঠাৎ করে কোনো উপসংহার ছাড়া শেষ করবো না। কিন্তু উপসংহারটা হবে খুব ছোট। এই ধরো- উপসংহারটা যেনো একটা গাছ। আমি এক লাফেই উঠে যাবো উপসংহার নামের ঐ গাছটায়!

১৮
রাখেন যদি আল্লাহ মারবে তাহলে কে?
দু’রাত পরের কথা। আহমদের বাণিজ্য কাফেলার আমীর বাণিজ্য শেষে এ-পথেই ‘কারখ’ ফিরছিলেন। দু’দিন আগে ঘটে গেলো যেখানে এ-রক্তারক্তি কাণ্ড, সেখানে কাফেলা পৌঁছতেই আমীর দেখলেন পাঁচ-সাতটা গাধা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আশপাশে কোনো মানুষ নজরে পড়ছে না। পরিবেশটা কেমন যেনো থমথমে। আমীর চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে কাফেলাকে থামতে বললেন। সওয়ারী থেকে নেমে খানিকটা এগিয়ে গেলেন। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই তার চোখে পড়লো একটু ঢালুতে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে আহমদকে! আহমদ আহত। প্রচণ্ড ক্ষুধায় তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। তার পাশেই পড়ে আছে খালাফ ও কর্মচারীর প্রাণহীন ও রক্তাক্ত দেহ। আমীর দ্রুত আহমদের বাঁধন খুলে দিলেন। গরম দুধ ও পরিচর্যায় আহমদ চোখ মেলে তাকালো। শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে এলো। আস্তে আস্তে তখন সে আমীরকে বললো- তার বেঁচে যাওয়ার কাহিনী এবং দুই লাশের কাহিনী! কাহিনী বলতে বলতে তার দু চোখে নেমে এলো অশ্রু!

আহমদ বললো, ‘এক পর্যায়ে খালাফ আমাকে হত্যা করতে আমার বুকে চেপে বসলো। খাপ থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করার চেষ্টা করছিলো খালাফ। কোনো কারণে’ ছুরিটা খাপ থেকে বের হতে চাচ্ছিলো না। তখন সে উঠে দাঁড়ালো এবং বাম হাতে খাপের একটা অংশ চেপে ধরে ডান হাতে ছুরিটা টানছিলো প্রচণ্ড শক্তি খাটিয়ে। আমাকে তখন খারাপ ভাষায় গালিও দিচ্ছিলো। আমি তখন বেঁচেও মরা! সর্বান্তকরণ সঁপে দিয়ে ডাকছিলাম আল্লাহকে। শুধু ডাকছিলাম। হঠাৎ দেখলাম- ছুরিটা তীব্র বেগে বেরিয়ে এলো! নাপিতের ক্ষুরের মতো ধারালো এ-ছুরিটির অগ্রভাগ ছিলো খালাফের বুকের দিকে। প্রচণ্ড বেগে বের হওয়ার কারণে সাথে সাথে তা নিয়ন্ত্রণহীন খালাফের গর্দানের এক পাশে এসে ঢুকে পড়লো। রক্তে লাল হয়ে গেলো খালাফের সারা দেহ। ফ্যাকাশে হয়ে এলো তার দৃষ্টি।

না, এরপর খালাফের আর উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হলো না। কথাও বের হলো না মুখে। একটু আগের মহা সংহারী রূপ’টা নিমিষেই ‘নেই’ হয়ে গেলো। আমি অবাক-বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম তার করুণ পরিণতির দিকে। একটু পর দেখলাম তার প্রাণহীন রক্তাক্ত অসাড় দেহটা পড়ে আছে আমার সামনে!’

১৯
আল্লাহ মুমিনের বন্ধু ও সাহায্যকারী
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনের হয়ে লড়াই করেন’

-আল-কুরআন

কাফেলার সবাই ঘটনার বিবরণ শুনে বিস্মিত হলো। আহমদ তখন মৃদু হেসে বললো, ‘বন্ধুরা! বিস্ময়ের কিছু নেই। অনেক দিন আগে আমার পিতা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘আমার মৃত্যুর পর তোমার ভাই তোমার প্রতি জুলুম করলে কে তোমাকে দেখবে, রক্ষা করবে?’ আমি সেদিন বলেছিলাম, ‘আল্লাহ!’

বন্ধুরা আমার! দেখো, কী কঠিন বিপদ ও জুলুম থেকে আল্লাহ আজ আমাকে বাঁচালেন। কীভাবে তিনি আমার হয়ে এক জালিমের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিলেন!

কাফেলা সরদার উচ্চ কণ্ঠে কালেমা বলে উঠলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই!’

সত্যি, যার সাথে আল্লাহ থাকেন তার কোনো ভয় নেই? আল্লাহ জালিমদেরকে মাঝে-মধ্যে সুযোগ দেন, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেন না। অবশ্য জালিমরা বড়ো অদূরদর্শী। সময় থাকতে তারা বোঝে না, শিক্ষা নেয় না। পৃথিবীর সব জালিমের চরিত্রই এমন। বিংশ শতাব্দির বড় বড় জালিমরা কি শিক্ষা নেবে খালাফের পরিণতি থেকে?

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন