HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

লেখকঃ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতি প্রতিরোধ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম

সম্পাদনা : ড. মোঃ আবদুল কাদের

ভূমিকা:
দুর্নীতি মানব সভ্যতার জন্য চরম অভিশাপ। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধক। মানব সভ্যতার সূচনা থেকে বিভিন্ন সময়ে এ জঘন্য ব্যাধির প্রকোপ ও প্রসার দেখা গেছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও বিস্তার নিরূপণ করতে গেলে দেখা যায় যে এ ব্যাধির সর্বাধিক প্রবৃদ্ধি ও প্রসার ঘটে উপনিবেশিক শাসনামলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে প্রশাসনের সকল স্তরে, ধনিক-বণিক শ্রেণীসহ সমাজের সুবিধাভোগী উচ্চস্তরে এর প্রসার ঘটে থাকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। বিভিন্ন যুগে ও সময়ে যে হারে বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রসার হয়েছে; সে হারে এর সমীক্ষা ও গবেষণা হয় নি এ কারণে এ জন্য ব্যাধির প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও বিস্তারের কারণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তথ্য নির্ভর প্রমাণাদি পাওয়া অতীব দুরূহ ও কষ্টকর। তবে ঐতিহাসিকগণ সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা কালে যে সকল বিবরণ সংগ্রহ ও বর্ণনা করেছেন, তা থেকে কিছু তথ্য পওয়া যায়। এ ছাড়া ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামেও যুগোপযোগী ও বাস্তবধর্মী নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে দুর্নীতির কারণ, এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে জ্ঞানার্জন অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়। সর্বোপরি একজন মুসলিম হিসাবে ইসলামের আলোকে দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন প্রত্যেকের ঈমানী দায়িত্ব। আলোচ্য প্রবন্ধে দুর্নীতির কারণ এবং তার প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করাই উদ্দেশ্য।

দুর্নীতির পরিচয়ঃ
‘দুর্নীতি’ শব্দটি নেতিবাচক। এটির ইতিবাচক শব্দ ‘নীতি’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দুর্নীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ: রীতি বা নীতিবিরূদ্ধ আচরণ, কুনীতি, অসদাচরণ ও নীতিহীনতা ইত্যাদি। এর আরবী প্রতিশব্দ আল-ফাসাদ বা আল-ইফসাদ। [ইবন মানযুর লিসানুল ‘আরব’ ১ম খন্ড (মিশর: দারুল হাদীস, ২০০৩ খৃ.) পৃ. ১০০; মুনীর আল-বা‘লাবাক্কী, আল-মওয়ারিদ ( বৈরূত: দারুল ‘আলম লিল-মালায়্যীন, ১৯৯৮ খৃ.) পৃ. ২২০।] এর ইংরেজি প্রতিশব্দ corruption। [A. T. Dev, students favourite dictionary, English to Bengali (calcutta: Mallennium edition, 2001), p. 318.] আল-কুরআনে শব্দটির ব্যবহার এভাবে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ وَيَسۡعَوۡنَ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَسَادٗاۚ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُفۡسِدِينَ ٦٤ ﴾ [ المائ‍دة : ٦٤ ]

‘‘তারা পৃথিরীতে ফাসাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ আল্লাহ তা‘য়ালা ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কখনই পছন্দ করেন না।’’ [আল-কুরআন, ৫:৬৪।] (সূরা আল মায়িদা, আয়াত-৫:৬৪)।

দুর্নীতি বলতে নীতি বা আইন বিরুদ্ধ কাজকেই বুঝানো হয়। দুর্নীতির কোন সাধারণ বা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কারণ কিছু কিছু কাজ সকল দেশেই দুর্নীতি বলে চিহ্নিত হলেও বিভিন্ন দেশের দুর্নীতি প্রতিরোধকারী সংস্থাগুলোর তালিকাভুক্ত অপরাধের মধ্যে যথেষ্ঠ পার্থক্য বিদ্যমান। তাই প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব অপরাধের তালিকার ভিত্তিতে দুর্নীতির বিষয়টি অনুধাবন করে থাকে। দুর্নীতির সংজ্ঞা প্রদানে কেউ বলেন, ‘‘ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যদি কোন পক্ষ শুধু তার একক অথবা অপর পক্ষের/পক্ষসমূহের যৌথ আর্থিক অথবা বৈষয়িক স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অন্য কোন পক্ষের/পক্ষসমূহের ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে আইন পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে ঐ কাজকে দুর্নীতি বলে চিহ্নিত করা হয়। এ সম্পর্কে Oxford advanced Learners dictionary তে বলা হয়েছে Willing to use their power to do dishonest or illegal things in return money or to get an advantage.

ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ ক্ষমতা, অর্থ প্রাপ্তি বা কোন অবৈধ সুযোগ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে অসৎ বা কোন অসঙ্গত কাজে ব্যবহার করাকে বলা হয় দুর্নীতি। [A. s. Horn by, Oxford advanced Learners dictionary (New York: Oxford University Press, 1993), p.২৪৪.]

দুর্নীতি সংজ্ঞা প্রসংগে Social work dictionary তে বর্ণিত হয়েছে, Corruption is in political and public service administration, the abuse of office for personal gain usually through bribery, extortion, influence pedding and special treatment given to some citizens and not to others. [মোঃ আতিকুর রহমান, বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক সমস্যা ও সরকারী নীতি (ঢাকা : আল-কুরআন পাবলিকেন্স, ২০০০ খৃ.), পৃ. ৩৩৫]

‘‘রাজনৈতিক ও সরকারী প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে সাধারণত ঘুষ, বল প্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব বা ব্যক্তি বিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে অফিস আদালতকে ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে বুঝায়।’’

এ সম্পর্কে ভারতীয় সমাজ বিজ্ঞানী রামনাথ শর্মা বলেন, In corruption a person willfully neglected his specified duty in order to have an undue advantage. ‘‘অবৈধ সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য কোন ব্যক্তির নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত অবহেলা-ই-দুর্নীতি।’’ [Ramanath Sharma, Indian Social problems (Bombay : Media promoters and publishers pvt. Ltd. 1982), p. 101.] এছাড়া Transparency international এর অভিমত হলো, corruption is the abuse of public office for private gain ‘‘ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভের জন্য গণপ্রশাসনের অপব্যবহারকেই দুর্নীতি বলা হয়। [নূরুল ইসলাম, ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতি প্রতিরোধ, মাসিক পৃথিবী, বর্ষ-২৬, সংখ্যা-৫ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, মার্চ-২০০৭ খৃ.) পৃ. ২২।]

দুর্নীতির মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা লাভবান হলেও সামগ্রিকভাবে সমাজ ও অর্থনীতির উপর এর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাই সার্বিক বিচারে দুর্নীতি সব সময়ই নেতিবাচক ও পরিত্যাজ্য। সম্পদ পাচার, নিয়ম বর্হিভূতভাবে সম্পদ অর্জন, ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা এবং দারিদ্রের কারণে দুর্নীতি, মজুদদারী এবং ব্যংকের টাকা আত্মসাৎ প্রভৃতি সকল অপকর্মই দুর্নীতি। [ড. মোহাম্মদ জাকির হুসাইন, আর্থ-সমাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪ খৃ.) ৪০৮-৪১০।]

সুতরাং সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন বা ব্যক্তি বিশেষের অবৈধ ও অসংগত সুবিধা গ্রহণ এবং নীতি বিরুদ্ধ সকল কাজকেই দুর্নীতি বলা হয়।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দুর্নীতিঃ
মানব সভ্যতায় কবে, কোথায় এবং কার মাধ্যমে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে তা একটি বিচার্য বিষয় এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলার মত কোন দালীলিক প্রমাণ নেই। তবে ধারণা করা হয় যে, দুর্নীতি কোন সাম্প্রতিক বিষয় নয়, যদিও এ মুহূর্তে ব্যাপকতার কারণে বিষয়টি বহুল আলোচিত। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সাধারণ গণ সমর্থনহীন শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের সময় এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মাধ্যমে দুর্নীতি করে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের দুর্নীতির সবচেয়ে বেশি প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই ইংরেজ কোম্পানী তাদের এদেশীয় দোসরদের সাথে দুর্নীতির মাধ্যমে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা এদেশীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে নিজেদের অর্থ যাতে বাড়ে; সে জন্য বিনাশুল্কে ব্যবসা করার জন্য বহু ব্যক্তিকে অসঙ্গতভাবে দস্তক [দস্তক : বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকারকে ‘‘দস্তক’’ বলা হয়। দ্রষ্টব্য: মেসবাহুল হক, পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭), পৃ. ৫।] ব্যবহার করতে দিত।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবার সিরাজ-উদ-দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য সেনাপতি মীর জা‘ফরসহ অসংখ্য নবাব কর্মচারী দুর্নীতির মাধ্যমে ইংরেজদের সাথে হাত মেলায়। অবশ্য ইংরেজরা পূর্ব থেকেই দুর্নীতিতে অভ্যস্থ ছিল। এজন্য তার ‘‘শঠে শঠাং’’ নীতিবাক্য অনুসরণ করে নবাব কর্মচারীদের সাথে জাল চুক্তিনামা করে চরমভাবে প্রতারিত করে। ক্লাইভ ও অন্যান্য ইংরেজ কর্মচারী বাংলার ধনদৌলত লুট করার যে বন্দোবস্ত করল, তা দেখে কারও বুঝতে বাকী রইল না যে কারা প্রকৃত দুর্নীতিবাজ। স্বদেশী ও বিদেশী দুর্নীতিবাজদের দল একত্রিত হয়ে দেশদ্রোহিতা ও চারিত্রিক অধঃপতনের যে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল তাতে বিশ্ববাসী বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল। [প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।] দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে মসনদ থেকে হটানোর পর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি ও লুটপাট শুরু হয়ে যায়। মীর জা‘ফরকে মসনদে বসিয়ে ক্লাইভ পুরস্কার পেলেন ২,৩৪,০০০ পাউন্ড। কোম্পানীর কর্মচারীরা প্রত্যেকে লাভ করল পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড। ক্লাইভ দলীল দস্তাবেজ জাল করে এমন ব্যবস্থা করল যে,ষড়যন্ত্রকারী উমিচাঁদের ভাগ্যে কিছুই জুটল না। ৮৮০ মাইল এলাকা জুড়ে চবিবশ পরগণার জমিদারী কোম্পানীর হাতে চলে গেল। বছরে এখান থেকে মোটামোটি দেড় লক্ষ পাউন্ড খাজনা আদায় হত। এ চবিবশ পরগণা পরে ক্লাইভকে জায়গীর হিসাবে প্রদান করা হয়। কোষাগার শূন্য হয়ে যাওয়ায় নবাব ক্লাইভকে অনুনয় করে এ শর্তে রাযী করান যে, ক্লাইভ মুর্শিদাবাদের ভুমি রাজস্ব থেকে সাড়ে বার লক্ষ পাবেন। সাড়ে দশ লক্ষ পাবেন বর্ধমান, কৃষ্ণনগর আর হুগলী থেকে; তারপরও বছরে ঊনিশ লক্ষ টাকার জন্য ঐ তিনটি জেলা বন্ধক থাকবে। কেউ কেউ বলেন, কোম্পানী চাকরীজীবীদের বেতন অল্প হওয়ায় তারা উপঢৌকন গ্রহণে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। বলা যায়, পলাশীর পর অর্থ লাভের ব্যপারে মাত্রা জ্ঞান আর কারো রইল না।কামধনুকে দোহন করার জন্য উন্মত্ত আবেগ তখন কর্মচারীদের পেয়ে বসেছিল। কোম্পানীর কর্মচারীদের মধ্যে তখন নিজেদের স্বার্থ যথাসম্ভব দ্রুত বিপুল সমৃদ্ধি সংগ্রহের কামনা উদগ্র হয়ে উঠেছিল। [প্রাগুক্ত, পৃ.১১৪০; সম্পাদনা, অধ্যপক আব্দুল গফুর, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭ খৃ.), পৃ. ১৪-১৯।]

পরবর্তীতে যারাই ইংরেজদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে, যার কর্মকান্ড ইংরেজ স্বার্থে আঘাত লেগেছে; তাকেই ইংরেজরা হয় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে অথবা শঠতা, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেছে অথবা তাকে দীপান্তর বা নির্বাসনে পাঠিয়েছে। ইংরেজদের দুশো বছরের এ দুঃশাসন অবসানে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটলে, দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রবন্ধ হয়নি বরং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে দুর্নীতি শুরু হয়ে যায়। বেসরকারী পর্যায়ে এ সময় কোটি কোটি টাকার সম্পদ পাচার হয়ে যায়, এ সময় উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা, কর্মচারী সরকারী অর্থ আত্মসাতের দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় আজও এদেশের অধিকাংশ উন্নায়ন প্রকল্পে পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত ব্যাপক দুর্নীতি ঘটছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলন পাকিস্তনী শাসকদের অনমনীয় মনোভাব ও অত্যাচারের কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় এবং অবশেষে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরূদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদ। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দুর্নীতি নির্মূল না হয়ে বরং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। [প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬০-২৬৪ ও ২৭৭-২৭৯।]

বাংলাদেশে দুর্নীতিঃ
বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবন যাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এ জঘন্য ব্যাধির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বর্তমান সমাজে দুর্নীতির অবস্থান এতই শক্তিশালী যে দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে তাদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। গত ৩২ বছরে বাংলাদেশ পর পর তিনবার দুর্নীতির জন্য বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। transparencey International এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ এ পাঁচ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। [ড. মোহাম্মদ জাকির হুসাইন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, প্রাগুক্ত, ৪১১।] বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে দুর্নীতি এত বিস্তার লাভ করেছে যে, এদেশের যা কিছু ভাল অর্জন যথা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, জামানত ছাড়াই উন্নয়নমূলক ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী, ডায়রিয়া প্রতিরোধী ওরস্যালাইনের আবিষ্কার, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, নারী শিক্ষা ও রপ্তানীমুখী তৈরী পোশাক শিল্পের প্রসার ইত্যাদিকেই ম্লান করে দিয়েছে। দুর্নীতি এখন শুধু কোন এক সেক্টরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল সত্মরে দুর্নীতি মাকড়সার জালের মত বিস্তার লাভ করেছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুর্নীতির চিত্র সংক্ষেপে উপস্থাপিত হলো:

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেঃ
রাজনৈতিক দল দেশের মূল চালিকাশক্তি অথচ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে। যেমন জনগণের সাথে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বরখেলাফ, ক্ষমতায় থাকলে নিজ পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সুয়োগ-সুবিধা অন্যায়ভাবে নিজের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও নিজ দলীয় কর্মী সমর্থকদের স্বার্থে কাজে লাগোনো, তাদেরকে নির্মাণ কাজের ঠিকাদারী বা হাটবাজার ইজারা প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স দেয়া, ব্যবসায়ী মহলসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার নিকট থেকে কমিশন গ্রহণ ও চাঁদা আদায় এবং বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন অন্যায় সুবিধা প্রদান, সরকারী অর্থের অপচয় ও আত্মসাৎসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে এদেশে স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। [প্রাগুক্ত।]

প্রশাসনিক ক্ষেত্রেঃ
বর্তমানে বাংলাদেশ কোন সরকারী দপ্তর বা বিভাগ দুর্নীতি মুক্ত নয়। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ সরকারী অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকারী সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদি প্রশাসনে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। [দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ জুন, ২০০৮খৃ., ৫২ মতিঝিল বানিজ্যক এলাকা, ঢাকা-১০০০।]

শিক্ষা ক্ষেত্রে:
পরীক্ষায় নকল প্রবণতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানে চরম অবনতি ঘটছে। এজন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে উঠছে না। [ড. মোহাম্মদ জাকির হুসাইন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, প্রাগুক্ত, ৪১১।]

ধর্মীয় ক্ষেত্রে:
ধর্মকে কেন্দ্র করে এদেশে নানা ধরনের দুর্নীতি চলছে। জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা, স্বার্থসিদ্ধি, অর্থ-উপার্জন ও জনস্বার্থ বিরোধী সকল কাজ ধর্মীয় দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত।

১০
বেসরকারী খাতে দুর্নীতি:
শুধু সরকারী নয় বরং বেসকারী ক্ষেত্রেও দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারী সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাস-ব্যসন বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশী ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না করা, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া, শেয়ার মার্কেট কেলেংকারী ও ঋণ খেলাফী ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। [প্রাগুক্ত,পৃ. ৪১১।]

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০০৮ সালের ১৮ জুন প্রকাশিত রিপোর্টে বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০০৭ সালের জুন পর্যন্ত সময়কালে সার্বিকভাবে দেশের ৬৬.৭ শতাংশ পরিবার সেবা গ্রহণ করার সময় কোন না কোন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৪২.১ শতাংশ পরিবারকে ঘুষ দিতে হয়েছে। সেবা গ্রহীতারা বিভিন্ন খাতে গড়ে ৪১৩৪ টাকা ঘুষ দিয়েছে। এই ঘুষের পরিমাণ তাদের মাথা পিছু আয়ের ৩.৮৪ শতাংশ। জাতীয়ভাবে প্রদত্ত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ৫৪৭৪ কোটি টাকা।

এসব ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িত রয়েছেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় ও সরকারের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারী প্রায় সকলেই। উক্ত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সার্বিক ভাবে ঘুষ নিয়েছে ৮৭৯ কোটি টাকা। গবেষণার ঘুষ গ্রহণসহ দায়িত্ব পালনে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, আত্মসাৎ, প্রতারণা এবং ভীতি প্রদর্শন করাকেও দুর্নীতি হিসেবে ধরা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ভূমি প্রশাসনে ঘুষ দিতে হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর পরিমাণ ১৬০৬ কোটি টাকা। অন্য শীর্ষ স্থানীয় দুর্নীতিগ্রস্থ সেবা খাতগুলো হলো বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে, স্বাস্হ্য, শিক্ষা,বিদ্যুত, ব্যাংকিং, এনজিও এবং কর খাত। অন্যান্য সংস্থায় দুর্নীতি বলতে ওয়াসা, গ্যাস এবং তার ও টেলিফোন বোর্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। [দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ জুন, ২০০৮খৃ. আষাঢ় ১৪১৫, পৃ. ১ও২।] ২০০৮ সালের ১৮ই জুন transparency International বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুর্নীতির যে খতিয়ান উপস্থাপন করেছে। তাতে বাংলাদেশের দুর্নীতির করাল গ্রাসের বাস্তব প্রমাণ মেলে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেবা খাতের দুর্নীতির করাল গ্রাসের বাস্তব প্রমান মেলে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেবা খাতের দুর্নীতি সারণীর মাধ্যমে নিম্নে প্রদত্ত হলো। [প্রাগুক্ত।]

খাতের নাম - সেবা গ্রহণকালে দুর্নীতির শিকার - সেবা গ্রহণকালে ঘুষের শিকার - সেবা গ্রহণকালে প্রদানকৃত গড় ঘুষের পরিমাণ (টাকা) - জাতীয়ভাবে মোট ঘুষের পরিমাণ (কোটি টাকায়)

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা - ৯৬.৬- ৬৪.৫- ৩,৯৪০ - ৮৭৯

স্থানীয় সরকার - ৫৩.৪- ৩২.৫- ৮৮৩- ১৮৭

ভূমি প্রশাসন - ৫২.৭ - ৫১.১ - ৪,৪০৯ - ১,৬০৬

বিচার - ৪৭.৭ - ৪১.৭ - ৪,৮২৫ – ৬৭১

স্বাস্থ্য - ৪৪.১ - ১৬.৩ – ৫২০ – ১০৮

শিক্ষা - ৩৯.২ - ৮.৮ - ১,২৯৬ - ১১৭

বিদ্যুত - ৩৩.২ - ১৪.৩ - ১,৯৯৩ - ৪৭৪

ব্যাংকিং- ২৮.৭- ১৫.৭- ৭,৭৯৫ - ৫২৫

এনজিও - ১৩.৫- ৬.৫ – ৪২১ - ২০

কর - ৬.৪ - ৫.১ - ২,২৯৩ - ১৪৯

অন্যান্য - ৩১.৩ - ১৬.৬ - ৭,৫৭৮- ৭০৮

১১
দুর্নীতির কারণঃ এক. রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা:
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের তীব্র আকাঙ্খা দুর্নীতি বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য নির্বাচনে বিপুল পরিমাল অর্থ অবৈধভাবে ব্যয়ের মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় উঠাতে থাকে। এছাড়া ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতিবাজরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতি করে থাকে। [শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির, ‘দুর্নীতি : এর নানারূপ, কারণ ও প্রতিকার, মাসিক পৃথিবী, বর্ষ-২৭, সংখ্যা-২ (ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ডিসেম্বর-২০০৭ খৃ), পৃ. ৩৩; আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, পৃ. ৪১১-৪১২।]

১২
দুই. উচ্চাভিলাষী জীবনের মোহ:
রাতারাতি আর্থ-সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠালাভের তীব্র আকাঙ্খা দুর্নীতি বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ। স্বল্প সময়ে অধিক সম্পদ লাভের প্রচেষ্টায় সমাজের উচ্চ শ্রেণী স্ব-স্ব ক্ষমতা ও পেশাগত পদবীর মাধ্যমে দুর্নীতি করে থাকে। [শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির, দুর্নীতি : এর নানারূপ কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩-৩৪।]

১৩
তিন. ঐতিহাসিক কারণঃ
উপনিবেশিক শাসনামলে বিদেশী শাসক-শোষকদের স্বার্থরক্ষার জন্য এদেশে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আমলা ও মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি করা হয়েছিল; যারা দুর্নীতি, প্রতারণা ও বঞ্চনার মাধ্যমে জনগণকে শোষন করত। বৃটিশ শাসনামলেও সে ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের নব্য ব্যবসায়ীরা প্রচুর মুনাফার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। ফলে প্রশাসনিক কাঠামোতে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে দুর্নীতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দুর্নীতির সে ধারা আরও ব্যাপকভাবে বিসত্মার লাভ করে। [মেসবাহুল হক, পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭), পৃ. ৫।]

১৪
চার. ধর্মীয় শিক্ষার অভাবঃ
ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে দুর্নীতি থেকে বিমুক্ত রাখতে পারে। দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। এজন্য বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষার অনুপস্থিতিই দুর্নীতি বিস্তারের বিশেষ কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। [শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির, সম্পদনা পরিষদ, হাদীস ও সামাজিক বিজ্ঞান(ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪), পৃ. ২৫১।]

১৫
পাঁচ. আর্থিক অসচ্ছলতাঃ
আর্থিক অসচ্ছলতা ও নিম্ন জীবন যাত্রার মান দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম বিশেষ কারণ। দারিদ্রের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ সমাজে স্বাভাবিক উপায়ে মৌলক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে অস্বাভাবিক উপায় অবলম্বন করছে। যার ফলে সমাজে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে।

১৬
ছয়. অপর্যাপ্ত বেতন ও পারিশ্রমিকঃ
আমাদের দেশে কর্মজীবী মানুষের বেতন ও পারিশ্রমিক চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপর্যাপ্ত। ফলে তারা বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ বা বিকল্প কোন অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে বাংলাদেশে স্বল্প বেতনভূক্ত কর্মচারীদের মাঝে দুর্নীতি পরায়ণতা সৃষ্টির পিছনে অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামো অনেকাংশে দায়ী। [শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির, ‘দুর্নীতি : এর নানারূপ, কারণ ও প্রতিকার, প্রাগুক্ত পৃ. ৩৩-৩৪।]

১৭
সাত. বেকারত্বঃ
বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য অনেকে অবৈধ উপায়ে এবং ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করে। আবার চাকরি পাওয়ার পর তারাও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ঘুষের লেনদেনে জড়িয়ে পড়ে। ফলে দুর্নীতি ক্রমশ বাড়তে থাকে।

১৮
আট. দুর্নীতি দমনে সদিচ্ছার অভাবঃ
দুনীতি অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন, সরকারী অর্থ আত্মসাৎ বা ক্ষমতা অপব্যবহারের জন্য চাকরিচ্যুত বা বিচারের সম্মুখীন করার ব্যাপারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি বাজদের সাথে শসক গোষ্ঠীর গোপন আতাত থাকায় দুর্নীতি নির্মূল না হয়ে বরং প্রসার লাভ করছে।

১৯
নয়. অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাঃ
আমাদের সমাজে দেখা যায় যত বেশী অর্থ সে তত প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকারী। সামাজিক মর্যাদা লাভের এই অসম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সমাজে দুর্নীতি বিস্তারে সহায়তা করে থাকে। সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের মাধ্যমে দ্রুত সম্পদশালী হওয়া সম্ভব নয় মনে করে অনেকে দুর্নীতির মাধ্যমে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়ার চেষ্টা করে। [৪১১। ড. মোহাম্মদ জাকির হুসাইন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৮-৪১০।]

২০
দুর্নীতি সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে নীতিবিরুদ্ধ যে কোনো কাজই দুর্নীতি এবং মারাত্মক অপরাধ। দুর্নীতি প্রতিরোধ প্রসংগে ইসলাম দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে। কোন ব্যক্তি হয়ত এ চেতনায় দুর্নীতি করে যে, তার অপরাধের কোন সাক্ষী নেই অথবা তার বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্য প্রদানে সাহস করবে না অথবা কোন ব্যক্তি বা সম্পর্কের মাধ্যমে ও প্রভাবে সে দুর্নীতি অপরাধ হতে অব্যাহতি লাভে সমর্থ হবে। আর যদি শাস্তি হয়েই যায় তবে তা কৃত অপরাধ বা সে যে পরিমাণ দুর্নীতি করেছে,তার চেয়ে কম হবে। [গাজি শামছুর রহমান, ইসলামের দন্ড-বিধি (ঢাকা : ইসলামামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯২ খৃ.) পৃ. ৪৫।] আল্লাহ তা‘আলাকে যে ভয় করে এবং আখিরাতের প্রতি যার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে, সে কখনও দুর্নীতি করতে পারে না। এ বিশ্বাসই তাকে দুর্নীতি হতে ফিরায়ে রাখে। কারণ সে বিশ্বাস করে যে , গাঢ় অন্ধকার বা কোন নিভৃত জায়গা বা প্রকোষ্ঠে বা ক্ষমতা অথবা দাপট দেখিয়ে দুর্নীতি করলেও তা এ পৃথিবীর কোন কিছুই তার দৃষ্টির বাইরে নয়। দুনিয়ার দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষ, পুলিশ বা লোক চক্ষুকে ফাঁকি দিতে পারলেও আল্লাহ তা‘আলার নিযুক্ত বাহিনীকে সে কখনও ফাঁকি দিতে পারবে না। সুতরাং দুনিয়ার শাস্তি হতে রেহাই পেলেও আখেরাতের শাস্তি তার জন্য অবধারিত। শুধু তাই নয়, তার দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে ও প্রতিটি কাজের রেকর্ড রাখা হচ্ছে। তাই দুনিয়ার শাস্তি হতে অব্যাহতি পেলেও পরকালে সে অবশ্যই ধৃত হবে। [প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫-৪৬।] এ বোধ ও ঈমানী চেতনাই মানুষকে দুর্নীতি হতে ফিরিয়ে রাখে। তারপরও যদি সে দুর্নীতি করে তখন ইসলাম দুর্নীতির প্রকৃতি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ঠ সকল বিষয় বিবেচনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করে। এজন্য ইসলাম প্রথমত ব্যক্তির মন-মানসিকতায় এ প্রত্যয় সৃষ্টি করে যে, যত সংগোপনে দুর্নীতি করুক না কেন, আল্লাহ তা‘আলা তা দেখছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ أَمۡ يَحۡسَبُونَ أَنَّا لَا نَسۡمَعُ سِرَّهُمۡ وَنَجۡوَىٰهُمۚ بَلَىٰ وَرُسُلُنَا لَدَيۡهِمۡ يَكۡتُبُونَ ٨٠ ﴾ [ الزخرف : ٨٠ ]

‘‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি, আমার নিয়োজিত ফেরেশতাগণ তো তাদের নিকট থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।’’ [আল-কুরআন, ৪৩:৮০।](সূরা যুখরুফ:৮০)

এ সম্পর্কে আল-কুরআনে আরও বর্ণিত হয়েছে,

﴿ هَٰذَا كِتَٰبُنَا يَنطِقُ عَلَيۡكُم بِٱلۡحَقِّۚ إِنَّا كُنَّا نَسۡتَنسِخُ مَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ٢٩ ﴾ [ الجاثية : ٢٩ ]

‘‘এটা আমার কিতাব, যা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, সত্যতা সহকারে। তোমরা যা করতে তা আমি লিপিবদ্ধ করেছিলাম।’’ [আল-কুরআন, ৪৫: ২৯।](সূরা আল যাছিয়া:২৯)

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী,যারা দুনিয়ায় আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না, আখিরাতের জবাবদিহিতা বিশ্বাস করে না, তারা এ পৃথিবীর জীবন ছাড়া আর কিছুই নেই বলে মনে করে এবং এ বিশ্ব সম্পদ, জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা লাভের উপর ভিত্তি করে জীবনের সফলতা বা বিফলতা নির্ধারণ করে। তারা অনেকাংশে উচ্ছৃংখল পশুর মত জীবন-যাপন করে এবং নীতি নৈতিকতার কোন পরোয়া করে না। তাদের নৈতিক মূল্যবোধ নিজ ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। হীন লক্ষ্য যা অর্জনের জন্য তারা যে কোন ধরনের দুর্নীতি সংঘটনে পিছপা হয় না। এ সকল লোকের দুর্নীতি ও কুকর্মে সমগ্র পৃথিবী অন্যান্যদের জন্যে নরকে পরিণত হয়। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ ظَهَرَ ٱلۡفَسَادُ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ بِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِي ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعۡضَ ٱلَّذِي عَمِلُواْ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٤١ ﴾ [ الروم : ٤١ ]

‘‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়ায়ে পড়ে। যার ফলে তাদের কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করাবেন। যাতে তারা ফিরে আসে। [আল-কুরআন, ৩০:৪১।]( সূরা আর রুম:৪১) ।

যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার পথ থেকে দূরে সরে গেছে এবং পরকালীন জীবনকে বিশ্বাস করে না। সে অন্যান্য দিক দিয়ে বড় হলেও পশুর মত জীবন-যাপন করে। কেননা সে কেবলমাত্র পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ, লোভ-লালসা এবং সুযোগ-সুবিধাকেই প্রাধান্য দেয়। এ হীন মানসিকতাই তাকে নৈতিক মূল্যবোধ পরিত্যাগ করতে বাধ্য করে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَلَقَدۡ ذَرَأۡنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِۖ لَهُمۡ قُلُوبٞ لَّا يَفۡقَهُونَ بِهَا وَلَهُمۡ أَعۡيُنٞ لَّا يُبۡصِرُونَ بِهَا وَلَهُمۡ ءَاذَانٞ لَّا يَسۡمَعُونَ بِهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡغَٰفِلُونَ ١٧٩ ﴾ [ الاعراف : ١٧٩ ]

‘‘আমি বহু জিন ও মানুষের জন্যে জাহান্নাম তৈরী করেছি। তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তদ্বারা তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চক্ষু আছে, তদ্বারা তারা দেখে না। এবং তাদের কর্ণ আছে, তদ্বারা তারা শ্রবণ করে না। এরা পশুর মত বরং তদপেক্ষা আরও পথভ্রষ্ট। এরাই বিপথগামী।’’ [আল-কুরআন, ৭:১৭৯।](সূরা আল আ‘রাফ:১৭৯ )

সুতরাং যে ব্যক্তি তার পরকালীন জীবনে হিসাব দেয়াকে মানে না। ভাল কাজের পুরস্কার এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তির ফায়সালায় বিশ্বাস করে না। তাকে দুর্নীতি ও অশ্লিল কাজ হতে কে রক্ষা করবে? অধঃপতনের অতল গহবরে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। পরিশেষে একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ভয় এবং পরকালে তার নিকট জবাবদিহির অনুভূতিই মানুষকে সকল প্রকার দুর্নীতি হতে রক্ষা করতে পারে।’’ [গাযী শামছুর রহমান, ইসলামের দন্ড-বিধি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।]

সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে দু্র্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন আল্লাহ তা‘আলার ভয় এবং আখিরাতের দৃঢ় চেতনা। কারণ আখিরাতের জবাবদিহিতে যে বিশ্বাস করে, দুর্নীতির সুযোগ থাকলেও সে কখনও এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হবে না।

২১
দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলামঃ
ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজকে অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত রাখতে চায়। এ লক্ষে যুগে যুগে জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, সমাজ-সংস্কারক ও প্রথিতযশা জ্ঞান-তাপসগণ বিভিন্ন পন্থা ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। সে পন্থা ও পদ্ধতির আলোকে গৃহীত হয়েছে নানা ধরনের কর্মনীতি ও কর্মসূচী। পৃথিবীর দেশে দেশে দুর্নীতি দমনের জন্য যে ধরনেরই পদক্ষেপে গৃহীত হউক না কেন দুর্নীতি দমন না হয়ে বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রোগের চিকিৎসার চেয়ে তার প্রতিরোধই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। এ জন্য ইসলাম দুর্নীতি সংঘটনের পূর্বেই তার সুযোগ ও সম্ভাবনাকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায়। এ ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, শিক্ষা -প্রশিক্ষণ ও বাস্তব ভিত্তিক সর্মসূচীর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকে। এরপরও কেউ দুর্নীতি করলে ইসলাম সেক্ষেত্রে কোনরূপ দ্বিধা না করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও করেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে যুগে যুগে ইসলামে অভিজ্ঞ পন্ডিতগণের বস্ত্তনিষ্ঠ গবেষণায় যে সমস্ত পদক্ষেপের পরিচয় পাওয়া যায়। তা নিম্নে উপস্থাপিত হলো:

প্রথমত: প্রতিরোধমূলক

দ্বতীয়ত: শাস্তিমূলক

তৃতীয়ত: বাস্তব পদক্ষেপ

২২
প্রথমত: প্রতিরোধমূলক:
ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য শুমুমাত্র শাস্তির ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং কেউ যেন দুর্নীতি করতে না পারে সেজন্য যুগোপযোগী ও কার্যকরী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। এসম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো

ইবাদাত:

সমাজ থেকে দুর্নীতি দূরীভূত করার জন্য প্রয়োজন সৎ, যোগ্য ও নির্ভীক ব্যক্তি। যারা কোন মানুষের বা শাসনদন্ডের ভয়ে নয় বরং মহান আল্লাহ তা‘আলার ভয় ও ভালাবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যাবতীয় দুর্নীতি প্রতিরোধ করবে। আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের সে লক্ষ্যে গড়ে তোলার জন্য তাদের উপর কতকগুলো মৌলিক ইবাদাত ফরয করেছেন। যেমন, সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাত প্রভৃতি। এ সকল ইবাদাতের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত পক্ষেই আদর্শ মানুষে পরিণত হয়। যেমন, সালাত বা নামাযের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন :

﴿ ۖ إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِۗ ٤٥ ﴾ [ العنكبوت : ٤٥ ]

‘‘নিশ্চয় সালাত বা নামায (মানুষকে) যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে ফিরিয়ে রাখে।’’ [আল-কুরআন, ২৯ :৪৫।]( সূরা আর আনকাবুত:৪৫)

সাওম বা রোযার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [ البقرة : ١٨٣ ]

‘‘তোমাদের উপর সাওম বা রোযা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা খোদাভীরু হতে পার।’’ [আল-কুরআন, ২: ১৮৩।](সূরা আল বাকারাহ: ১৮৩)

আর খোদাভীরু ব্যক্তি অবশ্যই দুর্নীতিমূলক কাজ হতে দূরে থাকবে। কাজেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ‘‘ ইবাদাতের মাধ্যমে দুর্নীতির মত অপকর্ম হতে বিরত থাকার মানসিকতা গড়ে তোলা যায়। মানুষকে দুর্নীতি হতে দূরে রাখার জন্য ইবাদাত পালন এক অমোগ ও অব্যর্থ অস্ত্র।

আখিরাতের চেতনা:

দুনিয়ার জীবনই মানুষের শেষ নয় বরং মৃত্যর পর মানুষকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করতে হবে। সেদিন তাকে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে। মূলত আখিরাতের চেতনা মানুষের জীবনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যে ব্যক্তি আখিরাতে সত্যিকার বিশ্বাস করে সে কখনও দুর্নীতি করতে পারে না। কেননা মানুষ পৃথিবীতে দীর্ঘদিন ভোগ-বিলাসে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকার জন্য দুর্নীতি করে থাকে। এক্ষেত্রে ইসলাম ঘোষণা করেছে, মানুষের দুনিয়ার জীবন হচ্ছে অতি সংক্ষিপ্ত এবং আখিরাতই হচ্ছে অনন্ত জীবন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:

﴿ بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٧ ﴾ [ الاعلا : ١٦، ١٧ ]

‘‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে বেশী প্রধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী’’ [আল-কুরআন, ৮৭: ১৬-১৭।](সূরা আল আ‘লা: ১৬-১৭ )

এ সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন, «الدنيا سجن للمؤمن وجنة للكافر»

‘‘দুনিয়া মুমিনদের জন্য জেলখানা স্বরূপ, আর কাফিরদের জন্য স্বর্গ। [ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ২য় খন্ড (দেওবন্দ : মাতবা‘উ আসাহ-হিল মাতাবে‘আ, তা. বি.), পৃ. ৪০৭।]

এ চেতনা যখন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হবে, তখন সে অবশ্যই দুর্নীতি থেকে বিরত থাকবে।

হালাল হারামের দিক-নির্দেশনা :

দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য জনগণকে হালাল-হারামের দিক নির্দেশনামূলক শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এ জন্য ইসলাম হালাল বা বৈধ বিষয় উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে এবং হারাম উপার্জন বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ فَكُلُواْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَٱشۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ١١٤ ﴾ [ النحل : ١١٤ ]

‘‘আল্লাহ তোমাদের হালাল এবং পবিত্র যা দিয়েছেন তা হতে তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর , যদি তোমরা কেবল তারই ইবাদত কর।’’ [আল-কুরআন, ১৬ : ১১৪।](সূরা আন নাহল:১১৪ )

এ সম্পর্কে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে :

«الرجل يطيل السفر اشعث اغبر يمد يديه إلى السماء ويقول يا رب ومطعمه حرام ومشربه حرام وملبسه حرام وغذى بالحرام فأنى يستجاب لذلك»

‘‘মহানবী (সঃ) বলেন, এক ব্যক্তি দীর্ঘ পথ সফর করল। তার মাথার চুল এলোমেলো, উস্কো-খুস্কো, পদযুগল ধুলা-মলিন। সে তার হাত দু‘টি উপরের দিকে তুলে বার বার দু‘আ করে, আল্লাহ! আল্লাহ! কিন্তু তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিচ্ছদ হারাম, হারাম খাদ্যে সে লালিত-পালিত হয়েছে। এ রূপ ব্যক্তির দু‘আ আল্লাহর কাছে কিভাবে কবুল হতে পারে? [ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ২য় খন্ড (দেওবন্দ : মাতবা‘উ আসাহ-হিল মাতাবে‘আ, তা. বি.), পৃ. ৩২৬।]

নিবর্তনমূলকঃ

সৎকাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। সমাজের কোথাও দুর্নীতিসহ অন্যান্য অপরাধ-অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখলে, তখন প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:

﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [ ال عمران : ١١٠ ]

‘‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, যাদের আবির্ভাব ঘটেছে মানুষের জন্য, তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় ও দুর্নীতিমূলক কাজসমূহ প্রতিরোধ করবে। আর আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনবে।’’ [আল-কুরআন, ৩ : ১১০।](সূরা আলে ইমরান :১১০ )

মহানবী (সঃ) অন্যায় কাজ বন্ধের জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উভয় পন্থা প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে মহানবী (সঃ) বলেন :

«من رأى منكم منكرا فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان»

‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যায় ও দুর্নীতি সংঘটিত হতে দেখলে, সে যেন উহা শক্তি প্রয়োগে প্রতিহত করে। তাতে সক্ষম না হলে সে সদুপদেশ বা কথার মাধ্যমে প্রতিবিধান করবে। তাতেও সক্ষম না হলে সে যেন আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে। আর এটা হলো দুর্বলতম ঈমানের লক্ষণ।’’ [ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০-৫১।]

সংশোধনমূলকঃ

আল্লাহ তা‘আলার হক [হককুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার হক। আল্লাহ ত‘আলার হক বা অধিকার বলতে বুঝায়, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাঁর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষের কর্তব্য হচ্ছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার হুকুম মেনে চলা। এজন্য ঈমান আনয়নের পর নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতি ইবাদাত আদায়ের পাশাপাশি আল্লাহর সাথে শরীক না করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, শোকর করা প্রভৃতি নিষ্ঠার সাথে পালন করা কর্তব্য। দ্রষ্টব্য : মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, নৈতিকতা ও মানসিক মূল্যবোধের ধারণা (ঢাকা : আজিজিয়া বুক ডিপো, ২০০৭ খৃ.), পৃ. ১৫০-১৫৮।] সংক্রান্ত ব্যাপারে অপরাধের জন্য অপরাধী তাওবা করলে তার শাস্তি প্রদান করা ইসলামের নীতি নয়। বরং অপরাধী তাওবা করলে তার শাস্তি প্রদান করা ইসলামের নীতি নয়। বরং অপরাধী যদি তার ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করে এবং খালিস নিয়তে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাওবা করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেন। ফলে সে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। [আব্দুল কাদির ‘আওদাহ’ আত-তাশরী‘উল জানাইল ইসলামী, ১ম খন্ড ১ম ভাগ (বৈরুত : মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ১৯৯৮ খৃ.) পৃ. ৪৮৯-৫০৫। সম্পাদনা পরিষদ, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪ খৃ.), পৃ, ৪৫৭-৪৫৮।]

মানুষের অধিকার বিষয়কঃ

দুর্নীতির মাধ্যমে যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই মানুষের অধিকার বিষয়ক। যেমন, যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান, প্রমোশন প্রদান, সুযোগ-সুবিধা, স্বজনপ্রীতি ও অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। মানুষের অধিকার যথাযথ প্রদানের নির্দেশ দিয়ে আল-কুর‘আনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا ﴾ [ النساء : ٥٨ ]

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার মালিককে প্রত্যার্পন কর।’’ [আল-কুরআন, ৪ : ৫৮।](সূরা আন নিসা: ৫৮)

মহানবী (সঃ) এ সম্পর্কে বলেন,

» فأعط كل ذى حق حقه»

‘‘তোমরা প্রত্যেককে তার প্রাপ্য যথাযথভাবে প্রদান কর।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ১ম খন্ড (দেওবন্দ : মাতবা‘উ আসাহ-হিল মাতাবে‘আ, তা. বি.), পৃ. ২৬৪।]

সম্পদ অর্জনে ইসলামী নীতিঃ

দুর্নীতির কারণ সম্পর্কে গবেষণায় দেখা গেছে, সম্পদের মোহ এবং উচ্চাভিলাষী জীবন-যাপনই দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষ মৃত্যুর কথা এবং আখিরাতকে ভুলে দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এজন্য আল-কুরআনে বারবার মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে বলা হয়েছে,

﴿ كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ ﴾ [ ال عمران : ١٨٥ ]

‘‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’’ [আল-কুরআন, ৩ : ১৮৫।](সূরা আলে ইমরান: ১৮৫ )

মহানবী (সঃ) এ সম্পর্কে বলেন

«ازهد في الدنيا يحبك الله وازهد ما في أيدى الناس يحبوك»

‘‘পার্থিব ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর লোকের কাছে যা আছে তার লালসা পরিত্যাগ কর। তাহলে অন্যরা তোমাকে ভালবাসবেন।’’ [ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ’ ১৯৯৮ খৃ.), পৃ. ৪৬৩।]

উপদেশমূলক :

সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানুষকে সদুপদেশ প্রদান ও সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ﴾ [ النحل : ١٢٥ ]

‘‘তোমরা তোমাদের প্রভুর পথে প্রজ্ঞার সাথে এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর। আর উৎকৃষ্ট যুক্তি প্রয়োগে তাদের মোকাবিলা কর।’’ [আল-কুরআন, ১৬ : ১২৫।](সূরা আন নাহল: ১২৫)

আল্লাহর পথে ব্যয়ে উৎসাহঃ

সম্পদের মোহ মানুষের স্বভাবজাত। এ মোহ সীমা অতিক্রম করলে অন্তর কলুষিত হয়ে পড়ে। ফলে সে অবৈধ সম্পদ অর্জনে ঝুঁকে পড়ে। অন্যদিকে আল্লাহর পথে ব্যয় করার প্রবণতা অর্থের মোহ দূরীভূত হয়ে আখিরাত কেন্দ্রীক জীবন-চেতনা বৃদ্ধি পায়। ফলে অবৈধ সম্পদের লিপ্সা দূরীভূত হয়ে দুর্নীতির মোহ কেটে যায়। এজন্য আল-কুরআন ও হাদীসে আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ ٣٥ ﴾ [ التوبة : ٣٣، ٣٥ ]

‘‘যারা সোনা-রূপা জমা করে এবং আল্লাহর রাস্তায় তা খরচ করে না, তাদের আপনি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। সেদিন ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। তোমরা যা কিছু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এ গুলো তো সেসব ধন-সম্পদ। সুতরাং তোমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে এখন তার স্বাদ গ্রহণ কর।’’ [আল-কুরআন, ৯ : ৩৪-৩৫।](সূরা আত তাওবা:৩৩-৩৪)

বিত্তহীনদের মর্যাদা দানঃ

মানুষ দ্রুত বিত্তের অধিকারী হওয়ার জন্য সাধারণত দুর্নীতি করে থাকে। কিন্তু মহানবী (সঃ) বিত্তশালীর চেয়ে বিত্তহীনের বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। যেমন তিনি (সা.) বলেন,

«إن الفقراء المؤمنين يدخلون الجنة قبل أغنياءهم بنصف يوم خمس مائة عام»

‘‘বিত্তহীনেরা বিত্তশালীদের চেয়ে পাঁচশত বছর পূর্বে বেহেশতে প্রবেশ করবে।’’ [ইবন মাজাহ, আস-সুনান, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৪৭৬।]

ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদার মাপকাঠি অর্থবিত্ত নয় বরং ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে যে যতবেশী তাকওয়া সম্পন্ন বা খোদাভীরু, সে ততবেশী মর্যাদাবান। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿اْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ ﴾ [ الحجرات : ١٣ ]

নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত যে অধিক তাকওয়ার অধিকারী।’’ [আল-কুরআন, ৪৯ : ১৩।]( সূরা আল হুজরাত:১৩)

২৩
দ্বিতীয়ত : শাস্তিমূলকঃ
ইসলাম সমাজ থেকে দুর্নীতি চিরতরে উচ্ছেদ করতে চায়। এ জন্য ইসলাম শুধুমাত্র উপদেশ, সতর্কবাণী ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা করেই তার দায়িত্ব শেষ করে নি। বরং কোন ব্যক্তি যদি এ সকল ব্যবস্থার পরও দুর্নীতি করে, তাহলে তার জন্য ইসলাম শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। দুর্নীতির শাস্তি তা‘যীর [তা‘যীর আরবী শব্দ। এর অভিধানিক অর্থ তিরস্কার করা, শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া, নিবৃত্ত করা, উপদেশ দেয়া, সংশোধন করা, শৃংখলা বিধান করা, সাহায্য-সহযোগিতা করা ইত্যাদি। শরী‘আতের পরিভাষায়-এর অর্থ যে সব অপরাধের ক্ষেত্রে হদ্দ ও কাফফারার বিধান নেই, সে অপরাধের কারণে শাস্তি দেয়া। কেউ কেউ বলেন, যেসব অপরাধের কোন সুনির্দিষ্ট শাস্তি বা কাফফারার বিধান ব্যবস্থা ইসলামী শরী‘আতে নেই, সেসব অপরাধের জন্য বিচারক স্বীয় সুবিবেচনার দ্বারা অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থাকেই তা‘যীর বলা হয়। যেমন, মিথ্যা সাক্ষ্য দান, ঘুষ গ্রহণ, সুদী কারবার করা, আমানতে খিয়ানত করা, অপরাধীদের আত্মগোপনে সাহায্য করা, যিনা ছাড়া অন্য কোন অপরাধ মিথ্যামিথ্যি কারও উপর আরোপ করা এবং নামায রোযা, যাকাত, প্রভৃতি ফরয কাজ ত্যাগ করা ইত্যাদি। দ্রষ্টব্য : আত-তাশরী‘উল জানাইল ইসলামী, ১ম খন্ড, ১ম ভাগ, পৃ. ৬৮৫-৬৮৬; ড. আহমদ ফাতহী ভ্যনসী, আল-উকুবাতু ফীল ফিকাহিল ইসলামী ( বৈরুত : দারুস শুরুক, ১৯৮৩ খৃ.), পৃ. ১২৯; ‘আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন হাবীব আল-বাগদাদী আল-মাওরিদী, আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ‘ইসলামীয়্যাহ, ১৯৮৫ খৃ.), ২৯৩; ইবন কুদামাহ, আল-মুগনী. ৫ম খন্ড ( বৈরম্নত : দারুল ফিকর, ১৯৯৭ খৃ.) পৃ. ৩৪২-৩৪৩ ইসলামের দন্ডবিধি, পৃ. ২৩৪-২৪৪।] পর্যায়ে অপরাধ অর্থাৎ বিচারক তাকে অপরাধের মাত্রা ও প্রকৃতি অনুযায়ী আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে হদ্দের শা [হদ্দ : হদ্দ এর বহুবচন হুদূদ। এর শাব্দিক অর্থ, প্রতিরোধ, বাধাদান, চৌহদ্দী, দু‘টি বিষয় বা বস্ত্তর মধ্যকার প্রতিবন্ধক, যা একটিকে অপরটি হতে পৃথক করে। শরী‘আতের পরিভাষায় আল্লাহর অধিকার লংঘনের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে অথবা তার রসূলের পক্ষ যে শাস্তি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তাকে হদ্দ বলে। ইসলামী শরী‘আতের হদ্দের প্রকার নিম্নরূপ : ১. চুরি, ২. ডাকাতি, ৩. ব্যবিচার, ৪. ব্যভিচারের অপবাদ। এ চারটির শাস্তি আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। ৫. মাদক গ্রহণ। এটি সাহাবায়ে কেরামের ইজমা‘ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে কোন কোন ফিকহ বিশারদ হদ্দের আওতাভুক্ত অপরাধ হিসাবে আলোচনা করেছেন এবং কেউ কেউ স্বতন্ত্র ভাবে আলোচনা করেছেন। অতএব বলা যায়, উক্ত ছয়টি বিষয় হদ্দের আওতাভুক্ত অপরাধ। দ্রষ্টব্য: আল‘কুবাতু ফীল ফিকহিল ইসলামী, পৃ. ১২৩-১২৪; ‘আব্দুর রহমান আল-জাযায়িরী, কিতাবুল ফিকহি আলা মাযাহিবিল আরবা‘আ, ৫ম খ-, ( বৈরুত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, তা. বি.), পৃ. ১১-১২; দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃ. ৪৫৮-৪৫৯; সম্পাদনা বোর্ড, গাযী শামছুর রহমান, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ১ম খন্ড, ১ম ভাগ, ( ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯৫ খৃ.), পৃ. ২৪২; সম্পদনা পরিষদ, ফাতাওয়া ও মাসাইল, ৫ম খন্ড, (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০১ খৃ. ), পৃ. ১৬৬-১৬৭।]স্তি ব্যতিরেকে, দলীয়করণ, মিথ্যাচার, স্বজনপ্রীতি, সরকারী অর্থ আত্মসাৎ, প্রশাসনিক মিথ্যা সাক্ষ্য, হয়রানী করা, কাজে ফাঁকি দেওয়া ও ঘুষ গ্রহণ ইত্যাদি। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

ক. অর্থ আত্মসাৎঃ

রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ অনেক সময় সরকারী ও বেসরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে থাকেন। ইসলাম অবৈধভাবে যে কোন প্রকার অর্থ আত্মসাৎকে হারাম ঘোষণা করেছে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ ﴾ [ النساء : ٢٩ ]

‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ কর না।’’ [আল-কুরআন, ৪ : ২৯।](সূরা আন নিসা: ২৯)

এ সম্পর্কে মহনবী (সাঃ) বলেন-

«من أخذ من الأرض شيئا بغير حقه خسف به يوم القيامة إلى سبع أرصين»

‘‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে অন্যের জমির কিয়দাংশ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সপ্ত জমির নীচে ঢুকিয়ে দেয়া হবে’’। [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৩২।]

এ ছাড়া এটা তা‘যীর পর্যায়ের অপরাধ। এর জন্য তা‘যীরের শাস্তি প্রযোজ্য হবে। কেউ কেউ বলেন, আত্মসাৎ ইসলামী শরী‘আতে চুরির হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রে কেউ যদি অন্যায়ভাবে আত্মসাতে লিপ্ত হয়, তবে চুরির আইন অনুযায়ী তার হাতকাটা হতে পারে। চুরির শাস্তি সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ وَٱلسَّارِقُ وَٱلسَّارِقَةُ فَٱقۡطَعُوٓاْ أَيۡدِيَهُمَا جَزَآءَۢ بِمَا كَسَبَا نَكَٰلٗا مِّنَ ٱللَّهِۗ ٣٨ [ المائ‍دة : ٣٨ ]

চোর পুরুষ হোক অথবা নারী হোক উভয়ের হাত কেটে দাও। এটা তাদের কৃতকর্মের ফল।’’ [আল-কুরআন, ৫ : ৩৮।](সূরা আল মায়িদাহ: ৩৮ )

খ. দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতিঃ

চাকুরি, টেন্ডার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ইত্যদি সততা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নয় বরং দলের কর্মী বা নেতার আত্মীয় হওয়ার সুবাদে প্রদান, ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। এ সমস্ত চাকুরি, টেন্ডার, ডিলার, পারমিট, লাইসেন্স, ও এল, সি প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের নিকট আমানত। ইসলাম এ সমস্ত আমানত তার যোগ্য প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا ﴾ [ النساء : ٥٨ ]

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার যথার্থ মালিককে প্রত্যার্পণ কর।’’ [আল-কুরআন, ৪: ৫৮।]( সূরা আন নিসা: ৫৮)

মহানবী (সঃ) বলেন:

« كلكم راع وكلكم مسؤل عن رعيته»

‘‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ. ১০৫৭; ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ. ১২২।] এটা তা‘যীর পর্যায়ের অপরাধ। বিচারক এজন্য তা‘যীরের আওতায় শাস্তি প্রদান করতে পারেন। [ইসলামের দন্ডবিধি, পৃ. ২৩৪-২৪।]

গ. মিথ্যাচার :

মিথ্যাচার সকল যুগ ও ধর্মেই অপরাধ ও দুর্নীতি হিসাবে বিবেচিত এবং এটি বহু দুর্নীতির উৎস হিসাবে স্বীকৃত। মিথ্যাচার পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করে থাকে। এ জন্য ইসলামে মিথ্যাচার কবীরা গুনাহ ও মহা পাপের অন্তর্ভুক্ত। [আফীফ আব্দুল ফাত্তাহ তাব্বারা, ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ (আল-খাতায়ু ফী নযরিল ইসলাম) (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪ খৃ.) পৃ. ১৭২-১৭৩।] এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ وَٱجۡتَنِبُواْ قَوۡلَ ٱلزُّورِ ٣٠ ﴾ [ الحج : ٣٠ ]

‘‘ সুতরাং তোমরা মূর্তি পূজার অপবিত্রতা বর্জন কর এবং মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক।’’ [আল-কুরআন, ২২ : ৩০।](সূরা আল হজ্ব: ৩০)

আল্লাহ তা‘আলার খাঁটি বান্দাহ হওয়ার জন্য মিথ্যা কথা বর্জন করা অত্যাবশ্যক। এছাড়া এটি তা‘যীর পর্যায়ের অপরাধ। ইসলামে মিথ্যাচার মুনাফিকের নিদর্শন বলে বর্ণিত হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (স.)বলেন

«آية المنافق ثلاث إذا حدث كذب»

‘‘মুনাফিকীর লক্ষণ তিনটি। এর মধ্যে একটি হলো, যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৯; ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৬; ইামাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ২য় খণ্ড ( দেওবন্দ : মাতবাউ‘ আসাহলিল মাতাবে‘আ, তা. বি.) পৃ. ৬৮১।] আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ فِي ٱلدَّرۡكِ ٱلۡأَسۡفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ ﴾ [ النساء : ١٤٥ ]

‘‘মুনাফিকদের স্থান হবে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে।’’ [আল-কুরআন, ৪ : ১৫।](সূরা আন নিসা: ১৫)

ঘ. সরকারী অর্থ অপচয় ও অপব্যয় :

ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থ অপব্যয় ও অপচয় করা নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, এম.পি. সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ সরকারি অর্থের আপচয় ও অপব্যয় করে থাকেন। ইসলামে এ ধরনের অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন,

إن كره لكم ثلاثا قيل واضاعة المال وكثرة السؤال» «

‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্যে তিনটি জিনিস অপছন্দ করেছেন। ১. অনর্থক ও বাজে কথা বলা ২. সম্পদ অপচয় ও অপব্যয় করা ৩. অত্যাধিক প্রশ্ন করা।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ২০০।]

ঙ. ওয়াদা খেলাফ করাঃ

ইসলামের দৃষ্টিতে ওয়াদা খেলাফ করা মারাত্মক অপরাধ। সাধারণত রাজনীতি বিদগণ ভোট পাওয়ার জন্য এবং সরকারি কর্মকর্তাগণ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন ওয়াদা করে থাকেন, কিন্তু পরবর্তীতে তারা সেসব ওয়াদার কথা ভুলে যান। ইসলাম ওয়াদা ভঙ্গ করাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছে। ওয়াদা পালন সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَوۡفُواْ بِٱلۡعُقُودِۚ ﴾ [ المائ‍دة : ١ ]

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ওয়াদা পূর্ণ কর।’’ [আল-কুরআন, ৫ : ১।](সূরা আল মায়িদাহ: ১)

মহানবী (স.) বলেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি। ১. যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে ২. যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে এবং ৩. তার নিকট যখন আমানত রাখা হয়, সে তার খেয়ানত করে। [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২।]

চ. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়াঃ

ডাক্তারগণ বিভিন্ন সময় আসামী বা বাদীর মেডিক্যাল রিপোর্ট লিখতে মিথ্যার আশ্রয় নেন, পুলিশ অফিসাররা কেসের চার্জশীট প্রদানে মিথ্যার আশ্রয় রের। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মূলত মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হয় যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বা হারাম।

এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন,

«أكبر الكبائر ثلاثة الإشراك بالله وعقوق الوالدين وشهادة الزور»

‘‘মহাপাপসমূহের মধ্যে অতি জঘন্যতম হলো, আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতা মাতার সাথে দুর্ব্যবহার এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬২।]

ছ. কর্মে ফাঁকি দেয়াঃ

ইসলামী নীতি অনুযায়ী কর্মচারী বা শ্রমিকের পক্ষে চুক্তিবদ্ধ কাজে কোন প্রকার ফাঁকি না দিয়ে পূর্ণ সামর্থ অনুযায়ী কাজ করা উচিত। পূর্ণ মজুরী বা বেতন নিয়ে কাজ কম করলে তা অবৈধ হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَيۡلٞ لِّلۡمُطَفِّفِينَ ١ ٱلَّذِينَ إِذَا ٱكۡتَالُواْ عَلَى ٱلنَّاسِ يَسۡتَوۡفُونَ ٢ وَإِذَا كَالُوهُمۡ أَو وَّزَنُوهُمۡ يُخۡسِرُونَ ٣ ﴾ [ المطففين : ١، ٣ ]

‘‘তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি দেওয়া হবে যারা মাপে কম বেশী করে, নিজের হক দেওয়ার সময় পুরোপুরি আদায় করে কিন্তু অন্যকে দিতে গেলেই কম দেয়।’’ [সূরাহ আল-মুতাফ্ফিফীন : ১-৩।]( সূরা মুতাফফিফীন: ১-৩ )

জ.মজুদদারীঃ

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মজুদদারী মারাত্মক অপরাধ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আটকিয়ে রেখে অস্বাভাবিকভাবে মুনাফা হাসিল করাকে ইহতিকার বা মজুদদারী বলা হয়। মজুদ্দারীর ফলে সমাজে দুর্ভিক্ষ ও অনাচার দেখা দেয়। এ জন্য ইসলাম মজুদ্দারীকে চিরতরে হারাম ঘোষণা করেছে এবং মজুদদার ব্যক্তিকে একজন অভিশপ্ত ও পাপী বলে উল্লেখ করেছে। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী’’। [; ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ. ৩১; ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, ১ম খ-, ( দেওবন্দ : মাতবাউ‘ আসাহলিল মাতাবে‘আ, তা. বি.) পৃ. ১৫২; দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃ. ৫১৩-৫১৬।]

ঝ. ঘুষঃ

ঘুষ হচ্ছে স্বাভাবিক ও বৈধ উপায়ে যা কিছু পাওয়া যায় তার পরও অবৈধ পন্থায় অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা। কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার উপর দায়িত্বপালনের জন্য নিয়মিত বেতন/ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি রাড়তি কিছু অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করে তাহলে তা ঘুষ হিসাবে বিবেচিত। অনেক সময় স্বীয় অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঘুষ দেয়া হয়। আবার অনেক সময় টাকা-পয়সা ছাড়াও উপহারের নামে নানা সমগ্রী প্রদান করা হয়। সুতরাং যেভাবেই হোক, আর যে নামেই হোক তা ঘুষের অমত্মর্ভুক্ত। ইসলামে ঘুষ সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেন,

«لعنة الله على الراشى والمرتشي»

‘‘ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহিতা উভয়ের উপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত’’। [প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১৬; হাদীস ও সামাজিক বিজ্ঞান, পৃ. ২২১-২২২।]

ঞ.সন্ত্রাসঃ

সন্ত্রাস বিবেকহীন মানুয়ের অস্বাভাবিক ও পাশবিক আচরণেরই ফল। ইসলাম সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীকে মোটেই পছন্দ করে না। ইসলাম সন্ত্রাসকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এর জন্য কঠিন শাসিত্মর নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ إِنَّمَا جَزَٰٓؤُاْ ٱلَّذِينَ يُحَارِبُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَسۡعَوۡنَ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوٓاْ أَوۡ يُصَلَّبُوٓاْ أَوۡ تُقَطَّعَ أَيۡدِيهِمۡ وَأَرۡجُلُهُم مِّنۡ خِلَٰفٍ أَوۡ يُنفَوۡاْ مِنَ ٱلۡأَرۡضِۚ ذَٰلِكَ لَهُمۡ خِزۡيٞ فِي ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ ٣٣ ﴾ [ المائ‍دة : ٣٣ ]

‘‘যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরম্নদ্ধে লড়াই করে এবং পৃথিরীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাসিত্ম এই যে, তাদেরকে হত্যা করা অথবা শুলবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত বা পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে কিংবা তাদেরকে নির্বাসিত করা হবে। এটি হলো তাদের কৃতকর্মের শাসিত্ম।’’ [আল-কুরআন, ৫ : ৩৩।]( সূরা আল মায়িদাহ: ৩৩)

২৪
তৃতীয়তঃ বাস্তব পদক্ষেপ
আধুনিক যুগ ও অবস্থার আলোকে আরও কতিপয় দিককে দুর্নীতি প্রতিরোধের বাসত্মব অবস্থা হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে শর্ত হলো সেগুলো অবশ্যই আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে অনুমোদিত হতে হবে। নিমেণ এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

বাজেয়াপ্তকরণঃ

স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি প্রয়োজনে বাজেয়াপ্ত বা মালিকানা নিষিদ্ধ করে দুর্নীতির প্রবণতা দূর করা যেতে পারে।

ইসলামী সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনঃ

ইসলামী সমাজ ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব সমগ্র মুসলিম উম্মাহর উপর অর্পিত হলেও আলস্নাহ তা‘আলা এ দায়িত্ব পালনের জন্য এমন সহজ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন; যাতে মুসলিম উম্মাহ সর্বকালের জন্য কর্তব্য সচেতন থাকতে পারে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

﴿ وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ ﴾ [ ال عمران : ١٠٤ ]

‘‘তোমাদের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় থাকা আবশ্যক, যারা কল্যাণের পথে আহবান জানাবে, অসৎ ও অপরাধমূলক কাজে প্রতিরোধ করবে এবং তারাই হচ্ছে সফলকাম।’’ [আল-কুরআন, ৪ :১০৪।](সূরা আলে ইমরান: ১০৪)

অর্থাৎ সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য প্রয়োজন, এমন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা, যারা সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার জন্য হবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ মূলনীতির আলোকে মহানবী (সা.) মদীনায় ইসলামী সমাজ কায়েম করেছিলেন এবং তার ওফাতের পর খুলাফায়ে রাশিদুন তারই পদাংক অনুস্বরণের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে সমাজ থেকে যাবতীয় দুর্নীতি দূর করার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। [আব্দুল কাদির ‘আওদাহ, আত-তাশরী‘উল জানাইল ইসলামী, ১ম খন্ড, প্রগুক্ত, পৃ. ১৮৯-৫০৫।]

ব্যাপক প্রচারণাঃ

দেশের সকল প্রচার মাধ্যম জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য রেডিও, টেলিভিশনসহ পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যদি জনগণকে দুর্নীতির কুফল ও তার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা যায়, তাহলে তা দুর্নীতি প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।

উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদানঃ

প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প বেতনের কারণে মানুষ দুর্নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এজন্য ইসলাম প্রত্যেককে এমন মজুরি বা বেতন প্রদানের কথা বলেছে যে তা দ্বারা সে তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে। শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘‘ তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। কারো ভাই তার অধীনে থাকলে তার উচিত নিজে যা খাবে তাই খাওয়াবে। নিজে যা পরবে তাকেও তা পরতে দিবে এবং তাকে দিয়ে এমন কাজ করাবে না যা তার সাধ্যাতীত। কোনভাবে তার উপর আরোপিত বোঝা বেশি হয়ে গেলে নিজেও সে কাজে তাকে সাহায্য করবে।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ. ৮৯৪।]

যোগ্য, অভিজ্ঞ ও সৎ কর্মচারী নিয়োগঃ

দুর্নীতির কারণ হচ্ছে প্রশাসনের নিভিন্ন স্তরে ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ও অসৎ কর্মচারী নিয়োগ দান করা। অথচ প্রশাসনকে দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য ইসলামের দির্দেশ হচ্ছে সৎ, বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। [ইমাম ইবন তাইমিয়া, আস-সিয়াসাতুশ শার‘ঈয়্যাহ (কুয়েত : জাম‘ঈয়াতু ইহইয়াত তুরাছিল ইসলামী, ১৯৯৬ খৃ.), পৃ. ৬।] আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,

﴿ إِنَّ خَيۡرَ مَنِ ٱسۡتَ‍ٔۡجَرۡتَ ٱلۡقَوِيُّ ٱلۡأَمِينُ ٢٦ ﴾ [ القصص : ٢٦ ]

‘‘ তোমার জন্য সর্বোত্তম কর্মচারী হতে পারে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত। [আল-কুরআন, ২৮ : ২৬।](সূরা আল কাসাস:২৬)

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন আমানত তার মালিককে প্রত্যার্পণ কর।’’ [আল-কুরআন, ৪ : ৫৮।]

এছাড়া মহানবী (সা.) আমানতের খিয়ানত করাকে কিয়ামতের আলামত হিসাবে অভিহিত করেছেন। এভাবে ইসলাম সৎ, যোগ্য ও বিশ্বস্ত কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি সংঘটনের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিতে চায়।

গণসচেতনতাঃ

দুর্নীতির ভয়াবহতা এবং এর নেতিবাচক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক

ভূমিকা সম্পর্কে সকল সত্মরের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। যাতে সমাজের প্রতিটি মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কেননা এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং সরল প্রকৃতির। তাদেরকে যদি দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ইহকালীন ও পরকালীন ও পরিণতির বিষয় বুঝিয়ে দেয়া যায়। তাহলে তা সময় সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয়। এজন্য কিছু পন্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

প্রথমত: মসজিদে খুতবার সাহায্য গ্রহণ:

বছরে বায়ান্ন দিন এলাকার জনগণ জসজিদে জুম‘আর নামাযে শামিল হন। এ নামাযের খুতবায় নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়। সে সব বিষয়ের পাশাপাশি যদি ইমাম সাহেবগণ দুর্নীতির ভয়াবহতা ও তার ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে দেন। তাহলে ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।

দ্বিতীয়তঃ

দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়ায-মাহফিল, তাফসীর-মাহফিল, ইসলামী জলসা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে বরেণ্য ‘উলামায়ে কেরাম’ যুগশ্রেষ্ঠ মুফাসসির এবং খ্যাতনামা অভিজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তিগণ বক্তব্য রেখে থাকেন। এসব অনুষ্ঠানে নানা বয়স, পেশা, শিক্ষা ও পদমর্যাদার বহু লোকের সমাগম হয়ে থাকে। সুতরাং এসব অনুষ্ঠানে যদি দুর্নীতির মারাত্মক পরিণতির কথা বুঝিয়ে বক্তব্য রাখা যায়। তাহলে নিঃসন্দেহে আলোড়ন সৃষ্টি হবে এবং জনমত গড়ে উঠবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা। [আর্থ-সমাজিক সমস্যা সমাধানে আল-হাদীসের অবদান: প্রেক্ষি ত বাংলাদেশ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪৯।]

জবাবদিহিতাঃ

দুর্নীতিমুক্ত সুষমা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য জবাবদিহিতার কোন বিকল্প নেই। সরকারের সবের্বাচ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরণ দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এ সম্পর্কে মহানবী (স.) বলেন, ‘‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর তোমরা প্রত্যেকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ. ১০৫৭; ইমাম মুসলিম, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ. ১২২।]

একবার হযরত আলী (রা.) হযরত উমার (রা.)- কে মদীনার বাইরে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? উমার (রা.) বললেন, সাদকার একটি উট পালিয়েছে, আমি তা খুঁজতে বেরিয়েছি। হযরত আলী (রা.) তখন বললেন, আপনি তো আপনার পরবর্তী খলিফাগণের জন্য খেলাফতের দায়িত্ব পালন অত্যন্ত কঠিন করে দিচ্ছেন। [ইবন কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭ম খন্ড (কায়রো : দারু আইয়ান লিত তুরাছ, ১৯৮৮ র্খ,) পৃ. ১৪১।] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হযরত উমার (রা.) একদা মসজিদে খুতবা দিতে উঠলেন। এমন সময় জনৈক বেদুইন তাকে সম্মোধন করে বলল, হে উমার! আমি আপনার কথা শুনব না এবং আপনার প্রতি আনুগত্যও প্রদর্শন করব না। যতক্ষণ না আপনি জবাব দেবেন যে, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের মাঝে যে কাপড় বণ্টন করা হয়েছে, তা দিয়ে কোন ক্রমেই এত বড় জামা তৈরি করা সম্ভব নয়। আপনি আমাদের চেয়ে বেশি কাপড় না নিলে কিভাবে আপনার জামা তৈবি করা সম্ভব হল। [ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতে প্রতিরোধ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪।] হযরত উমার (রা.) এর কোন প্রতিবাদ না করে স্বীয় পুত্রের দৃষ্টি আকষণ করেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা.) বলেন, মদীনার সকল অধিবাসীর মত আমি ও আমার পিতা এক খন্ড করে দু‘খন্ড কাপড় পেয়েছিলাম। আমার পিতা দীর্ঘকায় হেতু তার প্রাপ্ত কাপড় দ্বারা জামা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমার ও তার কাপড় একত্র করে জামা তৈরি করা হয়েছে। একজন সাধারণ প্রজার কাছে রাষ্ট্রনায়কের জবাবদিহিতার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

দুর্নীতি বিরোধী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড:

দুর্নীতি বিরোধী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড গণমানুষকে সচেতন করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিভিন্ন শাখায় দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতির প্রতিফলন ঘটিয়ে দর্শক, শ্রোতা ও পাঠক হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা যেতে পারে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ

দুর্নীতি প্রতিরোধের অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। বিচার বিভাগকে সরকারের যাবতীয় হস্তক্ষেপ, প্রভাব ও চাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীন হতে হবে; যাতে করে সম্মানিত বিচারকবৃন্দ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক নির্ভয়ে-নিঃসঙ্ক চিত্তে রায় প্রদান করতে পারেন। মহানবী (সা.) এর যুগে মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির দায়ে ধৃত হয়। তখন মহানবী (সা.) এর নিকট তার দন্ড মওকুফের জন্য সুপারিশ করা হলে তিনি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান এবং বলেন,

«إنما هلك من كان قبلكم إنهم كانوا يقيمون الحد على الوضبع ويتركون على الشريف والذى نفسي بيده لو فاطمة فعلت ذلك لقطعت يدها»

‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ কারণে ধ্বংস হয়েছে যে, যখন তাদের মধ্যে দুর্বল কেউ চুরি করত, তখন তারা তার উপর দন্ড প্রয়োগ করত এবং সম্ভ্রান্ত কেউ চুরি করলে তাকে ছেড়ে দিত। সেই সত্তার কসম, যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ, ফাতিমাও (মুহাম্মদ (স.) এর মেয়ে) যদি চুরি করে, তবে তারও হাত আমি অবশ্যই কেটে দিব।’’ [ইমাম বুখারী, আস- সহীহ, ২য় খন্ড, পৃ.১০০৩।]

দুর্নীতিবাজদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানঃ

দুর্নীতি দমনের জন্য যারা বিচারের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত হবে; তাদেরকে যথাযথ ও উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন মানুষ শাস্তির পরিণতির ভয়ে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকে। [ইসলামের দৃষ্টিতে দুর্নীতি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩।]

দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালনঃ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির জন্য দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালন করা যেতে পারে। এজন্য দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালন উপলক্ষে উন্মুক্ত কক্তৃতা ও বিতর্কসহ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।

দুর্নীতি বিরোধী পোষ্টারঃ

পোষ্টার, লিফলেট ও স্টিকারের মাধ্যমে দুর্নীতি বিরোধী জনমত সৃষ্টি করা যেতে পারে। পোষ্টার, লিফলেট ইত্যাদির আকর্ষণীয় আবেদন ও ভাষা মানুষের বিবেককে নাড়া দেয় এবং অনুভূতিকে আকর্ষণ করে। এজন্য দুর্নীতি বিরোধী পোষ্টার, লিফলেট ও স্টিকার লিখে পরিকল্পিতভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাগিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।

গণপ্রতিরোধঃ

উপরে বর্ণিত পদক্ষেপ ছাড়াও দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এর সবই জনগণ নির্ভর। জনগণই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। নিম্নে এ সম্পর্কে কতিপয় পন্থা উল্লেখ করা হলো:

ক. সম্পর্কচ্ছেদঃ যারা দুর্নীতিবাজ তাদের পরিচিতি যাই হোক না কেন, তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। তারা যেন বুঝতে পারে দুর্নীতির কারণেই জনগণ তাদের সঙ্গ বর্জন করেছে। কাজটি কঠিন হলেও সকলে এগিয়ে এলে তা দুঃসাধ্য নয়।

খ. জনপ্রতিনিধি না বানানোঃ দুর্নীতিবাজদের জনপ্রতিনিধিত্ব মূলক কোন বিষয়ে নির্বাচিত হতে দেয়া যাবে না। তারা ভোট প্রার্থী হলে, তারা যেন ভোট না পায় সেজন্য প্রচারণা চালাতে হবে। জনগণকে বুঝাতে হবে এসব লোকের কারণেই সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল হচ্ছে না।

গ. সামাজিকভাবে বয়কটঃ যারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত হবে তাদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক বর্জন করতে হবে। বিশেষ করে ছেলে-মেয়ের বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক বর্জন করার ব্যবস্থা করতে হরে। পরিশেষে বলা যায় যে, উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর যথাযথ প্রয়োগ হলে তা দুর্নীতি প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।

উপসংহারঃ

বর্তমানে দুর্নীতি সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস ও অধঃপতনের অতল গহবরে নিক্ষেপ করছে। আগামী দিনের সুস্থ-সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি অবশ্যই পরিত্যজ্য। বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় আলোচ্য অংশে দুর্নীতির কারণ এবং তা প্রতিরোধে ইসলামী নীতিমালা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটি যত আলোচিত হবে জনগণ এ বিষয়ে তত সচেতন হবে এবং তার সুফল ভোগে সমর্থ হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, প্রবন্ধে উল্লেখিত নীতিমালা ও পদক্ষেপসমূহ যদি সমাজে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে অবশ্যই সমাজ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন