hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান ও মর্যাদার বিষয়ে আহলে সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাস

লেখকঃ ড. মো: আমিনুল ইসলাম

২১
পঞ্চম অধ্যায়: সাহাবীগণের ইতিহাস আলোচনার মূলনীতিমালা
প্রথমত: সাহাবীগণের মাঝে সংঘটিত বিষয় নিয়ে কথা বলাটাই আসল নয়; বরং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিকট মৌলিক আকীদাগত বিষয় হলো সাহাবীগণের মাঝে (অনাকাঙ্খিতভাবে) সংঘটিত বিষয়ে আলোচনা ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকা। আর এটাই আকীদা বিষয়ে লিখিত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকল কিতাবে বিস্তৃত হয়ে আছে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বলের ‘আস-সুন্নাহ’, ইবন আবি ‘আসেমের ‘আস-সুন্নাহ’, আস-সাবুনীর ‘আকীদাতু আসহাবিল হাদীস’, ইবনু বাত্তার ‘আল-ইবানা’, ত্বহাবীয়া ইত্যাদি।

আর এটা জোর দেয়, ঐ ব্যক্তির নিকট এ ধরনের বিষয় আলোচনা করা থেকে বিরত থাকার বিষয়টিকে, যার নিকট এমন আলোচনা করলে জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে আর এ ধরনের জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে তার স্মৃতিতে সাহাবীগণ, তাদের ফযীলত, মর্যাদা ও ন্যায়পরায়ণতার সম্পর্কে যে ধারণা রয়েছে, তার সাথে ঐসব বর্ণনার বিরোধের মাধ্যমে, তার বয়সের স্বল্পতার কারণে বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে না পারার কারণে অথবা দীনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার নতুনত্বের কারণে... সাহাবীগণের মাঝে যা সংঘটিত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে তাদের ইজতিহাদী তথা গবেষণাগত মতবিরোধের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে না পারা। ফলে সে এমন ফিতনা বা বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হবে যে, সে তার অজান্তেই সাহাবীগণের মর্যাদাহানি করে বসবে।

আর এটা হচ্ছে পূর্ববর্তী আলেমদের নিকট একটা স্বীকৃত শিক্ষানীতির ভিত্তি, আর তা হলো: জনগণের নিকট এমন কোনো জ্ঞানগত মাসআলা বা বিষয় পেশ না করা, যা তাদের আকল বা মেধা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। ইমাম বুখারী রহ. বলেন: باب من خص بالعلم قوما دون قوم كراهية أن لا يفهموا [পরিচ্ছেদ: বুঝতে না পারার আশঙ্কায় ইলম শিক্ষায় কোনো এক কওম (গোত্র বা জাতি)-কে বাদ দিয়ে অন্য আরেক কওমকে বেছে নেওয়া।] [ফতহুল বারী: ১/১৯৯; সহীহুল বুখারী: ১/৪১, ইলম অধ্যায়, বাব নং ৪৯ (মুদ্রণ: তুর্কী)।] আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

«حدثوا الناس بما يعرفون , أتحبون أن يكذب الله تعالى ورسوله صلى الله عليه وسلم» .

“তোমরা মানুষের কাছে সে ধরনের কথা বল, যা তারা বুঝতে পারে। তোমরা কি পছন্দ কর যে, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হোক?” [ইমাম বুখারী র. তাঁর সহীহ গ্রন্থের ইলম অধ্যায়ের, ৪৯ নং পরিচ্ছেদে এ হাদীসখানা বর্ণনা করেন।]

আর হাফেয ইবন হাজার ‘আসকালানী রহ. এর ব্যাখ্যায় ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন: “এর মধ্যে এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সাধারণ জনগণের নিকট ‘মুতাশাবেহ’ বা অস্পষ্ট বিষয় আলোচনা করা উচিত নয়।”

অনুরূপ কথা বলেছেন ‘আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু:

«مَا أَنْتَ بِمُحَدِّثٍ قَوْمًا حَدِيثًا لاَ تَبْلُغُهُ عُقُولُهُمْ إِلاَّ كَانَ لِبَعْضِهِمْ فِتْنَةً» .

“যখন তুমি কোনো সম্প্রদায়ের কাছে এমন কোনো হাদীস বর্ণনা করবে যা তাদের বোধগম্য নয়, তখন তা তাদের কারও কারও পক্ষে ফিতনা হয়ে দাঁড়াবে।” [সহীহ মুসলিম, মুকাদ্দামাতুস সহীহ, ১/১১; আর দেখুন: তার তাখরীজসহ, ‘জামে‘উল উসুল, ৮/১৭]

অনুরূপভাবে ইমাম আহমদ রহ., তিনিও অপছন্দ করতেন ঐসব হাদীস নিয়ে আলোচনা করা, যেগুলোর বাহ্যিক আবেদন হলো ক্ষমতাসীন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। ইমাম মালেক রহ. অপছন্দ করতেন সিফাত তথা গুণাবলীর হাদীসসমূহ নিয়ে বেশি আলোচনা করতে। ইমাম আবু ইউসূফ রহ. অপছন্দ করতেন দুর্বোধ্য অর্থসম্পন্ন হাদীসসমূহ নিয়ে আলোচনা করতে...শেষ পর্যন্ত তিনি বলেন: “আর এ (দুর্বোধ্য অর্থসম্পন্ন হাদীস) ব্যাপারে বিধিবদ্ধ নিয়ম হলো, হাদীসের বাহ্যিক দিকটি বিদ‘আতকে শক্তিশালী করবে এবং তার বাহ্যিক দিকটি মূলত উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং যে ব্যক্তির ব্যাপারে তার বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের আশঙ্কা করা হবে তার নিকট এ ধরনের হাদীস আলোচনা করা থেকে বিরত থাকা। আর আল্লাহই সবচেয়ে বেশি ভালো জানেন।” [ফতহুল বারী: ১/১৯৯-২০০; আরও চমৎকার আলোচনা দেখুন, আস-সুলামী, মানহজু কিতাবাতিত্ তারিখিল ইসলামী: পৃষ্ঠা ২২৮]

দ্বিতীয়ত: যখন সাহাবীগণের মাঝে (অনাকাঙ্খিতভাবে) সংঘটিত বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিবে, তখন অবশ্যই সাহাবীগণের মাঝে সংঘটিত বিশৃঙ্খলাকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত বর্ণনাসমূহের সত্য-মিথ্যা বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ ٦﴾ [ الحجرات : ٦ ]

“হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখ এ আশঙ্কায় যে, অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৬]

এ আয়াত মুমিনদেরকে তাদের নিকট ফাসিকদের মাধ্যমে আসা সংবাদের ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা বিচার-বিশ্লেষণ করার নির্দেশ দিচ্ছে, যাতে তার আবশ্যকীয়তা দ্বারা জনগণের ওপর এমন কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া না হয়, যার কারণে তারা লজ্জিত হবে। সুতরাং মুমিনদের নেতা সাহাবীগণের সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে, সে ব্যাপারে বিচার-বিশ্লেষণ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক হওয়াটা অতি উত্তম ও যুক্তিসঙ্গত। বিশেষ করে আমরা জানি যে, এসব বর্ণনাগুলোর মধ্যে মিথ্যা ও বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, হয় মূল বর্ণনার দিক থেকে অথবা কম ও বেশি করার মাধ্যমে বিকৃত করা হয়েছে, ফলে বর্ণনাটি নিন্দা ও অপবাদের উৎপত্তিস্থলে পরিণত হয়। আর এ প্রসঙ্গে বর্ণিত বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই সুস্পষ্ট অপবাদের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত প্রসিদ্ধ মিথ্যাবাদীগণ বর্ণনা করেছে। যেমন, আবু মিখনাফ লূত ইবন ইয়াহইয়া, হিশাম ইবন মুহাম্মদ ইবন সায়েব আল-কালবী এবং তাদের উভয়ের মতো আরও অনেকে। [মিনহাজুস সুন্নাহ: ৫/৭২ এবং তার পরবর্তী পৃষ্ঠা ৮১; আরও দেখুন সমালোচনামূলক পর্যালোচনা: ইয়াহইয়া আল-ইয়াহইয়া রচিত, মারবিয়াতু আবি মিখনাফ ফিত তারিখিত তাবারী -রাশেদীনের যুগ, মুদ্রণ: দারুল ‘আসিমা, ১৪১০ হি.]

এ জন্য সাহাবীগণের সৌন্দর্য বা সততা এবং তাদের মর্যাদার বিবরণ সংক্রান্ত মুতাওয়াতির পর্যায়ের বর্ণনাসমূহকে এমন বর্ণনার দ্বারা প্রত্যাখ্যান করা বৈধ হবে না যে বর্ণনাগুলোর কিছু বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত, কিছু বিকৃত। কারণ, সন্দেহপূর্ণ বিষয় দ্বারা নিশ্চিত বিষয়ের নড়চড় হয় না। আর তাদের মার্যাদার ব্যাপারে যা সাব্যস্ত ও প্রমাণিত আছে, আমরা তা নিশ্চিতভাবে জানি। সুতরাং বর্ণনার ক্ষেত্রে সন্দেহপূর্ণ কোনো বিষয় এ ক্ষেত্রে দোষারোপ করতে পারে না। [মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/৩০৫ (শব্দের রূপ পরিবর্তন করে)।]

তৃতীয়ত: যখন বিশুদ্ধতা যাছাইয়ের মানদণ্ডে বর্ণনাটি সহীহ হবে এবং তার বাহ্যিক অর্থটি নিন্দা বা অপবাদের মত মনে হবে, তখন তাদের জন্য অপবাদ থেকে মুক্ত করার সর্বোত্তম পথ ও উপায় অনুসন্ধান করবে। ইবন আবু যায়েদ বলেন, মানুষের উপর তাদের হক হচ্ছে তাদের মাঝে (অনাকাঙ্খিতভাবে) সংঘটিত বিতর্কের বিষয়ে আলোচনা ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকা আর মানুষের নিকট তাদের অন্যতম হক বা অধিকার হলো, তাদের জন্য (মন্দ সমালোচনা থেকে) বের হওয়ার সর্বোত্তম পথ অনুসন্ধান করা এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোত্তম ধারণা পোষণ করা। [মুকাদ্দামাতু রিসালাতি ইবনে আবি যায়েদ আল-কায়রাওয়ানী: ৮; আরও দেখুন: আত-তাতানী (মৃ. ৯৪২ খ্রি.), তানবীরুল মাকালা ফী হাল্লি আলফাযির রিসালাত, বিশ্লেষণ: ড. মুহাম্মদ ইবন ‘আয়াশ, ১/৩৬৭ এবং তার পরবর্তী পৃষ্ঠা।]

ইবন দাকীকুল ‘ঈদ রহ. বলেন: “তাদের মাঝে সংঘটিত বিষয় ও তারা যে ক্ষেত্রে মতবিরোধ করেছেন, সে বিষয়ে তাদেরকে নিয়ে যেসব বর্ণনা এসেছে, তার মধ্য থেকে কিছু বর্ণনা এমন, যা বাতিল ও মিথ্যা। সুতরাং কেউ যেন সে দিকে দৃষ্টি না দেয় আর তন্মধ্যে যা বিশুদ্ধ আমরা তার উত্তম ব্যাখ্যা করব। কারণ, পূর্বে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের প্রশংসা বিবৃত হয়েছে আর তাদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সমালোচনামূলক যেসব কথা আলোচিত হয়েছে, তা ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রাখে। আর সন্দেহ ও ধারণাপূর্ণ বিষয় বাস্তব ও জ্ঞাত বিষয়কে বাতিল করতে পারে না।” [আবদুল আযীয আল-‘আজলান, আসহাবু রাসূলিল্লাহ ওয়া মাযাহিবুন্নাস ফী হিম, পৃষ্ঠা ৩৬০] তাদের দোষারোপ করে যত বর্ণনা এসেছে, তার সবগুলোর ব্যাপারে এ কথা প্রযোজ্য।

চতুর্থত: আর তাদের মাঝে সংঘটিত বিষয়ে বিশেষভাবে যা বর্ণিত হয়েছে এবং বিশুদ্ধতা যাছাইয়ের মানদণ্ডে যা সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তারা ছিলেন মুজতাহিদ তথা গবেষক আর এটা তখন হয়, যখন সমস্যাগুলো সন্দেহ ও সংশয়পূর্ণ হয়। সুতরাং যখন সমস্যাগুলোর সন্দেহ ও সংশয়ের ব্যাপারটি প্রকট আকার ধারণ করে, তখন তাদের ইজতিহাদ বা গবেষণা বিরোধপূর্ণ হয়ে উঠে এবং তারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েন:

১. প্রথম শ্রেণী: ইজতিহাদের মাধ্যমে তাদের নিকট স্পষ্ট হয় যে, এ পক্ষের মধ্যেই হক বা সত্য বিষয়টি বিদ্যমান আর তার বিরোধিতাকারী হলো বিদ্রোহী। সুতরাং তাদের ওপর আবশ্যক হয়ে যায় তাকে সাহায্য করা এবং তার বিরোধিতাকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করা যা তারা বিশ্বাস করেছে। অতঃপর এ কাজ করেছে আর এমন গুণসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য তার বিশ্বাস অনুযায়ী বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের মুকাবিলায় ন্যায়পরায়ণ ইমামকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকাটা বৈধ ছিল না।

২. দ্বিতীয় শ্রেণী: আর দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহাবীরা হলেন তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত, ইজতিহাদের মাধ্যমে তাদের নিকট স্পষ্ট হয় যে, হক বা সত্য বিষয়টি অপর পক্ষের সাথেই রয়েছে। সুতরাং তাদের ওপর আবশ্যক হলো তাকে সাহায্য করা এবং তার বিরোধিতাকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করা।

৩. তৃতীয় শ্রেণী: এ শ্রেণীর সাহাবীগণের উপর সমস্যাটি সন্দেহ ও সংশয়পূর্ণ হয়ে উঠে এবং তারা সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেন; কিন্তু তাদের নিকট উভয় পক্ষের কোনো এক পক্ষকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো বিষয়টি স্পষ্ট হয় নি। ফলে তারা উভয় দলকে পরিত্যাগ করে। আর এ পরিত্যাগ করাটাই তাদের পক্ষে ওয়াজিব (আবশ্যক) ছিল। কারণ, মুসলিমের সাথে লড়াই করতে পদক্ষেপ নেওয়া বৈধ নয়, যতক্ষণ না এর যথার্থতা ও উপযুক্ততা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। [মুসলিম, ইমাম নববীর ব্যাখ্যাসহ: ১৫/১৪৯, ১৮/১১; আরও দেখুন, আল-ইসাবা: ২/৫০১, ৫০২; ফতহুল বারী: ১/১৯৯; এহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন: ১/১০২]

অতএব, এ যুদ্ধের ব্যাপারে তারা ব্যাখ্যা দানকারী প্রত্যেক দলেরই একটা সংশয় ছিল, সে সংশয়ের কারণে তারা বিশ্বাস করত যে, তারা সঠিক পথে আছে। আর এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাদেরকে ‘আদালত তথা ন্যায়পরায়ণতা থেকে বের করে দেয় না; বরং তারা ফিকহের মাসআলার ক্ষেত্রে মুজতাহিদ তথা গবেষকদের বিধানের মধ্যে শামিল। সুতরাং এটা তাদের কারও ত্রুটি হওয়াকে অপরিহার্য করে না; বরং তাদের অবস্থান ছিল একটি এবং দু’টি পুরস্কার অর্জনের মধ্যে। [মুজতাহিদ ভুল করলে একটি পুরস্কার এবং সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে দু’টি পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে।]

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা জানি যে, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের মাঝে সংঘটিত যুদ্ধ নেতৃত্ব লাভের উদ্দেশ্যে ছিল না, উষ্ট্রের যুদ্ধে ও সিফফীনের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ব্যতীত অন্য কোনো ইমাম বা নেতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধ করেন নি। আর মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও বলতেন না যে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বাদ দিয়ে তিনিই ইমাম বা নেতা আর তালহা ও যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাও এ ধরনের কথা বলেন নি; বরং অধিকাংশ আলেমের মতে যুদ্ধটি ছিল (উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হত্যাকারীদের থেকে কিসাস তথা প্রতিশোধ গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে তাদের ইজতিহাদ বা গবেষণার কারণে ঘটে যাওয়া) একটা ফিতনা বা বিপর্যয়। আর তা ন্যায়পন্থী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের মতো একটা যুদ্ধ। আর তা হলো ইমাম ব্যতীত অন্য ব্যক্তির আনুগত্যের প্রশ্নে বিধিসম্মত ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সংঘটিত যুদ্ধ, দীনী বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানূনের জন্য যুদ্ধ নয়। অর্থাৎ দীনের মূলনীতির প্রশ্নে বিরোধের কারণে যুদ্ধ নয়। [মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/৩০৫ (শব্দের রূপ পরিবর্তন করে); তার পরবর্তী আলোচনার জন্য দেখুন, পৃষ্ঠা ৩৪০]

উমার ইবন শাব্বাহ বলেন, “কোনো একজনও বর্ণনা করেন নি যে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ও তার সাথে যারা ছিলেন, তারা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে খিলাফত প্রশ্নে বিরোধ করেছেন, আর তারা কাউকে আহ্বানও করেন নি যাতে তারা তাকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন; বরং তারা শুধু আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হত্যাকারীদের সাথে যুদ্ধ করতে নিষেধ করা এবং তাদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি উপেক্ষা করার কারণে তার নিকট প্রতিবাদ জানিয়েছেন।” [উমার ইবন শাব্বাহ, আখবারুল বসরা, ফতহুল বারী থেকে উদ্ধৃত: ১৩/৫৬]

আর এটাকে সমর্থন করে ইমাম যাহাবী রহ. যা উল্লেখ করেছেন: “আবু মুসলিম আল-খাওলানী ও তার সাথে আরও কিছু মানুষ মিলে তারা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট আগমন করে বলল: আপনি কি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে বিবাদ করছেন, নাকি আপনি তার মতো? জবাবে তিনি বললেন: আল্লাহর কসম! না, নিশ্চয় আমি জানি তিনি আমার চেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন এবং আমার চেয়ে শাসন ক্ষমতার বেশি হকদার; কিন্তু তোমরা কি জান না যে, উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মাযলুম (নির্যাতিত) অবস্থায় নিহত হয়েছেন, আর আমি তার চাচাত ভাই এবং আমি তার রক্তের বদলা দাবি করছি। সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং তাকে বল, তিনি যেন উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হত্যাকারীদেরকে আমার নিকট পাঠিয়ে দেন। অতঃপর তারা আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট আসল এবং তার সাথে এ প্রসঙ্গে কথা বলল; কিন্তু তিনি তাদেরকে (হত্যাকারীদেরকে) তার নিকট সোপর্দ করেন নি।” [যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ৩/১৪০; বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের সনদে তা বর্ণনা করা হয়, যেমনটি বলেছেন আরনাউত।]

ইবন কাছীরের এক বর্ণনায় আছে: “ঐ সময়ে শাম তথা সিরিয়াবাসী মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে যুদ্ধ করার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।” [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৩২; আরও দেখুন ইমামুল হারামাইনের বক্তব্য এবং তার ওপর আত-তাবানী’র ব্যাখ্যা; ইতহাফু যবিউন নাজাবা, পৃষ্ঠা ১৫২, ১৫৩]

তাছাড়া অধিকাংশ সাহাবী এবং অধিক মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবীগণের মধ্য থেকেও অধিকাংশই ফিতনায় অংশগ্রহণ করেন নি। আব্দুল্লাহ ইবন ইমাম আহমদ রহ. বলেন,

«حدثني أبي، قال : حدثنا إسماعيل بن علية، قال : حدثنا أيوب السختياني، عن محمد بن سيرين، قال : هاجت الفتنة وأصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم عشرة آلاف، فما حضرها منهم مئة، بل لم يبلغوا ثلاثين» .

“আমার নিকট আমার পিতা হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেন ইসমা‘ঈল ইবন ‘উলাইয়া, তিনি বলেন: আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেন আইয়ুব আস-সাখতিয়ানী, তিনি হাদীস বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবন সীরীন থেকে, তিনি বলেন: ফিতনার উৎপত্তি হলো এমতাবস্থায় যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী ছিলেন দশ হাজারের মতো। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে একশত জনও তাতে উপস্থিত হয় নি; বরং তাদের সংখ্যা ত্রিশ জনেও পৌঁছে নি।” [মাওসু‘আতু আকওয়ালিল ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল ফিল জারহে ওয়াত তা‘দীল, ক্রমিক নং ৪৩১৮]

ইমাম ইবন তাইমিয়্যা রহ. বলেন: “এ সনদটি জমিনের উপরে সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদের অন্তর্ভুক্ত। আর মুহাম্মদ ইবন সীরীন তার কথা বলার ক্ষেত্রে বেশি আল্লাহ ভীরু মানুষ, আর তার মুরসাল বর্ণনাসমূহ সবচেয়ে বিশুদ্ধ মুরসাল বর্ণনাসমূহের অন্তর্ভুক্ত।” [মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/২৩৬, ২৩৭; একই জায়গায় অন্যান্য বক্তব্যসমূহ দেখুন, যা ফিতনা তথা বিপর্যয়ের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতির প্রমাণ করে।]

সুতরাং কোথায় ন্যায়পরায়ণ গবেষকগণ, তারা এ ধরনের বিশুদ্ধ বক্তব্যসমূহ অধ্যয়ন করবে, যাতে তা তাদের জন্য শুভসূচনা হবে, তারা তাদের মেধা বা স্মৃতিকে ঐতিহাসিকদের তালগোল পাকানো ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ কথাবার্তা দ্বারা কলুষিত করবে না। অতঃপর তারা তাদের নিকট যে মধুময় মুলধন বা পুঁজি রয়েছে, সে অনুযায়ী বিশুদ্ধ নস বা বক্তব্যসমূহকে ব্যাখ্যা করবে।

পঞ্চমত: সাহাবীগণের ইজতিহাদ (গবেষণা) ও তাদের ব্যাখ্যাদান সত্ত্বেও তাদের মধ্যে সংঘটিত ফিতনা বা বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম ব্যক্তির যে বিষয়টি জেনে রাখা খুবই জরুরি তা হলো, সাহাবায়ে কিরামের মনে এ বিষয়ে ভীষণভাবে দুঃখ পাওয়া এবং চলমান ঘটনায় তাদের লজ্জিত হওয়া প্রমাণ করে যে তাদের নেক নিয়তের কোনো ঘাটতি ছিল না। এমনকি তাদের মনে কখনও এ কথা উদয় হয় নি যে, বিষয়টি অচিরেই এত দূর পর্যন্ত পৌঁছাবে যে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, বরং তাদের কেউ কেউ প্রচণ্ডভাবে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যখন তার নিকট তার অপর সাহাবী ভাইয়ের নিহত হওয়ার সংবাদ পৌঁছল; বরং তাদের কেউ কেউ কল্পনাও করতে পারে নি যে, বিষয়টি খুব দ্রুত যুদ্ধে রূপ নিবে। আপনার উদ্দেশ্যে এ নস বা বক্তব্যসমূহ থেকে কিছু সংখ্যক উপস্থাপন করা হল:

এ তো ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, যা যুহুরী রহ. তার থেকে বর্ণনা করেন:

«إنما أريد أن يحجز بين الناس مكاني، ولم أحسب أن يكون بين الناس قتال، ولو علمت ذلك لم أقف ذلك الموقف أبداً» .

“আমি তো শুধু মানুষের মাঝে আমার অবস্থানকে সংরক্ষণ করতে চেয়েছি মাত্র। আর ভাবতেই পারি নি যে, মানুষের মাঝে যুদ্ধ লেগে যাবে আর আমি যদি এটা জানতে পারতাম, তবে আমি কখনও এ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতাম না।” [যুহুরীর মাগাযী, পৃষ্ঠা ১৫৪]

আর তিনি যখন পাঠ করতেন:

﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ﴾ [ الاحزاب : ٣٣ ]

“আর তোমরা তোমাদের ঘরের মধ্যে অবস্থান কর।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩] তখন তিনি কাঁদতেন, এমনকি চোখের পানিতে তার উড়না ভিজে যেত।” [যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ২/১৭৭]

আর এ আমীরুল মুমিনীন আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে শা‘বী রহ. বলেন: “যখন তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিহত হন এবং আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে নিহত অবস্থায় দেখলেন তখন তিনি তার চেহারা থেকে ধুলোবালি মুছতে শুরু করলেন এবং বলেন, আলীর বন্ধু হে আবু মুহাম্মদ! আমি তোমাকে আকাশের নক্ষত্রের নিচে অত্যাধিক ঝগড়ার মাঝে দেখতাম। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আল্লাহর নিকট আমার অপারগতা ও কষ্টের কথা ব্যক্ত করব এবং তিনি ও তার সঙ্গীগণ তার ব্যাপারে কাঁদলেন। আর তিনি বললেন,

«يا ليتني مت قبل هذا اليوم بعشرين سنة» .

“হায়! আমি যদি এ দিনের বিশ বছর পূর্বে মারা যেতাম, তাহলে কতইনা ভালো হত।” [ইবনুল আছীর, উসুদুল গাবা: ৩/৮৮, ৮৯]

আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আরও বলেন:

«يا حسن , يا حسن ما ظن أبوك أن الأمر يبلغ إلى هذا , ود أبوك : لو مات قبل هذا بعشرين سنة» .

“হে হাসান! হে হাসান! তোমার পিতা ধারণা করতে পারে নি যে, বিষয়টি এ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তোমার পিতা কামনা করে, সে যদি এ ঘটনার বিশ বছর পূর্বে মারা যেত, তাহলে কতইনা ভালো হত।” [মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/২০৯]

আর তিনি সিফফীনের রাত্রিসমূহে বলতেন:

«لله در مقام قامه عبد الله بن عمر وسعد ابن مالك ( وهما ممن اعتزل الفتنة ) إن كان برا إن أجره لعظيم وإن كان إثما إن خطره ليسير .

“আল্লাহর কসম! সাফল্যজনক স্থানে অবস্থান করেছে আবদুল্লাহ ইবন উমার ও সা‘দ ইবন মালেক (আর তারা উভয়ে ফিতনা থেকে দূরে অবস্থান করেছিলেন); যদি তা পুণ্যের কাজ হয়, তবে তার প্রতিদান মহান; আর যদি তা পাপজনক সিদ্ধান্ত হয়, তবে তার শঙ্কা খুবই সামান্য।” [প্রাগুক্ত: ৬/২০৯]

সুতরাং এ হলো আমীরুল মুমিনীনের কথা; যদিও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কথা হল: নিশ্চয়ই আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং তাঁর সাথে যারা ছিলেন, তারা সত্যের কাছাকাছি ছিল।” [ফতহুল বারী: ১২/৬৭]

আর এ তো যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«إن هذه لهي الفتنة التي كنا نحدث عنها فقال له مولاه أتسميها فتنة وتقاتل فيها قال ويحك إنا نبصر ولا نبصر ما كان أمر قط إلا علمت موضع قدمي فيه غير هذا الأمر فإن لا أدري أمقبل أنا فيه أم مدبر» .

“নিশ্চয় এটি সেই ফিতনা, যার সম্পর্কে আমরা আলোচনা করতাম। (আর তিনি হলেন ঐ ব্যক্তি, যিনি ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন)। সুতরাং তার মাওলা (আযাদকৃত গোলাম) তাকে উদ্দেশ্য করে বলল: আপনি এটাকে ফিতনা বলে আখ্যায়িত করছেন এবং তাতে আবার যুদ্ধও করছেন? জবাবে তিনি বললেন: তোমার জন্য আফসোস! আমরা তো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করব এবং শুধু তাকিয়ে দেখব না। এ ব্যাপারে আমার অবস্থান স্থল নিশ্চিতভাবে না জেনে আমি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না। কারণ, আমি জানি না, এ ক্ষেত্রে আমি কি সামনে অগ্রসর হব, নাকি পিছনে যাব।” [তারিখুত তাবারী: ৪/৪৭৬]

আর এ তো মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যখন তার নিকট আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র মৃত্যুর সংবাদ আসল তখন তিনি বসে পড়লেন এ কথা বলতে থাকলেন:

إنا لله وإنا إليه راجعون، وجعل يبكي فقالت له فاختة : أنت بالامس تطعن عليه واليوم تبكي عليه، فقال : ويحك إنما أبكي لما فقد الناس من حلمه وعلمه وفضله وسوابقه وخيره، و في رواية : ويحك إنك لا تدرين ما فقد الناس من الفضل و الفقه و العلم .

“নিশ্চয় আমরা আল্লাহর আর আমাদেরকে তার নিকট ফিরে যেতে হবে ( إنا لله وإنا إليه راجعون )। আর তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। অতঃপর তার স্ত্রী বললেন, তুমি গতদিন তার সাথে যুদ্ধ করেছে আর আজ কাঁদছ? জবাবে তিনি বললেন: তোমার জন্য আফসোস! আমি তো শুধু কাঁদছি এ জন্য যে, তার মৃত্যুতে জনগণ তার বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, অবদান, অভিজ্ঞতা ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্য বর্ণনায় আছে: তোমার জন্য আফসোস! নিশ্চয় তুমি জান না, তার মৃত্যুতে জনগণ অবদান, ফিকহ বা বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান থেকে কী পরিমাণ বঞ্চিত হয়েছে।” [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৫, ১২৩]

আর এত সব বর্ণনার পরেও কীভাবে তাদেরকে এমন সব বিষয়ের মাধ্যমে তিরস্কার করা হবে, যেসব বিষয় তাদের নিকট সংশয়পূর্ণ ছিল। অতঃপর তারা সে বিষয়ে ইজতিহাদ বা গবেষণা করেছেন, তাদের কেউ কেউ সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন এবং বাকিরা ভুল করেছেন। আর তাদের সকলেই একটি প্রতিদান বা দু’টি প্রতিদানের প্রাপক। আর এর পরেও তারা সংঘটিত অনাকাঙ্খিত ঘটনার কারণে লজ্জিত আর তারা এর থেকে তাওবা করেছেন। আর তারা যে বিপদ-আপদের শিকার হয়েছিলেন, তার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং তার বদলে তাদের সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«ما يزال البلاء بالمؤمن والمؤمنة في نفسه وولده وماله حتى يلقى الله وما عليه خطيئة» .

“মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর জীবন, সন্তান-সন্ততি ও সম্পদে সার্বক্ষণিক বালা-মুসিবত লেগে থাকে, শেষ পর্যন্ত সে আল্লাহর দরবারে হাযির হয় এমতাবস্থায় যে, তার কোনো গুনাহ থাকে না।” [তিরমিযী (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা), হাদীস নং ২৩৯৯; তিনি বলেন, হাদিসটি হাসান সহীহ; ইবনু হিব্বান হাদিসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন; হাকেম হাদিসটি বর্ণনা করেন, তিনি এবং যাহাবী তার সম্পর্কে চুপ থাকেন: ১/৪১; আর আলবানী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন; মিশকাত, ১/৪৯২, সা‘দের হাদিস থেকে, তিনি (আলবানী) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, আস-সহীহা ( الصحيحة ), হাদীস নং ১৪৪; দেখুন: শাওয়াহেদ ( شواهد ), ৫/১৪৩, ১৪৫; আরও দেখুন: আল-ফাতহ ( الفتح ): ১০/১১১, ১১২]

আর ন্যূনতম পক্ষে এ ব্যাপারে তাদের কারও কারও যদি বাস্তবে গুনাহ হয়েও থাকে, তবে আল্লাহ তা‘আলা অনেক কারণে তার গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। তন্মধ্যে প্রধান কারণ হলো তাদের অভিজ্ঞতা বা অগ্রগামীতা, মহৎকার্যাবলী, জিহাদ লড়াই সংগ্রাম, গুনাহ ক্ষমাকারী বিপদ-আপদ, ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তাওবা করার মতো অতীত সৎকর্ম, যার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদের পাপকে পূণ্যে পরিবর্তন করেন। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। আর আল্লাহ হলেন মহান অনুগ্রহ দানকারী। [বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/২০৫-২৩৯; তিনি তাতে গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার দশটি কারণ উল্লেখ করেছেন।]

ষষ্ঠত: সর্বশেষ আমরা বলব যে, নিশ্চয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এ আকীদা বা বিশ্বাস পোষণ করেন না যে, সাহাবীগণের প্রত্যেকেই কবীরা ও সগীরা গুনাহ থেকে মুক্ত (নিষ্পাপ); বরং এক কথায় তাদের পক্ষ থেকে গুনাহ হওয়াটা স্বাভাবিক। আর যদি তাদের থেকে কোনো গুনাহ সংঘটিত হয় তবে তাদের জন্য যে সব অগ্রাধিকার ও মর্যাদার বিষয় রয়েছে, তা তাদের ক্ষমাকে ত্বরান্বিত করে। অতঃপর যখন তাদের কারও পক্ষ থেকে কোনো গুনাহ সংঘটিত হত, তখন হয় তিনি তার থেকে তাওবা করতেন অথবা তাকে এমন সাওয়াব দেওয়া হত, যা সে গুনাহকে মিটিয়ে দিত অথবা তার অগ্রবর্তীতার কারণে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হত অথবা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশের কারণে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, আর তারা হলেন মানুষের মধ্যে রাসূলের শাফা‘আত বা সুপারিশ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার অথবা তাকে দুনিয়াতে বালা-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষা করে তার দ্বারা ক্ষমার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং বাস্তবিক পাপের ক্ষেত্রে যখন এ নিয়ম, তখন কীভাবে এমন বিষয়ে তাদের গুনাহ হবে বা তাদেরকে তিরস্কার করা হবে, যে বিষয়ে তারা ছিলেন মুজতাহিদ বা গবেষক। যদি তারা তাতে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তবে তাদের জন্য রয়েছে দু’টি সাওয়াব এবং যদি তারা তাতে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তবে তাদের জন্য রয়েছে একটি সাওয়াব। আর ভুলটিকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

অতঃপর মর্যাদা এমন বিষয়, যা তাদের কারও পক্ষ থেকে তুচ্ছ কাজকেও অপছন্দ করে। তবে জাতির মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব, আর ঈমান, জিহাদ, হিজরত, সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা, উপকারী ইলম (জ্ঞান) এবং ভালো কাজের দিক থেকে তাদের সৌন্দর্যের বিবেচনায় সে তুচ্ছ অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। [দেখুন: শরহু খলিল হাররাস ‘আলাল ‘আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, পৃষ্ঠা ১৬৪-১৬৭]

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন: “তারা এমন সম্প্রদায়, যাদের রয়েছে ইসলাম গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা আর আছে তাদের মাঝে সংঘটিত অনকাঙ্খিত ত্রুটি মিটিয়ে দেওয়ার মতো আমল, অপরাধ নিশ্চিহ্নকারী জিহাদ এবং পরিশুদ্ধকারী ইবাদত। আর আমরা এমন ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত হব না, যে ব্যক্তি তাদের কোনো একজনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে এবং আমরা তাদেরকে নিষ্পাপ বলেও দাবি করব না।” [যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ১০/৯৩]

অতএব, সাহাবীগণের ন্যায়পরায়ণতার প্রতি আমাদের আকীদা বা বিশ্বাস তাদের নিষ্পাপ হওয়াকে আবশ্যক করে না। কারণ, ন্যায়পরায়ণতা হলো চরিত্র ও দীনের দৃঢ়তা। আর এ গুণ অর্জনকারী ব্যক্তি ধাবিত হয় আত্মাকে মজবুতভাবে গঠনের দিকে, যা নির্ভর করে নিরবচ্ছিন্ন তাকওয়া ও ব্যক্তিত্বকে ধারণ করার ওপর। ফলে সে তার সততা দ্বারা তার আত্মার মজবুতি অর্জন করবে... অতঃপর ‘ন্যায়পরায়ণতার জন্য সামগ্রিকভাবে পাপমুক্ত হওয়া শর্ত নয়’ এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। [আল-গাজালী, আল-মুসতাছফা: ১/১৫৭; আরও অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন: আল-আ‘জামী, মানহাজুন নকদ ‘ইনদাল মুহাদ্দিসীন, পৃষ্ঠা ২৩-২৯]

আর তা সত্ত্বেও সাধারণভাবে তাদের দোষ-ত্রুটি ও মন্দ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকাটা ওয়াজিব হবে, যে আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে। আর যদি সাহাবীর ত্রুটি-বিচ্যূতি অথবা ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করাটা জরুরি হয়ে পড়ে, তবে আবশ্যক হলো ঐ আলোচনার সাথে এ সাহাবীর মর্যাদা ও তার অবস্থান পরিষ্কার করা। যেমন, তার তাওবা, জিহাদ করা এবং তার অবদানসমূহের উল্লেখ করা। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আমরা যদি হাতেব ইবন আবি বোলতা‘আহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র তাওবার কথা আলোচনা না করে শুধু তার পদস্খলনের কথা আলোচনা করি, তবে তা পরিষ্কার যুলুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, কোনো অপরাধী তাওবা করলে, তার তাওবা কবুল করা হয়। [আবূ না‘য়ীম, আল-ইমামা, পৃষ্ঠা ২৪০-২৪১; মিনহাজুস সুন্নাহ: ৬/২০৭]

সুতরাং কোনো ব্যক্তির জীবনকালের কোনো এক সময়ে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যূতি হলে এবং তা থেকে সে তাওবা করলে, তবে সে কারণে তাকে দোষারোপ করা যাবে না। কারণ, চূড়ান্তভাবে পরিপূর্ণতার বিষয়টিকে বিবেচনা করা হবে, সূচনা লগ্নের অসম্পূর্ণ কোনো বিষয়কে (সিদ্ধান্তের জন্য) বিবেচনা করা হবে না। বিশেষ করে কারও যদি পূণ্যরাশি ও মহৎ কার্যাবলী থাকে এবং কেউ যদি তার প্রশংসা না করে, তবে তার ব্যাপারে কেমন সিদ্ধান্ত হতে পারে, যখন তার স্রষ্টা অন্তর্জ্ঞানী আল্লাহ স্বয়ং তার প্রশংসা করেন।

পরিশেষে আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ﴾ [ الحشر : ١٠ ]

“হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন