hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

শির্ক কী ও কেন

লেখকঃ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী

১৭২
বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীতে অন্ধভাবে মাযহাব পালনের বাস্তব উদাহরণ:
কোন বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বিশুদ্ধ হাদীস থাকলে এ জাতীয় হাদীসের ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী, সে ব্যাপারে হাদীসবিদগণ বলেন :

যদি উক্ত ধরনের উভয় হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়, তা হলে তা করে উভয় হাদীসের উপর ‘আমল করতে হবে।

আর যদি উভয়ের মাঝে কোনো সামঞ্জস্য বিধান করা না যায়, তা হলে দেখতে হবে যে, এর মধ্যকার কোনো একটি অপরটির জন্য নাসিখ তথা রহিতকারী কি না। তা জানা গেলে রহিতকারী হাদীসকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেটির উপর ‘আমল করতে হবে এবং মানসূখ তথা রহিতকৃত হাদীসকে বাদ দিতে হবে।

তা জানা সম্ভব না হলে একটিকে অপরটির উপর অগ্রাধিকার দানের নিয়মানুযায়ী একটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৪) তাও যদি সম্ভব না হয়, তা হলে কোনো একটিকে অগ্রাধিকার দেয়ার মত কোনো কারণ না পাওয়া পর্যন্ত উভয় হাদীসের উপর ‘আমল করা থেকে বিরত থাকতে হবে। [. ড. মাহমূদ ত্বহ্হান, তাইছীরু মুসত্বলাহিল হাদীস; (করাচী : ক্বদীমী কুতুবখানা, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ৫৭।]

কোন বিষয়ে যদি পরস্পর বিপরীতমুখী বিশুদ্ধ হাদীস থাকে অথবা একটি হাদীস থেকে দু’রকমের অর্থ গ্রহণের সম্ভাব্যতা থাকে, আর সে কারণে যদি তা নিয়ে ইমামগণের ইজতেহাদের মাঝেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এবং পরবর্তী আলেমগণও যদি কোনোভাবেই সে ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে দু’রকম ‘আমল করেন, আর তাঁদের অনুসরণে আমরাও সে রকম করি, তা হলে আশা করি এতে তাঁরা এবং আমরা সবাই আল্লাহর কাছে উপযুক্ত উজরখাহী করতে পারবো। কিন্তু যে বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীতে অপর কোনো বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া যায় না এবং এর বাহ্যিক অর্থেরও ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না, এমন হাদীসের উপর ‘আমল করার ক্ষেত্রে কারো ভিন্ন মত পোষণ করার কোনই এখতিয়ার থাকে না। অনুরূপভাবে একটি কর্ম যদি সাহাবীদের যুগ থেকে দু’ভাবে করা জায়েয হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে এর একটিকে গ্রহণ করে অপরটিকে না জায়েয বা মকরূহ বলারও কারো কোনো অধিকার নেই। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মাযহাবের অন্ধ অনুসরণের কারণে আমাদের সমাজে এমনও কিছু ‘আমলের প্রচলন রয়েছে যার মধ্যে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ‘আমলের বিরোধিতা রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। পাঠক সমাজের বুঝার সুবিধার্থে নিমেণ এর তিনটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো :

এক. এক মিছলের পর দ্বিতীয় মিছলের শুরু থেকেই আসর নামাযের ওয়াক্ত আরম্ভ হয় :

ইবনে ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা বর্ণিত হয়েছে যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নামাযের সময় শিক্ষাদান উপলক্ষে দু’দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ইমামত করেছিলেন। প্রথম দিনে আসরের নামায প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছিল [মিছল বলতে বুঝায়, অনুরুপ হওয়াকে। অর্থাৎ যে কোনো বস্তুর ছায়া তার অনুরূপ দৈঘ্যে লম্বা হয়ে মাটিতে পড়া। [সম্পাদক]] পূর্ণ হওয়ার সময় অথবা পূর্ণ হওয়ার পর অর্থাৎ দ্বিতীয় মিছিলের প্রারম্ভে আদায় করেছিলেন এবং দ্বিতীয় দিনে তা প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দুই মিছিল হওয়ার পর অর্থাৎ তৃতীয় মিছিলের প্রারম্ভে আদায় করেছিলেন। এর পর তিনি বলেছিলেন : নামাযের ওয়াক্ত এ দুই ওয়াক্তের মধ্যে। [. ইমাম তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সালাত ‘আন রাসূলিল্লাহ, বাব নং ১১৩, হাদীস নং ১৪৯, ১/২৭৯; ইবনে হিববাস, প্রগুক্ত; কিতাবুস সালাত, বাব নং ২, হাদীস নং ১৪৭২, ৪/৩৩৫।] এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আসরের নামাযের ওয়াক্ত প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দুই মিছল হওয়ার পর তৃতীয় মিছলের প্রারম্ভে আরম্ভ না হয়ে দ্বিতীয় মিছিলের প্রারম্ভ থেকেই হয়ে যায়। অথচ আমাদের মাযহাবে বিষয়টি এর সম্পূর্ণ বিপরীত রয়েছে। দ্বিতীয় মিছলের প্রারম্ভ থেকে আসরের নামাযের ওয়াক্ত আরম্ভ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা মাযহাবের কথানুযায়ী তা স্বীকার করি না।

ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) তাঁর মুওয়াত্ত্বা গ্রন্থে আসরের নামাযের ওয়াক্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করেছেন। তাতে রয়েছে: ‘আব্দুল্লাহ ইবনে রাফে‘ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নামাযের ওয়াক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। এতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : যখন তোমার নিজের ছায়া এক মিছল হয় তখন তুমি যোহরের নামায পড় এবং যখন তোমার ছায়া দু’ মিছল হয় তখন আসরের নামায পড় ...।’’ [. আশ-শায়বানী, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান, মুওয়াত্ত্বা; (দেওবন্দ : আশরাফী বুক ডিপো, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন) পৃ. ৪২।] এরপর ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন : এটিই হচ্ছে ‘আসরের নামাযের ওয়াক্তের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মত।

‘আসরের নামাযের ওয়াক্তের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর উপর্যুক্ত মত হলেও তাঁর এ মতের সাথে তাঁর কোনো শিষ্যই ঐকমত্য পোষণ করেন নি। সে জন্য ইমাম মুহাম্মদ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মত বর্ণনা করার পর বলেন :

‘‘আমরা বলি : যখন ছায়া এক মিছলের চেয়ে একটু বেশী হয় তখন পশ্চিম দিকে সূর্য ঢলা থেকে যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছলের চেয়ে একটু বেশী হয়, তখনই ‘আসরের ওয়াক্ত এসে যায়’’। [. তদেব; পৃ. ৪৪।]

ইমাম মুহাম্মদের উক্ত কথার উপর টীকা লিখতে গিয়ে মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী বলেন :

“আসরের ওয়াক্ত আগমন সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মদ যা বলেছেন সে-কথাটি ইমাম আবু ইউসুফ, হাসান, যুফার, ইমাম শাফিঈ, আহমদ, ত্বহাবী ও অন্যান্যরাও বলেছেন। এমনকি সাধারণ কিতাবাদির বর্ণনানুযায়ী এটি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর দ্বিতীয় মত হিসেবে তাঁর শিষ্য হাসান কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আল-মাবসূত্ব গ্রন্থের বর্ণনানুযায়ী ইমাম মুহাম্মদও ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। এ-কথাগুলো মুহাম্মদ ইবন আমীর আল-হাজ্জ আল-হালাবী কর্তৃক রচিত ‘মুনইয়াতুল মুসল্লী’ নামক গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘হিলয়াতুল মুহাল্লা’ নামক গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। হানাফী মাযহাবের বিভিন্ন ফিকহের কিতাবসমূহেও এ মতের অগ্রগণ্যতার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। যেমন ‘গারারাতুল আযকার’ নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে :

" هو المأخوذ به "

‘আসরের ওয়াক্তের ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মদ ও অন্যান্যরা যা বলেছেন সেটাই গৃহীত হয়েছে। ‘আল-বুরহান’ নামক গন্থে রয়েছে:

" هو الأظهر لبيان جبريل "

জিবরাঈল (আ.) এর বর্ণনার কারণে এটাই সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্ট কথা। কীরকি কর্তৃক লিখিত ‘ফয়েয’ নামক গ্রন্থে রয়েছে :

" وعليه عمل الناس اليوم وبه يفتى كذا في الدر المختار ".

‘‘এ মতের উপরেই বর্তমান সময়ের লোকজনের ‘আমল রয়েছে, এ মতের দ্বারাই ফতোয়া প্রদান করা হয়ে থেকে। অনুরূপ কথা ‘দুররে মুখতার’ গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে’’। [.আবুল হাসানাত আব্দুল হাই, আত-তা‘লীকুল মুমাজ্জদ আলা মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মদ;পৃ.৪৪। টীকা নং (১); শরহুল বেক্বায়াঃ; পৃ.৩০।]এ-সব উদ্ধৃতির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অতীতে হানাফী মাযহাবের গণ্যমান্য মনীষীগণ আছরের নামায দুই মিছলের পরে আদায় না করে এক মিছলের পরেই আদায় করতেন।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপর্যুক্ত হাদীস নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যায় যে, তিনি তাঁর এ বক্তব্যের দ্বারা মূলত যোহর বা ‘আসরের নামাযের প্রারম্ভিক সময়ের কথা বলতে চান নি, বরং এর দ্বারা তিনি নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্তের শেষ সময়সীমার বর্ণনা দিতে চেয়েছিলেন। সে-জন্যে ইমাম ত্বাহবী হানাফী বলেন:

“আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাঁর ইমামতে দ্বিতীয় দিনে নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্তের সর্বশেষ সীমা পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য যে যে সময়ে নামায আদায় করেছিলেন, তা বর্ণনা করা। কেননা, বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, জিব্রাঈল (আ.) দু’দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামাযের ইমামত করেছিলেন ...তখন তিনি প্রথম দিনে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলার পর যোহরের নামায পড়েছিলেন এবং প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছিল হওয়ার পর ‘আসরের নামায আদায় করেছিলেন ...অতঃপর দ্বিতীয় দিনে তিনি তাঁর সাথে প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছল পূর্ণ হওয়ার সময়ে যোহরের নামায আদায় করেছিলেন এবং প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দু’ মিছল হওয়ার সময় ‘আসরের নামায আদায় করেছিলেন। ...আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর উক্ত কথার দ্বারা এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন।’’ [. তদেব;পৃ.৪২। ৭ নং টীকা দ্রষ্টব্য।]

আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী তাঁর টীকাতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতের সহায়ক দু’টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। যার একটি সুনানে আবী দাউদ ও ইবনে মা-জাঃতে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে ‘আলী ইবনে শায়বান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন : আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট মদীনায় আগমন করলাম এবং তাঁকে ‘আসরের নামায উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকা পর্যন্ত বিলম্ব করতে দেখলাম’’। অপরটি মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাঃতে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে দু’মিছিল হওয়ার পর নামায আদায় করেন’’। এর পর বলেন: ইমাম ‘আইনী তাঁর ‘উমদাতুল ক্বারী’ গ্রন্থে এ’ দুটি হাদীস প্রসঙ্গে বলেছেন: এ দু’টি হাদীস দু’ মিছলের সময় নামায আদায় করা জায়েয হওয়ার কথা প্রমাণ করে, এ-সময়ের পূর্বে ‘আসরের ওয়াক্ত হয় না-এ-কথাটি প্রমাণ করে না’’। [. তদেব; টীকা নং ২।]

এরপর লক্ষ্ণৌভী বলেন: ‘‘এ-ক্ষেত্রে ইনসাফের কথা হচ্ছে: এক মিছলের হাদীসসমূহ সুস্পষ্ট ও সহীহ এবং দু’ মিছলের হাদীসসমূহ দু’ মিছল না হলে ‘আসরের ওয়াক্ত হয় না এ-কথা বর্ণনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নয়। যারাই দুই মিছলের কথা গ্রহণ করেছেন তাদের অধিকাংশই তাদের বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে কিছু হাদীস বর্ণনা করে তাত্থেকে দু’ মিছলের বিষয়টি ইজতেহাদ করে বের করেছেন, অথচ ইজতেহাদ করে বের করা বিষয় সুস্পষ্ট বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। ‘বাহরুর রা-ইক্ব’ এর লেখক এ-বিষয়ে পৃথক একটি গ্রন্থে অনেক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, তবে এর দ্বারা তিনি তার দাবী প্রমাণিত হতে পারে এমন কিছু উপস্থাপন করতে পারেন নি’’। [. তদেব; পৃ.৪৪।]

দু’ মিছলের প্রারম্ভ থেকেই ‘আছরের নামাযের ওয়াক্ত এসে যাওয়ার কথা জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্ত শিক্ষাদান সংক্রান্ত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর দ্বিতীয় মত ও হানাফী মাযহাবের বিশিষ্ট মনীষীদের মতামতের দ্বারা তা স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও আমরা ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর প্রথম মতকেই ধরে রয়েছি। আর দু’ মিছল শেষে তৃতীয় মিছল শুরু হওয়ার পূর্বে ‘আছরের নামাযের ওয়াক্ত হয় না- এ-কথা বলার কারণে আমরা সাধারণ ও আলেম নির্বিশেষে নিম্নে বর্ণিত অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছি:

এতে আমরা বিশুদ্ধ ও সুস্পষ্ট হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের বিরোধিতা করছি।

নিজ মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ও মূল প্রচারকদের মতের অনুসরণ না করে মাযহাবের দ্বিতীয় পর্যায়ের কিছু আলেমদের অনুসরণ করছি।

জিব্রাঈল কর্তৃক বর্ণিত ‘‘নামাযের ওয়াক্ত এ’ দুই ওয়াক্তের মাঝখানে’’ এ-কথার অনুসরণে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- ও তাঁর সাহাবীগণ অধিকাংশ সময়ে দ্বিতীয় মিছলের মাঝামাঝি সময়ে ‘আসরের নামায পড়ার কারণে আমরা তাঁদেরকে ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বে নামায আদায় করেছেন বলে অভিযুক্ত করছি।

বিশুদ্ধ হাদীসে আউয়াল ওয়াক্তে নামায আদায় করার অনেক গুরুত্ব ও ফযীলত থাকার কথা বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা ‘আসরের নামায সর্বদা মুস্তাহাব ওয়াক্তের সর্বশেষ সময়ে আদায় করছি, যা আউয়াল ওয়াক্তে নামায আদায় করার ফজীলত সংক্রান্ত সহীহ হাদীসের সম্পূর্ণ বিপরীত।

‘আসরের ওয়াক্ত আগমনের ব্যাপারে নিজ মাযহাবের ফতোয়ারও বিরোধিতা করছি।

দুই, নামাযের কাতারে পরস্পর কাঁধ ও পা মিলিয়ে দাঁড়ানো:

সহীহ বুখারী শরীফে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

‘‘তোমরা তোমাদের কাতার সোজা করো, কেননা, আমি তোমাদেরকে আমার পিঠের পিছন থেকে (বাঁকা অবস্থায়) দেখতে পাই। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: (রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে) আমাদের একজন তাঁর কাঁধ ও পা তাঁর পার্শ্বের জনের কাঁধ ও পায়ের সাথে মিলিয়ে রাখতো’’। [.বুখারী, প্রাগুক্ত;কিতাবুল আ-যান, বাব নং ৪৭, হাদীস নং ৬৯২, ১/২৫৪;ইবনে হাজার, ফতহুল বারী; কিতাবুল আ-যান, বাব নং ৭৬, হাদীস নং ৭২৫, ২/২১১।]

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তাঁর সাহাবীগণকে নামাযে কাতার সোজা করার ব্যাপারে নির্দেশ করেছিলেন। তিনি তাঁর সাহাবীগণকে এ-জন্য পরস্পরের সাথে কাঁধে কাঁধ ও পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়াতে না বললেও তাঁরা কাতার সোজা করার জন্য এমনটি করেছিলেন। তবে ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর এ সংক্রান্ত অপর একটি নির্দেশ পালন করতে গিয়েই এমনটি করেছিলেন। রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বলেছেন:

‘‘কাতার সোজা করো, কাঁধের সাথে কাঁধ বরাবর করো, ফাঁক বন্দ করো, শয়তানের জন্য কোনো ফাঁক রাখবে না। যে ব্যক্তি কাতারের সংযোগ স্থাপন করে আল্লাহও তার সাথে সংযোগ স্থাপন করেন, আর যে কাতার ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সাথে সংযোগ ছিন্ন করেন’’। [.হাদীসটি নিম্নরূপ: عن ابن عمر رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال :" أقيموا الصفوف وحاذوا بين المناكب و سدوا الخلل و لا تذروا فرجات للشيطان ، و من وصل وصله الله ، ومن قطع قطعه الله ." দেখুন:আবু দাউদ, প্রাগুক্ত;কিতাবুস সালাত, বাব নং ৯৫, হাদীস নং ৬৬৬, ১/১৭৮।] এ হাদীসটি ইমাম ইবনে খুযায়মাঃ ও ইমাম হাকিম সহীহ বলে মন্তব্য করেছেন। [. দেখুন: ইবনে হাজার ‘আসক্বলানী, ফতহুল বারী; প্রাগুক্ত; ২/২১১।]

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- কাতার সোজা করে দাঁড়ানোর নির্দেশ করার পাশাপাশি দু’জনের পায়ের মধ্যখানে কোনো ফাঁক না রাখার ব্যাপারেও তাঁর সাহাবীদের প্রতি নির্দেশ করেছিলেন। আর সে-জন্যেই তাঁরা পরস্পরের সাথে কাঁধে কাঁধ বরাবর করার পাশাপাশি পায়ের সাথে পা-ও মিলিয়ে দাঁড়াতেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, নামাযের কাতারে পরস্পরের সাথে কাঁধ ও পা যথাসম্ভব লাগিয়ে দাঁড়ানো সুন্নাত। এ বিষয়টি অন্যান্য মাযহাব দ্বারা সমর্থিত হলেও হানাফী মাযহাবে শুধু পরস্পর মিলিয়ে ও কাঁধের সাথে কাঁধ বরাবর করে দাঁড়ানোর বিষয়টি সমর্থিত হয়েছে। পায়ের সাথে পা মিলানোর বিষয়টি সমর্থিত হয় নি। যেমন, হানাফী মাযহাবের ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘বাদাই‘উস সানয়ে‘উ-তে এ-প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:

‘‘আর যখন কাতারে দাঁড়াবে তখন পরস্পর মিলে দাঁড়াবে এবং কাঁধের সাথে কাঁধ বরাবর করবে; কেননা; রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেছেন: তোমরা পরস্পর মিলে দাঁড়াও এবং কাঁধের সাথে কাঁধ মিলাও’’। [. যেমন কিতাবে এসেছে, وإذا قاموا في الصفوف تراصوا وسووا بين مناكبهم، لقوله صلى الله عليه وسلم : تراصوا و ألصقوا المناكب بالمناكب .দেখুন: আল-কা-সানী, ‘আলাউদ্দীন আবু বকর ইবন মাস‘উদ, বাদাই‘উস সানায়ে‘; (করাচী: এস.এম.সাঈদ কম্পানী, ১ম সংস্করণ, ১৯১০ ইং), ১/১৫৯।]

এ হাদীসে পায়ের সাথে পা মিলাও, এ-কথাটি না থাকায় আমাদের মাযহাবে পায়ের সাথে পা মিলানোর বিষয়টি কোনো গুরুত্ব পায় নি। যদিও তা উপর্যুক্ত আনাস ও ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, মাযহাবে যেটুকু করার নির্দেশ রয়েছে আমাদের সমাজে সেটুকু করারও প্রচলন নেই। নামাযে দাঁড়ালে প্রতি দু’জন নামাযীর মাঝখানে বিস্তর ফাঁক পরিলক্ষিত হয়। কাঁধের সাথে কাঁধ মিলানো তো দূরের কথা একটু কাছে আসতে বললেও তারা আসতে চান না। উল্লেখ্য যে, ‘সাহাবীগণ পায়ের সাথে পা লাগাতেন’ এ-কথাটিকে আমাদের মাযহাবের কোনো কোনো বিদ্বান ‘পায়ের গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলাতেন’ মর্মে ব্যাখ্যা করেছেন। সে-কারণেই আমরা পায়ের সাথে পা মিলাতে চাই না। যদিও ইমাম ইবনে হাজার ‘আসক্বলানী এর বর্ণনানুযায়ী এ-ব্যাখ্যাটি একটি অনুল্লেখযোগ্য মত, যা মাযহাবের মুহাক্কিক বিদ্বানদের দ্বারা সমর্থিত নয়। [. ইবনে হাজার ‘আসক্বলানী, ফতহুলবারী;২/২১১।]

উপর্যুক্ত হাদীসসমূহের বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যের প্রতি লক্ষ্য করলে পায়ের সাথে পা মিলানোর কথাই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। কেননা, রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- দু’জনের মধ্যে শয়তানের দাঁড়ানোর স্থান রাখতে নিষেধ করেছেন। কাঁদের সাথে কাঁধ বরাবর করে দাঁড়ালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত নির্দেশটি আংশিকভাবে পালিত হলেও পায়ের সাথে পা লাগিয়ে দাঁড়ালে তা পূর্ণভাবে পালিত হয়। এ ছাড়া সহীহ বুখারীতে নু‘মান ইবনে বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন:

‘‘আমি আমাদের একজনকে তাঁর পাশের জনের পায়ের গ্রন্থির সাথে তাঁর পায়ের গ্রন্থি মিলাতে দেখেছি’’ [. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল আযান, বাব নং ৪৭;১/২৫৪।]।

বস্তুত পায়ের সাথে পা মিলানো কথাটি হাদীসে সুস্পষ্টভাবে থাকা সত্ত্বেও গোড়ালির সাথে গোড়ালি মিলানোর দ্বারা এর ব্যাখ্যা করা আদৌ সমীচীন নয়। কেননা, ‘কা‘ব’ ( كعب ) শব্দটির আভিধানিক অর্থ: টাখনু বা গ্রন্থি। তা পায়ের গোড়ালির অর্থ প্রকাশ করার কথা কোনো অভিধানে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া এর দ্বারা যদি গোড়ালির অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে থাকতো, তা হলে আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও নু‘মান ইবনে বশীর এর হাদীসে বর্ণিত ‘ক্বাদাম’ ও ‘কা‘ব’ শব্দের পূর্বের ক্রিয়াপদটি ( يُلْزِقُ ) না হয়ে ( يُسَوِّيْ ) ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ কথাটি এভাবে হতো: ‘আমাদের একজন তাঁর পায়ের গোড়ালী অপরজনের গোড়ালির বরাবর করতো’। কিন্তু কথাটি এভাবে না হয়ে হয়েছে: ‘আমাদের একজন তাঁর পা অপরজনের পায়ের সাথে লাগাতেন’। এতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবীগণ আসলে পায়ের সাথেই পা মিলাতেন। কেননা, এতে দু’জনের মাঝে ফাঁক না রাখা সংক্রান্ত রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নির্দেশ পূর্ণভাবে পালিত হয়; যা গোড়ালির সাথে গোড়ালি বরাবর করলে সঠিকভাবে পালিত হয় না। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এ ব্যাখ্যাটি হাদীস বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এবং মাযহাবের সকলের দ্বারা সমর্থিত না হয়ে কারো কারো দ্বারা সমর্থিত হওয়া সত্ত্বেও এটাই আমাদের নিকট অনুসরণীয় হয়ে রয়েছে। যা আদৌ উচিত নয়।

তিন, জানাযার নামাযে সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ:

সহীহ বুখারীতে ত্বলহা ইবন ‘আব্দিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন: ‘‘আমি ইবনে ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পিছনে একটি জানাযার নামায আদায় করলাম, তিনি তখন তাতে সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ করলেন। তিনি বললেন: এটি পাঠ করা সুন্নাত’’। [. হাদীসটি নিম্নরূপ: " عن طلحة بن عبد الله بن عوف قال : صَلَّيْتُ خَلْفَ ابنِ عباسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ . قَالَ لِتَعْلَمُوْا أنَهَّاَ سُنَّةٌّ . দেখুন: বুখারী, প্রাগুক্ত;কিতাবুল জানাইয, বাব: নং ৬৪, হাদীস নং ১২৭০, ১/৪৪৮; ইবনে হাজার আসক্বালানী, ফতুহুতল বারী; বাব নং ৬৫, হাদীস নং ১৩৩৫; ৩/২০৩।] সুনানে নাসাঈ এর বর্ণনায় রয়েছে: ‘‘তিনি তখন তাতে সূরা ফাতিহাঃ এবং অপর একটি সূরা সশব্দে পাঠ করলেন, এমনকি আমরা তা শুনতে পেলাম। জানাযা শেষ হলে পরে আমি তাঁর হাত ধরে তাঁকে তা সশব্দে পাঠ করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন: তোমরা যাতে অবগত হতে পারো যে, এটা পাঠ করা সুন্নাত ও হক, সে-জন্যেই আমি তা সশব্দে পাঠ করলাম’’। [. সুনানে নাসাঈর বর্ণনাটি নিম্নরূপ: فِقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَ سُوْرَةً، وَجَهَرَ حَتَّى أَسْمَعنَا، فَلَمَّا فَرَغَ أَخَذْتُ بِيَدِهِ ، فَسَأَلْتُهُ ؟ قَالَ : إِنَّمَا جَهَرْتُ لِتَعْلَمُوْا أَنَّهَا سُنَّةٌ وًَ حَقٌّ ." - দেখুন:ইমাম নাসাঈ, প্রাগুক্ত;কিতাবুল জানাইয, বাব: আদ-দু‘আ, হাদীস নং১৯৮৭, ৪/৭৬; ইবনে হিববান, প্রাগুক্ত;৭/৩৪০।]

উপর্যুক্ত এ-হাদীস দু’টি দ্বারা জানাযার নামাযে সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ করার কথা প্রমাণিত হয়। ইমাম ইবনে হাজার ‘আসক্বলানী বলেন:

‘‘জানাযার নামাযে সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ করার বিষয়টি বিরোধপূর্ণ। ইমাম ইবনুল মুনযির রহ. ইবনে মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, হাসান ইবনে ‘আলী ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে তা পাঠ করার বিধানের কথা বর্ণনা করেছেন। আর এটাই ইমাম শাফিঈ, আহমদ ও ইসহাক্বের মত। তবে আবু হুরায়রা ও ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর ‘আমল থেকে জানাযার নামাযে কোনো কিরাত না থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে। আর এটি ইমাম মালিক ও কূফাবাসীদের মত। [. ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী; ৩/২০৩।]

ইমাম নাসাঈ কর্তৃক উপরে বর্ণিত হাদীসটি ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করার পর বলেন:

‘‘এ হাদীসটি হাসান-সহীহ। রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কতিপয় সাহাবী এবং অন্যান্য কিছু বিদ্বানগণের এ হাদীসের উপর ‘আমল রয়েছে, তাঁরা প্রথম তকবীরের পর সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ করাকে পছন্দ করেন। এটাই ইমাম শাফিঈ, আহমদ ও ইসহাকের মত। আবার কোনো কোনো বিদ্বান বলেছেন: জানাযার নামাযে কুরআন পাঠ করা হবে না। কেননা, জানাযার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা, তাঁর রাসূলের প্রতি দরূদ পাঠ করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দো‘আ করা বৈ আর কিছুই নয়। এটিই ইমাম ছাওরী ও অন্যান্য কূফাবাসীদের মত’’। [. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানাইয, বাব নং ৩৯, হাদীস নং ১০২৭; ৩/৩৪৬।]

আমাদের দেশে জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহাঃ পাঠ করার প্রচলন নেই। কারণ, আমাদের মাযহাবে এটি পাঠ করার অনুমোদন নেই। যেমন ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) তাঁর মুওয়াত্ত্বা গ্রন্থে লিখেছেন:

" لا قراءة على الجنازة ، و هو قول أبي حنيفة "

‘‘জানাযার নামাযে কোনো কিরাত নেই, এটিই ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মত’’। [.আশ-শয়বানী, ইমাম মুহাম্মদ ইবন হাসান, প্রাগুক্ত;পৃ.১৬৯; সারখাসী, আবু বকর মুহাম্মদ ইবন আহমদ, আল-মাবসূত; (করাচী: এদারাতুল কুরআন ওয়াল ‘উলূমিল ইসলামিয়্যাঃ, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮৭ইং), ২ / ৬৪।] দলীল হিসেবে তিনি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর ‘আমল সম্বলিত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে তিনি বলেন: যখন জানাযা রাখা হয় তখন আমি তকবীর পাঠ করি, অতঃপর আল্লাহর প্রশংসা করি এবং তাঁর রাসূলের উপর দরূদ পাঠ করি। এরপর মৃতের জন্য দো‘আ করি...’’। [. ইমাম মুহাম্মদ, প্রাগুক্ত; পৃ.১৬৮।]

জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহাঃ পাঠ করার বিধান হানাফী মাযহাব ও অপর কোনো কোনো ইমামদের মতে না থাকলেও নিম্নে বর্ণিত কারণে আমাদের পক্ষে তা পাঠ করা উচিত:

জানাযার নামাযে তা পাঠ করা সুন্নাত হওয়ার বিষয়টি উপর্যুক্ত বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। না পাঠ করার বিষয়টি কোনো কোনো সাহাবীদের ‘আমল দ্বারা প্রমাণিত হলেও যেহেতু তা পাঠ করাও সাহাবীদের ‘আমল দ্বারা সুন্নাত বলে প্রমাণিত, সেহেতু মৃতের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে তা পাঠ করাই উত্তম।

কোন সাহাবী যদি কোনো বিষয়ে এ-কথা বলেন: ‘‘এমনটি করা সুন্নাত’’, তা হলে হানাফী মাযহাবের অগ্রবর্তী ফিকহের উসূলবিদ [.হানাফী ফিকাহবিদদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইমাম ইবনুল হুমাম তাঁর ‘আত-তাহরীর’ গ্রন্থে এবং এর ভাষ্যকার ইবনে আমীর আল-হাজও এ-জাতীয় কথাকে মুসনাদ মরফূ‘ হাদীস হিসাবে গ্রহণ করার বিষয়টিকে সঠিক মাযহাব বলে স্বীকার করেছেন। দেখুন:ইবনে আমীর আল-হাজ্জ, শরহুত তাহরীর; ২/২২৪।] ও শাফিঈ মাযহাবের উসূলবিদদের [.দেখুন: ইমাম নববী, ইয়াহইয়া ইবনে শরফ, আল-মাজমূ‘ শরহুল মুহায্যাব; (স্থান বিহীন: দারুল ফিকর, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ৫/২৩২।] মতে এ-কথাটি মুসনাদ মুরফূ‘ হাদীস হিসেবে গণ্য হবে। এ নিয়মের দৃষ্টিকোণ থেকেও তা পাঠ করা সুন্নাত বলে প্রমাণিত হয়। যদিও হানাফী মাযহাবের পরবর্তী ফকীহগণ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এ হাদীসকে উক্ত নিয়মের আওতাধীন মনে করেন না। তাঁরা এটাকে বেদ‘আতের বিপরীত যে সুন্নাত রয়েছে, সে রকম সুন্নাত বলে মনে করেন। অর্থাৎ তাঁদের মতে জানাযার নামায সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ ক’রে এবং না ক’রে দু’ভাবে আদায় করাই সুন্নাত।

ইমাম আছরামের বর্ণনামতে বিশিষ্ট তাবে‘ঈ মুজাহিদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি তা পাঠ করার বিষয়টি ১৮ জন সাহাবীকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা সকলেই তা পাঠ করার কথা বলেছেন। [.আল-লক্ষ্ণৌভী, আবুল হাসানাত মুহাম্মদ আব্দুল হাই আল-হানাফী, আত-তা‘লীকুল মুমাজ্জাদ ‘আলা মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ; (দেওবন্দ: আশরাফী বুক ডিপো, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ.১৬৯।]

তা পাঠ করার বিষয়টি উম্মে শুরাইক রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত একটি মুসনাদ হাদীস দ্বারাও সমর্থিত। তিনি বলেন: ‘‘রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- আমাদেরকে জানাযার নামাযে সূরায়ে ফাতিহাঃ পাঠ করার নির্দেশ করেছেন।’’ [. ইবনে মা-জাঃ, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানাইয, বাব নং ২২, হাদীস নং ১৪৭৬, ৩/৪৭৯। [(এর সনদ দুর্বল), সম্পাদক]] এ হাদীসের সনদে সামান্য দুর্বলতা থাকলেও [.ইমাম ইবনে হাজার ‘আছক্বালানী এ হাদীসের সনদে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। দেখুন : আবুল হাসানাত আব্দুল হাই, প্রাগুক্ত; পৃ.১৬৯। [শাইখ আলবানীও হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন]] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত এবং অন্যান্য সাহাবীদের মতামত দ্বারা এ হাদীসের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার ফলে তা পাঠ করার বিষয়টি রাসূল -সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয়।

তা পাঠ না করার বিষয়টি কোনো কোন সাহাবীর ব্যক্তিগত ‘আমল দ্বারা প্রমাণিত হলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোনো সহীহ বা দুর্বল হাদীস দ্বারা তা পাঠ না করার বিষয়টি প্রমাণিত নয়।

সাহাবীদের মধ্যে যারা তা পাঠ না করার পক্ষে ছিলেন, তাঁরা হয়তো তা পাঠ করা সুন্নাত এ কথাটি অবগত হতে পারেন নি। পরবর্তীতে যখন সাহাবাদের মাঝে এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত দেখা দেয়, তখন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা তা সশব্দে পাঠ ক’রে এর সুন্নাত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এ ঘটনার বর্ণনা প্রসঙ্গে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস দ্বারা এ-কথাই প্রমাণিত হয়।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এবং অন্যান্য ইমামগণের নিকট ইবনে আব্বাসের হাদীস পৌঁছে থাকলে তাঁরা অবশ্যই তা পাঠ করার ব্যাপারে মত দিতেন। কেননা, তাঁরা বলেছেন : ‘‘হাদীস যখন সহীহ হিসেবে পাওয়া যাবে তখন সেটাই হবে আমাদের মত’’। [.ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেছেন: إذا صح الحديث فهو مذهبي . ‘‘হাদীস যখন সহীহ হবে সেটাই আমার মাযহাব হবে’’। দেখুন:ইবনে ‘আবিদীন, হাশিয়াতু রদ্দিল মুহতার ‘আলাদ দুররিল মুখতার; ১/৬৭।] অথবা অন্তত তাঁরা এমনটি বলতেন : তা পাঠ করা উত্তম, তবে না করলেও কোনো অসুবিধা নেই।

জানাযার নামাযে রুকু‘ ও সেজদা না থাকলেও তা ফরয নামাযের ন্যায় ক্বিবলা মুখী হয়ে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমার সাথে আদায় করতে হয়। এর উদ্দেশ্য মৃত মানুষের জন্য দো‘আ হয়ে থাকলেও শর‘য়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক ধরনের নামায। সে জন্যে তাতে সূরা ফাতিহাঃ পাঠ করা আবশ্যক। কেননা, ‘‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহাঃ পাঠ করে নি তার কোনো নামায নেই’’ [.বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাব নং ১৬, সিফাতিস সালাত, বাব নং ১৩, হাদীস নং ৭২৩, ১/২৬৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; ১/২৯৫;তিরমিযী, প্রাগুক্ত; ২/২৫।], এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক যে সব সাধারণ হাদীস রয়েছে, জানাযার নামাযও সে সব সাধারণ হাদীসের আওতায় পড়ে।

তা ক্বিরাত হিসেবে না পাঠ করলেও অন্তত আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও দো‘আ হিসেবে পাঠ করা-ই উত্তম। হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম ত্বহাবী [.ইবনে হাজার ‘আসক্বালানী, ফতহুলবারী;৩/২০৪।] এবং ইমাম ইবনুল হুমাম দো‘আ হিসেবে তা পাঠ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। [.ইবনুল হুমাম, কামাল উদ্দীন মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহিদ, শরহে ফতহুল ক্বাদীর; (দ্বার এহইয়াউত তুরাছিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ১/৪৫৯।]

কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কুরআন পাঠ করা জায়েয হওয়ার পক্ষে কোনো দলীল না থাকা সত্ত্বেও আমরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কবরস্থ ব্যক্তির কল্যাণের জন্য ফাতেহা পাঠ করার একটি সুন্নাত জারি করেছি, অথচ জানাযা করার সময় তা পাঠ করা জায়েয হওয়ার প্রমাণে এত সব দলীল ও যুক্তি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মাযহাবের দোহাই দিয়ে আমরা তা পাঠ করাকে জায়েয মনে করি না।

জানাযার নামাযে ফাতিহাঃ পাঠ করার প্রমাণে এত সব দলীল প্রমাণাদি থাকার কারণে তা পাঠ করা জায়েয হওয়ার বিষয়টি বিশিষ্ট হানাফী ফকীহ হাসান ইবন হাসান শরম্বুলালী (মৃত ১৮২৭ খ্রি.) ও মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী স্বীকার করেছেন। যারা তা পাঠ করাকে মকরূহ বলেন তাদের কথার প্রতিবাদ করার জন্য শরম্বুলালী

( النظم المستطاب لحكم القراءة في صلاة الجنازة بأم الكتاب )

নামে একটি পুস্তকও রচনা করেছেন এবং মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী বলেছেন : তা পাঠ করা মকরূহ বলার কোনই যুক্তি নেই। [. আবুল হাসানাত আব্দুল হাই, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৬৯।]

উপর্যুক্ত বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমরা যাদি সত্যিকার অর্থে কুরআন ও হাদীসের যথার্থ অনুসারী হয়ে থাকি, তা হলে আমাদেরকে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ও উম্মে শুরাইক রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীসের উপর ‘আমল করা উচিত বলে বিবেচিত হবে। জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা : পাঠ করার বিধান আমাদের মাযহাবে নেই, এ কথা বলে ‘আলেম সমাজের পার পাবার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, এর অর্থ হচ্ছে : আমরা দু’টি জায়েয কর্মের মধ্যে যে কাজটি উত্তম, সেটিকে উত্তম বলে স্বীকৃতি না দিয়ে যে কাজটি করা শুধুমাত্র জায়েয সেটির উপর ‘আমল করে সেটিকে উত্তমের পর্যায়ে উন্নীত করছি, আর উত্তম কর্মকে না জায়েয ও মকরূহ বলে তা পরিত্যাগ করছি এবং এ-সব করছি কেবল নিজ মাযহাবের দোহাই দিয়ে অন্ধভাবে তা অনুসরণ করার কারণেই। আবার অনেককে এ-সব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে এবং সহীহ হাদীস অনুযায়ী যা পালন করা উত্তম তা পালন না করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন : এ সব বিষয়ের ফয়সালা বহু পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। এ সব নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কোনই অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো : এ সব নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ যদি না-ই থাকে, তা হলে আমাদের মাযহাবেরই বিশিষ্ট মনীষীগণ কেনইবা আমাদের মধ্যে প্রচলিত এসব ‘আমলের বিপরীত ‘আমলকে সঠিক বলে মন্তব্য করলেন? এতে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের মাঝে প্রচলিত কোনো কোনো ‘আমলের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ রয়েছে। আর সে জন্যেই তাঁরা উপর্যুক্ত ধরনের মন্তব্য করেছেন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আমাদের মাঝে এমনও কিছু কর্ম রয়েছে যা প্রচলিত নিয়মে না হয়ে অন্যভাবে হওয়াই উচিত ও উত্তম ছিল। কিন্তু মাযহাবে অনুত্তম কর্ম প্রচলিত হয়ে গেছে বলেই আমরা আর সঠিক ও উত্তম ‘আমলে ফিরে যেতে চাই না। অনুসরণের ক্ষেত্রে এমন মানসিকতা পোষণ করা কি সঠিক তা আমাদের ভেবে দেখা উচিত। এ-ভাবে মাযহাবের অন্ধ তাকলীদ করার কথা বলে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সঠিক বা উত্তম ‘আমল পরিত্যাগ করলে আখেরাতে কি পরিত্রাণ পাওয়া যাবে? এতে কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যথার্থ অনুসরণ ও আনুগত্য হবে?

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন