HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কুরআন ও সুন্নাহ’য় বর্ণিত শাফা‘আত এবং শাফা‘আতকারী

লেখকঃ শাইখ ইবরাহীম ইবন আবদিল্লাহ আল-হাযেমী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কুরআন ও সুন্নাহ’য় বর্ণিত

শাফা‘আত এবং শাফা‘আতকারী

শাইখ ইবরাহীম ইবন আবদিল্লাহ আল-হাযেমী

অনুবাদক : ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা... .. .
লেখক এ গ্রন্থে শাফা‘আত ও শাফা‘আতের প্রকারভেদ এবং স্বীকৃত ও অস্বীকৃত শাফা‘আত সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অতঃপর তিনি শির্কী শাফা‘আত এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য কিয়ামতের দিন যে সকল শাফা‘আত সাব্যস্ত হবে সেগুলো বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া কোনো কোনো কাজ শাফা‘আত লাভের মাধ্যম, তাও বর্ণনা করে শাফা‘আত সম্পর্কিত জাল ও দুর্বল হাদীসসমূহ তুলে ধরেছেন।

ভূমিকা
بسم الله الرحمن الرحيم

নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর নিকট তাওবা করি, আর আমাদের নফসের জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। সুতরাং আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই, আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর প্রতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনের প্রতি রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন।

অতঃপর..

মুসলিম ব্যক্তির ওপর আবশ্যক হলো একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং কথায় ও কাজে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়া, আর স্বচ্ছল ও সংকটময় পরিস্থিতিতে তাঁর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করা। আর আল-কুরআন ও সুন্নাহ’র নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণে পথ চলা।

‘শাফা‘আত’ এর বিষয়টি এমন একটি বিষয়, যার পাঠ ও আলোচনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মুমিন বান্দার ভালোবাসায় বৃদ্ধি করে। আর তিনি হলেন এমন মহান নবী, যিনি তার রব আল্লাহ তা‘আলার নিকট ওসীলা ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আমরা আশা করি একক অদ্বিতীয় মুখাপেক্ষীহীন আল্লাহ কিয়ামতের দিনে আমাদেরকে তার শাফা‘আত থেকে বঞ্চিত করবেন না।

শাফা‘আতের গুরুত্ব বিবেচনায় এনে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ একে আকিদার কিতাবসমূহের মধ্যে সন্নিবেশিত করেছেন; তাই আপনি আকীদা বিষয়ক লেখকদের খুব কম সংখ্যক লেখককেই পাবেন, যারা তার আকিদা সংক্রান্ত কিতাবের মধ্যে শাফা‘আত সম্পর্কে একটি অধ্যায় বা একটি পরিচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করেন নি। যাতে হক তথা আসল বিষয়টি স্পষ্ট হয় এবং বাতিল বিষয়টির মূলোৎপাটন হয়ে যায়।

আর এই কিতাবটি যা আপনার সামনে পেশ করা হল, আল্লাহ চায় তো (ইনশাআল্লাহ) তা ঐ কিতাবসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম একটি কিতাব।... আমি তা রচনার ক্ষেত্রে আল-কুরআনুল কারীম ও সহীহ সুন্নাহ’র ওপর নির্ভর করেছি... আর আমি দুর্বল হাদীস পরিহার করেছি এবং এ বিষয়ে যাঁরা পূর্বে লিখেছেন, তাদের থেকে সহযোগিতা গ্রহণ করেছি।

আর আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যাতে তা কবুল করেন এবং তার দ্বারা পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা তাঁর বান্দাদেরকে উপকৃত করেন।

আর তিনি হলেন এর তত্ত্বাবধায়ক এবং তাতে তিনি সক্ষম।

লিখেছেন: ইবরাহীম ইবন আবদিল্লাহ আল-হাযেমী

(আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন এবং তার ভুলত্রুটিকে শুধরিয়ে দিন)

রিয়াদ: ২৭/০১/১৪১৩ হি.

শাফা‘আত শব্দের শাব্দিক অর্থ
ইবনুল আছীর ‘আন-নিহায়া’ ( النهاية ) গ্রন্থে বলেন: হাদীসের মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে الشفاعة (শাফা‘আত) শব্দটি বারবার আলোচিত হয়েছে, আর তার অর্থ হলো তাদের মধ্যকার সংঘটিত অন্যায় ও অপরাধ থেকে পরিত্রাণের ব্যাপারে আবেদন-নিবেদন করা। বলা হয়:

شفع يشفع شفاعة فهو شافع و شفيع .

সুপারিশকারীকে আরবিতে شافع شفيع বলা হয়। আর যিনি শাফা‘আত তথা সুপারিশ গ্রহণ করেন, তাকে আরবিতে المشفِّع বলা হয়; পক্ষান্তরে যার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, তাকে আরবিতে المشفَّع বলা হয়।

‘আল-কামূস’ ( القاموس ) ও ‘তাজুল ‘আরূস’ ( تاج العروس )-এর মধ্যে আছে: الشفيع মানে: শাফা‘আতের অধিকারী তথা সুপারিশকারী, তার বহুবচন হলো شفعاء আর সুপারিশকারী হলো অন্যের জন্য প্রার্থনাকারী, যাকে সেই ব্যক্তি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করার জন্য সুপারিশকারীরূপে গ্রহণ করল।

উপরোক্ত অভিধানদ্বয়ের মধ্যে আরও আছে: বলা হয়ে থাকে, وشفّعته فيه تشفيعا حين شفع (আর আমি তার ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করেছি, যখন সে সুপারিশ করেছে) অর্থাৎ আমি তার সুপারিশ গ্রহণ করেছি, যেমনটি ‘আল-‘উবাব’ ( العباب ) নামক গ্রন্থে আছে, হাতেম (ত্বাই) নু‘মানকে সম্বোধন করে বলেন:

فككت عديا كلها من إسارها فأفضل و شفعني بقيس بن جحدر

তুমি ‘আদী গোত্রের সকলকে তাদের বাধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছ। সুতরাং আরও একটু বাড়িয়ে দয়া কর এবং কায়েস ইবন জাহদারের ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ কর।

আর ‘হদ’ তথা শরী‘আত নির্ধারিত শাস্তি সম্পর্কিত হাদীসে এসেছে,

«إِذَا بَلَغَ الحدُّ السُّلْطَانَ فَلَعَنَ اللَّهُ الشَّافِعَ وَالْمُشَفِّعَ»

“যখন সুলতান তথা রাষ্ট্র প্রধানের নিকট ‘হদ’ তথা শরী‘আত নির্ধারতি শাস্তির বিষয়টি পৌঁছে যাবে, তখন আল্লাহ সুপারিশকারী ও সুপারিশ গ্রহণকারী উভয়ের ওপর লা‘নত করেন। [যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম রা. থেকে বর্ণিত হাদীস, হাদীসটি বিশুদ্ধ মাওকুফ। (দেখুন: তাবরানী ও মুওয়াত্তা মালেক। -সম্পাদক।)]

আর আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ থেকে বর্ণিত আছে:

« القرآن شافع مشفع , ومَاحِلٌ مُصَدَّق » .

“আল-কুরআন হচ্ছে সুপারিশকারী, যার সুপারিশ গৃহীত হবে এবং এমন পক্ষ বা বিপক্ষ অবলম্বনকারী, যার পক্ষ ও বিপক্ষ সাক্ষীকে সত্যায়ণ করা হয়।” [হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মাওকুফ সনদে বর্ণিত। আর জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ‘মারফু’ সনদে হাদীসটি বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত। দেখুন, ইবন হিব্বান, ১০/১৯৮, হাদীস নং ১০৪৫০; আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ, হাদীস নং ২০১৯; সহীহুল জামি‘উ, হাদীস নং ৪৪৪৩। [সম্পাদক]] অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে এবং তাতে যা রয়েছে তার ওপর আমল করবে, তাহলে কুরআন তার জন্য এমন সুপারিশকারী হবে, যার সুপারিশ গৃহীত হবে; তার গুনাহ ও পদস্খলন থেকে মুক্ত করার জন্য। আর যে তার ওপর আমল ছেড়ে দিবে, সে অপরাধের কারণে গুনাহগার হবে, তার বিরুদ্ধে যে গুণাহের কথা উত্থিত হবে কুরআন সেটার সত্যায়ণ করবে।

সুতরাং المشفِّع মানে: যিনি শাফা‘আত তথা সুপারিশ গ্রহণ করেন, আর المشفَّع মানে: যার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। আর এই অর্থেই হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে: «اشْفَعْ تُشَفَّعْ» (আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে) [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৩।]।

استشفعه إلى فلان অর্থাৎ সে তার কাছে প্রার্থনা করেছে যে, সে যেন তার জন্য অমুকের নিকট সুপারিশ করে। যেমন, সাগানী আ‘শার কবিতা আবৃত্তি করেছেন:

تقول بنتي و قد قربت مرتحلا يا رب جنب أبي الأوصاب و الوجع

واستشفعت من سراة الحي ذا شرف [এখানে ‘আসাসুল বালাগাহ’ ও ‘লিসানুল আরব’ গ্রন্থে ذا شرف বদলে ذا ثقة শব্দটি এসেছে।] فقد عصاها أبوها و الذي شفع

আমার মেয়ে বলে, যখন আমি যাওয়ার সময়ের নিকটবর্তী হয়ে গেছি, হে আমার রব! তুমি আমার পিতার অসুস্থতা ও কষ্টসমূহ দূর করে দাও।

তুমি সম্ভ্রান্ত ভদ্র মানুষদেরকে সুপারিশকারী বানিয়েছ, অথচ তার পিতা গোত্রের নেতৃবৃন্দ ও যে সুপারিশ করবে তার অবাধ্য হয়েছে।

যে সকল আয়াতে শাফা‘আত ও শাফা‘আতকারী নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا يُؤۡخَذُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٤٨﴾ [ البقرة : ٤٨ ]

“আর তোমরা সেদিনের তাকওয়া অবলম্বন কর, যেদিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না। আর কারো সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারো কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না। আর তারা সাহায্যও প্রাপ্ত হবে না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৪৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰكُم مِّن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَ يَوۡمٞ لَّا بَيۡعٞ فِيهِ وَلَا خُلَّةٞ وَلَا شَفَٰعَةٞۗ ﴾ [ البقرة : ٢٥٤ ]

“হে মুমিনগণ! আমরা যা তোমাদেরকে যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে, যেদিন বেচা-কেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৪]

আল্লাহ তা‘আলা কোনো এক সৎ ব্যক্তির বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন:

﴿ءَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً إِن يُرِدۡنِ ٱلرَّحۡمَٰنُ بِضُرّٖ لَّا تُغۡنِ عَنِّي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُنقِذُونِ ٢٣﴾ [ يس : ٢٣ ]

“আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ্ গ্রহণ করব? রহমান আমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ২৩] সুতরাং এই আয়াতসমূহে শাফা‘আতের নেতিবাচক দিকের বর্ণনা রয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:

﴿وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ٥١ ﴾ [ الانعام : ٥١ ]

“আর আপনি এর দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করুন, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রব-এর কাছে সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী। যাতে তারা তাকওয়ার অধিকারী হয়।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১]

আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামবাসীদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

﴿فَمَا لَنَا مِن شَٰفِعِينَ ١٠٠ وَلَا صَدِيقٍ حَمِيمٖ ١٠١ فَلَوۡ أَنَّ لَنَا كَرَّةٗ فَنَكُونَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١٠٢﴾ [ الشعراء : ١٠٠، ١٠٢ ]

“অতএব, আমাদের কোনো সুপারিশকারী নেই এবং কোনো সহৃদয় বন্ধুও নেই। হায়! যদি আমাদের একবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ ঘটত, তাহলে আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম!” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১০০-১০২]

আয়াতে উল্লিখিত حميم শব্দের অর্থ: নিকটতম, আর كرة শব্দের অর্থ: দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তন করা।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ ٤﴾ [ السجدة : ٤ ]

“আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿أَمِ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ شُفَعَآءَۚ قُلۡ أَوَلَوۡ كَانُواْ لَا يَمۡلِكُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَعۡقِلُونَ ٤٣ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ لَّهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٤٤﴾ [ الزمر : ٤٣، ٤٤ ]

“তবে কি তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সুপারিশকারী ধরেছে? বলুন, ‘তারা কোনো কিছুর মালিক না হলেও এবং তারা না বুঝলেও?’ বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন, আসমানসমূহ ও যমীনের মালিকানা তাঁরই, তারপর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৩-৪৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَأَنذِرۡهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡأٓزِفَةِ إِذِ ٱلۡقُلُوبُ لَدَى ٱلۡحَنَاجِرِ كَٰظِمِينَۚ مَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ حَمِيمٖ وَلَا شَفِيعٖ يُطَاعُ ١٨ ﴾ [ غافر : ١٨ ]

আর আপনি তাদেরকে সতর্ক করে দিন আসন্ন দিন [এখানে আয়াতে ٱلۡأٓزِفَةُ শব্দটি এসেছে, যা কিয়ামতের একটি নাম, এ নামকরণের কারণ হচ্ছে, কিয়ামত অতি নিকটে। যেমন, অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ﴿أَزِفَتِ ٱلۡأٓزِفَةُ ٥٧ لَيۡسَ لَهَا مِن دُونِ ٱللَّهِ كَاشِفَةٌ ٥٨﴾ [ النجم : ٥٧، ٥٨ ]] সম্পর্কে -যখন দুঃখ-কষ্ট সম্বরণরত অবস্থায় তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। যালিমদের জন্য কোনো অন্তরংগ বন্ধু নেই এবং এমন কোনো সুপারিশকারীও নেই যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।” [সূরা গাফির, আয়াত: ১৮]

যে সকল আয়াতে শাফা‘আত ও শাফা‘আতকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ ﴾ [ البقرة : ٢٥٥ ]

“কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৫] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ إِذۡنِهِۦۚ ﴾ [ يونس : ٣ ]

“তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَلَدٗاۗ سُبۡحَٰنَهُۥۚ بَلۡ عِبَادٞ مُّكۡرَمُونَ ٢٦ لَا يَسۡبِقُونَهُۥ بِٱلۡقَوۡلِ وَهُم بِأَمۡرِهِۦ يَعۡمَلُونَ ٢٧ يَعۡلَمُ مَا بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَمَا خَلۡفَهُمۡ وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ وَهُم مِّنۡ خَشۡيَتِهِۦ مُشۡفِقُونَ ٢٨﴾ [ الانبياء : ٢٦، ٢٨ ]

“আর তারা বলে, ‘দয়াময় (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তিনি পবিত্র মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা তাঁর আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে। তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে, তা সবই তিনি জানেন। আর তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যই, যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৬-২৮]

এসব আয়াতে শর্তসাপেক্ষে শাফা‘আতকারীর অস্তিত্ব সাব্যস্ত করা হয়েছে; অচিরেই সে শর্তগুলোর বিবরণ আসবে ইনশাআল্লাহ।

তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:

﴿وَيَسۡ‍َٔلُونَكَ عَنِ ٱلۡجِبَالِ فَقُلۡ يَنسِفُهَا رَبِّي نَسۡفٗا ١٠٥ فَيَذَرُهَا قَاعٗا صَفۡصَفٗا ١٠٦ لَّا تَرَىٰ فِيهَا عِوَجٗا وَلَآ أَمۡتٗا ١٠٧ يَوۡمَئِذٖ يَتَّبِعُونَ ٱلدَّاعِيَ لَا عِوَجَ لَهُۥۖ وَخَشَعَتِ ٱلۡأَصۡوَاتُ لِلرَّحۡمَٰنِ فَلَا تَسۡمَعُ إِلَّا هَمۡسٗا ١٠٨ يَوۡمَئِذٖ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُۥ قَوۡلٗا ١٠٩ ﴾ [ طه : ١٠٥، ١٠٩ ]

“আর তারা আপনাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, ‘আমার রব এগুলোকে সমূলে উৎপাটন করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। ‘তারপর তিনি তাকে পরিণত করবেন মসৃণ সমতল ময়দানে, যাতে আপনি বাঁকা ও উঁচু দেখবেন না।’ সেদিন তারা আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে, এ ব্যাপারে এদিক ওদিক করতে পারবে না। আর দয়াময়ের সামনে সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে; কাজেই মৃদু ধ্বনি ছাড়া আপনি কিছুই শুনবেন না। দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, সে ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোনো কাজে আসবে না।” [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১০৫-১০৯] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَلَا يَمۡلِكُ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِ ٱلشَّفَٰعَةَ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦﴾ [ الزخرف : ٨٦ ]

“আর তিনি ছাড়া তারা যাদেরকে ডাকে, তারা সুপারিশের মালিক হবে না, তবে তারা ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়।” [সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]

হাফেয ইবন কাসীর রহ. বলেন: তারপর আল্লাহ্ বলেন: ‘আর তিনি ব্যতীত তারা দেব-দেবী ও মূর্তিসমূহের মধ্য থেকে যাদেরকে ডাকে, তারা সুপারিশের মালিক হবে না; অর্থাৎ তারা তাদের জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখে না। আর আয়াতে আল্লাহর বাণী,

﴿إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ﴾

“তবে তারা ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়” –এটা استثناء منقطع তথা ভিন্ন শ্রেণি থেকে ব্যতিক্রম বর্ণনা [আরবী استثناء এর অর্থ, কোনো কিছুকে ব্যতিক্রম বলা। এই ব্যতিক্রম দুই প্রকার; কখনো কখনো পূর্বোল্লোখিত কথা বা বিধান থেকে ব্যতিক্রম বলা উদ্দেশ্য হয়। তখন এটাকে বলা হয়, استثناء متصل , যা এখানে উদ্দেশ্য নয়। আবার কখনও কখনও নতুন একটি ভিন্নধর্মী ব্যতিক্রম উল্লেখ করা উদ্দেশ্য হয়, যার সাথে পূর্বোক্ত বিধান বা কথার সম্পৃক্ততা থাকে না। এটাকেই বলা হয়, استثناء منقطع হাফেয ইবনে কাসীরের মতে এটাই এখানে উদ্দেশ্য। কারণ, যদি পূর্বোক্ত কথা বা বিধান থেকে এখানে ব্যতিক্রম বলা উদ্দেশ্য ধরা হয়, তবে সেখানে আল্লাহ ছাড়া আরও অন্যান্যদের জন্য শাফা‘আতের মালিকানা সাব্যস্ত করতে হয়, যা অন্যান্য আয়াতের পরিপন্থি।] অর্থাৎ কিন্তু যে বুদ্ধিমত্তার সাথে জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়, তাঁর নিকট তাঁর অনুমতি সাপেক্ষ তার সুপারিশ তাকে উপকৃত করবে।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ لَا تُغۡنِي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ أَن يَأۡذَنَ ٱللَّهُ لِمَن يَشَآءُ وَيَرۡضَىٰٓ ٢٦ ﴾ [ النجم : ٢٦ ]

আর আসমানসমূহে বহু ফিরিশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর; যার জন্য তিনি ইচ্ছে করেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬]

এই আয়াতসমূহ শর্তসাপেক্ষে শাফা‘আত সাব্যস্ত করার ওপর প্রমাণবহ। অচিরেই সে শর্তসমূহের বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

শাফা‘আত সংক্রান্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক আয়াতসমূহে সামঞ্জস্য বিধান
উপরোক্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক শাফা‘আতে সামঞ্জস্য বিধান এভাবে সম্ভব যে, যেসব আয়াতে শাফা‘আত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা দ্বারা ঐ শাফা‘আতটিকে অগ্রহণযোগ্য বা নেতিবাচক সাব্যস্ত করা হয়েছে, যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট চাওয়া হয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ ﴾ [ الزمر : ٤٤ ]

“বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন’।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৪]

আর ইতিবাচক শাফা‘আত কতগুলো শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা হবে:

১. শাফা‘আত করার ব্যাপারে শাফা‘আতকারী ক্ষমতাবান হওয়া, যেমন আল্লাহ তা‘আলা ঐ সুপারিশকারীর ব্যাপারে বলেন, যার কাছে সুপারিশ কামনা করা হয়, অথচ সে সুপারিশ করতে অক্ষম:

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ قُلۡ أَتُنَبِّ‍ُٔونَ ٱللَّهَ بِمَا لَا يَعۡلَمُ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ١٨ ﴾ [ يونس : ١٨ ]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ‘ইবাদাত করছে, যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।’ বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনের এমন কিছুর সংবাদ দিবে, যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র’ এবং তারা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَلَا يَمۡلِكُ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِ ٱلشَّفَٰعَةَ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦﴾ [ الزخرف : ٨٦ ]

আর তিনি ছাড়া তারা যাদেরকে ডাকে, তারা সুপারিশের মালিক হবে না, তবে তারা ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়।” [সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৮৬] সুতরাং এ থেকে জানা গেল যে, মৃতদের কাছে শাফা‘আত বা সুপারিশ কামনা করার অর্থই হচ্ছে, এমন ব্যক্তির নিকট সুপারিশ চাওয়া, যে তার মালিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ ١٣ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثۡلُ خَبِيرٖ ١٤﴾ [ فاطر : ١٣، ١٤ ]

“আর তোমরা তাঁর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো খেজুর আঁটির আবরণেরও অধিকারী নয়। তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দিবে না। আর তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ, তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ আল্লাহর মত কেউই আপনাকে অবহিত করতে পারে না।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৩, ১৪] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُ﴾ [ سبا : ٢٢، ٢٣ ]

“বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ্ মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়। আর এ দু’টিতে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয়।’ আর আল্লাহ্ যাকে অনুমতি দিবেন, সে ছাড়া তাঁর কাছে কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২, ২৩]

২. যার জন্য সুপারিশ করা হবে, সে ব্যক্তি মুসলিম হওয়া; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿مَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ حَمِيمٖ وَلَا شَفِيعٖ يُطَاعُ ١٨ ﴾ [ غافر : ١٨ ]

“যালিমদের জন্য কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই এবং এমন কোনো সুপারিশকারীও নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।” [সূরা গাফের, আয়াত: ১৮] এখানে ‘যালিমগণ’ দ্বারা কাফিরদেরকে বুঝানো হয়েছে; তার দলীল হল, শাফা‘আতের ক্ষেত্রে মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসসমূহ, যা ‘আহলুল কাবায়ের’ তথা কবীরা গুনাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য সাব্যস্ত। অচিরেই যথাস্থানে তার বিবরণ আসবে ইনশাআল্লাহ। আর হাফেয বায়হাকী রহ. তার ‘আশ-শো‘য়াব’ ( الشعب ) গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ২০৫ পৃষ্ঠায় বলেন: এখানে ‘যালিমগণ’ হলো ‘কাফিরগণ’, আর এর প্রমাণ হলো আয়াতের সূচনা হয়েছে কাফিরদের আলোচনা প্রসঙ্গে।

আর হাফেয ইবন কাসীর রহ. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: অর্থাৎ যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছে শির্ক করার মাধ্যমে, তাদের জন্য তাদের মধ্য থেকে কোনো নিকটতম ব্যক্তি থাকবে না, যে তাদের উপকার করবে এবং এমন কোনো সুপারিশকারীও থাকবে না, যে তাদের ব্যাপারে সুপারিশ করবে; বরং তাদের সাথে সকল প্রকার কল্যাণের মাধ্যম বা উপায়সমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

আর মুশরিকদের মধ্য থেকে আবূ তালিবকে আলাদা (ব্যতিক্রম) বিষয় হিসেবে ধর্তব্য করা হয়। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য সুপারিশ করবেন, শেষ পর্যন্ত সে জাহান্নামের উপরিভাগে তথা পায়ের গ্রন্থি পর্যন্ত জাহান্নামের আগুনে থাকবে; অচিরেই যথাস্থানে হাদীসসমূহে তার বিবরণ আসবে ইনশাআল্লাহ।

৩. সুপারিশকারীর জন্য অনুমতি প্রদান; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ [ البقرة : ٢٥٥ ]

“কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৫]

৪. যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তার প্রতি সন্তুষ্টি বা সম্মতি থাকা; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ لَا تُغۡنِي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ أَن يَأۡذَنَ ٱللَّهُ لِمَن يَشَآءُ وَيَرۡضَىٰٓ ٢٦﴾ [ النجم : ٢٦ ]

“আর আসমানসমূহে বহু ফিরিশ্তা রয়েছে; তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর; যার জন্য তিনি ইচ্ছে করেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ﴾ [ الانبياء : ٢٨ ]

“আর তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যই, যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৮]

শাফা‘আত সম্পর্কিত অধ্যায় [শাইখ আবদুল্লাহ ইবন সুলাইমান ইবন মুহাম্মদ ইবন আবদিল ওহ্হাব তার গ্রন্থ ‘তাইসীরুল ‘আযীযিল হামীদ ফী শরহে কিতাবিত তাওহীদ’ ( تيسير العزيز الحميد في شرح كتاب التوحيد ), পৃ. ২৩৫ থেকে উদ্ধৃত।]
প্রাচীনকালে ও আধুনিক কালে মুশরিকগণ শির্কে লিপ্ত হয়ে থাকে কেবলমাত্র শাফা‘আতের আঁচলে লটকে থাকার কারণে; যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [ يونس : ١٨ ]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ‘ইবাদাত করছে, যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [ الزمر : ٣ ]

“আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৩]

সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা (এ মুশরিকরা যাদের কাছে শাফা‘আত কামনা-বাসনা করে শির্ক করছে) তাদের সেসব বাসনাকে কর্তন করে দিয়েছেন এবং তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, তা হলো শির্ক, তিনি নিজে তা থেকে পবিত্র এবং তিনি ব্যতীত সৃষ্টির জন্য কোনো বন্ধু অথবা সুপারিশকারী হয় না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَمَا بَيۡنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍۚ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ ٤ ﴾ [ السجدة : ٤ ]

“আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ৪]

এই অধ্যায়ে লেখক (শাইখ ইমাম মুহাম্মাদ ইবন আবদুল ওহহাব) এটার সপক্ষে দলীল দিতে চেয়েছেন যে, এটা (শাফা‘আত কামনা-বাসনা-ই) হলো প্রকৃত শির্ক, আর শাফা‘আতের ব্যাপারে ঐ ব্যক্তির ধারণা দুনিয়া ও আখিরাতে একেবারেই অস্তিত্বহীন-অসম্ভব ও অবাস্তব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ডাকে এ অজুহাতে যে, সে তার জন্য সুপারিশ করবে, যেমনিভাবে মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করে। অথচ আল্লাহই প্রথমে সুপারিশকারীকে সুপারিশের অনুমতি দিবেন; সুপারিশকারী প্রথমে সুপারিশ করবে না, যেমনটি ধারণা করে আল্লাহর শত্রুগণ।

অতঃপর যদি তুমি বল: যখন কোনো লোক আল্লাহর নিকট কাউকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, তখন তো এভাবে সুপারিশকারীদের মাধ্যমে মহান রবকে সম্মান করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তখন এই সম্মান করাটা শির্ক কীভাবে হবে?

জবাবে বলা হবে: তার সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্য প্রমাণ করে না যে, এটা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। কারণ, এমন অনেক ব্যক্তি আছে, যারা কোনো কোনো ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করার উদ্দেশ্য করে থাকে, অথচ তারা তাকে সম্মান করার দ্বারা মূলত তাকে অসম্মানই করে থাকে, আর এ জন্যই প্রসিদ্ধ প্রবাদের মধ্যে বলা হয়েছে: ‘মূর্খ বন্ধু ক্ষতি করবে কিন্তু জ্ঞানী শত্রু অনিষ্ট করবে না।’ কেননা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সুপারিশকারী ও শরীকদের গ্রহণ করার মাধ্যমে প্রভূত্বের হক নষ্ট করা হয়, ইলাহ’র বড়ত্বকে খাট করে দেখা হয় এবং জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা হয়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَيُعَذِّبَ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقَٰتِ وَٱلۡمُشۡرِكِينَ وَٱلۡمُشۡرِكَٰتِ ٱلظَّآنِّينَ بِٱللَّهِ ظَنَّ ٱلسَّوۡءِۚ عَلَيۡهِمۡ دَآئِرَةُ ٱلسَّوۡءِۖ ﴾ [ الفتح : ٦ ]

“আর যাতে তিনি মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী, মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারী যারা আল্লাহ্ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাদেরকে শাস্তি দেন। অমঙ্গল চক্র তাদের ওপরই আপতিত হয়।” [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ৬] কারণ, তারা তাঁর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত তারা তাঁর সাথে শির্ক করেছে; তারা যদি তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করত, তাহলে তারা তাঁকে সত্যিকার অর্থে একক সত্তা হিসেবে মেনে নিত। আর এজন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মুশরিকদের ব্যাপারে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দান করে না। আর কীভাবেই বা ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে যথাযথ মর্যাদা দান করবে, যে ব্যক্তি অন্যকে তাঁর সমকক্ষ বা সুপারিশকারী গ্রহণ করে, তাকে ভালোবাসে, ভয় করে, তার নিকট পাওয়ার প্রত্যাশা করে, তার প্রতি বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করে, তার ক্রোধ থেকে পলায়ন করে, তার সন্তুষ্টিতে প্রভাবিত হয়, তাকে ডাকে এবং তার উদ্দেশ্যে জবাই ও মানত করে। আর এসবই হলো সমতা বিধান করা, যা মুশরিকগণ আল্লাহ তা‘আলা ও তাদের উপাস্যগণের মধ্যে সাব্যস্ত করে থাকে। আর তারা জাহান্নামে অবস্থানকালে জানতে পারবে যে, এসব ছিল বাতিল ও ভ্রষ্টতা; তাই তখন তারা জাহান্নাম থেকে বলবে:

﴿تَٱللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٩٧ إِذۡ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٨ ﴾ [ الشعراء : ٩٧، ٩٨ ]

“আল্লাহর শপথ! আমরা তো স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টিকুলের রব-এর সমকক্ষ গণ্য করতাম।” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ৯৭-৯৮] আর এটা জানা কথা যে, তারা সত্ত্বাগত, গুণগত ও কর্মের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে তাদেরকে সমকক্ষ মনে করে না, আর তারা এটাও বলে না যে, তাদের উপাস্যগণ (ইলাহগণ) আকাশমণ্ডলী ও যমীন সৃষ্টি করেছে কিংবা তারা জীবন ও মৃত্যু দান করেছে; বরং (তারা যে বিষয়ে তাদের উপাস্যদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিয়েছে, তা হচ্ছে) তারা ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে তাদের উপাস্যদেরকে সমকক্ষ মনে করেছে; যেমন তুমি যার ওপর মুসলিম নামধারী শির্কপন্থীদেরকে দেখতে পাও।

আর (আমরা যে বলেছি যে) এটা (আল্লাহ কাছে অন্যকে সুপারিশকারী হিসেবে নির্ধারণ করা) দ্বারা প্রভূত্বের হক নষ্ট করা হয়, ইলাহের শ্রেষ্ঠত্বকে খাট করা দেখা হয় এবং জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা হয়; এর কারণ হচ্ছে, সুপারিশকারী নির্ধারণ ও সমকক্ষ গ্রহণকারী ব্যক্তি- হয় ধারণা করে থাকে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বিশ্বের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তাঁর সাথে ওযীর (মন্ত্রী) অথবা সাহায্য ও সহায়তাকারীর প্রয়োজন মনে করেন, আর এটা (এ ধরনের ধারণা) হলো ঐ সত্ত্বার জন্য বড় ধরনের খুঁত, যিনি সত্ত্বাগতভাবে তিনি ভিন্ন সকল কিছু থেকে মুখাপেক্ষীহীন এবং তিনি ভিন্ন সকল কিছুই প্রকৃতিগতভাবে তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী। অথবা সে ধারণা করে থাকে যে, তিনি (আল্লাহ) জানেন না, যতক্ষণ না সুপারিশকারী তাঁকে জানিয়ে দেয় অথবা তিনি (কারও ওপর) দয়া করবেন না, যতক্ষণ না তার প্রতি সুপারিশকারী ব্যক্তি দয়া করা শুরু করবে অথবা তিনি একা একা কোনো কাজের জন্য যথেষ্ট নন অথবা তিনি বান্দার প্রার্থিত বিষয় বান্দাকে প্রদান করেন না, যতক্ষণ না সে (সুপারিশকারী বা সমকক্ষ) তাঁর নিকট সুপারিশ করবে, যেমনিভাবে বান্দাদের মধ্যে এ ধরণের সুপারিশের প্রচলন রয়েছে অথবা তিনি তাঁর বান্দাদের দো‘আ কবুল করেন না, যতক্ষণ না তারা সুপারিশকারীর নিকট আবেদন করে যে, সে যেন তাদের প্রয়োজনের কথা তাঁর নিকট উপস্থাপন করে, যেমনটি দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের দরবারে হয়ে থাকে। আর বস্তুত এটাই হলো সৃষ্টির (মানুষের) শির্ক সংঘটিত হওয়ার প্রকৃত কারণ। অথবা তার ধারণা, তিনি (আল্লাহ) শুনেন না, যতক্ষণ না সুপারিশকারী এই বিষয়টি তাঁর নিকট পেশ করে; অথবা তার ধারণা, তাঁর ওপর সুপারিশকারীর অধিকার রয়েছে, ফলে সে অধিকারের জোরে তার ওপর কসম করে সে দাবী আদায় করে নিবে ও সে এই সুপারিশকারীর মাধ্যমে তাঁর নিকট মিনতি করে, যেমনিভাবে মানুষ মহাজন ও রাজা-বাদশাদের নিকট তাদের প্রিয় ব্যক্তির মাধ্যমে আবেদন-নিবেদন পেশ করে। বস্তুতঃ এ ধরনের সব কিছুই প্রভূত্বকে অসম্মান করে ও তার অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। ইবনুল কাইয়্যেম অনুরূপ আলোচনা করেছেন। সুতরাং এসব বিষয় ও অন্যান্য বিষয়ের কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ ধরনের সব কিছুই শির্ক এবং তা থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ قُلۡ أَتُنَبِّ‍ُٔونَ ٱللَّهَ بِمَا لَا يَعۡلَمُ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ١٨ ﴾ [ يونس : ١٨ ]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ‘ইবাদাত করছে, যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।’ বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনের এমন কিছুর সংবাদ দিবে, যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র’ এবং তারা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮]

অতঃপর যদি তুমি বল: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তো ঐ ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে শির্ক সাব্যস্ত করেছেন, যে সুপারিশকারীদের উপাসনা করে; পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তাদেরকে শুধু সুপারিশ করার জন্য ডাকে, সে তো তাদের উপাসনা করে না। সুতরাং এটা শির্ক হবে না।

জবাবে বলা হবে: শুধুমাত্র কাউকে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করাই শির্ক আবশ্যক করে, আর শির্কও সুপারিশের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত; যেমনিভাবে শির্কের সাথে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে হীনতা ও অপমান অবশ্যম্ভাবী উপাদান, আর হীনতা বা অসম্মানও শির্কের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শির্ককারী মুশরিক সেটা স্বীকার করুক বা অস্বীকার করুক। এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, প্রকৃত অর্থে উপরোক্ত প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে অসার, এ প্রশ্নের কোনো অস্তিত্ব বাইরে নেই, এটা শুধু এমন জিনিস যা মুশরিকরা তাদের স্মৃতিপটে স্থির করেছে। কারণ, দো‘আ বা আহ্বান করাই তো ‘ইবাদত, বরং তা ইবাদতের মগজ তথা মূল। সুতরাং সে যখন তাদেরকে সুপারিশ করার জন্য ডাকে, তখন সে তাদের উপাসনা করে এবং সে আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে শির্ক করে, সে সেটা স্বীকার করুক বা না করুক।

তিনি (অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওহহাব) বলেন: আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ﴾ [ الانعام : ٥١ ]

“আর আপনি এর দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করুন, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রব-এর কাছে সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১]

ব্যাখ্যা: الإنذار (ভয় প্রদর্শন) অর্থ: ভয়ানক জায়গা সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া, আর তাঁর বাণী: به -এর ব্যাখায় আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, بالقرآن (আল-কুরআনের মাধ্যমে) আর তাঁর বাণী: ﴿ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ ﴾ [ الانعام : ٥١ ] “যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রব-এর কাছে সমবেত করা হবে...” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১] অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! আপনি আল-কুরআনের মাধ্যমে ঐসব লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন করুন, যারা তাদের প্রতিপালকের ভয়ে শঙ্কিত। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, ভয় করে মন্দ হিসাবকে এবং তারা মুমিন যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা ও সুদ্দী রহ. থেকে। আর ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত: তিনি তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টিকে সাবধান করেন না, বরং তিনি সাবধান করেন শুধু তাদেরকে, যারা বুদ্ধিমান; তাই তো তিনি বলেন: ﴿وَأَنذِرۡ بِهِ ٱلَّذِينَ يَخَافُونَ أَن يُحۡشَرُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّهِمۡ﴾ “আর আপনি এর দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করুন, যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রব-এর কাছে সমবেত করা হবে” অর্থাৎ তারা হলেন মুমিন, সতর্ক হৃদয়ের অধিকারী। সুতরাং তারা কাঙ্খিত ব্যক্তিবর্গ, যাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। তারা ঐশ্বর্যশালী দাম্ভিক ও কর্তৃত্বের অধিকারী অহংকারী নয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা-ছবি ও ধন-সম্পদের প্রতি দৃষ্টি দেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কৃতকর্মের প্রতি লক্ষ্য করেন।

আর তাঁর বাণী: ﴿لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ ﴾ [ الانعام : ٥١ ] “তিনি ছাড়া তাদের জন্য থাকবে না কোনো অভিভাবক বা সুপারিশকারী।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১] এ আয়াত সম্পর্কে যাজ্জাজ বলেন: ليس এর জায়গাটি হাল ( حال ) হওয়ার ভিত্তিতে নসবের অবস্থানে, মনে হয় যেন তিনি বলেন: (হাশরের মাঠে আসবে) এমতাবস্থায় যে, তারা বন্ধু ও সুপারিশকারী থেকে মুক্ত, আর তাতে ‘আমিল ( عامل ) হলো: يخافون (তারা ভয় করে) আর ইবন কাসীর বলেন: সেদিন তিনি ব্যতীত তাদের জন্য, তিনি যদি তাদেরকে শাস্তি দিতে চান, তাহলে তাঁর শাস্তি থেকে রক্ষাকারী কোনো বন্ধু ও সুপারিশকারী নেই। (তারপর আল্লাহ বলেন) ﴿لَّعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ﴾ তাহলে আশা করা যায় তারা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করবে, (ভয় করবে), ফলে তারা এ দুনিয়ার জগতে এমন আমল করবে, যার বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাঁর শাস্তি থেকে তাদেরকে মুক্তি দিবেন।

আমি (শাইখ সুলাইমান ইবন মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওহহাব) বলি: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মুমিনদের জন্য তিনি ব্যতীত অন্য কোনো বন্ধু ও সুপারিশকারী হওয়ার ব্যাপারটি সে অর্থে অস্বীকার করেছেন, যেমনটি মুশরিকদের বিশ্বাস [কারণ, মুশরিকরা মনে করে থাকে যে, আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত বা কোনো রূপ শর্ত ছাড়াই কোনো কোনো লোক তাদের জন্য সুপারিশ করবে, আর তারা তাই তাদের কাছে সুপারিশ চেয়ে বেড়ায়। এটাই আয়াতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু যে সুপারিশ কবিরা গোনাহগার মুমিনদের কাজে আসবে, তা হচ্ছে ঐ সুপারিশ যাতে মুমিনরা বিশ্বাস করে যে তা সংঘটিত হবে শর্ত সাপেক্ষে, আর তারা তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে চেয়ে বেড়ায় না। [সম্পাদক]] সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত কোনো সুপারিশকারী গ্রহণ করে, সে ব্যক্তি মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তার শাফা‘আত নসীব হবে না। তবে আয়াতের মধ্যে আল্লাহর অনুমতিক্রমে কবীরা গুনাহকারী ব্যক্তিদের জন্য শাফা‘আত সাব্যস্ত না হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রমাণ নেই, যেমনটি দাবি করে মু‘তাযিলাগণ, বরং তাঁর অনুমতিক্রমে শাফা‘আত সাব্যস্ত হয়েছে (আল-কুরআনের) অনেক জায়গায়। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا مِن شَفِيعٍ إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ إِذۡنِهِۦۚ ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُوهُۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [ يونس : ٣ ]

“তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব; কাজেই তোমরা তাঁরই ‘ইবাদাত কর। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩]

তিনি (অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওহহাব) বলেন: আর তাঁর (আল্লাহর) বাণী:

﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ ﴾ [ الزمر : ٤٤ ]

“বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন’।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৪]

ব্যাখ্যা: লেখক এভাবেই তা পেশ করেছেন, আর আমরা তার ওপর এবং তার পূর্ববর্তী আয়াতের ওপর আলোচনা করব, যাতে অর্থটি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿أَمِ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ شُفَعَآءَۚ قُلۡ أَوَلَوۡ كَانُواْ لَا يَمۡلِكُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَعۡقِلُونَ ٤٣ قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ لَّهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٤٤﴾ [ الزمر : ٤٣، ٤٤ ]

“তবে কি তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সুপারিশকারী ধরেছে? বলুন, ‘তারা কোনো কিছুর মালিক না হলেও এবং তারা না বুঝলেও?’ বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন, আসমানসমূহ ও যমীনের মালিকানা তাঁরই, তারপর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৪৩-৪৪]

এখানে আল্লাহর বাণী: ﴿أَمِ ٱتَّخَذُواْ ﴾ এর হামযা (أ ) টি অস্বীকার করার অর্থে; অর্থাৎ বরং মুশরিকগণ আল্লাহ ব্যতীত কিছু সুপারিশকারী নির্ধারণ করে নিয়েছে [এভাবে সুপারিশকারী নির্ধারণ করার কাজটি তারা মোটেই ঠিক করে নি। আর এটাই استفهام إنكاري বা অস্বীকারমূলক প্রশ্ন করার অর্থ। যখনই কোথাও এ ধরনের প্রশ্ন আসে, তখন পূর্বের কাজটিকে অস্বীকার করা হয়, অনুমোদিত নয় বলা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। [সম্পাদক]]। অর্থাৎ তারা (সুপারিশকারীগণ) কি তাদের জন্য তাদের ধারণা অনুযায়ী আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করবে [অর্থাৎ কখনও তারা তা করবে না। কারণ তারা সে শাফা‘আতের মালিক নয়। [সম্পাদক]]? যেমনটি তিনি বলেছেন:

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [ يونس : ١٨ ]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ‘ইবাদাত করছে, যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী [অর্থাৎ পূর্ববর্তী আয়াতের শাফা‘আতের বিষয়টি এ আয়াতের আলোকে বুঝতে হবে। এখানে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে তারা এভাবে কাউকে শাফা‘আতকারী ভেবে ভুল করছে, তেমনি পূর্ববর্তী আয়াতেও শাফা‘আতকারী নির্ধারণ করাকে ভুল ও গর্হিত কাজ হিসেবে দেখানো হয়েছে। [সম্পাদক]]।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮] তিনি আর বলেন:

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣﴾ [ الزمر : ٣ ]

“আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে এনে দিবে।’ তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৩] সুতরাং এই (আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সুপারিশকারী সাব্যস্ত করার) কারণে তিনি তাদেরকে মিথ্যাবাদী ও প্রচণ্ড কাফির বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿فَلَوۡلَا نَصَرَهُمُ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ قُرۡبَانًا ءَالِهَةَۢۖ بَلۡ ضَلُّواْ عَنۡهُمۡۚ وَذَٰلِكَ إِفۡكُهُمۡ وَمَا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ ٢٨ ﴾ [ الاحقاف : ٢٨ ]

“অতঃপর তারা আল্লাহ সান্নিধ্য লাভের জন্য আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছিল তারা তাদেরকে সাহায্য করল না কেন? বরং তাদের ইলাহগুলো তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল। আর এটা ছিল তাদের মিথ্যাচার; এবং যা তারা অলীক উদ্ভাবন করছিল।” [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ২৮]

সুতরাং এটাই হলো মুশরিকগণ যাদের ইবাদত বা উপাসনা করে, তাদের নিকট থেকে তাদের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া, আর তা হল, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের জন্য সুপারিশ করা।

আর তাঁর বাণী: ﴿مِن دُونِ ٱللَّهِ﴾ (আল্লাহ ছাড়া) অর্থাৎ আল্লাহর অনুমতি ও নির্দেশ ছাড়া; বাস্তব অবস্থা হল, তাঁর নিকট তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ সুপারিশ করতে পারবে না, আর যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তাকেও তাঁর পছন্দসই ব্যক্তি হওয়া লাগবে, আর এখানে দু’টি শর্তই নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ছাড়া অন্যদেরকে সুপারিশকারী গ্রহণ করা এবং তাদের ডাকাডাকি করাকে তাঁর অনুমতি ও সন্তুষ্টির উপলক্ষ্য বানান নি, বরং এটা হলো তাঁর অনুমতি না পাওয়া ও অসন্তুষ্টির কারণ।

তাঁর বাণী: ﴿قُلۡ أَوَلَوۡ كَانُواْ لَا يَمۡلِكُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَعۡقِلُونَ﴾ “বলুন, ‘তারা কোনো কিছুর মালিক না হলেও এবং তারা না বুঝলেও?” [সূরা যুমার, আয়াত: ৪৩] অর্থাৎ এই ধরনের (হীন) গুণাগুণবিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কি তারা সুপারিশ করতে পারবে? যেমন তোমরা তাদেরকে দেখতে পাচ্ছ নিষ্প্রাণ, শক্তি-সামর্থ্যহীন ও অবুঝ অথবা মৃত, এমনকি তারা সুপারিশের মালিকও নয়, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ ﴾ [ الزمر : ٤٤ ]

“বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন’।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৪৪] অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে তিনিই সে সুপারিশের মালিক। সুতরাং তোমরা যাদেরকে ডাক, তা থেকে তারা কোনো কিছুরই মালিক নয়। বায়যাবী রহ. বলেন, এটা সম্ভবত: তাদের একটি অভিযোগের উত্তর, তারা অভিযোগ করে বলতে পারে যে, সুপারিশকারীরা (যাদেরকে তার সুপারিশ করার মালিক মনে করছে) তারা তো আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা, আর এগুলো সেসব (নৈকট্যপ্রাপ্ত) বান্দাদেরই প্রতিকৃতি সুতরাং তারা সুপারিশের মালিক হতে পারে, তখন তার উত্তরেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, বলুন, সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন। তার মানে- তিনি শাফা‘আতের একচ্ছত্র মালিক, তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউই সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখে না এবং তিনি ব্যতীত কেউই এর ব্যাপারে স্বনির্ভর হতে পারে না।

আর তাঁর বাণী: ﴿لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ﴾ [ الحديد : ٢ ] “আসমানসমূহ ও যমীনের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২] এখানেও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সুপারিশকারী গ্রহণের অসারতার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কারণ, তিনি হলেন গোটা সাম্রাজ্য ও কর্তৃত্বের মালিক; তাঁর কোনো বিষয়ে কোনো ব্যক্তি তাঁর অনুমতি ও সম্মতি ব্যতীত কথা বলার অধিকার রাখে না। সুতরাং শাফা‘আতের মালিকানার বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অতএব, তিনিই যখন শাফা‘আতের মালিক, তখন তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে, সে যে-ই হোক না কেন, শাফা‘আতের অধিকারী (মালিক) হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়।

আর তাঁর বাণী: ﴿ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ﴾ “তারপর তাঁরই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে”। অর্থাৎ তোমরা জেনে রাখ যে, তারা সুপারিশ করবে না, আর তাদের পূজা করার ক্ষেত্রে তোমাদের সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা বিফল হবে, বরং তারা তোমাদের জন্য হিতে বিপরীত হবে এবং তোমাদের পূজা-অর্চনা থেকে তারা দায়মুক্ত হয়ে পড়বে, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَيَوۡمَ نَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشۡرَكُواْ مَكَانَكُمۡ أَنتُمۡ وَشُرَكَآؤُكُمۡۚ فَزَيَّلۡنَا بَيۡنَهُمۡۖ وَقَالَ شُرَكَآؤُهُم مَّا كُنتُمۡ إِيَّانَا تَعۡبُدُونَ ٢٨ فَكَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدَۢا بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمۡ إِن كُنَّا عَنۡ عِبَادَتِكُمۡ لَغَٰفِلِينَ ٢٩﴾ [ يونس : ٢٨، ٢٩ ]

“আর যেদিন আমরা তাদের সবাইকে একত্র করে যারা মুশরিক তাদেরকে বলব, ‘তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে তারা নিজ নিজ স্থানে অবস্থান কর।’ অতঃপর আমরা তাদেরকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দেব এবং তারা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, ‘তোমরা তো আমাদের ‘ইবাদাত করতে না।’ সুতরাং আল্লাহই আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট যে, তোমরা আমাদের ‘ইবাদাত করতে এ বিষয়ে তো আমরা গাফিল ছিলাম।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৮-২৯]

তিনি (মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওহহাব) বলেন, আর তাঁর বাণী:

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ ﴾ [ البقرة : ٢٥٥ ]

“কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৫]

“ব্যাখ্যা: এই আয়াতের মধ্যে ঐসব মুশরিকদের দাবির জবাব রয়েছে, যারা আল্লাহ তা‘আলাকে বাদ দিয়ে ফিরিশতা ও নবীগণের মধ্য থেকে এবং নেক বান্দা ও অন্যান্যদের আকৃতিতে রূপ দেওয়া মূর্তিসমূহ থেকে সুপারিশকারী গ্রহণ করে এবং ধারণা করে যে, তারা তাঁর নিকট তাঁর অনুমতি ছাড়াই সুপারিশ করবে। ফলে এই আয়াতটি তাদের এমন বিশ্বাসের প্রতিবাদ করেছে এবং তাঁর ক্ষমতার মহত্ব ও বড়ত্ব বর্ণনা করেছে, আরও বর্ণনা করছে যে, কিয়ামতের দিন কোনো ব্যক্তির কথা বলার ক্ষমতা হবে না যতক্ষণ না তিনি কথা বলার অনুমতি দিবেন, যেমন তাঁর বাণী:

﴿لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابٗا ٣٨﴾ [ النبا : ٣٨ ]

“সেদিন কেউ কথা বলবে না, তবে ‘রহমান’ যাকে অনুমতি দিবেন সে ছাড়া এবং সে সঠিক কথা বলবে।” [সূরা আল-নাবা, আয়াত: ৩৮] তিনি আরও বলেন:

﴿يَوۡمَ يَأۡتِ لَا تَكَلَّمُ نَفۡسٌ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ ﴾ [ هود : ١٠٥ ]

“যখন সেদিন আসবে, তখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না।” [সূরা হূদ, আয়াত: ১০৫] ইবন জারির রহ. এই আয়াতের ব্যাপারে বলেন: এ আয়াতটি তখনি নাযিল হয়েছে যখন কাফিরগণ বলল: আমরা এসব দেব-মূর্তিদের পূজা-অর্চনা করি শুধু এই জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿لَهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَكِيلٗا ١٧١﴾ [ النساء : ١٧١ ]

“আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই, আর কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৭১] আর এই আয়াতের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা শাফা‘আত (সুপারিশ) করার ব্যাপারে অনুমতি দিবেন, আর তাঁরা হলেন নবী, আলেম প্রমূখ। আর অনুমতিটি কখনও কখনও নির্দেশে রূপান্তরিত হবে, যেমনটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলায় বর্ণিত হয়েছে, যখন তাঁকে বলা হবে: আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। একাধিক মুফাসসির অনুরূপ বক্তব্য পেশ করেছেন।

তিনি (মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওহহাব) বলেন: আর তাঁর বাণী:

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ لَا تُغۡنِي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ أَن يَأۡذَنَ ٱللَّهُ لِمَن يَشَآءُ وَيَرۡضَىٰٓ ٢٦ ﴾ [ النجم : ٢٦ ]

“আর আসমানসমূহে বহু ফিরিশতা রয়েছে, তাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর। যার জন্য তিনি ইচ্ছে করেন ও যার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬]

ব্যাখ্যা: আবূ হাইয়্যান রহ. বলেন: আয়াতে উল্লিখিত كم টি খবরিয়া ( خبرية ) এবং তার অর্থ অধিক, আর তা মুবতাদা ( مبتدأ ) হওয়ার কারাণে রফা‘ ( رفع ) এর অবস্থানে এবং তার খবর ( خبر ) হলো: لَا تُغۡنِي । আর الغناء শব্দের অর্থ, কল্যণ বয়ে আনা বা অকল্যাণ দূর করা, যেখানে যেটা প্রয়োজন। আর كم শব্দগতভাবে একবচন এবং অর্থগতভাবে বহুবচন। আর নৈকট্যবান ফিরিশতাগণের সুপারিশ যখন কোনো উপকার করবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্টি চিত্তে কারও জন্য সুপারিশ করার অনুমতি ও সম্মতি দিবেন, আর আল্লাহর সন্তুষ্টি তখনই হবে যখন তাকে সুপারিশকারী হিসেবে যোগ্য মনে করবেন। সুতরাং দেব-মূর্তিসমূহ কীভাবে তাদের পূজারী’র জন্য সুপারিশ করবে? আমি বলি: এই আয়াতের মধ্যে শাফা‘আত লাভ অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ফিরিশতা ও সৎলোকদের উপাসনা করে, তার দাবিটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে রদ করা হয়েছে। কারণ, তারা যখন শুরুতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করতে পারবে না। সুতরাং কোনো অর্থে তাদেরকে ডাকা হবে এবং তাদের উপাসনা করা হবে? তাছাড়া আল্লাহ তা‘আালাও এমন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কাউকে (শাফা‘আত করার জন্য) অনুমতি দিবেন না, যার কথা ও কাজ তিনি পছন্দ করবেন। আর তিনি হবেন ঐ ব্যক্তি যিনি তাওহীদ তথা একত্ববাদী, মুশরিক নন; যেমনটি তিনি বলেছেন:

﴿يَوۡمَئِذٖ لَّا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَرَضِيَ لَهُۥ قَوۡلٗا ١٠٩ ﴾ [ طه : ١٠٩ ]

দয়াময় যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, সে ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোনো কাজে আসবে না।” [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১০৯] আর আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদ ব্যতীত অন্য কোনো মতে সন্তুষ্ট হবেন না। যেমন, তিনি বলেন,

﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥ ﴾ [ ال عمران : ٨٥ ]

“আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫] আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَسْعَد النَّاس بِشَفَاعَتِي يَوْم الْقِيَامَة مَنْ قَالَ : لَا إِلَه إِلَّا اللَّه خالصا من قلبه» .

“কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আতের মাধ্যমে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ হবে ঐ ব্যক্তি, যে একান্ত আন্তরিকতার সাথে বলে: لَا إِلَه إِلَّا اللَّه (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই)” [সহীহ সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৯।]। লক্ষ্য করুন, তিনি বলেন নি যে, আমার শাফা‘আতের মাধ্যমে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ হবে ঐ ব্যক্তি, যে আমাকে ডাকে।

আর মুশরিক ব্যক্তি যদি বলে, আমি জানি যে, তারা তাঁর অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করবে না, কিন্তু আমি তাদেরকে ডাকি এই জন্য যে, যাতে আল্লাহ আমার জন্য সুপারিশ করার ক্ষেত্রে তাদেরকে অনুমতি প্রদান করেন; তাহলে বলা হবে: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে শির্ক করা ও তিনি ভিন্ন অন্য কাউকে আহ্বান করাকে তাঁর অনুমতি ও সম্মতির কারণ বা উপলক্ষ নির্ণয় করেন নি, বরং এটা তাঁর ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আর এ জন্যই তিনি অপর এক আয়াতে তিনি ভিন্ন অপর কাউকে ডাকাডাকি করতে নিষেধ করেছেন। যেমন, তিনি বলেন,

﴿وَلَا تَدۡعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَۖ فَإِن فَعَلۡتَ فَإِنَّكَ إِذٗا مِّنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٠٦ ﴾ [ يونس : ١٠٦ ]

“আর আপনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবেন না, যা আপনার উপকারও করে না, অপকারও করে না। কারণ, এটা করলে তখন আপনি অবশ্যই যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৬]

সুতরাং পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ফিরিশতা, নবী ও তাঁরা ভিন্ন অন্যদের মধ্য থেকে সৎকর্মশীলদেরকে ডাকাডাকি (পূজা) করা শির্ক, যেমনিভাবে প্রথম কালের মুশরিকগণ তাদেরকে আহ্বান করত, যাতে তারা তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করতে পারে, আর আল্লাহ তা‘আলা এই পদ্ধতির প্রতিবাদ করেছেন এবং তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তা পছন্দ করেন না এবং তিনি তা নির্দেশও করেন না, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ أَرۡبَابًاۗ أَيَأۡمُرُكُم بِٱلۡكُفۡرِ بَعۡدَ إِذۡ أَنتُم مُّسۡلِمُونَ ٨٠ ﴾ [ ال عمران : ٨٠ ]

“অনুরূপভাবে ফিরিশতাগণ ও নবীগণকে রবরূপে গ্রহণ করতে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দেন না। তোমাদের মুসলিম হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফুরীর নির্দেশ দিবেন?” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿إِذۡ تَبَرَّأَ ٱلَّذِينَ ٱتُّبِعُواْ مِنَ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُواْ وَرَأَوُاْ ٱلۡعَذَابَ ﴾ [ يونس , البقرة : ١٦٦ ]

“যখন যাদের অনুসরণ করা হয়েছে তারা, যারা অনুসরণ করেছে তাদের থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেবে এবং তারা শাস্তি দেখতে পাবে।” [সূরা ইউনুস/আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৬৬] ইবন কাসীর রহ. বলেন, ফিরিশতাগণ তাদের থেকে নিজেদেরকে বিমুক্ত ঘোষণা করে নেবে, যারা ধারণা করত যে, তারা দুনিয়াতে তাদের উপাসনা করেছে। অতঃপর ফিরিশতাগণ বলবে: আমরা তাদের থেকে বিমুক্ত হয়ে আপনার নিকট আশ্রয় চাই, তারা আমাদের ইবাদত করতো না। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ءَأَنتَ قُلۡتَ لِلنَّاسِ ٱتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَٰهَيۡنِ مِن دُونِ ٱللَّهِۖ قَالَ سُبۡحَٰنَكَ مَا يَكُونُ لِيٓ أَنۡ أَقُولَ مَا لَيۡسَ لِي بِحَقٍّۚ ﴾ [ المائ‍دة : ١١٦ ]

“আরও স্মরণ করুন, আল্লাহ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়াম তনয় ‘ঈসা! আপনি কি লোকদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার জননীকে দুই ইলাহরূপে গ্রহণ কর?’ তিনি বলবেন, ‘আপনিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই, তা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়।” [সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ১১৬] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦﴾ [ الاسراء : ٥٦ ]

“বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ইলাহ মনে কর, তাদেরকে আহ্বান কর; তাহলে দেখতে পাবে যে, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬] আর সা‘ঈদ ইবন মানসুর, ইমাম বুখারী, নাসায়ী ও ইবন জারীর রহ. আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ থেকে আয়াত প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন: মানুষের মধ্য থেকে এক দল জিন্নের মধ্য থেকে এক দলের ‘ইবাদত করত, অতঃপর জিন্নের মধ্য থেকে এক দল ইসলাম গ্রহণ করল, অথচ মানুষেরা সেসব জিন্নের উপাসনায় মগ্ন থাকল তখন আল্লাহ নাযিল করলেন:

﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ ﴾ [ الاسراء : ٥٧ ]

“ওরা যাদেরকে আহ্বান করে, তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৭] এখানে يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ দু’টি শব্দটি ياء দ্বারা পঠিত হয়েছে [অর্থাৎ যাদেরকে তারা ডাকছে, আহ্বান করছে, তারা কিন্তু নিজেরা নিজেদেরকে ইলাহ হওয়ার দাবী করছে না; উপরন্তু তারাই (যাদেরকে কাফের-মুশরিকরা ডাকছে) তাদের রবের নৈকট্য তালাশে ব্যস্ত। [সম্পাদক]]। আর ইবন জারীর ও ইবন আবি হাতেম আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে আয়াত প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন: শির্কপন্থীগণ ফিরিশতা, মাসীহ ও ওযায়ের আলাইহিস সালামের উপাসনা করত [তখন অর্থ হবে, শির্কপন্থীরা ফিরিশতা, মাসীহ কিংবা উযায়েরকে আহ্বান করছে, অথচ সকল ফিরিশতা, মাসীহ এবং উযায়ের কখনও এ আহ্বানে রাজী নয়, তারা আল্লাহ তা‘আলা নৈকট্য তালাশে ব্যস্ত। [সম্পাদক]]। উপরোক্ত গ্রন্থদ্বয়ে আল্লাহর এই বাণীর

﴿فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ ﴾ [ الاسراء : ٥٦ ]

“তাহলে দেখতে পাবে যে, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬] এই বাণীর ব্যাপারে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে অপর এক বর্ণনায় এসেছে যে, এখানে যাদের ক্ষমতা নেই বলা হয়েছে, তারা হচ্ছেন, ‘ঈসা, তাঁর মাতা ও ‘ওযায়ের।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿إِنَّكُمۡ وَمَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ أَنتُمۡ لَهَا وَٰرِدُونَ ٩٨ لَوۡ كَانَ هَٰٓؤُلَآءِ ءَالِهَةٗ مَّا وَرَدُوهَاۖ وَكُلّٞ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٩٩ لَهُمۡ فِيهَا زَفِيرٞ وَهُمۡ فِيهَا لَا يَسۡمَعُونَ ١٠٠ إِنَّ ٱلَّذِينَ سَبَقَتۡ لَهُم مِّنَّا ٱلۡحُسۡنَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ عَنۡهَا مُبۡعَدُونَ ١٠١﴾ [ الانبياء : ٩٨، ١٠١ ]

“নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে। যদি তারা ইলাহ হত, তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না, আর তাদের সবাই তাতে স্থায়ী হবে, সেখানে থাকবে তাদের নাভিশ্বাসের শব্দ এবং সেখানে তারা কিছুই শুনতে পাবে না। নিশ্চয় যাদের জন্য আমাদের কাছ থেকে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে, তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৯৮-১০১] ইবন ইসহাক রহ. এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় ইবনুয যাব‘য়ারী ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যকার বিতর্কের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন [ইবনুয যাব‘য়ারী বলতে আরম্ভ করল যে, আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকেই ইবাদাত করা হয়, তারা সবাই যদি জাহান্নামের ইন্ধন হয়, তবে সেখানে ঈসা, উযায়ের ও অন্যান্য সৎলোকদেরও ইবাদাত করা হয়েছে, তারাও তো জাহান্নামের ইন্ধন হওয়া আবশ্যক হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা পরবর্তী আয়াত নাযিল করে তাদেরকে পূর্বোক্ত বিধানের আলাদা ঘোষণা করলেন। কারণ, তারা কেউই আল্লাহ ছাড়া তাদের ইবাদাত করা হোক সেটাতে রাযী নন। (আল-আহাদীসুল মুখতারা, ১১/৩৪৫, নং ৩৫১) [সম্পাদক]], আর তখন-ই আল্লাহ নাযিল করেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ سَبَقَتۡ لَهُم مِّنَّا ٱلۡحُسۡنَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ عَنۡهَا مُبۡعَدُونَ ١٠١ ﴾ [ الانبياء : ١٠١ ]

“নিশ্চয় যাদের জন্য আমাদের কাছ থেকে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে, তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০১] অর্থাৎ ‘ঈসা ও ‘ওযায়ের আলাইহিস সালাম এবং ঐসব পণ্ডিত ও দুনিয়া বিমুখদের মধ্য থেকে যাদের উপাসনা করা হয়েছে, যারা আল্লাহর বিধানের ওপর জীবন অতিবাহিত করেছেন; অথচ পথভ্রষ্টরা আল্লাহকে ছাড়া তাদেরকেই রব হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে [অর্থাৎ তাদের কোনো অপরাধ নেই। কারণ, তারা এসব বিভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট লোকদের ইবাদাতে রাজী ছিল না। সুতরাং তারা জাহান্নাম থেকে দূরে থাকবে। [সম্পাদক]]।

আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٖ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّآ إِذَا تَمَنَّىٰٓ أَلۡقَى ٱلشَّيۡطَٰنُ فِيٓ أُمۡنِيَّتِهِۦ فَيَنسَخُ ٱللَّهُ مَا يُلۡقِي ٱلشَّيۡطَٰنُ ثُمَّ يُحۡكِمُ ٱللَّهُ ءَايَٰتِهِۦۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٥٢﴾ [ الحج : ٥٢ ]

“আর আমরা আপনার পূর্বে যে রাসূল কিংবা নবী প্রেরণ করেছি, তাদের কেউ যখনই (ওহীর কিছু) তিলাওয়াত করেছে, তখনই শয়তান তাদের তিলাওয়াতে (কিছু) নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু শয়তান যা নিক্ষেপ করে, আল্লাহ তা বিদূরিত করেন। তারপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৫২] ইবন আবি হাতেম ইমাম যুহুরী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: সূরা আন-নাজম নাযিল (শুরু) হয়েছে, আর মুশরিকগণ বলাবলি করত যে, এই লোকটি যদি আমাদের ইলাহসমূহের ব্যাপারে ভালো আলোচনা করত, তাহলে আমরা তাকে ও তার সাথীদেরকে স্বীকৃতি দিতাম; কিন্তু ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তার দীনের বিরোধিতা করে সে তার সমালোচনা করে না, যেভাবে সে গাল-মন্দের মাধ্যমে আমাদের উপাস্যদের সমালোচনা করে, আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ তাদের পক্ষ থেকে যে কষ্ট ও মিথ্যারোপের শিকার হচ্ছিলেন, তাঁর ওপর তা খুব কষ্টকর মনে হচ্ছিল এবং তাদের পথভ্রষ্টতা তাঁকে চিন্তিত করে তুলছিল; তখন তিনি তাদের হিদায়াতের প্রত্যাশা করতেন; অতঃপর যখন আল্লাহ তা‘আলা সূরা আন-নাজম নাযিল করলেন, তখন তিনি বললেন:

﴿أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠﴾ [ النجم : ١٩، ٢٠ ]

“অতএব, তোমরা আমাকে জানাও ‘লাত’ ও ‘উয্যা’ সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্পর্কে?” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ১৯-২০] এই তাগুতদের (অর্থাৎ লাত- উয্যা ও মানাত, এদের) আলোচনার সময় শয়তান এগুলো উচ্চারণের পর তার নিকট থেকে কতিপয় কথা ছেড়ে দিল, সে বলল:

تلك الغرانيق العُلى وأن شفاعتهن لترتجى

(যার অর্থ, ‘এগুলো হচ্ছে উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং তাদের সুপারিশ অবশ্যই আশা করা যাবে’) বস্তুত এটা ছিল শয়তানের অন্তমিলযুক্ত কথা ও তার ফিতনা (পরীক্ষা); (যা সে আল্লাহর বাণীর পরে প্রক্ষিপ্ত করেছিল) অতঃপর এই বাণী দু’টি মক্কার মুশরিকদের মনে প্রভাব বিস্তার করল এবং তার কারণে তাদের ভাষাসমূহ সংযত হতে লাগল, আর তারা এর দ্বারা পরস্পরকে সুসংবাদ দিল এবং তারা বলল: নিশ্চয় মুহাম্মাদ তার প্রথম তথা পূর্বের ধর্মে এবং তার সম্প্রদায়ের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছে। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তিলাওয়াত করতে করতে) সূরা আন-নাজমের শেষ প্রান্তে পৌঁছলেন, তখন তিনি সাজদাহ করলেন এবং উপস্থিত সকল মুসলিম ও মুশরিকরাও সাজদাহ করল। তারপর এ কথা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে গেল এবং শয়তান তা প্রকাশ করে দিল, এমনকি এই সংবাদ হাবশা পর্যন্ত পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করলেন:

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٖ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّآ إِذَا تَمَنَّىٰٓ أَلۡقَى ٱلشَّيۡطَٰنُ فِيٓ أُمۡنِيَّتِهِۦ﴾ [ الحج : ٥٢ ]

“আর আমরা আপনার পূর্বে যে রাসূল কিংবা নবী প্রেরণ করেছি, তাদের কেউ যখনই (ওহীর কিছু) তিলাওয়াত করেছে, তখনই শয়তান তাদের তিলাওয়াতে (কিছু) নিক্ষেপ করেছে।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৫২] অতঃপর যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সিদ্ধান্ত ও শয়তানের অপপ্রচার থেকে তাঁর মুক্ত থাকার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করলেন, তখন মুশরিকগণ মুসলিমদের জন্য তাদের শত্রুতা ও ভ্রষ্টতাকে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসল এবং সে ব্যাপারে তারা কঠোর হয়ে উঠল। আর এটা একটা প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ ঘটনা (কাহিনী), যা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্য থেকে কিছু কিছু সনদ বিশুদ্ধ। আর তাবে‘য়ীগণের একদল থেকেও বিশুদ্ধ সনদে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে, যাদের রয়েছেন ‘ওরওয়া, সা‘ঈদ ইবন জুবায়ের, আবূল ‘আলীয়া, আবূ বকর ইবন আবদির রহমান, ‘ইকরামা, দাহহাক, কাতাদা, মুহাম্মাদ ইবন কা‘ব আল-কুরাযী, মুহাম্মাদ ইবন কায়েস ও সুদ্দী রহ. প্রমূখ। আর এই ঘটনাটি ঐতিহাসিকগণ ও অন্যান্যরাও আলোচনা করেছেন এবং তার মূলবিষয় ‘সহীহাইন’ তথা সহীহ বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে রয়েছে [এ বর্ণনাটি সম্পর্কে বিবিধ মত রয়েছে। শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী রহ. এ ঘটনাটিকে পুরোপুরিই অস্বীকার করেছেন এবং একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার নাম দিয়েছেন, نصب المجانيق على قصة الغرانيق তবে বিভিন্ন বর্ণনায় আসার কারণে এবং সেগুলোর কোনো কোনোটি গ্রহণযোগ্য তাবে‘ঈদের কাছ থেকে আসায় অনেক আলেম ঘটনাটির মূল সাব্যস্ত রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন, যদিও বিস্তারিত কিছু বর্ণনা সম্পর্কে আপত্তি দিয়েছেন। [সম্পাদক]]।

মূল উদ্দেশ্য হল, এ ঘটনাতে উল্লিখিত, ‘এগুলো হচ্ছে উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং তাদের সুপারিশ অবশ্যই আশা করা যাবে’ এ কথাটুকু। কারণ, এক মতানুসারে الغرانيق তথা উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হলো ফিরিশতাগণ। আর অপর মতে, الغرانيق তথা উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হলো ‘দেব-মূতিসকল’। তবে উভয় মতের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। কারণ, তাদের উপাসনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো দেবদেবতা, ফিরিশতা ও সৎ ব্যক্তিগণ, যেমন বায়যাবী রহ. থেকে পূর্বের আলোচনা অতিবাহিত হয়েছে। সুতরাং যখন মুশরিকগণ এমন কথা শ্রবণ করল, যা আল্লাহর নিকট সুপারিশ করার আশায় ফিরিশতাদের ইবাদত করাটাকে বৈধ বলে দাবি করে, তখন তারা ধারণা করেছে যে, এটা তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামই বলেছেন। ফলে তারা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেল, তাঁর সাথে তারাও সাজদাহ করল এবং তারা অভিমত প্রকাশ করল যে, সুপারিশের জন্য ফিরিশতা ও দেব-দেবীর প্রার্থনা করার ব্যাপারে তিনি তাদের ধর্মের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন, এমনকি এ কথা দিকদিগন্তে ছড়িয়ে গেল এবং হাবশার মুহাজিরগণের নিকট এ সংবাদ পৌঁছে গেল যে, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সন্ধি করেছে। সুতরাং বুঝা গেল যে, তাদের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে বিরোধের অন্যতম বিষয় ছিল ‘শাফা‘আত’। কারণ, তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী তারা বলে, আমরা ফিরিশতা ও তাদের আকৃতিতে তৈরি করা কল্পিত দেব-দেবীগণের নিকট চাই যে, তারা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করবে; অপরদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট আগমন করেছেন এ ধরনের চিন্তাধারাকে বাতিল করার জন্য; তা থেকে বিরত রাখতে; যে ব্যক্তি এ মতে বিশ্বাসী হবে, তাকে কাফির ও পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করতে; তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে নিবুদ্ধিতা বলে প্রমাণ করতে। শাফা‘আত প্রশ্নে তিনি তাদের জন্য কোনো ফিরিশতা, নবী ও দেব-দেবীর অধিকার আছে বলার সুযোগ দেন নি, বা ছাড় দেন নি; বরং তিনি তাদের কাছে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণী নিয়ে এসেছেন, যাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗاۖ ﴾ [ الزمر : ٤٤ ]

বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহরই মালিকানাধীন’।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৪৪] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ءَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً إِن يُرِدۡنِ ٱلرَّحۡمَٰنُ بِضُرّٖ لَّا تُغۡنِ عَنِّي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُنقِذُونِ ٢٣ إِنِّيٓ إِذٗا لَّفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٢٤﴾ [ يس : ٢٣، ٢٤ ]

“আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ্ গ্রহণ করব? রহমান আমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না। এরূপ করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়ব।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ২৩-২৪] আর কুরআনে এ ধরনের নির্দেশ যদি খোঁজা হয়, তবে তার সংখ্যা অনেক হবে।

উদ্দেশ্য হচ্ছে, (একথা সাব্যস্ত করা যে) প্রথম পর্যায়ের মুশরিকগণ ফিরিশতা ও সৎ ব্যক্তিদেরকে আহ্বান করত, যাতে তারা তাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করতে পারে, তার প্রমাণ আল-কুরআনের বক্তব্যসমূহ এবং তাফসীর ও সীরাত গ্রন্থসমূহ, আর আসার তথা হাদীসের কিতাবসমূহে ভরপুর, আর ন্যায়নীতিবান বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীই যথেষ্ট, যাতে তিনি বলেন:

﴿وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ يَقُولُ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَهَٰٓؤُلَآءِ إِيَّاكُمۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٤٠ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ أَنتَ وَلِيُّنَا مِن دُونِهِمۖ بَلۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٱلۡجِنَّۖ أَكۡثَرُهُم بِهِم مُّؤۡمِنُونَ ٤١﴾ [ سبا : ٤٠، ٤١ ]

“আর স্মরণ করুন, যেদিন তিনি তাদের সকলকে একত্র করবেন, তারপর ফিরিশতাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘এরা কি তোমাদেরই ইবাদাত করত? ফিরিশতারা বলবে, ‘আপনি পবিত্র, মহান! আপনিই আমাদের অভিভাবক, তারা নয়; বরং তারা তো ইবাদাত করত জিন্নদের। তাদের অধিকাংশই জিন্নদের প্রতি ঈমান রাখত।” [সূরা সাবা, আয়াত: ৪০-৪১]

তিনি (মুহাম্মাদ ইবন আবদিল ওহ্‌হাব রহ.) বলেন: আর মহান আল্লহার বাণী:

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [ سبا : ٢٢ ]

বলুন, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ্ মনে করতে তাদেরকে ডাক। তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২]

ব্যাখ্যা: এ আয়াতটির ব্যাপারে আলেমদের কেউ কেউ বলেন: যে ব্যক্তি এই আয়াতটি অনুধাবন করেছে, তা সেই ব্যক্তির অন্তর থেকে শির্ক নামক বৃক্ষের শিকড়সমূহ কেটে যাবে। ইবনুল কাইয়্যেম রহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: আল্লাহ তা‘আলা শির্কের সকল উপায় বা উপলক্ষ্যসমূহ মুশরিকরা যে গুলোর সাথে তারা সম্পৃক্ত থাকে; সে সবই মূলোৎপাটন করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে জানতে ও বুঝতে পারবে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অভিভাবক বা বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত হলো মাকড়সার মত, যে ঘর বানায়, আর ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম। কারণ, মুশরিক ব্যক্তি তো তাকেই উপাস্যরূপে গ্রহণ করে, যার দ্বারা সে কোনো প্রকার উপকার হাসিল করতে পারে, আর কারও কাছ থেকে তখনই উপকার হাসিল করতে পারে, যখন সে ব্যক্তির মধ্যে এ চারটি বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে কোনো একটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকবে: হয় সে তার উপাসক তার নিকট যা চায়, তার মালিক হবে, আর যদি সে সেটার মালিক না হয়, তাহলে সে মূল মালিকের সাথে শরীক বা অংশিদার হবে, আর যদি সে তাতে শরীকও না হয়, তাহলে সে তার সহায়ক ও সাহায্যকারী হবে, আর সে যদি তার সহায়ক ও সাহায্যকারীও না হয়, তাহলে সে তার নিকট সুপারিশকারী হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এই চারটি বৈশিষ্ট্যকেই উপর থেকে নিচ (প্রথম বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে শেষ বৈশিষ্ট্য) পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে সবগুলোকে অন্য কারও কাছে থাকার কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন। সুতরাং তিনি মালিকানা, অংশীদারিত্ব, সাহায্য-সহযোগিতা ও মুশরিকদের দাবী করা শাফা‘আতকে অস্তিত্বহীন ঘোষণা করেছেন, আর তিনি এমন শাফা‘আতকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যাতে মুশরিকের জন্য কোনো অংশ নেই, আর তা হচ্ছে, তাঁর অনুমতি সাপেক্ষ শাফা‘আত।

তিনি (ইবনুল কাইয়্যেম রহ.) বলেন: সুতরাং তিনিই (আল্লাহ তা‘আলাই) সুপারিশকারীকে অনুমতি দিবেন, আর তিনি যদি তাকে অনুমতি না দেন, তাহলে সে তাঁর সম্মুখে শাফা‘আতের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না; যেমনটি ঘটে থাকে [অর্থাৎ দুনিয়ায় মানুষ একে অপরের কাছে যখন সুপারিশ করে, তখন সুপারিশ যার কাছে করা হচ্ছে, তার অনুমতি ব্যতীতই কখনও কখনও সুপারিশ অনুষ্ঠিত হয়ে যায়; সেখানে যার কাছে সুপারিশ করা হচ্ছে, তিনি হয়ত সুপারিশকারীর কথা শুনতে বাধ্য; কারণ, সুপারিশকারীর কাছে তার এমন কিছু প্রয়োজন আছে যা পেতে হলে তাকে সুপারিশকারীর কথা অনিচ্ছাস্বত্বেও শুনতে হবে, নতুবা তার প্রয়োজন পূরণ হবে না। সুতরাং ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় দুনিয়ার রাজা-বাদশারা তাদের মন্ত্রীদের সুপারিশ, অনুরূপভাবে মন্ত্রীরা তাদের সচিবদের সুপারিশ, জনপ্রতিনিধিরা তাদের দলীয় নেতৃস্থানীয়দের সুপারিশ শুনতে বাধ্য, নতুবা সে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, তাদের সমর্থন কমে যাবে, তাদের ক্ষমতা খর্ব হবে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি প্রয়োজন বশত কারও সুপারিশ বিনা অনুমতিতে শুনতে বাধ্য নন। কারণ, উপরোক্ত সম্ভাবনার কোনোটিই আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না; হতে পারে না। বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। [সম্পাদক]] সৃষ্টির বেলায়। কারণ, সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুপারিশকারীর নিকট সুপারিশকৃত ব্যক্তির প্রয়োজন থাকে [যে প্রয়োজন সে একা পূরণ করতে অসমর্থ, তাই তাকে সুপারিশকারীর সুপারিশ শুনতে বাধ্য করে। [সম্পাদক]] সুতরাং যার নিকট সুপারিশ করা হচ্ছে সে ব্যক্তি, সুপারিশকারীর মুখাপেক্ষী, সে তার সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে। ফলে সে তার সুপারিশ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়; যদিও সে ব্যক্তি সুপারিশের অনুমতি তাকে না দেয়।

আল্লাহর ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, তিনি ব্যতীত সকলেই মৌলিকভাবে তাঁর মুখাপেক্ষী, আর তিনি মৌলিকভাবে সকল কিছু থেকে মুখাপেক্ষীহীন ও স্বনির্ভর। সুতরাং কীভাবে তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি তাঁর নিকট সুপারিশ করবে? সুতরাং এই আয়াতটি আলো, দলীল, নাজাত (মুক্তি), নির্ভেজাল তাওহীদ হিসেবে এবং শির্ক ও তার শিকড়সমূহের মূলোৎপাটনের মাধ্যম হিসেবে ঐ ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট, যে তা অনুধাবন করে। আর আল-কুরআন এ ধরণের উপমা ও দৃষ্টান্তে ভরা [যেমন, কেউ যদি এ আয়াতটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে তবে তার কাছে এ বিষয়টি সর্বসময়ের জন্যই স্পষ্ট হয়ে যাবে, আয়াতটি হচ্ছে, ﴿وَقُلِ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِي لَمۡ يَتَّخِذۡ وَلَدٗا وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ شَرِيكٞ فِي ٱلۡمُلۡكِ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ وَلِيّٞ مِّنَ ٱلذُّلِّۖ وَكَبِّرۡهُ تَكۡبِيرَۢا ١١١﴾ [ الاسراء : ١١١ ] “বলুন, ‘প্রশংসা আল্লাহ্‌রই যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন নি, তাঁর সার্বভৌমত্বে কোন অংশীদার নেই এবং দুর্দশাগ্রস্ততা থেকে বাঁচতে তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন নেই। আর আপনি সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১১১] সুতরাং তাঁর যেমন সন্তান নেই যে সন্তানের মায়ায় তাকে সন্তানের অবৈধ আব্দার রাখতে হবে, তেমনি তার রাজত্বে কারও কোনো অংশিদারিত্ব নেই যে, অংশিদারের কথা না শুনলে রাজত্বের স্থায়ীত্ব নষ্ট হবে, তদ্রূপ তার রাজত্ব চালাতে কোনো সহকারী বা ডেপুটিরও প্রয়োজন পড়ে না যে, তাকে সে ডেপুটির কথা না শুনলে তার রাষ্ট্র যন্ত্র বিকল হয়ে পড়বে। সুতরাং সর্বকাজে তিনিই সর্বেসর্বা। তিনি কারও সুপারিশ শুনতে বাধ্য নন। তাই আমরা সসম্ভ্রমে তার মহত্ব ঘোষণা করব। [সম্পাদক]], কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বাস্তব ঘটনাগুলোকে সে আয়াতসমূহের অধীনে নিয়ে আসা, সেটার অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। তারা সেসব দৃষ্টান্তকে মনে করে এমন এক জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ইতোপূর্বে গত হয়ে গেছে এবং তারা কোনো উত্তরাধিকারী রেখে যায় নি [অর্থাৎ তারা মনে করে যে, কুরআনের আয়াতসমূহ এক বিগত জাতির জন্য প্রদত্ত হয়েছে; তাদের মত আর কারও জন্য সেটা প্রযোজ্য হতে পারে না। সে জাতিসমূহের মত আর কোনো জাতি যেন হতে পারে না। এটা যে ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না; কারণ কুরআন সর্বকালের সর্বযুগের সর্ব এলাকার লোকদের জন্যই তার উপমা ও দৃষ্টান্তসমূহ প্রদান করেছে। আগে যেমন এ ধরনের লোকের অস্তিত্ব ছিল, এখনও তেমনি সে ধরণের লোকদের ওয়ারিস রয়ে গেছে। সুতরাং সেগুলোকে বাস্তবে নিয়ে এসে সেটার আলোকে বিধান দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। [সম্পাদক]], আর এটাই অন্তর ও কুরআন বুঝার মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টি করে। আল্লাহর কসম! যদি ঐসব লোক গত হয়ে যায়, তাহলে তাদের উত্তরাধিকারী হয় এমন ব্যক্তি, যে তাদের মত, তাদের চেয়ে নিকৃষ্ট ব তাদের কাছাকাছি, আর কুরআন যেভাবে পূর্বাক্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছে, সেভাবে পরবর্তী শ্রেণীর লোকদেরকেও সে বিধি-বিধান ও দৃষ্টান্তের অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু বাস্তব বিষয়টি হলো যেমন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন: ‘ইসলামের রশি [আকীদা-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধান ইত্যাদি। [সম্পাদক]]সমূহ একটা একটা করে নষ্ট হয়ে যাবে, যখন কোনো ব্যক্তি জাহেলিয়াত সম্পর্কে না জেনেই ইসলামের মধ্যে বেড়ে উঠে।’ [ইবনুল কাইয়্যেম রহ. এ বাণীটি উমর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম ইবন কাসীর তাঁর তাফসীরে এ বাণীটি উসমান রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। সম্ভবতঃ তারা দুজনেই এ বাণীটি বলে থাকবেন। [সম্পাদক]] আর এটা এ জন্য যে, যখন সে জানবে না জাহেলিয়াত ও শির্ক সম্পর্কে এবং জানবে না কুরআন কোনো বিষয়কে সমর্থন করে ও কোনোটাকে নিন্দা করে, তখন সে তাতে জড়িয়ে যাবে, তাকে স্বীকৃতি দিবে, তার দিকে অন্যকে আহ্বান করবে, তাকে সঠিক এবং উত্তম বলে মনে করবে, আর সে বুঝতে পারবে না যে, সে যার ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে, তা যে জাহেলিয়াত অথবা তার অনুরূপ কিছু অথবা তার চেয়ে নিকৃষ্ট অথবা তার কাছাকাছি কোনো কিছু; ফলে এর দ্বারা ইসলামের রশি বা খুঁটিসমূহ নষ্ট হয়ে যাবে, আর ভালো কাজ মন্দ কাজে পরিণত হবে, মন্দ কাজ ভালো কাজে পরিণত হবে, আর বিদ‘আত সুন্নাতে পরিণত হবে, সুন্নাত বিদ‘আতে পরিণত হবে, আর কোনো ব্যক্তিকে নির্ভেজাল ঈমান ও তাওহীদের কারণে কাফের বলে বসবে, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা এবং প্রবৃত্তি ও বিদ‘আত থেকে দূরে থাকাটাকে বিদ‘আত বলবে। আর যে ব্যক্তির দূরদৃষ্টি ও প্রাণবন্ত হৃদয় আছে, সে এটাকে স্বচক্ষে দেখতে পাবে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলাই হলেন সাহায্যস্থল। আর ঐসব পূর্ববর্তী মুশরিকদের বক্তব্য নকল করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ فِي مَا هُمۡ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي مَنۡ هُوَ كَٰذِبٞ كَفَّارٞ ٣﴾ [ الزمر : ٣ ]

“আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে এনে দিবে।’ তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে, নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দিবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।” [সূরা যুমার, আয়াত: ৩] সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে এবং ধারণা করে যে, সে তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে সে লোকের প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এটিই। আর যে এই বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, সে কতই না সম্মানিত হতে পেরেছে, বরং সে কতই না সম্মানিত, যে এ ধরণের আকীদা-বিশ্বাস অপছন্দকারী ব্যক্তির সাথে শত্রুতা পোষণ করে না। আর ঐসব মুশরিক ও তাদের পূর্বসুরীদের অন্তরের মধ্যে যা আছে, তা হলো তাদের উপাস্যগণ তাদের জন্য সুপারিশ করবে, আর এটা হলো প্রকৃত শির্ক, আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবের মধ্যে তার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, তা বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, শাফা‘আত সম্পূর্ণভাবে তাঁর মালিকানায়, তাঁর নিকট কেউ সুপারিশ করতে পারবে না, তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে কারও ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি দিলে এবং তিনি তার কথা ও কাজে সন্তুষ্ট হলে, সে সুপারিশ করতে পারবে। আর তারা হলো তাওহীদপন্থী লোক সকল, যারা আল্লাহকে ছাড়া কাউকে সুপারিশকারীরূপে গ্রহণ করে নি। সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদের ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য যাকে ইচ্ছা অনুমতি দান করবেন, যেহেতু তারা তাঁকে বাদ দিয়ে তাদেরকে সুপারিশকারী বলে গ্রহণ করে নি। সুতরাং যাকে আল্লাহ তা‘আলা অনুমতি দিবেন, তার সুপারিশ দ্বারা সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ হবে তাওহীদপন্থী ব্যক্তি, যিনি আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে সুপারিশকারীরূপে গ্রহণ করেন নি। আর যে শাফা‘আতকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাযথ বলে সুনিশ্চিত করেছেন, তা হলো তাঁর অনুমতিক্রমে তাওহীদপন্থী ব্যক্তির জন্য অনুষ্ঠিত শাফা‘আত, আর যে শাফা‘আতকে আল্লাহ তা‘আলা অনুমোদন দেন নি, তা হলো শির্ক মিশ্রিত শাফা‘আত, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সুপারিশকারীদেরকে গ্রহণকারী মুশরিকদের অন্তরে বদ্ধমূল, ফলে তাদেরকে তাদের সুপারিশ সংক্রান্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীত প্রতিফল দেওয়া হবে [অর্থাৎ তাদের সুপারিশ নসীব হবে না। [সম্পাদক]] এবং তাওহীদ তথা একত্ববাদীগণ তার দ্বারা সফল হয়ে যাবে।

কিন্তু আপনি আয়াতটি [উদ্দেশ্য, কুরআনুল কারীমের যেখানে যেখানে কাফের-মুশরিকদেরকে তাদের মা‘বুদদের ডাকার নির্দেশ দিয়েছে, সে সকল আয়াত। যেমন সূরা আল-আ‘রাফের এই আয়াত: ﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ عِبَادٌ أَمۡثَالُكُمۡۖ فَٱدۡعُوهُمۡ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١٩٤﴾ [ الاعراف : ١٩٤ ] অনুরূপভাবে, সূরা আল-ইসরার এই আয়াত: ﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦﴾ [ الاسراء : ٥٦ ]অনুরূপভাবে সূরা সাবার এই আয়াত: ﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ﴾ [ سبا : ٢٢ ]] নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করুন, দেখবেন, কীভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ফিরিশতাদেরকে ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন, যে নির্দেশ পালন করতে তারা ব্যর্থ হবেই হবে। উদ্দেশ্য হলো, তারা যে কোনো কিছুরই মালিক নয়, তা বর্ণনা করা। সুতরাং তাদেরকে শাফা‘আতের জন্য অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ডাকা যাবে না; অতঃপর তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা যাদেরকে তাদের ধারণা বা বিশ্বাস অনুযায়ী সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করেছে, তিনি সেই বিষয়টিকে তাদের ধারণা ও মিথ্যা দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সম্পৃক্ত করেছেন [অর্থাৎ শাফা‘আত সংক্রান্ত এসব আকীদা-বিশ্বাস একান্তভাবেই তাদের ধারণা-প্রসূত। যাদেরকে শাফা‘আতকারী নির্ধারণ করেছে তারাও যেমন তা বলেন নি, তেমনি আল্লাহ তা‘আলাও এ আকীদা-বিশ্বাসের পক্ষে কোনো প্রমাণাদি নাযিল করেন নি। [সম্পাদক]], তারা যার সূত্রপাত করেছে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোনো প্রকার দলীল-প্রমাণ ছাড়াই, আর এই আয়াতটি ফিরিশতাদের আহ্বানের ব্যাপারেই মূলত নাযিল হয়েছে। একইভাবে তাতে (আহ্বানে সাড়া দিতে অপারগ হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে) অন্যান্য মা’বুদরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে [অর্থাৎ ফিরিশতারা যদি আহ্বানে সাড়া দিতে না পারে, তবে অন্যরা তো মোটেই পারবে না। [সম্পাদক]]। যেমনিভাবে তাঁর বাণী: ﴿وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢﴾ [ سبا : ٢٢ ] “আর তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২] –এর ব্যাপারে ইবন আবি হাতিম সুদ্দী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে সহায়তা [অর্থাৎ আয়াতে বর্ণিত, [তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয়] দ্বারা ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর কোনো সাহায্যকারী নেই সেটা বলা উদ্দেশ্য। [সম্পাদক]]। আর যেমনিভাবে তার ওপর প্রমাণ পেশ করে, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿حَتَّىٰٓ إِذَا فُزِّعَ عَن قُلُوبِهِمۡ ...﴾ [ سبا : ٢٣ ]

“অবশেষে যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় বিদূরিত হয়...” [সূরা সাবা, আয়াত: ২৩] [এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা পক্ষ থেকে যখন কোনো নির্দেশ আসে তখন তা যেন পাথরের উপর জিঞ্জির পড়ার মত শব্দ হয়, আর ফিরিশতারা তা শুনেই বেহুঁস হয়ে পড়েন। তারপর যখন তাদের হুঁস আসে, তখন তারা একে অপরকে জিজ্ঞেস করে যে, তোমাদের রব কি বলেছেন, তখন তারা সে নির্দেশ নিয়ে আলোচনা করেন ও বাস্তবায়ন করেন।’ সুতরাং ফিরিশতারাই প্রথম নির্দেশ শ্রোতা ও বাস্তবায়নে আদিষ্ট। তারা কখনও আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের আগে কিছুই করতে সক্ষম নয়। সুতরাং তারাই যেহেতু আল্লাহর সামনে এ অবস্থার সম্মুখীন হয়, তখন অন্যদের অবস্থা কেমন হতে পারে তা কল্পনাতীত। [সম্পাদক]]। সুতরাং যখন আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত ফিরিশতাদেরকে সুপারিশকারীরূপে গ্রহণ করাটা শির্ক হয়, তখন কীভাবে মৃতদেরকে (সুপারিশকারীরূপে) গ্রহণ করা যাবে, যেমনটি কবর পূজারীগণ করে? অথবা কীভাবে অপরাধী ও পাপী শয়তানের ভাইদেরকে সুপারিশকারীরূপে গ্রহণ করা যাবে, যাদেরকে ইবলিস তার পাশে অবস্থান ও তার আনুসরণ করতে আকৃষ্ট করেছে? আর এর চেয়ে জঘন্য ঐসব অন্তসার শূন্য অভিশপ্ত ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে প্রভূত্বের বিশ্বাস লালন করা, অথচ মানুষ তাদের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষ করে পাপাচারিতা, বিভিন্ন প্রকারের ফাসেকী, সালাত বর্জন, অন্যায় ও অশ্লীল কাজসমূহ এবং বাজারের মধ্যে উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করা।

যেমনিভাবে পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলেম বলেন:

كقوم عراة في ذرى مصرما على عورة منهم هناك ثياب

يدورون فيها كاشفين لعورة تواتر هذا لا يقال كذاب

يعدونهم في مصرهم فضلاءهم دعاؤهم فيما يرون مجاب

যেমন এক সম্প্রদায় যারা কোনো শহরে ঘুরাফিরা করে,

সেখানে তাদের লজ্জাস্থানের ওপর নেই কোনো কাপড়;

তারা তাতে লজ্জাস্থান উন্মুক্ত করে ঘুরে বেড়ায়

এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে, বলা যাবে না তাকে মিথ্যাবাদী;

তাদের শহরে তাদেরকে মর্যাদাবান গণ্য করা হয়

আর মনে করা হয় যে, তাদের দো‘আ কবুল করা হয়!!

আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা এমন কিছু নিয়ে আসতে পারে নি, যা প্রমাণ করবে যে ঐসব শয়তানেরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত; আল্লাহর ওলী হওয়া তো সুদূর পরাহত। আর তাদেরকে আহ্বান করা ও তাদের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা তো দূরের কথা। তবে তারা কিছু অলৌকিক ঘটনা, জাদু ও ভেলকি নিয়ে আসতে পারে এবং দাবি করতে পারে যে, তাদের কিছু কারামত রয়েছে, আর মনে করতে পারে যে, তারা অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ করার কারণে নিশ্চিত তারা ওলী [বস্তুতঃ অলৌকিক কিছু ঘটাতে পারলেই অলী হতে পারে না। আর আল্লাহর অলী হওয়ার জন্য অলৌকিক কিছু ঘটানোও শর্ত নয়। আল্লাহর অলী হতে হলে শরী‘আতকে পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে সক্ষম হচ্ছে কি না তাই দেখার ও বিবেচনার বিষয়। যারাই শরী‘আত পুরোপুরি মানবে তারাই আল্লাহর অলী, নয়তো তারা শয়তানের অলী। [সম্পাদক]]।

জেনে রাখুন, নিশ্চয় পথভ্রষ্টতা ও কুফুরী পরবর্তীদের অধিকাংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কারণ, তারা আল্লাহর কিতাবকে তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেলেছে, যে ব্যক্তি তাদেরকে জাদু করেছে ও তার ইবাদত ও আনুগত্যের দিকে ডাকছে, তার প্রতি সুধারণা পোষণ করে থাকে। তাছাড়া আরও কারণ হচ্ছে, তারা তাদের নিজেদের জন্য বানানো নিয়মকানুন, অন্তসারশূণ্য ব্যাপক দাবী ও নিজেদের জন্য জারী করা ব্যবস্থাপনার পিছনে নিজেদেরকে বেঁধে ফেলেছে। তা না করে তারা যদি আল্লাহর কিতাব পাঠ করতো, তার মধ্যে যা আছে তা জেনে নিত এবং মতবিরোধের সময় তার দিকে ফিরে আসত, তাহলে তার মধ্যে তারা হিদায়াত, (মনের) সুস্থতা ও আলো পেয়ে যেত; কিন্তু তারা তাকে তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেলেছে এবং তাকে কম মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করেছে। সুতরাং তারা যা ক্রয়-বিক্রয় করে, তা কতই না নিকৃষ্ট, আর বাকি আয়াতের ওপর আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।

লেখক বলেন,

قال أبو العباس : نَفَى الله عَمَّا سِوَاهُ كُلَّ مَا يَتَعَلَّقُ بِهِ الْمُشْرِكُونَ فَنَفَى أَنْ يَكُونَ لِغَيْرِهِ مُلْكٌ أَوْ قِسْطٌ مِنْ الْمُلْكِ أَوْ يَكُونَ عَوْنًا لِلَّهِ وَلَمْ يَبْقَ إلَّا الشَّفَاعَةُ ؛ فَبَيَّنَ أَنَّهَا لَا تَنْفَعُ إلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّبُّ كَمَا قَالَ تَعَالَى : ﴿وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ ﴾ [ الانبياء : ٢٨ ]. فَهَذِهِ الشَّفَاعَةُ الَّتِي يَظُنُّهَا الْمُشْرِكُونَ ؛ هِيَ مُنْتَفِيَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَمَا نَفَاهَا الْقُرْآنُ , وَ أَخْبَرَ بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : « أَنَّهُ يَأْتِي فَيَسْجُدُ لِرَبِّهِ وَيَحْمَدُهُ لَا يَبْدَأُ بِالشَّفَاعَةِ أَوَّلًا , ثم يُقَالُ لَهُ : أَيْ مُحَمَّدُ ارْفَعْ رَأْسَك وَقُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ . وَقَالَ لَهُ أَبُو هُرَيْرَةَ : مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِك يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟ قَالَ : مَنْ قَالَ : لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ » . فَتِلْكَ الشَّفَاعَةُ هِيَ لِأَهْلِ الْإِخْلَاصِ بِإِذْنِ اللَّهِ , وَلَا تَكُونُ لِمَنْ أَشْرَكَ بِاَللَّهِ . وَحَقِيقَتُهُ أَنَّ اللَّهَ هُوَ الَّذِي يَتَفَضَّلُ عَلَى أَهْلِ الْإِخْلَاصِ وَالتَّوْحِيدِ فَيَغْفِرُ لَهُمْ بِوَاسِطَةِ دُعَاءِ من أَذِنَ لَهُ أَنْ يَشْفَعَ لِيُكْرِمَهُ وَيَنَالَ بِهِ الْمَقَامَ الْمَحْمُودَ . فَالشَّفَاعَةُ الَّتِي نَفَاهَا الْقُرْآنُ مُطْلَقًا ؛ مَا كَانَ فِيهَا شِرْكٌ وَتِلْكَ مُنْتَفِيَةٌ مُطْلَقًا ؛ وَلِهَذَا أَثْبَتَ الشَّفَاعَةَ بِإِذْنِهِ فِي مَوَاضِعَ وَتِلْكَ قَدْ بَيَّنَ الرَّسُولُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهَا لَا تَكُونُ إلَّا لِأَهْلِ التَّوْحِيدِ وَالْإِخْلَاصِ .

আবুল আব্বাস বলেন, ‘আল্লাহ তিনি ব্যতীত এমন প্রত্যেক কিছুকে (সুপারিশ করার) অযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন, যার সাথে মুশরিকগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সুতরাং তিনি ব্যতীত অন্যের জন্য মালিকানা অথবা মালিকানার অংশীদার হওয়াকে তিনি না করেছেন অথবা না করেছেন আল্লাহর জন্য সাহায্যকারী সাব্যস্ত হওয়াকে, আর বাকি থাকল শুধু শাফা‘আতের বিষয়টি; তারপর তিনি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, প্রতিপালক আল্লাহ যার জন্য অনুমতি দিবেন, শাফা‘আত বা সুপারিশ সে ভিন্ন অন্য কারও উপকার করতে পারবে না; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যই যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৮ সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৮] সুতরাং মুশরিকগণের ধ্যান-ধারাণায় লালিত এই শাফা‘আত কিয়ামতের দিন অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য, যেমনিভাবে আল-কুরআন তাকে না করে দিয়েছে। আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আসবেন, অতঃপর তিনি তাঁর প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সাজদাহ করবেন, তাঁর প্রশংসা করবেন, প্রথমেই তিনি শাফা‘আতের মাধ্যমে সূচনা করবেন না; তারপর তাঁকে বলা হবে: হে মুহাম্মাদ! আপনি আপনার মাথা উঠান; আপনি বলুন, আপনার কথা শুনা হবে; আপনি চান, আপনাকে দেওয়া হবে; আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। আর আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে জিজ্ঞাসা করে বললেন: কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশের দ্বারা কোনো ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে? তিনি বললেন: যে ব্যক্তি একান্ত আন্তরিকতার সাথে বলে: لَا إِلَه إِلَّا اللَّه (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই] আর এই শাফা‘আত আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাওহীদের অনুসারী একনিষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে এবং ঐ ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হবে না, যে আল্লাহর সাথে শরীক করে। আর বাস্তব ব্যাপার হল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নির্ভেজাল একত্ববাদের অনুসারীদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। ফলে তিনি তাদেরকে ঐ ব্যক্তির দো‘আর মাধ্যমে ক্ষমা করবেন, যাকে তিনি সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন, যাতে তিনি তাকে সম্মানিত করতে পারেন এবং তিনি প্রশংসিত স্থান লাভ করতে পারেন। আর আল-কুরআন যে শাফা‘আতকে না করে দিয়েছে, তা হলো যার মধ্যে শির্ক থাকে, আর এ জন্যই তিনি তাঁর অনুমতিক্রমে (আল-কুরআনের) বিভিন্ন জায়গায় শাফা‘আতকে বিধিবদ্ধ করেছেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, শাফা‘আত শুধু তাওহীদ ও ইখলাসের (একনিষ্ঠতার) অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য।

ব্যাখ্যা: তার (লেখকের) কথা: قال أبو العباس (অর্থাৎ আবুল আব্বাস বলেন) এখানে আবূল আব্বাস হলেন, শাইখুল ইসলাম তকী উদ্দিন আহমদ ইবন আবদিল হালিম ইবন আবদিস সালাম ইবন তাইমিয়্যা, প্রসিদ্ধ ইমাম ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা; ইসলামের বিভিন্ন বিষয় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁর খ্যাতি ও নেতৃত্ব রয়েছে, যা তাঁর গুণাগুণ বর্ণনায় বাড়তি কিছু বলার অপেক্ষায় রাখে না। ইমাম যাহাবী বলেন, তার পূর্বে পাঁচশত বছর যাবত তাঁর মত কোনো ব্যক্তির আগমন ঘটে নি। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, চারশত বছর। তিনি আরও বলেন: আমি যদি (কা‘বা ঘরের) রুকনে ইয়ামানী ও মাকামে ইবরাহীমের মাঝখানে শপথ করে বলতে পারতাম, তাহলে আমি শপথ করে বলতাম যে, আমি তাঁর মত কাউকে দেখি নি, আর তিনি তাঁর দু’চোখ দ্বারা তাঁর নিজের মত কাউকে দেখেন নি। আর ইবন দাকীকুল ‘ঈদ বলেন: আমি যখন ইবন তাইমিয়্যা’র নিকট সমবেত হয়েছি, তখন আমি তাকে দেখেছি এমন এক ব্যক্তি হিসেবে, যার দু’চোখের সামনে সকল জ্ঞানের সমাহার, তিনি যা ইচ্ছা গ্রহণ করেন এবং যা ইচ্ছা ছেড়ে দেন। মোটকথা, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ. এর যুগের পরে তাঁর মত কোনো ব্যক্তির আগমন ঘটে নি, আর তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ৭২৮ সনে।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: نَفَى الله عَمَّا سِوَاهُ كُلَّ مَا يَتَعَلَّقُ بِهِ الْمُشْرِكُونَ (আল্লাহ তিনি ব্যতীত এমন প্রত্যেক কিছুকে (সুপারিশ করার) অযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন, যার সাথে মুশরিকগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা উল্লিখিত আয়াতের মধ্যে এমন প্রত্যেক বস্তুকে না করেছেন, যার সাথে মুশরিকগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে, যেমন তারা বিশ্বাস করে যে, ‘গাইরুল্লাহ’ তথা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের মধ্যে মালিকানা, তার মধ্যে অংশীদারীত্ব, তার সহযোগিতা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং এই চারটি বিষয় এমন, যার সাথে মুশরিকদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: فَنَفَى أَنْ يَكُونَ لِغَيْرِهِ مُلْكٌ (সুতরাং তিনি ব্যতীত অন্যের জন্য মালিকানা সাব্যস্ত হওয়াকে তিনি না করেছেন), আর এই বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা’র বাণীর মধ্যে রয়েছে, তিনি বলেন:

﴿لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [ سبا : ٢٢ ]

“তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২] সুতরাং যে ব্যক্তি এই (অণু) পরিমাণের মালিক হতে পারে না, তাহলে সে এমন ব্যক্তি হতে পারে না, যাকে আহ্বান করা হবে।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: أو قسط منه (অথবা তার অংশিদারীত্ব) অর্থাৎ মালিকানার অংশিদারীত্ব, আর القسط শব্দটি ‘কাফ’ অক্ষরে যের যোগে অর্থ হলো কোনো কিছুর অংশ, আর এই বিষয়টি রয়েছে আল্লাহর বাণীর মধ্যে, তিনি বলেন:

﴿وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ ﴾ [ سبا : ٢٢ ]

“আর এ দু’টিতে তাদের কোনো অংশও নেই”। [সূরা সাবা, আয়াত: ২২] অর্থাৎ ফিরিশতা ও অন্যান্যদের মধ্য থেকে তোমরা যাকে ডাক, আসমানসমূহ ও যমীনের মধ্যে তার কোনো অংশ নেই, আর যে ব্যক্তি মালিক নয় এবং মালিকের অংশীদারও নয়, আল্লাহ ব্যতীত তাকে কীভাবে আহ্বান করা হয়?

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: أَوْ يَكُونَ عَوْنًا لِلَّهِ (অথবা তিনি আল্লাহর জন্য সাহায্যকারী হওয়াকে না করেছেন), আর এটা রয়েছে তাঁর বাণীর মধ্যে, তিনি বলেন:

﴿وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢ ﴾ [ سبا : ٢٢ ]

“আর তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২] অর্থাৎ তোমরা যাদেরকে আহ্বান কর, তাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহর সাহায্যকারীও নয়।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: وَلَمْ يَبْقَ إلَّا الشَّفَاعَةُ ؛ فَبَيَّنَ أَنَّهَا لَا تَنْفَعُ إلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّبُّ .... إلخ (আর বাকি থাকল শুধু শাফা‘আতের বিষয়টি; তারপর তিনি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, প্রতিপালক আল্লাহ যার জন্য অনুমতি দিবেন, শাফা‘আত সে ভিন্ন অন্য কারও উপকার করতে পারবে না... শেষ পর্যন্ত)

যে সকল শর্তের মধ্য থেকে কোনো একটি যাকে ডাকবে সে আহুত ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া জরুরি। আর তা হচ্ছে চারটি, যা পাওয়া গেলেই শুধু সে আহ্বানে সাড়া দিতে সক্ষম হবে।

প্রথমত: মালিকানা। সুতরাং তিনি তা তাঁর বাণীর মাধ্যমে না করে দিয়েছেন, তিনি বলেন,

﴿لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [ سبا : ٢٢ ]

“তারা আসমানসমূহে অণু পরিমাণ কিছুরও মালিক নয়, যমীনেও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২]

দ্বিতীয়ত: যখন সে মালিক না হবে, তখন সে মালিকের অংশিদার হবে, আর তিনি তাও না করে দিয়েছেন তাঁর বাণীর মাধ্যমে:

﴿وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ ﴾ [ سبا : ٢٢ ]

“আর এ দু’টিতে তাদের কোনো অংশও নেই।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২]

তৃতীয়ত: যখন সে মালিকও হবে না এবং মালিকের শরীক বা অংশিদারও হবে না, তখন সে তার সাহায্যকারী ও ওযীর (মন্ত্রী) হবে, আর তিনি তাও না করে দিয়েছেন তাঁর বাণীর মাধ্যমে:

﴿وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢﴾ [ سبا : ٢٢ ]

“আর তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সহায়কও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২]

চতুর্থত: যখন সে মালিক হবে না, মালিকের শরীকও হবে না এবং মালিকের সাহায্যকারীও হবে না, তখন সে সুপারিশকারী হবে, আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করার বিষয়ে না করেছেন। কারণ, তিনিই প্রথম সুপারিশকারীকে অনুমতি দিবেন, অতঃপর সে সুপারিশ করবে। সুতরাং এসব বিষয়কে না করার দ্বারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে আহ্বান করার বিষয়টি বাতিল হয়ে গেছে; যখন তাঁর নিকট অন্যরা উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না, তখন তার প্রতি ইবাদত থেকে কোনো কিছুর ইচ্ছা পোষণ করাও আবশ্যক হয় না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةٗ لَّا يَخۡلُقُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ وَلَا يَمۡلِكُونَ لِأَنفُسِهِمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗا وَلَا يَمۡلِكُونَ مَوۡتٗا وَلَا حَيَوٰةٗ وَلَا نُشُورٗا ٣ ﴾ [ الفرقان : ٣ ]

“আর তারা তাঁর পরিবর্তে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে অন্যদেরকে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না, বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং তারা নিজেদের অপকার কিংবা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। আর মৃত্যু, জীবন ও উত্থানের ওপরও কোনো ক্ষমতা রাখে না।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৩] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ ءَالِهَةٗ لَّعَلَّهُمۡ يُنصَرُونَ ٧٤ لَا يَسۡتَطِيعُونَ نَصۡرَهُمۡ وَهُمۡ لَهُمۡ جُندٞ مُّحۡضَرُونَ ٧٥﴾ [ يس : ٧٤، ٧٥ ]

“আর তারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করেছে এ আশায় যে, তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু তারা (এ সব ইলাহ্) তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম নয়, আর তারা তাদের বাহিনীরূপে উপস্থিতকৃত হবে।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৭৪-৭৫] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُهُمۡ وَلَا يَضُرُّهُمۡۗ وَكَانَ ٱلۡكَافِرُ عَلَىٰ رَبِّهِۦ ظَهِيرٗا ٥٥﴾ [ الفرقان : ٥ 5]

“আর তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ‘ইবাদাত করে, যা তাদের উপকার করতে পারে না এবং তাদের অপকারও করতে পারে না। আর কাফের তো তার রব-এর বিরোধিতায় সহযোগিতাকারী”। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৫৫]

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: فَهَذِهِ الشَّفَاعَةُ الَّتِي يَظُنُّهَا الْمُشْرِكُونَ ؛ هِيَ مُنْتَفِيَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَمَا نَفَاهَا الْقُرْآنُ (সুতরাং মুশরিকগণের ধ্যান-ধারাণায় লালিত এই শাফা‘আত কিয়ামতের দিন অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য, যেমনিভাবে আল-কুরআন তাকে না করে দিয়েছে) অর্থাৎ মুশরিকগণ আল্লাহকে ছাড়া অন্যান্য সুপারিশকারী ও শরীকদের নিকট যে সুপারিশ প্রার্থনা করে, তা দুনিয়া ও আখিরাতে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য; যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা একজন মুমিনের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সূরা ইয়াসীনে বলেন,

﴿ءَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً إِن يُرِدۡنِ ٱلرَّحۡمَٰنُ بِضُرّٖ لَّا تُغۡنِ عَنِّي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُنقِذُونِ ٢٣ إِنِّيٓ إِذٗا لَّفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٢٤ ﴾ [ يس : ٢٣، ٢٤ ]

“আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ্ গ্রহণ করব? রহমান আমার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না। এরূপ করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়ব।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ২৩-২৪] আর আল্লাহ তা‘আলা ফির‘আউন বংশের কোনো এক মুমিনের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,

﴿لَا جَرَمَ أَنَّمَا تَدۡعُونَنِيٓ إِلَيۡهِ لَيۡسَ لَهُۥ دَعۡوَةٞ فِي ٱلدُّنۡيَا وَلَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ﴾ [ غافر : ٤٣ ]

নিঃসন্দেহ যে, তোমরা আমাকে যার দিকে ডাকছ, সে দুনিয়া ও আখিরাতে কোথাও ডাকের যোগ্য নয়।” [সূরা গাফের, আয়াত: ৪৩); আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿فَلَوۡلَا نَصَرَهُمُ ٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ قُرۡبَانًا ءَالِهَةَۢۖ بَلۡ ضَلُّواْ عَنۡهُمۡۚ وَذَٰلِكَ إِفۡكُهُمۡ وَمَا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ ٢٨﴾ [ الاحقاف : ٢٨ ]

“অতঃপর তারা আল্লাহ সান্নিধ্য লাভের জন্য আল্লাহ পরিবর্তে যাদেরকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেছিল তারা তাদেরকে সাহায্য করল না কেন? বরং তাদের ইলাহগুলো তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল। আর এটা ছিল তাদের মিথ্যাচার; এবং যা তারা অলীক উদ্ভাবন করছিল।” [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ২৮] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿وَمَا ظَلَمۡنَٰهُمۡ وَلَٰكِن ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡۖ فَمَآ أَغۡنَتۡ عَنۡهُمۡ ءَالِهَتُهُمُ ٱلَّتِي يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مِن شَيۡءٖ لَّمَّا جَآءَ أَمۡرُ رَبِّكَۖ وَمَا زَادُوهُمۡ غَيۡرَ تَتۡبِيبٖ ١٠١﴾ [ هود : ١٠١ ]

“আর আমরা তাদের প্রতি যুলুম করি নি কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল। অতঃপর যখন আপনার রবের নির্দেশ আসল, তখন আল্লাহ ছাড়া তারা যে ইলাহসমূহের ‘ইবাদাত করত, তারা তাদের কোনো কাজে আসল না। আর তারা ধ্বংস ছাড়া তাদের অন্য কিছুই বৃদ্ধি করল না।” [সূরা হূদ, আয়াত: ১০১] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَلَقَدۡ جِئۡتُمُونَا فُرَٰدَىٰ كَمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ أَوَّلَ مَرَّةٖ وَتَرَكۡتُم مَّا خَوَّلۡنَٰكُمۡ وَرَآءَ ظُهُورِكُمۡۖ وَمَا نَرَىٰ مَعَكُمۡ شُفَعَآءَكُمُ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُمۡ أَنَّهُمۡ فِيكُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْۚ لَقَد تَّقَطَّعَ بَيۡنَكُمۡ وَضَلَّ عَنكُم مَّا كُنتُمۡ تَزۡعُمُونَ ٩٤ ﴾ [ الانعام : ٩٤ ]

“আর অবশ্যই তোমরা আমাদের কাছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় এসেছ, যেমন আমরা প্রথম বার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম, আর আমরা তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম তা তোমরা তোমাদের পিছনে ফেলে এসেছ। আর তোমরা যাদেরকে তোমাদের ব্যাপারে (আল্লাহর সাথে) শরীক মনে করতে, তোমাদের সে সুপারিশকারীদেরকেও আমরা তোমাদের সাথে দেখছি না। তোমাদের মধ্যকার সম্পর্ক অবশ্যই ছিন্ন হয়েছে এবং তোমরা যা ধারণা করেছিলে, তাও তোমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯৪] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَقِيلَ ٱدۡعُواْ شُرَكَآءَكُمۡ فَدَعَوۡهُمۡ فَلَمۡ يَسۡتَجِيبُواْ لَهُمۡ وَرَأَوُاْ ٱلۡعَذَابَۚ لَوۡ أَنَّهُمۡ كَانُواْ يَهۡتَدُونَ ٦٤ ﴾ [ القصص : ٦٤ ]

“আর তাদেরকে বলা হবে, ‘তোমাদের (পক্ষ থেকে আল্লাহর জন্য শরীক করা) দেবতাগুলোকে ডাক।’ তখন তারা ওদেরকে ডাকবে। কিন্তু ওরা এদের ডাকে সাড়া দিবে না। আর তারা শাস্তি দেখতে পাবে। হায়! এরা যদি সৎপথ অনুসরণ করত।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৪] সুতরাং দুনিয়া ও আখিরাতে এটাই হবে প্রত্যেকের অবস্থা, আল্লাহ ব্যতীত যাকে সুপারিশ করার জন্য অথবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আহ্বান করা হবে।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: أَخْبَــرَ بِــهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : «أَنَّهُ يَأْتِي فَيَسْجُدُ لِرَبِّهِ وَيَحْمَدُهُ لَا يَبْدَأُ بِالشَّفَاعَةِ أَوَّلًا ...» إلى آخره . (আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আসবেন, অতঃপর তিনি তাঁর প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সাজদাহ করবেন, তাঁর প্রশংসা করবেন, প্রথমেই তিনি শাফা‘আতের মাধ্যমে সূচনা করবেন না... হাদীসের শেষ পর্যন্ত)। এই হাদীসটি সহীহাইন তথা বুখারী ও মুসলিম এবং অন্যান্য হাদীসের গ্রন্থে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত ও প্রমাণিত। শাফা‘আতের হাদীসের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«فَأَقُومُ فَأَمْشِي بَيْنَ سِمَاطَيْنِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ حَتَّى أَسْتَأْذِنَ عَلَى رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ , فَيُؤْذَنَ لِي فَإِذَا رَأَيْتُ رَبِّي وَقَعْتُ أَوْ خَرَرْتُ سَاجِدًا إِلَى رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي , قَالَ : ثُمَّ يُقَالُ : ارْفَعْ مُحَمَّدُ , قُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ , فَأَرْفَعُ رَأْسِي فَأَحْمَدُ بِتَحْمِيدٍ يُعَلِّمُنِيهِ , ثُمَّ أَشْفَعُ فَيَحُدُّ لِي حَدًّا فَأُدْخِلُهُمْ الْجَنَّة , َ ثُمَّ أَعُودُ إِلَيْهِ الثَّانِيَةَ , فَإِذَا رَأَيْتُ رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ وَقَعْتُ أَوْ خَرَرْتُ سَاجِدًا لِرَبِّي , فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي , ثُمَّ يُقَالُ : ارْفَعْ مُحَمَّدُ , قُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ , فَأَرْفَعُ رَأْسِي فَأَحْمَدُهُ بِتَحْمِيدٍ يُعَلِّمُنِيهِ , ثُمَّ أَشْفَعُ فَيَحُدُّ لِي حَدًّا فَأُدْخِلُهُمْ الْجَنَّةَ , ثُمَّ أَعُودُ إِلَيْهِ الثَّالِثَةَ , فَإِذَا رَأَيْتُ رَبِّي وَقَعْتُ أَوْ خَرَرْتُ سَاجِدًا لِرَبِّي عَزَّ وَجَلَّ , فَيَدَعُنِي مَا شَاءَ اللَّهُ أَنْ يَدَعَنِي , ثُمَّ يُقَالُ : ارْفَعْ مُحَمَّدُ وَقُلْ تُسْمَعْ وَسَلْ تُعْطَهْ وَاشْفَعْ تُشَفَّعْ , فَأَرْفَعُ رَأْسِي فَأَحْمَدُهُ بِتَحْمِيدٍ يُعَلِّمُنِيهِ , ثُمَّ أَشْفَعُ فَيَحُدُّ لِي حَدًّا فَأُدْخِلُهُمْ الْجَنَّةَ , ثُمَّ أَعُودُ الرَّابِعَةَ , فَأَقُولُ : يَا رَبِّ مَا بَقِيَ إِلَّا مَنْ حَبَسَهُ الْقُرْآن » .

“অতঃপর আমি দাঁড়াবো এবং মুমিনদের দুই কাতার বা সারির মাঝখান দিয়ে হাঁটব, শেষ পর্যন্ত আমি আমার রবের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করব, অতঃপর আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। তারপর যখন আমি আমার প্রতিপালককে দেখতে পাব, তখন আমি আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সাজদায় অবনত হয়ে পড়ব। অতঃপর আল্লাহ আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থার মধ্যে রেখে দিবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আমাকে এই অবস্থায় রেখে দিতে চাইবেন; অতঃপর তিনি বলবেন: মুহাম্মাদ! আপনি উঠুন। বলুন, আপনার কথা শোনা হবে। আপনি চান, আপনাকে তা দেওয়া হবে, আর আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। অতঃপর আমি আমার মাথা উঠাব, তারপর আমি এমন প্রশংসার দ্বারা তাঁর প্রশংসা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি সুপারিশ করব, তারপর তিনি আমাকে সুপারিশ করার ব্যাপারে সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন। তারপর আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। অতঃপর আমি তাঁর নিকট দ্বিতীয় বারের মত ফিরে আসব। তারপর যখন আমি আমার রবকে দেখতে পাব, তখন আমি আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সাজদায় অবনত হয়ে পড়ব। অতঃপর আল্লাহ আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থার মধ্যে রেখে দিবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আমাকে এই অবস্থায় রেখে দিতে চাইবেন, অতঃপর তিনি বলবেন: মুহাম্মাদ! আপনি উঠুন। বলুন, আপনার কথা শোনা হবে। আপনি চান, আপনাকে তা দেওয়া হবে, আর আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। অতঃপর আমি আমার মাথা উঠাব; তারপর আমি এমন প্রশংসার দ্বারা তাঁর প্রশংসা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি সুপারিশ করব, তারপর তিনি আমাকে সুপারিশ করার ব্যাপারে সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন, তারপর আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব। অতঃপর আমি তাঁর নিকট তৃতীয় বারের মত ফিরে আসব, তারপর যখন আমি আমার প্রতিপালককে দেখতে পাব, তখন আমি আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে সাজদায় অবনত হয়ে পড়ব। অতঃপর আল্লাহ আমাকে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থার মধ্যে রেখে দিবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আমাকে এই অবস্থায় রেখে দিতে চাইবেন। অতঃপর তিনি বলবেন: মুহাম্মাদ! আপনি উঠুন। বলুন, আপনার কথা শোনা হবে, আপনি চান, আপনাকে তা দেওয়া হবে, আর আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। অতঃপর আমি আমার মাথা উঠাব, তারপর আমি এমন প্রশংসার দ্বারা তাঁর প্রশংসা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি সুপারিশ করব, তারপর তিনি আমাকে সুপারিশ করার ব্যাপারে সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন, তারপর আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব; অতঃপর আমি তাঁর নিকট চতুর্থ বারের মত ফিরে আসব, তারপর আমি বলব: হে আমার রব! যে ব্যক্তিকে আল-কুরআন আটকিয়ে ফেলেছে, সে ব্যতীত আর কেউ অবশিষ্ট নেই। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১১৬; ৩/২৪৪।]

সুতরাং হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করে দিলেন যে, তিনি সুপারিশের অনুমতি এবং যাদের জন্য সুপারিশ করা হবে, তাদের ব্যাপারটি অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত সুপারিশ করবেন না। কারণ, তিনি বলেছেন, অতঃপর তিনি আমাকে সুপারিশের ব্যাপারে সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন, ফলে আমি তাদেরকে জান্নাত প্রবেশ করাব।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা: وَقَالَ لَهُ أَبُو هُرَيْرَةَ : مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِك يَوْمَ الْقِيَامَةِ ... إلى آخره . (আর আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে জিজ্ঞাসা করে বললেন: কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশের দ্বারা কোনো ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে?... শেষ পর্যন্ত)। এই হাদীসটি ইমাম বুখারী, মুসলিম ও নাসায়ী রহ. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি বললাম:

«يا رسول الله من أسعد الناس بشفاعتك يوم القيامة ؟ قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : لقد ظننت يا أبا هريرة أن لا تسألني عن هذا الحديث أحد أول منك , لما رأيت من حرصك على الحديث , اسعد الناس بشفاعتي يوم القيامة من قال : لا إله إلا الله خالصا من قلبه أو نفسه» .

“হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিন আপনার শাফা‘আত লাভে কে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবূ হুরায়রা! আমি ধারণা করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার আগে আমাকে আর কেউ প্রশ্ন করবে না। কারণ, আমি দেখেছি হাদীসের প্রতি তোমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান হবে সেই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি একান্ত আন্তরিকতার সাথে বলে: لَا إِلَه إِلَّا اللَّه (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই) [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৯।] অপর এক বর্ণনায় রয়েছে: «خالصا مخلصا من قلبه أو نفسه» . (একান্ত আন্তরিকতাসহকারে অথবা বিশুদ্ধ মনে)” [এভাবে একসাথে কোথাও পাওয়া যায়নি, তবে এক হাদীসে خالصا এসেছে যেমন বুখারীর বর্ণনা, অপর হাদীসে خالصا এর স্থানে مخلصا শব্দটি এসেছে, যেমন ইবন আবী আসেমের আস-সুন্নাহর (৮২৫) বর্ণনা। [সম্পাদক]]। ইমাম আহমদ রহ. এই হাদীসটি অপর এক সনদে বর্ণনা করেছেন এবং তাকে ইবন হিব্বান সহীহ বলেছেন, আর তাতে রয়েছে:

«وشفاعتي لمن شهد أن لا إله إلا الله مخلصا يصدق قلبه لسانه و لسانه قلبه» .

“আর আমার শাফা‘আত ঐ ব্যক্তির জন্য, যে একনিষ্ঠভাবে সাক্ষ্য দিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই, তার অন্তর তার মুখের কথাকে সত্যায়িত করে এবং তার মুখের কথা তার অন্তরকে সত্যায়িত করে [মুসনাদে আহমাদ ২/৩০৭, ৫১৮; ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৬৬৬৪।]।”

শাইখুল ইসলাম বলেন: সুতরাং তিনি তাঁর শাফা‘আতের দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান বলে চিহ্নিত করেছেন, যে তাদের মধ্যে একনিষ্ঠতার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি কামিল বা পরিপূর্ণ। আর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সহীহ হাদীসের মধ্যে বলেন:

« مَنْ سَأَلَ الله لِىَ الْوَسِيلَةَ حَلَّتْ عليهُ شفاعتي يوم القيامة » .

“যে ব্যক্তি আমার জন্য আল্লাহর নিকট অসীলার (উচ্চ মর্যাদার) দো‘আ করবে, তার জন্য কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত হালাল হয়ে যাবে।” সেখানে তিনি এটা বলেন নি যে, ‘আমার শাফা‘আত তথা সুপারিশ দ্বারা মানুষের মধ্যে সে সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে।

এর দ্বারা জানা গেল যে, বান্দার জন্য তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ) ও ইখলাসের মাধ্যমেই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত ও অন্যান্য বিষয় অর্জিত হবে, যা এতদ্ভিন্ন অন্য আমল দ্বারা অর্জিত হবে না। যদিও সে বান্দা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য অসীলার (উচ্চ মর্যাদার) প্রার্থনা করার মাধ্যমে সুপারিশ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে [কিন্তু সুপারিশ লাভ করবে, তা বলা হয় নি। বরং নিছক ন্যূনতম যোগ্যতা বিবেচিত হবে। অথচ পূর্বোক্ত তাওহীদের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে সুপারিশ লাভের সৌভাগ্যবান হবে বলে ঘোষিত হয়েছে। [সম্পাদক]]। (কিন্তু রাসূলের প্রদর্শিত আদেশ-নিষেধ ও নীতির বাইরে চলে কেউই শাফা‘আতের যোগ্য হতে পারে বলে কোথাও বলা হয় নি) তাহলে কীভাবে তিনি যে কাজের নির্দেশ তিনি দেন নি, বরং তা থেকে নিষেধ করেছেন, তার দ্বারা তার শাফা‘আত অর্জিত হবে? সুতরাং এ অবস্থায় সে দুনিয়া ও আখিরাতের কোনো কল্যাণ লাভ করতে পারবে না। যেমন, মসীহের ব্যাপারে খ্রিষ্টানদের বাড়াবাড়ি তা তাদের ক্ষতি করে, তাদের কোনো উপকার করে না, আর এর দৃষ্টান্ত রয়েছে ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«لِكُلِّ نَبِىٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِىٍّ دَعْوَتَهُ وَإِنِّى اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِى شَفَاعَةً لأُمَّتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَهِىَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللَّهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِى لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا » .

“প্রত্যেক নবীর জন্য একটি বিশেষ মাকবুল দো‘আ আছে। তন্মধ্যে সকলেই তাদের দো‘আ পৃথিবীতেই করে নিয়েছেন। আমি আমার দো‘আটি কিয়ামত দিবসে আমার উম্মতের জন্য রেখে দিয়েছি। আমার উম্মতের যে ব্যক্তি কোনো প্রকার শির্ক না করা অবস্থায় মারা যাবে সে ইনশাআল্লাহ আমার এই দো‘আ পাবে।” [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৮, ১৯৯।] অনুরূপভাবে শাফা‘আত সংক্রান্ত সকল হাদীসে রয়েছে যে, তিনি শুধু তাওহীদপন্থীদের ব্যাপারে সুপারিশ করবেন। সুতরাং শুধুমাত্র বান্দা কর্তৃক তার রবের প্রতি তাওহীদ তথা একত্ববাদ এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য তার দীনের ইখলাস তথা একনিষ্ঠতার কারণেই সে শাফা‘আত ও অন্যান্য বিষয় দ্বারা আল্লাহর অনুগ্রহের অধিকারী হবে।

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. তার অর্থ সম্পর্কে যা বলেন তার অর্থ হচ্ছে, এই হাদীসটি সম্পর্কে ভেবে দেখুন, কীভাবে তিনি শুধু তাওহীদ তথা একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাসকে শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে নির্ণয় করে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তাঁর শাফা‘আত লাভ করা যাবে। অপরদিকে মুশরিকদের ধ্যানধারণা হলো সুপারিশকারী গ্রহণ করা, তাদের উপাসনা করা এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদেরকে বন্ধু বা অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে শাফা‘আত লাভ করা যাবে। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মিথ্যা ধ্যানধারণাকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, কেবল তাওহীদের অনুসরণই হচ্ছে শাফা‘আত লাভের উপায়, আর তা তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন আল্লাহ তা‘আলা সুপারিশকারীকে সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন। আর মুশরিক ব্যক্তির অন্যতম অজ্ঞতা হলো, সে বিশ্বাস করে যে, সে যাকে ওলী তথা অভিভাবক অথবা সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করবে, সে তার জন্য সুপারিশ করবে এবং আল্লাহর দরবারে তাকে উপকৃত করবে, যেমনিভাবে রাষ্ট্রনায়ক ও প্রশাসকগণের বিশেষ ব্যক্তিগণ ঐ ব্যক্তির উপকার করে থাকে, যে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে, অথচ তারা জানে না যে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ সুপারিশ করতে পারবে না, আর তিনি সুপারিশ করার জন্য শুধু ঐ ব্যক্তির ব্যাপারেই অনুমতি দিবেন, যার কথা ও কাজে তিনি সন্তুষ্ট। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা প্রথম অংশে বলেন:

﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ ﴾ [ البقرة : ٢٥٥ ]

“কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৫], আর দ্বিতীয় অংশে তিনি বলেন:

﴿وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ ﴾ [ الانبياء : ٢٨ ]

“আর তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যই, যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৮] আর অবশিষ্ট থাকল তৃতীয় অংশ, আর তা হলো, তিনি তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা ব্যতীত কোনো ব্যক্তির কথা ও কাজে সন্তুষ্ট হবেন না। সুতরাং এই তিনটি অংশ ঐ ব্যক্তির অন্তর থেকে শির্ক নামক বৃক্ষের মূলোৎপাটন করবে, যে ব্যক্তি তা সচেতনার সাথে ধারণ ও অনুধাবন করতে পারবে...।

হাফেয ইবন হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন: এখানে যে শাফা‘আতের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তা হচ্ছে ঐ শাফা‘আত, যারা প্রকারসমূহ থেকে কোনো কোনো প্রকারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলবেন: ‘আমার উম্মত! আমার উম্মত!!’ তখন তাঁকে বলা হবে: যার অন্তরে অনু পরিমাণ ঈমান আছে, আপনি তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিন। সুতরাং এই শাফা‘আতের মাধ্যমে ঐ ব্যক্তিই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ হবে, শেষ পর্যন্ত যার ঈমান তার চেয়ে নিম্নস্তরের ব্যক্তির চেয়ে অধিক পরিপূর্ণ হবে। আর মহান শাফা‘আত বা ‘বড় শাফা‘আত’ তার মানে হলো (হাশরের ময়দানে) অবস্থানস্থলের মহাসঙ্কট থেকে নিষ্কৃতি প্রদান করার শাফা‘আত, আর এ ধরনের সুপারিশ দ্বারা ঐ ব্যক্তিই সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষ হবে, যে ব্যক্তি সবার আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর এ শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ হলেন, যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তি, যে তাদের পরপর জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর সে এমন ব্যক্তি, যে ব্যক্তি হিসাবের মুখোমুখি ও শাস্তির উপযুক্ত হওয়ার পর শাস্তি ভোগ না করেই তাতে (জান্নাতে) প্রবেশ করবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তি সৌভাগ্যবান হবে, যে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুনে আক্রান্ত হবে এবং তাতে পতিত হবে না।

আর জেনে রাখুন, কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত হবে ছয় প্রকারের, যেমনটি ইবনুল কাইয়্যেম রহ. উল্লেখ করেছেন:

প্রথমত: মহান শাফা‘আত, যার ব্যাপারে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তথা নবীগণ পিছিয়ে থাকবেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত তা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে পৌঁছবে, অতঃপর তিনি বলবেন: أنا لها অর্থাৎ ‘তার জন্য আমি আছি’। আর এটা তখন হবে, যখন সকল মানুষ নবীদের নিকট গিয়ে তাদের আকাঙ্খা ব্যক্ত করবে, যাতে তারা তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করেন, যাতে তিনি তাদেরকে হাশরের ময়দানের সঙ্কটময় অবস্থান থেকে মুক্তি দান করেন। আর এটা এমন শাফা‘আত, যা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যই বরাদ্ধ, যাতে অন্য কোনো ব্যক্তি অংশীদার হবে না।

দ্বিতীয়ত: জান্নাতবাসীদের জন্য তাতে প্রবেশের ব্যাপারে তাঁর শাফা‘আত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. কর্তৃক বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আলোচনা করেছেন।

তৃতীয়ত: তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে পাপী সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর শাফা‘আত, যাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব (অবধারিত) হয়ে গেছে, ফলে তিনি তাদের জন্য সুপারিশ করবেন, যাতে তারা তাতে (জাহান্নামে) প্রবেশ না করে।

চতুর্থত: তাওহীদ তথা একত্ববাদের অনুসারীদের মধ্য থেকে ঐসব পাপীদের ব্যাপারে তাঁর শাফা‘আত, যারা তাদের গুনাহের কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে, আর এই প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির সনদে হাদীসসমূহ বর্ণিত, আর সকল সাহাবী ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ এই ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। যারা এটাকে অস্বীকার করে তারা তাদেরকে বিদ‘আতের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন এবং চতুর্দিক দিকে তাদেরকে পাকড়াও করার জন্য বলেছেন এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

পঞ্চমত: জান্নাতবাসীদের মধ্য থেকে কোনো এক সম্প্রদায়ের জন্য তাদের সাওয়াব বৃদ্ধি ও উচ্চ মর্যাদার ব্যাপারে তাঁর শাফা‘আত, আর এর ব্যাপারে কারও পক্ষ থেকে কোনো বিরোধ নেই।

ষষ্ঠত: জাহান্নামবাসী কোনো কোনো কাফিরের ব্যাপারে তাঁর শাফা‘আত, এমনকি তাতে তার শাস্তি হালকা করা হবে, আর এই শাফা‘আত শুধুমাত্র একমাত্র আবূ তালিবের সাথে নির্দিষ্ট।

তার (ইবন তাইমিয়্যা’র) কথা:

وَحَقِيقَتُهُ أي حقيقة الأمر , أي أمر الشفاعة أَنَّ اللَّهَ هُوَ الَّذِي يَتَفَضَّلُ عَلَى أَهْلِ الْإِخْلَاصِ وَالتَّوْحِيدِ فَيَغْفِرُ لَهُمْ بِوَاسِطَةِ دُعَاءِ من أَذِنَ لَهُ أَنْ يَشْفَعَ لِيُكْرِمَهُ وَيَنَالَ بِهِ الْمَقَامَ الْمَحْمُودَ

(আর শাফা‘আতের বিষয়টির বাস্তবতা হলো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নির্ভেজাল একত্ববাদের অনুসারীদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। ফলে তিনি তাদেরকে ঐ ব্যক্তির দো‘আর মাধ্যমে ক্ষমা করবেন, যাকে তিনি সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন, যাতে তিনি তাকে সম্মানিত করতে পারেন এবং সে প্রশংসিত স্থান লাভ করতে পারে)। সুতরাং এটাই হলো শাফা‘আতের বাস্তব চিত্র। বিষয়টি এমন নয় যেমনটি ধারণা করে মুশরিক ও জাহিলগণ; তারা মনে করে যে, শাফা‘আত মানে হলো সুপারিশকারী প্রথম দিকেই যাকে ইচ্ছা তার ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারবে, ফলে সে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবে। আর এই জন্য তারা মৃত ব্যক্তিগণ ও অন্যান্যদের নিকট তা (সুপারিশ) প্রার্থনা করে, যখন তারা তাদেরকে যিয়ারত করে, আর এরাই বলে: সম্মানিত মৃত ব্যক্তি, আল্লাহ তা‘আলার নিকট যার আত্মার নৈকট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, সার্বক্ষণিক তার নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও অনুগ্রহ আসে এবং তার আত্মার ওপর কল্যাণসমূহ প্রবাহিত হয়। সুতরাং যিয়ারতকারী যখন তার আত্মাকে তার সাথে সম্পর্কিত করে এবং তাকে তার নিকটবর্তী করে, তখন যিয়ারতকৃত ব্যক্তির আত্মা থেকে যিয়ারতকারীর আত্মার ওপর তার মাধ্যমে ঐসব ভৌতিক ও অবাস্তব কল্যাণসমূহ প্রবাহিত হয়, যেমনিভাবে স্বচ্ছ আয়না, পানি ও অনুরূপ কোনো বস্তু থেকে তার সামনে দণ্ডায়মানরত ব্যক্তির উপর আলোক রশ্মি বা প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়। তারা বলে: পরিপূর্ণ যিয়ারত মানেই, যিয়ারতকারী ব্যক্তি কর্তৃক তার আত্মা ও অন্তরকে মৃত ব্যক্তির অভিমুখি করা, তার অভিপ্রায়কে তার ওপর ন্যস্ত করা এবং তার সকল ইচ্ছা ও মনোযোগকে তার ওপর এমনভাবে ন্যস্ত করা, যাতে অন্যের প্রতি দৃষ্টির দেওয়ার অবকাশ থাকে না [ইবন তাইমিয়্যা রহ. এর উদ্দেশ্য হলো, এগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণ ভ্রষ্ট কথা। যা তারা কবর যিয়ারতের মাধ্যমে লাভ হয় বলে মনে করে। অথচ এটা শির্কী ও কুফুরীর মধ্যেই মানুষকে নিমজ্জিত করে। [সম্পাদক]]।

ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই যিয়ারতের কথা বলেছ ইবন সীনা, আল-ফারাবী ও অন্যান্যরা, আর নক্ষত্র পূজারীরা গ্রহ-নক্ষত্র পূজার ক্ষেত্রে তা স্পষ্ট বর্ণনা করেছে এবং তারা বলেছে: যখন বাকশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি উর্ধ্বতন আত্মাসমূহের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দেয়, তখন তাদের পক্ষ থেকে তার ওপর আলো সঞ্চারিত হয়। আর এই রহস্যময় কারণেই সে নক্ষত্র পূজা করেছে, তার প্রতিমূর্তি গ্রহণ করেছে, তার জন্য দো‘আ বা প্রর্থনা রচনা করেছে এবং তার শরীরী মূর্তিকে (উপাস্য হিসেবে) গ্রহণ করেছে, আর এটাই মূল দর্শন, যা কবর পূজারীদের জন্য আবশ্যক করে দিয়েছে কবরকে উৎসবের জায়গা হিসেবে গ্রহণ করা, তার ওপর পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া, তার ওপর বাতি জ্বালানো এবং মাসজিদ নির্মাণ করা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করেছিলেন তাদের এ সব কিছুকেই পুরোপুরিভাবে বাতিল ও সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার এবং তার দিকে ধাবিত করে এমন সব উপলক্ষ বন্ধ করে দেওয়ার। অতঃপর মুশরিকগণ তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো এবং তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধিতা করল, ফলে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পক্ষ নিয়েছিলেন এবং ঐসব মুশরিকগণ আরেক পক্ষ নিয়েছিল।

আর ঐসব মুশরিকগণ কবর যিয়ারত প্রসঙ্গে যা আলোচনা করেছে, তাই হলো (তাদের নিকট) শাফা‘আত, যার ব্যাপারে তারা ধারণা করে যে, তাদের উপাস্যগণ তার দ্বারা তাদেরকে উপকৃত করবে এবং তারা তার জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে। তারা বলে: বান্দা যখন আল্লাহর নৈকট্যবান বিশিষ্ট ও মর্যাদাবান ব্যক্তির আত্মার সাথে সম্পর্ক রাখবে, তার অভিপ্রায়কে তার অভিমুখী করবে এবং তার অন্তরকে আল্লাহ থেকে বিরত রাখবে, তাহলে সে হবে তার সাথে কঠিন সম্পর্ককারী ব্যক্তি, আর এটাকে তারা ঐ ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছে, যে ব্যক্তি কোনো সম্মানিত ও সম্রাটের নিকটতম ব্যক্তির খিদমত করেছে। সুতরাং সেই ব্যক্তি সম্রাটের কারণে যে পুরস্কার ও সম্মান লাভ করবে, সেও এই সংশ্লিষ্ট পুরস্কারটি তার সাথে সম্পর্ক অনুসারে লাভ করবে। সুতরাং এটাই হলো মূর্তিপূজার মূল রহস্য, আর যাকে বাতিল করার জন্য এবং তার অনুসরণকারীদেরকে কাফির বলে চিহ্নিত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন, আর তিনি তাদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন, তাদের রক্ত, সম্পদ ও তাদের বংশধরদের বন্দী করাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য জাহান্নামকে আবশ্যক করে দিয়েছেন, আর আল-কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার (মূর্তিপূজার) অনুসারীকে ও তাদের মতবাদকে বাতিলকরণ প্রসঙ্গে বর্ণিত আয়াত দ্বারা পরিপূর্ণ।

[ ১ ]

মহান শাফা‘আত
১. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে গোশত এনে তাঁকে সামনের রান পরিবেশন করা হলো, যা তিনি পছন্দ করতেন। অতঃপর তিনি তার থেকে কামড় দিয়ে খেলেন এবং এরপর বললেন:

«أنا سيد الناس يوم القيامة وهل تدرون مم ذلك ؟ يجمع الله الناس الأولين والآخرين في صعيد واحد يسمعهم الداعي وينفذهم البصر , وتدنو الشمس فيبلغ الناس من الغم والكرب ما لا يطيقون ولا يحتملون , فيقول الناس : ألا ترون ما قد بلغكم ؟ ألا تنظرون من يشفع لكم إلى ربكم ؟ فيقول بعض الناس لبعض : عليكم بآدم , فيأتون آدم عليه السلام : فيقولون له : أنت أبو البشر خلقك الله بيده , ونفخ فيك من روحه , وأمر الملائكة فسجدوا لك , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى إلى ما نحن فيه ؟ ألا ترى إلى ما قد بلغنا ؟ فيقول آدم : إن ربي قد غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله ولن يغضب بعده مثله , وإنه نهاني عن الشجرة فعصيته , نفسي , نفسي , نفسي , اذهبوا إلى غيري , اذهبوا إلى نوح , فيأتون نوحا فيقولون : يا نوح إنك أنت أول الرسل إلى أهل الأرض , وقد سماك الله عبدا شكورا , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى إلى ما نحن فيه ؟ فيقول : إن ربي عز و جل قد غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله ولن يغضب بعده مثله , وإنه قد كانت لي دعوة , دعوتها على قومي , نفسي , نفسي , نفسي , اذهبوا إلى غيري , اذهبوا إلى إبراهيم , فيأتون إبراهيم , فيقولون : يا إبراهيم أنت نبي الله وخليله من أهل الأرض , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى إلى ما نحن فيه ؟ فيقول لهم : إن ربي قد غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله ولن يغضب بعده مثله , وإني قد كنت كذبت ثلاث كذبات-فذكرهن أبو حيان في الحديث نفسي , نفسي , نفسي , اذهبوا إلى غيري , اذهبوا إلى موسى . فيأتون موسى , فيقولون : يا موسى أنت رسول الله , فضلك الله برسالته وبكلامه على الناس , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى إلى ما نحن فيه ؟ فيقول : إن ربي قد غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله ولن يغضب بعده مثله , وإني قد قتلت نفسا لم أومر بقتلها , نفسي , نفسي , نفسي , اذهبوا إلى غيري , اذهبوا إلى عيسى , فيأتون عيسى فيقولون : يا عيسى أنت رسول الله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه , وكلمت الناس في المهد صبيا , اشفع لنا , ألا ترى إلى ما نحن فيه ؟ فيقول عيسى : إن ربي قد غضب اليوم غضبا لم يغضب قبله مثله قط ولن يغضب بعده مثله-ولم يذكر ذنبا نفسي , نفسي , نفسي , اذهبوا إلى غيري , اذهبوا إلى محمد صلى الله عليه و سلم . فيأتون محمدا صلى الله عليه و سلم , فيقولون : يا محمد أنت رسول الله , وخاتم الأنبياء , وقد غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر , اشفع لنا إلى ربك , ألا ترى إلى ما نحن فيه ؟ فأنطلق فآتي تحت العرش فأقع ساجدا لربي عز و جل , ثم يفتح الله علي من محامده , وحسن الثناء عليه شيئا لم يفتحه على أحد قبلي , ثم يقال : يا محمد ارفع رأسك سل تعطه , واشفع تشفع , فأرفع رأسي فأقول : أمتي يا رب , أمتي يا رب , فيقال : يا محمد أدخل من أمتك من لا حساب عليهم من الباب الأيمن من أبواب الجنة وهم شركاء الناس فيما سوى ذلك من الأبواب , ثم قال : والذي نفسي بيده إن ما بين المصراعين من مصاريع الجنة كما بين مكة وحمير أو كما بين مكة وبصرى » .

“আমি হব কিয়ামতের দিন মানবকুলের সরদার। তোমাদের কি জানা আছে তা কেন? কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী ও পূর্ববর্তী সকল মানুষ এমন এক ময়দানে সমবেত হবে, যেখানে একজন আহ্বানকারী’র আহ্বান সকলে শুনতে পাবে এবং সকলেই এক সঙ্গে দৃষ্টিগোচর হবে। সূর্য নিকটে এসে যাবে। মানুষ এমনি কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হবে, যা অসহনীয় ও অসহ্যকর হয়ে পড়বে। তখন লোকেরা বলবে, তোমরা কী বিপদের সম্মুখীন হয়েছ, তা কি দেখতে পাচ্ছ না? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজে বের করবে না, যিনি তোমাদের রবের কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশ করবেন? কেউ কেউ অন্যদের বলবে যে, আদম আলাইহিস সালামের কাছে চল। তখন সকলে তার কাছে এসে তাকে বলবে, আপনি আবুল বাশার [‘আবুল বাশার’ অর্থ: মানব জাতির পিতা।]। আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে স্বীয় হাত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর রূহ আপনার মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন এবং তিনি ফিরিশতাদের নির্দেশ দিলে তারা আপনাকে সাজদাহ করেন। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কিসের মধ্যে আছি? আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কী অবস্থায় পৌঁছেছি? তখন আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, আজ আমার রব এত রাগান্বিত হয়েছেন যে, যার আগেও কোনো দিন এত রাগান্বিত হন নি এবং পরেও এরূপ রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে একটি বৃক্ষের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি অমান্য করেছি, নাফসী! নাফসী! নাফসী! (আমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি) তোমরা অন্যের কাছে যাও, তোমরা নূহ আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তখন সকলে নূহ আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, হে নূহ আলাইহিস সালাম! নিশ্চয় আপনি পৃথিবীর মানুষের প্রতি প্রেরিত প্রথম রাসূল। [কারণ, তিনি শরী‘য়তের হুকুম-আহকামের প্রথম রাসূল। কারণ, রাসূলগণ সাধারণত; ঈমানদার ও কাফের উভয় কাউমের কাছেই প্রেরিত হন। নূহ আলাইহিস সালামের কওমের পূর্বে অপরাধ থাকলেও শির্ক ছিল না। সুতরাং তিনিই প্রথম রাসূল। আর আদম আলাইহিস সালাম প্রথম নবী। অথবা সমস্ত পৃথিবী প্রলয়ংকারী বন্যায় প্লাবিত হওয়ার পর পৃথিবীর তিনি সর্বপ্রথম রাসূল ছিলেন। [সম্পাদক]] আর আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে পরম কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কিসের মধ্যে আছি? তখন আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, আজ আমার রব এত বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, যার আগেও কোনো দিন এত রাগান্বিত হন নি এবং পরেও এরূপ রাগান্বিত হবেন না। আমার একটি গ্রহণীয় দো‘আ ছিল, যা আমি আমার কাওমের ব্যাপারে করে ফেলেছি, (এখন) নাফসী! নাফসী! নাফসী!। তোমরা অন্যের কাছে যাও- যাও তোমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তখন তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, হে ইবরাহীম! আপনি আল্লাহর নবী এবং পৃথিবীর মানুষের মধ্যে থেকে আপনি (বিশেষভাবে অন্তরঙ্গ) আল্লাহর বন্ধু। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কিসের মধ্যে আছি? তিনি তাদের বলবেন, আজ আমার রব এত বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, যার আগেও তিনি কোনো দিন এত রাগান্বিত হন নি এবং পরেও এরূপ রাগান্বিত হবেন না। আর আমি তো তিনটি মিথ্যা বলে ফেলেছিলাম। বর্ণনাকারী আবূ হাইয়ান তাঁর বর্ণনায় এগুলোর উল্লেখ করেছেন- (এখন) নাফসী! নাফসী! নাফসী!। তোমরা অন্যের কাছে যাও- যাও মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তারা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, হে মূসা আলাইহিস সালাম! আপনি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ আপনাকে রিসালাতের সম্মান দান করেছেন এবং আপনার সাথে কথা বলে সমগ্র মানব জাতির ওপর মর্যাদা দান করেছেন। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কিসের মধ্যে আছি? তিনি তাদের বলবেন, আজ আমার রব এত বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, যার আগেও তিনি কোনো দিন এত রাগান্বিত হন নি এবং পরেও এরূপ রাগান্বিত হবেন না। আর আমি তো এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেলেছিলাম, যাকে হত্যা করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয় নি। (এখন) নাফসী! নাফসী! নাফসী!। তোমরা অন্যের কাছে যাও- যাও ‘ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তখন তারা ‘ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, হে ‘ঈসা আলাইহিস সালাম! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং কালেমা [‘কালেমা’ দ্বারা " كُن " শব্দকে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু এই শব্দটি বলার সাথে সাথে ‘ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কুদরতে মাতৃগর্ভে আসেন, সেহেতু তাকে ‘তাঁর কালেমা’ বলা হয়।], যা তিনি মরিয়ম আলাইহিস সালামের উপর ঢেলে দিয়েছিলেন। আপনি ‘রূহ’ [‘রূহ’ দ্বারা ফিরিশতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান ফিরিশতা জিবরীল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে অথবা রূহ দ্বারা আল্লাহর আদেশকে বুঝানো হয়েছে, যেহেতু আল্লাহর নির্দেশে তিনি (জিবরীল) এসে মারইয়ামকে তার পুত্রের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, তাই বলা হয় ‘তাঁর রূহ’।]। আপনি দোলনায় থেকে মানুষের সাথে কথা বলেছেন। সুতরাং আজ আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কিসের মধ্যে আছি? তখন ‘ঈসা আলাইহিস সালাম বলবেন, আজ আমার রব এত বেশি রাগান্বিত হয়েছেন যে, যার আগেও তিনি কোনো দিন এত রাগান্বিত হন নি এবং পরেও এরূপ রাগান্বিত হবেন না। তিনি নিজের কোনো গুনাহের কথা বলবেন না। নাফসী! নাফসী! নাফসী!। তোমরা অন্যের কাছে যাও- যাও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলবে, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী। আল্লাহ তা‘আলা আপনার আগের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না যে, আমরা কিসের মধ্যে আছি? তখন আমি ‘আরশের নিচে এসে আমার রবের সামনে সাজদায় অবনত হয়ে যাব। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রশংসা ও গুণগানের এমন সুন্দর পদ্ধতি আমার সামনে খুলে দিবেন, যা এর পূর্বে কাউকে খুলে দেন নি। এরপর বলা হবে, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার মাথা উঠান। আপনি যা চান, তা আপনাকে দেওয়া হবে। আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। এরপর আমি আমার মাথা উঠিয়ে বলব, হে আমার রব! আমার উম্মত। হে আমার রব! আমার উম্মত। হে আমার রব! আমার উম্মত। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার উম্মতের মধ্যে যাদের কোনো হিসাব-নিকাশ হবে না, তাদেরকে জান্নাতের দরজাসমূহের ডান পার্শ্বের দরজা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিন। এ দরজা ছাড়া অন্যদের সাথে অন্য দরজা দিয়েও তাদের প্রবেশের অধিকার থাকবে। তারপর তিনি বলবেন, যার হাতে আমার প্রাণ, সে সত্তার কসম! বেহেশতের এক দরজার দুই পার্শ্বের মধ্যবর্তী প্রশস্ততা হলো যেমন মক্কা ও হিমইয়ারের মধ্যবর্তী দূরত্ব অথবা মক্কা ও বসরার মাঝখানের দূরত্ব।” [সহীহ বুখারী, তাফসীর অধ্যায় (২/৩৮৫), হাদীস নং ৪৩৫৭; সহীহ মুসলিম (১/১৮৪); তিরমিযী; আহমদ (২/৪৩৫)।]

২. কাতাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«يَجْمَعُ الله المؤمنين يوم القيامة كذلك فيقولون لو استشفعنا إلى ربنا حتى يريحنا من مكاننا هذا فيأتون آدم فيقولون يا آدم أما ترى الناس خلقك الله بيده وأسجد لك ملائكته وعلمك أسماء كل شيء اشفع لنا إلى ربنا حتى يريحنا من مكاننا هذا فيقول لست هناك ويذكر لهم خطيئته التي أصاب ولكن ائتوا نوحا فإنه أول رسول بعثه الله إلى أهل الأرض فيأتون نوحا فيقول لست هناكم ويذكر خطيئته التي أصاب ولكن ائتوا إبراهيم خليل الرحمن فيأتون إبراهيم فيقول لست هناكم ويذكر لهم خطاياه التي أصابها ولكن ائتوا موسى عبدا آتاه الله التوراة وكلمه تكليما فيأتون موسى فيقول لست هناكم ويذكر لهم خطيئته التي أصاب ولكن ائتوا عيسى عبد الله ورسوله وكلمته وروحه فيأتون عيسى فيقول لست هناكم ولكن ائتوا محمدا صلى الله عليه و سلم عبدا غفر له ما تقدم من ذنبه وما تأخر فيأتونني فأنطلق فأستأذن على ربي فيؤذن لي عليه فإذا رأيت ربي وقعت له ساجدا فيدعني ما شاء الله أن يدعني ثم يقال لي ارفع محمد وقل يسمع وسل تعطه واشفع تشفع فأحمد ربي بمحامد علمنيها ثم أشفع فيحد لي حدا فأدخلهم الجنة ثم أرجع فإذا رأيت ربي وقعت ساجدا فيدعني ما شاء الله أن يدعني ثم يقال ارفع محمد وقل يسمع وسل تعطه واشفع تشفع فأحمد ربي بمحامد علمنيها ربي ثم أشفع فيحد لي حدا فأدخلهم الجنة ثم أرجع فإذا رأيت ربي وقعت ساجدا فيدعني ما شاء الله أن يدعني ثم يقال ارفع محمد قل يسمع وسل تعطه واشفع تشفع فأحمد ربي بمحامد علمنيها ثم أشفع فيحد لي حدا فأدخلهم الجنة ثم أرجع فأقول يا رب ما بقي في النار إلا من حبسه القرآن ووجب عليه الخلود » .

قال النبي صلى الله عليه و سلم : « يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن شعيرة ثم يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وكان في قلبه من الخير ما يزن برة ثم يخرج من النار من قال لا إله إلا الله وكان في قلبه ما يزن من الخير ذرة » .

“কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে অনুরূপভাবে একত্রিত করবেন, তখন তারা বলবে, আমরা যদি কাউকে আমাদের প্রতিপালকের কাছে সুপারিশের জন্য অনুরোধ করতাম, যাতে তিনি আমাদেরকে আমাদের এই সংকটময় স্থান থেকে স্বস্তি প্রদান করতেন। অতঃপর তারা আদম আলাইহিস সালামের কাছে গিয়ে বলবে: হে আদম আলাইহিস সালাম! আপনি কি মানুষের অবস্থা দেখছেন না? অথচ আল্লাহ তা‘আলা স্বহস্তে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন, আপনাকে তাঁর ফিরিশতাগণ সাজদাহ করেছেন এবং আপনাকে তিনি সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং আপনি আমাদের প্রতিপালকের কাছে সুপারিশ করুন, যাতে তিনি আমাদেরকে আমাদের এই সংকটময় স্থান থেকে স্বস্তি প্রদান করেন। আদম আলাইহিস সালাম তখন বলবেন, আমি এই কাজের জন্য যোগ্য নই। তিনি তাঁর ত্রুটির কথা স্মরণ করিয়ে তাদেরকে বলবেন, তোমরা বরং নূহ আলাইহিস সালামের কাছে যাও; যেহেতু তিনিই আল্লাহর প্রথম রাসূল, যাকে তিনি যমীনবাসীর নিকট পাঠিয়েছেন। (এ কথা শুনে) তারা নূহ আলাইহিস সালামের কাছে আসবে। তখন তিনিও বলবেন, আমি এই কাজের জন্য যোগ্য নই। তিনি তাঁর ত্রুটির কথা উল্লেখ করে বলবেন, তোমরা বরং আল্লাহ’র খলীল (বন্ধু) ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তখন তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে আসবে। তখন তিনিও বলবেন, আমি এই কাজের জন্য যোগ্য নই। তিনি তাঁর ত্রুটিসমূহের কথা উল্লেখ করে বলবেন, তোমরা বরং মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তিনি এমন এক বান্দা, যাকে আল্লাহ তাওরাত প্রদান করেছেন এবং তাঁর সাথে প্রত্যক্ষ বাক্যালাপ করেছেন। তখন তারা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে আসবে। তখন তিনিও বলবেন, আমি এই কাজের জন্য যোগ্য নই। তিনি তাঁর ত্রুটিসমূহের কথা উল্লেখ করে বলবেন, তোমরা বরং ‘ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও; যিনি আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল, ‘কালিমা’ ও ‘রূহ’ [রূহ অর্থ: আত্মা, আদেশ; আর কালিমা অর্থ: কথা। যেহেতু ‘ঈসা আলাইহিস সালাম সরাসরি আল্লাহ’র আদেশে সৃষ্ট, সেজন্য তাকে ‘রূহুল্লাহ’ ও ‘কালিমাতুল্লাহ’ বলা হয়।]; তখন তারা ‘ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে আসবে। তখন তিনিও বলবেন, আমি এই কাজের যোগ্য নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও; তিনি এমন এক বান্দা, যার আগের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই আমার কাছে আসবে। আমি তখন আমার রবের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করব এবং আমাকে এর অনুমতি দেওয়া হবে। অতঃপর আমি যখন আমার প্রতিপালককে দেখতে পাব, তখনই আমি তাঁর সামনে সাজদায় অবনত হয়ে যাব; অতঃপর আল্লাহ তাঁর মরজী অনুসারে যতক্ষণ আমাকে সেভাবে রাখার রেখে দিবেন। তারপর আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠান। (যা বলার) বলুন, শুনা হবে। (যা চাওয়ার) চান, দেওয়া হবে। (যা সুপারিশ করার) করুন, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি আমার প্রতিপালকের শিখিয়ে দেওয়া প্রশংসারাজির দ্বারা তাঁর প্রশংসা করব, তারপর আমি শাফা‘আত করব। আর আমার জন্য (শাফা‘আতের) একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এরপর আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিব। তারপর আমি ফিরে আসব। আবার যখন আমি আমার রবকে দেখতে পাব, তখনই আমি তাঁর সামনে সাজদায় অবনত হয়ে যাব। অতঃপর আল্লাহ তাঁর মর্জি অনুসারে যতক্ষণ আমাকে সেভাবে রাখার রেখে দিবেন। তারপর আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠান। বলুন, শুনা হবে। চান, দেওয়া হবে। সুপারিশ করুন, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি আমার রবের শিখিয়ে দেওয়া প্রশংসারাজির দ্বারা তাঁর প্রশংসা করব, তারপর আমি শাফা‘আত করব। তখনও আমার জন্য একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এরপর আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেব। তারপর আমি ফিরে আসব। এবারও যখন আমি আমার প্রতিপালককে দেখতে পাব, তখনই আমি তাঁর সামনে সাজদায় অবনত হয়ে যাব। অতঃপর আল্লাহ তাঁর মর্জি অনুসারে যতক্ষণ আমাকে সেভাবে রাখার রেখে দিবেন। তারপর আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠান। বলুন, শুনা হবে। চান, দেওয়া হবে। সুপারিশ করুন, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি আমার রবের শিখিয়ে দেওয়া প্রশংসারাজির দ্বারা তাঁর প্রশংসা করব, তারপর আমি শাফা‘আত করব। তখনও আমার জন্য একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এরপর আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিব। এরপর আমি তাঁর কাছে ফিরে গিয়ে বলব, হে রব! এখন একমাত্র তারাই জাহান্নামে অবশিষ্ট রয়েছে, যাদেরকে কুরআন আটক করে রেখে দিয়েছে এবং যাদের ওপর স্থায়ীভাবে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গিয়েছে।

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ পড়েছে, অথচ তার হৃদয়ে একটি যবের ওজনের পরিমাণ ভালো কিছু (ঈমান) আছে, তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। তারপর জাহান্নাম থেকে বের করা হবে তাকেও, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ পড়েছে এবং তার হৃদয়ে একটি গমের ওজনের পরিমাণ ভালো কিছু (ঈমান) আছে। (সর্বশেষে) জাহান্নাম থেকে তাকে বের করা হবে, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ পড়েছে এবং তার হৃদয়ে অণু পরিমাণ মাত্র ভালো কিছু (ঈমান) আছে।” [সহীহ বুখারী, তাওহীদ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: মহান আল্লাহ’র বাণী: ‘যাকে আমি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি’ ( باب قول الله تعالى : لما خلقت بيدي ); হাদীস নং ৬৯৭৫; সহীহ মুসলিম (১/১৮০); আহমদ (৩/১১৬)]

৩. হাম্মাদ ইবন যায়েদ মা‘বাদ ইবন হিলাল আল-আনাযী রহ. থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা বসরার অধিবাসী কিছু লোক একত্রিত হয়ে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র নিকট গেলাম এবং আমাদের সাথে সাবিত আল-বুনানীকে নিয়ে গেলাম, যাতে তিনি আমাদের জন্য আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত শাফা‘আত সম্পর্কিত হাদীসটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন। আমরা তাকে তার মহলেই চাশতের সালাত আদায়রত অবস্থায় পেলাম। তার কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তিনি আমাদেরকে অনুমতি দিলেন। তখন তিনি তার বিছানায় বসা অবস্থায় আছেন। অতঃপর আমরা সাবিতকে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন শাফা‘আতের হাদীসটি জিজ্ঞাসা করার পূর্বে অন্য কিছু জিজ্ঞাসা না করেন। তখন সাবিত বললেন, হে আবূ হামযা! এরা বসরাবাসী আপনার ভাই, তারা শাফা‘আতের হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে এসেছে। তারপর আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমাদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন:

«إذا كان يوم القيمة ماج الناس بعضهم في بعض فيأتون آدم فيقولون اشفع لنا إلى ربك فيقول لست لها ولكن عليكم بإبراهيم فإنه خليل الرحمن فيأتون إبراهيم فيقول لست لها ولكن عليكم بموسى فإنه كليم الله فيأتون موسى فيقول لست لها ولكن عليكم بعيسى فإنه روح الله وكلمته فيأتون عيسى فيقول لست لها ولكن عليكم بمحمد صلى الله عليه و سلم فيأتونني فأقول أنا لها فأستأذن على ربي فيؤذن لي ويلهمني محامد أحمده بها لا تحضرني الآن فأحمده بتلك المحامد وأخر له ساجدا فيقال يا محمد ارفع رأسك وقل يسمع لك وسل تعط واشفع تشفع فأقول يا رب أمتي أمتي فيقال انطلق فأخرج منها من كان في قلبه مثقال شعيرة من إيمان فأنطلق فأفعل ثم أعود فأحمده بتلك المحامد ثم أخر له ساجدا فيقال يا محمد ارفع رأسك وقل يسمع لك وسل تعط واشفع تشفع فأقول يا رب أمتي أمتي فيقال انطلق فأخرج منها من كان في قلبه مثقال ذرة أو خردلة من إيمان فأنطلق فأفعل ثم أعود فأحمده بتلك المحامد ثم أخر له ساجدا فيقال يا محمد ارفع رأسك وقل يسمع لك وسل تعط واشفع تشفع فأقول يا رب أمتي أمتي فيقول انطلق فأخرج من كان في قلبه أدنى أدنى أدنى مثقال حبة خردل من إيمان فأخرجه من النار فأنطلق فأفعل » . فلما خرجنا من عند أنس قلت لبعض أصحابنا لو مررنا بالحسن وهو متوار في منزل أبي خليفة فحدثناه بما حدثنا أنس بن مالك فأتيناه فسلمنا عليه فأذن لنا فقلنا له يا أبا سعيد جئناك من عند أخيك أنس بن مالك فلم نر مثل ما حدثنا في الشفاعة فقال هيه فحدثناه بالحديث فانتهى إلى هذا الموضع فقال هيه فقلنا لم يزد لنا على هذا فقال لقد حدثني وهو جميع منذ عشرين سنة فلا أدري أنسي أم كره أن تتكلوا قلنا يا أبا سعيد فحدثنا فضحك وقال خلق الإنسان عجولا ما ذكرته إلا وأنا أريد أن أحدثكم حدثني كما حدثكم به وقال : « ثم أعود الرابعة فأحمده بتلك المحامد ثم أخر له ساجدا فيقال يا محمد ارفع رأسك وقل يسمع وسل تعطه واشفع تشفع فأقول يا رب ائذن لي فيمن قال لا إله إلا الله فيقول وعزتي وجلالي وكبريائي وعظمتي لأخرجن منها من قال لا إله إلا الله» .

“যখন কিয়ামতের দিন আসবে, তখন মানুষ (ভয়ে) সমুদ্রের ঢেউয়ের মত একে অপরের উপর পড়বে। ফলে তারা আদম আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, আপনি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। তিনি বলবেন: এ কাজের জন্য আমি উপযুক্ত নই। তোমরা বরং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে যাও। কেননা তিনি হলেন আল্লাহর খলীল (বন্ধু) তখন তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে আসবে। তিনি বলবেন: আমি এ কাজের উপযুক্ত নই। তবে তোমরা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। কারণ, তিনি আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন। তখন তারা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে আসবে এবং তিনি বলবেন: আমি তো এ কাজের উপযুক্ত নই। তোমরা বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাও। এরপর তারা আমার কাছে আসবে আমি বলব, আমিই এ কাজের জন্য। আমি তখন আমার রবের কাছে অনুমতি চাইব, অতঃপর আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমাকে প্রশংসা সম্বলিত বাক্য ইলহাম করা হবে, যা দিয়ে আমি আল্লাহর প্রশংসা করব, যেগুলো এখন আমার জানা নেই, আমি সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে তাঁর প্রশংসা করব এবং সাজদায় পড়ে যাব। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তুমি বল, তোমার কথা শোনা হবে। তুমি চাও, তা দেওয়া হবে; সুপারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! বলা হবে, যাও, যাদের হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে দাও, আমি গিয়ে তাই করব। তারপর আমি ফিরে আসব এবং পুনরায় সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে তাঁর প্রশংসা করব এবং সাজদায় পড়ে যাব। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! আপনার মাথা উঠান; আপনি বলুন, আপনার কথা শোনা হবে, আপনি যা চান, তা আপনাকে দেওয়া হবে। আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত! আমার উম্মত! অতঃপর বলা হবে, যান, যাদের এক অণু কিংবা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করুন। আমি গিয়ে তাই করব। আমি পুনরায় প্রত্যাবর্তন করব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে তাঁর প্রশংসা করব এবং সাজদায় পড়ে যাব। তখন আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! আপনার মাথা উঠান; আপনি বলুন, আপনার কথা শোনা হবে, আপনি যা চান, তা আপনাকে দেওয়া হবে। আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত! আমার উম্মত! এরপর আল্লাহ বলবেন: যাও, যাদের অন্তরে সরিষার দানা অপেক্ষা ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র পরিমাণও ঈমান থাকে, তাদেরকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আনুন। আমি যাব এবং তাই করব। আমরা যখন আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র নিকট থেকে বের হয়ে আসছিলাম, তখন আমি আমার সাথীদের কোনো একজনকে বললাম, আমরা যদি আবূ খলীফার বাড়িতে আত্মগোপনরত হাসান বসরী’র কাছে গিয়ে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র বর্ণিত হাদীসটি তাঁর কাছে বর্ণনা করতাম। এরপর আমরা হাসান বসরী’র কাছে এসে তাঁকে অনুমতির সালাম দিলাম। তিনি আমাদেরকে প্রবেশ করতে অনুমতি দিলেন। আমরা তাঁকে বললাম, হে আবূ সাঈদ! আমরা আপনারই ভাই আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র কাছ থেকে আপনার কাছে আসলাম। শাফা‘আত সম্পর্কে তিনি যেরূপ বর্ণনা দিয়েছেন, অনুরূপ বর্ণনা করতে আমরা আর কাউকে দেখিনি। তিনি বললেন, আমার কাছে সেটি বর্ণনা কর। আমরা তাঁকে হাদীসটি বর্ণনা করে শোনালাম। এরপর আমরা শেষস্থলে এসে বর্ণনা শেষ করলাম। তিনি বললেন, আরও বর্ণনা কর। আমি বললাম, তিনি তো এর বেশি আমাদের কাছে বর্ণনা করেন নি। তিনি বললেন, জানি না, তিনি কি ভুলেই গেলেন, না তোমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়বে বলে অবশিষ্টটুকু বর্ণনা করতে অপছন্দ করলেন, বিশ বছর পূর্বে যখন তিনি শক্তি সামর্থ্যে ও স্মরণশক্তিতে মজবুত ছিলেন, তখন আমার কাছেও হাদীসটি বর্ণনা করেছিলেন। আমরা বললাম, হে আবূ সা‘ঈদ! আমাদের কাছে হাদীসটি বর্ণনা করুন। তিনি হাসলেন এবং বললেন, মানুষকে তো অতিমাত্রায় ত্বরা প্রিয় করে সৃষ্টি করা হয়েছে; আমি তো বর্ণনার উদ্দেশ্যেই তোমাদের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলাম। তিনি তোমাদের কাছে যা বর্ণনা করেছেন, আমার কাছেও তা বর্ণনা করেছেন, তবে পরে এটুকুও বলেছিলেন: আমি চতুর্থ বার ফিরে আসব এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে তাঁর (আল্লাহর) প্রশংসা করব এবং সাজদায় পড়ে যাব। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! আপনার মাথা উঠান; আপনি বলুন, আপনার কথা শোনা হবে, আপনি যা চান, তা আপনাকে দেওয়া হবে। আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলব, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তাদের সম্পর্কে শাফা‘আত করার অনুমতি দান কর, যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে। তখন আল্লাহ বলবেন, আমার ইজ্জত, আমার পরাক্রমশীলতা, আমার বড়ত্ব ও আমার মহত্তের কসম! যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনব।” [সহীহ বুখারী, তাওহীদ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ: কিয়ামতের দিনে নবী ও অপরাপরের সাথে মহান আল্লাহর কথাবার্তা ( باب كلام الرب يوم القيامة مع الأنبياء وغيرهم ); হাদীস নং ৬৮৮৭; সহীহ মুসলিম: (১/১৮২)]

৪. আবূ হাযেম রহ. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন এবং আবূ মালেক রাব‘য়ী থেকে বর্ণনা করেন, আর তিনি বর্ণনা করেন হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে, তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« يَجْمَعُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى النَّاسَ فَيَقُومُ الْمُؤْمِنُونَ حَتَّى تُزْلَفَ لَهُمُ الْجَنَّةُ فَيَأْتُونَ آدَمَ فَيَقُولُونَ يَا أَبَانَا اسْتَفْتِحْ لَنَا الْجَنَّةَ . فَيَقُولُ وَهَلْ أَخْرَجَكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ إِلاَّ خَطِيئَةُ أَبِيكُمْ آدَمَ لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ اذْهَبُوا إِلَى ابْنِى إِبْرَاهِيمَ خَلِيلِ اللَّهِ-قَالَ-فَيَقُولُ إِبْرَاهِيمُ لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ إِنَّمَا كُنْتُ خَلِيلاً مِنْ وَرَاءَ وَرَاءَ اعْمِدُوا إِلَى مُوسَى -صلى الله عليه وسلم- الَّذِى كَلَّمَهُ اللَّهُ تَكْلِيمًا . فَيَأْتُونَ مُوسَى -صلى الله عليه وسلم- فَيَقُولُ لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ اذْهَبُوا إِلَى عِيسَى كَلِمَةِ اللَّهِ وَرُوحِهِ . فَيَقُولُ عِيسَى -صلى الله عليه وسلم- لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ . فَيَأْتُونَ مُحَمَّدًا -صلى الله عليه وسلم- فَيَقُومُ فَيُؤْذَنُ لَهُ وَتُرْسَلُ الأَمَانَةُ وَالرَّحِمُ فَتَقُومَانِ جَنَبَتَىِ الصِّرَاطِ يَمِينًا وَشِمَالاً فَيَمُرُّ أَوَّلُكُمْ كَالْبَرْقِ » . قَالَ قُلْتُ بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى أَىُّ شَىْءٍ كَمَرِّ الْبَرْقِ قَالَ : « أَلَمْ تَرَوْا إِلَى الْبَرْقِ كَيْفَ يَمُرُّ وَيَرْجِعُ فِى طَرْفَةِ عَيْنٍ ثُمَّ كَمَرِّ الرِّيحِ ثُمَّ كَمَرِّ الطَّيْرِ وَشَدِّ الرِّجَالِ تَجْرِى بِهِمْ أَعْمَالُهُمْ وَنَبِيُّكُمْ قَائِمٌ عَلَى الصِّرَاطِ يَقُولُ رَبِّ سَلِّمْ سَلِّمْ حَتَّى تَعْجِزَ أَعْمَالُ الْعِبَادِ حَتَّى يَجِىءَ الرَّجُلُ فَلاَ يَسْتَطِيعُ السَّيْرَ إِلاَّ زَحْفًا-قَالَ-وَفِى حَافَتَىِ الصِّرَاطِ كَلاَلِيبُ مُعَلَّقَةٌ مَأْمُورَةٌ بِأَخْذِ مَنْ أُمِرَتْ بِهِ فَمَخْدُوشٌ نَاجٍ وَمَكْدُوسٌ فِى النَّارِ » . وَالَّذِى نَفْسُ أَبِى هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ إِنَّ قَعْرَ جَهَنَّمَ لَسَبْعُونَ خَرِيفًا » .

“আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সমবেত করবেন। মুমিনগণ দাঁড়িয়ে থাকবে, জান্নাতকে তাদের নিকটবর্তী করা হবে। অবশেষে সবাই আদম আলাইহিস সালামের কাছে এসে বলবে, আমাদের জন্য জান্নাত খুলে দেওয়ার প্রার্থনা করুন। আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, তোমাদের পিতা আদমের পদস্খলনের কারণেই তো তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আমি এর যোগ্য নই। তোমরা পুত্র ইবরাহীমের কাছে যাও, তিনি আল্লাহর বন্ধু। (এরপর সবাই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে এলে) তিনি বললেন: না, আমিও এর যোগ্য নই, আমি আল্লাহর বন্ধু ছিলাম বটে, তবে তা ছিল অন্তরাল থেকে। [অর্থাৎ সরাসরি আল্লাহর সাথে আমার কথা হয় নি, যেমন মূসার হয়েছিল।] তোমরা মূসার কাছে যাও। কারণ, তিনি আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলতেন। সবাই মূসার কাছে আসবে। তিনি বলবেন: আমিও এর যোগ্য নই; বরং তোমারা ‘ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তিনি আল্লাহর দেওয়া ‘কালেমা’ ও ‘রূহ’। সবাই তাঁর কাছে আসলে তিনি বলবেন: আমিও তার উপযুক্ত নই। তখন সকলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসবে; তিনি দো‘আর জন্য দাঁড়াবেন এবং তাকে অনুমতি প্রদান করা হবে। আমানত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক পুলসিরাতের ডানে-বামে এসে দাঁড়াবে। আর তোমাদের প্রথম দলটি এ সিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হয়ে যাবে। সাহাবী বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হউক। আমাকে বলে দিন, ‘বিদ্যুৎ গতির ন্যায়’ কথাটির অর্থ কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আকাশের বিদ্যুৎ চমক কি কখনও দেখ নি? চক্ষের পলকে এখান থেকে সেখানে চলে যায়, আবার ফিরে আসে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এর পরবর্তী দলগুলো যথাক্রমে বায়ুর বেগে, পাখির গতিতে, তারপর লম্বা দৌড়ের গতিতে পার হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই তার আমল অনুযায়ী তা অতিক্রম করবে। আর তোমাদের নবী সেই অবস্থায় পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে এ দো‘আ করতে থাকবে: ‘আল্লাহ এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌঁছে দিন। এরূপে মানুষের আমল মানুষকে চলতে অক্ষম করে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এ সিরাত অতিক্রম করতে থাকবে। শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে, সে নিতম্বের উপর ভর করে পথ অতিক্রম করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, সিরাতের উভয় পার্শ্বে ঝুলান থাকবে কাঁটাযুক্ত লৌহশলকা। এরা আল্লাহর নির্দেশক্রমে চিহ্নিত পাপীদেরকে পাকড়াও করবে। তন্মধ্যে কাউকে তো ক্ষত-বিক্ষত করেই ছেড়ে দিবে; সে নাজাত পাবে। আর কতক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হবে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, শপথ সে সত্তার, যাঁর হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ; জেনে রাখ, জাহান্নামের গভীরতা সত্তর খরীফ (অর্থাৎ সত্তর হাজার বছরের মত) [ইবন খুযাইমা তার ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থে হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন, পৃ. ২৪৫; আবূ ‘আওয়ানা (১/১৭৪); সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায় (১/১৮৬)।]

৫. আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: কোনো একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল বেলায় উপনীত হলেন, অতঃপর ফজরের সালাত আদায় করলেন, তারপর বসলেন, শেষ পর্যন্ত যখন দ্বিপ্রহর হয়ে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন, তারপর তাঁর জায়গায় বসে থাকলেন, শেষ পর্যন্ত (সেখানে একাধারে) যোহর, আসর ও মাগরিবের সালাত আদায় করলেন। এই গোটা সময়ে তিনি কোনো কথা বললেন না, এমনকি সবশেষে এশা’র সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তাঁর পরিবার-পরিজনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তারপর জনগণ আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন: আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করুন, তাঁর অবস্থা কী? তিনি আজকে এমন কিছু কাজ করেছেন, যা আর কখনও করেন নি; বর্ণনাকারী বলেন: অতঃপর তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, জবাবে তিনি বললেন:

«نعم عرض علي ما هو كائن من أمر الدنيا وأمر الآخرة , فجمع الأولون والآخرون بصعيد واحد ففظع الناس بذلك حتى انطلقوا إلى آدم عليه السلام والعرق يكاد يلجمهم , فقالوا : يا آدم أنت أبو البشر , وأنت اصطفاك الله عز و جل , اشفع لنا إلى ربك , قال : لقد لقيت مثل الذي لقيتم , انطلقوا إلى أبيكم بعد أبيكم إلى نوح { إن الله اصطفى آدم ونوحا وآل إبراهيم وآل عمران على العالمين } قال : فينطلقون إلى نوح عليه السلام , فيقولون : اشفع لنا إلى ربك فأنت اصطفاك الله واستجاب لك في دعائك ولم يدع على الأرض من الكافرين ديارا , فيقول : ليس ذاكم عندي , انطلقوا إلى إبراهيم عليه السلام , فإن الله عز و جل اتخذه خليلا , فينطلقون إلى إبراهيم فيقول : ليس ذاكم عندي , ولكن انطلقوا إلى موسى عليه السلام , فإن الله عز و جل كلمه تكليما فيقول موسى عليه السلام : ليس ذاكم عندي , ولكن انطلقوا إلى عيسى بن مريم , فإنه يبرئ الأكمه والأبرص ويحيى الموتى فيقول عيسى : ليس ذاكم عندي , ولكن انطلقوا إلى سيد ولد آدم , فإنه أول من تنشق عنه الأرض يوم القيامة , انطلقوا إلى محمد صلى الله عليه و سلم فيشفع لكم إلى ربكم عز و جل , قال : فينطلق فيأتي جبريل عليه السلام ربه فيقول الله عز و جل : ائذن له وبشره بالجنة , قال : فينطلق به جبريل فيخر ساجدا قدر جمعة , ويقول الله عز و جل : ارفع رأسك يا محمد , وقل يسمع , واشفع تشفع , قال : فيرفع رأسه , فإذا نظر إلى ربه عز و جل خر ساجدا قدر جمعة أخرى , فيقول الله عز و جل : ارفع رأسك , وقل يسمع , واشفع تشفع , قال : فيذهب ليقع ساجدا فيأخذ جبريل عليه السلام بضبعيه فيفتح الله عز و جل عليه من الدعاء شيئا لم يفتحه على بشر قط , فيقول : أي رب خلقتني سيد ولد آدم ولا فخر , وأول من تنشق عنه الأرض يوم القيامة ولا فخر حتى أنه ليرد على الحوض أكثر مما بين صنعاء وأيلة , ثم يقال : ادعوا الصديقين فيشفعون , ثم يقال : ادعوا الأنبياء , قال : فيجيء النبي ومعه العصابة , والنبي ومعه الخمسة والستة , والنبي وليس معه أحد , ثم يقال : ادعوا الشهداء فيشفعون لمن أرادوا , وقال : فإذا فعلت الشهداء ذلك قال : يقول الله عز و جل : أنا أرحم الراحمين , ادخلوا جنتي من كان لا يشرك بي شيئا , قال : فيدخلون الجنة , قال : ثم يقول الله عز و جل : انظروا في النار , هل تلقون من أحد عمل خيرا قط , قال : فيجدون في النار رجلا , فيقول له : هل عملت خيرا قط ؟ فيقول : لا , غير أني كنت أسامح الناس في البيع والشراء , فيقول الله عز و جل : اسمحوا لعبدي كإسماحه إلى عبيدي , ثم يخرجون من النار رجلا فيقول له : هل عملت خيرا قط ؟ فيقول : لا , غير أني قد أمرت ولدي إذا مت فاحرقوني بالنار , ثم اطحنوني حتى إذا كنت مثل الكحل فاذهبوا بي إلى البحر فاذروني في الريح , فوالله لا يقدر علي رب العالمين أبدا , فقال الله عز و جل : لم فعلت ذلك ؟ قال : من مخافتك , قال : فيقول الله عز و جل : انظر إلى ملك أعظم ملك فإن لك مثله وعشرة أمثاله , قال : فيقول : لم تسخر بي وأنت الملك ؟ قال : وذاك الذي ضحكت منه من الضحى» .

“হ্যাঁ, দুনিয়া ও আখিরাতের যেসব বিষয় সৃষ্টি হওয়ার, সেসব কিছু আমার নিকট পেশ করা হয়েছে, অতঃপর একই ভূমিতে প্রথম ও শেষ ব্যক্তিগণকে একত্রিত করা হয় এবং এই কারণে মানুষ কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়, শেষ পর্যন্ত তারা আদম আলাইহিস সালামের নিকট ছুটে যায়, আর তখন ঘাম তাদের মুখের ভিতরে ডুকে যাওয়ার উপক্রম হয়; অতঃপর তারা বলল, হে আদম আলাইহিস সালাম! আপনি মানব জাতির পিতা, আর আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে মনোনীত করেছেন, আপনি আপনার রবের নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। তখন তিনি বলেন, আমিও তোমাদের মতো একই পরিস্থিতির শিকার; তোমরা বরং তোমাদের পিতার পর তোমাদের আরেক পিতা নূহ আলাইহিস সালামের নিকট যাও (নিশ্চয় আল্লাহ আদম, নূহ ও ইব্রাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের ওপর মনোনীত করেছেন); তিনি বলেন: অতঃপর তারা নূহ আলাইহিস সালামের নিকট ছুটে গেল, তারপর তারা বলল, আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে মনোনীত করেছেন, আপনার দো‘আ কবুল করেছেন এবং তিনি যমীনে কাফিরদের মধ্যে কোনো গৃহবাসীকে (ধ্বংসের কবল থেকে) অব্যাহতি দেন নি। তখন তিনি বলেন: তোমাদের এহেন পরিস্থিতিতে আমার কিছুই করার নেই। তোমরা বরং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নিকট চলে যাও; কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। অতঃপর তারা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নিকট চলে যায়, তখন তিনি বলেন: তোমাদের এহেন পরিস্থিতিতে আমার কিছুই করার নেই। তোমরা বরং মূসা আলাইহিস সালামের নিকট চলে যাও। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে কথা বলেছেন, তখন মূসা আলাইহিস সালাম বলেন: তোমাদের এহন পরিস্থিতিতে আমার কিছুই করার নেই। তোমরা বরং ‘ঈসা ইবন মারইয়াম আলাইহিস সালামের নিকট চলে যাও। কারণ, তিনি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে রোগমুক্ত করেছেন এবং জীবিত করেছেন মৃত ব্যক্তিদেরকে। তখন ‘ঈসা আলাইহিস সালাম বলেন: তোমাদের এহেন পরিস্থিতিতে আমার কিছুই করার নেই। তোমরা বরং আদম সন্তানদের নেতার নিকট চলে যাও। কারণ, তিনিই প্রথম ব্যক্তি, কিয়ামতের দিনে যার থেকে যমীন উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চলে যাও, অতঃপর তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করবেন; তিনি বলেন: অতঃপর তিনি ছুটে যাবেন, তারপর জিবরীল আলাইহিস সালাম তার রবের নিকট আসবেন এবং আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি তাকে অনুমতি দাও এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান কর। তিনি বলেন, তারপর জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁকে নিয়ে ছুটে যাবেন, অতঃপর তিনি এক সপ্তাহ পরিমাণ সময় ধরে সাজদায় অবনত হয়ে থাকবেন এবং আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে মুহাম্মাদ! আপনি আপনার মাথা উত্তোলন করুন এবং কথা বলুন, আপনার কথা শুনা হবে; আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে; তিনি বলেন, অতঃপর তিনি তাঁর মাথা উঠাবেন। তারপর তিনি যখন তাঁর প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃষ্টি দিবেন, তখন আরও এক সপ্তাহ সাজদায় অবনত হয়ে থাকবেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: আপনি আপনার মাথা উত্তোলন করুন এবং কথা বলুন, আপনার কথা শুনা হবে; আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে; তিনি বলেন, অতঃপর তিনি সাজদায় অবনত হতে যাবেন, তখনই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর বাহুদ্বয়ে ধরে ফেলবেন; অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ব্যাপারে এমন কিছু দো‘আর সূচনা করবেন, যা অন্য কোনো মানুষের ব্যাপারে করেন নি। অতঃপর তিনি বলবেন, হে আমার রব! আপনি আমাকে আদম সন্তানতের নেতা করে সৃষ্টি করেছেন, এতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই এবং আমাকে প্রথম ব্যক্তি বনিয়েছেন, কিয়ামতের দিনে যার থেকে যমীন উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, এতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই, শেষ পর্যন্ত তাঁকে এমন এক হাউযের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে, যার প্রশস্ততা সান‘আ ও আয়লার মধ্যকার দূরেত্বের চেয়ে বেশি। অতঃপর বলা হবে, আপনি সিদ্দীকগণকে আহ্বান করুন, তারপর তারা সুপারিশ করবে; অতঃপর বলা হবে, আপনি নবীগণকে আহ্বান করুন, তিনি বলেন, (ডাকার পর) এক নবী আসবেন এবং তার সাথে একদল লোক থাকবে; আরেক নবী আসবেন, যার সাথে পাঁচ-ছয় জন লোক থাকবে; আরেক নবী আসবেন, যার সাথে কেউই নেই। অতঃপর বলা হবে, আপনি শহীদদেরকে আহ্বান করুন, অতঃপর তারা যার জন্য ইচ্ছা সুপারিশ করবে, আর তিনি বলেন, তারপর যখন শহীদগণ এই কাজ করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমি দয়াবানদের চেয়ে আরও অনেক বেশি দয়ালু, তোমরা যারা আমার সাথে কোনো কিছুর শরীক কর নি, তারা জান্নাতে প্রবেশ কর, তিনি বলেন: অতঃপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি বলেন: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তোমরা জাহান্নামের দিকে লক্ষ্য কর, এমন কারও দেখা পাও কিনা, যে কখনও কোনো ভালো কাজ করেছে; তিনি বলেন: অতঃপর তারা জাহান্নামের মধ্যে এক ব্যক্তিকে পাবে, তখন তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, তুমি কি কখনও কোনো ভালো কাজ করেছ? জবাবে সে বলবে: না, তবে আমি বেচাকেনার ক্ষেত্রে মানুষের সাথে নম্র ব্যবহার করতাম; তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তোমরা আমার বান্দার প্রতি কোমল আচরণ কর, যেমনিভাবে সে আমার বান্দাদের প্রতি কোমল আচরণ করত; অতঃপর তারা জাহান্নাম থেকে এক ব্যক্তিকে বের করে আনবে, তারপর তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বলবেন, তুমি কি কখনও কোনো ভালো কাজ করেছ? জবাবে সে বলবে: না, তবে আমি আমার সন্তানদেরকে নির্দেশ দিয়েছি যে, যখন আমি মারা যাই, তখন তোমরা আমাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে, অতঃপর তোমরা আমাকে পিষে ফেলবে, শেষ পর্যন্ত যখন আমি সুরমার মতো হয়ে যাবে, তখন তোমরা আমাকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে যাবে এবং আমাকে বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিবে; তাহলে আল্লাহর কসম করে বলছি, জগতসমূহের রব আল্লাহ আমার ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না। তার কথা শুনে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞেসা করে বলবেন, তুমি কেন এ ধরনের কাজ করলে? জবাবে সে বলবে, তোমার ভয়ে; তিনি বলেন: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি কোনো রাজত্বের দিকে লক্ষ্য করে তার মতো রাজত্ব কামনা কর, নিশ্চয় তোমার জন্য রয়েছে তার অনুরূপ ও তার মত করে আরও দশটি অনুরূপ রাজত্ব; তিনি বলেন: তখন সে বলবে, (হে রব!) কেন তুমি আমার সাথে উপহাস করছ? অথচ তুমি হলে রাজা বা ক্ষমতাধর; তিনি বলেন: আর এ কারণেই আমি দ্বিপ্রহরে হেসেছিলাম।” [আহমদ (১/৪); ইবন খুযাইমা হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন, পৃ. ৩১০; আবূ ‘আওয়ানা (১/১৭৫); ইবন হিব্বান, পৃ. ৬৪২ (মাওয়ারেদ); আর হাইছামী ‘আল-মাজমা‘’-এর মধ্যে বলেন, হাদীসটি ইমাম আহমদ, আবূ ই‘য়ালা ও বাযার প্রায় একই রকমভাবে বর্ণনা করেছেন এবং বর্ণনাকারীগণ সকলেই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।]

৬. আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«إن الناس يصيرون يوم القيامة جثا كل أمة تتبع نبيها , يقولون : يا فلان اشفع لنا , حتى تنتهي الشفاعة إلى النبي صلى الله عليه و سلم , فذلك يوم يبعثه الله المقام المحمود » .

“নিশ্চয় কিয়ামতের দিন লোকেরা ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। প্রত্যেক নবীর উম্মত নিজ নিজ নবীর অনুসরণ করবে। তারা বলবে: হে অমুক (নবী)! আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। হে অমুক (নবী)! আপনি সুপারিশ করুন। (তারা কেউ সুপারিশ করতে রাজি হবেন না) শেষ পর্যন্ত সুপারিশের দায়িত্ব নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর বর্তাবে। আর এ দিনেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ‘মাকামে মাহমুদ’ তথা প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” [এই হাদীসটি মাওকুফ হাদীস (আর সাহাবীর কথা বা কাজকে ‘মাওকুফ’ হাদীস বলা হয়); ইমাম বুখারী রহ. হাদীসখানা তাঁর গ্রন্থের ‘তাফসীর’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, সূরা আল-ইসরা, পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿عَسَىٰٓ أَن يَبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامٗا مَّحۡمُودٗا ٧٩﴾ “আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে”; কিন্তু ইবন জারিরের নিকট হাদীসটি ‘মারফু’ হিসেবে এসেছে, ১৫ খণ্ড, পৃ. ১৪৬, মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহ ইবন আবদিল হেকাম বলেন, আমাদের নিকট শো‘আইব ইবন লাইস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমার নিকট ‘উবায়দুল্লাহ ইবন আবি জা‘ফর বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি হামযা ইবন আবদিল্লাহকে বলতে শুনেছি যে, আমি আবদুল্লাহ ইবন ওমর রা. কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন এবং তিনি হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। হাদীসটির সকল বর্ণনাকারী বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাকারী; আর হাফেয হাইছামী ‘মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ’ ( مجمع الزوائد ) দশম খণ্ড, পৃ. ৩৭১–এর মধ্যে হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেছেন: আমি বলি: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: فيقضي الله بين الخلق إلى آخره থেকে সংক্ষেপ করে ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।]

৭. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ , وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ , وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ » .

“আমি কিয়ামতের দিনে আদম সন্তানদের নেতা হব এবং আমিই হব প্রথম ব্যক্তি যার কবর উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, আর আমিই প্রথম সুপারিশকারী হব এবং আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ফযীলত ( الفضائل ), পরিচ্ছেদ: আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমুদয় সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান প্রসঙ্গে ( باب تَفْضِيلِ نَبِيِّنَا صلى الله عليه وسلم عَلَى جَمِيعِ الْخَلاَئِقِ ), হাদীস নং ৬০৭৯।]

৮. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿عَسَىٰٓ أَن يَبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامٗا مَّحۡمُودٗا ٧٩ ﴾ [ الاسراء : ٧٩ ]

“আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৭৯] -এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন:

«هي الشفاعة » . هذا حديث حسن

তা হলো শাফা‘আত।” এই হাদীসটি হাসান পর্যায়ের। [তিরমিযী (৪/৩৬৫); আহমদ (২/৪৪১); আবূ না‘ঈম, আল-হিলইয়া [ الحلية ] (৮/৩৭২), আর এটা হাসান হাদীস, যেমনটি ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন।]

৯. আবূ সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« أنا سيد ولد آدم ولا فخر , وأنا أول من تنشق الأرض عنه يوم القيامة ولا فخر , وأنا أول شافع وأول مشفع ولا فخر , ولواء الحمد بيدي يوم القيامة ولا فخر » .

“আমি আদম সন্তানদের নেতা হব এবং তাতে অহঙ্কারের কিছু নেই। আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, কিয়ামতের দিনে যার যমীন (কবর) উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে এবং তাতে অহঙ্কারের কিছু নেই, আর আমিই প্রথম সুপারিশকারী হব এবং আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে এবং তাতে আমি অহঙ্কার করি না, আর কিয়মাতের দিনে প্রশংসার পতাকা আমার হাতে থাকবে এবং তাতে আমি অহঙ্কার করি না।” [ইবন মাজাহ, জুহুদ অধ্যায় ( كتاب الزهد ), পরিচ্ছেদ: শাফা‘আতের আলোচনা ( باب ذكر الشفاعة ), হাদীস নং ৪৩০৮; তিরমিযী হাদীসটিকে সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন, আর এটা হাসান হাদীস।]

১০. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أنا سيد ولد آدم يوم القيامة , وأنا أول من تنشق عنه الأرض , و لواء الحمد معي و تحته آدم , و من دونه و من بعده من المؤمنين » .

“আমি কিয়ামতের দিনে আদম সন্তানদের নেতা হব, আর আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, কিয়ামতের দিনে যার যমীন (কবর) উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, আর প্রশংসার পতাকা আমার সাথে থাকবে এবং তার নিচে থাকবে আদম আলাইহিস সালাম, তাঁর নিকটতম স্তরের ব্যক্তিগণ ও তাঁর পরবর্তী মুমিন বান্দাগণ।” [আবূ না‘ঈম, দালায়েল (১/১৩); তার সমর্থনে হাদীস বর্ণনা করেছেন দারেমী (১/২৭); আহমদ (৩/১৪৪); হাদীসটি ইনশাআল্লাহ হাসান। দেখুন: ইবন ‘আসেম, আস-সুন্নাহ (২/৩৭০)।]

১১. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের মধ্য থেকে একদল লোক তাঁর অপেক্ষায় বসে আছে, তিনি বলেন: অতঃপর তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বের হলেন, এমনকি যখন তিনি তাদের নিকটবর্তী হয়ে গেলেন, তখন তিনি তাদেরকে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করতে শুনলেন; অতঃপর তিনি তাদের কথা শুনলেন, তাদের কেউ কেউ বলেন: আশ্চর্য্যের বিষয় হলো যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে বন্ধু গ্রহণ করেছেন। তিনি ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন, অতঃপর ‘ঈসা আলাইহিস সালাম হলেন আল্লাহর ‘কালেমা’ ও ‘রূহ’; অপর একজন বললেন: আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালামকে মনোনীত করেছেন। অতঃপর তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে সালাম পেশ করলেন এবং বললেন:

«قد سمعت كلامكم وعجبكم , إن إبراهيم خليل الله وهو كذلك , وموسى نجي الله وهو كذلك , وعيسى روحه وكلمته وهو كذلك , وآدم اصطفاه الله تعالى وهو كذلك , ألا وأنا حبيب الله ولا فخر , وأنا حامل لواء الحمد يوم القيامة ولا فخر , وأنا أول من يحرك بحلق الجنة ولا فخر , فيفتح الله لي فيدخلنيها ومعي فقراء المؤمنين ولا فخر , وأنا أكرم الأولين والآخرين على الله ولا فخر » .

“আমি তোমাদের কথাবার্তা এবং তোমাদের বিস্ময় প্রকাশের বিষয়টি শ্রবণ করেছি; নিশ্চয় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর খলিল তথা অন্তরঙ্গ বন্ধু, আর তিনি এ রকমই, আর মূসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ নাজাত দিয়েছেন, আর তিনি এ রকমই, আর ‘ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর ‘রূহ’ ও ‘কালেমা’, আর তিনি এ রকমই, আর আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তা‘আলা মনোনীত করেছেন, আর তিনি এ রকমই। জেনে রাখ, আমি হলাম আল্লাহর হাবীব তথা প্রিয় ব্যক্তি এবং এতে আমি অহঙ্কার করি না, আর আমি কিয়ামতের দিনে প্রশংসার পতাকা বহনকারী এবং এতে আমি অহঙ্কার করি না, আর আমিই হলাম প্রথম ব্যক্তি, যে সর্বপ্রথম জান্নাতের কড়া ধরে নাড়া দিবে এবং এতে আমি অহঙ্কার করি না। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য (জান্নাত) খুলে দিবেন এবং তিনি আমাকে তাতে প্রবেশ করাবেন, আর আমার সাথে থাকবে মুমিন ফকীরগণ, আর এতে আমি অহঙ্কার করি না, আর আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ব্যক্তির চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় এবং এতে আমার অহঙ্কার নেই।” [দারেমী (১/২৬); দায়লামী (১/২/৩০৮); অন্য হাদীসের সমর্থনের কারণে হাদীসটি হাসান। -দেখুন: ‘আস-সিলসিলা আস-সহীহা’ ( السلسلة الصحيحة ): ৪/পৃ. ৯৭–৯৯ [লেখক](তবে বিস্তারিত বর্ণনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাদীসে উল্লিখিত, وأنا حبيب الله এ অংশটুকু দুর্বল। দেখুন, সিলসিলা সহীহা, ৫/৪৮০) [সম্পাদক]]

১২. উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«كُنْتُ فِى الْمَسْجِدِ فَدَخَلَ رَجُلٌ يُصَلِّى فَقَرَأَ قِرَاءَةً أَنْكَرْتُهَا عَلَيْهِ ثُمَّ دَخَلَ آخَرُ فَقَرَأَ قِرَاءَةً سِوَى قِرَاءَةِ صَاحِبِهِ فَلَمَّا قَضَيْنَا الصَّلاَةَ دَخَلْنَا جَمِيعًا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ إِنَّ هَذَا قَرَأَ قِرَاءَةً أَنْكَرْتُهَا عَلَيْهِ وَدَخَلَ آخَرُ فَقَرَأَ سِوَى قِرَاءَةِ صَاحِبِهِ فَأَمَرَهُمَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم , فَقَرَءَا فَحَسَّنَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم شَأْنَهُمَا فَسُقِطَ فِى نَفْسِى مِنَ التَّكْذِيبِ وَلاَ إِذْ كُنْتُ فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَلَمَّا رَأَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَا قَدْ غَشِيَنِى ضَرَبَ فِى صَدْرِى فَفِضْتُ عَرَقًا وَكَأَنَّمَا أَنْظُرُ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فَرَقًا فَقَالَ لِى : « يَا أُبَىُّ أُرْسِلَ إِلَىَّ أَنِ اقْرَإِ الْقُرْآنَ عَلَى حَرْفٍ فَرَدَدْتُ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى أُمَّتِى . فَرَدَّ إِلَىَّ الثَّانِيَةَ اقْرَأْهُ عَلَى حَرْفَيْنِ .

فَرَدَدْتُ إِلَيْهِ أَنْ هَوِّنْ عَلَى أُمَّتِى . فَرَدَّ إِلَىَّ الثَّالِثَةَ اقْرَأْهُ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ فَلَكَ بِكُلِّ رَدَّةٍ رَدَدْتُكَهَا مَسْأَلَةٌ تَسْأَلُنِيهَا . فَقُلْتُ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لأُمَّتِى . اللَّهُمَّ اغْفِرْ لأُمَّتِى . وَأَخَّرْتُ الثَّالِثَةَ لِيَوْمٍ يَرْغَبُ إِلَىَّ الْخَلْقُ كُلُّهُمْ حَتَّى إِبْرَاهِيمُ صلى الله عليه وسلم » .

“আমি মাসজিদে ছিলাম। এক ব্যক্তি প্রবেশ করে সালাত আদায় করতে লাগল এবং সে এমন এক ধরনের কিরাত পাঠ করতে লাগল, যা আমার কাছে অভিনব মনে হলো। পরে আরেকজন প্রবেশ করে তার পূর্ববর্তী ব্যক্তি হতে ভিন্ন ধরনের কিরাত পাঠ করতে লাগল। সালাত শেষে আমরা সবাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। অতঃপর আমি বললাম, এই ব্যক্তি এমন কিরাত পাঠ করেছে, যা আমার কাছে অভিনব মনে হয়েছে এবং অন্যজন প্রবেশ করে তার পূর্ববর্তী জন হতে ভিন্ন কিরআত পাঠ করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উভয়কে (কিরাত পাঠ করতে) নির্দেশ দিলেন। তারা উভয়েই কিরাত পাঠ করল। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দু’জনের (কিরাতের) ধরনকে সুন্দর বললেন। ফলে আমার মনে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআনের প্রতি মিথ্যা অবিশ্বাস ও সন্দেহের উন্মেষ দেখা দিল। এমনকি জাহেলী যুগেও আমার এমন খটকা জাগেনি। আমার ভিতরে সৃষ্ট খটকা অবলোকন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুকে সজোরে আঘাত করলেন। ফলে আমি ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম এবং যেন আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মহা মহীয়ান আল্লাহর দিকে দেখছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে উবাই! আমার কাছে (জিবরীল আলাইহিস সালামকে) প্রেরণ করা হয়েছে যে, আমি যেন কুরআন এক হরফে তিলাওয়াত করি। আমি তখন তাঁর কাছে পুনরায় অনুরোধ করলাম, আমার উম্মতের জন্য সহজ করুন। দ্বিতীয়বার আমাকে বলা হলো যে, দুই হরফে তা তিলাওয়াত করবে। তখন তাঁর কাছে আবার অনুরোধ করলাম, আমার উম্মতের জন্য সহজ করে দিতে। তৃতীয়বার আমাকে বলা হলো যে, সাত হরফে তা তিলাওয়াত করবে এবং যতবার আপনাকে জবাব দিয়েছি তার প্রতিটির বদলে আপনার জন্য একটি আবেদনের সুযোগ থাকবে। অতঃপর আমি বললাম: হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন। আর তৃতীয় প্রার্থনাটি বিলম্বিত করে রেখেছি সেদিনের জন্য, যেদিন সারা সৃষ্টি, এমনকি ইবরাহীম আলাইহিস সালামও আমার প্রতি আকৃষ্ট হবেন।” [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরের সালাত ( صلاة المسافرين ), পরিচ্ছেদ: কুরআন সাত হরফে অবতীর্ণ হওয়ার বিবরণ ও এর মর্মার্থ ( باب بَيَانِ أَنَّ الْقُرْآنَ عَلَى سَبْعَةِ أَحْرُفٍ وَبَيَانِ مَعْنَاهُ ), হাদীস নং ১৯৪১।]

১৩. আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি তোফায়েল ইবন উবাই ইবন কা‘ব রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তাঁর পিতা উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إذا كان يوم القيامة كنت إمام النبين و خطيبهم و صاحب شفاعتهم غير فخر» .

“যখন কিয়ামতের দিন হবে, তখন আমি নবীদের ইমাম ও খতীব হব এবং কোনো প্রকার অহঙ্কার ছাড়াই বলছি আমি তাদের শাফা‘আতের লোক হব।”

বর্ণনাকারী আরও বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«لولا الهجرة لكنت امرءا من الأنصار و لو سلك الناسُ واديا أو شِعبا لكنتُ مع الأنصار» .

“যদি হিজরত না হত, তাহলে আমি আনসারদের অন্তর্ভুক্ত এক ব্যক্তি হতাম, আর যদি মানুষ কোনো উপাত্যকা বা গিরিপথ অতিক্রম করত, তাহলে আমি আনসারদের সাথে থাকতাম।”

বর্ণনাকারী আরও বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إذا كان يوم القيامة كنت إمام الناس وخطيبهم وصاحب شفاعتهم ولا فخر» .

“যখন কিয়ামতের দিন হবে, তখন আমি মানুষের ইমাম ও খতীব হব এবং তাদের শাফা‘আতের অধিকারী হব, আর তাতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই।” [আবদুল্লাহ ইবন ইমাম আহমদ, ‘যাওয়ায়েদুল মুসনাদ’ ( زوائد المسند ) (৫/১৩৮); তিরমিযী (৫/২৪৭); হাকেম (১/৭১) এবং (৪/৮৭), তিনি হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন এবং হাদীসটি এরকমই।]

১৪. আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَنَا أَوَّلُ مَنْ يُؤْذَنُ لَهُ بِالسُّجُودِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ , وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يُؤْذَنُ لَهُ أَنْ يَرْفَعَ رَأْسَهُ فَأَنْظُرَ إِلَى بَيْنِ يَدَيَّ فَأَعْرِفَ أُمَّتِي مِنْ بَيْنِ الْأُمَمِ , وَمِنْ خَلْفِي مِثْلُ ذَلِكَ , وَعَنْ يَمِينِي مِثْلُ ذَلِكَ . وَعَنْ شِمَالِي مِثْلُ ذَلِكَ » . فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! كَيْفَ تَعْرِفُ أُمَّتَكَ مِنْ بَيْنِ الْأُمَمِ فِيمَا بَيْنَ نُوحٍ إِلَى أُمَّتِكَ ؟ قَالَ : «هُمْ غُرٌّ مُحَجَّلُونَ مِنْ أَثَرِ الْوُضُوءِ . لَيْسَ أَحَدٌ كَذَلِكَ غَيْرَهُمْ , وَأَعْرِفُهُمْ أَنَّهُمْ يُؤْتَوْنَ كُتُبَهُمْ بِأَيْمَانِهِمْ , وَأَعْرِفُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ ذُرِّيَّتُهُمْ» .

“আমিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে কিয়ামতের দিনে সাজদাহ করার অনুমতি দেওয়া হবে, আর আমিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে সাজদাহ থেকে মাথা উঠানোর অনুমতি দেওয়া হবে; অতঃপর আমি আমার সামনের দিকে লক্ষ্য করব এবং আমি (বিভিন্ন নবীর) উম্মতদের মধ্য থেকে আমার উম্মতকে চিনে নিব, আর অনুরূপভাবে আমি আমার পিছনের দিকে তাকাব এবং আমার উম্মতকে চিনে নিব, আর অনুরূপভাবে আমি আমার ডান দিকে ও বাম দিকে তাকাব এবং আমার উম্মতকে চিনে নেব; (বর্ণনাকারী বলেন) অতঃপর তাঁকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! কীভাবে আপনি অন্যান্য উম্মতের মধ্য থেকে আপনার উম্মতকে চিনে নিবেন, যেখানে আপনার উম্মতের সাথে নূহ আলাইহিস সালামের উম্মত থাকবে? তখন তিনি বললেন: তাদের আযুর চিহ্নসমূহের মধ্যে বিশেষ উজ্জ্বলতা পরিলক্ষিত হবে; তারা ব্যতীত আর কেউ অনুরূপ হবে না, আর আমি তাদেরকে আরও চিনতে পারব যে, তাদেরকে তাদের আমলনামাসমূহ ডান হাতে দেওয়া হবে এবং আমি তাদেরকে চিনতে পারব তাদের সম্মুখে তাদের সন্তানগণ ছুটাছুটি করবে।” [আহমদ, মুসনাদ, হাদীস নং ২১৭৩৭; এই হাদীসটি ‘হাসান হাদীস’ ইনশাআল্লাহ।]

আবদুর রহমান ইবন যোবায়ের ইবন নুফায়ের থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ যর ও আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে শুনেছেন, তারা উভয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَنَا أَوَّلُ مَنْ يُؤْذَنُ لَهُ فِي السُّجُودِ » فَذَكَرَ مَعْنَاهُ .

“আমিই প্রথম ব্যক্তি, যাকে কিয়ামতের দিনে সাজদাহ করার অনুমতি দেওয়া হবে। অতঃপর তিনি উপরোক্ত হাদীসের অর্থে (হাদীস) উল্লেখ করেছেন।” [আহমদ, মুসনাদ, হাদীস নং ২১৭৩৯।]

১৫. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أنا أولهم خروجا وأنا قائدهم إذا وفدوا , وأنا خطيبهم إذا أنصتوا , وأنا مشفعهم إذا حبسوا , وأنا مبشرهم إذا آيسوا , الكرامة والمفاتيح يومئذ بيدي , وأنا أكرم ولد آدم على ربي , يطوف علي ألف خادم كأنهم بيض مكنون أو لؤلؤ منثور» .

“বের হওয়ার দিক থেকে আমিই তাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি, আর তারা যখন গমন করে, তখন আমি তাদের নেতা, আর যখন তারা চুপ থাকে, তখন আমি তাদের খতীব, আর তারা যখন অবরুদ্ধ হয়ে যায়, তখন আমি তাদের জন্য সুপারিশকারী, আর তারা যখন নিরাশ হয়, তখন আমি তাদেরকে সুসংবাদ দানকারী, আর সেদিন মর্যাদা ও চাবিকাঠিসমূহ আমার হাতে থাকবে, আর আমি আমার প্রতিপালকের নিকট আদম সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রিয়, আমার খেদমতে এক হাজার খাদেম আমার নিকট প্রদক্ষিণ করবে, তারা যেন সুরক্ষিত ডিন্ব অথবা বিক্ষিপ্ত মণিমুক্তা।” [দারেমী (১/২৬); তিরমিযী (৫/২৪৫); আর এই হাদীসের সমর্থনে আরও হাদীস রয়েছে।]

১৬. জাবের ইবন আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أنا قائد المرسلين ولا فخر وأنا خاتم النبيين ولا فخر وأنا أول شافع ومشفع ولا فخر»

“আমি হলাম রাসূলগণের নেতা এবং তাতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই, আর আমি হলাম সর্বশেষ নবী এবং তাতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই, আর আমিই প্রথম সুপারিশকারী হব এবং আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে এবং তাতে আমার কোনো অহঙ্কার নেই।” [দারেমী (১/২৭); ইবন ‘আসেম, আস-সুন্নাহ (২/৩৭০); আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]

১৭. জাবের ইবন আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أعطيت خمسا لم يعطهن أحد قبلي : نصرت بالرعب مسيرة شهر , وجعلت لي الأرض مسجدا وطهورا , فأيما رجل من أمتي أدركته الصلاة فليصل , وأحلت لي المغانم ولم تحل لأحد قبلي , وأعطيت الشفاعة , وكان النبي يبعث إلى قومه خاصة وبعثت إلى الناس عامة» .

“আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে কাউকে দেওয়া হয় নি। (১) আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যে, এক মাসের দূরত্বেও তা প্রতিফলিত হয়। (২) সমস্ত যমীন আমার জন্য পবিত্র ও সালাত আদায়ের উপযোগী করা হয়েছে। কাজেই আমার উম্মতের যে কোনো লোকের সালাতের সময় হলেই সে যেন সালাত আদায় করে নেয়। (৩) আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করে দেওয়া হয়েছে, যা আমার আগে আর কারও জন্য হালাল করা হয় নি। (৪) আমাকে (ব্যাপক) শাফা‘আতের অধিকার দেওয়া হয়েছে। (৫) সমস্ত নবী প্রেরিত হতেন কেবল তাদের সম্প্রদায়ের জন্য, আর আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য।” [সহীহ বুখারী, তায়াম্মুম অধ্যায়, হাদীস নং ৩২৮]

১৮. আবদুর রহমান ইবন আবদিল্লাহ ইবন কা‘ব ইবন মালেক রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি কা‘ব ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يبعث الناس يوم القيامة فأكون أنا وأمتى على تل , ويكسونى ربى تبارك وتعالى حلة خضراء , ثم يؤذن لى فأقول ما شاء الله أن أقول فذلك المقام المحمود» .

কিয়ামতের দিনে মানুষকে পুনরায় জীবিত করা হবে, তখন আমি ও আমার উম্মত মাটির টিলার উপর থাকব, আর আমার রব মহান আল্লাহ আমাকে সবুজ পোষাক পরিধান করাবেন। অতঃপর তিনি আমাকে (শাফা‘আতের) অনুমতি দিবেন, তারপর আমি তাই বলব, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দিয়ে যা বলাতে চান, আর এটাই হলো ‘মাকামে মাহমুদ’ তথা প্রশংসিত স্থান।” [ইবন জারীর (১৫/১৪৬); হাকেম (২/৩৬৩) এবং তিনি বলেন, হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তের আলোকে সহীহ, আর যাহাবী তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর হাইছামী, আল-মাজমা‘ (২/৩৭৭); আর তাবারানী ‘আল-কাবীর’ ও ‘আল-আওসাত’ এর মধ্যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, আর ‘আল-কাবীর’ এর একটি সনদের বর্ণনাকারীগণ সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী; আর ইবন জারীরের নিকট হাদীসটির সমর্থনে একটি বিশুদ্ধ ‘মাওকুফ’ হাদীস বর্ণিত আছে (১৫/১৪৬)।]

১০
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁর উম্মতের জন্য জান্নাতে প্রবেশের ব্যাপারে সুপারিশ করা এবং তাঁর প্রথম সুপারিশকারী হওয়া
প্রথম হাদীসের মধ্যে পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, তাঁকে বলা হবে:

«يا محمد أدخل من أمتك من لا حساب عليهم من الباب الأيمن من أبواب الجنة وهم شركاء الناس فيما سوى ذلك من الأبواب » .

“হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার উম্মতের মধ্যে যাদের কোনো হিসাব-নিকাশ হবে না, তাদেরকে জান্নাতের দরজাসমূহের ডান পার্শ্বের দরজা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দিন। এ দরজা ছাড়া অন্যদের সাথে অন্য দরজা দিয়েও তাদের প্রবেশের অধিকার থাকবে।”

আর দ্বিতীয় হাদীসের মধ্যে আলোচনা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করবেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করবেন এবং তাঁর জন্য সীমানা নির্ধারণ করে দিবেন, অতঃপর তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

১৯. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« أَنَا أَوَّلُ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ , وَأَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا » .

“আমি প্রথম ব্যক্তি, যে জান্নাতের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করব, আর নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি।” [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “আমি প্রথম ব্যক্তি, যে জান্নাতের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করব, আর নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি” ( باب فِى قَوْلِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم : «أَنَا أَوَّلُ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ وَأَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا» ), হাদীস নং ৫০৪।]

২০. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« أَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ , وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ يَقْرَعُ بَابَ الْجَنَّةِ » .

“কিয়ামতের দিনে নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি এবং আমিই সবার আগে জান্নাতের কড়া নাড়ব।” [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “আমি প্রথম ব্যক্তি, যে জান্নাতের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করব, আর নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি” ( باب فِى قَوْلِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم : «أَنَا أَوَّلُ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ وَأَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا» ), হাদীস নং ৫০৫।]

২১. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«آتِى بَابَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَسْتَفْتِحُ فَيَقُولُ الْخَازِنُ : مَنْ أَنْتَ؟ فَأَقُول : مُحَمَّدٌ , فَيَقُولُ : بِكَ أُمِرْتُ لاَ أَفْتَحُ لأَحَدٍ قَبْلَكَ» .

“কিয়ামত দিবসে আমি জান্নাতের গেইটে এসে দরজা খোলার অনুমতি চাইব। তখন খাজাঞ্চি বলবেন, আপনি কে? আমি উত্তরে বলব, মুহাম্মাদ। খাজাঞ্চি বলবেন: ‘আপনার জন্যই দরজা খুলতে আমি আদিষ্ট হয়েছি। আপনার পূর্বে অন্য কারোর জন্য দরজা খুলব না’।” [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: “আমি প্রথম ব্যক্তি, যে জান্নাতের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে শাফা‘আত করব, আর নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশি” ( باب فِى قَوْلِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم : « أَنَا أَوَّلُ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ وَأَنَا أَكْثَرُ الأَنْبِيَاءِ تَبَعًا » ), হাদীস নং ৫০৭।]

২২. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«يُطَوَّلُ يَوْمُ الْقِيَامَةِ عَلَى النَّاسِ فَيَقُولُ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ : انْطَلِقُوا بِنَا إِلَى آدَمَ أَبِي الْبَشَرِ فَيَشْفَعُ لَنَا إِلَى رَبِّنَا عَزَّ وَجَلَّ فَلْيَقْضِ بَيْنَنَا , فَيَأْتُونَ آدَمَ و آتي الجبار و أسجد له فَيَقُول : ُ ارْفَعْ رَأْسَكَ يا محمد , و تكلم يُسْمَعْ مِنْكَ , وَ قل يقبل قولك , وَ اشْفَعْ تُشَفَّعْ , فَأقُولُ : أُمَّتِي أُمَّتِي , فَيَقُولُ : اذهب إلى أمتك فمَنْ وجدت فِي قَلْبِهِ مِثْقَال نصف حبة من شَعِير مِنْ الإِيمَان فأدخله الجنة , فأذهب , فمَنْ وجدت فِي قَلْبِهِ مِثْقَال ذلك فأدخله الجنة , قَالَ : فَآتي الجبار و أسجد له فَيَقُول : ُ ارْفَعْ رَأْسَكَ يا محمد , و تكلم يُسْمَعْ مِنْكَ , وَ اشْفَعْ تُشَفَّعْ , فأرفع رأسي , فَأقُولُ : أُمَّتِي , أُمَّتِي , أي رب , فَيَقُولُ : اذهب , فمَنْ وجدت فِي قَلْبِهِ مِثْقَال حبة من خردل مِنْ إِيمَان» .

“মানুষের ওপর কিয়ামতের দিবসকে দীর্ঘায়িত করা হবে, তখন তাদের একদল অপরদলকে বলবে: তোমরা আমাদেরকে মানব জাতির পিতা আদম আলাইহিস সালামের নিকট নিয়ে যাও, ফলে তিনি আমাদের জন্য আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করেন, যাতে তিনি আমাদের মাঝে বিচার ফয়সালার কাজটি সমাপ্ত করেন; অতঃপর তারা আদম আলাইহিস সালামের নিকট আসবে;... আর আমি আসব পরাক্রমশালী আল্লাহর দরবারে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে সাজদাহ করব, অতঃপর তিনি বলবেন: হে মুহাম্মাদ! আপনি তোমার মাথা উঠান এবং কথা বলুন, আপনার কথা শোনা হবে; আপনি কথা বলুন, আপনার কথা গ্রহণ করা হবে; সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে; তখন আমি বলব: আমার উম্মত! আমার উম্মত!! তখন তিনি বলবেন: তুমি তোমার উম্মতের নিকট যাও, তারপর যার অন্তরের মধ্যে যবের অর্ধেক দানা পরিমাণ ঈমান পাবে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও; অতঃপর আমি যাব এবং যার অন্তরের মধ্যে এই পরিমাণ (ঈমান) পাব, তাকে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাব; তিনি বলেন: তারপর আমি আসব পরাক্রমশালী আল্লাহর দরবারে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে সাজদাহ করব, অতঃপর তিনি বলবেন: হে মুহাম্মাদ! আপনি তোমার মাথা উঠান এবং কথা বলুন, আপনার কথা শোনা হবে; আপনি কথা বলুন, আপনার কথা গ্রহণ করা হবে; সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে; তখন আমি বলব: আমার উম্মত! আমার উম্মত!! হে আমার রব! তখন তিনি বলবেন: যাও, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান পাবে, (তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও)

১১
কবীরা গুনাহকারী’র জন্য শাফা‘আত
পূর্বে কতগুলো হাদীসের উদ্ধৃতি অতিবাহিত হয়েছে, যেগুলো কবীরা গুনাহে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য শাফা‘আতের প্রমাণ বহন করে। যেমন, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস, আরা তা হলো দ্বিতীয় হাদীস:

« يخرج من النار مَنْ قَالَ : لَا إِلَه إِلَّا اللَّه ... إلى آخره » .

“যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই) বলবে, সে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে।”

অনুরূপভাবে তৃতীয় হাদীস, আর ইবন ‘আসেম ‘আস-সুন্নাহ’ নামক গ্রন্হে (২/৩৯৯) বলেন, আর ঐসব খবর বা হাদীসসমূহ, যা আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছি শাফা‘আত ও তাঁকে সুপারিশকারী বানানো প্রসঙ্গে, তার দ্বারা আল্লাহ তাঁকে মর্যাদা দান করেছেন। আর তিনি যেসব ক্ষেত্রে সুপারিশ করবেন, সে ব্যাপারে অনেক হাদীস রয়েছে, যা প্রকৃত জ্ঞানকে আবশ্যক করে। আর মুতাওয়াতির পর্যায়ের জ্ঞানকে আবশ্যক করে, এমন খবর বা হাদীস অস্বীকারকারী ব্যক্তি কাফির।

আল্লাহ আমাদেরকে এবং তাঁর ওপর ঈমানদার শাফা‘আতের আশাকারী প্রত্যেক মুমিনকে সে শাফা‘আত নসীব করুন।

২৩. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বলা হল: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কিয়ামতের দিন কোনো ব্যক্তি আপনার শাফা‘আতের দ্বারা সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে? জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«لَقَدْ ظَنَنْت يَا أَبَا هُرَيْرَة أَنْ لَا يَسْأَلنِي عَنْ هَذَا الْحَدِيث أحد أَوّلَ مِنْك لِمَا رَأَيْت مِنْ حِرْصك عَلَى الْحَدِيث , أَسْعَد النَّاس بِشَفَاعَتِي يَوْم الْقِيَامَة مَنْ قَالَ : لَا إِلَه إِلَّا اللَّه , فأدخله الجنة فأذهب فَمَنْ وَجَدْتُ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالَ ذَلِكَ أَدْخَلْتُهُمْ الْجَنَّةَ وَفَرَغَ اللَّهُ مِنْ حِسَابِ النَّاسِ وَأَدْخَلَ مَنْ بَقِيَ مِنْ أُمَّتِي النَّارَ مَعَ أَهْلِ النَّارِ , فَيَقُولُ أَهْلُ النَّار : ِ مَا أَغْنَى عَنْكُمْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَعْبَدُونَ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا تُشْرِكُونَ بِهِ شَيْئًا , فَيَقُولُ الْجَبَّارُ عَزَّ وَجَلَّ : فَبِعِزَّتِي لَأُعْتِقَنَّهُمْ مِنْ النَّارِ فَيُرْسِلُ إِلَيْهِمْ فَيَخْرُجُونَ وَقَدْ امْتَحَشُوا فَيَدْخُلُونَ فِي نَهَرِ الْحَيَاةِ فَيَنْبُتُونَ فِيهِ كَمَا تَنْبُتُ الْحِبَّةُ فِي غُثَاءِ السَّيْلِ , وَيُكْتَبُ بَيْنَ أَعْيُنِهِمْ : هَؤُلَاءِ عُتَقَاءُ الْجَبَّارِ عَزَّ وَجَلَّ» .

“হে আবূ হুরায়রা! আমি ধারণা করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার আগে আমাকে আর কেউ প্রশ্ন করবে না। কারণ, আমি দেখেছি হাদীসের প্রতি তোমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান হবে সেই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি একান্ত আন্তরিকতার সাথে বলে: لَا إِلَه إِلَّا اللَّه (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই); তাকে আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাব; অতঃপর আমি যাব এবং যার অন্তরের মধ্যে এই পরিমাণ (ঈমান) পাব, তাকে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাব। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হিসাব নেওয়ার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করবেন এবং আমার বাকি উম্মতকে জাহান্নামবাসীদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন; অতঃপর জাহান্নামবাসীগণ বলবে: তোমরা যে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করতে না, তা তোমাদের কোনো উপকারে আসল না; তখন পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: আমার ইজ্জতের কসম! অবশ্যই আমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করব। অতঃপর তিনি তাদের নিকট ফরমান পাঠাবেন, তারপর তার বের হয়ে আসবে এমতাবস্থায় যে, তারা পুড়ে গেছে। অতঃপর তারা জীবন নদীতে প্রবেশ করবে, তারপর তারা তাতে সজীব হয়ে উঠবে, যেমনিভাবে স্রোতের পলিতে শস্য অঙ্কুরিত হয় এবং তাদের কপালে লিখে দেওয়া হবে: ‘এরা পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত।” [আহমদ (৩/১৪৪ এবং ২৪৭) এবং তার বর্ণনাকারীগণ সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী; দারেমী (১/২৭–২৮)]

২৪. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«لكل نبي دعوة مستجابة يدعو بها وأريد أن أختبئ دعوتي شفاعة لأمتي في الآخرة» .

“প্রত্যেক নবীর এমন একটি মাকবুল দো‘আ রয়েছে, যার দ্বারা তিনি দো‘আ করে থাকেন। আর আমার ইচ্ছা, আমি আমার সে দো‘আর অধিকার আখিরাতে আমার উম্মতের শাফা‘আতের জন্য মুলতবী রাখি।” [সহীহ বুখারী, দো‘য়া অধ্যায় ( كتاب الدعوات ), পরিচ্ছেদ: প্রত্যেক নবীর একটি মাকবুল দো‘আ রয়েছে ( باب لكل نبي دعوة مستجابة ), হাদীস নং ৫৯৪৫।]

২৫. আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«خيرت بين الشفاعة وبين أن يدخل نصف أمتي الجنة , فاخترت الشفاعة لأنها أعم وأكفى , أترونها للمتقين؟ لا ولكنها للمذنبين الخطائين المتلوثين» .

শাফা‘আত এবং আমার অর্ধেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করা -এই দু’টির মধ্যে কোনো একটিকে গ্রহণ করার ব্যাপারে আমাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, অতঃপর আমি শাফা‘আতের বিষয়টিকে পছন্দ করেছি। কারণ, তা অনেক ব্যাপক ও পর্যাপ্ত। তোমরা কি তা মুত্তাকীদের জন্য মনে করেছ? না, বরং তা গুনাহগার অপরাধী পঙ্কিলদের জন্য।” [ইবন মাজাহ (২/১৪৪১); আল-বূসীরী ‘আয-যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে বলেন, তার সনদ সহীহ এবং বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত।]

২৬. আবূ বুরদা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«ان النبي صلى الله عليه و سلم كان يحرسه أصحابه , فقمت ذات ليلة فلم أره في منامه فأخذني ما قدم وما حدث فذهبت أنظر فإذا أنا بمعاذ قد لقي الذي لقيت فسمعنا صوتا مثل هزيز الرحا فوقفا على مكانهما فجاء النبي صلى الله عليه وسلم من قبل الصوت , فقال : « هل تدرون أين كنت؟ وفيم كنت؟ أتاني آت من ربي عز و جل فخيرني بين ان يدخل نصف أمتي الجنة وبين الشفاعة , فاخترت الشفاعة» فقالا : يا رسول الله ! ادع الله عز و جل أن يجعلنا في شفاعتك , فقال : «أنتم ومن مات لا يشرك بالله شيئا في شفاعتي» .

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সাহাবীগণ পাহারা দিত, কোনো এক রাতে আমি ঘুম থেকে জাগ্রত হলাম, তারপর আমি তাঁকে তাঁর ঘুমানোর জায়গায় দেখতে পেলাম না, অতঃপর হাঁটাহাঁটি ও কথাবর্তার আওয়াজ শুনতে পেলাম, তারপর আমি বিষয়টি দেখতে গেলাম, হঠাৎ আমার সাথে মু‘আযের দেখা হয়ে গেল; অতঃপর আমরা জাঁতাকলের কড় কড় শব্দের ন্যায় শব্দ শুনতে পেলাম; অতঃপর তারা তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আওয়াজের দিক থেকে আসলেন এবং বললেন: তোমরা কি জান যে, আমি কোথায় ছিলাম এবং কাদের মধ্যে ছিলাম? আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আমার নিকট এক আগন্তুত আসল, অতঃপর শাফা‘আত এবং আমার অর্ধেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করা -এই দু’টির মধ্যে কোনো একটিকে গ্রহণ করার ব্যাপারে আমাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, অতঃপর আমি শাফা‘আতের বিষয়টিকে পছন্দ করেছি। অতঃপর তারা উভয়ে বলল: হে আল্লাহ রাসূল! আপনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করেন, তিনি যাতে আমাদেরকে আপনার শাফা‘আতের মধ্যে গণ্য করেন, তখন তিনি বলেন: তোমরা এবং যারা আল্লাহর সাথে শির্ক না করে মারা যাবে, তারা আমার শাফা‘আতের আওতায় থাকবে।” [আহমদ (৪/৪০৪); তাবারানী, আস-সাগীর (২/৮); তার সনদ সহীহ; ইমাম আহমদের নিকট এই হাদীসের সমর্থনে ‘আওফ ইবন মালিক থেকে হাদীস বর্ণিত আছে (৬/২৮)।]

২৭. আবূ বুরদা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أعطيت خمسا بعثت إلى الأحمر والأسود , وجعلت لي الأرض طهورا ومسجدا , وأحلت لي الغنائم ولم تحل لمن كان قبلي , ونصرت بالرعب شهرا , وأعطيت الشفاعة وليس من نبي الا وقد سأل شفاعة وإني أخبأت شفاعتي ثم جعلتها لمن مات من أمتي لم يشرك بالله شيئا» .

“আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে: (১) আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের (সকল মানুষের) নিকট। (২) আমার জন্য যমীনকে পবিত্র ও সালাত আদায়ের উপযোগী করা হয়েছে। (৩) আর আমার জন্য গনীমতের মাল হালাল করে দেওয়া হয়েছে, যা আমার আগে আর কারও জন্য হালাল করা হয় নি। (৪) আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যে, এক মাসের দূরত্বেও তা প্রতিফলিত হয় (৫) আর আমাকে শাফা‘আতের অধিকার দেওয়া হয়েছে; প্রত্যেক নবীই শাফা‘আতের অধিকার চেয়েছেন, আর আমি আমার শাফা‘আতের আবেদনকে বিলম্বিত করেছি, অতঃপর আমি তা কাজে লাগাব আমার উম্মতের মধ্য থেকে ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করে নি।” [আহমদ (৪/৪১৬); আর তিনি বুখারী ও মুসলিমের শর্তের ভিত্তিতে হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন।]

২৮. আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أعطيت خمسًا لم يعطها نبى قبلى بعثت إلى الأحمر والأسود , وإنما كان النبى يبعث إلى قومه , ونصرت بالرعب مسيرة شهر , وأطعمت المغنم ولم يطعمه أحد كان قبلى , وجعلت لى الأرض طهورًا ومسجدًا , وليس من نبى إلا وقد أعطى دعوة فتعجلها وإنى أخرت دعوتى شفاعتى لأمتى وهى بالغة إن شاء الله من مات لا يشرك بالله شيئًا» .

“আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার পূর্বে আর কোনো নবীকে দেওয়া হয় নি: (১) আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের (সকল মানুষের) নিকট, আর অপাপর নবীদেরকে প্ররেণ করা হয়েছে তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নিকট। (২) আমাকে এমন প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে যে, এক মাসের দূরত্বেও তা প্রতিফলিত হয়। (৩) আমি গনিমতের সম্পদ ভোগ করি, যা আমার পূর্বে কেউ ভোগ করত না। (৪) আমার জন্য যমীনকে পবিত্র ও সালাত আদায়ের উপযোগী করা হয়েছে। (৫) যে নবীকেই একটি বিশেষ দো‘আর সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তিনি তা তাৎক্ষণিকভাবে দাবি করেছেন, কিন্তু আমি আমার শাফা‘আতের আবেদন বা দো‘আটিকে আমার উম্মতের জন্য বিলম্বিত করেছি, আর আল্লাহ চায় তো তা ঐ ব্যক্তির নিকট পৌঁছাবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করে মারা গেছে।” [তাবারানী, আল-আওসাত, তার সনদ হাসান পর্যায়ের; দেখুন: ‘মাজামা‘উয যাওয়ায়েদ’ [ مجمع الزوائد ] (৮/২৬৯)]

২৯. আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«شفاعتي لأهل الكبائر من أمتي» .

“আমার উম্মতের মধ্যে কবীরা গুনাহের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জন্য আমার শাফা‘আত তথা সুপারিশ প্রয়োগ করা হবে।” [তিরমিযী (৪/১৪৫); ইবন খুযাইমা তাকে সহীহ বলেছেন, পৃ. ২৭০; ইবন হিব্বান, পৃ. ৬৪৫; ইবন আবি ‘আসেম, ‘আস-সুন্নাহ’ (২/৩৯৯); হাকেম তাকে সহীহ বলেছেন (১/২৯); ইবন কাছীর তার তাফসীরে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন (১/৪৮৭); ইমাম বায়হাকী হাদীসটি গ্রহণ করেছেন।]

১২
জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আত প্রসঙ্গে
৩০. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أمر بقوم من أمتي قد أمر بهم إلى النار , قال : فيقولون : يا محمد ! ننشدك الشفاعة , قال : فآمر الملائكة أن يعفوا بهم . قال : فأنطلق و استأذن على الرب عز و جل فيأذن لي فأسجد و أقول : يا رب , قوم من أمتي قد أمر بهم إلى النار , قال : فيقول لي : انطلق فأخرج منهم , قال : فانطلق و أخرج منهم من شاء الله أن أخرج , ثم ينادي الباقون : يا محمد ! ننشدك الشفاعة , فأرجع إلى الرب فاستأذن فيؤذن لي فأسجد فيقال لي : ارفع رأسك , و سل تعطه و اشفع تشفع , فأثني على الله بثناء لم يثن عليه أحد , أقول : ثم قوم من أمتي قد أمر بهم إلى النار , فيقول : انطلق فأخرج منهم , قال : فأقول يا رب , أخرج من قال : لا إله إلا الله , ومن كان في قلبه حبة من إيمان , قال : فيقول : يا محمد ! ليست تلك لك , تلك لي , قال : فانطلق و أخرج من شاء الله أن أخرج , قال : و يبقى قوم فيدخلون النار , فيعيرهم أهل النار , فيقولون : أنتم كنتم تعبدون الله و لا تشركون به أدخلكم النار , فيحزنون لذلك , قال : فيبعث الله ملكا بكف من ماء فينضح بها في النار , و يعبطهم أهل النار , ثم يخرجون و يدخلون الجنة فيقال : انطلقوا فتضيفوا الناس , فلو أنهم جميعهم نزلوا برجل واحد كان لهم عنده سعة و يسمون المحررين» .

“আমার উম্মতের একদলের ব্যাপারে জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, তিনি বলেন, অতঃপর তারা বলবে: হে মুহাম্মাদ! আমরা আপনার নিকট শাফা‘আতের সন্ধান চাচ্ছি; তিনি বলেন: অতঃপর আমি ফিরিশতাদেরকে নির্দেশ দিব, তারা যাতে তাদেরকে নিয়ে অবস্থান করে। তিনি বলেন: অতঃপর আমি ছুটে যাব এবং আমার রব আল্লাহ তা‘আলার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করব, অতঃপর তিনি আমাকে অনুমতি দিবেন, তারপর আমি সাজদায় অবনত হব এবং আমি বলব: হে আমার রব! আমার উম্মতের একদলের ব্যাপারে জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, তিনি বলেন: তখন তিনি আমাকে বলবেন: আপনি যান এবং তাদের থেকে বের করে নিয়ে আসুন; তিনি বলেন: অতঃপর আমি যাব এবং তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ যাকে বের করে নিয়ে আসতে চান, আমি তাকে বের করে নিয়ে আসব; অতঃপর অবশিষ্টগণ ডাকবেন: হে মুহাম্মাদ! আমরা আপনার নিকট শাফা‘আতের সন্ধান চাচ্ছি; অতঃপর আমি পুনরায় আমার রবের নিকট নিকট ফিরে যাব, তারপর আমি তার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করব, অতঃপর তিনি আমাকে অনুমতি দিবেন, তারপর আমি সাজদায় অবনত হব, তখন আমাকে বলা হবে: আপনি আপনার মাথা উঠান এবং চান, আপনাকে তা দেওয়া হবে; আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রগণ করা হবে; অতঃপর আমি এমন প্রশংসার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করব, এভাবে কোনো দিন কেউ তাঁর প্রশংসা করে নি। আমি বলব: অতঃপর আমার উম্মতের একদলের ব্যাপারে জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, তখন তিনি বলবেন: আপনি যান এবং তাদের থেকে বের করে নিয়ে আসুন। তিনি বলেন: অতঃপর আমি বলব, হে আমার রব! আমি তাকে বের করে নিয়ে আসব, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই) বলেছে এবং যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে; তিনি বলেন: অতঃপর তিনি বলবেন, হে মুহাম্মাদ! এটা আপনার জন্য নয়, এটা আমার জন্য; তিনি বলেন: অতঃপর আমি যাব এবং তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ যাকে বের করে নিয়ে আসতে চান, আমি তাকে বের করে নিয়ে আসব; তিনি বলেন: একদল অবশিষ্ট থাকবে এবং তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে; অতঃপর জাহান্নামবাসীগণ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবে: তোমরা আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তার সাথে শির্ক করতে না, তিনি তোমাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করালেন! তিনি বলেন: অতঃপর তারা এই জন্য দুঃখ পাবে ও চিন্তিত হয়ে পড়বে; তিনি বলেন: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এক অঞ্জলি পানিসহ একজন ফিরিশতা পাঠাবেন, অতঃপর সে তা দ্বারা জাহান্নামের আগুনকে সিক্ত করবে এবং জাহান্নামবাসীগণ তাদের ব্যাপারে ঈর্ষা করবে; অতঃপর তারা বের হয়ে আসবে এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে; অতঃপর বলা হবে: তোমরা যাও এবং জনগণের মেহমান হয়ে যাও; তারপর যদি তারা সকলেই এক লোকের নিকট অবতরণ করে, তাহলেও তার নিকট তাদেরকে ধারণ করার মত ক্ষমতা থাকবে। আর তাদেরকে ‘মুক্তিপ্রাপ্ত’ বলে আখ্যায়িত করা হবে।” [আবূ বকর ইবন আবিদ্দুনিয়া, আল-আহওয়াল ( الأهوال ); আর এটি হাসান হাদীস, তার বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।]

হাফেয ইবন কাসীর বলেন: এই হাদীসটি দাবি করে ঐসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই শাফা‘আত তিনবার হওয়া, যাদের ব্যাপারে জাহান্নামের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, যাতে তারা তাতে প্রবেশ না করে, আর তাঁর কথা: أخرج মানে হলো: বাঁচাও; এর দলীল হলো তাঁর পরবর্তী কথা: «و يبقى قوم فيدخلون النار» (একদল অবশিষ্ট থাকবে এবং তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে) আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সঠিক বিষয় সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ভালো জানেন।

১৩
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশের ব্যাপারে শাফা‘আত প্রসঙ্গে
৩১. আবদুর রহমান ইবন আবি বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إن ربي أعطاني سبعين ألفا من أمتي يدخلون الجنة بغير حساب» فقال عمر : يا رسول الله فهلا استزدته ؟ قال : « قد استزدته فأعطاني مع كل رجل سبعين ألفا» قال عمر : فهلا استزدته ؟ قال : « قد استزدته فأعطاني هكذا» . وفرج عبد الله بن بكر بين يديه وقال عبد الله وبسط باعيه وحثا عبد الله وقال هشام وهذا من الله لا يدرى ما عدده» .

“নিশ্চয় আমার রব আমাকে আমার সত্তর হাজার উম্মতকে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতঃপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি তাঁর নিকট আরও অতিরিক্ত প্রার্থনা করেন নি? জবাবে তিনি বললেন: আমি তাঁর নিকট আরও অতিরিক্ত প্রার্থনা করেছি, অতঃপর তিনি আমাকে প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে আরও সত্তর হাজার প্রবেশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতঃপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি তাঁর নিকট আরও অতিরিক্ত প্রার্থনা করেন নি? জবাবে তিনি বললেন: আমি তাঁর নিকট আরও অতিরিক্ত প্রার্থনা করেছি, অতঃপর তিনি আমাকে আরও অনুরূপ সংখ্যক প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর (হাদীসের একজন বর্ণনাকারী ইমাম আহমদের উস্তাদ) আবদুল্লাহ ইবন বকর তাঁর সম্মুখের জায়গা প্রশস্ত করে দেখান। আর আবদুল্লাহ বললেন: আর তিনি তাঁর দুই বাহু সম্প্রসারিত করলেন। আর তা আবদুল্লাহ তার হাত দিয়ে মাটি পূর্ণ করলেন। আর হিশাম বলেন: আর এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে, যার সংখ্যা সম্পর্কে জানা যায় না।” [আহমদ (১/১৯৭); আর অন্য বর্ণনার সমর্থনের কারণে হাদীসটি হাসান পর্যায়ের। (বস্তুত হাদীসটি দুর্বল। শাইখ শু‘আইব আল-আরনাউত দুর্বল বলেছেন। [সম্পাদক])]

৩২. আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«وعدني ربي أن يدخل الجنة من أمتي سبعين ألفا لا حساب عليهم ولا عذاب , مع كل ألف سبعون ألفا , وثلاث حثيات من حثيات ربي» .

“আমার রব আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার উম্মত বিনা হিসাবে কোনো শাস্তি ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে; প্রত্যেক হাজারের সাথে আরও সত্তর হাজার এবং আমার প্রতিপালকের অঞ্জলিসমূহ থেকে পরিপূর্ণ তিন অঞ্জলি প্রবেশ করবে।” [তিরমিযী (৪/৪৫); ইবন মাজাহ (২/১৪৩৩); আহমদ (৫/২৬৮); হাফেয ইবন কাছীর তার তাফসীরে (১/৩৯৪) বলেন, এর সনদটি উত্তম।]

৩৩. আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«ان الله عز و جل وعدني ان يدخل من أمتي الجنة سبعين ألفا بغير حساب» فقال يزيد بن الأخنس السلمي : والله ما أولئك في أمتك الا كالذباب الأصهب في الذبان فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : «كان ربي عزو جل قد وعدني سبعين ألفا مع كل ألف سبعون ألفا وزادني ثلاث حثيات» قال : فما سعة حوضك يا نبي الله قال : «كما بين عدن إلى عمان وأوسع وأوسع يشير بيده قال فيه مثعبان من ذهب وفضة» قال : فما حوضك يا نبي الله قال : «أشد بياضا من اللبن وأحلى مذاقة من العسل وأطيب رائحة من المسك من شرب منه لم يظمأ بعدها ولم يسود وجهه أبدا» .

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমার উম্মতের মধ্য থেকে সত্তর হাজার উম্মত বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর ইয়াযিদ ইবনুল আখনাস আস-সুলামী বললেন: আল্লাহর কসম! আপনার উম্মতের মধ্যে তারা তো মাছির পালের মধ্যে লাল-হলুদ-সাদা মাছির মতো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সত্তর হাজারের এবং প্রত্যেক হাজারের সাথে সত্তর হাজারের, আর তিনি আমার নিকট আরও তিন অঞ্জলি বৃদ্ধির কথা বলেছেন। তিনি বলেন: হে আল্লাহর নবী! আপনার হাউযের প্রশস্ততা কতটুকু? জবাবে তিনি বলেন: ‘আদন থেকে ‘আম্মান পর্যন্ত মধ্যকার দূরত্বের মত, আরও বেশি প্রশস্ত, আরও বেশি প্রশস্ত -বলতে বলতে তিনি তাঁর হাত দ্বারা ইঙ্গিত করেন, তিনি বলেন, তাতে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ঝর্ণধারাসমূহ রয়েছে। তিনি আবার জিজ্ঞাসার সুরে বললেন: হে আল্লাহর নবী! আপনার হাউয কোনো ধরনের? জবাবে তিনি বললেন: দুধের চেয়ে অনেক বেশি সাদা, মধুর চেয়ে অনেক বেশি মিষ্টি এবং মেশকের চেয়ে অনেক বেশি সুগন্ধময়; যে ব্যক্তি একবার তার থেকে পান করবে, সে ব্যক্তি পরবর্তীতে আর কোনো দিন পিপাসার্ত হবে না এবং কোনো দিন তার চেহারা মলিন হবে না।” [আহমদ (২/২৫০); হাফেয ইবন কাছীর তার তাফসীরের মধ্যে বলেন, তার সনদ হাসান; আর হাফেয হাইছামী ‘আল-মাজমা‘ ( المجمع ) গ্রন্থে বলেন, হাদীসটি ইমাম আহমদ ও তাবারানী রহ. বর্ণনা করেছেন এবং আহমদ রহ.-এর বর্ণনাকারীগণ ও তাবারানীর কোনো কোনো সনদের বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ।]

৩৪. রিফা‘আ আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«أقبلنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم حتى إذا كنا بالكديد أو قال : بقديد فجعل رجال منا يستأذنون إلى أهليهم فيأذن لهم , فقام رسول الله صلى الله عليه و سلم فحمد الله وأثنى عليه ثم قال : « ما بال رجال يكون شق الشجرة التي تلي رسول الله صلى الله عليه و سلم أبغض إليهم من الشق الآخر فلم نر عند ذلك من القوم الا باكيا , فقال رجل ان الذي يستأذنك بعد هذا لسفيه، فحمد الله وقال : حينئذ أشهد عند الله لا يموت عبد يشهد أن لا إله الا الله وإني رسول الله صدقا من قلبه , ثم يسدد الا سلك في الجنة . قال : وقد وعدني ربي عز و جل أن يدخل من أمتي سبعين ألفا لا حساب عليهم ولا عذاب , وإني لأرجو أن لا يدخلوها حتى تبوؤا أنتم ومن صلح من آبائكم وأزواجكم وذرياتكم مساكن في الجنة وقال : إذا مضى نصف الليل أو قال : ثلثا الليل ينزل الله عز و جل إلى السماء الدنيا، فيقول : لا أسأل عن عبادي أحدا غيري، من ذا يستغفرنى فاغفر له , من الذي يدعوني أستجيب له من ذا الذي يسألني أعطيه حتى ينفجر الصبح» .

“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আগমন করতে লাগলাম, এমনকি যখন আমরা ‘আল-কাদীদ’ নামক স্থানে পৌঁছালাম, তখন আমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক তাদের পরিবার-পরিজনের নিকট যাওয়ার জন্য তাঁর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করতে শুরু করল এবং তিনি তাদেরকে অনুমতি প্রদান করলেন; অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (ভাষণ দেওয়ার জন্য) দাঁড়ালেন, তারপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলেন, অতঃপর তিনি বললেন: লোকজনের কী অবস্থা হল, গাছের যে অংশ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত, অপর অংশের চেয়ে তাদের নিকট গাছের সেই অংশ অধিক অপছন্দনীয়, আর আমরা সেই সময় সম্প্রদায়ের সকল লোককে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পেলাম। জনৈক ব্যক্তি বলল: এর পরেও যে ব্যক্তি আপনার নিকট অনুমতি চাইবে, সে তার বোকামীর জন্যই চাইবে; অতঃপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং তিনি বললেন: যখন আমি আল্লাহর নিকট সাক্ষ্য দিব, তখন যে বান্দা মনে-প্রাণে এই সাক্ষ্য দিয়ে মারা যাবে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, অতঃপর ঠিক সেই অনুযায়ী সে কাজ করে, তাহলে সে জান্নাতের পথেই চলে, আর তিনি বলেন: আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমার উম্মতের মধ্যে সত্তর হাজার উম্মত বিনা হিসাবে কোনো শাস্তি ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর আমি অবশ্যই আশা করি যে, তারা তাতে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা এবং তোমাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী-পরিজন ও সন্তান-সন্ততী’র মধ্য থেকে যারা সৎকর্ম করে, তারা জান্নাতের মধ্যে আবাসগৃহ তৈরি করবে, আর তিনি বললেন: যখন রাতের অর্ধেক অতিবাহিত হয় অথবা তিনি বলেছেন, যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং তারপরে বলেন: আমি আমার বান্দাদের অবস্থা সম্পর্কে আমাকে ব্যতীত অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করব না; কে আছ আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব; কে আছ আমার নিকট দো‘আ করবে, আমি তার দো‘আ কবুল করব; কে আছ আমার নিকট কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব, এভাবে করে শেষ পর্যন্ত উষার আলো উদ্ভাসিত হয়ে সকাল হয়ে যাবে।” [আহমদ (৪/১৬); আত-তায়ালাসী (১/২৭); ইবন খুযাইমা, পৃ. ১৩২; ইবন হিব্বান (১/২৫৩); তাবারানী, আল-কাবীর (৫/৪৩), আর হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. এর শর্তের আলোকে বর্ণিত ও প্রতিষ্ঠিত।হাফেয ইবন কাছীর রহ. ‘আন-নেহায়া’ (২/১০৮) গ্রন্থে বলেন, হাফেয জিয়া বলেন, এটা আমার নিকট বিশুদ্ধ হাদীসের শর্তের আলোকে বর্ণিত।]

[ ৬ ]

১৪
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক জান্নাতে প্রবেশকারীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির জন্য তার আমলের চাহিদার চেয়ে উন্নত মর্যাদার জন্য সুপারিশ করা
৩৫. আবূ বুরদা থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«لما فرغ النبي صلى الله عليه و سلم من حنين بعث أبا عامر على جيش إلى أوطاس فلقي دريد بن الصمة , فقتل دريد وهزم الله أصحابه , قال أبو موسى : وبعثني مع أبي عامر فرمي أبو عامر في ركبته رماه جشمي بسهم فأثبته في ركبته فانتهيت إليه فقلت : يا عم من رماك ؟ فأشار إلى أبي موسى , فقال ذاك قاتلي الذي رماني , فقصدت له فلحقته , فلما رآني ولى فاتبعته , وجعلت أقول له : ألا تستحي , ألا تثبت فكف فاختلفنا ضربتين بالسيف فقتلته , ثم قلت لأبي عامر قتل الله صاحبك , قال : فانزع هذا السهم , فنزعته , فنزا منه الماء , قال : يا ابن أخي ! أقرئ النبي صلى الله عليه و سلم السلام وقل له : استغفر لي . واستخلفني أبو عامر على الناس فمكث يسيرا ثم مات , فرجعت فدخلت على النبي صلى الله عليه و سلم في بيته على سرير مرمل , وعليه فراش , قد أثر رمال السرير بظهره وجنبيه , فأخبرته بخبرنا وخبر أبي عامر وقال : قل له استغفر لي , فدعا بماء فتوضأ ثم رفع يديه فقال : «اللهم اغفر لعبيد أبي عامر » . ورأيت بياض إبطيه ثم قال : « اللهم اجعله يوم القيامة فوق كثير من خلقك من الناس » . فقلت : ولي فاستغفر فقال : «اللهم اغفر لعبد الله بن قيس ذنبه وأدخله يوم القيامة مدخلا كريما» . قال أبو بردة : إحداهما لأبي عامر والأخرى لأبي موسى .

“যখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনায়েন যুদ্ধ থেকে অবসর হলেন, তখন তিনি আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে একটি সৈন্যবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করে আওতাস গোত্রের প্রতি পাঠালেন। যুদ্ধে তিনি (আবূ ‘আমির) দুরায়দ ইবন সিম্মার সাথে মুকাবিলা করলে দুরায়দ নিহত হয় এবং আল্লাহ তার সহযোগী যোদ্ধাদেরকেও পরাজিত করেন। আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র সাথে আমাকেও পাঠিয়েছিলেন। এ যুদ্ধে আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র হাঁটুতে একটি তীর নিক্ষিপ্ত হয়। জু‘শাম গোত্রের এক লোক তীরটি তাঁর হাঁটুর মধ্যে বসিয়ে দিয়েছিল। তখন আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, চাচাজান! কে আপনার ওপর তীর ছুঁড়েছে? তখন তিনি আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে ইশারার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়ে বললেন যে, ঐ যে, ঐ ব্যক্তি আমাকে তীর মেরেছে। আমাকে হত্যা করেছে। আমি লোকটিকে লক্ষ্য করে তার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম, আর সে আমাকে দেখামাত্র ভাগতে শুরু করল। আমি এ কথা বলতে বলতে তার পশ্চাদ্ভাবন করলাম, (পালাচ্ছ কেন) বেহায়া দাঁড়াও না, দাঁড়াও। লোকটি থেমে গেল। এবার আমরা দু’জনে তরবারি দিয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করলাম এবং শেষ পর্যন্ত আমি তাকে হত্যা করে ফেললাম। তারপর আমি আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললাম, আল্লাহ আপনার আঘাতকারীকে হত্যা করেছেন। তিনি বললেন, (ঠিক আছে, এবার তুমি আমার হাঁটু থেকে) তীরটি বের করে দাও। আমি তীরটি বের করে দিলাম। তখন ক্ষতস্থান থেকে কিছু পানিও বের হয়ে আসল। তিনি আমাকে বললেন, হে ভাতিজা! (আমি হয়ত বাঁচবো না) তুমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার সালাম জানাবে এবং আমার মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করতে বলবে। আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁর স্থলে আমাকে সেনাবাহিনীর আমীর নিযুক্ত করলেন। এরপর তিনি কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন, তারপর ইন্তিকাল করলেন। (যুদ্ধ শেষে) আমি ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ি প্রবেশ করলাম। তিনি তখন পাকানো দড়ির তৈরি একটি খাটিয়ায় শায়িত ছিলেন। খাটিয়ার ওপর (নামেমাত্র) একটি বিছানা ছিল। কাজেই তাঁর পিঠে এবং পার্শ্বদেশে পাকানো দড়ির দাগ পড়ে গিয়েছিল। আমি তাঁকে আমাদের এবং আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র সংবাদ জানালাম। (তাঁকে এ কথাও বললাম যে) তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) বলে গিয়েছেন, তাঁকে (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) আমার মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করতে বলবে। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানি আনতে বললেন এবং ওযু করলেন। তারপর তিনি তাঁর দু’হাত উপরে তুলে দো‘আ করে বললেন, হে আল্লাহ! তোমার প্রিয় বান্দা আবূ ‘আমিরকে ক্ষমা কর। (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আর মুহূর্তে হাতদ্বয় এত উপরে তুললেন যে) আমি তাঁর বগলদ্বয়ের শুভ্রাংশ দেখতে পেয়েছি। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! কিয়ামত দিবসে তুমি তাঁকে তোমার অনেক মাখলুকের ওপর, অনেক মানুষের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান কর। আমি বললাম: আমার জন্যও (দো‘আ করুন) তিনি দো‘আ করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আবদুল্লাহ ইবন কায়েসের গুনাহ ক্ষমা করে দাও এবং কিয়ামত দিবসে তুমি তাঁকে সম্মানিত স্থানে প্রবেশ করাও। বর্ণনাকারী আবূ বুরদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, দু’টি দো‘আর একটি ছিল আবূ ‘আমির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র জন্য, আর অপরটি ছিল আবূ মূসা (আশ‘আরী) রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র জন্য।” [সহীহ বুখারী, মাগাযী অধ্যায় ( كتاب المغازي ), পরিচ্ছেদ: আওতাস যুদ্ধ প্রসঙ্গে ( باب غزوة أوطاس ), হাদীস নং ৪০৬৮।]

৩৬. উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে গেলেন। তখন তাঁর চোখগুলো উন্মুক্ত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখগুলো বন্ধ করে দিলেন এবং বললেন:

«إِنَّ الرُّوحَ إِذَا قُبِضَ تَبِعَهُ الْبَصَرُ » . فَضَجَّ نَاسٌ مِنْ أَهْلِهِ فَقَالَ : «لاَ تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ إِلاَّ بِخَيْرٍ فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ يُؤَمِّنُونَ عَلَى مَا تَقُولُونَ» . ثُمَّ قَالَ : «اللَّهُمَّ اغْفِرْ لأَبِى سَلَمَةَ وَارْفَعْ دَرَجَتَهُ فِى الْمَهْدِيِّينَ وَاخْلُفْهُ فِى عَقِبِهِ فِى الْغَابِرِينَ وَاغْفِرْ لَنَا وَلَهُ يَا رَبَّ الْعَالَمِينَ وَافْسَحْ لَهُ فِى قَبْرِهِ . وَنَوِّرْ لَهُ فِيهِ» .

“নিশ্চয় রূহ যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন চোখ তার প্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এ কথা শুনে তার পরিবারের লোকেরা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের জন্য অমঙ্গলজনক কোনো দো‘আ করো না। কেননা ফিরিশতাগণ তোমাদের কথার ওপর আমীন বলে থাকেন। তিনি তারপর বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আবূ সালামাকে মাফ করে দাও, হিদায়াত প্রাপ্তদের মধ্যে তার মর্যাদাকে সুউচ্চ করে দাও এবং তার উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিযুক্ত কর। হে রাব্বুল আলামীন! আমাদেরকে এবং তাঁকে মাফ করে দাও, আর তাঁর জন্য কবরকে প্রশস্ত করে দাও এবং তাঁর কবরকে আলোকময় করে দাও।” [সহীহ মুসলিম, জানাযা অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: মৃত ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হলে তার চক্ষু বন্ধ করে দেওয়া ও তার জন্য দো‘আ করা প্রসঙ্গে ( باب فِى إِغْمَاضِ الْمَيِّتِ وَالدُّعَاءِ لَهُ إِذَا حُضِرَ ), হাদীস নং ২১৬৯।]

১৫
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁর চাচা আবূ তালিবের শাস্তি হালকা করার জন্য সুপারিশ প্রসঙ্গে
৩৭. আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

«ما أغنيت عن عمك فإنه كان يحوطك ويغضب لك ؟ قال : « هو في ضحضاح من نار ولولا أنا لكان في الدرك الأسفل من النار » .

“আপনি কি আপনার কর্মের দ্বারা (তার) কোনো উপকার করতে পেরেছেন, অথচ তিনি তো আপনাকে হিফাযত করতেন এবং আপনার জন্য (অন্যের প্রতি) ক্রোধাম্বিত হতেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: (হ্যাঁ), তিনি কেবল পায়ের গ্রন্থি পর্যন্ত জাহান্নামের আগুনে থাকবেন, আর যদি আমি না হতাম, তবে জাহান্নামের অতল তলেই তাকে অবস্থান করতে হত।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সাহাবীদের ফযিলত ( كتاب فضائل الصحابة ), পরিচ্ছেদ: আবূ তালিবের কাহিনী ( باب قصة أبي طالب ), হাদীস নং ৩৬৭০; সহীহ মুসলিম (১/১৯৪)।]

৩৮. আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাঁর চাচা (আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু) আলোচনা করার সময় শুনেছেন; অতঃপর এক পর্যায়ে তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:

«لعله تنفعه شفاعتي يوم القيامة فيجعل في ضحضاح من النار يبلغ كعبيه يغلي منه دماغه» .

“আশা করা যায়, কিয়ামতের দিন তাঁর ব্যাপারে আমার সুপারিশ কাজে আসবে। তাঁকে জাহান্নামের উপরিভাগে এমনভাবে রাখা হবে যে, আগুন তার পায়ের গিরা পর্যন্ত পৌঁছবে; এতেই তার মগজ উথলাতে থাকবে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সাহাবীদের ফযীলত ( كتاب فضائل الصحابة ), পরিচ্ছেদ: আবূ তালিবের কাহিনী ( باب قصة أبي طالب ), হাদীস নং ৩৬৭২।]

এই হাদীস দু’টি প্রমাণ করে যে, আবূ তালিব কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। কারণ, তিনি যদি মুসলিম হতেন, তাহলে একত্ববাদে বিশ্বাসীদের সাথে তিনিও জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসতে পারতেন, যেমনিভাবে একত্ববাদে বিশ্বাসীদের জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলোর সংখ্যা মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর অচিরেই এই প্রসঙ্গে বর্ণিত কিছু সংখ্যক হাদীসের বিবরণ আসবে ইনশাআল্লাহ।

আর এই দু’টি হাদীসের মধ্যে আবূ তালিবের ইসলাম গ্রহণ না করার ব্যাপারে যে প্রমাণ বহন করে, তাকে সমর্থন ও শক্তিশালী করে ইমাম বুখারী রহ. তাঁর ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থে যা বর্ণনা করেছেন; ইবন শিহাব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমার নিকট বর্ণনা করেছেন সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রহ., তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন:

«أنه لما حضرت أبا طالب الوفاة جاءه رسول الله صلى الله عليه و سلم فوجد عنده أبا جهل بن هشام وعبد الله بن أمية بن المغيرة قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لأبي طالب : « يا عم قل لا إله إلا الله كلمة أشهد لك بها عند الله » . فقال أبو جهل وعبد الله بن أمية يا أبا طالب أترغب عن ملة عبد المطلب فلم يزل رسول الله صلى الله عليه و سلم يعرضها عليه ويعودان بتلك المقالة حتى قال أبو طالب آخر ما كلمهم هو على ملة عبد المطلب وأبى أن يقول لا إله إلا الله . فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : « أما والله لأستغفرن لك ما لم أنه عنك» . فأنزل الله تعالى فيه : ﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣﴾ [ التوبة : ١١٣ ]».

“আবূ তালিবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আসলেন। তিনি সেখানে আবূ জাহল ইবন হিশাম ও আবদুল্লাহ ইবন আবূ উমাইয়্যা ইবন মুগীরাকে উপস্থিত দেখতে পেলেন। (বর্ণনাকারী বলেন) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ তালিবকে লক্ষ্য করে বললেন: চাচাজান! ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমা পাঠ করুন, তাহলে এর ওসীলায় আমি আল্লাহর সমীপে আপনার জন্য সাক্ষ্য দিতে পারব। আবূ জাহল ইবন হিশাম ও আবদুল্লাহ ইবন আবূ উমাইয়্যা বলে উঠল: ওহে আবূ তালিব! তুমি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম থেকে বিমূখ হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে কালেমা পেশ করতে থাকেন, আর তারা দু’জনও তাদের কথা পুনারাবৃত্তি করতে থাকে। অবশেষে আবূ তালিব তাদের সামনে শেষ কথাটি যা বলল, তা এই যে, সে আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের ওপর অবিচল রয়েছে, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহর কসম! তবুও আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকব, যতক্ষণ না আমাকে তা থেকে নিষেধ করা হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:

﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣﴾ [ التوبة : ١١٣ ]

“আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য সংগত নয়, যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১১৩]। [সহীহ বুখারী, জানাযা অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: মুশরিক ব্যক্তির মৃত্যুকালে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ প্রসঙ্গে ( باب إذا قال المشرك عند الموت لا إله إلا الله ), হাদীস নং ১২৯৪।]

তিনি (ইমাম বুখারী রহ.) হাদীসটি তার ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থের ভিন্ন আরো কয়েক জায়াগায় বর্ণনা করেছেন এবং তাতে রয়েছে:

«فنزلت : ﴿مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَن يَسۡتَغۡفِرُواْ لِلۡمُشۡرِكِينَ وَلَوۡ كَانُوٓاْ أُوْلِي قُرۡبَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَحِيمِ ١١٣ ﴾ [ التوبة : ١١٣ ] و نزلت : ﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ ... ٥٦ ﴾ [ القصص : ٥٦ ] » .

“অতঃপর নাযিল হয়েছে: আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য সংগত নয়, যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নিশ্চিতই তারা প্রজ্বলিত আগুনের অধিবাসী”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১১৩] এবং আরও নাযিল হয়েছে: আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না...।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৬]

আর (আবূ তালিবের ইসলাম গ্রহণ না করার ব্যাপারে) সমর্থন করে, যা ইমাম মুসলিম রহ. তাঁর ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন; আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচা (আবূ তালিব)-এর অন্তিমকালে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

«قُلْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ أَشْهَدُ لَكَ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ » . فَأَبَى فَأَنْزَلَ اللَّهُ ﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ﴾ [ القصص : ٥٦ ].

“আপনি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন. কিয়ামত দিবসে আমি আপনার জন্য সাক্ষ্য দিব। কিন্তু তিনি অস্বীকার করলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করলেন:

﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ ... الآيَةَ ٥٦ ﴾ [ القصص : ٥٦ ]

“আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না...।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৬] [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ঈমানের প্রথম বিষয় হল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা ( باب أَوَّلُ الإِيمَانِ قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ), হাদীস নং ১৪৩; তিরমিযী (৪/১৫৯); আহমদ (২/৪৪১)।]

আর তিনিএই হাদীসটি অপর আরেকটি সনদে বর্ণনা করেছেন এবং তাতে তিনি (আবূ তালিব) বলেন:

«لَوْلاَ أَنْ تُعَيِّرَنِى قُرَيْشٌ يَقُولُونَ إِنَّمَا حَمَلَهُ عَلَى ذَلِكَ الْجَزَعُ , لأَقْرَرْتُ بِهَا عَيْنَكَ , فَأَنْزَلَ اللَّهُ : ﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٥٦ ﴾ [ القصص : ٥٦ ]

“কুরাইশ কর্তৃক এরূপ দোষারোপ করার আশঙ্কা যদি যদি না থাকত, তাহলে আমি তা (কালেমা তাওহীদ) পাঠ করে তোমার চোখ জুড়াতাম; এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:

﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٥٦﴾

“আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন”। [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৬] [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ঈমানের প্রথম বিষয় হল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা ( باب أَوَّلُ الإِيمَانِ قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ), হাদীস নং ১৪৪।]

নাজিয়া ইবন কা‘ব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম:

«إِنَّ عَمَّكَ الشَّيْخَ الضَّالَّ قَدْ مَاتَ . قَالَ : « اذْهَبْ فَوَارِ أَبَاكَ ثُمَّ لاَ تُحْدِثَنَّ شَيْئًا حَتَّى تَأْتِيَنِى» . فَذَهَبْتُ فَوَارَيْتُهُ وَجِئْتُهُ فَأَمَرَنِى فَاغْتَسَلْتُ وَدَعَا لِى» .

“আপনার বৃদ্ধ পথভ্রষ্ট চাচা মারা গিয়েছে; তখন তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: ‘যাও, তুমি তোমার পিতাকে (মাটি দ্বারা) ঢেকে রাখ, অতঃপর আমার নিকট না আসা পর্যন্ত কোনো কিছুই করবে না; অতঃপর আমি গেলাম, তারপর তাকে (মাটি দ্বারা) ঢেকে দিলাম এবং তাঁর (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিকট আসলাম; অতঃপর তিনি আমাকে (গোসল করার) নির্দেশ দিলেন; আমি গোসল করলাম, আর তিনি আমার জন্য দো‘আ করলেন।” [আবূ দাউদ (৩/ ৫৪৭); নাসায়ী (১/৯২); আহমদ (১/৯৭); আর হাদীসটি হাসান পর্যায়ের; দেখুন: আলবানী, ‘আহকামুল জানায়েয’।আর যিনি আবূ তালিবের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে শি‘য়াদের সন্দেহ-সংশয়সমূহের জবাবের ব্যাপারে আরও বেশি জানতে চান, তার জন্য আবশ্যক হল ইবন হাজার ‘আসকালানী’র ‘আল-ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা’ [ الإصابة في تمييز الصحابة ] (৪/১১৫) এবং ‘ফাতহুল বারী বিশরহে সহীহিল বুখারী’ ( فتح الباري بشرح صحيح البخاري )।]

১৬
একত্ববাদীদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার জন্য সুপারিশ প্রসঙ্গে
একত্ববাদে বিশ্বাসীগণের জাহান্নাম থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণকারী হাদীসসমূহ ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের, আর এই ব্যাপারে প্রমাণকারী হাদীসসমূহের কিছু কিছু পূর্বে আলোচিত হয়েছে; যেমন- আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীস, (এই বইয়ে) হাদীস নং ২ ও ৩; আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীস, ক্রমিক নং- ৫, আর এই ব্যাপারে প্রমাণ পেশ করে নিম্নে বর্ণিত হাদীসসমূহ:

৩৯. যুহুরী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার নিকট সা‘ঈদ ইবনুল মুসায়্যিব ও ‘আতা ইবন ইয়াযিদ আল-লাইসী রহ. হাদীস বর্ণনা বর্ণনা করেছেন; তাদের নিকট আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের রবকে দেখতে পাব? জবাবে তিনি বলেন:

«هل تمارون في القمر ليلة بدر ليس دونه حجاب ؟ . قالوا لا يا رسول الله , قال : فهل تمارون في الشمس ليس دونها سحاب ؟ . قالوا لا , قال : فإنكم ترونه كذلك , يحشر الناس يوم القيامة فيقول : من كان يعبد شيئا فليتبع , فمنهم من يتبع الشمس , ومنهم من يتبع القمر , ومنهم من يتبع الطواغيت , وتبقى هذه الأمة فيها منافقوها , فيأتهم الله فيقول : أنا ربكم , فيقولون : هذا مكاننا حتى يأتينا ربنا , فإذا جاء ربنا عرفناه , فيأتيهم الله فيقول : أنا ربكم , فيقولون : أنت ربنا , فيدعوهم , فيضرب الصراط بين ظهراني جهنم , فأكون أول من يجوز من الرسل بأمته ولا يتكلم يومئذ أحد إلا الرسل , وكلام الرسل يومئذ : اللهم سلم سلم , وفي جهنم كلاليب مثل شوك السعدان , هل رأيتم شوك السعدان ؟ . قالوا : نعم , قال : فإنها مثل شوك السعدان , غير أنه لا يعلم قدرعظمها إلا الله , تخطف الناس بأعمالهم فمنهم من يوبق بعمله , ومنهم من يخردل ثم ينجو , حتى إذا أراد الله رحمة من أراد من أهل النار أمر الله الملائكة أن يخرجوا من كان يعبد الله فيخرجونهم ويعرفونهم بآثار السجود , وحرم الله على النار أن تأكل أثر السجود , فيخرجون من النار , فكل ابن أدم تأكله النار إلا أثر السجود , فيخرجون من النار قد امتحشوا , فيصب عليهم ماء الحياة فينبتون كما تنبت الحبة في حميل السيل , ثم يفرغ الله من القضاء بين العباد , ويبقى رجل بين الجنة والنار وهو آخر أهل النار دخولا الجنة مقبل بوجهه قبل النار , فيقول : يا رب اصرف وجهي عن النار , قد قشبني ريحها وأحرقني ذكاؤها , فيقول : هل عسيت إن فعل ذلك بك أن تسأل غير ذلك ؟ فيقول : لا وعزتك , فيعطي الله ما يشاء من عهد وميثاق , فيصرف الله وجهه عن النار .

فإذا أقبل به على الجنة رأى بهجتها سكت ما شاء الله أن يسكت , ثم قال : يا رب قدمني عند باب الجنة , فيقول الله له : أليس قد أعطيت العهود والميثاق أن لا تسأل غير الذي كنت سألت ؟ فيقول : يا رب لا أكون أشقى خلقك , فيقول فما عسيت إن أعطيت ذلك أن لا تسأل غيره ؟ فيقول : لا وعزتك لا أسأل غير ذلك , فيعطي ربه ما شاء من عهد وميثاق فيقدمه إلى باب الجنة , فإذا بلغ بابها فرأى زهرتها وما فيها من النضرة والسرور , فيسكت ما شاء الله أن يسكت , فيقول : يارب أدخلني الجنة , فيقول الله : ويحك يا بن آدم ما أغدرك أليس قد أعطيت العهد والميثاق أن لا تسأل غير الذي أعطيت ؟ فيقول : يا رب لا تجعلني أشقى خلقك , فيضحك الله عز و جل منه , ثم يأذن له في دخول الجنة , فيقول : تمن , فيتمنى , حتى إذا انقطعت أمنيته , قال الله عز و جل : من كذا وكذا أقبل , يذكره ربه حتى إذا انتهت به الأماني , قال الله تعالى : لك ذلك ومثله معه» .

قال أبو سعيد الخدري لأبي هريرة رضي الله عنهما : إن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال : « قال الله : لك ذلك وعشرة أمثاله » . قال أبو هريرة : لم أحفظ من رسول الله صلى الله عليه و سلم إلا قوله : «لك ذلك ومثله معه » . قال أبو سعيد إني سمعته يقول : « ذلك لك وعشرة أمثاله » .

“মেঘমুক্ত পূর্ণিমার রাতের চাঁদকে দেখার ব্যাপারে তোমরা কি সন্দেহ পোষণ কর? তাঁরা বললেন, না, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য দেখার ব্যাপারে কি তোমাদের কোনো সন্দেহ আছে? সবাই বললেন, না। তখন তিনি বললেন: নিঃসন্দেহে তোমরাও আল্লাহকে অনুরূপভাবে দেখতে পাবে। কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: যে যার উপাসনা করত, সে যেন তার অনুসরণ করে; তাই তাদের কেউ সূর্যের অনুসরণ করবে, কেউ চন্দ্রের অনুসরণ করবে, কেউ তাগুতের অনুসরণ করবে। আর অবশিষ্ট থাকবে শুধু এ উম্মাহ, তবে তাদের সাথে মুনাফিকরাও থাকবে। তাদের মাঝে এ সময় আল্লাহ তা‘আলা শুভাগমন করবেন এবং বলবেন: আমি তোমাদের রব। তখন তারা বলবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রবের শুভাগমন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব। আর তাঁর যখন শুভাগমন হবে, তখন আমরা অবশ্যই তাঁকে চিনতে পারব। তখন তাদের মাঝে মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ আগমন করবেন এবং বলবেন: আমি তোমাদের রব। তারা বলবে, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব। আল্লাহ তা‘আলা তাদের ডাকবেন। আর জাহান্নামের ওপর একটি সেতুপথ (পুলসিরাত) স্থাপন করা হবে। রাসূলগণের মধ্যে আমিই সবার আগে আমার উম্মত নিয়ে এ পথ অতিক্রম করব। সেদিন রাসূলগণ ব্যতীত আর কেউ কথা বলবে না। আর রাসূলগণের কথা হবে: ‘ اللهم سلم سلم ’ (আল্লাহুম্মা সাল্লিম সাল্লিম), অর্থাৎ হে আল্লাহ! রক্ষা করুন, রক্ষা করুন। আর জাহান্নামে বাঁকা লোহার বহু শলাকা থাকবে; সেগুলো হবে সা‘দান কাঁটার মত। তোমরা কি সা‘দান কাঁটা দেখেছ? তারা বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। তিনি বললেন, সেগুলো দেখতে সা‘দান [সা‘দান চতুর্পাশ্বে কাঁটা বিশিষ্ট এক প্রকার গাছ, মরু অঞ্চলে জন্মে, যার কাঁটাগুলো বাঁকা হয়ে থাকে। এগুলো উটের খাদ্য।] কাঁটার মতই। তবে সেগুলো কত বড় হবে তা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। সে কাঁটা লোকের আমল অনুযায়ী তাদের তড়িৎ গতিতে ধরবে। তাদের কিছু লোক ধ্বংস হবে আমলের কারণে। আর কারোর পায়ে জখম হবে, কিছু লোক কাঁটায় আক্রান্ত হবে, তারপর নাজাত পেয়ে যাবে। জাহান্নামীদের থেকে যাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা রহমত করতে ইচ্ছা করবেন, তাদের ব্যাপারে ফিরিশতাগণকে নির্দেশ দিবেন যে, যারা আল্লাহর ইবাদত করত, তাদের যেন জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হয়। ফিরিশতাগণ তাদের বের করে আনবেন এবং সাজদাহর চিহ্ন দেখে তাঁরা তাদের চিনতে পারবেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের জন্য সাজদাহ’র চিহ্নগুলো মিটিয়ে দেওয়া হারাম করে দিয়েছেন। ফলে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে। কাজেই সাজদাহর চিহ্ন ছাড়া আগুন বনী আদমের সব কিছুই গ্রাস করে ফেলবে। অবশেষে, তাদেরকে অঙ্গারে পরিণত অবস্থায় জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। তাদের ওপর ‘আবে-হায়াত’ ঢেলে দেওয়া হবে, ফলে তারা স্রোতে বাহিত ফেনার ওপর গজিয়ে উঠা উদ্ভিদের মত সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে। এরপর আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের বিচার কাজ সমাপ্ত করবেন। কিন্তু একজন লোক জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে থেকে যাবে। তার মুখমণ্ডল তখনও জাহান্নামের দিকে ফিরানো থাকবে। জাহান্নামবাসীদের মধ্যে জান্নাতে প্রবেশকারী সেই শেষ ব্যক্তি। সে তখন নিবেদন করবে, হে আমার রব! জাহান্নাম থেকে আমার চেহারা ফিরিয়ে দিন, এর দূষিত হাওয়া আমাকে বিষিয়ে তুলছে, এর লেলিহান শিখা আমাকে যন্ত্রনা দিচ্ছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: তোমার নিবেদন গ্রহণ করা হলে, তুমি এ ছাড়া আর কিছু চাইবে না তো? সে বলবে, না, আপনার ইজ্জতের শপথ! সে তার ইচ্ছামত আল্লাহ তা‘আলাকে অঙ্গিকার ও প্রতিশ্রুতি দিবে। কাজেই আল্লাহ তা‘আলা তার চেহারাকে জাহান্নামের দিক থেকে ফিরিয়ে দিবেন। এরপর সে যখন জান্নাতের দিকে মুখ ফিরাবে, তখন সে জান্নাতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে পাবে। যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা সে চুপ করে থাকবে। তারপর সে বলবে, হে আমার রব! আপনি জান্নাতের দরজার কাছে পৌঁছিয়ে দিন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে বলবেন, তুমি পূর্বে যা চেয়েছিলে, তা ছাড়া আর কিছু চাইবে না বলে তুমি কি অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দাও নি? তখন সে বলবে, হে আমার রব! তোমার সৃষ্টির সবচেয়ে হতভাগ্য ব্যক্তি আমি হতে চাই না। আল্লাহ তাৎক্ষণিক বলবেন, তোমার এটি পুরণ করা হলে তুমি এ ছাড়া কিছু চাইবে না তো? সে বলবে, না, আপনার ইজ্জতের কসম! এছাড়া আর কিছুই চাইব না। এ ব্যাপারে সে তার ইচ্ছানুযায়ী অঙ্গিকার ও প্রতিশ্রুতি দিবে। সে যখন জান্নাতের দরজায় পৌঁছবে, তখন জান্নাতের অনাবিল সৌন্দর্য্য ও তার অভ্যন্তরীণ সুখ শান্তি ও আনন্দঘন পরিবেশ দেখতে পাবে। যতক্ষণ আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করবেন, সে চুপ করে থাকবে। এরপর সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও! তখন পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ বলবেন: হে আদম সন্তান, কি আশ্চর্য! তুমি কত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী! তুমি কি আমার সঙ্গে অঙ্গিকার কর নি এবং প্রতিশ্রুতি দাওনি যে, তোমাকে যা দেওয়া হয়েছে, তা ছাড়া আর কিছু চাইবে না? তখন সে বলবে, হে আমার রব! আপনার সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে হতভাগ্য আমাকে করবেন না। এতে আল্লাহ হেসে দিবেন। এরপর তাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিবেন এবং বলবেন, চাও। তখন সে চাইবে, এমনকি তার চাওয়ার আকাঙ্খা ফুরিয়ে যাবে। তখন পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ বলবেন: এটা চাও, ওটা চাও। এভাবে তার রব তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবেন। অবশেষে যখন তার আকাঙ্খা শেষ হয়ে যাবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: এ সবই তোমার, এর সাথে আরও সমপরিমাণ (তোমাকে দেওয়া হলো)।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: এ সবই তোমার, তার সাথে আরও দশগুণ (তোমাকে দেওয়া হল] আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুধু এ কথাটি স্মরণ রেখেছি যে, এ সবই তোমার এবং তারা সাথে সমপরিমাণ। আবূ সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি তাঁকে বলতে শুনেছি যে, এসব তোমার এবং এর সাথে আরও দশগুণ।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: সালাতের বিবরণ ( كتاب صفة الصلاة ), পরিচ্ছেদ: সাজদার ফযীলত ( باب فضل السجود ), হাদীস নং ৭৭৩।]

৪০. আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি কিয়ামতের দিন আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? তখন তিনি বলেন:

«هل تضارون في رؤية الشمس والقمر إذا كانت ضحوا ؟ . قلنا : لا , قال : « فإنكم لا تضارون في رؤية ربكم يومئذ إلا كما تضارون في رؤيتهما » . ثم قال : « ينادي مناد ليذهب كل قوم إلى ما كانوا يعبدون , فيذهب أصحاب الصليب مع صليبهم , وأصحاب الأوثان مع أوثانهم , وأصحاب كل آلهة مع آلهتهم حتى يبقى من كان يعبد الله من بر أو فاجر , وغبرات من أهل الكتاب , ثم يؤتى بجهنم تعرض كأنها سراب , فيقال لليهود : ما كنتم تعبدون ؟ قالوا : كنا نعبد عزير ابن الله , فيقال : كذبتم , لم يكن لله صاحبة ولا ولد , فما تريدون ؟ قالوا : نريد أن تسقينا , فيقال : اشربوا , فيتساقطون في جهنم , ثم يقال للنصارى : ما كنتم تعبدون ؟ فيقولون : كنا نعبد المسيح ابن الله , فيقال : كذبتم , لم يكن لله صاحبة ولا ولد , فما تريدون ؟ فيقولون : نريد أن تسقينا , فيقال : اشربوا , فيتساقطون حتى يبقى من كان يعبد الله من بر أو فاجر , فيقال لهم : ما يحبسكم وقد ذهب الناس ؟ فيقولون : فارقناهم ونحن أحوج منا إليه اليوم , وإنا سمعنا مناديا ينادي ليلحق كل قوم بما كانوا يعبدون , وإنما ننتظر ربنا , قال : فيأتيهم الجبار في صورة غير صورته التي رأوه فيها أول مرة , فيقول : أنا ربكم , فيقولون : أنت ربنا فلا يكلمه إلا الأنبياء , فيقول : هل بينكم وبينه آية تعرفونه ؟ فيقولون : الساق , فيكشف عن ساقه , فيسجد له كل مؤمن , ويبقى من كان يسجد لله رياء وسمعة , فيذهب كيما يسجد فيعود ظهره طبقا واحدا , ثم يؤتى بالجسر فيجعل بين ظهري جهنم » . قلنا : يا رسول الله وما الجسر ؟ قال : « مدحضة مزلة عليه خطاطيف وكلاليب وحسكة مفلطحة لها شوكة عقيفة تكون بنجد يقال لها : السعدان , المؤمن عليها كالطرف وكالبرق وكالريح وكأجاويد الخيل والركاب فناج مسلم , وناج مخدوش , ومكدوس في نار جهنم , حتى يمر آخرهم يسحب سحبا , فما أنتم بأشد لي مناشدة في الحق قد تبين لكم من المؤمن يومئذ للجبار , وإذا رأوا أنهم قد نجوا في إخوانهم يقولون : ربنا إخواننا كانوا يصلون معنا ويصومون معنا , ويعملون معنا , فيقول الله تعالى : اذهبوا فمن وجدتم في قلبه مثقال دينار من إيمان فأخرجوه , ويحرم الله صورهم على النار , فيأتونهم وبعضهم قد غاب في النار إلى قدمه , وإلى أنصاف ساقيه , فيخرجون من عرفوا , ثم يعودون فيقول : اذهبوا فمن وجدتم في قلبه مثقال نصف دينار فأخرجوه فيخرجون من عرفوا , ثم يعودون فيقول اذهبوا فمن وجدتم في قلبه مثقال ذرة من إيمان فأخرجوه فيخرجون من عرفوا » . قال أبو سعيد فإن لم تصدقوني فاقرؤوا : ﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَظۡلِمُ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖۖ وَإِن تَكُ حَسَنَةٗ يُضَٰعِفۡهَا﴾ [ النساء : ٤٠ ].

« فيشفع النبيون والملائكة والمؤمنون , فيقول الجبار : بقيت شفاعتي فيقبض قبضة من النار فيخرج أقواما قد امتحشوا , فليقون في نهر بأفواه الجنة , يقال له : ماء الحياة , فينبتون في حافتيه كما تنبت الحبة في حميل السيل , قد رأيتموها إلى جانب الصخرة , و إلى جانب الشجرة , فما كان إلى الشمس منها كان أخضر , وما كان منها إلى الظل كان أبيض , فيخرجون كأنهم اللؤلؤ فيجعل في رقابهم الخواتيم , فيدخلون الجنة , فيقول أهل الجنة : هؤلاء عتقاء الرحمن , أدخلهم الجنة بغير عمل عملوه , ولا خير قدموه , فيقال لهم : لكم ما رأيتم ومثله معه» .

“মেঘমুক্ত আকাশে তোমরা সূর্য ও চন্দ্র দেখতে কোনো বাধাপ্রাপ্ত হও কি? আমরা বললাম, না। তিনি বললেন: সেদিন তোমরাও তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে বাধাপ্রাপ্ত হবে না এতটুকু ব্যতীত, যতটুকু সূর্য ও চন্দ্র দেখার সময় পেয়ে থাক। সেদিন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবেন, যারা যে জিনিসের ইবাদত করতে, তারা সে জিনিসের কাছে গমন কর। এরপর যারা ক্রুশধারী ছিল, তারা যাবে তাদের ক্রুশের কাছে। মূর্তিপুজারীরা যাবে তাদের মূর্তির সাথে। সকলেই তাদের উপাস্যের সাথে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতকারীরা; নেককার ও গুনাহগার সবাই এবং আহলে কিতাবের কিছু সংখ্যক লোকও থাকবে। অতঃপর জাহান্নামকে আনা হবে। সেটি তখন মরীচিকার মত থাকবে। ইয়াহূদীদেরকে সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমরা কিসের ইবাদত করতে? উত্তরে তারা বলবে, আমরা আল্লাহর পুত্র ‘উযায়ের আলাইহিস সালামের ইবাদত করতাম। তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ কারণ, আল্লাহর কোনো স্ত্রীও নেই এবং নেই তাঁর কোনো সন্তান। এখন তোমরা কি চাও? তারা বলবে, আমরা চাই, আপনি আমাদেরকে পানি পান করান। তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা পানি পান কর। এরপর তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে থাকবে। তারপর নাসারাদেরকে হবে, তোমরা কিসের ইবাদত করতে? উত্তরে তারা বলে উঠবে, আমরা আল্লাহর পুত্র ‘মসীহের ইবাদত করতাম। তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ। কারণ, আল্লাহর কোনো স্ত্রীও ছিল না, সন্তানও ছিল না। এখন তোমরা কি চাও? তারা বলবে, আমাদের ইচ্ছা আপানি আমাদেরকে পানি পান করতে দিন। তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা পানি পান কর। এরপর তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে থাকবে। পরিশেষে অবশিষ্ট থাকবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতকারীগণ; তাদের নেককার ও গুনাহগার সবাই। তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হবে, কোনো জিনিস তোমাদেরকে আটকে রেখেছে? অথচ অন্যরা তো চলে গিয়েছে। তারা বলবে, আমরা তো সেদিন তাদের থেকে পৃথক ছিলাম, যেদিন আজকের অপেক্ষা বেশি প্রয়োজন ছিল। আমরা একজন ঘোষণাকারীকে ঘোষণাটি দিতে শুনেছি যে, যারা যাদের ইবাদত করত, তারা যেন তাদের সাথে যায়। আমরা প্রতীক্ষা করছি আমাদের প্রতিপালকের জন্য। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাদের কাছে আগমন করবেন। এবার তিনি সে আকৃতিতে আগমন করবেন না, যে আকৃতিতে তাঁকে প্রথমবার ঈমানদারগণ দেখেছিলেন এসে তিনি ঘোষণা দিবেন -আমি তোমাদের প্রতিপালক, সবাই তখন বলে উঠবে, আপনিই আমাদের প্রতিপালক। আর সেদিন নবীগণ ছাড়া তাঁর সঙ্গে কেউ কথা বলতে পারবে না। আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমাদের এবং তাঁর মাঝখানে পরিচায়ক কোনো আলামত আছে কি? তারা বলবেন, ‘পায়ের নলা’। তখন পায়ের নলা খুলে দেওয়া হবে। তা দেখে ঈমানদারগণ সবাই সাজদায় পতিত হবে। বাকি থাকবে তারা, যারা লোক দেখানো এবং লোক শুনানো সাজদাহ করেছিল। তবে তারা সাজদাহর মনোবৃত্তি নিয়ে সাজদাহ করার জন্য যাবে, কিন্তু তাদের মেরুদণ্ড একটি তক্তার ন্যায় শক্ত হয়ে যাবে। এমন সময় পুল (পুলসিরাত) স্থাপন করা হবে জাহান্নামের ওপর। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে পুলটি কি ধরনের হবে? তিনি বলরেন: দুর্গম পিচ্ছিল জায়গা হবে। এর ওপর আংটা ও হুক থাকবে, যা শক্ত ও চওড়া কাঁটা বিশিষ্ট হবে, যা নাজদ দেশের সা‘দান বৃক্ষের কাঁটার মত হবে। সে পুলের ওপর দিয়ে ঈমানদারগণের কেউ অতিক্রম করবে চোখের পলকের মতো, কেউ বিজলীর মতো, কেউ বা বাতাসের মতো, আবার কেউ দ্রুতগামী ঘোড়া ও সাওয়ারের মতো। তবে মুক্তিপ্রাপ্তগণ কেউ নিরাপদে চলে আসবে, আবার কেউ জাহান্নামের আগুনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। একেবারে শেষে পার হবে যে ব্যক্তিটি, সে হেঁচড়িয়ে কোনো রকমে পার হয়ে আসবে। এখন তোমরা হকের ব্যাপারে আমার অপেক্ষা বেশি কঠোর নও; মহাপরক্রমশালী আল্লাহর সমীপে মুমিনদের অবস্থাটি তোমাদের নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। যখন তারা (মুমিনগণ) দেখবে যে, তাদের ভাইদের মধ্যে তারা মুক্তি পেয়ে গেছে, তখন তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমাদের সেসব ভাই কোথায়, যারা আমাদের সাথে সালাত আদায় করত, সাওম (রোযা) পালন করত এবং আমাদের সাথে ভালো কাজ করত? তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাও, যাদের অন্তরে এক দিনার পরিমাণ ঈমান পাবে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আস; আল্লাহ তা‘আলা তাদের চেহারাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। এদের কারও কারও দু‘পা ও দু‘পায়ের নলার অধিক পর্যন্ত জাহান্নামের মধ্যে হারিয়ে যাবে। তারা যাদেরকে চিনতে পারবে, তাদেরকে বের করে নিয়ে আসবে। তারপর এরা আবার প্রত্যাবর্তন করবে। আল্লাহ আবার তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাও, যাদের অন্তরে অর্ধ দিনার পরিমাণ ঈমান পাবে, তাদেরকে বের করে নিয়ে আসবে। তারা গিয়ে তাদেরকেই বের করে নিয়ে আসবে, যাদেরকে তারা চিনতে পারবে। তারপর এরা আবার প্রত্যাবর্তন করবে। আল্লাহ আবার তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাও, যাদের অন্তরে অণু পরিমাণ ঈমান পাবে, তাদেরকে বের করে নিয়ে আসবে। বর্ণনাকারী আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না কর, তাহলে আল্লাহর এই বাণীটি পড়: আল্লাহ অণু পরিমাণও যুলুম করেন না এবং অণু পরিমাণ পুণ্য কাজ হলেও আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ করেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪০]

তারপর নবীসাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ফিরিশতা ও মুমিনগণ সুপারিশ করবেন। তখন মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ বলবেন, এখন একমাত্র আমার শাফা‘আতই বাকি রয়েছে। তিনি জাহান্নাম থেকে একমুষ্টি ভরে এমন কতগুলো কাওম (সম্প্রদায়)-কে বের করবেন, যারা জ্বলে পুরে দগ্ধ হয়ে গিয়েছে। তারপর তাদেরকে জান্নাতের সামনে অবস্থিত ‘হায়াত’ নামক নহরে ঢালা হবে। তারা সে নহরের দু’পার্শ্বে এমনভাবে উদ্ভূত হবে, যেমন পাথর এবং গাছের কিনারে বহন করে আনা আবর্জনায় বীজ থেকে তৃণ উদ্ভূত হয়। তন্মধ্যে সূর্যের আলোর অংশের গাছগুলো সাধারণত সবুজ হয়, ছায়ার অংশেরগুলো সাদা হয়। তারা সেখান থেকে মুক্তার দানার মত বের হবে। তাদের গর্দানে মোহর লাগানো হবে। জান্নাতে যখন তারা প্রবেশ করবে, তখন অপরাপর জান্নাতবাসীরা বলবেন, এরা হলেন রহমান কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত, যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কোনো ভালো আমল কিংবা কল্যাণমূলক কাজ ছাড়া জান্নাতে দাখিল করেছেন। তখন তাদেরকে ঘোষণা দেওয়া হবে: তোমরা যা দেখেছ, সবই তো তোমাদের, এর সাথে আরও সমপরিমাণ দেওয়া হলো তোমাদেরকে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: আল্লাহর একত্ববাদ ( كتاب التوحيد ), পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “সেদিন কোনো কোনো মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।” باب قول الله تعالى ﴿ وُجُوهٞ يَوۡمَئِذٖ نَّاضِرَةٌ ٢٢ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٞ ٢٣﴾ [ القيامة : ٢٢، ٢٣ ] , হাদীস নং ৭০০১।]

৪১. আবূ সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أَمَّا أَهْلُ النَّارِ الَّذِينَ هُمْ أَهْلُهَا فَإِنَّهُمْ لاَ يَمُوتُونَ فِيهَا وَلاَ يَحْيَوْنَ وَلَكِنْ نَاسٌ أَصَابَتْهُمُ النَّارُ بِذُنُوبِهِمْ أَوْ قَالَ بِخَطَايَاهُمْ فَأَمَاتَهُمْ إِمَاتَةً حَتَّى إِذَا كَانُوا فَحْمًا أُذِنَ بِالشَّفَاعَةِ فَجِىءَ بِهِمْ ضَبَائِرَ ضَبَائِرَ فَبُثُّوا عَلَى أَنْهَارِ الْجَنَّةِ ثُمَّ قِيلَ يَا أَهْلَ الْجَنَّةِ أَفِيضُوا عَلَيْهِمْ . فَيَنْبُتُونَ نَبَاتَ الْحِبَّةِ تَكُونُ فِى حَمِيلِ السَّيْلِ» . فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ كَأَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ كَانَ بِالْبَادِيَةِ» .

“জাহান্নামীদের মধ্যে যারা প্রকৃতপক্ষে জাহান্নামী, তাদের মৃত্যুও ঘটবে না এবং তারা পুনর্জীবিতও হবে না। তবে তন্মধ্যে তোমাদের এমন কতিপয় লোকও থাকবে, যারা গুনাহের দায়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এরপর আল্লাহ তা‘আলা (তাদের ওপর পতিত আযাবের নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে) তাদেরকে কিছুকাল নির্জীব করে রেখে দিবেন। অবশেষে তারা পুড়ে সম্পূর্ণ অঙ্গার হয়ে যাবে। এ সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাফা‘আতের অনুমতি হবে। তখন এদেরকে দলে দলে নিয়ে আসা হবে এবং জান্নাতের নহরগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। পরে বলা হবে, হে জান্নাতীরা তোমরা এদের গায়ে পানি ঢেলে দাও! ফলে স্রোতবাহিত পলিতে গজিয়ে ওঠা শস্যদানার মতো তারা সজিব হয়ে উঠবে। উপস্থিতদের মধ্যে একজন বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন এককালে গাঁয়ে অবস্থান করেছিলেন।” [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: শাফা‘আত ও তাওহীদবাদীদের জাহান্নাম থেকে উদ্ধার লাভের প্রমাণ ( باب إِثْبَاتِ الشَّفَاعَةِ وَإِخْرَاجِ الْمُوَحِّدِينَ مِنَ النَّارِ ), হাদীস নং ৪৭৭।]

৪২. জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إذا ميز أهل الجنة وأهل النار , فدخل أهل الجنة الجنة , وأهل النار النار , قامت الرسل فشفعوا , فيقول : انطلقوا أو اذهبوا فمن عرفتم فأخرجوه فيخرجونهم قد امتحشوا فيلقونهم في نهر أو على نهر , يقال له : الحياة , قال : فتسقط محاشهم على حافة النهر , ويخرجون بيضا مثل الثعارير , ثم يشفعون فيقول : اذهبوا أو انطلقوا فمن وجدتم في قلبه مثقال قيراط من إيمان فأخرجوهم , قال فيخرجون بشرا ثم يشفعون فيقول اذهبوا أو انطلقوا فمن وجدتم في قلبه مثقال حبة من خردلة من إيمان فأخرجوه , ثم يقول الله عز و جل : أنا الآن أخرج بعلمي ورحمتي , قال : فيخرج أضعاف ما أخرجوا وأضعافه , فيكتب في رقابهم عتقاء الله عز و جل ثم يدخلون الجنة فيسمون فيها الجهنميين » .

“যখন জান্নাতবাসীগণ ও জাহান্নামবাসীগণ পৃথক হয়ে যাবে, তখন জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং জাহান্নামবাসীগণ জাহান্নামে প্রবেশ করবে, আর রাসূলগণ দাঁড়িয়ে যাবে এবং সুপারিশ করবে; অতঃপর তিনি বলবেন: তোমরা যাও, অতঃপর তোমরা যাকে চিনতে পার, তাকে বের করে নিয়ে আস; অতঃপর তাঁরা তাদেরকে বের করে নিয়ে আসবে এমতাবস্থায় যে, তারা পুড়ে গেছে; অতঃপর তাঁরা তাদেরকে ঝর্ণা বা নদীতে নিক্ষেপ করবে, যাকে ‘আবে হায়াত’ বলা হয়; তিনি বলেন: নদীর কিনারে তাদের (দেহের) ভস্মীভূত বস্তু পতিত হবে এবং তারা রসুনের মত সাদা হয়ে বের হয়ে আসবে; অতঃপর তাঁরা আবার সুপারিশ করবে, তারপর তিনি বলবেন: তোমরা যাও, তারপর তোমরা যার অন্তরে এক কিরাত [কিরাত ( قيراط ) হলো ওজনবিশেষ, কোন বস্তুর এক-চব্বিশাংশ, কারো মতে দিরহামের এক-দ্বাদশাংশ, এক-দশমাংশ দিনারের অর্ধেক, আঙুলের প্রশস্ততা পরিমাণ। -আরবী-বংলা অভিধান, ২য় খণ্ড, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ।] পরিমাণ ঈমান পাও, তাদেরকে বের করে নিয়ে আস; তিনি বলেন: অতঃপর তাঁরা কিছু লোককে বের করে আনবে; অতঃপর তাঁরা আবার সুপারিশ করবে, তারপর তিনি বলবেন: তোমরা যাও, তারপর তোমরা যার অন্তরের মধ্যে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান পাও, তাদেরকে বের করে নিয়ে আস। তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: এখন আমি আমার ইলম (জ্ঞান) ও রহমতের দ্বারা বের করে আনব, তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: অতঃপর তিনি তাঁরা যা বের করে আনবে, তার কয়েকগুণ পরিমাণ বের করে নিয়ে আসবেন; অতঃপর তাদের ঘাড়ে লিখে দেওয়া হবে ‘আল্লাহ তা‘আলার আযাদকৃত’; অতঃপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে; তারপর তাতে তাদেরকে ‘জাহান্নামী’ বলে আখ্যায়িত করা হবে।” [আহমদ (৩/৩২৫); এটি হাসান হাদীস।]

* ‘ইমরান ইবন হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يَخْرُج قَوْم مِنْ النَّار بِشَفَاعَةِ مُحَمَّد . فَيَدْخُلُونَ الْجَنَّة , وَيُسَمَّوْنَ الْجَهَنَّمِيِّينَ» .

“একদল লোককে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফা‘আতে (সুপারিশে) জাহান্নাম থেকে বের করা হবে, অতঃপর তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তাদেরকে জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত করা হবে।” [সহীহ বুখারী, রিকাক (কোমল) অধ্যায় ( كتاب الرقاق ), পরিচ্ছেদ: জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা ( باب صفة الجنة والنار ), হাদীস নং ৬১৯৮।]

৪৩. হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«يخرج الله قوما منتنين قد محشتهم النار بشفاعة الشافعين فيدخلهم الجنة فيسمون الجهنميون قال حجاج : الجهنميين » .

“আল্লাহ তা‘আলা আগুনে পোড়ানো দুর্গন্ধপূর্ণ একদল মানুষকে সুপারিশকারীগণের সুপারিশের কারণে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন, তারপর তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; ফলে তাদেরকে ‘জাহান্নামী’ বলে আখ্যায়িত করা হবে; বর্ণনাকারী হাজ্জাজ الجهنميون এর পরিবর্তে الجهنميين বলেছেন”। [আহমদ (৫/৪০২); ইবন খুযাইমা, পৃ. ২৭৫; তার সনদটি সহীহ; হাইছামী ও ইবন হাজার তাকে বিশুদ্ধ বলেছেন।]

৪৪. হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:

«يقول إبراهيم يوم القيامة : يا رباه فيقول الرب جل وعلا : يا لبيكاه فيقول إبراهيم : يا رب حرقت بني فيقول : أخرجوا من النار من كان في قلبه ذرة أو شعيرة من إيمان » .

“ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কিয়ামতের দিনে বলবেন: হে রব! অতঃপর মহান রব বলবেন: হে আমি হাযির; তারপর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বলবেন: হে আমার রব! আপনি আমার সন্তানদেরকে আগুনে পোড়াচ্ছেন; তারপর তিনি বলবেন: যার অন্তরে অণু অথবা যবের দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে নিয়ে আস।” [ইবন হিব্বান, ‘আস-সহীহ, পৃ. ৬৪৫; তার সনদটি সহীহ।]

১৭
মুমিনগণ কর্তৃক শাফা‘আত প্রসঙ্গে
৪৫. আবূ সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إن من أمتي من يشفع للفئام , ومنهم من يشفع للقبيلة , ومنهم من يشفع للعصبة , ومنهم من يشفع للرجل حتى يدخلوا الجنة » .

“আমার উম্মতের মধ্যে কেউ কেউ একদল লোকের জন্য সুপারিশ করবে; আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক গোত্রের জন্য সুপারিশ করবে, আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ সগোত্রীয় লোকদের জন্য সুপারিশ করবে; আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে, শেষ পর্যন্ত তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [তিরমিযী (৪/৪৬); আহমদ (৩/২০ এবং ৬৩); আর হাদীসটি অন্য হাদীসের সমর্থনের কারণে হাসান।]

৪৬. আবদুল্লাহ ইবন কায়েস রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হারেস ইবন আকইয়াশ রহ.–কে হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি যে, আবূ বারযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«ان من أمتي لمن يشفع لأكثر من ربيعة ومضر , وان من أمتي لمن يعظم للنار حتى يكون ركنا من أركانها » .

“নিশ্চয় আমার উম্মতের মধ্যে এমন ব্যক্তি রয়েছে, যে ব্যক্তি ‘রবী‘আ’ ও ‘মুদার’ গোত্রের চেয়ে বেশি সংখ্যক লোকের জন্য সুপারিশ করবে, আর আমার উম্মতের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছে, যে জাহান্নামে এত বড় হবে যে, শেষ পর্যন্ত সে তার একটি বিশাল অংশ দখল করে থাকবে।” [আহমদ (৪/২১২) (তবে হাদীসের সনদ দুর্বল, যদিও এর প্রথম অংশের জন্য আরও শাহেদ পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ দুর্বল। [সম্পাদক])]

৪৭. আবদুল্লাহ ইবন কায়েস রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হারেস ইবন আকইয়াশ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আবূ বারযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র নিকট কোনো এক রাতে উপস্থিত ছিলাম, সেই রাতে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«ما من مسلمين يموت لهما أربعة أفراط الا ادخلهما الله الجنة بفضل رحمته » . قالوا يا رسول الله : وثلاثة ؟ قال : « وثلاثة » قالوا : واثنان ؟ « وان من أمتي لمن يدخل الجنة بشفاعته مثل مضر » قال : واثنان , قال : « وان من أمتي لمن يعظم للنار حتى يكون أحد زواياها » .

“যে দুই মুসলিমেরই [উদ্দেশ্য, মুসলিম স্বামী-স্ত্রী। [সম্পাদক]] চারটি সন্তান মারা যাবে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দয়ার বরকতে তাদের উভয়কে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহ রাসূল! তিনজন মারা গেলে? তিনি বললেন: তিনজন মারা গেলেও (তিনি তাদের উভয়কে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন); সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহ রাসূল! দুইজন মারা গেলে? আর আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যার সুপারিশের দ্বারা ‘মুদার’ গোত্রের সমপরিমাণ লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি বললেন: দুইজন মারা গেলেও (তিনি তাদের উভয়কে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন); তিনি বলেন: আর আমার উম্মতের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছে, যে জাহান্নামের এত বড় ও প্রকাণ্ড হবে, শেষ পর্যন্ত সে সেটার একটি কোণ পূর্ণ করে রাখবে”। [আহমদ (৫/৩১২); ইবন খুযাইমা, পৃ. ৩১৩; ইবন মাজাহ (২/১৪৪৬); তাবারানী, আল-কাবীর (৩/৩০১); হাকেম (১/৭১); তিনি (হাকেম) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, আর ইমাম যাহাবীও একই কথা বলেছেন; আর হাফেজ ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে হারেস ইবন আকইয়াশের জীবনী’তে বলেছেন: তার সনদ বিশুদ্ধ।]

৪৮. আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:

«ليدخلن الجنة بشفاعة رجل ليس بنبي مثل الحيين أو مثل أحد الحيين ربيعة ومضر , فقال رجل : يا رسول الله أو ما ربيعة من مضر ؟ فقال : «إنما أقول ما أقول» .

“নবী নয় এমন এক ব্যক্তির সুপারিশে ‘রবী‘য়া’ ও ‘মুদার’ গোত্রের সমপরিমাণ অথবা কোনো এক গোত্রের সামান সংখ্যক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে; অতঃপর জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল: হে আল্লাহর রাসূল! ‘রবী‘য়া’ গোত্র কি ‘মুদার’ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত নয় [আসলে রবী‘আ কখনও মুদার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, তারা দু’জন নাযার ইবন মা‘আদ ইবন আদনান এর ছেলে। দু’ ছেলে থেকে দু’টি গোত্রের উৎপত্তি হয়েছে। তাই এ প্রশ্ন বাহুল্য। এ জন্যই কোনো কোনো বর্ণনাকারী এ শেষাংশটুকু বর্ণনা করেন নি। [সম্পাদক]]? জবাবে তিনি বললেন: আমি যা বলার তা বলেছি”। [আহমদ (৫/২৫৬); ইবন খুযাইমা, পৃ. ৩১৩; তাবারানী (৮/১৬৯); আর হাদীসটি হাসান পর্যায়ের, যেমনটি হাফেয ইরাকী বলেছেন, ফয়যুল কাদির (৪/১৩০)। (তবে হাদীসের শেষাংশ দুর্বল। [সম্পাদক])]

৪৯. আবদুল্লাহ ইবন শাকিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি ‘ইলিয়া’ নামক স্থানে একদল লোকের নিকট বসলাম, আর আমি হলাম তাদের চতুর্থ ব্যক্তি, সুতরাং তাদের মধ্যকার একজন বলল, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«ليدخلن الجنة بشفاعة رجل من أمتي أكثر من بني تميم , قلنا : سواك يا رسول الله؟ قال : سواي» .

“আমার উম্মতের এক ব্যক্তির সুপারিশে বনী তামীম গোত্রের চেয়ে বেশি সংখ্যক লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে; আমরা বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ছাড়াই? তিনি বললেন: আমি ছাড়াই।” [আহমদ (৩/৪৬৯) এবং (৫/৩৬৬); তিরমিযী; ইবন মাজাহ (২/১৪৪৪); দারেমী (২/৩২৮); হাকেম হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন (১/৭০); হাদীসটি ইমাম মুসলিমের শর্তের আলোকে গ্রহণযোগ্য। (হাদীসে বর্ণিত, আমি ছাড়াই এর অর্থ হচ্ছে, সে ব্যক্তিটি আমি নই, আমার উম্মতের একজন লোক। [সম্পাদক])]

৫০. যিয়াদ ইবন ‘আলাকা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি জারির ইবন আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে মুগীরা ইবন শো‘বা’র মৃত্যুর দিন (মিম্বরে) দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে শুনেছি, ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন:

«عليكم باتقاء الله عز و جل والوقار والسكينة حتى يأتيكم أمير , فإنما يأتيكم الآن , ثم قال : اشفعوا لأميركم فإنه كان يحب العفو , وقال : أما بعد فإني أتيت رسول الله صلى الله عليه و سلم فقلت : أبايعك على الإسلام فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم واشترط على النصح لكل مسلم , فبايعته على هذا , ورب هذا المسجد انى لكم لناصح جميعا , ثم استغفر ونزل» .

“তোমরা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সদা সচেতন থাক এবং নতুন কোনো আমীর না আসা পর্যন্ত শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখ; এখনই তোমাদের আমীর আসবেন। এরপর তিনি (জারীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন: তোমাদের আমীরের জন্য সুপারিশ কর (ক্ষমা প্রার্থনা কর)। কারণ, তিনি ক্ষমা করাকে ভালোবাসতেন। তারপর বললেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললাম: আমি আপনার কাছে ইসলামের বায়‘আত গ্রহণ করতে চাই। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন... এবং তিনি (অন্যান্য বিষয়ের সাথে) আমার ওপর শর্ত আরোপ করলেন: আর সকল মুসলিমের কল্যাণ কামনা করবে; অতঃপর আমি তাঁর কাছে এই শর্তের ওপর বায়‘আত গ্রহণ করলাম। এই মাসজিদের রবের কসম! আমি তোমাদের সকলের কল্যাণকামী; অতঃপর তিনি (আল্লাহর কাছে) মাগফিরাত কামনা করলেন এবং (মিম্বর থেকে) নেমে গেলেন।” [আহমদ (৪/৩৫৭); হাদীসটির সনদ বিশুদ্ধ।]

হাদিসের বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাকারী; তার মূলবিষয়টি সহীহাইন তথা বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে; তবে বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে রয়েছে তিনি বলেন: استعفوا لأميركم অর্থাৎ তোমরা আমীরের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর এটা তাঁর কথা: «فإنه كان يحب العفو» (কারণ, তিনি ক্ষমা করাকে ভালোবাসতেন) এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কেননা জাযা বা জওয়াবটি আমলের শ্রেণিভুক্ত। হাফেয ইবন হাজার (আল-ফাতহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২৯) বলেন: তাঁর কথা: «استعفوا لأميركم» (তোমরা আমীরের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর), আর অধিকাংশ বর্ণনার মধ্যে অনুরূপ রয়েছে, আর ইবন ‘আসাকীরের বর্ণনার মধ্যে রয়েছে: «استغفروا» (তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর), আর এটাই ‘আল-মুসতাখরাজ’-এর মধ্যে ইসমা‘ঈলীর বর্ণনা।

৫১. আবূ সা‘ঈদ আল-আনমারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إن ربي وعدني أن يدخل الجنة من أمتي سبعين ألفا بغير حساب , ويشفع كل ألف لسبعين ألفا , ثم يحثي ربي ثلاث حثيات بكفيه » . كذا قال قيس : فقلت لأبي سعيد : أنت سمعت هذا من رسول الله صلى الله عليه وسلم ؟ قال : نعم , بأذني ووعاه قلبي , قال أبو سعيد : قال يعني رسول الله صلى الله عليه وسلم : «وذلك إن شاء الله يستوعب مهاجري أمتي ويوفي الله عز وجل بقيته من أعرابنا» .

“নিশ্চয় আমার রব আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমার উম্মতের মধ্য থেকে সত্তর হাজার উম্মত বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর প্রতি হাজার উম্মত সুপারিশ করবে আরও সত্তর হাজার উম্মতের জন্য; অতঃপর আমার প্রতিপালক তাঁর দুই হাতের তালু দ্বারা তিন অঞ্জলি জান্নাতে প্রবেশ করবেন। কায়েস অনুরূপ বলেছেন; অতঃপর আমি আবূ সা‘ঈদকে বললাম: আপনি কি এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছেন? জবাবে সে বলল: হ্যাঁ, আমি আমার নিজ কানে শুনেছি এবং আমার অন্তর তা সংরক্ষণ করেছে; আবূ সা‘ঈদ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আর এটা আল্লাহ চায় তো তিনি আমার উম্মতের (সকল) মুহাজিরকে শামিল করবেন এবং আল্লাহ তার বাকিটা পূর্ণ করবেন আমাদের বেদুঈনদের মধ্য থেকে।” [ইবন আবি ‘আসেম, ‘আস-সুন্নাহ’ (২/৩৮৫); তাবারানী; আবূ আহমদ হাকেম; আর হাফেয ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থের মধ্যে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন।]

(আবূ সা‘ঈদ বলেন: অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তার হিসাব হলো এবং তা চল্লিশ কোটি নব্বই হাজারে পৌঁছালো)।

৫২. ইবন মুহাইরিয থেকে বর্ণিত, তিনি সুনাবিহী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ‘উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সুনাবিহী রহ.) বলেন:

«دَخَلْتُ عَلَيْهِ وَهُوَ فِى الْمَوْتِ فَبَكَيْتُ فَقَالَ : مَهْلاً لِمَ تَبْكِى ؟ فَوَاللَّهِ لَئِنِ اسْتُشْهِدْتُ لأَشْهَدَنَّ لَكَ , وَلَئِنْ شُفِّعْتُ لأَشْفَعَنَّ لَكَ , وَلَئِنِ اسْتَطَعْتُ لأَنْفَعَنَّكَ , ثُمَّ قَالَ : وَاللَّهِ مَا مِنْ حَدِيثٍ سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَكُمْ فِيهِ خَيْرٌ إِلاَّ حَدَّثْتُكُمُوهُ إِلاَّ حَدِيثًا وَاحِدًا , وَسَوْفَ أُحَدِّثُكُمُوهُ الْيَوْمَ وَقَدْ أُحِيطَ بِنَفْسِى , سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : « مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ النَّارَ » .

“আমি উবাদার কাছে গেলাম, তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় ছিলেন, আমি কেঁদে ফেললাম। তিনি আমাকে বললেন, চুপ থাক, কাঁদছ কেন? আল্লাহর শপথ! যদি আমাকে সাক্ষী বানানো হয়, তাহলে আমি তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দেব; যদি আমাকে সুপারিশকারী বানানো হয়, তাহলে অবশ্যই আমি তোমার জন্য সুপারিশ করব এবং যদি আমার সাধ্য থাকে, তবে আমি তোমার উপকার করব। তারপর উবাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আল্লাহ শপথ! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শ্রুত একটি ছাড়া সব হাদীসই তোমাদেরকে শুনিয়েছি, যাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। তোমাদের কাছে সে হাদীসটি আজ বর্ণনা করছি, কেননা আজ আমি মৃত্যুর দুয়ারে উপস্থিত। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন।” [সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তি ঈমানসহ তার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং জাহান্নাম তার জন্য হারাম হয়ে যাবে ( باب مَنْ لَقِىَ اللَّهَ بِالإِيمَانِ وَهُوَ غَيْرُ شَاكٍّ فِيهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَحَرُمَ عَلَى النَّارِ ), হাদীস নং ১৫১; তিরমিযী (৪/১৩২); আহমদ (৬/৩১৮)।]

১৮
ইমাম ইবরাহীম আল-হারবী’র বিস্ময়কর কাহিনী
মুহাম্মাদ ইবন খালফ ওকী বলেন: ইবরাহীম আল-হারবী’র এক ছেলে ছিল, আর তার বয়স ছিল এগার বছর, সে আল-কুরআন হিফয (মুখস্থ) করেছে এবং তিনি তাকে ইলমুল ফিকহের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি (মুহাম্মাদ ইবন খালফ) বলেন: সে (ছেলেটি) মারা গেল, তারপর আমি তাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য আসলাম, তিনি বলেন: তারপর তিনি (ইবরাহীম আল-হারবী) আমাকে বললেন: আমি আমার এই ছেলের মৃত্যু কামনা করেছিলাম, তিনি বললেন: আমি বললাম: হে আবূ ইসহাক (ইসহাকের পিতা) ! আপনি দুনিয়া শ্রেষ্ঠ আলেম, আপনি একটি সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয় শিশুর ব্যাপারে এই কথা বলছেন, অথচ আপনি তাকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা দিয়েছেন!! তিনি বললেন: হ্যাঁ, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, মনে হচ্ছে যেন কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে এবং কতগুলো শিশু, যাদের হাতে মূল্যবান পাত্র, তাতে রয়েছে পানি, যা তারা মানুষকে পান করাচ্ছে, আর দিনটি মনে হচ্ছিল প্রচণ্ড গরমের দিন; অতঃপর আমি তাদের একজনকে বললাম, এই পানি থেকে আমাকে পান করাও; তিনি বলেন: তখন সে আমার দিকে তাকাল এবং বলল: আপনি আমার পিতা নন; তখন আমি বললাম: তোমরা কারা? তখন সে বলল: আমরা ঐসব শিশু, যারা দুনিয়ার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেছি এবং আমাদের পিতাদেরকে পিছনে রেখে এসেছি, আমরা তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানাবো, তারপর তাদেরকে পানি পান করাব। তিনি বলেন: এ জন্যই আমি তার মৃত্যু কামনা করেছি। (ত্ববাকাতে হানাবেলা, ১/৮৯, ৯০) [এটি একটি ব্যক্তিগত ইজতেহাদ। এর উপর ভিত্তি করে যেন কেউ তার সন্তানদের মৃত্যু কামনা না করে। কারণ, সন্তানরা আল্লাহর নে‘আমত। তারা কোন অবস্থায় বেশি কাজে আসবে সেটা আল্লাহ ভালো জানেন। হয়ত: এমন হবে যে, সে সন্তান বড় হয়ে জগদ্বিখ্যাত আলেম হবে ও ভালো কাজ করবে এবং তার পিতা-মাতা তার কর্মকাণ্ডকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কবরে বসে পেতে থাকবে। [সম্পাদক]]

৫৩. সাবেত আল-বুনানী থেকে বর্ণিত, তিনি আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إن الرجل يشفع للرجلين وللثلاثة , والرجل للرجل» .

“নিশ্চয় এক ব্যক্তি দুই ব্যক্তি ও তিন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে, আর সুপারিশ করতে পারবে এক ব্যক্তি কমপক্ষে এক ব্যক্তির জন্য।” [ইবন খুযাইমা, পৃ. ৩১৫; তার সনদ সহীহ।]

৫৪. নিমরান ইবন ‘উতবা আয-যিমারী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন:

«دَخَلْنَا عَلَى أُمِّ الدَّرْدَاءِ وَنَحْنُ أَيْتَامٌ فَقَالَتْ : أَبْشِرُوا فَإِنِّى سَمِعْتُ أَبَا الدَّرْدَاءِ يَقُولُ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : « يُشَفَّعُ الشَّهِيدُ فِى سَبْعِينَ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ » .

“আমরা ইয়াতীম অবস্থায় উম্মু দারদার নিকট হাযির হলাম, তখন তিনি বললেন: তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। কারণ, আমি আবূ দারদাকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: শহীদ ব্যক্তি তার পরিবার-পরিজনের মধ্য থেকে সত্তর জনের ব্যাপারে সুপারিশ করবে।” [আবূ দাউদ (৩/৩৪); ইবন হিব্বান, পৃ. ৩৮৮; বায়হাকী (৯/১৬৪); আলবানী তার ‘সহীহ আল-জামে’ ( صحيح الجامع ) –এর মধ্যে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন, হাদীস নং ৪৯৭৯]

৫৫. মিকদাম ইবন মা‘দিইয়াকরাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« للشهيد عند الله ست خصال : يغفر له في أول دفعة , ويرى مقعده من الجنة , ويجار من عذاب القبر , ويأمن من الفزع الأكبر , ويوضع على رأسه تاج الوقار , الياقوتة منها خير من الدنيا وما فيها , ويزوج اثنتين وسبعين زوجة من الحور العين , ويشفع في سبعين من أقاربه » .

“আল্লাহর নিকট ছয়টি শহীদের বৈশিষ্ট্য রয়েছে: প্রথমেই থাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে; সে (দুনিয়াতেই) তার জান্নাতের আসনটি দেখতে পাবে; তাকে কবরের আযাব থেকে মুক্তি দেওয়া হবে; মহাভীতি [‘মহাভীতি’ বলে শিঙ্গার ফুঁৎকার বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]] থেকে নিরাপদে থাকবে; তার মাথায় মর্যাদার মুকুট পরানো হবে, যার একটি ইয়াকুত পাথর দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম; তাকে ডাগর চক্ষুবিশিষ্টা হূরদের মধ্য থেকে বাহাত্তর জন স্ত্রী প্রদান করা হবে এবং সে তার নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে সত্তর জনের ব্যাপারে সুপারিশ করবে।” [তিরমিযী (৩/১০৬); ইবন মাযাহ (২/৯৩৫); আহমদ (৩/১৩১); আল-আজরী ফী আশ-শরী‘য়ত ( الاجري في الشريعة ), পৃ. ৩৪৯; আর হাদীসটি হাসান।]

৫৬. আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«كنت جالسا مع النبي صلى الله عليه وسلم , فذكر الحديث في فضل الحج و فيه : «إن الله يقول لهم عند وقوفهم بعرفة : أفيضوا عبادي مغفورا لكم , ولمن شفعتم» .

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বসা ছিলাম; তারপর তিনি হাজ্জের ফযিলত প্রসঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাতে ছিল: নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আরাফাতের ময়দানে তাদের অবস্থানের সময় তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলবেন: আমার বান্দাদেরকে ক্ষমাকৃত অবস্থায় আরাফাত থেকে নিয়ে যাও, আর তাদের জন্যও যাদের জন্য তোমরা সুপারিশ করবে।” [আল-বাযার, কাশফুল আসতার (২/৮); হাইছামী, আল-মাজমা (৪/২৭৫); আল-বাযার বর্ণনা করেন যে, হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সকলেই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।]

১৯
সন্তান কর্তৃক তাদের পিতা-মাতার’র জন্য সুপারিশ
৫৭. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«ان الله عز و جل ليرفع الدرجة للعبد الصالح في الجنة فيقول : يا رب أنى لي هذه ؟ فيقول : باستغفار ولدك لك» .

“আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে নেক বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি বা সুউচ্চ করে দিবেন। ফলে সে বলবে: হে আমার রব! আমার জন্য এটা কীভাবে হল? তখন তিনি বলবেন: তোমার সন্তান কর্তৃক তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার কারণে।” [আহমদ (২/৫০৯); তার সনদ সহীহ।]

৫৮. আবূ হাসসান রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

« قُلْتُ لأَبِى هُرَيْرَةَ : إِنَّهُ قَدْ مَاتَ لِىَ ابْنَانِ , فَمَا أَنْتَ مُحَدِّثِى عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِحَدِيثٍ تُطَيِّبُ بِهِ أَنْفُسَنَا عَنْ مَوْتَانَا ؟ قَالَ : قَالَ نَعَمْ , « صِغَارُهُمْ دَعَامِيصُ الْجَنَّةِ يَتَلَقَّى أَحَدُهُمْ أَبَاهُ-أَوْ قَال : َ أَبَوَيْهِ-فَيَأْخُذُ بِثَوْبِهِ أَوْ قَالَ : بِيَدِهِ كَمَا آخُذُ أَنَا بِصَنِفَةِ ثَوْبِكَ هَذَا , فَلاَ يَتَنَاهَى-أَوْ قَالَ فَلاَ يَنْتَهِى-حَتَّى يُدْخِلَهُ اللَّهُ وَأَبَاهُ الْجَنَّةَ » .

“আমি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কে বললাম: আমার দু’টি ছেলে মারা গেছে; আপনি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন কোনো হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার দ্বারা আমাদের মৃতদের ব্যাপারে আমাদের আত্মা আনন্দ বা প্রশান্তি অনুভব করবে? সে বলল: তিনি বলেন: হ্যাঁ, তাদের ছোট সন্তানগণ জান্নাতের অধিবাসী, তাদের কেউ তার পিতার সাথে সাক্ষাৎ করবে অথবা তিনি বলেছেন: তার পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাৎ করবে, অতঃপর সে তার কাপড়ে ধরবে অথবা তিনি বলেছেন: তার হাতে ধরবে, যেমনিভাবে আমি তোমার এই কাপড়ের এক প্রান্তে ধরলাম; অতঃপর সে নিবৃত হবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তা‘আলা তাকে ও তার পিতাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” [সহীহ মুসলিম (৪ /২০২৯)।]

৫৯. মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«ما من مسلمين يموت لهما ثلاثة أولاد لم يبلغوا الحنث الا أدخلهما الله وأباهم بفضل رحمته الجنة , وقال : يقال لهم : ادخلوا الجنة , قال : فيقولون : حتى يجيء أبوانا . قال ثلاث مرات فيقولون مثل ذلك , فيقال لهم : ادخلوا الجنة أنتم وأبواكم» .

“যে মুসলিমদ্বয়েরই তিনটি সন্তান অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় মারা গিয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এবং তাদের পিতা-মাতাকে তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন; তিনি বলেন: তাদেরকে বলা হবে: তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর; তিনি বলেন: তখন তারা বলবে: (আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব না) যতক্ষণ না আমাদের পিতা-মাতা আসবে। তিনি তিনবার বলেন, আর তারও অনুরূপভাবে তিনবার বলবে; অতঃপর তাদেরকে বলা হবে: তোমরা এবং তোমাদের পিতা-মাতা জান্নাতে প্রবেশ কর। [আহমদ (২/৫১০); নাসাঈ (৪/২২); বায়হাকী; আর হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তের ভিত্তিতে বর্ণিত।]

৬০. শুরাহবীল ইবন শোফ‘আহ্‌ থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু সংখ্য সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:

«يقال للولدان يوم القيامة : ادخلوا الجنة , قال : فيقولون : يا رب حتى يدخل آباؤنا وأمهاتنا , قال : فيأتون , قال : فيقول الله عز و جل : مالي أراهم محبنطئين , ادخلوا الجنة , قال : فيقولون : يا رب آباؤنا وأمهاتنا قال فيقول ادخلوا الجنة أنتم وآباؤكم» .

“কিয়ামতের দিনে (শিশু অবস্থায় মারা যাওয়া) সন্তানদেরকে বলা হবে: তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর; তিনি বলেন: তখন তারা বলবে: হে প্রতিপালক! (আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব না) যতক্ষণ না আমাদের পিতা ও মাতাগণ প্রবেশ করবেন; তিনি বলেন: অতঃপর তারা আসবে; তিনি বলেন: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: আমার কী হলো, আমি তো তাদেরকে মোটা ও খাটোদেহী ক্রোধে পরিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পাচ্ছি; তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর; তিনি বলেন: তখন তারা বলবে: হে প্রতিপালক! আমাদের পিতা ও মাতাগণ? তিনি বলেন: অতঃপর তিনি বলবেন: তোমরা এবং তোমাদের পিতা-মাতা জান্নাতে প্রবেশ কর।” [আহমদ (৪/১০৫); আল-ফাসাবী, আল-মা‘রেফাতু ওয়াত তারিখ [ المعرفة والتاريخ ] (২/৩৪৩); হাইছামী, আল-মাজমা‘ (৩/১১); ইমাম আহমদের বর্ণনার বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত।]

৬১. যায়েদ ইবন সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ সালামকে বলতে শুনেছেন, আমার নিকট ‘আমের ইবন যায়েদ আল-বাকালী হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ‘উতবা ইবন (আবদ [আল-মুনযেরী, তার তারগীব ওয়াত তারহীব গ্রন্থে পিতার নাম উল্লেখ করেছেন। [সম্পাদক]]) আস-সুলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছেন:

«جاء أعرابي إلى رسول الله عليه السلام , فقال : ما حوضك الذي تحدث عنه؟ قال : « هو كما بين البيضاء إلى بصرى , ثم يمدني الله عز و جل بكراع فلا يدري بشر ممن خلق أين طرفاه , فكبر عمر بن الخطاب , فقال : « أما الحوض فيزدحم عليه فقراء المهاجرين الذين يقاتلون في سبيل الله ويموتون في سبيل الله » . و أرجو أن يوردني الله عز و جل الكراع فأشرب منه , فقال رسول الله : « إن ربي وعدني أن يدخل الجنة من أمتي سبعين ألفا بغير حساب , ثم يشفع كل ألف بسبعين ألف ثم يحثي ربي تبارك وتعالى بكفيه ثلاث حثيات » . فكبر عمر , وقال : « إن السبعين الأولى ليشفعهم الله في آبائهم وأبنائهم وعشائرهم » وأرجو أن يجعلني الله في إحدى الحثيات الأواخ » . فقال الأعرابي : يا رسول الله أفيها فاكهة ؟ قال : « نعم , وفيها شجرة تدعى طوبى هي تطابق الفردوس» . فقال : أي شجر أرضنا تشبه ؟ قال : « ليس تشبه من شجر أرضك ولكن أتيت الشام ؟» . فقال : لا يا رسول الله ! قال : « فإنها تشبه شجرة في الشام تدعى الجوزة , تنبت على ساق واحد , ثم ينتشر أعلاها » . قال : فما عظم أصلها ؟ قال : « لو ارتحلت جذعة من إبل أهلك لما قطعتها حتى تنكسر ترقواها هرما » . قال : فيها عنب ؟ قال : « نعم , قال ما عظم العنقود منها ؟ قال : « مسيرة شهر للغراب الأبقع لا ينثني ولا يفتر» . قال : « فما عظم الحبة منه ؟ قال : هل ذبح أبوك من غنمه تيسا عظيما ؟» . قال : نعم , قال : « فسلخ إهابها فأعطاه أمك فقال ادبغي هذا ثم افري لنا منه دلوا نروي منها شئيا ؟» . قال : نعم , قال : « فإن تلك الحبة تشبعني وأهل بيتي؟» . فقال النبي : نعم , وعامة عشيرتك » .

“জনৈক আরব বেদুইন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করল, তারপর সে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন: আপনার হাউযটি কোনো ধরনের, যার ব্যাপারে আপনি আলোচনা করেন? জবাবে তিনি বলেন: তা হলো বায়দা থেকে বসরা পর্যন্ত দূরত্বের মত বিস্তৃত; অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য তার প্রান্তদেশকে সম্প্রসারিত করবেন, ফলে তাঁর সৃষ্ট কোনো মানুষ জানতে পারবে না তার দুই প্রান্তের সীমানা কোথায়; তিনি (উতবা) বলেন: অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর দিলেন; অতঃপর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: হাউযের কিনারে ঐসব মুহাজির ফকীরগণ ভিড় করবে, যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে লড়াই করে এবং আল্লাহ তা‘আলার পথে মৃত্যুবরণ করে। আর (উতবা বা আরব বেদুইন বলেন) আমি আশা করি আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তার কোনো এক প্রান্তে অবতরণ করাবেন, অতঃপর আমি তার থেকে পান করব; অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: নিশ্চয় আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, বিনা হিসাবে আমার সত্তর হাজার উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে; অতঃপর প্রত্যেক হাজার আরও সত্তর হাজারের ব্যাপারে সুপারিশ করবে; অতঃপর তিনি তাঁর দুই হাতের তালুর মাধ্যমে (আমার উম্মতের মধ্য থেকে) তিন অঞ্জলি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অতঃপর উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর দিলেন; তারপর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: প্রথম সত্তর হাজারকে আল্লাহ তা‘আলা তাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততী ও আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে সুপারিশ করার সুযোগ দিবেন। আর (উতবা বা আরব বেদুইন বলেন) আমি আশা করি আল্লাহ তা‘আলা আমাকে শেষ তিন অঞ্জলির কোনো একটার মধ্যে শামিল করবেন। আর আরব বেদুঈন বলল: হে আল্লাহর রাসূল! তাতে কি ফলমূল আছে? জবাবে তিনি বললেন: না, তাতে ‘তুবা’ নামক একটি বৃক্ষ আছে, তা ফিরদাউস নামক জান্নাতের উপযোগী। সে বলল: আমাদের দেশের কোনো বৃক্ষের সাথে তার সাদৃশ্যতা রয়েছে? জবাবে তিনি বললেন: তোমাদের দেশের কোনো গাছের সাথেই তার মিল নেই, তবে তুমি কি শাম দেশে গিয়েছ? জবাবে সে বলল: না, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি বললেন: নিশ্চয় তা শাম দেশের ‘জূযা’ নামক বৃক্ষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তা এক কাণ্ডের ওপর অঙ্কুরিত উদ্ভিদ এবং তার উপরিভাগ ছড়িয়ে যায়। সে বলল: তার মূলের বড়ত্ব কী পরিমাণ? তিনি বললেন: যদি পরিপূর্ণ চার বছরের তোমার পরিবারের একটি উট অনবরত সে বেষ্টনীতে ভ্রমণ করে, তবে সেটার কণ্ঠনালী বৃদ্ধ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে, কিন্তু তার শেষ পর্যন্ত যেতে পারবে না। সে বলল: তাতে কি আঙ্গুর ফল থাকবে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, সে বলল: তার মধ্যকার আঙ্গুরের কাঁদি বা গুচ্ছের বড়ত্ব কেমন? তিনি বললেন: বিরামহীন গতিতে চলমান একটি কাকের এক মাসের রাস্তার সমপরিমাণ। সে বলল: তার দানার বড়ত্ব কেমন? তিনি বললেন: তোমার পিতা কি কখনও বড় ধরনের পাহাড়ী বকরা (পুরুষ ছাগল) জবাই করেছে? সে বলল: হ্যাঁ, তিনি বললেন: অতঃপর সে কি তার চামড়া খসিয়েছে, তারপর তা তোমার মাকে দিয়ে বলেছে যে, তুমি এটা আমাদের জন্য প্রক্রিয়াজাত কর, তারপর তার থেকে আমাদের জন্য একটি বালতি প্রস্তুত কর, যাতে আমরা তা থেকে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি? সে বলল: হ্যাঁ [অর্থাৎ সেটার দানা এত বড় হবে। [সম্পাদক]]। সে বলল: নিশ্চয় এই দানা আমাকে ও আমার পরিবার-পরিজনকে পরিতৃপ্ত করবে? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হ্যাঁ, তোমার গোটা বংশধরকে পরিতৃপ্ত করবে।” [আল-মু‘জামুল আওসাত ( المعجم الأوسط ), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৬; তাবারানী; আল-ফাসাবী, আল-মা‘রেফাতু ওয়াত তারিখ [ المعرفة والتاريخ ] (২/৩৪১); হাফেয আল-মাকদাসী বলেন, এই হাদীসের কোনো দুর্বলতা বা ত্রুটি আমার জানা নেই। (শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীবে এ হাদীসকে সহীহ লি গাইরিহী বলেছেন। [সম্পাদক])]

৬২. শো‘বা থেকে বর্ণিত, তিনি মু‘য়াবিয়া ইবন কুররা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«أن رجلا كان يأتي النبي صلى الله عليه و سلم ومعه ابن له , فقال له النبي صلى الله عليه و سلم : «أتحبه ؟ فقال : يا رسول الله أحبك الله كما أحبه , ففقده النبي صلى الله عليه و سلم , فقال لي : ما فعل ا بن فلان ؟ قالوا : يا رسول الله مات فقال النبي صلى الله عليه و سلم لأبيه : «أما تحب أن لا تأتي بابا من أبواب الجنة إلا وجدته ينتظرك» . فقال الرجل : يا رسول الله أله خاصة , أم لكلنا ؟ قال : «بل لكلكم» .

জনৈক ব্যক্তি তার ছেলেসহ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে, তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: তুমি কি তাকে ভালোবাস? অতঃপর সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসেন, যেমনিভাবে আমি তাকে ভালোবাসি; অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হারিয়ে ফেললেন, তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করে বললেন: অমুকের ছেলে কী করে? তখন তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল! সে মারা গেছে; অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তুমি কি পছন্দ করবে না যে, তুমি জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্য থেকে যে কোনো দরজার সামনে উপস্থিত হবে, আর তুমি তাকে দেখতে পাবে সে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। অতঃপর সে ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি তার জন্য নির্দিষ্ট, নাকি আমাদের প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য হবে? তখন তিনি বললেন: বরং তোমাদের সকলের জন্য।” [আহমদ (৫/৩৫); আর হাদীসের বর্ণনাকারীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত।]

২০
শাফা‘আতের কারণ ও উপলক্ষসমূহ
আল-কুরআনের শাফা‘আত:

৬৩. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«إن سورة من القرآن ثلاثون آية شفعت لرجل حتى غفر له وهي سورة تبارك الذي بيده الملك» .

“আল-কুরআনের একটি সূরার ত্রিশটি আয়াত কোনো ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর তা হলো সূরা আল-মুলক; ﴿تَبَٰرَكَ ٱلَّذِي بِيَدِهِ ٱلۡمُلۡكُ﴾ (বরকতময় তিনিই, যাঁর হতে রাজত্ব ও কর্তৃত্ব)।” [তিরমিযী (৪/২৩৮); আবূ দাউদ (২/১১৯); ইবন মাজাহ (২/১২৪৪); আহমদ (২/৩২১); ইবন হিব্বান, পৃ. ৩২১; হাকেম (১/৫৬৫), আর এটা হাসান হাদীস।]

৬৪. ‘আসেম ইবন আবি নাজুদ থেকে বর্ণিত, তিনি শা‘বী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«يجيء القرآن يوم القيامة فيشفع لصاحبه فيكون له قائدا إلى الجنة ويشهد عليه ويكون سائقا به إلى النار» .

“কিয়ামতের দিনে আল-কুরআন আগমন করবে, অতঃপর সে তার সাথীর জন্য সুপারিশ করবে; অতঃপর সে তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে, আর সে তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে এবং তাকে জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।” [দারেমী (২/৪৩৩); আবদুর রাজ্জাক, আল-মুসান্নাফ (৩/৩৭৩); তাবারানী, আল-কাবীর (৯/১৪১); সহীহ সনদে আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ‘মাওকুফ’ হাদীস হিসেবে বর্ণিত।]

৬৫. ‘জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«القرآن شافع مشفع , وماحل مصدق , من جعله أمامه قاده إلى الجنة , ومن جعله خلف ظهره ساقه إلى النار» .

“আল-কুরআন হচ্ছে সুপারিশকারী, যার সুপারিশ গৃহীত হবে এবং এমন পক্ষ বা বিপক্ষ অবলম্বনকারী, যার পক্ষ ও বিপক্ষ সাক্ষীকে সত্যায়ণ করা হয়।” [হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মাওকুফ সনদে বর্ণিত; আর জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ‘মারফু’ সনদে হাদীসটি বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত। দেখুন, ইবন হিব্বান, ১০/১৯৮, হাদীস নং ১০৪৫০; আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ, হাদীস নং২০১৯; সহীহুল জামি‘উ, হাদীস নং ৪৪৪৩। [সম্পাদক]]

৬৬. মু‘য়াবিয়া ইবন সালাম থেকে বর্ণিত, তিনি যায়েদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবূ সালাম বলেন: আমাকে আবূ উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাদীস বর্ণনা করে বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ وَسُورَةَ آلِ عِمْرَانَ فَإِنَّهُمَا تَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ أَصْحَابِهِمَا اقْرَءُوا سُورَةَ الْبَقَرَةِ فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ وَلاَ تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ» .

“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করবে। কেননা কিয়ামতের দিন তা তিলাওয়াতকারীদের জন্য সুপারিশকারীরূপে উপস্থিত হবে। তোমরা সুপারিশকারী দুই সমুজ্জ্বল সূরা আল-বাকারাহ ও সূরা আলে ইমরান তিলাওয়াত করবে। কারণ, এ দু’টি কিয়ামতের দিন উপস্থিত হবে, মনে হবে যেন দু’টি মেঘখণ্ড বা বাদল, কিংবা দু’টি ডানা বিস্তারকারী পাখির ঝাঁক, যারা তাদের তিলাওয়াতকারীদের পক্ষে প্রতিরোধকারী-সাহায্যকারী হবে। তোমরা সূরা বাকারা তিলাওয়াত করবে। কারণ, তা তিলাওয়াত করাতে বরকত রয়েছে, আর তা বর্জন করা আফসোসের এবং বাতিলপন্থীরা [অথবা জাদুকরের জাদু এর পাঠকারীর উপর ক্রিয়া করে না। [সম্পাদক]] তার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবে না।” [মুসলিম (১/৫৫৩); আহমদ (৫/২৪৯)]

৬৭. আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«يَجِيءُ الْقُرْآنُ يَشْفَعُ لِصَاحِبِهِ يَقُولُ : يَا رَبِّ لِكُلِّ عَامِلٍ عُمَالَةٌ مِنْ عَمَلِهِ , وَإِنِّي كُنْتُ أَمْنَعُهُ اللَّذَّةَ وَالنَّوْمَ فَأَكْرِمْهُ , فَيُقَالُ : ابْسُطْ يَمِينَكَ , فَتُمْلَأُ مِنْ رِضْوَانِ اللَّهِ , ثُمَّ يُقَالُ : ابْسُطْ شِمَالَكَ , فَتُمْلَأُ مِنْ رِضْوَانِ اللَّهِ , وَيُكْسَى كِسْوَةَ الْكَرَامَةِ , وَيُحَلَّى بِحِلْيَةِ الْكَرَامَةِ , وَيُلْبَسُ تَاجَ الْكَرَامَةِ» .

“আল-কুরআন আগমন করবে, সে তার সাথীর জন্য সুপারিশ করবে, সে বলবে: হে আমার রব! প্রত্যেক আমলকারীর জন্য তার আমলের মজুরীর ব্যবস্থা রয়েছে, আর আমি তাকে আমোদ-প্রমোদ ও নিদ্রা থেকে বাধা প্রদান করতাম। সুতরাং আপনি তাকে সম্মানিত করুন; অতঃপর তাকে বলা হবে: তুমি তোমার ডান হাত প্রসারিত কর, অতঃপর তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হবে। অতঃপর বলা হবে: তুমি তোমার বাম হাত প্রসারিত কর, অতঃপর তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হবে, আর তাকে সম্মানের পোষাক পরিধান করানো হবে এবং তাকে সম্মানের অলঙ্কার পরিধান করানো হবে, আর তাকে পরিধান করানো হবে সম্মানের মুকুট।” [দারেমী (২/৪৩০); তার সনদ হাসান পর্যাযের।]

৬৮. আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة , يقول الصيام : أي رب منعته الطعام والشهوات بالنهار فشفعني فيه , ويقول القرآن : منعته النوم بالليل فشفعني فيه قال : فيشفعان» .

“কিয়ামতের দিনে বান্দার জন্য সাওম (রোযা) ও আল-কুরআন সুপারিশ করবে; সাওম বলবে: হে আমার প্রতিপালক! আমি দিনের বেলায় তাকে খাবার গ্রহণ ও যৌন ক্ষুধা পূরণ থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আপনি আমাকে তার ব্যাপারে সুপারিশ করার সুযোগ দিন, আর আল-কুরআন বলবে: আমি রাতের বেলায় তাকে ঘুমাতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং আপনি আমাকে তার ব্যাপারে সুপারিশ করার সুযোগ দিন; তিনি বলেন: অতঃপর তারা উভয়ে সুপারিশ করবে।” [আহমদ (২/১৭৪); ইবন নসর, ‘কিয়ামুল লাইল’ ( قيام الليل ), পৃ. ২৫; হাকেম (১/৫৫৪) এবং তিনি বলেন, হাদীসটি ইমাম মুসলিম রহ. এর শর্তের ভিত্তিতে বর্ণিত। আলবানী তার ‘সহীহ আল-জামে’ ( صحيح الجامع ) –এর মধ্যে হাদীসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন, হাদীস নং ৩৭৭৬।]

৬৯. আবূ সালেহ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছি:

«اقرؤوا القرآن فإنه نعم الشفيع يوم القيامة , انه يقول يوم القيامة : يا رب حله حلية الكرامة , فيحلى حلية الكرامة , يا رب اكسه كسوة الكرامة , فيكسى كسوة الكرامة , يا رب البسه تاج الكرامة , يا رب أرض عنه , فليس بعد رضاك شيء» .

“তোমরা আল-কুরআন পাঠ কর। কারণ, কিয়ামতের দিনে তা উত্তম সুপারিশকারী; কিয়ামতের দিনে সে বলবে: হে আমার প্রতিপালক! আপনি তাকে সম্মানের অলঙ্কার পরিয়ে দিন, অতঃপর তিনি তাকে সম্মানের অলঙ্কার পরিয়ে দিবেন; হে আমার রব! আপনি তাকে সম্মানের পোষাক পরিয়ে দিন, অতঃপর তিনি তাকে সম্মানের পোষাক পরিয়ে দিবেন; হে আমার রব! আপনি তাকে সম্মানের মুকুট পরিয়ে দিন, হে আমার রব! আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, কেননা আপনার সন্তুষ্টির পরে আর কিছুই নেই।” [দারেমী (২/৪৩০); তিরমিযী (২/২৪৯) এবং তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন; হাকেমের নিকট হাদীসটির অপর আরেকটি সনদ রয়েছে (১/৫৫২); আবূ না‘ঈম (৭/২০৬) এবং হাদীসটি হাসান।]

২১
শাফা‘আত লাভের অন্যতম একটি উপায় হলো মদীনায় বসবাস করা এবং সেখানে মারা যাবে
৭০. মাহরীর আযাদকৃত গোলাম আবূ সা‘ঈদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«أَنَّهُ جَاءَ أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِىَّ لَيَالِىَ الْحَرَّةِ فَاسْتَشَارَهُ فِى الْجَلاَءِ مِنَ الْمَدِينَةِ وَشَكَا إِلَيْهِ أَسْعَارَهَا , وَكَثْرَةَ عِيَالِهِ , وَأَخْبَرَهُ أَنْ لاَ صَبْرَ لَهُ عَلَى جَهْدِ الْمَدِينَةِ وَلأْوَائِهَا . فَقَالَ لَهُ : وَيْحَكَ لاَ آمُرُكَ بِذَلِكَ إِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : «لاَ يَصْبِرُ أَحَدٌ عَلَى لأْوَائِهَا فَيَمُوتَ إِلاَّ كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا أَوْ شَهِيدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا كَانَ مُسْلِمًا» .

“তিনি হাররা [ইয়াযিদের সেনাপতি কর্তৃক মদীনা আক্রান্ত হয়ে সেখানকার মানুষ অমানষিক কষ্টের মধ্যে পড়েন। সে ঘটনায় মদীনার হাররায় বহু লোক মারা যায়। ইতিহাসে সেটা ‘হাররা’র ঘটনা নামে খ্যাত। [সম্পাদক]] ঘটনার সময় কোনো এক রাত্রে আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট আগমন করেন; তারপর তিনি মদীনা ত্যাগের ব্যাপারে তাঁর নিকট পরামর্শ চাইলেন এবং তাঁর নিকট মদীনার দ্রব্যমূল্য ও তার পরিবারের লোকসংখ্যার আধিক্যের ব্যাপারে অনুযোগ করলেন, আর তাকে জানিয়ে দিলেন যে, মদীনার কষ্ট ও তার দুর্বিষহ জীবনযাপনে তার কোনো প্রকার ধৈর্য নেই। তখন সাহাবী তাকে বললেন: তোমার জন্য আফসোস! আমি তোমাকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত দেই না, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: যে কোনো ব্যক্তি মদীনার দুর্বিষহ জীবনযাপনে ধৈর্য ধারণ করবে, তারপর মারা যাবে, আমি কিয়ামতের দিনে তার জন্য সুপারিশকারী অথবা সাক্ষী হব, যখন সে মুসলিম হবে”। [সহীহ মুসলিম (২/১০০২); আহমদ (৩/২৯)।]

৭১. আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«مَنْ صَبَرَ عَلَى لأْوَائِهَا كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا أَوْ شَهِيدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ» .

“যে ব্যক্তি মদীনার দুর্বিষহ জীবনযাপনে ধৈর্য ধারণ করবে, আমি কিয়ামতের দিনে তার জন্য সুপারিশকারী অথবা সাক্ষী হব।” [সহীহ মুসলিম (২/১০০৪)।]

৭২. যোবায়েরের আযাদকৃত গোলাম ইউহান্নেস থেকে বর্ণিত, তার নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র নিকটে বিপর্যস্ত [আর তা হলো ইয়াযিদের যামানায় সংঘটিত উত্তপ্ত পরিস্থিতি।] পরিস্থিতে বসা ছিলেন; অতঃপর তাঁর নিকট তাঁর আযাদ করা এক দাসী এসে তাঁকে সালাম পেশ করল, তারপর বলল:

«إِنِّى أَرَدْتُ الْخُرُوجَ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ اشْتَدَّ عَلَيْنَا الزَّمَانُ . فَقَالَ لَهَا عَبْدُ اللَّهِ : اقْعُدِى لَكَاعِ فَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : «لاَ يَصْبِرُ عَلَى لأْوَائِهَا وَشِدَّتِهَا أَحَدٌ إِلاَّ كُنْتُ لَهُ شَهِيدًا أَوْ شَفِيعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ» .

“হে আবূ আবদির রহমান! আমি (মদীনা থেকে) বের হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছি, আমাদের ওপর যুগ-যামানা কঠোর হয়ে গেছে। অতঃপর আবদুল্লাহ তাকে বললেন: বোকা মেয়ে, তুমি বস। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি: যে কোনো ব্যক্তি মদীনার দুর্বিষহ ও কঠিন জীবনযাপনে ধৈর্য ধারণ করবে, আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী অথবা সাক্ষী হব”। [সহীহ মুসলিম (২/১০০৪)]

৭৩. সুফিয়া বিনতে আবি ‘উবাইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:

« من استطاع منكم أن لا يموت إلا بالمدينة فليمت بها ، فإنه من يمت بها يشفع له ويشهد له » .

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি মদীনাতেই মারা যাওয়ার সামর্থ্য রাখে, সে যেন সেখানে মারা যায়। কারণ, যে ব্যক্তি সেখানে মারা যাবে, তার জন্য তিনি সুপারিশ করবেন এবং তার পক্ষে তিনি সাক্ষ্য দিবেন”। [ইবন হিব্বান, পৃ. ২৫৫; হাদীসটি ইমাম মুসলিম রহ. এর শর্তের ভিত্তিতে বর্ণিত।]

৭৪. আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من استطاع أن يموت بالمدينة فليمت بها , فإني أشفع لمن يموت بها» .

“যে ব্যক্তির মদীনায় মারা যাওয়ার সামর্থ্য আছে, সে যেন সেখানে মারা যায়। কারণ, যে ব্যক্তি তাতে মারা যাবে, আমি তার জন্য সুপারিশ করব।” [আহমদ (২/৭৪ এবং ১০৪); তিরমিযী (৫/২৭৭) এবং তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]

২২
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দুরূদ পাঠ ও তাঁর জন্য ওসীলা প্রার্থনা করা
৭৫. আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনিল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:

«إِذَا سَمِعْتُمُ الْمُؤَذِّنَ فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ ثُمَّ صَلُّوا عَلَىَّ فَإِنَّهُ مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا ثُمَّ سَلُوا اللَّهَ لِىَ الْوَسِيلَةَ فَإِنَّهَا مَنْزِلَةٌ فِى الْجَنَّةِ لاَ تَنْبَغِى إِلاَّ لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ وَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَنَا هُوَ فَمَنْ سَأَلَ لِىَ الْوَسِيلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ» .

“যখন তোমরা মুয়াজ্জিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন তোমরা সে যা বলে তাই বলবে। তারপর আমার ওপর দুরূদ পাঠ করবে। কারণ, যে আমার ওপর একবার দুরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার বিনিময়ে তার ওপর দশবার রহমত নাযিল করেন। পরে আল্লাহর কাছে আমার জন্য ওসীলার দো‘আ করবে। ওসীলা হলো হল জান্নাতের একটি বিশেষ স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কোনো এক বান্দাকে দেওয়া হবে। আমি আশা করি যে, আমিই হব সেই বান্দা। যে আমার জন্য ওসীলার দো‘আ করবে, তার জন্য আমার শাফা‘আত হালাল হয়ে যাবে।” [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: সালাত ( كتاب الصلاة ), পরিচ্ছেদ: আযানের জবাবে মুয়াজ্জিনের অনুরূপ বলা মুস্তাহাব; এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরূদ পাঠ করা এবং তাঁর জন্য ওসীলা’র দো‘য়া করা ( باباسْتِحْبَابِ الْقَوْلِ مِثْلَ قَوْلِ الْمُؤَذِّنِ لِمَنْ سَمِعَهُ ثُمَّ يُصَلِّى عَلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- ثُمَّ يَسْأَلُ اللَّهَ لَهُ الْوَسِيلَةَ ), হাদীস নং ৮৭৫।]

৭৬. আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«سلوا الله لي الوسيلة فإنه لم يسألها لي عبد في الدنيا إلا كنت له شهيدا أو شفيعا يوم القيامة » .

“তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট ওসীলার প্রার্থনা কর। কারণ, যে বান্দাই দুনিয়াতে আমার জন্য তা প্রার্থনা করবে, কিয়ামতের দিনে আমি তার জন্য সাক্ষী অথবা সুপারিশকারী হব।” [তাবারানী; আর ইসমাঈল কাযী তার ‘ফাদলুস সালাত ‘আলান নাবিয়্যে সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ ( فضل الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم ) –এর মধ্যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, পৃ. ৫০ এবং তার সনদটি হাসান, আর তার সমর্থনে অন্য বর্ণনাও রয়েছে।]

৭৭. রুয়াইফা ইবন সাবিত আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من صلى على محمد وقال اللهم أنزله المقعد المقرب عندك يوم القيامة وجبت له شفاعتى» .

“যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের ওপর দুরূদ পাঠ করবে এবং বলবে: হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে কিয়ামতের দিনে আপনার নিকটবর্তী আসনে অবতরণ করুন, তার জন্য আমার শাফা‘আত বা সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যাবে।” [ইসমাঈল কাযী তার ‘ফাদলুস সালাত ‘আলান নাবিয়্যে সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ ( فضل الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم ) –এর মধ্যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, পৃ. ৫৩; তাবারানী, আল-কাবীর (৫/১৪); আহমদ (৪/১০৭); মুনযেরী তার ‘আত-তারগীব’ গ্রন্থে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন (২/৫০৫): হাইছামী, আল-মাজমা‘ [ المجمع ] (১/১৬৩)। (তবে সঠিক কথা হচ্ছে, হাদীসটি দুর্বল। শাইখুল আলবানী এবং শাইখ শু‘আইব আল-আরনাউত্ব উভয়েই হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। [সম্পাদক])]

৭৮. আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من صلى علي حين يصبح عشرًا , وحين يمسى عشرًا , أدركته شفاعتى يوم القيامة» .

“যে ব্যক্তি সকাল ও সন্ধ্যায় আমার ওপর দশবার দুরূদ পাঠ করবে, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনে আমার শাফা‘আত লাভ করবে।” [তাবারানী, আল-মু‘জাম আল-কাবীর [ المعجم الكبير ] (৫/১৪); আবূ ‘আসেম আস-সুন্নাহ্‌। শাইখ আলবানী তার ‘সহীহ আল-জামে’ ( صحيح الجامع ) –এর মধ্যে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন, হাদীস নং ৬২৩৩]

৭৯. জাবির ইবন আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«من قال حين يسمع النداء : اللهم رب هذه الدعوة التامة والصلاة القائمة , آت محمد الوسيلة والفضيلة , وابعثه مقاما محمودا الذي وعدته , حلت له شفاعتي يوم القيامة» .

“যে ব্যক্তি আযান শুনে দো‘আ করবে: ‘হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহ্বান ও প্রতিষ্ঠিত সালাতের প্রভূ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান কর ওসীলা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন এবং তাঁকে ‘মাকামে মাহমুদ’ তথা প্রশংসিত স্থানে পৌঁছে দিন, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাঁকে দিয়েছেন’— কিয়ামতের দিন তার জন্য আমার শাফা‘আত হালাল হবে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: আযান ( كتاب الأذان ), পরিচ্ছেদ: আযানের সময়কালীন দো‘আ ( باب الدعاء عند النداء ), হাদীস নং ৫৮৯।]

৮০. তারেক ইবন শিহাব রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«ما من مسلم يقول إذا سمع النداء , فيكبر المنادى فيكبر , ثم يشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله فيشهد على ذلك , ثم يقول : اللهم أعط محمدا الوسيلة , واجعل فى الأعلين درجته , وفى المصطفين محبته , وفى المقربين ذكره , إلا وجبت له شفاعتى يوم القيامة» .

“যে মুসলিম ব্যক্তি বলবে যখন সে আযান শুনে- মুয়াজ্জিন যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে, তখন সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে; অতঃপর সে (মুয়াজ্জিন) যখন সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, তখন সে এই ব্যাপারে সাক্ষ্য দিবে; অতঃপর সে বলবে: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওসীলা দান কর, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর মর্যাদাকে শামিল কর, মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর মহব্বত সৃষ্টি করে দাও এবং নৈকট্যবান বান্দাদের মধ্যে তাঁর আলোচনার ব্যবস্থা করে দাও- তখন সেই ব্যক্তির জন্য কিয়ামতের দিনে আমার শাফা‘আত জরুরী হয়ে যায়।” [ত্বাহাবী, ‘শরহু মা‘আনীল আসার [ شرح معاني الآثار ] (১/১৪৫); তাবারানী, আল-কাবীর [ الكبير ] (১০/১৬); হাইছামী বলেন, হাদীসের বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য; আর ইবনুস সুন্নী’র ‘আমালুল ইয়াওমে ওয়াল লাইলাহ্‌ গ্রন্থে এর সমর্থনে আরও একটি বর্ণনা রয়েছে, পৃ. ৪৭ এবং ৫৮।]

দৃষ্টি আকর্ষণ:

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত ও তা তাঁর শাফা‘আত লাভের অন্যতম উপায় বলে উৎসাহ দান প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্য থেকে কোনো কিছুই প্রমাণিত নয়; অচিরেই আমি তন্মধ্য থেকে কিছু বিষয় ও তথ্যসূত্র সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করছি।

১. উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«من زار قبري أو قال من زارني كنت له شفيعا أو شهيدا ومن مات في احد الحرمين بعثه الله في الامنين يوم القيامة » .

যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে অথবা তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে যিয়ারত করবে, আমি তার জন্য সুপারিশকারী অথবা সাক্ষী হব, আর যে ব্যক্তি হারামাইন তথা মক্কা ও মদীনার কোনো একটিতে মারা যাবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিনে নিরাপদ ব্যক্তিদের মাঝে তার পুনরুত্থান ঘটাবেন।” (বায়হাকী, ৫/২৪৫) আর তিনি বলেন: এই হাদীসের সনদ অজ্ঞাত; দেখুন: ইবন আবদিল হাদী, ‘আস-সারেমুল মুনাক্কী ফির রাদ্দি ‘আলাস্ সাবাকী’ ( الصارم المنكي في الرد على السبكي )

২. ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من زار قبري وجبت له شفاعتي» .

“যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফা‘আত ওয়াজিব হয়ে যাবে।”[হাদীসটি দারাকুতনী (২/২৭৮) ও বায়হাকী রহ. বর্ণনা করেন] আর বায়হাকী রহ. বলেন: এই হাদীসটি ‘মুনকার’। আর এই অর্থে সেখানে অনেক ‘মাওযু’ (বানোয়াট) ও দুর্বল হাদীস বর্ণিত আছে।

তবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাসজিদ যিয়ারত করা, তাতে সালাত আদায় করা এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাম পেশ করা অতি ফযিলতের কাজ, যা আল্লাহর জান্নাত ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের দিকে নিয়ে যায়। আর আল্লাহই হলেন সাহায্য প্রার্থনার স্থল।

২৩
তাওহীদপন্থী মৃত ব্যক্তির সালাতুল জানাযায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিগণ কর্তৃক তার জন্য সুপারিশ করা
৮১. আবূ কিলাবা থেকে বর্ণিত, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা’র দুধভাই আবদুল্লাহ ইবন ইয়াযিদ রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন:

«مَا مِنْ مَيِّتٍ يُصَلِّى عَلَيْهِ أُمَّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُونَ مِائَةً كُلُّهُمْ يَشْفَعُونَ لَهُ إِلاَّ شُفِّعُوا فِيهِ » .

“কোনো মৃত ব্যক্তি, যার ওপর একদল মুসলিম ব্যক্তি জানাযার সালাত আদায় করবে, যাদের সংখ্যা একশ’তে পৌঁছবে এবং তাদের প্রত্যেকে তার জন্য সুপারিশ করবে, তবে তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ গ্রহণীয় হবে।” [সহীহ মুসলিম, জানাযা অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তির ওপর একশত ব্যক্তি জানাযার সালাত আদায় করবে, তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ গ্রহণীয় হবে ( باب مَنْ صَلَّى عَلَيْهِ مِائَةٌ شُفِّعُوا فِيهِ ), হাদীস নং ২২৪১।]

৮২. শরীক ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবি নমর থেকে বর্ণিত, তিনি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র মাওলা (আযাদ করা গোলাম) কুরাইব রহ. থেকে বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁর এক ছেলে কুদায়দ অথবা ‘উসফান নামক স্থানে ইন্তিকাল করলেন; তখন তিনি বললেন, হে কুরায়ব! দেখ তো, তার জানাযার জন্য কি পরিমাণ মানুষ সমবেত হয়েছে? আমি দেখলাম, কিছু লোক সমবেত হয়েছে; আমি তাঁকে এ খবর দিলাম; তখন তিনি বললেন, তাদের সংখ্যা কি চল্লিশ হবে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন: মৃতদেহ বের কর। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«مَا مِنْ رَجُلٍ مُسْلِمٍ يَمُوتُ فَيَقُومُ عَلَى جَنَازَتِهِ أَرْبَعُونَ رَجُلاً لاَ يُشْرِكُونَ بِاللَّهِ شَيْئًا إِلاَّ شَفَّعَهُمُ اللَّهُ فِيهِ» .

“যখন কোনো মুসলিম মারা যায় এবং তার জানাযায় এমন চল্লিশজন লোক অংশ নেয়, যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করে না, তখন তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হয়।” [সহীহ মুসলিম, জানাযা অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: যে ব্যক্তির উপর চল্লিশ ব্যক্তি জানাযার সালাত আদায় করবে, তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ গ্রহণীয় হবে ( باب مَنْ صَلَّى عَلَيْهِ أَرْبَعُونَ شُفِّعُوا فِيهِ ), হাদীস নং ২২৪২]

৮৩. আবূ সালেহ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:

«من صلى عليه مائة من المسلمين غفرالله له» .

“যে ব্যক্তির ওপর একশত মুসলিম জানাযার সালাত আদায় করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন।” [ইবন মাজাহ (১/৪৭৭), তার সনদ সহীহ; আলবানী তাকে সহীহ বলেছেন।]

৮৪. আবদুল্লাহ ইবন সালিত থেকে বর্ণিত, তিনি উম্মহাতুল মুমিনীনের অন্যতম একজন মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«ما من ميت يصلي عليه أمة من الناس إلا شفعوا فيه» فسألت أبا المليح عن الأمة قال أربعون» .

“যে কোনো মৃত ব্যক্তির জানাযায় মানুষের মধ্য থেকে একদল অংশগ্রহণ করবে, তারা তার ব্যাপারে সুপারিশ করবে।” [নাসাঈ (৪/৬২); সহীহ বুখারী, আল-কাবীর [ الكبير ] (৫/১১২); আহমদ (৬/৩৩১); ইবন আবি শায়বা, আল-মুসান্নাফ (৩/৩২১)। অন্য বর্ণনার সমর্থনের কারণে এই হাদীসটি হাসান পর্যায়ের ইনশাআল্লাহ।]

(অতঃপর আমি আবূল মালিহকে ‘উম্মত’ বা দল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম? জবাবে তিনি বললেন: চল্লিশ। অপর এক বর্ণনায় আছে: ‘উম্মত’ বা দল বলতে চল্লিশ থেকে একশ’র মধ্যকার যে কোনো পরিমাণ লোক সংখ্যাকে বুঝায়)।

২৪
বিভিন্ন প্রকার কর্মকাণ্ড শাফা‘আতের উপলক্ষসমূহের অন্তর্ভুক্ত
৮৫. বনী মাখযুমের আযাদকৃত গোলাম যিয়াদ ইবন আবি যিয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম কোনো পুরুষ অথবা নারী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খাদেমকে উদ্দেশ্য করে বলতেন:

«أَلَكَ حَاجَةٌ؟ قَالَ : حَتَّى كَانَ ذَاتَ يَوْمٍ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ حَاجَتِى أَنْ تَشْفَعَ لِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، قَالَ : وَمَنْ دَلَّكَ عَلَى هَذَا ؟ قَالَ : رَبِّى عز وجل، قَالَ : أما لا فَأَعِنِّى بِكَثْرَةِ السُّجُودِ» .

তোমার কি কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে? তিনি বলেন: শেষ পর্যন্ত সে কোনো একদিন বলে বসলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমার প্রয়োজন হলো আপনি কিয়ামতের দিনে আমার জন্য সুপারিশ করবেন; তিনি বললেন: এই ব্যাপারে তোমাকে কে নির্দেশনা দিয়েছে? সে বলল: আমার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা; তিনি বললেন: কেন সুপারিশ করব না, তবে তুমি (আল্লাহকে) বেশি বেশি সাজদাহ করার মাধ্যমে আমাকে সহযোগিতা কর।” [আহমদ (৩/৫০০); হাইছামী তার ‘মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ’ ( مجمع الزوائد )–এর ২য় খণ্ডের ২৪৯ পৃষ্ঠায় বলেন, তার বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাকারী।]

৮৬. মুস‘আব আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«انطلق غلام منا، فأتى النبي صلى الله عليه وسلم ، فقال : أسألك أن تجعلني ممن تشفع له يوم القيامة ، قال : من أمرك أو علمك، أو دلك؟ قال : ما أمرني بها إلا نفسي، قال : إني أشفع لك، ثم رده فقال : أعني على نفسك بكثرة السجود» .

“আমাদের কাছ থেকে কোনো এক গোলাম চলে গেল; তারপর সে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসল, অতঃপর সে বলল: আমি আপনার নিকট চাই যে, আপনি আমাকে সেই ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত করবেন, যার জন্য কিয়ামতের দিনে আপনি সুপারিশ করবেন; তিনি বললেন: কে তোমাকে নির্দেশ দিয়েছে অথবা কে তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছে অথবা কে তোমাকে নির্দেশনা দিয়েছে? জবাবে সে বলল: আমার মনই আমাকে নির্দেশ দিয়েছে। তিনি বললেন: আমি তোমার জন্য সুপারিশ করব, অতঃপর তিনি তার কথা প্রত্যাহার করে নিলেন এবং বললেন: তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে (আল্লাহকে) বেশি বেশি সাজদাহ করার মাধ্যমে আমাকে সহযোগিতা কর।” [তাবারানী, বাগবী ও আল-বাযার; হাইছামী বলেন, তাবারানী বর্ণনা করেন এবং তার বর্ণনাকারীগণ বিশুদ্ধ হাদীসের বর্ণনাকারী। পূর্ববর্তী হাদীসটি তার সমর্থক এবং ফাতিমা বিনতে হোসাইনের বর্ণিত মুরসাল হাদীসটিও তার সমর্থক; ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ ( الزهد ), পৃ. ৪৫৫।]

২৫
যে মুসলিম ব্যক্তির সুপারিশ (শাফা‘আত) গ্রহণ করা হবে না
৮৭. উম্মু দারদা থেকে বর্ণিত, তিনি আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«إِنَّ اللَّعَّانِينَ لاَ يَكُونُونَ شُهَدَاءَ وَلاَ شُفَعَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» .

“নিশ্চয় কিয়ামতের দিন অভিশাপ দানকারীগণ সাক্ষী ও সুপারিশকারী হবে না।” [সহীহ মুসলিম (৪/২০০৬)।]

২৬
দুনিয়াবী শাফা‘আত
দুনিয়াবী শাফা‘আতসমূহ থেকে কিছু শরী‘আতসম্মত এবং কিছু শরী‘আতসম্মত নয়; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

﴿مَّن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةً حَسَنَةٗ يَكُن لَّهُۥ نَصِيبٞ مِّنۡهَاۖ وَمَن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةٗ سَيِّئَةٗ يَكُن لَّهُۥ كِفۡلٞ مِّنۡهَاۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ مُّقِيتٗا ٨٥﴾ [ النساء : ٨٥ ]

“কেউ কোনো ভালো কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে এবং কেউ কোনো মন্দ কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর নজর রাখেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮৫]

হাফেয ইবন কাসীর রহ. বলেন: আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿مَّن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةً حَسَنَةٗ يَكُن لَّهُۥ نَصِيبٞ مِّنۡهَاۖ ﴾ “কেউ কোনো ভালো কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে” অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো বিষয়ে চেষ্টা-সাধনা করে, অতঃপর তার ওপর ভালো কিছু গড়ে উঠে, তাহলে তার জন্য এর থেকে অংশ থাকবে।

﴿وَمَن يَشۡفَعۡ شَفَٰعَةٗ سَيِّئَةٗ يَكُن لَّهُۥ كِفۡلٞ مِّنۡهَاۗ ﴾ “আর কেউ কোনো মন্দ কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে।” অর্থাৎ ঐ কাজের দায়ভার তার ওপর চেপে বসবে, যা তার চেষ্টা-সাধনা ও পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে উদ্ভূত হয়েছে; যেমনটি সহীহ হাদীসের মধ্যে সাব্যস্ত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«اشفعوا تؤجروا ويقضي الله على لسان نبيه صلى الله عليه و سلم ما شاء» .

“তোমরা সুপারিশ কর, তোমাদেরকে সাওয়াব দেওয়া হবে, আর আল্লাহ যেন তাঁর ইচ্ছা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে চূড়ান্ত করেন”। [সহীহ বুখারী (৩/৩৯৯); সহীহ মুসলিম (৪/২০২৬)।]

আর শাফা‘আতের মধ্য থেকে যা বৈধ এবং যা হারাম বা অবৈধ, পবিত্র সুন্নাহ তার বর্ণনা নিয়ে এসেছে।

৮৮. আবূ মূসা আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«كان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا جاءه السائل أو طلبت إليه حاجة قال : «اشفعوا تؤجروا ويقضي الله على لسان نبيه صلى الله عليه و سلم ما شاء» .

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কেউ কিছু চাইলে বা প্রয়োজনীয় কিছু চাওয়া হলে তিনি বলতেন: তোমরা সুপারিশ কর, তোমাদেরকে সাওয়াব দেওয়া হবে, আর আল্লাহ যেন তাঁর ইচ্ছা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে চূড়ান্ত করেন”। [সহীহ বুখারী (৩/৩৯৯); সহীহ মুসলিম (৪/২০২৬)।]

৮৯. মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا، فَإِنِّى لأُرِيدُ الأَمْرَ فَأُؤَخِّرُهُ كَيْمَا تَشْفَعُوا فَتُؤْجَرُوا , فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : «اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا» .

“তোমরা সুপারিশ কর, তোমাদেরকে সাওয়াব দেওয়া হবে। সুতরাং আমি কোনো বিষয়ে (ফয়সালা দিতে) বিলম্ব করি, যাতে তোমরা সুপারিশ কর এবং তোমাদেরকে সাওয়াব দেওয়া হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা সুপারিশ কর, তোমাদেরকে সাওয়াব দেওয়া হবে’।” [আবূ দাউদ (৫/৩৪৭); নাসায়ী (৫/৫৮); তার সনদ সহীহ।]

৯০. ‘আমর ইবন শো‘আইব থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (তাঁর দাদা) বলেন:

«شهدت رسول الله صلى الله عليه و سلم يوم حنين , وجاءته وفود هوازن فقالوا : يا محمد انا أصل وعشيرة فمن علينا من الله عليك , فإنه قد نزل بنا من البلاء مالا يخفي عليك , فقال : «اختاروا بين نسائكم وأموالكم وأبنائكم» .

قالوا : خيرتنا بين أحسابنا وأموالنا نختار أبناءنا .

فقال : «أما ما كان لي ولبني عبد المطلب فهو لكم فإذا صليت الظهر فقولوا انا نستشفع برسول الله صلى الله عليه وسلم على المؤمنين وبالمؤمنين على رسول الله صلى الله عليه و سلم في نسائنا وأبنائنا » .

قال : ففعلوا , فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : « أما ما كان لي ولبني عبد المطلب فهو لكم» .

وقال المهاجرون ما كان لنا فهو لرسول الله صلى الله عليه و سلم وقالت الأنصار مثل ذلك .

وقال عيينة بن بدر : أما ما كان لي ولبني فزارة فلا .

وقال الأقرع بن حابس : أما أنا وبنو تميم فلا .

وقال عباس بن مرداس : أما أنا وبنو سليم فلا .

فقالت الحيان كذبت , بل هو لرسول الله صلى الله عليه و سلم .

فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : «يا أيها الناس ردوا عليهم نساءهم وأبناءهم فمن تمسك بشيء من الفيء فله علينا ستة فرائض من أول شيء يفيئه الله علينا» .

ثم ركب راحلته وتعلق به الناس , يقولون : اقسم علينا فيئنا بيننا حتى ألجؤوه إلى سمرة فخطفت رداءه .

فقال : «يا أيها الناس ! ردوا على ردائي , فوالله لو كان لكم بعدد شجر تهامة نعم لقسمته بينكم , ثم لا تلقوني بخيلا ولا جبانا , ولا كذوبا» .

ثم دنا من بعيره فأخذ وبرة من سنامه فجعلها بين أصابعه السبابة والوسطى , ثم رفعها فقال : « يا أيها الناس ليس لي من هذا الفيء ولا هذه الا الخمس والخمس مردود عليكم فردوا الخياط والمخيط فإن الغلول يكون على أهله يوم القيامة عارا ونارا وشنارا» .

فقام رجل معه كبة من شعر , فقال : أني أخذت هذه أصلح بها بردعة بعير لي قال : «أما ما كان لي ولبني عبد المطلب فهو لك» .

فقال الرجل : يا رسول الله أما إذ بلغت ما أرى فلا أرب لي بها ونبذها» .

“আমি হুনাইন যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত; তাঁর নিকট হাওয়াযিন গোত্রের প্রতিনিধি দল আগমন করল। অতঃপর তারা বলল: হে মুহাম্মাদ! আমরা (তোমার) বংশের মূল ও আত্মীয়স্বজন। সুতরাং তুমি আমাদের ওপর দয়া কর, আল্লাহ তোমার ওপর দয়া করবেন। কারণ, তিনি আমাদেরকে এমন এক বালা-মুসিবতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন, যা তোমার কাছে অস্পষ্ট নয়; তখন তিনি বললেন: তোমরা তোমাদের নারীগণ, ধন-সম্পদ ও সন্তানদের মাঝ থেকে বেছে নাও।

তারা বলল: আপনি আমাদেরকে আমাদের বংশ ও ধন-সম্পদের ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে বেছে নিচ্ছি।

অতঃপর তিনি বললেন: তবে আমার এবং বনু আবদুল মুত্তালিবের জন্য যা রয়েছে, তা তোমাদের জন্য। সুতরাং আমি যখন যোহরের সালাত আদায় করব, তখন তোমরা বলবে: আমরা আমাদের নারী ও সন্তানগণের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের মাধ্যমে মুমিনগণের নিকট সুপারিশ প্রার্থনা করব এবং মুমিনগণের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূলের নিকট সুপারিশ প্রার্থনা করব।

তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন: অতঃপর তারা তাই করল; তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার এবং বনু আবদুল মুত্তালিবের জন্য যা রয়েছে, তা তোমাদের জন্য।

অতঃপর মুহাজিরগণ বলল: আমাদের জন্য যা রয়েছে, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য, আর আনসারগণও অনুরূপ বলল।

আর ‘উয়াইনা ইবন বদর বলেন: তবে আমার ও বনু ফাযারা’র জন্য যা রয়েছে, তা নয়।

আর আকরা‘ ইবন হাবেস বলেন: আর আমার ও বনু তামীমের জন্য যা রয়েছে, তা নয়।

আর আব্বাস ইবন মিরদাস বলেন: আর আমার ও বনু সুলাইমের জন্য যা রয়েছে, তা নয়।

অতঃপর দু’গোত্রের লোকেরা [অনুরূপ রয়েছে ‘আল-মুসনাদ’ এর মধ্যে, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৮; সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৯২; আল-বিদায়া, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৫৩। সুতরাং বনু সুলাইম বলেছে: না, যা আমাদের জন্য রয়েছে, তা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য; তিনি বলেন, আব্বাস বলেছেন: হে বনু সুলাইম! তোমরা আমাকে দুর্বল করে দিয়েছ।] বলল: তুমি মিথ্যা বলেছ; বরং তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে জনগণ! তোমরা তাদের নিকট তাদের নারী ও সন্তানদেরকে ফেরত দিয়ে দাও। সুতরাং এরপর এ ‘ফায়’ (যুদ্ধলব্ধ) সম্পদ যদি কারও কাছে থাকে তবে সে যেন তাও দিয়ে দেয়, অতঃপর প্রথম যে ‘ফায়’ সম্পদ আল্লাহ আমাদেরকে দান করবেন, তা থেকে আমি তাকে ছয়টি অংশ প্রদান করব।

অতঃপর তিনি তাঁর বাহনে আরোহন করলেন এবং মানুষ তাঁর সাথে লেগে গেল, তারা বলল: আপনি আমাদের মধ্যে আমাদের ফায়ের সম্পদ বণ্টন করে দিন, এমনকি তারা তাঁকে ‘সামুরা’ নামক বৃক্ষের নিকট আশ্রয় নিতে বাধ্য করল, অতঃপর তারা তাঁর চাদরও ছিনতাই করে নিল।

অতঃপর তিনি বলেন: হে মানুষ সকল! তোমরা আমাকে আমার চাদরটি ফেরত দাও। কারণ, আল্লাহর শপথ! যদি তোমাদের জন্য মক্কা নগরীর গাছপালার সংখ্যা পরিমাণ উট অর্জিত হয়, তবে তা আমি তোমাদের মাঝে বন্টন করে দিব; অতঃপর তোমরা আমাকে কৃপণ, কাপুরুষ ও মিথ্যাবাদী হিসেবে পাবে না।

অতঃপর তিনি তাঁর উটের নিকটবর্তী হলেন এবং তার কুঁজের পশম ধরলেন, তারপর তা তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলের মাঝখানে রাখলেন; অতঃপর তিনি তা উঁচু করলেন এবং বললেন: হে মানুষ সকল! আমার জন্য এই ‘ফায়’ নামক সম্পদ ও এই (পশম) থেকে এক-পঞ্চমাংশ ব্যতীত আর কিছুই নেই, আর এক-পঞ্চমাংশও তোমাদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং তোমরা সুঁই-সুতার মত তুচ্ছ জিনিসও ফেরত দিয়ে দাও। কারণ, আত্মসাৎকৃত সম্পদ কিয়ামতের দিনে তার পরিবার-পরিজনের জন্য অপমান অথবা আগুন অথবা কলংকজনক হবে।

অতঃপর জনৈক ব্যক্তি দাঁড়ালেন, তাঁর সাথে ছিল এক গোছা চুল; তারপর সে বলল: আমি এটা নিয়েছি এর দ্বারা আমার উটের গদি পরিষ্কার করব; তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: আমার এবং আবদুল মুত্তালিবের জন্য যা রয়েছে, তা তোমার জন্য।

অতঃপর লোকটি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! অবস্থা যখন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যা আমি দেখছি, তখন তা আমার কোনো প্রয়োজন নেই।” [আহমদ (২/১৮৪); ইবন ইসহাক, যেমন সীরাতে ইবন হিশামে (২/২/৪৮৯) রয়েছে; আর সনদে কোনো সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ।]

৯১. আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, বারীরার স্বামী ক্রীতদাস ছিল, তাকে মুগীস বলে ডাকা হত। আমি যেন তাকে এখনও দেখছি, সে বারীরার পিছনে কেঁদে কেঁদে ঘুরছে, আর তার দাড়ি বেয়ে অশ্রু ঝরছে; তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

«يا عباس ! ألا تعجب من حب مغيث بريرة ومن بغض بريرة مغيثا ؟ . فقال النبي صلى الله عليه و سلم : لو راجعته . قالت يا رسول الله تأمرني ؟ قال : إنما أنا أشفع . قالت لا حاجة لي فيه» .

“হে ‘আব্বাস! বারীরার প্রতি মুগীসের ভালোবাসা এবং মুগীসের প্রতি বারীরার অনাসক্তি দেখে তুমি কি আশ্চর্যাম্বিত হও না? এরপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: (বারীরা) তুমি যদি তার কাছে আবার ফিরে যেতে! সে বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন: আমি সুপারিশ করছি মাত্র। সে বলল: আমার জন্য তার মধ্যে কোনো প্রয়োজন নেই।” [সহীহ বুখারী, তালাক অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: বারীরার স্বামীর ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ ( باب شفاعة النبي صلى الله عليه وسلم على زوج بريرة ), হাদীস নং ৪৯৭৯।]

২৭
যে ব্যাপারে সুপারিশ করা বৈধ নয়
৯২. ‘উরওয়া থেকে বর্ণিত, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«أن قريشا أهمهم شأن المرأة المخزومية التي سرقت , فقالوا : ومن يكلم فيها رسول الله صلى الله عليه و سلم ؟ فقالوا : ومن يجترئ عليه إلا أسامة ابن زيد حب رسول الله صلى الله عليه و سلم , فكلمه أسامة , فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم : « أتشفع في حد من حدود الله » . ثم قام فاختطب ثم قال : « إنما أهلك الذين قبلكم أنهم كانوا إذا سرق فيهم الشريف تركوه , وإذا سرق فيهم الضعيف أقاموا عليه الحد , وايم الله ! لو أن فاطمة بنت محمد سرقت لقطعت يدها» .

“মাখযোমী গোত্রের একজন মহিলা চুরি করলে (তার প্রতি হদ প্রয়োগের ব্যাপারে) কুরাইশগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁরা বলল, কে এই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কথা বলতে (সুপারিশ করতে) পারে? তখন তাঁরা বললেন, এ ব্যাপারে উসামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ব্যতীত আর কারও সাহস নেই। তিনি হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তিনি এ ব্যাপারে কথোপকথন করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি কি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হদ্দের (শাস্তির) ব্যাপারে সুপারিশ করতে চাও? অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন: ‘হে লোকসকল! নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণ ধ্বংস হয়েছে এই কারণে যে, তাদের মধ্যে যখন কোনো সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যদি কোনো দুর্বল লোক চুরি করত, তবে তারা তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত, তবে নিশ্চয় আমি তার হাত কেটে দিতাম।” [সহীহ বুখারী (৬/৫১৩); সহীহ মুসলিম (৩/১৩১৫)।]

৯৩. ইয়াহইয়া ইবন রাশেদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র অপেক্ষায় বসেছিলাম, অতঃপর তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে আসলেন এবং বসলেন, তারপর বললেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

«مَنْ حَالَتْ شَفَاعَتُهُ دُونَ حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ فَقَدْ ضَادَّ اللَّهَ , وَمَنْ خَاصَمَ فِى بَاطِلٍ وَهُوَ يَعْلَمُهُ لَمْ يَزَلْ فِى سَخَطِ اللَّهِ حَتَّى يَنْزِعَ عَنْهُ , وَمَنْ قَالَ فِى مُؤْمِنٍ مَا لَيْسَ فِيهِ أَسْكَنَهُ اللَّهُ رَدْغَةَ الْخَبَالِ حَتَّى يَخْرُجَ مِمَّا قَالَ» .

“যে ব্যক্তির সুপারিশ আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত হদ্দ বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে আল্লাহর বিরোধিতা করে, আর যে ব্যক্তি জেনে বুঝে বাতিলের পক্ষে বিতর্ক করে, সে আল্লাহর অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ না সে তা থেকে বিরত থাকে, আর যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের ব্যাপারে এমন কথা বলে যা তার মধ্যে নেই, সেই ব্যক্তিকে আল্লাহ ধ্বংসের কাদা-পানিতে বসবাস করাবেন, যতক্ষণ না সে তার বলা কথা প্রত্যাহার করবে।” [আবূ দাউদ (৪/২৩); আহমদ (২/৭০); হাকেম (২/২৭); বায়হাকী (৮/২৩২); হাকেম বলেন, সনদটি বিশুদ্ধ এবং তাকে ইমাম যাহাবী স্বীকৃতি দিয়েছেন; তার সমর্থনে ইমাম আহমদের মতে আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র বর্ণিত হাদীস রয়েছে (২/৮২)। সুতরাং হাদীসটি সহীহ।]

৯৪. হিশাম ইবন ‘উরওয়া থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«شفع الزبير في سارق , فقيل : حتى يبلغه الإمام , فقال : إذا بلغ الإمام فلعن الله الشافع والمشفع كما قال رسول الله صلى الله عليه و سلم» .

“যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চোরের ব্যাপারে সুপারিশ করলেন, তখন তাঁকে বলা হলো, সুপারিশ করতে পারবে বিষয়টি ইমামের নিকট পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত। অতঃপর তিনি বললেন: যখন ইমামের নিকট (বিষয়টি) পৌঁছাবে, তখন (সুপারিশ করলে) আল্লাহ তা‘আলা সুপারিশকারী ও যার জন্য সুপারিশ করা হয় উভয়ের প্রতি লা‘নত (অভিশাপ বর্ষণ) করেন, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন।” [দারাকুতনী (৩/২০৫); হাইছামী, আল-মাজমা‘ (৬/২৫৯); তাবারানী, ‘আল-কাবীর’ ও ‘আল-আওসাত’ এবং তাতে আবূ গুযাইয়া নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যাকে আবূ হাতেম ও অন্যান্যরা দুর্বল বলেছেন, আর হাকেম তাকে সিকা বা নির্ভরযোগ্য বলেছেন, হাযেমী রহ. বলেছেন: হাদীসটির সমর্থনে ইমাম মালেক রহ.-এর ‘মুয়াত্তা’র মধ্যে হাদীস রয়েছে (৩/৪৯); আর বায়হাকী রহ.-এর নিকট তার সনদে কোনো সমস্যা নেই; আর দারাকুতনী’র মতে, এই হাদীসটির সমর্থনে আর একটি হাদীস সাফওয়ান ইবন উমাইয়া থেকে বর্ণিত আছে (৩/২০৪)।]

৯৫. ‘উরওয়া ইবন যোবায়ের থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:

«اشفعوا في الحدود ما لم تبلغ السلطان فإذا بلغت السلطان فلا تشفعوا» .

“তোমরা শরী‘আত নির্ধারিত শাস্তির ব্যাপারে ততক্ষণ পর্যন্ত সুপারিশ কর, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিষয়টি বিচারক বা শাসকের দরবারে না পৌঁছায়। সুতরাং যখন বিষয়টি শাসক বা বিচারকের দরবারে পৌঁছাবে, তখন তোমরা আর সেই ব্যাপারে সুপারিশ করবে না। [বায়হাকী (৮/৩৩৩), আর তার সনদের বর্ণনাকারীগণ সকলেই বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।]

২৮
ফায়দা ও গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা
* নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কার জন্য সর্বপ্রথম সুপারিশ করবেন, তা বর্ণনায় কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই; তবে ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বর্ণিত হাদীসটি মউদু‘ তথা বানোয়াট, তার শব্দ হলো, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«أول من أشفع له يوم القيامة من أمتي أهل بيتي ثم الأقرب فالأقرب من قريش ثم الأنصار ثم من آمن بي واتبعني من أهل اليمن ثم من سائر العرب ثم الأعاجم ومن أشفع له أولا أفضل» .

“কিয়ামতের দিনে আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম আমি যার জন্য সুপারিশ করব, তারা হলো আমার পরিবার-পরিজন, অতঃপর কুরাইশ বংশের পরপর নিকটাত্মীয়গণ, অতঃপর আনসারগণ, অতঃপর ইয়ামানের অধিবাসীগণের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং আমাকে অনুসরণ করেছে, অতঃপর সকল আরববাসীর মধ্য থেকে (যে ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান এনেছে এবং আমাকে অনুসরণ করেছে), অতঃপর অনারবগণ, আর সর্বপ্রথম আমি যার জন্য সুপারিশ করব, সে উত্তম। -হাদীসটি আল-খতীব বর্ণনা করেছেন, মুদিহু আওহামিল জাম‘য়ি ওয়াত তাফরীক [ موضح أوهام الجمع والتفريق (২/৪৮)], আর তাতে হাফস ইবন সুলাইমান নামে একজন বর্ণনাকারী আছেন, তার ব্যাপারে ইমাম আহমদ ও নাসায়ী রহ. বলেছেন: সে ‘মাতরুক’ (পরিত্যাজ্য) আর ইবনুল জাওযী হাদীসটিকে ‘আল-মাউযু‘আত’ ( الموضوعات ) এর মধ্যে (৩/২৫০) উল্লেখ করেছেন এবং তাকে সুয়ুতী (মাউযু বলে) ‘আল-লা‘লী ( اللألي ) এর মধ্যে (২/৪৫০) স্বীকৃতি দিয়েছেন।

* আর অপর এক বর্ণনায় এসেছে:

«أول من أشفع له أهل المدينة وأهل مكة وأهل الطائف»

“আমি প্রথম যার জন্য সুপারিশ করব, তারা হলো মদীনাবাসী, মক্কাবাসী ও তায়েফবাসী। হাদীসটি ইমাম বুখারী রহ. বর্ণনা করেছেন, আত-তারীখ [ التاريخ (৫/৪০৪)] গ্রন্থে। এই হাদীসটি এমন, যা দুর্বল ও অপরিচিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হাদীসসমূহের অন্তর্ভুক্ত, আর এই জন্য হাফেয হাইছামী রহ. বলেন: হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং তাতে একদল আছেন, যাদেরকে আমি চিনি না।

* বর্ণিত আছে:

«من سقى الناس شربة من ماء , أو قضى حاجة للناس , فإنهم يشفعون له» .

“যে ব্যক্তি মানুষকে পানি পান করাবে অথবা মানুষের কোনো প্রয়োজন পূরণ করবে, তারা তার জন্য সুপারিশ করবে। -হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবন আবিদ দুনিয়া, ‘কাদাউল হাওয়ায়েয’ ( قضاء الحوائج ), পৃ. ৯৯; কিন্তু হাদীসটি দুর্বল। কেননা তার সনদে ইয়াযীদ আর-রাকাশী নামে একজন বর্ণনাকারী আছে, যে দুর্বল। বরং ইমাম নাসায়ী বলেছেন: (সে কঠোরভাবে সমালোচিত) পরিত্যক্ত ও পরিত্যাজ্য।

* বর্ণিত আছে: ওসমান ইবন ‘আফফান রহ. রবী‘আ ও ‘মুদার’ গোত্রের সমপরিমাণ লোকের ব্যাপারে সুপারিশ করবেন, কিন্তু হাদীসটি হাসান আল-বসরীর মুরসাল বর্ণনাসমূহের একটি; বর্ণিত আছে: তিনি ওয়াইস আল-কারনী... দেখুন: আমাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ইমাম আলকারী’র ‘কিতাবুল মা‘দান আল-মা‘দানী ফী ফদলে ওয়াইস আল-কারনী’ ( كتاب المعدن المعدني في أويس القرني )

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«من خَرَج حاجّاً يُرِيد وَجهَ اللّهِ ، فَقَد غَفَرَ اللّهُ لَه ما تَقَدَّمَ من ذَنَبِه وَمَا تَأَخَّر، وَشَفَعَ فِيمَن دَعَا لَه» .

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হাজ্জ পালনকারী অবস্থায় বের হবে, আল্লাহ তার পূর্বের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন, আর সে ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করবে, যে তার জন্য দো‘আ করবে।” -হাদীসটি আবূ না‘ঈম ‘আল-হিলয়া’ ( الحلية ) গ্রন্থে (৭/২৩৫) বর্ণনা করেছেন এবং তার সনদে ইসমাঈল ইবন ইয়াহইয়া আত-তায়মী নামে এক বর্ণনাকারী রয়েছে, যে বানিয়ে বানিয়ে হাদীস বর্ণনা করত।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«ما من معمر يعمر في الإسلام ... فإذا بلغ التسعين غفر الله له ما تقدم من ذنبه وما تأخر , وسمي أسير الله في أرضه وشفع لأهل بيته» .

“যে কোনো বয়স্ক ব্যক্তি, যে ইসলামের মধ্যে থেকে দীর্ঘজীবী হয়... সুতরাং যখন সে নব্বই বছর বয়সে উপনীত হবে, তখন আল্লাহ তার পূর্বের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন, আর আল্লাহর যমীনে সে ‘আল্লাহর বন্দী’ নামে খ্যাতি লাভ করবে এবং সে তার পরিবার-পরিজনের জন্য সুপারিশ করবে।”

হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আহমদ (৩/২১৭); ইবন হিব্বান, আদ-দু‘আফা ( الضعفاء ), ৩/১৩২, তার সনদে ইউসূফ ইবন আবি বুরদা নামে এক বর্ণনাকারী রয়েছে: কোনোভাবেই সে গ্রহণযোগ্য নয়। দেখুন: ইবনুল জাওযী, ‘আল-মাউযু‘আত’ ( الموضوعات ) [১/১৭৯-১৮১]।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«إن من فتح عسقلان يبعث الله منها خمسين ألف شهيد يشفع الرجل منهم في مثل ربيعة و مضر» .

“যে ব্যক্তি ‘আসকালান জয় করবে, আল্লাহ তা‘আলা সেখান থেকে পঞ্চাশ হাজার শহীদ প্রেরণ করবেন, তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি ‘রবী‘য়া’ ও ‘মুদার’ গোত্রের সমপরিমাণ লোকের ব্যাপারে সুপারিশ করবে।”

হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইবন হিব্বান, আদ-দু‘আফা ( الضعفاء ), ৩/১৩২, তার সনদে হামযা ইবন হামযা নামে এক বর্ণনাকারী রয়েছে, যার হাদীস পরিত্যাক্ত, এক পয়সার সমানও নয়!

দেখুন: ইবনুল জাওযী, ‘আল-মাউযু‘আত’ ( الموضوعات ) [২/৫২]।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয় যে, ‘সিলা’ নামের এক ব্যক্তির সুপারিশে এই পরিমাণ এই পরিমাণ লোক জানাতে প্রবেশ করবে। — হাদীসটি আবূ না‘ঈম ‘আল-হিলয়া’ ( الحلية ) গ্রন্থে (২/২৪১) বর্ণনা করেছেন, কিন্তু হাদীসটি ‘মু‘দাল’।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«أنا شفيع لكلّ رجلين اتّخيا في الله من مبعثي إلى يوم القيامة» .

“আমি এমন প্রত্যেক দুই ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করব, যারা আল্লাহর উদ্দেশ্য একে অপরের ভাই হয়েছে। আমার রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হতে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত”। -হাদীসটি আবূ না‘ঈম ‘আল-হিলয়া’ ( الحلية ) গ্রন্থে (১/৩৬৭) বর্ণনা করেছেন, তার সনদে ‘আমর ইবন খালেদ আল-কুফী নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যে মুহাদ্দিসদের নিকট মিথ্যাবাদী বলে পরিচিত।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«من أحيا بين الصلاتين غفر له , و شفع له ملكا» .

“যে ব্যক্তি দুই সালাতের মধ্যস্থিত সময় জীবিত রাখবে (ইবাদতের মাধ্যমে), তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং তার জন্য তার ফিরিশতাদ্বয় সুপারিশ করবে।” -হাদীসটি আবূ না‘ঈম ‘আখবারু আসবাহান’ ( أخبار أصبهان ) গ্রন্থে (২/৩৪৫) বর্ণনা করেছেন, তার সনদে সাফাদী ইবন সিনান নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যে কোনো কিছুই (বর্ণনাকারীই) নয়, যেমনটি ইয়াহইয়া ইবন মু‘ঈন বলেছেন।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«ثلاثة أنا شفيع لهم يوم القيامة : الضارب بسيفه أمام ذريتي، والقاضي لهم حوائجهم عندما اضطروا إليه، والمحبّ لهم بقلبه ولسانه» .

কিয়ামতের দিনে আমি তিন ব্যক্তির জন্য সুপারিশকারী হব: তারা হলো: (১) আমার বংশধরের সামনে (তাদেরকে রক্ষার উদ্দেশ্য) নিজ তরবারী নিয়ে অবস্থানকারী ব্যক্তি। (২) তাদের প্রয়োজনসমূহ পূরণকারী ব্যক্তি, যখন তারা তার নিকট বাধ্য হয়। (৩) অন্তর দিয়ে ও মুখের ভাষায় তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী ব্যক্তি। শাওকানী এই হাদীসটিকে ‘আল-ফাওয়ায়েদুল মাজমু‘আ’ ( الفوائد المجوعة ) গ্রন্থে ‘মাউযু’ (বানোয়াট) বলেছেন, পৃ. ৩৯৭।

* হাদীসসমষ্টি:

«من حفظ على أمتي أربعين حديثا في السنة كنت له شفيعا يوم القيامة» .

“যে ব্যক্তি আমার উম্মতের জন্য সুন্নাহ প্রসঙ্গে চল্লিশটি হাদীস মুখস্থ করবে, তাহলে কিয়ামতের দিনে আমি তার জন্য সুপারিশকারী হব।

এই হাদীসটি বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে কোনোটিই শুদ্ধ নয় [দেখুন: জামে‘উ বয়ানিল ‘ইলম ওয়া ফাদলুহু ( جامع بيان العلم وفضله ), পৃ. ৫২; কাযী ‘আইয়ায, আল-আলমা‘উ ( الألماع ), পৃ. ২৩; ইরাকীর তাখরীজসহ ‘ইহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন ( إحياء علوم الدين ) [১/১৫]; ইবনুল জাওযী, আল-‘ইলালুল মুতানাহিয়্যা [ العلل المتناهية ] (১/১১১)।]।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«من غش العرب لم يدخل في شفاعتي ولم تنله مودتي»

“যে ব্যক্তি আরবদেরকে প্রতারিত করে, সেই ব্যক্তি আমার শাফা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হবে না এবং সে আমার ভালোবাসা লাভ করবে না।” -ইমাম তিরমিযী (৫/৩৮১) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তার সনদে হুসাইন ইবন উমার আল-আহমাসী নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যাকে মুহাদ্দিসগণ দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর ইবন তাইমিয়্যা রহ. বলেন: হাদীস বিশারদগণের নিকট এটা হাদীস নয় এবং তার মধ্যে অপরিচিত বর্ণনা হওয়ার দিকটি সুস্পষ্ট, আমি বলি: হ্যাঁ, আল্লাহর কসম!

* মাওকুফ হিসেবে সহীহ:

«من كذب بالشفاعة فليس له فيها نصيب» .

“যে ব্যক্তি শাফা‘আতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, সেই ব্যক্তির জন্য তাতে কোনো অংশ নেই।”

সুতরাং এসব মূর্খদের সাবধান হওয়া উচিত, যারা শাফা‘আতের হাদীসসমূহকে ‘আহাদ’ হাদীস বলে দলীল দিয়ে অস্বীকার করে; যেভাবে আমি তা দেখেছি..., বিষয়টি আসলে অনুরূপ নয়, আর তাদের দলীলসমূহ দুর্বল হওয়ার কারণে তা আলোচনার যোগ্যতা রাখে না। আর যাদের অন্তরে অন্ধত্ব রয়েছে তাদের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

* এই হাদীসটি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত নয় যে, তিনি বলেছেন:

«يشفع يوم القيامة ثلاثة : الأنبياء , ثم العلماء , ثم الشهداء» .

“কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর মানুষ সুপারিশ করবেন: নবীগণ, অতঃপর আলেমগণ, অতঃপর শহীদগণ।”

হাদিসটি আল-আজুররী ‘আশ-শরী‘য়াহ’ ( الشريعة ) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, পৃ. ৩৫০; ইবন আবদিল বার বর্ণনা করেছেন ‘জামে‘উ বয়ানিল ‘ইলম ওয়া ফাদলুহু’ ( جامع بيان العلم و فضله ) নামক গ্রন্থে, আর তাদের পূর্বে বর্ণনা করেছেন ইমাম ইবন মাজাহ তাঁর ‘আস-সুনান’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন (২/১৪৪৩) হাদীসটি খুবই দুর্বল। কেননা তার সনদে ‘আল্লাক ইবন আবি মুসলিম নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। আর আছে ‘আনবাসা ইবন আবদির রহমান নামে এক বর্ণনাকারী, যার ব্যাপারে ইমাম যাহাবী (আল-মিযান গ্রন্থে) ও বুখারী রহ. বলেন: মুহাদ্দিসগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আর আবূ হাতেম বলেন: সে বানিয়ে বানিয়ে হাদীস বর্ণনা করত।

* এই হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«يبعث الله العالم والعابد ، فيقال للعابد : ادخل الجنة ويقال للعالم : اشفع للناس كما أحسنت أدبهم» .

“আল্লাহ আলেম ও ইবাদতকারী ব্যক্তিকে পুনরুত্থিত করবেন। অতঃপর ‘আবেদ তথা ইবাদতকারী ব্যক্তিকে বলা হবে: তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর, আর আলেমকে বলা হবে: তুমি মানুষের জন্য সুপারিশ কর, যেমনিভাবে তুমি তাদের আদব-কায়দাকে সুন্দর করেছ।” -হাদীসটি ইবন আবদিল বার ‘জামে‘উ বয়ানিল ‘ইলম ওয়া ফাদলিহী’ ( جامع بيان العلم و فضله ) নামক গ্রন্থের (১/২৭) মধ্যে বর্ণনা করেছেন। আর হাদীসটি নিম্নোক্ত দুর্বল বর্ণনাকারীদের ধারাবাকিতায় বর্ণিত:

১. শুবল ইবনুল ‘আলা কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ সঠিক নয়। [দেখুন: হাফেয ইবন হাজার ‘আসকালানী, ‘লিসানুল মীযান’ ( لسان الميزان )।]

২. হাবীব ইবন ইবরাহীম অপরিচিত শাইখ। [দেখুন: হাফেয ইবন হাজার ‘আসকালানী, ‘লিসানুল মীযান’ ( لسان الميزان )।]

* হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«من طاف بالبيت شُفع في سبعين من أهل بيته» .

“যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করবে, সেই ব্যক্তিকে তার পরিবার-পরিজন থেকে সত্তর জনের ব্যাপারে সুপারিশ করার সুযোগ দেওয়া হবে।” এই হাদীসটি খুবই দুর্বল। [তার সনদে মুগীরা ইবন কায়েস নামে এক বর্ণনাকারী রয়েছে, যার ব্যাপারে আবূ হাতেম বলেন, সে মুনকার হাদীস বর্ণনাকারী। আর তার সনদে ইয়াহইয়া আল-কাদাহ নামে এক বর্ণনাকারী রয়েছে, যার অনেকগুলো মুনকার হাদীস রয়েছে।] আর এই হাদীসটি আল-আযরাকী ‘আখবারু মক্কা’ ( أخبار مكة ) নামক গ্রন্থে (২/৪) বর্ণনা করেছেন।

* হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়:

«إذا كان عشية عرفة ... و إني قد شفعت محسنهم في مسيئه » .

“যখন আরাফার দিনের সন্ধ্যা হবে... আর আমি তাদের সৎকর্মশীলদেরকে তাদের গুনাহগারদের ব্যাপারে সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করে নেব বরং হাদীসটি মউযু‘ (বানোয়াট); হাদীসটি আবূ না‘ঈম ‘আখবারু আসবাহান’ ( أخبار أصبهان ) গ্রন্থে (১/৪১৮) বর্ণনা করেছেন।

এর কারণ হলো, তার সনদে ইসহাক ইবন বিশর আল-কামেলী নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যে মিথ্যাবাদী, যেমনটি ‘আল-মীযান’ নামক গ্রন্থে রয়েছে। [দেখুন: ইবনুল জাওযী, ‘আল-মাউযু‘আত’ ( الموضوعات ) [২/২১৬]।]

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য নিবেদিত, যিনি গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করাটাকে সহজ করে দিয়েছেন, তাঁর জন্য রয়েছে সার্বক্ষণিক প্রশংসা।

وسبحانك اللهم و بحمدك نشهد أن لا إله إلا أنت نستغفرك و نتوب إليك .

(হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র, আপনার জন্য প্রশংসা, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই, আমরা আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আমরা আপনার নিকট তাওবা করি)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন