hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

ওমর ইবনে আবদুল আজীজ

লেখকঃ রশীদ আখতার নদভী

হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র) এর দাদা মারওয়ান ইবনে হাকাম
মারওয়ান ইবনে হাকাম ইবনে আবুল আছ ইবনে উমাইয়া ইবনে আবদে শামছ ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে কুসাই।

বংশের দিক দিয়ে মারয়ান ছিলেন কুরাইশ বংশের লোক। তিনি ছিলেন আবদে শামছেন পুত্র ও উমাইয়া ছিলেন পরস্পর বৈমত্রেয় ভাই। ফলে তাদের মাঝে বৈমাতৃক সুলভ আচরণ বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে উমাইয়া হাশিমের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ ভাব পোষণ করতেন। এ হিংসা-বিদ্বেষ তাদের উত্তর পুরুষদের মধ্যেও বংশানুক্রমে চলে আসছিল।

হাশিম ও উমাইয়ার বংশধরগণ তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে একে অন্যের হিংসা-বিদ্বেষের কথা বিস্মৃত হতে পারেনি।

একই পিতামাহের বংশধর হওয়ার পরিণতি এটাই। তা না হলে হর্ব ও আবুল আস দু’জনই ধ্যান-ধারণায় একে অন্যের খুব ঘনিষ্টজন ছিলেন এবং তাদের মধ্যে এ জাতীয় হিংসা-বিদ্বেষ কখনো ছিল না। হরব এবং আবুল আস জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই একে অন্যের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন। তাদের এদু’য়ের ঐক্যের প্রভাব তাদের পূর্বপুরুষ আবু সুফিয়ান, হাকাম ও আফফানের উপরও পড়েছিল। আফফান এবং হাকাম একে অন্যের এতই ঘনিষ্ট ছিল যে, তাদের দু’জনের আশা-আকাঙ্ক্ষাও ছিল এক। তারা তাদের বংশধরগণকেও এ ধ্যান-ধারণার অংশীদা করেছিল। যদিও আফফানের পুত্র ওসমান এবং হাকামের পুত্র মারওয়ান ধ্যান-ধারণায় একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে ছিলেন, তবুও তারা একে অপরকে প্রীতির চোখে দেখতেন।

ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা) সেসব সাহাবাদের অন্যতম ছিলেন, যারা ইসলামের প্রথম দিকে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ও চাচা ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাঁকে কঠোর শাস্তি দিত এবং তারা উভয়ে হযরত ওসমান (লা) কে ইচ্ছামত প্রহার করত। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, যখন হাকাম মদীনায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, তখন হযরত ওসামন (রা) তাঁর ব্যক্তিগত ভদ্রতা বা পৈতৃক সম্পর্কের কারণে শুধু তাঁকে নিজগৃহেই আশ্রয়ই দেননি, এমনকি তার চাচা এবং চাচাত ভাইকে তাঁর ধন-সম্পদ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশীদার করেছিলেন।

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ইবনে সাদ হযরত ওসমান (রা) ও মারওয়ানের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বর্ণনা করে বলেন- হযরত মুহাম্মদ (রা)-এর ইন্তেকালের সময় মারওয়ানের বয়স ছিল আট বছর। তার পিতা হাকামের মৃত্যূ পর্যন্ত তিনিও তার পিতার সাথে মদীনায় বাস করছিলেন। হযরত ওসমান (রা)-এর খেলাফতকালে তাঁর চাচা হাকামের মৃত্যু হলে মারওয়ান সবসময় তাঁর চাচত ভাই ওসমান (রা)-এর সঙ্গী ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর প্রধান সচিব। হযরত ওসামন (রা) তাঁকে প্রচুর সম্পদ দান করেছিলেন। (তাবাকাতে ইবনে সা’দ, ৫ম খন্ড, পৃঃ ২৪, লন্ডনে মুদ্রিত)

ইনে সাদ আরও বলেন, হযরত ওসামন (রা)-এর সাথে মারওয়ানের এ ঘনিষ্টতার কারণে সাহাবায়ে কেরাম (রা) তাঁকে কটু কথা বলতেন, ভীরু ও দুর্বল বলতেন; কিন্তু এ ব্যাপারে হযরত ওসামন (রা) কারও কথা শুনতেন না। তিনি সবসময় মারওয়ানকে ভালবাসতেন, তাকে পরম প্রীতির চোখে দেখতেন, এমনকি যখন লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে ঘরে অবরোধ করল, তখন তাদের একটি দল তাঁর নিকট এসে এ প্রস্তাব দিল যে, মারওয়ানকে আমাদের হাতে সমর্পণ করুন, আমরা তার সাথে বুঝ-পড়া করব।

কিনতু হযরত ওসামান (রা) বিদ্রোহের ভাবমূর্তি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বিদ্রোহীদের শক্তি সম্পর্কেও তিনি অবগত ছিলেন। তিনি জানতেন, যদি বিদ্রোহীদের কথা রক্ষানা করেন তবে তাঁর প্রাণ বিপন্ন হবে। এতদসত্ত্বেও তিনি মারওয়ানকে বিদ্রোহীদের হাতে সমর্পণ করেননি।

(আবদুল ফরিদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮০)

তিনি মারওয়ানের প্রতি সহৃদয়তা প্রদর্শন করতে গিয়েই হযরত আলী, হযরত সাদ, হযরত যুবাইর, হযরত তালহা, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম ৯রা) গণের মতো বিশিষ্ট বন্ধু-বান্ধবের প্রিয়ভাজন হতে পারেননি।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবদুর রাব্বিহি বলেন- হযরত ওসমান (রা)-এর উপর মারওয়ানের অসাধারণ প্রভাবই তাঁর শাহাদাতের অন্যতম কারণ ছিল। বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামগণ চাইতেন যাতে খলীফা হযরত ওসমান (রা) মারওয়ানে প্রভাবমুক্ত থাকেন এবং খেলাপতের কাজ পরিচালনায় তিনিও যেন পূর্ববর্তী খলীফাদ্বয়ের মত বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম (রা) গণকে তাঁর পার্শ্বে রাখতে পারেননি। (ইবনে আবদে রাব্বিহি, ৪র্থ খণ্ড, ৯০ পৃ.)

ইবনে আবদে রাব্বিহি আরও বর্ণনা করেন- এ হাকাম রাসূলুল্লাহ (রা) হযরত আবুবকর (রা) এবং হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর চরম শত্রু ছিল অথচ হযরত ওসামন (লা) তাকে এনে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। (ইবনে আবদে রাব্বিহি ৩য় খণ্ড, ৯০ পৃ.)

হযরত ওসামন এবন আফফান (লা)-এর পিতা এবং হাকামের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, তার প্রভাব হযরত ওসমান (লা) ও মারওয়ানের মধ্যেও প্রতিষ্ঠিত ছিল। হযরত ওসমান (রা) সমস্ত দুনিয়াকেই নিজের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন তবুও মারওয়ানের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেননি।

ইবনে সাদ এ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন- অধিকাংশ লোক হযরত ওসমান (রা)-এর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করত যে, তিনি মারওয়ান কে তাঁর পার্শ্বে কেন রেখেছেন? এবং কেনইবা তিনি তার কথায় কাজ করেন? লোকেরা দেখত, যে সমস্ত নির্দেশ হযরত ওসমান (রা) দিয়েছেন বলে প্রচারিত হতো কিন্তু অধিকাংশই হযরত ওসমান( (রা) অবগত ছিলেন না। মারওয়ান নিজেই সেগুলি প্রচার করতেন। সে নির্দেশ পত্রে মারওয়ানের ব্যক্দিহ মতামতও থাকত অথচ খলীফা হযরত ওসমান (রা) এটা জানতেনই না। (তাবাবাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, ২৪-২৫পৃ.)

এটাই পরবর্তীতে হযরত ওসমান (রা)-এর শাহাদাতের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা)-এর পদচ্যুতির ব্যাপারে সরকারী সীলমোহর যুক্ত যে নির্দেশনামা প্রেণ করা হয়েছিল, সেটাও মারওয়ানের পক্ষ থেকেই প্রেণ করা হয়েছিল। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা) তাঁর সঙ্গী সাথীদেরসহ ফিরে এসে যখন হযরত ওসমান (রা)-এর নিকট এর ব্যাখ্যা দাবী করলেন, তখন তিনি এ নির্দেশনামার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এবং শপথ করে বললেন যে, তিনি এ ফরমান লিখেননি এবং প্রেরণও করেননি। এ ফরমান মারওয়ানের নিকটই রক্ষিত ছিল। এতো কিছু জানার পরও হযরত ওসমান (রা) তাকে পদচ্যুত করেননি এবং তার কোনো প্রকার শাস্তিরও ব্যবস্থা করেননি।

মারওয়ানের সাথে হযরত ওসমান (রা)-এর যে প্রীতি-ভালবাসার সম্পর্ক ছিল তা একমুখী ছিল না, বরং মারওয়ানও তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন।

ইবনে সাদ বলেন, বিদ্রোহীরা যখন হযর ওসমান (রা)-এর ঘর অবরোধ করল, তখন মারওয়ান খলীফা হযরত ওসমান (রা)-এর পক্ষে প্রাণপণে যুদ্ধ করে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। এক দুর্দান্ত সিপাহী তার পৃষ্ঠদেশ এমন জোরে তরবারী দ্বারা আঘাত করল যে, তিন সওয়ারী থেকে নীচে পড়ে গেলেন। এমন সময় উবাইদ ইবনে রীফা নামক এক ব্যাক্তি ছুরি হাতে তার উরপ ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে দিতে উদ্যত হল। তখন ছাকাফী বংশীয় ফাতেমা নাম্নী একজন মহিলা তাকে তিরষ্কার করে বলল, এ লোকটি পূর্বেই ইন্তেকাল করেছে, অনর্থক ছুরিটি নষ্ট করছ কেন?

ইবনে সাদ আরও বলেন- মারওয়ানের পূর্বপূরুষগণ এ মহিলার অপরিসীম অনুগ্রহের কথা কোনদিন বিস্মৃত হয়নি। সে সময় যদি এ মহিরা সে সিপাহীর সামনে অন্তরায় সৃষ্টি না করত তবে সে ব্যক্তি ছুরি দ্বারা তার দেহ থেকে মস্তক আলাদ করে দিত। এ মহিলা শুধু তাকে হত্যা করতেই নিষেধ করেনি, উপরন্তু তাকে উঠিয়ে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছিল।

জঙ্গে-জামালের বা উটের যুদ্ধেল পর মারওয়ানসহ হযরত ওসমান (রা)-এর অন্যান্য গুণমুগ্ধ ও সহানুভূতিশীল লোকেরা যখন পরাজিত হল এবং হযরত আলী (রা) জয়ী হলেন, তখন মারওয়ান হযরত আলী (রা)-এর হাতে বায়আত করে মদীনায় এসে বসবাস করতে লাগলেন।

হযরত আলী (রা) –এর শাহাদত এবং হযরত হাসান (লা)-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের পর যখন আমীরে মুয়াবিয়া (রা) খেলাফতের মসদন দখল করে নিয়ে মারওয়ানকে মদীনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন, তখন যে ভদ্র মহিলা তাকে তার প্রাণ রক্ষা করেছিল এবং তার চিকিৎসার ব্যব্থা করেছিল, তিনি তাকে ও তার বংশধরগণকে পুরস্কৃত করলেন।

হযরত মুয়াবিয়া (রা) কিছুদিন পর মারওয়ানকে মদীনার শাসনকর্তার পদ থেকে বরখাস্ত করে সাঈদ ইবনে আসকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেন। তারপর আবার তিনি সাঈদ ইবনে আসকে বরখাস্ত করে মারওয়ানকে সে পদে পুণর্বহাল করলেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) মারওয়ানকে তার মৃত্যুর পূর্বে দু’বার এ পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন।

হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর পুত্র ইয়াযিদের রাজত্বকালে যখন মদীনার লোকেরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং যার পরিণতি ইয়াওমে হারারায়, তখন মারওয়ান ইয়াযিদের কর্মচারীগণকে বিশেষভাবে সাহায্য-সহায়তা করেছিল। এতে ইয়যিদ তার কাজে মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তাকে দামেস্কে ডেকে নিয়ে তার কাজের ভয়সী প্রশংসা করেন এবং তাকে তার ব্যক্গিত উপদেষ্ট পদে নিয়োগ দান করলেন। ইয়াযিদের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তার প্রধান উপদেষ্টা পদেই কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ইয়াযিদের মৃত্যুর পর যখন তার পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠত হলেন তখন তিনি মারওয়ানকে তার এ সম্মানিত পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন।

যেহেতু হযরত মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযিদ খেলাফতের মহান দায়িত্ব পরিচালনা করা পছন্দ করতেন না, কাজেই যুহহাক ইবনে কায়েসের হাতেই সমস্ত সামরিক- বেসামরিক ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযিদ মাত্র তিন মাস তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে রাজকীয় পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অবশেষে তিনি পরলোকের পথে যাত্রা করলেন।

ইবনে সাদ আরও বলেন- যখন হযরত মুয়াবিয় (রা)-এর মৃত্যুর সময় ঘনিযে আসতে লাগল, তখন মারওয়ান ও তাঁর অন্যান্য উপদেষ্টাগণ তাঁর নিকট আরজ করল যে, আপনার পর খেলাফতের জন্য কারো নাম ঘোষণা করুন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) উত্তর দিলেন, যে বস্তু জীবনে আমাকে সুখী করতে পারেনি, মৃত্যুর পর তার বোঝা বহন করতে যাব কেন? আমি যখন মহান আল্লাহ পাকের দরবারে চলে যাব, তখন তিনি আমাকে অবশ্যই এটা জিজ্ঞেস করবেন না যে, আমি কাকে আমার পরবর্তী খলীফা নির্বাচন করে এসেছি।

হযরত মুয়াবিয়া (রা) তাঁর পবর্তী খলীফার জন্য কাউকে মনোনীত করেননি, তবে জনসাধারণ স্বাধীনভাবে তাদের খলীফা নির্বাচন করে তাঁর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুহহাক ইবনে কায়েসকে খেলাফতের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে দিলেন।

যুহহাক ইবনে কায়েস হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর সমর্থক ছিলেন। আর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরও (রা) তকন মক্কায় তাঁর স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যুহহাকের মত সিরিয়ার কিছু নেতৃস্থানীয় লোকও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর সমর্থক ছিলেন। অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করে মারওয়ান ও তাঁর অন্যান্য উমাইযা নেতারাও দামেস্ক ত্যাগ করে হেজাজে চলে গেল।

তারা তখনও রাস্তায়ই ছিল, ইউনিসিয়া জনপগের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিল। এমন সময় ইবনে যিয়াদ তার সঙ্গী-সাথীসহ সেখানে এসে পৌঁছল এবং মারওয়ানের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আপনি কোথায় যাওয়ার সংকল্প করেছেন? মারওয়ান উত্তর করল, ইবনে যুবাইর (রা)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করতে মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছা করছি।

ইবনে সাদ আরও বলেন, এটা শুনে ইবনে যিয়াদ তাকে তিরস্কার করে বলল-(আরবী)

অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ, আপনি আবদে মান্নাফ বংশের একজন বিশিষ্ট নেতা হওয়া সত্ত্বেও ইবন যুবাইরের হাতে বায়আত হতে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন? আল্লাহর কসম! আপনি তো তার থেকেও অধিক যোগ্য ব্যক্তি! (তাবাকাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৩)

এ সেই আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ ইয়াজিদের খুশির জন্য যে হযরত ইমাম হুসাইন (রা) কে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। নবী পরিবারের বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল, তাঁদের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করেছিল। তার দৃষিটতে একমাহত্র আবদে মান্নাফের বংশধরদেরই সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। নৈতিক চরিত্র, যোগ্যতা এবং উন্নত ধ্যানধারণার কোন মূল্যই তার কাছে ছিল না। যে তাচ্ছিল্যের সাথে সে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর কথা উল্লেখ করেছিল, এর দ্বারাই তার ধ্যান-ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। সাহাবায়ে কেরাম গণের (রা) দুশমন, সৎকর্মশীল লোকদের প্রধান শত্রু যে মারওয়ান, আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা)-এর মত একজন সাহাবীর পরিবর্তে খেলাফতের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ তাকেই অধিক যোগ্য বলে বিবেচনা করল। অথচ ইমাম হুসাইন (রা) ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর পর আল্লহভীরুতা, পবিত্রতা, উন্নত চরিত্র এবং সার্বিক যোগ্যতার দিক দিয়ে বিচার করলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা) ছিলেন তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারা। হযরত যুবাইর (রা)-এর পুত্র বিশ্ব মুসলিম জননী হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা)-এর ভগিনা এবঙ ইলামের প্রথম খললীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর দৌহিত্র। যাহোক, মারওয়ান যিয়াদের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, তবে তোমার মতামত কি?

যিয়াদ বলল, আপনি দামেশকে ফিরে গিয়ে স্বীয় খেলাফতের জন্য লোকদের আহ্বান করুন, আমি আপনাকে সর্বাতভাবে সাহায্য করব।

আমর ইবনে সাঈদও তাকে এ কথাই বলল। আমর ইবনে সাঈদ ছিল ইয়ামেনে বসবাসকারী আরব নেতা। ইয়ামেনবাসীগণ তার অনুগত ছিল। সে মারওয়ানকে পরামর্শ দিল যে, ইয়াযিদের বিধবা স্ত্রী, যুকব খালেদের মাতাকে বিবাহ কর, পথের কাঁটা খালেদও দূরে চলে যাবে।

তাদের তিন জনের মধ্যে একট গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হল এবং তারা একই সাথে দামেশকে ফিরে আসল। ইবনে যিয়াদ দামেশকের কারাদিস ফটকে আবতরণ করল এবং যুহহাক ইবনে কায়েসের সাথে সাক্ষাৎ করে তার হাতে চুম্বন করে তার ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও বংশ গৌরবের ভূয়সী প্রশংসা করল। অবশেসে স্বগৃহে ফিরে আসল। পরের দিন আবার েইবনে কায়েসের দরবারে হাজির হয়ে পূর্বের মতহই তোষামোদ করে ফিরে আসল। তৃতীয় দিন পুনরায় এসে তার সাথে নির্জনে কথা বলল। যিয়াদ বিস্ময় প্রকাশ করে ইবনে কায়েসকে বলল, আপনিও একজন কুরাইশ বংশীয় নেতা, আপনি ইবনে যুবাইর (রা) অপেক্ষা অধিকতর যোগ্য ও জনপ্রিয়। আপনি কি করে ইবনে যুবাইর (রা) কে সমর্থন করেন?

ইবনে যিয়াদ অতীব কৌশলী, মৃদবাক ও একজন বিশিষ্ট বাগ্মী ছিল। যুহহাক ইবনে কায়ে একজন সরল-সোজা সৈনিক ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই ইবনে যিয়াদ তাকে কাঁচের সিড়িতে দাঁড় করিয়ে দিল এবং ইবনে যুবাইর (রা)-এর পরিবর্তে তার নিজের খেলাফতের দাবী করতে তাকে উৎসাহিত করে তুলল। অতিএব যুহহাক ইবনে কায়েস তার কথা অনুযায়ী মানুষের এক সমাবেশে তার হাতে খেলাফতের বায়আত করতে লোকদের আহবান করলেন। কিছু লোক তার হাতে বায়আত করল। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যারা ইবনে যুবাইর (রা)-এর সমর্থক ছিল তারা তার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করল।

ইবনে যিয়াদের ধূর্তার ফলে যুহহাক ইবনে কায়েসের মত একজন বিশিষ্ট সেনাপতির বিপুল শক্তি এমনিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। এ নরাধম জালেম তাকে আবরও পরামর্শ দিল যে, আপনি দামেশকের শহর ছেড়ে বাইর তাঁবু স্থাপন করে সাধারণ সৈনিক ও নগরবাসীকে আপনার প্রতি আহবান করুন। যুহহাক ইবনে কায়েস তার এ পরামর্শ মেনে দামেশকে নগরী থেকে বের হয়ে ময়দানে এসে তাঁবু স্থাপন করল। অপরদিকে ইবনে যিয়াদ নগরেই অবস্থান করতে লাগল এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিকগণকে মারওয়ানের প্রত আকৃষ্ট ও তরে তুলতে লাগল।

এ সময় মারওয়ান ও উমাইয়া বংশের অন্যান্য লোকেরা তাদমীরে অবস্থান করছিল। ইয়াযিদের যুবক পত্রি খালেদ এবং তার মা আল-জাবিয়ায় অবস্থান করছিল। উবায়দুল্লাহকে ইবনে যিয়াদ মারওয়ানের নিকট একথা বলে দূত প্রেরণ করল যে, বনু উমাইয়াকে সংঘবদ্ধ করে তাদের বায়আত গ্রহণ করে নিন এবং আল-জাবিয়ায় গিয়ে খালেদের মাতাকে বিবাহ করুন।

মারওয়ান ইবনে যিয়াদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে লাগল। সে প্রথমতঃ বনু উমাইয়াদের নিকট থেকে বায়আত গ্রহণ করল। তারপর আল-বাজিয়ারয় গমন করল। এখানে ইয়াযিদের পুত্র খালেদ তার পরম সুহৃদ খালূ হাসসান ইবনে মালেকের তত্ত্বাধানে ছিল। আল-জাবিয়ায় মারওয়ানের আগমনের পূর্বে হাসসান ইয়াযিদির পুত্র খালেদের পক্ষেই খেলাফতের বায়আত করতে লোকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু যখন মারওয়ান আল-জাবিয়ায় এসে পৌঁছল, তখন হাসসানের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। সে মারওয়ানের প্রভাবে প্রভাবন্বিত হয়ে তার হাতেই বায়আত করল। তার সে বায়আতের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকাপর সমস্ত জনগণ মারওয়ানকে খলীফা হিসেবে স্বীকার করে নিল। এভাবেই হাকাম ইবনে আসের পুত্র মারওয়ানের জন্য খেলাফতের পথ সুগম হয়ে গেল। তিনি খেলাফতের বায়আত গ্রহণ করেই ইয়াযিদের বিধবা স্ত্রী খালিদের মাতাকে বিবাহ করে তার পথের সকল বাধা বিপত্তি দূর করে দিলেন।

ইবনে সাদ বলেন- এদিকে আল-জাবিয়ায় লোকেরা মারওয়ানের হাতে খেলাফরেত বায়আত গ্রহণ করব, অপরদিকে ইবনে যিয়াদ দামেশকে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সে দিনই মারওয়ানের পক্ষে দামেশকবাসীদের বায়আত গ্রহণ করল এবং তাকে লিখে পাঠাল যে, যুহহাক ইবনে কায়েস মারজে রাহাতে অবস্থান করছে সুতরাং আপনি তার দিকেই অগ্রসর হোন।

হাসসান ইবনে মালেক এবং সাঈদ ইবনে আমর তাদের সৈন্য নিয়ে মারওয়াণের সাথে মিলিত হতওয়ার ফলে তাদে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল ছয় হাজার। তিনি উক্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে মারজে রাহতের দিক অগ্রসর হলেন। ইবনে যিয়াদও সাত হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মারজে রাহাতে এসে উপস্থিত হল। এভবে মারওয়ানের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়াল তের হাজার।

অপরদিকে যুহহাক ইবনে কায়েসের সঙ্গে ত্রিশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী ছিল্ তিনি আহবন করতেই বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে তারা দ্রুতগতিতে সেখানে এসে উপস্থিত হল।

যদিও যুহহাক ইবনে কায়েসের সৈন্য সংখ্যা মারওয়ানের সৈন্যের প্রায় আড়াই গুণ বেশি ছিল, কিন্তু মারওয়ানের সঙ্গে উমাইয়া বংশের সমস্ত লোক জড়িত থাকারয় যুহহাকের সৈন্য বাহিনীর উপর মারওয়ানের একটা বিরাট প্রভাব পড়ে গেল।

ইবনে সাদ বলেন- দীর্ঘ বিশ দিন যাবৎ উভয় বাহিনীর মধ্যে তীব্র যুদ্ধের ফলে প্রচুর রক্তপাত হল। অবশেষে এটা ইকটি গোত্রীয় যুদ্ধে পর্যবসিত হয়ে গেল। এক দিকে ইয়ামেনী লোক অপরদিকে কায়েসী লোক।

যুদ্ধের বিশতম দিকেন যুহহাক ইবনে কায়েস তার কয়েকজন বিশিষ্ট সঙ্গী-সাথীসহ নিহত হলেন। ফলে অবশিষ্ট সৈনবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করল।

মারজে রাতের যে ময়দানে এ যুদ্ধ হয়েছিল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই সে দিন বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন কায়েসী বীরগণ নিহত হয়েছিল। ইয়াযিদের অযোগ্যতা এবং তার পুত্রের ভীরুতার কারণে বনু উমাইয়াদের নিকট থেকে নেতৃত্ব ও শাসনের যে সম্মানিত পোষকা অবহৃত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ, আমর ইবনে সাঈদ এবং হাসসান ইবনে মালেক প্রমুখ নেতৃবৃন্দের বুদ্ধিমত্তা ও সতর্কতার ফলেই তা পুনরায় তাতের পক্ষেই এসে গেল।

প্রকৃতপক্ষেএটা মারওয়ান ও ইবনে যুবাইর বা যুহহাকের মধ্যে যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল আরবের দু’টি প্রসিদ্ধ যুদ্ধপ্রিয় গোষ্ঠী-কায়সী ও ইয়ামেনীদের পারস্পরিক যুদ্ধ। সৌভাগ্যক্রমে মারওয়ান ইয়ামেনী সৈন্যদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ইবনে যিয়াদ, আমর ইবনে সাঈদ ও হাসসান ইবনে মালেকের মত চতুর ও তীক্ষ্ণ মেধাবী বন্ধুরা এর দ্বারা তাদের আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করেছিল। তখন সৈন্যবাহিনী যদি ইয়ামেনী ও কায়েসী এ দু’শিবিরে বিভক্ত না হত, তাহলে মারওয়ানও সফল হতেন না এবং রাজ সিংহাসন লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না।

এভাবে মারজে রাহাতে ইয়মেনীদের হাতে কায়েসীদের পরাজয় বনু উমাইয়াদের পতনোন্মুখ রাজপ্রাসাদকে সোজা করে দাঁড় করে দিয়েছিল।

মারওয়ান বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দামেশকে আগমন করল, হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর প্রতিষ্ঠিত সিংহাসনে আরোহন করল এবং ইবনে সাদের ভাষ্য মতে, আমীরে মুয়াবিয়া (রা)-এর ন্যায় সরকারী কোষাগারের দ্বার খুলে দিয়ে সাধারণ, অসাধারণ সর্বস্তরের মানুষেল হৃদয় জয় করে নিল। অত্যন্ত আ্শ্চর্যের বিষয় হল- হযরত ওসামন (রা) আমীরে মুয়াবিয়া (রা) এবং ইয়াযিদের যুগে যে মারওয়ান ধিকৃত ছিল, মদীনার লোকেরা যাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করত, সে আজ খলিফার আসনে সমাসীন হল।

মারওয়ান জর্ডানে পৌঁছে স্বয়ং আশ্চার্যান্বিত হয়ে বলেছিলেন, মনে হয় আল্লাহ পাক পূর্ব থেকেই আমর জন্য খেলাফতের সিংহাসন নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।

বাস্তবিক পক্ষে আল্লাহ পাক তাঁ জন্য পূর্ব থেকেই খেলাফতের পদ নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ, আমর ইবনে সাঈদ এবং হাসসান ইবনে মালেকের মত সুচতুর, বুদ্ধিমান, উদ্দ্যমশীল অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ তার পার্শ্বে এসেই তার ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছিল।

মারওয়ানকে যারা সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল, তন্মধ্যে তাঁর বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন যুবক পুত্র আবদুল মালেক এবং আবদুল আজীজের ভূমিকাও অত্যন্ন প্রখর ছিল। তাঁর এ পুত্রদ্বয় যদি বলিষ্ঠ, বুদ্ধিসম্পন্ন, সাহসিী ও মেধাবী না হত তবে হয়ত তিনি এরূপ সফলতা অর্জন করতে পারতেন না।

খেলাফত লাভের ছয় বা আট মাস পরেই যখন তার মৃত্যর সময় ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি তর দু’ পুত্রকে একের পর এক করে স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করলেন। আবদুল মালেক বয়সের দিক দিয়ে বড় ছিলেন বলে তাকে প্রথম এবং আবদুল আজীজকে তার পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনীত করলেন। তার মৃত্যুর সময় আবদুল মালেক তার পার্শ্বেই অবস্থানি করছিলেন এবং আবদুল আজীজ যখন মিসরে ছিলেন।

এ মরওয়ানই আবদুল আজীজে পিতা এবং ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (র)-এর দাদা ছিলেন। (তাবকাতে ইবনে সাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৭)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন