hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহিমান্বিত জীবনের শেষ একশ দিনের অসিয়্যতসমূহ

লেখকঃ সালেহ ইবন আব্দুর রহমান আল-হুসাইন, আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ আল-হাজ

১৩
একাদশ অসিয়্যত: শির্ক ও এর যাবতীয় মাধ্যম থেকে সতর্ক করা
১- ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. আয়েশা ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, তারা বলেন,

«لَمَّا نَزَلَ بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَفِقَ يَطْرَحُ خَمِيصَةً لَهُ عَلَى وَجْهِهِ، فَإِذَا اغْتَمَّ بِهَا كَشَفَهَا عَنْ وَجْهِهِ، فَقَالَ وَهُوَ كَذَلِكَ : «لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى اليَهُودِ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا» .

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তিনি তাঁর একটা চাদরে নিজ মুখমণ্ডল আবৃত করতে লাগলেন যখন শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো, তখন মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দিলেন এমতাবস্থায় তিনি বললেন, ইয়াহূদী ও নাসারাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ, তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে (এ বলে)। তারা যে (বিদ‘আতী) কার্যকলাপ করত তা থেকে তিনি সতর্ক করলেন”। [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩১। .]

২- ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন, যে রোগ থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর সুস্থ হয়ে উঠেন নি সে রোগাবস্থায় তিনি বলেছেন,

«لَعَنَ اللَّهُ اليَهُودَ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» ، قَالَتْ عَائِشَةُ : «لَوْلاَ ذَلِكَ لَأُبْرِزَ قَبْرُهُ خَشِيَ أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدًا» .

“ইহুদীদের প্রতি আল্লাহ লা‘নত করেছেন, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, এরূপ প্রথা যদি না থাকত তবে তাঁর কবরকেও খোলা রাখা হতো; কারণ তাঁর কবরকেও মসজিদ (সাজদাহর স্থান) বানানোর আশংকা ছিল”। [মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৪৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২৯।]

৩- ইমাম মুসলিম রহ. জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে তাকে বলতে শুনেছেন,

«أَلَا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ، أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ، إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ» .

“সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবী ও সৎলোকের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়েছিল। সাবধান! তোমরাও কবরকে মসজিদ বানিও না, আমি তোমাদের তা থেকে নিষেধ করছি”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩২।]

৪- ইমাম বুখারী ও মুসলিম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণনা করেন, উম্মে হাবীবা ও উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হাবশায় তাদের দেখা একটি গির্জার কথা বলেছিলেন, যাতে বেশ কিছু মূর্তি ছিল। তাঁরা উভয়ে বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন,

«إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ، بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ القِيَامَةِ» .

“তাদের অবস্থা ছিল এমন যে, কোনো সৎলোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ বানাতো। আর তার ভিতরে ঐ লোকের মূর্তি তৈরী করে রাখতো। কিয়ামতের দিন তারাই আল্লাহর কাছে সবচাইতে নিকৃষ্ট সৃষ্টি বলে গণ্য হবে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২৮।]

৫- ইমাম মুসলিম আবুল হাইয়্যাজ আল-আসাদী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

قَالَ لِي عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ : أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ «أَنْ لَا تَدَعَ تِمْثَالًا إِلَّا طَمَسْتَهُ وَلَا قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ» .

“আমাকে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি কি তোমাকে এমন কাজে পাঠাবো না যে কাজে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন? তা হচ্ছে, কোনো (জীবের) প্রতিকৃতি বা ছবি দেখলে তা চূর্ন-বিচূর্ন না করে ছাড়বে না, আর কোন উঁচু কবর দেখলে তাও সমান না করে ছাড়বে না”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৬৮।]

৬- ইমাম মুসলিম জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

«نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ، وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ، وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ» .

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করতে, কবরের উপর বসতে ও কবরের উপর স্থাপনা বানাতে নিষেধ করেছেন”। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৭০।]

ভূমিকা:

আল্লাহ তাঁর বান্দাহকে যে সব আদেশ দিয়েছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আদেশ হলো তাঁর তাওহীদ, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা ও তাঁরই কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ﴾ [ البينة : ٥ ]

“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আয-যিলযাল, আয়াত: ৫] একমাত্র এ উদ্দেশ্যেই সমস্ত নবী-রাসূল ও কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ٢٥﴾ [ الانبياء : ٢٥ ]

“আর তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল আমরা পাঠাই নি যার প্রতি আমরা এ অহী নাযিল করি নি যে, আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা আমার ইবাদাত করো”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]

পক্ষান্তরে সবচেয়ে বড় গুনাহ, মারাত্মক অপরাধ ও ধ্বংসাত্মক কবীরাহ গুনাহ হলো আল্লাহর সাথে শির্ক করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ﴾ [ النساء : ٤٨ ]

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮]

﴿إِنَّهُ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُ﴾ [ المائ‍دة : ٧٢ ]

“নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার ওপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭২]

﴿وَلَقَدۡ أُوحِيَ إِلَيۡكَ وَإِلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكَ لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ٦٥﴾ [ الزمر : ٦٤ ]

“আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে অহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শির্ক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৪]

শির্ক এতো মারাত্মক হওয়ায় উম্মতের সত্যিকার নসীহতকারী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে শির্ক, শির্কের যাবতীয় মাধ্যম ও যা কিছু শির্কের দিকে ধাবিত করে সব কিছু থেকে কঠোর হুশিয়ারী করেছেন।

শির্কের কারণ ও উপায়সমূহ:

শির্কের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উপায়, কারণ ও যেসব জিনিস শির্কের দিকে ধাবিত করে তাহলো সালেহীনদের (সৎলোকদের) নিয়ে বাড়াবাড়ি বিশেষ করে মৃত সৎলোকদের নিয়ে বাড়াবাড়ি, তাদের কবরসমূহ উপাসনালয়ে পরিণত করা ও তাতে গৃহ নির্মাণ করা। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أَمَّا وَدٌّ كَانَتْ لِكَلْبٍ بِدَوْمَةِ الجَنْدَلِ، وَأَمَّا سُوَاعٌ كَانَتْ لِهُذَيْلٍ، وَأَمَّا يَغُوثُ فَكَانَتْ لِمُرَادٍ، ثُمَّ لِبَنِي غُطَيْفٍ بِالْجَوْفِ، عِنْدَ سَبَإٍ، وَأَمَّا يَعُوقُ فَكَانَتْ لِهَمْدَانَ، وَأَمَّا نَسْرٌ فَكَانَتْ لِحِمْيَرَ لِآلِ ذِي الكَلاَعِ، أَسْمَاءُ رِجَالٍ صَالِحِينَ مِنْ قَوْمِ نُوحٍ، فَلَمَّا هَلَكُوا أَوْحَى الشَّيْطَانُ إِلَى قَوْمِهِمْ، أَنِ انْصِبُوا إِلَى مَجَالِسِهِمُ الَّتِي كَانُوا يَجْلِسُونَ أَنْصَابًا وَسَمُّوهَا بِأَسْمَائِهِمْ، فَفَعَلُوا، فَلَمْ تُعْبَدْ، حَتَّى إِذَا هَلَكَ أُولَئِكَ وَتَنَسَّخَ العِلْمُ عُبِدَتْ» .

“ওয়াদ ‘দাওমাতুল জান্দাল’ নামক স্থানে অবস্থিত কালব গোত্রের একটি দেবমূর্তি, সুও‘আ হুযাইল গোত্রের একটি দেবমূর্তি এবং ইয়াগুস ছিল মুরাদ গোত্রের, অবশ্য পরবর্তীতে তা বনী গুতাইফ গোত্রের হয়ে যায়, যাদের আস্তানা ছিল, সাবার নিকটে ‘জাওফ’ নামক স্থানে। আর ইয়া‘ঊক, তা তো ছিল হামাদান গোত্রের দেবমূর্তি। নাসর ছিল যুলকালা‘ গোত্রের হিমইয়ারীদের মূর্তি। এগুলো নূহ আলাইহিস সালামের জাতির কতিপয় সৎলোকের নাম ছিল। তারা মারা গেলে শয়তান তাদের জাতির লোকদের হৃদয়ে এই কথা ঢুকিয়ে দিল যে, তারা যেখানে বসে মজলিস করত, সেখানে তোমরা কিছু মূর্তি স্থাপন করো এবং ঐ সকল সৎলোকের নামানুসারেই এগুলোর নামকরণ করো। সুতরাং তারা তাই করল; কিন্তু তখনও ঐসব মূর্তির পূজা করা হতো না। তবে মূর্তি স্থাপনকারী লোকগুলো মারা গেলে এবং মূর্তিগুলো সম্পর্কে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলে লোকজন তাদের পূজা করতে শুরু করে দেয়”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৯২০।]

কুরআনে আল্লাহ মুশরিকদের যে লাতের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি মূলত একজন সৎলোক ছিলেন। তিনি হাজীদের জন্য খাদ্য তৈরি করতেন। তিনি মারা গেলে লোকেরা তার কবরে ঝুঁকে পড়ে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি আল্লাহর বাণীর ব্যাখ্যায় বলেন,

«﴿أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ١٩﴾ [ النجم : ١٩ ] كَانَ اللَّاتُ رَجُلًا يَلُتُّ سَوِيقَ الحَاجِّ» .

“তোমরা লাত ও ‘উয্যা সম্পর্কে আমাকে বলো? [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ১৯] এখানে ‘লাত’ বলে এ ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে, যে হাজীদের জন্য ছাতু গুলত”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৮৫৯।]

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, শির্কের অন্যতম কারণ ও উপকরণ হলো সৎলোকদের কবর স্থাপন করা, তাদের প্রতিমূর্তি স্থাপন করা, তাদের কবরে ঘর নির্মাণ ও তাদের কবরসমূহ ইবাদতের স্থান করা ইত্যাদি। সৎলোকদের প্রতিমা স্থাপন, তাদের কবরের উপর গম্বুজ করা ও তাদের কবরসমূহ ইবাদতের স্থান স্থাপনের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও হুশিয়ারী সম্পর্কে একটু চিন্তা-ভাবনা করলেই, তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “কোনো প্রতিমা দেখলেই ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিবে, কোনো উঁচু কবর দেখলেই তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিবে” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ নির্দেশের হিকমত আমাদের সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন বর্তমান বিশ্বে মুসলিম দেশের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে ও আহলে ইলমের এ ব্যাপারে নিষেধ করতে উদাসীনতা দেখলে, ‘আদাত (রীতিনীতি) ও তাকালীদের (অন্ধ অনুসরণ) প্রভাব খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলাফল এ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, এ সবের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে খুব অল্প লোকেরাই সতর্ক করে ও পরিবর্তনের চেষ্টা করে। ইমাম শাওকানী রহ. ‘শরহে সুদূর’ কিতাবে বলেছেন, ‘কবর উঁচু করা, এতে গম্বুজ তৈরি করা, মসজিদ বানানো এবং একে দর্শনীয় করে তোলা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এ সব কর্মকারীকে লা‘নত দিয়েছেন। তিনি আবার বলেছেন,

«اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» .

“আল্লাহর ভীষণ রাগ সেসব লোকের ওপর যারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে”। [মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ৫৯৩।] যারা নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদ-দো‘আ করেছেন যে, তাদের এ মারাত্মক পাপের কারণে আল্লাহ তাদের ওপর ভীষণ রাগান্বিত হন। এটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আবার তিনি সেগুলোকে ধ্বংস করতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে তিনি এসব কাজকে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরো সতর্ক করে বলেছেন,

«لا تتخذوا قبري وثناً» .

“তোমরা আমার কবরকে মূর্তি বানিও না”। [মুসনাদে বাযযার, হাদীস নং ৯০৮৭।]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,

«لَا تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا»

“তোমরা আমার কবরকে ঈদ বানিও না”। [মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং ৮৮০৪।] অর্থাৎ কোন উৎসবের উপলক্ষ্য বানিও না, যেমনিভাবে অনেক লোক কবরকে উৎসবের উপলক্ষ্য বানায় এবং যারা বিশ্বাস করে যে, মৃতব্যক্তির অনেক শক্তি আছে। ফলে তারা কবরের পাশে একত্রিত হয়ে ইবাদাত করে এবং এতে সিজদা করে। নিঃসন্দেহে মৃতব্যক্তির শক্তির বিশ্বাসের মূল কারণ হলো শয়তান তাদেরকে এসব কিছু সুসজ্জিত করে ধোঁকায় ফেলে দেয়। শয়তানের ধোঁকায় মানুষ কবরকে উঁচু করে, এতে সুন্দর পর্দা দেয়, কবরকে পাকা করে, একে চমৎকারভাবে সুসজ্জিত করে ও সুন্দরভাবে আলোকসজ্জা করে। ফলে অজ্ঞ লোকেরা যখনই এসব কবরের উঁচু উঁচু গম্বুজ দেখে তারা এতে প্রবেশ করে, এর চমৎকার গম্বুজ, পর্দা, রঙ-বেরঙয়ের আলোকিত বাতি ও চারিদিকে সাজানো সুগন্ধি দেখে তখন তাদের অন্তরে এসব কবরের প্রতি সম্মান সৃষ্টি হয়, তার স্মৃতিশক্তি এ মৃতব্যক্তির মর্যাদার কথা স্মরণ করে দুর্বল হয়ে যায় এবং তার মনে শয়তানী ভয়-ভীতি ঢুকে যায়, যা মুসলিমের জন্য শয়তানের সবচেয়ে মারাত্মক চক্রান্ত। সে ধীরে ধীরে বান্দাহকে পথভ্রষ্টের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি পরিশেষে তার কাছে এমন সব কিছু চেয়ে বসে যা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কেউ দিতে পারে না। কখনো কখনো এ সব মাজার যিয়ারতের প্রথম দর্শনেই এ ধরণের শির্ক হয়ে যায়; কেননা তার মনে এ ধরণের ধারণা জন্মায় যে, জীবিত মানুষেরা এ মৃতব্যক্তির থেকে কোনো ফায়েদা ছাড়া আসে না; হয়ত তা দুনিয়াবী ফায়েদা বা আখেরাতের ফায়েদা। তখন সে ভাবে, এসব কবর এতবড় জ্ঞানী-গুণিরা যিয়ারত করে, এতে সাজদাহ করে ও কবরের খুঁটি ধরে দো‘আ করে। এসব দেখে নিজেকে ছোট মনে করে। ফলে শির্কে লিপ্ত হয়।

শয়তান বনী আদমের শয়তানরূপী কিছু মানুষকে এসব কবরের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যিয়ারতকারীদেরকে ধোঁকায় ফেলে দেয়। তাদের কাছে ব্যাপারটি অনেক বড় করে তোলে এবং অবাক অবাক কাণ্ড ঘটিয়ে মৃতব্যক্তির দিকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করে যা বিচক্ষণ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ বুঝতে পারে না। কারামতের নামে অনেক মিথ্যা ও রূপকথার কাহিনী সাজিয়ে মানুষের মাঝে ছড়ায় এবং এসব মিথ্যাকথা নানা মজলিসে ও মানুষের সাথে দেখা হলেই বারবার উল্লেখ করে। ফলে তাদের কিছু ভক্ত ও অনুসারী তৈরি হয়ে যায়। যারা উক্ত মৃতব্যক্তির সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে তারা তার থেকে উপকার খোঁজতে থাকে। তাদের সম্পর্কে যেসব মিথ্যা ও রূপকথার কাহিনী বর্ণনা করা হয় তা তাদের বিবেক খুব সহজেই মেনে নেয় এবং সে যেভাবে শুনেছে সেভাবেই আবার অন্যের কাছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বর্ণনা করে। এগুলো আলোচনা করার ফলে অজ্ঞ মানুষের মনে শির্কী বিশ্বাস জন্ম নেয়। ফলে তারা ধন-সম্পদ লাভের প্রত্যাশায় উক্ত মৃত ব্যক্তির নামে মান্নত করে এবং তার কবরের পাশে নিজেকে আটকে রাখে। কেননা সে ধারণা করে যে, উক্ত মৃতব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে সেও অনেক কল্যাণ ও মহাপ্রতিদান লাভ করবে। সে বিশ্বাস করে, এভাবে করা হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, লাভজনক আনুগত্য ও কবুল হওয়া সাওয়াব। ফলে শয়তান তার অনুরূপ বনী আদমের থেকে ইচ্ছামত শয়তানী অর্জন করতে সক্ষম হয়। কেননা তারা এসব উদ্ভট, মিথ্যা ও বানোয়াট কাজ-কর্ম করে মানুষের কাছে বিষয়টিকে অনেক বড় করে তোলে। নানা রকম মিথ্যা কিচ্ছা-কাহিনী সাজিয়ে লোকদের থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ ধরণের ভ্রষ্ট পদ্ধতিতে ও ইবলিসি কায়েদায় কবরের আশেপাশে অবস্থান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করে”।

ইমাম আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইসমাঈল আস-সান‘আনী রহ. বলেছেন, ‘জেনে রেখো, এসব বিষয় (কবরপূজা) নিষেধের ব্যাপারে অনেক সতর্কীকরণ, সমালোচনা ও এসবের আস্তানা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা চলছে। মূলতঃ এসব কাজ সে সমস্ত লোকদের দ্বারাই বেশী সংঘটিত হচ্ছে যারা কোনো দলীল-প্রমাণ ছাড়াই বাপ-দাদার দেখাদেখি ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ ছাড়াই ইসলামের ওপর চলে আসছে। এদের কেউ নিজ গ্রামে-গঞ্জে শৈশব থেকেই এগুলো দেখে দেখে বড় হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই এগুলোকে বিশ্বাসের নামে জয়গান গেয়ে বড় হচ্ছে। তারা তাদের বড়দেরকে দেখছে যে, তারা এসব মাজারে মান্নত করে আসছে, একে সম্মান করছে এবং তাদের ছেলে-সন্তানদেরকে নিয়ে মাজারে যাচ্ছে। ফলে বাল্য বয়স থেকেই ছোটদের অন্তরে এ সবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা স্থির হয়ে যায়। তারা এগুলোকে সর্বাধিক সম্মানের জিনিস মনে করেন। ফলে এ ধরণের চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে ছোটরা বেড়ে উঠে এবং এভাবেই বড় হচ্ছে। তারা এগুলোর বিরুদ্ধে কারো কোনো প্রতিবাদ ও নিষেধাজ্ঞা তো শুনেই নি; বরং দেখছে অনেক আলেম, বিচারক, মুফতি, শিক্ষক, দায়িত্বশীল, জ্ঞানী লোক, শাসক ও সরকার এসবের প্রতি অনেক বড় কিছু মনে করে খুব সম্মান দেখায়, মানত করে এবং কবরের জন্য জবাই করা পশুর গোশত ভক্ষণ করে। ফলে সাধারণ মানুষ এসব কাজকেই দীন ইসলাম মনে করেন এবং এগুলোকে দীনের মূল ও সুউচ্চ শিখর মনে করেন। এ ব্যাপারে কেউ চিন্তা-ভাবনা করে না। একমাত্র কুরআন, সুন্নাহ ও হাদীসের জ্ঞানে জ্ঞানীরাই এসব সম্পর্কে জানেন। যদিও কোনো আলেমের এ ধরণের অন্যায় দেখে চুপ থাকা এগুলো জায়েয হওয়ার দলীল নয়; কেননা সব চুপ থাকা সন্তুষ্ট হওয়ার দলীল নয়। প্রকৃতপক্ষে এসব অন্যায়ের মূলহোতা অনেকাংশেই যাদের হাতে ঢাল-তলোয়ার রয়েছে সেসব (নেতৃস্থানীয় ও ক্ষমতাধর) লোক, মানুষের জীবন ও সম্পদ তাদের ক্ষমতা ও কলমের তলায় জিম্মি থাকে, লোকদের মান-সম্মান তাদের কথা ও বাক্যে থাকে। তাহলে নগণ্য কিছু লোক কীভাবে এগুলোর প্রতিবাদ করবে? এসব গম্বুজ ও দর্শনীয় জিনিসগুলো শির্কের সবচেয়ে বড় উপকরণ হিসেবে কাজ করে ইসলামকে ধ্বংস ও দীনের বুনিয়াদ নিশ্চিহ্নের সর্বোচ্চ মাধ্যম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যারা এগুলোর দেখাশুনা করে তারা রাজা-বাদশা, নেতৃস্থানীয় ও ক্ষমতাধর লোক। তারা হয়ত এসব মৃতব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন অথবা তার সম্পর্কে ভালো ধারণাকারী সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ বা আলেম বা সূফি বা ফকির বা বয়স্ক লোকজন। মৃতব্যক্তির এসব পরিচিতজনেরা তার যিয়ারতের জন্য তাদের কবরে আসে, যদিও তারা তখন কারো উসিলা তালাশ করে না বা তাদের নামে জয়ধ্বনি দেয় না। তারা শুধু তাদের জন্য দো‘আ করে। এভাবে সময়ের পরিবর্তনে পরিচিত অনেকের কাছেই উক্ত মৃতব্যক্তির আসল নাম বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। পরবর্তীতে এদের পরের প্রজন্মের লোকেরা সেখানে এসে কবরে গম্বুজ, মোমবাতি জ্বালানো, অনেক দামীদামী কার্পেট, পর্দা ও কবরের উপরে নানা রঙ বেরঙয়ের গোলাপ ও ফুল ছিটানো দেখতে পায়। ফলে আগত মানুষেরা মনে করেন, এসব কিছু উপকার সাধন ও ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করা হয়। তার উপর আবার মৃতব্যক্তি সম্পর্কে কিছু মিথ্যাচারী আজগুবি গল্পকারীদের মিথ্যাচার যোগ হয়। তারা বলে বেড়ায় যে, অমুক লোক এই এই বিস্ময়কর কাজ করেছে। তার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করার কারণে অমুকের এমন এমন ক্ষতি হয়েছে এবং ভালো মন্তব্য করার কারণে অমুকের এমন এমন কল্যাণ সাধিত হয়েছে। এভাবে তারা যিয়ারতকারীদের মনে যতসব বাতিল ধ্যান ধারণা জন্মে দেয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে বাতি জ্বালানো, এতে লেখা ও গৃহ নির্মাণকারীকে লা‘নত করেছেন। এ ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত আছে। এসব কাজ করা যেমন নিষেধ, তেমনি এসব কাজ নানা ফিতনা ফাসাদের পথ সুগম করে।

কেউ এখানে প্রশ্ন করতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের ওপর তো গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে এবং এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। জবাবে বলব: মূলত প্রকৃত অবস্থা না জানার কারণে কারো মনে এ ধরণের প্রশ্ন জাগতে পারে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের গম্বুজ তিনি, তাঁর সাহাবীগণ, তাবে‘ঈ, তাবে-তাবে‘ঈ বা এ উম্মতের কোনো আলেম নির্মাণ করেন নি; বরং এটি পরবর্তী যুগের কতিপয় রাজা-বাদশাদের দ্বারা নির্মিত হয়েছে। এটি ৬৭৮ খৃস্টাব্দে মালিক মানসূর নামে খ্যাত ‘কালাঊন আস-সালেহী’ নির্মাণ করেছেন। এটি মূলত রাষ্ট্রীয় কাজ ছিলো, যা পরবর্তী কারো জন্য দীনের অনুসরণযোগ্য কোনো দলীল হতে পারে না’।

ভারতীয় বিজ্ঞ আলেম শাইখ সিদ্দীক হাসান খান কানূজী রহ. বলেন, ‘যুগে যুগে সব দেশেই আলেমগণ মানুষকে তাওহীদে একনিষ্ঠ হতে ও সব ধরণের শির্ক থেকে দূরে থাকতে নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। কিন্তু শির্ক যেহেতু পিঁপড়ার মন্থর গতির মতো গোপনভাবে চলে আসছে (যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন) তাই তা অনেক আলেমের কাছেও অস্পষ্ট ও অজানা। সঠিক ইলমের অভাবে ও অসাবধানতার কারণে অনেক আলেমরাও শির্কে পতিত হচ্ছে। এ ধরণের অসাবধানতা অনেক বিশিষ্ট আলেমের রচনাবলীতে ও অনেক কবির কবিতায় পাওয়া যায়। বিশেষ করে যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদা ও রাজা-বাদশাহর প্রশংসায় কবিতা রচনা করেছেন। তাদের কবিতায় অসাবধানতা বশত এমন কিছু শির্ক পাওয়া যায় যা দেখলে শরীরের চামড়া শিহরে উঠে ও আত্মা প্রকম্পিত হয়। এ ধরণের রচনাবলীর লেখক তো দূরের কথা পাঠকের ওপরও আল্লাহর আযাব নেমে আসার আশঙ্কা করা হয়। এ ধরণের ভুল অনেক সময় কিছু লেখালেখিতে শুধু অমনোযোগিতা এবং অসাবধানতার কারণেই সঙ্ঘটিত হয় নি; বরং এর প্রধান কারণ হলো কবর পাকা করা, এতে গম্বুজ নির্মাণ, মূল্যবান পর্দা দিয়ে কবরকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করা, কবরে বাতি জ্বালানো, কবরের পাশে গেলে অতিভক্তি করে মাথা নত করা, মৃতব্যক্তির কাছে কিছু চাওয়া এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তাদের কাছে দো‘আ করা।

এ জঘন্য কাজ পূর্বরর্তীদের থেকে পরবর্তীরা বংশ পরম্পরায় পেয়ে থাকে। তারা তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করে। ফলে বিষয়টি প্রকোপ আকার ধারণ করে, অন্যায়টি দিন দিন বৃদ্ধি পায় এবং ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। প্রতিটি অঞ্চলে, এমনকি প্রতিটি দেশ, শহর, গ্রাম ও সমাজে এ ধরণের মৃতলোক পাওয়া যায়। সে সমাজের একদল লোক মৃতব্যক্তির শক্তি সম্পর্কে বিশ্বাস করে এবং তারা তাদের কবরের পাশে লেগে থাকে। শির্ককারী এ জঘন্য অপরাধীদের কাছে এটি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার, তাদের বিবেকসূলভ পরিচিত কাজ, তাদের মস্তিষ্ক এ কাজকে ভালো মনে করে এবং তাদের অন্তর একে প্রসার করে। এমনকি যখনই তাদের কোনো সন্তান জন্ম নেয় এবং তারা বুঝতে শিখে তখন তারা এ সব কবরের প্রতি আহ্বানকারীর আহ্বান শুনে। তারা এতে সাজদাহ ও যিয়ারত করতে আহ্বান করে। তারা দেখে, কেউ বিপদে পড়লে এসব কবরে কাছে বিপদমুক্তি প্রার্থনা করে, অসুস্থ হলে রোগমুক্তির জন্য মৃতব্যক্তির জন্য মানত করে, বিপদে-আপদে এসব কবরবাসীর উসিলা খোঁজে। নানা ফন্দি-ফিকিরে মানুষের সম্পদ ভক্ষণকারী কবরের ও এর আশেপাশে অবস্থানকারীদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের তারা তাদেরকে দান-সদকা করে। এভাবে যখন শিশুরা বড় হয় এবং মানুষের কাছে এসব কাহিনী শোনে ও সচক্ষে দেখে তখন তা তাদের মস্তিষ্কে ও চিন্তা-চেতনায় স্থির হয়ে যায়। কেননা ছোটদের স্বভাবই হলো কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। একটু বড় হলে যখন সে তার পিতামাতা ও মুরুব্বীদের থেকে আলাদা হয়ে বাহিরের জগতে যায় তখনও সে দেখে যে, অন্যান্য মানুষও তার পিতামাতার মতই একই কাজ করে। অনেক ঘটনা শোনা যায় যে, ভূমিষ্ঠ শিশুর বাইরের জগতে সর্বপ্রথম ভ্রমনের স্থান ও দর্শনীয় জায়গা হলো ঐ সব ভ্রান্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী মাজারসমূহ, যারা কারণে মানুষ আজ মহাপরীক্ষার সম্মুখীন ও সংকটাপন্ন। সে সেখানে পিতামাতা ও গুরুজন থেকে মানুষে ভীড়, শোরগোল, চিৎকার, চেঁচামেচি ও দো‘আ করা ইত্যাদি দেখতে পায়। ফলে তার পিতামাতা থেকে প্রাপ্ত বিশ্বাসটি আরো সুদৃঢ়, মজবুত, স্থায়ী ও শক্তিশালী হয়। বিশেষ করে যখন সে কবরে মূল্যবান নির্মাণ, দেওয়ালগুলো রঙ বেরঙয়ের কারুকার্য খচিত, এতে ঝুলে আছে মূল্যবান পর্দা, চারিদিকে আছে ‘ঊদ ও মিশক আম্বার সাজানো দামী দামী সুগন্ধি, চতুর্দিকে আলোকসজ্জা, মোমবাতি, আগরবাতি; এর সাথে আবার নানা কৌশলে মানুষের সম্পদ ভক্ষণকারী সেসব কবরে অবস্থানকারীর নানা আজগবি গল্প শুনে, তখন সে দেখতে পায় যে, মানুষ এসবের প্রতি যথাসম্ভব সম্মান ও মর্যাদা দেয়। ফলে এসবের ভয়-ভীতি মানুষের অন্তরে প্রবেশ করে। যিয়ারতকারীরা ও ভ্রমণকারীরা সেসব স্থানে হাত বেঁধে ও সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে আসতে থাকে। তারা সামান্য বেয়াদবিও করা থেকে বিরত থাকে। এভাবে এসব কবরের প্রতি গরিব-মিসকীনদের বিশ্বাস বাড়তে থাকে। তাদের অন্তরে ভ্রান্ত আকীদা সুদৃঢ়ভাবে স্থায়ী হয়ে যায়, যা আল্লাহর তাওফিক, হিদায়াত, দয়া ও হেফাযত ছাড়া দূর হয় না।

আর তখন ইলম অন্বেষণকারী কচিকাঁচা ছাত্ররা দেখে যে, তথাকথিত আহলে ইলমের অধিকাংশরাই মৃতব্যক্তি সম্পর্কে এ ধরণের বিশ্বাস রাখেন। তারা দেখতে পায় যে, আলেমগণ এসব মৃতব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখায় এবং এদের ভালোবাসা আল্লাহর অশেষ নি‘আমতের ভাণ্ডার মনে করেন। আর যারা এসব ভ্রান্ত কাজের সমালোচনা করেন তাদেরকে অভিসম্পাত দিয়ে থাকেন। এরা বলে বেড়ায়, এ লোকটি আল্লাহর অলীদের প্রতি বিশ্বাসী নয় এবং তাদেরকে ভালোবাসে না। ফলে তালিবে ইলমের অন্তরে এদের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় এবং এসব বিশ্বাস সুদৃঢ়ভাবে স্থায়ী হয়।

এসব মারাত্মক বিদ‘আত ও ভয়ঙ্কর ফিতনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সর্বত্রে ছড়িয়ে আছে। অনেক মানুষই মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এসব ভ্রান্ত আকীদায় বিশাসী। অবস্থা এতোই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা কবর পাকা করা, এতে মূল্যবান গম্বুজ নির্মাণ, কবর যিয়ারতকারীদের জন্য একে এমনভাবে ভীতিকর ও আকর্ষণীয় করে তোলা যাতে একে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয় ইত্যাদি কর্ম করাকে ঈমানের মৌলিক ও ইসলামের সর্বোচ্চ সহযোগিতা মনে করে। এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জ্ঞানী-গুণীরা এসবের বিরোধিতা করতে সক্ষম হচ্ছে না। এ ফিতনায় পড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো তাওহীদে ইখলাস না থাকা।

উপরোক্ত আলোচনার ব্যাপারে কেউ সন্দেহ পোষণ করলে এবং তা বিবেকপ্রসূত মনে না হলে তাকে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিসংখ্যান করে দেখতে অনুরোধ করছি। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানের অধিকাংশ ফলাফলই এমন হবে যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রায় সবাই উপরোক্ত ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাসে বিশ্বাসী।

কানূজী রহ. একথা বলে উপসংহার টানেন যে, “পরিশেষে বলব, পূর্ববর্তী কিতাব, কবিতা, খুৎবা ও পুস্তিকায় যেসব নাজায়েয আকীদা ও বিশ্বাস পাওয়া যায় সেগুলোর বাস্তবতা ও সঠিকতা নিরূপণ করবো, এতে যা আছে তা মানুষের কাছে তুলে স্পষ্ট করবো এবং এগুলোর আমল থেকে দূরে থাকার জন্য সাধারণ মানুষকে সতর্ক করবো। এগুলো যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করে সঠিকটা গ্রহণ করবো এবং লেখকের পরিণতি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিবো। বিবেক ও জ্ঞান যা প্রত্যাখ্যান করে এমন সব ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে অজুহাত ও ক্ষমা পেশ করবো। এর বেশী আল্লাহ আমাদেরকে দায়িত্ব দেন নি এবং আমরা এর বেশী নিজেদের ওপর অত্যাবশ্যকীয়ও করে নিবো না। (এখানে ইমাম কানূজী রহ. এর কথা শেষ)’।

পাঠক উপরোক্ত কথাগুলো চিন্তা করলে তার কাছে শির্ক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়্যতের গুঢ় রহস্য এবং এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যধিক গুরুত্ব প্রদানের কারণ স্পষ্ট হয়ে যাবে।

অষ্টম শতাব্দিত এক আলেম এ সম্পর্কে বলেছেন, একমাত্র আল্লাহ যাকে হিফাযত করেন সে লোক ব্যতীত অনেকেই শয়তানের এ বড় চক্রান্তে পতিত হয়। কবরের এ ফিতনা সম্পর্কে আল্লাহ পূর্বযুগে ও পরবর্তীযুগে অহী নাযিল করেছেন। অবস্থা এতই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এসব লোকের ইবাদাত করতো। তারা মারা গেলে তাদের কবরে পূজা করতো, কবরকে মূর্তি বানাতো, এতে গৃহ নির্মাণ করতো, এসব লোকের প্রতিকৃতি বানাতো, অতঃপর এসব প্রতিকৃতিতে শরীরের আবরণ দিতো, অতঃপর একে প্রতিমা হিসেবে গ্রহণ করতো এবং আল্লাহর সাথে এদেরও ইবাদাত করতো। এ মহাভয়ঙ্কর কাজটি সর্বপ্রথম করেছে নূহ আলাইহিস সালামের জাতিরা। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে আল-কুরআনে বলেছেন,

﴿قَالَ نُوحٞ رَّبِّ إِنَّهُمۡ عَصَوۡنِي وَٱتَّبَعُواْ مَن لَّمۡ يَزِدۡهُ مَالُهُۥ وَوَلَدُهُۥٓ إِلَّا خَسَارٗا٢١ وَمَكَرُواْ مَكۡرٗا كُبَّارٗا٢٢ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا٢٣ وَقَدۡ أَضَلُّواْ كَثِيرٗاۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا ضَلَٰلٗا٢٤﴾ [ نوح : ٢١، ٢٤ ]

“নূহ বলল, হে আমার রব! তারা আমার অবাধ্য হয়েছে এবং এমন একজনের অনুসরণ করেছে যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কেবল তার ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়। আর তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছে। আর তারা বলে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না; বর্জন করো না ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে। বস্তুত তারা অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে, আর (হে আল্লাহ) আপনি যালিমদেরকে ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই বাড়াবেন না”। [সূরা নূহ, আয়াত: ২১-২৪]

ইবন জারীর রহ. বলেছেন, নিম্নোক্ত বর্ণনাকারীদের থেকে আমার কাছে সংবাদ পৌছেছে, আমাকে ইবন হুমাইদ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তার কাছে মিহরান হাদীস বর্ণনা করেছেন, তার কাছে সুফিয়ান, তিনি মূসা এবং তিনি মুহাম্মাদ ইবন কায়েস থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ইয়াগুস, ইয়া‘ঊক ও নাসর বনী আদমের তিনজন সৎব্যক্তি ছিলেন। তাদের কিছু অনুসারী ছিলো তারা তাদের অনুসরণ করত। অতঃপর তারা যখন মারা যায় তখন তাদের অনুসারীরা বললো, আমরা যদি এদের ছবি অংকন করে রাখি তাহলে যখন এদের কথা স্মরণে পড়বে তখন আমরা ইবাদাতের প্রতি বেশি আসক্ত হবো। তাই তারা এদের ছবি আঁকলো। এরা মারা গেলে এদের পরবর্তী লোকদের কাছে শয়তান এসে ধোঁকা দিতে লাগল। সে তাদেরকে বললো, তোমাদের পূর্বের লোকেরা তো এদের ইবাদাত করতো। তারা তাদের অসিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতো। ফলে এরাও তাদের ইবাদাত করতে শুরু করলো। [তাফসীরে ত্বাবারী, ২৩/৬৩৯।]

ইমাম শাওকানী রহ. বলেছেন, কবর উঁচু করা, এতে চুনকাম করা, বাতি জ্বালানো ইত্যাদি কাজ থেকে শরী‘আত প্রণেতার ধমক ও সতর্কের পূর্ণ প্রজ্ঞা সম্পর্কে ভেবে দেখুন। আমি সবচেয়ে আশ্চর্যান্বিত হই যখন দেখি তাদের সত্যবাদী ও সত্যায়িত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে এ ধরণের কাজ থেকে ধমক ও সর্বাত্মক সতর্ক করেছেন, এমনকি তিনি তাঁর মৃত্যুর সময়ও বলেছেন,

«لَعَنَ اللَّهُ اليَهُودَ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» .

“ইহুদীদের প্রতি আল্লাহ লা‘নত করেছেন তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে”। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৪৪১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২৯।]

এতকিছু সত্ত্বেও পৃথিবীর সব প্রান্তে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র এ শির্কটি ছড়িয়ে আছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজি‘ঊন।

শাওকানী, সান‘আনী ও কানূজীর মতো বিজ্ঞ আলেমগণ কবরে গৃহ নির্মাণ এবং কবরকে মসজিদে পরিণত না করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়্যত অমান্য করার ব্যাপারে যা উল্লেখ করেছেন তা বাস্তব ও লক্ষণীয় ব্যাপার। অনেক সাধারণ মুসলিম ও অজ্ঞরা না জেনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদেশের বিরোধিতা করে শির্কে পতিত হচ্ছে। এর চেয়েও মারাত্মক হচ্ছে এদের অনেকেই সৎ বান্দার কবরে গিয়ে তাদের কাছে উপকার সাধন ও ক্ষতি থেকে রক্ষা চেয়ে দো‘আ করছে। কেউ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ চিন্তা করলে দেখতে পাবে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দো‘আ করাকে তাওহীদ আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দো‘আ করাকে শির্ক বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿قُلۡ إِنَّمَآ أَدۡعُواْ رَبِّي وَلَآ أُشۡرِكُ بِهِۦٓ أَحَدٗا٢٠﴾ [ الجن : ٢٠ ]

“বলুন, নিশ্চয় আমি আমার রবকে ডাকি এবং তার সাথে কাউকে শরীক করি না”। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿فَإِذَا رَكِبُواْ فِي ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ٦٥﴾ [ العنكبوت : ٦٥ ]

“তারা যখন নৌযানে আরোহন করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শির্কে লিপ্ত হয়”। [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৬৫]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ٦٠﴾ [ غافر : ٦٠ ]

“আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের জন্য সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকার বশতঃ আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে”। [সূরা গাফের, আয়াত: ৬০]

মুফাসসিরগণ আয়াতে বর্ণিত ﴿عِبَادَتِي﴾ দ্বারা “আমার কাছে দো‘আ” বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا ٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا٥٧﴾ [ الاسراء : ٥٦، ٥٧ ]

“বলুন, তাদেরকে ডাক, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে (উপাস্য) মনে করো। তারা তো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। তারা যাদেরকে ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের রবের কাছে নৈকট্যের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে তাঁর নিকটতর? আর তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার রবের আযাব ভীতিকর”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬-৫৭]

‘যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকে’-এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেছেন, তারা হলেন আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতাগণ, ঈসা আলাইহিস সালাম ও ‘উযাইর আলাইহিস সালাম, যাদেরকে মুশরিকগণ ডেকে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَلَا تَدۡعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَۖ فَإِن فَعَلۡتَ فَإِنَّكَ إِذٗا مِّنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٠٦ وَإِن يَمۡسَسۡكَ ٱللَّهُ بِضُرّٖ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَۖ وَإِن يُرِدۡكَ بِخَيۡرٖ فَلَا رَآدَّ لِفَضۡلِهِۦۚ يُصِيبُ بِهِۦ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۚ وَهُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ١٠٧﴾ [ يونس : ١٠٦، ١٠٧ ]

“আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। অতএব, তুমি যদি করো, তাহলে নিশ্চয় তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো ক্ষতি পৌঁছান, তবে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই। আর তিনি যদি তোমার কল্যাণ চান, তবে তাঁর অনুগ্রহের কোন প্রতিরোধকারী নেই। তিনি তার বান্দাদের যাকে ইচ্ছা তাকে তা দেন। আর তিনি পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৬-১০৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿قُلۡ أَفَرَءَيۡتُم مَّا تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ إِنۡ أَرَادَنِيَ ٱللَّهُ بِضُرٍّ هَلۡ هُنَّ كَٰشِفَٰتُ ضُرِّهِۦٓ أَوۡ أَرَادَنِي بِرَحۡمَةٍ هَلۡ هُنَّ مُمۡسِكَٰتُ رَحۡمَتِهِ٣٨ ﴾ [ الزمر : ٣٧ ]

“বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ- আল্লাহ আমার কোনো ক্ষতি চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাক তারা কি সেই ক্ষতি দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমাকে রহমত করতে চাইলে তারা সেই রহমত প্রতিরোধ করতে পারবে?”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩৭]

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ» .

“দো‘আ হলো ইবাদাত”। [আবু দাউদ, হাদীস নং ১৪৭৯; তিরমিযী, হাদীস নং ২৯৬৯। তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

«الدُّعَاءُ مُخُّ العِبَادَةِ» .

“ইবাদাতের সারবস্তু হলো দো‘আ”। [তিরিমিযী, হাদীস নং ৩৩৭১। তিনি হাদীসটিকে গরীব বলেছেন।]

তাওহীদ ও শির্কের সাথে দো‘আর সম্পৃক্ততা এভাবে প্রকাশ পায় যে, মানুষ যখন উপকার সাধন বা ক্ষতি থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করে তখন জানে ও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তার কথা শোনেন, তার অবস্থা জানেন, তিনি তার ডাকে সাড়া দিতে সক্ষম এবং একই সময়ে আল্লাহ অন্যান্যদের কথাও শোনেন, তাদের অবস্থা জানেন; এতে আহ্ববানকারীর সংখ্যা যতই হোক, তারা যে ভাষাভাষী হোক এবং তাদের প্রয়োজন যে কোন ধরণেরই হোক। আর মানুষ যখন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ডাকে, বা তার কাছে দো‘আ করে, যেমন, খৃস্টানরা তাদের কিদ্দীসদেরকে (সাধক) বা মারইয়াম আলাইহাস সালামকে ডাকে বা কিছু অজ্ঞ মুসলিমরা তাদের দো‘আয় কবরবাসীকে ডাকে ও তার কাছে উপকার সাধন ও ক্ষতি থেকে মুক্তি চায়, তারা এ অবস্থায় এ ধরণের কাজ এ বিশ্বাসে করে যে, তারা যাকে ডাকছে তারাও তাদের কথা শোনে, তাদের অবস্থা জানে, তাদের অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে তারা অবগত, এমনিভাবে তারা অন্যদের দো‘আও শোনে, তাদের অবস্থা জানে এবং তাদের অন্তরের সব কিছু তাদের অবগত, এমনিভাবে অন্যদের সংখ্যা যতই বেশি হোক না কেন, তারা যে ভাষাভাষীই হোক না কেন, তাদের প্রয়োজন যাই হোক না কেন এবং তারা যতই দূরত্বে থাকুক তাদের দো‘আও ওরা শোনে ও তাদের অবস্থাও ওরা জানে। (সুতরাং এভাবে তারা আল্লাহর বহু সমকক্ষ সাব্যস্ত করছে)

খৃস্টান ও কিছু অজ্ঞ মুসলিমরা এ বিশ্বাসে আল্লাহর কিছু গুণাবলীকে তার সৃষ্টজীবের জন্য সাব্যস্ত করে এবং স্রষ্টার কিছু ইবাদাতকে সৃষ্টজীবের প্রতি নিবদ্ধ করে। আর এসব কিছুই তাওহীদের বিপরীত। খৃস্টান ও কিছু অজ্ঞ মুসলিমের এ অজুহাত কোনো কাজে আসবে না যে, তারা বলেন, আমরা মারইয়াম আলাইহাস সালাম, বা কিদ্দীস (সাধক) বা আওলিয়া বা সালেহীনরা এককভাবে উপকার সাধন বা ক্ষতি দূর করতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করি না; বরং আমরা তো তাদেরকে শুধু আল্লাহ ও আমাদের মাঝে উসিলা মনে করি। কেননা আল্লাহ তাদের এ অজুহাত খণ্ডন করে স্পষ্টভাবে বলেছেন,

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [ الزمر : ٣ ]

“আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদাত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ﴾ [ يونس : ١٨ ]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮] অথচ আল্লাহ এদের সম্পর্কে বলেছেন, এরা নিজেরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ, তার রহমতের প্রত্যাশা ও আযাবকে ভয় পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِهِۦ فَلَا يَمۡلِكُونَ كَشۡفَ ٱلضُّرِّ عَنكُمۡ وَلَا تَحۡوِيلًا٥٦ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُۥٓۚ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحۡذُورٗا٥٧﴾ [ الاسراء : ٥٦، ٥٧ ]

“বলুন, তাদেরকে ডাক, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে (উপাস্য) মনে কর। তারা তো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। তারা যাদেরকে ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের রবের কাছে নৈকট্যের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে তাঁর নিকটতর? আর তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার রবের আযাব ভীতিকর”। [সূরা : আল-ইসরা, আয়াত: ৫৬-৫৭]

আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী যুগের খৃস্টান ও আরবের মুশরিকদের সম্পর্কে আল-কুরআনে বলেছেন যে, তারা মারইয়াম আলাইহাস সালাম, কিদ্দীস (পুণ্যাত্মা), ফিরিশতা ও মূর্তির এজন্য অসিলা তালাশ করে যে, এগুলো তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে ও আল্লাহর সামনে সুপারিশ করবে। তারা সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির সময় এদেরকে ডাকে; কিন্তু বিপদাপদে একমাত্র আল্লাহকেই একনিষ্ঠভাবে ডাকে, দো‘আর সময় তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনো সৃষ্টজীবকে শরীক করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَإِذَا رَكِبُواْ فِي ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ٦٥﴾ [ العنكبوت : ٦٥ ]

“তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে, তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্থলে পৌঁছে দেন, তখনই তারা শির্কে লিপ্ত হয়”। [সূরা আল-আনকাবূত, আয়াত: ৬৫]

আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে আরো বলেছেন,

﴿حَتَّىٰٓ إِذَا كُنتُمۡ فِي ٱلۡفُلۡكِ وَجَرَيۡنَ بِهِم بِرِيحٖ طَيِّبَةٖ وَفَرِحُواْ بِهَا جَآءَتۡهَا رِيحٌ عَاصِفٞ وَجَآءَهُمُ ٱلۡمَوۡجُ مِن كُلِّ مَكَانٖ وَظَنُّوٓاْ أَنَّهُمۡ أُحِيطَ بِهِمۡ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ﴾ [ يونس : ٢٢ ]

“এমনকি যখন তোমরা নৌকায় থাক, আর তা তাদেরকে নিয়ে চলতে থাকে অনুকূল হাওয়ায় এবং তারা তা নিয়ে আনন্দিত হয়, (এ সময়) তাকে পেয়ে বসে ঝড়ো হাওয়া, আর চারদিক থেকে ধেয়ে আসে তরঙ্গ এবং তাদের নিশ্চিত ধারণা হয় যে, তাদেরকে পরিবেষ্টন করা হয়েছে। তখন তারা আল্লাহকে ডাকতে থাকে, তাঁর জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ২২]

যখন দেখি কতিপয় অজ্ঞ মুসলিম বিপদাপদ ও সচ্ছলতার সময় কবরবাসী এবং অদৃশ্য অলী ও সালেহীনদের ডাকে তখন অন্তর দুঃখে ভরাক্রান্ত হয়ে যায়।

এর চেয়েও আশ্চর্য হলো আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী যুগের মুশরিকদের সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা একথা জানেন, রিযিক, ক্ষতি, উপকার, কোনো কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটানো ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর হাতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ٣١﴾ [ يونس : ٣١ ]

“বলুন, আসমান ও জমিন থেকে কে তোমাদের রিযিক দেন? অথবা কে (তোমাদের) শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহের মালিক? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। সুতরাং, আপনি বলুন, তারপরও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না?”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩১]

তা সত্ত্বেও আমরা দেখি, কিছু অজ্ঞ মুসলিম আল্লাহর সৃষ্টজীব কবরবাসী ও সালেহীন বান্দাহকে তার সাথে সম্পৃক্ত করে। কেউ আবার তাদেরকে ক্ষতি, উপকার, রিযিক, অভাব মিটানো, বিশ্ব পরিচালনা, ইলমে গায়েব ইত্যাদির জন্য তাদেরকে ‘আবদাল’ (সম্পূরক ক্ষমতার অধিকারী) ও ‘আকতাব’ (কুতুব বা চুম্বক ক্ষমতার অধিকারী) নামে অভিহিত করেন। বরং এ ধরণের ভ্রান্ত আকীদা কিছু আলেম; বিশেষ করে তাদের ‘অলিদের কারামত’ সংক্রান্ত কিতাবসমূহে দেখতে পাওয়া যায়।

অথচ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নবী, রাসূলদের সর্দার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার রব আদেশ দিয়েছেন,

﴿قُلۡ إِنِّي لَآ أَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا رَشَدٗا٢١﴾ [ الجن : ٢١ ]

“বলুন, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য না কোন অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখি এবং না কোন কল্যাণ করার”। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ২১]

আল্লাহ তা‘আলা তাকে আরো বলেছেন,

﴿قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُ﴾ [ الاعراف : ١٨٧ ]

“বলুন, ‘আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না; তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮৭]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,

﴿قُل لَّآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ﴾ [ الانعام : ٥٠ ]

“বলুন, তোমাদেরকে আমি বলি না, আমার কাছে আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ রয়েছে এবং আমি গায়েব জানি না”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫০]

কিছু অজ্ঞ মুসলিম এ ধরণের ভুল-ভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার কারণ হলো কতিপয় আলেমদের অসচেতনতা, তাদের পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী হুকুম দেওয়া এবং সেসব লেখকদের বইসমূহ কুরআন ও হাদীসের মানদণ্ডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে শুধু সুধারণা বশতঃ তা গ্রহণ করা। সাধারণ মুসলিমদের অজ্ঞতার অজুহাতে একথা বলা যায়; কিন্তু যারা নিজেকে আলেম দাবী করে তাদের কী ওযর থাকতে পারে? আর রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে বলা যায়, যখন কুসংস্কার বৃদ্ধি পায় তখন অনুভূতি কমে যায়। আমরা দেখি, খুব অল্প সংখ্যক ইসলামী আন্দোলনের লোকেরাই (যদিও তারা ইলম ও প্রজ্ঞা অবলম্বন করে) এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় অথচ শির্ক মুক্ত হওয়া ইসলামের মৌলিক বিষয় এবং প্রথম রুকন। সুতরাং ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ (আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সৎকার করা বা খারাপ কাজ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই)।

এখানেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক কবরে গৃহ নির্মাণ করতে নিষেধ করা, একে সমান করার নির্দেশ দেওয়া এবং কবরকে সালাতের স্থান না বানানোর আদেশের অসিয়্যতের প্রজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে উঠে। কেননা এসব কিছু কবরপূজারীদের ফিতনায় টেনে নেয় এবং এসব কাজ থেকে বেঁচে থাকা হলো সবচেয়ে বড় তাওহীদ ও আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদাত। আল্লাহই সাহায্যকারী।

শির্কের কিছু নমুনা:

শির্কের নানা ধরণের হতে পারে। উপদেশ দানকারী এ লেখক নিজেই শির্ক থেকে মুক্ত থাকতে আপ্রান চেষ্টা করে এবং এর সমস্ত পথ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেক মুসলিমই কোনটি শির্ক আর কোনটি না এ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখে না। ফলে তারা না জেনে শির্কে পতিত হচ্ছে। শির্কের কিছু নমুনা এখানে পেশ করা হলো:

১- জীবিত বা মৃত আওলিয়া ও সালেহীনের নামে জবেহ করা।

২- তাদের নামে মান্নত করা।

৩- বিপদাপদ ও অভাব পূরণের জন্য তাদের কাছে দো‘আ করা।

৪- বান্দা ও আল্লাহর মাঝে তাদেরকে মাধ্যম ও অসীলা বা মানা।

৫- তাদের কবরসমূহকে সম্মানার্থে ঈদ তথা সম্মিলনস্থল ও মাযার তথা যিয়ারাতস্থল বানানো।

৬- তাদের থেকে কিছু আশা করা ও তাদেরকে ভয় করা।

সতর্কীকরণ:

এ অধ্যয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। এর কারণ হলো:

প্রথমত: শির্কের ভয়াবহতার কারণে। কেননা শির্ক ইসলামের মূলভিত্তি তাওহীদকে ধ্বংস করে দেয় এবং আল্লাহর কাছে মুসলিমের আলম নষ্ট করে দেয়। এ বিষয়ে সব ধরণের পথ ও পদ্ধতি বন্ধে সতর্ক করা অত্যাবশ্যক। ইতিহাস সাক্ষ্য যে, শির্কের সর্বাধিক উপায় হলো সালেহীনদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কবরকে ইবাদাত ও আনন্দ-উল্লাসের স্থান বানানো, তাদের কবরকে সম্মান দেখাতে পাকা করা ও এতে গম্বুজ ও গৃহ নির্মাণ করা।

দ্বিতীয়ত: শির্কের যাবতীয় উপায় সতর্ক করতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাধিক আগ্রহ দেখানো। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষ জীবনে কবরকে ইবাদতের স্থান বানাতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তিনি মারা যাওয়ার পাঁচ দিন পূর্বে এ সম্পর্কে আবারো সতর্ক করেছেন। অতঃপর তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তেও কবরকে পাকা করা ও এতে গৃহ নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং কেউ এরূপ করে থাকলে তা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন।

তৃতীয়ত: মুসলিম দেশে ব্যাপকভাবে এ মুসিবত পরিলক্ষিত হওয়া; এমনকি ইসলামী বিশ্বের এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে এ ফিতনা প্রবেশ করে নি।

চতুর্থত: এ ব্যাপারে অনেক সংস্কারকদের গুরুত্বহীনতা ও অসচেতনতা। অথচ এটা তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম কাজ ও সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো।

মুসলিমদের মধ্যে এ জঘন্য কাজটি ব্যাপক হারে দেখা দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো মিসরে ফাতেমী শাসনামলের রাজা-বাদশাহদের চাল-চলন ও আচার-আচরণে এ কাজটি দেখা দিয়েছিলো। এ কথা সর্বজন বিদিত যে, শক্তি ও সামর্থ্যের কারণে কোনো কাজ ব্যাপক হয়। আর এ শক্তি-সামর্থ কাজটি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনিভাবে সে সময় এ ধরণের নিকৃষ্ট মজলিশ বসতো। সে সব হালকায় অন্যায়কে ন্যায় ও ন্যায়কে অন্যায় বানাতো। অন্যদিকে সে সময় ফতওয়া প্রদানকারী সংস্কারকদের কণ্ঠও হারিয়ে গিয়েছিলো। যদিও নানা দেশ ও স্থান থেকে অনেক আলেম এ মুসিবত সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলেছেন যেমনিভাবে তাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছিলেন। আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী।

আরেকটি সতর্কীকরণ:

কেউ শির্ক বা কুফরী কাজ করলেই তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার হুকুম দেওয়া যাবে না বা তার সাথে কাফির ও মুশরিকের মতো আচরণ করা যাবে না। কারণ একথা সর্বজন বিদিত যে, এ ধরণের শির্কী কাজে লিপ্ত অজ্ঞ মুসলিমকে যদি কাফের হওয়া ও মারা যাওয়া এ দু’টি অপশনের মধ্যে কোনো একটিকে বাছাই করতে সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সে কাফির হওয়ার চেয়ে মারা যাওয়াকেই নির্বাচন করবে। বরং এ ধরণের শির্কী কাজে লিপ্ত অনেক লোক এমনও আছে অন্যান্য প্রকৃত মুসিলমদের মতই এরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে এবং তারা ঈমান রাখে যে কুরআন সত্য।

আসলে তারা অজ্ঞতা ও না জানার কারণে তাওহীদ পরিপন্থী কাজে লিপ্ত হচ্ছে। অতএব, আমাদের ওপর দায়িত্ব হলো এ ধরণের অজ্ঞ ও অসতর্ক লোকদেরকে পথ দেখানো।

ভয়ঙ্কর মূল সমস্যা হলো তাদের নিয়ে যারা এ সম্পর্কে অবগত এবং কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে যেসব নিষেধাজ্ঞা এসেছে সেগুলো জেনেও এর ওপর অটুট থাকে এবং মানুষকে এর হুকুম সম্পর্কে বলে না। নিম্নোক্ত আয়াতই তাদের সতর্কতার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡتُمُونَ مَآ أَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلۡهُدَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا بَيَّنَّٰهُ لِلنَّاسِ فِي ٱلۡكِتَٰبِ أُوْلَٰٓئِكَ يَلۡعَنُهُمُ ٱللَّهُ وَيَلۡعَنُهُمُ ٱللَّٰعِنُونَ١٥٩ إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُواْ وَأَصۡلَحُواْ وَبَيَّنُواْ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَتُوبُ عَلَيۡهِمۡ وَأَنَا ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ١٦٠﴾ [ البقرة : ١٥٩، ١٦٠ ]

“নিশ্চয় যারা গোপন করে সু-স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও হিদায়াত যা আমি নাযিল করেছি, কিতাবে মানুষের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর, তাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেন এবং লা‘নতকারীগণও তাদেরকে লা‘নত করে। তারা ছাড়া, যারা তাওবা করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব, আমি তাদের তাওবা কবূল করব। আর আমি তাওবা কবূলকারী, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৯-১৬০] এ আয়াত শিহরিত করে তোলে, অন্তর প্রকম্পিত হয়ে উঠে, উপদেশ প্রদানকারী নিজে যেহেতু জানে যে তারও শেষ পরিণতি হচ্ছে মৃত্যু, পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশ, সুতরাং সেও ভীত সন্ত্রস্ত যে এ ধমকি না আবার তাকেও পেয়ে বসে। বস্তুত আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন