HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
তাক্বওয়া অর্জনের উপায়
লেখকঃ মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِه مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِه وَصَحْبِه اَجْمَعِيْنَ
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর উপর।
তাক্বওয়া মুমিনের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তাক্বওয়া এত মূল্যবান জিনিস যে, এর ফলে যে কল্যাণ ও উপকার পাওয়া যায় অন্য কিছুর দ্বারা তা পাওয়া যায় না। যেমন কুরআন থেকে হেদায়াত লাভে ধন্য হয় মুত্তাকীরা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿هُدًىْ لِّلْمُتَّقِيْنَ﴾
যাদের তাক্বওয়া আছে তারাই এর থেকে হেদায়াত পায়। (সূরা বাকারা- ২)
চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির ঠিকানা হলো জান্নাত। সেই জান্নাতে মুত্তাকীরাই যাবে। যত নেক আমল রয়েছে এর বাহ্যিক কাঠামো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তাক্বওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾
তোমাদের কুরবানীর পশুর রক্ত এবং গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তাক্বওয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছে। (সূরা হাজ্জ- ৩৭)
এ বইটিতে তাক্বওয়ার সংজ্ঞা, তাক্বওয়ার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য, তাক্বওয়ার পার্থিব ফলাফল, তাক্বওয়ার পরকালীন পুরস্কার, তাক্বওয়া অর্জন না করার পরিণাম ও মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটি মুসলিম ভাই-বোনদের অনেক উপকারে আসবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মুত্তাকী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
বইটি প্রকাশনার কাজে যাদের সহযোগিতা রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা যেন সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করেন এবং এ প্রচেষ্টাকে পরকালের মুক্তির ওসীলা বানিয়ে দেন। আমীন
মা‘আস্সালাম
মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর উপর।
তাক্বওয়া মুমিনের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তাক্বওয়া এত মূল্যবান জিনিস যে, এর ফলে যে কল্যাণ ও উপকার পাওয়া যায় অন্য কিছুর দ্বারা তা পাওয়া যায় না। যেমন কুরআন থেকে হেদায়াত লাভে ধন্য হয় মুত্তাকীরা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿هُدًىْ لِّلْمُتَّقِيْنَ﴾
যাদের তাক্বওয়া আছে তারাই এর থেকে হেদায়াত পায়। (সূরা বাকারা- ২)
চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির ঠিকানা হলো জান্নাত। সেই জান্নাতে মুত্তাকীরাই যাবে। যত নেক আমল রয়েছে এর বাহ্যিক কাঠামো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তাক্বওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾
তোমাদের কুরবানীর পশুর রক্ত এবং গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; বরং তাক্বওয়াই আল্লাহর কাছে পৌঁছে। (সূরা হাজ্জ- ৩৭)
এ বইটিতে তাক্বওয়ার সংজ্ঞা, তাক্বওয়ার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য, তাক্বওয়ার পার্থিব ফলাফল, তাক্বওয়ার পরকালীন পুরস্কার, তাক্বওয়া অর্জন না করার পরিণাম ও মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটি মুসলিম ভাই-বোনদের অনেক উপকারে আসবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মুত্তাকী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
বইটি প্রকাশনার কাজে যাদের সহযোগিতা রয়েছে আল্লাহ তা‘আলা যেন সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করেন এবং এ প্রচেষ্টাকে পরকালের মুক্তির ওসীলা বানিয়ে দেন। আমীন
মা‘আস্সালাম
মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) হচ্ছে সকল ইবাদাতের মূল। এর মাধ্যমেই ঈমানী জীবনের প্রকৃত রূপ বা সৌন্দর্য পরিষ্ফুটিত হয়। প্রতিটি মুমিন ব্যক্তি এর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে এবং পরকালে এর উপর ভিত্তি করেই পুরস্কার লাভ করবে।
اَلتَّقْوٰى (আত-তাকবওয়া) এর আভিধানিক অর্থ :
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে আল্লাহভীতি। এটি وَقَايَةٌ শব্দ থেকে উৎপন্ন, যার মূলধাতু হচ্ছে ي - ق - و এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বেঁচে থাকা, হেফাযত করা, রক্ষা করা ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে এটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রত্যেক অর্থই মূল অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন- বলা হয়েছে,
﴿وَأَنْ تَعْفُوْاۤ أَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى﴾
আর ক্ষমা করে দেয়াই আল্লাহভীতির অধিক নিকটতম। (সূরা বাক্বারা- ২৩৭)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি আল্লাহভীতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾
আর যারা নিজেদেরকে কৃপণতা হতে মুক্ত করেছে, তারাই সফলকাম। (সূরা হাশর- ৯)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি সংরক্ষিত রাখা বা হেফাযত করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْۤ اِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ﴾
অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নিকট তোমাদেরকে একত্র করা হবে। (সূরা মায়েদা- ৯৬)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি ভয় করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْاۤ اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا وَّقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে ঐ অগ্নি হতে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সূরা তাহরীম- ৬)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি বাঁচানো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অতএব কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দের আভিধানিক অর্থগুলো হলো- বেঁচে থাকা, সাবধান হওয়া, বিরত থাকা, আল্লাহভীতি অর্জন করা, মুক্তি লাভ করা, নিষ্কৃতি লাভ করা, সতর্ক থাকা ইত্যাদি।
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) এর পারিভাষিক অর্থ :
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে,
هِىَ صِفَةٌ فِى النَّفْسِ تَحْمِلُ الْاِنْسَانَ عَلٰى فِعْلِ مَا اَمَرَ اللهُ وَالْاِمْتِنَاعِ عَمَّا نَهٰى عَنْهُ
তাক্বওয়া হচ্ছে আত্মার এমন একটি গুণ, যা মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে এবং তার নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।
ইন্টারনেটভিত্তিক বিখ্যাত বিশ্বকোষ Wikipedia-তে বলা হয়েছে, ‘‘তাক্বওয়া হচ্ছে একটি ইসলামী ধারণা বা বিশ্বাস, যা আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা (Allah-consciousness) বুঝায়।’’
কুরআনে ব্যাপকভাবে তাক্বওয়া বলতে being conscious of Allah তথা আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা-ই বলা হয়েছে এবং আরো বলা হয়েছে যে, তাক্বওয়া হলো আত্মা বিনাশকারী সব কাজ থেকে বিরত থাকা এবং একই সাথে সচেতনভাবে নিজেকে (আধ্যাত্মিকভাবে) শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করা।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন,
اَلتَّقْوٰى فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهٖ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ
তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা বাস্তবায়ন করা এবং তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা। [মাজমুউল ফাতাওয়া- ৩/১২০ (মাকতাবাতুশ শামেলা)।]
হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন,
وَالتَّقْوٰى : اِسْمٌ جَامِعٌ لِفِعْلِ الطَّاعَاتِ وَتَرْكِ الْمُنْكَرَاتِ .
তাক্বওয়া এমন একটি ব্যাপক অর্থবোধক বিশেষ্য, যা (আল্লাহর) আনুগত্যশীল কর্ম সম্পাদন ও অপছন্দনীয় বিষয় পরিহার করাকে বুঝায়। [তাফসীরে ইবনে কাসীর- ১/৪৯২ (সূরা বাক্বারা-১৭৯ নং আয়াতের তাফসীর)।]
عَرَّفَ عَلِيُّ بْنِ أَبِيْ طَالِبٍ اَلتَّقْوٰى فَقَالَ : هِيَ الْخَوْفُ مِنَ الْجَلِيْلِ وَالْعَمَلِ بِالتَّنْزِيلِ وَالْقَنَاعَةُ بِالْقَلِيْلِ وَالْإِسْتِعْدَادُ لِيَومِ الرَّحِيْلِ .
আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) তাক্বওয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, সেটা হচ্ছে আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা, কুরআনের উপর আমল করা, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। (আয়াতুত তাক্বওয়া ফিল কুরআনিল কারীম)
অতএব اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) এমন একটি গুণকে বুঝায়, যার তাগিদে মানুষ আল্লাহর ক্রোধ, অসন্তোষ এবং তাঁর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য তাঁর নির্দেশিত বিষয়সমূহ যথাযথভাবে পালন করে এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হতে বিরত থাকে।
اَلتَّقْوٰى (আত-তাকবওয়া) এর আভিধানিক অর্থ :
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে আল্লাহভীতি। এটি وَقَايَةٌ শব্দ থেকে উৎপন্ন, যার মূলধাতু হচ্ছে ي - ق - و এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বেঁচে থাকা, হেফাযত করা, রক্ষা করা ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে এটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রত্যেক অর্থই মূল অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন- বলা হয়েছে,
﴿وَأَنْ تَعْفُوْاۤ أَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى﴾
আর ক্ষমা করে দেয়াই আল্লাহভীতির অধিক নিকটতম। (সূরা বাক্বারা- ২৩৭)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি আল্লাহভীতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾
আর যারা নিজেদেরকে কৃপণতা হতে মুক্ত করেছে, তারাই সফলকাম। (সূরা হাশর- ৯)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি সংরক্ষিত রাখা বা হেফাযত করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْۤ اِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ﴾
অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নিকট তোমাদেরকে একত্র করা হবে। (সূরা মায়েদা- ৯৬)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি ভয় করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قُوْاۤ اَنْفُسَكُمْ وَاَهْلِيْكُمْ نَارًا وَّقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে ঐ অগ্নি হতে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সূরা তাহরীম- ৬)
অত্র আয়াতে اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দটি বাঁচানো অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অতএব কুরআন মাজীদে ব্যবহৃত اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দের আভিধানিক অর্থগুলো হলো- বেঁচে থাকা, সাবধান হওয়া, বিরত থাকা, আল্লাহভীতি অর্জন করা, মুক্তি লাভ করা, নিষ্কৃতি লাভ করা, সতর্ক থাকা ইত্যাদি।
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) এর পারিভাষিক অর্থ :
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে,
هِىَ صِفَةٌ فِى النَّفْسِ تَحْمِلُ الْاِنْسَانَ عَلٰى فِعْلِ مَا اَمَرَ اللهُ وَالْاِمْتِنَاعِ عَمَّا نَهٰى عَنْهُ
তাক্বওয়া হচ্ছে আত্মার এমন একটি গুণ, যা মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে এবং তার নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।
ইন্টারনেটভিত্তিক বিখ্যাত বিশ্বকোষ Wikipedia-তে বলা হয়েছে, ‘‘তাক্বওয়া হচ্ছে একটি ইসলামী ধারণা বা বিশ্বাস, যা আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা (Allah-consciousness) বুঝায়।’’
কুরআনে ব্যাপকভাবে তাক্বওয়া বলতে being conscious of Allah তথা আল্লাহ সম্পর্কে সচেতনতা-ই বলা হয়েছে এবং আরো বলা হয়েছে যে, তাক্বওয়া হলো আত্মা বিনাশকারী সব কাজ থেকে বিরত থাকা এবং একই সাথে সচেতনভাবে নিজেকে (আধ্যাত্মিকভাবে) শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করা।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন,
اَلتَّقْوٰى فِعْلُ مَا أَمَرَ اللهُ بِهٖ وَتَرْكُ مَا نَهَى اللهُ عَنْهُ
তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা বাস্তবায়ন করা এবং তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা পরিত্যাগ করা। [মাজমুউল ফাতাওয়া- ৩/১২০ (মাকতাবাতুশ শামেলা)।]
হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন,
وَالتَّقْوٰى : اِسْمٌ جَامِعٌ لِفِعْلِ الطَّاعَاتِ وَتَرْكِ الْمُنْكَرَاتِ .
তাক্বওয়া এমন একটি ব্যাপক অর্থবোধক বিশেষ্য, যা (আল্লাহর) আনুগত্যশীল কর্ম সম্পাদন ও অপছন্দনীয় বিষয় পরিহার করাকে বুঝায়। [তাফসীরে ইবনে কাসীর- ১/৪৯২ (সূরা বাক্বারা-১৭৯ নং আয়াতের তাফসীর)।]
عَرَّفَ عَلِيُّ بْنِ أَبِيْ طَالِبٍ اَلتَّقْوٰى فَقَالَ : هِيَ الْخَوْفُ مِنَ الْجَلِيْلِ وَالْعَمَلِ بِالتَّنْزِيلِ وَالْقَنَاعَةُ بِالْقَلِيْلِ وَالْإِسْتِعْدَادُ لِيَومِ الرَّحِيْلِ .
আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) তাক্বওয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, সেটা হচ্ছে আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা, কুরআনের উপর আমল করা, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। (আয়াতুত তাক্বওয়া ফিল কুরআনিল কারীম)
অতএব اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) এমন একটি গুণকে বুঝায়, যার তাগিদে মানুষ আল্লাহর ক্রোধ, অসন্তোষ এবং তাঁর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য তাঁর নির্দেশিত বিষয়সমূহ যথাযথভাবে পালন করে এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ হতে বিরত থাকে।
১. আল্লাহর ব্যাপারে সচেতনতা অবলম্বন করা :
তাক্বওয়া শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে সচেতন হওয়া বা সতর্ক হওয়া। কথাবার্তা ও কর্মক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, শাস্তিদাতা, পুরস্কারদাতা, আইনদাতা, জীবন-মৃত্যুদাতা হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আর এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, এসব কর্মে তার সাথে অন্য কোন অংশীদার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًا﴾
তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে, কোনকিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না।
(সূরা নিসা- ৩৬)
২. আল্লাহর ক্রোধকে ভয় করা :
তাক্বওয়া বলতে কুরআন মাজীদে কখনো কখনো আল্লাহর ক্রোধ বা রাগের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহকেও বুঝানো হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- আল্লাহর ক্রোধকে ভয় করা এবং যেসব কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা রাগান্বিত হন, সেসব কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا تَعْمَلُوْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক মানুষেরই ভেবে দেখা উচিত যে, সে আগামীকালের (কিয়ামতের) জন্য কী পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত। (সূরা হাশর- ১৮)
৩. আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা :
তাক্বওয়া বলতে কুরআন মাজীদে কখনো কখনো আল্লাহর শাস্তির সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহকেও বুঝানো হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- দুনিয়াতে আল্লাহর কোন আযাব অথবা পরকালীন জীবনে জাহান্নামের শাস্তিকে ভয় করা। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ اُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ﴾
তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। এটা তৈরি করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। (সূরা বাক্বারা- ২৪)
৪. কিয়ামত দিবসের কঠিন মুহূর্তকে ভয় করা :
তাক্বওয়া শব্দটি কুরআন মাজীদে কখনো কখনো কিয়ামত দিবসকে ভয় করার নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- কিয়ামত দিবসের কঠিন মুহূর্তকে ভয় করা। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاتَّقُوْا يَوْمًا لَّا تَجْزِيْ نَفْسٌ عَنْ نَّفْسٍ شَيْئًا وَّلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَّلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَّلَا هُمْ يُنْصَرُوْنَ﴾
আর তোমরা এমন এক দিনকে ভয় করো, যেদিন কেউ কারো হতে বিন্দুমাত্র উপকৃত হতে পারবে না, কারো নিকট হতে কোন প্রকার বিনিময়ও গ্রহণ করা হবে না, কারো শাফা‘আত (সুপারিশ) কাজে লাগবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। (সূরা বাক্বারা- ১২৩)
﴿قُلْ اِنِّۤيْ اَخَافُ اِنْ عَصَيْتُ رَبِّيْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ﴾
বলো, আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি, তবে আমি ভয় করি এক মহাদিনের শাস্তির। (সূরা আন‘আম- ১৫)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, অন্যের ইবাদাত করতে আমি ভয় করি এজন্য যে, তিনি আমাকে শাস্তি দিবেন। [তাফসীরে কুরতুবী ৬/৩৯৭।]
৫. আল্লাহর আনুগত্য করা :
তাক্বওয়া বলতে যেমনিভাবে একদিকে আল্লাহভীতিকে বুঝানো হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে আল্লাহভীতি অর্জনের জন্য যা করা প্রয়োজন তথা আল্লাহর আনুগত্য করার প্রতিও তাগিদ প্রদান করে থাকে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহ বিনা প্রতিবাদে ও বিনা শর্তে সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করে নিয়ে তা পালন করা এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যেমন- কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,
﴿ يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ ﴾ أَطِيْعُوْا اللهَ ﴿حَقَّ تُقَاتِهٖ﴾ وَحَق َّتُقَاتِهٖ أَنْ يُّطَاعَ فَلَا يَعْصِىْ وَأَنْ يَّشْكُرَ فَلَا يَكْفُرُ وَأَنْ يَّذْكُرَ فَلَا يَنْسٰى وَيُقَالُ أَطِيْعُوْا الله كمَا يَنْبَغِيْ
অর্থাৎ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো’’ তথা আল্লাহর আনুগত্য করো। আর যথাযথ ভয় বলতে বুঝানো হয়েছে যে, আনুগত্য করা, অতঃপর অবাধ্য না হওয়া; শুকরিয়া আদায় করা, অতঃপর অস্বীকার না করা; (আল্লাহকে) স্মরণ করা, অতঃপর ভুলে না যাওয়া। সুতরাং বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যেরকমভাবে ভয় করা উচিত। [আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ), তানভীরুল মুকাববাস মিন তাফসীরি ইবনি আববাস (রাঃ)।]
৬. অন্তরকে পাপাচার থেকে পবিত্র করা :
তাক্বওয়া শব্দ দ্বারা যেসব কর্মের উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্তরকে পাপাচার থেকে পবিত্র করা। কেননা অন্তর যখন সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত হবে, তখন তাতে আল্লাহভীতি প্রবেশ করবে; ফলে সে উত্তম কর্ম সম্পাদনের প্রতি ধাবিত হবে। অবশেষে সে মানবজীবনের প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَآئِزُوْنَ﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম। (সূরা নূর- ৫২)
তাক্বওয়া শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে সচেতন হওয়া বা সতর্ক হওয়া। কথাবার্তা ও কর্মক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, শাস্তিদাতা, পুরস্কারদাতা, আইনদাতা, জীবন-মৃত্যুদাতা হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। আর এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, এসব কর্মে তার সাথে অন্য কোন অংশীদার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْئًا﴾
তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে, কোনকিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না।
(সূরা নিসা- ৩৬)
২. আল্লাহর ক্রোধকে ভয় করা :
তাক্বওয়া বলতে কুরআন মাজীদে কখনো কখনো আল্লাহর ক্রোধ বা রাগের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহকেও বুঝানো হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- আল্লাহর ক্রোধকে ভয় করা এবং যেসব কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা রাগান্বিত হন, সেসব কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا تَعْمَلُوْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক মানুষেরই ভেবে দেখা উচিত যে, সে আগামীকালের (কিয়ামতের) জন্য কী পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত। (সূরা হাশর- ১৮)
৩. আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা :
তাক্বওয়া বলতে কুরআন মাজীদে কখনো কখনো আল্লাহর শাস্তির সাথে সম্পর্কিত বিষয়সমূহকেও বুঝানো হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- দুনিয়াতে আল্লাহর কোন আযাব অথবা পরকালীন জীবনে জাহান্নামের শাস্তিকে ভয় করা। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِيْ وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ اُعِدَّتْ لِلْكَافِرِيْنَ﴾
তোমরা সেই জাহান্নামকে ভয় করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। এটা তৈরি করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। (সূরা বাক্বারা- ২৪)
৪. কিয়ামত দিবসের কঠিন মুহূর্তকে ভয় করা :
তাক্বওয়া শব্দটি কুরআন মাজীদে কখনো কখনো কিয়ামত দিবসকে ভয় করার নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- কিয়ামত দিবসের কঠিন মুহূর্তকে ভয় করা। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاتَّقُوْا يَوْمًا لَّا تَجْزِيْ نَفْسٌ عَنْ نَّفْسٍ شَيْئًا وَّلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَّلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَّلَا هُمْ يُنْصَرُوْنَ﴾
আর তোমরা এমন এক দিনকে ভয় করো, যেদিন কেউ কারো হতে বিন্দুমাত্র উপকৃত হতে পারবে না, কারো নিকট হতে কোন প্রকার বিনিময়ও গ্রহণ করা হবে না, কারো শাফা‘আত (সুপারিশ) কাজে লাগবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। (সূরা বাক্বারা- ১২৩)
﴿قُلْ اِنِّۤيْ اَخَافُ اِنْ عَصَيْتُ رَبِّيْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ﴾
বলো, আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি, তবে আমি ভয় করি এক মহাদিনের শাস্তির। (সূরা আন‘আম- ১৫)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, অন্যের ইবাদাত করতে আমি ভয় করি এজন্য যে, তিনি আমাকে শাস্তি দিবেন। [তাফসীরে কুরতুবী ৬/৩৯৭।]
৫. আল্লাহর আনুগত্য করা :
তাক্বওয়া বলতে যেমনিভাবে একদিকে আল্লাহভীতিকে বুঝানো হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে আল্লাহভীতি অর্জনের জন্য যা করা প্রয়োজন তথা আল্লাহর আনুগত্য করার প্রতিও তাগিদ প্রদান করে থাকে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে- আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহ বিনা প্রতিবাদে ও বিনা শর্তে সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করে নিয়ে তা পালন করা এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যেমন- কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,
﴿ يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ ﴾ أَطِيْعُوْا اللهَ ﴿حَقَّ تُقَاتِهٖ﴾ وَحَق َّتُقَاتِهٖ أَنْ يُّطَاعَ فَلَا يَعْصِىْ وَأَنْ يَّشْكُرَ فَلَا يَكْفُرُ وَأَنْ يَّذْكُرَ فَلَا يَنْسٰى وَيُقَالُ أَطِيْعُوْا الله كمَا يَنْبَغِيْ
অর্থাৎ ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো’’ তথা আল্লাহর আনুগত্য করো। আর যথাযথ ভয় বলতে বুঝানো হয়েছে যে, আনুগত্য করা, অতঃপর অবাধ্য না হওয়া; শুকরিয়া আদায় করা, অতঃপর অস্বীকার না করা; (আল্লাহকে) স্মরণ করা, অতঃপর ভুলে না যাওয়া। সুতরাং বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যেরকমভাবে ভয় করা উচিত। [আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ), তানভীরুল মুকাববাস মিন তাফসীরি ইবনি আববাস (রাঃ)।]
৬. অন্তরকে পাপাচার থেকে পবিত্র করা :
তাক্বওয়া শব্দ দ্বারা যেসব কর্মের উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে, অন্তরকে পাপাচার থেকে পবিত্র করা। কেননা অন্তর যখন সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত হবে, তখন তাতে আল্লাহভীতি প্রবেশ করবে; ফলে সে উত্তম কর্ম সম্পাদনের প্রতি ধাবিত হবে। অবশেষে সে মানবজীবনের প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَآئِزُوْنَ﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম। (সূরা নূর- ৫২)
ইসলামের দৃষ্টিতে তাক্বওয়া অর্জন করা প্রত্যেকের উপর ওয়াজিব।
وَالتَّقْوٰى وَاجِبَةٌ عَلَى الْخَلْقِ وَقَدْ أَمَرَ اللهُ بِهَا وَوَصّٰى بِهَا فِي غَيْرِ مَوْضَعٍ وَذَمَّ مَنْ لَا يَتَّقِي اللهَ وَمَنِ اسْتَغْنٰى عَنْ تَقْوَاهُ
সৃষ্টির উপর তাক্বওয়া অর্জন করা ওয়াজিব। যে ব্যাপারে আল্লাহ একাধিক স্থানে নির্দেশ ও উপদেশ দিয়েছেন এবং যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করে না, আল্লাহ তার নিন্দা করেছেন। [শারহু উমদাতুল আহকাম- ৩/৬২৭।]
কুরআনের অসংখ্য আয়াতে এবং অনেক সহীহ হাদীসে এ ব্যাপারে সরাসরি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন- কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللّٰهَ﴾
তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। (সূরা নিসা- ১৩১)
আর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ - - قَالَ : قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ - - اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানে থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে বা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কোন কারণ বশতঃ পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে; তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দেবে। [তিরমিযী, হা/১৯৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৪; সুনানে দারেমী, হা/২৮৪৭; মিশকাত, হা/৫০৮৩।]
وَالتَّقْوٰى وَاجِبَةٌ عَلَى الْخَلْقِ وَقَدْ أَمَرَ اللهُ بِهَا وَوَصّٰى بِهَا فِي غَيْرِ مَوْضَعٍ وَذَمَّ مَنْ لَا يَتَّقِي اللهَ وَمَنِ اسْتَغْنٰى عَنْ تَقْوَاهُ
সৃষ্টির উপর তাক্বওয়া অর্জন করা ওয়াজিব। যে ব্যাপারে আল্লাহ একাধিক স্থানে নির্দেশ ও উপদেশ দিয়েছেন এবং যে ব্যক্তি তাক্বওয়া অর্জন করে না, আল্লাহ তার নিন্দা করেছেন। [শারহু উমদাতুল আহকাম- ৩/৬২৭।]
কুরআনের অসংখ্য আয়াতে এবং অনেক সহীহ হাদীসে এ ব্যাপারে সরাসরি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন- কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللّٰهَ﴾
তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। (সূরা নিসা- ১৩১)
আর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ - - قَالَ : قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ - - اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানে থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে বা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কোন কারণ বশতঃ পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে; তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দেবে। [তিরমিযী, হা/১৯৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৪; সুনানে দারেমী, হা/২৮৪৭; মিশকাত, হা/৫০৮৩।]
তাক্বওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, এটি হচ্ছে মানবজাতির জন্য একটি মানদন্ড, যা মানুষকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে। অপরদিকে এটি হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের একটি অবস্থা, যেখানে সর্বদা আল্লাহর স্মরণ উপস্থিত থাকে। ফলে তা মানুষকে সৎকর্মের দিকে উৎসাহিত করে এবং অসৎকর্ম থেকে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, এ নির্দেশের অর্থ হল-
أَنْ يُّطَاعَ فَلَا يُعْصٰى، وَأَنْ يُّذْكَرَ فَلَا يُنْسٰى، وَأَنْ يُّشْكَرَ فَلَا يُكْفَر
আল্লাহর আনুগত্য করবে, অতঃপর তার অবাধ্য হবে না; আল্লাহকে স্মরণ করবে, অতঃপর তাকে ভুলে যাবে না; তাঁর শুকরিয়া আদায় করবে, অতঃপর অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না। [তাফসীর ইবনে কাসীর ২/৮৬-৮৭; সূরা আলে ইমরান ১০২ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।]
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْاؕ اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقَاكُمْؕ اِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ﴾
হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তোমাদের জন্য জাতি ও গোত্র বানিয়েছি, যাতে করে (এর মাধ্যমে) তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। কিন্তু আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে (আল্লাহকে) বেশি ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সবকিছুর খবর রাখেন।
(সূরা হুজুরাত- ১৩)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির মধ্যে অবস্থিত জাতিগত, বর্ণগত, শ্রেণিগত সকল প্রকার ভেদাভেদ দূর করে কেবলমাত্র তাক্বওয়াকেই প্রকৃত মর্যাদার মানদন্ড হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। সুতরাং যার মধ্যে তাক্বওয়ার গুণটি যতবেশি পরিলক্ষিত হবে, সে মহান আল্লাহর কাছে ততবেশি মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে এবং তিনি তাঁকে ততবেশি পুরস্কৃত করবেন। এ ক্ষেত্রে দুনিয়ার সকল জাতিগত, বর্ণগত, শ্রেণিগত ইত্যাদি সকল ধরনের ভেদাভেদ একেবারেই মূল্যহীন।
অপর দিকে তাক্বওয়া হচ্ছে দুর্ভেদ্য বর্ম, যা বান্দাকে গুমরাহীর শত ধরনের আক্রমণ ও কুপ্রভাব থেকে আত্মরক্ষার ক্ষমতা প্রদান করে। সুতরাং তাক্বওয়াধারী ব্যক্তি কখনো গুমরাহ হতে পারে না এবং তার কোন ভ্রান্তি তাকে স্পর্শও করতে পারে না। ফলে তার কাজে কর্মে ও চলাফেরায় সর্বদা কল্যাণকামিতা বজায় থাকে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ ﷺ মানুষকে সর্বদা তাক্বওয়ার দিকেই আহবান করতেন; এমনকি তার পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলও তাই করতেন। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন কোন সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যে বাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন তিনি তাদেরকে সকল অবস্থায় তাক্বওয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিতেন।
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, এ নির্দেশের অর্থ হল-
أَنْ يُّطَاعَ فَلَا يُعْصٰى، وَأَنْ يُّذْكَرَ فَلَا يُنْسٰى، وَأَنْ يُّشْكَرَ فَلَا يُكْفَر
আল্লাহর আনুগত্য করবে, অতঃপর তার অবাধ্য হবে না; আল্লাহকে স্মরণ করবে, অতঃপর তাকে ভুলে যাবে না; তাঁর শুকরিয়া আদায় করবে, অতঃপর অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না। [তাফসীর ইবনে কাসীর ২/৮৬-৮৭; সূরা আলে ইমরান ১০২ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।]
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوْبًا وَّقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْاؕ اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقَاكُمْؕ اِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ﴾
হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তোমাদের জন্য জাতি ও গোত্র বানিয়েছি, যাতে করে (এর মাধ্যমে) তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। কিন্তু আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে (আল্লাহকে) বেশি ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সবকিছুর খবর রাখেন।
(সূরা হুজুরাত- ১৩)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির মধ্যে অবস্থিত জাতিগত, বর্ণগত, শ্রেণিগত সকল প্রকার ভেদাভেদ দূর করে কেবলমাত্র তাক্বওয়াকেই প্রকৃত মর্যাদার মানদন্ড হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। সুতরাং যার মধ্যে তাক্বওয়ার গুণটি যতবেশি পরিলক্ষিত হবে, সে মহান আল্লাহর কাছে ততবেশি মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে এবং তিনি তাঁকে ততবেশি পুরস্কৃত করবেন। এ ক্ষেত্রে দুনিয়ার সকল জাতিগত, বর্ণগত, শ্রেণিগত ইত্যাদি সকল ধরনের ভেদাভেদ একেবারেই মূল্যহীন।
অপর দিকে তাক্বওয়া হচ্ছে দুর্ভেদ্য বর্ম, যা বান্দাকে গুমরাহীর শত ধরনের আক্রমণ ও কুপ্রভাব থেকে আত্মরক্ষার ক্ষমতা প্রদান করে। সুতরাং তাক্বওয়াধারী ব্যক্তি কখনো গুমরাহ হতে পারে না এবং তার কোন ভ্রান্তি তাকে স্পর্শও করতে পারে না। ফলে তার কাজে কর্মে ও চলাফেরায় সর্বদা কল্যাণকামিতা বজায় থাকে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ ﷺ মানুষকে সর্বদা তাক্বওয়ার দিকেই আহবান করতেন; এমনকি তার পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলও তাই করতেন। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন কোন সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্যে বাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন তিনি তাদেরকে সকল অবস্থায় তাক্বওয়া অবলম্বন করার নির্দেশ দিতেন।
১. তাক্বওয়া অবলম্বন করার ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ :
﴿ يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো। (সূরা তাওবা- ১১৯)
﴿وَاِيَّايَ فَارْهَبُوْنِ﴾
আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করো। (সূরা বাক্বারা- ৪০)
২. তাক্বওয়া অবলম্বন করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপদেশ :
عَنِ الْعِرْبَاضِ قَالَ صَلّٰى بِنَا رَسُولُ اللّٰهِ - - ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللّٰهِ كَأَنَّ هٰذِهٖ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللّٰهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهٗ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সাথে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ করে আমাদের উদ্দেশ্যে এমন এক মর্মস্পর্শী নসীহত করলেন, যাতে চক্ষুসমূহ অশ্রু প্রবাহিত করল এবং অন্তরসমূহ ভীত-বিহবল হলো। এ সময় এক ব্যক্তি বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! এ মনে হচ্ছে বিদায় গ্রহণের উপদেশ। আমাদেরকে আরো কিছু উপদেশ দিন। তখন নবী করীম ﷺ বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার বা তাক্বওয়াবান হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি এবং নেতার কথা শুনতে ও তার আনুগত্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে হাবশী গোলাম হয়। আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অল্প দিনের মধ্যে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সৎপথ প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে এবং তাকে মাড়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে ধরে থাকবে। অতএব সাবধান তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে কিতাব ও সুন্নাহর বাইরে) নতুন সৃষ্ট কাজ হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন কাজই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। [তিরমিযী, হা/২৩০৫; মিশকাত, হা/১৬৫।]
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন কোন সময় ব্যক্তিগতভাবে অনেককেই তাক্বওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিতেন। যেমন-
রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মৃত্যুকালীন রোগে বিছানায় শুয়েছিলেন, তখন তিনি স্বীয় কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-কে সর্বশেষ উপদেশ হিসেবে বলেন,
فَاتَّقِي اللهَ وَاصْبِرِي فَإِنِّي نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ
অতএব তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্যধারণ করো। আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রযাত্রী। [সহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; সহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০।]
অনুরূপভাবে তিনি যখন কোথাও বাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন তিনি উক্ত দলের আমীরকেও অনুরূপ উপদেশ প্রদান করতেন। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللّٰهِ - - إِذَا أَمَّرَ أَمِيرًا عَلٰى جَيْشٍ أَوْ سَرِيَّةٍ أَوْصَاهُ فِى خَاصَّتِهٖ بِتَقْوَى اللّٰهِ وَمَنْ مَعَهٗ مِنَ الْمُسْلِمِينَ خَيْرًا
বুরায়দা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন কোন সৈন্যদলের আমীর নির্ধারণ করতেন, তখন তাকে বিশেষভাবে আল্লাহকে ভয় করার তথা তাক্বওয়া অবলম্বন করার জন্য আদেশ করতেন এবং সাধারণ মুসলিম যুদ্ধাদেরকে তাক্বওয়া অর্জনের উপদেশ দিতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১৭৩১; মিশকাত, হা/৩৯২৯।]
৩. তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরাই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অধিক নৈকট্য লাভকারী :
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ لَمَّا بَعَثَهٗ رَسُولُ اللّٰهِ إِلَى الْيَمَنِ خَرَجَ مَعَهٗ رَسُولُ اللّٰهِ يُوصِيهِ وَمُعَاذٌ رَاكِبٌ وَرَسُولُ اللّٰهِ يَمْشِي تَحْتَ رَاحِلَتِهٖ فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ يَا مُعَاذُ إِنَّكَ عَسٰى أَنْ لَا تَلْقَانِي بَعْدَ عَامِي هٰذَا أَوْ لَعَلَّكَ أَنْ تَمُرَّ بِمَسْجِدِي هٰذَا أَوْ قَبْرِي فَبَكٰى مُعَاذٌ جَشَعًا لِفِرَاقِ رَسُولِ اللّٰهِ ثُمَّ الْتَفَتَ فَأَقْبَلَ بِوَجْهِه نَحْوَ الْمَدِينَةِ فَقَالَ إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِي الْمُتَّقُونَ مَنْ كَانُوا وَحَيْثُ كَانُوا
মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে ইয়ামান পাঠান, তখন তিনি তাকে উপদেশ দেয়ার জন্য তার সাথে বের হলেন। মু‘আয সওয়ারীর উপরে আরোহণ করলেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ সওয়ারীর নিচে হাঁটছিলেন। তিনি উপদেশ শেষে বললেন, মু‘আয! সম্ভবত এ বছরের পর তোমার সাথে আমার আর সাক্ষাৎ হবে না। তুমি আমার মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে পার হয়ে যাবে। মু‘আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিচ্ছিন্নতায় চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন এবং মদীনার দিকে ফিরে দেখলেন। তারপর নবী করীম ﷺ বললেন, তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরাই আমার সবচেয়ে নিকটে। তারা যেই হোক না কেন, যেখানেই হোক না কেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০৫২; মিশকাত, হা/৫২২৭।]
৪. নবী ﷺ নিজেও তাক্বওয়া অর্জনের দু‘আ করতেন :
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ عَنِ النَّبِىِّ - - أَنَّهٗ كَانَ يَقُولُ اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْهُدٰى وَالتُّقٰى وَالْعَفَافَ وَالْغِنٰى
আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সূত্রে নবী ﷺ হতে বর্ণিত। তিনি এ মর্মে প্রার্থনা করতেন যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট সঠিক পথ, পরহেযগারিতা, গোনাহ হতে নিষ্কলুষতা এবং অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭২১; মিশকাত, হা/২৪৮৪।]
৫. তাক্বওয়া অবলম্বনে সালফে সালেহীনদের অসিয়ত :
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর সাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈসহ অনেক সালফে সালেহীন লোকদেরকে তাক্বওয়া অবলম্বন করার উপদেশ দিয়েছেন। নিম্নে এর মধ্য হতে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
(১) আবু বকর (রাঃ) খুৎবা প্রদানকালে বলতেন, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহভীতি অর্জনের, তাঁর যথাযথ প্রশংসা করার, কোন কিছু কামনার সাথে ভীত হওয়ার, কোন কিছু প্রার্থনার ক্ষেত্রে বিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটানোর। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৩-১৪।] কেননা আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া ও তাঁর পরিবার পরিজনের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন,
﴿اِنَّهُمْ كَانُوْا يُسَارِعُوْنَ فِى الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّرَهَبًاؕ وَكَانُوْا لَنَا خَاشِعِيْنَ﴾
তারা (নবীগণ) সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করতেন, তারা আমাকে ডাকতেন আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিলেন আমার নিকট বিনীত। (সূরা আম্বিয়া- ৯০)
যখন আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে এবং উমরের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন, তখন তিনি উমর (রাঃ)-কে ডেকে বিভিন্ন উপদেশ দিলেন। তাকে তিনি প্রথম যা বললেন, তা হচ্ছে اِتَّقِ اللهَ يَا عُمَرَ হে উমর! আল্লাহকে ভয় করো। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৩-১৪।]
(২) উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহর নিকটে পত্র লিখলেন এ বলে যে,
فَإِنِّىْ أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَإِنَّهٗ مَنِ اتَّقَاهُ وَقَاهُ وَمَنْ أَقْرَضَهٗ جَزَاهُ وَمَنْ شَكَرَهٗ زَادَهٗ وَاجْعَلِ التَّقْوٰى نَصَبَ عَيْنَيْكَ وَجَلَاءَ قَلْبِكَ
আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করার। কেননা যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন। যে তাঁকে ভয় করবে না, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন। আর যে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে, তাকে নিয়ামত বাড়িয়ে দিবেন। তাক্বওয়াকে তোমার চোখের মণি ও অন্তরের উজ্জলতা বৃদ্ধিকারী করে নাও। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৪।]
(৩) আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) কোন অভিযান প্রেরণকালে প্রধান সেনাপতিকে বলতেন,
أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ الَّذِي لَا بُدَّ لَكَ مِنْ لِقَائِه
আমি তোমাকে ঐ আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি, যাঁর সাথে অবশ্যই তোমার সাক্ষাৎ ঘটবে। [সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ৬; মুহাম্মাদ ইবনু সালেহ আল-উসায়মীন, কিতাবুল ইলম, পৃঃ ৬২।]
(৪) উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে এক যুদ্ধে দায়িত্ব প্রদান করেন। অতঃপর তাকে বলেন,
أُوصِيْكَ بَتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ الَّتِي لَا يُقْبَلُ غَيرُهَا وَلَا يُرْحَمُ إِلَّا أَهْلُهَا وَلَا يُثَابُ إِلَّا عَلَيْهَا فَإِنِ الْوَاعِظِينَ بِهَا كَثِيرٌ وَالْعَامِلِينَ بِهَا قَلِيْلٌ جَعَلَنَا اللهُ وَإِيَّاكَ مِنَ الْمُتَّقِينَ
আমি তোমাকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি, যা ব্যতীত কোন কিছু কবুল হয় না। তাক্বওয়াবান ব্যতীত কারো উপর রহম করা হয় না। মুত্তাক্বী ব্যতীত কাউকে সওয়াব দেয়া হয় না। তাক্বওয়ার ব্যাপারে উপদেশ দানকারী অনেক। কিন্তু তাক্বওয়াভিত্তিক আমলকারীর সংখ্যা নগণ্য। আল্লাহ আমাদেরকে ও তোমাদেরকে মুত্তাক্বীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৪; শায়খ আলী ইবনু নায়েফ আশ-মুহুদ, মাওসূ‘আতুল খুতাব ওয়াদ দুরুস, পৃঃ ২।]
(৫) শু‘বাহ (রহ.) বলেন, আমি যখন কোথাও গমনের ইচ্ছা করতাম, তখন হাকামকে বলতাম, তোমার কোন প্রয়োজন আছে কি? তখন সে বলত, তোমাকে আমি ঐ উপদেশ দিচ্ছি, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে দিয়েছিলেন,
اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَاَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا
যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করবে, কোন কারণবশত পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে, তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দিবে। [তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৮৩।]
(৬) ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ইবনু আওন এক লোককে বিদায় দানকালে বললেন তোমার জন্য আবশ্যক হলো তাক্বওয়া অবলম্বন করা। কেননা মুত্তাক্বী কখনো নিঃসঙ্গ ও একাকী হয় না। [আবদুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ, মাওয়ারিদুয যামআন রিদুরুসিয যামান, মদীনা; ৩০তম সংস্করণ, ১৪২৪ হিঃ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৭৫।]
(৭) সুফিয়ান সাওরী (রহ.) ইবনু আবী যিবকে বলেন, তুমি আল্লাহকে ভয় করলে তিনি তোমাকে মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন। আর তুমি মানুষকে ভয় করলে মানুষ তোমাকে আল্লাহ থেকে অমুখাপেক্ষী করতে পারবে না। [ইবনুল কাইয়্যিম, আল-ফাওয়ায়েদ, ১ম খন্ড, মিসর : কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, তা.বি, পৃঃ ৫২।]
৬. তাক্বওয়া হলো বান্দার সর্বোত্তম পরিচ্ছদ :
﴿يَا بَنِيْۤ اٰدَمَ قَدْ اَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُّوَارِيْ سَوْاٰتِكُمْ وَرِيْشًاؕ وَلِبَاسُ التَّقْوٰى ذٰلِكَ خَيْرٌ ذٰلِكَ مِنْ اٰيَاتِ اللهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ﴾
হে বনী আদম! তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করা ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে পোশাক দান করেছি এবং (আরো দিয়েছি) তাক্বওয়ার পোশাক, আর এটাই সর্বোত্তম (পোশাক)। এটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম, হয়তো তারা (এর মাধ্যমে) উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে। (সূরা আ‘রাফ- ২৬)
অত্র আয়াতে তাক্বওয়ার পোশাককেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা এটি হচ্ছে এমন পোশাক, যা অন্তরকে আচ্ছাদিত করে রাখে। যার কারণে অন্তর বাহিরের যেকোন প্রকার অসাধু চিন্তাচেতনা থেকে মুক্ত থাকে। অতঃপর তা ব্যক্তির আচার-আচরণ ও বাহ্যিক বেশভূষার মধ্যে ফুটে উঠে।
৭. তাক্বওয়া বান্দার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয় :
মানবজীবন হচ্ছে একটি দীর্ঘ সফরের সমতুল্য। যেকোন সফরের জন্য যেরূপ পাথেয় গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি, অনুরূপভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের জন্যও পাথেয় গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া অবলম্বন করা। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَزَوَّدُوْا فَاِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوٰىؗ وَاتَّقُوْنِ يَاۤ اُولِى الْاَلْبَابِ﴾
তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো; বস্তুত উৎকৃষ্টতম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহভীতি। অতএব হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকে ভয় করো। (সূরা বাক্বারা- ১৯৭)
৮. তাক্বওয়া হচ্ছে মানুষের সম্মান ও মর্যাদার প্রকৃত মানদন্ড :
মানুষ সাধারণত বংশ, গোত্র, সম্পদ ও পরিচিতির মানদন্ডে একে অপরকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা যেটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য, সেটি কেবল তাক্বওয়ার মানদন্ডেই নির্ধারিত হয়। এজন্যই কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقَاكُمْ﴾
আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে তারাই অধিক সম্মানিত, যারা তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাক্বী। (সূরা হুজুরাত- ১৩)
অনুরূপভাবে হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ سُئِلَ رَسُولُ اللّٰهِ أَيُّ النَّاسِ أَكْرَمُ قَالَ أَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللّٰهِ أَتْقَاهُمْ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোন্ ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক তাক্বওয়াবান, আল্লাহর নিকট সে-ই সবচেয়ে সম্মানিত। [সহীহ বুখারী, হা/৪৬৮৯; সুনানে দারেমী, হা/২২৯।]
عَنْ سَمُرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ -- : الْحَسَبُ الْمَالُ وَالْكَرَمُ التَّقْوٰى
সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, বংশগৌরব বা আভিজাত্য হলো ধন-সম্পদ। আর সম্মান হলো তাক্বওয়া অবলম্বন করা। [বায়হাকী, হা/১৪১৫০; তিরমিযী, হা/৩৩২৫; মিশকাত, হা/৪৯০১।]
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ قَالَ إِنَّ أَنْسَابَكُمْ هٰذِهٖ لَيْسَتْ بِسِبَابٍ عَلٰى أَحَدٍ وَإِنَّمَا أَنْتُمْ وَلَدُ اٰدَمَ طَفُّ الصَّاعِ لَمْ تَمْلَئُوهُ لَيْسَ لِأَحَدٍ فَضْلٌ إِلَّا بِالدِّينِ أَوْ عَمَلٍ صَالِحٍ حَسْبُ الرَّجُلِ أَنْ يَكُونَ فَاحِشًا بَذِيًّا بَخِيلًا جَبَانًا
উক্ববা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের বংশপরিচয় এমন কোন বস্তু নয় যে, তার কারণে তোমরা অন্যকে গালমন্দ করবে। তোমরা সকলেই আদমের সন্তান; দাঁড়িপাল্লার উভয় দিকে যেমন সমান থাকে, যখন তোমরা পূর্ণ করনি। দ্বীন ও তাক্বওয়া ব্যতীত একের উপর অন্যের কোন মর্যাদা নেই। তবে কোন ব্যক্তির মন্দ হওয়ার জন্য অশ্লীল বাক্যাচারী ও কৃপণ হওয়াই যথেষ্ট। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩১৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৮১৪; জামেউল আহাদীস, হা/৭৫৯১; কানযুল উম্মাল, হা/১৩০০; মাজমাউয যাওয়াইদ, হা/১৩০৭৬।]
৯. তাক্বওয়াবানরা আল্লাহর বন্ধু :
﴿اَلَاۤ اِنَّ اَوْلِيَآءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‐ اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (তারা হচ্ছে ঐসব ব্যক্তি) যারা ঈমান আনয়ন করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে। (সূরা ইউনুস- ৬২, ৬৩)
১০. আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াবানদের অভিভাবক :
﴿وَاللهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
আর আল্লাহ মুত্তাক্বীদের অভিভাবক। (সূরা জাসিয়া- ১৯)
১১. তাক্বওয়ার কাজে সহযোগিতা করার নির্দেশ :
তাক্বওয়ার ভিত্তিতে যে কাজই করা হোক না কেন, সেটি মানবজাতির জন্য খুবই কল্যাণকর। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾
তোমরা সৎকর্ম ও তাক্বওয়ার বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর। (সূরা মায়েদা- ২)
১২. তাক্বওয়াই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে উত্তম ভিত্তি :
﴿اَفَمَنْ اَسَّسَ بُنْيَانَهٗ عَلٰى تَقْوٰى مِنَ اللهِ وَرِضْوَانٍ خَيْرٌ اَمْ مَّنْ اَسَّسَ بُنْيَانَهٗ عَلٰى شَفَا جُرُفٍ هَارٍ فَانْهَارَ بِهٖ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَؕ وَاللهُ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ﴾
যে ব্যক্তি তার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টির উপর- সে ব্যক্তি উত্তম? নাকি ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে তার ঘরের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে এমন একটি গর্তের কিনারায়, যার তলায় মাটি নেই। ফলে এটা তাকে সহ (অচিরেই) জাহান্নামের (অতল) আগুনের খাদে গিয়ে পড়বে। আর আল্লাহ কখনো যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না। (সূরা তাওবা- ১০৯)
অত্র আয়াতে একটি উদাহরণের মাধ্যমে তাক্বওয়াহীন জীবনের অসারতার কথা আলোচনাপূর্বক তাক্বওয়াবান জীবনকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে।
১৩. তাক্বওয়াই হলো ইবাদাতের সারবস্তু :
﴿لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾
আল্লাহর নিকট তার গোশত এবং রক্ত কিছুই পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাক্বওয়াটাই তাঁর নিকট পৌঁছে। (সূরা হজ্জ- ৩৭)
১৪. তাক্বওয়া দ্বারা আল্লাহর রহমত লাভ হয় :
﴿وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍؕ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِاٰيَاتِنَا يُؤْمِنُوْنَ﴾
আমার দয়া প্রত্যেক বস্তুতে ব্যপ্ত। সুতরাং আমি সেটা তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৬)
১৫. তাক্বওয়া জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় :
﴿وَاِنْ مِّنْكُمْ اِلَّا وَارِدُهَاۚ كَانَ عَلٰى رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا ‐ ثُمَّ نُنَجِّى الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا﴾
তোমাদের প্রত্যেকেই সেটা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাক্বীদেরকে উদ্ধার করব এবং যালিমদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দেব। (সূরা মারইয়াম- ৭১, ৭২)
১৬. তাক্বওয়া জান্নাত লাভের মাধ্যম :
﴿وَسِيْقَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ اِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا﴾
যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। (সূরা যুমার- ৭৩)
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ : سُئِلَ النَّبِيِّ : مَا أَكْثَرُ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ الْجَنَّةَ ؟ قَالَ : تَقَوَى اللهِ وَحُسْنُ الْخُلُقِ قِيْلَ : فَمَا أَكْثَرُ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ النَّارَ ؟ قَالَ اَلْأَجْوَفَانِ : اَلْفَمُ وَالْفَرَجُ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ জিনিস মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করায়? তিনি বললেন, আল্লাহর ভয় বা তাক্বওয়া ও উত্তম চরিত্র। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, মানুষকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নামে প্রবেশ করায় কোন্ জিনিস? তিনি বললেন, তা হলো দুটি গর্ত- মুখ ও লজ্জাস্থান। [ইবনে মাজাহ, হা/৪২৪৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৭৬; জামেউল আহাদাী, হা/৩৩৪৩৪; আদাবুল মুফরাদ, হা/২৯৪।]
১৭. তাক্বওয়া শয়তানের ধোঁকাবাজি ধরিয়ে দেয় :
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَآئِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ﴾
যারা তাক্বওয়ার অধিকারী হয় তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়। (সূরা আ‘রাফ- ২০১)
যারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে ভয় করে এবং অসৎকাজ থেকে দূরে থাকতে চায়, তাদের মনে যদি কখনো অসৎ চিন্তার সামান্যতম স্পর্শও লাগে, তাহলে তা তাদের মনকে ঠিক তেমনিভাবে আহত করে, যেমন চোখে বালি পড়লে মানুষ যন্ত্রণাবোধ করে। তাদের বিবেক জেগে উঠে এবং তারা অসৎ প্রবণতার এ ধূলোমাটি ঝেড়ে ফেলার কাজে লেগে যায়। অন্যদিকে যারা আল্লাহকে ভয় করে না, অসৎকাজ থেকে বাঁচতেও চায় না এবং শয়তানকে সাথে রেখে চলে, তাদের মনে অসৎ চিন্তা ও অসৎ উদ্দেশ্য পরিপক্কতা লাভ করতে থাকে এবং তারা এসব পঁচা দুর্গন্ধময় আবর্জনায় কোন প্রকার অস্বস্তি অনুভব করে না।
১৮. তাক্বওয়া সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَّكُمْ فُرْقَانًا وَّيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْؕ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ﴾
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়। (সূরা আনফাল- ২৯)
যখন আল্লাহ তা‘আলা কাউকে এই শক্তিটি প্রদান করবেন, তখন সে প্রতিটি কর্মের সত্য-মিথ্যা অথবা যথার্থতা সম্পর্কে অতি সহজেই জানতে পারবে। অতঃপর এভাবেই সে মনজিলে মাকসূদে পৌঁছে যাবে।
১৯. তাক্বওয়া উন্নতি লাভের উপায় :
﴿وَلَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤى اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ وَلٰكِنْ كَذَّبُوْا فَاَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ﴾
যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের সকল কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি। (সূরা আ‘রাফ- ৯৬)
২০. তাক্বওয়াবান ব্যতীত অন্য কারো জন্য সম্পদ ব্যয় করা উচিত নয় :
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ : لَا تُصَاحِبْ إِلَّا مُؤْمِنًا وَلَا يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلَّا تَقِىٌّ
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী করীম ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, ঈমানদার ছাড়া কাউকে সাথী করো না। আর পরহেযগার ব্যতীত কেউ যেন তোমার খাদ্য না খায়। [তিরমিযী, হা/২৩৯৫; আবু দাউদ, হা/৪৮৩৪।]
২১. তাক্বওয়া পাপ মোচনে সাহায্য করে :
عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ - - قَالَ : قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ - - اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানে থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে বা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কোন কারণবশত পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে। তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দেবে। [তিরমিযী, হা/১৯৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৪; সুনানে দারেমী, হা/২৮৪৭; মিশকাত, হা/৫০৮৩।]
২২. তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরা জাহান্নামে যাবে না :
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ - - قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَا يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكٰى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتّٰى يَعُوْدَ اللَّبَنُ في الضَّرْعِ وَلَا يَجْتَمِعُ غُبَارٌ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَدُخَانُ جَهَنَّمَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে জাহান্নামে যাবে না। দুধ যেমন গাভীর ওলানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। আল্লাহর পথের ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন একসাথে জমা হবে না। [তিরমিযী, হা/১৬৩৩; নাসাঈ, হা/৩১০৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১২৬৯, ৩৩২৪; মিশকাত, হা/৩৮২৮।]
২৩. তাক্বওয়া আখিরাতমুখী জীবন গঠনের সহায়ক :
﴿قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَّالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ لِّمَنِ اتَّقٰى وَلَا تُظْلَمُوْنَ فَتِيْلًا﴾
বলো, দুনিয়ার জীবন ও সম্পদ খুবই নগণ্য। আর পরকাল খোদাভীরু লোকদের জন্য সর্বাধিক উত্তম; অনন্তর তোমাদের প্রতি একবিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না। (সূরা নিসা- ৭৭)
২৪. তাক্বওয়া সফলতা লাভের অতি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَابْتَغُوْاۤ اِلَيْهِ الْوَسِيْلَةَ وَجَاهِدُوْا فِيْ سَبِيْلِهٖ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করো এবং তাঁর পথে জিহাদ করো, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার। (সূরা মায়েদা- ৩৫)
২৫. তাক্বওয়া একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে :
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَّنِسَآءً﴾
হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার স্ত্রীকেও সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের উভয় হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। (সূরা নিসা- ১)
২৬. তাক্বওয়া শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় :
﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللّٰهِ وَرَسُوْلِهٖ وَاتَّقُوا اللّٰهَ إِنَّ اللّٰهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের অগ্রবর্তী হয়ো না, আর আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন। (সূরা হুজুরাত- ১)
২৭. তাক্বওয়া কথাবার্তায় সংযমতা আনয়ন করে :
﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ إِذَا تَنَاجَيْتُمْ فَلَا تَتَنَاجَوْا بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُوْلِ وَتَنَاجَوْا بِالْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَاتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِيْۤ إِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন পরস্পর গোপন কথা বল, তখন গোনাহ, সীমালঙ্ঘন ও রাসূলের নাফরমানির কথাবার্তা বলো না; বরং সৎকর্ম ও আল্লাহকে ভয় করে চলার কথাবার্তা বলো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যার সামনে তোমাদের সকলকে একত্রিত করা হবে। (সূরা মুজাদালাহ- ৯)
২৮. তাক্বওয়া অন্তরে উদারতার গুণ আনয়ন করে :
﴿فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوْا وَأَطِيْعُوْا وَأَنْفِقُوْا خَيْرًا لِّأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾
তোমরা সাধ্যমতো আল্লাহকে ভয় করো; শ্রবণ করো ও আনুগত্য করো এবং আল্লাহর পথে ধনসম্পদ ব্যয় করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যে সকল লোক তার মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা পেয়ে গেল, শুধু তারাই সফলকাম। (সূরা তাগাবুন- ১৬)
২৯. তাক্বওয়া মাগফিরাতের পথ সহজ করে দেয় :
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَّاَجْرٌ كَبِيْرٌ﴾
নিশ্চয় যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সূরা মুলক- ১২)
৩০. তাক্বওয়া বাতিলের মোকাবেলায় অন্তরকে দৃঢ়তা দান করে :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اصْبِرُوْا وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا وَاتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ করো, (শত্রুর মোকাবেলায়) দৃঢ়তা প্রদর্শন করো, পারস্পরিক বন্ধন মজবুত করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা আলে ইমরান- ২০০)
৩১. তাক্বওয়া ঈমানের অনিবার্য দাবি :
﴿قُلْ يَا عِبَادِ الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا رَبَّكُمْ لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوْا فِيْ هٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَّأَرْضُ اللّٰهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾
বলো, হে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যারা এ দুনিয়াতে নেক ও সৎকাজ করে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান; আল্লাহর জমিন প্রশস্ত; ধৈর্য অবলম্বনকারীদেরই অগণিত প্রতিদান দেয়া হয়। (সূরা যুমার- ১০)
৩২. তাক্বওয়া আখিরাতে কল্যাণ লাভের চাবিকাঠি :
﴿زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُوْنَ مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۘ وَالَّذِيْنَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِؕ وَاللهُ يَرْزُقُ مَنْ يَّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾
যারা কুফরী করেছে দুনিয়ার জীবনকে তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। ফলে তারা মুমিনদেরকে উপহাস করে, অথচ কিয়ামতের দিন মুত্তাক্বীরাই তাদের ওপরে থাকবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে অগণিত রিযিক দান করেন। (সূরা বাক্বারা- ২১২)
৩৩. তাক্বওয়া আল্লাহর ভালোবাসা লাভের উপায় :
﴿بَلٰى مَنْ أَوْفٰى بِعَهْدِهٖ وَاتَّقٰى فَإِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
যে ব্যক্তি নিজে ওয়াদা পূরণ করে এবং খোদাভীতি অবলম্বন করে, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা এমন মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান- ৭৬)
৩৪. তাক্বওয়া আল্লাহর রহমত লাভের উপযুক্ত করে :
﴿وَاكْتُبْ لَنَا فِيْ هٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْاٰخِرَةِ إِنَّا هُدْنَاۤ إِلَيْكَ قَالَ عَذَابِيْۤ أُصِيْبُ بِهٖ مَنْ أَشَآءُ وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍؕ فَسَاَكْتُبُهَا لِلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِاٰيَاتِنَا يُؤْمِنُوْنَ﴾
অতএব আমাদের জন্য এ দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালের কল্যাণ লিখে দিন। আমরা আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি। আল্লাহ বলেন, শাস্তি তো আমি যাকে ইচ্ছা তাকে দেই, কিন্তু আমার অনুগ্রহ প্রত্যেক বস্তুর উপর বিস্তৃত। সুতরাং আমি সেটা তাদের জন্য নির্ধারণ করব যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৬)
৩৫. তাক্বওয়া ইবাদাত কবুলের পূর্বশর্ত :
﴿وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَاَ ابْنَيْ اٰدَمَ بِالْحَقِّۘ اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِؕ قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَؕ قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
তুমি তাদেরকে আদমের দু’পুত্রের বিবরণ সঠিকভাবে বর্ণনা করো। যখন তারা কুরবানী করেছিল তখন তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানী কবুল করা হয়নি। সে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ একমাত্র পরহেযগারদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন। (সূরা মায়েদা- ২৭)
৩৬. আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قَاتِلُوا الَّذِيْنَ يَلُوْنَكُمْ مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوْا فِيْكُمْ غِلْظَةً وَّاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে জিহাদ করো, যেন তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তাওবা- ১২৩)
﴿وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَآفَّةً كَمَا يُقَاتِلُوْنَكُمْ كَآفَّةً وَّاعْلَمُوْاۤ أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
আর মুশরিকদের সাথে তোমরা সকলে মিলে লড়াই করো, যেমনিভাবে তারা সকলে মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করছে। আর জেনে রেখো! আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তওবা- ৩৬)
﴿إِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّالَّذِيْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَ﴾
আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন, যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে। (সূরা নাহল- ১২৮)
৩৭. তাক্বওয়া মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে :
﴿اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَيْنَ اَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ﴾
মুমিনরা একে অপরের ভাই। অতএব (বিরোধ দেখা দিলে) তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে নাও। আর আল্লাহকে ভয় করো; আশা করা যায়, তোমাদের ওপর দয়া করা হবে। (সূরা হুজুরাত- ১০)
৩৮. তাক্বওয়া মন্দ কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করে :
﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَّلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَّأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِيْمٌ﴾
হে ঈমানদারগণ! অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা কোন কোন ধারণা গোনাহের নামান্তর; তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি করো না। আর তোমাদের কেউ যেন অপরের গীবত না করে, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বরং তোমরা নিজেরাই তো এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে থাক। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াবান। (সূরা হুজুরাত- ১২)
৩৯. তাক্বওয়া মানুষের কর্মকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে :
عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ قَالَ : دَخَلْتُ عَلٰى رَسُولِ اللهِ فَذَكَرَ الْحَدِيْثِ بِطُوْلِه إِلٰى أَنْ قَالَ : قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَوْصِنِي قَالَ : أُوصِيكَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَ جَلَّ فَإِنَّهٗ أَزْيَنُ لِأَمْرِكَ كُلِّه
আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট প্রবেশ করলাম। এরপর বর্ণনাকারী দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন। এক পর্যায়ে বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে উপদেশ দিন। নবী করীম ﷺ বললেন, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি তাক্বওয়া তথা খোদাভীতি অবলম্বন করো। কেননা এটা তোমার সমস্ত কাজ সুন্দর, সুষ্ঠু ও সৌন্দর্যমন্ডিত করে দেবে। [শু‘আবুল ঈমান হা/৪৯৪২; মিশকাত হা/৪৮৬৬।]
৪০. তাক্বওয়া সমস্ত কল্যাণের উৎস :
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ أَوْصِنِي قَالَ عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهٗ جِمَاعُ كُلِّ خَيْرٍ
আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করো। কেননা এটাই সমস্ত কল্যাণের মূল উৎস। [জামেউল আহাদীস হা/১৪২৪৭; কানযুল উম্মাল হা/৪৩৪৩৭; মু‘জামুয যাওয়াইদ হা/১৮১৭১; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১০০০।]
৪১. তাক্বওয়া হালাল উপার্জনের অনুপ্রেরণা যোগায় :
عَنْ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ اِنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوْتَ حَتّٰى تَسْتَكْمِلَ رِزْقَهَا فَاتَّقُوْا اللهَ فَأجْمِلُوْا فِيْ الطَّلَبِ وَلَا يَحْمِلَنَّكُمْ اِسْتِبْطَاءُ الرِّزْقِ أَنْ تَطْلُبُوْهُ بِمَعَاصِي اللهِ عَزَّ وَ جَلَّ فَإِنَّ اللهَ لَا يُدْرَكَ مَا عِنْدَهٗ إِلَّا بِطَاعَتِهِ
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিযিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোন লোকই মৃত্যুবরণ করবে না। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জনের চেষ্টা করো। রিযিকপ্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদের অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে, তা কেবল তাঁর প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে লাভ করা যায়। [কানযুল উম্মাল হা/৯৩০৯; জামেউল আহাদীস হা/১৯৩৭৫।]
﴿ يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো। (সূরা তাওবা- ১১৯)
﴿وَاِيَّايَ فَارْهَبُوْنِ﴾
আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করো। (সূরা বাক্বারা- ৪০)
২. তাক্বওয়া অবলম্বন করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপদেশ :
عَنِ الْعِرْبَاضِ قَالَ صَلّٰى بِنَا رَسُولُ اللّٰهِ - - ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللّٰهِ كَأَنَّ هٰذِهٖ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللّٰهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهٗ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ
ইরবায ইবনে সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সাথে সালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ করে আমাদের উদ্দেশ্যে এমন এক মর্মস্পর্শী নসীহত করলেন, যাতে চক্ষুসমূহ অশ্রু প্রবাহিত করল এবং অন্তরসমূহ ভীত-বিহবল হলো। এ সময় এক ব্যক্তি বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! এ মনে হচ্ছে বিদায় গ্রহণের উপদেশ। আমাদেরকে আরো কিছু উপদেশ দিন। তখন নবী করীম ﷺ বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার বা তাক্বওয়াবান হওয়ার উপদেশ দিচ্ছি এবং নেতার কথা শুনতে ও তার আনুগত্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে হাবশী গোলাম হয়। আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অল্প দিনের মধ্যে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সৎপথ প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে এবং তাকে মাড়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে ধরে থাকবে। অতএব সাবধান তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে কিতাব ও সুন্নাহর বাইরে) নতুন সৃষ্ট কাজ হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন কাজই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। [তিরমিযী, হা/২৩০৫; মিশকাত, হা/১৬৫।]
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন কোন সময় ব্যক্তিগতভাবে অনেককেই তাক্বওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিতেন। যেমন-
রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন মৃত্যুকালীন রোগে বিছানায় শুয়েছিলেন, তখন তিনি স্বীয় কন্যা ফাতিমা (রাঃ)-কে সর্বশেষ উপদেশ হিসেবে বলেন,
فَاتَّقِي اللهَ وَاصْبِرِي فَإِنِّي نِعْمَ السَّلَفُ أَنَا لَكِ
অতএব তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং ধৈর্যধারণ করো। আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রযাত্রী। [সহীহ বুখারী, হা/৬২৮৬; সহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০।]
অনুরূপভাবে তিনি যখন কোথাও বাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন তিনি উক্ত দলের আমীরকেও অনুরূপ উপদেশ প্রদান করতেন। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللّٰهِ - - إِذَا أَمَّرَ أَمِيرًا عَلٰى جَيْشٍ أَوْ سَرِيَّةٍ أَوْصَاهُ فِى خَاصَّتِهٖ بِتَقْوَى اللّٰهِ وَمَنْ مَعَهٗ مِنَ الْمُسْلِمِينَ خَيْرًا
বুরায়দা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন কোন সৈন্যদলের আমীর নির্ধারণ করতেন, তখন তাকে বিশেষভাবে আল্লাহকে ভয় করার তথা তাক্বওয়া অবলম্বন করার জন্য আদেশ করতেন এবং সাধারণ মুসলিম যুদ্ধাদেরকে তাক্বওয়া অর্জনের উপদেশ দিতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/১৭৩১; মিশকাত, হা/৩৯২৯।]
৩. তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরাই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর অধিক নৈকট্য লাভকারী :
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ لَمَّا بَعَثَهٗ رَسُولُ اللّٰهِ إِلَى الْيَمَنِ خَرَجَ مَعَهٗ رَسُولُ اللّٰهِ يُوصِيهِ وَمُعَاذٌ رَاكِبٌ وَرَسُولُ اللّٰهِ يَمْشِي تَحْتَ رَاحِلَتِهٖ فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ يَا مُعَاذُ إِنَّكَ عَسٰى أَنْ لَا تَلْقَانِي بَعْدَ عَامِي هٰذَا أَوْ لَعَلَّكَ أَنْ تَمُرَّ بِمَسْجِدِي هٰذَا أَوْ قَبْرِي فَبَكٰى مُعَاذٌ جَشَعًا لِفِرَاقِ رَسُولِ اللّٰهِ ثُمَّ الْتَفَتَ فَأَقْبَلَ بِوَجْهِه نَحْوَ الْمَدِينَةِ فَقَالَ إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِي الْمُتَّقُونَ مَنْ كَانُوا وَحَيْثُ كَانُوا
মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে ইয়ামান পাঠান, তখন তিনি তাকে উপদেশ দেয়ার জন্য তার সাথে বের হলেন। মু‘আয সওয়ারীর উপরে আরোহণ করলেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ সওয়ারীর নিচে হাঁটছিলেন। তিনি উপদেশ শেষে বললেন, মু‘আয! সম্ভবত এ বছরের পর তোমার সাথে আমার আর সাক্ষাৎ হবে না। তুমি আমার মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে পার হয়ে যাবে। মু‘আয (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিচ্ছিন্নতায় চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন এবং মদীনার দিকে ফিরে দেখলেন। তারপর নবী করীম ﷺ বললেন, তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরাই আমার সবচেয়ে নিকটে। তারা যেই হোক না কেন, যেখানেই হোক না কেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২২০৫২; মিশকাত, হা/৫২২৭।]
৪. নবী ﷺ নিজেও তাক্বওয়া অর্জনের দু‘আ করতেন :
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ عَنِ النَّبِىِّ - - أَنَّهٗ كَانَ يَقُولُ اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْهُدٰى وَالتُّقٰى وَالْعَفَافَ وَالْغِنٰى
আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সূত্রে নবী ﷺ হতে বর্ণিত। তিনি এ মর্মে প্রার্থনা করতেন যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট সঠিক পথ, পরহেযগারিতা, গোনাহ হতে নিষ্কলুষতা এবং অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭২১; মিশকাত, হা/২৪৮৪।]
৫. তাক্বওয়া অবলম্বনে সালফে সালেহীনদের অসিয়ত :
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মৃত্যুর পর সাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈসহ অনেক সালফে সালেহীন লোকদেরকে তাক্বওয়া অবলম্বন করার উপদেশ দিয়েছেন। নিম্নে এর মধ্য হতে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
(১) আবু বকর (রাঃ) খুৎবা প্রদানকালে বলতেন, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহভীতি অর্জনের, তাঁর যথাযথ প্রশংসা করার, কোন কিছু কামনার সাথে ভীত হওয়ার, কোন কিছু প্রার্থনার ক্ষেত্রে বিনয়ের সংমিশ্রণ ঘটানোর। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৩-১৪।] কেননা আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া ও তাঁর পরিবার পরিজনের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন,
﴿اِنَّهُمْ كَانُوْا يُسَارِعُوْنَ فِى الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّرَهَبًاؕ وَكَانُوْا لَنَا خَاشِعِيْنَ﴾
তারা (নবীগণ) সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করতেন, তারা আমাকে ডাকতেন আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিলেন আমার নিকট বিনীত। (সূরা আম্বিয়া- ৯০)
যখন আবু বকর (রাঃ) এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে এবং উমরের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন, তখন তিনি উমর (রাঃ)-কে ডেকে বিভিন্ন উপদেশ দিলেন। তাকে তিনি প্রথম যা বললেন, তা হচ্ছে اِتَّقِ اللهَ يَا عُمَرَ হে উমর! আল্লাহকে ভয় করো। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৩-১৪।]
(২) উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) স্বীয় পুত্র আবদুল্লাহর নিকটে পত্র লিখলেন এ বলে যে,
فَإِنِّىْ أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَإِنَّهٗ مَنِ اتَّقَاهُ وَقَاهُ وَمَنْ أَقْرَضَهٗ جَزَاهُ وَمَنْ شَكَرَهٗ زَادَهٗ وَاجْعَلِ التَّقْوٰى نَصَبَ عَيْنَيْكَ وَجَلَاءَ قَلْبِكَ
আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করার। কেননা যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন। যে তাঁকে ভয় করবে না, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন। আর যে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে, তাকে নিয়ামত বাড়িয়ে দিবেন। তাক্বওয়াকে তোমার চোখের মণি ও অন্তরের উজ্জলতা বৃদ্ধিকারী করে নাও। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৪।]
(৩) আলী ইবনে আবু তালেব (রাঃ) কোন অভিযান প্রেরণকালে প্রধান সেনাপতিকে বলতেন,
أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ الَّذِي لَا بُدَّ لَكَ مِنْ لِقَائِه
আমি তোমাকে ঐ আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি, যাঁর সাথে অবশ্যই তোমার সাক্ষাৎ ঘটবে। [সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ৬; মুহাম্মাদ ইবনু সালেহ আল-উসায়মীন, কিতাবুল ইলম, পৃঃ ৬২।]
(৪) উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে এক যুদ্ধে দায়িত্ব প্রদান করেন। অতঃপর তাকে বলেন,
أُوصِيْكَ بَتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ الَّتِي لَا يُقْبَلُ غَيرُهَا وَلَا يُرْحَمُ إِلَّا أَهْلُهَا وَلَا يُثَابُ إِلَّا عَلَيْهَا فَإِنِ الْوَاعِظِينَ بِهَا كَثِيرٌ وَالْعَامِلِينَ بِهَا قَلِيْلٌ جَعَلَنَا اللهُ وَإِيَّاكَ مِنَ الْمُتَّقِينَ
আমি তোমাকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি, যা ব্যতীত কোন কিছু কবুল হয় না। তাক্বওয়াবান ব্যতীত কারো উপর রহম করা হয় না। মুত্তাক্বী ব্যতীত কাউকে সওয়াব দেয়া হয় না। তাক্বওয়ার ব্যাপারে উপদেশ দানকারী অনেক। কিন্তু তাক্বওয়াভিত্তিক আমলকারীর সংখ্যা নগণ্য। আল্লাহ আমাদেরকে ও তোমাদেরকে মুত্তাক্বীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। [ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ১৪; শায়খ আলী ইবনু নায়েফ আশ-মুহুদ, মাওসূ‘আতুল খুতাব ওয়াদ দুরুস, পৃঃ ২।]
(৫) শু‘বাহ (রহ.) বলেন, আমি যখন কোথাও গমনের ইচ্ছা করতাম, তখন হাকামকে বলতাম, তোমার কোন প্রয়োজন আছে কি? তখন সে বলত, তোমাকে আমি ঐ উপদেশ দিচ্ছি, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ মু‘আয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে দিয়েছিলেন,
اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَاَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا
যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করবে, কোন কারণবশত পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে, তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দিবে। [তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৮৩।]
(৬) ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ইবনু আওন এক লোককে বিদায় দানকালে বললেন তোমার জন্য আবশ্যক হলো তাক্বওয়া অবলম্বন করা। কেননা মুত্তাক্বী কখনো নিঃসঙ্গ ও একাকী হয় না। [আবদুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ, মাওয়ারিদুয যামআন রিদুরুসিয যামান, মদীনা; ৩০তম সংস্করণ, ১৪২৪ হিঃ, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৭৫।]
(৭) সুফিয়ান সাওরী (রহ.) ইবনু আবী যিবকে বলেন, তুমি আল্লাহকে ভয় করলে তিনি তোমাকে মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন। আর তুমি মানুষকে ভয় করলে মানুষ তোমাকে আল্লাহ থেকে অমুখাপেক্ষী করতে পারবে না। [ইবনুল কাইয়্যিম, আল-ফাওয়ায়েদ, ১ম খন্ড, মিসর : কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, তা.বি, পৃঃ ৫২।]
৬. তাক্বওয়া হলো বান্দার সর্বোত্তম পরিচ্ছদ :
﴿يَا بَنِيْۤ اٰدَمَ قَدْ اَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُّوَارِيْ سَوْاٰتِكُمْ وَرِيْشًاؕ وَلِبَاسُ التَّقْوٰى ذٰلِكَ خَيْرٌ ذٰلِكَ مِنْ اٰيَاتِ اللهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ﴾
হে বনী আদম! তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করা ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে পোশাক দান করেছি এবং (আরো দিয়েছি) তাক্বওয়ার পোশাক, আর এটাই সর্বোত্তম (পোশাক)। এটা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম, হয়তো তারা (এর মাধ্যমে) উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে। (সূরা আ‘রাফ- ২৬)
অত্র আয়াতে তাক্বওয়ার পোশাককেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা এটি হচ্ছে এমন পোশাক, যা অন্তরকে আচ্ছাদিত করে রাখে। যার কারণে অন্তর বাহিরের যেকোন প্রকার অসাধু চিন্তাচেতনা থেকে মুক্ত থাকে। অতঃপর তা ব্যক্তির আচার-আচরণ ও বাহ্যিক বেশভূষার মধ্যে ফুটে উঠে।
৭. তাক্বওয়া বান্দার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ পাথেয় :
মানবজীবন হচ্ছে একটি দীর্ঘ সফরের সমতুল্য। যেকোন সফরের জন্য যেরূপ পাথেয় গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি, অনুরূপভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের জন্যও পাথেয় গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাক্বওয়া অবলম্বন করা। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَزَوَّدُوْا فَاِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوٰىؗ وَاتَّقُوْنِ يَاۤ اُولِى الْاَلْبَابِ﴾
তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো; বস্তুত উৎকৃষ্টতম পাথেয় হচ্ছে আল্লাহভীতি। অতএব হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকে ভয় করো। (সূরা বাক্বারা- ১৯৭)
৮. তাক্বওয়া হচ্ছে মানুষের সম্মান ও মর্যাদার প্রকৃত মানদন্ড :
মানুষ সাধারণত বংশ, গোত্র, সম্পদ ও পরিচিতির মানদন্ডে একে অপরকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা যেটি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য, সেটি কেবল তাক্বওয়ার মানদন্ডেই নির্ধারিত হয়। এজন্যই কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقَاكُمْ﴾
আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে তারাই অধিক সম্মানিত, যারা তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাক্বী। (সূরা হুজুরাত- ১৩)
অনুরূপভাবে হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ سُئِلَ رَسُولُ اللّٰهِ أَيُّ النَّاسِ أَكْرَمُ قَالَ أَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللّٰهِ أَتْقَاهُمْ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোন্ ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক তাক্বওয়াবান, আল্লাহর নিকট সে-ই সবচেয়ে সম্মানিত। [সহীহ বুখারী, হা/৪৬৮৯; সুনানে দারেমী, হা/২২৯।]
عَنْ سَمُرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ -- : الْحَسَبُ الْمَالُ وَالْكَرَمُ التَّقْوٰى
সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, বংশগৌরব বা আভিজাত্য হলো ধন-সম্পদ। আর সম্মান হলো তাক্বওয়া অবলম্বন করা। [বায়হাকী, হা/১৪১৫০; তিরমিযী, হা/৩৩২৫; মিশকাত, হা/৪৯০১।]
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ قَالَ إِنَّ أَنْسَابَكُمْ هٰذِهٖ لَيْسَتْ بِسِبَابٍ عَلٰى أَحَدٍ وَإِنَّمَا أَنْتُمْ وَلَدُ اٰدَمَ طَفُّ الصَّاعِ لَمْ تَمْلَئُوهُ لَيْسَ لِأَحَدٍ فَضْلٌ إِلَّا بِالدِّينِ أَوْ عَمَلٍ صَالِحٍ حَسْبُ الرَّجُلِ أَنْ يَكُونَ فَاحِشًا بَذِيًّا بَخِيلًا جَبَانًا
উক্ববা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমাদের বংশপরিচয় এমন কোন বস্তু নয় যে, তার কারণে তোমরা অন্যকে গালমন্দ করবে। তোমরা সকলেই আদমের সন্তান; দাঁড়িপাল্লার উভয় দিকে যেমন সমান থাকে, যখন তোমরা পূর্ণ করনি। দ্বীন ও তাক্বওয়া ব্যতীত একের উপর অন্যের কোন মর্যাদা নেই। তবে কোন ব্যক্তির মন্দ হওয়ার জন্য অশ্লীল বাক্যাচারী ও কৃপণ হওয়াই যথেষ্ট। [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৩১৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৮১৪; জামেউল আহাদীস, হা/৭৫৯১; কানযুল উম্মাল, হা/১৩০০; মাজমাউয যাওয়াইদ, হা/১৩০৭৬।]
৯. তাক্বওয়াবানরা আল্লাহর বন্ধু :
﴿اَلَاۤ اِنَّ اَوْلِيَآءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‐ اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। (তারা হচ্ছে ঐসব ব্যক্তি) যারা ঈমান আনয়ন করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে। (সূরা ইউনুস- ৬২, ৬৩)
১০. আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াবানদের অভিভাবক :
﴿وَاللهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
আর আল্লাহ মুত্তাক্বীদের অভিভাবক। (সূরা জাসিয়া- ১৯)
১১. তাক্বওয়ার কাজে সহযোগিতা করার নির্দেশ :
তাক্বওয়ার ভিত্তিতে যে কাজই করা হোক না কেন, সেটি মানবজাতির জন্য খুবই কল্যাণকর। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾
তোমরা সৎকর্ম ও তাক্বওয়ার বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে একে অন্যের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে খুবই কঠোর। (সূরা মায়েদা- ২)
১২. তাক্বওয়াই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে উত্তম ভিত্তি :
﴿اَفَمَنْ اَسَّسَ بُنْيَانَهٗ عَلٰى تَقْوٰى مِنَ اللهِ وَرِضْوَانٍ خَيْرٌ اَمْ مَّنْ اَسَّسَ بُنْيَانَهٗ عَلٰى شَفَا جُرُفٍ هَارٍ فَانْهَارَ بِهٖ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَؕ وَاللهُ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ﴾
যে ব্যক্তি তার ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টির উপর- সে ব্যক্তি উত্তম? নাকি ঐ ব্যক্তি উত্তম, যে তার ঘরের ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে এমন একটি গর্তের কিনারায়, যার তলায় মাটি নেই। ফলে এটা তাকে সহ (অচিরেই) জাহান্নামের (অতল) আগুনের খাদে গিয়ে পড়বে। আর আল্লাহ কখনো যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না। (সূরা তাওবা- ১০৯)
অত্র আয়াতে একটি উদাহরণের মাধ্যমে তাক্বওয়াহীন জীবনের অসারতার কথা আলোচনাপূর্বক তাক্বওয়াবান জীবনকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে।
১৩. তাক্বওয়াই হলো ইবাদাতের সারবস্তু :
﴿لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰى مِنْكُمْ﴾
আল্লাহর নিকট তার গোশত এবং রক্ত কিছুই পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাক্বওয়াটাই তাঁর নিকট পৌঁছে। (সূরা হজ্জ- ৩৭)
১৪. তাক্বওয়া দ্বারা আল্লাহর রহমত লাভ হয় :
﴿وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍؕ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِاٰيَاتِنَا يُؤْمِنُوْنَ﴾
আমার দয়া প্রত্যেক বস্তুতে ব্যপ্ত। সুতরাং আমি সেটা তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৬)
১৫. তাক্বওয়া জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় :
﴿وَاِنْ مِّنْكُمْ اِلَّا وَارِدُهَاۚ كَانَ عَلٰى رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا ‐ ثُمَّ نُنَجِّى الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا﴾
তোমাদের প্রত্যেকেই সেটা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাক্বীদেরকে উদ্ধার করব এবং যালিমদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দেব। (সূরা মারইয়াম- ৭১, ৭২)
১৬. তাক্বওয়া জান্নাত লাভের মাধ্যম :
﴿وَسِيْقَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ اِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا﴾
যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। (সূরা যুমার- ৭৩)
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ : سُئِلَ النَّبِيِّ : مَا أَكْثَرُ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ الْجَنَّةَ ؟ قَالَ : تَقَوَى اللهِ وَحُسْنُ الْخُلُقِ قِيْلَ : فَمَا أَكْثَرُ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ النَّارَ ؟ قَالَ اَلْأَجْوَفَانِ : اَلْفَمُ وَالْفَرَجُ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন্ জিনিস মানুষকে সবচেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করায়? তিনি বললেন, আল্লাহর ভয় বা তাক্বওয়া ও উত্তম চরিত্র। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, মানুষকে সবচেয়ে বেশি জাহান্নামে প্রবেশ করায় কোন্ জিনিস? তিনি বললেন, তা হলো দুটি গর্ত- মুখ ও লজ্জাস্থান। [ইবনে মাজাহ, হা/৪২৪৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৭৬; জামেউল আহাদাী, হা/৩৩৪৩৪; আদাবুল মুফরাদ, হা/২৯৪।]
১৭. তাক্বওয়া শয়তানের ধোঁকাবাজি ধরিয়ে দেয় :
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَآئِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ﴾
যারা তাক্বওয়ার অধিকারী হয় তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়। (সূরা আ‘রাফ- ২০১)
যারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে ভয় করে এবং অসৎকাজ থেকে দূরে থাকতে চায়, তাদের মনে যদি কখনো অসৎ চিন্তার সামান্যতম স্পর্শও লাগে, তাহলে তা তাদের মনকে ঠিক তেমনিভাবে আহত করে, যেমন চোখে বালি পড়লে মানুষ যন্ত্রণাবোধ করে। তাদের বিবেক জেগে উঠে এবং তারা অসৎ প্রবণতার এ ধূলোমাটি ঝেড়ে ফেলার কাজে লেগে যায়। অন্যদিকে যারা আল্লাহকে ভয় করে না, অসৎকাজ থেকে বাঁচতেও চায় না এবং শয়তানকে সাথে রেখে চলে, তাদের মনে অসৎ চিন্তা ও অসৎ উদ্দেশ্য পরিপক্কতা লাভ করতে থাকে এবং তারা এসব পঁচা দুর্গন্ধময় আবর্জনায় কোন প্রকার অস্বস্তি অনুভব করে না।
১৮. তাক্বওয়া সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَّكُمْ فُرْقَانًا وَّيُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْؕ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيْمِ﴾
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অতিশয় মঙ্গলময়। (সূরা আনফাল- ২৯)
যখন আল্লাহ তা‘আলা কাউকে এই শক্তিটি প্রদান করবেন, তখন সে প্রতিটি কর্মের সত্য-মিথ্যা অথবা যথার্থতা সম্পর্কে অতি সহজেই জানতে পারবে। অতঃপর এভাবেই সে মনজিলে মাকসূদে পৌঁছে যাবে।
১৯. তাক্বওয়া উন্নতি লাভের উপায় :
﴿وَلَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤى اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ وَلٰكِنْ كَذَّبُوْا فَاَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ﴾
যদি সেসব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের সকল কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি। (সূরা আ‘রাফ- ৯৬)
২০. তাক্বওয়াবান ব্যতীত অন্য কারো জন্য সম্পদ ব্যয় করা উচিত নয় :
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ عَنِ النَّبِىِّ - - قَالَ : لَا تُصَاحِبْ إِلَّا مُؤْمِنًا وَلَا يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلَّا تَقِىٌّ
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি নবী করীম ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, ঈমানদার ছাড়া কাউকে সাথী করো না। আর পরহেযগার ব্যতীত কেউ যেন তোমার খাদ্য না খায়। [তিরমিযী, হা/২৩৯৫; আবু দাউদ, হা/৪৮৩৪।]
২১. তাক্বওয়া পাপ মোচনে সাহায্য করে :
عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ - - قَالَ : قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ - - اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানে থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে বা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কোন কারণবশত পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে। তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দেবে। [তিরমিযী, হা/১৯৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৪; সুনানে দারেমী, হা/২৮৪৭; মিশকাত, হা/৫০৮৩।]
২২. তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরা জাহান্নামে যাবে না :
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ - - قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - لَا يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكٰى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتّٰى يَعُوْدَ اللَّبَنُ في الضَّرْعِ وَلَا يَجْتَمِعُ غُبَارٌ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَدُخَانُ جَهَنَّمَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে সে জাহান্নামে যাবে না। দুধ যেমন গাভীর ওলানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। আল্লাহর পথের ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন একসাথে জমা হবে না। [তিরমিযী, হা/১৬৩৩; নাসাঈ, হা/৩১০৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১২৬৯, ৩৩২৪; মিশকাত, হা/৩৮২৮।]
২৩. তাক্বওয়া আখিরাতমুখী জীবন গঠনের সহায়ক :
﴿قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَّالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ لِّمَنِ اتَّقٰى وَلَا تُظْلَمُوْنَ فَتِيْلًا﴾
বলো, দুনিয়ার জীবন ও সম্পদ খুবই নগণ্য। আর পরকাল খোদাভীরু লোকদের জন্য সর্বাধিক উত্তম; অনন্তর তোমাদের প্রতি একবিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না। (সূরা নিসা- ৭৭)
২৪. তাক্বওয়া সফলতা লাভের অতি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَابْتَغُوْاۤ اِلَيْهِ الْوَسِيْلَةَ وَجَاهِدُوْا فِيْ سَبِيْلِهٖ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করো এবং তাঁর পথে জিহাদ করো, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার। (সূরা মায়েদা- ৩৫)
২৫. তাক্বওয়া একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে :
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيْرًا وَّنِسَآءً﴾
হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার স্ত্রীকেও সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের উভয় হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। (সূরা নিসা- ১)
২৬. তাক্বওয়া শিষ্টাচার শিক্ষা দেয় :
﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللّٰهِ وَرَسُوْلِهٖ وَاتَّقُوا اللّٰهَ إِنَّ اللّٰهَ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের অগ্রবর্তী হয়ো না, আর আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন। (সূরা হুজুরাত- ১)
২৭. তাক্বওয়া কথাবার্তায় সংযমতা আনয়ন করে :
﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ إِذَا تَنَاجَيْتُمْ فَلَا تَتَنَاجَوْا بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُوْلِ وَتَنَاجَوْا بِالْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَاتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِيْۤ إِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন পরস্পর গোপন কথা বল, তখন গোনাহ, সীমালঙ্ঘন ও রাসূলের নাফরমানির কথাবার্তা বলো না; বরং সৎকর্ম ও আল্লাহকে ভয় করে চলার কথাবার্তা বলো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যার সামনে তোমাদের সকলকে একত্রিত করা হবে। (সূরা মুজাদালাহ- ৯)
২৮. তাক্বওয়া অন্তরে উদারতার গুণ আনয়ন করে :
﴿فَاتَّقُوا اللّٰهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوْا وَأَطِيْعُوْا وَأَنْفِقُوْا خَيْرًا لِّأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِهٖ فَأُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾
তোমরা সাধ্যমতো আল্লাহকে ভয় করো; শ্রবণ করো ও আনুগত্য করো এবং আল্লাহর পথে ধনসম্পদ ব্যয় করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যে সকল লোক তার মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা পেয়ে গেল, শুধু তারাই সফলকাম। (সূরা তাগাবুন- ১৬)
২৯. তাক্বওয়া মাগফিরাতের পথ সহজ করে দেয় :
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَّاَجْرٌ كَبِيْرٌ﴾
নিশ্চয় যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সূরা মুলক- ১২)
৩০. তাক্বওয়া বাতিলের মোকাবেলায় অন্তরকে দৃঢ়তা দান করে :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اصْبِرُوْا وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا وَاتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ করো, (শত্রুর মোকাবেলায়) দৃঢ়তা প্রদর্শন করো, পারস্পরিক বন্ধন মজবুত করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা আলে ইমরান- ২০০)
৩১. তাক্বওয়া ঈমানের অনিবার্য দাবি :
﴿قُلْ يَا عِبَادِ الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا رَبَّكُمْ لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوْا فِيْ هٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةٌ وَّأَرْضُ اللّٰهِ وَاسِعَةٌ إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾
বলো, হে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যারা এ দুনিয়াতে নেক ও সৎকাজ করে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম প্রতিদান; আল্লাহর জমিন প্রশস্ত; ধৈর্য অবলম্বনকারীদেরই অগণিত প্রতিদান দেয়া হয়। (সূরা যুমার- ১০)
৩২. তাক্বওয়া আখিরাতে কল্যাণ লাভের চাবিকাঠি :
﴿زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُوْنَ مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۘ وَالَّذِيْنَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِؕ وَاللهُ يَرْزُقُ مَنْ يَّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ﴾
যারা কুফরী করেছে দুনিয়ার জীবনকে তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। ফলে তারা মুমিনদেরকে উপহাস করে, অথচ কিয়ামতের দিন মুত্তাক্বীরাই তাদের ওপরে থাকবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে অগণিত রিযিক দান করেন। (সূরা বাক্বারা- ২১২)
৩৩. তাক্বওয়া আল্লাহর ভালোবাসা লাভের উপায় :
﴿بَلٰى مَنْ أَوْفٰى بِعَهْدِهٖ وَاتَّقٰى فَإِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
যে ব্যক্তি নিজে ওয়াদা পূরণ করে এবং খোদাভীতি অবলম্বন করে, অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা এমন মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান- ৭৬)
৩৪. তাক্বওয়া আল্লাহর রহমত লাভের উপযুক্ত করে :
﴿وَاكْتُبْ لَنَا فِيْ هٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْاٰخِرَةِ إِنَّا هُدْنَاۤ إِلَيْكَ قَالَ عَذَابِيْۤ أُصِيْبُ بِهٖ مَنْ أَشَآءُ وَرَحْمَتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍؕ فَسَاَكْتُبُهَا لِلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكَاةَ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِاٰيَاتِنَا يُؤْمِنُوْنَ﴾
অতএব আমাদের জন্য এ দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালের কল্যাণ লিখে দিন। আমরা আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি। আল্লাহ বলেন, শাস্তি তো আমি যাকে ইচ্ছা তাকে দেই, কিন্তু আমার অনুগ্রহ প্রত্যেক বস্তুর উপর বিস্তৃত। সুতরাং আমি সেটা তাদের জন্য নির্ধারণ করব যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৬)
৩৫. তাক্বওয়া ইবাদাত কবুলের পূর্বশর্ত :
﴿وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَاَ ابْنَيْ اٰدَمَ بِالْحَقِّۘ اِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْاٰخَرِؕ قَالَ لَاَقْتُلَنَّكَؕ قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
তুমি তাদেরকে আদমের দু’পুত্রের বিবরণ সঠিকভাবে বর্ণনা করো। যখন তারা কুরবানী করেছিল তখন তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানী কবুল করা হয়নি। সে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ একমাত্র পরহেযগারদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন। (সূরা মায়েদা- ২৭)
৩৬. আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قَاتِلُوا الَّذِيْنَ يَلُوْنَكُمْ مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوْا فِيْكُمْ غِلْظَةً وَّاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে জিহাদ করো, যেন তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তাওবা- ১২৩)
﴿وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَآفَّةً كَمَا يُقَاتِلُوْنَكُمْ كَآفَّةً وَّاعْلَمُوْاۤ أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
আর মুশরিকদের সাথে তোমরা সকলে মিলে লড়াই করো, যেমনিভাবে তারা সকলে মিলে তোমাদের সাথে লড়াই করছে। আর জেনে রেখো! আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তওবা- ৩৬)
﴿إِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّالَّذِيْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَ﴾
আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন, যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে। (সূরা নাহল- ১২৮)
৩৭. তাক্বওয়া মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে :
﴿اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَيْنَ اَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ﴾
মুমিনরা একে অপরের ভাই। অতএব (বিরোধ দেখা দিলে) তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে নাও। আর আল্লাহকে ভয় করো; আশা করা যায়, তোমাদের ওপর দয়া করা হবে। (সূরা হুজুরাত- ১০)
৩৮. তাক্বওয়া মন্দ কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করে :
﴿يَاۤ أَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَّلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَّأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِيْمٌ﴾
হে ঈমানদারগণ! অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা কোন কোন ধারণা গোনাহের নামান্তর; তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি করো না। আর তোমাদের কেউ যেন অপরের গীবত না করে, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বরং তোমরা নিজেরাই তো এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে থাক। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াবান। (সূরা হুজুরাত- ১২)
৩৯. তাক্বওয়া মানুষের কর্মকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে :
عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ قَالَ : دَخَلْتُ عَلٰى رَسُولِ اللهِ فَذَكَرَ الْحَدِيْثِ بِطُوْلِه إِلٰى أَنْ قَالَ : قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَوْصِنِي قَالَ : أُوصِيكَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَ جَلَّ فَإِنَّهٗ أَزْيَنُ لِأَمْرِكَ كُلِّه
আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট প্রবেশ করলাম। এরপর বর্ণনাকারী দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন। এক পর্যায়ে বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে উপদেশ দিন। নবী করীম ﷺ বললেন, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি তাক্বওয়া তথা খোদাভীতি অবলম্বন করো। কেননা এটা তোমার সমস্ত কাজ সুন্দর, সুষ্ঠু ও সৌন্দর্যমন্ডিত করে দেবে। [শু‘আবুল ঈমান হা/৪৯৪২; মিশকাত হা/৪৮৬৬।]
৪০. তাক্বওয়া সমস্ত কল্যাণের উৎস :
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ أَوْصِنِي قَالَ عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهٗ جِمَاعُ كُلِّ خَيْرٍ
আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করো। কেননা এটাই সমস্ত কল্যাণের মূল উৎস। [জামেউল আহাদীস হা/১৪২৪৭; কানযুল উম্মাল হা/৪৩৪৩৭; মু‘জামুয যাওয়াইদ হা/১৮১৭১; মুসনাদে আবু ই‘আলা, হা/১০০০।]
৪১. তাক্বওয়া হালাল উপার্জনের অনুপ্রেরণা যোগায় :
عَنْ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ اِنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوْتَ حَتّٰى تَسْتَكْمِلَ رِزْقَهَا فَاتَّقُوْا اللهَ فَأجْمِلُوْا فِيْ الطَّلَبِ وَلَا يَحْمِلَنَّكُمْ اِسْتِبْطَاءُ الرِّزْقِ أَنْ تَطْلُبُوْهُ بِمَعَاصِي اللهِ عَزَّ وَ جَلَّ فَإِنَّ اللهَ لَا يُدْرَكَ مَا عِنْدَهٗ إِلَّا بِطَاعَتِهِ
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিযিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোন লোকই মৃত্যুবরণ করবে না। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জনের চেষ্টা করো। রিযিকপ্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদের অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে, তা কেবল তাঁর প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে লাভ করা যায়। [কানযুল উম্মাল হা/৯৩০৯; জামেউল আহাদীস হা/১৯৩৭৫।]
১. নূহ (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ قَوْمُ نُوْحِ نِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ نُوْحٌ اَلَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১০৫-১০৮)
২. হুদ (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ عَادُنِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ هُوْدٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
আদ সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই হুদ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১২৩-১২৬)
৩. সালেহ (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ صَالِحٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
সামূদ সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই সালেহ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১৪১-১৪৪)
৪. লূত (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوْطِ نِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ لُوْطٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
লূতের সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই লূত তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১৬০-১৬৩)
৫. শুয়াইব (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَ اَصْحَابُ الْاَيْكَةِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ شُعَيْبٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
আইকাবাসীরা রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল, যখন শুয়াইব তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১৭৬-১৭৯)
৬. ইলয়াস (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿وَاِنَّ اِلْيَاسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لِقَوْمِهٖۤ اَلَا تَتَّقُوْنَ﴾
নিঃসন্দেহে ইলয়াসও ছিলেন রাসূলদের মধ্যে অন্যতম। স্মরণ করো, যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? (সূরা সাফ্ফাত- ১২৩, ১২৪)
৭. মূসা (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿وَاِذْ نَادٰى رَبُّكَ مُوْسٰۤى اَنِ ائْتِ الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ ‐ قَوْمَ فِرْعَوْنَؕ اَ لَا يَتَّقُوْنَ﴾
স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক মূসাকে ডেকে বললেন, তুমি যালিম সম্প্রদায়- ফিরাউনের সম্প্রদায়ের নিকট যাও। তারা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? (সূরা শু‘আরা- ১০, ১১)
৮. ঈসা (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿وَجِئْتُكُمْ بِاٰيَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
আমি তোমাদের কাছে এসেছি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন সহকারে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার অনুসরণ করো। (সূরা আলে ইমরান- ৫০)
৯. মুহাম্মাদ ﷺ এর দাওয়াত :
﴿اَرَاَيْتَ اِنْ كَانَ عَلَى الْهُدٰى ‐ اَوْ اَمَرَ بِالتَّقْوٰى﴾
তুমি কি দেখেছ, যদি তিনি সৎপথে থাকেন অথবা আল্লাহভীতি শিক্ষা দেন (তবে এটা কতই না ভালো হতো)। (সূরা আলাক্ব- ১১, ১২)
﴿كَذَّبَتْ قَوْمُ نُوْحِ نِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ نُوْحٌ اَلَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
নূহের সম্প্রদায় রাসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১০৫-১০৮)
২. হুদ (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ عَادُنِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ هُوْدٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
আদ সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই হুদ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১২৩-১২৬)
৩. সালেহ (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ صَالِحٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
সামূদ সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই সালেহ তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১৪১-১৪৪)
৪. লূত (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَتْ قَوْمُ لُوْطِ نِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ اَخُوْهُمْ لُوْطٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
লূতের সম্প্রদায় রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল। যখন তাদের ভাই লূত তাদেরকে বললেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১৬০-১৬৩)
৫. শুয়াইব (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿كَذَّبَ اَصْحَابُ الْاَيْكَةِ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لَهُمْ شُعَيْبٌ اَ لَا تَتَّقُوْنَ ‐ اِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ اَمِيْنٌ ‐ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
আইকাবাসীরা রাসূলগণকে মিথ্যারোপ করেছিল, যখন শুয়াইব তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা শু‘আরা, ১৭৬-১৭৯)
৬. ইলয়াস (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿وَاِنَّ اِلْيَاسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ ‐ اِذْ قَالَ لِقَوْمِهٖۤ اَلَا تَتَّقُوْنَ﴾
নিঃসন্দেহে ইলয়াসও ছিলেন রাসূলদের মধ্যে অন্যতম। স্মরণ করো, যখন তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? (সূরা সাফ্ফাত- ১২৩, ১২৪)
৭. মূসা (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿وَاِذْ نَادٰى رَبُّكَ مُوْسٰۤى اَنِ ائْتِ الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ ‐ قَوْمَ فِرْعَوْنَؕ اَ لَا يَتَّقُوْنَ﴾
স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক মূসাকে ডেকে বললেন, তুমি যালিম সম্প্রদায়- ফিরাউনের সম্প্রদায়ের নিকট যাও। তারা কি (আল্লাহকে) ভয় করবে না? (সূরা শু‘আরা- ১০, ১১)
৮. ঈসা (আঃ) এর দাওয়াত :
﴿وَجِئْتُكُمْ بِاٰيَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْنِ﴾
আমি তোমাদের কাছে এসেছি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন সহকারে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার অনুসরণ করো। (সূরা আলে ইমরান- ৫০)
৯. মুহাম্মাদ ﷺ এর দাওয়াত :
﴿اَرَاَيْتَ اِنْ كَانَ عَلَى الْهُدٰى ‐ اَوْ اَمَرَ بِالتَّقْوٰى﴾
তুমি কি দেখেছ, যদি তিনি সৎপথে থাকেন অথবা আল্লাহভীতি শিক্ষা দেন (তবে এটা কতই না ভালো হতো)। (সূরা আলাক্ব- ১১, ১২)
اَلتَّقْوٰى (আত-তাক্বওয়া) শব্দের ন্যায় اَلْمُتَّقِى (আল-মুত্তাক্বী) শব্দটিও وَقَايَةٌ শব্দ থেকে উৎপন্ন। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহভীতি অর্জনকারী, হেফাজতকারী, রক্ষাকারী ইত্যাদি। আর ইসলামিক পরিভাষায় মুত্তাক্বী বলা হয় ঐসব ব্যক্তিকে, যাদের মধ্যে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহে বর্ণিত মুত্তাক্বীদের গুণাবলি যথাযথভাবে পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে যার মধ্যে যতবেশি গুণের সমাবেশ ঘটবে, সে তত বড় মুত্তাক্বী হিসেবে বিবেচিত হবে। নিম্নে মুত্তাক্বীদের বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. মুত্তাক্বীরা গায়েবের প্রতি সুদৃঢ় ঈমান আনয়ন করে :
মুত্তাক্বীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়সমূহের প্রতি যথাযথভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। যেমন- আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, কিয়ামত দিবসের প্রতি, জান্নাতের সুখ ও জাহান্নামের শাস্তির প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে মুত্তাক্বীদের গুণাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এ বৈশিষ্ট্যটিই উল্লেখ করেছেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿ذٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَۚ فِيْهِۚ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ – اَلَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ – وَالَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَيْكَ وَمَاۤ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَۚ وَبِالْاٰخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ – اُولٰٓئِكَ عَلٰى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْۗ وَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾
এটা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। আর এটা মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াতস্বরূপ। এরা (মুত্তাক্বীগণ) ঐ সকল লোক, যারা অদৃশ্য বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা হতে ব্যয় করে। আর তারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তার প্রতি এবং পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। তারাই তাদের রবের পক্ষ হতে প্রাপ্ত হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।
(সূরা বাক্বারা, ২-৫)
অত্র আয়াত থেকে আরো জানা যায় যে, মুত্তাক্বীগণ যথাযথভাবে সালাত প্রতিষ্ঠা করে, হালাল পন্থায় উপার্জন করে এবং তা হতেই ব্যয় করে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে এবং তারা সর্বদা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।
২. মুত্তাক্বীগণ সর্বদা সৎকর্মে ব্যস্ত থাকে :
মুত্তাক্বী বান্দাগণ নিজেদেরকে সর্বদা সৎকর্মে ব্যস্ত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে তাদের পরিচয় প্রদানপূর্বক কিছু বিশেষ সৎকর্মের কথা উল্লেখ করে বলেন,
﴿لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوَلُّوْا وُجُوْهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَالْمَلَآئِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّيْنَۚ وَاٰتَى الْمَالَ عَلٰى حُبِّه ذَوِى الْقُرْبٰى وَالْيَتَامٰى وَالْمَسَاكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَالسَّآئِلِيْنَ وَفِى الرِّقَابِۚ وَاَقَامَ الصَّلَاةَ وَاٰتَى الزَّكَاةَۚ وَالْمُوْفُوْنَ بِعَهْدِهِمْ اِذَا عَاهَدُوْاۚ وَالصَّابِرِيْنَ فِى الْبَاْسَآءِ وَالضَّرَّآءِ وَحِيْنَ الْبَاْسِؕ اُوْلٰٓئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْاؕ وَاُوْلٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ﴾
তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে ঘুরাও তাতে কোন পুণ্য নেই; বরং পুণ্য তো সে ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং তাঁরই ভালোবাসা অর্জনের জন্য আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, দরিদ্র, পথিক, ভিক্ষুক ও দাসত্ব মোচনের জন্য দান করে এবং যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে ও অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করে। আর যারা অভাবে, কষ্টে এবং যুদ্ধকালে ধৈর্যশীল, তারাই সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাক্বী। (সূরা বাক্বারা - ১৭৭)
৩. মুত্তাক্বীগণ মানুষকে ক্ষমা করে :
মুত্তাক্বীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা অন্যদেরকে ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَنْ تَعْفُوْاۤ أَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى﴾
মাফ করে দেয়াই তাক্বওয়ার নিকটতম। (সূরা বাক্বারা- ২৩৭)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَلْيَعْفُوْا وَلْيَصْفَحُوْاۤ اَلَا تُحِبُّوْنَ اَنْ يَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾
তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা নূর- ২২)
অতএব যেহেতু মুত্তাক্বীগণ সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যস্ত থাকে, সুতরাং তারা অনেক সময় কারো কাছ থেকে অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে তাকে ক্ষমা করার মাধ্যমেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে। আর এটাই হচ্ছে ঈমানের অন্যতম দাবি। কেননা প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধ সীমা হচ্ছে, কারো প্রতি যতটুকু অন্যায় করা হয়েছে সে তার প্রতি ঠিক ততটুকুই প্রতিশোধ নেবে। তার চেয়ে বেশি কিছু করার অধিকার তার নেই। অন্যের কৃত যুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে যেয়ে নিজেই যালিম হওয়া উচিত নয়। একটি অন্যায়ের পরিবর্তে তার চেয়ে বড় অন্যায় করে ফেলা বৈধ নয়। যদি কেউ কাউকে একটি চপেটাঘাত করে তাহলে সে তাকে একটি চপেটাঘাতই করতে পারে, অসংখ্য লাথি ও ঘুষি মারতে পারে না। অনুরূপ গোনাহের প্রতিশোধ গোনাহের কাজের মাধ্যমে নেয়া ঠিক নয়। যেমন কোন দুষ্ট লোক যদি কারো বোন বা কন্যার সাথে ব্যভিচার করে, তাহলে সেই ব্যক্তির জন্য তার বোন বা কন্যার সাথে ব্যভিচার করা জায়েয হবে না।
৪. মুত্তাক্বীগণ ক্রোধ সংবরণ করে থাকে :
মুত্তাক্বীদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সর্বদা ক্রোধ সংবরণ করে চলে এবং একান্ত বাধ্য না হলে তা প্রকাশ করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ فِى السَّرَّآءِ وَالضَّرَّآءِ وَالْكَاظِمِيْنَ الْغَيْظَ وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِؕ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
যারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের মধ্যে থেকেও ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান- ১৩৪)
উল্লেখ্য যে, তাদের ক্রোধান্বিত হওয়ার ভিত্তিটিও তাদের ঈমানের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং যখন তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোন কাজ করতে দেখে, তখন ক্রোধান্বিত হয় এবং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কোন কাজ করতে দেখে, তখন আনন্দিত হয়।
৫. তারা কবীরা গোনাহ থেকে বিরত থাকে :
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَآئِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِۚ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ﴾
যারা তাক্বওয়ার অধিকারী- শয়তান যখন তাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয়, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়।
(সূরা আ‘রাফ- ২০১)
অতএব শয়তান যখন তার কুমন্ত্রণা প্রয়োগের মাধ্যমে কোন মুত্তাক্বী বান্দাকে বিচ্যুত করতে সক্ষম হয়, তখন সাথে সাথেই তাদের অন্তরে তা ধরা পড়ে যায়। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং আল্লাহর কথা স্মরণপূর্বক বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করে পুনরায় নেকীর কাজসমূহে মনোযোগী হয়। অতঃপর তারা এর উপরই অটল থাকে।
৬. মুত্তাক্বীগণ সগীরা গোনাহসমূহ হতেও বিরত থাকে :
মুত্তাক্বীগণ কবীরা গুনাহসমূহ হতে বিরত থাকার পাশাপাশি সগীরা গুনাহসমূহের ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। তারা সগীরা গুনাহসমূহকে সগীরা গুনাহ মনে না করে কবীরা গুনাহের সমতুল্যই মনে করে থাকে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالًا هِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ إِنْ كُنَّا لَنَعُدُّهَا عَلٰى عَهْدِ النَّبِيِّ مِنَ الْمُوبِقَاتِ
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি (ভাষণ প্রদানকালে) বলেন, (হে লোকসকল!) তোমরা এমন এমন কাজ করে থাক, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চোরের চেয়ে সূক্ষ্ম। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যামানায় আমরা সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৯২; বায়হাকী হা/২১২৮০; সুনানে দারেমী হা/২৮২৪।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرٰى ذُنُوبَهٗ كَأَنَّهٗ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرٰى ذُنُوبَهٗ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلٰى أَنْفِه
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) নবী ﷺ এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মুমিন ব্যক্তি তার গোনাহগুলোকে এত বিরাট মনে করে যে, যেন সে একটা পর্বতের নিচে বসে রয়েছে। আর সে আশংকা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপরে ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গোনাহগুলোকে মাছির মতো মনে করে, যা তার নাকে বসে চলে যায়। [সহীহ বুখারী, হা/৬৩০৮।]
৭. তারা শয়তান ও তার সঙ্গীদের থেকে দূরে থাকে :
মুত্তাক্বীগণ সর্বদা শয়তান ও তার অনুচরদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কেননা তারা ভালো করেই জানে যে, তারা কখনো তাদের কল্যাণ কামনা করে না। বরং শয়তান ও তার অনুচরবৃন্দ সর্বদা আল্লাহর বান্দাদেরকে কীভাবে পথভ্রষ্ট করা যায়- এই কর্মেই ব্যস্ত থাকে এবং মানুষকে এর দিকেই আহবান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاِخْوَانُهُمْ يَمُدُّوْنَهُمْ فِى الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُوْنَ﴾
তাদের সঙ্গী-সাথিরা তাদেরকে ভ্রান্তির দিকে টেনে নেয় এবং এ বিষয়ে তারা কোন ত্রুটি করে না। (সূরা আ‘রাফ- ২০২)
এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِى السِّلْمِ كَآفَّةً وَّلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِۚ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
(সূরা বাক্বারা- ২০৮)
৮. তারা বিশ্বাসে ও কাজে-কর্মে সত্যবাদী :
মুত্তাক্বীগণ বিশ্বাসে ও কাজে-কর্মে সর্বদা সত্যপরায়ণ হয়। সত্যকে মেনে নিতে তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿وَالَّذِيْ جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهۤ أُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ﴾
যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই তো মুত্তাক্বী। (সূরা যুমার- ৩৩)
﴿أُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَ أُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ﴾
এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাক্বী। (সূরা বাক্বারা- ১৭৭)
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।
(সূরা তাওবা- ১১৯)
আর তারা এ কর্মটি এজন্যই করে যে, কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে মিথ্যা না বলার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتّٰى يَكُونَ صِدِّيقًا وَإِنَّ الْكِذْبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتّٰى يُكْتَبَ عِنْدَ اللّٰهِ كَذَّابًا
আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সূত্রে নবী ﷺ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সততা নেকীর পথ দেখায় এবং নেকী জান্নাতের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্যের উপর দৃঢ় থাকে, তাকে আল্লাহর নিকটে সত্যনিষ্ঠ হিসেবে লিখে নেয়া হয়। আর মিথ্যা পাপাচারের দিকে পথ দেখায় এবং পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর নিকটে মিথ্যুক হিসেবে লিখে নেয়া হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৯৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭।]
৯. তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে :
আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সেগুলোকে সম্মান করা ঈমানের অন্যতম একটি দাবি। তাই এটিও মুত্তাক্বীদের জন্য অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يُّعَظِّمْ شَعَآئِرَ اللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ﴾
যদি কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করে, তবে এটা তো তার অন্তরের তাক্বওয়া মাত্র। (সূরা হজ্জ- ৩২)
উল্লেখ্য যে, شَعَآئِرَ তথা নিদর্শনাবলী দু’ধরনের হতে পারে- (১) আল্লাহর ইবাদাতমূলক কর্ম তথা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি। (২) আল্লাহকে স্মরণ হয় এমন স্মৃতিচিহ্ন তথা বাইতুল্লাহ বা কা‘বাঘর, সাফা-মারওয়া, কুরবানীর জন্য চিহ্নিত জন্তু, হজ্জের স্থানসমূহ ইত্যাদি। এ সম্মান প্রদর্শন হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকায়িত তাক্বওয়ার ফলেই সংঘটিত হয়। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি জেনে-বুঝে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কোন অমর্যাদা পোষণ করে, তাহলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তার মনে আল্লাহর কোন ভয় নেই।
১০. তারা সর্বদা ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করে :
মুত্তাক্বীগণ সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করে থাকে। যেমন- তিনি বলেন,
﴿اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا تَعْمَلُوْنَ﴾
তোমরা ইনসাফ করো, কারণ এ কাজটি আল্লাহকে ভয় করে চলার অধিক নিকটতর পন্থা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অবহিত। (সূরা মায়েদা- ৮)
অনুরূপভাবে তারা স্বীয় নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারেও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করে। কেননা হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَامِرٍ قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُولُ أَعْطَانِي أَبِي عَطِيَّةً فَقَالَتْ عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ لَا أَرْضٰى حَتّٰى تُشْهِدَ رَسُولَ اللّٰهِ فَأَتٰى رَسُولَ اللّٰهِ فَقَالَ إِنِّي أَعْطَيْتُ ابْنِي مِنْ عَمْرَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ عَطِيَّةً فَأَمَرَتْنِي أَنْ أُشْهِدَكَ يَا رَسُولَ اللّٰهِ قَالَ أَعْطَيْتَ سَائِرَ وَلَدِكَ مِثْلَ هٰذَا قَالَ لَا قَالَ فَاتَّقُوا اللهَ وَاعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلَادِكُمْ قَالَ فَرَجَعَ فَرَدَّ عَطِيَّتَهٗ
আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ)-কে মিম্বারের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত আমি সম্মত নই। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সকল ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা করো। নুমান বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। [সহীহ বুখারী, হা/২৫৮৭; বায়হাকী, হা/১২৩৫১; মিশকাত, হা/৩০১৯।]
১১. মুত্তাক্বীগণ জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে :
জিহাদ হচ্ছে ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া। এর মধ্যেই রয়েছে শাহাদাতের বিশেষ মর্যাদা। আর এর প্রয়োগ ক্ষেত্রও ব্যাপক। এর জন্য অনেক সময় জান ও মাল বিলিয়ে দেয়াও আবশ্যক হয়ে যায়। তাই মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَا يَسْتَاْذِنُكَ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ اَنْ يُّجَاهِدُوْا بِاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفُسِهِمْؕ وَاللهُ عَلِيْمٌ ۢبِالْمُتَّقِيْنَ﴾
যারা আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে, তারা তোমার নিকট নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদ করা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করে না। আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। (সূরা তাওবা- ৪৪)
১২. মুত্তাক্বীগণ সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে :
সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করা তাক্বওয়ার অন্যতম পরিচায়ক। কেননা অনেক সন্দেহযুক্ত বিষয় এরূপ রয়েছে যে, সেগুলো পালন করলে গুনাহে পতিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা হতে বিরত থাকলেও কোন সমস্যা নেই। এরূপ আশংকাবোধের কারণে মুত্তাক্বী ব্যক্তিগণ অনেক সময় অনেক বৈধ কাজ থেকেও বিরত থাকে। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন,
لَا يَبْلُغُ الْعَبْدُ حَقِيقَةَ التَّقْوٰى حَتّٰى يَدَعَ مَا حَاكَ فِي الصَّدْرِ
মানুষের মনে যে বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় সেটা ত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ তাত্বওয়ার উচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারবে না । [সহীহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান, মুয়াল্লীক সূত্রে বর্ণিত।]
আবদুর রহমান আল-মুবারকপুরী (রহ.) বলেন,
اَلْمُتَّقِىْ مَنْ يَّتْرُكُ مَا لَا بَأْسَ بِهٖ خَوْفًا مِمَّا فِيْهِ بَأْس
মুত্তাক্বী (আল্লাহভীরু) হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে সেসব বিষয়ও পরিত্যাগ করে, যাতে ক্ষতি নেই। এ ভয়ে যে যাতে ক্ষতি আছে (তাতে পতিত না হয়)। [তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/২০১।]
এছাড়াও হাদীসে এসেছে,
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللّٰهِ - - يَقُولُ : إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِه وَعِرْضِه وَمَنْ وَقَعَ فِى الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِى الْحَرَامِ كَالرَّاعِى يَرْعٰى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللّٰهِ مَحَارِمُهٗ أَلَا وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ أَلَا وَهِىَ الْقَلْبُ
নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট, আর এ উভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়, অনেক লোকই সেগুলো জানে না। যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে, সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে। যেমন কোন রাখাল যদি সংরক্ষিত চারণভূমির পাশে পশু চরায়, তাহলে এ আশংকা রয়েছে যে, সে পশু তার ভেতরে গিয়ে ঘাস খাবে। সাবধান! প্রত্যেক রাজারই সংরক্ষিত এলাকা থাকে, সাবধান! আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হলো তাঁর হারামকৃত বিষয়সমূহ। জেনে রেখো! দেহের মধ্যে এক টুক্রা গোশ্ত আছে। যখন তা সুস্থ থাকে, তখন সমস্ত দেহই সুস্থ থাকে। আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায়, তখন সমস্ত দেহই নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রেখো! তা হলো ‘কাল্ব’ তথা হৃদয়। [সহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩৯৮; মিশকাত, হা/২৭৬২।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِى الْحَوْرَاءِ السَّعْدِىِّ قَالَ قُلْتُ لِلْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ مَا حَفِظْتَ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ ؟ قَالَ حَفِظْتُ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلٰى مَا لَا يَرِيبُكَ
আবু হাওরা‘ আস-সাদী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হাসান ইবনে আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কী মুখস্ত করেছেন? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে মুখস্ত করেছি যে, সন্দেহযুক্ত বিষয় ছেড়ে সন্দেহমুক্ত বিষয়ের দিকে ধাবিত হও। [তিরমিযী, হা/২৫১৮; সুনানে দারেমী, হা/২৫৮৭; নাসাঈ, হা/৫৭১১।]
১৩. মুত্তাক্বীগণ কিয়ামত দিবসের শাস্তিকে ভয় করে :
কিয়ামত হচ্ছে পৃথিবীতে আগত সমস্ত মানুষের একত্রিত হওয়ার দিন। এ দিনের পরিস্থিতি হবে খুবই ভয়াবহ। তাই মুত্তাক্বীগণ সর্বদা এ দিবসের শাস্তিকে খুবই ভয় করে থাকে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَاَنْذِرْ بِهِ الَّذِيْنَ يَخَافُوْنَ اَنْ يُّحْشَرُوْاۤ اِلٰى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِّنْ دُوْنِهٖ وَلِيٌّ وَّلَا شَفِيْعٌ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ﴾
যারা ভয় করে এ দ্বারা তুমি তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করো যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের নিকট সমবেত করা হবে। এমতাবস্থায় তিনি ব্যতীত তাদের জন্য অন্য কোন অভিভাবক বা সুপারিশকারী থাকবে না। (এ উপদেশের মাধ্যমে) হয়তো তারা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা আন‘আম- ৫১)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, তুমি এ কুরআন দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করো, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, ক্বিয়ামতের দিন তারা প্রভুর রহমত লাভ করবে। যেদিন তাদের কোন স্বজন ও সুপারিশকারী থাকবে না, যদি তিনি তাদেরকে শাস্তি দিতে চান। যাতে তারা তাক্বওয়াবান হয়। আর তাদেরকে সতর্ক করুন এটা দ্বারা যে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত কোন ফায়সালাকারী নেই। যাতে তারা মুত্তাক্বী হয়। ফলে তারা এ দুনিয়াতে এমন আমল করবে, যা দ্বারা আল্লাহ তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দিবেন এবং এর দ্বারা তাদের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। [তাফসীর ইবনে কাসীর ৪/৪৫৫।]
অতএব মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিনকে ভীষণভাবে ভয় করে এবং তার জন্য যথাসাধ্য প্র্রস্তুতি গ্রহণ করে। এতদসত্ত্বেও তারা গোপন ক্রটি ও অপ্রকাশ্য পাপ প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁদে। তারা সেদিনের ভয় করে, যেদিন চোখ নিম্নগামী হবে, কণ্ঠস্বর থেমে যাবে, এদিক-সেদিক তাকানো বন্ধ হয়ে যাবে। গোপনীয়তা প্রকাশ্য হয়ে যাবে, আড়ালের পাপ বেরিয়ে পড়বে, মানুষ তাদের আমলনামা নিয়ে চলবে, ছোটরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে, বৃদ্ধরা উন্মাদ হয়ে যাবে। বন্ধু দুষ্প্রাপ্য হবে, জাহান্নাম দৃষ্টির সামনে চলে আসবে। কাফেররা হতাশ হয়ে পড়বে, আগুন প্রজ্বলিত হবে, মানুষের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাবে এবং তাদের বাকশক্তি রুদ্ধ করা হবে, কথা বলবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
১৪. মুত্তাক্বীগণ কিয়ামত দিবসের জবাবদিহিতাকে ভয় করে :
মুত্তাক্বী বান্দাগণ কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতা করাকে খুবই ভয় করে থাকে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَخَافُوْنَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيْهِ الْقُلُوْبُ وَالْاَبْصَارُ﴾
তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। (সূরা নূর- ৩৭)
অপর আয়াতে বলা হয়েছে,
﴿وَلَقَدْ اٰتَيْنَا مُوْسٰى وَهَارُوْنَ الْفُرْقَانَ وَضِيَآءً وَّذِكْرًا لِّلْمُتَّقِيْنَ ‐ اَلَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَهُمْ مِّنَ السَّاعَةِ مُشْفِقُوْنَ﴾
ইতিপূর্বে আমি মূসা ও হারূনকে সত্য-মিথ্যার ফায়সালাকারী জ্যোতির্ময় এবং মুত্তাক্বীদের জন্য নসীহত তথা উপদেশবাণী সম্বলিত কিতাব তাওরাত প্রদান করেছি, যারা না দেখেই নিজেদের প্রভুকে ভয় করে। আর যারা (হিসাব-নিকাশের বিভীষিকাময়) কিয়ামতের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। (সূরা আম্বিয়া- ৪৮, ৪৯)
১৫. মুত্তাক্বীগণ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে :
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাটা হচ্ছে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশ। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে অনেক সুস্পষ্ট নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। যেমন- কুরআন মাজীদে ‘উলুল আলবাব’ তথা বিবেকবান বান্দার গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে,
﴿وَالَّذِيْنَ يَصِلُوْنَ مَاۤ أَمَرَ اللهُ بِه ۤ أَنْ يُّوْصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُوْنَ سُوْٓءَ الْحِسَابِ﴾
আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন, যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে।
(সূরা রাদ- ২১)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَالْاَرْحَامَؕ اِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا﴾
সুতরাং তোমরা ঐ আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরের কাছে প্রার্থনা কর এবং আত্মীয়তাকেও ভয় করো (অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো), নিশ্চয় আল্লাহই তোমাদের প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা- ১)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ أَنَّهٗ سَمِعَ النَّبِيَّ يَقُولُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ
যুবাইর ইবনে মুতঈম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৬; আবু দাউদ, হা/১৬৯৮।]
অতএব মুত্তাক্বীগণ যে কোন ধরনের সম্পর্ক বিশেষ করে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। সুতরাং এটা তাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
১৬. মুত্তাক্বীগণ রাত্রিজাগরণ করে আল্লাহর ইবাদাত করে :
নফল ইবাদাতসমূহের মধ্যে রাত্রিজাগরণ তথা শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করাটা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। কেননা এর মাধ্যমে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হওয়া যায়। আর মুত্তাক্বী বান্দাগণ কখনো এ সুযোগ হাতছাড়া করে না। এজন্যই কুরআন মাজীদে মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
﴿تَتَجَافٰى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا وَّمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ﴾
তাদের দেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, তারা তাদের প্রতিপালককে আহবান করতে থাকে ভয় ও আশার সাথে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। (সূরা সাজদা- ১৬)
অত্র আয়াতে দেহকে বিছানা থেকে আলাদা বলতে রাত্রিজাগরণ করে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করাকেই বুঝানো হয়েছে।
১৭. মুত্তাক্বীগণ পৃথিবীতে দম্ভ করে বেড়ায় না :
পৃথিবীতে দম্ভ করে বেড়ানো এবং সেখানে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা অবশ্যই শয়তানের কাজ। মুত্তাক্বী বান্দাগণ কখনো এরূপ কর্মে লিপ্ত হয় না। বরং তারা সর্বদা এর বিপরীত কর্মে তথা যারা এরূপ কর্মে লিপ্ত তাদেরকে দমানো যায়, সেই কাজে সচেষ্ট থাকে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِى الْاَرْضِ وَلَا فَسَادًاؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
এটা (জান্নাত) আখিরাতের সে আবাস যা আমি নির্ধারিত করে রেখেছি তাদের জন্য, যারা এ পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাক্বীদের জন্যই। (সূরা ক্বাসাস- ৮৩)
১৮. মুত্তাক্বীগণ অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, বিনীত ও অনুগত হয়ে থাকে :
﴿قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِّنْ ذٰلِكُمْ لِلَّذِيْنَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَّرِضْوَانٌ مِّنَ اللّٰهِ وَاللهُ بَصِيْرٌ ۢبِالْعِبَادِ ‐ اَلَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ إِنَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‐ اَلصَّابِرِيْنَ وَالصَّادِقِيْنَ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْمُنْفِقِيْنَ وَالْمُسْتَغْفِرِيْنَ بِالْأَسْحَارِ﴾
হে নবী, আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চেয়ে উত্তম জিনিসের সন্ধান দেব? (তবে শোনো!) যারা মুত্তাক্বী তাদের জন্য স্বীয় প্রভুর নিকট রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়, সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে, পবিত্র স্ত্রীগণ তাদের সাথী হবে এবং সন্তোষলাভে তারা ধন্য হবে; আল্লাহ নিশ্চয় তার বান্দাদের উপর গভীর দৃষ্টি রাখেন। (এসব মুত্তাক্বী লোকদের পরিচয় হল-) যারা বলে, হে আমাদের রব, আমরা ঈমান এনেছি, আমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দাও এবং আমাদের জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করো। তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, বিনীত, অনুগত, দানশীল এবং রাতের শেষভাগে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী।
(সূরা আলে ইমরান : ১৫-১৭)
১৯. মুত্তাক্বীগণ ইবাদাত করে ভয় ও আশা সহকারে :
কারো ইবাদাত কবুল হওয়া এবং না হওয়াটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাই কোন ইবাদাত করার পর সেটা কবুল হবেই হবে অথবা অবশ্যই বাতিল হবে- এরূপ ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। বরং এ ক্ষেত্রে এরূপ ধারণা পোষণ করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা এটি ইচ্ছা করলে কবুল নাও করতে পারেন এবং দৃঢ়ভাবে এ আশায়ও রাখতে হবে যে, এটি আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন। এ কারণেই মুত্তাক্বী বান্দাগণ ইবাদাত করে ভয় ও আশার সাথে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا﴾
তারা তাদের প্রতিপালককে আহবান করতে থাকে ভয়ে ও আশায়।
(সূরা সাজদা- ১৬)
উল্লেখ্য যে, এরূপ ধারণা অবশ্যই যথাসম্ভব আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ অনুসারে করতে হবে।
এই হলো মুত্তাক্বী বান্দাদের প্রকৃত পরিচয়। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের সমাজে মুত্তাক্বী বান্দাদের পরিচয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন ধারণা পোষণ করা হয়ে থাকে, যা অতি বিভ্রান্তিকর। যেমন-
কেউ কেউ মনে করে যে, যে ব্যক্তি অধিক অপরিচ্ছন্ন থাকে, ছেঁড়া জামা পরিধান করে, চুল এলোমেলো ও জমাটবাধা অবস্থায় থাকে, সে-ই মুত্তাক্বী ব্যক্তি।
আবার কেউ কেউ মনে করে যে, যে ব্যক্তি সমাজে ও রাষ্ট্রের নানা ধরনের ঝামেলা থেকে বিশেষ করে রাজনৈতিক ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু মসজিদে বসে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ যিকির করে, সে-ই সবচেয়ে বড় মুত্তাক্বী।
সুতরাং কাউকে মুত্তাক্বী হিসেবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া অতি জরুরি।
১. মুত্তাক্বীরা গায়েবের প্রতি সুদৃঢ় ঈমান আনয়ন করে :
মুত্তাক্বীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়সমূহের প্রতি যথাযথভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। যেমন- আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, কিয়ামত দিবসের প্রতি, জান্নাতের সুখ ও জাহান্নামের শাস্তির প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে মুত্তাক্বীদের গুণাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এ বৈশিষ্ট্যটিই উল্লেখ করেছেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿ذٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَۚ فِيْهِۚ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ – اَلَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ – وَالَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَيْكَ وَمَاۤ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَۚ وَبِالْاٰخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ – اُولٰٓئِكَ عَلٰى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْۗ وَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾
এটা ঐ গ্রন্থ যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। আর এটা মুত্তাক্বীদের জন্য হেদায়াতস্বরূপ। এরা (মুত্তাক্বীগণ) ঐ সকল লোক, যারা অদৃশ্য বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা হতে ব্যয় করে। আর তারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তার প্রতি এবং পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। তারাই তাদের রবের পক্ষ হতে প্রাপ্ত হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।
(সূরা বাক্বারা, ২-৫)
অত্র আয়াত থেকে আরো জানা যায় যে, মুত্তাক্বীগণ যথাযথভাবে সালাত প্রতিষ্ঠা করে, হালাল পন্থায় উপার্জন করে এবং তা হতেই ব্যয় করে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে এবং তারা সর্বদা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।
২. মুত্তাক্বীগণ সর্বদা সৎকর্মে ব্যস্ত থাকে :
মুত্তাক্বী বান্দাগণ নিজেদেরকে সর্বদা সৎকর্মে ব্যস্ত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে তাদের পরিচয় প্রদানপূর্বক কিছু বিশেষ সৎকর্মের কথা উল্লেখ করে বলেন,
﴿لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوَلُّوْا وُجُوْهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَالْمَلَآئِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّيْنَۚ وَاٰتَى الْمَالَ عَلٰى حُبِّه ذَوِى الْقُرْبٰى وَالْيَتَامٰى وَالْمَسَاكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَالسَّآئِلِيْنَ وَفِى الرِّقَابِۚ وَاَقَامَ الصَّلَاةَ وَاٰتَى الزَّكَاةَۚ وَالْمُوْفُوْنَ بِعَهْدِهِمْ اِذَا عَاهَدُوْاۚ وَالصَّابِرِيْنَ فِى الْبَاْسَآءِ وَالضَّرَّآءِ وَحِيْنَ الْبَاْسِؕ اُوْلٰٓئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْاؕ وَاُوْلٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ﴾
তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল পূর্ব অথবা পশ্চিম দিকে ঘুরাও তাতে কোন পুণ্য নেই; বরং পুণ্য তো সে ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করে এবং তাঁরই ভালোবাসা অর্জনের জন্য আত্মীয়স্বজন, ইয়াতীম, দরিদ্র, পথিক, ভিক্ষুক ও দাসত্ব মোচনের জন্য দান করে এবং যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে ও অঙ্গীকার করলে তা পূর্ণ করে। আর যারা অভাবে, কষ্টে এবং যুদ্ধকালে ধৈর্যশীল, তারাই সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাক্বী। (সূরা বাক্বারা - ১৭৭)
৩. মুত্তাক্বীগণ মানুষকে ক্ষমা করে :
মুত্তাক্বীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তারা অন্যদেরকে ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَنْ تَعْفُوْاۤ أَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى﴾
মাফ করে দেয়াই তাক্বওয়ার নিকটতম। (সূরা বাক্বারা- ২৩৭)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَلْيَعْفُوْا وَلْيَصْفَحُوْاۤ اَلَا تُحِبُّوْنَ اَنْ يَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ﴾
তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সূরা নূর- ২২)
অতএব যেহেতু মুত্তাক্বীগণ সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যস্ত থাকে, সুতরাং তারা অনেক সময় কারো কাছ থেকে অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে তাকে ক্ষমা করার মাধ্যমেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে। আর এটাই হচ্ছে ঈমানের অন্যতম দাবি। কেননা প্রতিশোধ গ্রহণের বৈধ সীমা হচ্ছে, কারো প্রতি যতটুকু অন্যায় করা হয়েছে সে তার প্রতি ঠিক ততটুকুই প্রতিশোধ নেবে। তার চেয়ে বেশি কিছু করার অধিকার তার নেই। অন্যের কৃত যুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে যেয়ে নিজেই যালিম হওয়া উচিত নয়। একটি অন্যায়ের পরিবর্তে তার চেয়ে বড় অন্যায় করে ফেলা বৈধ নয়। যদি কেউ কাউকে একটি চপেটাঘাত করে তাহলে সে তাকে একটি চপেটাঘাতই করতে পারে, অসংখ্য লাথি ও ঘুষি মারতে পারে না। অনুরূপ গোনাহের প্রতিশোধ গোনাহের কাজের মাধ্যমে নেয়া ঠিক নয়। যেমন কোন দুষ্ট লোক যদি কারো বোন বা কন্যার সাথে ব্যভিচার করে, তাহলে সেই ব্যক্তির জন্য তার বোন বা কন্যার সাথে ব্যভিচার করা জায়েয হবে না।
৪. মুত্তাক্বীগণ ক্রোধ সংবরণ করে থাকে :
মুত্তাক্বীদের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সর্বদা ক্রোধ সংবরণ করে চলে এবং একান্ত বাধ্য না হলে তা প্রকাশ করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ فِى السَّرَّآءِ وَالضَّرَّآءِ وَالْكَاظِمِيْنَ الْغَيْظَ وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِؕ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
যারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের মধ্যে থেকেও ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান- ১৩৪)
উল্লেখ্য যে, তাদের ক্রোধান্বিত হওয়ার ভিত্তিটিও তাদের ঈমানের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং যখন তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কোন কাজ করতে দেখে, তখন ক্রোধান্বিত হয় এবং যখন আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কোন কাজ করতে দেখে, তখন আনন্দিত হয়।
৫. তারা কবীরা গোনাহ থেকে বিরত থাকে :
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَآئِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِۚ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ﴾
যারা তাক্বওয়ার অধিকারী- শয়তান যখন তাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয়, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়।
(সূরা আ‘রাফ- ২০১)
অতএব শয়তান যখন তার কুমন্ত্রণা প্রয়োগের মাধ্যমে কোন মুত্তাক্বী বান্দাকে বিচ্যুত করতে সক্ষম হয়, তখন সাথে সাথেই তাদের অন্তরে তা ধরা পড়ে যায়। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং আল্লাহর কথা স্মরণপূর্বক বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করে পুনরায় নেকীর কাজসমূহে মনোযোগী হয়। অতঃপর তারা এর উপরই অটল থাকে।
৬. মুত্তাক্বীগণ সগীরা গোনাহসমূহ হতেও বিরত থাকে :
মুত্তাক্বীগণ কবীরা গুনাহসমূহ হতে বিরত থাকার পাশাপাশি সগীরা গুনাহসমূহের ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। তারা সগীরা গুনাহসমূহকে সগীরা গুনাহ মনে না করে কবীরা গুনাহের সমতুল্যই মনে করে থাকে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالًا هِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ إِنْ كُنَّا لَنَعُدُّهَا عَلٰى عَهْدِ النَّبِيِّ مِنَ الْمُوبِقَاتِ
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি (ভাষণ প্রদানকালে) বলেন, (হে লোকসকল!) তোমরা এমন এমন কাজ করে থাক, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চোরের চেয়ে সূক্ষ্ম। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যামানায় আমরা সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৯২; বায়হাকী হা/২১২৮০; সুনানে দারেমী হা/২৮২৪।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرٰى ذُنُوبَهٗ كَأَنَّهٗ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرٰى ذُنُوبَهٗ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلٰى أَنْفِه
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) নবী ﷺ এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, মুমিন ব্যক্তি তার গোনাহগুলোকে এত বিরাট মনে করে যে, যেন সে একটা পর্বতের নিচে বসে রয়েছে। আর সে আশংকা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপরে ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গোনাহগুলোকে মাছির মতো মনে করে, যা তার নাকে বসে চলে যায়। [সহীহ বুখারী, হা/৬৩০৮।]
৭. তারা শয়তান ও তার সঙ্গীদের থেকে দূরে থাকে :
মুত্তাক্বীগণ সর্বদা শয়তান ও তার অনুচরদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কেননা তারা ভালো করেই জানে যে, তারা কখনো তাদের কল্যাণ কামনা করে না। বরং শয়তান ও তার অনুচরবৃন্দ সর্বদা আল্লাহর বান্দাদেরকে কীভাবে পথভ্রষ্ট করা যায়- এই কর্মেই ব্যস্ত থাকে এবং মানুষকে এর দিকেই আহবান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاِخْوَانُهُمْ يَمُدُّوْنَهُمْ فِى الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُوْنَ﴾
তাদের সঙ্গী-সাথিরা তাদেরকে ভ্রান্তির দিকে টেনে নেয় এবং এ বিষয়ে তারা কোন ত্রুটি করে না। (সূরা আ‘রাফ- ২০২)
এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِى السِّلْمِ كَآفَّةً وَّلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِۚ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
(সূরা বাক্বারা- ২০৮)
৮. তারা বিশ্বাসে ও কাজে-কর্মে সত্যবাদী :
মুত্তাক্বীগণ বিশ্বাসে ও কাজে-কর্মে সর্বদা সত্যপরায়ণ হয়। সত্যকে মেনে নিতে তারা সর্বদা প্রস্তুত থাকে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿وَالَّذِيْ جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهۤ أُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ﴾
যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই তো মুত্তাক্বী। (সূরা যুমার- ৩৩)
﴿أُولٰٓئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَ أُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ﴾
এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাক্বী। (সূরা বাক্বারা- ১৭৭)
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।
(সূরা তাওবা- ১১৯)
আর তারা এ কর্মটি এজন্যই করে যে, কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে মিথ্যা না বলার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللّٰهِ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَصْدُقُ حَتّٰى يَكُونَ صِدِّيقًا وَإِنَّ الْكِذْبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ وَإِنَّ الرَّجُلَ لَيَكْذِبُ حَتّٰى يُكْتَبَ عِنْدَ اللّٰهِ كَذَّابًا
আবদুল্লাহ (রাঃ) এর সূত্রে নবী ﷺ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সততা নেকীর পথ দেখায় এবং নেকী জান্নাতের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্যের উপর দৃঢ় থাকে, তাকে আল্লাহর নিকটে সত্যনিষ্ঠ হিসেবে লিখে নেয়া হয়। আর মিথ্যা পাপাচারের দিকে পথ দেখায় এবং পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর নিকটে মিথ্যুক হিসেবে লিখে নেয়া হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৬০৯৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৬০৭।]
৯. তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে :
আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সেগুলোকে সম্মান করা ঈমানের অন্যতম একটি দাবি। তাই এটিও মুত্তাক্বীদের জন্য অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يُّعَظِّمْ شَعَآئِرَ اللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ﴾
যদি কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করে, তবে এটা তো তার অন্তরের তাক্বওয়া মাত্র। (সূরা হজ্জ- ৩২)
উল্লেখ্য যে, شَعَآئِرَ তথা নিদর্শনাবলী দু’ধরনের হতে পারে- (১) আল্লাহর ইবাদাতমূলক কর্ম তথা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি। (২) আল্লাহকে স্মরণ হয় এমন স্মৃতিচিহ্ন তথা বাইতুল্লাহ বা কা‘বাঘর, সাফা-মারওয়া, কুরবানীর জন্য চিহ্নিত জন্তু, হজ্জের স্থানসমূহ ইত্যাদি। এ সম্মান প্রদর্শন হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকায়িত তাক্বওয়ার ফলেই সংঘটিত হয়। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি জেনে-বুঝে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কোন অমর্যাদা পোষণ করে, তাহলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তার মনে আল্লাহর কোন ভয় নেই।
১০. তারা সর্বদা ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করে :
মুত্তাক্বীগণ সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করে থাকে। যেমন- তিনি বলেন,
﴿اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا تَعْمَلُوْنَ﴾
তোমরা ইনসাফ করো, কারণ এ কাজটি আল্লাহকে ভয় করে চলার অধিক নিকটতর পন্থা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে অবহিত। (সূরা মায়েদা- ৮)
অনুরূপভাবে তারা স্বীয় নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারেও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করে। কেননা হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَامِرٍ قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُولُ أَعْطَانِي أَبِي عَطِيَّةً فَقَالَتْ عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ لَا أَرْضٰى حَتّٰى تُشْهِدَ رَسُولَ اللّٰهِ فَأَتٰى رَسُولَ اللّٰهِ فَقَالَ إِنِّي أَعْطَيْتُ ابْنِي مِنْ عَمْرَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ عَطِيَّةً فَأَمَرَتْنِي أَنْ أُشْهِدَكَ يَا رَسُولَ اللّٰهِ قَالَ أَعْطَيْتَ سَائِرَ وَلَدِكَ مِثْلَ هٰذَا قَالَ لَا قَالَ فَاتَّقُوا اللهَ وَاعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلَادِكُمْ قَالَ فَرَجَعَ فَرَدَّ عَطِيَّتَهٗ
আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ)-কে মিম্বারের উপর বলতে শুনেছি যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন (আমার মাতা) আমরা বিনতে রাওয়াহা (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত আমি সম্মত নই। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সকল ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজের সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা করো। নুমান বলেন, অতঃপর তিনি ফিরে গেলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। [সহীহ বুখারী, হা/২৫৮৭; বায়হাকী, হা/১২৩৫১; মিশকাত, হা/৩০১৯।]
১১. মুত্তাক্বীগণ জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে :
জিহাদ হচ্ছে ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়া। এর মধ্যেই রয়েছে শাহাদাতের বিশেষ মর্যাদা। আর এর প্রয়োগ ক্ষেত্রও ব্যাপক। এর জন্য অনেক সময় জান ও মাল বিলিয়ে দেয়াও আবশ্যক হয়ে যায়। তাই মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَا يَسْتَاْذِنُكَ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ اَنْ يُّجَاهِدُوْا بِاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفُسِهِمْؕ وَاللهُ عَلِيْمٌ ۢبِالْمُتَّقِيْنَ﴾
যারা আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে, তারা তোমার নিকট নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদ করা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করে না। আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। (সূরা তাওবা- ৪৪)
১২. মুত্তাক্বীগণ সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে :
সন্দেহযুক্ত বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করা তাক্বওয়ার অন্যতম পরিচায়ক। কেননা অনেক সন্দেহযুক্ত বিষয় এরূপ রয়েছে যে, সেগুলো পালন করলে গুনাহে পতিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা হতে বিরত থাকলেও কোন সমস্যা নেই। এরূপ আশংকাবোধের কারণে মুত্তাক্বী ব্যক্তিগণ অনেক সময় অনেক বৈধ কাজ থেকেও বিরত থাকে। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন,
لَا يَبْلُغُ الْعَبْدُ حَقِيقَةَ التَّقْوٰى حَتّٰى يَدَعَ مَا حَاكَ فِي الصَّدْرِ
মানুষের মনে যে বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় সেটা ত্যাগ না করা পর্যন্ত কেউ তাত্বওয়ার উচ্চ স্তরে পৌঁছতে পারবে না । [সহীহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান, মুয়াল্লীক সূত্রে বর্ণিত।]
আবদুর রহমান আল-মুবারকপুরী (রহ.) বলেন,
اَلْمُتَّقِىْ مَنْ يَّتْرُكُ مَا لَا بَأْسَ بِهٖ خَوْفًا مِمَّا فِيْهِ بَأْس
মুত্তাক্বী (আল্লাহভীরু) হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে সেসব বিষয়ও পরিত্যাগ করে, যাতে ক্ষতি নেই। এ ভয়ে যে যাতে ক্ষতি আছে (তাতে পতিত না হয়)। [তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/২০১।]
এছাড়াও হাদীসে এসেছে,
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللّٰهِ - - يَقُولُ : إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِه وَعِرْضِه وَمَنْ وَقَعَ فِى الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِى الْحَرَامِ كَالرَّاعِى يَرْعٰى حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللّٰهِ مَحَارِمُهٗ أَلَا وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ أَلَا وَهِىَ الْقَلْبُ
নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট, আর এ উভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়, অনেক লোকই সেগুলো জানে না। যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদাকে নিরাপদে রাখে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়ে পতিত হবে, সে হারামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়বে। যেমন কোন রাখাল যদি সংরক্ষিত চারণভূমির পাশে পশু চরায়, তাহলে এ আশংকা রয়েছে যে, সে পশু তার ভেতরে গিয়ে ঘাস খাবে। সাবধান! প্রত্যেক রাজারই সংরক্ষিত এলাকা থাকে, সাবধান! আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হলো তাঁর হারামকৃত বিষয়সমূহ। জেনে রেখো! দেহের মধ্যে এক টুক্রা গোশ্ত আছে। যখন তা সুস্থ থাকে, তখন সমস্ত দেহই সুস্থ থাকে। আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায়, তখন সমস্ত দেহই নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রেখো! তা হলো ‘কাল্ব’ তথা হৃদয়। [সহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩৯৮; মিশকাত, হা/২৭৬২।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِى الْحَوْرَاءِ السَّعْدِىِّ قَالَ قُلْتُ لِلْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ مَا حَفِظْتَ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ ؟ قَالَ حَفِظْتُ مِنْ رَّسُوْلِ اللهِ دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلٰى مَا لَا يَرِيبُكَ
আবু হাওরা‘ আস-সাদী (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হাসান ইবনে আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কী মুখস্ত করেছেন? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে মুখস্ত করেছি যে, সন্দেহযুক্ত বিষয় ছেড়ে সন্দেহমুক্ত বিষয়ের দিকে ধাবিত হও। [তিরমিযী, হা/২৫১৮; সুনানে দারেমী, হা/২৫৮৭; নাসাঈ, হা/৫৭১১।]
১৩. মুত্তাক্বীগণ কিয়ামত দিবসের শাস্তিকে ভয় করে :
কিয়ামত হচ্ছে পৃথিবীতে আগত সমস্ত মানুষের একত্রিত হওয়ার দিন। এ দিনের পরিস্থিতি হবে খুবই ভয়াবহ। তাই মুত্তাক্বীগণ সর্বদা এ দিবসের শাস্তিকে খুবই ভয় করে থাকে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَاَنْذِرْ بِهِ الَّذِيْنَ يَخَافُوْنَ اَنْ يُّحْشَرُوْاۤ اِلٰى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِّنْ دُوْنِهٖ وَلِيٌّ وَّلَا شَفِيْعٌ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ﴾
যারা ভয় করে এ দ্বারা তুমি তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করো যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের নিকট সমবেত করা হবে। এমতাবস্থায় তিনি ব্যতীত তাদের জন্য অন্য কোন অভিভাবক বা সুপারিশকারী থাকবে না। (এ উপদেশের মাধ্যমে) হয়তো তারা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা আন‘আম- ৫১)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, তুমি এ কুরআন দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করো, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, ক্বিয়ামতের দিন তারা প্রভুর রহমত লাভ করবে। যেদিন তাদের কোন স্বজন ও সুপারিশকারী থাকবে না, যদি তিনি তাদেরকে শাস্তি দিতে চান। যাতে তারা তাক্বওয়াবান হয়। আর তাদেরকে সতর্ক করুন এটা দ্বারা যে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত কোন ফায়সালাকারী নেই। যাতে তারা মুত্তাক্বী হয়। ফলে তারা এ দুনিয়াতে এমন আমল করবে, যা দ্বারা আল্লাহ তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দিবেন এবং এর দ্বারা তাদের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। [তাফসীর ইবনে কাসীর ৪/৪৫৫।]
অতএব মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিনকে ভীষণভাবে ভয় করে এবং তার জন্য যথাসাধ্য প্র্রস্তুতি গ্রহণ করে। এতদসত্ত্বেও তারা গোপন ক্রটি ও অপ্রকাশ্য পাপ প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায় সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁদে। তারা সেদিনের ভয় করে, যেদিন চোখ নিম্নগামী হবে, কণ্ঠস্বর থেমে যাবে, এদিক-সেদিক তাকানো বন্ধ হয়ে যাবে। গোপনীয়তা প্রকাশ্য হয়ে যাবে, আড়ালের পাপ বেরিয়ে পড়বে, মানুষ তাদের আমলনামা নিয়ে চলবে, ছোটরা বৃদ্ধ হয়ে যাবে, বৃদ্ধরা উন্মাদ হয়ে যাবে। বন্ধু দুষ্প্রাপ্য হবে, জাহান্নাম দৃষ্টির সামনে চলে আসবে। কাফেররা হতাশ হয়ে পড়বে, আগুন প্রজ্বলিত হবে, মানুষের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যাবে এবং তাদের বাকশক্তি রুদ্ধ করা হবে, কথা বলবে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
১৪. মুত্তাক্বীগণ কিয়ামত দিবসের জবাবদিহিতাকে ভয় করে :
মুত্তাক্বী বান্দাগণ কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতা করাকে খুবই ভয় করে থাকে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَخَافُوْنَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيْهِ الْقُلُوْبُ وَالْاَبْصَارُ﴾
তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। (সূরা নূর- ৩৭)
অপর আয়াতে বলা হয়েছে,
﴿وَلَقَدْ اٰتَيْنَا مُوْسٰى وَهَارُوْنَ الْفُرْقَانَ وَضِيَآءً وَّذِكْرًا لِّلْمُتَّقِيْنَ ‐ اَلَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَهُمْ مِّنَ السَّاعَةِ مُشْفِقُوْنَ﴾
ইতিপূর্বে আমি মূসা ও হারূনকে সত্য-মিথ্যার ফায়সালাকারী জ্যোতির্ময় এবং মুত্তাক্বীদের জন্য নসীহত তথা উপদেশবাণী সম্বলিত কিতাব তাওরাত প্রদান করেছি, যারা না দেখেই নিজেদের প্রভুকে ভয় করে। আর যারা (হিসাব-নিকাশের বিভীষিকাময়) কিয়ামতের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। (সূরা আম্বিয়া- ৪৮, ৪৯)
১৫. মুত্তাক্বীগণ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে :
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখাটা হচ্ছে ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশ। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে অনেক সুস্পষ্ট নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। যেমন- কুরআন মাজীদে ‘উলুল আলবাব’ তথা বিবেকবান বান্দার গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে,
﴿وَالَّذِيْنَ يَصِلُوْنَ مَاۤ أَمَرَ اللهُ بِه ۤ أَنْ يُّوْصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُوْنَ سُوْٓءَ الْحِسَابِ﴾
আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন, যারা তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে।
(সূরা রাদ- ২১)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِيْ تَسَآءَلُوْنَ بِهٖ وَالْاَرْحَامَؕ اِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيْبًا﴾
সুতরাং তোমরা ঐ আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরের কাছে প্রার্থনা কর এবং আত্মীয়তাকেও ভয় করো (অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো), নিশ্চয় আল্লাহই তোমাদের প্রতি তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা- ১)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ أَنَّهٗ سَمِعَ النَّبِيَّ يَقُولُ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ
যুবাইর ইবনে মুতঈম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৫৯৮৪; সহীহ মুসলিম, হা/২৫৫৬; আবু দাউদ, হা/১৬৯৮।]
অতএব মুত্তাক্বীগণ যে কোন ধরনের সম্পর্ক বিশেষ করে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। সুতরাং এটা তাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
১৬. মুত্তাক্বীগণ রাত্রিজাগরণ করে আল্লাহর ইবাদাত করে :
নফল ইবাদাতসমূহের মধ্যে রাত্রিজাগরণ তথা শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করাটা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। কেননা এর মাধ্যমে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হওয়া যায়। আর মুত্তাক্বী বান্দাগণ কখনো এ সুযোগ হাতছাড়া করে না। এজন্যই কুরআন মাজীদে মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে,
﴿تَتَجَافٰى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا وَّمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ﴾
তাদের দেহ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, তারা তাদের প্রতিপালককে আহবান করতে থাকে ভয় ও আশার সাথে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। (সূরা সাজদা- ১৬)
অত্র আয়াতে দেহকে বিছানা থেকে আলাদা বলতে রাত্রিজাগরণ করে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করাকেই বুঝানো হয়েছে।
১৭. মুত্তাক্বীগণ পৃথিবীতে দম্ভ করে বেড়ায় না :
পৃথিবীতে দম্ভ করে বেড়ানো এবং সেখানে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা অবশ্যই শয়তানের কাজ। মুত্তাক্বী বান্দাগণ কখনো এরূপ কর্মে লিপ্ত হয় না। বরং তারা সর্বদা এর বিপরীত কর্মে তথা যারা এরূপ কর্মে লিপ্ত তাদেরকে দমানো যায়, সেই কাজে সচেষ্ট থাকে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِى الْاَرْضِ وَلَا فَسَادًاؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
এটা (জান্নাত) আখিরাতের সে আবাস যা আমি নির্ধারিত করে রেখেছি তাদের জন্য, যারা এ পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাক্বীদের জন্যই। (সূরা ক্বাসাস- ৮৩)
১৮. মুত্তাক্বীগণ অত্যন্ত ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, বিনীত ও অনুগত হয়ে থাকে :
﴿قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِّنْ ذٰلِكُمْ لِلَّذِيْنَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَّرِضْوَانٌ مِّنَ اللّٰهِ وَاللهُ بَصِيْرٌ ۢبِالْعِبَادِ ‐ اَلَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ إِنَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‐ اَلصَّابِرِيْنَ وَالصَّادِقِيْنَ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْمُنْفِقِيْنَ وَالْمُسْتَغْفِرِيْنَ بِالْأَسْحَارِ﴾
হে নবী, আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চেয়ে উত্তম জিনিসের সন্ধান দেব? (তবে শোনো!) যারা মুত্তাক্বী তাদের জন্য স্বীয় প্রভুর নিকট রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়, সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে, পবিত্র স্ত্রীগণ তাদের সাথী হবে এবং সন্তোষলাভে তারা ধন্য হবে; আল্লাহ নিশ্চয় তার বান্দাদের উপর গভীর দৃষ্টি রাখেন। (এসব মুত্তাক্বী লোকদের পরিচয় হল-) যারা বলে, হে আমাদের রব, আমরা ঈমান এনেছি, আমাদের গোনাহসমূহ মাফ করে দাও এবং আমাদের জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করো। তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, বিনীত, অনুগত, দানশীল এবং রাতের শেষভাগে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী।
(সূরা আলে ইমরান : ১৫-১৭)
১৯. মুত্তাক্বীগণ ইবাদাত করে ভয় ও আশা সহকারে :
কারো ইবাদাত কবুল হওয়া এবং না হওয়াটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাই কোন ইবাদাত করার পর সেটা কবুল হবেই হবে অথবা অবশ্যই বাতিল হবে- এরূপ ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। বরং এ ক্ষেত্রে এরূপ ধারণা পোষণ করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা এটি ইচ্ছা করলে কবুল নাও করতে পারেন এবং দৃঢ়ভাবে এ আশায়ও রাখতে হবে যে, এটি আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন। এ কারণেই মুত্তাক্বী বান্দাগণ ইবাদাত করে ভয় ও আশার সাথে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَّطَمَعًا﴾
তারা তাদের প্রতিপালককে আহবান করতে থাকে ভয়ে ও আশায়।
(সূরা সাজদা- ১৬)
উল্লেখ্য যে, এরূপ ধারণা অবশ্যই যথাসম্ভব আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ অনুসারে করতে হবে।
এই হলো মুত্তাক্বী বান্দাদের প্রকৃত পরিচয়। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের সমাজে মুত্তাক্বী বান্দাদের পরিচয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন ধারণা পোষণ করা হয়ে থাকে, যা অতি বিভ্রান্তিকর। যেমন-
কেউ কেউ মনে করে যে, যে ব্যক্তি অধিক অপরিচ্ছন্ন থাকে, ছেঁড়া জামা পরিধান করে, চুল এলোমেলো ও জমাটবাধা অবস্থায় থাকে, সে-ই মুত্তাক্বী ব্যক্তি।
আবার কেউ কেউ মনে করে যে, যে ব্যক্তি সমাজে ও রাষ্ট্রের নানা ধরনের ঝামেলা থেকে বিশেষ করে রাজনৈতিক ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু মসজিদে বসে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ যিকির করে, সে-ই সবচেয়ে বড় মুত্তাক্বী।
সুতরাং কাউকে মুত্তাক্বী হিসেবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া অতি জরুরি।
১. আল্লাহর ইবাদাত করা :
﴿وَلَقَدْ اَرْسَلْنَا نُوْحًا اِلٰى قَوْمِهٖ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَيْرُهٗؕ اَفَلَا تَتَّقُوْنَ﴾
আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ্ নেই; তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না? (সূরা মু’মিনূন- ২৩)
২. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা :
﴿وَاِبْرَاهِيْمَ اِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللهَ وَاتَّقُوْهُ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ﴾
স্মরণ করো, যখন ইবরাহীম তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁকে ভয় করো, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে! (সূরা আনকাবূত- ১৬)
৩. সালাত প্রতিষ্ঠা করা :
﴿مُنِيْبِيْنَ اِلَيْهِ وَاتَّقُوْهُ وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ﴾
অতএব তোমরা তাঁর অভিমুখী হও এবং তাঁকে ভয় করো, সালাত কায়েম করো এবং তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (সূরা রূম- ৩০)
﴿وَاْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْاَلُكَ رِزْقًاؕ نَحْنُ نَرْزُقُكَؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰى﴾
তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অটল থাকো। আমি তোমার নিকট কোন রিযিক চাই না, কেননা আমিই তো তোমাকে রিযিক দেই। আর শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য। (সূরা ত্বা-হা- ১৩২)
৪. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করা :
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَؕ اِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْمًا حَكِيْمًا﴾
হে নবী! আল্লাহকে ভয় করো এবং কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা আহযাব- ১)
৫. সত্য কথা বলা :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।
(সূরা আহযাব- ৭০)
৬. সৎ লোকের সঙ্গী হওয়া :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও। (সূরা তাওবা- ১১৯)
৭. পারস্পরিক সুসম্পর্ক অটুট রাখা :
﴿اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَيْنَ اَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ﴾
নিশ্চয় মুমিনরা একে অপরের ভাইস্বরূপ। তাই তোমাদের ভাইদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আশা করা যায় তোমাদের ওপর দয়া করা হবে। (সূরা হুজুরাত- ১০)
৮. অঙ্গীকার ভঙ্গ না করা :
﴿اِنَّ شَرَّ الدَّوَآبِّ عِنْدَ اللهِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُوْنَ اَلَّذِيْنَ عَاهَدْتَّ مِنْهُمْ ثُمَّ يَنْقُضُوْنَ عَهْدَهُمْ فِي كُلِّ مَرَّةٍ وَّهُمْ لَا يَتَّقُوْنَ﴾
আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই, যারা কুফরী করে এবং ঈমান আনয়ন করে না। তাদের মধ্যে তুমি যাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ, তারা প্রত্যেকবার তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা সাবধান হয় না। (সূরা আনফাল- ৫৫, ৫৬)
﴿اِلَّا الَّذِيْنَ عَاهَدْتُّمْ مِّنَ الْمُشْرِكِيْنَ ثُمَّ لَمْ يَنْقُصُوْكُمْ شَيْئًا وَّلَمْ يُظَاهِرُوْا عَلَيْكُمْ اَحَدًا فَاَتِمُّوْاۤ اِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ اِلٰى مُدَّتِهِمْؕ اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ, তারপর যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি, তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদেরকে পছন্দ করেন। (সূরা তাওবা- ৪)
৯. যুদ্ধের ময়দানে অটল থাকা :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قَاتِلُوا الَّذِيْنَ يَلُوْنَكُمْ مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوْا فِيْكُمْ غِلْظَةً وَّاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে জিহাদ করো, যেন তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তাওবা- ১২৩)
১০. ঈমানের দৃঢ়তা অর্জন করা :
﴿وَلَأَجْرُ الْاٰخِرَةِ خَيْرٌ لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
আর পরকালের কর্মফল তাদের জন্য অধিক কল্যাণময় এবং উত্তম, যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অর্থাৎ পরহেযগারিতা অবলম্বন করে। (সূরা ইউসুফ- ৫৭)
১১. আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান করা :
﴿وَمَنْ يُّعَظِّمْ شَعَآئِرَ اللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ﴾
যদি কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করে, তবে এটা তো তার অন্তরের তাক্বওয়া মাত্র। (সূরা হাজ্জ- ৩২)
﴿وَلَقَدْ اَرْسَلْنَا نُوْحًا اِلٰى قَوْمِهٖ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَيْرُهٗؕ اَفَلَا تَتَّقُوْنَ﴾
আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদাত করো, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ্ নেই; তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না? (সূরা মু’মিনূন- ২৩)
২. আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা :
﴿وَاِبْرَاهِيْمَ اِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللهَ وَاتَّقُوْهُ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ﴾
স্মরণ করো, যখন ইবরাহীম তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁকে ভয় করো, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে! (সূরা আনকাবূত- ১৬)
৩. সালাত প্রতিষ্ঠা করা :
﴿مُنِيْبِيْنَ اِلَيْهِ وَاتَّقُوْهُ وَاَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ﴾
অতএব তোমরা তাঁর অভিমুখী হও এবং তাঁকে ভয় করো, সালাত কায়েম করো এবং তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (সূরা রূম- ৩০)
﴿وَاْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْاَلُكَ رِزْقًاؕ نَحْنُ نَرْزُقُكَؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰى﴾
তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গকে সালাতের আদেশ দাও ও তাতে অটল থাকো। আমি তোমার নিকট কোন রিযিক চাই না, কেননা আমিই তো তোমাকে রিযিক দেই। আর শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য। (সূরা ত্বা-হা- ১৩২)
৪. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করা :
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّبِيُّ اتَّقِ اللهَ وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَؕ اِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيْمًا حَكِيْمًا﴾
হে নবী! আল্লাহকে ভয় করো এবং কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা আহযাব- ১)
৫. সত্য কথা বলা :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।
(সূরা আহযাব- ৭০)
৬. সৎ লোকের সঙ্গী হওয়া :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও। (সূরা তাওবা- ১১৯)
৭. পারস্পরিক সুসম্পর্ক অটুট রাখা :
﴿اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ فَاَصْلِحُوْا بَيْنَ اَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ﴾
নিশ্চয় মুমিনরা একে অপরের ভাইস্বরূপ। তাই তোমাদের ভাইদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আশা করা যায় তোমাদের ওপর দয়া করা হবে। (সূরা হুজুরাত- ১০)
৮. অঙ্গীকার ভঙ্গ না করা :
﴿اِنَّ شَرَّ الدَّوَآبِّ عِنْدَ اللهِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُوْنَ اَلَّذِيْنَ عَاهَدْتَّ مِنْهُمْ ثُمَّ يَنْقُضُوْنَ عَهْدَهُمْ فِي كُلِّ مَرَّةٍ وَّهُمْ لَا يَتَّقُوْنَ﴾
আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই, যারা কুফরী করে এবং ঈমান আনয়ন করে না। তাদের মধ্যে তুমি যাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ, তারা প্রত্যেকবার তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা সাবধান হয় না। (সূরা আনফাল- ৫৫, ৫৬)
﴿اِلَّا الَّذِيْنَ عَاهَدْتُّمْ مِّنَ الْمُشْرِكِيْنَ ثُمَّ لَمْ يَنْقُصُوْكُمْ شَيْئًا وَّلَمْ يُظَاهِرُوْا عَلَيْكُمْ اَحَدًا فَاَتِمُّوْاۤ اِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ اِلٰى مُدَّتِهِمْؕ اِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছ, তারপর যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি, তোমরা তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদেরকে পছন্দ করেন। (সূরা তাওবা- ৪)
৯. যুদ্ধের ময়দানে অটল থাকা :
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قَاتِلُوا الَّذِيْنَ يَلُوْنَكُمْ مِّنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوْا فِيْكُمْ غِلْظَةً وَّاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! কাফিরদের মধ্যে যারা তোমাদের সীমান্তের কাছাকাছি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে এমনভাবে জিহাদ করো, যেন তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তাওবা- ১২৩)
১০. ঈমানের দৃঢ়তা অর্জন করা :
﴿وَلَأَجْرُ الْاٰخِرَةِ خَيْرٌ لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
আর পরকালের কর্মফল তাদের জন্য অধিক কল্যাণময় এবং উত্তম, যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অর্থাৎ পরহেযগারিতা অবলম্বন করে। (সূরা ইউসুফ- ৫৭)
১১. আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান করা :
﴿وَمَنْ يُّعَظِّمْ شَعَآئِرَ اللهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ﴾
যদি কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করে, তবে এটা তো তার অন্তরের তাক্বওয়া মাত্র। (সূরা হাজ্জ- ৩২)
ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে তাক্বওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি উভয় জগতে ব্যাপক কল্যাণ বয়ে আনে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهٖ وَيُعْظِمْ لَهٗۤ اَجْرًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পাপ মোচন করবেন এবং তাকে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। (সূরা তালাক্ব- ৫)
﴿اِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
নিশ্চয় শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য। (সূরা হুদ- ৪৯)
﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَآئِزُوْنَ﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম। (সূরা নূর- ৫২)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ فَقَالَ يَا رَسُولَ الله أَوْصِنِي قَالَ عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهٗ جِمَاعُ كُلِّ خَيْرٍ
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, তোমার উপর আবশ্যক হচ্ছে তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কেননা এটিই হচ্ছে সকল কল্যাণের সমাবেশকারী। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮৬৯।]
অপর হাদীসে এসেছে,
أُوصِيكَ بِتَقْوَى اللّٰهِ فَإِنَّهٗ رَأْسُ كُلِّ شَيْءٍ
আমি তোমাকে তাক্বওয়া অর্জন করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা এটা হচ্ছে সকল কিছুর মূল। [সিলসিলা সহীহাহ হা/৫৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১; মাযমাউয যাওয়াইদ, হা/৭১১১।]
অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَنْ يَزَالَ بِخَيْرٍ مَا اتَّقَى اللهَ
নিশ্চয় তোমাদের কেউ ততক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তাক্বওয়াবান থাকবে। [সহীহ বুখারী, হা/২৯৬৪।]
যেহেতু তাক্বওয়ার মধ্যেই সকল কল্যাণের সমাবেশ ঘটেছে, সুতরাং এর ফলাফলও ব্যাপক। তবে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ক) পার্থিব ফলাফল এবং খ) পরকালীন ফলাফল। নিম্নে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهٖ وَيُعْظِمْ لَهٗۤ اَجْرًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পাপ মোচন করবেন এবং তাকে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। (সূরা তালাক্ব- ৫)
﴿اِنَّ الْعَاقِبَةَ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
নিশ্চয় শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য। (সূরা হুদ- ৪৯)
﴿وَمَنْ يُّطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الْفَآئِزُوْنَ﴾
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম। (সূরা নূর- ৫২)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ لِلنَّبِيِّ فَقَالَ يَا رَسُولَ الله أَوْصِنِي قَالَ عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فَإِنَّهٗ جِمَاعُ كُلِّ خَيْرٍ
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি নবী ﷺ এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন, তোমার উপর আবশ্যক হচ্ছে তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কেননা এটিই হচ্ছে সকল কল্যাণের সমাবেশকারী। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৮৬৯।]
অপর হাদীসে এসেছে,
أُوصِيكَ بِتَقْوَى اللّٰهِ فَإِنَّهٗ رَأْسُ كُلِّ شَيْءٍ
আমি তোমাকে তাক্বওয়া অর্জন করার উপদেশ দিচ্ছি। কেননা এটা হচ্ছে সকল কিছুর মূল। [সিলসিলা সহীহাহ হা/৫৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৭৯১; মাযমাউয যাওয়াইদ, হা/৭১১১।]
অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
وَإِنَّ أَحَدَكُمْ لَنْ يَزَالَ بِخَيْرٍ مَا اتَّقَى اللهَ
নিশ্চয় তোমাদের কেউ ততক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তাক্বওয়াবান থাকবে। [সহীহ বুখারী, হা/২৯৬৪।]
যেহেতু তাক্বওয়ার মধ্যেই সকল কল্যাণের সমাবেশ ঘটেছে, সুতরাং এর ফলাফলও ব্যাপক। তবে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ক) পার্থিব ফলাফল এবং খ) পরকালীন ফলাফল। নিম্নে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
তাক্বওয়ার পার্থিব ফলাফলগুলো হচ্ছে নগদ পুরস্কার। এগুলো কখনো কখনো অতি দ্রুত প্রতিফলিত হয়, আবার কখনো কখনো কিছুটা দেরীতে প্রতিফলিত হয়। বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কেননা তিনি কখনো কখনো এর মাধ্যমেও বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন যে, বান্দা এত দ্রুত প্রতিফল পাওয়ার কারণে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে কি না অথবা দেরী হওয়ার কারণে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে কি না। অতএব তাক্বওয়ার পার্থিব ফলাফল পাওয়ার জন্য অনুরূপ মানসিক প্র্রস্তুতি থাকা খুবই জরুরি। নিম্নে পার্থিব ফলাফলের কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলো :
১. অকল্পনীয় উৎস থেকে জীবিকা লাভ হয় :
তাক্বওয়াবান বান্দাগণ তাক্বওয়ার ফলস্বরূপ আল্লাহর পক্ষ হতে এমন উৎস হতে রিযিক লাভ করে থাকে, যে সম্পর্কে সে কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا ‐ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার উপায় বের করে দেন এবং তিনি ঐ ব্যক্তিকে এমন দিক হতে রিযিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (সূরা তালাক্ব- ২, ৩)
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَأَلَّوِ اسْتَقَامُوْا عَلَى الطَّرِيْقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُمْ مَّآءً غَدَقًا﴾
তারা যদি সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত থাকত, তাদেরকে আমি প্রচুর বারি বর্ষণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতাম। (সূরা জিন- ১৬)
২. সকল কাজকর্ম সহজসাধ্য হয়ে যায় :
যে ব্যক্তি পাপাচার পরিত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় আনুগত্যপূর্ণ কাজ ঐ বান্দার জন্য সহজ করে দেন। তিনি বলেন,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مِنْ اَمْرِهٖ يُسْرًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজকর্ম সহজ করে দেন। (সূরা তালাক্ব- ৪)
৩. উপকারী জ্ঞান লাভ করা যায় :
যখন কোন বান্দা আল্লাহকে ভয় করে এবং এর ভিত্তিতে সৎকর্ম করার প্রতি মনোযোগী হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আর তাকে অনেক উপকারী জ্ঞান দান করেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاتَّقُوا اللهَ وَيُعَلِّمُكُمُ اللهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ﴾
তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (সূরা বাক্বারা- ২৮২)
৪. সূক্ষ্ম ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া যায় :
এটি আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ অনুগ্রহ। আর তাক্বওয়াবান বান্দাদের জন্য এ গুণটি অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় তার পক্ষে দ্বীনের উপর টিকে থাকা খুবই কঠিন। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াবান বান্দাদেরকে এগুণটি দান করেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَّكُمْ فُرْقَانًا﴾
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন। (সূরা আনফাল- ২৯)
৫. উত্তম ব্যক্তিত্ব লাভ করা যায় :
তাক্বওয়াবান বান্দাগণ পার্থিব জীবনে মানুষের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভালোবাসেন; ফলে ফেরেশতারাও তাদেরকে ভালোবাসে এবং তাদের জন্য দু‘আ করে; ফলে সে দুনিয়াতে অবস্থিত সৎ বান্দাদের কাছেও প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿بَلٰى مَنْ أَوْفٰى بِعَهْدِه وَاتَّقٰى فَإِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
হ্যাঁ- কেউ তার অঙ্গীকার পূর্ণ করলে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে চললে আল্লাহ মুত্তাক্বীদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান- ৭৬)
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمٰنُ وُدًّا﴾
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, দয়াময় অবশ্যই তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন। (সূরা মারইয়াম- ৯৬)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ إِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا نَادٰى جِبْرِيلَ إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّ فُلَانًا فَأَحِبَّهٗ فَيُحِبُّهٗ جِبْرِيلُ ثُمَّ يُنَادِي جِبْرِيلُ فِي السَّمَاءِ إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ فَيُحِبُّهٗ أَهْلُ السَّمَاءِ وَيُوْضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي أَهْلِ الْأَرْضِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি; সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। তখন তিনি তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিবরীল (আঃ) আসমানবাসীকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন; সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আসমানবাসী তাকে ভালোবাসেন। আর তার জন্য যমীনে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৭৪৮৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৪; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৭১০।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أن رَسُولُ اللّٰهِ قَالَ إِذَا أَحَبَّ اللّٰهُ عَبْدًا نَادٰى جِبْرِيْلَ إِنِّىْ أَحْبَبْتُ فُلَانًا فَأَحِبَّهٗ فَيُنَادِىْ فِىْ السَّمَاءِ ثُمَّ تَنْزِلُ لَهُ الْمَحَبَّةُ فْىْ أَهْلِ الْأَرْضِ فَذٰلِكَ قَوْلُ اللهِ ﴿إِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمٰنُ وُدًّا﴾ وَإِذَا أَبْغَضَ اللهُ عَبْدًا نَادٰى جِبْرِيْلَ إِنِّىْ قَدْ أَبْغَضْتُ فُلَانًا فَيُنَادِىْ فِىْ السَّمَاءِ ثُمَّ تَنْزِلُ لَهُ الْبَغْضَاءُ فِى الْأَرْضِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। (রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন) তখন জিবরীল (আঃ) আসমানে ঘোষণা করেন। অতঃপর আসমানবাসীর মাঝে তার জন্য ভালোবাসা নাযিল করা হয়। আর এ সম্পর্কেই আল্লাহর বাণী- ‘‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে দয়াময় তাদের জন্য সৃষ্টি করবেন ভালোবাসা’’- (সূরা মারিয়াম- ৯৬)। আর যখন আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দার উপর রাগান্বিত হন, তখন জিবরাঈল (আঃ)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুকের উপর রাগান্বিত হয়েছি। অতঃপর তিনি আসমানবাসীদের কাছে এটি ঘোষণা করে দেন। তারপর জমিনেও তার উপর ক্রোধ বর্ষিত হয়। [তিরমিযী, হা/৩১৬১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৪।]
৬. আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায় :
তাক্বওয়াবান লোকেরা সরাসরি আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তা লাভ করে থাকেন। ফলে শত্রুরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর কখনো কখনো তারা সাময়িকভাবে তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হলেও চূড়ান্তভাবে মুত্তাক্বীরাই বিজয়ী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَّاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তাওবা- ১২৩)
অপর আয়াতে বলেন,
﴿قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِيْ مَعَكُمَاۤ اَسْمَعُ وَاَرٰى﴾
তিনি বললেন, তোমরা ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি। (সূরা ত্বা-হা- ৪৬)
অর্থাৎ আমি তোমাদের সঙ্গে আছি তোমাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতার দ্বারা। আর আল্লাহর সাহায্য যে কোনভাবে এবং যে কোন সময়ই আসতে পারে। বদরের যুদ্ধে আল্লাহর প্রকাশ্য সাহায্য এর উত্তম উদাহরণ। সুতরাং আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে, মুত্তাক্বীদেরকে অবশ্যই ধৈর্যধারণ করতে হবে।
৭. শত্রুর চক্রান্ত থেকে মুক্তি লাভ করা যায় :
﴿وَاِنْ تَصْبِرُوْا وَتَتَّقُوْا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًاؕ اِنَّ اللهَ بِمَا يَعْمَلُوْنَ مُحِيْطٌ﴾
যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু বেষ্টন করে আছেন। (সূরা আলে ইমরান- ১২০)
৮. পার্থিব বিপদাপদ ও সংকট থেকে রক্ষা পাওয়া যায় :
﴿وَاَنْجَيْنَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
অতঃপর যারা মুমিন ও মুত্তাক্বী ছিল, তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছি। (সূরা নামল- ৫৩)
৯. তাদের যে কোন সংকট দূর করে দেন :
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার (সংকট থেকে বের হওয়ার) পথ বের করে দেন। (সূরা তালাক্ব- ২)
১০. যাবতীয় কল্যাণ লাভ করা যায় :
তাক্বওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য আকাশ ও জমিনের সকল ধরনের কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। তিনি বলেন,
﴿وَلَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤى اٰمَنُوْا وَاتَّقُوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ﴾
যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম।
(সূরা আ‘রাফ- ৯৬)
১১. সুসংবাদ লাভ করা যায় :
মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর পক্ষ হতে আগত সুসংবাদ পেয়ে ধন্য হয়ে থাকেন। আল্লাহ বলেন,
﴿أَلَاۤ إِنَّ أَوْلِيَآءَ اللّٰهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‐ اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ ‐ لَهُمُ الْبُشْرٰى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْاٰخِرَةِ﴾
জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। যারা বিশ্বাস করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে; তাদের জন্য আছে সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে। (সূরা ইউনুস: ৬২-৬৪)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে এসেছে,
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ سَأَلْتُ رَسُولَ اللّٰهِ عَنْ قَوْلِه تَبَارَكَ وَتَعَالٰى ﴿لَهُمُ الْبُشْرٰى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْاٰخِرَةِ﴾ فَقَالَ هِيَ الرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ يَرَاهَا الْمُسْلِمُ أَوْ تُرٰى لَهٗ
উবাদাহ ইবনে সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আল্লাহর বাণী ‘তাদের জন্য আছে সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে’- (সূরা ইউনুস- ৬৪) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা হচ্ছে উত্তম স্বপ্ন, যা মুসলিম ব্যক্তি দেখে থাকে অথবা তাকে দেখানো হয়। [ইবনে মাজাহ হা/৪০৩১; তিরমিযী, হা/২২৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৭৫৬৬।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أُمِّ كُرْزٍ الْكَعْبِيَّةِ قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللّٰهِ يَقُولُ ذَهَبَتِ النُّبُوَّةُ وَبَقِيَتِ الْمُبَشِّرَاتُ
উম্মে কুরয আল-কা‘বিয়্যাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, নবুওয়াত চলে গেছে; তবে সুসংবাদ অবশিষ্ট রয়েছে। [ইবনে মাজাহ হা/৩৮৯৬।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ و إنَّ الرِّسالَةَ والنُّبُوَّةَ قَدِ انْقَطَعَتْ فَلَا رَسُوْلَ بَعْدِيْ ولَا نَبِيَّ ولٰكِنِ المُبَشِّرَاتِ رُؤْيَا الرَّجُلِ الْمُسْلِمِ وَهِيَ جُزْءٌ مِنْ أَجْزَاءِ النُّبُوَّةِ
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, রিসালাত ও নবুওয়াত বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আমার পরে কোন রাসূল নেই, কোন নবীও নেই। অতঃপর তিনি বলেন, সুসংবাদ বাকী আছে। আর তা হলো, মুসলিমদের স্বপ্ন। এটা নবুওয়াতের অংশগুলোর একটি অংশ। [তিরমিযী, হা/২২৭২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৮১৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৮৫১।]
১২. সন্তান-সন্ততিও অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পায় :
তাক্বওয়াবান লোকের সন্তান-সন্ততি সকল প্রকার অনিষ্ট হতে আল্লাহর আশ্রয় লাভ করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيْمَيْنِ فِى الْمَدِيْنَةِ وَكَانَ تَحْتَهٗ كَنْزٌ لَّهُمَا وَكَانَ اَبُوْهُمَا صَالِحًا﴾
আর ঐ প্রাচীরটি ছিল নগরবাসীর মধ্যে দু’জন ইয়াতীম কিশোরের, যার নিচে আছে তাদের গুপ্তধন এবং যাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। (সূরা কাহফ- ৮২)
সুতরাং ঐ দুই বালককে ও তাদের সম্পদকে রক্ষা করেছে তাদের পিতার সৎকর্ম।
১৩. পার্থিব জীবনের আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায় :
আল্লাহ তা‘আলা কিছু কিছু পাপের শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করে থাকেন। তবে মুত্তাক্বী বান্দাগণ ঐ শাস্তি থেকে সহজেই পরিত্রাণ লাভ করতে সক্ষম হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনাতেই এর উত্তম উদাহরণ বিদ্যমান। যেমন- সামুদ জাতির ঘটনা বর্ণনায় কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَأَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمٰى عَلَى الْهُدٰى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُوْنِ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ ‐ وَنَجَّيْنَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
আর সামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, আমি তাদেরকে পথ-নির্দেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা সৎপথের পরিবর্তে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করেছিল। অতঃপর তাদেরকে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আঘাত হানল তাদের কৃতকর্মের পরিণামস্বরূপ। আমরা উদ্ধার করলাম তাদেরকে যারা ঈমান এনেছিল এবং যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করত। (সূরা হামীম আস-সাজদা- ১৭, ১৮)
১. অকল্পনীয় উৎস থেকে জীবিকা লাভ হয় :
তাক্বওয়াবান বান্দাগণ তাক্বওয়ার ফলস্বরূপ আল্লাহর পক্ষ হতে এমন উৎস হতে রিযিক লাভ করে থাকে, যে সম্পর্কে সে কল্পনাও করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا ‐ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার উপায় বের করে দেন এবং তিনি ঐ ব্যক্তিকে এমন দিক হতে রিযিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (সূরা তালাক্ব- ২, ৩)
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَأَلَّوِ اسْتَقَامُوْا عَلَى الطَّرِيْقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُمْ مَّآءً غَدَقًا﴾
তারা যদি সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত থাকত, তাদেরকে আমি প্রচুর বারি বর্ষণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতাম। (সূরা জিন- ১৬)
২. সকল কাজকর্ম সহজসাধ্য হয়ে যায় :
যে ব্যক্তি পাপাচার পরিত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় আনুগত্যপূর্ণ কাজ ঐ বান্দার জন্য সহজ করে দেন। তিনি বলেন,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مِنْ اَمْرِهٖ يُسْرًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজকর্ম সহজ করে দেন। (সূরা তালাক্ব- ৪)
৩. উপকারী জ্ঞান লাভ করা যায় :
যখন কোন বান্দা আল্লাহকে ভয় করে এবং এর ভিত্তিতে সৎকর্ম করার প্রতি মনোযোগী হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আর তাকে অনেক উপকারী জ্ঞান দান করেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاتَّقُوا اللهَ وَيُعَلِّمُكُمُ اللهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ﴾
তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (সূরা বাক্বারা- ২৮২)
৪. সূক্ষ্ম ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া যায় :
এটি আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ অনুগ্রহ। আর তাক্বওয়াবান বান্দাদের জন্য এ গুণটি অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় তার পক্ষে দ্বীনের উপর টিকে থাকা খুবই কঠিন। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাক্বওয়াবান বান্দাদেরকে এগুণটি দান করেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنْ تَتَّقُوا اللهَ يَجْعَلْ لَّكُمْ فُرْقَانًا﴾
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দেবেন। (সূরা আনফাল- ২৯)
৫. উত্তম ব্যক্তিত্ব লাভ করা যায় :
তাক্বওয়াবান বান্দাগণ পার্থিব জীবনে মানুষের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভালোবাসেন; ফলে ফেরেশতারাও তাদেরকে ভালোবাসে এবং তাদের জন্য দু‘আ করে; ফলে সে দুনিয়াতে অবস্থিত সৎ বান্দাদের কাছেও প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿بَلٰى مَنْ أَوْفٰى بِعَهْدِه وَاتَّقٰى فَإِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ﴾
হ্যাঁ- কেউ তার অঙ্গীকার পূর্ণ করলে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে চললে আল্লাহ মুত্তাক্বীদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আলে ইমরান- ৭৬)
﴿اِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمٰنُ وُدًّا﴾
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, দয়াময় অবশ্যই তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন। (সূরা মারইয়াম- ৯৬)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ إِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالٰى إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا نَادٰى جِبْرِيلَ إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّ فُلَانًا فَأَحِبَّهٗ فَيُحِبُّهٗ جِبْرِيلُ ثُمَّ يُنَادِي جِبْرِيلُ فِي السَّمَاءِ إِنَّ اللهَ قَدْ أَحَبَّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ فَيُحِبُّهٗ أَهْلُ السَّمَاءِ وَيُوْضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي أَهْلِ الْأَرْضِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি; সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। তখন তিনি তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিবরীল (আঃ) আসমানবাসীকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন; সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আসমানবাসী তাকে ভালোবাসেন। আর তার জন্য যমীনে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। [সহীহ বুখারী, হা/৭৪৮৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৪; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৭১০।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أن رَسُولُ اللّٰهِ قَالَ إِذَا أَحَبَّ اللّٰهُ عَبْدًا نَادٰى جِبْرِيْلَ إِنِّىْ أَحْبَبْتُ فُلَانًا فَأَحِبَّهٗ فَيُنَادِىْ فِىْ السَّمَاءِ ثُمَّ تَنْزِلُ لَهُ الْمَحَبَّةُ فْىْ أَهْلِ الْأَرْضِ فَذٰلِكَ قَوْلُ اللهِ ﴿إِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمٰنُ وُدًّا﴾ وَإِذَا أَبْغَضَ اللهُ عَبْدًا نَادٰى جِبْرِيْلَ إِنِّىْ قَدْ أَبْغَضْتُ فُلَانًا فَيُنَادِىْ فِىْ السَّمَاءِ ثُمَّ تَنْزِلُ لَهُ الْبَغْضَاءُ فِى الْأَرْضِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো। (রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন) তখন জিবরীল (আঃ) আসমানে ঘোষণা করেন। অতঃপর আসমানবাসীর মাঝে তার জন্য ভালোবাসা নাযিল করা হয়। আর এ সম্পর্কেই আল্লাহর বাণী- ‘‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে দয়াময় তাদের জন্য সৃষ্টি করবেন ভালোবাসা’’- (সূরা মারিয়াম- ৯৬)। আর যখন আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দার উপর রাগান্বিত হন, তখন জিবরাঈল (আঃ)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুকের উপর রাগান্বিত হয়েছি। অতঃপর তিনি আসমানবাসীদের কাছে এটি ঘোষণা করে দেন। তারপর জমিনেও তার উপর ক্রোধ বর্ষিত হয়। [তিরমিযী, হা/৩১৬১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৬৪।]
৬. আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যায় :
তাক্বওয়াবান লোকেরা সরাসরি আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তা লাভ করে থাকেন। ফলে শত্রুরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর কখনো কখনো তারা সাময়িকভাবে তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হলেও চূড়ান্তভাবে মুত্তাক্বীরাই বিজয়ী হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَّاعْلَمُوْاۤ اَنَّ اللّٰهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ﴾
জেনে রেখো! নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাক্বীদের সাথেই রয়েছেন। (সূরা তাওবা- ১২৩)
অপর আয়াতে বলেন,
﴿قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِيْ مَعَكُمَاۤ اَسْمَعُ وَاَرٰى﴾
তিনি বললেন, তোমরা ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি। (সূরা ত্বা-হা- ৪৬)
অর্থাৎ আমি তোমাদের সঙ্গে আছি তোমাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতার দ্বারা। আর আল্লাহর সাহায্য যে কোনভাবে এবং যে কোন সময়ই আসতে পারে। বদরের যুদ্ধে আল্লাহর প্রকাশ্য সাহায্য এর উত্তম উদাহরণ। সুতরাং আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে, মুত্তাক্বীদেরকে অবশ্যই ধৈর্যধারণ করতে হবে।
৭. শত্রুর চক্রান্ত থেকে মুক্তি লাভ করা যায় :
﴿وَاِنْ تَصْبِرُوْا وَتَتَّقُوْا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًاؕ اِنَّ اللهَ بِمَا يَعْمَلُوْنَ مُحِيْطٌ﴾
যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু বেষ্টন করে আছেন। (সূরা আলে ইমরান- ১২০)
৮. পার্থিব বিপদাপদ ও সংকট থেকে রক্ষা পাওয়া যায় :
﴿وَاَنْجَيْنَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
অতঃপর যারা মুমিন ও মুত্তাক্বী ছিল, তাদেরকে আমি উদ্ধার করেছি। (সূরা নামল- ৫৩)
৯. তাদের যে কোন সংকট দূর করে দেন :
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَّهٗ مَخْرَجًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার (সংকট থেকে বের হওয়ার) পথ বের করে দেন। (সূরা তালাক্ব- ২)
১০. যাবতীয় কল্যাণ লাভ করা যায় :
তাক্বওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য আকাশ ও জমিনের সকল ধরনের কল্যাণের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। তিনি বলেন,
﴿وَلَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤى اٰمَنُوْا وَاتَّقُوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ﴾
যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম।
(সূরা আ‘রাফ- ৯৬)
১১. সুসংবাদ লাভ করা যায় :
মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর পক্ষ হতে আগত সুসংবাদ পেয়ে ধন্য হয়ে থাকেন। আল্লাহ বলেন,
﴿أَلَاۤ إِنَّ أَوْلِيَآءَ اللّٰهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‐ اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ ‐ لَهُمُ الْبُشْرٰى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْاٰخِرَةِ﴾
জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না। যারা বিশ্বাস করে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করে; তাদের জন্য আছে সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে। (সূরা ইউনুস: ৬২-৬৪)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদীসে এসেছে,
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ سَأَلْتُ رَسُولَ اللّٰهِ عَنْ قَوْلِه تَبَارَكَ وَتَعَالٰى ﴿لَهُمُ الْبُشْرٰى فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْاٰخِرَةِ﴾ فَقَالَ هِيَ الرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ يَرَاهَا الْمُسْلِمُ أَوْ تُرٰى لَهٗ
উবাদাহ ইবনে সামেত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে আল্লাহর বাণী ‘তাদের জন্য আছে সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে’- (সূরা ইউনুস- ৬৪) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা হচ্ছে উত্তম স্বপ্ন, যা মুসলিম ব্যক্তি দেখে থাকে অথবা তাকে দেখানো হয়। [ইবনে মাজাহ হা/৪০৩১; তিরমিযী, হা/২২৭৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৭৫৬৬।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أُمِّ كُرْزٍ الْكَعْبِيَّةِ قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللّٰهِ يَقُولُ ذَهَبَتِ النُّبُوَّةُ وَبَقِيَتِ الْمُبَشِّرَاتُ
উম্মে কুরয আল-কা‘বিয়্যাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, নবুওয়াত চলে গেছে; তবে সুসংবাদ অবশিষ্ট রয়েছে। [ইবনে মাজাহ হা/৩৮৯৬।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ و إنَّ الرِّسالَةَ والنُّبُوَّةَ قَدِ انْقَطَعَتْ فَلَا رَسُوْلَ بَعْدِيْ ولَا نَبِيَّ ولٰكِنِ المُبَشِّرَاتِ رُؤْيَا الرَّجُلِ الْمُسْلِمِ وَهِيَ جُزْءٌ مِنْ أَجْزَاءِ النُّبُوَّةِ
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, রিসালাত ও নবুওয়াত বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং আমার পরে কোন রাসূল নেই, কোন নবীও নেই। অতঃপর তিনি বলেন, সুসংবাদ বাকী আছে। আর তা হলো, মুসলিমদের স্বপ্ন। এটা নবুওয়াতের অংশগুলোর একটি অংশ। [তিরমিযী, হা/২২৭২; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৮১৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৮৫১।]
১২. সন্তান-সন্ততিও অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পায় :
তাক্বওয়াবান লোকের সন্তান-সন্ততি সকল প্রকার অনিষ্ট হতে আল্লাহর আশ্রয় লাভ করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاَمَّا الْجِدَارُ فَكَانَ لِغُلَامَيْنِ يَتِيْمَيْنِ فِى الْمَدِيْنَةِ وَكَانَ تَحْتَهٗ كَنْزٌ لَّهُمَا وَكَانَ اَبُوْهُمَا صَالِحًا﴾
আর ঐ প্রাচীরটি ছিল নগরবাসীর মধ্যে দু’জন ইয়াতীম কিশোরের, যার নিচে আছে তাদের গুপ্তধন এবং যাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। (সূরা কাহফ- ৮২)
সুতরাং ঐ দুই বালককে ও তাদের সম্পদকে রক্ষা করেছে তাদের পিতার সৎকর্ম।
১৩. পার্থিব জীবনের আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায় :
আল্লাহ তা‘আলা কিছু কিছু পাপের শাস্তি দুনিয়াতেই প্রদান করে থাকেন। তবে মুত্তাক্বী বান্দাগণ ঐ শাস্তি থেকে সহজেই পরিত্রাণ লাভ করতে সক্ষম হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ঘটনাতেই এর উত্তম উদাহরণ বিদ্যমান। যেমন- সামুদ জাতির ঘটনা বর্ণনায় কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَأَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمٰى عَلَى الْهُدٰى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُوْنِ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ ‐ وَنَجَّيْنَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ﴾
আর সামূদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার তো এই যে, আমি তাদেরকে পথ-নির্দেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা সৎপথের পরিবর্তে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করেছিল। অতঃপর তাদেরকে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আঘাত হানল তাদের কৃতকর্মের পরিণামস্বরূপ। আমরা উদ্ধার করলাম তাদেরকে যারা ঈমান এনেছিল এবং যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করত। (সূরা হামীম আস-সাজদা- ১৭, ১৮)
এটি হচ্ছে তাক্বওয়া অবলম্বন করার চিরস্থায়ী ও মূল ফলাফল, যা অর্জিত হবে মৃত্যুর পর কিয়ামতের মাঠে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো :
১. পাপ মোচন হবে ও অশেষ সওয়াব লাভ করা যাবে :
তাক্বওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং অশেষ সওয়াব দান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهٖ وَيُعْظِمْ لَهٗۤ اَجْرًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পাপ মোচন করবেন এবং তাকে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। (সূরা তালাক্ব- ৫)
অতএব আয়াতের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে- (১) আল্লাহ তাদেরকে সামান্য আমলের বিনিময়ে অনেক বেশি সওয়াব দান করেন। ফলে তাদের সওয়াবের পরিমান গোনাহের থেকে বেশি হয়ে যায়। সুতরাং সেসব গুনাহও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা হয়ে যায়। (২) তাক্বওয়াবান ব্যক্তিদের তওবা ও ইস্তেগফার সহ কিছু বিশেষ আমলের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
২. ক্বিয়ামতের দিন মর্যাদার শীর্ষস্থান লাভ করা যাবে :
কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত মানুষ একত্রিত হবে, তখন মুত্তাক্বীদেরকেই সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُوْنَ مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَالَّذِيْنَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ﴾
যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিকট পার্থিব জীবন সুশোভিত। তারা মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকে; অথচ যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে কিয়ামতের দিন তারা তাদের ঊর্ধ্বে থাকবে। (সূরা বাকারা- ২১২)
শীর্ষস্থান লাভের দুটি দিক হতে পারে- (১) দুনিয়াতে কাফিরদের যে অবস্থা ছিল, পরকালে মুমিনদের অবস্থা হবে তার শীর্ষে। (২) মুমিনরা পরকালে থাকবে (জান্নাতের) প্রকোষ্ঠে এবং কাফিররা থাকবে জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে।
৩. পুলসিরাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে :
পুলসিরাত হচ্ছে জাহান্নামের উপর অবস্থিত একটি বিশেষ রাস্তা বা পুল, যা সকলকেই অতিক্রম করতে হবে। এটি অতিক্রম করতে না পারলে জাহান্নামে পতিত হতে হবে। একমাত্র মুত্তাক্বী বান্দা ছাড়া এটিকে কেউ সুষ্ঠুভাবে অতিক্রম করতে পারবে না। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاِنْ مِّنْكُمْ اِلَّا وَارِدُهَاۚ كَانَ عَلٰى رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا ‐ ثُمَّ نُنَجِّى الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا﴾
তোমাদের প্রত্যেকেই সেটা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাক্বীদেরকে উদ্ধার করব এবং যালিমদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দেব। (সূরা মারইয়াম- ৭১, ৭২)
৪. জান্নাত লাভ করা যাবে :
তাক্বওয়া অর্জনের চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে জান্নাত লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা পরকালে মুত্তাক্বী বান্দাদেরকে তা দান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِيْ نُوْرِثُ مِنْ عِبَادِنَا مَنْ كَانَ تَقِيًّا﴾
এই সেই জান্নাত, যার অধিকারী করব আমার বান্দাদের মধ্যে মুত্তাক্বীদেরকে। (সূরা মারইয়াম- ৬৩)
﴿وَسَارِعُوْاۤ اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوَاتُ وَالْاَرْضُ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ধাবিত হও, যার প্রসারতা ও বিস্তৃতি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সদৃশ। আর তা মুত্তাক্বীদের জন্যই নির্মিত হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান- ১৩৩)
﴿إِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ﴾
অবশ্যই মুত্তাক্বীদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে ভোগবিলাসপূর্ণ জান্নাত। (সূরা কালাম- ৩৪)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَسِيْقَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتّٰۤى اِذَا جَآءُوْهَا وَفُتِحَتْ اَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوْهَا خَالِدِيْنَ﴾
যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং এর দরজা খুলে দেয়া হবে, তখন তার রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতারা বলবে, হে জান্নাতীরা! তোমাদের প্রতি সালাম। তোমাদের আগমন শুভ হোক। তোমরা চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে প্রবেশ করো। (সূরা যুমার- ৭৩)
হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, এটা হচ্ছে সৌভাগ্যবান মুমিনদের সম্পর্কে সংবাদ, যখন তারা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার স্তরের দিকে অগ্রসর হবে। অর্থাৎ দলবদ্ধভাবে জান্নাতের দিকে অগ্রসর হবে। দলে দলে বলতে নৈকট্যশীলদের দল, অতঃপর পুণ্যবানদের দল, অতঃপর তাদের নিকটতর সকল দল। অর্থাৎ নবীগণের সাথে নবীগণ সত্যপরায়ণদের সাথে তাদের সমগোত্রীয়গণ, শহীদদের সাথে তাদের সমপর্যায়ের লোক, ওলামায়ে কেরামের সাথে তাদের নিকটবর্তীগণ, অনুরূপভাবে প্রত্যেক দলের সাথে তাদের সমপর্যায়ভুক্ত দলবদ্ধ হয়ে। [তাফসীর ইবনে কাসীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১১৯, সূরা যুমার ৭৩নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।]
৫. তারা জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর ও সর্বোত্তম নিয়ামত লাভ করবে :
মুত্তাক্বী বান্দাগণ কেবল জান্নাত পেয়ে ক্ষান্ত হবে না; বরং তারা তাক্বওয়ার ভিত্তিতে জান্নাতের বিভিন্ন স্তরে এমনকি শীর্ষস্থান পর্যন্তও আরোহণ করবে। অতঃপর তারা সেখানে সর্বোত্তম নিয়ামত লাভ করবে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿اِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ مَفَازًا ﴾
নিশ্চয় মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে অনেক পুরস্কার। (সূরা নাবা- ৩১)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَإِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ لَحُسْنَ مَاٰبٍ﴾
মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে উত্তম আবাস। (সূরা সোয়াদ- ৪৯)
﴿جَنَّاتِ عَدْنٍ مُّفَتَّحَةً لَّهُمُ الْأَبْوَابُ ‐ مُتَّكِئِيْنَ فِيْهَا يَدْعُوْنَ فِيْهَا بِفَاكِهَةٍ كَثِيْرَةٍ وَّشَرَابٍ ‐ وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ أَتْرَابٌ ‐ هٰذَا مَا تُوْعَدُوْنَ لِيَوْمِ الْحِسَابِ ‐ إِنَّ هٰذَا لَرِزْقُنَا مَا لَهٗ مِنْ نَّفَادٍ﴾
চিরস্থায়ী জান্নাত, তাদের জন্য উন্মুক্ত যার দ্বার। সেথায় তারা আসীন হবে হেলান দিয়ে, সেথায় তারা বহুবিধ ফলমূল ও পানীয়ের জন্য আদেশ দিবে এবং তাদের পার্শ্বে থাকবে আনতনয়না সমবয়স্কা তরুণীগণ। এটাই হিসাব দিবসের জন্য তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি। এটাই আমার দেয়া রিযিক, যা নিঃশেষ হবে না। (সূরা সোয়াদ: ৫০-৫৪)
﴿وَزُخْرُفًاؕ وَاِنْ كُلُّ ذٰلِكَ لَمَّا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَاؕ وَالْاٰخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
কিন্তু এগুলো তো শুধু পার্থিব জীবনের ভোগ সম্ভার। আর মুত্তাক্বীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে আখিরাত (এর কল্যাণ)। (সূরা যুখরুফ- ৩৫)
﴿تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِى الْاَرْضِ وَلَا فَسَادًاؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
এটা আখিরাতের আবাস যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্য, যারা এ পৃথিবীতে উগ্রতা প্রকাশ করে না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য। (সূরা ক্বাসাস- ৮৩)
৬. তারা দু‘টি জান্নাত লাভ করবে :
﴿وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ جَنَّتَانِ – فَبِاَيِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ﴾
আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি জান্নাত। অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামত অস্বীকার করবে? (সূরা আর রহমান- ৪৬, ৪৭)
এ দুটি জান্নাতের বর্ণনায় হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ قَيْسٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ قَالَ جَنَّتَانِ مِنْ فِضَّةٍ اٰنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا وَجَنَّتَانِ مِنْ ذَهَبٍ اٰنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا وَمَا بَيْنَ الْقَوْمِ وَبَيْنَ أَنْ يَنْظُرُوا إِلٰى رَبِّهِمْ إِلَّا رِدَاءُ الْكِبْرِ عَلٰى وَجْهِه فِي جَنَّةِ عَدْنٍ
দুটি জান্নাত এবং তার পাত্রসমূহ ও অন্যান্য সবকিছু হবে রুপার তৈরি। আরো দুটি জান্নাত এবং তার পাত্রসমূহ ও অন্যান্য সবকিছুই হবে স্বর্ণের তৈরি। আদন নামক জান্নাতে জান্নাতবাসীগণ ও তাদের বরকতময় মহান প্রভুর দীদার লাভের মাঝখানে তাঁর চেহারার উপর তাঁর গৌরবের চাদর ব্যতীত আর কোন প্রতিবন্ধক থাকবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৭৮, ৭৪৪৪; সহীহ মুসলিম, হা/৪৬৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৬।]
৭. কিয়ামতের দিন মুত্তাক্বী বান্দাদের বন্ধুত্ব লাভ করা যাবে :
কিয়ামতের দিন যখন নিজেদের আমলনামা নিয়ে সকল মানুষ দিশেহারা হয়ে যাবে, তখন প্রত্যেকেই একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, তখন কেবলমাত্র মুত্তাক্বী বান্দাগণ একে অপরের বন্ধুত্ব লাভ করবে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿اَلْاَخِلَّآءُ يَوْمَئِذٍ ۢبَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الْمُتَّقِيْنَ﴾
সেদিন বন্ধুরা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, তবে মুত্তাক্বীরা ব্যতীত।
(সূরা যুখরুফ- ৬৭)
﴿إِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنَّاتٍ وَّعُيُوْنٍ ‐ اُدْخُلُوْهَا بِسَلَامٍ اٰمِنِيْنَ ‐ وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُوْرِهِمْ مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلٰى سُرُرٍ مُّتَقَابِلِيْنَ﴾
মুত্তাক্বীরা থাকবে প্রস্রবণ-বহুল জান্নাতে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাতে প্রবেশ করো। আমি তাদের অন্তর থেকে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দেব। তারা পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করবে। তারা উঁচু উঁচু আসনে হেলান দিয়ে বসবে। (সূরা হিজর: ৪৫-৪৭)
১. পাপ মোচন হবে ও অশেষ সওয়াব লাভ করা যাবে :
তাক্বওয়া অবলম্বন করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং অশেষ সওয়াব দান করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَّتَّقِ اللهَ يُكَفِّرْ عَنْهُ سَيِّئَاتِهٖ وَيُعْظِمْ لَهٗۤ اَجْرًا﴾
যে আল্লাহকে ভয় করে তিনি তার পাপ মোচন করবেন এবং তাকে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। (সূরা তালাক্ব- ৫)
অতএব আয়াতের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে- (১) আল্লাহ তাদেরকে সামান্য আমলের বিনিময়ে অনেক বেশি সওয়াব দান করেন। ফলে তাদের সওয়াবের পরিমান গোনাহের থেকে বেশি হয়ে যায়। সুতরাং সেসব গুনাহও আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা হয়ে যায়। (২) তাক্বওয়াবান ব্যক্তিদের তওবা ও ইস্তেগফার সহ কিছু বিশেষ আমলের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
২. ক্বিয়ামতের দিন মর্যাদার শীর্ষস্থান লাভ করা যাবে :
কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত মানুষ একত্রিত হবে, তখন মুত্তাক্বীদেরকেই সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿زُيِّنَ لِلَّذِيْنَ كَفَرُوا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَيَسْخَرُوْنَ مِنَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَالَّذِيْنَ اتَّقَوْا فَوْقَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ﴾
যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিকট পার্থিব জীবন সুশোভিত। তারা মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে থাকে; অথচ যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে কিয়ামতের দিন তারা তাদের ঊর্ধ্বে থাকবে। (সূরা বাকারা- ২১২)
শীর্ষস্থান লাভের দুটি দিক হতে পারে- (১) দুনিয়াতে কাফিরদের যে অবস্থা ছিল, পরকালে মুমিনদের অবস্থা হবে তার শীর্ষে। (২) মুমিনরা পরকালে থাকবে (জান্নাতের) প্রকোষ্ঠে এবং কাফিররা থাকবে জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে।
৩. পুলসিরাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে :
পুলসিরাত হচ্ছে জাহান্নামের উপর অবস্থিত একটি বিশেষ রাস্তা বা পুল, যা সকলকেই অতিক্রম করতে হবে। এটি অতিক্রম করতে না পারলে জাহান্নামে পতিত হতে হবে। একমাত্র মুত্তাক্বী বান্দা ছাড়া এটিকে কেউ সুষ্ঠুভাবে অতিক্রম করতে পারবে না। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاِنْ مِّنْكُمْ اِلَّا وَارِدُهَاۚ كَانَ عَلٰى رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا ‐ ثُمَّ نُنَجِّى الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا﴾
তোমাদের প্রত্যেকেই সেটা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাক্বীদেরকে উদ্ধার করব এবং যালিমদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দেব। (সূরা মারইয়াম- ৭১, ৭২)
৪. জান্নাত লাভ করা যাবে :
তাক্বওয়া অর্জনের চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে জান্নাত লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা পরকালে মুত্তাক্বী বান্দাদেরকে তা দান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِيْ نُوْرِثُ مِنْ عِبَادِنَا مَنْ كَانَ تَقِيًّا﴾
এই সেই জান্নাত, যার অধিকারী করব আমার বান্দাদের মধ্যে মুত্তাক্বীদেরকে। (সূরা মারইয়াম- ৬৩)
﴿وَسَارِعُوْاۤ اِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوَاتُ وَالْاَرْضُ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ধাবিত হও, যার প্রসারতা ও বিস্তৃতি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সদৃশ। আর তা মুত্তাক্বীদের জন্যই নির্মিত হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান- ১৩৩)
﴿إِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ﴾
অবশ্যই মুত্তাক্বীদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে ভোগবিলাসপূর্ণ জান্নাত। (সূরা কালাম- ৩৪)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَسِيْقَ الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتّٰۤى اِذَا جَآءُوْهَا وَفُتِحَتْ اَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوْهَا خَالِدِيْنَ﴾
যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং এর দরজা খুলে দেয়া হবে, তখন তার রক্ষণাবেক্ষণকারী ফেরেশতারা বলবে, হে জান্নাতীরা! তোমাদের প্রতি সালাম। তোমাদের আগমন শুভ হোক। তোমরা চিরস্থায়ীভাবে জান্নাতে প্রবেশ করো। (সূরা যুমার- ৭৩)
হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, এটা হচ্ছে সৌভাগ্যবান মুমিনদের সম্পর্কে সংবাদ, যখন তারা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার স্তরের দিকে অগ্রসর হবে। অর্থাৎ দলবদ্ধভাবে জান্নাতের দিকে অগ্রসর হবে। দলে দলে বলতে নৈকট্যশীলদের দল, অতঃপর পুণ্যবানদের দল, অতঃপর তাদের নিকটতর সকল দল। অর্থাৎ নবীগণের সাথে নবীগণ সত্যপরায়ণদের সাথে তাদের সমগোত্রীয়গণ, শহীদদের সাথে তাদের সমপর্যায়ের লোক, ওলামায়ে কেরামের সাথে তাদের নিকটবর্তীগণ, অনুরূপভাবে প্রত্যেক দলের সাথে তাদের সমপর্যায়ভুক্ত দলবদ্ধ হয়ে। [তাফসীর ইবনে কাসীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১১৯, সূরা যুমার ৭৩নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।]
৫. তারা জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তর ও সর্বোত্তম নিয়ামত লাভ করবে :
মুত্তাক্বী বান্দাগণ কেবল জান্নাত পেয়ে ক্ষান্ত হবে না; বরং তারা তাক্বওয়ার ভিত্তিতে জান্নাতের বিভিন্ন স্তরে এমনকি শীর্ষস্থান পর্যন্তও আরোহণ করবে। অতঃপর তারা সেখানে সর্বোত্তম নিয়ামত লাভ করবে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿اِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ مَفَازًا ﴾
নিশ্চয় মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে অনেক পুরস্কার। (সূরা নাবা- ৩১)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَإِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ لَحُسْنَ مَاٰبٍ﴾
মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে উত্তম আবাস। (সূরা সোয়াদ- ৪৯)
﴿جَنَّاتِ عَدْنٍ مُّفَتَّحَةً لَّهُمُ الْأَبْوَابُ ‐ مُتَّكِئِيْنَ فِيْهَا يَدْعُوْنَ فِيْهَا بِفَاكِهَةٍ كَثِيْرَةٍ وَّشَرَابٍ ‐ وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ أَتْرَابٌ ‐ هٰذَا مَا تُوْعَدُوْنَ لِيَوْمِ الْحِسَابِ ‐ إِنَّ هٰذَا لَرِزْقُنَا مَا لَهٗ مِنْ نَّفَادٍ﴾
চিরস্থায়ী জান্নাত, তাদের জন্য উন্মুক্ত যার দ্বার। সেথায় তারা আসীন হবে হেলান দিয়ে, সেথায় তারা বহুবিধ ফলমূল ও পানীয়ের জন্য আদেশ দিবে এবং তাদের পার্শ্বে থাকবে আনতনয়না সমবয়স্কা তরুণীগণ। এটাই হিসাব দিবসের জন্য তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি। এটাই আমার দেয়া রিযিক, যা নিঃশেষ হবে না। (সূরা সোয়াদ: ৫০-৫৪)
﴿وَزُخْرُفًاؕ وَاِنْ كُلُّ ذٰلِكَ لَمَّا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَاؕ وَالْاٰخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
কিন্তু এগুলো তো শুধু পার্থিব জীবনের ভোগ সম্ভার। আর মুত্তাক্বীদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে আখিরাত (এর কল্যাণ)। (সূরা যুখরুফ- ৩৫)
﴿تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِى الْاَرْضِ وَلَا فَسَادًاؕ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ﴾
এটা আখিরাতের আবাস যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্য, যারা এ পৃথিবীতে উগ্রতা প্রকাশ করে না এবং বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য। (সূরা ক্বাসাস- ৮৩)
৬. তারা দু‘টি জান্নাত লাভ করবে :
﴿وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ جَنَّتَانِ – فَبِاَيِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ﴾
আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে, তার জন্য রয়েছে দু’টি জান্নাত। অতএব হে জিন ও মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামত অস্বীকার করবে? (সূরা আর রহমান- ৪৬, ৪৭)
এ দুটি জান্নাতের বর্ণনায় হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ قَيْسٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ رَسُولَ اللّٰهِ قَالَ جَنَّتَانِ مِنْ فِضَّةٍ اٰنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا وَجَنَّتَانِ مِنْ ذَهَبٍ اٰنِيَتُهُمَا وَمَا فِيهِمَا وَمَا بَيْنَ الْقَوْمِ وَبَيْنَ أَنْ يَنْظُرُوا إِلٰى رَبِّهِمْ إِلَّا رِدَاءُ الْكِبْرِ عَلٰى وَجْهِه فِي جَنَّةِ عَدْنٍ
দুটি জান্নাত এবং তার পাত্রসমূহ ও অন্যান্য সবকিছু হবে রুপার তৈরি। আরো দুটি জান্নাত এবং তার পাত্রসমূহ ও অন্যান্য সবকিছুই হবে স্বর্ণের তৈরি। আদন নামক জান্নাতে জান্নাতবাসীগণ ও তাদের বরকতময় মহান প্রভুর দীদার লাভের মাঝখানে তাঁর চেহারার উপর তাঁর গৌরবের চাদর ব্যতীত আর কোন প্রতিবন্ধক থাকবে না। [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৭৮, ৭৪৪৪; সহীহ মুসলিম, হা/৪৬৬; ইবনে মাজাহ, হা/১৮৬।]
৭. কিয়ামতের দিন মুত্তাক্বী বান্দাদের বন্ধুত্ব লাভ করা যাবে :
কিয়ামতের দিন যখন নিজেদের আমলনামা নিয়ে সকল মানুষ দিশেহারা হয়ে যাবে, তখন প্রত্যেকেই একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, তখন কেবলমাত্র মুত্তাক্বী বান্দাগণ একে অপরের বন্ধুত্ব লাভ করবে। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿اَلْاَخِلَّآءُ يَوْمَئِذٍ ۢبَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ اِلَّا الْمُتَّقِيْنَ﴾
সেদিন বন্ধুরা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে, তবে মুত্তাক্বীরা ব্যতীত।
(সূরা যুখরুফ- ৬৭)
﴿إِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنَّاتٍ وَّعُيُوْنٍ ‐ اُدْخُلُوْهَا بِسَلَامٍ اٰمِنِيْنَ ‐ وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُوْرِهِمْ مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلٰى سُرُرٍ مُّتَقَابِلِيْنَ﴾
মুত্তাক্বীরা থাকবে প্রস্রবণ-বহুল জান্নাতে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাতে প্রবেশ করো। আমি তাদের অন্তর থেকে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে দেব। তারা পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করবে। তারা উঁচু উঁচু আসনে হেলান দিয়ে বসবে। (সূরা হিজর: ৪৫-৪৭)
তাক্বওয়া অর্জন করলে যেমনিভাবে অসংখ্য কল্যাণ ও পুরস্কার লাভ করা যায়, অনুরূপভাবে তাক্বওয়া অর্জন না করলে এর বিপরীত পরিণতি চেপে বসে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. মুত্তাক্বীদের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হতে হয় :
তাক্বওয়া অর্জন না করলে কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে তাদের জন্য যেসব পুরস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে, তা হতে বঞ্চিত হতে হয়। কেননা তারা সেসব পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত নয়।
২. জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যায় :
তাক্বওয়া অর্জন না করার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে পরকালীন জীবনে জাহান্নামের উপযুক্ত হওয়া। কেননা জান্নাতে যাওয়ার জন্য যেসব আমল করা আবশ্যক, সেগুলো কেবল মুত্তাক্বী বান্দাদের দ্বারাই সম্ভব। তাছাড়া তাক্বওয়াবিহীন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়।
৩. সমাজব্যবস্থার চরম অবনতি ঘটে :
একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থার জন্য উক্ত সমাজের লোকদের তাক্বওয়া অর্জন করা খুবই জরুরি। কেননা এর অনুপস্থিতিতে সামাজিক অবক্ষয়মূলক কর্মকান্ড দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। ফলে সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
৪. রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে :
রাষ্ট্র হচ্ছে কতগুলো সমাজের সামষ্টিক শক্তি। এটিকে শক্তিশালী করতে পারলে প্রতিটি সমাজেরই অশেষ কল্যাণ লাভ হয়। আর এর সার্বিক কল্যাণ লাভ হয় রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বরত লোকদের সততা ও একনিষ্ঠতার মাধ্যমে। কিন্তু তাক্বওয়াবান ব্যক্তি ব্যতীত এ গুণগুলো পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় এর বিপরীত ফলাফল সংঘটিত হয়। যেমন- রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, অনৈতিক রীতিনীতি নির্ধারণ, বিশৃঙ্খল বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি।
৫. অর্থনৈতিক বিপর্যয় সংঘটিত হয় :
তাক্বওয়ার অনুপস্থিতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা একজন তাক্বওয়াবান ব্যক্তি এবং একজন তাক্বওয়াহীন ব্যক্তির লেনদেন এক নয়। তাক্বওয়াহীন ব্যক্তির পক্ষে বৈধ-অবৈধ যে কোন প্রকার লেনদেন করা সম্ভব; কিন্তু একজন তাক্বওয়াবান ব্যক্তির পক্ষে তা সম্ভব নয়। বরং তাক্বওয়াবান ব্যক্তি লেনদেনের ক্ষেত্রে কেবল ঐ সব রীতিনীতিই অবলম্বন করবে, যা ইসলাম তাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত অর্থনীতিই সবচেয়ে কল্যাণময়।
১. মুত্তাক্বীদের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হতে হয় :
তাক্বওয়া অর্জন না করলে কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহে তাদের জন্য যেসব পুরস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে, তা হতে বঞ্চিত হতে হয়। কেননা তারা সেসব পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত নয়।
২. জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে যায় :
তাক্বওয়া অর্জন না করার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে পরকালীন জীবনে জাহান্নামের উপযুক্ত হওয়া। কেননা জান্নাতে যাওয়ার জন্য যেসব আমল করা আবশ্যক, সেগুলো কেবল মুত্তাক্বী বান্দাদের দ্বারাই সম্ভব। তাছাড়া তাক্বওয়াবিহীন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়।
৩. সমাজব্যবস্থার চরম অবনতি ঘটে :
একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থার জন্য উক্ত সমাজের লোকদের তাক্বওয়া অর্জন করা খুবই জরুরি। কেননা এর অনুপস্থিতিতে সামাজিক অবক্ষয়মূলক কর্মকান্ড দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। ফলে সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
৪. রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে :
রাষ্ট্র হচ্ছে কতগুলো সমাজের সামষ্টিক শক্তি। এটিকে শক্তিশালী করতে পারলে প্রতিটি সমাজেরই অশেষ কল্যাণ লাভ হয়। আর এর সার্বিক কল্যাণ লাভ হয় রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বরত লোকদের সততা ও একনিষ্ঠতার মাধ্যমে। কিন্তু তাক্বওয়াবান ব্যক্তি ব্যতীত এ গুণগুলো পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় এর বিপরীত ফলাফল সংঘটিত হয়। যেমন- রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, অনৈতিক রীতিনীতি নির্ধারণ, বিশৃঙ্খল বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি।
৫. অর্থনৈতিক বিপর্যয় সংঘটিত হয় :
তাক্বওয়ার অনুপস্থিতিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা একজন তাক্বওয়াবান ব্যক্তি এবং একজন তাক্বওয়াহীন ব্যক্তির লেনদেন এক নয়। তাক্বওয়াহীন ব্যক্তির পক্ষে বৈধ-অবৈধ যে কোন প্রকার লেনদেন করা সম্ভব; কিন্তু একজন তাক্বওয়াবান ব্যক্তির পক্ষে তা সম্ভব নয়। বরং তাক্বওয়াবান ব্যক্তি লেনদেনের ক্ষেত্রে কেবল ঐ সব রীতিনীতিই অবলম্বন করবে, যা ইসলাম তাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত অর্থনীতিই সবচেয়ে কল্যাণময়।
তাক্বওয়ার স্তর সম্পর্কে আলেমগণ ভিন্ন ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন-
আল্লামা নু‘মান ইবনে মুহাম্মাদ আল-আলূসী ‘তুহফাতুল ইখওয়ান’ গ্রন্থে বলেন, তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন ও তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়কে পরিহার করা। এর তিনটি স্তর রয়েছে। যথা-
১. শিরক থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহর চিরস্থায়ী আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوٰى﴾
তাদেরকে তাক্বওয়ার নীতি মেনে চলতে বাধ্য করলেন। (সূরা ফাতহ- ২৬)
২. এমন সব কাজ ত্যাগ করা, যা পাপে নিপতিত করে কিংবা ছগীরা (ছোট) গোনাহ পরিত্যাগ করা। পারিভাষিক অর্থে এটাই তাক্বওয়া হিসেবে জনগণের মাঝে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤى اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ﴾
যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম।
(সূরা আ‘রাফ- ৯৬)
এ মর্মে ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) বলেন,
اَلتَّقْوٰى تَرْكُ مَا حَرَّمَ اللهُ وَأَدَاءُ مَا افْتَرَضَ اللهُ ، فَمَا رَزَقَ اللهُ بَعْدَ ذٰلِكَ فَهُوَ خَيْرٌ اِلٰى خَيْر
তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা ত্যাগ করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপর যা তিনি দান করেন তা ভালোর চেয়ে ভালো।
৩. আল্লাহর সন্তোষপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখে এমন বিষয় থেকে মুক্ত থাকা। এটাই উদ্দিষ্ট প্রকৃত তাক্বওয়া। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)
আলেমগণের নিকট তাক্বওয়ার আরো তিনটি স্তর রয়েছে। যথা-
১. শিরক থেকে বেঁচে থাকা :
আল্লাহর একত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে সকল প্রকার শিরক থেকে বিরত থাকা। শিরক অতি বড় গোনাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ﴾
নিশ্চয় শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুলুম। (সূরা লুক্বমান- ১৩)
শিরকের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿اِنَّهٗ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَاْوَاهُ النَّارُؕ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ﴾
যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (ফলে) তার আবাস হবে জাহান্নাম। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা- ৭২)
২. বিদআত থেকে বেঁচে থাকা :
আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় বা সওয়াবের আশায় ইসলামে এমন কোন কাজ করা, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না এবং যে ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কোন অনুমোদন বা সমর্থন নেই, সেটা হচ্ছে বিদআত।
বিদআতের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে হাদীসে সবিস্তার বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, বিদআতীর আমল কবুল হয় না। যেমন- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هٰذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এই দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। [সহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭]
৩. ছোট গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা :
গোনাহ ছোট হোক বা বড় হোক তা থেকে বেঁচে থাকা মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,
﴿لَيْسَ عَلَى الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيْمَا طَعِمُوْاۤ اِذَا مَا اتَّقَوْا وَّاٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَّاٰمَنُوْا ثُمَّ اتَّقَوْا وَّاَحْسَنُوْاؕ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারা পূর্বে যা খেয়েছে তার জন্য তাদের কোন গোনাহ নেই। যদি তারা সাবধান হয় এবং ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, পুনরায় সাবধান হয় ও বিশ্বাস স্থাপন করে, পুনরায় সাবধান হয় ও সৎকর্ম করে; তবে তো আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।
(সূরা মায়েদা- ৯৩)
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَآئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُّدْخَلًا كَرِيْمًا﴾
যদি তোমরা কবীরা গোনাহসমূহ থেকে দূরে থাক, যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তবে আমি তোমাদের সগীরা গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব। (সূরা নিসা- ৩১)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالًا هِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ إِنْ كُنَّا لَنَعُدُّهَا عَلٰى عَهْدِ النَّبِيِّ مِنَ الْمُوبِقَاتِ
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমরা এমন আমল করে থাক, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে আমরা সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৯২; মিশকাত, হা/৫৩৫৫]
হাসান বসরী (রহ.) বলেন, মুত্তাক্বীর তাক্বওয়া ততক্ষণ থাকে, যতক্ষণ হারামে পতিত হওয়ার আশংকায় বহু হালাল বিষয় ত্যাগ করে। মূসা ইবনে আ‘য়ূনও অনুরূপ বলেছেন। সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেন, মুত্তাক্বী নামকরণ করার কারণ হচ্ছে সে ঐসব বিষয় ছেড়ে দেয়, যা তাক্বওয়া বিরোধী। [ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ২৬; ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ৯।]
আল্লামা নু‘মান ইবনে মুহাম্মাদ আল-আলূসী ‘তুহফাতুল ইখওয়ান’ গ্রন্থে বলেন, তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন ও তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়কে পরিহার করা। এর তিনটি স্তর রয়েছে। যথা-
১. শিরক থেকে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আল্লাহর চিরস্থায়ী আযাব থেকে পরিত্রাণ লাভ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَاَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ التَّقْوٰى﴾
তাদেরকে তাক্বওয়ার নীতি মেনে চলতে বাধ্য করলেন। (সূরা ফাতহ- ২৬)
২. এমন সব কাজ ত্যাগ করা, যা পাপে নিপতিত করে কিংবা ছগীরা (ছোট) গোনাহ পরিত্যাগ করা। পারিভাষিক অর্থে এটাই তাক্বওয়া হিসেবে জনগণের মাঝে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَوْ اَنَّ اَهْلَ الْقُرٰۤى اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ﴾
যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাক্বওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম।
(সূরা আ‘রাফ- ৯৬)
এ মর্মে ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) বলেন,
اَلتَّقْوٰى تَرْكُ مَا حَرَّمَ اللهُ وَأَدَاءُ مَا افْتَرَضَ اللهُ ، فَمَا رَزَقَ اللهُ بَعْدَ ذٰلِكَ فَهُوَ خَيْرٌ اِلٰى خَيْر
তাক্বওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা ত্যাগ করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপর যা তিনি দান করেন তা ভালোর চেয়ে ভালো।
৩. আল্লাহর সন্তোষপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখে এমন বিষয় থেকে মুক্ত থাকা। এটাই উদ্দিষ্ট প্রকৃত তাক্বওয়া। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِه وَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান- ১০২)
আলেমগণের নিকট তাক্বওয়ার আরো তিনটি স্তর রয়েছে। যথা-
১. শিরক থেকে বেঁচে থাকা :
আল্লাহর একত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করে সকল প্রকার শিরক থেকে বিরত থাকা। শিরক অতি বড় গোনাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ﴾
নিশ্চয় শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুলুম। (সূরা লুক্বমান- ১৩)
শিরকের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿اِنَّهٗ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَاْوَاهُ النَّارُؕ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ اَنْصَارٍ﴾
যে আল্লাহর সাথে শরীক করে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। (ফলে) তার আবাস হবে জাহান্নাম। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা- ৭২)
২. বিদআত থেকে বেঁচে থাকা :
আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় বা সওয়াবের আশায় ইসলামে এমন কোন কাজ করা, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল না এবং যে ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কোন অনুমোদন বা সমর্থন নেই, সেটা হচ্ছে বিদআত।
বিদআতের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে হাদীসে সবিস্তার বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, বিদআতীর আমল কবুল হয় না। যেমন- রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هٰذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এই দ্বীনে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। [সহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭]
৩. ছোট গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা :
গোনাহ ছোট হোক বা বড় হোক তা থেকে বেঁচে থাকা মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহ বলেন,
﴿لَيْسَ عَلَى الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيْمَا طَعِمُوْاۤ اِذَا مَا اتَّقَوْا وَّاٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَّاٰمَنُوْا ثُمَّ اتَّقَوْا وَّاَحْسَنُوْاؕ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ﴾
যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারা পূর্বে যা খেয়েছে তার জন্য তাদের কোন গোনাহ নেই। যদি তারা সাবধান হয় এবং ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, পুনরায় সাবধান হয় ও বিশ্বাস স্থাপন করে, পুনরায় সাবধান হয় ও সৎকর্ম করে; তবে তো আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।
(সূরা মায়েদা- ৯৩)
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَآئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُّدْخَلًا كَرِيْمًا﴾
যদি তোমরা কবীরা গোনাহসমূহ থেকে দূরে থাক, যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তবে আমি তোমাদের সগীরা গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব। (সূরা নিসা- ৩১)
হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالًا هِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ إِنْ كُنَّا لَنَعُدُّهَا عَلٰى عَهْدِ النَّبِيِّ مِنَ الْمُوبِقَاتِ
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমরা এমন আমল করে থাক, যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে আমরা সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম। [সহীহ বুখারী, হা/৬৪৯২; মিশকাত, হা/৫৩৫৫]
হাসান বসরী (রহ.) বলেন, মুত্তাক্বীর তাক্বওয়া ততক্ষণ থাকে, যতক্ষণ হারামে পতিত হওয়ার আশংকায় বহু হালাল বিষয় ত্যাগ করে। মূসা ইবনে আ‘য়ূনও অনুরূপ বলেছেন। সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেন, মুত্তাক্বী নামকরণ করার কারণ হচ্ছে সে ঐসব বিষয় ছেড়ে দেয়, যা তাক্বওয়া বিরোধী। [ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ২৬; ড. আহমাদ ফরীদ, আত-তাক্বওয়া, পৃঃ ৯।]
তাক্বওয়া অন্তরের বিষয়, এটি কোন দৃশ্যমান বস্তু নয়। একদা এক বক্তব্য প্রদানকালে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
اَلتَّقْوٰى هٰاهُنَا وَأَشَارَ بِيَدِه إِلٰى صَدْرِه ثَلَاثَ مَرَّاتٍ
তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি এখানে থাকে। এ কথা বলে তিনি নিজ হাত দ্বারা তিনবার নিজের বক্ষের দিকে ইশারা করলেন। [সহীহ মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৭৪২।]
অত্র হাদীসে বক্ষের দিকে বলতে অন্তরের দিকে বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া এর সমর্থনে অন্যান্য অনেক হাদীসও রয়েছে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللّٰهِ - - يَقُولُ ...... أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ
নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, মনে রেখো! নিশ্চয় মানুষের দেহে একটি গোশত পিন্ড রয়েছে, যা ঠিক থাকলে সমগ্র দেহই ঠিক থাকে। আর তার বিকৃতি ঘটলে সমস্ত দেহেরই বিকৃতি ঘটে। আর সেটি হলো অন্তর। [সহীহ বুখারী, হা/৪১৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৯; মিশকাত, হা/২৬৪২।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قِيْلَ لِرَسُوْلِ اللهِ أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلٌ قَالَ كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ صَدُوْقُ اللِّسَانِ . قَالُوا صَدُوْقُ اللِّسَانِ نَعْرِفُهٗ . فَمَا مَخْمُوْمُ الْقَلْبِ ؟ قَالَ هُوَ التَّقِيُّ النَّقِيْثُ . لَا إِثْمَ فِيْهِ وَلَا بَغْيَ وَلَا غِلَّ وَلَا حَسَدَ
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলা হলো, সবচেয়ে উত্তম মানুষ কে? তিনি বললেন, প্রত্যেক মাখমূমুল ক্বালব এবং ছদূকুল লিসান। সাহাবীগণ বললেন, আমরা জিহবার সত্যবাদিতা বুঝি, কিন্তু মাখমূমুল ক্বালব কী? নবী করীম ﷺ বললেন, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে পরহেযগার এবং নিষ্কলুষ। যার মধ্যে (১) পাপ নেই, (২) সীমালংঘন নেই (৩) খিয়ানত নেই (৪) হিংসা নেই। [সুনানে ইবনে মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত, হা/৫২২১।]
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ - - إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلٰى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلٰكِنْ يَنْظُرُ إِلٰى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বাহ্যিক আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি লক্ষ্য করেন। [সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৯৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪।]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, তাক্বওয়ার স্থান হচ্ছে অন্তর, যা দৃশ্যমান নয়। তবে মানুষের আচার-আচরণ ও কাজকর্মে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর মাধ্যমেই একজন ব্যক্তিকে মুমিন, কাফির অথবা মুনাফিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কেননা মানুষের আমলসমূহ কবুল করার জন্য আল্লাহর কাছে তাক্বওয়া যেমন জরুরি, তদ্রূপ সে অনুযায়ী আমল করাটাও অতি জরুরি। কেননা আমল ছাড়া তথা আল্লাহর আদেশসমূহ পালন না করে এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার না করে আল্লাহকে ভয় করার মৌখিক দাবিটা একটি মিথ্যা দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন লোককে প্রকৃত মুমিন অথবা প্রকৃত মুত্তাক্বী কোনটিই বলা যায় না। কোন কোন সময় সে মুসলিমও থাকে না।
اَلتَّقْوٰى هٰاهُنَا وَأَشَارَ بِيَدِه إِلٰى صَدْرِه ثَلَاثَ مَرَّاتٍ
তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি এখানে থাকে। এ কথা বলে তিনি নিজ হাত দ্বারা তিনবার নিজের বক্ষের দিকে ইশারা করলেন। [সহীহ মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৭৪২।]
অত্র হাদীসে বক্ষের দিকে বলতে অন্তরের দিকে বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া এর সমর্থনে অন্যান্য অনেক হাদীসও রয়েছে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللّٰهِ - - يَقُولُ ...... أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهٗ أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ
নু‘মান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি যে, মনে রেখো! নিশ্চয় মানুষের দেহে একটি গোশত পিন্ড রয়েছে, যা ঠিক থাকলে সমগ্র দেহই ঠিক থাকে। আর তার বিকৃতি ঘটলে সমস্ত দেহেরই বিকৃতি ঘটে। আর সেটি হলো অন্তর। [সহীহ বুখারী, হা/৪১৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৯; মিশকাত, হা/২৬৪২।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قِيْلَ لِرَسُوْلِ اللهِ أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلٌ قَالَ كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ صَدُوْقُ اللِّسَانِ . قَالُوا صَدُوْقُ اللِّسَانِ نَعْرِفُهٗ . فَمَا مَخْمُوْمُ الْقَلْبِ ؟ قَالَ هُوَ التَّقِيُّ النَّقِيْثُ . لَا إِثْمَ فِيْهِ وَلَا بَغْيَ وَلَا غِلَّ وَلَا حَسَدَ
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলা হলো, সবচেয়ে উত্তম মানুষ কে? তিনি বললেন, প্রত্যেক মাখমূমুল ক্বালব এবং ছদূকুল লিসান। সাহাবীগণ বললেন, আমরা জিহবার সত্যবাদিতা বুঝি, কিন্তু মাখমূমুল ক্বালব কী? নবী করীম ﷺ বললেন, সে হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে পরহেযগার এবং নিষ্কলুষ। যার মধ্যে (১) পাপ নেই, (২) সীমালংঘন নেই (৩) খিয়ানত নেই (৪) হিংসা নেই। [সুনানে ইবনে মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত, হা/৫২২১।]
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ - - إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلٰى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلٰكِنْ يَنْظُرُ إِلٰى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বাহ্যিক আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি লক্ষ্য করেন। [সহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৯৪; মিশকাত, হা/৫৩১৪।]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, তাক্বওয়ার স্থান হচ্ছে অন্তর, যা দৃশ্যমান নয়। তবে মানুষের আচার-আচরণ ও কাজকর্মে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এর মাধ্যমেই একজন ব্যক্তিকে মুমিন, কাফির অথবা মুনাফিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কেননা মানুষের আমলসমূহ কবুল করার জন্য আল্লাহর কাছে তাক্বওয়া যেমন জরুরি, তদ্রূপ সে অনুযায়ী আমল করাটাও অতি জরুরি। কেননা আমল ছাড়া তথা আল্লাহর আদেশসমূহ পালন না করে এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় পরিহার না করে আল্লাহকে ভয় করার মৌখিক দাবিটা একটি মিথ্যা দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন লোককে প্রকৃত মুমিন অথবা প্রকৃত মুত্তাক্বী কোনটিই বলা যায় না। কোন কোন সময় সে মুসলিমও থাকে না।
প্রতিটি মুমিন ও মুত্তাক্বী ব্যক্তির জন্য আল্লাহকে সর্বক্ষেত্রে ভয় করাটা অত্যন্ত জরুরি। কেননা এটাই হচ্ছে প্রকৃত তাক্বওয়ার পরিচায়ক। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ - - قَالَ : قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ - - اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানে থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে বা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কোন কারণবশত পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে। তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দেবে। [তিরমিযী, হা/১৯৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৪; সুনানে দারেমী, হা/২৮৪৭; মিশকাত, হা/৫০৮৩।]
অতএব তাক্বওয়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রসমূহ অত্যন্ত ব্যাপক। নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সহকারে তাক্বওয়া প্রদর্শনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. প্রকাশ্য ও গোপনে :
যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করতে হয়, তার প্রতিটিই প্রকাশ্য ও গোপন এ দুটি ভাগে সীমাবদ্ধ। তবে উভয় ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ - - قَالَ لَهٗ أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فِي سِرِّ أَمْرِكَ وَعَلَانِيَّتِه وَإِذَا أَسَأْتَ فَأَحْسِنْ وَلَا تَسْألَنَّ أَحَدًا شَيْئًا وَإِنْ سَقَطَ سَوْطُكَ وَلَا تَقْبِضْ أَمَانَةً
আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বলেছেন, আমি তোমাকে গোপন ও প্রকাশ্য কাজে আল্লাহকে ভয় করার অসিয়ত করছি। (আরো অসিয়ত করছি যে) যখন তুমি কোন পাপ কাজ করে ফেলবে, তখন সাথে সাথেই ভাল কাজ করে নেবে। আর তুমি কারো কাছে কোন কিছু চাইবে না; এমনকি (উটের পিঠে আরোহণরত অবস্থায়) তোমার চাবুক পড়ে গেলেও (উঠিয়ে দিতে বলবে না), আমানতের খেয়ানত করবে না। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৬১৩; সহীহুল জামে‘ হা/২৫৪৪; কানযুল উম্মাল, হা/৪৩৫০৩; মিশকাত, হা/৩৭১৩; ।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَوْصِنِيْ قَالَ عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ مَا اسْتَطَعْتَ وَاذْكُرِ اللهَ عِنْدَ كُلِّ حَجَرٍ وَشَجَرٍ وَمَا عَمِلَتَ مِنْ سُوءٍ فَأَحْدِثْ لَهٗ تَوْبَةَ السِّرِّ بِالسِّر وَالْعَلَانِيَّةِ بِالْعَلَانِيَّةِ
মু‘আয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। নবী করীম ﷺ বললেন, তোমার জন্য যথাসম্ভব তাক্বওয়া অবলম্বন করা জরুরি। আল্লাহকে স্মরণ করো প্রত্যেক পাথর ও গাছের নিকটে। আর কোন পাপ কাজ করলে তার জন্য তওবা করো। পাপ প্রকাশ্যে হলে তওবা প্রকাশ্যে করো; পাপ গোপনে হলে তওবা গোপনে করো। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩১৪৪; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৩৩১।]
২. স্বীয় অবস্থান স্থলে ও সফরে :
আমরা যখন যে অবস্থাতেই থাকি না কেন- মুক্বীম অবস্থায় হোক অথবা মুসাফির অবস্থায় সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে এবং তাকে ভয় করতে হবে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ ! إِنِّيْ أُرِيْدُ أَنْ أُسَافِرَ فَأَوْصِنِيْ قَالَ : عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللّٰهِ تَعَالٰى وَالتَّكْبِيرِ عَلٰى كُلِّ شَرَفٍ فَلَمَّا ولَّى الرَّجُلُ قَالَ اَلّٰلهُمَّ اطْوِ لَهُ الْبَعِيْدَ وهَوِّنْ عَلَيْهِ السَّفَرَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সফরে যাওয়ার মনঃস্থ করেছি; অতএব আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বলেন, তুমি অবশ্যই আল্লাহভীতি (তাক্বওয়া) অবলম্বন করবে এবং প্রতিটি উচ্চ স্থানে আরোহণকালে তাকবীর ধ্বনি দিবে। তারপর লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হে আল্লাহ! তার পথের দূরত্ব সংকুচিত করে দাও এবং সফর তার জন্য সহজসাধ্য করে দাও। [তিরমিযী হা/৩৪৪৫; কানযুল উম্মাল, হা/৫৬৩৬; মিশকাত, হা/২৪৩৮।]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জীবনের প্রতিটি ধাপে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে হবে। কেননা তাক্বওয়াহীন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় নয়; অথচ আমাদের জীবনের প্রতিটি সৎকর্মই ইবাদাত এবং প্রতিটি অসৎকর্মই কোন না কোন গোনাহের কারণ। অতএব জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে মুত্তাক্বী হওয়ার তাওফীক দান করুন।
عَنْ أَبِي ذَرٍّ الْغِفَارِيِّ - - قَالَ : قَالَ لِي رَسُولُ اللّٰهِ - - اِتَّقِ اللهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বলেছেন, তুমি যেখানে থাকবে আল্লাহকে ভয় করবে বা তাক্বওয়া অবলম্বন করবে। কোন কারণবশত পাপ কাজ হয়ে গেলে তারপর ভালো কাজ করবে। তা তোমার পাপকে মিটিয়ে দেবে। [তিরমিযী, হা/১৯৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৫৪; সুনানে দারেমী, হা/২৮৪৭; মিশকাত, হা/৫০৮৩।]
অতএব তাক্বওয়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রসমূহ অত্যন্ত ব্যাপক। নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সহকারে তাক্বওয়া প্রদর্শনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. প্রকাশ্য ও গোপনে :
যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করতে হয়, তার প্রতিটিই প্রকাশ্য ও গোপন এ দুটি ভাগে সীমাবদ্ধ। তবে উভয় ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দেয়া অতীব জরুরি। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ ذَرٍّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ - - قَالَ لَهٗ أُوصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ فِي سِرِّ أَمْرِكَ وَعَلَانِيَّتِه وَإِذَا أَسَأْتَ فَأَحْسِنْ وَلَا تَسْألَنَّ أَحَدًا شَيْئًا وَإِنْ سَقَطَ سَوْطُكَ وَلَا تَقْبِضْ أَمَانَةً
আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বলেছেন, আমি তোমাকে গোপন ও প্রকাশ্য কাজে আল্লাহকে ভয় করার অসিয়ত করছি। (আরো অসিয়ত করছি যে) যখন তুমি কোন পাপ কাজ করে ফেলবে, তখন সাথে সাথেই ভাল কাজ করে নেবে। আর তুমি কারো কাছে কোন কিছু চাইবে না; এমনকি (উটের পিঠে আরোহণরত অবস্থায়) তোমার চাবুক পড়ে গেলেও (উঠিয়ে দিতে বলবে না), আমানতের খেয়ানত করবে না। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৬১৩; সহীহুল জামে‘ হা/২৫৪৪; কানযুল উম্মাল, হা/৪৩৫০৩; মিশকাত, হা/৩৭১৩; ।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَوْصِنِيْ قَالَ عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللهِ مَا اسْتَطَعْتَ وَاذْكُرِ اللهَ عِنْدَ كُلِّ حَجَرٍ وَشَجَرٍ وَمَا عَمِلَتَ مِنْ سُوءٍ فَأَحْدِثْ لَهٗ تَوْبَةَ السِّرِّ بِالسِّر وَالْعَلَانِيَّةِ بِالْعَلَانِيَّةِ
মু‘আয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। নবী করীম ﷺ বললেন, তোমার জন্য যথাসম্ভব তাক্বওয়া অবলম্বন করা জরুরি। আল্লাহকে স্মরণ করো প্রত্যেক পাথর ও গাছের নিকটে। আর কোন পাপ কাজ করলে তার জন্য তওবা করো। পাপ প্রকাশ্যে হলে তওবা প্রকাশ্যে করো; পাপ গোপনে হলে তওবা গোপনে করো। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩১৪৪; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৩৩১।]
২. স্বীয় অবস্থান স্থলে ও সফরে :
আমরা যখন যে অবস্থাতেই থাকি না কেন- মুক্বীম অবস্থায় হোক অথবা মুসাফির অবস্থায় সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ রাখতে হবে এবং তাকে ভয় করতে হবে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللّٰهِ ! إِنِّيْ أُرِيْدُ أَنْ أُسَافِرَ فَأَوْصِنِيْ قَالَ : عَلَيْكَ بِتَقْوَى اللّٰهِ تَعَالٰى وَالتَّكْبِيرِ عَلٰى كُلِّ شَرَفٍ فَلَمَّا ولَّى الرَّجُلُ قَالَ اَلّٰلهُمَّ اطْوِ لَهُ الْبَعِيْدَ وهَوِّنْ عَلَيْهِ السَّفَرَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সফরে যাওয়ার মনঃস্থ করেছি; অতএব আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বলেন, তুমি অবশ্যই আল্লাহভীতি (তাক্বওয়া) অবলম্বন করবে এবং প্রতিটি উচ্চ স্থানে আরোহণকালে তাকবীর ধ্বনি দিবে। তারপর লোকটি যখন চলে যাচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হে আল্লাহ! তার পথের দূরত্ব সংকুচিত করে দাও এবং সফর তার জন্য সহজসাধ্য করে দাও। [তিরমিযী হা/৩৪৪৫; কানযুল উম্মাল, হা/৫৬৩৬; মিশকাত, হা/২৪৩৮।]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জীবনের প্রতিটি ধাপে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে হবে। কেননা তাক্বওয়াহীন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় নয়; অথচ আমাদের জীবনের প্রতিটি সৎকর্মই ইবাদাত এবং প্রতিটি অসৎকর্মই কোন না কোন গোনাহের কারণ। অতএব জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে মুত্তাক্বী হওয়ার তাওফীক দান করুন।
১. জ্ঞান অর্জন করা :
জ্ঞান মানুষের অমূল্য সম্পদ। এর মূল উৎস হলো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এটির ভিত্তিতেই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির আসনে অধিষ্ঠিত। অনুরূপভাবে তাক্বওয়াও হচ্ছে মানুষের জীবনের অন্য আরো একটি অমূল্য সম্পদ এবং উভয়টির সম্পর্ক খুবই গভীর। কেননা কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জন ছাড়া উক্ত বিষয়ে কারো প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় না। এজন্যই কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَآءُ﴾
নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে থাকে।
(সূরা ফাতির- ২৮)
এর স্বরূপ হচ্ছে এই যে, যখন কোন বান্দা জানতে পারবে যে, আল্লাহ কে? তিনি কোথায় থাকেন? তিনি কী করেন? তাঁর ক্ষমতা কতটুকু? তাঁর রাগ কেমন? পৃথিবীতে যেসব জাতির উপর তা প্রতিফলিত হয়েছিল, তাদের কীরূপ অবস্থা হয়েছিল? জান্নাত কী? জাহান্নাম কী? তাক্বওয়া কী জিনিস? এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এর উপকার কী এবং এর অনুপস্থিতির অপকারসমূহ কী কী......ইত্যাদি, তাহলেই উক্ত বান্দার মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এসব বিষয়ে কোন কিছু জানতেই পারবে না, তার পক্ষে আল্লাহকে ভয় করা কখনো সম্ভব নয়। বরং সে ভয় করবে ঐসব বিষয়কে, যেসব কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। আর শয়তান এ সুযোগটিই গ্রহণ করে থাকে, যাতে করে উক্ত বান্দা আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে তাকেই ভয় করে।
২. কুরআন নিয়ে গবেষণা করা :
কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য একটি মহাবিস্ময়কর গ্রন্থ। এতে সমন্বয় ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জগতের যাবতীয় বিষয়ের আলোচনা। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿تِلْكَ اٰيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيْمِ﴾
এগুলো বিজ্ঞানময় কিতাবের আয়াত। (সূরা লুক্বমান- ২)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَلَقَدْ جِئْنَاهُمْ بِكِتَابٍ فَصَّلْنَاهُ عَلٰى عِلْمٍ هُدًى وَّرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ﴾
অবশ্যই আমি তাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলাম এমন এক কিতাব, যা আমি পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম; আর তা ছিল মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমতস্বরূপ। (সূরা আ‘রাফ- ৫২)
অতএব কোন ব্যক্তি কুরআন নিয়ে যতবেশি গবেষণা করবে, সে ততবেশি জ্ঞানার্জন করতে পারবে।
৩. আল্লাহর ইবাদাতে মনোনিবেশ করা :
মানুষ সৃষ্টি করার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত করা। এ কাজে মনোনিবেশ করলে বান্দা অনেক দিক থেকেই উপকৃত হয়। বিশেষ করে এর মাধ্যমে বান্দার সবচেয়ে বড় সম্পদ তাক্বওয়া অর্জিত হয়। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত করো, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পার। (সূরা বাক্বারা- ২১)
৪. আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা :
তাক্বওয়া অর্জনের প্রধান দাবি হচ্ছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহ তথা আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা। তাছাড়া এটিও আল্লাহর ইবাদাতের অন্যতম একটি অংশ। এ কাজের মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের মধ্য হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের প্রিয় বান্দাদেরকে নির্বাচিত করে থাকেন। আর এ কাজেই আল্লাহ তা‘আলা অধিক সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। সুতরাং এ কাজে যতবেশি মনোনিবেশ করা যাবে, ততবেশি তাক্বওয়া অর্জন করা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَكُمْ فِى الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَّاۤ اُولِى الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
হে জ্ঞানবান লোকেরা! কিসাস (প্রতিশোধ) গ্রহণের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে। (এ পদ্ধতির মাধ্যমে) তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পারবে। (সূরা বাক্বারা- ১৭৯)
৫. রোযা রাখা :
রোযা হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জনের জন্য একটি প্রশিক্ষণমূলক ইবাদাত। বান্দা রমাযান মাস ছাড়াও অন্যান্য যে কোন মাসে যতবেশি রোযা রাখবে, সে ততবেশি তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল; যাতে করে তোমরা মুত্তাক্বী হতে পার। (সূরা বাক্বারা- ১৮৩)
অপরদিকে রোযা হচ্ছে মানুষের জন্য ঢাল স্বরূপ, যা তাকে পাপের পথ থেকে বিরত রাখে এবং সৎকর্মের দিকে ধাবিত করে। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়ার নিদর্শন। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ ... وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهٗ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهٗ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সিয়াম হচ্ছে (পাপ থেকে বেঁচে থাকার) ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো সিয়াম পালনের দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায় সে যেন বলে আমি একজন সিয়াম পালনকারী। [সহীহ বুখারী, হা/১৮০৫; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; মিশকাত, হা/১৯৫৯।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ اللهِ قَالَ الصِّيَامُ جُنَّةٌ وَحِصْنٌ حَصِيْنٌ مِنَ النَّارِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সিয়াম হচ্ছে ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার একটি স্থায়ী দুর্গ। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৮০।]
৬. সালাত কায়েম করা :
সালাত কায়েম করার সাথে তাক্বওয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কেননা তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরাই অধিক সালাত আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করে। তাছাড়া কুরআন মাজীদেও সালাত আদায় করার নির্দেশের সাথে সাথে তাক্বওয়া অর্জনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন-
﴿وَاَنْ اَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاتَّقُوْهُ وَهُوَ الَّذِيْۤ اِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ﴾
সালাত কায়েম করো এবং তাঁকে (আল্লাহকে) ভয় করো। তিনিই তো সেই সত্তা, যার নিকট তোমাদেরকে সমবেত করা হবে। (সূরা আন‘আম- ৭২)
৭. অর্থ বুঝে কুরআন পাঠ করা :
তাক্বওয়া অর্জনের অন্য একটি উপায় হচ্ছে, আল্লাহর বাণীসমূহ পাঠ করে সেগুলো যথাযথভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করা। কেননা অনুভূতি ও তাক্বওয়ার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে অন্তর। অনুভূতি ছাড়া তাক্বওয়া অর্জিত হয় না। আর আল্লাহর বাণীসমূহ পাঠ করে কিছু বুঝতে না পারলে অনুভূতি সৃষ্টি হয় না। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ﴾
এ কুরআন আরবি ভাষায় (অবতীর্ণ করা হয়েছে), এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই। (এর মাধ্যমে) তারা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা যুমার- ২৮)
৮. সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকা :
সত্যবাদীগণ হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। তাক্বওয়াবান ব্যক্তিগণ নিজেদের আল্লাহভীতির তাগিদেই সত্যবাদীতার গুণ অর্জন করে থাকেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে তাক্বওয়া অর্জন করার সাথে সাথে সত্যবাদী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।
(সূরা তাওবা- ১১৯)
৯. সঠিক পথের অনুসরণ করা :
সরল-সঠিক পথ হচ্ছে আল্লাহর দিকে পৌঁছার একমাত্র পথ। এ পথেই রয়েছে চিরমুক্তি। একমাত্র এ পথ অনুসরণ করেই সৎ ও মুত্তাক্বী বান্দাগণ তাদের চির গন্তব্যস্থল জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। সুতরাং এ পথের অনুসরণ করাটাই হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম উপায়। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَاَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُۚ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهٖؕ ذٰلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
এ পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করো এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করো না, নতুবা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা আন‘আম- ১৫৩)
১০. রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণ করা :
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাতের অনুসরণ করাটাই হচ্ছে সরল-সঠিক পথের আরেক নাম। কেননা এটিকে ছাড়া অথবা এটিকে এড়িয়ে অন্য কোন পন্থায় উক্ত পথের পথিক হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَاۤ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُۚ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْاۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾
রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তোমরা তা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর। (সূরা হাশর- ৭)
১১. মহিলাদের পর্দা করা :
পর্দা হচ্ছে মহিলাদের জন্য পালনীয় একটি আবশ্যকীয় বিধান, যা আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট নির্দেশের মাধ্যমে স্থির করেছেন। সুতরাং একজন মুমিন মহিলাকে তাক্বওয়ার তাগিদে অবশ্যই এ বিধান মেনে চলতে হবে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা পর্দার বিধান দেয়ার প্রথমেই তাক্বওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿يَا نِسَآءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا ‐ وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُوْلٰى﴾
হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কোন সাধারণ স্ত্রীলোকের মতো নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কণ্ঠে কথা বলবে না, যাতে করে যার অন্তরে (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে সে লালায়িত হয়। আর তোমরা (কথা বলার সময়) ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাথমিক জাহেলী যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। (সূরা আহযাব- ৩২, ৩৩)
১২. সঠিক কথা বলা :
সঠিক কথা বলাটা হচ্ছে সত্যবাদী ও মুত্তাক্বী বান্দাদের অন্যতম গুণ। সুতরাং এ গুণটি অর্জন করলেও তাক্বওয়া অর্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। (সূরা আহযাব- ৭০)
১৩. কিয়ামতের ভয়ংকর প্রকম্পনকে ভয় করা :
কিয়ামত হচ্ছে একটি ভয়ংকর দিন। এ দিন মানবজাতি ভীষণ সংকটে পতিত হবে। সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ঘুরাফেরা করবে। কেউ কারো দিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করবে না। সেদিন সমস্ত মানুষের বিচার করা হবে। কিয়ামত সম্পর্কে এসবকিছু চিন্তা-ভাবনা করলে তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায়। এ জন্যই কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْۚ اِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيْمٌ﴾
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো; নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন খুবই ভয়ংকর। (সূরা হজ্জ- ১)
১৪. নিজের আমল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা :
দুনিয়াতে আমরা যা কিছু করে থাকি না কেন- সবকিছুই হচ্ছে আমাদের আমল। এর প্রতি অংশ সম্মানিত ফেরেশতাগণ প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন। কিয়ামতের দিন এগুলো আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হাতে তুলে দিবেন। এ ক্ষেত্রে যার আমলনামা ভালো হবে, তাকে তার আমলনামা ডান দিক হতে প্রদান করা হবে এবং যার আমলনামা খারাপ হবে, তাকে তার আমলনামা বাম দিক হতে প্রদান করা হবে। আর এই আমলনামা হাতে পাওয়ার জন্য মানুষ কঠিন চিন্তামগ্ন থাকবে। কেননা এটি হাতে পাওয়ার পরই তাদের জন্য অপেক্ষা করবে জান্নাত অথবা জাহান্নাম। নিজের আমলনামা নিয়ে এরূপ চিন্তা-ভাবনা করলেও তাক্বওয়া অর্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا تَعْمَلُوْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক মানুষেরই ভেবে দেখা উচিত যে, সে আগামীকালের (কিয়ামতের) জন্য কী পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত। (সূরা হাশর- ১৮)
১৫. তাক্বওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করা :
আল্লাহর নিয়ামতসমূহের মধ্যে তাক্বওয়া অর্জন করাটাও হচ্ছে অন্যতম একটি বিশেষ নিয়ামত। এটি সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। একমাত্র আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ এটি অর্জন করতে সক্ষম হন। সুতরাং এজন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করা অত্যন্ত জরুরি, যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে দু‘আ করতেন। হাদীসে এসেছে, নবী ﷺ এ মর্মে দু‘আ করতেন যে,
اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْهُدٰى وَالتُّقٰى وَالْعَفَافَ وَالْغِنٰى
আবদুল্লাহ (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি এ মর্মে দু‘আ করতেন যে, ‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে হেদায়াত, পরহেযগারিতা, নৈতিক পবিত্রতা এবং স্বচ্ছলতা বা অন্যের অমুখাপেক্ষিতা প্রার্থনা করছি।’’ [সহীহ মুসলিম, হা/২৭২১।]
অপর হাদীসে এসেছে,
اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ اللّٰهُمَّ اٰتِ نَفْسِى تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَابُ لَهَا
হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য ও কবরের আযাব হতে। হে আল্লাহ! আমার আত্মাকে তাক্বওয়া দান করুন, একে পবিত্র করুন, আপনিই শ্রেষ্ঠ পবিত্রকারী, আপনি তার অভিভাবক ও প্রভু। হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি এমন ইলম হতে যা উপকার করে না। এমন অন্তর হতে যা ভয় করে না। এমন আত্মা হতে যা তৃপ্তি লাভ করে না এবং এমন দু‘আ হতে যা কবুল হয় না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭২২।]
১৬. সফর করা :
সফর হচ্ছে আল্লাহভীতি অর্জন করার আরো একটি মাধ্যম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সফরের মাধ্যমে মানুষকে তাঁর অনেক নিদর্শন দেখিয়ে থাকেন এবং তাদেরকে অনেক ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করে থাকেন। অতঃপর বিজয়ী বান্দাদেরকে নিজের সন্তুষ্টির দ্বারা অনেক পুরস্কার প্রদান করে থাকেন। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন সফরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে এ দু‘আ করতেন :
اَللّٰهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِىْ سَفَرِنَا هٰذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوٰى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضٰى
হে আল্লাহ! আমরা এই সফরে আপনার নিকট নেকী ও তাক্বওয়া চাই। আর আপনার পছন্দনীয় আমল চাই। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৩৯; আবু দাঊদ, হা/২৬০৪; তিরমিযী, হা/৩৪৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫৩; মিশকাত, হা/২৪৩৪।]
১৭. আত্মসমালোচনা করা :
তাক্বওয়া অর্জনের জন্য আত্মসমালোচনা করাটা হচ্ছে একটি অতি জরুরি বিষয়। আত্মসমালোচনা করলে নিজের মন্দ কর্মের জন্য তওবা এবং সৎকর্মের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর এ কাজটি মানুষকে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে। এজন্যই অনেক মনীষী তাক্বওয়া অর্জনের জন্য আত্মসমালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন-
মায়মূন ইবনে মিহরান বলেন,
لَا يَكُوْنُ الرَّجُلُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ حَتّٰى يُحَاسِبُ نَفْسَهٗ أَشَدٌّ مِنْ مُحَاسَبَةِ شَرِيْكَهٗ حَتّٰى يَعْلَمُ مِنْ أَيْنَ مُطْعِمَهٗ وَمِنْ أَيْنَ مُلْبِسَهٗ ، وَمِنْ أَيْنَ مُشْرِبَهٗ ، أَمِنْ حَلَالٍ ذٰلِكَ أَمْ مِنْ حَرَامٍ
মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাক্বী হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্যদের সমালোচনার চেয়ে স্বীয় নফস সম্পর্কে কঠোরভাবে আত্মসমালোচনা করবে। যাতে করে সে জানতে পারে যে, তার খাদ্য কোথা হতে এসেছে, তার পানীয় কোথা হতে এসেছে এবং তার পরিধেয় কোথা হতে এসেছে। সেটা হালাল উৎস থেকে এসেছে নাকি হারাম উৎস থেকে? [হিলয়াতুল আওলিয়া ১/১১৪।]
হারেছ ইবনে আসাদ আল-মুহাসেবী বলেন,
اَصْلُ التَّقْوٰى مُحَاسَبَةُ النَّفْسِ
তাক্বওয়ার মূল হচ্ছে আত্মসমালোচনা। [হিলয়াতুল আওলিয়া ২/২৮২।]
১৮. হালাল ভক্ষণ করা :
ইবাদাত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন করা এবং হালাল ভক্ষণ করা। সুতরাং মানুষ ইবাদাত কবুল না হওয়ার ভয়ে হারাম ত্যাগ করে হালাল উপার্জন ও হালাল ভক্ষণের মাধ্যমেও তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : اَيُّهَا النَّاسُ اِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ اِلَّا طَيِّبًا وَّاِنَّ اللهَ اَمَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ بِمَا اَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِيْنَ فَقَالَ : يَا اَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا اِنِّى بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ وَقَالَ : يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ . ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ اَشْعَثَ اَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ اِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهٗ حَرَامٌ وَّمَشْرَبُهٗ حَرَامٌ وَّمَلْبَسُهٗ حَرَامٌ وَّغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَاَنّٰى يُسْتَجَابُ لِذٰلِكَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুমিনদেরকেও একই নির্দেশ দিয়েছে; অতঃপর (আল্লাহ) বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র জিনিস খাও এবং নেক আমল করো। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবগত আছি।’ আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে তোমরা পবিত্র জিনিস খাও।’
অতঃপর তিনি (রাসূলুল্লাহ ﷺ) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন যে দীর্ঘ সফর করে, এলোমেলো কেশবিশিষ্ট, ধূলোমলিন শরীর, সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারামের দ্বারা সে প্রতিপালিত হচ্ছে, সুতরাং কীভাবে তার দু‘আ কবুল হবে? [সহীহ মুসলিম, হা/১০১৫।]
অনুরূপভাবে শেষ যামানার কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ হালাল উপার্জনের মাধ্যমেও তাক্বওয়া অর্জন করবে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنْ الْحَرَامِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, মানুষের উপর এমন একটি সময় আসবে, যখন মানুষ উপার্জনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করবে না যে, সেটি কি হালাল উৎস থেকে এসেছে নাকি হারাম উৎস থেকে এসেছে। [সহীহ বুখারী, মিশকাত, হা/২৭৬১।]
অনুরূপভাবে মানুষ হালাল খাদ্য পরিত্যাগ করে হারাম খাদ্য গ্রহণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারার ভয়েও তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ بَكْرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِيَ بِالْحَرَامِ
আবু বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, হারাম খাদ্য দ্বারা পরিপুষ্ট শরীর জান্নাতে যাবে না। [বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৭৮৭, সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬০৯।]
১৯. শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক হওয়া :
তাক্বওয়া অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শয়তান। সে তার বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষকে তাক্বওয়া অর্জন করা থেকে বিরত রাখে। আর সে হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু, যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদেই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
﴿اِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوًّاؕ اِنَّمَا يَدْعُوْا حِزْبَهٗ لِيَكُوْنُوْا مِنْ اَصْحَابِ السَّعِيْرِ﴾
নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমরা তাকে শত্রু হিসেবেই গ্রহণ করো। সে তো তার দলবলকে শুধু এজন্যই আহবান করে, যেন তারা (পথভ্রষ্ট হয়ে) জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ফাতির- ৬)
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِؕ وَمَنْ يَّتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَاِنَّهٗ يَاْمُرُ بِالْفَحْشَآءِ وَالْمُنْكَرِ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে ব্যক্তি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে (সে জেনে রাখুক যে), নিশ্চয় শয়তান কেবল অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়। (সূরা নূর- ২১)
সুতরাং তাক্বওয়া অর্জনের জন্য শয়তানের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সেগুলো থেকে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
২০. আল্লাহর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস :
সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি স্বচ্ছ ও দৃঢ়ভাবে ঈমান আনয়ন করার মাধ্যমেই অধিক তাক্বওয়া অর্জিত হয়। যখন কোন বান্দা আল্লাহর প্রতি এরূপ বিশ্বাস রাখবে যে, তিনি সর্বদা তার প্রকাশ্য ও গোপন সকল কর্মকান্ডসমূহ সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তখন গুনাহ করার সময় এক ধরনের লজ্জাশীলতা অথবা ভয় তৈরি হবে। আর এই বিশ্বাসটি তৈরি হবে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীর মাধ্যমে-
﴿وَهُوَ مَعَكُمْ اَيْنَ مَا كُنْتُمْؕ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ﴾
তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি (জানার দিক দিয়ে) তোমাদের সঙ্গেই আছেন। আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন। (সূরা হাদীদ- ৪)
অনুরূপভাবে এ আয়াতের মাধ্যমেও-
﴿أَلَاۤ إِنَّهُمْ يَثْنُوْنَ صُدُوْرَهُمْ لِيَسْتَخْفُوْا مِنْهُ أَلَا حِيْنَ يَسْتَغْشُوْنَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّوْنَ وَمَا يُعْلِنُوْنَ إِنَّهٗ عَلِيْمٌ ۢبِذَاتِ الصُّدُوْرِ﴾
সাবধান! তারা তাঁর নিকট গোপন রাখার জন্য তাদের বক্ষ দ্বিভাঁজ করে। সাবধান! তারা যখন নিজেদেরকে বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে, তখন তারা যা গোপন করে ও প্রকাশ করে, তিনি তা জানেন। আর অন্তরে যা কিছু আছে, সে সম্পর্কেও তিনি সবিশেষে অবহিত। (সূরা হুদ- ৫)
জ্ঞান মানুষের অমূল্য সম্পদ। এর মূল উৎস হলো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এটির ভিত্তিতেই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির আসনে অধিষ্ঠিত। অনুরূপভাবে তাক্বওয়াও হচ্ছে মানুষের জীবনের অন্য আরো একটি অমূল্য সম্পদ এবং উভয়টির সম্পর্ক খুবই গভীর। কেননা কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জন ছাড়া উক্ত বিষয়ে কারো প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় না। এজন্যই কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿اِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَآءُ﴾
নিশ্চয় আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে থাকে।
(সূরা ফাতির- ২৮)
এর স্বরূপ হচ্ছে এই যে, যখন কোন বান্দা জানতে পারবে যে, আল্লাহ কে? তিনি কোথায় থাকেন? তিনি কী করেন? তাঁর ক্ষমতা কতটুকু? তাঁর রাগ কেমন? পৃথিবীতে যেসব জাতির উপর তা প্রতিফলিত হয়েছিল, তাদের কীরূপ অবস্থা হয়েছিল? জান্নাত কী? জাহান্নাম কী? তাক্বওয়া কী জিনিস? এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এর উপকার কী এবং এর অনুপস্থিতির অপকারসমূহ কী কী......ইত্যাদি, তাহলেই উক্ত বান্দার মনে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এসব বিষয়ে কোন কিছু জানতেই পারবে না, তার পক্ষে আল্লাহকে ভয় করা কখনো সম্ভব নয়। বরং সে ভয় করবে ঐসব বিষয়কে, যেসব কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। আর শয়তান এ সুযোগটিই গ্রহণ করে থাকে, যাতে করে উক্ত বান্দা আল্লাহকে ভয় করার পরিবর্তে তাকেই ভয় করে।
২. কুরআন নিয়ে গবেষণা করা :
কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য একটি মহাবিস্ময়কর গ্রন্থ। এতে সমন্বয় ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ পার্থিব ও আধ্যাত্মিক জগতের যাবতীয় বিষয়ের আলোচনা। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,
﴿تِلْكَ اٰيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيْمِ﴾
এগুলো বিজ্ঞানময় কিতাবের আয়াত। (সূরা লুক্বমান- ২)
অপর আয়াতে এসেছে,
﴿وَلَقَدْ جِئْنَاهُمْ بِكِتَابٍ فَصَّلْنَاهُ عَلٰى عِلْمٍ هُدًى وَّرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ﴾
অবশ্যই আমি তাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলাম এমন এক কিতাব, যা আমি পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলাম; আর তা ছিল মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমতস্বরূপ। (সূরা আ‘রাফ- ৫২)
অতএব কোন ব্যক্তি কুরআন নিয়ে যতবেশি গবেষণা করবে, সে ততবেশি জ্ঞানার্জন করতে পারবে।
৩. আল্লাহর ইবাদাতে মনোনিবেশ করা :
মানুষ সৃষ্টি করার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত করা। এ কাজে মনোনিবেশ করলে বান্দা অনেক দিক থেকেই উপকৃত হয়। বিশেষ করে এর মাধ্যমে বান্দার সবচেয়ে বড় সম্পদ তাক্বওয়া অর্জিত হয়। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত করো, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পার। (সূরা বাক্বারা- ২১)
৪. আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা :
তাক্বওয়া অর্জনের প্রধান দাবি হচ্ছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধসমূহ তথা আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা। তাছাড়া এটিও আল্লাহর ইবাদাতের অন্যতম একটি অংশ। এ কাজের মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের মধ্য হতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের প্রিয় বান্দাদেরকে নির্বাচিত করে থাকেন। আর এ কাজেই আল্লাহ তা‘আলা অধিক সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। সুতরাং এ কাজে যতবেশি মনোনিবেশ করা যাবে, ততবেশি তাক্বওয়া অর্জন করা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَكُمْ فِى الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَّاۤ اُولِى الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
হে জ্ঞানবান লোকেরা! কিসাস (প্রতিশোধ) গ্রহণের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে। (এ পদ্ধতির মাধ্যমে) তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পারবে। (সূরা বাক্বারা- ১৭৯)
৫. রোযা রাখা :
রোযা হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জনের জন্য একটি প্রশিক্ষণমূলক ইবাদাত। বান্দা রমাযান মাস ছাড়াও অন্যান্য যে কোন মাসে যতবেশি রোযা রাখবে, সে ততবেশি তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল; যাতে করে তোমরা মুত্তাক্বী হতে পার। (সূরা বাক্বারা- ১৮৩)
অপরদিকে রোযা হচ্ছে মানুষের জন্য ঢাল স্বরূপ, যা তাকে পাপের পথ থেকে বিরত রাখে এবং সৎকর্মের দিকে ধাবিত করে। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহভীতি বা তাক্বওয়ার নিদর্শন। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللّٰهِ ... وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهٗ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهٗ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, সিয়াম হচ্ছে (পাপ থেকে বেঁচে থাকার) ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো সিয়াম পালনের দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায় সে যেন বলে আমি একজন সিয়াম পালনকারী। [সহীহ বুখারী, হা/১৮০৫; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; মিশকাত, হা/১৯৫৯।]
অপর হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ اللهِ قَالَ الصِّيَامُ جُنَّةٌ وَحِصْنٌ حَصِيْنٌ مِنَ النَّارِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সিয়াম হচ্ছে ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার একটি স্থায়ী দুর্গ। [সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৯৮০।]
৬. সালাত কায়েম করা :
সালাত কায়েম করার সাথে তাক্বওয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কেননা তাক্বওয়াবান ব্যক্তিরাই অধিক সালাত আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করে। তাছাড়া কুরআন মাজীদেও সালাত আদায় করার নির্দেশের সাথে সাথে তাক্বওয়া অর্জনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। যেমন-
﴿وَاَنْ اَقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَاتَّقُوْهُ وَهُوَ الَّذِيْۤ اِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ﴾
সালাত কায়েম করো এবং তাঁকে (আল্লাহকে) ভয় করো। তিনিই তো সেই সত্তা, যার নিকট তোমাদেরকে সমবেত করা হবে। (সূরা আন‘আম- ৭২)
৭. অর্থ বুঝে কুরআন পাঠ করা :
তাক্বওয়া অর্জনের অন্য একটি উপায় হচ্ছে, আল্লাহর বাণীসমূহ পাঠ করে সেগুলো যথাযথভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করা। কেননা অনুভূতি ও তাক্বওয়ার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে অন্তর। অনুভূতি ছাড়া তাক্বওয়া অর্জিত হয় না। আর আল্লাহর বাণীসমূহ পাঠ করে কিছু বুঝতে না পারলে অনুভূতি সৃষ্টি হয় না। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ﴾
এ কুরআন আরবি ভাষায় (অবতীর্ণ করা হয়েছে), এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই। (এর মাধ্যমে) তারা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারবে। (সূরা যুমার- ২৮)
৮. সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকা :
সত্যবাদীগণ হচ্ছেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। তাক্বওয়াবান ব্যক্তিগণ নিজেদের আল্লাহভীতির তাগিদেই সত্যবাদীতার গুণ অর্জন করে থাকেন। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে তাক্বওয়া অর্জন করার সাথে সাথে সত্যবাদী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُوْنُوْا مَعَ الصَّادِقِيْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও।
(সূরা তাওবা- ১১৯)
৯. সঠিক পথের অনুসরণ করা :
সরল-সঠিক পথ হচ্ছে আল্লাহর দিকে পৌঁছার একমাত্র পথ। এ পথেই রয়েছে চিরমুক্তি। একমাত্র এ পথ অনুসরণ করেই সৎ ও মুত্তাক্বী বান্দাগণ তাদের চির গন্তব্যস্থল জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। সুতরাং এ পথের অনুসরণ করাটাই হচ্ছে তাক্বওয়া অর্জনের অন্যতম উপায়। কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿وَاَنَّ هٰذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُۚ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهٖؕ ذٰلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ﴾
এ পথই আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ করো এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করো না, নতুবা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার। (সূরা আন‘আম- ১৫৩)
১০. রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণ করা :
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাতের অনুসরণ করাটাই হচ্ছে সরল-সঠিক পথের আরেক নাম। কেননা এটিকে ছাড়া অথবা এটিকে এড়িয়ে অন্য কোন পন্থায় উক্ত পথের পথিক হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَاۤ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُۚ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْاۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ﴾
রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তোমরা তা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাকো। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর। (সূরা হাশর- ৭)
১১. মহিলাদের পর্দা করা :
পর্দা হচ্ছে মহিলাদের জন্য পালনীয় একটি আবশ্যকীয় বিধান, যা আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট নির্দেশের মাধ্যমে স্থির করেছেন। সুতরাং একজন মুমিন মহিলাকে তাক্বওয়ার তাগিদে অবশ্যই এ বিধান মেনে চলতে হবে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা পর্দার বিধান দেয়ার প্রথমেই তাক্বওয়া অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- তিনি বলেন,
﴿يَا نِسَآءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا ‐ وَقَرْنَ فِيْ بُيُوْتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْاُوْلٰى﴾
হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কোন সাধারণ স্ত্রীলোকের মতো নও। যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কথা বলার সময় এমনভাবে কোমল কণ্ঠে কথা বলবে না, যাতে করে যার অন্তরে (কুপ্রবৃত্তির) রোগ রয়েছে সে লালায়িত হয়। আর তোমরা (কথা বলার সময়) ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাথমিক জাহেলী যুগের ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। (সূরা আহযাব- ৩২, ৩৩)
১২. সঠিক কথা বলা :
সঠিক কথা বলাটা হচ্ছে সত্যবাদী ও মুত্তাক্বী বান্দাদের অন্যতম গুণ। সুতরাং এ গুণটি অর্জন করলেও তাক্বওয়া অর্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُوْلُوْا قَوْلًا سَدِيْدًا﴾
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। (সূরা আহযাব- ৭০)
১৩. কিয়ামতের ভয়ংকর প্রকম্পনকে ভয় করা :
কিয়ামত হচ্ছে একটি ভয়ংকর দিন। এ দিন মানবজাতি ভীষণ সংকটে পতিত হবে। সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ঘুরাফেরা করবে। কেউ কারো দিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ করবে না। সেদিন সমস্ত মানুষের বিচার করা হবে। কিয়ামত সম্পর্কে এসবকিছু চিন্তা-ভাবনা করলে তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায়। এ জন্যই কুরআন মাজীদে এসেছে,
﴿يَاۤ اَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْۚ اِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيْمٌ﴾
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো; নিশ্চয় কিয়ামতের প্রকম্পন খুবই ভয়ংকর। (সূরা হজ্জ- ১)
১৪. নিজের আমল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা :
দুনিয়াতে আমরা যা কিছু করে থাকি না কেন- সবকিছুই হচ্ছে আমাদের আমল। এর প্রতি অংশ সম্মানিত ফেরেশতাগণ প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন। কিয়ামতের দিন এগুলো আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হাতে তুলে দিবেন। এ ক্ষেত্রে যার আমলনামা ভালো হবে, তাকে তার আমলনামা ডান দিক হতে প্রদান করা হবে এবং যার আমলনামা খারাপ হবে, তাকে তার আমলনামা বাম দিক হতে প্রদান করা হবে। আর এই আমলনামা হাতে পাওয়ার জন্য মানুষ কঠিন চিন্তামগ্ন থাকবে। কেননা এটি হাতে পাওয়ার পরই তাদের জন্য অপেক্ষা করবে জান্নাত অথবা জাহান্নাম। নিজের আমলনামা নিয়ে এরূপ চিন্তা-ভাবনা করলেও তাক্বওয়া অর্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍۚ وَاتَّقُوا اللهَؕ اِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ ۢبِمَا تَعْمَلُوْنَ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। প্রত্যেক মানুষেরই ভেবে দেখা উচিত যে, সে আগামীকালের (কিয়ামতের) জন্য কী পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সর্বাধিক অবহিত। (সূরা হাশর- ১৮)
১৫. তাক্বওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করা :
আল্লাহর নিয়ামতসমূহের মধ্যে তাক্বওয়া অর্জন করাটাও হচ্ছে অন্যতম একটি বিশেষ নিয়ামত। এটি সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। একমাত্র আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ এটি অর্জন করতে সক্ষম হন। সুতরাং এজন্য আল্লাহর নিকট দু‘আ করা অত্যন্ত জরুরি, যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে দু‘আ করতেন। হাদীসে এসেছে, নবী ﷺ এ মর্মে দু‘আ করতেন যে,
اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ الْهُدٰى وَالتُّقٰى وَالْعَفَافَ وَالْغِنٰى
আবদুল্লাহ (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি এ মর্মে দু‘আ করতেন যে, ‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে হেদায়াত, পরহেযগারিতা, নৈতিক পবিত্রতা এবং স্বচ্ছলতা বা অন্যের অমুখাপেক্ষিতা প্রার্থনা করছি।’’ [সহীহ মুসলিম, হা/২৭২১।]
অপর হাদীসে এসেছে,
اَللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ اللّٰهُمَّ اٰتِ نَفْسِى تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَابُ لَهَا
হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য ও কবরের আযাব হতে। হে আল্লাহ! আমার আত্মাকে তাক্বওয়া দান করুন, একে পবিত্র করুন, আপনিই শ্রেষ্ঠ পবিত্রকারী, আপনি তার অভিভাবক ও প্রভু। হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি এমন ইলম হতে যা উপকার করে না। এমন অন্তর হতে যা ভয় করে না। এমন আত্মা হতে যা তৃপ্তি লাভ করে না এবং এমন দু‘আ হতে যা কবুল হয় না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৭২২।]
১৬. সফর করা :
সফর হচ্ছে আল্লাহভীতি অর্জন করার আরো একটি মাধ্যম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সফরের মাধ্যমে মানুষকে তাঁর অনেক নিদর্শন দেখিয়ে থাকেন এবং তাদেরকে অনেক ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করে থাকেন। অতঃপর বিজয়ী বান্দাদেরকে নিজের সন্তুষ্টির দ্বারা অনেক পুরস্কার প্রদান করে থাকেন। এজন্যই রাসূলুল্লাহ ﷺ কোন সফরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে এ দু‘আ করতেন :
اَللّٰهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِىْ سَفَرِنَا هٰذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوٰى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضٰى
হে আল্লাহ! আমরা এই সফরে আপনার নিকট নেকী ও তাক্বওয়া চাই। আর আপনার পছন্দনীয় আমল চাই। [সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৩৯; আবু দাঊদ, হা/২৬০৪; তিরমিযী, হা/৩৪৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৫৩; মিশকাত, হা/২৪৩৪।]
১৭. আত্মসমালোচনা করা :
তাক্বওয়া অর্জনের জন্য আত্মসমালোচনা করাটা হচ্ছে একটি অতি জরুরি বিষয়। আত্মসমালোচনা করলে নিজের মন্দ কর্মের জন্য তওবা এবং সৎকর্মের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আর এ কাজটি মানুষকে ক্রমান্বয়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে। এজন্যই অনেক মনীষী তাক্বওয়া অর্জনের জন্য আত্মসমালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন-
মায়মূন ইবনে মিহরান বলেন,
لَا يَكُوْنُ الرَّجُلُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ حَتّٰى يُحَاسِبُ نَفْسَهٗ أَشَدٌّ مِنْ مُحَاسَبَةِ شَرِيْكَهٗ حَتّٰى يَعْلَمُ مِنْ أَيْنَ مُطْعِمَهٗ وَمِنْ أَيْنَ مُلْبِسَهٗ ، وَمِنْ أَيْنَ مُشْرِبَهٗ ، أَمِنْ حَلَالٍ ذٰلِكَ أَمْ مِنْ حَرَامٍ
মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাক্বী হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্যদের সমালোচনার চেয়ে স্বীয় নফস সম্পর্কে কঠোরভাবে আত্মসমালোচনা করবে। যাতে করে সে জানতে পারে যে, তার খাদ্য কোথা হতে এসেছে, তার পানীয় কোথা হতে এসেছে এবং তার পরিধেয় কোথা হতে এসেছে। সেটা হালাল উৎস থেকে এসেছে নাকি হারাম উৎস থেকে? [হিলয়াতুল আওলিয়া ১/১১৪।]
হারেছ ইবনে আসাদ আল-মুহাসেবী বলেন,
اَصْلُ التَّقْوٰى مُحَاسَبَةُ النَّفْسِ
তাক্বওয়ার মূল হচ্ছে আত্মসমালোচনা। [হিলয়াতুল আওলিয়া ২/২৮২।]
১৮. হালাল ভক্ষণ করা :
ইবাদাত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন করা এবং হালাল ভক্ষণ করা। সুতরাং মানুষ ইবাদাত কবুল না হওয়ার ভয়ে হারাম ত্যাগ করে হালাল উপার্জন ও হালাল ভক্ষণের মাধ্যমেও তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : اَيُّهَا النَّاسُ اِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ اِلَّا طَيِّبًا وَّاِنَّ اللهَ اَمَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ بِمَا اَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِيْنَ فَقَالَ : يَا اَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوْا صَالِحًا اِنِّى بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ وَقَالَ : يَا اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ . ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيْلُ السَّفَرَ اَشْعَثَ اَغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ اِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ وَمَطْعَمُهٗ حَرَامٌ وَّمَشْرَبُهٗ حَرَامٌ وَّمَلْبَسُهٗ حَرَامٌ وَّغُذِىَ بِالْحَرَامِ فَاَنّٰى يُسْتَجَابُ لِذٰلِكَ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন মুমিনদেরকেও একই নির্দেশ দিয়েছে; অতঃপর (আল্লাহ) বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র জিনিস খাও এবং নেক আমল করো। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে বিষয়ে আমি অবগত আছি।’ আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে তোমরা পবিত্র জিনিস খাও।’
অতঃপর তিনি (রাসূলুল্লাহ ﷺ) এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন যে দীর্ঘ সফর করে, এলোমেলো কেশবিশিষ্ট, ধূলোমলিন শরীর, সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং হারামের দ্বারা সে প্রতিপালিত হচ্ছে, সুতরাং কীভাবে তার দু‘আ কবুল হবে? [সহীহ মুসলিম, হা/১০১৫।]
অনুরূপভাবে শেষ যামানার কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ হালাল উপার্জনের মাধ্যমেও তাক্বওয়া অর্জন করবে। যেমন- হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ قَالَ يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ مَا أَخَذَ مِنْهُ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنْ الْحَرَامِ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেন, মানুষের উপর এমন একটি সময় আসবে, যখন মানুষ উপার্জনের ক্ষেত্রে বিবেচনা করবে না যে, সেটি কি হালাল উৎস থেকে এসেছে নাকি হারাম উৎস থেকে এসেছে। [সহীহ বুখারী, মিশকাত, হা/২৭৬১।]
অনুরূপভাবে মানুষ হালাল খাদ্য পরিত্যাগ করে হারাম খাদ্য গ্রহণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে না পারার ভয়েও তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ بَكْرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَالَ : لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِيَ بِالْحَرَامِ
আবু বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, হারাম খাদ্য দ্বারা পরিপুষ্ট শরীর জান্নাতে যাবে না। [বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৭৮৭, সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬০৯।]
১৯. শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক হওয়া :
তাক্বওয়া অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শয়তান। সে তার বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষকে তাক্বওয়া অর্জন করা থেকে বিরত রাখে। আর সে হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু, যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদেই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
﴿اِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوًّاؕ اِنَّمَا يَدْعُوْا حِزْبَهٗ لِيَكُوْنُوْا مِنْ اَصْحَابِ السَّعِيْرِ﴾
নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমরা তাকে শত্রু হিসেবেই গ্রহণ করো। সে তো তার দলবলকে শুধু এজন্যই আহবান করে, যেন তারা (পথভ্রষ্ট হয়ে) জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (সূরা ফাতির- ৬)
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِؕ وَمَنْ يَّتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَاِنَّهٗ يَاْمُرُ بِالْفَحْشَآءِ وَالْمُنْكَرِ﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে ব্যক্তি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে (সে জেনে রাখুক যে), নিশ্চয় শয়তান কেবল অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়। (সূরা নূর- ২১)
সুতরাং তাক্বওয়া অর্জনের জন্য শয়তানের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সেগুলো থেকে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি।
২০. আল্লাহর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস :
সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি স্বচ্ছ ও দৃঢ়ভাবে ঈমান আনয়ন করার মাধ্যমেই অধিক তাক্বওয়া অর্জিত হয়। যখন কোন বান্দা আল্লাহর প্রতি এরূপ বিশ্বাস রাখবে যে, তিনি সর্বদা তার প্রকাশ্য ও গোপন সকল কর্মকান্ডসমূহ সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তখন গুনাহ করার সময় এক ধরনের লজ্জাশীলতা অথবা ভয় তৈরি হবে। আর এই বিশ্বাসটি তৈরি হবে আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীর মাধ্যমে-
﴿وَهُوَ مَعَكُمْ اَيْنَ مَا كُنْتُمْؕ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ﴾
তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি (জানার দিক দিয়ে) তোমাদের সঙ্গেই আছেন। আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা দেখেন। (সূরা হাদীদ- ৪)
অনুরূপভাবে এ আয়াতের মাধ্যমেও-
﴿أَلَاۤ إِنَّهُمْ يَثْنُوْنَ صُدُوْرَهُمْ لِيَسْتَخْفُوْا مِنْهُ أَلَا حِيْنَ يَسْتَغْشُوْنَ ثِيَابَهُمْ يَعْلَمُ مَا يُسِرُّوْنَ وَمَا يُعْلِنُوْنَ إِنَّهٗ عَلِيْمٌ ۢبِذَاتِ الصُّدُوْرِ﴾
সাবধান! তারা তাঁর নিকট গোপন রাখার জন্য তাদের বক্ষ দ্বিভাঁজ করে। সাবধান! তারা যখন নিজেদেরকে বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে, তখন তারা যা গোপন করে ও প্রকাশ করে, তিনি তা জানেন। আর অন্তরে যা কিছু আছে, সে সম্পর্কেও তিনি সবিশেষে অবহিত। (সূরা হুদ- ৫)
যেসব কাজে তাক্বওয়া অর্জিত হয় এর বিপরীত কর্মকান্ডসমূহই হচ্ছে তাক্বওয়া বিরোধী কর্মকান্ড। নিম্নে এসব বিষয় সম্পর্কে সংক্ষিপ্তরূপে আলোচনা করা হলো :
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যাচরণ করা :
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য না করা এবং ইসলামী আইন-কানুন সমূহ মেনে না চলাটা তাক্বওয়া বিরোধী কর্মকান্ডসমূহের অন্যতম অংশ। যেমন- যথাযথভাবে সালাত আদায় না করা, সিয়াম পালন না করা, বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করা, অবাধে পাপকর্ম করে বেড়ানো, যিনা করা, চুরি করা, ডাকাতি করা, আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি।
২. বিজাতির অনুসরণ করা :
বিজাতি তথা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী লোকের অনুসরণ করাটা হচ্ছে তাক্বওয়ার পথে আরো একটি বাধার কারণ। কেননা বিজাতিরা প্রতিটি মুসলিমের জন্য শত্রুসমতুল্য এবং শয়তানের বন্ধু বা অনুচর। তারা একজন মুসলিম থেকে ইসলামী কর্মকান্ডসমূহ প্রকাশ পাওয়াটা কোনভাবেই সমর্থন করে না। বরং তারা তাদের থেকে কেবল কুফরী কর্মকান্ডসমূহই কামনা করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَدُّوْا لَوْ تَكْفُرُوْنَ كَمَا كَفَرُوْا فَتَكُوْنُوْنَ سَوَآءً﴾
তারা কামনা করে যে, তারা যেরূপ কুফরী করেছে তোমরাও সেরূপ কুফরী কর, যাতে তোমরা তাদের সমান হয়ে যাও। (সূরা নিসা- ৮৯)
উল্লেখ্য যে, বিজাতির অনুসরণ করার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে এই যে, তাদের মতো পোশাক পরিধান করা, বিজ্ঞানের সূত্রানুসারে তাদের মতো বিশ্বাস স্থাপন করা, সালাত থেকে দূরে থাকা, সওম পালন না করা, যাকাত না দেয়া, খেলাধুলা ও বিনোদনের প্রতি ঝুঁকে পড়া, পূজিবাদী চিন্তা-চেতনার অনুসরণ করা, তাদের তৈরি আইন অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা ইত্যাদি।
৩. ইবাদাতে শিথিলতা প্রদর্শন করা :
ইসলামী ইবাদাতসমূহের মূলনীতি হচ্ছে, সেগুলোতে যথাসম্ভব একনিষ্ঠতা প্রদর্শন করা। কাজেই কোন একনিষ্ঠ মুসলিমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তানের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে, তার অন্তরে বিভিন্ন ইবাদাত তথা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি পালনের ক্ষেত্রে শিথিলতা আনয়ন করা। অপরদিকে ইবাদাতে একনিষ্ঠতার উপস্থিতিই হচ্ছে তাক্বওয়ার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং এ কর্মটিও তাক্বওয়া অর্জনের পথে বাধা হওয়ার অন্যতম কারণ।
৪. হারাম-হালাল বাছ-বিচার না করা :
কোন কোন মানুষ আধ্যাত্মিক জীবন ও বৈষয়িক জীবনকে আলাদা মনে করে। এজন্য আয়-রোজগারে হালাল-হারাম বাছ-বিচার করে না। সুদ-ঘুষ, মুনাফাখোরী, মজুদদারী, ধোঁকা-প্রবঞ্চনাসহ নানা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে সম্পদ বৃদ্ধি করে। তাদের মানসিকতা যেন এমন যে, ইহকালের বিষয় এখন ভাবি; আর পরকালীন বিষয় পরে ভাবা যাবে। তাদের কাছে পার্থিব জীবনই মুখ্য, পরকালীন বিষয় নিতান্তই গৌণ। এ ধরনের আচরণ আল্লাহভীতির পরিপন্থী।
৫. অপরের অধিকার পূর্ণ না করা :
সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা অপরের অধিকারের ব্যাপারে উদাসীন। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্যের হকের প্রতি তারা ভ্রুক্ষেপ করে না। আবার উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে, তাদের মধ্যে কোন একজনকে অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত সম্পদ দান করার মতো হীন কাজও করে থাকে। এ ধরনের কাজ তাক্বওয়ার খেলাফ।
৬. আমানতদারিতার অভাব :
আমানত রক্ষা করা ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছে যাদের নিকট কোন কিছু গচ্ছিত রাখলে, তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে না। সম্পদের ক্ষেত্রে যেমন আমানত রক্ষা করে না, তেমনি মানুষের গোপনীয়তাও রক্ষা করে না। অথচ সম্পদের ক্ষেত্রে যেমন আমানতের খেয়ানত হয়, গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেয়াতেও তেমনি আমানতের খেয়ানত হয়। এ ধরনের কর্মকান্ডে আমানত রক্ষা না করা তাক্বওয়াহীনতার পরিচায়ক।
৭. দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ না করা :
মানুষের হাত ও মুখ দ্বারা অন্য মানুষ নানাভাবে অত্যাচারিত হয়। আবার মুখ দ্বারা মিথ্যাচার করা হয়। আর লজ্জাস্থান দ্বারা যেনা-ব্যভিচার সংঘটিত হয়। এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মাটির মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে। তাক্বওয়াবানদের পক্ষেই কেবল এই অঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই অঙ্গের যথেচ্ছা ব্যবহার তাক্বওয়া পরিপন্থী কাজ।
৮. আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর প্রতি মিথ্যাচার :
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যা বলেননি, তাঁদের নামে তা বলা, তাঁদের হারামকৃত বস্তুকে হালাল বলা এবং তাঁদের হালালকৃত বস্তুকে হারাম সাব্যস্ত করা আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি মিথ্যারোপের শামিল। এক শ্রেণীর আলেম আছেন, যারা নিজেদের স্বার্থে কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করেন। কোন কোন সময় নিজেদের মনগড়া কথাকে রাসূল ﷺ এর কথা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। সেসবই আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর উপর মিথ্যারোপের নামান্তর। এ সকল কাজ যেমন তাক্বওয়া পরিপন্থী; তেমনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস জেনে প্রচার না করা এবং তার উপর আমল না করাও তাক্বওয়ার খেলাফ কাজ। এহেন জঘন্য কাজ থেকে সবাইকে সর্বোতভাবে বিরত থাকতে হবে।
৯. হিংসা-বিদ্বেষ :
হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা মানুষের অত্যন্ত খারাপ একটি গুণ। কোন মানুষের মধ্যে এই ধরনের দোষ থাকলে সে অন্যের দুঃখে আনন্দিত এবং অন্যের সুখে ব্যথিত হয়। যা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলো কারো মাঝে থাকলে সে জীবনে শান্তি লাভ করতে পারে না। অপরের কল্যাণে সে জ্বলে-পুড়ে মরে। কোন কোন সময় সে মানুষের অকল্যাণ চিন্তা করে। এ ধরনের কাজ আল্লাহভীরুতার পরিচায়ক নয়। তাক্বওয়ার দাবি হচ্ছে উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকা।
১০. অহংকার :
অহংকার এমন বিষয়, যার কারণে মানুষ নিজেকে বড় বলে জ্ঞান করে এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট ভাবে। এ ধরনের মানুষ অন্যদের সাথে মিশতে দ্বিধা করে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য সে হয় সচেষ্ট ও মরিয়া। গর্ব ও অহংকারে তাদের পা যেন মাটি স্পর্শ করে না। এ ধরনের কাজ শুধু তাক্বওয়া বিরোধীই নয়; বরং মুমিনের স্বভাববিরোধী। আল্লাহভীতির দাবি হচ্ছে নিজেকে আদমের সন্তান হিসেবে বিনয়ী ও নিরহংকারভাবে গড়ে তোলা।
১১. শিরক-বিদ‘আতে লিপ্ত থাকা :
আল্লাহ মানুষকে শিরক থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকতে আদেশ দিয়েছেন। এরপরও মানুষ ভক্তির আতিশয্যে অনেককে আল্লাহর স্তরে পৌঁছে দিয়ে তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করে বসে। মাজারপুজা, কবরপুজাসহ হাজারো শিরকে লিপ্ত হয়। পীর বাবার কাছে রোগ থেকে মুক্তি চাওয়া, বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি চাওয়া, সন্তান ও সম্পদ প্রার্থনা করা, পরকালীন মুক্তির জন্য অসীলা হিসেবে গ্রহণ করা জঘন্য শিরক। এর কারণে মানুষের জীবনের সমস্ত সৎ আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। তওবা না করে মারা গেলে শিরককারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। তাই এটা তাক্বওয়া বিরোধী কাজ। এ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
মানুষের আমল কবুল হওয়ার জন্য আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো তা রাসূলের তরীকায় সম্পন্ন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর তরীকায় না হলে তা হবে বিদআত। এই বিদআতের কারণে মানুষ পরকালে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শাফাআত থেকে বঞ্চিত হবে। নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামের অতল গহবরে। রাসূলুল্লাহ ﷺ যা করতে বলেছেন, তা না করা এবং যা করতে বলেননি তা করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ও চরম ধৃষ্টতার শামিল। এ ধরনের কাজ তাক্বওয়ার পরিচায়ক নয়।
১২. কুফর ও নিফাকে লিপ্ত থাকা :
আল্লাহ ও রাসূলের বিধানকে প্রত্যাখ্যান করা কুফরী। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও রাসূলের বিধানকে পাশ কাটিয়ে বৃহত্তর স্বার্থের দোহাই দিয়ে ভিন্নপথ অবলম্বন করাও কুফরীর শামিল। এটা আল্লাহভীতির বিপরীত কাজ। আবার মুখে এক কথা এবং কাজে ভিন্নতা থাকা নেফাকী বা কপটতার পরিচায়ক। এটা তাক্বওয়া বিরোধী কাজ। পক্ষান্তরে কথা ও কাজে মিল থাকা মুত্তাক্বী মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
উল্লেখিত বিষয়গুলো তাক্বওয়াহীনতার কতিপয় নমুনামাত্র। এছাড়া আরো অনেক বিষয় আছে যা দেখে মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি না থাকার বিষয়টি পরিষ্ফুটিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ এহেন কর্মকান্ড থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যাচরণ করা :
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য না করা এবং ইসলামী আইন-কানুন সমূহ মেনে না চলাটা তাক্বওয়া বিরোধী কর্মকান্ডসমূহের অন্যতম অংশ। যেমন- যথাযথভাবে সালাত আদায় না করা, সিয়াম পালন না করা, বিশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা করা, অবাধে পাপকর্ম করে বেড়ানো, যিনা করা, চুরি করা, ডাকাতি করা, আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি।
২. বিজাতির অনুসরণ করা :
বিজাতি তথা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী লোকের অনুসরণ করাটা হচ্ছে তাক্বওয়ার পথে আরো একটি বাধার কারণ। কেননা বিজাতিরা প্রতিটি মুসলিমের জন্য শত্রুসমতুল্য এবং শয়তানের বন্ধু বা অনুচর। তারা একজন মুসলিম থেকে ইসলামী কর্মকান্ডসমূহ প্রকাশ পাওয়াটা কোনভাবেই সমর্থন করে না। বরং তারা তাদের থেকে কেবল কুফরী কর্মকান্ডসমূহই কামনা করে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَدُّوْا لَوْ تَكْفُرُوْنَ كَمَا كَفَرُوْا فَتَكُوْنُوْنَ سَوَآءً﴾
তারা কামনা করে যে, তারা যেরূপ কুফরী করেছে তোমরাও সেরূপ কুফরী কর, যাতে তোমরা তাদের সমান হয়ে যাও। (সূরা নিসা- ৮৯)
উল্লেখ্য যে, বিজাতির অনুসরণ করার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে এই যে, তাদের মতো পোশাক পরিধান করা, বিজ্ঞানের সূত্রানুসারে তাদের মতো বিশ্বাস স্থাপন করা, সালাত থেকে দূরে থাকা, সওম পালন না করা, যাকাত না দেয়া, খেলাধুলা ও বিনোদনের প্রতি ঝুঁকে পড়া, পূজিবাদী চিন্তা-চেতনার অনুসরণ করা, তাদের তৈরি আইন অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা ইত্যাদি।
৩. ইবাদাতে শিথিলতা প্রদর্শন করা :
ইসলামী ইবাদাতসমূহের মূলনীতি হচ্ছে, সেগুলোতে যথাসম্ভব একনিষ্ঠতা প্রদর্শন করা। কাজেই কোন একনিষ্ঠ মুসলিমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তানের প্রাথমিক কাজ হচ্ছে, তার অন্তরে বিভিন্ন ইবাদাত তথা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি পালনের ক্ষেত্রে শিথিলতা আনয়ন করা। অপরদিকে ইবাদাতে একনিষ্ঠতার উপস্থিতিই হচ্ছে তাক্বওয়ার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং এ কর্মটিও তাক্বওয়া অর্জনের পথে বাধা হওয়ার অন্যতম কারণ।
৪. হারাম-হালাল বাছ-বিচার না করা :
কোন কোন মানুষ আধ্যাত্মিক জীবন ও বৈষয়িক জীবনকে আলাদা মনে করে। এজন্য আয়-রোজগারে হালাল-হারাম বাছ-বিচার করে না। সুদ-ঘুষ, মুনাফাখোরী, মজুদদারী, ধোঁকা-প্রবঞ্চনাসহ নানা অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে সম্পদ বৃদ্ধি করে। তাদের মানসিকতা যেন এমন যে, ইহকালের বিষয় এখন ভাবি; আর পরকালীন বিষয় পরে ভাবা যাবে। তাদের কাছে পার্থিব জীবনই মুখ্য, পরকালীন বিষয় নিতান্তই গৌণ। এ ধরনের আচরণ আল্লাহভীতির পরিপন্থী।
৫. অপরের অধিকার পূর্ণ না করা :
সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা অপরের অধিকারের ব্যাপারে উদাসীন। পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্যের হকের প্রতি তারা ভ্রুক্ষেপ করে না। আবার উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে, তাদের মধ্যে কোন একজনকে অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত সম্পদ দান করার মতো হীন কাজও করে থাকে। এ ধরনের কাজ তাক্বওয়ার খেলাফ।
৬. আমানতদারিতার অভাব :
আমানত রক্ষা করা ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছে যাদের নিকট কোন কিছু গচ্ছিত রাখলে, তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে না। সম্পদের ক্ষেত্রে যেমন আমানত রক্ষা করে না, তেমনি মানুষের গোপনীয়তাও রক্ষা করে না। অথচ সম্পদের ক্ষেত্রে যেমন আমানতের খেয়ানত হয়, গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেয়াতেও তেমনি আমানতের খেয়ানত হয়। এ ধরনের কর্মকান্ডে আমানত রক্ষা না করা তাক্বওয়াহীনতার পরিচায়ক।
৭. দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ না করা :
মানুষের হাত ও মুখ দ্বারা অন্য মানুষ নানাভাবে অত্যাচারিত হয়। আবার মুখ দ্বারা মিথ্যাচার করা হয়। আর লজ্জাস্থান দ্বারা যেনা-ব্যভিচার সংঘটিত হয়। এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মাটির মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে। তাক্বওয়াবানদের পক্ষেই কেবল এই অঙ্গগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই অঙ্গের যথেচ্ছা ব্যবহার তাক্বওয়া পরিপন্থী কাজ।
৮. আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর প্রতি মিথ্যাচার :
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যা বলেননি, তাঁদের নামে তা বলা, তাঁদের হারামকৃত বস্তুকে হালাল বলা এবং তাঁদের হালালকৃত বস্তুকে হারাম সাব্যস্ত করা আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি মিথ্যারোপের শামিল। এক শ্রেণীর আলেম আছেন, যারা নিজেদের স্বার্থে কুরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করেন। কোন কোন সময় নিজেদের মনগড়া কথাকে রাসূল ﷺ এর কথা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। সেসবই আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর উপর মিথ্যারোপের নামান্তর। এ সকল কাজ যেমন তাক্বওয়া পরিপন্থী; তেমনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস জেনে প্রচার না করা এবং তার উপর আমল না করাও তাক্বওয়ার খেলাফ কাজ। এহেন জঘন্য কাজ থেকে সবাইকে সর্বোতভাবে বিরত থাকতে হবে।
৯. হিংসা-বিদ্বেষ :
হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা মানুষের অত্যন্ত খারাপ একটি গুণ। কোন মানুষের মধ্যে এই ধরনের দোষ থাকলে সে অন্যের দুঃখে আনন্দিত এবং অন্যের সুখে ব্যথিত হয়। যা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলো কারো মাঝে থাকলে সে জীবনে শান্তি লাভ করতে পারে না। অপরের কল্যাণে সে জ্বলে-পুড়ে মরে। কোন কোন সময় সে মানুষের অকল্যাণ চিন্তা করে। এ ধরনের কাজ আল্লাহভীরুতার পরিচায়ক নয়। তাক্বওয়ার দাবি হচ্ছে উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকা।
১০. অহংকার :
অহংকার এমন বিষয়, যার কারণে মানুষ নিজেকে বড় বলে জ্ঞান করে এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট ভাবে। এ ধরনের মানুষ অন্যদের সাথে মিশতে দ্বিধা করে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য সে হয় সচেষ্ট ও মরিয়া। গর্ব ও অহংকারে তাদের পা যেন মাটি স্পর্শ করে না। এ ধরনের কাজ শুধু তাক্বওয়া বিরোধীই নয়; বরং মুমিনের স্বভাববিরোধী। আল্লাহভীতির দাবি হচ্ছে নিজেকে আদমের সন্তান হিসেবে বিনয়ী ও নিরহংকারভাবে গড়ে তোলা।
১১. শিরক-বিদ‘আতে লিপ্ত থাকা :
আল্লাহ মানুষকে শিরক থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকতে আদেশ দিয়েছেন। এরপরও মানুষ ভক্তির আতিশয্যে অনেককে আল্লাহর স্তরে পৌঁছে দিয়ে তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করে বসে। মাজারপুজা, কবরপুজাসহ হাজারো শিরকে লিপ্ত হয়। পীর বাবার কাছে রোগ থেকে মুক্তি চাওয়া, বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি চাওয়া, সন্তান ও সম্পদ প্রার্থনা করা, পরকালীন মুক্তির জন্য অসীলা হিসেবে গ্রহণ করা জঘন্য শিরক। এর কারণে মানুষের জীবনের সমস্ত সৎ আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। তওবা না করে মারা গেলে শিরককারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। তাই এটা তাক্বওয়া বিরোধী কাজ। এ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
মানুষের আমল কবুল হওয়ার জন্য আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো তা রাসূলের তরীকায় সম্পন্ন হতে হবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর তরীকায় না হলে তা হবে বিদআত। এই বিদআতের কারণে মানুষ পরকালে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শাফাআত থেকে বঞ্চিত হবে। নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামের অতল গহবরে। রাসূলুল্লাহ ﷺ যা করতে বলেছেন, তা না করা এবং যা করতে বলেননি তা করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ও চরম ধৃষ্টতার শামিল। এ ধরনের কাজ তাক্বওয়ার পরিচায়ক নয়।
১২. কুফর ও নিফাকে লিপ্ত থাকা :
আল্লাহ ও রাসূলের বিধানকে প্রত্যাখ্যান করা কুফরী। অনুরূপভাবে আল্লাহ ও রাসূলের বিধানকে পাশ কাটিয়ে বৃহত্তর স্বার্থের দোহাই দিয়ে ভিন্নপথ অবলম্বন করাও কুফরীর শামিল। এটা আল্লাহভীতির বিপরীত কাজ। আবার মুখে এক কথা এবং কাজে ভিন্নতা থাকা নেফাকী বা কপটতার পরিচায়ক। এটা তাক্বওয়া বিরোধী কাজ। পক্ষান্তরে কথা ও কাজে মিল থাকা মুত্তাক্বী মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
উল্লেখিত বিষয়গুলো তাক্বওয়াহীনতার কতিপয় নমুনামাত্র। এছাড়া আরো অনেক বিষয় আছে যা দেখে মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি না থাকার বিষয়টি পরিষ্ফুটিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ এহেন কর্মকান্ড থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।
নবী করীম ﷺ তাক্বওয়ার উত্তম দৃষ্টান্ত। মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক তাক্বওয়ার অধিকারী ছিলেন তিনি। এক হাদীসে তিনি বলেন,
وَاللهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلّٰهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهٗ
আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু এবং সর্বাপেক্ষা মুত্তাক্বী। [সহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩।]
অন্যত্র তিনি আরো বলেন,
فَوَاللهِ إِنِّي أَخْشَاكُمْ لِلّٰهِ وَأَحْفَظُكُمْ لِحُدُودِه
আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে অধিক ভয় করি এবং তাঁর নির্ধারিত সীমার অধিক সংরক্ষক। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৮৯৩; ইরওয়ালুল গালীল হা/২০১৫ এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৭৮২ এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।]
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আগের এবং পরের সকল গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবুও তিনি রাত্রি জেগে ইবাদাত করতেন। সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতেন। এ সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ :
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ إِذَا أَمَرَهُمْ أَمَرَهُمْ مِنْ الْأَعْمَالِ بِمَا يُطِيقُونَ قَالُوا إِنَّا لَسْنَا كَهَيْئَتِكَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ اللهَ قَدْ غَفَرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَيَغْضَبُ حَتّٰى يُعْرَفَ الْغَضَبُ فِي وَجْهِه ثُمَّ يَقُولُ إِنَّ أَتْقَاكُمْ وَأَعْلَمَكُمْ بِاللهِ أَنَا
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবীদেরকে যখন কোন কাজের নির্দেশ দিতেন, তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্দেশ দিতেন। একবার তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো আপনার মতো নই। আল্লাহ তা‘আলা আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে তিনি রাগ করলেন, এমনকি তাঁর মুখমন্ডলে রাগের চিহ্ন ফুটে উটল। অতঃপর তিনি বললেন, তোমাদের চেয়ে আমিই আল্লাহকে অধিক ভয় করি ও আল্লাহ সম্পর্কে বেশি জানি। [সহীহ বুখারী, হা/২০।]
عَنْ عُمَرَ بْنِ أَبِى سَلَمَةَ أَنَّهٗ سَأَلَ رَسُولَ اللهِ - - أَيُقَبِّلُ الصَّائِمُ فَقَالَ لَهٗ رَسُولُ اللهِ - سَلْ هٰذِهِ لِأُمِّ سَلَمَةَ فَأَخْبَرَتْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ - - يَصْنَعُ ذٰلِكَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ قَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ . فَقَالَ لَهٗ رَسُولُ اللهِ - - أَمَا وَاللهِ إِنِّى لأَتْقَاكُمْ للهِ وَأَخْشَاكُمْ لَهٗ
উমর ইবনে আবু সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন, সাওম পালনকারী ব্যক্তি চুম্বন করতে পারে কী? তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, কথাটি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করো। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এরূপ করেন। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সমুদয় গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, শোনো! আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের সকলের চেয়ে বেশি ভয় করি। [সহীহ মুসলিম, হা/১১০৮।]
এসব হাদীসে আল্লাহভীতি সম্পর্কে স্বীকৃতির বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। তবে তার আমল থেকেও তাঁর সর্বাধিক তাক্বওয়াবান হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। যেমন-
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ - - إِذَا صَلّٰى قَامَ حَتّٰى تَفَطَّرَ رِجْلَاهُ قَالَتْ عَائِشَةُ يَا رَسُولَ اللهِ أَتَصْنَعُ هٰذَا وَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَقَالَ يَا عَائِشَةُ أَفَلَا أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রাতের সালাত আদায় করতেন, এমনকি তাঁর দু‘পা ফুলে যেত। আয়েশা (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত (ইবাদাত) করেন? অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, হে আয়েশা! আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮২০।]
অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন,
أَفَلَا أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا
আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না? [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৩৭।]
عَنْ ثَابِتٍ عَنْ مُطَرِّفٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ - - يُصَلِّى وَفِى صَدْرِه أَزِيزٌ كَأَزِيزِ الرَّحٰى مِنَ الْبُكَاءِ
সাবিত মুতাররফ হতে এবং তিনি স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সালাতরত অবস্থায় দেখেছি। কান্নার কারণে তাঁর বুকের মধ্য হতে যাঁতা পেষার আওয়াজের মতো আওয়াজ বের হতো। [আবু দাউদ, হা/৯০৪।]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ غُلَامٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِه فَجَاءَ يَوْمًا بِشَيْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلَامُ أَتَدْرِي مَا هٰذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ إِلَّا أَنِّي خَدَعْتُهٗ فَلَقِيَنِي فَأَعْطَانِي بِذٰلِكَ فَهٰذَا الَّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهٗ فَقَاءَ كُلَّ شَيْءٍ فِي بَطْنِه
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ) এর একটা গোলাম ছিল, যে তাঁকে কিছু কর প্রদান করত। আর আবু বকর (রাঃ) তার কর হতে খাবার গ্রহণ করতেন। একদা এ গোলাম কিছু জিনিস নিয়ে এল এবং আবু বকর (রাঃ) তা থেকে কিছু আহার করলেন। তখন গোলামটি তাঁকে বলল, আপনি কি জানেন এটা কী (যা আপনি খেলেন)? আবু বকর (রাঃ) বললেন, সেটা কী ছিল? সেই গোলাম বলল, জাহেলী যুগে আমি এক লোকের ভবিষ্যৎ গণনা করেছিলাম। মূলত আমি ভাগ্য গুণতে জানতাম না। বরং তাকে আমি প্রতারিত করেছিলাম মাত্র। আজ সে লোকটি আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে ঐ কাজের মূল্য প্রদান করল। এটাই সে বস্তু যা থেকে আপনি খেলেন। এ কথা শুনে আবু বকর (রাঃ) নিজের হাতখানা মুখে প্রবেশ করিয়ে বমি করে পেটের সব কিছু বের করে দিলেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩৮৪২।]
ইবনে উমর (রাঃ) একদা সূরা মুত্বাফফিফীন পড়তে শুরু করলেন। যখন তিনি এ আয়াতে পৌঁছলেন يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ যেদিন সমস্ত মানুষ জগতসমূহের প্রতিপালকের সম্মুখে দাঁড়াবে- (সূরা মুত্বাফফিফীন- ৬)। তখন কাঁদতে শুরু করলেন। এমনকি তিনি পড়ে গেলেন এবং এর পরে আর পড়তে পারলেন না। [আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীম আল-লাহীদান, আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন ১/৭।]
নাফে‘ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন ইবনে উমর (রাঃ) এ আয়াত পড়তেন-
﴿أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ اٰمَنُوْاۤ أَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَكَثِيْرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُوْنَ﴾
যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? আর পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মত যেন তারা না হয়- বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তর কঠিন হয়ে পড়েছিল - (সূরা হাদীদ- ১৬)
তখন তিনি কাঁদতে শুরু করতেন, এমনকি ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। [আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীম আল-লাহীদান, আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন ১/৭।]
তামীম আদ-দারী (রাঃ) এক রাতে সূরা জাসিয়া তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। যখন তিনি এ আয়াতে পৌঁছলেন-
﴿أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَآءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَآءَ مَا يَحْكُمُوْنَ﴾
দুষ্কৃতিকারীরা কি মনে করে যে, আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে তাদেরকে তাদের সমান গণ্য করব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ? (সূরা জাসিয়া- ২১)
তখন তিনি এ আয়াত পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। এমনকি সকাল হয়ে গেল। [শাইখ নাবীল আল-আওযী, খুত্বাব ওয়া মুহাযরাত, ৪৪/২।]
একদা উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) সূরা তূর তিলাওয়াত করছিলেন। তিনি যখন এ আয়াতে পৌঁছলেন,
﴿إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَاقِعٌ﴾
তোমার প্রতিপালকের শাস্তি তো অবশ্যম্ভাবী- (সূরা তূর- ৭)
তখন অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। এমনকি তিনি অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন বিছানায় শয্যাশয়ী থাকলেন। [আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন- ১/১০।]
সুফিয়ান (রহ.) বলেন, সাঈদ ইবনে সায়েব আত-তায়েফীর অশ্রু শুকাত না। সারাক্ষণ যেন তার অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকত। সালাত আদায়কালে, বায়তুল্লাহর তাওয়াফের সময় এবং কুরআন তিলাওয়াতের সময়ও কাঁদতেন। রাস্তায় তার সাথে সাক্ষাৎ হলেও আমি তাকে কাঁদতে দেখতাম। [মাওসূ‘আল খুতাবিল মুনীর ১/১৮৭৬; ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব ৪/৩২, ১৪/৯৪, শামসুদ্দীন আয-যাহাবী ১৫/৪৫৯।]
হাফছ ইবনে উমর বলেন, হাসান বসরী কাঁদলেন। তাকে বলা হলো, কোন্ জিনিস আপনাকে কাঁদাল? তিনি বললেন, আমি আশংকা করছি যে, আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে; অথচ আমার কোন উপায় থাকবে না। [ফারীক আমল, দাওয়াত আলা মানহাজিন নবুওয়াত ২/৫২; মুহাম্মাদ খালফ সালামাহ, মাওরিদুল আযবুল মুঈন মিন আছারি আ‘আলামিত তাবেঈন, ১/৪৬।]
কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবী বকর হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি প্রত্যহ সকালে আয়েশা (রাঃ) এর বাড়িতে যেতাম এবং তাঁকে সালাম দিতাম। একদা সকালে তাঁর নিকট গিয়ে দেখলাম যে, তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে এ আয়াত তিলাওয়াত করছেন-
﴿فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُوْمِ﴾
অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি হতে রক্ষা করেছেন- (সূরা তূর- ২৭) এবং দু‘আ করছেন, কাঁদছেন এবং আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করছেন। তখন আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, এমনকি দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট বোধ করলাম। অতঃপর আমার কোন প্রয়োজনে আমি বাজারে গেলাম। আমি ফিরে এসেও দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, যেভাবে সালাত আদায় করছিলেন এবং কাঁদছেন। এরূপ একটি বর্ণনা উরওয়া ইবনে জুবায়ের থেকেও রয়েছে। [আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন, ১/৭; ড. ত্বলা‘আত মুহাম্মাদ আফীফী সালেম, হায়াতুছ সাহাবিয়াত, ১/২০, ৩২।]
আল্লাহভীরুদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে ক্ষত হয়, চোখ ক্রন্দন করে। তারা বলেন, আমরা কিভাবে আনন্দিত হতে পারি অথচ মৃত্যু আমাদের পিছনে, কবর আমাদের সম্মুখে, ক্বিয়ামত আমাদের ঠিকানা, জাহান্নামের উপর আমাদের রাস্তা এবং আল্লাহর সম্মুখে আমাদের অবস্থানস্থল।
وَاللهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلّٰهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهٗ
আমি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু এবং সর্বাপেক্ষা মুত্তাক্বী। [সহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩।]
অন্যত্র তিনি আরো বলেন,
فَوَاللهِ إِنِّي أَخْشَاكُمْ لِلّٰهِ وَأَحْفَظُكُمْ لِحُدُودِه
আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে অধিক ভয় করি এবং তাঁর নির্ধারিত সীমার অধিক সংরক্ষক। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৮৯৩; ইরওয়ালুল গালীল হা/২০১৫ এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৭৮২ এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।]
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর আগের এবং পরের সকল গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবুও তিনি রাত্রি জেগে ইবাদাত করতেন। সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতেন। এ সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ :
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ إِذَا أَمَرَهُمْ أَمَرَهُمْ مِنْ الْأَعْمَالِ بِمَا يُطِيقُونَ قَالُوا إِنَّا لَسْنَا كَهَيْئَتِكَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ اللهَ قَدْ غَفَرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَيَغْضَبُ حَتّٰى يُعْرَفَ الْغَضَبُ فِي وَجْهِه ثُمَّ يَقُولُ إِنَّ أَتْقَاكُمْ وَأَعْلَمَكُمْ بِاللهِ أَنَا
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবীদেরকে যখন কোন কাজের নির্দেশ দিতেন, তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্দেশ দিতেন। একবার তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো আপনার মতো নই। আল্লাহ তা‘আলা আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে তিনি রাগ করলেন, এমনকি তাঁর মুখমন্ডলে রাগের চিহ্ন ফুটে উটল। অতঃপর তিনি বললেন, তোমাদের চেয়ে আমিই আল্লাহকে অধিক ভয় করি ও আল্লাহ সম্পর্কে বেশি জানি। [সহীহ বুখারী, হা/২০।]
عَنْ عُمَرَ بْنِ أَبِى سَلَمَةَ أَنَّهٗ سَأَلَ رَسُولَ اللهِ - - أَيُقَبِّلُ الصَّائِمُ فَقَالَ لَهٗ رَسُولُ اللهِ - سَلْ هٰذِهِ لِأُمِّ سَلَمَةَ فَأَخْبَرَتْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ - - يَصْنَعُ ذٰلِكَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ قَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ . فَقَالَ لَهٗ رَسُولُ اللهِ - - أَمَا وَاللهِ إِنِّى لأَتْقَاكُمْ للهِ وَأَخْشَاكُمْ لَهٗ
উমর ইবনে আবু সালামা (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন, সাওম পালনকারী ব্যক্তি চুম্বন করতে পারে কী? তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, কথাটি উম্মে সালামাকে জিজ্ঞেস করো। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এরূপ করেন। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সমুদয় গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, শোনো! আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের সকলের চেয়ে বেশি ভয় করি। [সহীহ মুসলিম, হা/১১০৮।]
এসব হাদীসে আল্লাহভীতি সম্পর্কে স্বীকৃতির বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। তবে তার আমল থেকেও তাঁর সর্বাধিক তাক্বওয়াবান হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। যেমন-
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللهِ - - إِذَا صَلّٰى قَامَ حَتّٰى تَفَطَّرَ رِجْلَاهُ قَالَتْ عَائِشَةُ يَا رَسُولَ اللهِ أَتَصْنَعُ هٰذَا وَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَقَالَ يَا عَائِشَةُ أَفَلَا أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রাতের সালাত আদায় করতেন, এমনকি তাঁর দু‘পা ফুলে যেত। আয়েশা (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এত (ইবাদাত) করেন? অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তিনি বললেন, হে আয়েশা! আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না। [সহীহ মুসলিম, হা/২৮২০।]
অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন,
أَفَلَا أُحِبُّ أَنْ أَكُونَ عَبْدًا شَكُورًا
আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না? [সহীহ বুখারী, হা/৪৮৩৭।]
عَنْ ثَابِتٍ عَنْ مُطَرِّفٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ - - يُصَلِّى وَفِى صَدْرِه أَزِيزٌ كَأَزِيزِ الرَّحٰى مِنَ الْبُكَاءِ
সাবিত মুতাররফ হতে এবং তিনি স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সালাতরত অবস্থায় দেখেছি। কান্নার কারণে তাঁর বুকের মধ্য হতে যাঁতা পেষার আওয়াজের মতো আওয়াজ বের হতো। [আবু দাউদ, হা/৯০৪।]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ لِأَبِي بَكْرٍ غُلَامٌ يُخْرِجُ لَهُ الْخَرَاجَ وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يَأْكُلُ مِنْ خَرَاجِه فَجَاءَ يَوْمًا بِشَيْءٍ فَأَكَلَ مِنْهُ أَبُو بَكْرٍ فَقَالَ لَهُ الْغُلَامُ أَتَدْرِي مَا هٰذَا فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ وَمَا هُوَ قَالَ كُنْتُ تَكَهَّنْتُ لِإِنْسَانٍ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَمَا أُحْسِنُ الْكِهَانَةَ إِلَّا أَنِّي خَدَعْتُهٗ فَلَقِيَنِي فَأَعْطَانِي بِذٰلِكَ فَهٰذَا الَّذِي أَكَلْتَ مِنْهُ فَأَدْخَلَ أَبُو بَكْرٍ يَدَهٗ فَقَاءَ كُلَّ شَيْءٍ فِي بَطْنِه
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবু বকর (রাঃ) এর একটা গোলাম ছিল, যে তাঁকে কিছু কর প্রদান করত। আর আবু বকর (রাঃ) তার কর হতে খাবার গ্রহণ করতেন। একদা এ গোলাম কিছু জিনিস নিয়ে এল এবং আবু বকর (রাঃ) তা থেকে কিছু আহার করলেন। তখন গোলামটি তাঁকে বলল, আপনি কি জানেন এটা কী (যা আপনি খেলেন)? আবু বকর (রাঃ) বললেন, সেটা কী ছিল? সেই গোলাম বলল, জাহেলী যুগে আমি এক লোকের ভবিষ্যৎ গণনা করেছিলাম। মূলত আমি ভাগ্য গুণতে জানতাম না। বরং তাকে আমি প্রতারিত করেছিলাম মাত্র। আজ সে লোকটি আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে ঐ কাজের মূল্য প্রদান করল। এটাই সে বস্তু যা থেকে আপনি খেলেন। এ কথা শুনে আবু বকর (রাঃ) নিজের হাতখানা মুখে প্রবেশ করিয়ে বমি করে পেটের সব কিছু বের করে দিলেন। [সহীহ বুখারী, হা/৩৮৪২।]
ইবনে উমর (রাঃ) একদা সূরা মুত্বাফফিফীন পড়তে শুরু করলেন। যখন তিনি এ আয়াতে পৌঁছলেন يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ যেদিন সমস্ত মানুষ জগতসমূহের প্রতিপালকের সম্মুখে দাঁড়াবে- (সূরা মুত্বাফফিফীন- ৬)। তখন কাঁদতে শুরু করলেন। এমনকি তিনি পড়ে গেলেন এবং এর পরে আর পড়তে পারলেন না। [আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীম আল-লাহীদান, আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন ১/৭।]
নাফে‘ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন ইবনে উমর (রাঃ) এ আয়াত পড়তেন-
﴿أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ اٰمَنُوْاۤ أَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَكَثِيْرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُوْنَ﴾
যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয় ভক্তি-বিগলিত হওয়ার সময় কি আসেনি, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে? আর পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মত যেন তারা না হয়- বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে যাদের অন্তর কঠিন হয়ে পড়েছিল - (সূরা হাদীদ- ১৬)
তখন তিনি কাঁদতে শুরু করতেন, এমনকি ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। [আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীম আল-লাহীদান, আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন ১/৭।]
তামীম আদ-দারী (রাঃ) এক রাতে সূরা জাসিয়া তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। যখন তিনি এ আয়াতে পৌঁছলেন-
﴿أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَآءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَآءَ مَا يَحْكُمُوْنَ﴾
দুষ্কৃতিকারীরা কি মনে করে যে, আমি জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে তাদেরকে তাদের সমান গণ্য করব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ? (সূরা জাসিয়া- ২১)
তখন তিনি এ আয়াত পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। এমনকি সকাল হয়ে গেল। [শাইখ নাবীল আল-আওযী, খুত্বাব ওয়া মুহাযরাত, ৪৪/২।]
একদা উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ.) সূরা তূর তিলাওয়াত করছিলেন। তিনি যখন এ আয়াতে পৌঁছলেন,
﴿إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَاقِعٌ﴾
তোমার প্রতিপালকের শাস্তি তো অবশ্যম্ভাবী- (সূরা তূর- ৭)
তখন অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। এমনকি তিনি অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন বিছানায় শয্যাশয়ী থাকলেন। [আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন- ১/১০।]
সুফিয়ান (রহ.) বলেন, সাঈদ ইবনে সায়েব আত-তায়েফীর অশ্রু শুকাত না। সারাক্ষণ যেন তার অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকত। সালাত আদায়কালে, বায়তুল্লাহর তাওয়াফের সময় এবং কুরআন তিলাওয়াতের সময়ও কাঁদতেন। রাস্তায় তার সাথে সাক্ষাৎ হলেও আমি তাকে কাঁদতে দেখতাম। [মাওসূ‘আল খুতাবিল মুনীর ১/১৮৭৬; ইবনু হাজার আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব ৪/৩২, ১৪/৯৪, শামসুদ্দীন আয-যাহাবী ১৫/৪৫৯।]
হাফছ ইবনে উমর বলেন, হাসান বসরী কাঁদলেন। তাকে বলা হলো, কোন্ জিনিস আপনাকে কাঁদাল? তিনি বললেন, আমি আশংকা করছি যে, আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে; অথচ আমার কোন উপায় থাকবে না। [ফারীক আমল, দাওয়াত আলা মানহাজিন নবুওয়াত ২/৫২; মুহাম্মাদ খালফ সালামাহ, মাওরিদুল আযবুল মুঈন মিন আছারি আ‘আলামিত তাবেঈন, ১/৪৬।]
কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবী বকর হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি প্রত্যহ সকালে আয়েশা (রাঃ) এর বাড়িতে যেতাম এবং তাঁকে সালাম দিতাম। একদা সকালে তাঁর নিকট গিয়ে দেখলাম যে, তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে এ আয়াত তিলাওয়াত করছেন-
﴿فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُوْمِ﴾
অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে অগ্নিশাস্তি হতে রক্ষা করেছেন- (সূরা তূর- ২৭) এবং দু‘আ করছেন, কাঁদছেন এবং আয়াতটি পুনরাবৃত্তি করছেন। তখন আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, এমনকি দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট বোধ করলাম। অতঃপর আমার কোন প্রয়োজনে আমি বাজারে গেলাম। আমি ফিরে এসেও দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, যেভাবে সালাত আদায় করছিলেন এবং কাঁদছেন। এরূপ একটি বর্ণনা উরওয়া ইবনে জুবায়ের থেকেও রয়েছে। [আল-বুকাউ ইনদা ক্বিরাআতিল কুরআন, ১/৭; ড. ত্বলা‘আত মুহাম্মাদ আফীফী সালেম, হায়াতুছ সাহাবিয়াত, ১/২০, ৩২।]
আল্লাহভীরুদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে ক্ষত হয়, চোখ ক্রন্দন করে। তারা বলেন, আমরা কিভাবে আনন্দিত হতে পারি অথচ মৃত্যু আমাদের পিছনে, কবর আমাদের সম্মুখে, ক্বিয়ামত আমাদের ঠিকানা, জাহান্নামের উপর আমাদের রাস্তা এবং আল্লাহর সম্মুখে আমাদের অবস্থানস্থল।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন