HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

নবুওয়তের দাবীদারদের উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক পরিণতি

লেখকঃ ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
নবুওয়তের দাবীদারদের উৎপত্তি

ও ঐতিহাসিক পরিণতি

ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকাঃ
মুসলিম মাত্রই এটা বিশ্বাস করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ্ নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছেন, সুতরাং তাঁর পরে আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। এটি এমন এক বিশ্বাস যা না করলে ঈমানই শুদ্ধ হবে না।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পর, উমাইয়া ও আববাসী যুগে এমনকি বর্তমান কালেও মাঝে মধ্যে নবুওয়াতের দাবীদারদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের শত্রুদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্ররোচনা, তাদের ষড়যন্ত্র এবং তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় কিছু সময়ের জন্য তাদের কারো কারো কণ্ঠ উঁচু হতেও দেখা যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তাঁর দীন ইসলামকে যেমন পূর্ণ করেছেন তেমনি তার সংরক্ষণের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফলে যুগে যুগে এ সমস্ত নবুওয়তের দাবীদাররা ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। সাময়িকভাবে তারা পরিচিতি ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হলেও পরবর্তিতে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ‘‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহ্‌র জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্ তার বিপরীত করলেন, যেন তার নুর পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে। যদিও তা কাফিরদের মনে খারাপ লাগছে। তিনিই সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে সঠিক পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, যেন আর সব দীনের উপর বিজয়ী করতে সক্ষম হন, মুশরিকরা যদিও তাতে বিরক্ত হয়।’’ [সূরা আত-তাওবাহঃ ৩২-৩৩।]

আলোচ্য প্রবন্ধে ইতিহাসের পাতা থেকে সে সমস্ত ভন্ড নবীদের কথা বর্ণনা করা হবে যাদের অনুসারী তৈরী হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের আক্বীদা ও বিশ্বাসের প্রভাব রয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া অন্য যে সমস্ত নবুওয়তের দাবীদার রয়েছে কিন্তু তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের প্রভাব শেষ হয়ে গেছে বা তাদের অনুসারী-অনুগামী দল তৈরী হয়নি, তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে না।

এ প্রবন্ধের প্রথমেই নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি সংক্রান্ত দলীল-প্রমাণাদি পেশ করা হবে। তারপর বিভিন্ন যুগে কারা কিভাবে নবুওয়তের দাবী করেছিল তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

১ নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি ও তার প্রমাণাদি
মহান আল্লাহ্ যুগে যুগে নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। তাদের মাধ্যমে শরীয়ত ও দীনের উৎকর্ষ সাধন করেছেন। সবশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে তাঁকে শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণ শর‘আত প্রদান করে নবুওয়াত ও রিসালাতের পূর্ণতা দান করেছেন। যাতে কিয়ামত পর্যন্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিয়ে রেখেছেন। ফলে তাঁর পরে আর কোন নবী-রাসূল প্রেরণের আবশ্যকতা রইল না। যেমনি রইল না কোন কিতাব নাযিল করার। নিম্নে এর সপক্ষে আমরা কুরআন, হাদীস এবং সাহাবা-তাবে‘ঈন ও ইমামগণের উক্তি বর্ণনা করব।

১.১ নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের ঘোষণাঃ
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ

﴿ مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠﴾ [ الأحزاب :40]

‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহ্র রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ [সূরা আল-আহযাবঃ ৪০।]।’’

কুরআনের তাফসীরকারগণ সবাই এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এ আয়াতে خَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ এর অর্থ, শেষ নবী [যেমন: ইমাম তাবারী : মুহাম্মাদ ইবন্ জারীর ও জামেউল বায়ান,(কায়রো: দারুল হাদীস), ১৯৮৭, খ. ২২, পৃ. ১৬, আয-যামাখশারী: জারুল্লাহ উমর, আল-কাশশাফ, (বৈরুত, দারুল মা‘রিফাহ), খ.৩, পৃ. ২৩৯, ইবনুল জাওযী : আব্দুর রাহমান ইবন্ মুহাম্মাদ, যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর, (বৈরুত: আলমাকতাবুল ইসলামী), ১৪০৪ হি. খ.৬ পৃ. ২৯৩, আল-বাগাভী, আবু মুহাম্মাদ হুসাইন ইবন মাসউদ, মা‘আলিমুত তানযীল, (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ), ১৯৮৬, খ.৬, পৃ. ৫৬৫, আন-নাসাফী : আব্দুল্লাহ ইবন আহমাদ আবুল বারাকাত, তাফসীরে নাসাফী, (বৈরুত: দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ), ১৯৮৮, খ. ৩, পৃ. ২২৪।]।

মহান আল্লাহ্ আরও বলেনঃ

﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [ المائدة : 3]

‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাংগ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম [সূরা আল-মায়িদাহ: ৩।]’’।

এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাঁর মুমিন বান্দাদের উপর তার দয়া প্রদর্শনপূর্বক এটা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের দীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং আর কোন নবী এসে কোন সংযোজন বা বিয়োজন করার সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তাই এ দীনের উপরই আমল করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে [জহীর : ইহসান ইলাহী, আল-কাদিয়ানিয়্যাহ, দিরাসাহ ও তাহলীল, (পাকিস্তান: ইদারাতু তারজামানুস সুন্নাহ), ১৩৯৫, পৃ.২৭২। আল-গামেদী : আহমাদ সা‘দ, আকীদাতু খাতমিন নাবুওয়্যাহ, (রিয়াদ: দারু তাইবাহ), ১৪১৪ হি. পৃ.২৭২।]।

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেনঃ

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ ءَامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلۡكِتَٰبِ ٱلَّذِي نَزَّلَ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ وَٱلۡكِتَٰبِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ مِن قَبۡلُۚ ﴾ [ النساء : 136]

‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্‌র প্রতি, তাঁর রাসুলের প্রতি, তিনি যে কিতাব তাঁর রাসুলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তার প্রতি এবং যেসব কিতাব তিনি আগে অবতীর্ণ করেছেন সেসবে ঈমান আন’’ [সূরা আন-নিসা: ১৩৬।]।

এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমরা পূর্ববর্তী রাসূলগণের নিকট যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান আন। কিন্তু এ কথা বলা হয়নি যে, পরবর্তীতে যা নাযিল হবে তার উপরও ঈমান আনিও। পক্ষান্তরে পূর্ববর্তী উম্মতদের থেকে আমাদের নবী ও তাঁকে প্রদত্ত কিতাব কুরআন অনুসরণের অঙ্গিকার নেয়া হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেনঃ

﴿ وَإِذۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِيثَٰقَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ لَمَآ ءَاتَيۡتُكُم مِّن كِتَٰبٖ وَحِكۡمَةٖ ثُمَّ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مُّصَدِّقٞ لِّمَا مَعَكُمۡ لَتُؤۡمِنُنَّ بِهِۦ وَلَتَنصُرُنَّهُۥۚ قَالَ ءَأَقۡرَرۡتُمۡ وَأَخَذۡتُمۡ عَلَىٰ ذَٰلِكُمۡ إِصۡرِيۖ قَالُوٓاْ أَقۡرَرۡنَاۚ قَالَ فَٱشۡهَدُواْ وَأَنَا۠ مَعَكُم مِّنَ ٱلشَّٰهِدِينَ ﴾ [ آل عمران : 81]

‘‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্ নবীদের অংগীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসুল আসবে তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অংগীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে?’ তারা বলল, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ তিনি বললেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম’’ [সূরা আলে ইমরান: ৮১।]।

এ আয়াতে রাসূল বলে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। সুতরাং তার উপর ঈমান আনয়ন করার জন্য সমস্ত নবী-রাসূলগণ আদিষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ অঙ্গিকার নেয়া হয়নি, কারণ তারপরে আর কোন নবী-রাসূল আসবে না।

১.২ নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি সংক্রান্ত পবিত্র হাদীস থেকে উদ্ধৃতিঃ
পবিত্র কুরআনে যে ভাবে স্পষ্টভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী ঘোষনা করা হয়েছে তেমনিভাবে বিভিন্ন হাদীসেও তা এসেছে। নিম্নে কয়েকটি বিখ্যাত হাদীস বর্ণনা করছিঃ

এক. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমার উম্মতের মধ্য থেকে অনেক মিথ্যাবাদির উদ্ভব ঘটবে যারা প্রত্যেকেই মনে করবে যে, সে নবী, অথচ আমি নবীদের শেষ, আমার পরে আর কোন নবী নেই [আত-তিরমিযী , আবু ঈসা মুহাম্মাদ ইবন ঈসা, আল-জামেউত তিরমিযী, (বৈরুত, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ), ১৪১৮হি, হাদীস নং (২২১৯)।]।’

দুই. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘আমি নবীদের নেতা, গর্ব করে বলছি না। আমি শেষ নবী, গর্ব করে বলছি না। আমি প্রথম সুপারিশকারী এবং প্রথম যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, এটাও গর্ব করে বলছি না। [ইবন হাম্বল , আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ, আল-মুসনাদ খ. ১ পৃ.২৭।]’

তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘আমি হাজার হাজার নবীদের শেষ নবী। প্রত্যেক অনুসৃত নবীই তাদের উম্মতকে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন’ [হাকিম আন-নিশাপুরী : আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ, আল-মুস্তাদরাক ‘আলাস সাহীহাইন, (বৈরুত, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ), ১৪১১ হি, খ.২ পৃ.৫৯৭।]।

চার. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ ‘নবুওয়াত শেষ হয়ে গেছে তবে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত শুভসংবাদ বাকী রয়েছে [ইবন্ হাম্বল আল-মুসনাদ, (বৈরুত, আল-মাকতাবুল ইসলামী), ১৪১৪ হি. খ.৬ পৃ. ৩৮১।]’।

পাঁচ. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ ‘বনী ইসরাঈলদেরকে তাদের নবীরা শাসন করত। যখন কোন নবী মারা যেত তখনি অন্য নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতো। কিন্তু আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলীফা হবে আর তাদের সংখ্যাও বেশী হবে [বুখারী , মুহাম্মাদ ইবন ইসমাঈল, আস-জামে আস-সহীহ, (রিয়াদ: দারুস সালাম), ১৪১৭ হি. হাদীস নং (৩২৬৮), সহীহ মুসলিম , ইবন্ হাজ্জাজ আল-কুশায়রী, (কায়রো: দারুল হাদীস), ১৪১২ হি. আস-সহীহ, হাদীস নং (১৮৪২)।]।’

ছয়. তাছাড়া ‘আমার পরে আর কোন নবী নেই’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তি মুতাওয়াতির বা অকাট্যভাবে অগণিত অসংখ্য বর্ণনায় এসেছে [আল-গামেদী , প্রাগুক্ত পৃ. ৩১।]।

১.৩ নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি প্রমাণকারী সাহাবা, তাবেয়ীন ও ইমামগণের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডঃ
সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর নবুওয়তের দাবীদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছিলেন।

যে সমস্ত হাদীসে ‘খাতমে নবুওয়াত’ বা নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি সাব্যস্ত হয়েছে সেগুলো সাহাবাগণই বর্ণনা করেছেন।

এ সমস্ত হাদীস অত্যন্ত অকাট্যভাবে এত অধিক হারে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।

যে সমস্ত সাহাবা থেকে হাদীসে ‘খাতমে নবুওয়াত’ সংক্রান্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাদের সংখ্যাঃ ৩৭ জনে দাঁড়িয়েছে [প্রাগুক্ত পৃ. ৬৭, আত-তাইয়্যেব, আস‘আদ মুহাম্মাদ, আল-মুতানাবিবয়ূন, নাশআতুহুম, উসুলুহুম ওয়া নিহায়াতুহুম, (বৈরুত, দারু ইবন্ হাযম), ১৪১৭হি. পৃ. ১৪.]।

তাছাড়া উম্মতের সত্যনিষ্ঠ আলেমগণ এ ব্যাপারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, নিম্নে এর কয়েকটি উদ্ধৃত করা হলোঃ

ইমাম আবু হানিফা রাহেমাহুল্লাহর সময়ে এক ব্যক্তি নবুওয়তের দাবী করল এবং তার দাবীর সমর্থনে দলীল-প্রমাণাদি উত্থাপনের সুযোগ চাইল। তখন ইমাম আবু হানিফা রাহেমাহুল্লাহ বলেছিলেনঃ ‘যে কেউ তার থেকে তার নবুওয়তের সমর্থনে কোন দলীল-প্রমাণ পেশ করতে বলবে সে কাফের হয়ে যাবে; কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আমার পরে কোন নবী নেই’ [আল-কারদারী, মানাকেবে আবু হানিফা, (বৈরুত, দারুল মা‘রিফাহ), ১৪১২ হি, খ.১, পৃ.১৬১।]’। অর্থাৎ, নবুওয়তের দাবীদারদেরকে তাদের দাবীর সমর্থনে কোন প্রমাণ বা যুক্তি-তর্ক পেশ করারও সুযোগ দেয়া যাবে না; কারণ এটা আমাদের কুরআন ও হাদীসের সরাসরি বিপরীত কাজ।

ইমাম আবু ইউসুফ রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘যদি কোন নবুওয়তের দাবীদার বের হয় এবং নবুওয়তের দাবী করে তখন যে কেউ তার কাছে তার দাবীর সমর্থনে প্রমাণ পেশ করতে বলবে, সে নিজেই কাফের হয়ে যাবে। কারণ, তখন সে সরাসরি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহকে অস্বীকার করেছে [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত পৃ. ৭২।]’।

ইমাম তাহাভী রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীদের মধ্যে শেষ নবী, সমস্ত মুত্তাকীদের ইমাম এবং সমস্ত রাসূলদের নেতা। তাঁর পরে এ ধরনের যাবতীয় দাবী পথভ্রষ্টতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ [আত-তাহাভী, আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবন্ সালামাহ আল-আযদী, আল-আকীদাতুত তাহাভীয়্যাহ, (রিয়াদ, ওযারাতুশ শুয়ুনুল ইসলামিয়্যাহ), সম্পাদনা: শায়খ আহমাদ শাকের, ১৪২২ হি. পৃ. ৯৫।]’।

২ যুগে যুগে নবুওয়াতের দাবীদারদের উৎপাত
আগেই বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে ভন্ড নবীদের উত্থানের বিষয়ে পূর্বাহ্নেই সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পরে ত্রিশের মত মিথ্যুক, দাজ্জাল বা প্রতারক লোকের উদ্ভব না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামত আসবে না, যাদের প্রত্যেকেই ধারনা করবে যে, সে আল্লাহ্র রাসূল [বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৩৪১৩, ৬৫৩৬, মুসলিম, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ১৫৭।]’।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বানী প্রমাণিত হয়েছে। যুগে যুগে ভন্ড নবীদের উত্থান ঘটেছে। নিম্নে তাদের উত্থান, পতন ও বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।

২.১ ইসলামের প্রাথমিক যুগে ভন্ড নবীদের উত্থান
ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই ভন্ড নবীদের উত্থান শুরু হয়। সবপ্রথম যে সমস্ত ভন্ডের উৎপত্তি হয়েছিল তারা হলো, আল-আসওয়াদ আল-আনাসী, তুলাইহা ইবন খুয়াইলিদ, মুসাইলামাহ আল-কাযযাব এবং সাজাহ। নিম্নে তাদের প্রত্যেকের পরিচিত ও পরিণতি দেয়া হলো।

২.১.১ আল-আসওয়াদ আল-আনাসীঃ
তার নাম ছিল ‘আবহালাহ’ পিতার নাম কা‘ব [ইবুনল আসীর, আল-কামিল ফিত তারিখ, (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ), ১৪২০ হি, খ.২, পৃ.৩৩৬।]। সর্বদা পাগড়ী পড়া ও মুখ ঢাকা অবস্থায় থাকত। বিভিন্ন তেলেসমাতি দিয়ে মানুষদের ধোকা দিত। ইয়ামানের এক বিরাট অংশে সে তার প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হলো। একসময় মুসলমানগণ তার অনুসারীদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে মদীনায় এসে এসব ঘটনা জানতে পারলেন। তিনি মুসলমানদেরকে এ ফেতনা রুখে দাড়ানোর নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ তার স্ত্রী (যিনি সত্যিকার ঈমানদার মহিলা ছিলেন) তার সহযোগিতায় তাকে হত্যা করলেন। তার সময়কাল ছিল মাত্র তিন মাস। মতান্তরে চার মাস। তার মৃত্যুর সাথে সাথে তার সাথীরা পুনরায় ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসতে শুরু করে [ইবন্ কাসীর, আবুল ফিদা ইসমাইল ইবন উমর ইবন কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, (মিশর, দারু হাজার), ১৪১৮ হি,খ.৬, পৃ.৩০৭।]।

১০
২.১.২ তুলাইহা ইবন্ খুয়াইলিদঃ
তার নাম তুলাইহা, পিতার নাম খুয়াইলিদ, গোত্র বনু আসাদ। সে আরবের সাহসী বীরদের অন্যতম ছিল। হিজরী নবম সনে সে বনু আসাদ গোত্রের প্রতিনিধিদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দেখা করতে আসে এবং তার স্বজাতির সাথে ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর সে তার দেশে ফিরে গিয়ে নবুওয়তের দাবী করে বসে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিযুক্ত গভর্ণর দ্বারার ইবনুল-আযওয়ার তাকে আক্রমন করে কিন্তু তরবারী আঘাতে তার শরীরে কাজ করেনি। এটা দেখে মানুষের মধ্যে তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। আরবের বনু আসাদ, গাতফান এবং ত্বাই গোত্রের অপরিনামদর্শী অনেকেই তার সাথী হয়ে যায় [আত-ত্বাবারী , আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবন্ জারীর, তারিখুল উমামে ওয়াল মুলুক, (বৈরুত: দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ), ১৪০৭ হি, খ. ৩, পৃ. ২৬১।]। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যান।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খলীফা হয়ে তার বিরুদ্ধে খালেদ ইবন ওয়ালিদকে প্রেরণ করেন। সে যুদ্ধে তুলাইহা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তার স্ত্রী সহ সিরিয়ায় পলায়ন করে। সেখানে থাকা অবস্থায় সে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার পরবর্তী জীবন ইসলামের ছায়াতলেই কাটিয়েছিল। পরবর্তীতে নাহাওয়ান্দের যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতা করেছিল এবং সে যুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন [আল-উমারী, আহমাদ মারয়ী, খাসায়েসুর রিসালাতুল মুহাম্মাদিয়্যাহ, মাষ্টার্স থিসিস, (মক্কা: উম্মুল কুরা ইউনিভাসিটি), ১৩৯৮ হি, পৃ. ২৩৮।]।

১১
২.১.৩. মুসাইলামাহ আল কায্যাবঃ
তার নাম মুসাইলামাহ, পিতা সুমামাহ, গোত্র বনু হানিফা। নাজদের ইয়ামামাহ অঞ্চলের আল-আইনিয়্যাহ এলাকায় তার জন্ম। লোকেরা তাকে রাহমানুল ইয়ামামাহ বলত। হিজরী নবম সনে তার গোত্র বনু হানিফার সাথে সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়। সে তখন বলেছিল যে, মুহাম্মদ যদি আমাকে তার সাথে নবুওয়তে অংশীদার মেনে নেয় তবে আমি তার অনুসরণ করবো। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবেত ইবন কায়েস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সাথে নিয়ে তার কাছে এক খন্ড গাছের ছোট ডাল নিয়ে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ ‘যদি তুমি আমার কাছে এ কাঠটিও প্রত্যাশা কর, তাহলেও আমি তোমাকে তা দিব না। আল্লাহ্র নির্দেশ নবুওয়াত বা ওহী তোমার ভাগ্যে জুটবে না। যদি তুমি তোমার দেশে ফিরে যাও তবে তিনি (আল্লাহ) তোমাকে জবাই করবেন [বুখারী, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৩৪২৪, মুসলিম, প্রাগুক্ত, হাদীস নং ২২৭৩,২২৭৪।]।

ইয়ামামায় ফিরে গিয়ে মুসাইলামাহ মুরতাদ হয়ে যায় এবং নবুওয়তের দাবী করে বসে ও বিভিন্ন কথা মিথ্যা বানিয়ে বলতে আরম্ভ করে। তারপর দশম হিজরী সনে মদীনায় তার পক্ষ থেকে দূত প্রেরণ করে এবং তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নবুওয়তের অংশীদার হিসেবে মেনে নেয়ার আহবান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উত্তরে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে, ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমান, আল্লাহ্‌র রাসূল মুহাম্মাদ হতে মিথ্যুক মুসাইলামাহর প্রতি। যে হিদায়েত অনুসরণ করে তার প্রতি সালাম। তারপরঃ যমীনের মালিকানা আল্লাহ্রই। তিনি তার বান্দাদের মাঝে যাকে ইচ্ছা ওয়ারিশ বানান। আর শুভ পরিণাম শুধু মুত্তাকীদের জন্য। [আল-হাইসামী, নূরুদ্দীন, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ ওয়া মানবা‘উল ফাওয়ায়েদ, (বৈরুত: মুআসসাসাতুল মা‘আরিফ), ১৪০৬হি, খ. ৫, পৃ. ৫৬৭। ইবন হিশাম, আব্দুল মালিক, আসসীরাতুন নাবওয়ীয়্যাহ, (বৈরুত, দারুল মা‘রিফাহ), ১৪১১ হি, খ.৪, পৃ. ৩৪৮।]’’

ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খলীফা নিযুক্ত হলেন। তিনি খালেদ ইবন ওয়ালীদ, ইকরিমা ইবন্ আবি জাহল এবং শুরাহবীল ইবন হাসানাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এর নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করলেন। তারা তার শক্তিকে ধ্বংস করতে সামর্থ হলেন। রাসূলের চাচা হামযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে যিনি শহীদ করেছিলেন সেই ওয়াহশী পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এ যুদ্ধে মুসাইলামাহকে হত্যা করেছিলেন।

তার মৃত্যুর সাথে সাথেই সমস্ত মানুষ দীন ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। এটা ছিল হিজরী ১১ তম সনের ঘটনা [ইবন কাসীর : প্রাগুক্ত, খ.৬, পৃ.৩২৩।]।

১২
২.১.৪ সাজাহ বিন্ত হারিস
এ মহিলার পূর্ণ নাম, সাজাহ বিনত হারিস ইবন সুওয়াইদ ইবন উকফান। সে সিরিয়ার আরব্য গোত্র বনু তাগলিবের নাসারাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে সে নবুওয়াতের দাবী করে। তার গোত্রের লোকেরা তাকে সহযোগিতা করে। সে আশে পাশের অন্যান্য গোত্রের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সামর্থ হয়। এমনকি তার ক্ষমতায় ভীত হয়ে মুসাইলামাহ তার সাথে সন্ধির প্রস্তাব করে। সন্ধির মজলিসে মুসাইলামাহ তাকে বিয়ের প্রস্তাব করে এবং তার সাথে তিনদিন অবস্থান করে। তারপর সে বনু তাগলিবে অবস্থান করতে থাকে [এখানে এটা সুস্পষ্ট যে, মুসলমানগণ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি কারণ সে নাসারাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে পূর্বে মুসলমান হয়নি এবং মুর্তাদও ছিল না। তাছাড়া সে তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজেকে জড়ায়নি।]।

পরবর্তীতে আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করলে সে ইরাকের বাসরায় চলে যায় এবং সেখানে অবস্থান করে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে সে পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং সাহাবী সামুরাহ ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার মৃত্যুর পর তার উপর জানাযার সালাত আদায় করেছিলেন [আত-তাবারী, প্রাগুক্ত, খ.৩, পৃ.২৭১, ইবন কাসীর, প্রাগুক্ত, খ. ৬, পৃ. ৩১৯, ইবনুল আসীর, প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ.৩৫৭।]।

১৩
২.২ উমাইয়া ও আববাসী যুগে ভন্ড নবীদের উত্থান
উমাইয়া ও আববাসী যুগেও বেশ কয়েকজন নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করেছিল। নিম্নে তাদের মধ্যে বিখ্যাতদের আলোচনা করা হলোঃ

১৪
২.২.১ আল-মুখতার
তার নামঃ আল মুখতার, পিতার নামঃ আবু উবাইদ ইবন্ মাসউদ। গোত্র বনু সাকীফ। তার পিতা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি তাকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেননি। এ জন্য তাকে কেউ সাহাবী হিসেবে গণ্য করেনি। ইবনুল আসীর বলেনঃ তার পিতা ইসলামের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন এবং পারসিকদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

কিন্তু তার পুত্র মুখতার। সে প্রথমে নিজেকে শিয়াদের মতবাদে বিশ্বাসী বলে প্রচার করল। তারপর বলতে শুরু করল যে, তার কাছে জিবরীল ফিরিশ্তা আসে এবং তাকে জানিয়ে দেয়। এভাবে সে নবুওয়াতের দাবী করে বসে। শিয়া মতবাদের অনুসারীরা তার আনুগত্য করল। ফলে সে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ইরাকের কূফা নগরী দখল করে বসে। তখন আব্দুল্লাহ্ ইবন যুবাইর তার ভাই মুস‘আব ইবন্ যুবাইরকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হওয়ার পর হিজরী ৬৭ সনে সে চুড়ান্তভাবে পরাজিত ও নিহত হয় [আল-বাগদাদী, আবু মনসূর, আল-ফারক বাইনাল ফিরাক, (বৈরুত, দারুল মা‘রিফাহ), পৃ.৪৫, ইবন কাসীর, প্রাগুক্ত, খ.৮, পৃ. ২৮৯।]।

১৫
২.২.২ আল-হারেস ইবন সা‘য়ীদ
তার নামঃ আল হারেস ইবন্ সা‘য়ীদ, দাস শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। দামেস্কে অবস্থান করত। সেখানে সে ইবাদত ও পরহেযগারীতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে সে পদস্খলিত হয়ে পড়ে। প্রাথমিক জীবনে তার অবস্থা এমন ছিল যে, তাকে দেখলে ও তার কথা শুনলে সবাই প্রভাবিত না হয়ে পারত না। ইতোমধ্যে সে বিভিন্নভাবে শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হতে আরম্ভ করে। সে তার পিতার নিকট তার বিভিন্ন অবস্থা লিখে পাঠায় যে, আমাকে মনে হচ্ছে শয়তান কুপ্ররোচনা দিচ্ছে। কিন্তু তার পিতা তাকে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয় যে, তুমি তো আবেদ মানুষ, তোমাকে শয়তান প্ররোচনা দিবে কেন? সুতরাং যা দেখছ তাই বলে বেড়ায়। এতে সে আরো বেশী উৎসাহী হয়ে যায় এবং নবুওয়তের দাবী করে বসে। খলীফা আব্দুল মালেক ইবন মারওয়ান তাকে ডেকে এনে আলেমদের মাধ্যমে অনেক উপদেশ দেয়। কিন্তু সে তার নবুওয়তের দাবী থেকে পিছপা হয়নি। তখন ৭৯ হিজরী সালে তিনি তাকে শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করেন [ইবনুল জাওযী , আবুল ফারজ আব্দুর রহমান, তালবীসে ইবলীস, (দাম্মাম: দারু ইবনুল জাওযী), ১৪২০হি, পৃ. ৪২৯। ইবন কাসীর, প্রাগুক্ত, খ.৯, পৃ. ২৮।]।

১৬
২.২.৩ বায়ান ইবন সাম‘আন
তার নামঃ বয়ান ইবন সাম‘আন। গোত্রঃ আন-নাহদী। তিনি বনী তামীমের লোক ছিলেন। হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষে সে নবওয়তের দাবী করে। তার অনুসারীদের ‘‘আল-বায়ানীয়্যাহ’’ বলা হতো [আশ-শাহরাস্তানী, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল করীম, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, (বৈরুত: দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ), ১৪১৩, খ.১, পৃ. ১৭৬।]।

সে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তাই তার মধ্যে ইমাম নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা কাজ করছিল। তার মতে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পুত্র ‘মুহাম্মাদ আল-হানাফীয়্যাহ’র পুত্র আবু হাশিম হলো হক্ক ইমাম। আবু হাশিমের মৃত্যুর পর ইমামত বা শিয়াদের নেতৃত্ব তার অর্থাৎ, বায়ান ইবন সাম‘আনের উপর অর্পিত হয়েছে। সে অদ্ভুত কিছু বিশ্বাসের অধিকারী ছিল। সে মনে করত যে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে আল্লাহ‌্‌র কিছু অংশ বর্তমান (নাউযুবিল্লাহ) সে হিসেবে এটি ধীরে ধীরে পুনর্জন্মবাদ মতবাদের মাধ্যমে তার (বয়ান ইবন্ সাম‘আনের) মধ্যেও সন্নিবেশিত হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)। শেষ পর্যন্ত সে নবওয়তের দাবী করল।

সে যুগের ইরাকের বিখ্যাত গভর্ণর খালিদ ইবন্ আবদুল্লাহ আল-কাছরীকে তার সম্পর্কে জানানো হলো তিনি বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে তাকে পাকড়াও করতে সামর্থ হন। তিনি তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করেন। কারও কারও মতে তাকে তিনি পুড়িয়ে মেরেছিলেন [ইবন হাযম, আবু মুহাম্মাদ আলী ইবন্ আহমাদ, আল-ফিসাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নিহাল, (কায়রো, মাকতাবাতুল খানজি), খ.৪, পৃ. ১৮৫।]।

১৭
২.২.৪ আল-মুগীরাহ ইবন সা‘ঈদ আল-‘ইজলী
তার নামঃ আল-মুগীরাহ ইবন্ সা‘ঈদ। গোত্রঃ আল ‘ইজলী। সে কুফার অধিবাসী ছিল। ইরাকের গভর্ণর খালিদ ইবন আব্দুল্লাহ আল-কাছরীর দাস ছিল [আশ-শাহরাস্তানী, প্রাগুক্ত, খ.১, পৃ. ১৭৬।]।

নিজে শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় তার মধ্যে ইমাম হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সে প্রথমে দাবী করে বসল যে, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান ‘নাফসে যাকীয়্যাহ’ এর উত্তরসূরী ইমাম। কিছুদিন পর দাবী করে বসল যে, সে রাসূল এবং জিবরীল তার কাছে ওহী নিয়ে আসে। তাছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে এমন সব বাজে মন্তব্য করতে লাগল যা কোন সুস্থ বিবেক মেনে নেয় না [আল-বাগদাদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৯।]।

ইরাকের গভর্ণর খালিদ ইবন্ আব্দুল্লাহ আল-কাছরী তার সম্পর্কে জানার পর তাকে পাকড়াও করলেন এবং তাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বললেন। কিন্তু সে তা করতে সমর্থ হলো না। এমতাবস্থায় তিনি তাকে ১১৯ হিজরী সনে হত্যা করেন [ইবন কাসীর, প্রাগুক্ত, খ.৯, পৃ. ৩২৩।]। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩২।]।

১৮
২.২.৫ আবু মানসূর আল-‘ইজলী
লোকটি তার কুনিয়াত আবু মানসূর নামেই প্রসিদ্ধ। সেও আল-‘ইজলী গোত্রের লোক ছিল। কুফায় বসবাস করত। তবে সে মোটেই লেখাপড়া জানত না।

লোকটি শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিল। সে প্রথমে নিজেকে ‘আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবন আল-হুসাইন ‘‘আল-বাকের’’এর খলীফা দাবী করত। পরবর্তীতে দাবী করল যে, আল-বাকের তাকে ইমামতের দায়িত্ব প্রদান করে গেছেন [আল-বাগদাদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৪।]।

তারপর সে ঘোষণা করল যে, রিসালতের ধারা সমাপ্ত হয়নি। আলী ইবন্ আবী তালেব একজন রাসূল। অনুরূপভাবে হাসান, হুসাইন এবং হুসাইনের সন্তানগণ সবাই রাসূল। তারপর যখন (তার ধারণা মতে) মুহাম্মাদ আল বাকের তাকে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে সুতরাং সেও রাসূল। এরপর দাবী করল যে, জিবরীল তার কাছে ওহী নিয়ে আসে।

খলীফা হিশাম ইবন্ আবদুল মালিক এর খিলাফত কালে তার পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইরাকের গভর্ণর ইউসুফ ইবন্ উমর আস-সাকাফী তাকে পাকড়াও করে এবং শুলের মাধ্যমে হত্যা করে [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৪।]।

১৯
২.২.৬ আবুল খাত্তাব আল-আসাদী
তার নামঃ মুহাম্মাদ ইবন্ আবি যয়নব [আল-আশ‘আরী , আবুল হাসান আলী, মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন, (বৈরুত, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ), ১৪১১ হি. খ. ১, পৃ. ৭৬।]। কূফার বনী আসাদ গোত্রের দাস ছিল। সে ইমাম জা‘ফর সাদেকের মাযহাবের অনুসারী বলে নিজেকে পরিচয় দিত। কিন্তু ইমাম জা‘ফর সাদেক তার আচার-আচরণ সম্পর্কে অবগত হয়ে তার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেন [আশ-শাহরাস্তানী , প্রাগুক্ত, খ.১, পৃ. ১৭৯।]।

এতে সে রাগান্বিত হয়ে নিজেকে ইমাম ঘোষণা করে বসে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সে নবুওয়তের দাবী করে এবং জান্নাত ও জাহান্নাম অস্বীকার করে বসে।

আববাসী খলীফা মানসূর তার সম্পর্কে জানার পর কূফার গভর্ণর ঈসা ইবন মূসাকে তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন। ঈসা ইবন মূসা তাকে গ্রেফতার ও হত্যা করলেন। মতান্তরে তিনি তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করেন [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৬।]।

২০
২.২.৭ আলী ইবন্ ফাদল আল-হিময়ারী
তার নামঃ আলী ইবন ফাদল ইবন আহমাদ আল-খানফারী আল-হিময়ারী [ইবন খালদুন, আব্দুর রহমান, দিওয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খাবার.. (বৈরুত, মুআসসাসাতু জামাল লিততাবা‘আতি ওয়ান নাশরি), খ.৪, পৃ.৩০-৩৪, আল-মাকরীযী, ইত্তে‘আযুল হুনাফা, (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ), ১৪১৩ হি. খ.১, পৃ. ১২, আল-ইয়াফে‘য়ী, মিরআতুল জিনান, হায়দরাবাদ, ১৩৩৭ হি. খ.১, ৪৪৬, ৪৭০, আল-মাস‘উদী: মারুজুয যাহাব, বৈরুত, দারুল কুতুবুল ইলমিয়্যাহ, ১৩৯১ হি.খ.১, ৮৬, ও খ.২, ১৫৪, যিরিকলী : খাইরুদ্দিন, আল-আ‘লাম, বৈরুত, দারুল ইলম লিলমালাইন, খ.৪, পৃ. ৩১৯, খ.৫, ১৯৪, খ.৭, ১৩৫, খ.৮, ১৪১।]। শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিল। সে হজ্জ ও কারবালায় হুসাইনের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন আল-কাদ্দাহ নামক কারামাতী (কিরমতী) সম্প্রদায়ের নেতার সাথে সাক্ষাত হয়। উবাইদুল্লাহ এ লোককে দেখেই বুঝতে পারল যে তাকে পথভ্রষ্টতায় খাটানো যাবে। সুতরাং সে তাকে ইয়ামেনে প্রতিনিধি নিযুক্ত করল।

ইয়ামেনে ফিরে আলী ইবন্ ফাদল নিজেকে বড় সূফী হিসেবে প্রকাশ করল। লোকেরা তার চারপাশে জড়ো হতে লাগল। এভাবে সে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং ইয়ামনের বিরাট অংশ দখল করে নেয়। তারপর ‘সান‘আ’য় প্রবেশ করে সেখানকার এক মসজিদের মিম্বরে উঠে নিজেকে নবী হিসেবে দাবী করে এবং প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ইয়ামনবাসীগণ তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠে এবং তাকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোনভাবেই তারা এ কাজে সফল হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত একজন বিজ্ঞ ডাক্তার তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করল। আর সেটা ছিল ৩০৩ হিজরী সনের ঘটনা [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৮।]।

২১
৩ পরবর্তীকালের নবুওয়তের দাবীদার
আববাসী যুগের শেষের দিকে মুসলমানদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়লেও নবুওয়তের দাবীদারদের সংখ্যা তখন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে ছিল না। তারপর উসমানীয় তুর্কী খিলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নবুওয়তের দাবীদারদের পুনরুত্থান ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে তুর্কী খিলাফত অবসান হয়ে যাওয়ার পর এ ফিতনা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ এবং উমাইয়া ও আববাসীয় যুগের মিথ্যা নবুওয়তের দাবীদারদের শেষ পরিণতি এই ছিল যে, তারা তৎকালীন খলীফা বা গভর্ণরের হস্তক্ষেপে অবদমিত হয়। ফলে তাদের কোন অনুসারী অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম খিলাফতের পতনের পর দীন বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিকারের ধারা স্তব্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুসলমানগণ ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে এ যুগে যারা নবুওয়তের মিথ্যা দাবী করেছিল তাদের দমন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

এ সময়কার নবুওয়তের দাবীদারদের মধ্যে যারা বেশী প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল তাদের মধ্যে নিম্নোক্ত ব্যক্তিগুলো অন্যতমঃ

২২
৩.১ আলী মুহাম্মাদ আলী মীর্যা। (আল-বাব)
১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে ইরানের শীরাজে শিয়া সম্প্রদায়ের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারে তার জম্ম হয়। সে নিজেকে আহলে-বাইত তথা রাসূলের বংশধর বলে দাবী করত, যা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। তার পিতা মারা যাওয়ার পরে মক্তবে পড়ালেখায় ভর্তি হলেও লেখাপড়ায় ছিল সম্পূর্ণ অমনোযোগী। পরবর্তীতে আরবী ও ফার্সী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে। তারপর সে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে কিন্তু সে ব্যবসায় ভালো না করতে পেরে বুশহর নগরীতে গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা আরম্ভ করে এবং তার ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে [জহীর, ইহসান ইলাহী, আল-বাবিয়্যাহ, পৃ.৫১।]।

এ সময়ে তৎকালীন শিয়া আলেম জাওয়াদ আত-তাবাতাবায়ীর সাথে তার সাক্ষাত হয় এবং বেশ কিছু দিন তার সান্নিধ্যে কাটায়। পরবর্তীতে সে বড় ধরনের আবেদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তারপর সে সুফীবাদে প্রভাবিত হয়ে সর্বেশ্বর মতবাদে বিশ্বাসী হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে সে দাবী করে বসে যে, শীয়াদের দ্বাদশ ইমাম ‘‘মাহদী’’র আত্মা তার ভিতরে প্রবেশ করেছে [প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।]।

১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে সে নিজেকে মাহদীর কাছে পৌঁছার পথ বা মাধ্যম বলে প্রচার করে। এরপর সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে [আত-তাইয়্যেব, আস‘আদ মুহাম্মাদ, আল-মুতানাবিবয়্যুন নাশআতুহুম উসুলুহুম ও নিহায়াতুহুম,(বৈরুত: দারু ইবন্ হাযম), প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৭, পৃ. ৫৬।]।

তৎকালীন ইরান সরকার তাকে গ্রেফতার করে এবং ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে তাকে হত্যা করে তার লাশকে শহরের বাইরে নিক্ষেপ করে [প্রাগুক্ত।]।

২৩
৩.২ হুসাইন আলী মাযন্দারানী আল-বাহা
বাহাঈ সম্প্রদায়ের প্রবর্তক হুসাইন আলী মাযান্দারানী ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে ইরানের মাযান্দারান শহরে জন্ম গ্রহণ করে। তার শিক্ষা জীবনের শুরুতে তৎকালীন সময়ে তেহরানে প্রচলিত বিভিন্ন জ্ঞান আহরন করে। তারপর সুফীবাদে দীক্ষিত হয় এবং সুফীদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করে।

আলী মুহাম্মাদ আলী মীর্যা বাবের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা তৎকালীন ইরানের বাদশাহকে আক্রমন করার ফলে বাদশাহর সৈন্যরা তাকে এ ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সে ছাড়া পায় এবং বাগদাদে পলায়ন করে। সেখানে আলী মুহাম্মাদ আলী মীর্যা বাবের অনুসারীগণ ধীরে ধীরে তার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করে। এতে সে তার নিজের ব্যাপারে ভীত হয়ে সেখান থেকে কুর্দিস্তানে পলায়ন করে। সেখানে সুফী-দরবেশদের আখড়ায় অবস্থান করতে থাকে। পরবর্তীতে তার অনুসারীরা তাকে বাগদাদে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। সে ফিরে আসার পর তারা সেখানে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি করে। এমতাবস্থায় তুর্কী খলীফা তাদেরকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। সেখানেও তারা অনুরূপ সমস্যা সৃষ্টি করলে খলীফা তাদেরকে ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘‘আদরানাহ’’ নামক স্থানে নির্বাসনে পাঠায়। সেখানে তারা তাদের গোপন দাওয়াত প্রসারিত করে। সেখানে সে নিজেকে পর্যায়ক্রমে মাহদী, মাসীহ , নবী এমনকি ইলাহ হওয়ারও দাবী করে। ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে ৭৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয় [আল-ওয়াকীল, আব্দুর রাহমান, আল-বাহাইয়্যাহ, (কায়রো: মাতবায়াতুস সুন্নাতুল মুহাম্মাদিয়্যাহ), প্রথম সংস্করণ, ১৯৬২,পৃ.১৪৩-১৪৪।]।

অন্যান্য নবুওয়তের ভন্ড দাবীদারদের মত তার অনুসারীরা শেষ হয়ে যায়নি। কারণ উপনিবেশবাদীরা তাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষ-ফোঁড়া হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে [বাংলাদেশের ঢাকায় হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের পাশে বাহাঈ সম্প্রদায়ের প্রধান কেন্দ্র অবস্থিত। তারা সেখানে সাধারণ মানুষকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করছে।]।

২৪
৩.৩ গোলাম আহমাদ ইবন্ মীর্যা গোলাম কাদিয়ানী
১৮৩৬ বা ১৮৩৭ অথবা ১৮৩৯ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান নগরীতে তার জম্ম হয়। নিজেকে সে আহলে বাইত তথা কুরাইশ বংশীয় বলে দাবী করতে দ্বিধা করেনি। অথচ সে নিজেই তার বংশধারা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছে। একবার বলেছে যে সে পারস্য বংশোদ্ভূত। আবার কখনো কখনো বলত যে, সে মঙ্গোলীয় বা মোগল [আবুল হাসান আলী আন-নদভী, আল-কাদিয়ানী ওয়াল কাদিয়ানিয়্যাহ, পৃ. ২০। জহীর , ইহসান ইলাহী, আল-কাদিয়্যানিয়্যাহ, দিরাসাহ্ ওয়া তাহলীল পৃ. ১২৫-১২৬।]।

পাঞ্জাবের তৎকালীন মহারাজা রনজিত সিং এর সময়ে মীর্যা পরিবারের প্রতি মহারাজার দৃষ্টি সুপ্রসন্ন হয়। ফলে তারা এলাকায় মহারাজার একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ইংরেজরা এদেশ দখল করলে মীর্যা পরিবার তাদের কৃপা লাভের প্রচেষ্টা চালায়। মীর্যা গোলাম আহমাদ নিজেই ইংরেজ প্রশাসনকে বিভিন্ন পত্রাদি দিয়ে এ বিষয়টির স্বীকৃতি দিয়ে কৃপা লাভের প্রচেষ্টা চালায় [আওয়াজী, ড. গালিব, ফিরাকুন মু‘আসারাতুন, দামনাহুর: মাকতাবাতু লীনাহ, প্রথম সংস্করণ, ১৪১৪ হি. খ.২ পৃ. ৪৯৭-৫০৩।]।

যখন মীর্যার বয়স ২৫ বছর হয় তখন সে তৎকালীন ইংরেজ সরকারের অধীনে কেরানীর চাকুরী গ্রহণ করে। ১৮৫৫ বা ১৮৫৩ সালে মীর্যা গোলাম আহমাদ প্রথম বিয়ে করে।

১৮৭৯ সালে মীর্যা গোলাম প্রথম দাবী করতে শুরু করে যে সে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রেরিত সংস্কারক ও সংশোধনকারী রাসূল [আত-তাইয়্যেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬।]। ১৮৮৪ সালে সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। এরপর সে দাবী করে বসে যে, সেই প্রতিশ্রুত মাহদী, যার সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তারপর সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে [প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭-৭৯।]। তারপর বাকী ৩০ বছর সে যে সমস্ত গ্রন্থ রচনা করে সেগুলোকে সে আল্লাহ‌্‌র পক্ষ থেকে অহী বলে দাবী করতে থাকে [আওয়াজী, প্রাগুক্ত খ.২ পৃ. ৪৯১, ৪৯২।]। এভাবে সে মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা ও ফেতনার সৃষ্টি করে। ১৯০৮ সালে লাহোর নগরীতে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। তাকে কাদিয়ানে দাফন করা হয় [প্রাগুক্ত, খ. ২, পৃ. ৫৬১।]।

গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর অনুসারীরা বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী মুসলিম-বিদ্বেষী শাসকগোষ্ঠী কাদিয়ানীদের যাবতীয় সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে [বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের অনুসারী ও অফিস আছে। বিশেষ করে ঢাকার বখশীবাজার এলাকায় আহমাদীয়া মসজিদ কমপ্লেক্স তাদের প্রধান দপ্তর।]।

২৫
৪ নবুওয়তের দাবী করার কারণ
নবুওয়তের মিথ্যা দাবীদারদের দিকে লক্ষ্য করলে আমাদের কাছে তাদের নবুওয়তের দাবীর পেছনে যে কয়েকটি কারণ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে তা হলোঃ

২৬
৪.১ গোত্রীয় গোঁড়ামী:
আরব্য সমাজ ব্যবস্থা গোত্রনির্ভর। আল্লাহ্ তা‘আলা তার রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন কুরাইশ গোত্রের বনী কুসাই অংশে পাঠালেন কুরাইশ গোত্রের অপর অংশের নিকট তা অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে লাগলো। আবু জাহল বলতঃ আল্লাহর শপথ! আমি জানি যে, মুহাম্মাদ হকের উপর আছে। কিন্তু বনু কুসাই এটা বলবে যে, আমাদের থেকে নবী হয়েছে আর বনু মাখযুম তাদের অনুসরণ করেছে এটা মানা যায় না সুতরাং আমি এটা কখনো করতে পারিনা [ইবন্ কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ: খ.৩, পৃ.৬৪।]।

এটা ছিল একই গোত্রের দু অংশের গোড়ামী। তাছাড়া আরবে বহু গোত্র ছিল। তাদের কেউ কেউ মনে করত যে, তারা কুরাইশদের সমকক্ষ। সুতরাং তাদের নিজেদের মধ্য হতেও নবী হওয়া জরুরী। যেমন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ‘মুদ্বার’ এর বংশধর। যাদেরকে মুদ্বারীয় বলা হতো। অপরপক্ষে ছিল রাবী‘য়াহ ও আসাদ গোত্র। যখনই আরবে মুদ্বার থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হলো তখনি রবী‘য়াহ ও আসাদ গোত্রের লোকেরা নবুওয়তের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। তারা এটাকে তাদের গোত্রের জন্য সম্মানের বিষয় বিবেচনা করতে থাকে। ফলে দেখা যায় পরবর্তীতে এ দু’গোত্র থেকেই নবুওয়তের মিথ্যা দাবীদারদের উত্থান বেশী হয়। মুসাইলামাহ ছিল রবী‘য়াহ গোত্রের আর তুলাইহা ছিল আসাদ গোত্রের। তারা নিজেদের গোত্রের সম্মান রক্ষার্থে সত্য-মিথ্যা বিচার না করে নিজেদের গোত্রীয় লোকদের অনুসরণ করতে থাকে। এর একটি প্রমাণ আমারা দেখতে পাই মুসাইলামার সাথে তার গোত্রের এক লোকের কথোপকথনের মাধ্যমে। লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলো যে, তোমার কাছে কি এমন কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে যে তোমার অনুসরণ করব? মুসাইলামাহ তখন কিছু বানিয়ে বলল। লোকটি তখন বলল: ‘আমি জানি তুমি মিথ্যাবাদী। কিন্তু আমার নিকট রবী‘য়াহ গোত্রের মিথ্যাবাদী মুদ্বার গোত্রের সত্যবাদী থেকে প্রিয়। সুতরাং আমি তোমার অনুসরণ করলাম’ [প্রাগুক্ত, খ.৬, পৃ. ৩২৭।]।

কিন্তু পরবর্তীতে তাদের মধ্যে ঈমানের দৃঢ়তা আসার পর গোত্রীয় কৌলিন্যের জন্য নবুওয়তের দাবীদার খুব বেশী দেখা যায় না। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, নবুওয়াত কোন দাবীর বিষয় নয়। আল্লাহ তা‘আলা জানেন কে নবুওয়তের বেশী উপযুক্ত। সে হিসেবেই তিনি তার রহমত বন্টন করেন।

২৭
৪.২ জাতিগত গোঁড়ামী:
আরবদের মধ্যে যেমন গোত্রীয় গোঁড়ামী কাজ করত, তেমনিভাবে অনারবদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা সচল। ইসলামের বিজয়ের ফলে অনারবগণ প্রচুর পরিমানে আল্লাহ্র দীনে প্রবেশ করতে থাকে। তাদের মধ্যে দীনের খাদেম যেমন তৈরী হয়, তেমনি তাদের মধ্যে অনেকের মধ্যে জাতিগত গোঁড়ামীও কার্যকর থাকে। বিশেষ করে তখনকার দিনে সবচেয়ে বড় অনারব জাতি ছিল পারসিক জাতি। তাদের মধ্যে এ ধারনা প্রবল হলো যে, একসময় তারা শাসক ছিল এখন মুসলমান আরবদের অধীনে শাসিত হচ্ছে। সুতরাং তাদের মধ্যে এমন বহু সংখ্যক মুনাফিক চরিত্রের লোকের আবির্ভাব হলো যারা মুখে ইসলামের বাণী বলত, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিম উম্মতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। ফলে তারা শীয়া, মু‘তাজিলা, খারেজী ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের ভিতকে দূর্বল করা। তাদের মত ছিল যে, যেভাবে আল্লাহ্ আরবদের থেকে নবী বানিয়েছেন সেভাবে অনারবদের থেকেও নবী বানাবেন। এ জন্য তারা নিজেদের জাতিগত চিন্তাধারাকে তাদের অনুসারীদের মধ্যে বপন করতে সক্ষম হয়। ফলে তাদের মধ্যে অনেক নবুওয়তের দাবীদারদের উত্থান হয় [ইবন্ হাযম, আবু মুহাম্মাদ আলী ইবন হায্ম, আল-ফিসাল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়ায়ি ওয়ান নিহাল, খ. ২, পৃ. ১১৫।]। উমাইয়া, আববাসী যুগ এবং পরবর্তী যুগের নবুওয়তের দাবীদার অধিকাংশই ছিল অনারব। এমনকি গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীও একই কথা তার বিভিন্ন বক্তৃতায় প্রকাশ করে বেড়াত [আত-তাইয়্যেব, প্রাগুক্ত পৃ. ৮১।]।

২৮
৪.৩ প্রতিহিংসা
৪.৩.১ মুসলিম জাতির প্রতি ইয়াহূদী জাতির প্রতিহিংসা:

মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইয়াহূদী জাতির প্রতিহিংসা সবারই জানা। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনেই সেটা ঘোষণা করেছেন [সূরা আল-মায়েদাহ: ৮২।]। আমরা এর প্রমাণ পাই রাসূলের সাথে মদীনার ইয়াহূদীদের বিভিন্ন আচরণে। পরবর্তীতে তারা সম্মুখসমর পরিত্যাগ করে ইসলামের মধ্যে মুসলিম নামধারী তাদের অনুচরদের মাধ্যমে এ শত্রুতা চালিয়ে যেতে থাকে।

শিয়া সম্প্রদায় থেকেই উমাইয়া, আববাসী তথা পরবর্তী অধিকাংশ নবুওয়তের দাবীদারদের উত্থান হয়েছিল। আমরা যদি শিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তি সম্পর্কে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাব যে, তাদের উত্থানের মূলে ছিল: ‘আব্দুল্লাহ ইবন্ সাবা’ নামক জনৈক ইয়াহূদী। সে ইয়াহূদী ধর্ম থেকে বিভিন্ন আকীদা বিশ্বাস নিয়ে এসে চটকদার আহবানের মাধ্যমে পারসিকদেরকে তার নিজের দলে ভিড়াতে আরম্ভ করে। পরবর্তীতে তারই রেখে যাওয়া মতবাদের উপর শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে [যাকারিয়্যাহ, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ, আশ-শিরক ফিল কাদীম ওয়াল হাদীস, (আর-রিয়াদ: মাকতাবাতুর রুশদ), ২য় সংস্করণ, ১৪২২ হি. খ.২, পৃ.৬৪৯।]।

অন্য আরেকটি বিষয়ও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, তা হলো: বাবিয়্যাহ ও বাহাহিয়্যাহ সম্প্রদায়ের অনুসারীদের অনেকেই ইয়াহূদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যের উপর টিকে আছে। এমনকি গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ও তার অনুসারীরা ইয়াহূদী রাষ্ট্র ও সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে [আত-তাইয়্যেব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০-৯১।]।

৪.৩.২ মুসলিম জাতির প্রতি উপনিবেশবাদী তথা খ্রিষ্ট জগতের প্রতিহিংসা:

সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধে ক্রুসেডের যুদ্ধে মুসলিমদেরকে পরাভূত করতে অসমর্থ হওয়ার পর খ্রিষ্টজগত মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। তারা মুসলমানদেরকে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ, হানাহানি, মারামারিতে লিপ্ত করার যাবতীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। তাই তারা যত বেশী সম্ভব খারাপ আকীদা-বিশ্বাস, সন্দেহ ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রবিষ্ট করতে থাকে। এভাবে উপনিবেশ শাসন অবসানের পরও মুসলমানরা তাদের চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি-বিবেককে উপনিবেশবাদীদের শিখিয়ে দেয়া বুলির বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি।

পাদ্রী ‘যুওয়াইমার’ বলেন: ‘মুসলমানদেরকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো তাদের নিজেদের মধ্য থেকে কোন নবীর আবির্ভাব ঘটানো, তাদের মধ্যে বিবেদ সৃষ্টি করা, যাতে করে কোন গাছের শাখাই সেই গাছ কেটে ফেলার মত কাজ করে’ [এল, এল, শানলি, আল-গাররা আলাল আলামিল ইসলামী, আরবী অনুবাদ: মুহিববুদ্দিন আল-খতীব, (কায়রো: ২য় সংস্করণ, আল-মাতবা‘য়াতুস সালাফিয়্যাহ), পৃ. ৩২।]।

তাছাড়া ১৮৬৯ সালে উপনিবেশবাদী চক্র ভারতের মুসলমানদের সম্পর্কে একটি রিপোর্ট দেয় তা হলো, ‘‘যেহেতু ভারতীয় মুসলমানরা তাদের নেতার পিছনেই চলে থাকে তাই তাদেরকে তাদের দীন থেকে তখনই দূরে সরানো যাবে যখন তাদের মধ্য থেকেই একজনকে নবুওয়তের দাবীদার বানানো যাবে। যাতে করে একটি গোষ্ঠী তার অনুসারী হয়ে পড়ে।’’ [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৫।]

এভাবে তারা তাদের মনের মত করে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে তৈরী করে। যে ব্যক্তি তাদের জন্য হাদীয়া হিসেবে ঘোষণা করে যে, ব্রিটিশ বেনিয়াদের আনুগত্য করা ফরয এবং তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা না জায়েয। সে আরও ঘোষণা করে যে, জ্বিহাদ বলতে কিছু নেই।

যেভাবে ব্রিটিশরা ভারতে গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে তৈরী করে তেমনি করেছিল, ইরানেও রাশিয়া ও ফ্রান্সের উপনিবেশবাদীরা বাব এবং বাহাকে তৈরী করেছিল। তারা মুসলমানদের শক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন খাতে পরিচালিত করে নিজেদেরকে নিরাপদ করতে চেয়েছিল।

২৯
৪.৪. চিন্তার বিকৃতি:
শীয়া এবং সুফী সম্প্রদায়ের মধ্যে চিন্তার যে বিস্তর বিকৃতি হয়েছিল তা-ই নবওয়তের মিথ্যা দাবীতে ইন্ধন যুগিয়েছিল। শীয়া সম্প্রদায় তাদের দ্বাদশ ইমামের আগমনের জন্য এতই ব্যস্ত থাকত যে, যে কেউ এ ধরনের দাবী করত তারা তার পিছনে ছুটে বেড়াত। পরবর্তীতে সে ব্যক্তি মানুষের অসতর্কতাকে কাজে লাগিয়ে নবুওয়তের দাবী করে বসত।

অনুরূপভাবে সুফী সম্প্রদায় তাদের অত্যধিক ইবাদত প্রবণতার কারণে ইসলামের সীমা ছড়িয়ে যেত। পরবর্তীতে তারা খুব বেশী ধারণাপ্রবণ হয়ে যায়। তাদের ধারণা হতো যে, তাদের কাছে কেউ অহী নিয়ে আসছে। এভাবে তাদের মধ্যে এক ধরণের বিকৃতি তৈরী হয়। যা থেকে নবুওয়তের দাবী করা তাদের জন্য সহজ হয়ে পড়ে।

আর এ জন্যই ইমাম ইবন্ হাযম রাহেমাহুল্লাহ বলেন: ‘‘মনে রাখবে যারাই এ ধরনের কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে তাদের মূল হলো হয় শীয়া সম্প্রদায় নতুবা সুফী শ্রেণীর লোকেরা’’ [ইবন্ হাযম, প্রাগুক্ত খ. ৪, পৃ. ১৮৮।]।

আমরা যদি নবুওয়তের দাবীদারদের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব যে, নবুওয়তের দাবীদারদের একটি বড় অংশ শীয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। তারা প্রথমে ইমাম হওয়ার দাবী করত। যা শেষ পর্যন্ত নবুওয়তের দাবী পর্যন্ত গিয়ে ঠেকত। যেমন, মুগীরাহ ইবন্ সাঈদ আল-ইজলী, আবু মনসুর আল-ইজলী, আবুল খাতাব আল-আসাদী, আল-মুখতার ইবন আবি উবাইদ আল-কাযযাব এবং বয়ান ইবন সাম‘আন। অনুরূপভাবে শীয়াদের মধ্য থেকে নবওয়াতের দাবীদার অপর এক শ্রেণী নিজেদেরকে প্রথমে ইমাম মাহদী হওয়ার দাবী করেছিল যেমন, আলী ইবন্ ফাদ্ল আল হিমইয়ারী আল ইয়ামানী। সে শিয়াদের বার ইমামী বা ‘ইশনা আশারী’ উপদলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর সেই শিয়াদের অপর উপদল ‘ইসমাইলী’ শিয়াদের প্ররোচনায় পড়ে এবং নিজেই মাহদী হওয়ার দাবী করে বসে। সবশেষে সে নিজকে নবী বলে দাবী করতে আরম্ভ করে।

তাছাড়া নবওয়তের দাবীদারদের দ্বিতীয় অংশের উপর সুফী প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন, হারেস ইবন্ সা‘ঈদ। তার অবস্থা এমন ছিল যে, সে সময়ের সবাই তাকে সবচেয়ে বড় পরহেযগার মনে করত। কিন্তু শয়তান তাকে ধোকা দিয়ে পদস্খলিত করে এবং শেষ পর্যন্ত সে নিজেকে নবী বলে দাবী করে বসে। অনুরূপভাবে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী জীবনের প্রথমে তাসাউফ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সর্বেশ্বরবাদের প্রবক্তা সুফী ইবন্ আরাবীর গ্রন্থসমূহ থেকেও সে তথ্য সংগ্রহ করত। যা শেষ পর্যন্ত তাকে নবওয়তের দাবী করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল [আল-গামেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৮-৩৪১।]।

৩০
৪.৫. দীন সম্পর্কে অজ্ঞতা
মূলত নবুওয়তের দাবীদারদেরকে যে কাজটি সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করেছিল তা হলো, যে সমস্ত সমাজে তাদের উদ্ভব হয়েছিল সে সমস্ত সমাজের ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব। ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কারণে নবুওয়তের দাবীদাররা তাদের মতামত সে সমস্ত সমাজে খাটাতে সক্ষম হয়েছিল। যারা ইসলামকে সত্যিকার অর্থে বুঝেছে তাদের মধ্যে এ ধরনের দাবী সাধারণত দেখা যায় না। শীয়া সম্প্রদায় এবং সুফী সম্প্রদায় দ্বারা প্রভাবিত লোকদের মধ্যে সাধারণত উচ্চতর ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব থাকে। তারা তখন যে কোন আহবানের সাড়া না জেনে বুঝেই সাড়া দিয়ে দেয় [প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৩।]।

৩১
৪.৬ মুসলিম উম্মতের বেহাল দশা
নবুওয়তের দাবীদাররা মুসলিম উম্মতের খারাপ অবস্থার সুযোগই নিয়েছিল সবচেয়ে বেশী। যে কোন উম্মতের যখন বেহাল দশা হয়, তখন তারা নতুন নতুন জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মুসলিম উম্মতের দুর্বল অবস্থানের সময় নবুওয়তের দাবীদাররা নবুওয়তের দাবী করলে অনেক অশিক্ষিত অথবা অপরিণামদর্শীদের কাছে তা গৃহীত হয়।

মুহাম্মাদ ইকবাল বলেনঃ ‘‘ইতিহাস সাক্ষী থাকে যে, কোন উম্মতের যখন অবস্থা খারাপ এবং বেহাল দশা হয়, তখন সেই উম্মতের চিন্তাশক্তির অবস্থা অনুরূপ হয়।’’

মুসলিম উম্মতের বেহাল দশার কারণেই নবুওয়তের দাবীদাররা মাথা উঠানোর সুযোগ নিয়েছিল। বর্তমানের মুসলিম উম্মতের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো হওয়ায় এ ধরনের নবুওয়তের দাবীদারদের উৎপাত লক্ষ্য করা যায় না। আবার কোথাও কোথাও সেটা শোনা গেলেও স্বল্প দিনের মধ্যেই তা অস্তিত্বহীন বা বিলীন হয়ে পড়ে।

৩২
৫ নবুওয়তের দাবীদারদের পতনে মুসলমানদের কর্তব্য ও শেষ কথা ৫.১ খতমে নবুওয়াত বা নবুওয়তের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে সকলকে অবগত করাঃ
আর তা নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে করা যেতে পারেঃ

৫.১.১ সর্বশেষ নবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, এ কথা প্রত্যেককে জানিয়ে দিতে হবে। আরও জানিয়ে দিতে হবে যে, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর নবী এসেছে বলে দাবী করে, সে মিথ্যাবাদী।

৫.১.২ ইসলাম কেন ও কিভাবে পুর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তা পরিষ্কারভাবে সকলকে বুঝাতে হবে।

৫.১.৩ ভন্ড নবী ও শীয়া-সুফিদের বইসমূহ ছোট শিশুদেরকে পড়ার অনুমতি না দেয়া; কেননা, তাদের এখনো সত্য আর অসত্য পার্থক্য করার চিন্তা আসেনি।

৫.১.৪ প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট উপদল যেমন, শীয়া, সুফি, বাতেনি ইত্যাদি ফের্কার অনুসরণ থেকে সাবধান করে দিতে হবে এবং এই পথভ্রষ্ট উপদলগুলোর মূলকথা সকল মানুষকে জানিয়ে দিতে হবে।

৩৩
৫.২ পথভ্রষ্টতার প্রচারক থেকে মুসলিম উম্মতকে হেফাযত করাঃ
সকল মুসলিম বিশেষ করে মুসলিম সরকারের কর্তব্য মুসলিম উম্মতকে পথভ্রষ্ট প্রচারক, নবুওয়তের দাবীদার প্রভৃতি থেকে হেফাযত রাখা। এটি মুসলিম সরকারের অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচিত। কেননা, এসব পথভ্রষ্টরাই মুসলিম উম্মতের মধ্যে বিশৃংখলা এবং সংশয়-সন্দেহের সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে আরও গভীর হয়।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন