HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

নেশাজাত দ্রব্যের বিধান

লেখকঃ শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
আহকামুল মুসকিরাত

নেশাজাত দ্রব্যের বিধান

বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য, বিড়ি-সিগারেট ও অন্যান্য তামাকজাত

বস্তুসমূহ গ্রহণ করা এবং এসব ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান।

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

আরবি প্রভাষক :

আলহাজ্জ মোহাম্মদ ইউসুফ মেমোরিয়াল দারুল হাদীস মাদরাসা

৮-৯ লুৎফর রহমান লেন, সুরিটোলা, ঢাকা- ১১০০

সম্পাদনা

মোহাম্মদ ইমাম হোসাইন কামরুল

ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ইমাম পাবলিকেশন্স লিঃ

ভূমিকা
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى رَسُوْلِهٖ مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِهٖ وَصَحْبِهٖ اَجْمَعِيْنَ

‘‘নেশাজাত দ্রব্যের বিধান’’ বইটি বের করতে পেরে মহান আল্লাহর অগণিত শুক্রিয়া আদায় করছি। দরূদ ও সালাম পেশ করছি বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর উপর।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানবজাতিকে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। আর এ লক্ষ্যেই তিনি ঈমানদারদের উপর কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। কিছু জিনিসকে তিনি হালাল করেছেন আবার কিছু জিনিসকে করেছেন হারাম। মানুষের শরীর আল্লাহ তা‘আলার একটি বড় নিয়ামত। এর সুস্থতার উপরই নির্ভর করে মানুষের সকল কাজকর্ম। তাই যেসব জিনিস মানুষের শরীরের ক্ষতি করে আল্লাহ তা‘আলা ঐসব বসত্মু হারাম করেছেন। এই হারাম বসত্মুসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নেশাজাত দ্রব্যসমূহ। এসব নেশাজাত বসত্মু হতে বিরত থাকা একজন মুমিনের জন্য অত্যাবশ্যক।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক লোকই এসব নেশাজাত দ্রব্য ব্যবহার করছে। যার ফলে একদিকে তারা আল্লাহর বিধান লঙ্গন করছে, অপরদিকে নিজেদের শরীরের ক্ষতি সাধন করছে।

মদের ব্যাপারে কুরআন মাজীদে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এসেছে এবং এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একাধিক হাদীসও রয়েছে। কিন্তু অনেকে মদের নাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন নামে নেশাজাত দ্রব্য ব্যবহার করছে। আবার অনেকে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, তামাক ইত্যাদি ব্যবহার করছে এবং তারা বলে থাকে যে, এ ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের যথেষ্ট দলীল প্রমাণ রয়েছে, যা এসব বসত্মুর ব্যবহারকে নিষেধ করে।

এ গ্রন্থে নেশাজাত দ্রব্যসমূহ ব্যবহারের হুকুম ও এসবের ক্ষতিকর দিকগুলো দলীল-প্রমাণসহ উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে করে এসব হারাম বসত্মু হতে মুসলিম জাতি বিরত থাকতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা সবাইকে হারাম বসত্মুসমূহ ব্যবহার করা থেকে হেফাযত করুন। আমীন

মা‘আস্সালাম

শাইখ আবদুর রহমান বিন মুবারক আলী

নেশা সৃষ্টিকারী বসত্মুর হুকুম
ইসলামে সর্বপ্রকার নেশা সৃষ্টিকারী জিনিসই হারাম করা হয়েছে, তা যে কোন নামেই হোক না কেন। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ الله عَنْهَا قَالَتْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ - - يَقُوْلُ : كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ وَمَا أَسْكَرَ مِنْهُ الْفَرْقُ فَمِلْءُ الْكَفِّ مِنْهُ حَرَامٌ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, সর্বপ্রকার নেশা সৃষ্টিকারী জিনিসই হারাম। আর যে জিনিস এক ফারাক পরিমাণ ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি করে, তা হাতের অঞ্জলি পরিমাণ ব্যবহার করাও হারাম। [আবু দাউদ, হা/৩৬৮৯; তিরমিযী, হা/১৮৬৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৪৭৬; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৩৮৩; মিশকাত, হা/৩৬৪৬।]

اَلْفَرْقُ (ফারাক) মদিনার একটি পরিমাপ বিশেষ, যার পরিমাণ ৩ সা’-এর সমান। এক সা’ আমাদের দেশীয় হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন সের। এখানে ফারাক দ্বারা অনেক বেশি পরিমাণ উদ্দেশ্য।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ -- : مَا أَسْكَرَ كَثِيرُه فَقَلِيْلُه حَرَامٌ

জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে জিনিস অধিক পরিমাণ ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি করে তার সামান্য পরিমাণও হারাম। [আবু দাউদ, হা/৩৬৮৩; তিরমিযী, হা/১৮৬৫; নাসাঈ, হা/৬৫০৭; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৯৩; মিশকাত, হা/৩৬৪৫।]

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ نَبِىَّ اللهِ - - نَهٰى عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَالْكُوْبَةِ وَالْغُبَيْرَاءِ وَقَالَ : كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মদ, জুয়া, কূবা ও গোবায়রা প্রভৃতিকে নিষেধ করেছেন এবং তিনি আরো বলেছেন, নেশা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক জিনিসই হারাম। [আবু দাউদ, হা/৩৬৮৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬২৫; বায়হাকী, হা/২০৭৮১; মিশকাত, হা/৩৬৫২।]

কূবা বলা হয় দাবা খেলা অথবা তবলা বাজানোকে। আর গোবায়রা হচ্ছে, এক প্রকার মদ। হাবশার লোকেরা গম হতে তা প্রসত্মুত করত।

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ : سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ عَنِ الْبِتْعِ وَهُوَ شَرَابُ الْعَسَلِ، وَكَانَ أَهْلُ الْيَمَنِ يَشْرَبُوْنَه ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : ‏ كُلُّ شَرَابٍ أَسْكَرَ فَهُوَ حَرَامٌ

আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বিত’ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। আর এটি হলো মধু থেকে তৈরি এক প্রকার মদ, যা ইয়ামানবাসীরা পান করত। রাসূলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, নেশা সৃষ্টিকারী যে কোন পানীয় হারাম। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৫৪০; সহীহ বুখারী, হা/৫৫৮৬; সহীহ মুসলিম, হা/৫৩৩০; আবু দাউদ, হা/৩৬৮৩; তিরমিযী, হা/১৮৬৩; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৮৬।]

মদের সংজ্ঞা
আরবি ভাষায় মদকে খামর বলা হয়। اَلْخَمْرُ (খামর)-এর আভিধানিক অর্থ হলো, বিলুপ্ত করা, আচ্ছন্ন করা ইত্যাদি। মহিলাদের মাথা, চুল ইত্যাদি যে কাপড় দ্বারা আবৃত করা হয় তাকে خِمَارٌ (খিমার) বা উড়না বলা হয়। উড়না যেমন মাথাকে আবৃত করে, তেমনিভাবে মদও জ্ঞানকে লোপ করে দেয়।

পারিভাষিক অর্থে : যেসব দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে, তার আচরণের পরিবর্তন ঘটে এবং তার জ্ঞান লোপ করে দেয় তাকে মদ বলে। উমর (রাঃ) বলেন,

اَلْخَمْرُ مَا خَامَرَ الْعَقْلُ

অর্থাৎ খামর ঐ জিনিসকে বলা হয়, (যা পান করলে) জ্ঞান-বুদ্ধিকে আচ্ছাদিত করে ফেলে। [সহীহ বুখারী, হা/৪৬১৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭৭৪৪; আবু দাউদ, হা/৩৬৭১; নাসাঈ, হা/৫৫৭৮।]

মাদকদ্রব্য হচ্ছে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি বসত্মু, যা ব্যক্তির চিমত্মা, চেতনা ও মানসিকতার পরিবর্তনের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত এবং বার বার ব্যবহারে মাদকনির্ভরশীলতা তৈরি হয়। এমনকি পরিবার ও সমাজে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে।

যেসব জিনিস হতে মদ তৈরি করা হয়
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ - : الْخَمْرُ مِنْ هَاتَيْنِ الشَّجَرَتَيْنِ النَّخْلَةِ وَالْعِنَبَةِ

আবু হুরায়রা্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, মদ তৈরি হয় দুটি গাছ (এর ফল) হতে, তা হলো- খেজুর ও আঙ্গুর। [৭ সহীহ মুসলিম, হা/৫২৫৭; আবু দাউদ, হা/৩৬৮০; তিরমিযী, হা/১৮৭৫; নাসাঈ, হা/৫৫৭২; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৭৮।]

عَنِ ابْنِ عُمَرَ ، قَالَ : سَمِعْتُ عُمَرَ ، عَلٰى مِنْبَرِ النَّبِيِّ يَقُوْلُ أَمَّا بَعْدُ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّه نَزَلَ تَحْرِيْمُ الْخَمْرِ وَهِيَ مِنْ خَمْسَةٍ مِنَ الْعِنَبِ وَالتَّمْرِ وَالْعَسَلِ وَالْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالْخَمْرُ مَا خَامَرَ الْعَقْلَ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি উমর (রাঃ) কে তার খিলাফতকালে নবী ﷺ এর মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছি, হে লোকেরা! মদ হারাম হওয়ার বিধান নাযিল হয়েছে। তা (বর্তমানে) পাঁচটি বসত্মু থেকে তৈরি হয়- আঙ্গুর, খেজুর, মধু, গম ও যব হতে। আর যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে লুপ্ত করে দেয়, তা-ই মদ। [৮ সহীহ বুখারী, হা/৪৬১৯; সহীহ মুসলিম, হা/৭৭৪৫; আবু দাউদ, হা/৩৬৭১; নাসাঈ, হা/৫৫৭৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৩৫৮; মিশকাত, হা/৩৬৩৫।]

তৎকালীন আরবে সাধারণত হাদীসে উল্লেখিত এই জিনিসগুলো দ্বারাই মদ তৈরি করা হতো। তবে মদ কেবলমাত্র এই পাঁচটি জিনিসের মধ্যে সীমাদ্ধ নয়; বরং যাকিছু নেশা সৃষ্টি করে তাই মদ বলে পরিগণিত হবে।

বর্তমান সময়ের বিভিন্ন মাদকদ্রব্য ও তার ব্যবহারের ধরন
عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : لَيَشْرَبَنَّ نَاسٌ مِنْ أُمَّتِي الْخَمْرَ ، يُسَمُّوْنَهَا بِغَيْرِ اسْمِهَا ، يُعْزَفُ عَلٰى رُؤُوْسِهِمْ بِالْمَعَازِفِ ، وَالْمُغَنِّيَاتِ ، يَخْسِفُ اللهُ بِهِمُ الْأَرْضَ ، وَيَجْعَلُ مِنْهُمُ الْقِرَدَةَ وَالْخَنَازِيْرَ

আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক মদ পান করবে। তারা মদের নাম রাখবে মদ বাদ দিয়ে অন্য নামে। তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র বাজানো হবে। আর তারা গায়িকা ও নর্তকী দ্বারা খেলা করবে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের সহকারে ভূমিধস ঘটাবেন এবং তাদের মধ্য হতে কাউকে বানর এবং শুকরে রূপামত্মরিত করবেন। [ইবনে মাজাহ, হা/৪০২০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৬৭৫৮; সুনানুল কুবরা লিত তাবারানী, হা/৩৩৪২; বায়হাকী, হা/২০৭৭৮; জামেউস সগীর, হা/৯৫৮৫; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৭৮।]

বিভিন্ন নামে মাদকদ্রব্য :

বর্তমানে মাদকদ্রব্যগুলো বিভিন্ন নামে প্রচলিত আছে। যেমন- ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যথ্যাইন, মদ, চরস, ভাঙ, আফিম, হাসিস, কোকেন, হেম্প, মারিজুয়ানা, ব্রাউন সুগার, এল.এস.ডি, স্মাক ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে হেরোইন আজ সব নেশাকেই ছাড়িয়ে গেছে। এর মাদকাসক্তিও অত্যমত্ম তীব্র। যদি কেউ একবার হেরোইন সেবন করে তাহলে সে সহজেই এ নেশার কবলে পড়ে যায়।

প্রচলিত মাদকদ্রব্য ব্যবহারের পদ্ধতিও বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তার মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে, ইনহেল বা নাকে শোঁকা পদ্ধতি, স্কিস পপিং বা ইনজেকশন পদ্ধতি ও ত্বকের নিচে গ্রহণ পদ্ধতি এবং মেইন লাইনিং বা সরাসরি রক্ত প্রবাহে অনুপ্রবেশকরণ পদ্ধতি ইত্যাদি।

মদ হারাম হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়
আরবের লোকেরা স্বাভাবিকভাবে মদ্যপানে অভ্যসত্ম ছিল। আর এটি হঠাৎ করে ছেড়ে দেওয়াও তাদের জন্য কঠিন ছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা মদকে হঠাৎ করেই হারাম করে দেননি। বরং তিনি তা পর্যায়ক্রমে হারাম করেছেন।

১ম পর্যায় :

আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে কেবল এ ধারণা দিয়েছেন যে, হালাল খাদ্য থেকেই হারাম মদ তৈরি করা হয়। সুতরাং হালাল খাদ্যকে তার যথাযথ পদ্ধতিতে ব্যবহার করো এবং এগুলোকে হারাম পদ্ধতিতে ব্যবহার করা থেকে সাবধান থাকো। তিনি বলেন,

﴿وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيْلِ وَالْاَعْنَابِ تَتَّخِذُوْنَ مِنْهُ سَكَرًا وَّرِزْقًا حَسَنًا اِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيَةً لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ﴾

তোমরা খেজুর বৃক্ষের ফল ও আঙ্গুর হতে মাদক ও উত্তম খাদ্য গ্রহণ করে থাক; এতে অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন। (সূরা নাহল- ৬৭)

অত্র আয়াতে মাদককে উত্তম খাদ্য থেকে পৃথক করা হয়েছে। আর এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, ফলের রসে এমন উপাদানও রয়েছে, যা মানুষের জন্য খাদ্যে পরিণত হতে পারে। আবার এমন উপাদানও আছে, যা পরে মাদকদ্রব্যে পরিণত হয়। সুতরাং কখনো এটা মনে করো না যে, হালাল বস্ত্ত হতে হারাম বস্ত্ত তৈরি হতে পারে না অথবা হালাল বস্ত্ত কখনো কোন কারণে হারাম হতে পারে না। তোমরা যে মদ তৈরি করছ তার উপাদান হালাল বস্ত্ত থেকেই গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তা উত্তম খাদ্য নয়। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকার মানসিকতা তৈরি করো।

২য় পর্যায় :

এ পর্যায়ে এ ধারণা দেয়া হয়েছে যে, মদ ও জুয়ায় উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,

﴿يَسْاَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِؕ قُلْ فِيْهِمَاۤ اِثْمٌ كَبِيْرٌ وَّمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَاِثْمُهُمَاۤ اَ كْبَرُ مِنْ نَّفْعِهِمَا﴾

লোকেরা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, এ দুটির মধ্যে বড় ধরনের গোনাহ রয়েছে। এতে মানুষের জন্য কিছুটা উপকার রয়েছে, তবে এ দুটির পাপ উপকারের চেয়ে অনেক বড়। (সূরা বাক্বারা- ২১৯)

অত্র আয়াতে মদকে বড় ধরনের গোনাহের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেননা মদ্যপান করার কারণে ব্যক্তি অনেক ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পরতে পারে। যেমন- চুরি ছিনতাই, ডাকাতি, যিনা, মিথ্যা কথা বলা, গালিগালাজ করা, চাঁদাবাজী করা ইত্যাদি। আবার এর কারণে অনেক ইবাদাতেও বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং যে জিনিসের মধ্যে এতগুলো বড় বড় অপকারিতা বিদ্যমান, তা ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত।

৩য় পর্যায় :

এ পর্যায়ে কেবল সালাতের সময় মদ্যপান নিষিদ্ধ করা হয়। আল্লাহ তা’য়ালার বাণী-

﴿يَاۤا َيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَاَنْتُمْ سُكَارٰى حَتّٰى تَعْلَمُوْا مَا تَقُوْلُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা যা বল তা বুঝতে পার। (সূরা নিসা- ৪৩)

আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনসারদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি তাকে এবং আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) কে মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানালেন। আর এ ঘটনা ছিল মদ হারাম হওয়ার পূর্বের। ফলে তারা মদ্যপান করলেন এবং মাগরীবের সালাত আদায় করলেন। তখন আলী (রাঃ) ইমামতি করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি সূরা কাফিরূন পাঠ করার সময় ভুল করে বসেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন।

৪র্থ পর্যায় :

এ পর্যায়ে চূড়ান্তভাবে মদ ও জুয়া হারাম করে দেয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَاۤ اَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْاۤ اِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْاَنْصَابُ وَالْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ اِنَّمَا يُرِيْدُ الشَّيْطَانُ اَنْ يُّوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَآءَ فِى الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلَاةِۚ فَهَلْ اَنْتُمْ مُّنْتَهُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার দেবী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর (তীর) ঘৃণ্যবস্তু ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। নিশ্চয় শয়তান মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত আদায় করা হতে বাধা প্রদান করতে চায়। অতঃপর তোমরা কি বিরত থাকবে না? (সূরা মায়েদা- ৯০, ৯১)

উপরোক্ত আয়াতটি মদ হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে নাযিলকৃত সর্বশেষ আয়াত। এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আর কারো জন্য মদ্যপানের বৈধতা অবশিষ্ট রাখা হয়নি। তখন থেকে কিয়ামত পর্যমত্ম মদ বা নেশাজাত দ্রব্যসমূহ আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।

মদের হুকুম
মদ হারাম হওয়ার ব্যাপারে সমসত্ম উলামা ও ইমামদের ঐক্যমত রয়েছে। চাই তা যে কোন নামেই পান করা হোক না কেন। যে ব্যক্তি এটাকে হালাল মনে করে পান করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি হারাম মনে করে পান করবে, সে কবীরা গুনাহের শাসিত্মর উপযুক্ত হবে। এজন্য তাকে খালিছভাবে তওবা করতে হবে এবং ভবিষ্যতে মদ্যপান করা থেকে দূরে থাকতে হবে।

মদ ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম :

যে জিনিস খাওয়া বা পান করা হারাম ইসলামী শরীয়তে সেটা ক্রয়-বিক্রয় করাও হারাম। সুতরাং হারাম জিনিসের ব্যবসা করা কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। হাদীসে এসেছে,

আবদুর রহমান ইবনে ওয়ালাতা আস সাবাঈ মিস্রী (রহ.) হতে বর্ণিত। একদা তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) এর নিকট আঙ্গুরের রস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এক মশক মদ উপহারস্বরূপ নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, তুমি কি জান না যে, আল্লাহ এটা হারাম করে দিয়েছেন? সে বলল, না। অতঃপর সে এক ব্যক্তির সাথে কানাকানি করল। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাকে গোপনে কী বললে? সে বলল, আমি তাকে এটা বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছি।

এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন,

إِنَّ الَّذِيْ حَرَّمَ شُرْبَهَا حَرَّمَ بَيْعَهَا ‏

যিনি (আল্লাহ) এটা পান করা হারাম করেছেন তিনি এর বিক্রিও হারাম করে দিয়েছেন। রাবী বলেন, এরপর সে মশ্কের মুখ খুলে দিল এবং তার মধ্যে যা কিছু ছিল সব পড়ে গেল। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৫৪৩; সহীহ মুসলিম, হা/৪১২৮; নাসাঈ, হা/৪৬৬৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৯৪২।]

মদ ও মদ দ্বারা উপার্জিত সম্পদ হারাম :

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ - - قَالَ : إِنَّ اللهَ حَرَّمَ الْخَمْرَ وَثَمَنَهَا وَحَرَّمَ الْمَيْتَةَ وَثَمَنَهَا وَحَرَّمَ الْخِنْزِيْرَ وَثَمَنَه

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা মদকে ও মদের পয়সাকে, মৃত পশুকে ও তার পয়সাকে হারাম করেছেন এবং শুকর ও তার পয়সাকেও হারাম করেছেন। [আবু দাউদ, হা/৩৪৮৭; দার কুতনী, হা/২৮১৬; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হা/১১৩৭১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৫৮।]

মদের পাত্র ভেঙ্গে ফেলতে হবে :

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) আবু তালহা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি সেসব ইয়াতীমদের জন্য কিছু মদ ক্রয় করেছি, যারা আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, মদ ফেলে দাও এবং তার পাত্রগুলোও ভেঙ্গে ফেলো। [তিরমিযী, হা/১২৯৩; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/৪৫৮১; মিশকাত, হা/৩৬৪৯।]

আবার অন্য বর্ণনায় আছে, আবু তালহা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, তার তত্ত্বাবধানে যেসব ইয়াতীম আছে, মীরাস সূত্রে তারা কিছু মদের মালিক হয়েছে। (এখন সেগুলো কী করব?) রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তা ফেলে দাও। আবু তালহা (রাঃ) বললেন, আচ্ছা- আমি কি সেগুলো দ্বারা সিরকা বানাতে পারি? তিনি বললেন, না। [আবু দাউদ, হা/৩৬৭৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২২১০; বায়হাকী, হা/১০৯৮০; মিশকাত, হা/৩৬৪৯।]

কোন ঈমানদার ব্যক্তি মদ্যপান ও মদের ব্যবসা করতে পারে না :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ ، قَالَ : مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلَا يَشْرَبِ الْخَمْرَ، مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلَا يَجْلِسْ عَلٰى مَائِدَةٍ يُشْرَبُ عَلَيْهَا الْخَمْرُ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে মদ্যপান করতে পারে না এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে ব্যক্তি সেই দসত্মরখানে (টেবিলে বা স্থানে) বসতে পারে না যেখানে মদ্যপান করা হয়। [মু‘জামূল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১১৩০০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৬৯২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭২।]

তওবা করে মদ্যপান ছেড়ে দিলে আল্লাহ পূর্বের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন :

﴿لَيْسَ عَلَى الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيْمَا طَعِمُوْاۤ اِذَا مَا اتَّقَوْا وَّاٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَّاٰمَنُوْا ثُمَّ اتَّقَوْا وَّاَحْسَنُوْاؕ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ﴾

যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তারা পূর্বে যা খেয়েছে তার জন্য তাদের কোন গোনাহ নেই। যদি তারা সাবধান হয় এবং ঈমান আনয়ন করে ও সৎকর্ম করে, পুনরায় সাবধান হয় ও বিশ্বাস স্থাপন করে, পুনরায় সাবধান হয় ও সৎকর্ম করে; তবে তো আল্লাহ সৎকর্ম পরায়ণশীলদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা মায়েদা- ৯৩)

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা আমি আবু তালহার ঘরে কিছু লোককে মদ পরিবেশন করছিলাম। সে সময় মদ হারাম হওয়ার বিধান নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ একজনকে তা প্রচার করতে নির্দেশ দিলেন। ফলে সে প্রচার করছিল। তখন আবু তালহা (রাঃ) বললেন, বাইরে গিয়ে দেখে আসো- এ কিসের শব্দ শোনা যায়। আনাস বলেন, অতঃপর আমি গেলাম এবং শুনে এসে আবু তালহা (রাঃ) কে বললাম- এটা প্রচার করা হচ্ছে যে, মদ হারাম করা হয়েছে। তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি গিয়ে সব মদ ফেলে দাও। আনাস বলেন, সেদিন মদিনার রাসত্মায় রাসত্মায় মদের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল। তিনি আরো বলেছেন, সেই সময়ের মদ খেজুর থেকে প্রস্ত্তত করা হতো। এ ঘটনার পর একদল লোক বলা শুরু করলো যে, পেটে মদ নিয়েই তো আগে অনেক লোক শহীদ হয়েছে। (তাদের কি হবে?) আনাস বলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন। [সহীহ বুখারী, হা/২৪৬৪; সহীহ মুসলিম, হা/৫২৪৬; তিরমিযী, হা/৩০৫০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৩৪০০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৩৫০।]

মদ্যপানের পরিণতি
মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্ব মানবতার জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। এর সর্বানাশা মরণ ছোবলে জাতি আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। ভেঙ্গে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এর সাথে যোগ হচ্ছে চোরাচালানসহ মানবতা বিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ। নিম্নে এর পরিণতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

মদ্যপান একটি শয়তানী কাজ :

মদ্যপান শয়তানী কাজ। এর ফলে মানুষ সালাত আদায় করা ও সিয়াম পালন করা থেকে দূরে সরে যায়। শয়তান মানুষকে সৎপথ থেকে বিতাড়িত করে পাপাচারের দিকে ধাবিত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّمَا يُرِيْدُ الشَّيْطَانُ اَنْ يُّوْقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَآءَ فِى الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ اَنْتُمْ مُّنْتَهُوْنَ﴾

নিশ্চয় শয়তান মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে ও সালাত আদায় করা থেকে বাধা দিতে চায়। তবুও কি তোমরা (এসব অন্যায় হতে) বিরত থাকবে না? (সূরা মায়েদা- ৯১)

মদ নিজেই রোগ :

عَنْ وَائِلٍ الْحَضْرَمِىِّ أَنَّ طَارِقَ بْنَ سُوَيْدٍ الْجُعْفِىَّ سَأَلَ النَّبِىَّ - - عَنِ الْخَمْرِ فَنَهَا أَوْ كَرِهَ أَنْ يَصْنَعَهَا فَقَالَ إِنَّمَا أَصْنَعُهَا لِلدَّوَاءِ فَقَالَ : إِنَّه لَيْسَ بِدَوَاءٍ وَلٰكِنَّه دَاءٌ

ওয়ায়িল আল-হায্রামী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তারিক ইবনে সুওয়াইদ জু‘ফী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ কে মদ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। অতঃপর তিনি তাকে বারণ করলেন, কিংবা মদ প্রস্তুত করাকে খুব জঘন্য মনে করলেন। তিনি [তারিক (রাঃ)] বললেন, আমি তো শুধু ঔষধ তৈরি করার জন্য মদ প্রসত্মুত করি। তিনি বললেন, এটি তো (ব্যাধি নিরামক) ঔষধ নয়, বরং এটি নিজেই ব্যাধি। [সহীহ মুসলিম, হা/৫২৫৬; ইবনে মাজাহ, হা/৩৫০০; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৮৮২; মিশকাত, হা/৩৬৪২।]

আল্লাহ তা‘আলা কোন হারাম বসত্মুর মধ্যে রোগ নিরাময়ের কোন উপকরণ রাখেননি। মূলত মদ্যপানে সাময়িকভাবে দেহের বা স্বাস্থ্যের বাহ্যিক উপকার বা উন্নতি দেখা গেলেও তার শেষ পরিণতি খারাপ ছাড়া কিছু নেই।

মদ্যপানের সময় মদ্যপানকারীর ঈমান থাকে না :

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ قَالَ : ‏ لَا يَزْنِي الزَّانِي حِيْنَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِيْنَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِيْنَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ ‏

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী ﷺ বলেছেন, কোন লোক ঈমানদার অবস্থায় ব্যভিচার করতে পারে না। কোন লোক ঈমানদার অবস্থায় মদ্যপান করতে পারে না। কোন লোক ঈমানদার অবস্থায় চুরি করতে পারে না। [সহীহ বুখারী, হা/৫৫৭৮; সহীহ মুসলিম, হা/২১১; আবু দাউদ, হা/৪৬৯১;নাসাঈ, হা/৪৮৭০; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হা/১০২২০; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৮৬; মিশকাত, হা/৫৩।]

আল্লাহ তা‘আলা ৪০ দিন পর্যমত্ম মদ্যপানকারীর সালাত কবুল করেন না :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ -- : مَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ لَمْ يَقْبَلِ اللهُ لَه صَلَاةً أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا فَإِنْ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ فَإِنْ عَادَ لَمْ يَقْبَلِ اللهُ لَه صَلَاةً أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا فَإِنْ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ فَإِنْ عَادَ لَمْ يَقْبَلِ اللهُ لَه صَلَاةً أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا فَإِنْ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ فَإِنْ عَادَ الرَّابِعَةَ لَمْ يَقْبَلِ اللهُ لَه صَلَاةً أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا فَإِنْ تَابَ لَمْ يَتُبِ اللهُ عَلَيْهِ وَسَقَاهُ مِنْ نَهْرِ الْخَبَالِ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি (একবার) মদ্যপান করে, আল্লাহ তা‘আলা ৪০ দিন পর্যমত্ম তার সালাত কবুল করেন না। অবশ্য যদি সে তওবা করে তবে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। যদি সে (দ্বিতীয়বার) পুনরায় মদ্যপান করে, আল্লাহ ৪০ দিন পর্যমত্ম তার সালাত কবুল করেন না। আবার যদি সে তওবা করে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করেন। অতঃপর যদি সে আবারও (তৃতীয়বার) মদ্যপান করে, আল্লাহ তা‘আলা ৪০ দিন পর্যমত্ম তার সালাত কবুল করেন না। পুনরায় যদি সে তওবা করে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করেন। যদি সে চতুর্থবারও মদ্যপানের পুনরাবৃত্তি করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার ৪০ দিনের সালাত কবুল করেন না। এবারও যদি সে তওবা করে তবে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন না এবং আল্লাহ তা‘আলা তাকে নহরে খাবাল হতে অর্থাৎ জাহান্নামীদের রক্ত ও পুঁজের নহর হতে পান করাবেন। [তিরমিযী, হা/১৮৬২; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৭৭; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৩৫৭; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৭২৩২; মিশকাত, হা/৩৬৪৩।]

৪০ দিনের সালাত কবুল হয় না- এর অর্থ হচ্ছে সে সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে না। আর চতুর্থবারের পর তার তওবা কবুল হয় না- এর অর্থ হচ্ছে, সে সদা মদ্যপানের কারণে মদের প্রতি এমন আসক্ত হয়ে পড়ে যে, তওবা করা তার নসীব হয় না এবং তা পান করা অবস্থায়ই তার মৃত্যু ঘটে।

মদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিশাপ :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ - - فِى الْخَمْرِ عَشَرَةً عَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَشَارِبَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُوْلَةَ إِلَيْهِ وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَاٰكِلَ ثَمَنِهَا وَالْمُشْتَرِىَ لَهَا وَالْمُشْتَرَاةَ لَه

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মদের সাথে সংশ্লিষ্ট ১০ ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন- (১) মদ তৈরিকারী, (২) যে মদ তৈরি করে নেয়, (৩) মদ্যপানকারী, (৪) মদ বহনকারী, (৫) যার নিকট বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, (৬) মদ পরিবেশনকারী, (৭) মদ ক্রয়কারী, (৮) মদ বিক্রয়ের অর্থ ভক্ষণকারী, (৯) মদ বিক্রয়কারী এবং (১০) যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়। [তিরমিযী, হা/১২৯৫; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৮১; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৫৭; মিশকাত, হা/২৭৭৬।]

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, আমার নিকট জিবরাঈল (আঃ) এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ তা‘আলা মদকে, মদ প্রসত্মুতকারককে, যে মদ তৈরি করে নেয় তাকে, মদ্যপানকারীকে, মদ বহনকারীকে, যার জন্য মদ বহন করা হয় তাকে, মদ বিক্রেতা ও ক্রেতাকে এবং মদ পরিবেশনকারী ও যার জন্য মদ পরিবেশন করা হয় তাকে অভিশাপ করেছেন। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮৯৯; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৩৫৬; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/২২৩৪।]

মদ পান করা শিরকের সমতুল্য অপরাধ :

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন মদকে হারাম করে দেয়া হয়েছিল, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাহাবীগণ কেউ কেউ একে অন্যের নিকট গেলেন এবং বললেন, মদকে হারাম করে দেয়া হয়েছে এবং পাপের দিক থেকে শিরকের সমতুল্য করে দেয়া হয়েছে। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৭২২৭; মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১২২২৯; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৭১।]

মদ সকল অন্যায়ের মূল :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : اجْتَنِبُوا الْخَمْرَ فَإِنَّهَا مِفْتَاحُ كُلِّ شَرٍّ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তোমরা মদ্যপান করা থেকে দূরে থাকো। কেননা এটি সকল অনিষ্টের মূল। [মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৭২৩১; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৭১; আদাবুল মুফরাদ, হা/১৮; শু‘আবুল ঈমান, হা/৫১৯৯; মিশকাত, হা/৫৮০; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৬৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৭৯৮।]

মদ পানকারী অন্যান্য পাপেও জড়িয়ে পড়ে :

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, একদা বনী ইসরাঈলের এক বাদশা এক ব্যক্তিকে ধরে আনল এবং তাকে পাঁচটি বিষয় থেকে যে কোন একটি বিষয় গ্রহণ করার জন্য সুযোগ দিল। আর সে পাঁচটি বিষয় হচ্ছে, (১) মদ্যপান করা, (২) কোন ছোট বালককে হত্যা করা, (৩) ব্যভিচার করা, (৪) শুকরের মাংস খাওয়া, (৫) যদি সে এগুলোর কোন একটি করতে অস্বীকার করে তবে তাকে মেরে ফেলা হবে। অতঃপর সে লোকটি (কোন বড় ধরনের অন্যায় মনে না করে) মদ্যপান করাকে বেছে নিল। ফলে সে যখন মদ্যপান করল তখন সে অবশিষ্ট কাজসমূহও সম্পাদন করে ফেলল, যা কিছু তারা তার থেকে ইচ্ছা করছিল। [মু‘জামুল কাবীর লিত তাবারানী, হা/১৫২৮; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/২৪৫৪৩; সিলসিলা সহীহাহ, হা/২৬৯৫।]

এ হাদীসে বর্ণিত অপরাধগুলো উদাহরণ মাত্র। তবে বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে এসব অপরাধের মাত্রা অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়।

দৈহিক ক্ষমতা হ্রাস :

মাদকাসক্তি মানব দেহে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। এটি গ্রহণের ফলে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা শুরু হয়। যকৃতের তীব্র প্রদাহ, অনিদ্রা, পেটে ব্যাথাসহ লিভারের যাবতীয় রোগে আক্রামত্ম হয়। মাদকাসক্তির ফলে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে বলে বৈজ্ঞানিকদের অভিমত রয়েছে।

নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় :

মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার নীতিবোধ হারিয়ে ফেলে। সমাজে বিদ্যমান অপকর্মের বেশিরভাগ তার দ্বারাই সংগঠিত হয়। যেমন ব্যভিচার, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, রাহাজানি ইত্যাদি। এর ফলে পারিবারিক অশামিত্ম সৃষ্টি হয়। সমাজ জীবনে নেমে আসে নানা বিপর্যয়। মদ্যপায়ী ব্যক্তি সমাজে হয়ে যায় অবাঞ্চিত ও ঘৃণিত। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেন,

لَا تُسَلِّمُوْا عَلٰى شَرَبَةِ الْخَمْرِ

অর্থাৎ তোমরা মদ্যপানকারীদেরকে সালাম প্রদান করো না। [সহীহ বুখারী, মু‘আলাল্লাক সূত্রে ‘‘কারো গোনাহের কারণে কাউকে সালাত প্রদান না করা’’ অধ্যায়; শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৫২২।]

অর্থনৈতিক দিক :

মদ্যপানকারীর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ তার আর্থিক দিক। অব্যাহতভাবে মদ্যপান করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, যা মদ্যপায়ী স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবক থেকে না পেয়ে দারস্থ হয় নানামুখী অপকর্মের দিকে। যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, বন্ধু-বান্ধবদের থেকে ধার নেয়া, পরিবার-পরিজনকে অশামত্মকরণ ইত্যাদি। মাদকাসক্তি অর্থ অপচয়ের অন্যতম একটি মাধ্যম। এর ফলে সংসার জীবনে নেমে আসে দুঃখ দুর্দশা। বেড়ে যায় ঋণের বোঝা।

মানসিক দিক :

মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে মানুষের বিবেকের উপর অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। উদাসীনতায় ভোগে। হারিয়ে ফেলে সব রকমের কর্মস্পৃহা। সমাজ সংসার ছেড়ে বৈরাগ্য জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। অনেক সময় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলে।

মদ্যপানকারীদের ধবংস অনিবার্য :

উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার জীবন! আমার উম্মতের কতিপয় লোক রাত্রিযাপন করবে গর্বকারী, অহংকারী এবং খেল-তামাসায় রত অবস্থায়। অতঃপর তারা সকাল করবে বানর এবং শুকরে রূপামত্মরিত অবস্থায়। এর কারণ হলো রাত্রে তারা হারামকে হালাল করে নেবে, গায়িকা ও নর্তকী (নাচের নারী) গ্রহণ করবে, মদ্যপান করবে, সুদ খাবে এবং রেশমী পোষাক পরিধান করবে। [মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৮৪২; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৭৭।]

عَنْ أَنَسٍ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ  : إِِذَا اسْتَحَلَّتْ أُمَّتِي خَمْسًا فَعَلَيْهِمُ الدَّمَارُ، إِِذَا ظَهَرَ التَّلَاعُنُ، وَشَرِبُوْا الْخُمُوْرَ، وَلَبِسُوا الْحَرِيْرَ، وَاتَّخِذُوا الْقِيَانَ ، وَاكْتَفَى الرِّجَالُ بِالرِّجَالِ، وَالنِّسَاءُ بِالنِّسَاءِ

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার উম্মত যখন পাঁচটি বসত্মুকে হালাল মনে করবে, তখন তাদের ধবংস অপরিহার্য। (১) যখন পরস্পরকে অভিসম্পাত করার ব্যাপকতা লাভ করবে, (২) যখন তারা মদ্যপান করবে, (৩) যখন (পুরুষরা) রেশম কাপড় পরিধান করবে, (৪) যখন তারা গানের জন্য গায়িকা গ্রহণ করবে (নর্তকী নাচাবে) এবং (৫) যখন পুরুষরা পুরুষদের সাথে সমকামিতাকেই যথেষ্ট ভেবে বিবাহকে ত্যাগ করবে এবং নারীরা নারীদের সাথে সঙ্গম করে বিবাহকে ত্যাগ করবে। [শু‘আবুল ঈমান, হা/৫০৮৬; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৫৩।]

১০
দুনিয়াতে মদ্যপানকারীর শাসিত্ম
যদি কোন মদ্যপায়ীকে পাকড়াও করে আনা হয় আর জনগণ সাক্ষ্য দেয় যে, সে মদ পান করেছে অথবা তাকে নেশাগ্রসত্ম অবস্থায় আনা হয়েছে কিংবা তার মুখ থেকে মদ্যপানের গন্ধ পাওয়া যায় অথবা সে মদ্যপানের কথা স্বীকার করে তখন তার উপর হদ (শাসিত্ম) প্রয়োগ করতে হবে।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، أَنَّ النَّبِيَّ ضَرَبَ فِي الْخَمْرِ بِالْجَرِيْدِ وَالنِّعَالِ وَجَلَدَ أَبُو بَكْرٍ أَرْبَعِيْنَ وفى رواية أَنَّ النَّبِىَّ - كَانَ يَضْرِبُ فِى الْخَمْرِ بِالنِّعَالِ وَالْجَرِيْدِ أَرْبَعِيْنَ

আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ মদ্যপানের জন্য খুরমা গাছের ডাল ও জুতার দ্বারা প্রহার করতেন এবং আবু বকর (রাঃ) ৪০ চাবুক মারতেন। [সহীহ বুখারী, হা/৬৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৫১; আবু দাউদ, হা/৪৪৮১; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৪৪৯।] অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ মদ্যপায়ীকে জুতা ও খেজুরের ডাল দ্বারা ৪০ বার প্রহার করতেন। [সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৫৩; ইবনে মাজাহ, হা/২৫৭০; বায়হাকী, হা/১৭৩১১; মিশকাত, হা/৩৬১৫।]

সায়িব ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে, আবু বকর (রাঃ) এর খিলাফতকালে ও উমর (রাঃ) এর খিলাফতের প্রারম্ভে মদ্যপায়ীকে উপস্থিত করতাম এবং আমাদের হাত, জুতা ও চাদর দ্বারা তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করতাম। কিন্তু উমর (রাঃ) এর খিলাফতের শেষ পর্যায়ে এর ব্যতিক্রম ঘটে। তখন তিনি ৪০ চাবুক মারতেন। আর যখন তারা (মদ্যপায়ীরা) সীমা অতিক্রম করতে লাগল এবং পাপে লিপ্ত হতে শুরু করল, তখন তিনি ৮০ দোররা মারতে লাগলেন। [সহীহ বুখারী, হা/৬৭৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৭৫৭; বায়হাকী, হা/১৭৩১৪; মিশকাত, হা/৩৬১৬।]

আবদুর রহমান ইবনে আযহার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একটি দৃশ্যকে আমি যেন এখনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর তা হলো এই যে, একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এক ব্যক্তিকে এমন অবস্থায় উপস্থিত করা হলো, যখন সে মদ্যপান করছিল। তখন তিনি লোকদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা তাকে মারো। সুতরাং তাদের কেউ কেউ তাকে জুতা দ্বারা আবার কেউ কেউ লাঠি দ্বারা এবং কেউ কেউ খেজুর ডাল দ্বারা আঘাত করতে লাগলো।

বর্ণনাকারী ইবনে ওহাব বলেন, অত্র হাদীসে মীখা-এর অর্থ হলো খেজুরের কাঁচা ডাল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বয়ং নিজেই জমিন হতে কিছু মাটি তুলে নিলেন এবং (ঘৃণা ও নিন্দার ছলে) তা তার মুখের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। [আবু দাউদ, হা/৪৪৮৯; মিশকাত, হা/৩৬২১।]

চতুর্থবার মদ্যপানকারীকে হত্যা করতে হবে :

عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ أَبِى سُفْيَانَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ --: إِذَا شَرِبُوا الْخَمْرَ فَاجْلِدُوْهُمْ ثُمَّ إِنْ شَرِبُوْا فَاجْلِدُوْهُمْ ثُمَّ إِنْ شَرِبُوْا فَاجْلِدُوْهُمْ ثُمَّ إِنْ شَرِبُوْا فَاقْتُلُوْهُمْ

মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যখন কেউ মদ্যপান করে তখন তাকে দোররা মারো। তারপরও যদি পান করে তবে তাকে আবারও দোররা মারো। তারপরও যদি পান করে তবে তাকে আবারও দোররা মারো। তারপরও যদি পান করে তবে তাকে হত্যা করো। [আবু দাউদ, হা/৪৪৮৪; ইবনে মাজাহ, হা/২৫৭৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৯০৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৪৪৪৬; মুসত্মাদরাকে হাকেম, হা/৮১১৭; বায়হাকী, হা/১৭২৭৮।]

মদ্যপান পরিহার না করলে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে :

عَنْ دَيْلَمٍ الْحِمْيَرِىِّ قَالَ سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ - - فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّا بِأَرْضٍ بَارِدَةٍ نُعَالِجُ فِيْهَا عَمَلًا شَدِيْدًا وَإِنَّا نَتَّخِذُ شَرَابًا مِنْ هٰذَا الْقَمْحِ نَتَقَوّٰى بِه عَلٰى أَعْمَالِنَا وَعَلٰى بَرْدِ بِلَادِنَا . قَالَ : هَلْ يُسْكِرُ . قُلْتُ نَعَمْ . قَالَ : فَاجْتَنِبُوْهُ . قَالَ قُلْتُ فَإِنَّ النَّاسَ غَيْرُ تَارِكِيْهِ ، قَالَ : فَإِنْ لَمْ يَتْرُكُوهُ فَقَاتِلُوهُمْ

দায়লাম হিময়ারী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা শীতপ্রধান দেশে বাস করি এবং সেখানে আমরা কঠোর পরিশ্রমের কাজ করি। আমরা গম দ্বারা (এক প্রকার) মদ তৈরি করি। তা পান করলে আমাদের দেহে শক্তি সঞ্চার হয় এবং (কঠিন কাজে) আমাদের শরীরে শক্তি যোগায়। (আর দেহ ও মনকে সতেজ ও চাঙ্গা করে তোলে) এবং আমাদের অঞ্চলের শীত হতে আত্মরক্ষা করি। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, তাতে কি নেশা হয়? আমি বললাম, হ্যাঁ- তাতে নেশা হয়। তখন তিনি বললেন, তা হতে বেঁচে থাকো অর্থাৎ তা পান করো না। আমি বললাম, আমাদের দেশের লোকেরা তা বর্জন করবে না। তখন তিনি বললেন, যদি তারা তা পরিহার না করে তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করো। [আবু দাউদ, হা/৩৬৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮০৬৩; বায়হাকী, হা/১৭১৪৩; মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হা/৫৭৩; মিশকাত, হা/৩৬৫১।]

১১
পরকালে মদ্যপানকারীর পরিণাম
যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ্যপান করবে সে আখিরাতে তা পান করতে পারবে না :

عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ : ‏ كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ وَمَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ فِي الدُّنْيَا فَمَاتَ وَهُوَ يُدْمِنُهَا لَمْ يَتُبْ لَمْ يَشْرَبْهَا فِي الْاٰخِرَةِ ‏

ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যা কিছু নেশা তৈরি করে তা-ই মদ। আর নেশাজাত সকল দ্রব্যই নিষিদ্ধ। যে লোক দুনিয়াতে মদ্যপান করবে এবং তওবা না করেই এ অবস্থায় মৃত্যুমুখে পতিত হবে, সে আখিরাতে তা পান করতে পারবে না। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৩৩৬; আবু দাউদ, হা/৩৬৮১; তিরমিযী, হা/১৮৬১।]

যে ব্যক্তি নেশাযুক্ত জিনিস পান করবে তাকে ‘‘তীনাতুল খাবাল’’ পান করানো হবে :

عَنْ جَابِرٍ أَنَّ رَجُلًا قَدِمَ مِنْ جَيْشَانَ - وَجَيْشَانُ مِنَ الْيَمَنِ - فَسَأَلَ النَّبِىَّ - - عَنْ شَرَابٍ يَشْرَبُوْنَه بِأَرْضِهِمْ مِنَ الذُّرَةِ يُقَالُ لَهُ الْمِزْرُ فَقَالَ النَّبِىُّ -- : أَوَمُسْكِرٌ هُوَ . قَالَ نَعَمْ . قَالَ رَسُولُ اللهِ -- -: كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ إِنَّ عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ عَهْدًا لِمَنْ يَشْرَبُ الْمُسْكِرَ أَنْ يَسْقِيَه مِنْ طِينَةِ الْخَبَالِ . قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا طِيْنَةُ الْخَبَالِ قَالَ : عَرَقُ أَهْلِ النَّارِ أَوْ عُصَارَةُ أَهْلِ النَّارِ

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা জাইশান থেকে জনৈক লোক আগমন করলো। আর জাইশান হচ্ছে, ইয়ামানের একটি অঞ্চল। অতঃপর সে নবী ﷺ কে তাদের অঞ্চলে শস্য দিয়ে প্রসত্মুতকৃত ‘মিয্র’ নামক মদ্যপান করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। নবী ﷺ বললেন, এটা কি নেশা তৈরি করে? সে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ ﷺ আরো বললেন, নেশা উদ্রেক করে এমন সবই নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন, যে ব্যক্তি নেশাযুক্ত জিনিস পান করবে তাকে তিনি ‘‘তীনাতুল খাবাল’’ পান করিয়ে ছাড়বেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তীনাতুল খাবাল কী? তিনি বললেন, জাহান্নামবাসীদের ঘাম বা মলমূত্র। [সহীহ মুসলিম, হা/৫৩৩৫; নাসাঈ, হা/৫৭০৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৪৯২৩; মিশকাত, হা/৩৬৩৯।]

মদ্যপানকারী কিয়ামতের দিন মূর্তিপূজকদের সাথে মিলিত হবে :

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  : مَنْ لَقِيَ اللهَ مُدْمِنَ خَمْرٍ لَقِيَه كَعَابِدِ وَثَنٍ

ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মদ্যপানকারী অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে সে আল্লাহর সাথে মূর্তিপূজকের মতো সাক্ষাৎ করবে। [সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৩৪৮; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৬৪; শু‘আবুল ঈমান, হা/৫২০৮।]

নিত্য মদ্যপানকারীর জন্য জান্নাত হারাম :

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو عَنْ النَّبِيِّ قَالَ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنَّانٌ وَلَا عَاقٌّ وَلَا مُدْمِنُ خَمْرٍ

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, উপকার করে খোঁটাদানকারী, মাতাপিতার অবাধ্য ও মদ্যপানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [নাসাঈ, হা/৫৬৭২; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৩৩৮৪; দারেমী, হা/২০৯৪; মিশকাত, হা/৩৬৫৩।]

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তিন শ্রেণির লোকের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। নিত্য মদ্যপানকারী, পিতামাতার অবাধ্য ও দাইউস অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার পরিবারের কুকর্মকে স্বীকৃতি দেয়। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৩৭২; জামেউস সগীর, হা/৫৩৬৩; সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৩৬৬; মিশকাত, হা/৩৬৫৫।]

১২
মাদক প্রতিরোধের উপায়
সর্বনাশা মাদক বর্তমান সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। মাদক নৈতিকতা বিরোধী কাজে মরণাস্ত্রের ন্যায় কাজ করছে। অতএব সর্বগ্রাসী এ ছোবল থেকে জাতিকে মুক্ত করে একটি কল্যাণকর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর প্রভাব থেকে বাঁচার নিম্নোক্ত নীতিগুলো অনুসরণ করা অপরিহার্য :

কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ :

মদ, মদের ব্যবহার, মাদক সংশ্লিষ্ট যত রকমের বাণী কুরআন ও সুন্নাহতে রয়েছে তা যেমন নিজে জানতে হবে, তেমনি জানাতে হবে সমাজের অন্যান্যদেরকেও। তাদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। কেননা একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসনই মুক্তি দিতে পারে এ মরণছোবল থেকে।

সচেতনতা :

মাদক দ্রব্যের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এটির জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেহেতু এটি একটি সামাজিক অপরাধ, সেহেতু এর প্রতিরোধের দায়িত্বও সমাজের সুবিবেচক সদস্যদের উপর বর্তায়।

ঈমান :

প্রত্যেকটি মুসলমানকে ঈমানের বলে বলীয়ান হতে হবে। কোন ঈমানদার ব্যক্তি কোনক্রমেই মাদকদ্রব্য গ্রহণ কিংবা এতদসংশ্লিষ্ট গর্হিত কাজে যোগ দিতে পারে না।

সালাত :

সালাত মানুষকে ন্যায়ের পথে ও কল্যাণের পথে নিয়ে আসে। একজন সালাত আদায়কারী ব্যক্তি কখনোই মদ্যপায়ী হতে পারে না। আর সালাত মানুষের দেহ ও মনকে সকল প্রকার পাপ ও অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهٰى عَنِ الْفَحْشَآءِ وَالْمُنْكَرِ﴾

নিশ্চয় সালাত মানুষকে অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে দূরে রাখে। (সূরা আনকাবূত- ৪৫)

সাওম :

রোযার মাধ্যমেও মদের মতো বাজে জিনিস থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে অভ্যসত্ম হয়ে উঠা যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,

اَلصِّيَامُ جُنَّةٌ

অর্থাৎ রোযা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/৬৮২; সহীহ বুখারী, হা/১৮৯৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৭৬১; আবু দাউদ, হা/২৩৬৫; নাসাঈ, হা/২২২৮; ইবনে মাজাহ, হা/১৬৩৯; জামেউস সগীর, হা/৭৩২৩।]

তাকওয়ার মাধ্যমে :

তাকওয়া একটি মহৎ গুণ। যে ব্যক্তি তাকওয়ার বলে বলীয়ান সে কখনোই মন্দকাজের চিমত্মা করতে পারে না। এমনকি মদ্যপানের মতো গর্হিত কাজ তাকওয়াশীল লোকের পক্ষে করা একেবারেই অসম্ভব। কারণ সে সর্বদায় আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿-وَاَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوٰى فَاِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوٰى﴾

যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ভয় করে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তি হতে বিরত রাখে তার ঠিকানা হবে জান্নাত। (সূরা নাযিয়াত- ৪০)

পরিবারের ভূমিকা :

পরিবার সমাজ জীবনের প্রথম ভিত্তি। পরিবারেই সমত্মান প্রাথমিক ও সঠিক শিক্ষা পেয়ে থাকে। পরিবার প্রধান হিসেবে বাবা-মা তার সমত্মানদেরকে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করবেন এবং সজাগ থাকবেন যেন সমত্মানরা অসৎসঙ্গ লাভ করে মাদকের দিকে ধাবিত না হয়।

মদ প্রসত্মুতকারী ও সরবরাহকারীর ভূমিকা :

মাদকদ্রব্য প্রসত্মুতকারী সংস্থা ও মাদকদ্রব্যের কাঁচামাল ও প্রযুক্তির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা এবং নিষিদ্ধ মাদক উদ্ভিদের চাষ বন্ধ করে বিকল্প ফসল উৎপাদনের চিমত্মা করতে হবে।

ইমামদের ভূমিকা :

মাদক প্রতিরোধে ইমামদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। তারা নিজ নিজ মুসল্লিদেরকে মাদক সম্পর্কে সতর্ক করবেন এবং ইসলামে মদ্যপানকারীর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেও সাবধান করে দেবেন।

রাষ্ট্রের ভূমিকা :

মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে একটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মাদক বিরোধী আইন প্রণয়ন এবং তা যথাযথ বাসত্মবায়নের মাধ্যমে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র তার রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মদ উৎপাদন, আমদানীকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সবকিছু অবৈধ ঘোষণা করবে এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী শাসিত্মর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

১৩
তামাকজাত দ্রব্য
বর্তমান সময়ে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিণামের দিক থেকে মাদকদ্রব্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি তামাকজাত দ্রব্যেরও ব্যাপক ক্ষতিকর দিক রয়েছে।

তামাক এক ধরনের গাছ। এর পাতা এবং ডাল থেকে মানুষ নানা ধরনের দ্রব্য তৈরি করে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন- কেউ সরাসরি তামাকপাতা পানের সাথে সেবন করে, আবার কেউ জর্দা হিসেবে একে সেবন করে, আবার কেউ গুল হিসেবেও ব্যবহার করে, আবার কেউ হুক্কা হিসেবেও ব্যবহার করে। আর বিড়ি-সিগারেট হিসেবেই তামাক ব্যবহারের মাত্রা আরো বেশি। নিম্নে এ সম্পর্কে বিসত্মারিত আলোচনা করা হলো।

১৪
ধূমপান
ধূমপান একটি নীরব ঘাতক- এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। আমরা সকলে জানি যে, ধূমপান স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপানের ক্ষতির তুলনায় শ্লোগানটা খুবই হাল্কা। কারণ ধূমপান শুধু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর, আত্মার জন্য ক্ষতিকর, স্বভাব-চরিত্রের জন্য ক্ষতিকর, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। এর চেয়ে বড় ক্ষতির দিক হলো ধূমপানের মাধ্যমে ইসলামিক নৈতিকতা লংঘন।

ধোঁয়ার কারণে যেমন রান্নাঘরে কালো আবরণ পড়ে। তেমনিভাবে ধূমপানকারীর দাঁতে, মুখে ও ফুসফুসে কালো আবরণ তৈরি হয়। ঘরের আবরণ পরিস্কার করা গেলেও ফুসফুসের আবরণ পরিস্কার করা সম্ভব হয় না। ফলে তাকে অনেক রোগ ব্যাধির শিকার হতে হয়।

সমাজে যারা বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়ায় তাদের ৯৮% ভাগ ধূমপান করে থাকে। যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে তাদের ৯৫% ভাগ প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়। তারপর মাদক সেবন শুরু করে। এমনকি ধূমপানকারী মায়ের সন্তানও উগ্র স্বভাবের হয়ে থাকে। [দৈনিক ইনকিলাব তারিখ ১৫-১২-২০০০ ইং।]

ধূমপান নারীদের জরায়ু ও স্তনে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। নারীর ধূমপানের ফলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে, গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, অকাল গর্ভপাত হয়। মায়ের ধূমপানের কারণে বাচ্চার মধ্যে ঘনঘন খিচুনি ও রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয় এবং বুক ও চামড়া সংবেদনশীল হয়।

ব্যবসায়ীরা জীবনের মূল্য তেমন বুঝে না, যেমন বুঝে না অপ্রাপ্ত বয়স্করা। ফলে মদ ব্যবসায়ীরা জীবনের মূল্যকে তুচ্ছ করে অর্থের লোভে মরিয়া হয়ে এ ব্যবসা করে থাকে। ছোটরা যৌবনের কৌতুহলে এমন অনেক কিছুই করে থাকে, যার জন্য পরবর্তীতে দুঃখিত হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত, ধূমপান বিষয়ে সতর্ক হওয়া, এ বিষয়ে জানা এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নিম্নে এ বিষয়ে বিসত্মারিত আলোচনা করা হলো।

১৫
ধূমপানের ইতিহাস
ইউরোপীয়রা ১৪৯২ইং সালে তামাক সম্পর্কে প্রথম ধারণা লাভ করে, যখন কলম্বাস তার বাহিনীসহ আমেরিকায় অবতরণ করে। আমেরিকান আদিবাসী তথা ‘‘রেড ইন্ডিয়ানরা’’ তাদের ভূমিতে তামাক চাষ করত ও তা জ্বালিয়ে ধোঁয়া গ্রহণ করত। তাদের থেকে কলম্বাস ও তার সাথিরা তামাকের প্রথম ধারণা লাভ করে। খ্রিষ্টীয় ১৬০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে তামাক চাষের সূচনা হয়। প্রথমে ফ্রান্স, অতঃপর পর্তুগাল, স্পেন এবং সর্বশেষ বৃটেন ক্রমানুসারে তামাক চাষ করে। ১৮৮১ইং সনে আমেরিকায় সর্বপ্রথম সিগারেটের কারখানা তৈরি হয়।

মুসলিম দেশে ধূমপানের প্রবেশ :

১৭০০ শতাব্দীতে ভারত, ইরান ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তামাক আমদানি হয়। অতঃপর তুর্কীদের দ্বারা আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশে তামাকের প্রবেশ ঘটে। পরবর্তীতে ইসলামের শত্রুরা মুসলিম দেশে তামাকের প্রচলন শুরু করার জন্য মাঠে নামে। জনৈক খৃষ্টান ইংরেজ তুরস্কে সর্বপ্রথম ধূমপান নিয়ে আসে। জনৈক ইয়াহুদি মরক্কোতে সর্বপ্রথম ধূমপানের প্রচলন ঘটায়। সুদানে সর্বপ্রথম ধূমপানের প্রচলন করে জনৈক অগ্নিপূজক। অতঃপর মিসর, আরব উপদ্বীপ, ইয়ামান, হিন্দুস্তান ও অধিকাংশ মুসলিম দেশে তার প্রসার ঘটতে থাকে এবং ধীরে ধীরে এ ব্যাধি ব্যাপক আকার ধারণ করে।

১৬
কুরআনের দৃষ্টিতে ধূমপান
ধূমপায়ীদেরকে যখন বলা হয় ইসলামে ধূমপান করা বৈধ নয়, তখন তারা তা মানতে চায় না। অনেকে এটাও বলে- কুরআনে কোথাও বলা হয়নি যে, তোমরা ধূমপান করো না এবং হাদীসের কোথাও নেই যে, ধূমপান করা যাবে না। তাহলে ধূমপান ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ হলো কীভাবে? আবার অনেকে বলে থাকে যে, ধূমপান করা হারাম নয়, বরং এটি মাকরূহ। কেননা ধূমপান করলে জ্ঞান লোপ পায় না। আর এ কারণে এটি মাদকেরও অমত্মর্ভুক্ত নয়।

যারা ধূমপান করাকে মাকরূহ মনে করে তাদের উচিত নিম্নোক্ত আয়াতগুলো নিয়ে ভাবা। তাহলে ইসলামে ধূমপানের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে জানা যাবে-

ধূমপান খারাপ ও খবীস জিনিসের অমত্মর্ভুক্ত :

﴿وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَآئِثَ﴾

তিনি তোমাদের জন্য হালাল করে দেন ভালো ও উত্তম বসত্মুসমূহ এবং হারাম করে দেন খারাপ ও ক্ষতিকর বসত্মুসমূহ। (সূরা আরাফ- ১৫৭)

এ আয়াতের ভিত্তিতে এমন অনেক জিনিস আছে, যা হারাম হিসেবে সাব্যসত্ম হয়েছে। কিন্তু এখানে সেগুলোর প্রত্যেকটির নাম ধরে বলা হয়নি। অতএব এ আয়াতের সূত্রানুযায়ী যেসব জিনিস হালাল বসত্মু হিসেবে সাব্যসত্ম হবে তা হালাল এবং যেসব বসত্মু হারাম ও খাবায়িস এর অমত্মর্ভুক্ত হবে তা হারাম।

ধূমপান আত্মহত্যার সমতুল্য :

﴿وَلَا تُلْقُوْا بِأَيْدِيْكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ﴾

তোমরা নিজেদের জীবন ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। (সূরা বাকারা- ১৯৫)

এ আয়াতের দাবীতেও ধূমপান নিষেধ। কেননা ধূমপানের কারণে অনেক জীবন বিধ্বংসী রোগ-ব্যাধি হয়ে থাকে। সুতরাং এটি এক ধরনের আত্মহত্যার শামিল।

ধূমপান জাহান্নামের খাবারের মতো :

আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামীদের খাদ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,

﴿لَا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِيْ مِنْ جُوْعٍ﴾

এটা তাদের পুষ্টিও যোগাবে না এবং ক্ষুধাও নিবারণ করবে না। (সূরা গাশিয়া- ৭)

ধূমপানের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, তা পানকারীর পুষ্টির যোগান দেয় না, ক্ষুধাও মিটায় না। সুতরাং ধূমপানের তুলনা জাহান্নামের খাবারের সাথেই করা যায়।

ধূমপানকারীরা শয়তানের ভাই :

যারা ধূমপান করার জন্য সম্পদ খরচ করে তারা শয়তানের ভাই। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ كَانُوْاۤ إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ﴾

তোমরা অপচয় করো না। অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। (সূরা বনী ইসরাইল- ২৭)

আর এটি এমন একটি অপচয়, যাতে মানুষের জন্য কেবল ক্ষতিই বিদ্যমান।

১৭
হাদীসের আলোকে ধূমপান
আল্লাহ তা‘আলা ধূমপায়ীদেরকে পছন্দ করেন না :

মুগীরা (রাঃ) কে প্রেরিত এক চিঠিতে মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন,

إِنَّ اللهَ كَرِهَ لَكُمْ ثَلَاثًا قِيْلَ وَقَالَ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ

আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের তিনটি বিষয়ে ঘৃণা করেন। আর তা হলো, (১) ভিত্তিহীন ও সনদবিহীন কথাবার্তা, (২) সম্পদ নষ্ট করা এবং (৩) অধিক হারে প্রশ্ন করা। [সহীহ বুখারী, হা/১৪৭৭; সহীহ মুসলিম, হা/৪৫৮২; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮২০৪; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫৭১৯।]

আর ধূমপায়ীরা ধূমপানের পেছনে যে সম্পদ নষ্ট করে- এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কেননা এর দ্বারা কোন উপকার হয় না। বরং এর দ্বারা প্রতিনিয়ত ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়। সুতরাং যারা ধূমপান করে এভাবে সম্পদ নষ্ট করে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পছন্দ করেন না।

ধূমপায়ীরা প্রতিবেশীদেরকে কষ্ট দেয় :

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া ইসলামে বৈধ নয়। অথচ ধূমপায়ী ব্যক্তি যারা ধূমপান করে না তাদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এটা একটা বড় ধরনের অন্যায়।

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ ، عَنِ النَّبِيِّ قَالَ : مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ فَلَا يُؤْذِيْ جَارَه

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী ﷺ হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। [সহীহ বুখারী, হা/৫১৮৫; সহীহ মুসলিম, হা/১৮৩; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭২১৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/৫০৬।]

ধূমপানকারী তার ধূমপানের দ্বারা স্ত্রী, পরিবার-পরিজন, সহযাত্রী, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও আশেপাশের লোকজনকে কষ্ট দিয়ে থাকে। অনেকে নীরবে কষ্ট সহ্য করে মনে মনে ধূমপানকারীকে অভিশাপ দেয়।

তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাতেও প্রমাণিত হয়েছে যে, ধূমপানকারীর প্রতিবেশীরা শারীরিকভাবে অনুরূপ ক্ষতিগ্রসত্ম হন, যেরূপ ধূমপানকারী হয়ে থাকে। কেননা ধূমপানের ধোঁয়া কেবল ধূমপানকারীকেই ক্ষতিগ্রসত্ম করে না, বরং সেই ধোঁয়া আশেপাশে যত জনের নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করবে ততজনই ধূমপানকারীর সমপরিমাণ ক্ষতিগ্রসত্ম হবে। একজন ধূমপায়ীর পরিবার-পরিজন, সমত্মান-সমত্মানাদি ও প্রতিবেশীরা ধূমপান না করেও ধূমপানজনিত সকল ধরনের রোগে আক্রামত্ম হতে পারেন।

অতএব যারা এভাবে নিজে ক্ষতিগ্রসত্ম হয় এবং প্রতিবেশীদেরকেও ক্ষতিগ্রসত্ম করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَانًا وَّاِثْمًا مُّبِيْنًا﴾

আর যারা অপরাধবিহীন কোন মুমিন নর বা মুমিন নারীকে কষ্ট দেয়, তারা তো মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে থাকে। (সূরা আহযাব- ৫৮)

ধূমপায়ীরা নিজে ক্ষতিগ্রসত্ম হয় এবং অপরকেও ক্ষতিগ্রসত্ম করে :

ধূমপায়ী ধূমপান করে একদিকে সে নিজের ক্ষতি করে, অর্থের অপচয় করে, শরীরের ক্ষতি সাধন করে; অপরদিকে সে আশেপাশের লোকজনেরও ক্ষতি করে এবং তাদেরকে কষ্ট দেয়। আর এ সকল কাজ ইসলামে নিষেধ। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ ، أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ قَضٰى أَنْ لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ

উবাদা ইবনে সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, তুমি এমন কাজ সম্পাদন করবে, যা দ্বারা কারো ক্ষতি হবে না এবং কেউ ক্ষতির শিকারও হবে না। [ইবনে মাজাহ, হা/২৩৪০; মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/১৪২৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৮৬৭; দার কুতনী, হা/৪৫৩৯; বায়হাকী, হা/১১৬৫৭।]

অথচ ধূমপানের কারণে অপর ভাই কষ্ট পায়, ধূমপানের কারণে বায়ু দূষণ হয়, অন্যদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। বিশেষ করে যখন জনসাধারণের সমাগম স্থানে ধূমপান করা হয়।

ধূমপায়ীরা ফেরেশতাদেরকে কষ্ট দেয় :

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

فَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ تَتَأَذّٰى مِمَّا يَتَأَذّٰى مِنْهُ بَنُو اٰدَمَ

অর্থাৎ মানুষের জন্য যা কষ্টদায়ক, ফেরেশতাদের জন্যও তা কষ্টদায়ক। [সহীহ মুসলিম, হা/১২৮২; নাসাঈ, হা/৭০৭; ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫১৯৮; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হা/১৬৬৮; সহীহ ইবনে হিববান, হা/১৬৪৪।]

হালাল হওয়া সত্তেও নবী ﷺ পেয়াজ, রসুন ইত্যাদি দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু খেয়ে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন, যেন মুসল্লিরা কষ্ট না পায়, তাদের ইবাদাতে একাগ্রতা ও আল্লাহর সাথে মোনাজাতে যেন বিঘ্ন না ঘটে।

মসজিদ আল্লাহর ঘর, আল্লাহ তার ঘরের মর্যাদা বৃদ্ধি করা ও তাতে যিকির করার আদেশ করেছেন। তাতে প্রবেশ করার আগে তিনি আমাদেরকে সৌন্দর্য গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিমত্মু ধূমপান করে মসজিদে গেলে আল্লাহর বান্দারা কষ্ট পায় এবং ফেরেশতারাও কষ্ট পায়। কেউ যখন আল্লাহর সামনে ধূমপান করে সালাতে দাঁড়ায়, আর তার মুখ থেকে ধূমপানের দুর্গন্ধ বের হয়, তখন আল্লাহর সম্মান ও মর্যাদার দাবী কোথায় রইল?

১৮
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধূমপান
সুস্থতা মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ। সুস্থতাই মানুষের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবনে সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সাহায্য করে। ধূমপান জীবন বিধ্বংসী অনেক রোগের জন্ম দেয়। এর মধ্যে কতক রোগের পরিণতি হলো মৃত্যু। যেমন-

১. শ্বাসকষ্ট : ধূমপানের ফলে ফুসফুসে ক্যান্সার, গলনালির ক্যান্সার, ফুসফুস ফোলা ও শ্বাসকষ্ট হয়।

২. হৃদরোগ : ধূমপানের ফলে হার্ট এটাক ও হঠাৎ অসুস্থতার ঝুঁকি বাড়ে।

৩. বদ হজম : ধূমপানের ফলে ঠোঁট, মুখ ও খাদ্যনালির মধ্যে ক্যান্সার দেখা দেয়, পেটে ক্ষত সৃষ্টি হয়।

৪. মূত্রনালি : ধূমপানের ফলে মূত্রনালি বা কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৫. স্নায়ুযন্ত্র : ধূমপানের ফলে মাথা ব্যাথা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ও খিটখিটে মেজাজ তৈরি হয়।

ধূমপায়ীর সুস্থতা দেখে অনেক মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়। তারা মনে করে যে, ধূমপান শরীরে কোন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু দেরিতে হলেও শরীর ধূমপান দ্বারা আক্রান্ত হবেই। কারণ তাতে বিষ রয়েছে।

সিরিয়ার চিকিৎসক ‘ডা. কিনাআন আল-জাবি’ ঘোষণা করেছেন, ক্যান্সারের উপর আমার চিকিৎসার ২৫ বছর গত হয়েছে। আমার নিকট গলনালির ক্যান্সার আক্রান্ত এমন কোন রোগী আসেনি যে ধূমপায়ী ছিল না।

ধূমপান মানুষের মেধাকে বিনষ্ট করে দেয় :

মানুষের বিবেক ও মেধা আল্লাহর দেয়া বড় নিয়ামত। এ নিয়ামতের কারণে আল্লাহ আপনাকে অন্য মাখলুকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। অথচ আপনি ধূমপান করে বিবেক বিনষ্ট করছেন, তার প্রখরতা নিস্তেজ করে দিচ্ছেন। কারণ ধূমপানের কারণে বিবেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মেধা দুর্বল হয় ও দেহ-মনে পতনের আলামত দেখা যায়, ধূমপায়ী ও অধূমপায়ী ছাত্রদের মাঝে তুলনা করলে বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।

আমেরিকার একদল বিশেষজ্ঞ- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মাঝে এক পরিসংখ্যান করে দেখেছেন যে, ধূমপায়ী ছাত্রদের স্মৃতিশক্তি ও বুঝার ক্ষমতা অধূমপায়ী ছাত্রদের তুলনায় অনেক কম। বরং অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের তুলনায় ধূমপানের প্রভাব মস্তিস্কে খুব দ্রুত বিস্তার করে। সিগারেট জ্বালিয়ে ধূমপান আরম্ভ করার এক মিনিটের কম সময়ে তার ক্রিয়া মগজে পৌঁছে যায়।

ধূমপান মানুষের দাঁতের ক্ষতি করে :

দাঁত মুখের সৌন্দর্য। অথচ ধূমপানের ফলে দাঁতের মাড়ি, মুখ, জিহবা, ঠোঁট ও দাঁত কালো, ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্গন্ধময় হয়।

১৯
ধূমপানের ব্যাপারে ফতোয়া
ধূমপান করা হারাম এ মর্মে শাইখ আব্দুল আযিয ইবনে বায (রহ.) ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া লক্ষ্য করুন।

প্রশ্ন : ধূমপানের হুকুম কী? ধূমপান কুরআনে হারাম না মকরূহ? ধূমপান ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান কি?

উত্তর : প্রথমত : ধূমপান হারাম। ধূমপান কুরআনে বর্ণিত নিষিদ্ধ খবিস বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। ধূমপানে রয়েছে বিভিন্ন রোগের উপাদান। আল্লাহ তা‘আলা বান্দার উপর পবিত্র খাদ্য ও পানীয় হালাল করেছেন এবং অপবিত্র ও খারাপ বস্তু তিনি বান্দার উপর হারাম করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿يَسْأَلُوْنَكَ مَاذَاۤ أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ﴾

তারা তোমাকে প্রশ্ন করে, তাদের জন্য কী বৈধ করা হয়েছে? বলো, তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে প্রত্যেক পবিত্র বস্তু। (সূরা মায়েদা- ৪)

অন্য আয়াতে তিনি নবী ﷺ এর গুণাগুণ বর্ণনায় বলেন,

﴿فَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا بِهٖ وَعَزَّرُوْهُ وَنَصَرُوْهُ وَاتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِۤيْ اُنْزِلَ مَعَهٗۤ اُولٰٓئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ﴾

যারা তাঁর (নবীর) প্রতি ঈমান আনয়ন করে, তাঁকে সম্মান করে ও সাহায্য করে এবং যে নূর তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (সূরা আ‘রাফ- ১৫৭)

সর্বপ্রকার ধূমপান খবিস বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। যেমনিভাবে সকল প্রকার নেশাজাতদ্রব্য খবিস বস্ত্তর অন্তর্ভুক্ত। তাই ধূমপানের ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য মদের মতই হারাম। যারা ধূমপান করে অথবা তার ব্যবসায় জড়িত তাদের সবার উপর ওয়াজিব হচ্ছে, দ্রুত তওবা করে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা। পূর্বের কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় অঙ্গীকার করা। সত্যিকার অর্থে যে তওবা করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿ وَتُوْبُوْاۤ اِلَى اللهِ جَمِيْعًا اَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ﴾

হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর- ৩১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন-

﴿وَاِنِّيْ لَغَفَّارٌ لِّمَنْ تَابَ وَاٰمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا ثُمَّ اهْتَدٰى﴾

অবশ্যই আমি তার প্রতি ক্ষমাশীল, যে তওবা করে, ঈমান আনে, সৎকর্ম করে ও সৎপথে অবিচল থাকে। (সূরা ত্বা-হা- ৮২)

দ্বিতীয়ত : ধূমপানে রয়েছে শারীরিক ক্ষতি ও অর্থের অপচয়, অথচ ইসলাম শরীর ও সম্পদ সংরক্ষণ করার নির্দেশ প্রদান করেছে। মানব জাতির সংরক্ষণ ও উম্মতের হেফাযতের জন্য আলেমগণ যে পাঁচটি বস্তু হেফাযত করা অতি জরুরি ঘোষণা করেছেন, তার মধ্যে শরীর ও সম্পদ অন্যতম। অতএব শরীর ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করা অপরিহার্য। হাদীসে সম্পদ নষ্টের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সন্দেহ নেই ধূমপানের জন্য সম্পদ ব্যয় করা অপচয়ের শামিল, বরং ধূমপানের জন্য খরচ করা প্রকৃতপক্ষে নিজের ও সমাজের অনিষ্ট সাধন করা। [ফতোয়া লাজনায়ে দায়েমাহ, ২২/ ১৭৯-১৮০ পৃঃ।]

২০
একনজরে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো
নিম্নে ধূমপানের কয়েকটি পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

০১. ধূমপানের মাধ্যমে আল্লাহর নাফরমানি করা হয়।

০২. ধূমপানকারী ফেরেশতাদেরকে কষ্ট দেয়।

০৩. যারা ধূমপান করে না, ধূমপায়ী তাদের কষ্টের কারণ হয়।

০৪. ধূমপান সুন্দর পরিবেশকে দূষিত করে।

০৫. ধূমপান দ্বারা ইসলামের দুশমনদের সহযোগিতা করা হয়।

০৬. ধূমপানকারী গুনাহের কাজকে হালকা করে দেখে।

০৭. ধূমপানের সকল সামগ্রী দুর্গন্ধময় এবং ধূমপানকারীকেও এভাবে দুর্গন্ধময় করে।

০৮. ধূমপান একজন মানুষের সম্ভ্রম হনন করে এবং সম্মান হানি ঘটায়।

০৯. ধূমপানকারী একজন আদর্শহীন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।

১০. ধূমপানকারীর জন্য ইবাদাত-বন্দেগী করা কঠিন হয়ে যায়।

১১. ধূমপান মানুষকে ইলিম এবং আল্লাহর যিকির হতে দূরে রাখে।

১২. ধূমপান মানুষকে খারাপ মানুষের সাথে উঠা-বসায় বাধ্য করে।

১৩. এটি স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়।

১৪. অতিরিক্ত ধূমপানের কারণে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।

১৫. বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১৬. ধূমপানের কারণে যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১৭. ধূমপানের কারণে দাঁতের সৌন্ধর্য্য নষ্ট হয়।

এত কিছুর পরও কি একজন জ্ঞানী লোকের জন্য ধূমপান করা উচিত?

২১
ধূমপায়ীদের বাহানা ও অজুহাত
যদি কোন ধূমপায়ীকে প্রশ্ন করা হয় যে, আপনি কেন ধূমপান করছেন? তাহলে সে তার উত্তরে নানা বাহানা ও অজুহাত পেশ করে।

কেউ বলে, আমি যখন বিষণ্ণ থাকি তখন ধূমপান করি, যেন আমার অন্তরের বিষণ্ণতা দূর হয়। কেউ বলে, পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্ট ও একাকীত্ব দূর করার জন্য ধূমপান করি। কেউ বলে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় অধিক আনন্দ উপলব্ধির জন্য ধূমপান করি। কেউ বলে, স্বাদ উপভোগ করার জন্য ধূমপান করি। কেউ বলে, রাগ ও পেরেশানি দূর করার জন্য ধূমপান করি। কেউ বলে, বন্ধুত্বের খাতিরে ধূমপান করি। কেউ বলে, অমুকের দেখাদেখি ধূমপান করি। কেউ বলে, ছোট বেলা থেকে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়েছি, এখন ত্যাগ করা কঠিন হয়ে গেছে ইত্যাদি।

অনেক ধূমপায়ী এখনো জীবন্ত অন্তরের অধিকারী, ইসলামী মূল্যবোধে আপ্লুত। তাদের অন্তরে রয়েছে কল্যাণের প্রতি টান। তাদের হৃদয় ইসলাম ও মুসলিমের মহববতে পরিপূর্ণ। তবুও তারা ধূমপান ব্যাধিতে আক্রান্ত।

২২
ধূমপান ছাড়ার কিছু সহায়ক উপায়
অনেক ধূমপায়ী ধূমপানের বিভীষিকা অস্বীকার করেন না, শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপর এর অনিষ্ট সম্পর্কে তাদের কোন সন্দেহ নেই। বরং তাদের অনেকে ধূমপান ত্যাগ করার ইচ্ছা লালন করেন, কিমত্মু পারেন না। নিচে ধূমপান ছাড়ার কিছু সহায়ক উপায় বর্ণনা করা হলো :

১. স্মরণ করুন, ধূমপান ক্ষতিকর ও শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম। এ দুটি বিষয়ই আপনাকে ধূমপান ত্যাগ করতে সহায়তা করবে। বারবার ধূমপান করা, ধূমপানের নিষেধাজ্ঞার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা, ধূমপান বৈধ স্বীকৃতি দেয়া ও তার অনিষ্টতার ব্যাপারে উদাসীন থাকার ফলে মানুষ ধূমপান ছাড়তে পারে না।

২. ধূমপান করব না মর্মে খালেস দিলে তওবা করুন। আপনার নিকট যখন স্পষ্ট হলো যে, ধূমপান শরীর ও দ্বীনের জন্য ক্ষতিকর, অতএব আপনি আপনার রবের নিকট তওবা করুন। ধূমপানের কারণে আপনার শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই আপনি হেদায়েতের দিকে ফিরে আসুন। হঠাৎ মৃত্যু আসার আগেই আপনি সঠিক পথ গ্রহণ করুন। কখনো আগামীকাল বা এই ছেড়ে দিচ্ছি, ছেড়ে দেব- এসব বলবেন না, কারণ এটাও এক ধরনের পাপ।

৩. আল্লাহর জন্য ইখলাস গ্রহণ করুন। খাঁটি ইখলাসই ধূমপান ও অন্যান্য হারাম বস্তু ত্যাগ করার জন্য যথেষ্ট। আপনি যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার নিমিত্তে এবং তার ভয় ও আযাব থেকে দূরে থাকার জন্য ইখলাস গ্রহণ করেন, সত্যিকার তওবা করেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিবেন, আপনার তওবা কবুল করবেন। ধূমপান ত্যাগ করা আপনার জন্য তিনি সহজ করবেন।

৪. অন্তর আল্লাহর মহববত দ্বারা পূর্ণ করুন। বস্তুত মানুষের অন্তরে আল্লাহর মহববতের ঘাটতির অনুপাতে চিন্তা, পেরেশানি ও দুঃখ বাসা বাঁধে। আল্লাহর মহববত থেকে যে অন্তর একেবারে শূন্য, সে অন্তর দুশ্চিন্তা, দুঃখ ও কষ্ট থেকে কখনো মুক্তি পায় না। তার অন্তরে অন্য সকল মহববত ভিড় করে, তার কার্যাদি বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো করে দেয়। অতএব ধূমপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি আল্লাহর মহববত দ্বারা অন্তর পূর্ণ করা ব্যতীত কোন উপায় নেই।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন, আল্লাহর ইবাদাত ও মহববত ও তার দিকে মনোনিবেশ ব্যতীত অন্তর কখনো সুখ, সফলতা, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা পায় না। উপভোগ ও বিনোদনের সকল বস্তু থাকা সত্তেও সে তৃপ্ত হয় না, প্রকৃত আনন্দ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ তার অন্তর সে উপাদান থেকে শূন্য- যার মাধ্যমে প্রকৃত সুখ ও কল্যাণ লাভ হয়।

৫. ধূমপান ত্যাগ করার উপকরণ গ্রহণ করুন। যেমন- যখন ধূমপান করতে ইচ্ছা হবে তখন হালাল খাদ্যের মধ্যে কোন কিছু চিবাতে বা চুষতে থাকুন। অতঃপর আপনার বিষয় আল্লাহর নিকট সোপর্দ করুন। তার নিকট সাহায্য কামনা করুন। আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন, আপনার উপর সদয় হবেন, যা আপনার কল্পনাতীত। আর তিনিই সর্বোত্তম সাহায্যকারী ও অভিভাবক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿وَمَنْ يَّتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُه ﴾

আর যে আল্লাহর উপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। (সূরা তালাক- ৩)

৬. দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করুন। আপনার মধ্যে ধূমপান ত্যাগ করার যত ইচ্ছা থাক, আপনি ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে যতই জানুন, যদি আপনার মধ্যে সত্যিকার প্রতিজ্ঞা না থাকে ধূমপান ত্যাগ করতে পারবেন না।

৭. ধূমপান ত্যাগের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করুন। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রচেষ্টাকারীর জন্য কল্যাণ, হেদায়াত ও তাওফীকের সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَاِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ﴾

যারা আমার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন। (সূরা আনকাবূত- ৬৯)

৮. অবসরতা পরিহার করুন। অবসর সময় মানুষকে ধূমপানে অভ্যস্ত করে। তাই একা দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে না থেকে কাজে ব্যস্ত হোন।

৯. নিরাশ হবেন না। আপনি এক বা একাধিক বার ধূমপান ত্যাগ করার ইচ্ছা করেছেন কিন্তু ত্যাগ করতে পারেননি। অথবা দীর্ঘ এক সময় ধূমপান ত্যাগ করেছিলেন, অতঃপর আবার আরম্ভ করেছেন। এ জন্য আপনার মধ্যে হতাশা আসতে পারে, অথবা শয়তান আপনার অন্তরে ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে যে, ধূমপান ত্যাগ করার কোন পথ নেই। আপনি নিরাশ হবেন না। খুব সম্ভব একবার বিফল হলে আরেকবার সফল হবেন।

১০. অসৎ সঙ্গ থেকে দূরে থাকুন। অসৎ সঙ্গ খারাপকে ভালো ও ভালোকে খারাপ করে পেশ করে। খারাপের দিকে ধাবিত করে ও ভালো থেকে দূরে রাখে। মনে রাখুন, মানুষ তার বন্ধুর স্বভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়।

১১. সৎ সঙ্গ গ্রহণ করুন। সৎ সঙ্গ আপনার দোষ ধরিয়ে দেবে, আপনাকে সৎ পথ দেখাবে। আর খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে রাখবে এবং পাপ থেকে দূরে রাখবে। ইনশা-আল্লাহ

১২. শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চান। শয়তান আপনার সামনে পাপকে সুন্দরভাবে পেশ করে ও তাতে আকৃষ্ট করে। তাই যখন আপনার মনে ধূমপান করার ইচ্ছা হয়, আপনি শয়তান থেকে পানাহ চান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

﴿وَاِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللهِؕ اِنَّهٗ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ﴾

যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও, নিশ্চয় তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন। (সূরা আ‘রাফ- ২০০)

প্রিয় পাঠক, আল্লাহর মহববতকে যদি আপনার মূল লক্ষ্যে পরিণত করেন, গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে স্মরণ করেন, তাহলে আপনার প্রবৃত্তি ও নফসের ওপর আপনি বিজয়ী হবেন। শয়তানকে আপনি পরাস্ত করতে পারবেন। ইনশা-আল্লাহ!

২৩
সন্দেহ থেকে দূরে থাকুন
শরীয়তে অনেক জিনিস রয়েছে যা স্পষ্ট হারাম। আবার অনেক জিনিস রয়েছে যা স্পষ্ট হালাল। আর উভয়ের মধ্যে কিছু জিনিস রয়েছে যা সন্দেহ সৃষ্টিকারী। কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যা জানতে পেরেছি তাতে ধূমপান যে হারাম এতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরও কেউ যদি এটাকে হারাম মানতে রাজি না হয় তবে- এটা যে স্পষ্ট হালাল জিনিস নয় এ কথায় কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। আর যে জিনিস স্পষ্ট হালাল নয় বরং সন্দেহজনক- যাকে তারা মাকরূহ বলে থাকেন, সেটা থেকে দূরে থাকা ঈমানের দাবী। হাদীসে এসেছে,

عَنْ نُعْمَانَ بْنَ بَشِيْرٍ يَقُوْلُ : سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ : اَلْحَلَالُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشَبَّهَاتٌ لَا يَعْلَمُهَا كَثِيْرٌ مِّنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الْمُشَبَّهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِيْنِه وَعِرْضِه ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ كَرَاعٍ يَرْعٰى حَوْلَ الْحِمٰى يُوْشِكُ أَنْ يُّوَاقِعَه أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى أَلَا إِنَّ حِمَى اللهِ فِي أَرْضِه مَحَارِمُه أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّه ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّه أَلَا وَهِيَ الْقَلْبُ

নু’মান ইবনে বাশীর (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি, হালাল ও হারাম প্রকাশ্য। তবে এ দু’য়ের মাঝে সন্দেহজনক কিছু বিষয় রয়েছে, যা অনেকেই জানে না। কাজেই যে ব্যক্তি এসব সন্দেহজনক বস্তু থেকে নিজেকে রক্ষা করবে, সে যেন স্বীয় দ্বীন ও সম্মান রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঐসব সন্দেহজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়বে, তার উদাহরণ ঐ রাখালের ন্যায়, যে কোন চারণভূমির আশেপাশে স্বীয় পশু চরায়। হতে পারে হঠাৎ করে তার জানোয়ারগুলো সরকারী চারণভূমিতে ঢুকেও পড়তে পারে। (জেনে রেখো) প্রত্যেক বাদশাহরই একটি চারণভূমি থাকে। তাই (হে সাহাবীগণ), সাবধান! (এ দুনিয়াতে) আল্লাহর চারণভূমি হলো তাঁর হারামকৃত বস্তুসমূহ। মানুষের শরীরে এমন একটি গোশতের টুকরা রয়েছে, যা ভালো থাকলে গোটা দেহ ভালো থাকবে। আর যখন তা বিনষ্ট হবে তখন গোটা দেহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। মনে রাখবে, তা হলো ক্বলব। [সহীহ বুখারী, হা/৫২; সহীহ মুসলিম, হা/৪১৭৮; আবু দাউদ, হা/৩৩৩১-৩২; ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৮৪; দারেমী, হা/২৫৩১; মিশকাত, হা/২৭৬২।]

অতএব এ হাদীসের দিকে লক্ষ্য করে ধূমপান ছেড়ে দিন। তাহলে দ্বীন ও ঈমান হেফাযতে থাকবে। ইনশা-আল্লাহ!

২৪
ধূমপানের পূর্বে চিন্তা করুন
 কোন জন্তু বা পাখি তামাক গাছের নিকটবর্তী হয় না। আপনি কেন হবেন?

 কয়েক ফোঁটা নিকোটিন একটি কুকুর হত্যার জন্য যথেষ্ট। ধূমপান করে আপনি কেন নিজের টাকায় নিজেকে হত্যা করবেন?

 ধূমপান প্রায় ২৫টি রোগের কারণ, আর প্রত্যেকটি রোগ জীবনের জন্য বড় হুমকি। আপনি কেন নিজের টাকা খরচ করে রোগ কিনবেন?

 ধূমপান করে আপনি কেন ধূমপায়ী নামে পরিচিত হবেন?

 ধূমপান করে কেন আপনি নিজ সাথিদেরকে কষ্ট দেবেন?

 সুস্থতা আল্লাহর নিয়ামত। আর ধূমপান হচ্ছে অসুস্থতা, ভেবে দেখুন কোনটা গ্রহণ করবেন?

 আপনার মুখে ধূমপানের নিদর্শন নিয়ে কীভাবে মালাকুল মাউতের সাথে সাক্ষাৎ করবেন?

 ধূমপানের উপকারিতা কী? ধূমপানের আগে একটু চিন্তা করে দেখুন।

 জ্ঞানীরা সম্মান অর্জন করে এবং মর্যাদার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করে। অথচ আপনি ধূমপান করে নিচে অবতরণ করছেন।

 ধূমপানের খাতে ব্যয় করা প্রতি টাকার জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। কেননা আপনার সম্পদের প্রকৃত মালিকানা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। তিনি আপনাকে এ সম্পদের মালিক বানিয়েছেন। এ সম্পদ তিনি বৈধ পন্থায় অর্জন করা ও বৈধ পন্থায় খরচ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি যদি ধূমপান করে সম্পদ নষ্ট করেন তাহলে আপনি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলেন এবং একটি বড় ধরনের গোনাহের ভাগিধার হলেন।

২৫
আহবান
এ বইটি পড়ে যদি আপনি মনে করেন যে,

এর দ্বারা কেউ উপকৃত হবে

তবে আপনার পড়া শেষে বইটি অন্যজনকে পড়তে দিন।

যদি সম্ভব হয় তবে কিছু কপি সংগ্রহ করে উপহার দিন।

এটা উত্তম সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে।

আপনার মাধ্যমে যদি একজন মানুষ দ্বীনের আলো পায়,

তবে এটা আপনার জন্য বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর ক্বসম! হে ‘আলী, তুমি জেনে রেখো! তোমার হাতে কাউকে আল্লাহ যদি হিদায়াত দান করেন, তবে তা তোমার জন্য রক্তিম বর্ণের উট পাওয়ার চেয়েও উত্তম। সুবহা-নাল্লাহ!

(সহীহ বুখারী, হা/৩০০৯, ২৯৪২, ৩৭০১, ৪২১০; সহীহ মুসলিম, হা/৬৩৭৬; আবু দাউদ, হা/৩৬৬৩)

আপনার উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে যদি কেউ কোন নেক আমল করে তবে আপনিও এর সমান সওয়াবের অংশিদার হবেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে কোন উত্তম কাজের দিক নির্দেশনা দেয় সেও ঐ পরিমাণ সওয়াব পায়, যতটুকু সওয়াব এর আমলকারী পায়। সুবহা-নাল্লাহ!

(সহীহ মুসলিম, হা/৫০০৭; আবু দাউদ, হা/৫১৩১; তিরমিযী, হা/২৬৭১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১২৫; সহীহ ইবনে হিববান, হা/২৮৯)

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন