hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

হারাম শরীফের দেশ ফজিলত ও আহকাম

লেখকঃ দা‘ওয়াহ ও উসূলুদ্দীন ফ্যাকাল্টি, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়

২৭
তৃতীয় অধ্যায়: হারাম শরীফের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে করণীয় ও বর্জনীয়
হারাম শরীফ থেকে দূরবর্তী যে সকল দেশের মুসলিমদের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়ে থাকে, তারা কা‘বা শরীফ দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে এবং এ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যে, সুযোগ হলে তারা মক্কা এসে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করবে ও এখানে কিছুদিন অবস্থান করবে। তাদের কেউ যখন কা‘বার ছবি দেখে, এর প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণ ও ভালোবাসায় তখন কেঁদে ফেলে। সরাসরি দেখতে না পারার বেদনায় তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। সরাসরি কা‘বা দেখেছে এমন কোন মুসলিম ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাৎ হলে সে তার চক্ষু দ্বয়ে চুমু খায় ও ভীষণ খুশি হয়।

এসব বিষয় দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হারাম শরীফে আগত ও অবস্থানকারী ব্যক্তির উচিত হল সে যেন ঐ অনুগ্রহের কথা উপলব্ধি করে, যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন এবং সে নিয়ামতের কথা স্মরণ করে, যা লাভের আকাঙ্ক্ষা করেও বহু লোক তা লাভ করতে পারে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও যখন নবী (ﷺ)-কে মক্কা থেকে বের করে দেয়া হয়, তখন তিনি বলেছিলেন :

والله إنك لخير أرض الله وأحب أرض الله إلى الله ولولا أني أخرجت منك ما خرجت .

‘‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট ও সবচেয়ে প্রিয় জমিন। যদি তোমার থেকে আমাকে বহিষ্কার করা না হত, তাহলে স্বেচ্ছায় আমি বের হতাম না।’’ [ইতোপূর্বে হাদীসটির রিওয়ায়াত সংক্রান্ত তথ্য দেয়া হয়েছে। দেখুন পৃঃ]

সুতরাং ঐ ব্যক্তির কীরূপ উপলব্ধি করা উচিত, যে ব্যক্তি মক্কার জমিনে জন্মগ্রহণ করেছে, তথায় অবস্থিত যমযমের পানি পান করেছে, সেখানে বেড়ে উঠেছে ও জীবন যাপন করেছে, কেউই তাকে সেখান থেকে বের করে দিচ্ছে না এবং কোন জালিম সেখানে বসবাস করা থেকে তাকে বাধাও দিচ্ছে না।

সালাফে সালেহীন বায়তুল্লাহর প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং অন্তরে এর প্রতি এক বিশাল শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। এমনকি গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় মক্কায় অবস্থানের ব্যাপারেও তারা বিচলিত থাকতেন।

ইবনে রজব বলেন, একদল সাহাবি মক্কায় অবস্থান করা থেকে বিরত থাকতেন- এ ভয়ে যে, না জানি সেখানে কোন পাপে লিপ্ত হয়ে পড়েন ......। উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কায় একটি গুনাহে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে অন্যত্র সত্তরটি গুনাহে লিপ্ত হওয়াও আমার কাছে অধিকতর সহজ। [জামি‘ আল ‘উলূম ওয়াল হিকাম, পৃঃ ৩৩২।]

হারাম শরীফে পাপ কাজে লিপ্ত হওয়াকে কীভাবে বান্দা ভয় না পেয়ে থাকতে পারে? অথচ আল্লাহ বলেছেন :

وَمَنْ يُرِدْ فِيهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿الحج :25﴾

‘‘আর যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘনের মাধ্যমে মসজিদুল হারামে অন্যায় ও বাতিল কাজের ইচ্ছা পোষণ করে, তাকে আমি পীড়াদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাব।’’ [সূরা আল-হাজ্জঃ ২৫।]

হারাম শরীফে বাতিল কাজে লিপ্ত ব্যক্তির অপরাধ ভয়াবহ এবং এর পরিণাম অত্যন্ত মর্মান্তিক। ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :

أبغض الناس إلى الله ثلاثة : ملحد في الحرم ، ومبتغ في الإسلام سنة الجاهلية ، ومطلب دم امرئ بغير حق ليهريق دمه .

‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য মানুষ তিনজন: হারাম শরীফের সীমানায় অন্যায় কাজে লিপ্ত ব্যক্তি, ইসলামের মধ্যে জাহেলী যুগের প্রথা প্রচলনে আগ্রহী ব্যক্তি এবং ঐ ব্যক্তি যে অন্যায়ভাবে কারো রক্তপাত ঘটাতে (প্রাণ সংহার করতে) চায়। [সহীহুল বুখারী- কিতাবুদ দিয়াত, অনুচ্ছেদঃ যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো রক্তপাত ঘটাতে চায়, হাদীস নং ৬৮৮২।]

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি আল্লাহর পূর্বোক্ত বাণী-

وَمَنْ يُرِدْ فِيهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿الحج :25﴾

এ ব্যাপারে বলেন, যদি কোন ব্যক্তি এডেন শহর থেকেও হারামে অন্যায় ও পাপ কাজের ইচ্ছা পোষণ করে, তাকেও আল্লাহ অবশ্যই মর্মান্তিক শাস্তি প্রদান করবেন। [আল-মুসতাদরাক ২/৩৮৮। হাকিম বলেন, ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী হাদীসটি সহীহ। ইমাম যাহাবীও একে সহীহ বলেছেন। তবে বুখারী ও মুসলিমে হাদীসটি বর্ণিত হয়নি।]

আয়াতটির অর্থের ব্যাপারে সালাফে সালেহীন থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত সমূহ উল্লেখ করে ইবনে কাসীর বলেন : এ বর্ণনাসমূহ দ্বারা যদিও বুঝা যায় যে, এগুলোতে বর্ণিত কাজসমূহ ‘ইলহাদ’, তবু সঠিক বক্তব্য হচ্ছে ‘ইলহাদ’ আরো ব্যাপকার্থক। এ দ্বারা আরো ভয়াবহ কাজে এ স্থানে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে। এ জন্যই হস্তীবাহিনী যখন বায়তুল্লাহ ধ্বংসের ইচ্ছা করেছিল, আল্লাহর তাদের উপর আবাবীল পাখি পাঠালেন, যারা তাদের উপর সিজ্জীল পাথর নিক্ষেপ করছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে ভক্ষিত তৃণ সদৃশ করে দেন। অর্থাৎ তাদেরকে ধ্বংস করে বায়তুল্লায় খারাপ কাজের ইচ্ছা পোষণকারীদের জন্য শিক্ষা লাভের উপকরণ করে দিয়েছেন। [তাফসীর ইবনে কাসীর ৩/২১৫।]

আশ্চর্যের বিষয় হল জাহেলী যুগের লোকেরাও হারাম শরীফের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত এবং এর মর্যাদার কথা মনে রেখে বায়তুল্লাহর যাবতীয় অধিকার রক্ষা করত। এ সম্পর্কিত কিছু উদ্ধৃতি নীচে পেশ করা হল:

হামাবী বলেন, হারব ইবনে উমাইয়া বলেছেন : হাদরামী নামক এক ব্যক্তি মক্কায় অবতরণের দিকে আহবান জানালেন। তিনি হারব ইবনে উমাইয়ার মিত্র বনী নাফাসা গোত্রের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তার উপনাম ছিল আবূ মাতার। হারাম সীমানার বাইরে তিনি অবতরণ করতে চাইলে হারব নিম্নের চরণগুলো আবৃত্তি করলেন :

أبا مطر هلم إلـى الصلاح فيكفيك الندامى من قريش

وتـنـزل بلدة عزت قديما وتأمن أن يزورك رب جيش

فتأمن وسطهم وتعيش فيهم أبا مطر هديت بخير عيش

অর্থাৎ- ‘‘হে আবূ মাতার! আপনি কল্যাণের দিকে আসুন। কুরাইশদের অনুতপ্ত লোকেরাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আপনি এমন শহরে অবতরণ করছেন, যা আদিকাল থেকে মর্যাদাপূর্ণ। কোন সেনাদলের অধিপতির সাথে সাক্ষাৎ থেকে আপনি নিরাপদ থাকবেন। আপনি তাদের মধ্যে নিরাপদে থেকে তাদের সাথে বসবাস করবেন। হে আবূ মাতার! আপনি উৎকৃষ্ট জীবন প্রাপ্ত হোন- এটাই কামনা।’’

দেখাই যাচ্ছে, কীভাবে হারব তাকে তার মক্কায় অবস্থানকালে নিরাপত্তা প্রদান করছিলেন। [মু’জামুল বুলদান ৫/২১৩]

বায়তুল্লাহর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা পোষণের আরেকটি বহিঃপ্রকাশ ছিল এই যে, যখন তারা বায়তুল্লাহকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে চেয়েছিল, তখন এর খরচের পুরোটাই যেন উত্তম ও হালাল রোজগারের মধ্য হতে হয় সে ব্যাপারে তারা ছিল খুবই উৎসুক। ইবনে ইসহাক তার সিরাত গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, আবূ ওহাব ইবনে ‘আমর কুরাইশদেরকে বললেন, তোমরা তোমাদের উপার্জন হতে এ কাজে উত্তম রোজগার ছাড়া আর কিছু খরচ করো না। তোমরা এতে বেশ্যার উপার্জন, সুদি বেচা কেনার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ এবং কোন মানুষের প্রতি জুলুম করে উপার্জিত সম্পদের কোন কিছু মিশ্রিত করো না। [সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২২০, আল-খাবার ফিস সিয়ার ওয়াল-মাগাযী পৃঃ ১০৪, তারীখুত তাবারী ২/২৮৭, ইবনে হিশাম এ উদ্ধৃতিটি আয়েয ইবনে ইমরান ইবনে মাখযুম থেকে বর্ণনা করেন।]

এজন্যই বায়তুল্লাহ নির্মাণের প্রয়োজনীয় খরচের অর্থ তাদের কাছে সংগৃহীত হয়নি। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলেছিলেন :

إن قومك قصرت بهم النفقة .......

‘‘তোমার সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ব্যয়ের অর্থ কম ছিল....। [সহীহুল বুখারী- কিতাবুল হাজ্জ, অনুচ্ছেদঃ মাক্কার ফযীলত ও এর নির্মাণ কাজ- হাদীস নং ১৫৮৪।]

অর্থাৎ বায়তুল্লাহর নির্মাণকালে। ফলে তারা ‘আল-হিজর’এর দিক থেকে ইবরাহীম (আঃ)-এর ভিত্তি নির্মাণ কাজে অপারগ হলেন, যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।

জাহেলী যুগে কুরাইশদের কাছে বায়তুল্লাহর সম্মান ও মর্যাদার আরো প্রমাণ হল এই যে, তারা সকল আরবের উপর এটা শিরোধার্য করে দিয়েছিল যে, হারামে প্রবেশ করলেই তারা ‘হিল’ তথা হারাম সীমানার বাইরের পাথেয় রেখে আসবে এবং ‘হিল’ এর পোশাক ছেড়ে হারামের পোশাক পরবে। ক্রয় করার মাধ্যমে কিংবা ধার করে হোক অথবা দানের মাধ্যমে লাভ করে হোক। যদি তারা পোশাক না পেত, তাহলে উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করত। [ফতহুল বারী ৫/২১৪, উরওয়া ইবনেয যুবাইয়ের বক্তব্য এ ব্যাপারে মূল দলীল। দেখুন- সহীহুল বুখারী, কিতাবুল হাজ্জ-অনুচ্ছেদঃ অকুফে আ’রাফা-হাদীস নং ১৬৬৫।]

জাহেলী যুগের এক মহিলা তার কোন এক ছেলেকে হারাম শরীফের প্রতি মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শনের অসিয়ত করে বলছেন :

أبني لا تظلم بـمكة لا الصغير ولا الكبير

أبني من يظلم بـمكة يلق آفات الشرور

أبني قد جـربـتهـا فوجدت ظالـمها يـبور .

অর্থাৎ- ‘‘হে প্রিয় বৎস! মক্কায় ছোট হোক ও বড় হোক, কোন ধরনের জুলুম করো না। ছেলে আমার! জেনে রাখ, যে মক্কায় জুলুম করে, সে একরাশ মন্দের মুখোমুখী হবে। প্রিয় বৎস আমার! এখানে জুলুম ও অন্যায় করেছে এমন লোকদের ধ্বংস হয়ে যেতে আমি দেখেছি।’’ [এ চরণগুলোর রচয়িতা হলেন সুবাই‘য়াহ বিনতে আহবব। তিনি তার ছেলে খালিদ ইবনে আবদে মুন্নাফকে মাক্কার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অসিয়ত করেছিলেন এবং এখানে অন্যায় ও গর্হিত কাজ করা থেকে নিষেধ করেছিলেন। এটি একটি বড় কাসীদা। দেখুন- সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৫, আল-বিদয়া ওয়ান নিহায়া ৩/১২৬।]

জাহেলী যুগের লোকেরা বায়তুল্লাহকে এভাবেও সম্মান প্রদর্শন করত যে, কোন ব্যক্তি তার বাবার হত্যাকারীকে এখানে দেখতে পেলে প্রতিশোধ স্পৃহায় উত্তেজিত ও বিচলিত হত না এবং প্রতিশোধ নিয়ো না। ইমাম কুরতুবী বলেন, জাহেলী যুগে যারা হারামে প্রবেশ করে আশ্রয় নিত, তারা আক্রমণ ও হত্যার হাত থেকে নিরাপদ থাকত। [আল-জামে‘ লিআহকামিল কুরআন ৪/৯১।]

এটাই ছিল যখন জাহেলী যুগের লোকদের অবস্থা, তখন এ পার্থক্যের কথা ভেবে অবাক হতে হয় যে, বর্তমানে বহু সংখ্যক মুসলিম হারাম শরীফের হক ও অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞানতায় নিমজ্জিত। এর প্রতি তাদের অন্তরে সম্মানবোধের মাত্রা খুবই কম। তারা সেখানে এমন সব কাজ করে থাকে, যা ভূ-পৃষ্ঠের সবচেয়ে সম্মানিত স্থানের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা পোষণকারীদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

অথচ আমরা দেখি রাসূল (ﷺ) শিরক ও পাপ এবং নাজাসাত ও অপবিত্র বস্ত্ত হতে মক্কাকে পবিত্র করতে খুবই উৎসুক ছিলেন। আজকের যুগে কিছু লোক শরিয়তের নিষিদ্ধ বিষয়ে জাহেলী যুগের লোকদের অনুকরণে লিপ্ত হয়েছে এবং যে সম্মান প্রদর্শন তাদের উপর ওয়াজিব ছিল, তার বিপরীত অনেক কাজ তারা করছে। গায়রুল্লাহর উদ্দেশে কোন এবাদত আদায়ের মত ভয়াবহ ও মারাত্মক অন্যায় কাজ তারা সেখানে করছে। যেমন- ঘরবাড়ি নির্মাণের সময় এখানে তারা পশু জবেহ করছে, তাদের ধারণা অনুযায়ী জিনের ক্ষতি হতে বাঁচার জন্য জাদুকর ও মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে ঝাড়ফুঁককারীদের কাছে তারা এসে থাকে, সালাত আদায়ে অলসতা প্রদর্শন করে থাকে, বরং অনেকে সালাতেও ত্যাগ করে থাকে, জন সাধারণ্যে প্রচলিত বিদ‘আতী দু‘আ ও যিকির তারা এখানে পাঠ করে থাকে, আল্লাহর কাছে ছাওয়াব লাভের উদ্দেশে তারা বিভিন্ন বিদ‘আতী উৎসব পালন ও মৌসুমি রাত্রি জাগরণ করে থাকে, এখানে তারা বেশ কিছু স্থান, গিরিপথ ও কূপের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে যার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিধান শরিয়ত প্রণয়ন করেনি। অনেকে আবার এখানে অশ্লীল কাজ করে থাকে, নেশাকর বস্ত্ত পান করে, মাদকদ্রব্যের আদান-প্রদান করে, ভিডিও ক্যাসেট, হারাম গান কিংবা ডিশ এন্টিনার মত হারামের দিকে উদ্বুদ্ধকারী মাধ্যমসমূহ বেচা-কেনা করে, কেউ আবার অসৎলোকদের সাথে আড্ডা দেয়, রাত জেগে এমন সব হারাম কাজে লিপ্ত থেকে সময় কাটায়, একজন মুসলিমের জন্য যেসব কাজ করা শুধু হারাম শরীফেই নয়, বরং যে কোন স্থানেই পুরোপুরি অসংগত।

এ পবিত্র স্থানের মর্যাদাকে যারা খুবই খাটো করে দেখে, তাদের ব্যাপারটি কতই না আশ্চর্যজনক! কীভাবে তারা এমনটি করে? অথচ ‘‘আল্লাহর হারামে, তাঁর পবিত্র শহরে ও এর ভূমিতে কোন পাপ কাজ করা পৃথিবীর অন্য যে কোন স্থানে করার চেয়েও ভয়াবহ...’’। [যাদুল মাআ‘দ ১/৫১।]

অতএব পবিত্র হারামের দেশে বসবাসকারীদের উপর আরোপিত দায়িত্ব অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি। তাই অন্যদের চেয়েও উত্তম আদর্শের গুণে গুণান্বিত হওয়া তাদের জন্যই বেশি বাঞ্ছনীয় ও সমুচিত। এ কাজটি করার জন্য সালাফে সালেহীনের জীবনী অধ্যয়ন করা তাদের প্রয়োজন, কীভাবে সালাফগণ পরিপূর্ণ হক আদায় করে বায়তুল্লাহ্র প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন, এ অনুভূতি সহকারে যে, তা অন্তরের তাকওয়ারই অংশ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ ﴿الحج :32﴾

‘‘এটাই আল্লাহর বিধান। অন্যদিকে কেউ আল্লাহ্র নিদর্শনা বলীকে সম্মান করলে তা হবে হৃদয়ের তাকওয়া সঞ্জাত।’’ [সূরা আল-হাজ্জঃ ৩২।]

শাইখ আবদুর রহমান সা’দী (রহ.) বলেন, ‘‘আল্লাহর নিদর্শনা বলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হৃদয়ের তাকওয়া থেকেই সৃষ্ট। কেননা এটা সম্মান প্রদর্শনকারীর তাকওয়া ও বিশুদ্ধ ঈমানের প্রমাণ। কারণ নিদর্শনা বলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন মূলত: আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর’’। [তাইসিরুল কারিম আর-রহমান ৩/৩২০।]

এভাবে সালাফে সালেহীনের অবস্থা জানা ও অধ্যয়নের মাধ্যমে তাদের অনুকরণ ও অনুসরণ করা সহজ হবে, তাদের নীতির আলোকে জীবন পরিচালনা করা যাবে এবং আল্লাহ যেগুলোকে সম্মান দিয়েছেন, সেগুলোর প্রতি সঠিক পদ্ধতিতে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে তারা যে পথ ধরে চলেছেন, সে পথের অনুগামী হওয়া যাবে।

সম্মান প্রদর্শনের অর্থ এই নয় যে, মুসলিমরা এমন কিছু প্রতীকী ও বাহ্যিক কাজ-কর্ম করবে, যে কাজগুলো অনুমোদনের ব্যাপারে শরিয়তে কিছুই আসেনি এবং সালাফে সালেহীন (রাঃ)-ও এগুলো করেননি।

আজ জনসাধারণের কাছে এমন কিছু বাতিল আক্বীদা ও প্রথা পাওয়া যায়, যা সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী। এগুলো তাদেরকে এমন সব ইবাদত পালনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নতুন উদ্ভাবিত। তাদের ধারণার মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য ও ছাওয়াব অর্জন করছে। এসব কাজের কোন শরয়ি দলিল ছাড়াই তারা এগুলো দ্বারা সম্মান ও তাযীম প্রদর্শনের নিয়ত করছে। কিছু সংখ্যক মুসলিম কর্তৃক পালিত সম্মান প্রদর্শনের কিছু চিত্র আমরা এখানে তুলে ধরছি, যা শরিয়তে অনুমোদিত নয়।

১- সালাত আদায় করা, দু‘আ করা ও বরকত লাভের উদ্দেশে কতিপয় স্থান যিয়ারত করা, যেমন- গারে হেরা, গারে সাওর, জাবালে আরাফাত এবং রাসূল (ﷺ)-এর জন্মস্থান বলে কথিত স্থান। [যে স্থানে রাসূল (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে স্থান নির্ধারণ করার ব্যাপারে কোন সঠিক নির্ভরযোগ্য পাওয়া যায় না। ইবনে ইসহাক সর্বপ্রথম তা নির্ধারণ করেছিলেন এবং তারপর সীরাহ গ্রন্থের রচয়িতাগণ এ বিষয়ে তাকে অনুসরণ করেছিলেন। তবারী তার ‘তারীখ’ গ্রন্থে (১/৪৫৩) বলেন, ইবনে হুমাইদ সালামাহ থেকে এবং তিনি ইবনে ইসহাক থেকে আমার কাছে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমুল ফীল বা হস্তি-বর্ষে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে যে, তিনি ‘দার ইবনে ইউসুফ’ নামক ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে ইসহাক থেকে এ বর্ণনার সনদটি খুবই দুর্বল। এ সনদে রয়েছেঃ মুহাম্মাদ ইবনে হুমাইদ ইবনে হিববান আর-রাযী। অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার দুর্বলতার ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া হয়েছে যে, তিনি মাকলূব ও মুনকার হাদীসসমূহ বর্ণনা করতেন। ইমাম নাসায়ী, আবূ যুরআ’ ও ইবনে দারাহ বলেন, তাকে লোকেরা মিথ্যা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। আর ‘আলেমদের কেউ কেউ তার যে প্রশংসা করেছেন তা এজন্য যে, তিনি সুন্নাহর ব্যাপারে কঠিন ছিলেন। দেখুন- তাহযীবুল কামাল (২৫/১০৭-১০৮), আল-কামিল, ইবনে আ’দী (৩/৯৯)। আর সালামাহ হচ্ছেন ইবনুল ফাদল আল-আবরাশ। তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে দুর্বল রাবী এবং মাগাযী তথা যুদ্ধের বর্ণনার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। দেখুন- তাহরীর আত-তাকরীব (২/৫৯)। আর ইবনে ইসহাক হচ্ছেন রাবী হিসাবে ‘সদূক’ (সত্যবাদী)। তিনি কর্মবাচ্যের শব্দে জন্মস্থান নির্ধারণের সংবাদটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কথিত আছে যে, তিনি ‘দার ইবনে ইউসুফ’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, তার থেকে বর্ণিত নির্ধারণের খবরটি দুর্বল। কেননা তিনি এ খবরের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না।এ খবরটি দুর্বল হওয়ার আরো প্রমাণের মধ্যে রয়েছে, ইবনে ইসহাক থেকে ইউনুস ইবনে বুকাইর এর বর্ণনায় নবী (ﷺ)-এর জন্মের ঘটনা ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের যে অংশে বর্ণিত হয়েছে, সেটি ইতোমধ্যেই মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে জন্মস্থান সম্পর্কিত খবরটি নেই।ইবনে ইসহাক থেকে যিয়াদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-বুকালির বর্ণনায় সীরাতে ইবনে হিশামেও এ খবরটি নেই। ইবনে আ’সাকির ‘তারীখে দিমাশক’ গ্রন্থের শুরুতে নবীজীর সিরাত সম্পর্কে ইবনে ইসহাকের খবরসমূহ বর্ণনা করেছেন, সেখানেও এটি নেই।তদুপরি ইবনে ইসহাক যদি নবী (ﷺ) থেকে কোন খবর নিশ্চিত হয়েও বর্ণনা করেন, তবু তা হচ্ছে ‘মু’দাল’। কেননা তিনি শুধু দু’টো মাধ্যমেই নবী (ﷺ) থেকে বর্ণনা করেন, যে মাধ্যম দু’টোর স্থান সনদের প্রথম দিকে। অতএব কোন অবস্থাতেই জন্মস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ খবরটির উপর নির্ভর করা শুদ্ধ নয়। এ জন্যই সালেহী সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ’ গ্রন্থে (১/৩৭) রাসূল (ﷺ)-এর জন্মের আরো কয়েকটি স্থান উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সীরাত লেখকগণও এসব স্থান উল্লেখ করেছেন। যদিও সীরাত গ্রন্থের অধিকাংশ রচয়িতাগণ মনে করেন যে, রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম মাক্কাতেই হয়েছিল, কিন্তু স্থানটি সুনির্দিষ্টভাবে তারা নির্ধারণ করেননি।নবী (ﷺ)-এর জন্মস্থান নির্ধারণের বিষয়টি যে কারণে আরো অধিক দুর্বল বলে মনে হয় তা হল, যে বৃক্ষটির কাছে বাইয়া’তুর রিদওয়ান সম্পন্ন হয়েছিল, সেটি সাহাবাগণ বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের অধিকাংশই নিশ্চিতভাবে বৃক্ষটির স্থান নির্ধারণে সক্ষম ছিলেন না। অথচ তারা ছিলেন বাইয়াতের ঘটনার খুবই কাছাকাছি সময়ের এবং তারা প্রায় সকলেই তাতে উপস্থিত ছিলেন। আর আল্লাহ তা‘আলাও সূরা আল-ফাতহে বাইয়াতের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমরা পরবর্তী বৎসর ফিরে আসলাম। আমাদের মধ্য থেকে কোন দু’জন ব্যক্তিও সে গাছটির ব্যাপারে একমত হতে পারলো না যে গাছটির নিচে আমরা বাইয়াত করেছিলাম। বুখারী ২৯৫৮ নং হাদীসে এটি বর্ণনা করেন।সায়ীদ ইবনেুল মুসাইয়িব বলেন, আমার বাবা বলেছেন, তিনি সে সকল ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা গাছের নিচে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে বাইয়াত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমরা পরবর্তী বছর আসলে গাছটিকে ভুলে গেলাম। গাছটি আর চিনতে পারলাম না।সাঈদ বলেন, মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ গাছটি চিনত না। আর তোমরা তা জান! তাহলে তো তোমরা বেশি জান!! বুখারী ৪১৬৩ নং হাদীসে এটি বর্ণনা করেন।অতএব সাহাবাদের দু’জন ব্যক্তিও যখন গাছটির স্থান নির্ধারণের ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না, অথচ ঘটনাটি ছিল খুবই নিকটবর্তীকালের, তাহলে রাসূল (ﷺ)-এর জন্মস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে একমত না হওয়ার ব্যাপারটি আরো উত্তমভাবে প্রযোজ্য; কেননা ঘটনাটি ছিল অনেক আগের। আর এসব কিছু জানার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ না থাকার কারণ ছিল যাতে সে সকল মাধ্যম প্রতিহত হয় যা শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপের দিকে পরিচালিত করে। উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এ রকমই করেছিলেন যখন তাকে বলা হলো- একটি গাছ সেখানে আছে, মানুষের ধারণা এর নিচে বাইয়াত গ্রহণ করা হয়েছিল। এর কাছে এসে তারা সালাত আদায় করে। তিনি গাছটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলে গাছটি কেটে ফেলা হল, যাতে মানুষ একে উৎসবের উপলক্ষ হিসাবে গ্রহণ না করে। ইবনে সা’দ ‘তাবাকাত’ গ্রন্থে সহীহ সনদে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।রাসূল (ﷺ)-এর জন্মস্থান নির্ধারণের বিষয়টিকে যারা অস্বীকার করেছেন তাদের একজন হলেন আল-ইয়াশী আল-মাগরিবি (মৃত্যু ১০৯১ হিঃ)। তিনি তার বিখ্যাত মাক্কা ভ্রমণ (১/২২৫) গ্রন্থে রাসূল (ﷺ)-এর জন্মস্থান নির্ধারণ বিষয়ে সীরাত গ্রন্থসমূহের মতপার্থক্য বর্ণনা শেষে বলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার হল- তারা শয়নের স্থান পরিমাণ ঘরের একটি স্থানকে নির্ধারণ করে বলছেন যে, এটি রাসূল (ﷺ)-এর জন্মস্থান। শুদ্ধ কিংবা দুর্বল যে কোন পন্থায়ই এটা নির্ধারণ করা আমাদের কাছে সুদূর পরাহত। কেননা তার জন্ম মাক্কায় হয়েছে নাকি মাক্কার বাইরে সে ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এরপর তিনি বলেন, দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর এবং খবরের সনদ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর ঘরের সে স্থানটিকে নির্ণয় করা সম্পূর্ণ দুরূহ। জন্মের ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল জাহেলী যুগে তখন এমন কেউ ছিল না যিনি স্থান স্মরণ রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দেবেন, বিশেষ করে যখন এর সাথে তাদের কোন উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট ছিল না। ইসলাম আগমনের পর সাহাবা ও তাবেয়ীগণের অবস্থা থেকে এটা জানা যায় যে, তারা সে সকল স্থানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকে কোন গুরুত্ব দিতেন না, যেগুলোর সাথে শরীয়তের কোন আমলের সম্পর্ক ছিল না। কেননা অসি ও বাকযন্ত্রের মাধ্যমে শরীয়তের হেফাযত করার মত আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো ছিল, তারা সে সবের প্রতিই যাবতীয় গুরুত্বারোপ করতেন। ইসলামের বহু ঐতিহাসিক চিহ্ন অস্পষ্ট থাকার কারণ ছিল এটাই।আল-ইয়াশী যা উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে আবদুস সালাম আদ্-দিরঈ আল-মাগরিবি তার প্রসিদ্ধ দু’টো ভ্রমণ কাহিনীতে তার প্রতি তাকিদ দিয়েছেন। দেখুন- তালখীস আল-মুআররিখ আল-আদীব হামাদ আল-জাসির রহ. পৃঃ ১৩৮।আল-জাসিরও এ কথার প্রতি জোর দিয়ে বলেন, যে স্থানে রাসূল (ﷺ) জন্মস্থান করেছেন, সে স্থানের ব্যাপারে, মতভেদ এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, সাধারণ মানুষের কাছে জন্মস্থান নামে যে স্থানটি পরিচিত সেটি বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক কোন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। (মাজাল্লাতুল আরব ৩য় ও ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৭, সংখ্যা রামাযান ও শাওয়াল ১৪০২)যদি ধরেও নেয়া হয় যে, রাসূল (ﷺ)-এর জন্মস্থানটি পরিচিত ও চিহ্নিত, তাহলেও এ কথা জানা দরকার যে, কোন অবস্থাতেই একে ইবাদাত করা ও বরকত চাওয়ার স্থান হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ নয়, যেরূপ আজকাল অনেক জাহেল লোক এখানে সালাত আদায়, সেজদা করা বরকত অর্জনের উদ্দেশ্যে চুমু খাওয়া ও মাসেহ করার মত গর্হিত কাজগুলোর মাধ্যমে করে থাকে। কেননা রাসূল (ﷺ) এমনটি করেননি। তার কোন সাহাবা, তাবেয়ী এবং মান্যবর ইমামগণও তা করেননি। সালাফদের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে সকল কল্যাণ এবং পরবর্তী যুগের লোকদের বিদআতের মধ্যেই রয়েছে সকল অকল্যাণ।]

২- মুআ’ল্লায় কিংবা অন্যত্র শাফায়াত চাওয়ার জন্য, অসীলা করা, কবরবাসীদের কাছে দু‘আ চাওয়া অথবা কবরের পাশে আল্লাহর কাছে দু‘আ করার জন্য কবর যিয়ারত করা। কেননা এ কাজগুলো শিরক কিংবা শিরকের প্রতি পরিচালনাকারী মাধ্যম।

প্রজ্ঞাবান শরিয়ত প্রণেতা শর‘ঈ পন্থায় কবরসমূহ যিয়ারতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তা হলো কবরস্থ ব্যক্তির জন্য দু‘আ করা, মৃত্যু ও আখেরাতকে স্মরণ করা, উপদেশ গ্রহণ, পাষাণ হৃদয়কে কোমল করা, অশ্রুহীন চোখে অশ্রু প্রবাহিত করা।

৩- যে পানি দ্বারা কা‘বা ধৌত করা হয় সে পানি দ্বারা বরকত অর্জন এবং গোসল করা।

৪- কা‘বার গিলাফের কাপড় দ্বারা বরকত অর্জন করার জন্য উক্ত কাপড়ের অংশ সংগ্রহ করা এবং তা সংরক্ষণ করা ও তার অসিলা দিয়ে আরোগ্য চাওয়া। এছাড়া কিছু লোক গিলাফের কাপড় কেটে নিয়েও বাড়বাড়ি করে থাকে।

৫- মাকামে ইবরাহীম, কা‘বার গিলাফ, মসজিদুল হারামের দরজা ও পিলারসমূহ বরকত লাভের নিয়তে মাসেহ করা ও এগুলোকে চুমু খাওয়া।

৬- এ বিশ্বাস করা যে, যমযমের পানি অন্য দেশে নিয়ে গেলে তার স্বাদ পরিবর্তন হয়ে যায়।

৭- কাবার যে কোন স্থানে চুমো দেয়া। এমনিভাবে মাকামে ইবরাহীম চুমো দেয়া বা মাসেহ করা। ইবনে জারির রহ. স্বীয় সনদ ও মুহাদ্দিস আজরকির সনদে কাতাদা রহ. এর বরাত দিয়ে কুরআনের আয়াত-

وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى ﴿125﴾

এর ব্যাখ্যায় বলেন, (মাকামে ইব্রাহিমের নিকট নামাজ আদায় করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, একে হাতে স্পর্শ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়নি...) [ইবনে জারির (৩/৩৫) হা. ২০০০। আজরকি (২/২৯) দ্র. তরতুশির ‘হাওয়াদেস অল বিদা’ পৃ:১০৩।]

৮- বিদায়ি তাওয়াফের পর মসজিদুল হারামকে সামনে রেখে পিছন দিকে উল্টা হেঁটে বের হওয়া। [দেখুন- আল-ইখতিয়ারাত আল-ইলমিয়াহ, ইবনে তাইমিয়াহ, পৃঃ ৭০। আযহারী বলেন, হাদীসের মধ্যে ‘আল-কাহকারা’ একাধিকবার এসেছে। এর অর্থ হল- যে দিকে সে হাঁটছে সে দিকে মুখ না ফিরিয়ে পিছন দিকে উল্টা হাঁটা। (তাহযীবুল্লুগাহ ৫/১২১)]

৯- এ বিশ্বাস রাখা যে, জুমু‘আর দিন অকুফে আরাফা করতে পারলে তা বাহাত্তরটি হজের সমতুল্য হবে। [দেখুন- মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল উমরা, আলবানী পৃঃ ৫৬।]

১০- তাওয়াফ এবং সা‘ঈর প্রত্যেক চক্করের জন্য দু‘আ নির্দিষ্ট করা। তাওয়াফকারী শুরু করার সময়, মাকামে ইবরাহীমের কাছে ও যমযমের পানি পান প্রভৃতি কাজের সময় এমন বিশেষ দু‘আ পাঠ করা যা নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়নি।

১১- এ বিশ্বাস রাখা যে, কা‘বার দিকে শুধু তাকানোই একটি এবাদত। এ বিষয়ে কোন সহীহ হাদিস নেই। ইবাদতের মূলনীতি হল- তা ওহি নির্ভর। সালাতের মধ্যেও কা‘বার দিকে তাকানোর ব্যাপারে কেউ কেউ এ রকম ধারণা পোষণ করে। এ বিশ্বাস নবী (ﷺ) যে আমল করেছেন তার বিরোধী। কেননা তিনি যখন সালাত আদায় করতেন, তখন মস্তক অবনত রাখতেন এবং জমিনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। [হাকিম মুস্তাদরাক গ্রন্থে (২/৩৯৩) আবূ হুরাইরাহ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, তা হল- রাসূল (ﷺ) যখন সালাত আদায় করতেন তার দৃষ্টি আসমান অভিমুখে উঠাতেন। তখন নাযিল হল, الذين هم في صلاتهم خشعون ‘‘যারা সলাতে বিনয়াবনত থাকে’’। এরপর তিনি মস্তক অবনত রাখতেন। হাদীসটি হাকিম শুদ্ধ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবীও তার সাথে একমত হয়েছেন- এ অধ্যায়ে আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত আছে, যা হাকিম ও বায়হাকী বুখারী ও মুসলিমে শর্তের ভিত্তিতে সহীহ সনদে রিওয়ায়াত করেছেন। (সালাতুন্নাবী (ﷺ) পৃঃ ৮০)]

১২- মিযাবের নীচে নিম্নোক্ত ছায়ার নীচে সেদিন ছায়া প্রদান করুন, যেদিন আপনার ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া দু‘আটি পড়া - اللهم أظلني في ظلك يوم لا ظل إلا ظلك ‘‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার থাকবে না। [মানাসিকুল হাজ্জ ওয়াল ‘উমরা, আলবানী ৫২ পৃঃ।]

১৩- কা‘বা থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি দ্বারা বরকত অর্জন। [প্রাগুক্ত।]

১৪- জনসাধারণ ও গন্ড-মূর্খ লোকদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, কা‘বার অভ্যন্তরে যে প্রবেশ করবে তার জন্য খালি পায়ে জমিনে চলাফেরা করা জায়েয নয়, কা‘বার ভেতর সে যা দেখেছে তা বর্ণনা ও কা‘বার ছাদের দিকে তাকানো বৈধ নয়। যে কা‘বার ছাদের দিকে তাকায় সে অবশ্যই অন্ধ হয়ে যাবে। এ ধরনের আরো যত ধারণামূলক কল্পনা ও কুসংস্কার রয়েছে- এগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। [আত্-তারিখুল কাবীম লিমাক্কাহ ওয়া বায়তুল্লাহ আল-কারীম, মুহাম্মাদ তাহির আল-কুরদী, ২/৫২২-৫২৩।]

অনেক হাজীর ধারণা যে, কাবায় প্রবেশ করা ওয়াজিব এবং তা হজের গুরুত্বপূর্ণ কাজের অন্তর্ভুক্ত। এটা অজ্ঞতা। এমনকি দেখা গেছে যে, কা‘বার দরজা খোলার সময় ঢুকতে না পারার কারণে কোন কোন হাজী অত্যধিক দুশ্চিন্তায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হয়েছিল।

এ ধরনের লোকেরা এসব এবাদত পালন ও আক্বীদা পোষণ করার কারণ হল- তাদের মধ্যে মিথ্যা ও দুর্বল হাদিসের প্রসার, যার উপর তারা নিজেদের কাজের সমর্থনে নির্ভর করে এবং দলিল দিয়ে থাকে।

কোন কোন বইয়ে উদ্ধৃত ও মুখে মুখে প্রচলিত এ সকল হাদিসের কিছু আমরা নীচে উল্লেখ করলাম, যেগুলো হাদিস বিশারদদের মতে দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

১- ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এই ঘরে প্রত্যেক দিবস ও রজনিতে একশত বিশটি রহমত নাজিল করেন, যার ষাটটি তাওয়াফকারীদের জন্য, চল্লিশটি মুসল্লিদের জন্য, বিশটি বায়তুল্লাহর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধকারীর জন্য।’’ এটি একটি দুর্বল হাদিস। [আলবানী এ হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন। দেখুন- সিলসিলাতুল আহাদীস আদ-দায়ীফাহ ১/২২১-২২৩, দায়ীফ আল-জামে’ হাদীস নং- ১৭৬০।]

২- যে ব্যক্তি মক্কার গরমে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তার থেকে জাহান্নামের গরম দূরীভূত করবেন। আবূ জাফর আল-উকাইলী বলেন, এটি ভিত্তিহীন। [আল-কাশফ আল-ইলাহী, মুহাম্মাদ আত-তরাবলূসী ২/৬৭৮।]

৩- ‘মক্কার নির্বোধ ব্যক্তিরা হবে জান্নাতের অতিরিক্ত জনবল’ এ হাদিসটির কোন ভিত্তি নেই। হাফেজ ইবনে হাজারকে এ হাদিস সম্পর্ক জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আমি এ হাদিস সম্পর্কে অবগত নই। [আল-আজওয়েবাহ আল-মুহিশাহ, পৃঃ ২৬৫; এছাড়া আরো দেখুন- মুখতাসারুল মাকাদেস আল-হাসানাহ, হাদীস নং- ৫৩১।]

৪- আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, কা‘বার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা এবাদত। [আলবানী একে দুর্বল বলেছেন। দাঈফুল জামে’ হাদীস নং- ৫৯৯০।]

৫- ‘মক্কার নিদ্রিত ব্যক্তি অন্য জায়গায় সালাতে দন্ডায়মান ব্যক্তির সমতুল্য’। এটি সাধারণ কিছু লোকের মুখে প্রচলিত যার কোন ভিত্তি নেই।

৬- ‘নূহের কিসতি বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করে দু’রাকাত‘আত সালাত আদায় করেছিল’। [ইবনেুল জাওযী ‘আল-মাওদু‘আত’ গ্রন্থে এটি উল্লেখ করেছেন ১/১০০।]

৭- ‘যে ব্যক্তি বায়তুল্লায় প্রবেশ করল, সে একটি নেকির কাজে প্রবেশ করল এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে একটি পাপ থেকে নিষ্কৃতি পেল’। [এটি বায়হাকী সুনান গ্রন্থে (৫/১৮৫) বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, আবদুল্লাহ ইবনেুল যোআম্মিল এটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন এবং তিনি শক্তিশালী নন। ইমাম নাবাবী বলেন, তিনি দুর্বল। আল-মাজমু ৮/২০৮।]

ভিত্তিহীন এসব অশুদ্ধ হাদিসের মধ্যে একটি হল, ‘সপ্তাহান্তে সাত চক্কর তাওয়াফ করলে গুনাহ-খাতা মাফ হয়। সাত চক্কর সাতটি গুনাহ মাফ করে’। আরেকটি হল, ‘বৎসরান্তে ‘ওমরাহ পালন বৎসরের সকল পাপ মোচন করে’। আরেকটি হল, ‘যমযমের পানি বিধৌত কাফন, উক্ত কাফন পরিহিত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত কামনা করে’।

নবী (ﷺ)-এর উপর মিথ্যাচারের ভয়াবহতা এবং তা প্রসারের বিপদ ছাড়াও বেদআত ও বিভ্রান্তি প্রচলনে, শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত প্রকৃত তা’যীম ও সম্মান প্রদর্শনের অনুপস্থিতিতে ও পরিবর্তে ফাসেদ আক্বীদা এবং অর্থহীন প্রাণশূন্য প্রতীকী কিছু কাজ প্রচলনের পেছনে এ সকল হাদিস প্রচারিত হওয়ার বিরাট প্রভাব রয়েছে।

অতএব মুসলিমদের উচিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) যাকে সম্মানিত করেছেন তার প্রতি শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত বিশুদ্ধ পন্থায় সম্মান প্রদর্শন করা এবং আল্লাহ যাকে সম্মান দেয়ার নির্দেশ দেননি তাকে সম্মানিত করার মাধ্যমে কিংবা আল্লাহ কর্তৃক অবতারিত কোন প্রমাণ ছাড়াই সম্মান প্রদর্শনের বিভিন্ন পন্থা উদ্ভাবনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা থেকে সতর্ক থাকা।

কেননা রাসূল (ﷺ)-এর আদর্শ ও সুন্নাতের সুন্দর ও সঠিক অনুকরণ ছাড়া শুধুমাত্র ইখলাস ও নিয়তের সততার দাবি যথেষ্ট নয়।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন