hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

সাহিত্যিক মাওলানা আহমাদ আলী

লেখকঃ হাদীছ ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ

২৯
চরিত্র :
মাওলানা আহমাদ আলীর চরিত্রে একই সঙ্গে সমাবেশ ঘটেছিল লেখনী, বাগ্মিতা, নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক প্রতিভার দুর্লভ গুণসমূহ। সেই সঙ্গে তাঁর কতগুলি মানবিক গুণ ছিল অতীব মূল্যবান- যা সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করতো। তিনি ছিলেন মৃদু ও মিষ্টভাষী, সদালাপী ও অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। ভিতরে-বাহিরে সহজ-সরল ও নির্ভেজাল সৎ। তিনি ছিলেন গভীর ধৈর্যশীল ও কঠিন নিয়মানুবর্তী। হালাল রোযগারের প্রতি ছিল তাঁর কঠোর ও সুক্ষ্ম দৃষ্টি। নিজের আক্বীদা ও আমলে অবিচল থেকে প্রতিকূল পরিবেশে সবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার এক অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তাঁর। কারু অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ছিল তাঁর চিরকালের স্বভাব বিরুদ্ধ।

তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জনাব আব্দুল্লাহ আল-বাকী (৮৮) বলেন, আববা কখনো কারু মুখাপেক্ষী হতেন না। তাঁর জীবনটাই ছিল সংগ্রাম মুখর। কিন্তু তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি সর্বদা নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতেন। তাঁকে কেউ দমাতে পারেনি’।[6]

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট মনোনীত সাতক্ষীরা-কলারোয়ার নির্বাচিত এম. এল. এ. জনাব মোমতায আহমাদ (৯২) বলেন, মাওলানা আহমাদ আলী ছিলেন বৈষয়িক, সরল, মিষ্টভাষী, নরম মেযাজের ও সকলের হৃদয়ের মানুষ। রাস্তা দিয়ে যখন সাইকেলে যেতেন, তখন সকলে সমস্বরে বলত, ঐ যে উস্তাদজী যাচ্ছেন। তিনি ছিলেন আমাদের মাথার মুকুট। তিনি ছিলেন একটি মাইলফলক, একটি ইতিহাস’।

কাকডাঙ্গা মাদরাসার প্রতিষ্ঠাকালীন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, মাওলানা আহমাদ আলী মাদরাসা করবেন। কিন্তু ঝাউডাঙ্গায় করবেন, না কাকডাঙ্গায় করবেন, এ নিয়ে কাকডাঙ্গায় মুন্সী যয়েনুদ্দীন স্কুল প্রাঙ্গণে মাওলানা আহমাদ আলীর সভাপতিত্বে বড় একটা সভা ডাকা হয়। সেখানে আমার দীর্ঘ বক্তৃতার পর চারদিক থেকে ধ্বনি ওঠে, ‘কাকডাঙ্গা মাদরাসা যিন্দাবাদ’। পরের দিন কাকডাঙ্গা মসজিদে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হ’ল যে, মাদরাসার নাম হবে ‘কাকডাঙ্গা আহমাদিয়া মাদরাসা’। এটাই হ’ল কাকডাঙ্গা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার গোড়ার ইতিহাস। এর মূলে দু’টি কারণ ছিল : (১) ঝাউডাঙ্গায় হানাফী সংখ্যা বেশী। আহলেহাদীছ ছেলেরা লজিং পেতনা (২) জমঈয়ত থেকে পৃথক বুঝানো’। কে পরে এই নাম পাল্টালো, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ইঙ্গিতে বলেন, কিছু শয়তান’।[7] এজন্যেই কথায় বলে, ‘পকেটের চাকুতে পেট কাটে’।

কনিষ্ঠ পুত্র ডঃ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বলেন, সবাই ‘ফকীরী বিদ্যা’ বলত বলে আমি মাদরাসায় পড়তে চেতাম না। কিন্তু আববার ভয়ে কিছু বলতাম না। একদিন বাড়ীতে বারান্দায় বসে ভাত খাওয়ার সময় সাহস করে ভাই আববাকে বললেন, আববা! আমাদের বংশে কোন ‘ডাক্তার’ নেই। খোকার মাথা ভাল। ওকে মাদরাসায় না পড়িয়ে ডাক্তারী পড়ালে কেমন হয়? কিছুক্ষণ চুপ থেকে আববা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আব্দুল্লাহ! তোমার ছেলেকে তুমি ডাক্তার বানাও, আমার ছেলেকে আমি ফকীর বানাবো’। এর মধ্যে দ্বীনী শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃঢ়চিত্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।

আরেকদিনের ঘটনা। তখন সবেমাত্র ‘কেরোলিন’ কাপড় বেরিয়েছে। সেŠখিন কাপড় হিসাবে তখন বাজারে খুব কদর। মা ও বোন জামীলা মিলে আমাকে একটা কেরোলিনের পাঞ্জাবী বানিয়ে দিয়েছেন। আববাকে লুকিয়ে গায়ে দেই। কিন্তু একদিন আববার নযরে পড়ে যাই। আববা আমাকে কিছু না বলে মাকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ছেলেকে কেরোলিনের জামা আমি কিনে দিতে পারতাম না? এখুনি দামী জামা গায়ে দিলে পরে কি আর কম দামী জামা গায়ে দিতে পারবে? একথার মধ্যে সন্তান গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর গভীর দূরদৃষ্টি ফুটে ওঠে। তখন আমি আলীপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস থ্রি-র ছাত্র। এরপর থেকে আমি আর কোনদিন সূতী জামা ব্যতীত কেরোলিন জামা গায়ে দেয়নি। বলা বাহুল্য, আমার স্কুল জীবনের লেখাপড়া ঐ থ্রি পর্যন্তই। এরপর থেকে মাদরাসা।

মাওলানা আহমাদ আলী কেমন শিক্ষক ও সময়ানুবর্তী ছিলেন নিম্নের ঘটনাতে সেটা বুঝা যায়। শনিবার ভোরে তিনি বের হবেন বুলারাটি থেকে কাকডাঙ্গা মাদরাসা অভিমুখে। কাঁচা ও ভগ্ন রাস্তা সাতক্ষীরা-মাধবকাটি হয়ে কাকডাঙ্গা প্রায় ১৭ মাইল। সাইকেলের পিছনে ও সামনে কনিষ্ঠ পুত্র ও নাতি ছদরুল আনাম। কনিষ্ঠ পুত্র ক্ষীর ও রসের পিঠার ভক্ত। মা ও বোন জামীলা দু’জন দু’টি থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাচ্চাদের খাওয়াবেন। কিন্তু না। সময়মত ১ম পিরিয়ড ধরতে পারবেন না বিধায় চলে গেলেন। দুই মা ও দুই সন্তান অপলক নেত্রে এই করুণ দৃশ্য দেখল’।

বুলারাটি থেকে কাকডাঙ্গা পর্যন্ত রাস্তায় যতটি গ্রাম, শহর ও বাজার পড়তো, সবগুলির হিসাব নিতেন ক্ষুদে প্যাসেঞ্জারদ্বয়ের কাছ থেকে। মাঝে-মধ্যে এগুলি বাক্যাকারে শুদ্ধ বাংলায় ও আরবীতে জিজ্ঞেস করতেন। না পারলে বলে দিতেন। বাজারে গেলে ছাত্রদের খোসাওয়ালা খাদ্য যেমন পাকা কলা, বাদাম ইত্যাদি খেতে বলতেন। কিন্তু সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি আলগা খাবারে নিষেধ করতেন। কোন ছাত্রকে বাজারে টুপীবিহীন দেখলে পরদিন ক্লাসে সাবধান করতেন। তিনি ছাত্রদের কাগজ মাড়াতে নিষেধ করতেন ও বলতেন, দেখ! কাগজেই তোমার বিদ্যা। ওটা পায়ে দাবাতে নেই। বাজারের ঠোঙা বা লেখা কোন কাগজ পড়ে থাকলে তা কুড়িয়ে তিনি পড়তে বলতেন। কেননা সেখানেও কোন জ্ঞানের কথা লেখা থাকতে পারে। তিনি অপচয়ের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ওযূর পানিতে বা অন্য কিছুতে কোনরূপ অপচয় তিনি বরদাশত করতেন না। কোন বস্ত্ত তিনি ফেলে দিতে চাইতেন না। ছাত্রদের তিনি শিখাতেন, ‘জিনিষ আমারে চিনিস।’ তিনি ছাত্রদের কাছে কেমন প্রিয় ছিলেন যে, যখনই কোথাও থেকে সাইকেলে এসে মাদরাসার সামনে নামতেন, অমনি সব ক্লাস থেকে ছাত্ররা দৌড়ে চলে আসত সাইকেলটা কে আগে ধরবে ও যথাস্থানে রাখবে, সেজন্য। কেউ সাইকেল মোছার কাজে, কেউ তাঁকে পানির বদনা এনে দেবার কাজে, কেউবা পায়ের কাদা ধোয়া ও জুতা ছাফ করার কাজে লেগে যেত। এজন্য কাউকে ডাকার প্রয়োজন হ’ত না।

কনিষ্ঠ পুত্র বলেন, আববাকে কখনো ক্লাসে কোন ছাত্রকে মারতে দেখিনি। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বকে ছাত্ররা সর্বদা সমীহ করত। তিনি চেয়ারে কম বসতেন। প্রায়ই ক্লাসে হেঁটে হেঁটে পড়া ধরতেন ও মুখস্ত করাতেন। তিনি সর্বদা নিত্য ব্যবহার্য কথাগুলির আরবী বলে দিতেন ও তা মুখস্ত শুনতেন। আরবী ব্যাকরণ এমনভাবে পড়াতেন যে, তা খুবই সহজ মনে হ’ত। একবার তিনি যশোরে যাবেন শুনে আমার জন্য একটা দু’ব্যাটারী লাইট আনতে বললাম। জবাবে আববা বললেন, ঐ কথাটি আরবীতে বাক্যাকারে লিখে দাও। কিন্তু টর্চ লাইটের আরবী আমি জানিনা। কিন্তু লিখতে না পারলে লাইট পাবো না। আবার কাউকে জিজ্ঞেস করাও নিষেধ। ফলে দিন-রাত খেটে কোন রকমে আরবীতে বাক্য বানিয়ে পরদিন সকালে আববাকে দিলাম। আববা খুশী হয়ে আমাকে ‘এভারেডী’ (EVERADY) লাইট কিনে এনে দিলেন। তখনকার সময় ওটা ছিল খুবই আকর্ষণীয় পুরস্কার। ‘আলেম’ পরীক্ষার আগে আববা আমাকে বললেন, ‘খোকা! মাত্র ৩ নম্বরের জন্য আমি আলেমে স্কলারশিপ পাইনি। তুমি যদি সেটা পাও, তাহ’লে আমি সবচেয়ে খুশী হব’। আল্লাহর রহমতে তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল। হাঁ, এবারে আববা কিনে দিলেন ‘কেমি’ (CAMY) ঘড়ি। তখন (CAMY) ও (CAVALRY) ছিল বাজারের সেরা ঘড়ি।

তিনি বলেন, আববার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী। যখন শিক্ষকরা উর্দূ ‘মীযান’ ও ফার্সী ‘নাহুমীর’ পড়াতে অভ্যস্ত, তখন তিনি শিক্ষকদের ওগুলি বাংলায় অনুবাদ করে বুঝিয়ে পড়াতে বলতেন এবং পরীক্ষার খাতায় উর্দূ অথবা বাংলায় উত্তর লেখার নির্দেশ দিতেন। তিনি সবাইকে বলতেন, আমার ছেলে যখন মাতৃভাষা বাংলাই ভাল করে শিখেনি, তখন সে কিভাবে একটি বিদেশী ভাষা আরবী অন্য একটি বিদেশী ভাষা উর্দূ বা ফার্সীর মাধ্যমে শিখবে?

কৈশোরে ও যৌবনে তিনি যেমন ছিলেন খেলায় ও মাছ ধরায় পটু, তেমনি ছিলেন পাখি শিকারে উস্তাদ। বাড়ীতে ছিল পাঁচটি বন্দুক। নিজ হাতে বন্দুক ও গুলি তৈরী করতেন তিনি। পাখি শিকারে তাঁর লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। মাছ শিকারে ছিল দারুণ ঝোঁক। কয়েক রকমের জালই ছিল তার নিজ হাতের তৈরী। জাল বোনা, মাদুর বোনা ছাড়াও চাষাবাদের সবরকম কাজে তাঁর হাত ছিল পাকা। উচ্চলম্ফ, দীর্ঘ লম্ফ, বংশ লম্ফ ও লম্বা দৌড়ে কেউ তাঁর সাথে এঁটে উঠতে পারতো না। তিনি স্বীয় নাক বরাবর ঊর্ধলম্ফ এবং ১৮ হাত দীর্ঘ লম্ফে অভ্যস্ত ছিলেন।

তাঁর কতগুলি অভ্যাস ছিল সারা জীবনের। যেমন- ভোরে উঠে খালিপেটে বাসি চাউল-পানি। ফজরের ছালাতের পর খালি পায়ে অথবা জুতা পায়ে দৌড়ানো। লাবসায় থাকাকালে ফজর পর লাবসা হ’তে মাধবকাটি পর্যন্ত তিন তিন ছয় মাইল রাস্তা দৌড়াতেন। বৃদ্ধ বয়সে মসজিদের বারান্দায় হ’লেও দৌড়ানোর অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন। তিনি বাসি পানি ব্যতীত টাটকা টিউবওয়েলের পানি কখনো পান করতেন না। দুধ তাঁর অত্যন্ত প্রিয় হ’লেও গোশতের পরে কখনোই দুধ খেতেন না। পায়খানার পরে খাওয়া এবং খাওয়ার পরে পেশাব করা ছিল তাঁর অন্যতম অভ্যাস। দুপুরে খাওয়ার পরে সামান্য গড়াগড়ি ও রাতে খাওয়ার পরে দীর্ঘক্ষণ হাঁটা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল। খাওয়ার মধ্যে পানি পান করতেন না। সকালে-বিকালে হাল্কা নাশতা করতেন। সর্বদা অল্প কিন্তু উত্তম খাবার খেতেন। তিনি বলতেন, ‘মানুষ খেয়ে মরে, না খেয়ে মরে না’।

যত রাতেই তিনি শোন না কেন, তাহাজ্জুদের ছালাত ক্বাযা হ’ত না। যখন জিন-ভূতের ভয়ে কেউ ফজরের জামা‘আতে মসজিদে আসত না, তখন তিনি কাকডাঙ্গা মসজিদে দীর্ঘ ক্বিরাআতে ফজর পড়তেন। মাঝে-মধ্যে কান্নায় ক্বিরাআত বন্ধ হয়ে যেত। একবার বুলারাটি মসজিদের ঘড়ি চুরি হয়ে গেলে জুম‘আর খুৎবায় তিনি এক সপ্তাহ সময় দিলেন। তাঁর বদ দো‘আর ভয়ে চোর দু’দিনের মধ্যেই ঘড়ি যথাস্থানে রেখে গেল। তিনি ছিলেন অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী। লম্বায় চওড়ায় মধ্যম গড়ন, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এই মানুষটির চরম বার্ধক্যেও গাত্রচর্ম ঢিলা হয়নি। মাত্র ৫২ বৎসর বয়সে সকল দাঁত হারালেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর মাথার বাবরী চুলগুলো ছিল কালো কুচকুচে। লম্বা সিঁথির মাঝ বরাবর অল্প কিছু চুলে পাক ধরেছিল। দাড়ি ছিল কাঁচা-পাকা। মাথার তালুতে সামান্য নারিকেলের তৈল অথবা লক্ষ্মীবিলাস তৈল ব্যতীত সমস্ত চুলে কখনোই তৈল মাখতেন না। গায়ে সাবান দিতেন না। অথচ কখনোই গা গন্ধ হ’ত না। বরং গেঞ্জি সুঘ্রাণ লাগতো। শীতকালে কাঁচা রোদে বসে দেহে খাঁটি সরিষার তৈল মর্দন পসন্দ করতেন। কখনো খালি গায়ে চলতেন না। ভাল গামছা ও গেঞ্জি পরতেন। সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকতেন। কিন্তু কোনরূপ পোষাকী বিলাসিতা তাঁর ছিল না। মেটো রংয়ের মোটা সূতী কাপড়ের মধ্যম ঝুলের পাঞ্জাবী পরতেন। যৌবনে ‘ছাদরিয়া’ ও পীত বর্ণের পাগড়ীতে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে বৃদ্ধ বয়সে কেবল টুপী পরতেন। বড় তালি দেওয়া জামা পরেও যেকোন মজলিসে স্বাচ্ছন্দ্যে যোগদান করতেন। একবার গরালী সফরে গিয়ে নদীতে ভাটা থাকায় ছাত্র আব্দুছ ছামাদ তাঁকে আড়কোলা করে নৌকায় তোলে। ওপারে গিয়ে লোকেরা পোষাকের বাহার দেখে ছাত্রকেই প্রধান অতিথি ভেবে সম্মান দেখাতে থাকে। তিনি বলতেন, আমার এলাকায় আমিই প্রথম সাইকেল কিনি। যেদিন আমি কলিকাতা থেকে ‘হাম্বার’ (HUMBER) সাইকেল ও ‘ওমেগা’ (OMEGA) পকেট ঘড়ি নিয়ে বাড়ী আসি, সেদিন তা দেখার জন্য মাহমূদপুর হাটখোলায় মানুষের ঢল নামে। কিভাবে দু’চাকার সাইকেলে মানুষ বসে থাকতে পারে, অথচ হেলে পড়ে যায় না, এটাই ছিল সকলের প্রশ্ন। পকেটের ঘড়িতে কিভাবে সূর্য্যের টাইম জানা যায়, এগুলো বুঝাতেই আমি গলদঘর্ম হয়ে যেতাম।

মৃত্যুর এক বৎসর পূর্বে (১৯৭৫ খৃঃ) সাতক্ষীরায় ইসলামী সেমিনার উপলক্ষে আগত দেশের সেরা ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে সাতক্ষীরা সরকারী আই.বি. রেষ্ট হাউসে গামছায় বাঁধা কাপড়ের পোটলা বগলদাবা করে পিঠের দিকে প্রায় পৌনে একহাত লম্বা তালি দেওয়া জামা গায়ে উপস্থিত হলে কনিষ্ঠ পুত্রের প্রশ্নের জওয়াবে হাসিমুখে বলেছিলেন- ‘বাবা! চেনা বামনের পৈতা লাগে না’। এক বৎসর পরে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক আ.ন.ম. আব্দুল মান্নান খান কেঁদে ফেলেছিলেন এবং ঐদিনের উক্ত ঘটনা উল্লেখ করে ক্লাস বন্ধ করে তাঁর স্মৃতিতে বক্তৃতার এক স্থানে ছাত্রদের সামনে বলেছিলেন, ‘এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেম কখনো দেখিনি। সাতক্ষীরায় না গেলে এমন মানুষটি সম্পর্কে আমি কখনোই জানতে পারতাম না’।

মৃত্যুর এক বছর আগে রামাযান মাসে বুলারাটি থেকে প্রায় ১৯ মাইল সাইকেল চালিয়ে ব্রজবাকসায় পৌঁছেন ইফতারের সামান্য পূর্বে। গরমের দিন। ঐ সময় আগে থেকে সেখানে উপস্থিত কনিষ্ঠ পুত্র দৌড়ে হাতপাখা এনে বাতাস করতে থাকলে তিনি হাসতে হাসতে মানা করে বলেন, এতটুকুর জন্য বাতাস খেতে হবে?’ তিনি যে কেমন কষ্টসহিঞ্চু ছিলেন, তা এতে বুঝা যায়।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। মেহমান ছাড়া খেতে তিনি অস্বস্তিবোধ করতেন। ছাত্রদেরকে তিনি সন্তানবৎ স্নেহ করতেন। নিজে বক্তৃতা লিখে মুখস্থ করিয়ে মসজিদে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের বক্তৃতা শুনতেন। তারপর বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সঙ্গে নিয়ে তিনি তাদের বক্তৃতা করাতেন। বক্তৃতা ভাল হৌক বা না হৌক সর্বদা পিঠ থাবড়ে ‘মারহাবা’ বলে উৎসাহ দিতেন। তাদেরকে সর্বদা প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প ও অভিনন্দনপত্র লেখায় উদ্বুদ্ধ করতেন। এভাবে সমাজের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির ব্যাপারে তাঁর চিন্তাধারা ছিল অত্যন্ত গঠনমূলক ও সুদূরপ্রসারী। তিনি নিজে বাংলায় ও উর্দূতে কবিতা লিখতে পারতেন। বাংলা পদ্য ছন্দে তাঁর দু’টি পুস্তিকাও রয়েছে। উর্দূ কবিতায় অভিনন্দনপত্র রচনা করে তিনি ছাত্রদের দিয়ে কখনো কখনো সম্মানিত মেহমানদের শুনাতেন। যেমন ঝাউডাঙ্গার এক ইসলামী জালসায় জনৈক আহলেহাদীছ নেতার আগমনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর লেখা উর্দূ অভিনন্দন মূলক কবিতা তাঁর প্রিয় ছাত্র আব্দুর রহমান (কাকডাঙ্গা) শুনিয়েছিল। যার প্রথম লাইন ছিল ‘আফযালুল ফুযালা তুঈ হ্যায় নায়েবে খায়রিল ওয়ারা...’। তিনি সর্বদা ছাত্র পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে ভালবাসতেন। তিনি বলতেন, ‘যেখানে আমার ছাত্র নেই, সেখানে যেন আল্লাহ আমাকে না নিয়ে যান’।

ছাত্রাবস্থায় ছেলেদের বিয়ে দেবার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। সে যুগে বাল্য বিবাহ রীতি সিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ভালো ছেলেদের ছাত্রজীবন থেকেই মেয়ের বাবারা পিছু নিতেন। মাওলানার কনিষ্ঠ পুত্র ‘আলেম’ বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষায় সারা দেশে ১৬ তম স্থান অধিকার করলে চারদিক থেকে বিয়ের পয়গাম আসতে থাকে। মাওলানা সে সময় শুভাকাংখীদের বলতেন, ‘ও আমার রেসের ঘোড়া! ওর পায়ে দড়ি বেঁধনা’। কনিষ্ঠ পুত্রকে তিনি সর্বদা নিজের কাছেই মসজিদে রাখতেন। ছোট থেকে তাকে বাংলা মাসিক ‘মোহাম্মাদী’র গ্রাহক করে দেন। পরবর্তীতে লাহোরের সাপ্তাহিক ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকার গ্রাহক করে দেন উর্দূ ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য। এই সময় বাংলা ‘মার্কিন বার্তা’ ফ্রি আসত। সেটাও নিয়মিত ছেলেকে পড়তে দিতেন। তাকে লেখার জন্য সর্বদা উৎসাহ দিতেন। মাদরাসায় আসা মেহমানদের উদ্দেশ্যে অভিনন্দন পত্র ও বিদায়ী ছাত্রদের পক্ষে ‘বিদায় বাণী’ লেখার দায়িত্ব প্রায়ই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের উপরেই পড়ত। তিনি সেই লেখা নিয়ে সবাইকে পড়াতেন ও ছেলেকে উৎসাহ দিতেন। ‘বিদ্যা অমূল্য ধন’ শিরোনামে এক পৃষ্ঠার একটি বক্তৃতা লিখে দিয়ে তিনি ছেলেকে তা মুখস্ত করতে বলেন। পরে ইটেগাছার জালসায় সভাপতি হিসাবে তাঁর নির্দেশে ভয়ে ভয়ে সেটা পাঠ করে মঞ্চ থেকে পালিয়ে যান। বলা বাহুল্য, এটাই ছিল তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের সর্বপ্রথম জনসভায় বক্তৃতার সূচনা। ভাষা শেখার জন্য কনিষ্ঠ পুত্রকে সর্বদা গ্রামার ও ডিকশনারি চর্চা করতে বলতেন। সেভাবে ইংরেজী, বাংলা ও আরবী ভাষায় তিনি ছোটবেলাতেই ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিন ভাষায় তিন বন্ধুর কাছে তিনি নিয়মিত পত্র লিখতেন। বাংলায় যশোরের এ. এইচ. এম. শামসুর রহমান (অধ্যাপক, দৌলতপুর বি এল কলেজ), ইংরেজীতে যশোরের বদরুদ্দোজা (অধ্যাপক, কেশবপুর ডিগ্রী কলেজ) ও আরবীতে আগরদাঁড়ীর আব্দুল খালেক মন্ডল (অধ্যক্ষ, আগরদাঁড়ী কামেল মাদরাসা)। এর মাধ্যমে রীতিমত ভাষার প্রতিযোগিতা হ’ত। ছেলে আরবী কবিতায় পত্র লিখতেন। আব্দুল খালেক মন্ডল গদ্যে জবাব দিতেন। কবিতায় জবাব দিতে পারতেন না। মাওলানা সব পত্র পড়তেন ও ছেলেকে উৎসাহ দিতেন। কাকডাঙ্গা মাদরাসা থেকে বিদায়ের সময় ছেলে আরবী কবিতায় দীর্ঘ ‘বিদায় বাণী’ লিখে ও পাঠ করে শুনালে ছাত্র ও শিক্ষকগণ খুশীতে প্রাণভরে দো‘আ করেন। এভাবে তিনি পাথরঘাটা মসজিদে প্রায় এক বছর ও কাকডাঙ্গা মসজিদে দশ বছর কাছে রেখে ছেলেকে ছোট থেকে গড়ে তোলেন।

বাচ্চাদের প্রতি তাঁর স্নেহদৃষ্টি ছিল অপরিমেয়। যখনি বাড়ী ফিরতেন পাড়ার ছেলেমেয়েরা ছুটে এসে ভিড় জমাতো বিস্কুট বা লজেন্স খাওয়ার জন্য। লজেন্স বলতে তখন ‘গুলি মেঠাই’ বুঝাতো। গর্ভবতী মায়েদের প্রতি ছিল তাঁর অত্যন্ত সংবেদনশীল অনুভূতি। নিকটাত্মীয়াদের মধ্যে কেউ অন্তঃসত্ত্বা জানতে পারলে নিজে গিয়ে তাকে ঝাড়-ফুঁক করে সন্দেশ বা রসগোল্লা খাইয়ে আসা তাঁর একটি নিয়মিত অভ্যাস ছিল। কোন ভিক্ষুক বা সায়েলকে তিনি কখনোই খালি হাতে ফিরাতেন না। বাড়ীতে ভিক্ষুক এলে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘তোমরা জানের ছাদাক্বা দাও’।

অর্থ সঞ্চয় করা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুল ছিল তাঁর চরিত্রের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ পাক তাঁকে কখনো অভাব-অনটনে কষ্ট দেননি। তবে ’৭১-য়ে রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতনজনিত কারণে তাঁকে কয়েকমাস কষ্টে কাটাতে হয়েছিল, যা তিনি গভীর ধৈর্যের সঙ্গে মুকাবিলা করেছিলেন। জীবনে কোন সঞ্চয় তাঁর ছিল না। এমনকি মৃত্যুর পরে তাঁর কাফনের কাপড় কিনতে হয় কনিষ্ঠ পুত্রের স্কলারশিপের টাকা দিয়ে।

তিনি যেন ছিলেন অজাতশত্রু। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁকে দেখলে সম্মানে নুইয়ে পড়তো। তাঁর ঝাড়-ফুঁকে আল্লাহ পাক বরকত দান করেছিলেন, যাতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই উপকৃত হ’ত। একদা তিনি বোয়ালিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে সাইকেল চড়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় দেখলেন যে, আগুনের লেলিহান শিখা একটি পাড়াকে গ্রাস করে ফেলেছে। লোকেরা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ওঝার আশ্রয় নিয়েছে। কালবিলম্ব না করে তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে শিরকী কালামে অভ্যস্ত ওঝাগুলোকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন। অতঃপর কালামে পাক থেকে কিছু আয়াত পড়ে ফুঁক দিয়ে এক কলসী পানি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে একটি ঘরের উপরে ছিটিয়ে দিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় সমস্ত আগুন একই সঙ্গে নিভে গেল। এ ধরনের অনেক ঘটনা অনেকের মুখে প্রায়ই শুনা যায়।

তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্দুল্লাহ আল-বাকী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে বাড়ীতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। শরীরে স্যালাইন টানা বন্ধ হয়ে গেছে। ডাক্তার নিরাশ হয়ে গেছেন। আসন্ন মৃত্যুর আশংকায় কান্নাকাটি পড়ে গেছে। এমন সময় পিতা মাওলানা আহমাদ আলীকে ১৭ মাইল দূরের কর্মস্থল কাকডাঙ্গা থেকে ছাত্র আব্দুর রহমান তাঁকে সাইকেলের পিছনে করে নিয়ে এল। তিনি এসে পুত্রের মুখ দর্শন না করে সোজা মসজিদে গিয়ে সিজদায় পড়ে গেলেন। আল্লাহর কি অপার অনুগ্রহ! কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু পথযাত্রী পুত্রের অসাড় দেহে যেন নব জীবনের সঞ্চার হ’ল। মসজিদে সংবাদ গেল। তিনি উঠে পুনরায় দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেরিয়ে এসে পুত্রের উজ্জ্বল মুখ দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললেন।

পীরপূজার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী মাওলানা আহমাদ আলী নিজের অজান্তেই মানুষের হৃদয়ের গভীরে আসন করে নিয়েছিলেন। পূর্বপাক জমঈয়তে আহলেহাদীছের প্রেসিডেন্ট মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী (১৯০০-১৯৬০ খৃঃ) তাঁকে লেখা চিঠিতে ‘হযরত শাহ ছূফী মাওলানা আহমাদ আলী শ্রদ্ধাষ্পদেষু’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি যেখানেই বসতেন পানি পড়া ও মাথায় ফুঁক দেওয়ার হিড়িক পড়ে যেত। তাঁর নববিবাহিতা দ্বিতীয়া স্ত্রী ঘরে এলে কোন এক ভক্ত স্বপ্নে দেখেন যে, হুযুরের স্ত্রীর পানি পড়া খেলে তার রোগ সেরে যাবে। অনভ্যস্ত স্ত্রী বাধ্য হয়ে তাকে পানি পড়ে দেন। তাতে লোকটি কঠিন অসুখ থেকে মুক্তি পায়। অতঃপর লোকটি গরুর গাড়ী ভরে জমির ফসল ও অন্যান্য উপঢৌকনাদি নিয়ে চলে আসে। এভাবে শুরু হ’ল চারদিক থেকে হাদিয়া-তোহফা আসার প্রতিযোগিতা। বারবার নিষেধ করেও কাজ হয় না। অবশেষে মাওলানা সবাইকে জানিয়ে দিলেন, যদি এগুলি বন্ধ না করা হয়, তাহ’লে তিনি বা তাঁর স্ত্রী আর কাউকে পানি পড়া বা ফুঁক দেবেন না। ফলে এই সিলসিলা বন্ধ হয়। আলহামদুলিল্লাহ উভয়ে আমৃত্যু এভাবে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করে গেছেন এবং মানুষকে আল্লাহর উপরে দৃঢ়ভাবে ভরসা করার উপদেশ দিয়েছেন। মাওলানার মৃত্যুর পর অনেক হানাফী ভক্ত-অনুরাগী আলেম দাবী করেছিলেন যে, মাওলানাকে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ মহাসড়কের পার্শ্বে তাঁর নিজস্ব জমিতে সমাহিত করা হউক। যাতে লোকদের যেয়ারত করা সহজ হয়। কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্র ছাফ জওয়াব দিয়েছিলেন যে, এর ফলে ঐ কবর একদিন পূজার স্থানে পরিণত হবে। যার বিরুদ্ধে আববা সারা জীবন লড়াই করেছেন। ফলে অনেকে রাযী হলেও অবশেষে তা আর সম্ভব হয়নি।

মৃত্যুর ১৮ দিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি সাতক্ষীরায় ছোট মেয়ে হালীমার বাসায় ছিলেন সেবা ও চিকিৎসা সুবিধার জন্য। সেখানে তাঁকে দেখার জন্য দৈনিক বহু লোক আসতো দূর-দূরান্ত হ’তে। একদিন সাতক্ষীরার তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট সিরাজুল হক তাবলীগ জামা‘আতে আগত জনৈক সঊদী মেহমানকে নিয়ে তাঁর নিকটে আনেন। তিন পাশে বালিশে ঠেস দিয়ে মাওলানাকে বসিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি স্বচ্ছন্দে আরবীতে আলাপ শুরু করলে উক্ত সঊদী মেহমান বিস্মিত হয়ে যা মন্তব্য করেছিলেন তার অর্থ দাঁড়ায় ‘এই বৃদ্ধ বয়সে কঠিন রোগশয্যায় এমন একজন গভীর পান্ডিত্যসম্পন্ন আলেমের সাক্ষাৎ ও দো‘আ লাভ করে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি’।

মৃত্যুর ৩৫ দিন পূর্বে সাতক্ষীরায় ইসলামী সেমিনারে আগত সম্মানিত অতিথি অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল বারী (রা:বি:), অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মাদ মুস্তাফীযুর রহমান (ঢা:বি:), বিচারপতি এ,কে,এম, বাকের (ঢাকা), মাওলানা এ,কে,এম, ইউসুফ (খুলনা) সকলে একত্রে একদিন সকালে মাওলানাকে দেখতে এলেন। নীচু কুঁড়েঘরে গোলপাতার চালের নীচে বারান্দায় শয্যাশায়ী মাওলানাকে হঠাৎ এভাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বরেণ্য মনীষীবৃন্দ দেখতে আসবেন, কেউ কল্পনাও করেনি। অতিথিবৃন্দের সঙ্গে স্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষের সমাগমে ক্ষুদ্র আঙিনা মুখর হয়ে ওঠে। মেহমানগণ মাওলানাকে ঘিরে বসে তাঁর নিকট দো‘আ চাইলেন। মাওলানা সবার জন্য দো‘আ করলেন। তার আগে অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মাদ মুস্তাফীযুর রহমান ও অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল বারী নিজ নিজ হাতে তরমুজ উঠিয়ে মাওলানাকে খাওয়ান। বিদায়ের সময় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জাস্টিস বাকের মন্তব্য করলেন, ‘কুঁড়েঘরের নীচে এমন রত্ন লুকিয়ে আছে আগে তো জানতাম না!’

যেকোন বিপদকে হাসিমুখে মুকাবিলা করার অন্যতম দুর্লভ গুণ ছিল তাঁর চরিত্রে। জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁর নিকট হ’তে এর যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে। মৃত্যুর প্রায় দু’মাস পূর্বেও এর নমুনা পাওয়া যায়। একদিন সকালে ছেলেমেয়েদের কাছে ডেকে বললেন, ‘আমার মন যেন বলছে আমি এ যাত্রায় বাঁচব না। আমি মরে গেলে তোমাদের হয়ত দুঃখ থাকবে যে, আববাকে এলোপ্যাথি চিকিৎসা করালে বোধ হয় বাঁচানো যেত। তোমরা এক্ষণে আমাকে এলোপ্যাথি করাতে পারো। তবে দেখ, জাতবৈদ্য এনো কিন্তু। বলা বাহুল্য, সাতক্ষীরার সেরা এলোপ্যাথদের দিয়ে চিকিৎসা করিয়েও কোন ফলোদয় হয়নি। অবশেষে আবার তাঁকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাতে হয় সাতক্ষীরার ‘খোকা’ ডাক্তারের কাছে।

মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজ হাতে বিনা চশমায় রোগ বিবরণী লিখে ডাক্তারের নিকট পাঠিয়েছেন। তিনি এত ছোট লিখতেন যে, একটি পোষ্টকার্ডে ৬৫ লাইন লেখার রেকর্ড তাঁর আছে। তবে লেখা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, যা পড়তে কারু বেগ পেতে হ’ত না।

নিজ কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সদা সজাগ থাকতেন তিনি। এমনকি মৃত্যুকালেও তিনি এর স্পষ্ট নযীর রেখে গিয়েছেন। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মিনিট পূর্ব পর্যন্ত তিনি কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পর্কে স্বচ্ছন্দে আলাপ করেছেন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন