hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

নবী মুহাম্মদ সা. এর আগমনের প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য, দা‘ওয়াতের পদ্ধতি ও কৌশল

লেখকঃ ড. মো: আবদুল কাদের

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমন
ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত ধর্ম। প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের সমুদয় সময় ও ক্ষনকে এই দীনের প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে অতিবাহিত করেছেন। দীন প্রচারের সুমহান দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ

﴿ هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّ‍ۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ ﴾ [ الجمعة : ٢ ]

‘‘তিনি সেই সত্ত্বা যিনি নিরক্ষরদের মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াত সমূহ পড়ে শুনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন। অথচ ইতোপূর্বে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-জুম‘আ : ২।]

সুতরাং আয়াত সমুহের তেলাওয়াত, আত্মার পরিশুদ্ধি, কিতাবুল্লাহ তথা কুরআনের শিক্ষাদান বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা, উন্নত নৈতিকতা ও চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনের গুরুদায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। তাঁর আগমনের প্রাক্কালে আরবের লোকেরা ধ্বংসের দ্বার-প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে তাদেরকে ধ্বংস থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কেননা আল্লাহর রীতি হলো, কোন জালিম সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার পূর্বে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করা, যিনি তাদেরকে সত্য ও সঠিক পথের দিকে আহবান করবেন। এ মর্মে সূরা আল-কাসাসে এসেছেঃ

﴿وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهۡلِكَ ٱلۡقُرَىٰ حَتَّىٰ يَبۡعَثَ فِيٓ أُمِّهَا رَسُولٗا يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِنَاۚ وَمَا كُنَّا مُهۡلِكِي ٱلۡقُرَىٰٓ إِلَّا وَأَهۡلُهَا ظَٰلِمُونَ ٥٩ ﴾ [ القصص : ٥٩ ]

‘‘আপনার পালকর্তা জনপদ সমূহকে ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ না করেন। যিনি তাদের কাছে আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং আমি জনপদসমূহকে তখনই ধ্বংস করি যখন তার বাসিন্দারা জুলুম করে।’’ [আল-কুরআন, সুরা আল-কাসাস : ৫৯।]

অতএব, আল্লাহ প্রদত্ত ওহীর জ্ঞান মানুষের মাঝে প্রচার করার মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায়কে মুক্তির অমীয় সূধা পানের জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আভির্ভুত হয়েছিলেন।

তিনি (মুহাম্মদ সা.) মানবজাতিকে আল্লাহর ভীতিপ্রদর্শন ও জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন, যাতে মানুষেরা অকল্যাণকর ও যাবতীয় অবৈধ পন্থা অবলম্বন থেকে দূরে থাকে। [মহান আল্লাহ বলেন ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ شَٰهِدٗا وَمُبَشِّرٗا وَنَذِيرٗا ٤٥ وَدَاعِيًا إِلَى ٱللَّهِ بِإِذۡنِهِۦ وَسِرَاجٗا مُّنِيرٗا ٤٦ ﴾ [ الاحزاب : ٤٥، ٤٦ ] ‘‘হে নবী ! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে সুসংবাদতা ও ভীতিপ্রদর্শন রূপে এবং আল্লাহর নির্দেশ তার প্রতি আহবানকরী উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।’’ আল-কুরআন, সূরা আল-আহযাব : ৪৫-৪৬।] মূলতঃ এ সুসংবাদ ও ভীতিপ্রদর্শক রূপেই আল্লাহ ত’আলা যুগে যুগে নবী-রাসূলদের এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যেন মানব জাতি কিয়ামতের দিন এ আপত্তি করতে না পারে যে, হে আল্লাহ ! কিসে তোমার সন্তুষ্টি এবং কিসে অসন্তুষ্টি তা আমরা অবগত ছিলাম না। যদি আমরা জানতাম তা হলে সে অনুসারে জীবন পরিচালনা করতাম। এ ধরনের কোন দলীল বা প্রমাণ যেন মানুষ উপস্থাপন করতে না পারে সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই আল্লাহ নবী-রাসূলগণের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেনঃ

﴿ رُّسُلٗا مُّبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا ١٦٥ ﴾ [ النساء : ١٦٥ ]

‘‘আমি সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূল আগমনের পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’’ [আল-কুরআন, সূরা আন্ নিসা : ১৬৫।]

মু?হাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা বিশ্বের জন্য ভীতিপ্রদর্শনরূপে প্রেরিত হয়েছেন, যেন আহলে কিতাবরা (ইয়াহূদী ও খৃষ্টান) অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে যে, আমাদের কাছে কোন সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শক আসে নি। [আল্লাহর বাণী ﴿ يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ قَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ عَلَىٰ فَتۡرَةٖ مِّنَ ٱلرُّسُلِ أَن تَقُولُواْ مَا جَآءَنَا مِنۢ بَشِيرٖ وَلَا نَذِيرٖۖ فَقَدۡ جَآءَكُم بَشِيرٞ وَنَذِيرٞۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٩ ﴾ [ المائ‍دة : ١٩ ] ‘‘হে আহলে কিতাবগণ ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল আগমন করেছেন, যিনি রাসূলগণের বিরতির পর তোমাদের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা একথা বলতে না পার যে, আমাদের কাছে কোন সুসংবদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শক আগমন করেনি। অতএব, তোমাদের কাছে সুসংবাদ দাতা ভীতিপ্রদর্শক এসে গেছে আর তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।’’ আল-কুরআন, সূরা আল-মায়িদা : ১৯।] এ মর্মে সূরা ত্বা-হায় এসেছে, মহান আল্লাহ বলেনঃ

﴿ وَلَوۡ أَنَّآ أَهۡلَكۡنَٰهُم بِعَذَابٖ مِّن قَبۡلِهِۦ لَقَالُواْ رَبَّنَا لَوۡلَآ أَرۡسَلۡتَ إِلَيۡنَا رَسُولٗا فَنَتَّبِعَ ءَايَٰتِكَ مِن قَبۡلِ أَن نَّذِلَّ وَنَخۡزَىٰ ١٣٤ ﴾ [ طه : ١٣٤ ]

‘‘যদি আমি এদেরকে ইতপূর্বে কোন শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম, তবে এরা বলত : হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করলেন না কেন? তাহলে তো আমরা অপমানিত ও হেয় হওয়ার পূর্বেই আপনার নিদর্শনসমূহ মেনে চলতাম।’’ [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা : ১৩৪।]

তাঁর আগমনের পূর্বে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কোন ভীতি প্রদর্শক আগমন করেনি। ফলে মানুষের সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য করার অনুভূতি পর্যন্ত লোপ পেয়ে যায়। এ জন্যে মহান আল্লাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেন সর্বশেষ ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা রূপে। আর এটি ছিল বান্দার প্রতি মা‘বুদের রহমত বা করুণাস্বরূপ। [এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ﴿ وَلَوۡلَآ أَن تُصِيبَهُم مُّصِيبَةُۢ بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيهِمۡ فَيَقُولُواْ رَبَّنَا لَوۡلَآ أَرۡسَلۡتَ إِلَيۡنَا رَسُولٗا فَنَتَّبِعَ ءَايَٰتِكَ وَنَكُونَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٤٧ ﴾ [ القصص : ٤٧ ] আল-কুরআন,সূরা আল-কাসাস : ৪৭।]

নবুওয়ত লাভের প্রারম্ভে তিনি এ মর্মে আদিষ্ট হয়েছেন এবং সর্বপ্রথম নিজ পরিবার ও নিকটতম আত্মীয়স্বজনকে আল্লাহর আযাবের ভয় প্রদর্শন করেন। তাঁর উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব মহাগ্রন্থ আল-কুরআনেও বিষয়টি এমনভাবে ধ্বনিত হয়েছে, যা প্রমান করছে যে, কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যও তাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং নিজেই এ কথার স্বীকৃতি দিয়েছেন এভাবে, ‘‘আমার প্রতি এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কুরআন পৌঁছেছে সবাইকে ভীতি প্রদর্শন করি।’’ [আল্লাহ বলেন, ﴿وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانُ لِأُنذِرَكُم بِهِۦ وَمَنۢ بَلَغَۚ ١٩ ﴾ [ الانعام : ١٩ ] আল-কুরআন, সূরা আল-আনআম : ১৯]

এ পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ দু’টি। একটি হল সরল সঠিক পথ বা সিরাতুল মুস্তাকীম। অপরটি গোমরাহীর পথ। এ দু’পথের যে কোন পথে মানুষ পরিচালিত হতে পারে। এজন্যে পরকালেও জান্নাত এবং জাহান্নাম এ দু’ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। পবিত্র কুরআন গোটা জাতিকে মুমিন এবং কাফির দু’ শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। মুমিনগণ কিসের ভিত্তিতে জীবন চালাবেন এবং কোনটি তাদের জীবন নির্বাহের পথ, সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই তাঁর আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ‘‘ছিরাতুল মোস্তাকীম’’-এর পথ দেখানো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয় আপনি প্ররিত রাসূলগণের একজন। সরল পথে প্রতিষ্ঠিত।’’ [আল-কুরআন, সূরা ইয়াসিন : ১-২।]

তিনি মানব জাতিকে জাহেলিয়াতের যাবতীয় কুসংস্কার আকীদা-বিশ্বাস প্রভৃতির অজ্ঞতা থেকে ঈমানের আলোর দিকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁর উপর অবতীর্ণ আল-কুরআনও মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দিতে অবতীর্ণ হয়েছে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনের সূরা ইবরাহিমে এসেছে,

﴿ الٓرۚ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ ٰطِ ۡعَزِيزِ ۡحَمِيدِ ١ ﴾ [ ابراهيم : ١ ]

‘‘আলিফ, লাম, রা। এটি একটি গ্রন্থ। যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন, পরাক্রান্ত ও প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে।’’ [আল-কুরআন, সূরা ইবরাহিম : ১।] অতএব, সব মানুষকে অন্ধকার তথা তাগুতের পথ থেকে বের করে আলোর পথ তথা সরল সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়তের উচ্চ সোপানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আদর্শ শুধু স্বীয় অনুসারীদের হেদায়েত লাভের মাধ্যমই ছিল না বরং তাঁর উম্মতের বিকীরিত হেদায়েত দ্বারা অন্যান্য উম্মতও অন্ধকার হতে আলোর পথের দিশা পেত। তাঁর সত্ত্বাগত আবির্ভাবের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘‘তিনিই উম্মীদের মধ্য হতে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের নিকট আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবে। তাদেরকে পবিত্র করবে এবং শিক্ষা দিবে কিতাব ও হিকমত।’’ [ ﴿ هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّ‍ۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ ﴾ [ الجمعة : ٢ ] আল-কুরআন, সূরা আল-জুম’আ : ২।] অপর আয়াতে তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে আলোর বিকীরণ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ ﴾ [ ال عمران : ١١٠ ]

‘‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ কর।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-ইমরান : ১১০।]

উপরোক্ত আয়াতে কারীমা হতে প্রতীয়মান হয়ে যে, যেমনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবী হিসেবে প্রেরণ তাঁর উম্মতের জন্য যে উদ্দেশ্য হয়েছিল, অনুরূপ তাঁর উম্মতের প্রেরণ ছিল অন্যান্য জাতির প্রতি আলোকবর্তিকারূপে। আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত হতে এটি আরো সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়ঃ

﴿لِيَكُونَ ٱلرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيۡكُمۡ وَتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ ٧٨﴾ [ الحج : ٧٨ ]

‘‘যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় এবং তোমরা সাক্ষীস্বরূপ হও মানবজাতির জন্য।’’ [আল-কুরআন, সূরা হজ্জ : ৭৮।]

সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উভয় পর্যায়ের পূর্ণ যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন; আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এ দু’পর্যায়ের পূর্ণ যোগ্যতা প্রদান করেছিলেন। [শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাতিল বালিগাহ, ১ম খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪।]

সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে পরিচয় করে দিতে এবং স্রষ্টার ইবাদতের দিকে আহবান জানানো ছিল নবী-রাসূলদের অন্যতম কাজ। আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন না করে একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করার ব্যপারে মহান আল্লাহ বলেন ‘‘আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলকে পাঠিয়েছি তাকে এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছি যে, নিশ্চয় আমি ব্যতীত তাদের কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’ [ ﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥ ﴾ [ الانبياء : ٢٥ ] আল-কুরআন, সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫।]

কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষ আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমূখ হয়ে বিভিন্ন দেব-দেবীর, গাছ, সূর্য, চন্দ্র, তারকা প্রভৃতির ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়ে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাঁর ইবাদতের দিকে ধাবিত করতে এবং তাগুতকে অস্বীকার করার আহবান বার্তা নিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেন। সে কারণে কিছু লোক হেদায়েত প্রাপ্ত হল এবং কিছু সংখ্যক লোক গোমরাহীর পথে রয়ে গেল। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান জানিয়েছেন এবং এর মাধ্যমেই তাদের একমাত্র সফলতা নিহিত রয়েছে, এ মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। [আল্লাহর বাণী ﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ فَمِنۡهُم مَّنۡ هَدَى ٱللَّهُ وَمِنۡهُم مَّنۡ حَقَّتۡ عَلَيۡهِ ٱلضَّلَٰلَةُۚ ٣٦ ﴾ [ النحل : ٣٦ ] “আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তারা আমার ইবাদত করবে এবং তাগুত থেকে বিরত থাকবে। অতঃপর তাদের কিছু সংখ্যক হেদায়াত প্রাপ্ত হল এবং কিছু সংখ্যক গোমরাহ হয়ে পড়ল।’’ আল-কুরআন, সূরা আন-নহল : ৩৬।]

কোন জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য যে কাজটি সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করে তা হল, পারস্পারিক জুলুম-নির্যাতন। এর মাধ্যমে মানুষ অন্যায় ও অসত্যের পথে পা বাড়ায়। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমালংঘন করে। শয়তানের পদাংক অনুসরন করে পথভ্রষ্ট হয়। যুগে যুগে এ সব জুলুম-নির্যাতনের ব্যপারে নবী-রাসূলগণের কণ্ঠ ছিল খুবই উচ্চকিত। তারা জুলুম নির্যাতনের বিপরীতে ইনসাফ ও সুবিচার সমাজে কায়েম করেছেন। মানুষের মাঝে যখনই কোন মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল তখনই রাসূলগণ কিতাব এবং মিযান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুবিচার কায়েম করে জুলুমের মুলোৎপাটন করেন। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জুলুম নির্যাতনের চরম পর্যায়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং এর বিপরীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন। নবুওয়ত লাভের পূর্বে যুবক বয়সেই তিনি সমাজ হতে যাবতীয় ন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ও অসত্যকে দুর করার জন্যে ‘‘হিলফূল ফূযুল’’ নামক সংঘে যোগ দেন। মানুষের মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজেও বিচারকের আসনে সমাসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ফলে বহু বিবাদ নিরসনে স্বয়ং তাঁর শত্রুরাও তাঁকে বিচারক হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিতাব ও রাষ্ট্রীয় শক্তি এ উভয়টি করতলগত করার মাধ্যমে সমাজে স্থায়ী সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এ মর্মে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

﴿ لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَنزَلۡنَا مَعَهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡمِيزَانَ لِيَقُومَ ٱلنَّاسُ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَأَنزَلۡنَا ٱلۡحَدِيدَ فِيهِ بَأۡسٞ شَدِيدٞ وَمَنَٰفِعُ لِلنَّاسِ ٢٥ ﴾ [ الحديد : ٢٥ ]

‘‘নিশ্চয় আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যয়নীতি যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। তাদের প্রতি আমি লৌহ দন্ড (রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ত) দিয়েছি, যাতে আছে প্রচন্ড রণশক্তি এবং মানুষের জন্য অনেক কল্যাণ।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-হাদীদ : ২৫।]

অতএব সমাজ হতে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার অপনোদন করে সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমন হয়েছিল। যখনই তিনি তা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন তখন মুমিনগণ তা আকুন্ঠচিত্তে মেনে নিয়েছে। [আল-কুরআন, সূরা আন্ নূর : ৫১।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবে পৃথিবীতে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। তাঁর নবুওয়ত মানুষের ধ্যান-ধারণা ও আক্বীদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা ও সমাজিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং জ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন বিশেষ অবদান রেখেছে যা কিয়ামত পর্যন্ত কায়েম থাকবে। তাঁর আগমনের সুবাদে জুলুম-অত্যাচারের পরিবর্তে ন্যায় ও সুবিচার, মূর্খতার পরিবর্তে জ্ঞান ও ভব্যতা, অন্যায়-অপরাধের পরিবর্তে আনুগত্য ও ইবাদত, অবাধ্যতা ও দাম্ভিকতার পরিবর্তে বিনয় ও নম্রতা, স্বেচ্ছাচারী ও নিপীড়নের পরিবর্তে ধৈর্য এবং কুফর ও শির্কের পরিবর্তে ঈমান ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তাঁর নবুওয়ত স্নেহ-দয়া, প্রেম-ভালবাসা ও অনুগ্রহ-অনুকম্পার বাণী শুনিয়েছে। তাঁর দা‘ওয়াত মানব সমাজ সৃষ্টি, মানব জীবন ও মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যে অলৌকিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছে, তার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তিনি স্বীয় শিক্ষার বদৌলতে মানবতাকে অধঃপতনের অতল গহ্বর হতে উদ্ধার করে প্রগতি ও উন্নতির চরম শিখরে সমাসীন করেছেন। তিনি ঈমানের আলো ও জ্যেতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁর আবির্ভাবের ফলে মানুষের আত্মা আলো লাভ করেছে এবং শির্ক, কুফর ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে। তাঁর আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ায় প্রচলিত ও প্রচারিত যাবতীয় মতাদর্শের অসারতা প্রমাণ করে দীনের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়া এবং দীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে মানুষের মাঝে তুলে ধরা। তাই তিনি হেদায়েত ও সত্য দীন সহকারে এ ধরাধামে আগমন করেছেন। এ মর্মে কুরআনে এসেছেঃ

﴿ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ ٩ ﴾ [ الصف : ٩ ]

‘‘তিনি সেই সত্তা (আল্লাহ), যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দীন সহ প্রেরণ করেছেন, যাতে অপরাপর সকল দীন ও মতাদর্শের উপর একে (ইসলামকে) বিজয়ী ঘোষণা দেয়া যায়।’’ [আল-কুরআন, সূরা আস্ সাফ : ৯ ।]

এ বিজয় ছিল বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক, জ্ঞানগত এবং বর্ণনাগত। ইসলাম দলীল-প্রমাণ এবং জ্ঞানগত শক্তি ও যুক্তি দ্বারা প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন জ্ঞান ও দর্শনের উৎস। আকীদা-বিশ্বাস, রীতি-নীতি ও শিষ্টাচার, ইবাদাত, লেন-দেন, বিবাহ-শাদী, রাষ্ট্রনীতি-পারিবারিক প্রশাসন, আম্বিয়া-ই কিরামের জীবনী ও পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ইতিহাস সম্পর্কিত জ্ঞান দান করে মানুষকে ধন্য করেছেন। তাঁর আগমনের সময় সমগ্র বিশ্ব ‘আমল ও আকীদা, ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার ও প্রথা প্রচলনের অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনায় দাসত্ববোধ চাপিয়ে দিয়েছিল। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সকল কুপ্রথার মূলে কুঠারাঘাত করেন, আতঙ্ক ও আশংকার পরিবর্তে শান্তি ও নিরাপত্তা, জুলুম-অত্যাচারের পরিবর্তে ন্যায় ও সুবিচার, গোত্র ও শ্রেণী বৈষম্যের পরিবর্তে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহজ ও সরলপন্থা প্রবর্তন ও প্রচলন করে মানুষের স্কন্ধ হতে ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার দুর্বহ বোঝা অপসারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,

﴿ وَيَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَٰلَ ٱلَّتِي كَانَتۡ عَلَيۡهِمۡۚ ١٥٧ ﴾ [ الاعراف : ١٥٧ ]

‘‘এবং সে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃংখল হতে, যা তাদের উপর চেপে বসেছিল।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ : ১৫৭।]

তাঁর নবুওয়ত বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন। তিনি সমগ্র সৃষ্টিজগত ও বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর সমগ্র জীবন ও শিক্ষায় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি তাঁর স্নেহ, দয়া ও প্রেম-ভালবাসা প্রকটভাবে বিদ্যমান। পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল নিজ নিজ সম্প্রদায় নিজ নিজ এলাকা ও কালের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নবুওয়ত ছিল সর্বকালের সকল মানুষের জন্যে। [এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗ ٢٨ ﴾ [ سبا : ٢٨ ] ‘‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য সুসংবাদ দাতা ও ভীতিপ্রদর্শকরূপে প্রেরণ করেছি।’’ আল-কুরআন, সূরা সাবা : ২৮।]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন