hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল্লাহর দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের বাস্তব কিছু নমুনা

লেখকঃ সাঈদ ইবন আলী ইবন ওহাফ আল-কাহতানী

দ্বিতীয় পরিচ্ছদ: মক্কায় প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়াত
প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে নিকটাত্মীয়দের ইসলামের দা‘ওয়াত দিতে নির্দেশ দেন। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়া আরম্ভ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ٢١٤ وَٱخۡفِضۡ جَنَاحَكَ لِمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢١٥ فَإِنۡ عَصَوۡكَ فَقُلۡ إِنِّي بَرِيٓءٞ مِّمَّا تَعۡمَلُونَ﴾ [ الشعراء : 214-216]

“আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর। আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তুমি তোমার বাহুকে অবনত কর। তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বল, তোমরা যা কর, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ২১৬]

আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মধ্যে প্রকাশ্যে দা‘ওয়াত দেওয়ার সূচনা করেন। প্রথমে তিনি তার স-গোত্রের লোকদের দা‘ওয়াত দিতে আরম্ভ করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন, যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের মধ্যে দ্রুত ইসলামের দা‘ওয়াত ছড়িয়ে দেন এবং প্রসার ঘটান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবর, ইখলাস ও সাহসের ফলে তার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা শির্কের মূলোৎপাটন ঘটায়। কিয়ামত পর্যন্ত মুশরিকদের অপমানিত ও অপদস্থ জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়াত দিতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব হিকমত অবলম্বন করেছিলেন তা ছিল নিম্ন রূপ:

এক:

সাফা পাহাড়ের উপর আরোহণ করে সমগ্র লোকদের একত্র করে আল্লাহর একত্ববাদের দা‘ওয়াত দেওয়া। এ বিষয়ে হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে একটি ঘটনা বর্ণিত, তিনি বলেন,

«لما نزلت ﴿وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ﴾ صعد النبي صلى الله عليه وسلم على الصفا فجعل ينادي : «يا بني فهر، يا بني عدي» لبطون قريش حتى اجتمعوا، فجعل الرجل إذا لم يستطع أن يخرج أرسل رسولا لينظر ما هو، فجاء أبو لهب، وقريش، فقال : «أرأيتكم لو أخبرتكم أن خيلاً بالوادي تريد أن تغير عليكم، أكنتم مصدقي»؟ قالوا : نعم، ما جربنا عليك إلا صدقاً . قال : «فإني نذير لكم بين يدي عذاب شديد» . فقال أبو لهب : تبًّا لك سائر اليوم ألهذا جمعتنا؟ فنزلت : ﴿تَبَّتۡ يَدَآ أَبِي لَهَبٖ وَتَبَّ ١ مَآ أَغۡنَىٰ عَنۡهُ مَالُهُۥ وَمَا كَسَبَ﴾»

“আল্লাহ তা‘আলা যখন এ আয়াত নাযিল করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ের উপর আরোহণ করে, প্রতিটি গোত্রের নাম উচ্চারণ করে, তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। কুরাইশদের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ডাকে সাড়া দিল এবং কুরাইশের সমগ্র মানুষ পাহাড়ের পাশে একত্র হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানের পর তাদের মধ্যে মক্কায় তার ডাকে সাড়া দেওয়ার একটি হিড়িক পড়ে যায়। এমনকি যদি কোনো লোক কোনো কারণে উপস্থিত হতে পারে নি, সে তার একজন প্রতিনিধি পাঠাত, যাতে মুহাম্মাদ কী বলে, তা তার মাধ্যমে জানতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আবূ জাহেলসহ বড় বড় কুরাইশ নেতা ও বিভিন্ন বংশের লোকেরা উপস্থিত হলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত লোকদের সম্বোধন করে বললেন, আমি যদি তোমাদের খবর দেই যে, এ উপত্যকার অপর প্রান্তে একটি সশস্ত্র সৈন্যদল তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? তারা সবাই এক বাক্যে উত্তর দিল হ্যাঁ! আমরা অবশ্যই তোমাকে বিশ্বাস করব। কারণ, তোমাকে আমরা কখনোই মিথ্যা বলতে দেখি নি। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বলল, তোমরা মনে রাখ! আমি তোমাদের ভয়াবহ আযাবের পরিণতি সম্পর্কে ভয় দেখাচ্ছি। এ কথা শোনে কমবখত আবূ লাহাব সাথে সাথে বলল, তোমার জন্য ধ্বংস! তুমি আমাদের পুরো দিনটি নষ্ট করলে। এ জন্যই তুমি আমাদের ডেকে একত্র করছ! তার কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন”। [সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর: পরিচ্ছেদ: ﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ ৫০১/৮ হাদীস নং ৪৭৭০; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদ: ﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ﴾ ১৯৪/১, হাদীস নং ২০৮, আয়াত: ১-২ সূরা মাসাদ থেকে।]

অপর একটি বর্ণনায় আব হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ বংশের লোকদের একটি একটি করে প্রতিটি গোত্রের লোকদের ডাকেন এবং প্রতিটি গোত্রের লোকদের সম্বোধন করে তিনি বলেন,

«( أنقذوا أنفسكم من النار ...) ، ثم قال : ( يا فاطمة أنقذي نفسك من النار؛ فإني لا أملك لكم من اللَّه شيئاً، غير أن لكم رحماًَ سأبلها ببلاها

“(তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচাও..) তারপর তিনি তার প্রাণাধিক প্রিয় একমাত্র কন্যা ফাতেমাকে সম্বোধন করে বলেন, (হে ফাতেমা! তুমি তোমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাচাও! কারণ, আমি আল্লাহর থেকে তোমাদের কল্যাণে কোনো কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না। তবে তোমাদের সাথে আমার রয়েছে আত্মীয়তা। আমি তার দ্বারা তোমাদের সাথে কেবল আমার সম্পর্কেই সিক্ত করব)। [সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর, পরিচ্ছেদ: ﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ﴾ পৃ: ৫০১/৮, হাদীস নং ৪৭৭০; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান। পরিচ্ছেদ: ﴿وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ﴾ ১৯৪/১, হাদীস নং ২০৮, আয়াত: ১-২ সূরা মাসাদ থেকে।] এ আহ্বান ছিল, দা‘ওয়াতের সর্বচ্চো সোপান। তিনি সমবেত লোকদের সবোর্চ্চ ভয় দেখান এবং সর্বচ্চো সতর্ক করেন। কারণ, তিনি প্রথমে তার একদম কাছের লোকদের এ কথা স্পষ্ট করেন যে, তাদের সাথে সম্পর্কের মানদণ্ড হলো, এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনা ও রিসালাতের ওপর বিশ্বাস করা। যারা এ দু’টি বিষয়ের ওপর বিশ্বাস করবে তারাই হলো, তার নিকট সবচেয়ে আপন লোক। তিনি আরবদের আরও জানিয়ে দেন যে, জাতিগত, বর্ণগত ও বংশগত যেসব বিবাধ ও বৈষম্য আরবরা দীর্ঘকাল ধরে লালন করে আসছে, আজকের এ আহ্বানের মাধ্যমে তার একটি পরিসমাপ্তি ও ইতি ঘটল। এসব বিষয় নিয়ে কোনো প্রকার বিবাধ বৈষম্য অর্থহীন। এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সমবেত লোকদের ইসলামের দিকে আহ্বান করেন এবং মূর্তিপূজা থেকে তাদের বারণ করেন। যারা তার আহ্বানে সাড়া দিবে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দেন, আরা যারা তার এ দা‘ওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করবে তাদের তিনি জাহান্নামের ভয় দেখান।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুরুত্বপূর্ণ দা‘ওয়াতের পর মক্কাবাসী তা সাথে সাথে প্রত্যাখ্যান করে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শক্ত হাতে মোকাবেলা ও প্রতিহত করার অঙ্গিকার করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দা‘ওয়াত ছিল, তাদের পুরনো অভ্যাস, অন্ধানুকরণ ও জাহেলিয়্যাতের রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ফলে তারা এ দা‘ওয়াতকে অংকুরে গুটিয়ে দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরোধিতা, গর্জন ও হুংকারে কোনো প্রকার কর্ণপাত করেন নি, বিচলিত কিংবা দুর্বল হন নি। তিনি তার ওপর অর্পিত রিসালাতের গুরু দায়িত্ব অত্যন্ত সাহসিকতা ও প্রত্যয়ের সাথে চালিয়ে যেতে থাকেন। কারণ, তিনি তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন রাসূল; যদি সারা পৃথিবীও তার বিরোধিতা করে এবং তাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়, তাহলেও আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা পালন করাই হলো তার একমাত্র কাজ। তিনি তো কোনো ক্রমেই তা থেকে পিছপা হতে পারেন না। তার ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সারা দুনিয়ার সমগ্র মানুষও যদি একত্র হয়ে তার বিরোধিতা করে, তারপরও তিনি তা থেকে এক চুল পরিমাণও পিছু হটবে না। [দেখুন: আর-রাহীকুল মাখতুম: পৃ. ৭৮; ইমাম গাযালী রহ.-এর সীরাত গ্রন্থ পৃ. ১০১, মুস্তাফা আস-সাবায়ী রহ.-এর সীরাতুন নববী ও শিক্ষনীয় বিষয়, পৃ. ৪৭।]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে দা‘ওয়াতের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে রাত-দিন (চব্বিশ ঘণ্টা), তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দিতে থাকেন। প্রকাশ্যে ও গোপনে, ব্যক্তি ও সামগ্রিক পর্যায়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে বিরামহীনভাবে আহ্বান করতে থাকেন। কোনো প্রকার বাধা-বিপত্তি তাঁকে তার দা‘ওয়াত থেকে ধময়ে কিংবা ফিরিয়ে রাখতে পারে নি। কোনো বিরোধিতাকারীর বিরোধিতা তার দা‘ওয়াতের চলন্ত মিশনের গতিরোধ কিংবা বিঘ্ন ঘটাতে পারে নি। তাঁকে দা‘ওয়াত থেকে বিরত রাখার জন্য কাফিরদের হাজারো চেষ্টা ও কৌশল কোনো কাজে আসে নি। তারা তাঁকে তাঁর মিশন থেকে বিরত রাখতে পারে নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় মানুষকে দা‘ওয়াত (আল্লাহর দিকে আহ্বান) দেওয়ার কাজে লেগেই থাকতেন। তিনি তাদেরকে তাদের কোনো মজলিশ হোক বা মাহফিল, সব জায়গায় তাদের দা‘ওয়াত দিতে থাকতেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমে তিনি তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেই থাকেন। বিশেষ করে হজের মৌসুমে যখন লোকেরা বাইতুল্লাহ’র উদ্দেশ্যে একত্র হত, তখন তিনি এ সময়টাকে দা‘ওয়াতের জন্য গণীমত মনে করতেন। এ সময়ে যার সাথে দেখা হত তাকেই তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেন; চাই সে গোলাম হোক বা স্বাধীন, ধনী হোক বা গরীব তার নিকট সবাই সমান; কারো প্রতি তিনি কোনো প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন করতেন না। কে দুর্বল আর কে সবল তা তার নিকট বিবেচ্য নয়। তিনি সবাইকে তার দা‘ওয়াতের আওতায় নিয়ে আসতেন এবং আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। একজন দা‘ঈর জন্য এসব গুণাগুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনোভাবে ক্ষান্ত করতে না পেরে, মক্কার মুশরিকরা ক্ষোভে বিক্ষোভে অগ্নি-শর্মা হয়ে পড়ল। তারা তাদের করনীয় হিসেবে যুলুম নির্যাতনের পথকেই বেচে নিলো। ফলে তারা রাসূল ও তার অনুসারীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের যুলুম নির্যাতন করতে আরম্ভ করল এবং তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপপ্রচার চালানো শুরু করল। কারণ, তারা কোনো ক্রমেই আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস করা ও মূর্তি পূজাকে ছাড়তে রাজি হলো না। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪০/৩।]

কাফিরদের বিরোধিতা, অপপ্রচার ও যুলুম-নির্যাতনের পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দা‘ওয়াতী কাজে একটুও দুর্বল হন নি। তার দা‘ওয়াতের মাধ্যমে যারা ইসলামে প্রবেশ করছে, তাদের তা‘লীম-তরবিয়ত দেওয়া ও দীনের সুযোগ্য সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি কোনো প্রকার কার্পণ্য ও নমনীয়তা প্রদর্শন করেন নি। কুরাইশদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের নিয়ে পরিবারের বিভিন্ন ঘরে একত্র হতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা‘লীম ও তরবিয়তের ফলে ধীরে ধীরে তার অনুসারীরা এমন একটি সাহসী ও ত্যাগী জাতিতে পরিণত হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে তাদের দৃষ্টান্ত দুর্লভ। তারা ইসলামকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাবতীয় সব ধরনের (দৈহিক ও মানসিক) নির্যাতন সইতে প্রস্তুত ছিল। যত প্রকার যুলুম নির্যাতনই আসুক না কেন, তারা তাদের আদর্শ থেকে একটুও পিছপা হবে না বলে ছিল প্রত্যয়ী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা‘লীম-তরবিয়ত ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশেষ একটি জামা‘আত তৈরি হলো, যারা তাদের ঈমানে ছিল দৃঢ়, বিশ্বাসে ছিল অটুট, দায়িত্ব সম্পর্কে ছিল সচেতন, তাদের প্রভূর নির্দেশ পালনে তারা ছিল একনিষ্ঠ, রাসূলের নেতৃত্বর ওপর ছিল তারা আস্থাভাজান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কোনো নির্দেশ দিতেন, তা পালনে তারা ছিল অতীব আন্তরিক ও উৎসাহী। তার মুখের থেকে কোনো কথা বের হতে দেরী হত, কিন্তু তারা তা লোপয়ে নিতে একটুও সময় ক্ষেপণ করত না। তারা তার নেতৃত্বের প্রতি এতই অনুগত ছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা তাঁকে এত বেশি মুহাব্বত করত ও ভালোবাসতো যার কোনো তুলনা আজ পর্যন্ত কোনো জাতি উপস্থাপন করতে পারে নি।

এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, সঠিক দিক নির্দেশনা ও অটুট-অবিচল নীতি আদর্শের কারণে রিসালাতের গুরু দায়িত্ব আদায়, আমানতের সংরক্ষণ ও উম্মতের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হন। তিনি আজীবন আল্লাহর রাহে সত্যিকার সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি মানবজাতির জন্য এমন এক পথ ও পদ্ধতি বাতিয়ে দেন, যা আমাদের দা‘ওয়াত, কর্ম ও চলার পথের জন্য চিরন্তন আদর্শ।

মোটকথা, তিনিই আমাদের আদর্শ, আমাদের ইমাম; আমরা তার আদর্শের অনুসারী ও তার হিকমত ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত।

তিনি অতীব পছন্দনীয়, সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি ও উন্নত মূলনীতি দিয়ে মানুষকে আল্লাহর দীনের প্রতি দা‘ওয়াত দেওয়া আরম্ভ করেন, যার ফলে মানুষ তার দা‘ওয়াতে সাড়া দিয়ে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং তার রিসালাতের ওপর বিশ্বাস করে। একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তার দা‘ওয়াত কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য খাস ছিল না, তার দা‘ওয়াত ছিল ব্যাপক, সমগ্র মানুষের জন্য আর তিনি ছিলেন সমগ্র মাখলুকের জন্য রহমত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার দা‘ওয়াতী ময়দানে কাজ করছিলেন, তখন তিনি এমন কতক লোকদের চিহ্নিত করেন, যাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভা ছিল বিদ্যমান। এছাড়াও যাদের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, তারা তার দা‘ওয়াত কবুল করবে এবং তার রিসালাতে বিশ্বাস করবে, তাদেরকেই তার দা‘ওয়াতের জন্য প্রাথমিকভাবে চয়ন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কৌশল ও হিকমতের কারণে এমন একটি ভিত রচনা করতে সক্ষম হন, যার ওপর স্থাপিত হয় দা‘ওয়াতের ভিত্তি। এমন কতক খুঁটি তৈরি করেন, যাদের ওপর নির্ভর করে দা‘ওয়াতের রোকনসমূহ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। [মাহমুদ সাকের রহ.-এর তারিখে ইসলামী: ৬৫/২।]

আল্লাহর দীনের দা‘ওয়াতের জন্য রাসূলের প্রচেষ্টায় কোনো প্রকার ঘাটতি ছিল না। তিনি অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান এবং প্রতিদিনই নতুন নতুন কৌশল ও হিকমত আবিষ্কার করেন। কিন্তু এত চেষ্টা সত্ত্বেও একটি কথা স্পষ্ট যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই কাউকে হত্যা বা গুপ্ত হত্যা করার নির্দেশ দেন নি। ইসলামের বিরোধিতাকারী হিসেবে সে যত বড় শত্রুই হোক না কেন, তাকে তিনি নিজে বা তার সাহাবীগণের কেউ গোপনে হত্যা করে নি। অথচ তখন গোপনে হত্যা করা সহজ ও সম্ভব ছিল; ইচ্ছা করলে তা করতে পারতেন। তা সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো কাফির বা ইসলামের শত্রুকে গোপনে হত্যা করে, তার ওপর পরিচালিত যুলুম নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে চান নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি ইশারা করতেন, তাহলে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত সাহাবীর অভাব ছিল না। তিনি সাহাবীগণকে বড় বড় কাফির নেতা ও ইসলামের শত্রুদের গোপনে হত্যা করার নির্দেশ দিলে, তারা তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিত। যেমন, ওলীদ ইবন মুগীরা আল মাখযুমী, আস ইবন ওয়ায়েল আস-সাহমী, আবূ জাহেল আমর ইবন হিশাম, আবূ লাহাব, আব্দুল উজ্জা ইবন আব্দুল মুত্তালিব, নজর ইবন হারেস, উকবা ইবন আবূ মু‘ঈত, উবাই ইবন খালফ ও উমাইয়া ইবন খালফ প্রমুখ। এরা সবাই ইসলামের ঘোর বিরোধী ও বড় বড় শত্রু ছিল। এরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবর্ণনীয় ও সীমাহীন কষ্ট দিত। তারপরও রাসূল এদের কাউকে বা এরা ছাড়াও ইসলামের অন্য কোনো শত্রু গোপনে হত্যা করেন নি এবং হত্যার নির্দেশ দেন নি। কারণ, এ ধরনের কাণ্ড-জ্ঞানহীন কাজ ইসলামের অগ্রযাত্রার জন্য ক্ষতিকর। যারা এ ধরনের কাজ করে ইসলামের শত্রুরা তাদের একেবারে নিঃশেষ করে দেয় অথবা তাদের অগ্রসর হওয়ার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। যেমনটি আজ আমরা সমগ্র দুনিয়াব্যাপী বিষয় ভালোভাবেই প্রত্যক্ষ করি। ইসলামের শত্রু যারা ইসলামকে নির্মূল করতে চায়, তাদের দ্বারা আজ আমরা আক্রান্ত ও ভুক্তভোগী। আল্লাহর পক্ষ থেকেও তার নবীকে এ ধরনের গোপনীয় কোনো কিছু করার নির্দেশ দেওয়া হয় নি। কারণ, তিনি তো (আহকামুল হাকেমীন) মহা জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ, তিনি যাবতীয় কর্মের বিদারক ও পরিণতি সম্পর্কে সম্যক অবগত।

একটি কথা মনে রাখতে হবে, যমীনের উপর ও আসমানের নিচে যত দা‘ঈ আছে, তাদের সবাইকে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ পথেরই অনুসরণ করতে হবে, যে পথ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য তার হিজরতের পূর্বে ও পরে দেখিয়ে গেছেন। সুতরাং মনে রাখতে হবে, বিশুদ্ধ দা‘ওয়াতের পদ্ধতি হলো, রাসূলের শিক্ষা ও আদর্শকে আঁকড়িয়ে ধরা, তার আখলাক ও চরিত্রের অনুসরণ করা। তিনি যেভাবে দা‘ওয়াতের কাজ করেছেন, সেভাবে দা‘ওয়াতী কাজকে আঞ্জাম দেওয়া। [মাহমুদ সাকের রহ.-এর তারিখে ইসলামী: ৬৫/২।]

দুই.

কুরাইশ প্রতিনিধিদের প্রস্তাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসম্মতি এবং আল্লাহর দীনের দা‘ওয়াতের ওপর তার অটুট ও অবিচল নীতি কুরাইশদের হতাশা বৃদ্ধি করে।

কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার দা‘ওয়াতী কার্যক্রম থেকে কোনোভাবেই বিরত রাখতে পারছিল না। তাদের যুলুম, নির্যাতন ও নির্মম অত্যাচার কোনোটাই কাজে আসতে ছিল না। নিরুপায় হয়ে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে থামানো ও ধময়ে রাখার আরেকটি নতুন কৌশল অবলম্বন করল, যে কৌশলের মূল থিম হলো, তারা রাসূলকে একদিকে প্রলোভন দিবে অপরদিকে তারা তাকে ভয় দেখাবে। তাদের কৌশল হলো, তারা উভয়টিকে একত্র করে তাঁকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করবে। একদিকে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পার্থিব জগতের যত চাহিদা আছে সব কিছুই তারা তাঁকে দিতে প্রস্তুত আর অপরদিকে তাঁর চাচা (আবূ তালিব) যিনি তাঁকে দেখা-শোনা ও সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাঁকে সতর্ক করবে, যাতে তিনি মুহাম্মাদকে তার দীনের প্রচার হতে বিরত রাখে। [আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৪১/৩; মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ.-এর সীরাত গ্রন্থ পৃ. ১১২।]

কুরাইশদের কৌশল ছিল নিম্নরূপ:

এক.

কুরাইশ নেতারা আবূ তালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আবূ তালিব! তুমি বয়সে আমাদের জ্যৈষ্ঠ, আমাদের মধ্যে তোমার যথেষ্ট ইজ্জত ও সম্মান রয়েছে। তুমি জান! আমরা তোমার ভাতিজাকে আল্লাহর দীন ও তাওহীদের দা‘ওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বার বার বলছি, কিন্তু সে আমাদের কথায় কোনো প্রকার কর্ণপাত করে নি এবং তাওহীদের দা‘ওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকে নি। আমরা আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমরা তার এ অবস্থার ওপর আর বেশি দিন ধৈর্যধারণ করতে পারছি না। সে আমাদের বাপ-দাদার সমালোচনা করে, আমাদের উপাস্যদের বদনাম করে এবং আমাদের চিন্তা চেতনার ওপর কুঠার আঘাত করে। তুমি হয়তো তাকে বিরত রাখবে অন্যথায় তার সাথে ও তোমার সাথে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হব; হয় তোমরা ধ্বংস হবে অথবা আমরা ধ্বংস হব।

আবূ তালিবের নিকট কুরাইশদের এ ধরনের কঠিন হুমকি, সগোত্রীয় লোকদের বিরোধিতা ও তাদের সাথে সম্পর্কের টানা-পোড়ন, একটি দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। কুরাইশ নেতাদের এ ধরনের কথার কারণে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের প্রতি যে দা‘ওয়াত দিচ্ছে, তাতে তিনি খুশি হতে পারলেন না, আবার অন্যদিকে তারা মুহাম্মাদকে অপমান করবে তাতেও তিনি সন্তুষ্ট নয়। তাই নিরুপায় হয়ে আবূ তালিব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তোমার গোত্রের লোকেরা আমার নিকট এসেছিল, তারা আমাকে এসব কথা বলেছে, আমি আমার ও তোমার উভয়ের বিষয়ে আশংকা করছি। তুমি আমার ওপর এমন কোনো দায়িত্ব চাপাবে না, যা বহন করতে আমি বা তুমি অক্ষম। সুতরাং তোমার যে কথা তারা অপছন্দ করে তা বলা হতে তুমি নিজেকে বিরত রাখ!

আবূ তালিবের এ প্রস্তাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে, তিনি তার দা‘ওয়াতের ওপর অটল ও অবিচল রইলেন। তিনি আল্লাহর দীনের দা‘ওয়াত দেওয়া থেকে বিন্দু পরিমাণও পিছপা হলেন না। যারা তার সমালোচনা এ বিরোধিতা করল তাদের বিরোধিতা ও সমালোচনাকে তিনি কোনো প্রকার ভয় করলেন না। কারণ, তিনি জানেন, তিনি সত্যের ওপর আছেন, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তার দীনকে বিজয় করবে এবং তার বাণীকে সমুন্নত রাখবে। আবূ তালিব যখন রাসূলের দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখতে পেল এবং তার কথায় তার ভাতিজা তাওহীদের দিকে দা‘ওয়াত দেওয়া ছেড়ে দিবে- এ ধরনের আশা ছেড়ে দিল, সে তাকে বলল,

والله لن يصلوا إليك بجمعهم

حتى أُوسَّد في التراب دفينا

فاصدع بأمرك ما عليك غضاضة

وأبشر وقر بذاك منك عيونا

“আল্লাহর শপথ করে বলছি, তারা সবাই একত্র হয়েও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। যদি তারা তোমার কোনো ক্ষতি করে, আমি তাদেরকে মাটিতে দাফন করে ফেলব। তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও! তোমার কোনো ভয় নেই। আর তুমি আমার পক্ষ থেকে সু-সংবাদ গ্রহণ কর এবং তুমি তোমার চক্ষুকে শীতল কর” [দেখুন! সীরাতে ইবন হিশাম ২৭৮/২; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪২/৩,৩; মুহাম্মাদ আল-গাযালী রহ.-এর সীরাত: পৃ. ১১৪; আর-রাহীকুল মাখতুম: পৃ. ৯৪।]।

দুই.

উমার ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম ও হামযা ইবন আব্দুল মুত্তালিবের ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের কালো আকাশ থেকে মেঘ সরে যেতে আরম্ভ করল। ইসলাম ও মুসলিমদের যে অবস্থান তৈরি হলো, তা দেখে মক্কার কাফির মুশরিকদের ঘুম হারাম হয়ে গেল। মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া, তারা প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেওয়া ও মুশরিকদের বিরোধিতার কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করা, তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করল ও রীতিমত তারা আতংকিত হয়ে পড়ল।

কোনো প্রকার উপায় না দেখে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কুরাইশরা তাদের নেতাদের আবারো পাঠালেন, যাতে তারা তাকে এমন কিছু পার্থিব বিষয়ে লোভ দেখায়, যেগুলোর প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে, সে আল্লাহর দীনের দা‘ওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেয়। তারা ঠিক করল, যদি মুহাম্মাদ তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়, তাহলে তাকে দুনিয়াবী ও পার্থিব জগতের অসংখ্য অগণিত সুযোগ-সুবিধা দিবে। তার যত প্রকার চাহিদা আছে তা সবই তারা পূরণ করবে।

তাদের চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী কুরাইশ নেতা উতবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে তাঁর নিকট বসল এবং বলল, হে আমার ভাতিজা! তুমি আমাদের মধ্যে কতটুকু আদর ও সম্মানের তা তোমার অজানা নয়, তোমার বংশ মর্যাদার কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু তুমি গোত্রের লোকদের নিকট এমন একটি বিষয় উপস্থাপন করছ, যা তাদের ঐক্যে পাটল ধরিয়েছ, চিন্তা চেতনায় আঘাত হানছে, দীর্ঘদিন থেকে লালিত স্বপ্নকে তুমি ভঙ্গুর করে দিয়েছ। এ ছাড়াও তুমি তাদের ইলাহ ও ধর্মকে তুমি কটাক্ষ করছ এবং তাদের বাপ-দাদাদের রীতিনীতিকে অস্বীকার করছ। আমি তোমার নিকট কিছু প্রস্তাব নিয়ে এসেছি, তুমি মনোযোগ দিয়ে শোন এবং গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ, হয়তো, বিষয়গুলো তোমার নিকট ভালো লাগবে এবং তুমি তার কিছু হলেও গ্রহণ করবে। তার কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, قل أبا الوليد أسمع হে আবুল ওয়ালিদ! তুমি তোমার কথা বল, আমি তোমার কথা শুনবো! তখন সে বলল, হে ভাতিজা! যদি তোমার এ দা‘ওয়াতের দ্বারা ধন-সম্পদ উপার্জন করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তুমি বল, আমরা তোমার চাহিদা অনুযায়ী ধন-সম্পদ তোমার জন্য একত্র করব। ফলে তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে অধিক সম্পদের অধিকারী হবে। আর যদি তুমি আমাদের নেতৃত্ব দিতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা নির্বাচিত করব এবং আমরা তোমাদের নেতৃত্বকে মেনে নিব। আমরা তোমার সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব না। তুমি আমাদের যখন যা করতে বল, আমরা তাই করব এবং তোমার অনুগত হয়ে চলব। আর যদি তুমি আমাদের রাজত্ব চাও, তাতেও আমরা রাজি। আমরা তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে দিব।

আর তুমি যা করছ ও বলছ, তা যদি কোনো রোগের কারণে হয়, তবে আমরা তোমার জন্য কবিরাজ বা ডাক্তারের সন্ধান করব এবং তোমার যত ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন তার সবই আমরা করব। তোমার চিকিৎসার জন্য যত টাকা প্রয়োজন আমরা খরচ করব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উতবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর যখন উতবা তার কথা শেষ করল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

أفرغت أبا الوليد؟ قال نعم، قال : فاستمع مني قال : افعل، فقال : ﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم * حم * تَنزِيلٌ مِّنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ * كِتَابٌ فُصِّلَتْ آيَاتُهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ * بَشِيرًا وَنَذِيرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لا يَسْمَعُونَ * وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِّمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ ...

“হে আবুল ওয়ালিদ! তুমি তোমার কথা শেষ করছ? বলল, হ্যাঁ। তাহলে এবার তুমি আমার থেকে কিছু কথা মনোযোগ দিয়ে শোন। তখন সে বলল, আচ্ছা এবার তুমি বল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলল, তুমি আমার থেকে কুরআনের আয়াত শোন। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করছিল। উতবা চুপ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত শুনছিল। উতবা দুই হাত পিছনের দিক দিয়ে হেলান দিয়ে বসে কুরআনের তিলাওয়াত শুনছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিলাওয়াত করতে করতে যখন সাজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছল, তখন সে সাজদায় পড়ে গেল”। [সূরা ফুস্সিলাত, আয়াত: ১৩] তারপর রাসূল তাকে বলল, হে আবুল ওলিদ! তুমি আমার কাছ থেকে যা শুনলে, এটাই হলো আমার মিশন। এখন তুমি চিন্তা করে দেখ কি করবে?

অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছল,

﴿فَإِنۡ أَعۡرَضُواْ فَقُلۡ أَنذَرۡتُكُمۡ صَٰعِقَةٗ مِّثۡلَ صَٰعِقَةِ عَادٖ وَثَمُودَ﴾ [ فصلت : 13]

“অতঃপর যদি তারা প্রত্যাখ্যান করে তুমি তাদের বল, আমি তোমাদের আদ ও সামুদ সম্প্রদায়ের লোকদের বিকট শব্দের মতো শব্দের ভয় দেখাচ্ছি! উতবা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ চেপে ধরল এবং বলল, আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ ও আত্মীয়তার শপথ করে বলছি, আর তিলাওয়াত করো না! তুমি তোমার তিলাওয়াত বন্ধ কর। তারপর সে তার বংশের লোকদের নিকট এমনভাবে দৌড়ে আসল যেন বজ্র বা বিদ্যুৎ তাকে তাড়া করছে। আর কুরাইশদের সে বলল, তোমরা মুহাম্মাদকে তার আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও, তার সাথে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। সে তাদের বিষয়টি বুঝাতে আরম্ভ করেন [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৬২/৩; তাফসীরে ইবন কাসীর: ৬২/৪; ইমাম শামসুদ্দিন আয-যাহাবী রহ. সীরাত গ্রন্থ: পৃ. ১৫৮; মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ.-এর সীরাত: পৃ. ১১৪ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ. ১০২।]।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর মেহেরবানী, স্বীয় বুদ্ধিমত্তা ও হিকমতের মাধ্যমে এমন একটি আয়াত নির্বাচন করেন, যে আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল ও রিসালাতের মর্মবাণী উপস্থাপিত ছিল এবং তাতে এ কথা স্পষ্ট করা হলো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মাখলুকের নিকট এমন একটি কিতাব নিয়ে এসেছেন, যে কিতাব তাদের গোমরাহি থেকে হেদায়েতের দিকে ডাকে এবং তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলো, এ কিতাবের ওপর বিশ্বাস করা, তদনুযায়ী আমল করা ও তার আহকাম সম্পর্কে অবগত হওয়া বিষয়ে সর্বাগ্রে দায়িত্বশীল। যদি আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে অবিচল থাকার নির্দেশ দেন, সে বিষয়ে মুহাম্মাদই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই হলো সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি কোনো রাজত্ব চান না, ধন-সম্পদ চান না এবং ইজ্জত সম্মান লাভের প্রতি তার কোনো অভিলাষ নেই। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এগুলো সবই দিয়েছেন, যার ফলে তিনি ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার পচা-গন্ধ জিনিসের প্রতি হাত বাড়ানো থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকেন। কারণ, তিনি তার দা‘ওয়াতে একজন সত্যবাদী আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ। [মুহাম্মাদ আল গাযালী রহ.-এর সীরাত: পৃ. ১১৩]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত যে হিকমত অবলম্বন করেন, তা যে কত মহান ছিল তার বর্ণনা কখনো শেষ করা যাবে না। তিনি তার দা‘ওয়াতে ছিল সবচেয়ে সত্যবাদী। তার মধ্যে ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, ইজ্জত-সম্মান, নারী-বাড়ী, গাড়ী কোনো কিছুর প্রতি তার কোনো লোভ ছিল না। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওলিদকে সময় উপযোগী কথা শোনান যার ওপর সে অভিভূত হয়ে পড়ে এবং তার নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। এটাই হলো, প্রকৃত হিকমত ও বুদ্ধিমত্তা।

তিন:

মুশরিকরা সিদ্ধান্ত নিলো যে, ইসলাম ও মুসলিম বিরুদ্ধে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে যা যা করা দরকার আমরা তাই করব। যে দিন থেকে রাসূল প্রকাশ্যে ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়া ও জাহেলিয়্যাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ করেন, সেদিন থেকে মক্কাবাসীদের ক্রোধের আর অন্ত রইল না। তারা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। মুসলিমগণ তাদের নিকট একটি নিকৃষ্ট ও অপরাধী জাতিতে পরিণত হলো। তারা বুঝতে পারল যে, তাদের পায়ের নিচ থেকে ধীরে ধীরে মাটি সরে যাচ্ছে। নিরাপত্তা বেষ্টিত হেরম এলাকায় তাদের ধন-সম্পদ, ইজ্জত সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। ফলে তারা মুসলিমদের সাথে ঠাট্টা বিদ্রূপ, তাদের ওপর মিথ্যা-রোপ, ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, ইসলামের বিষয়ে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি, মিথ্যা অপবাদ দেওয়াসহ হাজারো ষড়যন্ত্র শুরু করে। কুরআনের অবমাননা, কুরআন সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি (কুরআন হলো পূর্বেকার লোকদের বানানো ও বানোয়াট কাহিনী) করে। এ ছাড়া তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের ইলাহগুলোর ইবাদত ও আল্লাহর ইবাদত এক সাথে চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাগল, যাদুকর, মিথ্যুক গণক ইত্যাদি বলে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালায়। কিন্তু এত কিছুর পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিন্দু পরিমাণ ও পিছপা হন নি। তিনি ধৈর্যধারণ করেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দীনের বিষয়ে তাকে সাহায্য করা হবে এ আশায় কাজ চালিয়ে যান। [দেখুন: ইমাম গাযালী রহ.-এর ফিকহুস সীরাহ: পৃ. ১০৬; আর-রাহীকুল মাখতুম পৃ. ৮০, ৮২; মাহমুদ শাকেরের তারিখে ইসলামী: ৮৫/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: ১১০।]

মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন এমন অমানবিক নির্যাতন চালাতে আরম্ভ করে, যা অনেক সময় একজন সাধারণ মুসলিমের ওপরও চালাত না। এমনকি আবূ জাহেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধুলায় মিটিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাকে আবূ জাহেলের হাত থেকে হিফাযত করে এবং তার ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়। যেমন, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আবূ জাহেল বলল, মুহাম্মাদ কি তোমাদের সামনে মাটিতে মাথা ঝুঁকায়? তাকে উত্তর দেওয়া হলো, হ্যাঁ! তখন সে বলল, লাত ও উজ্জার নামে কসম করে বলছি, আমি যদি তাকে মাটিতে মাথা ঝুঁকাতে দেখি, আমি তার ঘাড়ে পারাবো অথবা তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিব! তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাত আদায় করতে ছিল, ঠিক তখন সে উপস্থিত হলো, তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাজদায় যায়, তখন সে তার ঘাড়ে পা রাখার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল; কিন্তু সে পারলো না। যখন সে সামনের দিকে যাচ্ছিল তখন সে সামনের দিকে যেতে পারল না বরং সে আরও পিছিয়ে যাচ্ছিল এবং দু হাত দিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছিল। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কী ব্যাপার তোমার কী হয়েছে? তখন সে বলল, আমি দেখতে পেলাম আমার ও তার মাঝে আগুনের একটি পরিখা, মহা প্রলয় ও শক্তিশালী বাহু! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি সে আমার কাছে আসত, তাহলে ফিরিশতারা তাকে টুকরা টুকরা করে চিনিয়ে নিত। তিনি বলেন, তারপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [ইমাম মুসলিম মুনাফিক অধ্যায়; পরিচ্ছেদ: আল্লাহ তা‘আলার বাণীর তাফসীরে ﴿كَلا إِنَّ الإِنسَانَ لَيَطْغَى، أَن رَّآهُ اسْتَغْنَى﴾ হাদীস নং ২১৪৫/৪, ২৭৯৭। আরো দেখুন: শরহে নববী ১৪০/১৭।]

আল্লাহ তা‘আলা রাসূলকে এত বড় যালেমের হাত থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের হাজারো যুলুম নির্যাতন সহ্য করেন এবং তিনি তার জান-মাল ও সময় তার রাহে ব্যয় করেন।

চার:

ইসলামের শত্রু আবূ জাহেলের লেলিয়ে দেওয়ার কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নির্যাতনের স্বীকার হন তার বিবরণ:

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«بينما رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم يصلي عند البيت، وأبو جهل وأصحاب لـه جلوس، وقد نحرت جزور بالأمس، فقال أبو جهل : أيكم يقوم إلى سلا جزور بني فلان، فيأخذه فيضعه على ظهر محمد إذا سجد، فانبعث أشقى القوم فأخذه، فلما سجد النبي صلى الله عليه وسلم وضعه بين كتفيه، قال : فاستضحكوا، وجعل بعضهم يميل على بعض، وأنا أنظر، لو كانت لي منعة طرحته عن ظهر رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم، والنبي صلى الله عليه وسلم ساجد ما يرفع رأسه، حتى انطلق إنسان فأخبر فاطمة،

فجاءت وهي جويرية، فطرحته عنه، ثم أقبلت عليهم تشتمهم، فلما قضى النبي صلى الله عليه وسلم صلاته، رفع صوته، ثم دعا عليهم، وكان إذا دعا دعا ثلاثاً، وإذا سأل سأل ثلاثاً، ثم قال : «اللَّهم عليك بقريش« ثلاث مرات، فلما سمعوا صوته ذهب عنهم الضحك، وخافوا دعوته، ثم قال : «اللَّهم عليك بأبي جهل بن هشام، وعتبة بن ربيعة، وشيبة بن ربيعة، والوليد بن عتبة، وأمية بن خلف، وعقبة بن أبي معيط»، وذكر السابع ولم أحفظه، فوالذي بعث محمداً صلى الله عليه وسلم بالحق لقد رأيت الذي سمى صرعى يوم بدر، ثم سحبوا إلى القليب، قليب بدر» .

“একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার পাশে সালাত আদায় করছিল। আবূ জাহেল তার সাথী-সঙ্গীদের নিয়ে একটি মজলিশে বসা ছিল। বিগত দিনের যবেহকৃত একটি উটের ভূরি পড়ে আছে দেখে, আবূ জাহেল বলল, তোমাদের মধ্যে কে আছে যে অমুক গোত্রের ভুঁড়িটি নিয়ে মুহাম্মাদ যখন সাজদাহ করে তখন তার মাথার উপর রেখে দিবে? তার একথা শোনে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ (উকবা ইবন আবি মু‘ঈত) উঠে দাঁড়ালো এবং সে দৌড়ে গিয়ে ভুঁড়িটি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাজদায় গেলে তার দুই কাঁধের ওপর রেখে দেয়। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তারা হাসাহাসি করতে আরম্ভ করে। হাসতে হাসতে তারা একে অপরের ওপর ঢলে পড়ল। আমি নীরবে এ দৃশ্য দেখতে ছিলাম, আমার কিছুই করার ছিল না। সেদিন আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘাড় থেকে তা সরিয়ে দিতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাজদায় পড়ে আছেন, কোনো ক্রমেই মাথা উঠাতে পারছিল না। একজন পথিক এ দৃশ্য দেখে ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে খবর দিলেন, খবর পেয়ে সে দৌড়ে আসলেন এবং তার ঘাড়ের উপর থেকে ভুঁড়িটি সরালেন। অসহ্য হয়ে তিনি কাফিরদের সামনে এসে তাদের কিছুক্ষণ গালি-গালাজ করলেন। তারপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় সম্পন্ন করেন, তিনি উচ্চস্বরে তাদের জন্য বদ-দো‘আ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো দো‘আ করতেন তিনবার দো‘আ করতেন আবার যখন কোনো কিছু চাইতেন তখনও তিন বার চাইতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাত তুলে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের পাকড়াও কর! কাফিররা তার বদ-দোয়ার আওয়াজ শোনে, আতংকিত হয় এবং তাদের মুখের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আবূ জাহেল ইবন হিশাম, উতবা ইবন রাবিয়াহ, ওয়ালিদ ইবন উতবা, উমাইয়া ইবন খলফ ও উকবা ইবন আবি মুইত প্রমুখ ধ্বংস কর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাতজন ব্যক্তির নাম নেন, কিন্তু সপ্তম ব্যক্তির নামটি আমি ভুলে যাই। বর্ণনাকারী বলেন, যে আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যের বাণী নিয়ে দুনিয়াতে পাঠান, তার শপথ করে বলছি, রাসূল যাদের নাম নিয়েছে তাদেরকে বদরের দিন বদর প্রান্তে চিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। তারপর গলায় রশি লাগিয়ে তাদের বদর প্রান্তের কুপের দিকে টেনে হেঁচড়ে নেওয়া হয়। [সহীহ বুখারী, অযু অধ্যায়: পরিচ্ছেদ, কোনো মুসল্লীর ওপর সালাতরত অবস্থায় কোনো মরা বস্তু বা নাপাকি নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে তার সালাত বাতিল হবে না। হাদীস নং ২৪০, ৩৪৯/১ এবং সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জিহাদ। পরিচ্ছেদ: মুশরিক ও মুনাফিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব নির্যাতন করে তার বিবরণ। হাদীস নং ১৭৯৪, ১৪১৮/২।]

পাঁচ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুশরিকদের সবচেয়ে জঘন্য ও খারাপ দুর্ব্যবহারের বর্ণনা:

উরওয়া ইবন যুবাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলি,

«أخبرني بأشد ما صنع المشركون برسول اللَّه صلى الله عليه وسلم؟ قال : بينما رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم يصلي في حجر الكعبة، إذ أقبل عقبة بن أبي معيط، فأخذ بمنكب رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم ولوى ثوبه في عنقه، فخنقه خنقاً شديداً، فأقبل أبو بكر، فأخذ بمنكبه، ودفعه عن رسول اللَّه صلى الله عليه وسلم وقال : ﴿أَتَقْتُلُونَ رَجُلا أَن يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُم بِالْبَيِّنَاتِ مِن رَّبِّكُمْ» .

“মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সবচেয়ে খারাপ যে ব্যবহার করে তুমি আমাকে তার বিবরণ দাও! তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বা গৃহের পাশে সালাত আদায় করছিল ঠিক ঐ মুহূর্তে উকবা ইবন আবি মু‘ঈত এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গলা চেপে ধরল এবং কাপড় দিয়ে তার গলা পেঁচালো। তারপর খুব জোরে তার গল চেপে টানাটানি করে তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করে। এ অবস্থা দেখে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু দৌড়ে এসে তার দিকে অগ্রসর হলো এবং তার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে দূরে সরাল। তারপর বলল,

﴿أَتَقۡتُلُونَ رَجُلًا أَن يَقُولَ رَبِّيَ ٱللَّهُ وَقَدۡ جَآءَكُم بِٱلۡبَيِّنَٰتِ مِن رَّبِّكُمۡۖ﴾ [ غافر :28]

“তোমরা এমন একজন লোককে হত্যা করবে যে বলে আমার রব আল্লাহ! অথচ সে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়েই তোমাদের নিকট এসেছে”। [সূরা গাফির, আয়াত: ২৮]

এভাবে মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছে, সেসব মুসলিমদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালাত। তার সাথীরা তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করল। তার নিকট দো‘আ চাইল এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়ার জন্য আবেদন জানাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে আল্লাহর সাহায্য লাভ ও তাদের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং বললেন, শেষ পরিণতি কেবলই মুত্তাকীদের জন্য।

খাব্বাব ইবন আরত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বা ঘরের ছায়াতলে একটি চাদরকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে ছিল। আমরা তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তখন রাসূল আমাদের বললেন,

«قد كان من قبلكم يؤخذ الرجل فيحفر لـه في الأرض، فيجعل فيها، فيجاء بالمنشار فيوضع على رأسه فيجعل نصفين، ويمشط بأمشاط الحديد [ ما دون عظامه من لحم وعصب ] ، فما يصده ذلك عن دينه، واللَّه ليُتَمَّنَّ هذا الأمر، حتى يسير الراكب من صنعاء إلى حضرموت لا يخاف إلا اللَّه والذئب على غنمه، ولكنكم تستعجلون» .

“তোমাদের পূর্বের উম্মতদের অবস্থা ছিল, তাদের একজন লোককে ধরে আনা হত, তারপর যমীনে তার জন্য গর্ত খনন করা হত এবং তাতে তাকে নিক্ষেপ করত। তারপর তার জন্য করাত আনা হত, আর সে করাত দ্বারা তার মাথাকে দ্বিখণ্ড করে তাকে হত্যা করা হত। আবার কোনো কোনো সময় কাউকে কাউকে লোহার চিরুনি দিয়ে আচড় দিয়ে তার হাড় থেকে মাংস ও চামড়া তুলে নিয়ে আলাদা করা হত। এত বড় নির্যাতন সহ্য করা সত্ত্বেও তাদেরকে দীন থেকে এক চুল পরিমাণও এদিক সেদিক করতে পারত না। (রাসূল বলেন) আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই এ দীনকে পরিপূর্ণ করবে। এমনকি একজন সফরকারী সুনায়া থেকে হাজরা-মাওত পর্যন্ত নিরাপদে ভ্রমণ করবে, সে তার নিরাপত্তার জন্য একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। তবে তোমরা হলে এমন জাতি, যারা তাড়াহুড়াকে পছন্দ কর”। [সহীহ বুখারী, কিতাবুল মানাকেব পরিচ্ছেদ: ইসলামে নবুওয়াতের আলামত ৬১৯/৬, ৩৬১২। আনসারীদের মানাকেব অধ্যায়: পরিচ্ছেদ, মক্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ মক্কায় মুশরিকদের পক্ষ থেকে যেসব নির্যাতনের সম্মুখীন হন, তার বর্ণনা। কিতাবুল ইকরাহ।]

নিরপরাধ মুসলিমদের ওপর মুশরিকদের নির্যাতন দিন দিন আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছিল। আল্লাহর ওপর ঈমান আনা, হক গ্রহণ করা, আল্লাহর দীনের ওপর অবিচল থাকা এবং নিরেট তাওহীদের প্রতি দা‘ওয়াত ও মূর্তিপূজাকে প্রত্যাখ্যান করাই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ।

ছয়:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারী মুসলিমদের ওপর শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত নন, বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার আনিত দীনের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও ক্ষোভ এতই তীব্র ছিল, শেষ পর্যন্ত তারা কোনো প্রকার উপায় অন্তর না দেখে তার নামকেও সহ্য করতে পারত না। ফলে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামটিকে বিকৃত ও পরিবর্তন করে দেয়। প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ বশত যে নামটি দ্বারা তার প্রশংসা বোঝাতো অর্থাৎ মুহাম্মাদ তা পরিবর্তন করে, যে নাম দ্বারা তার বদনাম বুঝায় অর্থাৎ মুযাম্মাম, সে নাম বলে ডাকতে আরম্ভ করে। আর যখন তারা তার নাম উল্লেখ করত, তখন তারা বলত, আল্লাহ তা‘আলা মুযাম্মাম এর সাথে এ আচরণ করেন। অথচ মুযাম্মাম তার নাম নয় এবং এ নামে তিনি পরিচিতিও নয়। [দেখুন: ফতহুল বারী: ৫৫৮/৬।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«ألا تعجبون كيف يصرف اللَّه عني شتم قريش، ولعنهم؟ ! يشتمون مذمماً، ويلعنون مذمماً، وأنا محمد»

“তোমরা কি আশ্চর্যবোধ কর না! আল্লাহ তা‘আলা কীভাবে কুরাইশদের অভিশাপ ও গাল-মন্দকে আমার থেকে প্রতিহত করেন। তারা মুযাম্মামকে গালি দেয় ও অভিশাপ করে, আমি মুযাম্মাম নই আমি হলাম মুহাম্মাদ। [সহীহ বুখারী, কিতাবুল মানাকেব, হাদীস নং ৫৫৪/৬, ৩৫৩৩।] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাঁচটি নাম আছে। তার মধ্যে তার একটি নামও মুযাম্মাম নেই”। [সহীহ বুখারী, কিতাবুল মানাকেব, হাদীস নং ৫৫৪/৬, ৩৫৩৩।]

সুরা লাহাব অবতীর্ণ হওয়ার পর আবূ লাহাবের স্ত্রী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসে। তখন তার হাতে এক মুষ্টি পাথর ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু কে সাথে নিয়ে মসজিদে বসা ছিলেন। সে তাদের উভয়ের কাছে আসলে, আল্লাহ তা‘আলা তার দৃষ্টি থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আড়াল করে ফেলে। ফলে সে এক মাত্র আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছাড়া আর কাউকে দেখতে পারছিল না। সে বলল, হে আবু বকর! তোমার সাথি কোথায়? আমার নিকট সংবাদ পৌঁছেছে, সে নাকি আমার দুর্নাম করে! আমি শপথ করে বলছি! আজ যদি আমি তাকে পেতাম, তাহলে আমি এ পাথর গুলো তার মাথায় নিক্ষেপ করতাম। একটি কথা মনে রাখবে, আমি একজন কবি এ বলে সে একটি কাব্য বলে,

مُذَممــــــــاً عصينا

وأمره أبينا ودينه قلينا

“আমরা মুযাম্মামকে প্রত্যাখ্যান করলাম, তার নির্দেশকে অস্বীকার করলাম এবং তার দীনকে ঘৃণা করলাম।”

মুশরিকরা মুসলিমদের ওপর সব ধরনের যুলুম নির্যাতন অবিরাম চালিয়ে যেতে লাগল। মুসলিমদের জন্য তাদের যুলুম-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় অবশিষ্ট রইল না। কিন্তু তাদের যুলুম নির্যাতন সত্ত্বেও মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে লাগল। মুসলিমদের সংখ্যা যত বাড়তে ছিল, তাদের নির্যাতন করার মাত্রাও দিন দিন বাড়তে ছিল। তারা মুসলিমদের ওপর যুলুম নির্যাতনের সাথে সাথে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপপ্রচার ও তথ্য সন্ত্রাস চালাত। আল্লাহর হিফাযত ছাড়া তাদের বাঁচার আর কোনো উপায় ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আল্লাহর হিফাযতে ছিলেন। তারপর তার চাচা আবূ তালিব মক্কায় তাকে নিরাপত্তা দেন; যার কারণে তার নিরাপত্তা নিয়ে তেমন কোনো আতংক ছিল না। কিন্তু রাসূলের সাথে যারা ঈমান আনছিল সেসব মুসলিমদের ওপর কাফিরদের নির্যাতন কোনো ক্রমেই বাধা দিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। মুশরিকদের নির্যাতনের ফলে অসহ্য হয়ে অনেকেই মারা যান, আবার কেউ কেউ এমন আছেন, যারা তাদের যুলুম নির্যাতন সহ্য করে কোনো রকম বেঁচে আছেন। মুসলিমদের এহেন নাজুক পরিস্থিতি দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি পেয়ে সর্বপ্রথম বারোজন সাহাবী চারজন নারী উসমান ইবন আফ্‌ফানের নেতৃত্বে আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত আরম্ভ করেন। তারা যখন সমুদ্রের তীরে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য দু’টি নৌকার ব্যবস্থা করে দেন। এ দু’টি নৌকা যোগে তারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আবিসিনিয়ার মাটিতে পৌঁছেন। এ ঘটনাটি ছিল নবুওয়াতের পঞ্চম বছর রজব মাসে। কুরাইশরা মুসলিমদের হিজরতের খবর জানতে পেরে, কোনো প্রকার কাল বিলম্ব না করে তাদেরকে ধরার জন্য পিছু নেয় এবং অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়ে। তালাশ করতে করতে তারা একেবারে নদীর সন্নিকটে পৌঁছে। কিন্তু তথায় তারা কাউকে পায় নি এবং মুসলিমদের ধরার যে চেষ্টা তারা চালিয়েছিল তা ব্যর্থ হয়। এ দিকে মুসলিমগণ নিরাপদে আবিসিনিয়ায় পৌঁছে যায় এবং সেখানে তারা নিরাপদে বসবাস করতে থাকে। কয়েকদিন পর তাদের নিকট খবর পৌঁছল, কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এখন আর কষ্ট দেয় না এবং তারা ইসলামের আনুগত্য মেনে নেয়। এ খবর শুনে তারা আবিসিনিয়া থেকে পুনরায় মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। তারা যখন মক্কার নিকট এসে পৌঁছল, তখন জানতে পারল, তাদের নিকট যে খবরটি পৌঁছল, তা ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তারা কেউ কেউ আবার আবিসিনিয়ায় ফিরে গেল আর কেউ কেউ আশ্রয় নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করল। যারা মক্কায় প্রবেশ করল, তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন মাসূদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিল অন্যতম। আবার কেউ কেউ কারো কোনো আশ্রয় না নিয়ে গোপনে মক্কায় প্রবেশ করে। এ ঘটনার পর মুসলিমদের ওপর কাফিরদের নির্যাতন আরও বৃদ্ধি পেল। যারা মক্কায় প্রবেশ করছে, তাদের প্রতি মুশরিকদের নির্যাতনের মাত্র আরও বাড়িয়ে দিল। অবস্থার অবনতি দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি পেয়ে তিরাশি জন মুসলিম যাদের মধ্যে আম্মার ইবন ইয়াসের ও নয়জন নারী ছিল, তারা সবাই আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এরা আবিসিনিয়ায় নাজ্জাশী বাদশাহ’র অধীনে নিরাপদে বসবাস করছিল। মক্কার মুশরিকরা যখন জানতে পারল, এরা আবিসিনিয়ায় অবস্থান করছে, তখন তারা নাজ্জাশী বাদশাহ’র নিকট উপটৌকন দিয়ে মুসলিমদের বিপক্ষে কতক লোক পাঠালেন, তারা তাকে প্রস্তাব দিল, সে যেন মুসলিমদেরকে তার দেশ থেকে বের করে দিয়ে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়। নাজ্জাশী বাদশাহ তাদের থেকে বিস্তারিত জানার পর তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুসলিমদের তাদের হাতে তুলে দিতে নারাজি প্রকাশ প্রকাশ করেন। বাদশাহ তাদের হাদিয়া গ্রহণ না করে, হাদীয়া তাদের হাতে ফেরত দেন। তারপর মুসলিমগণ আবিসিনিয়ায় নিরাপদে অবস্থান করতে থাকেন। কিন্তু খাইবরের তারা বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবার ফিরে আসেন। [দেখুন: যাদুল মা‘আদ ২৩/৩, ৩৬, ৩৮; সীরাতে ইবন হিশাম ৩৪৩/১; ইমাম যাহবী রহ.-এর তারিখুল ইসলাম সীরাত অধ্যায় পৃ. ১৮৩; বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৬৬/৩, মাহমুদ শাকের রহ.-এর তারিখে ইসলামী ১০৯, ৯৮/২ এবং হাযাল হাবীবু ইয়া মুহিব্ব: পৃ. ১২০, আর-রাহীকুল মাখতুম ৮৯।]

আট:

কুরাইশরা ইসলামের অগ্রযাত্রা, মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া এবং আবিসিনিয়ায় যারা হিজরত করছে, তাদের প্রতি বাদশাহ নাজাসীর ইতিবাচক মনোভাব, ইজ্জত, সম্মান ও মেহমানদারি দেখে ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা আরও বহুগুণে বেড়ে গেল। তারা নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আরম্ভ করে। বনী হাসেম, বনী আব্দুল মুত্তালিব ও বনী আবদে মুনাফের বিরুদ্ধে তারা বয়কট করার বিষয়ে একমত হয়। তারা ঘোষণা দিল, যতদিন পর্যন্ত মুহাম্মাদকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া না হবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের সাথে কোনো বেচা-কেনা করবে না, বিবাহ-সাদী দিবে না, কোনো প্রকার কথা-বার্তা, উঠা-বসা ও লেন-দেন করবে না। তারা এ বিষয়ে একটি চুক্তিনামা তৈরি করে, কাবা ঘরের গিলাফের সাথ ঝুলিয়ে দেয়। একমাত্র আবূ লাহাব ছাড়া বনী হাশেম, বনী মুত্তালিবের মুমিন কাফির সবাই এ চুক্তির কারণে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে যায়। আবূ লাহাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরুদ্ধে কাফিরদের সহযোগী ছিলেন বলে, তাকে কাফিররা তাদের দলের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের সপ্তম বছর মুহাররমের চাঁদে কাফিররা তাকে শুয়াবে আবী তালেবে গৃহবন্দী করে রাখে এবং তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে তারা অতি কষ্টে বন্দীদশায় জীবন যাপন করতে থাকে। প্রায় তিন বছর পর্যন্ত তাদের খাদ্য ও পানীয় সাপ্লাই দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে এবং তাদের সাথে যাবতীয় লেন-দেন করা থেকে বিরত থাকে। ফলে তাদের কষ্টের আর কোনো অন্ত রইল না। সীমাহীন দূর্ভোগের মধ্যে তাদের জীবন যাপন করতে হয়। এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় শুয়াবে আবি তালিবের অভ্যন্তর থেকে বাচ্চাদের কান্নাকাটির আওয়াজ ও চিৎকার বাহির থেকে শোনা যেত। এভাবে তিন বছর অতিবাহিত হয়। তারপর আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুক্তিনামা সম্পর্কে জানিয়ে দেন যে, একটি উই পোকা পাঠানো হয়েছে, সে একমাত্র আল্লাহর নাম ছাড়া আর যেসব শর্তাবলী তাতে লেখা ছিল, তা সবই খেয়ে ফেলছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চাচা আবূ তালিবকে বিষয়টি জানালে, তিনি কুরাইশদের নিকট গিয়ে বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছে, তোমাদের চুক্তি নামায় একমাত্র আল্লাহর নামের অংশ ছাড়া বাকী সবটুকু অংশ পোকা খেয়ে ফেলছে। যদি সে তার কথায় মিথ্যুক হয়, আমি তাকে তোমাদের সোপর্দ করে দিব। আর যদি সত্যবাদী হয়, তাহলে তোমরা আমাদের সাথে যে চুক্তি করছ, তা থেকে ফিরে আসবে এবং আমাদের ওপর যুলুম অত্যাচার করা থেকে বিরত থাকবে। তারা সবাই সমস্বরে বলল, তুমি একটি ইনসাফ-পূর্ণ কথা বলেছে! তারপর তারা চুক্তিনামাটি নামাল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সংবাদ দিলেন, ঠিক সেভাবেই দেখতে পেল। এ ঘটনার পর তারা চুক্তি থেকে ফিরে আসা-তো দূরের কথা, বরং তাদের কুফরি আরো বৃদ্ধি পেল। নবুওয়াত লাভের দশ বছর পর, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথীরা শুয়াবে আবূ তালিবের বন্দীশালা থেকে বের হন। এ ঘটনার মাত্র ছয় মাস পর আবূ তালিব দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেয়। আবূ তালিবের মৃত্যুর তিন দিন পর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মীনী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা মারা যান। [সীরাতে ইবন হিশাম ৩৭১/১; ইমাম যাহাবী রহ.-এর তারিখুল ইসলাম, সীরাত অধ্যায় পৃ. ১২৬, ১৩৭; বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৬৪/৩; যাদুল মা‘আদ ৩০/৩; মাহমুদ শাকের রহ.-এর তারিখে ইসলামী ১০৯/২ এবং আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ. ১১২।]

চুক্তি ভঙ্গ হওয়ার পর, সামান্য সময়ের ব্যবধানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই সহযোগী আবূ তালিব ও খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যু হয়। তাদের উভয়ের মৃত্যুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। মুশরিকরা তাদের মৃত্যুকে তাদের জন্য সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায়। মুশরিকদের পক্ষ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায় এবং তাদের দুঃসাহস সীমা ছড়িয়ে যায়। তাদের মৃত্যুর পর সগোত্রের কাফিরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফের অধিবাসীরা তার দা‘ওয়াতে সাড়া দিবে, তার কাওমের বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করবে অথবা তাকে আশ্রয় দিবে এ আশা নিয়ে তায়েফ গমনের সংকল্প করেন। কিন্তু আশা আশাই থাকল, বাস্তবায়ন হলো না। সেখানে তিনি কোনো সাহায্যকারী কিংবা আশ্রয়দাতা ও ইসলাম গ্রহণকারী না পেয়ে সেখান থেকেও হতাশ হয়ে আবারো মক্কায় ফিরে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফে তায়েফের অধিবাসীদের থেকে এমন যুলুম নির্যাতনের সম্মুখীন হন, যা মক্কার কাফিরদের যুলুম-নির্যাতনকেও হার মানিয়ে দেয়। [যাদুল মা‘আদ: ৩১/৩, রাহীকুল মাখতুম পৃ. ১১৩।]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন