HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

একজন ঈমানদার দা‘ঈর গুণাবলী

লেখকঃ মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
একজন ঈমানদার দা‘ঈর গুণাবলী

মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকা
একজন মু’মিনকে দেখে অপর একজন বিধর্মী ঈমান গ্রহণ করে, যা আমরা রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর যুগে এবং তৎপরবর্তী যুগে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই। তাই তাকে অবশ্যই কতিপয় গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে যা দ্বারা মানুষ তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। নিম্নে সে সকল গুণাবলীর উল্লেখযোগ্য কতিপয় গুণাবলী উল্লেখ করা হল:

ঈমানদার হওয়া
১. ঈমানদার হওয়া: ঈমান একজন মানুষকে আল্লাহ্, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ যাবতীয় বিষয়ের প্রতি দৃঢ় ও পূর্ণাঙ্গ আস্থাশীল করতে শেখায়। একজন ঈমানদার নিজেকে এবং তার ধ্যান ধারণা, আবেগ, অনুভূতি সবকিছুকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেন। ঈমান তাঁকে সব সময় কর্তব্য কাজে নিয়োজিত রাখে এবং ভাল কাজে উৎসাহ দেয়। এ ঈমানের বলে বলীয়ান হয়েই সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নেতৃত্বে মাত্র ৩১৩ জনের ক্ষুদ্র একটি নিরস্ত্র দল অস্ত্রে-সস্ত্রে সজ্জিত কাফিরদের বদর প্রান্তরে পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মু’মিনকে যে আদর্শের অনুসারী সে আদর্শের উপর দৃঢ় ও অবিচল ঈমান রাখতে হবে।

নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার
2. নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার: একজন দা'ঈ ন্যায়বিচার ও পক্ষপাতহীন আচরণ নিশ্চিত করবেন। এ ক্ষেত্রে তাকে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, আঞ্চলিকতা কিংবা জাতীয়তার উর্ধ্বে থাকতে হবে। এর মাধ্যমে দা'ঈর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تُؤَدُّواْ ٱلۡأَمَٰنَٰتِ إِلَىٰٓ أَهۡلِهَا وَإِذَا حَكَمۡتُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ أَن تَحۡكُمُواْ بِٱلۡعَدۡلِۚ إِنَّ ٱللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ سَمِيعَۢا بَصِيرٗا ٥٨ ﴾ [ النساء : ٥٨ ]

“নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দেন যে, তোমরা আমানত পৌঁছে দাও তার প্রাপকদের কাছে। আর যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক বিচার করবে। আল্লাহ্ যে উপদেশ তোমাদের দেন তা কত উত্তম! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সব শোনেন, সব দেখেন।’’ [. সূরা আন-নিসা: ৫৮।]

বিনয় ও কোমলতা
৩. বিনয় ও কোমলতা: একজন মুসলিম হবেন অত্যন্ত বিনয়ী ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি অন্যান্য মুমিনদেরকে বটবৃক্ষের মত ছায়া দান করবেন যেন তার মাধ্যমে অন্যকে স্বীয় আদর্শে আকৃষ্ট করা যায়। আর কঠোরতা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল ও নবীদের সর্দার হওয়া সত্ত্বেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণ ছিল বিনয়পূর্ণ ও কোমলতায় ভরপুর। তাঁর এ প্রশংসায় আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ فَبِمَا رَحۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ وَلَوۡ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ ٱلۡقَلۡبِ لَٱنفَضُّواْ مِنۡ حَوۡلِكَۖ فَٱعۡفُ عَنۡهُمۡ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ ﴾ [ ال عمران : ١٥٩ ]

“আর আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত থাকার দরুন আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন ; কিন্তু যদি আপনি কর্কশ স্বভাব ও কঠোর হৃদয় হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং আপনি তাদের মাফ করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন। ... [. সূরা আলে ‘ইমরান, ৩ : ১৫৯।]

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় জানা যায়, “নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ঐ ব্যক্তি যে তার অধীনস্ত লোকদের প্রতি কঠোর। তোমরা সতর্ক থাকবে যাতে তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না পড়।’’ [. মুসলিম, হাদীস নং-৮২।]

ভদ্রতা, নম্রতা ও শালীনতা মানব জীবনের এক মহৎ গুণ। বিনয়-নম্রতা মানব চরিত্রের ভূষণ। এসব গুণের কারণে মানুষ সমাজে নন্দিত ও প্রশংসিত হয়। আর এসব গুণের অভাবে মানুষ নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, অপমানিত ও নিন্দিত হয়। মহান আল্লাহ নিজে নম্র,তিনি নম্রতাকে পছন্দ করেন, ভালবাসেন। তাই প্রত্যেক দা'ঈ, মু’মিন ও মুসলিমের উচিত সকল ক্ষেত্রে নম্রতাকে অবলম্বন করা। আল্লাহ বলেন:

﴿ خُذِ ٱلۡعَفۡوَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡعُرۡفِ وَأَعۡرِضۡ عَنِ ٱلۡجَٰهِلِينَ ١٩٩ ﴾ [ الاعراف : ١٩٩ ]

“ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, সৎকাজের আদেশ দাও, মূর্খ লোকদের এড়িয়ে চল।” [. সূরা আল-আ‘রাফ ১৯৯।] এ আয়াতে আদর্শবান হওয়ার জন্য আল্লাহ ৩টি গুণ অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। (১) ক্ষমাশীল হওয়া। ক্ষমার মাধ্যমে মানুষ মহৎ হতে পারে। (২) সৎকাজের আদেশ দেওয়া। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে মানুষকে সদা পাপকাজে লিপ্ত করার চেষ্টা করে। এজন্য মানুষকে শয়তানের কবল থেকে রক্ষার জন্য মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে সৎকাজের আদেশ দেয়া। অনুরূপভাবে অন্যায়-অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার জন্য মানুষকে বাধা দিতে হবে। যাতে তারা ঐসব কাজ থেকে বিরত থাকে। (৩) মূর্খদের সংসর্গ পরিহার করা। তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা। অর্থাৎ তাদের অন্যায় কাজের সমর্থক ও সহযোগী না হওয়া।

অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন:

﴿وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ﴾ [ المائ‍دة : ٢ ]

‘তোমরা কল্যাণকর কাজে ও পরহেযগারিতার ব্যাপারে একে অন্যকে সহযোগিতা কর। পাপ ও সীমালংঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর না। [. সূরা আল-মায়েদাহ: ২] এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা করার এবং আল্লাহর নাফরমানী বা অবাধ্যতার কাজে সহযোগিতা না করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ নির্দেশ মান্য করা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তিনি আরো বলেন:

﴿ وَٱلۡعَصۡرِ ١ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَفِي خُسۡرٍ ٢ إِلَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ ٣ ﴾ [ العصر : ١، ٣ ]

‘যুগের শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ মহা ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, নেক আমল করেছে, পরস্পরকে হকের উপদেশ দিয়েছে এবং ধৈর্যধারণের উপদেশ দিয়েছে। [. সূরা আসর: ১-৩]

আদী ইবনু হাতেম রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাক এক টুকরা খেজুর দিয়ে হলেও। আর যদি তা না পাও তবে উত্তম কথার মাধ্যমে। [. বুখারী, হাদীস নং ১৪১৩] উক্ত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদেরকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভের জন্য দু’টি জিনিসের মাধ্যমে চেষ্টা করতে বলেছেন। (১) দান করার মাধ্যমে, যদিও সে দান অতি সামান্য জিনিসও হয়। অন্য বর্ণনায় খেজুরের ছাল পরিমাণ জিনিস হলেও। (২) উত্তম কথার মাধ্যমে। অর্থাৎ দান করার মত কোন জিনিস না পেলে সে যেন উত্তম বাক্য বিনিময় করে। মাসরূক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা আব্দুল্লাহ ইবনু আমরের নিকটে গেলাম, যখন তিনি মু‘আবিয়ার সাথে কুফায় গমন করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা উল্লেখ করে বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশালীন ছিলেন না। ইচ্ছা করেও অশালীন কথা বলতেন না। তিনি আরও বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম, যার স্বভাব-চরিত্র উত্তম। [. বুখারী, হাদীস নং-৩৫৫৯,] উক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উত্তম চরিত্রের ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। এ ধরনের ব্যক্তি সমাজে নন্দিত ও সমাদৃত হয়। পক্ষান্তরে চরিত্রহীন মানুষ সমাজে নিন্দিত ও নিগৃহীত হয়। এজন্য মুসলিম জাতিকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে কোমলতা ও নম্রতা অবলস্বন সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ فَبِمَا رَحۡمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ لِنتَ لَهُمۡۖ وَلَوۡ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ ٱلۡقَلۡبِ لَٱنفَضُّواْ مِنۡ حَوۡلِكَۖ فَٱعۡفُ عَنۡهُمۡ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ وَشَاوِرۡهُمۡ فِي ٱلۡأَمۡرِۖ فَإِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ ١٥٩ ﴾ [ ال عمران : ١٥٩ ]

‘আল্লাহর রহমতে আপনি কোমল হৃদয়ের হয়েছেন। আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আর কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলার উপরে ভরসা করুন। আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালবাসেন।” [. সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

এ আয়াতে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কয়েকটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। যথা:

(১) কোমল স্বভাবের হওয়া (২) রূঢ় প্রকৃতির না হওয়া (৩) মানুষদের প্রতি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা (৪) তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চাওয়া (৫) যে কোনো কাজে তাদের সাথে পরামর্শ করা (৬) সকল কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করা। এসব হচ্ছে আদর্শ মানুষের গুণাবলী।

জারীর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যাকে কোমলতা বা নম্রতা হতে বঞ্চিত করা হয় তাকে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়। [. আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৭৫; ইবনু মাজাহ, হাদীস নং-৩৬৭৭]

উপরোক্ত হাদীস হতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মুসলিম নারী-পুরুষ সকলকেই কোমলতা ও নম্রতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা কোমলতা হচ্ছে মানব চরিত্রের এক অনুপম বৈশিষ্ট্য। যার অভাবে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতের অনেক কিছু হতে বঞ্চিত হয়। আবার ঐ গুণের কারণে মানুষ ইহকালে ও পরকালে প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হয়। এই গুণের দ্বারাই মানুষ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে। আর এ গুণের অভাবে মানুষের পার্থিব জীবনে নেমে আসে অশান্তির ঘনঘটা। তাই নারীপুরুষ সবাইকে এ গুণ অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে।

আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য
৪. আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য: একজন মু’মিনকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে হবে এবং তিনি প্রতিটি পদক্ষেপেই ইসলামের নির্দেশিত পন্থা অনুসরণ করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [ النساء : ٥٩ ]

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ফায়সালার অধিকারী। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ কর, তবে তা প্রত্যর্পণ কর আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি যদি তোমরা ঈমান এনে থাক আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি। আর এটাই উত্তম এবং পরিণামে কল্যাণকর।’’ [. সূরা আন-নিসা, ৪ : ৫৯।]

চিন্তা ও মতামতের স্বাধীনতা
৫. চিন্তা ও মতামতের স্বাধীনতা: একজন সত্যিকার মুমিন তার মুমিন ভাইয়ের গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন। তার ভুল ত্রুটি দেখলে দোষ না খুঁজে সমালোচনা না করে সংশোধনের ব্যবস্থা করবেন। কেননা দ্বীন হচ্ছে পারস্পরিক কল্যাণ কামনা। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, “দ্বীন হচ্ছে নসীহত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন: কার জন্য হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন: আল্লাহ্, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গের এবং তাদের সাধারণ অনুসারীদের জন্য।’’ [. মুসলিম, হাদীস নং-৮২।]

উত্তম চরিত্র
৬. উত্তম চরিত্র: চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। বক্তৃতা, বিবৃতি ও ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে যা সম্ভব হয় না তা চারিত্রিক মাধুর্য্য দিয়ে অর্জিত হয়। এ জন্য মু’মিনকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। কথা ও কাজের সাদৃশ্য থাকবে। আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য রক্ষা করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفۡعَلُونَ ٢ ﴾ [ الصف : ٢ ]

“হে মু’মিনগণ তোমরা যা কর না তা কেন বল।’’ [. সূরা আল-হুজুরাত, ৪৯ : ২।]

সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করা
৭. সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করা: একজন মু’মিনকে সর্বদা গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿فَإِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ ١٥٩ ﴾ [ ال عمران : ١٥٩ ]

“...আর যখন কোন সংকল্প করেন তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ভালবাসেন তাঁর উপর ভরসাকারীদের।’’ [. সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯।]

১০
ভুল স্বীকার করার মনোবৃত্তি থাকা
৮. ভুল স্বীকার করার মনোবৃত্তি থাকা: একজন মু'মিন এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে নিজ কাজ ও নিজের প্রতি আস্থা সৃষ্টি হয়। কেননা আমরা সবাই মানুষ, আর মানুষ মাত্রই ভুল করে, কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়, তাই কোনো সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রতীয়মান হলে তা বিনয়ের সাথে স্বীকার করতে হবে। অনুরূপভাবে অপরের ভুলকে ক্ষমা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

১১
প্রজ্ঞা ও উত্তম ভাষণের মাধ্যমে আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদান
৯. প্রজ্ঞা ও উত্তম ভাষণের মাধ্যমে আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদান: একজন ইসলামী দা'ঈকে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় মানুষদেরকে দাওয়াত প্রদান করতে হবে যাতে মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ইসলামের দিকে ধাবিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥ ﴾ [ النحل : ١٢٥ ]

“আপনি আহবান করুন মানুষকে আপনার রবের পথের দিকে হিকমত ও উত্তম পন্থায়। নিশ্চয় আপনার রব সে ব্যক্তিকে বিশেষভাবে জানেন যে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং তিনি সৎপথগামীদেরকেও ভালভাবে জানেন।’’ [. সূরা আন-নাহল, ১৬ : ১২৫]

১২
মুজাহাদায়ে নফস
১০. মুজাহাদায়ে নফস: আমাদের প্রত্যেককে নিজের মনের সাথে লড়াই করে প্রথমে তাকে মুসলিম ও আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগত বানাতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় জানা যায়, “ফুদালা ইবন ‘উবায়দ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, সেই প্রকৃত মুজাহিদ, যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের নফসের সাথে সংগ্রাম করে।’’ [. আবূ ‘আব্দুল্লাহ, আহমাদ ইব্ন হাম্বল, আল-মুসনাদ, (মিশর : কর্ডোভা, তা.বি.), ৬ষ্ঠ খ., পৃ. ২০ ও ২২, হাদীস নং-২৩৯৯৭ ও ২৪০১১।]

১৩
হিজরত তথা নাফরমানী পরিত্যাগ করা
১১. হিজরত তথা নাফরমানী পরিত্যাগ করা: আমরা হিজরত বলতে দেশত্যাগ বুঝি। তা যেমন সত্য তেমনি আল্লাহ্ তা‘আলার নাফরমানী থেকে পালিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের দিকে অগ্রসর হওয়াও হিজরত। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: ...রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল সর্বোত্তম হিজরত কি? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি সে সব কাজ পরিহার করবে যা আল্লাহ্ তা‘আলা অপছন্দ করেন। [.আত-তাবারানী, আল-মু‘জামুল আওসাত, ৭ম খ., পৃ. ২৭, হাদীস নং-৬৭৫০।]

মূলত ভিতরের বিদ্রোহী তথা নিজের কূপ্রবৃত্তি যদি অনুগত না হয়, তাহলে মানুষের দেশত্যাগ করা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট নিতান্তই মূল্যহীন। অতএব ঈমানদারকে এ মহৎ গুণটি অবশ্যই অর্জন করতে হবে।

১৪
ইসলামের জন্য উৎসর্গ হওয়ার মনোভাব:
১২. ইসলামের জন্য উৎসর্গ হওয়ার মনোভাব: মু’মিন হিসেবে সকলকে অবশ্যই ইসলামের জন্য উৎসর্গ হওয়ার মনোভাব তৈরী করতে হবে। এ প্রসঙ্গে একাধিক হাদীসের ভাষ্যে গোপন প্রকাশ্য সকল অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারও প্রতি সদয় থাকি অথবা ক্রুদ্ধ, সকল অবস্থায় ইনসাফ যেন কায়েম করি। দারিদ্র্য অথবা আর্থিক সাচ্ছল্য উভয় অবস্থায় যেন সততা ও ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারি। যে আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে তার সাথে যেন সম্পর্ক স্থাপন করি। যে আমাকে বঞ্চিত করে তাকে যেন দান করি। কেউ আমার উপর জুলুম করলে তাকে যেন মাফ করে দিই। আমার নীরবতা যেন সৎ চিন্তায় পরিণত হয়। আমার কথাই যেন আল্লাহর ইবাদত হয়। আমার দৃষ্টি হয় শিক্ষণীয়।

১৫
বুদ্ধিমত্তার সাথে কার্য সম্পাদন করা
১৩. বুদ্ধিমত্তার সাথে কার্য সম্পাদন করা: একজন দা'ঈ ও মু’মিনকে অবশ্যই মেধাবী হতে হবে। কেননা যদি মেধাবী শক্তিতে সে অপরিপক্ক হয় তাহলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল হতে পারে। কুর’আনে এ বুদ্ধিমত্তাকে হিকমত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি হলো আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি নি‘য়ামত। এ প্রসঙ্গে বলেন:

﴿ يُؤۡتِي ٱلۡحِكۡمَةَ مَن يَشَآءُۚ وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِيَ خَيۡرٗا كَثِيرٗاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٦٩ ﴾ [ البقرة : ٢٦٩ ]

“তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত প্রদান করা হয় সে তো প্রচুর কল্যাণ প্রাপ্ত হয়। জ্ঞানবানরা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না।’’ [. সূরা আল-বাকারাহ : ২৬৯।]

১৬
শক্তিমত্তা
১৪. শক্তিমত্তা: একজন দা'ঈকে অবশ্যই শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। দা'ঈ তার কার্যক্রম ও দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “দুর্বল মু’মিনের চেয়ে শক্তিশালী মু’মিন আল্লাহর নিকট উৎকৃষ্ট ও অধিক প্রিয়।’’ [. মুসলিম, আস-সহীহ, ১৩ তম খ., পৃ. ১৪২, হাদীস নং-৪৮১৬।]

১৭
আমানত প্রবণতা
১৫. আমানত প্রবণতা: আমানত প্রবণতা মু’মিনের জীবনে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং অপরিহার্য গুণ। এটাই একজন মু’মিনের বড় পরিচয়। আর যারা খিয়ানতকারী তাদের কথায় মানুষ আস্থা পোষণ করে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِأَمَٰنَٰتِهِمۡ وَعَهۡدِهِمۡ رَٰعُونَ ٨ ﴾ [ المؤمنون : ٨ ]

“আর যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে।’’ [. সূরা আল-মু’মিনুন : ৮; অনুরূপ সূরা আল-মা‘আরিজ: ৩২।]

আমানত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা রক্ষা করা প্রত্যেক মু’মিনের প্রতি আবশ্যক করা হয়েছে। আমানতের খিয়ানতকারীকে ঈমানহীন বলা হয়েছে। সেজন্য প্রত্যেককে আমানত রক্ষা করে চলতে হবে। খিয়ানতকারীর জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ্ বলেন: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা জেনেশুনে আল্লাহ্ এবং তাঁ র রাসূলের সাথে খিয়ানত কর না এবং নিজেদের আমানতের খিয়ানত কর না’। [. সূরা আল-আনফাল: ২৭] খিয়ানত দুই প্রকার। ১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের বিধান অমান্য করার মাধ্যমে খিয়ানত। ২. মানুষের গচ্ছিত সম্পদ ভক্ষণ করা কিংবা রক্ষিত জিনিস বিনষ্ট করার মাধ্যমে খিয়ানত করা। এ উভয় প্রকার খিয়ানত হতে বেঁচে থাকা আবশ্যক। অপর একটি আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন: আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন মালিকের নিকটে আমানত পৌঁছে দেওয়ার জন্য’। [. সূরা আন-নিসা: ৫৮]

আবু উমামা ইয়াস ইবনু ছা‘লাবা আল-হারেছী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মিথ্যা শপথ করে যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের হক আত্মসাৎ করবে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করেছেন। এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল! যদি সামান্য বস্তুও হয়? তিনি বললেন: পিলু গাছের একটি ডালই হোক না কেন’?। [. মুসলিম, হাদীস নং-১৩৭]

এ হাদীস বুঝা যায় যে, সামান্য জিনিসও আত্মসাৎ করে থাকে, তবুও জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম অবধারিত। সুতরাং আত্মসাৎ করা কোন আদর্শ পুরুষের কাজ নয়। প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য আত্মসাৎ পরিহার করা অবশ্য কর্তব্য। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে গণীমতের মালে খেয়ানত করা যে জঘন্যতম অপরাধ এবং এর পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ, এ সম্পর্কে আলোচনা করার পর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বললেন: ক্বিয়ামতের দিন আমি তোমাদের কাকেও যেন এই অবস্থায় দেখতে না পাই, সে স্বীয় কাঁধের উপর একটি চীৎকাররত উট বহন করে আসবে, আর সে আমাকে লক্ষ্য করে বলবে হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান আগেই (দুনিয়াতে) জানিয়ে দিয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাকেও এ অবস্থায় দেখতে না পাই, সে কাঁধের উপর একটি চীৎকাররত ঘোড়া বহন করে আসবে। আর সে আমাকে লক্ষ্য করে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান আগেই (দুনিয়াতে) জানিয়ে দিয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাকেও এ অবস্থায় দেখতে না পাই, সে কাঁধের উপর একটি চীৎকাররত বকরী বহন করে আসবে। আর সে আমাকে লক্ষ্য করে বলবে হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান আগেই (দুনিয়াতে) জানিয়ে দিয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাকেও এ অবস্থায় দেখতে না পাই, সে কাঁধের উপর একটি চীৎকাররত মানুষকে বহন করে আসবে। আর সে আমাকে লক্ষ্য করে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান আগেই (দুনিয়াতে) জানিয়ে দিয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাকেও এ অবস্থায় দেখতে না পাই, সে কাঁধের উপর কাপড় ইত্যাদির এক খন্ড বহন করে আসছে। আর তা ভীষণভাবে তার ঘাড়ের উপর দুলছে। তখন সে আমাকে লক্ষ্য করে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান আগেই (দুনিয়াতে) জানিয়ে দিয়েছি। ক্বিয়ামতের দিন আমি যেন তোমাদের কাউকেও এমন অবস্থায় দেখতে না পাই, সে কাঁধের উপর একটি অচেতন সম্পদ (সোনা-চাঁদি ইত্যাদি) বহন করে আসছে। আর সে আমাকে লক্ষ্য করে বলবে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে সাহায্য করুন। আর আমি বলব, আজ আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। আমি তো তোমাকে আল্লাহর বিধান আগেই (দুনিয়াতে) জানিয়ে দিয়েছি’। [. বুখারী, হাদীস নং-৩০৩৭; মুসলিম, হাদীস নং-১৮৩১।]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে একটি গোলাম হাদিয়া দিয়েছিল, যার নাম মিদআম। এক সময় মিদআম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাহন প্রস্তুত করছিল। হঠাৎ অজ্ঞাত তীর নিক্ষেপকারীর তীর তার গায়ে লাগল। তীর তাকে নিহত করল। লোকেরা বলল: তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: কখনো নয়। সে খায়বরের দিন দশের সম্পদ হতে একটি চাদর আত্মসাৎ করেছিল। এ চাদর জাহান্নামের আগুনকে তার উপর ক্ষিপ্ত করেছে। লোকেরা একথা শুনে কোন ব্যক্তি একটি জুতার ফিতা বা দু’টি জুতার ফিতা নিয়ে আসল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: একটি জুতার ফিতা বা দু’টি জুতার ফিতার সমান জিনিস আত্মসাৎ করবে তার জন্য জাহান্নাম’। [. বুখারী, হাদীস নং-৪২৩৪।]

১৮
সাহসিকতা
১৬. সাহসিকতা: কাপুরুষতা একজন পরিপূর্ণ মু’মিনের গুণ নয় বরং সাহসিকতাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَن يَرۡتَدَّ مِنكُمۡ عَن دِينِهِۦ فَسَوۡفَ يَأۡتِي ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ يُحِبُّهُمۡ وَيُحِبُّونَهُۥٓ أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ يُجَٰهِدُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوۡمَةَ لَآئِمٖۚ ذَٰلِكَ فَضۡلُ ٱللَّهِ يُؤۡتِيهِ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ ٥٤ ﴾ [ المائ‍دة : ٥٤ ]

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ দ্বীন থেকে ফিরে গেলে অচিরেই আল্লাহ্ এমন এক কওম নিয়ে আসবেন যাদের তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাঁকে ভাল বাসবে; তারা মু’মিনদের প্রতি কোমল হবে আর কাফিরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে তিনি ইচ্ছা করেন তা দান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যদানকারী, সর্বজ্ঞ।" [. সূরা আল-মায়িদাহ, ৫৪।]

১৯
লজ্জা ও শালীনতাবোধ
১৭. লজ্জা ও শালীনতাবোধ: লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। যার লজ্জা নেই, সে যা ইচ্ছা করতে পারে। আর লজ্জা মানুষ প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তোলে। লজ্জার গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল:

আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোত্তম হল ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই’ একথা বলা এবং সর্বনিম্ন স্তর হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো। আর লজ্জা হল ঈমানের একটি শাখা’। [. বুখারী, হাদীস নং- ৯; মুসলিম, হাদীস নং-৩৫।]

ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘লজ্জা ও ঈমান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুতরাং এর একটি তুলে নেয়া হলে অপরটিও তুলে নেয়া হয়’। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর এক বর্ণনায় আছে ‘যখন উভয়ের কোন একটিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়, তখন অপরটিও তার পশ্চাতে অনুগমন করে। [. আত-তারগীব, হাদীস নং-২৬৩৬]

যায়েদ ইবনু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘প্রত্যেক দ্বীনের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। আর দ্বীন ইসলামের বিশেষ স্বভাব হল লজ্জাশীলতা’। [. ছহীহ আত-তারগীব, হাদীস নং-২৬৩২]

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘নির্লজ্জতা কোন জিনিসের মধ্যে থাকলে তাকে ত্রুটিপূর্ণ করে। আর লাজুকতা কোনো জিনিসের মধ্যে থাকলে তার শ্রী বৃদ্ধি করে। [. ছহীহ আত-তারগীব, হাদীস নং-২৬৩৫; তিরমিযী হাদীস নং- ১৯৭৪।]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘হে আয়েশা! লজ্জা যদি কোন লোক হয় তাহলে সে হবে সৎ ব্যক্তি। আর অশ্লীলতা (লজ্জাহীনতা) কোন লোক হলে নিশ্চয়ই সে হবে নিকৃষ্ট লোক। [. ছহীহ আত-তারগীব, হাদীস নং-২৬৩১]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘পূর্ববর্তী নবীগণের বাণী হ’তে পরবর্তী লোকেরা (অবিকৃতাবস্থায়) যা পেয়েছে (এবং যা অদ্যাবধি বিদ্যমান) তা হ’ল তুমি যখন বেহায়া হয়ে যাবে তখন তুমি যা ইচ্ছা তাই কর। [. বুখারী, হাদীস নং-৩৪৮৩, ৩৪৮৪।]

কুররাহ ইবনু ইয়াস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। তাঁর নিকটে লজ্জাশীলতার কথা উল্লেখ করা হল। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন:হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! লজ্জাশীলতা হচ্ছে দ্বীনের অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:‘বরং সেটা (লাজুকতা) হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। [. আত-তারগীব, হাদীস নং-২৬৩০]

আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা আল্লাহকে যথাযথ লজ্জা কর। রাবী বলেন: আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা অবশ্যই আল্লাহর ব্যাপারে লজ্জা করি, আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বলেন: এটা নয়। বরং আল্লাহকে যথাযথ লজ্জা করতে হবে। অর্থাৎ তুমি তোমার মাথাকে ও উহা যা স্মরণ রাখে তাকে হেফাযত করবে। পেট ও উহার অভ্যন্তরীণ বিষয়কে হেফাযত করবে। মৃত্যু ও পরীক্ষাকে স্মরণ করবে। আর যে আখিরাতের আশায় দুনিয়ার সৌন্দর্য ত্যাগ করে,সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্কে লজ্জা করে’। [. আত-তারগীব, হাদীস নং-২৬৩৮; তিরমিযী, ২৪৫৮।]

উপরোক্ত হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈমান ও লজ্জাশীলতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যার লজ্জা নেই তার ঈমান নেই। আর যার ঈমান নেই, তার স্থান জাহান্নামে। অপরপক্ষে লজ্জাহীন মানুষ পশুতুল্য। বর্তমানে নারী-পুরুষ লজ্জাহীন হয়ে উঠছে। নিজেদের ইয্যত-আব্রু খোলা রাখার প্রতিযোগিতায় যেন তারা লিপ্ত হয়েছে। পুরুষের চেয়ে নারীরা বর্তমানে অধিকতর খোলামেলা পোষাক পরিধান করে চলাফেরা করে। যার পরিণতি হচ্ছে ধর্ষণ-অপহরণ ইত্যাদি। এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের স্ত্রী-কন্যাদের শালীন পোষাক পরিধানের পাশাপাশি যথাযথ পর্দায় রাখা একান্ত আবশ্যক। কোনো ঈমানদার লজ্জাশীল পুরুষ তার স্ত্রী-কন্যা, পরিবার-পরিজনকে অশালীন, নগ্ন পোষাক পরিয়ে অন্য মানুষের ঈমান হরণ করতে পারে না।

মোদ্দাকথা লজ্জা মু’মিনের ভূষণ। সুতরাং মু’মিন নর-নারীকে সেই ভুষণ আঁকড়ে থাকা অপরিহার্য।

২০
ধৈর্য ও সংযম
১৮. ধৈর্য ও সংযম: মানবজীবনে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। এটি একজন মু’মিনের জন্য একটি অপরিহার্য গুণ বরং এটি মুমিনের মেরুদন্ডস্বরূপ। কেননা এ কাজে বিভিন্ন মেজাজের লোকদের সাথে মেলা-মেশা করা প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে ধৈর্য ও সংযম ব্যতীত এ কাজ সম্ভব নয়। আর ধৈর্য ধারণ সম্পকে আল-কুর’আনে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ فَٱصۡبِرۡ كَمَا صَبَرَ أُوْلُواْ ٱلۡعَزۡمِ مِنَ ٱلرُّسُلِ وَلَا تَسۡتَعۡجِل لَّهُمۡۚ كَأَنَّهُمۡ يَوۡمَ يَرَوۡنَ مَا يُوعَدُونَ لَمۡ يَلۡبَثُوٓاْ إِلَّا سَاعَةٗ مِّن نَّهَارِۢ ۚ بَلَٰغٞۚ فَهَلۡ يُهۡلَكُ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ٣٥ ﴾ [ الاحقاف : ٣٥ ]

“অতএব আপনি সবর করুন যেভাবে দৃঢ়চেতা রাসূলগণ সবর করেছিলেন এবং ওদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। ওদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা যেদিন তারা দেখবে, তখন তাদের মনে হবে যেন তারা দিনের এক মুহুর্তের বেশি পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটা সংবাদ পৌঁছিয়ে দেয়া মাত্র। তারাই ধ্বংস হবে, যারা পাপাচারী।’’ [. সূরা আল-আহকাফ, ৪৬ : ৩৫।]

২১
ক্ষমা
১৯. ক্ষমা: ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। মু’মিনকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেয়ার মত মহৎ গুণের অধিকারী হতে হবে। এতে মানুষের মনের বিদ্বেষ ভাব দূরীভূত হয়ে মু’মিনের সাথে গড়ে উঠবে নিবীড় সম্পর্ক, অগাধ ভালবাসা ও বিশ্বাস। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿وَلَا تَسۡتَوِي ٱلۡحَسَنَةُ وَلَا ٱلسَّيِّئَةُۚ ٱدۡفَعۡ بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ فَإِذَا ٱلَّذِي بَيۡنَكَ وَبَيۡنَهُۥ عَدَٰوَةٞ كَأَنَّهُۥ وَلِيٌّ حَمِيمٞ ٣٤ ﴾ [ فصلت : ٣٤ ]

“ভাল ও মন্দ সমান নয়। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করুন, ফলে আপনার সাথে যার শত্রুতা আছে সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে।’’ [. সূরা আল-বাকারাহ, ২ : ২৬৯।]

২২
সত্যবাদিতা
২০. সত্যবাদিতা: সত্যবাদিতা এমন এক গুণ যার ব্যাপারে কুর’আন-হাদীসে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কথা-বার্তায় সত্যবাদিতা মু’মিনের অপরিহার্য গুণাগুণ। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় পাওয়া যায়। ‘আব্দুল্লাহ ইব্ন মাস‘ঊদ রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সত্য কথা বলা তোমাদের উপর কর্তব্য। কেননা সত্যবাদিতা মানুষের নেক কাজের পথ উন্মুক্ত করে। আর নেক কাজ মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করায়। কোন ব্যক্তি যখন সত্য কথা বলতে থাকে এবং সত্য কথা বলার চেষ্টা অব্যাহত রাখে তখন এভাবে একসময় আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী বলে লিখিত হয়ে যায়। আর তোমরা মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকবে, কেননা মিথ্যা পাপ কাজের পথ দেখায়। আর পাপ কাজ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর কোন ব্যক্তি যখন মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যা বলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তখন এক সময় সে আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী হিসেবেই লিপিবদ্ধ হয়।’’ [. তিরমিযী, হাদীস নং-১৮৯৪।]

২৩
স্নেহশীলতা ও দয়া
২১. স্নেহশীলতা ও দয়া: দয়া-মমতা আল্লাহ্ তা‘আলার একটি মহৎ গুণ। যা গোটা সৃষ্টি জগতব্যাপী বিস্তৃত। তাই মানব সমাজেও পরস্পরে দয়া মমতা থাকা একান্ত অপরিহার্য। আর এটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি মহান গুণ ছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٢٨ ﴾ [ التوبة : ١٢٨ ]

“তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল। তার পক্ষে অতি দুঃসহ-দুর্বহ সে সব বিষয় যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে। তিনি তোমাদের অতিশয় হিতকামী, মু’মিনদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল, খুবই দয়ালু।’’ [. সূরা আত-তাওবাহ, ১২৮।]

২৪
দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি
২২. দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি: মানুষ যা কিছু চিন্তা করে তা তার ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করে। এ ইচ্ছা শক্তিতে প্রবৃত্তির তাড়না অলসতা বা আরামপ্রিয়তা বা ভীতি ইত্যাদি প্রভাব বিস্তার করে। তাই অনেক সময় মানুষ দুর্বল চিত্ত হয়ে পড়ে। এ ইচ্ছা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে প্রজ্ঞা ও শরী‘আতের বিধি-বিধান অনুসারে। আর একজন মুমিনের একটি মহৎ গুণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ فَإِن لَّمۡ يَسۡتَجِيبُواْ لَكَ فَٱعۡلَمۡ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهۡوَآءَهُمۡۚ وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّنِ ٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ بِغَيۡرِ هُدٗى مِّنَ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥٠ ﴾ [ القصص : ٥٠ ]

“তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে আপনি জানবেন যে, তারা শুধু স্বীয় প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে থাকে। আল্লাহর হিদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? আল্লাহ্ তো জালিম লোকদেরকে পথ দেখান না।’’ [. সূরা আল-কাসাস, ৫০।]

২৫
অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম করার অধিকারী
২৩. অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম করার অধিকারী: মু’মিনকে সবকিছু সহজেই অনুধাবন করার ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَإِذَا جَآءَهُمۡ أَمۡرٞ مِّنَ ٱلۡأَمۡنِ أَوِ ٱلۡخَوۡفِ أَذَاعُواْ بِهِۦۖ وَلَوۡ رَدُّوهُ إِلَى ٱلرَّسُولِ وَإِلَىٰٓ أُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنۡهُمۡ لَعَلِمَهُ ٱلَّذِينَ يَسۡتَنۢبِطُونَهُۥ مِنۡهُمۡۗ وَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَٱتَّبَعۡتُمُ ٱلشَّيۡطَٰنَ إِلَّا قَلِيلٗا ٨٣ ﴾ [ النساء : ٨٣ ]

“আর যখন তাদের কাছে পৌঁছে কোন সংবাদ নিরাপত্তা কিংবা ভয় সংক্রান্ত, তখন তারা তা প্রচার করে দেয়। যদি তারা তা সোপর্দ করত রাসূলের কাছে কিংবা তাদের মধ্যে যারা ফায়সালার অধিকারী তাদের কাছে তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে তারা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের উপর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না থাকত, তাহলে অল্প কয়েকজন ছাড়া তোমরা সবাই শয়তানের অনুগামী হয়ে যেত।’’ [. সূরা আন-নিসা, ৮৩।]

২৬
সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গী ও সিদ্ধান্তে পৌঁছার সামর্থ্য
২৪. সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গী ও সিদ্ধান্তে পৌঁছার সামর্থ্য: একজন দা‘ঈর বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা, অনুসন্ধান ও বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। এ সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গীকে আল-কুর’আনে ‘বাসীরাহ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ وَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٠٨ ﴾ [ يوسف : ١٠٨ ]

“আপনি বলুন: এটাই আমার পথ, আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করি প্রমাণের উপর কায়েম থেকে-আমি ও আমার অনুসারীরাও। আল্লাহ্ মহান পবিত্র। আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই।’’ [. সূরা ইউসুফ, ১০৮।]

২৭
আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালবাসা
২৫. আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালবাসা: মু’মিনকে আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালবাসা থাকতে হবে। সে প্রেরণা নিয়ে কাজ করলে তিনি অনেক সমস্যা থেকে বেঁচে যেতে পারেন। আর মু’মিনগণ আল্লাহকেই অধিক ভালবাসেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ وَلَوۡ يَرَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓاْ إِذۡ يَرَوۡنَ ٱلۡعَذَابَ أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا وَأَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعَذَابِ ١٦٥ ﴾ [ البقرة : ١٦٥ ]

“মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে তাঁর(আল্লাহ) সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে যেরূপ ভালবাসতে হয় সেরূপ তাদের ভালবাসে। কিন্তু যারা প্রকৃত ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তম। শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পর জালিমরা যেমন বুঝবে এখন যদি তারা তেমন বুঝত! নিশ্চয়ই সব শক্তি শুধু আল্লাহরই এবং আল্লাহ্ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর।’’ [. সূরা আল-বাকারাহ, ১৬৫।]

২৮
জিহাদী চেতনা
২৬. জিহাদী চেতনা: মু’মিনকে অবশ্যই জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। একজন মু’মিনের জিহাদ তার কু-প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে, শয়তানী কুমন্ত্রণার বিরুদ্ধে, শয়তানী শক্তি তথা তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে। আর জিহাদ হবে কথা, কৌশল, ধনসম্পদ, কলম ও অস্ত্রের দ্বারা। সর্বোতভাবে জিহাদ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ٱنفِرُواْ خِفَافٗا وَثِقَالٗا وَجَٰهِدُواْ بِأَمۡوَٰلِكُمۡ وَأَنفُسِكُمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤١ ﴾ [ التوبة : ٤١ ]

“তোমরা অভিযানে বের হয়ে পড়, স্বল্প সরঞ্জামের সাথে কিংবা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে; এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের মাল দিয়ে ও নিজেদের জান দিয়ে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানতে।’’ [. সূরা আত-তাওবাহ, ৪১।]

২৯
পরামর্শের মনোবৃত্তি
২৭. পরামর্শের মনোবৃত্তি: একজন দা‘ঈ ও মু’মিনকে পরস্পর পরামর্শের মনোবৃত্তি অর্জন করতে হবে এবং কোন কাজে অগ্রসর হতে হলে তাকে এ সকল পরামর্শের ভিত্তিতেই অগ্রসর হতে হবে। আর এটি মূলত: মু’মিনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যও বটে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱلَّذِينَ ٱسۡتَجَابُواْ لِرَبِّهِمۡ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَمۡرُهُمۡ شُورَىٰ بَيۡنَهُمۡ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣٨ ﴾ [ الشورا : ٣٨ ]

“আর যারা তাদের রবের ডাকে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে পারস্পরিক কর্ম সম্পাদন করে এবং যে রিযিক আমি তাদের দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’’ [. সূরা শুরা, ৩৮।]

৩০
ছিদ্রান্বেষণ না করা
২৮. ছিদ্রান্বেষণ না করা: প্রতিটি মানুষের মাঝে কিছু না কিছু দুর্বল দিক থাকে। একজন পরিপূর্ণ মু’মিনের উচিত হবে মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা। অপরের ছিদ্রান্বেষণ না করা। নিন্দা না-করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَ لَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ ١٢ ﴾ [ الحجرات : ١٢ ]

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয়ই কোন কোন অনুমান পাপজনক হয়ে থাকে। আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ্ বড়ই তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।’’ [. সূরা আল-হুজুরাত, ১২।]

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহও কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তির দোষ ত্রুটি গোপন রাখবেন।’’ [. ইব্ন মাজাহ, হাদীস নং-২৫৩৬।]

৩১
সৎকাজের সহযোগিতা করা
২৯. সৎকাজের সহযোগিতা করা: ভাল কাজ অবিলম্বে সম্পন্ন করার জন্য প্রতিযোগিতা করা মু’মিনের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। এতে কর্মীরা কাজের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلِكُلّٖ وِجۡهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَاۖ فَٱسۡتَبِقُواْ ٱلۡخَيۡرَٰتِۚ أَيۡنَ مَا تَكُونُواْ يَأۡتِ بِكُمُ ٱللَّهُ جَمِيعًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٤٨ ﴾ [ البقرة : ١٤٨ ]

“আর প্রত্যেকেরই রয়েছে একটি দিক, যে দিকে সে মুখ করে। সুতরাং তোমরা সৎকাজে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাও। যেখানেই তোমরা থাক না কেন, আল্লাহ্ তোমাদের সবাইকে একত্রে সমবেত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’’ [. সূরা আল-বাকারাহ, ১৪৮।]

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمُهَيۡمِنًا عَلَيۡهِۖ فَٱحۡكُم بَيۡنَهُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُۖ وَلَا تَتَّبِعۡ أَهۡوَآءَهُمۡ عَمَّا جَآءَكَ مِنَ ٱلۡحَقِّۚ لِكُلّٖ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةٗ وَمِنۡهَاجٗاۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَجَعَلَكُمۡ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ وَلَٰكِن لِّيَبۡلُوَكُمۡ فِي مَآ ءَاتَىٰكُمۡۖ فَٱسۡتَبِقُواْ ٱلۡخَيۡرَٰتِۚ إِلَى ٱللَّهِ مَرۡجِعُكُمۡ جَمِيعٗا فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ فِيهِ تَخۡتَلِفُونَ ٤٨ ﴾ [ المائ‍دة : ٤٨ ]

“আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি সত্যসহ এ কিতাব যা সত্যায়নকারী পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের এবং সংরক্ষণকারী তাতে যা আছে তার। সুতরাং আপনি তাদের মধ্যে ফয়সালা করুন আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তদনুসারে এবং আপনার কাছে যে সত্য এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করবেন না। আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি নির্দিষ্ট শরী‘আত ও নির্দিষ্ট পন্থা। আর যদি আল্লাহ্ চাইতেন, তবে অবশ্যই তিনি তোমাদের সবাইকে এক জাতি করে দিতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের পরীক্ষা করতে চান যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন তার মাধ্যমে। অতএব নেক কাজের প্রতি ধাবিত হও। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তারপর তিনি তোমাদের অবহিত করবেন সে বিষয় যাতে তোমরা মতভেদ করতে।’’ [. সূরা আল-মায়িদাহ, ৪৮।]

৩২
প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা
৩০. প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা: ওয়াদা দিয়ে তা রক্ষা করা একজন মু’মিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। আর এটি একজন মু’মিনের জন্য একটি অপরিহার্য গুণ। কারণ প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা মুনাফেকীর লক্ষণ। এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা এ বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَوۡفُواْ بِٱلۡعُقُودِۚ أُحِلَّتۡ لَكُم بَهِيمَةُ ٱلۡأَنۡعَٰمِ إِلَّا مَا يُتۡلَىٰ عَلَيۡكُمۡ غَيۡرَ مُحِلِّي ٱلصَّيۡدِ وَأَنتُمۡ حُرُمٌۗ إِنَّ ٱللَّهَ يَحۡكُمُ مَا يُرِيدُ ١ ﴾ [ المائ‍دة : ١ ]

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে। তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে চতুষ্পদ জন্তু, সেগুলো ছাড়া যা তোমাদের কাছে বর্ণিত হচ্ছে, তবে ইহরাম অবস্থায় শিকার করাকে হালাল মনে করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ্ আদেশ করেন যা তিনি ইচ্ছা করেন।’’ [. সূরা আল মায়িদাহ, ১।]

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় জানা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন কথা বলে তখন মিথ্যা বলে। প্রতিশ্রুতি দিলে ভঙ্গ করে এবং তার কাছে কোন কিছু আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে।’’ [. মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং-৮৯।]

৩৩
সালাম দেয়া
৩১. সালাম দেয়া: ‘সালাম’ আরবী শব্দ, এর আভিধানিক অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে মুসলিমগণ পারস্পরিক সাক্ষাতে যে বাক্য বিনিময় করে থাকে তাকে সালাম বলে। পৃথিবীর সূচনাকাল থেকে প্রত্যেক জাতির মাঝে সালাম বা অভিবাদনের রীতি প্রচলিত ছিল এবং বর্তমানেও আছে। তবে এই রীতি-পদ্ধতির মাঝে ভিন্নতা রয়েছে। তবে ইসলামী সালাম রীতি একই যা আদি পিতা আদম আলাইহিস সালাম থেকে চলে আসছে। মুসলিমদেরকে সালামের নির্দেশ দিয়ে এরশাদ করেন :

﴿فَإِذَا دَخَلۡتُم بُيُوتٗا فَسَلِّمُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِكُمۡ تَحِيَّةٗ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُبَٰرَكَةٗ طَيِّبَةٗۚ﴾ [ النور : ٦١ ]

‘যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে, তখন নিজেদের লোকদেরকে সালাম করবে। এটা আল্লাহর পক্ষ হতে বরকতময় ও পবিত্র অভিবাদন।’ [. সূরা আন নূর, ৬১]

অন্যত্র মহান আল্লাহ আরো বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَدۡخُلُواْ بُيُوتًا غَيۡرَ بُيُوتِكُمۡ حَتَّىٰ تَسۡتَأۡنِسُواْ وَتُسَلِّمُواْ عَلَىٰٓ أَهۡلِهَاۚ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَذَكَّرُونَ ٢٧ ﴾ [ النور : ٢٧ ]

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ কর না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর এবং তার বাসিন্দাকে সালাম কর। ওটা তোমাদের জন্য উত্তম। যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। [. সূরা আন নূর, ২৭]

তিনি আরো বলেন:

﴿ وَإِذَا حُيِّيتُم بِتَحِيَّةٖ فَحَيُّواْ بِأَحۡسَنَ مِنۡهَآ أَوۡ رُدُّوهَآۗ ﴾ [ النساء : ٨٦ ]

‘যখন তোমরা সালাম কর উত্তম পন্থায় সালাম কর। অথবা সালাম দাতার কথাগুলোই উত্তরে বলে দিবে। [. সূরা আন নিসা, ৮৬]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনয়ন করবে। আর তোমরা ঈমানদার হিসাবে গণ্য হবে না যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন উপায় নির্দেশ করব না যা অবলম্বন করলে তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করবে। [. মুসলিম, হাদীস নং-৪৬৩১]

উপরোক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মানুষের জন্য সরাসরি জান্নাতে প্রবেশ করতে হলে পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে হবে। আর পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য প্রয়োজন মুসলিমদের একে অপরকে ভালবাসা এবং পরস্পরকে ভালবাসার মাধ্যম হচ্ছে সালাম। পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে একে অপরের সাথে ভালবাসা সৃষ্টি হয়। আর এ ভালবাসার মাধ্যমে মু’মিন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।

হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, বারা ইবনু আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন সাতটি কাজের। (১) রোগীর খোঁজ-খবর নেয়া (২) জানাযার সঙ্গে গমন করা (৩) হাঁচিদাতার জন্য দো‘আ করা (৪) দুর্বলকে সাহায্য করা (৫) মাযলূমের সাহায্য করা (৬) সালামের উত্তর দেয়া (৭) কসমকারীর কসম পূর্ণ করা। [. বুখারী, হাদীস নং-৫৭৫৪]

৩৪
অত্যাচার না করা
৩২. অত্যাচার না করা: যুলুম-অত্যাচার ইসলামের একটি জঘন্য অপরাধ, যাকে সবাই ঘৃণা করে। এর কারণে পার্থিব জীবনে মানুষ হবে লাঞ্ছিত এবং পরকালে ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন ‘যালিমদের জন্য পরকালে কোন দরদী বন্ধু থাকবে না এবং তাদের জন্য কোন সুপারিশকারীও হবে না যার কথা মান্য করা হবে’। [. সূরা আল মুমিন ১৮]

অন্যত্র তিনি আরো বলেন ‘যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী থাকবে না’। [. সূরা আল হজ্জ ৭১]

আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘তোমরা বলতে পার সবচেয়ে নিঃস্ব কে? ছাহাবীগণ বললেন: আমাদের মাঝে সবচেয়ে দরিদ্র সেই যার কোন অর্থ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার উম্মতে সবচেয়ে গরীব এমন ব্যক্তি যে সালাত, সিয়াম ও যাকাতের নেকী নিয়ে ক্বিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। অপরদিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণ করা, অপবাদ দেয়া ও গালি দেয়ার অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হবে। তখন তার নেকী হতে তাদেরকে পরিশোধ করা হবে। তার নেকী শেষ হয়ে গেলে তাদের পাপ নিয়ে তার উপর চাপানো হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’। [. মুসলিম,, হাদীস নং-৪৬৭৮]

অত্র হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অত্যাচারে হক নষ্ট করা হয়, যা পাপের অন্তর্ভুক্ত। এটার দায় ক্বিয়ামতের দিন পরিশোধ করতে হবে। আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আল্লাহ তা‘আলা অত্যাচারীকে এক নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে তাকে যখন পাকড়াও করেন,তখন তাকে আর ছাড়েন না। অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করলেন ‘তোমার প্রতিপালকের ধরা এইরূপ যে যখন তিনি অত্যাচারী জনপদকে পাকড়াও করেন, তাঁর ধরা বড় কঠিন’। [. বুখারী, হাদীস নং-৪৩১৮]

৩৫
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা
৩৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা: আত্মীয়তার সম্পর্ক ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে বিষয়ে সতর্ক-সাবধান থাকা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কেননা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী জান্নাতে যাবে এবং সম্পর্ক ছিন্নকারী জাহান্নামী হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন। পক্ষান্তরে আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করলে তাদের প্রাপ্য হক বিনষ্ট হয়। আল্লাহ এ হক রক্ষা করতে বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:

﴿وَءَاتِ ذَا ٱلۡقُرۡبَىٰ حَقَّهُۥ وَٱلۡمِسۡكِينَ وَٱبۡنَ ٱلسَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرۡ تَبۡذِيرًا ٢٦﴾ [ الاسراء : ٢٦ ]

‘আত্মীয়-স্বজনের প্রাপ্য হক তাদের দিয়ে দাও এবং অভাবগ্রস্ত মুসাফিরকেও’। [. সূরা বানী ইসরাঈল ২৬]

আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মিসকীনদের হক আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘সেই ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে, বিনিময়ের স্বার্থে তা রক্ষা করে। বরং সে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী যার সাথে তা ছিন্ন করার পর পুনঃস্থাপন করে’। [. বুখারী, হাদীস নং-৫৫৩২]

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন কিছু পাওয়ার স্বার্থে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয়। বরং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে। অনেক এলাকায় দেখা যায়, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ যদি বোনেরা না নেয়, তাহলে ভাইদের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালই থাকে। কিন্তু যদি বোনেরা ঐ সম্পদ গ্রহণ করে, তাহলে ভাইদের সাথে বোনদের আর কোন সুসম্পর্ক থাকে না। এসব জাহেলী চিন্তাধারা। এগুলো থেকে বিরত থাকাই প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে ক্বিয়মাতের দিন জিজ্ঞেস করবেন। তিনি বলেন:

﴿وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١ ﴾ [ النساء : ١ ]

‘আল্লাহকে ভয় কর, যার নামে তোমরা পরস্পরের নিকট জিজ্ঞেস করে থাক এবং অত্মীয়তার ব্যাপারে সতর্ক থাক’। [. সূরা আন নিসা ১]

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

﴿۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا وَبِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ وَٱلصَّاحِبِ بِٱلۡجَنۢبِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخۡتَالٗا فَخُورًا ٣٦﴾ [ النساء : ٣٦ ]

‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কাউকে শরীক কর না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, নিকট প্রতিবেশী এবং সফরসঙ্গী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীদের প্রতিও।নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না’। [. আন সূরা নিসা: ৩৬]

এ আয়াতে নিজের হকের সাথে পিতা-মাতার হকের কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর নিকটাত্মীয়দের হকের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই ইসলামে এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। (১) পিতা-মাতা (২) নিকটাত্মীয় (৩) ইয়াতীম (৪) মিসকীন (৫) প্রতিবেশী (৬) নিকট প্রতিবেশী,(৭) অসহায় মুসাফির (৮) সফরসাথী (৯) দাস-দাসীর সাথে সদয় আচরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে এসব বিষয়ের প্রতি মানুষ কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবার প্রতি মানুষ কোন লক্ষ্য করে না। পক্ষান্তরে শ্বশুর-শাশুড়ীর জন্য সবাই নিজেকে উজাড় করে দেয়। নিজের ভাই-বোনের প্রতি খেয়াল করে না অথচ শ্যালক-শ্যালিকার জন্য হাত খুলে খরচ করে। নিকটাত্মীয়দের প্রতি কর্তব্য পালনে থাকে উদাসীন, তাদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা প্রকাশ করে, অথচ বন্ধু-বান্ধবের জন্য উদার হস্তে খরচ করে। এসব উল্টা কাজ থেকে বিরত হয়ে প্রত্যেকের হক যথাযথভাবে আদায় করা উচিত।

এ হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যকারী নিযুক্তি ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে অসদাচরণকারীর পরিণতি সম্পর্কে সবিস্তার আলোচনা পেশ করা হয়েছে। তাই আমাদের সকলের এ ব্যাপারে সতর্ক-সাবধান হওয়া জরূরী।

হাদীসে এসেছে, আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘বিদ্রোহকারী ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মত কোন পাপই এত জঘন্য নয় যে, পাপীকে আল্লাহ তা‘আলা খুব শীঘ্রই এই পৃথিবীতে তার শাস্তি দেন এবং আখিরাতেও তার জন্য শাস্তি জমা করে রাখেন’। [. আবুদাউদ, হাদীস নং-৪২৫৬]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর দুনিয়াতেও শাস্তি হবে এবং পরকালেও তার জন্য শাস্তি নির্ধারিত থাকবে।হাদীসে এসেছে, আবু আইউব আনছারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত এক ব্যক্তি বলল: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। উপস্থিত লোকজন বলল: তার কি হয়েছে? তার কি হয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এরপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, সালাত আদায় করবে, যাকাত আদায় করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করবে’। [. বুখারী, হাদীস নং-৫৯৮৩]

ইবনু শিহাব হতে বর্ণিত মুহাম্মাদ ইবনু জুবাইর ইবনু মতঈম বলেন যে, জুবায়র ইবনু মুতঈম খবর দিয়েছেন যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। [. বুখারী, হাদীস নং-৫৯৮৪]

উল্লেখিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন, যা পালন করলে সে জান্নাতে যেতে পারবে। বিষয়গুলি হচ্ছে- (১) আল্লাহর ইবাদত করা (২)তাঁর সাথে শির্ক না করা (৩) ছালাত আদায় করা (৪) যাকাত আদায় করা (৫) আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ইবাদতের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার কথা বলেছেন: যা পালন করলে মানুষ সহজেই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। উপরোল্লেখিত হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় পুরুষের দায়িত্বই বেশী। কেননা তারা অর্থ উপার্জন করে এবং সম্পদের রক্ষক হয়। প্রত্যেককে তার যথাযথ প্রাপ্য প্রদান করলে এবং সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চললে এ সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকে। আর এ কাজ মূলতঃ পুরুষের। তাই এক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

৩৬
প্রতিবেশীর হক আদায় করা
৩৪. প্রতিবেশীর হক আদায় করা: প্রতিবেশী আত্মীয় হোক অথবা অনাত্মীয়, মুসলিম হোক অথবা অমুসলিম যে কোন অবস্থায় সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহায়তা করা ও তাদের খবরাখবর নেয়া জরূরী। যারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, তারা জান্নাতে যাবে না। এদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কসম করে বলেছেন: যেসব কারণে মানুষ জান্নাতে যাবে না, প্রতিবেশীকে কষ্ট প্রদানকারী তার অন্যতম। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

﴿وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا وَبِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ وَٱلصَّاحِبِ بِٱلۡجَنۢبِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخۡتَالٗا فَخُورًا ٣٦﴾ [ النساء : ٣٦ ]

‘আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীনদের সাথে ভাল ব্যবহার কর। নিকট প্রতিবেশী ও দূর প্রতিবেশী এবং সহকর্মীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর। পথিক ও দাস-দাসীর সাথে ভাল ব্যবহার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অহংকারী-দাম্ভিককে পছন্দ করেন না’। [. সুরা আন নিসা ৩৬]

৩৭
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার
৩৫. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার: পিতা-মাতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অতুল্য নে‘আমত। আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পরেই পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম হিসাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন। পিতা-মাতাকে পেয়ে তাদের সাথে সদাচরণ করে যে ব্যক্তি জান্নাত লাভ করতে পারল না, তার চেয়ে হতভাগ্য আর নেই। পিতা-মাতা অত্যাচারী, অন্যায়কারী, এমনকি বিধর্মী হলেও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন:

﴿ وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ ١٤ ﴾ [ لقمان : ١٤ ]

‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। একাধারে দু’বছর দুধ পান করিয়েছে। অতএব আমার প্রতি ও পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আর আমার নিকটেই তোমাদের ফিরে আসতে হবে’। [. সুরা লোক্বমান ১৪]

তিনি আরো বলেন:

﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [ الاسراء : ٢٣، ٢٤ ]

‘তোমার পালনকর্তা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তাকে ছাড়া যেন অন্য কারো ইবাদত না কর। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দিও না ও তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সাথে নম্রভাবে করুণার ডানা অবনত করে দাও এবং বল হে আমার পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর যেমন শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে’। [. সুরা বানী ইসরাঈল, ২৩-২৪]

অত্র আয়াতে আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পরেই পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। (১) কারো কোন কাজের জন্য তার পিতামাত কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। (২) তাদের কোন কাজের জন্য তাদেরকে ধমক বা কষ্ট দেয়া যাবে না।তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে। তাদের সাথে সদা নম্র-ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। (৩) বৃদ্ধাবস্থায় তাদের প্রতি দয়ার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। (৪) তাদের মৃত্যুর পরে তাদের জন্য দো‘আ করতে হবে। এ আয়াত ব্যতীত আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ এভাবে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা নির্দেশ দিয়েছেন।

পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনু আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! আল্লাহ্র নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘সময়মত ছালাত আদায় করা। আবার জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তারপর হচ্ছে পিতা-মাতার অনুগত হওয়া। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম,এরপর কি? তিনি বললেন: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। [. মুসলিম, হাদীস নং-৫৬৮]

এ হাদীসে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় আমল সময়মত সালাত আদায়ের পরই পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের কথা বলা হয়েছে। এমনকি এতে জিহাদের উপরেও পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, পিতা-মাতার মধ্যে মায়ের মর্যাদা পিতার চেয়ে তিনগুণ বেশী বলে হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আরয করল, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমার নিকট সর্বাপেক্ষা অধিক সৌজন্যমূলক আচরণ পাওয়ার অধিকারী কে? উত্তরে তিনি বললেন: তোমার মা। সে আবার জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার মা। সে আবার জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি বললেন: তোমার পিতা’। [. মুসলিম, হাদীস নং-৪৯১১]

এ হাদীসে প্রথমে তিনবার মায়ের কথা বলে চর্তুবার পিতার কথা বলা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, মায়ের মর্যাদা সর্বোচ্চে।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তার নাক ধূলায় মলিন হোক (একথা তিনি তিন বার বললেন)। বলা হল, সে ব্যক্তি কে? তিনি বললেন: যে ব্যক্তি বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অথবা দু’জনের একজনকে পেল (অথচ তাদের সেবা করল না) সে জান্নাত লাভ করতে পারল না’। [. মুসলিম, হাদীস নং-৪৯১২]

আমর ইবনু আছ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: বড় গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সাথে শরীক করা। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মানুষকে হত্যা করা এবং মিথ্যা কসম করা’। [. আত-তারগীব, হাদীস নং-৩৫৬৮]

ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতি দয়ার দৃষ্টি দিবেন না। (১) পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি (২) নিয়মিত নেশাদার দ্রব্য পানকারী (৩) দান করার পর খোটা দানকারী। তিনি আবার বলেন: তিন শ্রেণীর মানুষ জান্নাতে যাবে না। পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, দায়ূছ ব্যক্তি, পুরুষের বেশধারী নারী’। [. আত-তারগীব, হাদীস নং-৩৫৭০]

আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তিন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে, যাদের ফরয ও নফল ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। (১) পিতা-মাতার অবাধ্য ব্যক্তি, (২)খোটা দানকারী (৩) ভাগ্যকে অস্বীকারকারী’। [. আত-তারগীব, হাদীস নং-৩৫৭৩]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘পিতা-মাতার অনুগত হলে বয়স বৃদ্ধি পায়। মিথ্যা কথা রুযী কমিয়ে দেয়। দো‘আ নির্ধারিত ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়’। [. আত-তারগীব হাদীস নং-৪২০৩]

ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর স্ত্রীর (সারার) মাঝে যা হবার হয়ে গেল, তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম শিশুপুত্র ইসমাঈল এবং তার মাকে নিয়ে বের হলেন। তাদের সঙ্গে একটি থলে ছিল, যাতে পানি ছিল। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর মা মশক হতে পানি করতেন। ফলে শিশুর জন্য তার স্তন দুধ বাড়তে থাকে। অবশেষে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কায় পৌঁছে হাজেরাকে একটি বিরাট গাছের নিচে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। অতঃপর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বীয় পরিবারের (সারার) নিকট ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর মা কিছু দূর পর্যন্ত তার অনুসরণ করলেন। অবশেষে যখন কাদা নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন তিনি পিছন হতে ডেকে বললেন: হে ইবরাহীম! আপনি আমাদেরকে কার নিকট রেখে যাচ্ছেন? ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন: আল্লাহর কাছে। হাজেরা আলাইহিস সালাম বললেন: আমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। রাবী বলেন:অতঃপর হাজেরা আলাইহিস সালাম ফিরে আসলেন, তিনি মশক হতে পানি পান করতেন। আর শিশুর জন্য দুধ বাড়ত। অবশেষে যখন পানি শেষ হয়ে গেল। তখন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর মা বললেন: আমি যদি গিয়ে এদিকে সেদিকে তাকাতাম, তাহলে হয়তো কোন মানুষ দেখতে পেতাম। রাবী বলেন: অতঃপর ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর মা গেলেন এবং ছাফা পাহাড়ে উঠলেন। আর এদিকে ওদিকে তাকালেন এবং কাউকে দেখেন কিনা এজন্য বিশেষভাবে তাকিয়ে দেখলেন। কিন্তু কাউকেও দেখতে পেলেন না। তখন দ্রুত বেগে মারওয়া পাহাড়ে এসে গেলেন এবং এভাবে কয়েক চক্কর দিলেন। পুনরায় তিনি বললেন: যদি গিয়ে দেখতাম যে, শিশুটি কি করছে? অতঃপর তিনি গেলেন এবং দেখতে পেলেন যে, সে তার অবস্থায়ই আছে। সে যেন মরণাপন্ন হয়ে গেছে। এতে তার মন স্বস্তি পাচ্ছিল না। তখন তিনি বললেন: যদি সেখানে যেতাম এবং এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখতাম, সম্ভবত কাউকে দেখতে পেতাম। অতঃপর তিনি গেলেন, ছাফা পাহাড়ের উপর উঠলেন এবং এদিক সেদিক দেখলেন এবং গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। এমনকি তিনি সাতটি চক্কর পূর্ণ করলেন। তখন তিনি বললেন: যদি যেতাম তখন দেখতাম যে, সে কি করছে? হঠাৎ তিনি একটি শব্দ শুনতে পেলেন। অতঃপর তিনি মনে মনে বললেন: যদি আপনার কোন সাহায্য করার থাকে, তবে আমাকে সাহায্য করুন। হঠাৎ তিনি জিবরাঈল আলাইহিস সালাম-কে দেখতে পেলেন। রাবী বলেন: তখন তিনি (জিবরাঈল) তার পায়ের গোড়ালী দ্বারা এরূপ করলেন। হঠাৎ গোড়ালী দ্বারা যমীনের উপর আঘাত করলেন। রাবী বলেন: তখনি পানি বেরিয়ে আসল। এ দেখে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর মা অস্থির হয়ে গেলেন এবং গর্ত খুঁড়তে লাগলেন। রাবী বলেন: এ প্রসঙ্গে আবুল কাসেম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হাজেরা আলাইহিস সালাম যদি একে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দিতেন, তাহলে পানি বিসৃতত হয়ে যেত। রাবী বলেন: তখন হাজেরা আলাইহিস সালাম পানি পান করতে লাগলেন এবং তার সন্তানের জন্য তার দুধ বাড়তে থাকে। রাবী বলেন: অতঃপর জুরহুম গোত্রের এক দল লোক উপত্যকার নিচু ভূমি দিয়ে অতিক্রম করছিল। হঠাৎ তারা দেখল কিছু পাখি উড়ছে। তারা যেন তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। আর তারা বলতে লাগল, এসব পাখিতো পানি ব্যতীত কোথাও থাকতে পারে না। তখন তারা সেখানে তাদের একজন পাঠাল। সে খোনে গিয়ে দেখল, সেখানে পানি মওজুদ আছে। তখন সে তার দলের লোকদের নিকট ফিরে আসল এবং তাদেরকে সংবাদ দিল। অতঃপর তারা হাজেরা আলাইহিস সালাম-এর নিকট এসে বলল: হে ইসমাঈলের মা! আপনি কি আমাদেরকে আপনার নিকট থাকা অথবা (রাবী বলেছেন:) আপনার নিকট বসবাস করার অনুমতি দিবেন? হাজেরা আলাইহিস সালাম তাদেরকে বসবাসের অনুমতি দিলেন এবং এভাবে অনেক দিন কেটে গেল। অতঃপর তার ছেলে বয়ঃপ্রাপ্ত হল। তখন তিনি (ইসমাঈল) জুরহুম গোত্রেরই একটি মেয়েকে বিয়ে করলেন। রাবী বলেন: পুনরায় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর মনে জাগল, তখন তিনি তার স্ত্রী (সারা)-কে বললেন: আমি আমার পরিত্যক্ত পরিজনের খবর নিতে চাই। রাবী বলেন: অতঃপর তিনি আসলেন এবং সালাম দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইসমাঈল কোথায়? ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রী বলল: তিনি শিকারে গেছেন। তিনি পুত্রবধূকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। সে বলল: আমরা অতি দুরাবস্থায়, অতি টানাটানি ও খুব কষ্টে আছি। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন: সে যখন আসবে তখন তুমি তাকে আমার এ নির্দেশের কথা বলবে, তুমি তোমার ঘরের চৌকাঠ খানা বদলিয়ে ফেলবে। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম যখন আসলেন, তখন স্ত্রী তাকে খবরটি জানালেন। তিনি স্ত্রীকে বললেন: তুমি সেই চৌকাঠ। অতএব তুমি তোমার পিতার নিকট চলে যাও। রাবী বলেন: অতঃপর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর আবার মনে পড়ল। তখন তিনি স্ত্রী (সারা)-কে বললেন: আমি আমার নির্বাসিত পরিবারের খবর নিতে চাই। অতঃপর তিনি সেখানে আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ইসমাঈল কোথায়? ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর স্ত্রী বলল: তিনি শিকারে গেছেন। পুত্রবধূ তাকে বললেন: আপনি কি আমাদের এখানে অবস্থান করবেন না? কিছু পানাহার করবেন না? তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন: তোমাদের খাদ্য ও পানীয় কি? স্ত্রী বলল: আমাদের খাদ্য হল গোশত এবং পানীয় হল পানি। তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো‘আ করলেন, হে আল্লাহ! তাদের খাদ্য এবং পানীয় দ্রব্যের মধ্যে বরকত দিন। রাবী বলেন: আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দো‘আর কারণেই বরকত রয়েছে। রাবী বলেন: আবার কিছু দিন পর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর মনে তাঁর নির্বাসিত পরিজনের কথা জাগল। তখন তিনি তাঁর স্ত্রী (সারা)-কে আমি আমার পরিত্যক্ত পরিজনের খবর নিতে চাই। অতঃপর তিনি এলন এবং ইসমাঈলের দেখা পেলেন, তিনি যমযম কূপের পিছনে বসে তার একটি তীর মেরামত করছেন। তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ডেকে বললেন: হে ইসমাঈল! তোমার রব তাঁর জন্য এক খানা ঘর নির্মাণ করতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম আপনার রবের নির্দেশ পালন করুন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন: তিনি আমাকে এও নির্দেশ দিয়েছেন যে, তুমি যেন আমাকে এ বিষয়ে সহায়তা কর। ইসমাঈল আলাইহিস সালাম বললেন: তাহলে আমি তা করব অথবা তিনি অনুরূপ কিছু বলেছিলেন। অতঃপর উভয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ইমারত বানাতে লাগলেন। আর ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তাঁকে পাথর এনে দিতে লাগলেন। আর তারা উভয়ে দো‘আ করছিলেন, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এ কাজ কবুল করুন। আপনিতো সবকিছু শোনেন এবং জানেন? রাবী বলেন: এরই মধ্যে প্রাচীর উঁচু হয়ে গেল আর বৃদ্ধ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এতটা উঠতে দুর্বল হয়ে পড়লেন। তখন তিনি (মাকামে ইবরাহীমের) পাথরের উপর দাঁড়ালেন। ইসমাঈল তাঁকে পাথর এগিয়ে দিতে লাগলেন। আর উভয়ে এ দো‘আ পড়তে লাগলেন, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এ কাজটুকু কবুল করুন। নিঃসন্দেহে আপনি সবকিছু শোনেন ও জানেন। [. বাক্বারাহ ১২৭; বুখারী, হাদীস নং-৩৩৬৫]

৩৮
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা
৩৬. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা: সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজের নিষেধ করা মুসলিমদের উপর আল্লাহ রাববুল আলামীনের নির্দেশ। তিনি বলেন:

﴿ وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ ﴾ [ ال عمران : ١٠٤ ]

‘তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকতে হবে, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম’। [. সুরা আলে-ইমরান ১০৪]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

﴿ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ ٧١ ﴾ [ التوبة : ٧١ ]

“মু’মিন পুরুষ ও নারী তারা পরস্পরের বন্ধু শুভাকাঙ্খী। তারা ভালকাজের আদশে করে এবং মন্দকাজের নিষেধ করে। তারা আল্লাহকে মান্য করে, তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। তারা এমন মানুষ যাদের প্রতি আল্লাহ দয়া করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরা.মশালী প্রজ্ঞাময়’। [. সুরা আত তওবা ৭১]

পরের আয়াতে তিনি বলেন:

﴿ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا وَمَسَٰكِنَ طَيِّبَةٗ فِي جَنَّٰتِ عَدۡنٖۚ وَرِضۡوَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ أَكۡبَرُۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ٧٢ ﴾ [ التوبة : ٧٢ ]

“তারা এমন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী যাদেরকে আল্লাহ এমন জান্নাত দেওয়ার ওয়াদা করেছেন, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান রয়েছে। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। তাদের জন্য আদন নামক জান্নাতে পবিত্র পরিচ্ছন্ন বসবাসের স্থান থাকবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদান। আর এটাই হল সবচেয়ে বড় সফলতা’। [. সূরা আলে ইমরান: ৭২]

লোকমান হাকীম তার ছেলেকে বলেন:

﴿ يَٰبُنَيَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَآ أَصَابَكَۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ١٧ ﴾ [ لقمان : ١٧ ]

‘হে আমার পুত্র! ছালাত কায়েম কর, ভালকাজের আদেশ দাও, মন্দকাজের নিষেধ কর। আর যে বিপদই আসুক না কেন তাতে ধৈর্য ধারণ কর। এ কাজগুলি এমন যাতে খুব বেশী বেশী তাকীদ করা হয়েছে’। [. সূরা লোকমান: ১৭]

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘সবচেয়ে উত্তম জিহাদ হচ্ছে যালিম শাসকের নিকটে হক কথার দাওয়াত দেয়া’। [. তারগীব, হাদীস নং-৩২৯৯] জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘শহীদদের সর্দার হচ্ছেন হামযা ইবনু আবদুল মুত্তালিব এবং সেই ব্যক্তিও শহীদদে সর্দার যে অত্যাচারী নেতার নিকটে গেল এবং তাকে ভাল কাজের আদেশ করল এবং মন্দ কাজের নিষেধ করল। তখন সে তাকে হত্যা করল’। [. তিরমিযী, হাদীস নং-৩৩০২]

এ হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, অত্যাচারী শাসকের নিকট হকের দাওয়াত দেয়া খুবই কঠিন কাজ। এমন স্থানে দাওয়াত দেওয়ার পরিণতি জীবন বিসর্জনও হতে পারে। তবে তার বিনিময় হবে জান্নাত। আর তার মর্যাদা হবে শহীদদের মর্যাদার সমান। অত্যাচারী শাসকের ভয়ে দাওয়াতের কাজ থেমে থাকতে পারে না, স্তিমিত বা শিথিল হতে পারে না। বরং যালিমের মোকাবিলায় আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে জোরে শোরে দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে।

উসামা ইবনু যায়েদ বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ক্বিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তখন আগুনে পুড়ে তার নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাবে। এসময় সে ঘুরতে থাকবে, যেমন গাধা তার চাকা নিয়ে তার চার পার্শ্বে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামবাসীরা তার নিকট একত্রিত হয়ে তাকে বলবে হে অমুক ব্যক্তি! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না আমাদেরকে ভালকাজের আদেশ করতে আর অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতে? সে বলবে, আমি তোমাদেরকে ভালকাজের আদেশ করতাম বটে, কিন্তু আমি তা করতাম না। আর আমি তোমাদেরকে অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতাম অথচ আমিই তা করতাম’। [. বুখারী, হাদীস নং-৫১৩৯]

আনাস ইবনু মালিক বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে রাতে আমাকে মি‘রাজে নিয়ে যাওয়া হল, সে রাতে কতগুলি লোককে দেখলাম, যাদের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হচ্ছে। আমি বললাম, হে জিবরাঈল! এরা কারা? তিনি বললেন: এরা আপনার উম্মতের বক্তা, যারা মানুষকে ভাল কাজের আদেশ করত, কিন্তু নিজেরা আমল করত না’। [. তারগীব, হাদীস নং-৩৩২৮]

জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ আযদী বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সে ব্যক্তির উদাহরণ যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণের দাওয়াত দেয়, নিজে আমল করে না। সে সেই মোমবাতির মত, যে মোমবাতির মত। যে মোমবাতি মানুষকে আলো দেয় এবং নিজেকে জ্বালিয়ে দেয়’। [. তাবারানী, তারগীব, হাদীস নং-৩৩৩১]

ইমরান ইবনু হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আমার অবর্তমানে তোমাদের উপর যেটা সবচেয়ে বেশী ভয় করি তারা হচ্ছে সেই সব লোক যারা মুখে জ্ঞানী, মুনাফেক’। [. তাবারানী, তারগীব, হাদীস নং-৩৩৩২]

কাজেই যারা মুখে ধর্মের কথা বলে, নিজে আমল করে না। এদের বিষয়টি সবচেয়ে ভয়াবহ।এরা মুখে জ্ঞানী, কর্মে মুনাফিক।

আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমাদের কোন ব্যক্তি অন্যের চোখে ক্ষুদ্র-কুটা দেখতে পায়, কিন্তু নিজের চোখে গাছের শিকড়, বড় কাঠ খন্ড দেখতে পায় না। [. তাবারানী, তারগীব, হাদীস নং-৩৩৩৬]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, মানুষ অপরের ক্ষুদ্র দোষ দেখতে পায় কিন্তু নিজের বড় দোষ দেখতে পায় না। ভাল কাজের আদেশ দেয়া আর নিজের বড় দোষ দেখতে পায় না। ভাল কাজের আদেশ দেয়া আর নিজে না করা সবচেয়ে বড় দোষ।

৩৯
মেহমানের সমাদর করা
৩৭. মেহমানের সমাদর করা: অতিথি নিকটাত্মীয় হোক কিংবা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হোক তাদের মর্যাদানুসারে সাধ্যমত আদর-যতড়ব করা এবং যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য একান্ত কর্তব্য। মেহমান আপ্যায়নের ব্যাপারে নারী-পুরুষ উভয়কেই সচেষ্ট হতে হবে।অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারে পুরুষের ভূমিকা সর্বাধিক। তারা প্রয়োজনীয় উপকরণ এনে দিলে ঘরের মহিলারা তা প্রস্তুত করে দিতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের সদিচ্ছার অভাবে ঘরে পর্যাপ্ত দ্রব্যাদি থাকার পরেও অতিথি আপ্যায়ন যথাযথ হয় না। তাই নর-নারী উভয়কেই অতিথি আপ্যায়নে সচেষ্ট হতে হবে। উভয়ের প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছায়ই অতিথি আপ্যায়ন যথোপযুক্ত হবে। তবে এক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা বেশী থাকা প্রয়োজন।

মেহমান আপ্যায়নের ব্যাপারে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন:

﴿هَلۡ أَتَىٰكَ حَدِيثُ ضَيۡفِ إِبۡرَٰهِيمَ ٱلۡمُكۡرَمِينَ ٢٤ إِذۡ دَخَلُواْ عَلَيۡهِ فَقَالُواْ سَلَٰمٗاۖ قَالَ سَلَٰمٞ قَوۡمٞ مُّنكَرُونَ ٢٥ فَرَاغَ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦ فَجَآءَ بِعِجۡلٖ سَمِينٖ ٢٦ فَقَرَّبَهُۥٓ إِلَيۡهِمۡ قَالَ أَلَا تَأۡكُلُونَ ٢٧ ﴾ [ الذاريات : ٢٤، ٢٧ ]

‘তোমাদের নিকট কি ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানের কথা পৌঁছেছে? যখন তারা তার নিকট প্রবেশ করল, তখন তারা বলল: সালাম। তিনিও বললেন: সালাম। তারা ছিল অপরিচিত ব্যক্তি। তিনি ঘরে গিয়ে ভুনাকৃত একটি বাছুর এনে তাদের সামনে রেখে দিলেন এবং বললেন: তোমরা খাচ্ছ না কেন’? [. সূরা আয-যারিয়াত ২৪-২৭]

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর নিকট আগত মেহমানগণ ছিলেন ফেরেশতা। তারা মানুষের রূপ ধারণ করে এসেছিলেন। তারা ছিলেন অপরিচিত। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাদের জন্য দ্রুত খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য যত দ্রুত সম্ভব অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা জরূরী। মেহমানদের সমাদর করার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতীব গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন অবশ্যই তার মেহমানের সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। অন্য বর্ণনায় প্রতিবেশীর স্থলে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন আত্মীয়ের সম্পর্ক বজায় রাখে’। [. বুখারী, হাদীস নং-৪০৫৯]

এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনের চারটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা: (১) অতিথির সম্মান করা (২) প্রতিবেশীকে কোনভাবে কষ্ট না দেয়া (৩) সর্বদা ভাল কথা বলা। তা সম্ভব না হলে চুপ করে থাকা (৪) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল: আমি ক্ষুধার্ত। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কোন স্ত্রীর কাছে খাবারের খোঁজে লোক পাঠালে তিনি বললেন: যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! আমার নিকট পানি ছাড়া কিছুই নেই। তারপর তিনি অন্য এক স্ত্রীর নিকট লোক পাঠালে তিনিও একই কথা বললেন। এভাবে তারা সকলেই একই কথা বললেন। তখন রাসূল বললেন: আজ রাতে কে লোকটির মেহমানদারী করবে? আল্লাহ তার উপর রহম করুন।এসময়ে জনৈক আনছার ব্যক্তি উঠে বলল: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি। এরপর লোকটিকে নিয়ে আনছারী নিজ গৃহে গেলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন: তোমার কাছে কি কিছু আছে? সে বলল: না। শুধু বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু খাবার আছে। তিনি বললেন: তুমি তাদেরকে কিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখ। আর যখন মেহমান প্রবেশ করবে,তখন আলোটা নিভিয়ে দিবে। তুমি তাকে দেখাবে যে আমরাও খাচ্ছি। সে যখন খাওয়া শুরু করবে, তখন আলোর নিকট গিয়ে তা নিভিয়ে দিবে। বর্ণনাকারী বলেন: এরপর তারা বসে রইল। আর মেহমান খেতে লাগল। সকালে আনছার লোকটি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আজ রাতে মেহমানের সাথে তোমরা দু’জনে যে আচরণ করেছে, তাতে আল্লাহ তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। [. মুসলিম, হাদীস নং-৫১৮৬]

অন্য আরেক বর্ণনায় আছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: জনৈক আনছার ব্যক্তির গৃহে এক মেহমান রাত যাপন করলেন। উক্ত আনছারের নিকট বাচ্চাদের জন্য সামান্য খাবার ছাড়া কিছু ছিল না। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন: বাচ্চাদের ঘুমিয়ে দাও এবং আলোটা নিভিয়ে দাও। আর তোমার কাছে যা আছে তাই মেহমানের জন্য উপস্থিত কর।

বর্ণনাকারী বলেন: অতঃপর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়- ‘তারা নিজেদের উপরে অন্যকে প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব থাকে’। [. মুসলিম, হাদীস নং-৫১৮৭]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলের স্ত্রীদের নিকটে কখনো কখনো পানি ব্যতীত কিছু থাকতো না। তবু অভাবের তাড়নায় কখনো তারা রাসূলকে ছেড়ে যাননি। অপরদিকে আনছার লোকটিও ছিল হতদরিদ্র। যার ঘরে বাচ্চাদের জন্য সামান্য খাবার ছাড়া কিছু ছিল না। তবু তারা নিজেরা না খেয়ে এবং বাচ্চাদের অভুক্ত রেখে মেহমানের আপ্যায়ন করেছেন। কতটা আল্লাহভীরু হলে এরূপ করা সম্ভব! এজন্যই তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হয়েছেন। আর তাদের সম্পর্কে কুরআনের আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের মত অতিথিপরায়ণ মানুষের বর্তমানে খুব অভাব। ঐ ছাহাবীদের মত মানুষ বর্তমানে থাকলে এ সমাজও সোনার সমাজে পরিণত হত।আব্দুর রহমান ইবনু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আছহাবে ছুফ্ফার লোকজন ছিল দরিদ্র। তাই একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: যার নিকট দু’জনের খাবার আছে সে যেন তৃতীয়জনকে নিয়ে যায়। আর যার নিকট চারজনে খাবার আছে, সে যেন পঞ্চম অথবা ষষ্ঠজনকে নিয়ে যায়। রাবী বলেন: আবু বকর তিনজনকে নিয়ে আসলেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশজনকে নিয়ে গেলেন। আমাদের পরিবারে আমরা ছিলাম তিনজন। আমি, আমার পিতা ও মাতা। বর্ণনাকারী বলেন: আমি জানি না তিনি বলেছেন কি-না আমার স্ত্রী এবং আমার বাড়ীতে আবু বকরের খাদেম। রাবী বলেন:আবু বকর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গৃহে রাতের খাবার খেলেন। এরপর তিনি অপেক্ষা করলেন। অবশেষে এশার সালাত আদায় করা হল। সালাত শেষে প্রত্যাবর্তন করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী রাত্রির কিয়দাংশ অতিবাহিত হলে তিনি গৃহে ফিরে আসলেন। তার স্ত্রী তাকে বললেন: মেহমান রেখে দেরী করে ফিরলে কেন? তিনি বললেন: কেন, তুমি কি তাদের রাতের খাবার খাওয়াওনি? তার স্ত্রী বললেন: তুমি না আসা পর্যন্ত তারা আহার করতে অস্বীকার করেছে। কয়েকবারই খাবার পেশ করা হয়েছে। কিন্তু মেহমানরা তাদের কথা পরিবর্তন করেনি। আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি লুকিয়ে রইলাম। তিনি বলেন: হে নির্বোধ! তারপর তিনি আমাকে বকাবকি করলেন। আর মেহমানদের বললেন: ভাল হল না, আপনারা খাবার খেয়ে নিন। তিনি আরো বললেন: আল্লাহর কসম! আমি আহার করব না (কারণ খাবার ছিল কম)। আব্দুর রহমান বলেন: আল্লাহর শপথ! আমরা যে লোকমাই গ্রহণ করছিলাম। তার চেয়ে অধিক পরিমাণে বেড়ে যেত। এমনকি আমরা পরিতৃপ্ত হয়েও আমাদের খাদ্য পূর্বে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী হয়ে গেল। আবু বকর খাবারের প্রতি লক্ষ্য করলেন, তা যেমন ছিল তেমনি আছে বা তার চেয়েও অধিক হয়েছে। তিনি তার স্ত্রীকে বললেন: হে বনি ফিরাসের বোন! এ কি ব্যাপার? তিনি বললেন: কিছু না, আমার চোখের প্রশান্তি। এগুলি যা ছিল, তার চেয়ে তিনগুণ বেড়ে গেছে। আব্দুর রহমান বলেন: এরপর আবু বকর কিছু খেলেন এবং বললেন: কসমটা ছিল শয়তানের। অতঃপর তিনি আরো এক লোকমা খেলেন। তারপর সেগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট নিয়ে গেলেন। আব্দুর রহমান বলেন: আমিও তার কাছে সকাল পর্যন্ত থাকলাম। তিনি বলেন: আমাদের ও কোন এক সম্প্রদায়ের মাঝে একটি চুক্তি ছিল।চুক্তি শেষ হয়ে গেলে আমরা বারজন লোক নিযুক্ত করলাম। প্রত্যেক লোকের সাথে অনেক লোক ছিল। আল্লাহই ভাল জানেন প্রত্যেক লোকের সাথে কত লোক ছিল।তাদের প্রত্যেকের নিকট এ খাবার পাঠান হল। তারা সকলেই সে খাবার খেল। [. মুসলিম, হাদীস নং-৫১৯২]

জাবের ইবনু আবদিল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: পরিখা খননের সময় আমি রাসূলের শরীরে ক্ষুধার লক্ষণ দেখতে পেলাম। তারপর আমার স্ত্রীর নিকট ফিরে এসে তাকে বললাম, তোমার নিকট কিছু আছে কি? কেননা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দেখেছি। সে একটি চামড়ার থলে বের করল, যাতে এক ছা‘ পরিমাণ যব ছিল।আর আমাদের গৃহপালিত একটি মেষ (ভেড়ার বাচ্চা) ছিল। আমি সেটা যবেহ করলাম এবং আমার স্ত্রী যবগুলো পিষে নিল। আমার কাজ সমাধার সাথে সাথে সেও তার কাজ শেষ করল। আমি রান্নার জন্য গোশত কেটে ডেকচিতে রাখলাম। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে এলাম। যাওয়ার সময় স্ত্রী আমাকে বলল: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের দ্বারা তুমি আমাকে লজ্জিত কর না। অতঃপর আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে চুপে চুপে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা একটি মেষ যবেহ করেছি এবং আমার স্ত্রী আমাদের এক ছা‘ (প্রায় আড়াই কেজি) পরিমাণ যব ছিল, তাই পিষে নিয়েছে। কাজেই আপনি কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসুন। এটা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চকণ্ঠে বললেন: ওহে খন্দকবাসি! জাবের তোমাদের জন্য কিছু খাবার প্রস্তুত করেছে,তোমরা সকলে চল। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন: আমি না আসা পর্যন্ত তোমাদের ডেক চুলা থেকে নামাবে না এবং খামীর দিয়ে রুটি বানাবে না। আমি আসলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের আগে আগে আসলেন। আমি আমার স্ত্রীর কাছে এলে সে আমাকে বলল: তোমার সর্বনাশ হোক! তোমার সর্বনাশ হোক! আমি বললাম, আমি তাই করেছি, তুমি যা আমাকে বলেছিলে। অতঃপর সে খামীরগুলি বের করল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে একটু লালা (থু) লাগিয়ে দিলেন এবং বরকতের দো‘আ করলেন। অতঃপর তিনি ডেকের কাছে গিয়ে তাতেও একটু লালা দিলেন এবং বরকতের দো‘আ করলেন। তারপর তিনি বললেন: রুটি প্রস্তুতকারিণীকে ডাক, তোমার সাথে রুটি প্রস্তুত করবে। আর তুমি ডেক থেকে পেয়ালা ভরে ভরে নিবে। আর ডেক চুলা থেকে নামাবে না। তারা ছিলেন এক হাজার লোক। আল্লাহর নামের কসম! তারা সকলেই আহার করলেন। অবশেষে তারা তা ছেড়ে এমন অবস্থায় ফিরে গেলেন যে, আমাদের ডেগ পূর্বের মত উথলাচ্ছিল। আর আমাদের খামীর হতে আগের মত রুটি বানানো হচ্ছিল’। [. মুসলিম, হাদীস নং-৫১৪২]

আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আবু তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু উম্মু সুলাইমকে বললেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুর্বল কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম, তিনি ক্ষুধার্ত। তোমার নিকট কি কিছু আছে? তখন উম্মু সুলাইম কয়েকটি যবের রুটি বের করলেন।তারপর তার ওড়না বের করে এর একাংশ দ্বারা রুটিগুলো পেচিয়ে আমার কাপড়ের মধ্যে গুজে দিলেন এবং অন্য অংশ আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পাঠালেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আমি এগুলো নিয়ে গেলাম এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মসজিদে পেলাম। তাঁর সঙ্গে অনেক লোক। আমি তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আবু তালহা তোমাকে পাঠিয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন: খাওয়ার জন্য? আমি বললাম, হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাথীদেরকে বললেন: ওঠ। তারপর তিনি চললেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:আমিও তাদের আগে আগে চলতে লাগলাম। অবশেষে আবু তালহার কাছে এসে পৌঁছলাম। আবু তালহা বললেন: হে উম্মু সুলাইম! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো অনেক লোক নিয়ে এসেছেন। অথচ আমাদের কাছে এ পরিমাণ খাবার নেই, যা তাদের খাওয়াব। উম্মু সুলাইম বললেন: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: তারপর আবু তালহা গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তারপর আবু তালহা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মু সুলাইমকে ডেকে বললেন: তোমার কাছে যা আছে তা নিয়ে আস। উম্মু সুলাইম ঐ রুটি নিয়ে আসলেন।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করলে তা টুকরা টুকরা করা হল। উম্মু সুলাইম (ঘি বা মধুর) পাত্র নিংড়িয়ে ব্যাঞ্জন বানালেন (এক ধরনের খাবার)। মাশাআল্লাহ তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে (কিছু বরকতের দো‘আ) যা পড়ার তা পড়লেন। এরপর বললেন: দশজনকে আসতে অনুমতি দাও। তাদের আসতে বলা হলে তারা তৃপ্তিসহ আহার করে বেরিয়ে গেলেন। আবার বললেন: দশজনকে আসতে অনুমতি দাও। তাদের অনুমতি দেয়া হলে তারা আহার করে তৃপ্ত হয়ে চলে গেলেন। এভাবে দলের যারা ছিলেন সবাই দশ দশজন করে আসলেন এবং খেয়ে তৃপ্ত হলেন। তারা মোট আশিজন ছিলেন। [. মুসলিম, হাদীস নং-৫১৪২]

উপরোল্লেখিত হাদীস সমূহ দ্বারা বুঝা যায় মেহমানদারীতে পুরুষের ভূমিকা অধিক। সেই সাথে নারীর সহযোগিতাও একান্ত যরূরী। আর মেহমানদারীতে রয়েছে ঈমানের পূর্ণতা, আয়ুবৃদ্ধি ও রুযিতে বরকত। এছাড়া অনাহারীকে খাদ্য খাওয়ানোর মাধ্যমে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা যাবে। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত হাদীসটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত ছিলাম, তুমি আমাকে দেখতে আসনি। তখন মানুষ বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি কিভাবে তোমাকে দেখতে আসব, অথচ তুমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে,আমার বান্দা অমুক অসুস্থ হয়েছিল? তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে নিশ্চয়ই আমাকে তার নিকট পেতে। আল্লাহ আবার বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি তোমার নিকট খানা চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খানা দাওনি। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমাকে কিভাবে খাদ্য দিতাম? অথচ তুমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার বান্দা অমুক তোমার নিকট খানা চেয়েছিল। তুমি তাকে খানা দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে খানা দিতে নিশ্চয়ই তার নিকটে আমাকে পেতে। আল্লাহ আবার বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি তোমার নিকট পানি চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। মানুষ বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমাকে কিভাবে পানি পান করাতাম? অথচ তুমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার নিকট পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি পান করাওনি। তুমি কি জানতে না যে, যদি তুমি তাকে পানি পান করাতে তাহলে তুমি তা আমার নিকট পেতে। [. মুসলিম, হাদীস নং-১৪৪২]

উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, পার্থিব জগতের কোন কাজই অনর্থক নয়। তা যতই ক্ষুদ্র বা নগণ্য হোক না কেন। অতি সামান্য কাজের বিনিময়ও ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে। তাছাড়া দুনিয়াতে ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত মানুষকে পানাহার করানো আমাদের অবশ্য করণীয়। তেমনি পীড়িত ব্যক্তির সেবা-শুশ্রূষা করা ও তাকে দেখতে যাওয়া প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য করণীয়। এর বিনিময় পরকালে আল্লাহ দান করবেন।

এখানে একজন প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মু’মিন এবং যিনি দাওয়াতের কাজ ব্রতী হবেন তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি মু’মিনের উচিত এ সকল গুণাবলী অর্জন করে সে অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করা। তাহলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করবে ইনশাআল্লাহ্।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন