hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

মুক্তবাসিনী-২

লেখকঃ আবু বকর সিরাজী

৩০
হৃদয় ভাঙার গল্প
মানুষ আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী এক অনন্য সৃষ্টি। মানুষের সৃষ্টিতে এমন কিছু উপাদান আছে, যা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। ভালোবাসাও স্নেহ-প্রীতি বস্তুটা পৃথিবীর সব মাখলূকের মধ্যে থাকলেও মানুষের ভালোবাসা ও স্নেহ-প্রীতির ধরন ও প্রকৃতি কিন্তু ভিন্ন। এই ভিন্নতাই মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। যখন এই ভিন্নতা থাকবে না তখন অন্য প্রাণী থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল সেটাও বহাল থাকবে না।

সেই বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা হচ্ছে ভালোবাসা ও স্নেহ-প্রীতির ক্ষেত্রে প্রথমত বৈধতা-অবৈধতার বিষয় বিবেচনা করা। দ্বিতীয়ত ভালোবাসার মাত্রা ঠিক রাখা। এর গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামাতা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন-

« أَحْبِبْ حَبِيبَكَ هَوْنًا مَا عَسَى أَنْ يَكُونَ بَغِيضَكَ يَوْمًا مَا وَأَبْغِضْ بَغِيضَكَ هَوْنًا مَا عَسَى أَنْ يَكُونَ حَبِيبَكَ يَوْمًا مَا » .

‘তুমি তোমার বন্ধুকে পরিমিত মহব্বত করো। কেননা কখনও সে তোমার দুশমনে পরিণত হতে পারে। আর দুশমনের প্রতিও ভারসাম্য বজায় রেখে ক্রোধপ্রকাশ করো। কেননা কোনোদিন সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।’ [তিরমিযী : ২১২৮ [তবে এর সনদ দুর্বল। [যাকারিয়া]]]

আসলে বাণীটির তাৎপর্য এত বেশি যে, এর ওপর আমল করতে পারলে জীবনের অনেক কঠিন বিষয় খুব সহজে সমাধা হয়ে যাবে। এর তাৎপর্য অনুধাবন করি না বলেই আমাদের কারো কারো জীবন নেমে আসে চরম অন্ধকার। যেমন এসেছিল সুমার জীবনে। এই ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল করার কারণে।

মানুষের প্রতীক্ষা বস্তুটা পৃথিবীর কঠিনতম ‘পদার্থের’ একটি। বিজ্ঞানীরা কঠিন ওজনবিশিষ্ট এক ধরনের পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন বলে দাবি করে থাকেন, যার ওজন এত বেশি যে, একদিকে ওই একটুকরো পদার্থ রেখে অন্যদিকে লোহা বা শিসার মতো বিরাট আকারের ধাতুখণ্ড রাখলেও তা শূন্যে ঝুলতে থাকবে। জানি না বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত সেই বস্তুটা কী। কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারা সে সময় প্রতীক্ষা নামের বস্তুটাকে মাপার কথা চিন্তা করেন নি। অন্যথায় তারা এই প্রতীক্ষাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু বলে অভিহিত করতেন।

সে যাকগে, প্রতীক্ষা মানুষকে বেকারার করে। আবার প্রতীক্ষার পরীক্ষায় কাউকে পাশ করতে দেখলে মানুষ অতিমাত্রায় অভিভূত, মুগ্ধ হয়। মুগ্ধতার আবহে নিজেকে প্রশ্নহীনভাবে তার কাছে সোপর্দ করে। জীবনবাজি রাখা এই সিদ্ধান্ত কখনও বা আত্মঘাতী বলে প্রমাণিত হয়।

দীর্ঘ ছয় মাস যাবত সেলফোন বন্ধ করে রেখেছেন সুমা। বেশ সংগ্রামমুখর জীবন। জীবনে প্রতিষ্ঠা হওয়ার দৃঢ় সংকল্পের চাদরে নিজের জীবনকে গুটিয়ে রেখেছেন। ঢাকায় বাসা নেই। মা বাবাও থাকেন না। তাই অনেক কষ্ট করেই ঢাকা থাকতে হয় সংকল্পকে বাস্তবতার লেবাসে অভিষিক্ত করতে। কলেজের পড়াশোনার পাশাপাশি সাইফুরসে কোচিং করেন। কলেজের পড়াশোনার স্বীকৃত অনুষঙ্গ হচ্ছে ভালোবাসা, প্রেমপ্রীতি। হয়ত অভিভাবকরা এ ব্যাপারটি জেনেশুনেই সন্তানদেরকে কলেজে দেন। আর ছেলেমেয়েরাও ‘ফ্রেন্ডস’ নাম ব্যবহার করে পিতামাতার কাছ থেকে কৌশলে এভাবে ভালোবাসার স্বীকৃতি ও বৈধতা বাগিয়ে নেয়। এ কারণে আজ আর কোনো অভিভাবককে তার মেয়ের ‘ছেলেবন্ধু’ আছে কথাটা শুনে মুখ মলিন করতে দেখা যায় না। কিংবা বাসায় কোনো মেয়েসঙ্গী এনে বা মেয়েসঙ্গীর বাসায় গিয়ে আড্ডা দেয়াকেও এখন আর অভিভাবকের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় বিষয় বলে ধরা পড়ে না।

এক শ্বাসরুদ্ধ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এভাবেই এগিয়ে চলেছে আমাদের জীবন। এই জীবনের সাথে কেউ স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়লেও অনেকে চায় দূরে থাকতে। কিন্তু যুগের গড্ডালিকা কেবলই তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে। যুগের অশালীন বায়ুর প্রবলতা তাকে ধাক্কা দিয়ে সততার আঙিনা থেকে দূরে ফেলে দেয়। তাই কারো কারো জীবনের ঘটনা অতি নিদারুণ হলেও তা কেবলই অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত এবং অনিচ্ছাকৃত। সুমার জীবনটাও সম্ভবত এই অনভিপ্রেত উপাখ্যানের পঙ্কে আটকে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।

মুল কথায় আসি। কলেজে পড়ার সময় আতিকের নজরে পড়েন তিনি। প্রথম নজরেই তিনি আতিকের মনে ভালোবাসার জন্ম দেন। ভালোবাসার ডালি নিয়ে আতিক সুমার সম্মুখে উপস্থিত হয়। কিন্তু সুমা সাড়া দেন না। নিজের একটা অক্ষমতা বা প্রতিবন্ধকতা ছিল, হাত ও পায়ে একটা অস্বাভাবিক দাগ ছিল তার। সেটা তিনি জানান তাকে। কিন্তু আতিক কোনো কিছু মানতে রাজি নয়। তার ভালোবাসা চাইই চাই। প্রথম দফায় ঘটনা ততদূর এগোয় না। সুমা কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সংকোচের মধ্যে আবর্তিত হন। তাই ফোনটা বন্ধ রাখেন ঠিক ছয় মাস। ছয় মাস পর সিমটা চালু করা মাত্রই সেই আতিকের কল আসে। আশ্চর্য বিমুগ্ধতার ব্যাপার! তবে কি সে এই দীর্ঘ ছয় মাস অবিরাম ভাবে কল দিয়ে চেষ্টা করে গেছে? সম্ভবত তাই। মোহের সূচনা তো! যে কোনো কিছুর সূচনাতে কিছু উন্মাদনা থাকে। বিষয়টা যদি মোহের হয় তবে তার পরিমাণটা সন্দেহতীত ভাবেই বেশি।

সুমা সে সময় পান্থপথে সাইফোর্সে কোর্স করেন। এক রাতে মেসেজ পাঠিয়ে আতিক সুমার কাছে জানতে চায় আগামীকাল সে কোর্সে যাবে কিনা? সুমা বুঝতে পারলেন সে তার সাথে দেখা করার জন্যই প্রশ্ন করেছে। তাই তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন, না আগামীকাল ক্লাসে যাবো না। কিন্তু আতিক ফিরতি জবাবে জানালো, সুমা ক্লাসে যাক আর না যাক সে পান্থপথে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকবে তার জন্য। সুমা তাকে বারণ করলেন কিন্তু আতিক বারণ শুনল না। শেষ পর্যন্ত সংকোচ আর ভয় নিয়েই কোর্সের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন সুমা।

গিয়ে দেখেন ঠিক ঠিক দাঁড়িয়ে আছে সে। তাকে দেখে ভয়ে হাত পা কাঁপতে শুরু হলো সুমার। ভয়ে না উত্তেজনায়? সেটা সুমা নিজেও বলতে পারবেন না! আতিক সুমার হাত ধরে টেনে রিক্সায় তুলল এবং বলল, এই একটু আমরা ফার্মগেটে দাঁড়াবো এবং সামান্য সময় গল্প করে চলে আসব। সুমা বললেন, আমি ক্লাস মিস করতে পারব না। কিন্তু সে বলল, আরে একদিন ক্লাস মিস্ করা কোনো ব্যাপার না। আমরাও তো ক্লাস করি এবং এখনও করছি।

যাহোক, সে জোর করে সুমাকে ফার্মগেটে নিয়ে এসে দাঁড়ালো এবং একই বক্তব্য পেশ করল- ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব।’ সুমা বললেন, কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। এরপর সে তার কাছ থেকে একটি প্যাড নিয়ে তাতে কবিতার দুটি লাইন লিখল- ‘তোমার উঠোনে এনে দিব আমি সাতটি অমরাবতী।’ অর্থাৎ শুধু এক স্বর্গ নয়, সাত সাতটি স্বর্গই তোমার উঠোনে এনে হাজির করে দেব! হায় মোহ! মোহের জালে ছটফট করা বিহঙ্গ বুঝি এভাবেই অন্যের জন্য স্বপ্নে জাল বোনে?

বিয়ের জন্য চাপাচাপি বাড়তেই থাকে তার। হাজার বার অস্বীকার করলেও সুমা তো মেয়ে মানুষ। মেয়েলী সরলতা তাকে আচ্ছন্ন করে। এদিকে আতিকও নিজেকে সুমার কাছে করুণার পাত্র করে উপস্থাপন করে। তখন সে অসুস্থ। অসুস্থতাকেই সে হাতিয়ার বানায়। সুমাকে সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে খাবে না, চিকিৎসা গ্রহণ করবে না এবং পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করবে না। আতিকের এই বালখিল্যতায় ভড়কে যান সুমা। ‘তুমি কথা না বললে আমি খাবো না’ আতিকের এই কথাটি সুমার মনে মায়ার শক্ত বাঁধন তৈরি করে। তার কারণে একটা লোক যদি সুস্থ হয়ে যায় তবে তা কম কি?

অসুস্থ একটা লোককে ভালো করার পরিকল্পনা থেকে অসুস্থ একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় দুইজনের মধ্যে। তখন ডিজুসের ফ্রি অফারের যুগ! ফ্রির সুবাধে তারা দুইজনে সারাদিন মোবাইলে কথা বলতে থাকেন। কথায় কথায় কোন ফাঁকে যে সুমার মনে দুর্বলতা ঢুকে পড়ে তা তিনি নিজেও টের পান না। তাছাড়া আতিক তাকে একটি মধুর স্বপ্ন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করত। প্রলুব্ধ হতেন সুমা। আতিকের দেখানো সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে যেতেন তিনি। সে বেশির ভাগ সময় স্বপ্ন দেখাতো একটা ফুটফুটে মেয়ে সন্তানের। সেই স্বপ্নের তাড়নায় আচ্ছন্ন হন সুমা।

এক পর্যায়ে আতিকের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তিনি। আতিক ব্যক্তি উদ্যোগে বিয়ে করতে চাইলেও সুমা এখানে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বলেন, এভাবে নয় অভিভাবকের মাধ্যমে বিয়ে হোক। তোমার অভিভাবককে আমার বাবা-মার কাছে পাঠাও। সে বলে ঠিক আছে আমি নিজেও যাচ্ছি তোমার মা বাবার কাছে। সুমার মা বাবা তাকে আগে পড়ালেখা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মনোপুত না হওয়ায় বাইরে গিয়ে সে সুমাকে ফোন দিয়ে বলে, আমি বিয়ের যে দিন ঠিক করবো তাতে যদি তুমি সম্মত না হও তবে আমি আত্মহত্যা করব। সুমা তাকে সাধ্যমতো বোঝানোর চেষ্টা করেন। বলেন, দেখ এভাবে যদি বিয়ে করো, তাহলে কখনও আমাকে ছেড়ে যেত পারো। তখন তো আমি মা-বাবাও হারালাম, তোমাকে তো হারালমই।

সে বলল, দেখ, আমাদের পরিবারে বউ ছাড়ানোর রেকর্ড নেই। আমার বড় ভাইও ভালোবাসা করে বিয়ে করেছেন এবং প্রথমে বন্ধুসার্কেল নিয়ে বিয়ে করে পরে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করেছেন। এভাবে তারা এক বিয়ে মোট তিনবার করেছেন! আর আমি তো তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করছি। তোমাকে ফেলে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে আরও বলে, তুমি যত রকমের গ্যারান্টি চাও তা দেব। এরই সূত্রে কাবিননামায় সে সাতলাখ টাকা নির্ধারণ করে।

বিফল হন সুমা। বাধ্য হন আতিকের বিয়ের ডাকে সাড়া দিতে। টাকার তো ব্যবস্থা নেই! আতিক বলল, তুমি টাকার ব্যবস্থা করো, পরে আমি শোধ করে দেব। কিন্তু সুমা কোথায় পাবেন বিয়ের টাকা? কোনো নারী কি নিজের বিয়ের পিঁড়ি রচনার টাকা নিজে সংগ্রহ করে রাখে? কিন্তু অভাগী সুমা তাই করলেন। নিজের যে গহনা ছিল তা গোপনে বিক্রি করে বিয়ের আয়োজন করলেন। বিয়ে করলেন বোনের সহযোগিতায়। বোনের স্বামী ছিলেন একজন উকিল। তিনি তার ওকালতি জ্ঞান দিয়ে কীভাবে বাবা-মার অমতে বিয়ে করতে হয় তা তাকে শিখিয়ে দিলেন। তাই কোনো সমস্যায় পড়তে হলো না সুমাকে।

বিয়ের আগে আতিক জানতে চায় সুমার জন্য সে কী নিয়ে আসবে? সুমা জানান, কিছুই আনতে হবে না। শুধু পাঁচ টাকার একটা টিপ নিয়ে আসলেই হবে। পরের দিন হাজির হয় আতিক। তাকে দেখে বিয়ের পোশাক পরিধান করতে থাকেন সুমা। কাপড় পড়া শেষ হলে আতিকের কাছে টিপটা চান তিনি। কিন্তু আতিক দুঃখ প্রকাশ করে বলে, ওহ্হো, টিপটা তো আনা হয়নি! বন্ধুরা রাতে ওয়েইন খাওয়ার জন্য পাঁচশত করে চাঁদা ধরেছিল। সেখানে টাকা দেয়া হয়েছে। আর এনিয়ে ঝগড়া হওয়ায় টিপটা কেনার কথা মনে নেই!

থমকে যান সুমা। নিজের গহনা বিক্রির অর্থে বিয়ের আয়োজন করে মাত্র পাঁচ টাকার একটা টিপও স্বামীর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া হলো না! অথচ পাঁচশ টাকা দিলো বন্ধুদেরকে ওয়েন খাওয়ার জন্য! বিয়ের বাকি পথ পরিক্রমার একটু ইশারা যেন এখানেই হয়ে যায় সুমার। যাহোক, মনোকষ্ট নিয়েই তারা বিয়ে করেন এবং বিয়ে করার পর বোন এবং একজন চাচীর মাধ্যমে বাড়িতে জানানো হয় যে, সুমা বিয়ে করেছেন।

দশ মাস পেটে ধারন করা মা, সংসারযুদ্ধে অবতীর্ণ রণক্লান্ত সন্তানের মুখ উজ্জ্বল করার প্রত্যাশায় অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে যাওয়া পিতা নিজেদের অগোচরে সংঘটিত হওয়া সন্তানের বিয়ের সংবাদে কতটুকু মর্মাহত হন তা জানিনে, অনুমান করার বৃথা চেষ্টা করে মা বাবার কষ্টকে তাচ্ছিল্যও করতে চাই না।

সুমার মা বাবা সহজে না হলেও বিয়েটা মেনে নিলেন। এক অসংযত ও লজ্জিত পদক্ষেপে বাড়ির আঙিনায় পা রাখলেন সুমা এবং বাড়ির নতুন জামাই আতিক। সুমা অনুরোধ করে বললেন, আমাকে যা করার করো, বলার বলো কিন্তু আতিকের সাথে কিছু করো না। তাকে জামাইর মতোই স্বাভাবিকভাবে বরণ করে নাও।

প্রথম থেকেই অমত ছিল সুমার বাবা-মার। শেষ পর্যন্ত তারা পীড়াপীড়ি করেছেন আতিকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার। কিন্তু মা বাবা যতই বলেছেন আতিকের প্রতি সুমার মায়া ততই প্রগাঢ় হয়েছে। সুমা বড্ড আদরে আর আহ্লাদে লালিত পালিত হয়েছিলেন। বাবা-মা খুবই স্নেহ করতেন তাকে। জামা-কাপড়ে রাজকীয় জীবন-যাপন করতেন। তাই আতিককে স্বামী হিসেবে পাওয়ার পর তাকেও সাজান নিজের মনের মতো করে। নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে তাকে নতুন নতুন জামা কিনে দিতে থাকেন।

রাস্তা-ঘাটে, হাটে-মার্কেটে কারও গায়ে দেখা কোনো জামা পছন্দ হলেই তিনি তা পছন্দ করে আতিককে কিনে দিতেন। ভালোবাসার মানুষটিকে তিনি এভাবেই সাজাতেন মনের মতো করে। তখন তার মনে হতো আতিক তার আঙিনায় সত্যিই সাতটি অমরাবতী এনে দিয়েছে!

আতিক তখন লিভারের সমস্যা ও আলসারের মতো কঠিন রোগে আক্রান্ত। কিন্তু দমে যান না সুমা। অসুস্থ স্বামীকে মনেপ্রাণে সেবা করেন তিনি। এক সাথে খেতে বসে নিজ হাতে গ্রাস তুলে দেন স্বামীকে। পেট পুরে খাইয়ে পরে নিজের জন্য মুখে খানা তুলতে গিয়েও থেমে যান। বলেন যদি এই লোকমা খাও তবে আমি খানা খাবো।

এভাবে ভালোবাসার সব উপহার পেশ করেন অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ করে তোলার প্রত্যাশায়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ঔষধালয় থেকে স্বামীর সুস্বাস্থ্যের জন্য ঔষধ সংগ্রহ করেন। কিন্তু কিছুতেই পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছিল না আতিক। স্কিনের দাগ উঠিয়ে ফেলার জন্য অনেক দিন থেকে টাকা সঞ্চয় করছিলেন সুমা। সাধ ছিল একদিন এই টাকা দিয়ে দেহ ও হাতে এই অবাঞ্ছিত দাগগুলো দূর করে দেবেন। সুন্দর ত্বকে মেহেদী লাগাবেন! আরও কত স্বপ্ন!

কিন্তু ভালোবাসার স্বার্থে নিজের স্বপ্নটাকে চাদরেই মুড়িয়ে রাখতে হয় সুমাকে। স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি সেই টাকা স্বামীর চিকিৎসা সেবায় ব্যয় করেন। সুমার স্বপ্নের টাকায় ফার্মগেটের এক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সুস্থ হয়ে ওঠে আতিক। সেদিন সুমা কী খুশি!

কিন্তু সুস্থ হলেও বাড়িতে থেকে স্বামীর সেবাযত্ন করে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না সুমা। তাই আলাদা বাসা ভাড়া নেন তিনি। নয় হাজার টাকা মাহিনায় চাকরি নেন নুরে আলম সিদ্দিকী গ্রুপের এক অফিসে। এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন সুমা। অফিস, রান্নাবান্না, স্বামীর সেবা এবং তার লেখাপড়াসহ ব্যক্তিগত যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা!

শত কষ্টের মধ্যেও বেশ ভালোই কাটছিল সুমার এই সংগ্রামী জীবন। নিজের শরীরের ওপর দায়িত্বের এই বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রাখলেও কখনও এর ভার অনুভব হয়নি। কিন্তু একদিনের একটি ঘটনা হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো করে দেয় তার। একটা মেয়ের কল আসে আতিকের নাম্বারে। আতিক প্রথমে স্বীকার করতে চায় না যে, এটা কোনো মেয়ের নাম্বার। পরে চাপাচাপিতে স্বীকার করে কিন্তু সুমাকে ধমকি দেয় সে। সে বলে আমাকে পরীক্ষা করার জন্য বোধ হয় তুমিই মেয়েটাকে নাম্বার দিয়েছো। যদি তাই করো তাহলে অনেক সমস্যা হবে বলে দিচ্ছি- বলে আতিক সুমাকে হুমকি দেয়।

সুমার অস্বীকৃতিতে আতিক একটু অভিনয় করে। সে তার বন্ধুদেরকে নাম্বারটি দিয়ে মেয়েটিকে গালি দিতে বলে এমনকি সে তার ছোটভাইকে দিয়েও মেয়েটিকে বকা খাওয়ায়। এক পর্যায়ে অবস্থা শান্ত হয়ে আসে। সুমাও প্রশান্তির সাথে অফিস করেন, স্বামী সেবা করেন এবং একহাতে সংসারে সব কাজ সম্পাদন করেন। কিন্তু সুমার শান্ত মনে হঠাৎ ঝড় ওঠে। একদিন তিনি শুনতে পান যে, আতিক কুমিল্লায় গিয়ে মেয়েটির সাথে দেখা করে এসেছে। শোনার পরও নিশ্চুপ থাকেন সুমা। তবে নাম্বারটা খুব ভালো করে মনে রাখেন। দেখতে পান সেই নাম্বারে নিয়মিত কথা বলে আতিক।

একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন ভাত তরকারী সব আপন স্থানে পড়ে আছে। আতিক খায়নি। প্রথমে ভেবেছিলেন হয়ত বাইরে ছিল, তাই হোটেলে খেয়ে নিয়েছে। কিন্তু খুব অল্প সময়েই আতিক ধরা খেয়ে যায়। জামাটা খুলে রেখে গোসলখানায় ঢুকে আতিক। সে সময় তার নাম্বারে কল আসে। মোবাইলটা বের করতে গিয়ে কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বের হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। মোবাইলের সাথে বাসের একটা টিকিটও উঠে আসে। টিকিটটা কুমিল্লার একটা বাসের। কলটাও সেই মেয়ের, যার সাথে দেখা করার জন্য টিকিটটা কিনতে হয়েছিল আতিককে। তাই ভাত না খাওয়ার রহস্য আর অস্পষ্ট থাকে না সুমার।

কলদাতার পরিচয় জানতে চাইলে আতিক বলে এটা তার অফিসের এক পুরুষের নাম্বার। সুমা বলেন কই, সেতো মেয়ে মানুষের কল! তিনি নাছোড়বান্দা। বলেন, ঠিক আছে আমাকে নাম্বার দাও, আমি কল দেব। তার পীড়াপীড়িতে ক্ষিপ্ত হয় আতিক। ফলে সে বেদম প্রহার করে সুমাকে। সুমা বলেন, আমাকে মেরেও ফেললে আমি দেখব কার নাম্বার এটি। তবুও দিতে চায় না আতিক। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার হুমকি দেন সুমা। তখন আতিক বলে নাম্বারটি একটা মেয়ের। তবে আমি তার সাথে ব্যবসা করি। এরপর সুমা স্বামীর সামনেই নিজের মোবাইল থেকে মেয়েটির নাম্বারে কল দিয়ে বলেন, দেখো বোন! আমি আতিকের স্ত্রী, আমার মনে হয় তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে। অনুগ্রহ করে তুমি আতিকের নাম্বারে আর কল দিওনা।

লাইনটা কেটে দেয়ামাত্রই আতিকের মোবাইলটা বেজে ওঠে। নাম্বারটা দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয় আতিক। সুমার দৃষ্টি থেকে তা আড়াল থাকে না। তিনি তাকে লাউডস্পিকারে কথা বলতে বলেন। লাউডস্পিকারে শ্রুত স্পষ্ট বক্তব্য সুমার দিলে মারাত্মক চোট দেয়। মেয়েটি বলে, একটু আগে যে ‘মেয়েটি’ ফোন দিলো সে কে? আতিক তড়িঘড়ি করে বলে, তুমি ওসব ধরো না, ওটা কিছু না! এভাবে আতিক দু’কূলই রক্ষা করার প্রয়াস করলেন। কিন্তু এটা তো শাশ্বত বাস্তবতা যে, স্ত্রী আর পরকীয়ার দুটি বিপরীতমুখী স্রোত একসাথে চলতে পারে না। তাই দু’কূল রক্ষা করার প্রয়াসও সফল হয় না। হয় দু’কূলই হারাতে হয় নতুবা স্বামীত্বের মানহানী করে পরনারীর হাত ধরে পলায়ন করার কাপুরুষতা প্রদর্শন করতে হয়।

স্ত্রী পরিচয় দেয়া সত্ত্বেও কলারের ‘মেয়ে’ কথাটা আর স্বামীর ‘ওটা কিছু না’ কথাটা সুমাকে নিদারুণ ব্যথিত করল। আরো কতক্ষণ কথা কাটাকাটি চলল। আতিক রাগে-ক্ষোভে আরও প্রহার করল সুমাকে। এরপর আতিক বাসা থেকে বের হয়ে যায় আর সুমা চলে যান অফিসে। অফিসে গিয়ে আতিকের নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখেন নাম্বার ব্যস্ত। সাথে সাথে মেয়েটির নাম্বারে কল দিয়ে দেখেন সে নাম্বারটাও ব্যস্ত। এরপর তিনি অফিস থেকে বাসায় চলে আসেন। অসময়ে জায়নামাজ বিছিয়ে সালাত আদায় করেন। মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ‘হে আল্লাহ! আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্তু আমি যে আর পারছি না। তাই পাপের আগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমার এই মহাপাপ ক্ষমা করে দিও।’

অফিসের একটা লোক তাকে ছোট বোন মনে করতেন এবং তাকে খুব স্নেহ করতেন। সুমার ব্যাপারটি তিনি আগে থেকেই জানতেন। অফিসে তিনি সুমাকে না দেখে শঙ্কিত হলেন। কল দিলেন তার নাম্বারে। জায়নামাযে কান্নারত অবস্থাতেই কলটা আসে সুমার নাম্বারে। তিনি কল রিসিভ করে বলেন, আমি সালাতে আছি, একটু পরে কল দেন। একথা বলে লাইনটা কেটে দিয়ে মোবাইল অফ করে দেন সুমা। এরপর বিষ পান করেন।

বিষের প্রতিক্রিয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। তখন তিনি শেষবারে মতো স্বামী ও অন্যান্য আপনজনদের কাছ থেকে চিরবিদায় নেয়ার জন্য ফোনটা অন করেন। প্রথমেই ফোন দেন ভালোবাসার মানুষটিকে। আতিককে বলেন, তোমার কষ্টের দিন শেষ হচ্ছে, তোমার আপদ দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছে। নিরসকণ্ঠে আতিক বলে কী হয়েছে? সুমা বলেন, আমি দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি তাই বিষ খেয়েছি। কথাটা শুনে চমকে ওঠে আতিক। সে কসম করে বলে বিশ্বাস করো, আমি আর কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে কথা বলব না। তুমি সুস্থ হয়ে যাও, ডাক্তারের কাছে যাও।

ইতিমধ্যে সেই ভাইটিও বাসায় চলে আসেন। কিন্তু দরজা বন্ধ করে রাখেন সুমা। লোকটি দরজা খুলতে বললে সুমা বলেন, আমি তো বাঁচার জন্য বিষ খাইনি। তিনি বলেন, যদি দরজা না খোলো তাহলে আমি চিৎকার করতে বাধ্য হবো। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে দরজা খোলাতে সক্ষম হন তিনি এবং তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। অনেকদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন সুমা। কিন্তু আতিক সেই যে প্রথম শুনল এরপর আর কোনোদিন কল দেয়নি এবং জানারও চেষ্টা করেনি যে, সুমা কী করে সুস্থ হয়ে উঠল।

এই কঠিন মুহূর্তে সুমার কথা মনে না পড়লেও এক কারণে ঠিকই মনে পড়ল। একবার সে ফোন করে জানালো, তার হাতে টাকা নেই। সে একবেলা খেয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। বুকটা কেঁপে উঠল সুমার। হাতে যে টাকা নেই সে কথাই ভাবলেন না তিনি। তৎক্ষণাৎ স্বামীকে ঢাকায় ডেকে নিলেন এবং সর্বশেষ স্মৃতি হাতের রিংটা আতিকের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, যাও বিক্রি করে তোমার প্রয়োজন মেটাও। সেই টাকা শেষ হলে আবার টাকা চায় সে সুমার কাছে। এর মধ্যে একদিন বাসাওয়ালা সুমাকে বললেন, আপনি যদি দুয়েকদিন বাসায় না থাকেন তাহলে আপনার স্বামীকে একটা মেয়ের সাথে ধরিয়ে দিতে পারব!

কথাটা শুনে আত্মার পানি শুকিয়ে যায় সুমার। আতিককে বললে, সে বলে বাড়িওয়ালা দুষ্টামি করে কথাটা বলেছে। এরপর থেকে নিয়মিত তিনি আতিকের পরিবর্তন দেখতে পেলেন। ভালোবাসার পাটটা ভয়ানকভাবে প্রহার আর নির্যাতনের দিকে গড়াতে লাগল। আতিক অসুস্থ দেখে সুমা তাকে চাকরি করতে দেননি। দুর্বল ঘাড়ে একাই টেনেছেন সংসার নামক ভারি জোয়াল।

আতিক থাকত চট্রগ্রামে। তাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন তিনি। কিন্তু আতিক স্ত্রীর এই অবদানের মূল্য দেয়নি। স্ত্রীর উপার্জন ঢেলেছে সে পরনারীর পেছনে। তার বন্ধুরাও তাকে ভর্ৎসনা করে বলত, স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা এনে পরনারীর পেছনে ব্যয় করতে লজ্জা করে না তোর? জানিনা এরচেয়ে বড় খেয়ানত আর স্ত্রীর ভালোবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতার দ্বিতীয় নজির আছে কিনা?

নয়টার সময় অফিস সুমার। সারারাত আতিকের পা চেপে দিতে হয়। কখনও কখনও ভোরের আলো পড়ে আতিকের পায়ে লুটিয়ে পড়া সুমার ক্লান্ত ও ঘুমন্ত দেহের ওপর। দীর্ঘ রজনীতে ঝিঁ ঝিঁ পোকাও ডাকতে ডাকতে একসময় ক্লান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দেয়। হয়তবা আপন নীড়ে আশ্রয় নেয় বিশ্রামের কোলে। কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ মেলে না সুমার। কিছুটা স্বামীর নির্দেশ পালন আর বাকিটা মনের টানেই তাকে মধ্য রজনী এবং কখনও কখনও সারারাত পা দাবাতে হয়। ভোরের আলো ফুটলে আবার হাতে নিতে হয় থালাবাসন, ডেকসি-পাতিল। কিন্তু স্বামীর কঠোর নির্দেশ এসময় সামান্য পরিমাণও শব্দ হতে পারবে না। এক পাতিলের সাথে অন্য পাতিলের সংঘর্ষ বা ঠোকাঠুকি হতে পারবে না! পাছে যদি তার ঘুমের-আরামের ব্যঘাত ঘটে!

সুমা চেষ্টা করেন স্বামীর নির্দেশ পালনের। কিন্তু ‘অবুঝ পাতিল’ বোঝে না সুমার কষ্টের কথা। তাই অজান্তেই তারা একে অপরের সাথে ঠোকাঠুকি করে। পরিণামে সুমার কপালে জোটে আতিকের তীব্র বক্র চাহনি, কঠিন গালমন্দ আর কখনও কখনও প্রহারের হাত! সকালে আবার ডিম সিদ্ধ করে খাওয়াতে হয়। তাও আবার কাঁটায় কাঁটায় বিশুদ্ধ (?) সিদ্ধ হতে হবে! কম সিদ্ধ হলে কিংবা বেশি সিদ্ধ হলেই কপালে জুটবে গালমন্দ।

আতিক একদিন বলল, এত সিদ্ধ হলে হবে না। ভালোবাসায় অন্ধ সুমা বললেন, ঠিক আছে আজ খাও, আগামীকাল তোমার মনের মতো সিদ্ধ করে দেব। পরের দিন বলল, এত কম সিদ্ধ খাবো না। তো সুমা বললেন, ঠিক আছে তুমি ব্রাশ করতে যাও, আমি তোমার মতো করে সিদ্ধ করে নিয়ে আসছি। এভাবে মানসিক চাপের মধ্যে কাটতে লাগল সুমার জীবন। একদিন দেখলেন তার ব্রাশ, টিস্যু এবং ব্যবহারিক আসবাবপত্র সব খাটের নিচে। কারণ জিজ্ঞেস করলে আতিক বলল, এগুলো এখন থেকে এখানেই থাকবে। কোনো কারণ নেই, হেতু নেই কেবলই সুমাকে কষ্ট দেয়া! সুমা বললেন, অফিসে যেতে তাড়াহুড়া থাকে, রান্নাবান্না করে এমনিতেই সময় পাই না। আবার কাজের সময় যদি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে না পাই তাহলে চলবে কীভাবে? তাই তুমি জিনিসগুলো আগের জায়গা রেখে দাও।

আতিক এসব যৌক্তিক কথা শুনতে নারাজ। সুমা তাকে আদেশ দিলেন কেন, এই অপরাধে তৎক্ষণাৎ সে খাট থেকে নেমে তার চুল ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলে বুকের ওপর পা দিয়ে চেপে ধরে। এক অনিঃশেষ বেদনায় কেঁদে উঠে সুমার আত্মা। আজ কী দেখছেন তিনি? এই সেই আতিক, যাকে তিনি নিজের গহনা বিক্রি করে সুস্থ করে তুলেছেন? নিজে না খাইয়ে তার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেছেন? সারারাত জেগে পা দাবিয়ে দিয়েছেন? সারাদিন পরিশ্রম করে লেখাপড়ার খরচ জুটিয়েছেন? শেষ সম্বল হাতের রিংটা বিক্রি করে তিনবেলা খাবার নিশ্চিত করেছেন? সেই আতিক, যে তার আঙিনায় সাতটি বেহেশত (অমরাবতী) এনে দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল? তবে এটাই কি আতিকের বেহেশত? পায়ের নিচের এই বেহেশতের কথাই কি তাহলে এনে দেয়ার পণ করেছিল সে?

পৃথিবীর সবচেয়ে আপন আর প্রিয় মানুষটির পদপিষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসা সুমার চিন্তা শক্তি থমকে যায়। চোখ বন্ধ হয় আসে। নিশ্বাস তুলতে কষ্ট হয়। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি পাহাড়টি কেউ তার বুকে চেপে ধরেছে! তপ্ত বুক ফেড়ে কেবল একটি গরম নিশ্বাস বের হয়ে আসে সুমার। তা দেখে বুটের চাপ আলগা হয়ে আসে আতিকের। একরাশ দহন, বেদনা, পীড়া আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে উঠে দাঁড়ান সুমা। স্বামীর প্রতি আজ অভিমানেরও ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন অফিসের সময় বয়ে যায়। নাহ্, দেরি করা যায় না! এই স্বামী, এই সংসারের জন্যই যে তাকে অফিসে ছুটে যেতে হবে! তাই দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠা স্বপ্নদ্রষ্টার মতো হতবিহলতা নিয়ে অফিস পানে ছুটে চলেন সুমা। পেছনে ফেলে আসেন ভালোবাসার প্রতিদানের এক বিকৃত উপমা।

আরেকদিনের ঘটনা। অফিসের আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। বাসা থেকে অফিসে যেতে গুণে দশ মিনিটই লাগে। রান্না করে এনে খানা খেতে বসে আতিককে খাওয়ার জন্য ডাকলেন সুমা। কিন্তু আতিক এখন খাবে না বলে সুমাকে খেয়ে যেতে বলল। কিছুক্ষণ পর যখন অফিসের আর মাত্র দশমিনিট বাকি তখন সুমাকে খানা দিতে বলে আতিক। তার কথায় কিছুটা বিরক্ত হলেন সুমা। সম্ভবত দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম স্বামীর সাথে রাগ করার ঘটনা ঘটল সুমার। শ্লেষের সাথে বললেন, আমার তো অফিস সময় হয়ে যাচ্ছে, যখন সাধলাম তখন খেলে না। এবার একটু কষ্ট করে নিজেই বেড়ে খাও না!

পৃথিবীর কোনো অভিধানে কিংবা আইনে এটাকে মোটেই স্ত্রীর দায়িত্ব অবহেলা কিংবা স্বামীর প্রতি অবহেলা বুঝায় না। বরং স্বামীর হঠকারিতাই বুঝায়। সেই হঠকারিতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আতিক কর্কশকণ্ঠে বলল, না, তুমিই খানা দিয়ে যাও। এবার আরেকটু শক্ত হলেন সুমা। স্বামীর সাথে বিরক্তি প্রকাশ না করতে পেরে পাশে থাকা বোতলটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। ফলে মেজাজে তিরিক্কি খেলে যায় আতিকের। সে শক্ত একটা ঝাড়– হাতে তুলে নেয় এবং সর্বশক্তি ব্যয় করে সুমার পিঠে আঘাত করে।

কৃশকায়, দুর্বল, রাতজাগা আর দিনেখাটা ‘মেয়েটি’ আঘাতের প্রচণ্ডতার কাছে হার মানতে বাধ্য হন। মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সুমা। মা বাবা থেকে দূরে, একমাত্র ভালোবাসার মানুষের আশ্রয়ে একান্তই অসহায় সুমার দেহটি নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। কি জানি হয়ত আরো কষ্টের বোঝা বহনের জন্য তখনও তার দেহে প্রাণবায়ুর যাতায়াত অব্যহত থাকে। অনেকক্ষণ এভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায় আতিক। ভালোবাসা কিংবা মায়ায় নয়, ভয়ে সে তাকে বিছানায় নিয়ে যায় এবং সেবা করে সুস্থ করে তোলে। সদ্য মৃত্যুদুয়ার থেকে ফিরে আসা সুমা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আর লুকিয়ে রাখার সাহস পান না তিনি। তাই তিনি ঘটনা আতিকের ভাইকে জানাতে চান। কিন্তু সে তার কাছে আবারও ক্ষমা প্রার্থনা করে পার পেয়ে যায়।

আতিক চট্রগ্রামে থাকত আর মাঝেমধ্যেই সুমাকে ডেকে নিয়ে যেত সেখানে। একদিনের ঘটনা। সুমাকে চট্রগ্রামে ডেকেছে আতিক। স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই সুদূর চট্রগ্রামে হাজির হলেন সুমা। আতিক তাকে নিয়ে উঠল এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখানে কী এক কথা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে আতিক। সুমাকে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করে, প্রহার করতেও বাদ রাখে না। ব্যথিত হৃদয়ে সুমা বলেন, তুমি তো আমাকে সবসময় মারই। মারার জন্য এখানে ডেকে নিয়ে আসলে কেন, তুমি আমাকে বলতে। টাকা দিতাম ঢাকায় গিয়ে মেরে আসতে!

জানা নেই, আতিকের আত্মাটা কোন পাথরে গড়া! কোনো পাথরকেও সামনে রেখে কোনো অসহায় নারী যদি এভাবে আকুতি জানায় তবু পাথরও বোধ হয় না গলে থাকতে পারবে না। কিন্তু তবু গলে না আতিকের মন। তার প্রতি সুমার সব করুণা, ত্যাগ, অবদান আর অনুকম্পার কথা এক মুহূর্তের জন্যও স্মরণে আনতে চায় না সে। স্মরণের পুরো অংশ জুড়ে থাকে কেবল সেই অতিথি নারীটি।

সে আরও বলে, সামনে কোনো সময় যদি চট্রগ্রাম আসো তবে কাউকে তা জানাবে না। কথাটা শুনে অবাক হন সুমা। তিনি বলেন, আমি তোমার স্ত্রী। সবাই তা জানে, তাই লুকিয়ে আসতে হবে কেন? মেরেটেরে ফেলবে নাকি! সুমার বিদ্রুপে ক্ষীপ্ত হয় আতিক। এ কথাটিকে কেন্দ্র করেও সুমাকে প্রহার করে সে।

আতিক তখন বাড়িতে। একদিন সে ফোন দিয়ে সুমাকে জানায় সে আজ তার কাছে আসছে। শুনে মনের কোণে হিল্লোল বয়ে যায় সুমার। বহুদিন পর প্রিয় স্বামী কাছে আসছে! কার না ভালো লাগে? শিহরণে তাই চোখ বন্ধ হয়ে আসে সুমার। বিকেল তিনটার সময় রওয়ানা হয় আতিক। কিন্তু পাঁচটার সময় থেকে ফোনটা বন্ধ পান সুমা। চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসে তার। তখন থেকে একটানা কল দিতে থাকেন স্বামীর নাম্বারে। কিন্তু কল ঢোকে না। রাত দশটার দিকে তার অন্য খেয়াল হয়। সেই মেয়েটার নাম্বারে কল দেন তিনি। দেখেন মেয়েটি রাস্তায়। সে বলে অফিস থেকে বের হলাম বাবা আমাকে নিতে এসেছে। ঘটনা বুঝতে বাকি থাকে না সুমার।

তিনি কথা না বাড়িয়ে আবার ফোন দেন আতিকের নাম্বারে। সেটা তো বন্ধই কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটির নাম্বারও বন্ধ পাওয়া যায়। আতিকের অবৈধ অভিসারে বিচলিত হতে থাকে একজন প্রতিপরায়ণ নারীর নিরাপরাধ অন্তর। তিনি সারারাত স্বামীর জন্য টেনশন করেন আর একটানা কল দিতে থাকেন। ভোর পাঁচটার দিকে আতিকের নাম্বারে কল ঢোকে। অভিমানের সাথে আতিকের কাছে জানতে চান তোমার না আমার কাছে আসার কথা ছিল? তুমি এখন কোথায়? আতিক বলে সে চট্টগ্রামে এসেছে এবং মোবাইলে চার্জ না থাকায় তা বন্ধ ছিল! সামান্য প্রতিবাদ করে থেমে যান সুমা। জানেন প্রতিবাদের ভাষা এখানে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে!

এভাবে বহুবার সুমাকে প্রতারিত করেছে আতিক। রাতের কিছুক্ষণ কথা বলেই সে বলত, ফোন রাখো, এখন ঘুমাব। রাতে আর কল দেবে না। কিন্তু মন মানত না সুমার। তিনি মাঝ রজনীতে স্বামীর নাম্বারে কল দিতেন। ঘুমের ব্যাখ্যা পেতে দেরি হতো না। মোবাইলের স্কিনে ভেসে ওঠা busy শব্দটিই বলে দিতো আতিক কোন ঘুমের জন্য স্ত্রীকে ফোন দিতে বারণ করেছে!

আতিক বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্ত্রী সুমা এব্যাপারে একেবারে অন্ধকারে। একদিন সে ঠিক ঠিক বিদেশ চলে গেল। কিন্তু স্ত্রীকে সে কথাটুকুও জানালো না। এদিকে স্বামীর নাম্বারে কল দিয়ে না পেয়ে ব্যাকুল আর অস্থির হয়ে ওঠেন সুমা। দীর্ঘ দুই মাস পর জানতে পারেন আতিক বিদেশ গেছে!

সে সময় সুমা কঠিন মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। দুই দুইবার বিষ খাওয়ার কারণে শরীরটা এমনিতেই নিষ্ক্রিয় হতে চলেছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনমাস অফিস করতে পারেননি। কর্তৃপক্ষ এই তিন মাসের বেতন দিতে চাইলেও কোনো এক সমস্যার কারণে দিতে পারছিল না। এই কঠিন সময়ে তিনি বারবার স্বামীর কাছে কিছু সাহায্য চেয়ে ফোন করেছেন। কিন্তু প্রতিবার আতিক জানিয়েছে কোম্পানি থেকে বেতন পাচ্ছে না। তাই তার পক্ষে টাকা পাঠানো সম্ভব না। সাহায্য করা তো দূরের কথা এই সময় সে সুমাকে নিজ থেকে কলও দিত না।

মিসড কল দিয়ে সুমার সাথে কথা বলত সে। চারতলার বাসা থেকে নিচে নামতে অসুস্থ সুমার প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগে যেত। তিনি নেমে মোবাইলে টাকা তুলে তবেই আতিকের সাথে কথা বলতেন। আতিক বলত, সে যে অফিসে আছে সেখান থেকে কল রিসিভ করা যায় কিন্তু কল দেয়া যায় না! মিথ্যাচারিতা আর কাকে বলে? এই বিধান সুমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও সুমীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। সুমাকে আতিকের বন্ধুরা জানিয়েছে, সে সুমাকে কল না দিলেও সুমীর সাথে নিয়মিত কথা বলে!

দুর্দশার এই সময়ে খুব করে মনে পড়তো আতিকের অসুস্থ সময়ের কথা। তখন তাকে এক লোকমা ভাত বেশি খাওয়ার জন্য কত চেষ্টাই না করেছেন সুমা! শিশু বাচ্চার মতো স্বামীর সাথে ঢংঢাঙ করেছেন, সে না খেলে নিজে খাবেন না বলে বেশি করে খাইয়েছেন। আর আজ? আজ যখন তরে ঘরে খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই, কয়েকমুঠো চাল সম্বল ভেবে সুমা তা দেখে দেখে রাখেন আর অফিসের লাঞ্চ দিয়ে পুরো দিন কাটিয়ে দেন, পরের দিন আবার লাঞ্চের সময় হলেই কেবলমাত্র কিছু মুখে দেন তখন আতিকের একবারের জন্যও ভাবোদয় হয়নি। মনে হয়নি যে, মা বাবা থেকে বিচ্ছিন, অসুস্থ স্ত্রীটির মুখে কয়েক মুঠো ভাত তুলে দেয়ার জন্য তার কিছু টাকা পাঠানো দরকার!

কিছুদিন পর আতিক ফোনে সুমাকে জানালো যে সে দেশে ফিরে আসছে। তবে কবে আসছে সে কথা জানালো না সুমাকে। তবু সুমার মনে আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। কতদিন পর স্বামীকে দেখবেন তিনি! আদর করে নিজ হাতের রান্না খাওয়াবেন! হাতের একমাত্র সম্বল পাঁচশত টাকা দিয়ে বাজার থেকে আম কিনে আনলেন স্বামীকে খাওয়ানোর জন্য। কবে নিজ হাতে কেটে স্বামীর সামনে তা তুলে ধরবেন- সেই প্রতীক্ষায় দিনগণনার পালা। দিন যেন শেষই হতে চায় না। দিন শেষ হলো বটে কিন্তু সুমা তা জানতে পারলেন না। একদিন আতিকের বিদেশের নাম্বারে কল দিলেন। বন্ধ! দেশের নাম্বারে কল দিলেন। বন্ধ! বেকারার হবেন না? হলেন।

দুশ্চিন্তায় কল দিলেন শ্বশুর তথা আতিকের বাবার কাছে। বাবা জানালেন সে তো দেশে চলে এসেছে! এর কিছুক্ষণ পর সুমার নাম্বারে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসল। রিসিভ করে আতিকের কণ্ঠ শুনতে পেলেন তিনি। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে বাজখাই গলায় সে বলল, বাবার নাম্বারে কল দিয়েছো কেন? আতিককে কে বুঝাবে যে, এই কলটা তো পতিপরায়ণ, পতিকল্যাণব্রতে অস্থির নারীর স্বামীর অনুসন্ধানের কল্যাণকামী কল? কিন্তু সে বোঝে না।

ঝাঝালো কণ্ঠে তাকে শাসন করে এবং তার বাসায় যাবে না বলে জানিয়ে দেয়। অসুস্থ সময়ে বহু কষ্ট করে পাঁচশত টাকা সংগ্রহ করে আতিকের পছন্দের খাবার যোগাড় করেছিলেন সুমা। শিশু মেলা থেকে পাঁচ কেজি আমও সংগ্রহ করেছিলেন আতিকের জন্য। কিন্তু আতিকের এই প্রত্যাখ্যানে বুক ভেঙে যায় সুমার। তিনি বেদনার একরাশি জল তার বুকটাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়।

এর কয়েকদিন পর আরও তিক্ত সংবাদ শোনায় আতিক। সুমাকে সে ফোন দিয়ে বলে তার সাথে সংসার করা তার পক্ষে সম্ভব না! কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়েন সুমা। ওই মেয়েটির সাথে ঘর বাঁধার জন্য তাকে ছাড়তে চাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আতিক তা সরাসরী অস্বীকার করে। বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে বলে, ঠিক আছে যদি দশ লাখ টাকা দাও তবে আমি তোমার সাথে সংসার করতে রাজি আছি। আসলে এটা ছিল আতিকের বাহানা।

একবার সুমার অর্থ দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে, এবার চাচ্ছে তার টাকা দিয়ে সেই সুস্থ শরীরে আরেকজনকে বিয়ে করার! কিন্তু ব্যথা, বেদনায় জর্জরিত আর বিপর্যস্ত ভাঙাচোরা হাড্ডিসার শরীর ছাড়া সুমার দেবার আর কিছুই বাকি ছিল না। তাই তিনি মহিলা পরিষদের দ্বারস্থ হলেন। মহিলা পরিষদ থেকে আতিক বরাবর উকিল নোটিশ দেয়া হলে সে সেখানে উপস্থিত হলো। সেখানে সে পরিষ্কার অস্বীকার করে বসল অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কের কথা। অথচ সে যখন সবার সাথে কথা বলছিল তখনও সুমী নামের সেই মেয়েটি তাকে কল দিচ্ছিল আর সে মেসেজ লেখে তার ব্যস্ততার কথা জানাচ্ছিল তাকে।

এক পর্যায়ে সুমা তাকে কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করার কথা বলেন। কিন্তু নির্ভিকচিত্তে কুরআন শরীফ ছুঁয়েই আতিক অন্য নারীর সাথে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে! যখন সে একহাতে কুরআন ছুঁয়ে শপথ করছিল তখন তার অন্য হাত ছিল ফোনের বাটনে সুমী নামের সেই মেয়েটির নাম্বার কেটে দেয়ার কাজে! কাবিনের টাকা ও ভরণপোষণ বাবদ আতিককে দশলাখ টাকা দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু সে এক ফাঁকে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে মোবাইলে সে সুমাকে তালাক দেবে বলে জানায়। কিন্তু সুমা তখনও আশাবাদী ছিলেন।

সামনে ঈদ আসছে। বেশকিছু টাকা যোগাড় করেছেন এবার ঈদে আতিককে নিজ হাতে কাপড়চোপড় কিনে দেবেন বলে। স্বপ্ন বুনছেন আতিককে সাথে নিয়েই মার্কেট করবেন এবং তার পছন্দ মতো কাপড় কিনবেন। কিন্তু আতিকের সাড়া নেই। ঈদের মাত্র একদিন বাকি। এই সময়ে সুমার নামে একটা চিঠি আসল। আতিক আসছে জানিয়ে চিঠিটা লিখছে মনে করে মনে মনে দারুণ উৎফুল্ল হলেন সুমা। উত্তেজনায় হাত কম্পন করায় ঠিক মতো চিঠিটা খুলতেও পারছেন না তিনি! এক পর্যায়ে চিঠিটা খুলতে সক্ষম হলেন। পড়ামাত্রই বেদনায় নীল হয়ে গেল তার গোটা অস্তিত্ব। ঘরে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আতিককে ফোন দিলেন তিনি। বললেন, আতিক! তোমার ঈদের উপহার আমি পেয়েছি! একজন নারীর জন্য এরচেয়ে সেরা কোনো উপহার হয় না! তার কথা শুনে আতিক শুধু একবার মুচকি হাসল।

কান্নায় দম বন্ধ হয়ে আসে সুমার। চিনচিনে ব্যথায় বুক চেপে ধরেন তিনি। ঈদের আগের দিন স্বামীর পক্ষ থেকে তালাকের চিঠির চেয়ে নারীর জন্য ‘বড় ঈদ উপহার’ আর কীইবা হতে পারে!!!

মুক্তবাসের জীবন আমাদের নারীদেরকে এই উপহারই দিয়ে চলেছে অহর্নিশ। তবু আমরা থামছি না, থামাটাকে দরকার বলে মনে করছি না! সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন-

جبلت القلوب على حب من أحسن اليه

‘ইহসানকারীর প্রতি ইহসানগ্রহীতার দিল বাঁধা থাকে।’

চিরবাস্তব কথা। কিন্তু আতিকদের সেই কৃতজ্ঞতাবোধ কোথায় গেল? যে মেয়েটি তাকে এত ভালোবাসল, বাবা মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, নিজের সখের বস্তু বিক্রি করে তাকে সুস্থ করে তুলল, দুর্বল শরীরে চাকরি করে স্বামীর লেখাপড়া ও তার জীবিকার আয়োজন করল, স্বামীর যাবতীয় খরচ নিজে বহন করল সে কি এই প্রতিদান পাওয়ারই যোগ্য ছিল? পরনারীর পেছনে ঢালার জন্যই কি সে কৃশকায় দেহ নিয়ে অর্থোপার্জন করত আর তা স্বামীর হাতে তুলে দিত?

যে নারী তার জন্য এতকিছু করল, তাকে এভাবে অসম্মান করা, এত কষ্ট দেয়া ঠিক হলো? হাদীসের ভাষ্যানুযায়ী কি এগুলো ভদ্রতার আওতায় পড়ে? যে তোমার জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ফুল বিছিয়ে দিলো তুমি তার জীবনপথে এভাবে কাঁটা ছড়িয়ে দিতে পারলে? স্ত্রীর জীবনকে এভাবে দুর্বিষহ করে তোলা মানুষের কাজ?

এর চেয়ে অকৃতজ্ঞতা, নেমকহারামীর জঘন্য দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? মুক্তবাস আর উচ্ছৃঙ্খল জীবন আমাদের অভিধান থেকে এভাবে একে একে মুছে দেবে সততা, কৃতজ্ঞতাবোধ ও শালীনতা!

সুমা! জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাও। এসব ধূর্তলোকের স্মৃতি মন থেকে যত দ্রুত সম্ভব দূর করে দাও। যে একবার তোমার সুখ কেড়ে নিয়েছে দ্বিতীয়বার সে তোমাকে সুখ দিতে আসবে না। আসলে আবার আসবে তোমাকে লুট করার জন্য। কমিনাদের চরিত্র কখনও বদলায় না। বলা হয়ে থাকে-

وَلَوْ سَمِعْتُمْ أَنَّ جَبَلًا زَالَ عَنْ مَكَانِهِ فَصَدِّقُوهُ ، وَإِنْ سَمِعْتُمْ أَنَّ رَجُلًا تَغَيَّرَ عَنْ خَلْقِهِ أَيْ الْأَصْلِيِّ فَلَا تُصَدِّقُوهُ .

‘পাহাড় স্থানচ্যুত হওয়ার সংবাদ বিশ্বাস করো কিন্তু মানুষ তার আসল চরিত্র বদলিয়েছে এরূপ সংবাদ বিশ্বাস করো না।’ [মিরকাতুল মাফাতিহ : ১৫/২৫]

সুতরাং এদের আর বিশ্বাস করতে যাবে কেন এবং এদের প্রতি ভালোবাসা দীর্ঘায়িত করে নিজেকে আক্ষেপ আর অনুশোচনার চিতায় প্রজ্জ্বলিত করবে কেন? আর মন ভেঙো না।

وَنَظَرَ ابْنُ عُمَرَ يَوْمًا إِلَى الْبَيْتِ أَوْ إِلَى الْكَعْبَةِ فَقَالَ مَا أَعْظَمَكِ وَأَعْظَمَ حُرْمَتَكِ وَالْمُؤْمِنُ أَعْظَمُ حُرْمَةً عِنْدَ اللَّهِ مِنْكِ .

‘একবার ইবন ‘উমর (রা) কা‘বা গৃহের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে কা‘বা! তোমার মর্যাদা আর সম্মান কত উঁচুতে! কিন্তু মুমিনের দাম তোমার চেয়ে অনেক বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে। [জামে তিরমিযী : ২১৬৪]

অতএব, যারা মুমিনের কলব ভাঙবে তারা আবরাহার পরিণতির শিকার হবে। আসমানী গজবই ‘তায়রে আবাবীল’ হয়ে তাদের ওপর ধ্বংসের পাথর নিক্ষেপ করবে।

সুমা! অনেক হয়েছে। এবার আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গ নিয়ে জীবনপথে এগিয়ে চলো। তবে আগের মতো নয়-জীবনটার মোড় ঘুরিয়ে, আখেরাত আর আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসাকে সাথে নিয়ে। দেখবে অতীতের গ্লানী ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে তোমার জীবনকে সমৃদ্ধ করবে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন