মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
প্রবাসী স্বামীর কফিন কল্পনায় আচ্ছন্ন থাকতেন ফারজানা (ছদ্মনাম)। আশায় থাকতেন কবে শুনবেন সড়ক কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় স্বামীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়েছে, কফিনে ভরে লাশ ফিরে আসছে- সেই আশায়। দীর্ঘ দেড়টি যুগ কাটল এই আশায় আশায়!
অনেকে হয়ত অবিশ্বাস করবেন কথাটা। কেউ কেউ লেখকের মস্তিষ্ক সুস্থতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এর কোনোটাই করতে হবে না আপনাকে। আমাদের সমাজে কত অবিশ্বাস্য ঘটনাই তো ঘটে। হয়ত দেখার আগে আপনি তা বিশ্বাস করতে চান না। দেখার পরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করতেই হয়। এমনই অবিশ্বাস্য কিন্তু বাস্তব ঘটনায় মোড়া আমাদের বর্তমান সমাজ!
দিনাজপুরের এই মেয়েটি বাবার খুব আদরের সন্তান। অত্যন্ত চঞ্চল আর দূরন্ত। বাবা তাকে অত্যধিক স্নেহ ও মায়া করেন। সারা সময় ধরে মেয়েটি খেলা করে বেড়ায়। গাছের মগডালে উঠে বসে থাকে। তবে পরীক্ষার সময় ভালো ফলাফল করে। এভাবে মেট্রিক পাশ করার পর ফারজানা (ছদ্মনাম) মামার কাছে ঢাকায় চলে আসে। এখানে এসেই শুরু হয় সেই অবাঞ্ছিত জীবনের পথে পা মাড়ানো।
ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হন ফারজানা। বহুদিন আগে ভার্সিটিরই এক ছাত্রের লেখা ‘ভার্সিটির মেয়েরা’ নামের বইটি পড়ে ভার্সিটির মেয়েদের হালহাকিকত সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সে প্রসঙ্গে আর যেতে চাই না। ভার্সিটির ক্যাম্পাস আর আশেপাশের এলাকাগুলো যেন অবাধ চারণভূমি। এখানে যে যা খুশি তাই করতে পারেন। কেউ কাউকে বাধা দেয়ার মতো অযথা বোকামী করতে যান না। এমন মুক্তবাসের ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়ে অবাক হয়ে যান ফারজানা। গ্রামের এই সরল মেয়েটির কাছে প্রথম প্রথম শহরের হাবভাব অদ্ভুত লাগে।
ভার্সিটির ক্যাম্পাস এলাকা তার কাছে রীতিমতো বিস্ময়কর আঙিনা হয়ে ধরা দেয়! তবে ঘোর কাটতে সময় লাগল না। তিনিও আর দশটি মেয়ের মতো জুটি যোগাড়ে সফল হলেন। ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা একদিকে ব্যাচেলর আবার অন্য দিকে আজন্ম দাম্পত্য জীবন তাদের!
প্রথমে বড় বোনই তাকে একাজে সহায়তা করলেন। আজকাল তো প্রেম-প্রীতি ফ্যাশনের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন একটা কাপড় কিনল তো অপর বন্ধু বা বান্ধবীকেও সেই কাপড় কিনতে উৎসাহিত করল। এভাবে একজন প্রেমে পড়ল তো অপরজনকেও ঝুটি ধরিয়ে দিয়ে বলল, তুমি ওর সাথে লেগে পড়ো...
একবার ভার্সিটিতে কী এক উপলক্ষ্যে আর্টের প্রদর্শনী করা হলো। ফারজানার বড় বোন (মামাতো) বললেন, তোকে আজ একটা লোক দেখাবো রে...
তখন থেকেই শুরু। বোনের দেখানো লোকটি সুদর্শন। ব্যস, বাহ্যিক রূপের কাছে অন্য নারীদের মতো ফারজানাও হার মানলেন। শুরু হলো অন্যদের মতো প্রেম দরিয়ায় সাঁতার কাটা। বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর বিয়ের প্রসঙ্গ আসল। ফারজানার মা-বাবা নিম রাজি হলেন। কিন্তু প্রেম আর অন্যদের চাপাচাপিতে পুরো রাজি না হয়ে পারলেন না তারা। ফলে বিয়েতে রাজি হতে হলো। দিনাজপুরের গ্রামের বাড়িতে বিয়ে সম্পন্ন হলো। ছেলেকে দেখে বিয়ের আগেই স্নেহময়ী পিতা কেঁদে ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমার মন বলছে, এই স্বামী নিয়ে তুই সুখী হতে পারবি না মা!
বাবার সেদিনের সেই আশঙ্কা কানে নেয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা ছিল না ফারজানার। তাই বাবার আশঙ্কা প্রেমের দুর্বার ঝড়ে হাওয়ায় উড়ে গেল। বিয়ের পর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। ফারজানা লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন- এই তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞার মধ্যেই কোল ভরাট করে সন্তানের আগমন ঘটল। জন্ম লাভের মাত্র একমাস পর সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে ঢাকায় রওয়ানা হলেন ফারজানা। রাস্তায় কান্না চাপা রাখতে পারলেন না। মাত্র দেড় বছরের মেয়েটা প্রতি মুহূর্তে তার চোখে ভাসছে। বাসের সিট চোখের জলে ভেজাতে ভেজাতে ঢাকায় পা রাখলেন তিনি। ঢাকায় এসে এবার মাথায় বাজ পড়ার মতো একটা সংবাদ কানে পড়ল তার। এক বান্ধবীর মুখে তার স্বামীর নেশা করার কথা শুনতে পেয়ে আকাশসম শূন্যতা তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করল। অস্পষ্ট হলেও বাবার সেই আশঙ্কাটা তার কানে বাজতে শুরু করল- এই ছেলেকে নিয়ে...
তিনি অধৈর্য হয়ে উঠলেন এবং সংবাদটা শোনামাত্র বিলম্ব না করে সোজা স্বামীর বাসা মগবাজারে চলে গেলেন। স্বামী সে সময় ঘুমিয়েছিলেন। ফারজানা তাকে জাগিয়ে তুলে বললেন, তুমি নাকি নেশা করো?
ক্লাশের টেবিলে মাথা ঝুঁকিয়ে ঘুমানো ছাত্রটি কোন দিন স্বীকার করেছে যে, সে ঘুমিয়েছে? নেশাখোররা তো আরও বড় অপরাধী। তারা অপরাধ স্বীকার করবে কেন? তাই ফারজানার স্বামীও নেশা গ্রহণ করার কথা স্বীকার করলেন না। উল্টো স্ত্রীর গালে পৌরষ ফলিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। প্রিয় মানুষের এমন রুদ্রমূর্তি আর পরিণামের এমন অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে এলেন ফারজানা। রাস্তায় প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ছিল বাবার সেই আশঙ্কার কথা- এই ছেলেকে নিয়ে...
সন্দেহ-সংশয় আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে এগিয়ে চলল তাদের জীবন। বৈবাহিক সম্পর্কের ভাঙনটা বেশ কয়েকবার আছড়ে পড়েছিল তাদের দাম্পত্যের জীবনপাড়ে। কিন্তু কী এক বাধার কাছে আটকে গিয়েছিল তা। প্রেম করে বিয়ে করা সুদর্শন লোকটাকে এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে চাননি বলে ফারজানা বিয়ের সম্পর্ককে দীর্ঘায়িত করেছেন। একপর্যায়ে জীবিকার সন্ধানে আমেরিকার পথে পা বাড়ালেন ফারজানার স্বামী। তার পেটে তখন দেড় মাসের নতুন অতিথি। আগত সন্তানের মুখ না দেখেই প্রবাসের পথে পা রাখতে হলো তার স্বামীকে।
আমেরিকা বস্তুজগতের মানুষের কাছে এক জীবন্ত স্বর্গ যেন! সেই স্বর্গে পা দিয়ে কী আর দুনিয়ার কথা মনে থাকে কারও? অন্য দশজনের মতো ফারজানার স্বামীর বেলায়ও তাই ঘটল। তিনি যেন ভুলেই গেলেন যে, দেশে একজন স্ত্রী, একটা মেয়ে এবং স্ত্রীর গর্ভে একজন নতুন অতিথি রেখে এসেছেন। ফলে স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ কমে গেল তার। স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য খরচাপাতিও পাঠাতেন না তেমন। মাঝেমধ্যে দশবিশ হাজার টাকা পাঠাতেন। মাত্র একবার এক সাথে এক লাখ টাকা পাঠিয়েছিলেন। তাও ফারজানা তা জানতেন না। সে সময় তার শাশুড়ী অসুস্থ ছিল বলে তাকে দেখতে গেলেন। শাশুড়ী তাকে দেখে বললেন, হুঁ, টাকার গন্ধ পাইছো না!
ফারজানা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আম্মা আমি টাকার কথা জানি না। এসেছি আপনাকে দেখতে। এভাবে মাস, বছর পেরিয়ে যুগও পেরিয়ে গেল। কিন্তু স্বামীর দেশে ফেরার নাম নেই। সন্তান আর স্ত্রী পরিজনেরও খবর নেন না তিনি। জীবনটা অর্থহীন মনে হতে থাকে ফারজানার কাছে। এদিকে দুটি সন্তানকে নিয়ে তিনি পড়েন বিপাকে। তবে হাল না ছেড়ে তাদেরকে মানুষ করার কাজে লেগে যান। ফ্যাশন ডিজাইনের কাজ শেখেন তিনি। অল্পদিনে বেশ অর্থকড়িও কামাতে সক্ষম হন। এক সময় তিনি নিজেই কয়েকটি দোকানের মালিক হন। উত্তরাতেও একটি শো রুম খোলেন। স্বামী পরিত্যক্ত বলে কেউ কেউ তাকে বিদ্রূপও করত। কিন্তু জীবনের তাগিদে আর সন্তানদেরকে মানুষ করার মানসে সে সব গা করার চিন্তা করতেন না তিনি। দীর্ঘ ষোলটি বছর কেটে যায় স্বামীর অবজ্ঞা, অবহেলা আর উদাসীনতার মধ্য দিয়ে। এই সময়টাতেই তিনি স্বামীর প্রতি মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে তার কফিন কল্পনা করতেন। ভাবতেন কবে তিনি তার অকৃতজ্ঞ স্বামীর সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ শুনবেন আর শুনবেন যে তার কফিন দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে!
আহ্! কী নিদারুণ কল্পনা! একজন স্ত্রীর স্বামীর কফিন কল্পনা যে কত দুঃসহ বেদনার সাগর পাড়ি দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অমানবিক, অবিশ্বাস্য হলেও একজন স্ত্রীর মধ্যে এধরনের কল্পনা সৃষ্টি হয়েছে। আর মনে আছে তো, কেন এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল? মুক্তবাসের জীবন সরল মেয়েটি ফারজানাকে ঢাকার আবওহাওয়া এমন কষ্টের এমন মরুপ্রান্তরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এর দায় একা ফারজানার না। যারা এই সরল মেয়েটিকে এ পথে টেনে এনেছিল, ছেলে বন্ধুর যোগাড় করে দিয়েছিল এবং যারা একে সমর্থন দিয়েছিল দায় তাদের সকলের। পাপের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা এই যে, সবাই তোমাকে পাপ কাজে উৎসাহ যোগাবে কিন্তু যখন পাপের দায়ভার গ্রহণ করার পালা আসবে তখন কাউকে আর পাশে পাবে না। যে ফারজানাকে সকলে মিলে এই পথে টেনে এনেছিল তার বিপদের দিনে কেউ কি তাকে যথাযথভাবে সহায়তা করেছে? স্বামীর কফিন কল্পনার মতো কঠিন নির্মোহ জীবনে তাকে আশার বাণী শুনিয়েছে?
যাহোক, এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ ১৬টি বছর। এরই মধ্যে ফারজানা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। ঢাকার নামীদামী মার্কেটে তার পোশাকের দোকান গড়ে উঠেছে। স্বামীর অর্থ আনুকূল্য এখন তার কাছে অতীত। কাম্য শুধু তার সঙ্গটাই। কিন্তু তা থেকেও তিনি তাকে নিষ্ঠুরভাবে বঞ্চিত করেছেন। তাই মাঝেমধ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে তার কফিন কল্পনাটা মাথায় চেপে বসে। এরই মধ্যে আমেরিকা থেকে একটা কল আসল। আমেরিকান এক পুলিশ কল দিয়েছে। পুলিশের পরিচয় পেয়েও মনটা নড়ে উঠল না ফারজানার। পুলিশ জানালো আপনার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার লাশ আপনারা গ্রহণ করবেন কিনা? হায়! তার কল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবিত হলো! কিন্তু তিনি ভাবলেশহীন কণ্ঠে পুলিশকে জানালেন, লাশ আমেরিকাতেই দাফন করে দেয়া হোক।
স্ত্রী স্বামীর লাশ কবুল করতে না চাইলেও যে কোনো কারণেই হোক তার লাশ ঢাকায় আসে। জিয়া বিমানবন্দরে লাশ গ্রহণ করতে হাজির হন ফারজানা তার ষোল বছরে মেয়ে তন্দ্রা এবং চৌদ্দ বছরের ছেলে তারেক। ফারজানা সেদিন স্বামীর কফিনের সামনে কেঁদেছিলেন বটে, তবে সেটা স্বামীর শোকে নয়। ছেলেটি যখন পেটে ছিল তখন এই লোকটি জীবিত অবস্থায় এই বিমানবন্দর দিয়েই আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। আজ ছেলে যখন দুনিয়া দেখা শুরু হয়েছে সেদিন সে দেশে ফিরে আসছে কিন্তু লাশ হয়ে! এই আমার ছেলের ভাগ্য? এসব ভেবে কেঁদেছিলেন ফারজানা।
তো ফারজানার ‘আশা’ দীর্ঘায়িত হয়েছে বটে কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। একজন মানুষের আশা আল্লাহ তা‘আলা দীর্ঘদিন অপূর্ণ রাখেন না। চাই সেই আশা অন্যের জন্য যতই নির্মম হোক না কেন। দুয়েকটি তো নিজ চোখেই দেখেছি এমন। আল্লাহর এই দুনিয়ায় আরও কত কিছু ঘটবে সে সবের খবর আলেমুল গায়ব আল্লাহ ছাড়া আর কে রাখে। ছেলেমেয়েকে সাথে নিয়ে জিয়া বিমানবন্দর থেকে যেদিন আমেরিকায় সড়ক দুর্ঘটনার শিকার স্বামীর কফিনে ভরা লাশ গ্রহণ করেছিলেন সেদিন তার আশার প্রদীপ জ্বলেছিল। যে প্রদীপের ফিতায় তিনি দীর্ঘ ষোল বছর ধরে ক্ষোভের জ্বালানী সরবরাহ করেছিলেন।
বিমানবন্দরে সেদিন কফিন গ্রহণ করতে স্বামী শোকে ফারজানার বুক কাঁপেনি তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। মুক্তবাসের অভিশপ্ত জীবন তাকে এমন নিষ্ঠুর করে তুলেছিল। কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে যা হয় নিজ চোখে একবার তা দেখেছি।
দুই.
২০১১ইং সালের ১৫ই নভেম্বরের ঘটনা। পরের দিন ঈদুল আজহা। ফযরের নামাযের আগে কুরআন তিলাওয়াত করছি এমন সময় জনৈক আলেম তাকবীরে তাশরীকের মাসআলা জানার জন্য ফোন দিলেন। তার সমাধান বলে ফোনটা রেখেছি এমন সময় বড় ভাই ফোন দিলেন। সময়ের অস্বাভাবিকতার কারণে প্রথমে ভড়কে গেলাম। আগের লোকের ফোনের কথা ভেবে চিন্তা করলাম, হয়ত তিনিও তাকবীরে তাশরীকের মাসআলা জানার জন্যই ফোন দিয়েছেন। কিন্তু ফোন রিসিভ করেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। বড় ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে! মাসুদ ভাই (বড় ভগ্নিপতি) মারা গেছেন!
অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদে একেবারে থ হয়ে গেলাম। বোন ও মাসুম দুটি ভাগ্নে-ভাগ্নির নিষ্পাপ চেহারা আমার চোখে ভেসে উঠল। ফযর সালাত আদায় করেই টঙ্গি থেকে মহাখালীর দিকে ছুটলাম। পরের দিন ঈদ। মানুষ শিকড়ের টানে আনন্দ করতে ছুটছে গ্রামের বাড়ি। আর আমি ছুটছি আমার ইয়াতিম ভাগ্নে-ভাগ্নির পিতৃহারা বেদনার মুখচ্ছবি দেখতে! সারাপথ শুধু একথা ভাবলাম যে, কী অবস্থায় দেখতে পাবো আমি আমার সদ্য বিধবা অসহায় বোনটিকে? আমি কি তার অসহায়ত্বের সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাবো? তাকে আমি কী অবস্থায় দেখবো? প্রবাসে স্বামীর মৃত্যশয্যায় উপস্থিত থাকতে না পারা একজন স্ত্রীর যে দুঃখ, পৃথিবীর কোনো ভাষায় কি সেই দুঃখ নিবারণ করার শক্তি আছে? আমি কি ভাষাহীন সেই অসহায় অভিযাত্রী নই?
ঢাকার সেদিনের মানুষের ঢল আমার কাছে নিরর্থক মনে হলো। এই যে বাঁধভাঙা ঢল, কোথায় গিয়ে থামবে এর চলার গতি? শেষ পর্যন্ত কবরই তো? আসলে সারা পৃথিবীটাই আল্লাহর কাছে নিরর্থক। মশার ডানা পরিমাণও এর মূল্য নেই তাঁর দৃষ্টিতে। ইরশাদ হয়েছে-
‘আল্লাহর কাছে যদি দুনিয়ার মূল্য একটি মশার পাখার সমানও হত তবে কোনো কাফের এ থেকে একফোঁটা পানিও পেত না।’ [তিরমিযী : ২৩২০]
কথাটা আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ বোঝেন জীবনের প্রতি মুহূর্তে। আর আমরা বুঝি কেবল বিপদগ্রস্ত হলে। যাহোক, কম্পিত পদে বোনের বাসায় হাজির হলাম। ঘরের বাইরে থেকেই কান্নার রোল শোনা যাচ্ছে। এমনি এক অসহায় মুহূর্তে আপন বলতে আমিই কেবল উপস্থিত তখন। লেখাপড়া করার জন্য যখন ঢাকায় এসেছি তখন গোটা অচেনা নগরীতে একমাত্র বড় বোনটাই ছিলেন আমার সেই ছোটো বেলার আশ্রয়। সারা সপ্তায় মাদ্রাসায় কাটিয়ে সদ্য ঢাকায় পা রাখা গ্রামের একটি ছেলের মনের মধ্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হতো, সেই শূন্যতা কাটাতে বোনের বাসায় ছুটে যেতাম। বোনের, মায়ের সব আদর এখানেই খুঁজে ফিরতাম আমি। তিনিও আমাকে স্নেহ দিয়ে, সাহস দিয়ে নির্ভার করতেন। এমন উপকারী বড় বোনটির এই বেদনাহত দৃশ্য দেখে আমি নিজেকে শক্ত রাখার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তা সহসাই ভেঙে গেল। আমি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তিনি আমার কাছে স্বামী হারানোর ব্যাকুলতা করুণ সুরে ব্যক্ত করলেন। ব্যাকুলতার সে সব ভাষা আমার বুকে সুঁই হয়ে বিঁধতে শুরু করল।
তার মর্সিয়ার ভাষাগুলো নিদারুণ বেদনার ঢেউ তোলে মনে। বিদেশ যাওয়ার অল্পদিন পরেই ভগ্নিপতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মাত্র সাতমাস বয়সী আদরের মেয়েটির মায়াবী চেহারাটা চোখে ভেসে উঠতেই তিনি উদাস হয়ে যেতেন। এসব উদাসীনতা থেকে বড় ধরনের রোগ জন্ম নিয়েছিল। অসুস্থতার দিনগুলো তিনি হাসপাতালের বেডে একা কাটিয়েছেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিয়ে তিনি অফিস থেকে রাত করে একবার বাসায় ফিরলেন। শারীরিক অসুস্থতা, সারাদিনের ব্যস্ততার ক্লান্তি আর রাত গভীরে বাজার করে রান্না করে খাওয়ার সাহস হলো না বলে সরল মনে মামীকে দুটি রুটি বানিয়ে দিতে বললেন। আমার বোনের কাছে মামী এ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করলেন। মামীর অভিযোগ শুনে বোন দিশেহারা হয়ে গেলেন। আপনজন থেকে বহুদূরে অবস্থিত অসুস্থ স্বামীর এতটুকু বিরক্তি বরদাশত করার অনুরোধ করবেন, না স্বামীকে হাজারো কষ্টের সাথে আরেকটু কষ্ট স্বীকার করার পরামর্শ দেবেন- তিনি তা ভেবে পান না। হায়! অসুস্থ মানুষের অতি নগন্য এই আব্দারের জন্য সেই সুইডেন থেকে অভিযোগ দিতে হয়!
বোনের এসব করুণ আখ্যান শুনে শুনে আমার চোখের পাতা আরও বেশি করে ভিজে উঠল। তবু আমি নিজেকে শান্ত রাখলাম এবং বোনকে আমার সাধ্যমতো সান্ত্বনা দিতে থাকলাম। স্বামীর সাথে গত রাতেও কথা বলেছেন তিনি। শেষ কথার রাতটি এখনও শেষ হয়নি। ফযর নামাযের জন্য দেয়া এলার্ম এখনো বেজে ওঠে নি। এমন সময় সুইডেন থেকে ভগ্নিপতির মামা ফোন দিলেন। ঘুমের জড়তা নিয়ে বোন ফোন ধরলেন। ফোনদাতা কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললেন, ফাহিমের মা! বাস্তবতা মেনে নাও। তোমার স্বামী ইন্তেকাল করেছে!
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা একজন নারী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি সহজে মেনে নিতে পারে? তাই একটি করুণ চিৎকার ধ্বনি দিয়ে তিনি বেঁহুশ হয়ে খাট থেকে পড়ে গেলেন।
স্বামীর কত শত স্মৃতির কথা ভেসে উঠছে তার রিক্তহৃদয়ে। সেগুলো বলে বলে মর্সিয়া করছেন আর স্বামীর লাশটা দেখার জন্য আকুতি জানাচ্ছেন। ভগ্নিপতিকে সুইডেনে নিয়েছিলেন তার মামা, নিজের কোম্পানিতে কাজে নিয়োগ দেয়ার জন্য। তাই লাশ পাঠাতে হলে তারই খরচে পাঠাতে হবে। ফোনে মামার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানালেন এত টাকা খরচ করে লাশ পাঠানো সম্ভব না! দরকার হলে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে এখানে এসে বাবার কবর যিয়ারত করে যাবে! হায় বিলাসী ভাবনা! মানুষ নিজের স্বার্থে অন্যকে এভাবেই বিলাসী স্বপ্ন দেখিয়ে থাকে?
এরপর নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু ভারি আব্দার শোনার ভয়ে তিনি ফোন রিসিভ করা বাদ দিলেন। আমার বোন তার শাশুড়ীর সাথে যোগাযোগ করলেন। তাকে জোর তাগিদ দিয়ে বললেন, আমি আমার স্বামীর লাশ শেষবারের মতো দেখতে চাই। তাছাড়া, ফাহিমের আব্বা বারবার বলত আমাকে যেন আমার বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। তার শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ করার ব্যবস্থা করা হোক। বোনের পীড়াপীড়ি আর মায়ের আত্মার ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হলেন মামা। তিনি লাশ পাঠাবেন বলে ওয়াদা দিলেন।
১লা ডিসেম্বর বুধবার। সুদূর সুইডেন থেকে লাশ আসবে জিয়া বিমানবন্দরে। যে বিমানবন্দর দিয়ে আত্মীয়স্বজন আর আপনজনকে কাঁদিয়ে বিদেশের পথে পা রেখেছিলেন সেই বিমানবন্দর দিয়েই আজ লাশ হয়ে ফিরে আসবেন তিনি। বিমানবন্দরগুলোতে দুটি পরিচিত দৃশ্য দেখা যায়। যারা বিদেশ যায় তাদের আপনজনরা অশ্রু বিয়োগ করে আর যারা বিদেশ থেকে ফেরত আসে তাদের আপনজনরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়। কিন্তু আমার ভগ্নিপতির বেলায় ঘটল এর উল্টোটা। তিনি যাওয়ার সময়েও কাঁদিয়েছিলেন, আসার সময়েও কাঁদাবেন। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই আমি, বড় ভাই এবং ছোট ভগ্নিপতি হাসান বিমানবন্দরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলাম ভেতরে। ধারণা ছিল যাত্রীবাহিনী বিমানেই কফিন আসবে। একদিকে বেরিয়ে আসবে দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরা আনন্দে উচ্ছল একদল যাত্রী, যারা আপনজন আর ছেলেমেয়েকে আনন্দে জরিয়ে ধরবে। আর তাদের পাশ দিয়েই বেরুবে আমার ভগ্নিপতির কফিন, যার ওপর আছড়ে পড়বে তার মা, স্ত্রী এবং দশ বছরের অবুঝ ভাগ্নে ফাহিম? কিন্তু বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারলাম লাশ আসবে কার্গো বিমানে।
যাহোক, আমরা পরিচয় দিয়ে অনুমতি নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসে প্রবেশ করলাম। ভেতরে সে কী কর্মতৎপরতা! হাজার রকমের মাল-সামানা আসছে বিদেশ থেকে। মানুষ সেগুলো গ্রহণ করছে, হইচই করছে। আর আমরা কয়েকজন মানুষ শুকনো মুখে একজন মানুষের নিথর দেহ আগমনের অপেক্ষায় আছি। ইমিগ্রেশন অফিসে বয়স্ক এক মহিলা কর্মরত ছিলেন। লাশের ঠিকানা দেখে নিজ এলাকার হওয়ায় তিনি সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন। আনুষ্ঠানিকতা সারতে কেটে গেল অনেক সময়।
পৃথিবীর কারও কাছে লাশের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু আজ আমাদের কাছে সেই লাশই অমূল্য সম্পদ! কাগজপত্রের কাজ চলাকালেই শুনলাম কফিনবাহী সেই কার্গো বিমানটি অবতরণ করেছে। রক্ষীদেরকে এক রকম ফাঁকি দিয়েই বিমানের কাছাকাছি পৌঁছলাম। বিমানের সব মাল খালাস করা হয়েছে। সে সব মালামালের সাথে অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে একটি কফিনও। বুঝতে বাকি থাকল না যে, এটাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই কফিন বক্স। হায় অবিনশ্বর পৃথিবী! এখানে মৃতের মূল্য এত নগন্য! যে মানুষগুলোকে নিয়ে এত কর্মব্যস্ততা সেই মানুষটির প্রাণ বের হয়ে গেলেই সে এত মূল্যহীন? ইচ্ছে হলো কফিনটা একবার ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু পাহাদারদেরকে এক্ষেত্রে ফাঁকি দেয়া গেল না। তারা আমাদেরকে সরিয়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে বাইরে এসে পৌঁছেছেন বোন ও ভাগ্নেরাও। তারা নিষ্ঠুর এক প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। সব আনুষ্ঠিকতা সেরে ট্রলিতে কফিন উঠানো হলো। ট্রলির চাকা ঘুরছে আর আমার হৃদপিণ্ড কাঁপছে। কফিনটা দেখে না জানি বোন, মা ও তার সন্তানেরা কী করে বসে। আমার আশঙ্কাই বাস্তবিত হলো। কফিন দেখামাত্রই এর ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আশেপাশের মানুষের চোখেও বেদনার অশ্রু। ট্রলি বহনকারী লোকটিকে কিছু বকশিশ দিতে গেলাম। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করলেন না। বললেন, আমরা লাশ বহন করে বকশিশ গ্রহণ করি না। আসলে এটা এমন এক বেদনাবিধুর পরিবেশ যেখানে কেউই চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। তাই বাংলাদেশের মতো বকশিশ পাগল দেশের লোকেরাও এখানে বকশিশ গ্রহণ করে না!
সেদিনের কফিনকে ঘিরে যে বেদনা ও কষ্টের দৃশ্য দেখেছিলাম, স্বামীহারা বোনকে যেভাবে অশ্রুসিক্ত হতে দেখেছিলাম ফারজানাও কি স্বামী হারিয়ে, তার কফিনের সামনে এধরনের কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন? তার আত্মা কি সেদিন স্বামী হারার বেদনায় কেঁপে ওঠেনি? তার কথায় বুঝা যায়, তিনি তেমন কিছু অনুভব করেন নি। বরং দীর্ঘদিন ধরে যে স্বাভাবিকভাবে স্বামীর কফিন কল্পনা করেছেন, কফিনের সামনে দাঁড়িয়েও তেমন স্বাভাবিকতা দেখিয়েছেন। কীসে তাকে এতো নির্মম করে তুলেছিল? অনৈতিক সম্পর্ক, প্রেম-ভালোবাসা আর মুক্তবাস এভাবেই মানুষকে নির্মম করে তোলে? স্বামীর কফিনের সামনে দাঁড়িয়েও কোনো নারী নির্দয়, নিষ্ঠুর আর অবিচল থাকতে পারে?
স্বামীকে ছাড়াই তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। নিজে বিউটিশিয়ান হিসেবে প্রচুর টাকা উপার্জন করা শুরু করেছিলেন। তাই স্বামীর মৃত্যু তাকে তেমন ভাবায়নি। অবশ্য মৃত্যুর আগেই সুদীর্ঘ ষোল বছর ঘর-সংসার করার পর তাকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। তাই এখন নতুন করে ঘর করার পথেও কোনো বাধা নেই। এরই মধ্যে আরেকজন লোক নতুন করে প্রেম প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় তার সামনে। সে ফারজানাকে এক নজর দেখার জন্য তার অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও তার পায়ে পড়ে তার প্রেমের আকুলতা ব্যক্ত করত। সে আরও বলত, তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। তার ‘অকৃত্রিম’ ভালোবাসার কাছে আবার হার মানেন ফারজানা। জীবনের এক দরজা দিয়ে প্রথম স্বামীর মৃত্যু কফিন বের হয়ে গেছে তো আরেক দরজা দিয়ে দ্বিতীয় স্বামীর পাল্কি প্রবেশ করেছে। প্রথম স্বামীর কবরের তাজা মাটির ওপর নির্মাণ করেছেন দ্বিতীয় সংসারের সুখপ্রাসাদ!
তিন.
আমি তার ইচ্ছার সততাকে কলুষিত করতে চাই না। প্রথম স্বামীর সীমাহীন নির্যাতনে তিনি চরম হতাশ হয়েছিলেন একথাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বাস্তব অবস্থা দেখে তাই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে তিনি দ্বিতীয় স্বামীর কবরের মাটি কত তাড়াতাড়ি শুকোয় সেটার কামনা করছেন। মনে পড়ে গেল আরবী সাহিত্যের বিশ্বখ্যাত কিতাব ‘আন-নাযারাত’ এর একটি ঘটনা। ড. মুস্তাফা লুতফী আল-মানফালুতীর লেখা এই কিতাবটি আরবী সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য ও বিপুল সমাদৃত কিতাব। ‘গাদারুল মারআ (নারীর প্রতারণা)’ নামে তিনি যে ঘটনাটি এই কিতাবে লিখেছেন তা এখানে তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তাই পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
বিখ্যাত এক গ্রিক দার্শনিক। জ্ঞানে-গুণে দেশজুড়ে পরিচিতি তার। স্ত্রীকে তিনি ভালোবাসেন প্রচণ্ড। ভালোবাসায় সিক্ত রাখেন তাকে, আপ্লুত থাকেন নিজে। সেই ভালোবাসার তোড়েই মাঝেমধ্যে স্ত্রীকে চিরচেনা সেই প্রশ্নটি করে বসেন- ‘আমার পরে তুমি কি কাউকে বিয়ে করবে?’
দার্শনিক স্বামীর এমন ভূতুড়ে প্রশ্নে গাল ফোলান স্ত্রী। অভিমান করে বলেন, আমাকে ভালোবাস না বলেই তুমি অমন প্রশ্ন করো! স্ত্রীর অভিমানে চুপসে যান দার্শনিক। দীর্ঘদিন পর্যন্ত বন্ধ থাকে প্রশ্নের এই ধারা। কিন্তু আবার প্রশ্ন জাগে মনে। পুনরায় প্রশ্ন করেন স্ত্রীকে। স্ত্রীও চরম অভিমানে ফুঁসে ওঠেন। স্বামীর ভালোবাসার ব্যাপারে উল্টো তিনিও প্রশ্ন তোলেন।
দার্শনিক একবার কোনো কারণে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরতি পথে দেখা একটি ঘটনা তার মনের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তিনি দেখতে পান, নতুন এক কবরে জনৈক মহিলা পাখা দিয়ে বাতাস করছে। তিনি দার্শনিক মানুষ। এসব কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় দার্শনিকদের একটু বেশি ভাবুক করে তোলে। তিনি তাই কৌতূহল নিয়ে কবরের পাশে যান। মহিলাকে কবরে বাতাস করার কারণ জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু মহিলা এদিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। সে বলল, আমি অত্যন্ত ব্যস্ত আছি। অনুগ্রহ করে আমাকে বিরক্ত করবেন না! কিন্তু দার্শনিক এই ‘ধমকে’ দমবার পাত্র নন। তিনি ঘটনার শেষটা দেখার প্রতিজ্ঞা করলেন এবং মহিলাকে বললেন, তুমি অনেকক্ষণ ধরে বাতাস করছ। সুযোগ দিলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি! মহিলা তাকে সদয় সুযোগ দিল। সুযোগ পেয়ে মহিলার হাত থেকে পাখা নিয়ে বাতাস করা শুরু করলেন তিনি। দু’জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কবরের তাজা মাটি কিছুটা শুকিয়ে উঠল। মহিলা এবার দার্শনিকের দিকে মনোনিবেশ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল, মাননীয় দার্শনিক সাহেব! আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার এই সহযোগিতার কথা কোনোদিন ভুলব না। আপনাকে আমি চিনি। কিন্তু করার কিছু ছিল না। আপনার সহায়তা পেয়ে কাজটি সহজ হলো। তাই এবার শুনুন আমার কাহিনী।
স্বামী আমাকে অত্যধিক ভালোবাসতেন- বলা শুরু করলেন তিনি। সেই ভালোবাসার তাগিদেই তিনি বারবার আমাকে বলতেন, তার মৃত্যুর পর আমি অন্য কোনো পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করব কিনা? আমি তার প্রতিদিনের জিজ্ঞাসা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে নাকচ করে দিতাম। একদিন তিনি নাছোড় হয়ে ধরলেন আমাকে। আমার কাছ থেকে তিনি চূড়ান্ত কিছু শুনতে চাইলেন। আমিও দৃঢ়ভাবে তার আশঙ্কা দূর করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি মানলেন না। শেষে নিজের পক্ষ থেকেই বললেন- আচ্ছা, একটা কাজ করো। আমি মরার পর তুমি স্বামী গ্রহণ করলেও অন্তত কবরের মাটি শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আমি প্রথমে তার এই কথা কানেই তুললাম না। কিন্তু তার পীড়াপীড়িতে এক প্রকার অবহেলা করেই বললাম, আচ্ছা যাও, তাই হবে।
এরপর একদিন তিনি সত্যিই মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সাথে সাথে অন্য এক পুরুষ আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। প্রস্তাবদাতাকে ফিরিয়ে দিতে মন সরল না। এদিকে স্বামীকেও ওয়াদা করেছিলাম তার কবরের মাটি না শুকানো পর্যন্ত বিয়ে করব না। কী করব দ্বিধা করছিলাম। এরই মধ্যে মাথায় বুদ্ধি আসল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম। দুই কুল রক্ষা করার সিদ্ধান্ত। সেই মোতাবেক আমি স্বামীর কবরে বাতাস করা শুরু করলাম। অবশেষে আপনার সহায়তায় আমার কাজটা সহজ হলো। এই নিন আপনার উপহার! যে রেশমি পাখা দিয়ে বাতাস করে আমার আজকের দ্বিতীয় বাসরটা ত্বরান্বিত করেছেন সেটা আপনারই প্রাপ্য!
দার্শনিক বলেন, মহিলা আমাকে রেশমি পাখাটি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। আমি তাকে বাধা দিলাম না। কেননা, সে এখন দ্বিতীয় বাসরের স্বপ্নে বিভোর। আমি সম্বিতহারা যন্ত্রচালিতের মতো ঘরপানে এগিয়ে চললাম আর সারা পথ ভাবতে থাকলাম এই মহিলার ‘ওয়াফাদারী’র কথা! ঘরে এসে আমি রেশমি পাখাটা স্ত্রীকে দিয়ে বললাম, এই নাও স্বজাতির পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া হাদিয়া!
আমার স্ত্রী এই পাখার কাহিনী জানতে চাইল। আমি তাকে পুরো ঘটনা শুনিয়ে সেই আগের কথা মনে করিয়ে দিলাম। সে উত্তেজিতকণ্ঠে বলল, পৃথিবীর সব নারীকে তুমি এক পাল্লায় মাপো, তাই না? আমিও কি কখনও ওই সর্বনাশী বেওয়াফা নারীর মতো হতে পারি? এসব কথা বলে সে ওই নারীকে আচ্ছা করে বকতে শুরু করল। বকাঝকা করে মনের আয়েশ মিটিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো সে।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। মান-অভিমান মিলেই কাটল দিনগুলো। এর মধ্যে দার্শনিক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আজ তিনি জীবন সায়াহ্নে উপনীত। শয্যা থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরবেন কিনা- স্বয়ং দার্শনিকই তাতে সন্দিহান। রোগ বাড়তে থাকল। চরম অবস্থা ধারণ করলে একদিন তিনি স্ত্রীকে কাছে ডাকলেন এবং তার মৃত্যুর পর কাউকে জীবনসঙ্গীনী বানিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু স্বামীর এই পরামর্শে সেই আগের মতোই ক্ষিপ্ত হলেন স্ত্রী। এই শেষ সফরেও তোমার সন্দেহ গেল না- বলে স্বামীকে তিরস্কার করলেন।
সেই রাতে স্ত্রীকে আবার ডাকলেন দার্শনিক। বললেন, অভিজ্ঞতায় বলছে এটাই আমার জীবনের শেষ রাত। যদি ভালো মনে করো তবে আমার পরামর্শ মোতাবেক কাজ করবে। বিদায়বেলায় স্ত্রীকে অনেক কথা বললেন তিনি। শেষে বললেন, এখান থেকে চলে যাবার সময় আমাকে কাফনের কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে যাবে। রাতে আর কাউকে এই ঘরে ঢুকতে দেবে না। তুমিও ঢুকবে না। তোমার সাথে আমার জীবদ্দশার শেষ দেখা এটি। আগামীকাল যখন শহরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক জমায়েত হবে তখন আমার জানাযার ব্যবস্থা করবে। বিদায়...
স্বামীর শেষ কথায় বুক ফেটে কান্না আসল স্ত্রীর। স্বামীর দেহে কাফনের কাপড় জড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন তিনি। অন্য ঘরে বসে মৃত স্বামীর জন্য মর্সিয়া করতে থাকলেন।
রাত তখন মধ্য পথে থমকে আছে। ঘরের ভেতর এখনও কাঁদছেন সদ্যপ্রয়াত দার্শনিকের স্ত্রী। রাত গভীরে থমকে থমকে ভেসে আসা করুণ বিলাপে শোকাতর হচ্ছে নীরব পরিবেশও। ঠিক এই অসময়ে মালিকার ঘরে করাঘাত করল এক দাসী। দরজা খুলে দাসীর দিকে জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকালেন দার্শনিকের স্ত্রী। দাসী মালিকার চাহনির জবাবে বললেন, দূর থেকে আসা এক যুবক তার প্রিয় গুরুর মৃত্যুতে চরম শোকাতর হয়েছে। মেহমানখানায় সে কেবলই গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার অবস্থা খুবই নাযুক!
দার্শনিকের স্ত্রী বললেন- তাকে থাকার জায়গা করে দাও। আর খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করো। দাসী বলল, সে তার গুরুর শোকে শোকাচ্ছন্ন। খাবারের নামও নেয়া দায় হবে তার সামনে। সে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।
এমন এক শোকাবহ পরিবেশে অচেনা আগন্তুকের সাথে দেখা করতে মন সরছিল না দার্শনিকপত্নীর। কিন্তু দাসীর পীড়াপীড়িতে না করতেও পারলেন না। তাই বাধ্য হয়ে দাসীর সাথে আগন্তুক যুবকের সাথে দেখা করতে বের হলেন।
ক্রন্দনরত যুবকের দিকে দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলেন দার্শনিকের স্ত্রী। এমন সুদর্শন মানুষ হয়! ইউসূফ আলাইহিস সালামের বংশের কেউ না তো? স্বল্প সময়ের জন্য তিনি মৃত্যুশোক ভুলে গেলেন। আগন্তুক যুবকের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেন অনেক সময়। যুবকের সৌন্দর্যের অস্বাভাবিকতা শোকের ভার তার ঘাড় থেকে নামিয়ে দিল। তিনি প্রবল আগ্রহ নিয়ে যুবকের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। যুবক বহু দূর থেকে তার আসার কারণ বর্ণনা করল এবং প্রিয় গুরুর মৃত্যুতে সীমাহীন আঘাত পেয়েছে বলে জানালো। এরপর সে আবার কাঁদা শুরু করল। এবার তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভার দার্শনিকের স্ত্রীর! তিনি বলা শুরু করলেন, হে যুবক! মৃতকে নিয়ে আর কত শোক করবে? জীবন বাস্তব, মৃত্যু অতীত। এসো আমরা বাস্তবকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি!
সদ্য বৈধব্যের শোকমালা পরা নারীর ইশারা বুঝতে পারলেন না যুবক। শোকের মধ্যেই তিনি কথাটার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। দার্শনিকের স্ত্রী জড়তা মেশানো কণ্ঠে বললেন, না বোঝার কী আছে? দার্শনিক তোমার গুরু আর আমার স্বামী। আমরা দুজনেই শোক পেয়েছি। তাই শোক থেকে বেরিয়ে আসার দায়িত্বও আমাদের দুজনেরই। চলো, আমরা শোক কাটিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করি!
মহিলার মোটা দাগের ইশারাও যেন বুঝতে পারছে না যুবক। সে আবার মহিলার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসুনেত্রে। যুবকের অবুঝপনা দেখে বিরক্ত হলেন দার্শনিকপত্নী। তিনি রুষ্টকণ্ঠে বললেন, তুমি বিশ্বখ্যাত একজন দার্শনিকের শিষ্য, অথচ সোজা কথাটা বুঝতেও তোমাকে এত গলদঘর্ম করতে হয়! আমি চাই মৃত্যুশোক দ্রুত কাটিয়ে উঠতে আমরা নতুন করে ঘর শুরু করব! একথাটাই আমি তোমাকে বোঝাতে চাচ্ছি। বোকা যুবক, কিচ্ছু বোঝে না!
কান্নার মধ্যে হাসি পেল শিষ্যের। হায় নারী! ত্বকের সৌন্দর্যই তোর কাছে সব? এই তোর পতিপরায়ণতা? পৃথিবীতে বহু পুরুষ এমন আছে যার মনের শুভ্রতা দিয়ে যদি ত্বকে প্রলেপ দেয়া হতো তবে ত্বক দুধের মতো সাদা হয়ে যেত। কিন্তু কয়জন নারী এমন মহৎ পুরুষকে সম্মান দেখাতে পেরেছে? বাইরের ত্বকই যাদের ধ্যান-জ্ঞান তারা স্বামীর অবর্তমানটাকে উপভোগ করবে না কেন?
কিন্তু যুবক তাকে হতাশ করল। তাকে নিবৃত করে বলল, কিন্তু আমি যে অক্ষম! আমি এমন এক দুরারোগ্যে আক্রান্ত পৃথিবীর কোনো হাকিমের কাছে যার চিকিৎসা নেই।
মহিলা হতাশকণ্ঠে বললেন, কী সেই রোগ তোমার?
-এমন রোগ যা বলতেও ভয় করে!
-বলোই না!
-রোগটা আভ্যন্তরীণ। আমি পৃথিবীর বহু বিখ্যাত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছি। অনেকে রোগের কথা শুনেই আমাকে বিদায় করে দিয়েছেন। আর কেউ কেউ চিকিৎসা দিতে পারবেন বলেছেন। কিন্তু সেই চিকিৎসাবস্তু যোগাড় করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
-কী সেই বস্তু, শুনতে পারি?
- শুনে কী হবে? যার ব্যবস্থা নেই তা শুনেও লাভ নেই!
-আহ্, তুমি বেশি ভণিতা করছ! তুমি বলো দেখি আমি সেই বস্তু যোগাড় করতে পারি কিনা? যে কোনো মূল্য আমাদেরকে নতুন ঘর বাঁধতে হবে। তাই যেভাবেই হোক আমি তোমার সেই চিকিৎসার বস্তু যোগাড় করতে তৎপর হবো।
-যদি শুনতেই চান তবে শুনুন। সেই বস্তুটি হচ্ছে সদ্যপ্রয়াত কোনো ব্যক্তির মাথার মগজ!
কথাটা শুনে প্রথমে চমকে গেলেন দার্শনিকের স্ত্রী। বাকরুদ্ধ থাকলেন অনেকক্ষণ। তার মুখ থেকে কথা ফুটছে না দেখে শিষ্য বলল, আমি আগেই বলেছিলাম, আমার রোগের কোনো পথ্য নেই। আমি কত জায়গায় ঘুরেছি। কতভাবে মানুষকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছি। কিন্তু কেউই আমাকে এই বস্তু সংগ্রহ করে দেয়ার আশ্বাস দেয় নি। তাই জীবন সম্পর্কে আমি নিরাশ হয়ে গেছি। আমার বাঁচাও হবে না, কারও সাথে ঘরও করা হবে না। কথাগুলো বলে লম্বা করে একটা শ্বাস নিলো যুবক। তা দেখে বেদনায় মুখশ্রীটা নীল হয়ে গেল দার্শনিক পত্নীর। তিনি তাকে সাহস দিয়ে বললেন, আমি বলব, তারপরেও তোমার নিরাশ হওয়া উচিত নয়!
-পৃথিবীর সব চিকিৎসক যেখানে আমাকে নিরাশ করেছে সেখানে আপনি আমাকে আশাবাদী হতে বলেন? আমি এমন কৌতুক আশা করিনি আপনার কাছ থেকে।
-কৌতুক বলছ কেন যুবক! আমি তোমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলাম। তুমি এবার নিশ্চিন্ত হতে পারো।
কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন দার্শনিক পত্নী। তার প্রস্থানপথের দিকে চরম কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন দার্শনিকশিষ্য।
ঘর থেকে বের হয়ে সোজা অস্ত্র ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি। কদমে তার দৃঢ়তা। ইচ্ছায় অদম্যতা। ঘরে ঢুকে ধারালো কুড়ালটা হাতে তুলে নিলেন। কুড়ালটার চাকচিক্যে রাতের আঁধারটাও যেন ক্ষণিকের জন্য দূরে পালালো। তিনি বিদ্যুৎবেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। তার সিদ্ধান্তের নির্মমতায় কেঁপে উঠল আকাশ। সদ্যপ্রয়াত স্বামীর লাশের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করল দাসী। ঘরের খিড়কী খুলে তিনি সাদা কাফনের ঢাকা স্বামীর লাশের মাথার দিকে দাঁড়ালেন। ‘সদ্যমৃত’ লাশের মগজ হলেই তিনি নতুন করে ঘর বাঁধতে পারবেন। এই ‘ছোট্ট’ একটা বাধা তাকে অতিক্রম করতেই হবে। তিনি কুড়ালটাকে আরও দৃঢ়ভাবে ধরলেন। বামহাত দিয়ে মাথা থেকে কাফনের সাদা কাপড়টা সরিয়ে দিলেন। ডানহাতে কুড়ালটা উঠাতে যাবেন ঠিক সে সময় দার্শনিক বেচারা ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। চৌকাঠে সম্মিলিতকণ্ঠের হাসির আওয়াজও শোনা গেল। দার্শনিকপত্নী চকিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন আগন্তুক যুবক ও দাসী মিটমিট করে হাসছে! তার বোঝার আর কিছু বাকি থাকল না। দার্শনিক স্বামী তাকে এত নিষ্ঠুর পরীক্ষায় ফেলবেন বলে কস্মিনকালেও ধারণা হয় নি। তিনি ভাষা হারিয়ে ফেললেন। হতবাক, বাকরুদ্ধ স্ত্রীকে দার্শনিক শুধু একটা কথাই বললেন, তোমার এই কুড়ালের চেয়ে রেশমী পাখাওয়ালা ওই মহিলা কি উত্তম নয়?
স্বামীর তীর্যকবাক্য, অতিথি ও দাসীর বিদ্রূপাত্মক হাসি অপ্রস্তুত করে তুলল দার্শনিকপত্নীকে। তিনি লজ্জায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।
এভাবে প্রথম স্বামীর লাশ মাড়িয়ে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের আশা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল দার্শনিকপত্নীর। বাঁধার আগেই ভেঙে গেল নতুন ঘরের স্বপ্ন। এরপরে কী হয়েছিল ইতিহাস সে ব্যাপারে নীরব। কিন্তু আমাদের ফারজানার দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের ইতিহাসটা অজানা নয়। তিনি প্রথম স্বামীর কফিন কল্পনার মধ্য দিয়ে যে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেছিলেন সেই দ্বিতীয় স্বামী তাকে আরও বেশি আঘাত দিয়েছিল।
সরকারী চাকরিজীবি এই লোকটা প্রথমে হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিলেন। সে ধর্ম ত্যাগ করে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ফারজানাকে দেখে তিনি তার প্রেমে পড়ে যান। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এজন্য কত যে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কখনও কখনও তিনি ফারজানার অফিসে, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। কখনও পা জড়িয়ে ধরে বলতেন, আমাকে বাঁচান, আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচব না। মুক্তবাস উচ্ছৃঙ্খল জীবনের পরিণাম একবার দেখা হয়ে গিয়েছিল ফারজানার। তাই দ্বিতীয়বার তিনি এপথে পা মাড়াতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু লোকটির সীমাহীন পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। প্রায় দেড় যুগ পরে একই তরিকায় দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। বিয়ের সময় শর্ত দিয়েছিলেন, আগের ঘরের ছেলেমেয়েদের সাথে তিনি যোগাযোগ রাখতে পারবেন কিন্তু স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতে হবে।
দীর্ঘদিনের স্বামীসান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত ফারজানা নতুন স্বামী পেয়ে নতুন জীবন লাভ করলেন। দীর্ঘ ষোল বছরের তৃষিত, বঞ্চিত দাম্পত্যভূমিতে এই নতুন স্বামী এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আগমন করল তার জীবনে। পুনরায় সজীব হয়ে উঠেছিল ফারজানার নিষ্প্রভ আত্মা। কিন্তু কী কারণে যেন এই সজীবতা স্থায়ী হলো না। দ্বিতীয় দাম্পত্য স্থায়ী হলো মাত্র আট মাস। এ যেন শিয়ালের বিয়ের বৃষ্টি! একদিকে রোদ তো অন্যদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
ফারজানা অনেক অনুনয় বিনয় করেছিলেন দ্বিতীয় স্বামীর কাছে। বলেছিলেন, এ নিয়ে কম তো আর হলো না। তাই নতুন করে আর কিছু চাই না, শুধু স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়টা অটুট থাকতে দাও। স্ত্রীত্বের সম্মানটা নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার সুযোগ দাও। অন্তত আমার এই সম্মানটুকু রক্ষা করো!
বস্তুত একটা নারী ধনী হোক বা গরীব, তার কাছে স্বামীর পরিচয় থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের একটি। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল। টঙ্গীর চেরাগ আলীর ঘটনা এটি। এক প্রতিবন্ধীর চার চারটে স্ত্রী! দু’পা ভালো থাকার সময় করেছিলেন দুই বিয়ে আর সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা হারানোর পর করেছিলেন আরো দুই বিয়ে। চার স্ত্রীকে নিয়ে তার জীবনযাত্রাও বেশ বিচিত্র। প্রতিদিন তিনি গার্মেন্টে চাকরিরত একেক স্ত্রীর কাছে যান। তার ওখানে খাওয়া-দাওয়া করেন আর আসার সময় ১৮ টাকা রিক্সা ভাড়া এবং ১২ টাকা চা নাস্তার খরচ নেন। মাসের তিরিশটি দিন নাকি তার কাটে এভাবেই!
ঘটনার বর্ণনাকারীকে প্রশ্ন করলাম, একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চার চারজন মহিলা স্বামী হিসেবে বরণ করবে একথা আমরা বিশ্বাস করতে যাবো কেন? তিনি বললেন, ‘স্বামী আছে’ পরিচয় দেয়ার এতটুকু স্বার্থে তারা তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল!
এই ঘটনা সত্যই প্রমাণ করে, একজন নারীর কাছে স্বামী পরিচয়ের চেয়ে বড় মর্যাদার কোনো পরিচয় নেই। সেই পরিচয় রক্ষার্থেই ফারজানা দ্বিতীয় স্বামীর কাছে অনেক অনুনয় করেছিলেন। কিন্তু বিফলে গেল তার সব আকুতি। দ্বিতীয় স্বামী তাকে ততধিক অপমান, লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন।
ফারজানার মেয়ে এবং ফারজানা নিজেও একথা স্বীকার করেছেন যে, তিনি অত্যন্ত রাগী ও জেদি নারী। তার এই ভস্ম পরিণতি মুক্তবাসের ছাই না জেদের আগুনের ছাই- তা নির্ণয় করা কঠিন। হয়ত উভয়টাই। এই দুটি বস্তুই নারীর জন্য অশুভ। নারীর জেদ নিয়ে প্রবাদ বাক্যও কম তৈরি হয়নি। একটি আঞ্চলিক প্রবাদ এরূপ : ‘পুরুষের জেদে বাদশা, আর নারীর জেদে বেশ্যা।’
হয়ত প্রবাদের ভাষাটা একটু বেশি কঠিন ও অশালীন। তবে প্রবাদটার সবটুকু মিথ্যা বলার সুযোগ নেই, অবশ্যই সত্যের কিছু না কিছু অংশ আছে এখানে।
দুই দুটি সংসার চোখের সামনে এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল ফারজানার। অবাঞ্ছিত পথে গড়া বিয়ের পিঁড়িগুলো এভাবেই উঁইপোকায় খাওয়া প্রমাণিত হয় সমাজ-সংসারে। কিন্তু শাশ্বত এই বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নেয় কয়জন সেটাই দেখার বিষয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/657/9
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।