মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
মুসলমানদের কাছে জেরুসালেম শহর ‘আল-কুদ্স’ নামে পরিচিত। এর অন্য নাম হচ্ছে বাইতুল মাকদিস। ‘আল-কুদ্স’ নামটাই সর্বাধিক পরিচিত।
যদিও কোনটার উপর কোনটার প্রাধান্যের বিশেষ কারণ নেই। মসজিদে আকসাকেও কুদ্স বলা হয়।
‘কুদ্স’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্র। পক্ষান্তরে, ‘বাইতুল মাকদিস’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, ‘হাইকালে সুলাইমানী’ বা সুলাইমান (আঃ)-এর তৈরি ইবাদাতগাহ। [আল-মো’জাম আল-ওয়াসীত-২য় খণ্ড, মাজমাউল লুগাহ আল-আরাবিয়াহ, কায়রো থেকে প্রকাশিত।] হিব্রু শব্দ Bethammiqdash থেকে ‘মাকদিস’ শব্দের উৎপত্তি। মাকদিস শব্দের মূলেও ‘কুদ্স’ শব্দ রয়েছে। মূলকথা হল, এটি পবিত্র শহর। এই শহরেই প্রখ্যাত আল আকসা মসজিদ রয়েছে।
এই শহরের অন্যান্য নামগুলো হচ্ছে, ‘মাদীনাতুল হক’ (সত্যের শহর), ‘মাদীনাতুল্লাহ’ (আল্লাহর শহর), ‘আল-মাদীনাহ্ আত-তাহিরাহ’ (পবিত্র শহর) এবং ‘আল-মাদীনাহ আল-মুকাদ্দাসহ’ (পবিত্র শহর)। ‘জেরুসালেম’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘ইউরোসালেম’ শব্দ থেকে। রোমানরা জেরুসালেমকে এই নামেই অভিহিত করে। মু’জাম আল-বুলদানের লেখক ইয়াকুত হামাওয়ী এর আরেকটি নাম উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, ‘আল-বালাত’। অর্থ হল, রাজপ্রাসাদ।
‘ইউরোসালেম’ একটি কেনানী শব্দ। আরব ইয়াবুসী গোত্রের ১ম শাসকের উপাধি ছিল ‘সালেম’। সালেম অর্থ শান্তিপ্রিয়। তিনি শান্তিপ্রিয় ছিলেন বলে তাঁকে সবাই এই উপাধিতে ভূষিত করে। তার আসল নাম ছিল মালিক সাদেক। তাঁর এই কেনানী নামানুসারে শহরের নামকরণ করা হয় ইউরোসালেম। [আল-আকসা ওয়াল কুদ্স, আল ফাতাহ মুক্তি সংস্থার পুস্তিকা, সৌদী আরব, ১৩৯৬ হিজরী।] বর্তমান যুগে, এটাকেই জেরুসালেম বলা হয়। খৃস্টপূর্ব ৩ হাজার সালে আরবের ইয়াবুসী গোত্রের বসবাসের ভিত্তিতে এই শহরের প্রাচীন নাম হচ্ছে ‘ইয়াবুস’।
বর্ণিত আছে, ইয়াবুসী শাসক জেরুসালেমে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে স্বাগত জানান এবং আঙ্গুর ও রুটি দিয়ে তাঁর মেহমানদারী করেন। [আল আকসা ওয়াল কুদ্স; সৌদী আরব, ১৩৯৬ হিঃ।]
[এখানে হার্ড কপি বইয়ে ছবি ছিল]
পুরাতন জেরুসালেম শহরের বর্তমান দেয়ালের সীমানা
ভৌগোলিক অবস্থান
জেরুসালেম ৩৪ ডিগ্রী অক্ষাংশ ও ৩১.৫২ ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশের উত্তরে অবস্থিত। শহরটি একটি পাহাড়ী এলাকা অর্থাৎ অধিত্যকা। এর চারদিকে রয়েছে পাহাড়। উল্লেখযোগ্য পাহাড়গুলো হচ্ছে : [আত্-তাতাউর আল-উমরানী লি মদীনাতিল কুদ্স-ডঃ আঃ আলীম আবদুর রহমান খোদার, ১৯৮১ খৃঃ।]
১. মোরিয়া পাহাড় : এই পাহাড়ের উপরই মসজিদে সাখরা ও মসজিদে আকসা অবস্থিত।
২. যাইতুন পাহাড় : এর অপর নাম হচ্ছে তূর পাহাড়। এটি শহরের পূর্বদিকে সাগরের স্তর থেকে ৮২৬ মিটার উপরে অবস্থিত। হারামে কুদ্সের দেয়ালের পার্শ্বে দাঁড়ালে এই পাহাড়ের পাথরগুলো দৃষ্টিগোচর হয়। হারাম শরীফ ও পাহাড়ের মাঝখানে আছে ‘কাদরুন’ উপত্যকা। তালমুদে এই পাহাড়কে ‘মাসেহ’ বা ‘তাতইজ’ পাহাড় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তালমুদে আরো বর্ণিত আছে, ইহুদীরা এই পাহাড়ে লাল গাভী জ্বালিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এর ছাই সংগ্রহ করে তা হাইকালে সুলাইমানীতে ছিটিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য কুরআনের তাফসীরকারগণ বলেছেন, গাভী লাল ছিল না বরং গাঢ় হলুদ রংএর ছিল। যাইতুন পাহাড়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, খৃস্টানদের ধারণা অনুযায়ী সেখানকার ‘মুআসরাহ’ কিংবা ‘জাতসমানী’ বাগানের কাছে ইয়াসু নামায পড়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ পাহাড়ে একটি গর্ত আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে হযরত ঈসা (আঃ) কিছু শিক্ষা দান করেছিলেন, তার হাওয়ারীদের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন এবং জেরুসালেমের জন্য কেঁদেছিলেন।
৩. সাহ্ইউন পাহাড় : এই পাহাড়ের অপর নাম হচ্ছে দাউদ নবীর পাহাড়। এটি সাগরের স্তর থেকে ৭৭০ মিটার উপরে অবস্থিত।
৪. আকরা পাহাড় : এই পাহাড়ের উপর খৃস্টানদের ‘কিয়ামাহ’ গীর্জা অবস্থিত।
৫. যাইতা পাহাড় : এটি বাব-আস-সাহেরার নিকটবর্তী একটি পাহাড়।
৬. গাওল পাহাড় : এটি জেরুসালেম শহরের উত্তর দিকে এবং সাগরের স্তর থেকে ৮৩৯ মিটার উপরে অবস্থিত। প্রাচীন যুগে এই পাহাড়ের উপরই কেনানীদের ‘হাবআহ’ শহর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
৭. সামউইল নবীর পাহাড় : এটি শহরের উত্তর পশ্চিম দিকে অবস্থিত। সাগরের স্তর থেকে এর উচ্চতা হচ্ছে ৮৮৫ মিটার।
এছাড়াও শহরের চারপাশে আরো অনেক পাহাড় আছে। শহরটি সাগরের স্তর থেকে ৭৩৫ মিটার উপরে অবস্থান করছে। পাহাড়ী এলাকার কারণে তা কোন প্রধান বাণিজ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত নয় এবং শহরের মাঝে কোন নদীনালাও নেই। অপরদিকে প্রাকৃতিক কারণে শহর সম্প্রসারণের বেশী সুযোগ নেই।
জেরুসালেম শহর প্রাকৃতিকভাবে দুইভাগে বিভক্ত। পুরাতন জেরুসালেম ও নতুন জেরুসালেম। ১৯৪৮ সালে নতুন ও পুরাতন জেরুসালেমের মোট আয়তন ছিল ৪১ বর্গকিলোমিটার। শহর সম্প্রসারণের পর বর্তমান আয়তন হচ্ছে, ১১০ বর্গকিলোমিটার। পুরাতন জেরুসালেম শহর ৪ দিক থেকে দেয়ালঘেরা। দেয়ালের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪ কিলোমিটার এবং উচ্চতা হচ্ছে ১২ মিটার। দেয়ালে মোট ৮টা গেট আছে। বিভিন্ন দিক থেকে লোকেরা এ সকল গেট দিয়ে তাতে প্রবেশ করে। প্রসিদ্ধ গেটগুলো হচ্ছে, উত্তরে বাবুল আ’মুদ, দক্ষিণে বাবুল মাগারিবা, পূর্বে সানস্টিফান ও পশ্চিমে বাবুল খলীল। পূর্বদিকে অবস্থিত বাবুজ্জাহাবী নামক ৮ম গেটটি বন্ধ থাকে। ১৫৩৬ খৃস্টাব্দে উসমানী সুলতান সুলাইমান ৫ বছরব্যাপী ঐ দেয়াল নির্মাণ করেন।
লোকবসতি
১৯৮০ খৃঃ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেরুসালেমের লোকসংখ্যা হচ্ছে ৩ লাখ ৯২ হাজার। [আত্-তাতাউর আল-উমরানী লি মদীনাতিল কুদ্স; ডঃ আবদুল আলীম আব্দুর রহমান খোদার-প্রকাশ-১৯৮১ খৃঃ (৬) ঐ।] ১৯৬৭ খৃঃ থেকে ১৯৮০ খৃঃ পর্যন্ত বর্ধিত জনসংখ্যার ৫৮% ভাগ হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে জেরুসালেমে আগত ইহুদী সম্প্রদায়। জেরুসালেম শহরের বিভিন্ন অংশে ইহুদী বসতি গড়ে তোলা হয়েছে এবং সেখানে ইয়েমেন, ইথিওপিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ থেকে ইহুদীদেরকে এনে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। ইসরাইল সরকার অধিকৃত ফিলিস্তিনের মুসলমানদেরকে তাড়িয়ে ইহুদীদেরকে পুনর্বাসন করছে। যাতে করে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং শহরের আরব ও ইসলামী বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ইহুদীকরণ করা সম্ভব হয়। ইসরাইল সরকার ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধে, জর্দানের শাসন থেকে জেরুসালেম জবরদখল করার পর ২৫শে জুলাই এক আদমশুমারী পরিচালনা করে ও উপস্থিত আরব মুসলমানদেরকে ইসরাইলী পরিচয়পত্র গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়। এতে করে যুদ্ধের ফলে পালিয়ে যাওয়া ১ লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনীকে অনুপস্থিত ধরে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে সেই স্থানে ইহুদীদের পুনর্বাসন করে। বর্তমান সময়ে (১৯৯১ খৃঃ) পুনর্বাসনের ফলে ইহুদী জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জেরুসালেমে ইহুদীদের সংখ্যা হচ্ছে ৪ লাখ। ১৯৯২ সালে জেরুসালেমের লোকসংখ্যা হচ্ছে, ৫ লাখ ৫৫ হাজার। [Deliberate deceptions facing the facts about the U.S.-Israel relationship, Paul Pandly, U. S.] এর মধ্যে পূর্ব জেরুসালেমে বাস করছে ১ লাখ ৪০ হাজার ইহুদী। পক্ষান্তরে, মুসলমানদের সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার। ১৯৯৩ সালে ৫৫ হাজার আবাসিক ইউনিট নির্মান শেষ হয়েছে। এতে করে মুসলমানদের চাইতে ইহুদীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে।
আবহাওয়া
জেরুসালেমের গড় তাপমাত্রা মাঝারি ধরনের। শীত ও গ্রীষ্ম ঋতু বাদ দিলে, অন্যান্য সময়ের তাপমাত্রা গড়ে ১৮ সেন্টিগ্রেড। সেখানকার ফসল, গাছপালা ও কৃষি ভূমধ্যসাগরের আবহাওয়ার আর্দ্রতা ভোগ করে। জানুয়ারী মাসে সর্বাধিক ঠাণ্ডা থাকে। তখন তাপমাত্রা থাকে ৯.৭ সেন্টিগ্রেড। পক্ষান্তরে আগস্ট মাসে সর্বাধিক গরম থাকে, তখন তাপমাত্রা থাকে ২৫ সেন্টিগ্রেড। তবে শীতকালে, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ৪ সেন্টিগ্রেড।’ [আত্ তাতাউর আল উমরানী লি মাদীনাতিল কুদ্স, ডঃ আবদুল আলীম আবদুর রহমান খোদার, ১৯৮১ খৃঃ।]
জেরুসালেমের গোড়ার কথা
মসজিদে আকসা সম্পর্কে জানতে হলে, আগে জেরুসালেম সম্পর্কে জানতে হবে। খৃস্টপূর্ব ৩ হাজার সালে আরবের ইয়াবুসী গোত্রের শাসক মালিক সাদেক জেরুসালেম শহর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেন এবং শহরটির ভিত্তি স্থাপন করেন। এটাই তাদের দেশের প্রধান কেন্দ্র ও রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইয়াবুসী গোত্রের লোকদেরকে কেনানী আরবও বলা হয়। ইয়াবুসী সম্প্রদায়ের লোকেরা শহরে বহু বাড়ী-ঘর নির্মাণ করে। তারা ‘সাহ্ইউন’ পাহাড়ের উপর শহরের প্রতিরক্ষার জন্য একটি দুর্গ তৈরি করে। দুর্গটি প্রধানত হিব্রু ও মিসরীয়সহ অন্যান্য অত্যাচারী এবং লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়। তারা ১৫৫০ খৃস্টপূর্ব সালে হিব্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মিসরের প্রথম ফেরআউন তাহতামেসের সাথে মৈত্রীচুক্তি করে। প্রায় ২ হাজার বছর পর্যন্ত তাদের হাতে শহরের নিয়ন্ত্রণ থাকে। খৃস্টপূর্ব ১১ সাল পর্যন্ত তারা শহরের উপর কর্তৃত্ব করে।
হযরত মূসা (আঃ) এর ইন্তিকালের পর বনি ইসরাইল হযরত ইউশা’ বিন নূনের নেতৃত্বে জেরুসালেমে প্রবেশ করে। ৩২২ খৃস্টপূর্ব সালে আলেকজান্ডার মাকদুনীর হাতে পরাজয় বরণ করার পর জেরুসালেমে বনি ইসরাইলের কর্তৃত্বের অবসান হয়।
যাই হোক, ইয়াবুসী শাসনামলে জেরুসালেমসহ সিরিয়া ও ইরাকব্যাপী যে সভ্যতা বিরাজ করে তাকে আবিলা সভ্যতা বলা হয়। বিজ্ঞানীরা মাটি খনন করে সেই যুগের বহু আরবী লেখার নিদর্শন উদ্ধার করেন। ১৯২৯-৩১ খৃঃ, ফরাসী বিজ্ঞানীরা ‘রাস-শামরা’ নামক স্থানে খনন করে আরবী লেখা সমৃদ্ধ আবিলা সংস্কৃতির বহু পাথর উদ্ধার করেছেন।
ইয়াবুসীরা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী সংস্কৃতি চালু করে। তারা আল্লাহর নৈকট্যের জন্য রুটি পেশ করত। ঐ আমলে শহরে পানি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন কূপ থেকে সরু খাল কেটে পানির ঝর্না প্রবাহিত করা হয়।
জেরুসালেম শহরের গুরুত্ব
এই শহরে মসজিদে আকসার মত পবিত্র স্থান রয়েছে। এটি আম্বিয়ায়ে কিরামের অবস্থান ও ইবাদতের স্থান এবং শত-সহস্র আল্লাহ-প্রেমিকের ভ্রমণকেন্দ্র। আসমানের কত অগণিত ফেরেশতা এখানে এসেছেন। এক হাদীস অনুযায়ী এখানেই ময়দানে হাশর ও নশর (উত্থান-বিস্তার) হবে। এই শহরের উপর দিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মে’রাজ হয়েছে। মসজিদে আকসার মধ্যে সুলাইমান (আঃ) এর আসন ও দাউদ (আঃ) এর মেহরাব রয়েছে। এই শহরে রয়েছে ‘আইনে সালওয়ান’ বা সালওয়ান পানির নালা। এই নালার পানিকে হাউজে কাউসারের পানির মত মর্যাদাবান মনে করা হয়। [আল-আকসা ওয়াল-কুদ্স, আল-ফাতাহ মুক্তি সংস্থার পুস্তিকা।] এখানে রয়েছে মেহরাবে মরিয়ম।
জেরুসালেম শহর পৃথিবীর একটি সর্ববৃহৎ পর্যটনকেন্দ্র। এটাকে একটি বহুজাতিক শহরও বলা যায়। মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদীদের ধর্মীয় উপাসনালয়ের কারণে এখানে বহিরাগত বহু পর্যটক ও তীর্থযাত্রীর আগমন ঘটে। হযরত ঈসার জন্মস্থানও এই জেরুসালেম শহরে। এখানে মসজিদে আকসা ব্যতীত আরো ৩৫টি মসজিদ আছে।
মসজিদে আকসার দেয়ালের বাইরে পূর্বদিকে ‘বাবুর রাহমাহ’ সংলগ্ন রয়েছে দুইটি প্রখ্যাত মুসলিম গোরস্তান। এই গোরস্তানে শায়িত আছেন দুইজন প্রখ্যাত সাহাবী। তাঁরা হলেন, উবাদাহ ইবন সামেত বদরী। তিনি ৬৫৩ খৃস্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যজন হচ্ছেন, শাদ্দাদ বিন আউস– আনসারী। তিনি ৬৭৭ খৃস্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। [আল-আকসা ওয়াল কুদ্স, আল-ফাতাহ মুক্তি সংস্থার পুস্তিকা, ১৩৯৬ হিঃ।]
পবিত্র কুরআনে জেরুসালেম শহরকে বরকতময় ও পবিত্র ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ বলেন– الذى باركنا حوله
অর্থাৎ আমরা মসজিদে আকসার আশপাশকে বরকতপূর্ণ করে দিয়েছি। এখানে মসজিদে আকসার ‘আশপাশ’ বলতে জেরুসালেম শহরকেই বুঝানো হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জেরুসালেম শহরের সেই বরকতপূর্ণ জিনিসগুলো কি কি?
এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, জেরুসালেম শহরের নদীনালা, মিষ্টি পানি ও ফল-ফলাদি হচ্ছে সেই বরকতময় জিনিস। এছাড়াও যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে যেখানে বহু নবী-রাসূল ও আউলিয়া শায়িত আছেন, তাদের মত নেককার লোকদের জীবন-মৃত্যুর স্থান অবশ্যই বরকতময়। [আত্-তাতাউর আল-উমরানী লি-মাদীনাতিল কুদ্স, ডঃ আবদুল আলীম আবদুর রহমান খোদার।]
অন্য এক আয়াতে ঐ বরকতের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ বলেছেন,
واذ قلنا أدلوا هذه القرية فكلوا منها حيث شئتم رغدا
‘আমরা যখন তাদেরকে আদেশ দিলাম, এই জনপদে প্রবেশ কর এবং সেখানকার যেখানে ইচ্ছা সেখানে পর্যাপ্ত খাও’। এই আয়াতে জেরুসালেম শহরে পর্যাপ্ত খাওয়া-পরার নির্দেশ থেকে বুঝা যায়, তা আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতে বরকতপূর্ণ।
মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য ও পানীয় বেশী প্রয়োজন। জেরুসালেম শহরের অনুকূল আবহাওয়া কৃষিকাজের উপযোগী। এছাড়াও পর্যাপ্ত মিষ্টি পানি থাকায় খাদ্যসামগ্রীর অভাবের কোন প্রশ্নই ওঠে না। খাদ্য ও পানীয়ের পর্যাপ্ততার জন্য এই শহরটি বরকতময় হয়েছে।
মসজিদে আকসার তাৎপর্য ও ফজীলত
মসজিদে আকসার মোট ৭টি নাম রয়েছে। ১টি হচ্ছে, মসজিদে আকসা। ‘আকসা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দূরবর্তী’। মসজিদে আকসার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, দূরবর্তী মসজিদ। মক্কার মসজিদে হারাম থেকে মে’রাজের সূচনা হয়। সেই উপলক্ষে, কুরআনের সূরা ইসরায় ‘মসজিদে আকসা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। সম্ভবতঃ মক্কা থেকে এটি দূরে বলে আল্লাহ ঐ মসজিদকে ‘দূরবর্তী মসজিদ’ বা মসজিদে আকসা বলে অভিহিত করেন। আগে এর নাম ছিল, বাইতুল মাকদিস। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইসলামী যুগ থেকে ঐ মসজিদের নামকরণ করা হয় ‘মসজিদে আকসা’। এর অন্য নামগুলো হচ্ছে, ৩ আল-কুদ্স ৪. মসজিদে ইলিয়া ৫. সালাম ৬. উরুশলেম ও ৭. ইয়াবুস।
উলামায়ে কেরাম ও ঐতিহাসিকদের মতে, মে’রাজের সময় মসজিদে আকসার কোন ঘর ছিল না। বরং পরবর্তীতে সেখানে মসজিদে আকসা ও মসজিদে সাখরার ভবন তৈরি হয়। সূরা ইসরার মধ্যে যুগ যুগ ধরে নবীদের পুরাতন এবাদতের উক্ত খালি স্থানকে ‘মসজিদে আকসা’ বলা হয়েছে। খালি স্থানকে মসজিদ বলার কারণ হল, সেটি ইবাদতের স্থান ছিল। [আত্ তাতাউর আল-উমরানী লি মাদীনাতিল কুদ্স, ডঃ আবদুল আলীম আবদুর রহমান খোদার।] পরবর্তীতে সেখানে মসজিদে সাখরা ও মসজিদে আকসা নামে ২টি মসজিদ তৈরি হয়। যদিও মসজিদে সাখরা মূলতঃ মসজিদে আকসারই অংশ।
উলামায়ে কেরামের মতে, মসজিদে আকসা বর্তমান মসজিদ ভবন ছাড়াও আরো বিরাট অংশের নাম। বরং ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গেইট বিশিষ্ট বড় দেয়ালের ভেতরের সবটুকু অংশই মসজিদে আকসা। [কাবলা আনইউ হাদ্দাসা আল-আকসা-আবদুল আযীয মোস্তফা, সৌদী আরব, প্রকাশ-১৯৯০ খৃঃ] মসজিদে আকসা মূলতঃ ইবাদতের একটি বিরাট খালি স্থানের নাম। ঐ খালি স্থানের অংশ বিশেষের উপর মসজিদে আকসা ও সাখরা নির্মিত হয়েছে। বাকী অংশটুকু চারদিক থেকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত।
মসজিদে আকসা পুরাতন জেরুসালেম শহরের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত।
মসজিদে আকসার কারণেই মূলতঃ জেরুসালেম শহরের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত প্রায় অধিকাংশ নবী সেখানে ইবাদাত করেছেন। এখান থেকেই মিরাজ সংঘটিত হয়েছে এবং মিরাজেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেছেনঃ
অর্থ : ‘সেই সত্তার জন্য পবিত্রতা যিনি তাঁর বান্দাহকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় রাতে সফর করিয়েছেন। মসজিদে আকসার আশেপাশে আমরা বরকত নাযিল করেছি। যেন আমরা তাকে আমাদের নিদর্শন দেখাতে পারি। নিঃসন্দেহে তিনি সর্বাধিক শ্রোতা ও দ্রষ্টা।’ (সূরা আল ইসরা : ১)
এ আয়াতে আল্লাহ মসজিদে হারামের পর মসজিদে আকসার কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে যে দু’টি মসজিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে মসজিদে আকসা ১টি। মসজিদে আকসা ২টি বড় ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১টা হচ্ছে, ( إسراء ) অর্থাৎ রাতের সফর তথা যমীনের ভ্রমন। আর ২য় টা হচ্ছে, মিরাজের আসমানী সফর। মসজিদে আকসা যেমন যমীনের সফরের শেষ কেন্দ্র, একই সময়ে তা আসমানী সফরেরও সূচনা কেন্দ্র। অনুরূপভাবে তা মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন ও মসজিদে হারামের উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রার কেন্দ্রও বটে।
মসজিদে আকসা মুসলমানদের কাছে গত ১৪শ’ বছর যাবত দুই কিবলার প্রথম কিবলা হিসেবে বিবেচিত।
মসজিদে আকসা সেই তিন মসজিদের একটি, যেগুলোতে ইবাদাত ও সাওয়াবের উদ্দেশ্যে সফর করার অনুমতি রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
لا تشد الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد : المسجد الحرام ومسجد الأول ومسجد الأقصى .
অর্থ : ‘তিন মসজিদ ব্যতীত সাওয়াবের উদ্দেশ্যে অন্য কোন মসজিদে সফর করা যাবে না। তিন মসজিদ হচ্ছে, মসজিদে হারাম, মসজিদে নবওয়ী ও মসজিদে আকসা।’ (বুখারী ও মুসলিম)
দীর্ঘ ১৭ মাস যাবত মুসলমানগণ প্রথম কিবলাহ বাইতুল মাকদিসের দিকে মুখ করে নামায পড়েন। এই কথার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ কুরআন মজীদে বলেনঃ
وما جعلنا القبلة التي نت عليها الأ لتعلم من يتبع الرسول من ينقلب على عقبيه و ان كانت الكبيرة الأعلى الذين هدى الله وما كان الله ليضيع ايمانكن ان الله بالناس لرةؤوف رحيم -
অর্থ : “হে নবী! আপনি যে কিবলার উপর ছিলেন, তা এই জন্য পরিবর্তন করা হল (অর্থাৎ বাইতুল মাকদিস থেকে কাবার দিকে) যেন আমরা জানতে পারি, কে রাসূলের অনুসরণ করে সেই সমস্ত লোকদের মাঝ থেকে, যারা নিজেদের উপর ভর করে পেছন দিকে সরে যায়। আল্লাহ যাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন এটা তাদের জন্য মোটেই কোন বড় বিষয় নয়। আল্লাহ আপনাদের নামায বরবাদ করবেন না। আল্লাহ মানুষের প্রতি পরম দয়ালু ও মেহেরবান।” (সূরা আল বাকারা)
মসজিদে আকসার নামায অন্যান্য মসজিদের নামাযের চাইতে ৫শ’ গুণ উত্তম। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর একটি হাদীস রয়েছে। তিবরানী আবুদ দারদা থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মসজিদে হারামের নামাযে ১ লাখ গুণ, আমার মসজিদে ১ হাজার গুণ, ও বায়তুল মাকদিসে ৫শ’ গুণ সওয়াব হয়।’
ইবনে খোযায়মাহ এবং বাজ্জারও এই একই হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাজাহ হযরত আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ঘরে নামায পড়লে এক গুণ, মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জামে মসজিদে পড়লে ৫শ’ গুণ, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নবওয়ীতে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদে হারামে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাওয়া যাবে।
মসজিদে আকসায় অন্যান্য ইবাদতেরও একই পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে। তাতে কুরআন শরীফ খতম করা, রোযা রাখা, ইতেকাফ করা ও ইলম অর্জন করা মোস্তাহাব। এমন কি ইবাদতের উদ্দেশ্যে সেখানে মসজিদের প্রতিবেশী হওয়াও উত্তম। [আত্-তাতাউর আল-উমরানী লি মাদীনাতিল কুদ্স, ডঃ আবদুল আলীম আবদুর রহমান খোদার।]
বর্ণিত আছে, মসজিদে আকসায় গুনাহও অন্য জায়গার গুনাহর চাইতে বহুগুণ বেশী। কেননা, সম্মানজনক সময় ও স্থানের গুনাহ আল্লাহর প্রতি কম ভয় ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় বহন করে।
হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘বেহেশত বাইতুল মাকদিসের দিকে ঝুঁকে আছে। বাইতুল মাকদিসের সাখরাহ জান্নাতুল ফেরদাউস থেকে এসেছে এবং তা যমীনের জন্য কলসীস্বরূপ।’ [আ’লামুল মাসাজিদ, যারাকসী, ২৮৬ পৃঃ।]
সাখরা অর্থ পাথর। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ইবনে ফারেস বলেছেন, আল্লাহর নবীগণ বাইতুল মাকদিস নির্মাণ ও আবাদ করেছেন। এতে এক বিঘত জায়গাও এমন নেই, যেখানে নবীরা নামায পড়েননি কিংবা ফেরেশতারা অবস্থান করেননি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দাসী মাইমূনাহ বর্ণনা করে, আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল! বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন! তখন তিনি বলেন, এটি হচ্ছে হাশর ও নশরের স্থান; তোমরা সেখানে গিয়ে নামায পড়। সেখানকার নামাযে ১ হাজার গুণ সওয়াব রয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ) আবু দাউদ শরীফে আরো একটু বেশী বর্ণিত আছে। মাইমুনাহ জিজ্ঞেস করেন, আমি যদি সেখানে যেতে না পারি? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে বলেন, “তুমি সেই মসজিদের বাতির জন্য তেল পাঠিয়ে দিলেই সেখানে যাওয়ার সওয়াব পাবে।’
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি একই বছর হজ্জ করে এবং মসজিদে নবওয়ী ও মসজিদে আকসায় নামায পড়ে, সে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ নবজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ [আ’লামূল মাসাজিদ, যারাকসী।]
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘কেউ যদি বেহেশতের কোন অংশ দেখতে চায়, সে যেন বাইতুল মাকদিসের দিকে তাকায়।’ [আ’লামূল মাসাজিদ, যারাকসী, পৃঃ ২১১।]
হিজরাতের এক বছর কয়েক মাস আগে ২৭শে রজব, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঐতিহাসিক মিরাজ বা আসমানী সফর অনুষ্ঠিত হয়। সেই মিরাজের প্রতি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস স্থাপন করে হযরত আবু বাকর (রাঃ) ‘সিদ্দিক’ উপাধি লাভ করেন। মিরাজের প্রতি বিশ্বাস মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গবিশেষ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তিনি (নবী) জিবরীল (আঃ)-কে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে দেখেছেন। সেখানে রয়েছে জান্নতুল মাওয়া। যখন সিদরাহকে ঢেকে রেখেছিল সেই জিনিস, যা তাকে ঢেকে রাখে। (নবীর) চোখ ভুল দেখেনি এবং আদেশ অমান্য করেনি। তিনি তার রবের বিরাট নিদর্শন দেখতে পেয়েছেন। (সূরা নাজম : ১৩-১৮)
সেই ঐতিহাসিক মিরাজ উপলক্ষে রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতারা মসজিদে আকসায় সমবেত হয়েছিলেন। সেখানেই তিনি আম্বিয়ায়ে কিরামকে সাথে নিয়ে নামায পড়েন ও নিজে নামাযের নেতৃত্ব দেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ বুঝিয়ে দেন যে, ইমাম ও ইমামতির কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে তা মক্কায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।
বাইতুল মাকদিসের হিফাজত বিরাট ইসলামী দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুসলমানদেরকে সেই দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে তাকিদ দিয়ে বলেছেন, হে মুআজ! আল্লাহ আমার পরে তোমাকে সিরিয়ার উপর বিজয় দান করবেন। মিসরের আরীস থেকে ইরাকের ফোরাত পর্যন্ত তোমরা বিজয় লাভ করবে। তাদের নারী ও পুরুষেরা কিয়ামাত পর্যন্ত এই ভূমির হেফাজতে নিয়োজিত থাকবে। তোমাদের কেউ যদি সিরিয়া উপকূল কিংবা বাইতুল মাকদিসকে বসবাসের জন্য নির্বাচন করে, সে কিয়ামাত পর্যন্ত জিহাদের মধ্যে নিয়োজিত বলে পরিগণিত হবে। [আস্-সীরাতুন নাবাওইয়াহ আবদুল হামীদ, দারে মিসর লিত্-তাবাআহ্।]
বাইতুল মাকদিস প্রথম দিন থেকেই আল্লাহর একটি স্ট্রাটেজিক বা কৌশলগত স্থান। এই কারণে তিনি মে’রাজের ঘটনার মাধ্যমে তাকে ইসলামের অধীন করে দিয়েছেন।
অনেকে মসজিদে আকসাকে মক্কা ও মদীনার দুই হারাম শরীফের মত ৩য় হারাম শরীফ হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু গোটা মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, মসজিদে আকসা ‘হারাম শরীফ’ নয়। (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, পৃঃ ৪৩৪) অনুরূপভাবে, শেখ আবু বকর আবু যায়েদ ও তাঁর ‘মু’জাম আল-মানাহী আল্লাফজিয়া’ গ্রন্থে এবং শেখ মোহাম্মদ সালেহ ওসাইমিন তাঁর ‘ফারায়েদুল ফাওয়ায়েদ’ গ্রন্থে একই কথা বলেছেন।
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে, জেরুসালেমের হারাম শরীফ কিংবা আল-খলীল শহরের মসজিদে ইবরাহীমকে ‘হারামে ইবরাহীমি’ বলা ঠিক নয়। তাঁর মতে, বাইতুল মাকদিসে ‘হারাম শরীফ’ নামে কোন স্থান নেই। (আল-ফাতাওয়া আল-কোবরা, ২৭ খণ্ড, পৃঃ ১৪)
মসজিদে আকসার বর্ণনা
পরিবেষ্টিত এলাকার দক্ষিণাংশে মসজিদে আকসার বর্তমান ভবন অবস্থিত। মসজিদে সাখরা, মসজিদে আকসা এবং অন্যান্য সেবা ভবনসহ চার দেয়ালের ভেতরের মোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৯শ’ বর্গমিটার। মসজিদে আকসা মসজিদে সাখরা থেকে ৫শ’ মিটার দক্ষিণে অবস্থিত। একই সীমানার ভেতর আরো রয়েছে মসজিদে উমার ও জামে নিসা।
পশ্চিম দেয়াল থেকে মসজিদে আকসার উত্তর-পশ্চিম কোণের দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ৭০ মিটার। মসজিদের সীমানার দেয়াল থেকে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মসজিদে আকসার দূরত্ব সমান। মসজিদের উত্তর থেকে দক্ষিণে একটি সরল রেখা টানলে পূর্ব ও পশ্চিমে ২৮৫ মিটার সমান দূরত্ব পাওয়া যায়। উত্তর দিক থেকে মসজিদে প্রবেশ করলে সামনে একটি বিরাট বারান্দা পড়ে। সেখান থেকে মসজিদের ৭টি দরজায় যাওয়ার পথ আছে। এই ৭টি দরজা ছাড়াও মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে আরো ২টি দরজা আছে। মসজিদের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে রয়েছে মহিলাদের পৃথক প্রবেশ পথ। মসজিদে আকসার পূর্ব দিকে ‘জামে উমার’ নামে আরেকটি মসজিদ আছে। জেরুসালেম বিজয়ের সময় হযরত উমার (রাঃ) সেখানে যে মসজিদ তৈরি করেছিলেন বর্তমান মসজিদ তারই অবশিষ্টাংশ।
মসজিদে অনেকগুলো স্তম্ভ আছে। এগুলোতে খুবই সুন্দর নকশা অংকন করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে সুন্দর ও মনোরম নকশা খচিত মেহরাবে যাকারিয়া।
মসজিদে কয়েকটি মিনারা আছে। সেগুলো হচ্ছে ১. বাবুল আসবাত মিনারা ২. বাবুল মাগারেবা মিনারা বা বাবুল গাওয়ানিমা মিনারা এবং ৩. বাবুস্ সিলসিলাহ মিনারা।
মসজিদে আকসায় অজু ও পানি পান করার কয়েকটা জায়গা আছে। সেগুলোর মধ্যে সাবিল কায়েতবায়, সাবিল কাসেম পাশা, সাবিল বুদাইরী, সাবিল শালান এবং সাবিল বাবুল হাব্স অন্যতম।
মসজিদে আকসার দক্ষিণ দেয়াল খুবই মজবুত। ফলে মসজিদে আকসায় ইসরাইলীদের প্রসিদ্ধ অগ্নিকাণ্ডে এ দেয়ালের কোন ক্ষতি হয়নি। মসজিদে আকসার ১১টা দরজা আছে। সেগুলো হচ্ছে উত্তরদিকে ৭টি, পূর্বদিকে ১টি, পশ্চিমে ২টি এবং দক্ষিণে ১টি দরজা। [রেসালাতুল মাসজিদ ফিল ইসলাম, ডঃ আবদুল আযীয মুহাম্মদ আল লোমাইলাম, প্রকাশকাল ১৯৭৮, রিয়াদ, সৌদী আরব।] সেগুলোর নাম হলো : ১. বাবুল আসবাত ২. বাবুল মাগারেবা ৩. বাবুল গাওয়ানিমা ৪. বাবুস সিলসিলা ৫. বাবুল হাবস ৬. বাবুন নাযির ৭. বাবুল কাত্তান ৮. বাবে হিত্তাহ ও ৯. বাবে শারফিল আম্বিয়া বা বাবে ফয়সল ইত্যাদি। দক্ষিণ দিকে জামে আন্ নিসা নামে মহিলাদের জন্য একটি মসজিদ আছে।
উমাইয়া খলীফাহ আবদুল মালেক বিন মারওয়ান প্রথমে মসজিদে সাখরার সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করেন। তিনি মসজিদে আকসার নির্মাণ কাজ শুরু করলেও তা শেষ করতে পারেননি। ৭২ হিঃ মোতাবেক ৬৯০ খৃঃ তার ছেলে ওয়ালিদ বিন আবদুল মালেক মসজিদে আকসা নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেন।
মসজিদে আকসার দৈর্ঘ্য ৮০ মিটার ও প্রস্থ ৫৫ মিটার। এতে মারবেল পাথরের তৈরি মোট ৫৩টি স্তম্ভ আছে এবং পাথরের তৈরি ৪৯টি বর্গাকৃতির খুঁটি আছে। স্তম্ভ ও খুঁটিগুলোর উচ্চতা হচ্ছে ৫ মিটার। এগুলোর উপর ৯ মিটার চওড়া পাথরের ধনুক নির্মাণ করা হয়েছে এবং এর উপর নির্মিত হয়েছে ছাদ। স্তম্ভগুলোকে তামার তৈরি পাত দ্বারা মোড়ানো হয়েছে। মসজিদের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে বিরাট গম্বুজ। শিশা দ্বারা গম্বুজের চারদিক ঢালাই করা হয়েছে। মসজিদের সামনের গম্বুজটি ১৭ মিটার উঁচু ও তাতে মোজাইক করা হয়েছে। এতে বহু কারুকার্য করা হয়েছে।
মসজিদে কিবলার দিকে মিম্বার নূরুদ্দিন ও মেহরাব সালাহউদ্দিন অবস্থিত। মসজিদে একটা বড় মেহরাব আছে যা মিম্বার থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত। এর নামকরণ করা হয়েছে মেহরাবে দাউদ। তারপর লোকেরা এর নামকরণ করেছে মেহরাবে উমার। মসজিদের শুরুতে মিম্বার থেকে পশ্চিমে আরেকটি মেহরাব আছে। একে মেহরাবে মুআওইয়াহ বলা হয়।
মসজিদে আকসার ভবন পূর্ব সীমানার দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছেনি। কেননা, হযরত উমার (রাঃ) লোকদেরকে পশ্চিম সীমানায় মসজিদ ভবন নির্মাণের নির্দেশ দেয়ায় তখন থেকে পূর্বাংশ খালি পড়ে আছে।
মসজিদে আকসার সীমানার ভেতর কয়েকটি মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে। সেগুলো হল, মাদ্রাসা নাহওইয়া, মাদ্রাসা নাসরিয়া ও মাদ্রাসা ফারেসিয়া। মসজিদে আকসা ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এতে তাফসীর, হাদীস, ফিকহসহ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষা দান করা হয়।
অনেক দিন পর্যন্ত মসজিদে আকসায় ৪ মাজহাবের ৪ জন ইমামের মাধ্যমে নামাযের ব্যবস্থা আঞ্জাম দেয়া হতো। এর ফলে তা বিরাট ইসলামী শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে মাজহাব-ভিত্তিক ইমামতির পদ্ধতি বাতিল করা হয়। মসজিদে আকসার চারপাশে অনেকগুলো ‘গরীব বোর্ডিং’ আছে। যেয়ারতকারী গরীব মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি বা সংস্থা তা কায়েম করেছেন।
মসজিদে আকসার পশ্চিম দেয়ালকে ‘বোরাক শরীফ’ বলা হয়। এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বোরাক বাঁধা হয়েছিল। ইহুদীরা এটাকে ‘আল-হায়েত আল-মাবকী’ বলে। এই দেয়ালটি বিরাট পাথর দ্বারা নির্মিত। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৫৬ ফুট এবং উচ্চতা ৬৫ ফুট। ইহুদীদের দাবী হচ্ছে, এটি হাইকালে সুলাইমানীর অবশিষ্টাংশ। কিন্তু বর্তমানে তা মসজিদের আঙিনার অংশ ও মসজিদের ওয়াকফ বিভাগের মালিকানাধীন।
মসজিদে আকসার দরজাগুলোতে অতি বেশী নকশা ও সুন্দর ডিজাইন করা হয়েছে। ১৯২২ খৃঃ মসজিদে আকসা সংস্কার সংক্রান্ত সর্বোচ্চ ফিলিস্তিনী কমিটি মসজিদের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামতের জন্য মিসর ও তুরস্কের প্রকৌশলীদেরকে আহবান করে। কমিটি অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে, মসজিদের বিভিন্ন খুঁটি ও স্তম্ভগুলোতে ফাটল ধরেছে এবং এগুলোর পক্ষে আর মসজিদের ছাদ বহন করা সম্ভব নয়। তারা মসজিদের নকশা ও ডিজাইন বহাল রেখে মেরামতের কাজ শেষ করেন। ১৯২৭ খৃঃ মোতাবেক ১৩৪৬ হিঃ মসজিদে আকসার গম্বুজ সংস্কার করা হয়। একই বছর ভূমিকম্পে মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফাটল ধরে। ১৯৩৮ খৃঃ উক্ত ফাটল মেরামত করা হয়। বিভিন্ন সংস্কারের সময় মসজিদে আকসার নকশা ও কারুকার্য অক্ষুন্ন রাখা হয়। এটি পৃথিবীর একটি সুন্দর স্থাপত্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/613/3
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।