HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কুরআনের আলোকে মূসা আলাইহিস সালামের ব্যক্তিত্ব ও দা‘ওয়াহ কার্যক্রম

লেখকঃ মো: আবদুল কাদের

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কুরআনের আলোকে মূসা আলাইহিস সালামের ব্যক্তিত্ব ও দা‘ওয়াহ কার্যক্রম

মো: আবদুল কাদের

সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ভূমিকা
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। পৃথিবীতে মানুষকে সরল সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য যুগে যুগে আল্লাহ তা‘আলা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীতে এমন কোন জনপদ ও জনগোষ্ঠী নেই যাদের কাছে আল্লাহ্‌ নবী-রাসূল পাঠাননি। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ বলেন: আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি, যেন তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে বেঁচে থাক। [আল-কুরআন, সূরা আন নাহল: ৩৬।] পৃথিবীর সমুদয় বস্তুর প্রকৃত ও সাম্যক জ্ঞান লাভে মানুষ অপারগ। কেননা, মহান আল্লাহ অত্যন্ত স্বল্প ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়েই তাদের পাঠিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘‘আর তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে’’। [আল-কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৬।]

অতএব, স্বল্প জ্ঞানের মানুষেরা জানে না কিসের উপর তাদের কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ভর করে। সৃষ্টি জীবের মধ্যে মানুষের জন্য কোনটি উপকারী এবং কোনটি অপকারী নবী-রাসূলগণ এ সকল তথ্য ও গূঢ় রহস্য সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং যাবতীয় উপকারী-অপকারী ও মঙ্গল-অমঙ্গলের পথ নির্দেশ করেন। যুগে যুগে এ সকল পথ নির্দেশক শ্রেষ্ঠ মানবগণ মানুষকে স্বীয় স্রষ্টার প্রতি ঈমান আনয়ন ও তার ঐকান্তিক দাসত্ব করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে মহান আল্লাহ তা‘আলা সকল নবী-রাসূলকে দু’টি বিষয় সম্পাদনের জোরালো নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং উম্মতগণকে সে বিষয়ের প্রতি দা‘ওয়াত দেয়ার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন,‘‘আপনার পূর্বে আমি যে রাসূল-ই প্রেরণ করেছি তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই, সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’ [আল-কুরআন, সূরা আম্বিয়া : ২৫।]

উক্ত আদেশপ্রাপ্ত নবী-রাসূলগণের মাঝে পাঁচজনকে মহান ও শ্রেষ্ঠ, হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তারা হলেন:

নূহ আলাইহিস সালাম

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম

মূসা আলাইহিস সালাম

ঈসা আলাইহিস সালাম

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

আলোচ্য প্রবন্ধে মূসা আলাইহিস সালাম এর ব্যক্তিত্ব ও দা‘ওয়াহ কার্যক্রম অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে বিবৃত হলো।

১. মূসা আলাইহিস সালাম এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
মূসা আলাইহিস সালাম ‘‘ أولوا العزم ’’ [যে সকল রাসূল অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত ও উচ্চ মর্যাদশীল এবং যাদের কাছ থেকে মহান আল্লাহ্‌ প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন তাদেরকে “ أولوا العزم ’’ বলা হয়। আল কুরআন, সূরা আহযাব: ৭।] এর অন্তর্গত একজন মহাসম্মানিত রাসূল ছিলেন। তিনি ইংরেজী বাইবেলে ‘মোশাস’ ও হিব্রু বাইবেলে ‘‘মোশী’ নামে উল্লেখিত। [সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ২য় খ-, (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, তা.বি) পৃ.২৩৪।] কিবতী ভাষায় ‘মূ’ অর্থ পানি আর ‘শা’ অর্থ গাছ। তিনি যে বাক্সে ছিলেন তা গাছ থেকে তৈরী ও তা পানিতে পাওয়া গিয়েছিল বলে তার উক্ত নামকরণ করা হয়েছে। [ইবনে জারির, তারীখুল উমাম ওয়াল মুলূক, ১ম খ-, (মিসর: দারুল মা‘আরিফ, ১৯৬০), পৃ.৩৯০।] অপর এক বর্ণনায় এসেছে, মূসা হিব্রু শব্দের ‘মূশা’ হতে উদ্ভুত, যার অর্থ ‘নাজাতদানকারী। তিনি যেহেতু বনী ইসরাঈলকে চারশত বছরের গোলামী হতে নাজাত দান করেছেন সেজন্যে তার উক্ত নামকরণ করা হয়েছে। [মুহাম্মদ জামীল আহমদ, আম্বিয়া-ই কুরআন, ২য় খ-, (লাহোর: শায়খ গুলাম আলী এ- সন্স, তা.বি.), পৃ. ৪৬৪।] ইঞ্জিলে ‘মূসা’ শব্দটি এভাবে এসেছে, যার অর্থ পানি হতে সংগৃহীত। যেহেতু ফের‘আউন কন্যা অথবা তার স্ত্রী তাকে নীল নদ হতে সংগ্রহ করেছিল, সেজন্যে উক্ত নামে নামকরণ করা হয়েছে। তার উপাধি হল ‘কালিমুল্লাহ’ তিনি সরাসরি আল্লাহর সাথে কথা বলেছিলেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে “আর আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালাম এর সাথে সরাসরিই কথা বলেছেন।’’ [আল-কুরআন, সূরা আন নিসা : ১৬৪।] এ ছাড়াও হাদীসে আদম আলাইহিস সালাম তাঁর এ উপাধির স্বীকৃতি দিয়েছেন। [ইমাম বুখারী, আল-জা’মি আস-সহীহ, ২য় খ-, কিতানু আহাদিসিল-আম্বিয়া দেওবন্দ: কুতুব খানায়ে রাহীমিয়া তা. বি.), পৃ. ৪৬৪।]

মূসা আলাইহিস সালাম ইবরাহীম এর অষ্টম মতান্তরে সপ্তম পুরুষে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বংশ তালিকা নিন্মরূপঃ ‘‘মূসা ইবন ইমরান ইবন কাহাছ ইবন আযির ইবন লাবী ইবন ইয়াকুব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম।’’ [ইবনে কাছির কাছাসুল আম্বিয়া, আম্মান: মাকতাবাতুর রিসালাহ, তা.বি, প্র. ২২৩; ইবনুল আছির, আল-কামিল ফি আত-তারিখ, ১ম খ-, ( বৈরুত: দারুল কিতাব আল-ইলমিয়্যা, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৭), পৃ. ১৩০।]

মূসা আলাইহিস সালাম এর পিতার নাম ইমরান। কুরআনুল কারীমে তার জন্ম প্রসঙ্গে তার মাতা ও ভগ্নীর উল্লেখ আছে কিন্তু তার পিতা সম্পর্কে কোন বর্ণনা নেই। এ জন্য অনেকের ধারণা যে, মূসা আলাইহিস সালাম এর জন্মের সময় তিনি জীবিত ছিলেন না। [.মুহাম্মদ জামীল আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ.৯৬৭।] তার মায়ের নাম সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। সুহাইলীর বর্ণনা মতে, তার নাম ‘আয়ারেখা’ মতান্তরে ‘আয়াযাখত’ [ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১ম খ-, কায়রো: দারুদ দিয়ান লিত্তুরাছিল ইরলামী ১৯৯৭, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৪।] হিফজুর রহমান সিউহারবীর মতে, ইউকাবাদ। [হিফজুর রহমান সিউহারবী, কাছাছুল কোরআন, ২য় খ-, (উর্দু), অনুবাদ মাওঃ নুরুর রহমান, (ঢাকা: এমদাদীয়া লাইব্রেরী, ১৯৯৭), পৃ. ১৪] তিনি ছিলেন মূসা আলাইহিস সালাম এর পিতা ইমরান এর ফুফু অর্থাৎ লাবীর কন্যা। [আব্দুল ওহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, বৈরুত। দারুল ফিকর, তা. বি.), পৃ. ১৫৬।] মূসা আলাইহিস সালাম মাতা ছিলেন একজন সম্মানিতা মহিলা এবং আল্লাহর প্রিয় পাত্রী। তার গর্ভে দু‘জন খ্যাতিমান নবীর আবির্ভাবের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে গৌরবাম্বিত করেছেন। এ ছাড়াও আল্লাহ তার নিকট প্রত্যাদেশ প্রেরণ করে তাকে সম্মানিত ও মর্যাদাবতী করেছেন। এ সম্পর্কে কুরআনে এসেছেঃ ‘‘আমি মূসার মাকে ইশারা করলাম একে স্তনদান কর, তারপর যখন তার প্রাণের ভয় করবে তখন দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবে এবং কোন ভয় ও দুঃখ করবে না। তাকে তোমারই কাছে ফিরিয়ে আনবো এবং তাকে রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত করবো।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস: ৭।]

২. মূসা আলাইহিস সালাম-এর ব্যক্তিত্বঃ
মূসা আলাইহিস সালাম অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি অসংখ্য গুণের আঁধার ছিলেন। নিম্নে তার ব্যক্তিত্বের কতিপয় দিক তুলে ধরা হলঃ

(ক) একনিষ্ঠতা: মূসা আলাইহিস সালাম অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি যাবতীয় দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে একনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন। মহান আল্লাহর কঠিন ও দুর্বোধ্য আদেশ পালনে তিনি অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: আর কুরআন মজিদে মূসা আলাইহিস সালাম-এর কথা স্বরণ করুন। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ রাসূল ও নবী।’’ [আল-কুরআন, সূরা মারয়াম: ৫১।]

(খ) বিশ্বস্ততা : বিশ্বস্ততা ও শক্তিশালী হওয়ার দিক থেকে মূসা আলাইহিস সালাম ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । তার এই বিশ্বস্ততা ও শক্তি দেখেই এক কন্যা স্বীয় পিতার নিকট তাকে তাদের পরিবারে কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার আবেদন করেছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সূরা আল কাসাসে এসেছে, ‘‘নারীদ্বয়ের একজন বলল হে পিতা! এ লোককে চাকর নিযুক্ত করুন, নিশ্চয়ই শক্তিমান ও বিশ্বাসী লোকই চাকর হওয়ার উপযুক্ত।’ [আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস: ২৬।]

এছাড়াও নারীদ্বয়ের নিকট তার মার্জিত আচরণ, নৈতিকতা, সহযোগিতার মানসিকতা, চলন-বলন, দৈহিক শক্তি সামর্থ ইত্যাদি গুণাবলী পরিদৃষ্ট হয়েছে।

(গ) সহযোগিতা ও সহমর্মিতা: তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়াশীল ও অপরের হিতাকাংখী। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি খুব আনন্দবোধ করতেন। অসহায়-অবলাদের সাহায্যার্থে তিনি সবসময় এগিয়ে আসতেন। ‘মাদইয়ানে’ [‘মাদইয়ান’ মিসরের পূর্ব দিকে লূত সম্প্রদায়ের আবাসস্থলের নিকটে অবস্থিত। লূত সম্প্রদায় মৃত সাগরের কাছে বাস করত। আর ‘মাদইয়ান’- এর নিকটে দক্ষিন-পূর্ব দিকে অবস্থিত। খ্যাতনামা ভূগোলবিদ ইয়াকুব আল-হামাবী বলেন, আবু যায়িদ এর বর্ণনা মতে, মাদইয়ান নগরী বাহর-ই কুলযুম তথা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত। (ইয়কুব আল-হামাবী, মু‘জামুল বুলদান, ৫ম খ-, বৈরুত: দারু সাদির ,১৯৫৭) , পৃ. ৭৭-৭৮; ড. সালাহ আল-খালেদী, আল-কাসাসুল কুরআনী, ২য় খ-, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৪-৩২৫)এটি আকাবা উপসাগরের উত্তরে অবস্থিত। এর পূর্বে ফিলিস্তিন ও উত্তরে হেজাজ। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর এক পুত্র সেখানে বসবাস করতেন। তার নামানুসারেই এ শহরের নাম রাখা হয়েছে মাদইয়ান। আব্দুল ওহাব আন-নাজ্জার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮২।] অবস্থান কালে তিনি দু‘ নারীকে কুপ হতে পানি উত্তোলনে সহযোগিতা করেছেন।

(ঘ) অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠঃ তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন। যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠ। তৎকালীন মিসরে এক কিবতীকে একজন ইসরাঈলীর উপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার করতে দেখে তিনি তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন। [১৯আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস:২৩।]

(ঙ) অনুশোচনা প্রিয়ঃ মূসা আলাইহিস সালাম ছিলেন স্বীয় কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা প্রিয়। তাই কিবতী হত্যাকে তিনি অন্যায় ভেবে মহান আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। আর আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে,

‘‘সে (মূসা আ.) বলল: হে আমার রব! আমি নিজের উপর যুলুম করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’’ [২০আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস:১৪,১৫]

উপরোল্লিখিত যাবতীয় গুনের আধার হিসেবে তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘‘মূসা আলাইহিস সালাম এর আল্লাহর সমীপে বিশেষ সম্মানিত।’’ [২১আল-কুরআন, সূরা আল-আহযাব: ৬৯]

৩. মূসা আলাইহিস সালাম-এর সমকালীন অবস্থাঃ
মূসা আলাইহিস সালাম এর আবির্ভাবের সময় মিসরের শাসন ক্ষমতায় ফের‘আউন [ফের‘আউন কোন ব্যক্তি বিশেষের আম নয়। যে কোন মিশরীয় বাজার নামও নয় । এটি বংশীয় উপাধী কিবতী ভায়ায় এর অর্থ মহান বংশ। (দ্র.ড. মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান কুরআন পরিচিতি, (ঢাকা: খোসরোজ কিতাব মহল, ১৯৯৯ খ্রি.) , পৃ. ৯৯) এটা মিশরের শাসকবর্গের উপাধী হিসেবে খ্যাত। তার বংশক্রম নিন্মরূপ: ওয়ালিদ ইবনে মুসয়াব ইবনে মুয়াবিয়া ইবনে আবি নু‘মাযের ইবনিল হাওয়াশ ইবনে লায়ছ ইবনে হারান ববিনে আমর ইবনে আমলাক। (দ্র. ইবনুল জাওযী, আল মুনতাজাম ফি তারীখিল মুলুক ওয়াল উমাম, বৈরম্নত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ-১৯৯৫ খ্রি.), পৃ. ৩৩২।] অধিষ্ঠিত ছিল। তার নাম কাবুস ইবন মুস‘আব ইবন মুযারিফ। কারো কারো মতে, ওয়ালিদ ইবনে মুস‘আব ইবন রাইয়্যান। সে ছিল কিবতী বংশোদ্ভুত (আমালেকা গোত্রের)। তৎকালীন সময়ে মিসরে আরেক শ্রেণী লোকের আবাস ছিল যাদেরকে বনী ইসরাঈল [হযরত উয়াকুব (আ.) এর অপর নাম ইসরাঈল। তার বংশধরদেরকে বনী ইসরাঈল বলা হয়। (দ্র. ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, প্রগুক্ত, পৃ. ১০০।) ইসরাইল হিব্রু ভাষার শব্দ। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাদেরকে বনী ইয়াকুব সম্মোধন না করে বনী ইসরাঈল নাম ব্যবহার করেছেন। যাতে স্বয়ং নিজেদের নাম ও উপাধি থেকেই বুঝতে পারে যে, তারা আব্দুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা। মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী, প্রগুক্ত, পৃ.৯৭৫। বনী ইসরাঈল ছিল অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ ও ধার্মিক । জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও সাহিত্যে তারা মিসরীদের হার মেনে দ্রুত সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছিল। তাদের এ দ্রুত অগ্রগতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং মিসরীয়দের মনে তাদের প্রতি হিংসার বীজ তৈরী করেছিল। (দ্র. মোস্তফা সায়িদ কানিজ, কুরআনে নবীদের ইতিহাস, (কলকাতা: বানী প্রকাশ, ১৯৯০), পৃ. ৬২-৬৩।) তারা ছিল শাম দেশের বাসিন্দা। স্বদেশ যেতে তাদেরকে ফের‘আউন বাধা দিত। এভাবে চারশত বছর ধরে তারা ফেরআউনের বন্দীশালায় গোলামীর জীবন-যাপন করেছিল। অবশেষে তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ছয় লাখ ত্রিশ হাজার। (মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭৫।)] নামে আখ্যায়িত করা হত। পবিত্র কুরআনে তাকে বা সত্মম্ভ অধিপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অহংকারে নিজেকে সে প্রভু বলে দাবী করত। পৃথিবীর ইতিহাসে সে আজো একজন যালিম শাসক হিসেবে পরিচিত।

ফের‘আউন নিদারুণ স্বেচ্ছাচারী ও অত্যাচারী শাসক। বনী ইসরাঈলকে সে নিদারুন জীবন যাপনে বাধ্য করেছিল। তার পূর্বেকার সব ফের‘আউন-ই বনী ইসরাঈলের উপর অত্যাচার করত। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম এর সময়কার ফের‘আউনের অত্যাচারই ছিল সবচেয়ে কঠোর ও দীর্ঘমেয়াদী। সে তাদেরকে দাস-দাসী বানিয়ে রাখে এবং কঠিনতর কাজে নিয়োগ করে। এক শ্রেণীকে গৃহ নির্মাণ কাজে, এক শ্রেণীকে কৃষি কর্মে ও এক শ্রেণীকে উৎপাদন কর্মে ব্যস্ত রাখত। আর যে কোন কর্মে নিয়োজিত ছিল না, তাকে রাজস্ব কর দিতে হত। এভাবে তাদেরকে বিভিন্ন দল ও গোত্রে বিভক্ত করে। [‘আফিফ ‘আবদুল ফাত্তাহ, বৈরুত: দারুল ইলম লিল মালাঈন, ১৬শ সংস্করণ, ১৯৮৭ ১৬ পৃ. ২১৭-২১৮।]

সে তাদের দ্বারা ‘রামসিস’ ও ‘তাফায়ছুন’ নামক দু‘টি শহর নির্মাণ করে। প্রত্নতাত্বিক খননের দ্বারা উক্ত শহর দু‘টির পরিচয় পাওয়া যায়। একটির শিলালিপি হতে জানা যায় যে, একটার নাম ‘বার তুম’ অথবা ‘ফয়ছুম’ যার অর্থ ‘তুম দেবতার ঘর’ অপরটির নাম ‘রামসিস’ যার অর্থ ‘রামসিস’ প্রাসাদ’। [হিফজুর বহমান সিউহাররী, প্রাগুক্ত, ১ম খ-, পৃ. ৩৬১-৩৬২।] এতদ্ব্যতীত সে বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অপদস্ত করতঃ তাদের ছেলেদের হত্যা করত এবং মেয়েদের জীবিত রাখত। পবিত্র কুরআন তার অত্যাচারের চিত্রটি তুলে ধরেছে। ইরশাদ হয়েছে:

‘নিশ্চয় ফের‘আউন তার দেশে ঔদ্ধত্য এবং দেশবাসীকে নানা দল-উপদল ও গোত্রে বিভক্ত করে তাদের একদলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত এবং নারীদের জীবিত রাখতো। নিশ্চয়ই সে ছিল বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। [আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস : ৪।]

এখানে বুঝানো হয়েছে যে, ফের‘আউন দাসত্বের স্থান থেকে উঠে সেচ্ছাচারী ও প্রভুর রুপ ধারণ করেছে। অধীন হয়ে থাকার পরিবর্তে প্রবল হয়ে গেছে এবং স্বৈরাচারী ও অহংকারী হয়ে যুলুম করতে শুরু করেছিল। [সাইয়েদ আবুল ‘আলা মওদুদী, তাফহীমুল কুরআন, অনু: আব্দুল মান্নান তালিব, ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী, ৫ম প্রকাশ, ২০০৩, ১০ম খ-, পু, ২২০-২২১।] ইবন কাছীর বলেন, ফের‘আউন যমীনে মাথা উঁচু করে ও অহংকার প্রদর্শন করে চলতো। আর দেশের অধিবাসীদের নানা দলে বিভক্ত করে রাখত এবং প্রত্যেক দলকে দিয়ে সাম্রাজ্যের যে কাজ ইচ্ছা তা করাতো। তাদের এক দলকে দুর্বল মনে করত, আর সে দলটি ছিল বনী ইসরাঈল। অথচ তারা ছিল সে সময়ের উত্তম জাতি। [ইবন কাছীর, তাফসীরূল কুরআনিল আযিম, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৪০ হি., ৩য় খ-, পৃ. ৩৩৪৫।] তাদেরকে যেমনি বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রাখত, তেমনিভাবে তাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করে রাখত, যাতে তারা ঐক্য হতে না পারে। কিবতীদের সম্মানিত আসনে সমাসীন করত এবং বনী ইসরাঈলকে লাঞ্ছিত ও অপামনিত করত। [কাজী ছানাউল্লাহ পানিপথি, আত তাফসীরূল মাযহারী, দিল্লী: নদওয়াতুল মুসান্নিফীন, তা. বি, ৭ম খ-, পৃ. ১৪৩।] মিসরে এভাবে সুদীর্ঘ ৪০০ বছর যাবৎ ফের‘আউন বনী ইসরাঈলদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। [মুহাম্মদ আলী আছ-ছাবুনী, আন-নবুয়ত ওয়াল আম্বিয়া, বৈরুত। মুা‘আসসাসাতুদুদিয়ান, ১৯৯৯ খৃ., পৃ. ১৮৪।]

সে এ অত্যাচার এজন্য করত যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রচলিত একটি সুসংবাদ তাকে প্রভাবিত করেছিল, তা হল: ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর স্ত্রী সারার সাথে মিসর অধিপতি কুকর্ম করতে চেয়েছিল, যা আল্লাহর রহমতে বাস্তবায়িত হয়নি। তখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, তার বংশে অতিসত্তর এমন এক সন্তান জন্ম নিবে, যার হাতে মিসরের বাদশাহর পতন হবে। এ সুসংবাদ বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল। অতঃপর কিবতীগণও এটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকে, যা মন্ত্রীবর্গের মাধ্যমে ফের‘আউনের কর্ণগোচর হয়। তাই এ শিশুর আবির্ভাবের ভয়ে সে বনী ইসরাঈলের পুত্র সন্তানদের হত্যার নির্দেশ দেয়। [ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১ম খ-, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২] মূলতঃ ফের‘আউন বনী ইসরাঈলদের বংশ বৃদ্ধি, সুখ-স্বাচ্ছন্দে বসবাস ও মিসরীদের তুলনায় স্বতন্ত্র আবাস গ্রহণ সর্বোপরি জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের উন্নতির প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে এবং নিজের আধিপত্য দীর্ঘমেয়াদী টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে তাদের উপর এরূপ যুলুম করত।

৪. দা‘ওয়াতী কার্যক্রমঃ
মূসা আলাইহিস সালাম যখন শক্তি সামর্থ এবং প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের দিক থেকে পূর্ণ হয়ে পরিণত বয়সে উপনীত হন, তখন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রিসালাতের গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত হন। এ মর্মে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘যখন মূসা যৌবনে পদার্পন করলেন এবং পরিণত বয়সে উপনীত হলেন, তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম। এভাবে আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। [আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস: ১৪।]

অত্র আয়াতে ‘‘হুকুম’’ বলে নবুয়্যত ও রেসালাত বুঝানো হয়েছে। আর পরিণত বয়স বলতে চল্লিশ বছরকেই বুঝানো হয়েছে। [মুফতী মোহাম্মদ শফী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭।] মুলতঃ আল্লাহ তা‘আলা তাকে চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়ত দান করেছিলেন। কারো কারো মতে, তখন তার বয়স ত্রিশ ও চল্লিশ এর মধ্যে অবস্থান করেছিল। [ড. ফুয়াদ আব্দুল্লাহ্ উমর, আল-উনছুল জালীল ফি কিসসাতে মুসা ওয়া ফির‘আউন ওয়া বনী ইসরাইল, (কুয়েত: মাকতাবাতু মানার আল-ইসলামিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৮), পৃ. ২৯।] তবে, অধকাংশের মতে চল্লিশ বছর। কেননা, মানুষের জ্ঞান, শক্তি-সামর্থের পূর্ণতা ঘটে মূলতঃ চল্লিশ বছর বয়সে। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে এসেছে, ‘‘অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থের বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে (তখন আমি তাকে নবুওয়ত দান করি)। [আল-কুরআন, সূরা আল-আহকাফ: ১৫।]

এখানে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে তারই ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন এবং কিয়ামত দিবসের কথা অবহিত করেন। এ গুলোই হলো দীনের মূলনীতি। অতএব, তিনি মূসাকে লক্ষ্য করে বলেন ‘‘আর আমি নবী হিসেবে তোমাকে মনোনীত করেছি, সুতরাং তোমার প্রতি যে সকল ওহী হয় তা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে শুন। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা : ১৩।] নিশ্চয় আমি আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমার ইবাদত কর, আর আমার স্মরণ হিসাবে নামায কায়েম কর। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা : ১৪-১৫।] অতঃপর আখিরাত সম্পর্কে বলেন,

‘‘কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী। আমি কিয়ামত আসার নির্দিষ্ট তারিখ সমস্ত সৃষ্টির কাছে গোপন রাখতে চাই। কিয়ামত আসবে, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বীয় কৃতকর্মের প্রতিফল পেতে পারে। কাজেই আপনাকে যেন এমন ব্যক্তি কিয়ামতের জন্য প্রস্তুত হওয়া থেকে বিরত না রাখতে পারে, যে এ সম্পর্কে বিশ্বাস রাখে নি এবং স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে। যদি কিয়ামতের জন্য প্রস্তুত হতে নির্লিপ্ত হয়ে যাও, তা হলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা : ১৬।]

উপরোক্ত আয়াতে কারীমাগুলো মানব জীবনের অন্যতম প্রধান দিক আকীদা-বিশ্বাস সংশোধনের নিমিত্তে দীনের মূলনীতির প্রতি আলোকপাত করেছে। যেমন-

(ক) তাওহীদঃ আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তার সাথে কেউ শরীক নেই। তিনি আমাদের প্রতিপালক, রিযিকদাতা, পরিচয় এভাবে উপস্থাপন করেছেন। সুতরাং তিনিই একমাত্র উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। মহান আল্লাহ নিজেই তার পরিচয় এভাবে উপস্থাপন করেছেন। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র এসেছে,

‘‘হে মুসা! আমি আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা :১৩।]

(খ) রিসালাতঃ যুগে যুগে মানব জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে আল্লাহ অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। উপরোল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামিন তার প্রতিনিধিস্বরূপ মূসা আলাইহিস সালাম কে মনোনীত করার মাধ্যমে তার রিসালাতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

(গ) আখিরাত : মানুষের জন্য দু‘টি জীবন রয়েছে। একটি ইহকালীন, অপরটি পরকালীন। ইহকালীন জীবন হলো ক্ষণস্থায়ী। কাজেই তাকে জীবনের চুড়ান্ত মনযিল ভাবা যাবে না। আর পরকালীন জীবন হলো চিরস্থায়ী। যেখানে মানুষকে অবশ্যই যাবতীয় কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। পরকালীন জীবনে মানুষের কৃতকর্ম অনুসারে পুরষ্কৃত ও তিরস্কৃত করা হবে।

(ঘ) ইবাদত : আল্লাহ এক ও একক হিসেবে তিনিই একমাত্র ইবদাত পাওয়ার যোগ্য। এছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য মানা যাবে না। এখানে ইবাদত বলতে সর্বপ্রধান ইবাদত নামাযকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ইসলামী দা‘ওয়াহর মূল বিষয়বস্তু। যুগে যুগে নবী-রসূলগণ এ সব বিষয়ের প্রতিই মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। নিম্নে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে মূসা আলাইহিস সালাম এর দা‘ওয়াহ কার্যক্রম বিধৃত হলো:

এক. আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান
সর্বপ্রথম ফের‘আউনকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। আর আল্লাহই একমাত্র রব বা প্রতিপালক। এক্ষেত্রে অন্য কাউকে রব বা প্রতিপালক মনে করা মস্তবড় অপরাধ। এক আল্লাহর দিকে আহ্বান মানুষকে আল্লাহর সামনে সমপর্যায়ের করে থাকে। সে ক্ষেত্রে রাজা-প্রজার কোন ভেদাভেদ থাকে না। [জুমআ আলী আল-খাওলী, তারিখু দাও‘ওয়াহ, মিসর: দারুত তাব‘আতিল মুহাম্মাদিয়া, ১ম সংস্করণ, ১৪০৪ হি., ১ম খন্ড, পৃ. ২৮১।] পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূল মানুষদেরকে এর প্রতিই আহ্বান করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে :‘‘আপনার পূর্বে আমি যে রাসূল প্রেরণ করেছি তাকে এ আদেশই দিয়েছি যে, আমি ব্যতিত অন্য কোন উপাস্য নাই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর। [আল-কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া: ২৫।]

ইসলামী দা‘ওয়াতের মূল ও প্রতিপাদ্য বিষয় হল তাওহীদ। মূসা আলাইহিস সালাম তাওহীদের দা‘ওয়াতকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। মহান আল্লাহ নিজেই তার নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘‘তিনি আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তার অসংখ্য সর্বোত্তম নাম রয়েছে। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা :৮।] মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর একত্ববাদের এজন্য গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, তৎকালীন ক্ষমতার মসনদে আসীন ফের‘আউন নিজেই উপাস্য হবার দাবী করেছিল। সে তাকে ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য আছে বলে বিশ্বাস করত না। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘‘আর ফের‘আউন বলল, হে সভাসদবর্গ! আমি নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোন প্রভু আছে বলে জানি না।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস: ৩৮।] মিসরবাসী তাকে সূর্য দেবতার অবতার বলে জানত। তারা বিশ্বাস করত যে, মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির লালন-পালনের দায়িত্ব সূর্য দেবতার, আর মিসরের রাজ সিংহাসনের অধিকারী ফের‘আউন, সে সূর্য দেবতারই প্রতিচ্ছবি। তাই সমগ্র জগতের প্রতিপালনের অধিকারও তার করায়ত্তে। ফলে মিসরের সিংহাসনে যে অধিষ্ঠিত হত তার উপাধি হত ‘ফারা’ আর পরবতীর্তে এ উপাধীই ফের‘আউন রূপ ধারণ করে। [তাহের সুরাটী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৯।] মূসা আলাইহিস সালাম এর এ আহ্বান শ্রবণের পর ফের‘আউনের সভাসদমণ্ডলী উত্তেজিত হয়ে মূসা আলাইহিস সালাম এর শাস্তি দাবী করে। কুরআনে এসেছে, ‘‘আর ফের‘আউনের জাতির সরদাররা বলল, তুমি কি মূসা ও তার জাতীকে অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে দিলে যে, তারা দেশে ইচ্ছেমত বিপর্যয় সৃষ্টি করুক, আর তোমাকে ও তোমার উপাস্য হওয়াকে পরিত্যাগ করুক। [আল-কুরআন, সূরা আল-আরাফ: ১২৭।]

এখানে ‘ইলাহ’ শব্দটি শুধুমাত্র স্রষ্টার উপাস্য অর্থে নয়, বরং সার্বভৌম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসক এবং আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মূসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবী-রাসূলগণের ন্যায় স্বীয় কাওমকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছিলেন। কেননা, আল্লাহর রুবুবিয়াত তার ইবাদতকে অত্যাবশ্যক করে। তাছাড়া মূলতঃ সবাই আল্লাহর বান্দা। সে হিসেবে তিনি বনী ইসরাঈলের নিকট হতে আল্লাহর ইবাদত করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। ইরশাদ হয়েছে :‘‘আর স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন আমি বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না। [আল-কুরআন, সূরা আল বাকারা: ৮৩।]

কিন্তু প্রতিশ্রুতি লাভের পরও বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ লোক আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়নি। ফলে তিনি আফসোস করে বলেন, ‘‘হে আমার সম্প্রদায় ! ব্যাপার কি? আমি তোমাদেরকে দা‘ওয়াত দেই মুক্তির দিকে , আর তোমারা আমাকে দাওয়াত দাও জাহান্নামের দিকে। তোমরা আমাকে বল যাতে আমি আল্লাহকে অস্বীকার করি এবং তার সাথে শরীক স্থাপন করি এমন বস্তুকে যার কোন প্রমাণ আমার কাছে নেই, অথচ আমি তোমাদেরকে পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল আল্লাহর দিকে আহ্বান করছি। [আল-কুরআন, সূরা আল-মু‘মিনুন: ৪১-৪২।]

দুই. রিসালাতের প্রতি আহ্বান
মূসা আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম পরাক্রমশালী ও অত্যাচারী শাসক ফের‘আউনের কাছে বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের পক্ষ হতে নিজের রাসূল হওয়ার খবর দিলেন। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে এসেছেঃ

‘‘আর মূসাআলাইহিস সালাম বললেন, হে ফের‘আউন! আমি রাববুল আলামীনের প্রেরিত রাসূল। আমার জন্য কোন ক্রমেই শুভনীয় নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সত্য ব্যতীত অন্য কিছু বলি। নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের রবের তরফ থেকে প্রমান এবং নিদর্শন নিয়ে এসেছি।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল- আ‘রাফ: ১০৪-১০৫।]

অত্র আয়াতের মাধ্যমে মূসা (আ) নিজেই নিজের রাসূল হওয়ার কথা ঘোষণা করলেন, যাতে পরাক্রমশালী রবের দাবী উত্থাপনকারী ফের‘আউনের অন্তর জাগরিত হয় এবং সে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারে।

তিন. বনী ইসরাঈলের মুক্তির দাবী
ফের‘আউন বনী ইসরাঈলদের উপর নানাভাবে অত্যাচার করত। বনী ইসরাইলের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া বশতঃ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব তাদের অধিকারে যাওয়ার আশংকায় এ অত্যাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি হতে লাগল। সে তাদেরকে বিভিন্ন দলে-গোত্রে বিভক্ত করে রাখত, যাতে তাদের শক্তি বৃদ্ধি না পায়। রাষ্ট্রীয় অত্যন্ত ছোট খাট কাজগুলো সে তাদের মাধ্যমে করাতো, সে তাদেরকে দাস-দাসী বানিয়ে রাখে এবং কঠিনতর কার্যে নিয়োগ করে। গৃহ নির্মাণ, কৃষিকর্ম ও উৎপাদনকর্মের মত কঠিন কাজ তাদের মাধ্যমে আঞ্জাম দেয়া হত, আর যে কোন কর্মে নিয়োজিত ছিল না তাকে রাজস্ব কর দিতে বাধ্য করত। [আফীফ আব্দুল ফাত্তাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৭-২১৮।] মূসা আলাইহিস সালাম তাদের উপর প্রদত্ত অত্যাচার নির্যাতন বন্ধের জন্য ফের‘আউনের নিকট জোর আবেদন জানান। তিনি বনী ইসরাঈলকে ছেড়ে দিতে ও তাদের উপর হতে নির্যাতন-নিপীড়নের খর্গ উঠিয়ে নেয়ার জন্য ফের‘আউনকে আহ্বান জানান। [আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ: ১০৪।] এটি তার পয়গম্বরসূলভ আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। কেননা, নবী-রাসূলদের অন্যতম মিশন ছিল মজলুমের পক্ষ ও জালিমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া। বিধায়, এক কিবতীকে বনী ইসরাঈলের উপরে অন্যায়ভাবে জুলূম করতে দেখে তিনি অত্যাচারীকে তা হতে নিবৃত করার চেষ্টা করেছিলেন।

১০
৫. বিরুদ্ধবাদীদেরকে সত্যপথে আহ্বানের ক্ষেত্রে মূসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক গৃহীত কৌশলসমূহঃ
ইসলামী দা‘ওয়াহর পথ অত্যন্ত বন্ধুর ও কন্টকাকীর্ণ। এ সর্বোচ্চ কৌশলের পরিচয় দিতে হয়। দা‘ওয়াহর প্রতিটি কর্মই হিকমতপূর্ণভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে বিরুদ্ধবাদীদের দীনের দিকে আকৃষ্ট করা সম্ভব। মূসা আলাইহিস সালাম এর দা‘ওয়াতী কাজে এ পদ্ধতির সমাবেশ ঘটেছিল। পরবর্তীতে সকল নবী রাসূল তাদের দা‘ওয়াতী মিশনে হিকমতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। মূসা আলাইহিসসালাম কর্তৃক গৃহীত সে সকল কৌশলগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো:

১১
(ক) ব্যক্তিগত প্রস্তুতি গ্রহণ
ইসলামী দা‘ওয়াহ মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া এক মহান দায়িত্ব। যুগে যুগে সকল নবী রাসূল এ দা‘ওয়াত নিয়েই এসেছিলেন। মানবের সৃষ্টিগত দিকটি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, সৃষ্টিগতভাবেই একটি শিশু সত্য মিথ্যা, ভাল-মন্দ ইত্যাদি মৌলিক কিছু মুল্যবোধ নিয়েই বেড়ে উঠে। এরই নাম ‘ফিতরাত’। অতএব, সত্য গ্রহণের যোগ্যতা তাদের মাঝেও নিহিত আছে। মহান আল্লাহ বলেন ‘‘এটা আল্লাহর দেয়া ফিতরাত (স্বভাব প্রকৃতি) যার উপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই।” [আল-কুরআন, সূরা আর রুম-৩০।]

সুতরাং এ ফিতরাতের বিকাশ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার সামর্থ্য সংকীর্ণ। ফলে সে নিজে নিজে বিকশিত হতে পারছে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় করুণায় মানুষকে পথ দেখালেন তার সেই সুপ্ত শক্তি বিকাশের জন্য, যেন সে কোন দিন আপত্তি তুলতে না পারে, এ জন্যই তিনি যুগে যুগে আম্বিয়া ও রাসূলগণকে দা‘ওয়াতের মিশন নিয়ে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি, যাতে প্রেরণের পর আল্লাহর কাছে আপত্তি করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে যে, আমরা সত্য জানতাম না, তাই তোমার আদর্শ মানতে পারিনি।” [আল-কুরআন, সূরা আন-নিসা-: ১৬৫।]

এ মানব জাতিকে সত্যপথে আহ্বান জানানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় মনোনীত বান্দাদের জন্মলগ্ন থেকেই কতিপয় নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী সম্বলিত করে প্রেরণ করেন। সে হিসেবে মূসা আলাইহিস সালাম বাল্যকাল হতেই সত্য ও শান্ত ছিলেন। ফের‘আউনের গৃহে অবস্থান কালে তার অন্যায় অবিচারকে তিনি অসত্য ও অপরাধ হিসেবেই মনে করতেন। খুব ছেলে বেলায়ই আল্লাহ তা‘আলা তার মাকে এ বলে সান্তনা দিয়েছিলেন যে, ‘‘তাকে তিনি রাসূলগণের অন্তর্ভুক্ত করবেন।’’ সুতরাং শৈশব হতেই তার মাঝে পয়গম্বরসূলভ আচরণ পরিলক্ষিত হয়।

তদুপরি ব্যক্তিগত প্রস্তুতির জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীন তাকে নিজ দেশ মিসর হতে ‘হিজরত’ [হিজরত অর্থ দেশ ত্যাগ করা, কোন কিছু ছেড়ে দেয়া, বিরত থাকা পরিত্রাণ ইত্যাদি। পরিভাষায়, কাফের অধ্যুষিত দেশ হতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশের দিকে চলে যাওয়াকে বুঝায়। (ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০৩; সায়া‘দী আবু যাইব , আল কামুসূলে ফিকহী, (পাকিস্তান: ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলুম আল-ইসলামীয়া, তা. বি.). পৃ. ৩৬৫] করিয়ে ‘মাদইয়ান’ শহরে নিয়ে যান এবং সেখানকার এক নেককার ব্যক্তির সংস্পর্শে পাঠান। সূদীর্ঘ দশবছর যাবত তার গৃহে অবস্থান করায় তিনি জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণে সক্ষম হন। তিনি (মূসা) এর সময়ে একদিকে যেমন পারস্পরিক আচার-আচারণ, লেন-দেন, উঠা-বসা, চাল-চলন, ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়েছিলেন, তেমনি সেখানে বকরী চরানোর কারণে নেতৃত্বের গুণাবলী, ধৈর্য, কষ্ট-সহিঞ্চুতা, আনুগত্য, পরিশ্রমপ্রিয়তা, বিনয় ও নম্রতা, প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। এ মর্মে হাদীসে এসেছে, ‘‘আল্লাহ সকল নবীকে বকরীর রাখাল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। [ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত, কিতাবুল ইজারাত, হাদীস নং-২১০২।] অতএব বকরী চরানো পয়গম্বরদের সুন্নাত। এতে নেতৃত্বের গুনাবলী অর্জিত হয়। কেননা, ছাগল সাধারণতঃ পাল থেকে আলাদা হয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে। ফলে রাখালের মনে বার বার ক্রোধের উদ্রেক হয়। ক্রোধের বশবতী হয়ে রাখাল যদি পলাতক ছাগল হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, তবে ছাগল হাতছাড়া হয়ে কোন বাঘের খোরাকে পরিণত হবে। পক্ষান্তরে, ইচ্ছামত পরিচালনা করার জন্য যদি সে ছাগলকে মারপিট করে, ক্ষীনকায় জন্তু হওয়ার কারণে হাত পা ভেঙ্গে যাওয়া বিচিত্র নয়। এ জন্যেই রাখালকে অত্যাধিক ধৈর্য্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। রাসূলগণের সাথে সাধারণ মানব সমাজের ব্যবহার ও তদ্রুপ হয়ে থাকে। এতে রাসূলগণ তাদের তরফ হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেও পারেন না এবং তাদেরকে কঠোরতার মাধ্যমেও পথে আনতে পারেন না। ফলে ধৈর্য্য ও সহনশীলতার পথই তাদেরকে অবলম্বন করতে হয়।

১২
(খ) দা‘ওয়াতের কাজে সহযোগী নির্ধারণ
ইসলামী দা‘ওয়াহ’র পথ পুষ্প বিছানো শয্যার মত নয়। এটি অত্যন্ত কঠিন ও কাঁটা যুক্ত পথ। এতে একাকী পথ চলা দুর্গম ও দুর্বোধ্য। তাছাড়া এটি মূলতঃ একটি সামষ্টিক কাজ। ব্যক্তির পাশাপাশি সামষ্টিক সংশোধনের জন্য এ দা‘ওয়াহ। অতএব, এক ব্যক্তির পক্ষে আঞ্জাম দেয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। ফলে একাজে সহযোগীর গুরুত্ব অত্যাধিক। তাই মূসা আলাইহিস সালাম তার দাওয়াতী কাজে সহযোগিতা করার জন্য একান্ত আপনজনকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার দরবারে প্রার্থনা করেন। তিনিই একমাত্র রাসূল যিনি রিসালাতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সর্বপ্রথম সাহায্যকারী চেয়েছেন। [আব্দুল্রাহ আল-আলূসী, তারিখুত দা‘ওয়াহ ইলাল্রাহি বাইনাল আমছি ওয়াল ইয়াওম, (কায়রো: মাকতাবা ওয়াহবা, তা. বি), ৬০।] পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘‘আমার জন্য আপনজন হতে আমার ভাই হারূনকে সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও। তার মাধ্যমে আমার হাত শক্তিশালী কর এবং তাকে আমার কাজে শরীক করে দাও, যাতে আমরা খুব বেশী করে তোমাকে স্মরণ করতে পারি। নিঃসন্দেহে আপনি আমাদের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন।” [আল-কুরআন, সূরা ত্ব-হা : ২৯-৩৫।] অত্র আয়াতের মাধ্যমে মূসা আলাইহিস সালাম নবুওয়তের মহান দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করার জন্য স্বীয় ভাইয়ের নবুওয়ত প্রার্থনা করেছিলেন। এ ছাড়া দা‘ওয়াতের এক্ষেত্রে একজনের বক্তব্যের চেয়ে দু‘জনের বক্তব্য অধিক শক্তিশালী ও জোরালো হয়ে থাকে। ফলে সামষ্টিকভাবে দা‘ওয়াহকে সহজতর পন্থায় মানব সমাজের সামনে তুলে ধরার কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।

১৩
(গ) শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত ব্যক্তিবর্গের নিকট দা‘ওয়াত
মূসা আলাইহিস সালাম এর সময়ে মিসরের রাজ সিংহাসনে ফের‘আউন নামক এক অত্যাচারী ও অত্যাধিক ক্ষমতাধর শাসক সমাসীন ছিলেন। সে তার অধীনস্থ বনী ইসরাঈলদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো, তাদের শক্তিকে দুর্বল রাখার জন্য বিভিন্ন দল, উপদল বিভক্ত করত। অপরদিকে নিজ বংশোদ্ভুত কিবতীদের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিল। কেননা তারা তাকে প্রতিপালক মনে করত। আর, সেও নিজেকে প্রতিপালকের আসনে সমাসীন করত। পরিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: ‘‘সে সকলকে সমবেত করল এবং উচ্চস্বরে ঘোষণা করল যে, আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক’’ [আল-কুরআন, সূরা আন-নাজিয়াত : ২৩-২৮; এ মর্মে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ফের‘আউন কলল, সে সভাসদবৃন্দ! আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে জানি না’’ আল-কুরআন, সুরা কাসাস : ৩৮।]

মূসা আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম এ ধরনের প্রভু হওয়ার দাবীদার, মিসরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত অত্যাচারী শাসক ফের‘আউনের নিকট দীনের দা‘ওয়াত উপস্থাপন করেন। কেননা মানুষ সাধারণত তাদের রাজা-বাদশাদের অনুসারী হয়ে থাকে। রাজাদের প্রভাব প্রজাদের উপর পড়ে এবং প্রজাগণ তাদের (রাজা) দ্বারা প্রভাবিত হন। অতএব, তাদের সামনে দীনের দা‘ওয়াত দানের মাধ্যমে সঠিক পথ প্রদর্শন করা সম্ভব হলে প্রজাদেরকেও দীনের দিকে ধাবিত করা খুবই সহজ হবে। তাই তিনি অন্যান্য নবী-রাসূলদের ন্যায় প্রথমতঃ নিকট আত্মীয়দের নিকট দা‘ওয়াত পেশ না করে সরাসরি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠত ব্যক্তির নিকট দা‘ওয়াত পেশ করেন। রাসূলকুলের শিরোমনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার বাইরের তৎকালীন যুগের শক্তিশালী ও ধনাঢ্য রাষ্ট্র রোম ও পারস্যের সম্রাটের প্রতি প্রেরিত চিঠিতে প্রজাদের ইসলাম প্রহণ করা ও না করার ব্যাপারে রাজাকে দায়ী করেছেন এবং সর্বপ্রথম রাজাকে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার আহ্বান জানান। তিনি রোমের বদশাহ হিরাক্লিয়াসের নিকট প্রখ্যাত সাহারী হযবত দিহয়াতুল কালবী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মারফতে একটি চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন। তাতে লিখা ছিলঃ ‘‘আমি আপনাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করছি। ইসলাম প্রহণ করুন, তাহলে মুক্তি ও নিরাপত্তা পাবেন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুন পুরুস্কার প্রদান করবেন। আর ইসলাম প্রহণ করতে অস্বীকার করলে আপনি রোমানদের পাপের অংশীদার হবেন। [ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪।]

১৪
(ঘ) বিনয় ও নম্রভাবে দা‘ওয়াত উপাস্থাপন
বিনয় ও নম্র এক উত্তম চারিত্রিক ভূষণ। আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদানকারীদের ক্ষেত্রে এর অধিকারী হওয়া অত্যাবশ্যক। বিনয় আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদানকারীকে মানুষের নিকটতম করে দেয় এবং তার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে। আত্মম্ভিরতা ও অহংকার মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। মহান আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামকে দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে; ‘‘অতএব, তোমরা (মূসা ও হারূন আলাইহিস সালাম উভয়ে ফের‘আউনের সাথে নম্রভাবে কথা বল, সে হয়ত উপদেশ প্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’’ [আল-কুরআন, সূরা ত্ব-হা : ৪৪।]।

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ফের‘আউন এর নিকট বিনীতভাবে দা‘ওয়াত উপস্থাপন করতে বলেছেন, যাতে তার অন্তর নরম হয় এবং দা‘ওয়াত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়। [জুমআ আলী আল-খাওলী, প্রাগুক্ত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮৩।] আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি বান্দাদের উপর সর্বদা অনুকম্পা ও অনুগ্রহের হাতছানি দিয়ে রেখেছেন। ফের‘আউন যদি কঠোর অবস্থা হতে নম্রতা প্রদর্শন করে তাহলে আল্লাহ দা‘ওয়াত গ্রহণে সাহায্য করবেন। ওহাব ইবনে মুনাববাহ বলেন, আয়াতের অর্থ হল- তোমরা ফের‘আউনকে বলে দাও, (আল্লাহ) আমি আমার ক্রোধ অপেক্ষায় রহমত ও অনুগ্রহের অধিক নিকটবর্তী। [ইবনে কাছির, তাফসীর আল-কুরআন আল-আযীম, ৫ম খ-, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬১।] যেহেতু ফের‘আউন ঔদ্বত্য প্রদর্শন করতঃ অহংকার বশে ইলাহ হওয়ার দাবী করেছিল সেহেতু তাকে কঠোর ভাষায় দা‘ওয়াত দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত বিনয়ের সুরে তাকে দীনের দিকে আহ্বান জানাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দা‘ওয়াহর’ ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি গ্রহণের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ্ বলেন- “আল্লাহর অনুগ্রহেই আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয়ের ছিলেন। যদি আপনি কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তাহলে তারা আপনার আশ-পাশ হতে দূরে সরে যেত।” [আল-কুরআন, সূরা আলে-ইমরান : ১৫৯।]

ইসলামী দা‘ওয়াহর ক্ষেত্রে এটি ‘হিকমত’স্বরূপ। যার অর্থ বিবেক, প্রজ্ঞা ও মেধা। [ইবন কাছির, তাফসীর আল-কুরআন আল-আযীম, ৩য় খ-, প্রাগুক্ত, পৃ ৪৪৪।] হিকমত বলতে সে সব বাক্য সমষ্টিকে বুঝায়, যা দ্বারা মানুষ উপদেশ গ্রহণ করতে পারে ও যা মানুষের অন্তরকে প্রভাবাম্বিত করে তা সংরক্ষণ করে অপরের নিকট পৌঁছায়। [আবু হাইয়্যান আন্দালুসী, আল-বাহর আল-মুহীত, ২য় খণ্ড-, বৈরুত: দারুল ফিকর, তা. বি.), পৃ. ৩২০।] এ মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে-

‘‘হে রাসূল! আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে হিকমত, উত্তম উপদেশ ও উত্তম বিতর্কের মাধ্যমে আহ্বান করুন। [আল-কুরআন, সূরা আন-নাহল: ১২৫।]

১৫
(ঙ) তাকওয়া অবলম্বনের দা‘ওয়াত
মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউনকে তাকওয়া তথা আল্লাহকে ভয় করার প্রতি আহ্বান জানান। আল্লাহর ভয় মানুষকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, কুফর-শির্ক, অশ্লীলতা বেহায়াপনা এবং সমস্ত অপরাধ প্রবণতা থেকে রেহাই দিয়ে দীনের উপর অটল ও অবিচল রাখতে সাহায্য করে। তাকওয়া মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে জানতে আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং তার ইবাদতকে আবশ্যক করে। কেবলমাত্র মুত্তাকীরাই আল্লাহর হেদায়াত লাভে ধন্য হয়। তিনি ফের‘আউনের সামনে এ মূল্যবান ও গুরুত্বপুর্ণ দা‘ওয়াত উপস্থাপন করেছিলেন, যাতে করে ফের‘আউনকে গোমরাহি হতে রক্ষা করা সম্ভব হয়। পবিত্র কুরআনে এসেছে ‘‘যখন আপনার পালনকর্তা মূসা আলাইহিস সালামকে ডেকে বললেন, হে মূসা! তুমি পাপিষ্ট সম্প্রদায়ের তথা ফের‘আউন সম্প্রদায়ের নিকট যাও, তারা কি ভয় করে না? [আল-কুরআন, সূরা আশ শু‘আরা: ১১।] তিনি (মূসা আ.) ফের‘আউনকে যাবতীয় কুসংস্কার, যুলুম, নির্যাতন এবং অশ্লীলতা -বেহায়াপনা হতে পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রতিও আহ্বান জানান। এ মর্মে তিনি আল্লাহর নিকট হতে আদিষ্ট হয়েছেন। মূলতঃ তাযকীয়া বা পরিশুদ্ধতার মিশন নিয়েই সকল নবী-রাসূলের এ ধরাধামে আবির্ভাব ঘটেছে। এ জন্য মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন- ‘‘ফের‘আউনের কাছে যাও। নিশ্চয় সে সীমালংঘন করেছে। অতঃপর বল তোমার পবিত্র হওয়ার আগ্রহ আছে কি? আমি তোমাকে তোমার পালনকর্তার দিকে পথ দেখাব, যাতে করে তুমি তাকে ভয় কর।’’ [আল-কুরআন, সূরা আন-নাযিয়াত : ১৭-২০।]

১৬
(চ) উৎসাহ উদ্দীপনা ও ভয়ভীতি সঞ্চার
তিনি স্বজাতিকে কল্যাণ ও হিতকর কাজের জন্য উৎসাহ প্রদান এবং অন্যায়-অবিচার, পাপ-পঙ্কিলতা প্রভৃতি গর্হিত কাজ সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করতেন, যাতে মানুষ দুনিয়াতে শান্তিতে বসবাস করে এবং পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভে সক্ষম হয়। ইসলামী দা‘ওয়াহ প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হল প্রেরণা সৃষ্টি ও ভীতি সঞ্চার। মূসা আলাইহিস সালাম এর দা‘ওয়াতে দু‘টিরই সমাবেশ ঘটেছিল। তবে তার দা‘ওয়াতের মাঝে প্রেরণা সৃষ্টির চেয়ে ভীতি সঞ্চারের পরিমাণ বেশী ছিল, ফলে ফের‘আউনের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি সঠিক পথ অনুকরণের বিনিময়ে সূসংবাদ এবং মিথ্যারোপ ও পৃষ্ঠপ্রদর্শনের জন্য কঠিন শাস্তির হুশিয়ারবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ ‘‘(মূসা আলাইহিস সালাম বলল) আমরা তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের নিদর্শন নিয়ে এসেছি। যে সঠিক পথ অনুসরণ করবে তার জন্য শাস্তি। আর ওহীর মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্য যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।’’ [আল-কুরআন, সূরা ত্ব-হা : ৪৭-৪৮।]

১৭
(ছ) উত্তম নসীহত
নবী-রাসূলগণ তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কল্যাণ কামনায় ও হিতকর ব্যবস্থাপনায় নিজেদের শ্রম, মেধা, যোগ্যতা ও প্রতিভার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতেন। একজন মুসলিমের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি সর্বাবস্থায় তার কল্যাণ কামনা করা অপরের উপর অত্যাবশ্যক। এটি পারস্পরিক হকও বটে। মূলত: দীন হচ্ছে একে অপরের কল্যাণ কামনা। এ মর্মে হাদীসে এসেছে :‘‘দীন হচ্ছে কল্যাণ কামনা। আমরা (সাহাবাগণ) জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! এটা কাদের জন্য? তখন রাসূল (স) বললেন, এটা আল্লাহ, তার রাসূল, মুসলিম নেতৃবৃন্দ, ও জনসাধারণ সকলের জন্য। [ইমাম মুসলিম, প্রগুক্ত, কিতাবুল ঈমান, হাদীস নং-৮২।]

মূসা আলাইহিস সালাম উত্তম নসীহত বা উপদেশের মাধ্যমে স্বীয় জাতিকে মুক্তির দিকে আহ্বান করেছেন। তিনি তার সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের কি হয়েছে? আমি তোমাদেরকে ডাকি মুক্তির দিকে আর তোমরা আমাকে জাহান্নামের দিকে ডাকছ।’’ [আল-কুরআন, সূরা মুমিন: ৪১।] নসীহত বা কল্যাণ কামনার মাধ্যমে একে অপরের সাহায্যার্থে এগিয়ে তারা যায়। দীনী দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে ও পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা সম্ভব হয়। মূসা আলাইহিস সালাম এর সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি গোপনে তার প্রতি ঈমান এনেছিল। সে উত্তম উপদেশের মাধ্যমে মূসার দা‘ওয়াতী মিশনকে এমনি এক ক্রান্তি লগ্নে সাহায্য করেছিল যখন পাপিষ্ট ফের‘আউন এক কিবতী হত্যার অজুহাতে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে এসেছেঃ ‘‘এক ব্যক্তি শহরের দূর প্রান্তর হতে ছুটে এল এবং বলল, হে মূসা! ফের‘আউনের সরদারদের মধ্যে তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ফলে এখান হতে বের হয়ে যাও। নিশ্চয় আমি তোমার মঙ্গলাকাংখী।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস : ২০।]

১৮
(জ) যুবকদের অগ্রাধিকার দান
ইসলামী দা‘ওয়াহর কাজ আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে যুবকেরাই অগ্রণী ভুমিকা পালন করে থাকে। কোন সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গা ও গড়ার কাজ তারাই আঞ্জাম দেয় এবং যে কোন সমাজ ব্যবস্থা ভাঙ্গা ও গড়ার শক্তি তারাই রাখে। ফলে, সমাজের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত? ব্যক্তিগণ যুবকদের সাথে আঁতাত রেখেই অপরাধ কর্ম নির্দ্বিধায় চালিয়ে যায়। আর সমাজের সে সকল যুবকরা যদি দীনের ছায়াতলে এসে সমবেত হয় তাহলে সমাজে দীন প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে পড়ে। এ যুবকদের শক্তিকে ভাল ও কল্যাণকর কাজে ব্যয় করার জন্য মূসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য দিতেন। তার দা‘ওয়াতে যুবকেরাই বেশী সাড়া দিয়েছিল। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে এসেছে

‘‘ফের‘আউন ও তার সভাসদবৃন্দের নির্যাতনের ভয়ে তার (মূসা) সম্প্রদায়ের একদল যুবক ছাড়া কেউ তার প্রতি ঈমান আনল না’’। [আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ৮৩।]

এখানে ( ذرية ) বলতে তার বংশধর ও সন্তান সন্তুতি উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে প্রথম দিকে মূসাআলাইহিস সালাম এর উপর বনী ইসরাঈলের কিছু সংখ্যক যুবক ঈমান এনেছিল। [সীরাত বিশ্বকোষ, প্রাগুক্ত, ২য় খ-, পৃ. ৪২২।] তাছাড়া আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে যুবকেরাই সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করেছিল এবং তিনিও তাদেরকে বেশী অগ্রাধিকার দিতেন। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে, যিনি বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, যিনি পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রহণ করেন। পরবর্তীতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর দা‘ওয়াতে মক্কার বিপুল সংখ্যক যুবক ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের ইসলাম গ্রহণের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রর্থনা `করেছিলেন। হাদীসে এসেছে: ‘‘তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করেন এ মর্মে, হে আল্লাহ! তুমি আমার সর্বাধিক প্রিয় দু‘জন ব্যক্তিকে ইসলামের মর্যাদা দান কর, তারা হলেন আবু জাহেল অথবা উমর ইবন খাত্তাব। বর্ণনাকারী বলেন, তাদের দু‘জনের মধ্যে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার কাছে অত্যাধিক প্রিয় ছিলেন’’ [ইমাম তিরমিযী, জামি‘ আত তিরমিযি, কিতাবুল মানাকিব, প্রাগুক্ত, হাদিস নং- ৩৬১৪।] কেননা, উমর ছিলেন টগবগে যুবক। সুতরাং সে ইসলাম গ্রহণ করলে ইসলামের বিরোধী শক্তি ভয় পাবে এবং ইসলামের সম্প্রসারণ খুব দ্রুত হবে।

১৯
(ঝ) আল্লাহর অনুগ্রহের স্মরণ
মানুষের প্রতি আল্লাহর অগণিত অনুগ্রহ রয়েছে। এ অনুগ্রহরাজির সংখ্যা হিসাব করে শেষ করা যাবে না। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-‘‘তোমরা আমার নেয়ামতরাজি গণনা করে শেষ করতে পারবে না।’’ [আল-কুরআন, সূরা ইবরাহীম: ৩৪।] আল্লাহর অনুগ্রহের স্মরণ ইসলামী দা‘ওয়াহর অন্যতম একটি মাধ্যম। মূসা আলাইহিস সালাম এর জীবদ্দশায় এ পদ্ধতির সমাবেশ ঘটেছিল। তাই তিনি যখন ফের‘আউনের সাথে দা‘ওয়াত গ্রহণের বিষয়ে প্রকাশ্য যুক্তি-তর্কে লিপ্ত হন, তখন তার যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপনের শেষ পর্যায়ে তিনি ফের‘আউনকে আল্লাহর কতিপয় অনুগ্রহ স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন, হে ফের‘আউন! আল্লাহই এ যমীন এবং যমীনের উপরস্থ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। আকাশ থেকে বারি বর্ষিয়ে এ যমীনকে শস্য শ্যামল করেছেন। ফল-ফুল আর ঘন বৃক্ষ দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। এ মাটি হতেই আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। মৃত্যুর পর এ মাটি হতেই তোমাদের পুনর্জীবিত করে উঠানো হবে। সুতরাং অহংকার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে কারও কোন গত্যন্তর নেই। সবার জন্যেই সে মহাশক্তির অধিকারী সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, তার সম্প্রদায়কে আযাব থেকে নাজাতের একমাত্র পথ। [এ মর্মে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘‘তিনি এমন এক সত্ত্বা যিনি যমীনকে তোমাদের জন্য বিছানাস্বরূপ বানিয়েছেন এবং তাতে তোমাদের জন্য বাসস্থানসমূহ তৈরী করেছেন। আর আসমান হতে পানি বর্ষণ করেছেন। অতঃপর আমি তা দ্বারা বিবিধ প্রকার উদ্ধিদ উৎপন্ন করেছি। তোমরা নিজেরা খাও এবং পশু পালন কর। এ সবের মাঝে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে নিদর্শনসমূহ। এ মাটি হতেই আমি তোমাদেরকে বানিয়েছি এবং এটিতেই আমি তোমাদের প্রত্যাবর্তন করাব। তা হতেই পুনরায় তোমাদেরকে বের করব।’’ আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ৫৩:৫৫।] আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের স্মরণ মানুষের অন্তরকে জাগরিত করে এবং কোন বিষয়ের নিগুঢ় সহস্য উদঘাটনে সহায়তা করে। স্বয়ং আল্লাহ্‌ তা‘আলাও বনী ইসরাঈলদেরকে এ পদ্ধতিতে দীনের দিকে আহ্বান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,

‘‘আর স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন আমি তোমাদেরকে ফের‘আউনের কবল হতে মুক্তি দিয়েছি যারা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দিত। তোমাদের পুত্র সন্তানদের জবাই করত এবং তোমাদের স্ত্রীদের ছেড়ে দিত। বস্তুতঃ তাতে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এক মহা পরীক্ষা ছিল। আর যখন আমি তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিখন্ডিত করেছি, অতঃপর তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছি এবং ফের‘আউনের লোকদের ডুবিয়েছি, আর সে সময় তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে। [আল-কুরআন, সূরা আল-বাকারা : ৪৯-৫০।] অত্র আয়াতগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলদেরকে তার প্রতি ও মূসা আলাইহিস সালাম এর প্রতি দৃঢ়ভাবে ঈমান আনার আহ্বান করেছেন।

২০
(ঞ) প্রাঞ্জলময় বক্তৃতা প্রদান
দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে বক্তৃতার গুরুত্ব অপরিসীম। বক্তৃতা একটি শিল্প, যার মাধ্যমে যে কোন বিষয়কে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং এর মাধ্যমে শ্রোতামণ্ডলি প্রভাবিত হয়। সুবক্তাগণ অনেক সময় কঠিন ও দূর্বোধ্য বিষয়কেও সহজ ও প্রাঞ্জলময় করে পেশ করতে সক্ষম হয়। ইসলামী দা‘ওয়াহ’র একটি শৈল্পিক ও সাহিত্যিক ভাবধারা রয়েছে যা, বক্তৃতার মাধ্যামে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব হয়। মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউনের সামনে সর্বপ্রথম আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী অত্যন্ত কোমল ও মধুরবাণী সহকারে বিনয়ের সাথে তার বক্তৃতাকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি বাকপটু ছিলেন না এবং অনর্গল ও দ্রুত কথা বলতে পারতেন না। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে মুখের জড়তা খুলে দেয়ার প্রার্থনা করেন। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ২৭-২৮।] মহান আল্লাহ তার মুখের জড়তা ততটুকু পরিমাণ দূর করে দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে শ্রোতারা তার বক্তব্য বুঝতে সক্ষম হয়। তিনি বেশী কথা বলতে পারতেন না, এজন্যে স্বীয় ভাই হারূনকে সাহায্যকারী নিযুক্ত করতে প্রার্থনা করেছিলেন। হারূন আলাইহিস সালাম ছিলেন সুমধুর বক্তা, সুন্দর ভাবে তিনি দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করতে পারতেন, যা মূসার দ্বারা সম্ভব হত না। [ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩য় খ-, প্রাগুক্ত,পৃ. ১৫৪। পবিত্র কুরআনে এ মর্মে এসছে ‘‘আর আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে বেশী মার্জিত ভাষী। তাকে আমার সাহায্যকারী হিসাবে পাঠান, তাতে সে আমাকে সমর্থন দেয়। আমার ভয় হচ্ছে তারা আমার প্রতি মিথ্যারোপ করবে।’’ আল-কুরআন, সূরা আল-কাসাস: ৩৪।] ফের‘আউন ও মূসা আলাইহিস সালাম এর কথোপকথনে হারূন আলাইহিস সালাম উভয়ের মধ্যে দোভাষীরূপে থাকতেন। আর মূসা আলাইহিস সালাম এর প্রমাণগুলোকে নিতান্ত মার্জিত ভাষায় বর্ণনা করতেন। [হিফজুর রহমান সিউহারবী, প্রাগুক্ত, ২য় খ-, পৃ. ৬৩।] বক্তৃতার প্রভার জাদুর ন্যায়। জাদু যেমনি মুহুর্তের মধ্যে জনগণের চক্ষুকে প্রতারিত করে অন্য দিকে ধাবিত করতে সক্ষম হয়, ঠিক তেমনি বক্তৃতার মাধ্যমেও শ্রোতাদের মনকে জয়ী করা সম্ভব । কখনও কখনও বক্তৃতার প্রভাব জাদুর চেয়েও বেশী হয়ে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নিশ্চয় কোন কোন বক্তৃতা জাদুর মত প্রভাব ফেলে।’’ [ইমাম বুখারী, প্রগুক্ত, কিতাবুত তিবব, হাদীস নং ৫৩২৫।]

২১
(ট) মাদ‘ঊ তথা যাদের কাছে দাওয়াত প্রদান করা হবে, তাদের প্রতি সাহায্যের হাত সম্প্রসারণ
মাদ‘ঊ হল যাকে দা‘ওয়াত দান করা হয় অর্থাৎ দা‘ওয়াতের টার্গেটভুক্ত ব্যক্তি ও সম্প্রদায়। মুসলিম-অমুসলিম, নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষই মাদ‘ঊ হিসেবে গণ্য। [মুহাম্মদ আবুল ফাতাহ আল-বয়নুনী, আল মাদখাল ইলা ইলমিদ দা‘ওয়াহ, বৈরুত: মুয়াসসাতুল রিসালাহ, ১৯৯১ খৃ. পৃ. ৪১-৪২।] যাদেরকে দীনের দিকে আহ্বান করা হয়েছে, তাদের অন্তরকে আকৃষ্ট করার জন্য এবং দীনের দিকে তাদের ধাবিত করতে কঠিন পরিস্থিতি ও বিপদের সময় তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা দা‘ওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউন ও তার সম্প্রদায়কে দীনের পথে আহ্বানের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির অনুসরণ করেছিলেন। তিনি মজলুমের সাহায্য করতেন এবং জালিমের বিপক্ষে অবস্থান নিতেন। নবুওয়ত লাভের পূর্বে এক কিবতীকে তিনি জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইসরাঈলী মজলুমের পক্ষ অবলম্বন করেন। অত্যন্ত প্রতিকুল ও বিপদের সময়েও তিনি অবলা ও অসহায় দু‘জন কিবতীকে তাদের কর্ম সস্পাদনে সাহায্য করেছিলেন। ফের‘আউন সম্প্রদায়ের নিকট যখন আল্লাহর আযাব আসতে লাগল তখন তারা মূসা আলাইহিস সালাম এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে। তাদেরকে প্রথমে দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে আযাব দেয়া হয়। [আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ: ১৩০।] এভাবে তাদের উপর তুফান, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত প্রভৃতি বহুবিধ আযাব আসছিল [আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ : ১৩৩।] এবং পরবর্তীতে মূসা আলাইহিস সালাম এর দো‘আয় তা রহিত করা হয়। তদুপরি তারা ঈমানের ছায়াতলে আসে নি।

মূসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে এ মর্মে তারা প্রতিশ্রুতি দিত যে, আল্লাহ যদি আমাদের উপর থেকে আযাব সরিয়ে নেন, তাহলে আমরা ঈমান আনব এং বনী ইসরাঈলদের মুক্তি দেব। কিন্তু বিপদ মুক্ত হলে তারা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেত এবং ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত। এভাবে বহুবার মূসা আলাইহিস সালাম তাদের শান্তি লাঘবের প্রার্থনা করেন। পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ ‘‘আর তাদের উপর যখন কোন আযাব পতিত হয় তখন তারা বলে, হে মূসা! তোমার রবের কাছে সে বিষয়ে দো‘আ কর যা তিনি তোমার সাথে ওয়াদা করেছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব সরিয়ে দাও তবে অবশ্যই আমরা তোমার উপর ঈমান আনব এবং বনী ইসরাঈলদেরকে ছেড়ে দেব। অতঃপর যখন আমি তাদের উপর থেকে আযাব তুলে নিতাম, নির্ধারিত একটি সময় পর্যন্ত যেখান পর্যন্ত তাদেরকে পৌঁছানো উদ্দেশ্য ছিল, তখন তড়িঘড়ি তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করত।’’ [আল-কুরআন, সূরা আল-আ‘রাফ: ১৩৪-১৩৫।]

আয়াতে বুঝা যায় যে তাদের উপর প্লেগ রোগের মহামারী চাপিয়ে দেয়া হয়, যাতে তাদের সত্তর হাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছিল। মূসা আলাইহিস সালাম এর দো‘আয় প্লেগের আযাবও তাদের উপর থেকে সরে যায়। কিন্তু তারা যথারীতি ওয়াদা ভঙ্গ করে। [মওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭৮।]

২২
(ঠ) পারস্পরিক কথোপকথন ও যুক্তিতর্ক খণ্ডন
আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ অনুযায়ী মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউনের নিকট দীনে হকের দা‘ওয়াত নিয়ে উপস্থিত হন এবং পারস্পারিক সংলাপ ও কথোপকথনের মাধ্যমে দা‘ওয়াত উপস্থাপন করেন। সর্বপ্রথম তিনি (মূসা) তাকে আল্লাহ একত্ববাদের স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানান এবং সাথে সাথে নিজের রাসূল হওয়ার খবর দিলেন। কিন্তু ধূর্ত ফের‘আউন এ সম্পর্কিত আলোচনায় না যেয়ে মূসা আলাইহিস সালাম এর ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে এমন সব অভিযোগ তুলতে শুরু করে যা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে ফেলে। সুচতুর প্রতিপক্ষ সাধারণতঃ যখন আসল বিষয়ের জবাব দিতে অক্ষম হয়, তখন অপরপক্ষের ব্যক্তিগত দুর্বলতা খোঁজ করে এবং বর্ণনা করে, যাতে সে লজ্জিত হয়ে যায় এং জনমনে তার ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়। তাই ধূর্ত ফের‘আউন ও এ পন্থাই বেছে নেয় এবং দু‘টি বিষয় বর্ণনা করে।

এক. তুমি আমাদের গৃহে লালিত-পালিত হয়েছ এবং এখানেই যৌবনে পদার্পন করেছ। তোমার প্রতি আমাদের অনেক অনুগ্রহ রয়েছে। কাজেই, তোমার সাধ্য কি যে, আমাদের সামনে কথা বল।

দুই. তুমি একজন কিবতীকে অহেতুক হত্যা করেছ। এটা যেমন যুলুম তেমনি নিমকহারামী ও কৃতঘ্নতা। যে সম্প্রদায়ের স্নেহে লালিত-পালিত হয়েছ এবং যৌবনে পদার্পণ করেছ, তাদেরই একজনকে তুমি হত্যা করেছ।

এ সবের মাধ্যমে ফের‘আউনের উদ্দেশ্য ছিল, যুক্তি প্রমান উপস্থাপনে নৈতিকভাবে মূসা আলাইহিস সালামকে দুর্বল করে ফেলা। মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউনের এসব কটুকথা এবং অমূলক অভিযোগ জনিত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার সমাধান প্রক্রিয়া পূর্বেই আল্লাহর নিকট হতে শিখে নিয়েছিলেন। তাই তিনি এসব অমূলক অভিযোগের জবাব দিয়ে তাকে নিরুত্তর করে ফেলেন। ফের‘আউনকে প্রতিটি কথার জবাবে তিনি রাব্বুল আ‘লামীন তথা নিখিল জাহানের পালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলার এসব গুণ-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচিতি উল্লেখ করেছিলেন। ফের‘আউন দেখল রব বা পালনকর্তা বলে সে ব্যতীত অন্য কোন সত্তাকে উদ্দেশ্য করা হচ্ছে আর এর মাধ্যমে মূসা (আ.) এর উদ্দেশ্য পরিষদের কাছে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। অপরদিকে মূসা আলাইহিস সালাম এর বক্তব্য এড়িয়ে যাওয়ায় তার যে একঘেয়ে মানসিকতা ও প্রবণতা তাও উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলির বোধগম্য হওয়া স্বাভাবিক। তাই সে নিতান্ত বাধ্য হয়েই মূসা আলাইহিস সালাম এর কথিত রাববুল আ‘লামীন সম্পর্কিত আলোচনায় ফিরে আসে। এবার সে বলল, হে মূসা! আমি ব্যতীত কি এমন কোন সত্তা আছে যাকে তুমি বিশ্ব রব বলে আখ্যায়িত করছ। এ মর্মে কুরআনে এসেছ, ‘‘হে মুসা! কে তোমাদের প্রতিপালক?’’ [আল-কুরআন, সূরা ত্ব-হা: ৪৯।] কুরআনের অন্যত্রে এসেছে ফের‘আউন কলল, জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কি? [আল-কুরআন, সূরা আশ্-শু‘আরা: ২৩।] ‘‘তখন মুসা আলাইহিস সালাম অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন:

‘‘তিনি বলেন, তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের এবং এতদুভয়ের মধ্যকার সব কিছুরই রব, যদি তোমরা বিশ্বাসী হতে চাও।’’ [আল-কুরআন, সূরা আশ্-শু‘আরা: ২৪।]

এ জগতসমুহের পালনকর্তা তিনি যিনি এ দৃশ্যমান আসমান ও যমীন এবং এর মধ্যবর্তী সবকিছু মেঘ, বৃষ্টি, বায়ু, শস্যাদি, প্রাণীকুল তথা যাবতীয় জিনিস সৃষ্টি করেছেন। জ্ঞানী মাত্রই জানেন যে, এসব জিনিস আপনা আপনি সৃষ্টি হয়নি। নিশ্চয় এর একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। জ্ঞানী মাত্রই জানেন যে, এসব জিনিস আপনা আপনি সৃষ্টি হয় নি। নিশ্চয় এর একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তিনিই হলেন আল্লাহ জগতসমুহের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। মূসা আলাইহিস সালাম এখানে আল্লাহর ক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরেছেন। [ড. ফুয়াদ আব্দুল্লাহ ওমর, আরউনসুল জালীল ফী কিসসাতে মূসা ওয়া ফিরআউন ওয়া বনী ইসরাঈল, কুয়েত: মাকতাবাত মানার আল ইসলামীয়্যাহ, ১ম সঙস্করণ, ১৯৯৮ খৃ. পৃ. ৫৮।] উল্লেখিত বক্তব্য পেশের মধ্য দিয়ে মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউনকে একথাই জানিয়ে দিলে যে, আমি যে সত্তাকে বিশ্ব রব হিসেবে দাবী করছি, তোমার মাঝে যদি নূন্যতম বিবেক বুদ্ধিও অবশিষ্ট থাকত, তাহলে তুমি নিশ্চয় তা বুঝতে পারতে। অতএব, নিজেকে রব বা পালনকর্তা দাবীর স্বপক্ষে তোমার কাছে কি কি প্রমাণ রয়েছে? আসমান যমীনের সব কিছুর রব কি তুমি? সুতরাং কিসের ভিত্তিতে তুমি এমন অমুলক দাবী করছ? ফের‘আউন দেখল, তার মিথ্যা দাবীর স্বরূপ অচিরেই পরিষদের কাছে উদঘটিত হতে চলেছে। তাই সে সভাসদকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাদের উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গ করে বলল,

‘‘সে কি বলছে তোমরা কি তা শুনতে পাচ্ছ না?’’ [আল-কুরআন, সূরা আশ্-শু‘আরা: ২৫।]

তার এ ব্যঙ্গোক্তির উদ্দেশ্য ছিল, উপস্থিত শ্রোতাদের চিন্তা স্রোতকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং মূসা আলাইহিস সালাম এর উপস্থাপিত যুক্তি-প্রমাণ ভিত্তিহীন, অবাস্তব ও অমূলক সাব্যস্ত করা। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম ধূর্ত ফের‘আউনের এসব কুটচালে দমবার পাত্র নন। তাই তিনি রবের পরিচয় আরো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘‘মূসা আলাইহিস সালাম বলেন, তিনিই আমাদের রব যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যথার্থ রূপ দিয়েছিল। তারপর পথ প্রদর্শন করেছেন। [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ৫০।]

মূসা (আ) এর এ জবাব পেয়ে ফের‘আউন আরও বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হয়। কেননা, রবের পরিচয়ে ফের‘আউন বলল, তিনিই আমাদের প্রতিপালক যিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা আকৃতিদাতা ও পথপ্রদর্শক। ইবন আব্বাসের মতে, তিনি সবকিছু জোড়াজোড়া সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তাদের বিবাহ-শাদী, খানা-পিনা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। [কুরতুবী, প্রাগুক্ত, ১১শ খ-, পৃ. ২০৪।] প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য যা উপযোগী তা-ই তিনি তাদের প্রদান করেছেন। অথচ ফের‘আউন যে সামান্য একটি মাছিরও সৃষ্টিকর্তা নয় বা যোগ্যতাও রাখে না। এটা সবাই জানে। সুতরাং মূসা আলাইহিস সালাম এর জবাবে তার সকল অমূলক দাবীর সর্বনাশ হয়েছে। এবার সে মূসা আলাইহিস সালামকে উপস্থিত জনসাধারণের সম্মুখে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসল, ‘‘ঐ সব লোকের কি অবস্থা হবে যারা (প্রথম যুগে) অতীতে চলে গেছে।’’ [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ৫১।]

এখানে পূর্ববর্তী বা প্রথম যুগ বলতে নূহ আলাইহিস সালাম, হূদ আলাইহিস সালাম ও সালেহ আলাইহিস সালাম এর সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছে, যারা মূর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল এবং রবের ইবাদতের স্বীকৃতি দিত না। [ড. ফুয়াদ আব্দুল্লাহ ওমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯।] তাহলে তাদের পরিণাম কি হবে? এ প্রশ্নে ফের‘আউনের উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু আগেকার প্রায় সব সম্প্রদায়ের লোকেরা দেব-দেবীর মূর্তির উপাসনা করত। তারা বর্তমান জীবিতদের পিতৃপুরুষ আর মূসা আলাইহিস সালাম মূর্তিপুজার কারণে তাদের সকলকে পথভ্রষ্ট বললে, উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলি মূসা আলাইহিস সালামকে নিন্দা জানাবে এবং তার প্রতি সন্দেহপরায়ণ হবে। ফলে তারা মূসা আলাইহিস সালাম এর উপস্থাপিত সব যুক্তি-প্রমাণের প্রতি আস্থা হারাবে। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম ফের‘আউনের ষড়যন্ত্র অনুধাবন করে ফেলেন এবং এমন বিজ্ঞজনোচিত জবাব দিলেন, যার মাধ্যমে মূল বক্তব্যও ফুটে উঠেছে এবং ফের‘আউনও বিভ্রান্তি ছড়াবার সুযোগ পায় নি। তাই তাদের পরিণাম সম্পর্কে নিজে কিছু না বলে আল্লাহর প্রতি সোপর্দ করে মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, “তাদের পরিণাম আমার পালনকর্তার কাছে লিখিত আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না।’’ [আল-কুরআন, সূরা ত্বা-হা: ৫২।]

উপরোক্ত অকাট্য ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় ফের‘আউন নির্বাক, আর উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলি মূসা আলাইহিস সালাম এর উপস্থাপিত যুক্তির অকাট্যতা ও শক্তিমত্তা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়। সুতরাং যতই সময় যাচ্ছে ততই পরিস্থিতি প্রতিকূল হচ্ছে। তাই ফের‘আউন আর আগ্রহ না বাড়িয়ে আজকের মত আলোচনায় ইতি টানে।

২৩
(ড) যুগশ্রেষ্ঠ চ্যালেঞ্জিং শক্তির ব্যবহার
মূসা আলাইহিস সালাম এর আবির্ভাবের সময় মিসর তৎকালীন সভ্যতার ইতিহাসে শিক্ষা দীক্ষায় বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। মিসরে শিক্ষা দীক্ষায় সকল বিদ্যার চর্চা হত। যাবতীয় বিদ্যা ও শিক্ষণীয় বিষয়সমূহের মধ্যে জাদু একটি স্বতন্ত্র বিদ্যার মর্যাদা ছিল। জাদুকরদের মর্যাদা মিসরীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ বলে বিবেচিত হত। এমনকি রাজদরবারেও তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। [হিফজুর রহমান সিউহারবী, প্রাগুক্ত, ২য় খন্ড, পৃ. ৬৪.] তাদের মতামত অনুসারেই যুদ্ধ, সন্ধি, কারও জন্ম-মৃত্যু প্রভৃতি বিষয়ে আমল করা হত। ধর্মীয় বিষয়েও তাদের মতামত গৃহীত হত। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে জাদু ছিল অলৌকিক বিষয়। ফলে সে সময়ে মিসর জাদু বিদ্যায় উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহন করেছিল। আর এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ) কে ফের‘আউনের কাছে এমন মু‘জিযা প্রদান করে পাঠিয়েছিলেন, যা তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ জাদুবিদ্যাকে পরাস্ত ও পরাভূত করে আল্লাহর ঐশী ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রমাণে সক্ষম হয়। আল্লাহ তা‘আলার নিয়ম হল, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিষয়ের অধিক প্রভাব থাকে ও যে বিষয়টি তাদের গর্বের কারণ হয়, সে গোত্রের কাছে প্রেরিত নবী-রাসূলগণকে এমন মু‘জিযাই প্রদান করেন, যা তাদের গর্ব ও অহংবোধকে ধুলায় মিশিয়ে বিজয় লাভে সক্ষম হয়। ঈসা আলাইহিস সালামকে যে সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল, সে সম্প্রদায়ের লোকেরা চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শীছিল। তৎকালীন সময়ে দুনিয়াতে তারা ছিল অতুলনীয়। আল্লাহ তা‘আলা ঈসা আলাইহিস সালাম এমন মু‘জিযা দিয়ে প্রেরণ করলেন, যার সম্মুখে তাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রের সর্বাধিক উন্নতিও মলিন হয়ে যায়। কেননা, তারা কোন জন্মন্ধ ব্যক্তিকে আরোগ্য করার ঔষধ আবিস্কার করতে পারে নি। এমনকি কুষ্ঠরোগেরও কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়নি, অথচ ঈসা আলাইহিস সালাম আবির্ভূত হয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় জন্মান্ধকে দৃষ্টিদান, কুষ্ঠব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে কুষ্ঠরোগ নিরাময় করে দিতে লাগলেন, যা তাদের জাতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নতির গর্বকে ম্লান করে দেয়। এ মর্মে কুরআনে এসেছে,

‘‘আর আল্লাহর হুকুমে সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠরোগীকে। আর জীবিত করে দেই মৃত্যুকে।’’ [আল-কুরআন, সূরা ইমরান : ৪৯।]

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামকে এমন মু‘জিযা প্রদান করলেন যে, তার হাতের লাঠি সর্পে পরিণত হয়ে যেত। তার হাত হতে শুভ্র আলোর বিকিরণ হত, যা দেখতে জাদুর ন্যায় মনে হলেও জাদু বিদ্যার চুড়ান্ত পর্যায়ের বিধি-বিধান বহির্ভূত ছিল।

২৪
দা‘ওয়াতের প্রতিক্রিয়াঃ
মূসা আলাইহিস সালাম নবুওয়ত লাভের পূর্ব হতেই অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ ও সত্যপ্রিয় ছিলেন। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল সর্বদাই বলিষ্ঠ। বনী ইসরাইলদেরকে ফের‘আউনের গোলামী হতে রক্ষা করার জন্যে তিনি প্রাণপন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তদুপরি তাদেরকে দীনের ছায়াতলে আবদ্ধ করতে সক্ষম হননি। তার দা‘ওয়াতে সম্প্রদায়ের কতিপয় যুবকই সাড়া দিয়েছিল। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘‘ফের‘আউন ও তার সভাসদবৃন্দের নির্যাতনের ভয়ে তার সম্প্রদায়ের একদল যুবক ছাড়া কেউ তার প্রতি ঈমান আনয়ন করে নি।’’ [. আল-কুরআন, সূরা ইউসূফ: ৮৩।]

অপরদিকে ফের‘আউন সম্প্রদায় তার দা‘ওয়াতকে স্তব্দ করে দেয়ার জন্যে হীন কুট-কৌশল অবলম্বন করেছিল। তারা স্বয়ং দা‘ঈর ব্যক্তিগত বিষয়ে বিভিন্ন অপবাদের আশ্রয় নেয়। তাদের দৃষ্টিতে মূসা আলাইহিস সালাম একজন সাধারণ মানুষ, [আল-কুরআন, সূরা মু‘মিনুন: ৪৮।] জাদুকর, [আল-কুরআন, সূরা আশ শু‘আরা : ৩৪।] বদ্ধপাগল, [আল-কুরআন, সূরা আশ শু‘আরা : ২৭।] জাদুগ্রস্থ, [আল-কুরআন, সূরা বনী ইসরাঈল: ১০১।] পূর্বতন ধর্মের বিকৃতকারী ও নব্য ধর্মের প্রবর্তক। মূলতঃ সাধারণ মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখতে এবং তার দা‘ওয়াতকে বিফলে পর্যবসিত করতে তারা এ ধরনের কুট-কৌশলের পায়তারা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূসা আলাইহিস সালাম তাদের উপর বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তাদের মনগড়া মতাদর্শ পরাজিত হয়েছিল।

২৫
আমাদের জন্য যা শিক্ষণীয়ঃ
মূসা আলাইহিস সালাম এর জীবনী ও দা‘ওয়াতী কার্যক্রম থেকে সমকালীন দা‘ঈদের জন্য অসংখ্য উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামী দা‘ওয়াতকে আরো গতিশীল, বেগবান ও ফলপ্রসূ করা সম্ভব। যেমনঃ

২৬
ক) নম্র ও উত্তম ব্যবহার
ইসলামী দা‘ওয়াহর ক্ষেত্রে এ গুণটির গুরুত্ব অপরিসীম। নম্রতা দা‘ঈকে মাদউদের নিকটতম করে দেয় এবং তাদেরকে দীন প্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। নূহ আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম সহ আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এ গুণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পবিত্র কুরআনে এসেছে, [আল-কুরআন, সূরা আলেইমরান : ১৫৯।]

আল্লাহ্‌র দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন; যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তারপর আপনি কোন সংকল্প করলে আল্লাহ্‌র উপর নির্ভর করবেন; নিশ্চয় আল্লাহ্ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালবাসেন।

২৭
(খ) সুস্পষ্ট বক্তৃতা ও বিবৃতি দানঃ
দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে বক্তৃতা ও বিবৃতি চুম্বকের ন্যায় মানুষকে আকৃষ্ট করে থাকে। সুস্পষ্ট বক্তৃতা মানুয়ের হৃদয়ে জাদুর ন্যায় প্রভাব ফেলে। মানব হৃদয়ে এক রকমের আলোড়ন সৃষ্টি করে মানুষকে সত্য ও সুন্দর গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। কর্কশ ও কঠোর হৃদয়কেও নম্র, ভদ্র, শালীন ও হকের উপদেশ প্রহণের উপযোগী করে তোলে। যেমনটি মূসা আলাইহিস সালাম ও ফের‘আউন এবং তার সম্প্রদায়ের মাঝে দেখা যায়।

২৮
(গ) উৎসাহ ও ভীতিসঞ্চার উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধনঃ
দা‘ঈ মানুষকে যাবতীয় সৎকাজে উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, পাপ-পঙ্কিলতা প্রভৃতি গর্হিত কার থেকেও সতর্কতা প্রদর্শনমূলক ভীতি সঞ্চারে উদ্বুদ্ধ হবে। তাহলেই দা‘ওয়াত পূর্ণরূপে কার্যকর হবে। সকল নবী রাসূল মানুষকে আল্লাহ্‌র পুরুস্কার ঘোষণার সাথে সাথে তার শাস্তির বাণীও উচ্চারণ করে স্ব-স্ব জাতিকে সতর্ক করেছিলেন।

২৯
(ঘ) প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নিকট দা‘ওয়াত উপস্থাপনঃ
দা‘ওয়াতের টার্গেটভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বশীর্ষে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা, তাদেরকে দীনের ছায়াতলে সংঘবদ্ধ করতে পারলে খুব সহজেই অনুসারীদের অনুপ্রবেশ লক্ষ করা যায় মূসা আলাইহিস সালাম এ জন্যে তৎকালীন ক্ষমতার মসনদে সমাসীন ফের‘আউনের নিকট দা‘ওয়াত উপস্থাপন করেছিলেন।

৩০
(ঙ) দা‘ওয়াতের পাশাপাশি সমসাময়িক উপকরণ ব্যবহারঃ
দাঈ আল্লাহর উপর পূর্ণনির্ভর ও ভরসা রেখে যুগশ্রে্ষ্ট বাহ্যিক উপকরণাদি ব্যবহার করতে পারবে। এটি তাওয়াক্কুল এর পরিপন্থি নয়। বরং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের জন্য সঠিক সর্মপন্থা। মহান আল্লাহ তার মনোনীত নবী-রাসূলদেরকে সমসাময়িক যুগের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে সে সময়কার যাবতীয় উপকরণ ব্যবহার করার মাধ্যমে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম পরিচালিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তারা তা ব্যবহারে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে, তার ভিন্ন ভিন্ন মু‘যিজা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যা বিরোধীদের জন্য এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে সমাদৃত ছিল।

৩১
(চ) সামষ্টিক ভাবে দা‘ওয়াত উপস্থাপনঃ
ইসলামী দা‘ওয়াতের কাজ একটি সামাজিক মিশনও বটে। একজন ব্যক্তির পক্ষে এটা আঞ্জাম দেয়া খুবই দূরহ। তাছাড়া একজন অপেক্ষা সমষ্টির দা‘ওয়াতের মূল্যায়ণ ও প্রভাব সাধারণত বেশী হয়ে থাকে। অতএব, দা‘ওয়াতী কর্যক্রমে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টি বা দলের গুরুত্ব সর্বাধিক।

৩২
(ছ) সর্বোত্তম পন্থায় বিরোধীদের বক্তব্য খন্ডনঃ
এটি হিকমতের নামান্তর এবং ইসলামী দা‘ওয়াহ প্রচারের অত্যন্ত কার্যকর একটি পন্থা। মূসা আলাইহিস সালাম বিরোধীদের যারতীয় বক্তব্যকে অসার ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার নিমিত্তে সর্বোত্তম পন্থায় তাদের সাথে যুক্তি তর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। আজকেও যারা ইসলামের বিরোধীতায় ব্রত হয় তাদের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য দা‘ঈদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমে সর্বোত্তম পন্থায় তার উত্তর প্রদানে সচেষ্ট হতে হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন‘‘হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপন পালনকর্তার পথে হিকমত, উত্তম উপদেশ ও সর্বোত্তম পন্থায় তর্কের মাধ্যমে আহ্বান করুন।’’ [আল-কুরআন, সূরা আন নাহল : ১২৫।]

৩৩
(জ) অনুকুল-প্রতিকূল সর্বাবস্থায় দীনে হকের উপর অবিচল থাকাঃ
একজন দাঈ দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে যেমনি হিকমত অবলম্বন করবে, তেমনি অনুকূল ও প্রতিকূল সর্বাবস্থায় সত্য দীনের উপর অটল ও অবিচল থাকবে। এক্ষেত্রে কোন অত্যাচারী শাসকের অত্যাচার ও হুমকির ফলে সত্যপথ হতে বিচ্যুত হবে না। মূসা আলাইহিস সালাম জন্ম থেকেই প্রতিকূল অবস্থায় দিনাতিপাত করে পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। তবুও এক মুহুর্তের জন্যেও সত্যদীন বিমুখ হননি। ঘোর শত্রু ফের‘আউনের গৃহে আল্লাহ তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অতএব, মহান আল্লাহর নিকট সর্বাবস্থায় সাহায্য প্রর্থনা ও আশ্রয় প্রত্যাশার মাধ্যমে সত্য ও সঠিক পথে অবিচল থাকা ষম্ভব।

৩৪
উপসংহারঃ
পরিশেষে বলা যায় যে, মূসা আলাইহিস সালাম একজন বড়মাপের দা‘ঈ ও মুজাহিদ ছিলেন। একজন দা‘ঈ ইলাল্লাহ হিসেবে অসংখ্য গুণের আঁধার ছিলেন তিনি। অত্যন্ত প্রতকিূল পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে আগমন করেও যিনি সারাজীবন দীনে হকের উপর অবিচল থাকার অভিপ্রায় নিয়ে মানুষকে যাবতীয় যুলুম নির্যাতন হতে রক্ষা করে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইসলামী দা‘ওয়াতকে মানুষের মাঝে স্পষ্ট ও কাঙ্খিত উপায়ে তুলে ধরার জন্য তিনি স্থান, কাল, পাত্র ভেদে বিভিন্ন হিকমতপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এমনকি, দা‘ওয়াহকে ফলপ্রসূ করার নিমিত্তে আল্লাহর সাহয্য ও তার প্রতি পূর্ণ নির্ভর হওয়ার পাশাপাশি সমসাময়িক যুগশ্রেষ্ঠ উপকরণ ব্যবহার করতেও দ্বিধা করেন নি। মহান আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলে তাকে মর্যাদাবান করেছেন। অতএব, আজকের যুগে যারা দা‘ওয়াতী কার্যক্রমে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন, তারা যদি তার আদর্শ ও পন্থা বেছে নিয়ে ব্যক্তিগত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে দা‘ওয়াতী কাজ আঞ্জাম দেন, তবে দা‘ওয়াহর ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সাধন সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন