hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আহমদ দীদাত রচনাবলি - ফজলে রাব্বী ও মুহাম্মদ গোলাম মোস্তাফা

লেখকঃ আহমদ দীদাত

২৭
অধ্যায় তিনঃ কিছু ভাল ইহুদী
জার্মানির একটি সংবাদপত্রের নাম ফ্রাঙ্কফুটার জেইতুং। ১৯৯২ সালের শেষের দিকে এই সংবাদপত্রের প্রতিনিধি লিওপোন্ডওয়াইজ জেরুজালেম পরিদর্শনে আসেন। তিনি ছিলেন অস্ট্রো, জার্মান, ইহুদী বংশদ্ভূত। তার এক বন্ধুর বাড়িতে ইহুদীবাদী আন্দোলনের একজন প্রধান ডক্টর শাস ওয়াইজম্যানের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছিল। তার চারপাশ ছিল তার তরুণ অনুসারী- বেন গুরিয়ন, বেগিন ও ডায়ান দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাদের সামনে টেবিলের উপর ফিলিস্তিনের একটা মানচিত্র। তারা আলোচনা করছিলেন কীভাবে ইহুদী রাষ্ট্র এর মাঝ থেকে বের করবেন।

আরবদের কী হবে?

তরুণ ইহুদী সাংবাদিক দেখলেন ফিলিস্তিনে বসবাসকারী আরবদের সম্পর্কে তারা কোন চিন্তা করছেন না। আইনসঙ্গতভাবে বসবাসকারী আরবদেরকে অন্যায়ভাবে উৎখাত করার পরিকল্পনা চলছে। নব্য ইহুদীবাদী সাংবাদিক নিশ্চুপ থাকতে না পেরে ড. শাম ওয়াইজম্যানকে প্রশ্ন করলো, “আরবদের কি হবে?” এ বিষয়ে তরুণ সাংবাদিক তার প্রতিবেদনে লিখেছেনঃ “আলোচনার মাঝখানে আমার প্রশ্ন মনে হলো সবাইকে হতচকিত করে দিয়েছে। ড. ওয়াইজম্যান তার হাতের টুপিটা টেবিলের উপর রেখে ধীরে ধীরে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমারই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন, আরবদের কী হবে? হ্যাঁ, যারা এই দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী সেই আরবদের চরম বিরোধিতার মাঝ দিয়ে তোমরা তাহলে ফিলিস্তিনকে তোমাদের আবাসভূমি করার আশা পোষণ কর কীভাবে? ইহুদী নেতা কাঁদে ঝাকুনি দিয়ে বললেন, “আমরা আশা করি আরবরা আর কয়েক বছরের মধ্যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় থাকবে না।”

“সম্ভবত তাই। আপনারা এই সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার চাইতে আপনারা ভাল জানেন। আরবরা বাধা সৃষ্টি করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সৃষ্টি করবে কি করবে না সে বিষয় বাদ দিয়ে আপনারা কি কখনো এর নৈতিক দিকটা বিবেচনা করেছেন? যারা চিরকাল এখানে পুরুষানুক্রমে বসবাস করছে তাদেরকে উৎখাত করা যে অমানবিক ও অন্যায় সে দিকটা কি ভেবেছেন?

ড. ওয়াইজম্যান ভুরু কুচকিয়ে জবাব দিলেন, “কিন্তু এই দেশ আমাদের দেশ। অন্যায়ভাবে আমাদেরকে যে দেশ হতে বঞ্চিত করা হয়েছিল আমরা সেই দেশ ফিরিয়ে নিচ্ছি।” আমি এটা ভেবে পাচ্ছি না কীভাবে একটি সৃষ্টিশীল বুদ্ধিমান জাতি ইহুদী আরব বিরোধের কেবল একচোখা ইহুদীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে পারে? তারা কী একথা বুঝতে পারে? তারা অনুধাবন করতে পারছে না যে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সমস্যা কেবল মাত্র আরবদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে সমাধান সম্ভব?

তাদের বর্তমান নীতি ভবিষ্যতে দুঃখজনক ও কষ্টকর হবে সেই বিষয়ে তারা এত নৈরাশ্যজনকভাবে অন্ধ কেন? প্রতিকূল আরব সমুদ্রের মাঝে তারা একটি দ্বীপ মাত্র। সাময়িকভাবে হয়তো তারা সফল হতে পারে। কিন্তু চিরকাল ঘৃণা তিক্ততা ও সংঘর্ষের মধ্যে বসবাস করা কি সম্ভব? সবচাইতে দুঃখজনক ও আশ্চর্যের বিষয়, যে জাতি সুদীর্ঘকাল নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে, তারাই এখন একদেশদর্শী হয়ে স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপর এক জাতির উপর চরম অন্যায় করতে যাচ্ছে। অথচ সেই জাতি অতীতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে সকল নির্যাতন পরিচালিত হয়েছে সেইগুলির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্দোষ। (যখন শেষ অনুচ্ছেদটি পাঠ করা হল তখন অনেকেরই চোখ ভিজে গিয়েছিল)।

আমি জানি এমন ঘটনা ইতিহাসে অজানা নেই। কিন্তু আমার চোখের সামনে এমন ঘটনার পরিকল্পনা প্রণয়ন হতে দেখে আমি সত্যিই দুঃখিত।

মস্তিষ্ক ধোলাই

প্রশ্ন উঠতে পারে ‘এটা কি করে সম্ভব হয়েছিল?’ হ্যাঁ সম্ভব। সব কিছুই সম্ভব। মস্তিষ্ক ধোলাই অথবা প্রোগামিং-এর মাধ্যমে অতি সহজ অত্যন্ত সভ্য সংস্কৃতিবান জার্মান জাতি ৬ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছিল এই মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের মাধ্যমে। কেউ কেউ বলে এই সংখ্যা সত্য নয়। না হোক, জাতি বিদ্বেষের নামে ছয়শ কেন, ছয় জন ইহুদীকেও যদি ধ্বংস করা হয় তাহলে সেটাই যথেষ্ট নাটকীয়। এটা কি করে সম্ভব হয়েছিল? এটি সম্ভব কারণ জার্মানদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা যেতে পারে, ইহুদীদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা যেতে পারে, মুসলমানদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা যেতে পারে, খ্রিস্টানদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা যেতে পারে।

ইহুদীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক

পঞ্চাম দশকের প্রথমদিকে আমি ইহুদীদের জন্য কাজ করতাম। তারা আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত ও পারিশ্রমিকও ভাল দিত। বাণিজ্য জগতে আমার দীর্ঘ পেশাকালে তাদের মধ্যে আমি অনেক ভাল মনিব পেয়েছি। যে কোম্পানিতে আমি চাকুরি করতাম তখন তাদের ৯টি দোকান ছিল। এখন সেই ‘বিয়ার ব্রাদার্সের’ ১২৫টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একদিন আমার মনিব মিস্টার বেরিন বিয়ার তার অফিস কক্ষে ডেকে নিলেন এবং বললেন আর্জেটিনা হতে এক ইহুদী দম্পতি তার এখানে বেড়াতে এসেছেন। তার ইচ্ছা আমি তাদেরকে নিয়ে ডারবান শহরের ভারতীয় এলাকায় নিয়ে যাই। তাদের নিয়ে শহরটা দেখাই। তারপর কোন ভারতীয় রেস্তোরায় গিয়ে মশলাদার খাবার খাওয়ানো যাবে। তিনি আমার পরামর্শ চাইলেন। আমি বললাম ‘গুডউইল লাউঞ্জ’ নামে একটি ভারতীয় রেস্তোরা আছে। কিন্তু সেটা ভারতীয় হলেও অন্যান্য ইউরোপীয় রেস্তোরার মতোই। তবে কারি-পাউডার দিয়ে কিছু একটা রান্না করে বলে ভারতীয় খাবার। তার চেয়ে আমার বাড়িতেই আসুন না কেন? সেখানে আমরা মুসলমানরা যা খাই তাই খাওয়াব। ভারতীয় গান শোনাব। তারপর দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় মসজিদ ঘুরিয়ে দেখাব। আমার প্রস্তাব তার মনপূত হল। তবে ঠিক হলো তিনি তার স্ত্রীর মতামত জেনে বলবেন। পরের দিন সকালে তিনি আবার ডেকে বললেন, আমার প্রস্তাব নাকি তার স্ত্রীর খুব ভাল লেগেছে। যা হোক নির্ধারিত দিনে আমাকে অবাক করে ছয়জন মেহমান এসে যথাসময়ে উপস্থিত। মিস্টার ও মিসেস বিয়ার, মিস্টার ও মিসেস দানিয়েল আর আর্জেটিনা হতে আগত দম্পতি। সবাই ইহুদী। ভাত, তরকারি ও চাপাতি সবাই উপভোগ করলেন। হাল্কা গল্প হচ্ছে, এমন সময় আজান শোনা গেল। জুমা মসজিদ আমার বাড়ির নিকটে। আজানের সঙ্গে সঙ্গে আমি তার অর্থ করে তাদেরকে শোনাতে লাগলাম। আজানও শেষ হল আমাদের খাওয়া ততক্ষণে শেষ। আমি বললাম তাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে মসজিদে গিয়ে মুসলমানরা কিভাবে নামায পড়ে তা তারা দেখতে পারেন। মিস্টার বিয়ার জানতে চাইলেন মসজিদে তাদেরকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে কি না? তিনি সম্ভবত আমার মূল প্রস্তাব ভুলে গিয়েছিলেন। আমি বললাম, “অবশ্যই”। দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমান অধিবাসীরা উদার হৃদয়ের মানুষ। অমুসলিমদের প্রতি তারা কোন প্রকার বিদ্বেষ বা হিংসা পোষণ করে না, এখানকার আলেমরা তাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাজরানের একদল খ্রিস্টানকে মসজিদে নববীতে থাকতে দিয়েছিলেন। তিনদিন তিনরাত তারা সেখানে ছিলেন। সেখানেই খাওয়া দাওয়া করেছেন, ঘুমিয়েছেন ও তিনদিন সম্ভবত তিন রাতও আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। এমনকি যখন রোববার হল তখন তিনি তাদেরকে সেই মসজিদেই তাদের ধর্মীয় কৃত করতে বলেছিলেন।

মসজিদে ইহুদী

মসজিদে পৌঁছানোর পর আমি আমার মনিব ও মেহমানদেরকে জুতা খোলার পরামর্শ দিলাম। বুঝলাম জুতা খোলার কথায় তাদের অসুবিধা হতে পারে। তাই তাদেরকে বললাম, জুতা খোলার কারণ তারা জানেন কি না। তারা বললেন, না। আমি তখন ব্যাখ্যা করে বললাম, “আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে হযরত মূসা (আ) সিনাই পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।” একথা বলে বাইবেলের একটা অংশ তাদেরকে শোনালাম?

তখন তিনি বললেন, এ স্থানের নিকটবর্তী হয়ো না, তোমার পদ হতে জুতা খুলে ফেল; কেননা যে স্থানে তুমি দাঁড়িয়ে আছ, তা পবিত্র ভূমি।

- যাত্রা পুস্তক ৩:৫

তারা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমি ওযূ করতে গেলাম। ওযূ করে ফিরে এসে তাদেরকে বললাম, “দেখুন স্যার, মুসলমানরা প্রতিদিন পাঁচবার নামায পড়তে বাধ্য। তারা বছরের প্রতিদিনই পাঁচবার নামায পড়তে বাধ্য। যে ব্যক্তি নিয়মিত বছরের প্রতিদিন পাঁচবার যথারীতি নামায পড়ে সে প্রতিবার ভালভাবে হাত, পা, মুখ ধোয়। শরীরের যেসব অংশ খোলা থাকে যেমন হাত পা, মুখ নাকের ছিদ্র, ঘাড় এগুলো ধুতে হয়। ভাল করে দাঁত মাজতে হয়। গড়গড়া করে কুলি করতে হয়। আমার মনে হয় এই আনুষ্ঠানিকতার পেছনে তিনটি ভাল কারণ রয়েছে। জ্ঞানী ব্যক্তি হয়তো আরো কারণ খুঁজে পেতে পারেন।

(১) সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যগত কারণে যে পাঁচবার এভাবে ওযু করে তাতে কোন দোষ থাকতে পারে না। স্বাস্থ্যগতভাবে এটা একটা ভাল অভ্যাস, তাই নয় কি? তারা আমার সঙ্গে একমত হলেন।

(২) ওযুর মাধ্যমে একটি মানসিক কাজও হয়। যে ব্যক্তি ওযু করে সে কেবল ময়লা পরিস্কার করার জন্যই তা করে না বরং সে তার প্রভুর সম্মুখে উপস্থিত হতে যাচ্ছে মনে করেই ওযু করে।

(৩) তদুপরি মূসা (আ)-এর নিকট এই বিষয়ে একটি নির্দেশও ছিল— তা হতে মোশি, হারুন ও তাঁর পুত্রগণ আপন আপন হস্ত ধৌত করতেন; যখন তাঁরা সমাগম তাম্বুতে প্রবেশ করতেন, কিম্বা বেদির নিকটবর্তী হতেন, তৎকালে ধৌত করতেন, যেমন সদাপ্রভু মোশিকে আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

— যাত্রা পুস্তক ৪০: ৩১-৩২

এ কথা বলে আমি তাদেরকে মসজিদের ভেতর নিয়ে গেলাম। সেখানে তারা পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকলেন। আমি এশার নামাজ পড়তে কাতারে দাঁড়ালাম। তারা বসে বসে আমাদের নামাজ পড়া দেখলেন। নামাজ পড়া শেষ হলে আমি তাদের কাছে ফিরে এসে আরও ব্যাখ্যা করে মুসলমানদের নামাযে তথা প্রার্থনায় বিভিন্ন ভঙ্গি যেমন, দাঁড়ানো, রুকুতে যাওয়া, অথবা সেজদায় যাওয়া এসবের বৈশিষ্ট্য কি তা বললাম। এ সময় দুজন নফল নামায় পড়ছিলেন ও সেজদায় গিয়েছিলেন। আমি বললাম এ ভাবেই সকল পয়গম্বর প্রার্থনা করতেন। আমার মন্তব্য বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে কিন্তু তা নয়। আপনারা যদি আপনাদের বাইবেল ভাল করে পড়ে দেখেন তাহলে দেখবেন। এ কথা বলে আমি নিচের অংশগুলো শোনালাম।

(১) তখন আব্রাহাম উপুড় হয়ে পড়লেন, এবং ঈশ্বর তাঁর সাথে আলাপ করে বললেন.... (আদি পুস্তক ১৭: ৩)

(২) তখন মোশি ও হারোন সমাজের সাক্ষাৎ হতে সমাগত-তাম্বুর দ্বারে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লেন; আর সদাপ্রভুর প্রতাপ তাদের দৃষ্টিগোচর হল। (গণনা পুস্তক ২০: ৬)

(৩) তখন যিহোশূয় ভূমিতে উপুড় হয়ে পড়ে প্রাণপাত করলেন ও তাঁকে বললেন.. (যিহোশূয় ৫: ১৪)

(৪) পরে তিনি (যিশু) কিঞ্চিৎ অগ্রে গিয়ে উপুড় হয়ে প্রার্থনা করে বললেন.... (মথি ২৬: ৩৯)

মিস্টার বিয়ার অবাক হয়ে বললেন, “দীদাত, তোমরা দেখছি ইহুদীদের চেয়ে অনেক বেশি ইহুদী।” সেখানে যদি কোন খ্রিস্টান থাকত তাহলে বলতাম, “জী স্যার, খ্রিস্টানদের চেয়েও বেশি খ্রিস্টান। মুসলমানদের অনেক দুর্বলতা থাকতে পারে। কিন্তু তারা গর্ব করে বলতে পারে বাইবেলের পয়গম্বরদের পদাঙ্ক অনুসারী হিসাবে তারা অনেক বেশি অনুসরণকারী, যত না বাইবেল অনুসারীরা অনুসরণ করে।

কুরআন পরিচয়

ইহুদী সঙ্গীদের নিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে এলাম। আরেক পর্ব হালকা চা নাস্তার ব্যবস্থা হল। চা ও সমুসা তৈরি হচ্ছিল। আমি মিস্টার বিয়ারকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি কি কুরআন শরীফ দেখেছেন?’ তিনি বললেন, ‘না, তোমার কাছে কি ইংরেজি অনুবাদ আছে?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। আপনি কি একবার দেখবেন?’ তিনি আপত্তি করলেন না। আবদুল্লাহ ইউসুফ আলীর তিন খণ্ডের অনুবাদ এনে প্রত্যেক দম্পতির হাতে একেক খণ্ড করে দিলাম। শেষ খণ্ডটি দিয়েছিলাম আমার মনিবের হাতে। কারণ ঐ খণ্ডের শেষে বিস্তারিত নির্ঘণ্ট রয়েছে।

আমার অতিথিরা কুরআন শরীফ পাতা উল্টিয়ে দেখছিলেন, আমি মিস্টার বিয়ারকে বললাম নির্ঘণ্ট দেখতে। সেখানে হযরত মূসা (আ)-এর প্রসঙ্গগুলো দেখতে অনুরোধ করলাম। তিনি কয়েকটি বরাত দেখে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘দীদাত, তোমাদের এই গ্রন্থটি দেখছি অদ্ভুত।’ আমি বললাম, ‘কি অদ্ভুত স্যার?’ তিনি বললেন, ‘এই গ্রন্থে দেখছি আমাদের পক্ষে কথা রয়েছে, অথচ তোমরা মুসলমানরা আমাদের বিপক্ষে?” আমি বললাম, ‘এ কথা সত্য মিশরীয়রা আপনাদের জাতিকে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলেছিল, তারা আপনাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অন্যায় সাধন করেছে, আপনাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করেছে, কিন্তু কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রেখেছিল।’

( وَإِذۡ نَجَّیۡنَـٰكُم مِّنۡ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ یَسُومُونَكُمۡ سُوۤءَ ٱلۡعَذَابِ یُذَبِّحُونَ أَبۡنَاۤءَكُمۡ وَیَسۡتَحۡیُونَ نِسَاۤءَكُمۡۚ وَفِی ذَ  ٰ⁠ لِكُم بَلَاۤء مِّن رَّبِّكُمۡ عَظِیم ۝ وَإِذۡ فَرَقۡنَا بِكُمُ ٱلۡبَحۡرَ فَأَنجَیۡنَـٰكُمۡ وَأَغۡرَقۡنَاۤ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ )

স্মরণ কর, যখন আমি ফেরাউনী সম্প্রদায় হতে তোমাদেরকে নিষ্কৃতি দিয়েছিলাম, যারা তোমাদের পুত্রগণকে জাবহু করে ও তোমাদের নারীগণকে জীবিত রেখে তোমাদেরকে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিত; এবং এতে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এক মহাপরীক্ষা ছিল; যখন তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিধা-বিভক্ত করেছিলাম এবং তোমাদেরকে উদ্ধার করেছিলাম ও ফেরাউনী সম্প্রদায়কে নিমজ্জিত করেছিলাম আর তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।

– কুরআন ২:৪৯-৫০

এখানে মহান আল্লাহ্ তা'আলা বলছেন তোমাদের জাতি বনি ইসরাইলদের বিরুদ্ধে মিশরীয় পৌত্তলিকরা অসংখ্য নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। তোমরা আজ আমাদের স্বদেশ জোর করে দখল করেছ। আমার মনিব বললেন, ‘দীদাত, এ কথা তুমি বল কি করে, ফিলিস্তিন আমাদের দেশ।” আমি বললাম, ‘কেমন করে স্যার?” তিনি বললেন, ‘প্রভু আমাদের নিকট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।” কোথায় স্যার?” তিনি তখন পাঠ করলেনঃ

আর তুমি (আব্রাহাম) এই যে কনান (ফিলিস্তিন) দেশে প্রবাস করছ,-এর সমুদয় আমি তোমাকে ও তোমার ভাবী বংশকে চিরস্থায়ী অধিকারার্থে দেব, আর আমি তাদের ঈশ্বর হব।

— বাইবেল আদি পুস্তক ১৭: ৮

ইসরাইলী ঠাট্টা

আমি দুজন দক্ষিণ আফ্রিকান ইহুদীকে জানি তারা কালোদের প্রতি সাদা চামড়ার শাসকদের অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে তাদের পবিত্র দেশ ইসরাইলে চলে গিয়েছিল। তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় এপারথেড ল (বিদ্বেষী নীতি) বিদ্যমান ছিল। ইসরাইলে দুসপ্তাহ থেকেই তারা দেশে ফিরে আসে। ইসরাইলে ফিলিস্তিনদের অবস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার কালোদের চেয়ে খারাপ। তারা দেখেছে ইসরাইলে ফিলিস্তিনীদের প্রতি যে অন্যায় ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হয় সেই তুলনায় বর্ণবিদ্বেষ নীতির অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনেক কম অন্যায় আচরণ করা হয়।

ইসরাইলে সবচেয়ে বড় বিদ্রুপ সে ইহুদীর শোক প্রকাশ। আপনি ইসরাইলের কোন ইহুদীকে প্রশ্ন করেন তোমাদেরকে ফিলিস্তিন কে দিল? (তারা সবাই আদি পুস্তক ১৭: ৮ দ্বারা মস্তিষ্ক ধোলাইকৃত হয়ে আছে) নির্দ্বিধায় জবাব দেবে, “ঈশ্বর”। “হ্যাঁ। মহান শক্তিশালী আল্লাহ্ ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিন দিয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা যায় তুমি কি আল্লাহ্ বিশ্বাস কর? শতকরা ৭৫ জন উত্তরে বলবে, “না”। তবুও ফিলিস্তিনিদের ভূমি জবরদখল করার জন্য এইসব নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদী মিথুক মিথ্যামিথ্যি আল্লাহ্ নাম ব্যবহার করে।

তাদের হাস্যকর দাবি

.. এই যে কনান (ফিলিস্তিন) দেশে-আমি তোমাকে ও তোমার ভাবী বংশকে চিরস্থায়ী অধিকারার্থে দেব... (আদি পুস্তক ১৭: ৮)

উপরের পঙ্গক্তিটি মুখস্থ করে রাখুন। খ্রিস্টান ও ইহুদীদের বিরুদ্ধে দারুণ কাজে লাগবে। এটাই ইহুদীদের পবিত্র দলিল। যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবায়িত হবে। অতীতের হাজার হাজার বছরে মুসলমানরা এই ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করেনি। ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বোঝাতে হবে নীতিগত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিলিস্তিনে তাদের কোন অধিকার নেই।

ভবিষ্যৎ বাণীর প্রকৃত পরীক্ষা

আমার মনিবের সঙ্গে যখন আলোচনা করছিলাম বাকি কয়জন ইহুদী মেহমান গভীর মনোযোগের সঙ্গে আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। আমি আমার মনিবকে বললাম, “আপনি তওরাত গ্রন্থ থেকে যে উদ্ধৃতি দিলেন সেটি হযরত ইবরাহীম ও তার বংশধরদের জন্য আল্লাহ্ তা'আলার প্রতিশ্রুতি।” তিনি উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ”। আমি বললাম, “আল্লাহ তওরাত গ্রন্থে বলেছেন কোন ভবিষ্যৎ বাণী তার নামে বলা হলে সেটি সত্যই তার বলা কিনা, সেটি পরীক্ষা করার পদ্ধতি রয়েছে।” তিনি বললেনঃ

আর তুমি যদি মনে মনে বল, সদাপ্রভু যে বাক্য বলেননি, তা আমরা কি প্রকারে জানব? [তবে শুন] কোন ভাববাদী সদাপ্রভুর নামের কথা বললে যদি সেই বাক্য পরে সিদ্ধ না হয় ও তার ফল উপস্থিত না হয়, তবে সেই বাক্য সদাপ্রভু বলেননি; ঐ ভাববাদী দুঃসাহসপূর্বক তা বলেছে, তুমি তা হতে উদ্বিগ্ন হয়ো না।

– দ্বিতীয় বিবরণ ১৮: ২১-২২

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কি সঠিক পরীক্ষা পদ্ধতি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। আমি বললাম, ‘তাহলে ভবিষ্যৎ বাণীর ক্ষেত্রে এটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।

তওরাত গ্রন্থে বলা হয়েছে ইবরাহীম (আ)-এর মৃত্যুর পর—

আর তার পুত্র ইসহাক ও ইশ্মায়েল... গুহাতে তার কবর দিলেন। আব্রাহাম হেতের সন্তানদের কাছে সেই ক্ষেত্র ক্রয় করেছিলেন। সেই স্থানে আব্রাহাম ও তাঁর স্ত্রী সারার কবর দেওয়া হয়। – আদি পুস্তক ২৫: ৯-১০

তদুপরি বাইবেলে আল্লাহর অপূর্ণ “ইসরাইলি প্রবীণদের নিকট ও পিতা ইবরাহীম (আ)-এর নিকট দেওয়া প্রতিশ্রুতি” সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

বিশ্বাসানুরূপে তাঁরা সবাই মরলেন; তাঁরা প্রতিজ্ঞাকলাপের ফল প্রাপ্ত হননি, কিন্তু দূর হতে তা দেখতে পেয়ে সাদর সম্ভাষণ করেছিলেন —ইব্রীয় ১১: ১৩

পবিত্র দলিল অপেক্ষা এই বক্তব্য অধিকতর স্পষ্ট নয় কি?

আর বলেছিলেন, তুমি স্বদেশ হতে ও আপন জ্ঞাতি-কুটুম্বদের মধ্য হতে বের হও, এবং আমি যে দেশ তোমাকে দেখাই, সেই দেশে চল। তখন তিনি কলদীয়দের দেশ হতে বের হয়ে গিয়ে হারনে বসতি করলেন; আর তাঁর পিতার মৃত্যু হলে পর [ঈশ্বর] তাঁকে তথা হতে এই দেশে আনলেন, যে দেশে আপনারা এখন বাস করছেন, কিন্তু এই দেশের মধ্যে তাঁকে অধিকার দিলেন না, এক পাদ পরিমিত ভূমিও না; আর অঙ্গীকার করলেন, তিনি তাকে ও তার পরে তাঁর বংশকে অধিকারার্থে তা দেবেন, যদিও তখন তাঁর সন্তান হয়নি। — প্রেরিতদের কার্য ৭:৩-৫

এখনও ভাল ইহুদী আছে

আমি আমার ইহুদী মেহমানদের প্রশ্ন করলাম যে এই সহজ বক্তব্য কি গসপেল সত্য? তারা আমাকে অবাক করে উত্তর দিল, হ্যাঁ। তখন পবিত্র কুরআনের কথা মনে পড়ল।

( مِّنۡهُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَأَكۡثَرُهُمُ ٱلۡفَـٰسِقُونَ )

তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মু'মিন আছে; কিন্তু তাদের অধিকাংশ সত্যত্যাগী।

—কুরআন ৩: ১১০

মুসলমানদের উচিত ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ভক্ত ও আন্তরিক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। আমার মনিব স্বীকার করলেন যে এ কথা সত্য বাইবেলে অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির কথা আছে। তখন আমি বললাম, তাহলে আল্লাহ্ কখনই সেই প্রতিশ্রুতি দেবেন না, যা রক্ষিত হবে না। কুরআন শরীফেও এই বিষয়ে বলা হয়েছে। তিনি যে প্রতিশ্রুতি দেন তা রক্ষা করেন। বাইবেলেও আছে—দ্বিতীয় বিবরণ ১: ২২

( وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّ اۚ )

আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য।

—কুরআন ৪: ১২২

হযরত মূসা (আ) দ্বিতীয় বিবরণ ১৮: ২২-এ যে সর্বশেষ ইচ্ছাপত্র ও কথা বলছেন তার দ্বারা আদি পুস্তকের ১৭: ৮ যে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে যার উপর ভিত্তি করে ফিলিস্তিন ইহুদীদের দেশ এই দলিল নাকচ হয়ে যায়-এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আমার মনিবের মত সমঝদার ইহুদীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ হল। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে। তাই আমি বললাম, আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমি তোমাকে এবং তোমার পরে তোমার বংশধরকে কানানের সকল ভূমি চিরস্থায়ীভাবে দেব।

আব্রাহামের বংশধর

ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতার প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা একমত হলাম। তারপর আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আব্রাহামের বংশধর কারা?’ মিস্টার বিয়ার বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে উত্তর দিলেন, “আমরা ইহুদীরা”। আমি বললাম, ‘এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে আপনারা ইবরাহীমের বংশধর। কিন্তু আপনারাই কি একমাত্র বংশধর? বাইবেলের প্রথম পুস্তকে কমপক্ষে বার জায়গায় বলা হয়েছে আরবদের পূর্বপুরুষ ইসমাইল (আ)। তিনি ইবরাহিমের পুত্র।’

১) পরে হাগার অব্রামের নিমিত্তে পুত্র প্রসব করল; আর অব্রাহম হাগারের গর্ভজাত আপনার সেই পুত্রের নাম ইশ্মায়েল রাখলেন। (আদি পুস্তক ১৬: ১৫)

২) পরে আব্রাহাম আপন পুত্র ইম্মায়েলকে... (আদি পুস্তক ১৭: ২৩)

৩) আর তাঁর পুত্র ইশ্মায়েলের লিঙ্গাগের ত্বছেদন কালে তার বয়স তের বছর। (আদি পুস্তক ১৭:২৫

৪) সেই দিনেই আব্রাহাম ও তাঁর পুত্র ইশ্যায়েল, উভয়ের ত্বছেদ হল। (আদি পুস্তক ১৭: ২৬)

৫) আর তাঁর পুত্র ইসহাক ও ইশ্মায়েল মম্রির সম্মুখে হেতীয় সোহরের পুত্র ইফ্রোণের ক্ষেত্রস্থিত মকপেলা গুহাতে তাকে কবর দিলেন। — আদি পুস্তক ২৫: ৯

৬) আব্রাহামের পুত্র ইম্মায়েলের বংশবৃত্তান্ত এই। সারার দাসী মিস্রীয়া হাগার... (আদি পুস্তক ২৫: ১২)

ইসমাঈল (আ) যে ইবরাহীম (আ)-এর পুত্র এ কথা স্বয়ং স্রষ্টাই যখন তৌরাতে স্বীকার করেছেন সেই ক্ষেত্রে আমরা অস্বীকার করব কি করে? প্রথম সন্তান যদি অনাদত স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান হয় তবুও তার অধিকার আল্লাহ বঞ্চিত করতে কাউকেই দেবেন না। (দ্বিতীয় বিবরণ ২১: ১৬)

প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইসমাঈলের সন্তান আরব জাতি ও ইসরাইলের সন্তান ইহুদী জাতি। কেন একত্রে সুখে শান্তিতে আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে বাস করতে পারে না?

জোর যার মুল্লুক তার

আমার মনিব তত্ত্বগতভাবে আমার যুক্তি মেনে নিতে রাজি। কিন্তু পূর্ব সংস্কার সহজে মরে না। তিনি পাল্টা বলল, “দীদাত, ফিলিস্তিন আমাদের। এই দেশে দাউদ (আ) ও সোলায়মান (আ) সময় আমরা শাসন করেছি।” আমি বললাম, “স্যার কোন এক অঞ্চল শক্তি প্রয়োগের দ্বারা শাসন করার অর্থ এই নয় যে তার বদৌলতে সেই দেশ আপনি পুনর্দখল করতে পারেন। তাহলে মুসলমানদের যদি শক্তি থাকত তাহলে স্পেন পুনরায় শাসন করার দাবি করতে পারত। মুসলমানরা প্রায় আটশ বছর স্পেন শাসন করেছে। ইহুদীরা ফিলিস্তীনীদের একটি অংশ যতদিন শাসন করেছে তার চেয়ে অনেক দীর্ঘকাল মুসলমানরা স্পেন শাসন করেছে। এখনও স্পেনে মুসলমানদের ফেলে আসা অসংখ্য দালান-কোঠা, অট্টালিকা, উদ্যান ও ফোয়ারা একমাত্র দর্শনীয় বস্তু। তার অর্থ কি এই যে, মুসলমানরা স্পেনকে পুনরায় উপনিবেশ বানানোর দাবি করবে? একই যুক্তিতে ওলন্দাজদের পূর্বপুরুষ তিনশ বছর ইন্দোনেশিয়ায় শাসন করেছিল। এজন্য তারাও কি ইন্দোনেশিয়া ফিরে পাবে? অথবা সিজার এক সময় রোম, ব্রিটেন শাসন করেছিল সেই কারণে এখন ইতালি কি ব্রিটেন দখল করার দাবি করতে পারে?” মিস্টার বিয়ার বললেন, ‘না। ওগুলো বিদেশীদের জয়। কিন্তু ফিলিস্তিন আমাদের মাতৃভূমি। যেখান থেকে আমাদেরকে অন্যায়ভাবে অধিকারচ্যুত করা হয়েছিল। আমরা কেবল সেটাই পুনরায় গ্রহণ করেছি।” আমি বললাম, ‘ক্ষমা করবেন, আপনি একটি মারাত্মক ঐতিহাসিক ভুল করছেন। ইহুদীরাও যোশুয়ার নেতৃত্বে তিন হাজার বছর আগে ফিলিস্তিন আক্রমণ করেছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদের পরাজিত করে সে দেশ অধিকার করেছিলেন। আপনারাও ত্রিশ দিনে ত্রিশটি রাজ্য জয় করেছিলেন (যিহোশূয়ের পুস্তক ১২: ২৪)। ইসরাইলের বারগোত্রের মিলিত বাহিনীর একেকটি বিভক্ত গ্রাম সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল, তোমরা যাকে বলেছ রাজা, তাকে আক্রমণ করেছে। এমনিভাবে তারা আমোরাইট, ইডোমাইট, ফিলিস্তীনী, মোয়াবাইটস, হিট্টিটিজ ও অসংখ্য রাজ্য পরাভূত করেছে। সেটা করেছিল তোমাদের পূর্বপুরুষেরা।

আর তারা খড়গধারে নগরের স্ত্রী পুরুষ আবাল বৃদ্ধ এবং গো, মেষ ও গর্দভ সকলই নিঃশেষে বিনষ্ট করল। – যিহোশূয়ের পুস্তক ৬: ২১।

রডিনসনের ক্রন্দন

অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল ধ্বংসযজ্ঞ ইসরাইলের জন্য একটি নিরবিচ্ছিন্ন যুদ্ধের অপছায়া। ফিলিস্তিনে ইহুদী সমস্যার কোন সমাধান আরবদের সহযোগিতা ব্যতীত সম্ভব নয়। নীতিগতভাবে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিলিস্তনে ইহুদীদের কোন দাবী থাকতে পারে না। রডিনসন একজন সম্ভ্রান্ত ইহুদী। তার “ইসরাইল ও আরব” নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ

“ইসরাইলীরা বলতে পারে না যে যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষ দুই হাজার বছর আগে এখানে বসবাস করতেন। অতএব এই দেশ তাদের। তাদের এটা বোঝা উচিত, তারা অন্য এক জাতির উপর ঘোরতর অন্যায় করেছে, কারণ তাদেরকে তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। যাদের উপর এই অন্যায় করা হয়েছে তাদের মনে সে তিক্ততা যতদিন বিদ্যমান থাকবে ততদিন ইসরাইলের অধিকার সম্পূর্ণভাবে শূন্যগর্ভ থাকবে। তারা আশা করতে পারে একদিন আরবরা তাদেরকে স্বীকার করবে। যখন তারা স্বীকার করবে তখনই কেবল তাদের অধিকার বাস্তব হবে।”

আরবদেরও অধিকার আছে। অনেক দিক দিয়ে বলা যায় তাদের অধিকার অনেক বেশি। ইংল্যান্ডে যেমন ইংরেজদের অধিকার, ফ্রান্সে যেমন ফরাসিদের অধিকার তেমনি ফিলিস্তিন ভূমিতে আরবদের অধিকার। তাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার উস্কানি ব্যতিরেকে তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। ইসরাইলরা সত্যই আরবদের প্রতি মারাত্মক অন্যায় করেছে।”

ইহুদী পুরোহিত যতই স্বীকার করুন, দোষ মেনে নেন অথবা যতই মনস্তাপ প্রকাশ করুন তবুও ইহুদীরা বলে ফিলিস্তিন আমাদের দখলে রয়েছে, আমাদের দখলেই থাকবে। আইনে নাকি বলে দখলে রাখাই দশ ভাগের নয় ভাগ আইনসঙ্গত হয়ে যায়। আমার মনিবের সেই রকমই মানসিকতা। তাই আমি প্রশ্ন করলাম আপনারা কিভাবে দখল করলেন? গায়ের জোরে? তাহলে আরবদেরও অধিকার আছে। গায়ের জোরে পুনরায় তাদের পিতৃভূমি দখল করার।

দীদারের পদোন্নতি

স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমার নিয়োগকর্তা যথেষ্ট বিনয়ী। তিনি বললেন, “দীদাত, আমরা জানতাম না আরবদেরও তাদের পক্ষে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি আছে।” তিনি বললেন, ‘আমাদের যে আলোচনা হয়েছে সেটি যদি আমি লিখে দিতে পারি তাহলে তিনি সেটি টেম্পোল ডেভিড ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে দেবেন।’ আমি বললাম, ‘আমি তো লেখক নই।’ তিনি তখন বললেন, “দীদাত, তুমি যেভাবে কথাগুলি বলেছ সেইভাবেই লেখ। আমি সংশোধন করে দেব।” আমি জানতাম তিনি যা বলেছেন আন্তরিকতার সঙ্গেই বলেছেন, আজ ত্রিশ বছর পর আমার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে যে কোন মুসলমান আশঙ্কা করবে যে তার ইহুদী নিয়োগকর্তা অবশ্যই তাকে চাকুরিচ্যুত করবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে এই কোম্পানিতে আমার প্রতি সম্মান বৃদ্ধি পেল। ছিলাম দীদাত, এখন হলাম মিস্টার দীদাত। এর পর থেকেই শুনতে পেতাম “গুড মর্নিং মিস্টার দীদাত। গুড আফটার নুন মিস্টার দীদাত। গুড ইভনিং মিস্টার দীদাত।” আমার সঙ্গে মিস্টার বিয়ারের যে আলোচনা হয়েছিল সেই বিষয় তিনি অন্যান্য ইহুদী কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। বিশেষ করে কোম্পানির বস্ত্র বিভাগের ম্যানেজার মিস্টার বেইনাট-এর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন।

ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে কটুক্তি

কয়েকদিন পর মিস্টার বেইনাটের বিভাগের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি সে রকম মনিবের সঙ্গে আমার যে আলোচনা হয়েছে সেগুলো কি হয়েছে তা বললেন। তিনি বললেন, “তুমি আমাকে বুঝ দিতে পারবে না যেমনটি তুমি মিস্টার বিয়ারের ক্ষেত্রে করেছ। ইসমাইলের কথা বলেছ, আরবদের পূর্বপুরুষ এই ইসমাইল ছিল তো জারজ সন্তান।”

লোকটি সম্ভবত কিছু একটা গোলমাল পাকাতে চাচ্ছিল। কারণ এ কথা শোনার পর যে কোন মুসলমান ঐ লোকের গলা কেটে ফেলত। দোকান চলাকালে তর্ক বা আলোচনা কোনটাই সম্ভব নয়। আমি বেইনাটকে পরামর্শ দিলাম তার স্ত্রীসহ আমার বাড়িতে এসে নৈশভোজ করতে। সে সহজে রাজি হচ্ছিল না। সপ্তাহ খানেক অনুরোধ করার পর তাকে রাজি করানো গেল। অতঃপর একদিন মিস্টার ও মিসেস বেইনাট, মিস্টার ও মিসেস ফিল এবং মিস্টার টাউনসেন্ট নৈশভোজের জন্য আমার বাড়িতে এলেন। এবারও আগের মত খাওয়া-দাওয়ার পর মসজিদে নিয়ে গেলাম। সেখান থেকে ফিরে চা, সিঙ্গাড়া খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। তারপর হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বেইনাট ইতোপূর্বে যে অশ্লীল মন্তব্য করেছিল সেই কথার সূত্র ধরে আমি বললাম, মিস্টার বেইনাট, সেদিন তুমি আরব জাতির পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে এক মারাত্মক মিথ্যা অভিযোগ এনেছিলে। তুমি কি এখনো সেই অভিমত পোষণ কর, মিস্টার বেইনাট বলল, অবশ্যই। আমি ভেবেছিলাম খাওয়া দাওয়া আতিথেয়তার কারণে সে হয়ত একটু বিনম্রভাবে বলবে। কিন্তু না, তার কোন পরিবর্তন হয়নি।

ইহুদীরা তিন দফায় দোষী

আমি বেইনাটকে প্রশ্ন করলাম ইহুদী মতে কোনটা বেশি অগ্রাধিকার পেতে পারে, যেমন সন্তান কার মাধ্যমে জন্ম দেওয়া উত্তম, অর্থাৎ নিজের ভগ্নীর মাধ্যমে অথবা একজন ক্রীতদাসীর মাধ্যমে। সে বলল, “দাসীর মাধ্যমে।” আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “সুপ্রজননঃ বিদ্যা অনুসারে একজন মানুষের পক্ষে কার মাধ্যমে সন্তান লাভ অধিকতর বাঞ্ছনীয়-আপন ভগ্নীর মাধ্যমে অথবা আফ্রিকার কালো মহিলার মাধ্যমে অথবা দাসীর মাধ্যমে?” সে বিশেষ কিছু চিন্তা না করে বলল, “দাসীর মাধ্যমে”। অতঃপর তৃতীয় দফায় আমি প্রশ্ন করলাম, “যে সাধারণ বুদ্ধিতে কোন পদ্ধতি সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত-ভগ্নির মাধ্যমে অথবা ক্রীতদাসীর মাধ্যমে।” সে পুনরায় বলল, “এই দুইটির মধ্যে অবশ্যই ক্রীতদাসীর মাধ্যমেই বংশ রক্ষা অধিকতর বাঞ্ছনীয়।” ইহুদী ভদ্রলোক বারবার যেভাবে একঘেয়ে একই উত্তর দিচ্ছিলেন অন্য যে কোন লোক তার সাথে একমত হয়ে একই উত্তর দিতেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতঃপর আমি মিস্টার বেইনাটের দৃষ্টি বাইবেলের আদিপুস্তকের দিকে আকৃষ্ট করলাম যেখানে বলা হয়েছে আব্রাহাম তার সুন্দরী স্ত্রী সারাকে নিয়ে জেরাবে গিয়েছিলেন। তখন সেখানকার রাজা তার স্ত্রীকে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন যে মহিলা তার কি হয়? তিনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, সম্পর্কে ভগ্নি। তখন রাজা তাকে হারেমে নিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। আব্রাহাম অনুগতভাবে তাকে হারেমের ভিতর পাঠিয়ে দেন। কি অজ্ঞাত কারণে রাজা সারার সঙ্গে কোন সম্পর্ক করতে পারেন নি। পরের দিন বিরক্তি সহকারে রাজা আব্রাহামকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, “সারার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি?” এখন তিনি সত্য কথাই বললেন যে, “সারা তার স্ত্রী।” মিথ্যা বলার জন্য রাজা আব্রাহামকে ভৎসনা করলেন। তখন আব্রাহাম বললেন, ‘তিনি একেবারে মিথ্যে বলেননি।’

আর সে আমার ভগিনী, এটাও সত্য বটে, কেননা, সে আমার পিতৃকন্যা, কিন্তু মাতৃকন্যা নহে, পরে সে আমার ভাৰ্য্যা হল। (আদি পুস্তক ২০: ১২)

আব্রাহামের পুত্র যাকোব; যাকোবের পুত্র যিহুদা ও তাঁর ভ্রাতৃগণ। (মথি ১: ২)

অতএব মিস্টার বেইনাটকে আপনি যে মানদণ্ডের কথা বলেছেন সেই হিসাবে যদি ইসমাইল জারজ সন্তান হয়ে থাকে তাহলে তো ইসরাইল বড় জারজ হয়ে যান। আমার মনে নেই এ কথার পর মিস্টার বেইনাটের ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আমরা সব সময়ই বন্ধুভাবাপন্ন ছিলাম। তার সাথে কখনো কোন ঝগড়া বিবাদ হয়নি।

আশ্চর্যের বিষয় ইহুদীদের আব্রাহাম, সারা ও রাজাকে নিয়ে অনেক ছোটখাট কাহিনী আছে। এরপর ছয় অধ্যায়ে ইসরাইল সেই রাজার সাথে একই রকম ঘটনা ঘটেছিল।

পলেস্টীয়দের রাজা অবীমেলক বাতায়ন দিয়ে দৃষ্টিপাত করলেন, আর দেখ, ইসহাক আপন স্ত্রী রিবিকার সাথে ক্রীড়া করছেন। তখন অবীমেলক ইসহাককে ডেকে বললেন, দেখুন, ঐ স্ত্রী অবশ্য আপনার ভার্যা; তবে আপনি ভগিনী বলে তাঁর পরিচয় কেন দিয়েছিলেন? – আদি পর্ব ২৬: ৯-৯

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন