hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

দয়া ও ভালোবাসার অনন্য বিশ্ব নবী

লেখকঃ আবু আব্দুর রাহমান

১৬
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বোচ্চ ধৈর্যধারণ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দাওয়াতী ময়দানে এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, যেগুলোর মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

তিনি আল্লাহর নৈকট্য এবং তার থেকে বিনিময় লাভকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। এ কথা আমরা সবাই জানি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনীয় দাওয়াতের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করেন। এমনকি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ধৈর্যের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

দাওয়াতী ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ধৈর্যের দৃষ্টান্ত স্থাপনের অসংখ্য ঘটনা বিদ্যমান। তবে আমরা বাস্তবমুখী কয়েকটি ঘটনা বর্ণনা করব।

প্রথম দৃষ্টান্ত: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ছাফা পাহাড়ে আরোহণ এবং সবাইকে একত্রিত করে ইসলামের দাওয়াত দেয়া

আল্লাহ তাআলা তার নবীকে সর্ব প্রথম নিকট আত্মীয়দের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য আদেশ দেন। আল্লাহ বলেনঃ

وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ﴿214﴾ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ﴿215﴾ فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ ﴿216﴾

‘‘আর তুমি তোমার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক কর। আর যে সব ঈমাদাররা তোমার অনুকরণ করে তাদের প্রতি বিনয়ী হও। আর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয় তুমি তাদের বলে দাও, তোমরা যা করো তার দায় হতে আমি মুক্ত।’’ [সুরা আশ-শুআরা ২১৪-২১৪]

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেন। ইসলামের শক্তি প্রদর্শনের জন্য তিনি একটি অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেন ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। যার ফলে আল্লাহ তাআলা ইসলামের দাওয়াতের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটান। দাওয়াতের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বুদ্ধিমত্তা, তার সাহসিকতা, সহনশীলতা, সুন্দর ব্যবহার এবং ইখলাস - আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ঐকান্তিক আগ্রহ- ইত্যাদি অনেক কিছুই তার জীবনীতে ফুটে উঠে।

সাথে সাথে এর একটি চিত্র এও দেখতে পাই; তা হল, যারা তাওহীদের বিরোধিতা করে, নবী ও রাসূলদের সাথে দুর্ব্যবহার ও তাদের যারা কষ্ট দেয়, তাদের পরিণতি লাঞ্ছনা বঞ্চনা এবং দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।

ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- যখন আল্লাহর বাণী

وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ

‘‘আর তুমি তোমার নিকট আত্মীয়দের সতর্ক কর।’’ যখন অবতীর্ণ হল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাফা পাহাড়ের উপর আরোহণ করে প্রতিটি গোত্রের নাম ধরে ধরে ডাক দিলেন- হে বনী ফাহর! হে বনী আদি ! এ রকমভাবে কুরাইশের সম্ভ্রান্ত বংশকে-ডাকতে আরম্ভ করেন। তার ডাক শুনে সমস্ত মানুষ একত্রিত হল। এমনকি যদি কোন ব্যক্তি না আসতে পারতো, সে একজন প্রতিনিধিকে পাঠাতো, কি বলে তা শুনার জন্য। আবু জাহেল নিজে এবং কুরাইশরা সবাই উপস্থিত হল। তারপর তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি যদি বলি, এ পাহাড়ের পাদদেশে অস্ত্র সজ্জিত এক বাহিনী তোমাদের উপর আক্রমণের অপেক্ষায় আছে, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?’ সকলে এক বাক্যে বলল, ‘অবশ্যই বিশ্বাস করব।’ কারণ, আমরা কখনো তোমাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি। তিনি বললেন, আমি তোমাদের সতর্ক করছি ভয়াবহ শাস্তি- আল্লাহর আজাব সম্পর্কে।

এ কথা শুনে আবু লাহাব বলল, ‘তোমার জন্য ধ্বংস! পুরো দিনটাই তুমি আমাদের নষ্ট করলে। এ জন্যই কি আমাদের একত্রিত করেছ ?’

তার এ কথার উত্তরে আয়াত নাযিল হলো।

تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ

‘‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার ধন সম্পদ এবং তার কোন উপার্জন কাজে আসে নাই।’’ [সহীহ আল - বুখারী:৪৭৭০,সহীহ মুসলিম :২০৮ আয়াত : সুরা মাসাদ: ১-২]

আবু হুরাইরা রা. এর বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. এক এক গোত্রকে আলাদা করে ডাকেন এবং প্রতিটি গোত্রকে বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কর।’ এবং কলিজার টুকরা ফাতেমা রা. কে ডেকে বলেন, ‘হে ফাতেমা! তুমি তোমাকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কর। কারণ, আল্লাহ পাকড়াও হতে তোমাদের রক্ষা করার মত কোন ক্ষমতা আমি রাখি না। হাঁ, তবে আমার সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক থাকায় আমি তোমাকে আদর-যত্নে সিক্ত করতে পারার আশা রাখি।’ [সহীহ আল - বুখারী ৪৭৭১, সহীহ মুসলিম ২০৬]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে যে ব্যাপক আহবান বা ঘোষণা দেন তা ছিল একটি ঐতিহাসিক আহবান ও যুগান্তকারী ঘোষণা।

তাছাড়া তার সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তিকে বলে দিলেন, ঈমান ও আখেরাতের বিশ্বাস এবং রেসালতের স্বীকৃতিই হল তাদের সাথে সম্পর্কের মানদন্ড।

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমা রা. কে ডেকে বললেন, ‘হে ফাতেমা! তুমি তোমাকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কর। কারণ, আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের বিষয়ে আমাকে কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি।’

উলেখিত হাদীসে দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াত ছিল সর্বোচ্চ তাবলীগ ও ভীতি প্রদর্শন। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বিষয় স্পষ্ট করেন যে, কোন ব্যক্তির নাজাতের উপায় কখনো বংশ মর্যাদা, পিতা-মাতার পরিচয়, আত্মীয়তা কিংবা জাতীয়তা ইত্যাদির মানদন্ডে হতে পারে না বরং এর মানদন্ড হল তাওহীদ ও রিসালাতের উপর বিশ্বাস। এ ঘোষণার পর আরবদের মাঝে বংশ মর্যাদা এবং আত্মীয়তা ইত্যাদির গৌরব আর অহংকারের যে প্রবণতা ছিল, তা আর অবশিষ্ট রইল না। এবং আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি আনুগত্য ভিন্ন অন্য যে কোন উপকরণ-আত্মীয়তা, বংশ-বর্ণ ইত্যাদির ভিত্তিতে যে সব জাতীয়তা গড়ে উঠে তা একে বারে মূল্যহীন।

গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং প্রতিকুল প্রেক্ষাপটে ও তার বংশের লোকদের সর্বোচ্চ সতর্ক করলেন তিনি । তাদের ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার আহবান জানালেন। আল্লাহর কঠিন আজাব হতে ভয় দেখালেন এবং তাদের মূর্তি পূজা হতে বিরত থাকতে আহবান করলেন।

কিন্তু মক্কাবাসীরা তার আহবানে সাড়াতো দিলই না বরং তারা তার মিশনের বিরোধিতা করলো। ফু দিয়ে তা নিভিয়ে দিতে সচেষ্ট হলো। কারণ, তারা বুঝতে পারল, এ আহবান এমন এক দাওয়াত, শত শত বছর ধরে লালন করা ঐতিহ্য এতে বিলুপ্ত হবে এবং বাপ দাদার অন্ধ অনুকরণ ব্যাহত হবে। জাহেলিয়্যাতের যে গতিধারা তাদের সমাজে অব্যাহত ছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটবে।

কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরোধিতা কোনভাবেই আমলে নেননি। বরং তার উপর আরোপিত দায়িত্ব পালনে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কারণ, তিনি আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্বে কোন প্রকার অবহেলা করবেন না বলে বদ্ধ পরিকর। যদি সমগ্র বিশ্বের সমস্ত মানুষ তার মিশনকে প্রত্যাখ্যান বা প্রতিহত করে, তারপরও তিনি দাওয়াত অব্যাহত রাখবেন এবং বাস্তবেও তাই করেছেন।

রাতদিন গোপনে-প্রকাশ্যে যাকে যেখানে পেতেন দাওয়াত দিতেই থাকতেন। তার চিন্তা চেতনায় শুধু একটি জিনিসই কাজ করতো কীভাবে মানুষকে অন্ধকার হতে বের করে আলোর পথ দেখাবেন। কীভাবে মানুষকে শিরক থেকে মুক্ত করবেন এবং তাওহীদের পতাকা তলে একত্রিত করবেন । তাকে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কার, কোন যালিমের যুলুম-অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন, লোভ-লালসা ও প্রলোভন কোন কিছুই বিরত রাখতে পারেনি এবং পারেনি কোন কিছুই তার গতিকে থামিয়ে দিতে।

মানুষের সম্মেলনে, অনুষ্ঠানে এবং হাটে বাজারে মোট কথা যাকে যেখানে পেতেন আল্লাহর দিকে তাকে আহবান করতেন।

বিশেষ করে হজের মাওসুম- যখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে মানুষ একত্রিত হতো- তখন এ সুযোগকে কাজে লাগাতেন। সমগ্র মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতেন।

ধনী-দরিদ্র, দুর্বল-সবল, স্থানীয়-মুসাফির, পথিক-পর্যটক এমন কোন লোক অবশিষ্ট ছিল না যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দাওয়াত পৌছাননি। এ দাওয়াতে সমস্ত মানুষ তার নিকট ছিল সম-মর্যাদার। কোন প্রকার বৈষম্য বা পার্থক্য করেননি কারো মধ্যে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মক্কার ক্ষমতাবান লোকেরা তার শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তাকে এবং তার অনুসারীদেরকে মানসিক, শারীরিকসহ অমানবিক নির্যাতন নিপীড়ন আরম্ভ করল। মক্কাবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লো। তারা কোন ভাবেই তাকে মেনে নিতে পারেনি এবং তাকে মেনে নিতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানাল।

তা সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থমকে যাননি, তার মিশন চালিয়ে যেতে লাগলেন এবং ইসলামে দীক্ষিত সংখ্যালঘু মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন। গোপনে গোপনে কোন কোন পরিবারের বাড়িতে গিয়েও তাদের তালীম-তারবিয়ত, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিতেন।

তালীম-তরবিয়ত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এমন একটি জামাত গঠনে সক্ষম হলেন, যারা তার মিশনের ধারক বাহক হিসেবে তার এ গুরু দায়িত্ব পালনে শরীক হলেন। এদের মত একটি জামাত পেয়ে তার মনে আশার সঞ্চার হলো। ধীরে ধীর তারা এমন একটি জামাতে পরিণত হল, তারা তাদের জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করতে এবং সব কিছুর উপর একমাত্র দীনকে প্রাধান্য দিতে নিজেদের সম্পূর্ণ প্রস্ত্তত করে নিলেন। তারা দৃঢ় ঈমান এবং প্রগাঢ় বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন। ধৈর্য ও সহনশীলতার যে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে ছিল একেবারেই বিরল।

আল্লাহর আদেশের আনুগত্য এবং তার প্রতি যে প্রগাঢ় ভালোবাসা তারা দেখিয়েছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। একজন আমীরের আনুগত্য এবং তার প্রয়োজনীয়তা শুধু বর্ণনা করে বুঝিয়ে দেননি বরং তা বাস্তবায়নের যে ইতিহাস আমরা তাদের মধ্যে দেখতে পাই, বর্তমান আধুনিক পৃথিবীর নেতা নেত্রীরা তা কল্পনাও করতে পারে না।

তাদেরকে কোন আদেশ বা নিষেধের জন্য বাধ্য করার প্রয়োজন হতো না। বরং রাসূলের মুখ থেকে কোন বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা মাত্রই স্বতঃস্ফুর্তভাবে তা পালন করার জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়তো। তার আদেশের প্রতি যে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ছিল, তার তুলনায় দুনিয়ার অন্য সবকিছুর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তাদের নিকট ছিল নেহায়েত তুচ্ছ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, যথাযথ তালীম তারবিয়ত, অবিচল নীতি অবিরাম সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার ফলে দীনের এ আমানত এবং ওহীর এ গুরু দায়িত্ব পালনে তারা সক্ষম হন। আর আমাদের জন্য একটি চিরন্তন আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

রাসূল আল্লাহর দীনকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও মেধার পরিচয় দেন তা চিরদিন আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত :কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বর্গের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণ

কুরাইশরা যখন দেখতে পেল শুধু নির্যাতন এবং দমননীতি অবলম্বন করে মুসলমানদের থামানো সম্ভব নয় তখন তারা ভিন্ন কৌশল হিসেবে একটি আপোশ প্রস্তাব নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে আসে। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়াবী যে কোন প্রস্তাবে সম্মত করাতে প্রচেষ্টা চালায়। এদিকে রাসূলের চাচা আবু তালেব, যিনি তাকে দেখাশুনা করেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য সহযোগিতা এবং আশ্রয় দিয়ে থাকেন তাকেও একটি প্রস্তাব দেয়। দাবি জানায়, তিনি যেন মুহাম্মাদকে বিরত রাখেন এবং দীনের দাওয়াত বন্ধ করে দেন। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪১/৩]

কুরাইশের সরদার এবং নেতারা আবু তালেবের নিকট এসে বলল, ‘তুমি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত, বয়স্ক, মর্যাদাবান এবং সম্মানী ব্যক্তি। আমরা অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম তুমি তোমার ভাতিজাকে নিষেধ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হল তুমি নিষেধ করোনি। আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। সে আমাদের বাপ দাদা সম্পর্কে মন্তব্য করে। আমাদের প্রতি অশুভ আচরণ করে। আমাদের উপাস্যগুলোর প্রতি কটূক্তি করে। আমরা আর বিলম্ব করতে পারব না। হয়, তুমি তাকে বিরত রাখ অন্যথায় তুমি যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নাও। এতে হয় তোমরা ধ্বংস হবে অথবা আমরা ধ্বংস হব।’

আবু তালেব তাদের অসাধারণ হুমকি এবং সময় বেধে দেয়াকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন এবং তা আমলে নেয়ার জন্য চেষ্টা করেন।

তিনি তার স্বজাতি হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা করলেন। আর এই মুহূর্তে স্বজাতি হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তাদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার মত অনুকুল পরিবেশ তার ছিল না। তাই তিনি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং উভয় সংকটে জড়িয়ে পড়েন। একদিকে ইসলাম গ্রহণকে সহজে মেনে নিতে পারছেন না, অন্য দিকে তার ভাতিজার অপমান এবং তার উপর কোন প্রকার অন্যায় অবিচারকে সহ্য করতে পারছিলেন না।

নিরুপায় হয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‘হে ভাতিজা! নিজ বংশের লোকেরা আমার নিকট এসে এ ধরনের কথা বার্তা বলেছে। এ বলে তিনি তাদের কথার বিবরণ শোনালেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে । তারপর আবু তালেব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ‘তোমার সাধ্যের বাইরে কোন কাজ করা দরকর নাই। এমন কোন কাজের দায়িত্ব নিতে যাবে না, আমি যার সমাধান করতে পারব না। সুতরাং আমার পরামর্শ হল, তোমার স্বজাতি যে সব কাজ অপছন্দ করে তুমি সে সব কাজ হতে বিরত থাক।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চাচার কথায় একটুও কর্ণপাত করলেন না। তিনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত এবং তাওহীদের দাওয়াত অব্যাহত রাখলেন।

আল্লাহর দিকে আহবান করতে গিয়ে কারো কোন কথায় গুরুত্ব দিতে তিনি সম্পূর্ণ নারাজ। কারণ, তিনি জানেন তিনি হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি বিশ্বাস করেন, তার এ দীনকে আল্লাহই সাহায্য করবেন। তার এ দাওয়াত আল্লাহ তাআলা একটি পর্যায়ে অবশ্যই পৌঁছাবেন। কিছু দিন যেতে না যেতে আবু তালেব দেখতে পেল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নীতি আদর্শের উপর অটল, অবিচল এবং কুরাইশদের দাবী অনুসারে তাওহীদের দাওয়াত তিনি কখনো ছাড়বেন না।

আবু তালেব রাসূলুল্লাহ সা. কে বললেন, ‘আমি কসম করে বলছি, তারা তোমার নিকট একত্রিত হয়ে আসতে পারবে না, যতদিন না আমি মাটিতে প্রোথিত হবো এবং মাটিকে বালিশ বানাবো। তুমি নির্ভয়ে তোমার কাজ চালিয়ে যাও আর সু সংবাদ গ্রহণ কর। আর এ সুসংবাদ দ্বারা তোমার চোখকে শীতল কর।’ [সীরাতে ইবনে হিশাম: ২৭৮/১ আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৪২/৩]

তৃতীয় দৃষ্টান্ত: উতবা বিন রবিয়ার ঘটনা।

হামজা বিন আব্দুল মুত্তালেব রা. এবং উমার বিন খাত্তাব রা. এ দুজনের ইসলাম গ্রহণের পর মুশরিকদের আনন্দ ঘন আকাশে ফাটল ধরলো। তাদের দুশ্চিন্তার আর অন্ত রইলো না।

এ ছাড়াও মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়া, প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা, ইসলামের বড় বড় দুশমনদের বিরোধিতা এবং তাদের জুলুম নির্যাতনের কোন পরোয়া না করা, ইত্যাদি বিষয় তাদের ঘুমকে হারাম করে দিল। তাদের মনের আশঙ্কা, ভয়ভীতি এবং দুশ্চিন্তা আরো বৃদ্ধি পেল।

তারপর তারা উতবা বিন রাবিয়াকে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পাঠালো। তাদের ধারণা এর কোন একটি প্রস্তাবে তাকে রাজি করানো যেতে পারে।

তাদের প্রস্তাব নিয়ে উতবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, ‘হে আমার ভাতিজা! তুমি জান, তুমি আমাদের নিকট একজন উচচ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তোমার বংশ মর্যাদা আরবের সমগ্র মানুষের চাইতে বেশি সম্ভ্রান্ত। কিন্তু তুমি তোমার স্বজাতির নিকট এমন একটি বিষয় নিয়ে উপস্থিত হয়েছো যা আমরা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। কারণ, তুমি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করছো। আমাদের স্বপ্নকে ধুলিস্যাত করে দিচ্ছো। এবং আমাদের উপাস্যগুলোকে কটাক্ষ করছো। আর আমাদের বাপ দাদাদের হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্যে আঘাত হানছো।

সুতরাং তোমাকে কয়েকটি প্রস্তাব দিচ্ছি। মনোযোগ দিয়ে শুন। আশা করি যে কোন একটি প্রস্তাবে তুমি সম্মতি জ্ঞাপন করবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিনীত ভাবে বললেন, ‘হে আবুল ওয়ালিদ! আপনার প্রস্তাবগুলো তুলে ধরুন! তারপর সে বলল, ‘যদি তোমার এ মিশনের উদ্দেশ্য টাকা পয়সা, অর্থ প্রাচুর্য হয়ে থাকে, তাহলে তোমাকে আমরা এত পরিমাণ ধন সম্পদের মালিক বানাব তাতে তুমি মক্কার মধ্যে সবার চেয়ে বেশি সম্পদশালী হবে। আর যদি তুমি নেতৃত্ব চাও, তোমাকে যাবতীয় সব কিছুর নেতা বানিয়ে দেব, তোমাকে ছাড়া একটি পাতাও তার জায়গা হতে সরবে না। আর যদি রাজত্ব চাও, তাহলে তোমাকে পুরো রাজত্ব দিয়ে দেব। আর যদি এমন হয় যে, তুমি যে সব কথা বলছ, তা কোন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে; কারণ, অনেক সময় এমন হয়, তোমার মাথা হতে বিষয়টি কোন ভাবে নামানো যাচ্ছে না। তাহলে আমরা তোমাকে উচ্চ চিকিৎসার জন্য যত অর্থের প্রয়োজন, তার সবই জোগান দেব। হতে পারে অনেক সময় মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি কোন খেয়াল বা কল্পনার কারণে লোপ পায়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব মনোযোগ দিয়ে উতবার কথা শুনতে লাগলেন। তারপর যখন কথা শেষ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার কথা শেষ হয়েছে হে আবুল ওয়ালিদ?’ বলল, ‘হ্যাঁ।’

তা হলে এবার আমার থেকে শোন! তারপর সে বলল, ‘আচ্ছা বল।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শোনালেন-

حم ﴿1﴾ تَنْزِيلٌ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ﴿2﴾ كِتَابٌ فُصِّلَتْ آَيَاتُهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ﴿3﴾ بَشِيرًا وَنَذِيرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ ﴿4﴾ وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ وَفِي آَذَانِنَا وَقْرٌ وَمِنْ بَيْنِنَا وَبَيْنِكَ حِجَابٌ فَاعْمَلْ إِنَّنَا عَامِلُونَ ﴿5﴾

‘‘হা-মীম। রাহমান রাহিম এর পক্ষ হতে অবতীর্ণ। এটা এমন একটি কিতাব, যাতে তাঁর নিদর্শন সমূহের ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে থাকে, আরবী কুরআন এমন জাতির জন্য যারা জানে। যা সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী। কিন্তু অধিকাংশ লোক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সুতরাং তারা শুনবে না। আর তারা বলে, তুমি যে দিকে আহবান করো সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আচ্ছাদিত আর আমাদের কানে ছিপি লাগানো এবং তোমার মাঝে আর আমার মাঝে রয়েছে পর্দা। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর আর আমরা আমাদের কাজ করি।’’ [সুরা ফুসসিলাত: ১-৫]’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতগুলো পড়তে থাকেন। উতবা যখন কুরআনের আয়াত শুনতে পেলো তখন সে কান খাড়া করে দিলো। এবং তার দু হাত ঘাড়ের উপর রেখে হেলান দিয়ে কুরআন শুনতে আরম্ভ করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সেজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেন তিনি সেজদা করলেন উতবাও তার সাথে সেজদা করল। তারপর তিনি বললেন, ‘হে আবুল ওয়ালিদ! ‘তুমি আমার কথা শুনেছো, তুমি এখন ফিরে যেতে পার।’ [আল-বিদায়া ওয়ান-নিহয়া : ৬২/৩ আর রাহিকুল মাখতুম: ১০৩]

অপর এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন পড়তে পড়তে যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌছলেন

فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ

‘‘যদি তারা বিমুখ হয়, তুমি তাদের বল আমি তোমাদের ভয়ংকর শাস্তির ভয় দেখাচ্ছি যে ভয়ংকর শাস্তি সামুদ এবং আদ জাতির অনুরূপ।’’ [সুরা ফুসসিলাত: ১৩] তখন উতবা বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সে তার হাতকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখে রেখে বলল, ‘আমি আল্লাহর কসম দিচ্ছি এবং আত্মীয়তার কসম দিচ্ছি, তুমি এ দাওয়াত হতে বিরত থাক।’ এ কথা বলে সে দৌড়ে তার নিজ গোত্রের নিকট চলে গেল। এমনভাবে দৌড় দিল, যেন বিদ্যুৎ তার মাথার উপর পড়ছিলো। গিয়ে কুরাইশদের পরামর্শ দিল, তারা যেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামায় এবং তাকে তার আপন অবস্থায় কাজ করতে ছেড়ে দেয়। সে বার বার তাদের বুঝানোর জন্য চেষ্টা চালায়। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৬২/৩]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শুনানোর জন্য এ আয়াতকে নির্বাচন করেন। কারণ, তিনি যাতে উতবাকে বুঝাতে সক্ষম হন, রিসালাত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাকীকত কি হতে পারে। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের জন্য এমন এক কিতাব নিয়ে এসেছেন, যদ্বারা তিনি তাদের পথভ্রষ্টতা হতে বের করে সৎপথে পরিচালনা করেন। তাদের তিনি অন্ধকার হতে বের করে আলোর পথ দেখান। তাদের তিনি জাহান্নাম হতে বাঁচান এবং জান্নাতের সন্ধান দেন। আর তিনি নিজেই সকলের পূর্বে এর ধারক বাহক। তাই এ দীনের পরিপূর্ণ বিশ্বাস সর্বপ্রথম তাকেই করতে হবে এবং সর্বপ্রথম তাকেই তার বিধান সম্পর্কে জানতে হবে।

আল্লাহ যখন সমগ্র মানুষকে কোন নির্দেশ দেন, তা মানার বিষয়ে সর্ব প্রথম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই সর্বাধিক বিবেচ্য ব্যক্তি। তিনি কোন রাজত্ব চান না এবং কোন টাকা পয়সা চান না। এবং কোন ইজ্জত-সম্মান চান না। আল্লাহ তাআলা তাকে সব কিছুর সুযোগ দেন এবং তিনি তা হতে নিজেকে বিরত রাখেন। ক্ষণস্থায়ী জীবনের মালামালের প্রতি লোভ-লালসা বলতে কিছুই তার ছিল না ।

কারণ, তিনি তার দাওয়াতে সত্যবাদী আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ঐকান্তিক। [ফিকহুস সীরাত: গাজালীর :১১৩]

তার এ অবস্থান, তাকে আল্লাহর পক্ষ হতে যে প্রজ্ঞা ও পরম ধৈর্য দেয়া হয়েছে, তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তিনি তার দাওয়াত এবং মিশনকে সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কোন ধন-সম্পদ অর্থ-প্রাচুর্য নারী-বাড়ী, গাড়ী এবং রাজত্ব কোন কিছুকেই তার বিনিময় প্রাধান্য দেননি এবং স্থান কাল পাত্র বেধে এমন কথা পেশ করলেন যা তখনকার সময়ের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। মনে রাখতে হবে একেই বলে হিকমত এবং সর্বোত্তম আদর্শ।

চতুর্থ দৃষ্টান্ত: আবু জাহেলের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আচরণ

কাফেররা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেয়াসহ ইসলামে প্রবেশকারী মুসলমানদের উপর নির্যাতনের সাথে সাথে ইসলামের জাগরণকে ঠেকাতে সব ধরনের কলা কৌশল এবং অপপ্রচার চালিয়ে যাবে।

তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন ভাবে অপবাদ দিতে লাগল, তারা তাকে পাগল, যাদুকর, গণক, মিথ্যুক ইত্যাদি বলে গালি গালাজ করতে আরম্ভ করে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অটল অবিচল। তাদের কথায় কোন প্রকার কর্ণপাত করেননি। আল্লাহর রহমত এবং আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার আশায় সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের পক্ষ হতে এমন কষ্টের সম্মুখীন হন যে, কোন ঈমানদার এত কষ্টের সম্মুখীন হননি। আবু জাহেল তার মাথাকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে এবং তাকে দুনিয়া থেকে চির বিদায় দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন এবং আবু জাহেলের ষড়যন্ত্রকে তারই বিপক্ষে প্রয়োগ করেন।

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু জাহেল তার সাথীদের জিজ্ঞাসা করল, ‘মুহাম্মাদ কি তোমাদের সম্মুখে চেহারা মাটিতে মেশায়?’ বলা হল, ‘অবশ্যই, ‘সে আমাদের সম্মুখে মাথা মাটিতে ঝুঁকায়।’ এ কথা শোনে সে বলল, ‘লাত এবং উযযার কসম করে বলছি, আমি যদি তাকে মাটিতে মাথা ঝোঁকানো অবস্থায় দেখতে পাই, তার গর্দানকে পদপৃষ্ঠ করব অথবা তার চেহারাকে ধুলা বালিতে মিশিয়ে দেব।’ তারপর একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় করতে ছিলেন। দেখতে পেয়ে আবু জাহেল তার গর্দান পদপৃষ্টর করার জন্য তার দিকে অগ্রসর হল। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে এল, হঠাৎ সে পিছু হঠতে আরম্ভ করল এবং দু-হাত দিয়ে নিজেকে আত্মরক্ষা করতে আরম্ভ করল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তোমার কি হয়েছে, তুমি এমন করছো কেন?’ তখন সে উত্তর দিল, ‘আমি আমার এবং তার মাঝে আগুনের একটি পরিখা দেখতে পাই এবং তাতে অসংখ্য ডানা দেখতে পাই।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যদি সে আমার কাছে আসতো, তাহলে ফেরেশতারা তাকে টুকরা টুকরা করে ফেলতো।’

তারপর এ ঘটনার ইঙ্গিত দিয়ে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযেল করেন -كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى থেকে সুরা আলাকের শেষ পর্যন্ত। [সহীহ মুসলিম : ২৭৯৭]

আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঐ দুর্বৃত্ত এবং অন্যান্য দুর্বৃত্তের হাত হতে রক্ষা করেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল প্রকার কষ্ট, জুলুম নির্যাতন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নীরবে সয়ে যান এবং তার জান, মাল ও সময় আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করেন।

পঞ্চম দৃষ্টান্তঃ রাসূলের পিঠে উটের ভুঁড়ি রাখা

এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ রা. বর্ণনা করেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহর পাশে নামাজ আদায় করতে ছিলেন। আবু জাহেল এবং তার সাথি- সঙ্গীরা এক সাথে বসা ছিল। বিগত দিন একটি উট জবেহ করা হয়েছিল। আবু জাহেল বলল, ‘কে উটের ভুঁড়িটি নিয়ে আসবে এবং মুহাম্মাদ যখন সেজদা করবে তার পিঠের উপর রেখে দেবে।’ তারপর তার দলের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে ব্যক্তি, সে উষ্ট্রের ভুঁড়িটি নিয়ে আসল [লোকটির নাম উকবা বিন আবি মুয়াইত।] এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদা করলে তার দুই কাঁধের উপর রেখে তারা হাসাহাসি করতে আরম্ভ করে। তারা হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ডলে পড়তো। আমি পুরো বিষয়টি দেখতে পেলাম, যদি কোন ক্ষমতা থাকতো তা হলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পৃষ্ট হতে তা সরিয়ে নিতাম! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজদায় পড়ে রইলেন। কোনভাবে মাথা উঠাতে পারছিলেন না। এক লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এ দৃশ্য দেখে ফাতেমা রা. কে সংবাদ দেন। তিনি খবর শোনামাত্র দৌড়ে আসেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথা থেকে উটের ভুঁড়ি নামালেন। তারপর তাদের গালি গালাজ করতে লাগলেন। নামাজ শেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চ আওয়াজে তাদের জন্য বদ দুআ করতে আরম্ভ করেন। আর তার অভ্যাস ছিল, যখন দুআ করতেন, তিন বার দুআ করতেন। আবার যদি কোন কিছু চাইতেন, তিন বার চাইতেন। রাসূল বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের শাস্তি দাও।’ তিনবার বলেন। যখন তারা রাসূল এর বদ দুআর আওয়াজ শুনতে পেল, তাদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। এবং তারা তার দুআকে ভয় করতে আরম্ভ করে। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নাম ধরে ধরে বদ দুআ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আবু জাহেল ইবনে হিশামকে ধ্বংস কর, উতবা বিন রাবিয়াকে ধ্বংস কর, শাইবা বিন রাবিয়া, ওয়ালিদ বিন উতবা, উমাইয়া বিন খালফ, উকবা বিন আবি মুয়িতকে ধ্বংস কর।’ এভাবে তিনি সাত জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন আমি সপ্তম ব্যক্তির নাম ভুলে যাই।

আল্লাহর কসম করে বলছি, যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যের পয়গাম নিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন, তিনি যাদের নাম নেন, তাদের সবাইকে বদর যুদ্ধের দিন দিন অধঃমুখে হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। তারপর তাদের বদর গর্তে নিক্ষেপ করা হল। [সহীহ আল - বুখারী ২৪০, সহীহ সহীহ মুসলিম : ১৭৯৪]

ষষ্ঠ দৃষ্টান্ত : মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সবচেয়ে কঠিন যে আচরণ করে তার বর্ণনা

সহীহ আল-বুখারীতে [সহীহ আল - বুখারী ৩৮৫৬] উরওয়াহ বিন যুবায়ের হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আসকে বলি, মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সবচেয়ে খারাপ যে আচরণ করেছে আপনি আমাকে তার বিবরণ দিন। তিনি বলেন, ‘একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহর পাশে নামাজ আদায় করতে ছিলেন এ অবস্থায় উকবা বিন আবি মুয়াইত এসে রাসুলের গলা চেপে ধরে এবং তার শরীরের কাপড়কে তার গলায় পেঁছিয়ে দেয়, তারপর সে খুব জোরে গলা চাপা দিলো, আবু বকর রা. এসে তার গলাও চেপে ধরলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাকে দুরে সরিয়ে দিলেন এবং বললেন,

أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ

‘তোমরা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে যে বলে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ ! এবং তিনি তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে প্রমাণসমূহ নিয়ে এসেছেন?’ [সুরা গাফের : ২৮]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীদের উপর মুশরিকদের নির্যাতনের আর কোন অন্ত রইল না। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে অনেকেই সাহায্য চাইলেন এবং আল্লাহর কাছে দুআ প্রার্থনা করতে এবং তাঁর সাহায্য কামনা করতে বলেন।

তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সাহায্য লাভে প্রত্যয়ী ছিলেন এবং আল্লাহর মদদ তার পক্ষেই হবে এ বিশ্বাস তার পুরোপুরি ছিল। কারণ, তিনি জানতেন শেষ শুভপরিণতি একমাত্র মুত্তাকীদের পক্ষেই হয়ে থাকে এবং তারাই পরিশেষে সফলকাম হয়।

খাববাব ইবনুল আরত রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি চাদরকে বালিশ বানিয়ে কাবা শরীফের ছায়ায় শুয়ে আছেন এ অবস্থায় তার নিকট গিয়ে অভিযোগের স্বরে আমরা বললাম, ‘মুশরিকদের নির্যাতনে আমরা অসহায় হয়ে পড়ছি, আপনি কি আমাদের জন্য বিজয় প্রার্থনা করবেন না? আমাদের জন্য দুআ করবেন না?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘তোমাদের পূর্বের লোকদের নির্যাতনের অবস্থা ছিল : তাদের কোন এক লোককে ধরে আনা হতো এবং মাটিতে তার জন্য কূপ খনন করে তাকে এ কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হতো। অথবা একটি কাঠ কাটার করাত দিয়ে মাথার উপর হতে নীচ পর্যন্ত কেটে দুই টুকরা করা হত এবং তাদের শরীরকে লোহার চিরুনি দ্বারা চিরুনি করা হতো। শরীরের হাড় ও রগ হতে গোশ্তকে আলাদা করে ফেলতো, তারপরও তাদের আল্লাহর ধর্ম থেকে বিন্দু পরিমাণও দূরে সরানো যেত না । আল্লাহর কসম করে বলছি, আল্লাহ তার দীনকে পরিপূর্ণতা দান করবেন। ফলে এমন একটি সময় আসবে যখন একজন লোক ‘সানাআ’ হতে ‘হাদ্রামাউত’ পর্যন্ত এমন নিরাপদে ভ্রমণ করবে যে, সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। ছাগলের জন্য বাঘকে হুমকি মনে করবে না। কিন্তু তোমরা অতি তাড়াতাড়ি চাচ্ছো।’ [সহীহ আল - বুখারী : ৩৬১২]

মোট কথা, মুসলমানদের এবং বিশেষ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর তারা বিরামহীন নির্যাতন চালাতো এবং তাদের সর্ব প্রকার কষ্ট, যন্ত্রনা, মুসলমানদের সহ্য করতে হতো। কারণ, তাদের একমাত্র অপরাধ, তারা আল্লাহর দীনকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিয়েছে। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। হক ও সত্যের উপর অটল ও অবিচল থেকেছে। জাহেলিয়্যাতকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের কুসংস্কার এবং প্রতিমা পূজাকে বর্জন করেছে। এ ছাড়া তাদের আর কী অপরাধ ছিল?

সপ্তম দৃষ্টান্ত : আবু লাহাবের স্ত্রীর ঘটনা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের পক্ষ হতে কঠিন নির্যাতনের সম্মুখীন হন ।

এমনকি তাকে এবং তার আনীত দীনকে অপমান করার উদ্দেশ্যে তার নামের মধ্যে পর্যন্ত বিকৃতি আনতে কোন প্রকার কুণ্ঠা বোধ করেনি। তাদের শক্রতা এবং বিরোধীতা ধর্মীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে তা তার ব্যক্তি পর্যায়েও নিয়ে আসে।

কুরাইশরা রাসুলের প্রতি তাদের অযৌক্তিক দুশমনী ও বাড়াবাড়িতে সীমা ছড়িয়ে যায়। যে নাম দ্বারা তার প্রশংসা বুঝায় তা পরিবর্তন করে, তার জন্য একটি বিপরীত নাম রাখে। যার অর্থ প্রকৃত নামের সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা ‘মুজাম্মাম’ বলে তার নামকরণ করে। আর যখন তার নাম আলোচনা করত, বলত : ‘মুজাম্মাম এ কাজ করেছে এবং মুজাম্মাম এখানে এসেছে।’ অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রসিদ্ধ নাম হলো মুহাম্মাদ। মুজাম্মাম বলে কোন নাম তার নেই।

কিন্তু তার পরিণতিতে দেখা গেল, যে উদ্দেশ্যে এসব অপকর্মের আশ্রয় নিল, তা তাদের জন্য হিতে বিপরীত আকার ধারণ করল। [ফতহুল বারি: ৫৫৮/৬]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এতে তোমরা আশ্চর্য বোধ কর না যে, আল্লাহ কীভাবে আমার থেকে কুরাইশদের গালি ফিরিয়ে নেন এবং তাদের অভিশাপ দেন। তারা মুজম্মামকে গালি দিত এবং মুজাম্মামকে অভিশাপ করতো আর আমিতো মুজাম্মাম নই, আমি মুহাম্মাদ।’ [সহীহ আল - বুখারী ৩৫৩৩]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাঁচটি নাম ছিল [সহীহ আল - বুখারী ৩৫৩২] তার একটি নামও মুজাম্মাম ছিল না ।

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল তার সম্পর্কে এবং তার স্বামী সম্পর্কে কুরআনে অবতীর্ণ চিরন্তন বাণীর কথা শুনে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল, রাসূল তখন কাবা গৃহের পাশে বসা ছিলেন। তার সাথে ছিল আবু বকর রা.। আর আবু লাহাবের স্ত্রীর হাতে এক মুষ্টি পাথর ছিল। সে যখন তাদের নিকটে এসে পৌঁছলো আল্লাহ তার দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নিলেন। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আর দেখতে পেল না। শুধু মাত্র আবু বকরকে দেখতে পেল। তার উপর পর চড়াও হয়ে বলল, ‘হে আবু বকর তোমার সাথি কোথায়? শুনতে পেলাম সে আমার দুর্নাম করে, শপথ করে বলছি, যদি তাকে পেতাম, আমি তার মুখে এ পাথরগুলো ছুড়ে মারতাম।’ মনে রেখো, আমি একজন কবি এবং তার বদনাম করতে আমিও কার্পণ্য করব না।

তারপর সে এ কাব্যাংশ আবৃতি করেঃ

‘আমি মুজাম্মামের নাফরমানি করি, তার নির্দেশের অমান্য করি এবং তার দীনকে ঘৃণা করি।’ [সীরাতে ইবনে হিশাম: ৫২৩/৪]

মুশরিকরা রাসূল এবং তার অনুসারীদের কষ্ট দেয়া অব্যাহত রাখল এবং মুসলমানদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পেতে লাগল তাদের নির্যাতনের মাত্রা এবং মুসলমানদের প্রতি তাদের হিংসা বিদ্বেষ তত প্রকট আকার ধারণ করল। তারা তাদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি এবং বদনাম রটাতে অপচেষ্টা চালাত।

তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুসলমানদের দুরাবস্থা দেখতে পান এবং তিনি নিজেই একমাত্র আল্লাহর হেফাজতে বেচে আছেন এবং চাচা আবু তালেব তাকে সহযোগিতা করলেও সে মুসলমানদের কোন উপকার করতে পারছে না তাদের উপর যে ধরণের নির্যাতন চলছে তা সে কোন ভাবেই ঠেকাতে পারে না। এভাবে মুসলমানদের দিনকাল অতিবাহিত হচ্ছিল, এরই মধ্যে অনেকে মারা যেত আবার কেউ কেউ অন্ধ হয়ে যেত আবার কেউ অর্ধাঙ্গ আবার কেউ বিকলাঙ্গ হয়ে যেত।

বাধ্য হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদের আবিসিনিয়ায় (ইথিওপিয়া) হিজরত করার অনুমতি দেন। ফলে উসমান বিন আফ্ফানের নেতৃত্বে বার জন পুরুষ এবং চার জন মহিলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তারা সাগর তীরে পৌছলে আল্লাহ তাদের জন্য দুটি নৌকার ব্যবস্থা করেন। তা দ্বার তারা তাদের গন্তব্য আবিসিনিয়ায় পৌছতে সক্ষম হন। তখন নবুওয়তের পঞ্চম বছরের রজব মাস।

এদিকে কুরাইশরা তাদের সন্ধানে ঘর থেকে বের হলো এবং সাগরের তীর পর্যন্ত গিয়ে উপস্থিত হলো। কিন্তু তাদেরই দুর্ভাগ্য সেখানে গিয়ে তারা কাউকে পায়নি। তারপর তারা সেখান থেকে ক্রুদ্ধ হয়ে মক্কায় ফিরে আসে।

পরবর্তীতে আবিসিনিয়ায় একটি মিথ্যা সংবাদ পৌছলো যে, কুরাইশরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের অনেকেই মুসলমান হয়ে গেছে। তাই তারা পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন।

কিন্তু তারা মক্কায় ফিরে এসে যখন জানতে পারেন এ খবরটা ছিল মিথ্যা-অপপ্রচার এবং এও জানতে পারেন, মুশরিকরা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন মুসলমানদের আরো বেশি কষ্ট দেয়। তাই তাদের কেউ কেউ অন্যের আশ্রয় নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন আবার কেউ গোপনে মক্কায় প্রবেশ করেন। আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ রা. আশ্রয় প্রার্থনা করে মক্কায় প্রবেশ করেন।

এ ঘটনার পর হতে মুসলমানদের উপর নির্যাতন আরো বেড়ে যায় এবং আরো কঠিন অত্যাচারের সম্মুখীন হন ।

তাদের জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার তাদের আবিসিনিয়ায় হিজরত করার অনুমতি দেন। দ্বিতীয়বার যারা হিজরত করেন তাদের সংখ্যা হল আশি জন। তাদের মধ্যে ছিলেন আম্মার বিন ইয়াসার এবং নয়জন মহিলা। তারা সে দেশে নাজ্জাশী বাদশার আশীর্বাদে নিরাপদে বসবাস করতে থাকলেন। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে কুরাইশরা যখন জানতে পারল তখন তারা বিভিন্ন প্রকার উপঢৌকন নিয়ে নাজ্জাশী বাদশার নিকট দূত প্রেরণ করে। যেন সে আশ্রিত মুসলমানদের তার দেশ থেকে বের করে দেয় ও আবার মুশরিকদের নিকট ফেরত পাঠায়। [যাদুল মায়াদ:২৩,৩৬,৩৮/৩ , আর রাহীকুল মাখতুমপ:৮৯]

অষ্টম দৃষ্টান্ত : উপত্যকায় রাসূলের বন্দি জীবন

যখন কুরাইশরা ইসলামের প্রচার প্রসার, ব্যাপকভাবে মানুষের ইসলাম গ্রহণ, ইথিওপিয়ায় মুহাজিরদের সম্মান ও নিরাপদ আশ্রয় ও কুরাইশ প্রতিনিধি দল নিরাশ হয়ে ফিরে আসার ব্যাপারগুলো অবলোকন করল, তখন ইসলামের অনুসারীদের প্রতি তাদের ক্রোধ বেড়ে গেল এবং তারা বনী হাশেম, বনী আব্দুল মুত্তালিব ও বনী আবদে মানাফের বিরুদ্ধে পরস্পর চুক্তি সম্পাদন করতে একত্র হল। তারা তাদের সাথে লেনদেন করবে না। পরস্পর বিবাহ শাদী করবে না। কথা বার্তা বলবে না ও উঠা বসা করবে না। যাকে বলা যায় অবরোধ বা বয়কট। এ অবরোধ চলতে থাকবে যতক্ষণ না তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের হাতে সমর্পণ করবে। অতঃপর একটি চুক্তিনামা লিখে কাবার ছাদে ঝুলিয়ে দিল।

ফলে আবু লাহাব ব্যতীত বনী হাশেম ও বনী আব্দুল মুত্তালিবের কাফের মুসলিম সকলে এক পক্ষ অবলম্বন করল। তারা মুসলিমদের সাথে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। আবু লাহাব এদের গোত্রভুক্ত হওয়া সত্বেও সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, বনী হাশেম ও বনী আব্দুল মুত্তালিবের বিরুদ্ধে কুরাইশদের সমর্থক থেকে গেল।

নবুওয়তের সপ্তম বছরে মুহাররম মাসের শুরুর দিকের কোন এক রাত্রিতে আবু তালেব ঘাঁটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবরুদ্ধ করা হল। তারা সেখানে আবদ্ধ সংকীর্ণতা ও খাদ্য সমাগ্রীর অভাব এবং বিচ্ছিন্নাবস্থায় তিন বছর যাবৎ অবরোধের দিনগুলো অতিবাহিত করলেন। এমনি হয়েছিল যে, ঘাটির আড়াল থেকে ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের কান্নাকাটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুক্তিপত্রের সম্পর্কে অবহিত করলেন যে, একটি উঁই পোকা পাঠিয়ে জোর, জুলুম, আত্মীয়তা ছিন্নের চুক্তির সব লেখা খাইয়ে দিয়েছেন। শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার নামটি অবশিষ্ট আছে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে সকলকে সংবাদ দিলেন। ফলে একজন কুরাইশদের কাছে গেল এবং সংবাদ দিল যে, মুহাম্মাদ চুক্তিপত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বলছে। যদি সে এতে মিথ্যাবাদী হয় তাহলে আমরা তাকে তোমাদের হাতে দিয়ে দেব। আর যদি সত্যবাদী হয় তাহলে তোমাদের এই অবরোধ ও বয়কট থেকে ফিরে আসতে হবে। তারা বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ।’ অতঃপর তারা কাগজের টুকরাটি নামিয়ে আনল। যখন তারা এই বিষয়টি রাসূলের কথামত দেখতে পেল তখন তাদের কুফরী আরো বেড়ে গেল। নবুয়তের দশম বছরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথীরা অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে থেকে বের হয়ে আসলেন। এর ছয় মাস পর আবু তালেব মৃত্যুবরণ করল। তার মৃত্যুর তিন দিন পর খাদিজা রা. ইন্তেকাল করেন। [যাদুল মায়াদ:৩০/৩ ইবনে হিশাম:৩৭১/১...] কেউ কেউ অন্য মতও প্রকাশ করেছেন।

বয়কট ও অবরোধ অবসানের পর অল্প দিনের ব্যবধানে আবু তালেব ও খাদিজার ইন্তেকাল হয়ে গেল। ফলে রাসূলের উপর তার সম্প্রদায়ের নির্বোধরা দুঃসাহসিকতার সাথে, প্রকাশ্যে, আরো বেশি উৎপীড়ন- নিপীড়ন করতে থাকল। যার কারণে তার দুঃচিন্তা বেড়ে গেল এবং তাদের থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন। এবং তিনি তায়েফে চলে গেলেন এ আশায় যে, তায়েফবাসীরা তার ডাকে সাড়া দেবে। তাকে আশ্রয় দেবে। তাকে তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে। সেখানেও কেউ তাকে আশ্রয় দেয়নি, কেউ সাহায্য করেনি। এবং তারা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছে এবং তার সম্প্রদায়ে চেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে। [যাদুল মায়াদ:৩১/৩]

নবম দৃষ্টান্ত : তায়েফ বাসীর সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

নবুয়তের দশম বছরে শাওয়াল মাসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ বাসীর উদ্দেশ্যে বের হলেন। তার ধারণা ছিল যে, তিনি সকীফ গোত্রে তার দাওয়াতের প্রতি সাড়া ও সাহায্য পাবেন। তার সাথে ছিল আজাদ কৃত গোলাম যায়েদ বিন হারেসা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পথিমধ্যে যে গোত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেন তাদের ইসলামের দাওয়াত দেন। তবে তাদের কেউ তার ডাকে সাড়া দেয়নি।

যখন তিনি তায়েফে পৌঁছলেন তখন সেখানকার নেতাদের নিয়ে বসলেন এবং ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তার দাওয়াতে তারা কোন ভাল উত্তর দেয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে দশদিন অবস্থান করেন। এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় লোকদের কাছে গিয়ে ইসলামের কথা বলেন । তাতে ও ভাল কোন সাড়া পাননি। বরং তারা বলল, ‘তুমি আমাদের দেশ থেকে বের হও! আমরা তোমার দাওয়াত গ্রহণ করতে পারলাম না।’ তারা তাদের নির্বোধ ও বাচ্চাদেরকে তার প্রতি ক্ষেপিয়ে তার পিছনে লেলিয়ে দিল। অতঃপর যখন তিনি বের হতে ইচ্ছা করলেন তখন নির্বোধরা তার পিছু ধরল। তারা দু সারি হয়ে তাকে পাথর নিক্ষেপ করল। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করল এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পাথর নিক্ষেপ করে তার জুতাদ্বয় রক্তে রঞ্জিত করে দিল। আর যায়েদ বিন হারেসা নিজেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করতে ছিলেন। যার কারণে তার মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফ থেকে দুশ্চিন্তা ও ভগ্ন হৃদয় নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় আসার পথে আল্লাহ তাআলা পাহাড়-পর্বতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতাসহ জিবরীলকে পাঠান । সে তার কাছে অনুমতি চাচ্ছিল যে, দুটি পাহাড় যা তায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত তা মক্কাবাসীর উপর নিক্ষেপ করতে। [যাদুল মায়াদ: ৩১/৩, আর- রাহিকুল মাখতুম:১২২]

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে কি উহুদ যুদ্ধের দিন অপেক্ষা আরো কোন ভয়ানক দিন এসেছে?’ তিনি বললেন যে, আমি তোমার সম্প্রদায় থেকে যে কষ্ট পাওয়ার তাতো পেয়েছি। তবে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আকাবার দিন। যখন আমি ইবনে আবদে ইয়ালীল বিন আবদে কিলালের কাছে দাওয়াত পেশ করলাম তারা আমার আহবানে সাড়া না দেয়ায় আমি চিন্তিত বেহুশ অবস্থায় চলে এলাম। ‘কারনুস শাআলব’ নামক স্থানে এসে সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মাথা উত্তোলন করি তখন আমি একটি খন্ডমেঘ দেখতে পাই, যা আমাকে ছায়া দিচ্ছে। মেঘের দিকে তাকালে জিবরীলকে দেখি। অতঃপর সে আমাকে ডেকে বলল, ‘আল্লাহ তাআলা আপনার সম্প্রদায়ের কথা ও তাদের উত্তর শুনেছেন।’

তিনি আপনার নিকট পর্বতমালার দায়িত্বে নিয়েজিত ফেরেশ্তাকে পাঠিয়েছেন। আপনি তাদের ব্যাপারে যে শাস্তি চান তাকে নির্দেশ করতে পারেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পর্বতমালার দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশ্তা আমাকে আওয়াজ দিল এবং আমাকে সালাম দিল। অতঃপর বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনার জাতি আপনাকে যা বলেছে আল্লাহ তাআলা তা শুনেছেন। আর আমিতো পর্বতমালার দায়িত্বে নিয়েজিত ফেরেশ্তা। আমার প্রভু আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে আপনার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। যদি আপনি চান তাহলে দু পর্বতের মাঝে তাদেরকে মিশিয়ে দেব।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘বরং আমি চাই যে, আল্লাহ তাআলা তাদের পরবর্তী বংশধর থেকে এমন প্রজন্ম বের করবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে যার কোন শরীক নাই। এবং তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না।’

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ উত্তরের মধ্যে তার অনন্য ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। এবং তার যে মহান চরিত্র ছিল, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করেছিলেন, তাও প্রকাশ পেয়েছে।

এর মাধ্যমে তার জাতির প্রতি তার দয়া, ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। আর এটাই আল্লাহ তাআলার এ বাণীর সাথে মিলে যায়ঃ

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِك ( سورة آل عمران 159)

‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, তুমি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত হয়ে গেছ। আর তুমি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয় হতে, তবে নিশ্চয়ই তারা তোমার সংসর্গ হতে ফিরে যেত।’ [সূরা আলে ইমরান ২৫৩]

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ﴿ سورة الأنبياء 107﴾

‘আমি তো তোমাকে সৃষ্টিকুলের প্রতি শুধু রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি।’ [সূরা আল-আম্বিয়া ১০৭]

আল্লাহ তাআলার অগণিত সালাত ও সালাম তার উপর বর্ষিত হউক।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘নাখলা’ নামক স্থানে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করলেন। এবং মক্কায় ফিরে আসতে সংকল্প করলেন। ইসলাম ও আল্লাহর শ্বাশত রেসালাত পেশ করার ব্যাপারে তার প্রথম পরিকল্পনা নতুন করে আরম্ভ করার ইচ্ছা করলেন নতুন উদ্যমে। তখনই যায়েদ বিন হারেসা রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ‘তাদের কাছে নতুন করে কিভাবে যাবেন? তারা তো আপনাকে বের করে দিয়েছে।’ যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে যায়েদ! তুমি যা দেখতে পাচ্ছো, আল্লাহ তাআলা এর থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা দেখিয়ে দিবেন। আল্লাহ তার দীনের সাহায্য করবেন ও তার নবীকে বিজয় দান করবেন।

এরপর চলতে চলতে মক্কায় পৌঁছলেন। একজনকে ‘খুজাআ’ গোত্রের মুতয়েম বিন আদীর নিকট তার আশ্রয় প্রার্থনা করে পাঠালেন। মুতয়েম সাড়া দিলেন। তার সন্তান ও গোত্রের লোকদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা যুদ্ধাস্ত্র ধর এবং কাবা ঘরের কোণায় অবস্থান গ্রহণ কর। কেননা, আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ বিন হারেসা রা. কে সাথে নিয়ে প্রবেশ করে কাবা ঘরে গিয়ে যাত্রা শেষ করলেন। মুতয়েম বিন আদী তার সওয়ারীর উপর দাঁড়িয়ে ডাক দিয়ে বললেন, ‘হে কুরাইশ গোত্র! আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিয়েছি। তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তার সাথে বিদ্রুপ করবে না।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকনে ইয়ামানির কাছে গেলেন তা স্পর্শ করলেন। এবং দু রাকাত নামায আদায় করলেন। এরপর নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। মুতয়েম বিন আদী ও তার সন্তানেরা তার বাড়িতে প্রবেশ করা পর্যন্ত তাকে অস্ত্র দ্বারা পরিবেষ্টন করে রেখেছিলো । [দেখুন যাদুল মাআদ ৩/৩৩ এবং সীরতে ইবনে হিশাম ২/২৮ বিদায়া অন নিহায়া ৩/১৩৭ আর রহীকুল মাখতুম ১২৫ পৃঃ]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে এই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন তায়েফ সফরে, এটা তার দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অদম্য ইচ্ছার স্পষ্ট প্রমাণ। এবং মানুষেরা তার দাওয়াতে সাড়া না দেয়ায় তিনি আশাহত হননি। যখন প্রথম প্রান্তরে কোন বাধা এসে উপস্থিত হয়েছে, তখন দাওয়াতের নতুন প্রান্তর খুঁজেছেন।

এর মধ্যে এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রজ্ঞার শিক্ষক ছিলেন। আর এটা এ কারণে যে, তিনি যখন তায়েফ আসলেন তখন সমস্ত দলপতি ও তায়েফের সাকীফ গোত্রের প্রধানকে দাওয়াতের জন্য বাছাই করলেন। আর এটা তো জানা কথাই, তারা দাওয়াত গ্রহণ করলে সমস্ত তায়েফবাসীর দাওয়াত গ্রহণ করবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দুই পা থেকে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার মধ্যে একথার সব চেয়ে বড় প্রমাণ যে, আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের কাজে কতবড় কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি।

নিজের জাতি ও তায়েফবাসীর উপর তার বদ-দুআ না করা, আর পর্বতসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশ্তার পক্ষ থেকে তাদেরকে দুই পাহাড়ের মধ্যে ধ্বংস করার প্রস্তাবে সম্মতি না দেয়ার মধ্যে আরো বড় উদাহরণ যে, দায়ীর দাওয়াত গ্রহণ না করলে তাকে কত পরিমাণ ধৈয ধারণ করতে হয়। এবং তাদের হেদায়েত না পাওয়ার কারণে নিরাশ হওয়া যাবে না। হতে পারে আল্লাহ পরবর্তীতে তাদের বংশধরদের মধ্য থেকে এমন কাউকে বের করবেন, যে এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কৌশলের মধ্য থেকে ছিল, মুতয়েম বিন আদির আশ্রয় গ্রহণ করার পূর্বে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেননি । আর এভাবেই দায়ীর উচিত এমন কাউকে তালাশ করা যে তাকে শত্রুর ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করবে, যাতে সে চাহিদা অনুযায়ী দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে পারে। [দেখুন সীরাতে নববী শিক্ষা ও উপদেশ মুস্তফা সুবায়ী লিখিত ৮৫ পৃঃ এবং অহাজাল হাবিব ইয়া মুহিব ১৩৪ পৃঃ]

দশম উদাহরণঃ ব্যবসায়ী ও মওসুমী লোকদের কাছে তার দাওয়াত উপস্থাপন-

নবুওতের দশম বর্ষে জিলকদ মাসে তায়েফ থেকে মক্কায় ফেরার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতের কাজ শুরু করলেন। তিনি সেখানকার মওসুমী বাজারগুলোতে যেতে আরম্ভ করলেন। যেমন, উকাজ, মাজান্নাহ, জিল-মাজাজ ইত্যাদি যে সমস্ত বাজারে আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা উপস্থিত হতো ব্যবসার উদ্দেশ্যে, কবিতা পাঠের আসরে যোগ দেয়ার জন্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সমস্ত গোত্রের নিকট নিজেকে উপস্থাপন করলেন আল্লাহর দিকে তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে। একই বছর হজের মওসুম আসল তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতিটি গোত্রের নিকট গেলেন। তাদের নিকট ইসলাম উপস্থাপন করলেন, যেমন তিনি তাদেরকে নবুওতের চতুর্থ বর্ষ থেকে দাওয়াত দিতেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলাম পেশ করে ক্ষ্যান্ত থাকেননি, বরং ব্যক্তির কাছেও ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত মানুষদেরকে উৎসাহ দিতেন সফলতার দিকে।

আব্দুর রহমান বিন আবিজ যানাদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন,

তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি আমাকে সংবাদ দিল, যে রবিয়াহ বিন আববাদ বলে পরিচিত। সে বনি দাইল গোত্রের এবং জাহেলী যুগের লোক ছিলো। সে বলল, আমি জাহেলী যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিল মাজাজ বাজারে দেখলাম। তিনি বলছেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তা হলে তোমরা সফলকাম হবে।’ এ অবস্থায় লোকেরা তার পাশে জড়ো হয়ে আছে। এবং তার পিছনে প্রশস্ত চেহারার এক ব্যক্তি দাড়িয়ে আছে। সে বড় বড় ব্যাকা চোখের অধিকারী। সে বলছে, ‘এই মুহাম্মদ নতুন ধর্ম নিয়ে এসেছে, সে মিথ্যাবাদী।’ যেখানইে তিনি যাচ্ছেন, এ লোকটি তার পিছনে পিছনে যাচ্ছে। আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা আমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বংশ পরিচয় উল্লেখ করল এবং বলল, ‘সাথের এ লোকটি তার চাচা আবু লাহাব।’ [আহমদ ৪/৩৪৭,৩ /৪৯২’ তার বর্ণনা সুত্র সুন্দর হাকেম]

অন্যান্য আরবের মত আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরাও হজ করত। কিন্তু ইহুদীরা হজ করত না। যখন আনছাররা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবস্থা এবং দাওয়াতকে দেখল তখন বুঝতে পারল যে, ইনিই সেই লোক যার সম্পর্কে ইহুদীরা তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাই তারা ইহুদীদের আগে ঈমান আনতে চাইল। কিন্তু তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে এ বছর বাইয়াত গ্রহণ করল না। মদীনায় ফিরে গেল।

নবুওতের একাদশ বর্ষে হজের মওসুমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন গোত্রের নিকট উপস্থিত হলেন। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদের নিকট উপস্থিত হচ্ছিলেন, সে সময় মিনার গিরিপথে ইয়াসরেবের ছয় যুবককে পেলেন। তাদের নিকট ইসলাম পেশ করলেন। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত কবুল করলেন। তারা ইসলামের দীক্ষা নিয়ে তাদের জাতির নিকট ফিরে গেলেন। [তারিখে ইসলাম মাহমুদ শাকেরের ২য় খন্ড ১৩৭ পৃঃ ওয়া হাজাল হবিব ইয়া মুহিব ২য় খন্ড ১৪৫ পৃঃ রহিকুল মাখতুম ১৩২ পৃঃ ১যাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড ৪৫ পৃঃ ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৩৮ পৃঃ বিদায়া নিহায়া ৩য় খন্ড ১৪৯ পৃঃ]

অতঃপর বছর ঘুরে নতুন বছর আসল। নবুওতের দ্বাদশ বর্ষে লোকেরা হজে করতে আসল। ইয়াসরেবের হাজীদের মধ্য থেকে বারজন আসল। এদের মধ্যে গত বছরের ছয়জনের পাঁচজনও ছিল। অঙ্গীকার অনুযায়ী মিনার গিরিপথে তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে মিলিত হল ও ইসলাম গ্রহণ করল। এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করল। যা ইতিহাসে বাইয়াতুন নিসা নামে পরিচিত। [সীরাতে ইবনে হিশাম]

উবাদাহ বিন ছামেত রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাহদের একটি দল পরিবেষ্টিত অবস্থায় বললেন, ‘আস! তোমরা আমার নিকট বাইয়াত গ্রহণ কর। শপথ কর এ কথার উপর যে, তোমরা আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করবে না। চুরি করবে না। ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না। তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। তোমাদের নিজের কৃত অপরাধকে অন্যের উপর অপবাদ হিসেবে চাপিয়ে দেবে না। কোন ন্যায় কাজে আমার অবাধ্য হবে না। যে এ অঙ্গীকারগুলো পরিপূর্ণরূপে পালন করবে তার প্রতিদান আল্লাহর দায়িত্বে। আর যে ব্যক্তি এর মধ্য থেকে কোন কাজ করে ফেলবে, অতঃপর পৃথিবীতে তাকে শাস্তি দেয়া হলে তা তার জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এর মধ্য থেকে কোন কাজ করে, অতঃপর আল্লাহ গোপন রাখেন, তাহলে তার বিষয়টি আল্লাহর নিকট অর্পিত। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দিতে পারেন অথবা মাফ করে দিতে পারেন।’ এই কথাগুলোর উপর আমরা তার নিকট বাইয়াত (শপথ) গ্রহণ করলাম। [সহীহ আল - বুখারী ফতহুলবারী সহ ৭ম খন্ড ২১৯ পৃঃ ত্ম সনদকে হাফেজ ইবনে হাজার হাসান বলেছেন।]

যখন বাইয়াতের কাজ সম্পন্ন হল, এবং হজ মওসুম শেষ হল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে মুছআব বিন উমায়ের রা. কে পাঠালেন মুসলমানদেরকে ইসলামী শরীয়ত শিক্ষা ও ইসলাম প্রচারের কাজ করার জন্য। তিনি তার দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করলেন। নবুওতের ত্রয়োদশ বর্ষে হজের মওসুমে হজ পালনের জন্য ইয়াসরেব থেকে তিয়াত্তর জন পুরুষ এবং দুইজন মহিলা উপস্থত হলেন এবং তারা সকলেই ইসলাম গ্রহণ করলেন।

যখন তারা মক্কায় আসল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকাবায় তাদের সাথে বৈঠকের ব্যবস্থা করলে তারা সময়মত সেখানে উপস্থিত হল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে কথা বললেন। অতপর তারা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার নিকট কি বিষয়ের উপর বাইয়াত গ্রহণ করব? তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার নিকট বাইয়াত করবে সুখ ও দুঃখ সর্বাস্থায় আমার আনুগত্য করবে এবং আমার কথা শুনবে। সুখে দুঃখে খরচ করবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে। এক আল্লাহর কথা বলবে। এ বিষয়ে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারের ভয় করবে না। এবং আমাকে সাহায্য করবে। আমার কাছ থেকে বাধা দেবে ঐ সমস্ত জিনিস যা তোমরা তোমাদের নিজের থেকে ও স্ত্রীদের থেকে এবং সন্তানদের থেকে বাধা দিয়ে থাক। তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।’ তারা সবাই উঠে রাসুলের কাছাকাছি গেল এবং তার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করল।

আর এই বাইয়াত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য বারজন নেতা ঠিক করে দিলেন, যারা তাদের গোত্র প্রধান হবেন। নয়জন ছিল খাজরাজ গোত্রের এবং তিনজন ছিল আওস গোত্রের। অতঃপর তারা ইয়াসরেবে ফিরে গেল। এবং সেখানে পৌঁছার পর তারা ইসলাম প্রকাশ করল। আল্লাহর প্রতি দাওয়াতে তাদের দ্বারা অনেক খেদমত হল। [তারিখে ইসলাম মাহমুদ শাকেরের ২য় খন্ড ১৪২ পৃঃ পৃঃ রহিকুল মাখতুম ১৪৩ পৃঃ ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৩৯ পৃঃ বিদায়া ওযান নিহায়া ৩য় খন্ড ১৫৮ পৃঃ]

দ্বিতীয় আকাবার বাইয়াতের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় সফল হলেন। সংবাদটি অধিকহারে মক্কায় প্রচার হল এবং কুরায়েশদের নিকট এ কথা প্রমাণ হল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াসরেববাসীদের নিকট থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। এতে মক্কায় যারা মুসলমান হয়েছিল তাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেল। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। মুসলমানরা হিজরত করল । কুরাইশরা বৈঠকে বসল। তখন নবুওয়তের চতুর্দশ বর্ষে ২৬শে ছফর তারিখ। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার বিষয়ে একমত হল। এ সংবাদ অহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিলেন। তার সুন্দর কৌশল ছিল। তিনি আলী রা. কে নির্দেশ দিলেন, সে যেন আজ রাতে তার বিছানায় ঘুমায়। মুশরিকরা দরজার ফাক দিয়ে আলী রা. কে দেখে মুহাম্মাদ ভেবে অপেক্ষা করতে থকল। এ অবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হয়ে গেলেন এবং আবু বকরকে সাথে নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন। [ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৯৫ পৃঃ বিদায়া ওযান নিহায়া ৩য় খন্ড ১৭৫ পৃঃ জাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড ৫৪ পৃঃ সিরাতে নববী মু্স্তফা সুবায়ী রচিত ৬১ পৃঃ ওয়া হাজাল হাবিব ইয়া মুহিব ১৬৫ প]

আর এই মহান অবস্থান যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গ্রহণ করেছিলেন, স্পষ্ট প্রমাণ যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৌশল বা হিকমত অবলম্বন করেছেন, এবং তিনি ধৈর্য্য ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। আর তিনি যখন জানতে পারলেন যে, কুরাইশরা সীমালংঘন করেছে ও দাওয়াতকে অস্বীকার করেছে তখন এমন একটি স্থান তালাশ করেছেন, যাকে ইসলামী দাওয়াতের ঘাটি বানাবেন। তিনি শুধু এ পরিকল্পনা করেই ক্ষ্যান্ত হননি, বরং তাদের নিকট থেকে ইসলামকে সাহায্য করার ব্যাপারে বাইয়াত ও অঙ্গীকার নিয়েছেন। এ কাজটি সম্পন্ন হয়েছে দুটি সম্মেলনের মাধ্যমে : প্রথম আকাবার বাইয়াত, অতঃপর দ্বিতীয় আকাবার বাইয়াত। তিনি একটি স্থানকে দাওয়াতের ঘাটি বানাবেন বলে খুঁজছিলেন যখন তা পেয়ে গেলেন এবং দাওয়াতের সাহায্যকারীও পেয়ে গেলেন। তিনি তার সাথীদেরকে হিজরতের অনুমতি দিলেন। যখন তার বিরুদ্ধে কুরায়েশরা চক্রান্ত করল তখন তিনি কৌশল অবলম্বন করলেন।। আর এ কাজটিকে কাপুরুষতা ধরা হয় না, বা মৃত্যু থেকে পলায়নও বলা যায় না। হ্যাঁ আল্লাহর উপর ভরসা করে উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। আর এই প্রজ্ঞাপূর্ণ কুটনীতিই হল দাওয়াতের সফলতার কারণ। আল্লাহর দিকে আহবানকারীদের এমনই হওয়া উচিত, কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন তাদের আদার্শ ও নেতা। [সহীহ আল - বুখারী ৩৪৭৭ সহীহ মুসলিম ১৭৯২ শরহে নববী ১২খন্ড ১৪৮ পৃঃ]

একাদশ উদাহরণঃ তার মুখমন্ডল ক্ষতবিক্ষত হল এবং দানদান মুবারক শহীদ হল

সাহল বিন সাআদ রা. থেকে বর্ণিত, তাকে প্রশ্ন করা হল, উহুদ দিবসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহত হওয়া সম্পর্কে। তিনি বললেন, ‘তার মুখমন্ডল আহত হল, এবং তার দাঁতগুলো ভেঙ্গে গেল। বর্মের ভাঙ্গা অংশ তার মাথায় প্রবেশ করল। ফাতেমা রা. রক্ত পরিস্কার করছিলেন, এবং আলী রা. রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। যখন দেখলেন রক্ত বন্ধ না হয়ে আরো বেশি পরিমাণে বের হচ্ছে তখন ফাতেমা চাটাইতে আগুন ধরিয়ে দিলেন, পুড়ে ছাই হয়ে গেল । অতঃপর তা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন, তখনই রক্ত বন্ধ হয়ে গেল। [সহীহ আল - বুখারী ৪০৭৩ সহীহ মুসলিম ১৭৯৩]

আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কঠিন কষ্ট বরদাশত করছিলেন। যার মহত্বের কাছে পাহাড়ও কেঁপে উঠে। তিনি এমন এক নবী, যিনি এ অবস্থায়ও তার জাতির বিরুদ্ধে বদ-দুআ করেননি। বরং তাদের জন্য ক্ষমার দু‘আ করেছেন। কেননা তারা বুঝে না।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এখনো মনে হয় আমি রাসুলের দিকে চেয়ে আছি আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কোন নবীর ঘটনা বর্ণনা করছেন যাকে তার জাতি মেরেছে। এ অবস্থায় তিনি চোখ থেকে পানি মুছছিলেন। এবং বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জাতিকে মাফ করে দিন তারা বুঝে না।’ [সীরাতে নববী দুরুস ও ইবর ১১৬ পৃঃ]

সমস্ত নবীগণ এবং তাদের মধ্যে সবার উপরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধৈর্য ও সহনশীলতা, ক্ষমা, ও দয়ার মুর্ত প্রতীক ছিলেন। তিনি তার জাতির জন্য ক্ষমা ও করুণার সকল দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ ঐ জাতির উপর অধিক হারে পতিত হয়, যে জাতি তাদের রাসুলের সাথে এ আচরণ করে। এ কথা বলার সময় তিনি তার দাঁতের দিকে ইঙ্গিত করছিলেন। আল্লাহ তাআলার ক্রোধ কঠোরতর হল এমন ব্যক্তির উপর, যে আল্লাহর রাসুল এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। [শরহে নববী ১২ খন্ড ৪৩৬ পৃঃ]

উহুদ দিবসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহত হওয়ার মধ্যে দাওয়াত-কর্মীদের জন্য সান্তনা রয়েছে; তারা আল্লাহর রাস্তায় তাদের শরীরে যে কষ্ট বরদাশত করবে, অথবা তাদের স্বাধীনতা হরণ করা হবে অথবা তাদেরকে যে নির্যাতন করা হবে সে সকল বিষয়ে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন উত্তম আদর্শ। তাকে যখন কষ্ট দেওয়া হয়েছে আর তিনি তাতে ধৈর্য ধারণ করেছেন। তাহলে অন্য দাওয়াত-কর্মীদের তো তা বরদাশত করতেই হবে। [সীরাতে নববী দুরুস ও ইবর]

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন