মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
‘‘আমি তো তোমাকে বিশ্ব জগতের প্রতি শুধু রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি।’’ [সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭]
যারা ঈমান এনেছে তারা এ রহমত-অনুগ্রহকে গ্রহণ করেছে। এ জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করেছে। কিন্তু অন্যেরা প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহর এ অনুগ্রহকে কুফরী দ্বারা পরিবর্তন করেছে। আল্লাহর নেআমাত ও রহমতকে অস্বীকার করেছে। [তাইসীরম্নল কারীম আর-রাহমান ফি তাফসীরি কঠলামিল মান্নান]
ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান আনল, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার জন্য রহমত-করুণা লিখে দিলেন। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনল না তারা অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ন্যায় শাস্তি ও দুর্যোগ ভোগ করবে।’ [তাফসীরম্ন জামিইল বয়ান : আত-তাবারী]
ইমাম তাবারী রহ. বলেন, ‘উপরে উল্লেখিত দু’টো বক্তব্যের মধ্যে প্রথম বক্তব্যটি অধিকতর সঠিক, যা ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে ও সৃষ্টিকুলের জন্য করুণা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মুমিন ও কাফের সকলের জন্য। মুমিনগনকে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ এর মাধ্যমে পথ প্রদর্শন করলেন। তাদের ঈমানে প্রবশে করালেন, আমলের তাওফীক দিলেন। ফলে তারা জান্নাত লাভ করবে। আর যারা তাকে অস্বীকার করল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কারণে তাদের উপর আল্লাহর গজব ও শাস্তি বিলম্বিত হয়েছে। এদিক বিবেচনায় রাসূলুল্লাহ হলেন কাফিরদের জন্য রহমত। কেননা অন্যান্য নবী ও রাসূলগনকে অস্বীকার করার শাস্তি সংশ্লিষ্ট নবী রাসূলদের জীবদ্দশায় হয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলের জন্য রহমত হিসেবে আসার কারণে কাফেরদের উপর শাস্তি বিলম্বিত হয়েছে।’ [জামেউল বয়ান : আত-তাবারী ৫৫২/১৮]
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রহমত ছিল সার্বজনীন ও ব্যাপক। যেমন আবু হুরাইরা রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হল, ‘হে রাসূল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুআ করুন!’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমাকে অভিসম্পাতকারী হিসেবে প্রেরণ করা হয়নি। আমাকে রহমত- দয়া ও করুণা হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’ [সহীহ মুসলিম ২৫৯৯]
সাহাবী হুজাইফা রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমি যদি রাগ করে আমার উম্মতের কাউকে গালি দেই বা লা’নত করি তবে তোমরা জেনে রাখ আমি একজন মানব সন্তান। তোমরা যেমন রাগ করে থাকো আমিও তেমনি রাগ করে থাকি। কিন্তু আমাকে তো সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত-করুণা হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। কেয়ামত দিবসে আমার এ গালি বা লানতকে তাদের জন্য রহমতে পরিণত করে দেব।’ [সহীহ সুনানে আবু দাউদ, ১৩৪/৩]
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি মুহাম্মাদ, আহমদ, আল-মুকাফফী, আল-হাশের, তাওবার নবী ও রহমত-করুণার নবী।’ [সহীহ মুসলিম ২৩৫৫]
দ্বিতীয়ত : এ প্রসঙ্গে বাস্তব ঘটনাবলী ও তার প্রকারঃ
প্রথম প্রকার : তার শত্রুদের প্রতি দয়া ও করুণা
প্রথম দৃষ্টান্ত : নিজ শত্রুদের জন্য তার রহমত ও করুণা :
তার রহমত- করুণা থেকে তার শত্রুরাও বঞ্চিত হয়নি। এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধ, লড়াই ও জিহাদ করার সময়েও তাদের প্রতি দয়া-রহমত ও করুণার প্রমাণ দিয়েছেন।
ইসলামে আল্লাহর পথে জিহাদের ব্যাপারে মূলনীতি রয়েছে। যারা জিহাদে নিয়োজিত থাকে তাদের এ সকল মূলনীতি অবশ্যই মানতে হবে। কারণ আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
‘‘তোমরা সীমা লঙ্ঘন করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা ললনকারীদের পছন্দ করেন না।’’ [সূরা আল-বাকারা : ১৯০]
এ আয়াতের আলোকে জিহাদে যে সকল বিষয় নিষিদ্ধ তা হল : মৃত দেহে কোন রকম আঘাত করা বা কাটা, সম্পদ আত্নসাত-লুট-পাট, নারী শিশু বৃদ্ধদের হত্যা করা, যে সকল বৃদ্ধরা যুদ্ধে কোন ভূমিকা রাখে না তাদের হত্যা করা। এমিনভাবে পাদ্রী, ধর্ম যাজক, অসুস্থ, অন্ধ, গির্জা, চার্চ, মন্দিরের অধিবাসীদের হত্যা করা নিষেধ। যদি তারা যুদ্ধে অংশ নেয় তখন ভিন্ন কথা। [আল-মুগনী : ইবনে কুদামা ১৭৫-১৭৯/১৩]
এমনিভাবে প্রাণী হত্যা, গাছ-পালা বৃক্ষ নষ্ট করা, শস্য ক্ষেত্র ফল-ফলাদির বাগান নষ্ট করা, নলকূপ, পুকুর, পানির ব্যবস্থা ও গৃহ ধ্বংস করা নিষিদ্ধ। [তাফসীর ইবনে কাসীর : ২২৭/১]
কোন এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধ ক্ষেত্রে এক নারীর লাশ দেখতে পেলেন। তখনই তিনি যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুদের হত্যা নিষিদ্ধ করে দিলেন। [সহীহ আল - বুখারী ৩০১৪ম ৩০১৫]
এ কারণে যখন তিনি কোন অভিযান প্রেরণ করতেন, তখন তার সেনাপতিকে নির্দেশ দিতেন সকল বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করতে, অধীনস্থদের সাথে ভাল আচরণ করতে। অতঃপর বলতেন, ‘আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে লড়াই করবে। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ করবে কিন্তু বাড়াবাড়ি করবে না, লুট-পাট করবে না, মৃত দেহ বিকৃত করবে না, শিশুদের মারবে না। যখন শত্রেুর মুখোমুখি হবে তখন তাদের তিনটি বিষয়ে আহবান করবে . . .। [সহীহ মুসলিম , জিহাদ অধ্যায়]
অতঃপর তিনি বিষয় তিনটি বললেন,
(ক) ইসলাম ও হিজরতের প্রতি আহবান করবে অথবা হিজরত ব্যতীত শুধু ইসলামের দিকে আহবান করবে। শুধু ইসলাম গ্রহণ করলে তারা বেদুইন মুসলমানদের মধ্যে গণ্য হবে।
(খ) যদি ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করে তখন তাদের জিযিয়া কর দিতে বলবে।
(গ) যদি এ দুটোর কোনটা না শুনে তাহলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাবে ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। [সহীহ মুসলিম , জিহাদ অধ্যায়]
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত : নিজ শত্রুদের সাথে প্রতিশ্রুতি পালন
জিহাদের গুরুতবপূর্ণ মূলনীতির একটি হল ওয়াদা রক্ষা করা খেয়ানত না করা। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন:
‘‘যদি তুমি কোন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ভঙ্গের আশঙ্কা করো, তবে তোমার চুক্তিকেও প্রকাশ্যভাবে তাদের সামনে নিক্ষেপ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।’’ [সূরা আল-আনফাল : ৫৮]
যদি কাফের ও মুসলিমদের মধ্যে কোন চুক্তি থাকে বা নিরাপত্তা দেয়ার কথা থাকে, তখন আক্রমণ করা মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়। অবশ্যই মুসলিমগন চুক্তি রক্ষা করবে। যদি কাফেরদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেয় তখন মুসলিমগণ তাদের এ বিষয়ে সংবাদ দেবে যে, ‘তোমরা যদি চুক্তি ভঙ্গ করতে চাও আমরা তাহলে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেব।’
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যদি কাফের বা শত্রুদের পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গের ভয় না থাকে তাহলে মুসলিমদের জন্য চুক্তি রক্ষা করা অপরিহার্য হয়ে যাবে। [তাফসীর ইবনে কাসীর ৩২১/২]
তাইতো আমরা দেখতে পাই, সালীম ইবনে আমের বলেন, মুআবিয়া ও রোম সাম্রাজ্যের মধ্যে চুক্তি ছিল। তিনি রোমের দিকে এ উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন যে, যখন চুক্তি শেষ হয়ে যাবে তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করবেন। তখন দেখা গেল ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আল্লাহু আকবর, চুক্তি রক্ষা করা উচিত, ভঙ্গ করা নয়।’ লোকেরা তার দিকে তাকাল, দেখা গেল সে আমর ইবনে আবাসা রা.। মুআবিয়া রা. তার কাছে লোক পাঠিয়ে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলতেন, ‘যদি কোন সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি থাকে তবে তার গিঁট শক্ত করবে না ও খুলেও ফেলতে চাবে না। যতক্ষণ না তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় অথবা উভয় পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে।’ এ কথা শুনে মুআবিয়া রা. তার বাহিনী নিয়ে ফিরে গেলেন। [আবু দাউদ, ১৫৮০ জিহাদ অধ্যায়] কেননা এ ধরনের তৎপরতা চুক্তি ভঙ্গের চেষ্টা করার নামান্তর।
তৃতীয় দৃষ্টান্ত : নিজ শত্রুদের উপর শাস্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
এ বিষয়ে সুন্দর দৃষ্টান্ত হল, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুশরিকরা প্রস্তর আঘাতে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল তখন পাহাড়-পর্বত সমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশ্তা এসে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ আপনার জাতির কথা শুনেছেন, যা তারা আপনাকে বলেছে। আমি হলাম পাহাড়ের দায়িত্বশীল। আমার প্রতিপালক আমাকে আপনার খেদমতে পাঠিয়েছেন। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে যে কোন নির্দেশ দিতে পারেন। যদি আপনি চান আমি দু আখবাশ একত্র করে তাদের পিষে দেই।’ (আখবাস হল মক্কার দু পাশের দু পাহাড়। যার মাঝে মক্কা নগরী অবস্থিত) এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের ফেরেশতাকে বললেন, ‘আমি আশা করি এদের থেকে আল্লাহ তাআলা এমন প্রজন্ম বের করবেন যারা এক আললাহরই ইবাদত করবে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।’ [সহীহ আল - বুখারী ৩২৩১, সহীহ মুসলিম ১৭৯৫]
চতুর্থ দৃষ্টান্ত : রাসূলুল্লাহর উদার মানসিকতা ও ইহুদীদের কল্যাণ কামনা
এর সুন্দর দৃষ্টান্ত হল আনাস রা. এর হাদীস, তিনি বলেন, ‘এক ইহুদী যুবক ছিল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত করতো। সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ তাকে দেখতে এলেন। তার মাথার কাছে বসলেন। তাকে বললেন, ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করো।’ এ কথা শুনে সে তার বাপের মুখের দিকে তাকাল। বাপ তাকে বলল, ‘আবুল কাসেম (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা বলে তা শোনো।’ সে তৎক্ষণাৎ ইসলাম কবুল করল। (নাসায়ীর বর্ণনায় সে ঘোষণা দিল, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছ থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, ‘প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি ছেলেটাকে আগুন থেকে মুক্তি দিলেন।’ [সসহীহ আল - বুখারী ১৩৫৬]
‘‘তোমাদের নিকট আগমন করেছে তোমাদেরই মধ্যকার এমন একজন রাসূল। যার কাছে তোমাদের ক্ষতিকর বিষয় অতি কষ্টদায়ক মনে হয়। সে হচ্ছে তোমাদের খুবই হিতাকাংখী, মুমিনদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল, করুণাপরায়ন।’’ [সূরা আত-তাওবা ১২৮]
আল্লাহ এ নবীকে পাঠিয়েছেন সাধারণভাবে সকল মানুষের জন্য আর বিশেষভাবে মুমিনদের জন্য। যারা তাকে চিনে, তার থেকে উপকার নিতে জানে। তিনি মুমিনদের কল্যাণ কামনা করেন সর্বদা। তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য সর্বদা প্রচেষ্টা চালান। তাদের উপর কোন বিপদ আসলে তিনিও তাতে আহত হন। তাদের ঈমানের দিকে পথ চলাতে সর্বদা আগ্রহী থাকেন। তাদের জন্য যে কোন ধরনের ক্ষতি তিনি অপছন্দ করেন। পিতা-মাতারা সন্তানকে যেভাবে ভালবাসে তিনি ঈমানদারদেরকে তার চেয়ে বেশি বেশি ভালোবাসেন। এ জন্যই তার হক সকলের চেয়ে বেশি। উম্মতের জন্য অবশ্য কর্তব্য হল তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। তাকে সম্মান করা। তাকে সাহায্য করা। [তাইসীরুল কারিম আর-রাহমান]
‘‘নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তার স্ত্রীরা তাদের মাতা।’’ [সূরা আল-আহযাব : ৬]
তাই নিজের চেয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বেশি ভালোবাসতে হবে। যদি নিজের কোন সিদ্ধান্তের সাথে নবীর সিদ্ধান্ত বিরোধী হয় তখন নিজের মতামত বাদ দিয়ে নবীর মতামত বা সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে।
‘‘অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, তুমি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত; আর তুমি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয় হতে, তবে নিশ্চয় তারা তোমার সঙ্গ হতে দুরে সরে যেত অতএব তুমি তাদের ক্ষমা করো ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কার্য সম্পর্কে তাদের সাথে পরামর্শ করো; যখন তুমি সংকল্প করো তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করো। যারা তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’’ [সূরা আল-আলে ইমরান : ১৫৯]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি মুমিনদের অতি নিকটবর্তী তাদের নিজেদের চেয়েও। অতএব যে ইন্তেকাল করে ও তার উপর ঋণ থাকে, সেই ঋণ পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার। আর যদি সে সম্পদ রেখে যায়, তা তার উত্তরাধিকারদের প্রাপ্য।’’ [সহীহ আল - বুখারী ৬৭৩১, সহীহ মুসলিম ১৬১৯]
তৃতীয় প্রকার: তার করুণা ও ভালোবাসা সকল মানুষের জন্য
১- সাহাবী জরীর ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে মানুষের প্রতি দয়া করে না আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না।’ [সহীহ মুসলিম ২৩১৯]
২- আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমি আবুল কাসেম (রাসূলুল্লাহ) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন ‘হতভাগ্য ব্যতীত অন্য করো থেকে রহমত-দয়ার চরিত্র উঠিয়ে নেয়া হয় না।’ [তিরমিজী ১৯২৩]
৩- সাহাবী আমর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যারা অন্যের প্রতি দয়া-করুণা করে দয়াময় আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করেন। যারা পৃথিবীতে আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া-রহমত হল দয়াময় আল্লাহর নৈকট্য, যে এতে পৌছতে পারল সে আল্লাহর কাছে পৌছে গেল, আর যে এটা কেটে ফেলল সে তার সাথে সম্পর্ক কেটে ফেলল।’ [তিরমিজী ১৯২৪]
চতুর্থ প্রকার : শিশুদের প্রতি তার দয়া ও মমতা
১- আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, এক বৃদ্ধ লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আসল, লোকেরা তাকে জায়গা করে দিতে দেরি করল। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যে ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা দেখায় না ও প্রবীণদের সম্মান করে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ [তিরমিজী ১৯১৯]
২- আমর ইবনে শুআইব তার পিতা থেকে, তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ছোটদের প্রতি স্নেহ মমতার আচরণ করে না, আমাদের বড়দের সম্মান বুঝে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ [তিরমিজী ১৯২০]
পঞ্চম প্রকার : কন্যা সন্তানদের প্রতি তার দয়া-মমতা :
১- আবু সায়ীদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কোন ব্যক্তির তিনটি কন্যা বা তিনটি বোন অথবা দুটি কন্যা বা দুটি বোন থাকে। তাদের ব্যাপারে আললাহকে ভয় করে এবং তাদের সাথে উত্তম আচরণ করে আল্লাহ অবশ্যই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ [আবু দাউদ ৫১৪৭, তিরমিজী ১৯১২]
২- আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি কন্যা বা তিনটি কন্যা লালন-পালন করবে, অথবা দুটি বোন বা তিনটি বোন লালন-পালন করবে বিবাহ দেয়া পর্যন্ত বা মৃত্যু পর্যন্ত। সে ব্যক্তি ও আমি জান্নাতে এক সঙ্গে থাকব।’ [আহমাদ ১২৪৯৮]
ষষ্ঠ প্রকার : ইয়াতীমদের প্রতি তার দয়া ও ভালোবাসা
১- আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি ও ইয়াতীমের লালন-পালনকারী জান্নাতে এমনভাবেই থাকব।’ একথা বলে তিনি তার তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করেছেন। [সহীহ আল - বুখারী ৬০৫ সহীহ মুসলিম ২৯৮৩] (অর্থাৎ একত্রে থাকব)
২- আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে নিজ অন্তরের কঠোরতা সম্পর্কে অভিযোগ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও, অভাবীকে আহার দাও।’ [আহমদ ৫৫৮/১৪]
সপ্তম প্রকার : নারী ও দুর্বলদের প্রতি তার দয়া-মমতা:
১- আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আল্লাহ ! আমি দুই দুর্বলের অধিকারের ব্যাপারে ভয় করি ; ইয়াতীমের অধিকার ও নারীর অধিকার।’ [আন-নিহায়াতু ফি গারীবিল হাদীস ৩৬১/১]
২- আমের ইবনুল আহওয়াছ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বিদায় হজে অংশ নিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সানা ও প্রশংসা করলেন, ওয়াজ করলেন, স্মরণ করিয়ে দিলেন। অতঃপর এক পর্যায়ে বললেন, ‘আমি নারীদের সাথে সুন্দর আচরণের জন্য তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছি। তারা তোমাদের জীবন সাথি। তোমরা এ (সাহচর্য) ছাড়া তাদের আর কিছুর মালিক নও।’ [সহীহ সুনানে ইবনে মাজা ২৯৮/২]
৩- আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাতে নিজের স্ত্রীদের ও উম্মে সুলাইমের ঘর ছাড়া অন্য কোন নারীর ঘরে প্রবেশ করতেন না। তাকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘আমি তার প্রতি দয়া-মমতার কারণে তাকে (উম্মে সুলাইমকে) দেখতে যাই। কারণ তার ভাই আমার সাথে থেকে নিহত হয়েছে।’ [সহীহ আল - বুখারী ২৮৪৪]
অষ্টম প্রকার : ইয়াতীম ও বিধবাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দয়া-মমতা
১- আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বিধবা ও অভাবী লোকদের জন্য যে প্রচেষ্টা চালায়, সে মর্যাদায় আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের ন্যায় অথবা ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সারা রাত সালাতে কাটায় ও দিবসে রোযা রাখে।’ [সহীহ আল - বুখারী ৫৩৫৩, সহীহ মুসলিম ২৯৮২]
২- আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক পরিমাণে জিকির করতেন। অনর্থক বিষয় পরিহার করতেন। সালাত দীর্ঘ করতেন। খুতবা সংক্ষেপ করতেন এবং বিধবা ও অভাবী লোকদের প্রয়োজন পূরণে বের হতে দেরি করতেন না।’ [সহীহ সুনানে নাসায়ী ১৪১৫]
উল্লেখিত হাদীসগুলো পাঠ করে আমরা দেখলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিধবা ও অভাবী লোকদের সাহায্য করতে তাদের প্রয়োজন পূরণে কতটা দয়ার্দ্র ও মমতাময়ী ছিলেন।
নবম প্রকার : জ্ঞান অন্বেষনকারী ছাত্রদের প্রতি রাসূলুল্লাহর দয়া ও স্নেহ
১- আবু সায়ীদ খুদরী হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য তোমাদের কাছে অনেক সম্প্রদায় আসবে। যখন তোমরা তাদের দেখবে স্বাগত জানিয়ে বলবে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশক্রমে তোমাদের স্বাগত জানাই।’ এবং তাদের শিক্ষা দেবে। শিক্ষায় সাহায্য করবে।’ [তিরমিজী ২৬৫০, ইবনে মাজা ২৪৭]
২- মালেক ইবনে হুয়াইরিস রা, বলেন, ‘আমরা সমবয়সী কয়েকজন যুবক নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে আসলাম। বিশ দিন বিশ রাত কাটালাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আমাদের প্রতি খুবই দয়ার্দ্র ও স্নেহময়ী। যখন তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা আমাদের পরিবারের কাছে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছি, তখন তিনি আমাদের সকলের কাছ থেকে জেনে নিলেন আমরা বাড়িতে কাদের রেখে এসেছি। তিনি বললেন, ‘তোমরা তোমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাও। তাদের কাছে অবস্থান করো। তাদের শিক্ষা দাও। . . .আর আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ তোমরা সেভাবে সালাত আদায় করবে। যখন সালাতের সময় আসবে তোমাদের একজন আজান দেবে, তোমাদের মধ্যে বয়োজেষ্ঠ ব্যক্তি ইমামতি করবে।’ [সহীহ আল - বুখারী ৬২৮, ৬৩১]
দেখুন জ্ঞান অর্জনে নিয়োজিত ছাত্রদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত দয়ালু ও স্নেহময়ী ছিলেন।
দশম প্রকারঃ বন্দি ও কয়েদীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর দয়া ও মমতা
আবু মূছা আল-আশআরী রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘বন্দিদের মুক্ত করে দাও। ক্ষুধার্তকে আহার দাও। অসুস্থদের সেবা করো।’ [সহীহ আল - বুখারী ৩০৪৬]
এ হাদীসে মুসলিম বন্দিদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দয়া ও রহমতের প্রমাণ আমরা পাই। তিনি বন্দিদের মুক্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর ক্ষুধার্তকে অন্ন দিতে ও রোগীর সেবা করতে আদেশ করেছেন।
একাদশ প্রকার: রোগীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দয়া ও মমতা -
১- আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘মুসলমানদের প্রতি মুসলমানদের ছয়টি অধিকার রয়েছে।’ জিজ্ঞেস করা হল, ‘হে আল্লাহর রাসূল সেগুলো কি?’ তিনি বললেন, ‘যখন দেখা হবে সালাম দেবে। যখন সে তোমাকে দাওয়াত দেবে, তুমি সাড়া দেবে। যখন সে পরামর্শ চাবে তাকে পরামর্শ দেবে। যখন সে হাঁচি দিয়ে আল-হামদুলিল্লাহ বলবে তার উত্তর দেবে। যখন সে অসুস্থ হবে তখন তার দেখাশুনা করবে এবং যখন সে মৃত্যু বরণ করবে তখন তার দাফন কাফনে অনুগামী হবে।’ [সহীহ আল - বুখারী ১২৪০, ২১৬২]
২- আলী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘যখন কোন মুসলমান এক অসুস্থ মুসলমানকে সকাল বেলায় সেবা করতে আসে তখন সত্তর হাজার ফেরেশে্তা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দুআ করতে থাকে। আর যখন রাতের বেলা সেবা করতে আসে তখন সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দুআ করে থাকে। আর জান্নাতে তার জন্য একটি বাগান তৈরি করা হয়।’ [তিরমিজী ৯৬৯]
৩- ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুপথ যাত্রী নয় এমন রোগীকে দেখতে যাবে এবং তার কাছে বসে সাত বার যদি এ দুআটি পড়ে
أسألك الله العظيم رب العرش العظيم أن يشفيك
(আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যিনি মহান আরশের প্রভু তিনি যেন তোমাকে সুস্থ করে দেন।) তাহলে আল্লাহ অবশ্যই তাকে সুস্থ করে দেবেন।’ [সহীহ সুনানে আবু দাউদ ৩১৬০]
এ সকল হাদীস আমাদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগাক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রতি কত বড় দয়ালু-মেহেরবান ছিলেন। শুধু তিনি দয়ালু ছিলেন তাই নয়। বরং তিনি উম্মতকে শিখিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন রোগাক্রান্ত মানুষকে সেবা করার জন্য, তাদের প্রতি দয়া-করুণা প্রদর্শন করার জন্য।
দ্বাদশ প্রকার : জীবজন্তু, পাখ-পাখালী ও পোকা-মাকড়ের প্রতি রাসূলুল্লাহর দয়া -
১- আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি দেখল একটু কুকুর পিপাসায় কাঁদা খাচ্ছে,। লোকটি কুকুরটিকে পানি পান করাল। পানি পান করে সে আল্লাহর শোকর আদায় করল। এ কারণে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করে জান্নাতে প্রবেশ করালেন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসূলাললাহ! জন্তু জানোয়ারের ব্যাপারেও আমাদের জন্য পুরস্কার আছে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘প্রতিটি আদ্র কলিজার অধিকারী (প্রাণী) র প্রতি দয়া-মমতায় তোমাদের জন্য পুরস্কার আছে।’ [সহীহ আল - বুখারী ১৭৩, ২৪৯৯, সহীহ মুসলিম ২২৪৪]
২- আবু হুরাইরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেন যে, ‘এক ব্যভিচারী নারী পিপাসার কারণে মৃত মুখে পতিত এক কুকুর দেখতে পেল। সে নিজের পায়ের মোজা খুলে তাতে নিজের ওড়না লাগিয়ে কূপ দিয়ে পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করাল। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।’ [সহীহ আল - বুখারী ৩৩২১]
৩- আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জনৈক মহিলা একটি বিড়ালকে বেধে রেখেছিল। ফলে সে না খেয়ে মারা গেল। আল্লাহ এ কারণে মহিলাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। কেন সে বিড়ালটিকে খাবার না দিয়ে আটকে রাখল? সে তাকে ছেড়ে দিত, যমীন থেকে সে খাবার সংগ্রহ করে নিত।’ [সহীহ আল - বুখারী ২৩৬৫, সহীহ মুসলিম ২২৪৩]
৪- আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে কোন মুসলমান কোন বৃক্ষ রোপণ করে, কোন শস্য চাষ করে। অতঃপর তা থেকে কোন পাখি বা মানুষ অথবা কোন জন্তু-জানোয়ার খাবার খায়, তাহলে এটা তার জন্য ছদকাহ হিসেবে আল্লাহর কাছে গ্রহণ করা হয়।’ [সহীহ আল - বুখারী ২৩২০, সহীহ মুসলিম ১৫৫২]
৫- ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বকরী জবেহ করার জন্য শুইয়ে দিল। তারপর চাকু ধারালো করতে লাগল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে বললেন, ‘তুমি কি বকরীটিকে কয়েকবার মৃত্যুর কষ্ট দিতে চাও? কেন তাকে শোয়ানোর পূর্বে চাকু ধারালো করলে না?’ [হাকেম ২৩৩/৪]
৬- শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সকল কিছুর ব্যাপারে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব যখন তোমরা কোন কিছু হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে তা সম্পাদন করবে। যখন কোন কিছু খাওয়ার জন্য জবেহ করবে, তখন সুন্দরভাবে তা করবে। তোমরা চাকু ধারালো করে নিবে। জবেহ করা জন্তুটিকে প্রশান্তি দেবে।’ [সহীহ মুসলিম ১৯৫৫]
৭- ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে যথাযথ কারণ ব্যতীত কোন পাখিকে হত্যা করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার হিসাব নেবেন।’ জিজ্ঞেস করা হল, ‘হে রাসূল! যথাযথ কারণ বলতে কি বুঝায়?’ তিনি বললেন, খাওয়ার জন্য জবেহ করা। এমন যেন না হয় যে অযথা জবেহ করে ফেলে দিলে।’ [নাসায়ী ৪৪৪৫]
৮- একবার ইবনে উমার রা. কুরাইশ গোত্রের কয়েকজন ছেলেকে দেখলেন তারা একটি পাখি বা মুরগীকে বেঁধে তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করছে। তারা যখন ইবনে উমার রা. কে দেখল তখন সরে পড়ল। ইবনে উমার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে এমন কাজ করেছে? যারা এ রকম কাজ করে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত। যার প্রাণ আছে, এমন কোন কিছুকে যে লক্ষ্যস্থল করে (তীর বা গুলির জন্য) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অভিসম্পাত করেছেন।’ [আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : মুনজিরী]
৯- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। আমরা একটা প্রয়োজনে দুরে গেলাম। দেখলাম একটি লাল পাখি তার সাথে দুটো বাচ্চা। আমরা বাচ্চা দুটো কে ধরে নিয়ে আসলাম। তখন মা পাখিটি চলে আসল। বাচ্চা দুটোর কাছে আসার জন্য পাখিটি মাটির কাছে অনবরত উড়তে লাগল। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে পড়লেন। তিনি এ অবস্থা দেখে বললেন, ‘কে এ বাচ্চা এনে তাদের মাকে কষ্ট দিচ্ছে? বাচ্চা তার মায়ের কাছে রেখে এসো।’ তিনি দেখলেন, আমরা এক পিঁপড়ার ঝাঁককে পুড়িয়ে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কে এদের আগুন দিয়ে পুড়েছে? উত্তরে বললাম, ‘আমরা পুড়েছি।’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের এটা উচিত হয়নি। আগুন দিয়ে শাস্তি দেবেন শুধু আগুনের স্রষ্টা। [সহীহ সুনানে আবু দাউদ ১৪৬/২]
১০- জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি গাধার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যার মুখমন্ডলে লোহা পুড়ে দাগ দেয়া ছিল। তিনি বললেন, ‘যে লোহা দিয়ে দাগ দিয়েছে তার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত।’
১১- জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্তু জানোয়ারের মুখমন্ডলে আঘাত করতে ও লোহা দিয়ে দাগ দিতে নিষেধ করেছেন। [সহীহ মুসলিম ২১১৬]
১২- আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাকে পিছনে বসালেন। আমাকে নিয়ে তিনি এক আনসারী সাহাবীর আঙিনায় প্রবেশ করলেন। সেখানে একটি উট ছিল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে ঢুকরে কেঁদে উঠল ও তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। উটটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘাড়ে হাত বুলালে সে কান্না থামাল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ উটটির মালিক কে?’ এক আনসারী যুবক এসে বলল, ‘উটটি আমার ইয়া রাসূলাললাহ!’ তিনি বললেন, ‘তুমি কি জন্তু জানোয়ারের ব্যাপারে আললাহকে ভয় করবে না, যিনি তোমাকে এর মালিক বানিয়েছেন? উটটি আমার কাছে নালিশ করছে তুমি তাকে কষ্ট দাও ও সাধ্যের চেয়ে বেশি কাজ চাপিয়ে দাও।’ [সহীহ সুনানে আবু দাউদ ১১০/২ , আহমাদ ২০৫/১]
এগুলো হল কয়েকটি নমুনা মাত্র। যাতে দেখা গেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ শত্রুদের প্রতি, বন্ধুদের প্রতি, মুসলমানের প্রতি, অমুসলিমের প্রতি, পুরুষের প্রতি, নারীর প্রতি, ছোটদের প্রতি, বড়দের প্রতি, জন্তু-জানোয়ারের প্রতি, পাখিদের প্রতি, পিঁপড়া ও পোকা মাকড়ের প্রতি কীভাবে দয়া, করুণা, মমতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেছেন। যতদিন রাত দিবস আবর্তিত হতে থাকবে, ততদিন আল্লাহ তার উপর শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আমাদের পক্ষ থেকে হাজারো সালাত ও সালাম তার জন্য নিবেদিত হোক।
ত্রয়োদশ প্রকার : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তরের কোমলতা ও বিভিন্ন সময়ে কান্নাকাটি করা-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো উচ্চ শব্দে কান্নাকাটি করতেন না। যেমনিভাবে তিনি অট্টহাসি হাসতেন না। কিন্তু কান্নার সময় তার চোখে অশ্রু দেখা যেত ও বুকের মধ্যে মৃদু আওয়াজ অনুভূত হতো। কখনো তিনি কেঁদেছেন মৃত ব্যক্তির প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে, কখনো কেঁদেছেন তার উম্মতের প্রতি ভয় ও তাদের প্রতি স্নেহ মমতার কারণে। কখনো কেঁদেছেন আল্লাহ তাআলার ভয়ে। আবার কখনো কেঁদেছেন আল্লাহর কালামের তেলাওয়াত শুনে। আর সে ক্রন্দন ছিল আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালোবাসা ও তাঁর মহত্ত্ব অনুভবে।
যে সকল অবস্থায় তিনি ক্রন্দন করেছেন তার কিছু দৃষ্টান্ত :
১- রাতের তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহ তাআলার ভয়ে কান্নাকাটি করেছেন অনেক সময়। বেলাল রা. বলতেন, ‘হে রাসূল! আপনি কাঁদছেন কেন? আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘আমি কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? রাতে আমার উপর একটি আয়াত অবতীর্ণ হলো, দুর্ভাগ্য তার, যে তা পাঠ করলো কিন্তু তাতে চিন্তা করলো না। আয়াতটি হল :
‘‘নিশ্চয় আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনা বলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।’’ [সূরা আলে ইমরান ১৯০, সহীহ ইবনে হিববান ৬২০]
২- সালাত আদায়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আসলাম, দেখলাম তিনি সালাত আদায় করছেন, আর তার বুক থেকে ধুকে ধুকে কান্নার আওয়াজ বের হচ্ছে। [আবু দাউদ ৯০৪, ও সহীহ মুখতাছার শামায়েলে তিরমিজী ২৭৬]
৩- কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণের সময় রাসূলের কান্না : আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে কুরআন পাঠ করে শুনাও।’ আমি বললাম, ইয়া রাসূলাললাহ! আমি আপনাকে কুরআন শুনাবো অথচ কুরআন আপনার উপর নাযিল হয়েছে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অন্যের থেকে শুনতে আমার ভাল লাগে।’
ইবনে মাসউদ বলেন, ‘আমি সূরা নিসা তেলাওয়াত শুরু করে দিলাম। যখন এ আয়াতে পৌঁছে গেলাম
‘‘যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং তোমাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত দাঁড় করাবো তখন কী অবস্থা হবে?’’ [সূরা আন-নিসা : ৪১]
দেখলাম তার দু চক্ষু দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। [সহীহ আল - বুখারী ৪৫৮২, সহীহ মুসলিম ৮০০]
৪- প্রিয়নজনকে হারানোর বেদনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেঁদেছেন। নিজ সন্তান ইবরাহীমের ইন্তেকালে তিনি কেঁদেছেন। তার দু চক্ষু দিয়ে অশ্রু গড়িয়েছে। আব্দুররহমান ইবনে আউফ তা দেখে বললেন, ‘হে রাসূল! আপনিও কাঁদছেন?’ তিনি বললেন, ‘হে আউফের ছেলে! এটা হল দয়া-মমতা . . . চোখ অশ্রু প্রবাহিত করে, অন্তর দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়, কিন্তু আমরা এমন কথাই বলবো যাতে আমাদের প্রতিপালক সন্তুষ্ট হন। হে ইবরাহীম! তোমাকে হারানোর বেদনায় আমরা দুঃখে ও শোকে ভারাক্রান্ত হয়ে গেছি।’ [সহীহ আল - বুখারী ১৩০৩, সহীহ মুসলিম ২৩১৫]
৫- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মেয়ে- উসমান রা. এর স্ত্রী- উম্মে কুলসূম রা. এর ইন্তেকালের কারণে কেঁদেছেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কবরের কাছে বসলেন, দেখলাম তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। [সহীহ আল - বুখারী ১২৮৫]
৬- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আরেক মেয়ের মৃত্যুতে কেঁদেছেন। ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার একটি মেয়ে যখন মৃত্যু শয্যায় তখন তাকে কোলে তুলে নিলেন। তার কোলেই সে ইন্তেকাল করল। উম্মে আইমান চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি আল্লাহর রাসূলের কাছে বসে চিৎকার করে কাঁদছো!’ সে বলল, ‘আমি কি আপনাকে কাঁদতে দেখছি না?’ তিনি বললেন, ‘আমি আসলে তোমার মত কাঁদছিনা। বরং এটা হল দয়া-মমতার প্রকাশ।’ [আহমদ ২৬৮/১]
৭- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এক নাতীর ইন্তেকালে কেঁদেছেন। উসামা বিন যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে তার মেয়ের মাধ্যমে খবর পাঠালাম যে, আমার ছেলে মৃত্যু শয্যায়, আপনি আমাদের কাছে একটু আসুন। তিনি আমাকে সালাম পাঠিয়ে বললেন, ‘যা আল্লাহ নিয়েছেন তা তাঁরই, তিনি যা দিয়েছেন তাও তাঁর। সকল বিষয়ে তাঁর কাছে রয়েছে একটি নির্ধারিত মেয়াদ।’ এরপর তিনি আসলেন। তার সাথে ছিল সাআদ বিন উবাদা, মুআজ বিন জাবাল, উবাই বিন কাআব, যায়েদ বিন সাবেত ও অন্যান্য অনেক সাহাবী। ছেলেটিকে তার কোলে দেয়া হল, তিনি কোলে বসালেন। এমন সময় সে হেঁচকি দিয়ে উঠল, মনে হল সে বিদায় নিল। তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চক্ষু দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হল। সাআদ বিন উবাদা দেখে বলে উঠলেন, ‘হে রাসূল! এটা কী? (কাঁদছেন কেন) তিনি বললেন, ‘এটা হল রহমত-দয়া। যা আল্লাহ মানুষের মধ্যে যাকে চান তার হৃদয়ে দিয়ে থাকেন। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যারা দয়াশীল তিনি তাদের প্রতি দয়া করেন।’ [সহীহ আল - বুখারী ১২৮৪, সহীহ মুসলিম ৯২৩]
৮- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সঙ্গী-সাথিদের ইন্তেকালে কেঁদেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘উসমান ইবনে মাজঊন ইন্তেকাল করার পর রাসূলুল্লাহ তাকে চুমো দিলেন। আমি দেখলাম তার চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে।’ তিরমিজীর বর্ণনায় এসেছে, উসমান ইবনে মাজঊন মৃত্যু বরণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চুমো দিলেন ও কাঁদলেন। তার দু চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল। [সহীহ সুনানে আবু দাউদ ২৮৯/২, তিরমিজী ৯৮৯, ইবনে মাজা ১৪৫৬]
৯- মুতার যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য কেঁদেছেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়েদ ও জাফরের প্রশংসা করেছেন, তাদের শাহাদাতের খবর আসার পূর্বেই। তিনি বললেন, ‘যায়েদ ইবনে হারেসা পতাকা হাতে নিল সে আক্রান্ত হলো। এরপর জাফর পতাকা তুলে নিল সেও আক্রান্ত হল। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা হাতে তুলে নিল সেও আক্রান্ত হল- কথাগুলো বলার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল- শেষে আল্লাহর এক তরবারি সাইফুল্লাহ পতাকা হাতে তুলে নিল, বিজয় হল।’ [সহীহ আল - বুখারী ৪২৬২]
১০- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মায়ের কবর যিয়ারতের সময় ক্রন্দন করেছেন। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মায়ের কবর যিয়ারত করলেন, তখন কাঁদলেন। তার সাথে যারা ছিল তারাও কাঁদল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চাইলাম, অনুমতি পাওয়া যায়নি। তার কবর যিয়ারতের অনুমতি চাইলাম, অনুমতি দেয়া হল। তোমরা কবর যিয়ারত কর, তা তোমাদের মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’ [সহীহ মুসলিম ১০৮]
১১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাআদ বিন উবাদার মৃত্যু শয্যায় অসুস্থতা দেখতে যেয়ে কেঁদেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘সাআদ বিন উবাদা রা. রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে আসেন। তার সাথে আরো ছিলেন আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। যখন তার কাছে পৌছলেন দেখলেন তার পরিবার-পরিজন তার খেদমতে ব্যস্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইন্তেকাল হয়ে গেছে নাকি?’ তারা বলল, না, হে রাসূল! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁদতে শুরু করলেন। অন্যেরা তার কান্না দেখে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তিনি বললেন, ‘তোমরা শুনে রাখো! আল্লাহ তাআলা চোখের অশ্রুর কারণে কাউকে শাস্তি দেবেন না। কিন্তু তিনি শাস্তি দেবেন এর কারণে।’ এ বলে তিনি, মুখের দিকে ইশারা করলেন। [সহীহ আল - বুখারী ১৩০৪, সহীহ মুসলিম ৯২৪]
১২। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের নিকট কেঁদেছেন। এ ব্যাপারে বারা বিন আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক জানাযায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ছিলাম। তিনি একটি কবরের কিনারায় বসলেন। অতঃপর তিনি এত কাঁদলেন যে মাটি পর্যন্ত সিক্ত হয়ে গেল। তারপর বললেন, ‘হে আমার ভ্রাতাগণ! তোমরা এ কবরের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ কর।’ [ইবনে মাজাহ ৪১৯৫]
১৩। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর যুদ্ধের রাত্রিতে নামাজ পড়ে প্রভুর সাথে গোপন আলাপ ও দু‘আ করতে করতে সকাল পর্যন্ত কেঁদেছেন। এ ব্যাপারে আলী বিন আবু তালেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন বদর যুদ্ধে ছিলাম, আমি দেখলাম যে, আমাদের সকলে ঘুমন্ত কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি গাছের নীচে সকাল পর্যন্ত নামাজ পড়ছেন আর কেঁদেছেন। [ইবনে খুযাইমা ২,৮৯৯, আহমাদ ১২৫/১]
১৪। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য গ্রহণের নামাজে কেঁদেছেন। এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়ে সূর্য গ্রহণ লাগল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়তে দাঁড়ালেন। তারপর সেজদা করলেন। অতঃপর তিনি তখনও মাথা উত্তোলন করেননি এর মধ্যে তিনি ফুঁক দিতে লাগলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, নামাজ শেষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়ালেন এবং আল্লাহ তাআলার প্রশংসা, স্ত্ততি গাইলেন। অতঃপর বললেন যে, জাহান্নাম আমার সামনে পেশ করা হল তখন আমি তাতে ফুঁক দিতে লাগলাম এবং আশংকা করলাম যে, তা তোমাদের গ্রাস করে নেবে। এ ব্যাপারে আরো বর্ণনা আছে যে, তিনি বলেন হে প্রভু! তুমি কি আমাকে প্রতিশ্রুতি দাওনি যে, তুমি তাদের শাস্তি দেবে না।’ [ইবনে খুযাইমা ৯০১]
১৫। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর যুদ্ধের বন্দিদের মুক্তিপণ গ্রহণ করার কারণে কেঁদেছেন। এ বিষয়ের হাদীস আব্দুল্লাহ বিন আববাস রা. উমার বিন খাত্তাব রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন তারা বন্দিদের কয়েদ করল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রা. ও উমার রা. কে বললেন তোমরা এদের ব্যাপারে কি বল? আবু বকর বলল, ‘হে আল্লাহর নবী! তারা তো আপনার চাচার বংশধর ও আপনার গোত্রের লোক, তাই আমি মনে করি যে, আপনি তাদের থেকে মুক্তিপণ নিয়ে নেন। যা দিয়ে আমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে শক্তি যোগাব। আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তাদের ইসলামের হেদায়েত দান করবেন।’ তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে উমার! তোমার মতামত কি? তিনি বললেন যে, ‘আমি বললাম ‘না, আল্লাহর শপথ! হে আল্লাহর রাসূল! আবু বকর যে মতামত দিয়েছে আমি তার সাথে একমত নই। তবে আমি মনে করি যে, আপনি আমাকে সুযোগ করে দেবেন, আর আমি তাদের গর্দান উড়িয়ে দেব। সুতরাং আলীকে সুযোগ করে দেবেন আকীলকে হত্যা করার, এবং আমাকে অমুক ব্যক্তি যে আমার আত্মীয় তাকে হত্যা করার সুযোগ করে দেবেন। নিশ্চয় তারা কাফেরদের নেতা ও তাদের সরদার।’ পরিশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকরের সিদ্ধান্ত পছন্দ করলেন। আর আমার সিদ্ধান্ত পছন্দ করেননি। পরের দিন যখন আমি আসলাম, তখন দেখলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর রা. উপবিষ্ট অবস্থায় কাঁদছেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে বলুন কেন আপনি ও আপনার বন্ধু কাঁদছেন? যদি আমি কাঁদতে পারি তাহলে কাঁদব আর যদি কাঁদতে না পারি তাহলে আপনাদের ক্রন্দনের মত করে নিজেকে পেশ করব।’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যে মুক্তিপণ গ্রহণের কথা তোমার সাথিরা পেশ করেছে তার জন্য কাঁদছি।’ অবশ্যই তাদের শাস্তি আমার সামনে পেশ করা হয়েছে এই গাছের থেকে আরো নিকটবর্তী করে যে গাছটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে ছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।
‘‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাত। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ তার জন্য তোমাদের উপর আপতিত হত মহা-শাস্তি। সুতরাং যুদ্ধে তোমার যা লাভ করেছ তা বৈধ ও উত্তম হিসাবে গ্রহণ কর।’’ সূরা আল-আনফাল : ৬৭-৬৯
এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য গণীমত হালাল করে দিলেন। [সহীহ মুসলিম ১৭৬৩]
১৬। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতের প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে কেঁদেছেন এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইব্রাহীম আ. সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াতখানা আবৃত্তি করলেন :
‘‘হে প্রভু! নিশ্চয় তারা অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছেন। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলের আর যে আমার অবাধ্য হবে নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, করুণাময়।’’ সূরা ইবরাহীম : ৩৬
‘‘যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন তাহলে তারা আপনার বান্দা। আর যদি ক্ষমা করে দেন, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি শক্তিশালী প্রজ্ঞাময়’’। সূরা আল-মায়েদা : ১১৮
অতঃপর উভয় হাত উত্তোলন করলেন এবং বললেন, ‘হে আললাহ! আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ এবং কাঁদলেন। আল্লাহ তাআলা বললেন: ‘‘হে জিবরীল তুমি মুহাম্মাদের কাছে যাও আর তোমার প্রভু তার ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত। তারপর তাকে সালাম দাও এবং বল আপনি কেন কাঁদছেন?’’ জিবরীল তার নিকট আসলো এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলে দিলেন যা তিনি বলেছেন, আর আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে বেশি জ্ঞাত। আল্লাহ তাআলা বললেন: ‘‘হে জিবরীল! মুহাম্মাদের নিকট যাও এবং বল অবশ্যই আমি তোমাকে তোমার উম্মতের ব্যাপারে খুশি করব তোমাকে কষ্ট দেয় এমন কিছু করব না।’’ [সহীহ মুসলিম ২০২]
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/408/7
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।