HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
মুসলমানদের পতন অতীত বর্তমান (সালাহউদ্দীন আইউবীর আবির্ভাব পূর্ব ইসলামি বিশ্ব ও বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা)
লেখকঃ মুহাম্মদ আল আবদাহ
বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠী যেসব বিষয় চর্চা করে এবং যেসব বিষয় আয়ত্ত করার জন্য দূর-দূরান্তে সফর করে, ইতিহাস তার অন্যতম। ইতিহাস এমন একটা প্রমাণসিদ্ধ বিষয়, অতীতের নানা জাতি- গোষ্ঠীর ঘটনা প্রবাহে যে সম্পর্কে হ্রাস- বৃদ্ধি করা যায় না এবং এর অভ্যন্তরে নিহিত রয়েছে চিন্তা-গবেষণার উপকরণ আর গোটা বিশ্ব প্রকৃতির সূক্ষ্ম তত্ত্ব। ঘটনাবলীর প্রকৃতি আর তার কার্যকারণের গভীর জ্ঞান। আর এর সূক্ষ্ম তত্ত্বের জন্য তা হচ্ছে এক মৌলিক উপাদান।
--ইবনে খালদূন
--ইবনে খালদূন
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। আদিকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ কথার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসকে যুগভিত্তিক বিভক্ত করা হলেও মূলত: সব যুগের শিক্ষাই এক। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা একচ্ছত্র মালিকানায় অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করা স্বীয় প্রবৃত্তির দাসত্ব, মানুষের উপরে ক্ষমতার দাপটে প্রভুত্ব চালিয়ে ভোগ বিলাসের রাজত্ব কায়েম করা- এ সবই দেখা যায় শক্তিধর বিত্তবানদের মধ্যে। মাত্র কিছুকাল পূর্বে ঘটে যাওয়া প্রলয়ের কথা নূহ পরবর্তী মানুষগুলো ভুলে গেল। আদ-সামুদ আর অন্যান্য জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ স্বচক্ষে দেখেও মক্কার কোরাইশরা ভ্রষ্টতা ও কুফুরীর পথকেই আঁকড়ে ধরে সৃষ্টিকর্তার প্রভুত্বকে অস্বীকার করে একই পথে অগ্রসর হলো। এমনিভাবে বনী ইসরাঈল ও বারবার তাদের আম্বিয়া কেরামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইতিহাস ধিক্কৃত হয়ে শাস্তি ভোগ করেও শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনে পুনরায় একই আচরণ করল। আল্লাহ তাআলা সূরা আল-ইসরা এর ২য় আয়াত থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে তাদেরকে পূর্ব ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শেষ নবীর সাথে এই একই আচরণের পরিণতির কথা বলে সাবধান করেন। কিন্তু মানবতার শত্রু বনী ইসরাঈল বা ইয়াহুদীরা কি তাদের আচরণে আদৌ কোন পরিবর্তন এনেছে? এর পর আল্লাহ তাআলা পরবর্তী আরেকটি আয়াতে একটি সার্বজনীন মূলনীতির কথা স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছেন, ‘‘তোমরা ভাল আচরণ করলে তার সুফল তোমরা পাবে, আর অসৎ আচরণ করলে তার পরিণতি তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে’’। কুরআনের এ নীতি কোন নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর জন্য নয়। যে জাতি ভালভাবে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিচালিত করে খেলাফতের গুরু দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করবে, তার খেলাফতকে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসবে। আল্লাহ তাঁর সমস্ত কল্যাণ ও রহমতের দ্বার সে জাতির সম্মুখে উদারভাবে খুলে দেবেন। এটাই আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ও অমোঘ বিধান। এই হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতি অন্য কোন বস্ত্তর নাম নয়। আল্লাহর বিধান অনুসারে চলতে পারলেই শান্তি ও কল্যাণ। আর বিপরীত পথে অগ্রসর হলেই বিপর্যয় ও শাস্তি।
গ্রন্থকার মুহাম্মদ আল-আবদাহ আমার ব্যক্তিগত পরিচিত কেউ নন। তাঁর প্রাক সালাহউদ্দীন আইয়ুবী যুগের বিশৃঙ্খলার উপর লিখিত ইতিহাসের বইটি আমাকে অত্যন্ত আকৃষ্ট করেছে।
এই বইটিতে মূলত: হিজরী ৩য় শতাব্দী থেকে প্রায় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত আরব জাহানের শাসকদের বিলাস বহুল জীবন যাপন, অপব্যয়-অপচয় সহ রাষ্ট্র পরিচালনা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত, বাতেনী সম্প্রদায়ের সন্ত্রাস, ওবায়দী, বুয়াইহী, কারামেতা, বনু হামদান, ও সুলাইহী সম্প্রদায়ের কর্তৃত্বের লোভে হত্যা ষড়যন্ত্র ও সংঘর্ষের লোমহর্ষক কাহিনি সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। আরো বর্ণিত হয়েছে আববাসীয় খলিফাদের আমলে সুন্নাহর প্রকাশ ও জ্ঞান- বিজ্ঞান প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং উলামায়ে কেরামের ইসলাম প্রতিষ্ঠার জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনের কথা।
তদানীন্তনকালে ও আজকের ন্যায় মুসলিম বিশ্ব পরস্পর সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ সব হয়েছিল ব্যক্তিস্বার্থ ও ছোটোখাটো বিষয়ে মতভেদ এবং মতপার্থক্যের কারণে। ক্ষমতার মসনদ দখল করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তারা পরস্পরের সাথে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলত। একে অন্যকে পরাজিত করার জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকে সাহায্য নিতেও দ্বিধা করতো না। আর এই সব কারণেই তাদের মধ্যে হিংস্রতা চলে আসে। তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ে। দূরীভূত হয় আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া। দুনিয়াবী ভোগবিলাসে আর লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে শাসক শ্রেণি। বিত্ত আর ক্ষমতার মোহে তারা ভুলে যায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত সত্য পথে আহবানের কথা।
বর্তমান যুগের ইতিহাসের সঙ্গে সে যুগের কী অভূতপূর্ব সাদৃশ্য। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধরদের দাপট আর স্বার্থান্বেষী ও অর্থ লোভীদের সাম্রাজ্যের কথা একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের দুর্নীতি ও জুলুম অত্যাচারের কাহিনির সাথে আববাসীয় যুগের মন্ত্রীদের অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। তাই প্রশ্ন জাগে ‘‘ইতিহাসের কি সত্যিই পুনরাবৃত্তি ঘটে?’’
আল-কুরআনে ফেরাউন ও নমরুদের কাহিনির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা মিশর আর ইরাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এদের কাহিনি শুধু সেই বিশেষ যুগের জন্যও নয় বরং বংশ পরম্পরায় আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে। মিশরের জামাল আব্দুল নাসের আর মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুতুল সরকার মূলত সেই স্বৈরাচারের বংশোদ্ভুত। তাদের হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছেন বিশ্ব বরেণ্য ইসলামি মনীষী হাসানুল বান্না, প্রখ্যাত মোফাসসের ও প্রতিভাবান লেখক সাইয়েদ কুতুবসহ আরও অসংখ্য ইসলামি চিন্তাবিদ, ওলামা ও সংস্কারবাদী মুসলিম মনীষীগণ। এদের অপরাধ ছিল একটাই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার আহবান।
وَمَا نَقَمُوا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوا بِاللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ ﴿৮﴾
‘‘ওরা (কাফেরগণ) তাদের নিকট থেকে এই অপরাধেরই প্রতিশোধ নিয়েছে যে, তারা সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহর প্রভুত্বেই বিশ্বাস স্থাপন করতো।’’ (সূরা বুরুজ)।
লেখক অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে আববাসীয় যুগের বহু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ : ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন ‘‘সুলতান মালিক শাহর (হিজরী ৪৮০ সন) কন্যার বিবাহের জৌলুসের কাহিনি। তিনি বলেন, সে বছর মুহররম মাসে রাজধানীতে বাদশাহর মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩০টি উষ্ট্রের পৃষ্ঠ বোঝাই করে মেয়ের জন্য আনা উপঢৌকনগুলো রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়। রোমের মহামূল্যবান দিবাজ’ বস্ত্র দ্বারা উষ্ট্রগুলোকে সাজানো হয়। এসব উপঢৌকনের বেশির ভাগই ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত তৈজসপত্র। এছাড়া ৭৪টি খচ্চরকে দেশীয় রাজকীয় পোশাক পরিচ্ছদ দ্বারা সজ্জিত করে তাদের পৃষ্ঠেও বহন করে আরো উপঢৌকন সামগ্রী রাজধানীতে আনা হয়। এর সঙ্গে কি আমাদের দেশের ঢাকায় অনুষ্ঠিত (২৮ মার্চ ২০০০) ২০ হাজার মেহমান আগমনে বিশ বিবাহ মজলিসের জৌলুসের কথা তুলনা করা যায় না? পত্র পত্রিকা থেকে এই বিয়ের ও বউভাতের যে হিসেব পাওয়া যায়, সেখানে খরচ হয়েছিল কয়েক কোটি টাকা। বিয়ে ও বউভাতের ১ দিনের হিসেবে মোটামুটিভাবে যা জানা গেল তাতে দেখা যায় যে, মেহমান ছিল ২০ হাজার, গরু জবাই হয়েছে ২৬টি, খাসি ৬০ টি ও মুরগি ছিল ২০ হাজার। এটি কি একটি গরিব জাতির দুর্দশার সঙ্গে প্রহসন নয়? অথচ দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে। মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনা, একটি আরব দেশের প্রেসিডেন্টের ছেলের বিয়ের আনন্দ উৎসবের চিত্র সারা বিশ্বের লোকদের হতবাক করে দিয়েছিল। বিশ্বের আনাচে কানাচে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের হাজার হাজার নর্তক ও নর্তকীদের আমদানি করে দশ দিন যাবৎ নাচ গানের উৎসব করা হয়েছিল। এই বিয়ের মূল বাজেট ছিল কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি কি গরিব মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণের সঙ্গে ঠাট্টা করা নয়? এই তো সেদিন খবর বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ গত চার বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনে ফেলেছেন। বাড়ি কিনেছেন লন্ডনে, সিঙ্গাপুরে, দুবাইয়ে, মালয়েশিয়ায়।
বইটিতে আরও একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আর তা হচ্ছে ধর্মের নামে ভন্ডামির নানা চিত্র। তথাকথিত তাসাউফের নামে সরলপ্রাণ মুসলিমদেরকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে জড়ানোর বিচিত্র রূপ হচ্ছে আমাদের দেশের দেওয়ানবাগী, আটরশী, মাইজভান্ডারী। আর ইবলিসের ন্যায় তারাও শিখন্ডী হিসেবে জনগণের মাথায় চেপে বসেছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। আরও মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন চক্রান্তে। ইসলামের বিজয়ের পর পরাজিত ইহুদি চক্র ছদ্মবেশে মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে আসছিল, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকেই। আহলে বাইতের নাম করে অত্যন্ত নাজুক ও গুরুত্বপূর্ণ শিরার উপর তারা আঙুল স্থাপন করেছিল সময় ও সুযোগ বুঝেই। যা মুসলিম বিশ্ব আজও ছিন্ন করতে পারেনি। এরা আহলে বাইতের ভালোবাসার ভান করত: মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দেশ দখল করে নিয়েছিল। তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আঘাত করতে থাকে মুসলিম উম্মার পশ্চাৎ দিক থেকে। খ্রিস্টীয় রোমান আর পৌত্তলিক তাতারি হায়েনাদের সম্মুখে মুসলমানদেরকে তুলে দেয় শিকারের জন্তু হিসেবে। টেনে হিঁচড়ে দীর্ঘদিনের ক্ষুধা নিবারণের জন্য, এভাবেই তারা মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস ও নিঃশেষ করার গোপন জিঘাংসা পূর্ণ করে। লেখক তাঁর বইতে এই বিষয়টি যথার্থ সফলতার সাথে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। হক্কানি উলামায়ে কেরাম সেই যুগেও বিক্রি হয়ে যায়নি জালিম ষড়যন্ত্রকারী ও বহিরাগতদের কাছে। তাই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত সে যুগের হক্কানি উলামায়ে কেরামদের নাম ধরে ধরে ড: মুহাম্মদ আবদাহ তার বইতে এ সব উলামায়ে কেরামদের খেদমতকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তখনও মিটি মিটি তারা জ্বলছিল। এ তারাগুলোর সমষ্টিগত আলোকচ্ছটা একদিন উজ্বল হয়ে তার মধ্যে থেকেই চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলোর উদ্ভাবন ঘটে। আর এভাবেই দূরীভূত হয়ে যায় মেঘের ঘনঘটা। সুন্নাহ ফিরে পায় তার প্রকৃত উচ্চাসন। তখন উলামায়ে কেরামের অবিরাম প্রচেষ্টায় শিয়া ইজমের বেড়াজল ছিন্ন হয়ে পড়ে। সত্য সমাগত হয়, মিথ্যা অপসারিত হয়।
আল কুদস মুক্তির জন্য আইয়ুবী আন্দোলন মূল তৎপরতা তাদের একার নয়। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আগমনের পূর্ব থেকেই উলামায়ে কেরামগণের লাগাতার জেহাদ ও লেখনীরই ফল ছিল এ রক্তক্ষয়ী অভিযান ও ভয়াবহ যুদ্ধ। যে কোন মুক্তি আন্দোলন এক দিনে দানা বাদে না এবং সংগঠিত হয় না। আর গুটিকয় মুজাহিদদের দ্বারাও তা সম্ভব হয়ে উঠে না। সম-সাময়িককালের অন্যান্য আন্দোলনেও আমরা এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করি। বিশেষভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন কুসংস্কার আর স্বার্থান্ধতার প্রাচীর দাঁড় করানো হয়, তখন ধর্মান্ধতা ও অজ্ঞতা পথে ছড়িয়ে পড়ে এবং পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে । এসব জাহেলি ঝঞ্জাট দূরীভূত করার সংগ্রাম অত্যন্ত দুরূহ। একটু চোখ মেলে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই সে সম্পর্কে আমরা ধারণা নিতে পারি। বিভিন্ন ধারার ও রূপের সুফিবাদ তাসাউফ এর নামে পীর মুরিদী ব্যবসা, কবর পূজার শেরকী কার্যক্রম ধর্মীয় আবরণে নানা ধরনের অনাচার রাজনৈতিকভাবে সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র মুসলিম সমাজ রূপী বিশ বটবৃক্ষকে যেন পরগাছার ন্যায় সর্বতোভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। এখন এ বৃক্ষকে পরগাছার রাহু গ্রাস থেকে আজাদ করা ছোট একটি ব্যাপার নয়। এজন্য প্রয়োজন দুর্দান্ত এক অভিযানের। সর্বোপরি রয়েছে ঠিক সেই যুগের ন্যায় নানা ধরনের আন্তর্জাতিক গোপন ও প্রকাশ্য চক্রান্ত। যা ছিন্ন করার কাজও তত সহজ নয়। কারণ এ সবগুলোই দেশীয় গাদ্দারদের সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। সেইজন্যই প্রয়োজন দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে আন্দোলনে অগ্রসর হওয়া। ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলাদেশি সমাজে শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত বিভিন্ন ফিরকার সংখ্যা অতি নগণ্য। কিন্তু ওইসব মতবাদের প্রভাব থেকে এ সমাজও মুক্ত নয়। যা এদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন রূপে দেশের সাধারণ সরলপ্রাণ মানুষদের বিভ্রান্ত করেছে। সে যুগের বাতেনী ফিরকাগুলোর সাথে আমাদের দেশের শয়তানি পীর- মুরিদী চিন্তা ধারার হুবহু মিল না থাকলেও মূলত: তা একই বৃক্ষেরই নানান ডাল। এটিই মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে রেখেছে অসংখ্য ফেরকায়। আববাসীয়দের সেই আমলের মুসলিম অধঃপতনের মূল কারণগুলো মূলত: অভিন্ন। আমরা কি এর রেশ ধরেই পতনের গভীর সমুদ্রের অতল গহবরে বিলীন হয়ে পড়ছি? আমাদের উলামায়ে কেরাম, লেখক, সাহিত্যিকগণ বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও কুসংস্কার থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্ত করার জন্য জাগ্রত হয়ে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আগমন পূর্ব পরিস্থিতির মত করে এগিয়ে আসবেন সর্বতোভাবে জেহাদ করার উদ্দেশ্যে? আর আল কুদসসহ ইসলামি উম্মার হারানো অংশগুলোকে পুনরায় একত্রিত করে সারাবিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করবেন? জগৎবাসী আজ তাকিয়ে আছে সেই নেতৃত্বের উপযোগী যোগ্য উলামায়ে কেরামের দিকে। তারা ঐক্যবদ্ধ হলে এখনও সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর আগমন সম্ভব। আমাদের প্রভু, বিশ্ব জগতের মালিক রাববুল আমীন সদা জাগ্রত। বান্দারা প্রস্ত্তত হলেই তিনি সাহায্যের হাত প্রসারিত করবেন; এটিই সত্য আগামী দিনের সূর্যোদয়ের ন্যায়।
ইতিহাসের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি ঘটে ঠিক কালে কালে, যুগে যুগে, অক্ষরে অক্ষরে এটা কোন বোকাও বলবে না। ফেরাউন ও নমরূদের স্বেচ্ছাচারিতা, অহমিকা, খোদা দ্রোহী তার সাথে সাথে তাদের তখতে তাউস এর রূপের প্রকাশ ঘটেছিল রেজা শাহ পাহলভীসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য স্বেচ্ছাচারীরা যেমন বিশ্বকে তাদের দাবা খেলার পাতায় রেখে ভাগ বাটোয়ারা করতো, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি কি তার চাইতে ভিন্ন? চেচেনদের ছোট্ট দেশটিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করার ষড়যন্ত্র, কাশ্মীরকে অস্ত্রের মুখে নিশ্চিহ্ন করার ব্রাক্ষণবাদীদের পৌত্তলিক আগ্রাসন, আফগানিস্থান ইরাককে দখল করে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা, সোমালিয়ায় মার্কিন আগ্রাসন, তাতারি চেঙ্গীস খাঁন আর হালাকদের চাইতে কি ভিন্ন? নাম ধামের পার্থক্য থাকলেও মূল দৃশ্যটা কিন্তু একই। বর্তমান বিশ্ব ইহুদি চক্রের হোয়াইট হাউজের লোকেরা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলের মূল্যবান সম্পদ। মুসলিম নামধারী দালালদের প্রতারণা, ধোঁকা আর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ছিন্ন ভিন্ন করে খাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের অফুরন্ত সম্পদশালী অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যকে। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের সাথে সে অধ্যায়ের সঙ্গে, পরিস্থিতি ও মূল ভাবধারার মিল রয়েছে। যুগ, কাল, তামাদ্দুনিক অবস্থা ভিন্ন হলেও প্রকৃত অবস্থাটি এক ও অভিন্ন।
ইতিহাসের বিবর্তন নামের এই বইটিতে আরব জাহানের বিভিন্ন শাসকদের মধ্যে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও অসতর্কতার বর্ণনা রয়েছে। আর-এ সুযোগে পূর্ব থেকে ঘাপটি মেরে থাকা মিথ্যাবাদীরা যে সক্রিয় হয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে ইসলাম এবং ইসলামি জাহানের ক্ষতি সাধনের লক্ষ্যে তথাকথিত মুসলমান ও ইসলামের দাবি নিয়ে ইহুদিদের গোপন পরামর্শে স্থান-কাল ও অবস্থা ভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে বিভক্ত হয়ে জেগে উঠে ছিল তার কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে। আর এজন্য তখনকার মুসলিম শাসকদেরকে এ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় বহু মূল্য দিতে হয়েছে। মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ও মুসলিম জাহানের ঐ সব শত্রুরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বংশধরের মিথ্যা দাবি নিয়ে, মিথ্যা নছব তৈরি করে যুগের পর যুগ বিভিন্ন রাজ্য শাসন করেছে। মূলত: এরা ছিল ইহুদিদের এজেন্ট। তাদের কাজ ছিল মুসলমানদের ক্ষতি ও ধ্বংস সাধন করা। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল বাতেনী, ওবায়দী, বুয়াইহী, কারামেতা, বনু হাবদান ও সুলাইহী সম্প্রদায়সমূহ।
প্রথম দিকে ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে না পারার কারণে এরা পরদার অন্তরালে থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আর মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে গর্জে উঠে। তথাকথিত এসব মুসলমান নামধারীরা ইসলাম ও ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা দখল ছাড়াও নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সুযোগ পেলেই মুসলিম উম্মার পিছন দিক থেকে তারা ছুরিকাঘাত করতো। এভাবে দুনিয়াবী ভোগ বিলাস আর লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে তারা। আর ক্ষমতার মোহে হারিয়ে যায় তাদের মনুষ্যত্ব। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে নানা অপসংস্কৃতি ও ইসলামের অপ ব্যাখ্যা। বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হয় তারা। তাদের শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লোভে মুসলমানদের উপর যেই সীমাহীন নির্যাতন, হত্যা, সংঘর্ষ আর বর্বর ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে, তার বর্ণনাও এই বইটিতে রয়েছে। বইটির শেষাংশে হক্কানি উলামায়ে কেরামের জেহাদ, সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আন্দোলন ও শাসন এবং আববাসীয় খলিফার আমলে সুন্নাহের প্রকাশ ও জ্ঞান- বিজ্ঞান প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন এবং সংস্কার আন্দোলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
বইটির অনুবাদ ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে আমাদের অজান্তে ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। এজন্য সেসব ভুলত্রুটি আমাদেরকে অবহিত করার অনুরোধ থাকল। বইটির অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রকাশনায় যাদের সহযোগিতা পেয়েছি তাদের সকলের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
এ বইয়ের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব বীর যোদ্ধা গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর উপর একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি আমরা পরিশিষ্টে সংযোজন করলাম।
ভূমিকায় নিজ অভিমত লিখে কলেবর বৃদ্ধি করার চাইতে পাঠকদের দৃষ্টি মূল বইয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আমি এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০০২
হাফেজ নেছার উদ্দিন আহমদ
ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। আদিকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ কথার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। ইতিহাসকে যুগভিত্তিক বিভক্ত করা হলেও মূলত: সব যুগের শিক্ষাই এক। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা একচ্ছত্র মালিকানায় অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করা স্বীয় প্রবৃত্তির দাসত্ব, মানুষের উপরে ক্ষমতার দাপটে প্রভুত্ব চালিয়ে ভোগ বিলাসের রাজত্ব কায়েম করা- এ সবই দেখা যায় শক্তিধর বিত্তবানদের মধ্যে। মাত্র কিছুকাল পূর্বে ঘটে যাওয়া প্রলয়ের কথা নূহ পরবর্তী মানুষগুলো ভুলে গেল। আদ-সামুদ আর অন্যান্য জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ স্বচক্ষে দেখেও মক্কার কোরাইশরা ভ্রষ্টতা ও কুফুরীর পথকেই আঁকড়ে ধরে সৃষ্টিকর্তার প্রভুত্বকে অস্বীকার করে একই পথে অগ্রসর হলো। এমনিভাবে বনী ইসরাঈল ও বারবার তাদের আম্বিয়া কেরামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইতিহাস ধিক্কৃত হয়ে শাস্তি ভোগ করেও শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনে পুনরায় একই আচরণ করল। আল্লাহ তাআলা সূরা আল-ইসরা এর ২য় আয়াত থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে তাদেরকে পূর্ব ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শেষ নবীর সাথে এই একই আচরণের পরিণতির কথা বলে সাবধান করেন। কিন্তু মানবতার শত্রু বনী ইসরাঈল বা ইয়াহুদীরা কি তাদের আচরণে আদৌ কোন পরিবর্তন এনেছে? এর পর আল্লাহ তাআলা পরবর্তী আরেকটি আয়াতে একটি সার্বজনীন মূলনীতির কথা স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছেন, ‘‘তোমরা ভাল আচরণ করলে তার সুফল তোমরা পাবে, আর অসৎ আচরণ করলে তার পরিণতি তোমাদেরকেই ভোগ করতে হবে’’। কুরআনের এ নীতি কোন নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর জন্য নয়। যে জাতি ভালভাবে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিচালিত করে খেলাফতের গুরু দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করবে, তার খেলাফতকে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসবে। আল্লাহ তাঁর সমস্ত কল্যাণ ও রহমতের দ্বার সে জাতির সম্মুখে উদারভাবে খুলে দেবেন। এটাই আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ও অমোঘ বিধান। এই হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতি অন্য কোন বস্ত্তর নাম নয়। আল্লাহর বিধান অনুসারে চলতে পারলেই শান্তি ও কল্যাণ। আর বিপরীত পথে অগ্রসর হলেই বিপর্যয় ও শাস্তি।
গ্রন্থকার মুহাম্মদ আল-আবদাহ আমার ব্যক্তিগত পরিচিত কেউ নন। তাঁর প্রাক সালাহউদ্দীন আইয়ুবী যুগের বিশৃঙ্খলার উপর লিখিত ইতিহাসের বইটি আমাকে অত্যন্ত আকৃষ্ট করেছে।
এই বইটিতে মূলত: হিজরী ৩য় শতাব্দী থেকে প্রায় ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত আরব জাহানের শাসকদের বিলাস বহুল জীবন যাপন, অপব্যয়-অপচয় সহ রাষ্ট্র পরিচালনা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাত, বাতেনী সম্প্রদায়ের সন্ত্রাস, ওবায়দী, বুয়াইহী, কারামেতা, বনু হামদান, ও সুলাইহী সম্প্রদায়ের কর্তৃত্বের লোভে হত্যা ষড়যন্ত্র ও সংঘর্ষের লোমহর্ষক কাহিনি সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। আরো বর্ণিত হয়েছে আববাসীয় খলিফাদের আমলে সুন্নাহর প্রকাশ ও জ্ঞান- বিজ্ঞান প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং উলামায়ে কেরামের ইসলাম প্রতিষ্ঠার জিহাদ ও সংস্কার আন্দোলনের কথা।
তদানীন্তনকালে ও আজকের ন্যায় মুসলিম বিশ্ব পরস্পর সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ সব হয়েছিল ব্যক্তিস্বার্থ ও ছোটোখাটো বিষয়ে মতভেদ এবং মতপার্থক্যের কারণে। ক্ষমতার মসনদ দখল করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তারা পরস্পরের সাথে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলত। একে অন্যকে পরাজিত করার জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকে সাহায্য নিতেও দ্বিধা করতো না। আর এই সব কারণেই তাদের মধ্যে হিংস্রতা চলে আসে। তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ে। দূরীভূত হয় আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া। দুনিয়াবী ভোগবিলাসে আর লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে শাসক শ্রেণি। বিত্ত আর ক্ষমতার মোহে তারা ভুলে যায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদর্শিত সত্য পথে আহবানের কথা।
বর্তমান যুগের ইতিহাসের সঙ্গে সে যুগের কী অভূতপূর্ব সাদৃশ্য। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধরদের দাপট আর স্বার্থান্বেষী ও অর্থ লোভীদের সাম্রাজ্যের কথা একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের দুর্নীতি ও জুলুম অত্যাচারের কাহিনির সাথে আববাসীয় যুগের মন্ত্রীদের অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। তাই প্রশ্ন জাগে ‘‘ইতিহাসের কি সত্যিই পুনরাবৃত্তি ঘটে?’’
আল-কুরআনে ফেরাউন ও নমরুদের কাহিনির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা মিশর আর ইরাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এদের কাহিনি শুধু সেই বিশেষ যুগের জন্যও নয় বরং বংশ পরম্পরায় আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে। মিশরের জামাল আব্দুল নাসের আর মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুতুল সরকার মূলত সেই স্বৈরাচারের বংশোদ্ভুত। তাদের হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছেন বিশ্ব বরেণ্য ইসলামি মনীষী হাসানুল বান্না, প্রখ্যাত মোফাসসের ও প্রতিভাবান লেখক সাইয়েদ কুতুবসহ আরও অসংখ্য ইসলামি চিন্তাবিদ, ওলামা ও সংস্কারবাদী মুসলিম মনীষীগণ। এদের অপরাধ ছিল একটাই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার আহবান।
وَمَا نَقَمُوا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوا بِاللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ ﴿৮﴾
‘‘ওরা (কাফেরগণ) তাদের নিকট থেকে এই অপরাধেরই প্রতিশোধ নিয়েছে যে, তারা সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহর প্রভুত্বেই বিশ্বাস স্থাপন করতো।’’ (সূরা বুরুজ)।
লেখক অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে আববাসীয় যুগের বহু ঘটনার উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ : ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন ‘‘সুলতান মালিক শাহর (হিজরী ৪৮০ সন) কন্যার বিবাহের জৌলুসের কাহিনি। তিনি বলেন, সে বছর মুহররম মাসে রাজধানীতে বাদশাহর মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩০টি উষ্ট্রের পৃষ্ঠ বোঝাই করে মেয়ের জন্য আনা উপঢৌকনগুলো রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়। রোমের মহামূল্যবান দিবাজ’ বস্ত্র দ্বারা উষ্ট্রগুলোকে সাজানো হয়। এসব উপঢৌকনের বেশির ভাগই ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত তৈজসপত্র। এছাড়া ৭৪টি খচ্চরকে দেশীয় রাজকীয় পোশাক পরিচ্ছদ দ্বারা সজ্জিত করে তাদের পৃষ্ঠেও বহন করে আরো উপঢৌকন সামগ্রী রাজধানীতে আনা হয়। এর সঙ্গে কি আমাদের দেশের ঢাকায় অনুষ্ঠিত (২৮ মার্চ ২০০০) ২০ হাজার মেহমান আগমনে বিশ বিবাহ মজলিসের জৌলুসের কথা তুলনা করা যায় না? পত্র পত্রিকা থেকে এই বিয়ের ও বউভাতের যে হিসেব পাওয়া যায়, সেখানে খরচ হয়েছিল কয়েক কোটি টাকা। বিয়ে ও বউভাতের ১ দিনের হিসেবে মোটামুটিভাবে যা জানা গেল তাতে দেখা যায় যে, মেহমান ছিল ২০ হাজার, গরু জবাই হয়েছে ২৬টি, খাসি ৬০ টি ও মুরগি ছিল ২০ হাজার। এটি কি একটি গরিব জাতির দুর্দশার সঙ্গে প্রহসন নয়? অথচ দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে। মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনা, একটি আরব দেশের প্রেসিডেন্টের ছেলের বিয়ের আনন্দ উৎসবের চিত্র সারা বিশ্বের লোকদের হতবাক করে দিয়েছিল। বিশ্বের আনাচে কানাচে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের হাজার হাজার নর্তক ও নর্তকীদের আমদানি করে দশ দিন যাবৎ নাচ গানের উৎসব করা হয়েছিল। এই বিয়ের মূল বাজেট ছিল কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি কি গরিব মুসলিম বিশ্বের জনসাধারণের সঙ্গে ঠাট্টা করা নয়? এই তো সেদিন খবর বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদ গত চার বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কিনে ফেলেছেন। বাড়ি কিনেছেন লন্ডনে, সিঙ্গাপুরে, দুবাইয়ে, মালয়েশিয়ায়।
বইটিতে আরও একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আর তা হচ্ছে ধর্মের নামে ভন্ডামির নানা চিত্র। তথাকথিত তাসাউফের নামে সরলপ্রাণ মুসলিমদেরকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে জড়ানোর বিচিত্র রূপ হচ্ছে আমাদের দেশের দেওয়ানবাগী, আটরশী, মাইজভান্ডারী। আর ইবলিসের ন্যায় তারাও শিখন্ডী হিসেবে জনগণের মাথায় চেপে বসেছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। আরও মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন চক্রান্তে। ইসলামের বিজয়ের পর পরাজিত ইহুদি চক্র ছদ্মবেশে মুসলমানদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে আসছিল, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ থেকেই। আহলে বাইতের নাম করে অত্যন্ত নাজুক ও গুরুত্বপূর্ণ শিরার উপর তারা আঙুল স্থাপন করেছিল সময় ও সুযোগ বুঝেই। যা মুসলিম বিশ্ব আজও ছিন্ন করতে পারেনি। এরা আহলে বাইতের ভালোবাসার ভান করত: মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দেশ দখল করে নিয়েছিল। তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আঘাত করতে থাকে মুসলিম উম্মার পশ্চাৎ দিক থেকে। খ্রিস্টীয় রোমান আর পৌত্তলিক তাতারি হায়েনাদের সম্মুখে মুসলমানদেরকে তুলে দেয় শিকারের জন্তু হিসেবে। টেনে হিঁচড়ে দীর্ঘদিনের ক্ষুধা নিবারণের জন্য, এভাবেই তারা মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস ও নিঃশেষ করার গোপন জিঘাংসা পূর্ণ করে। লেখক তাঁর বইতে এই বিষয়টি যথার্থ সফলতার সাথে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন। হক্কানি উলামায়ে কেরাম সেই যুগেও বিক্রি হয়ে যায়নি জালিম ষড়যন্ত্রকারী ও বহিরাগতদের কাছে। তাই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত সে যুগের হক্কানি উলামায়ে কেরামদের নাম ধরে ধরে ড: মুহাম্মদ আবদাহ তার বইতে এ সব উলামায়ে কেরামদের খেদমতকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তখনও মিটি মিটি তারা জ্বলছিল। এ তারাগুলোর সমষ্টিগত আলোকচ্ছটা একদিন উজ্বল হয়ে তার মধ্যে থেকেই চন্দ্রের স্নিগ্ধ আলোর উদ্ভাবন ঘটে। আর এভাবেই দূরীভূত হয়ে যায় মেঘের ঘনঘটা। সুন্নাহ ফিরে পায় তার প্রকৃত উচ্চাসন। তখন উলামায়ে কেরামের অবিরাম প্রচেষ্টায় শিয়া ইজমের বেড়াজল ছিন্ন হয়ে পড়ে। সত্য সমাগত হয়, মিথ্যা অপসারিত হয়।
আল কুদস মুক্তির জন্য আইয়ুবী আন্দোলন মূল তৎপরতা তাদের একার নয়। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আগমনের পূর্ব থেকেই উলামায়ে কেরামগণের লাগাতার জেহাদ ও লেখনীরই ফল ছিল এ রক্তক্ষয়ী অভিযান ও ভয়াবহ যুদ্ধ। যে কোন মুক্তি আন্দোলন এক দিনে দানা বাদে না এবং সংগঠিত হয় না। আর গুটিকয় মুজাহিদদের দ্বারাও তা সম্ভব হয়ে উঠে না। সম-সাময়িককালের অন্যান্য আন্দোলনেও আমরা এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করি। বিশেষভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন কুসংস্কার আর স্বার্থান্ধতার প্রাচীর দাঁড় করানো হয়, তখন ধর্মান্ধতা ও অজ্ঞতা পথে ছড়িয়ে পড়ে এবং পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে । এসব জাহেলি ঝঞ্জাট দূরীভূত করার সংগ্রাম অত্যন্ত দুরূহ। একটু চোখ মেলে পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই সে সম্পর্কে আমরা ধারণা নিতে পারি। বিভিন্ন ধারার ও রূপের সুফিবাদ তাসাউফ এর নামে পীর মুরিদী ব্যবসা, কবর পূজার শেরকী কার্যক্রম ধর্মীয় আবরণে নানা ধরনের অনাচার রাজনৈতিকভাবে সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র মুসলিম সমাজ রূপী বিশ বটবৃক্ষকে যেন পরগাছার ন্যায় সর্বতোভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। এখন এ বৃক্ষকে পরগাছার রাহু গ্রাস থেকে আজাদ করা ছোট একটি ব্যাপার নয়। এজন্য প্রয়োজন দুর্দান্ত এক অভিযানের। সর্বোপরি রয়েছে ঠিক সেই যুগের ন্যায় নানা ধরনের আন্তর্জাতিক গোপন ও প্রকাশ্য চক্রান্ত। যা ছিন্ন করার কাজও তত সহজ নয়। কারণ এ সবগুলোই দেশীয় গাদ্দারদের সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। সেইজন্যই প্রয়োজন দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে আন্দোলনে অগ্রসর হওয়া। ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলাদেশি সমাজে শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত বিভিন্ন ফিরকার সংখ্যা অতি নগণ্য। কিন্তু ওইসব মতবাদের প্রভাব থেকে এ সমাজও মুক্ত নয়। যা এদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন রূপে দেশের সাধারণ সরলপ্রাণ মানুষদের বিভ্রান্ত করেছে। সে যুগের বাতেনী ফিরকাগুলোর সাথে আমাদের দেশের শয়তানি পীর- মুরিদী চিন্তা ধারার হুবহু মিল না থাকলেও মূলত: তা একই বৃক্ষেরই নানান ডাল। এটিই মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে রেখেছে অসংখ্য ফেরকায়। আববাসীয়দের সেই আমলের মুসলিম অধঃপতনের মূল কারণগুলো মূলত: অভিন্ন। আমরা কি এর রেশ ধরেই পতনের গভীর সমুদ্রের অতল গহবরে বিলীন হয়ে পড়ছি? আমাদের উলামায়ে কেরাম, লেখক, সাহিত্যিকগণ বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও কুসংস্কার থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্ত করার জন্য জাগ্রত হয়ে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আগমন পূর্ব পরিস্থিতির মত করে এগিয়ে আসবেন সর্বতোভাবে জেহাদ করার উদ্দেশ্যে? আর আল কুদসসহ ইসলামি উম্মার হারানো অংশগুলোকে পুনরায় একত্রিত করে সারাবিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করবেন? জগৎবাসী আজ তাকিয়ে আছে সেই নেতৃত্বের উপযোগী যোগ্য উলামায়ে কেরামের দিকে। তারা ঐক্যবদ্ধ হলে এখনও সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর আগমন সম্ভব। আমাদের প্রভু, বিশ্ব জগতের মালিক রাববুল আমীন সদা জাগ্রত। বান্দারা প্রস্ত্তত হলেই তিনি সাহায্যের হাত প্রসারিত করবেন; এটিই সত্য আগামী দিনের সূর্যোদয়ের ন্যায়।
ইতিহাসের সম্পূর্ণ পুনরাবৃত্তি ঘটে ঠিক কালে কালে, যুগে যুগে, অক্ষরে অক্ষরে এটা কোন বোকাও বলবে না। ফেরাউন ও নমরূদের স্বেচ্ছাচারিতা, অহমিকা, খোদা দ্রোহী তার সাথে সাথে তাদের তখতে তাউস এর রূপের প্রকাশ ঘটেছিল রেজা শাহ পাহলভীসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য স্বেচ্ছাচারীরা যেমন বিশ্বকে তাদের দাবা খেলার পাতায় রেখে ভাগ বাটোয়ারা করতো, আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি কি তার চাইতে ভিন্ন? চেচেনদের ছোট্ট দেশটিকে সম্পূর্ণ গ্রাস করার ষড়যন্ত্র, কাশ্মীরকে অস্ত্রের মুখে নিশ্চিহ্ন করার ব্রাক্ষণবাদীদের পৌত্তলিক আগ্রাসন, আফগানিস্থান ইরাককে দখল করে লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা, সোমালিয়ায় মার্কিন আগ্রাসন, তাতারি চেঙ্গীস খাঁন আর হালাকদের চাইতে কি ভিন্ন? নাম ধামের পার্থক্য থাকলেও মূল দৃশ্যটা কিন্তু একই। বর্তমান বিশ্ব ইহুদি চক্রের হোয়াইট হাউজের লোকেরা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলের মূল্যবান সম্পদ। মুসলিম নামধারী দালালদের প্রতারণা, ধোঁকা আর বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ছিন্ন ভিন্ন করে খাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের অফুরন্ত সম্পদশালী অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যকে। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের সাথে সে অধ্যায়ের সঙ্গে, পরিস্থিতি ও মূল ভাবধারার মিল রয়েছে। যুগ, কাল, তামাদ্দুনিক অবস্থা ভিন্ন হলেও প্রকৃত অবস্থাটি এক ও অভিন্ন।
ইতিহাসের বিবর্তন নামের এই বইটিতে আরব জাহানের বিভিন্ন শাসকদের মধ্যে আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও অসতর্কতার বর্ণনা রয়েছে। আর-এ সুযোগে পূর্ব থেকে ঘাপটি মেরে থাকা মিথ্যাবাদীরা যে সক্রিয় হয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে ইসলাম এবং ইসলামি জাহানের ক্ষতি সাধনের লক্ষ্যে তথাকথিত মুসলমান ও ইসলামের দাবি নিয়ে ইহুদিদের গোপন পরামর্শে স্থান-কাল ও অবস্থা ভেদে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে বিভক্ত হয়ে জেগে উঠে ছিল তার কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে। আর এজন্য তখনকার মুসলিম শাসকদেরকে এ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় বহু মূল্য দিতে হয়েছে। মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ও মুসলিম জাহানের ঐ সব শত্রুরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বংশধরের মিথ্যা দাবি নিয়ে, মিথ্যা নছব তৈরি করে যুগের পর যুগ বিভিন্ন রাজ্য শাসন করেছে। মূলত: এরা ছিল ইহুদিদের এজেন্ট। তাদের কাজ ছিল মুসলমানদের ক্ষতি ও ধ্বংস সাধন করা। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল বাতেনী, ওবায়দী, বুয়াইহী, কারামেতা, বনু হাবদান ও সুলাইহী সম্প্রদায়সমূহ।
প্রথম দিকে ইসলামের ক্ষতি সাধন করতে না পারার কারণে এরা পরদার অন্তরালে থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আর মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে গর্জে উঠে। তথাকথিত এসব মুসলমান নামধারীরা ইসলাম ও ধর্মের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা দখল ছাড়াও নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সুযোগ পেলেই মুসলিম উম্মার পিছন দিক থেকে তারা ছুরিকাঘাত করতো। এভাবে দুনিয়াবী ভোগ বিলাস আর লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে তারা। আর ক্ষমতার মোহে হারিয়ে যায় তাদের মনুষ্যত্ব। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে নানা অপসংস্কৃতি ও ইসলামের অপ ব্যাখ্যা। বিভক্তি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হয় তারা। তাদের শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লোভে মুসলমানদের উপর যেই সীমাহীন নির্যাতন, হত্যা, সংঘর্ষ আর বর্বর ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে, তার বর্ণনাও এই বইটিতে রয়েছে। বইটির শেষাংশে হক্কানি উলামায়ে কেরামের জেহাদ, সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আন্দোলন ও শাসন এবং আববাসীয় খলিফার আমলে সুন্নাহের প্রকাশ ও জ্ঞান- বিজ্ঞান প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন এবং সংস্কার আন্দোলনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
বইটির অনুবাদ ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে আমাদের অজান্তে ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। এজন্য সেসব ভুলত্রুটি আমাদেরকে অবহিত করার অনুরোধ থাকল। বইটির অনুবাদ, সম্পাদনা ও প্রকাশনায় যাদের সহযোগিতা পেয়েছি তাদের সকলের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
এ বইয়ের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব বীর যোদ্ধা গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর উপর একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি আমরা পরিশিষ্টে সংযোজন করলাম।
ভূমিকায় নিজ অভিমত লিখে কলেবর বৃদ্ধি করার চাইতে পাঠকদের দৃষ্টি মূল বইয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আমি এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০০২
হাফেজ নেছার উদ্দিন আহমদ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাববুল আমীনের জন্য। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য। জালিম ছাড়া অন্য কারো প্রতি অন্যায় বাড়বাড়ি নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল, যিনি প্রেরিত হয়েছেন সত্য- সঠিক দীন এবং সুস্থ- সুন্দর জীবন বিধান সহকারে। আল্লাহ তাঁকে গোটা বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন।
মুসলমানদের উপর এমন একটা কাল অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের অনুভূতি শিথিল এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতিহাস পাঠের উপকারিতা আর শিক্ষা তাদের মধ্যে লোপ পায়। গভীর আর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে ইতিহাস অধ্যয়ন থেকে তারা বিমুখ হয়ে পড়ে। অথচ ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় মুসলিম ঐতিহাসিকরা ইতিহাস- চর্চায় প্রবৃত্ত হয়েছেন, যেমন ইমাম তাবারী ইবনে ইসহাক এবং ইবনে সাআদ প্রমুখ ইতিহাসবেত্তা ইতিহাস- চর্চায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়েছেন।
অতীত জাতিসমূহের ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বারোপের প্রতি কুরআন মজীদে অনেক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইঙ্গিত পাওয়া যায় অতীত জাতিগুলোর ইতিকাহিনি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ ( سورة يوسف : ১১১)
‘‘তাদের ঘটনাবলীতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।’’ (সূরা ইউসুফ: ১১১)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُروا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ ﴿آل عمران : ১৩৭﴾
‘‘তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীব নাচার। তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ, যারা (দীনকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে, তাদের পরিণতি কি হয়েছে।’’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৭)
অদূর ভবিষ্যতে যেসব বিপর্যয় দেখা দেবে, যেসব দুর্বলতা আর বিভেদ ও অনৈক্য দেখা দিতে পারে, মহানবির সময় সেসব সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। যাতে মুসলিম উম্মাহ অন্য জাতির খেল- তামাশার বস্ত্ততে পরিণত না হয়। ভবিষ্যতে যেসব ঘটনা সংঘটিত হবে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সম্পর্কে তাঁর উম্মতে অবহিত করে গেছেন।
বর্তমান কালে ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ মুসলমানরা তাদের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার চিন্তার- ভাবনা করছে এবং তারা পুনরায় নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে একটা প্রশ্ন বার বার উদিত হয়; ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়? কেউ হয়তো এ প্রশ্নের নেতিবাচক জবাব দেন, কেউ হয়তো ইতিবাচক জবাব দিয়ে থাকেন, এ উভয় জবাবের মধ্যে এক ধরনের তাড়া-হুড়া রয়েছে, যা প্রশংসনীয় নয়, অথবা এ জবাবের মধ্যে এমন কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে, যাতে নিহিত রয়েছে এক ধরনের স্বস্তি। এ স্বস্তি জবাবের বিস্তারিত বিবরণে ডুবে না যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া বা বিষয়টা নিয়ে গভীরতায় প্রবেশ না করার মধ্যেই এক ধরনের স্বস্তি।
আর আসল কথা হচ্ছে এই যে, স্থান-কাল নির্ণয় করে ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় না অথবা এক একটা ঘটনার উদাহরণ টেনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। কারণ পৃথিবীতে এভাবে ঘটনা প্রবাহ সংগঠিত হয় না এবং আল্লাহর সৃষ্টির নিয়মও এরকম নয়। আল্লাহ বলেন :
وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ ( آل عمران : ১৪০)
‘‘আর আমরা মানুষের মধ্যে পালাক্রমে এ দিনগুলোর আবর্তন ঘটিয়ে থাকি।’’ (সূরা আলে ইমরান: ১৪০)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন-
كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ ﴿الرحمن : ২৯﴾
‘‘তিনি সর্বদা কোন না কোন কাজে রত আছেন।’’ (সূরা আর রাহমান: ২৯)
সুতরাং একটি ঘটনা পুরোপুরি অন্য আর একটি ঘটনার সাথে মিলে না, তবে তাতে সামঞ্জস্য আর সাদৃশ্য থাকতে পারে। তবে কোন ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটে না, তাই মানব বুদ্ধির প্রকৃতি এবং যে প্রকৃতিতে আল্লাহ মানুষকে সৃজন করেছেন, তা অনেকাংশে সাদৃশ্য হয়ে থাকে। স্থান- কালের ব্যবধান সত্ত্বেও এ ভাবেই ঘটনা- প্রবাহ সংঘটিত হয়। আর এ রীতিতেই মানব- মন চিন্তা করে।
প্রতিটি যুগেই আমরা দু’টি শ্রেণি দেখতে পাই। একটি শ্রেণি দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে। অপর শ্রেণিটি দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি করে, হ্রাস- বৃদ্ধি করে। সব যুগেই এমন কিছু লোক দেখা যায়, যারা জ্ঞান- বুদ্ধিকে পবিত্র মনে করে এবং তাকে কুরআন- হাদীসে র সব বিধানের উপরে স্থান দেয়। সকল যুগে স্বৈর- শাসন একই থাকে, তবে তার ধরন আর প্রকৃতি বদলায়। আল্লাহ তাআলা এ স্বৈর- শাসনের জন্য ফিরাউনকে দৃষ্টান্তমূলক চরিত্র হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, যে ছিল অহমিকা আর জাতিতে জাতিতে বিভেদ সৃষ্টির একটা প্রাতিষ্ঠানিক নাম।
ঐশ্বর্য, বিলাসিতা আর উল্লাস- উৎফুল্লতার প্রকাশ বারবার ঘটে; তবে এর ধরন আর প্রকৃতির বদল হয় সভ্যতা- সংস্কৃতির স্তর অনুযায়ী। পুঁজিবাদের নিকৃষ্ট রূপের উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়েছে কারূনকে একটা প্রতীক হিসাবে।
ক্রুসেডের যুদ্ধে ইংরেজ- খ্রিস্টানরা মুসলমানদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছিল, তাতে মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভূমিকা বর্তমান যুগে ইংরেজদের রাজনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শত শত বৎসর পূর্বে মিশর আর সুদানে ইংরেজরা যে খেলায় মেতে উঠেছিল, পাশ্চাত্য আজ সে খেলাই খেলছে। ‘সিরিয়ায় ইংরেজ আর মিশরীয়দের পতনের পর এবং গর্ডন পাশার হত্যান্তে ইংরেজরা মিশরের প্রতি ইঙ্গিত করে (আর এখানে ইঙ্গিত নির্দেশের স্থলাভিষিক্ত) যে, তাদের উচিত হচ্ছে সুদান ত্যাগ করে চলে যাওয়া এবং তাদের অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া। আর এটা ছিল তাদের সুদান জয় করার কেবল ভূমিকা মাত্র। তারা মিশরীয় সৈন্যদেরকে বিতাড়িত করে। তাদের পরিচালিত করে ইংরেজ সৈন্য, যাদের কর্তৃত্বে ছিল জেনারেল কিতসেনর। অতঃপর মিশরীয় লোকজনের সহায়তায় তারা সুদান জয় করে নেয়। আর মিশরীয়দেরকে বলে, সুদান আমাদের সমান মালিকানাধীন [মুসলিম জাহানের বর্তমান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯৬।] ........ পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক আসা বাঞ্জলার বলেন, ‘‘তথায় এথেন্স আর প্যারিসের মধ্যে এক এক বিস্ময়কর মিল দেখা যায় এরিস্টটল এবং কান্ট- এর মধ্যে। আলেকজান্ডারের বিজয়ের পর বিশ্ব জয় আর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের মধ্যে দেখা যায় এক বিস্ময়কর সামঞ্জস্য [ডঃ আহমদ মাহমুদ ছাবহীঃ ইতিহাসের দর্শন প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ২৫২। আর ‘বিশ্ব বিজয়’ ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটা উপায় মাত্র।]’’
লাম্পট্য নৈরাজ্য আর সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ সব যুগেই বারবার দেখা যায়; তবে বিভিন্ন নামে। ‘‘অতীত ভবিষ্যতের সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন সাদৃশ্যপূর্ণ পানির সঙ্গে পানি [ইবনে খালদূনঃ অ মুকাদ্দিমা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৯২।]’’। ‘‘অতীত ক্রমবিকাশের আলোকে বর্তমান সমস্যা অনুধাবন করা মানুষকে বর্তমান প্রয়োজন অনুধাবনের যোগ্য করে তোলে [লুই জুবেতশিকঃ আমরা কি ভাবে ইতিহাস অধ্যায়ন করবো পৃষ্ঠা ২০১।]। বর্তমানকে অনুধাবন করা যেমন অতীতের প্রতি প্রত্যাবর্তনের উপর নির্ভরশীল, অনুরূপভাবে কখনো কখনো বর্তমান অনুধাবনের উপর অতীত অনুধাবন নির্ভর করে। আর এসব কিছু আমাদেরকে বলতে বাধ্য করে; হ্যাঁ, ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তবে ভিন্ন রূপে আর ভিন্ন রঙ্গে। আর এ জন্যই কুরআন মজীদে আম্বিয়ায়ে কেরামের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে ঔদ্ধত্য পরায়ণ স্বৈরাচারীদের কাহিনি এবং নানা জাতির ধ্বংসের কারণ। কারণ, মানব জাতির ইতিহাসে সেসব কাহিনি আর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বারবার। কোন জাতির সর্বশেষ প্রজন্মের লোকগুলোকে প্রাথমিক যুগের লোকগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে অতীত মু’মিনদের সামঞ্জস্য ফুটে উঠে। আর অতীত কাফেরদের সঙ্গে বর্তমান কাফেরদের মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। কুরআন মজীদে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নীতি অনড় ও অপরিবর্তনীয় [ইমাম ইবনে তাইমিয়াঃ আল-ফাতাওয়া, ২৮ খন্ড, পৃষ্ঠা ৪২৫।]।
وَلَوْ قَاتَلَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوَلَّوُا الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ﴿২২﴾ سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلُ ( سورة الفتح : ২২-২৩)
‘‘কাফিররা যদি তোমাদের মোকাবিলা করতো তবে অবশ্যই তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতো। তখন তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পেতো না। এটাই আল্লাহর নীতি, যা পূর্ব থেকে চালু আছে।’’ (সুরা ফাতহ: ২২-২৩)
নানাবিধ বাতেনী ফেরকা অতীতে যে সব ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড চালিয়েছে, তা অনুধাবন করা বর্তমান যুগে তাদের চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র হৃদয়ংগম করতে আমাদেরকে সাহায্য করে। বিশেষ করে যখন দৃষ্টান্ত স্পষ্ট আর একজন মুসলিম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আল্লাহরনীতি সম্পর্কে অবগত হয়, তখন এটা তাকে প্রচুর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে দেয়, যে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তার ক্ষুদ্র জীবনের স্থিতিগুলোও যথেষ্ট নয়।
যে সময়টা সম্পর্কে আমরা লিখতে যাচ্ছি, তা হচ্ছে হিজরী চতুর্থ শতাব্দী এবং তৎপরবর্তী কালের চিত্র। তখন থেকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আবির্ভাব কাল পর্যন্ত পরিবর্তন কীভাবে সূচিত হয়েছে? সে পরিবর্তনের শুরু কোথা থেকে এবং কীভাবে হয়েছে? কোন রকম ভূমিকা আর পূর্বাভাস ছাড়া হঠাৎ করে নূরুদ্দীন জঙ্গি আর সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মতো মহানায়কের আবির্ভাব ঘটে না। সেকালে যা কিছু ঘটেছে এবং তৎপর বর্তী কালে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তার সঙ্গে কোন কোন দিক থেকে বর্তমান যুগের মিল রয়েছে। আমরা দেখতে পাবও, কীভাবে জাগরণের সূচনা হয়েছে। আবার কীভাবে ক্ষণকাল তা দমিত হয়ে পুনরায় শক্তিশালী রূপে তা প্রকাশ পেয়েছে। এটা স্বাভাবিক যে, সময়টা ছিল ধারণা- কল্পনার চেয়েও বেশি দীর্ঘ। কারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যে বিধান পূর্ব থেকে চলে আসছিল, তা এতই গভীরে প্রোথিত ছিল যে, তা দূর করার জন্য প্রচন্ড আঘাতের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল অনেক পানি সিঞ্চনের। এরপরও তা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। এবং দু’জন ন্যায় পরায়ণ শাসকের পরও তা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তাই বলে সংস্কার আর নবায়নের আন্দোলন বন্ধ হয়নি। আন্দোলন হয়েছে আলেম সমাজের পক্ষ থেকে এবং শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকেও। আধুনিক যুগেও জাগরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে; কিন্তু তা অতি ধীর গতিতে। তাকে বহন করছে অতীত কালের বোঝা আর গ্লানি। আশা করা যায় যে, আল্লাহর হুকুমে তা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আর ঈপ্সিত সংস্কারের দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিন কাজ নয়। আল্লাহ ই তাওফীকের মালিক।
-গ্রন্থকার
মুসলমানদের উপর এমন একটা কাল অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও এর গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের অনুভূতি শিথিল এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। ইতিহাস পাঠের উপকারিতা আর শিক্ষা তাদের মধ্যে লোপ পায়। গভীর আর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে ইতিহাস অধ্যয়ন থেকে তারা বিমুখ হয়ে পড়ে। অথচ ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় মুসলিম ঐতিহাসিকরা ইতিহাস- চর্চায় প্রবৃত্ত হয়েছেন, যেমন ইমাম তাবারী ইবনে ইসহাক এবং ইবনে সাআদ প্রমুখ ইতিহাসবেত্তা ইতিহাস- চর্চায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়েছেন।
অতীত জাতিসমূহের ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বারোপের প্রতি কুরআন মজীদে অনেক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইঙ্গিত পাওয়া যায় অতীত জাতিগুলোর ইতিকাহিনি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَقَدْ كَانَ فِي قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِأُولِي الْأَلْبَابِ ( سورة يوسف : ১১১)
‘‘তাদের ঘটনাবলীতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।’’ (সূরা ইউসুফ: ১১১)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-
قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانْظُروا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ ﴿آل عمران : ১৩৭﴾
‘‘তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীব নাচার। তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ, যারা (দীনকে) মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে, তাদের পরিণতি কি হয়েছে।’’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৭)
অদূর ভবিষ্যতে যেসব বিপর্যয় দেখা দেবে, যেসব দুর্বলতা আর বিভেদ ও অনৈক্য দেখা দিতে পারে, মহানবির সময় সেসব সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। যাতে মুসলিম উম্মাহ অন্য জাতির খেল- তামাশার বস্ত্ততে পরিণত না হয়। ভবিষ্যতে যেসব ঘটনা সংঘটিত হবে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সম্পর্কে তাঁর উম্মতে অবহিত করে গেছেন।
বর্তমান কালে ইতিহাস অধ্যয়নের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ মুসলমানরা তাদের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনার চিন্তার- ভাবনা করছে এবং তারা পুনরায় নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।
অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে একটা প্রশ্ন বার বার উদিত হয়; ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়? কেউ হয়তো এ প্রশ্নের নেতিবাচক জবাব দেন, কেউ হয়তো ইতিবাচক জবাব দিয়ে থাকেন, এ উভয় জবাবের মধ্যে এক ধরনের তাড়া-হুড়া রয়েছে, যা প্রশংসনীয় নয়, অথবা এ জবাবের মধ্যে এমন কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে, যাতে নিহিত রয়েছে এক ধরনের স্বস্তি। এ স্বস্তি জবাবের বিস্তারিত বিবরণে ডুবে না যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া বা বিষয়টা নিয়ে গভীরতায় প্রবেশ না করার মধ্যেই এক ধরনের স্বস্তি।
আর আসল কথা হচ্ছে এই যে, স্থান-কাল নির্ণয় করে ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি ঘটায় না অথবা এক একটা ঘটনার উদাহরণ টেনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। কারণ পৃথিবীতে এভাবে ঘটনা প্রবাহ সংগঠিত হয় না এবং আল্লাহর সৃষ্টির নিয়মও এরকম নয়। আল্লাহ বলেন :
وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ ( آل عمران : ১৪০)
‘‘আর আমরা মানুষের মধ্যে পালাক্রমে এ দিনগুলোর আবর্তন ঘটিয়ে থাকি।’’ (সূরা আলে ইমরান: ১৪০)
আল্লাহ অন্যত্র বলেন-
كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ ﴿الرحمن : ২৯﴾
‘‘তিনি সর্বদা কোন না কোন কাজে রত আছেন।’’ (সূরা আর রাহমান: ২৯)
সুতরাং একটি ঘটনা পুরোপুরি অন্য আর একটি ঘটনার সাথে মিলে না, তবে তাতে সামঞ্জস্য আর সাদৃশ্য থাকতে পারে। তবে কোন ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটে না, তাই মানব বুদ্ধির প্রকৃতি এবং যে প্রকৃতিতে আল্লাহ মানুষকে সৃজন করেছেন, তা অনেকাংশে সাদৃশ্য হয়ে থাকে। স্থান- কালের ব্যবধান সত্ত্বেও এ ভাবেই ঘটনা- প্রবাহ সংঘটিত হয়। আর এ রীতিতেই মানব- মন চিন্তা করে।
প্রতিটি যুগেই আমরা দু’টি শ্রেণি দেখতে পাই। একটি শ্রেণি দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে। অপর শ্রেণিটি দ্বীনের ব্যাপারে ত্রুটি করে, হ্রাস- বৃদ্ধি করে। সব যুগেই এমন কিছু লোক দেখা যায়, যারা জ্ঞান- বুদ্ধিকে পবিত্র মনে করে এবং তাকে কুরআন- হাদীসে র সব বিধানের উপরে স্থান দেয়। সকল যুগে স্বৈর- শাসন একই থাকে, তবে তার ধরন আর প্রকৃতি বদলায়। আল্লাহ তাআলা এ স্বৈর- শাসনের জন্য ফিরাউনকে দৃষ্টান্তমূলক চরিত্র হিসাবে উপস্থাপন করেছেন, যে ছিল অহমিকা আর জাতিতে জাতিতে বিভেদ সৃষ্টির একটা প্রাতিষ্ঠানিক নাম।
ঐশ্বর্য, বিলাসিতা আর উল্লাস- উৎফুল্লতার প্রকাশ বারবার ঘটে; তবে এর ধরন আর প্রকৃতির বদল হয় সভ্যতা- সংস্কৃতির স্তর অনুযায়ী। পুঁজিবাদের নিকৃষ্ট রূপের উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়েছে কারূনকে একটা প্রতীক হিসাবে।
ক্রুসেডের যুদ্ধে ইংরেজ- খ্রিস্টানরা মুসলমানদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছিল, তাতে মুসলিম ঐতিহাসিকদের ভূমিকা বর্তমান যুগে ইংরেজদের রাজনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শত শত বৎসর পূর্বে মিশর আর সুদানে ইংরেজরা যে খেলায় মেতে উঠেছিল, পাশ্চাত্য আজ সে খেলাই খেলছে। ‘সিরিয়ায় ইংরেজ আর মিশরীয়দের পতনের পর এবং গর্ডন পাশার হত্যান্তে ইংরেজরা মিশরের প্রতি ইঙ্গিত করে (আর এখানে ইঙ্গিত নির্দেশের স্থলাভিষিক্ত) যে, তাদের উচিত হচ্ছে সুদান ত্যাগ করে চলে যাওয়া এবং তাদের অবস্থায় তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া। আর এটা ছিল তাদের সুদান জয় করার কেবল ভূমিকা মাত্র। তারা মিশরীয় সৈন্যদেরকে বিতাড়িত করে। তাদের পরিচালিত করে ইংরেজ সৈন্য, যাদের কর্তৃত্বে ছিল জেনারেল কিতসেনর। অতঃপর মিশরীয় লোকজনের সহায়তায় তারা সুদান জয় করে নেয়। আর মিশরীয়দেরকে বলে, সুদান আমাদের সমান মালিকানাধীন [মুসলিম জাহানের বর্তমান, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১৯৬।] ........ পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক আসা বাঞ্জলার বলেন, ‘‘তথায় এথেন্স আর প্যারিসের মধ্যে এক এক বিস্ময়কর মিল দেখা যায় এরিস্টটল এবং কান্ট- এর মধ্যে। আলেকজান্ডারের বিজয়ের পর বিশ্ব জয় আর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের মধ্যে দেখা যায় এক বিস্ময়কর সামঞ্জস্য [ডঃ আহমদ মাহমুদ ছাবহীঃ ইতিহাসের দর্শন প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা ২৫২। আর ‘বিশ্ব বিজয়’ ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটা উপায় মাত্র।]’’
লাম্পট্য নৈরাজ্য আর সাম্রাজ্যবাদের প্রকাশ সব যুগেই বারবার দেখা যায়; তবে বিভিন্ন নামে। ‘‘অতীত ভবিষ্যতের সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন সাদৃশ্যপূর্ণ পানির সঙ্গে পানি [ইবনে খালদূনঃ অ মুকাদ্দিমা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৯২।]’’। ‘‘অতীত ক্রমবিকাশের আলোকে বর্তমান সমস্যা অনুধাবন করা মানুষকে বর্তমান প্রয়োজন অনুধাবনের যোগ্য করে তোলে [লুই জুবেতশিকঃ আমরা কি ভাবে ইতিহাস অধ্যায়ন করবো পৃষ্ঠা ২০১।]। বর্তমানকে অনুধাবন করা যেমন অতীতের প্রতি প্রত্যাবর্তনের উপর নির্ভরশীল, অনুরূপভাবে কখনো কখনো বর্তমান অনুধাবনের উপর অতীত অনুধাবন নির্ভর করে। আর এসব কিছু আমাদেরকে বলতে বাধ্য করে; হ্যাঁ, ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তবে ভিন্ন রূপে আর ভিন্ন রঙ্গে। আর এ জন্যই কুরআন মজীদে আম্বিয়ায়ে কেরামের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে ঔদ্ধত্য পরায়ণ স্বৈরাচারীদের কাহিনি এবং নানা জাতির ধ্বংসের কারণ। কারণ, মানব জাতির ইতিহাসে সেসব কাহিনি আর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বারবার। কোন জাতির সর্বশেষ প্রজন্মের লোকগুলোকে প্রাথমিক যুগের লোকগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে অতীত মু’মিনদের সামঞ্জস্য ফুটে উঠে। আর অতীত কাফেরদের সঙ্গে বর্তমান কাফেরদের মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। কুরআন মজীদে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নীতি অনড় ও অপরিবর্তনীয় [ইমাম ইবনে তাইমিয়াঃ আল-ফাতাওয়া, ২৮ খন্ড, পৃষ্ঠা ৪২৫।]।
وَلَوْ قَاتَلَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوَلَّوُا الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يَجِدُونَ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ﴿২২﴾ سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلُ ( سورة الفتح : ২২-২৩)
‘‘কাফিররা যদি তোমাদের মোকাবিলা করতো তবে অবশ্যই তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতো। তখন তারা কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পেতো না। এটাই আল্লাহর নীতি, যা পূর্ব থেকে চালু আছে।’’ (সুরা ফাতহ: ২২-২৩)
নানাবিধ বাতেনী ফেরকা অতীতে যে সব ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড চালিয়েছে, তা অনুধাবন করা বর্তমান যুগে তাদের চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র হৃদয়ংগম করতে আমাদেরকে সাহায্য করে। বিশেষ করে যখন দৃষ্টান্ত স্পষ্ট আর একজন মুসলিম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আল্লাহরনীতি সম্পর্কে অবগত হয়, তখন এটা তাকে প্রচুর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে দেয়, যে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তার ক্ষুদ্র জীবনের স্থিতিগুলোও যথেষ্ট নয়।
যে সময়টা সম্পর্কে আমরা লিখতে যাচ্ছি, তা হচ্ছে হিজরী চতুর্থ শতাব্দী এবং তৎপরবর্তী কালের চিত্র। তখন থেকে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর আবির্ভাব কাল পর্যন্ত পরিবর্তন কীভাবে সূচিত হয়েছে? সে পরিবর্তনের শুরু কোথা থেকে এবং কীভাবে হয়েছে? কোন রকম ভূমিকা আর পূর্বাভাস ছাড়া হঠাৎ করে নূরুদ্দীন জঙ্গি আর সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর মতো মহানায়কের আবির্ভাব ঘটে না। সেকালে যা কিছু ঘটেছে এবং তৎপর বর্তী কালে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, তার সঙ্গে কোন কোন দিক থেকে বর্তমান যুগের মিল রয়েছে। আমরা দেখতে পাবও, কীভাবে জাগরণের সূচনা হয়েছে। আবার কীভাবে ক্ষণকাল তা দমিত হয়ে পুনরায় শক্তিশালী রূপে তা প্রকাশ পেয়েছে। এটা স্বাভাবিক যে, সময়টা ছিল ধারণা- কল্পনার চেয়েও বেশি দীর্ঘ। কারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যে বিধান পূর্ব থেকে চলে আসছিল, তা এতই গভীরে প্রোথিত ছিল যে, তা দূর করার জন্য প্রচন্ড আঘাতের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল অনেক পানি সিঞ্চনের। এরপরও তা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। এবং দু’জন ন্যায় পরায়ণ শাসকের পরও তা অব্যাহত থাকে। কিন্তু তাই বলে সংস্কার আর নবায়নের আন্দোলন বন্ধ হয়নি। আন্দোলন হয়েছে আলেম সমাজের পক্ষ থেকে এবং শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকেও। আধুনিক যুগেও জাগরণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে; কিন্তু তা অতি ধীর গতিতে। তাকে বহন করছে অতীত কালের বোঝা আর গ্লানি। আশা করা যায় যে, আল্লাহর হুকুমে তা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আর ঈপ্সিত সংস্কারের দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিন কাজ নয়। আল্লাহ ই তাওফীকের মালিক।
-গ্রন্থকার
অতীত ঘটনা ইতিহাস বলে পরিচিত। আজকের ঘটনা আগামী দিন ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন কত সব ঘটনা ঘটছে, কে তার খবর রাখে। ইতিহাস দর্শনের স্থপতি বলে পরিচিত আল্লামা ইবনে খলদুন তদীয় বিরল রচনা ‘আল-মুকাদ্দিমা’য় বলেন: ‘‘ইতিহাস একটা প্রমাণসিদ্ধ বিষয় যার মধ্যে নিহিত রয়েছে চিন্তা- গবেষণার উপকরণ এবং গোটা বিশ্ব প্রকৃতির সূক্ষ্ম তত্ত্ব। নানা জাতি- গোষ্ঠী ইতিহাস চর্চা আর আয়ত্ব করার জন্য দূর- দূরান্ত সফর করে।’’ পৃথিবীতে প্রতিদিন এমন অনেক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে, যাতে মানুষের শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নিহিত রয়েছে। এসব ঘটনা প্রবাহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। জীবনকে করতে পারে সুন্দর ও সমৃদ্ধ এবং পৃথিবীকে পরিণত করতে পারে শান্তি ধামে। কিন্তু মানুষ তা করছে না। কুরআন মজীদে নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর শিক্ষণীয় ইতিহাস আলোচনার পর বলা হয়েছে;
‘‘আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে এমন অনেক নিদর্শন আছে, যা মানুষ প্রত্যক্ষ করে কিন্তু সে সব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’’ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থের উৎস আল-কুরআন। আমরা কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করি না, অনুধাবন করি না। কুরআন মজীদে বর্ণিত ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করি না। এ কারণে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর আগমনের পূর্বে মুসলিম জাহানের অবস্থা এবং সমসাময়িক ইতিহাসের তুলনামূলক আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন আরব জাহানের খ্যাতনামা লেখক ও তাত্ত্বিক শায়খ মুহাম্মদ আল-আবদাহ। তিনি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ ইবনে খলদুনের কিতাবুল ইবার, আল্লামা হাফিয ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর প্রণীত কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এবং ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর প্রণীত ‘তারিখূল কামিল’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে অনেক খন্ড চিত্র উপস্থাপন করেছেন এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে। লেখক বইটির নাম দিয়েছেন ইতিহাসের কি পুনরাবর্তন ঘটে? (উড়বং যরংঃড়ৎু ৎবঢ়বধঃং রঃংবষভ) এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, আলেম শ্রেণি তথা শিক্ষিত সমাজ হলো দেহে রক্তের ন্যায়, কারো শরীরে রক্ত দূষিত হয়ে গেলে যেমন তার সুস্থতা আশা করা যায় না, তেমনি সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে বিকৃতি দেখা দিলে সে সমাজের পতন আর পঁচন অনিবার্য হয়ে ওঠে, বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের বর্তমান সামাজিক অবস্থা তারই বাস্তব নমুনা হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্ধুবর হাফেজ মাওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ বইটির প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সাংবাদিক বন্ধু সেলিম উদ্দীন নিযামীর সহযোগিতা ছাড়া এ বই প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। আমি তাদেরকে এজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সুধী পাঠক শ্রেণি এ গ্রন্থ পাঠ করে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য উদ্যোগী হলে শ্রম সার্থক জ্ঞান করব। মহান আল্লাহ সকলকে তাওফীক দান করুন।
গোলাম সোবহান সিদ্দিকী
নিরিবিলি ১২-ই ১/৩৮ মীরপুর ঢাকা-১২১৬
‘‘আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে এমন অনেক নিদর্শন আছে, যা মানুষ প্রত্যক্ষ করে কিন্তু সে সব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়’’ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থের উৎস আল-কুরআন। আমরা কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করি না, অনুধাবন করি না। কুরআন মজীদে বর্ণিত ঐতিহাসিক শিক্ষণীয় ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করি না। এ কারণে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীর আগমনের পূর্বে মুসলিম জাহানের অবস্থা এবং সমসাময়িক ইতিহাসের তুলনামূলক আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন আরব জাহানের খ্যাতনামা লেখক ও তাত্ত্বিক শায়খ মুহাম্মদ আল-আবদাহ। তিনি নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ ইবনে খলদুনের কিতাবুল ইবার, আল্লামা হাফিয ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর প্রণীত কালজয়ী ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ এবং ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর প্রণীত ‘তারিখূল কামিল’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে অনেক খন্ড চিত্র উপস্থাপন করেছেন এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে। লেখক বইটির নাম দিয়েছেন ইতিহাসের কি পুনরাবর্তন ঘটে? (উড়বং যরংঃড়ৎু ৎবঢ়বধঃং রঃংবষভ) এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, আলেম শ্রেণি তথা শিক্ষিত সমাজ হলো দেহে রক্তের ন্যায়, কারো শরীরে রক্ত দূষিত হয়ে গেলে যেমন তার সুস্থতা আশা করা যায় না, তেমনি সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে বিকৃতি দেখা দিলে সে সমাজের পতন আর পঁচন অনিবার্য হয়ে ওঠে, বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের বর্তমান সামাজিক অবস্থা তারই বাস্তব নমুনা হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্ধুবর হাফেজ মাওলানা নেছারুদ্দীন আহমদ বইটির প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সাংবাদিক বন্ধু সেলিম উদ্দীন নিযামীর সহযোগিতা ছাড়া এ বই প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। আমি তাদেরকে এজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সুধী পাঠক শ্রেণি এ গ্রন্থ পাঠ করে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য উদ্যোগী হলে শ্রম সার্থক জ্ঞান করব। মহান আল্লাহ সকলকে তাওফীক দান করুন।
গোলাম সোবহান সিদ্দিকী
নিরিবিলি ১২-ই ১/৩৮ মীরপুর ঢাকা-১২১৬
ক্রুসেড যুদ্ধের পূর্বে মুসলমানদের সাধারণ অবস্থা
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শুরু থেকে হিজরী ৫ম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলমানদের রাজনৈতিক অবস্থার১ চিত্র অঙ্কন করতে গেলে আমরা দেখতে পাই দুর্বলতা আর দলাদলি, যা ছিল সে সময়ে মুসলিম জাহানের সাধারণ চিত্র। তৎকালে মুসলিম জাহান পরস্পর সংঘাত মুখর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তখন ব্যক্তি স্বার্থ বিশেষ প্রাধান্য পায়। ক্ষমতার ভাষায় তারা কথা বলতো। ক্ষমতার মসনদ দখল করাই ছিল তাদের চরম লক্ষ্য। এজন্য কাফেরদের নিকট থেকে সাহায্য প্রার্থনা করতে হলেও তারা কুণ্ঠিত হতো না। অথবা কোন শহর দুশমনের হাতে চলে গেলেও সেজন্য কোন চিন্তা কর তো না, নিজেদের সাধারণ স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসার সাহস কেউ দেখায়নি, পুনরায় ঐক্যের আন্দোলন শুরু করাতো দূরের কথা।
এ সময় মুসলমানরা বাতেনী আন্দোলন দ্বারা পরীক্ষায় নিপতিত হয়। এসব বাতেনী আন্দোলন শিয়া মতবাদকে আড়াল হিসাবে গ্রহণ করে। এ দ্বারা সাধারণ মানুষ এবং নীচ শ্রেণির লোকদেরকে প্রতারিত করে এবং এ সুযোগে মূল ইসলামের নিন্দাবাদ প্রচার করে। যেসব ঐতিহাসিক এবং জ্ঞানী- গুণী ব্যক্তি নানা দল- উপদল সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই বলেছেন যে, এসব বাতেনী আন্দোলন আরবদের ইসলামি বিজয়ের বিরুদ্ধে পারসিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। মুসলিম বিজেতাদের সামরিক বিজয় দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তারা বুঝতে পারে যে, ইসলামের বিজয় রোধ করা যাবে না, তখন এরা ভেতর থেকে ক্ষতি সাধনের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়। তারা জানতো যে, আহলে বাইত (নবীর বংশধর) এর প্রতি আহবান আর তাদের প্রতি ভক্তি- শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রকাশ অনেক কর্ণকেই আকৃষ্ট করবে এবং মুসলমানদের দুর্বল অনুভূতি২ তাদের দিকে টানতে সক্ষম হবে। আর সাধারণ মানুষ বেখবর। এ সুযোগে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাদেরকে ধোঁকা দেয়া যাবে।
বাতেনী আন্দোলনগুলো এহেন দুরবস্থাকে মূলধন হিসাবে গ্রহণ করে এ থেকে ফায়দা হাসিল করে। শিয়া মতবাদকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে তারা গোপনে এবং প্রকাশ্যে নিজেদের আন্দোলনের মৌল বিষয় প্রচার করার সুযোগ পায়। অতঃপর তাদের অনুসারীরা তলে তলে বেরিয়ে গিয়ে এবং বাইরে থেকে মুসলমানদের সহায়তা করে যে পরীক্ষায় পতিত হয়, অন্য কোন যুগে মুসলমানরা এমন পরীক্ষায় পতিত হয়নি। ধীরে ধীরে খেলাফতকে দুর্বল করে ফেলে। এভাবেই তারা তাতারি আর ক্রুসেডারদের সহায়তা করে। ব্যক্তি বিশেষকে গোপনে হত্যা করার পন্থা অবলম্বন করে তারা অনেক মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। আর এ ক্ষেত্রে তারা সাময়িকভাবে সফলও হয়েছে। এরা হচ্ছে ইহুদিদের মতো, তারা যখনই পৃথিবীতে গোলযোগ আর বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তখন আল্লাহ এমন লোক তৈয়ার করেন, যারা তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু এরপরও তারা ফিরে আসে না এবং শিক্ষা গ্রহণ করে না।
كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ ( سورة ألمائدة : ৬৪)
‘‘যখনই তারা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত করে, আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন।’’ (সূরা মায়েদা: ৬৪)।
নিঃসন্দেহে সুন্নাহর অনুসারীরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল আর এটাই তাদেরকে শক্তি জোগায়। তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে শরিয়তসম্মত কর্মসূচী অবলম্বন করে, তখন আল্লাহর হুকুমে তারাই বিজয়ী হয়। কেউ কেউ এমন মতও সমর্থন করে, যাতে বলা হয়েছে : সেকালে রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে অনেক দুর্বলতা নিহিত ছিল। কারণ, সেগুলো নতুন রাষ্ট্র। আর সত্য কথা এই যে, তাদের আক্বীদা- বিশ্বাসের কথা বাদ দিলেও রাজনৈতিক আর সাময়িক ক্ষেত্রে তারা নূতন কল্যাণকর কিছুই করতে পারেনি। রোমকদের প্রতিরোধে এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধে হামদানিরা যা কিছু করতে পেরেছিল, কেবল তাই ছিল তাদের সম্বল। আর তা ছিল একটা সীমিত সময়ের জন্য। রোমকদের পতনের পর তাদের পূর্বতন অবস্থা ফিরে আসে। শুরু হয় খুন- খারাবি। অবশ্য বনূ-বুয়াইহ এবং বনূ ওবায়দরা মুসলমানদের কর্তৃত্ব স্থাপনে তাদের নূতন শক্তি কাজে লাগায়। ইসলামি রাষ্ট্রের সীমায় নূতন রাষ্ট্র যোগ করাতো দূরের কথা, তারা এদের প্রতিরোধেও সে শক্তি ব্যবহার করেনি। জ্ঞানের প্রতি তাদের ভালোবাসা, আলেম- ওলামাদের প্রতি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ- অনুপ্রাণিত করা, সাহিত্যিকদের প্রতি অনুপ্রাণিত করা ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় এবং তাদের গ্রন্থ রাজির সমাহার ঘটানো সম্পর্কে যা কিছু প্রচার করা হয় তাদের জুলুম- নির্যাতন আর সুন্নাহর অনুসারী আলেমদেরকে হত্যা করা এবং নিজেদের ধর্মমতের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্বের সামনে তা তুচ্ছ ও মূল্যহীন৩। আর কারামেতা সম্প্রদায়ের আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্ব নিকৃষ্ট।
মুসলিম জাহানের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্রের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু পরিমাণ ইতিহাসও উপস্থাপন কর বোনা, ভবিষ্যতে মর্যাদা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ইতিহাসেরও উল্লেখ কর বোনা। অন্য কিছুও উল্লেখ করবোনা। যে যুগটা প্রসঙ্গে আমরা যখন আলোচনা করব, তখন আমরা সে যুগের সর্বাত্মক অবস্থাই বুঝাবো। অন্যথায় এমন উজির- মন্ত্রীরও অস্তিত্ব ছিল, যাদের মধ্যে শক্তি আর কল্যাণ ছিল, যেমন উজির অ ইবনে ঈসা ইবনে দাউদ ইবনুল জারাহ। তিনি ছিলেন একাধারে ইমাম এবং মুহাদ্দিস। আববাসীয় খলিফা মুকতাদির বিল্লাহ এবং কাহির বিল্লাহর শাসনামলে তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অনেক আলেমের কথা তিনি শ্রবণ করেন। সত্য- সঠিক দীনে তিনি ছিলেন অটল- অবিচল এবং জ্ঞানে- গুণে তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। তাঁর মজলিস আলেমদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকতো। ঐতিহাসিক শূলী বলেন, ‘পবিত্রতা- পরিচ্ছন্নতা, দুনিয়া ত্যাগ এবং কুরআন মজীদ হিফযের ক্ষেত্রে বনু আববাসের মন্ত্রীদের মধ্যে তাঁর মতো কেউ ছিল না। তিনি জুলুম অত্যাচারের বিচার- মীমাংসা করতে বসতেন এবং সত্যিকার ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতেন। হিজরী ৩৩৪ সালে মক্কায় তিনি ইন্তেকাল করেন৪। তাদের মধ্যে রয়েছেন ‘ইফছাহ’ গ্রন্থের প্রণেতা উজির ইবনে হুতায়রা ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ। তিনি কুরআন মজীদ পাঠ করতেন এবং হাদিস শরীফ অধ্যয়ন করতেন। আরবি ব্যাকরণ বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মাজহাবের তিনি ছিলেন একজন বড় ফকীহ। তিনি ছিলেন আববাসী খলীফ মুত্তাযীর উজির। হিজরী ৫৬০ সালে তিনি ইন্তিকাল করেন৫।
এ যুগের বিপুল সংখ্যক আলেম মুসলমানদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। যদিও তাদের নিকট আরো বড় কিছুর প্রত্যাশা ছিল।
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর শুরু থেকে হিজরী ৫ম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলমানদের রাজনৈতিক অবস্থার১ চিত্র অঙ্কন করতে গেলে আমরা দেখতে পাই দুর্বলতা আর দলাদলি, যা ছিল সে সময়ে মুসলিম জাহানের সাধারণ চিত্র। তৎকালে মুসলিম জাহান পরস্পর সংঘাত মুখর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তখন ব্যক্তি স্বার্থ বিশেষ প্রাধান্য পায়। ক্ষমতার ভাষায় তারা কথা বলতো। ক্ষমতার মসনদ দখল করাই ছিল তাদের চরম লক্ষ্য। এজন্য কাফেরদের নিকট থেকে সাহায্য প্রার্থনা করতে হলেও তারা কুণ্ঠিত হতো না। অথবা কোন শহর দুশমনের হাতে চলে গেলেও সেজন্য কোন চিন্তা কর তো না, নিজেদের সাধারণ স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসার সাহস কেউ দেখায়নি, পুনরায় ঐক্যের আন্দোলন শুরু করাতো দূরের কথা।
এ সময় মুসলমানরা বাতেনী আন্দোলন দ্বারা পরীক্ষায় নিপতিত হয়। এসব বাতেনী আন্দোলন শিয়া মতবাদকে আড়াল হিসাবে গ্রহণ করে। এ দ্বারা সাধারণ মানুষ এবং নীচ শ্রেণির লোকদেরকে প্রতারিত করে এবং এ সুযোগে মূল ইসলামের নিন্দাবাদ প্রচার করে। যেসব ঐতিহাসিক এবং জ্ঞানী- গুণী ব্যক্তি নানা দল- উপদল সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই বলেছেন যে, এসব বাতেনী আন্দোলন আরবদের ইসলামি বিজয়ের বিরুদ্ধে পারসিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। মুসলিম বিজেতাদের সামরিক বিজয় দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তারা বুঝতে পারে যে, ইসলামের বিজয় রোধ করা যাবে না, তখন এরা ভেতর থেকে ক্ষতি সাধনের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়। তারা জানতো যে, আহলে বাইত (নবীর বংশধর) এর প্রতি আহবান আর তাদের প্রতি ভক্তি- শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রকাশ অনেক কর্ণকেই আকৃষ্ট করবে এবং মুসলমানদের দুর্বল অনুভূতি২ তাদের দিকে টানতে সক্ষম হবে। আর সাধারণ মানুষ বেখবর। এ সুযোগে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাদেরকে ধোঁকা দেয়া যাবে।
বাতেনী আন্দোলনগুলো এহেন দুরবস্থাকে মূলধন হিসাবে গ্রহণ করে এ থেকে ফায়দা হাসিল করে। শিয়া মতবাদকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে তারা গোপনে এবং প্রকাশ্যে নিজেদের আন্দোলনের মৌল বিষয় প্রচার করার সুযোগ পায়। অতঃপর তাদের অনুসারীরা তলে তলে বেরিয়ে গিয়ে এবং বাইরে থেকে মুসলমানদের সহায়তা করে যে পরীক্ষায় পতিত হয়, অন্য কোন যুগে মুসলমানরা এমন পরীক্ষায় পতিত হয়নি। ধীরে ধীরে খেলাফতকে দুর্বল করে ফেলে। এভাবেই তারা তাতারি আর ক্রুসেডারদের সহায়তা করে। ব্যক্তি বিশেষকে গোপনে হত্যা করার পন্থা অবলম্বন করে তারা অনেক মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। আর এ ক্ষেত্রে তারা সাময়িকভাবে সফলও হয়েছে। এরা হচ্ছে ইহুদিদের মতো, তারা যখনই পৃথিবীতে গোলযোগ আর বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তখন আল্লাহ এমন লোক তৈয়ার করেন, যারা তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু এরপরও তারা ফিরে আসে না এবং শিক্ষা গ্রহণ করে না।
كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ ( سورة ألمائدة : ৬৪)
‘‘যখনই তারা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত করে, আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন।’’ (সূরা মায়েদা: ৬৪)।
নিঃসন্দেহে সুন্নাহর অনুসারীরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল আর এটাই তাদেরকে শক্তি জোগায়। তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে শরিয়তসম্মত কর্মসূচী অবলম্বন করে, তখন আল্লাহর হুকুমে তারাই বিজয়ী হয়। কেউ কেউ এমন মতও সমর্থন করে, যাতে বলা হয়েছে : সেকালে রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে অনেক দুর্বলতা নিহিত ছিল। কারণ, সেগুলো নতুন রাষ্ট্র। আর সত্য কথা এই যে, তাদের আক্বীদা- বিশ্বাসের কথা বাদ দিলেও রাজনৈতিক আর সাময়িক ক্ষেত্রে তারা নূতন কল্যাণকর কিছুই করতে পারেনি। রোমকদের প্রতিরোধে এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধে হামদানিরা যা কিছু করতে পেরেছিল, কেবল তাই ছিল তাদের সম্বল। আর তা ছিল একটা সীমিত সময়ের জন্য। রোমকদের পতনের পর তাদের পূর্বতন অবস্থা ফিরে আসে। শুরু হয় খুন- খারাবি। অবশ্য বনূ-বুয়াইহ এবং বনূ ওবায়দরা মুসলমানদের কর্তৃত্ব স্থাপনে তাদের নূতন শক্তি কাজে লাগায়। ইসলামি রাষ্ট্রের সীমায় নূতন রাষ্ট্র যোগ করাতো দূরের কথা, তারা এদের প্রতিরোধেও সে শক্তি ব্যবহার করেনি। জ্ঞানের প্রতি তাদের ভালোবাসা, আলেম- ওলামাদের প্রতি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ- অনুপ্রাণিত করা, সাহিত্যিকদের প্রতি অনুপ্রাণিত করা ইত্যাদি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় এবং তাদের গ্রন্থ রাজির সমাহার ঘটানো সম্পর্কে যা কিছু প্রচার করা হয় তাদের জুলুম- নির্যাতন আর সুন্নাহর অনুসারী আলেমদেরকে হত্যা করা এবং নিজেদের ধর্মমতের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্বের সামনে তা তুচ্ছ ও মূল্যহীন৩। আর কারামেতা সম্প্রদায়ের আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্ব নিকৃষ্ট।
মুসলিম জাহানের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্রের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু পরিমাণ ইতিহাসও উপস্থাপন কর বোনা, ভবিষ্যতে মর্যাদা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ইতিহাসেরও উল্লেখ কর বোনা। অন্য কিছুও উল্লেখ করবোনা। যে যুগটা প্রসঙ্গে আমরা যখন আলোচনা করব, তখন আমরা সে যুগের সর্বাত্মক অবস্থাই বুঝাবো। অন্যথায় এমন উজির- মন্ত্রীরও অস্তিত্ব ছিল, যাদের মধ্যে শক্তি আর কল্যাণ ছিল, যেমন উজির অ ইবনে ঈসা ইবনে দাউদ ইবনুল জারাহ। তিনি ছিলেন একাধারে ইমাম এবং মুহাদ্দিস। আববাসীয় খলিফা মুকতাদির বিল্লাহ এবং কাহির বিল্লাহর শাসনামলে তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অনেক আলেমের কথা তিনি শ্রবণ করেন। সত্য- সঠিক দীনে তিনি ছিলেন অটল- অবিচল এবং জ্ঞানে- গুণে তিনি ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। তাঁর মজলিস আলেমদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকতো। ঐতিহাসিক শূলী বলেন, ‘পবিত্রতা- পরিচ্ছন্নতা, দুনিয়া ত্যাগ এবং কুরআন মজীদ হিফযের ক্ষেত্রে বনু আববাসের মন্ত্রীদের মধ্যে তাঁর মতো কেউ ছিল না। তিনি জুলুম অত্যাচারের বিচার- মীমাংসা করতে বসতেন এবং সত্যিকার ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতেন। হিজরী ৩৩৪ সালে মক্কায় তিনি ইন্তেকাল করেন৪। তাদের মধ্যে রয়েছেন ‘ইফছাহ’ গ্রন্থের প্রণেতা উজির ইবনে হুতায়রা ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ। তিনি কুরআন মজীদ পাঠ করতেন এবং হাদিস শরীফ অধ্যয়ন করতেন। আরবি ব্যাকরণ বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মাজহাবের তিনি ছিলেন একজন বড় ফকীহ। তিনি ছিলেন আববাসী খলীফ মুত্তাযীর উজির। হিজরী ৫৬০ সালে তিনি ইন্তিকাল করেন৫।
এ যুগের বিপুল সংখ্যক আলেম মুসলমানদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। যদিও তাদের নিকট আরো বড় কিছুর প্রত্যাশা ছিল।
ঐতিহাসিক ইবনে কাছির হিজরী ৩২৪ সালে আববাসীয় খেলাফতের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
খেলাফতের অনুষঙ্গ অতীব দুর্বল হয়ে পড়ে। আশপাশের নবাবরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে এবং বাগদাদের বাইরে খলিফার কোন কর্তৃত্বই অবশিষ্ট ছিল না। আর অন্যান্য আশপাশের অঞ্চলের মধ্যে বসরা যোগ দেয় ইবনে রায়েকের সঙ্গে। খুজিস্তান যোগ দেয় আবু আব্দুল্লাহ বুরাইদীর সঙ্গে। আর পারস্য যোগ দেয় ইমাদুদ দওলাহ ইবনে বুয়াইহ এর সঙ্গে, কেরমান যোগ দেয় আবু আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইলইয়াস ইবনে আল- ইয়াসা এর সঙ্গে; মুসেল, যাজীরা, দিয়ারে বকর এবং মুদার ও রবী’আ গোত্র যোগ দেয় বনু হামদান এর সঙ্গে, আর মিশর এবং সিরিয়া ছিল মুহাম্মদ ইবনে তাগজ- এর হাতে। আফ্রিকান দেশগুলো (তিউনিসিয়া) এবং মরক্কো ছিল ফাতেমী খলিফা কাসেম ইবনে মাহদীর হাতে; খুরাসান আর মা-ওয়ারাউন নহর বা মার্ভে ছিল নছর সামানীর হাতে আর বাহরাইন, হাজর এবং ইয়ামামা ছিল আবু তাহের সুলায়মান ইবনে আবু সাঈদ আল- জানাবী আল- কারমাতীর হাতে1।
এমনই ছিল সে সময়ের দ্বন্দ্ব- সংঘাত, আর এভাবেই তারা টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছিল।
আমি মনে করি, ইবনে কাছীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, খেলাফতের অবস্থা তার চেয়েও শোচনীয় ছিল। কোন কোন সময় এমনও দাঁড়ায় যে, খলিফা যে প্রাসাদে বাস করতেন, তার বাইরে তাঁর কোন কর্তৃত্ব আছে বলে গণ্য করা হতো না। এটা ছিল এক বিস্ময়কর দুর্বলতা। বাগদাদের খলিফারা ছিল খাদেম আর চাকর- বাকরদের হাতের পুতুল। তারা দ্রুত ছুটে যেত আমির- ওমরাদের সৈন্যের জন্য। তারা নিজেরা এ দুর্বলতা উপলব্ধি করতো কিনা, জানি না। কিন্তু তারা মনে করতো যে, তবে তাদের দাস হয়ে থাকার চেয়ে এভাবে বেঁচে থাকা শ্রেয়। অথবা পদ মর্যাদার প্রতি ভালোবাসা এবং এর পেছনে যে সুখ আর বিলাস ও আরাম- আয়েশ রয়েছে, তা যিল্লতী মেনে নেয়ার সীমা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।2 খলিফা মুহাম্মদ ইবনে আহমদ, যার উপাধি ছিল কাহির বিল্লাহ, তিনি যখন পদচ্যুত হন, তখন একটি জুববা ব্যতীত তাঁর কাছে কোন পরিধেয় বস্ত্র ছিল না। এ বস্ত্র খন্ডই তিনি গায়ে জড়াতেন। আর তাঁর পায়ে ছিল কাবকাব নামক এক প্রকার কাষ্ঠ নির্মিত পাদুকা (আমাদের ভাষায় যাকে খড়ম বলা হয়)। তিনি মসজিদে ঘুরে ঘুরে মানুষের নিকট হাত পাততেন3। আর খলিফা একটা বিপ্লবী অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর পলায়ন করে বাগদাদের জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ইবনুল জাসসাস এর নিকট আত্নগোপন করেন। অতঃপর তাঁর উপর হামলা চালিয়ে পৈশাচিকভাবে তাকে হত্যা করা হয় (তাঁর অন্ড-কোষ দ্বয় থেঁতলে দেয়া হয়)। অতঃপর একটা চাদরে আবৃত করে তাঁর লাশ পরিবার- পরিজনের নিকট প্রেরণ করা হয়4। আর খলিফা মুস্তাকফীকে (মৃত্যু ৩৩৪ হিজরী) ভাতা দেয়া হয়, যার পরিমাণ ছিল বার্ষিক ৫ হাজার দিরহাম। এ ভাতা দেয়া হয় সিংহাসনারোহী আহমদ ইবনে বুয়াইহ্ এর পক্ষ থেকে। এরপর পাগড়ি ছিঁড়ে ফেলে চক্ষু ফুটা করে5 তাকে পদচ্যুত করে বন্দী করা হয় এবং বন্দী দশাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। খলিফা মুতি লিল্লাহ শাসনামলে রাষ্ট্রের সকল কর্তৃত্ব ছিল মুইযযুদ দওলাহ বুয়াইহীর হাতে আর বড় পদ, যেমন কাজি বা বিচারপতি, পুলিশ বিভাগ এবং হিসাব বিভাগের পদ কেনা- বেচা হতো (আর এটাই ছিল নিরাপত্তার ধরন)।
আর খলিফা আল- মুকতাদির বিল্লাহ- এর জীবনৈতিহাস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ১৩ বৎসর বয়সে তাঁর পক্ষে বায়য়াত গ্রহণ করা হয়। তাঁর শাসনামলে খেলাফত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তার মান নীচে নেমে যায়। রাজত্বের প্রথম দিকেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইবনে মু’তায এর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করা হয়। এটা সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই পুনরায় মুকতাদির পদচ্যুত হন। অতঃপর কাহির এর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করা হয়। এরপর আবার মুকতাদিরকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তৃতীয় দফায় তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনি সম্পদ অপচয় করতেন। রাষ্ট্র ভান্ডারের সমুদয় অর্থ তিনি ব্যয় করে ফেলেন। এরপর সৈন্যদের বেতন দিতে অভাবে পড়লে বেতন না পেয়ে সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করে6 ।
খলিফা মুহাম্মদ ইবনে মুকতাদির আররাযী বিল্লাহ এর জীবনী সম্পর্কে খতিব আবু বকর বলেন : তাঁর অনেক গুণ- বৈশিষ্ট্য আছে। সে সবের অন্যতম হচ্ছে তিনি হচ্ছেন সে খলিফা, যিনি জুমার দিন খুতবা পাঠ করেন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যিনি একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি ছিলেন দানশীল, আলেম প্রেমিক। হিজরী ৩২৯ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন7।
বর্তমানকালে অনেক বিপ্লবই আমাদেরকে সমকালীন আরবীয় ঘটনাবলীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে যারা এ শিল্পে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের নীতি হচ্ছে দেশের পুরোপুরি সর্বনাশ না করে তারা কিছুতেই ক্ষমতা ত্যাগ করবেন না।
আমরা অতীতের উদাহরণের দিকে ফিরে যাই। খলিফা কাহির বিল্লাহ যখন তার দু’ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সংঘাতে জয় লাভ করেন, তাদের একজন হচ্ছেন; মুনেস আল- কায়েদ আর অন্যজন হচ্ছে ; উজির আলী ইবনে বুলাইক। তখন তাদের উভয়কেই বন্দী করেন এবং বন্দী দশায় কক্ষে প্রবেশ করে তাদেরকে জবাই করে হত্যা করেন। অতঃপর চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তাদের কর্তিত মস্তক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রেরণ করা হয়8।
খলিফা মুকতাদির এর পুত্র অ মুত্তাকী লিল্লাহ ইব্রাহীম এর জীবনী সম্পর্কে বলা হয়েছে :
গোলযোগ পূর্ণ সময়ে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইবনে রায়েক আর বারিদীর ফিতনার ফলে রাজধানী বাগদাদে লুঠপাট শুরু হলে খলিফা মুত্তাকী এবং তাঁর পুত্র মুসলে পলায়ন করেন। তখন বাগদাদে বারিদীর শাসন কর্তৃত্ব চলে। অতঃপর সাইফুদদৌলা আল হামদানী ওয়াসেত- এ আগমন করে বারিদীকে পরাজিত করেন। অতঃপর তূযুন বাগদাদে প্রবেশ করলে খলিফা তাকে আমীরুল উমারা নিযুক্ত করেন। খলিফা বাগদাদ ত্যাগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে মিশরের শাসনকর্তা আখশীদের সাহায্য কামনা করেন। আখশীদ তাকে উপদেশ দেন বাগদাদ ছেড়ে সিরিয়া বা মিশর গমন করার জন্য। কিন্তু খলিফা এ উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে বাগদাদে ফিরে যান। তাঁর বাগদাদ পৌঁছা মাত্র তুর্কি সেনাপতি তুযূন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত: চক্ষু উৎপাটন করে। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে কাছির বলেন : এ বৎসর (হিজরী ৩৩১ সালে) বাগদাদে রাফেযী ধর্মমত বিস্তার লাভ করে। তখন শহরে ঘোষণা জারি করা হয়: কেউ কোন সাহাবির নিন্দা করলে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করবে না9।
ঐ চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কেবল বাগদাদেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী। ব্যক্তি স্বার্থ আর আমিত্ব প্রবল হয়ে দেখা দেয়, এর ফলে দেশে গোলযোগ, বিপর্যয় আর অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। হিজরী ৩৩২ সালের ঘটনাবলীতে রেকর্ড করা হয়েছে যে, আবু আব্দুল্লাহ বারিদী তার ভাই আবু ইউসুফের সম্পদ হস্তগত করার জন্য তাকে হত্যা করে10। বাতীহার অধিপতি হুসাইন ইবনে ইমরান ইবনে শাহিন আপন ভাই গাইলাকে হত্যা করার জন্য লোক নিয়োগ করে।
হিজরী ৪০৩ সালে মুনচেহের আপন পিতা জুরজানের অধিপতি কাবূস ইবনে শামকীরকে হত্যা করার জন্য তার সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে, যাতে পুত্র সর্বময় কর্তৃত্ব করায়াত্ত করতে পারে11। হিজরী ৪৮৭ সালে সুলতান বারাকিয়ারক আপন চাচা তকসকে সপুত্রক পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে12। বিবেক- বুদ্ধি কতটা লোপ পেতে পারে, তার প্রমাণ এই যে, সুলতানের মৃত্যু উপস্থিত হলে ৪ বৎসরের শিশু পুত্র মালিক শাহকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। অথচ আপন ভাই সুলতান মুহাম্মদ তখন বর্তমান ছিলেন। রাজত্ব নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধও চলে। কিন্তু ভাইয়ের হাতে তিনি শাসন-ভার ন্যস্ত করেননি। কার্যত: তখন তার ভাই-ই ছিলেন কর্তৃত্বের অধিকারী। সেনাবাহিনীও ছিল তার কর্তৃত্বাধীন। কিন্তু এ যোগ্য ভাইকে বাদ দিয়ে বাগদাদে শিশু পুত্রের নামে খুতবা পাঠ করা হয়। অতঃপর সুলতান মুহাম্মদ আগমন করলে বাগদাদের পূর্বাঞ্চলে শিশু পুত্রের পক্ষে খুতবা পাঠ করা হয় এবং পশ্চিমাঞ্চলে খুতবা পাঠ করা হয় সুলতান মুহাম্মদের সমর্থনে13।
সীমাহীন আমিত্বের আরো দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়, যদিও তা মুসলমানদেরকে দুর্বলতার দিকে চালিত করে এবং দুশমনদেরকে শক্তিশালী করে তোলে। দামেশকের অধিপতি মুঈনুদ্দীন আনর ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে মুসেলের অধিপতি গাজি সাইফুদ্দীনের সহায়তা কামনা করে বার্তা প্রেরণ করলে জাবাবে তিনি বলেন : আমি বিদ্রোহের করছি। দামেশক আমার হাতে অর্পণ কর, যাতে আমি নিরাপদে থাকতে পারি। আমি তোমার জন্য শপথ বাক্য পাঠ করব, যদি সাহায্য আমাদের পক্ষে হয়। আমি দামেশ্ককে অধিকার করব না। সেখানে অবস্থানও করব না। কিন্তু মুঈনুদ্দীন আনর নিশ্চিত হতে পারেননি এবং তাকে দামেশকে প্রবেশের অনুমতিও দেনননি14। দুর্বল অবস্থায় কোন রকমে টিকে থাকাকেও তিনি একজন মুসলমান বাদশাহের সহায়তা গ্রহণ করা থেকে শ্রেয় মনে করেন।
হিল্লাহ অঞ্চলের শাসনকর্তা দাবীস ইবনে ছাদাকা আল- আসাদী দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করলে আববাসীয় খলিফা তাকে তলব করেন। তিনি খলিফার তলবে হাজির না হয়ে পার্শ্ববর্তী রোম দেশে পলায়ন করেন। অথচ এই রোমকরা হালব রাজ্য অবরোধ করে রেখেছিল। দাবিস হালব অবরোধে তাদের সহায়তা করে। এই আশায় যে, তিনি তাদের নিকট থেকে হালব অধিকার করতে পারবেন। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। তারা এতে সফল হতে পারেনি15। দাবীসের আশা পূরণ হয়নি। ফলে তিনি খলিফার ভয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান।
হালবের অধিপতি রিদওয়ান ইবনে তাতাশ আপন দু’ভাইকে হত্যা করে বাতেনী সম্প্রদায়ের সাহায্য গ্রহণ করে। আর এসব কিছুই করা হয় রাজত্ব লাভের লোভে16। রাহা নগরটি দু’জন আমির নিজেদের মধ্যে ভাগ- বাটোয়ারা করে নেন। এ দু’জন আমির হচ্ছেন ইবনু উতাইর এবং নাছরুদ দৌলা ইবনে মারওয়ান। ইবনু উতাইর রোম সম্রাট আরমানুসের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। ২০ হাজার দীনারের বিনিময়ে সে তার অংশ রোম সম্রাট আরমানুসের নিকট বিক্রয় করে দেয়। তখন রোমনরা নগরে প্রবেশ করে তার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে। এমন কি মসজিদ পর্যন্ত ধ্বংস করে17।
হিজরী ৪২৬ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইবনে ওয়াসসার নোমাইরী আরবের বদ্দুদেরসহ অন্যদের সহযোগিতায় এক বিশ বাহিনী সমবেত করে রাহা অঞ্চল থেকে রোমানদেরকে বিতাড়িত করেন। নছর ইবনে মারওয়ান নগরীর উদ্দেশ্যে বহির্গত হয়ে লুট-তরাজ আর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চায়18। এদের সম্পর্কে কবি আবুল আলা আল মাআররী বলেন :
يسوسون الأنام بغير عقل : فينفذ أمرهم ويقال ساسه .
‘কোন জ্ঞান- বুদ্ধি ছাড়াই ওরা জনগণের উপর শাসন- কর্তৃত্ব চায়। এদের নির্দেশ জারি হয় এবং বলা হয়- এরাই রাজনীতিবিদ। ’
আন্দালুস তথা স্পেনেও এ ব্যাধি বিস্তার লাভ করে। এ ছিল যেন এক মহামারী, যা অঞ্চলের পর অঞ্চল উজাড় করেছে। ৩০ ফরসখ আয়তন অঞ্চলের মালিক সেজে বসে ৪ জন লোক। এরা প্রত্যেকেই নিজেকে আমীরুল মুমিনীন বলে দাবি করে। ফলে এটা এক চরম হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়19। কর্ডোভার বিপর্যয় আর অরাজকতার দিনগুলোতে উমাইয়া ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে হিশাম ইবনে আব্দুল জববার ইবনে নাছের উঠে দাঁড়ায় এবং প্রাচীর ডিঙিয়ে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করে সহায়তা কামনা করলে কর্ডোভার কোন একজন তাকে বলে: আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এ বিপর্যয়ে তোমার জীবন যাবে। কারণ, সৌভাগ্য তোমাদেরকে ত্যাগ করেছে। জবাবে তিনি বলেন, আজ আমার হাতে শপথ কর। কাল আমাকে হত্যা করবে20। কোন একজন সেলজুক শাসক ক্রুসেড হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা চালান, কিন্তু তিনি কোন সাহায্য পাননি। তবে তাদের ফিরে আসার পথে সম্রাট মারদিন পেছন থেকে হামলা করে লুণ্ঠন করে21। নিজের গদি হারাবার আশঙ্কায় ফাতেমী উজির ‘শাওর’ ক্রুসেডারদের সঙ্গে মাখামাখি করে এবং তাদের সাহায্য- সহায়তা কামনা করে। এটা করে এজন্য যাতে মিশর সুলতান নুরুদ্দীন মাহমুদের হাতে চলে না যায়।
এহেন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব- সংঘাতের কারণে বাইরের দুশমনরা লোলুপ দৃষ্টি ফেলে। তারা আশপাশের অঞ্চলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তখন তাদেরকে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। হিজরী ৩৫১ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, রোমানরা ‘আইন যারবা’ নগরে চড়াও হয় এবং তা অধিকার করে নেয়। রোমান বাহিনীর অধিনায়ক ‘দামাস্তাক’ শহরের মুসলমানদেরকে একটা মসজিদে সমবেত করে। যারা মসজিদের বাহিরে ছিল তাদের সকলকে হত্যা করে। অতঃপর যারা মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরকে নির্দেশ দেয় যেদিকে খুশি সরে পড়তে। তখন তারা দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক- সেদিক ছুটোছুটি করে। তারা জানে না কোন দিকে যেতে হবে। দামাস্তাক ‘আইন যারাবা’ নগরীতে একুশ দিন অবস্থান করে। আশপাশের অনেক দুর্গ সে অধিকার করে নেয়22। একই বৎসর রোমানরা হালব নগরী অধিকার করে নেয়। সাইফুদ্দৌলা প্রতিরোধের কোন প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেনি। ফলে তাদের নিকট পরাজয় বরণ করতে হয়। রোমানরা নগর অধিকার করে নিয়ে লুঠতরাজ আর হত্যাকান্ড চায়। অনেককে বন্দী করে। বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। এসব ধন-সম্পদের মধ্যে সাইফুদ্দৌলার সম্পদও ছিল। ছিল তার অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য রাজকোষের রসদ সম্ভারও23।
হিজরী ৩৫৩ সালে রোমানরা পুনরায় ফিরে আসে। তারা ‘মুহাইছা’ নগর অবরোধ করে রাখে। নগরবাসীকে হত্যা করে। নগরের বাড়ি- ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারা ফিরে যায়24।
হিজরী ৩৫৮ সালে রোম সম্রাট সিরিয়ায় প্রবেশ করে। কেউ তাকে বাধা দেয়নি। কেউ তার সঙ্গে লড়াইও করেনি। সে ত্রিপোলী পর্যন্ত ছুটে বেড়ায়। শহর- বন্দর জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে দেয়। অতঃপর হেমস নগরে আগমন করে। উপসাগরীয় অঞ্চলে গমন করত: লুঠতরাজ চায়। শহরের পর শহর ধ্বংস করে। তখন হালব নগরীতে সাইফুদদৌলার গোম ‘কারউইয়া’ অবস্থান করছিল। সে রোমানদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়25।
হিজরী ৫৩৯ সালে রোমানরা আশপাশের খ্রিস্টানদের সহায়তায় এন্তাকিয়া শহর অধিকার করে নেয়। তারা শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদেরকে বহিষ্কার করে এবং যুবক আর যুবতীদেরকে বন্দীকরে26।
এ সময় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কিছুই না। তারা কোন উচ্চ বাচ্যই করেনি। যেমন বর্তমান আমাদের অবস্থা, যখন ইসরাইল যে কোন আরব দেশে হামলা চাচ্ছে, অথচ অন্যান্য আরব দেশগুলো নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। গোটা মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে তাদের কোন উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা নেই। বর্তমানের অবস্থা আরো করুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো কোন মুসলিম দেশ আক্রমণ করলে অন্যান্য মুসলিম দেশ তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করে। আর কাফেরদের সহযোগিতা করে ও তাদের নিকট সহায়তা কামনা করে ইসলামপন্থী ও ইসলামি আন্দোলন কর্মীদের দমনের জন্য। আজ প্রায় সকল মুসলিম শাসকদের ভূমিকা এমনি। তারা পাশ্চাত্যের অনুসারীদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাদের আনুগত্যে প্রতিযোগিতা করে। মনে করে সকল সুখ-শান্তি আর সম্মান শক্তি আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের হাতেই। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তারা সমঝোতা আর সহায়তা করতে ব্যস্ত। সম্পর্ক গড়ে তুলতে তারা উৎকণ্ঠিত। এসব শাসকরা নিজেদের জন্য ইতিহাস রচনা করে। কিন্তু তাদের সে ইতিহাস অন্ধকার ইতিহাস। এ ইতিহাস তাদেরকে মর্যাদা দেয় না। মর্যাদা দেয় না তাদেরকেও, যাদের সম্পর্কে তারা নীরবতা অবলম্বন করে।
খেলাফতের অনুষঙ্গ অতীব দুর্বল হয়ে পড়ে। আশপাশের নবাবরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে এবং বাগদাদের বাইরে খলিফার কোন কর্তৃত্বই অবশিষ্ট ছিল না। আর অন্যান্য আশপাশের অঞ্চলের মধ্যে বসরা যোগ দেয় ইবনে রায়েকের সঙ্গে। খুজিস্তান যোগ দেয় আবু আব্দুল্লাহ বুরাইদীর সঙ্গে। আর পারস্য যোগ দেয় ইমাদুদ দওলাহ ইবনে বুয়াইহ এর সঙ্গে, কেরমান যোগ দেয় আবু আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইলইয়াস ইবনে আল- ইয়াসা এর সঙ্গে; মুসেল, যাজীরা, দিয়ারে বকর এবং মুদার ও রবী’আ গোত্র যোগ দেয় বনু হামদান এর সঙ্গে, আর মিশর এবং সিরিয়া ছিল মুহাম্মদ ইবনে তাগজ- এর হাতে। আফ্রিকান দেশগুলো (তিউনিসিয়া) এবং মরক্কো ছিল ফাতেমী খলিফা কাসেম ইবনে মাহদীর হাতে; খুরাসান আর মা-ওয়ারাউন নহর বা মার্ভে ছিল নছর সামানীর হাতে আর বাহরাইন, হাজর এবং ইয়ামামা ছিল আবু তাহের সুলায়মান ইবনে আবু সাঈদ আল- জানাবী আল- কারমাতীর হাতে1।
এমনই ছিল সে সময়ের দ্বন্দ্ব- সংঘাত, আর এভাবেই তারা টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছিল।
আমি মনে করি, ইবনে কাছীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, খেলাফতের অবস্থা তার চেয়েও শোচনীয় ছিল। কোন কোন সময় এমনও দাঁড়ায় যে, খলিফা যে প্রাসাদে বাস করতেন, তার বাইরে তাঁর কোন কর্তৃত্ব আছে বলে গণ্য করা হতো না। এটা ছিল এক বিস্ময়কর দুর্বলতা। বাগদাদের খলিফারা ছিল খাদেম আর চাকর- বাকরদের হাতের পুতুল। তারা দ্রুত ছুটে যেত আমির- ওমরাদের সৈন্যের জন্য। তারা নিজেরা এ দুর্বলতা উপলব্ধি করতো কিনা, জানি না। কিন্তু তারা মনে করতো যে, তবে তাদের দাস হয়ে থাকার চেয়ে এভাবে বেঁচে থাকা শ্রেয়। অথবা পদ মর্যাদার প্রতি ভালোবাসা এবং এর পেছনে যে সুখ আর বিলাস ও আরাম- আয়েশ রয়েছে, তা যিল্লতী মেনে নেয়ার সীমা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।2 খলিফা মুহাম্মদ ইবনে আহমদ, যার উপাধি ছিল কাহির বিল্লাহ, তিনি যখন পদচ্যুত হন, তখন একটি জুববা ব্যতীত তাঁর কাছে কোন পরিধেয় বস্ত্র ছিল না। এ বস্ত্র খন্ডই তিনি গায়ে জড়াতেন। আর তাঁর পায়ে ছিল কাবকাব নামক এক প্রকার কাষ্ঠ নির্মিত পাদুকা (আমাদের ভাষায় যাকে খড়ম বলা হয়)। তিনি মসজিদে ঘুরে ঘুরে মানুষের নিকট হাত পাততেন3। আর খলিফা একটা বিপ্লবী অভিযানে ব্যর্থ হওয়ার পর পলায়ন করে বাগদাদের জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ইবনুল জাসসাস এর নিকট আত্নগোপন করেন। অতঃপর তাঁর উপর হামলা চালিয়ে পৈশাচিকভাবে তাকে হত্যা করা হয় (তাঁর অন্ড-কোষ দ্বয় থেঁতলে দেয়া হয়)। অতঃপর একটা চাদরে আবৃত করে তাঁর লাশ পরিবার- পরিজনের নিকট প্রেরণ করা হয়4। আর খলিফা মুস্তাকফীকে (মৃত্যু ৩৩৪ হিজরী) ভাতা দেয়া হয়, যার পরিমাণ ছিল বার্ষিক ৫ হাজার দিরহাম। এ ভাতা দেয়া হয় সিংহাসনারোহী আহমদ ইবনে বুয়াইহ্ এর পক্ষ থেকে। এরপর পাগড়ি ছিঁড়ে ফেলে চক্ষু ফুটা করে5 তাকে পদচ্যুত করে বন্দী করা হয় এবং বন্দী দশাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। খলিফা মুতি লিল্লাহ শাসনামলে রাষ্ট্রের সকল কর্তৃত্ব ছিল মুইযযুদ দওলাহ বুয়াইহীর হাতে আর বড় পদ, যেমন কাজি বা বিচারপতি, পুলিশ বিভাগ এবং হিসাব বিভাগের পদ কেনা- বেচা হতো (আর এটাই ছিল নিরাপত্তার ধরন)।
আর খলিফা আল- মুকতাদির বিল্লাহ- এর জীবনৈতিহাস সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ১৩ বৎসর বয়সে তাঁর পক্ষে বায়য়াত গ্রহণ করা হয়। তাঁর শাসনামলে খেলাফত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তার মান নীচে নেমে যায়। রাজত্বের প্রথম দিকেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইবনে মু’তায এর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করা হয়। এটা সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই পুনরায় মুকতাদির পদচ্যুত হন। অতঃপর কাহির এর পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করা হয়। এরপর আবার মুকতাদিরকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তৃতীয় দফায় তাঁকে হত্যা করা হয়। তিনি সম্পদ অপচয় করতেন। রাষ্ট্র ভান্ডারের সমুদয় অর্থ তিনি ব্যয় করে ফেলেন। এরপর সৈন্যদের বেতন দিতে অভাবে পড়লে বেতন না পেয়ে সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করে6 ।
খলিফা মুহাম্মদ ইবনে মুকতাদির আররাযী বিল্লাহ এর জীবনী সম্পর্কে খতিব আবু বকর বলেন : তাঁর অনেক গুণ- বৈশিষ্ট্য আছে। সে সবের অন্যতম হচ্ছে তিনি হচ্ছেন সে খলিফা, যিনি জুমার দিন খুতবা পাঠ করেন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যিনি একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তিনি ছিলেন দানশীল, আলেম প্রেমিক। হিজরী ৩২৯ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন7।
বর্তমানকালে অনেক বিপ্লবই আমাদেরকে সমকালীন আরবীয় ঘটনাবলীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে যারা এ শিল্পে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের নীতি হচ্ছে দেশের পুরোপুরি সর্বনাশ না করে তারা কিছুতেই ক্ষমতা ত্যাগ করবেন না।
আমরা অতীতের উদাহরণের দিকে ফিরে যাই। খলিফা কাহির বিল্লাহ যখন তার দু’ প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সংঘাতে জয় লাভ করেন, তাদের একজন হচ্ছেন; মুনেস আল- কায়েদ আর অন্যজন হচ্ছে ; উজির আলী ইবনে বুলাইক। তখন তাদের উভয়কেই বন্দী করেন এবং বন্দী দশায় কক্ষে প্রবেশ করে তাদেরকে জবাই করে হত্যা করেন। অতঃপর চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তাদের কর্তিত মস্তক রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রেরণ করা হয়8।
খলিফা মুকতাদির এর পুত্র অ মুত্তাকী লিল্লাহ ইব্রাহীম এর জীবনী সম্পর্কে বলা হয়েছে :
গোলযোগ পূর্ণ সময়ে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইবনে রায়েক আর বারিদীর ফিতনার ফলে রাজধানী বাগদাদে লুঠপাট শুরু হলে খলিফা মুত্তাকী এবং তাঁর পুত্র মুসলে পলায়ন করেন। তখন বাগদাদে বারিদীর শাসন কর্তৃত্ব চলে। অতঃপর সাইফুদদৌলা আল হামদানী ওয়াসেত- এ আগমন করে বারিদীকে পরাজিত করেন। অতঃপর তূযুন বাগদাদে প্রবেশ করলে খলিফা তাকে আমীরুল উমারা নিযুক্ত করেন। খলিফা বাগদাদ ত্যাগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে মিশরের শাসনকর্তা আখশীদের সাহায্য কামনা করেন। আখশীদ তাকে উপদেশ দেন বাগদাদ ছেড়ে সিরিয়া বা মিশর গমন করার জন্য। কিন্তু খলিফা এ উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে বাগদাদে ফিরে যান। তাঁর বাগদাদ পৌঁছা মাত্র তুর্কি সেনাপতি তুযূন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত: চক্ষু উৎপাটন করে। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে কাছির বলেন : এ বৎসর (হিজরী ৩৩১ সালে) বাগদাদে রাফেযী ধর্মমত বিস্তার লাভ করে। তখন শহরে ঘোষণা জারি করা হয়: কেউ কোন সাহাবির নিন্দা করলে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করবে না9।
ঐ চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কেবল বাগদাদেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী। ব্যক্তি স্বার্থ আর আমিত্ব প্রবল হয়ে দেখা দেয়, এর ফলে দেশে গোলযোগ, বিপর্যয় আর অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। হিজরী ৩৩২ সালের ঘটনাবলীতে রেকর্ড করা হয়েছে যে, আবু আব্দুল্লাহ বারিদী তার ভাই আবু ইউসুফের সম্পদ হস্তগত করার জন্য তাকে হত্যা করে10। বাতীহার অধিপতি হুসাইন ইবনে ইমরান ইবনে শাহিন আপন ভাই গাইলাকে হত্যা করার জন্য লোক নিয়োগ করে।
হিজরী ৪০৩ সালে মুনচেহের আপন পিতা জুরজানের অধিপতি কাবূস ইবনে শামকীরকে হত্যা করার জন্য তার সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করে, যাতে পুত্র সর্বময় কর্তৃত্ব করায়াত্ত করতে পারে11। হিজরী ৪৮৭ সালে সুলতান বারাকিয়ারক আপন চাচা তকসকে সপুত্রক পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে12। বিবেক- বুদ্ধি কতটা লোপ পেতে পারে, তার প্রমাণ এই যে, সুলতানের মৃত্যু উপস্থিত হলে ৪ বৎসরের শিশু পুত্র মালিক শাহকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। অথচ আপন ভাই সুলতান মুহাম্মদ তখন বর্তমান ছিলেন। রাজত্ব নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধও চলে। কিন্তু ভাইয়ের হাতে তিনি শাসন-ভার ন্যস্ত করেননি। কার্যত: তখন তার ভাই-ই ছিলেন কর্তৃত্বের অধিকারী। সেনাবাহিনীও ছিল তার কর্তৃত্বাধীন। কিন্তু এ যোগ্য ভাইকে বাদ দিয়ে বাগদাদে শিশু পুত্রের নামে খুতবা পাঠ করা হয়। অতঃপর সুলতান মুহাম্মদ আগমন করলে বাগদাদের পূর্বাঞ্চলে শিশু পুত্রের পক্ষে খুতবা পাঠ করা হয় এবং পশ্চিমাঞ্চলে খুতবা পাঠ করা হয় সুলতান মুহাম্মদের সমর্থনে13।
সীমাহীন আমিত্বের আরো দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়, যদিও তা মুসলমানদেরকে দুর্বলতার দিকে চালিত করে এবং দুশমনদেরকে শক্তিশালী করে তোলে। দামেশকের অধিপতি মুঈনুদ্দীন আনর ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে মুসেলের অধিপতি গাজি সাইফুদ্দীনের সহায়তা কামনা করে বার্তা প্রেরণ করলে জাবাবে তিনি বলেন : আমি বিদ্রোহের করছি। দামেশক আমার হাতে অর্পণ কর, যাতে আমি নিরাপদে থাকতে পারি। আমি তোমার জন্য শপথ বাক্য পাঠ করব, যদি সাহায্য আমাদের পক্ষে হয়। আমি দামেশ্ককে অধিকার করব না। সেখানে অবস্থানও করব না। কিন্তু মুঈনুদ্দীন আনর নিশ্চিত হতে পারেননি এবং তাকে দামেশকে প্রবেশের অনুমতিও দেনননি14। দুর্বল অবস্থায় কোন রকমে টিকে থাকাকেও তিনি একজন মুসলমান বাদশাহের সহায়তা গ্রহণ করা থেকে শ্রেয় মনে করেন।
হিল্লাহ অঞ্চলের শাসনকর্তা দাবীস ইবনে ছাদাকা আল- আসাদী দেশে গোলযোগ সৃষ্টি করলে আববাসীয় খলিফা তাকে তলব করেন। তিনি খলিফার তলবে হাজির না হয়ে পার্শ্ববর্তী রোম দেশে পলায়ন করেন। অথচ এই রোমকরা হালব রাজ্য অবরোধ করে রেখেছিল। দাবিস হালব অবরোধে তাদের সহায়তা করে। এই আশায় যে, তিনি তাদের নিকট থেকে হালব অধিকার করতে পারবেন। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। তারা এতে সফল হতে পারেনি15। দাবীসের আশা পূরণ হয়নি। ফলে তিনি খলিফার ভয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান।
হালবের অধিপতি রিদওয়ান ইবনে তাতাশ আপন দু’ভাইকে হত্যা করে বাতেনী সম্প্রদায়ের সাহায্য গ্রহণ করে। আর এসব কিছুই করা হয় রাজত্ব লাভের লোভে16। রাহা নগরটি দু’জন আমির নিজেদের মধ্যে ভাগ- বাটোয়ারা করে নেন। এ দু’জন আমির হচ্ছেন ইবনু উতাইর এবং নাছরুদ দৌলা ইবনে মারওয়ান। ইবনু উতাইর রোম সম্রাট আরমানুসের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। ২০ হাজার দীনারের বিনিময়ে সে তার অংশ রোম সম্রাট আরমানুসের নিকট বিক্রয় করে দেয়। তখন রোমনরা নগরে প্রবেশ করে তার কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে। এমন কি মসজিদ পর্যন্ত ধ্বংস করে17।
হিজরী ৪২৬ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইবনে ওয়াসসার নোমাইরী আরবের বদ্দুদেরসহ অন্যদের সহযোগিতায় এক বিশ বাহিনী সমবেত করে রাহা অঞ্চল থেকে রোমানদেরকে বিতাড়িত করেন। নছর ইবনে মারওয়ান নগরীর উদ্দেশ্যে বহির্গত হয়ে লুট-তরাজ আর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চায়18। এদের সম্পর্কে কবি আবুল আলা আল মাআররী বলেন :
يسوسون الأنام بغير عقل : فينفذ أمرهم ويقال ساسه .
‘কোন জ্ঞান- বুদ্ধি ছাড়াই ওরা জনগণের উপর শাসন- কর্তৃত্ব চায়। এদের নির্দেশ জারি হয় এবং বলা হয়- এরাই রাজনীতিবিদ। ’
আন্দালুস তথা স্পেনেও এ ব্যাধি বিস্তার লাভ করে। এ ছিল যেন এক মহামারী, যা অঞ্চলের পর অঞ্চল উজাড় করেছে। ৩০ ফরসখ আয়তন অঞ্চলের মালিক সেজে বসে ৪ জন লোক। এরা প্রত্যেকেই নিজেকে আমীরুল মুমিনীন বলে দাবি করে। ফলে এটা এক চরম হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়19। কর্ডোভার বিপর্যয় আর অরাজকতার দিনগুলোতে উমাইয়া ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে হিশাম ইবনে আব্দুল জববার ইবনে নাছের উঠে দাঁড়ায় এবং প্রাচীর ডিঙিয়ে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করে সহায়তা কামনা করলে কর্ডোভার কোন একজন তাকে বলে: আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এ বিপর্যয়ে তোমার জীবন যাবে। কারণ, সৌভাগ্য তোমাদেরকে ত্যাগ করেছে। জবাবে তিনি বলেন, আজ আমার হাতে শপথ কর। কাল আমাকে হত্যা করবে20। কোন একজন সেলজুক শাসক ক্রুসেড হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা চালান, কিন্তু তিনি কোন সাহায্য পাননি। তবে তাদের ফিরে আসার পথে সম্রাট মারদিন পেছন থেকে হামলা করে লুণ্ঠন করে21। নিজের গদি হারাবার আশঙ্কায় ফাতেমী উজির ‘শাওর’ ক্রুসেডারদের সঙ্গে মাখামাখি করে এবং তাদের সাহায্য- সহায়তা কামনা করে। এটা করে এজন্য যাতে মিশর সুলতান নুরুদ্দীন মাহমুদের হাতে চলে না যায়।
এহেন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব- সংঘাতের কারণে বাইরের দুশমনরা লোলুপ দৃষ্টি ফেলে। তারা আশপাশের অঞ্চলে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তখন তাদেরকে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। হিজরী ৩৫১ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে, রোমানরা ‘আইন যারবা’ নগরে চড়াও হয় এবং তা অধিকার করে নেয়। রোমান বাহিনীর অধিনায়ক ‘দামাস্তাক’ শহরের মুসলমানদেরকে একটা মসজিদে সমবেত করে। যারা মসজিদের বাহিরে ছিল তাদের সকলকে হত্যা করে। অতঃপর যারা মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরকে নির্দেশ দেয় যেদিকে খুশি সরে পড়তে। তখন তারা দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক- সেদিক ছুটোছুটি করে। তারা জানে না কোন দিকে যেতে হবে। দামাস্তাক ‘আইন যারাবা’ নগরীতে একুশ দিন অবস্থান করে। আশপাশের অনেক দুর্গ সে অধিকার করে নেয়22। একই বৎসর রোমানরা হালব নগরী অধিকার করে নেয়। সাইফুদ্দৌলা প্রতিরোধের কোন প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেনি। ফলে তাদের নিকট পরাজয় বরণ করতে হয়। রোমানরা নগর অধিকার করে নিয়ে লুঠতরাজ আর হত্যাকান্ড চায়। অনেককে বন্দী করে। বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। এসব ধন-সম্পদের মধ্যে সাইফুদ্দৌলার সম্পদও ছিল। ছিল তার অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য রাজকোষের রসদ সম্ভারও23।
হিজরী ৩৫৩ সালে রোমানরা পুনরায় ফিরে আসে। তারা ‘মুহাইছা’ নগর অবরোধ করে রাখে। নগরবাসীকে হত্যা করে। নগরের বাড়ি- ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তারা ফিরে যায়24।
হিজরী ৩৫৮ সালে রোম সম্রাট সিরিয়ায় প্রবেশ করে। কেউ তাকে বাধা দেয়নি। কেউ তার সঙ্গে লড়াইও করেনি। সে ত্রিপোলী পর্যন্ত ছুটে বেড়ায়। শহর- বন্দর জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে দেয়। অতঃপর হেমস নগরে আগমন করে। উপসাগরীয় অঞ্চলে গমন করত: লুঠতরাজ চায়। শহরের পর শহর ধ্বংস করে। তখন হালব নগরীতে সাইফুদদৌলার গোম ‘কারউইয়া’ অবস্থান করছিল। সে রোমানদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়25।
হিজরী ৫৩৯ সালে রোমানরা আশপাশের খ্রিস্টানদের সহায়তায় এন্তাকিয়া শহর অধিকার করে নেয়। তারা শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে নারী, শিশু এবং বৃদ্ধদেরকে বহিষ্কার করে এবং যুবক আর যুবতীদেরকে বন্দীকরে26।
এ সময় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কিছুই না। তারা কোন উচ্চ বাচ্যই করেনি। যেমন বর্তমান আমাদের অবস্থা, যখন ইসরাইল যে কোন আরব দেশে হামলা চাচ্ছে, অথচ অন্যান্য আরব দেশগুলো নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। গোটা মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে তাদের কোন উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা নেই। বর্তমানের অবস্থা আরো করুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো কোন মুসলিম দেশ আক্রমণ করলে অন্যান্য মুসলিম দেশ তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করে। আর কাফেরদের সহযোগিতা করে ও তাদের নিকট সহায়তা কামনা করে ইসলামপন্থী ও ইসলামি আন্দোলন কর্মীদের দমনের জন্য। আজ প্রায় সকল মুসলিম শাসকদের ভূমিকা এমনি। তারা পাশ্চাত্যের অনুসারীদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তাদের আনুগত্যে প্রতিযোগিতা করে। মনে করে সকল সুখ-শান্তি আর সম্মান শক্তি আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের হাতেই। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তারা সমঝোতা আর সহায়তা করতে ব্যস্ত। সম্পর্ক গড়ে তুলতে তারা উৎকণ্ঠিত। এসব শাসকরা নিজেদের জন্য ইতিহাস রচনা করে। কিন্তু তাদের সে ইতিহাস অন্ধকার ইতিহাস। এ ইতিহাস তাদেরকে মর্যাদা দেয় না। মর্যাদা দেয় না তাদেরকেও, যাদের সম্পর্কে তারা নীরবতা অবলম্বন করে।
কোন দেশের নৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থায় যখন চরম ধস নেমে আসে, তখন সে জনপদের মানুষের মনে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয়, জেগে উঠে সম্পদ সঞ্চয় করার এক উগ্র বাসনা। আর এ বাসনা এক চরম রূপ ধারণ করে। শুরু হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় ধন- ভান্ডার থেকে সম্পদ আহরণের উম্মত প্রতিযোগিতা আর লুঠপাট। সম্পদ আহরণ করার লোভ জাগে সকলের। যেন তা এক অতি মোহনিয় দুর্লভ বস্ত্ত আর কি! মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়ে। এরা হালাল-হারামের ধার ধারে না। এমনকি ইহকাল আর পরকালও বুঝে না। ফলে ইহকালেও তারা অখিদন্তু ব্যর্থ হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মালিকানায় নব-নব সংযোজন ঘটে; কিন্তু তাদের বাকি জীবন অতিবাহিত হয় নিতান্ত যিল্লতী আর সংকীর্ণতার মধ্য দিয়ে। মনে এক রাশ দুঃখ নিয়ে তাদের প্রাণ বায়ু নির্বাপিত হয়। সংক্ষেপে আরব জাহান বা তৃতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত অঞ্চলে বারবার এ কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটে। এটাকে বলা যায় মোটা তাজা বিড়ালের কাহিনি। এরা জাতির সম্পদ লুঠপাট করে দেশকে উজাড় করে তোলে, যেন তা মসৃণ সমতল ভূমি আর কি! বিবেক তাদেরকে তিরস্কার করে না, মানবীয় অনুভূতিও না। তবে পূর্বসূরিদের চেয়ে বর্তমানকালের ধন কুবেরা কিছুটা ব্যতিক্রম। বর্তমান কালের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সঞ্চিত অর্থ সুইস আর মার্কিন ব্যাংকগুলোতে পাচার করে দিচ্ছে।
মুইজ্জুদ্দৌলা বুয়াইহীর ক্রীতদাস এবং তুর্কি দেহরক্ষী সুবুক্তগীন এর জীবনেতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি অঢেল সম্পদ রেখে মারা যান। তার পরিত্যক্ত সম্পদের মধ্যে ছিল লক্ষ লক্ষ দীনার এবং মণি-মাণিক্য ভর্তি কয়েকটা সিন্দুক1। মিসরে ফাতেমী খলিফাদের উজির আফয ছিলেন আর্মেনীয় বাহিনীর সেনাধ্যক্ষের পুত্র। তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদ সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি এক বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ- রৌপ্য, মণি-মাণিক্য, মূল্যবান পোশাক- আশাক, দাস-দাসী, অশ্ব আর সুগন্ধি ছেড়ে যান, যার সঠিক পরিমাণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না2।
আয়াদুদ্দৌলা বুয়াইহী একটা বাগান নির্মাণ করান, যাতে পানি সিঞ্চনের খরচসহ ব্যায় করা হয় ৫০ লক্ষ দিরহাম3
উজির ইবনুল ফুরাত সম্পর্কে জানা যায় যে, মহামূল্যবান ধাতু নির্মিত চামচ ছাড়া তিনি আহার্য গ্রহণ করতেন না। উজির ইবনু কালস এর দাস দাসীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার। তাঁর নিকট যেসব মণি- মাণিক্য পাওয়া যায়, তার মূল্য ছিল ৪ লক্ষ দিনার। 4
ঐতিহাসিক ইবনে কাছীর হিজরী ৪৮০ সালে সুলতান মালিক শাহ এর কন্যার বিবাহে প্রদত্ত উপঢৌকনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন : সে বৎসর মুহররম মাসে সুলতানের কন্যার উপঢৌকন রাজধানীতে আনা হয় ১৩০ টি উষ্ট্রের পৃষ্ঠে বোঝাই করে। রোমের মহামূল্যবান ‘দীবাজ’ বস্ত্র দ্বারা উষ্ট্রগুলোকে সাজানো হয়। এসব উপঢৌকনের বেশিরভাগ ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত তৈজসপত্র। এছাড়া ৭৪ টি খচ্চরকে দেশীয় রাজকীয় পোশাক পরিচ্ছদ দ্বারা সজ্জিত করে তাদের পৃষ্ঠেও বহন করে আরো উপঢৌকন সামগ্রী রাজধানীতে আনা হয়5
এসব বিরাট অংকের কথা শ্রবণ করে ধারণা জন্মাতে পারে যে, দেশের মানুষের অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু আসলে তা নয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ অতি কষ্টে জীবন কাটাতো। করের বোঝা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছিল। তদুপরি তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় সেনাবাহিনী। হিজরী ৩৩১ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানা যায় যে, তখন দ্রব্যমূল্য এতটা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মানুষ কুকুর খেতে বাধ্য হয়। পরিণামে দেশে মহামারি দেখা দেয়।6
হিজরী ৩৬১ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানা যায় যে, দেশে প্রতারক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা বিপর্যয় সৃষ্টি করে। জনগণের ধন- সম্পদ অপহরণ করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বাণিজ্য কেন্দ্র আল- কারখ অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হয়।7 হিজরী ৩৭৬ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানা যায় যে, তখন ইরাকে পণ্য মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে অধিকাংশ লোক দেশ ছেড়ে চলে যায়। হিজরী ৩৮৩, ৩৯৭, ৪১৬, ৪২০ এবং ৪২৪ সালেও দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এ সঙ্গে প্রতারক শ্রেণি এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সংখ্যাও বেড়ে যায়।
হিজরী ৪৪৮ সালেও চুরি- ডাকাতি আর লুট-তরাজের ভয়ে রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে পণ্য-মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। মানুষ মৃত জন্তু ভক্ষণ করতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী গুদাম জানত করে এবং সংকটকালে তা বিক্রয়ের জন্য বাজারে ছাড়ে। এ সময় কায়রোয় জনৈক ব্যক্তি মাত্র ২০ কেজি আটার বিনিময়ে একটা গৃহ ক্রয় করে। অথচ ইতিপূর্বে গৃহটি ক্রয় করা হয় ৯শত দীনার মূল্যে। আর একটা ডিম বিক্রি হতো ১ দীনার মূল্যে।8 ধনী আর অভিজাত শ্রেণির বিদেশ থেকে পণ্য আম দানীর বহর বৃদ্ধি পায়। মিশরের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী আফ্ফান ইবনে সুলায়মানের মৃত্যু হলে শাসক আখশীদ তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ৪ লক্ষ দীনার গ্রহণ করেন। তখন মানুষের মুখে মুখে একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত হয় ;
‘কেউ মারা গেলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ সাইফুদ্দৌলা তথা শাসক গোষ্ঠীর জন্য।’9
এ সময় শাসক শ্রেণির সেনাবাহিনীর লোকেরা জনগণের সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এরা গ্রামের কৃষকদের উপর নির্যাতন চালাতো। তাদের শস্য লুট করে নিয়ে যেতো, কিন্তু বাধা দেয়ার সাহস কারো হতো না। এ সময় উজির মুহাল্লাবীর জন্য তিন দিনে ১ হাজার দীনারের ফুল ক্রয় করা হয়। তার মজলিসে এসব ফুল ছিটানো হয় এবং এটাকে মহা কল্যাণকর ও পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়।10
এই ছিল শাসক শ্রেণি উজির আর ওমরাদের অবস্থা। এ সময় আমরা দেখতে পাই যে, মালেকী মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ কাজি আব্দুল ওয়াহহাব তাগলাবী বাগদাদের জন্য দুঃখ করে বাগদাদ ছেলে চলে যান। তাঁকে বিদায় দেওয়ার জন্য যারা সমবেত হয়, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন : শক সন্ধ্যা দুটি রুটিও যদি জুটতো তাহলে তোমাদের শহরের সমকক্ষ আমি অন্য কোন শহরকে বিবেচনা করতাম না। এ সম্পর্কে তিনি একটা কবিতা রচনা করেন। তাতে বলেন : 11
سلام على بغداد فى كل موطنوحق لها منى سلام مضاعف
فوالله ما فارقتها عن قلىً لها وأنى بشطى جانبيها لعارف
ولكنها ضاقت علىّ بأسرها ولم تكن الأرزاق فيها تساعف .
সালাম বাগদাদ নগরীকে সকল দেশ থেকে।
আমার কাছে তার আরো অতিরিক্ত সালাম পাওয়ার অধিকার আছে।
খোদার শপথ, আমি তাকে জানি না বিধায় ত্যাগ করছি না।
তার দু‘তীর সম্পর্কে আমি ভালো করেই জানি।
কিন্তু তা আদপেই আমার প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে।
সেখানে জীবিকা মোটেই সহজলভ্য নয়।
তিনি আরো বলেন : 12
بغداد دارلاهل المال طيبةوللمفاليس دار الضنك والضيق
ظللت حيرانَ أمشى فى ازقّقتها كاننى مصحف فى بيت زندق
ধনীদের জন্য বাগদাদ চমৎকার বাসস্থান।
আর গরিব- নিঃস্বদের জন্য সংকীর্ণতার স্থান।
তার অলিতে- গলিতে আমি ঘোরাফেরা করেছি, বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে,
যেন আমি নাস্তিকের ঘরে কুরআন শরীফ।
তাঁর সম্পর্কে ইবনে বাসাম ‘যাখীরা’ গ্রন্থে বলেন :
অবশিষ্ট মানুষ ছিল যেন, ধারণা- কল্পনার অনুসারীদের শিকার। আরবি সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ ব্যক্তিত্ব পন্ডিত আবু আলীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালে তিনি ব্যক্তিগত পাঠাগারের মূল্যবান গ্রন্থ রাজি বিক্রয় করতে বাধ্য হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এসব বই- পুস্তক বিক্রয় করে তিনি আন্দুলুসিয়া তথা স্পেনে চলে যাবেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে ‘জামহারা’ গ্রন্থের একটি কপিও ছিল। বইটি বিক্রয় করতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। শরীফ মুর-তাজা নামে জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তি বইটি ক্রয় করেন। বইটিতে আবু অর নিজের হাতে নীচের কবিতাটি লেখা ছিল :
أنست بها عشرين حولا وبعتها فقد طال وجدى بعدها وحنينى
وما كان ظنى أننى سأبيعها ولو خلدتنى فى السجون ديونى
ولكن لضعف افتفار وصبيةصغار عليهم تستهل جفونى
-দীর্ঘ কুড়িটা বৎসর তার সঙ্গে কাটিয়ে এখন তা বিক্রয় করতে হচ্ছে
তার সঙ্গে আমার ছিল দীর্ঘ ভালোবাসা, আর তারপরে কান্না,
তা বিক্রয় করতে হবে এমন ধারণা আমার ছিল না কখনো,
যদিও ঋণ আমাকে সারাজীবন কারাগারে বন্দী করে রাখে।
কিন্তু দুর্বলতা, দরিদ্র আর শিশুদের কারণে
তুচ্ছ তাদের কাছে, ক্ষুণ্ণ আমার মান!
অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এ মিলের জন্য মানুষ অবাক হতে পারে, কিন্তু সেখানেও একটা স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। আর তা এই যে, অতীতের কোন কোন শাসক সত্যের দিকে ফিরে আসতো। যখন তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো, যখন উপদেশ দেয়া হতো। আর এখন? উপদেশ আর প্রচার তাদের কোনই কাজে আসে না, কোনই কল্যাণ বয়ে আনে না। ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া’য় বলা হয়েছে; এক শুক্রবার প্রসিদ্ধ ওয়ায়েয ইবনুল ইবাদী মজলিসে বসে কথা বলছিলেন। সেলজুক বাদশাহ সুলতান মাসঊদও সে মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জনগণের ক্রয়- বিক্রয়ে অন্যায়ভাবে কর আরোপ করেন। তখন ইবনুল ইবাদী বললেন, হে সুলতান, আপনি খুশি হয়ে গায়িকাদের কর হ্রাস করেন, তাদের করের পরিমাণ মুসলমান জনগণের উপর আরোপিত করের চেয়ে কম। আপনি আমাকে একজন গায়িকা দান করুন, যার প্রতি আপনি সন্তুষ্ট, আর আপনার প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ এ কর হ্রাস করুন। সুলতান হাতের ইঙ্গিতে বললেন হ্যাঁ আমি তা করব। জনগণ চিৎকার করে তাঁর জন্য দোয়া করে। 13
এ ঘটনা কি আমাদেরকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না যে, আজকাল শাসক শ্রেণি গায়ক-গায়িকাদের প্রতি কেমন কৃপা-বৃষ্টি বর্ষণ করছে। আর এটা করছে অন্যায়ভাবে জনগণের সম্পদ ভক্ষণ করার জন্য। অতঃপর এ সম্পদ চলে যাবে আল্লাহর দুশমনদের হাতে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জনগণ অতি কষ্টে দিন গুজরান করছে।
অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছে, যখন রাষ্ট্র জামানতের বিধান প্রবর্তন করে। আর তা হচ্ছে কোন ব্যক্তিকে কোন শহর বা অঞ্চল থেকে নির্ধারিত পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করে সরকারের নিকট অগ্রিম জমা দেবে। এভাবে সঞ্চিত আর পরিশোধিত ট্যাক্সের মধ্যে একটা ব্যবধান থাকে। জমিদার ব্যক্তি ট্যাক্স সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করবে ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা। আবার কখনো কখনো ক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়াই এ কাজ করবে। আদায়কৃত ট্যাক্সের যাবতীয় হিসাবপত্র রাখা হয় সরকারের প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী। অবশ্য এটা স্বাভাবিক যে, এসব ক্ষেত্রে জামিনদার ব্যক্তি আপ্রাণ চেষ্টা করে, কৃষকদের নিকট থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করার। এজন্য যদি পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করতে হয় তবুও তা করবে। তা যদি কৃষক জনতার সাধ্যাতীত হয়, তবুও করবে। এভাবে সে আদায় করবে সর্বোচ্চ পরিমাণ, কিন্তু সরকারের নিকট জমা দেবে সম্ভাব্য সর্বনিম্ন পরিমাণ। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির লাভ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর প্রণীত ‘তারীখুল কামিল’ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই; আবু আলী ইবনে ফাজল দু’লক্ষ দীনারের বিনিময়ে ওয়াসেত অঞ্চলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আর আবু সাঈদ সাবুর ইবনুল মুজাফ্ফর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বসরা অঞ্চলের।14 বুয়াইহী শাসকরা সেনাবাহিনীর জন্য জায়গীরদারী প্রথার প্রবর্তন করলে ব্যাপারটা আরো চরমে পৌঁছে। তারা সামরিক বাহিনীর লোকজনকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন- ভাতা না দিয়ে ভূমি দান করেন। সেনাবাহিনীর লোকেরা এটাকে তাদের সেবার বিনিময়ের চেয়ে বেশি মনে করল। আর এটা স্বাভাবিক যে, সেনাবাহিনীর লোকেরা চাষাবাদে প্রবৃত্ত হবে না। বরং তাদের কাছে চাষাবাদ করার লোক থাকবে। ভূমির উৎপাদিত ফসলে এরা সন্তুষ্ট না হলে শক্তি প্রয়োগে ভূমি অন্যরা দখল করে নেবে। ফলে অসহায় কৃষক তার ভূমি হারাতে বাধ্য হবে। আর চাষা-বাদ-যোগ্য ভূমি, পতিত ভূমিতে পরিণত হবে। কেউ ভূমিতে কোন কাজ করবে না। যার ফলশ্রুতিতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।15 তারা আরো একটি কুৎসিত নিয়ম প্রবর্তন করে।
এ নিয়মও প্রবর্তিত হয় বুয়াইহী শাসকের শাসনামলে। হিজরী ৩৫০ সালে আবুল আববাস ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবুল শাওয়ারিব বার্ষিক দু’ লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে কাজি বা বিচারপতির পদ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি অর্থের বিনিময়ে বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে এমন নিয়ম ছিল না। কিন্তু আববাসীয় খলিফা আল-মুতী লিল্লাহ এ নিয়ম মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি এই কাজিকে বিচারালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেননি। এই কাজি যখন জামানতের দ্বার উন্মুক্ত করেন, তখন বাগদাদে হিসাব বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগেও এ নিয়ম প্রবর্তিত হয়।16 আর এসব হচ্ছে সামাজিক বিকৃতি এবং রাষ্ট্রের দুর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ। ঐতিহাসিক ইবনে খলদুনের নিকট এ বিষয়টির ভয়াবহতা স্পষ্ট ছিল। তাইতো তিনি আল-মুকাদ্দিমায় বলেন : জানা উচিত যে, জনগণের উপর অর্থনৈতিক শোষণ- নির্যাতন চালানো হলে তাদের সম্পদ উপার্জনের স্পৃহা নস্যাৎ হয়ে যায়। আর যখন তাদের স্পৃহা নস্যাৎ হয়ে যায়, তখন জনগণ অর্থকরী কর্মকান্ডে শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ে তখনই বাজারে মন্দা দেখা দেয়। দেশের বাসিন্দারা হয়ে উঠে কর্মবিমুখ এবং উজাড় হয়ে যায় নগর- বন্দর আর জনপদ।17 গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে ইবনে খলদূন আরো বলেন : কোন বিনিময় ব্যতিরেকে সম্পদের মালিকের হাত থেকে সম্পদ নিয়ে নেয়া বা কোন কারণ ছাড়া কারো সম্পদ হস্তগত করা জুলুম বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে, কেবল তাকেই জুলুম- শোষণ বলে মনে করবে না, বরং জুলুম আরো ব্যাপক অর্থ জ্ঞাপক। কোন অধিকার ছাড়া যারা সম্পদ আহরণ করে তারা জালিম। যারা সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে, তারা জালিম এবং যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে, তারাও জালিম। মালিকানা হরণকারীরাও সাধারণত: জালিম। আর এসব কিছুর খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়ে রাষ্ট্রের উপর সামাজিক বিকৃতির আকারে।18 তিনি আরো বলেন, যেন তিনি বর্তমান কালের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কথা বলছেন : সমাজ আর রাষ্ট্রের বিকৃতির ক্ষেত্রে এর চেয়েও বড় জুলুম হচ্ছে জনগণের হাতে যা আছে, সব চেয়ে তুচ্ছ মূল্যে তাদের নিকট থেকে সেসব ক্রয় করা। অতঃপর অতি চড়া মূল্যে তাদের উপর মূলধন চাপানো জোর- জবরদস্তি করে ছিনতাইয়ের আকারে।19
যেসব গুরুত্বপূর্ণ কারণে রাষ্ট্র জনগণের সম্পদ আহরণ করে, তার সূক্ষ্ম তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে সমাজ তাত্ত্বিক ইবনে খলদূন বলেন : জানা উচিত যে, এসবের একমাত্র কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র আর শাসন- কর্তৃপক্ষের বেশি বেশি সম্পদ আহরণ করার লোভ। এর ফলে তাদের সামনে বিলাসের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ফলে তাদের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এটা রোধ করার জন্য প্রচলিত আইন যথেষ্ট নয়। ফলে তারা কর আরোপের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করে। এর ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিলাস আর জৌলুস বৃদ্ধি পায়, বৃদ্ধি পায় কর আর ট্যাক্সের বহরও। জনগণের সম্পদের প্রতি প্রয়োজন এমনই তীব্র হয়ে দেখা দেয়, যার ফলে সম্পদ সঞ্চয়ের সীমা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, দূর হয়ে যায় তার নিয়ম-নীতিও।20
মুইজ্জুদ্দৌলা বুয়াইহীর ক্রীতদাস এবং তুর্কি দেহরক্ষী সুবুক্তগীন এর জীবনেতিহাস সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি অঢেল সম্পদ রেখে মারা যান। তার পরিত্যক্ত সম্পদের মধ্যে ছিল লক্ষ লক্ষ দীনার এবং মণি-মাণিক্য ভর্তি কয়েকটা সিন্দুক1। মিসরে ফাতেমী খলিফাদের উজির আফয ছিলেন আর্মেনীয় বাহিনীর সেনাধ্যক্ষের পুত্র। তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদ সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি এক বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ- রৌপ্য, মণি-মাণিক্য, মূল্যবান পোশাক- আশাক, দাস-দাসী, অশ্ব আর সুগন্ধি ছেড়ে যান, যার সঠিক পরিমাণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না2।
আয়াদুদ্দৌলা বুয়াইহী একটা বাগান নির্মাণ করান, যাতে পানি সিঞ্চনের খরচসহ ব্যায় করা হয় ৫০ লক্ষ দিরহাম3
উজির ইবনুল ফুরাত সম্পর্কে জানা যায় যে, মহামূল্যবান ধাতু নির্মিত চামচ ছাড়া তিনি আহার্য গ্রহণ করতেন না। উজির ইবনু কালস এর দাস দাসীর সংখ্যা ছিল ৪ হাজার। তাঁর নিকট যেসব মণি- মাণিক্য পাওয়া যায়, তার মূল্য ছিল ৪ লক্ষ দিনার। 4
ঐতিহাসিক ইবনে কাছীর হিজরী ৪৮০ সালে সুলতান মালিক শাহ এর কন্যার বিবাহে প্রদত্ত উপঢৌকনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন : সে বৎসর মুহররম মাসে সুলতানের কন্যার উপঢৌকন রাজধানীতে আনা হয় ১৩০ টি উষ্ট্রের পৃষ্ঠে বোঝাই করে। রোমের মহামূল্যবান ‘দীবাজ’ বস্ত্র দ্বারা উষ্ট্রগুলোকে সাজানো হয়। এসব উপঢৌকনের বেশিরভাগ ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত তৈজসপত্র। এছাড়া ৭৪ টি খচ্চরকে দেশীয় রাজকীয় পোশাক পরিচ্ছদ দ্বারা সজ্জিত করে তাদের পৃষ্ঠেও বহন করে আরো উপঢৌকন সামগ্রী রাজধানীতে আনা হয়5
এসব বিরাট অংকের কথা শ্রবণ করে ধারণা জন্মাতে পারে যে, দেশের মানুষের অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু আসলে তা নয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ অতি কষ্টে জীবন কাটাতো। করের বোঝা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছিল। তদুপরি তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় সেনাবাহিনী। হিজরী ৩৩১ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানা যায় যে, তখন দ্রব্যমূল্য এতটা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে মানুষ কুকুর খেতে বাধ্য হয়। পরিণামে দেশে মহামারি দেখা দেয়।6
হিজরী ৩৬১ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানা যায় যে, দেশে প্রতারক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা বিপর্যয় সৃষ্টি করে। জনগণের ধন- সম্পদ অপহরণ করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বাণিজ্য কেন্দ্র আল- কারখ অঞ্চলে আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হয়।7 হিজরী ৩৭৬ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানা যায় যে, তখন ইরাকে পণ্য মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে অধিকাংশ লোক দেশ ছেড়ে চলে যায়। হিজরী ৩৮৩, ৩৯৭, ৪১৬, ৪২০ এবং ৪২৪ সালেও দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এ সঙ্গে প্রতারক শ্রেণি এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সংখ্যাও বেড়ে যায়।
হিজরী ৪৪৮ সালেও চুরি- ডাকাতি আর লুট-তরাজের ভয়ে রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে পণ্য-মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। মানুষ মৃত জন্তু ভক্ষণ করতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী গুদাম জানত করে এবং সংকটকালে তা বিক্রয়ের জন্য বাজারে ছাড়ে। এ সময় কায়রোয় জনৈক ব্যক্তি মাত্র ২০ কেজি আটার বিনিময়ে একটা গৃহ ক্রয় করে। অথচ ইতিপূর্বে গৃহটি ক্রয় করা হয় ৯শত দীনার মূল্যে। আর একটা ডিম বিক্রি হতো ১ দীনার মূল্যে।8 ধনী আর অভিজাত শ্রেণির বিদেশ থেকে পণ্য আম দানীর বহর বৃদ্ধি পায়। মিশরের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী আফ্ফান ইবনে সুলায়মানের মৃত্যু হলে শাসক আখশীদ তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে ৪ লক্ষ দীনার গ্রহণ করেন। তখন মানুষের মুখে মুখে একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত হয় ;
‘কেউ মারা গেলে তার পরিত্যক্ত সম্পদ সাইফুদ্দৌলা তথা শাসক গোষ্ঠীর জন্য।’9
এ সময় শাসক শ্রেণির সেনাবাহিনীর লোকেরা জনগণের সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এরা গ্রামের কৃষকদের উপর নির্যাতন চালাতো। তাদের শস্য লুট করে নিয়ে যেতো, কিন্তু বাধা দেয়ার সাহস কারো হতো না। এ সময় উজির মুহাল্লাবীর জন্য তিন দিনে ১ হাজার দীনারের ফুল ক্রয় করা হয়। তার মজলিসে এসব ফুল ছিটানো হয় এবং এটাকে মহা কল্যাণকর ও পুণ্যের কাজ বলে মনে করা হয়।10
এই ছিল শাসক শ্রেণি উজির আর ওমরাদের অবস্থা। এ সময় আমরা দেখতে পাই যে, মালেকী মাযহাবের বিশিষ্ট ফকীহ কাজি আব্দুল ওয়াহহাব তাগলাবী বাগদাদের জন্য দুঃখ করে বাগদাদ ছেলে চলে যান। তাঁকে বিদায় দেওয়ার জন্য যারা সমবেত হয়, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন : শক সন্ধ্যা দুটি রুটিও যদি জুটতো তাহলে তোমাদের শহরের সমকক্ষ আমি অন্য কোন শহরকে বিবেচনা করতাম না। এ সম্পর্কে তিনি একটা কবিতা রচনা করেন। তাতে বলেন : 11
سلام على بغداد فى كل موطنوحق لها منى سلام مضاعف
فوالله ما فارقتها عن قلىً لها وأنى بشطى جانبيها لعارف
ولكنها ضاقت علىّ بأسرها ولم تكن الأرزاق فيها تساعف .
সালাম বাগদাদ নগরীকে সকল দেশ থেকে।
আমার কাছে তার আরো অতিরিক্ত সালাম পাওয়ার অধিকার আছে।
খোদার শপথ, আমি তাকে জানি না বিধায় ত্যাগ করছি না।
তার দু‘তীর সম্পর্কে আমি ভালো করেই জানি।
কিন্তু তা আদপেই আমার প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে।
সেখানে জীবিকা মোটেই সহজলভ্য নয়।
তিনি আরো বলেন : 12
بغداد دارلاهل المال طيبةوللمفاليس دار الضنك والضيق
ظللت حيرانَ أمشى فى ازقّقتها كاننى مصحف فى بيت زندق
ধনীদের জন্য বাগদাদ চমৎকার বাসস্থান।
আর গরিব- নিঃস্বদের জন্য সংকীর্ণতার স্থান।
তার অলিতে- গলিতে আমি ঘোরাফেরা করেছি, বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে,
যেন আমি নাস্তিকের ঘরে কুরআন শরীফ।
তাঁর সম্পর্কে ইবনে বাসাম ‘যাখীরা’ গ্রন্থে বলেন :
অবশিষ্ট মানুষ ছিল যেন, ধারণা- কল্পনার অনুসারীদের শিকার। আরবি সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ ব্যক্তিত্ব পন্ডিত আবু আলীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালে তিনি ব্যক্তিগত পাঠাগারের মূল্যবান গ্রন্থ রাজি বিক্রয় করতে বাধ্য হন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এসব বই- পুস্তক বিক্রয় করে তিনি আন্দুলুসিয়া তথা স্পেনে চলে যাবেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে ‘জামহারা’ গ্রন্থের একটি কপিও ছিল। বইটি বিক্রয় করতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। শরীফ মুর-তাজা নামে জনৈক বিখ্যাত ব্যক্তি বইটি ক্রয় করেন। বইটিতে আবু অর নিজের হাতে নীচের কবিতাটি লেখা ছিল :
أنست بها عشرين حولا وبعتها فقد طال وجدى بعدها وحنينى
وما كان ظنى أننى سأبيعها ولو خلدتنى فى السجون ديونى
ولكن لضعف افتفار وصبيةصغار عليهم تستهل جفونى
-দীর্ঘ কুড়িটা বৎসর তার সঙ্গে কাটিয়ে এখন তা বিক্রয় করতে হচ্ছে
তার সঙ্গে আমার ছিল দীর্ঘ ভালোবাসা, আর তারপরে কান্না,
তা বিক্রয় করতে হবে এমন ধারণা আমার ছিল না কখনো,
যদিও ঋণ আমাকে সারাজীবন কারাগারে বন্দী করে রাখে।
কিন্তু দুর্বলতা, দরিদ্র আর শিশুদের কারণে
তুচ্ছ তাদের কাছে, ক্ষুণ্ণ আমার মান!
অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এ মিলের জন্য মানুষ অবাক হতে পারে, কিন্তু সেখানেও একটা স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। আর তা এই যে, অতীতের কোন কোন শাসক সত্যের দিকে ফিরে আসতো। যখন তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো, যখন উপদেশ দেয়া হতো। আর এখন? উপদেশ আর প্রচার তাদের কোনই কাজে আসে না, কোনই কল্যাণ বয়ে আনে না। ইতিহাস গ্রন্থ ‘আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া’য় বলা হয়েছে; এক শুক্রবার প্রসিদ্ধ ওয়ায়েয ইবনুল ইবাদী মজলিসে বসে কথা বলছিলেন। সেলজুক বাদশাহ সুলতান মাসঊদও সে মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জনগণের ক্রয়- বিক্রয়ে অন্যায়ভাবে কর আরোপ করেন। তখন ইবনুল ইবাদী বললেন, হে সুলতান, আপনি খুশি হয়ে গায়িকাদের কর হ্রাস করেন, তাদের করের পরিমাণ মুসলমান জনগণের উপর আরোপিত করের চেয়ে কম। আপনি আমাকে একজন গায়িকা দান করুন, যার প্রতি আপনি সন্তুষ্ট, আর আপনার প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ এ কর হ্রাস করুন। সুলতান হাতের ইঙ্গিতে বললেন হ্যাঁ আমি তা করব। জনগণ চিৎকার করে তাঁর জন্য দোয়া করে। 13
এ ঘটনা কি আমাদেরকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না যে, আজকাল শাসক শ্রেণি গায়ক-গায়িকাদের প্রতি কেমন কৃপা-বৃষ্টি বর্ষণ করছে। আর এটা করছে অন্যায়ভাবে জনগণের সম্পদ ভক্ষণ করার জন্য। অতঃপর এ সম্পদ চলে যাবে আল্লাহর দুশমনদের হাতে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জনগণ অতি কষ্টে দিন গুজরান করছে।
অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরমে পৌঁছে, যখন রাষ্ট্র জামানতের বিধান প্রবর্তন করে। আর তা হচ্ছে কোন ব্যক্তিকে কোন শহর বা অঞ্চল থেকে নির্ধারিত পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করে সরকারের নিকট অগ্রিম জমা দেবে। এভাবে সঞ্চিত আর পরিশোধিত ট্যাক্সের মধ্যে একটা ব্যবধান থাকে। জমিদার ব্যক্তি ট্যাক্স সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করবে ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা। আবার কখনো কখনো ক্ষমতা প্রয়োগ ছাড়াই এ কাজ করবে। আদায়কৃত ট্যাক্সের যাবতীয় হিসাবপত্র রাখা হয় সরকারের প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী। অবশ্য এটা স্বাভাবিক যে, এসব ক্ষেত্রে জামিনদার ব্যক্তি আপ্রাণ চেষ্টা করে, কৃষকদের নিকট থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণ ট্যাক্স আদায় করার। এজন্য যদি পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করতে হয় তবুও তা করবে। তা যদি কৃষক জনতার সাধ্যাতীত হয়, তবুও করবে। এভাবে সে আদায় করবে সর্বোচ্চ পরিমাণ, কিন্তু সরকারের নিকট জমা দেবে সম্ভাব্য সর্বনিম্ন পরিমাণ। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির লাভ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর প্রণীত ‘তারীখুল কামিল’ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই; আবু আলী ইবনে ফাজল দু’লক্ষ দীনারের বিনিময়ে ওয়াসেত অঞ্চলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন আর আবু সাঈদ সাবুর ইবনুল মুজাফ্ফর দায়িত্ব গ্রহণ করেন বসরা অঞ্চলের।14 বুয়াইহী শাসকরা সেনাবাহিনীর জন্য জায়গীরদারী প্রথার প্রবর্তন করলে ব্যাপারটা আরো চরমে পৌঁছে। তারা সামরিক বাহিনীর লোকজনকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন- ভাতা না দিয়ে ভূমি দান করেন। সেনাবাহিনীর লোকেরা এটাকে তাদের সেবার বিনিময়ের চেয়ে বেশি মনে করল। আর এটা স্বাভাবিক যে, সেনাবাহিনীর লোকেরা চাষাবাদে প্রবৃত্ত হবে না। বরং তাদের কাছে চাষাবাদ করার লোক থাকবে। ভূমির উৎপাদিত ফসলে এরা সন্তুষ্ট না হলে শক্তি প্রয়োগে ভূমি অন্যরা দখল করে নেবে। ফলে অসহায় কৃষক তার ভূমি হারাতে বাধ্য হবে। আর চাষা-বাদ-যোগ্য ভূমি, পতিত ভূমিতে পরিণত হবে। কেউ ভূমিতে কোন কাজ করবে না। যার ফলশ্রুতিতে উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।15 তারা আরো একটি কুৎসিত নিয়ম প্রবর্তন করে।
এ নিয়মও প্রবর্তিত হয় বুয়াইহী শাসকের শাসনামলে। হিজরী ৩৫০ সালে আবুল আববাস ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবুল শাওয়ারিব বার্ষিক দু’ লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে কাজি বা বিচারপতির পদ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি অর্থের বিনিময়ে বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে এমন নিয়ম ছিল না। কিন্তু আববাসীয় খলিফা আল-মুতী লিল্লাহ এ নিয়ম মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি এই কাজিকে বিচারালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেননি। এই কাজি যখন জামানতের দ্বার উন্মুক্ত করেন, তখন বাগদাদে হিসাব বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগেও এ নিয়ম প্রবর্তিত হয়।16 আর এসব হচ্ছে সামাজিক বিকৃতি এবং রাষ্ট্রের দুর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ। ঐতিহাসিক ইবনে খলদুনের নিকট এ বিষয়টির ভয়াবহতা স্পষ্ট ছিল। তাইতো তিনি আল-মুকাদ্দিমায় বলেন : জানা উচিত যে, জনগণের উপর অর্থনৈতিক শোষণ- নির্যাতন চালানো হলে তাদের সম্পদ উপার্জনের স্পৃহা নস্যাৎ হয়ে যায়। আর যখন তাদের স্পৃহা নস্যাৎ হয়ে যায়, তখন জনগণ অর্থকরী কর্মকান্ডে শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ে তখনই বাজারে মন্দা দেখা দেয়। দেশের বাসিন্দারা হয়ে উঠে কর্মবিমুখ এবং উজাড় হয়ে যায় নগর- বন্দর আর জনপদ।17 গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে ইবনে খলদূন আরো বলেন : কোন বিনিময় ব্যতিরেকে সম্পদের মালিকের হাত থেকে সম্পদ নিয়ে নেয়া বা কোন কারণ ছাড়া কারো সম্পদ হস্তগত করা জুলুম বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে, কেবল তাকেই জুলুম- শোষণ বলে মনে করবে না, বরং জুলুম আরো ব্যাপক অর্থ জ্ঞাপক। কোন অধিকার ছাড়া যারা সম্পদ আহরণ করে তারা জালিম। যারা সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে, তারা জালিম এবং যারা মানুষের ন্যায্য অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে, তারাও জালিম। মালিকানা হরণকারীরাও সাধারণত: জালিম। আর এসব কিছুর খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়ে রাষ্ট্রের উপর সামাজিক বিকৃতির আকারে।18 তিনি আরো বলেন, যেন তিনি বর্তমান কালের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কথা বলছেন : সমাজ আর রাষ্ট্রের বিকৃতির ক্ষেত্রে এর চেয়েও বড় জুলুম হচ্ছে জনগণের হাতে যা আছে, সব চেয়ে তুচ্ছ মূল্যে তাদের নিকট থেকে সেসব ক্রয় করা। অতঃপর অতি চড়া মূল্যে তাদের উপর মূলধন চাপানো জোর- জবরদস্তি করে ছিনতাইয়ের আকারে।19
যেসব গুরুত্বপূর্ণ কারণে রাষ্ট্র জনগণের সম্পদ আহরণ করে, তার সূক্ষ্ম তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে সমাজ তাত্ত্বিক ইবনে খলদূন বলেন : জানা উচিত যে, এসবের একমাত্র কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র আর শাসন- কর্তৃপক্ষের বেশি বেশি সম্পদ আহরণ করার লোভ। এর ফলে তাদের সামনে বিলাসের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ফলে তাদের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এটা রোধ করার জন্য প্রচলিত আইন যথেষ্ট নয়। ফলে তারা কর আরোপের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করে। এর ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিলাস আর জৌলুস বৃদ্ধি পায়, বৃদ্ধি পায় কর আর ট্যাক্সের বহরও। জনগণের সম্পদের প্রতি প্রয়োজন এমনই তীব্র হয়ে দেখা দেয়, যার ফলে সম্পদ সঞ্চয়ের সীমা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, দূর হয়ে যায় তার নিয়ম-নীতিও।20
রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা আর রাফেজী সম্প্রদায়ের উদ্ভবের পরিবেশের মধ্যেও আহলুস সুন্নাহর আলেম সমাজ ইলমের প্রচার- প্রসার আর ছাত্রদের দীক্ষা দানে অটল- অবিচল ছিলেন। হাদিস, ফিকাহ এবং অভিধান বিষয়ের উৎসাহী ছাত্রদের উপস্থিতিতে তখনকার দিনে মসজিদগুলো পরিপূর্ণ থাকতো। তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান, কারিগরি জ্ঞান আর জ্যোতির্বিদ্যা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। এভাবে সঠিক ধারায় জ্ঞানের লন হয়। তা টিকে থাকে সুন্দরভাবে। কেটে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। প্রতিপালিত হয় অর্পিত দায়িত্ব। গঠন করা হয় জনসাধারণের মন-মানসিকতা আর খর্ব করা হয় শাসক শ্রেণির দম্ভ- অহমিকা।1
আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর বুদ্ধিবৃত্তি অবস্থার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ যুগে আমরা যেমন আলেম সমাজের প্রাচুর্য প্রত্যক্ষ করি, তেমনি প্রত্যক্ষ করি উৎপাদন ক্ষেত্রেও প্রাচুর্য। ব্যাপারটা কি স্বাভাবিক, না-কি রাজনৈতিক অস্থিরতা জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না?
আসলে কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা- দুর্বলতা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তবে সেখানে জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রে কিছু কারণ কাজ করেছে। সেসব কারণের অন্যতম হচ্ছে :
১. তদানীন্তন কালে মুসলিম দেশগুলোর সীমান্ত এলাকা ছিল উন্মুক্ত। ফলে আলেম সমাজ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গমনাগমন করতেন। তাঁরা নিজেরাও উপকৃত হতেন আর অন্যদেরও উপকার সাধন করতেন। কোন দেশে গমন- নির্গমনের জন্য ভিসার কোন প্রয়োজন হতো না। তখন তাঁদের নিকট গোটা বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত ছিল : দারুল ইসলাম আর দারুল হারব। অথচ দেশ ছিল অনেক আর ভিন্ন ভিন্ন।
২. এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অন্যান্য দেশের সঙ্গে খ্যাতি আর প্রতিযোগিতার জন্য উৎসুক ছিল। সকল দেশের শাসক- সুলতান আগ্রহী ছিলেন যে, তাঁর রাজ দরবারে বেশি বেশি আলেম, সাহিত্যিক বা চিকিৎসকের সমাবেশ ঘটুক, যাদেরকে নিয়ে তারা গর্ব করতে পারেন। যদিও অধিকাংশ ফকীহ আর মুহাদ্দিস কোন রকম ভয়- ভীতি আর লোভ লালসা বা কারো উৎসাহ ছাড়াই নিজেরা জ্ঞান বিস্তার করতেন। এজন্য তারা কারো সহায়তার অপেক্ষায় থাকতেন না।
৩. শাসকশ্রেণী আলেম সমাজের পেছনে লাগতেন না। তারা তাদেরকে নিজ নিজ অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। আলেম সমাজের পক্ষ থেকে শাসক শ্রেণির জন্য কোন রকম শঙ্কা বা হুমকি ছিল না। ফলে তাঁরা আলেম সমাজকে তাঁদের অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। বরং কোন কোন তুর্কি সেনাধ্যক্ষ আলেম সমাজকে শ্রদ্ধা করতেন। যদিও অকারণে রক্তপাত করতে তারা ভয় করতেন না।
এসব কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই যে, এসব মহান আলেমদের দ্বারা আল্লাহ তাআলা তার দীনের হেফাজত করেন। এসব মহান আলেমদের সম্পর্কে নমুনা স্বরূপ আমরা কিছু আলোচনা করব। জ্ঞান বিস্তারে আল্লাহ তাআর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া তাঁদের অন্য কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না।
হিজরী চতুর্থ শতকের কয়েকজন বড় বড় আলেম -
ইবনে খুযায়মা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক।
শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থের রচয়িতা হুসাইন ইবনে মাসউদ আল- ফাররা আল- বাগাবী। (মৃত্যু ৫১৬ হিজরী)
ফকীহ আবু বকর ইবনুল মুনযির।
ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারী।
এ যুগের কয়েকজন মশহুর আলেম -
হাদীসে র মশহুর কিতাব সুনানে আবু দাঊদের বাখ্যাদাতা আবু সুলাইমান আল- খাত্তাবী আল- বুস্তী (মৃত্যু ৩৪৯ হি:)।
প্রখ্যাত হাফিজ ও মুজতাহিদ ‘আ-আনওয়া ওয়াত তাকাসীম’ গ্রন্থের রচয়িতা ইবনে হাববান আল- বুস্তী (মৃত্যু ৩৫৪ হি:)।
প্রখ্যাত তাফসীরবিদ মহান হাফিজ ‘আল- জারহু ওয়াত তা’দীল’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্দুর রহমান ইবনে হাতিম আররাযী (মৃত্যু ৩২৭ হিজরী)।
হাম্বলী মজহাবের বড় ফকীহ, আলেম, যাহিদ এবং ওয়ায়েয আবূ মুহাম্মদ আল-বারবাহারী। বিদআতপন্থী আর পাপাচারের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কঠোর।2
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মজহাবে ফিকাহের কিতাব ‘আল-মুখতাছার’ গ্রন্থের রচয়িতা ওমর ইবনে হুসাইন আল-খারকী। তিনি ছিলেন ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। বাগদাদে অন্যায় অনাচার বৃদ্ধি পেলে এবং সাহাবায়ে কেরামকে গালমন্দ দেয়া শুরু হলে তিনি বাগদাদ থেকে হিজরত করে অন্যত্র গমন করেন।3
মহান হাফিজ সমালোচনা বিষয়ে ‘আল-কামিল’ গ্রন্থের রচয়িতা আবূ আহমদ ইবনে আদী।
আবূ আব্দুল্লাহ আ- হাকেম নীশাপুরী।
শাফেয়ি মাযহাবের মহান ফকীহ আবূ হামেদ আল- ইসফারাইনী।
ইমামুল হারা-মাইনের পিতা, ফিকাহ, ঊসুল এবং সাহিত্য বিষয়ের ইমাম আবু মুহাম্মদ আল জুয়াইনী।
ইবনু সুরাইজ শাফেয়ি।
মালেকী মাজহাবের ইবনুল হাদ্দাদ আল- মাগরেবী। তিনি উবাইদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুনাযারা করেন। তাদের প্রতাপে ভীত হননি।
রাষ্ট্র শাসন ও রাজ্য পরিচালনা বিষয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ আল- আহকামুস সুলতানিয়া গ্রন্থের প্রণেতা আবুল হাসান আল মাওয়ার্দী। ফিকাহ বিষয়ে তাঁর আল- হাবী গ্রন্থও প্রসিদ্ধ।
ইলমে হাদীসে যুগের ইমাম হাফেজ দারে কুতনী।
কাজি আলী ইবনে আব্দুল আযীয আল- জুরজানী।
আশআরী মাজহাবের শীর্ষস্থানীয় মুতাকাল্লিম কাজি আবু বকর আল- তাকিল্লানী।
হাম্বলী মজহাবের অন্যতম প্রধান আলেম ইবনে বাত্তা নামে পরিচিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আল- আকবারী। ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে নিষেধে তিনি ছিলেন খ্যাত।
তারিখে বাগদাদ গ্রন্থের রচয়িতা ঐতিহাসিক খতিব বাগদাদী।
হাদিস শাস্ত্রের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ইমাম বায়হাকী।
সাহিত্য ও অভিধান বিষয়ে পন্ডিতদের মধ্যে ছিলেন-
কুরআন মজীদের অভিধান গ্রন্থ ‘মা‘আনিল কুরআন’ এর প্রণেতা আযযুজাজ।
আবু সাঈদ আল- সায়রাফী।
ইবনু খুওয়াইহ।
আবু আলী আল- কাল।
প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন-
কবি আল মুতানাববী, ইবনুল আমীদ, ছাহেব ইবনে আববাদ এবং আবু ইসহাক আছ-ছাবী।
অংক ও চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব-
আল-বিরুনী। অংক শাস্ত্রে ইনি ছিলেন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী রাজি।
অংক শাস্ত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবুল ওয়াফা আল- বুযজানী।
ইবনুল বাইতার। গ্রহ- নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ বিষয় তাঁর বেশ দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন নক্ষত্র পূজারি। পরে ইসলাম গ্রহণ করেন বলে কথিত আছে। এটা হচ্ছে আলেমদের দীর্ঘ তালিকার মধ্য থেকে একটা মাত্র নগণ্য অংশ।
ইতিহাস আর জীবনী গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে জানা যাবে যে, মুসলিম বিশ্বের দিকে দিকে হাজার হাজার আলেম- উলামা ছড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা অধ্যয়ন আর অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। সন্দেহ নেই যে, এর ফলে দীন ইসলামের হেফাজত হয়েছে। হেফাজত হয়েছে মুসলিম উম্মারও। এতে বিপুল সংখ্যক আলেম - উলামার উপস্থিতি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে মুসলমানদের দুর্বলতার বোঝা লাঘব হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাজনৈতিক পতনের প্রতি লক্ষ্য করবে এবং আলেম সমাজের জীবনী অধ্যয়ন করবে সে অনুধাবন করবে যে, সেখানে দু’টি বিচ্ছিন্ন জগৎ। অথচ শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে তারা কোন কষ্ট পেলে আলেম সমাজের হাতেই তারা মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণতো।
আল্লাহ তাআলার বাণী :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ( النساء : ৫৯)
‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ তাআলার, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলুল আমর এর।’’ (সূরা নিসা : ৫৯)।
এ আয়াতে আলেম সমাজই উদ্দেশ্য। মুফাসসিরগন বলেন : উলুল আমর অর্থ আলেম সমাজ এবং শাসক শ্রেণি। তবে কোন বিপদাপদে তাঁদের নিকট ফিরে আসার শিক্ষা তাঁরা কেন জনগণকে দেন না।
যদিও কিছু কিছু আলেম উপদেশ আর ভালো কাজের নির্দেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক আলেমের তুলনায় তাদের সংখ্যা কম। আলেম সমাজের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে শায়খ রশীদ রেজা বলেন . আববাসীয় শাসকদের শাসনামলে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। আর উলামায়ে দীন তা অব্যাহত রাখেন। অথচ বনু উমাইয়াদের শাসনামল এবং আববাসীয়দের শাসনামলের প্রথম দিক পর্যন্ত অতীত কালের আলেম সমাজ শাসক শ্রেণিকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন।4
কিছু কিছু আলেম আর ছাত্রদের বক্তব্য ছিল এরকম : ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিপ্লব, রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়া ছুঁড়ি আর ফেৎনা-ফাসাদে জড়ানো থেকে আমরা দূরে থাকি। ইসলামকে ভালোবাসে এমন জাতির লালন আর জ্ঞান বিস্তারে আমরা নিয়োজিত থাকি যাতে জ্ঞান নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। সন্দেহ নেই যে, এটা একটা মহান লক্ষ্য। এটা যে বিরাট কাজ তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এ কাজে নিয়োজিত হতে হয় নিবিষ্ট মনে। কিন্তু যে জাতিটার লালন করা হচ্ছে, বিকৃতির সংশোধন আর উম্মার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে, তাদেরতো একটা ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে।
অধিকাংশ বিদ্যার্থী সে সংকীর্ণ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। অথবা শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে তাদের জন্য যে ছক এঁকে দেয়া হয়েছে, তা হয়তো তাদের বিপুল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের জীবন যাপনের কারণ হতে পারে। অথবা তাসাঊফের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু এরপরও একটা প্রশ্ন অবশিষ্ট থেকে যায়; গোটা জাতি যখন ফিতনা ফাসাদ আর বিপদাপদের ঘনঘটায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত,,বেদআতপন্থী আর শরিয়ত বিরোধীদের যখন দোর্দন্ড প্রতাপ, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়, তখন আলেম সমাজ বা ইলমে দ্বীনের শিক্ষার্থীরা কীরূপে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারে? এ সয়লাব রোধে আলেম সমাজ কীভাবে হাত- পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? অনাচার আর অশ্লীলতার সয়লাব রোধে কেন তাদের কার্যকর ভূমিকা থাকবে না? আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই যে, মুসলিম উম্মার দুর্বলতা আর অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে উম্মার নেতৃত্ব থেকে আলেম সমাজের দূরে সরে থাকা। তাদের শাসন কার্য থেকে দূরে সরে থাকাও এর একটা বড় কারণ। ক্ষমতা আর শাসন কার্য থেকে আলেম সমাজের দূরে সরে থাকার চিন্তাটাই একটা ভুল চিন্তা। আর এ ভুল চিন্তাটাই বর্তমানে ব্যাপকতা লাভ করেছে। মুসলিম সমাজে এমন কিছু উলামায়ে রাববানী আছেন, যারা উম্মতের তরবিয়তের দায়িত্ব পালন করেন আর রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার কারণে এদেরকে সমাজে উত্তম ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।5 এদেরকে সমাজের উত্তম ব্যক্তি মনে করাটাই একটা বড় বিপদ। আর এ বড় বিপদটাই চেপে বসেছে মুসলিম সমাজে। মুসলিম সমাজের এটাই বড় দুর্বলতা। কোন মুসলমান কি কাউকে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বড় আলেম এবং বড় মুত্তাকী মনে করতে পারে? অথচ বদর, ওহুদ, খন্দক, ইত্যাদি বড় বড় যুদ্ধে তিনি নিজে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।62
এ অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন . সত্যাশ্রয়ী রাজনীতির জন্য ফকীহদের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণেই মুসলিম সমাজে দুর্বলতা আর বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে; শরিয়ত আর রাজনীতি দুশমনকে আহবান জানায় শরিয়তের দিকে। আর দুশমন আহবান জানায় শুধু রাজনীতির দিকে। আর এর কারণ হচ্ছে সন্নাহ বুঝার ব্যাপারে এদের দুর্বলতা, অক্ষমতা।63
জনৈক আরব কবি তাঁর কবিতায় আলেম সমাজ আর বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিক শ্রেণির রাজনীতি থেকে দূরে থাকার চিত্র অঙ্কন করেছেন। পাষাণ- জালিম তুর্কিদের দয়ার নীচে কীভাবে তারা খলিফাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে, তিনি তারও চিত্র অঙ্কন করেন। ব্যাকরণের বিতর্কে প্রবৃত্ত মক্কার একটি দলকে লক্ষ্য করে কবি বলেন . 64
اما تستحون الله يا معدن النحوشغلتم بذا والناس فى اعظم الشغل
أمامكم أضحى قتيلا مجندلا وقد أصبح الإسلام مفترق الشمل
وأنتم على الأشعار والنحو عكّفاًتصيحون بالأصوات في أحسن السبل
হে ব্যাকরণের খনি তোমরা কি ভয় করনা আল্লাহ কে?
তোমরাতো এটা নিয়েই ব্যস্ত, আর লোকেরা ব্যস্ত বড় কাজে।
তোমাদের ইমাম নিহত হচ্ছে নির্মমভাবে, ইসলাম দাঁড়িয়েছে ক্রান্তি কালে।
আর তোমরা কিনা কবিতা আর ব্যাকরণ নিয়ে ব্যস্ত।
চমৎকার সড়কে তোমরা চিৎকার জুড়ে দিয়েছ।
সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল এই যে, বিচার বিভাগ ছিল একটা স্বাধীন সংস্থা, সরকারের প্রভাব থেকে তা অনেকাংশে মুক্ত ছিল। সে যুগে তা-ও জামিনদারের নিকট জিম্মি করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আমরা এখানে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করব। বিস্তারিত আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এখানে দুটি বিষয়ে উল্লেখ করা জরুরি।
এক . জনজীবন থেকে আলেম সমাজের বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক রাজনীতি থেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়টা ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন রেকর্ড করেছেন। তিনি বলেন .
‘আলেম সমাজ রাজনীতি আর রাজনৈতিক দর্শন থেকে অনেক দূরে। এর কারণ হচ্ছে, তারা দার্শনিক চিন্তা আর অন্তর্নিহিত রহস্য নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। বাইরের অনুভূতির জগৎ থেকে তাদের চিন্তার রাজ্য বিচ্ছিন্ন। গোটা বিষয়টা তাদের মন- মানসে অনুপস্থিত। এহেন দূরত্বে অবস্থান করে তারা বাইরের জগতের সাথে তা খাপ খাওয়াতে চান।65 তিনি বলতে চান যে আলেম সমাজের অধিকাংশ কিতাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কিতাবের ভিতর দিয়েই তারা বাইরের জগতের দিকে তাকান। অথচ বাইরের বাস্তব অবস্থা, রাষ্ট্র এবং মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এর বিপরীত; অথবা তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তা গবেষণা করা আবশ্যক। অবশ্য কিতাবের ভিতর দিয়ে তাঁরা বাইরের যে দৃশ্য অবলোকন করেন, তা আবশ্যিক ভাবেই ভুলের দিকে চালিত করতে বাধ্য। বাস্তব সম্পর্কে যার কোন ধারণা নেই, তিনি মনে করেন যে, সমসাময়িক শাসকরাও কোন কোন উমা-ইয়া আববাসীয় শাসকের মতো। অথচ এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। রাজনীতি সম্পর্কে ইবনে খালদূন বলেন, বাইরের জগতের প্রতি লক্ষ্য রাখাও রাজনীতির জন্য আবশ্যক। বাইরের যে অবস্থা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তা সূক্ষ্ম আর প্রচ্ছন্ন হলেও তৎ প্রতি দৃষ্টি দান করা কর্তব্য।66 যখন রাজনীতির অর্থ হবে বাস্তবকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা আর এ বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে তাকে ইসলামের কাঙ্ক্ষিত মান আর স্তরে নিয়ে যাওয়া, তখন এটা কার্যকর করা সম্ভব হবে। কিন্তু যখন রাজনীতির অর্থ হবে দ্বন্দ্ব- সংঘাত, প্রতারণা- প্রবঞ্চনা। তৈল মর্দন শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করা আর মুনাফেকিতে সিদ্ধহস্ত হওয়া, তখন নিষ্ঠাবান আলেম সমাজ যে এহেন রাজনীতির পরিবেশ থেকে দূরে থাকবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁদের নিকট এটাই হবে শরিয়ত ভিত্তিক রাজনীতি। আর এটাই ইজতিহাদের দাবি। অবশ্য তাঁরা মনে করেন যে, এ পরিবেশেও জ্ঞান বিস্তার করাই হচ্ছে উত্তম কাজ। শরিয়ত সম্মত রাজনীতি বিষয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যেমন আল-মাওয়ার্দী রচিত ‘আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ’ এবং ইমাম জুয়াইনী রচিত ‘গিয়াসুল উমাম ফি ইলতিয়াসিস যুলাম’। (এ বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘সিয়াসতে শারইয়াহ’ গ্রন্থেও উল্লেখযোগ্য। যার বাংলা অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে- অনুবাদক)। এ ক্ষেত্রে ইবনে খালদূনের উক্তি নিঃশর্তরূপে গ্রহণ করা যায় না। কারণ তিনি ছিলেন অতি বাস্তববাদী।
দুই . যে বিষয়টি ইবনে খালদুন রেকর্ড করেছেন, তা হচ্ছে আলেম সমাজের সামাজিক- অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনি বলেন . দ্বীনি বিষয় যথা বিচার ফয়সালা করা, ফতোয়া দান, শিক্ষা দান এবং ইমামতি করা- এসব কাজ অধিকন্তু তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে না। আর এর কারণ হচ্ছে এই যে, বিত্তবানরা তাদের জন্য জীবিকার একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন, তাদের প্রয়োজন অনুপাতে। এতে তাঁরা প্রতাপশালী সেনাধ্যক্ষদের সমকক্ষ হতে পারেন না। আর আলেম সমাজ তাঁদের সম্মানজনক জীবিকার কারণে জনগণের নিকট সম্মানের পাত্র। তাঁরা সম্মানের পাত্র নিজেদের নিকটও। জীবিকার প্রাচুর্যের জন্য তাঁরা ক্ষমতাসীনদের নিকট নত হতে পারেন না। পারেন ধর্ণা দিতে। এজন্য তাঁদের অবসরও থাকে না। কারণ সম্মানজনক সামান্য জীবিকা নিয়েই তাঁরা মহান দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত।67
সুতরাং ইবনে খালদূনের মতে আলেম সমাজের করুন অবস্থার কারণ এই যে, তাঁরা ক্ষমতাসীন আর বিত্তবানদের তোষামোদ করতে পারেন না। তাঁরা জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান বিতরণের কাজে ব্যস্ত। অনুন্নত অনেক দেশই বিচার কার্য, ইমামতি এবং ফতোওয়া দানের কোন গুরুত্ব অনুধাবন করে না। ফলে তারা আলেম সামজের কোন প্রয়োজনও বোধ করে না। এটা বাস্তব সত্য। ফলে উলামাদের ভাতা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের ভাতার ধারে কাছেও পৌঁছে না। আববাসীয় বা উবাইদিয়া শাসনামলে একজন মন্ত্রীর ভাতা মাসিক ৫ হাজার দীনার পর্যন্ত ছিল। কম করে হলেও তা ছিল ৩ হাজার দীনার। অথচ তখন একজন প্রধান বিচারপতির ভাতা ছিল মাসিক একশো দীনার।68 এসব তত্ত্ব পেশ করে ইবনে খালদূন বলেন .
এটা এমন এক প্রমাণ, যা সম্পর্কে দৃষ্টি দেয়া এবং চিন্তা- ভাবনা করা উচিত। কারণ, তা এখনো আমাদের সামনে বর্তমান রয়েছে। ওয়াকফ দফতরের দায়িত্বশীলরা কেবল কোন রকমে প্রাণে বেঁচে থাকা পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করতেন। এ বিষয়টা বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে মসজিদের ইমামদেরকে এমন ভাবে দৃশ্যে প্রকাশ করা যায়, যা তাদের উপযুক্ত নয়। ফলে মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাবে। এসব ইমাম-মুয়াযযিনরাই হচ্ছেন এর প্রমাণ। এ কারণে অনেক আলেম তিজারত বা ব্যবসা- বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেছেন। ফলে তাঁদেরকে কারো তোয়াজ- তোষামোদ করতে হতো না। আলেম সমাজ নিজেরাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন। ফলে তাঁরা হক কথা বলতে সক্ষম হবেন। জ্ঞান আর শিক্ষা কেন্দ্রও এ সমাধানের অংশ হতে পারে। এটা করতে পারলে আলেম সমাজ তাঁদের নিজেদের বিষয়ের দায়িত্ব-ভার দুশমনদের হাতে তুলে দেবেন না। সুতরাং তাঁদের সমস্যার সমাধান তাঁদের নিজেদেরকেই করতে হবে।
আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর বুদ্ধিবৃত্তি অবস্থার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ যুগে আমরা যেমন আলেম সমাজের প্রাচুর্য প্রত্যক্ষ করি, তেমনি প্রত্যক্ষ করি উৎপাদন ক্ষেত্রেও প্রাচুর্য। ব্যাপারটা কি স্বাভাবিক, না-কি রাজনৈতিক অস্থিরতা জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না?
আসলে কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা- দুর্বলতা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তবে সেখানে জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রে কিছু কারণ কাজ করেছে। সেসব কারণের অন্যতম হচ্ছে :
১. তদানীন্তন কালে মুসলিম দেশগুলোর সীমান্ত এলাকা ছিল উন্মুক্ত। ফলে আলেম সমাজ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গমনাগমন করতেন। তাঁরা নিজেরাও উপকৃত হতেন আর অন্যদেরও উপকার সাধন করতেন। কোন দেশে গমন- নির্গমনের জন্য ভিসার কোন প্রয়োজন হতো না। তখন তাঁদের নিকট গোটা বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত ছিল : দারুল ইসলাম আর দারুল হারব। অথচ দেশ ছিল অনেক আর ভিন্ন ভিন্ন।
২. এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অন্যান্য দেশের সঙ্গে খ্যাতি আর প্রতিযোগিতার জন্য উৎসুক ছিল। সকল দেশের শাসক- সুলতান আগ্রহী ছিলেন যে, তাঁর রাজ দরবারে বেশি বেশি আলেম, সাহিত্যিক বা চিকিৎসকের সমাবেশ ঘটুক, যাদেরকে নিয়ে তারা গর্ব করতে পারেন। যদিও অধিকাংশ ফকীহ আর মুহাদ্দিস কোন রকম ভয়- ভীতি আর লোভ লালসা বা কারো উৎসাহ ছাড়াই নিজেরা জ্ঞান বিস্তার করতেন। এজন্য তারা কারো সহায়তার অপেক্ষায় থাকতেন না।
৩. শাসকশ্রেণী আলেম সমাজের পেছনে লাগতেন না। তারা তাদেরকে নিজ নিজ অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। আলেম সমাজের পক্ষ থেকে শাসক শ্রেণির জন্য কোন রকম শঙ্কা বা হুমকি ছিল না। ফলে তাঁরা আলেম সমাজকে তাঁদের অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। বরং কোন কোন তুর্কি সেনাধ্যক্ষ আলেম সমাজকে শ্রদ্ধা করতেন। যদিও অকারণে রক্তপাত করতে তারা ভয় করতেন না।
এসব কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই যে, এসব মহান আলেমদের দ্বারা আল্লাহ তাআলা তার দীনের হেফাজত করেন। এসব মহান আলেমদের সম্পর্কে নমুনা স্বরূপ আমরা কিছু আলোচনা করব। জ্ঞান বিস্তারে আল্লাহ তাআর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া তাঁদের অন্য কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না।
হিজরী চতুর্থ শতকের কয়েকজন বড় বড় আলেম -
ইবনে খুযায়মা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক।
শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থের রচয়িতা হুসাইন ইবনে মাসউদ আল- ফাররা আল- বাগাবী। (মৃত্যু ৫১৬ হিজরী)
ফকীহ আবু বকর ইবনুল মুনযির।
ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারী।
এ যুগের কয়েকজন মশহুর আলেম -
হাদীসে র মশহুর কিতাব সুনানে আবু দাঊদের বাখ্যাদাতা আবু সুলাইমান আল- খাত্তাবী আল- বুস্তী (মৃত্যু ৩৪৯ হি:)।
প্রখ্যাত হাফিজ ও মুজতাহিদ ‘আ-আনওয়া ওয়াত তাকাসীম’ গ্রন্থের রচয়িতা ইবনে হাববান আল- বুস্তী (মৃত্যু ৩৫৪ হি:)।
প্রখ্যাত তাফসীরবিদ মহান হাফিজ ‘আল- জারহু ওয়াত তা’দীল’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্দুর রহমান ইবনে হাতিম আররাযী (মৃত্যু ৩২৭ হিজরী)।
হাম্বলী মজহাবের বড় ফকীহ, আলেম, যাহিদ এবং ওয়ায়েয আবূ মুহাম্মদ আল-বারবাহারী। বিদআতপন্থী আর পাপাচারের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কঠোর।2
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মজহাবে ফিকাহের কিতাব ‘আল-মুখতাছার’ গ্রন্থের রচয়িতা ওমর ইবনে হুসাইন আল-খারকী। তিনি ছিলেন ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। বাগদাদে অন্যায় অনাচার বৃদ্ধি পেলে এবং সাহাবায়ে কেরামকে গালমন্দ দেয়া শুরু হলে তিনি বাগদাদ থেকে হিজরত করে অন্যত্র গমন করেন।3
মহান হাফিজ সমালোচনা বিষয়ে ‘আল-কামিল’ গ্রন্থের রচয়িতা আবূ আহমদ ইবনে আদী।
আবূ আব্দুল্লাহ আ- হাকেম নীশাপুরী।
শাফেয়ি মাযহাবের মহান ফকীহ আবূ হামেদ আল- ইসফারাইনী।
ইমামুল হারা-মাইনের পিতা, ফিকাহ, ঊসুল এবং সাহিত্য বিষয়ের ইমাম আবু মুহাম্মদ আল জুয়াইনী।
ইবনু সুরাইজ শাফেয়ি।
মালেকী মাজহাবের ইবনুল হাদ্দাদ আল- মাগরেবী। তিনি উবাইদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুনাযারা করেন। তাদের প্রতাপে ভীত হননি।
রাষ্ট্র শাসন ও রাজ্য পরিচালনা বিষয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ আল- আহকামুস সুলতানিয়া গ্রন্থের প্রণেতা আবুল হাসান আল মাওয়ার্দী। ফিকাহ বিষয়ে তাঁর আল- হাবী গ্রন্থও প্রসিদ্ধ।
ইলমে হাদীসে যুগের ইমাম হাফেজ দারে কুতনী।
কাজি আলী ইবনে আব্দুল আযীয আল- জুরজানী।
আশআরী মাজহাবের শীর্ষস্থানীয় মুতাকাল্লিম কাজি আবু বকর আল- তাকিল্লানী।
হাম্বলী মজহাবের অন্যতম প্রধান আলেম ইবনে বাত্তা নামে পরিচিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আল- আকবারী। ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে নিষেধে তিনি ছিলেন খ্যাত।
তারিখে বাগদাদ গ্রন্থের রচয়িতা ঐতিহাসিক খতিব বাগদাদী।
হাদিস শাস্ত্রের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ইমাম বায়হাকী।
সাহিত্য ও অভিধান বিষয়ে পন্ডিতদের মধ্যে ছিলেন-
কুরআন মজীদের অভিধান গ্রন্থ ‘মা‘আনিল কুরআন’ এর প্রণেতা আযযুজাজ।
আবু সাঈদ আল- সায়রাফী।
ইবনু খুওয়াইহ।
আবু আলী আল- কাল।
প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন-
কবি আল মুতানাববী, ইবনুল আমীদ, ছাহেব ইবনে আববাদ এবং আবু ইসহাক আছ-ছাবী।
অংক ও চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব-
আল-বিরুনী। অংক শাস্ত্রে ইনি ছিলেন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।
চিকিৎসা বিজ্ঞানী রাজি।
অংক শাস্ত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবুল ওয়াফা আল- বুযজানী।
ইবনুল বাইতার। গ্রহ- নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ বিষয় তাঁর বেশ দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন নক্ষত্র পূজারি। পরে ইসলাম গ্রহণ করেন বলে কথিত আছে। এটা হচ্ছে আলেমদের দীর্ঘ তালিকার মধ্য থেকে একটা মাত্র নগণ্য অংশ।
ইতিহাস আর জীবনী গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে জানা যাবে যে, মুসলিম বিশ্বের দিকে দিকে হাজার হাজার আলেম- উলামা ছড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা অধ্যয়ন আর অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। সন্দেহ নেই যে, এর ফলে দীন ইসলামের হেফাজত হয়েছে। হেফাজত হয়েছে মুসলিম উম্মারও। এতে বিপুল সংখ্যক আলেম - উলামার উপস্থিতি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে মুসলমানদের দুর্বলতার বোঝা লাঘব হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাজনৈতিক পতনের প্রতি লক্ষ্য করবে এবং আলেম সমাজের জীবনী অধ্যয়ন করবে সে অনুধাবন করবে যে, সেখানে দু’টি বিচ্ছিন্ন জগৎ। অথচ শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে তারা কোন কষ্ট পেলে আলেম সমাজের হাতেই তারা মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণতো।
আল্লাহ তাআলার বাণী :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ( النساء : ৫৯)
‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ তাআলার, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলুল আমর এর।’’ (সূরা নিসা : ৫৯)।
এ আয়াতে আলেম সমাজই উদ্দেশ্য। মুফাসসিরগন বলেন : উলুল আমর অর্থ আলেম সমাজ এবং শাসক শ্রেণি। তবে কোন বিপদাপদে তাঁদের নিকট ফিরে আসার শিক্ষা তাঁরা কেন জনগণকে দেন না।
যদিও কিছু কিছু আলেম উপদেশ আর ভালো কাজের নির্দেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক আলেমের তুলনায় তাদের সংখ্যা কম। আলেম সমাজের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে শায়খ রশীদ রেজা বলেন . আববাসীয় শাসকদের শাসনামলে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। আর উলামায়ে দীন তা অব্যাহত রাখেন। অথচ বনু উমাইয়াদের শাসনামল এবং আববাসীয়দের শাসনামলের প্রথম দিক পর্যন্ত অতীত কালের আলেম সমাজ শাসক শ্রেণিকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন।4
কিছু কিছু আলেম আর ছাত্রদের বক্তব্য ছিল এরকম : ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিপ্লব, রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়া ছুঁড়ি আর ফেৎনা-ফাসাদে জড়ানো থেকে আমরা দূরে থাকি। ইসলামকে ভালোবাসে এমন জাতির লালন আর জ্ঞান বিস্তারে আমরা নিয়োজিত থাকি যাতে জ্ঞান নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। সন্দেহ নেই যে, এটা একটা মহান লক্ষ্য। এটা যে বিরাট কাজ তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এ কাজে নিয়োজিত হতে হয় নিবিষ্ট মনে। কিন্তু যে জাতিটার লালন করা হচ্ছে, বিকৃতির সংশোধন আর উম্মার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে, তাদেরতো একটা ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে।
অধিকাংশ বিদ্যার্থী সে সংকীর্ণ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। অথবা শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে তাদের জন্য যে ছক এঁকে দেয়া হয়েছে, তা হয়তো তাদের বিপুল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের জীবন যাপনের কারণ হতে পারে। অথবা তাসাঊফের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু এরপরও একটা প্রশ্ন অবশিষ্ট থেকে যায়; গোটা জাতি যখন ফিতনা ফাসাদ আর বিপদাপদের ঘনঘটায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত,,বেদআতপন্থী আর শরিয়ত বিরোধীদের যখন দোর্দন্ড প্রতাপ, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়, তখন আলেম সমাজ বা ইলমে দ্বীনের শিক্ষার্থীরা কীরূপে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারে? এ সয়লাব রোধে আলেম সমাজ কীভাবে হাত- পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? অনাচার আর অশ্লীলতার সয়লাব রোধে কেন তাদের কার্যকর ভূমিকা থাকবে না? আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই যে, মুসলিম উম্মার দুর্বলতা আর অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে উম্মার নেতৃত্ব থেকে আলেম সমাজের দূরে সরে থাকা। তাদের শাসন কার্য থেকে দূরে সরে থাকাও এর একটা বড় কারণ। ক্ষমতা আর শাসন কার্য থেকে আলেম সমাজের দূরে সরে থাকার চিন্তাটাই একটা ভুল চিন্তা। আর এ ভুল চিন্তাটাই বর্তমানে ব্যাপকতা লাভ করেছে। মুসলিম সমাজে এমন কিছু উলামায়ে রাববানী আছেন, যারা উম্মতের তরবিয়তের দায়িত্ব পালন করেন আর রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার কারণে এদেরকে সমাজে উত্তম ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।5 এদেরকে সমাজের উত্তম ব্যক্তি মনে করাটাই একটা বড় বিপদ। আর এ বড় বিপদটাই চেপে বসেছে মুসলিম সমাজে। মুসলিম সমাজের এটাই বড় দুর্বলতা। কোন মুসলমান কি কাউকে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বড় আলেম এবং বড় মুত্তাকী মনে করতে পারে? অথচ বদর, ওহুদ, খন্দক, ইত্যাদি বড় বড় যুদ্ধে তিনি নিজে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।62
এ অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন . সত্যাশ্রয়ী রাজনীতির জন্য ফকীহদের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণেই মুসলিম সমাজে দুর্বলতা আর বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে; শরিয়ত আর রাজনীতি দুশমনকে আহবান জানায় শরিয়তের দিকে। আর দুশমন আহবান জানায় শুধু রাজনীতির দিকে। আর এর কারণ হচ্ছে সন্নাহ বুঝার ব্যাপারে এদের দুর্বলতা, অক্ষমতা।63
জনৈক আরব কবি তাঁর কবিতায় আলেম সমাজ আর বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিক শ্রেণির রাজনীতি থেকে দূরে থাকার চিত্র অঙ্কন করেছেন। পাষাণ- জালিম তুর্কিদের দয়ার নীচে কীভাবে তারা খলিফাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে, তিনি তারও চিত্র অঙ্কন করেন। ব্যাকরণের বিতর্কে প্রবৃত্ত মক্কার একটি দলকে লক্ষ্য করে কবি বলেন . 64
اما تستحون الله يا معدن النحوشغلتم بذا والناس فى اعظم الشغل
أمامكم أضحى قتيلا مجندلا وقد أصبح الإسلام مفترق الشمل
وأنتم على الأشعار والنحو عكّفاًتصيحون بالأصوات في أحسن السبل
হে ব্যাকরণের খনি তোমরা কি ভয় করনা আল্লাহ কে?
তোমরাতো এটা নিয়েই ব্যস্ত, আর লোকেরা ব্যস্ত বড় কাজে।
তোমাদের ইমাম নিহত হচ্ছে নির্মমভাবে, ইসলাম দাঁড়িয়েছে ক্রান্তি কালে।
আর তোমরা কিনা কবিতা আর ব্যাকরণ নিয়ে ব্যস্ত।
চমৎকার সড়কে তোমরা চিৎকার জুড়ে দিয়েছ।
সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল এই যে, বিচার বিভাগ ছিল একটা স্বাধীন সংস্থা, সরকারের প্রভাব থেকে তা অনেকাংশে মুক্ত ছিল। সে যুগে তা-ও জামিনদারের নিকট জিম্মি করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আমরা এখানে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করব। বিস্তারিত আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এখানে দুটি বিষয়ে উল্লেখ করা জরুরি।
এক . জনজীবন থেকে আলেম সমাজের বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক রাজনীতি থেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়টা ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন রেকর্ড করেছেন। তিনি বলেন .
‘আলেম সমাজ রাজনীতি আর রাজনৈতিক দর্শন থেকে অনেক দূরে। এর কারণ হচ্ছে, তারা দার্শনিক চিন্তা আর অন্তর্নিহিত রহস্য নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। বাইরের অনুভূতির জগৎ থেকে তাদের চিন্তার রাজ্য বিচ্ছিন্ন। গোটা বিষয়টা তাদের মন- মানসে অনুপস্থিত। এহেন দূরত্বে অবস্থান করে তারা বাইরের জগতের সাথে তা খাপ খাওয়াতে চান।65 তিনি বলতে চান যে আলেম সমাজের অধিকাংশ কিতাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কিতাবের ভিতর দিয়েই তারা বাইরের জগতের দিকে তাকান। অথচ বাইরের বাস্তব অবস্থা, রাষ্ট্র এবং মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এর বিপরীত; অথবা তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তা গবেষণা করা আবশ্যক। অবশ্য কিতাবের ভিতর দিয়ে তাঁরা বাইরের যে দৃশ্য অবলোকন করেন, তা আবশ্যিক ভাবেই ভুলের দিকে চালিত করতে বাধ্য। বাস্তব সম্পর্কে যার কোন ধারণা নেই, তিনি মনে করেন যে, সমসাময়িক শাসকরাও কোন কোন উমা-ইয়া আববাসীয় শাসকের মতো। অথচ এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। রাজনীতি সম্পর্কে ইবনে খালদূন বলেন, বাইরের জগতের প্রতি লক্ষ্য রাখাও রাজনীতির জন্য আবশ্যক। বাইরের যে অবস্থা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তা সূক্ষ্ম আর প্রচ্ছন্ন হলেও তৎ প্রতি দৃষ্টি দান করা কর্তব্য।66 যখন রাজনীতির অর্থ হবে বাস্তবকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা আর এ বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে তাকে ইসলামের কাঙ্ক্ষিত মান আর স্তরে নিয়ে যাওয়া, তখন এটা কার্যকর করা সম্ভব হবে। কিন্তু যখন রাজনীতির অর্থ হবে দ্বন্দ্ব- সংঘাত, প্রতারণা- প্রবঞ্চনা। তৈল মর্দন শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করা আর মুনাফেকিতে সিদ্ধহস্ত হওয়া, তখন নিষ্ঠাবান আলেম সমাজ যে এহেন রাজনীতির পরিবেশ থেকে দূরে থাকবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁদের নিকট এটাই হবে শরিয়ত ভিত্তিক রাজনীতি। আর এটাই ইজতিহাদের দাবি। অবশ্য তাঁরা মনে করেন যে, এ পরিবেশেও জ্ঞান বিস্তার করাই হচ্ছে উত্তম কাজ। শরিয়ত সম্মত রাজনীতি বিষয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যেমন আল-মাওয়ার্দী রচিত ‘আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ’ এবং ইমাম জুয়াইনী রচিত ‘গিয়াসুল উমাম ফি ইলতিয়াসিস যুলাম’। (এ বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘সিয়াসতে শারইয়াহ’ গ্রন্থেও উল্লেখযোগ্য। যার বাংলা অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে- অনুবাদক)। এ ক্ষেত্রে ইবনে খালদূনের উক্তি নিঃশর্তরূপে গ্রহণ করা যায় না। কারণ তিনি ছিলেন অতি বাস্তববাদী।
দুই . যে বিষয়টি ইবনে খালদুন রেকর্ড করেছেন, তা হচ্ছে আলেম সমাজের সামাজিক- অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনি বলেন . দ্বীনি বিষয় যথা বিচার ফয়সালা করা, ফতোয়া দান, শিক্ষা দান এবং ইমামতি করা- এসব কাজ অধিকন্তু তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে না। আর এর কারণ হচ্ছে এই যে, বিত্তবানরা তাদের জন্য জীবিকার একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন, তাদের প্রয়োজন অনুপাতে। এতে তাঁরা প্রতাপশালী সেনাধ্যক্ষদের সমকক্ষ হতে পারেন না। আর আলেম সমাজ তাঁদের সম্মানজনক জীবিকার কারণে জনগণের নিকট সম্মানের পাত্র। তাঁরা সম্মানের পাত্র নিজেদের নিকটও। জীবিকার প্রাচুর্যের জন্য তাঁরা ক্ষমতাসীনদের নিকট নত হতে পারেন না। পারেন ধর্ণা দিতে। এজন্য তাঁদের অবসরও থাকে না। কারণ সম্মানজনক সামান্য জীবিকা নিয়েই তাঁরা মহান দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত।67
সুতরাং ইবনে খালদূনের মতে আলেম সমাজের করুন অবস্থার কারণ এই যে, তাঁরা ক্ষমতাসীন আর বিত্তবানদের তোষামোদ করতে পারেন না। তাঁরা জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান বিতরণের কাজে ব্যস্ত। অনুন্নত অনেক দেশই বিচার কার্য, ইমামতি এবং ফতোওয়া দানের কোন গুরুত্ব অনুধাবন করে না। ফলে তারা আলেম সামজের কোন প্রয়োজনও বোধ করে না। এটা বাস্তব সত্য। ফলে উলামাদের ভাতা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের ভাতার ধারে কাছেও পৌঁছে না। আববাসীয় বা উবাইদিয়া শাসনামলে একজন মন্ত্রীর ভাতা মাসিক ৫ হাজার দীনার পর্যন্ত ছিল। কম করে হলেও তা ছিল ৩ হাজার দীনার। অথচ তখন একজন প্রধান বিচারপতির ভাতা ছিল মাসিক একশো দীনার।68 এসব তত্ত্ব পেশ করে ইবনে খালদূন বলেন .
এটা এমন এক প্রমাণ, যা সম্পর্কে দৃষ্টি দেয়া এবং চিন্তা- ভাবনা করা উচিত। কারণ, তা এখনো আমাদের সামনে বর্তমান রয়েছে। ওয়াকফ দফতরের দায়িত্বশীলরা কেবল কোন রকমে প্রাণে বেঁচে থাকা পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করতেন। এ বিষয়টা বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে মসজিদের ইমামদেরকে এমন ভাবে দৃশ্যে প্রকাশ করা যায়, যা তাদের উপযুক্ত নয়। ফলে মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাবে। এসব ইমাম-মুয়াযযিনরাই হচ্ছেন এর প্রমাণ। এ কারণে অনেক আলেম তিজারত বা ব্যবসা- বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেছেন। ফলে তাঁদেরকে কারো তোয়াজ- তোষামোদ করতে হতো না। আলেম সমাজ নিজেরাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন। ফলে তাঁরা হক কথা বলতে সক্ষম হবেন। জ্ঞান আর শিক্ষা কেন্দ্রও এ সমাধানের অংশ হতে পারে। এটা করতে পারলে আলেম সমাজ তাঁদের নিজেদের বিষয়ের দায়িত্ব-ভার দুশমনদের হাতে তুলে দেবেন না। সুতরাং তাঁদের সমস্যার সমাধান তাঁদের নিজেদেরকেই করতে হবে।
সে কালে বাতেনী সম্প্রদায়ের উদ্ভব মুসলমানদের উপর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ ডেকে আনে। মাটিকে করে আরো সিক্ত। আলেম ওলামা, আর আহলে সুন্নাহর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে হত্যা আর বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা তারা মানুষের মনে ভয়- ভীতি আর সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। মুসলিম সমাজকে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তারা চোরাগোপ্তা হত্যার পথ গ্রহণ করে। সংকটজনক সময়ে তারা উজির, বাদশাহ এবং আলেম- ওলামাদেরকে হত্যা করে। ক্রসেডার আর তাতারদের ন্যায় ইসলামের দুশমনদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। সুন্নাহ পন্থীদের প্রতি বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে বর্তমানকালের বাতেনীরা ইহুদি এবং পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের সঙ্গে যে গাঁট-ছাড়া বাঁধছে, এ চিত্র তা থেকে মোটেই ভিন্ন নয়। বর্তমানকালে লেবাননে মুসলমানরা এদের হাতে অনেক দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ফিলিস্তিনীরা সবচেয়ে তিক্ত দু’টি দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। পাকিস্তানে কাদিয়ানি আর ইসমাঈলিয়া সম্প্রদায় ইংরেজ আর পাশ্চাত্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। বাহাই সম্প্রদায় সখ্য স্থাপন করছে ইহুদিদের সঙ্গে।
বাতেনী সম্প্রদায় কোন একটা বিশেষ গোষ্ঠীর নাম নয়। হাশাশী, কারামেতা, খারমিয়া, ইসমাঈলিয়া, দুরজিয়া ইত্যাদি নানা সম্প্রদায় এদের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের আরো অনেক সম্প্রদায়ের নাম এদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এদের মূল বুলি এই যে, কুরআনের দু'টা অর্থ আছে- একটা জাহেরী, অপরটা বাতেনী। আসলে তারা কুরআন মজীদের প্রতি বিশ্বাসী নয়। মানুষকে আল্লাহর বন্দেগির বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য এ বিশ্বাসকে তারা একটা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। নিজেদের অপরাধমূলক লক্ষ্য- উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তারা শিয়া ইজমকেও হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। আসলে তারা ইসলামে বিশ্বাসীই নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো আর নবুওয়্যাত রিসালাত অস্বীকার করা। রাফেযী ধর্মমত হচ্ছে তাদের বাহ্যিক ধর্ম, আর তাদের বাতেনী বিশ্বাস হচ্ছে নিছক কুফরি মতবাদ ছড়ানো।1 অতীত এবং বর্তমানে বারবার বাতেনী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ডের উদ্ভব ঘটেছে। অতীত ইতিহাস অধ্যয়নকারীর সম্মুখে বর্তমানের চিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। অতীত সম্পর্কে অবগত হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানরা কি কুখ্যাত হাসান সাবাহ- এর কুকীর্তির ইতিহাস পাঠ করেছে? শাম দেশের শায়খুল জাবাল এর ইতিহাস পড়েছে? কারামেতা সম্প্রদায়ের কাহিনি অধ্যয়ন করেছে ? বর্তমান যুগেও তাদের অপকর্ম নমুনা হিসাবে পেশ করা হবে।
হাসান সাববাহ কায়রোর ইসমাঈলী উবায়দী সম্প্রদায়ের নিকট থেকে তার কর্মকান্ডের মূলনীতি গ্রহণ করে। অতঃপর ইরান গমন করে তার অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটা গোপন আস্তানা স্থাপন করে। সেখান থেকে সে আহলে সুন্নাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। সেলজুক বংশের শক্তিধর উজির হাসান ইবনে আলী এর হত্যার মাধ্যমে তার পরিকল্পনার নীল নকশা আঁকে। বাতেনী সম্প্রদায়ের নিকট তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি। কারণ, তিনি আলেমদের সহায়তা করতেন, জ্ঞান বিস্তার আর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা দ্বারা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। বাতেনীরা তাঁর এসব কর্মতৎপরতা সহ্য করতে পারেনি। ফলে উজির নিয়ামুল মূলক সর্ব প্রথম তাদের মূল্যবান শিকারে পরিণত হন। দাইলামী বংশের একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর নিকট প্রেরণ করা হয় সাহায্য কামনার ভান করে। সাহায্য প্রার্থী এ ব্যক্তিটি ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। হিজরী ৪৯৬ সালে রায় দেশে আবুল মুজাফ্ফর ইবনুল খাজান্দীকে হত্যা করা হয়। ইনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ওয়ায়েয।2 হিজরী ৪৯৮ সালে শাফেয়ি মজহাবের অন্যতম প্রধান শায়েখ আবু জাফর ইবনুল মুশাতকে তারা হত্যা করে। একই বৎসর বায়হাক অঞ্চলের তুরাইসীস গ্রাম থেকে বিপুল সংখ্যক ইসমাঈলিয়া এসে সমবেত হয়। তারা সেখানে তুলকাম কান্ড ঘটায়। অনেককে হত্যা করে অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। ফলে গোটা অঞ্চলে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দাপট বৃদ্ধি পায়। একই বৎসর মা- ওয়ারাউন নাহার, খোরাসান এবং ভারতবর্ষের হজ্বযাত্রীদের হজ থেকে ফিরে আসার পথে রায় অঞ্চলের ‘খাওয়ার’ নামক স্থানে পৌছলে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা ভোর রাত্রে হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে তাদেরকে হত্যা করে মাল-সামান লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।3
হিজরী ৪৯৯ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা কাজি আবুল‘আলা ছায়েদ ইবনে আবু মুহাম্মদ নীশাপূরীকে ইসফাহানের জামে মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হত্যা করে। তিনি ছিলেন হানাফি মাজহাবের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।4 হিজরী ৫০২ সালে ইসফাহানের কাজি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আলী আল-খতিবকে হত্যা করা হয়। বাতেনীদের ভয়ে তিনি সর্বদা লৌহ বর্ম পরিধান করে থাকতেন।5 ৫১৬ হিজরীতে বাতেনীরা সুলতান মাহমুদ সালজুকীর উজির আবূ তালিব সুমাইরীর উপর হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে।6
৫১৯ হিজরীতে দুঃখজনক ঘটনাবলীতে কাজী আবূ সা’আদ মুহাম্মদ ইবনে নছর আল- হারবীকে হামাদানে হত্যা করা হয়। সুলতান সানজারের নিকট খলিফার একটা বিশেষ পয়গাম নিয়ে তিনি সেখানে গমন করেছিলেন।7 হিজরী ৫২০ সালে মুসেলের আমির আবূ সাঈদ আল- বারসাকীকে হত্যা করা হয়। বাতেনীরা তাঁকে জুমার দিন মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় হত্যা করে। মুসেলের জামে মসজিদে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর সম্পর্কে বলেন . তিনি ছিলেন একজন তুর্কি ক্রীতদাস এবং অত্যন্ত ভালো মানুষ। আলেম-ওলামা এবং নেকারদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। ন্যায়নীতি পছন্দ করতেন এবং নিজেও তা মেনে চলতেন।8
হিজরী ৫২৫ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা দামেশকের অধিপতি বূরী ইবনে তাগতেগীন-এর উপর হামলা চালিয়ে তাঁকে মারাত্মকভাবে আহত করে। আহত অবস্থায় এক বৎসর বেঁচে থেকে পরবর্তী বৎসর তিনি ইন্তিকাল করেন। তিনি ছিলেন একজন অগ্রবর্তী বীর মুজাহিদ।9 তাঁর উপর হত্যার উদ্দেশ্যে এ হামলা চানোর কারণ এই ছিল যে, ইসমাঈলিয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার অভিযোগে তিনি স্বীয় উজিরকে হত্যা করেছিলেন। এ হত্যার বদলা নেওয়ার উদ্দেশ্যে গোপনে তাঁকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে হাসান ইবনে সাববাহ জনৈক খতিবকে প্রেরণ করে।10
হিজরী ৫২৯ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা আববাসীয় খলিফা আল-মুস্তারশিদ বিল্লাহ ফজল ইবনে আববাসকে হত্যা করে। হত্যার পর তারা তার দেহের বিকৃতি সাধন করে উলঙ্গ লাশ ফেলে রাখে। 11 হাফেজ শামসুদ্দীন আয-যাহাবী তাঁর সম্পর্কে বলেন . তিনি ছিলেন দ্বীনদার- পরহেজগার একজন বীর মুজাহিদ।
মুসেলের আমির মওদুদ ইবনে জঙ্গিকে ক্রুসেড যুদ্ধে সুলতান গিয়াসুদ্দীন সালজুকীর পক্ষ থেকে ত্যক্ত বিরক্ত করা হলে তিনি যাজীরা অঞ্চল থেকে বিপুল সৈন্য সংগ্রহ করেন। এ বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি শাম দেশে গমন করেন এবং ক্রুসেডারদের নিকট থেকে অনেক দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। দামেশক পৌঁছে নামাজ আদায় করার জন্য তিনি দামেশকের জামে মসজিদে প্রবেশ করলে বাতেনী সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি ভিক্ষুকের বেশে তাঁর নিকট গমন করে ভিক্ষা চাইলে তিনি তাকে কিছু সাহায্য করেন। লোকটি কাছে গিয়ে তাঁকে ছুরিকাঘাত করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইন্তিকাল করেন।12
কথিত আছে যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের ক্রুসেড শাসক দামেশকের শাসনকর্তার নিকট একটা বাণী প্রেরণ করেন। এতে তিনি বলেন . যে জাতি তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ঈদের দিন মা’বুদের গৃহে হত্যা করতে পারে, সে জাতিকে ধ্বংস করা ন্যায়ত . আল্লাহর কর্তব্য। হিজরী পঞ্চম শতকের শুরুতে ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের প্রচারক বাহরাম সিরিয়া আগমন করে প্রচার কার্য শুরু করলে অনেক সাধারণ মানুষ এবং নীচ স্তরের লোকেরা তাতে সাড়া দেয়। তাদের কোপানলের ভয়ে অনেক আলেম এবং শরিয়তের পতাকাবাহী নীরবতা অবলম্বন করেন। 13
এসব বাতেনীরা হয় মুসলমানদেরকে হত্যা করে, অথবা তাদের বিরুদ্ধে দুশমনদেরকে সহায়তা দান করে। অথবা দুশমনদের নিকট সহায়তা কামনা করে। ওয়াদী তাইম14 এর রঈম দাহহাদ ইবনে জুন্দল- এর উদ্ধৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . মুসলমান এবং ইংরেজরা তার সহায়তা করে। এবং এক সম্প্রদায় দ্বারা অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কামনা করা হয়। অবশেষে দামেশক অধিপতি ইসমাঈল ইবনে বুরী আগমন করত: তাদের নিকট থেকে শাকীফ দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন।15 এটা জানা কথা যে, ওয়াদী তাইম-এ দ্রুত ইসমাঈলিয়া সম্প্রদায়ের প্রচার কার্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল।
বাতেনী সম্প্রদায়ের হাতে যেসব আলিম- ওলামা নিহত হন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিশিষ্ট আলেম জাহিদ এবং আল্লাহ ওয়া আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মাঅ ইবনে কায়েদ আল আওয়ানী16। এ মহান আলেমের গ্রামের জনৈক বাতেনী ঘাতক একজন ওয়ায়েজিনের বেশ ধারণ করে প্রবেশ করত: তাঁর সঙ্গে মসজিদে কথা বলে। ইবনে কায়েদকে হত্যাস্থলে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন . হে কুকুর নীচে নেমে যায়! এ সময় সাধারণ মানুষ ছুটে এসে তীর নিক্ষেপ করলে সে পলায়ন করে। এ বাতেনী ঘাতকের উপর যা কিছু ঘটে গেছে, সে সম্পর্কে সিরিয়ার ইসমাঈলিয়াদের নেতা সিনানকে অবহিত করা হয়। আওয়ানীর ঘটনা জানতে পেরে সিনান তার অনুসারী দু’জন লোককে ইবনে কায়েদ এর নিকট প্রেরণ করে। তারা এসে কয়েক মাস তাঁর সঙ্গে অবস্থান করে ইবাদত- বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকে। অবশেষে তারা তাঁকে এবং তাঁর খাদেমকে হত্যা করে বাগানে আশ্রয় নেয়। বাগানের মালিরা জানতে পেরে তাদের উভয়কে হত্যা করে লাশ জ্বালিয়ে দেয়।17
এখানে আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি, তা কেবল হাশাশী ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ড। অন্যান্য বাতেনীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আমরা কিছুই উল্লেখ করিনি। এরা আর অন্যান্য কারামেতারা শিয়াদের সহায়তায় লালিত এবং তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতেই এদের উদ্ভব ঘটেছে। ওস্তাদ মুহাম্মদ কুর্দ আলী বলেন .
বিস্ময়ের বিষয় এই যে, শিয়ারা হচ্ছে ক্রুসেড দলের লোক। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করে। এরা পর্বতে আশ্রয় নিয়ে ক্রুসেডারদের সঙ্গে মিলে হামলা চায়। এবং ক্রুসেডারদের গাইড আর দোভাষী হিসাবে কাজ করে।18
বাতেনী সম্প্রদায় কোন একটা বিশেষ গোষ্ঠীর নাম নয়। হাশাশী, কারামেতা, খারমিয়া, ইসমাঈলিয়া, দুরজিয়া ইত্যাদি নানা সম্প্রদায় এদের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের আরো অনেক সম্প্রদায়ের নাম এদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এদের মূল বুলি এই যে, কুরআনের দু'টা অর্থ আছে- একটা জাহেরী, অপরটা বাতেনী। আসলে তারা কুরআন মজীদের প্রতি বিশ্বাসী নয়। মানুষকে আল্লাহর বন্দেগির বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য এ বিশ্বাসকে তারা একটা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। নিজেদের অপরাধমূলক লক্ষ্য- উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তারা শিয়া ইজমকেও হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। আসলে তারা ইসলামে বিশ্বাসীই নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো আর নবুওয়্যাত রিসালাত অস্বীকার করা। রাফেযী ধর্মমত হচ্ছে তাদের বাহ্যিক ধর্ম, আর তাদের বাতেনী বিশ্বাস হচ্ছে নিছক কুফরি মতবাদ ছড়ানো।1 অতীত এবং বর্তমানে বারবার বাতেনী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ডের উদ্ভব ঘটেছে। অতীত ইতিহাস অধ্যয়নকারীর সম্মুখে বর্তমানের চিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। অতীত সম্পর্কে অবগত হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানরা কি কুখ্যাত হাসান সাবাহ- এর কুকীর্তির ইতিহাস পাঠ করেছে? শাম দেশের শায়খুল জাবাল এর ইতিহাস পড়েছে? কারামেতা সম্প্রদায়ের কাহিনি অধ্যয়ন করেছে ? বর্তমান যুগেও তাদের অপকর্ম নমুনা হিসাবে পেশ করা হবে।
হাসান সাববাহ কায়রোর ইসমাঈলী উবায়দী সম্প্রদায়ের নিকট থেকে তার কর্মকান্ডের মূলনীতি গ্রহণ করে। অতঃপর ইরান গমন করে তার অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটা গোপন আস্তানা স্থাপন করে। সেখান থেকে সে আহলে সুন্নাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। সেলজুক বংশের শক্তিধর উজির হাসান ইবনে আলী এর হত্যার মাধ্যমে তার পরিকল্পনার নীল নকশা আঁকে। বাতেনী সম্প্রদায়ের নিকট তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি। কারণ, তিনি আলেমদের সহায়তা করতেন, জ্ঞান বিস্তার আর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা দ্বারা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। বাতেনীরা তাঁর এসব কর্মতৎপরতা সহ্য করতে পারেনি। ফলে উজির নিয়ামুল মূলক সর্ব প্রথম তাদের মূল্যবান শিকারে পরিণত হন। দাইলামী বংশের একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর নিকট প্রেরণ করা হয় সাহায্য কামনার ভান করে। সাহায্য প্রার্থী এ ব্যক্তিটি ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। হিজরী ৪৯৬ সালে রায় দেশে আবুল মুজাফ্ফর ইবনুল খাজান্দীকে হত্যা করা হয়। ইনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ওয়ায়েয।2 হিজরী ৪৯৮ সালে শাফেয়ি মজহাবের অন্যতম প্রধান শায়েখ আবু জাফর ইবনুল মুশাতকে তারা হত্যা করে। একই বৎসর বায়হাক অঞ্চলের তুরাইসীস গ্রাম থেকে বিপুল সংখ্যক ইসমাঈলিয়া এসে সমবেত হয়। তারা সেখানে তুলকাম কান্ড ঘটায়। অনেককে হত্যা করে অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। ফলে গোটা অঞ্চলে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দাপট বৃদ্ধি পায়। একই বৎসর মা- ওয়ারাউন নাহার, খোরাসান এবং ভারতবর্ষের হজ্বযাত্রীদের হজ থেকে ফিরে আসার পথে রায় অঞ্চলের ‘খাওয়ার’ নামক স্থানে পৌছলে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা ভোর রাত্রে হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে তাদেরকে হত্যা করে মাল-সামান লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।3
হিজরী ৪৯৯ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা কাজি আবুল‘আলা ছায়েদ ইবনে আবু মুহাম্মদ নীশাপূরীকে ইসফাহানের জামে মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে হত্যা করে। তিনি ছিলেন হানাফি মাজহাবের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।4 হিজরী ৫০২ সালে ইসফাহানের কাজি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আলী আল-খতিবকে হত্যা করা হয়। বাতেনীদের ভয়ে তিনি সর্বদা লৌহ বর্ম পরিধান করে থাকতেন।5 ৫১৬ হিজরীতে বাতেনীরা সুলতান মাহমুদ সালজুকীর উজির আবূ তালিব সুমাইরীর উপর হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে।6
৫১৯ হিজরীতে দুঃখজনক ঘটনাবলীতে কাজী আবূ সা’আদ মুহাম্মদ ইবনে নছর আল- হারবীকে হামাদানে হত্যা করা হয়। সুলতান সানজারের নিকট খলিফার একটা বিশেষ পয়গাম নিয়ে তিনি সেখানে গমন করেছিলেন।7 হিজরী ৫২০ সালে মুসেলের আমির আবূ সাঈদ আল- বারসাকীকে হত্যা করা হয়। বাতেনীরা তাঁকে জুমার দিন মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় হত্যা করে। মুসেলের জামে মসজিদে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর সম্পর্কে বলেন . তিনি ছিলেন একজন তুর্কি ক্রীতদাস এবং অত্যন্ত ভালো মানুষ। আলেম-ওলামা এবং নেকারদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। ন্যায়নীতি পছন্দ করতেন এবং নিজেও তা মেনে চলতেন।8
হিজরী ৫২৫ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা দামেশকের অধিপতি বূরী ইবনে তাগতেগীন-এর উপর হামলা চালিয়ে তাঁকে মারাত্মকভাবে আহত করে। আহত অবস্থায় এক বৎসর বেঁচে থেকে পরবর্তী বৎসর তিনি ইন্তিকাল করেন। তিনি ছিলেন একজন অগ্রবর্তী বীর মুজাহিদ।9 তাঁর উপর হত্যার উদ্দেশ্যে এ হামলা চানোর কারণ এই ছিল যে, ইসমাঈলিয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার অভিযোগে তিনি স্বীয় উজিরকে হত্যা করেছিলেন। এ হত্যার বদলা নেওয়ার উদ্দেশ্যে গোপনে তাঁকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে হাসান ইবনে সাববাহ জনৈক খতিবকে প্রেরণ করে।10
হিজরী ৫২৯ সালে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা আববাসীয় খলিফা আল-মুস্তারশিদ বিল্লাহ ফজল ইবনে আববাসকে হত্যা করে। হত্যার পর তারা তার দেহের বিকৃতি সাধন করে উলঙ্গ লাশ ফেলে রাখে। 11 হাফেজ শামসুদ্দীন আয-যাহাবী তাঁর সম্পর্কে বলেন . তিনি ছিলেন দ্বীনদার- পরহেজগার একজন বীর মুজাহিদ।
মুসেলের আমির মওদুদ ইবনে জঙ্গিকে ক্রুসেড যুদ্ধে সুলতান গিয়াসুদ্দীন সালজুকীর পক্ষ থেকে ত্যক্ত বিরক্ত করা হলে তিনি যাজীরা অঞ্চল থেকে বিপুল সৈন্য সংগ্রহ করেন। এ বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি শাম দেশে গমন করেন এবং ক্রুসেডারদের নিকট থেকে অনেক দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। দামেশক পৌঁছে নামাজ আদায় করার জন্য তিনি দামেশকের জামে মসজিদে প্রবেশ করলে বাতেনী সম্প্রদায়ের জনৈক ব্যক্তি ভিক্ষুকের বেশে তাঁর নিকট গমন করে ভিক্ষা চাইলে তিনি তাকে কিছু সাহায্য করেন। লোকটি কাছে গিয়ে তাঁকে ছুরিকাঘাত করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইন্তিকাল করেন।12
কথিত আছে যে, বায়তুল মুকাদ্দাসের ক্রুসেড শাসক দামেশকের শাসনকর্তার নিকট একটা বাণী প্রেরণ করেন। এতে তিনি বলেন . যে জাতি তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ঈদের দিন মা’বুদের গৃহে হত্যা করতে পারে, সে জাতিকে ধ্বংস করা ন্যায়ত . আল্লাহর কর্তব্য। হিজরী পঞ্চম শতকের শুরুতে ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের প্রচারক বাহরাম সিরিয়া আগমন করে প্রচার কার্য শুরু করলে অনেক সাধারণ মানুষ এবং নীচ স্তরের লোকেরা তাতে সাড়া দেয়। তাদের কোপানলের ভয়ে অনেক আলেম এবং শরিয়তের পতাকাবাহী নীরবতা অবলম্বন করেন। 13
এসব বাতেনীরা হয় মুসলমানদেরকে হত্যা করে, অথবা তাদের বিরুদ্ধে দুশমনদেরকে সহায়তা দান করে। অথবা দুশমনদের নিকট সহায়তা কামনা করে। ওয়াদী তাইম14 এর রঈম দাহহাদ ইবনে জুন্দল- এর উদ্ধৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . মুসলমান এবং ইংরেজরা তার সহায়তা করে। এবং এক সম্প্রদায় দ্বারা অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কামনা করা হয়। অবশেষে দামেশক অধিপতি ইসমাঈল ইবনে বুরী আগমন করত: তাদের নিকট থেকে শাকীফ দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন।15 এটা জানা কথা যে, ওয়াদী তাইম-এ দ্রুত ইসমাঈলিয়া সম্প্রদায়ের প্রচার কার্য ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল।
বাতেনী সম্প্রদায়ের হাতে যেসব আলিম- ওলামা নিহত হন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিশিষ্ট আলেম জাহিদ এবং আল্লাহ ওয়া আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মাঅ ইবনে কায়েদ আল আওয়ানী16। এ মহান আলেমের গ্রামের জনৈক বাতেনী ঘাতক একজন ওয়ায়েজিনের বেশ ধারণ করে প্রবেশ করত: তাঁর সঙ্গে মসজিদে কথা বলে। ইবনে কায়েদকে হত্যাস্থলে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন . হে কুকুর নীচে নেমে যায়! এ সময় সাধারণ মানুষ ছুটে এসে তীর নিক্ষেপ করলে সে পলায়ন করে। এ বাতেনী ঘাতকের উপর যা কিছু ঘটে গেছে, সে সম্পর্কে সিরিয়ার ইসমাঈলিয়াদের নেতা সিনানকে অবহিত করা হয়। আওয়ানীর ঘটনা জানতে পেরে সিনান তার অনুসারী দু’জন লোককে ইবনে কায়েদ এর নিকট প্রেরণ করে। তারা এসে কয়েক মাস তাঁর সঙ্গে অবস্থান করে ইবাদত- বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকে। অবশেষে তারা তাঁকে এবং তাঁর খাদেমকে হত্যা করে বাগানে আশ্রয় নেয়। বাগানের মালিরা জানতে পেরে তাদের উভয়কে হত্যা করে লাশ জ্বালিয়ে দেয়।17
এখানে আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি, তা কেবল হাশাশী ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের কর্মকান্ড। অন্যান্য বাতেনীদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আমরা কিছুই উল্লেখ করিনি। এরা আর অন্যান্য কারামেতারা শিয়াদের সহায়তায় লালিত এবং তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতেই এদের উদ্ভব ঘটেছে। ওস্তাদ মুহাম্মদ কুর্দ আলী বলেন .
বিস্ময়ের বিষয় এই যে, শিয়ারা হচ্ছে ক্রুসেড দলের লোক। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করে। এরা পর্বতে আশ্রয় নিয়ে ক্রুসেডারদের সঙ্গে মিলে হামলা চায়। এবং ক্রুসেডারদের গাইড আর দোভাষী হিসাবে কাজ করে।18
এহেন দুর্বলতা আর নানা দলে বিভক্ত হওয়ার কারণে এবং এসব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর বাতেনী সম্প্রদায়ের বিপর্যয়ের ফলে ইংরেজ আর ক্রুসেডাররা যখন সিরিয়ায় হামলা চায়, তখন বাগদাদ আর অন্যান্য স্থানের মুসলমানরা তাদের ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেনি। ক্রুসেডাররা যখন বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌঁছে যায়, মুসলিম জাহান তখনও এসব ঘটনা থেকে দূরে জীবন যাপন করছিল। যেন তাদের কর্ণ বোধির হয়ে আছে। ঠিক অবিকল অনুরূপ ঘটনাই আজ ঘটছে। আজ ইহুদিরা যখন বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করে নেয়, তখন দূরের বা নিকটের কোন দেশেরই চৈতন্যোদয় হয় না। তারা কেবল প্রতিবাদ করা আর জাতিসংঘ বা বিশ্ব জনমতের নিকট নিন্দা জ্ঞাপন করাই যথেষ্ট মনে করে। ইহুদিরা ফিলিস্তিনী যুবকদের হাত গুঁড়িয়ে দিচ্ছে- এ দৃশ্য কারো অন্তরে নাড়া দেয় না। এ দুর্বল জবাব আর দুর্বল প্রতিবাদ ইতিহাসের ঘটনায় রেকর্ড হয়ে রয়েছে। অথবা আমরা বলতে পারি যে, আদৌ এ সব ঘটনার কোন জবাবই দেয়া হয়নি। হিজরী ৩৬১ সালে যাজীরা অঞ্চলের আর-রাহা নগরীতে রোমানরা হামলা চায়। নগরীর অধিবাসীদের একটা প্রতিনিধি দল বাগদাদ গমন করে রোমের হামলা সম্পর্কে অবহিত করে। বিষয়টা জানাবার জন্য বাগদাদের কিছু বিশিষ্ট বুয়াইহী শাসক বখতিয়ারের নিকট গমন করে তাকে শিকারে মত্ত দেখতে পেয়ে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে ফিরে আসেন।
রোমানদের সঙ্গে জিহাদ শুরু হলে মুসলিম শাসক ইমরান ইবনে শাহিন জিহাদে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তখন বখতিয়ার এমন ভাব দেখান যে, তিনি জিহাদে গমন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং খলিফার নিকট বিপুল অর্থের দাবি পেশ করেছেন। অথচ তিনি জানেন যে, অর্থ খলিফার হাতে নয়, বরং তাঁর হাতে রয়েছে। এ আহবানে সাড়া দিয়ে খলিফা তার গৃহের আসবাবপত্র বিক্রয় করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কিন্তু বখতিয়ার সেসব অর্থ নিজের বিশেষ প্রয়োজনের কাজে ব্যয় করেন। ফলে জিহাদ সম্পর্কে কোন আলোচনাই হয়নি।1
ক্রুসেড যোদ্ধারা শাম দেশে উপনীত হলে ত্রিপোলীর শাসনকর্তা কাজি আবু আলী ইবনে আম্মার দ্রুত ছুটে এসে বাগদাদ গমন করেন এবং শাম দেশ মুক্ত করার জন্য মুসলমানদের সাহায্য কামনা করেন। জিহাদের আহবান জানিয়ে তিনি বাগদাদের মসজিদে খুতবা দেন। জনগণ উদ্দীপ্ত হয়ে প্রস্ত্ততি নেয়। সুলতান তাকে সৈন্য প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কার্যত: কিছুই করা হয়নি। ফলে কাজি ত্রিপোলী ফিরে এসে দেখতে পান যে, মিশরের অধিপতি ওবায়দীরা (ফাতেমী) ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার পরিবর্তে উল্টো তাঁর শহরটা অধিকার করে নিয়েছে।2
ক্রুসেড যোদ্ধারা বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করে নেয়ার পর জনগণ অস্থির হয়ে ঊর্ধ্ব শ্বাসে ইরাক ছুটে যায়। তারা বায়তুল মুকাদ্দাসে ক্রুসেডারদের বর্বরতা আর রক্তপাতের বিবরণ পেশ করলে খলিফা ফকীহদেরকে বহির্গত হয়ে জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত হতে শাসকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। জনগণের মধ্যে ছুটোছুটি আর হৈ-চৈ শুরু হয়। অনেক কথাবার্তাও হয়। কিন্তু এসব কোন কাজে আসেনি।3 আমি বিশ্বাস করি না যে, এটা খলিফা বা আলেম সমাজের একটা অভিনয় মাত্র। কিন্তু যে দুর্বলতা আর গভীর সু সুপ্তি মুসলিম জাহানের উপর চেপে বসেছিল, তা তাদেরকে উপযুক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে তা কার্যকর করতে ইতস্তত করে তোলে। ফলে বড় কাজে হাত দিতে তারা বিরত থাকে। হিজরী ৫০৪ সালে বাগদাদের আলেমগনসহ কিছু লোক জিহাদের উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করার জন্য প্রস্ত্ততি নেয়। কিন্তু ইংরেজদের সংখ্যাধিক্যের কথা জানতে পেরে তাদের অধিকাংশ পথিমধ্য থেকে ফিরে যায়।4
হিজরী ৪৯২ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . সিরিয়া থেকে যারা ফিরে আসে, তারা রমজান মাসে বাগদাদে কাজি আবূ সায়াদ হারবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়। তারা দফতরে এমন কথাবার্তা বলেন, যাতে অনেকের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়। অনেক অন্তর ব্যথিত হয়। তারা জুমার দিন জামে মসজিদে সমবেত হয়ে ফরিয়াদ জানায়। তারা নিজেরাও ক্রন্দন করে আর অন্যদেরকেও কাঁদায়। পবিত্র নগরী (বায়তুল মুকাদ্দাসে) অকস্মাৎ মুসলমানদের উপর যে বিপদ আপতিত হয়েছে, যেমন পুরুষদেরকে হত্যা করা, নারী আর শিশুদের বন্দী করা, অর্থ- সম্পদ লুণ্ঠন করা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তখন খলিফা কাজি দামগানী, আবু বকর শাশী এবং আবুল ওয়াফা ইবনে আকীল হাওয়ান সফর করে আসার নির্দেশ দেন। কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধি ছাড়াই তারা সফর করে ফিরে আসেন।5
হিজরী ৫০৫ সালে সালজুক সুলতান সিরিয়ায় মুসলমানদের সহায়তা করার জন্য উদ্দীপ্ত হন। আমির মওদুদসহ অন্যান্য আমিরদের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত করা হয়। এসব আমীরদের মধ্যে ছিলেন তাবরীযের শাসনকর্তা সাকমান আল- কুতবী, মারাগা অঞ্চলের শাসক আহমদীল, মারদিন- এর শাসনকর্তা আমির এলগানী। এ বাহিনী ইংরেজদের নিকট থেকে কিছু দুর্গ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অধিকাংশ আমির নিজেদের উপর বিপদ পতিত হওয়ার আশঙ্কায় ফিরে আসেন। এছাড়াও বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা আমির মওদুদকে দামেশকের উমা-ইয়া মসজিদের অভ্যন্তরে হত্যা করে। দুর্বল প্রতিরোধের আরো দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। এক্কা প্রাচীরের আশ-পাশে তীব্র লড়াই চলছে। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী দেখতে পেলেন যে, এক্কা প্রাচীরের অভ্যন্তরের মুসলমানরা দীর্ঘ অবরোধের ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি তাদের কষ্ট লাঘব করতে চাইলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি মুওয়াহহেদীন শাসনাধীন ‘মাগরেব’ অঞ্চলের শাসক আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবনে আব্দুল মু'মেনের নিকট একটা পয়গাম প্রেরণ করে। পয়গামে তিনি সাহায্য-সহায়তা কামনা করে। বিশেষ করে নৌবহর কামনা করেন, যাতে এক্কায় যুদ্ধরত ইংরেজরা সাহায্য না পায়। আবু ইউসুফের নিকট পয়গাম পৌঁছে। কিন্তু তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে সহায়তা দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কারণ, সুলতান সাহউদ্দিনের পয়গামে তাঁকে আমীরুল মু'মেনীন বলে সম্বোধন করেননি।
বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়ার পর মিশরের ওবায়দী শাসকদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল? তাদের উজির আকম ইবনে বদর জামী ক্রুসেড যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। আসকানে সৈন্যদের উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে এবং আফজলের সৈন্যদের ক্যাম্পে যা কিছু ছিল, সব লুট করে নিয়ে যায়। উজির আফজলের সৈন্যরা পরাজিত হয়। কারণ, তারা যুদ্ধের জন্য তখন প্রস্ত্তত ছিল না। ফলে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এ ঘটনা আমাদের ১৯৬৭ সালে আরব- ইসরাইল যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ যুদ্ধে মিশরীয় সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে সিনাই প্রান্তরের দিকে ছুটে যায়। কারণ নেতৃত্ব তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়নি। ফলে খোলা প্রান্তরে মিশরীয় সৈন্যদের প্রতি গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এটা ছিল নিছক এক ধরনের রাজনৈতিক চালবাজি।
এ দুঃখজনক অবস্থার জন্য কাজি আবুল মুজাফফর আবিয়ুর্দী অশ্রুপাত করে বায়তুল মুকাদ্দাসের জন্য শোক গাঁথা রচনা করেন। এ শোকগাথায় তিনি মুসলমানদেরকে জিহাদের জন্যও উদ্বুদ্ধ করেন .
مزجنا دماءً بالدموع السواجمفلم يبق منا عُرضةٌ للمراحمِ
وشرُّسلاح المرء دمعٌ يفيضُهإذالحربُ شُبَّت نارها بالصوارمِ
فإيهاً بني الإسلام إنّ وارءكموقائعَ يُلحقن الذُرّى بالمناسمِ
أتهويمة فى ظل أمن وغبطةوعيش كنوّار الخميلة ناعمِ
وإخوانكم بالشام يضحى مقيلُهمظهورَ المذاكى أو بطون القشاعمِ
تسومُهم الرومُ الهوانَ وأنتمُتجرُّون ذيلَ الخفضِ فعـلَ المسالمِ
أرى أمتي لا يُشرعون الى العدىرماحَهُمُ والدينُ واهى الدعائمِ
فليتَهُمُ إذلم يذودوا حميةًعن الدين، ضَنُّوا غيرةً بالمحارمِ
অশ্রু আর পানি আমরা একাকার করেছি।
কাজেই আমাদের পক্ষ থেকে আর দয়ার কোন সুযোগ নেই।
যুদ্ধের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে,
তখন মানুষ যে অশ্রু প্রবাহিত করে,
তা-ই হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট অস্ত্র।
সুতরাং হে ইসলামের সন্তানরা! তোমাদের পেছনে রয়েছে
এমন সব ঘটনাপ্রবাহ, যা প্রাণীর সঙ্গে সংযোগ ঘটায় অশ্রুর।
তুমি কি শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়াতলে তা কামনা করছ ?
কামনা করছ তুমি সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে তা, যেন বৃক্ষের ছায়ায় আলোর মতো।
আর তোমাদের ভ্রাতারা শাম দেশে বিসর্জন দিচ্ছে তাদের বিশ্রাম,
জবাইকারীর পৃষ্ঠ বা বড় বড় উদরের মতো।
লাঞ্ছিত রোম তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পরিণত করছে আর তোমরা ;
আছ বিনয়ীর বেশে সন্ধি স্থাপনকারীর মতো আচরণ করে।
আমি দেখছি আমার লোকদেরকে, তারা ছুটছে না শত্রু-পানে,
তাদের তীর-বর্শা, যখন কিনা দীনের ভিত্তি নিতান্ত দুর্বল।
যদি তারা না হতো, তবে দীনের প্রতিরোধ হতো না।
তবেতো ঈর্ষাকাতর হয়ে তারা কৃপণতা করতো হারাম কর্মে।
রোমানদের সঙ্গে জিহাদ শুরু হলে মুসলিম শাসক ইমরান ইবনে শাহিন জিহাদে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তখন বখতিয়ার এমন ভাব দেখান যে, তিনি জিহাদে গমন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং খলিফার নিকট বিপুল অর্থের দাবি পেশ করেছেন। অথচ তিনি জানেন যে, অর্থ খলিফার হাতে নয়, বরং তাঁর হাতে রয়েছে। এ আহবানে সাড়া দিয়ে খলিফা তার গৃহের আসবাবপত্র বিক্রয় করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কিন্তু বখতিয়ার সেসব অর্থ নিজের বিশেষ প্রয়োজনের কাজে ব্যয় করেন। ফলে জিহাদ সম্পর্কে কোন আলোচনাই হয়নি।1
ক্রুসেড যোদ্ধারা শাম দেশে উপনীত হলে ত্রিপোলীর শাসনকর্তা কাজি আবু আলী ইবনে আম্মার দ্রুত ছুটে এসে বাগদাদ গমন করেন এবং শাম দেশ মুক্ত করার জন্য মুসলমানদের সাহায্য কামনা করেন। জিহাদের আহবান জানিয়ে তিনি বাগদাদের মসজিদে খুতবা দেন। জনগণ উদ্দীপ্ত হয়ে প্রস্ত্ততি নেয়। সুলতান তাকে সৈন্য প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কার্যত: কিছুই করা হয়নি। ফলে কাজি ত্রিপোলী ফিরে এসে দেখতে পান যে, মিশরের অধিপতি ওবায়দীরা (ফাতেমী) ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার পরিবর্তে উল্টো তাঁর শহরটা অধিকার করে নিয়েছে।2
ক্রুসেড যোদ্ধারা বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করে নেয়ার পর জনগণ অস্থির হয়ে ঊর্ধ্ব শ্বাসে ইরাক ছুটে যায়। তারা বায়তুল মুকাদ্দাসে ক্রুসেডারদের বর্বরতা আর রক্তপাতের বিবরণ পেশ করলে খলিফা ফকীহদেরকে বহির্গত হয়ে জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত হতে শাসকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। জনগণের মধ্যে ছুটোছুটি আর হৈ-চৈ শুরু হয়। অনেক কথাবার্তাও হয়। কিন্তু এসব কোন কাজে আসেনি।3 আমি বিশ্বাস করি না যে, এটা খলিফা বা আলেম সমাজের একটা অভিনয় মাত্র। কিন্তু যে দুর্বলতা আর গভীর সু সুপ্তি মুসলিম জাহানের উপর চেপে বসেছিল, তা তাদেরকে উপযুক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে তা কার্যকর করতে ইতস্তত করে তোলে। ফলে বড় কাজে হাত দিতে তারা বিরত থাকে। হিজরী ৫০৪ সালে বাগদাদের আলেমগনসহ কিছু লোক জিহাদের উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করার জন্য প্রস্ত্ততি নেয়। কিন্তু ইংরেজদের সংখ্যাধিক্যের কথা জানতে পেরে তাদের অধিকাংশ পথিমধ্য থেকে ফিরে যায়।4
হিজরী ৪৯২ সালের ঘটনাবলী সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . সিরিয়া থেকে যারা ফিরে আসে, তারা রমজান মাসে বাগদাদে কাজি আবূ সায়াদ হারবীর সান্নিধ্যে উপস্থিত হয়। তারা দফতরে এমন কথাবার্তা বলেন, যাতে অনেকের চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়। অনেক অন্তর ব্যথিত হয়। তারা জুমার দিন জামে মসজিদে সমবেত হয়ে ফরিয়াদ জানায়। তারা নিজেরাও ক্রন্দন করে আর অন্যদেরকেও কাঁদায়। পবিত্র নগরী (বায়তুল মুকাদ্দাসে) অকস্মাৎ মুসলমানদের উপর যে বিপদ আপতিত হয়েছে, যেমন পুরুষদেরকে হত্যা করা, নারী আর শিশুদের বন্দী করা, অর্থ- সম্পদ লুণ্ঠন করা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তখন খলিফা কাজি দামগানী, আবু বকর শাশী এবং আবুল ওয়াফা ইবনে আকীল হাওয়ান সফর করে আসার নির্দেশ দেন। কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধি ছাড়াই তারা সফর করে ফিরে আসেন।5
হিজরী ৫০৫ সালে সালজুক সুলতান সিরিয়ায় মুসলমানদের সহায়তা করার জন্য উদ্দীপ্ত হন। আমির মওদুদসহ অন্যান্য আমিরদের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত করা হয়। এসব আমীরদের মধ্যে ছিলেন তাবরীযের শাসনকর্তা সাকমান আল- কুতবী, মারাগা অঞ্চলের শাসক আহমদীল, মারদিন- এর শাসনকর্তা আমির এলগানী। এ বাহিনী ইংরেজদের নিকট থেকে কিছু দুর্গ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অধিকাংশ আমির নিজেদের উপর বিপদ পতিত হওয়ার আশঙ্কায় ফিরে আসেন। এছাড়াও বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকেরা আমির মওদুদকে দামেশকের উমা-ইয়া মসজিদের অভ্যন্তরে হত্যা করে। দুর্বল প্রতিরোধের আরো দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। এক্কা প্রাচীরের আশ-পাশে তীব্র লড়াই চলছে। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী দেখতে পেলেন যে, এক্কা প্রাচীরের অভ্যন্তরের মুসলমানরা দীর্ঘ অবরোধের ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি তাদের কষ্ট লাঘব করতে চাইলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি মুওয়াহহেদীন শাসনাধীন ‘মাগরেব’ অঞ্চলের শাসক আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবনে আব্দুল মু'মেনের নিকট একটা পয়গাম প্রেরণ করে। পয়গামে তিনি সাহায্য-সহায়তা কামনা করে। বিশেষ করে নৌবহর কামনা করেন, যাতে এক্কায় যুদ্ধরত ইংরেজরা সাহায্য না পায়। আবু ইউসুফের নিকট পয়গাম পৌঁছে। কিন্তু তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে সহায়তা দানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কারণ, সুলতান সাহউদ্দিনের পয়গামে তাঁকে আমীরুল মু'মেনীন বলে সম্বোধন করেননি।
বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়ার পর মিশরের ওবায়দী শাসকদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল? তাদের উজির আকম ইবনে বদর জামী ক্রুসেড যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। আসকানে সৈন্যদের উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে এবং আফজলের সৈন্যদের ক্যাম্পে যা কিছু ছিল, সব লুট করে নিয়ে যায়। উজির আফজলের সৈন্যরা পরাজিত হয়। কারণ, তারা যুদ্ধের জন্য তখন প্রস্ত্তত ছিল না। ফলে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বন-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এ ঘটনা আমাদের ১৯৬৭ সালে আরব- ইসরাইল যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ যুদ্ধে মিশরীয় সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে সিনাই প্রান্তরের দিকে ছুটে যায়। কারণ নেতৃত্ব তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়নি। ফলে খোলা প্রান্তরে মিশরীয় সৈন্যদের প্রতি গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এটা ছিল নিছক এক ধরনের রাজনৈতিক চালবাজি।
এ দুঃখজনক অবস্থার জন্য কাজি আবুল মুজাফফর আবিয়ুর্দী অশ্রুপাত করে বায়তুল মুকাদ্দাসের জন্য শোক গাঁথা রচনা করেন। এ শোকগাথায় তিনি মুসলমানদেরকে জিহাদের জন্যও উদ্বুদ্ধ করেন .
مزجنا دماءً بالدموع السواجمفلم يبق منا عُرضةٌ للمراحمِ
وشرُّسلاح المرء دمعٌ يفيضُهإذالحربُ شُبَّت نارها بالصوارمِ
فإيهاً بني الإسلام إنّ وارءكموقائعَ يُلحقن الذُرّى بالمناسمِ
أتهويمة فى ظل أمن وغبطةوعيش كنوّار الخميلة ناعمِ
وإخوانكم بالشام يضحى مقيلُهمظهورَ المذاكى أو بطون القشاعمِ
تسومُهم الرومُ الهوانَ وأنتمُتجرُّون ذيلَ الخفضِ فعـلَ المسالمِ
أرى أمتي لا يُشرعون الى العدىرماحَهُمُ والدينُ واهى الدعائمِ
فليتَهُمُ إذلم يذودوا حميةًعن الدين، ضَنُّوا غيرةً بالمحارمِ
অশ্রু আর পানি আমরা একাকার করেছি।
কাজেই আমাদের পক্ষ থেকে আর দয়ার কোন সুযোগ নেই।
যুদ্ধের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে,
তখন মানুষ যে অশ্রু প্রবাহিত করে,
তা-ই হল সবচেয়ে নিকৃষ্ট অস্ত্র।
সুতরাং হে ইসলামের সন্তানরা! তোমাদের পেছনে রয়েছে
এমন সব ঘটনাপ্রবাহ, যা প্রাণীর সঙ্গে সংযোগ ঘটায় অশ্রুর।
তুমি কি শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়াতলে তা কামনা করছ ?
কামনা করছ তুমি সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে তা, যেন বৃক্ষের ছায়ায় আলোর মতো।
আর তোমাদের ভ্রাতারা শাম দেশে বিসর্জন দিচ্ছে তাদের বিশ্রাম,
জবাইকারীর পৃষ্ঠ বা বড় বড় উদরের মতো।
লাঞ্ছিত রোম তাদেরকে লক্ষ্যস্থলে পরিণত করছে আর তোমরা ;
আছ বিনয়ীর বেশে সন্ধি স্থাপনকারীর মতো আচরণ করে।
আমি দেখছি আমার লোকদেরকে, তারা ছুটছে না শত্রু-পানে,
তাদের তীর-বর্শা, যখন কিনা দীনের ভিত্তি নিতান্ত দুর্বল।
যদি তারা না হতো, তবে দীনের প্রতিরোধ হতো না।
তবেতো ঈর্ষাকাতর হয়ে তারা কৃপণতা করতো হারাম কর্মে।
শিয়া এবং বাতেনী ভাবধারায় কর্তৃত্ব লাভের চেষ্টা
হিজরী চতুর্থ শতাব্দী সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এ সময় এখানে-সেখানে শিয়া রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, যেন পানির উপর তেলের ফোটা আর কি! অতঃপর তা বিস্তৃত আর প্রশস্ত হতে থাকে। এমনকি দর্শকের নিকট প্রতিভাত হয় যে, মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের উপরই তাদের কর্তৃত্ব চলছে।
অধিকাংশ শহরে শিয়াদের হাঁক-ডাকে সাড়া দেওয়ার লোক তৈয়ার করায় তাদের আহবান সাফল্য অর্জন করে। সন্দেহ নেই যে, কেন্দ্রীয় খেলাফতের দুর্বলতা, দূর দূরান্ত বা পার্বত্য অঞ্চলে শিয়া প্রচারকদের উৎসাহ, কর্মতৎপরতা, পরিবর্তনের প্রতি মানুষের আগ্রহ, নূতন রাষ্ট্র আর নতুন পরিবার দেখার জন্য তাদের ব্যাগ্রতা- ব্যাকুলতা- এসব হচ্ছে তাদের উদ্ভবের কারণ। শিয়া ধর্ম মতের একজন আলেম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর এ প্রমাণের উল্লেখ করে বলেন .
ইবনু নুমান রাফেযীদের শাসন, তাদের পক্ষে ওকালতকারি, আশপাশের দেশগুলোর শাসকদের নিকট তার ছিল মর্যাদা আর সম্মান। কারণ, সেকালের অনেকেই ঝুঁকে পড়ে শিয়া ধর্মমতের প্রতি। তার অসংখ্য ছাত্রদের মধ্যে শরীফ রযী আর মুতাযাও ছিলেন।1
আল্লাহর ইচ্ছায় এসব রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সম্পর্কে আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। এসব রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইসলাম আর মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর ছিল কিনা, আমরা সে বিষয়েও সংক্ষেপে আলোচনা করব। মুসলমানদের প্রবৃদ্ধি আর শতধা বিচ্ছিন্নতায় এসব শিয়া রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করেছিল কিনা, তা-ও আলোচনা করব। এসব বিষয়ের আলোচনা দ্বারা হিজরী চতুর্থ শতাব্দী এবং তৎপর বর্তী কালে মুসলিম সমাজের সাধারণ অবস্থার একটা চিত্র পাঠকের সম্মুখে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে।
হিজরী চতুর্থ শতাব্দী সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এ সময় এখানে-সেখানে শিয়া রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে, যেন পানির উপর তেলের ফোটা আর কি! অতঃপর তা বিস্তৃত আর প্রশস্ত হতে থাকে। এমনকি দর্শকের নিকট প্রতিভাত হয় যে, মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের উপরই তাদের কর্তৃত্ব চলছে।
অধিকাংশ শহরে শিয়াদের হাঁক-ডাকে সাড়া দেওয়ার লোক তৈয়ার করায় তাদের আহবান সাফল্য অর্জন করে। সন্দেহ নেই যে, কেন্দ্রীয় খেলাফতের দুর্বলতা, দূর দূরান্ত বা পার্বত্য অঞ্চলে শিয়া প্রচারকদের উৎসাহ, কর্মতৎপরতা, পরিবর্তনের প্রতি মানুষের আগ্রহ, নূতন রাষ্ট্র আর নতুন পরিবার দেখার জন্য তাদের ব্যাগ্রতা- ব্যাকুলতা- এসব হচ্ছে তাদের উদ্ভবের কারণ। শিয়া ধর্ম মতের একজন আলেম সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর এ প্রমাণের উল্লেখ করে বলেন .
ইবনু নুমান রাফেযীদের শাসন, তাদের পক্ষে ওকালতকারি, আশপাশের দেশগুলোর শাসকদের নিকট তার ছিল মর্যাদা আর সম্মান। কারণ, সেকালের অনেকেই ঝুঁকে পড়ে শিয়া ধর্মমতের প্রতি। তার অসংখ্য ছাত্রদের মধ্যে শরীফ রযী আর মুতাযাও ছিলেন।1
আল্লাহর ইচ্ছায় এসব রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি সম্পর্কে আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। এসব রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইসলাম আর মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর ছিল কিনা, আমরা সে বিষয়েও সংক্ষেপে আলোচনা করব। মুসলমানদের প্রবৃদ্ধি আর শতধা বিচ্ছিন্নতায় এসব শিয়া রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করেছিল কিনা, তা-ও আলোচনা করব। এসব বিষয়ের আলোচনা দ্বারা হিজরী চতুর্থ শতাব্দী এবং তৎপর বর্তী কালে মুসলিম সমাজের সাধারণ অবস্থার একটা চিত্র পাঠকের সম্মুখে পরিস্ফুট হয়ে উঠবে।
খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গোপন আন্দোলন আর গুপ্ত তৎপরতা চরমে পৌঁছে এবং তাদের জন্য একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ তীব্র গতিতে চলতে থাকে। এ আন্দোলন এমন একটা আবরণে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, যার বাহ্যিক রূপ ছিল শিয়া ইজমের প্রচার আর অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল নিছক কুফরি, তথা নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা। সামিয়া শহর2 থেকে যে গোপন ইসমাঈলী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা ‘সামিয়াকে কেন্দ্র করে উত্তর আফ্রিকায় উর্বর ভূমি অধিকার করতে সক্ষম হয়। তারা পথের কাঁটা অপসারণের মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে। এদের মূল নেতা ছিল হুসাইন ইবনে আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া ছানআনী। যার উপাধি ছিল আবু আব্দুল্লাহ। শিয়া ধর্মমতের প্রচারক হিসেবে সে পরিচিত ছিল। তার পরিচয় নিয়ে জানা যায় যে, লোকটি ছিল অতি ধুরন্ধর। নিঃস্ব আর নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিতান্ত একাকী সে আফ্রিকায় প্রবেশ করে নিজের চেষ্টার বদৌলতে আফ্রিকার মালিক বনে বসে3। নিজ মিশনের কাজে তার গুরু ছিল ইবনে হাওশাব। গুরু তাকে শিখিয়ে দেয় যে, হজের মওসুমে মরক্কোর কাতামা গোত্রের সঙ্গে গোপনে মিলিত হবে। তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপনে তাদেরকে প্রভাবিত করতে চালাকির জোরে সে সক্ষম হয়। সে তাদের জ্ঞান- বুদ্ধি নিয়ে খেলা শুরু করে। সে তাদেরকে চমৎকৃত করে তোলে এবং তাদের সঙ্গে তাদের দেশে গমন করে। কাতামা এবং অন্যান্য সম্প্রদায় তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠে। তারা অন্যান্য গোত্রের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রবৃত্ত হয়। ফলে মধ্য মরক্কোর শহরগুলোর পতন ঘটে। এসব শহরের মধ্যে সাজমাসা, মিলা, তাহারাত এবং রিকাদা ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে স্থির হওয়ার পর আন্দোলনের নেতাকে সেখানে আগমন করে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করার জন্য আহবান জানায়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই নেতা ছিল ওবায়দুল্লাহ। সে পারসিক বংশোদ্ভুত বাতেনী সম্প্রদায় ভুক্ত আব্দুল্লাহ ইবনে মায়মুন আল- ফাদাহা- এর বংশধর। আবার কেউ কেউ বলেন, সে ছিল হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মায়মুন আল- ফাদাহ এর পালক পুত্র।4 কিন্তু সে নিজেকে রাসূল তনয়া ফাতেমা রা. এর বংশধর বলে দাবি করতো। অধিকাংশ আলেম, ঐতিহাসিক এবং বংশ বিশারদ তার এ দাবি অস্বীকার করেন। সিরিয়া ত্যাগের পর চরম আত্মগোপন থেকে ওবায়দুল্লাহ নিষ্কৃতি লাভ করে। এ অবস্থায় সে মরক্কো পৌঁছে। কিন্তু সাজমাসার শাসনকর্তা তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়ে হত্যা না করে কারাগারে আটক রাখে। এটা ছিল তার এক চরম ভুল। অতঃপর শিয়া ধর্মমতের অনুসারী আবু আব্দুল্লাহ তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং শিয়া ধর্মমত প্রচারের নেতা হিসাবে জনগণের সামনে উপস্থিত করে। এরা তার হাতে শপথও করে। সে নিজে মাহদী উপাধি ধারণ করে। সেই ছিল ওবায়দিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, যা ফাতেমী শাসক গোষ্ঠী নামে ইতিহাসে পরিচিত। উদ্ভব থেকে পতন পর্যন্ত ওবায়দী বা ফাতেমী রাষ্ট্রের উপস্থাপন করা আমাদের লক্ষ্য নয়। তাদের কর্মকান্ড এবং আহলে সুন্নাহ সম্পর্কে তাদের ভূমিকার প্রতি আমরা শুধু পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ইসলামের মানদন্ডে আমরা তাদের মূল্যায়ন করব, প্রয়োজন অনুপাতে তাদেরকে ওজন করব মাত্র।
ওবায়দী রাষ্ট্র একটা বাতেনী রাষ্ট্র, ফাতেমী নয়। কেবল মাত্র আমাদের নয়, বরং উম্মতের অধিকাংশ আলেমেরই এ মত। যারা তাদের বংশধারা সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন, যারা তাদের অন্তর্নিহিত রহস্য আর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতেন, তাদের বংশধারা সঠিক এবং নির্ভুল হয়ে থাকলে কেন তারা তা খোলাখুলি ব্যক্ত করেনি? তারাতো মিশর, সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার শাসন-কর্তৃত্ব লাভ করেছিল। তখন তাদের ছিল দোর্দন্ড প্রতাপ, অপ্রতিহত শক্তি আর অপ্রতিরোধ্য দাপট। তারা কাদেরকে ভয় পেতো? কেন তারা বলেনি . আমাদের প্রাণ নাশ হতে পারে- এ আশঙ্কায় গোপন আন্দোলন কালে আমরা বংশ ধারা গোপন রাখতে বাধ্য ছিলাম। মিশর বিজেতা তাদের রাজা ইবনে তাবাতাবা, যার উপাধি ছিল আল-মুইয আল- ওবায়দী, শরীফ তাঁকে বংশধারা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তরবারি কোষ মুক্ত করে তিনি জবাব দেন . এটাই হচ্ছে আমার বংশধারা এই বলে তিনি স্বর্ণ ছড়ান। এবার তিনি বলেন; এটাই হচ্ছে আমার বংশ পরিচয়।5 তাদের সম্পর্কে কবি যথার্থই বলেছেনঃ6
إنا سمعنا نسَباًمنكراً يُتلى على المنبر فى الجامع
إن كنتَ فيما تدَّعي صادقاًفاذكر أباً بعدَ الأب الرابع
আমরা শুনতে পাই মিথ্যা বংশের কথা।
মসজিদের মিম্বরে যা পাঠ করা হয়।
তোমার দাবিতে তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকলে,
চতুর্থ পুরুষের পর কে বলদেখি হে!
আন্দালুসিয়ায় উমাইয়া বংশের খলিফা হাকাম ইবনে আব্দুর রহমান নাছের- এর নিকট আযীয ওবায়দী তাকে গাল-মন্দ আর নিন্দা করে লিখেন- গাল-মন্দের জবাবে চারটা কথা বলা আমি যথেষ্ট মনে করি: তুমি আমাদেরকে জান, তাই নিন্দা কর। আমরা তোমাদের জানলে অবশ্যই জবাব দিতাম।7 আরো একটা বিষয় বিবেচ্য। সে পরিবারটি যে নবী কন্যা ফাতেমার পরিবার হবে- তা প্রকৃতিগত ভাবেই অসম্ভব, অবাস্তব- ফাতেমা রা. এর পরিবারের জন্য এবং ইসলামের জন্য এটা হবে দুঃখ আর কলঙ্ক। তাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তির উদ্ভব হবে, যিনি তাদেরকে আসল বংশধারায় ফিরিয়ে নেবেন। তাঁর সত্য উৎস তাকে সত্যের দিকে নিয়ে যাবে। তবে একটা পরিবার সম্পূর্ণরূপে বাতেলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে, তাতো হতে পারে না। মুহাম্মদ ইবনে তুমার্ত এর আহবানে সাড়া দিয়ে মুওয়াহহেদীনরা মরক্কোয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। মুহাম্মদ ইবনে তুমার্ত নিজে মাহদী উপাধি ধারণ করে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সে নিহত ব্যক্তিদের হাড় হাজির করে এবং নানা অলৌকিক কর্মকান্ডের দাবিও উপস্থাপন করে। এরপর তার সঙ্গী এবং তারপরে দ্বিতীয় ব্যক্তি মু'মেনের পরিবার দেশ শাসন করে। আব্দুল মু'মেনের বংশে এমন সব শাসকের উদ্ভব হয়, যারা ইবনে তুমার্ত এর মাহদী আর মাসুম হওয়ার দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে। অতঃপর হাশেমী বংশের উদ্ভব হয় এবং তারা আন্দালুসে শাসন কার্য চালায়। যারা বানু-হামদুন নামে পরিচিত। তাবারিস্তানে বানু হাসান ইবনে যায়েদ শাসন কার্য চালায়। কেউ তাদের বংশধারা অস্বীকার করেনি। ওবায়দিয়ার শাসন কর্তাদের মতো আচরণও তারা করেনি। আমরা এদের এমন সব কর্মকান্ড দেখতে পাই, যাতে তাদের বীভৎস চরিত্র আর উৎকট অন্তরাত্মার পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাবো যে, তারা ছিল মুসলমানদের গলার কাঁটা এবং মু'মেনদের উপর চেপে বসা একটা আপদ। সুলতান সালাহউদ্দীনের হাতে তাদের পতন আর ন্যায়পরায়ণ শাসন নূরুদ্দীনের নির্দেশক্রমে তাদের পতন হলে তখন আর তাদের কোন আলামতই অবশিষ্ট থাকে না .
كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ ﴿২৬﴾ ابراهيم : ২৬
‘‘যেমন নোংরা বৃক্ষ, যাকে মাটির উপর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে এর কোন স্থিতি নেই (সূরা ইবরাহীম : ২৬)
তাদের কর্মকান্ড আর অন্তর্নিহিত রহস্যের কিছু দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করা হচ্ছে .
১. ওবায়দুল্লাহর অপরাধমূলক কর্মকান্ডের একটি হচ্ছে . তার ঘোড়া মসজিদে প্রবেশ করে। তার লোকজনকে বলা হয় . কীভাবে তোমরা মসজিদে ঘোড়া প্রবেশ করালে? জবাবে তারা বলে: তার মল-মূত্র পাক, কারণ, তা মাহদীর ঘোড়া। মসজিদের কর্মকর্তারা এ কথার প্রতিবাদ করলে তাদেরকে মাহদীর দরবারে নিয়ে হত্যা করা হয়। তার সম্পর্কে ইবনুল আসীর বলেন . শেষ জীবনে ওবায়দুল্লাহ এক বীভৎস ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তার গুহ্যদ্বারে কীট দেখা দেয়। এসব একটি একটি অন্ত্র কেটে কেটে খেতে থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।8 আবু শামা ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে বলেন . সে ছিল খাবীছ যিন্দীক এবং ইসলামের দুশমন। শিয়া ধর্মমতে বিশ্বাসী বলে জাহির করতো। মিল্লাতে ইসলামির বিনাশে সে ছিল আগ্রহী। ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং বিপুল সংখ্যক লোককে সে হত্যা করে। তার সন্তানরাও সেভাবেই গড়ে উঠে। সুযোগ পেলে তারা ঐ রূপ কাজ করতো, অন্যথায় গোপন রাখতো।9
২. মনসুর ইবনে আযীয, যর উপাধি ছিল অ হাকেম বিআমরিল্লাহ, তার নির্দেশে কায়রো শহর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কায়রোর অধিবাসীরা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। শাসনকর্তা ওবায়দ এবং তার সৈন্যদের সঙ্গে ঘোরতর সংঘর্ষ হয়। বাড়ীঘরে আগুন জ্বলে। ফলে হাকেম ওবায়দ প্রতিদিন বের হয়ে এ দৃশ্য দেখে কেঁদে কেঁদে বলতো . ওবায়দদের সঙ্গে এমন আচর করার এ নির্দেশ কে দিয়েছে? সে নিজে বেরিয়ে আসার কথা প্রকাশ করতো, যে সে উভয় পক্ষের মধ্যে বিচ্ছেদ চাচ্ছে।10
আর এসব এমনই তৎপরতা, যা বাতেনীরা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করতোনা। এ ক্ষেত্রে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, আর যাদের রক্তের সঙ্গে বাতেনীদের রক্ত মিশে গেছে। এ যুগের অর্থাৎ হিজরী ১৫শ শতকের কেউ বাতেনীদের এসব কর্মতৎপরতার ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। এ ব্যাখ্যা দিতে গেলে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। লোকেরা অবাক হবে আর বিস্ময় প্রকাশ করবে যে, কীভাবে লেবাননে বাতেনীরা ফিলিস্তিনীদেরকে মার দিচ্ছে। এরপর আবার তারাই ফিলিস্তিনীদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছে। তারাই আবার দুশমনদের সঙ্গে যুদ্ধ করার আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং ফিলিস্তিনী ভূমি মুক্ত করার খায়েশ জাহির করছে! কীভাবে তারা আহলে সুন্নাহকে মার দিচ্ছে এবং জাতীয়তার ধ্বজা উত্তোলন করছে। যারা ইতিহাস অধ্যয়ন করে না, সে সব অবচেতনরা আবার কিনা এসব দাবিতে বিশ্বাসও করছে!
৩. ওবায়দীদের ইতিহাস যারা অধ্যয়ন করেছে, তারা কেবল তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই জানে না। তারা কেবল এতটুকুই জানে যে, অমুক প্রস্থান করেছে আর অমুক তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। ওবায়দীদের সম্পর্কে তারা কেবল এটাই জানে যে, এরা জ্ঞান- বিজ্ঞানকে ভালোবাসে আর তার বিস্তার ঘটায়। এদের উদ্দেশ্য দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ প্রচার করা। যারা আলেমদের জীবনী রচনা আর আলোচনা করেন, তারা ছাড়া একথা আর কেউ বলে না যে, এসব জালিমরা আহলে সুন্নাহর আলেমদের প্রতি হস্ত প্রসারিত করেছে। ওদের রক্তে নিজেদের হস্ত রঞ্জিত করেছে। বরং যেসব ছাত্ররা ইসলামের ইতিহাস পাঠ করে, তারা মাআদ ইবনে ইসমাঈলের কথাও উল্লেখ করে, যার উপাধি ছিল মুইয্ . তা এমন ভঙ্গিতে উল্লেখ করে, যেন সে ইতিহাসের কোন মহান হিরো। যেন সে-ই কায়রো নগরীর পত্তন করেছে এবং আল-আজহারের ভিত্তি স্থাপন করেছে। বরং কায়রোকে তার নামের সঙ্গে যুক্ত করে তারা বলে মুইয্- এর কায়রো। অথচ . সেনাপতি জাওহর মিসরবাসীদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, সুন্নাহর প্রতি অবিচল থাকার জন্য তারা প্রয়োজনে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু সৈন্যরা যখন দেশে প্রবেশ করে শক্ত হয়ে বসে এবং মুইজ কায়রোয় ফিরে আসে, তখন আর এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং তখন ফাতেমীরা মিশরীয়দেরকে উস্কে দিতে ত্রুটি করেনি।11 এই বিশ্বাসঘাতক মুইযই প্রখ্যাত আলেম আবু বকর নাবলসীকে হেস্তনেস্ত করেন, যখন উক্ত আলেমকে মুইজ এর সম্মুখে উপস্থিত করা হয় এবং তাদের মধ্যে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়: মুইজ . তুমি না সে ব্যক্তি, যে বলে আমার কাছে দশটি তীর থাকলে নয়টি রোমানদের প্রতি নিক্ষেপ করতাম এবং একটি নিক্ষেপ করতাম মিসরিদের (ওবায়দী) প্রতি?
শায়খ . না, বরং আমি তোমাদের প্রতি নয়টি তীর নিক্ষেপ করতাম আর একটি নিক্ষেপ করতাম রোমানদের প্রতি।
. কেন?
. কারণ তোমরা মুসলিম উম্মার দীনে পরিবর্তন সাধন করেছ, নেককার লোকদেরকে হত্যা করেছ এবং তোমরা আল্লাহর আলোকে নির্বাপিত করেছ।
তখন এ মহান আলেমকে চাবুক মারা হয়। অতঃপর তাঁর গায়ের চামড়া ছিলে ফেলা হয়। অবশেষে তাঁকে হত্যা করা হয়। আর এ কাজটি করে একজন ইহুদি। জালিমদের উপর আল্লাহর লা’নত।
এদের হাতে যেসব আলেমকে জীবন দিতে হয়, বারাকা শহরের কাজি মুহাম্মদ ইবনে হুবলা তাদের অন্যতম। বারাকা শহরের শাসক কাজির নিকট আগমন করে বলে- আগামী কাল ঈদ হবে। কাজি বললেন, চাঁদ না দেখলে ঈদ হবে না। মানুষ রোজা ভাঙবে না। জোরপূর্বক ঈদ করালে পাপের দায়িত্ব বহন করতে হবে তোমাকে। এরপর শাসক ঈদের প্রস্ত্ততি শুরু করে। কাজি বললেন . আমি বের হব না এবং নামাজও পড়াব না। ওবায়দুল্লাহর দৌহিত্র মনসুর ওবায়দী কাজিকে তলব করে বললেন . তুমি পদত্যাগ কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলেন। ফলে তাঁকে সূর্যের তাপে দগ্ধ করে শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রৌদ্রের তাপে ছটফট করতে করতে তিনি ইন্তিকাল করেন। পিপাসায় কাতর হয়ে পানি চাইলে তাঁকে পানি পান করাতে অস্বীকার করা হয়। অতঃপর তাঁর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। জালিমদের প্রতি আল্লাহর লা’নত।12
তাদের হাতে নিহত আলেমদের মধ্যে আরেকজন হচ্ছেন ইমাম ইবনুল বারদূন। ইনি আবু ওসমান ইবনুল হাদ্দাদ এর শিষ্য ছিলেন। শিয়া মতাবলম্বী আবু আব্দুল্লাহ তাঁকে হত্যা করে। তাঁকে হত্যার জন্য প্রস্ত্তত করার পর জিজ্ঞাসা করা হয় . তুমি কি তোমার ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করবে? তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন . আমি কি ইসলাম ত্যাগ করব? অতঃপর তাঁকে শূলী বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা আলেম আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন।13
তাঁদের মধ্যে আর একজন ছিলেন ইমাম আবু জা’ফর মুহাম্মদ ইবনে খাইরূন আল-মাগাফিরী। ওবায়দুল্লাহ মাহদীর নির্দেশক্রমে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চরম নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে। এর কারণ তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুজাহিদ। ওবায়দুল্লাহ এবং তার সৈন্যদেরকে তিনি ঘৃণা করতেন।14
ওবায়দীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে যে সব আলেম অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অপর একজন হচ্ছেন আবুল আরব মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে তামীম আল- মাগরেবী। আবু ইয়াযীদ খারেজীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি অংশগ্রহণ করেন। আহলে সুন্নাহর আলেমগন বলতেন . কাফির ওবায়দীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে আমরা আহলে কিবলা অর্থাৎ খারেজিদের সঙ্গে এক যোগে কাজ করতে পারি।
হাফেজ শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন . ওবায়দ বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্পর্কে মরক্কোর আলেমগন একমত। কারণ, ঐ আলেমগন ওবায়দীদের মধ্যে স্পষ্ট কুফরি প্রত্যক্ষ করেন, যার কোন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। এ বিষয়ে আমি অনেক ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। ইতিহাসের সকল ঘটনাই এর স্বপক্ষে মত দেয়। ওবায়দুল্লাহর পুত্র কায়েস এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য অনেক আলেম এবং আবিদ আবু ইয়াযীদ খারেজীর সঙ্গে এক জোট হয়ে বহির্গত হন। তাঁরা বলেন . যারা আহলে কেবলা নয়, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা সকল কেবলা পন্থীরা এক জোট হয়ে কাজ করতে পরি। 15
হিজরী ৩৮১ সালের ঘটনাবলীতে দেখা যায়, জনৈক মিশরীয় ব্যক্তিকে প্রহার করে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। তার অপরাধ এই যে, তাঁর কাছে ইমাম মালেক সংকলিত হাদিস গ্রন্থ মুয়াত্তা পাওয়া গেছে।16 বিশিষ্ট তার্কিক এবং আলেম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল- হাজবী বলতেন . আরবের জালিম বর্বররা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কায়রোয়ান, তিউনিসিয়া এবং আলজেরীয়ার অনেক অঞ্চলে মালেকি মাজহাব প্রচার হতে পারেনি। ফাতেমীরা এসব বর্বরকে মিশর থেকে বিতাড়িত করে যেন তাদেরকে আজাবের ঘোড়ার মতো চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এসব বর্বররা ৪৪৯ হিজরীতে কায়রোয়ান শহর ধ্বংস করে সেখান থেকে আলেম দেরকে নির্বাসিত করে। অনেকেই তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।17
ওবায়দীদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং কারামেতাদের সঙ্গে যোগসূত্র
যেসব গ্রন্থকার, মুহাদ্দেসীন ওবায়দী রাষ্ট্র সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁরা কেবল তাদের রাজনৈতিক জীবন চরিত লিপিবদ্ধ করেছেন। কাছে বা দূরে থেকে তাদের শাসকদের জঘন্য বিশ্বাস সম্পর্কে তারা কোন আলোচনাই করেননি। তাঁরা একথাও বলেন না যে, তারা আসলে ছিল বাতেনী সম্প্রদায়ের লোক, যদিও তারা তা অস্বীকার করতো। কারণ, যে জাতিকে তারা শাসন করতো, তাদের সম্মুখে তারা ‘তাকিয়া’ নীতি প্রয়োগ করতো। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ওবায়দীদের সর্বশেষ শাসক আল- আযেদ-এর উপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করার ব্যাপারে আলেম সমাজের নিকট ফতোওয়া তলব করেন। তাকে হত্যা করা জায়েয হবে বলে আলেমগন ফতোওয়া দান করেছেন। কারণ, আযেদ এবং তার সঙ্গী-সাথীদের আক্বীদা-বিশ্বাসে বিকৃতি-বিচ্যুতি ঘটেছিল। এ ফতোওয়া দানে শায়খ নাজমুদ্দীন খাবুশানী ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নীতির লোক। তিনি এদের এক একটি কুকীর্তি শুমার করে তাদের ঈমান-ই নেই বলে মত প্রকাশ করেন।18
তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান বলেন . আযেদ ছিল চরমপন্থী শিয়া। সাহাবায়ে কেরামের নিন্দাবাদে সে ছিল অত্যন্ত কঠোর নীতির অনুসারী। কোন সুন্নী মতাবলম্বীকে দেখতে পেলেই তার রক্ত হালাল বলে মনে করতো।19 নাস্তিক কারামেতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে এদের ছিল গভীর সম্পর্ক। উভয় সম্প্রদায়ের আহবান আর প্রচারের মূল সূর ছিল এক ও অভিন্ন। মিশর দুর্গ অবরোধের খবর শুনে ফাতেমী খলিফা মুইজ কারামেতাদের নিকট পত্র প্রেরণ করে। এতে সে নিজের ফজিলত আর কৃতিত্ব বর্ণনার পাশাপাশি নিজের পরিবার-পরিজনেরও কৃতিত্ব বর্ণনা করে বলে যে, কারামেতা আর আমাদের মূল আহবান এক ও অভিন্ন। কারামেতারা এ আহবানই জানিয়ে আসছে বলেও সে উল্লেখ করে।20 ইমাম শাতেবী বলেন . ওবায়দীয়াদের মুইদ হচ্ছে অন্যতম দাজ্জাল। এরা আফ্রিকার শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। এদের সম্পর্কে কথিত আছে যে, এরা মুয়াযযিনকে আশহাদু আন্না মুইদ্দান রাসূলুল্লাহ অর্থাৎ ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুইদ আল্লাহর রাসূল’’ বলতে বাধ্য করে। মুসলমানরা সে মুয়াযযিনকে হত্যা করতে উদ্যত হলে মুইদ তাকে এ নির্দেশ দিয়েছে কিনা, তা প্রমাণ করার তাকে মুইদের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কথা পেশ হলে সে বলে . তাদের প্রতি আজান ছুঁড়ে মার। তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক।21
আবু তাহের কারামেতী পবিত্র মক্কা নগরীতে অশ্লীল অপকর্ম চালাতে উদ্যত হলে ওবায়দুল্লাহ মাহদী সে সম্পর্কে জানতে পেরে তার ঐ উদ্যোগের নিন্দা করে তাকে লিখে . তুমি যা কিছু করেছ, তার দ্বারা তুমি আমাদের দল আর আমাদের রাষ্ট্রের প্রচারকদের উপর কুফরি ও নাস্তিক্যবাদী নাম আরোপ করলে, আমাদেরকে কাফের এবং নাস্তিক বলে প্রমাণ করলে22 বাগদাদে বাতেনীদের ধর-পাকড় শুরু হলে জনৈক কারামেতী বলে . মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে জা’ফর ছাদেক আমাদের ইমাম। তিনি মাহদী। মরক্কোয় তিনি অবস্থান করছেন।23
হিজরী ৪১৪ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানা যায় যে, মিসরে ওবায়দী শাসকদের একজন ভারী অস্ত্র দ্বারা হাজরে আসওয়াদে আঘাত হানতে থাকে। তার অপর হাতে ছিল তরবারি এবং সে বলছিল . হাজরে আসওয়াদ, মুহাম্মদ এবং আলীর কত কাল ধরে পূজা চলবে? ইয়া মানের জনৈক হাজি তার এসব কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং ফলে খঞ্জর দ্বারা তাকে খুন করেন।24
তাদের সম্পর্কে এটাই হচ্ছে আসল কথা। রিসালাত আর নবী- রাসূলদের প্রতি তাদের ঈমান নেই। তাদের আহবানে বিশ্বাসী জনৈক ব্যক্তির বক্তব্য থেকে এ কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের দিকে দিকে হাশাশী সম্প্রদায়ের লোকেরা যে সন্ত্রাস আর ভয়-ভীতির বীজ বপন করে, তা ছিল মিসরে ইসমাঈলী ওবায়দীদের কর্মকান্ডের ফল। মিসরে আল-মাওত দুর্গের নেতা হাসান সাববাহ, আলেম -ওলামা, ওমারা আর মুজাহিদদের হত্যা করার জন্য যে লোক প্রেরণ করতো, মিসরে ওবায়দীদের হাতেই সে এ দীক্ষা গ্রহণ করে। এই হাশাশী সম্প্রদায়ের লোকেরাই আলেম - ওলামাদেরকে হত্যা করে, যাদের সম্পর্কে পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। আর শাম দেশে দুরূজ আন্দোলনও ওবায়দী শাসকদের কর্মকান্ডের ফল। ওবায়দী শাসকদেরকে তারা খোদা মনে করে। এরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। এদের রাজনৈতিক ভূমিকা কলঙ্কময়। উক্ত অঞ্চলে রাজনীতি সম্পর্কে ব্রিটেন ছিল তাদের প্রতি আস্থাবান। ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের দুরূজ গ্রুপের রয়েছে ঘনিষ্ঠ এবং গভীর সম্পর্ক। এমনকি এ সম্পর্ক উল্লেখ করার জন্য দুরূজ গ্রুপের কোন কোন লেখক ব্যাকুল হয়ে উঠে। আর তাদের সম্পর্ক স্থাপনকে বৈধতা দেয়ার জন্যও তারা প্রচেষ্টা চায়।25 বর্তমানের সঙ্গে অতীতের যোগসূত্র প্রমাণ করার জন্য আমরা এখানে তাদের কেবল একটা ভূমিকার উল্লেখ করব, ১৯৮২ সালে ইসরাঈল দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালিয়ে বৈরুত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুন্নীণ মুসলমানরা এ হামলার প্রতিবাদ করে এবং তাদের যা অস্ত্রশস্ত্র আছে, তা দিয়ে প্রতিরোধ করে। কিন্তু দুরূজ গ্রুপ আদৌ কোন প্রতিরোধের চেষ্টাই চালায়নি। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার জনৈক নেতা স্পষ্ট বলেন . শেষ যুদ্ধে দুরুজরা কোন চেষ্টাই চালায়নি, অথচ তাদের হাতে ছিল উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র।26 কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরাইলী সৈন্যদের একটা দল শাওফ অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দুরূজ গ্রুপের নেতা মুহাম্মদ আবু শোকরা জনৈক মার্কিন সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন . ইসরাইলী সৈন্যরা দুরূজদের ছিনিয়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে।
তাদের মন্ত্রী বর্গ
শাসনকার্য পরিচালনায় ওবায়দীরা, ইহুদি-নাছারা এবং চরমপন্থী শিয়াদের সহায়তা গ্রহণ করে। তাদের একজন প্রসিদ্ধ মন্ত্রী এয়াকুব ইবনে কালস ছিল ইহুদি বংশদ্ভুত। বদর জামী এবং তার পুত্র আকম ছিল একজন শিয়া। তাদের রাষ্ট্রে এটাই ছিল বৈশিষ্ট্য। এজন্য কেউ তাদেরকে ঈর্ষা করতোনা। আসলে তারা মুসলিম জাহান গ্রাস করার পরিকল্পনা আঁটে। এ ক্ষেত্রে তাদের কাছে মাধ্যমের কোন গুরুত্ব ছিল না। কার কাছে থেকে সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, তা দেখতো না তারা। যেমন সাম্প্রতিক কালে আমরা খোমেনী এবং তার দলকে দেখতে পাই।
এদের কয়েকজন মন্ত্রী সম্পর্কে নমুনা স্বরূপ কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে।
১. ইয়া’কুব ইবনে কালস
আজীজ উপাধি ধারী নেযারের শাসনামলে ইয়াকুব ছিল প্রথম মন্ত্রী। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে আসাকের বলেন .
বাগদাদের বাসিন্দাদের মধ্যে সে ছিল একজন খাবীছ ইহুদি। ধুরন্ধর এ লোকটি অনেক চালাকি জানতো। কাফুর আখশীদির শাসনামলে সে মিসরে আগমন করে। তার মধ্যে পাকা বুদ্ধিমত্তা লক্ষ্য করে কাফুর বললেন . লোকটি যদি মুসলমান হতো তাহলে তার মন্ত্রী হতে পারত। এ কথা শুনে তার মধ্যে মন্ত্রী হওয়ার লোভ সৃষ্টি হয়। আর এ লোভেই সে মুসলমান হয়। উজির ইবনে খানজাবা তার মতলব বুঝতে পারেন। তিনি এ মতলববাজ লোকটাকে পাকড়াও করতে মনস্থ করেন। ধুরন্ধর লোকটা তা টের পেয়ে মরক্কোর দিকে পালিয়ে যায়। সেখানে সে কিছু ইহুদির সঙ্গে যোগ দেয়, যারা এক সময় মুইজ এর সঙ্গী ছিল। দুর্দিনে এরা মুইজ-এর জন্য টাকা কড়ি খরচ করে, তার জন্য অনেক পথ উন্মুক্ত করে, শাসক হওয়ার সুন্দর উপায় বের করে এবং তার সঙ্গে মিসরে আগমন করে।27 তার মৃত্যুতে শাসক আজীজ বেশ ব্যথিত হয়। ইবনে কালস এত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আর মণি-মাণিক্য ছেড়ে যায়, যার বর্ণনা দেয়া অসম্ভব।28 ঐতিহাসিকরা বলেন- সে মুসলমান হয়েছিল। তার অর্থ সে ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে ইসমাঈলী মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছি। আর এ ইসমাঈলী ধর্মমত ছিল তার গুরুদের ধর্ম। এটা কোন ইসলাম?
২. ঈসা ইবনে নাসতূরাস নাছরানী
ইবনে কালসের পর ঈসা ইবনে নাসতুরাস বাদশাহ আজীজের উজির হয়। এ সময় তার স্ব গোত্রীয় খ্রিস্টানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে মুসলমানরা চিৎকার জুড়ে দেয়। ইহুদিদেরকেও সে সহায়তা করে। ইহুদি মিনসাকে সে নিজের প্রতিনিধি করে সিরিয়ায় প্রেরণ করে। মিসরবাসীদের এ অভিযোগ শাসক আজীজের নিকট পৌঁছাবার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করে। তারা এক খন্ড কাগজের টুকরায় লিখে রৌপ্যের মূর্তির হাতে স্থাপন করে। তাতে লেখা ছিল . যিনি মিনসা দ্বারা ইহুদিদেরকে এবং ঈসা ইবনে নাসূতরাস দ্বারা খ্রিস্টানদেরকে সম্মানিত করেছেন, তার শপথ, আর শপথ তার, যিনি তোমার দ্বারা মুসলমানদেরকে অপদস্ত করেছেন। আর সে মূর্তিটাকে স্থাপন করে রাখে বাদশাহ আজীজের পথে। বাদশাহ আজীজ দেখে তা যে মূর্তি, সে কথা বুঝতে পারেনি। মূর্তির হাত থেকে পত্রটি তুলে নিয়ে তা পাঠ করে দেখে। এরপর কিছু দিন উযীরকে দূরে রাখে। পরে বাদশাহের কন্যার সুপারিশে তাকে পুনরায় কাছে ফিরিয়ে আনে।29
৩. শাসক ইবনুল আজীজ এর শাসনামলে (৩৮৬-৪৪১ হি:)
শাসক ইবনুল আজিজ হুসাইন ইবনে জাওহারকে সর্বময় কর্তা নিযুক্ত করে আর রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব তার হাতে ন্যস্ত করে। আর হুসাইন ইবনে জাওহার ফাহাদ ইবনে ইবরাহিম খ্রিস্টানকে তার সহকারী নিযুক্ত করে। এই হাফেজের শাসনামলে মনসুর ইবনে আবদুন নামে জনৈক খ্রিস্টান উজিরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। ইতিপূর্বে সে সিরিয়ায় একটা দফতরের দায়িত্বে ছিল। ইবনে ফানেস তার পরিচয় দিয়ে বলে . সে ছিল একজন ভীষণ খাবীছ লোক।30 এই হাকিমের শাসনামলে জুরয়া ইবনে ইসা ইবনে নাসরাস এবং ছায়েদ ইবনে ঈসা ইবনে নাসতূরাসকেও মন্ত্রীর পদে নিয়োজিত করা হয়।
৪. মুস্তানসিরের শাসনামলে (৪২৭-৪৮৭ হি:)
তার শাসনামলে ছাদকা ইবনে ইউসুফ আল ফালাহী মন্ত্রিত্ব লাভ করে, যে ছিল একজন ইহুদি। সে ইসমাঈলী ধর্মমত গ্রহণ করে। হিজরী ৪৩৬ থেকে ৪৩৯ সন পর্যন্ত মন্ত্রীপদে বহ ছিল। তার সময়ের প্রসিদ্ধ উজিরদের অন্যতম হচ্ছে বদর জামি। সেও ছিল একজন শিয়া মতাবলম্বী।
৫. মুস্তা’লী এবং আমের এর শাসনামল
এ যুগে মন্ত্রিত্ব লাভ করে বদর জামির পুত্র আফজ। তার সময়ে খলিফার মাতার প্রাসাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে জনৈক ইহুদি। ফলে ইহুদিদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্রীয় পদে ইহুদিদেরকে নিযুক্ত করা হয়।31 আর ইংরেজরা আন্তাকিয়া (এন্টিয়ক) শহরে প্রবেশ করলে এই আফজ তাদের নিকট সিরিয়াকে বিভক্ত করার প্রস্তাব পেশ করে। ফলে উত্তর সিরিয়া অধিকার করে নেয় ইংরেজরা, আর মিশর করায়াত্ত করে ফিলিস্তিন।32 কিন্তু পরবর্তীকালে প্রকাশ পায় যে, তার এ প্রস্তাব কোন সুফল বহন করে আনেনি। কারণ ক্রুসেডারদের প্রধান টার্গেট ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। ফলে ৪৯১ হিজরীতে বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করে নেয়। আমরা দেখতে পাই যে, এ সময় সুন্নীণ উজির ইবনুস সার ক্রুসেডারদের প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন ফেরত দানের ব্যাপারে নূরুদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা চালায়। এ সময় তাদের উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ছিল আমির উসামা ইবনে মুনকেয আল-কেনানী। তখন ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সুন্নীণ উজির ইবনুস সালার নৌবহর প্রস্ত্তত করেন। এজন্য তিনি তিন লক্ষ দীনার ব্যায় করেন।33
হাফেজের শাসনামলে ৫২৪-৫৪৪ হিজরীতে বাহরাম আরমানী উজির হন। হাফেজ তাকে সাইফুল ইসলাম এবং তাজুল খেলাফত উপাধি দান করেন। অথচ সে ছিল একজন ইহুদি। সে ইসলাম গ্রহণ করেনি। তাদের শেষ দিকের মন্ত্রীদের মধ্যে ছিল ‘তায়ে ইবনে রুজেক’, যে ছিল একজন আর্মেনীয় শিয়া।
তারা কি বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষা করেছে?
ক্রুসেডাররা যখন বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে তখন ফাতেমী খলিফা মুস্তা’লীর উজির আফজ জামী ছিল সেনা প্রধান। বায়তুল মুকাদ্দাস হেফাজত করা ছিল তার দায়িত্ব। ক্রুসেডাররা যখন বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে রাখে, তখন তারা যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। ফলে ইংরেজরা অতি সহজে তা অধিকার করে নেয়। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লেকান বলেন . তখন বায়তুল মুকাদ্দাস যদি সিরিয়ার তুর্কি শাসকদের অধীনে থাকত, তাহলে মুসলমানদের জন্য তাই-হতো কল্যাণকর।34 ‘শাওর’ ক্রুসেডারদের সাহায্য কামনা করে। সুলতান সালাহউদ্দিন যখন মিশর অধিকার করেন এবং ওবায়দীরা যখন শাসন-ক্ষমতা হারায় তখনও অবশিষ্ট ওবায়দীরা শাসন ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য একমত হয়ে কাজ করে। তারা সিসিলির ইংরেজদের সহায়তা কামনা করে তাদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করে। কিন্তু ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেয়ে যায় এবং ষড়যন্ত্রের বড় হোতা নিহত হয়।35 তবে কি বাতেনীদের হাতে সর্বদা মুসলমানরা পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, যারা আল্লাহর দুশমনদের হাতে দেশ তুলে দেয়? এরপরও মুসলমানরা এ জঘন্য আচরণের কথা ভুলে যায়। এরা মুসলমানদেরকে জাতীয়তা আর গণ স্বার্থের কথা বলে এখনও কি ধোঁকা দেবে?
রাষ্ট্র কি নিরপেক্ষ ছিল?
কোন কোন ঐতিহাসিক লেখক লিখেন যে, ওবায়দী রাষ্ট্র তাদের ইসমাঈলী ধর্মের ক্ষেত্রে গোঁড়া ছিল না। তারা একথা লিখেন যে, ওবায়দীরা শক্তি প্রয়োগ করে তাদের বাণী প্রচার করেনি। কিন্তু আসল সত্য এর বিপরীত। আসলে ওবায়দী রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা তাদের ধর্ম প্রচার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছে। তারা প্রচার কার্য আর প্রচারকদের যথাযথ আয়োজন করে। এ জন্য যথারীতি একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ইসমাঈলী ধর্মমত প্রচার আর তা সংগঠিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট স্বীকার করেছে উজির ইবনে কালস। তার চেষ্টা আর উদ্যোগে জামেয়া আযহারে একটা সুসংগঠিত পাঠ দানের ব্যবস্থা গড়ে তো হয়। জামেয়া আযহারে উজির ইবনে কালসকে শিক্ষা দানের জন্য এক দল ফকীহ নিযুক্ত করা হয়।36 এসব প্রচারকদের উপরে ছিল নকিব বা প্রধান। এদের সকলের উপর ছিল আরো বড় একজন কর্মকর্তা। তাকে রাষ্ট্র প্রধান আর ধর্মমতের অনুসারীদের যোগসূত্র বলে মনে করা হতো। সমস্ত রাষ্ট্রীয় ফকীহ আর প্রচারক এ প্রধান কর্মকর্তার অধীনে থাকতো। ধর্মের মূলনীতি বিষয়ে এদের রচিত নিবন্ধ সে প্রধান কর্মকর্তার নিকট উপস্থাপন করা হতো।37 প্রধান প্রচারক কাজি নোমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মনসুর নিজে মালেকী মাজহাবের অনুসারী হলেও এদের জন্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের ধর্মমত প্রচারে সহায়তা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বাতেনী ধর্মমত গ্রহণ করেন। এমনকি হানাফি, মালেকি এবং শাফেয়ি মাযহাবের38 বিরুদ্ধে তিনি গ্রন্থও রচনা করেন। আর দ্রুজদের প্রচারকরা সিরিয়া দেশের ওয়াদী মতী অঞ্চলে আরবদের মধ্যে তাদের প্রচার কার্য চালায়। হাসান ইবনে সাববাহ- এর মতো এরা ভীতি আর সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে মুসলিম বিশ্বে। তাদের আহবান আর আন্দোলনের প্রভাব এমনই ছিল যে হালব বা আলোপ্পোর শাসক মাহমুদ ইবনে ছালেহ ইবনে মিরদাস ওবায়দীদেরকে বাদ দিয়ে বনু আববাস এবং সেলজুকদের নামে খুতবা পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে আলোপ্পোর সাধারণ মানুষ এ উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করে। তার এর বিরুদ্ধে মসজিদে যা কিছু পাওয়া যায়, তা হাতে নিয়ে বলে . এগুলোতো আলী ইবনে আবু তালিবের চাটাই। আবু বাহর অন্য চাটাই নিয়ে আসুক, যার উপর মানুষ নামাজ পড়বে। দামেশকে যখন তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় তখন তারা দিকে দিকে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ বলে আজান দেয়া হয়। আবু বকর (রা:) এবং ওমর (রা:) কে গালিগালাজ করে নানা কথা মসজিদের দরজায় লেখা হয়। তুর্কি এবং কুর্দী শাসকদের শাসনামলে পরিবর্তন সাধনের পূর্ব পর্যন্ত তা বহ ছিল।39
হাফেজ শামসুদ্দীন আ্য-যাহাবী তাদের সাধারণ সৈন্যদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, তারা ছিল মন্দের মূল আর বদমেজাজি। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা যিন্দীক ছিল, তারা ছিল মন্দের এক শেষ। মুসলমানরা তাদের দ্বারা হত্যা, গালমন্দ আর ছিনতাইয়ের শিকার হয়। এমনকি ‘সূর’ অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের জুলুম নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রোমের খ্রিস্টানদের সহায়তা কামনা করেছিল। তারা রাস্তাঘাট আর হাম্মামখানা থেকে নারীদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যোতো।40 মিসরে আহলে সুন্নাহর আলেমদের ওপর এসব নির্যাতন কখনো কিছুটা হ্রাস করা হতো, যখন তারা প্রত্যক্ষ করতো যে, মরক্কোর আলেমদের উপর তাদের এসব নির্যাতন ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ তারা মনে করতো যে, নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক তাদেরকে বাতেনী ধর্মে দীক্ষিত করার সাধ্য তাদের রয়েছে।
ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর ওবায়দীয়া রাষ্ট্রের শাসকদের সম্পর্কে বলেন যে, চরিত্রের দিক থেকে তারা ছিল সবচেয়ে অপবিত্র শাসক। আর অভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির বিচারে এরা ছিল সবচেয়ে খাবীছ। তাদের শাসনামলে বেদআত আর অন্যায়-অশ্লীলতা দেখা দেয়। সন্ত্রাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সৎ আলেমদের সংখ্যা হ্রাস পায়। শাম দেশে খ্রিস্টান, দ্রুজ আর হাশিমী সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সাহেলী অঞ্চলে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।
এখানে একটা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, এসব ওবায়দী যদি কারামেতাদের মতো একই ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকে অথবা শিয়া হিসাবে হামদানীদের সঙ্গে যদি তাদের যোগসূত্র থাকে, তবে তারা কেন পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, কেন এক দল অপর দলকে হত্যা করে? আলোপ্পোর অধিকার করার জন্য ওবায়দীদেরকে সৈন্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আবুল ফাজায়েল হামদানী তাদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, রোমানদের সাহায্য গ্রহণ করেন। রোমান বাহিনীর অধিনায়ক হস্তক্ষেপের মূল্য আদায় করে হেমছ এবং শিজার অঞ্চল অধিকার করে নেয়।41 আর কারামেতা সম্প্রদায় মিসরে অভিযান পরিচালিত করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে গোপনে বাহরাইনে তাদের নিজ অঞ্চলে সরে যায়।
এ প্রশ্নের জবাব এই যে, সেকালে যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটানো ছিল সাধারণ ব্যাপার। আশপাশের সম্প্রসারণবাদী দেশগুলোর প্রতিরোধের জন্য শত্রুর কাছ থেকেও সাহায্য নেওয়া হতো। তখন নৈতিক মূল্যবোধ আর মানসিক শক্তি সাহস এমনই নীচে নেমে যায় যে, তারা কোন ধর্মের ধারে কাছেও ছিল না।
ওবায়দী রাষ্ট্র একটা বাতেনী রাষ্ট্র, ফাতেমী নয়। কেবল মাত্র আমাদের নয়, বরং উম্মতের অধিকাংশ আলেমেরই এ মত। যারা তাদের বংশধারা সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন, যারা তাদের অন্তর্নিহিত রহস্য আর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতেন, তাদের বংশধারা সঠিক এবং নির্ভুল হয়ে থাকলে কেন তারা তা খোলাখুলি ব্যক্ত করেনি? তারাতো মিশর, সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার শাসন-কর্তৃত্ব লাভ করেছিল। তখন তাদের ছিল দোর্দন্ড প্রতাপ, অপ্রতিহত শক্তি আর অপ্রতিরোধ্য দাপট। তারা কাদেরকে ভয় পেতো? কেন তারা বলেনি . আমাদের প্রাণ নাশ হতে পারে- এ আশঙ্কায় গোপন আন্দোলন কালে আমরা বংশ ধারা গোপন রাখতে বাধ্য ছিলাম। মিশর বিজেতা তাদের রাজা ইবনে তাবাতাবা, যার উপাধি ছিল আল-মুইয আল- ওবায়দী, শরীফ তাঁকে বংশধারা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তরবারি কোষ মুক্ত করে তিনি জবাব দেন . এটাই হচ্ছে আমার বংশধারা এই বলে তিনি স্বর্ণ ছড়ান। এবার তিনি বলেন; এটাই হচ্ছে আমার বংশ পরিচয়।5 তাদের সম্পর্কে কবি যথার্থই বলেছেনঃ6
إنا سمعنا نسَباًمنكراً يُتلى على المنبر فى الجامع
إن كنتَ فيما تدَّعي صادقاًفاذكر أباً بعدَ الأب الرابع
আমরা শুনতে পাই মিথ্যা বংশের কথা।
মসজিদের মিম্বরে যা পাঠ করা হয়।
তোমার দাবিতে তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকলে,
চতুর্থ পুরুষের পর কে বলদেখি হে!
আন্দালুসিয়ায় উমাইয়া বংশের খলিফা হাকাম ইবনে আব্দুর রহমান নাছের- এর নিকট আযীয ওবায়দী তাকে গাল-মন্দ আর নিন্দা করে লিখেন- গাল-মন্দের জবাবে চারটা কথা বলা আমি যথেষ্ট মনে করি: তুমি আমাদেরকে জান, তাই নিন্দা কর। আমরা তোমাদের জানলে অবশ্যই জবাব দিতাম।7 আরো একটা বিষয় বিবেচ্য। সে পরিবারটি যে নবী কন্যা ফাতেমার পরিবার হবে- তা প্রকৃতিগত ভাবেই অসম্ভব, অবাস্তব- ফাতেমা রা. এর পরিবারের জন্য এবং ইসলামের জন্য এটা হবে দুঃখ আর কলঙ্ক। তাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তির উদ্ভব হবে, যিনি তাদেরকে আসল বংশধারায় ফিরিয়ে নেবেন। তাঁর সত্য উৎস তাকে সত্যের দিকে নিয়ে যাবে। তবে একটা পরিবার সম্পূর্ণরূপে বাতেলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে, তাতো হতে পারে না। মুহাম্মদ ইবনে তুমার্ত এর আহবানে সাড়া দিয়ে মুওয়াহহেদীনরা মরক্কোয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। মুহাম্মদ ইবনে তুমার্ত নিজে মাহদী উপাধি ধারণ করে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সে নিহত ব্যক্তিদের হাড় হাজির করে এবং নানা অলৌকিক কর্মকান্ডের দাবিও উপস্থাপন করে। এরপর তার সঙ্গী এবং তারপরে দ্বিতীয় ব্যক্তি মু'মেনের পরিবার দেশ শাসন করে। আব্দুল মু'মেনের বংশে এমন সব শাসকের উদ্ভব হয়, যারা ইবনে তুমার্ত এর মাহদী আর মাসুম হওয়ার দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে। অতঃপর হাশেমী বংশের উদ্ভব হয় এবং তারা আন্দালুসে শাসন কার্য চালায়। যারা বানু-হামদুন নামে পরিচিত। তাবারিস্তানে বানু হাসান ইবনে যায়েদ শাসন কার্য চালায়। কেউ তাদের বংশধারা অস্বীকার করেনি। ওবায়দিয়ার শাসন কর্তাদের মতো আচরণও তারা করেনি। আমরা এদের এমন সব কর্মকান্ড দেখতে পাই, যাতে তাদের বীভৎস চরিত্র আর উৎকট অন্তরাত্মার পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাবো যে, তারা ছিল মুসলমানদের গলার কাঁটা এবং মু'মেনদের উপর চেপে বসা একটা আপদ। সুলতান সালাহউদ্দীনের হাতে তাদের পতন আর ন্যায়পরায়ণ শাসন নূরুদ্দীনের নির্দেশক্রমে তাদের পতন হলে তখন আর তাদের কোন আলামতই অবশিষ্ট থাকে না .
كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ ﴿২৬﴾ ابراهيم : ২৬
‘‘যেমন নোংরা বৃক্ষ, যাকে মাটির উপর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে এর কোন স্থিতি নেই (সূরা ইবরাহীম : ২৬)
তাদের কর্মকান্ড আর অন্তর্নিহিত রহস্যের কিছু দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করা হচ্ছে .
১. ওবায়দুল্লাহর অপরাধমূলক কর্মকান্ডের একটি হচ্ছে . তার ঘোড়া মসজিদে প্রবেশ করে। তার লোকজনকে বলা হয় . কীভাবে তোমরা মসজিদে ঘোড়া প্রবেশ করালে? জবাবে তারা বলে: তার মল-মূত্র পাক, কারণ, তা মাহদীর ঘোড়া। মসজিদের কর্মকর্তারা এ কথার প্রতিবাদ করলে তাদেরকে মাহদীর দরবারে নিয়ে হত্যা করা হয়। তার সম্পর্কে ইবনুল আসীর বলেন . শেষ জীবনে ওবায়দুল্লাহ এক বীভৎস ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তার গুহ্যদ্বারে কীট দেখা দেয়। এসব একটি একটি অন্ত্র কেটে কেটে খেতে থাকে। মৃত্যু পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে।8 আবু শামা ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে বলেন . সে ছিল খাবীছ যিন্দীক এবং ইসলামের দুশমন। শিয়া ধর্মমতে বিশ্বাসী বলে জাহির করতো। মিল্লাতে ইসলামির বিনাশে সে ছিল আগ্রহী। ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং বিপুল সংখ্যক লোককে সে হত্যা করে। তার সন্তানরাও সেভাবেই গড়ে উঠে। সুযোগ পেলে তারা ঐ রূপ কাজ করতো, অন্যথায় গোপন রাখতো।9
২. মনসুর ইবনে আযীয, যর উপাধি ছিল অ হাকেম বিআমরিল্লাহ, তার নির্দেশে কায়রো শহর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কায়রোর অধিবাসীরা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। শাসনকর্তা ওবায়দ এবং তার সৈন্যদের সঙ্গে ঘোরতর সংঘর্ষ হয়। বাড়ীঘরে আগুন জ্বলে। ফলে হাকেম ওবায়দ প্রতিদিন বের হয়ে এ দৃশ্য দেখে কেঁদে কেঁদে বলতো . ওবায়দদের সঙ্গে এমন আচর করার এ নির্দেশ কে দিয়েছে? সে নিজে বেরিয়ে আসার কথা প্রকাশ করতো, যে সে উভয় পক্ষের মধ্যে বিচ্ছেদ চাচ্ছে।10
আর এসব এমনই তৎপরতা, যা বাতেনীরা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করতোনা। এ ক্ষেত্রে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, আর যাদের রক্তের সঙ্গে বাতেনীদের রক্ত মিশে গেছে। এ যুগের অর্থাৎ হিজরী ১৫শ শতকের কেউ বাতেনীদের এসব কর্মতৎপরতার ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। এ ব্যাখ্যা দিতে গেলে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। লোকেরা অবাক হবে আর বিস্ময় প্রকাশ করবে যে, কীভাবে লেবাননে বাতেনীরা ফিলিস্তিনীদেরকে মার দিচ্ছে। এরপর আবার তারাই ফিলিস্তিনীদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছে। তারাই আবার দুশমনদের সঙ্গে যুদ্ধ করার আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং ফিলিস্তিনী ভূমি মুক্ত করার খায়েশ জাহির করছে! কীভাবে তারা আহলে সুন্নাহকে মার দিচ্ছে এবং জাতীয়তার ধ্বজা উত্তোলন করছে। যারা ইতিহাস অধ্যয়ন করে না, সে সব অবচেতনরা আবার কিনা এসব দাবিতে বিশ্বাসও করছে!
৩. ওবায়দীদের ইতিহাস যারা অধ্যয়ন করেছে, তারা কেবল তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই জানে না। তারা কেবল এতটুকুই জানে যে, অমুক প্রস্থান করেছে আর অমুক তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। ওবায়দীদের সম্পর্কে তারা কেবল এটাই জানে যে, এরা জ্ঞান- বিজ্ঞানকে ভালোবাসে আর তার বিস্তার ঘটায়। এদের উদ্দেশ্য দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ প্রচার করা। যারা আলেমদের জীবনী রচনা আর আলোচনা করেন, তারা ছাড়া একথা আর কেউ বলে না যে, এসব জালিমরা আহলে সুন্নাহর আলেমদের প্রতি হস্ত প্রসারিত করেছে। ওদের রক্তে নিজেদের হস্ত রঞ্জিত করেছে। বরং যেসব ছাত্ররা ইসলামের ইতিহাস পাঠ করে, তারা মাআদ ইবনে ইসমাঈলের কথাও উল্লেখ করে, যার উপাধি ছিল মুইয্ . তা এমন ভঙ্গিতে উল্লেখ করে, যেন সে ইতিহাসের কোন মহান হিরো। যেন সে-ই কায়রো নগরীর পত্তন করেছে এবং আল-আজহারের ভিত্তি স্থাপন করেছে। বরং কায়রোকে তার নামের সঙ্গে যুক্ত করে তারা বলে মুইয্- এর কায়রো। অথচ . সেনাপতি জাওহর মিসরবাসীদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, সুন্নাহর প্রতি অবিচল থাকার জন্য তারা প্রয়োজনে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু সৈন্যরা যখন দেশে প্রবেশ করে শক্ত হয়ে বসে এবং মুইজ কায়রোয় ফিরে আসে, তখন আর এ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হয়নি। বরং তখন ফাতেমীরা মিশরীয়দেরকে উস্কে দিতে ত্রুটি করেনি।11 এই বিশ্বাসঘাতক মুইযই প্রখ্যাত আলেম আবু বকর নাবলসীকে হেস্তনেস্ত করেন, যখন উক্ত আলেমকে মুইজ এর সম্মুখে উপস্থিত করা হয় এবং তাদের মধ্যে নিম্নরূপ কথোপকথন হয়: মুইজ . তুমি না সে ব্যক্তি, যে বলে আমার কাছে দশটি তীর থাকলে নয়টি রোমানদের প্রতি নিক্ষেপ করতাম এবং একটি নিক্ষেপ করতাম মিসরিদের (ওবায়দী) প্রতি?
শায়খ . না, বরং আমি তোমাদের প্রতি নয়টি তীর নিক্ষেপ করতাম আর একটি নিক্ষেপ করতাম রোমানদের প্রতি।
. কেন?
. কারণ তোমরা মুসলিম উম্মার দীনে পরিবর্তন সাধন করেছ, নেককার লোকদেরকে হত্যা করেছ এবং তোমরা আল্লাহর আলোকে নির্বাপিত করেছ।
তখন এ মহান আলেমকে চাবুক মারা হয়। অতঃপর তাঁর গায়ের চামড়া ছিলে ফেলা হয়। অবশেষে তাঁকে হত্যা করা হয়। আর এ কাজটি করে একজন ইহুদি। জালিমদের উপর আল্লাহর লা’নত।
এদের হাতে যেসব আলেমকে জীবন দিতে হয়, বারাকা শহরের কাজি মুহাম্মদ ইবনে হুবলা তাদের অন্যতম। বারাকা শহরের শাসক কাজির নিকট আগমন করে বলে- আগামী কাল ঈদ হবে। কাজি বললেন, চাঁদ না দেখলে ঈদ হবে না। মানুষ রোজা ভাঙবে না। জোরপূর্বক ঈদ করালে পাপের দায়িত্ব বহন করতে হবে তোমাকে। এরপর শাসক ঈদের প্রস্ত্ততি শুরু করে। কাজি বললেন . আমি বের হব না এবং নামাজও পড়াব না। ওবায়দুল্লাহর দৌহিত্র মনসুর ওবায়দী কাজিকে তলব করে বললেন . তুমি পদত্যাগ কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেবো। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলেন। ফলে তাঁকে সূর্যের তাপে দগ্ধ করে শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রৌদ্রের তাপে ছটফট করতে করতে তিনি ইন্তিকাল করেন। পিপাসায় কাতর হয়ে পানি চাইলে তাঁকে পানি পান করাতে অস্বীকার করা হয়। অতঃপর তাঁর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। জালিমদের প্রতি আল্লাহর লা’নত।12
তাদের হাতে নিহত আলেমদের মধ্যে আরেকজন হচ্ছেন ইমাম ইবনুল বারদূন। ইনি আবু ওসমান ইবনুল হাদ্দাদ এর শিষ্য ছিলেন। শিয়া মতাবলম্বী আবু আব্দুল্লাহ তাঁকে হত্যা করে। তাঁকে হত্যার জন্য প্রস্ত্তত করার পর জিজ্ঞাসা করা হয় . তুমি কি তোমার ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করবে? তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন . আমি কি ইসলাম ত্যাগ করব? অতঃপর তাঁকে শূলী বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা আলেম আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন।13
তাঁদের মধ্যে আর একজন ছিলেন ইমাম আবু জা’ফর মুহাম্মদ ইবনে খাইরূন আল-মাগাফিরী। ওবায়দুল্লাহ মাহদীর নির্দেশক্রমে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চরম নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে। এর কারণ তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুজাহিদ। ওবায়দুল্লাহ এবং তার সৈন্যদেরকে তিনি ঘৃণা করতেন।14
ওবায়দীদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে যে সব আলেম অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অপর একজন হচ্ছেন আবুল আরব মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে তামীম আল- মাগরেবী। আবু ইয়াযীদ খারেজীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি অংশগ্রহণ করেন। আহলে সুন্নাহর আলেমগন বলতেন . কাফির ওবায়দীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে আমরা আহলে কিবলা অর্থাৎ খারেজিদের সঙ্গে এক যোগে কাজ করতে পারি।
হাফেজ শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন . ওবায়দ বংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্পর্কে মরক্কোর আলেমগন একমত। কারণ, ঐ আলেমগন ওবায়দীদের মধ্যে স্পষ্ট কুফরি প্রত্যক্ষ করেন, যার কোন ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। এ বিষয়ে আমি অনেক ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। ইতিহাসের সকল ঘটনাই এর স্বপক্ষে মত দেয়। ওবায়দুল্লাহর পুত্র কায়েস এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য অনেক আলেম এবং আবিদ আবু ইয়াযীদ খারেজীর সঙ্গে এক জোট হয়ে বহির্গত হন। তাঁরা বলেন . যারা আহলে কেবলা নয়, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা সকল কেবলা পন্থীরা এক জোট হয়ে কাজ করতে পরি। 15
হিজরী ৩৮১ সালের ঘটনাবলীতে দেখা যায়, জনৈক মিশরীয় ব্যক্তিকে প্রহার করে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। তার অপরাধ এই যে, তাঁর কাছে ইমাম মালেক সংকলিত হাদিস গ্রন্থ মুয়াত্তা পাওয়া গেছে।16 বিশিষ্ট তার্কিক এবং আলেম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল- হাজবী বলতেন . আরবের জালিম বর্বররা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কায়রোয়ান, তিউনিসিয়া এবং আলজেরীয়ার অনেক অঞ্চলে মালেকি মাজহাব প্রচার হতে পারেনি। ফাতেমীরা এসব বর্বরকে মিশর থেকে বিতাড়িত করে যেন তাদেরকে আজাবের ঘোড়ার মতো চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এসব বর্বররা ৪৪৯ হিজরীতে কায়রোয়ান শহর ধ্বংস করে সেখান থেকে আলেম দেরকে নির্বাসিত করে। অনেকেই তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।17
ওবায়দীদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং কারামেতাদের সঙ্গে যোগসূত্র
যেসব গ্রন্থকার, মুহাদ্দেসীন ওবায়দী রাষ্ট্র সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁরা কেবল তাদের রাজনৈতিক জীবন চরিত লিপিবদ্ধ করেছেন। কাছে বা দূরে থেকে তাদের শাসকদের জঘন্য বিশ্বাস সম্পর্কে তারা কোন আলোচনাই করেননি। তাঁরা একথাও বলেন না যে, তারা আসলে ছিল বাতেনী সম্প্রদায়ের লোক, যদিও তারা তা অস্বীকার করতো। কারণ, যে জাতিকে তারা শাসন করতো, তাদের সম্মুখে তারা ‘তাকিয়া’ নীতি প্রয়োগ করতো। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ওবায়দীদের সর্বশেষ শাসক আল- আযেদ-এর উপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করার ব্যাপারে আলেম সমাজের নিকট ফতোওয়া তলব করেন। তাকে হত্যা করা জায়েয হবে বলে আলেমগন ফতোওয়া দান করেছেন। কারণ, আযেদ এবং তার সঙ্গী-সাথীদের আক্বীদা-বিশ্বাসে বিকৃতি-বিচ্যুতি ঘটেছিল। এ ফতোওয়া দানে শায়খ নাজমুদ্দীন খাবুশানী ছিলেন অত্যন্ত কঠোর নীতির লোক। তিনি এদের এক একটি কুকীর্তি শুমার করে তাদের ঈমান-ই নেই বলে মত প্রকাশ করেন।18
তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান বলেন . আযেদ ছিল চরমপন্থী শিয়া। সাহাবায়ে কেরামের নিন্দাবাদে সে ছিল অত্যন্ত কঠোর নীতির অনুসারী। কোন সুন্নী মতাবলম্বীকে দেখতে পেলেই তার রক্ত হালাল বলে মনে করতো।19 নাস্তিক কারামেতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে এদের ছিল গভীর সম্পর্ক। উভয় সম্প্রদায়ের আহবান আর প্রচারের মূল সূর ছিল এক ও অভিন্ন। মিশর দুর্গ অবরোধের খবর শুনে ফাতেমী খলিফা মুইজ কারামেতাদের নিকট পত্র প্রেরণ করে। এতে সে নিজের ফজিলত আর কৃতিত্ব বর্ণনার পাশাপাশি নিজের পরিবার-পরিজনেরও কৃতিত্ব বর্ণনা করে বলে যে, কারামেতা আর আমাদের মূল আহবান এক ও অভিন্ন। কারামেতারা এ আহবানই জানিয়ে আসছে বলেও সে উল্লেখ করে।20 ইমাম শাতেবী বলেন . ওবায়দীয়াদের মুইদ হচ্ছে অন্যতম দাজ্জাল। এরা আফ্রিকার শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। এদের সম্পর্কে কথিত আছে যে, এরা মুয়াযযিনকে আশহাদু আন্না মুইদ্দান রাসূলুল্লাহ অর্থাৎ ‘‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুইদ আল্লাহর রাসূল’’ বলতে বাধ্য করে। মুসলমানরা সে মুয়াযযিনকে হত্যা করতে উদ্যত হলে মুইদ তাকে এ নির্দেশ দিয়েছে কিনা, তা প্রমাণ করার তাকে মুইদের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কথা পেশ হলে সে বলে . তাদের প্রতি আজান ছুঁড়ে মার। তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক।21
আবু তাহের কারামেতী পবিত্র মক্কা নগরীতে অশ্লীল অপকর্ম চালাতে উদ্যত হলে ওবায়দুল্লাহ মাহদী সে সম্পর্কে জানতে পেরে তার ঐ উদ্যোগের নিন্দা করে তাকে লিখে . তুমি যা কিছু করেছ, তার দ্বারা তুমি আমাদের দল আর আমাদের রাষ্ট্রের প্রচারকদের উপর কুফরি ও নাস্তিক্যবাদী নাম আরোপ করলে, আমাদেরকে কাফের এবং নাস্তিক বলে প্রমাণ করলে22 বাগদাদে বাতেনীদের ধর-পাকড় শুরু হলে জনৈক কারামেতী বলে . মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে জা’ফর ছাদেক আমাদের ইমাম। তিনি মাহদী। মরক্কোয় তিনি অবস্থান করছেন।23
হিজরী ৪১৪ সালের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে জানা যায় যে, মিসরে ওবায়দী শাসকদের একজন ভারী অস্ত্র দ্বারা হাজরে আসওয়াদে আঘাত হানতে থাকে। তার অপর হাতে ছিল তরবারি এবং সে বলছিল . হাজরে আসওয়াদ, মুহাম্মদ এবং আলীর কত কাল ধরে পূজা চলবে? ইয়া মানের জনৈক হাজি তার এসব কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং ফলে খঞ্জর দ্বারা তাকে খুন করেন।24
তাদের সম্পর্কে এটাই হচ্ছে আসল কথা। রিসালাত আর নবী- রাসূলদের প্রতি তাদের ঈমান নেই। তাদের আহবানে বিশ্বাসী জনৈক ব্যক্তির বক্তব্য থেকে এ কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের দিকে দিকে হাশাশী সম্প্রদায়ের লোকেরা যে সন্ত্রাস আর ভয়-ভীতির বীজ বপন করে, তা ছিল মিসরে ইসমাঈলী ওবায়দীদের কর্মকান্ডের ফল। মিসরে আল-মাওত দুর্গের নেতা হাসান সাববাহ, আলেম -ওলামা, ওমারা আর মুজাহিদদের হত্যা করার জন্য যে লোক প্রেরণ করতো, মিসরে ওবায়দীদের হাতেই সে এ দীক্ষা গ্রহণ করে। এই হাশাশী সম্প্রদায়ের লোকেরাই আলেম - ওলামাদেরকে হত্যা করে, যাদের সম্পর্কে পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। আর শাম দেশে দুরূজ আন্দোলনও ওবায়দী শাসকদের কর্মকান্ডের ফল। ওবায়দী শাসকদেরকে তারা খোদা মনে করে। এরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। এদের রাজনৈতিক ভূমিকা কলঙ্কময়। উক্ত অঞ্চলে রাজনীতি সম্পর্কে ব্রিটেন ছিল তাদের প্রতি আস্থাবান। ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের দুরূজ গ্রুপের রয়েছে ঘনিষ্ঠ এবং গভীর সম্পর্ক। এমনকি এ সম্পর্ক উল্লেখ করার জন্য দুরূজ গ্রুপের কোন কোন লেখক ব্যাকুল হয়ে উঠে। আর তাদের সম্পর্ক স্থাপনকে বৈধতা দেয়ার জন্যও তারা প্রচেষ্টা চায়।25 বর্তমানের সঙ্গে অতীতের যোগসূত্র প্রমাণ করার জন্য আমরা এখানে তাদের কেবল একটা ভূমিকার উল্লেখ করব, ১৯৮২ সালে ইসরাঈল দক্ষিণ লেবাননে হামলা চালিয়ে বৈরুত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুন্নীণ মুসলমানরা এ হামলার প্রতিবাদ করে এবং তাদের যা অস্ত্রশস্ত্র আছে, তা দিয়ে প্রতিরোধ করে। কিন্তু দুরূজ গ্রুপ আদৌ কোন প্রতিরোধের চেষ্টাই চালায়নি। ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার জনৈক নেতা স্পষ্ট বলেন . শেষ যুদ্ধে দুরুজরা কোন চেষ্টাই চালায়নি, অথচ তাদের হাতে ছিল উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্র।26 কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরাইলী সৈন্যদের একটা দল শাওফ অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দুরূজ গ্রুপের নেতা মুহাম্মদ আবু শোকরা জনৈক মার্কিন সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন . ইসরাইলী সৈন্যরা দুরূজদের ছিনিয়ে নেয়া অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে।
তাদের মন্ত্রী বর্গ
শাসনকার্য পরিচালনায় ওবায়দীরা, ইহুদি-নাছারা এবং চরমপন্থী শিয়াদের সহায়তা গ্রহণ করে। তাদের একজন প্রসিদ্ধ মন্ত্রী এয়াকুব ইবনে কালস ছিল ইহুদি বংশদ্ভুত। বদর জামী এবং তার পুত্র আকম ছিল একজন শিয়া। তাদের রাষ্ট্রে এটাই ছিল বৈশিষ্ট্য। এজন্য কেউ তাদেরকে ঈর্ষা করতোনা। আসলে তারা মুসলিম জাহান গ্রাস করার পরিকল্পনা আঁটে। এ ক্ষেত্রে তাদের কাছে মাধ্যমের কোন গুরুত্ব ছিল না। কার কাছে থেকে সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, তা দেখতো না তারা। যেমন সাম্প্রতিক কালে আমরা খোমেনী এবং তার দলকে দেখতে পাই।
এদের কয়েকজন মন্ত্রী সম্পর্কে নমুনা স্বরূপ কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে।
১. ইয়া’কুব ইবনে কালস
আজীজ উপাধি ধারী নেযারের শাসনামলে ইয়াকুব ছিল প্রথম মন্ত্রী। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনে আসাকের বলেন .
বাগদাদের বাসিন্দাদের মধ্যে সে ছিল একজন খাবীছ ইহুদি। ধুরন্ধর এ লোকটি অনেক চালাকি জানতো। কাফুর আখশীদির শাসনামলে সে মিসরে আগমন করে। তার মধ্যে পাকা বুদ্ধিমত্তা লক্ষ্য করে কাফুর বললেন . লোকটি যদি মুসলমান হতো তাহলে তার মন্ত্রী হতে পারত। এ কথা শুনে তার মধ্যে মন্ত্রী হওয়ার লোভ সৃষ্টি হয়। আর এ লোভেই সে মুসলমান হয়। উজির ইবনে খানজাবা তার মতলব বুঝতে পারেন। তিনি এ মতলববাজ লোকটাকে পাকড়াও করতে মনস্থ করেন। ধুরন্ধর লোকটা তা টের পেয়ে মরক্কোর দিকে পালিয়ে যায়। সেখানে সে কিছু ইহুদির সঙ্গে যোগ দেয়, যারা এক সময় মুইজ এর সঙ্গী ছিল। দুর্দিনে এরা মুইজ-এর জন্য টাকা কড়ি খরচ করে, তার জন্য অনেক পথ উন্মুক্ত করে, শাসক হওয়ার সুন্দর উপায় বের করে এবং তার সঙ্গে মিসরে আগমন করে।27 তার মৃত্যুতে শাসক আজীজ বেশ ব্যথিত হয়। ইবনে কালস এত বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ আর মণি-মাণিক্য ছেড়ে যায়, যার বর্ণনা দেয়া অসম্ভব।28 ঐতিহাসিকরা বলেন- সে মুসলমান হয়েছিল। তার অর্থ সে ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে ইসমাঈলী মতাদর্শে দীক্ষিত হয়েছি। আর এ ইসমাঈলী ধর্মমত ছিল তার গুরুদের ধর্ম। এটা কোন ইসলাম?
২. ঈসা ইবনে নাসতূরাস নাছরানী
ইবনে কালসের পর ঈসা ইবনে নাসতুরাস বাদশাহ আজীজের উজির হয়। এ সময় তার স্ব গোত্রীয় খ্রিস্টানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে মুসলমানরা চিৎকার জুড়ে দেয়। ইহুদিদেরকেও সে সহায়তা করে। ইহুদি মিনসাকে সে নিজের প্রতিনিধি করে সিরিয়ায় প্রেরণ করে। মিসরবাসীদের এ অভিযোগ শাসক আজীজের নিকট পৌঁছাবার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করে। তারা এক খন্ড কাগজের টুকরায় লিখে রৌপ্যের মূর্তির হাতে স্থাপন করে। তাতে লেখা ছিল . যিনি মিনসা দ্বারা ইহুদিদেরকে এবং ঈসা ইবনে নাসূতরাস দ্বারা খ্রিস্টানদেরকে সম্মানিত করেছেন, তার শপথ, আর শপথ তার, যিনি তোমার দ্বারা মুসলমানদেরকে অপদস্ত করেছেন। আর সে মূর্তিটাকে স্থাপন করে রাখে বাদশাহ আজীজের পথে। বাদশাহ আজীজ দেখে তা যে মূর্তি, সে কথা বুঝতে পারেনি। মূর্তির হাত থেকে পত্রটি তুলে নিয়ে তা পাঠ করে দেখে। এরপর কিছু দিন উযীরকে দূরে রাখে। পরে বাদশাহের কন্যার সুপারিশে তাকে পুনরায় কাছে ফিরিয়ে আনে।29
৩. শাসক ইবনুল আজীজ এর শাসনামলে (৩৮৬-৪৪১ হি:)
শাসক ইবনুল আজিজ হুসাইন ইবনে জাওহারকে সর্বময় কর্তা নিযুক্ত করে আর রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব তার হাতে ন্যস্ত করে। আর হুসাইন ইবনে জাওহার ফাহাদ ইবনে ইবরাহিম খ্রিস্টানকে তার সহকারী নিযুক্ত করে। এই হাফেজের শাসনামলে মনসুর ইবনে আবদুন নামে জনৈক খ্রিস্টান উজিরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। ইতিপূর্বে সে সিরিয়ায় একটা দফতরের দায়িত্বে ছিল। ইবনে ফানেস তার পরিচয় দিয়ে বলে . সে ছিল একজন ভীষণ খাবীছ লোক।30 এই হাকিমের শাসনামলে জুরয়া ইবনে ইসা ইবনে নাসরাস এবং ছায়েদ ইবনে ঈসা ইবনে নাসতূরাসকেও মন্ত্রীর পদে নিয়োজিত করা হয়।
৪. মুস্তানসিরের শাসনামলে (৪২৭-৪৮৭ হি:)
তার শাসনামলে ছাদকা ইবনে ইউসুফ আল ফালাহী মন্ত্রিত্ব লাভ করে, যে ছিল একজন ইহুদি। সে ইসমাঈলী ধর্মমত গ্রহণ করে। হিজরী ৪৩৬ থেকে ৪৩৯ সন পর্যন্ত মন্ত্রীপদে বহ ছিল। তার সময়ের প্রসিদ্ধ উজিরদের অন্যতম হচ্ছে বদর জামি। সেও ছিল একজন শিয়া মতাবলম্বী।
৫. মুস্তা’লী এবং আমের এর শাসনামল
এ যুগে মন্ত্রিত্ব লাভ করে বদর জামির পুত্র আফজ। তার সময়ে খলিফার মাতার প্রাসাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে জনৈক ইহুদি। ফলে ইহুদিদের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং রাষ্ট্রীয় পদে ইহুদিদেরকে নিযুক্ত করা হয়।31 আর ইংরেজরা আন্তাকিয়া (এন্টিয়ক) শহরে প্রবেশ করলে এই আফজ তাদের নিকট সিরিয়াকে বিভক্ত করার প্রস্তাব পেশ করে। ফলে উত্তর সিরিয়া অধিকার করে নেয় ইংরেজরা, আর মিশর করায়াত্ত করে ফিলিস্তিন।32 কিন্তু পরবর্তীকালে প্রকাশ পায় যে, তার এ প্রস্তাব কোন সুফল বহন করে আনেনি। কারণ ক্রুসেডারদের প্রধান টার্গেট ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। ফলে ৪৯১ হিজরীতে বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার করে নেয়। আমরা দেখতে পাই যে, এ সময় সুন্নীণ উজির ইবনুস সার ক্রুসেডারদের প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন ফেরত দানের ব্যাপারে নূরুদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা চালায়। এ সময় তাদের উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ছিল আমির উসামা ইবনে মুনকেয আল-কেনানী। তখন ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সুন্নীণ উজির ইবনুস সালার নৌবহর প্রস্ত্তত করেন। এজন্য তিনি তিন লক্ষ দীনার ব্যায় করেন।33
হাফেজের শাসনামলে ৫২৪-৫৪৪ হিজরীতে বাহরাম আরমানী উজির হন। হাফেজ তাকে সাইফুল ইসলাম এবং তাজুল খেলাফত উপাধি দান করেন। অথচ সে ছিল একজন ইহুদি। সে ইসলাম গ্রহণ করেনি। তাদের শেষ দিকের মন্ত্রীদের মধ্যে ছিল ‘তায়ে ইবনে রুজেক’, যে ছিল একজন আর্মেনীয় শিয়া।
তারা কি বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষা করেছে?
ক্রুসেডাররা যখন বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে তখন ফাতেমী খলিফা মুস্তা’লীর উজির আফজ জামী ছিল সেনা প্রধান। বায়তুল মুকাদ্দাস হেফাজত করা ছিল তার দায়িত্ব। ক্রুসেডাররা যখন বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে রাখে, তখন তারা যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। ফলে ইংরেজরা অতি সহজে তা অধিকার করে নেয়। এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লেকান বলেন . তখন বায়তুল মুকাদ্দাস যদি সিরিয়ার তুর্কি শাসকদের অধীনে থাকত, তাহলে মুসলমানদের জন্য তাই-হতো কল্যাণকর।34 ‘শাওর’ ক্রুসেডারদের সাহায্য কামনা করে। সুলতান সালাহউদ্দিন যখন মিশর অধিকার করেন এবং ওবায়দীরা যখন শাসন-ক্ষমতা হারায় তখনও অবশিষ্ট ওবায়দীরা শাসন ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য একমত হয়ে কাজ করে। তারা সিসিলির ইংরেজদের সহায়তা কামনা করে তাদের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করে। কিন্তু ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেয়ে যায় এবং ষড়যন্ত্রের বড় হোতা নিহত হয়।35 তবে কি বাতেনীদের হাতে সর্বদা মুসলমানরা পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, যারা আল্লাহর দুশমনদের হাতে দেশ তুলে দেয়? এরপরও মুসলমানরা এ জঘন্য আচরণের কথা ভুলে যায়। এরা মুসলমানদেরকে জাতীয়তা আর গণ স্বার্থের কথা বলে এখনও কি ধোঁকা দেবে?
রাষ্ট্র কি নিরপেক্ষ ছিল?
কোন কোন ঐতিহাসিক লেখক লিখেন যে, ওবায়দী রাষ্ট্র তাদের ইসমাঈলী ধর্মের ক্ষেত্রে গোঁড়া ছিল না। তারা একথা লিখেন যে, ওবায়দীরা শক্তি প্রয়োগ করে তাদের বাণী প্রচার করেনি। কিন্তু আসল সত্য এর বিপরীত। আসলে ওবায়দী রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা তাদের ধর্ম প্রচার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছে। তারা প্রচার কার্য আর প্রচারকদের যথাযথ আয়োজন করে। এ জন্য যথারীতি একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ইসমাঈলী ধর্মমত প্রচার আর তা সংগঠিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট স্বীকার করেছে উজির ইবনে কালস। তার চেষ্টা আর উদ্যোগে জামেয়া আযহারে একটা সুসংগঠিত পাঠ দানের ব্যবস্থা গড়ে তো হয়। জামেয়া আযহারে উজির ইবনে কালসকে শিক্ষা দানের জন্য এক দল ফকীহ নিযুক্ত করা হয়।36 এসব প্রচারকদের উপরে ছিল নকিব বা প্রধান। এদের সকলের উপর ছিল আরো বড় একজন কর্মকর্তা। তাকে রাষ্ট্র প্রধান আর ধর্মমতের অনুসারীদের যোগসূত্র বলে মনে করা হতো। সমস্ত রাষ্ট্রীয় ফকীহ আর প্রচারক এ প্রধান কর্মকর্তার অধীনে থাকতো। ধর্মের মূলনীতি বিষয়ে এদের রচিত নিবন্ধ সে প্রধান কর্মকর্তার নিকট উপস্থাপন করা হতো।37 প্রধান প্রচারক কাজি নোমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মনসুর নিজে মালেকী মাজহাবের অনুসারী হলেও এদের জন্য গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের ধর্মমত প্রচারে সহায়তা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বাতেনী ধর্মমত গ্রহণ করেন। এমনকি হানাফি, মালেকি এবং শাফেয়ি মাযহাবের38 বিরুদ্ধে তিনি গ্রন্থও রচনা করেন। আর দ্রুজদের প্রচারকরা সিরিয়া দেশের ওয়াদী মতী অঞ্চলে আরবদের মধ্যে তাদের প্রচার কার্য চালায়। হাসান ইবনে সাববাহ- এর মতো এরা ভীতি আর সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে মুসলিম বিশ্বে। তাদের আহবান আর আন্দোলনের প্রভাব এমনই ছিল যে হালব বা আলোপ্পোর শাসক মাহমুদ ইবনে ছালেহ ইবনে মিরদাস ওবায়দীদেরকে বাদ দিয়ে বনু আববাস এবং সেলজুকদের নামে খুতবা পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে আলোপ্পোর সাধারণ মানুষ এ উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করে। তার এর বিরুদ্ধে মসজিদে যা কিছু পাওয়া যায়, তা হাতে নিয়ে বলে . এগুলোতো আলী ইবনে আবু তালিবের চাটাই। আবু বাহর অন্য চাটাই নিয়ে আসুক, যার উপর মানুষ নামাজ পড়বে। দামেশকে যখন তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় তখন তারা দিকে দিকে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ বলে আজান দেয়া হয়। আবু বকর (রা:) এবং ওমর (রা:) কে গালিগালাজ করে নানা কথা মসজিদের দরজায় লেখা হয়। তুর্কি এবং কুর্দী শাসকদের শাসনামলে পরিবর্তন সাধনের পূর্ব পর্যন্ত তা বহ ছিল।39
হাফেজ শামসুদ্দীন আ্য-যাহাবী তাদের সাধারণ সৈন্যদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, তারা ছিল মন্দের মূল আর বদমেজাজি। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা যিন্দীক ছিল, তারা ছিল মন্দের এক শেষ। মুসলমানরা তাদের দ্বারা হত্যা, গালমন্দ আর ছিনতাইয়ের শিকার হয়। এমনকি ‘সূর’ অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের জুলুম নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রোমের খ্রিস্টানদের সহায়তা কামনা করেছিল। তারা রাস্তাঘাট আর হাম্মামখানা থেকে নারীদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যোতো।40 মিসরে আহলে সুন্নাহর আলেমদের ওপর এসব নির্যাতন কখনো কিছুটা হ্রাস করা হতো, যখন তারা প্রত্যক্ষ করতো যে, মরক্কোর আলেমদের উপর তাদের এসব নির্যাতন ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ তারা মনে করতো যে, নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক তাদেরকে বাতেনী ধর্মে দীক্ষিত করার সাধ্য তাদের রয়েছে।
ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর ওবায়দীয়া রাষ্ট্রের শাসকদের সম্পর্কে বলেন যে, চরিত্রের দিক থেকে তারা ছিল সবচেয়ে অপবিত্র শাসক। আর অভ্যন্তরীণ রীতি-নীতির বিচারে এরা ছিল সবচেয়ে খাবীছ। তাদের শাসনামলে বেদআত আর অন্যায়-অশ্লীলতা দেখা দেয়। সন্ত্রাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সৎ আলেমদের সংখ্যা হ্রাস পায়। শাম দেশে খ্রিস্টান, দ্রুজ আর হাশিমী সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সাহেলী অঞ্চলে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।
এখানে একটা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, এসব ওবায়দী যদি কারামেতাদের মতো একই ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকে অথবা শিয়া হিসাবে হামদানীদের সঙ্গে যদি তাদের যোগসূত্র থাকে, তবে তারা কেন পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, কেন এক দল অপর দলকে হত্যা করে? আলোপ্পোর অধিকার করার জন্য ওবায়দীদেরকে সৈন্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আবুল ফাজায়েল হামদানী তাদের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, রোমানদের সাহায্য গ্রহণ করেন। রোমান বাহিনীর অধিনায়ক হস্তক্ষেপের মূল্য আদায় করে হেমছ এবং শিজার অঞ্চল অধিকার করে নেয়।41 আর কারামেতা সম্প্রদায় মিসরে অভিযান পরিচালিত করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে গোপনে বাহরাইনে তাদের নিজ অঞ্চলে সরে যায়।
এ প্রশ্নের জবাব এই যে, সেকালে যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটানো ছিল সাধারণ ব্যাপার। আশপাশের সম্প্রসারণবাদী দেশগুলোর প্রতিরোধের জন্য শত্রুর কাছ থেকেও সাহায্য নেওয়া হতো। তখন নৈতিক মূল্যবোধ আর মানসিক শক্তি সাহস এমনই নীচে নেমে যায় যে, তারা কোন ধর্মের ধারে কাছেও ছিল না।
পারস্যের দাইলামী বংশের বুয়াইহ ইবনে ফান্না খসরুর নামানুসারে এ সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়। এক শতাব্দীরও বেশি কাল এরা ইরাক আর পারস্যে শাসনকার্য চায়। এদের মোকাবিলায় বাগদাদের আববাসীয় খলিফারা যে দুর্বলতার প্রদর্শন করে, এদের সামনে তারা তার চেয়েও বেশি দুর্বল প্রমাণিত হয়। সে যুগের অন্য কোন পরিবার থেকে এ পরিবার ভিন্ন ছিল না। স্বৈরশাসন আর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিকৃতি- বিপর্যয়ের বিচারে তাদের মধ্যে এ ঐক্য ছিল। যদিও বুয়াইহী রাষ্ট্রের দু’জন প্রতিষ্ঠাতা আলী ইবনে বুয়াইহী এবং হাসান ইবনে বুয়াইহীর মধ্যে নেতৃত্ব, ধৈর্য আর সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতার গুণাবলি ছিল। কিন্তু তাদের দ্বিতীয় আর তৃতীয় পুরুষের মধ্যে ছিল কঠোরতা এবং শিয়া ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে আমরা দেখতে পাব যে, তারা কি ইসলামি সংস্কৃতিতে কোন অবদান রেখেছে? নাকি তারা শিয়াদেরই প্রতিধ্বনি করেছে, যাদের পতন আরো বিকৃত করে তুলেছিল নীতি আর কাঠামোকে।
এক নজরে তাদের ইতিহাস
ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বুয়াইহী এর সন্তান আলী হাসান এবং আহমদের উদ্ভব হয় তাদের কীর্তিমান পুরুষ আলীর উদ্ভবের মধ্য দিয়ে। যার উপাধি ছিল ইমাদুদ্দৌলা। এটা হিজরী ৩২১ সনের কথা। মারদাবীজ নামক জনৈক দাইলামী শাসকের পক্ষ থেকে সে ছিল ‘কারাজ’ নামক একটা ক্ষুদ্র অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত শাসনকর্তা। লোকজনের সঙ্গে সে সদাচার করতো, সদয় ব্যবহার করতো। ফলে আশপাশের দেশগুলোতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সকলে তাকে ভালোবাসতো শুরু করে তার বশ্যতা স্বীকার করে। এ ব্যাপারে তার ভাইয়েরা সহায়তা করে। ফলে সে পারস্য অঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। হিজরী ৩৩৪ সনে আহমদ ইবনে বুয়াইহী বাগদাদে অভিযান পরিচালনা করে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই বাগদাদে প্রবেশ করে, ফলে বাগদাদে বনী বুয়াইহীর কর্তৃত্বে আসে। খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং খলিফার উপাধি ধারণ করে আহমদের উপাধি হয় মুইজ্জুদ্দৌলা। তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে ২০ বৎসরেরও বেশি সময় সে ইরাকের শাসনকর্তা ছিল। হিজরী ৩৫৬ সনে তার মৃত্যু হয়। হাসান ইবনে বুয়াইহ রুকমুদ্দৌলা উপাধি ধারণ করে ইসফাহান, তাবারিস্তান এবং জুরজান শাসন করে এবং তাদের বড় ভাই ইমাদুদ্দৌলা শাসন করে শিরাজ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।। তবে বড় ভাইই ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর, যার কথা তারা সকলে শ্রবণ আর মান্য করতো। হিজরী ৩৩৮ সনে তার মৃত্যু হয়।
বুয়াইহীদের শিয়া ধর্মমত গ্রহণ
বুয়াইহীরা তাদের শিয়া ধর্মমত গোপন রাখেনি। বরং আহলে সুন্নার অনুসারীদের উপর নির্যাতনমূলক কর্ম তৎপরতা পরিচালনার জন্য তারা বাগদাদে তাদের ধর্মানুসারিদেরকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। তখন এমন কোন বৎসর যেতোনা যে শিয়া-সুন্নীণদের মধ্যে সংঘাত ঘটতো না। এতে অনেক প্রাণহানি ঘটতো, অনেক সম্পদ ধ্বংস হতো। বাড়ি-ঘর আর হাট-বাজারে অগ্নি সংযোগ করা হতো। ৩৫১ হিজরী সনের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানা যায় যে, বাগদাদের শিয়ারা মুইজ্জুদ্দৌলার নির্দেশক্রমে মুয়াবিয়া এবং তিন খলিফাকে লা’নত বর্ষণের নির্দেশ দেয় মসজিদগুলোর প্রতি। কিন্তু আববাসী খলিফার এটা রোধ করার ক্ষমতা ছিল না।1 হিজরী ৩৫২ সনের ঘটনাবলীতে দেখা যায়, মুইজ্জুদ্দৌলা হাট- বাজার, দোকান-পাট আর কেনা-বেচা বন্ধ করে আশুরা উপলক্ষ্যে শোক পালন করার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেয়। মাথার চুল উন্মুক্ত করে চেহারা কালো করে নারীদেরকে রাস্তায় রাস্তায় মাতম করার নির্দেশ দেয়। হুসাইন ইবনে আলীর জন্য তাদেরকে বুক চাপড়াতে হবে, চেহারায় চপেটাঘাত করতে হবে। ফলে লোকেরা তাই করে। সুন্নীণরা এটা রোধ করতে পারেনি। কারণ শিয়াদের সংখ্যা ছিল বেশি এবং শাসক শ্রেণি ছিল তাদের সঙ্গে।2
হিজরী ৩৯৮ সনের ঘটনাবলীতে দেখা যায় . বাগদাদে শিয়া-সুন্নীণ দাঙ্গা দেখা দেয়। একে অপরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। শিয়ারা আবু হামেদ ইসফারাইনী এবং ইবনুল আকাফানীকে গালমন্দ করে হত্যা করতে উদ্যত হলে তারা পলায়ন করে।3 হিজরী ৪০৭ সনে শিয়া আর সুন্নীণর মধ্যে ওয়াসেত শহরে এক বড় ধরনের লড়াই বাধে। এতে সুন্নীণরা জয়ী হয়। আর নাম করা শিয়ারা আলী ইবনে মাযীদের নিকট পলায়ন করলে তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন।4
আযদুদ্দৌলা (ফানা খসরু) যিনি ছিলেন রুকনুদ্দৌলার পুত্র, তিনি অঢেল সম্পদ ব্যয় করেন। মাশহাদে মাজার নির্মাণ কাজে তিনি সৈন্যদেরকে ব্যবহার করেন।5
খলিফাদের নিন্দা
বুয়াইহীরা খেলাফতের ভীতি দূর করার ব্যাপারে তুর্কিদের নীতি অনুসরণ করে। তারা এমন নীতি অনুসরণ করে, যার ফলে মনে হয় যেন খেলাফতের অস্তিত্ব নেই। এ থেকে তারা প্রমাণ করতে চায় যে, তারা নাগরিক অনুভূতি থেকে দূরে। তবে তাদের অন্তরে সুন্নাহর প্রতি বিদ্বেষ ঠিকই আছে। তারা মনে করতো যে, আববাসীয়রা জোর পূর্বক খেলাফত অধিকার করে নিয়েছে। এ কারণে মুইজ্জুদ্দৌলা যোগ্য অধিকারী অর্থাৎ অর বংশধরদের জন্য খেলাফত ছিনিয়ে নেয়া এবং মিসরে ওবায়দী শাসক মুইয এর জন্য বাইয়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে তার সভাসদদের পরামর্শ চায়। তার জনৈক সভাসদ বলে . আমি এ মত সমর্থন করি না। কারণ আজ তুমি এমন খলিফার সঙ্গে আছ, যার সম্পর্কে তোমার এবং তোমার সভাসদদের বিশ্বাস এই যে, সে খেলাফতের যোগ্য নয়। তুমি যদি তাদেরকে হুকুম দাও খলিফাকে হত্যা করার জন্য, তাহলে অবশ্যই তারা তা করবে। আর তুমি যদি কোন আলাবীকে খলিফার আসনে বসাও তবে তুমি এবং তোমার সভাসদরা যার খেলাফতকে বৈধ বলে মনে কর, সে তোমার সঙ্গে থাকবে। সে যদি তোমাকে হত্যা করার জন্য তাদেরকে হুকুম দেয়, তবে অবশ্যই তারা তা করবে।6 মুইজ্জুদ্দৌলা এ মতকে ভালো মনে করে এবং তার চিন্তাধারা ত্যাগ করে।
বাহাউদ্দৌলার সম্পদ হ্রাস পেলে তার উজির তাকে খলিফার পদ গ্রহণের পরামর্শ দেয় এবং তাকে সম্পদের লোভ দেখায়। ফলে বাহাউদ্দৌলা খেলাফত প্রাসাদে প্রবেশ করে খলিফাকে খেলাফতের আসন থেকে হটিয়ে দেয়। খলিফা অনেক ফরিয়াদ করে। কিন্তু কেউই সেদিকে কর্ণপাত করেনি। তারা খলিফার প্রাসাদে যা কিছু পায় লুঠপাট করে নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়।7 তার পূর্বসূরি মুইজ্জুদ্দৌলা বুয়াইহী মুস্তাকফীকে অপমান করত: পাগড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলার জন্য সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেয়। অতঃপর হুকুম দেয় তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার জন্য। মৃত্যু পর্যন্ত সে কারাগারেই কাটাবে।8
তাদের মন্ত্রী- উজির
ওবায়দীদের মন্ত্রী ছিল ইহুদি- খ্রিস্টান, অনুরূপ বুয়াইহীদের উজির ছিল খ্রিস্টান। আসদুদ্দৌলার শাসনামলে (ফান্না খসরু ইবনুল হাসান ইবনে বুয়াইহ) তার উজির ছিল নসর ইবনে হারুন। আযদুদ্দৌলা তাকে গির্জা নির্মাণের নির্দেশ দেয় এবং গরিব খ্রিস্টানদের জন্য সে সম্পদ উজাড় করে দেয়।9
বুয়াইহী আর কারামেতাদের সম্পর্ক
যারা বিচ্ছিন্ন আর বিক্ষিপ্তভাবে ইতিহাস অধ্যয়ন করে, তারা হয়তো না জানতে পারে যে, বাতেনী আন্দোলন এবং শিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে এসব আন্দোলনের কি সম্পর্ক রয়েছে। সেসব আন্দোলন সম্পর্কে তারা সতর্ক এবং সচেতনও হবে না। তারা এ কথাও মনে করতে পারে যে, প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বয়ং সম্পূর্ণ; অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। অনুরূপভাবে বর্তমান কালের অমনোযোগিরাও মনে করতে পারে। বাতেনী আর রাফেযী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, তারা তা দেখতে পায় না। আর কোন সম্পর্ক থেকে থাকলেও তাদের মতে তা সাময়িক রাজনৈতিক কারণে থাকবে। এসব অমনোযোগী ব্যক্তিরা আরো বলে যে, যে সব শিয়া ছাত্র ইউরোপে পড়ালেখা করে, তারা তাদের দেশের শিয়াদের মতো নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি ইতিহাস অধ্যয়ন করে এবং বর্তমান অধ্যয়ন করে উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করবে, সে হয়তো উভয়ের মধ্যে ভূমিকার ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখতে পাবে না।
হিজরী ৩৬০ সনের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানা যায় যে, এ বৎসরের জিলকদ মাসে কারামেতারা দামেশকে চড়াও হয়ে জা’ফর ইবনে ফালেহকে হত্যা করে, যিনি ছিলেন দামেশকে অস্থায়ী খলিফা। তখন কারামেতাদের নেতা ছিল হোসাইন ইবনে আহমদ ইবনে বাহরাম। আর বাগদাদ থেকে মুইজ্জুদ্দৌলা অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রচুর সৈন্য- সামন্ত দিয়ে তাকে মদদ জোগায়।10
হিজরী ৩৭৪ সালের ঘটনাবলীতে দেখা যায়, শরফুদ্দৌলা বুয়াইহী কারামেতাদের নিকট একজন দূত প্রেরণ করে। দূত ফিরে এসে বলে . কারামেতারা বাদশাহ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করে। আমি তাদেরকে জানাই যে তার চরিত্র ভালো। 11
বুয়াইহী শাসক আবু কীজার ফাতেমী প্রচারকদের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব মুয়াইয়্যেদ এর নিকট ৪৩৮ হিজরীতে তার ইসমাঈলী আহবানে প্রভাবিত হয়ে লিখে . যে মহান ব্যক্তিত্ব (মিসরে ওবায়দী শাসক অ- মুস্তানসির) সম্পর্কে আমি যা অবগত হতে পেরেছি এবং আমাদের আক্বীদা বিশ্বাসের স্বচ্ছতা সম্পর্কে আমি যতদূর তাকে অবহিত করেছি, তা তোমার ধারণা করা উচিত। তাদেরকে তোমার জানানো উচিত যে, এসব তুর্কমান (সেলজুকীরা) যারা খোরা-সান এবং রায় অঞ্চলের কর্মকান্ড সম্পর্কে দায়িত্বশীল, তাদের পদচারণা কেবল তাদের অধিকৃত নগরী (সিরিয়া এবং মিশর) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের দৃষ্টিতে আমাদের বিজয়ী সৈন্যদের দৃঢ়তাও প্রতিভাত করে তুলতে হবে। তাদের প্রাচীন নিদর্শন ধরে রাখার ব্যাপারে আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করেছি।12
আর এ বুয়াইহী শাসক মিসরে ওবায়দী শাসকদের সচ্চরিত্রের সাক্ষ্য দাবি করছে এবং তখন তাদেরকে এ ধারণা দিচ্ছে যে, সে-ই হচ্ছে তাদের পক্ষে প্রতিরোধকারী সুন্নীণ তুর্কমান সেলজুকী হামলার মুখে।
ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষায় তাদের ভূমিকা
রোমের হামলা রোধের নিমিত্তে জাযীরার অধিবাসীরা রাজধানী বাগদাদের নিকট ফরিয়াদ জানায়। আর বাগদাদ এ আহবানে সাড়াও দেয়। তারা জিহাদের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। মুইজ্জুদ্দৌলার পুত্র বখতিয়ারকে খলিফার নিকট প্রেরণ করে জিহাদের জন্য। লোক তৈয়ারের উদ্দেশ্যে ঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত বিক্রয় করতে উদ্যত হয়। কিন্তু বখতিয়ার সেসব অর্থ তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয় করে। আর জিহাদের প্রসঙ্গ সিকায় উঠে। এমনিভাবে প্রকাশ পায় যে, বখতিয়ার ছিল একজন প্রবঞ্চক। জিহাদের প্রস্ত্ততির জন্য অর্থ সঞ্চয়ে সে সত্যপরায়ণ ছিল না।
বুয়াইহী ও সামরিক সামন্তবাদ
সামরিক নেতা আর সাধারণ সৈন্যদেরকে ভূমি দান করা বুয়াইহীদের এমনি এক অভিনব কর্ম, যা ইতিপূর্বে আর কেউ করেনি। আর এ ভূমি দান করা হতো তাদের জন্য নগদ বেতন ভাতা ব্যয় করার পরিবর্তে। এসব ভূমি সরকারের খাস জমি ছিল না। কোন পতিত ভূমিও ছিল না, যা আবাদ করার জন্য দেওয়া হতো; বরং তা ছিল এমন ভূমি, যা কৃষকদের নিকট থেকে জোর জবরদস্তি করে কেড়ে নেয়া হতো। আর সৈন্যদের সেসব ভূমি পছন্দ না হলে বা তাদের আকাংখা অনুযায়ী ফসল না ফললে তারা সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য ভূমি দখল করতো। এর ফলে চাষাবাদের ধারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং রাষ্ট্রের শস্য ভান্ডার শূন্য হয়ে পড়ে। আর সৈন্যদের ভাতা সমস্যারও কোন সমাধান হয় না। ডা: আব্দুল আযীয দাওরী বলেন . আমার মতে বুয়াইহীরাই সর্ব প্রথম সামরিক জায়গিরদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। আমার মনে হয় তারা বিজিত দেশের ভূমিকে মুজাহিদদের জন্য গনিমত জ্ঞান করার দর্শন থেকে এ ধারণা গ্রহণ করে, কিন্তু ভূমি সম্পর্কে ইসলামের নীতি তারা বিস্মৃত হয় এবং তা অকেজো করে রাখে।13 যেমন বিচার ব্যবস্থায় জামানতের অভিনব প্রথা তাদের শাসনামলে চালু হয়। হিজরী ৩৫০ সালে মুইজ্জুদ্দৌলা আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান ইবনে আবুশ শাওয়ারেবকে বার্ষিক ২ লক্ষ দিরহাম পরিশোধের শর্তে বাগদাদের কাজি নিযুক্ত করার নির্দেশ জারি করেন।14
মূল্যায়ন
এভাবে পাঠক দেখতে পাবেন যে, সে রাষ্ট্রটি বোঝার উপর বড় বোঝায় পরিণত হয়েছিল। ইসলামি সংস্কৃতির কোন নূতন পথ উন্মোচন করতে পারেনি। অবশ্য তাদের উজির ছাহেব ইবনে আববাদ এর বদান্যতা-দানশীলতা আর সাহিত্যের জন্য তার উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি, ইরাকের কোন কোন প্রকল্পের জন্য আযদুদ্দৌলার আয়োজন, তাঁর আল-আযদী হাসপাতাল স্থাপন, ইসলামি সমাজের কোমর ভেঙে দেয়া, চুক্তি আর অর্থনৈতিক দিক থেকে ইসলামি সমাজ ধ্বংস করা ইত্যাকার কর্মকান্ডের সামনে সেসব তুচ্ছ ও মূল্যহীন। বুয়াইহী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে জ্ঞান- গরিমা আর ধৈর্য ও সহনশীলতার গুণে বিভূষিত করা- তা সাধারণ পরিণতিতে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। আর সাধারণ ফলাফল হচ্ছে এই যে, তাদের কল্যাণের চেয়ে অ-কল্যাণই বেশি। হাফেজ শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন . বনু বুয়াইহ এবং বনু ওবায়দদের মতো রাফেযীদের শাসনামলে ইসলামের নীতিমালা ধ্বংস হয়েছে। তারা জিহাদ বর্জন করেছে এবং রোমের খ্রিস্টানরা বিস্তার লাভ করেছে এবং তারা মাদায়েন অধিকার করেছে।15
এক নজরে তাদের ইতিহাস
ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বুয়াইহী এর সন্তান আলী হাসান এবং আহমদের উদ্ভব হয় তাদের কীর্তিমান পুরুষ আলীর উদ্ভবের মধ্য দিয়ে। যার উপাধি ছিল ইমাদুদ্দৌলা। এটা হিজরী ৩২১ সনের কথা। মারদাবীজ নামক জনৈক দাইলামী শাসকের পক্ষ থেকে সে ছিল ‘কারাজ’ নামক একটা ক্ষুদ্র অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত শাসনকর্তা। লোকজনের সঙ্গে সে সদাচার করতো, সদয় ব্যবহার করতো। ফলে আশপাশের দেশগুলোতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সকলে তাকে ভালোবাসতো শুরু করে তার বশ্যতা স্বীকার করে। এ ব্যাপারে তার ভাইয়েরা সহায়তা করে। ফলে সে পারস্য অঞ্চলের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে। হিজরী ৩৩৪ সনে আহমদ ইবনে বুয়াইহী বাগদাদে অভিযান পরিচালনা করে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই বাগদাদে প্রবেশ করে, ফলে বাগদাদে বনী বুয়াইহীর কর্তৃত্বে আসে। খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং খলিফার উপাধি ধারণ করে আহমদের উপাধি হয় মুইজ্জুদ্দৌলা। তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসাবে ২০ বৎসরেরও বেশি সময় সে ইরাকের শাসনকর্তা ছিল। হিজরী ৩৫৬ সনে তার মৃত্যু হয়। হাসান ইবনে বুয়াইহ রুকমুদ্দৌলা উপাধি ধারণ করে ইসফাহান, তাবারিস্তান এবং জুরজান শাসন করে এবং তাদের বড় ভাই ইমাদুদ্দৌলা শাসন করে শিরাজ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।। তবে বড় ভাইই ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর, যার কথা তারা সকলে শ্রবণ আর মান্য করতো। হিজরী ৩৩৮ সনে তার মৃত্যু হয়।
বুয়াইহীদের শিয়া ধর্মমত গ্রহণ
বুয়াইহীরা তাদের শিয়া ধর্মমত গোপন রাখেনি। বরং আহলে সুন্নার অনুসারীদের উপর নির্যাতনমূলক কর্ম তৎপরতা পরিচালনার জন্য তারা বাগদাদে তাদের ধর্মানুসারিদেরকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। তখন এমন কোন বৎসর যেতোনা যে শিয়া-সুন্নীণদের মধ্যে সংঘাত ঘটতো না। এতে অনেক প্রাণহানি ঘটতো, অনেক সম্পদ ধ্বংস হতো। বাড়ি-ঘর আর হাট-বাজারে অগ্নি সংযোগ করা হতো। ৩৫১ হিজরী সনের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানা যায় যে, বাগদাদের শিয়ারা মুইজ্জুদ্দৌলার নির্দেশক্রমে মুয়াবিয়া এবং তিন খলিফাকে লা’নত বর্ষণের নির্দেশ দেয় মসজিদগুলোর প্রতি। কিন্তু আববাসী খলিফার এটা রোধ করার ক্ষমতা ছিল না।1 হিজরী ৩৫২ সনের ঘটনাবলীতে দেখা যায়, মুইজ্জুদ্দৌলা হাট- বাজার, দোকান-পাট আর কেনা-বেচা বন্ধ করে আশুরা উপলক্ষ্যে শোক পালন করার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেয়। মাথার চুল উন্মুক্ত করে চেহারা কালো করে নারীদেরকে রাস্তায় রাস্তায় মাতম করার নির্দেশ দেয়। হুসাইন ইবনে আলীর জন্য তাদেরকে বুক চাপড়াতে হবে, চেহারায় চপেটাঘাত করতে হবে। ফলে লোকেরা তাই করে। সুন্নীণরা এটা রোধ করতে পারেনি। কারণ শিয়াদের সংখ্যা ছিল বেশি এবং শাসক শ্রেণি ছিল তাদের সঙ্গে।2
হিজরী ৩৯৮ সনের ঘটনাবলীতে দেখা যায় . বাগদাদে শিয়া-সুন্নীণ দাঙ্গা দেখা দেয়। একে অপরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। শিয়ারা আবু হামেদ ইসফারাইনী এবং ইবনুল আকাফানীকে গালমন্দ করে হত্যা করতে উদ্যত হলে তারা পলায়ন করে।3 হিজরী ৪০৭ সনে শিয়া আর সুন্নীণর মধ্যে ওয়াসেত শহরে এক বড় ধরনের লড়াই বাধে। এতে সুন্নীণরা জয়ী হয়। আর নাম করা শিয়ারা আলী ইবনে মাযীদের নিকট পলায়ন করলে তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন।4
আযদুদ্দৌলা (ফানা খসরু) যিনি ছিলেন রুকনুদ্দৌলার পুত্র, তিনি অঢেল সম্পদ ব্যয় করেন। মাশহাদে মাজার নির্মাণ কাজে তিনি সৈন্যদেরকে ব্যবহার করেন।5
খলিফাদের নিন্দা
বুয়াইহীরা খেলাফতের ভীতি দূর করার ব্যাপারে তুর্কিদের নীতি অনুসরণ করে। তারা এমন নীতি অনুসরণ করে, যার ফলে মনে হয় যেন খেলাফতের অস্তিত্ব নেই। এ থেকে তারা প্রমাণ করতে চায় যে, তারা নাগরিক অনুভূতি থেকে দূরে। তবে তাদের অন্তরে সুন্নাহর প্রতি বিদ্বেষ ঠিকই আছে। তারা মনে করতো যে, আববাসীয়রা জোর পূর্বক খেলাফত অধিকার করে নিয়েছে। এ কারণে মুইজ্জুদ্দৌলা যোগ্য অধিকারী অর্থাৎ অর বংশধরদের জন্য খেলাফত ছিনিয়ে নেয়া এবং মিসরে ওবায়দী শাসক মুইয এর জন্য বাইয়াত গ্রহণ করার ব্যাপারে তার সভাসদদের পরামর্শ চায়। তার জনৈক সভাসদ বলে . আমি এ মত সমর্থন করি না। কারণ আজ তুমি এমন খলিফার সঙ্গে আছ, যার সম্পর্কে তোমার এবং তোমার সভাসদদের বিশ্বাস এই যে, সে খেলাফতের যোগ্য নয়। তুমি যদি তাদেরকে হুকুম দাও খলিফাকে হত্যা করার জন্য, তাহলে অবশ্যই তারা তা করবে। আর তুমি যদি কোন আলাবীকে খলিফার আসনে বসাও তবে তুমি এবং তোমার সভাসদরা যার খেলাফতকে বৈধ বলে মনে কর, সে তোমার সঙ্গে থাকবে। সে যদি তোমাকে হত্যা করার জন্য তাদেরকে হুকুম দেয়, তবে অবশ্যই তারা তা করবে।6 মুইজ্জুদ্দৌলা এ মতকে ভালো মনে করে এবং তার চিন্তাধারা ত্যাগ করে।
বাহাউদ্দৌলার সম্পদ হ্রাস পেলে তার উজির তাকে খলিফার পদ গ্রহণের পরামর্শ দেয় এবং তাকে সম্পদের লোভ দেখায়। ফলে বাহাউদ্দৌলা খেলাফত প্রাসাদে প্রবেশ করে খলিফাকে খেলাফতের আসন থেকে হটিয়ে দেয়। খলিফা অনেক ফরিয়াদ করে। কিন্তু কেউই সেদিকে কর্ণপাত করেনি। তারা খলিফার প্রাসাদে যা কিছু পায় লুঠপাট করে নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়।7 তার পূর্বসূরি মুইজ্জুদ্দৌলা বুয়াইহী মুস্তাকফীকে অপমান করত: পাগড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলার জন্য সৈন্যদেরকে নির্দেশ দেয়। অতঃপর হুকুম দেয় তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার জন্য। মৃত্যু পর্যন্ত সে কারাগারেই কাটাবে।8
তাদের মন্ত্রী- উজির
ওবায়দীদের মন্ত্রী ছিল ইহুদি- খ্রিস্টান, অনুরূপ বুয়াইহীদের উজির ছিল খ্রিস্টান। আসদুদ্দৌলার শাসনামলে (ফান্না খসরু ইবনুল হাসান ইবনে বুয়াইহ) তার উজির ছিল নসর ইবনে হারুন। আযদুদ্দৌলা তাকে গির্জা নির্মাণের নির্দেশ দেয় এবং গরিব খ্রিস্টানদের জন্য সে সম্পদ উজাড় করে দেয়।9
বুয়াইহী আর কারামেতাদের সম্পর্ক
যারা বিচ্ছিন্ন আর বিক্ষিপ্তভাবে ইতিহাস অধ্যয়ন করে, তারা হয়তো না জানতে পারে যে, বাতেনী আন্দোলন এবং শিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে এসব আন্দোলনের কি সম্পর্ক রয়েছে। সেসব আন্দোলন সম্পর্কে তারা সতর্ক এবং সচেতনও হবে না। তারা এ কথাও মনে করতে পারে যে, প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বয়ং সম্পূর্ণ; অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। অনুরূপভাবে বর্তমান কালের অমনোযোগিরাও মনে করতে পারে। বাতেনী আর রাফেযী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, তারা তা দেখতে পায় না। আর কোন সম্পর্ক থেকে থাকলেও তাদের মতে তা সাময়িক রাজনৈতিক কারণে থাকবে। এসব অমনোযোগী ব্যক্তিরা আরো বলে যে, যে সব শিয়া ছাত্র ইউরোপে পড়ালেখা করে, তারা তাদের দেশের শিয়াদের মতো নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি ইতিহাস অধ্যয়ন করে এবং বর্তমান অধ্যয়ন করে উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করবে, সে হয়তো উভয়ের মধ্যে ভূমিকার ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখতে পাবে না।
হিজরী ৩৬০ সনের ঘটনাবলী সম্পর্কে জানা যায় যে, এ বৎসরের জিলকদ মাসে কারামেতারা দামেশকে চড়াও হয়ে জা’ফর ইবনে ফালেহকে হত্যা করে, যিনি ছিলেন দামেশকে অস্থায়ী খলিফা। তখন কারামেতাদের নেতা ছিল হোসাইন ইবনে আহমদ ইবনে বাহরাম। আর বাগদাদ থেকে মুইজ্জুদ্দৌলা অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রচুর সৈন্য- সামন্ত দিয়ে তাকে মদদ জোগায়।10
হিজরী ৩৭৪ সালের ঘটনাবলীতে দেখা যায়, শরফুদ্দৌলা বুয়াইহী কারামেতাদের নিকট একজন দূত প্রেরণ করে। দূত ফিরে এসে বলে . কারামেতারা বাদশাহ সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করে। আমি তাদেরকে জানাই যে তার চরিত্র ভালো। 11
বুয়াইহী শাসক আবু কীজার ফাতেমী প্রচারকদের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব মুয়াইয়্যেদ এর নিকট ৪৩৮ হিজরীতে তার ইসমাঈলী আহবানে প্রভাবিত হয়ে লিখে . যে মহান ব্যক্তিত্ব (মিসরে ওবায়দী শাসক অ- মুস্তানসির) সম্পর্কে আমি যা অবগত হতে পেরেছি এবং আমাদের আক্বীদা বিশ্বাসের স্বচ্ছতা সম্পর্কে আমি যতদূর তাকে অবহিত করেছি, তা তোমার ধারণা করা উচিত। তাদেরকে তোমার জানানো উচিত যে, এসব তুর্কমান (সেলজুকীরা) যারা খোরা-সান এবং রায় অঞ্চলের কর্মকান্ড সম্পর্কে দায়িত্বশীল, তাদের পদচারণা কেবল তাদের অধিকৃত নগরী (সিরিয়া এবং মিশর) এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের দৃষ্টিতে আমাদের বিজয়ী সৈন্যদের দৃঢ়তাও প্রতিভাত করে তুলতে হবে। তাদের প্রাচীন নিদর্শন ধরে রাখার ব্যাপারে আমরা অনেক অর্থ ব্যয় করেছি।12
আর এ বুয়াইহী শাসক মিসরে ওবায়দী শাসকদের সচ্চরিত্রের সাক্ষ্য দাবি করছে এবং তখন তাদেরকে এ ধারণা দিচ্ছে যে, সে-ই হচ্ছে তাদের পক্ষে প্রতিরোধকারী সুন্নীণ তুর্কমান সেলজুকী হামলার মুখে।
ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষায় তাদের ভূমিকা
রোমের হামলা রোধের নিমিত্তে জাযীরার অধিবাসীরা রাজধানী বাগদাদের নিকট ফরিয়াদ জানায়। আর বাগদাদ এ আহবানে সাড়াও দেয়। তারা জিহাদের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। মুইজ্জুদ্দৌলার পুত্র বখতিয়ারকে খলিফার নিকট প্রেরণ করে জিহাদের জন্য। লোক তৈয়ারের উদ্দেশ্যে ঘরের আসবাবপত্র পর্যন্ত বিক্রয় করতে উদ্যত হয়। কিন্তু বখতিয়ার সেসব অর্থ তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয় করে। আর জিহাদের প্রসঙ্গ সিকায় উঠে। এমনিভাবে প্রকাশ পায় যে, বখতিয়ার ছিল একজন প্রবঞ্চক। জিহাদের প্রস্ত্ততির জন্য অর্থ সঞ্চয়ে সে সত্যপরায়ণ ছিল না।
বুয়াইহী ও সামরিক সামন্তবাদ
সামরিক নেতা আর সাধারণ সৈন্যদেরকে ভূমি দান করা বুয়াইহীদের এমনি এক অভিনব কর্ম, যা ইতিপূর্বে আর কেউ করেনি। আর এ ভূমি দান করা হতো তাদের জন্য নগদ বেতন ভাতা ব্যয় করার পরিবর্তে। এসব ভূমি সরকারের খাস জমি ছিল না। কোন পতিত ভূমিও ছিল না, যা আবাদ করার জন্য দেওয়া হতো; বরং তা ছিল এমন ভূমি, যা কৃষকদের নিকট থেকে জোর জবরদস্তি করে কেড়ে নেয়া হতো। আর সৈন্যদের সেসব ভূমি পছন্দ না হলে বা তাদের আকাংখা অনুযায়ী ফসল না ফললে তারা সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য ভূমি দখল করতো। এর ফলে চাষাবাদের ধারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয় এবং রাষ্ট্রের শস্য ভান্ডার শূন্য হয়ে পড়ে। আর সৈন্যদের ভাতা সমস্যারও কোন সমাধান হয় না। ডা: আব্দুল আযীয দাওরী বলেন . আমার মতে বুয়াইহীরাই সর্ব প্রথম সামরিক জায়গিরদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। আমার মনে হয় তারা বিজিত দেশের ভূমিকে মুজাহিদদের জন্য গনিমত জ্ঞান করার দর্শন থেকে এ ধারণা গ্রহণ করে, কিন্তু ভূমি সম্পর্কে ইসলামের নীতি তারা বিস্মৃত হয় এবং তা অকেজো করে রাখে।13 যেমন বিচার ব্যবস্থায় জামানতের অভিনব প্রথা তাদের শাসনামলে চালু হয়। হিজরী ৩৫০ সালে মুইজ্জুদ্দৌলা আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান ইবনে আবুশ শাওয়ারেবকে বার্ষিক ২ লক্ষ দিরহাম পরিশোধের শর্তে বাগদাদের কাজি নিযুক্ত করার নির্দেশ জারি করেন।14
মূল্যায়ন
এভাবে পাঠক দেখতে পাবেন যে, সে রাষ্ট্রটি বোঝার উপর বড় বোঝায় পরিণত হয়েছিল। ইসলামি সংস্কৃতির কোন নূতন পথ উন্মোচন করতে পারেনি। অবশ্য তাদের উজির ছাহেব ইবনে আববাদ এর বদান্যতা-দানশীলতা আর সাহিত্যের জন্য তার উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি, ইরাকের কোন কোন প্রকল্পের জন্য আযদুদ্দৌলার আয়োজন, তাঁর আল-আযদী হাসপাতাল স্থাপন, ইসলামি সমাজের কোমর ভেঙে দেয়া, চুক্তি আর অর্থনৈতিক দিক থেকে ইসলামি সমাজ ধ্বংস করা ইত্যাকার কর্মকান্ডের সামনে সেসব তুচ্ছ ও মূল্যহীন। বুয়াইহী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে জ্ঞান- গরিমা আর ধৈর্য ও সহনশীলতার গুণে বিভূষিত করা- তা সাধারণ পরিণতিতে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে না। আর সাধারণ ফলাফল হচ্ছে এই যে, তাদের কল্যাণের চেয়ে অ-কল্যাণই বেশি। হাফেজ শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন . বনু বুয়াইহ এবং বনু ওবায়দদের মতো রাফেযীদের শাসনামলে ইসলামের নীতিমালা ধ্বংস হয়েছে। তারা জিহাদ বর্জন করেছে এবং রোমের খ্রিস্টানরা বিস্তার লাভ করেছে এবং তারা মাদায়েন অধিকার করেছে।15
কারামেতাদের সম্পর্কে বলার নতুন কিছু নেই। তাদের সম্পর্কে অনেকেই লিখেছেন। আর তাদের প্রসঙ্গটা মুসলমানদের মধ্যে প্রসিদ্ধ। তারা নিজেদের আক্বীদা-বিশ্বাস স্পষ্ট ব্যক্ত করে ঘোষণা দেয় তাদের নাস্তিক্যবাদী কর্মকান্ডের, ওবায়দীদের মতো শিয়া ইজম দ্বারা নিজেদেরকে আড় করে রাখে না। তবে তাদের সূচনা আর বীভৎস কর্মকান্ড, অন্যান্য শিয়া সুলভ তৎপরতা বা শিয়া ইজম দ্বারা যা প্রচ্ছন্ন করে রাখে, সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা অপরিহার্য।
হিজরী তৃতীয় শতকের শেষের দিকে ২৭৮ সালে কারামেতাদের উদ্ভব কোন বিস্ময়কর বা আকস্মিক ঘটনা ছিল না। নাস্তিক্যবাদী বাতেনী সম্প্রদায় ইসলামকে আঘাত করার জন্য যে ভূখন্ডটি বেছে নিয়েছিল, তার দাবিই ছিল সকল স্থানে বাণী প্রচারক ছড়িয়ে দেয়া, যারা স্বচ্ছ সুন্নীণ পরিবেশে তাকওয়ার প্রদর্শনী করবে, আবার দার্শনিক পরিবেশে প্রকাশ করবে দর্শনের প্রতি ভালোবাসা। এসব প্রচারকদের অন্যতম ছিল হুসাইন আহওয়াজী, যে কুফা ভূখন্ডে আগমন করে গন্ডমূর্খ সাধারণ নাগরিকদেরকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। সে সাধারণ মানুষকে অবস্থান্তরে নিয়ে যায়; নিয়ে যায় তাদেরকে কুফরি আর নাস্তিক্যবাদী দর্শনের দ্বারপ্রান্তে। নিয়ে যায় মানুষকে এমন বিশ্বাসের কাছাকাছি যে, মুসলমানদের হত্যা করা সাওয়াবের কাজ। এদের দলের জনৈক ব্যক্তি ছিল হামদান কারমাত। তার নামানুসারে তার অনুসারীরা কারামেতা নামে অভিহিত হয়।
হিজরী ২৮৬ সালে এই বিশ্রী আহবান বাহরাইনের কাতীফ এবং তৎ সন্নিহিত অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। পারস্যের আবু সাঈদ জানাবী এ আহবানে সাড়া দেয়। অনতিবিলম্বে বাগদাদের খেলাফতের সঙ্গে সংঘাতে সে বিজয় অর্জন করে এবং সমস্ত বন্দীকে হত্যা করে। হিজরী ২৮৯ সনে সিরিয়ার প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়ে এবং তারা দামেশক অবরোধ করে। দামেশক শাসক ‘তাগজ’ এর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ আর সংঘাত চলে। তূলুনী শাসকদের প্রতিনিধি হিসাবে ‘তাগজ’ দামেশক শাসন করেছিলেন। তাদের অন্যতম কর্তা ব্যক্তি জকরুয়াহ ইবনে মাহরুয়াহ দামেশক আর ইরাকের সীমান্ত অঞ্চলে কুফার দিক হামলা চালিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়। হিজরী ২৯৪ সালে তার জীবনাবসান হয়।
বাহরাইনে কারামেতাদের অন্যতম নেতা ছিল আবু তাহের আল- জানাবী সুলায়মান ইবনে হাসান। তার বীভৎস কর্মকান্ড তাতারি আর ক্রুসেডারদেরকেও হার মানায়। বাতেনীরা ব্যতীত অন্য কেউ এমন বর্বরোচিত কর্মকান্ড করতে পারেনি। তার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। হিজরী ৩১২ সনে হাজিদের একটা দল ইরাকে ফিরে আসছিল। এরা তাদেরকে সর্ব সান্ত করে সব কিছু লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। ক্ষুধা আর পিপাসায় তাদের অধিকাংশেরই সেখানে মৃত্যু হয়।1
৩১৭ হিজরী সনে মসজিদুল হারামে হাজিগণ সমবেত হন এহেন পাপিষ্ঠ খাবীছের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য। কিন্তু মসজিদে যারা সমবেত হয়েছিলেন, তাদের সকলকে হত্যা করে লাশ জমজম কূপে নিক্ষেপ করা হয়। মক্কার রাস্তা ঘাটে এবং আশপাশে ৩০ হাজারের অধিক লোককে হত্যা করা হয়। কা’বা শরীফের গিলাফ খুলে নিয়ে তা তার সঙ্গীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। মক্কাবাসীদের বাড়িঘর লুণ্ঠন করা হয়। হাজারে আসওয়াদ খুলে তাদের কেন্দ্রস্থল ‘হাজর’এ সঙ্গে করে নিয়ে যায়।2 বুকাইর ইবনে আহমদ আল হাদ্দাদ বলেন . ‘আমি যেন হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে আবুল হুসাইনকে দেখছি। তার প্রতি তরবারি চালানো হচ্ছে আর তিনি দু’হাতে দরজার চৌকাঠ ধরে আছেন। এমতাবস্থায় কা’বার আস্তানায় তাঁর মস্তক লুটিয়ে পড়ে।3
ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বলেন, তাদের আমির আবু তাহের তার প্রতি আল্লাহর লা’নত- কা’বা শরীফের দরজায় বলে . আমি আল্লাহ, আমি সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করি এবং ধ্বংস করি। ইবনে কাসীর আরো বলেন . আল্লাহ তাআলা তাৎক্ষনিকভাবে এসব নাস্তিক বিধর্মীর শাস্তির ব্যবস্থা করেননি, যেমন তিনি করেছিলেন আসহাবুল ফীল এর ক্ষেত্রে। তারা ছিল খ্রিস্টান, আর এরা হচ্ছে ইহুদি নাছারা এবং মজুসী তথা অগ্নিপুজকদের মধ্যে নিকৃষ্ট লোক। কারণ, আল্লাহ তাআলা কা’বা শরীফের সম্মানকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনের পূর্বাভাস করেছেন। তাঁর পরে আর কোন শরিয়ত প্রেরণ করেননি। তখন কা’বা শরীফের ধ্বংস সাধিত হলে মানব মন অবিশ্বাসী হতো। অবশ্য শরিয়ত নাজিল করার পর আল্লাহ চান যে, মুসলমানরা শরিয়ত রক্ষা করুক, শরিয়তকে মর্যাদা দান করুক এবং কাফির মুশরিকদের দমন করুক।4
৩৬০ হিজরী সালে এই কারামেতারা দামেশক পৌঁছে সেখানকার নাগরিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করে, যা কোন চক্ষু দেখেনি এবং কোন কর্ণ কখনো শ্রবণ করেনি।5
আববাসিয়া সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার চেষ্টা
কারামেতারা শক্তি অর্জন করলে আবু তাহের আল-জানাবী তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, তখন ইরাকের বেশির ভাগ মানুষ তাদের সঙ্গে থাকার কথা প্রকাশ করে। ওয়াসেত এবং আইনুত তামর শহরে তারা নানা দলে বিভক্ত হয়। ইতিপূর্বে তারা নিজেদেরকে গোপন রাখতো। আববাসীয় খলিফা তাদের সঙ্গে লড়াই করে বিজয় লাভ করেন।
হিজরী ৩৭৫ সালে কারামেতারা কুফার কর্তৃত্ব লাভ করে। তখন বুয়াইহী শাসকও তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করে। কিন্তু তারা বুয়াইহীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে অস্বীকার করলে সংঘাত সৃষ্টি হয়। এ সংঘাতে তাদের নেতা হাসান ইবনে মুনযির নিহত হলে তারা কুফা ত্যাগ করে।6
কারামেতা আর বুয়াইহীদের সম্পর্ক
হিজরী ৩৬০ সালে কারামেতারা দামেশকে আধিপত্য লাভ করে। ইতিপূর্বে দামেশকের কর্তৃত্ব ছিল মিশরের ওবায়দীদের পক্ষ থেকে জাফর ইবনে ফালাহ এর হাতে। কারণ, কারামেতারা দামেশকের শাসক সাবিক ইবনে তাগজ এর সঙ্গে একমত হয়েছিল যে, সে তাদেরকে ৩ লক্ষ দীনার দান করবে। তারা যখন সিরিয়ায় যুদ্ধের সংকল্প করে, তখন তাদের নেতা হুসাইন ইবনে আহমদ ইবনে বাহরাম বুয়াইহীদের সহায়তা কামনা করে তাদের বাদশাহ বখতিয়ারকে প্রেরণ করেন। তিনি এতে সাড়া দেন এবং দাবি পূরণ করেন।7
ফাতেমীদের সঙ্গে কারামেতাদের সম্পর্ক
ওবায়দী শাসক মুইয মিসরে কারামেতাদের যুদ্ধের অভিপ্রায় বিষয়ে জানতে পেরে তাদের নিকট একটা পত্র প্রেরণ করেন। এতে তিনি নিজের এবং আহলে বায়তের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেন। তিনি একথাও উল্লেখ করেন যে, উভয়ের মূল আহবান একই। আর কারামেতারাতো পূর্ব থেকেই তার এবং তার পূর্ব পুরুষদের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছে।8 কিন্তু হাসান ইবনে আহমদ ইবনে আবু সাঈদ তার এসব কথার কর্ণপাত করেনি। বরং সে মিসরে হামলা চালিয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। ফিলিস্তিনের রামাল্লা শহরে তার মৃত্যু হয়।9 এটা ছিল স্বাভাবিক। মূল আহবান এক হলেও অন্তরতো ক্ষুদ্র। দুনিয়ার পদ- মর্যাদার প্রতি কুকুরের মতো ছুটে যাওয়া- এটাইতো এ যুগে কার্যকর আছে।
কারামেতাদের দুর্বলতা এবং তাদের পতন
তাদের দুর্বলতার সূচনা এভাবে হয়েছে যে, তাদের সদর দফতর হিজর-এ জনৈক আহবায়কের নিকট তারা একত্র হয়। আর সে আহবায়ক ছিল তাদের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। সে জনৈক ব্যক্তিকে নির্দেশ দেয় আপন ভাইকে হত্যা করার জন্য। লোকটি তা-ই করে। কিন্তু আবু তাহের ব্যাপারটা ফাঁস করে দেয় এবং অনেক নেতা-কর্তাকে হত্যার করার পর তাকেও হত্যা করা হয়।10 অতঃপর সেলজুকদের হাতে সুন্নীণদের যুগ ফিরে আসে এবং বুয়াইহীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর ওবায়দীরাও দুর্বল হয়ে পড়ে। পুনরায় তাদের কেন্দ্রে ফিরে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এর পর তারা হয়ে পড়ে বিলীন। তবে তাদের চিহ্ন আর বিশ্বাস নিশ্চিত হয়নি। ইরানে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে হাশাশী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। হাসান ইবনে সাববাহ ছিল এই নব উদ্ভূত সম্প্রদায়ের নেতা।
হিজরী তৃতীয় শতকের শেষের দিকে ২৭৮ সালে কারামেতাদের উদ্ভব কোন বিস্ময়কর বা আকস্মিক ঘটনা ছিল না। নাস্তিক্যবাদী বাতেনী সম্প্রদায় ইসলামকে আঘাত করার জন্য যে ভূখন্ডটি বেছে নিয়েছিল, তার দাবিই ছিল সকল স্থানে বাণী প্রচারক ছড়িয়ে দেয়া, যারা স্বচ্ছ সুন্নীণ পরিবেশে তাকওয়ার প্রদর্শনী করবে, আবার দার্শনিক পরিবেশে প্রকাশ করবে দর্শনের প্রতি ভালোবাসা। এসব প্রচারকদের অন্যতম ছিল হুসাইন আহওয়াজী, যে কুফা ভূখন্ডে আগমন করে গন্ডমূর্খ সাধারণ নাগরিকদেরকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। সে সাধারণ মানুষকে অবস্থান্তরে নিয়ে যায়; নিয়ে যায় তাদেরকে কুফরি আর নাস্তিক্যবাদী দর্শনের দ্বারপ্রান্তে। নিয়ে যায় মানুষকে এমন বিশ্বাসের কাছাকাছি যে, মুসলমানদের হত্যা করা সাওয়াবের কাজ। এদের দলের জনৈক ব্যক্তি ছিল হামদান কারমাত। তার নামানুসারে তার অনুসারীরা কারামেতা নামে অভিহিত হয়।
হিজরী ২৮৬ সালে এই বিশ্রী আহবান বাহরাইনের কাতীফ এবং তৎ সন্নিহিত অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। পারস্যের আবু সাঈদ জানাবী এ আহবানে সাড়া দেয়। অনতিবিলম্বে বাগদাদের খেলাফতের সঙ্গে সংঘাতে সে বিজয় অর্জন করে এবং সমস্ত বন্দীকে হত্যা করে। হিজরী ২৮৯ সনে সিরিয়ার প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়ে এবং তারা দামেশক অবরোধ করে। দামেশক শাসক ‘তাগজ’ এর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ আর সংঘাত চলে। তূলুনী শাসকদের প্রতিনিধি হিসাবে ‘তাগজ’ দামেশক শাসন করেছিলেন। তাদের অন্যতম কর্তা ব্যক্তি জকরুয়াহ ইবনে মাহরুয়াহ দামেশক আর ইরাকের সীমান্ত অঞ্চলে কুফার দিক হামলা চালিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়। হিজরী ২৯৪ সালে তার জীবনাবসান হয়।
বাহরাইনে কারামেতাদের অন্যতম নেতা ছিল আবু তাহের আল- জানাবী সুলায়মান ইবনে হাসান। তার বীভৎস কর্মকান্ড তাতারি আর ক্রুসেডারদেরকেও হার মানায়। বাতেনীরা ব্যতীত অন্য কেউ এমন বর্বরোচিত কর্মকান্ড করতে পারেনি। তার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। হিজরী ৩১২ সনে হাজিদের একটা দল ইরাকে ফিরে আসছিল। এরা তাদেরকে সর্ব সান্ত করে সব কিছু লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। ক্ষুধা আর পিপাসায় তাদের অধিকাংশেরই সেখানে মৃত্যু হয়।1
৩১৭ হিজরী সনে মসজিদুল হারামে হাজিগণ সমবেত হন এহেন পাপিষ্ঠ খাবীছের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য। কিন্তু মসজিদে যারা সমবেত হয়েছিলেন, তাদের সকলকে হত্যা করে লাশ জমজম কূপে নিক্ষেপ করা হয়। মক্কার রাস্তা ঘাটে এবং আশপাশে ৩০ হাজারের অধিক লোককে হত্যা করা হয়। কা’বা শরীফের গিলাফ খুলে নিয়ে তা তার সঙ্গীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। মক্কাবাসীদের বাড়িঘর লুণ্ঠন করা হয়। হাজারে আসওয়াদ খুলে তাদের কেন্দ্রস্থল ‘হাজর’এ সঙ্গে করে নিয়ে যায়।2 বুকাইর ইবনে আহমদ আল হাদ্দাদ বলেন . ‘আমি যেন হাফেজ মুহাম্মদ ইবনে আবুল হুসাইনকে দেখছি। তার প্রতি তরবারি চালানো হচ্ছে আর তিনি দু’হাতে দরজার চৌকাঠ ধরে আছেন। এমতাবস্থায় কা’বার আস্তানায় তাঁর মস্তক লুটিয়ে পড়ে।3
ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বলেন, তাদের আমির আবু তাহের তার প্রতি আল্লাহর লা’নত- কা’বা শরীফের দরজায় বলে . আমি আল্লাহ, আমি সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করি এবং ধ্বংস করি। ইবনে কাসীর আরো বলেন . আল্লাহ তাআলা তাৎক্ষনিকভাবে এসব নাস্তিক বিধর্মীর শাস্তির ব্যবস্থা করেননি, যেমন তিনি করেছিলেন আসহাবুল ফীল এর ক্ষেত্রে। তারা ছিল খ্রিস্টান, আর এরা হচ্ছে ইহুদি নাছারা এবং মজুসী তথা অগ্নিপুজকদের মধ্যে নিকৃষ্ট লোক। কারণ, আল্লাহ তাআলা কা’বা শরীফের সম্মানকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনের পূর্বাভাস করেছেন। তাঁর পরে আর কোন শরিয়ত প্রেরণ করেননি। তখন কা’বা শরীফের ধ্বংস সাধিত হলে মানব মন অবিশ্বাসী হতো। অবশ্য শরিয়ত নাজিল করার পর আল্লাহ চান যে, মুসলমানরা শরিয়ত রক্ষা করুক, শরিয়তকে মর্যাদা দান করুক এবং কাফির মুশরিকদের দমন করুক।4
৩৬০ হিজরী সালে এই কারামেতারা দামেশক পৌঁছে সেখানকার নাগরিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করে, যা কোন চক্ষু দেখেনি এবং কোন কর্ণ কখনো শ্রবণ করেনি।5
আববাসিয়া সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার চেষ্টা
কারামেতারা শক্তি অর্জন করলে আবু তাহের আল-জানাবী তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, তখন ইরাকের বেশির ভাগ মানুষ তাদের সঙ্গে থাকার কথা প্রকাশ করে। ওয়াসেত এবং আইনুত তামর শহরে তারা নানা দলে বিভক্ত হয়। ইতিপূর্বে তারা নিজেদেরকে গোপন রাখতো। আববাসীয় খলিফা তাদের সঙ্গে লড়াই করে বিজয় লাভ করেন।
হিজরী ৩৭৫ সালে কারামেতারা কুফার কর্তৃত্ব লাভ করে। তখন বুয়াইহী শাসকও তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করে। কিন্তু তারা বুয়াইহীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে অস্বীকার করলে সংঘাত সৃষ্টি হয়। এ সংঘাতে তাদের নেতা হাসান ইবনে মুনযির নিহত হলে তারা কুফা ত্যাগ করে।6
কারামেতা আর বুয়াইহীদের সম্পর্ক
হিজরী ৩৬০ সালে কারামেতারা দামেশকে আধিপত্য লাভ করে। ইতিপূর্বে দামেশকের কর্তৃত্ব ছিল মিশরের ওবায়দীদের পক্ষ থেকে জাফর ইবনে ফালাহ এর হাতে। কারণ, কারামেতারা দামেশকের শাসক সাবিক ইবনে তাগজ এর সঙ্গে একমত হয়েছিল যে, সে তাদেরকে ৩ লক্ষ দীনার দান করবে। তারা যখন সিরিয়ায় যুদ্ধের সংকল্প করে, তখন তাদের নেতা হুসাইন ইবনে আহমদ ইবনে বাহরাম বুয়াইহীদের সহায়তা কামনা করে তাদের বাদশাহ বখতিয়ারকে প্রেরণ করেন। তিনি এতে সাড়া দেন এবং দাবি পূরণ করেন।7
ফাতেমীদের সঙ্গে কারামেতাদের সম্পর্ক
ওবায়দী শাসক মুইয মিসরে কারামেতাদের যুদ্ধের অভিপ্রায় বিষয়ে জানতে পেরে তাদের নিকট একটা পত্র প্রেরণ করেন। এতে তিনি নিজের এবং আহলে বায়তের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেন। তিনি একথাও উল্লেখ করেন যে, উভয়ের মূল আহবান একই। আর কারামেতারাতো পূর্ব থেকেই তার এবং তার পূর্ব পুরুষদের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছে।8 কিন্তু হাসান ইবনে আহমদ ইবনে আবু সাঈদ তার এসব কথার কর্ণপাত করেনি। বরং সে মিসরে হামলা চালিয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। ফিলিস্তিনের রামাল্লা শহরে তার মৃত্যু হয়।9 এটা ছিল স্বাভাবিক। মূল আহবান এক হলেও অন্তরতো ক্ষুদ্র। দুনিয়ার পদ- মর্যাদার প্রতি কুকুরের মতো ছুটে যাওয়া- এটাইতো এ যুগে কার্যকর আছে।
কারামেতাদের দুর্বলতা এবং তাদের পতন
তাদের দুর্বলতার সূচনা এভাবে হয়েছে যে, তাদের সদর দফতর হিজর-এ জনৈক আহবায়কের নিকট তারা একত্র হয়। আর সে আহবায়ক ছিল তাদের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। সে জনৈক ব্যক্তিকে নির্দেশ দেয় আপন ভাইকে হত্যা করার জন্য। লোকটি তা-ই করে। কিন্তু আবু তাহের ব্যাপারটা ফাঁস করে দেয় এবং অনেক নেতা-কর্তাকে হত্যার করার পর তাকেও হত্যা করা হয়।10 অতঃপর সেলজুকদের হাতে সুন্নীণদের যুগ ফিরে আসে এবং বুয়াইহীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর ওবায়দীরাও দুর্বল হয়ে পড়ে। পুনরায় তাদের কেন্দ্রে ফিরে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এর পর তারা হয়ে পড়ে বিলীন। তবে তাদের চিহ্ন আর বিশ্বাস নিশ্চিত হয়নি। ইরানে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে হাশাশী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। হাসান ইবনে সাববাহ ছিল এই নব উদ্ভূত সম্প্রদায়ের নেতা।
বিপ্লব আর রাজনৈতিক জাগরণের সে যুগটাতে অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো বনু হামদানদের উদ্ভব হয়। দাঙ্গা হাঙ্গামার অনেক আন্দোলনে তারা অংশগ্রহণ করে। মুসেল, জাযিরা এবং উত্তর সিরিয়া পর্যন্তও তারা পৌঁছে। কখনো তারা ছিল শাসকদের সঙ্গে, আবার কখনো দাঁড়ায় শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে। আরবের প্রসিদ্ধ ‘তগলব’ কবিলার সাথে এ পরিবার সম্পৃক্ত। ইসলাম এবং জাহেলি যুগে ফোরাতের একটা দ্বীপে ছিল এদের কেন্দ্র। এ পরিবারে প্রথম যে ব্যক্তিটির উদ্ভব ঘটে, সে ছিল হামদান ইবনে হামদূন তগলবী। আল-জাযিরায় খারেজীদের বিপ্লবের প্রতি সে সমর্থন জ্ঞাপন করে। ফলে আববাসীয় খলিফা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বহির্গত হয়ে জয় লাভ করেন। হামদান পলায়ন করে; কিন্তু সৈন্যরা তার পিছু ধাওয়া করে। ফলে তার জন্য পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে পড়লে সে আশ্রয় প্রার্থী হয়। খলিফা মুতায়েদ তাকে পাকড়াও করে বন্দী করে।1
খলিফা মুকতাফীর শাসনামলে আবুল হীজা আব্দুল্লাহ ইবনে হামদান ইবনে হামদূন মুসেল এবং তৎসান্নিহিত অঞ্চলের শাসনকর্তা হয়। আববাসীয় খলিফা আল- মুকতাদির- এর বিরুদ্ধে বিপ্লব আর গোলযোগে আবুল হীজা অংশ গ্রহণ করে। এই গোলযোগে সে নিহত হলে তার পুত্র হাসান মুসেল এর শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়। আর তার ভাই আলী সাইফুদ্দৌলা হালবের অধিপতি হয়ে ৩৩৩ হিজরী থেকে তাকে রাজধানীতে পরিণত করে। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধে সে দেশের সীমান্ত ভালোভাবে রক্ষা করে। রোমানদের শিক্ষা দেয়ার জন্য অনেক অভিযানে সে নিজে নেতৃত্ব দেয়। ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর তার সম্পর্কে বলেন . তার মধ্যে শিয়া মতবাদের ভাব থাকা সত্ত্বেও সাহসী শাসক এবং অনেক কল্যাণকর নৃপতিদের মধ্যে সে ছিল অন্যতম।2 তার এবং রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। ৩৩৯, ৩৪২ এবং ৩৪৩ হিজরীর ঘটনাবলীতে সাইফুদ্দৌলা রোমানদের বিরুদ্ধে বিপুল বিজয় অর্জন করে। কবি মোতানাববী তার একটি প্রসিদ্ধ কবিতায়ও এসব বীরত্বের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এরা প্রচুর রক্তপাত আর লুটতরাজের পরই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পেরেছে (যেভাবে সেকালে এবং একালে অধিকাংশ দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়)।
সাধারণত . এসব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে বীরত্ব এবং বিদ্যানুরাগের মতো কিছু মহৎ গুণ থাকে। সাইফুদ্দৌলার মধ্যেও এসব গুণাবলির প্রকাশ ঘটেছে। তবে সে রাষ্ট্রে শিয়া মতবাদের ভাবও ছিল। তবে তা ছিল বদ্দুদের শিয়া ভাব, যারা দর্শন নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না বা কোন তত্ত্ব নিয়ে বাড়বাড়িও করে না। তবে তার এ শিয়া ভাব অন্যান্য শিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেই হিজরী ৩৫৮ সালে আবু তগলব ইবনে হামদান কারামেতাদের নিকট কিছু উপঢৌকন প্রেরণ করেন, যার মূল্য ছিল ৫০ হাজার দিরহাম।3 কেবল উপঢৌকন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাদের বাস্তব সহযোগিতাও করেছেন। কারামেতারা মিশর এবং সিরিয়ার অধিপতি আখশীদাস এর হাত থেকে তাবারিয়া শহর অধিকার করতে চাইলে সাইফুদ্দৌলার নিকট লোহা দিয়ে সাহায্য করার আবেদন জানান। অস্ত্র তৈরির জন্য তিনি তাদের জন্য রিক্কা অঞ্চলের প্রাচীর দ্বার ভেঙে দেন। তিনি তাদের জন্য লৌহবৎ মানুষ লাভ করেন। এমনকি ব্যবসায়ীদের পরিমাপ যন্ত্র পর্যন্ত গ্রহণ করে এসব তাদের জন্য প্রেরণ করেন।4
হুসাইন ইবনে হামদান মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়ে ইবনুল মুতায এর জন্য বাইয়াত গ্রহণের চেষ্টা করেন। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . গোঁড়া শিয়া এবং আলী ও আহলে বায়তের প্রতি ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও ইবনুল মু’তায- এর বায়য়াতের জন্য তিনি চেষ্টা করেন। যদিও ইবনুল মু’তায ছিলেন আলীর বিরোধী এবং প্রতিকৃতি সম্পর্কে তার বাড়াবাড়ি ছিল।5 দিয়ারে বকর- এর শাসক আবু আলী ইবনে মারওয়ান এবং হামদানীদের যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন হুসাইন ইবনে হামদান বন্দী হয়। এহেন কঠিন দশায় মিশরের ওবায়দী শাসনকর্তা তার পক্ষে সুপারিশ করে পত্র লিখলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তখন সে মিশর চলে যায় এবং তখন তার থেকে হালবের দায়িত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়।6
আলী ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামদানের শাসনামলে এ রাষ্ট্র প্রস্ফুটিত হলেও তার মৃত্যুর পর উক্ত অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতোই কোন রকমে টিকে থাকে। শাসন কর্তৃত্ব লাভ করার জন্য চলে যুদ্ধ আর গুঁতাগুঁতি। শেষ পর্যন্ত তার পুত্র আবুল মা’আলী রোম শাসককে জিযিয়া দেয়। আবুল মাআলীর মৃত্যুর পর তার পুত্র সাঈদ আবুল ফাযায়েল ক্ষমতাসীন হয়ে ক্ষমতা-দর্পী তুর্কিদের হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তিন বার রোমানদের নিকট সাহায্য কামনা করে।7
খলিফা মুকতাফীর শাসনামলে আবুল হীজা আব্দুল্লাহ ইবনে হামদান ইবনে হামদূন মুসেল এবং তৎসান্নিহিত অঞ্চলের শাসনকর্তা হয়। আববাসীয় খলিফা আল- মুকতাদির- এর বিরুদ্ধে বিপ্লব আর গোলযোগে আবুল হীজা অংশ গ্রহণ করে। এই গোলযোগে সে নিহত হলে তার পুত্র হাসান মুসেল এর শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়। আর তার ভাই আলী সাইফুদ্দৌলা হালবের অধিপতি হয়ে ৩৩৩ হিজরী থেকে তাকে রাজধানীতে পরিণত করে। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধে সে দেশের সীমান্ত ভালোভাবে রক্ষা করে। রোমানদের শিক্ষা দেয়ার জন্য অনেক অভিযানে সে নিজে নেতৃত্ব দেয়। ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর তার সম্পর্কে বলেন . তার মধ্যে শিয়া মতবাদের ভাব থাকা সত্ত্বেও সাহসী শাসক এবং অনেক কল্যাণকর নৃপতিদের মধ্যে সে ছিল অন্যতম।2 তার এবং রোমানদের মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। ৩৩৯, ৩৪২ এবং ৩৪৩ হিজরীর ঘটনাবলীতে সাইফুদ্দৌলা রোমানদের বিরুদ্ধে বিপুল বিজয় অর্জন করে। কবি মোতানাববী তার একটি প্রসিদ্ধ কবিতায়ও এসব বীরত্বের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এরা প্রচুর রক্তপাত আর লুটতরাজের পরই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে পেরেছে (যেভাবে সেকালে এবং একালে অধিকাংশ দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়)।
সাধারণত . এসব রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে বীরত্ব এবং বিদ্যানুরাগের মতো কিছু মহৎ গুণ থাকে। সাইফুদ্দৌলার মধ্যেও এসব গুণাবলির প্রকাশ ঘটেছে। তবে সে রাষ্ট্রে শিয়া মতবাদের ভাবও ছিল। তবে তা ছিল বদ্দুদের শিয়া ভাব, যারা দর্শন নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না বা কোন তত্ত্ব নিয়ে বাড়বাড়িও করে না। তবে তার এ শিয়া ভাব অন্যান্য শিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেই হিজরী ৩৫৮ সালে আবু তগলব ইবনে হামদান কারামেতাদের নিকট কিছু উপঢৌকন প্রেরণ করেন, যার মূল্য ছিল ৫০ হাজার দিরহাম।3 কেবল উপঢৌকন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাদের বাস্তব সহযোগিতাও করেছেন। কারামেতারা মিশর এবং সিরিয়ার অধিপতি আখশীদাস এর হাত থেকে তাবারিয়া শহর অধিকার করতে চাইলে সাইফুদ্দৌলার নিকট লোহা দিয়ে সাহায্য করার আবেদন জানান। অস্ত্র তৈরির জন্য তিনি তাদের জন্য রিক্কা অঞ্চলের প্রাচীর দ্বার ভেঙে দেন। তিনি তাদের জন্য লৌহবৎ মানুষ লাভ করেন। এমনকি ব্যবসায়ীদের পরিমাপ যন্ত্র পর্যন্ত গ্রহণ করে এসব তাদের জন্য প্রেরণ করেন।4
হুসাইন ইবনে হামদান মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়ে ইবনুল মুতায এর জন্য বাইয়াত গ্রহণের চেষ্টা করেন। তার সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . গোঁড়া শিয়া এবং আলী ও আহলে বায়তের প্রতি ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও ইবনুল মু’তায- এর বায়য়াতের জন্য তিনি চেষ্টা করেন। যদিও ইবনুল মু’তায ছিলেন আলীর বিরোধী এবং প্রতিকৃতি সম্পর্কে তার বাড়াবাড়ি ছিল।5 দিয়ারে বকর- এর শাসক আবু আলী ইবনে মারওয়ান এবং হামদানীদের যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন হুসাইন ইবনে হামদান বন্দী হয়। এহেন কঠিন দশায় মিশরের ওবায়দী শাসনকর্তা তার পক্ষে সুপারিশ করে পত্র লিখলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তখন সে মিশর চলে যায় এবং তখন তার থেকে হালবের দায়িত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়।6
আলী ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে হামদানের শাসনামলে এ রাষ্ট্র প্রস্ফুটিত হলেও তার মৃত্যুর পর উক্ত অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতোই কোন রকমে টিকে থাকে। শাসন কর্তৃত্ব লাভ করার জন্য চলে যুদ্ধ আর গুঁতাগুঁতি। শেষ পর্যন্ত তার পুত্র আবুল মা’আলী রোম শাসককে জিযিয়া দেয়। আবুল মাআলীর মৃত্যুর পর তার পুত্র সাঈদ আবুল ফাযায়েল ক্ষমতাসীন হয়ে ক্ষমতা-দর্পী তুর্কিদের হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তিন বার রোমানদের নিকট সাহায্য কামনা করে।7
শিয়াদের সহায়তার বদৌলতে বাগদাদের পশ্চিমাঞ্চলের হিল্লা নগরীতে অপর একটি আরব গোত্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তবে বনু আসাদের এসব শাসকরা তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং আববাসীয় রাষ্ট্রের অনেক ঘটনা প্রবাহেই তারা অংশ গ্রহণ করে। এসব ঘটনাবলীর মধ্যে রয়েছে বিপর্যয় উস্কে দেয়া এবং খলিফার জন্য সংকট সৃষ্টি করা। অনুরূপ ভাবে তারা আশপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলোর তাৎক্ষণিক বিপ্লবেও অংশগ্রহণ করে।
আবুল হাসান আলী ইবনে মাযীদ আস- আসাদী এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। হিজরী ৩৮৭ সালের ঘটনাবলীতে তাকে একটি আরব গোত্রের আমির উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তার বেশ মর্যাদা রয়েছে এবং আশপাশের দেশগুলোও তাকে শুমার করে। হিজরী ৪০৩ হিজরীতে তার পুত্র দাবীস নেতা হয়। তার শাসনামলে এ গোত্রটি ইরাকের ঘটনাপ্রবাহে বিরাট ভূমিকা পালন করে। তখন সে বুয়াইহীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেও হস্তক্ষেপ করে। বুয়াইহী এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দ্বন্দ্বেও সে বেশ ভূমিকা পালন করে। বনু খাফাজার মতো অন্যান্য গোত্রের দ্বন্দ্বেও সে বেশ ভূমিকা পালন করে। বনু খাফাজার মতো অন্যান্য গোত্রের দ্বন্দ্বসংঘাতেও সে হস্তক্ষেপ করে।
এ গোত্রের সবচেয়ে খ্যাতিমান নেতা ছিলেন ছাদকা ইবনে মনসূর ইবনে দাবীস। যে কোন বিপর্যয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা তিনি দাদার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। আলাপ আরসান সলজুকীর নাতিদের মধ্যে যুদ্ধে তিনি নিজেকে উপস্থিত করেন। তিনিই শক্তিশালীদের সঙ্গে থাকতেন। এমন এক বিপর্যয়কালে তিনি নিহত হন। তিনিই হিল্লা নগরী পত্তন করেন। ইতিপূর্বে তারা তাঁবুতে বাস করতো। পুত্র দাবীসও তাঁর রীতি অনুসরণ করে চলেন। তাকে হিল্লা থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি সিরিয়া গমন করেন এবং হালব অবরোধে রোমকদের সহায়তা করেন এ শর্তে যে, মুসলমানদের উপর বিজয় লাভ করলে তাকে শাসনকর্তা করা হবে। কিন্তু হামলা ব্যর্থ হয় এবং দাবীস হিল্লায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এলে তাকে বন্দী এবং সুলতান মাসউদ সালজুকীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। এভাবে ৫৫১ হিজরীতে এ রাষ্ট্রের সমাপ্তি ঘটে। এ সময় খলিফা তাদের একাধিক বিপর্যয় আর দাঙ্গা- হাঙ্গামার জন্য অভিযুক্ত করে বনু আসাদকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।1
এ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি আরসালান বাসাসীরীকে সহায়তা দান করে, যে ছিল মিসরে ওবায়দীদের আনুগত্যের প্রতি আহবানকারী। সে ছিল বাহাউদ্দৌলা ইবনে আযদুদ্দৌলা বুয়াইহীর তুর্কি ক্রীতদাস। এরপর ধাপে ধাপে উন্নতি করে একজন মশহুর নেতা হয়। অতঃপর মিশরের শাসনকর্তাকে তিনি লিখেন বাগদাদ অধিকারে তাকে সহায়তা করার জন্য। এ ক্ষেত্রে দাবীস ইবনে মাযীদ তাকে সহায়তা করে। বাসাসীরী বাঘের মতো সাহস নিয়ে বাগদাদ প্রবেশ করে জামে মনসূরে ওবায়দী শাসনকর্তা মুস্তানসিরের পক্ষে খুতবা পাঠ করেন। কারখ বাসী রাফেযী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে গ্রহণ করে নেয় এবং তাদের নিকট থেকে পুরস্কার গ্রহণ করার অনুরোধ জানায়।2 তার নির্দেশে আজানে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ উচ্চারণ করা হয়। এটা হিজরী ৪৫০ সনের ঘটনা। দারুল খেলাফত লুণ্ঠন করে এলে তাকে মিসরে প্রেরণ করা হয় সেখানে গিয়ে বাগদাদে কি অর্জন করলেন তার বিবরণ দানের জন্য। কিন্তু ওবায়দী উজির তাকে বরণও করেনি, কোন গুরুত্বও দেয়নি। বরং তাকে ঘৃণা-ই করে। এরপর বেশি দিন যেতে না যেতেই সেলজুকী সুলতান তুগরল বেগ এর আগমন ঘটে। তিনি বাগদাদ প্রবেশ করে বাসাসীরীকে কুফা বা তার আশপাশ থেকে পাকড়াও করে আনার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তাকে পাকড়াও করতে সৈন্যরা সফল হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হয়।3 আসাদীরা শিয়া মতাবলম্বী বিধায় এ ধর্মত্যাগীদের সহায়তা করে, যেমন তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রোমানদের সহায়তা দান করে।
আবুল হাসান আলী ইবনে মাযীদ আস- আসাদী এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। হিজরী ৩৮৭ সালের ঘটনাবলীতে তাকে একটি আরব গোত্রের আমির উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তার বেশ মর্যাদা রয়েছে এবং আশপাশের দেশগুলোও তাকে শুমার করে। হিজরী ৪০৩ হিজরীতে তার পুত্র দাবীস নেতা হয়। তার শাসনামলে এ গোত্রটি ইরাকের ঘটনাপ্রবাহে বিরাট ভূমিকা পালন করে। তখন সে বুয়াইহীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেও হস্তক্ষেপ করে। বুয়াইহী এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দ্বন্দ্বেও সে বেশ ভূমিকা পালন করে। বনু খাফাজার মতো অন্যান্য গোত্রের দ্বন্দ্বেও সে বেশ ভূমিকা পালন করে। বনু খাফাজার মতো অন্যান্য গোত্রের দ্বন্দ্বসংঘাতেও সে হস্তক্ষেপ করে।
এ গোত্রের সবচেয়ে খ্যাতিমান নেতা ছিলেন ছাদকা ইবনে মনসূর ইবনে দাবীস। যে কোন বিপর্যয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা তিনি দাদার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। আলাপ আরসান সলজুকীর নাতিদের মধ্যে যুদ্ধে তিনি নিজেকে উপস্থিত করেন। তিনিই শক্তিশালীদের সঙ্গে থাকতেন। এমন এক বিপর্যয়কালে তিনি নিহত হন। তিনিই হিল্লা নগরী পত্তন করেন। ইতিপূর্বে তারা তাঁবুতে বাস করতো। পুত্র দাবীসও তাঁর রীতি অনুসরণ করে চলেন। তাকে হিল্লা থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি সিরিয়া গমন করেন এবং হালব অবরোধে রোমকদের সহায়তা করেন এ শর্তে যে, মুসলমানদের উপর বিজয় লাভ করলে তাকে শাসনকর্তা করা হবে। কিন্তু হামলা ব্যর্থ হয় এবং দাবীস হিল্লায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এলে তাকে বন্দী এবং সুলতান মাসউদ সালজুকীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। এভাবে ৫৫১ হিজরীতে এ রাষ্ট্রের সমাপ্তি ঘটে। এ সময় খলিফা তাদের একাধিক বিপর্যয় আর দাঙ্গা- হাঙ্গামার জন্য অভিযুক্ত করে বনু আসাদকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন।1
এ ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি আরসালান বাসাসীরীকে সহায়তা দান করে, যে ছিল মিসরে ওবায়দীদের আনুগত্যের প্রতি আহবানকারী। সে ছিল বাহাউদ্দৌলা ইবনে আযদুদ্দৌলা বুয়াইহীর তুর্কি ক্রীতদাস। এরপর ধাপে ধাপে উন্নতি করে একজন মশহুর নেতা হয়। অতঃপর মিশরের শাসনকর্তাকে তিনি লিখেন বাগদাদ অধিকারে তাকে সহায়তা করার জন্য। এ ক্ষেত্রে দাবীস ইবনে মাযীদ তাকে সহায়তা করে। বাসাসীরী বাঘের মতো সাহস নিয়ে বাগদাদ প্রবেশ করে জামে মনসূরে ওবায়দী শাসনকর্তা মুস্তানসিরের পক্ষে খুতবা পাঠ করেন। কারখ বাসী রাফেযী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে গ্রহণ করে নেয় এবং তাদের নিকট থেকে পুরস্কার গ্রহণ করার অনুরোধ জানায়।2 তার নির্দেশে আজানে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ উচ্চারণ করা হয়। এটা হিজরী ৪৫০ সনের ঘটনা। দারুল খেলাফত লুণ্ঠন করে এলে তাকে মিসরে প্রেরণ করা হয় সেখানে গিয়ে বাগদাদে কি অর্জন করলেন তার বিবরণ দানের জন্য। কিন্তু ওবায়দী উজির তাকে বরণও করেনি, কোন গুরুত্বও দেয়নি। বরং তাকে ঘৃণা-ই করে। এরপর বেশি দিন যেতে না যেতেই সেলজুকী সুলতান তুগরল বেগ এর আগমন ঘটে। তিনি বাগদাদ প্রবেশ করে বাসাসীরীকে কুফা বা তার আশপাশ থেকে পাকড়াও করে আনার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। তাকে পাকড়াও করতে সৈন্যরা সফল হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হয়।3 আসাদীরা শিয়া মতাবলম্বী বিধায় এ ধর্মত্যাগীদের সহায়তা করে, যেমন তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রোমানদের সহায়তা দান করে।
কায়রোয় ওবায়দীদের প্রতি আহবানকারী একটা রাষ্ট্র ইয়ামানে পাওয়া যাওয়া কোন বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। শিয়া মতাবলম্বী প্রচারক যিনি ওবায়দীদের জন্য রাজত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন, তিনি ছিলেন ইয়ামানের একজন প্রচারক। সেখান থেকে তিনি হেজায গমন করেন। হেজায থেকে গমন করেন উত্তর আফ্রিকায়। তিনি স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন করলেও প্রচার কার্য অব্যাহত ছিল। সে সব স্থানে এমন লোক ছিল, যারা তাদের পরিচিত ধারায় সন্দেহ সংশয়ে পতিত লোকজনকে আহবান জানাতো।
তাদের আহবানে প্রভাবিত হয় আলী ইবনে মুহাম্মদ সুলাইহী। আসলে তিনি ছিলেন সুন্নীণ পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা ছিলেন ইয়ামানের অন্যতম কাজি বা বিচারক। যে ব্যক্তি তাকে বিভ্রান্ত ও আগ্রহী করে তোলে, সে হচ্ছে আমের ইবনে আব্দুল্লাহ যাওয়াহী। তার মধ্যে শরাফতের কিছু লক্ষণ পাওয়া যায়। তাই ওছিয়ত করেন যে, তারপরে সুলাইহী হবে তাঁর খলিফা। যাওয়াহীর ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়। হিজরী ৪২৯ সালে সুলাইহী তদীয় সঙ্গীদের সঙ্গে মিসার পর্বতের শীর্ষ দেশে একটা বৈঠকে মিলিত হন এবং সেখানে একটা দুর্গ নির্মাণ করেন। এসব বন্ধুরাই তাকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করেছিল।
অতঃপর স্থানটি একটা মিলন কেন্দ্র এমনকি নগরে পরিণত হতে থাকে এবং মিসরে মুস্তানাসিরের পক্ষে আহবান জানানো শুরু হয়। ৪৪৫ হিজরীতে তিনি গোটা ইয়ামানের অধিপতি হন। তিহামার শাসনকর্তাকে হত্যা করার পর তিনি সানা তে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেন। তাঁর রাজত্বে স্ত্রী আসমা বিনতে শিহাবের বিরাট মর্যাদার আসন ছিল।
হিজরী ৪৫৯ সালে সুলাইহী হেজাযকে ওবায়দীয়া রাষ্ট্রের অনুগত করার জন্য বহির্গত হন। তার প্রতীক্ষায় ছিলেন সাঈদ ইবনে নাজাহ, যিনি ছিলেন তিহামার নিহত শাসকের পুত্র। কোন কোন গোত্র তাকে সহায়তা করে। ফলে তারা সুলাইহীকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
আলী ইবনে মুহাম্মদ সুলাইহীর হত্যার পর তাদের রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। যদিও তাদীয় পুত্র আহমদের সহায়তায় কিছু কাল সে রাষ্ট্র টিকে ছিল। কার্যত: এসময় নির্দেশ চলতো তার স্ত্রী আরওয়ার। হিজরী ৪৭১ সালে সে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তখন সে হোররা বা স্বাধীনা উপাধি ধারণ করে। ওবায়দী শাসক মুস্তানসির তাকে ‘হোররা সাহীদা’ বা ন্যায়পরায়ণা স্বাধীন রমণী বলে সম্বোধন করতেন। ৫২৫ হিজরীর পর যুবায়দা এবং ছা’দ স্বাধীন হয়। ধীরে ধীরে তাদের রাষ্ট্র পতনের দিকে এগিয়ে যায় এবং আল্লাহ তাদের থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেন।1
তাদের আহবানে প্রভাবিত হয় আলী ইবনে মুহাম্মদ সুলাইহী। আসলে তিনি ছিলেন সুন্নীণ পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা ছিলেন ইয়ামানের অন্যতম কাজি বা বিচারক। যে ব্যক্তি তাকে বিভ্রান্ত ও আগ্রহী করে তোলে, সে হচ্ছে আমের ইবনে আব্দুল্লাহ যাওয়াহী। তার মধ্যে শরাফতের কিছু লক্ষণ পাওয়া যায়। তাই ওছিয়ত করেন যে, তারপরে সুলাইহী হবে তাঁর খলিফা। যাওয়াহীর ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়। হিজরী ৪২৯ সালে সুলাইহী তদীয় সঙ্গীদের সঙ্গে মিসার পর্বতের শীর্ষ দেশে একটা বৈঠকে মিলিত হন এবং সেখানে একটা দুর্গ নির্মাণ করেন। এসব বন্ধুরাই তাকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করেছিল।
অতঃপর স্থানটি একটা মিলন কেন্দ্র এমনকি নগরে পরিণত হতে থাকে এবং মিসরে মুস্তানাসিরের পক্ষে আহবান জানানো শুরু হয়। ৪৪৫ হিজরীতে তিনি গোটা ইয়ামানের অধিপতি হন। তিহামার শাসনকর্তাকে হত্যা করার পর তিনি সানা তে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেন। তাঁর রাজত্বে স্ত্রী আসমা বিনতে শিহাবের বিরাট মর্যাদার আসন ছিল।
হিজরী ৪৫৯ সালে সুলাইহী হেজাযকে ওবায়দীয়া রাষ্ট্রের অনুগত করার জন্য বহির্গত হন। তার প্রতীক্ষায় ছিলেন সাঈদ ইবনে নাজাহ, যিনি ছিলেন তিহামার নিহত শাসকের পুত্র। কোন কোন গোত্র তাকে সহায়তা করে। ফলে তারা সুলাইহীকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
আলী ইবনে মুহাম্মদ সুলাইহীর হত্যার পর তাদের রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। যদিও তাদীয় পুত্র আহমদের সহায়তায় কিছু কাল সে রাষ্ট্র টিকে ছিল। কার্যত: এসময় নির্দেশ চলতো তার স্ত্রী আরওয়ার। হিজরী ৪৭১ সালে সে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তখন সে হোররা বা স্বাধীনা উপাধি ধারণ করে। ওবায়দী শাসক মুস্তানসির তাকে ‘হোররা সাহীদা’ বা ন্যায়পরায়ণা স্বাধীন রমণী বলে সম্বোধন করতেন। ৫২৫ হিজরীর পর যুবায়দা এবং ছা’দ স্বাধীন হয়। ধীরে ধীরে তাদের রাষ্ট্র পতনের দিকে এগিয়ে যায় এবং আল্লাহ তাদের থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেন।1
হিজরী চতুর্থ শতাব্দী শতাব্দী এবং তৎপর বর্তী কালে যেসব রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, সেসব সম্পর্কে এ বিবরণ পেশ করার পর আমরা নিম্নোক্ত ফলাফলে পৌঁছি।
এক . এসব রাষ্ট্র পরস্পরকে সহায়তা করে; যদিও বাহ্যদর্শী ব্যক্তি তাদের মধ্যে কোন সহযোগিতা বা সম্পর্ক দেখতে পায় না। শিয়াদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং তাদের অন্তর্নিহিত চরিত্র সম্পর্কে অবগত না হয়ে যে ব্যক্তি ইতিহাস অধ্যয়ন করে, সে জানবে না যে, তারা কেমন কর্মকান্ড চায় এবং কেমন আচরণ করে পরস্পরে। কোন সিদ্ধান্ত বা ইতিহাসের বাহ্যিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা সম্পর্কে সে কোন সঠিক পরিণতিতে পৌঁছতে পারবে না। আধুনিক কালের অনেক রাজনীতিকের নিকটই এটা কঠিন যারা আক্বীদা- বিশ্বাস আর নানা ধর্ম ও কৃষ্টির গভীরে পৌছেনি, তাদের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন হবে যে, তাদের রীতিনীতি আচার আচরণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও কেন অমুক রাফেযী সেক্যুলার বাতেনী রাষ্ট্রের সহায়তা করে। তারা যেসব দর্শন নিয়ে চিন্তা করে তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে না। তাদের জন্য এর ব্যাখ্যা কঠিন হবে যে, যে দেশে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করা হয়, অথচ তখন দেশটি সেক্যুলার শিয়া রাষ্ট্র, সে দেশে মন্ত্রী সভার প্রধান হিসাবে কীভাবে একজন মহিলা সফল হতে পারে। আর শিয়ারা তাকে সহায়তা করছে, মদদ জোগাচ্ছে। তাদের নিকট এতে কোন বৈপরীত্য নেই। যতক্ষণ দেশটি শিয়া রাষ্ট্র থাকবে, তাদের মতে সহযোগিতা করা অপরিহার্য।
এসব রাজনীতিকরা ইসরাইলের সঙ্গে রাফেযী আর বাতেনী রাষ্ট্রের সহায়তার কোন ব্যাখ্যাও খুঁজে পাবে না। তারা ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখতে পেতো যে, দাবীস ইবনে ছাদকা আসাদী রোমে পলায়ন করে এবং তাদেরকে নিয়ে হালব শহর অবরোধ করে, যাতে পরবর্তীকালে সে হালব শহরের শাসক হতে পারে। তারা দেখতে পেত যে, ওবায়দী- বাতেনী রাষ্ট্রে ইহুদি- খ্রিস্টানরা মন্ত্রী ছিল।
দুই . এসব রাষ্ট্র বা তার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুন্নাহর কাঁধে ভর করে। যদি সুন্নীণরা তা প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়তা না করতো বা প্রতিরোধ করতো তবে প্রথম সুযোগেই তার পতন হতো। কিন্তু সাধারণ সুন্নীণদের অবহেলা- অমনোযোগিতা তাদেরকে দুশমনদের হাতের খেলনায় পরিণত করেছে। তাদেরকে দিয়ে মার দিয়েছে এবং তাদের ঘাড়ের উপর সিংহাসন স্থাপন করা হয়েছে। শিয়াপন্থী আবু আব্দুল্লাহ তাদেরকে নিয়ে খেলা করার আগে কাতামা গোত্র শিয়া বা ইসমাঈলী কোনটাই ছিল না। অথচ তারাই প্রতিষ্ঠা করেছে ওবায়দিয়া রাষ্ট্র। আর বুয়াইহীরা খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ শাসন করেছে আর সুন্নীণ আলেম এবং উযীররা তাদের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদেরকে সহায়তা করেছে।
তিন . এসব দেশের কোন কোনটির সূচনা হয়েছে এমন সব স্থান আর অঞ্চল থেকে, যেখানকার অধিবাসীরা সুন্নাহ সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ- মূর্খ, বরং এ অজ্ঞতাই তাদের উপর কর্তৃত্ব করতো। অবশ্য তাদের পর যেসব বাতেনী ফের্কার উদ্ভব হয়েছে, তারা সুন্নাহর কেন্দ্রস্থল দূরে পর্বত বা দুর্গম স্থান বাছাই করে নেয়। এসব থেকে বুঝা যায় যে, এজন্য তারা পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করে নীল নকশা এঁকেছিল। এ থেকে মুসলমানদের জন্য সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া অপরিহার্য হয়ে যায়, যাতে কোন একটা স্থানও এমন শুন্য না থাকে, যেখানে দুশমনরা সুযোগ পেয়ে প্রবেশ করতে পারে।
চার . এ স্রোতধারা ছিল অতি তীব্র বেগবান আর এসব দেশের কোন কোনটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল বীজশূন্য বৃক্ষ। তা দ্রুত উপরে উঠে এবং বিস্তার লাভ করে। কিন্তু যখন পড়ে যায় তখন আর উঠতে পারে না। তার প্রতি দয়া করারও কেউ থাকে না। যতক্ষণ মুসলমানরা তীব্র গতিতে ছুটে না যাবে, ততক্ষণ একটা শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলামত দেখা দেবে না। তাদেরকে নামাতে হবে আগের রাষ্ট্রের পতাকা আর স্মৃতি চিহ্ন। যেন এ মুহূর্তটির জন্য তারা নিতান্ত ধৈর্য সহকারে প্রতীক্ষার প্রহরণ গুনছিল।
এক . এসব রাষ্ট্র পরস্পরকে সহায়তা করে; যদিও বাহ্যদর্শী ব্যক্তি তাদের মধ্যে কোন সহযোগিতা বা সম্পর্ক দেখতে পায় না। শিয়াদের আক্বীদা-বিশ্বাস এবং তাদের অন্তর্নিহিত চরিত্র সম্পর্কে অবগত না হয়ে যে ব্যক্তি ইতিহাস অধ্যয়ন করে, সে জানবে না যে, তারা কেমন কর্মকান্ড চায় এবং কেমন আচরণ করে পরস্পরে। কোন সিদ্ধান্ত বা ইতিহাসের বাহ্যিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা সম্পর্কে সে কোন সঠিক পরিণতিতে পৌঁছতে পারবে না। আধুনিক কালের অনেক রাজনীতিকের নিকটই এটা কঠিন যারা আক্বীদা- বিশ্বাস আর নানা ধর্ম ও কৃষ্টির গভীরে পৌছেনি, তাদের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন হবে যে, তাদের রীতিনীতি আচার আচরণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও কেন অমুক রাফেযী সেক্যুলার বাতেনী রাষ্ট্রের সহায়তা করে। তারা যেসব দর্শন নিয়ে চিন্তা করে তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে না। তাদের জন্য এর ব্যাখ্যা কঠিন হবে যে, যে দেশে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করা হয়, অথচ তখন দেশটি সেক্যুলার শিয়া রাষ্ট্র, সে দেশে মন্ত্রী সভার প্রধান হিসাবে কীভাবে একজন মহিলা সফল হতে পারে। আর শিয়ারা তাকে সহায়তা করছে, মদদ জোগাচ্ছে। তাদের নিকট এতে কোন বৈপরীত্য নেই। যতক্ষণ দেশটি শিয়া রাষ্ট্র থাকবে, তাদের মতে সহযোগিতা করা অপরিহার্য।
এসব রাজনীতিকরা ইসরাইলের সঙ্গে রাফেযী আর বাতেনী রাষ্ট্রের সহায়তার কোন ব্যাখ্যাও খুঁজে পাবে না। তারা ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখতে পেতো যে, দাবীস ইবনে ছাদকা আসাদী রোমে পলায়ন করে এবং তাদেরকে নিয়ে হালব শহর অবরোধ করে, যাতে পরবর্তীকালে সে হালব শহরের শাসক হতে পারে। তারা দেখতে পেত যে, ওবায়দী- বাতেনী রাষ্ট্রে ইহুদি- খ্রিস্টানরা মন্ত্রী ছিল।
দুই . এসব রাষ্ট্র বা তার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুন্নাহর কাঁধে ভর করে। যদি সুন্নীণরা তা প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়তা না করতো বা প্রতিরোধ করতো তবে প্রথম সুযোগেই তার পতন হতো। কিন্তু সাধারণ সুন্নীণদের অবহেলা- অমনোযোগিতা তাদেরকে দুশমনদের হাতের খেলনায় পরিণত করেছে। তাদেরকে দিয়ে মার দিয়েছে এবং তাদের ঘাড়ের উপর সিংহাসন স্থাপন করা হয়েছে। শিয়াপন্থী আবু আব্দুল্লাহ তাদেরকে নিয়ে খেলা করার আগে কাতামা গোত্র শিয়া বা ইসমাঈলী কোনটাই ছিল না। অথচ তারাই প্রতিষ্ঠা করেছে ওবায়দিয়া রাষ্ট্র। আর বুয়াইহীরা খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ শাসন করেছে আর সুন্নীণ আলেম এবং উযীররা তাদের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদেরকে সহায়তা করেছে।
তিন . এসব দেশের কোন কোনটির সূচনা হয়েছে এমন সব স্থান আর অঞ্চল থেকে, যেখানকার অধিবাসীরা সুন্নাহ সম্পর্কে ছিল অজ্ঞ- মূর্খ, বরং এ অজ্ঞতাই তাদের উপর কর্তৃত্ব করতো। অবশ্য তাদের পর যেসব বাতেনী ফের্কার উদ্ভব হয়েছে, তারা সুন্নাহর কেন্দ্রস্থল দূরে পর্বত বা দুর্গম স্থান বাছাই করে নেয়। এসব থেকে বুঝা যায় যে, এজন্য তারা পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করে নীল নকশা এঁকেছিল। এ থেকে মুসলমানদের জন্য সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দেয়া অপরিহার্য হয়ে যায়, যাতে কোন একটা স্থানও এমন শুন্য না থাকে, যেখানে দুশমনরা সুযোগ পেয়ে প্রবেশ করতে পারে।
চার . এ স্রোতধারা ছিল অতি তীব্র বেগবান আর এসব দেশের কোন কোনটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল বীজশূন্য বৃক্ষ। তা দ্রুত উপরে উঠে এবং বিস্তার লাভ করে। কিন্তু যখন পড়ে যায় তখন আর উঠতে পারে না। তার প্রতি দয়া করারও কেউ থাকে না। যতক্ষণ মুসলমানরা তীব্র গতিতে ছুটে না যাবে, ততক্ষণ একটা শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আলামত দেখা দেবে না। তাদেরকে নামাতে হবে আগের রাষ্ট্রের পতাকা আর স্মৃতি চিহ্ন। যেন এ মুহূর্তটির জন্য তারা নিতান্ত ধৈর্য সহকারে প্রতীক্ষার প্রহরণ গুনছিল।
অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাবর্তনের সূচনার উদাহরণ দেয়া যায়; সেসব ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে জ্ঞান- বিজ্ঞান এবং জিহাদ। এসব কার্যকারণের প্রভাব কখনো ছিল প্রত্যক্ষ আর কখনো ছিল পরোক্ষ। ফলে তা প্রকাশ পেতো বিলম্বে, এমনকি কয়েক দশক পরে কোন কোন আববাসীয় খলিফার সুন্নাহ প্রকাশের প্রচেষ্টা এবং সে জন্য জোর দেয়া, সুন্নাহর সপক্ষে গ্রন্থ রচনা এবং তা মানুষের নিকট পাঠ করার মাধ্যমে সর্ব প্রথম এ পরিবর্তনের সূচনা হয়।
খলিফা কাদের বিল্লাহর খেলাফতকালে তিনি মুতাযেলী ফকীহদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং রাফেযী- মুতাযেলী ধর্মমত এবং ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ব্যক্ত করেন।1
হিজরী ৪২০ সালে কাজি আর আলেমদেরকে একত্রিত করে তাদেরকে খলিফা কাদের বিল্লাহ সংগৃহীত একটা গ্রন্থ পাঠ করে শোনানো হয়। এ গ্রন্থে বেদআত পন্থীদের প্রতিবাদ করে শিয়া খতিবদের থেকে দূরে থাকার আহবান জানানো হয়।2 সুলতান মাহমুদ ইবনে সুবুক্তগীন এ ক্ষেত্রে আমিরুল মুমেনীনের নির্দেশ মেনে নেন এবং মু’তাযেলী, রাফেযী ও ইসমাঈলীদেরকে শাস্তি দানের ব্যাপারে আমীরুল মু'মেনীনের নীতি অনুসরণ করেন। বিদআতপন্থী সকল দলকে তিনি দূরে রাখেন এবং তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন ও তাদের দার্শনিক গ্রন্থাদি জ্বালিয়ে দেন।3
খলিফা কাদের বিল্লাহর খেলাফতকালে তিনি মুতাযেলী ফকীহদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং রাফেযী- মুতাযেলী ধর্মমত এবং ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ব্যক্ত করেন।1
হিজরী ৪২০ সালে কাজি আর আলেমদেরকে একত্রিত করে তাদেরকে খলিফা কাদের বিল্লাহ সংগৃহীত একটা গ্রন্থ পাঠ করে শোনানো হয়। এ গ্রন্থে বেদআত পন্থীদের প্রতিবাদ করে শিয়া খতিবদের থেকে দূরে থাকার আহবান জানানো হয়।2 সুলতান মাহমুদ ইবনে সুবুক্তগীন এ ক্ষেত্রে আমিরুল মুমেনীনের নির্দেশ মেনে নেন এবং মু’তাযেলী, রাফেযী ও ইসমাঈলীদেরকে শাস্তি দানের ব্যাপারে আমীরুল মু'মেনীনের নীতি অনুসরণ করেন। বিদআতপন্থী সকল দলকে তিনি দূরে রাখেন এবং তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন ও তাদের দার্শনিক গ্রন্থাদি জ্বালিয়ে দেন।3
১. সুলতান মাহমুদ গযনবী (৩৬০-৪২১ হিজরী)
মাহমুদ ইবনে সুবুক্তগীনের নেতৃত্বে চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রাচ্যে এক শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এ শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তাঁর হাতে ছিল। সাসানী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তিনি ছিলেন নীশাপুরের শাসনকর্তা। তাঁর পিতা সবুক্তগীন ছিলেন একজন বড় শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন গজনির অধিপতি আবু ইসহাকের ক্রীতদাস। শাসন পরিচালনার যোগ্য কাউকে না রেখে তদীয় মুনিব ইন্তিকাল করলে তাঁর হাতে বাইয়াত করার ব্যাপারে সৈন্যরা একমত হয়। কারণ, তাদেরকে শাসন করার যোগ্যতা তাঁর মধ্যে ছিল, তাঁর ছিল প্রজ্ঞা- বুদ্ধিমত্তা এবং সুচরিত্র। তার মৃত্যুর পর পুত্র মাহমুদ শাসন- কর্তৃত্ব লাভ করে খোরা-সানের শাসনকর্তা হন। তিনি সাসানী রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে বাগদাদে খলিফার জন্য খুতবা পাঠ করেন।
অতঃপর মাহমুদ জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত হন এবং দেশের উপর থেকে যুদ্ধ রহিত করেন। এবং তিনি অতীতের সমস্ত ভুল দূর করার সংকল্প করেন হিজরী ৩৯২ সনে তিনি সর্বপ্রথম জিহাদ করেন।1 তাঁর প্রথম জিহাদ অভিযান ছিল ভারত অভিমুখে। এ অভিযানে তিনি দেবলের শাসনকর্তার উপর জয়লাভ করেন। এরপর তিনি ভারতে দেশটির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং সোমনাথ মন্দিরের সর্ববৃহৎ মূর্তি ধ্বংস করেন। এটা হিজরী ৪১৬ সালের ঘটনা। ফলে ভারত ইসলামি শাসনের নিকট বশ্যতা স্বীকার করে। তিনি ভারতে ইসলামের বাণী প্রচার করেন।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর জীবনী প্রসঙ্গে বলেন: তিনি ছিলেন মহান শাসক মহান মুজাহিদ এবং গাজি। গযনী রাজ্যের অধিপতি আবুল কাসেম। ভারতে তিনি অনেক অভিযানে বিজয়ী হন। তার পূর্বে এবং পরে ভারতে অপর কোন শাসকের পক্ষে এমন বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তিনি প্রভূত গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। এত সবের পরও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত। পাপ এবং পাপীকে তিনি ঘৃণা করতেন। আলেম আর মুহাদ্দিসকে তিনি ভালোবাসতেন। দ্বীনদার এবং কল্যাণকর ব্যক্তিদেরকে তিনি ভালোবাসতেন।2
মিশরের ফাতেমী খলিফারা উপহার-উপঢৌকন দিয়ে তাঁর দেশে তাদের প্রোপাগান্ডার ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা চালালে তিনি গ্রন্থ আর উপঢৌকন জ্বালিয়ে দেন।3 এসব প্রোপাগান্ডায় তাদের প্রতিনিধি তাহাতীকেও তিনি হত্যা করেন। কাজি আবু মনসূর মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-ইযদীর নিকট তার খচ্চর উপহার হিসাবে প্রেরণ করে তিনি বলেন: এ খচ্চরের পিঠে আরোহণ করত: সবচেয়ে বড় নাস্তিক। এখন তার পিঠে আরোহণ করুক সবচেয়ে বড় তাওহীদবাদী।4 রায় অঞ্চল অধিকার করে তিনি খলিফা কদের বিল্লাহর নিকট পত্র লিখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন যে, মুইজ্জুদ্দৌলা বুয়াইহীর নিকট তিনি অনেক স্বাধীন রমণী দেখতে পান, যাদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের অধিক। এদের গর্ভে তার তিরিশটির অধিক সন্তান জন্ম নেয়। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে . এটা আমার পূর্ব পুরুষদের অভ্যাস। তার ঔরসে বাতেনী সম্প্রদায়ের সঙ্গীদের অনেকেরই জন্ম হয়েছে। তিনি মু’তাযেলী সম্প্রদায়ের লোকজনকে খোরাসানে নির্বাসিত করেন এবং দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যার বই পুস্তক জ্বালিয়ে দেন।5
এ মহান মুজাহিদ শাসক হিজরী ৪২১ সালে ইন্তিকাল করেন। এরপরও গযনীতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র দীর্ঘকাল টিকে ছিল। হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদে তাঁর দৌহিত্রও ছিল তাঁরই মতো। সুলতান মাহমুদ গযনবীর ভারত অধিকারের পর থেকে হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসন অটুট ছিল। এরপর ইংরেজদের শাসন চলে। ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় ভারতের শাসন ক্ষমতা হিন্দুদের হাতে দিয়ে যায়।
২. সেলজুক বংশ
গযনীর শাসকরা ভারতে অভিযান পরিচালনার প্রতি মনোযোগ দেয়, কিন্তু সেলজুক শাসকরা পশ্চিমের প্রতি মনোযোগ দিয়ে রাজধানী বাগদাদকে বুয়াইহী শাসকদের অধিকার থেকে মুক্ত করে। তারা আববাসীয় খলিফাকে বাসাসীরীদের আন্দোলন থেকেও মুক্ত করে। এই বাসাসীরীরা ছিল কায়রোর ওবায়দী শাসকদের সমর্থক। সেলজুক রাষ্ট্র সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এবং আনাযোলে রোমের প্রতিবেশী হয়। তারা প্রাচ্যে সমর-কন্দের মা-ওয়ারাউন নহর অতিক্রম করে যায়। তারা ইরাক এবং খোরাসানে রাফেযী এবং বাতেনীদের কোমর ভেঙে দেয়।
হিজরী ৪৩০ সালে সর্বপ্রথম এ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সেলজুকের নামানুসারে এ রাষ্ট্রের নামকরণ করা হয়। যিনি ছিলেন কাফের তুর্কি শাসকের অন্যতম সেনাপতি। তুর্কি শাসকের ভয়ে তিনি দেশ ত্যাগ করে মুসলিম দেশে গমন করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র মীকাঈল তুর্কি কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধের আয়োজন করে একটা যুদ্ধে নিহত হয়। মীকাঈলের স্থলাভিষিক্ত হয় মুহাম্মদ তুগরল বেগ এবং দাউদ জুগরী বেগ। কার্যত . এ দু’জনই সেলজুক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে তাকে সুদৃঢ় এবং সংহত করেন।1
তুগরল বেগের শাসনামলে তারা খোরাসান অধিকার করে বাগদাদ পর্যন্ত পৌঁছে। খলিফা বাসাসীরীদের নেতার হামলার আশঙ্কা রোধ করার জন্য তাদের নিকট ফরিয়াদ করলে তারা বাগদাদ নগরীতে প্রবেশ করে। তুগরল বেগের বাগদাদে প্রবেশের ফলে হিজরী ৪৪৭ সনে মসজিদের দরজা থেকে খলিফাদেরকে গালিগালাজ করে লেখা মুছে ফেলা হয়। রাষ্ট্র প্রধান রাফেযীদের নেতা আব্দুল্লাহ আল-জাল্লাবকে তার ভাড়াবাড়ির কারণে হত্যা করার নির্দেশ দেন।2 তুগরল বেগের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে দাউদ আলাপ আরসালান রাষ্ট্র প্রধান হন। তার শাসনামলে রাষ্ট্র চরম প্রসার লাভ করে এবং মুসলমানদের হারানো গৌরব ফিরে আসে। মুসলমানরা বিরাট বিজয় লাভ করে। আলপ আরসালান এবং রোম সেনাপতি আরমানুস এর মধ্যে সংঘটিত মাজকুর্দ এর যুদ্ধে মুসলমানরা রোমানদের উপর এমন স্মরণীয় বিজয় লাভ করে যা দীর্ঘদিন থেকে মুসলমানরা শুনতে পায়নি। অথচ এ যুদ্ধে রোম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে কয়েক শত গুণ বেশি ছিল3 এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বলেন .
হিজরী ৪৬৩ সালে রোম সেনাপতি আরমানুস পর্বতসম বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে। তার সঙ্গে ইংরেজ সৈন্যও। আলাপ আরসালান স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবিলা করেন। শত্রু পক্ষের ২০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী দেখে সুলতান কিছুটা ভীত হন। তখন ফকীহ আবু নছর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালেক আল বোখারি সুলতানকে শুক্রবার যুদ্ধ শুরু করতে বলেন, সে সময় সমস্ত মসজিদের ইমাম এবং খতিবরা যুদ্ধে তাদের বিজয়ের জন্য দোয়া করবে। উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলে সুলতান অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। আল্লাহ মুসলমানদেরকে সাহায্য করেন। বিশাল রোমান বাহিনী পরাজিত এবং তাদের অধিপতি বন্দী হয়।4
সুলতান আলাপ আরসালানের ভালো কাজের একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। হালব সফরকালে তিনি হালবের শাসনকর্তা মাহমুদ ইবনে মিরদাসকে তার সম্মুখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দান করেন। এ সময় মাহমুদ চালাকি করার চেষ্টা করে। উভয়ের মধ্যে দূত শরীফ তরাদ যায়নাবীকে বলে . সুলতানকে বল যে, মাহমুদ আববাসীয় খলিফাদের খিলাত পরিধান করেছে এবং তাদের পক্ষে খুতবা পাঠ করেছে। তখন সুলতান আরসালান বললেন . কোন বস্ত্ত তাদের খুতবার সমান হবে? তারাতো আজানে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ বলে। তাকে অবশ্যই হাজির হতে হবে।5
হিজরী ৪৬২ সালে মক্কার শাসনকর্তার দূত মুহাম্মদ ইবনে আবু হাশেম সুলতানের নিকট আগমন করে খলিফা কায়েম এবং সুলতানের পক্ষে খুতবা পাঠ করা, মিশরের ওবায়দী শাসকের পক্ষে খুতবা পাঠ ত্যাগ করা এবং আজানে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ ত্যাগ করার জন্য বললে সুলতান তাকে ৩০ হাজার দীনার দান করে বলেন . মদিনার আমির এ রকম কাজ করলে আমরা তাকে ২০ হাজার দীনার দান করব। তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . আলাপ আরসালান ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক, দানশীল এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি প্রচুর দান- দক্ষিণা করেন।6
আলাপ আরসালানের পুত্র মালেকশাহ- এর শাসনামলে রাষ্ট্রের শক্তি এবং বিস্তৃতি ঘটে। তবে অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো সে রাষ্ট্রেও দ্বীনি জযবা, রাষ্ট্র-প্রীতি আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং লোকজনের প্রতি কঠোরতার ঘটনা ঘটে। তবে তার একটা ভালো দিক এই যে, সে রাষ্ট্র এমন বীজ বপন করে, যার ফলাফল প্রকাশ পায় পরবর্তীকালে। তাদের স্বনামধন্য উজির ছিলেন হাসান ইবনে আলী, যার উপাধি ছিল নিযামুল মুলক। তিনি মালেক শাহকে পরামর্শ দেন এমন ব্যক্তিকে আমির এবং সেনাপতি নিয়োগ করার জন্য, যার মধ্যে রয়েছে চরিত্র, দীনদারি এবং বীরত্ব। এদের অন্যতম ছিলেন আক সানকার, যিনি ছিলেন নূরুদ্দীন মাহমুদের দাদা। হালব, দিয়ারে বকর ও জাযিরা অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর সম্পর্কে বলেন . চরিত্র আর অন্তর্নিহিত গুণ-মাধুর্যের বিচারে তিনি ছিলেন চমৎকার শাসক এবং সবচেয়ে বেশি দানশীল ব্যক্তি।7 তদীয় পুত্র ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদের সূচনা করেন। তাঁরপর তদীয় পুত্র নূরুদ্দীন মাহমুদ ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী সুলতান যাহের বায়বার্স এবং সুলতান কালাউন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যে বিজয় অভিযান শুরু করেন, এ পরিবার তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এর ফলে মুসলিম জাহানে তাওহীদ ও ঐক্যের যুগের সূচনা হয়।8
‘আক সানকার আল- বারসাকী’ও ছিলেন সুলতান মাহমুদ সেলজুকীর অন্যতম সেনাপতি। তিনি ছিলেন মুসেল অঞ্চলের শাসনকর্তা। ক্রুসেড যুদ্ধে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। ৫২০ হিজরীতে মুসেল মসজিদে নামাজরত অবস্থায় বাতেনীরা তাঁকে হত্যা করে। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর সম্পর্কে বলেন . তিনি একজন ভালো তুর্কি ক্রীতদাস। গুণী জ্ঞানী এবং নেককারদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। সুবিচার পছন্দ করতেন এবং নিজেও সুবিচার করতেন। তিনি ছিলেন অন্যতম উত্তম শাসক। সময় মতো যথারীতি নামাজ আদায় করতেন এবং রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন।9 সেলজুকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে খেলাফতের মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন, যা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিল: বিশেষ করে নিযামুল মূলকের মন্ত্রিত্বকালে। কারণ তিনি আইন এবং খেলাফতের মর্যাদা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন ভালোভাবে।10
নিযামুল মুলক জ্ঞানপিপাসাদের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সাহসিকতাপূর্ণ কাজ করেন। হিজরী ৪৫৯ সালে বাগদাদে নিযামিয়া মাদ্রাসার ইমারত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। নীশাপুর ইত্যাদি শহরেও তিনি মাদ্রাসার ইমারত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। সুন্নীণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার এ ধারা মিসরেও বিস্তার লাভ করে। অথচ তখন মিশর ছিল বাতেনী ওবায়দীদের শাসনাধীনে। খলিফা যাহের- এর উজির আবুল হাসান আলী ইবনে সালাম হিজরী ৫৪৪ সালে একটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং তার প্রধান করেন হাফেজ সালাফীকে। আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল শাফেয়িদের একমাত্র মাদ্রাসা। ৫৩২ হিজরীতে আওফিয়া মাদ্রাসা স্থাপিত হয় এবং মাদ্রাসার প্রধান নিযুক্ত করা হয় মালেকি ফকীহ ইবনে তাহের ইবনে আওফকে। এ দু’টি মাদ্রাসার উদ্দেশ্য শিয়াদের ধর্মমত সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সুন্নীণ মাজহাবের প্রতি আহবান জানানো।11
নিযামুল মুলক ছিলেন শাফেয়ি মজহাবের ফকীহ। হাদিস এবং অভিধান বিষয়েও তিনি ছিলেন পন্ডিত ব্যক্তি। ফকীহ আর আলেমদের দ্বারা তার দরবার জমজমাট ছিল। এরা তাঁর সঙ্গে সর্বদা সময় কাটাতেন। তিনি যথাসময়ে নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। তাঁর অন্যতম ভালো কাজ ছিল অন্যায় কর রহিত করা। যেসব আলেম তাকে কঠোর উপদেশ দিতেন এমন ব্যক্তিদেরকে তিনি সম্মান করতেন।12 ঐতিহাসিক আবু শামা তাঁর গুণাবলি আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন . তিনি ছিলেন আলেম , ফকীহ, বিশ্বস্ত, কল্যাণকামী, বিনয়ী এবং ন্যায়পরায়ণ। দ্বীনদারদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। তাঁর দান-ছদকা আর ওয়াকফ এর কোন সীমা ছিল না। সারা দুনিয়ায় তাঁর মাদ্রাসা খ্যাত। কোন শহর নগর এমন ছিল না, যেখানে তিনি মাদ্রাসা স্থাপন করেননি। এমনকি যাজীরা ইবনে আমর, যা ছিল দেশের এক প্রান্তে অবস্থিত, সেখানেও তিনি চমৎকার একটা বড় মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি যথারীতি নামাজ আদায় করতেন। ইবাদতের কাজে কেউ তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারতো না।13 আবু বকর তরতুশী এসব নির্মল জ্ঞান চর্চার প্রত্যক্ষ করেন এবং ‘সিরাজুল মুলুক’ গ্রন্থে তার বিবরণও দিয়েছেন। বাগদাদ সফরকালে তিনি এসব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেন।
হিজরী ৪৮৫ সালের শুরুতে উজির নিযামুল মূলক সুলতান মারেক শাহের সঙ্গে বাগদাদের উদ্দেশ্যে ইসফাহান থেকে বহির্গত হন। রমজানের দশম তারিখে নিহাওয়ান্দ এর নিকট একটা গ্রাম অতিক্রমকালে জনৈক বাতেনী বালক ভিখারির বেশে তাঁর নিকট আসে। বালকটি নিকটবর্তী হয়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে পালাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে নিহত হয়। কিছুক্ষণ পরই তিনি ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। বাতেনীরা ৫০০ হিজরীতে তাঁর পুত্র ফখরুল মুলককেও হত্যা করে।14
মাহমুদ ইবনে সুবুক্তগীনের নেতৃত্বে চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রাচ্যে এক শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এ শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব তাঁর হাতে ছিল। সাসানী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তিনি ছিলেন নীশাপুরের শাসনকর্তা। তাঁর পিতা সবুক্তগীন ছিলেন একজন বড় শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন গজনির অধিপতি আবু ইসহাকের ক্রীতদাস। শাসন পরিচালনার যোগ্য কাউকে না রেখে তদীয় মুনিব ইন্তিকাল করলে তাঁর হাতে বাইয়াত করার ব্যাপারে সৈন্যরা একমত হয়। কারণ, তাদেরকে শাসন করার যোগ্যতা তাঁর মধ্যে ছিল, তাঁর ছিল প্রজ্ঞা- বুদ্ধিমত্তা এবং সুচরিত্র। তার মৃত্যুর পর পুত্র মাহমুদ শাসন- কর্তৃত্ব লাভ করে খোরা-সানের শাসনকর্তা হন। তিনি সাসানী রাষ্ট্রের পতন ঘটিয়ে বাগদাদে খলিফার জন্য খুতবা পাঠ করেন।
অতঃপর মাহমুদ জিহাদের জন্য প্রস্ত্তত হন এবং দেশের উপর থেকে যুদ্ধ রহিত করেন। এবং তিনি অতীতের সমস্ত ভুল দূর করার সংকল্প করেন হিজরী ৩৯২ সনে তিনি সর্বপ্রথম জিহাদ করেন।1 তাঁর প্রথম জিহাদ অভিযান ছিল ভারত অভিমুখে। এ অভিযানে তিনি দেবলের শাসনকর্তার উপর জয়লাভ করেন। এরপর তিনি ভারতে দেশটির বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং সোমনাথ মন্দিরের সর্ববৃহৎ মূর্তি ধ্বংস করেন। এটা হিজরী ৪১৬ সালের ঘটনা। ফলে ভারত ইসলামি শাসনের নিকট বশ্যতা স্বীকার করে। তিনি ভারতে ইসলামের বাণী প্রচার করেন।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর জীবনী প্রসঙ্গে বলেন: তিনি ছিলেন মহান শাসক মহান মুজাহিদ এবং গাজি। গযনী রাজ্যের অধিপতি আবুল কাসেম। ভারতে তিনি অনেক অভিযানে বিজয়ী হন। তার পূর্বে এবং পরে ভারতে অপর কোন শাসকের পক্ষে এমন বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তিনি প্রভূত গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। এত সবের পরও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত। পাপ এবং পাপীকে তিনি ঘৃণা করতেন। আলেম আর মুহাদ্দিসকে তিনি ভালোবাসতেন। দ্বীনদার এবং কল্যাণকর ব্যক্তিদেরকে তিনি ভালোবাসতেন।2
মিশরের ফাতেমী খলিফারা উপহার-উপঢৌকন দিয়ে তাঁর দেশে তাদের প্রোপাগান্ডার ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা চালালে তিনি গ্রন্থ আর উপঢৌকন জ্বালিয়ে দেন।3 এসব প্রোপাগান্ডায় তাদের প্রতিনিধি তাহাতীকেও তিনি হত্যা করেন। কাজি আবু মনসূর মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-ইযদীর নিকট তার খচ্চর উপহার হিসাবে প্রেরণ করে তিনি বলেন: এ খচ্চরের পিঠে আরোহণ করত: সবচেয়ে বড় নাস্তিক। এখন তার পিঠে আরোহণ করুক সবচেয়ে বড় তাওহীদবাদী।4 রায় অঞ্চল অধিকার করে তিনি খলিফা কদের বিল্লাহর নিকট পত্র লিখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন যে, মুইজ্জুদ্দৌলা বুয়াইহীর নিকট তিনি অনেক স্বাধীন রমণী দেখতে পান, যাদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের অধিক। এদের গর্ভে তার তিরিশটির অধিক সন্তান জন্ম নেয়। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলে . এটা আমার পূর্ব পুরুষদের অভ্যাস। তার ঔরসে বাতেনী সম্প্রদায়ের সঙ্গীদের অনেকেরই জন্ম হয়েছে। তিনি মু’তাযেলী সম্প্রদায়ের লোকজনকে খোরাসানে নির্বাসিত করেন এবং দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যার বই পুস্তক জ্বালিয়ে দেন।5
এ মহান মুজাহিদ শাসক হিজরী ৪২১ সালে ইন্তিকাল করেন। এরপরও গযনীতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র দীর্ঘকাল টিকে ছিল। হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদে তাঁর দৌহিত্রও ছিল তাঁরই মতো। সুলতান মাহমুদ গযনবীর ভারত অধিকারের পর থেকে হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসন অটুট ছিল। এরপর ইংরেজদের শাসন চলে। ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় ভারতের শাসন ক্ষমতা হিন্দুদের হাতে দিয়ে যায়।
২. সেলজুক বংশ
গযনীর শাসকরা ভারতে অভিযান পরিচালনার প্রতি মনোযোগ দেয়, কিন্তু সেলজুক শাসকরা পশ্চিমের প্রতি মনোযোগ দিয়ে রাজধানী বাগদাদকে বুয়াইহী শাসকদের অধিকার থেকে মুক্ত করে। তারা আববাসীয় খলিফাকে বাসাসীরীদের আন্দোলন থেকেও মুক্ত করে। এই বাসাসীরীরা ছিল কায়রোর ওবায়দী শাসকদের সমর্থক। সেলজুক রাষ্ট্র সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এবং আনাযোলে রোমের প্রতিবেশী হয়। তারা প্রাচ্যে সমর-কন্দের মা-ওয়ারাউন নহর অতিক্রম করে যায়। তারা ইরাক এবং খোরাসানে রাফেযী এবং বাতেনীদের কোমর ভেঙে দেয়।
হিজরী ৪৩০ সালে সর্বপ্রথম এ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সেলজুকের নামানুসারে এ রাষ্ট্রের নামকরণ করা হয়। যিনি ছিলেন কাফের তুর্কি শাসকের অন্যতম সেনাপতি। তুর্কি শাসকের ভয়ে তিনি দেশ ত্যাগ করে মুসলিম দেশে গমন করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পুত্র মীকাঈল তুর্কি কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধের আয়োজন করে একটা যুদ্ধে নিহত হয়। মীকাঈলের স্থলাভিষিক্ত হয় মুহাম্মদ তুগরল বেগ এবং দাউদ জুগরী বেগ। কার্যত . এ দু’জনই সেলজুক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে তাকে সুদৃঢ় এবং সংহত করেন।1
তুগরল বেগের শাসনামলে তারা খোরাসান অধিকার করে বাগদাদ পর্যন্ত পৌঁছে। খলিফা বাসাসীরীদের নেতার হামলার আশঙ্কা রোধ করার জন্য তাদের নিকট ফরিয়াদ করলে তারা বাগদাদ নগরীতে প্রবেশ করে। তুগরল বেগের বাগদাদে প্রবেশের ফলে হিজরী ৪৪৭ সনে মসজিদের দরজা থেকে খলিফাদেরকে গালিগালাজ করে লেখা মুছে ফেলা হয়। রাষ্ট্র প্রধান রাফেযীদের নেতা আব্দুল্লাহ আল-জাল্লাবকে তার ভাড়াবাড়ির কারণে হত্যা করার নির্দেশ দেন।2 তুগরল বেগের মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ ইবনে দাউদ আলাপ আরসালান রাষ্ট্র প্রধান হন। তার শাসনামলে রাষ্ট্র চরম প্রসার লাভ করে এবং মুসলমানদের হারানো গৌরব ফিরে আসে। মুসলমানরা বিরাট বিজয় লাভ করে। আলপ আরসালান এবং রোম সেনাপতি আরমানুস এর মধ্যে সংঘটিত মাজকুর্দ এর যুদ্ধে মুসলমানরা রোমানদের উপর এমন স্মরণীয় বিজয় লাভ করে যা দীর্ঘদিন থেকে মুসলমানরা শুনতে পায়নি। অথচ এ যুদ্ধে রোম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে কয়েক শত গুণ বেশি ছিল3 এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বলেন .
হিজরী ৪৬৩ সালে রোম সেনাপতি আরমানুস পর্বতসম বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে। তার সঙ্গে ইংরেজ সৈন্যও। আলাপ আরসালান স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবিলা করেন। শত্রু পক্ষের ২০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী দেখে সুলতান কিছুটা ভীত হন। তখন ফকীহ আবু নছর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালেক আল বোখারি সুলতানকে শুক্রবার যুদ্ধ শুরু করতে বলেন, সে সময় সমস্ত মসজিদের ইমাম এবং খতিবরা যুদ্ধে তাদের বিজয়ের জন্য দোয়া করবে। উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলে সুলতান অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেন। আল্লাহ মুসলমানদেরকে সাহায্য করেন। বিশাল রোমান বাহিনী পরাজিত এবং তাদের অধিপতি বন্দী হয়।4
সুলতান আলাপ আরসালানের ভালো কাজের একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। হালব সফরকালে তিনি হালবের শাসনকর্তা মাহমুদ ইবনে মিরদাসকে তার সম্মুখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দান করেন। এ সময় মাহমুদ চালাকি করার চেষ্টা করে। উভয়ের মধ্যে দূত শরীফ তরাদ যায়নাবীকে বলে . সুলতানকে বল যে, মাহমুদ আববাসীয় খলিফাদের খিলাত পরিধান করেছে এবং তাদের পক্ষে খুতবা পাঠ করেছে। তখন সুলতান আরসালান বললেন . কোন বস্ত্ত তাদের খুতবার সমান হবে? তারাতো আজানে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ বলে। তাকে অবশ্যই হাজির হতে হবে।5
হিজরী ৪৬২ সালে মক্কার শাসনকর্তার দূত মুহাম্মদ ইবনে আবু হাশেম সুলতানের নিকট আগমন করে খলিফা কায়েম এবং সুলতানের পক্ষে খুতবা পাঠ করা, মিশরের ওবায়দী শাসকের পক্ষে খুতবা পাঠ ত্যাগ করা এবং আজানে ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ ত্যাগ করার জন্য বললে সুলতান তাকে ৩০ হাজার দীনার দান করে বলেন . মদিনার আমির এ রকম কাজ করলে আমরা তাকে ২০ হাজার দীনার দান করব। তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . আলাপ আরসালান ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক, দানশীল এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি প্রচুর দান- দক্ষিণা করেন।6
আলাপ আরসালানের পুত্র মালেকশাহ- এর শাসনামলে রাষ্ট্রের শক্তি এবং বিস্তৃতি ঘটে। তবে অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো সে রাষ্ট্রেও দ্বীনি জযবা, রাষ্ট্র-প্রীতি আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং লোকজনের প্রতি কঠোরতার ঘটনা ঘটে। তবে তার একটা ভালো দিক এই যে, সে রাষ্ট্র এমন বীজ বপন করে, যার ফলাফল প্রকাশ পায় পরবর্তীকালে। তাদের স্বনামধন্য উজির ছিলেন হাসান ইবনে আলী, যার উপাধি ছিল নিযামুল মুলক। তিনি মালেক শাহকে পরামর্শ দেন এমন ব্যক্তিকে আমির এবং সেনাপতি নিয়োগ করার জন্য, যার মধ্যে রয়েছে চরিত্র, দীনদারি এবং বীরত্ব। এদের অন্যতম ছিলেন আক সানকার, যিনি ছিলেন নূরুদ্দীন মাহমুদের দাদা। হালব, দিয়ারে বকর ও জাযিরা অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর সম্পর্কে বলেন . চরিত্র আর অন্তর্নিহিত গুণ-মাধুর্যের বিচারে তিনি ছিলেন চমৎকার শাসক এবং সবচেয়ে বেশি দানশীল ব্যক্তি।7 তদীয় পুত্র ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদের সূচনা করেন। তাঁরপর তদীয় পুত্র নূরুদ্দীন মাহমুদ ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী সুলতান যাহের বায়বার্স এবং সুলতান কালাউন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যে বিজয় অভিযান শুরু করেন, এ পরিবার তার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এর ফলে মুসলিম জাহানে তাওহীদ ও ঐক্যের যুগের সূচনা হয়।8
‘আক সানকার আল- বারসাকী’ও ছিলেন সুলতান মাহমুদ সেলজুকীর অন্যতম সেনাপতি। তিনি ছিলেন মুসেল অঞ্চলের শাসনকর্তা। ক্রুসেড যুদ্ধে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। ৫২০ হিজরীতে মুসেল মসজিদে নামাজরত অবস্থায় বাতেনীরা তাঁকে হত্যা করে। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তাঁর সম্পর্কে বলেন . তিনি একজন ভালো তুর্কি ক্রীতদাস। গুণী জ্ঞানী এবং নেককারদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। সুবিচার পছন্দ করতেন এবং নিজেও সুবিচার করতেন। তিনি ছিলেন অন্যতম উত্তম শাসক। সময় মতো যথারীতি নামাজ আদায় করতেন এবং রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন।9 সেলজুকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে খেলাফতের মর্যাদা ফিরিয়ে আনেন, যা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিল: বিশেষ করে নিযামুল মূলকের মন্ত্রিত্বকালে। কারণ তিনি আইন এবং খেলাফতের মর্যাদা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন ভালোভাবে।10
নিযামুল মুলক জ্ঞানপিপাসাদের জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সাহসিকতাপূর্ণ কাজ করেন। হিজরী ৪৫৯ সালে বাগদাদে নিযামিয়া মাদ্রাসার ইমারত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। নীশাপুর ইত্যাদি শহরেও তিনি মাদ্রাসার ইমারত নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। সুন্নীণ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার এ ধারা মিসরেও বিস্তার লাভ করে। অথচ তখন মিশর ছিল বাতেনী ওবায়দীদের শাসনাধীনে। খলিফা যাহের- এর উজির আবুল হাসান আলী ইবনে সালাম হিজরী ৫৪৪ সালে একটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং তার প্রধান করেন হাফেজ সালাফীকে। আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল শাফেয়িদের একমাত্র মাদ্রাসা। ৫৩২ হিজরীতে আওফিয়া মাদ্রাসা স্থাপিত হয় এবং মাদ্রাসার প্রধান নিযুক্ত করা হয় মালেকি ফকীহ ইবনে তাহের ইবনে আওফকে। এ দু’টি মাদ্রাসার উদ্দেশ্য শিয়াদের ধর্মমত সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সুন্নীণ মাজহাবের প্রতি আহবান জানানো।11
নিযামুল মুলক ছিলেন শাফেয়ি মজহাবের ফকীহ। হাদিস এবং অভিধান বিষয়েও তিনি ছিলেন পন্ডিত ব্যক্তি। ফকীহ আর আলেমদের দ্বারা তার দরবার জমজমাট ছিল। এরা তাঁর সঙ্গে সর্বদা সময় কাটাতেন। তিনি যথাসময়ে নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। তাঁর অন্যতম ভালো কাজ ছিল অন্যায় কর রহিত করা। যেসব আলেম তাকে কঠোর উপদেশ দিতেন এমন ব্যক্তিদেরকে তিনি সম্মান করতেন।12 ঐতিহাসিক আবু শামা তাঁর গুণাবলি আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন . তিনি ছিলেন আলেম , ফকীহ, বিশ্বস্ত, কল্যাণকামী, বিনয়ী এবং ন্যায়পরায়ণ। দ্বীনদারদেরকে তিনি ভালোবাসতেন। তাঁর দান-ছদকা আর ওয়াকফ এর কোন সীমা ছিল না। সারা দুনিয়ায় তাঁর মাদ্রাসা খ্যাত। কোন শহর নগর এমন ছিল না, যেখানে তিনি মাদ্রাসা স্থাপন করেননি। এমনকি যাজীরা ইবনে আমর, যা ছিল দেশের এক প্রান্তে অবস্থিত, সেখানেও তিনি চমৎকার একটা বড় মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি যথারীতি নামাজ আদায় করতেন। ইবাদতের কাজে কেউ তাঁকে অতিক্রম করে যেতে পারতো না।13 আবু বকর তরতুশী এসব নির্মল জ্ঞান চর্চার প্রত্যক্ষ করেন এবং ‘সিরাজুল মুলুক’ গ্রন্থে তার বিবরণও দিয়েছেন। বাগদাদ সফরকালে তিনি এসব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেন।
হিজরী ৪৮৫ সালের শুরুতে উজির নিযামুল মূলক সুলতান মারেক শাহের সঙ্গে বাগদাদের উদ্দেশ্যে ইসফাহান থেকে বহির্গত হন। রমজানের দশম তারিখে নিহাওয়ান্দ এর নিকট একটা গ্রাম অতিক্রমকালে জনৈক বাতেনী বালক ভিখারির বেশে তাঁর নিকট আসে। বালকটি নিকটবর্তী হয়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে পালাবার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা পড়ে নিহত হয়। কিছুক্ষণ পরই তিনি ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। বাতেনীরা ৫০০ হিজরীতে তাঁর পুত্র ফখরুল মুলককেও হত্যা করে।14
রাফেযী আর বাতেনী ধর্মমতের পতনের ফলে আহলে সুন্নাহর কাছে সংস্কারমূলক জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। প্রকাশ পায় জ্ঞান- চর্চার দু’টি স্রোতধারা। জ্ঞান- চর্চার ভাবধারা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে যার রয়েছে বিরাট প্রভাব আর ভূমিকা।
ইমাম মাওয়ার্দী শাফেয়ি (হিঃ ৩৬৪-৪৫০) ছিলেন সেসব আলেমদের অন্যতম; সেলজুক শাসকদের সংস্কারমূলক কর্মকান্ড প্রকাশ পাওয়ার পূর্বেই যেসব আলেম মুসলমানদের সংকট আর সমস্যা সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তার প্রণীত গ্রন্থ ‘আদাবুদ্দুনিয়া ওয়াদ-দীন’ গ্রন্থ মুসলমানদের জীবনের জটিল এবং সূক্ষ্ম বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর সে জটিল বিষয়টা হচ্ছে, ভারসাম্য রক্ষা করে আমরা কীভাবে দীন এবং দুনিয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি? ফলে দুনিয়া দ্বীনের উপর জেঁকে বসবে না, আবার দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জনও করা হবে না। আর সুফীরা এ ধারণাটা মুসলমানদের উপর মিশ্রিত করে ফেলেছেন। আল- মাওয়ার্দী বলেন . দুনিয়ার বিকৃতি কোন ক্ষতি করতে পারবে না, পারবে না তাকে কলঙ্কিত করতে। পক্ষান্তরে দুনিয়ার কল্যাণের সঙ্গে যার অবস্থার বিপর্যয় ঘটেছে আর দুনিয়ার কাজ কারবার ঠিকমতো চলেছে, সে দুনিয়ার কাজ ঠিক করার জন্য কোন স্বাদ আস্বাদন করবে না। আর ভালোভাবে দুনিয়ার কাজ সমাধা করার জন্য সে পাবে না কোন প্রভাব।1 আল-মাওয়ার্দী ‘আল-আহকামুস সুলতানিয়া’ গ্রন্থে শাসন কার্যে সমস্যাবলি সমাধান বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
এরপর শাফেয়ি এবং হাম্বলী দু’টি মাদ্রাসা প্রকাশ পায়। সুলতান ইমাদুদ্দীন জঙ্গি যে জিহাদ আর ইসলামি সংস্কার কাজের সূচনা করেন, এ মাদ্রাসা দ্বয় তার ক্ষেত্র প্রস্ত্ততে এবং তার জন্য পরিবেশ গড়ে তোলার কাজে সহায়তা করেছে।
শাফেয়ী চিন্তাধারা
বাগাদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসা থেকে এ মাদ্রাসার স্রোতধারা সৃষ্টি হয়, যে মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন আবু ইসহাক সিরাজী এবং আবু আব্দুল্লাহ তাবারীর মতো বিশিষ্ট আলেম । কালের সেরা আলেম, যারা যুগের বাস্তবতা অনুধাবন করতেন এবং যুগের সমস্যা সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করতেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মশহুর ছিলেন ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল- জুয়াইনী। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘গিয়াসুল উমাম ফী ইলতিয়াসিস যুলাম’ শরিয়তি বিধান সম্পর্কিত রাজনৈতিক গ্রন্থের মধ্যে প্রসিদ্ধ। এ গ্রন্থে মুসলমানদের বাস্তব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে কেবল তাত্ত্বিক আর দার্শনিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হয়নি। ইমামুল হারামাইন আল-জুয়াইনীর অন্যতম শিষ্য ছিলেন আবু হামেদ আ-গাযালী।2 মুসলমানদের অবস্থা সংশোধনের নিয়তে আল- গাযালী ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দীন’ গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গ্রন্থটি জাল আর দুর্বল হাদীসে ভরা। এছাড়াও তাতে রয়েছে সুফীদের অযৌক্তিক কল্প কাহিনি আর দার্শনিকদের ভ্রান্ত উক্তি। এরপরও তাঁর গ্রন্থে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি স্থান লাভ করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, ক্রুসেড যুদ্ধ আর ক্রুসেডারদের সিরিয়া অধিকারের আলোচনা করলেও কোন গ্রন্থেই তিনি জিহাদের উল্লেখ করেননি। তাঁর পক্ষ থেকে অভিযোগের জবাবে বলা হয় যে, ক্রুসেডের বিপদ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তবে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন আত্মার সংশোধনের প্রতি। তাঁর যুগে যা কিছু ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ জবাব যথেষ্ট নয়। তবে সুফিরা সাধারণত: জিহাদ কেন্দ্রিক নন।
তবে মানবারা সম্পর্কে ইমাম গাযালীর আলোচনা চমৎকার। মুসলমানদের অন্তরে সেসব আলোচনার বিরাট প্রভাবও রয়েছে। তিনি আলেম সমাজের অবস্থার সমালোচনা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন যে, আলেম সমাজ সংশোধন হলে শাসক শ্রেণি সংশোধন হয়। আর শাসকবর্গ সংশোধন হলে প্রজা বর্গও সংশোধন হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন . তবে বর্তমান লোভ- লালসা আলেম সমাজের টুঁটি চেপে ধরেছে, যার ফলে তারা নীরব। আর তাঁরা কথা বললেও তাঁদের কথা আর অবস্থার মধ্যে কোন মিল থাকে না। ফলে তাঁরা সফল হন না। জ্ঞানের হক আদায় করে তারা সত্য বললে অবশ্যই সফল হতেন। ফলে শাসকবর্গের বিকৃতির কারণে শাসক শ্রেণির বিকৃতি ঘটে। দুনিয়ার ভালোবাসা যার উপর জেঁকে বসে, হীন-নীচ লোকদের সমালোচনা করার ক্ষমতা তার থাকে না। তবে এমন লোক কেমন করে শাসকবর্গ আর বড় লোকদের সমালোচনা করবে?3 তিনি আলেমদের সমালোচনা করে বলেন, যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে যোগ নেই, এমন সব সমস্যার আলোচনায় তারা কীভাবে জড়াতে পারেন? তিনি বলেন . সাহাবায়ে কেরাম রা. কেবল নূতন নূতন ঘটনা আর সমস্যা সম্পর্কেই পরামর্শ করতেন। আমরা দেখি না যে, বিতর্ককারী কেবল সে সব সমস্যাকেই বাছাই করে নেন, যা খুবই জটিল; বরং তারা এমন দাবি করতেন, যা শোনা হতো। ফলে তাতে বিতর্কের সুযোগ থাকতো, অবস্থা যাই হোক না কেন।4 তর্ক বিতর্ক ভালোবাসার কারণে তারা ফিকাহ অধ্যয়ন করতেন এবং অন্যান্য জ্ঞান অধ্যয়ন করতেন না, অথচ ইসলামি সমাজের প্রয়োজন ছিল সেসব জ্ঞান অধ্যয়নের। বিচক্ষণ ব্যক্তি জানেন যে, তার অর্থাৎ বিদ্যার্থীর উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে ফরজে কিফায়ার ক্ষেত্রে হক আদায় করা, তবে অবশ্যই তার উপর ফরজে আইনকে অগ্রগণ্য করতেন। বরং অনেক ফরজে কিফায়াকে তার উপর অগ্রগণ্য করতেন। এমন অনেক শহর আছে, যেখানে মিসরী অর্থাৎ অমুসলিম ছাড়া কোন চিকিৎসক নেই। আর ফিকহী বিধানের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা জায়েজ নয়। এ ছাড়া আমরা এমন লোক দেখি না, যিনি ফতোয়া এবং তার বাস্তব জবাব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর কি কোন কারণ রয়েছে? তবে চিকিৎসা শাস্ত্র এমন বিষয় নয়, যেখান পর্যন্ত সহজে পৌঁছা যায়। এজন্য সময় ব্যয় করতে হয়........... এতিমের অর্থ সম্পদ বিচারের এমনকি সমসাময়িক লোকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।5
কোন কোন সামাজিক ব্যাধির উপশম প্রসঙ্গে তিনি ‘‘ধন সঞ্চয় ধনীদের মনস্তত্ত্ব’’- এ কথার উল্লেখ করে বলেন . কিছু লোক এমন আছেন, যারা মসজিদ, মাদ্রাসা, সরাইখানা এবং পুল নির্মাণ করতে আগ্রহী। এরা এসব নির্মাণ কার্যে নিজেদের নাম খোদাই করে। এসব লোকেরা দু’ভাবে প্রতারিত হয়। এক . সুদ-ঘুস আর জুলুম এবং পরস্ব অপহরণ দ্বারা এরা এসব নির্মাণ করে। দুই . তারা কোন কোন সময় বৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করে ঠিকই, কিন্তু মসজিদ নির্মাণের প্রতি মনোনিবেশ করায় লোক দেখানোর ব্যাধি এবং প্রশংসা লাভের আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে পেয়ে বসেছে। এমন কিছু লোকও আছে যারা হজে অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহী। অথচ তাদেরই প্রতিবেশীরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আরেক শ্রেণির লোক আছে, যারা সম্পদের ভান্ডার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। যাদেরকে কৃপণ বলা চলে। এরা শারীরিক ইবাদাতে ব্যতিব্যস্ত, যাতে কিছুই ব্যয় করতে হয় না। যেমন সারা দিন রোজা রাখা আর সারা রাত নামাজ পড়া।6
আসলে গাযযালী এখানে তাঁর সমাজ দর্শনে নীতি আদর্শ গ্রহণ করেছেন তাঁর শিক্ষক আবুল মাআলী আল- জুয়াইনীর চিন্তাধারা থেকে। শরিয়তি রাজনীতি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ইসলামি রাষ্ট্রের ভূমিকা বিবৃত করেছেন। আলেম সমাজ এবং শাসন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। উম্মার সংস্কার- সংশোধন, সুবিচার এবং অর্থনীতি বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘গিয়াসুল উমাম ফী ইলতিয়াসিস যুলাম’-এ তিনি সবিস্তারে আলোচনা করেন। এতে তিনি আলেম সমাজের ভূমিকা স্পষ্ট করে ব্যক্ত করে বলেন যে, মূলত . তাঁরাই হচ্ছে অনুসরণীয়। সেলজুকী7 উজির নিযামুল মুলুককে সম্বোধন করে তিনি বলেন . মহান মজলিসের নিকট আমি যা উপস্থাপন করতে চাই, তা হচ্ছে এই যে, সকল কাজে আলেম সমাজের কাছে প্রত্যাবর্তন করা কর্তব্য। কারণ, তাঁরাই হচ্ছেন বিধানের নেতা এবং ইসলামের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁরাই হচ্ছেন নবীর ওয়ারিস এবং উম্মার নেতা। মূলত . তাঁরাই নির্দেশ দানের উপযুক্ত ব্যক্তি। দায়িত্বশীল মহল (নেতা-কর্তা ব্যক্তি) তাদের নীতি- আদর্শ মেনে চলতে বাধ্য।8
তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন যে, শাসনকর্তা যদি ইজতিহাদ করার মতো মর্যাদায় উপনীত না হন তবে তাঁকে আলেম সমাজের অনুসরণ করতে হবে আর সুলতান তথা শাসনকর্তা হচ্ছে তাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি। তিনি হচ্ছে তাদের শক্তির মূল। আলেমের সঙ্গে শাসন, যেমন নবীর জমানায় রাজত্ব।9 যদি এমন সময় আসে, যেখানে কোন উপযুক্ত ইমাম বা সুলতান পাওয়া যায় না, তখন ব্যাপারটা আলেম দের নিকট ন্যস্ত হবে। জনগণের শ্রেণির যতই বিভিন্নতা থাকুক না কেন, তাদের কর্তব্য হবে আলেমদের নিকট প্রত্যাবর্তন করা।10
শাফেয়ি মাদ্রাসা আল- জুয়াইনী, আল-মাওয়ার্দী এবং আবু ইসহাক সিরাজীর মতো বড় বড় আলেম সৃষ্টি করে। এরপরও যে মাদ্রাসার আলেমদের মধ্য থেকে এমন সব বিরাট ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে, নূরুদ্দীন আর সালাহউদ্দীনের শাসনামলে যারা রাজনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে কাজি শহরজূরীর নাম উল্লেখযোগ্য, যিনি বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন।11 আরো যাদের নাম উল্লেখযোগ্য, তাদের মধ্যে ইবনু আবু আসরুন এবং ফকীহ আমির ঈসা আল- হাকারীও রয়েছেন। যথাস্থানে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী যেসব বড় বড় আলেমের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে মোহাদ্দেস আবু তাহের সালাফী এবং আহমদ ইবন মুহাম্মদ আল-ইসফাহানীর নাম উল্লেখযোগ্য। মুহাদ্দিস আবু তাহের সালাফী বাগদাদ আগমন করে কায়া আল-হারাসীকে নিয়ে ফিকহের আলোচনায় প্রবৃত্ত হন।12 অনুরূপভাবে স্পেনের আলেম আবু বকর তারতুশী বাগদাদ আগমন করে আবু বকর শাশীর নিকট ফিকাহের জ্ঞান অর্জন করেন। তরতুশী ছিলেন আলেম, ইমাম এবং দরবেশ। আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি ইন্তিকাল করেন।13
হাম্বলী চিন্তাধারা
সালাফে সালেহীনের আক্বীদা আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে হাম্বলীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পূর্ববর্তী আলেমদের নিকট থেকে তারা এ আক্বীদার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এ আক্বীদা রক্ষা করতে গিয়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল নির্যাতনের শিকার হন। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর আলোচনা প্রসঙ্গে ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে বারণ বিষয়ে তাদের ভূমিকা আলোচনা হয়েছে। বাগদাদে ছিল তাদের অনেকগুলো মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসায় অনেক আলেম আর ওয়ায়েজ মুরুববীর ভূমিকা পালন করেন। যেমন শায়খ আবুল ওয়াফা ইবনে আকীল14 ইমাম, হাফেজ ও ওয়ায়েজ শায়খ আবুল ফারজ ইবনুল জাওযী। দ্বীনের দিকে মানুষের প্রত্যাবর্তনে তাঁদের বিরাট প্রভাব ছিল। আবু সাঈদ আল- মাখরামী আল-হাম্বলীর মাদ্রাসাও ছিল প্রসিদ্ধ। আব্দুল কাদের জীলানী এই মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।15 জ্ঞান অম্বেষকদের জন্য এই মাদ্রাসা আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। হাম্বলী ফিকাহ শিক্ষা করা আর এই মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য শাম দেশের বড় বড় আলেমগন বাগদাদে আগমন করেন। হাফেজ আব্দুল গণী আল-মাকদেসীর জীবনী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি এবং মুওয়াফফাক ৫৬০ হিজরীতে বাগদাদ আগমন করলে শায়খ আব্দুল কাদের তাদেরকে নিজের কাছে অবস্থান করান, তাদেরকে সম্মান করেন এবং তাদের কথা শ্রবণ করেন। তাঁরা উভয়ে শায়খ ইবনুল জাওযীর নিকট জ্ঞান সাধনায় প্রবৃত্ত হন।16 এসব শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন আবু ওমর এবং তদীয় ভ্রাতা এবং তাদের মামাতো ভাই আব্দুল গনি এবং শায়খ ইমাদুদ্দীন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ফিরিঙ্গি দেশে যেসব মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করতেন, এসব আলেম তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন না। বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার কালেও এসব আলেমগন সুলতান সালাহউদ্দীনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।17
সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জীবদ্দশায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন ওয়ায়েয আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা। ইনি ছিলেন দামেশক এর অধিবাসী এবং হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী। বাগদাদে আগমন করে তিনি ফিকাহ এবং হাদীসে র জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর স্বদেশ ভূমি দামেশকে ফিরে যান। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর নিকট তাঁর বিরাট স্থান ছিল। মিসরে ওবায়দীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করার ক্ষেত্রে তিনি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে সহায়তা করেন।
ইমাম মাওয়ার্দী শাফেয়ি (হিঃ ৩৬৪-৪৫০) ছিলেন সেসব আলেমদের অন্যতম; সেলজুক শাসকদের সংস্কারমূলক কর্মকান্ড প্রকাশ পাওয়ার পূর্বেই যেসব আলেম মুসলমানদের সংকট আর সমস্যা সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তার প্রণীত গ্রন্থ ‘আদাবুদ্দুনিয়া ওয়াদ-দীন’ গ্রন্থ মুসলমানদের জীবনের জটিল এবং সূক্ষ্ম বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর সে জটিল বিষয়টা হচ্ছে, ভারসাম্য রক্ষা করে আমরা কীভাবে দীন এবং দুনিয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি? ফলে দুনিয়া দ্বীনের উপর জেঁকে বসবে না, আবার দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জনও করা হবে না। আর সুফীরা এ ধারণাটা মুসলমানদের উপর মিশ্রিত করে ফেলেছেন। আল- মাওয়ার্দী বলেন . দুনিয়ার বিকৃতি কোন ক্ষতি করতে পারবে না, পারবে না তাকে কলঙ্কিত করতে। পক্ষান্তরে দুনিয়ার কল্যাণের সঙ্গে যার অবস্থার বিপর্যয় ঘটেছে আর দুনিয়ার কাজ কারবার ঠিকমতো চলেছে, সে দুনিয়ার কাজ ঠিক করার জন্য কোন স্বাদ আস্বাদন করবে না। আর ভালোভাবে দুনিয়ার কাজ সমাধা করার জন্য সে পাবে না কোন প্রভাব।1 আল-মাওয়ার্দী ‘আল-আহকামুস সুলতানিয়া’ গ্রন্থে শাসন কার্যে সমস্যাবলি সমাধান বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
এরপর শাফেয়ি এবং হাম্বলী দু’টি মাদ্রাসা প্রকাশ পায়। সুলতান ইমাদুদ্দীন জঙ্গি যে জিহাদ আর ইসলামি সংস্কার কাজের সূচনা করেন, এ মাদ্রাসা দ্বয় তার ক্ষেত্র প্রস্ত্ততে এবং তার জন্য পরিবেশ গড়ে তোলার কাজে সহায়তা করেছে।
শাফেয়ী চিন্তাধারা
বাগাদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসা থেকে এ মাদ্রাসার স্রোতধারা সৃষ্টি হয়, যে মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন আবু ইসহাক সিরাজী এবং আবু আব্দুল্লাহ তাবারীর মতো বিশিষ্ট আলেম । কালের সেরা আলেম, যারা যুগের বাস্তবতা অনুধাবন করতেন এবং যুগের সমস্যা সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করতেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে মশহুর ছিলেন ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল- জুয়াইনী। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘গিয়াসুল উমাম ফী ইলতিয়াসিস যুলাম’ শরিয়তি বিধান সম্পর্কিত রাজনৈতিক গ্রন্থের মধ্যে প্রসিদ্ধ। এ গ্রন্থে মুসলমানদের বাস্তব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এতে কেবল তাত্ত্বিক আর দার্শনিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হয়নি। ইমামুল হারামাইন আল-জুয়াইনীর অন্যতম শিষ্য ছিলেন আবু হামেদ আ-গাযালী।2 মুসলমানদের অবস্থা সংশোধনের নিয়তে আল- গাযালী ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দীন’ গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গ্রন্থটি জাল আর দুর্বল হাদীসে ভরা। এছাড়াও তাতে রয়েছে সুফীদের অযৌক্তিক কল্প কাহিনি আর দার্শনিকদের ভ্রান্ত উক্তি। এরপরও তাঁর গ্রন্থে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গি স্থান লাভ করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, ক্রুসেড যুদ্ধ আর ক্রুসেডারদের সিরিয়া অধিকারের আলোচনা করলেও কোন গ্রন্থেই তিনি জিহাদের উল্লেখ করেননি। তাঁর পক্ষ থেকে অভিযোগের জবাবে বলা হয় যে, ক্রুসেডের বিপদ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তবে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন আত্মার সংশোধনের প্রতি। তাঁর যুগে যা কিছু ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ জবাব যথেষ্ট নয়। তবে সুফিরা সাধারণত: জিহাদ কেন্দ্রিক নন।
তবে মানবারা সম্পর্কে ইমাম গাযালীর আলোচনা চমৎকার। মুসলমানদের অন্তরে সেসব আলোচনার বিরাট প্রভাবও রয়েছে। তিনি আলেম সমাজের অবস্থার সমালোচনা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন যে, আলেম সমাজ সংশোধন হলে শাসক শ্রেণি সংশোধন হয়। আর শাসকবর্গ সংশোধন হলে প্রজা বর্গও সংশোধন হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন . তবে বর্তমান লোভ- লালসা আলেম সমাজের টুঁটি চেপে ধরেছে, যার ফলে তারা নীরব। আর তাঁরা কথা বললেও তাঁদের কথা আর অবস্থার মধ্যে কোন মিল থাকে না। ফলে তাঁরা সফল হন না। জ্ঞানের হক আদায় করে তারা সত্য বললে অবশ্যই সফল হতেন। ফলে শাসকবর্গের বিকৃতির কারণে শাসক শ্রেণির বিকৃতি ঘটে। দুনিয়ার ভালোবাসা যার উপর জেঁকে বসে, হীন-নীচ লোকদের সমালোচনা করার ক্ষমতা তার থাকে না। তবে এমন লোক কেমন করে শাসকবর্গ আর বড় লোকদের সমালোচনা করবে?3 তিনি আলেমদের সমালোচনা করে বলেন, যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে যোগ নেই, এমন সব সমস্যার আলোচনায় তারা কীভাবে জড়াতে পারেন? তিনি বলেন . সাহাবায়ে কেরাম রা. কেবল নূতন নূতন ঘটনা আর সমস্যা সম্পর্কেই পরামর্শ করতেন। আমরা দেখি না যে, বিতর্ককারী কেবল সে সব সমস্যাকেই বাছাই করে নেন, যা খুবই জটিল; বরং তারা এমন দাবি করতেন, যা শোনা হতো। ফলে তাতে বিতর্কের সুযোগ থাকতো, অবস্থা যাই হোক না কেন।4 তর্ক বিতর্ক ভালোবাসার কারণে তারা ফিকাহ অধ্যয়ন করতেন এবং অন্যান্য জ্ঞান অধ্যয়ন করতেন না, অথচ ইসলামি সমাজের প্রয়োজন ছিল সেসব জ্ঞান অধ্যয়নের। বিচক্ষণ ব্যক্তি জানেন যে, তার অর্থাৎ বিদ্যার্থীর উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে ফরজে কিফায়ার ক্ষেত্রে হক আদায় করা, তবে অবশ্যই তার উপর ফরজে আইনকে অগ্রগণ্য করতেন। বরং অনেক ফরজে কিফায়াকে তার উপর অগ্রগণ্য করতেন। এমন অনেক শহর আছে, যেখানে মিসরী অর্থাৎ অমুসলিম ছাড়া কোন চিকিৎসক নেই। আর ফিকহী বিধানের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা জায়েজ নয়। এ ছাড়া আমরা এমন লোক দেখি না, যিনি ফতোয়া এবং তার বাস্তব জবাব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর কি কোন কারণ রয়েছে? তবে চিকিৎসা শাস্ত্র এমন বিষয় নয়, যেখান পর্যন্ত সহজে পৌঁছা যায়। এজন্য সময় ব্যয় করতে হয়........... এতিমের অর্থ সম্পদ বিচারের এমনকি সমসাময়িক লোকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে।5
কোন কোন সামাজিক ব্যাধির উপশম প্রসঙ্গে তিনি ‘‘ধন সঞ্চয় ধনীদের মনস্তত্ত্ব’’- এ কথার উল্লেখ করে বলেন . কিছু লোক এমন আছেন, যারা মসজিদ, মাদ্রাসা, সরাইখানা এবং পুল নির্মাণ করতে আগ্রহী। এরা এসব নির্মাণ কার্যে নিজেদের নাম খোদাই করে। এসব লোকেরা দু’ভাবে প্রতারিত হয়। এক . সুদ-ঘুস আর জুলুম এবং পরস্ব অপহরণ দ্বারা এরা এসব নির্মাণ করে। দুই . তারা কোন কোন সময় বৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করে ঠিকই, কিন্তু মসজিদ নির্মাণের প্রতি মনোনিবেশ করায় লোক দেখানোর ব্যাধি এবং প্রশংসা লাভের আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে পেয়ে বসেছে। এমন কিছু লোকও আছে যারা হজে অর্থ ব্যয় করতে উৎসাহী। অথচ তাদেরই প্রতিবেশীরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আরেক শ্রেণির লোক আছে, যারা সম্পদের ভান্ডার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। যাদেরকে কৃপণ বলা চলে। এরা শারীরিক ইবাদাতে ব্যতিব্যস্ত, যাতে কিছুই ব্যয় করতে হয় না। যেমন সারা দিন রোজা রাখা আর সারা রাত নামাজ পড়া।6
আসলে গাযযালী এখানে তাঁর সমাজ দর্শনে নীতি আদর্শ গ্রহণ করেছেন তাঁর শিক্ষক আবুল মাআলী আল- জুয়াইনীর চিন্তাধারা থেকে। শরিয়তি রাজনীতি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ইসলামি রাষ্ট্রের ভূমিকা বিবৃত করেছেন। আলেম সমাজ এবং শাসন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। উম্মার সংস্কার- সংশোধন, সুবিচার এবং অর্থনীতি বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘গিয়াসুল উমাম ফী ইলতিয়াসিস যুলাম’-এ তিনি সবিস্তারে আলোচনা করেন। এতে তিনি আলেম সমাজের ভূমিকা স্পষ্ট করে ব্যক্ত করে বলেন যে, মূলত . তাঁরাই হচ্ছে অনুসরণীয়। সেলজুকী7 উজির নিযামুল মুলুককে সম্বোধন করে তিনি বলেন . মহান মজলিসের নিকট আমি যা উপস্থাপন করতে চাই, তা হচ্ছে এই যে, সকল কাজে আলেম সমাজের কাছে প্রত্যাবর্তন করা কর্তব্য। কারণ, তাঁরাই হচ্ছেন বিধানের নেতা এবং ইসলামের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁরাই হচ্ছেন নবীর ওয়ারিস এবং উম্মার নেতা। মূলত . তাঁরাই নির্দেশ দানের উপযুক্ত ব্যক্তি। দায়িত্বশীল মহল (নেতা-কর্তা ব্যক্তি) তাদের নীতি- আদর্শ মেনে চলতে বাধ্য।8
তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন যে, শাসনকর্তা যদি ইজতিহাদ করার মতো মর্যাদায় উপনীত না হন তবে তাঁকে আলেম সমাজের অনুসরণ করতে হবে আর সুলতান তথা শাসনকর্তা হচ্ছে তাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি। তিনি হচ্ছে তাদের শক্তির মূল। আলেমের সঙ্গে শাসন, যেমন নবীর জমানায় রাজত্ব।9 যদি এমন সময় আসে, যেখানে কোন উপযুক্ত ইমাম বা সুলতান পাওয়া যায় না, তখন ব্যাপারটা আলেম দের নিকট ন্যস্ত হবে। জনগণের শ্রেণির যতই বিভিন্নতা থাকুক না কেন, তাদের কর্তব্য হবে আলেমদের নিকট প্রত্যাবর্তন করা।10
শাফেয়ি মাদ্রাসা আল- জুয়াইনী, আল-মাওয়ার্দী এবং আবু ইসহাক সিরাজীর মতো বড় বড় আলেম সৃষ্টি করে। এরপরও যে মাদ্রাসার আলেমদের মধ্য থেকে এমন সব বিরাট ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে, নূরুদ্দীন আর সালাহউদ্দীনের শাসনামলে যারা রাজনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে কাজি শহরজূরীর নাম উল্লেখযোগ্য, যিনি বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন।11 আরো যাদের নাম উল্লেখযোগ্য, তাদের মধ্যে ইবনু আবু আসরুন এবং ফকীহ আমির ঈসা আল- হাকারীও রয়েছেন। যথাস্থানে এদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী যেসব বড় বড় আলেমের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে মোহাদ্দেস আবু তাহের সালাফী এবং আহমদ ইবন মুহাম্মদ আল-ইসফাহানীর নাম উল্লেখযোগ্য। মুহাদ্দিস আবু তাহের সালাফী বাগদাদ আগমন করে কায়া আল-হারাসীকে নিয়ে ফিকহের আলোচনায় প্রবৃত্ত হন।12 অনুরূপভাবে স্পেনের আলেম আবু বকর তারতুশী বাগদাদ আগমন করে আবু বকর শাশীর নিকট ফিকাহের জ্ঞান অর্জন করেন। তরতুশী ছিলেন আলেম, ইমাম এবং দরবেশ। আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি ইন্তিকাল করেন।13
হাম্বলী চিন্তাধারা
সালাফে সালেহীনের আক্বীদা আঁকড়ে ধরার ক্ষেত্রে হাম্বলীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পূর্ববর্তী আলেমদের নিকট থেকে তারা এ আক্বীদার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। এ আক্বীদা রক্ষা করতে গিয়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল নির্যাতনের শিকার হন। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর আলোচনা প্রসঙ্গে ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে বারণ বিষয়ে তাদের ভূমিকা আলোচনা হয়েছে। বাগদাদে ছিল তাদের অনেকগুলো মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসায় অনেক আলেম আর ওয়ায়েজ মুরুববীর ভূমিকা পালন করেন। যেমন শায়খ আবুল ওয়াফা ইবনে আকীল14 ইমাম, হাফেজ ও ওয়ায়েজ শায়খ আবুল ফারজ ইবনুল জাওযী। দ্বীনের দিকে মানুষের প্রত্যাবর্তনে তাঁদের বিরাট প্রভাব ছিল। আবু সাঈদ আল- মাখরামী আল-হাম্বলীর মাদ্রাসাও ছিল প্রসিদ্ধ। আব্দুল কাদের জীলানী এই মাদ্রাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।15 জ্ঞান অম্বেষকদের জন্য এই মাদ্রাসা আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। হাম্বলী ফিকাহ শিক্ষা করা আর এই মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য শাম দেশের বড় বড় আলেমগন বাগদাদে আগমন করেন। হাফেজ আব্দুল গণী আল-মাকদেসীর জীবনী সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি এবং মুওয়াফফাক ৫৬০ হিজরীতে বাগদাদ আগমন করলে শায়খ আব্দুল কাদের তাদেরকে নিজের কাছে অবস্থান করান, তাদেরকে সম্মান করেন এবং তাদের কথা শ্রবণ করেন। তাঁরা উভয়ে শায়খ ইবনুল জাওযীর নিকট জ্ঞান সাধনায় প্রবৃত্ত হন।16 এসব শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন আবু ওমর এবং তদীয় ভ্রাতা এবং তাদের মামাতো ভাই আব্দুল গনি এবং শায়খ ইমাদুদ্দীন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ফিরিঙ্গি দেশে যেসব মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করতেন, এসব আলেম তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন না। বায়তুল মুকাদ্দাস অধিকার কালেও এসব আলেমগন সুলতান সালাহউদ্দীনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।17
সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জীবদ্দশায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন ওয়ায়েয আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা। ইনি ছিলেন দামেশক এর অধিবাসী এবং হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী। বাগদাদে আগমন করে তিনি ফিকাহ এবং হাদীসে র জ্ঞান অর্জন করেন। অতঃপর স্বদেশ ভূমি দামেশকে ফিরে যান। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর নিকট তাঁর বিরাট স্থান ছিল। মিসরে ওবায়দীদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করার ক্ষেত্রে তিনি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে সহায়তা করেন।
বাতেনী সম্প্রদায়ের বিপদ সম্পর্কে লোকেরা বুঝতে পারে, অনুরূপ ভাবে বুঝতে পারেন শাসক শ্রেণিও। ফলে একের পর এক হামলা শুরু হয়, তাদের বীজ শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার জন্য। কারণ, তদানীন্তন কালে মুসলিম বিশ্বের জন্য তারা ছিল একটা আপদ। এবং গৃহের অভ্যন্তর থেকে তারা সন্ত্রাসীর ভূমিকা পালন করছিল। শাসক শ্রেণি যেসব ঘটনার মাধ্যমে তাদের বিপদ সম্পর্কে বুঝতে পারে এবং তাদের বীজ উপড়ে ফেলা বা তাদের সহায়তা থেকে বিরত রাখার জন্য নব পর্যায়ে যেসব অভিযান পরিচালনা করে, এখানে তার কিছু বিবরণ দেয়া হচ্ছে .
হিজরী ৪৩৬ সনে মা-ওয়ারাউন নহর এর শাসনকর্তা (বগরাখান) ইসমাঈলীদের একটা দলের উপর আক্রমণ চালান। মিসরে ওবায়দী শাসক দলের পক্ষে প্রচারণার জন্য এসব ইসমাঈলীরা মা-ওয়ারাউন নহর শহরে প্রবেশ করে। এই হামলায় ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের সকলকে হত্যা করা হয়। সমস্ত শহরে পত্র লিখে ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে গোটা দেশ তাদের থেকে মুক্ত হয়।1
হিজরী ৪৬৩ সনে হালব বা আলেপ্পোর আমির মাহমুদ ইবনে ছালেহ ইবনে মিরদাস আমীরুল মু’মিনীন কায়েম বি-আমরিল্লাহ এবং সুলতান আলপ আরসালানের পক্ষে খুতবা দান করেন। সুলতানের রাজত্বের শ্রীবৃদ্ধি- উন্নতি- অগ্রগতি দর্শন করে তিনি আলপ আরসালান আল কায়েম বি-আমরিল্লাহকে সমর্থন করে খুতবা দেন।
হিজরী ৪৯৪ সনে সেলজুক শাসনকর্তা সুলতান বরকিয়ারক বাতেনীদের হত্যার নির্দেশ দেন। ফলে ইসফাহানের লোকেরা তাদের মধ্যকার বাতেনীদের হত্যার জন্য উদ্যত হয়। এ কাজে নেতৃত্ব দেন শাফেয়ি মাজহাবের ফকীহ মাসউদ ইবনে মুহাম্মদ আল- খাজান্দী। বিপুল জনতা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয়। সুলতান গর্ত খনন করে তাতে অগ্নি প্রজ্বলিত করার নির্দেশ দেন। সাধারণ মানুষ বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকজনকে দলে দলে ধরে এনে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে।2 অনেককে ধরে আনে একক ভাবে। খুজিস্তান আর ফারেস অঞ্চলের অনেক দুর্গ বাতেনীদের দখলে ছিল। তাদের অনিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা ডাকাতি-রাহাজানি শুরু করে। সেলজুকী নেতা (জাওলী) অতর্কিতে তাঁদের উপর হামলা চালাবার সংকল্প করেন। সেলজুক নেতা প্রকাশ করলেন যে, তিনি তাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে চান। ওরা সকলে তার সঙ্গে বের হয় তার অস্ত্রশস্ত্র লাভ করার আশায়। পথিমধ্যে তিনি একটা ফাঁদ পেতে রাখেন। সেখানে পৌঁছোলে অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। ফলে তাদের মধ্যে একজনও রক্ষা পায়নি।3
হিজরী ৫০০ সনে সুলতান মুহাম্মদ ইবনে মালেক শাহ সেলজুকী তাদের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তারা প্রতারণা আর বিশ্বাস ঘাতকতার আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি তাদেরকে ইসফাহান দুর্গ থেকে নির্বাসিত করেন। তিনি বাতেনী সম্প্রদায়ের নেতা ইবনে গাতাশকে হত্যা করেন।4 তাদের নেতা বাহরাম এর আগমনে শাম দেশে বাতেনী সম্প্রদায়ের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরু থেকেই। বাহরামের আহবানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ এবং অজ্ঞ- মূর্খের দল সাড়া দেয়। আলেম সম্প্রদায় আর শরিয়তের ধারক- বাহকরা ইসমাইলিদের হাতে পাকড়াও হওয়ার ভয়ে চুপ থাকে।5 হিজরী ৫২৩ সনে ইসমাইলিরা ক্রুসেডারদের হাতে দামেশক অর্পণ করার চেষ্টা চায়। বিনিময়ে ক্রুসেডাররা সূর শহর তাদের হাতে অর্পণ করে। দামেশক শহরে শাসনকর্তা বূরী ইবনে তাগতিগীন এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। ফলে ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের নেতা মযদুকানীকে হত্যা করা হয় এবং শহরে বাতেনী সম্প্রদায়ের হত্যার আহবান জানানো হলে তাদের ৬ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। রমজান মাসে এ ঘটনা ঘটে।6
হিজরী ৫১১ সনের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . সুলতান মুহাম্মদ (সেলজুকী) জানতে পারেন যে, বাতেনী ইসমাঈলীদের চিহ্ন মুছে ফেলা, তাদের বাড়ি ঘরের বিনাস সাধন করা এবং তাদের দুর্গ আর প্রাচীর অধিকার করে নেয়ার সাথে দেশ ও জনগণের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। সেকালে হাসান ইবনে ছাববাহ এর জোর ছিল। হাসান ইবনে ছাববাহ রাজি ছিলেন (আল-মওত) দুর্গের অধিপতি। তার সময় ছিল বেশ দীর্ঘ। প্রায় ২৬ বৎসর তিনি এই দুর্গের অধিপতি ছিলেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ আর নরহত্যার কারণে আশপাশের জনগণের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ফলে সুলতান অনুশতগীন এর নেতৃত্বে তার বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। আশপাশের কয়েকটি দুর্গ অধিকার করে সৈন্যরা আল-মওত দুর্গ অভিমুখে রওয়ানা হয়। কয়েক মাস দুর্গটি অবরোধ করে রাখা হয়। তারা দুর্গ ত্যাগ করে নিরাপত্তা লাভের জন্য ভনিতা আর প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু নেতা নাছোড় বান্দা; তিনি কিছুতেই অবরোধ প্রত্যাহার করতে রাজি নন। অতঃপর সুলতানের মৃত্যুর খবরে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, কিন্তু দুর্গ জয় করা সম্ভব হয়নি।7 সুলতান সাঞ্জার এর শাসনামলে (হিজরী ৫২১ সনে) আল-মওত দুর্গে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা চালিয়ে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়।
নিঃসন্দেহে এসব অপরাধীদের চিহ্ন মুছে ফেলা ছিল প্রত্যাবর্তনের সুসংবাদ। তাদের উৎপাত থেকে মুসলমানরা, বরং গোটা দুনিয়া শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। তাদের টিকে থাকাকে মুসলমানদের গলার কাঁটা বলে বিবেচনা করা হতো। আর ভেতর থেকে তারা ছিল শান্তি আর নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। জনগণ ছিল তাদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। মুসলমানদের ঐক্যের জন্য তারা ছিল মুনাফিকদের চেয়েও বিপজ্জনক। সেলজুক শাসকরা ভালো কাজ করেছেন। তারা এদেরকে দমন করে রাখে এবং তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে নেক কাজের প্রতিদান দিন।8
হিজরী ৪৩৬ সনে মা-ওয়ারাউন নহর এর শাসনকর্তা (বগরাখান) ইসমাঈলীদের একটা দলের উপর আক্রমণ চালান। মিসরে ওবায়দী শাসক দলের পক্ষে প্রচারণার জন্য এসব ইসমাঈলীরা মা-ওয়ারাউন নহর শহরে প্রবেশ করে। এই হামলায় ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের সকলকে হত্যা করা হয়। সমস্ত শহরে পত্র লিখে ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে গোটা দেশ তাদের থেকে মুক্ত হয়।1
হিজরী ৪৬৩ সনে হালব বা আলেপ্পোর আমির মাহমুদ ইবনে ছালেহ ইবনে মিরদাস আমীরুল মু’মিনীন কায়েম বি-আমরিল্লাহ এবং সুলতান আলপ আরসালানের পক্ষে খুতবা দান করেন। সুলতানের রাজত্বের শ্রীবৃদ্ধি- উন্নতি- অগ্রগতি দর্শন করে তিনি আলপ আরসালান আল কায়েম বি-আমরিল্লাহকে সমর্থন করে খুতবা দেন।
হিজরী ৪৯৪ সনে সেলজুক শাসনকর্তা সুলতান বরকিয়ারক বাতেনীদের হত্যার নির্দেশ দেন। ফলে ইসফাহানের লোকেরা তাদের মধ্যকার বাতেনীদের হত্যার জন্য উদ্যত হয়। এ কাজে নেতৃত্ব দেন শাফেয়ি মাজহাবের ফকীহ মাসউদ ইবনে মুহাম্মদ আল- খাজান্দী। বিপুল জনতা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয়। সুলতান গর্ত খনন করে তাতে অগ্নি প্রজ্বলিত করার নির্দেশ দেন। সাধারণ মানুষ বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকজনকে দলে দলে ধরে এনে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে।2 অনেককে ধরে আনে একক ভাবে। খুজিস্তান আর ফারেস অঞ্চলের অনেক দুর্গ বাতেনীদের দখলে ছিল। তাদের অনিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা ডাকাতি-রাহাজানি শুরু করে। সেলজুকী নেতা (জাওলী) অতর্কিতে তাঁদের উপর হামলা চালাবার সংকল্প করেন। সেলজুক নেতা প্রকাশ করলেন যে, তিনি তাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে চান। ওরা সকলে তার সঙ্গে বের হয় তার অস্ত্রশস্ত্র লাভ করার আশায়। পথিমধ্যে তিনি একটা ফাঁদ পেতে রাখেন। সেখানে পৌঁছোলে অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। ফলে তাদের মধ্যে একজনও রক্ষা পায়নি।3
হিজরী ৫০০ সনে সুলতান মুহাম্মদ ইবনে মালেক শাহ সেলজুকী তাদের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তারা প্রতারণা আর বিশ্বাস ঘাতকতার আশ্রয় গ্রহণ করলে তিনি তাদেরকে ইসফাহান দুর্গ থেকে নির্বাসিত করেন। তিনি বাতেনী সম্প্রদায়ের নেতা ইবনে গাতাশকে হত্যা করেন।4 তাদের নেতা বাহরাম এর আগমনে শাম দেশে বাতেনী সম্প্রদায়ের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরু থেকেই। বাহরামের আহবানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ এবং অজ্ঞ- মূর্খের দল সাড়া দেয়। আলেম সম্প্রদায় আর শরিয়তের ধারক- বাহকরা ইসমাইলিদের হাতে পাকড়াও হওয়ার ভয়ে চুপ থাকে।5 হিজরী ৫২৩ সনে ইসমাইলিরা ক্রুসেডারদের হাতে দামেশক অর্পণ করার চেষ্টা চায়। বিনিময়ে ক্রুসেডাররা সূর শহর তাদের হাতে অর্পণ করে। দামেশক শহরে শাসনকর্তা বূরী ইবনে তাগতিগীন এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। ফলে ইসমাঈলী সম্প্রদায়ের নেতা মযদুকানীকে হত্যা করা হয় এবং শহরে বাতেনী সম্প্রদায়ের হত্যার আহবান জানানো হলে তাদের ৬ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। রমজান মাসে এ ঘটনা ঘটে।6
হিজরী ৫১১ সনের ঘটনাবলী প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . সুলতান মুহাম্মদ (সেলজুকী) জানতে পারেন যে, বাতেনী ইসমাঈলীদের চিহ্ন মুছে ফেলা, তাদের বাড়ি ঘরের বিনাস সাধন করা এবং তাদের দুর্গ আর প্রাচীর অধিকার করে নেয়ার সাথে দেশ ও জনগণের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। সেকালে হাসান ইবনে ছাববাহ এর জোর ছিল। হাসান ইবনে ছাববাহ রাজি ছিলেন (আল-মওত) দুর্গের অধিপতি। তার সময় ছিল বেশ দীর্ঘ। প্রায় ২৬ বৎসর তিনি এই দুর্গের অধিপতি ছিলেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ আর নরহত্যার কারণে আশপাশের জনগণের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ফলে সুলতান অনুশতগীন এর নেতৃত্বে তার বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। আশপাশের কয়েকটি দুর্গ অধিকার করে সৈন্যরা আল-মওত দুর্গ অভিমুখে রওয়ানা হয়। কয়েক মাস দুর্গটি অবরোধ করে রাখা হয়। তারা দুর্গ ত্যাগ করে নিরাপত্তা লাভের জন্য ভনিতা আর প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু নেতা নাছোড় বান্দা; তিনি কিছুতেই অবরোধ প্রত্যাহার করতে রাজি নন। অতঃপর সুলতানের মৃত্যুর খবরে সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, কিন্তু দুর্গ জয় করা সম্ভব হয়নি।7 সুলতান সাঞ্জার এর শাসনামলে (হিজরী ৫২১ সনে) আল-মওত দুর্গে বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর হামলা চালিয়ে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়।
নিঃসন্দেহে এসব অপরাধীদের চিহ্ন মুছে ফেলা ছিল প্রত্যাবর্তনের সুসংবাদ। তাদের উৎপাত থেকে মুসলমানরা, বরং গোটা দুনিয়া শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে। তাদের টিকে থাকাকে মুসলমানদের গলার কাঁটা বলে বিবেচনা করা হতো। আর ভেতর থেকে তারা ছিল শান্তি আর নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। জনগণ ছিল তাদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। মুসলমানদের ঐক্যের জন্য তারা ছিল মুনাফিকদের চেয়েও বিপজ্জনক। সেলজুক শাসকরা ভালো কাজ করেছেন। তারা এদেরকে দমন করে রাখে এবং তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে নেক কাজের প্রতিদান দিন।8
শিয়াদের অধিকার থেকে কোন কোন অঞ্চলের মুক্তি এবং সুন্নাহর প্রত্যাবর্তনে মানুষের আনন্দ। এটা আল্লাহরই বিধান যে, সত্য আর মিথ্যার মধ্যে সংঘাত ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত সত্য বিজয় লাভ করে। বাতেনীদের পতন এবং শক্তিশালী সুন্নীণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কোন কোন অঞ্চল শিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা ত্যাগ করে এবং খেলাফতের ছায়া তলে ফিরে আসে।
হিজরী ৪৬৮ সনে আমির (উকসীস) দামেশকের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে ফাতেমীদের হাত থেকে তা মুক্ত করেন। তিনি আববাসীয় খলিফা আল-মুকতাদী বিআমরিল্লাহর নামে খুতবা পাঠ করেন এবং ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ তথা ভালো কাজের দিকে এসো বলে আজান দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে দামেশকবাসী ভীষণ আনন্দিত হয়।1 ঐতিহাসিক ইবনু কাসীর এ সম্পর্কে বলেন . তিনি ছিলেন অন্যতম উত্তম বাদশাহ। তিনি দামেশকে দুর্গ স্থাপন করেন, যা ছিল শাম দেশে ইসলামের আশ্রয় কেন্দ্র।2
ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, মক্কার শাসন কর্তার দূত মুহাম্মদ ইবনে আবু হাশেম সুলতান আলাপ আরসালান এর নিকট শুভ সংবাদ নিয়ে আগমন করেন যে, মক্কার শাসক খলিফা কায়েম বি-আমরিল্লাহ এবং সুলতানের পক্ষে খুতবা পাঠ করত: মিসরে ফাতেমী শাসকদের পক্ষে খুতবা পাঠ বন্ধ করেছেন এবং ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ অর্থাৎ ‘ভালো কাজের দিকে এসো’ বলে আজান দেওয়া বন্ধ করেছেন।3 হিজরী ৪৩৫ সনে আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় শাসনকর্তা আবু তাযীম আববাসীয় খলিফার পক্ষে খুতবা পাঠ করেন, ফাতেমীদের পক্ষে খুতবা বন্ধ করেন এবং ফাতেমী পতাকায় অগ্নি সংযোগ করেন।4
হিজরী ৪৬৮ সনে আমির (উকসীস) দামেশকের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করে ফাতেমীদের হাত থেকে তা মুক্ত করেন। তিনি আববাসীয় খলিফা আল-মুকতাদী বিআমরিল্লাহর নামে খুতবা পাঠ করেন এবং ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ তথা ভালো কাজের দিকে এসো বলে আজান দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে দামেশকবাসী ভীষণ আনন্দিত হয়।1 ঐতিহাসিক ইবনু কাসীর এ সম্পর্কে বলেন . তিনি ছিলেন অন্যতম উত্তম বাদশাহ। তিনি দামেশকে দুর্গ স্থাপন করেন, যা ছিল শাম দেশে ইসলামের আশ্রয় কেন্দ্র।2
ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, মক্কার শাসন কর্তার দূত মুহাম্মদ ইবনে আবু হাশেম সুলতান আলাপ আরসালান এর নিকট শুভ সংবাদ নিয়ে আগমন করেন যে, মক্কার শাসক খলিফা কায়েম বি-আমরিল্লাহ এবং সুলতানের পক্ষে খুতবা পাঠ করত: মিসরে ফাতেমী শাসকদের পক্ষে খুতবা পাঠ বন্ধ করেছেন এবং ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল’ অর্থাৎ ‘ভালো কাজের দিকে এসো’ বলে আজান দেওয়া বন্ধ করেছেন।3 হিজরী ৪৩৫ সনে আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় শাসনকর্তা আবু তাযীম আববাসীয় খলিফার পক্ষে খুতবা পাঠ করেন, ফাতেমীদের পক্ষে খুতবা বন্ধ করেন এবং ফাতেমী পতাকায় অগ্নি সংযোগ করেন।4
আররাহা অঞ্চল বিজয় ও আস্থা স্থাপন
উজির নিযামুল মুলক জ্ঞান সাধনা আর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং যোগ্যতর ব্যক্তিদেরকে শাসক নিযুক্ত করার জন্য সেলজুক শাসকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। কিছুটা বিলম্বে হলেও উজির নিযামুল মুলুকের এসব কার্যক্রমের সুফল দেখা দেয়। হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরুত্বে ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ইবনে আক সংকার কাজি বাহাউদ্দীন শহরজুরীর ওয়াজে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘মুসেল’ অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করেন। নুরুদ্দিন জঙ্গি যোগ্যতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালিত করেন এবং জিহাদের সূচনা করেন, যা ফল দান করে। তদীয়-পুত্র নূরুদ্দীন মাহমুদ অতঃপর সালাহউদ্দীন ইউসুফের হাতে এর শুভ-ফল দেখা দেয়। দ্বীনদারী, বীরত্ব আর ইসলামের কল্যাণ কামনার দিক থেকে এ দু’জন শাসনকর্তা অন্যতম সেরা মুসলিম শাসক।
উজির নিযামুল মুলক এবং আলেম সমাজ সংস্কার আর সংশোধন প্রচেষ্টায় যেসব কাজ করেন, তা ছিল পানির বিন্দুর মতো, যা মাটির ফাটলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু পানি মরীচিকার মতো চিক চিক করে; অতঃপর একত্র হয়ে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা সৃষ্টি করে। মুসলিম মিল্লাত তার দুর্বলতার যুগেও জিহাদের ডাকে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠে। তার অনুভূতির গভীরে বান ডাকে, উচ্চাভিলাসের জন্য তাকে করে তোলে জাগ্রত। ত্রিপোলির শাসনকর্তা কাজি ফখরুল মুলক আবু আলী ইবনে আম্মার জিহাদের আহবান নিয়ে বাগদাদ আগমন করলে খলিফা তার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে প্রেরণ করেন তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য। তারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে যোগ্য আসনে বসান। সেলজুক শাসনকর্তাও অনুরূপ কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয় অন্য কোন শাসকের সঙ্গে তেমন আচরণ করা হয়নি। এ সবতো ছিল দুনিয়ার জিহাদের ফল। আর আখেরাতের ফলতো আরো অনেক বড়।1
ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ও ‘আররাহা’ অঞ্চল পুনরুদ্ধার
সুলতান মুহাম্মদ সেলজুকীর শাসনামলে ইমাদুদ্দীন জঙ্গি বাগদাদে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুসেল এর শাসনকর্তা মাসউদ ইবনুল বারসাকীর ইন্তিকাল হলে কাজি বাহাউদ্দীন শহরজুরী এবং সালাহউদ্দীন মুহাম্মদ সুলতানের নিকট আবেদন জানান, ইমাদুদ্দীনকে মুসেলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করার জন্য। সুলতান তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে পেরে এ প্রস্তাবে একমত হন।
ইমাদুদ্দীন জঙ্গি অল্প সময়ের মধ্যে জাযিরার অধিকাংশ অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। অতঃপর তিনি সিরয়ির প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং কিছু দুর্গ অধিকার করে নেন। রোম আর ফিরিঙ্গিরা ইমাদুদ্দীনের কর্মকান্ড দর্শন করে হালব অবরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইমাদুদ্দীন জঙ্গি তাদের সংখ্যার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে তাদের নিকটেই অবস্থান গ্রহণ করেন। এবং কাজি কামালুদ্দীন শহরজুরীকে বাগদাদে সুলতান মাসউদের নিকট প্রেরণ করেন তাকে বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত করে তাঁর নিকট সাহায্য কামনার জন্য। ইমাদুদ্দীনকে সুলতানের সৈন্যদের সাহায্য কামনা সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে কাজি বললেন . সুলতানের সৈন্যরা আগমন করলে তাকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করবে এবং শহরের মালিক হবে। তখন ইমাদুদ্দীন জঙ্গি বলেন . এই দুশমনদের লোভ হচ্ছে আমার সম্পর্কে। দুশমনরা হালব অধিকার করলে শাম দেশে আর ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে না। সর্বাবস্থায় হালব অধিকার করার জন্য কাফেরদের চেয়ে মুসলমানরাই বেশি যোগ্য।2
জঙ্গির উক্তি তাঁর পূর্ববর্তী শাসনকর্তাদের উক্তির চেয়ে ভিন্ন। কাফেরদের সাহায্য-সহায়তা গ্রহণ করে হলেও শাসন কর্তৃত্ব লাভে তারা ছিল চরম লোভী। আমরা দেখতে পাই যে, জঙ্গি সুলতানের সাহায্য নিয়ে হালব মুসলিম অধিকারে আনতে বাধ সাধেননি। হিজরী ৫২২ সনে হালব শহরকে আত্মসমর্পণ করাতে জঙ্গি সক্ষম হন। এভাবে ফিরিঙ্গিরা একজন শক্তিশালী ব্যক্তির মুখোমুখি দাঁড়ায়। যার পক্ষে সৈন্য আর সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব। অবস্থা স্বাভাবিক হলে সে দেখতে পায় সে, সব কিছু ঠিকঠাক, তখন ফিরিঙ্গিদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আসারির দুর্গ অধিকারের চেষ্টা চালায়। হালব ও আন্তাকিয়ার মধ্যস্থলে ছিল এ দুর্গের অবস্থান। আর এটা এজন্য যে, তা ছিল মুসলমানদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দুর্গ অবরোধ করে ক্রুসেডাররা অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী নিয়ে বহির্গত হয়। বিজয় মুসলমানদের পদ চুম্বন করে। ক্রুসেডারদের সাথে এটা ছিল মুসলমানদের প্রথম সংঘাত। হারেম দুর্গ বাসীরা ভীত হয়ে মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়। তখন থেকে জমানা অনেক দূর এগিয়ে যায়। এসব কাজে মুসলমানরা শক্তিশালী হয়। কাফেরদের শক্তি খর্ব হয়। তারা বুঝতে পারে যে, দেশে এমন কিছু ঘটেছে, যা ধারণা- কল্পনাও করা যায়নি।
তারা সব কিছুর মালিক হবে- এমন আশা করার পরও ছোটরাই তাদের হাতের সব কিছুর মালিক হতে সক্ষম হয়।3 হিজরী ৫৩২ সনে রোমানরা বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়। ফিরিঙ্গিরাও ছিল তাদের সঙ্গে। হালবের আশপাশের অঞ্চলের উপর তারা কর্তৃত্ব স্থাপন করে। অতঃপর তারা সিজার শহর অবরোধ করে। সিজার শহরের অধিপতি সুলতান ইবনে মুনকিস আল-কিনানী জঙ্গির নিকট সাহায্য কামনা করে দূত প্রেরণ করেন। তিনি আসেন এবং তার সাহায্যে দাঁড়ান। প্রতিদিন রোমানদের পক্ষ থেকে বাহিনী প্রেরিত হয়। তারা বলে . খোলা ময়দানে বেরিয়ে এসো। আমরাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি এটা করেন তাদেরকে ভয় দেখাবার জন্য। কিন্তু রোম বাদশাহ নিরাপত্তাকেই অগ্রাধিকার দান করেন এবং অতি সদরপণে স্বদেশে পাড়ি জমান।
হিজরী ৫৩৪ সনে জঙ্গি ফিরিঙ্গিদের দেশে অভিযান চালালে সকলে সমবেত হয়ে তাঁর মোকাবিলা করে। বারিন দুর্গের নিকটে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়। এ সময় মুসলমানরা এমন ধৈর্য ধারণ করে, যার কোন তুলনার কথা শোনা যায়নি। অবশ্য লাইলাতুল হারীর (কাদেসিয়া) এর সাথেই এর তুলনা চলে। আল্লাহ মুসলমানদেরকে সাহায্য করেন। ফিরিঙ্গি শাসকরা পলায়ন করে। অতঃপর নিরাপদে বারীন দুর্গ অধিকার করা হয়। হালবের পার্শ্ববর্তী মুসলমানরা শান্তি লাভ করে এবং হালবকে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে।4
জঙ্গির অভিপ্রায় ছিল জাযিরা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, যাতে দুশমনদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজ হয়। ফলে তিনি হাকারিয়া অঞ্চল সফর করেন। তখন এ অঞ্চল ছিল কুর্দীদের অধিকারে। তিনি তা অধিকার করে আক অঞ্চলও দখল করেন। আর এসব কিছু ছিল তাঁর একটা বড় কাজের ভূমিকা। আর সে বড় কাজটা ছিল আররাহা অঞ্চল জয় করা। হিজরী ৫৩৯ সনে জঙ্গি এই শহর অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। নগরটি ছিল ক্রুসেডারদের শাসনাধীন আর তার শাসক ছিল জোসলীন। ২৮ দিন নগরটি অবরোধ করে রাখার পর শক্তি প্রয়োগে তা অধিকার করা হয়। ক্রুসেডাররা অবনত হয়। পাদ্রী পুরোহিতদের পদানত করা হয়। নগরে জারি করা হয় ইসলামি বিধান। খ্রিস্টানদের নিকট নগরটি ছিল সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। অতঃপর আশপাশের দুর্গগুলোরও পতন ঘটে। ফলে গোটা জাযিরা অঞ্চল ফিরিঙ্গিদের শাসন আর অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়।5
এ পর্যায়ের কাজ সমাপ্ত করা জঙ্গির পক্ষে সম্ভব হয়নি। জেবর দুর্গ অবরোধকালে তিনি নিহত হন। জাযিরা অঞ্চলে ফোরাত নদীর তীরে এ দুর্গ অবস্থিত। তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল কাসীর বলেন . ‘জীবন চরিতের বিবেচনায় তিনি ছিলেন উত্তম শাসকদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বীর, সাহসী যোদ্ধা এবং দৃঢ়চেতা।’’ তিনিই তো ক্রুসেড যুদ্ধের সূচনা করেন এবং মুসলমানদের অন্তরে আস্থা ফিরিয়ে আনেন। অবশ্য তাঁর পুত্র নুরুদ্দীন মাহমুদের হাতে জিহাদী কর্মকান্ডের নবায়ন হয়।
উজির নিযামুল মুলক জ্ঞান সাধনা আর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং যোগ্যতর ব্যক্তিদেরকে শাসক নিযুক্ত করার জন্য সেলজুক শাসকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। কিছুটা বিলম্বে হলেও উজির নিযামুল মুলুকের এসব কার্যক্রমের সুফল দেখা দেয়। হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শুরুত্বে ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ইবনে আক সংকার কাজি বাহাউদ্দীন শহরজুরীর ওয়াজে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘মুসেল’ অঞ্চলের শাসনভার গ্রহণ করেন। নুরুদ্দিন জঙ্গি যোগ্যতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালিত করেন এবং জিহাদের সূচনা করেন, যা ফল দান করে। তদীয়-পুত্র নূরুদ্দীন মাহমুদ অতঃপর সালাহউদ্দীন ইউসুফের হাতে এর শুভ-ফল দেখা দেয়। দ্বীনদারী, বীরত্ব আর ইসলামের কল্যাণ কামনার দিক থেকে এ দু’জন শাসনকর্তা অন্যতম সেরা মুসলিম শাসক।
উজির নিযামুল মুলক এবং আলেম সমাজ সংস্কার আর সংশোধন প্রচেষ্টায় যেসব কাজ করেন, তা ছিল পানির বিন্দুর মতো, যা মাটির ফাটলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু পানি মরীচিকার মতো চিক চিক করে; অতঃপর একত্র হয়ে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা সৃষ্টি করে। মুসলিম মিল্লাত তার দুর্বলতার যুগেও জিহাদের ডাকে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠে। তার অনুভূতির গভীরে বান ডাকে, উচ্চাভিলাসের জন্য তাকে করে তোলে জাগ্রত। ত্রিপোলির শাসনকর্তা কাজি ফখরুল মুলক আবু আলী ইবনে আম্মার জিহাদের আহবান নিয়ে বাগদাদ আগমন করলে খলিফা তার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে প্রেরণ করেন তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য। তারা তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে যোগ্য আসনে বসান। সেলজুক শাসনকর্তাও অনুরূপ কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয় অন্য কোন শাসকের সঙ্গে তেমন আচরণ করা হয়নি। এ সবতো ছিল দুনিয়ার জিহাদের ফল। আর আখেরাতের ফলতো আরো অনেক বড়।1
ইমাদুদ্দীন জঙ্গি ও ‘আররাহা’ অঞ্চল পুনরুদ্ধার
সুলতান মুহাম্মদ সেলজুকীর শাসনামলে ইমাদুদ্দীন জঙ্গি বাগদাদে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুসেল এর শাসনকর্তা মাসউদ ইবনুল বারসাকীর ইন্তিকাল হলে কাজি বাহাউদ্দীন শহরজুরী এবং সালাহউদ্দীন মুহাম্মদ সুলতানের নিকট আবেদন জানান, ইমাদুদ্দীনকে মুসেলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করার জন্য। সুলতান তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে জানতে পেরে এ প্রস্তাবে একমত হন।
ইমাদুদ্দীন জঙ্গি অল্প সময়ের মধ্যে জাযিরার অধিকাংশ অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। অতঃপর তিনি সিরয়ির প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং কিছু দুর্গ অধিকার করে নেন। রোম আর ফিরিঙ্গিরা ইমাদুদ্দীনের কর্মকান্ড দর্শন করে হালব অবরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইমাদুদ্দীন জঙ্গি তাদের সংখ্যার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে তাদের নিকটেই অবস্থান গ্রহণ করেন। এবং কাজি কামালুদ্দীন শহরজুরীকে বাগদাদে সুলতান মাসউদের নিকট প্রেরণ করেন তাকে বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত করে তাঁর নিকট সাহায্য কামনার জন্য। ইমাদুদ্দীনকে সুলতানের সৈন্যদের সাহায্য কামনা সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে কাজি বললেন . সুলতানের সৈন্যরা আগমন করলে তাকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করবে এবং শহরের মালিক হবে। তখন ইমাদুদ্দীন জঙ্গি বলেন . এই দুশমনদের লোভ হচ্ছে আমার সম্পর্কে। দুশমনরা হালব অধিকার করলে শাম দেশে আর ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে না। সর্বাবস্থায় হালব অধিকার করার জন্য কাফেরদের চেয়ে মুসলমানরাই বেশি যোগ্য।2
জঙ্গির উক্তি তাঁর পূর্ববর্তী শাসনকর্তাদের উক্তির চেয়ে ভিন্ন। কাফেরদের সাহায্য-সহায়তা গ্রহণ করে হলেও শাসন কর্তৃত্ব লাভে তারা ছিল চরম লোভী। আমরা দেখতে পাই যে, জঙ্গি সুলতানের সাহায্য নিয়ে হালব মুসলিম অধিকারে আনতে বাধ সাধেননি। হিজরী ৫২২ সনে হালব শহরকে আত্মসমর্পণ করাতে জঙ্গি সক্ষম হন। এভাবে ফিরিঙ্গিরা একজন শক্তিশালী ব্যক্তির মুখোমুখি দাঁড়ায়। যার পক্ষে সৈন্য আর সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব। অবস্থা স্বাভাবিক হলে সে দেখতে পায় সে, সব কিছু ঠিকঠাক, তখন ফিরিঙ্গিদের মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আসারির দুর্গ অধিকারের চেষ্টা চালায়। হালব ও আন্তাকিয়ার মধ্যস্থলে ছিল এ দুর্গের অবস্থান। আর এটা এজন্য যে, তা ছিল মুসলমানদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দুর্গ অবরোধ করে ক্রুসেডাররা অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনী নিয়ে বহির্গত হয়। বিজয় মুসলমানদের পদ চুম্বন করে। ক্রুসেডারদের সাথে এটা ছিল মুসলমানদের প্রথম সংঘাত। হারেম দুর্গ বাসীরা ভীত হয়ে মুসলমানদের সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়। তখন থেকে জমানা অনেক দূর এগিয়ে যায়। এসব কাজে মুসলমানরা শক্তিশালী হয়। কাফেরদের শক্তি খর্ব হয়। তারা বুঝতে পারে যে, দেশে এমন কিছু ঘটেছে, যা ধারণা- কল্পনাও করা যায়নি।
তারা সব কিছুর মালিক হবে- এমন আশা করার পরও ছোটরাই তাদের হাতের সব কিছুর মালিক হতে সক্ষম হয়।3 হিজরী ৫৩২ সনে রোমানরা বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হয়। ফিরিঙ্গিরাও ছিল তাদের সঙ্গে। হালবের আশপাশের অঞ্চলের উপর তারা কর্তৃত্ব স্থাপন করে। অতঃপর তারা সিজার শহর অবরোধ করে। সিজার শহরের অধিপতি সুলতান ইবনে মুনকিস আল-কিনানী জঙ্গির নিকট সাহায্য কামনা করে দূত প্রেরণ করেন। তিনি আসেন এবং তার সাহায্যে দাঁড়ান। প্রতিদিন রোমানদের পক্ষ থেকে বাহিনী প্রেরিত হয়। তারা বলে . খোলা ময়দানে বেরিয়ে এসো। আমরাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি এটা করেন তাদেরকে ভয় দেখাবার জন্য। কিন্তু রোম বাদশাহ নিরাপত্তাকেই অগ্রাধিকার দান করেন এবং অতি সদরপণে স্বদেশে পাড়ি জমান।
হিজরী ৫৩৪ সনে জঙ্গি ফিরিঙ্গিদের দেশে অভিযান চালালে সকলে সমবেত হয়ে তাঁর মোকাবিলা করে। বারিন দুর্গের নিকটে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয়। এ সময় মুসলমানরা এমন ধৈর্য ধারণ করে, যার কোন তুলনার কথা শোনা যায়নি। অবশ্য লাইলাতুল হারীর (কাদেসিয়া) এর সাথেই এর তুলনা চলে। আল্লাহ মুসলমানদেরকে সাহায্য করেন। ফিরিঙ্গি শাসকরা পলায়ন করে। অতঃপর নিরাপদে বারীন দুর্গ অধিকার করা হয়। হালবের পার্শ্ববর্তী মুসলমানরা শান্তি লাভ করে এবং হালবকে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে।4
জঙ্গির অভিপ্রায় ছিল জাযিরা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, যাতে দুশমনদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজ হয়। ফলে তিনি হাকারিয়া অঞ্চল সফর করেন। তখন এ অঞ্চল ছিল কুর্দীদের অধিকারে। তিনি তা অধিকার করে আক অঞ্চলও দখল করেন। আর এসব কিছু ছিল তাঁর একটা বড় কাজের ভূমিকা। আর সে বড় কাজটা ছিল আররাহা অঞ্চল জয় করা। হিজরী ৫৩৯ সনে জঙ্গি এই শহর অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। নগরটি ছিল ক্রুসেডারদের শাসনাধীন আর তার শাসক ছিল জোসলীন। ২৮ দিন নগরটি অবরোধ করে রাখার পর শক্তি প্রয়োগে তা অধিকার করা হয়। ক্রুসেডাররা অবনত হয়। পাদ্রী পুরোহিতদের পদানত করা হয়। নগরে জারি করা হয় ইসলামি বিধান। খ্রিস্টানদের নিকট নগরটি ছিল সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। অতঃপর আশপাশের দুর্গগুলোরও পতন ঘটে। ফলে গোটা জাযিরা অঞ্চল ফিরিঙ্গিদের শাসন আর অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়।5
এ পর্যায়ের কাজ সমাপ্ত করা জঙ্গির পক্ষে সম্ভব হয়নি। জেবর দুর্গ অবরোধকালে তিনি নিহত হন। জাযিরা অঞ্চলে ফোরাত নদীর তীরে এ দুর্গ অবস্থিত। তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল কাসীর বলেন . ‘জীবন চরিতের বিবেচনায় তিনি ছিলেন উত্তম শাসকদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বীর, সাহসী যোদ্ধা এবং দৃঢ়চেতা।’’ তিনিই তো ক্রুসেড যুদ্ধের সূচনা করেন এবং মুসলমানদের অন্তরে আস্থা ফিরিয়ে আনেন। অবশ্য তাঁর পুত্র নুরুদ্দীন মাহমুদের হাতে জিহাদী কর্মকান্ডের নবায়ন হয়।
আমরা যদি সুলতান নূরুদ্দীনের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রভাব আর জিহাদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে চাই- তিনি এবং সালাহউদ্দীন ছিলেন স্ব স্ব সময়ে জিহাদ নবায়নের আদর্শ, তা হলে আমাদেরকে উল্লেখ করতে হয় ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে ইসমাঈল আল-মাকদেসী আশ শাফেয়ির উক্তি। যাঁর উপাধি ছিল আবু শামা। নূরুদ্দীন এবং সালাহউদ্দীনের শাসনামলের গুরুত্বের কারণ উল্লেখ প্রসঙ্গে নূরুদ্দীন সম্পর্কে তিনি বলেন . তার শাসনামল অনেক আগের হলেও তাঁর শাসনকালের প্রভাব দর্শন করে এবং তাঁর সম্পর্কে শ্রবণ করে আমি চমৎকৃত হয়েছি। তাঁর পরে যিনি ছিলেন সেরা শাসক, অর্থাৎ সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। তাঁর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। এরা দু’জন অর্থাৎ সুলতান নূরুদ্দীন জঙ্গি এবং সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ছিলেন অতীত কালের খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব এবং ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের মতো। জীবন চরিত আর চরিত্র মাধুর্যের দিক থেকে এরা দু’জন ছিলেন উত্তম শাসক। তবে কৃতিত্ব পূর্ববর্তী ব্যক্তিত্বের অর্থাৎ নুরুদ্দীন জঙ্গির। কারণ, এসব কল্যাণের মূল উৎস ছিলেন তিনি। সুবিচার, সুশাসন, ন্যায়নীতি আর জিহাদ দ্বারা তিনি গোটা দেশে কল্যাণের পথ উন্মুক্ত করে তোলেন। তবে সালাহউদ্দীন অধিক জিহাদ করেন এবং বেশি দেশ জয় করেন। তিনি নিজে ধৈর্য ধারণ করেন এবং অন্যদেরকে ধৈর্যের দীক্ষা দান করেন। ফলে আল্লাহ তাঁর হাতে বিরাট বিজয় সাধন করান। তিনিই হচ্ছেন সেই বীর সৈনিক, যাঁর হাতে আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের অধিকারে এনে দেন।1
হিজরী ৫১১ সনে ইরাকে নূরুদ্দীনের জন্ম হয়। পিতার সঙ্গে তিনি ইরাক, মুসেল এবং শাম দেশের নানা অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। পিতার মৃত্যুর পর তিনি হন পিতার স্থলাভিষিক্ত। তিনি হালব অঞ্চলে সুন্নাহর প্রচার প্রসার ঘটান। বেদআতের পরিবর্তন সাধন করেন। রাফেযী মতবাদের মূলোৎপাটন সাধন করেন এবং অনেক দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদ- মাদ্রাসার জন্য তিনি ওয়াকফের প্রচলন করেন এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ধর্মীয় গ্রন্থ ব্যাপক অধ্যয়ন করতেন এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ করতেন। নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। কুরআন মজীদ নিয়ম অনুযায়ী তিলাওয়াত করতেন। হালাম-হারামের বিধান কঠোরভাবে মেনে চলতেন এবং হারাম খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। ব্যয়ের ক্ষেত্রে তিনি সৎ পন্থা মেনে চলতেন। খাদ্য- দ্রব্য এবং পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও তিনি সতর্ক ছিলেন। তাঁর মুখে কখনো মন্দ কথা উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি।2
তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন .
আমি ইসলামের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কালের রাজা- বাদশাহদের জীবনী অধ্যয়ন করেছি। বর্তমান কাল পর্যন্ত সমস্ত শাসকদের জীবনী আমি অধ্যয়ন করে দেখেছি। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের পর তাঁর চেয়ে সুন্দর চরিত্রের কারো সম্পর্কে আমি জানতে পারিনি।3
খোদাভীতি এবং দুনিয়া ত্যাগের নীতি তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল। বৈধভাবে খরিদ করা অন্ন বস্ত্র ছাড়া অন্য কিছু তিনি ব্যবহার করতেন না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে গনিমতের অংশ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতেন না। মুসলমানদের ধনভান্ডার থেকে তিনি এক কপর্দকও নিতেন না। একবার তাঁর স্ত্রী অভাব অনটনের অভিযোগ করে বেশি খোরপোশ দাবি করলে তাঁর চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে। তিনি বলেন . আমি কোথা থেকে তার দাবি পূরণ করব? তার প্রেমে আমি জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। অতঃপর তিনি বলেন . হেমস শহরে আমার জন্য তিনটা দোকান নির্দিষ্ট আছে। এ দোকানগুলো থেকে সে ইচ্ছা মতো পণ্য গ্রহণ করতে পারে।4
তাঁর দরবারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর সম্পর্কে বলেন . একদিন আমি তাঁর সঙ্গে ‘আররাহার’ প্রান্তরে ছিলাম। সূর্যের তাপ ছিল আমাদের পৃষ্ঠের উপর। আমরা যতই অগ্রসর হই, ততই সূর্যের প্রখর তাপ আমাদের উপর পতিত হয়। আমরা যখন প্রত্যাবর্তন করি, তখন আমাদের ছাড়া পেছনে পতিত হয়। অশ্ব হাঁকিয়ে পেছনে তাকিয়ে তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বলেন . তুমি কি জান, কেন আমি অশ্ব হাঁকাই আর পেছনে তাকাই? আমি বললাম . না। তিনি বললেন . আমার মনে হয়েছে যে, পৃথিবীতে আমরা যে অবস্থায় আছি, তাতে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি দুনিয়া তালাশ করে, দুনিয়া তার থেকে পলায়ন করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে পলায়ন করে, দুনিয়ার তার পেছনে ছুটে চলে। আবু শামা বলেন . যে শাসনকর্তা এমন চিন্তা করতে পারেন, তাঁর প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্টি হন।5 ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . রাত্রিবেলা বেশির ভাগ সময় তিনি নামাজে রত থাকতেন। দোয়া- ইস্তিগফার করতেন। অশ্বারোহনের পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় কাটতো। কবির ভাষায় .
جمع الشجاعة والخشوع لربه ما أحسن المحراب في المحراب
বীরত্ব আর বিনয়ের সমাবেশ ঘটান তিনি আপন পালন কর্তার জন্য! মিহরাবের অভ্যন্তরে মিহরাব কতইনা চমৎকার।6
হানাফি মাজহাবের ফিকাহ সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন, তাই বলে তাঁর মধ্যে গোঁড়ামি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। সকল ব্যাপারে ইনসাফই ছিল তাঁর ভূষণ। বাস্তবিক পক্ষে ইনসাফ আর ন্যায় নীতি অনুসরণ করা, খাদ্য- পানীয় এবং পরিধেয় বস্ত্রের ক্ষেত্রে হারাম বর্জন করার রীতি শাসক শ্রেণির জন্য তিনিই নবায়ন করেন। তাঁর পূর্বে শাসক শ্রেণি ছিল জাহেলি যুগের অনুসারী। উদর পূর্তি আর যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র চিন্তা। ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো মন্দ কিছুই তারা চিনত না। সুবিচারের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে তিনি ছিলেন চরিত্রের দিক থেকে সর্বোত্তম শাসক। শাম দেশ, জাযিরা এবং মিসরে তাঁর শাসনকালে তিনি ট্যাক্স, কাষ্টম ডিউটি এবং ওশর রহিত করেন।7
দেশে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য তিনি একটা বিচারণীয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিচারালয় স্থাপনের কারণ ছিল এই যে, তাঁর নিয়োজিত শাসকবর্গ আর সেনাবাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা প্রতিবেশীদের উপর জুলুম করলে সকলে কাজি কামালুদ্দীনের নিকট অভিযোগ দায়ের করে। কাজি কোন কোন ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করলেও আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সুলতান নূরুদ্দীন এ বিষয়ে অবগত হতে পেরে এ বিচারালয় স্থাপন করেন। আসাদুদ্দীন এ সম্পর্কে জানতে পারলে সুলতান তার আমলাদের উদ্দেশ্যে বলেন . খোদার কসম করে বলছি, তোমাদের কারো কারণে আমাকে বিচারালয়ে উপস্থিত হতে হলে আমি অবশ্যই তাকে শুলিবিদ্ধ করব। যাও এবং নিজেদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে ফেলো। প্রতিপক্ষকে রাজি করো এবং ভালো ভাবে মীমাংসা কর।8 তখন তারা বলল . আমরা এটা করলে লোকেরাতো দাবি জোরদার করবে। তিনি বলেন . নূরুদ্দীনকে সালিশের পিতার চোখে দেখার চেয়ে আমার হাত থেকে আমার মালিকানাধীন সমস্ত কিছু ছুটে যাওয়াটা আমার নিকট অতি সহজ। নূরুদ্দীন সপ্তাহে দু’দিন এ বিচারালয়ে বসতেন। আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর অবস্থা সম্পর্কে জানতে পের তিনি আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতার সেজদা আদায় করেন।9
মুসলিম দেশগুলোতে তাঁর কল্যাণমূলক কাজ অনেক। তিনি শাম দেশে নগর প্রাচীর নির্মাণ করেন এবং তা অতিশয় মজবুত করে তৈয়ার করেন। হালব শহর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং দামেশকে তিনি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি দ্বীনদার ব্যক্তিদেরকে সুউচ্চ মহলে স্থান দিতেন। এজন্য আমির ওমরারা তাঁকে হিংসার চোখে দেখতো। তাঁর দরবারের অন্যতম আমির শায়েখ কুতুবুদ্দীন নীশাপুরী প্রসঙ্গটা তাঁর নিকট উপস্থাপন করলে সুলতান তাকে বলেন . তুমি যার বিরুদ্ধে কথা বলছো, সেতো পুণ্য করছে। তার সমস্ত পদস্খলন ক্ষমা করা হচ্ছে। আর তা হচ্ছে জ্ঞান ও দীন আর তুমি এবং তোমার সঙ্গীদের মধ্যে তুমি যা বলছ, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে। কিন্তু মাফ করানোর মতো কোন পুণ্য কর্ম তোমাদের নেই। তোমাদের নেক কাজ না থাকলেও আমি তোমাদের বদ কর্ম বহন করছি। তার মন্দ কর্ম যদি সত্যিই থেকে থাকে তবে কি আমি তা বহন করব না? অথচ তারতো নেক কাজ রয়েছে। তবে খোদার কসম করে বলছি, তুমি যা বলছ, আমি তা বিশ্বাস করি না। তুমি পুনরায় যদি তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলো তবে আমি নিশ্চিত তোমাকে শিক্ষা দিবো।10
তিনি এমনই নির্লোভ- নিস্পৃহ এবং খোদা ভীরু ছিলেন যে, নানা দেশের রাজা- বাদশাহরা তাঁর নিকট যেসব উপঢৌকন প্রেরণ করতেন, তিনি সেসব থেকে সামান্য অংশও ব্যবহার করতেন না। সেসব তিনি প্রেরণ করতেন বিচারপতিদের কমিটির নিকট। তাঁরা সেসব জিনিস বিক্রয় করে তার মূল্য বিরান মসজিদ সংস্কারের কাজে ব্যয় করতেন। মসজিদের মিম্বারে তাঁর জন্য দোয়া করার সময় তাঁর বড় বড় উপাধি ব্যবহার না করার জন্য তিনি খতিবদেরকে নির্দেশ দেন। তাঁর বর্ণনা প্রসঙ্গে আল- ইমাদ আল- ইসফাহানী বলেন . তিনি হচ্ছেন সে ব্যক্তি, যিনি শাম দেশে ইসলামের গৌরব ফিরিয়ে আনেন; অথচ ইতিপূর্বে সেখানে কুফরির প্রাধান্য ছিল। তিনি আশ্রয় স্থল উন্মুক্ত করেন এবং শরীফ সম্ভ্রান্ত রমণীদেরকে মুক্ত করেন।11 মুসেলের কর্তৃত্ব লাভের সময় তিনি পুলিশ বাহিনী প্রধানকে নির্দেশ দেন কাজির নির্দেশ অনুযায়ী শরিয়ত সম্মত পন্থায় যেন সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। ইতিপূর্বে রাজনীতির বিবেচনায় সমস্ত কার্য সম্পন্ন করা হতো।12 শাস্তি প্রয়োগে কঠোরতা আরোপের দাবি করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটা হবে শরিয়ত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা।
নূরুদ্দীনের শাসনামলে আলেম সমাজ
সুলতান নূরুদ্দীন যে সংস্কার সাধন করতে চাইতেন, তাতে আলেম সমাজের বিরাট ভূমিকা ছিল। সে কারণে তিনি আলেম দের জন্য ক্ষেত্র প্রশস্ত করে তাদেরকে বড় বড় সুযোগ- সুবিধাও দান করেন। এ জন্য আলেমগন দলে দলে তাঁর নিকট আগমন করতেন এবং তিনিও কঠিন কাজে আলেমদের নিকট থেকে সহায়তা চাইতেন।
শাফেয়ি মাদ্রাসা থেকে যেসব আলিমের উদ্ভব হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজি কামালুদ্দীন শহরজুরী। তাঁর আসল নাম ছিল মুহাম্মদ ইবনে আবু মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন বাগদাদে ইমাদুদ্দীন জঙ্গির দূত। পরবর্তীকালে সিরিয়ায় তিনি নূরুদ্দীনের সরকারে যোগদান করেন এবং কাজিদের নিয়োগকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি মন্ত্রীর পদে উন্নীত হন এবং শাম দেশে কর্তৃত্বের অধিকারী হন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ ফিকাহবিদ, নামকরা কবি এবং বীর বাহাদুর ব্যক্তি, বড় কুটনীতিক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ।13
তাদের মধ্যে আর একজন হচ্ছে বিশিষ্ট হাম্বলী ওয়ায়েজ আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা। তিনি বাগদাদে আগমন করত: ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। হাদীসে রও জ্ঞান লাভ করত: স্বদেশ ভূমি দামেশকে তিনি ফিরে যান। হিজরী ৫৬৪ সনে তিনি বাগদাদে নূরুদ্দীনের দূতের দায়িত্ব পালন করেন। সুলতান সালাহউদ্দীনের নিকট তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল।14
তাহাদের মধ্যে অপরজন হচ্ছে শাফেয়ি মাজহাবের অন্যতম ইমাম কাজি আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু আসরূন। নূরুদ্দীনের শাসনামলে তিনি গাযালিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা দান শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি হালবে গমন করলে নূরুদ্দীন তাঁর জন্য একটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। হেমসেও অপর একটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। হিজরী ৫৮৫ সনে তাঁর ইন্তিকাল হয়। 16
নূরুদ্দীন মাহমুদের জিহাদ
সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদের নিকট জিহাদ কোন সাময়িক সমাধান ছিল না, অথচ স্থান- কাল-পাত্রের দাবি অনুযায়ী জিহাদের কোন সুযোগও ছিল না; বরং মূল ব্যাপার ছিল জিহাদের জন্য প্রস্ত্ততি এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সুলতান নূরুদ্দীন সুলতান কুলিম আরসালান সেলজুকীকে তিরস্কার করেন, যিনি রোম দেশের প্রতিবেশী আনাযুল দেশের মালিতা, সীবাস এবং আকছারা অঞ্চল শাসন করতেন। তিরস্কার করেন এজন্য যে, মুসলিম দেশের উপর তিনি কর্তৃত্ব করতে চাইলেও রোমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্ত্তত নয়। তিনি বলেন, তুমি রোম দেশের প্রতিবেশী। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে প্রস্ত্তত নও। তোমার দেশ মুসলিম জাহানের একটা বিরাট অংশ। আমার সঙ্গে জিহাদে যোগদান করা তোমার জন্য অপরিহার্য।17
ক্রুসেডারদের সঙ্গে জিহাদের এক অভিপ্রায়ে তিনি তদীয় ভ্রাতা মুসেল অঞ্চলের শাসনকর্তা কুতুবুদ্দীন এবং ‘কাইফা’ ও ‘মর্দিন’ দুর্গের অধিপতির নিকট বাণী পাঠান। এরা সে বাণীর জবাবও দেন। কাইফা দুর্গের অধিপতির সঙ্গীরা তাকে বলেন . কোন বিষয়ে তুমি সংকল্প করেছ? তিনি বললেন, বসে থাকার ব্যাপারে। কারণ, নূরুদ্দীন নিজেকে এবং অন্যদেরকেও ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করতে চায়।18 ফলে তারাও তার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করে। পরদিন উপস্থিত হলে মুজাহিদদেরকে প্রস্ত্তত করার নির্দেশ দেন। তখন তারা তাকে বলে: যা প্রকাশ পেয়েছে তা বাদে? গতকাল আমরা তোমার থেকে পৃথক হয়েছি এক অবস্থায়, আজ আমরা তার বিপরীত দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন . নুরুদ্দীন আমার সঙ্গে এমন রীতি অবলম্বন করেছে; আমি তার সাহায্য না করলে জনগণ আমার আনুগত্য থেকে বের হয়ে যায়। কারণ, তিনি আবেদ যাহিদ তথা সাধু সজ্জনকে লিখে দিয়েছেন, যা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মুসলমানরা ফিরিঙ্গিদের নিকট থেকে যা কিছু লাভ করেছে। তিনি তাদের নিকট দোয়া চান এবং তাদের নিকট দাবি করেন, যাতে মুসলমানদেরকে গাজিদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে তারা বসে বসে ক্রন্দন করে, আমার উপর লা’নত করে এবং আমার জন্য বদ দোয়া করে। সুতরাং তার দিকে ছুটে যাওয়া কর্তব্য।19
বানইয়াসের ঘটনা এবং তার দুর্গ জয় করা কালে তার সঙ্গে আপন ভাই নছরুদ্দীনও ছিলেন। একটা তীর বিদ্ধ হয়ে তাঁর এক চক্ষু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নূরুদ্দীন তাকে দেখে বললেন . তোমার জন্য পুরস্কার প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে, তা যদি তোমার নিকট প্রকাশ পেতো তাহলে তুমি অপর চক্ষুটিও হারাবার কথা কামনা করতে। এ বিজয়কালে তার সঙ্গে মুঈনুদ্দীন আনর এর পুত্রও ছিল, যিনি বানইয়াস দুর্গ ফিরিঙ্গিদের হাতে অর্পণ করেন। তখন নূরুদ্দীন তাকে বলেন . এই বিজয়ে মুসলমানদের জন্য একটা আনন্দ, কিন্তু তোমার জন্য দুটা আনন্দ। তিনি বললেন . তা কীভাবে? বললেন . কারণ, আজ আল্লাহ তোমার পিতার দেহকে অগ্নি থেকে শীতল করেছেন।20
নূরুদ্দীনের বিজয় অভিযান
ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে তার জীবনের প্রাথমিক ঘটনাবলীতে দামেশকের শাসনকর্তা মুঈনুদ্দীন আনর এর সঙ্গে বা‘লা বাক্ক শহরে সাক্ষাৎকালে ত্রিপোলীর ক্রুসেডার শাসকের নিকট থেকে তার কাছে একটা পত্র আসে। তাতে ‘আল-আরীমা’ দুর্গ অধিকার করার জন্য এ পত্রে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ- অনুপ্রাণিত করা হয়। নূরুদ্দীনের নিকট এ দাবি বেশ কঠিন ঠেকায়। তিনি এবং মুঈনুদ্দীন দুর্গ অবরোধ করত: তা অধিকার করেন। হিজরী ৫৪৩ সনে নূরুদ্দীন শাম দেশের বছরা অঞ্চল সফর করেন। সেখানে ফিরিঙ্গিরাও একত্র হয় শাম দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল দখল করার অভিপ্রায় নিয়ে। সেখানে তাদের মুখোমুখি হয় এবং ঘোরতর যুদ্ধ হয়। অতঃপর আল্লাহ মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন, আর ফিরিঙ্গিদের করে পরাজিত।21 হিজরী ৫৪৪ সনে হারেম দুর্গে অভিযান চালিয়ে তার আশ পাশ ধ্বংস ও লুঠপাট করা হয়। অতঃপর সেখান থেকে ‘আম্ব’ দুর্গ অভিমুখে রওয়ানা করে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এতে মুসলমানরা বিজয় লাভ করে এবং আন্তাকিয়ার শাসনকর্তা এ সংঘর্ষে নিহত হয়। অতঃপর নূরুদ্দীন ‘ফামিয়া’ দুর্গ অভিমুখে রওয়ানা হন। তিনি দুর্গ অবরোধ করে সন্ধি সূত্রে তা অধিকার করেন।22
হিজরী ৫৪৬ সনে নূরুদ্দীন ফিরিঙ্গিদের অন্যতম শয়তান ‘জসলিন'কে বন্দী করেন। এরপর তিনি তিলবাসীর, আইনতাব, এজাজ, মিরয়াস ইত্যাদি দুর্গ অধিকার করে নেন। হালব এর বিভিন্ন অঞ্চলে এসব দুর্গ অবস্থিত। হিজরী ৫৪৯ সনে দামেশক তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। নূরুদ্দীন দীর্ঘকাল থেকে এজন্য পরিকল্পনা করে আসছিলেন। কারণ তার অবস্থান ছিল ক্রুসেডারদের পথে। একা দামেশক ছিল দুর্বল। শক্তি প্রয়োগে তা অধিকার করার চেষ্টা করা হলে তা অধিকার করা ক্রুসেডারদের নিকট আশ্রয় চাইতে বাধ্য করবে। অথচ নূরুদ্দীন রক্তপাত ঘটাতে চান না। এ কারণে মুজীরুদ্দীনের বিরুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করা হয় এবং অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। দামেশকবাসী শহর তাঁর নিকট অর্পণ করতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর এ অভিযান চালানো হয়। ফলে কোন উল্লেখযোগ্য লড়াই ছাড়াই তিনি দামেশক নগরীতে প্রবেশ করেন। আর মুজীরুদ্দীনকে হেমস নগর দান করেন।
হিজরী ৫৫৯ সনে ‘হারেম’ দুর্গ জয় করা হয়। এটা ছিল ক্রুসেডারদের সঙ্গে নূরুদ্দীনের বড় যুদ্ধগুলোর অন্যতম। এই যুদ্ধে ফিরিঙ্গিরা অশ্বারোহী বাহিনী আর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অংশগ্রহণ করে। সকলের আগে ছিল এন্তাকিয়ার শাসক বুরনুস (বায়মন্ড), ত্রিপোলীর শাসক ‘কিমহ’ এবং জসলিন তনয়। নূরুদ্দীন ‘হারেম’ দুর্গের বাইরে তাদেরকে টেনে আনতে সক্ষম হন এবং তাদের উপর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। আমির শাসক আর বাদশাহরা সকলে তার সম্মুখে বন্দী হয়ে আসে।
হিজরী ৫৬০ সনে তিনি ‘আল মানিতারা’ দুর্গ জয় করেন এবং তাতে বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল হস্তগত হয়। হিজরী ৫৬২ সনে নূরুদ্দীন ‘‘ছাফিতা’ এবং ‘আল-আরীমা’ দুর্গ অধিকার করেন।
মিশর-সিরিয়া ঐক্য
সুলতান মাহমুদের অন্তর থেকে একথা মুছে যায়নি যে, মিশর- সিরিয়ার ঐক্যই সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ, যার উপর নির্ভর করে ক্রুসেডারদের মোকাবিলা করা। মিসরে ওবায়দী শাসকদের উজির শাওর সাদী তাঁর নিকট আশ্রয় চাইলে এজন্য উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়। হৃত ওযারতীর পদ ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁর সহযোগিতা চাওয়া হয়। এ প্রস্তাবে নূরুদ্দীন দ্রুত সাড়া দেন এবং আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন এই শর্তে যে, নূরুদ্দীন মিশরের এক তৃতীয়াংশের দখল লাভ করবেন। নূরুদ্দীনের সৈন্যরা কায়রো শহরে প্রবেশ করে। তারা মন্ত্রী শাওরকে তার হারানো পদে পুনর্বহাল করে। কিন্তু শাওর চুক্তি লঙ্ঘন করে শেরকোহ এর নিকট মিশর ত্যাগের দাবি জানায়। সে ক্রুসেডারদের নিকট সাহায্য কামনা করে। ক্রুসেডাররা এটাকে একটা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। তখন আসাদুদ্দীন কোন রকম ক্ষয়- ক্ষতি ছাড়া ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কিন্তু তার মনে ছিল শাওরকে শিক্ষা দান করার জন্য পুনরায় মিসরে ফিরে আসা। হিজরী ৫৬২ সনে আসাদুদ্দীন পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে মিসরে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করেন এবং কায়রোর পশ্চিমে শিবির স্থাপন করেন। মিশরীয়দেরকে সঙ্গে নিয়ে ফিরিঙ্গিদের সহযোগিতায় শাওর এর সমর্থকদেরকে তিনি চরমভাবে পরাজিত করেন। অথচ এ সময় তার সঙ্গে মাত্র দু’হাজার অশ্বারোহী বাহিনী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতঃপর মিশরীয়রা অর্থের বিনিময়ে তার সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হয়। তাদের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি সিরিয়ায় ফিরে যান। এ সময় ফিরিঙ্গিরা শাওর এবং তার সরকারের নিকট স্থান লাভ করে এবং কয়েকটি শর্তে চুক্তি করে। এসব শর্তের মধ্যে একটা ছিল এই যে, কায়রোয় তাদের একটা গ্যারিসন থাকবে। তারা মুসলমানদের মধ্যে শক্ত হয়ে বসে এবং মিশর অধিকার করার জন্য ফিলিস্তিন থেকে ক্রুসেডারদেরকে ডেকে আনে। কাফিররা মিশর অধিকার করে নেবে বলে নূরুদ্দীন ভীষণ ভয় পান। আসাদুদ্দীন তৃতীয় বারের মতো প্রস্ত্ততি নেন এবং ভ্রাতুষ্পুত্র সালাহউদ্দীনকেও সঙ্গে নেন। অথচ তিনি সঙ্গে যেতে রাজি নন।
عَسَى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌلَكُمْ
‘হতে পারে, কোন জিনিস তোমরা অপছন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য মঙ্গলকর।’
মিশর থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য শাওর ক্রুসেডারদেরকে রাজি করান। তারা এতে সাড়া দেয়। কিন্তু আসাদুদ্দীন এবার মিসরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। শাওর ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয়া শুরু করে নূরুদ্দীনের সৈন্যদেরকে দূরে রাখার জন্য এবং আসাদুদ্দীনও তার লোকজনকে আয়ত্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুত্র কামেল গোপনে তাকে ইঙ্গিত দেয় তা না করার জন্য। তখন শাওর তাকে বলে . আমি তা না করলে আমাদের সকলকে হত্যা করা হবে। পুত্র বলে . মুসলিম অবস্থায় ইসলামি রাষ্ট্রে আমাদের নিহত হওয়া ফিরিঙ্গিদের বশ্যতা স্বীকার করার চেয়ে উত্তম। কিন্তু শাওর তার বিশ্বাসঘাতকতায় জিদ ধরে। আসাদুদ্দীনের সৈন্যরা তা বুঝতে পেরে তাকে হত্যার ব্যাপারে একমত হয়। তারা তার উৎপাত থেকে স্বস্তি পায়। শান্তি পায় মিশরও। পরে আসাদুদ্দীন মিশরের ওবায়দী সরকারের মন্ত্রী হয়। আযেদ ছিল মিসরে ওবায়দীদের সর্বশেষ মন্ত্রী। তার হাতে কোন ক্ষমতা ছিল না। শেরকোহের মন্ত্রিত্ব লাভ ছিল মিশরকে সুন্নাহর দিকে ফেরার পথে প্রথম পদক্ষেপ। মন্ত্রিত্ব লাভের দু’মাস পর তিনি ইন্তিকাল করে। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করেন। তিনি মিসরে ওবায়দীদের পতন ঘটান। নূরুদ্দীনের পীড়াপীড়ির পর আযেদের নামে খুতবা পড়া বাদ দিয়ে আববাসীয় খলিফার নামে খুতবা চালু করা হয় । মিসরবাসীদের ভয়ে সালাহউদ্দীন প্রথমে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাবে সাড়া দিলে কেউ তার বিরোধিতা করেনি এবং কেউ এ ব্যাপারে গুঁতাগুঁতিও করেনি। এভাবে মিশরকে সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সিরিয়ার সঙ্গে মিশরের ঐক্য স্থাপন করা হয়। নূরুদ্দীন যে মোবারক জিহাদের সূচনা করেন, এ ছিল তারই পদক্ষেপ। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। মুজাহিদ শাসক সুলতান সালাহউদ্দীন এ পদক্ষেপ পূর্ণ করেন।
অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক হুমকির মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চিন্তা -যদিও তার সূচনা পার্শ্ববর্তী দেশ দ্বারা হোক না কেন- হচ্ছে এক বিরাট পদক্ষেপ। বিশেষ করে এ ঐক্য যখন প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু ভিত্তির উপর। এই ঐক্যের বিপরীত হচ্ছে শতধা বিভক্ত হওয়া এবং সংকীর্ণ অঞ্চলে ভাগ হওয়ার জন্য উসকানি দেয়া। শরিয়ত অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। বর্তমানে এই ঐক্য অতীতের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। আজ গোটা বিশ্ব নানা ব্লকে বিভক্ত, যাতে একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে চ্যালেঞ্জের জন্য শক্তি সঞ্চয় কতে পারে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় ডুবে থেকে মুসলিম জাহান কেমন করে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে? নিষ্ঠাবান ঐক্যের আহবায়করা এগিয়ে না এলে বর্তমান বাস্তবতায় ঐক্য অর্জিত হবে না। কারণ, পরবর্তীকালের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারাই হচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি। অবশ্য অন্যদের ঐক্যের আহবানের মধ্যে সংশয় আর পঙ্কিলতা রয়েছে।
হিজরী ৫১১ সনে ইরাকে নূরুদ্দীনের জন্ম হয়। পিতার সঙ্গে তিনি ইরাক, মুসেল এবং শাম দেশের নানা অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। পিতার মৃত্যুর পর তিনি হন পিতার স্থলাভিষিক্ত। তিনি হালব অঞ্চলে সুন্নাহর প্রচার প্রসার ঘটান। বেদআতের পরিবর্তন সাধন করেন। রাফেযী মতবাদের মূলোৎপাটন সাধন করেন এবং অনেক দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদ- মাদ্রাসার জন্য তিনি ওয়াকফের প্রচলন করেন এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ধর্মীয় গ্রন্থ ব্যাপক অধ্যয়ন করতেন এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ করতেন। নিয়মিত জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন। কুরআন মজীদ নিয়ম অনুযায়ী তিলাওয়াত করতেন। হালাম-হারামের বিধান কঠোরভাবে মেনে চলতেন এবং হারাম খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। ব্যয়ের ক্ষেত্রে তিনি সৎ পন্থা মেনে চলতেন। খাদ্য- দ্রব্য এবং পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও তিনি সতর্ক ছিলেন। তাঁর মুখে কখনো মন্দ কথা উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি।2
তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন .
আমি ইসলামের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কালের রাজা- বাদশাহদের জীবনী অধ্যয়ন করেছি। বর্তমান কাল পর্যন্ত সমস্ত শাসকদের জীবনী আমি অধ্যয়ন করে দেখেছি। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং ওমর ইবনে আব্দুল আজীজের পর তাঁর চেয়ে সুন্দর চরিত্রের কারো সম্পর্কে আমি জানতে পারিনি।3
খোদাভীতি এবং দুনিয়া ত্যাগের নীতি তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল। বৈধভাবে খরিদ করা অন্ন বস্ত্র ছাড়া অন্য কিছু তিনি ব্যবহার করতেন না। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে গনিমতের অংশ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতেন না। মুসলমানদের ধনভান্ডার থেকে তিনি এক কপর্দকও নিতেন না। একবার তাঁর স্ত্রী অভাব অনটনের অভিযোগ করে বেশি খোরপোশ দাবি করলে তাঁর চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে। তিনি বলেন . আমি কোথা থেকে তার দাবি পূরণ করব? তার প্রেমে আমি জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। অতঃপর তিনি বলেন . হেমস শহরে আমার জন্য তিনটা দোকান নির্দিষ্ট আছে। এ দোকানগুলো থেকে সে ইচ্ছা মতো পণ্য গ্রহণ করতে পারে।4
তাঁর দরবারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর সম্পর্কে বলেন . একদিন আমি তাঁর সঙ্গে ‘আররাহার’ প্রান্তরে ছিলাম। সূর্যের তাপ ছিল আমাদের পৃষ্ঠের উপর। আমরা যতই অগ্রসর হই, ততই সূর্যের প্রখর তাপ আমাদের উপর পতিত হয়। আমরা যখন প্রত্যাবর্তন করি, তখন আমাদের ছাড়া পেছনে পতিত হয়। অশ্ব হাঁকিয়ে পেছনে তাকিয়ে তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বলেন . তুমি কি জান, কেন আমি অশ্ব হাঁকাই আর পেছনে তাকাই? আমি বললাম . না। তিনি বললেন . আমার মনে হয়েছে যে, পৃথিবীতে আমরা যে অবস্থায় আছি, তাতে বুঝা যায় যে, যে ব্যক্তি দুনিয়া তালাশ করে, দুনিয়া তার থেকে পলায়ন করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে পলায়ন করে, দুনিয়ার তার পেছনে ছুটে চলে। আবু শামা বলেন . যে শাসনকর্তা এমন চিন্তা করতে পারেন, তাঁর প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্টি হন।5 ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর বলেন . রাত্রিবেলা বেশির ভাগ সময় তিনি নামাজে রত থাকতেন। দোয়া- ইস্তিগফার করতেন। অশ্বারোহনের পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় কাটতো। কবির ভাষায় .
جمع الشجاعة والخشوع لربه ما أحسن المحراب في المحراب
বীরত্ব আর বিনয়ের সমাবেশ ঘটান তিনি আপন পালন কর্তার জন্য! মিহরাবের অভ্যন্তরে মিহরাব কতইনা চমৎকার।6
হানাফি মাজহাবের ফিকাহ সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন, তাই বলে তাঁর মধ্যে গোঁড়ামি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। সকল ব্যাপারে ইনসাফই ছিল তাঁর ভূষণ। বাস্তবিক পক্ষে ইনসাফ আর ন্যায় নীতি অনুসরণ করা, খাদ্য- পানীয় এবং পরিধেয় বস্ত্রের ক্ষেত্রে হারাম বর্জন করার রীতি শাসক শ্রেণির জন্য তিনিই নবায়ন করেন। তাঁর পূর্বে শাসক শ্রেণি ছিল জাহেলি যুগের অনুসারী। উদর পূর্তি আর যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র চিন্তা। ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো মন্দ কিছুই তারা চিনত না। সুবিচারের দৃষ্টিতে দেখতে গেলে তিনি ছিলেন চরিত্রের দিক থেকে সর্বোত্তম শাসক। শাম দেশ, জাযিরা এবং মিসরে তাঁর শাসনকালে তিনি ট্যাক্স, কাষ্টম ডিউটি এবং ওশর রহিত করেন।7
দেশে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য তিনি একটা বিচারণীয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিচারালয় স্থাপনের কারণ ছিল এই যে, তাঁর নিয়োজিত শাসকবর্গ আর সেনাবাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা প্রতিবেশীদের উপর জুলুম করলে সকলে কাজি কামালুদ্দীনের নিকট অভিযোগ দায়ের করে। কাজি কোন কোন ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করলেও আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সুলতান নূরুদ্দীন এ বিষয়ে অবগত হতে পেরে এ বিচারালয় স্থাপন করেন। আসাদুদ্দীন এ সম্পর্কে জানতে পারলে সুলতান তার আমলাদের উদ্দেশ্যে বলেন . খোদার কসম করে বলছি, তোমাদের কারো কারণে আমাকে বিচারালয়ে উপস্থিত হতে হলে আমি অবশ্যই তাকে শুলিবিদ্ধ করব। যাও এবং নিজেদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে ফেলো। প্রতিপক্ষকে রাজি করো এবং ভালো ভাবে মীমাংসা কর।8 তখন তারা বলল . আমরা এটা করলে লোকেরাতো দাবি জোরদার করবে। তিনি বলেন . নূরুদ্দীনকে সালিশের পিতার চোখে দেখার চেয়ে আমার হাত থেকে আমার মালিকানাধীন সমস্ত কিছু ছুটে যাওয়াটা আমার নিকট অতি সহজ। নূরুদ্দীন সপ্তাহে দু’দিন এ বিচারালয়ে বসতেন। আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর অবস্থা সম্পর্কে জানতে পের তিনি আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতার সেজদা আদায় করেন।9
মুসলিম দেশগুলোতে তাঁর কল্যাণমূলক কাজ অনেক। তিনি শাম দেশে নগর প্রাচীর নির্মাণ করেন এবং তা অতিশয় মজবুত করে তৈয়ার করেন। হালব শহর এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং দামেশকে তিনি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তিনি দ্বীনদার ব্যক্তিদেরকে সুউচ্চ মহলে স্থান দিতেন। এজন্য আমির ওমরারা তাঁকে হিংসার চোখে দেখতো। তাঁর দরবারের অন্যতম আমির শায়েখ কুতুবুদ্দীন নীশাপুরী প্রসঙ্গটা তাঁর নিকট উপস্থাপন করলে সুলতান তাকে বলেন . তুমি যার বিরুদ্ধে কথা বলছো, সেতো পুণ্য করছে। তার সমস্ত পদস্খলন ক্ষমা করা হচ্ছে। আর তা হচ্ছে জ্ঞান ও দীন আর তুমি এবং তোমার সঙ্গীদের মধ্যে তুমি যা বলছ, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে। কিন্তু মাফ করানোর মতো কোন পুণ্য কর্ম তোমাদের নেই। তোমাদের নেক কাজ না থাকলেও আমি তোমাদের বদ কর্ম বহন করছি। তার মন্দ কর্ম যদি সত্যিই থেকে থাকে তবে কি আমি তা বহন করব না? অথচ তারতো নেক কাজ রয়েছে। তবে খোদার কসম করে বলছি, তুমি যা বলছ, আমি তা বিশ্বাস করি না। তুমি পুনরায় যদি তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলো তবে আমি নিশ্চিত তোমাকে শিক্ষা দিবো।10
তিনি এমনই নির্লোভ- নিস্পৃহ এবং খোদা ভীরু ছিলেন যে, নানা দেশের রাজা- বাদশাহরা তাঁর নিকট যেসব উপঢৌকন প্রেরণ করতেন, তিনি সেসব থেকে সামান্য অংশও ব্যবহার করতেন না। সেসব তিনি প্রেরণ করতেন বিচারপতিদের কমিটির নিকট। তাঁরা সেসব জিনিস বিক্রয় করে তার মূল্য বিরান মসজিদ সংস্কারের কাজে ব্যয় করতেন। মসজিদের মিম্বারে তাঁর জন্য দোয়া করার সময় তাঁর বড় বড় উপাধি ব্যবহার না করার জন্য তিনি খতিবদেরকে নির্দেশ দেন। তাঁর বর্ণনা প্রসঙ্গে আল- ইমাদ আল- ইসফাহানী বলেন . তিনি হচ্ছেন সে ব্যক্তি, যিনি শাম দেশে ইসলামের গৌরব ফিরিয়ে আনেন; অথচ ইতিপূর্বে সেখানে কুফরির প্রাধান্য ছিল। তিনি আশ্রয় স্থল উন্মুক্ত করেন এবং শরীফ সম্ভ্রান্ত রমণীদেরকে মুক্ত করেন।11 মুসেলের কর্তৃত্ব লাভের সময় তিনি পুলিশ বাহিনী প্রধানকে নির্দেশ দেন কাজির নির্দেশ অনুযায়ী শরিয়ত সম্মত পন্থায় যেন সব কাজ সম্পন্ন করা হয়। ইতিপূর্বে রাজনীতির বিবেচনায় সমস্ত কার্য সম্পন্ন করা হতো।12 শাস্তি প্রয়োগে কঠোরতা আরোপের দাবি করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এটা হবে শরিয়ত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা।
নূরুদ্দীনের শাসনামলে আলেম সমাজ
সুলতান নূরুদ্দীন যে সংস্কার সাধন করতে চাইতেন, তাতে আলেম সমাজের বিরাট ভূমিকা ছিল। সে কারণে তিনি আলেম দের জন্য ক্ষেত্র প্রশস্ত করে তাদেরকে বড় বড় সুযোগ- সুবিধাও দান করেন। এ জন্য আলেমগন দলে দলে তাঁর নিকট আগমন করতেন এবং তিনিও কঠিন কাজে আলেমদের নিকট থেকে সহায়তা চাইতেন।
শাফেয়ি মাদ্রাসা থেকে যেসব আলিমের উদ্ভব হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজি কামালুদ্দীন শহরজুরী। তাঁর আসল নাম ছিল মুহাম্মদ ইবনে আবু মুহাম্মদ। তিনি ছিলেন বাগদাদে ইমাদুদ্দীন জঙ্গির দূত। পরবর্তীকালে সিরিয়ায় তিনি নূরুদ্দীনের সরকারে যোগদান করেন এবং কাজিদের নিয়োগকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি মন্ত্রীর পদে উন্নীত হন এবং শাম দেশে কর্তৃত্বের অধিকারী হন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ ফিকাহবিদ, নামকরা কবি এবং বীর বাহাদুর ব্যক্তি, বড় কুটনীতিক এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ।13
তাদের মধ্যে আর একজন হচ্ছে বিশিষ্ট হাম্বলী ওয়ায়েজ আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা। তিনি বাগদাদে আগমন করত: ফিকাহ শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। হাদীসে রও জ্ঞান লাভ করত: স্বদেশ ভূমি দামেশকে তিনি ফিরে যান। হিজরী ৫৬৪ সনে তিনি বাগদাদে নূরুদ্দীনের দূতের দায়িত্ব পালন করেন। সুলতান সালাহউদ্দীনের নিকট তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল।14
তাহাদের মধ্যে অপরজন হচ্ছে শাফেয়ি মাজহাবের অন্যতম ইমাম কাজি আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু আসরূন। নূরুদ্দীনের শাসনামলে তিনি গাযালিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা দান শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি হালবে গমন করলে নূরুদ্দীন তাঁর জন্য একটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। হেমসেও অপর একটা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। হিজরী ৫৮৫ সনে তাঁর ইন্তিকাল হয়। 16
নূরুদ্দীন মাহমুদের জিহাদ
সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদের নিকট জিহাদ কোন সাময়িক সমাধান ছিল না, অথচ স্থান- কাল-পাত্রের দাবি অনুযায়ী জিহাদের কোন সুযোগও ছিল না; বরং মূল ব্যাপার ছিল জিহাদের জন্য প্রস্ত্ততি এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সুলতান নূরুদ্দীন সুলতান কুলিম আরসালান সেলজুকীকে তিরস্কার করেন, যিনি রোম দেশের প্রতিবেশী আনাযুল দেশের মালিতা, সীবাস এবং আকছারা অঞ্চল শাসন করতেন। তিরস্কার করেন এজন্য যে, মুসলিম দেশের উপর তিনি কর্তৃত্ব করতে চাইলেও রোমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্ত্তত নয়। তিনি বলেন, তুমি রোম দেশের প্রতিবেশী। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে প্রস্ত্তত নও। তোমার দেশ মুসলিম জাহানের একটা বিরাট অংশ। আমার সঙ্গে জিহাদে যোগদান করা তোমার জন্য অপরিহার্য।17
ক্রুসেডারদের সঙ্গে জিহাদের এক অভিপ্রায়ে তিনি তদীয় ভ্রাতা মুসেল অঞ্চলের শাসনকর্তা কুতুবুদ্দীন এবং ‘কাইফা’ ও ‘মর্দিন’ দুর্গের অধিপতির নিকট বাণী পাঠান। এরা সে বাণীর জবাবও দেন। কাইফা দুর্গের অধিপতির সঙ্গীরা তাকে বলেন . কোন বিষয়ে তুমি সংকল্প করেছ? তিনি বললেন, বসে থাকার ব্যাপারে। কারণ, নূরুদ্দীন নিজেকে এবং অন্যদেরকেও ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করতে চায়।18 ফলে তারাও তার সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করে। পরদিন উপস্থিত হলে মুজাহিদদেরকে প্রস্ত্তত করার নির্দেশ দেন। তখন তারা তাকে বলে: যা প্রকাশ পেয়েছে তা বাদে? গতকাল আমরা তোমার থেকে পৃথক হয়েছি এক অবস্থায়, আজ আমরা তার বিপরীত দেখতে পাচ্ছি। তিনি বললেন . নুরুদ্দীন আমার সঙ্গে এমন রীতি অবলম্বন করেছে; আমি তার সাহায্য না করলে জনগণ আমার আনুগত্য থেকে বের হয়ে যায়। কারণ, তিনি আবেদ যাহিদ তথা সাধু সজ্জনকে লিখে দিয়েছেন, যা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মুসলমানরা ফিরিঙ্গিদের নিকট থেকে যা কিছু লাভ করেছে। তিনি তাদের নিকট দোয়া চান এবং তাদের নিকট দাবি করেন, যাতে মুসলমানদেরকে গাজিদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে তারা বসে বসে ক্রন্দন করে, আমার উপর লা’নত করে এবং আমার জন্য বদ দোয়া করে। সুতরাং তার দিকে ছুটে যাওয়া কর্তব্য।19
বানইয়াসের ঘটনা এবং তার দুর্গ জয় করা কালে তার সঙ্গে আপন ভাই নছরুদ্দীনও ছিলেন। একটা তীর বিদ্ধ হয়ে তাঁর এক চক্ষু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নূরুদ্দীন তাকে দেখে বললেন . তোমার জন্য পুরস্কার প্রস্ত্তত করে রাখা হয়েছে, তা যদি তোমার নিকট প্রকাশ পেতো তাহলে তুমি অপর চক্ষুটিও হারাবার কথা কামনা করতে। এ বিজয়কালে তার সঙ্গে মুঈনুদ্দীন আনর এর পুত্রও ছিল, যিনি বানইয়াস দুর্গ ফিরিঙ্গিদের হাতে অর্পণ করেন। তখন নূরুদ্দীন তাকে বলেন . এই বিজয়ে মুসলমানদের জন্য একটা আনন্দ, কিন্তু তোমার জন্য দুটা আনন্দ। তিনি বললেন . তা কীভাবে? বললেন . কারণ, আজ আল্লাহ তোমার পিতার দেহকে অগ্নি থেকে শীতল করেছেন।20
নূরুদ্দীনের বিজয় অভিযান
ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে তার জীবনের প্রাথমিক ঘটনাবলীতে দামেশকের শাসনকর্তা মুঈনুদ্দীন আনর এর সঙ্গে বা‘লা বাক্ক শহরে সাক্ষাৎকালে ত্রিপোলীর ক্রুসেডার শাসকের নিকট থেকে তার কাছে একটা পত্র আসে। তাতে ‘আল-আরীমা’ দুর্গ অধিকার করার জন্য এ পত্রে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ- অনুপ্রাণিত করা হয়। নূরুদ্দীনের নিকট এ দাবি বেশ কঠিন ঠেকায়। তিনি এবং মুঈনুদ্দীন দুর্গ অবরোধ করত: তা অধিকার করেন। হিজরী ৫৪৩ সনে নূরুদ্দীন শাম দেশের বছরা অঞ্চল সফর করেন। সেখানে ফিরিঙ্গিরাও একত্র হয় শাম দেশের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল দখল করার অভিপ্রায় নিয়ে। সেখানে তাদের মুখোমুখি হয় এবং ঘোরতর যুদ্ধ হয়। অতঃপর আল্লাহ মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন, আর ফিরিঙ্গিদের করে পরাজিত।21 হিজরী ৫৪৪ সনে হারেম দুর্গে অভিযান চালিয়ে তার আশ পাশ ধ্বংস ও লুঠপাট করা হয়। অতঃপর সেখান থেকে ‘আম্ব’ দুর্গ অভিমুখে রওয়ানা করে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এতে মুসলমানরা বিজয় লাভ করে এবং আন্তাকিয়ার শাসনকর্তা এ সংঘর্ষে নিহত হয়। অতঃপর নূরুদ্দীন ‘ফামিয়া’ দুর্গ অভিমুখে রওয়ানা হন। তিনি দুর্গ অবরোধ করে সন্ধি সূত্রে তা অধিকার করেন।22
হিজরী ৫৪৬ সনে নূরুদ্দীন ফিরিঙ্গিদের অন্যতম শয়তান ‘জসলিন'কে বন্দী করেন। এরপর তিনি তিলবাসীর, আইনতাব, এজাজ, মিরয়াস ইত্যাদি দুর্গ অধিকার করে নেন। হালব এর বিভিন্ন অঞ্চলে এসব দুর্গ অবস্থিত। হিজরী ৫৪৯ সনে দামেশক তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। নূরুদ্দীন দীর্ঘকাল থেকে এজন্য পরিকল্পনা করে আসছিলেন। কারণ তার অবস্থান ছিল ক্রুসেডারদের পথে। একা দামেশক ছিল দুর্বল। শক্তি প্রয়োগে তা অধিকার করার চেষ্টা করা হলে তা অধিকার করা ক্রুসেডারদের নিকট আশ্রয় চাইতে বাধ্য করবে। অথচ নূরুদ্দীন রক্তপাত ঘটাতে চান না। এ কারণে মুজীরুদ্দীনের বিরুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করা হয় এবং অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। দামেশকবাসী শহর তাঁর নিকট অর্পণ করতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর এ অভিযান চালানো হয়। ফলে কোন উল্লেখযোগ্য লড়াই ছাড়াই তিনি দামেশক নগরীতে প্রবেশ করেন। আর মুজীরুদ্দীনকে হেমস নগর দান করেন।
হিজরী ৫৫৯ সনে ‘হারেম’ দুর্গ জয় করা হয়। এটা ছিল ক্রুসেডারদের সঙ্গে নূরুদ্দীনের বড় যুদ্ধগুলোর অন্যতম। এই যুদ্ধে ফিরিঙ্গিরা অশ্বারোহী বাহিনী আর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অংশগ্রহণ করে। সকলের আগে ছিল এন্তাকিয়ার শাসক বুরনুস (বায়মন্ড), ত্রিপোলীর শাসক ‘কিমহ’ এবং জসলিন তনয়। নূরুদ্দীন ‘হারেম’ দুর্গের বাইরে তাদেরকে টেনে আনতে সক্ষম হন এবং তাদের উপর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। আমির শাসক আর বাদশাহরা সকলে তার সম্মুখে বন্দী হয়ে আসে।
হিজরী ৫৬০ সনে তিনি ‘আল মানিতারা’ দুর্গ জয় করেন এবং তাতে বিপুল পরিমাণ গনিমতের মাল হস্তগত হয়। হিজরী ৫৬২ সনে নূরুদ্দীন ‘‘ছাফিতা’ এবং ‘আল-আরীমা’ দুর্গ অধিকার করেন।
মিশর-সিরিয়া ঐক্য
সুলতান মাহমুদের অন্তর থেকে একথা মুছে যায়নি যে, মিশর- সিরিয়ার ঐক্যই সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ, যার উপর নির্ভর করে ক্রুসেডারদের মোকাবিলা করা। মিসরে ওবায়দী শাসকদের উজির শাওর সাদী তাঁর নিকট আশ্রয় চাইলে এজন্য উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়। হৃত ওযারতীর পদ ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁর সহযোগিতা চাওয়া হয়। এ প্রস্তাবে নূরুদ্দীন দ্রুত সাড়া দেন এবং আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন এই শর্তে যে, নূরুদ্দীন মিশরের এক তৃতীয়াংশের দখল লাভ করবেন। নূরুদ্দীনের সৈন্যরা কায়রো শহরে প্রবেশ করে। তারা মন্ত্রী শাওরকে তার হারানো পদে পুনর্বহাল করে। কিন্তু শাওর চুক্তি লঙ্ঘন করে শেরকোহ এর নিকট মিশর ত্যাগের দাবি জানায়। সে ক্রুসেডারদের নিকট সাহায্য কামনা করে। ক্রুসেডাররা এটাকে একটা সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। তখন আসাদুদ্দীন কোন রকম ক্ষয়- ক্ষতি ছাড়া ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কিন্তু তার মনে ছিল শাওরকে শিক্ষা দান করার জন্য পুনরায় মিসরে ফিরে আসা। হিজরী ৫৬২ সনে আসাদুদ্দীন পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে মিসরে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করেন এবং কায়রোর পশ্চিমে শিবির স্থাপন করেন। মিশরীয়দেরকে সঙ্গে নিয়ে ফিরিঙ্গিদের সহযোগিতায় শাওর এর সমর্থকদেরকে তিনি চরমভাবে পরাজিত করেন। অথচ এ সময় তার সঙ্গে মাত্র দু’হাজার অশ্বারোহী বাহিনী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অতঃপর মিশরীয়রা অর্থের বিনিময়ে তার সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত হয়। তাদের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি সিরিয়ায় ফিরে যান। এ সময় ফিরিঙ্গিরা শাওর এবং তার সরকারের নিকট স্থান লাভ করে এবং কয়েকটি শর্তে চুক্তি করে। এসব শর্তের মধ্যে একটা ছিল এই যে, কায়রোয় তাদের একটা গ্যারিসন থাকবে। তারা মুসলমানদের মধ্যে শক্ত হয়ে বসে এবং মিশর অধিকার করার জন্য ফিলিস্তিন থেকে ক্রুসেডারদেরকে ডেকে আনে। কাফিররা মিশর অধিকার করে নেবে বলে নূরুদ্দীন ভীষণ ভয় পান। আসাদুদ্দীন তৃতীয় বারের মতো প্রস্ত্ততি নেন এবং ভ্রাতুষ্পুত্র সালাহউদ্দীনকেও সঙ্গে নেন। অথচ তিনি সঙ্গে যেতে রাজি নন।
عَسَى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌلَكُمْ
‘হতে পারে, কোন জিনিস তোমরা অপছন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য মঙ্গলকর।’
মিশর থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য শাওর ক্রুসেডারদেরকে রাজি করান। তারা এতে সাড়া দেয়। কিন্তু আসাদুদ্দীন এবার মিসরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। শাওর ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয়া শুরু করে নূরুদ্দীনের সৈন্যদেরকে দূরে রাখার জন্য এবং আসাদুদ্দীনও তার লোকজনকে আয়ত্ত করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুত্র কামেল গোপনে তাকে ইঙ্গিত দেয় তা না করার জন্য। তখন শাওর তাকে বলে . আমি তা না করলে আমাদের সকলকে হত্যা করা হবে। পুত্র বলে . মুসলিম অবস্থায় ইসলামি রাষ্ট্রে আমাদের নিহত হওয়া ফিরিঙ্গিদের বশ্যতা স্বীকার করার চেয়ে উত্তম। কিন্তু শাওর তার বিশ্বাসঘাতকতায় জিদ ধরে। আসাদুদ্দীনের সৈন্যরা তা বুঝতে পেরে তাকে হত্যার ব্যাপারে একমত হয়। তারা তার উৎপাত থেকে স্বস্তি পায়। শান্তি পায় মিশরও। পরে আসাদুদ্দীন মিশরের ওবায়দী সরকারের মন্ত্রী হয়। আযেদ ছিল মিসরে ওবায়দীদের সর্বশেষ মন্ত্রী। তার হাতে কোন ক্ষমতা ছিল না। শেরকোহের মন্ত্রিত্ব লাভ ছিল মিশরকে সুন্নাহর দিকে ফেরার পথে প্রথম পদক্ষেপ। মন্ত্রিত্ব লাভের দু’মাস পর তিনি ইন্তিকাল করে। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করেন। তিনি মিসরে ওবায়দীদের পতন ঘটান। নূরুদ্দীনের পীড়াপীড়ির পর আযেদের নামে খুতবা পড়া বাদ দিয়ে আববাসীয় খলিফার নামে খুতবা চালু করা হয় । মিসরবাসীদের ভয়ে সালাহউদ্দীন প্রথমে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাবে সাড়া দিলে কেউ তার বিরোধিতা করেনি এবং কেউ এ ব্যাপারে গুঁতাগুঁতিও করেনি। এভাবে মিশরকে সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সিরিয়ার সঙ্গে মিশরের ঐক্য স্থাপন করা হয়। নূরুদ্দীন যে মোবারক জিহাদের সূচনা করেন, এ ছিল তারই পদক্ষেপ। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন। মুজাহিদ শাসক সুলতান সালাহউদ্দীন এ পদক্ষেপ পূর্ণ করেন।
অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক হুমকির মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চিন্তা -যদিও তার সূচনা পার্শ্ববর্তী দেশ দ্বারা হোক না কেন- হচ্ছে এক বিরাট পদক্ষেপ। বিশেষ করে এ ঐক্য যখন প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু ভিত্তির উপর। এই ঐক্যের বিপরীত হচ্ছে শতধা বিভক্ত হওয়া এবং সংকীর্ণ অঞ্চলে ভাগ হওয়ার জন্য উসকানি দেয়া। শরিয়ত অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। বর্তমানে এই ঐক্য অতীতের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। আজ গোটা বিশ্ব নানা ব্লকে বিভক্ত, যাতে একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে চ্যালেঞ্জের জন্য শক্তি সঞ্চয় কতে পারে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় ডুবে থেকে মুসলিম জাহান কেমন করে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে? নিষ্ঠাবান ঐক্যের আহবায়করা এগিয়ে না এলে বর্তমান বাস্তবতায় ঐক্য অর্জিত হবে না। কারণ, পরবর্তীকালের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারাই হচ্ছেন সবচেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি। অবশ্য অন্যদের ঐক্যের আহবানের মধ্যে সংশয় আর পঙ্কিলতা রয়েছে।
সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদ যে জিহাদের সূচনা করেন এবং সংস্কারমূলক কার্যে আলেম সমাজের ভূমিকা ফিরিয়ে আনার জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো হয়, এবং সালাহউদ্দীনের বাবা আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর মৃত্যুর পর সুলতান সালাহউদ্দীন যে প্রচেষ্টা চালান, তার আলোকে জিহাদের পরিমন্ডল গড়ে উঠে। সালাহউদ্দীন চেষ্টা করেন তাঁর চাচা শেরকোহ- এর মৃত্যুর পর কায়রোয় ওবায়দীদের শেষ বাদশাহ আযেদ এর মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করতে। কারণ, তিনি তার মধ্যে দুর্বলতার ধারণা করেন। তাঁর সঙ্গে যেসব সৈন্য রয়েছে তদ্দবারা তিনি মিশরের সহায়তা লাভ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু ব্যাপার ঘটে ধারণার বিপরীতে। সালাহউদ্দীন প্রস্ত্তত হয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি ক্রীড়া- কৌতুক পরিত্যাগ করলেন। দ্বীনের লেবাস পরিধান করলেন এবং শরিয়তের মর্যাদা হেফাজত করলেন।1 তিনি যে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তা প্রমাণ করে অনন্য ব্যক্তিত্ব, আর তা উৎসারিত হয় সত্যিকার খনি থেকে। ফলে তিনি ইসলাম এবং মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে উঠে দাঁড়ান, আপন পালন কর্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্বে তিনি স্বস্তি আস্বাদন করেননি, তাঁর মন পরিতৃপ্ত হয়নি।
আমরা এখানে আইয়ুবী রাজত্বের ইতিহাস আলোচনা করতে চাই না। আমরা কেবল আলোচনা করতে চাই সালাহউদ্দীন ব্যক্তিত্বের মধ্যে সেই জিহাদী আরবদের প্রভাব। আলিম সমাজ আর সেনা অধিপতিদেরকে তিনি কীভাবে প্রস্ত্তত করেছিলেন, যারা এ মহান অভিযানে তাঁকে সহায়তা করেছেন।
সালাহউদ্দীনকতিপয় কীর্তি
১. সুন্নাহর প্রতি মিশরকে ফিরিয়ে আনা
সালাহউদ্দীন মিশরীয়দের পদচ্যুত করেন ; কারণ তারা ছিল শিয়া। তিনি আব্দুল মালেক ইবনে দিরবাস শাফেয়িকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন। তারা আজানে পরিবর্তন সাধন করে (হাইয়্যা ‘আলা খায়রিল আমল)। মিসরে আববাসীয় খলিফাদের নামে খুতবা বন্ধ করার পর তিনি আববাসীয়দের নামে খুতবাহ চালু করেন। (২০৮ হিজরী)। আববাসীয় খলিফা নূরুদ্দীন মাহমুদ এ সুসংবাদ দান করেন। ফলে জনগণ খুশি হয়।
এ প্রসঙ্গে ইমাদ আল- ইসফাহানী কবিতা রচনা করেন .
توفي العاضدُ الدعيّ فما يفتحُ ذو بدعة بمصر فما
وعصرُ فرعونِها انفضى وغدايوسفُها في الأمور محتكما
وصار شمل الصلاح ملتئماًبها وعقد السداس منتظما
২. সিরিয়া- মিশর ঐক্য
নূরুদ্দীনের ইন্তিকাল এবং শাম দেশের অস্থিরতার পর সালাহউদ্দীনের আবির্ভাব ঘটে। ফলে তিনি দামেশক, হেমস এবং হেমাত অধিকার করেন এবং হালব শহর অবরোধ করেন। কিন্তু কর্মকর্তারা, যাদের ব্যাপারে ওছিয়ত করা হয়েছে, আলী ইবনে নূরুদ্দীন (ইসমাঈল) অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে জাতির নিকট সহায়তা দাবি করেন। নূরুদ্দীন যে শিয়া মতবাদ বাতিল করেন, মনে হয় যে, জাতির একটা বিরাট অংশ তাদের দিকে নুয়ে পড়ে। ফলে তারা সহায়তার জন্য কথা অনুযায়ী কাজের দাবি জানায়। শহরের নেতারা এ শর্তের পক্ষে রায় দেয়, কেবল কথাকেই তারা যথেষ্ট মনে করে না। তারা যখন সালাহউদ্দীনের শক্তি এবং আরব বোধে তার অব্যাহত থাকা লক্ষ্য করে, তখন তারা হাশাশী ইসমাঈলীদের নিকট থেকে সহায়তা দাবি করে। এরা বানিয়াসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ফলে তারা নিজেদের ধারায় চেষ্টা চালায়। বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা সালাহউদ্দীনকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। কিছু সময়ের জন্য অবরোধ তুলে নেন। পরে পুনরায় ফিরে আসেন। হাশাশী ইসমাঈলীরা পুনরায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এ কাজে তারা ব্যর্থ হয় এবং এ কাজের জন্য তাদের মধ্যে যারা এসেছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়। এরা নিজেদেরকে ‘ফেদাবিয়া’ বলে অভিহিত করে। হালব বাসীরা কেবল এটাকেই যথেষ্ট মনে করেনি। তারা বরং ত্রিপোলীর ক্রুসেডার শাসকের নিকট সাহায্য কামনা করে। সালাহউদ্দীন এটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি, বরং তিনি একটা ক্ষুদ্র পত্র প্রেরণ করেন।
এতদ সত্ত্বেও সালাহউদ্দীন হালব থেকে ফিরে আসেন, হালব বাসীদের সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধে তিনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করেননি। বিশেষ করে তারাতো সন্ধি প্রত্যাশী ছিল। এ ব্যাপারে তারা নুরুদ্দীন মাহমুদের কন্যার নিকট সুপারিশও চায়। কিন্তু মিশর- সিরিয়ার ঐক্য বিষয়ে সুলতানের অভিপ্রায় অটল ছিল। এমনকি দুশমনের মুখের সামনে দাঁড়াতেও তিনি ইতস্তত করেননি। এসময় তিনি বিপর্যয়ের জট উপড়ে ফেলার ইচ্ছা করেন এবং হাশাশীদের উপর আঘাত হানেন। তাদের মধ্যে অনেকে নিহত এবং অনেকে বন্দী হয়। কিন্তু তাঁর মামা শিহাবুদ্দীন হারেমী, যিনি হেমাত এর শাসক, তিনি তাদের জন্য সুপারিশ করলে সুলতান তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন।2 নূরুদ্দীনের পুত্রের মৃত্যুর পরই সুলতান হালবকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হন। তাঁরপর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে হালবের অধিবাসীরা তা সুলতানের হাতে অর্পণ করে। এমনিভাবে ক্রুসেডারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার শক্ত মূলনীতির দিকে ধাবিত হয়। যেমন কাজি ইবনু শাদাদ বলেন . সালাহউদ্দীন যখন নূরুদ্দীনের মৃত্যু এবং তাঁর সন্তান শিশু থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হন, যে ছোট শিশু রাষ্ট্রের বোঝা বহন করার জন্য এগিয়ে আসবে না, আর এই ছোট শিশু একা আল্লাহর দুশমনদের দমন করতে সক্ষম হবে না, সক্ষম হবে না তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে, তখন তিনি সিরিয়া অভিমুখে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্ত্তত হন। কারণ শাম দেশই হচ্ছে মূল মুসলিম দেশ।3 এতসব কিছু সত্ত্বেও সালাহউদ্দীন এসময় জিহাদ পরিত্যাগ করেননি। বরং মারজে উয়ুনের মতো কয়েকটি যুদ্ধে ক্রুসেডারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন। তবে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
সালাহউদ্দীনের জিহাদ
মিশর- সিরিয়া এবং জাযিরা অঞ্চলের অনেক শহরে সালাহউদ্দীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। জাযিরা অঞ্চলের এক অভিযানে তিনি অসুস্থ হন। তখন তিনি মানত করলেন যে, আল্লাহ তাঁকে আরোগ্য দান করলে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ আর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়েই তাঁর সমস্ত চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করবে। এবং তিনি নিজ হাতে ক্রুসেড (আল কার্ক এর শাসককে) হত্যা করবেন। তদীয় উজির কাজি ফাযেলের ইঙ্গিতে তিনি এই মানত করেন।4
অতঃপর আশপাশের শহরগুলোর উপর তিনি সমন্বিত হামলা শুরু করেন। আর এটা করেন আল্লাহ তাকে বড় বিজয়ে ধন্য করার পূর্বে। আর বড় বিজয় হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার করা। হিজরী ৫৭৫ সনে (মারজে উয়ুনের) ঘটনায় তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। বানিয়াসের যুদ্ধেও তিনি জয়লাভ করেন। তিনি খ্রিস্টান নেতাদেরকে বন্দী করেন এবং ছফদ অঞ্চলে দুঃখের দুর্গ ধ্বংস করেন। একের পর এক তিনি খ্রিস্টানদের দুর্গের উপর হামলা পরিচালনা করেন। হিত্তীনের সমভূমিতে তাঁর জন্য বিরাট বাহিনী প্রস্ত্তত হয়। এখানে এমন বড় ঘটনা ঘটে, যাতে খ্রিস্টানদের হাড্ডি ভেঙে যায় এবং বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ক্ষেত্রে প্রস্ত্তত হয়। খ্রিস্টান প্রধানদের মধ্যে যারা এ যুদ্ধে উপস্থিত ছিল, তারা আহত এবং নিহত হয়। নিহতদেরকে প্রত্যক্ষকারী ব্যক্তি বলে . সেখানে তো কোন বন্দী ব্যক্তি নেই, কে বন্দী দেখেছে? সেখানেতো কোন নিহত ব্যক্তি নেই। শাম দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে খ্রিস্টানদের উপর কর্তৃত্ব লাভের পর থেকে হিত্তীনের আহত মুসলমানদের জন্য এটা ছিল এক মুক্তি।5
আল-কার্ক (আরনাত) এর শাসনকর্তাও ছিলেন বন্দীদের মধ্যে, যে হাজিদেরকে পীড়া দিতো। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল মদিনা অধিকার করা। তাই সালাহউদ্দীন নিজ হাতে তাকে হত্যা করে মানত পুরা করেন। তিনি ফেদাবী আর ইসবার্তীদেরকেও হত্যা করেন। কারণ, তারা ছিল খ্রিস্টানদের শয়তান এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী। হিত্তীনের যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সুলতান সালাহউদ্দীন যেসব নগর আর দুর্গ জয় করতে সক্ষম হন, সেগুলো হলো আক্কা, নাবলুস, হাইফা, কায়সারিয়া, ছফুরিয়া এবং নাছেরা। হিজরী ৫৮৩ সনের ২৭ রজব জুমার দিন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের মিম্বার থেকে পুনরায় আজান ধ্বনিত হয় এবং ৯১ বৎসর পর বায়তুল মুকাদ্দাসের কর্তৃত্ব মুসলমানদের নিকট ফিরে আসে। এতে মুসলমানরা মহা আনন্দিত হয়। এ সুসংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুলতান আল্লাহর দরবারে বিনয় আর শুকরিয়া প্রকাশ করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ছিল সালাহউদ্দীনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। এ উদ্দেশ্যে তিনি একটা বড় মিম্বার প্রস্ত্তত করেন। বিশাল মিম্বার হাজির করা হয় এবং পরবর্তী জুমায় কাজি ইবনু যাকী মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা দান করেন। সালাহউদ্দীন শহরের ব্যবস্থাপনা করেন, মসজিদ- মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং যাবতীয় নাপাকী আর অপবিত্রতা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসকে পবিত্র করেন। জিহাদ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। তাই বায়তুল মুকাদ্দসে তিনি খুব স্বল্প সময় অবস্থান করেন। এরপর অন্যান্য বিজয় অভিযানে বহির্গত হন। তিনি ছায়দা ও বৈরুত বিজয় সম্পন্ন করেন। জাবা- লাযেকিয়া অধিকার করেন, ইহুদি দুর্গ, রোগরাস দুর্গ অধিকার করত: ছাফদ ও আল- কার্ক অঞ্চল অভিমুখে রওয়ানা করে তা অধিকার করে সাকীফ দুর্গও করায়ত্ত করেন।
এক তুমুল ক্রুসেড যুদ্ধে তারা এক্কা পুনর্দখলের চেষ্টা চালালে সুলতান সালাহউদ্দীন দ্রুত তথায় ছুটে যান এবং তাদের মুখোমুখী অবস্থান নেন। সমুদ্রের দিক থেকে খ্রিস্টানরা এক্কা অবরোধ করে রেখেছিল। সমুদ্রের দিক থেকে ক্রুসেডারদের জন্য অব্যাহত ধারায় সাহায্য আসতে থাকে। দীর্ঘ ৩৬ মাস ধরে মুসলমানরা চরম ধৈর্যের সঙ্গে খ্রিস্টানদের মোকাবিলা করে (হিজরী ৫৮৫ সনের রজব মাস থেকে ৫৮৮ সনের শাবান মাস পর্যন্ত।) এই অবরোধ কালে সুলতান সালাহউদ্দীন বিশাল ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর যাবৎ তিনি লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিলেন। ইবনু শাদ্দাদ বলেন: তিনি ছিলেন মহান বীর বাহাদুরদের অন্যতম। তাঁর মনোবল ছিল বিরাট আর যুদ্ধ স্পৃহা ছিল অটুট। কোন কিছুই তাঁকে টলাতে পারতো না এবং কিছুতেই তিনি বিচলিত হতেন না। এক রাত্রে ইংল্যান্ড থেকে ৭০টির বেশি যুদ্ধ জাহাজ এক্কা পৌঁছে, আসরের নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে আমি এসব জাহাজ শুমার করি। এতে তাঁর মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়।6 এই দীর্ঘ অবরোধকালে তাঁর এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তিনি বিজয়ও লাভ করেন। কিন্তু ইউরোপ থেকে ক্রমাগত সাহায্য আসতে থাকে সমুদ্র পথে। উভয় পক্ষ বিস্ময়কর ধৈর্যের পরিচয় দেয়। সংঘর্ষ চলে জলে-স্থলে। এই অবরোধকালে সুলতান সালাহউদ্দীন মরক্কোর বাদশাহের নিকট সাহায্য চান, যিনি ছিলেন মুওয়াহহিদদের রাষ্ট্রের প্রধান। কিন্তু বাদশাহ তাঁর সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, সুলতান পত্রে তাঁকে আমীরুল মুমিনীন বলে সম্বোধন করেননি। এই দুর্ভোগের শেষের দিকে সুলতান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং খ্রিস্টানদের সঙ্গে সন্ধির জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তারা পুনরায় এক্কা অধিকার করে নেয় এবং ইয়াফা দখল করারও চেষ্টা চায়; কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। সুলতান বায়তুল মুকাদ্দাস প্রত্যাবর্তন করে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। তিনি নগর প্রাচীর সংস্কার করেন। তিনি নিজে অশ্ব নিয়ে ছুটে যেতেন এবং দূর দূরান্ত থেকে পাথর বহন করে আনতেন। তিনি নিজে অশ্বের পিঠে পাথর বোঝাই করতেন। এই দৃশ্য দেখে সৈন্যরাও তাঁর অনুসরণ করে।7
রাজধানী থেকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর তিনি দামেশকে ফিরে আসেন। তাঁর অন্তরের কামনা ছিল হজের জন্য প্রস্ত্তত হওয়া। এ যাবৎ হজ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। ক্রুসেডারদের সঙ্গে জিহাদ অব্যাহত রেখে তাদেরকে স্বদেশ ভূমিতে কোণঠাসা করে রাখা ছিল তাঁর অভিপ্রায়। কিন্তু মৃত্যু তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে দেয়নি। ৫৮৯ হিজরী সনের ২৭ সফর তিনি দামেশকে ইন্তিকাল করেন। আল্লাহর তাঁর প্রতি করুণা ধারা বর্ষণ করুন।
জিহাদের প্রতি তার অন্তরের আকর্ষণ
কাজি ইবনু শাদাদ বলেন . জিহাদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও সদা তৎপর। জিহাদে তিনি অতীব গুরুত্বারোপ করতেন। কেউ যদি হলফ করে বলে যে, জিহাদে বহির্গত হওয়ার পর জিহাদ আর জিহাদে সহায়তা ছাড়া তিনি একটা দীনার এবং দিরহামও অন্য কাজে ব্যয় করেননি, তাহলে তিনি তার কসমে সত্য প্রমাণিত হবেন। তাঁর অন্তরাত্মা এবং সকল অঙ্গের উপর জিহাদ ভালোভাবে জেঁকে বসেছিল। তিনি কেবল জিহাদ নিয়েই কথা বলতেন এবং কেবল জিহাদের অস্ত্রের প্রতিই তাকাতেন। জিহাদের প্রেমে তিনি স্বজন- পরিজন, সন্তান- সন্ততি, স্বদেশ ভূমি এবং সুখ শান্তি বিসর্জন দেন। তাঁবুর ছায়ায় জীবন কাটিয়ে তিনি সুখ ভোগ করেন। বাতাস তাঁবুকে নিয়ে যায় কখনো ডানে আবার কখনো বাঁয়ে। কেউ তার সংস্পর্শে এলে তিনি তাকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। তাঁর জিহাদী তৎপরতা নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমি নিজেও তাঁর জিহাদ বিষয়ে একটা গ্রন্থ রচনা করেছি। এতে জিহাদ সম্পর্কিত কুরআন মজীদের আয়াত, রাসূলের হাদিস এবং জিহাদের আদব আলোচনা করেছি। ইমাদ ইস্পহানী বলেন, আক্কার পথে সুলতানের সঙ্গে আমরা নদীর তীরে তীরে গমন করেছি। তখন ছিল ভীষণ শীত। সমুদ্র ছিল উত্তাল। সমুদ্রের ঢেউ ছিল পর্বৎসম। সমুদ্র দর্শনে আমি ছিলাম নবীন, তাই আমার নিকট তা মনে হয়েছে ভয়ংকর। সমুদ্রগামী ব্যক্তির মতামতকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি। এ অবস্থায় আমি নিজের দিকে তাকাই এবং মনে মনে বলি . আল্লাহ যখন খুশি হবেন, তখন সমুদ্র তীরের অবশিষ্ট অংশও জয় করার তাওফীক দান করবেন। আমি দেশকে বিভক্ত করেছি এবং ওছিয়ত করে দেশ ত্যাগ করেছি, এবং তাদের দ্বীপের উদ্দেশ্যে আমি এই সমুদ্র ত্যাগ করেছি। তাতে আমি তাদের অনুগমন করেছি, পৃথিবীতে আল্লাহকে অস্বীকার করে এমন কাউকে আমি অবশিষ্ট রাখব না, অথবা আমি মৃত্যু বরণ করব। আমার উপর এ কথার বিরাট প্রভাব পড়ে এবং আমার মনে যা উদয় হয় তার কাছে আমি তা বলি, এই স্বভাবের প্রতি তাকাও, তা কতই না পবিত্র। এই আত্মার প্রতি লক্ষ্য করো, তা কতইনা বীর, কতইনা বাহাদুর! হে আল্লাহ ! তুমিতো জান যে, তোমাদের দ্বীনের সাহায্যে এবং তোমার রহমতের আশায় তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সুতরাং তুমি তার প্রতি দয়া করে। আর তাঁর সবর সম্পর্কে কী আর বলা যায়। আক্কার হাঙ্গামায় আমি তাঁকে দেখেছি; তিনি তখন চরম পীড়িত, পীড়া তাকে চরমভাবে আচ্ছন্ন করে। দেহের মধ্যস্থল থেকে হাঁটু পর্যন্ত এমন ভাবে ফোড়া বের হয়েছে যে, তিনি বসতে পারেন না। এরপরও ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত অশ্বা রোহণে কাটান। ব্যথার প্রচন্ডতায় তিনি ধৈর্য ধারণ করে বলেন: আমি যখন অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করি তখন থেকে অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করা পর্যন্ত ব্যথা দূর হয়ে যায়।8
তিনি আববাসী খলিফাকে উদ্দেশ্য করে লিখেন- এই তিনটি উদ্দেশ্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি জুলুম থেকে বিরত থাকা এবং খলিফার আনুগত্য- এগুলো হচ্ছে কোন রাষ্ট্রের নিকট থেকে খাদিমের কাম্য, যখন খাদিম সে রাষ্ট্র জয় করেন। আল্লাহ জানেন, সে সুখ ভোগ করার জন্য জিহাদ করে না। যে সুখ আসল সুখের চেয়েও হালকা; এমন উম্মার জন্যও সে জিহাদ করে না, যা চাক্ষুষ বিবরণ পূর্ণ করে।9 আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি কীভাবে তিনি নিজে পাথর বহন করতেন বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রাচীর নির্মাণের জন্য। তুমি যদি তাকে পাথর বহন করতে দেখতে তাহলে তুমি জানতে পারতে যে, তিনি এমন হৃদয়ের অধিকারী যার চিন্তায় পাথর বহন করতে পারে।10 তিনি দামেশক প্রত্যাবর্তন করে দেখতে পান যে, বায়তুল মালের দায়িত্বশীল তাঁর জন্য একটা গৃহ নির্মাণ করেছে, তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন . দামেস্ক বা অন্য কোথাও অবস্থান করার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। আমাদের জন্ম হয়েছে জিহাদের জন্য।
তাঁর জীবনাদর্শ ও চরিত্র- মাধুর্য
হিজরী ৫৩২ সনে ইরাকের তিকরীত দুর্গে সুলতান ইউসুফ ইবনে আইউবের জন্ম হয়। তাঁর পিতা আইউব ইবনে শাদী ছিলেন উক্ত দুর্গের শাসক। এরপর পিতা মুসেলে বদলী হন। ভাই আসাদুদ্দীন শেরকোহও সঙ্গে গমন করেন। অতঃপর পিতা সিরিয়ায় বা’লাবাক্ক দুর্গের অধিকর্তা হিসাবে দায়িত্ব নেন। পুত্রও পিতার সঙ্গে গমন করেন। নূরুদ্দীন পুত্রকে শিক্ষা দান শুরু করেন এবং তাঁর ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও ন্যস্ত করেন। ফলে তিনি চাচা আসাদুদ্দীন শেরকোহ মিসরে যে অভিযান চালান, তাতে তিনি প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন চাচার সঙ্গী হিসাবে। চাচার মৃত্যুর পর তিনি চাচার পদ গ্রহণ করেন অর্থাৎ ওবায়দী রাষ্ট্রের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রী হন। অতঃপর তিনি নিজ নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং জাযিরা অঞ্চলে ঐক্য সাধন করেন এবং জিহাদের ময়দানে আত্মনিয়োগ করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। হিজরী ৫৮৯ সনে তিনি দামেস্কে ইন্তিকাল করেন। তাঁর নিযুক্ত বিচারপতি কাজি ইবনে শাদাদ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন . খোদার কসম করে বলছি, কিছু লোকের কাছে আমি শুনে আসছিলাম যে, তারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে আগ্রহী, তাদের মতো ওরাও নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চায়। আমি নিজে এবং অপরের নিকট থেকে জানতে পেরেছি যে, ফিদিয়া গৃহীত হলে তিনি অবশ্যই নিজেকে ফিদিয়া দিতেন।11
ইবনু শাদাদ বলেন . সুলতান কোন সম্পদ আর সম্পত্তি রেখে যাননি। তিনি তাঁর আমির- কর্মকর্তা ইত্যাদি এমনকি দুশমনদেরকেও দান করতেন। কেবল মাত্র ৪৭ টি দিরহাম ছাড়া তিনি কোন স্বর্ণ- রৌপ্য রেখে যাননি। আর রেখে যান একটা মাত্র দীনার। তিনি সামান্য আহার করতেন, সামান্য বস্ত্র পরিধান করতেন এবং মামুলী যানবাহন ব্যবহার করতেন। তাঁর জন্য যা হালাল এবং যাতে তাঁর মন তুষ্ট হয়, এমন বস্ত্ত ছাড়া তিনি পরিধান করতেন না। তিনি যথারীতি জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত তিনি হাদিসও শ্রবণ করতেন, দুটি সারীর মধ্যস্থলে। অর্থাৎ জিহাদের ময়দানেও তিনি হাদিস শ্রবণ করতেন। আজে বাজে কথা থেকে তাঁর মজলিশ ছিল মুক্ত। তাঁর মজলিশে পাপীদের প্রতি কঠোরতা এবং মু’মিনদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করা হতো।12 পুত্র যাহেরকে তিনি হালবে নির্দেশ দেন যে, শিহাব সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করতে হবে। কারণ তিনি জানতে পারেন যে, শিহাব সোহরাওয়ার্দী দালালী শুরু করেছে এবং দীন থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী। কেউ দেখা করতে এলে তাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করার জন্য নিজে বেরিয়ে যেতেন। মানুষের বড় মর্যাদা দিতেন, অতি সম্মান করতেন। কখনো কখনো খাদেমের কাছে পানি চাইতেন; খাদেম কথা না শুনলেও তিনি তাদেরকে কিছুই বলতেন না। কাজি ফাজেল বলেন . তাঁর নিকট ফরিয়াদ পেশকালে ভিড়ের সময় তাঁর চাদর পদতলে পিষ্ট হতো। এতে তিনি মোটেই ক্ষুব্ধ হতেন না। একদিন প্রচন্ড বৃষ্টির সময় আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হই। বেশ প্যাঁক কাদার মধ্যে খচ্চর তার গায়ে পানি-কাদা ছিটায়, এমনকি তার সমস্ত কাপড়- চোপড় নষ্ট করলেও তিনি (কিছুই না বলে বরং) হাসছিলেন।13
তাঁর নিকট জ্ঞান আর জ্ঞানীদের স্থান
নূরুদ্দীনের শাসনামলে যে জ্ঞানের আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, সালাহউদ্দীনের শাসনামলেও তা অব্যাহত ছিল। সুলতান নিজে ওলামাদের নিকট গমন করতেন এবং তাদের দারসে উপস্থিত হতেন। হিজরী ৫৭২ সনে তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় গমন করেন এবং বার বার শায়খ আবু তাহের সালাফীর41 সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং হাদিস শ্রবণ করার দীর্ঘ সময় তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলেন। নূরুদ্দীনের শাসনামলে কাজি কামালুদ্দীন ছিলেন অন্যতম বড় আলেম ও উজির। সালাহউদ্দীন দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজিদেরকে স্ব স্ব পদে বহ রাখেন। অথচ কাজি কামালুদ্দীনের ধারণা ছিল, নূরুদ্দীনের শাসনামলের বিরোধকে কেন্দ্র করে সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁকে পদচ্যুত করবেন। হিজরী ৫৭৭ সনে সুলতান নবিজির হাদিস শ্রবণ করার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেন। এর ফলে আলেম - ওলামাদের সমাবেশ ঘটে। যে সব আলেম তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা দামেশকী হাম্বলী। তিনিই হচ্ছেন সেই আলেম , যিনি সুলতান সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিপ্লব করার জন্য মিশরের ওবায়দী শাসকদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করেছিলেন।42
তাঁদের অন্যতম ছিলেন শাফেয়ি মাজহাবের ফকীহ নাজমুদ্দীন খাবুশানী। ওবায়দী সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে ইনি সালাহউদ্দীনকে সাহস জোগান এবং তাদের পক্ষে খুতবা পাঠ বন্ধ করে দেন। সুলতান সালাহউদ্দীন একটা মাদ্রাসা স্থাপন করে সে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করেন।
ফকীহ এবং আমিরদের মধ্যে ফকীহ ঈসা আল- ছাকারীও ছিলেন। তিনি বীর- বাহাদুর এবং উদার সৈনিক। শায়খ আবুল কাসেম বারজীর নিকট ফিকাহের জ্ঞানলাভ করেন এবং আমির আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সুলতান সালাহউদ্দীনের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলতেন, যেভাবে অন্য কেউ কথা বলতে পারতোনা। সালাহউদ্দীন যখন আক্কা অবরোধ করে রাখেন, সে সময় তিনি ইন্তিকাল করেন।43 কোন আলেম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আগমন করলে তাঁকে বেশ মর্যাদা দান করতেন এবং তাঁকে তাঁর নিজের আর নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের জন্য উপঢৌকন না দিয়ে বিদায় দিতেন না।
আলেম সমাজ এবং আমীরদের সঙ্গে সংযোগ- সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া এমন মহান বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। কাজি ইবনে শাদাদ বলেন . তিনি প্রতি সোম এবং বৃহস্পতিবার বিচারের জন্য বসতেন। বিচারের এই খোলা মজলিসে ফকীহ এবং কাজিরা উপস্থিত থাকতেন। সফরে অবস্থান কালেও তিনি এই বিচার মজলিসের আয়োজন করতেন।44
আলে মাকদাসী নামে পরিচিত যে শ্রেণিটি দামেশকের সালেহিয়া অঞ্চলে বসবাস করতো, তাদের মধ্যে ছিলেন আবু ওমর মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে কুদামা এবং তাঁর ভাই হাফেজ আব্দুল গণী ও মামা শায়খ ইমাদ। যেসব মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সুলতান সালাহউদ্দীন বহির্গত হতেন, তাতে এরা অবশ্যই থাকতেন। বায়তুল মুকাদ্দাস, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল ইত্যাদি জয়কালে অভিযানে এরা উপস্থিত ছিলেন।45
তাঁর উজির আর আমির
বলা হয়ে থাকে যে, শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। শাসক সৎ হলে তিনি দ্বীনদার আর কল্যাণকামীদেরকে ভালোবাসবেন এবং ভালো আমির উজিরদের সংসর্গ দ্বারা আল্লাহ তাকে ধন্য করবেন। সুলতান সালাহউদ্দীনের ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি খাপ খায়। কাজি আব্দুর রহীম বায়সানীর সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন, যিনি ছিলেন তাঁর মন্ত্রী সভার উজির। সুস্থ চিন্তা আর সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী কাজি আব্দুর রহীম ছিলেন তাঁর নিকট বিরাট মর্যাদাবান। তাঁর মতামত সুলতান গ্রহণ করতেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর নিকট পরামর্শ চাইতেন। বিশিষ্ট লেখক ইমাদ ইসফাহানী তাঁর সম্পর্কে বলেন . সুলতান তাঁর কথা রাখতেন আর তিনিও মেনে চলতেন সুলতানের কথা। তাঁর মত অনুযায়ী সুলতান কোন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতেন। তাঁর লেখা ছিল সাহায্যের নিশ্চয়তা। তিনি ছিলেন বিশাল প্রজ্ঞার অধিকারী এবং তাঁর দুরদৃষ্টি কার্যকর করা হতো।46 তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি আক্কা অবরোধকালে সুলতানকে গুনাহের ভয় দেখিয়ে পত্র লিখেন এবং সতর্ক করে দেন কারো প্রতি সৈন্যদের জুলুম সম্পর্কে, যা হবে পরাজয়ের কারণ। তিনি বলেন . আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া তাঁকে সন্তুষ্ট করা যায় না এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ছাড়া কষ্ট- ক্লেশ দূর হয় না। যে কোন স্থানে পাপ কাজ করা হোকনা কেন, তা প্রকাশ পাবেই। আর যে কোন স্থানে অন্যায় করা হোক না কেন, তা ফাঁস হবেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের কর্তার হাতে পবিত্র বিজয়ের সূচনা করেছেন, যা আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রমাণ হবে। আমরা আল্লাহর নিকট তাঁর গজব থেকে পানাহ চাই, তা যেন তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ না হয়।47 জিহাদে নিষ্ঠাবান সৈন্যদের নেতৃত্ব দানের তাওফীক তাঁকে দেয়া হয়েছে। কখনো কখনো জিহাদী পরিমন্ডলের প্রভাব পড়তো সৈন্যদের উপর। তাঁর অন্যতম আমির ছিলেন ইজ্জুদ্দীন জর্দেক, আর তিনি ছিলেন নূরুদ্দীনের আযাদ করা ক্রীতদাস। তাঁর মধ্যে বিশ্বস্ততা আর বীরত্বের সমাবেশ ঘটেছিল।48 অপর জন ছিল সাইফুদ্দীন জাওনী। তিনিও ছিলেন বীর- বাহাদুর, যার মধ্যে দ্বীনদারী আর বন্দেগির সমাবেশ ঘটেছিল।49 আরো ছিলেন আবুল হীজা, ইবনুস সিমীন, ইবনুল মাশতুব, বাহাউদ্দীন কারাকুশ, যারা ছিলেন তাঁর সচিব ও আমির। এরা ছিলেন বীর-বাহাদুর, যারা কায়রো নগরীর প্রাচীর নির্মাণ করেন এবং পর্বত দুর্গ নির্মাণ করান। সালাহউদ্দীন তার হাতে এক্কা অঞ্চলের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। তিনি সেখানে থাকাকালে অবরোধের ঘটনা ঘটে এবং এ নিয়ে লোকেরা নানা কাহিনি রচনা করে, যা বিশুদ্ধ নয়।50
সালাহউদ্দীন কি ফিলিস্তিনের দাবি ত্যাগ করেছিলেন?
বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার পর ক্রুসেডারদের কুকুরের মতো কামড়া কামড়ি করা এবং তাদের এক্কা অধিকার করা সত্ত্বেও এবং সন্ধির জন্য সালাহউদ্দীন তিন বৎসর ব্যাকুলতার পরও তিনি ফিলিস্তিনের দাবি ত্যাগ করেননি। কারণ, ফিলিস্তিন তাঁর মালিকানাধীন ছিল না, বরং তা ছিল মুসলমানদের মালিকানাধীন। এবং ইংরেজ শাসকও তাঁর সঙ্গে চেষ্টা চালান; কিন্তু তিনি ফিলিস্তিনের কোন অংশ আল্লাহর দুশমনদের জন্য ছেড়ে দিতে কঠোরভাবে অস্বীকার করেন। আর মুসলমানদের অধিকার নিয়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করা সালাহউদ্দীনের মতো মহান ব্যক্তিত্বের স্বভাব হতে পারে না। ইংরেজ শাসক তাঁর কাছে লিখে . ইংরেজ আর মুসলমানরা ধ্বংস হয়েছে আর দেশের হয়েছে সর্বনাশ, জান আর মাল বিনষ্ট হয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের ইবাদতের স্থান; আমাদের একজন লোকও বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা তার দাবি ত্যাগ করব না। দেশতো আমাদের কাছে ফিরে আসবে; তা জর্দানকে বিচ্ছিন্ন করবে না। স্বভাবতই এটা হচ্ছে ইংরেজ শাসকের একটা কূট কৌশল, সম্ভাব্য পরিমাণে অথবা ন্যূনপক্ষে কিছু আদায় করার জন্য বিরাট কিছু দাবি করা- এটাই হচ্ছে ইংরেজদের কাজ।51
সালাহউদ্দীন তাকে জবাব দেন . বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের। তা আমাদের নবীদের বিচরণ স্থল। সুতরাং আমরা তার দাবি ত্যাগ করব এটা কল্পনাও করা যায় না। মুসলমানদের মধ্যে আমরা এমন কথা মুখে উচ্চারণও করতে পারি না। আর দেশ, মুলত . তাওতো আমাদেরই তৎকালে সেখানে যেসব মুসলমান ছিল, তাদের দুর্বলতার কারণে সাময়িকভাবে তোমরা তা দখল করে নিয়েছিলে।52 তখন ইংরেজ শাসক জবাব দেয় . আপনার নিকট আমি যা দাবি করছি, তা হচ্ছে এই যে, বায়তুল মুকাদ্দাস দুর্গে আমাদের বিশজন লোক থাকবে, আর নগরে যেসব খ্রিস্টান থাকবে, তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না।
জবাবে সুলতান বলেন . শুধু মাত্র জিয়ারত ছাড়া বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে তোমরা কোন কথাই বলতে পারবে না।53 সাবধান। বিগত রজনি কতইনা ভয়ার্ত ছিল। বর্তমান যুগে ইহুদিরা ফিলিস্তিন নিয়ে কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করছে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা তাদেরকে উসকানি দিচ্ছে। তারা সময়ে সঙ্গ দেয়, আবার সময়ে ধোঁকা দেয়, সুযোগ কাজে লাগানোই তাদের উদ্দেশ্য। তারা লাভ করতে চায় নতুন নতুন স্বার্থ। আর হাস্যকর শান্তির মোড়লরা শয়তানি অঙ্গীকারের অপেক্ষায় আছে। কারণ, মূলত . জিহাদ বা যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের নেই। যে কোন মূল্যে তারা শান্তি চায়। আর ইহুদিরা বিশেষভাবেই ভূমি চায়। রাশিয়ায় ইহুদিদের পক্ষ থেকে তাদের কাছে সাহায্য এসেছে।54
সুলতান ও সূর শহর
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর এ মর্মে সুলতান সালাহউদ্দীনকে অভিযুক্ত করেন যে, সূর নগরীর ব্যাপারে তিনি বাড়াবাড়ি করেছেন। কারণ, যে কোন অবরোধ বা বিজয় শেষে তিনি বন্দীদেরকে মুক্ত করে দিতেন এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দান করতেন। ফলে এরা সকলেই সূর নগরীতে সমবেত হতো, পরবর্তীকালে যা জয় করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর তিনিই আবার অভিযোগ করেন যে, সূর নগরীর সামনে তিনি দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হননি। এটা তাঁর অভ্যাস ছিল যে, কোন জনপদ তাঁর হস্তগত হলে সে জনপদ সম্পর্কে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন এবং তা ছেড়ে চলে যেতেন।55 তার ব্যাপারে সালাহউদ্দীন ছাড়া কারো অপরাধ ছিল না।56
এটা কি ঠিক যে, সালাহউদ্দীন সূর নগরীর প্রসঙ্গটা শিথিল করে দিয়েছিলেন এবং খ্রিস্টানদেরকে সেখানে সমবেত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন? এখানে আমরা এ জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমত . উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সালাহউদ্দীন সম্পর্কে ইবনুল আসীর এক ধরনের অন্যায় করেছেন। আর তার কারণ এই যে, জঙ্গি পরিবারের প্রতি ইবনুল আসীরের দুর্বলতা রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে বেশ সম্মান করেন। এবং তিনি মনে করেন যে, সালাহউদ্দীন জঙ্গি পরিবারের নিকট থেকে সিরিয়া ও মিশরের রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। এ কারণে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি সুযোগ পেলেই সালাহউদ্দীনের প্রতি টিপ্পনি কাটেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বৈরুতে ও জু-বাইল জয় করার পর সালাহউদ্দীনের নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আসফান ও বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করা, কারণ দুটোই ছিল মিশরের পথে। বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার মধ্যে রয়েছে বিরাট নাম ও খ্যাতি।57
নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে ইবনুল আসীর উল্লেখ করেন যে, তিনি সালাহউদ্দীন কে দেখতে পান তাঁর অতিথি মুইজ্জুদ্দীন কায়সার শাহ ইবনে কজ আরসালানকে বিদায় জানাতে (যিনি ছিলেন আনাযুল অঞ্চলে সেলজুক রাজত্বের অন্যতম শাসক) । সালাহউদ্দীন যখন আরোহণ করতে উদ্যত হন, মুইজ্জুদ্দীন বাহু ধরে তাকে আরোহণ করান। জঙ্গি পরিবার থেকে আলাউদ্দীন ইবনে ইজ্জুদ্দীন তার পোশাক ছিনিয়ে নেন। বর্ণনাকারী মন্তব্য করেন . হে আইউব তনয়! কী করছ তুমি? তুমি কি মৃত্যু বরণ করছ? সেলজুক বাদশাহ এবং ইবনে আতাবক জঙ্গি তোমাকে আরোহণ করাচ্ছে? 58 তাই ইবনুল আসীর এবং তাঁর বর্ণনাকারী উভয়ে বাড়াবাড়ি করে যাতে বনী আইউবের একজন লোক এই মর্যাদায় পুঁছতে পারে।
আরো একটা কথা। আমরা লক্ষ্য করি না যে, ইবনুল আসীর জালিম- ফাসিক বাদশাহদের নিন্দা করেন, সমালোচনা করেন। তিনি তাদের দোষত্রুটির উল্লেখ করেন না, বিশেষ করে মূসেল এবং সেলজুক শাসকদের।
দ্বিতীয়ত . সালাহউদ্দীন সম্পর্কে একথা বলাও সঠিক নয় যে, সকল বন্দীকেই তিনি মুক্ত করে দিতেন। কারণ, তিনি হারবী তথা যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছে, তাদেরকে বিশেষ করে ফিদাবিয়া আর ইসবরতিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করেন। কিন্তু তিনি যখন কোন নগর অবরোধ করেন এবং সে নগরের অধিবাসীরা তার কাছে নিরাপত্তা দাবি করে এই শর্তে যে, তারা দুর্গ জয়ে তাঁকে সাহায্য করবে, তাদেরকে তিনি নিরাপত্তা দান করেন এবং অঙ্গীকার পূরণ করেন। এ সম্পর্কে ইবনুল আসীর নিজেই বলেন . তিনি ছিলেন অতি ক্ষমাপরায়ণ, ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করতেন এবং উদারতা দেখাতেন।59 এটাই ছিল সালাহউদ্দীনের প্রবৃত্তি আর প্রকৃতি। তিনি ক্ষমা আর উদারতাকে ভালোবাসতেন। কোন শহর আর নগর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পদানত হলে এটাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করতেন। অবশ্য তিনি অতিষ্ঠ আর বিরক্ত হলে কোন শহর তার সম্মুখে দাঁড়ালে তিনি তা দেখে নিতেন একথা সঠিক নয়। তিনি এক্কা শহর অবরোধ করেন এবং এ অবরোধ চলে দীর্ঘ ৩৬ মাস, এরপরও তিনি বিরক্ত হননি এবং অবরোধ তুলেও নেননি। অবশ্য সূর নগর তিনি ত্যাগ করেন এটা এ জন্য যে, তিনি দেখতে পান একটা প্রতিষ্ঠিত দুর্গ। এবং অবরোধ দীর্ঘ করায় কোন ফল দেখা দেবে বলে তিনি মনে করেন না, বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে যেখানে তিনি নিজেও আছেন।60
তৃতীয়ত . নিছক সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইবনুল আসীর সমালোচনা করলে সে ব্যাপারে কিছু বলার নেই। সকল দৃষ্টিকোণের জন্যই রয়েছে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। যেমন তিনি বলেন . সূর ফাঁকা ছিল, কিন্তু সালাহউদ্দীন তা অধিকার করতে ভয় পান এবং তা রক্ষা করার শক্তি তার ছিল না। অন্যথায় পূর্বে যদি তা অধিকার করা শুরু করতেন তাহলে বিনা কষ্টে তা অধিকার করতে পারতেন। তার এ মন্তব্য সঠিক। যদিও শুরুতে তা অবরোধ করার ক্ষেত্রে সালাহউদ্দীন ছিলেন মুজতাহিদ।
আমরা এখানে আইয়ুবী রাজত্বের ইতিহাস আলোচনা করতে চাই না। আমরা কেবল আলোচনা করতে চাই সালাহউদ্দীন ব্যক্তিত্বের মধ্যে সেই জিহাদী আরবদের প্রভাব। আলিম সমাজ আর সেনা অধিপতিদেরকে তিনি কীভাবে প্রস্ত্তত করেছিলেন, যারা এ মহান অভিযানে তাঁকে সহায়তা করেছেন।
সালাহউদ্দীনকতিপয় কীর্তি
১. সুন্নাহর প্রতি মিশরকে ফিরিয়ে আনা
সালাহউদ্দীন মিশরীয়দের পদচ্যুত করেন ; কারণ তারা ছিল শিয়া। তিনি আব্দুল মালেক ইবনে দিরবাস শাফেয়িকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন। তারা আজানে পরিবর্তন সাধন করে (হাইয়্যা ‘আলা খায়রিল আমল)। মিসরে আববাসীয় খলিফাদের নামে খুতবা বন্ধ করার পর তিনি আববাসীয়দের নামে খুতবাহ চালু করেন। (২০৮ হিজরী)। আববাসীয় খলিফা নূরুদ্দীন মাহমুদ এ সুসংবাদ দান করেন। ফলে জনগণ খুশি হয়।
এ প্রসঙ্গে ইমাদ আল- ইসফাহানী কবিতা রচনা করেন .
توفي العاضدُ الدعيّ فما يفتحُ ذو بدعة بمصر فما
وعصرُ فرعونِها انفضى وغدايوسفُها في الأمور محتكما
وصار شمل الصلاح ملتئماًبها وعقد السداس منتظما
২. সিরিয়া- মিশর ঐক্য
নূরুদ্দীনের ইন্তিকাল এবং শাম দেশের অস্থিরতার পর সালাহউদ্দীনের আবির্ভাব ঘটে। ফলে তিনি দামেশক, হেমস এবং হেমাত অধিকার করেন এবং হালব শহর অবরোধ করেন। কিন্তু কর্মকর্তারা, যাদের ব্যাপারে ওছিয়ত করা হয়েছে, আলী ইবনে নূরুদ্দীন (ইসমাঈল) অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে জাতির নিকট সহায়তা দাবি করেন। নূরুদ্দীন যে শিয়া মতবাদ বাতিল করেন, মনে হয় যে, জাতির একটা বিরাট অংশ তাদের দিকে নুয়ে পড়ে। ফলে তারা সহায়তার জন্য কথা অনুযায়ী কাজের দাবি জানায়। শহরের নেতারা এ শর্তের পক্ষে রায় দেয়, কেবল কথাকেই তারা যথেষ্ট মনে করে না। তারা যখন সালাহউদ্দীনের শক্তি এবং আরব বোধে তার অব্যাহত থাকা লক্ষ্য করে, তখন তারা হাশাশী ইসমাঈলীদের নিকট থেকে সহায়তা দাবি করে। এরা বানিয়াসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ফলে তারা নিজেদের ধারায় চেষ্টা চালায়। বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা সালাহউদ্দীনকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। কিছু সময়ের জন্য অবরোধ তুলে নেন। পরে পুনরায় ফিরে আসেন। হাশাশী ইসমাঈলীরা পুনরায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এ কাজে তারা ব্যর্থ হয় এবং এ কাজের জন্য তাদের মধ্যে যারা এসেছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়। এরা নিজেদেরকে ‘ফেদাবিয়া’ বলে অভিহিত করে। হালব বাসীরা কেবল এটাকেই যথেষ্ট মনে করেনি। তারা বরং ত্রিপোলীর ক্রুসেডার শাসকের নিকট সাহায্য কামনা করে। সালাহউদ্দীন এটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি, বরং তিনি একটা ক্ষুদ্র পত্র প্রেরণ করেন।
এতদ সত্ত্বেও সালাহউদ্দীন হালব থেকে ফিরে আসেন, হালব বাসীদের সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধে তিনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করেননি। বিশেষ করে তারাতো সন্ধি প্রত্যাশী ছিল। এ ব্যাপারে তারা নুরুদ্দীন মাহমুদের কন্যার নিকট সুপারিশও চায়। কিন্তু মিশর- সিরিয়ার ঐক্য বিষয়ে সুলতানের অভিপ্রায় অটল ছিল। এমনকি দুশমনের মুখের সামনে দাঁড়াতেও তিনি ইতস্তত করেননি। এসময় তিনি বিপর্যয়ের জট উপড়ে ফেলার ইচ্ছা করেন এবং হাশাশীদের উপর আঘাত হানেন। তাদের মধ্যে অনেকে নিহত এবং অনেকে বন্দী হয়। কিন্তু তাঁর মামা শিহাবুদ্দীন হারেমী, যিনি হেমাত এর শাসক, তিনি তাদের জন্য সুপারিশ করলে সুলতান তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন।2 নূরুদ্দীনের পুত্রের মৃত্যুর পরই সুলতান হালবকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হন। তাঁরপর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে হালবের অধিবাসীরা তা সুলতানের হাতে অর্পণ করে। এমনিভাবে ক্রুসেডারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার শক্ত মূলনীতির দিকে ধাবিত হয়। যেমন কাজি ইবনু শাদাদ বলেন . সালাহউদ্দীন যখন নূরুদ্দীনের মৃত্যু এবং তাঁর সন্তান শিশু থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হন, যে ছোট শিশু রাষ্ট্রের বোঝা বহন করার জন্য এগিয়ে আসবে না, আর এই ছোট শিশু একা আল্লাহর দুশমনদের দমন করতে সক্ষম হবে না, সক্ষম হবে না তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে, তখন তিনি সিরিয়া অভিমুখে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্ত্তত হন। কারণ শাম দেশই হচ্ছে মূল মুসলিম দেশ।3 এতসব কিছু সত্ত্বেও সালাহউদ্দীন এসময় জিহাদ পরিত্যাগ করেননি। বরং মারজে উয়ুনের মতো কয়েকটি যুদ্ধে ক্রুসেডারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন। তবে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
সালাহউদ্দীনের জিহাদ
মিশর- সিরিয়া এবং জাযিরা অঞ্চলের অনেক শহরে সালাহউদ্দীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। জাযিরা অঞ্চলের এক অভিযানে তিনি অসুস্থ হন। তখন তিনি মানত করলেন যে, আল্লাহ তাঁকে আরোগ্য দান করলে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ আর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়েই তাঁর সমস্ত চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করবে। এবং তিনি নিজ হাতে ক্রুসেড (আল কার্ক এর শাসককে) হত্যা করবেন। তদীয় উজির কাজি ফাযেলের ইঙ্গিতে তিনি এই মানত করেন।4
অতঃপর আশপাশের শহরগুলোর উপর তিনি সমন্বিত হামলা শুরু করেন। আর এটা করেন আল্লাহ তাকে বড় বিজয়ে ধন্য করার পূর্বে। আর বড় বিজয় হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার করা। হিজরী ৫৭৫ সনে (মারজে উয়ুনের) ঘটনায় তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। বানিয়াসের যুদ্ধেও তিনি জয়লাভ করেন। তিনি খ্রিস্টান নেতাদেরকে বন্দী করেন এবং ছফদ অঞ্চলে দুঃখের দুর্গ ধ্বংস করেন। একের পর এক তিনি খ্রিস্টানদের দুর্গের উপর হামলা পরিচালনা করেন। হিত্তীনের সমভূমিতে তাঁর জন্য বিরাট বাহিনী প্রস্ত্তত হয়। এখানে এমন বড় ঘটনা ঘটে, যাতে খ্রিস্টানদের হাড্ডি ভেঙে যায় এবং বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ক্ষেত্রে প্রস্ত্তত হয়। খ্রিস্টান প্রধানদের মধ্যে যারা এ যুদ্ধে উপস্থিত ছিল, তারা আহত এবং নিহত হয়। নিহতদেরকে প্রত্যক্ষকারী ব্যক্তি বলে . সেখানে তো কোন বন্দী ব্যক্তি নেই, কে বন্দী দেখেছে? সেখানেতো কোন নিহত ব্যক্তি নেই। শাম দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে খ্রিস্টানদের উপর কর্তৃত্ব লাভের পর থেকে হিত্তীনের আহত মুসলমানদের জন্য এটা ছিল এক মুক্তি।5
আল-কার্ক (আরনাত) এর শাসনকর্তাও ছিলেন বন্দীদের মধ্যে, যে হাজিদেরকে পীড়া দিতো। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল মদিনা অধিকার করা। তাই সালাহউদ্দীন নিজ হাতে তাকে হত্যা করে মানত পুরা করেন। তিনি ফেদাবী আর ইসবার্তীদেরকেও হত্যা করেন। কারণ, তারা ছিল খ্রিস্টানদের শয়তান এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী। হিত্তীনের যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সুলতান সালাহউদ্দীন যেসব নগর আর দুর্গ জয় করতে সক্ষম হন, সেগুলো হলো আক্কা, নাবলুস, হাইফা, কায়সারিয়া, ছফুরিয়া এবং নাছেরা। হিজরী ৫৮৩ সনের ২৭ রজব জুমার দিন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের মিম্বার থেকে পুনরায় আজান ধ্বনিত হয় এবং ৯১ বৎসর পর বায়তুল মুকাদ্দাসের কর্তৃত্ব মুসলমানদের নিকট ফিরে আসে। এতে মুসলমানরা মহা আনন্দিত হয়। এ সুসংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুলতান আল্লাহর দরবারে বিনয় আর শুকরিয়া প্রকাশ করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ছিল সালাহউদ্দীনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। এ উদ্দেশ্যে তিনি একটা বড় মিম্বার প্রস্ত্তত করেন। বিশাল মিম্বার হাজির করা হয় এবং পরবর্তী জুমায় কাজি ইবনু যাকী মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা দান করেন। সালাহউদ্দীন শহরের ব্যবস্থাপনা করেন, মসজিদ- মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং যাবতীয় নাপাকী আর অপবিত্রতা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসকে পবিত্র করেন। জিহাদ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। তাই বায়তুল মুকাদ্দসে তিনি খুব স্বল্প সময় অবস্থান করেন। এরপর অন্যান্য বিজয় অভিযানে বহির্গত হন। তিনি ছায়দা ও বৈরুত বিজয় সম্পন্ন করেন। জাবা- লাযেকিয়া অধিকার করেন, ইহুদি দুর্গ, রোগরাস দুর্গ অধিকার করত: ছাফদ ও আল- কার্ক অঞ্চল অভিমুখে রওয়ানা করে তা অধিকার করে সাকীফ দুর্গও করায়ত্ত করেন।
এক তুমুল ক্রুসেড যুদ্ধে তারা এক্কা পুনর্দখলের চেষ্টা চালালে সুলতান সালাহউদ্দীন দ্রুত তথায় ছুটে যান এবং তাদের মুখোমুখী অবস্থান নেন। সমুদ্রের দিক থেকে খ্রিস্টানরা এক্কা অবরোধ করে রেখেছিল। সমুদ্রের দিক থেকে ক্রুসেডারদের জন্য অব্যাহত ধারায় সাহায্য আসতে থাকে। দীর্ঘ ৩৬ মাস ধরে মুসলমানরা চরম ধৈর্যের সঙ্গে খ্রিস্টানদের মোকাবিলা করে (হিজরী ৫৮৫ সনের রজব মাস থেকে ৫৮৮ সনের শাবান মাস পর্যন্ত।) এই অবরোধ কালে সুলতান সালাহউদ্দীন বিশাল ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর যাবৎ তিনি লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিলেন। ইবনু শাদ্দাদ বলেন: তিনি ছিলেন মহান বীর বাহাদুরদের অন্যতম। তাঁর মনোবল ছিল বিরাট আর যুদ্ধ স্পৃহা ছিল অটুট। কোন কিছুই তাঁকে টলাতে পারতো না এবং কিছুতেই তিনি বিচলিত হতেন না। এক রাত্রে ইংল্যান্ড থেকে ৭০টির বেশি যুদ্ধ জাহাজ এক্কা পৌঁছে, আসরের নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে আমি এসব জাহাজ শুমার করি। এতে তাঁর মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়।6 এই দীর্ঘ অবরোধকালে তাঁর এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তিনি বিজয়ও লাভ করেন। কিন্তু ইউরোপ থেকে ক্রমাগত সাহায্য আসতে থাকে সমুদ্র পথে। উভয় পক্ষ বিস্ময়কর ধৈর্যের পরিচয় দেয়। সংঘর্ষ চলে জলে-স্থলে। এই অবরোধকালে সুলতান সালাহউদ্দীন মরক্কোর বাদশাহের নিকট সাহায্য চান, যিনি ছিলেন মুওয়াহহিদদের রাষ্ট্রের প্রধান। কিন্তু বাদশাহ তাঁর সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, সুলতান পত্রে তাঁকে আমীরুল মুমিনীন বলে সম্বোধন করেননি। এই দুর্ভোগের শেষের দিকে সুলতান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং খ্রিস্টানদের সঙ্গে সন্ধির জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তারা পুনরায় এক্কা অধিকার করে নেয় এবং ইয়াফা দখল করারও চেষ্টা চায়; কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। সুলতান বায়তুল মুকাদ্দাস প্রত্যাবর্তন করে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। তিনি নগর প্রাচীর সংস্কার করেন। তিনি নিজে অশ্ব নিয়ে ছুটে যেতেন এবং দূর দূরান্ত থেকে পাথর বহন করে আনতেন। তিনি নিজে অশ্বের পিঠে পাথর বোঝাই করতেন। এই দৃশ্য দেখে সৈন্যরাও তাঁর অনুসরণ করে।7
রাজধানী থেকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর তিনি দামেশকে ফিরে আসেন। তাঁর অন্তরের কামনা ছিল হজের জন্য প্রস্ত্তত হওয়া। এ যাবৎ হজ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। ক্রুসেডারদের সঙ্গে জিহাদ অব্যাহত রেখে তাদেরকে স্বদেশ ভূমিতে কোণঠাসা করে রাখা ছিল তাঁর অভিপ্রায়। কিন্তু মৃত্যু তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে দেয়নি। ৫৮৯ হিজরী সনের ২৭ সফর তিনি দামেশকে ইন্তিকাল করেন। আল্লাহর তাঁর প্রতি করুণা ধারা বর্ষণ করুন।
জিহাদের প্রতি তার অন্তরের আকর্ষণ
কাজি ইবনু শাদাদ বলেন . জিহাদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও সদা তৎপর। জিহাদে তিনি অতীব গুরুত্বারোপ করতেন। কেউ যদি হলফ করে বলে যে, জিহাদে বহির্গত হওয়ার পর জিহাদ আর জিহাদে সহায়তা ছাড়া তিনি একটা দীনার এবং দিরহামও অন্য কাজে ব্যয় করেননি, তাহলে তিনি তার কসমে সত্য প্রমাণিত হবেন। তাঁর অন্তরাত্মা এবং সকল অঙ্গের উপর জিহাদ ভালোভাবে জেঁকে বসেছিল। তিনি কেবল জিহাদ নিয়েই কথা বলতেন এবং কেবল জিহাদের অস্ত্রের প্রতিই তাকাতেন। জিহাদের প্রেমে তিনি স্বজন- পরিজন, সন্তান- সন্ততি, স্বদেশ ভূমি এবং সুখ শান্তি বিসর্জন দেন। তাঁবুর ছায়ায় জীবন কাটিয়ে তিনি সুখ ভোগ করেন। বাতাস তাঁবুকে নিয়ে যায় কখনো ডানে আবার কখনো বাঁয়ে। কেউ তার সংস্পর্শে এলে তিনি তাকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। তাঁর জিহাদী তৎপরতা নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমি নিজেও তাঁর জিহাদ বিষয়ে একটা গ্রন্থ রচনা করেছি। এতে জিহাদ সম্পর্কিত কুরআন মজীদের আয়াত, রাসূলের হাদিস এবং জিহাদের আদব আলোচনা করেছি। ইমাদ ইস্পহানী বলেন, আক্কার পথে সুলতানের সঙ্গে আমরা নদীর তীরে তীরে গমন করেছি। তখন ছিল ভীষণ শীত। সমুদ্র ছিল উত্তাল। সমুদ্রের ঢেউ ছিল পর্বৎসম। সমুদ্র দর্শনে আমি ছিলাম নবীন, তাই আমার নিকট তা মনে হয়েছে ভয়ংকর। সমুদ্রগামী ব্যক্তির মতামতকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি। এ অবস্থায় আমি নিজের দিকে তাকাই এবং মনে মনে বলি . আল্লাহ যখন খুশি হবেন, তখন সমুদ্র তীরের অবশিষ্ট অংশও জয় করার তাওফীক দান করবেন। আমি দেশকে বিভক্ত করেছি এবং ওছিয়ত করে দেশ ত্যাগ করেছি, এবং তাদের দ্বীপের উদ্দেশ্যে আমি এই সমুদ্র ত্যাগ করেছি। তাতে আমি তাদের অনুগমন করেছি, পৃথিবীতে আল্লাহকে অস্বীকার করে এমন কাউকে আমি অবশিষ্ট রাখব না, অথবা আমি মৃত্যু বরণ করব। আমার উপর এ কথার বিরাট প্রভাব পড়ে এবং আমার মনে যা উদয় হয় তার কাছে আমি তা বলি, এই স্বভাবের প্রতি তাকাও, তা কতই না পবিত্র। এই আত্মার প্রতি লক্ষ্য করো, তা কতইনা বীর, কতইনা বাহাদুর! হে আল্লাহ ! তুমিতো জান যে, তোমাদের দ্বীনের সাহায্যে এবং তোমার রহমতের আশায় তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সুতরাং তুমি তার প্রতি দয়া করে। আর তাঁর সবর সম্পর্কে কী আর বলা যায়। আক্কার হাঙ্গামায় আমি তাঁকে দেখেছি; তিনি তখন চরম পীড়িত, পীড়া তাকে চরমভাবে আচ্ছন্ন করে। দেহের মধ্যস্থল থেকে হাঁটু পর্যন্ত এমন ভাবে ফোড়া বের হয়েছে যে, তিনি বসতে পারেন না। এরপরও ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত অশ্বা রোহণে কাটান। ব্যথার প্রচন্ডতায় তিনি ধৈর্য ধারণ করে বলেন: আমি যখন অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করি তখন থেকে অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করা পর্যন্ত ব্যথা দূর হয়ে যায়।8
তিনি আববাসী খলিফাকে উদ্দেশ্য করে লিখেন- এই তিনটি উদ্দেশ্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি জুলুম থেকে বিরত থাকা এবং খলিফার আনুগত্য- এগুলো হচ্ছে কোন রাষ্ট্রের নিকট থেকে খাদিমের কাম্য, যখন খাদিম সে রাষ্ট্র জয় করেন। আল্লাহ জানেন, সে সুখ ভোগ করার জন্য জিহাদ করে না। যে সুখ আসল সুখের চেয়েও হালকা; এমন উম্মার জন্যও সে জিহাদ করে না, যা চাক্ষুষ বিবরণ পূর্ণ করে।9 আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি কীভাবে তিনি নিজে পাথর বহন করতেন বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রাচীর নির্মাণের জন্য। তুমি যদি তাকে পাথর বহন করতে দেখতে তাহলে তুমি জানতে পারতে যে, তিনি এমন হৃদয়ের অধিকারী যার চিন্তায় পাথর বহন করতে পারে।10 তিনি দামেশক প্রত্যাবর্তন করে দেখতে পান যে, বায়তুল মালের দায়িত্বশীল তাঁর জন্য একটা গৃহ নির্মাণ করেছে, তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন . দামেস্ক বা অন্য কোথাও অবস্থান করার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। আমাদের জন্ম হয়েছে জিহাদের জন্য।
তাঁর জীবনাদর্শ ও চরিত্র- মাধুর্য
হিজরী ৫৩২ সনে ইরাকের তিকরীত দুর্গে সুলতান ইউসুফ ইবনে আইউবের জন্ম হয়। তাঁর পিতা আইউব ইবনে শাদী ছিলেন উক্ত দুর্গের শাসক। এরপর পিতা মুসেলে বদলী হন। ভাই আসাদুদ্দীন শেরকোহও সঙ্গে গমন করেন। অতঃপর পিতা সিরিয়ায় বা’লাবাক্ক দুর্গের অধিকর্তা হিসাবে দায়িত্ব নেন। পুত্রও পিতার সঙ্গে গমন করেন। নূরুদ্দীন পুত্রকে শিক্ষা দান শুরু করেন এবং তাঁর ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও ন্যস্ত করেন। ফলে তিনি চাচা আসাদুদ্দীন শেরকোহ মিসরে যে অভিযান চালান, তাতে তিনি প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন চাচার সঙ্গী হিসাবে। চাচার মৃত্যুর পর তিনি চাচার পদ গ্রহণ করেন অর্থাৎ ওবায়দী রাষ্ট্রের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রী হন। অতঃপর তিনি নিজ নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং জাযিরা অঞ্চলে ঐক্য সাধন করেন এবং জিহাদের ময়দানে আত্মনিয়োগ করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। হিজরী ৫৮৯ সনে তিনি দামেস্কে ইন্তিকাল করেন। তাঁর নিযুক্ত বিচারপতি কাজি ইবনে শাদাদ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন . খোদার কসম করে বলছি, কিছু লোকের কাছে আমি শুনে আসছিলাম যে, তারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে আগ্রহী, তাদের মতো ওরাও নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চায়। আমি নিজে এবং অপরের নিকট থেকে জানতে পেরেছি যে, ফিদিয়া গৃহীত হলে তিনি অবশ্যই নিজেকে ফিদিয়া দিতেন।11
ইবনু শাদাদ বলেন . সুলতান কোন সম্পদ আর সম্পত্তি রেখে যাননি। তিনি তাঁর আমির- কর্মকর্তা ইত্যাদি এমনকি দুশমনদেরকেও দান করতেন। কেবল মাত্র ৪৭ টি দিরহাম ছাড়া তিনি কোন স্বর্ণ- রৌপ্য রেখে যাননি। আর রেখে যান একটা মাত্র দীনার। তিনি সামান্য আহার করতেন, সামান্য বস্ত্র পরিধান করতেন এবং মামুলী যানবাহন ব্যবহার করতেন। তাঁর জন্য যা হালাল এবং যাতে তাঁর মন তুষ্ট হয়, এমন বস্ত্ত ছাড়া তিনি পরিধান করতেন না। তিনি যথারীতি জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত তিনি হাদিসও শ্রবণ করতেন, দুটি সারীর মধ্যস্থলে। অর্থাৎ জিহাদের ময়দানেও তিনি হাদিস শ্রবণ করতেন। আজে বাজে কথা থেকে তাঁর মজলিশ ছিল মুক্ত। তাঁর মজলিশে পাপীদের প্রতি কঠোরতা এবং মু’মিনদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করা হতো।12 পুত্র যাহেরকে তিনি হালবে নির্দেশ দেন যে, শিহাব সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করতে হবে। কারণ তিনি জানতে পারেন যে, শিহাব সোহরাওয়ার্দী দালালী শুরু করেছে এবং দীন থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী। কেউ দেখা করতে এলে তাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করার জন্য নিজে বেরিয়ে যেতেন। মানুষের বড় মর্যাদা দিতেন, অতি সম্মান করতেন। কখনো কখনো খাদেমের কাছে পানি চাইতেন; খাদেম কথা না শুনলেও তিনি তাদেরকে কিছুই বলতেন না। কাজি ফাজেল বলেন . তাঁর নিকট ফরিয়াদ পেশকালে ভিড়ের সময় তাঁর চাদর পদতলে পিষ্ট হতো। এতে তিনি মোটেই ক্ষুব্ধ হতেন না। একদিন প্রচন্ড বৃষ্টির সময় আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হই। বেশ প্যাঁক কাদার মধ্যে খচ্চর তার গায়ে পানি-কাদা ছিটায়, এমনকি তার সমস্ত কাপড়- চোপড় নষ্ট করলেও তিনি (কিছুই না বলে বরং) হাসছিলেন।13
তাঁর নিকট জ্ঞান আর জ্ঞানীদের স্থান
নূরুদ্দীনের শাসনামলে যে জ্ঞানের আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, সালাহউদ্দীনের শাসনামলেও তা অব্যাহত ছিল। সুলতান নিজে ওলামাদের নিকট গমন করতেন এবং তাদের দারসে উপস্থিত হতেন। হিজরী ৫৭২ সনে তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় গমন করেন এবং বার বার শায়খ আবু তাহের সালাফীর41 সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং হাদিস শ্রবণ করার দীর্ঘ সময় তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলেন। নূরুদ্দীনের শাসনামলে কাজি কামালুদ্দীন ছিলেন অন্যতম বড় আলেম ও উজির। সালাহউদ্দীন দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজিদেরকে স্ব স্ব পদে বহ রাখেন। অথচ কাজি কামালুদ্দীনের ধারণা ছিল, নূরুদ্দীনের শাসনামলের বিরোধকে কেন্দ্র করে সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁকে পদচ্যুত করবেন। হিজরী ৫৭৭ সনে সুলতান নবিজির হাদিস শ্রবণ করার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেন। এর ফলে আলেম - ওলামাদের সমাবেশ ঘটে। যে সব আলেম তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা দামেশকী হাম্বলী। তিনিই হচ্ছেন সেই আলেম , যিনি সুলতান সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিপ্লব করার জন্য মিশরের ওবায়দী শাসকদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করেছিলেন।42
তাঁদের অন্যতম ছিলেন শাফেয়ি মাজহাবের ফকীহ নাজমুদ্দীন খাবুশানী। ওবায়দী সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে ইনি সালাহউদ্দীনকে সাহস জোগান এবং তাদের পক্ষে খুতবা পাঠ বন্ধ করে দেন। সুলতান সালাহউদ্দীন একটা মাদ্রাসা স্থাপন করে সে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করেন।
ফকীহ এবং আমিরদের মধ্যে ফকীহ ঈসা আল- ছাকারীও ছিলেন। তিনি বীর- বাহাদুর এবং উদার সৈনিক। শায়খ আবুল কাসেম বারজীর নিকট ফিকাহের জ্ঞানলাভ করেন এবং আমির আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সুলতান সালাহউদ্দীনের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলতেন, যেভাবে অন্য কেউ কথা বলতে পারতোনা। সালাহউদ্দীন যখন আক্কা অবরোধ করে রাখেন, সে সময় তিনি ইন্তিকাল করেন।43 কোন আলেম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আগমন করলে তাঁকে বেশ মর্যাদা দান করতেন এবং তাঁকে তাঁর নিজের আর নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের জন্য উপঢৌকন না দিয়ে বিদায় দিতেন না।
আলেম সমাজ এবং আমীরদের সঙ্গে সংযোগ- সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া এমন মহান বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। কাজি ইবনে শাদাদ বলেন . তিনি প্রতি সোম এবং বৃহস্পতিবার বিচারের জন্য বসতেন। বিচারের এই খোলা মজলিসে ফকীহ এবং কাজিরা উপস্থিত থাকতেন। সফরে অবস্থান কালেও তিনি এই বিচার মজলিসের আয়োজন করতেন।44
আলে মাকদাসী নামে পরিচিত যে শ্রেণিটি দামেশকের সালেহিয়া অঞ্চলে বসবাস করতো, তাদের মধ্যে ছিলেন আবু ওমর মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে কুদামা এবং তাঁর ভাই হাফেজ আব্দুল গণী ও মামা শায়খ ইমাদ। যেসব মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সুলতান সালাহউদ্দীন বহির্গত হতেন, তাতে এরা অবশ্যই থাকতেন। বায়তুল মুকাদ্দাস, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল ইত্যাদি জয়কালে অভিযানে এরা উপস্থিত ছিলেন।45
তাঁর উজির আর আমির
বলা হয়ে থাকে যে, শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। শাসক সৎ হলে তিনি দ্বীনদার আর কল্যাণকামীদেরকে ভালোবাসবেন এবং ভালো আমির উজিরদের সংসর্গ দ্বারা আল্লাহ তাকে ধন্য করবেন। সুলতান সালাহউদ্দীনের ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি খাপ খায়। কাজি আব্দুর রহীম বায়সানীর সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন, যিনি ছিলেন তাঁর মন্ত্রী সভার উজির। সুস্থ চিন্তা আর সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী কাজি আব্দুর রহীম ছিলেন তাঁর নিকট বিরাট মর্যাদাবান। তাঁর মতামত সুলতান গ্রহণ করতেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর নিকট পরামর্শ চাইতেন। বিশিষ্ট লেখক ইমাদ ইসফাহানী তাঁর সম্পর্কে বলেন . সুলতান তাঁর কথা রাখতেন আর তিনিও মেনে চলতেন সুলতানের কথা। তাঁর মত অনুযায়ী সুলতান কোন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতেন। তাঁর লেখা ছিল সাহায্যের নিশ্চয়তা। তিনি ছিলেন বিশাল প্রজ্ঞার অধিকারী এবং তাঁর দুরদৃষ্টি কার্যকর করা হতো।46 তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি আক্কা অবরোধকালে সুলতানকে গুনাহের ভয় দেখিয়ে পত্র লিখেন এবং সতর্ক করে দেন কারো প্রতি সৈন্যদের জুলুম সম্পর্কে, যা হবে পরাজয়ের কারণ। তিনি বলেন . আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া তাঁকে সন্তুষ্ট করা যায় না এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ছাড়া কষ্ট- ক্লেশ দূর হয় না। যে কোন স্থানে পাপ কাজ করা হোকনা কেন, তা প্রকাশ পাবেই। আর যে কোন স্থানে অন্যায় করা হোক না কেন, তা ফাঁস হবেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের কর্তার হাতে পবিত্র বিজয়ের সূচনা করেছেন, যা আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রমাণ হবে। আমরা আল্লাহর নিকট তাঁর গজব থেকে পানাহ চাই, তা যেন তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ না হয়।47 জিহাদে নিষ্ঠাবান সৈন্যদের নেতৃত্ব দানের তাওফীক তাঁকে দেয়া হয়েছে। কখনো কখনো জিহাদী পরিমন্ডলের প্রভাব পড়তো সৈন্যদের উপর। তাঁর অন্যতম আমির ছিলেন ইজ্জুদ্দীন জর্দেক, আর তিনি ছিলেন নূরুদ্দীনের আযাদ করা ক্রীতদাস। তাঁর মধ্যে বিশ্বস্ততা আর বীরত্বের সমাবেশ ঘটেছিল।48 অপর জন ছিল সাইফুদ্দীন জাওনী। তিনিও ছিলেন বীর- বাহাদুর, যার মধ্যে দ্বীনদারী আর বন্দেগির সমাবেশ ঘটেছিল।49 আরো ছিলেন আবুল হীজা, ইবনুস সিমীন, ইবনুল মাশতুব, বাহাউদ্দীন কারাকুশ, যারা ছিলেন তাঁর সচিব ও আমির। এরা ছিলেন বীর-বাহাদুর, যারা কায়রো নগরীর প্রাচীর নির্মাণ করেন এবং পর্বত দুর্গ নির্মাণ করান। সালাহউদ্দীন তার হাতে এক্কা অঞ্চলের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। তিনি সেখানে থাকাকালে অবরোধের ঘটনা ঘটে এবং এ নিয়ে লোকেরা নানা কাহিনি রচনা করে, যা বিশুদ্ধ নয়।50
সালাহউদ্দীন কি ফিলিস্তিনের দাবি ত্যাগ করেছিলেন?
বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার পর ক্রুসেডারদের কুকুরের মতো কামড়া কামড়ি করা এবং তাদের এক্কা অধিকার করা সত্ত্বেও এবং সন্ধির জন্য সালাহউদ্দীন তিন বৎসর ব্যাকুলতার পরও তিনি ফিলিস্তিনের দাবি ত্যাগ করেননি। কারণ, ফিলিস্তিন তাঁর মালিকানাধীন ছিল না, বরং তা ছিল মুসলমানদের মালিকানাধীন। এবং ইংরেজ শাসকও তাঁর সঙ্গে চেষ্টা চালান; কিন্তু তিনি ফিলিস্তিনের কোন অংশ আল্লাহর দুশমনদের জন্য ছেড়ে দিতে কঠোরভাবে অস্বীকার করেন। আর মুসলমানদের অধিকার নিয়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করা সালাহউদ্দীনের মতো মহান ব্যক্তিত্বের স্বভাব হতে পারে না। ইংরেজ শাসক তাঁর কাছে লিখে . ইংরেজ আর মুসলমানরা ধ্বংস হয়েছে আর দেশের হয়েছে সর্বনাশ, জান আর মাল বিনষ্ট হয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের ইবাদতের স্থান; আমাদের একজন লোকও বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা তার দাবি ত্যাগ করব না। দেশতো আমাদের কাছে ফিরে আসবে; তা জর্দানকে বিচ্ছিন্ন করবে না। স্বভাবতই এটা হচ্ছে ইংরেজ শাসকের একটা কূট কৌশল, সম্ভাব্য পরিমাণে অথবা ন্যূনপক্ষে কিছু আদায় করার জন্য বিরাট কিছু দাবি করা- এটাই হচ্ছে ইংরেজদের কাজ।51
সালাহউদ্দীন তাকে জবাব দেন . বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের। তা আমাদের নবীদের বিচরণ স্থল। সুতরাং আমরা তার দাবি ত্যাগ করব এটা কল্পনাও করা যায় না। মুসলমানদের মধ্যে আমরা এমন কথা মুখে উচ্চারণও করতে পারি না। আর দেশ, মুলত . তাওতো আমাদেরই তৎকালে সেখানে যেসব মুসলমান ছিল, তাদের দুর্বলতার কারণে সাময়িকভাবে তোমরা তা দখল করে নিয়েছিলে।52 তখন ইংরেজ শাসক জবাব দেয় . আপনার নিকট আমি যা দাবি করছি, তা হচ্ছে এই যে, বায়তুল মুকাদ্দাস দুর্গে আমাদের বিশজন লোক থাকবে, আর নগরে যেসব খ্রিস্টান থাকবে, তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না।
জবাবে সুলতান বলেন . শুধু মাত্র জিয়ারত ছাড়া বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে তোমরা কোন কথাই বলতে পারবে না।53 সাবধান। বিগত রজনি কতইনা ভয়ার্ত ছিল। বর্তমান যুগে ইহুদিরা ফিলিস্তিন নিয়ে কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করছে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা তাদেরকে উসকানি দিচ্ছে। তারা সময়ে সঙ্গ দেয়, আবার সময়ে ধোঁকা দেয়, সুযোগ কাজে লাগানোই তাদের উদ্দেশ্য। তারা লাভ করতে চায় নতুন নতুন স্বার্থ। আর হাস্যকর শান্তির মোড়লরা শয়তানি অঙ্গীকারের অপেক্ষায় আছে। কারণ, মূলত . জিহাদ বা যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের নেই। যে কোন মূল্যে তারা শান্তি চায়। আর ইহুদিরা বিশেষভাবেই ভূমি চায়। রাশিয়ায় ইহুদিদের পক্ষ থেকে তাদের কাছে সাহায্য এসেছে।54
সুলতান ও সূর শহর
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর এ মর্মে সুলতান সালাহউদ্দীনকে অভিযুক্ত করেন যে, সূর নগরীর ব্যাপারে তিনি বাড়াবাড়ি করেছেন। কারণ, যে কোন অবরোধ বা বিজয় শেষে তিনি বন্দীদেরকে মুক্ত করে দিতেন এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দান করতেন। ফলে এরা সকলেই সূর নগরীতে সমবেত হতো, পরবর্তীকালে যা জয় করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর তিনিই আবার অভিযোগ করেন যে, সূর নগরীর সামনে তিনি দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হননি। এটা তাঁর অভ্যাস ছিল যে, কোন জনপদ তাঁর হস্তগত হলে সে জনপদ সম্পর্কে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন এবং তা ছেড়ে চলে যেতেন।55 তার ব্যাপারে সালাহউদ্দীন ছাড়া কারো অপরাধ ছিল না।56
এটা কি ঠিক যে, সালাহউদ্দীন সূর নগরীর প্রসঙ্গটা শিথিল করে দিয়েছিলেন এবং খ্রিস্টানদেরকে সেখানে সমবেত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন? এখানে আমরা এ জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমত . উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সালাহউদ্দীন সম্পর্কে ইবনুল আসীর এক ধরনের অন্যায় করেছেন। আর তার কারণ এই যে, জঙ্গি পরিবারের প্রতি ইবনুল আসীরের দুর্বলতা রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে বেশ সম্মান করেন। এবং তিনি মনে করেন যে, সালাহউদ্দীন জঙ্গি পরিবারের নিকট থেকে সিরিয়া ও মিশরের রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। এ কারণে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি সুযোগ পেলেই সালাহউদ্দীনের প্রতি টিপ্পনি কাটেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বৈরুতে ও জু-বাইল জয় করার পর সালাহউদ্দীনের নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আসফান ও বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করা, কারণ দুটোই ছিল মিশরের পথে। বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার মধ্যে রয়েছে বিরাট নাম ও খ্যাতি।57
নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে ইবনুল আসীর উল্লেখ করেন যে, তিনি সালাহউদ্দীন কে দেখতে পান তাঁর অতিথি মুইজ্জুদ্দীন কায়সার শাহ ইবনে কজ আরসালানকে বিদায় জানাতে (যিনি ছিলেন আনাযুল অঞ্চলে সেলজুক রাজত্বের অন্যতম শাসক) । সালাহউদ্দীন যখন আরোহণ করতে উদ্যত হন, মুইজ্জুদ্দীন বাহু ধরে তাকে আরোহণ করান। জঙ্গি পরিবার থেকে আলাউদ্দীন ইবনে ইজ্জুদ্দীন তার পোশাক ছিনিয়ে নেন। বর্ণনাকারী মন্তব্য করেন . হে আইউব তনয়! কী করছ তুমি? তুমি কি মৃত্যু বরণ করছ? সেলজুক বাদশাহ এবং ইবনে আতাবক জঙ্গি তোমাকে আরোহণ করাচ্ছে? 58 তাই ইবনুল আসীর এবং তাঁর বর্ণনাকারী উভয়ে বাড়াবাড়ি করে যাতে বনী আইউবের একজন লোক এই মর্যাদায় পুঁছতে পারে।
আরো একটা কথা। আমরা লক্ষ্য করি না যে, ইবনুল আসীর জালিম- ফাসিক বাদশাহদের নিন্দা করেন, সমালোচনা করেন। তিনি তাদের দোষত্রুটির উল্লেখ করেন না, বিশেষ করে মূসেল এবং সেলজুক শাসকদের।
দ্বিতীয়ত . সালাহউদ্দীন সম্পর্কে একথা বলাও সঠিক নয় যে, সকল বন্দীকেই তিনি মুক্ত করে দিতেন। কারণ, তিনি হারবী তথা যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছে, তাদেরকে বিশেষ করে ফিদাবিয়া আর ইসবরতিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করেন। কিন্তু তিনি যখন কোন নগর অবরোধ করেন এবং সে নগরের অধিবাসীরা তার কাছে নিরাপত্তা দাবি করে এই শর্তে যে, তারা দুর্গ জয়ে তাঁকে সাহায্য করবে, তাদেরকে তিনি নিরাপত্তা দান করেন এবং অঙ্গীকার পূরণ করেন। এ সম্পর্কে ইবনুল আসীর নিজেই বলেন . তিনি ছিলেন অতি ক্ষমাপরায়ণ, ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করতেন এবং উদারতা দেখাতেন।59 এটাই ছিল সালাহউদ্দীনের প্রবৃত্তি আর প্রকৃতি। তিনি ক্ষমা আর উদারতাকে ভালোবাসতেন। কোন শহর আর নগর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পদানত হলে এটাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করতেন। অবশ্য তিনি অতিষ্ঠ আর বিরক্ত হলে কোন শহর তার সম্মুখে দাঁড়ালে তিনি তা দেখে নিতেন একথা সঠিক নয়। তিনি এক্কা শহর অবরোধ করেন এবং এ অবরোধ চলে দীর্ঘ ৩৬ মাস, এরপরও তিনি বিরক্ত হননি এবং অবরোধ তুলেও নেননি। অবশ্য সূর নগর তিনি ত্যাগ করেন এটা এ জন্য যে, তিনি দেখতে পান একটা প্রতিষ্ঠিত দুর্গ। এবং অবরোধ দীর্ঘ করায় কোন ফল দেখা দেবে বলে তিনি মনে করেন না, বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে যেখানে তিনি নিজেও আছেন।60
তৃতীয়ত . নিছক সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইবনুল আসীর সমালোচনা করলে সে ব্যাপারে কিছু বলার নেই। সকল দৃষ্টিকোণের জন্যই রয়েছে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। যেমন তিনি বলেন . সূর ফাঁকা ছিল, কিন্তু সালাহউদ্দীন তা অধিকার করতে ভয় পান এবং তা রক্ষা করার শক্তি তার ছিল না। অন্যথায় পূর্বে যদি তা অধিকার করা শুরু করতেন তাহলে বিনা কষ্টে তা অধিকার করতে পারতেন। তার এ মন্তব্য সঠিক। যদিও শুরুতে তা অবরোধ করার ক্ষেত্রে সালাহউদ্দীন ছিলেন মুজতাহিদ।
এ দু’জন মুসলিম শাসকের কিছু কীর্তি উপস্থাপন করার পর আমাদের জন্য এখানে একথা উল্লেখ করা অপরিহার্য যে, তাঁরা যা কিছু করেছেন, অনেক বিবেচনায় তা ইসলাম সংস্কার বা নবায়ন বলে গণ্য। তাঁদের পূর্বে এবং পরে কোন কোন আলেম তাজদীদ বা নবায়নের কাজ করেছেন বটে, কিন্তু তাদের কাজকে পূর্ণাঙ্গ তাজদীদ বলা যায় না। সাধারণত: অবস্থা যাই ছিল, তাই রয়েছে। তবে একজন আলেম ব্যক্তি আক্বীদা পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা চালান এবং মানুষকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন।
আমরা এখানে তাজদীদের কয়েকটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো:
এক . জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা। শাসক কর্তৃপক্ষ উজির, নেতা এবং গণমানুষের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা দীর্ঘদিন থেকে পরিত্যক্ত হয়েছে। ফলে উম্মত মরে গেছে এবং তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে ইসলামের দুশমন বাতেনী সম্প্রদায় মুসলিম উম্মার উপর চেপে বসেছে ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে। এই সুযোগে রোম তাদের উপর হামলা পরিচালনা শুরু করে দেয়। এরপর আগমন ঘটে ক্রুসেডারদের। তারা মুসলমানদের ভূমি জবর দখল করে নেয়। আমরা নূরুদ্দীন এবং সালাহউদ্দীনের জিহাদী স্পৃহা প্রত্যক্ষ করি, প্রত্যক্ষ করি জিহাদের জন্য তাদের প্রস্ত্ততি, অনুশীলন, সামরিক অস্ত্রের মহড়া এবং দুর্গ আর প্রাচীর নির্মাণ। তাঁরা জনগণকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন, ওলামা আর ওয়ায়েজ শ্রেণি তাদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। এটা জানা কথা যে, জিহাদ উম্মতকে জাগ্রত করে এবং শক্তি সঞ্চয় করে। অবমাননার পর জিহাদ সম্মান আর মর্যাদায় ভূষিত করে। এর প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, বায়তুল মুকাদ্দাস এবং গোটা ফিলিস্তিন অঞ্চল অধিকার করার পর সালাহউদ্দীন দীর্ঘ ৩৬ মস এক্কা শহর অবরোধ করে রাখেন। এ সময় তিনি তাঁবুতে অবস্থান করেন। এক দন্ড শান্তি ছিল না। দুশমনের প্রতিরোধে তিনি প্রতিদিন অশ্বারোহন করে বের হতেন।
দুই . সুবিচারের ভাবধারা প্রচার। ইতিপূর্বে আমির-উজিররা জনগণের সম্পদ আর সম্পত্তি অন্যায়ভাবে করায়াত্ত করতো। শাসক গোষ্ঠী প্রচার করতো যে, এতে জনগণের সন্তুষ্টি আছে। এমনকি তাদের প্রতি রয়েছে জনগণের আনুগত্য। পক্ষান্তরে আমরা দেখতে পাই যে, নুরুদ্দীন মাহমুদের শাসনামলে সেনা প্রধান আসাদুদ্দীন শেরকোহ তার সমস্ত সম্পদ ত্যাগ করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এবং আদালতে তিনি নুরুদ্দীনের সম্মুখে বসতেও প্রস্ত্তত হন।
তিন . রাষ্ট্রের সম্পদ ভোগ না করা। এ বিষয়টা অতীতের সব রাষ্ট্র আর সরকার থেকে ভিন্ন। নূরুদ্দীনের নিকট কোন উপহার- উপঢৌকন এলে তিনি তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রেরণ করতেন। তাঁর স্ত্রী খরচ দাবি করলে তিনি তাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছু না দিয়ে হেমসের কয়েকটি দোকান দেখিয়ে দেন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ইন্তিকালের সময় এক দীনার এবং ৪০ দিরহাম রেখে যান। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং উমর ইবনে আব্দুল আজীজের পর এমন কথা আর শোনা যায়নি।
চার . সুশাসন প্রতিষ্ঠা। ইতিপূর্বের শাসকরা কোন কোন বিষয় মীমাংসার জন্য রাজনৈতিক গুরুদের নিকট প্রেরণ করতেন। শরিয়তের বিধান অনুসৃত হতো না এবং কিছু লোক বিচারের জন্য কাজির দরবারে গমন না করে গমন করতো পুলিশের নিকট এবং তারা নিজেদের আইন অনুযায়ী ফয়লা সা করতো। ঐতিহাসিক আবু শামা বলেন . নূরুদ্দীন যখন মুসেল অধিকার করেন তখন তিনি পুলিশ প্রধানকে নির্দেশ দেন শরিয়তের বিধান ছাড়া যেন কোন মীমাংসা না করা হয়। কাজির নির্দেশ যেন লঙ্ঘন না করা হয়। অতঃপর এই ঐতিহাসিক কাজি ইউসুফ ইবনে রাফে- এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, নূরুদ্দীন শরিয়ত বিরোধী বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন না।61 তিনি আরো বলেন . তিনি স্বীয় শাসনাধীন কোন অঞ্চলে ট্যাক্স, কাস্টম উিউটি এবং ও-শর আরোপ করেননি। বরং তিনি এ সব কর রহিত করেন।62 অর্থাৎ তিনি মানুষের উপর থেকে জুলুম প্রত্যাহার করেন এবং আল্লাহর হুকুমের বিরোধী আইন বাতিল করেন।
পাঁচ . আলেম সমাজের মর্যাদা। তাঁরা আলেমদেরকে ভালোবাসতেন, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং তাদেরকে যোগ্য স্থান আর মর্যাদা দান করতেন। তাঁরা মাদ্রাসা চালু করেন, জ্ঞানের চর্চা করেন এবং জ্ঞানের আসরে তাঁরা নিজেরা যোগদান করতেন। বরং সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁর দু’সন্তান আলী এবং ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় হাফেজ সাফীর আসরে যোগদান করতেন। আলেম কামালুদ্দীন শহরজুরী মন্ত্রিত্বের মর্যাদায় উন্নীত হন। সুলতান সালাহউদ্দীন উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট আলেম ও ওয়ায়েজ ইবনে নাজা হাম্বলী। আর তাঁর উজির কাজি ফাযেল ছিলেন চীপ সেক্রেটারী। তিনি ছিলেন জ্ঞান প্রেমিক। আলেম সমাজকে তিনি ভালোবাসতেন।
আমরা এখানে তাজদীদের কয়েকটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো:
এক . জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা। শাসক কর্তৃপক্ষ উজির, নেতা এবং গণমানুষের পক্ষ থেকে তা বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা দীর্ঘদিন থেকে পরিত্যক্ত হয়েছে। ফলে উম্মত মরে গেছে এবং তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে ইসলামের দুশমন বাতেনী সম্প্রদায় মুসলিম উম্মার উপর চেপে বসেছে ভেতর থেকে এবং বাইরে থেকে। এই সুযোগে রোম তাদের উপর হামলা পরিচালনা শুরু করে দেয়। এরপর আগমন ঘটে ক্রুসেডারদের। তারা মুসলমানদের ভূমি জবর দখল করে নেয়। আমরা নূরুদ্দীন এবং সালাহউদ্দীনের জিহাদী স্পৃহা প্রত্যক্ষ করি, প্রত্যক্ষ করি জিহাদের জন্য তাদের প্রস্ত্ততি, অনুশীলন, সামরিক অস্ত্রের মহড়া এবং দুর্গ আর প্রাচীর নির্মাণ। তাঁরা জনগণকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন, ওলামা আর ওয়ায়েজ শ্রেণি তাদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হন। এটা জানা কথা যে, জিহাদ উম্মতকে জাগ্রত করে এবং শক্তি সঞ্চয় করে। অবমাননার পর জিহাদ সম্মান আর মর্যাদায় ভূষিত করে। এর প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, বায়তুল মুকাদ্দাস এবং গোটা ফিলিস্তিন অঞ্চল অধিকার করার পর সালাহউদ্দীন দীর্ঘ ৩৬ মস এক্কা শহর অবরোধ করে রাখেন। এ সময় তিনি তাঁবুতে অবস্থান করেন। এক দন্ড শান্তি ছিল না। দুশমনের প্রতিরোধে তিনি প্রতিদিন অশ্বারোহন করে বের হতেন।
দুই . সুবিচারের ভাবধারা প্রচার। ইতিপূর্বে আমির-উজিররা জনগণের সম্পদ আর সম্পত্তি অন্যায়ভাবে করায়াত্ত করতো। শাসক গোষ্ঠী প্রচার করতো যে, এতে জনগণের সন্তুষ্টি আছে। এমনকি তাদের প্রতি রয়েছে জনগণের আনুগত্য। পক্ষান্তরে আমরা দেখতে পাই যে, নুরুদ্দীন মাহমুদের শাসনামলে সেনা প্রধান আসাদুদ্দীন শেরকোহ তার সমস্ত সম্পদ ত্যাগ করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন এবং আদালতে তিনি নুরুদ্দীনের সম্মুখে বসতেও প্রস্ত্তত হন।
তিন . রাষ্ট্রের সম্পদ ভোগ না করা। এ বিষয়টা অতীতের সব রাষ্ট্র আর সরকার থেকে ভিন্ন। নূরুদ্দীনের নিকট কোন উপহার- উপঢৌকন এলে তিনি তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রেরণ করতেন। তাঁর স্ত্রী খরচ দাবি করলে তিনি তাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছু না দিয়ে হেমসের কয়েকটি দোকান দেখিয়ে দেন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ইন্তিকালের সময় এক দীনার এবং ৪০ দিরহাম রেখে যান। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং উমর ইবনে আব্দুল আজীজের পর এমন কথা আর শোনা যায়নি।
চার . সুশাসন প্রতিষ্ঠা। ইতিপূর্বের শাসকরা কোন কোন বিষয় মীমাংসার জন্য রাজনৈতিক গুরুদের নিকট প্রেরণ করতেন। শরিয়তের বিধান অনুসৃত হতো না এবং কিছু লোক বিচারের জন্য কাজির দরবারে গমন না করে গমন করতো পুলিশের নিকট এবং তারা নিজেদের আইন অনুযায়ী ফয়লা সা করতো। ঐতিহাসিক আবু শামা বলেন . নূরুদ্দীন যখন মুসেল অধিকার করেন তখন তিনি পুলিশ প্রধানকে নির্দেশ দেন শরিয়তের বিধান ছাড়া যেন কোন মীমাংসা না করা হয়। কাজির নির্দেশ যেন লঙ্ঘন না করা হয়। অতঃপর এই ঐতিহাসিক কাজি ইউসুফ ইবনে রাফে- এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, নূরুদ্দীন শরিয়ত বিরোধী বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন না।61 তিনি আরো বলেন . তিনি স্বীয় শাসনাধীন কোন অঞ্চলে ট্যাক্স, কাস্টম উিউটি এবং ও-শর আরোপ করেননি। বরং তিনি এ সব কর রহিত করেন।62 অর্থাৎ তিনি মানুষের উপর থেকে জুলুম প্রত্যাহার করেন এবং আল্লাহর হুকুমের বিরোধী আইন বাতিল করেন।
পাঁচ . আলেম সমাজের মর্যাদা। তাঁরা আলেমদেরকে ভালোবাসতেন, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন এবং তাদেরকে যোগ্য স্থান আর মর্যাদা দান করতেন। তাঁরা মাদ্রাসা চালু করেন, জ্ঞানের চর্চা করেন এবং জ্ঞানের আসরে তাঁরা নিজেরা যোগদান করতেন। বরং সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁর দু’সন্তান আলী এবং ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় হাফেজ সাফীর আসরে যোগদান করতেন। আলেম কামালুদ্দীন শহরজুরী মন্ত্রিত্বের মর্যাদায় উন্নীত হন। সুলতান সালাহউদ্দীন উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট আলেম ও ওয়ায়েজ ইবনে নাজা হাম্বলী। আর তাঁর উজির কাজি ফাযেল ছিলেন চীপ সেক্রেটারী। তিনি ছিলেন জ্ঞান প্রেমিক। আলেম সমাজকে তিনি ভালোবাসতেন।
সুলতান সালাহউদ্দীন ছিলেন এক বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। তাঁর মধ্যে অনেক মহৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটে। সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদ জিহাদের যে পরিমন্ডল গড়ে তোলেন, তাতে জ্ঞানের মর্যাদা ছিল। আলেম সমাজকে উপযুক্ত স্থান দেয়া হতো এবং সুবিচারের প্রসার ঘটানো হতো। সালাহউদ্দীন মানস আর চরিত্র গঠনে এসব গুণাবলি সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। আমির আর উজির পর্যন্ত এসব গুণ বিস্তার লাভ করে। তবে যে প্রধান জটিল সমস্যাটি অবশিষ্ট ছিল, তা হলো এই যে, তাঁদের সংস্কার কোন শক্ত ভিত্তি পায়নি। তা রাষ্ট্র- সরকারের গণ-ধারায় পরিণত হয়নি। শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হলে নেতা বা প্রতিষ্ঠাতার অবর্তমানে তা বন্ধ হতো না। সালাহউদ্দীনের ইন্তিকালের পর তাঁর তিন পুত্র মিশর, সিরিয়া এবং হালব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। শাসন পদ্ধতিতে পূর্বাবস্থা ফিরে আসে। ভাইদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়, যা ছিল এহেন অবস্থায় স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যদি সুদৃঢ় ভিত্তি গড়ে উঠতো, যথা খেলাফত ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠতো, তাহলে নেতা বা প্রতিষ্ঠাতার অবর্তমানেও রাষ্ট্র বিভক্ত ও দুর্বল হতো না। কারণ, ব্যক্তি না থাকলেও শক্ত ভিততো বর্তমানে রয়েছে। প্রয়োজনীয় শর্তানুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তিকে যোগ্য পদে বাছাই করে নেয়া যায়।63 ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর বলেন . পিতার মৃত্যুর পর সালাহউদ্দীন পুত্র আফয ব্যবস্থাপনায় বিকৃতি সাধন করে। পিতার আমিরদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়, দূরের লোকজনকে নিকটে নিয়ে আসে এবং খেলা ধুলায় মত্ত হয়ে পড়ে।64 সালাহউদ্দীনের সন্তানদের পর ক্ষমতায় আসে তাদের পিতৃব্য আদিল। আদিলের সন্তানরা, যারা ছিল আইয়ূবী রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী, তারা কিছুটা হলেও ক্রুসেডারদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। আদিলের পুত্র ঈসা ক্রুসেডারদের সঙ্গে জিহাদ করেন। তিনি নিজে আলেম ছিলেন এবং আলেমদেরকে ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন . আমি তাহাবী আকীদায় বিশ্বাসী। দিময়াতের খ্রিস্টানদের সঙ্গে যুদ্ধে ভাই কামেলকে সহায়তা করে তিনি বলেন . দিময়াতের ঘটনা আমি আল্লাহর কাছে জমা রাখছি এবং আশা করি, তা দ্বারা আল্লাহ আমার প্রতি দয়া করবেন।65 কিন্তু ক্রুসেডাররা পুনরায় একত্র হয়ে হামলা চায় এবং সালাহউদ্দীন তাদের নিকট থেকে যা কিছু অধিকার করে নিয়েছিলেন, তারা সেসব ফেরত দেয়ার দাবি জানায়। ফলে তাদের এবং আদিলের পুত্রদের মধ্যে এই মর্মে সমঝোতা হয় যে, তারা কেবল বায়তুল মুকাদ্দাস দখলে রাখবে। হিজরী ৬৩৮ সনে আদিলের পুত্র সালেহ ইসমাইল ছায়দার খ্রিস্টান শাসনকর্তার নিকট শাকীক দুর্গ অর্পণ করেন। শায়খ ইজ্জ ইবনে আব্দুস সালাম এবং ইবনুল হাজিব এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালে তিনি তাদেরকে বন্দী করে পরে মুক্তি দেন। মুক্তি পেয়ে ইবনে আব্দুস সালাম মিশর গমন করেন।66 তখন আত্মকেন্দ্রিক হিংসা বিদ্বেষ দেখা দেয়। এই ইসমাইল আর ছালেহ আইউব ইবনে কামেল এর বিরোধকালে ছালেহ আইউব দামেশক দুর্গের ব্যাপারে খাওয়ারজেমীদের সঙ্গে পত্র মারফত যোগাযোগ করেন। রাজ প্রসাদ আর সুখ- সম্ভোগের মধ্যে যেসব সন্তানরা প্রতিপালিত হয়েছে, তারা যখন মোকাবিলা করতে অক্ষম হলো, তখন মামলুক বা দাস বংশ তাদের নিকট থেকে ক্ষমতা অধিকার করে নেয় এবং এরাই ক্রুসেডার আর তাতারদের ধ্বংস লীলা বন্ধ করে।
এভাবে আইয়ুবী রাষ্ট্রের সমাপ্তি ঘটে এবং মামলুকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও জিহাদী এবং সংস্কার কার্যের প্রভাব তখনও অব্যাহত ছিল। মামলুকরা (আইনে জুতে) আমির (কাতায)- এর নেতৃত্বে তাতারদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। জাহির বায়বার্স এর শাসনামলে সিরিয়া এবং মিসরে অনেক শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটে। হিজরী ৬৬৩ সনে শাসক জাহির কায়সারিয়া এবং আরসূফ অধিকার করে তথাকার সমস্ত খ্রিস্টানকে হত্যা করেন। অতঃপর দ্বিতীয় দফা ছকদ জয় করত: ইয়াফা এবং এন্তাফিয়া অধিকার করেন। ৬৬৯ হিজরী সনে এক্কা পুনরুদ্ধার করে নেয়। এ সম্পর্কে ইবনে কাসীর বলেন . ইসলাম এবং মুসলমানদের কল্যাণে তাঁর রয়েছে সদুদ্দেশ্য। তিনি নগর আর দুর্গ জয় করেন এবং ইসমাঈলীদের নিকট একটা দুর্গও ছাড়েননি। তিনি ছিলেন বীর-বাহাদুর এবং অতি সাহসী পুরুষ। রোম আর মুঘলদের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করেন, যুগ যুগ ধরে যার কথা শোনা যায়নি। পোশাক-আশাক এবং আহার-বিহারে তিনি ছিলেন মধ্যপন্থী। এ রকম ছিল তাঁর সৈন্যও। তিনি মদ্য পান রহিত করেন এবং ফাসেক- পাপাচারীদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। হিজরী ৬৭৬ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।67 কিন্তু ক্রুসেডারদের চূড়ান্ত প্রস্থান সম্পন্ন হয় আশরাফ ইবনে কারাউনের শাসনামলে হিজরী ৬৯০ সনে, যখন সূর এবং সায়দা আত্মসমর্পণ করে।
মুসলমানরা মামলুকদেরকে গ্রহণ করে নেয়। কারণ, তারা ছিল বীরপুরুষ। তাদের ছিল পর্যাপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ। ফলে তারা সুযোগ সন্ধানী দুশমনদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করেন। কিন্তু তারা জনগণকে বৈজ্ঞানিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গড়ে তোলেনি। যেন তাদের আশঙ্কা ছিল মুসলমানদেরকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলা হবে। ফলে তারা পদক্ষেপ নেয় ধীর মন্থর গতিতে। এসব মামলুকদের স্পষ্ট কোন রাজনৈতিক নীতিমালা ছিল না, যা তাদের রাজত্বকে স্থায়ী করতে পারে এবং তারা সাংস্কৃতিক দিক থেকেও চিন্তা করতে পারে। এভাবে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ত্রুটির কারণে এবং তা হচ্ছে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ না করা- সংস্কার কার্য অব্যাহত থাকতে পারেনি। এ ছাড়া ওলামাদের জন্য ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করাও ছিল অন্যতম করণ।
সুরা ইনস্টিটিউটের অনুপস্থিতি ইবনে খলদুনের মতো ঐতিহাসিককে আইন বিধিবদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। তিনি এই আইনকে অপরিহার্য মনে করেন। আর তা এই যে, কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাই তিন পুরুষ বা তিন শতাব্দীর বেশি কাল টিকে থাকতে পারে না। কারণ, তৃতীয় বা চতুর্থ পুরুষ অবশ্যই আইন রহিত করবে। ফলে রাষ্ট্রের পতনের সূচনা হবে। কোন রাষ্ট্র যদি এর চেয়ে বেশি সময় টিকে থাকে তবে তা মৃত্যুর টিকে থাকা। প্রথম দফায় শক্তির কারণে তার প্রাণ এই যায় আর এই আসে দশা। এ ধরনের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই ইবনে খালদূনের দর্শন খাপ খায়। অবশ্য রাষ্ট্র যদি শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যথা পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া, স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ এবং একাডেমিক ইনস্টিটিউশন ইত্যাদি, তখন অবস্থা ভিন্ন হতে পারে।
খেলাফতে রাশেদার রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরামর্শ ভিত্তিক ছিল, কিন্তু তা সুসংবাদ এবং সুস্পষ্ট বিধান ভিত্তিক ছিল না। কারণ, তৎকালে বিষয় ছিল জটিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় পরবর্তীকালে, যখন শুরা বিধিবদ্ধ হয়নি এবং সঠিক রূপে তার অনুশীলন হয়নি।
অন্য একটা প্রসঙ্গ, আর তা হচ্ছে ওলামাদের পক্ষ থেকে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দেয়া, যার ফলে কোন কোন শাসক তাদের সামনে দেখা দেয়া লেনদেন এবং রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার কোন সমাধানই খুঁজে পান না। কোন কোন সময় কেউ আশ্রয় নেয় ভবিষ্যৎ বক্তা বা এমন কিছুর নিকট, তারা যাকে বলে রাজনীতি। অথচ মুসলিম উম্মাহ মুজতাহিদমুক্ত থাকতেই পারে না। তাদের মধ্যে নিঃশর্ত ইজতিহাদের ক্ষমতা থাকতে হবে, যারা যে কোন সমস্যায় সঠিক শরিয়তের বিধান দিতে সক্ষম । এ দুটি হচ্ছে জিহাদ অব্যাহত না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ এবং আলোক ধন্য যুগের পর মুসলিম মিল্লাতের দুর্বলতা।
শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য, অনেক ক্ষেত্রে সূচনা হয় সংশয়,
কিন্তু নির্গমন দ্বারা প্রতিভাত হয় বিশ্বাস
কঠোর ও কট্টর দুশমনদের সম্মুখে অথবা অপেক্ষমাণ সংশয়বাদীদের মুখে আল্লাহর কিতাবে গচ্ছিত রাখা রীতির চেয়ে বেশি সত্য রীতি আর কিছুই নেই। .
وَالعَاقِبَةُ لِلمُتَّقينَ
‘শুভ পরিণাম নেককার মুত্তাকীদের জন্য।’
নবী ঈসা আলাইহিস সালামের জবানীতে বর্ণিত আছে যে, আমরা কীভাবে মিথ্যাবাদীকে চিনবো? তাঁকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : ফলাফল থেকেই তুমি তাদেরকে চিনতে পারবে। ব্যাপারটা যখন মানুষের নিকট তালগোল পাকিয়ে যায় এবং সত্য-মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা থাকে না, তখন তাদেরকে বলা হবে : তোমরা ফলাফলের অপেক্ষা করো, কে সত্যপন্থী, আর কে মিথ্যাপন্থী, তোমরা নিজেরাই তা প্রত্যক্ষ করতে পারবে .
فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ ﴿১৭﴾ ( الرعد : ১৭)
‘যা আবর্জনা তা ফেলে দেয়া হয়; আর যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে থেকে যায়। আল্লাহ এভাবে উপমা দিয়ে থাকেন।’ (সূরা রা’দ: ১৭)
সুতরাং শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য- এটা আল্লাহর চিরন্তন রীতি, জাতি- গোষ্ঠীর পরিণতির ক্ষেত্রে, যারা সরে দাঁড়ায় তাদের পালন কর্তার বিধান আর প্রকৃতির নিয়ম থেকে। সত্য মিথ্যার সংঘাতে আল্লাহর নীতি এই যে, সত্য উপরে থাকবে আর মিথ্যা থাকবে নীচে। সুতরাং যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে প্রতিষ্ঠিত- প্রমাণিত সত্য বস্ত্ত সন্ধান করে, যা স্থাপত্য তত্ত্বেরও দাবি, তখন প্রকৃতির রীতি তাদের সহায়তা- পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।68
ইতিহাস পর্যালোচনা এবং মানুষের জীবনধারা পর্যালোচনা এ নীতির প্রতি সমর্থন জানায়। আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, মিথ্যা যখনই স্ফীত হয়ে দম্ভ প্রকাশ করে, তখন আল্লাহর হুকুমে কিছু কাল পরে হলেও সত্য তার উপর জয়ী হবে। মিথ্যা কয়েকটা চক্কর কেটে খড় কুটের মতো উড়ে যায়। আর যা কল্যাণকর, তা-ই দীর্ঘস্থায়ী হয়। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র আর সভ্যতা- সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য। অতীতের এমনটি না ঘটে থাকলে ভবিষ্যতে অবশ্যই ঘটবে।
وَإِنْ مَا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِي نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَعَلَيْنَا الْحِسَابُ ﴿الرعد :৪০﴾
‘আমরা তাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাই, তার কিছু যদি তোমাকে দেখাই অথবা যদি ইতিপূর্বেই তোমার মৃত্যু ঘটাই- তোমার কর্তব্যতো কেবল প্রচার করা আর হিসাব- নিকাশতো আমাদের কাজ।’
(সূরা রা’দ : ৪০)
আর দুনিয়াতে এটা সংঘটিত না হলে আখিরাতে অবশ্যই ঘটবে:
وَسَيَعْلَمُ الْكُفَّارُ لِمَنْ عُقْبَى الدَّارِ ﴿الرعد : ৪২﴾
‘এবং কাফিররা অবিলম্বে জানতে পারবে যে, শুভ পরিণাম কাদের জন্য।’ (সূরা রা’দ: ৪২)
وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ ﴿ الشعراء : ২২৭﴾
‘জালিমরা শীঘ্র জানতে পারবে কোথায় তাদের গন্তব্যস্থল’ (সূরা শু’আরা . ২২৭)
وَقَالَتِ الْيَهُودُ لَيْسَتِ النَّصَارَى عَلَى شَيْءٍ وَقَالَتِ النَّصَارَى لَيْسَتِ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ﴿البقرة : ১১৩﴾
‘ইহুদিরা বলে, খ্রিস্টানদের কোন ভিত্তি নেই এবং খ্রিস্টানরা বলে- ইহুদিদের কোন ভিত্তি নেই; অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবে যারা কিছুই জানে না, তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ সে বিষয়ে মীমাংসা করবেন (সূরা আল- বাকারা . ১১৩)।
কতো তাগুতের পতন হয়েছে, কতো জালিম রাষ্ট্র বিলীন হয়ে গেছে, যেন কখনো তা ছিলই না। ইসলামের দুশমনরা ভেতর এবং বাইরে থেকে কতো চেষ্টা, কতো ষড়যন্ত্রইনা করেছে। পরিণতিতে ইসলামই টিকে আছে। টিকে থাকবে। বাতেনী সম্প্রদায়ের পক্ষে কতো বিপ্লব সাধিত হয়েছে। খোররামিয়া, বাবকিয়া, জঙ্গি আর ফাতেমীদের নামে; অতঃপর আহলে সুন্নাহর অথৈ সমুদ্র তলে তা লীন হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন .
كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ ( المائدة : ৬৪)
‘তারা যতবার যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত করে, ততবার আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন।’ (সূরা মায়িদা: ৬৪)
তাতার আর ক্রুসেডারদের আগমন ঘটে। বেশ দীর্ঘ কাল তাদের প্রতাপ চলে। অতঃপর সব কিছু তার মূলের দিকে ফিরে যায়। বাহ্যত: প্রকাশ পায় যে, রাফেযী আর বাতেনী সম্প্রদায় হিজরী চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে মুসলিম বিশ্বের উপর জেঁকে বসে। দু’শ বৎসর এ ধারা চলে। অতঃপর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে পরিস্থিতির এবং মানুষ ফিরে আসে সুন্নাহর দিকে।
সম্প্রতিকালে কমিউনিস্টরা ধারণা করে যে, তারাই ইতিহাস আর মানব সমাজ অনুধাবনের ক্ষেত্রে কেবল পূর্ণাঙ্গ দর্শনের অধিকারী। একজন মানুষের আয়ুষ্কালেরও কম সময়ের মধ্যে কমিউনিজম এমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেন তা বিগত কালের বিষয়।
আধুনিক যুগের তাগুত, যারা মুসলিম দেশের বিপুল অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফিরাউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সীমা লঙ্ঘন করে। অবশেষে যখন সময় এসে যায় তখন কেউ তাদের উপর দয়া করে না, জনপদ আর জনপদের বাসিন্দারা তাদের থেকে মুক্তি পায়।
শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য- এ মূলনীতিই কি মানদন্ড নয়?
ব্যক্তিগত পর্যায় সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বলেন . আমাদের আর বেদআত পন্থীদের মধ্যে পার্থক্যের মাপকাঠি হচ্ছে জানাজা। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চান যে, যে আলেম সুন্নাহর অনুসারী, জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করবে, বড় মর্যাদাবান মনে করবে। আল্লাহ সৃষ্টি লোকের অন্তরে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন। ফলে লোকেরা তার জানাজায় অংশ নেবে। পক্ষান্তরে যারা বেদআত পন্থী, তাদের গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা আর জালিম সরকারের নিকট সহায়তা কামনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা জনগণের ভালোবাসার পাত্র হতে পারে না। জনগণ তাদের মধ্যে কোন আকর্ষণ খুঁজে পায় না। প্রাচীন মু’তাযিলা পন্থীদের মধ্যে আজ কি কেউ আহমদ ইবনে আবু দাউদ এবং নায্যাম আর আল্লাফের নাম মুখে নেয়? অথবা কেউ কি চরমপন্থী কালাম শাস্ত্রবিদ বা চরমপন্থী সুফিদের কথা উল্লেখ করে? মানুষ কি তাদেরকে উম্মার পথপ্রদর্শক বলে মনে করে? আমরা দেখতে পাই যে, বিশ্ব সুন্নাহর যতো কাছাকাছি আসে, গ্রাহ্যতা আর জনপ্রিয়তা ততই বৃদ্ধি পায়। বেদআত পন্থীদের মধ্যে যারা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বিরুদ্ধে গোলযোগ সৃষ্টি করেছিল, আজ কেউ তাদের নাম নেয় না। তাদের বই পড়ে না; কিন্তু হিজরী ৮ম শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার গ্রন্থ ছড়িয়ে রয়েছে।
ইতিহাস অধ্যয়নের অনুসন্ধান প্রচেষ্টায় আমরা বর্তমানের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যশীল অতীত দেখতে পাই না। যে যুগটা সম্পর্কে আমরা অধ্যয়ন করেছি, তার চেয়ে বেশি শিক্ষণীয় যুগও আমরা আর দেখতে পাই না। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে অন্ধকার এমন বিস্তার লাভ করেছিল যে, মানুষ ধারণা করে বসে যে, পরিবর্তনের চেষ্টা করে আর কী লাভ হবে? চারিদিকে বেদআত পন্থীদের জয় জয়কার, শাসক গোষ্ঠী জেঁকে বসে আছে তাদের অবস্থানে অন্তত: স্বদেশ ভূমির হিসাবে হলেও; ফেরকাবন্দী আর বিভেদ- বিচ্ছেদ চরমে পৌঁছেছে। অতঃপর প্রশস্ততা দেখা দেয়। সুন্নাহর দিকে ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত হয়, জ্ঞান কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়ে এবং এমন সব নেতার আবির্ভাব ঘটে, যাদের মধ্যে দ্বীনদারী আছে, আছে বীরত্ব। বর্তমান পরিবেশ- পরিস্থিতির আনুকূল্য এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার কোন নজির ইতিপূর্বে ছিল না। মুসলমানদের সমস্যা লেগে থাকবে তীব্র স্রোতের মতো। আর এসব সমস্যায় তাদের নেতৃত্ব দেবেন জ্ঞানী আর বুদ্ধিজীবীরা। জ্ঞান আর রাজনীতির মিলন অবধি তাদের সমস্যা লেগে থাকবে। ফলে আবির্ভাব ঘটবে জ্ঞানী শাসকের; যেমন মিলন ঘটেছিল নূরুদ্দীন মাহমুদ এবং সালাহউদ্দীনের ব্যক্তিত্বে। আমি মনে করি আল্লাহর পথে আহবান কারীরা অল্পে তুষ্ট হয়ে বসে আছেন যে, আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে রীতি গচ্ছিত রেখেছেন, তা নিয়ে উত্থিত হওয়া ছাড়া পরিবর্তন সূচিত হবে না। আল্লাহ বলেন .
وَإِنْ كَادُوا لَيَسْتَفِزُّونَكَ مِنَ الْأَرْضِ لِيُخْرِجُوكَ مِنْهَا وَإِذًا لَا يَلْبَثُونَ خِلَافَكَ إِلَّا قَلِيلًا ﴿৭৬﴾ سُنَّةَ مَنْ قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنْ رُسُلِنَا وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا ﴿৭৭﴾ الإسراء : ৭৬-৭৭)
‘তোমাকে দেশ থেকে উৎখাত করার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা চালায় যাতে তোমাকে সেখান থেকে বহিষ্কার করতে পারে। তা হলে তোমার পরে তারাও সেখানে অল্প কালই কেবল টিকে থাকবে। আমরা রাসূলগণের মধ্যে তোমার পূর্বে যাদেরকে প্রেরণ করেছি, তাদের ক্ষেত্রেও এরূপ নিয়ম ছিল এবং তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না।’ (বনী ইসরাইল . ৭৬-৭৭) অথবা যে নিয়মের কথা রাসূল উল্লেখ করেছেন- যে সত্য তাঁর উপর নাজিল হয়েছে। মুসলমানরা যতক্ষণ দুর্বলতা আর লাঞ্ছনার কারণ খুঁজে বের না করবে, ততক্ষণ পরিবর্তন সূচিত হবে না। যেমন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া, বিবাদ- বিসংবাদ এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি, চরিত্র আর আমলের মধ্যে যা দ্বারা উম্মত শক্তিশালী হতে পারে, তা দ্বারা ভূষিত হওয়া এবং তার বিপরীত কর্ম থেকে বিরত থাকা। এ সবের মধ্যে সব কিছুর ঊর্ধ্বে হচ্ছে আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনা করা এবং কষ্টদায়ক বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করা, তা যতই বড় হোক না কেন।69 এ সব কিছুর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সূক্ষ্ম জ্ঞান আর প্রজ্ঞা।
এভাবে আইয়ুবী রাষ্ট্রের সমাপ্তি ঘটে এবং মামলুকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও জিহাদী এবং সংস্কার কার্যের প্রভাব তখনও অব্যাহত ছিল। মামলুকরা (আইনে জুতে) আমির (কাতায)- এর নেতৃত্বে তাতারদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। জাহির বায়বার্স এর শাসনামলে সিরিয়া এবং মিসরে অনেক শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটে। হিজরী ৬৬৩ সনে শাসক জাহির কায়সারিয়া এবং আরসূফ অধিকার করে তথাকার সমস্ত খ্রিস্টানকে হত্যা করেন। অতঃপর দ্বিতীয় দফা ছকদ জয় করত: ইয়াফা এবং এন্তাফিয়া অধিকার করেন। ৬৬৯ হিজরী সনে এক্কা পুনরুদ্ধার করে নেয়। এ সম্পর্কে ইবনে কাসীর বলেন . ইসলাম এবং মুসলমানদের কল্যাণে তাঁর রয়েছে সদুদ্দেশ্য। তিনি নগর আর দুর্গ জয় করেন এবং ইসমাঈলীদের নিকট একটা দুর্গও ছাড়েননি। তিনি ছিলেন বীর-বাহাদুর এবং অতি সাহসী পুরুষ। রোম আর মুঘলদের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করেন, যুগ যুগ ধরে যার কথা শোনা যায়নি। পোশাক-আশাক এবং আহার-বিহারে তিনি ছিলেন মধ্যপন্থী। এ রকম ছিল তাঁর সৈন্যও। তিনি মদ্য পান রহিত করেন এবং ফাসেক- পাপাচারীদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। হিজরী ৬৭৬ সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।67 কিন্তু ক্রুসেডারদের চূড়ান্ত প্রস্থান সম্পন্ন হয় আশরাফ ইবনে কারাউনের শাসনামলে হিজরী ৬৯০ সনে, যখন সূর এবং সায়দা আত্মসমর্পণ করে।
মুসলমানরা মামলুকদেরকে গ্রহণ করে নেয়। কারণ, তারা ছিল বীরপুরুষ। তাদের ছিল পর্যাপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ। ফলে তারা সুযোগ সন্ধানী দুশমনদের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করেন। কিন্তু তারা জনগণকে বৈজ্ঞানিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গড়ে তোলেনি। যেন তাদের আশঙ্কা ছিল মুসলমানদেরকে শেকড় থেকে উপড়ে ফেলা হবে। ফলে তারা পদক্ষেপ নেয় ধীর মন্থর গতিতে। এসব মামলুকদের স্পষ্ট কোন রাজনৈতিক নীতিমালা ছিল না, যা তাদের রাজত্বকে স্থায়ী করতে পারে এবং তারা সাংস্কৃতিক দিক থেকেও চিন্তা করতে পারে। এভাবে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ত্রুটির কারণে এবং তা হচ্ছে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ না করা- সংস্কার কার্য অব্যাহত থাকতে পারেনি। এ ছাড়া ওলামাদের জন্য ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করাও ছিল অন্যতম করণ।
সুরা ইনস্টিটিউটের অনুপস্থিতি ইবনে খলদুনের মতো ঐতিহাসিককে আইন বিধিবদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। তিনি এই আইনকে অপরিহার্য মনে করেন। আর তা এই যে, কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাই তিন পুরুষ বা তিন শতাব্দীর বেশি কাল টিকে থাকতে পারে না। কারণ, তৃতীয় বা চতুর্থ পুরুষ অবশ্যই আইন রহিত করবে। ফলে রাষ্ট্রের পতনের সূচনা হবে। কোন রাষ্ট্র যদি এর চেয়ে বেশি সময় টিকে থাকে তবে তা মৃত্যুর টিকে থাকা। প্রথম দফায় শক্তির কারণে তার প্রাণ এই যায় আর এই আসে দশা। এ ধরনের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই ইবনে খালদূনের দর্শন খাপ খায়। অবশ্য রাষ্ট্র যদি শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, যথা পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া, স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ এবং একাডেমিক ইনস্টিটিউশন ইত্যাদি, তখন অবস্থা ভিন্ন হতে পারে।
খেলাফতে রাশেদার রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরামর্শ ভিত্তিক ছিল, কিন্তু তা সুসংবাদ এবং সুস্পষ্ট বিধান ভিত্তিক ছিল না। কারণ, তৎকালে বিষয় ছিল জটিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় পরবর্তীকালে, যখন শুরা বিধিবদ্ধ হয়নি এবং সঠিক রূপে তার অনুশীলন হয়নি।
অন্য একটা প্রসঙ্গ, আর তা হচ্ছে ওলামাদের পক্ষ থেকে ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দেয়া, যার ফলে কোন কোন শাসক তাদের সামনে দেখা দেয়া লেনদেন এবং রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার কোন সমাধানই খুঁজে পান না। কোন কোন সময় কেউ আশ্রয় নেয় ভবিষ্যৎ বক্তা বা এমন কিছুর নিকট, তারা যাকে বলে রাজনীতি। অথচ মুসলিম উম্মাহ মুজতাহিদমুক্ত থাকতেই পারে না। তাদের মধ্যে নিঃশর্ত ইজতিহাদের ক্ষমতা থাকতে হবে, যারা যে কোন সমস্যায় সঠিক শরিয়তের বিধান দিতে সক্ষম । এ দুটি হচ্ছে জিহাদ অব্যাহত না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ এবং আলোক ধন্য যুগের পর মুসলিম মিল্লাতের দুর্বলতা।
শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য, অনেক ক্ষেত্রে সূচনা হয় সংশয়,
কিন্তু নির্গমন দ্বারা প্রতিভাত হয় বিশ্বাস
কঠোর ও কট্টর দুশমনদের সম্মুখে অথবা অপেক্ষমাণ সংশয়বাদীদের মুখে আল্লাহর কিতাবে গচ্ছিত রাখা রীতির চেয়ে বেশি সত্য রীতি আর কিছুই নেই। .
وَالعَاقِبَةُ لِلمُتَّقينَ
‘শুভ পরিণাম নেককার মুত্তাকীদের জন্য।’
নবী ঈসা আলাইহিস সালামের জবানীতে বর্ণিত আছে যে, আমরা কীভাবে মিথ্যাবাদীকে চিনবো? তাঁকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন : ফলাফল থেকেই তুমি তাদেরকে চিনতে পারবে। ব্যাপারটা যখন মানুষের নিকট তালগোল পাকিয়ে যায় এবং সত্য-মিথ্যা যাচাই করার ক্ষমতা থাকে না, তখন তাদেরকে বলা হবে : তোমরা ফলাফলের অপেক্ষা করো, কে সত্যপন্থী, আর কে মিথ্যাপন্থী, তোমরা নিজেরাই তা প্রত্যক্ষ করতে পারবে .
فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ ﴿১৭﴾ ( الرعد : ১৭)
‘যা আবর্জনা তা ফেলে দেয়া হয়; আর যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে থেকে যায়। আল্লাহ এভাবে উপমা দিয়ে থাকেন।’ (সূরা রা’দ: ১৭)
সুতরাং শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য- এটা আল্লাহর চিরন্তন রীতি, জাতি- গোষ্ঠীর পরিণতির ক্ষেত্রে, যারা সরে দাঁড়ায় তাদের পালন কর্তার বিধান আর প্রকৃতির নিয়ম থেকে। সত্য মিথ্যার সংঘাতে আল্লাহর নীতি এই যে, সত্য উপরে থাকবে আর মিথ্যা থাকবে নীচে। সুতরাং যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে প্রতিষ্ঠিত- প্রমাণিত সত্য বস্ত্ত সন্ধান করে, যা স্থাপত্য তত্ত্বেরও দাবি, তখন প্রকৃতির রীতি তাদের সহায়তা- পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।68
ইতিহাস পর্যালোচনা এবং মানুষের জীবনধারা পর্যালোচনা এ নীতির প্রতি সমর্থন জানায়। আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে, মিথ্যা যখনই স্ফীত হয়ে দম্ভ প্রকাশ করে, তখন আল্লাহর হুকুমে কিছু কাল পরে হলেও সত্য তার উপর জয়ী হবে। মিথ্যা কয়েকটা চক্কর কেটে খড় কুটের মতো উড়ে যায়। আর যা কল্যাণকর, তা-ই দীর্ঘস্থায়ী হয়। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র আর সভ্যতা- সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য। অতীতের এমনটি না ঘটে থাকলে ভবিষ্যতে অবশ্যই ঘটবে।
وَإِنْ مَا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِي نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَعَلَيْنَا الْحِسَابُ ﴿الرعد :৪০﴾
‘আমরা তাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাই, তার কিছু যদি তোমাকে দেখাই অথবা যদি ইতিপূর্বেই তোমার মৃত্যু ঘটাই- তোমার কর্তব্যতো কেবল প্রচার করা আর হিসাব- নিকাশতো আমাদের কাজ।’
(সূরা রা’দ : ৪০)
আর দুনিয়াতে এটা সংঘটিত না হলে আখিরাতে অবশ্যই ঘটবে:
وَسَيَعْلَمُ الْكُفَّارُ لِمَنْ عُقْبَى الدَّارِ ﴿الرعد : ৪২﴾
‘এবং কাফিররা অবিলম্বে জানতে পারবে যে, শুভ পরিণাম কাদের জন্য।’ (সূরা রা’দ: ৪২)
وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنْقَلَبٍ يَنْقَلِبُونَ ﴿ الشعراء : ২২৭﴾
‘জালিমরা শীঘ্র জানতে পারবে কোথায় তাদের গন্তব্যস্থল’ (সূরা শু’আরা . ২২৭)
وَقَالَتِ الْيَهُودُ لَيْسَتِ النَّصَارَى عَلَى شَيْءٍ وَقَالَتِ النَّصَارَى لَيْسَتِ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ﴿البقرة : ১১৩﴾
‘ইহুদিরা বলে, খ্রিস্টানদের কোন ভিত্তি নেই এবং খ্রিস্টানরা বলে- ইহুদিদের কোন ভিত্তি নেই; অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবে যারা কিছুই জানে না, তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ সে বিষয়ে মীমাংসা করবেন (সূরা আল- বাকারা . ১১৩)।
কতো তাগুতের পতন হয়েছে, কতো জালিম রাষ্ট্র বিলীন হয়ে গেছে, যেন কখনো তা ছিলই না। ইসলামের দুশমনরা ভেতর এবং বাইরে থেকে কতো চেষ্টা, কতো ষড়যন্ত্রইনা করেছে। পরিণতিতে ইসলামই টিকে আছে। টিকে থাকবে। বাতেনী সম্প্রদায়ের পক্ষে কতো বিপ্লব সাধিত হয়েছে। খোররামিয়া, বাবকিয়া, জঙ্গি আর ফাতেমীদের নামে; অতঃপর আহলে সুন্নাহর অথৈ সমুদ্র তলে তা লীন হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন .
كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ ( المائدة : ৬৪)
‘তারা যতবার যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্বলিত করে, ততবার আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন।’ (সূরা মায়িদা: ৬৪)
তাতার আর ক্রুসেডারদের আগমন ঘটে। বেশ দীর্ঘ কাল তাদের প্রতাপ চলে। অতঃপর সব কিছু তার মূলের দিকে ফিরে যায়। বাহ্যত: প্রকাশ পায় যে, রাফেযী আর বাতেনী সম্প্রদায় হিজরী চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে মুসলিম বিশ্বের উপর জেঁকে বসে। দু’শ বৎসর এ ধারা চলে। অতঃপর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে পরিস্থিতির এবং মানুষ ফিরে আসে সুন্নাহর দিকে।
সম্প্রতিকালে কমিউনিস্টরা ধারণা করে যে, তারাই ইতিহাস আর মানব সমাজ অনুধাবনের ক্ষেত্রে কেবল পূর্ণাঙ্গ দর্শনের অধিকারী। একজন মানুষের আয়ুষ্কালেরও কম সময়ের মধ্যে কমিউনিজম এমন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যেন তা বিগত কালের বিষয়।
আধুনিক যুগের তাগুত, যারা মুসলিম দেশের বিপুল অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফিরাউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সীমা লঙ্ঘন করে। অবশেষে যখন সময় এসে যায় তখন কেউ তাদের উপর দয়া করে না, জনপদ আর জনপদের বাসিন্দারা তাদের থেকে মুক্তি পায়।
শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য- এ মূলনীতিই কি মানদন্ড নয়?
ব্যক্তিগত পর্যায় সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ:) বলেন . আমাদের আর বেদআত পন্থীদের মধ্যে পার্থক্যের মাপকাঠি হচ্ছে জানাজা। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চান যে, যে আলেম সুন্নাহর অনুসারী, জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করবে, বড় মর্যাদাবান মনে করবে। আল্লাহ সৃষ্টি লোকের অন্তরে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন। ফলে লোকেরা তার জানাজায় অংশ নেবে। পক্ষান্তরে যারা বেদআত পন্থী, তাদের গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা আর জালিম সরকারের নিকট সহায়তা কামনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তারা জনগণের ভালোবাসার পাত্র হতে পারে না। জনগণ তাদের মধ্যে কোন আকর্ষণ খুঁজে পায় না। প্রাচীন মু’তাযিলা পন্থীদের মধ্যে আজ কি কেউ আহমদ ইবনে আবু দাউদ এবং নায্যাম আর আল্লাফের নাম মুখে নেয়? অথবা কেউ কি চরমপন্থী কালাম শাস্ত্রবিদ বা চরমপন্থী সুফিদের কথা উল্লেখ করে? মানুষ কি তাদেরকে উম্মার পথপ্রদর্শক বলে মনে করে? আমরা দেখতে পাই যে, বিশ্ব সুন্নাহর যতো কাছাকাছি আসে, গ্রাহ্যতা আর জনপ্রিয়তা ততই বৃদ্ধি পায়। বেদআত পন্থীদের মধ্যে যারা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বিরুদ্ধে গোলযোগ সৃষ্টি করেছিল, আজ কেউ তাদের নাম নেয় না। তাদের বই পড়ে না; কিন্তু হিজরী ৮ম শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার গ্রন্থ ছড়িয়ে রয়েছে।
ইতিহাস অধ্যয়নের অনুসন্ধান প্রচেষ্টায় আমরা বর্তমানের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যশীল অতীত দেখতে পাই না। যে যুগটা সম্পর্কে আমরা অধ্যয়ন করেছি, তার চেয়ে বেশি শিক্ষণীয় যুগও আমরা আর দেখতে পাই না। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে অন্ধকার এমন বিস্তার লাভ করেছিল যে, মানুষ ধারণা করে বসে যে, পরিবর্তনের চেষ্টা করে আর কী লাভ হবে? চারিদিকে বেদআত পন্থীদের জয় জয়কার, শাসক গোষ্ঠী জেঁকে বসে আছে তাদের অবস্থানে অন্তত: স্বদেশ ভূমির হিসাবে হলেও; ফেরকাবন্দী আর বিভেদ- বিচ্ছেদ চরমে পৌঁছেছে। অতঃপর প্রশস্ততা দেখা দেয়। সুন্নাহর দিকে ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত হয়, জ্ঞান কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়ে এবং এমন সব নেতার আবির্ভাব ঘটে, যাদের মধ্যে দ্বীনদারী আছে, আছে বীরত্ব। বর্তমান পরিবেশ- পরিস্থিতির আনুকূল্য এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার কোন নজির ইতিপূর্বে ছিল না। মুসলমানদের সমস্যা লেগে থাকবে তীব্র স্রোতের মতো। আর এসব সমস্যায় তাদের নেতৃত্ব দেবেন জ্ঞানী আর বুদ্ধিজীবীরা। জ্ঞান আর রাজনীতির মিলন অবধি তাদের সমস্যা লেগে থাকবে। ফলে আবির্ভাব ঘটবে জ্ঞানী শাসকের; যেমন মিলন ঘটেছিল নূরুদ্দীন মাহমুদ এবং সালাহউদ্দীনের ব্যক্তিত্বে। আমি মনে করি আল্লাহর পথে আহবান কারীরা অল্পে তুষ্ট হয়ে বসে আছেন যে, আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে রীতি গচ্ছিত রেখেছেন, তা নিয়ে উত্থিত হওয়া ছাড়া পরিবর্তন সূচিত হবে না। আল্লাহ বলেন .
وَإِنْ كَادُوا لَيَسْتَفِزُّونَكَ مِنَ الْأَرْضِ لِيُخْرِجُوكَ مِنْهَا وَإِذًا لَا يَلْبَثُونَ خِلَافَكَ إِلَّا قَلِيلًا ﴿৭৬﴾ سُنَّةَ مَنْ قَدْ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنْ رُسُلِنَا وَلَا تَجِدُ لِسُنَّتِنَا تَحْوِيلًا ﴿৭৭﴾ الإسراء : ৭৬-৭৭)
‘তোমাকে দেশ থেকে উৎখাত করার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা চালায় যাতে তোমাকে সেখান থেকে বহিষ্কার করতে পারে। তা হলে তোমার পরে তারাও সেখানে অল্প কালই কেবল টিকে থাকবে। আমরা রাসূলগণের মধ্যে তোমার পূর্বে যাদেরকে প্রেরণ করেছি, তাদের ক্ষেত্রেও এরূপ নিয়ম ছিল এবং তুমি আমার নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না।’ (বনী ইসরাইল . ৭৬-৭৭) অথবা যে নিয়মের কথা রাসূল উল্লেখ করেছেন- যে সত্য তাঁর উপর নাজিল হয়েছে। মুসলমানরা যতক্ষণ দুর্বলতা আর লাঞ্ছনার কারণ খুঁজে বের না করবে, ততক্ষণ পরিবর্তন সূচিত হবে না। যেমন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া, বিবাদ- বিসংবাদ এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি, চরিত্র আর আমলের মধ্যে যা দ্বারা উম্মত শক্তিশালী হতে পারে, তা দ্বারা ভূষিত হওয়া এবং তার বিপরীত কর্ম থেকে বিরত থাকা। এ সবের মধ্যে সব কিছুর ঊর্ধ্বে হচ্ছে আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনা করা এবং কষ্টদায়ক বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করা, তা যতই বড় হোক না কেন।69 এ সব কিছুর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সূক্ষ্ম জ্ঞান আর প্রজ্ঞা।
মূল বইয়ের সাথে অতিরিক্ত সংযোজন
[খ্রিস্টান জগতের আতঙ্ক ইসলামি ইতিহাসের অগ্নি পুরুষ ও বিশ্ব জগতের কিংবদন্তি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জীবনী লেখার ইচ্ছা এখানে না থাকলেও বইটি ঠিক প্রেসে যাওয়ার পূর্ব ক্ষণে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান শরীফের নামের ‘গাজি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী’ লেখাটি আমার নজরে আসে। একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি শামিল করতে পেরে আমি খুব প্রীত। এ বীর যোদ্ধার জীবনী আমাদের যুব সমাজকে ও সর্বস্তরের মানুষগুলোকে আলোড়িত করবে এটাই আমার বিশ্বাস। নিম্নে লেখাটি হুবহু প্রকাশিত হলো।]
ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য সমর নায়কের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দিকে দিকে তৌহিদের ঝান্ডা উড়িয়ে তারা অমর হয়ে আছেন। তবে সেরাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলংকৃত করে আছেন, তাদের অন্যতম হলেন গাজি সালাহউদ্দীন । শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে তার নামটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে।
অথচ সালাহউদ্দীন চেয়েছিলেন একজন ধর্মতত্ত্ববিদ হতে। অবশ্য, আল্লাহ কাকে কোন দায়িত্বের জন্য মনোনীত করেন, তা বোঝা মুশকিল। যে যুবকটি একজন বড় আলেম হতে চেয়েছিলেন, পারিপার্শ্বিকতায় এবং যুগের প্রয়োজনে তিনি হলেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা যোদ্ধা এবং গাজি। ইসলামের প্রধান তিনটি মসজিদের অন্যতম বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তিনটি প্রধান শহরের অন্যতম জেরুজালেম খ্রিস্টান জবর দখলকারীদের নিকট থেকে উদ্ধারকারী। অবশ্য ধর্মতত্ত্ব নিয়েই তিনি সাধনা করে গেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন করে গেছেন।
মুসলিম বিশ্বে সালাহউদ্দীন নামে পরিচিত হলেও পশ্চিমারা তাকে সালাদিন হিসাবেই জানে। তার পুরো নাম আল মারিকুন নাসির আবুল মুজাফ্ফর ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। ১১৩৮ খৃষ্টাব্দে (হিজরী ৫৩২ সালে) ইরাকের তিকরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আইয়ুব ও চাচা শিরকুহ সেলজুক সুলতানদের অধীনে চাকরি করতেন। তাদের আদি বাসস্থান ছিল আর্মেনিয়ার দিন অঞ্চলে। জাতিগত ভাবে তারা ছিলেন কুর্দী বংশোদদ্ভুবত। তবে পিতার চাকরির সুবাদে তাকে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে। বাল্যকালে তিনি ধর্মতত্ত্ব নিয়েই পড়াশোনা করেছিলেন।
এক যুগ সন্ধিক্ষণে জন্মে ছিলেন সালাহউদ্দীন। মুসলিম বিশ্ব এতো টালমাটাল অবস্থায় এর আগে কখনো পড়েনি। মুসলিম বিশ্বের সামনে তিনবার মহা দুর্যোগ কাল এসেছিল। প্রথমবার ক্রুসেডের সময়। দ্বিতীয়বার মঙ্গোলীয় (তাতার) বাহিনীর আক্রমণের সময়। এবং তৃতীয়টি বর্তমানে চলছে পশ্চিমাদের আগ্রাসনের মাধ্যমে। সালাহউদ্দীন ক্রুসেডারদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন মুসলিম বিশ্বকে। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গল অভিযান রুখে দিয়েছিলেন। মামলুক সুলতান কুতুজ এবং মহান সিপাহসালার বেবারস। এবারের তৃতীয় দফা থেকে মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করেন, তাই দেখার বিষয়।
জেরুজালেম উদ্ধার করার নামে ইউরোপিয়ান শক্তি বর্গ ক্রুসেড শুরুর ঘোষণা দিলেও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ইউরোপে তখনকার মারাত্মক দুর্ভিক্ষ এবং অপ-শাসন জনিত কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রবল ক্ষোভের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার জন্য রাজন্য বর্গ প্রাদ্রীদের প্ররোচনায় ক্রুসেডের ডাক দিয়েছিল। ১০৯৯ সালে প্রথমে ক্রুসেডেই খ্রিস্টান শক্তি জেরুজালেম দখল করে নেয়। ক্রুসেডারদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল ক্রমান্বয়ে পুরো মুসলিম বিশ্ব দখল করার। তখনকার মুসলিম বিশ্ব ছিল নানা ভাগে বিভক্ত। বাগদাদে খলিফা সিংহাসনে আসীন থাকলেও তিনি ছিলেন নামমাত্র। জেরুজালেমসহ আশপাশের মুসলিম এলাকাগুলো ছিল নানা ভাগে বিভক্ত। বর্তমানের মতো জাতীয়তাবাদী চেতনা না থাকলেও মুসলিম শাসকরা নানা ফেরকায় বিভক্ত ছিল। মিশরের ফাতেমীরা তো আববাসীয়দের খলিফা হিসেবেই স্বীকার করতো না। জেরুজালেম মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করতো। কিন্তু সবাইকে একত্রিত করা এবং একটি সম্মিলিত ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনি এক প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দীনের অভ্যুত্থান ঘটেছিল।
মিশর আক্রমণকারী ক্রুসেডারদের প্রতিহত করার জন্য ১১৬৪ সালে চাচা শেরকোহর ডাকে সাড়া দিয়ে সালাহউদ্দীন জিহাদে জড়িয়ে পড়েন। তখনই নতুন এক সালাহউদ্দীন আত্মপ্রকাশ ঘটে যায়। বাকি জীবনে তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। শেরকোহর অক্লান্ত পরিশ্রমে মিশর ক্রুসেডারদের হাত থেকে রেহাই পায়। শেরকোহ মিসরে ফাতেমীদের প্রধান উজিরের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ১১৬৯ খৃষ্টাব্দে তার ইন্তেকালের পর সালাহউদ্দীন উক্ত পদে তার স্থলাভিষিক্ত হন। এবার তিনি জেরুজালেম মুক্ত করার বাস্তব ভিত্তিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এ কাজে তিনি কম বাধার সম্মুখীন হননি। ক্রুসেডাররা তো বাধা হিসেবেই ছিল। কিন্তু স্ব-ধর্মের স্বার্থান্বেষী লোকের সংখ্যাও কম ছিল না। জেরুজালেম মুক্ত করতে গিয়ে তিনি যতগুলো যুদ্ধ করেছিলেন, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে। একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম বাহিনী গঠনের কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন।
১১৭১ সালে ফাতেমীয় সুলতান আল আদিদের ইন্তেকালের পর তিনি মিশরের ক্ষমতা লাভ করেন। ১১৭৪ সালে সুলতান নূরউদ্দীন জঙ্গি ইন্তেকাল করলে তিনি সিরিয়াকেও নিজের সালতানাতের আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি আববাসীয় খলিফার স্বীকৃতিও লাভ করেন। তিনি মিসরে দীর্ঘদিন পর আবার সুন্নীণ মাজহাব পুনরায় সর-কারী-ভাবে চালু করেন। ফলশ্রুতিতে মোটামুটিভাবে একটি সম্মিলিত মুসলিম ফ্রন্ট তৈরি করতে সক্ষম হন। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন, ‘মুহয়ী দাওলাত আমীরুল মুমেনীন’ বা মুমিনদের নেতার সাম্রাজ্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠা হিসেবে।
এবার তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জেরুজালেম মুক্ত করার দিকে অগ্রসর হন। চূড়ান্ত জিহাদে নামার আগে ক্রুসেডারদের শক্তিমত্তা যেমন বিশ্লেষণ করেছিলেন, তেমনি দুর্বলতার দিকেও নজর রেখেছেন। সম্ভাব্য সব পরিস্থিতিই তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। অবশেষে ১১৮৭ সালে তিনি তার চূড়ান্ত লক্ষের দিকে ধাবিত হন। তিনি তার নিজের পছন্দের পানিশূন্য ও বন্ধুর জায়গায় যুদ্ধ করার জন্য জেরুজালেমের রাজা গাইকে প্রলোভিত করেন। সেই ফাঁদে ধরা দেন তিনি। একই সালে ৪ঠা জুলাই হিত্তীনে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই এ নামেন। ক্রুসেডারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। এদের মধ্যে দু’হাজার নাইট আর বাকীরা পদাতিক। অন্যদিকে সালাহউদ্দীনের ছিল প্রায় ১৮ হাজার সৈন্য। সালাহউদ্দীন পরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে মূল যুদ্ধ শুরুর আগেই ক্ষুধা, পিপাসায় কাতর হয়ে ক্রুসেডারদের যুদ্ধ করার শক্তি মারাত্মকভাবে কমে যায়। ৪ঠা জুলাই মুসলমানরা যখন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন তাদেরকে আর যোদ্ধা বলে মনে হয়নি। তারা নির্জীব জড়োখন্ডে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধে রাজা গাই বন্দী হন। খ্রিস্টানরা তাদের জোশ বাড়ানোর জন্য যুদ্ধের ময়দানে মূল ক্রুশটিও নিয়ে এসেছিল। সেটিও মুসলমানদের হাতে এসে পড়ে। এ যুদ্ধই ছিল জেরুজালেমে খ্রিস্ট শক্তির পরিসমাপ্তি। এরপর জেরুজালেম মুসলমানদের হাতে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরপর গাজি হিসেবে সালাহউদ্দীন ১১৮৭ সালের ২রা অক্টোবর (৫৮৩ হিজরীর ২৭শে রজব) জেরুজালেমে প্রবেশ করেন। বায়তুল আকসাসহ জেরুজালেম আবার মুসলমানদের হাতে আসে।
তবে জেরুজালেম উদ্ধারের চেয়ে তার রক্ষাতেও সালাহউদ্দীন কৃতিত্ব কম ছিল না। মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব ফিরে যাওয়ার সংবাদে ইউরোপে আবার মাতম শুরু হয়। পুরো ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৃতীয় ক্রুসেডের নামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নেয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীসহ প্রায় সব ইউরোপিয়ান শক্তি এই আগ্রাসনে শরিক হয়। এতে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড ফ্রান্সের ফিলিপ পারস্পরিক সব বৈরিতা ভুলে ক্রুসেডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১১৮৯ সালে তাঁরা এই ক্রুসেড শুরু করেন। খ্রিস্ট শক্তি এতো বিশাল বাহিনী নিয়ে আর কখনো ক্রুসেডে আসেনি। কিন্তু তারা অবিরাম সংগ্রাম করেও আর জেরুজালেম দখল করতে পারেনি। শেষে তারা মুখ রক্ষামূলক একটি চুক্তিতে আসে। ১১৯২ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি ক্রুসেডারদের সাথে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে ৩ বছর ৮ মাসের জন্য একটি যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হয়। তিনি যদি সে সময় অন্যান্য স্থান থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পেতেন, তবে খ্রিস্ট শক্তিকে আরো শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে পারতেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাস পরই তিনি ইন্তিকাল করেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি জিহাদে নিয়োজিত থাকলেও ছোট বেলার পাঠাভ্যাস কখনো ভোলেননি। সারা জীবনই তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। তিনি ছিলেন গভীর ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন। হাদিস শাস্ত্রে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। বুদ্ধিবৃত্তি আলোচনায় তিনি তৃপ্তি পেতেন। সমসাময়িকদের শ্রেষ্ঠ বীর হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। সহকর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে পারতেন তিনি সহজেই। তিনি ছিলেন মার্জিত, সংস্কৃতিবান ও ভদ্রজনোচিত ব্যক্তি। কোন ধরনের রূঢ়তা বা জাঁকজমক পছন্দ করতেন না। সব সময়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। তবে প্রয়োজনে তিনি কঠোর হতে পারতেন। তার বদান্যতা, বিশ্বস্ততায় শত্রুরাও ছিল প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চরম শত্রু রাজা রিচার্ডও একাধিকবার সালাহউদ্দীনের দরদি হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সমকালীন প্রেক্ষাপটে তিনি বহু বিরল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কায়রো এবং জেরুজালেম পুনঃগঠনে তিনি অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশেষ করে মসজিদুল আকসাকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করার পর তিনি মসজিদ হিসেবে প্রস্ত্তত করেন। দূর- দূরান্ত থেকে তিনি মূল্যবান সামগ্রী সংগ্রহ করে সুন্দরভাবে মসজিদটিকে সাজিয়ে ছিলেন।
তিনি কখনো নিজের ক্ষমতার উপর অতিরিক্ত ভরসা করতেন না। শত্রু পক্ষের প্রকৃত শক্তি এবং দুর্বলতা তিনি চুল চেরা বিশ্লেষণ করতেন। নিজের অবস্থানও তার কাছে ছিল পরিষ্কার। মুসলিম বাহিনীকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তিনি সফলও হয়েছিলেন। তবে তৃতীয় ক্রুসেডের সময় অনেক স্থান থেকেই কাঙ্ক্ষিত সাহায্য পাননি। প্রথম দিকে তিনি সফল হয়েছিলেন। তার শক্তি বৃদ্ধিতে বাগদাদের খলিফাসহ অনেকেই ছিলেন ঈর্ষান্বিত। তবে তাদের অন্যায় আচরণ সত্ত্বেও হতোদ্যম হননি তিনি। নিজের যতটুকু সামর্থ্য ছিল, তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন তিনি।
যুদ্ধ জয়ের পরও তিনি ছিলেন শান্ত এবং সংযত। প্রতিশোধ নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠাই ছিল তার লক্ষ্য। মহৎ প্রাণ এই সুলতান বন্দী রাজা গাইকেও মুক্তি দিয়েছিলেন। এমনকি যুদ্ধবন্দি নাইটদেরও মুক্তিপণের মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। নাইট পরিবারগুলোকে অবাধে জেরুজালেমে ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছিলেন কাউকেই অন্যায়ভাবে দন্ডিত করেননি। অথচ মাত্র ৯০ বছর আগে জেরুজালেম দখল করার পর খ্রিস্টানরা যে পাশবিক আচরণ করেছিল, তার দাগ তখনও ছিল। তারা তখন জেরুজালেমের সকল মুসলমানকে হত্যা করেছিল। মসজিদ, মাদ্রাসাগুলোকে ধ্বংস করেছিল। পাঠাগারগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সালাহউদ্দীন এবার তার কোন প্রতিশোধ নেননি। এমনকি খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থানগুলো প্রাদ্রীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য বায়তুল মোকাদ্দাস, ডোম অব রকসহ ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন। তার ২৫ বছরের শাসনামল এক অনন্য সাধারণ ইতিহাস। এক ক্রান্তি লগ্নে তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। বিশ্বের সকল স্থানের মুসলমানদের জন্য তিনি এক শ্বা শত আদর্শ হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
সিরিয়া ছিল গাজি সালাহউদ্দীনের প্রিয় জায়গা। আর দামেস্ক শহরকেও তিনি ভালোবাসতেন। ১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ (৫৮৯ হিজরীতে) ইন্তিকালের পর তাকে প্রথমে দামেস্কে দুর্গের অভ্যন্তরে দাফন করা হয়। ১১৯৫ সালে উমা-ইয়া মসজিদের উত্তরে তাকে স্থায়ী কবরে দাফন করা হয়।
[খ্রিস্টান জগতের আতঙ্ক ইসলামি ইতিহাসের অগ্নি পুরুষ ও বিশ্ব জগতের কিংবদন্তি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জীবনী লেখার ইচ্ছা এখানে না থাকলেও বইটি ঠিক প্রেসে যাওয়ার পূর্ব ক্ষণে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান শরীফের নামের ‘গাজি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী’ লেখাটি আমার নজরে আসে। একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি শামিল করতে পেরে আমি খুব প্রীত। এ বীর যোদ্ধার জীবনী আমাদের যুব সমাজকে ও সর্বস্তরের মানুষগুলোকে আলোড়িত করবে এটাই আমার বিশ্বাস। নিম্নে লেখাটি হুবহু প্রকাশিত হলো।]
ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য সমর নায়কের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। দিকে দিকে তৌহিদের ঝান্ডা উড়িয়ে তারা অমর হয়ে আছেন। তবে সেরাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলংকৃত করে আছেন, তাদের অন্যতম হলেন গাজি সালাহউদ্দীন । শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে তার নামটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে।
অথচ সালাহউদ্দীন চেয়েছিলেন একজন ধর্মতত্ত্ববিদ হতে। অবশ্য, আল্লাহ কাকে কোন দায়িত্বের জন্য মনোনীত করেন, তা বোঝা মুশকিল। যে যুবকটি একজন বড় আলেম হতে চেয়েছিলেন, পারিপার্শ্বিকতায় এবং যুগের প্রয়োজনে তিনি হলেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা যোদ্ধা এবং গাজি। ইসলামের প্রধান তিনটি মসজিদের অন্যতম বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তিনটি প্রধান শহরের অন্যতম জেরুজালেম খ্রিস্টান জবর দখলকারীদের নিকট থেকে উদ্ধারকারী। অবশ্য ধর্মতত্ত্ব নিয়েই তিনি সাধনা করে গেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন করে গেছেন।
মুসলিম বিশ্বে সালাহউদ্দীন নামে পরিচিত হলেও পশ্চিমারা তাকে সালাদিন হিসাবেই জানে। তার পুরো নাম আল মারিকুন নাসির আবুল মুজাফ্ফর ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। ১১৩৮ খৃষ্টাব্দে (হিজরী ৫৩২ সালে) ইরাকের তিকরিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আইয়ুব ও চাচা শিরকুহ সেলজুক সুলতানদের অধীনে চাকরি করতেন। তাদের আদি বাসস্থান ছিল আর্মেনিয়ার দিন অঞ্চলে। জাতিগত ভাবে তারা ছিলেন কুর্দী বংশোদদ্ভুবত। তবে পিতার চাকরির সুবাদে তাকে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে। বাল্যকালে তিনি ধর্মতত্ত্ব নিয়েই পড়াশোনা করেছিলেন।
এক যুগ সন্ধিক্ষণে জন্মে ছিলেন সালাহউদ্দীন। মুসলিম বিশ্ব এতো টালমাটাল অবস্থায় এর আগে কখনো পড়েনি। মুসলিম বিশ্বের সামনে তিনবার মহা দুর্যোগ কাল এসেছিল। প্রথমবার ক্রুসেডের সময়। দ্বিতীয়বার মঙ্গোলীয় (তাতার) বাহিনীর আক্রমণের সময়। এবং তৃতীয়টি বর্তমানে চলছে পশ্চিমাদের আগ্রাসনের মাধ্যমে। সালাহউদ্দীন ক্রুসেডারদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন মুসলিম বিশ্বকে। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গল অভিযান রুখে দিয়েছিলেন। মামলুক সুলতান কুতুজ এবং মহান সিপাহসালার বেবারস। এবারের তৃতীয় দফা থেকে মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা করেন, তাই দেখার বিষয়।
জেরুজালেম উদ্ধার করার নামে ইউরোপিয়ান শক্তি বর্গ ক্রুসেড শুরুর ঘোষণা দিলেও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ইউরোপে তখনকার মারাত্মক দুর্ভিক্ষ এবং অপ-শাসন জনিত কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রবল ক্ষোভের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার জন্য রাজন্য বর্গ প্রাদ্রীদের প্ররোচনায় ক্রুসেডের ডাক দিয়েছিল। ১০৯৯ সালে প্রথমে ক্রুসেডেই খ্রিস্টান শক্তি জেরুজালেম দখল করে নেয়। ক্রুসেডারদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল ক্রমান্বয়ে পুরো মুসলিম বিশ্ব দখল করার। তখনকার মুসলিম বিশ্ব ছিল নানা ভাগে বিভক্ত। বাগদাদে খলিফা সিংহাসনে আসীন থাকলেও তিনি ছিলেন নামমাত্র। জেরুজালেমসহ আশপাশের মুসলিম এলাকাগুলো ছিল নানা ভাগে বিভক্ত। বর্তমানের মতো জাতীয়তাবাদী চেতনা না থাকলেও মুসলিম শাসকরা নানা ফেরকায় বিভক্ত ছিল। মিশরের ফাতেমীরা তো আববাসীয়দের খলিফা হিসেবেই স্বীকার করতো না। জেরুজালেম মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করতো। কিন্তু সবাইকে একত্রিত করা এবং একটি সম্মিলিত ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনি এক প্রেক্ষাপটে সালাহউদ্দীনের অভ্যুত্থান ঘটেছিল।
মিশর আক্রমণকারী ক্রুসেডারদের প্রতিহত করার জন্য ১১৬৪ সালে চাচা শেরকোহর ডাকে সাড়া দিয়ে সালাহউদ্দীন জিহাদে জড়িয়ে পড়েন। তখনই নতুন এক সালাহউদ্দীন আত্মপ্রকাশ ঘটে যায়। বাকি জীবনে তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। শেরকোহর অক্লান্ত পরিশ্রমে মিশর ক্রুসেডারদের হাত থেকে রেহাই পায়। শেরকোহ মিসরে ফাতেমীদের প্রধান উজিরের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ১১৬৯ খৃষ্টাব্দে তার ইন্তেকালের পর সালাহউদ্দীন উক্ত পদে তার স্থলাভিষিক্ত হন। এবার তিনি জেরুজালেম মুক্ত করার বাস্তব ভিত্তিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এ কাজে তিনি কম বাধার সম্মুখীন হননি। ক্রুসেডাররা তো বাধা হিসেবেই ছিল। কিন্তু স্ব-ধর্মের স্বার্থান্বেষী লোকের সংখ্যাও কম ছিল না। জেরুজালেম মুক্ত করতে গিয়ে তিনি যতগুলো যুদ্ধ করেছিলেন, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে। একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম বাহিনী গঠনের কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন।
১১৭১ সালে ফাতেমীয় সুলতান আল আদিদের ইন্তেকালের পর তিনি মিশরের ক্ষমতা লাভ করেন। ১১৭৪ সালে সুলতান নূরউদ্দীন জঙ্গি ইন্তেকাল করলে তিনি সিরিয়াকেও নিজের সালতানাতের আওতায় নিয়ে আসেন। তিনি আববাসীয় খলিফার স্বীকৃতিও লাভ করেন। তিনি মিসরে দীর্ঘদিন পর আবার সুন্নীণ মাজহাব পুনরায় সর-কারী-ভাবে চালু করেন। ফলশ্রুতিতে মোটামুটিভাবে একটি সম্মিলিত মুসলিম ফ্রন্ট তৈরি করতে সক্ষম হন। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন, ‘মুহয়ী দাওলাত আমীরুল মুমেনীন’ বা মুমিনদের নেতার সাম্রাজ্যের পুনঃ প্রতিষ্ঠা হিসেবে।
এবার তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জেরুজালেম মুক্ত করার দিকে অগ্রসর হন। চূড়ান্ত জিহাদে নামার আগে ক্রুসেডারদের শক্তিমত্তা যেমন বিশ্লেষণ করেছিলেন, তেমনি দুর্বলতার দিকেও নজর রেখেছেন। সম্ভাব্য সব পরিস্থিতিই তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। অবশেষে ১১৮৭ সালে তিনি তার চূড়ান্ত লক্ষের দিকে ধাবিত হন। তিনি তার নিজের পছন্দের পানিশূন্য ও বন্ধুর জায়গায় যুদ্ধ করার জন্য জেরুজালেমের রাজা গাইকে প্রলোভিত করেন। সেই ফাঁদে ধরা দেন তিনি। একই সালে ৪ঠা জুলাই হিত্তীনে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই এ নামেন। ক্রুসেডারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। এদের মধ্যে দু’হাজার নাইট আর বাকীরা পদাতিক। অন্যদিকে সালাহউদ্দীনের ছিল প্রায় ১৮ হাজার সৈন্য। সালাহউদ্দীন পরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে মূল যুদ্ধ শুরুর আগেই ক্ষুধা, পিপাসায় কাতর হয়ে ক্রুসেডারদের যুদ্ধ করার শক্তি মারাত্মকভাবে কমে যায়। ৪ঠা জুলাই মুসলমানরা যখন তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন তাদেরকে আর যোদ্ধা বলে মনে হয়নি। তারা নির্জীব জড়োখন্ডে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধে রাজা গাই বন্দী হন। খ্রিস্টানরা তাদের জোশ বাড়ানোর জন্য যুদ্ধের ময়দানে মূল ক্রুশটিও নিয়ে এসেছিল। সেটিও মুসলমানদের হাতে এসে পড়ে। এ যুদ্ধই ছিল জেরুজালেমে খ্রিস্ট শক্তির পরিসমাপ্তি। এরপর জেরুজালেম মুসলমানদের হাতে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরপর গাজি হিসেবে সালাহউদ্দীন ১১৮৭ সালের ২রা অক্টোবর (৫৮৩ হিজরীর ২৭শে রজব) জেরুজালেমে প্রবেশ করেন। বায়তুল আকসাসহ জেরুজালেম আবার মুসলমানদের হাতে আসে।
তবে জেরুজালেম উদ্ধারের চেয়ে তার রক্ষাতেও সালাহউদ্দীন কৃতিত্ব কম ছিল না। মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব ফিরে যাওয়ার সংবাদে ইউরোপে আবার মাতম শুরু হয়। পুরো ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৃতীয় ক্রুসেডের নামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নেয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীসহ প্রায় সব ইউরোপিয়ান শক্তি এই আগ্রাসনে শরিক হয়। এতে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড ফ্রান্সের ফিলিপ পারস্পরিক সব বৈরিতা ভুলে ক্রুসেডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১১৮৯ সালে তাঁরা এই ক্রুসেড শুরু করেন। খ্রিস্ট শক্তি এতো বিশাল বাহিনী নিয়ে আর কখনো ক্রুসেডে আসেনি। কিন্তু তারা অবিরাম সংগ্রাম করেও আর জেরুজালেম দখল করতে পারেনি। শেষে তারা মুখ রক্ষামূলক একটি চুক্তিতে আসে। ১১৯২ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তিনি ক্রুসেডারদের সাথে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে ৩ বছর ৮ মাসের জন্য একটি যুদ্ধ বিরতি ঘোষিত হয়। তিনি যদি সে সময় অন্যান্য স্থান থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পেতেন, তবে খ্রিস্ট শক্তিকে আরো শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে পারতেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাস পরই তিনি ইন্তিকাল করেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় তিনি জিহাদে নিয়োজিত থাকলেও ছোট বেলার পাঠাভ্যাস কখনো ভোলেননি। সারা জীবনই তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। তিনি ছিলেন গভীর ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন। হাদিস শাস্ত্রে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। বুদ্ধিবৃত্তি আলোচনায় তিনি তৃপ্তি পেতেন। সমসাময়িকদের শ্রেষ্ঠ বীর হওয়া সত্ত্বেও তার মধ্যে কোন অহংকার ছিল না। সহকর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে পারতেন তিনি সহজেই। তিনি ছিলেন মার্জিত, সংস্কৃতিবান ও ভদ্রজনোচিত ব্যক্তি। কোন ধরনের রূঢ়তা বা জাঁকজমক পছন্দ করতেন না। সব সময়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। তবে প্রয়োজনে তিনি কঠোর হতে পারতেন। তার বদান্যতা, বিশ্বস্ততায় শত্রুরাও ছিল প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চরম শত্রু রাজা রিচার্ডও একাধিকবার সালাহউদ্দীনের দরদি হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সমকালীন প্রেক্ষাপটে তিনি বহু বিরল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। কায়রো এবং জেরুজালেম পুনঃগঠনে তিনি অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশেষ করে মসজিদুল আকসাকে ক্রুসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করার পর তিনি মসজিদ হিসেবে প্রস্ত্তত করেন। দূর- দূরান্ত থেকে তিনি মূল্যবান সামগ্রী সংগ্রহ করে সুন্দরভাবে মসজিদটিকে সাজিয়ে ছিলেন।
তিনি কখনো নিজের ক্ষমতার উপর অতিরিক্ত ভরসা করতেন না। শত্রু পক্ষের প্রকৃত শক্তি এবং দুর্বলতা তিনি চুল চেরা বিশ্লেষণ করতেন। নিজের অবস্থানও তার কাছে ছিল পরিষ্কার। মুসলিম বাহিনীকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তিনি সফলও হয়েছিলেন। তবে তৃতীয় ক্রুসেডের সময় অনেক স্থান থেকেই কাঙ্ক্ষিত সাহায্য পাননি। প্রথম দিকে তিনি সফল হয়েছিলেন। তার শক্তি বৃদ্ধিতে বাগদাদের খলিফাসহ অনেকেই ছিলেন ঈর্ষান্বিত। তবে তাদের অন্যায় আচরণ সত্ত্বেও হতোদ্যম হননি তিনি। নিজের যতটুকু সামর্থ্য ছিল, তাই নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন তিনি।
যুদ্ধ জয়ের পরও তিনি ছিলেন শান্ত এবং সংযত। প্রতিশোধ নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠাই ছিল তার লক্ষ্য। মহৎ প্রাণ এই সুলতান বন্দী রাজা গাইকেও মুক্তি দিয়েছিলেন। এমনকি যুদ্ধবন্দি নাইটদেরও মুক্তিপণের মাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। নাইট পরিবারগুলোকে অবাধে জেরুজালেমে ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছিলেন কাউকেই অন্যায়ভাবে দন্ডিত করেননি। অথচ মাত্র ৯০ বছর আগে জেরুজালেম দখল করার পর খ্রিস্টানরা যে পাশবিক আচরণ করেছিল, তার দাগ তখনও ছিল। তারা তখন জেরুজালেমের সকল মুসলমানকে হত্যা করেছিল। মসজিদ, মাদ্রাসাগুলোকে ধ্বংস করেছিল। পাঠাগারগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সালাহউদ্দীন এবার তার কোন প্রতিশোধ নেননি। এমনকি খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থানগুলো প্রাদ্রীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য বায়তুল মোকাদ্দাস, ডোম অব রকসহ ইসলামিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন। তার ২৫ বছরের শাসনামল এক অনন্য সাধারণ ইতিহাস। এক ক্রান্তি লগ্নে তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। বিশ্বের সকল স্থানের মুসলমানদের জন্য তিনি এক শ্বা শত আদর্শ হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
সিরিয়া ছিল গাজি সালাহউদ্দীনের প্রিয় জায়গা। আর দামেস্ক শহরকেও তিনি ভালোবাসতেন। ১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ (৫৮৯ হিজরীতে) ইন্তিকালের পর তাকে প্রথমে দামেস্কে দুর্গের অভ্যন্তরে দাফন করা হয়। ১১৯৫ সালে উমা-ইয়া মসজিদের উত্তরে তাকে স্থায়ী কবরে দাফন করা হয়।
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন