hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

মুসলমানদের পতন অতীত বর্তমান (সালাহউদ্দীন আইউবীর আবির্ভাব পূর্ব ইসলামি বিশ্ব ও বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা)

লেখকঃ মুহাম্মদ আল আবদাহ

৩. আলেম সমাজ ও রাজনীতি
রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা আর রাফেজী সম্প্রদায়ের উদ্ভবের পরিবেশের মধ্যেও আহলুস সুন্নাহর আলেম সমাজ ইলমের প্রচার- প্রসার আর ছাত্রদের দীক্ষা দানে অটল- অবিচল ছিলেন। হাদিস, ফিকাহ এবং অভিধান বিষয়ের উৎসাহী ছাত্রদের উপস্থিতিতে তখনকার দিনে মসজিদগুলো পরিপূর্ণ থাকতো। তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান, কারিগরি জ্ঞান আর জ্যোতির্বিদ্যা চরম উৎকর্ষ লাভ করে। এভাবে সঠিক ধারায় জ্ঞানের লন হয়। তা টিকে থাকে সুন্দরভাবে। কেটে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী। প্রতিপালিত হয় অর্পিত দায়িত্ব। গঠন করা হয় জনসাধারণের মন-মানসিকতা আর খর্ব করা হয় শাসক শ্রেণির দম্ভ- অহমিকা।1

আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর বুদ্ধিবৃত্তি অবস্থার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ যুগে আমরা যেমন আলেম সমাজের প্রাচুর্য প্রত্যক্ষ করি, তেমনি প্রত্যক্ষ করি উৎপাদন ক্ষেত্রেও প্রাচুর্য। ব্যাপারটা কি স্বাভাবিক, না-কি রাজনৈতিক অস্থিরতা জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলে না?

আসলে কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা- দুর্বলতা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তবে সেখানে জ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকার ক্ষেত্রে কিছু কারণ কাজ করেছে। সেসব কারণের অন্যতম হচ্ছে :

১. তদানীন্তন কালে মুসলিম দেশগুলোর সীমান্ত এলাকা ছিল উন্মুক্ত। ফলে আলেম সমাজ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গমনাগমন করতেন। তাঁরা নিজেরাও উপকৃত হতেন আর অন্যদেরও উপকার সাধন করতেন। কোন দেশে গমন- নির্গমনের জন্য ভিসার কোন প্রয়োজন হতো না। তখন তাঁদের নিকট গোটা বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত ছিল : দারুল ইসলাম আর দারুল হারব। অথচ দেশ ছিল অনেক আর ভিন্ন ভিন্ন।

২. এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অন্যান্য দেশের সঙ্গে খ্যাতি আর প্রতিযোগিতার জন্য উৎসুক ছিল। সকল দেশের শাসক- সুলতান আগ্রহী ছিলেন যে, তাঁর রাজ দরবারে বেশি বেশি আলেম, সাহিত্যিক বা চিকিৎসকের সমাবেশ ঘটুক, যাদেরকে নিয়ে তারা গর্ব করতে পারেন। যদিও অধিকাংশ ফকীহ আর মুহাদ্দিস কোন রকম ভয়- ভীতি আর লোভ লালসা বা কারো উৎসাহ ছাড়াই নিজেরা জ্ঞান বিস্তার করতেন। এজন্য তারা কারো সহায়তার অপেক্ষায় থাকতেন না।

৩. শাসকশ্রেণী আলেম সমাজের পেছনে লাগতেন না। তারা তাদেরকে নিজ নিজ অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। আলেম সমাজের পক্ষ থেকে শাসক শ্রেণির জন্য কোন রকম শঙ্কা বা হুমকি ছিল না। ফলে তাঁরা আলেম সমাজকে তাঁদের অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। বরং কোন কোন তুর্কি সেনাধ্যক্ষ আলেম সমাজকে শ্রদ্ধা করতেন। যদিও অকারণে রক্তপাত করতে তারা ভয় করতেন না।

এসব কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই যে, এসব মহান আলেমদের দ্বারা আল্লাহ তাআলা তার দীনের হেফাজত করেন। এসব মহান আলেমদের সম্পর্কে নমুনা স্বরূপ আমরা কিছু আলোচনা করব। জ্ঞান বিস্তারে আল্লাহ তাআর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া তাঁদের অন্য কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না।

হিজরী চতুর্থ শতকের কয়েকজন বড় বড় আলেম -

ইবনে খুযায়মা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক।

শারহুস সুন্নাহ গ্রন্থের রচয়িতা হুসাইন ইবনে মাসউদ আল- ফাররা আল- বাগাবী। (মৃত্যু ৫১৬ হিজরী)

ফকীহ আবু বকর ইবনুল মুনযির।

ঐতিহাসিক ইবনে জারির তাবারী।

এ যুগের কয়েকজন মশহুর আলেম -

হাদীসে র মশহুর কিতাব সুনানে আবু দাঊদের বাখ্যাদাতা আবু সুলাইমান আল- খাত্তাবী আল- বুস্তী (মৃত্যু ৩৪৯ হি:)।

প্রখ্যাত হাফিজ ও মুজতাহিদ ‘আ-আনওয়া ওয়াত তাকাসীম’ গ্রন্থের রচয়িতা ইবনে হাববান আল- বুস্তী (মৃত্যু ৩৫৪ হি:)।

প্রখ্যাত তাফসীরবিদ মহান হাফিজ ‘আল- জারহু ওয়াত তা’দীল’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্দুর রহমান ইবনে হাতিম আররাযী (মৃত্যু ৩২৭ হিজরী)।

হাম্বলী মজহাবের বড় ফকীহ, আলেম, যাহিদ এবং ওয়ায়েয আবূ মুহাম্মদ আল-বারবাহারী। বিদআতপন্থী আর পাপাচারের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কঠোর।2

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মজহাবে ফিকাহের কিতাব ‘আল-মুখতাছার’ গ্রন্থের রচয়িতা ওমর ইবনে হুসাইন আল-খারকী। তিনি ছিলেন ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। বাগদাদে অন্যায় অনাচার বৃদ্ধি পেলে এবং সাহাবায়ে কেরামকে গালমন্দ দেয়া শুরু হলে তিনি বাগদাদ থেকে হিজরত করে অন্যত্র গমন করেন।3

মহান হাফিজ সমালোচনা বিষয়ে ‘আল-কামিল’ গ্রন্থের রচয়িতা আবূ আহমদ ইবনে আদী।

আবূ আব্দুল্লাহ আ- হাকেম নীশাপুরী।

শাফেয়ি মাযহাবের মহান ফকীহ আবূ হামেদ আল- ইসফারাইনী।

ইমামুল হারা-মাইনের পিতা, ফিকাহ, ঊসুল এবং সাহিত্য বিষয়ের ইমাম আবু মুহাম্মদ আল জুয়াইনী।

ইবনু সুরাইজ শাফেয়ি।

মালেকী মাজহাবের ইবনুল হাদ্দাদ আল- মাগরেবী। তিনি উবাইদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুনাযারা করেন। তাদের প্রতাপে ভীত হননি।

রাষ্ট্র শাসন ও রাজ্য পরিচালনা বিষয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ আল- আহকামুস সুলতানিয়া গ্রন্থের প্রণেতা আবুল হাসান আল মাওয়ার্দী। ফিকাহ বিষয়ে তাঁর আল- হাবী গ্রন্থও প্রসিদ্ধ।

ইলমে হাদীসে যুগের ইমাম হাফেজ দারে কুতনী।

কাজি আলী ইবনে আব্দুল আযীয আল- জুরজানী।

আশআরী মাজহাবের শীর্ষস্থানীয় মুতাকাল্লিম কাজি আবু বকর আল- তাকিল্লানী।

হাম্বলী মজহাবের অন্যতম প্রধান আলেম ইবনে বাত্তা নামে পরিচিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ আল- আকবারী। ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে নিষেধে তিনি ছিলেন খ্যাত।

তারিখে বাগদাদ গ্রন্থের রচয়িতা ঐতিহাসিক খতিব বাগদাদী।

হাদিস শাস্ত্রের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ইমাম বায়হাকী।

সাহিত্য ও অভিধান বিষয়ে পন্ডিতদের মধ্যে ছিলেন-

কুরআন মজীদের অভিধান গ্রন্থ ‘মা‘আনিল কুরআন’ এর প্রণেতা আযযুজাজ।

আবু সাঈদ আল- সায়রাফী।

ইবনু খুওয়াইহ।

আবু আলী আল- কাল।

প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন-

কবি আল মুতানাববী, ইবনুল আমীদ, ছাহেব ইবনে আববাদ এবং আবু ইসহাক আছ-ছাবী।

অংক ও চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব-

আল-বিরুনী। অংক শাস্ত্রে ইনি ছিলেন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব।

চিকিৎসা বিজ্ঞানী রাজি।

অংক শাস্ত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবুল ওয়াফা আল- বুযজানী।

ইবনুল বাইতার। গ্রহ- নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ বিষয় তাঁর বেশ দক্ষতা ছিল। তিনি ছিলেন নক্ষত্র পূজারি। পরে ইসলাম গ্রহণ করেন বলে কথিত আছে। এটা হচ্ছে আলেমদের দীর্ঘ তালিকার মধ্য থেকে একটা মাত্র নগণ্য অংশ।

ইতিহাস আর জীবনী গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে জানা যাবে যে, মুসলিম বিশ্বের দিকে দিকে হাজার হাজার আলেম- উলামা ছড়িয়ে ছিলেন। তাঁরা অধ্যয়ন আর অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। সন্দেহ নেই যে, এর ফলে দীন ইসলামের হেফাজত হয়েছে। হেফাজত হয়েছে মুসলিম উম্মারও। এতে বিপুল সংখ্যক আলেম - উলামার উপস্থিতি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে মুসলমানদের দুর্বলতার বোঝা লাঘব হয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি রাজনৈতিক পতনের প্রতি লক্ষ্য করবে এবং আলেম সমাজের জীবনী অধ্যয়ন করবে সে অনুধাবন করবে যে, সেখানে দু’টি বিচ্ছিন্ন জগৎ। অথচ শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে তারা কোন কষ্ট পেলে আলেম সমাজের হাতেই তারা মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণতো।

আল্লাহ তাআলার বাণী :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ ( النساء : ৫৯)

‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ তাআলার, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলুল আমর এর।’’ (সূরা নিসা : ৫৯)।

এ আয়াতে আলেম সমাজই উদ্দেশ্য। মুফাসসিরগন বলেন : উলুল আমর অর্থ আলেম সমাজ এবং শাসক শ্রেণি। তবে কোন বিপদাপদে তাঁদের নিকট ফিরে আসার শিক্ষা তাঁরা কেন জনগণকে দেন না।

যদিও কিছু কিছু আলেম উপদেশ আর ভালো কাজের নির্দেশ এবং মন্দ কাজে নিষেধের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক আলেমের তুলনায় তাদের সংখ্যা কম। আলেম সমাজের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে শায়খ রশীদ রেজা বলেন . আববাসীয় শাসকদের শাসনামলে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। আর উলামায়ে দীন তা অব্যাহত রাখেন। অথচ বনু উমাইয়াদের শাসনামল এবং আববাসীয়দের শাসনামলের প্রথম দিক পর্যন্ত অতীত কালের আলেম সমাজ শাসক শ্রেণিকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন।4

কিছু কিছু আলেম আর ছাত্রদের বক্তব্য ছিল এরকম : ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিপ্লব, রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়া ছুঁড়ি আর ফেৎনা-ফাসাদে জড়ানো থেকে আমরা দূরে থাকি। ইসলামকে ভালোবাসে এমন জাতির লালন আর জ্ঞান বিস্তারে আমরা নিয়োজিত থাকি যাতে জ্ঞান নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়। সন্দেহ নেই যে, এটা একটা মহান লক্ষ্য। এটা যে বিরাট কাজ তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এ কাজে নিয়োজিত হতে হয় নিবিষ্ট মনে। কিন্তু যে জাতিটার লালন করা হচ্ছে, বিকৃতির সংশোধন আর উম্মার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে, তাদেরতো একটা ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে।

অধিকাংশ বিদ্যার্থী সে সংকীর্ণ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। অথবা শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে তাদের জন্য যে ছক এঁকে দেয়া হয়েছে, তা হয়তো তাদের বিপুল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের জীবন যাপনের কারণ হতে পারে। অথবা তাসাঊফের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণ হতে পারে। কিন্তু এরপরও একটা প্রশ্ন অবশিষ্ট থেকে যায়; গোটা জাতি যখন ফিতনা ফাসাদ আর বিপদাপদের ঘনঘটায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত,,বেদআতপন্থী আর শরিয়ত বিরোধীদের যখন দোর্দন্ড প্রতাপ, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়, তখন আলেম সমাজ বা ইলমে দ্বীনের শিক্ষার্থীরা কীরূপে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারে? এ সয়লাব রোধে আলেম সমাজ কীভাবে হাত- পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? অনাচার আর অশ্লীলতার সয়লাব রোধে কেন তাদের কার্যকর ভূমিকা থাকবে না? আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই যে, মুসলিম উম্মার দুর্বলতা আর অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে উম্মার নেতৃত্ব থেকে আলেম সমাজের দূরে সরে থাকা। তাদের শাসন কার্য থেকে দূরে সরে থাকাও এর একটা বড় কারণ। ক্ষমতা আর শাসন কার্য থেকে আলেম সমাজের দূরে সরে থাকার চিন্তাটাই একটা ভুল চিন্তা। আর এ ভুল চিন্তাটাই বর্তমানে ব্যাপকতা লাভ করেছে। মুসলিম সমাজে এমন কিছু উলামায়ে রাববানী আছেন, যারা উম্মতের তরবিয়তের দায়িত্ব পালন করেন আর রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার কারণে এদেরকে সমাজে উত্তম ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।5 এদেরকে সমাজের উত্তম ব্যক্তি মনে করাটাই একটা বড় বিপদ। আর এ বড় বিপদটাই চেপে বসেছে মুসলিম সমাজে। মুসলিম সমাজের এটাই বড় দুর্বলতা। কোন মুসলমান কি কাউকে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে বড় আলেম এবং বড় মুত্তাকী মনে করতে পারে? অথচ বদর, ওহুদ, খন্দক, ইত্যাদি বড় বড় যুদ্ধে তিনি নিজে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।62

এ অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন . সত্যাশ্রয়ী রাজনীতির জন্য ফকীহদের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণেই মুসলিম সমাজে দুর্বলতা আর বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে; শরিয়ত আর রাজনীতি দুশমনকে আহবান জানায় শরিয়তের দিকে। আর দুশমন আহবান জানায় শুধু রাজনীতির দিকে। আর এর কারণ হচ্ছে সন্নাহ বুঝার ব্যাপারে এদের দুর্বলতা, অক্ষমতা।63

জনৈক আরব কবি তাঁর কবিতায় আলেম সমাজ আর বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিক শ্রেণির রাজনীতি থেকে দূরে থাকার চিত্র অঙ্কন করেছেন। পাষাণ- জালিম তুর্কিদের দয়ার নীচে কীভাবে তারা খলিফাদেরকে ছেড়ে দিয়েছে, তিনি তারও চিত্র অঙ্কন করেন। ব্যাকরণের বিতর্কে প্রবৃত্ত মক্কার একটি দলকে লক্ষ্য করে কবি বলেন . 64

اما تستحون الله يا معدن النحوشغلتم بذا والناس فى اعظم الشغل

أمامكم أضحى قتيلا مجندلا وقد أصبح الإسلام مفترق الشمل

وأنتم على الأشعار والنحو عكّفاًتصيحون بالأصوات في أحسن السبل

হে ব্যাকরণের খনি তোমরা কি ভয় করনা আল্লাহ কে?

তোমরাতো এটা নিয়েই ব্যস্ত, আর লোকেরা ব্যস্ত বড় কাজে।

তোমাদের ইমাম নিহত হচ্ছে নির্মমভাবে, ইসলাম দাঁড়িয়েছে ক্রান্তি কালে।

আর তোমরা কিনা কবিতা আর ব্যাকরণ নিয়ে ব্যস্ত।

চমৎকার সড়কে তোমরা চিৎকার জুড়ে দিয়েছ।

সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল এই যে, বিচার বিভাগ ছিল একটা স্বাধীন সংস্থা, সরকারের প্রভাব থেকে তা অনেকাংশে মুক্ত ছিল। সে যুগে তা-ও জামিনদারের নিকট জিম্মি করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তবে আমরা এখানে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করব। বিস্তারিত আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এখানে দুটি বিষয়ে উল্লেখ করা জরুরি।

এক . জনজীবন থেকে আলেম সমাজের বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক রাজনীতি থেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়টা ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন রেকর্ড করেছেন। তিনি বলেন .

‘আলেম সমাজ রাজনীতি আর রাজনৈতিক দর্শন থেকে অনেক দূরে। এর কারণ হচ্ছে, তারা দার্শনিক চিন্তা আর অন্তর্নিহিত রহস্য নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। বাইরের অনুভূতির জগৎ থেকে তাদের চিন্তার রাজ্য বিচ্ছিন্ন। গোটা বিষয়টা তাদের মন- মানসে অনুপস্থিত। এহেন দূরত্বে অবস্থান করে তারা বাইরের জগতের সাথে তা খাপ খাওয়াতে চান।65 তিনি বলতে চান যে আলেম সমাজের অধিকাংশ কিতাবপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কিতাবের ভিতর দিয়েই তারা বাইরের জগতের দিকে তাকান। অথচ বাইরের বাস্তব অবস্থা, রাষ্ট্র এবং মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এর বিপরীত; অথবা তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তা গবেষণা করা আবশ্যক। অবশ্য কিতাবের ভিতর দিয়ে তাঁরা বাইরের যে দৃশ্য অবলোকন করেন, তা আবশ্যিক ভাবেই ভুলের দিকে চালিত করতে বাধ্য। বাস্তব সম্পর্কে যার কোন ধারণা নেই, তিনি মনে করেন যে, সমসাময়িক শাসকরাও কোন কোন উমা-ইয়া আববাসীয় শাসকের মতো। অথচ এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। রাজনীতি সম্পর্কে ইবনে খালদূন বলেন, বাইরের জগতের প্রতি লক্ষ্য রাখাও রাজনীতির জন্য আবশ্যক। বাইরের যে অবস্থা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, তা সূক্ষ্ম আর প্রচ্ছন্ন হলেও তৎ প্রতি দৃষ্টি দান করা কর্তব্য।66 যখন রাজনীতির অর্থ হবে বাস্তবকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করা আর এ বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে তাকে ইসলামের কাঙ্ক্ষিত মান আর স্তরে নিয়ে যাওয়া, তখন এটা কার্যকর করা সম্ভব হবে। কিন্তু যখন রাজনীতির অর্থ হবে দ্বন্দ্ব- সংঘাত, প্রতারণা- প্রবঞ্চনা। তৈল মর্দন শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করা আর মুনাফেকিতে সিদ্ধহস্ত হওয়া, তখন নিষ্ঠাবান আলেম সমাজ যে এহেন রাজনীতির পরিবেশ থেকে দূরে থাকবেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁদের নিকট এটাই হবে শরিয়ত ভিত্তিক রাজনীতি। আর এটাই ইজতিহাদের দাবি। অবশ্য তাঁরা মনে করেন যে, এ পরিবেশেও জ্ঞান বিস্তার করাই হচ্ছে উত্তম কাজ। শরিয়ত সম্মত রাজনীতি বিষয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যেমন আল-মাওয়ার্দী রচিত ‘আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ’ এবং ইমাম জুয়াইনী রচিত ‘গিয়াসুল উমাম ফি ইলতিয়াসিস যুলাম’। (এ বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রচিত ‘সিয়াসতে শারইয়াহ’ গ্রন্থেও উল্লেখযোগ্য। যার বাংলা অনুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে- অনুবাদক)। এ ক্ষেত্রে ইবনে খালদূনের উক্তি নিঃশর্তরূপে গ্রহণ করা যায় না। কারণ তিনি ছিলেন অতি বাস্তববাদী।

দুই . যে বিষয়টি ইবনে খালদুন রেকর্ড করেছেন, তা হচ্ছে আলেম সমাজের সামাজিক- অর্থনৈতিক অবস্থা। তিনি বলেন . দ্বীনি বিষয় যথা বিচার ফয়সালা করা, ফতোয়া দান, শিক্ষা দান এবং ইমামতি করা- এসব কাজ অধিকন্তু তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে না। আর এর কারণ হচ্ছে এই যে, বিত্তবানরা তাদের জন্য জীবিকার একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন, তাদের প্রয়োজন অনুপাতে। এতে তাঁরা প্রতাপশালী সেনাধ্যক্ষদের সমকক্ষ হতে পারেন না। আর আলেম সমাজ তাঁদের সম্মানজনক জীবিকার কারণে জনগণের নিকট সম্মানের পাত্র। তাঁরা সম্মানের পাত্র নিজেদের নিকটও। জীবিকার প্রাচুর্যের জন্য তাঁরা ক্ষমতাসীনদের নিকট নত হতে পারেন না। পারেন ধর্ণা দিতে। এজন্য তাঁদের অবসরও থাকে না। কারণ সম্মানজনক সামান্য জীবিকা নিয়েই তাঁরা মহান দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত।67

সুতরাং ইবনে খালদূনের মতে আলেম সমাজের করুন অবস্থার কারণ এই যে, তাঁরা ক্ষমতাসীন আর বিত্তবানদের তোষামোদ করতে পারেন না। তাঁরা জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান বিতরণের কাজে ব্যস্ত। অনুন্নত অনেক দেশই বিচার কার্য, ইমামতি এবং ফতোওয়া দানের কোন গুরুত্ব অনুধাবন করে না। ফলে তারা আলেম সামজের কোন প্রয়োজনও বোধ করে না। এটা বাস্তব সত্য। ফলে উলামাদের ভাতা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের ভাতার ধারে কাছেও পৌঁছে না। আববাসীয় বা উবাইদিয়া শাসনামলে একজন মন্ত্রীর ভাতা মাসিক ৫ হাজার দীনার পর্যন্ত ছিল। কম করে হলেও তা ছিল ৩ হাজার দীনার। অথচ তখন একজন প্রধান বিচারপতির ভাতা ছিল মাসিক একশো দীনার।68 এসব তত্ত্ব পেশ করে ইবনে খালদূন বলেন .

এটা এমন এক প্রমাণ, যা সম্পর্কে দৃষ্টি দেয়া এবং চিন্তা- ভাবনা করা উচিত। কারণ, তা এখনো আমাদের সামনে বর্তমান রয়েছে। ওয়াকফ দফতরের দায়িত্বশীলরা কেবল কোন রকমে প্রাণে বেঁচে থাকা পরিমাণ ভাতা গ্রহণ করতেন। এ বিষয়টা বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে মসজিদের ইমামদেরকে এমন ভাবে দৃশ্যে প্রকাশ করা যায়, যা তাদের উপযুক্ত নয়। ফলে মানুষ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাবে। এসব ইমাম-মুয়াযযিনরাই হচ্ছেন এর প্রমাণ। এ কারণে অনেক আলেম তিজারত বা ব্যবসা- বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেছেন। ফলে তাঁদেরকে কারো তোয়াজ- তোষামোদ করতে হতো না। আলেম সমাজ নিজেরাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারেন। ফলে তাঁরা হক কথা বলতে সক্ষম হবেন। জ্ঞান আর শিক্ষা কেন্দ্রও এ সমাধানের অংশ হতে পারে। এটা করতে পারলে আলেম সমাজ তাঁদের নিজেদের বিষয়ের দায়িত্ব-ভার দুশমনদের হাতে তুলে দেবেন না। সুতরাং তাঁদের সমস্যার সমাধান তাঁদের নিজেদেরকেই করতে হবে।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন