মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
মুসলমানদের পতন অতীত বর্তমান (সালাহউদ্দীন আইউবীর আবির্ভাব পূর্ব ইসলামি বিশ্ব ও বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা)
লেখকঃ মুহাম্মদ আল আবদাহ
২৯
৩. সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবী
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/494/29
সুলতান নূরুদ্দীন মাহমুদ যে জিহাদের সূচনা করেন এবং সংস্কারমূলক কার্যে আলেম সমাজের ভূমিকা ফিরিয়ে আনার জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো হয়, এবং সালাহউদ্দীনের বাবা আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর মৃত্যুর পর সুলতান সালাহউদ্দীন যে প্রচেষ্টা চালান, তার আলোকে জিহাদের পরিমন্ডল গড়ে উঠে। সালাহউদ্দীন চেষ্টা করেন তাঁর চাচা শেরকোহ- এর মৃত্যুর পর কায়রোয় ওবায়দীদের শেষ বাদশাহ আযেদ এর মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করতে। কারণ, তিনি তার মধ্যে দুর্বলতার ধারণা করেন। তাঁর সঙ্গে যেসব সৈন্য রয়েছে তদ্দবারা তিনি মিশরের সহায়তা লাভ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু ব্যাপার ঘটে ধারণার বিপরীতে। সালাহউদ্দীন প্রস্ত্তত হয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি ক্রীড়া- কৌতুক পরিত্যাগ করলেন। দ্বীনের লেবাস পরিধান করলেন এবং শরিয়তের মর্যাদা হেফাজত করলেন।1 তিনি যে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তা প্রমাণ করে অনন্য ব্যক্তিত্ব, আর তা উৎসারিত হয় সত্যিকার খনি থেকে। ফলে তিনি ইসলাম এবং মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে উঠে দাঁড়ান, আপন পালন কর্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্বে তিনি স্বস্তি আস্বাদন করেননি, তাঁর মন পরিতৃপ্ত হয়নি।
আমরা এখানে আইয়ুবী রাজত্বের ইতিহাস আলোচনা করতে চাই না। আমরা কেবল আলোচনা করতে চাই সালাহউদ্দীন ব্যক্তিত্বের মধ্যে সেই জিহাদী আরবদের প্রভাব। আলিম সমাজ আর সেনা অধিপতিদেরকে তিনি কীভাবে প্রস্ত্তত করেছিলেন, যারা এ মহান অভিযানে তাঁকে সহায়তা করেছেন।
সালাহউদ্দীনকতিপয় কীর্তি
১. সুন্নাহর প্রতি মিশরকে ফিরিয়ে আনা
সালাহউদ্দীন মিশরীয়দের পদচ্যুত করেন ; কারণ তারা ছিল শিয়া। তিনি আব্দুল মালেক ইবনে দিরবাস শাফেয়িকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন। তারা আজানে পরিবর্তন সাধন করে (হাইয়্যা ‘আলা খায়রিল আমল)। মিসরে আববাসীয় খলিফাদের নামে খুতবা বন্ধ করার পর তিনি আববাসীয়দের নামে খুতবাহ চালু করেন। (২০৮ হিজরী)। আববাসীয় খলিফা নূরুদ্দীন মাহমুদ এ সুসংবাদ দান করেন। ফলে জনগণ খুশি হয়।
এ প্রসঙ্গে ইমাদ আল- ইসফাহানী কবিতা রচনা করেন .
توفي العاضدُ الدعيّ فما يفتحُ ذو بدعة بمصر فما
وعصرُ فرعونِها انفضى وغدايوسفُها في الأمور محتكما
وصار شمل الصلاح ملتئماًبها وعقد السداس منتظما
২. সিরিয়া- মিশর ঐক্য
নূরুদ্দীনের ইন্তিকাল এবং শাম দেশের অস্থিরতার পর সালাহউদ্দীনের আবির্ভাব ঘটে। ফলে তিনি দামেশক, হেমস এবং হেমাত অধিকার করেন এবং হালব শহর অবরোধ করেন। কিন্তু কর্মকর্তারা, যাদের ব্যাপারে ওছিয়ত করা হয়েছে, আলী ইবনে নূরুদ্দীন (ইসমাঈল) অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে জাতির নিকট সহায়তা দাবি করেন। নূরুদ্দীন যে শিয়া মতবাদ বাতিল করেন, মনে হয় যে, জাতির একটা বিরাট অংশ তাদের দিকে নুয়ে পড়ে। ফলে তারা সহায়তার জন্য কথা অনুযায়ী কাজের দাবি জানায়। শহরের নেতারা এ শর্তের পক্ষে রায় দেয়, কেবল কথাকেই তারা যথেষ্ট মনে করে না। তারা যখন সালাহউদ্দীনের শক্তি এবং আরব বোধে তার অব্যাহত থাকা লক্ষ্য করে, তখন তারা হাশাশী ইসমাঈলীদের নিকট থেকে সহায়তা দাবি করে। এরা বানিয়াসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। ফলে তারা নিজেদের ধারায় চেষ্টা চালায়। বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা সালাহউদ্দীনকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। কিছু সময়ের জন্য অবরোধ তুলে নেন। পরে পুনরায় ফিরে আসেন। হাশাশী ইসমাঈলীরা পুনরায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়। এ কাজে তারা ব্যর্থ হয় এবং এ কাজের জন্য তাদের মধ্যে যারা এসেছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়। এরা নিজেদেরকে ‘ফেদাবিয়া’ বলে অভিহিত করে। হালব বাসীরা কেবল এটাকেই যথেষ্ট মনে করেনি। তারা বরং ত্রিপোলীর ক্রুসেডার শাসকের নিকট সাহায্য কামনা করে। সালাহউদ্দীন এটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি, বরং তিনি একটা ক্ষুদ্র পত্র প্রেরণ করেন।
এতদ সত্ত্বেও সালাহউদ্দীন হালব থেকে ফিরে আসেন, হালব বাসীদের সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধে তিনি কোন রকম হস্তক্ষেপ করেননি। বিশেষ করে তারাতো সন্ধি প্রত্যাশী ছিল। এ ব্যাপারে তারা নুরুদ্দীন মাহমুদের কন্যার নিকট সুপারিশও চায়। কিন্তু মিশর- সিরিয়ার ঐক্য বিষয়ে সুলতানের অভিপ্রায় অটল ছিল। এমনকি দুশমনের মুখের সামনে দাঁড়াতেও তিনি ইতস্তত করেননি। এসময় তিনি বিপর্যয়ের জট উপড়ে ফেলার ইচ্ছা করেন এবং হাশাশীদের উপর আঘাত হানেন। তাদের মধ্যে অনেকে নিহত এবং অনেকে বন্দী হয়। কিন্তু তাঁর মামা শিহাবুদ্দীন হারেমী, যিনি হেমাত এর শাসক, তিনি তাদের জন্য সুপারিশ করলে সুলতান তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন।2 নূরুদ্দীনের পুত্রের মৃত্যুর পরই সুলতান হালবকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হন। তাঁরপর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে হালবের অধিবাসীরা তা সুলতানের হাতে অর্পণ করে। এমনিভাবে ক্রুসেডারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার শক্ত মূলনীতির দিকে ধাবিত হয়। যেমন কাজি ইবনু শাদাদ বলেন . সালাহউদ্দীন যখন নূরুদ্দীনের মৃত্যু এবং তাঁর সন্তান শিশু থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হন, যে ছোট শিশু রাষ্ট্রের বোঝা বহন করার জন্য এগিয়ে আসবে না, আর এই ছোট শিশু একা আল্লাহর দুশমনদের দমন করতে সক্ষম হবে না, সক্ষম হবে না তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে, তখন তিনি সিরিয়া অভিমুখে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্ত্তত হন। কারণ শাম দেশই হচ্ছে মূল মুসলিম দেশ।3 এতসব কিছু সত্ত্বেও সালাহউদ্দীন এসময় জিহাদ পরিত্যাগ করেননি। বরং মারজে উয়ুনের মতো কয়েকটি যুদ্ধে ক্রুসেডারদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হন। তবে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
সালাহউদ্দীনের জিহাদ
মিশর- সিরিয়া এবং জাযিরা অঞ্চলের অনেক শহরে সালাহউদ্দীন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। জাযিরা অঞ্চলের এক অভিযানে তিনি অসুস্থ হন। তখন তিনি মানত করলেন যে, আল্লাহ তাঁকে আরোগ্য দান করলে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ আর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়েই তাঁর সমস্ত চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করবে। এবং তিনি নিজ হাতে ক্রুসেড (আল কার্ক এর শাসককে) হত্যা করবেন। তদীয় উজির কাজি ফাযেলের ইঙ্গিতে তিনি এই মানত করেন।4
অতঃপর আশপাশের শহরগুলোর উপর তিনি সমন্বিত হামলা শুরু করেন। আর এটা করেন আল্লাহ তাকে বড় বিজয়ে ধন্য করার পূর্বে। আর বড় বিজয় হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার করা। হিজরী ৫৭৫ সনে (মারজে উয়ুনের) ঘটনায় তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। বানিয়াসের যুদ্ধেও তিনি জয়লাভ করেন। তিনি খ্রিস্টান নেতাদেরকে বন্দী করেন এবং ছফদ অঞ্চলে দুঃখের দুর্গ ধ্বংস করেন। একের পর এক তিনি খ্রিস্টানদের দুর্গের উপর হামলা পরিচালনা করেন। হিত্তীনের সমভূমিতে তাঁর জন্য বিরাট বাহিনী প্রস্ত্তত হয়। এখানে এমন বড় ঘটনা ঘটে, যাতে খ্রিস্টানদের হাড্ডি ভেঙে যায় এবং বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ক্ষেত্রে প্রস্ত্তত হয়। খ্রিস্টান প্রধানদের মধ্যে যারা এ যুদ্ধে উপস্থিত ছিল, তারা আহত এবং নিহত হয়। নিহতদেরকে প্রত্যক্ষকারী ব্যক্তি বলে . সেখানে তো কোন বন্দী ব্যক্তি নেই, কে বন্দী দেখেছে? সেখানেতো কোন নিহত ব্যক্তি নেই। শাম দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে খ্রিস্টানদের উপর কর্তৃত্ব লাভের পর থেকে হিত্তীনের আহত মুসলমানদের জন্য এটা ছিল এক মুক্তি।5
আল-কার্ক (আরনাত) এর শাসনকর্তাও ছিলেন বন্দীদের মধ্যে, যে হাজিদেরকে পীড়া দিতো। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল মদিনা অধিকার করা। তাই সালাহউদ্দীন নিজ হাতে তাকে হত্যা করে মানত পুরা করেন। তিনি ফেদাবী আর ইসবার্তীদেরকেও হত্যা করেন। কারণ, তারা ছিল খ্রিস্টানদের শয়তান এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বিদ্বেষী। হিত্তীনের যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সুলতান সালাহউদ্দীন যেসব নগর আর দুর্গ জয় করতে সক্ষম হন, সেগুলো হলো আক্কা, নাবলুস, হাইফা, কায়সারিয়া, ছফুরিয়া এবং নাছেরা। হিজরী ৫৮৩ সনের ২৭ রজব জুমার দিন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের মিম্বার থেকে পুনরায় আজান ধ্বনিত হয় এবং ৯১ বৎসর পর বায়তুল মুকাদ্দাসের কর্তৃত্ব মুসলমানদের নিকট ফিরে আসে। এতে মুসলমানরা মহা আনন্দিত হয়। এ সুসংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সুলতান আল্লাহর দরবারে বিনয় আর শুকরিয়া প্রকাশ করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় ছিল সালাহউদ্দীনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। এ উদ্দেশ্যে তিনি একটা বড় মিম্বার প্রস্ত্তত করেন। বিশাল মিম্বার হাজির করা হয় এবং পরবর্তী জুমায় কাজি ইবনু যাকী মিম্বরে আরোহণ করে খুতবা দান করেন। সালাহউদ্দীন শহরের ব্যবস্থাপনা করেন, মসজিদ- মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং যাবতীয় নাপাকী আর অপবিত্রতা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসকে পবিত্র করেন। জিহাদ তাঁর নেশায় পরিণত হয়। তাই বায়তুল মুকাদ্দসে তিনি খুব স্বল্প সময় অবস্থান করেন। এরপর অন্যান্য বিজয় অভিযানে বহির্গত হন। তিনি ছায়দা ও বৈরুত বিজয় সম্পন্ন করেন। জাবা- লাযেকিয়া অধিকার করেন, ইহুদি দুর্গ, রোগরাস দুর্গ অধিকার করত: ছাফদ ও আল- কার্ক অঞ্চল অভিমুখে রওয়ানা করে তা অধিকার করে সাকীফ দুর্গও করায়ত্ত করেন।
এক তুমুল ক্রুসেড যুদ্ধে তারা এক্কা পুনর্দখলের চেষ্টা চালালে সুলতান সালাহউদ্দীন দ্রুত তথায় ছুটে যান এবং তাদের মুখোমুখী অবস্থান নেন। সমুদ্রের দিক থেকে খ্রিস্টানরা এক্কা অবরোধ করে রেখেছিল। সমুদ্রের দিক থেকে ক্রুসেডারদের জন্য অব্যাহত ধারায় সাহায্য আসতে থাকে। দীর্ঘ ৩৬ মাস ধরে মুসলমানরা চরম ধৈর্যের সঙ্গে খ্রিস্টানদের মোকাবিলা করে (হিজরী ৫৮৫ সনের রজব মাস থেকে ৫৮৮ সনের শাবান মাস পর্যন্ত।) এই অবরোধ কালে সুলতান সালাহউদ্দীন বিশাল ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। দীর্ঘ সাড়ে তিন বৎসর যাবৎ তিনি লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিলেন। ইবনু শাদ্দাদ বলেন: তিনি ছিলেন মহান বীর বাহাদুরদের অন্যতম। তাঁর মনোবল ছিল বিরাট আর যুদ্ধ স্পৃহা ছিল অটুট। কোন কিছুই তাঁকে টলাতে পারতো না এবং কিছুতেই তিনি বিচলিত হতেন না। এক রাত্রে ইংল্যান্ড থেকে ৭০টির বেশি যুদ্ধ জাহাজ এক্কা পৌঁছে, আসরের নামাজের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে আমি এসব জাহাজ শুমার করি। এতে তাঁর মনোবল আরো বৃদ্ধি পায়।6 এই দীর্ঘ অবরোধকালে তাঁর এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তিনি বিজয়ও লাভ করেন। কিন্তু ইউরোপ থেকে ক্রমাগত সাহায্য আসতে থাকে সমুদ্র পথে। উভয় পক্ষ বিস্ময়কর ধৈর্যের পরিচয় দেয়। সংঘর্ষ চলে জলে-স্থলে। এই অবরোধকালে সুলতান সালাহউদ্দীন মরক্কোর বাদশাহের নিকট সাহায্য চান, যিনি ছিলেন মুওয়াহহিদদের রাষ্ট্রের প্রধান। কিন্তু বাদশাহ তাঁর সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, সুলতান পত্রে তাঁকে আমীরুল মুমিনীন বলে সম্বোধন করেননি। এই দুর্ভোগের শেষের দিকে সুলতান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং খ্রিস্টানদের সঙ্গে সন্ধির জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তারা পুনরায় এক্কা অধিকার করে নেয় এবং ইয়াফা দখল করারও চেষ্টা চায়; কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। সুলতান বায়তুল মুকাদ্দাস প্রত্যাবর্তন করে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। তিনি নগর প্রাচীর সংস্কার করেন। তিনি নিজে অশ্ব নিয়ে ছুটে যেতেন এবং দূর দূরান্ত থেকে পাথর বহন করে আনতেন। তিনি নিজে অশ্বের পিঠে পাথর বোঝাই করতেন। এই দৃশ্য দেখে সৈন্যরাও তাঁর অনুসরণ করে।7
রাজধানী থেকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর তিনি দামেশকে ফিরে আসেন। তাঁর অন্তরের কামনা ছিল হজের জন্য প্রস্ত্তত হওয়া। এ যাবৎ হজ করার সুযোগ তাঁর হয়নি। ক্রুসেডারদের সঙ্গে জিহাদ অব্যাহত রেখে তাদেরকে স্বদেশ ভূমিতে কোণঠাসা করে রাখা ছিল তাঁর অভিপ্রায়। কিন্তু মৃত্যু তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে দেয়নি। ৫৮৯ হিজরী সনের ২৭ সফর তিনি দামেশকে ইন্তিকাল করেন। আল্লাহর তাঁর প্রতি করুণা ধারা বর্ষণ করুন।
জিহাদের প্রতি তার অন্তরের আকর্ষণ
কাজি ইবনু শাদাদ বলেন . জিহাদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও সদা তৎপর। জিহাদে তিনি অতীব গুরুত্বারোপ করতেন। কেউ যদি হলফ করে বলে যে, জিহাদে বহির্গত হওয়ার পর জিহাদ আর জিহাদে সহায়তা ছাড়া তিনি একটা দীনার এবং দিরহামও অন্য কাজে ব্যয় করেননি, তাহলে তিনি তার কসমে সত্য প্রমাণিত হবেন। তাঁর অন্তরাত্মা এবং সকল অঙ্গের উপর জিহাদ ভালোভাবে জেঁকে বসেছিল। তিনি কেবল জিহাদ নিয়েই কথা বলতেন এবং কেবল জিহাদের অস্ত্রের প্রতিই তাকাতেন। জিহাদের প্রেমে তিনি স্বজন- পরিজন, সন্তান- সন্ততি, স্বদেশ ভূমি এবং সুখ শান্তি বিসর্জন দেন। তাঁবুর ছায়ায় জীবন কাটিয়ে তিনি সুখ ভোগ করেন। বাতাস তাঁবুকে নিয়ে যায় কখনো ডানে আবার কখনো বাঁয়ে। কেউ তার সংস্পর্শে এলে তিনি তাকে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। তাঁর জিহাদী তৎপরতা নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমি নিজেও তাঁর জিহাদ বিষয়ে একটা গ্রন্থ রচনা করেছি। এতে জিহাদ সম্পর্কিত কুরআন মজীদের আয়াত, রাসূলের হাদিস এবং জিহাদের আদব আলোচনা করেছি। ইমাদ ইস্পহানী বলেন, আক্কার পথে সুলতানের সঙ্গে আমরা নদীর তীরে তীরে গমন করেছি। তখন ছিল ভীষণ শীত। সমুদ্র ছিল উত্তাল। সমুদ্রের ঢেউ ছিল পর্বৎসম। সমুদ্র দর্শনে আমি ছিলাম নবীন, তাই আমার নিকট তা মনে হয়েছে ভয়ংকর। সমুদ্রগামী ব্যক্তির মতামতকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি। এ অবস্থায় আমি নিজের দিকে তাকাই এবং মনে মনে বলি . আল্লাহ যখন খুশি হবেন, তখন সমুদ্র তীরের অবশিষ্ট অংশও জয় করার তাওফীক দান করবেন। আমি দেশকে বিভক্ত করেছি এবং ওছিয়ত করে দেশ ত্যাগ করেছি, এবং তাদের দ্বীপের উদ্দেশ্যে আমি এই সমুদ্র ত্যাগ করেছি। তাতে আমি তাদের অনুগমন করেছি, পৃথিবীতে আল্লাহকে অস্বীকার করে এমন কাউকে আমি অবশিষ্ট রাখব না, অথবা আমি মৃত্যু বরণ করব। আমার উপর এ কথার বিরাট প্রভাব পড়ে এবং আমার মনে যা উদয় হয় তার কাছে আমি তা বলি, এই স্বভাবের প্রতি তাকাও, তা কতই না পবিত্র। এই আত্মার প্রতি লক্ষ্য করো, তা কতইনা বীর, কতইনা বাহাদুর! হে আল্লাহ ! তুমিতো জান যে, তোমাদের দ্বীনের সাহায্যে এবং তোমার রহমতের আশায় তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সুতরাং তুমি তার প্রতি দয়া করে। আর তাঁর সবর সম্পর্কে কী আর বলা যায়। আক্কার হাঙ্গামায় আমি তাঁকে দেখেছি; তিনি তখন চরম পীড়িত, পীড়া তাকে চরমভাবে আচ্ছন্ন করে। দেহের মধ্যস্থল থেকে হাঁটু পর্যন্ত এমন ভাবে ফোড়া বের হয়েছে যে, তিনি বসতে পারেন না। এরপরও ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত অশ্বা রোহণে কাটান। ব্যথার প্রচন্ডতায় তিনি ধৈর্য ধারণ করে বলেন: আমি যখন অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করি তখন থেকে অশ্ব পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করা পর্যন্ত ব্যথা দূর হয়ে যায়।8
তিনি আববাসী খলিফাকে উদ্দেশ্য করে লিখেন- এই তিনটি উদ্দেশ্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি জুলুম থেকে বিরত থাকা এবং খলিফার আনুগত্য- এগুলো হচ্ছে কোন রাষ্ট্রের নিকট থেকে খাদিমের কাম্য, যখন খাদিম সে রাষ্ট্র জয় করেন। আল্লাহ জানেন, সে সুখ ভোগ করার জন্য জিহাদ করে না। যে সুখ আসল সুখের চেয়েও হালকা; এমন উম্মার জন্যও সে জিহাদ করে না, যা চাক্ষুষ বিবরণ পূর্ণ করে।9 আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি কীভাবে তিনি নিজে পাথর বহন করতেন বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রাচীর নির্মাণের জন্য। তুমি যদি তাকে পাথর বহন করতে দেখতে তাহলে তুমি জানতে পারতে যে, তিনি এমন হৃদয়ের অধিকারী যার চিন্তায় পাথর বহন করতে পারে।10 তিনি দামেশক প্রত্যাবর্তন করে দেখতে পান যে, বায়তুল মালের দায়িত্বশীল তাঁর জন্য একটা গৃহ নির্মাণ করেছে, তখন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন . দামেস্ক বা অন্য কোথাও অবস্থান করার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। আমাদের জন্ম হয়েছে জিহাদের জন্য।
তাঁর জীবনাদর্শ ও চরিত্র- মাধুর্য
হিজরী ৫৩২ সনে ইরাকের তিকরীত দুর্গে সুলতান ইউসুফ ইবনে আইউবের জন্ম হয়। তাঁর পিতা আইউব ইবনে শাদী ছিলেন উক্ত দুর্গের শাসক। এরপর পিতা মুসেলে বদলী হন। ভাই আসাদুদ্দীন শেরকোহও সঙ্গে গমন করেন। অতঃপর পিতা সিরিয়ায় বা’লাবাক্ক দুর্গের অধিকর্তা হিসাবে দায়িত্ব নেন। পুত্রও পিতার সঙ্গে গমন করেন। নূরুদ্দীন পুত্রকে শিক্ষা দান শুরু করেন এবং তাঁর ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও ন্যস্ত করেন। ফলে তিনি চাচা আসাদুদ্দীন শেরকোহ মিসরে যে অভিযান চালান, তাতে তিনি প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন চাচার সঙ্গী হিসাবে। চাচার মৃত্যুর পর তিনি চাচার পদ গ্রহণ করেন অর্থাৎ ওবায়দী রাষ্ট্রের শেষের দিকে তিনি মন্ত্রী হন। অতঃপর তিনি নিজ নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং জাযিরা অঞ্চলে ঐক্য সাধন করেন এবং জিহাদের ময়দানে আত্মনিয়োগ করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। হিজরী ৫৮৯ সনে তিনি দামেস্কে ইন্তিকাল করেন। তাঁর নিযুক্ত বিচারপতি কাজি ইবনে শাদাদ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন . খোদার কসম করে বলছি, কিছু লোকের কাছে আমি শুনে আসছিলাম যে, তারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে আগ্রহী, তাদের মতো ওরাও নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চায়। আমি নিজে এবং অপরের নিকট থেকে জানতে পেরেছি যে, ফিদিয়া গৃহীত হলে তিনি অবশ্যই নিজেকে ফিদিয়া দিতেন।11
ইবনু শাদাদ বলেন . সুলতান কোন সম্পদ আর সম্পত্তি রেখে যাননি। তিনি তাঁর আমির- কর্মকর্তা ইত্যাদি এমনকি দুশমনদেরকেও দান করতেন। কেবল মাত্র ৪৭ টি দিরহাম ছাড়া তিনি কোন স্বর্ণ- রৌপ্য রেখে যাননি। আর রেখে যান একটা মাত্র দীনার। তিনি সামান্য আহার করতেন, সামান্য বস্ত্র পরিধান করতেন এবং মামুলী যানবাহন ব্যবহার করতেন। তাঁর জন্য যা হালাল এবং যাতে তাঁর মন তুষ্ট হয়, এমন বস্ত্ত ছাড়া তিনি পরিধান করতেন না। তিনি যথারীতি জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন নিয়মিত তিনি হাদিসও শ্রবণ করতেন, দুটি সারীর মধ্যস্থলে। অর্থাৎ জিহাদের ময়দানেও তিনি হাদিস শ্রবণ করতেন। আজে বাজে কথা থেকে তাঁর মজলিশ ছিল মুক্ত। তাঁর মজলিশে পাপীদের প্রতি কঠোরতা এবং মু’মিনদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করা হতো।12 পুত্র যাহেরকে তিনি হালবে নির্দেশ দেন যে, শিহাব সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করতে হবে। কারণ তিনি জানতে পারেন যে, শিহাব সোহরাওয়ার্দী দালালী শুরু করেছে এবং দীন থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী। কেউ দেখা করতে এলে তাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করার জন্য নিজে বেরিয়ে যেতেন। মানুষের বড় মর্যাদা দিতেন, অতি সম্মান করতেন। কখনো কখনো খাদেমের কাছে পানি চাইতেন; খাদেম কথা না শুনলেও তিনি তাদেরকে কিছুই বলতেন না। কাজি ফাজেল বলেন . তাঁর নিকট ফরিয়াদ পেশকালে ভিড়ের সময় তাঁর চাদর পদতলে পিষ্ট হতো। এতে তিনি মোটেই ক্ষুব্ধ হতেন না। একদিন প্রচন্ড বৃষ্টির সময় আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হই। বেশ প্যাঁক কাদার মধ্যে খচ্চর তার গায়ে পানি-কাদা ছিটায়, এমনকি তার সমস্ত কাপড়- চোপড় নষ্ট করলেও তিনি (কিছুই না বলে বরং) হাসছিলেন।13
তাঁর নিকট জ্ঞান আর জ্ঞানীদের স্থান
নূরুদ্দীনের শাসনামলে যে জ্ঞানের আবহ সৃষ্টি হয়েছিল, সালাহউদ্দীনের শাসনামলেও তা অব্যাহত ছিল। সুলতান নিজে ওলামাদের নিকট গমন করতেন এবং তাদের দারসে উপস্থিত হতেন। হিজরী ৫৭২ সনে তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় গমন করেন এবং বার বার শায়খ আবু তাহের সালাফীর41 সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং হাদিস শ্রবণ করার দীর্ঘ সময় তাঁর নিকট উপস্থিত ছিলেন। নূরুদ্দীনের শাসনামলে কাজি কামালুদ্দীন ছিলেন অন্যতম বড় আলেম ও উজির। সালাহউদ্দীন দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজিদেরকে স্ব স্ব পদে বহ রাখেন। অথচ কাজি কামালুদ্দীনের ধারণা ছিল, নূরুদ্দীনের শাসনামলের বিরোধকে কেন্দ্র করে সুলতান সালাহউদ্দীন তাঁকে পদচ্যুত করবেন। হিজরী ৫৭৭ সনে সুলতান নবিজির হাদিস শ্রবণ করার জন্য সময় নির্ধারণ করে দেন। এর ফলে আলেম - ওলামাদের সমাবেশ ঘটে। যে সব আলেম তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন আলী ইবনে ইবরাহিম ইবনে নাজা দামেশকী হাম্বলী। তিনিই হচ্ছেন সেই আলেম , যিনি সুলতান সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিপ্লব করার জন্য মিশরের ওবায়দী শাসকদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করেছিলেন।42
তাঁদের অন্যতম ছিলেন শাফেয়ি মাজহাবের ফকীহ নাজমুদ্দীন খাবুশানী। ওবায়দী সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে ইনি সালাহউদ্দীনকে সাহস জোগান এবং তাদের পক্ষে খুতবা পাঠ বন্ধ করে দেন। সুলতান সালাহউদ্দীন একটা মাদ্রাসা স্থাপন করে সে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করেন।
ফকীহ এবং আমিরদের মধ্যে ফকীহ ঈসা আল- ছাকারীও ছিলেন। তিনি বীর- বাহাদুর এবং উদার সৈনিক। শায়খ আবুল কাসেম বারজীর নিকট ফিকাহের জ্ঞানলাভ করেন এবং আমির আসাদুদ্দীন শেরকোহ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সুলতান সালাহউদ্দীনের সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলতেন, যেভাবে অন্য কেউ কথা বলতে পারতোনা। সালাহউদ্দীন যখন আক্কা অবরোধ করে রাখেন, সে সময় তিনি ইন্তিকাল করেন।43 কোন আলেম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আগমন করলে তাঁকে বেশ মর্যাদা দান করতেন এবং তাঁকে তাঁর নিজের আর নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের জন্য উপঢৌকন না দিয়ে বিদায় দিতেন না।
আলেম সমাজ এবং আমীরদের সঙ্গে সংযোগ- সুসম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া এমন মহান বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। কাজি ইবনে শাদাদ বলেন . তিনি প্রতি সোম এবং বৃহস্পতিবার বিচারের জন্য বসতেন। বিচারের এই খোলা মজলিসে ফকীহ এবং কাজিরা উপস্থিত থাকতেন। সফরে অবস্থান কালেও তিনি এই বিচার মজলিসের আয়োজন করতেন।44
আলে মাকদাসী নামে পরিচিত যে শ্রেণিটি দামেশকের সালেহিয়া অঞ্চলে বসবাস করতো, তাদের মধ্যে ছিলেন আবু ওমর মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে কুদামা এবং তাঁর ভাই হাফেজ আব্দুল গণী ও মামা শায়খ ইমাদ। যেসব মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সুলতান সালাহউদ্দীন বহির্গত হতেন, তাতে এরা অবশ্যই থাকতেন। বায়তুল মুকাদ্দাস, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল ইত্যাদি জয়কালে অভিযানে এরা উপস্থিত ছিলেন।45
তাঁর উজির আর আমির
বলা হয়ে থাকে যে, শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। শাসক সৎ হলে তিনি দ্বীনদার আর কল্যাণকামীদেরকে ভালোবাসবেন এবং ভালো আমির উজিরদের সংসর্গ দ্বারা আল্লাহ তাকে ধন্য করবেন। সুলতান সালাহউদ্দীনের ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি খাপ খায়। কাজি আব্দুর রহীম বায়সানীর সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন, যিনি ছিলেন তাঁর মন্ত্রী সভার উজির। সুস্থ চিন্তা আর সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী কাজি আব্দুর রহীম ছিলেন তাঁর নিকট বিরাট মর্যাদাবান। তাঁর মতামত সুলতান গ্রহণ করতেন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর নিকট পরামর্শ চাইতেন। বিশিষ্ট লেখক ইমাদ ইসফাহানী তাঁর সম্পর্কে বলেন . সুলতান তাঁর কথা রাখতেন আর তিনিও মেনে চলতেন সুলতানের কথা। তাঁর মত অনুযায়ী সুলতান কোন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতেন। তাঁর লেখা ছিল সাহায্যের নিশ্চয়তা। তিনি ছিলেন বিশাল প্রজ্ঞার অধিকারী এবং তাঁর দুরদৃষ্টি কার্যকর করা হতো।46 তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি আক্কা অবরোধকালে সুলতানকে গুনাহের ভয় দেখিয়ে পত্র লিখেন এবং সতর্ক করে দেন কারো প্রতি সৈন্যদের জুলুম সম্পর্কে, যা হবে পরাজয়ের কারণ। তিনি বলেন . আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া তাঁকে সন্তুষ্ট করা যায় না এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ছাড়া কষ্ট- ক্লেশ দূর হয় না। যে কোন স্থানে পাপ কাজ করা হোকনা কেন, তা প্রকাশ পাবেই। আর যে কোন স্থানে অন্যায় করা হোক না কেন, তা ফাঁস হবেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের কর্তার হাতে পবিত্র বিজয়ের সূচনা করেছেন, যা আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রমাণ হবে। আমরা আল্লাহর নিকট তাঁর গজব থেকে পানাহ চাই, তা যেন তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ না হয়।47 জিহাদে নিষ্ঠাবান সৈন্যদের নেতৃত্ব দানের তাওফীক তাঁকে দেয়া হয়েছে। কখনো কখনো জিহাদী পরিমন্ডলের প্রভাব পড়তো সৈন্যদের উপর। তাঁর অন্যতম আমির ছিলেন ইজ্জুদ্দীন জর্দেক, আর তিনি ছিলেন নূরুদ্দীনের আযাদ করা ক্রীতদাস। তাঁর মধ্যে বিশ্বস্ততা আর বীরত্বের সমাবেশ ঘটেছিল।48 অপর জন ছিল সাইফুদ্দীন জাওনী। তিনিও ছিলেন বীর- বাহাদুর, যার মধ্যে দ্বীনদারী আর বন্দেগির সমাবেশ ঘটেছিল।49 আরো ছিলেন আবুল হীজা, ইবনুস সিমীন, ইবনুল মাশতুব, বাহাউদ্দীন কারাকুশ, যারা ছিলেন তাঁর সচিব ও আমির। এরা ছিলেন বীর-বাহাদুর, যারা কায়রো নগরীর প্রাচীর নির্মাণ করেন এবং পর্বত দুর্গ নির্মাণ করান। সালাহউদ্দীন তার হাতে এক্কা অঞ্চলের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। তিনি সেখানে থাকাকালে অবরোধের ঘটনা ঘটে এবং এ নিয়ে লোকেরা নানা কাহিনি রচনা করে, যা বিশুদ্ধ নয়।50
সালাহউদ্দীন কি ফিলিস্তিনের দাবি ত্যাগ করেছিলেন?
বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার পর ক্রুসেডারদের কুকুরের মতো কামড়া কামড়ি করা এবং তাদের এক্কা অধিকার করা সত্ত্বেও এবং সন্ধির জন্য সালাহউদ্দীন তিন বৎসর ব্যাকুলতার পরও তিনি ফিলিস্তিনের দাবি ত্যাগ করেননি। কারণ, ফিলিস্তিন তাঁর মালিকানাধীন ছিল না, বরং তা ছিল মুসলমানদের মালিকানাধীন। এবং ইংরেজ শাসকও তাঁর সঙ্গে চেষ্টা চালান; কিন্তু তিনি ফিলিস্তিনের কোন অংশ আল্লাহর দুশমনদের জন্য ছেড়ে দিতে কঠোরভাবে অস্বীকার করেন। আর মুসলমানদের অধিকার নিয়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করা সালাহউদ্দীনের মতো মহান ব্যক্তিত্বের স্বভাব হতে পারে না। ইংরেজ শাসক তাঁর কাছে লিখে . ইংরেজ আর মুসলমানরা ধ্বংস হয়েছে আর দেশের হয়েছে সর্বনাশ, জান আর মাল বিনষ্ট হয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের ইবাদতের স্থান; আমাদের একজন লোকও বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা তার দাবি ত্যাগ করব না। দেশতো আমাদের কাছে ফিরে আসবে; তা জর্দানকে বিচ্ছিন্ন করবে না। স্বভাবতই এটা হচ্ছে ইংরেজ শাসকের একটা কূট কৌশল, সম্ভাব্য পরিমাণে অথবা ন্যূনপক্ষে কিছু আদায় করার জন্য বিরাট কিছু দাবি করা- এটাই হচ্ছে ইংরেজদের কাজ।51
সালাহউদ্দীন তাকে জবাব দেন . বায়তুল মুকাদ্দাস আমাদের। তা আমাদের নবীদের বিচরণ স্থল। সুতরাং আমরা তার দাবি ত্যাগ করব এটা কল্পনাও করা যায় না। মুসলমানদের মধ্যে আমরা এমন কথা মুখে উচ্চারণও করতে পারি না। আর দেশ, মুলত . তাওতো আমাদেরই তৎকালে সেখানে যেসব মুসলমান ছিল, তাদের দুর্বলতার কারণে সাময়িকভাবে তোমরা তা দখল করে নিয়েছিলে।52 তখন ইংরেজ শাসক জবাব দেয় . আপনার নিকট আমি যা দাবি করছি, তা হচ্ছে এই যে, বায়তুল মুকাদ্দাস দুর্গে আমাদের বিশজন লোক থাকবে, আর নগরে যেসব খ্রিস্টান থাকবে, তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না।
জবাবে সুলতান বলেন . শুধু মাত্র জিয়ারত ছাড়া বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে তোমরা কোন কথাই বলতে পারবে না।53 সাবধান। বিগত রজনি কতইনা ভয়ার্ত ছিল। বর্তমান যুগে ইহুদিরা ফিলিস্তিন নিয়ে কুকুরের মত কামড়া কামড়ি করছে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা তাদেরকে উসকানি দিচ্ছে। তারা সময়ে সঙ্গ দেয়, আবার সময়ে ধোঁকা দেয়, সুযোগ কাজে লাগানোই তাদের উদ্দেশ্য। তারা লাভ করতে চায় নতুন নতুন স্বার্থ। আর হাস্যকর শান্তির মোড়লরা শয়তানি অঙ্গীকারের অপেক্ষায় আছে। কারণ, মূলত . জিহাদ বা যুদ্ধের ইচ্ছা তাদের নেই। যে কোন মূল্যে তারা শান্তি চায়। আর ইহুদিরা বিশেষভাবেই ভূমি চায়। রাশিয়ায় ইহুদিদের পক্ষ থেকে তাদের কাছে সাহায্য এসেছে।54
সুলতান ও সূর শহর
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর এ মর্মে সুলতান সালাহউদ্দীনকে অভিযুক্ত করেন যে, সূর নগরীর ব্যাপারে তিনি বাড়াবাড়ি করেছেন। কারণ, যে কোন অবরোধ বা বিজয় শেষে তিনি বন্দীদেরকে মুক্ত করে দিতেন এবং তাদেরকে নিরাপত্তা দান করতেন। ফলে এরা সকলেই সূর নগরীতে সমবেত হতো, পরবর্তীকালে যা জয় করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর তিনিই আবার অভিযোগ করেন যে, সূর নগরীর সামনে তিনি দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হননি। এটা তাঁর অভ্যাস ছিল যে, কোন জনপদ তাঁর হস্তগত হলে সে জনপদ সম্পর্কে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন এবং তা ছেড়ে চলে যেতেন।55 তার ব্যাপারে সালাহউদ্দীন ছাড়া কারো অপরাধ ছিল না।56
এটা কি ঠিক যে, সালাহউদ্দীন সূর নগরীর প্রসঙ্গটা শিথিল করে দিয়েছিলেন এবং খ্রিস্টানদেরকে সেখানে সমবেত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন? এখানে আমরা এ জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমত . উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সালাহউদ্দীন সম্পর্কে ইবনুল আসীর এক ধরনের অন্যায় করেছেন। আর তার কারণ এই যে, জঙ্গি পরিবারের প্রতি ইবনুল আসীরের দুর্বলতা রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে বেশ সম্মান করেন। এবং তিনি মনে করেন যে, সালাহউদ্দীন জঙ্গি পরিবারের নিকট থেকে সিরিয়া ও মিশরের রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। এ কারণে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি সুযোগ পেলেই সালাহউদ্দীনের প্রতি টিপ্পনি কাটেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বৈরুতে ও জু-বাইল জয় করার পর সালাহউদ্দীনের নিকট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আসফান ও বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করা, কারণ দুটোই ছিল মিশরের পথে। বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার মধ্যে রয়েছে বিরাট নাম ও খ্যাতি।57
নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে ইবনুল আসীর উল্লেখ করেন যে, তিনি সালাহউদ্দীন কে দেখতে পান তাঁর অতিথি মুইজ্জুদ্দীন কায়সার শাহ ইবনে কজ আরসালানকে বিদায় জানাতে (যিনি ছিলেন আনাযুল অঞ্চলে সেলজুক রাজত্বের অন্যতম শাসক) । সালাহউদ্দীন যখন আরোহণ করতে উদ্যত হন, মুইজ্জুদ্দীন বাহু ধরে তাকে আরোহণ করান। জঙ্গি পরিবার থেকে আলাউদ্দীন ইবনে ইজ্জুদ্দীন তার পোশাক ছিনিয়ে নেন। বর্ণনাকারী মন্তব্য করেন . হে আইউব তনয়! কী করছ তুমি? তুমি কি মৃত্যু বরণ করছ? সেলজুক বাদশাহ এবং ইবনে আতাবক জঙ্গি তোমাকে আরোহণ করাচ্ছে? 58 তাই ইবনুল আসীর এবং তাঁর বর্ণনাকারী উভয়ে বাড়াবাড়ি করে যাতে বনী আইউবের একজন লোক এই মর্যাদায় পুঁছতে পারে।
আরো একটা কথা। আমরা লক্ষ্য করি না যে, ইবনুল আসীর জালিম- ফাসিক বাদশাহদের নিন্দা করেন, সমালোচনা করেন। তিনি তাদের দোষত্রুটির উল্লেখ করেন না, বিশেষ করে মূসেল এবং সেলজুক শাসকদের।
দ্বিতীয়ত . সালাহউদ্দীন সম্পর্কে একথা বলাও সঠিক নয় যে, সকল বন্দীকেই তিনি মুক্ত করে দিতেন। কারণ, তিনি হারবী তথা যারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছে, তাদেরকে বিশেষ করে ফিদাবিয়া আর ইসবরতিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করেন। কিন্তু তিনি যখন কোন নগর অবরোধ করেন এবং সে নগরের অধিবাসীরা তার কাছে নিরাপত্তা দাবি করে এই শর্তে যে, তারা দুর্গ জয়ে তাঁকে সাহায্য করবে, তাদেরকে তিনি নিরাপত্তা দান করেন এবং অঙ্গীকার পূরণ করেন। এ সম্পর্কে ইবনুল আসীর নিজেই বলেন . তিনি ছিলেন অতি ক্ষমাপরায়ণ, ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করতেন এবং উদারতা দেখাতেন।59 এটাই ছিল সালাহউদ্দীনের প্রবৃত্তি আর প্রকৃতি। তিনি ক্ষমা আর উদারতাকে ভালোবাসতেন। কোন শহর আর নগর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পদানত হলে এটাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করতেন। অবশ্য তিনি অতিষ্ঠ আর বিরক্ত হলে কোন শহর তার সম্মুখে দাঁড়ালে তিনি তা দেখে নিতেন একথা সঠিক নয়। তিনি এক্কা শহর অবরোধ করেন এবং এ অবরোধ চলে দীর্ঘ ৩৬ মাস, এরপরও তিনি বিরক্ত হননি এবং অবরোধ তুলেও নেননি। অবশ্য সূর নগর তিনি ত্যাগ করেন এটা এ জন্য যে, তিনি দেখতে পান একটা প্রতিষ্ঠিত দুর্গ। এবং অবরোধ দীর্ঘ করায় কোন ফল দেখা দেবে বলে তিনি মনে করেন না, বিশেষ করে এমন ক্ষেত্রে যেখানে তিনি নিজেও আছেন।60
তৃতীয়ত . নিছক সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইবনুল আসীর সমালোচনা করলে সে ব্যাপারে কিছু বলার নেই। সকল দৃষ্টিকোণের জন্যই রয়েছে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। যেমন তিনি বলেন . সূর ফাঁকা ছিল, কিন্তু সালাহউদ্দীন তা অধিকার করতে ভয় পান এবং তা রক্ষা করার শক্তি তার ছিল না। অন্যথায় পূর্বে যদি তা অধিকার করা শুরু করতেন তাহলে বিনা কষ্টে তা অধিকার করতে পারতেন। তার এ মন্তব্য সঠিক। যদিও শুরুতে তা অবরোধ করার ক্ষেত্রে সালাহউদ্দীন ছিলেন মুজতাহিদ।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/494/29
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।