মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
তাগুত অনেক প্রকারের হতে পারে, যা আমরা তাগুতের সংজ্ঞা থেকে জানতে পেরেছি। তবে কিছু তাগুত রয়েছে, যারা এদের মধ্যে প্রধান। নিম্নে তাদের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
১. শয়তান : গায়রুল্লাহর ইবাদাতের দিকে আহবানকারী শয়তান। চাই সে জিনের মধ্য হতে হোক অথবা মানুষের মধ্য হতে হোক।
২. শাসক : ঐ সকল শাসক, যারা নিজেরা সার্বভৌমত্বের দাবি করে এবং আল্লাহর আইন বাতিল করে নিজেরা আইন তৈরি করে।
৩. বিচারক : ঐ সকল বিচারক, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আইন বাদ দিয়ে মানবরচিত আইন দিয়ে বিচার-ফায়সালা করে।
৪. পীর-ফকির : আল্লাহর ইবাদাতের সাথে মাধ্যম ও অংশীদার হিসেবে ইবাদাত গ্রহণকারী পীর-ফকির, কবর-মাজার ও দরগা ইত্যাদি।
৫. গণক, জ্যোতিষী, জাদুকর : যারা ইলমুল গাইব বা অদৃশ্য জ্ঞানের দাবি করে।
৬. আল-হাওয়া : আল্লাহর হুকুম পালনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী আল-হাওয়া বা নাফস (প্রবৃত্তি)।
৭. তাক্বলিদে-আবা : কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে যে সকল বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষের দোহাই দিয়ে গায়রুল্লাহর ইবাদাত করা হয় সে সকল পূর্বপুরুষরাও তাগুত। যদি তারা এটা সমর্থন করে থাকেন।
উপরোক্ত প্রধান সাত প্রকার তাগুতের বিস্তারিত বিবরণ নিচে আলোচনা করা হলো :
১. শয়তান
শয়তান দুপ্রকার : (ক) মানুষ শয়তান ও (খ) জিন শয়তান। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(হে নবী) বলো, আমি আশ্রয় চাই মানুষের প্রতিপালকের কাছে। (আমি আশ্রয় চাই) মানুষের (আসল) বাদশার কাছে। (আমি আশ্রয় চাই) মানুষের (একমাত্র) মাবুদের কাছে। (আমি আশ্রয় চাই) কুমন্ত্রণাদানকারীর অনিষ্ট থেকে, যে (প্ররোচনা দিয়েই) গা ঢাকা দেয়। যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষদের মধ্য থেকে। (সূরা নাস)
এ সূরার শেষ আয়াতে খান্নাসকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। জিন খান্নাস ও মানুষ খান্নাস। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ শয়তানগুলো জিন শয়তানদের চেয়ে বেশি ভয়ংকর হয়ে থাকে। এরাও শয়তানের মতো মিথ্যাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুজিয়ে উপস্থাপন করে। কাফির ও মুশরিকদের নেতাদেরকে শয়তান বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মুনাফিকদের সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
আর যখন তারা তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্র। (সূরা বাকারা- ১৪)
আলোচ্য আয়াতে شَيْطَانٌ (শাইত্বান) শব্দটিকে বহুবচনে شَيَاطِيْنٌ (শায়াত্বীন) হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখানে شَيَاطِيْنٌ (শায়াত্বীন) বলতে মুশরিকদের বড় বড় সরদারদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ সরদাররা তখন ইসলামের বিরোধিতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
জিন শয়তান :
জিন শয়তানদের মধ্যে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদাতের দিকে আহবান করে অথবা অন্যের ইবাদাত করতে প্রেরণা জোগায়; বরং দৃষ্টির অন্তরাল থেকে নিজেই ইবাদাত নেয় তারা তাগুতের অন্তর্ভুক্ত। জিন শয়তানরা গণকদেরকে গায়েবের (অদৃশ্য) সংবাদ প্রদানের নামে সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত খবর প্রদান করে, যার কারণে মানুষ গণকদের কাছে গায়েব জানার জন্য যায়, যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না।
মানুষ শয়তান :
মানুষদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদাতের দিকে আহবান জানায় অথবা অন্যের ইবাদাতের প্রতি উৎসাহ যোগায় তারা এ শ্রেণির তাগুতের অন্তর্ভুক্ত। এরা হচ্ছে-
সেসব পীর এবং মাজারের খাদেম, যারা মানুষকে পীর ও মাজারে সিজদা দিতে এবং সেখানে মান্নত করতে আহবান জানায়।
কুফর এবং শিরকের ক্ষেত্রে শয়তানের আনুগত্য করাই হচ্ছে তার ইবাদাত করা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হচ্ছে,
হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে সতর্ক করিনি (এ বলে যে) তোমরা শয়তানের উপাসনা করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা ইয়াসীন- ৬০)
এ আয়াতে শয়তানের ইবাদাত করতে নিষেধ করা হয়েছে। শয়তান যে জিনিসের দিকে আহবান করে সেই জিনিসে লিপ্ত হওয়াই শয়তানের ইবাদাত ও আনুগত্যে লিপ্ত হওয়ার শামিল। শয়তানের পরিচয় ও তার কার্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন আমাদের বই ‘‘শয়তান থেকে বাঁচার কৌশল’’।
২. শাসক
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর গোলাম হিসেবে। মনিব বা মালিক হিসেবে নয়। মানুষ হলো গোলাম আর আল্লাহ হলেন মনিব। এই মানুষ যখন নিজের মূল পরিচয় ভুলে গিয়ে দাসত্বের সীমানা অতিক্রম করে মনিবের আসন দখল করে বসে তখনই সে তাগুত হিসেবে বিবেচিত হয়। এ জাতীয় তাগুত হওয়ার জন্য সর্বময় ক্ষমতার মালিক দাবি করা জরুরি নয়। বরং বিশেষ কোন এলাকা বা ভূখন্ডের ক্ষমতার মালিক ও বিধানদাতা দাবি করলেই সে ঐ অঞ্চলের ইলাহ বা রব হয়ে যায়। যুগে যুগে ফিরাউনরা এ জাতীয় ইলাহ ও রব হওয়ার দাবি করেছিল। কুরআনে ফিরাউন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
ফিরাউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে আমি তো জানি না। (সূরা ক্বাসাস– ৩৮)
এ আয়াতে সে নিজেকে স্পষ্টভাবে ইলাহ বলে দাবি করেছে। ফিরাউন মূলত নিজেকে মিশরের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং ইলাহ দাবি করেছিল। আর যেহেতু যিনি ক্ষমতার মালিক, তিনি আইন প্রনয়ণেরও অধিকারী। সে অর্থে সে নিজেকে রব বলে ঘোষণা করেছিল। অর্থাৎ মিশর ভূখন্ডে কেবলমাত্র তার ক্ষমতা ও রাজত্ব চলবে। সকল ক্ষেত্রে কেবলমাত্র তার হুকুম কার্যকর হবে। অন্য আয়াতে এসেছে,
ফিরাউন তার সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ঘোষণা করল যে, হে আমার সম্প্রদায়! মিশরের বাদশাহী কি আমার নয়? এ নদীগুলো আমার পাদদেশে প্রবাহিত, তোমরা কি তা দেখ না? (সূরা যুখরুফু ৫১)
এ আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, ফিরাউন নিজেকে যে ইলাহ ও রব বলে দাবি করেছিল সেটা শুধুমাত্র মিশরের। বর্তমানে যে সকল শাসকবর্গ নিজেদের কোন দেশ অথবা এলাকার সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে দাবি করে এবং তারা তাদের অধীনস্ত জনগণের জন্য আইন প্রণয়ন করে, প্রয়োজনে আল্লাহর আইনকে বাতিল করে বিকল্প আইন তৈরি করে- তারা সকলেই তাগুত। তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার ইলাহ ও রবে পরিণত হয়। পবিত্র কুরআনে কোন মানুষকে রব ও ইলাহ বানাতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
বলো, হে আহলে কিতাব! তোমরা এমন একটি কালিমার দিকে এসো, যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে সমান। আর তা হলো, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করব না এবং তার সাথে কোনকিছুকে শরীক স্থাপন করব না; আর আমাদের কেউ অপর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবে না। এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম। (সূরা আলে ইমরান- ৬৪)
তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের আলিম ও সংসার বিরাগীদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামের পুত্র মাসীহকেও। (সূরা তাওবা- ৩১)
এ আয়াতে বলা হয়েছে, ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের পন্ডিত তথা নেতানেত্রীদেরকে এবং সংসারবিরাগী তথা পীর-বুযুর্গদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব বানিয়ে নিয়েছিল। কীভাবে বানালো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নিম্নোক্ত হাদীসটিতে,
আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এলাম। তখন আমার গলায় স্বর্ণের ক্রুশ ছিল। (তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে, তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি তোমার গর্দান থেকে এই মূর্তিটি ফেলে দাও।) ঐ সময় আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে কুরআনের এ বাণী পাঠ করতে শুনলাম- ‘‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।’’ আদী ইবনে হাতেম বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তারা (ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা) তো তাদের পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদের ইবাদাত করে না। তাহলে তাদেরকে রব বানাল কী করে? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, অবশ্যই তারা তাদের পন্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে রব বানিয়েছে। কেননা তারা যখন আল্লাহর হারামকৃত কোন কিছুকে হালাল করে দেয় তখন লোকেরা সেটাকে হালাল হিসেবে মেনে নেয়। আবার তারা যদি আল্লাহর হালালকৃত কোন কিছুকে হারাম করে দেয় তখন তারা ওটাকে হারাম হিসেবে মেনে নেয়। সেক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের কোন তোয়াক্কা করে না। এটাই হচ্ছে তাদের ইবাদাত বা আনুগত্য। [বায়হাকী, হা/২০৮৪৭; তিরমিযী, হা/৩০৯৫।]
অর্থাৎ অধিকাংশ মুফাসসীরদের বক্তব্য হলো, এখানে اَلْاَرْبَابِ দ্বারা এটা উদ্দেশ্য নয় যে, তারা (ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা) তাদেরকে (নেতা এবং পীর-বুযুর্গদেরকে) গোটা সৃষ্টির রব বলে বিশ্বাস করত। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করত। [যিলালিল কুরআন, সাইয়েদ কুতুব (রহ.) ৪র্থ খন্ড, ২০ পৃ:।]
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে যে সকল শাসকবর্গ আল্লাহর হারামকৃত জিনিসকে হালাল করে দিয়েছে অথবা আল্লাহর হালালকৃত জিনিসকে হারাম করে তারা ফিরাউনের মতো নিজেরাই রব তথা আল্লাহর আসনে বসে আছে।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এ ঘোষণার প্রধান বাধা ছিল সমকালীন শাসকবর্গ। মূসা (আঃ) এর বিরুদ্ধে ফিরাউন বাধা সৃষ্টি করেছিল। ইবরাহীম (আঃ) এর বিরুদ্ধে নমরূদ, মুহাম্মাদ ﷺ এর বিরুদ্ধে আবু জাহেল ও আবু লাহাব। এরা সকলেই ছিল শাসক। ‘লা-ইলাহা’ বলে সর্বপ্রথম এই শাসক নামের তাগুতকে বর্জন করতে হবে। কেননা অন্যান্য তাগুতগুলো এদের ছত্র-ছায়ায় লালিত-পালিত হয়। এরা সকল প্রকার শিরকের হয়তো উদ্ভাবক, নয়তো সংরক্ষক নতুবা পৃষ্ঠপোষক।
সর্ব যুগে দুশ্রেণির লোকেরা ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে।
১. মানবরচিত আইনে পরিচালিত দেশের শাসক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ।
যুগে যুগে দুশ্রেণির লোক ইসলামের ক্ষতি সাধন করেছে। এক শ্রেণি হলো শাসকগোষ্ঠী, আর অপর শ্রেণি হলো ধর্মীয় আলেম ও সংসারবিরাগী পীর-পুরোহিত। [কিতাবুল জিহাদ, আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক, ১ম খন্ড, ২৭ পৃ:।]
সার্বভৌমত্বের মালিক জনগণ নয় বরং আল্লাহ :
রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন : ‘‘চূড়ান্ত, চরম, অসীম, অবাধ, অবিভাজ্য, হস্তান্তর যোগ্যহীন, শাস্তি প্রয়োগে পূর্ণ ক্ষমতাবান- এরূপ ক্ষমতা।’’
তাগুতী রাষ্ট্রে সাংবিধানিকভাবে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণ। সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তারা ভোট দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচন করে। এভাবে ভোটের মাধ্যমে গোটা দেশের জনগণের ক্ষমতা নির্দিষ্ট সংখ্যক সংসদ সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। অতঃপর সংসদ সদস্যগণ জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়। এভাবেই সংসদ গোটা দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, জনগণ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
বরকতময় সেই সত্তা, যাঁর হাতে সার্বভৌমত্ব; তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। (সূরা মুলক- ১)
এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বড়ই পবিত্র ও বরকতময়। কারণ তাঁর সত্তা সকল প্রকার শিরকের গন্ধমুক্ত। তাঁর সমজাতীয় কেউ নেই, ফলে তাঁর সার্বভৌমত্বে স্থলাভিষিক্ত কেউ নেই। সমগ্র রাজত্ব তাঁরই কর্তৃত্বাধীন। তিনি বিশ্বজাহানের প্রত্যেকটি জিনিসের সৃষ্টিকর্তা ও তাদের ক্ষমতা নির্ধারণকারী। এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল ক্ষমতা ও সর্বময় কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক। তিনি স্রষ্টা, বাকি সকলেই সৃষ্টি। সৃষ্টিকুলের সকল কিছুই স্রষ্টার অধীনে। আর যারা কারো অধীনে থাকে তারা সর্বময় ক্ষমতার মালিক হতে পারে না। তাই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হিসেবে শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই মেনে নিতে হবে।
সংবিধান হিসেবে কুরআন-সুন্নাহকে মানতে হবে :
তাগুতী রাষ্ট্রের একটি মৌলিক উপাদান হলো- তাদের নিজেদের বানানো সংবিধান। এ সংবিধান তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন বিষয়ে যদি আল্লাহর কালামের সাথে সংবিধানের সংঘর্ষ হয় সেক্ষেত্রে সংবিধান বহাল থাকবে। আল্লাহর কালামকে হয়তো অপব্যাখ্যা করবে নয়তো প্রয়োজনে বাতিল করবে। কোন বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিলে তারা সংবিধানের দিকে ফিরে যায়। অতঃপর সংবিধান থেকে প্রমাণ করতে পারলে সকলেই তা মেনে নেয়।
একজন মুসলিমকে বিশ্বাস করতে হবে যে, কুরআন ও সুন্নাহই হলো আইনের উৎস। অন্য কোন আইন যদি এর সাথে সামঞ্জস্যশীল না হয় তাহলে তা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। সকল বিতর্কের সমাধানের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর কাছে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
অতঃপর তোমাদের মাঝে যদি কোন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, তাহলে সে বিষয়টি ফায়সালার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করে থাক; এটাই উত্তম এবং চূড়ান্ত সিন্ধান্ত গ্রহণের জন্য অধিকতর উপযুক্ত। (সূরা নিসা- ৫৯)
আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দুটি জিনিসকে শক্তভাবে ধারণ করে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি জিনিস হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূলের সুন্নাহ (হাদীস)। [মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হা/ ৩৩৩৭; মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩১৯।]
আল্লাহর বিধানকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
বলো, তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে বিচারক মানব- যদিও তিনি তোমাদের প্রতি সুস্পষ্ট কিতাব অবতীর্ণ করেছেন? (সরা আন‘আম- ১১৪)
আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করার নামই ইসলাম। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর বিধানের কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ না করে তাহলে সে মুমিন হতে পারে না। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের ঝগড়া-বিবাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে। অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং তা মেনে না নেয়। (সূরা নিসা- ৬৫)
এ আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের ব্যাপারে কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রাখে এবং সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর বিধানের সামনে নিজেকে সপে না দেয় তাহলে সে মুমিন হতে পারবে না। অন্য আয়াতে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করা বা না করার ব্যাপারে কাউকে স্বাধীনতা না দিয়ে সকলকে এক বাক্যে তা মেনে নিতে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য এ অবকাশ নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন কাজের নির্দেশ দেন, তখন সে কাজে তাদের কোন নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে সে তো প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হয়। (সূরা আহযাব- ৩৬)
এ সকল আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে কোন সংবিধান রচনা করা আবার সে সংবিধান মানতে বাধ্য করা আল্লাহর সাথে চরম ধৃষ্টতা ও বিদ্রোহ করার শামিল।
সার্বভৌমত্বের আদেশই হচ্ছে আইন। সুতরাং যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক তিনিই আইন প্রণয়নের মালিক, অন্য কেউ নয়। কুরআনে বলা হয়েছে,
জেনে রেখো, সৃজন ও আদেশ তাঁরই; যিনি মহিমাময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ। (সূরা আ‘রাফ- ৫৪)
যখন কোন ব্যক্তি এ কথা মেনে নেয় যে, একমাত্র আল্লাহই পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা, তখন অনিবার্যভাবে তাকে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, ইলাহ ও রবও একমাত্র আল্লাহই। ইবাদাত ও আনুগত্যের হকদারও একমাত্র তিনিই। নিজের সৃষ্টির জন্য আইন প্রণেতা ও শাসক তিনি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। একজন হবেন স্রষ্টা, অন্যজন হবে মাবুদ, তৃতীয়জন হবে সংকট নিরসনকারী, চতুর্থজন ক্ষমতাসীন ও আনুগত্যের অধিকারী- এটা হতে পারে না। হালাল ও হারাম নির্ধারণ করার অধিকারও একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নেই। কেননা সকল প্রকার আইন প্রণয়ন করার অধিকার একমাত্র তাঁরই। সুতরাং অন্য যে ব্যক্তিই বৈধতা ও অবৈধতার ফায়সালা করার সাহস দেখাবে, সে-ই সীমালঙ্ঘন করবে।
আইন তৈরি করার জন্য যে সকল গুণাবলির প্রয়োজন সেসকল গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য কোন মানুষের ভেতর পাওয়া সম্ভব নয়। মানবজাতির জন্য আইন তৈরি করা ও সংবিধান প্রণয়ন করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার আছে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো এই ক্ষমতা ও অধিকার নেই। সুতরাং কেউ যদি মানুষের জন্য আইন তৈরি করে এবং নিজেকে আইন প্রণেতা বা সংবিধান রচয়িতা দাবি করে সে যেন নিজেকে আল্লাহ অথবা আল্লাহর অংশীদার বলে দাবি করল। অথচ আল্লাহ তা‘আলার কোন শরীক বা অংশীদার নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
তাদের জন্য কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? আর ফায়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের ব্যাপারে সিন্ধান্ত হয়েই যেত। নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা শুরা- ২১)
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের তৈরি করা বিধানকে শরীয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা شَرِيْعَةٌ (শারী‘আত) অর্থ হচ্ছে, اَلطَّرِيْقَةُ الْمُتْبَعَةُ حَقًّا كَانَتْ اَوْ بَاطِلًا অর্থাৎ ‘অনুসৃত পথ’ চাই তা সত্য হোক বা মিথ্যা হোক। এতে বুঝা যায় যে, কাফির-মুশরিকদের তৈরি করা বিধান স্বতন্ত্র একটি শরীয়াত, যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আরেকটি আয়াতে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে-
﴿لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ﴾
তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন আমার জন্য। (সূরা কাফিরূন- ৬)
এ আয়াতে দেখা গেল যে, ইসলাম যেরকম একটি স্বতন্ত্র দ্বীন সেরকমভাবে কাফির-মুশরিকদের মতবাদও একটি দ্বীন। আর দ্বীনে ইসলামের সাথে দ্বীনে কুফরের কোন সম্পর্ক নেই। জীবনের সকল ক্ষেত্রে হয়তো দ্বীনে ইসলাম থাকবে, নয়তো দ্বীনে কুফর থাকবে। যুগে যুগে ফিরাউনরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের দ্বীনে কুফরকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
ফিরাউন বলল, আমাকে ছেড়ে দাও আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার প্রতিপালককে ডাকুক। আমি আশঙ্কা করি যে, সে তোমাদের দ্বীনকে পরিবর্তন করে ফেলবে অথবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। (সূরা মু’মিনু ২৬)
এ আয়াতে দেখা গেল যে, ফিরাউন তার দ্বীন রক্ষার জন্য উত্তেজিত হয়ে মূসা (আঃ) কে হত্যা করার জন্য উদ্ধত হলো, যাতে মূসা (আঃ) তার দ্বীনকে পাল্টে দিতে না পারেন।
ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইরশাদ করেছেন,
যে ব্যক্তি ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন জীবনব্যবস্থা তালাশ করবে, তার কাছ থেকে কিছুই কবুল করা হবে না। অতঃপর আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা আলে ইমরান- ৮৫)
আল্লাহ তা‘আলার দেয়া দ্বীন ও শরীয়াত মঙ্গলময় ও কল্যাণকর। আর মানবরচিত দ্বীন ও শরীয়াত ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর। আল্লাহ তা‘আলার দেয়া দ্বীন ও শরীয়াতের উৎস স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা, যা ওহীর মাধ্যমে নবী ও রাসূলগণের প্রতি নাযিল করা হয়। পক্ষান্তরে মানবরচিত দ্বীন ও শরীয়াতের উৎস মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা, যা বিতাড়িত শয়তান কর্তৃক তার বন্ধুদের মাথায় প্রবেশ করানো হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
নিশ্চয় শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য প্ররোচনা দেয়। যদি তোমরা তাদের কথামতো চল, তবে অবশ্যই তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা আন‘আম- ১২১)
তাই প্রতিটি মানুষ হয়তো দ্বীনে হকের পক্ষে, নয়তো দ্বীনে বাতিলের পক্ষে। হয়তো আল্লাহর নাযিলকৃত সংবিধানের পক্ষে, নয়তো মানবরচিত তাগুতী সংবিধানের পক্ষে। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং যারা আল্লাহর নাযিলকৃত সংবিধানের পক্ষে তারা আল্লাহর অনুসারী আর যারা মানবরচিত সংবিধানের পক্ষে তারা হয়ত তাগুত; নতুবা তাগুতের অনুসারী।
৩. বিচারক
আল্লাহর পরিবর্তে যাদের আনুগত্য করা হয় এবং ইসলামের পরিভাষায় যাদেরকে তাগুত বলা হয় তাদের একটি মারাত্মক তাগুত হলো আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর বিধানের পরিবর্তে মানবরচিত বিধান দিয়ে বিচার-ফায়সালাকারী বিচারক। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, আবার তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়? অথচ তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। (সূরা নিসা- ৬০)
এখানে ‘তাগুত’ বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসককে বুঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে। মূলত যে বিচারব্যবস্থা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার আনুগত্য করে না এবং আল্লাহর কিতাবকে চূড়ান্ত সনদ হিসেবে স্বীকৃতিও দেয় না মূলত সেটাই তাগুত। কাজেই যে আদালত তাগুতের ভূমিকা পালন করছে, এ ব্যাপারে এ আয়াতটির বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট। আর আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের উপর ঈমান আনার অপরিহার্য দাবি অনুযায়ী এ ধরণের আদালতকে অস্বীকার করাই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। কেননা কুরআনের দৃষ্টিতে তাগুতকে অস্বীকার না করলে ঈমানদার হওয়া যায় না। আর আল্লাহ ও তাগুত উভয়ের সামনে একই সাথে মাথা নত করা হচ্ছে সুস্পষ্ট মুনাফিকী।
একদা জনৈক ইয়াহুদির সাথে জনৈক মুনাফিকের ঝগড়া হলে, ইয়াহুদি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বিচারক মানল। সে জানত, ধর্ম বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও তিনি পক্ষপাতিত্ব করবেন না। আর মুনাফিকের দাবি ছিল মিথ্যা, সে মনে করল, আমি বাইরে মুসলিম হলেও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট চালাকীতে কাজ হবে না। তাই একজন অসৎ ইয়াহুদি সরদার কা’ব ইবনে আশরাফকে বিচারক মানতে চাইল। অবশেষে উভয়েই রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট বিচারপ্রার্থী হলো এবং ইয়াহুদির জয় হলো। কিন্তু মুনাফিকটি এতে সন্তুষ্ট না হয়ে ওমর (রাঃ) এর নিকট গেল। সে ধারণা করেছিল ওমর (রাঃ) তার পক্ষেই রায় দেবেন। এদিকে ইয়াহুদিও মনে করল যে, ওমর (রাঃ) ন্যায়পরায়ণ; তিনি তার পক্ষেই রায় দেবেন। কাজেই মুনাফিকের প্রস্তাবে সে সম্মত হয়ে ওমর (রাঃ) কাছে গেল এবং সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল এবং এও বলল যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মীমাংসা করেছিলেন কিন্তু এ ব্যক্তি মানেনি। ওমর (রাঃ) তৎক্ষণাৎ তলোয়ার দ্বারা মুনাফিকের শিরোচ্ছেদ করে দিলেন এবং বললেন, ‘‘নবীর মীমাংসা অমান্য করার এটাই শাস্তি।’’ অতঃপর মুনাফিকটির ওয়ারীসরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বলল, একটা আপোষ মীমাংসার জন্যই ওমরের নিকট যাওয়া হয়েছিল, অনর্থক তিনি তাকে হত্যা করেছেন। কাজেই আমরা হত্যার প্রতিশোধ চাই। তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়।
আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার না করার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী বিচার-ফায়াসালা করে না তারা ফাসিক। (সূরা মায়েদা- ৪৭)
যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না, আল্লাহ তাদের পরিণাম সম্পর্কে তিনটি বিধান বর্ণনা করেছেন। (এক) তারা কাফির। (দুই) তারা যালিম। (তিন) তারা ফাসিক।
প্রথমতঃ তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটি কুফরী।
দ্বিতীয়তঃ তার এ কাজটি ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতির বিরোধী। কারণ আল্লাহ যথার্থ ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করল তখন সে মূলত যুলুম করল।
তৃতীয়তঃ বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যখন সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করল, তখনই সে দাসত্ব ও আনুগত্যের গন্ডীর বাইরে চলে গেল। আর এটিই হলো অবাধ্যতা বা ফাসিকী। সুতরাং যেখানেই আল্লাহর হুকুম অমান্য করে বিচার করা হবে, সেখানেই এ তিনটি অপরাধ থাকবে।
আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানবরচিত আইনে বিচার-ফায়সালাকারী যদি মনে করে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর বিধান মানুষের জন্য যথেষ্ট নয় এবং তা মানুষের জন্য কল্যাণকরও নয়। অথবা আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর বিধান এক সময় কল্যাণকর ছিল। বর্তমান আধুনিক যুগের জন্য তা উপযোগী নয়। অতঃপর তারা মানবরচিত বিধানে বিচার-ফায়সালা করে তবে তারা সর্বসম্মতিক্রমে কাফির।
আরেক প্রকার বিচারক রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর বিধান-ই হলো একমাত্র সঠিক ও কল্যাণকর বিধান এবং বর্তমান যুগেও এটি উপযোগী। তবে চাকরি ঠিক রাখার জন্য বাধ্য হয়ে মানবরচিত বিধানে বিচার-ফায়সালা করে। এরা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদাতসমূহও পালন করে। এ জাতীয় বিচারকদের ব্যাপারেও উলামায়ে কেরামদের একদল একই মতামত পোষণ করেছেন। কেননা তাদেরকে এই মানবরচিত আইনে বিচার-ফায়সালা করতে কেউ বাধ্য করেনি। তারা যদি সত্যিকারেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি পূর্ণ ঈমান রাখত তাহলে তারা কোন অবস্থাতেই মানবরচিত বিধানে বিচার-ফায়সালা করত না। কেননা কোন মুমিন নারী-পুরুষ আল্লাহর বিচার-ফায়সালা বা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোন প্রকার নিজস্ব মতামত বা বিবেচনা করার অধিকার রাখে না। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য এ অবকাশ নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন কাজের নির্দেশ দেন, তখন সে কাজে তাদের কোন নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল, সে তো প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হলো। (সূরা আহযাব- ৩৬)
এ আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশের ব্যাপারে অন্য কিছু করার অধিকার থাকে না। অন্য আয়াতে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, অন্য কিছু ইখতিয়ার করা তো দূরের কথা আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর বিধান মেনে নেয়া সত্ত্বেও যদি তার মনের মধ্যে কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে তবে সে মুমিন হতে পারবে না। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের ঝগড়া-বিবাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে। অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং তা মেনে না নেয়। (সূরা নিসা- ৬৫)
৪. পীর-ফকীর
আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদাত ও আনুগত্য করা হয় এবং যাদেরকে ইসলামের পরিভাষায় তাগুত বলে আখ্যায়িত করা হয় তাদের আরেকটি প্রকার হলো পীর-ফকীর ও দরগাহ-মাজার। অন্যান্য তাগুতগুলো মানুষদেরকে আল্লাহর ইবাদাতের পরিবর্তে নিজেদের ইবাদাতের দিকে আহবান করলেও তা ধর্মের নামে করে না। কিন্তু এ প্রকার তাগুত মানুষদেরকে আল্লাহর ইবাদাতের নামে নিজেদের দিকে আহবান করে। সে কারণে সাধারণ মানুষ আল্লাহর ইবাদাত মনে করেই তাদের ইবাদাত করে থাকে।
এরা সাধারণত মানুষের থেকে দুভাবে ইবাদাত নেয়। আকীদা বা বিশ্বাসগতভাবে এবং আমলগতভাবে। যেমন তারা বলে, পীরের কাছে মুরীদ হওয়া ফরয। [মাওয়াজে এছহাকিয়া, পৃ: ৫৫।] অথচ ফরয বিধান দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ ব্যতীত কোন ইবাদাতকে ফরয বলা যায় না।
পীর-সুফিগণ মনগড়া ইবাদাত তৈরি করে। যা কুরআন-হাদীসে নেই।
এছাড়াও তারা বহু তরীকা আবিষ্কার করেছেন। আবার এগুলোর জন্য এক এক তরীকার এক এক যিকির। আবার সেই যিকিরের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও অঙ্গভঙ্গি। এ সবকিছুই আল্লাহর শরীয়াত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এক শরীয়াত, যা পীর-সুফিগণ নিজেরা তৈরি করেছেন। অথচ এ জাতীয় শরীয়াত তৈরি করার অধিকার আল্লাহ তা‘আলা কাউকে দেননি। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
তাদের কি এমন কতকগুলো শরীকও আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শূরা- ২১)
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কঠোরভাবে নতুন কোন শরীয়াত তথা ইবাদাতের পদ্ধতি তৈরি করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াতের ভেতর বহু তরীকার কোন স্থান নেই। সুতরাং আল্লাহর প্রদত্ত বিধানের বিপরীতে কেউ কোন হুকুম দিলে তা মান্য করা যাবে না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
হাসান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, স্রষ্টাকে অমান্য করে সৃষ্টিজগতের কারো আনুগত্য চলবে না। [মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হা/৩৪৪০৬; মুসনাদুল হারেস, হা/৬০২; মুজামুল আওসাত, হা/৩২১; জামেউস সাগীর, হা/৯৯০৩।]
এ হাদীসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহর শরীয়াতের বিপরীতে কারো আনুগত্য করা যাবে না। হোক সে মা-বাপ, বড় ভাই, পীর-মুর্শিদ, আমির-উমারা। তবে যদি তারা আল্লাহর শরীয়াতের অনুকূলে কোন হুকুম করে তবে তা মান্য করা অপরিহার্য।
পীর-সুফিদের আকীদা-বিশ্বাস হলো আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাইতে হলে পীরদের মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়। কোন ব্যক্তি যদি অন্যায় করে আল্লাহর কাছে সরাসরি ক্ষমা চায়, সে ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সরাসরি ক্ষমা করেন না। ভেদে মারেফাত বা ইয়াদে খোদা বইয়ের ৩৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে যে, ‘‘বান্দা অসংখ্য গোনাহ করার ফলে আল্লাহ পাক তাকে কুবল করতে চান না। পীর সাহেব আল্লাহ পাকের দরবারে অনুনয়-বিনয় করিয়া ঐ বান্দার জন্য দু‘আ করবেন, যাতে তিনি কবুল করে নেন। ঐ দু‘আর বরকতে আল্লাহ পাক তাকে কবুল করে নেন।’’ অথচ আল্লাহর কালামে এমন কোন কথা নেই। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন,
আর যদি কেউ কোন মন্দকাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে; অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তবে সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবেই পাবে। (সূরা নিসা- ১১০)
পবিত্র কুরআনের এ আয়াত বলছে, আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি গোনাহগারদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এখানে কোন মাধ্যমের শর্তারোপ করা হয়নি। কেউ যদি অসীলা নিতে চায় তবে যেসব বিষয়ের অসীলা নেয়া জায়েয সেগুলোর অসীলা নিতে হবে। যেমন কোন নেক আমল করে আল্লাহর কাছে অসীলা নিতে পারে। যেমনিভাবে বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি বিপদে পড়ে তারা নিজেদের নেক আমলের অসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। [সহীহ বুখারী, হা/২৩৩৩।]
কোন মৃত ব্যক্তি চাই সে যত বড় ওলী বুযুর্গ বা নবীই হন না কেন- তাদের অসীলা নেয়া বা তাদের অসীলা নিয়ে দু‘আ করা জায়েয নেই।
বর্তমানে পীর-মুরিদীর যে সিলসিলা দেখা যাচ্ছে, এটা সম্পূর্ণ নতুন ও মনগড়াভাবে উদ্ভাবিত। এর মাধ্যমে অজ্ঞ লোকদেরকে মুরিদ বানিয়ে এক একটি বড় আকারের বিনা পুঁজির ব্যবসা সাজিয়ে বসেছে।
এই পীর-মুরিদীকে কেন্দ্র করে বহু ইলাহ ও বহু রবের ইবাদাত ইসলামে প্রবেশ করেছে। মাজার পূজা, কবর পূজা, গাছ পূজা, মাছ পূজা, কচ্ছপ পূজা, কুমীর পূজা, গজার মাছ পূজা, খাজা বাবা, গাজা বাবা, লেংটা বাবা, বান্দা নেওয়াজ, গরীব নেওয়াজ, জুলফেদরাজ, গেছোঁদরাজ, মুশকিলকুশাঁ, হাজতরাওয়াঁ, গাউস-কুতুব, আকতাব, আবদাল, গাউসুল আযম ইত্যাদি নাম দিয়ে বিভিন্নভাবে এদের ইবাদাত করা হয়।
যাদের নামে এগুলো করা হচ্ছে তারা যদি তাদের জীবদ্ধশায় এগুলো করার জন্য আদেশ করে গিয়ে থাকেন অথবা তাদেরকে কেন্দ্র করে এ ধরণের শিরক-বিদআত করা হতে পারে এ কথা জানা সত্ত্বেও যদি নিষেধ না করে থাকেন তাহলে তারা তাগুত বলে বিবেচিত হবেন। আর যদি তারা এগুলো নিষেধ করে গিয়ে থাকেন অথবা তাদের অজান্তেই এসব করা হয় তাহলে তারা তাগুত বলে গণ্য হবেন না। এ ক্ষেত্রে যারা এগুলো করেছে শুধুমাত্র তারাই গোনাহগার হবে।
এ প্রসঙ্গে ঈসা (আঃ) এর বিষয়টি দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায়। ঈসা (আঃ) কেও খ্রিস্টানরা আল্লাহর পুত্র দাবি করে তার ইবাদাত করেছে। কিন্তু এজন্য ঈসা (আঃ) কে তাগুত বলা যাবে না। কেননা তিনি এগুলো করতে বলেননি এবং তাঁর এগুলো জানাও ছিল না। পবিত্র কুরআনে রয়েছে,
যখন আল্লাহ বলবেন, হে মারইয়ামের ছেলে ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাকে দুজন ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করো? তখন সে বলবে, তুমি মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভনীয় নয়। যদি আমি তা বলতাম, তবে তুমি তো তা জানতে। তাছাড়া আমার অন্তরের কথা তুমি তো অবগত আছই, কিন্তু তোমার অন্তরের কথা আমি অবগত নই। নিশ্চয় তুমি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত। (সূরা মায়েদা– ১১৬)
৫. اَلسَّاحِرُ (যাদুকর)
আল্লাহর পরিবর্তে যাদের আনুগত্য করা হয় অথবা আল্লাহর কোন বিশেষ ক্ষমতা কেউ নিজের জন্য দাবি করে সে-ই তাগুত। এদের মধ্যে অন্যতম হলো, اَلسَّاحِرُ তথা যাদুকর।
اَلسِّحْرُ (আস সিহর) শব্দের অর্থ হচ্ছে, اَلشَّيْءُ الْخَفِىُّ তথা গোপন ও সুক্ষন বস্তু, ধোঁকা, ভেল্কিবাজি ও কৌশল ইত্যাদি। পরিভাষায় যাদু হচ্ছে,
اَلسِّحْرُ مَا خَفٰى وَلَطِفَ سَبَبَهٗ
অর্থাৎ যাদু এমন একটি বস্তু, যার কারণ সুক্ষ্ণ ও অদৃশ্য। [ফাতহুল মাজীদ, ৩৯৫ নং পৃ:।]
মোটকথা, যাদু হচ্ছে এমন কিছু মন্ত্র এবং ঝাড়ফুঁক, যা দেহ বা মনে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে মানুষ অসুস্থ হয়, মারা যায় অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবেদ সৃষ্টি করার মতো নিকৃষ্ট কাজ সংঘটিত হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
(১) হাক্বিক্বী যাদু এমন কিছু আমল, যা মানুষের দেহ অথবা মনের ভেতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যাতে মানুষ অসুস্থ হয়, মরে যায় অথবা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয় অথবা কোন কাজ করে ভুলে যায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ কে এ প্রকারের যাদু করা হয়েছিল।
(২) তাখঈলী যাদু হচ্ছে, যে যাদু চোখ এবং দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব ফেলে। যার কারণে কোন বস্তুকে বাস্তবতার বিপরীত দেখে। ফিরাউনের যাদুকররা মূসা (আঃ) এর সাথে এ প্রকারের যাদু করেছিল। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,
যখন তারা নিজেদের যাদু ছাড়ল, তখন তা দ্বারা লোকদের চোখে যাদু করল এবং তাদের আতঙ্কিত করে তুলল। (সূরা আ‘রাফ- ১১৬)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা ‘মানুষকে যাদু করল’ না বলে ‘মানুষের চোখে যাদু করেছে’ বলেছেন।
যাদুর শরয়ী বিধান :
কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় যাদু এমন কর্মকান্ড, যাতে কুফর, শিরক এবং পাপাচার অবলম্বন করে জিন ও শয়তানকে সন্তুষ্ট করে তাদের সাহায্য নেয়া হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা যা আবৃত্তি করত, তারা তারই অনুসরণ করছে। সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা লোকদেরকে যাদুবিদ্যা এবং যা বাবেল শহরে হারূত-মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল তা শিক্ষা দিত। তবে তারা উভয়ে কাউকে তা ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষা দিত না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এ কথা না বলত যে, আমরা পরীক্ষাস্বরূপ। অতএব, তুমি কুফরী করো না; অথচ তারা উভয়ের নিকট তা শিক্ষা করত যা দ্বারা স্বামী ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়। তবে তারা আল্লাহর হুকুম ব্যতীত তা দ্বারা কারো ক্ষতি করতে পারত না। আর তারা শিক্ষা করত এমন বিষয়, যা তাদের ক্ষতি করে এবং কোন উপকার করে না। আর নিশ্চয় তারা জ্ঞাত আছে যে, অবশ্য যে কেউ ওটা ক্রয় করেছে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। আর যার বিনিময়ে তারা নিজেদেরকে বিক্রয় করেছে তা নিকৃষ্ট যদি তারা তা জানত। আর যদি তারা ঈমান আনত এবং ভয় করত, তবে আল্লাহর নিকট হতে কল্যাণ লাভ করত, যদি তারা এটা বুঝত! (সূরা বাকারা- ১০২, ১০৩)
এ আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে,
১. যাদু শিক্ষা দেয়া একটি কুফরি কাজ এবং তা শয়তানের শিক্ষা। কোন নবী-রাসূল, ওলী-আওলিয়া ও ভালো মানুষের কাজ নয়। এগুলো শয়তানের কাজ।
২. ‘‘তারা উভয়ই এ কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিতো না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য আগমন করেছি। সুতরাং তুমি কাফির হয়ো না।’’ আয়াতের এ অংশ দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যাদু শিক্ষা করা একটি কুফরি কাজ।
৩. ‘‘তারা ভালোভাবে জানে যে, যে ব্যক্তি যাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই।’’ এর দ্বারা বুঝা গেল যে, যাদু শিক্ষা করা কাফিরদের কাজ। আর কাফিরদের জন্য পরকালে কোন হিস্যা (জান্নাত) নেই। সুতরাং যাদু এমন একটা কুফরি কাজ, যা দ্বারা জান্নাত চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
৪. ‘‘যদি তারা ঈমান আনত এবং আল্লাহভীরু হতো’’ আয়াতের এ অংশ থেকে আরো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যাদু ঈমান ও তাকওয়ার পরিপন্থী কাজ। যাদু শিক্ষা করলে ঈমান ও তাকওয়া থাকে না।
এসব আয়াত থেকে স্পষ্ট হলো যে, নিজে যাদু শিক্ষা করা এবং অপরকে শিক্ষা দেয়া উভয়টিই কুফরি কাজ। যে ব্যক্তি ঈমানের পরিবর্তে কুফরকে গ্রহণ করে সে ব্যক্তি কাফির হয়ে যায় এবং জান্নাত তার জন্য হারাম হয়ে যায়। তাছাড়া আরো প্রমাণিত হলো যে, যাদু একটি ঈমানের পরিপন্থী কাজ এবং তা ঈমান বিনষ্টকারী বিষয়সমূহের মধ্যে একটি। কেননা যাদুকররা মনে করে যে, তারা মানুষের লাভ-ক্ষতির অধিকারী, ইচ্ছে করলেই তারা কারো উপর বিপদাপদ নাযিল করতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে কারো থেকে বিপদাপদ দূর করে দিতে পারে। অথচ এ কাজগুলো একান্তই আল্লাহর বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু যাদুকররা আল্লাহর এ সকল বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী বলে নিজেদেরকে দাবি করে এবং মানুষ তাদের এসব কথা বিশ্বাস করে তাদের আনুগত্য করে তাই যাদুকররাও তাগুত।
اَلْكَاهِنُ (আল কাহিন) গণক বা জ্যোতিষী :
كَاهِنٌ (কাহিন) ঐ সকল গণক বা জ্যোতিষীকে বলা হয়, যারা হস্তরেখা দেখে অথবা বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ এবং তারকার উদয়-অস্তাচলের ভিত্তিতে অথবা অন্য কোন লক্ষণ দেখে বা তিথী গণনা করে অথবা শয়তানদের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং ইলমে গায়েবের দাবি করে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে জিন এবং শয়তানরা তাদের মানব বন্ধুদের কাছে বিভিন্ন খবর পৌঁছায়। সে অনুযায়ী ঐ শয়তানের বন্ধুরা ও জ্যোতিষীরা আগাম খবর দেয়। কিন্তু মূর্খ অনুসারীরা এটাকে কাশফ এবং কারামত মনে করে। আর এভাবেই অনেক মানুষ এদেরকে আল্লাহর ওলী মনে করে ধোঁকা খায়। বর্তমান যুগে আমাদের সমাজে এদের উৎপাত জাহেলী যুগকেও ছাড়িয়ে গেছে। কেউ পাগড়ি পরে বিজ্ঞাপন দেয় যে, তিনি অমুক দরবারের এত বছরের খাদেম, যিনি আপনাকে দেখামাত্র অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু বলে দেবেন। আবার কেউ সুন্দর চেহারা, মুখে দাড়ি, মাথায় পাগড়ি জড়িয়ে নিজেকে শাহ সাহেব অথবা জিন হুজুর দাবি করে সর্বরোগের মহাচিকিৎসক হিসেবে চ্যালেঞ্জ দিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
যেদিন তিনি তাদের সকলকে একত্র করবেন এবং বলবেন, হে জিন সম্প্রদায়! তোমরা তো অনেক লোককে তোমাদের অনুগামী করেছিলে। আর মানব সমাজের মধ্যে তাদের বন্ধুগণ বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের মধ্যে কতক অপরের দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং তুমি আমাদের জন্য যে সময় নির্ধারিত করেছিলে এখন আমরা তাতে উপনীত হয়েছি। সেদিন আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামই তোমাদের বাসস্থান, তোমরা সেথায় স্থায়ী হবে, যদি আল্লাহ অন্য রকম ইচ্ছা না করেন। তোমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রজ্ঞাময় ও সবিশেষ অবহিত। (সূরা আনআম- ১২৮)
এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, যে সকল পীর-বুযুর্গ আর জিন হুজুররা জিনদের মাধ্যমে বিভিন্ন খবরা-খবর সংগ্রহ করে মানুষের সামনে নিজেদের কারামত প্রকাশ করে, তারা কিয়ামতের দিন নিজেদের অপরাধ স্বীকার করবে এবং আল্লাহ তাদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।
আবু হুরায়রা ও হাসান (রাঃ) হতে বর্ণিত। তারা নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কোন গণক অথবা জ্যোতিষীর কাছে গেল এবং সে যা বলে তা বিশ্বাস করল, সে মুহাম্মাদ ﷺ এর প্রতি যা নাযিল হয়েছে তা অস্বীকার করল। [মুসনাদে আহমাদ, হা/৯৫৩৬; বায়হাকী, হা/১৬৯৩৮।]
যেহেতু গণক নিজেকে عَالِمُ الْغَيْبِ (অদৃশ্যের জ্ঞানী) বলে দাবি করে, যা একান্তই আল্লাহর কাজ এবং গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা-ই রাখেন সে কারণে সে বাতিল ইলাহ এবং বাতিল রব হিসেবে গণ্য হয়। আর যেহেতু সে এর মাধ্যমে লোকদেরকে নিজের আনুগত্যের দিকে আহবান করে এ কারণে সে তাগুত।
৬. اَلْهَوٰى (হাওয়া বা প্রবৃত্তির অনুসরণ)
তাগুতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি তাগুত হলো اَلْهَوٰى (হাওয়া) বা প্রবৃত্তির অনুসরণ। আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে এই হাওয়া নামক তাগুত অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে যখন তার হাওয়ার বিপরীতে কোন হুকুম করা হয় তখন আল্লাহর হুকুম পালন না করে নিজ হাওয়ার হুকুম পালন করে। এভাবে সে আল্লাহর পরিবর্তে হাওয়া তথা প্রবৃত্তির ইবাদাত করে। আর আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদাত করা হয় সেই তাগুত। অতএব হাওয়া একটি তাগুত।
اَلْهَوٰى শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ :
اَلْهَوٰى শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, আকৃষ্ট হওয়া, ভালোবাসা, আসক্ত হওয়া ইত্যাদি। আর এটা ভালো-মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। তবে সাধারণত মন্দ কাজে ইচ্ছা করার ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহার করা হয়। পরিভাষায় হাওয়া বলা হয়, মনে মনে কোন কিছুকে ভালোবেসে তাকে পাওয়া, অর্জন করা বা আনুগত্য করা।
اِتِّبَاعُ الْهَوٰى বা প্রবৃত্তির অনুসরণ দুই প্রকার :
১. اَلْهَوٰى بِمَعْنَى الْكُفْرِ الْاَكْبَرِ الْمُخْرِجُ عَنِ الْمِلَّةِ অর্থাৎ হাওয়া অর্থ হচ্ছে, বড় কুফর, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এ প্রকার হাওয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
তুমি কি ঐ ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে-শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন; আর তার চক্ষুর উপর রেখে দিয়েছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পর কে আছে, যে তাকে হেদায়াত করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (সূরা জাসিয়া- ২৩)
যে ব্যক্তি আল্লাহর পথনির্দেশকে অগ্রাহ্য করে নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে তার অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না। (সূরা ক্বাসাস- ৫০)
অর্থাৎ মানুষকে গোমরাহ করার মতো যত জিনিস আছে, তার মধ্যে মানুষের هَوٰى বা নফসই হচ্ছে সর্বপ্রধান পথভ্রষ্টকারী শক্তি। কারণ শয়তানকেও শয়তান বানিয়ে ছিল এই নফস। কেননা তখন শয়তানকে ধোঁকা দেয়ার জন্য অন্য কোন শয়তান ছিল না। বরং তার নফসই তাকে বলতে শিখিয়েছিল - اَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِىْ مِنْ نَّارٍ وَّخَقَلْتَهٗ مِنْ طِيْنٍ (আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি হতে)। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের هَوٰى বা প্রবৃত্তির দাসত্ব করবে, তার জন্য আল্লাহর বান্দা হওয়া একেবারেই অসম্ভব। কারণ যে কাজে টাকা পাওয়া যাবে, যে কাজ করলে সুনাম ও সম্মান পাওয়া যাবে, যে জিনিসে অধিক স্বাদ ও আনন্দ লাভ করা যাবে, সে কেবল সে কাজই করতে প্রাণপণ চেষ্টা করবে। সেসব কাজ করতে যদি আল্লাহ নিষেধও করে থাকেন, তবুও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করবে না। আর এসব জিনিস যেসব কাজে পাওয়া যাবে না সেসব কাজ করতে সে কখনো প্রস্তুত হবে না। আল্লাহ তা‘আলা যদি সেই কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকেন তবুও সে তার কোন পরোয়া করবে না। এমতাবস্থায় সে আল্লাহ তা‘আলাকে তার একমাত্র ইলাহ হিসেবে স্বীকার করেনি বরং তার নফসকেই সে তার ইলাহের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। কাজেই এমন ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াত লাভ করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তুমি কি ঐ ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য কর না, যে তার কামনা-বাসনাকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার কাজের জিম্মাদার হতে চাও? তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ শুনে ও বুঝে? তারা তো পশুর মতোই, বরং তার চেয়েও অধিক পথভ্রষ্ট! (সূরা ফুরক্বান- ৪৩, ৪৪)
যে ব্যক্তি নফসের দাস, সে যে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট তাতে কোন প্রকার সন্দেহ থাকতে পারে না। প্রত্যেক পশু সেই জিনিসই আহার করে এবং ঠিক সেই পরিমাণ খাদ্য খায়, যে পরিমাণ আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু এই মানুষ এমন এক শ্রেণির পশু যে, সে যখন নফসের দাস হয়ে যায় তখন সে এমনসব কাজ করে, যা দেখে শয়তানও ভয় পেয়ে যায়। মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়ার এটাই প্রথম কারণ। এ জাতীয় মানুষের অনুসরণ করতে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
তুমি তার আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ হতে অমনোযোগী করে দিয়েছি। অতঃপর সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে এবং কার্যকলাপের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে। (সূরা কাহফ- ২৮)
উপরোক্ত আয়াতে যারা নিজের হাওয়া বা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাদের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে।
২. اَلْهَوٰى بِمَعْنَى الْفُسُوْقِ اَوِ الْمَعْصِيَةِ الَّتِىْ هِىَ دُوْنَ الْكُفْرِ الْاَ كْبَرِ অর্থাৎ সাধারণ পাপ এবং নাফরমানী, যা কুফরে আকবারের চেয়ে ছোট। আর এটা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা (বিচার করতে গিয়ে) পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে (জেনে রেখো) তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক খবর রাখেন। (সূরা নিসা- ১৩৫)
অর্থাৎ ‘‘হাওয়া তথা প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখা বলতে ঐ সকল লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা গোনাহ করার ইচ্ছে করেছিল। কিন্তু কিয়ামত দিবসে হিসাব নিকাশের কথা স্মরণ করে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উক্ত গোনাহ থেকে বিরত থাকে।’’ আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য উপরোক্ত পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তাই হাওয়া নামক তাগুতকে বর্জন করা প্রতিটি মুমিনের জন্য খুবই জরুরি।
৭. تَقْلِيْدُ الْاَبَاءُ (তাক্বলীদুল আবা)
তাগুতগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তাগুত হলো تَقْلِيْدُ الْاَبَاءُ (তাক্বলীদুল আবা) অর্থাৎ বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করা। বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসা যত রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কার রয়েছে, সেগুলোকেই শক্তভাবে ধরে রাখা, তা যতই গর্হিত ও কুরআন-সুন্নাহবিরোধী হোক না কেন এটা কোন নতুন রোগ নয়। পূর্ব যুগের উম্মতরাও এই একই রোগে আক্রান্ত ছিল।
যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ যখনই মানুষকে কুরআন-সুন্নাহ তথা হক্বের দিকে আহবান করেছেন তখনই তারা পূর্বপুরুষ ও আকাবিরদের দোহাই দিয়ে বলত, এটা পূর্বপুরুষ হতে চলে এসেছে, অমুক অমুক বড় বড় বুযুর্গ এ কাজ করেছেন, তারা কি কম বুঝেছেন? অথচ কুরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে-
অনুরূপভাবে তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি তখনই তাদের সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিরা বলত, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের উপর এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি। তিনি (নবী) বলতেন, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে পথে পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তার চেয়ে উত্তম পথনির্দেশ আনয়ন করি তবুও কি (তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে)? তখন তারা বলত, তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। (সূরা যুখরুফ- ২৩, ২৪)
যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ করো তখন তারা বলে, বরং আমরা তাঁরই অনুসরণ করব, যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি। অথচ (এ ব্যাপারে) তাদের পিতৃপুরুষদের কোন জ্ঞান ছিল না এবং তারা হেদায়াতপ্রাপ্তও ছিল না। (সূরা বাক্বারা- ১৭০)
এ আয়াতে যে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা হলো মূর্খ লোকেরা আসমানি কিতাবের ইলিম না থাকা সত্ত্বেও নিজেদের পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করে। তাদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন রকম তরীকার যিকির-আযকার, অযীফা ও মিলাদ ইত্যাদি তৈরি করে দিয়েছিল। মানুষ এগুলোকেই দ্বীনের মৌলিক কাজ হিসেবে পালন করতে থাকে। পরবর্তীতে যখন সহীহ আলেমগণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ করতে আহবান জানায় তখন তারা এ আলেমদের বিরুদ্ধে নানা রকম কটূক্তি, সমালোচনা, গালি-গালাজ ও অপবাদ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে এবং জনগণকে বাপ-দাদা ও পূর্বপুরুষদের অনুসরণ করতে আহবান জানায়।
নূহ (আঃ) যখন তাওহীদের দাওয়াত দিলেন তখন তাদের জাতির উচিৎ ছিল এ দাওয়াতে সাড়া দিয়ে সাদরে গ্রহণ করা। কিন্তু তারা তার পরিবর্তে গোটা জাতিকে নূহ (আঃ) এর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিল। আর সেজন্য তারা কিছু নেক্কার লোকদের নাম উল্লেখ করল, যারা ব্যক্তিগতভাবে ভালো ছিল। লোকেরা তাদের মূর্তি তৈরি করে তাদের ইবাদাত করত। কুরআনে এসেছে,
তারা (একে অপরকে) বলেছে, তোমরা কখনো তোমাদের উপাস্যগুলোকে এবং ওয়াদ, সুওয়াআ, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসরকে পরিত্যাগ করো না। (সূরা নূহ- ২৩)
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, নূহ (আঃ) তার জাতিকে শুধু তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি কারো নাম নেননি। কারো বিরুদ্ধে বক্তব্য দেননি। কিন্তু তার জাতি সাধারণ মানুষদের উত্তেজিত করার জন্য তৎকালীন পাঁচজন বড় বড় আল্লাহওয়ালাদের নাম উল্লেখ করেছে।
সালেহ (আঃ) যখন তার সম্প্রদায়কে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন তখন তার সম্প্রদায় যে উত্তর দিয়েছিল তা হলো-
তারা বলল, হে সালেহ! এর পূর্বে তুমি ছিলে আমাদের বিশ্বস্ত। তুমি কি আমাদেরকে তাদের ইবাদাত করতে নিষেধ করছ, যাদের ইবাদাত করত আমাদের পিতৃপুরুষরা? অবশ্যই আমরা সে বিষয়ে বিভ্রান্তিকর সন্দেহের মধ্যে রয়েছি, যার প্রতি তুমি আমাদেরকে আহবান করছ। (সূরা হুদু ৬২)
শু‘আইব (আঃ) যখন তার সম্প্রদায়কে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন তখন তারা উত্তরে বলেছিল,
তারা বলল, হে শুয়াইব! তোমার সালাত কি তোমাকে এ নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃপুরুষরা যার ইবাদাত করত আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে, অথবা আমরা আমাদের ধনসম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও (বর্জন করতে হবে)? তুমি তো অবশ্যই সহিষ্ণু ও ভালো মানুষ। (সূরা হুদ- ৮৭)
যেহেতু লোকেরা পূর্বপুরুষদের আনুগত্য করে যদিও তাদের পূর্বপুরুষরা হেদায়াতপ্রাপ্ত না হয় তাই তারাও তাগুত। কেননা দ্বীনের ক্ষেত্রে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যার ইবাদাত করা হয় সেই তাগুত। যদি এসকল পূর্বপুরুষ তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গোমরাহী কাজের দিকে আহবান না করে থাকেন এবং তারা তাদের কাজে সন্তুষ প্রকাশ না করে থাকেন তবে তারা গোনাহগার হবে না। এ ক্ষেত্রে কেবল অনুসারীরাই গোনাহগার হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/57/24
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।