মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
“অতঃপর জেনে রাখ যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো হক্ব ইলাহ (উপাস্য) নেই। তোমার ও মুমিন পুরুষ এবং মুমিনাহ মহিলাদের ক্রটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা চাও; আর আল্লাহ জানেন তোমাদের গতিবিধি ও অবস্থান। [সূরা মুহাম্মাদ: ১৯]
“অতঃপর তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।” (সূরা আন-নাহল-৪৩) আর সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সহীহ হাদীছে বলেছেন-
«طلب العلم فريضة على كل مسلم»
”জ্ঞান অর্জন প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরয।”
তিনি আরও বলেন-
«فضل العالم على الجاهل كفضل القمر ليلة البدر على سائر الكواكب»
“একজন মূর্খের উপরে জ্ঞানীর মর্যাদা তেমনি যেমন পূর্ণিমার রাত্রিতে চন্দ্রের মর্যাদা সমস্ত নক্ষত্রের উপর।”
ইসলামে অত্যাবশ্যকীয়তার দিক থেকে জ্ঞানকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম ভাগ: প্রতিটি মুসলিম পুরুষ হোক মহিলা হোক, এটি অর্জন করা ফরয, কোনো ওজন আপত্তি দেখিয়ে এত্থেকে কেউ মূর্খ থাকতে পারে না। এটি হচ্ছে দলীল ও প্রমাণ সহকারে আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান।
দ্বিতীয় ভাগ: জ্ঞান অর্জনের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, ফরযে কিফায়াহ। এ বিষয়ে যখন যথেষ্ট সংখ্যক লোক জ্ঞান অর্জন করে, তখন অন্যদের এ জ্ঞান অর্জন না করলেও ক্ষমা করে দেওয়া হয়। তখন এটি বিশিষ্ট লোকদের জন্য ওয়াজিব না হয়ে, মুস্তাহাব বলে গণ্য হয়। এটি ইসলামী শরী‘আতের ঐ জ্ঞান যা মানুষকে বিচার করা ও ফাতওয়া দেওয়ার যোগ্যতা দান করে। তেমনি শিল্প ও জীবন ধারণের জন্য মুসলিমেরা যে প্রয়োজন অনুভব করে, এমনি প্রয়োজনীয় পেশা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। সুতরাং জীবনের জন্য প্রয়োজন এমন বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে যথেষ্ট জ্ঞানী যদি না পাওয়া যায়, তাহলে মুসলিমদের শাসক এ ধরনের জ্ঞান অর্জনকে অত্যাবশ্যকীয় করে দিবেন।
২. আকীদা বিশ্বাস:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন ঘোষণা দেন যে, সকল মানুষ এক আল্লাহর বান্দা। তাঁরই ইবাদাত করা সকলের উপরে ওয়াজিব এবং তাঁর এ ইবাদাতের ক্ষেত্রে তারা যেন যে কোনো মাধ্যম বাদ দিয়েই সরাসরি আল্লাহর সাথে যোগসূত্র গড়ে তুলে। যার বর্ণনা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” এর অর্থে পূর্বে আলোচিত হয়েছে। তিনি আরো নির্দেশ দিয়েছেন, একক আল্লাহর উপরে ভরসা করতে, তাকে ছাড়া অন্য কিছুকে ভয় না করতে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো কাছে কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করতে। কেননা তিনিই একমাত্র ভাল-মন্দ করতে পারেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তাকে ঐ গুণে পরিপূর্ণ গুণাম্বিত করতে, যে গুণে নিজেকে ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহকে গুণাম্বিত করেছেন। যেমন এর বর্ণনা পূর্বে দেওয়া হয়েছে।
৩. মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়া:
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমকে সৎ হওয়ার ও মানব জাতিকে কুফরীর অন্ধকার হতে বাঁচিয়ে ইসলামের জ্যোতির মধ্যে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য আমি আমার প্রতি অর্পিত ওয়াজিবের কিছু অংশ পালনের জন্য এ পুস্তক রচনা করেছি ও প্রকাশ করেছি।
একজন মুসলিম অপরের সাথে যে সম্পর্ক গড়বে তা হবে আল্লাহর প্রতি ঈমানের সম্পর্কে। এ নির্দেশও আল্লাহ দিয়েছেন। সুতরাং তিনি আল্লাহর সৎ বান্দাহ ও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত বান্দাদের ভালবাসবেন, যদিও তারা অনেক দূরের হোক না কেন এবং আল্লাহকে অস্বীকারকারী ও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবমাননাকারীদের উপরে তিনি অসন্তুষ্ট থাকবেন, যদিও তারা নিকটের হোক না কেন। ঈমানের এ সম্পর্কে ঐ সম্পর্ক, যা সকল বিচ্ছিন্ন ও মতভেদকারীদেরকে এক করে দেয়; পক্ষান্তরে বংশ, দেশ ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে উঠা ঐক্য, কেননা তা খুব শীঘ্রই নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“তুমি এমন কোনো কওমকে পাবে না, যারা আল্লাহর উপর ও শেষ দিনের উপরে ঈমান রেখে তাদের পিতৃপুরুষ অথবা সন্তান-সন্ততি অথবা ভ্রাতৃবৃন্দ অথবা গোত্রগোষ্ঠীকে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করা সত্ত্বেও তাকে ভালবাসে।” (সূরা আল-মুজাদালাহ্: ২২)
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই সর্বাধিক সম্মনিত যে সবচেয়ে বেশী তাকওয়া অর্জন করেছে।” (সূরা আল-হুজুরাত-১৩)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা প্রথম আয়াতটিতে জানিয়েছেন যে, নিশ্চয় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী কখনো নিকটতম হলেও আল্লাহর শত্রুদের ভালবাসেন না। দ্বিতীয়টিতে বলেছেন, যে কোনো রং ও যে কোনো জাতিরই হোক না কেন, আল্লাহ তা‘আলার নিকটে সর্বাধিক সম্মানিত ও সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে সে-ই, যে তাঁর অনুগত।
আল্লাহ তা‘আলা শত্রু ও বন্ধু সকলের প্রতি ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুলুমকে নিজের উপর হারাম ঘোষণা করেছেন আর তার বান্দাদের মাঝেও তা হারাম করেছেন। আমানত রক্ষা করা ও সত্য বলার নির্দেশ দিয়েছেন। খিয়ানত করাকে হারাম করেছেন। মাতা-পিতার প্রতি সদয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও দরিদ্রদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন, কল্যাণমূলক কাজে অংশ গ্রহণ, সকল কিছু; এমনকি পশুর প্রতিও ভাল ব্যবহার নির্দেশ দিয়েছেন। এদেরকে শাস্তি দিতে নিষেধ এবং এদের প্রতি করুণা করার হুকুম দিয়েছেন [এমন কি হালাল পশু জব্হ করার সময়ও যেমন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছুরিকে তীক্ষ্ণ ও জবেহকৃত পশুকে আরাম দানের নির্দেশ দিয়েছেন। জবেহের জায়গা গলা, শ্বাসনালী ও রক্ত প্রবাহের শিরা কেটে দিতে হবে, যাতে রক্ত প্রবাহিত হয়ে যায়। উটের হাঁটুর নিচে সিনাতে আঘাত করে নহর করতে হয়। পশুকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া বা মাথায় মারা প্রভৃতি হারাম। এটা খাওয়া জায়িয নয়।]। তবে ক্ষতিকারণ প্রাণী যেমন হিংস্র কুকুর, সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, চিল, গিরগিটিকে, এদের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য মারা যাবে, তবে শাস্তি দিয়ে নয়।
৪. মুমিনের জন্য আত্মপর্যালোচনা ও উপদেশ গ্রহণঃ
মহাগ্রস্থ কুরআনের আয়াতে মানুষদেরকে বলা হয়েছে যে, নিশ্চয় যেখানে তারা থাকে না কেন, আল্লাহ তাদেরকে দেখেন। তিনি তাদের সকল কর্ম সম্পর্কে জানেন। তাদের নিয়ত সম্পর্কে জানেন। তিনি তাদের কাজ ও কথা গণনার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর ফিরিশতারা তাদের সাথেই আছেন। তাদের থেকে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে যাই করা হয়, তারা তা লেখেন, তাঁরা যা করছে ও বলছে, অল্প সময়ের মধ্যেই তার হিসাব কিতাব নেওয়া হবে। এ জীবনে তার নাফরমানী করলে, তাঁর নির্দেশ অমান্য করলে, তাদেরকে কঠোর আযাবের হুঁশিয়ারী দিয়েছেন। আল্লাহর উপরে ঈমান স্থাপনকারীদের জন্য এটাই বড় ধমক, যা তাদেরকে গুনাহ থেকে বিরত রাখবে। সুতরাং তারা আল্লাহকে ভয় করে, অপরাধ ও তার বিরোধিতা বর্জন করবেন।
অপরদিকে যে আল্লাহকে ভয় করে না ও সুযোগ পেলেই পাপে লিপ্ত হয়, আল্লাহ তার জন্য সাজার ব্যবস্থা করেছেন; যা তাদেরকেও এ অপরাধ থেকে বিরত রাখে। আর সে ব্যবস্থাটি হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মুসলিমদের ভাল কাজের নির্দেশ ও খারাপ কাজ থেকে নিষেধের নির্দেশনা প্রদান। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম কাউকে কোনো পাপ কাজ করতে দেখলে তার অনুভূতিতে জেগে উঠবে যে অন্যরা যে অপরাধ করছে তার জন্য তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহী করতে হবে। তাই সে হাত দিয়ে শাস্তি দিয়ে প্রতিহত করার ক্ষমতা না রাখলে মুখ দিয়ে নিষেধ করে হলেও সেটা প্রতিহত করবে।
আর আল্লাহ মুসলিম শাসকদেরকে অপরাধীদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তির ব্যবস্থা (হুদুদ) কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘হুদুদ’ হচ্ছে অপরাধের মান অনুযায়ী ঐ সমস্ত সাজা যা আল্লাহ তার কুরআনে ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর হাদীসে বর্ণনা করেছেন। সেগুলোকে অপরাধীদের উপরে কার্যকর করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন যাতে করে ইনসাফ, নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা যথাযথভাবে বজায় থাকে।
৫. সামাজিক দায়িত্ববোধ ও পারষ্পরিক সহযোগিতা:
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে পরস্পরের মধ্যে আর্থিক ও মানবিক সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমনটি যাকাত ও ছদকার অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। যে কোনো প্রকারের কষ্টই হোক না কেন, এমনকি রাস্তা ও ছায়ায় পর্যন্তও কষ্টের কোনো কিছু রাখা আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের উপর হারাম করেছেন। যদিও এটা অন্যরা রেখে থাকে; এর পরও এটাকে সরিয়ে ফেলার জন্য আল্লাহ মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিরসনকারীর জন্য ছাওয়ার ও কষ্টদাতার জন্য শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
নিজের জন্য যা ভাল মনে করবে নিজের ভাইদের জন্যও তাই ভাল মনে করবে এবং নিজের জন্য যা খারাপ মনে করবে নিজের ভাইয়ের জন্যও তা খারাপ মনে করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন-
“যারা দানখয়রাত অথবা সৎ কাজ অথবা মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেয়, তারা ব্যতীত তাদের অধিকাংশের পরামর্শের মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই এবং যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একাজ করে, আমি তাদেরকে বড় পুরস্কার দান করবেন।” (সূরা নিসা-১১৪)
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন-
" لا يؤمن أحدكم حتى يحب لأخيه ما يحب لنفسه "
“তোমাদের কেউ নিজের জন্য যা পছন্দ করো অন্যের জন্য তা পছন্দ না করা পর্যন্ত মুমিন হবে না।’ (মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষ জীবনে বিদায় হজ্জে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় পূর্বে তিনি যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, সে সম্পর্কে আরো তাকীদ সহকারে বলেছেন যে,
«يا أيها الناس إن ربكم واحد، وأباكم واحد، ألا لا فضل لعربي على عجمي، ولا لعجمي على عربي، ولا لأسود على أحمر، ولا لأحمر على أسود، إلا بالتقوى، أبلغت؟ قالوا أبلغ رسول الله» .
“হে মানব জাতি তোমাদের রব এক, তোমাদের পিতা এক। হুঁশিয়ার, কোনো অনারবের উপরে আরবীয়ের, কোনো আরবীয়ের উপরে কোনো অনারবের, কোনো লাল রঙের মানুষের উপরে কালো মানুষের, কোনো কালো মানুষের উপর লাল মানুষের তাকওয়ার মানদন্ড ব্যতীত মর্যাদাতে কোনো পার্থক্য নেই। আমি কি এখন পৌঁছে দিয়েছি?”
তিনি আরো বলেন-
«إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليك حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا وفي بلدكم هذا ألا هل بلغت؟ قالوا : نعم . فرفع أصبعه إلى السماء، وقال : اللهم اشهد»
“নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্ভ্রম, তোমাদের এ দিন ও তোমাদের এ মাস ও তোমাদের এ শহরের মতই হারাম। (এদের এগুলোতে অন্যের হস্তক্ষেপ অবৈধ, সাবধান!) আমি কি একথা তোমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছি ? তারা বলল- হ্যাঁ।” এরপর তিনি আকাশের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে বললেন- হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন। [এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সার সংক্ষেপ বক্তৃতা, যা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদীস গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর ভিতর থেকে যা পাওয়া গেছে আল্লামা শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাদীদ তাঁর গ্রন্থ ‘‘আল ইবাদত শরহি খুতাবি হুজ্জাতিল ওদা‘তে একত্র করেছেন।]
৬. আভ্যন্তরীণ রাজনীতি
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের নিজেদের মধ্য হতে একজন ইমাম নিয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যার কাছে তারা নেতৃত্বের বাই‘আত গ্রহণ করবেন এবং তাদেরকে একসাথে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন। অতঃপর তারা হবে এক উম্মত। তাদের ইমাম ও আমীরদের প্রতি আল্লাহর অবাধ্য কোনো কিছু করতে নির্দেশ দান ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে আনুগত্য দেখাতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা আল্লাহর অবাধ্য কোনো কিছুতে সৃষ্টির আনুগত্য করতে হবে না।
আর আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, যদি কোনো মুসলিম তার নিজ দেশে ইসলামকে প্রকাশ্যভাবে পালন করে চলতে না পারেন, ইসলামের দিকে মানুষদের দাওয়াত দিতে না পারেন, তাহলে তাদেরকে আল্লাহ অন্য ইসলামী দেশে হিজরত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামী দেশ হচ্ছে এমন দেশ, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং যেখানে একজন মুসলিম শাসক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সেটা অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করেন।
ইসলাম ভৌগলিক সীমারেখা, জাতীয়তাবাদ-দেশাত্মবাদ অথবা সাম্প্রদায়িকতাকে স্বীকার করে না। মুসলিমদের জাতীয়তা হচ্ছে ইসলাম। বান্দাহগণ হচ্ছে আল্লাহর বান্দা। যমীন হচ্ছে, আল্লাহর যমীন। মুসলিম সেখানে আল্লাহর শরী‘আত মান্য করবেন এ শর্তে তিনি যে কোনো স্থানে চলাফেরার অধিকার রাখেন। এর কোনো একটির বিরোধিতা করলে আল্লাহর বিচার তার উপর কার্যকর হবে। আল্লাহর শরী‘আত পালন ও তার হুদুদ (নির্ধারিত সাজা) প্রতিষ্ঠার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা, সম্ভ্রম ও সম্পদ সংরক্ষিত হওয়ার গ্যারান্টি। প্রতিটি কল্যাণ এর মধ্যে নিহিত রয়েছে। এ থেকে ভিন্নমুখী হওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে সকল অমংগল।
আল্লাহ বিবেক সংরক্ষণ করেছেন: আল্লাহ তা‘আলা বিবেকের কার্যক্ষমতা নষ্টকারী মাদকতা হারাম করে বিবেক বুদ্ধিকে সংরক্ষণ করেছেন এবং প্রত্যেক মাদক দ্রব্য পানকারীর জন্য প্রত্যেকবারের চল্লিশ থেকে আশি বেত্রাঘাতের ব্যবস্থা করেছেন; তাকে এত্থেকে বিরত রাখা, তার বিবেক বুদ্ধিকে হেফাযত করা ও তার অনিষ্টতা থেকে মানুষদেরকে রক্ষা করার জন্য।
আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের রক্ত হেফাযত করেছেন: কোনো হত্যাকারী কাউকে অবৈধভাবে তার উপরে চড়াও হয়ে হত্যা করলে তার উপরে কিসাস (হত্যার পরিবর্তে হত্যা) বিধান প্রদান করে মুসলিমের রক্তকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেমন অংগ প্রত্যংগের জন্য শরী‘আত কিসাসের বিধান দিয়েছেন, তেমনি মুসলিমদেরকে জান, মাল ও মান সম্ভ্রমকে রক্ষা করার বিধান শরী‘আত প্রণয়ন করেছে। আল্লাহ বলেন-
“হে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ! তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে জীবন নিহিত রয়েছে, যেন তামরা তাকওয়াহ অর্জন করতে পার।” (সূরা আল-বাকারাহ-১৭৯)
আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-
«من قُتل دون نفسه فهو شهيد، ومن قتل دون أهله فهو شهيد، ومن قتل دون ماله فهو شهيد»
“যে ব্যক্তি নিজের নফছকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হল, সে শহীদ। যে তার পরিবার পরিজনকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হল, সে শহীদ। যে তার নিজের সম্পদকে রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হল সে শহীদ।”
আল্লাহ মুসলিমদের সম্ভ্রমকে হিফাযত করেছেন: তাই মুসলিমের অনুপস্থিতিতে হক ব্যতীত এমন কোনো কথা যা সে অপছন্দ করে তা শরী‘আত হারাম করেছে। শরী‘আতসম্মত প্রমাণাদি ব্যতীত সমকাম, যিনা প্রভৃতি চারিত্রিক অপরাধের মিথ্যা অপবাদকে শরী‘আত নিষিদ্ধ করে মুসলিমদের মান সম্ভ্রমকে সংরক্ষণ করেছে।
আল্লাহ মুসলিমদের বংশ ও নসবকে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া থেকে হেফাযত করেছে। মানুষের মান-সম্মানকে চারিত্রিক অপরাধ দ্বারা দূষিত করা থেকে হেফাযত করার জন্য যিনাকে কঠিনভাবে হারাম করেছে এবং সেটাকে বড় কবীরা গুনাহ ঘোষণা করেছে। যিনাকারীর উপরে কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছে, যখন সে প্রবর্তিত শাস্তি কার্যকরী করার শর্ত পাওয়া যাবে।
আল্লাহ তা‘আলা সম্পদকে হেফাযত করেছে: আর তাই চুরি, ধোঁকা, লটারী, সুদ প্রভৃতি অবৈধ (হারাম) উপার্জনকে আল্লাহ হারাম করে সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। শর্ত পূর্ণ হলে, চোর ও ডাকাতের হাত কাটার কঠোর শাস্তিকে ইসলাম শরী‘আতভুক্ত করেছে। অথবা শর্ত পরিপূর্ণ না হলে চুরির প্রমাণ পাওয়া গেলে, ঐ শাস্তির ব্যবস্থা করেছে, যা তাকে একাজ থেকে বিরত রাখবে।
এ সমস্ত শাস্তির বিধান (হুদুদ) প্রণয়নকারী হচ্ছেন আল্লাহ। কোনো কাজ তার সৃষ্টকে সংশোধনের উপযোগী, তা আল্লাহ ভালভাবেই জানেন। তিনি তাদের প্রতি অতীব দয়ালু। অপরাধী মুসলিমদের গোনাহ ক্ষমার জন্য এবং সমাজকে তাদের ও অন্যান্যদের অনিষ্টতা থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তিনি এ সমস্ত শাস্তির বিধান প্রণয়ন করেছেন। ইসলামের শত্রু ও তথাকথিত ইসলামের দাবীদারদের মধ্যে যারা হত্যাকারীকে হত্যা করা ও চোরের হাত কাটাকে দোষারূপ করে থাকে তাদের জানা উচিত যে তারা রোগীর এমন বিনষ্ট অঙ্গ কাটাকে দোষারূপ করছে যদি সে অঙ্গ কাটা না হয় তবে তার ক্ষতি গোটা সমাজকে আক্রান্ত করবে। [.আক্রান্ত রোগীর ও তার পরিবারের অনুমোদন ক্রমে তার আক্রান্ত অংগ তার শরীরের নিরাপত্তার জন্যই কেটে ফেলা উত্তম।] অথচ ইসলামের শত্রু ও তাদের সেবাদাস তথাকথিত ইসলামে দাবীদাররা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অত্যাচার করে নির্দোষদের হত্যাকে ভাল মনে করে!!!
৭. বহির্বিশ্ব বিষয়ক রাজনীতি
অমুসলিমদেরকে কুফরীর অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ দান করে আল্লাহর ঈমানের রোশনীতে আলোকিত করার জন্য ও পার্থিব জীবনের সম্পদের মধ্যে ডুবে থাকার অতৃপ্তি থেকে মুসলিম সত্যিকারের যে আধ্যাত্মিক প্রশান্তিকর নিয়ামত ভোগ করেছেন তা থেকে বঞ্চিতদেরকে মুক্তি দানের জন্য আল্লাহ মুসলিমগণ ও তাদের নেতাদেরকে ঐ সমস্ত লোকদেরকে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বস্তুত মুসলিমদের প্রতি আল্লাহর এ নির্দেশনা এজন্যেই এসেছে যে এর মাধ্যমে সে এমন সৎ ও সঠিক মানুষরূপে গড়ে উঠবে; যার সততা ও কল্যাণ থেকে সকল মানব সন্তান লাভবান হবে এবং সে সকল মানুষদেরকে পরিত্রাণের চেষ্টা করবে; পক্ষান্তরে মানুষের তৈরী জীবন-বিধানসমূহ এ থেকে ভিন্ন; কেননা এটি মানুষদের শুধু সৎ নাগরিক হওয়ার দাবী জানায়, অন্য কিছুর নয়। এটি এ পদ্ধতির অসারতা ও অপরিপূর্ণতা এবং ইসলামের উপযুক্ততা ও পরিপূর্ণতার প্রমাণ।
আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে সাধ্যমত শক্তি অর্জনের জন্য আল্লাহ মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন; যাতে ইসলাম ও মুসলিমরা নিরাপত্তায় থাকে এবং আল্লাহ ও মুসলিমদের শত্রুরা ভীত থাকে। তেমনি ইসলামী শরী‘আতের আলোকে প্রয়োজন হলে, অমুসলিমদের সাথে চুক্তিকে আল্লাহ মুবাহ করেছেন। যতক্ষণ শত্রুরা তাদের চুক্তি ভঙ্গ না করবে, অথবা যতক্ষণ তারা এমন কিছু না করবে, যা দ্বারা তারা যে চুক্তি ভঙ্গ করেছে তা বোঝা যাবে; ততক্ষণ শত্রুদের সাথেও চুক্তি মুসলিমদের জন্য ভঙ্গ করা আল্লাহ হারাম করেছেন।
মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ শুরু করার প্রথমেই তাদেরকে প্রথমত: ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দানের জন্য, মুসলিমদের নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তা করতে অস্বীকার করে তবে তাদের থেকে জিযিয়া তথা প্রাণরক্ষা কর এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি অনুগত থাকার আহ্বান জানাতে হবে, যদি তাও অস্বীকার করে তাহলে ফিতনা অপসারিত হয়ে সমগ্র দীন তথা জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালাতে হবে।
যুদ্ধের সময়ে সরাসরি যুদ্ধের কাজ করে বা পরামর্শ দিয়ে স্বপক্ষের যোদ্ধাদের সাথে অংশ গ্রহণ করেছে, এমন লোক ব্যতীত শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ ও উপসনালয়ের ধর্মযাজকদের হত্যা করাকে আল্লাহ মুসলিমদের উপরে হারাম করেছেন। আর মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে কয়েদীদের সাথে ইহসানপূর্ণ তথা সর্বোত্তম ব্যবহার করা হয়। এ থেকে বোঝা যায়, কারো উপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বা অন্যের সম্পদ ভোগ করার জন্য ইসলাম যুদ্ধ করে না। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, সত্যের প্রসার ও সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং মানুষদেরকে সৃষ্টের ইবাদত থেকে ফিরিয়ে স্রষ্টার ইবাদতমুখী করা।
৮. স্বাধীনতা:
ক. আকীদাহ বিশ্বাসের স্বাধীনতা: অমুসলিমগণ যারা ইসলামী হুকুমতের অধীনস্থ, তাদের কাছে ইসলাম বর্ণনা করা এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদানের পরে আল্লাহ তা‘আলা দীনে ইসলামে তাদের জন্য আকীদাহগত স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে এতে তাদের জন্য সুখ-শান্তি ও মুক্তি রয়েছে। আর যদি তারা তাদের দ্বীনের উপরে অবস্থান করে, তাহলে তারা নিজেরাই কুফরী, দুর্ভোগ ও জাহান্নামের শাস্তিকে অনিবার্য করে নিল। এর মাধ্যমে তাদের উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হলো। আল্লাহর নিকট পেশ করার জন্য তাদের আর কোনো ওজর থাকবে না। কিন্তু দুনিয়াতে মুসলিমগণ তাদেরকে তাদের স্ব স্ব-আকীদাহ বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকার স্বাধীনতা প্রদান করবেন, এ শর্তে যে, তারা নিজ হাতে মর্যাদাহীন অবস্থায় জিযিয়াহ তথা প্রাণরক্ষা কর প্রদান করবে এবং (তাদের ব্যাপারে) ইসলামের নির্দেশনার আনুগত্য করবে আর মুসলিমদের সম্মুখে তাদের কুফরী ধর্মীয় আচরণ প্রকাশ করে বেড়াবে না।
অপরদিকে ইসলামে প্রবেশ করে মুসলিম হওয়ার পরে ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, তা কোনোক্রমেই উপেক্ষা করা হবে না। যদি সে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয় (মুরতাদ হয়) তার প্রতিদান হচ্ছে হত্যা। কেননা তাওবাহ করা ও ইসলামের দিকে ফিরে আসা ব্যতীত তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কারণ সে সত্যকে জানার পর তাত্থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। আর যদি ইসলাম বিনষ্টকারী কারণসমূহের কোনো একটিতে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে সে মুরতাদ হয়ে থাকে; তাহলে সে এটাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে তাওবা করবে, উক্ত কাজে লিপ্ত হওয়াকে ঘৃণা করবে এবং আল্লাহর কছে গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে।
ইসলাম বিনষ্টকারী ও বিধ্বংসী কাজের সংখ্যা অনেক: তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে-
১. আল্লাহর সাথে শির্ক করা: শির্ক হচ্ছে, বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর সাথে অন্যকে ইলাহ বানিয়ে নেয়া। যদিও সে উক্ত ইলাহকে আল্লাহর কাছে তার জন্য দো‘আ করা, তাকে আল্লাহর নিকটতম করার জন্য মাধ্যম হিসাবে হয়ে থাকুক না কেন। জাহেলী যুগের মুশরিকগণ যেমন সৎ ব্যক্তিদের সুপারিশ লাভের জন্য তাদের প্রতীকি চিত্র তৈরী করে, মূর্তিপূজা করতে তেমনি ইবাদত ও ইলাহের নাম ও অর্থ বুঝে সে অনুযায়ী এগুলোকে ইলাহ স্বীকার করুক, অথবা উক্ত ইলাহ আল্লাহর সাথী ইলাহ, তার ইবাদত আল্লাহর ইবাদত তুল্য স্বীকার নাই করুক। যেমন ইসলামের দাবীদার মুশরিকগণকে যখন তাওহীদের দিকে আহ্বান করা হয়, তারা এ ভেবে এটি গ্রহণ করে না যে, নিশ্চয় শির্ক হচ্ছে, শুধুমাত্র আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিকে সিজদাহ করা বান্দার পক্ষ থেকে কোনো কিছুকে “এ আমার ইলাহ” বলা।
তাদের অবস্থা হচ্ছে তাদের মত, যারা মদকে অন্য নাম দিয়ে মদপান করে। তাদের অবস্থা পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-
“দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ করে তাঁর ইবাদত কর। সাবধান! বিশুদ্ধ দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা) হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে (তারা বলে) যাতে তারা আমাদেরকে মর্যাদার দিক থেকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে, কেবল সে জন্যই তাদের ইবাদাত করি। যে বিষয়ে তারা মত পার্থক্যে লিপ্ত হয়েছে, আল্লাহ তাদের মধ্যে এ বিষয়ে মীমাংসা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মিথ্যুক কাফিরকে হিদায়াত দান করেন না।” (যুমার-২-৩)
“তিনিই তো আল্লাহ, তোমাদের রব। তাঁর জন্যই সকল সার্বভৌমত্ব। তাঁকে ছেড়ে তোমরা যাদেরকে ডাক তারা খেজুরের আঁটির উপরের আবরণেরও মালিক নয়। যদি তোমরা তাদেরকে ডাক, তারা তোমাদের ডাক শুনবে না। যদি শুনেও তোমাদের জন্য সেটার উত্তর দিতে পারবে না। কিয়ামতের দিন তাদেরকে যে আল্লাহর সাথে তোমরা শরীক করেছ, তারা তা অস্বীকার করবে এবং তোমাকে (এ বিষয়ে) সর্বজ্ঞাত আল্লাহর ন্যায় কেউ সংবাদ দিতে পারবে না।” (ফাতির- ১৩-১৪)
২. মুশরিক ও তাদের মত ইয়াহূদী, খৃষ্টান, আল্লাহদ্রোহী ও অগ্নিপূজক প্রভৃতি কাফিরদেরকে এবং তাগুত তথা যারা আল্লাহর অবতীর্ণকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী বিধান প্রদান করে না এবং আল্লাহর হুকুমের উপরে সন্তুষ্ট নয় এমন লোকদের কাফির না বলা (ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়)। তারা যে কাফের, এটা জানার পরে যে তাদেরকে কাফির বলবে না, সেও কাফির হয়ে গেল।
৩. বড় শির্ককে অনিবার্য করে এমন জাদুর কাজ। সুতরাং জাদুর কাজ করা এবং এ কাজের উপরে সন্তুষ্ট থাকাকে কুফরী কাজ জেনেও যে এ কাজ করবে ও এর উপর সন্তুষ্ট থাকবে সে কাফির হয়ে যাবে।
৪. ইসলামী শরী‘আত ও জীবন পদ্ধতির চেয়ে অন্য শরী‘আত ও জীবন পদ্ধতিকে উত্তম বলে বিশ্বাস করা, অথবা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রদত্ত বিধি-বিধানের চেয়ে অন্যের বিধি-বিধানকে উত্তম বলে বিশ্বাস করা। অথবা আল্লাহর কর্তৃক প্রদত্ত বিধান ছাড়া অন্যের বিধান দ্বারা হুকুম দেওয়া বৈধ বলে বিশ্বাস করা।
৫. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ এবং তার শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত জানার পরেও কোনো কিছুর উপর সন্তুষ্ট না থাকা ও বিদ্বেষ বা ঘৃণা পোষণ করা।
৬. এমন কিছুকে নিয়ে ঠাট্রা বিদ্রূপ করা, যা সম্পর্কে সে জানে যে, এটি দীন ইসলামের অংশ।
৭. ইসলামের বিজয়ে অসন্তুষ্ট ও পরাজয়ে খুশী হওয়া।
৮. কাফিরদের বন্ধুরা কাফিরদের সাথে সংযুক্ত হবে; এটা জেনেও তাদেরকে ভালোবাসা ও সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা।
৯. যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শরী‘আত থেকে বের হয়ে যাওয়া যে সঠিক নয়, এটা জানার পরেও তাঁর শরীয়ত থেকে বের হয়ে যাওয়াকে সঠিক বলে বিশ্বাস করা।
১০. আল্লাহর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা। সুতরাং যদি কেউ এমনভাবে ইসলাম থেকে বিমুখ হয় যে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও সে ইসলামকে না জানে ও আমল না করে, সে কাফির হয়ে যাবে।
১১. ইজমা (উলামাদের একমত) অনুষ্ঠিত হয়েছে, এমন আহকাম (বিধানাবলী) হতে কোনো হুকুমকে জানার পরও তা অস্বীকার করা।
বস্তুত কুরআন ও সুন্নায় এ সব ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়ের বহু দলীল প্রমাণাদি রয়েছে।
খ. মতামতের স্বাধীনতা: আল্লাহ তা‘আলা দীনে ইসলামে মতামতের স্বাধীনতা দিয়েছেন। তবে শর্ত হচ্ছে, যেন এ মতামত ইসলামী শিক্ষার বিরোধী না হয়। তাই কোনো তিরষ্কারকারীর তিরস্কারকে তোয়াক্কা না করে সকলের সম্মুখে সত্য কথা বলার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং এটাকে উত্তম জিহাদ বলে চিহ্নিত করেছেন। মুসলিমদের শাসকগণকে উপদেশ দিতে এবং খারাপ কাজ থেকে তাদেরকে নিষেধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি হচ্ছে, মতামতকে সম্মান প্রদর্শণের উত্তম ও সুন্দর পদ্ধতি। অপরদিকে ইসলামী শরী‘আতের পরিপন্থী মতামতকে প্রচারের অনুমতি ইসলাম দেয় নি। কেননা, সেটা হচ্ছে, বিধ্বংসী ফিতনা ফ্যাসাদ ও সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
গ. ব্যক্তি স্বাধীনতা: পবিত্র ইসলামী শরী‘আতের সীমার মধ্যে থেকে আল্লাহ তা‘আলা দীনে ইসলামে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনুমোদন দান করেছেন। প্রতিটি মানুষ, পুরুষ হোক বা মহিলা, তাদের মধ্যে ও অন্যান্যদের মধ্যে অনুষ্ঠিত কার্যক্রম যেমন- বেচাকেনা, দান, ওয়াক্ফ, ক্ষমা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি পুরুষ মহিলাকে তাদের জোড়া বেছে নেয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যদি কেউ কাউকে পছন্দ না করে, এ ক্ষেত্রে তাকে তা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় নি। দীনের আকীদাহ-বিশ্বাসে যদি সমতা না থাকে তবে সেখানে এমন পুরুষ নির্বাচনের অনুমতি ইসলাম কোনো মহিলাকে দেয় নি। এটা উক্ত মহিলার আকীদা বিশ্বাস ও মান সম্ভ্রমকে রক্ষা করার জন্যই।
মহিলার ওলী-অভিভাবক তথা তার বংশের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধিই মহিলার বিয়ের দায়িত্ব নিবে; কারণ কেননা ব্যভিচারীনীর কাজের সাথে মিল থাকার কারণে মহিলা নিজে নিজে বিয়ে সম্পাদন করতে পারে না। সুতরাং দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে কন্যার অভিভাবক বরকে বলবেন “জনৈকা হচ্ছে তোমার স্ত্রী।” বর বলবে! “আমি গ্রহণ করলাম।”
ইসলাম কোনো মুসলিমকে আল্লাহর শরী‘আতের সীমা লংঘনের অনুমতি দেয় নি। কারণ সে এবং তার মালিকানাধীন সবার মালিকই তো আল্লাহ। সুতরাং তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড হতে হবে আল্লাহর শরী‘আতে সীমার গণ্ডির ভিতরেই, যে শরী‘আতকে তিনি তার বান্দাদের জন্য রহমত করে প্রণয়ন করেছেন। যে কেউ এ শরী‘আতের উপর চলবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে, তার সুখী সমৃদ্ধ জীবন লাভ হবে, পক্ষান্তরে যে এর বিরোধিতা করবে, সে দুঃখ লাভ করবে ও ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা যিনা, সমকামিতাকে শক্তভাবে হারাম করেছেন। অনুরূপভাবে আত্মহত্যা এবং আল্লাহ তার সৃষ্টিকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তা পরিবর্তন করাকে মুসলিমের উপরে হারাম করা হয়েছে। অপরদিকে গোঁফ খাটো করা, নখ কাটা, বগল সাফ করা, খৎনা দেওয়া এগুলো করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহর শত্রুদের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা বিশেষত্ব তথা চিহ্ন রয়েছে এ সবের অনুরূপ হওয়াকে আল্লাহ মুসলিমের জন্য হারাম করেছেন। কেননা বাহ্যিক দিক থেকে পূর্ণভাবে তাদের মত হওয়া ও তাদেরকে ভালবাসা, ধীরে ধীরে পূর্ণভাবে তাদের মত হতে ও প্রাণ দিয়ে তাদের ভালবাসতে উদ্বুদ্ধ করবে। আল্লাহ মুসলিমকে চান, যেন তিনি সঠিক ইসলামী চিন্তার উৎস হয়। যেন তিনি মানুষের চিন্তা-চেতনা ও তাদের মতামতের আমদানীকৃত স্থানে পরিণত না হয়। আল্লাহ চান, মুসলিম যেন উত্তম আদর্শবান হয়। অন্ধ অনুকরণকারী না হয়।
আর যদি অমুসলিমগণ যোগ্যতা, সঠিক কারিগরী ও কৌশলের অভিজ্ঞতার দিক থেকে মুসলিমদের চেয়ে অগ্রসর হয়ে যায়, তাহলে ইসলাম তাদের থেকে তা শিক্ষা করা ও গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। কেননা আল্লাহ হচ্ছেন মানুষের শিক্ষক (তিনিই তাদের তা শিক্ষা দিয়েছেন)।
“আল্লাহ মানুষকে যা তারা জানে না তা শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা আল-আলাক-৫)
মানুষ নিজের স্বাধীনতা হতে লাভবান হওয়া, তার মর্যাদা সংরক্ষণ করা ও মান সম্ভ্রমকে নিজের আত্মার অনিষ্টতা বা অন্যের অনিষ্টতা থেকে বাঁচানোর জন্য এটি হচ্ছে মানুষের সর্বোত্তম উপদেশ ও সংশোধনের উৎকৃষ্ট পন্থা।
ঘ. বাসস্থানের স্বাধীনতা: আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে বাসস্থান গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়েছেন। সুতরাং কারো জন্য অন্য কারো বাড়িতে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ বৈধ নয় এবং বিনা অনুমতিতে তার বাসস্থানের দিকে দৃষ্টিপাতও বৈধ নয়।
ঙ. উপার্জনের স্বাধীনতা: শরী‘আতের সীমারেখার মধ্যে থেকে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমকে উপার্জন ও ব্যয়ের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহ শ্রমদান ও উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে তার নিজের ও তার পরিবারের ভরণ পোষণ সংকুলান হয় এবং তা কল্যাণের ও ছাওয়াবের কাজে ব্যয় করতে পারে। একই সাথে সুদ, লটারী, ঘুষ, চুরি, ভবিষ্যৎ গণনা, জাদু, যিনা, সমকামিতা প্রভৃতির অবৈধ উপার্জনকে আল্লাহ হারাম করেছেন। এ সমস্ত উৎস থেকে যেমন উপার্জন হারাম তেমনি সেখানে ব্যয় করাও হারাম। সুতরাং শরী‘আতসম্মত পদ্ধতি ব্যতীত মুসলিম কোথাও ব্যয় করবে না। এটি হচ্ছে আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে মানুষের জন্য উপদেশ, হিদায়াত ও সংশোধনের উচ্চতর স্থান, যাতে করে তিনি হালাল আয়ের মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে সুখ সমৃদ্ধ জীবন যাপন করতে পারেন।
৯. পরিবার:
ইসলামী শরী‘আতে আল্লাহ তা‘আলা পরিবারের জন্য অত্যন্ত পরিপূর্ণ নিয়ম পদ্ধতি প্রণয়ন করেছেন, যারা তা গ্রহণ করবে তাদের জন্য সৌভাগ্যের যাবতীয় মাধ্যম বাস্তবায়িত হবে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতার প্রতি উত্তম কথা, যদি তারা তার থেকে দূরে থাকে তবে তাদের সাথে অবিরত সাক্ষাত-যিয়ারত, তাদের প্রয়োজন পূরণ, তাদের জন্য খরচ করা, তাদের উভয়ে কিংবা একজন যদি দরিদ্র হয় তবে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধ্যমে ইহসান তথা সর্বোত্তম আচার-আচরণ করার বিষয়টি শরী‘আতে বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তির ধমকি দিয়েছেন যারা পিতামাতার প্রতি গুরুত্ব দেয় না, পক্ষান্তরে যারা তাদের প্রতি ইহসান বা উত্তম ব্যবহার করে তাদের জন্য সৌভাগ্যশালী হওয়ার ওয়াদা করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা বিবাহের নিয়ম পদ্ধতি দিয়ে শরী‘আত প্রদান করেছেন এবং তার নিজের কিতাবে এবং রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভাষায় একে শরী‘আতের আওতাধীন করার বিজ্ঞানসম্মত কারণও বর্ণনা করেছেন। তা হচ্ছে,
১. চরিত্র পবিত্র রাখা এবং গুপ্তাঙ্গকে অবৈধ কাজ (যিনা) থেকে রক্ষা করা আর চোখকে হারাম দেখা থেকে রক্ষা করার মাধ্যমসমূহের মধ্যে বিবাহ হচ্ছে অন্যতম মাধ্যম।
২. বিবাহ স্বামী স্ত্রী উভয়কে পরস্পরের আরাম আয়েশ ও তৃপ্তিদানের ব্যবস্থা করে। কেননা আল্লাহ তাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়ার্দ্রতা সৃষ্টি করেছেন।
৩. বিবাহের মাধ্যমে শরী‘আত সম্মতভাবে মুসলিমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যা মুসলিমদেরকে চরিত্রবান ও যোগ্যতম করে।
৪. বিবাহে স্বভাবগত দিক থেকে আল্লাহ যাকে যা করার যোগ্যতা দান করেছেন সে অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সেবা করার সুযোগ দান করে।
সুতরাং পুরুষ ঘরের বাইরে কাজ করে, স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য খরচ করার সম্পদ উপার্জন করে। আর স্ত্রী বাড়ির মধ্যে কাজ করে, গর্ভধারণ করে, শিশুদের দুগ্ধ দান করে, প্রতিপালন করে, স্বামীর জন্য খাদ্য ও ঘর বিছানা তৈরী করে। যদি পুরুষ ক্লান্ত ও চিন্তাযুক্ত অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করে, তার ক্লান্তি ও চিন্তা দূর হয়। স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতির সংস্পর্শ লাভ করে এবং সকলেই আনন্দ উল্লাসে মুগ্ধ হয়ে দিন কাটায়। পারস্পরিক সন্তুষ্টির মাধ্যমে স্ত্রী যদি নিজের খরচ করা বা নিজ আয় দিয়ে স্বামীকে সহযোগিতা করার জন্য কিছু কাজ করে, তা নিষিদ্ধ নয়, তবে সেখানে কিছু শর্ত রয়েছে:
১. তার কাজ এমন হবে যেখানে পুরুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ নেই। যেমন তার ঘর, তার নিজের শষ্য ক্ষেত্র। নিজের স্বামীর, নিজের পরিবারের শস্য ক্ষেত্রে সে কাজ হতে হবে। অপর দিকে মিল-কারখানা, ব্যবসার স্থান,অফিস প্রভৃতি স্থানে পুরুষের সাথে মেলামেশা করে কাজ করা মহিলাদের জন্য জায়েয নয়। এ ধরনের কাজ করার জন্য কোনো নারীকে তার সন্তান, স্বামী, পিতামাতা ও নিকটতমদের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া ঠিক নয়। কেননা, এটি হচ্ছে তাকে ও সমাজকে ফাসাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার সমান। সুতরাং মহিলা যতক্ষণ নিজের বাড়িতে পবিত্রাবস্থায় সংরক্ষিতা হয়, ততক্ষণ কোনো পরুষের সংস্পর্শে সে আসে না, কোনো পাপিষ্ঠ হাত তার দিকে প্রসারিত হয় না, কোনো খেয়ানতকারীর চক্ষু তার দিকে তাকায় না। অপরদিকে যখন সে পুরুষের সামনে বের হয়, তখন সে হারিয়ে যায় এবং সে নেকড়ের মাঝে অবস্থিত ছাগলের অবস্থায় উপনীত হয়; যেন কিছুক্ষণ বিলম্ব না করেই তাকে টুকরা টুকরা করা হবে। এগুলো হচ্ছে, তার মান-মর্যাদার জন্য অতীব নিকৃষ্টতম অবস্থা।
যদি কোনো স্বামী এক স্ত্রীকে যথেষ্ট মনে না করে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য চারজন পর্যন্ত স্ত্রী অনুমোদন করেছেন, এ শর্ত সাপেক্ষে যে, বাসস্থান, খরচাদি, রাত্রি-যাপনের ক্ষেত্রে সে ইনসাফ করবে। তবে হৃদয়ে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ইনসাফকে শর্ত করা হয় নি। কেননা এটা ঐ বিষয়ে, যা মানুষের সামর্থ্যের উর্ধ্বে বলে আল্লাহ নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
“তুমি গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও কখনো স্ত্রীদের ভিতরে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না”। [সূরা আন-নিসা: ১২৯] আর তা হচ্ছে ভালোবাসা ও এ জাতীয় ব্যাপারে। বস্তুত এ ইনসাফ না করতে পারার জন্য আল্লাহ একাধিক বিয়ে করাকে নিষেধ করেন নি। কেননা, এটা সামর্থ্যের বাইরের বিষয়। আল্লাহ তার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং যারা সাধ্য অনুযায়ী ইনসাফ করতে পারবেন তাদের জন্য একাধিক বিয়েকে অনুমোদন করেছেন। কেননা, আল্লাহ তাদের জন্য কোনটি মঙ্গলের তা সবচেয়ে ভাল জানেন। এটা হচ্ছে পুরুষ ও মহিলা সকলের জন্যই কল্যাণকর। কেননা, একজন সুস্থ পুরুষের যৌন শক্তির দিক থেকে যে সামর্থ্য থাকে, তা দিয়ে সে চারজন মহিলার যৌনক্ষুধা নিবৃত্তি করে তাদেরকে চারিত্রিক কলুষমুক্ত করতে পারে। যদি তার জন্য একজন স্ত্রীকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়; যেমন খৃষ্টান [.আল্লাহর নবী ঈসা (আ) একাধিক বিবাহ হারাম করেন নি। এটা করেছে খৃষ্টানরা নিজেদের ইচ্ছা আকঙ্খাকে চরিতার্থ করার জন্য।] ও অন্যান্যগণ করে থাকে তাহলে বিশৃঙ্খলা ঘটতে পারে। তথাকথিত ইসলামের দাবীদাররা যে এক বিয়ের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে তাতে যদি বিয়েকে সীমাবদ্ধ করা হয় তাহলে নিম্ন বর্ণিত অঘটন ঘটতে পারে:
প্রথমত: যদি উক্ত ব্যক্তি মুমিন ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল হয়, আল্লাহকে ভয় করে, তাহলে সে নফছের হালাল প্রয়োজনকে সংকোচিত করে বঞ্চিত জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হবে। কেননা একজন মহিলার গর্ভধারণের শেষ সময়গুলোতে, নিফাস, হায়িয ও রোগের অবস্থায় যৌন কাজ সম্ভব হয় না। সুতরাং তার স্বামীকে জীবনের কিছু অংশ স্ত্রী ছাড়াই কাটাতে হয়। এটা ঐ সময়ে যখন উক্ত স্ত্রী তার স্বামীর কাছে আকর্ষনীয়া হয়ে থাকে, একে অপরকে ভালবাসে। পক্ষান্তরে যদি তার কাছে সে আকর্ষণীয়া না হয়, তাহলে বিষয়টি হয় আরো ঝুকিপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত: যদি স্বামী আল্লাহর অবাধ্য হয়, খিয়ানতকারী হয়, সে তার স্ত্রীকে ছেড়ে অশ্লীল যিনায় নিমগ্ন হবেই। অনেকেই যারা একাধিক বিয়েকে স্বীকার করে না ঠিকই, তারা অসংখ্য যিনা ও খিয়ানতের অপরাধে নিমজ্জিত হয়। এর চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ দিক এ যে, সে শরী‘আতসম্মত একাধিক বিবাহকে আল্লাহ মুবাহ করেছেন জানার পরও সে এর বিরোধিতা করে কুফরীর গন্ডিতে প্রবেশ করবে।
তৃতীয়ত: একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ হলে, বহু মহিলা বিবাহ হতে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হবে। এ অবস্থায় পবিত্রা চরিত্রবতী দরিদ্র অবস্থায় বঞ্চিত জাবনযাপন করবে। আর অসতী পাপিষ্ঠাদের সম্ভ্রম নিয়ে পাপীরা আনন্দের খেলা খেলতে থাকবে।
কারণ সবাই জানে যে, যুদ্ধ ও অন্যান্য বিপদজনক কাজ করতে গিয়ে পুরুষরা বেশি বেশি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। সে জন্য মহিলার সংখ্যা পৃথিবীতে বেশি। ঠিক তেমনি মহিলারা সাবালিকা হওয়ার সাথে সাথে বিবাহের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে মাহর সংগ্রহ ও দাম্পত্য জীবনের ব্যয়ভার বহনের অপরাগতার জন্য অনেক পুরুষ তা পেরে উঠে না। এর দ্বারা জানা গেল যে, নিশ্চয় ইসলাম মহিলাদের প্রতি ইনসাফ করেছে এবং তার প্রতি দয়া দেখিয়েছে। পক্ষান্তরে যারা একাধিক বিবাহের বিরোধিতা করে, তারা বস্তুত মহিলাদের, মানসম্ভ্রমের এবং নবী দের শত্রু। কারণ একাধিক বিবাহ নবীদের সুন্নাত। তারা মহিলাদের বিয়ে করতেন এবং তাদের প্রতি আল্লাহ যে শরী‘আত দিয়েছেন সেটা অনুযায়ী স্ত্রীদেরকে তাদের গৃহে একত্রিত করতেন।
অন্যদিকে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে প্রথম স্ত্রী যে হিংসা বা চিন্তা ভাবনায় পতিত হয়, বস্তুত এটি আবেগ জনিত কারণেই হযে থাকে। আর ইসলামে কোনো বিষয়ে আবেগকে প্রাধান্য দেওয়া ঠিক নয়। বিয়ের পূর্বে মহিলাদের পক্ষ থেকে তার বর্তমানে কোনো স্ত্রী গ্রহণ না করার শর্তারোপ সম্ভব। স্বামী এটা গ্রহণ করলে সে শর্ত পূর্ণ করা অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে যদি স্বামী তার ঐ স্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্যত্র বিয়ে করে তখন স্ত্রীর অধিকার থাকবে সে বিয়ে ভঙ্গ করার কিংবা প্রতিষ্ঠিত রাখার। আর তখন স্বামী মাহর হিসেবে তাকে যা দিয়েছে তার কোনো কিছুই ফেরত নিতে পারবে না।
আর আল্লাহ তা‘আলা বিয়েকে শরী‘আতসম্মত করেছেন। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতপার্থক্য থাকা, সুখী না হওয়া ও একের প্রতি অপরের ভালবাসা না থাকার ক্ষেত্রে। এটা এ উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে যেন মতপার্থক্য অবস্থায় অসুখী জীবন কাটাতে না হয়। যাতে তারা একে অপরের মনের মত জায়গা বেছে নিতে পারে এবং দুনিয়ার [মুসলিম সৎ মহিলারা পুনরুত্থান ও হিসাবের পরে জান্নাতে প্রবেশ করলে জান্নাতবাসী যাকে তিনি চান স্বামী হিসাবে গ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হবে। কোনো মুসলিম স্ত্রীর কয়েকবার বিয়ে হয়ে মারা গেলে, যিনি দুনিয়ায় তার সবচেয়ে প্রিয় স্বামী ছিলেন তিনি জান্নাতবাসী হলে, তাঁকেই তাঁকে দেওয়া হবে।] বাকী জীবন সৌভাগ্যের সাথে কাটাতে পারে, আর আখিরাতে সুখ ভোগ করতে পারে; যদি উভয়ে ইসলামের উপরে মৃত্যুবরণ করে।
১০. স্বাস্থ্য:
স্বাস্থ্য সম্পর্কে ইসলামী শরী‘আত চিকিৎসার সকল মূল বিষয়ে আলোচনা করেছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ও রাসূল মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীসসমূহে মানসিক ও শারীরিক রোগসমূহের ও তার চিকিৎসার বর্ণনা এসেছে।
“যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, আমি কুরআনে তা নাযিল করছি।” (বনী ইসরাইল: ৮২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
«ما أنزل الله من داء إلا أنزل له دواء، علمه من علم وجهله من جهل»
“আল্লাহ ঔষধ না দিয়ে কোনো রোগ পাঠান নি। যাকে জানানো হয়েছে জেনেছে, যাকে এত্থেকে মূর্খ রাখা হয়েছে, মূর্খ রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন-
«تداووا عباد الله ولا تداووا بحرام»
“হে আল্লাহর বান্দারা! চিকিৎসা কর, হারাম কিছু দিয়ে চিকিৎসা কর না।” আল্লামাহ ইমাম ইবনুল কাইয়িম রচিত “যাদুল মায়াদ ফি হাদিয়ী খাইরিল ইবাদ” গ্রন্থে এর বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে, তা দেখা যেতে পারে। কেননা, এটি ইসলামী গ্রন্থসমূহের মধ্যে ইসলামের বর্ণনা ও শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনী বিষয়ক অত্যন্ত উপকারী অত্যন্ত বিশুদ্ধ গ্রন্থ।
১১. অর্থনীতি,ব্যবসা,কারিগরি ও কৃষি:
পানি, খাদ্য, মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র এবং যে সমস্ত সংস্থা মানুষদের শহর ও গ্রামকে হেফাজত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সেখানে চলা-ফেরার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার, জালিয়াতি ও মিথ্যা প্রতিরোধ করা প্রভৃতির দায়িত্বভার গ্রহণ করে; এদের সম্পর্কে ইসলামে পরিষ্কার ও পুরিপূর্ণভাবে বর্ণনা এসেছে।
১২. গোপন শত্রু ও তাদের থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা কুরআনে কারীমে মুসলিমদেরকে উদ্দেশ্যে করে বলেছেন যে, তাদের বহু শত্রু রয়েছে। যদি সেসব শত্রুর নেতৃত্ব মেনে চল ও তাদের অনুসরণ কর তাহলে সেগুলো দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। তাই তিনি তাদের থেকে সাবধান করেছেন এং তাদের তেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার রাস্তাও বর্ণনা করেছেন। এ সকল শত্রু হচ্ছে:
প্রথম শত্রু: অভিশপ্ত শয়তান
এ শয়তান অন্যান্য শত্রুদেরকে মানুষের বিরুদ্ধে তৎপর হতে উদ্বুদ্ধ করে। সে আমাদের পিতা আদম আলাইহিস সালাম ও মাতা হাওয়া আলাইহাস সালামের এমন শত্রু যে তাদেরকে জান্নাত হতে বের করেছে। সে দুনিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আদম সন্তানদের জন্য চিরন্তন শত্রু। তারা যাতে কুফরীতে নিমজ্জিত হয়ে, তার সাথে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয় (আল্লাহর কাছে এ থেকে আশ্রয় চাচ্ছি) সেই চেষ্টা সাধনাই সে করে। যাকে সে কুফরিতে নিমজ্জিত করতে অক্ষম হয়, তাকে পাপে নিমজ্জিত করে; যাতে সে আল্লাহর গজব ও শাস্তি লাভ করে।
শয়তান এমন এক সত্তা যে মানুষের রক্ত প্রবাহের শিরা ও উপশিরাতে চলাচল করে। তাদের মনে কুমন্ত্রণা দেয়। খারাপকে সুন্দর করে উপস্থাপন করে, যাতে সে তার আনুগত্য করে খারাপের মধ্যে পতিত হয়। এ থেকে বাঁচার উপায়, যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেছেন, যখন মুসলিম রাগাম্বিত হয়ে পড়বে এবং গুনাহে নিমজ্জিত হবে তখন বলবে-
‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম’। “আমি বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।” তখন তার রাগ আর কাজ করবে না, সেও গুনাহের দিকে অগ্রসর হবে না। আর মুসলিম মনে প্রাণে এটা বিশ্বাস করবেন যে, পাপের দিকে ঠেলে দেওয়ার যে প্রবণতা মনে ধারণ করছে তা শয়তানের দ্বারাই সম্পাদিত হচ্ছে; যাতে তাকে ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত করতে পারে। অতঃপর শয়তান তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
“নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু এবং তাকে শত্রু বলেই মনে কর। সে তার দলকে আহ্বান জানায়, যাতে তারা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়।” (সূরা ফাতির-৬)
দ্বিতীয় শত্রু: আত্মপূজা এর দ্বারাই মানুষের মধ্যে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা ও অন্য কেউ সত্য নিয়ে আসলে তা গ্রহণ না করার মানসিকতা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ লংঘনের আকাঙ্খা জাগে। কেননা এগুলো সবই তার মন যা চায় তার উল্টো। আবেগকে সত্য ও ইনসাফের উপরে স্থান দেওয়া আত্মপূজার অন্তর্ভুক্ত। এ শত্রু থেকে মুক্তির পথ হচ্ছে, বান্দাহ আল্লাহর নিকটে আত্মপূজা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং যা আত্মপূজা করতে বাধ্য করে তা গ্রহণ করবে না, আত্মার আনুগত্য করবে না বরং সত্য বলবে এবং তিক্ত হলেও তা গ্রহণ করবে।
তৃতীয় শত্রু: খারাপ কাজের নির্দেশ দেয় এমন নফস
খারাপ কাজের নির্দেশের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মনের ও প্রাণের হারাম চাহিদা পূরণ। যেমন-যিনা, মদ্যপান, রমযানে ওযর ছাড়া সিয়াম ভঙ্গ প্রভৃতি। যেগুলোকে আল্লাহ হারাম করেছেন, সেগুলোর দিকে আকৃষ্ট হওয়া। এ শত্রু থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে, আল্লাহর নিকট নিজের নফসের ও শয়তানের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। হারাম চাহিদা পরিত্যাগের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। তেমনি যা খেলে ও পান করলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়, সে সমস্ত খাদ্য অথবা পানীয় আকর্ষনীয় হলেও বর্জন করে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। মনে মনে এ কথা স্মরণ করতে হবে যে, হারাম প্রবৃত্তি দ্রুত তিরোহিত হয়ে যায়, যার জন্য পরবর্তীতে লজ্জিত ও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অনুতপ্ত হওয়া ব্যতীত পথ থাকবে না।
চতুর্থ শত্রু: মনুষ্য শয়তানগণ
এরা হচ্ছে, আদম সন্তানদের মধ্যে পাপীগণ; যাদের নিয়ে শয়তান খেলা করে। তারা নিষিদ্ধ কাজ করতে থাকে এবং তাদের সাথী-সঙ্গীদের জন্য এ কাজকে সুন্দর করে প্রদর্শন করে। এ শত্রু থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে, তার থেকে সতর্ক থাকা, তার থেকে দূরে অবস্থান করা ও তার সংস্পর্শে না বসা।
১৩. মহৎ উদ্দেশ্য ও সুখকর জীবনঃ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা তাঁর বান্দাহ মুসলিমদের যে মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, তা এ পার্থিব জীবন নয় আর না এ নশ্বর আকর্ষণীয় কোনো কিছু। বরং যে দিক-নির্দেশনা দিয়ে তৈরী করছে তা হচ্ছে, শাশ্বত সত্য ভবিষ্যতের প্রস্তুতি। আর তা হচ্ছে মৃত্যুর পরে পারলৌকিক জীবন। সুতরাং মুসলিম মাত্রই এ জীবনকে পারলৌকিক জীবনের ওয়াসীলা হিসেবে গ্রহণ করে। এ জীবনকে পারলৌকিক জীবনের শষ্য ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করে। এ জীবনই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।
একজন সত্যিকার মুসলিম সর্বদা আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী স্মরণ করে-
“হে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। আর প্রতিটি নফসের চিন্তা করা উচিৎ; আগামীদিনের জন্য সে কি প্রেরণ করেছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। তোমরা যে কাজই কর, তা আল্লাহ নিশ্চয় সবিশেষ খবর রাখেন। যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে তিনি তাদেরকে নিজেদের ভুলিয়ে দিয়েছেন, তোমরা তাদের মত হয়ো না। এরা হচ্ছে ফাসিক। জাহান্নামবাসী ও জান্নাতবাসী সমান নয়, জান্নাতবাসীগণ হচ্ছে সফলকাম।” (সূরা হাশর; ১৮-২০)
“অতঃপর যে এক অনু পরিমাণ পূণ্য কাজ করে সে তা দেখবে এবং যে এক অনু পরিমাণ খারাপ কাজ করবে সে তা দেখবে।” (সূরা আয-যালযালাহ: ৭-৮)
সত্যিকারের মুসলিম আল্লাহর কালাম থেকে এ সকল আয়াত ও এর সমঅর্থের গুরুত্বপূর্ণ আয়াতসমূহ স্মরণ করবেন, ফলে যে মহান উদ্দেশ্য ও যে কারণে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যে ভবিষ্যত তাদের জন্য অবশ্য অবশ্যই অপেক্ষা করেছে, সে সম্পর্কে তারা উপদেশ লাভ করতে পারবেন। সুতরাং একক আল্লাহকে ইখলাসের সাথে ইবাদত করে এবং যে কাজ করলে তিনি সন্তুষ্ট হন সেই কাজের মাধ্যমে সত্যিকারের চিরস্থায়ী ঐ ভবিষ্যতের জন্য তার প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ। আল্লাহ তাহলে তার উপরে খুশী হবেন। তার আনুগত্যের কারণে এ দুনিয়াতে এবং মৃত্যুর পরে তার সম্মাণিত আবাসস্থলে প্রবেশ করিয়ে তিনি তাকে সম্মানিত করবেন। তাঁকে দুনিয়াতে সম্মানিত করা হবে, তাঁকে সুন্দর জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হবে। অতঃপর তিনি আল্লাহর বন্ধু হয়ে তারই তত্ত্বাবধানে বেঁচে থাকেন। তিনি আল্লাহর নূরেই দেখেন। যে সমস্ত ইবাদাতের নির্দেশ আল্লাহ তাকে দিয়েছেন, তা আদায় করেন ও এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গোপন কথা বলার স্বাদ তিনি অনুভব করতে থাকেন। নিজের ক্বলব ও মুখ দিয়ে আল্লাহর যিকির বা তাকে স্মরণ করতে থাকেন। আর এর দ্বারা তার ক্বলবও আরাম বোধ করে।
আর সে তার কথা ও কাজ দ্বারা মানুষের প্রতি ইহসান করে, ফলে সম্মানিত ব্যক্তিদের থেকে তার সুনামের স্বীকৃতি শুনতে পান, তারা তার জন্য দো‘আ করেন, যা তাকে আনন্দ দেয় ও তার বুককে প্রসারিত করে। তিনি তার প্রতি হিংসুক, তিরষ্কারকারী, তার সুখ্যাতির অস্বীকারকারীকে দেখেও তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখানো বন্ধ করে দেন না, কেননা তিনি তো এর দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ছওয়াব কামনা করেন। দীনদার ও দীনের প্রতি যারা বিরূপ এমনি দুষ্ট মানুষদেরকে তিনি তার প্রতি কষ্ট দিতে ও ঠাট্টা করতে দেখেন; যা তাকে আল্লাহর রাসূলগণের প্রতি যা করা হয়েছিল তা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং এটাই আল্লাহর রাস্তার কর্মীদের একমাত্র পাওনা জেনে ইসলামের প্রতি তার গভীর ভালবাসা আরও বৃদ্ধি পায় এবং তার উপরে সে পথ সুদৃঢ় হয়ে যায়। তিনি নিজ হাতে অফিস অথবা কৃষিক্ষেত্রে অথবা ব্যবসাকেন্দ্রে অথবা কারখানায় কাজ করেন এ জন্য যে, ইসলাম ও মুসলিমগণ তার উৎপাদন থেকে লাভবান হবেন। যেদিন তিনি আল্লাহর সাথে ইখলাস সহকারে সৎ নিয়ত নিয়ে মিলিত হবেন, সেদিন তিনি এর জন্য পূণ্য লাভ করবেনই। তা ছাড়াও এ দ্বারা দুনিয়াতে উত্তম উপার্জন সংগ্রহ করে, তিনি নিজের নফস ও পরিবারের জন্য তা খরচ করেন, তা থেকে দানও করেন। ফলে তার আত্মা ধনবান, ভদ্র, অল্পতুষ্ট হয়ে আল্লাহর নিকটে ছাওয়াব কামনার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে থাকে। কেননা আল্লাহ সামর্থ্যবান পেশাজীবি ঐ মুমিনকে পছন্দ করেন, যিনি খাবেন, পান করবেন, ঘুমাবেন তবে অপব্যয় করবেন না। যাতে এগুলোর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর আনুগত্যের জন্য শক্তি অর্জন করতে পারেন, আর যাতে নিজ স্ত্রীকে ও নিজেকে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা থেকে পবিত্র রাখার জন্য মেলামেশা করেন এবং যাতে এমন সন্তান-সন্ততি জন্ম দেন যারা আল্লাহর ইবাদত করবে ও তার জন্য জীবিত ও মৃত অবস্থায় দো‘আ করবে। যা দ্বারা সৎ কাজ অবিরত হতে থাকবে। এ দ্বারা মুসলিমদের সংখ্যা বাড়বে। তিনি আল্লাহর কাছে সেজন্য ছাওয়াব লাভ করবেন। তিনি আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সকল নিয়ামতের সাহায্য নিয়ে এবং এসব নিয়ামত যে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে তার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তার সকল নিয়ামতের শুকর আদায় করবেন ও এ কাজ দ্বারা ছাওয়াব লাব করবেন। তিনি অবশ্যই জানেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ কখনো কখনো ক্ষুধা, ভয়, রোগ, বিপদাপদ অবতীর্ণ হয়। যাতে আল্লাহ দেখেন, (যদিও আল্লাহ সবচেয়ে বেশী জানেন [আল্লাহ বান্দাদেরকে নির্দেশ দেন ও নিষেধ করেন, তিনি পূর্ব হতেই জানেন যে, কে তার আনুগত্য করবে আর কে তার নাফরমানী করবে এ জন্য যে, যাতে বান্দাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া যায়। তাহলে পাপী বলতে পারবে না যে, আমার রবই আমার ঐ গুনাহের জন্য আমাকে সাজা দিয়েছে, যে গুনাহ আমি করি নি। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমার রব তার বান্দাদের উপরে মোটেই অত্যাচারী নন।’’]) উক্ত বান্দাহ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাকদীরের উপরে সন্তুষ্ট থেকে কতটুকু ধৈর্য ধারণ করতে পারেন। সুতরাং মুসলিম তাতে ছবর করবেন, সন্তুষ্ট থাকবেন এবং সর্বাবস্থায় ধৈর্যশীলদের জন্য যে ছাওয়াব অপেক্ষা করছে তা লাভের জন্য সব সময় আল্লাহর প্রশংসা করবেন, তাহলে তার কাছে বিপদ খুব হালকা হয়ে যাবে। ফলে সে বিপদকে এমনভাবে গ্রহণ করে নিবে যেমন রোগী ঔষধের তিক্ততাকে আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে মেনে নেয়।
যদি মুসলিম এ জীবনে যেমন আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, এইরূপ উন্নত মানুষিকতা নিয়ে সত্যিকারে অবিনশ্বর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে, ঐ শাশ্বত কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারেন, দুনিয়ার কোনো কিছু যেটাকে ঘোলাটে করতে ব্যর্থ, মৃত্যুও যার প্রতিবন্ধক হয় না, তাহলে তার জন্য এ পার্থিব জীবনে ও মৃত্যুর পারলৌকিক জীবনে অনন্ত কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন-
“এটি পরকালের আবাসস্থল, এটি তাদের জন্যই নির্ধারিত, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও ফাসাদ করে না। আর উত্তম পরিণাম তো রয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।” (সূরা কাছাছ-৮৩)
“নর হোক অথবা নারী হোক মুমিন অবস্থায় যে কেউ ভাল কাজ করবে, আমি অবশ্যই তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদের সর্বোত্তম কৃতকর্ম অনুযায়ী তাদেরকে পুরষ্কৃত করব।” (সূরা নাহল-৯৭)
এ গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটিতে এবং তার মত অন্যান্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ বলেন যে, নিশ্চয় পুরুষ সৎ কর্মকারী ও মহিলা সৎকর্মকারিনী যারাই এ জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর আনুগত্য করবেন, আল্লাহ তাদেরকে তড়িৎ পুরষ্কার দিবেন। আর তা হচ্ছে ঐ সুখী সমৃদ্ধ পবিত্র জীবন, যে বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচন করেছি। তাছাড়াও বিলম্বে মৃত্যুর পরেও যে পুরষ্কার দিবেন, তা হচ্ছে শাশ্বত জান্নাতের নিয়ামত। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
«عجبًا للمؤمن إن أمره كله له خير إن أصابته سرَّاء شكر فكان خيرًا له، وإن أصابته ضرَّاء صبر فكان خيرًا له»
“আশ্চর্য, মুমিনের জন্য সব কাজই মঙ্গলময়। তাকে যদি আনন্দের কিছু স্পর্শ করে তাহলে সে শুকর আদায় করে, সেটি তার জন্য ভাল। আর যদি দুঃখজনক কিছু স্পর্শ করে এবং সে ধৈর্য ধরে তাও তার জন্য ভাল।”
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, একমাত্র ইসলামের মধ্যেই সঠিক চিন্তা ভাবনা, ভাল-মন্দের সঠিক মাপকাঠি, ইনসাফ ভিত্তিক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা নিহিত রয়েছে। সুতরাং মনোবিজ্ঞান, সমাজ, শিক্ষা, রাষ্ট্র, অর্থ ও অন্যান্য নিয়মনীতি এবং মানুষের তৈরী পদ্ধতির মধ্যে প্রত্যেকটি মতামত ও চিন্তাচেতনা ইসলামের আলোকেই সংশোধন ও এ থেকেই সংগ্রহ করা অত্যাবশ্যক। ইসলামের বিরোধিতা করে কৃতকার্য একেবারেই অসম্ভব বরং যারা ঐগুলোকে গ্রহণ করবে তাদের দুনিয়াও আখিরাতের জন্য ঐগুলোই হবে দুর্ভাগ্যের উৎসস্থল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/58/25
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।