মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
আল্লাহ তা‘আল ইলমের যে ইজ্জত ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন পার্থিব কোনো লালসায় পড়ে সেই ইজ্জত ও সম্মান নষ্ট না করা চাই। দুনিয়াদার কোনো লোকের কাছে বিনা কারণে কিংবা অত্যাবশ্যক কারণ ছাড়া আলেমের না যাওয়া উচিত। এমনকি দুনিয়াদার কোনো লোককে ইলম শিক্ষা দেয়ার জন্য তাদের ঘরে না যাওয়া, যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রাজা-বাদশা হন না কেন। বরং ইলমের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে তাদেরকেই দরসগাহে আসতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা।
এক্ষেত্রে ইমাম বুখারী (রহ.)-এর ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি জীবনে মোট চারবার বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। চতুর্থ ও সবচেয়ে বড় বিপদটি ছিল ইলমের মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে। আর এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল তার জীবনের শেষ বয়সে। শেষ বয়সে তিনি বুখারাতেই বসবাস করছিলেন। সে সময় বুখারার আমীর ছিলেন খালেদ যুহলী। তিনি ইমাম বুখারী (রহ.)-এর নিকট এই মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন ঘরে এসে তার সন্তানদেরকে দীনী ইলম শিক্ষা দেন। ইমাম বুখারী (রহ.) বললেন আমীর ও বাদশাদের ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষা দিয়ে আমি ইলমে হাদীছকে অপমানিত করতে চাই না। কেউ পড়তে চাইলে সে আমার কাছে এসে আমার দরসে শরীক হয়ে পড়ুক। আমি ফেরিওয়ালা নই যে, এই ইলম নিয়ে বাদশাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবো! এটা ইলমে নববীর মর্যাদার খেলাফ।
তার জবাব পেয়ে আমীর দ্বিতীয় প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি বললেন, তাহলে আপনার দরসে একটা স্বতন্ত্র মজলিস কায়েম করা হোক। সেই মজলিসে কেবল আমার সন্তানেরাই লেখাপড়া করবে, অন্য কেউ তাতে শরীক হতে পারবে না।
ইমাম বুখারী (রহ) এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আমি অন্যদেরকে ইলম হাসিল করা থেকে বঞ্চিত করলাম কিংবা বাধা দিলাম।
আমীর মনে করেছিলেন অন্যদের সঙ্গে তার সন্তানদের পড়ালেখা তার জন্য অবমাননাকর। তাই তিনি আলাদা একটি মজলিস কায়েমের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু যারা এক সঙ্গে বসে ইলম হাসিল করাকে অবমাননাকর ভাবে তাদের জন্য দরসের আলাদা মজলিস কায়েম করা ইমাম বুখারী (রহ)-এর দৃষ্টিতে চরম আপত্তিকর বলে মনে হলো। ফলে তিনি এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমীর খুব বেশি পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ফলে বাধ্য হয়ে ইমাম বুখারী (রহ) বললেন, হ্যাঁ, এক কাজ করা যেতে পারে। আপনি যদি এই মর্মে শাহী ফরমান জারি করেন যে, বুখারীর মজলিসে সাধারণ ছাত্ররা বসতে পারবে না তখন আমি অপরাগ বিবেচিত হবো এবং তখন বিষয়টি ভেবে দেখব। হয়ত ওই সময় আপনার সন্তানের জন্য আলাদা দরস কায়েম করা যেতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আম জলসার অনুমতি থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কারও জন্য আলাদা মজলিস কায়েম করতে পারব না।
ইমাম বুখারী (রহ)-এর এই প্রস্তাবে আমীর চরম নাখোশ হলেন এবং এর প্রতিশোধ নিতে তিনি তার বিরদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করলেন। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তার নামে তিনি নানারকম মিথ্যা রটনা করতে থাকেন এবং হাজার রকম অপবাদ দেওয়া শুরু করেন। এভাবে তাকে বুখারা থেকে বের করে দেয়ার জোর তৎপরতা শুরু হয় এবং এসব ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও মিথ্যা অপবাদের সূত্র ধরে একপর্যায়ে তাকে বুখারা থেকে বের করে দেয়ার আদেশও জারি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার এই প্রিয় বান্দার বদদু‘আ কার্যকর হতে সময় লাগে নি। ফলে স্বয়ং আমীর খালেদই সীমাহীন অপদস্থ হন। খলীফা তাকে বরখাস্ত করেন এবং তার আদেশে গভর্নরকে গাধায় চড়িয়ে সারা শহর ঘুরানো হয়।
ইসলামী ইতিহাসে এধরনের আরো অনেক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়। একবার খলীফা মাহদী ইমাম মালেক (রহ.)-এর কাছে তার দুই সন্তানকে পড়ানোর জন্য আবেদন করলে তিনি বললেন-
العلم أولى أن يوقر ويؤتى وفي رواية : العلم يزار ولا يزور ويؤتى ولا يأتي وفي رواية : أدركت أهل العلم يؤتون ولا يأتون
‘ইলমের শান হচ্ছে একে সম্মান করা এবং হাসিল করার জন্য ইলমের কাছে আসা। অন্য বর্ণনামতে, ইলম দর্শনার্থ; দর্শনার্থী নয়। একে হাসিল করতে আসতে হয়। এ কারো কাছে যায় না। আমি আহলে ইলমকে পেয়েছি, তারা ইলম বিস্তার করতে কারো কাছে ঘুরে বেড়াতেন না বরং ইলম শিখতে হলে তাদের কাছে আসতে হতো।’
তিনি আরো বলেন, একবার আমি খলীফা হারুনের কাছে গমন করলে তিনি আমাকে বললেন, আপনি বারবার আমাদের কাছে আসবেন। যাতে ঘরের বাচ্চারা আপনার কাছে মুআত্বা পাঠ করতে পারে। ইমাম মালেক (রহ.) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে সম্মানীত করুন। আমি তো দেখছি ইলম আপনাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে!... ইলম কারো কাছে যায় না। ইলমের কাছে যেতে হয়।’
খলীফা বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। এরপর বাচ্চাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, তোমরা মসজিদে যাও এবং অন্যদের সঙ্গে ইলম শিক্ষা করো।
বর্ণিত আছে, একবার হারুনুর রশীদ তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার বসবাসের ঘর আছে? জবাবে তিনি বললেন না। তখন খলীফা তাকে তিন হাজার দিনার দিয়ে বললেন, এগুলো দিয়ে ঘর বানাবেন। ইমাম মালেক (রহ.) দিনারগুলো গ্রহণ করলেন বটে কিন্তু খরচ করলেন না। এর কিছুদিন পর খলীফা ইরাক পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ইমাম মালেক (রহ.)-কে সঙ্গে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। জবাবে ইমাম মালেক (রহ.) বললেন, আপনার সঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা আমার নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মদীনা নগরী পাপ দূর করে যেভাবে হাপড় লোহার মরিচা দূর করে।’ [শারহু মা‘আনিল আছার: ১৮২৬; বুখারী: ৭২০৯ {বুখারীর বর্ণনা কিছুটা ভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে।]
এরপর তিনি বললেন, এই নিন আপনার দেওয়া সেই দিনারসমূহ। এই দিনারের কারণেই আপনি আমাকে মদীনা ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন। আমি ওই সময়েই এই আশঙ্কা করেছিলাম এবং সে কারণেই দিনারগুলো স্বস্থানে যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আমি কখনই দীনের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দেব না।’
সাধারণ মানুষ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সম্মান করতে হবে বটে কিন্তু তাদেরকে তোয়াজ ও মাত্রাতিরিক্ত খাতির করা যাবে না। এক্ষেত্রে সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-এর ঘটনা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, হারুনার রশিদ খলীফা হিসেবে নিযুক্ত হলে দেশের প্রায় সব আলেম তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এলেন। কিন্তু সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) এলেন না। অথচ দুইজনের মধ্যে এর আগে খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। নবনিযুক্ত খলীফা হারুনের কাছে ব্যাপারটি কষ্টদায়ক মনে হলো। তাই তিনি সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-এর কাছে একটি চিঠি লিখলেন। যার ভাষা ছিল নিম্নরূপ:
আল্লাহর নামে শুরু করছি। এটি আমীরুল মুমিনীন হারুনের পক্ষ থেকে দীনী ভাই সুফিয়ান ছাওরীর উদ্দেশ্যে লিখিত।
পরসমাচার, হে বন্ধু! আপনি জানেন যে, আল্লাহ তা‘আলা মুমিনীনের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। সেই সূত্রেই আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছি। এই বন্ধুত্বের মধ্যে সামান্যতম কৃত্রিমতা আছে বলে আমি মনে করি না। আল্লাহ তা‘আলা যদি আমার ঘাড়ে এই দায়িত্বের বোঝা না চাপাতেন তাহলে অবশ্যই আমি আপনার সমীপে হাজির হতাম এবং তা হামাগুড়ি দিয়ে হলেও। কেননা আমি আপনার শূন্যতা খুব বেশি অনুভব করছি। আর অন্যান্য পরিচিতজনের সবাই আমার সঙ্গে সাক্ষাত করে গেছেন এবং আমাকে আমার দায়িত্ব গ্রহণের কারণে সাধুবাদ জানিয়েছেন। শুধু আপনি একাই আছেন, যিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেননি। তবে অন্যের তুলনায় আমি আপনার সাক্ষাতকেই বেশি পছন্দ করি।
আমি আমার মালের ভাণ্ডারের মুখ খুলে দিয়েছি। এতে আমি সন্তুষ্ট, আমার চোখ এতে শীতল হয়। এমন এক সুসময়ে আপনার অনুপস্থিতি আমাকে নিদারুণ মর্মাহত করছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে পত্র লেখা। এতে আমি আমার ভালোবাসা ও প্রবল আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছি। হে আব্দুল্লাহ! আপনি তো জানেন মুসলিমের সঙ্গে মুসলিমের সাক্ষাত ও ভ্রাতৃত্বের ফযীলত কত বেশি! সুতরাং এই চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসবেন বলে আশা রাখি।’
চিঠিটা লিখে খলীফা হারুন আব্বাদ তালেকানীর হাতে দিলেন এবং এর গুরুত্ব বুঝিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত তা সুফিয়ান ছাওরীর হাতে পৌঁছে দেয়ার আদেশ দিলেন।
আব্বাদ তালেকানী (রহ.) বলেন, আমি চিঠিটা গ্রহণ করে কুফা অভিমুখে রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে আমি সুফিয়ান ছাওরী (রহ.)-কে মসজিদে দরস প্রদান করতে দেখলাম। আমি মসজিদের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম কিন্তু তিনি আমার দিকে ভ্রূক্ষেপই করলেন না বরং তীর্যকভাবে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আগন্তুকের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’
আব্বাদ বলেন, এরপর তিনি সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। অথচ তখন সালাতের সময় ছিল না। আমি মসজিদে প্রবেশ করে তাঁর ছাত্রদের সালাম দিলাম। কিন্তু ছাত্ররাও কেউ সালামের জবাব দিলেন না, এমনকি মাথা পর্যন্ত উঠালেন না।
আমি অনেকক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠলাম। কেউ আমাকে বসার কথাটুকুও বললেন না। তাদের এই আচরণ আমাকে হতবাক করে দিল। অগত্যা আমি দূর থেকেই সুফিয়ান ছাওরীর (রহ.) উদ্দেশ্যে খলীফা হারুনের লেখা চিঠিটি ছুঁড়ে মারলাম।
তিনি চিঠিটি পেয়ে কেঁপে উঠলেন। যেন তাঁর মেহরাবে ভয়ানক কোনো সাপ কিংবা বিচ্চু ঢুকে পড়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সিজদায় পতিত হলেন এবং সালাম ফিরিয়ে জেবে হাত ঢুকালেন এবং পেছনের একজনকে তা পড়ার ইঙ্গিত করে বললেন, আমি ওই বস্তু স্পর্শ করা থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি ও তার কাছে ক্ষমা চাই, যে বস্তু (চিঠি) একজন জালেম তার হাতে স্পর্শ করেছে। কিন্তু ছাত্ররা কেউ তা স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়ালেন না। আর তিনিও কাঁপছিলেন, যেন এটা চিঠি নয়- বিষাক্ত সাপ!
অবশেষে একজন ছাত্র চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলেন। তার পড়া শুনে সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) অবাক হয়ে মিটিমিটি করে হাসছিলেন। ছাত্রের পড়া শেষ হলে সুফিয়ান ছাওরী (রহ.) বললেন, এই চিঠির অপর পিঠেই জালেম বরাবর জবাব লিখে দাও!
কেউ একজন বললেন, হে আব্দুল্লাহ! হারুন একজন খলীফা, তাকে নতুন একটা কাগজে জবাব দিলে ভালো হয় না? তিনি বললেন, জালেমের কাছে চিঠির উল্টো পিঠেই জবাব লিখে দাও। কেননা, সে যদি হালালভাবে তা উপার্জন করে থাকে, তাহলে এটাই যথেষ্ট। আর যদি হারাম উপার্জন হয় তাহলে সে এই হারামের আগুনে জ্বলবে। আর আমরা জালেমের হাত স্পর্শ করা কোনো হারাম বস্তু এখানে রেখে দিতে চাই না। কেননা, তা আমাদের দীনকে বরবাদ করবে। তাকে বলা হলো; চিঠির জবাবে কী লেখা হবে? তিনি বললেন, লিখ:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, আল্লাহ তা‘আলার বান্দা সুফিয়ানের পক্ষ হতে আশা-আকাঙ্ক্ষায় ধোঁকা খাওয়া-প্রতারিত হারুনের প্রতি- যার ঈমানের স্বাদ ও কুরআন তিলাওয়াতের মজা কেড়ে নেওয়া হয়েছে- পরসমাচার, তোমাকে চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছি যে, আমি তোমার বন্ধুত্বের রশি ছিন্ন এবং ভালোবাসার বন্ধন কর্তন করে ফেলেছি। তুমি নিজেই চিঠির মাধ্যমে আমাকে অবহিত করেছ যে, তুমি মুসলিমের সম্পদ উন্মুক্ত করে তার অপব্যবহার শুরু করেছ। আল্লাহর বিধানের বাইরে গিয়ে তা খরচ করছ। তুমি শুধু অন্যায় করেই ক্ষান্ত হও নি। বরং আমাকে তোমার পাপের সাক্ষীও বানিয়েছ!
অতএব, আমি এবং আমার সঙ্গে যারা তোমার চিঠি পাঠের সময় উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই আগামী দিন ন্যায়পরায়ণ মহান বিচারক আল্লাহর কাছে এর যথাযথ সাক্ষ্য পেশ করবেন। হে হারুন! তুমি মুসলিমের সন্তুষ্টি ছাড়া তাদের সম্পদের কোষাগার খুলে দিয়েছ। তোমার কাজে কি যাকাত উসূলকারী, আল্লাহর রাস্তার মুজাহিদ এবং অভাবীরা সন্তুষ্ট? আহলে ইলম এবং কুরআনের বাহকরা কি তাতে সম্মত? ইয়াতিম বিধবা নারীরাও কি তাতে সন্তুষ্ট? অথবা সন্তুষ্ট তোমার প্রজারা?
হে হারুন! তুমি তোমার কোমরের কাপড় বেঁধে নাও এবং জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দাও। বিপদ প্রতিহত করার জন্য চাদর জড়িয়ে নাও। তুমি জেনে রেখ, অতিসত্ত্বর তোমাকে ন্যায়পরায়ণ বিচারকের সামনে দাঁড়াতে হবে। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, তোমার কুরআন তিলাওয়াতের স্বাদ মিটে গেছে, ইলম ও যুহদের মজা নিঃশেষ হয়ে গেছে। নেককার ও সৎ লোকের সান্নিধ্য তোমার অপ্রিয় লাগা শুরু হয়েছে। আর তুমি জালেম ও জালেমের সহায়তাকারী হওয়া পছন্দ করছ!
হে হারুন! তুমি সিংহাসনে আরোহন করা মাত্রই রেশমি পোশাক পরিধান করা শুরু করেছ! তোমার দরজার সামনে পর্দা টাঙিয়ে রাব্বুল আলামীনের শক্তির সাদৃশ্যতা অবলম্বন করেছ! এরপর তুমি এমন জালেম প্রহরীদেরকে পর্দার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছ, যারা নিজেরা জালেম, মানুষের প্রতি ইনসাফ করে না। তারা শরাবপানকারীদেরকে দণ্ড দেয় অথচ নিজেরাই শরাব পান করে! তারা ব্যভিচারিদেরকে বেত্রাঘাত করে অথচ নিজেরাই ব্যভিচারে লিপ্ত হয়! চোরের হাত কাটে আবার গোপনে নিজেরাই চুরি করে! এসব শাস্তি অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার আগে নিজেদের ওপরই কি প্রয়োগ করা উচিত ছিল না?
আগামী দিন কী হবে হে হারুন! যে দিন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একজন ঘোষক একথার ঘোষণা করবেন যে, জালেম ও জালেমের সহায়তাকারীদেরকে একত্রিত করো। আর সেদিন তুমি ঘাড়ে দুহাত বাঁধা অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার সামনে দণ্ডায়মান হবে?
তোমার ইনসাফ তোমাকে বাঁধন থেকে মুক্তি দেবে নাকি তোমার আশেপাশের জালেমরা তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে? অথবা তুমি তাদের জাহান্নামে টেনে নেবে? যেমন ফেরাউনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
‘সে তার সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে এবং তাদেরকে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেখানে তারা প্রবেশ করবে তা কত নিকৃষ্ট স্থান!’ {সূরা হুদ, আয়াত: ৯৮}
হে হারুন! আমি অনুভব করতে পারছি, তুমি তোমার নেককর্ম দেখতে পাবে অন্যের পাল্লায় আর অন্যের পাপ দেখবে তোমার পাল্লায়। বিপদের ওপর বিপদ এবং অন্ধকারের ওপর অন্ধকার। অতএব, হে হারুন! তুমি তোমার প্রজাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের ব্যাপারে সজাগ থাকো।
তুমি আরো জেনে রেখো, এই রাজত্ব ও খেলাফত তোমার কাছে চিরদিনের জন্য আসেনি। অতিসত্ত্বর তা অন্যের কাছে স্থানান্তরিত হবে। দুনিয়া এভাবেই একের পর আরেকজনকে নিয়ে খেলা করে। তাদের মধ্যে কেউ আছে যে পাথেয় সঞ্চয় করে আর কেউ আছে যে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টিকে বরবাদ করে।
তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এরপর তুমি কখনও আর আমার কাছে চিঠি লিখবে না। লিখলে আমি তার জবাব দেব না।
-ওয়াসসালাম
এরপর তিনি চিঠিটা ভাঁজ ও দস্তখত করা ছাড়াই আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। আমি তা গ্রহণ করলাম এবং কূফার বাজারের দিকে ছুটলাম। সুফিয়ান ছাওরীর প্রতিটি কথা ও আচরণ আমার মধ্যে রূপান্তরের ঝড় বইয়ে দিল। তার উপদেশমালা সমুদ্রের ঊর্মিমালা হয়ে আমার হৃদয়পাড়ে আছড়ে পড়তে লাগল। বাজারে গিয়ে আমি উচ্চস্বরে ঘোষণা দিলাম- ওই ব্যক্তিকে কে ক্রয় করবে, যে আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় পলায়ন করতে ইচ্ছুক?
বাজারের লোকজন আমার ঘোষণা শুনে দিনার দিরহাম নিয়ে হাজির হলো। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করে বললাম, আমার এসবের প্রয়োজন নেই। বরং একটি পশমের জুব্বা দরকার। এগুলো কে দিতে পারবে?
আমাকে এগুলোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। আমি শাহী লেবাস ছুঁড়ে ফেলে দিলাম এবং ওই মোটা জুব্বা পরিধান করে নগ্নপদে হারুনের দরবারে উপস্থিত হলাম। দরবারের রক্ষী আমাকে এই অবস্থায় দেখে আটকে দিল। আমি পুনরায় অনুমতি চাইলাম। খলীফা আমাকে দেখে ফেললেন এবং আক্ষেপ ও নিজের প্রতি অনুযোগ করে বললেন, ‘প্রেরিত সফল হয়েছে আর প্রেরক ব্যর্থ হয়েছে।’
আমি তার দিকে সেভাবেই চিঠিটি ছুঁড়ে মারলাম যেভাবে সুফিয়ান ছাওরী আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। খলীফা চিঠিটি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করলেন এবং পাঠ করে বিপুল পরিমাণে অশ্রুপাত করলেন।
চিঠির ভাষ্য কতক দরবারী লোককে পীড়া দিল। তাদের একজন প্রস্তাব দিয়ে বলল, আমীরুল মুমিনীন! সুফিয়ান ছাওরী আপনার প্রতি চরম দুঃসাহস দেখিয়েছেন। অতএব তাকে পাকড়াও করে কঠোর সাজা দিন। জেলের ঘানি টানার ব্যবস্থা করে দিন। অন্তত অন্যরা এ থেকে শিক্ষা পাবে।
হারুন বললেন, হে দুনিয়ার দাসকুল! সুফিয়ানকে তার অবস্থায় থাকতে দাও। প্রতারিত ও হতভাগা সে, যার সান্নিধ্যে তোমরা আছো। সুফিয়ান তো সুফিয়ানই সুফিয়ানই!
এরপর তিনি আদেশ দিলেন, প্রতিবার দরবার বসার আগে যেন তার এই চিঠিটি পাঠ করে শোনানো হয়। [আল-আহকামুস সুলতানিয়া: ২/১৬১-১৬৩]
আমাদের পূর্বসূরী আলেমগণ ইলমের ইজ্জত-সম্মান রক্ষার ব্যাপারে এরকমই তৎপর ছিলেন। ইলমের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে কখনও তারা রাজন্যবর্গকে প্রশ্রয় দেননি। ইতিহাসে এরকম হাজারও ঘটনা সংরক্ষিত আছে। খতীব বাগদাদী (রহ.) হাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.)-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, একবার আমি হাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.)-এর নিকট গমন করলাম। আমি তার সঙ্গে বসা আছি এমন সময় মুহাম্মাদ ইবন সুলায়মানের দূত দরজায় করাঘাত করল। অতপর সে ঘরে প্রবেশ করে সালাম প্রদান করল এবং মুহাম্মাদ ইবন সুলায়মানের প্রেরিত চিঠি পেশ করল। হাম্মাদ বললেন, তুমি পড়ো। চিঠিতে সালাম ও দু‘আর পর উল্লেখ করা হয়েছে, আমার একটি মাসআলাগত সমাধান প্রয়োজন। দয়া করে চিঠিটি পাওয়ার পর আমার কাছে আগমন করবেন। আপনার কাছ থেকে মাসআলার সমাধান জেনে নেব।’
জবাবে হাম্মাদ ইবন সালামা (রহ.) বললেন, চিঠির অপর পৃষ্ঠায় লিখে দাও যে, ‘আমরা আমাদের পূর্বসূরীগণকে পেয়েছি তারা অন্যের কাছে যেতেন না। বরং যার সমস্যা হতো তিনিই সমাধানের জন্য আসতেন। অতএব আপনার যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে আপনিই আমার কাছে আসুন। আর আপনি যদি আসেনই তবে একা আসবেন এবং পদব্রজে আসবেন। সঙ্গে কাউকে নিয়ে আসবেন না এবং সওয়ারী হয়েও আসবেন না।’
এর কিছুক্ষণ পর পুনরায় দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা গেল। দরজা খোলা হলে দেখা গেল স্বয়ং মুহাম্মাদ ইবন সুলায়মান উপস্থিত! তিনি ঘরে প্রবেশ করে বললেন, কী ব্যাপার! আপনার দিকে তাকিয়ে প্রথমে আমার সারা শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল যে! তখন হাম্মাদ (রহ.) বললেন,
سمعت ثابتاً البناني يقول : سمعت انس بن مالك يقول : سمعت رسول الله صلى الله عليه وعلى آله وسلم يقول : إنَّ العالِمَ إذا أراد بعلمِه وجهَ اللهِ هابه كلُّ شيءٍ , وإن أراد أن يكنِزَ به الكنوزَ هاب من كلِّ شيءٍ .
‘আমি ছাবেত বুনানীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি আনাছ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে ইলম হাসিল করে পৃথিবীর সব মাখলুক তাকে সমীহ করে। আর যদি দুনিয়ার কোনো সম্পদ পাওয়ার লোভে ইলম হাসিল করে তবে সে পৃথিবীর সবাইকে ভয় পায় ও সমীহ করে।’ [জামে ছগীর: ৩৮৩; আলবানী, সিলসিলা যয়ীফা: ৩৯২৮, যঈফ]
অবশ্য বিশেষ কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে এবং দীনী কল্যাণের প্রশ্ন হলে সেক্ষেত্রে নিয়ত ঠিক রেখে বিত্তশালী এবং রাজন্যবর্গের কাছে যাওয়াতে দোষ নেই। এমনিভাবে রাজন্যবর্গ যদি ইলমী মাকামের হয় তবে তাদের কাছেও যাতায়াত করাতে দোষ নেই। সালফে সালেহীনের অনেকেই শুধু এসব কারণে কখনও কখনও এরকম লোকদের শরণাপ্নন হয়েছেন এবং তাদের কাছে গেছেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কখনই দুনিয়া কিংবা পার্থিব স্বার্থ ছিল না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/550/85
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।