hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১ম খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৪২
হযরত হূদ (আ)-এর কাহিনী
হযরত হূদ (আ)-এর বংশ লতিকা হচ্ছেঃ (১) হৃদ ইবন শালিখ ইবন আরফাখশায ইবন সাম ইবন নূহ (আ); মতান্তরে হৃদ—যার নাম ছিল আবির ইবন আরফাখশায ইবন সাম ইবন নূহ (আ)। অন্য মতে, হৃদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন রাবাহ্ ইবনুল-জারূদ ইবন আয ই আওস ইবন ইরাম ইবন সাম ইবন নূহ (আ)। ইতিহাসবেত্তা ইবন জারীর (র) এই মতভেদের কথা উল্লেখ করেছেন। হূদ-এর গোত্রের নাম আদ (ইবন আওস ইবন সাম ইবন নূহ)। তারা ছিল আহকাফ অর্থাৎ বালুর ঢিবিপূর্ণ এলাকার অধিবাসী, যা ইয়ামানের ওমান ও হাজরা মাওতের টিলা অঞ্চলে অবস্থিত। এটি ছিল শাহর জলাশয়ের তীরবর্তী বসতি এলাকা। তাদের উপত্যকার নাম ছিল মুগীছ। উঁচু উঁচ খুঁটির উপর তাঁবু খাটিয়ে তারা বসবাস করত।

কুরআন মজীদে আল্লাহ বলেনঃ

( أَلَمۡ تَرَ كَیۡفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ ۝ إِرَمَ ذَاتِ ٱلۡعِمَادِ )

[Surat Al-Fajr 6 - 7]

অর্থাৎ—তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক কি করেছিলেন, আদ বংশের ইরাম গোত্রের প্রতি—যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের (সূরা ফাজরঃ ৬-৭)। এই আদ বংশ আদে ইরাম বা আদে উলা বলে পরিচিত। আদে সানী বা দ্বিতীয় আদ বংশের উদ্ভব হয় পরবর্তীকালে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে।

আদে উলা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা কুরআনে বলেছেনঃ

( أَلَمۡ تَرَ كَیۡفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ ۝ إِرَمَ ذَاتِ ٱلۡعِمَادِ ۝ ٱلَّتِی لَمۡ یُخۡلَقۡ مِثۡلُهَا فِی ٱلۡبِلَـٰدِ )

[Surat Al-Fajr 6 – 8]

অর্থাৎ—সুউচ্চ প্রাসাদের অধিকারী ইরাম গোত্র, যার সমতুল্য কোন দেশে বানানো হয়নি। (সূরা ফাজরঃ ৬-৮)

এখানে দু’রকম অর্থ হতে পারে—এক, এই ইরাম বংশের সমতুল্য বংশ ইতিপূর্বে কখনও আসেনি। দুই, এদের প্রাসাদের ন্যায় সুউচ্চ প্রাসাদ ইতিপূর্বে কোথাও নির্মিত হয়নি। তবে প্রথম অর্থই সঠিক। তাফসীর গ্রন্থে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

যাদের ধারণা, ইরাম একটা ভ্রাম্যমাণ শহর—কখনও সিরিয়া, কখনও ইয়ামানে, কখনও হেজাজে, কখনও বা অন্য কোথাও এর অবস্থান হয়েছে। তাদের এ ধারণা ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক ও অমূলক। সহীহ ইবন হিব্বান গ্রন্থে হযরত আবু যর (রা) থেকে নবী-রাসূলগণের বর্ণনা প্রসংগে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণিত আছে, যাতে নবী করীম (সা) বলেনঃ এঁদের মধ্যে আরব বংশোদ্ভূত নবী চারজন ও হৃদ, সালিহ, শু‘আয়ব এবং তোমার নবী। হে আবু যর! কেউ কেউ বলেছেন, হূদ (আ)-ই সর্ব প্রথম আরবী ভাষায় কথা বলেন। পক্ষান্তরে ওহাব ইবন মুনাব্বিহ (র)-এর মতে, হূদ (আ)-এর পিতাই প্রথমে আরবী ভাষায় কথা বলেছিলেন। কারো কারো মতে, হযরত নূহ (আ) প্রথমে আরবীতে কথা বলেন। কেউ কেউ সর্বপ্রথম আরবী ভাষীরূপে হযরত আদম (আ)-এর নাম উল্লেখ করেছেন আর এটাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মত। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মতেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

হযরত ইসমাঈল (আ)-এর পূর্বকালের আরববাসীদেরকে ‘আরাবুল আরিবা’ বলা হয়। এরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। যথা ‘আদ, ছামূদ, জুরহাম, তাসাম, জুদায়স, উমায়স, মাদয়ান, আমলাক, আবীল, জাসিম, কাহতান, বানূ-ইয়াকতান ইত্যাদি।

হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ)-এর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধরদেরকে ‘আরাবুল-মুসতারাবা’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। হযরত ইসমাঈল (আ) সর্বপ্রথম উচ্চাংগের প্রাঞ্জল আরবী ভাষা ব্যবহার করেন। হারম শরীফ এলাকায় ইসমাঈল (আ)-এর আম্মা হাজেরার আশে-পাশে বসবাসকারী জুরহাম গোত্রের লোকজনের কাছ থেকে শিশু ইসমাঈল এই ভাষা শিখেছিলেন যার বর্ণনা পরে আসছে। তবে আল্লাহ তাঁকে সর্বোচ্চ মানের ভাষা-জ্ঞান দান করেছিলেন। আর এ ভাষায়ই রাসূলুল্লাহ (সা) কথা বলতেন।

হযরত নূহ নবীর মহা প্লাবনের পরে আদে উলা সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা আরম্ভ করে। তাদের মূর্তি ছিল তিনটা (১) সাদদা, (২) সামূদা ও (৩) হাররা। আল্লাহ তাদের মাঝে হূদ (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করেন। তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন। যেমন সূরা আ'রাফে নূহ (আ)-এর কাহিনী শেষে আল্লাহ বলেনঃ

( وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ * قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِي سَفَاهَةٍ وَإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ الْكَاذِبِينَ * قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي سَفَاهَةٌ وَلَٰكِنِّي رَسُولٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ * أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ * أَوَعَجِبْتُمْ أَنْ جَاءَكُمْ ذِكْرٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ مِنْكُمْ لِيُنْذِرَكُمْ ۚ وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً ۖ فَاذْكُرُوا آلَاءَ اللَّهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ * قَالُوا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا ۖ فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ * قَالَ قَدْ وَقَعَ عَلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ رِجْسٌ وَغَضَبٌ ۖ أَتُجَادِلُونَنِي فِي أَسْمَاءٍ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا نَزَّلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ ۚ فَانْتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُنْتَظِرِينَ * فَأَنْجَيْنَاهُ وَالَّذِينَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا ۖ وَمَا كَانُوا مُؤْمِنِينَ ) [Surat Al-A'raf 65 – 72]

অর্থাৎ ‘আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হূদকে(আ) পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই, তোমরা কি সাবধান হবে না? তার সম্প্রদায়ের কাফির সর্দারগণ বলেছিল, আমরা তো দেখছি তুমি নির্বুদ্ধিতায় ডুবে রয়েছ, আর তোমাকে তো আমরা মিথ্যাবাদী মনে করি। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই, আমি তো রাব্বুল আলামীনের প্রেরিত রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাংখী। তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজনের মাধ্যমে তোমাদেরকে সতর্ক করার জন্যে উপদেশ বাণী এসেছে। আর স্মরণ কর যে, আল্লাহ তোমাদেরকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অবয়বে অন্যলোক অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছেন। অতএব, তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। হয়ত তোমরা সফলকাম হবে।

তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে এ উদ্দেশ্যে এসেছ যে, আমরা যেন শুধু এক আল্লাহর ইবাদত করি আর আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাদের উপাসনা করত তা বর্জন করি? সুতরাং তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যে জিনিসের ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো! সে বলল, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো তোমাদের জন্যে শান্তি ও গযব নির্ধারিত হয়েই আছে; তবে কি তোমরা আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও এমন কতগুলো (দেব-দেবীর) নাম সম্বন্ধে যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণ সৃষ্টি করেছ! আল্লাহ এ সম্বন্ধে কোন সনদ পাঠাননি। সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি। তারপর আমি তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে আমার অনুগ্রহে উদ্ধার করি; আর যারা আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং যারা মুমিন ছিল না তাদেরকে নির্মূল করেছিলাম। (সূরা আ'রাফঃ ৬৫-৭২)

সূরা হূদে নূহের কাহিনী শেষে আল্লাহ বলেনঃ

( وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۖ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا مُفْتَرُونَ * يَا قَوْمِ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا ۖ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى الَّذِي فَطَرَنِي ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ * وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ وَلَا تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِينَ * قَالُوا يَا هُودُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِي آلِهَتِنَا عَنْ قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ * إِنْ نَقُولُ إِلَّا اعْتَرَاكَ بَعْضُ آلِهَتِنَا بِسُوءٍ ۗ قَالَ إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ * مِنْ دُونِهِ ۖ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنْظِرُونِ * إِنِّي تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ رَبِّي وَرَبِّكُمْ ۚ مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا ۚ إِنَّ رَبِّي عَلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ * فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقَدْ أَبْلَغْتُكُمْ مَا أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَيْكُمْ ۚ وَيَسْتَخْلِفُ رَبِّي قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلَا تَضُرُّونَهُ شَيْئًا ۚ إِنَّ رَبِّي عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ حَفِيظٌ * وَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا هُودًا وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَنَجَّيْنَاهُمْ مِنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ * وَتِلْكَ عَادٌ ۖ جَحَدُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَعَصَوْا رُسُلَهُ وَاتَّبَعُوا أَمْرَ كُلِّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ * وَأُتْبِعُوا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ أَلَا إِنَّ عَادًا كَفَرُوا رَبَّهُمْ ۗ أَلَا بُعْدًا لِعَادٍ قَوْمِ هُودٍ )

[Surat Hud 50 - 60]

অর্থাৎ—‘আদ জাতির প্রতি তাদের ভাই হূদকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা তো কেবল মিথ্যা রচনাকারী। হে আমার সম্প্রদায়! এ জন্যে কোন পারিশ্রমিক আমি তোমাদের কাছে চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো তারই কাছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও অনুধাবন করবে না? হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। তারপর তার দিকেই ফিরে এস। তিনি তোমাদের জন্যে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং আরও শক্তি দিয়ে তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি করে দেবেন। অপরাধী হয়ে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিও না।

তারা বলল, হে হূদ! তুমি আমাদের কাছে কোন স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসনি। তোমার কথায়ই আমরা আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করার নই। আর আমরা তোমার প্রতি বিশ্বাসী নই। আমরা তো এটাই বলি যে, তোমার উপর আমাদের কোন উপাস্যের অশুভ নজর পড়েছে। হূদ (আ) বলল, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি আর তোমরাও সাক্ষী থাক যে, আল্লাহ ছাড়া তোমরা আর যেসব শরীক বানিয়ে রেখেছ সে সবের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তোমরা সকলে মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাও এবং আমাকে মোটেই অবকাশ দিও না। আমি নির্ভর করি আল্লাহর উপর, যিনি আমার এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। কোন জীব-জন্তু এমন নেই যা তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নয়। নিঃসন্দেহে আমার প্রতিপালক সরল পথে আছেন। তারপর তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি যে পয়গামসহ তোমাদের কাছে প্রেরিত হয়েছিলাম, তা আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এবং আমার প্রতিপালক ভিন্ন কোন সম্প্রদায়কে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। আর তোমরা তার কোনই ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। আমার প্রতিপালক নিশ্চয়ই সব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।

পরে যখন আমার ফরমান এসে পৌঁছল, তখন আমি আমার রহমতের দ্বারা হূদকে এবং তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে রক্ষা করলাম এবং এক কঠিন আযাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করলাম। এই হল আদ জাতি, তারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে এবং তাঁর নবী-রাসূলগণকে অমান্য করেছিল এবং তারা প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারীর অনুসরণ করত। এই দুনিয়ায়ও তাদের উপর লানত হয়েছিল। আর তারা কিয়ামতের দিনও লা’নতগ্রস্ত হবে। জেনে রেখ, ‘আদ সম্প্রদায় তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছিল। জেনে রেখ, ধ্বংসই হলো হূদের সম্প্রদায় আদের পরিণাম। (সূরা হূদঃ ৫০-৬০)

সূরা المؤ منون এ নূহের জাতির কাহিনী শেষে আল্লাহ বলেনঃ

( ثُمَّ أَنْشَأْنَا مِنْ بَعْدِهِمْ قَرْنًا آخَرِينَ * فَأَرْسَلْنَا فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۖ أَفَلَا تَتَّقُونَ * وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِلِقَاءِ الْآخِرَةِ وَأَتْرَفْنَاهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا مَا هَٰذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يَأْكُلُ مِمَّا تَأْكُلُونَ مِنْهُ وَيَشْرَبُ مِمَّا تَشْرَبُونَ * وَلَئِنْ أَطَعْتُمْ بَشَرًا مِثْلَكُمْ إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ * أَيَعِدُكُمْ أَنَّكُمْ إِذَا مِتُّمْ وَكُنْتُمْ تُرَابًا وَعِظَامًا أَنَّكُمْ مُخْرَجُونَ * هَيْهَاتَ هَيْهَاتَ لِمَا تُوعَدُونَ * إِنْ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوثِينَ * إِنْ هُوَ إِلَّا رَجُلٌ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا وَمَا نَحْنُ لَهُ بِمُؤْمِنِينَ * قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي بِمَا كَذَّبُونِ * قَالَ عَمَّا قَلِيلٍ لَيُصْبِحُنَّ نَادِمِينَ * فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ بِالْحَقِّ فَجَعَلْنَاهُمْ غُثَاءً ۚ فَبُعْدًا لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ )

[Surat Al-Mu'minun 31 - 41]

অর্থাৎ—তারপর তাদের পরে অন্য এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিলাম এবং তাদেরই একজনকে তাদের প্রতি রাসূল করে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না। তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ যারা কুফরী করেছিল ও আখিরাতের সাক্ষাৎকারকে অস্বীকার করছিল এবং যাদেরকে আমি পার্থিব জীবনে প্রচুর ভোগ-সম্ভার দান করেছিলাম তারা বলেছিলঃ এতো তোমাদের মত একজন মানুষই। তোমরা যা খাও, সেও তাই খায়, আর যা তোমরা পান কর, সেও তাই পান করে। যদি তোমরা তোমাদেরই মত একজন মানুষের আনুগত্য কর তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সে কি তোমাদের এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মাটি ও হাড়ে পরিণত হয়ে গেলেও তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে? অসম্ভব, তোমাদেরকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে তা অসম্ভব। একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি-বাঁচি এখানেই। আর কখনও আমরা পুনরুত্থিত হব না। সে তো এমন এক ব্যক্তি, যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে এবং আমরা কখনই তাকে বিশ্বাস করব না। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর; কারণ এরা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে।

আল্লাহ বললেন, অচিরেই এরা অনুতপ্ত হবেই। তারপর সত্য সত্যই এক বিকট আওয়াজ তাদেরকে আঘাত করল এবং আমি তাদেরকে তরঙ্গ তাড়িত আবর্জনা সদৃশ করেছিলাম। সুতরাং ধ্বংস হয়ে গেল জালিম সম্প্রদায়। (সূরা মু’মিনূনঃ ৩১-৪১)

সূরা শুআরায় নূহের কাহিনী শেষে আল্লাহ বলেনঃ

( كَذَّبَتْ عَادٌ الْمُرْسَلِينَ * إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ هُودٌ أَلَا تَتَّقُونَ * إِنِّي لَكُمْ رَسُولٌ أَمِينٌ * فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ * وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ ۖ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَىٰ رَبِّ الْعَالَمِينَ * أَتَبْنُونَ بِكُلِّ رِيعٍ آيَةً تَعْبَثُونَ * وَتَتَّخِذُونَ مَصَانِعَ لَعَلَّكُمْ تَخْلُدُونَ * وَإِذَا بَطَشْتُمْ بَطَشْتُمْ جَبَّارِينَ * فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ * وَاتَّقُوا الَّذِي أَمَدَّكُمْ بِمَا تَعْلَمُونَ * أَمَدَّكُمْ بِأَنْعَامٍ وَبَنِينَ * وَجَنَّاتٍ وَعُيُونٍ * إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ * قَالُوا سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَوَعَظْتَ أَمْ لَمْ تَكُنْ مِنَ الْوَاعِظِينَ * إِنْ هَٰذَا إِلَّا خُلُقُ الْأَوَّلِينَ * وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ * فَكَذَّبُوهُ فَأَهْلَكْنَاهُمْ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً ۖ وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُمْ مُؤْمِنِينَ * وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ ) [Surat Ash-Shu'ara 123 - 140]

অর্থাৎ—আদ সম্প্রদায় নবী-রাসূলগণকে অস্বীকার করেছে। যখন তাদের ভাই হুদ (আ) তাদেরকে বলল, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আমি এ জন্যে তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না। আমার পুরস্কার তো রাব্বুল আলামীনের কাছে আছে। তোমরা কি প্রতিটি উচ্চ স্থানেই অর্থহীনভাবে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করছ? আর তোমরা প্রাসাদ নির্মাণ করছ এই মনে করে যে, তোমরা চিরস্থায়ী হবে। আর যখন তোমরা আঘাত হান, তখন তোমরা আঘাত হেনে থাক কঠোরভাবে।

তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। ভয় কর তাকে যিনি তোমাদেরকে সেই সব কিছুই দিয়েছেন যা তোমরা জান। তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন জন্তু-জানোয়ার, সন্তান-সন্ততি, বাগ-বাগিচা এবং প্রস্রবণ। তোমাদের ব্যাপারে আমি এক মহাদিবসের আযাবের আশঙ্কা করছি। তারা জবাব দিল, তুমি নসীহত কর আর নাই কর, আমাদের জন্যে সবই সমান। এসবতো পূর্ববর্তীদেরই স্বভাব। আর আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হবার লোক নই। তারপর তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমরা তাদেরকে ধ্বংস করলাম। নিঃসন্দেহে এতে একটি নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই মুমিন নয়। এবং তোমার প্রতিপালক, তিনি তো প্রবল পরাক্রমশালী এবং পরম দয়ালুও। (সূরা শুআরাঃ ১২৩-১৪০)

সূরা ফুসসিলাত এ আল্লাহর বাণীঃ

( فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً ۖ أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً ۖ وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ * فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَىٰ ۖ وَهُمْ لَا يُنْصَرُونَ )

[Surat Fussilat 15 - 16]

অর্থাৎ— আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, তারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার করত এবং বলত আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তারা অশুভ দিনসমূহে কি লক্ষ্য করেনি যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করত। তারপর আমি তাদের পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করানোর জন্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া তাদের উপর পাঠিয়েছিলাম। এবং পরকালের আযাব তো এ থেকেও অধিক লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। (সূরা ফুসসিলাতঃ ১৫-১৬)

সূরা আহকাফে আল্লাহর বাণীঃ

( وَاذْكُرْ أَخَا عَادٍ إِذْ أَنْذَرَ قَوْمَهُ بِالْأَحْقَافِ وَقَدْ خَلَتِ النُّذُرُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ * قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَأْفِكَنَا عَنْ آلِهَتِنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ * قَالَ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَأُبَلِّغُكُمْ مَا أُرْسِلْتُ بِهِ وَلَٰكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ * فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا مُسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوا هَٰذَا عَارِضٌ مُمْطِرُنَا ۚ بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ ۖ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ * تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا فَأَصْبَحُوا لَا يُرَىٰ إِلَّا مَسَاكِنُهُمْ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ ) [Surat Al-Ahqaf 21 - 25]

অর্থাৎ স্মরণ কর, আদ-এর ভাই-এর কথা। যার পূর্বে এবং পরেও সতর্ককারীরা এসেছিল। সে তার আহকাফ বা বালুকাময় উচ্চ উপত্যকার অধিবাসী সম্প্রদায়কে এ মর্মে সতর্ক করেছিল যে, আল্লাহ ব্যতীত কারো ইবাদত করো না। আমি তোমাদের ব্যাপারে এক ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করছি। তারা বলেছিল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের উপাস্য দেব-দেবীদের থেকে নিবৃত্ত করতে এসেছ? তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যে ব্যাপারে ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে আস।

সে বলল, এর জ্ঞান তো আল্লাহর কাছেই রয়েছে, আমি যা সহ প্রেরিত হয়েছি কেবল তাই তোমাদের কাছে প্রচার করি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি, তোমরা একটি মূর্খ সম্প্রদায়। পরে তারা যখন তাদের উপত্যকার দিকে মেঘ আসতে দেখল, তখন তারা বলতে লাগল—এতো মেঘপুঞ্জ, আমাদেরকে বৃষ্টি দিবে। না, বরং এটা তো তাই যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এতে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তিবাহী এক ঝড়। তার প্রতিপালকের নির্দেশে সে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। তারপর তারা এমন হয়ে গেল যে, তাদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই রইলো না। বস্তুত অপরাধী সম্প্রদায়কে আমি এমনিভাবে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সূরা আহকাফঃ ২১-২৫)

সূরা যারিয়াতে আল্লাহর বাণীঃ

( وَفِي عَادٍ إِذْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الرِّيحَ الْعَقِيمَ * مَا تَذَرُ مِنْ شَيْءٍ أَتَتْ عَلَيْهِ إِلَّا جَعَلَتْهُ كَالرَّمِيمِ )

[Surat Adh-Dhariyat 41 - 42]

অর্থাৎ—আর নিদর্শন রয়েছে আদ জাতির ঘটনায়। যখন আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম অকল্যাণকর বায়ু তা যে জিনিসের উপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছিল তাই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। (সূরা যারিয়াতঃ ৪১-৪২)

সূরা নাজমে আল্লাহর বাণীঃ

( وَأَنَّهُ أَهْلَكَ عَادًا الْأُولَىٰ * وَثَمُودَ فَمَا أَبْقَىٰ * وَقَوْمَ نُوحٍ مِنْ قَبْلُ ۖ إِنَّهُمْ كَانُوا هُمْ أَظْلَمَ وَأَطْغَىٰ * وَالْمُؤْتَفِكَةَ أَهْوَىٰ * فَغَشَّاهَا مَا غَشَّىٰ * فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكَ تَتَمَارَىٰ )

[Surat An-Najm 50 - 55]

অর্থাৎ প্রথম আদকে তিনিই ধ্বংস করেছেন। এবং ছামূদ সম্প্রদায়ের কাউকেও তিনি বাকি রাখেননি। আর তাদের পূর্বে নুহের সম্প্রদায়কেও। ওরা ছিল অতিশয় জালিম ও অবাধ্য। উৎপাটিত আবাসভূমিকে উল্টিয়ে নিক্ষেপ করেছিলেন। ওটাকে আচ্ছন্ন করে নিল কী সর্বগ্রাসী শাস্তি! তবে তুমি তোমার প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে? (সূরা নাজমঃ ৫০-৫৫)

সূরা কামারে আল্লাহর বাণীঃ

( كَذَّبَتْ عَادٌ فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ * إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي يَوْمِ نَحْسٍ مُسْتَمِرٍّ * تَنْزِعُ النَّاسَ كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ مُنْقَعِرٍ * فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ * وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ ) [Surat Al-Qamar 18 - 22]

অর্থাৎ আদ সম্প্রদায় সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে কী কঠোর হয়েছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী! ওদের উপর আমি প্রেরণ করেছিলাম ঝড়-বায়ু নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের দিনে। মানুষকে তা উৎখাত করেছিল। উন্মুলিত খেজুর কাণ্ডের মত। কী কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী! কুরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব, উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (সূরা কামারঃ ১৮-২২)

সূরা আল-হাক্কায় আল্লাহর বাণীঃ

( وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوا بِرِيحٍ صَرْصَرٍ عَاتِيَةٍ * سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ حُسُومًا فَتَرَى الْقَوْمَ فِيهَا صَرْعَىٰ كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ * فَهَلْ تَرَىٰ لَهُمْ مِنْ بَاقِيَةٍ )

[Surat Al-Haqqah 6-8]

অর্থাৎ—আর ‘আদ সম্প্রদায়, ওদের ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝড়-বায়ু দ্বারা যা তিনি ওদের উপর প্রবাহিত করেছিলেন সাত রাত ও আট দিন বিরামহীনভাবে। তখন (উক্ত সম্প্রদায়) দেখতে পেতে ওরা সেখানে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খেজুর কাণ্ডের মত। এরপর ওদের কাউকে তুমি বিদ্যমান দেখতে পাও কি? (সূরা আল-হাক্কাহঃ ৬-৮)

সূরা আল-ফাজরে আল্লাহর বাণীঃ

( أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ * إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ * الَّتِي لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ * وَثَمُودَ الَّذِينَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ * وَفِرْعَوْنَ ذِي الْأَوْتَادِ * الَّذِينَ طَغَوْا فِي الْبِلَادِ * فَأَكْثَرُوا فِيهَا الْفَسَادَ * فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ * إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ )

[Surat Al-Fajr 6 - 14]

অর্থাৎ—তুমি কি লক্ষ্য করনি, তোমার প্রতিপালক আদ বংশের ইরাম গোত্রের সাথে কি করেছিলেন—যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের? যার সমতুল্য কোন দেশে নির্মিত হয়নি, এবং ছামূদের প্রতি—যারা উপত্যকায় পাথর কেটে ঘর নির্মাণ করেছিল এবং বহু সৈন্য শিবিরের অধিপতি ফিরআউনের প্রতি—যারা দেশে সীমালংঘন করেছিল এবং সেখানে প্রচুর অশান্তি সৃষ্টি করেছিল। এরপর তোমার প্রতিপালক ওদের উপর শাস্তির কষাঘাত হানলেন। তোমার প্রতিপালক অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। (সূরা আল-ফাজরঃ ৬-১৪)

এসব কাহিনী আমরা আমাদের তাফসীর গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে বিশদভাবে আলোচনা করেছি। আদ জাতির আলোচনা কুরআন মজীদের সূরা বারাআত, সূরা ইবরাহীম, সূরা ফুরকান, সূরা আনকাবূত, সূরা সা’দ ও সূরা কাফে করা হয়েছে। এ সকল স্থানের সামগ্রিক আলোচনার সাথে অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য মিলিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করব। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, আদ জাতিই নূহ (আ)-এর প্লাবনের পরে সর্বপ্রথম মূর্তিপূজার সূচনা করে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহর বাণীঃ

واذكروا إذ جعلكم خلفاء من بعد قوم نوح وزادكم في الخلق بشطة .

অর্থাৎ—এ কথা স্মরণ কর যে, নূহের সম্প্রদায়ের পরে আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অবয়বে অধিক শক্তি দান করেছেন। অর্থাৎ সমসাময়িক কালে তারাই ছিল দৈহিক গঠন ও শক্তিতে শ্রেষ্ঠ।

সূরা মুমিনূনে আল্লাহ বলেনঃ

ثُمَّ أَنْشَأْنَا مِنْ بَعْدِهِمْ قَرْنًا آخَرِينَ

অর্থাৎ—তারপর আমি অন্য এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করলাম। (সূরা মুমিনূনঃ ৩১)

সঠিক মতানুসারে এরা হল হূদ (আ)-এর সম্প্রদায়। তবে অন্যরা বলেন, এরা ছামূদ জাতি। প্রমাণস্বরূপ তারা কুরআনের এ আয়াত পেশ করেনঃ

فاخذتهم الصيحة بالحق فجعلناهم غثاء

অর্থাৎ সত্যি সত্যি এক বিকট শব্দ তাদেরকে পাকড়াও করল এবং আমি তাদেরকে শুকনো ঘাসের মত করে দিলাম। এখানে তাদের বক্তব্য হল, যে জাতিকে বিকট শব্দের দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছিল, তারা ছিল সালিহ (আ)-এর সম্প্রদায়, ছামূদ জাতি। পক্ষান্তরে আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ অর্থাৎ—আদ জাতিকে ভয়াবহ প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা-বায়ু দ্বারা ধ্বংস করা হয়। তাদের এ ব্যাখ্যা গ্রহণ করার পরও বলা যেতে পারে যে, আদ জাতির উপর বিকট শব্দ ও প্রচণ্ড বায়ু উভয় প্রকার আযাবই অবতীর্ণ হয়েছিল, যেমন মাদয়ানবাসী তথা আইকার অধিবাসীদের উপর বিভিন্ন প্রকার আযাব পতিত হয়েছিল। আর এ বিষয়ে কোন মতপার্থক্য নেই যে, আদ জাতি ছিল ছামূদ জাতির পূর্বসূরি।

মোটকথা, আদ সম্প্রদায় ছিল একটি অত্যাচারী কাফির, বিদ্বেষী, দাম্ভিক ও মূর্তিপূজারী আরব গোষ্ঠী। আল্লাহ তাদের মধ্য থেকেই একজনকে তাদের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করেন। তিনি তাদেরকে নিষ্ঠার সাথে এক আল্লাহর ইবাদত করার প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু তারা তাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে এবং তার বিরুদ্ধাচারণ করে এবং তাকে হেয়প্রতিপন্ন করে। ফলে, প্রবল পরাক্রমশালী আল্লাহ তাদেরকে কঠিনভাবে পাকড়াও করেন। নবী যখন তাদেরকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে এবং এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন এবং উদ্বুদ্ধ করেন, এর দ্বারা ইহকাল ও পরকালে পুরস্কার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং বিরুদ্ধাচরণে দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি ভোগের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন তখনঃ

قال الملاالذين كفروا من قومه انا كنر اك في شفاهة .

অর্থঃ সম্প্রদায়ের কাফির সর্দাররা বলল, আমরা তো দেখছি তুমি নির্বোধ অর্থাৎ আমরা যে সব মূর্তির পূজা করি তার স্থলে তুমি আমাদেরকে যেদিকে আহ্বান করছ তা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা এদের থেকে সাহায্য ও রুটি-রুজির আশা করি। তা ছাড়া তোমার রাসূল হওয়ার দাবিকেও আমরা মিথ্যা বলে মনে করি। জবাবে নবী বললেনঃ

قال يا قومی لیس بی شفاهة ولكنر سول من رب العالمين .

অর্থাৎ হে আমার সম্প্রদায়! আমি নির্বোধ নই, বরং আমি রাব্বুল আলামীনের প্রেরিত রাসূল অর্থাৎ তোমরা যে ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে বসে আছ ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।

( أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ )

[Surat Al-A'raf 68]

অর্থাৎ আমি আমার প্রতিপালকের বার্তা তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিচ্ছি আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাংক্ষী। (৭ আ'রাফঃ ৬৮) বার্তা পৌঁছানোর মধ্যে মিথ্যা বলার অবকাশ নেই, এক্ষেত্রে মূল বার্তায় হ্রাস-বৃদ্ধি করার কোন সুযোগ নেই।

তা ছাড়া কোন বার্তার ভাষা হয়ে থাকে প্রাঞ্জল, সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থ জ্ঞাপক। যা হয়ে থাকে দ্ব্যর্থহীন ও পরস্পর বিরোধিতা মুক্ত। বিতর্কের অবকাশ সেখানে থাকে না। এভাবে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেয়ার পরও তিনি নিজ জাতিকে সদুপদেশ দেন, তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করেন, তাদের সৎপথ প্রাপ্তির জন্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। তিনি তার এ কাজের জন্যে তাদের থেকে কোন বিনিময় বা পারিশ্রমিক কামনা করেননি। বরং তিনি দাওয়াতী কাজে ও উপদেশ বিতরণে একনিষ্ঠ ও অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তিনি কেবল তার প্রেরণকারী মাওলার কাছেই পুরস্কারের আশা করতেন, কেননা দুনিয়া ও আখিরাতের সর্ব প্রকার মঙ্গল তারই হাতেঃ

يَا قَوْمِ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا ۖ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى الَّذِي فَطَرَنِي ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

নবী বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের নিকট থেকে আমি কোন বিনিময় চাই না। আমার পুরস্কার তো রয়েছে তারই কাছে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও অনুধাবন করবে না? (সূরা হুদঃ ৫১)

অর্থাৎ তোমাদের কি এতটুকু বিবেক-বুদ্ধি নেই যার দ্বারা ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পার এবং এ কথা বুঝতে সক্ষম হও যে, আমি তোমাদের এমন এক সুস্পষ্ট সত্যের দিকে আহ্বান করছি তোমাদের স্বভাবধর্মই যার সত্যতার সাক্ষ্যবহ। এটাই সেই সত্য দীন যা আল্লাহ ইতিপূর্বে নূহের মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন এবং এর বিরোধিতাকারীদের খতম করে দিয়েছিলেন। আর এখন আমি তোমাদেরকে সেদিকেই আহ্বান করছি এবং এর বিনিময়ে তোমাদের থেকে কিছুই চাই না, বরং কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক আল্লাহর কাছেই এর পুরস্কারের প্রত্যাশা রাখি। এ কারণেই সূরা ইয়াসীনে জনৈক মু’মিনের উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে যেঃ

اتبعوا من لايشئلكم أجرا وهم مهتدون - ومالي لا أعبد الذى فطرنئ

واليه ترجعون .

অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায় না, আর যারা হিদায়াতপ্রাপ্ত। আমি কেন সেই সত্তার ইবাদত করব না, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, এবং যার কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে তার ইবাদত করব না? হূদ নবীর সম্প্রদায় তাকে জবাব দিলঃ

يَا هُودُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِي آلِهَتِنَا عَنْ قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ . إِنْ نَقُولُ إِلَّا اعْتَرَاكَ بَعْضُ آلِهَتِنَا بِسُوءٍ

অর্থাৎ হে হুদ! তুমি আমাদের কাছে কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসনি, তোমার মুখের কথায়ই আমরা আমাদের উপাস্য দেব-দেবীকে পরিত্যাগ করতে পারি না। আমরা তো তোমাকে বিশ্বাসই করি না। আমরা তো এটাই বলি যে, তোমার উপর আমাদের কোন উপাস্যের অশুভ দৃষ্টি পড়েছে। (সূরা হুদঃ ৫৩-৫৪)

তারা বলত, হে হুদ! তুমি তো এমন অলৌকিক কিছু নিয়ে আসনি, যা তোমার দাবির সত্যতার সপক্ষে সাক্ষ্য বহন করে। আর বিনা প্রমাণে আমরা কেবল তোমার মুখের কথায় আমাদের দেব-দেবীর উপাসনা ত্যাগ করব না। আমাদের ধারণা হচ্ছে, তুমি পাগল হয়ে গেছ, অর্থাৎ আমাদের কোন উপাস্য তোমার উপর ক্রুদ্ধ হওয়ায় তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে এবং এ কারণে তুমি পাগল হয়ে গেছ। তাদের উত্তরে নবী বললেনঃ

إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ . مِنْ دُونِهِ ۖ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنْظِرُونِ

আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি, আর তোমরাও সাক্ষী থাক যে, আল্লাহ ব্যতীত তোমরা আর যা কিছুকে আল্লাহর শরীক কর, সে সবের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অতঃপর সকলে মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর এবং আমাকে কোনরূপ অবকাশ দিও না। (সূরা হুদঃ ৫৫)।

এটা নবীর পক্ষ থেকে তাঁর সম্প্রদায়ের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। তাদের দেব-দেবী থেকে নিজেকে সম্পর্কহীন রাখার চূড়ান্ত ঘোষণা ও দেব-দেবীর অসারতা প্রতিপন্নকারী উক্তি। তিনি বলছেন, ঐসব দেব-দেবী না কোন উপকার করতে পারে, না কোন ক্ষতি; জড় পদার্থ ছাড়া ওগুলো আর কিছুই নয়, হুকুম একমাত্র আল্লাহর চলে এবং তিনিই সব কাজের নিয়ন্তা। তোমরা যা বিশ্বাস কর, ওরাই সাহায্য-উপকার করে। ওরাই ক্ষতি সাধন করে—এ বিশ্বাসের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই আমি এগুলোকে অভিসম্পাত দেই। فكيدوني ثم لا تنظرون অর্থাৎ—আমার বিরুদ্ধে তোমরা ষড়যন্ত্র পাকাও এবং আমাকে অবকাশ দিও না।

অর্থাৎ তোমাদের সমস্ত শক্তি ও উপায়-উপকরণ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে যা করার তা করতে পার। এ ব্যাপারে এক মুহূর্তও আমাকে অবকাশ দিও না; কেননা আমি তোমাদের কোন পরোয়া করি না, এতে আমি চিন্তিতও নই এবং তোমাদের প্রতি আদৌ কোন ভ্রক্ষেপও করি না।

إِنِّي تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ رَبِّي وَرَبِّكُمْ ۚ مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا ۚ إِنَّ رَبِّي عَلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

‘আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, তিনি আমার রব, তোমাদেরও রব, এমন কোন প্রাণী নেই যে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। বস্তুত আমার প্রতিপালকই সরল সঠিক পথে আছেন।'( সূরা হুদঃ ৫৬)

অর্থাৎ আমার ভরসা একমাত্র আল্লাহরই উপর। তাঁর নিকটই আমি সাহায্যপ্রার্থী, তার উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। যে ব্যক্তি তার কাছে স্বরণ নেয়, তাকে তিনি ধ্বংস হতে দেন না। তাঁকে ছাড়া কোন সৃষ্টির পরোয়া আমি করি না, তিনি ছাড়া অন্য কারও উপর আমি নির্ভর করি না। তিনি ছাড়া কারও ইবাদতও আমি করি না। এই একটি মাত্র বাক্যই এ ব্যাপারে অকাট্য দলীল যে, হযরত হূদ (আ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আর তার কওমের লোকেরা ভ্রান্তি ও মূর্খতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আল্লাহকে বাদ দিয়ে দেব-দেবীর পূজা করত। তারা নবীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। এটা তার আনীত দীনের সত্যতার ও বিরোধীদের মত ও পথের ভ্রান্তির প্রমাণবহ। হূদের(আ) পূর্বে নূহ (আ)ও ঠিক এ দলীলই পেশ করেছিলেন যেমনঃ -

يَا قَوْمِ إِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكُمْ مَقَامِي وَتَذْكِيرِي بِآيَاتِ اللَّهِ فَعَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْتُ فَأَجْمِعُوا أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوا إِلَيَّ وَلَا تُنْظِرُونِ

হে আমার সম্প্রদায়! আমার অবস্থিতি ও আল্লাহর নিদর্শনাবলী দ্বারা আমার উপদেশদান তোমাদের নিকট যদি দুঃসহ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে আমি তো আল্লাহর উপরই নির্ভর করি। তোমরা যাদেরকে শরীক করেছ তাদেরসহ তোমাদের কর্তব্য স্থির কর। পরে যেন কর্তব্য বিষয়ে তোমাদের কোন সংশয় না থাকে। আমার সম্বন্ধে তোমাদের কর্ম নিষ্পন্ন করে ফেল এবং আমাকে অবকাশ দিও না। (সূরা ইউনুসঃ ৭১)

হযরত ইবরাহীম খলীল (আ)-ও এরূপই বলেছিলেনঃ

وَلَا أَخَافُ مَا تُشْرِكُونَ بِهِ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ رَبِّي شَيْئًا ۗ وَسِعَ رَبِّي كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا ۗ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ * وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلَا تَخَافُونَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا ۚ فَأَيُّ الْفَرِيقَيْنِ أَحَقُّ بِالْأَمْنِ ۖ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ * الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ * وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَىٰ قَوْمِهِ ۚ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَنْ نَشَاءُ ۗ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ [Surat Al-An'am 80 - 83]

অর্থাৎ আমার প্রতিপালক অন্যরূপ ইচ্ছা না করলে তোমরা যাকে তাঁর শরীক কর তাকে আমি ভয় করি না। সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ত। তবে কি তোমরা অনুধাবন করবে না? তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর আমি তাকে কেমন করে ভয় করব, অথচ তোমরা আল্লাহর শরীক করতে ভয় কর না— যে বিষয়ে তিনি তোমাদেরকে কোন সনদ দেননি? সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল, দুই দলের মধ্যে কোন দল নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি নিরাপত্তা তাদেরই জন্য, তারাই সৎপথ প্রাপ্ত। এবং এটা আগের যুক্তিপ্রমাণ যা ইবরাহীমকে দিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের মুকাবিলায়, যাকে ইচ্ছে মর্যাদায় আমি উন্নীত করি; তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানী। (সূরা আনআমঃ ৮০-৮৩)

( وَقَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِلِقَاءِ الْآخِرَةِ وَأَتْرَفْنَاهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا مَا هَٰذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يَأْكُلُ مِمَّا تَأْكُلُونَ مِنْهُ وَيَشْرَبُ مِمَّا تَشْرَبُونَ * وَلَئِنْ أَطَعْتُمْ بَشَرًا مِثْلَكُمْ إِنَّكُمْ إِذًا لَخَاسِرُونَ * أَيَعِدُكُمْ أَنَّكُمْ إِذَا مِتُّمْ وَكُنْتُمْ تُرَابًا وَعِظَامًا أَنَّكُمْ مُخْرَجُونَ )

[Surat Al-Mu'minun 33 - 35]

অর্থাৎ তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ যারা কুফরী করেছিল এবং আখিরাতের সাক্ষাতকারকে অস্বীকার করেছিল এবং যাদেরকে আমি দিয়েছিলাম পার্থিব জীবনে প্রচুর ভোগ-সম্ভার, তারা বলেছিল, এতো তোমাদের মত একজন মানুষই; তোমরা যা খাও, সে তো তাই খায় এবং তোমরা যা পান কর, সেও তাই পান করে। যদি তোমরা তোমাদেরই মত একজন মানুষের আনুগত্য কর তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে কি তোমাদেরকে এ প্রতিশ্রুতি দেয়—তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মাটি ও হাড়ে পরিণত হয়ে গেলেও তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে। (সূরা মুমিনূনঃ ৩৩-৩৫)

একজন মানুষকে আল্লাহ রাসূলরূপে পাঠাবেন এটা তাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হত। প্রাচীন ও আধুনিক যুগের অনেক মূর্খ কাফির এ যুক্তিই উপস্থাপন করেছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَا إِلَىٰ رَجُلٍ مِنْهُمْ أَنْ أَنْذِرِ النَّاسَ

অর্থাৎ মানুষের জন্য এটা কি আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি তাদেরই একজনের কাছে ওহী প্রেরণ করেছি এ মর্মে যে, তুমি মানুষকে সতর্ক কর! (সূরা ইউনুসঃ ২) এবং আল্লাহর বাণীঃ

( وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَىٰ إِلَّا أَنْ قَالُوا أَبَعَثَ اللَّهُ بَشَرًا رَسُولًا * قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولًا )

[Surat Al-Isra' 94 - 95]

যখন তাদের কাছে আসে পথনির্দেশ তখন লোকদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখে , তাদের এ উক্তি, আল্লাহ কি মানুষকেই রাসূল করে পাঠিয়েছেন? বল, ফেরেশতাগণ যদি নিশ্চিন্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করত, তবে আমি আকাশ থেকে ফেরেশতাই তাদের নিকট রাসূল করে পাঠাতাম। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৯৪-৯৫)

এ কারণেই হূদ (আ) তাদেরকে বলেছিলেনঃ

أَوَعَجِبْتُمْ أَنْ جَاءَكُمْ ذِكْرٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ مِنْكُمْ لِيُنْذِرَكُمْ

অর্থ তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে যাতে সে তোমাদের সতর্ক করে। (সূরা আ'রাফঃ ৬৩)

মোটেই আশ্চর্যজনক নয়। কেননা আল্লাহই ভাল জানেন যে, তিনি রিসালতের দায়িত্ব কাকে দিবেন। আল্লাহর বাণীঃ

( أَيَعِدُكُمْ أَنَّكُمْ إِذَا مِتُّمْ وَكُنْتُمْ تُرَابًا وَعِظَامًا أَنَّكُمْ مُخْرَجُونَ * هَيْهَاتَ هَيْهَاتَ لِمَا تُوعَدُونَ * إِنْ هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوثِينَ * إِنْ هُوَ إِلَّا رَجُلٌ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا وَمَا نَحْنُ لَهُ بِمُؤْمِنِينَ * قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي بِمَا كَذَّبُونِ )

[Surat Al-Mu'minun 35 - 39]

অর্থ সে কি তোমাদেরকে এ প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মাটি ও হাড়ে পরিণত হলেও তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে? অসম্ভব, তোমাদেরকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা অসম্ভব। একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন। আমরা মরি-বাঁচি এখানেই এবং আমরা পুনরুত্থিত হব না। সে তো এমন এক ব্যক্তি যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে এবং আমরা তাকে বিশ্বাস করার পাত্র নই। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর; কারণ ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করে। (সূরা মুমিনূনঃ ৩৫-৩৯)

পুনরুথানকে তারা অযৌক্তিক মনে করত এবং মরে যাওয়ার পর দেহ মাটি ও হাড়ে পরিণত হয়ে গেলে সেই দেহ যে পুনর্গঠিত হতে পারে, তা তাদের বিশ্বাস হত না। এ কথাকে তারা অসম্ভব বলে বিশ্বাস করত। তাদের মতে, মরা-বাঁচা যা কিছু তা এই দুনিয়ার জীবনেই, এর পর আর কোন জীবন নেই। এখানে এক প্রজন্ম মারা যাবে, অন্য প্রজন্ম আসবে। সৃষ্টিধারা এভাবেই চলতে থাকবে। এটা হল নাস্তিকদের বিশ্বাস। যেমন ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী অনেক মূর্খলোক বলে থাকে যে, মাতৃগর্ভ বের করে দেয় এবং পৃথিবী গ্রাস করে নেয়।

পক্ষান্তরে পুনর্জন্মবাদীরা বিশ্বাস করে যে, তারা মৃত্যুর পর তিন হাজার এক বছর পর আবার এই জগতেই ফিরে আসবে। এ সব ধারণাই অমূলক, কুফরী, মূর্খতা, ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন। এর কোন দলীল-প্রমাণ বা যুক্তি নেই। আদম (আ)-এর সন্তানদের মধ্যকার মূর্খ, জ্ঞানহীন, কাফির, অনাচারী লোকরাই এ জাতীয় আকীদা পোষণ করে থাকে। আল্লাহর বাণীঃ

وَلِتَصْغَىٰ إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوا مَا هُمْ مُقْتَرِفُونَ

অর্থ এবং তারা এ উদ্দেশ্যে প্ররোচিত করে যে, যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাদের মন যেন তার প্রতি অনুরাগী হয় এবং এতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয় আর তারা যে অপকর্ম করে তারা যেন তাই করতে থাকে। (সূরা আনআমঃ ১১৩)

তাদেরকে উপদেশ হিসেবে আল্লাহ বলেনঃ

( أَتَبْنُونَ بِكُلِّ رِيعٍ آيَةً تَعْبَثُونَ * وَتَتَّخِذُونَ مَصَانِعَ لَعَلَّكُمْ تَخْلُدُونَ )

[Surat Ash-Shu'ara 128 - 129]

অর্থ “তোমরা কি প্রতিটি উচ্চস্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছ নিরর্থক? আর তোমরা প্রাসাদ নির্মাণ করছ এ মনে করে যে, তোমরা চিরস্থায়ী হবে?" (সূরা শু'আরাঃ ১২৮-১২৯)

অর্থাৎ তোমরা প্রতিটি উঁচু স্থানে বিরাট বিরাট প্রাসাদোপম সৌধ নির্মাণ করে থাক অথচ বসবাসের জন্যে এসব আড়ম্বরের কোনই প্রয়োজন নেই। যেহেতু তারা সবাই তাঁবুতে বসবাস করত। আল্লাহ বলেনঃ

( أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ * إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ * الَّتِي لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ )

[Surat Al-Fajr 6 - 8]

অর্থাৎ- তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক কি করেছিলেন? আদ বংশের ইরাম গোত্রের প্রতি, যারা অধিকারী ছিল স্তম্ভ বিশিষ্ট সুউচ্চ প্রাসাদের, যার সমতুল্য কোন দেশে নির্মিত হয়নি। (সূরা ফাজরঃ ৬-৮)

অতএব, দেখা যাচ্ছে ‘আদে-ইরাম-ই হল আদে উলা—যারা স্তম্ভের উপর নির্মিত তাঁবুসমূহে বসবাস করত। যাদের ধারণা, ইরাম স্বর্ণ-রৌপ্য নির্মিত একটি ভ্রাম্যমাণ শহর যা দেশ-দেশান্তরে স্থানান্তরিত হয়, তাদের বক্তব্য ভুল ও ভিত্তিহীন। আল্লাহর বাণীঃ و تتخيذون مصاني এর মধ্যে مصاني অর্থ কেউ বলেছেন প্রাসাদ; কেউ বলেছেন গোসলখানার গম্বুজ; কেউ বলেছেন জলাধার।

( وَإِذَا بَطَشْتُمْ بَطَشْتُمْ جَبَّارِينَ * فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ * وَاتَّقُوا الَّذِي أَمَدَّكُمْ بِمَا تَعْلَمُونَ * أَمَدَّكُمْ بِأَنْعَامٍ وَبَنِينَ * وَجَنَّاتٍ وَعُيُونٍ * إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ )

[Surat Ash-Shu'ara 130 - 135]

অর্থ এবং যখন তোমরা আঘাত হান, আঘাত হেনে থাক কঠোরভাবে? তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। ভয় কর তাকে যিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন ঐসব, যা তোমরা জ্ঞাত রয়েছ। তোমাদেরকে দিয়েছেন গবাদি পশু এবং সন্তান-সন্ততি, উদ্যানরাজি ও প্রস্রবণসমূহ; আমি তোমাদের জন্যে আশংকা করি মহা দিবসের শাস্তি। (সূরা শু'আরাঃ ১৩০-১৩৫)

তারা আরো বলেছিলঃ

قَالُوا أَجِئْتَنَا لِنَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا ۖ فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ

অর্থ তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে এই উদ্দেশ্যে এসেছ যে, আমরা যেন শুধু আল্লাহর ইবাদত করি এবং আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ যার ইবাদত করত তা বর্জন করি? সুতরাং তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এস অর্থাৎ তোমার প্রতিশ্রুত শাস্তি নিয়ে এস। (সূরা আ'রাফঃ ৭০)

কেননা আমরা তোমার উপর ঈমান আনি না। তোমার আনুগত্য করব না এবং তোমাকে সত্য বলে বিশ্বাসও করি না। তারা বললঃ

سواء علينا أوعظت املم تكن من الواعظين . إن هذا الأ خلق الأولين . وما نحن بمعدبين

অর্থাৎ তুমি উপদেশ দাও বা নাই দাও, আমাদের ক্ষেত্রে সবই সমান। এসব কথাবার্তা তো পূর্ববর্তী লোকদের অভ্যাস ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। আর আমরা শাস্তি পাবার যোগ্য নই।

خلك শব্দটিকে এখানে অন্য কিরাআত অনুযায়ী যবর যোগে خلق পড়া হয়ে থাকে, তখন তার অর্থ হবে ختلاق অর্থাৎ মনগড়া ব্যাপার—যা তুমি নিয়ে এসেছ তা পূর্ববর্তী কিতাব থেকে ধার করা। বেশ ক’জন সাহাবী ও তাবেয়ী এরূপ তাফসীর করেছেন। পক্ষান্তরে, প্রসিদ্ধ কিরাআত মতে خ ل এর উপর পেশ দিয়ে خلق পড়লে তার অর্থ হবে দীন। অর্থাৎ যে দীনের উপর আমরা আছি তা আমাদের বাপ-দাদা ও পূর্ব-পুরুষদেরই দীন; এ দীন আমরা ত্যাগ করব না। এতে কোন পরিবর্তন আনব না। এর উপরই অটল অবিচল থাকব। এখানে উভয় কিরাআতই তাদের সেই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যাতে তারা বলেছে যে, আমরা শাস্তি প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত নই। নবী জানালেনঃ

قَالَ قَدْ وَقَعَ عَلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ رِجْسٌ وَغَضَبٌ ۖ أَتُجَادِلُونَنِي فِي أَسْمَاءٍ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا نَزَّلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ ۚ فَانْتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُنْتَظِرِينَ

অর্থ সে বলল, তোমাদের প্রতিপালকের শাস্তি ও ক্রোধ তো তোমাদের জন্য নির্ধারিত হয়েই আছে; তবে কি তোমরা আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও এমন কতকগুলো নাম সম্পর্কে যা তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষগণ সৃষ্টি করেছ এবং যে সম্পর্কে আল্লাহ কোন সনদ পাঠাননি? সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি। (সূরা আ'রাফঃ ৭১)

অর্থাৎ এ জাতীয় কথার কারণে তোমরা আল্লাহর শাস্তি ও ক্রোধের পাত্র হয়ে গিয়েছ; এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের মুকাবিলায় তোমরা সেই সব মূর্তির পূজা করছ, যা তোমরা নিজেদের হাতে তৈরি করে নামকরণ করেছ- ইলাহ্ বলে আখ্যায়িত করেছ। আর তোমাদের পূর্ব-পুরুষরাও এই কর্মই করেছে। তোমাদের এরূপ কর্মের কোন দলীল বা ভিত্তি নেই। সুতরাং হক কথা শুনতে ও মানতে যখন অস্বীকার করছ এবং বাতিলের উপর অটল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আর আমার সতর্ক করা না করা যখন সমান হয়ে গেছে, তা হলে এখন তোমরা আল্লাহর আযাব ও শাস্তির অপেক্ষায় থাক যা ঠেকানোর শক্তি কারও নেই। আল্লাহর বাণীঃ

( قَالَ رَبِّ انْصُرْنِي بِمَا كَذَّبُونِ * قَالَ عَمَّا قَلِيلٍ لَيُصْبِحُنَّ نَادِمِينَ * فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ بِالْحَقِّ فَجَعَلْنَاهُمْ غُثَاءً ۚ فَبُعْدًا لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ ) [Surat Al-Mu'minun 39 - 41]

অর্থ সে বললঃ হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সাহায্য কর। কারণ, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে। আল্লাহ বললেন, অচিরেই তারা অবশ্যই অনুতপ্ত হবে। তারপর সত্যি সত্যিই এক বিকট আওয়াজ তাদেরকে আঘাত করল। আর আমি তাদেরকে তরঙ্গ-তাড়িত আবর্জনায় পরিণত করে দিলাম। সুতরাং ধ্বংস হয়ে গেল জালিম সম্প্রদায়। (সূরা মু’মিনূনঃ ৩৯-৪১)

আল্লাহর বাণীঃ

( قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَأْفِكَنَا عَنْ آلِهَتِنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ * قَالَ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَأُبَلِّغُكُمْ مَا أُرْسِلْتُ بِهِ وَلَٰكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ * فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا مُسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوا هَٰذَا عَارِضٌ مُمْطِرُنَا ۚ بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ ۖ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ * تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا فَأَصْبَحُوا لَا يُرَىٰ إِلَّا مَسَاكِنُهُمْ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ )

[Surat Al-Ahqaf 22 - 25]

অর্থাৎ—ওরা বলেছিল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদের দেব-দেবীর পূজা থেকে নিবৃত্ত করতে এসেছ? তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে এস! সে বলল, এর জ্ঞান তো কেবল আল্লাহর নিকট আছে। আমি যা সহ প্রেরিত হয়েছি কেবল তাই তোমাদের নিকট প্রচার করি। কিন্তু আমি দেখছি, তোমরা এক মূঢ় সম্প্রদায়। তারপর যখন ওদের উপত্যকার দিকে মেঘ আসতে দেখল, তখন ওরা বলতে লাগল, এতো মেঘ। আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। (হূদ বলল) বরং এটা তাই যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে। এতে রয়েছে এক ঝড়— মর্মন্তুদ শাস্তিবহ। আল্লাহর নির্দেশে এটা সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। তারপর তাদের পরিণাম হল এই যে, ওদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। অপরাধী সম্প্রদায়কে আমি এমনিভাবে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সূরা আহকাফঃ ২২-২৫)।

আদ জাতির ধ্বংসের সংবাদ আল্লাহ কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করেছেন, যার সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত বিবরণ আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। যেমন আল্লাহর বাণীঃ

فَأَنْجَيْنَاهُ وَالَّذِينَ مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَقَطَعْنَا دَابِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا ۖ وَمَا كَانُوا مُؤْمِنِينَ

অর্থ এর পর তাকে ও তার সংগীদেরকে আমার অনুগ্রহে উদ্ধার করেছিলাম, আর আমার নিদর্শনকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছিল আর যারা মুমিন ছিল না তাদেরকে নির্মূল করেছিলাম। (সূরা আ'রাফঃ ৭২)

অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ

( وَلَمَّا جَاءَ أَمْرُنَا نَجَّيْنَا هُودًا وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ بِرَحْمَةٍ مِنَّا وَنَجَّيْنَاهُمْ مِنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ * وَتِلْكَ عَادٌ ۖ جَحَدُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَعَصَوْا رُسُلَهُ وَاتَّبَعُوا أَمْرَ كُلِّ جَبَّارٍ عَنِيدٍ * وَأُتْبِعُوا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا لَعْنَةً وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ أَلَا إِنَّ عَادًا كَفَرُوا رَبَّهُمْ ۗ أَلَا بُعْدًا لِعَادٍ قَوْمِ هُودٍ )

[Surat Hud 58 - 60]

অর্থ যখন আমার নির্দেশ আসল তখন আমি হুদ(আ) ও তার সংগে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম এবং রক্ষা করলাম তাদেরকে কঠিন শাস্তি থেকে। এই আদ জাতি তাদের প্রতিপালকের নিদর্শন অস্বীকার করেছিল এবং অমান্য করেছিল তার রাসূলগণকে এবং ওরা প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারীর নির্দেশ অনুসরণ করত। এই দুনিয়ায় তাদেরকে করা হয়েছিল লা’নতগ্রস্ত এবং লা’নতগ্রস্ত হবে তারা কিয়ামতের দিনেও। জেনে রেখ! আদ সম্প্রদায় তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করেছিল। জেনে রেখ, ধ্বংসই হল হুদের(আ) সম্প্রদায় আদের পরিণাম। (সূরা হূদঃ ৫৮-৬০)

আল্লাহ আরও বলেনঃ

فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ بِالْحَقِّ فَجَعَلْنَاهُمْ غُثَاءً ۚ فَبُعْدًا لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

অতঃপর সত্যি সত্যিই এক বিকট আওয়াজ তাদেরকে আঘাত করল। আর আমি তাদেরকে তরঙ্গ-তাড়িত আবর্জনা সদৃশ করে দিলাম। (সূরা মু’মিনূনঃ ৪১)

আল্লাহ বলেনঃ

( فَكَذَّبُوهُ فَأَهْلَكْنَاهُمْ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً ۖ وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُمْ مُؤْمِنِينَ * وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ ) [Surat Ash-Shu'ara 139 - 140]

তারপর তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করল, সুতরাং আমি তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। নিশ্চয় এ ঘটনার মধ্যে রয়েছে নিদর্শন—উপদেশ। তাদের অধিকাংশই ঈমানদার ছিল না। আর তোমার প্রতিপালকই অত্যধিক পরাক্রমশালী, দয়াময়। (আস- শুয়ারাঃ ১৩৯-১৪০)

আদ জাতির ধ্বংসের পূর্ণাংগ চিত্র আল্লাহ কুরআনে দিয়েছেন যথাঃ

فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا مُسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوا هَٰذَا عَارِضٌ مُمْطِرُنَا ۚ بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ ۖ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ

অর্থ তারপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে আগত মেঘমালা দেখল, তখন বলল, এই তো মেঘ, আমাদের বৃষ্টি দান করবে। না, বরং ওটা তো তাই যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছ। এ একটা ঝঞ্ঝা-বায়ু, যার মধ্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। (আহকাফঃ ২৪)

এটা ছিল তাদের প্রতি আযাবের সূচনা। তারা দীর্ঘ দিন খরাগ্রস্ত ও দুর্ভিক্ষকবলিত ছিল এবং বৃষ্টির জন্যে অধীর হয়ে উঠেছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে হঠাৎ আকাশের কোণে মেঘ দেখতে পেল। মনে করল—এই তো রহমতের বৃষ্টি আসছে। বস্তুত তা ছিল আযাবের বৃষ্টি। আল্লাহ জানালেন بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ (অর্থাৎ এতো তাই যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছ।) অর্থাৎ শাস্তি আপতিত হওয়ার বিষয়। যেহেতু তারা বলেছিল فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ (তুমি যার ওয়াদা করছ তা নিয়ে আস, যদি সত্যবাদী হও।) এ জাতীয় আয়াত সূরা আ'রাফেও আছে।

এ আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরগণ ও অন্যান্য লেখক ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ইবন যাশশারের বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি এইঃ হূদ (আ)-এর কওমের লোকেরা ঈমান গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে যখন কুফরীর উপর দৃঢ় হয়ে থাকল, তখন আল্লাহ তিন বছর যাবত তাদের উপর বৃষ্টিপাত বন্ধ রাখেন। ফলে তারা দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। ঐ সময়ের নিয়ম ছিল যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিত, তখন তারা মুক্তির জন্যে আল্লাহর নিকট দু’আ করত এবং তা করা হত আল্লাহর ঘরের নিকট হারম শরীফে। সে যুগের মানুষের নিকট এটা ছিল একটি সুবিদিত রেওয়াজ। তখন সেখানে আমালিক জাতি বাস করত আমালিকরা হল আমলীক ই লাওজ ইবন সাম ইবন নূহ (আ)-এর বংশধর। সেকালে তাদের সর্দার ছিল মুআবিয়া ইবন বকর। মু’আবিয়ার মা ছিলেন আদ গোত্র সম্ভূত। তার নাম ছিল জালহাযা বিনত খায়বরী।

আদ সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রায় সত্তরজনের একটি দলকে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করতে হারম শরীফে পাঠায়। মক্কার উপকণ্ঠে মু’আবিয়া ইবন বকরের বাড়িতে গিয়ে তারা ওঠে। মু’আবিয়াও তাদেরকে আতিথ্য দেন। তারা সেখানে এক মাস অবস্থান করে। সেখানে তার মদ পান করত ও মু’আবিয়ার দুই গায়িকার গান শুনত। নিজেদের দেশ থেকে মুআবিয়ার কাছে যেতে তাদের এক মাস সময় লেগেছিল। এদের দীর্ঘদিন অবস্থানের ফলে আপন লোকদের দুর্গতির কথা ভেবে মু’আবিয়ার মনে করুণা হয় অথচ তাদেরকে ফিরে যাওয়ার কথা বলতেও তিনি সঙ্কোচ বোধ করেন। তাই তিনি একটি কবিতা রচনা করে তাদেরকে দেন এবং গানের মাধ্যমে তা শুনাবার জন্যে গায়িকাদেরকেও নির্দেশ দেন। কবিতাটিতে তিনি আদ জাতির ধরাজনিত দুরবস্থার বর্ণনা দিয়ে প্রতিনিধিদলকে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্যে অভিযুক্ত করে তাদেরকে তাদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করেন।

তখন দলের সবাই তাদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হল। সুতরাং সকলে হারম শরীফে গিয়ে উপস্থিত হল এবং গোত্রের লোকদের জন্যে দু’আ করতে লাগল। দু’আ পরিচালনা করল কায়ল ইবন আনায। তখন আল্লাহ সাদা, লাল ও কাল তিন ধরনের মেঘ সৃষ্টি করলেন। পরে আকাশ থেকে এ মর্মে ঘোষণা শোনা গেলঃ কায়ল! এই মেঘগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একটি তোমার নিজের এবং তোমার গোত্রের লোকের জন্যে বেছে নাও। কায়ল বলল, আমি কালটা বেছে নিলাম। কেননা কাল মেঘে বৃষ্টি বেশি হয়। পুনরায় গায়বী আওয়াজে তাকে জানান হল, তুমি ছাই-ভস্ম পছন্দ করেছ—ধ্বংসটাকে বাছাই করে নিয়েছ। এ মেঘ আদ গোত্রের কাউকে রেহাই দেবে না; পিতা-পুত্র কাউকেই ছাড়বে না। এটা বনু লূদিয়া ছাড়া সবাইকে ধ্বংস করবে। বনু লূদিয়া আদ গোত্রেরই একটি শাখা। এরা মক্কায় বসবাস করত। তারা এ আযাবের আওতায় পড়েনি। মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, দ্বিতীয় আদ বা ছামূদ জাতি এদেরই বংশধর। তারপর কায়ল ইবন আনায যে কাল মেঘটি পছন্দ করেছিল, আল্লাহ তা আদ গোত্রের দিকে প্রেরণ করেন। মেঘ মুগীছ নামক উপত্যকায় পৌছলে তা লোকদের দৃষ্টিগোচর হয়। মেঘ দেখেই তারা একে অপরকে আনন্দ বার্তা পৌঁছাতে থাকে যে, এই তো মেঘ এসে গেছে, এখনই বৃষ্টি হবে। আল্লাহ বলেনঃ

بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ ۖ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ * تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا

[Surat Al-Ahqaf 24 - 25]

অর্থ বরং এটা তো তাই যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা একটা ঝঞ্ঝা। এর মধ্যে আছে মর্মন্তুদ শাস্তি। তার প্রতিপালকের নির্দেশে তা সবকিছুকে ধ্বংস করে ফেলবে। (সূরা আহকাফঃ ২৪-২৫)

অর্থাৎ যেসব জিনিসকে ধ্বংস করার নির্দেশ আসবে তা সেসব জিনিসকেই ধ্বংস করবে। এ মেঘ যে আসলে একটি ঝঞ্ঝা-বায়ু এবং তার মধ্যে শাস্তি লুকিয়ে আছে, তা সর্ব প্রথম ফাহদ নাম্মী আদ গোত্রীয় এক মহিলার চোখে ধরা পড়ে। তা স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েই সে চীৎকার করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। চেতনা ফিরে আসার পর লোকজন জিজ্ঞেস করল, “ফাহদ! তুমি কি দেখেছিলে? সে বলল, দেখলাম একটা ঝাড়-বায়ু, তার মধ্যে যেন অগ্নিশিখা জ্বলছে। তার অগ্রভাগে কয়েকজন লোক তা ধরে টেনে আনছে।” তারপর তাদের উপর সে আযাব একটানা সাতরাত ও আটদিন যাবত অব্যাহত রাখেন। চিরদিনের জন্যে তারা সমূলে উৎখাত হয়ে যায়। তাদের একজন লোকও অবশিষ্ট রইলো না। হূদ (আ) মু’মিনদেরকে সংগে নিয়ে একটি প্রাচীর বেষ্টিত স্থানে চলে যান। এ ঝড়ের আঘাতে তাদেরকে স্পর্শ করেনি। বরং সে বাতাসের স্পর্শে তাদের ত্বক আরো কোমলতা লাভ করে এবং তাদের মনে ফুর্তি আসে। অথচ ঝাড়-বায়ু আদ সম্প্রদায়ের উপরে আসমান-যমীন জুড়ে আঘাত হানছিল এবং পাথর নিক্ষেপ করে তাদেরকে বিনাশ করছিল। ইবন ইসহাক (র) এ ঘটনা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (র) তার মুসনাদ গ্রন্থে হারিছ ইবন হাসান (র) মতান্তরে হারিছ ইবন য়াযীদ আল-বকরী (র) সূত্রে এ ঘটনার অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন। হারিছ বলেন, আমি একদা 'আলা ইবন হাযরামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্যে রাসূল (সা)-এর দরবারে রওয়ানা হই। পথে রাবযা নামক স্থানে বনু তামীমের পথহারা এক বৃদ্ধাকে, একাকী অবস্থায় দেখতে পাই। আমাকে দেখে সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমি একটি কাজে রাসূলুল্লাহর কাছে যেতে চাই, আমাকে আপনি তার নিকট পৌঁছিয়ে দেবেন? হারিছ বলেন, আমি বৃদ্ধা মহিলাটিকে নিয়ে মদীনায় এসে পৌঁছলাম। মসজিদে পৌঁছে দেখি, লোকে-লোকারণ্য। মধ্যে একটি কাল পতাকা দুলছে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্মুখে বিলাল (রা) একটি কোষবদ্ধ তলোয়ার হাতে দণ্ডায়মান। আমি জানতে চাইলাম, ব্যাপার কী? লোকজন জানাল, রাসূলুল্লাহ (সা) আমর ইবনুল আস (রা)-কে অভিযানে পাঠাতে যাচ্ছেন। রাবী বলেন, আমি তখন বসে পড়লাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে নবী করীম (সা) তাঁর ঘরে বা হাওদায় প্রবেশ করেন। আমি তখন তার নিকট যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করি। তিনি অনুমতি দিলেন। ভিতরে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে সালাম জানালাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের (বনু বকরের) মধ্যে ও বনু তামীমের মধ্যে কিছু ঘটেছে না কি? আমি বললাম— জী হ্যাঁ, তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আসার পথে আমি বনু তামীমের এক বৃদ্ধা মহিলাকে একাকী দেখতে পাই। সে তাকে আপনার নিকট নিয়ে আসার জন্যে আমাকে অনুরোধ জানায়। এখন সে এই দরজার কাছেই আছে। রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলেন। যখন সে ভিতরে প্রবেশ করল, তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যদি আমাদের ও বনু তামীমের মধ্যে কোন সীমারেখা নির্ধারণ করে দিতে চান, তাহলে প্রান্তরকেই সীমা সাব্যস্ত করে দিন। কেননা এটা আমাদেরই ছিল। হারিছ বলেন, বৃদ্ধা মহিলাটি তখন তার স্বগোত্রের পক্ষে সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে ওঠেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! তবে আপনার মুযার গোত্রকে কোথায় নিয়ে ঠেকাচ্ছেন? হারিছ বলেন, আমি তখন বললাম, আমার দৃষ্টান্তটা হচ্ছে পুরাকালের সেই প্রবাদের মত, যাতে বলা হয়েছেঃ ছাগলটি তার মৃত্যু ডেকে এনেছে। এই মহিলাকে আমিই উঠিয়ে নিয়ে এনেছি, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, সে আমার শত্রুপক্ষ। আমি আল্লাহ ও আঁর রাসূলের স্বরণ চাই, যেন আমি আদ গোত্রের প্রতিনিধির মত না হই।

রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, সে আবার কী? আদ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দলের কী হয়েছিল? তিনি এ সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কিছুটা রস আস্বাদন করতে চান। হারিছ বললেন, ‘আদ সম্প্রদায় একবার দুর্ভিক্ষে পতিত হয়। তখন কায়ল নামক জনৈক সর্দারকে তাদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি করে পাঠায়। কায়ল মু’আবিয়া ইবন বকরের নিকট গিয়ে সেখানে একমাস পর্যন্ত অবস্থান করে। সেখানে সে মদপান করত এবং জারাদাতান নাম্নী মু’আবিয়ার দুটি দাসী তাকে গান শুনাত। এভাবে একমাস কেটে যাবার পর সে তিহামার এক পর্বতে গিয়ে দু’আ করল, হে আল্লাহ! আপনি জানেন, আমি কোন রোগীর চিকিৎসার জন্যে কিংবা কোন কয়েদীকে মুক্ত করার জন্যে আসিনি। হে আল্লাহ! আদ জাতিকে আপনি বৃষ্টি দান করুন, যা আপনার মর্জি হয়। তখন আকাশে কয়েকটি কাল মেঘখণ্ড দেখা দেয়। মেঘের মধ্য থেকে আওয়াজ এল, এর মধ্য থেকে যে কোন একটি তুমি বেছে নাও! সে একটি ঘন কাল মেঘখণ্ডের দিকে ইংগিত করল। তখন মেঘের মধ্য থেকে আওয়াজ এল, নাও, ছাই-ভস্ম ও বন্যা। আদ সম্প্রদায়ের একজন লোককেও তা অবশিষ্ট রাখবে না। রাবী বলেনঃ আমি যদ্দুর জানতে পেরেছি, আমার হাতের এ আংটির ফাঁক দিয়ে যতটুকু বায়ু প্রবাহিত হতে পারে, ততটুকু বায়ুই কেবল প্রেরিত হয়ে আদ সম্প্রদায়কে নির্মূল করে দেয়। এ বর্ণনার একজন রাবী আবু ওয়াইল বলেন, বিবরণটি যথার্থ।

পরবর্তীকালে আরবের কোন নারী বা পুরুষ কোথাও কোন প্রতিনিধি প্রেরণ করলে বলে দিত—তোমরা আদ জাতির প্রতিনিধিদের মত হয়ো না যেন। এ হাদীছ ইমাম তিরমিযী (র) যায়দ ইবনুল হুবাব সূত্রে এবং ইমাম নাসাঈ আসিম ইবন বাহদালা সূত্রে বর্ণনা করেছেন এবং এই একই সূত্রে ইবন মাজাহও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবন জারীর প্রমুখ মুফাসসির আদ জাতির আলোচনাকালে এ ঘটনার এবং এ হাদীসের উল্লেখ করেছেন। আদে আখির বা দ্বিতীয় আদের ধ্বংসের বর্ণনায়ও এই কাহিনীটির উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কয়েকটি দিক বিবেচনা করলে এ মতের সমর্থন মেলে। যথাঃ (১) ইবন ইসহাক প্রমুখ ঐতিহাসিক এ ঘটনার বর্ণনায় মক্কার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ হযরত ইবরাহীম (আ), বিবি হাজেরা ও ইসমাঈল (আ)-কে মক্কায় অভিবাসিত করার পূর্বে মক্কা শহরের প্রতিষ্ঠাই হয়নি।

তারপর জুরহুম গোত্র এসে সেখানে বসতি স্থাপন করে যা পরে বর্ণিত হবে। আর প্রথম আদ হচ্ছে ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বেকার জাতি। (২) এই ঘটনায় মু’আবিয়া ইবন বকর ও তার কবিতার উল্লেখ আছে। এই কবিতাটি প্রথম আদের পরবর্তী যুগে রচিত। প্রাচীন যুগের লোকের ভাষার সাথে এর কোন মিল নেই। (৩) এই ঘটনার মধ্যে যে মেঘের কথা এসেছে তাতে অগ্নি শিখার উল্লেখ রয়েছে। আর প্রথম আদের ধ্বংসের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে بريح صرصر عالية ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস প্রমুখ তাবিঈ ইমামগণ বলেছেন صرصر - অর্থ ঠাণ্ডা এবং عاتية - অর্থ তীব্র।

আল্লাহর বাণী-

( سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ حُسُومًا

[Surat Al-Haqqah 7]

অর্থাৎ—পূর্ণ সাতরাত ও আটদিন এটা তাদের উপর অব্যাহতভাবে চাপিয়ে রাখা হয়। কারও মতে, এ আযাব শুরু হয়েছিল শুক্রবারে; কারও মতে বুধবারে।

আল্লাহর বাণীঃ

فَتَرَى الْقَوْمَ فِيهَا صَرْعَىٰ كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ )

[Surat Al-Haqqah 7]

অর্থ তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখতে, তারা সেখানে লুটিয়ে পড়ে আছে সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খেজুর কাণ্ডের মত। (সূরা হাক্কাঃ ৭)।

খেজুর গাছের মাথাবিহীন কাণ্ডের সাথে তাদের অবস্থার তুলনা করা হয়েছে। কেননা, প্রবল বায়ু এসে তাদেরকে শূন্যে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে মাথা নিচের দিকে করে নিক্ষেপ করে। ফলে মাথা ভেংগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে কেবল মাথাহীন দেহটি পড়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

( إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي يَوْمِ نَحْسٍ مُسْتَمِرٍّ * تَنْزِعُ النَّاسَ كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ مُنْقَعِرٍ ) [Surat Al-Qamar 19 - 20]

অর্থ (আমি তাদের উপর প্রেরণ করেছিলাম ঝঞ্ঝা-বায়ু নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের দিনে) অর্থাৎ এমন এক দিনে তাদের উপর ঝঞ্ঝা-বায়ু পাঠাই যা তাদের জন্যে দুর্ভাগ্য নিয়ে আসে এবং আযাব অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।

যা মানুষকে উৎখাত করেছিল খেজুরের কাণ্ডের মত। (সূরা কামারঃ ১৯-২০) যারা বলে থাকেন বুধবার হল চির দুর্ভাগ্যের দিন। আর এই ধারণা থেকেই তারা বুধবারকে অশুভ দিন বলে অভিহিত করে থাকেন। এটা তাদের ভুল ধারণা এবং এটা কুরআনের মর্মের পরিপন্থী। কেননা অপর আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ

فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ

[Surat Fussilat 16]

অর্থাৎ—“আমি তাদের উপর ঝঞ্ঝা-বায়ু প্রেরণ করি কয়েকটি অশুভ দিনে।” (সূরা হা-মীম আস-সাজদাঃ ১৬) এটা সুবিদিত যে, পর পর আটদিন পর্যন্ত এ ঝঞ্ঝা-বায়ু স্থায়ী থাকে। যদি দিনগুলোই অশুভ হত তাহলে সপ্তাহের সমস্ত দিনগুলোই অশুভ প্রতিপন্ন হয়ে যায়। কিন্তু এমন কথা কেউ-ই বলেনি। সুতরাং এখানে نحسات عليهم অর্থ হচ্ছে ঐ দিনগুলো তাদের জন্যে অশুভ ছিল।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَفِي عَادٍ إِذْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الرِّيحَ الْعَقِيمَ )

[Surat Adh-Dhariyat 41]

অর্থ (আর নিদর্শন রয়েছে আদ জাতির ঘটনায়, যখন আমি তাদের উপর অকল্যাণকর বায়ু প্রেরণ করলাম।) (সূরা যারিয়াতঃ ৪১) অর্থাৎ এমন বায়ু যা কোন মঙ্গল বয়ে আনে না। কেননা যে বায়ু মেঘ উৎপাদন করতে পারে, আর না গাছপালাকে ফলবান করতে পারে। তা তো বন্ধ্যাই বটে। তাতে কোন কল্যাণ নিহিত নাই। এ কারণেই আল্লাহ বলেছেনঃ

( مَا تَذَرُ مِنْ شَيْءٍ أَتَتْ عَلَيْهِ إِلَّا جَعَلَتْهُ كَالرَّمِيمِ )

[Surat Adh-Dhariyat 42]

যা কিছুর উপর দিয়েই তা প্রবাহিত হয়েছে তাকেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। (সূরা যারিয়াতঃ ৪২)। অর্থাৎ সম্পূর্ণ জীর্ণ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বস্তুর মত করে দিয়েছি যার দ্বারা কোনরকম কল্যাণ আশা করা যায় না।

বুখারী ও মুসলিমে হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ আমাকে পূবালী বায়ু দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে। আর আদ জাতিকে পেছন দিক থেকে আসা বায়ু দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَاذْكُرْ أَخَا عَادٍ إِذْ أَنْذَرَ قَوْمَهُ بِالْأَحْقَافِ وَقَدْ خَلَتِ النُّذُرُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ ) [Surat Al-Ahqaf 21]

অর্থ আদ জাতি-এর কাহিনী স্মরণ কর। আর এ রকম সতর্ককারী লোক তার পূর্বে ও পরে আগমন করেছিল, যখন সে উচ্চ উপত্যকায় নিজ জাতির জনগণকে এ মর্মে সতর্ক করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না। আমি তোমাদের উপর এক মহাদিবসের শাস্তির আশংকা বোধ করছি। (সূরা আহকাফঃ ২১)

এসব আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এই আদ হল প্রথম আদ জাতি। কেননা, এদের প্রাসংগিক অবস্থা হূদের সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অবশ্য এ সম্ভাবনাও কিছুটা আছে যে, উপরোক্ত ঘটনায় যে জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা হল দ্বিতীয় ‘আদ। এ মতের কিছু দলীল-প্রমাণ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া হযরত আয়েশা (রা) থেকে একখানা হাদীসও এ মর্মে বর্ণিত হযেছে— যা আমরা পরে উল্লেখ করব। আর আল্লাহর বাণীঃ

( فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا مُسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوا هَٰذَا عَارِضٌ مُمْطِرُنَا

অর্থ তারা যখন তাদের উপত্যকা অভিমুখী মেঘ দেখতে পেল তখন সবাই বলতে লাগল, এই তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। (সূরা আহকাফঃ ২৪)

কারণ, ‘আদ জাতির লোকেরা আকাশে যখন মেঘের মত একটি আবরণ দেখতে পেল, তখন তাকে বৃষ্টি দানকারী মেঘ বলেই ধারণা করল; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সেটা ছিল আযাবের মেঘ। তারা এটাকে রহমত বলে বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু আসলে তা ছিল শাস্তি। তারা আশা করেছিল, এতে রয়েছে কল্যাণ। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা পেল চূড়ান্ত পর্যায়ের অকল্যাণ। আল্লাহ বলেন, بل هو ما استعجلتم به বরং এটা হল ঐ জিনিস যা তোমরা তাড়াতাড়ি কামনা করছিলে অর্থাৎ আযাব। এরপর তার ব্যাখ্যা দেনঃ ريح فيها عذاب اليم অর্থাৎ এটা হল একটা ঝঞ্ঝা-বায়ু, এর মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।

এখানে আযাবের ব্যাখ্যা দু’রকম হতে পারে; এক. আযাব বলতে সেই প্রবল বেগে বয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা ঝঞ্ঝা-বায়ু বুঝানো হয়েছে যা তাদের উপর পতিত হয়েছিল এবং সাতরাত ও আটদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ফলে একজন লোকও বেঁচে থাকতে পারেনি। পাহাড়ে গর্ত-গুহায় প্রবেশ করে সেখান থেকেও তাদেরকে বের করে ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপর শক্ত ও সুদৃঢ় প্রাসাদসমূহ ভেংগে তাদের লাশের উপর স্তুপ করে রেখেছে। তারা নিজেদের শক্তির অহংকারে মত্ত হয়ে বলে বেড়াত—“আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আবার কে?' ফলে আল্লাহ তাদের উপর সেই জিনিস চাপিয়ে দেন, যা তাদের থেকে অধিক শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান। আর তা হল অশুভ বাতাস। দুই. এমনও হতে পারে যে, এই বাতাস শেষ পর্যায়ে কিছু মেঘ উৎপন্ন করে। তখন যারা মোটামুটি বেঁচেছিল তারা বলাবলি করছিল, এই মেঘের মধ্যে রহমত নিহিত রয়েছে এবং তা বেঁচে থাকা লোকদের রক্ষা করার জন্যে এসেছে। তখন আল্লাহ তাদের উপর আগুনের। লেলিহান শিখা প্রেরণ করেন। একাধিক মুফাসির এরূপও ব্যাখ্যা করেছেন। এরূপ অবস্থা মাদয়ানবাসীদেরও হয়েছিল। প্রথমে ঠাণ্ডা বায়ু ও পরে আগুন দ্বারা তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। (সূরা মু’মিনূনে উল্লেখিত) বিকট আওয়াজসহ এরূপ বিভিন্ন বিপরীতধর্মী বস্তু দ্বারা শাস্তিদানই নিঃসন্দেহে কঠিনতম শাস্তি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ইবন আবী হাতিম ইবন উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে বাতাসে ‘আদ জাতি ধ্বংস হয়েছিল তা ছিল একটি আংটি পরিমাণ স্থান দিয়ে নির্গত বায়ু মাত্র— যে টুকু আল্লাহ তাদের জন্যে খুলে দিয়েছিলেন। সে বায়ু খণ্ডটিই উপত্যকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং তথাকার লোকজন, জীব-জন্তু ও ধন-সম্পদ, আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী শূন্যে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ বায়ু দেখেই কওমে আদের শহরবাসীরা বলে উঠলঃ هذا عارض ممطر نا এইতো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে। কিন্তু বাতাস তখন উপত্যকার মানুষ ও জীব-জন্তুগুলোকে শহরবাসীদের উপর ফেলে দেয়। তাবারানী ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ কওমে আদের উপর একটি আংটির সমপরিমাণ বাতাস উন্মুক্ত করে দেন। তা প্রথমে উপত্যকা ও পরে শহর এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত করেন। শহরবাসী তা দেখে বলল, هذا عارض ممطرنا مستقبل اوديتنا এই তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে— যা আমাদের উপত্যকার দিকে এগিয়ে আসছে। সেখানে ছিল পল্লী এলাকার অধিবাসিগণ। তখন উপত্যকাবাসীদেরকে উপর থেকে নিচে শহরবাসীদের উপর নিক্ষেপ করা হয়। ফলে সকলেই ধ্বংস হয়ে যায়। ইবন আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেছেন, তাদের অহংকারী ধন-ভাণ্ডার দ্বারপ্রান্তে বের হয়ে আসে।

وما فتح الله على عاد من الريح الامثل موضع الخاتم فمرت باهل البادية فحملتهم و مواشيهم وأموالهم بين السماء والارض - فلما رای ذالك اهل الحاضرة من عاد الريح وما فيها قالوا هذا عارض ممطرنا .

উল্লেখিত হাদীসের নিম্নরূপ সমালোচনা করা হয়েছে (১) এ হাদীস মারফু হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে; (২) হাদীসের এক রাবী মুসলিম আল-মালাঈর ব্যাপারে মতভেদ আছে; (৩) হাদীসটি মুতারাব পর্যায়ের। আল্লাহই সর্বজ্ঞ; (৪) আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, 'আদ জাতি’ আকাশে সুস্পষ্ট মেঘের ঘনঘটা দেখেছিল। ( فلما رأوه عارضتا ) পক্ষান্তরে, এ হাদীসকে যদি উক্ত আয়াতের তাফসীরস্বরূপ ধরা হয়, তাহলে আয়াতের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়। কেননা, হাদীসে অতি সামান্য (আংটি বরাবর) মেঘের কথা বলা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীস উক্ত বিষয়টিকে আরও সুস্পষ্ট করে দেয়। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, যখন তীব্র গতিতে বাতাস বইত তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) এই দু’আ পড়তেনঃ

اللهم انی اسئلك خيرها وخير ما فيما وخير ما ارسلت به واعوذبك من شرها وشر ما فيها وشرما ارسلت به .

অর্থ হে আল্লাহ! আপনার নিকট এর মধ্যে যা কিছু কল্যাণ নিহিত আছে এবং এ বায়ুর সাথে যে কল্যাণ প্রেরিত হয়েছে আমি আপনার নিকট তাই প্রার্থনা করি। এ বায়ুতে যে অনিষ্ট নিহিত আছে এবং এ বায়ুর সাথে যে অনিষ্ট প্রেরিত হয়েছে তা থেকে পানাহ চাই। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আকাশ যখন মেঘে ছেয়ে যেতো তখন তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো। তিনি একবার ঘরে প্রবেশ করতেন আবার বের হয়ে যেতেন। একবার সম্মুখে যেতেন আবার পিছনে আসতেন। যখন বৃষ্টি নামতো তখন তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেত। হযরত আয়েশা (রা) এ পরিবর্তন লক্ষ্য করেন এবং এর কারণ কি তা জিজ্ঞেস করেন। জবাবে তিনি বলেন, হে আয়েশা! এটা সেরূপ মেঘও তো হতে পারে যা দেখে আদ জাতি বলেছিলঃ

فلما راوه عارضا مستقبل اوديتهم قالوا هذا عارض ممطرنا .

উপত্যকার দিকে আগত মেঘমালা দেখে তারা বলল, এই তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করবে। তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ (র) ইবন জুরায়য (র) থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ (র) ও হযরত আয়েশা (রা) থেকে হাদীসটি ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে কখনও মুখগহবর দেখা যায় এমন পরিপূর্ণ হাসি হাসতে দেখিনি; বরং তিনি সর্বদা মুচকি হাসতেন। যখন তিনি মেঘ কিংবা ঝড়ো বাতাস দেখতেন, তখন তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অন্য লোকেরা মেঘ দেখে বৃষ্টির আশায় আনন্দিত হয়। অথচ আমি দেখছি, মেঘ দেখলে আপনার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হে আয়েশা! এর মধ্যে কোন আযাব রয়েছে কিনা—সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। নূহ (আ)-এর সম্প্রদায়কে বায়ু দ্বারা আযাব দেয়া হয়েছে। অন্য আর এক সম্প্রদায় আযাব দেখে বলেছিল,

هذا عارض ممطرنا

(এই তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে।)

এই হাদীস থেকে অনেকটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ঘটনা মূলত দুইটি। পূর্বেই আমি এদিকে ইংগিত দিয়েছি। সুতরাং এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী সূরা আহকাফের ঘটনাটি হবে দ্বিতীয় আদ সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং কুরআনের অন্যান্য আয়াতের বর্ণনা প্রথম আদ সম্পর্কে। অনুরূপ হাদীস ইমাম মুসলিম (র) হারূন ইবন মা'রাফ থেকে এবং ইমাম বুখারী (র) ও আবু দাউদ (র) ইবন ওহাব (র) থেকে বর্ণনা করেছেন।

হূদ (আ)-এর হজ্জ সংক্রান্ত বর্ণনা হযরত নূহ (আ)-এর আলোচনা প্রসঙ্গে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত হূদ (আ)-এর কবর ইয়ামান দেশে অবস্থিত কিন্তু অন্যরা বলেছেন, তাঁর কবর দামেশকে। দামেশকের জামে মসজিদের সম্মুখ প্রাচীরের একটি নির্দিষ্ট স্থান সম্পর্কে কোন কোন লোকের ধারণা যে, এটা হযরত হূদ (আ)-এর কবর।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন