hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১ম খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৬৬
মূসা কালীমুল্লাহ্‌ (আ)-এর বিবরণ
তিনি হচ্ছেন মূসা ইব্‌ন ইমরান ইব্‌ন কাহিছ ইব্‌ন আযির ইব্‌ন লাওয়ী ইব্‌ন ইয়াকূব ইব্‌ন ইসহাক ইব্‌ন ইবরাহীম (আ)। আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনুল করীমের বিভিন্ন জায়গায় সংক্ষেপে ও বিস্তারিতভাবে মূসা (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর বর্ণনাকালে তাফসীরের কিতাবে আমি তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। এখানে মূসা (আ)-এর ঘটনার আদ্যোপান্ত কিতাব ও সুন্নতের আলোকে আমি বর্ণনা করতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ইসরাঈলী বর্ণনাসমূহ থেকে এ সম্পর্কে যে সব বর্ণনা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং আমাদের পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামও এগুলো বর্ণনা করেছেন তা এখানে পেশ করব।

আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

( وَٱذۡكُرۡ فِی ٱلۡكِتَـٰبِ مُوسَىٰۤۚ إِنَّهُۥ كَانَ مُخۡلَص ا وَكَانَ رَسُول ا نَّبِیّ ا ۝ وَنَـٰدَیۡنَـٰهُ مِن جَانِبِ ٱلطُّورِ ٱلۡأَیۡمَنِ وَقَرَّبۡنَـٰهُ نَجِیّ ا ۝ وَوَهَبۡنَا لَهُۥ مِن رَّحۡمَتِنَاۤ أَخَاهُ هَـٰرُونَ نَبِیّ ࣰا) [Surat Maryam 51 – 53]

অর্থাৎ–স্মরণ কর, এ কিতাবে উল্লেখিত মূসার কথা, সে ছিল বিশুদ্ধচিত্ত এবং সে ছিল রাসূল ও নবী। তাকে আমি অহ্বান করেছিলাম তুর পর্বতের দক্ষিণ দিক হতে এবং আমি অন্তরংগ আলাপে তাকে নৈকট্যদান করেছিলাম। আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভাই হারূনকে নবীরূপে। (সূরা মরিয়মঃ ৫১-৫৩) আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

طٰسٓمّٓ ﴿۱﴾ تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ ﴿۲﴾ نَتۡلُوۡا عَلَیۡکَ مِنۡ نَّبَاِ مُوۡسٰی وَ فِرۡعَوۡنَ بِالۡحَقِّ لِقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿۳﴾ اِنَّ فِرۡعَوۡنَ عَلَا فِی الۡاَرۡضِ وَ جَعَلَ اَہۡلَہَا شِیَعًا یَّسۡتَضۡعِفُ طَآئِفَۃً مِّنۡہُمۡ یُذَبِّحُ اَبۡنَآءَہُمۡ وَ یَسۡتَحۡیٖ نِسَآءَہُمۡ ؕ اِنَّہٗ کَانَ مِنَ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۴﴾ وَ نُرِیۡدُ اَنۡ نَّمُنَّ عَلَی الَّذِیۡنَ اسۡتُضۡعِفُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ نَجۡعَلَہُمۡ اَئِمَّۃً وَّ نَجۡعَلَہُمُ الۡوٰرِثِیۡنَ ۙ ﴿۵﴾ وَ نُمَکِّنَ لَہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ وَ نُرِیَ فِرۡعَوۡنَ وَ ہَامٰنَ وَ جُنُوۡدَہُمَا مِنۡہُمۡ مَّا کَانُوۡا یَحۡذَرُوۡنَ ﴿۶﴾

অর্থাৎ–ত্বাসীন মীম; এই আয়াতগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি তোমার নিকট মূসা ও ফিরআউনের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে বিবৃত করছি মুমিন সম্প্রদায়ের উদ্দেশে। ফিরআউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানকার অধিবাসীবৃন্দকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করেছিল। ওদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত থাকতে দিত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্বদান করতে ও উত্তরাধিকারী করতে এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে। ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে যা ওদের নিকট তারা আশঙ্কা করতো। (সূরা কাসাসঃ ১-৬)

সুরায়ে মরিয়মে মূসা (আ)-এর ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করে সূরায়ে কাসাসে কিছুটা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। এখানে মূসা (আ) ও ফিরআউনের ঘটনা যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন যেন এর শ্রোতা ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী। ফিরআউন দেশে (মিসরে) পরাক্রমশালী হয়েছিল; স্বৈরাচারী হয়েছিল এবং নাফরমান ও বিদ্রোহী হয়েছিল, পার্থিব জগতকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল; মহা পরাক্রমশালী প্রতিপালক আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল। আবার তাদের মধ্য থেকে একশ্রেণী (বনী ইসরাঈল)-কে হীনবল করেছিল; তারা ছিলেন বনী ইসরাঈলের একটি দল এবং এঁরা ছিলেন আল্লাহর নবী ইয়াকূব ইব্‌ন ইসহাক ইব্‌ন ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্ (আ)-এর বংশধর। সেই যামানায় তারাই ছিলেন পৃথিবীর সর্বোত্তম অধিবাসী। আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর এমন এক বাদশাহকে আধিপত্য দান করেছিলেন যে ছিল জালিম, অত্যাচারী, কাফির ও দুশ্চরিত্র। সে তাদেরকে তার দাসত্ব ও সেবায় নিয়োজিত রাখতো এবং তাদেরকে নিকৃষ্টতম কাজকর্ম ও পেশায় নিয়োজিত থাকতে বাধ্য করত। উপরন্তু সে তাদের পুত্রদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত রাখত। সে ছিল একজন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। তার এই অমানবিক কর্মকাণ্ডের পটভূমি হচ্ছে নিম্নরূপঃ

বনী ইসরাঈলগণ ইবরাহীম (আ) হতে প্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। যে বংশধর থেকে এমন এক যুবকের আবির্ভাব ঘটবে যার হাতে মিসরের বাদশাহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর এটা এজন্য যে, মিসরের তৎকালীন বাদশাহ্ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর স্ত্রী হযরত সারাহ্-এর সম্ভ্রম নষ্ট করতে মনস্থ করেছিল কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সম্ভ্রম রক্ষা করেন। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত। এ সুসংবাদটি বনী ইসরাঈলের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিবতীরা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত। ধীরে ধীরে তা ফিরআউনের কানে যায়। সুতরাং তার কোন পরামর্শদাতা কিংবা পারিষদ রাত্রিকালীন গল্পচ্ছলে এ প্রসঙ্গটি তুলে। তখন বাদশাহ বনী ইসরাঈলের পুত্রগণকে হত্যার নির্দেশ দিল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে?

সুদ্দী (র) ইব্‌ন আব্বাস, ইব্‌ন মাসউদ (রা) ও প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণনা করেন, একদিন ফিরআউন স্বপ্নে দেখল, যেন একটি অগ্নিশিখা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে এসে মিসরের বাড়ি-ঘর ও কিবতীদের সকলকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিল, কিন্তু মিসরে বসবাসরত বনী ইসরাঈলের কোন ক্ষতি করল না। ফিরআউন জেগে উঠে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। জ্যোতিষী ও জাদুকরদেরকে সমবেত করল এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইল। তারা তখন বলল, এই যুবক বনী ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করবে এবং তারই হাতে মিসরবাসী ধ্বংস হবে। এ কারণেই ফিরআউন বনী ইসরাঈলের পুত্রগণকে হত্যা করতে এবং নারীদের জীবিত রাখতে নির্দেশ দিল। এই জন্যেই আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন, আমি ইচ্ছা করলাম, সে দেশে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে; তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও দেশের অধিকারী করতে; এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে, আর ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা এদের নিকট তারা আশঙ্কা করত। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে হীনবল করা হয়েছিল। আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতিশ্রুতি হচ্ছে যে, তিনি শিগগিরই হীনবলকে শক্তিশালী করবেন, পরাভূতকে বিজয়ী করবেন এবং অবনমিতকে শক্তিমান করবেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সবকিছুই বনী ইসরাঈলের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ اَوۡرَثۡنَا الۡقَوۡمَ الَّذِیۡنَ کَانُوۡا یُسۡتَضۡعَفُوۡنَ مَشَارِقَ الۡاَرۡضِ وَ مَغَارِبَہَا الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا ؕ وَ تَمَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ الۡحُسۡنٰی عَلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ بِمَا صَبَرُوۡا ؕ وَ دَمَّرۡنَا مَا کَانَ یَصۡنَعُ فِرۡعَوۡنُ وَ قَوۡمُہٗ وَ مَا کَانُوۡا یَعۡرِشُوۡنَ ﴿۱۳۷﴾

অর্থাৎ–যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হত তাদেরকে আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি; এবং বনী ইসরাঈল সমন্ধে তোমার প্রতিপালকের শুভ বাণী সত্যে পরিণত হল যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। (সূরা আরাফঃ ১৩৭)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ

وَّ زُرُوۡعٍ وَّ مَقَامٍ کَرِیۡمٍ ﴿ۙ ۲۶﴾ وَّ نَعۡمَۃٍ کَانُوۡا فِیۡہَا فٰکِہِیۡنَ ﴿ۙ ۲۷﴾ کَذٰلِکَ وَ اَوۡرَثۡنٰہَا قَوۡمًا اٰخَرِیۡنَ ﴿۲۸﴾

অর্থাৎ–তারা পশ্চাতে রেখে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ, কত বিলাস উপকরণ, যা তাদের আনন্দ দিত এরূপই ঘটেছিল এবং আমি এই সমুদয়ের উত্তরাধিকারী করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। (সূরা দুখানঃ ২৫-২৮) অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে। এ সম্বন্ধে অন্যত্র আরো বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ্। মোটকথা, ফিরআউন সম্ভাব্য সবরকম সতর্কতা অবলম্বন করল যাতে মূসা (আ) দুনিয়াতে না আসতে পারে। সে এমন কিছু সংখ্যক পুরুষ ও স্ত্রীকে নিযুক্ত করল যাতে তারা রাজ্যে ঘুরে ঘুরে গর্ভবতী নারীদের সন্ধান করে ও তাদের প্রসবের নির্ধারিত সময় সম্বন্ধে অবগত হয়। আর যখনই কোন গর্ভবতী নারী পুত্র সন্তান প্রসব করত, তখনই এসব হত্যাকারী তাদেরকে হত্যা করে ফেলত।

কিতাবীদের ভাষ্য হচ্ছে এই যে, ফিরআউন পুত্র-সন্তানদেরকে এ উদ্দেশ্যে হত্যা করার হুকুম দিত যাতে বনী ইসরাঈলের শান-শওকত হ্রাস পেয়ে যায়।

সুতরাং কিবতীরা যখন তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে প্রয়াস পাবে কিংবা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে তখন তারা তা প্রতিরোধ করতে সমর্থ হবে না।

এ ভাষ্যটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, তাদের পুত্র-সন্তানদের এরূপ হত্যা করার হুকুম দেয়া হয়েছিল মূসা (আ)-এর নবুওতপ্রাপ্তির পর, জন্মলগ্নে নয়।

যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ

( فَلَمَّا جَاۤءَهُم بِٱلۡحَقِّ مِنۡ عِندِنَا قَالُوا۟ ٱقۡتُلُوۤا۟ أَبۡنَاۤءَ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ مَعَهُۥ وَٱسۡتَحۡیُوا۟ نِسَاۤءَهُمۡۚ )

[Surat Momin 25]

অর্থাৎ–তারপর মূসা আমার নিকট হতে সত্য নিয়ে তাদের নিকট উপস্থিত হলে তারা বলল, মূসার প্রতি যারা ঈমান এনেছে তাদের পুত্র-সন্তানদেরকে হত্যা কর এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখ। (সূরা মুমিনঃ ২৫) আর এজন্যেই বনী ইসরাঈল মূসা (আ)-কে বলেছিলঃ

قَالُوۡۤا اُوۡذِیۡنَا مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَاۡتِیَنَا وَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جِئۡتَنَا

অর্থাৎ—আমাদের নিকট তোমার আসার পূর্বে আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং তোমার আসার পরেও। (সূরা আরাফঃ ১২৯)

সুতরাং বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে এই যে, মূসা (আ) -এর দুনিয়ায় আগমন ঠেকাবার জন্যেই ফিরআউন বনী ইসরাঈলের পুত্র-সন্তানদের প্রথমে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। তাকদীর যেন বলছিল, হে বিপুল সেনাবাহিনীর অধিকারী। পরম ক্ষমতা ও রাজত্বের অধিপতি বিধায় অহংকারী পরাক্রমশালী সম্রাট! ঐ অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপ্রতিহত এবং অবিচল মহাশক্তির অধিকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, যেই সন্তানটি থেকে পরিত্রাণের আশায়, অগণিত, অসংখ্য নিস্পাপ পুত্র-সন্তান তুমি হত্যা করছ সেই সন্তান তোমার ঘরেই প্রতিপালিত হবে, তোমার ঘরেই সে লালিত-পালিত হবে, তোমার ঘরেই তোমার খাদ্য খেয়ে ও পানীয় পান করে বড় হয়ে উঠবে, তুমিই তাকে পালক-পুত্র হিসেবে গ্রহণ করবে ও তাকে লালন করবে অথচ তুমি এ রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে সক্ষম হবে না। অবশেষে তার হাতেই তোমার দুনিয়া ও আখিরাত সর্বস্ব বিনাশ হয়ে যাবে। কারণ সে যা কিছু প্রকাশ্য সত্য নিয়ে আসবে তুমি তার বিরোধিতা করবে, এবং তার কাছে যে ওহী নাযিল হবে, তুমি তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে- এটা এজন্য যাতে তুমি এবং গোটা জগদ্বাসী জানতে পারে যে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের প্রতিপালক যা ইচ্ছা তা আঞ্জাম দিয়ে থাকেন, তিনিই মহাপরাক্রমশালী একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ও তাঁর শক্তি ও ইচ্ছাকে কেউ প্রতিহত করতে পারে না।

একাধিক তাফসীরকার এরূপ বর্ণনা করেছেন- কিবতীরা ফিরআউনের কাছে এমর্মে অভিযোগ করে যে, বনী ইসরাঈলের পুত্র-সন্তান হত্যা করার কারণে তাদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে এবং তারা আশঙ্কা করতে বাধ্য হচ্ছে যে, ছোটদেরকে হত্যা করার কারণে বড়দের সংখ্যাও ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকবে। ফলে কিবতীদেরকে ঐ সব নিকৃষ্ট কাজ করতে হবে যেগুলো বনী ইসরাঈল করতে বাধ্য ছিল। এরূপ অভিযোগ ফিরআউনের কাছে পৌঁছার পর ফিরআউন এক বছর পর পর পুত্র-সন্তানদের হত্যা করতে নির্দেশ দিল। তাফসীরকারগণ উল্লেখ করেন, যে বছর পুত্র-সন্তানদের হত্যা না করার কথা সেই বছর হারূন (আ) জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে যে বছরে পুত্র-সন্তানদের হত্যা করার কথা সে বছরে মূসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন।

সুতরাং মূসা (আ)-এর আম্মা মূসা (আ)-কে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাই তিনি গর্ভবতী হওয়ার প্রথম দিন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে লাগলেন এবং গর্ভের কথা প্রকাশ হতে দিলেন না। যখন তিনি সন্তান প্রসব করলেন, একটি সিন্দুক তৈরি করার জন্যে তাঁকে সংগোপনে নির্দেশ প্রদান করা হল। তিনি সিন্দুকটিকে একটি রশি দিয়ে বেঁধে রাখলেন। তাঁর বাড়ি ছিল নীলনদের তীরে। তিনি তাঁর সন্তানকে দুধ পান করাতেন এবং যখনই কারো আগমনের আশঙ্কা করতেন তাকে সিন্দুকে রেখে সিন্দুক সমেত তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিতেন। আর রশির এক প্রান্ত তিনি নিজে ধরে রাখতেন। যখন শত্রুরা চলে যেত তখন তিনি তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসতেন। আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ

وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰۤی اُمِّ مُوۡسٰۤی اَنۡ اَرۡضِعِیۡہِ ۚ فَاِذَا خِفۡتِ عَلَیۡہِ فَاَلۡقِیۡہِ فِی الۡیَمِّ وَ لَا تَخَافِیۡ وَ لَا تَحۡزَنِیۡ ۚ اِنَّا رَآدُّوۡہُ اِلَیۡکِ وَ جَاعِلُوۡہُ مِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۷﴾ فَالۡتَقَطَہٗۤ اٰلُ فِرۡعَوۡنَ لِیَکُوۡنَ لَہُمۡ عَدُوًّا وَّ حَزَنًا ؕ اِنَّ فِرۡعَوۡنَ وَ ہَامٰنَ وَ جُنُوۡدَہُمَا کَانُوۡا خٰطِئِیۡنَ ﴿۸﴾ وَ قَالَتِ امۡرَاَتُ فِرۡعَوۡنَ قُرَّتُ عَیۡنٍ لِّیۡ وَ لَکَ ؕ لَا تَقۡتُلُوۡہُ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّنۡفَعَنَاۤ اَوۡ نَتَّخِذَہٗ وَلَدًا وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۹﴾

অর্থাৎ–মূসার মায়ের অন্তরে আমি ইংগিতে নির্দেশ করলাম, “শিশুটিকে বুকের দুধ পান করাতে থাক।” যখন তুমি তার সম্পর্কে কোন আশঙ্কা করবে, তখন তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ করবে এবং ভয় করবে না, দুঃখও করবে না। আমি তাকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলদের একজন করব। অবশেষে ফিরআউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিল। এর পরিণাম তো এই ছিল যে, সে তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হবে। ফিরআউন, হামান ও তাদের বাহিনী ছিল অপরাধী। ফিরআউনের স্ত্রী বলল, এই শিশু আমার ও তোমার নয়ন প্রীতিকর। একে হত্যা করবে না, সে আমাদের উপকারে আসতে পারে। আমরা তাকে সন্তান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে তারা এর পরিণাম বুঝতে পারেনি। (সূরা কাসাসঃ ৭-৯)

মূসার মায়ের কাছে যে ওহী পাঠানো হয়েছিল, তা ছিল ইলহাম ও নির্দেশনা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ اَوۡحٰی رَبُّکَ اِلَی النَّحۡلِ اَنِ اتَّخِذِیۡ مِنَ الۡجِبَالِ بُیُوۡتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعۡرِشُوۡنَ ﴿ۙ ۶۸﴾ ثُمَّ کُلِیۡ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ فَاسۡلُکِیۡ سُبُلَ رَبِّکِ ذُلُلًا

অর্থাৎ–তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে তার অন্তরে ইংগিতে নির্দেশ দিয়েছেন, ঘর তৈরি কর পাহাড়ে, গাছপালায় ও মানুষ যে ঘর তৈরি করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল থেকে কিছু কিছু আহার কর এবং তোমার প্রতিপালকের সহজপথ অনুসরণ কর। (সূরা নাহলঃ ৬৮)

এ ওহী নবুওতের ওহী নয়। ইব্‌ন হাযম (র) ও ইল্‌ম আকাইদ বিশারদগণের অনেকেই এটাকে মনে করেন, কিন্তু বিশুদ্ধ অভিমত হল প্রথম অভিমতটিই। আর এটিই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মত বলে আবুল হাসান আল আশ‘আরী (র) বর্ণনা করেছেন। সুহায়লী বলেছেন, মূসা (আ)-এর মায়ের নাম ছিল আয়ারেখা। আবার কেউ কেউ বলেন, তার নাম ছিল আয়াযাখ্‌ত। মোদ্দাকথা হল, উপরোক্ত কাজের দিকনির্দেশনা তাঁর অন্তরে দেয়া হয়েছিল। তাঁর অন্তরে ইলহাম করা হয়েছিল যে, তুমি ভয় করো না এবং দুঃখিত হয়ো না। কেননা, যদিও সন্তানটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা তা শিগগিরই ফেরত দেবেন। আর আল্লাহ তাঁকে অচিরেই রাসূল হিসেবে মনোনীত করবেন। তিনি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবকে দুনিয়া এবং আখিরাতে সমুন্নত করবেন। অতএব, মূসা (আ)-এর মা তাই করলেন যেভাবে তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন। একদিন তিনি তাকে ছেড়ে ছিলেন কিন্তু রশির প্রান্ত নিজের কাছে আটকে রাখতে ভুলে গেলেন। মূসা (আ) নীলনদের স্রোতে ভেসে গেলেন। তারপর ফিরআউনের বাড়ির ঘাটে গিয়ে পৌঁছলেন। ফিরআউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নিল। এটার পরিণাম তো এই ছিল যে, তিনি তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হবেন।

কেউ কেউ বলেন, ليكون এর মধ্যে لام অক্ষরটি পরিণাম জ্ঞাপক। এটি আয়াতাংশের فالتقطه এর সাথে সম্পৃক্ত হলে এ অর্থই স্পষ্ট। কিন্তু যদি বাক্যের মর্মার্থের সাথে তা সংযুক্ত হয়ে থাকে তাহলে لام -কে অন্যান্য لام -এর ন্যায় কারণ নির্দেশক বলে মনে করতে হবে। তাতে বাক্যের মর্ম দাঁড়াবে ফিরআউনের লোকজন তাকে উঠিয়ে নেবার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে সে তাদের শত্রু কিংবা দুঃখের কারণ হবে। এ সম্ভাবনাটির সমর্থন মিলছে আয়াতে উল্লেখিত—

( إِنَّ فِرۡعَوۡنَ وَهَـٰمَـٰنَ وَجُنُودَهُمَا كَانُوا۟ خَـٰطِـِٔینَ )

[Surat Al-Qasas 8]

আয়াতাংশ থেকে।

অর্থাৎ–ফিরআউন তার দুষ্ট উযীর হামান এবং তাদের অনুচররা ভ্রান্তির মধ্যে ছিল, তাই তারা এই শাস্তি ও হতাশার যোগ্য হয়ে পড়ে। তাফসীরকারগণ আরো উল্লেখ করেন যে, দাসীরা তাকে একটি বন্ধ সিন্দুকে দরিয়া থেকে উদ্ধার করে কিন্তু তারা তা খুলতে সাহস পায়নি। তারা ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া (রা) বিনতে মুযাহিস ইব্‌ন আসাদ ইব্‌ন আর-রাইয়ান ইবনুল ওলীদ-এর সামনে বন্ধ সিন্দুকটি রাখল।

এই ওলীদই ছিল ইউসুফ (আ)-এর যুগে মিসরের ফিরআউন। তৎকালীন মিসরের অধিপতিদের উপাধি ছিল ফিরআউন। আবার কেউ কেউ বলেন, আসিয়া ছিলেন বনী ইসরাঈল বংশীয় এবং মূসা (আ)-এর গোত্রের মহিলা। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন মূসা (আ)-এর ফুফু। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক সুহায়লীও এরূপ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই অধিক জ্ঞাত।

মারয়াম (রা) বিনতে ইমরানের ঘটনায় আসিয়া (রা)-এর গুণাবলী ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। কিয়ামতের দিন বেহেশতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্ত্রীদের সাথে তারা দুইজনও অন্তর্ভুক্ত হলেন।

আসিয়া যখন সিন্দুকটির দরজা খুললেন ও পর্দা হটালেন তখন দেখলেন মূসা (আ)-এর চেহারা নবুওতের উজ্জ্বল নূরে ঝলমল করছে। মূসা (আ)-কে দেখামাত্র আসিয়ার হৃদয়মন তার প্রতি স্নেহমমতায় ভরে উঠল। ফিরআউন আসার পর জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেটি কে?’ এবং সে তাকে যবেহ করার নির্দেশ দিল। কিন্তু আসিয়া ফিরআউনের কাছ থেকে তাঁকে চেয়ে নিলেন এবং এভাবে তাঁকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করলেন। আসিয়া বললেনঃ

অর্থাৎ এই শিশুটি তোমার ও আমার চোখ জুড়াবে। ফিরআউন বলল, এটা তোমার জন্যে হতে পারে, কিন্তু আমার জন্যে নয়। একে দিয়ে আমার কোনই প্রয়োজন নেই। কথা বাড়ালে বিপত্তিই বাড়ে। আসিয়া বলেছিলেনঃ অর্থাৎ-“সে আমাদের উপকারে আসতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সে আশা পূর্ণ করেছিলেন। দুনিয়ায় আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে মূসা (আ)-এর দ্বারা হিদায়াত দান করেছেন এবং আখিরাতে তাকে মূসা (আ)-এর কারণে স্বীয় জান্নাতে স্থান দেবেন। আবার তিনি বলেছিলেনঃ অর্থাৎ—“আমরা তাকে সন্তান হিসেবেও গ্রহণ করতে পারি।” তারা তাঁকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন; কেননা তাদের কোন সন্তান ছিল না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, অর্থাৎ তারা জানে না যে, তাকে সিন্দুক থেকে উঠিয়ে নেওয়ার জন্যে ফিরআউন পরিবারকে নিযুক্ত করে আল্লাহ্ তা‘আলা ফিরআউন ও তার সৈন্যদের প্রতি কিরূপ মহা আযাব অবতীর্ণ করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তী আয়াতে ঘটনার পরবর্তী অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ اَصۡبَحَ فُؤَادُ اُمِّ مُوۡسٰی فٰرِغًا ؕ اِنۡ کَادَتۡ لَتُبۡدِیۡ بِہٖ لَوۡ لَاۤ اَنۡ رَّبَطۡنَا عَلٰی قَلۡبِہَا لِتَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۰﴾ وَ قَالَتۡ لِاُخۡتِہٖ قُصِّیۡہِ ۫ فَبَصُرَتۡ بِہٖ عَنۡ جُنُبٍ وَّ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿ۙ ۱۱﴾ وَ حَرَّمۡنَا عَلَیۡہِ الۡمَرَاضِعَ مِنۡ قَبۡلُ فَقَالَتۡ ہَلۡ اَدُلُّکُمۡ عَلٰۤی اَہۡلِ بَیۡتٍ یَّکۡفُلُوۡنَہٗ لَکُمۡ وَ ہُمۡ لَہٗ نٰصِحُوۡنَ ﴿۱۲﴾ فَرَدَدۡنٰہُ اِلٰۤی اُمِّہٖ کَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُہَا وَ لَا تَحۡزَنَ وَ لِتَعۡلَمَ اَنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٪ ۱۳﴾

অর্থাৎ–মূসার মায়ের হৃদয় অস্থির হয়ে পড়েছিল, যাতে সে আস্থাশীল হয় তজ্জন্য আমি তার হৃদয়কে দৃঢ় করে না দিলে সে তার পরিচয় তো প্রকাশ করেই দিত। সে মূসার বোনকে বলল, এর পিছনে পিছনে যাও। সে তাদের অজ্ঞাতসারে দূর হতে তাকে দেখছিল। পূর্ব থেকেই আমি ধাত্রীর দুধপানে তাকে বিরত রেখেছিলাম। মুসার বোন বলল, “তোমাদের কি আমি এমন এক পরিবারের সন্ধান দেব, যারা তোমাদের হয়ে তাকে লালন-পালন করবে এবং তার মঙ্গলকামী হবে।” তারপর আমি তাকে ফেরত পাঠালাম তার মায়ের নিকট যাতে তার চোখ জুড়ায়, সে দুঃখ না করে এবং বুঝতে পারে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। (সূরা কাসাসঃ ১০-১৩)

আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা), মুজাহিদ (র), ইকরামা (র), সায়ীদ ইব্‌ন জুবাইর (রা) প্রমুখ বলেন, “মূসা (আ)-এর মায়ের অন্তর দুনিয়ার অন্যান্য চিন্তা ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র মূসা (আ)-কে নিয়ে চিন্তায় অস্থির ছিল। আল্লাহ্ তা‘আলা যদি তাকে ধৈর্য দান না করতেন ও তার হৃদয়ে দৃঢ়তা দান না করতেন তাহলে ব্যাপারটি তিনি প্রকাশ করে দিতেন এবং অন্যের কাছে প্রকাশ্যে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে ফেলতেন। তিনি তার বড় মেয়ে, মূসা (আ)-এর বোনকে তার পেছনে পেছনে গিয়ে খবরাখবর নেয়ার জন্যে পাঠালেন। মুজাহিদ (র) বলেন, সে দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করছিল। আর কাতাদা (র) বলেন, তিনি এমনভাবে তার প্রতি লক্ষ্য করছিলেন যেন এ ব্যাপারে তাঁর কোন আগ্রহ নেই। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা তা বুঝতে পারছিল না। ঘটনা হল এই, যখন ফিরআউনের ঘরে মূসা (আ)-এর থাকা সাব্যস্ত হলো তখন ফিরআউনের লোকজন তাকে দুধ পান করাবার চেষ্টা করল কিন্তু তিনি কারো বুকের দুধ গ্রহণ করলেন না বা অন্য কোন খাদ্যও গ্রহণ করলেন না। তারা তার ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল এবং তাঁকে যে প্রকারেই হোক না কেন তারা যে কোন খাদ্য খাওয়াতে চেষ্টা করল কিন্তু তারা তাতে ব্যর্থ হল। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ “পূর্ব থেকেই আমি অন্যের বুকের দুধ গ্রহণ থেকে তাকে বিরত রেখেছিলাম।” তারা তাঁকে ধাত্রী ও অন্যান্য নারীসমেত বাজারে পাঠালো যাতে তারা এমন লোক খুঁজে বের করতে পারে, যে তাকে দুধ পান করাতে সক্ষম হয়। তারা তাকে নিয়ে ছিল ব্যস্ত এবং বাজারের লোকজনও তাদের দিকে লক্ষ্য করে রয়েছে- এমন সময় মূসা (আ)-এর বোন মূসা (আ)-এর দিকে তাকালেন কিন্তু তিনি তাকে চিনেন বলে পরিচয় প্রকাশ করলেন না, বরং বললেনঃ

( ۞ هَلۡ أَدُلُّكُمۡ عَلَىٰۤ أَهۡلِ بَیۡت یَكۡفُلُونَهُۥ لَكُمۡ وَهُمۡ لَهُۥ نَـٰصِحُونَ )

[Surat Al-Qasas 12]

অর্থাৎ–তোমাদের কি আমি এমন এক পরিবারের সন্ধান দেব, যারা তোমাদের হয়ে তাকে লালন-পালন করবে এবং তার মঙ্গলকামী হবে?

আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেন, “মূসা (আ)-এর বোন যখন তাদেরকে এরূপ বললেন তখন তারা তাকে বলল, তুমি কেমন করে জান যে, তারা তার মঙ্গলকামী ও তার প্রতি মেহেরবান হবে? তিনি বললেনঃ বাদশাহর বেগমের ছেলের উপকার সাধনে সকলেই আগ্রহী। তখন তারা তাকে ছেড়ে দিল এবং তার সাথে তারা তাদের বাড়িতে গেল। তখন মূসা (আ)-এর মা মূসা (আ)-কে কোলে তুলে নিলেন ও তাকে নিজ বুকের দুধ খেতে দিলেন। মূসা (আ) মায়ের স্তন মুখে নিলেন, চুষতে আরম্ভ করলেন এবং দুধ পান করতে লাগলেন। এতে তারা সকলে অতীব খুশি হল। এক ব্যক্তি এ সুসংবাদ আসিয়াকে গিয়ে জানাল। তিনি মূসা (আ)-এর মাকে তাঁর নিজ মহলে ডেকে পাঠালেন এবং সেখানে অবস্থান করে তাকে উপকৃত করতে আসিয়া (রা) আহ্বান জানালেন। কিন্তু মূসা (আ)-এর মা তাতে রাযী হলেন না বরং বললেন, আমার স্বামী ও ছেলে-মেয়ে রয়েছে তাই আমি তাদেরকে ছেড়ে মহলে থাকতে পারি না, তবে আপনি যদি তাকে আমার নিকট পাঠিয়ে দেন তাহলে আমি তাকে দুধ পান করাতে পারি। তখন আসিয়া মূসা (আ)-কে তার মায়ের সাথে যেতে দিলেন। তিনি তার জন্যে বহু মূল্যবান উপঢৌকন দিলেন ও তাঁর খোরপোশের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দিলেন। মূসার মা মূসা (আ)-কে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে গেলেন এবং এভাবে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় মা-ছেলের মিলন ঘটালেন। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেনঃ

( فَرَدَدۡنَـٰهُ إِلَىٰۤ أُمِّهِۦ كَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُهَا وَلَا تَحۡزَنَ وَلِتَعۡلَمَ أَنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّ ࣱ )

[Surat Al-Qasas 13]

আমি তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। যাতে তার চোখ জুড়ায়, সে দুঃখ না করে এবং বুঝতে পারে যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। মূসা-জননীর কাছে মূসা (আ)-কে ফেরত প্রদানের মাধ্যমে একটি প্রতিশ্রুতি এভাবে পূর্ণ হল। আর এটাই নবুওতের সুসংবাদের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ অর্থাৎ তাদের অধিকাংশই এটা জানে না। যেই রাতে আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ)- এর সাথে কথোপকথন করেন সেই রাতেও এরূপ ইহসান প্রদর্শনের কথা আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেনঃ

وَ لَقَدۡ مَنَنَّا عَلَیۡکَ مَرَّۃً اُخۡرٰۤی ﴿ۙ ۳۷﴾ اِذۡ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰۤی اُمِّکَ مَا یُوۡحٰۤی ﴿ۙ ۳۸﴾ اَنِ اقۡذِفِیۡہِ فِی التَّابُوۡتِ فَاقۡذِفِیۡہِ فِی الۡیَمِّ فَلۡیُلۡقِہِ الۡیَمُّ بِالسَّاحِلِ یَاۡخُذۡہُ عَدُوٌّ لِّیۡ وَ عَدُوٌّ لَّہٗ ؕ وَ اَلۡقَیۡتُ عَلَیۡکَ مَحَبَّۃً مِّنِّیۡ ۬ۚ وَ لِتُصۡنَعَ عَلٰی عَیۡنِیۡ ﴿ۘ ۳۹﴾

অর্থাৎ– এবং আমি তো তোমার প্রতি আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম, যখন আমি তোমার মাকে জানিয়েছিলাম যা ছিল জানাবার এই মর্মে যে, তুমি তাকে সিন্দুকের মধ্যে রাখ তারপর এটাকে দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও যাতে দরিয়া এটাকে তীরে ঠেলে দেয়, এটাকে আমার শত্রু ও তার শত্রু নিয়ে যাবে। আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও। (সূরা তা-হাঃ ৩৭-৩৯)

শেষোক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় কাতাদা (র) প্রমুখ তাফসীরকার বলেন, যাতে আমার সামনে তুমি ভাল ভাল খাবার খেতে পার ও অতি উত্তম পোশাক পরতে পার। আর এগুলো সব আমার হেফাজত ও সংরক্ষণের দ্বারা সম্ভব হয়েছে, অন্য কারো এরূপ করার শক্তি, সামর্থ্য নেই। আল্লাহ তা‘আলা আরও ইরশাদ করেনঃ

اِذۡ تَمۡشِیۡۤ اُخۡتُکَ فَتَقُوۡلُ ہَلۡ اَدُلُّکُمۡ عَلٰی مَنۡ یَّکۡفُلُہٗ ؕ فَرَجَعۡنٰکَ اِلٰۤی اُمِّکَ کَیۡ تَقَرَّ عَیۡنُہَا وَ لَا تَحۡزَنَ ۬ؕ وَ قَتَلۡتَ نَفۡسًا فَنَجَّیۡنٰکَ مِنَ الۡغَمِّ وَ فَتَنّٰکَ فُتُوۡنًا ۬

অর্থাৎ–যখন তোমার বোন এসে বলল, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব কে এই শিশুর ভার নেবে? তখন আমি তোমাকে তোমার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিলাম যাতে তার চোখ জুড়ায় এবং সে দুঃখ না পায়; এবং তুমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে; অতঃপর আমি তোমাকে মনঃপীড়া হতে মুক্তি দেই। আমি তোমাকে বহু পরীক্ষা করেছি। (সূরা তা-হাঃ ৪০) পরীক্ষার ঘটনাসমূহ যথাস্থানে ইনশাআল্লাহ্ তুলে ধরা হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ لَمَّا بَلَغَ اَشُدَّہٗ وَ اسۡتَوٰۤی اٰتَیۡنٰہُ حُکۡمًا وَّ عِلۡمًا ؕ وَ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۴﴾ وَ دَخَلَ الۡمَدِیۡنَۃَ عَلٰی حِیۡنِ غَفۡلَۃٍ مِّنۡ اَہۡلِہَا فَوَجَدَ فِیۡہَا رَجُلَیۡنِ یَقۡتَتِلٰنِ ٭۫ ہٰذَا مِنۡ شِیۡعَتِہٖ وَ ہٰذَا مِنۡ عَدُوِّہٖ ۚ فَاسۡتَغَاثَہُ الَّذِیۡ مِنۡ شِیۡعَتِہٖ عَلَی الَّذِیۡ مِنۡ عَدُوِّہٖ ۙ فَوَکَزَہٗ مُوۡسٰی فَقَضٰی عَلَیۡہِ ٭۫ قَالَ ہٰذَا مِنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۵﴾ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ فَغَفَرَ لَہٗ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۶﴾ قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ فَلَنۡ اَکُوۡنَ ظَہِیۡرًا لِّلۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۷﴾

অর্থাৎ–যখন মূসা (আ) পূর্ণ যৌবনে উপনীত ও পরিণত বয়স্ক হল তখন আমি তাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করলাম; এইভাবে আমি সৎ কর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কার প্রদান করে থাকি। সে নগরীতে প্রবেশ করল, যখন এর অধিবাসীরা ছিল অসতর্ক। সেখানে সে দু’টি লোককে সংঘর্ষে লিপ্ত দেখল- একজন তার নিজ দলের এবং অপরজন তার শত্রুদলের। মূসা (আ)-এর দলের লোকটি তার শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে মূসা (আ)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল, তখন মূসা (আ) তাকে ঘুষি মারল; এভাবে সে তাকে হত্যা করে বসল। মূসা (আ) বললেন, এটা শয়তানের কাণ্ড। সেতো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তকারী। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার নিজের প্রতি জুলুম করেছি। সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর। তারপর তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সে আরো বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না। (সূরা কাসাসঃ ১৪-১৭)

যখন আল্লাহ্ তা‘আলা উল্লেখ করেন, তিনি তার মায়ের কাছে তাকে ফেরত দিয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ ও দয়া করেছেন তারপর তিনি উল্লেখ করতে শুরু করলেন যে, যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করেন এবং শারীরিক গঠন ও চরিত্রে উৎকর্ষ মণ্ডিত হল এবং অধিকাংশ উলামার মতে, যখন ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিকমত ও নবুওতের জ্ঞান দান করেন। যে বিষয়ে তাঁর মাতাকে পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

( إِنَّا رَاۤدُّوهُ إِلَیۡكِ وَجَاعِلُوهُ مِنَ ٱلۡمُرۡسَلِینَ )

[Surat Al-Qasas 7]

অর্থাৎ–“আমি তাকে তোমার নিকট ফেরত দেব এবং তাকে রাসূলদের একজন করব।” তারপর আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ)-এর মিসর থেকে বের হয়ে মাদায়ান শহরে গমন এবং সেখানে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অবস্থানের কারণ বর্ণনা শুরু করেন এবং মূসা (আ) ও আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে যে সব কথোপকথন হয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাকে যেরূপ মর্যাদা দান করেছেন তার প্রতিও ইংগিত করেছেন। যার আলোচনা একটু পরেই আসছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ ( وَدَخَلَ ٱلۡمَدِینَةَ عَلَىٰ حِینِ غَفۡلَة مِّنۡ أَهۡلِهَا অর্থাৎ -“সে নগরীতে প্রবেশ করল যখন তার অধিবাসীবৃন্দ ছিল অসতর্ক।” আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা), সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর (রা), ইকরিমা (র), কাতাদা ও সুদ্দী (র) বলেন, তখন ছিল দুপুর বেলা। অন্য এক সূত্রে বর্ণিত; আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেছেন, এটা ছিল মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়। সেখানে তিনি দু’জনকে সংঘর্ষে লিপ্ত পেলেন- একজন ছিল ইসরাঈলী এবং অন্যজন ছিল কিবতী। আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা), কাতাদা (র), সুদ্দী (র), মুহম্মদ ইব্‌ন ইসহাক (র) এ মত পোষণ করেন। মূসা (আ)-এর দলের লোকটি শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে মূসা (আ)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল। বস্তুত ফিরআউনের পালক-পুত্র হবার কারণে মিসরে মূসা (আ)-এর প্রতিপত্তি ছিল। মূসা (আ) ফিরআউনের পালক-পুত্র হওয়ায় এবং তার ঘরে লালিত-পালিত হওয়ায় বনী ইসরাঈলদেরও সম্মান বৃদ্ধি পায়। কেননা, তারা মূসা (আ)-কে দুধ পান করিয়েছিল-এ হিসাবে তারা ছিল মূসা (আ)-এর মামা গোত্রীয়। যখন ইসরাঈল বংশীয় লোকটি মূসা (আ)-এর সাহায্য প্রার্থনা করল তখন তিনি তার সাহায্যে এগিয়ে আসলেন। মুজাহিদ (র) فوكزاه শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, এর অর্থ তিনি তাকে ঘুষি দিলেন। কাতাদা (র) বলেন, তিনি তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে কিবতীটি মারা যায়। আর এই কিবতীটি ছিল কাফির ও মুশরিক। মূসা (আ) তাকে প্রাণে বধ করতে চাননি, বরং তিনি তাকে সাবধান ও নিরস্ত্র করতে চেয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও মূসা (আ) বললেনঃ

قَالَ ہٰذَا مِنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ عَدُوٌّ مُّضِلٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۵﴾ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ فَاغۡفِرۡ لِیۡ فَغَفَرَ لَہٗ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۶﴾ قَالَ رَبِّ بِمَاۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ فَلَنۡ اَکُوۡنَ ظَہِیۡرًا لِّلۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۷﴾ فَاَصۡبَحَ فِی الۡمَدِیۡنَۃِ خَآئِفًا یَّتَرَقَّبُ فَاِذَا الَّذِی اسۡتَنۡصَرَہٗ بِالۡاَمۡسِ یَسۡتَصۡرِخُہٗ ؕ قَالَ لَہٗ مُوۡسٰۤی اِنَّکَ لَغَوِیٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۸﴾ فَلَمَّاۤ اَنۡ اَرَادَ اَنۡ یَّبۡطِشَ بِالَّذِیۡ ہُوَ عَدُوٌّ لَّہُمَا ۙ قَالَ یٰمُوۡسٰۤی اَتُرِیۡدُ اَنۡ تَقۡتُلَنِیۡ کَمَا قَتَلۡتَ نَفۡسًۢا بِالۡاَمۡسِ ٭ۖ اِنۡ تُرِیۡدُ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ جَبَّارًا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا تُرِیۡدُ اَنۡ تَکُوۡنَ مِنَ الۡمُصۡلِحِیۡنَ ﴿۱۹﴾ وَ جَآءَ رَجُلٌ مِّنۡ اَقۡصَا الۡمَدِیۡنَۃِ یَسۡعٰی ۫ قَالَ یٰمُوۡسٰۤی اِنَّ الۡمَلَاَ یَاۡتَمِرُوۡنَ بِکَ لِیَقۡتُلُوۡکَ فَاخۡرُجۡ اِنِّیۡ لَکَ مِنَ النّٰصِحِیۡنَ ﴿۲۰﴾ فَخَرَجَ مِنۡہَا خَآئِفًا یَّتَرَقَّبُ ۫ قَالَ رَبِّ نَجِّنِیۡ مِنَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿٪ ۲۱﴾

অর্থাৎ–মূসা বলল, “এটা শয়তানের কাণ্ড। সেতো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তিকারী। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার নিজের প্রতি জুলুম করেছি, সুতরাং আমাকে ক্ষমা কর। তারপর তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সে আরো বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, (অর্থাৎ মর্যাদা ও প্রতিপত্তি দিয়েছ) আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হব না। তারপর ভীত-সতর্ক অবস্থায় সেই নগরীতে তার প্রভাত হল। হঠাৎ সে শুনতে পেল, পূর্বদিন যে ব্যক্তি তার সাহায্য চেয়েছিল, সে তার সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। মূসা তাকে বলল, তুমি তো স্পষ্টই একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। তারপর মূসা যখন উভয়ের শত্রুকে ধরতে উদ্যত হল, তখন সে ব্যক্তি বলে উঠল, হে মূসা! গতকাল তুমি যেমন একজনকে হত্যা করেছ সেভাবে আমাকেও কি হত্যা করতে চাচ্ছ! তুমি তো পৃথিবীতে স্বেচ্ছাচারী হতে চাচ্ছ, শান্তি স্থাপনকারী হতে চাও না? নগরীর দূর প্রান্ত হতে এক ব্যক্তি ছুটে আসল ও বলল, হে মূসা! পারিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করবার পরামর্শ করছে! সুতরাং তুমি বাইরে চলে যাও, আমি তো তোমার মঙ্গলকামী। ভীত-সতর্ক অবস্থায় সে সেখান থেকে বের হয়ে পড়ল এবং বলল, “হে আমার প্রতিপালক! তুমি জালিম সম্প্রদায় হতে আমাকে রক্ষা কর।” (কাসাসঃ ১৫-২১)

বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মূসা (আ) মিসর শহরে ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। পাছে তারা জেনে ফেলে যে, নিহত ব্যক্তির যে মামলাটি তাদের কাছে উত্থাপন করা হয়েছে তাকে বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির সাহায্যার্থে মূসা (আ)-ই হত্যা করেছেন। তা হলে তাদের ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, মূসা (আ) বনী ইসরাঈলেরই একজন। এতে পরবর্তীতে বিরাট অনর্থ ঘটে যেতে পারে। এজন্যই তিনি ঐদিন ভোরে এদিক ওদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলাফেরা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন, আগের দিন যে ইসরাঈলীটির তিনি সাহায্য করেছিলেন ঐ ব্যক্তি আজও অন্য একজনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে মূসা (আ)-কে সাহায্যের জন্য আহ্বান করছে। মূসা (আ) তাকে তার ঝগড়াটে স্বভাবের জন্য ভর্ৎসনা করলেন এবং বললেন, তুমি তো স্পষ্টই একজন বিভ্রান্ত ব্যক্তি। তারপর তিনি মূসা (আ) ও ইসরাঈলী ব্যক্তিটির শত্রু কিবতীটিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেন যাতে তিনি কিবতীটিকে প্রতিহত করতে পারেন এবং ইসরাঈলীকে তার কবল থেকে রক্ষা করতে পারেন। তারপর তাকে তিনি আক্রমণের জন্য উদ্যত হলেন ও কিবতীটির দিকে অগ্রসর হলেন। তখন লোকটি বলে উঠল।

( یَـٰمُوسَىٰۤ أَتُرِیدُ أَن تَقۡتُلَنِی كَمَا قَتَلۡتَ نَفۡسَۢا بِٱلۡأَمۡسِۖ إِن تُرِیدُ إِلَّاۤ أَن تَكُونَ جَبَّار ا فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا تُرِیدُ أَن تَكُونَ مِنَ ٱلۡمُصۡلِحِینَ )[Surat Al-Qasas 19]

অর্থাৎ, হে মূসা! গতকাল তুমি যেমন একব্যক্তিকে হত্যা করেছ, সেভাবে আমাকেও কি হত্যা করতে চাচ্ছ! তুমি তো পৃথিবীতে স্বেচ্ছাচারী হতে চাচ্ছ, শান্তি স্থাপনকারী হতে চাও না। কেউ কেউ বলেন, এ উক্তিটি ইসরাঈলীয়—যে মূসা (আ)-এর পূর্বদিনের ঘটনাটি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল, সে যখন মূসা (আ)-কে কিবতীটির দিকে অগ্রসর হতে দেখল, তখন সে ধারণা করল, তিনি তার দিকেও আসবেন—কেননা, তিনি তাকে প্রথমেই এই বলে ভর্ৎসনা করেছেন যে, তুমি তো একজন বিভ্রান্ত লোক। এজন্যেই সে মূসা (আ)-কে এ কথাটি বলে এবং পূর্বের দিন যে ঘটনা ঘটেছিল সে তা প্রকাশ করে দিল। তখন কিবতী মূসা (আ)-কে ফিরআউনের দরবারে তলব করানোর উদ্দেশ্যে চলে যায়। তবে এ অভিমতটি শুধু এ উক্তিকারীরই। অন্য কেউ তা উল্লেখ করেননি। এ উক্তিটি কিবতীটিরও হতে পারে। কেননা, সে যখন মূসা (আ)-কে তার দিকে অগ্রসর হতে দেখল, তাঁকে ভয় করতে লাগল এবং মূসা (আ)-এর মেযাজ থেকে ইসরাঈলী পক্ষে চরম প্রতিশোধের আশঙ্কা করে নিজ দূরদর্শিতার আলোকে সে উপরোক্ত উক্তিটি করেছিল। যেন সে বুঝতে পেরেছিল যে, সম্ভবত এ ব্যক্তিটিই গতকালের নিহত ব্যক্তিটির হত্যাকারী। অথবা সে ইসরাঈলীটির মূসা (আ)-এর কাছে সাহায্যের প্রার্থনা করা থেকেই সে ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরেছিল এবং উপরোক্ত বাক্যটি বলেছিল। আল্লাহই মহা জ্ঞানী।

মূলত ফিরআউনের কাছে এই সংবাদ পৌঁছেছিল যে, মূসা (আ)-ই গতকালের খুনের জন্য দায়ী। তাই ফিরআউন মূসা (আ)-কে গ্রেফতার করার জন্যে লোক পাঠাল, কিন্তু তারা মূসা (আ)-এর নিকট পৌঁছার পূর্বেই শহরের দূরবর্তী প্রান্ত থেকে সংক্ষিপ্ততর রাস্তা দিয়ে একজন হিতাকাঙ্ক্ষী মূসা (আ)-এর নিকট পৌঁছে দরদমাখা সুরে বললেন, হে মূসা (আ)! ফিরআউনের পারিষদবর্গ আপনাকে হত্যা করার সলাপরামর্শ করছে। কাজেই আপনি এখনই এই শহর থেকে বের হয়ে পড়ুন। আমি আপনার একজন হিতাকাঙ্ক্ষী অর্থাৎ আমি যা বলছি, সে ব্যাপারে। মূসা (আ) তাৎক্ষণিকভাবে মিসর থেকে বের হয়ে পড়েন কিন্তু তিনি রাস্তাঘাট চিনতেন না তাই বলতে থাকেন—

( رَبِّ نَجِّنِی مِنَ ٱلۡقَوۡمِ ٱلظَّـٰلِمِینَ )

[Surat Al-Qasas 21]

অর্থাৎ, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জালিম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَ لَمَّا تَوَجَّہَ تِلۡقَآءَ مَدۡیَنَ قَالَ عَسٰی رَبِّیۡۤ اَنۡ یَّہۡدِیَنِیۡ سَوَآءَ السَّبِیۡلِ ﴿۲۲﴾ وَ لَمَّا وَرَدَ مَآءَ مَدۡیَنَ وَجَدَ عَلَیۡہِ اُمَّۃً مِّنَ النَّاسِ یَسۡقُوۡنَ ۬۫ وَ وَجَدَ مِنۡ دُوۡنِہِمُ امۡرَاَتَیۡنِ تَذُوۡدٰنِ ۚ قَالَ مَا خَطۡبُکُمَا ؕ قَالَتَا لَا نَسۡقِیۡ حَتّٰی یُصۡدِرَ الرِّعَآءُ ٜ وَ اَبُوۡنَا شَیۡخٌ کَبِیۡرٌ ﴿۲۳﴾ فَسَقٰی لَہُمَا ثُمَّ تَوَلّٰۤی اِلَی الظِّلِّ فَقَالَ رَبِّ اِنِّیۡ لِمَاۤ اَنۡزَلۡتَ اِلَیَّ مِنۡ خَیۡرٍ فَقِیۡرٌ ﴿۲۴﴾

অর্থাৎ—যখন মূসা মাদায়ান অভিমুখে যাত্রা করল তখন বলল, আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে সরলপথ প্রদর্শন করবেন। যখন সে মাদায়ানের কূপের নিকট পৌঁছল, দেখল একদল লোক তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের পিছনে দু’জন নারী তাদের পশুগুলোকে আগলাচ্ছে। মূসা (আ) বলল, তোমাদের কি ব্যাপার?’ তারা বললেন, ‘আমরা আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ রাখালরা তাদের পশুগুলোকে নিয়ে সরে না যায়। আমাদের পিতা অতি বৃদ্ধ।’ মূসা (আ) তখন তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাল, তারপর তিনি ছায়ার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবে আমি তার কাঙ্গাল। (সূরা কাসাসঃ ২২-২৪)

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা আপন বান্দা, রাসূল ও কালীম মূসা (আ)-এর মিসর থেকে বের হয়ে যাবার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ফিরআউনের সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি তাকে দেখে ফেলে নাকি, এই ভয়ে চতুর্দিকে তাকাতে তাকাতে মূসা (আ) শহর থেকে বের হয়ে পড়লেন, কিন্তু কোথায় যাবেন বা কোন দিকে যাবেন তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ইতিপূর্বে মিসর থেকে আর কোনদিন বের হননি। যখন তিনি মাদায়ানে যাবার পথ ধরতে পারলেন তখন তিনি বলে উঠলেন, আমি আশা করি আমার প্রতিপালক আমাকে সোজা রাস্তা প্রদর্শন করবেন। অর্থাৎ সম্ভবত আমি এবার মনযিলে মকসুদে পৌঁছতে পারব। এভাবে বাস্তবে ঘটেছিলও তাই। এ পথই তাকে মনযিলে মকসুদে পৌঁছায়। কি সে মনযিলে মকসুদটি? মাদায়ানে একটি কূয়া ছিল যার পানি সকলে পান করত। মাদায়ান হলো সেই শহর যেখানে আল্লাহ তআলা ‘আইকাহ’ বাসীদের ধ্বংস করেছিলেন আর তারা ছিল শুয়ায়ব (আ)-এর সম্প্রদায়।

উলামায়ে কিরামের একটি মত অনুযায়ী মূসা (আ)-এর যুগের পূর্বে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যখন মূসা (আ) মাদায়ানের পানির কুপে পৌঁছলেন, সেখানে একদল লোক পেলেন যারা তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের পেছনে দু’জন নারীকে পেলেন যারা তাদের ছাগলগুলোকে আগলাচ্ছে, যাতে এগুলো সম্প্রদায়ের ছাগলগুলোর সাথে মিশে না যায়।

কিতাবীদের মতে, সেখানে সাতজন নারী ছিল। এটাও তাদের ভ্রান্ত ধারণা। তারা সাতজন হতে পারে তবে তাদের মধ্য হতে দু’জন পানি পান করাতে এসেছিল। তাদের বর্ণনা বিশুদ্ধ হলেই কেবল এ ধরনের সামঞ্জস্যসূচক উত্তর গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এটা স্পষ্ট যে, শুয়ায়ব (আ)-এর কেবল দুটি কন্যাই ছিল। মূসা (আ)-এর প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বললেন, আমরা আমাদের দুর্বলতার জন্যে রাখালদের পানি পান করার পূর্বে আমরা আমাদের পানির কাছে পৌঁছতে পারি না। আর এসব পশু নিয়ে আমাদের আসার কারণ হচ্ছে- আমাদের পিতার বৃদ্ধাবস্থা ও দুর্বলতা। তখন মূসা (আ) তাদের পশুগুলোকে পানি পান করালেন।

তাফসীরকারগণ বলেন, রাখালরা যখন তাদের জানোয়ারগুলোর পানি পান করানো শেষ করত, তখন তারা কূয়ার মুখে একটি বড় ও ভারী পাথর রেখে দিত। তারপর এই দুই নারী আসতেন এবং লোকজনের পশুগুলোর পানি পান করার পর যা উচ্ছিষ্ট থাকত তা হতে আপন বকরীগুলোকে পানি পান করাতেন। কিন্তু আজ মূসা (আ) আসলেন এবং একাই পাথরটি উঠালেন। তারপর তিনি তাদেরকে ও তাদের বকরীগুলোকে পানি পান করালেন এবং পাথরটি পূর্বের জায়গায় রেখে দিলেন।

আমীরুল মুমিনীন উমর (রা) বলেন, পাথরটি দশজনে উঠাতে পারত। তিনি একবালতি পানি উঠালেন এবং তাতে দু’জনের প্রয়োজন মিটে যায়। পুনরায় তিনি গাছের ছায়ায় ফিরে গেলেন। তাফসীরকারগণ বলেন, এটা সামার গাছের ছায়া। ইব্‌ন জারীর তাবারী (র) ইব্‌ন মাসউদ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি এই গাছটিকে সবুজ ও ছায়াদার দেখেছেন। মূসা (আ) বলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহই অবতীর্ণ করবেন আমি তার কাঙ্গাল।”

আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেন, মূসা (আ) মিসর থেকে মাদায়ান ভ্রমণকালে শাক সবজি ও গাছের পাতা ব্যতীত অন্য কিছু খেতে পাননি। তার পায়ে তখন জুতা ছিল না। জুতা না থাকায় দুই পায়ের তলায় যখম হয়ে গিয়েছিল। তিনি গাছের ছায়ায় বসলেন। তিনি ছিলেন সৃষ্টিকুলের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত ব্যক্তি। অথচ ক্ষুধার কারণে তাঁর পেট পিঠের সাথে লেগে গিয়েছিল এবং তার দেহে এর প্রভাব দৃশ্যমান ছিল। আর তখন তিনি এক টুকরো খেজুরের পর্যন্ত মুখাপেক্ষী ছিলেন। এ আয়াত প্রসঙ্গে আতা ইব্‌ন সাইব (র) বলেন। তিনি নারীদেরকে শুনিয়ে এ দু’আটি করেছিলেন।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَجَآءَتۡہُ اِحۡدٰىہُمَا تَمۡشِیۡ عَلَی اسۡتِحۡیَآءٍ ۫ قَالَتۡ اِنَّ اَبِیۡ یَدۡعُوۡکَ لِیَجۡزِیَکَ اَجۡرَ مَا سَقَیۡتَ لَنَا ؕ فَلَمَّا جَآءَہٗ وَ قَصَّ عَلَیۡہِ الۡقَصَصَ ۙ قَالَ لَا تَخَفۡ ٝ نَجَوۡتَ مِنَ الۡقَوۡمِ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۲۵﴾ قَالَتۡ اِحۡدٰىہُمَا یٰۤاَبَتِ اسۡتَاۡجِرۡہُ ۫ اِنَّ خَیۡرَ مَنِ اسۡتَاۡجَرۡتَ الۡقَوِیُّ الۡاَمِیۡنُ ﴿۲۶﴾ قَالَ اِنِّیۡۤ اُرِیۡدُ اَنۡ اُنۡکِحَکَ اِحۡدَی ابۡنَتَیَّ ہٰتَیۡنِ عَلٰۤی اَنۡ تَاۡجُرَنِیۡ ثَمٰنِیَ حِجَجٍ ۚ فَاِنۡ اَتۡمَمۡتَ عَشۡرًا فَمِنۡ عِنۡدِکَ ۚ وَ مَاۤ اُرِیۡدُ اَنۡ اَشُقَّ عَلَیۡکَ ؕ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰہُ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۲۷﴾ قَالَ ذٰلِکَ بَیۡنِیۡ وَ بَیۡنَکَ ؕ اَیَّمَا الۡاَجَلَیۡنِ قَضَیۡتُ فَلَا عُدۡوَانَ عَلَیَّ ؕ وَ اللّٰہُ عَلٰی مَا نَقُوۡلُ وَکِیۡلٌ ﴿٪ ۲۸﴾

অর্থাৎ–নারী দ্বয়ের একজন শরমজনিত পায়ে তার নিকট আসল এবং বলল, “আমার পিতা আপনাকে আমন্ত্রণ করেছেন, আমাদের জানোয়ারগুলোকে পানি পান করানোর পারিশ্রমিক দেয়ার জন্য, তারপর মূসা (আ) তাঁর নিকট এসে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলে সে বলল, ভয় করো না তুমি জালিম সম্প্রদায়ের কবল থেকে বেঁচে গিয়েছ। তাদের একজন বলল, হে পিতা! তুমি একে মজুর নিযুক্ত কর, কারণ তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।” সে মূসা (আ)-কে বলল, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই এ শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে- যদি তুমি দশবছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তুমি আমাকে সদাচারী পাবে। মূসা (আ) বলল, “আমার ও আপনার মধ্যে এ চুক্তিই রইল।’ এ দুটি মেয়াদের কোন একটি আমি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি আল্লাহ তার সাক্ষী। (২৮ কাসাসঃ ২৫-২৮)

মূসা (আ) গাছের ছায়ায় বসে যখন বললেনঃ

رب اني لما انزلت الي من خير فقير

তখন নারীদ্বয় তা শুনতে পান এবং তারা দু’জন তাদের পিতার কাছে গেলেন। কথিত আছে, তাঁদের এরূপ ত্বরান্বিত প্রত্যাবর্তনে শুয়ায়ব (আ) তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তারা যখন তাঁকে মূসা (আ)-এর ঘটনা সম্পর্কে জানালেন, তখন শুয়ায়ব (আ) তাদের একজনকে মূসা (আ)-কে ডেকে আনতে পাঠালেন। তাদের একজন আযাদ নারীসুলভ শরম জড়িত পায়ে তাঁর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমার পিতা পানি পান করানোর পারিশ্রমিক দেয়ার জন্যে আপনাকে ডাকছেন। তিনি কথাটি স্পষ্ট করে বললেন, যাতে মূসা (আ) তার কথায় কোনরূপ সন্দেহ না করেন। এটা ছিল তার লজ্জা ও পবিত্রতার পূর্ণতার প্রমাণ। যখন মূসা (আ) শুয়ায়ব (আ)-এর কাছে আগমন করলেন এবং তাঁর মিসর ও ফিরআউন থেকে তার পলায়ন করে আসার যাবতীয় ঘটনা শুয়ায়ব (আ)-এর কাছে বর্ণনা করলেন তখন তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি ভয় করো না, তুমি জালিম সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব থেকে বের হয়ে এসেছ, এখন আর তুমি তাদের রাজ্যে নও।’

এই বৃদ্ধ কে? এ নিয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, “তিনি হচ্ছেন শুয়ায়ব (আ)।” এটাই অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারীর কাছে সুপ্রসিদ্ধ অভিমত। হাসান বসরী (র) ও মালিক ইব্‌ন আনাস (র) এ মত পোষণ করেন। এ ব্যাপারে একটি হাদীসেও সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। তবে এর সনদে কিছু সন্দেহ রয়েছে। অন্য একজন প্রকাশ্যভাবে বলেছেন যে, শুয়ায়ব (আ) তার সম্প্রদায় ধ্বংস হবার পরও অনেকদিন জীবিত ছিলেন। অতঃপর মূসা (আ) তাঁর যুগ পান এবং তাঁর কন্যাকে বিবাহ করেন।

ইব্‌ন আবু হাতিম (র) প্রমুখ হাসান বসরী (র) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, মূসা (আ)-এর ঘটনা সংশ্লিষ্ট এ ব্যক্তির নাম শুয়ায়ব, তিনি মাদায়ানে কূয়ার মালিক ছিলেন কিন্তু তিনি মাদায়ানের নবী শুয়ায়ব নন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন শুয়ায়ব (আ)-এর ভাতিজা। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন শুয়ায়ব (আ)-এর চাচাতো ভাই। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন শুয়ায়বের সম্প্রদায়ের একজন মুমিন বান্দা। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন একজন লোক যার নাম ইয়াসরূন। কিতাবীদের গ্রন্থাদিতে এরূপ বিবরণ রয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, ইয়াসরূন ছিলেন একজন বড় ও জ্ঞানী জ্যোতিষী। আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) ও আবু উবায়দা ইব্‌ন আবদুল্লাহ (র) তাঁর নাম ইয়াসরূন বলে উল্লেখ করেছেন। আবু উবায়দা আরো বলেন, তিনি ছিলেন শুয়ায়ব (আ)-এর ভাতিজা। আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) এ বর্ণনায় বাড়িয়ে বলেন, তিনি ছিলেন মাদায়ানের লোক।

মোটকথা, যখন শুয়ায়ব (আ) মূসা (আ)-কে আতিথ্য ও আশ্রয় দান করলেন, তখন তিনি তাঁর সমস্ত কাহিনী শুয়ায়ব (আ)-এর কাছে বর্ণনা করলেন। তখন শুয়ায়ব (আ) তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, তিনি জালিমদের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করেছেন। তখন দুই কন্যার একজন তাঁর পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! তাকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তোমার বকরী চরাবার জন্যে নিযুক্ত কর। তারপর সে তার প্রশংসা করে বলল যে, মূসা (আ) শক্তিশালী এবং আমানতদারও বটে। উমর (রা), আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা), কাযী শুরায়হ (র), আবু মালিক (র), কাতাদা (র), মুহম্মদ ইব্‌ন ইসহাক (র) প্রমুখ বলেন, “শুয়ায়ব (আ)-এর কন্যা যখন মূসা (আ) সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করলেন, তখন তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, তুমি তা কেমন করে জানলে?” জবাবে তিনি বললেন, তিনি এমন একটি পাথর উত্তোলন করেছেন যা উত্তোলন করতে দশজন লোকের প্রয়োজন। আবার আমি যখন তার সাথে বাড়ি আসছিলাম, আমি তার সামনে পথ চলছিলাম, এক পর্যায়ে তিনি বললেন, “তুমি আমার পেছনে পেছনে চল, আর যখন বিভিন্ন রাস্তার মাথা দেখা দেবে তখন তুমি কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে আমাকে পথ নির্দেশ করবে।”

আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রা) বলেন, তিন ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা অতি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন—

(১) ইউসুফ (আ)-এর ক্রেতা–যখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, “সম্মান জনকভাবে তার থাকবার ব্যবস্থা কর।”

(২) মূসা (আ)-এর সঙ্গিনী—যখন তিনি বলেছিলেন, “হে আমার পিতা! তুমি তাকে মজুর নিযুক্ত কর, কারণ তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।”

(৩) আবু বকর সিদ্দীক (রা) যখন তিনি উমর (রা) ইব্ন আল খাত্তাবকে খলীফা মনোনীত করেন। অতঃপর শুয়ায়ব (আ) বলেনঃ

قَالَ إِنِّیۤ أُرِیدُ أَنۡ أُنكِحَكَ إِحۡدَى ٱبۡنَتَیَّ هَـٰتَیۡنِ عَلَىٰۤ أَن تَأۡجُرَنِی ثَمَـٰنِیَ حِجَج ۖ فَإِنۡ أَتۡمَمۡتَ عَشۡر ا فَمِنۡ عِندِكَۖ وَمَاۤ أُرِیدُ أَنۡ أَشُقَّ عَلَیۡكَۚ سَتَجِدُنِیۤ إِن شَاۤءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰلِحِینَ [Surat Al-Qasas 27]

অর্থাৎ– সে বলল, “আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে, যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহে তো তুমি আমাকে সদাচারী রূপে পাবে।”

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা আবু হানীফা (র)-এর কিছু সংখ্যক অনুসারী দলীল পেশ করেন যে, যদি কেউ বলে, আমি দুটি দাসের মধ্যে একটি, কিংবা কাপড় দু’টির একটি, অনুরূপভাবে অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রেও দুটির একটি বিক্রি করব তাহলে এরূপ বলা শুদ্ধ হবে। কেননা, শুয়ায়ব (আ) বলেছিলেন, অর্থাৎ- আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে। আসলে এ যুক্তি যথার্থ নয়; কেননা, বিয়ের ক্ষেত্রটি হচ্ছে পরস্পর সম্মতির ব্যাপার, ব্যবসায়ের মত লেনদেনের ব্যাপার নয়। আল্লাহ তা‘আলাই সম্যক জ্ঞাত।

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা ইমাম আহমদ (র)-এর অনুসারিগণ প্রচলিত প্রথা অনুসারে আহার ও বাসস্থানের বিনিময়ে মজুর নিযুক্তির বৈধতার প্রমাণ বলে পেশ করেন। ইব্‌ন মাজাহ্ (র) তার ‘সুনান গ্রন্থে باب استجار الاجير অর্থাৎ শ্রমিক নিয়োগ শিরোনামে পেটেভাতে মজুর নিযুক্তির বৈধতা প্রমাণার্থে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন-এ হাদীসটিও প্রসঙ্গক্রমে তারা উল্লেখ করেছেন। উতবা ইব্‌ন নুদ্‌র (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। রাসূল (সাঃ) সূরা কাসাস পাঠ করলেন। তিনি যখন মূসা (আ)-এর ঘটনায় পৌঁছলেন তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই মূসা (আ) আট বছর কিংবা দশ বছর পেটেভাতে এবং চরিত্রের পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে কায়িক শ্রম করেছেন। তবে হাদীসটি দুর্বল বিধায় এর দ্বারা দলীল পেশ করা যায় না। অন্য এক সূত্রে ইব্‌ন আবু হাতিম (র) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

( قَالَ ذَلِكَ بَیۡنِی وَبَیۡنَكَۖ أَیَّمَا ٱلۡأَجَلَیۡنِ قَضَیۡتُ فَلَا عُدۡوَنَ عَلَیَّۖ وَٱللَّهُ عَلَىٰ مَا نَقُولُ وَكِیل ࣱ)

[Surat Al-Qasas 28]

অর্থাৎ–মূসা (আ) তাঁর ভাবী শ্বশুরকে বলেন, আপনি যে চুক্তির কথা বলেছেন তাই স্থির হল, তবে দুই মেয়াদের মধ্যে যে কোনটাই আমি পূর্ণ করব, আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি আল্লাহ তার সাক্ষী। এতদসত্ত্বেও মূসা (আ) দু’টির মধ্যে দীর্ঘতমটি পূর্ণ করেন অর্থাৎ পূর্ণ ১০ বছর তিনি মজুরি করেন।

ইমাম বুখারী (র) সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র (রা) সূত্রে বর্ননা করেন, তিনি বলেন, হীরার অধিবাসী একজন ইহুদী আমাকে প্রশ্ন করল, اى الا جلين قضى موسى অর্থাৎ মূসা (আ) কোন্ মেয়াদটি পূরণ করেছিলেন? বললাম, আমি জানি না, তবে আরবের মহান শিক্ষিত লোকটির কাছে জিজ্ঞাসা করব। অতঃপর আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর নিকট এসে তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, দু’টির মধ্যে যেটা অধিক ও বেশি পছন্দনীয় সেটাই তিনি পূরণ করেছিলেন। কেননা, আল্লাহর নবী যা বলেন তা অবশ্যই করেন।

ইমাম নাসাঈ (র)ও অন্য এক সূত্রে সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র (রা) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেন।

ইব্‌ন জারীর তাবারী (র)ও অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, “একদিন আমি জিবরাঈল (আ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, “মূসা (আ) কোন্ মেয়াদটি পূর্ণ করেছিলেন? তখন তিনি বলেন, যেটা বেশি পরিপূর্ণ সেটাই তিনি পূরণ করেছিলেন।” ইমাম আল বাযযার (র) অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) হতে অনুরূপ বর্ণনা পেশ করেছেন।

ইমাম সানীদ (র) মুজাহিদ (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) একদিন এ ব্যাপারে জিবরাঈল (আ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন। পুনরায় জিবরাঈল (আ) এ সম্বন্ধে ইসরাফীল (আ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন। ইসরাফীল (আ) মহান প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলাকে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, যেটি অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর।

ইব্‌ন জারীর তাবারী (র)-ও অন্য এক সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, মূসা (আ) কোন্ মেয়াদটি পূরণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যেটা অধিক পরিপূর্ণ সেটাই তিনি পূরণ করেছিলেন। ইমাম আল বাযযার (র) ও ইব্‌ন আবু হাতিম (র) আবু যর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে একদিন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, মূসা (আ) কোন্ মেয়াদটি পূরণ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যেটা অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর। তিনি বলেন, “যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কোন কন্যাটিকে মূসা (আ) বিয়ে করেছিলেন, তখন বলে দাও, ছোট কন্যাটিকে।”

ইমাম আল বায্‌যার (র) ও ইব্‌ন আবূ হাতিম (র) অন্য এক সূত্রে উতবা ইব্‌ন নুদর (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, মূসা (আ) জীবিকা নির্বাহ ও চরিত্রের হেফাজতের জন্যে মজুরি করেছেন। এরপর তিনি যখন মেয়াদ পূরণ করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল কোন্ মেয়াদটি ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি উত্তরে বলেন, যেটি অধিক পরিপূর্ণ ও অধিক কল্যাণকর।

যখন মূসা (আ) শুয়ায়ব (আ) হতে বিদায় গ্রহণের ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, তাঁর পিতার নিকট থেকে কিছু বকরী চেয়ে নিতে যাতে তারা এগুলো দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। তাই এ বছর যতগুলো বকরী মায়ের রংয়ের ভিন্ন রং-এ জন্ম নিয়েছে সেগুলি তাকে দান করলেন। তাঁর বকরীগুলো ছিলো কালো ও সুন্দর। মূসা (আ) লাঠি নিয়ে গেলেন এবং একদিক থেকে এগুলোকে পৃথক করলেন। অতঃপর এগুলোকে পানির চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে গেলেন এবং পানি পান করালেন। মূসা (আ) চৌবাচ্চার পাশে দাঁড়ালেন। কিন্তু একটি বকরীও পানি পান শেষ করে নিজ ইচ্ছায় ছুটে আসল না। যতক্ষণ না তিনি একটি একটি করে মৃদু প্রহার করেন। বর্ণনাকারী বলেন, দুই-একটি ব্যতীত বকরীগুলো প্রতিটি যমজ, বকনা এবং মায়ের রংয়ের অন্য রং-এর বাচ্চা জন্ম দেয়। এগুলোর মধ্যে চওড়া বুক, লম্বা বাঁট, সংকীর্ণ বুক, একেবারে ছোট বাট এবং হাতে ধরা যায় না এরূপ বাটের অধিকারী বকরী ছিল না। অর্থাৎ সবগুলোই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যদি তোমরা সিরিয়া পৌঁছতে পারতে তাহলে তোমরা এখনও ঐ জাতের বকরী দেখতে পেতে। এসব বকরী হচ্ছে সামেরীয়। এ হাদীসটি মরফূ’ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

ইব্‌ন জারীর তাবারী (র) আনাস ইবনে মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন আল্লাহর নবী মূসা (আ) তার নিয়োগকর্তাকে মেয়াদপূর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন তিনি বললেন, প্রতিটি বকরীই তোমার, যা তার মায়ের রং-এ জন্ম নেবে। মূসা (আ) মানুষের একটি আকৃতি পানিতে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যখন বকরীগুলো মানুষের আকৃতি দেখল, ভয় পেয়ে গেল এবং ছুটাছুটি করতে লাগল। একটি ব্যতীত সবগুলোই চিত্রা বাচ্চা জন্ম দিল। মূসা (আ) ঐ বছরের সব বাচ্চা নিয়ে নিলেন। এ বর্ণনাটির রাবীগণ বিশ্বস্ত। অনুরূপ ঘটনা হযরত ইয়াকূব (আ) সম্পর্কেও পূর্বে বর্ণিত আছে। আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত। আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ

فَلَمَّا قَضٰی مُوۡسَی الۡاَجَلَ وَ سَارَ بِاَہۡلِہٖۤ اٰنَسَ مِنۡ جَانِبِ الطُّوۡرِ نَارًا ۚ قَالَ لِاَہۡلِہِ امۡکُثُوۡۤا اِنِّیۡۤ اٰنَسۡتُ نَارًا لَّعَلِّیۡۤ اٰتِیۡکُمۡ مِّنۡہَا بِخَبَرٍ اَوۡ جَذۡوَۃٍ مِّنَ النَّارِ لَعَلَّکُمۡ تَصۡطَلُوۡنَ ﴿۲۹﴾ فَلَمَّاۤ اَتٰىہَا نُوۡدِیَ مِنۡ شَاطِیَٴ الۡوَادِ الۡاَیۡمَنِ فِی الۡبُقۡعَۃِ الۡمُبٰرَکَۃِ مِنَ الشَّجَرَۃِ اَنۡ یّٰمُوۡسٰۤی اِنِّیۡۤ اَنَا اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ ۳۰﴾ وَ اَنۡ اَلۡقِ عَصَاکَ ؕ فَلَمَّا رَاٰہَا تَہۡتَزُّ کَاَنَّہَا جَآنٌّ وَّلّٰی مُدۡبِرًا وَّ لَمۡ یُعَقِّبۡ ؕ یٰمُوۡسٰۤی اَقۡبِلۡ وَ لَا تَخَفۡ اِنَّکَ مِنَ الۡاٰمِنِیۡنَ ﴿۳۱﴾ اُسۡلُکۡ یَدَکَ فِیۡ جَیۡبِکَ تَخۡرُجۡ بَیۡضَآءَ مِنۡ غَیۡرِ سُوۡٓءٍ ۫ وَّ اضۡمُمۡ اِلَیۡکَ جَنَاحَکَ مِنَ الرَّہۡبِ فَذٰنِکَ بُرۡہَانٰنِ مِنۡ رَّبِّکَ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۳۲﴾

মূসা (আ) যখন তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করবার পর সপরিবারে যাত্রা করল, তখন সে তুর পর্বতের দিকে আগুন দেখতে পেল। সে তার পরিবারবর্গকে বলল, তোমরা অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবত আমি সেখান থেকে তোমাদের জন্য খাবার আনতে পারি অথবা এক খণ্ড জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড আনতে পারি, যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। যখন মূসা (আ) আগুনের নিকট পৌঁছল, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষের দিক হতে তাকে আহ্বান করে বলা হল, হে মূসা! আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর,’ তারপর যখন সে এটাকে সাপের মত ছুটোছুটি করতে দেখল, তখন পেছনের দিকে ছুটতে লাগল এবং ফিরে তাকাল না। তাকে বলা হল, হে মূসা! সম্মুখে আস, ভয় করো না, তুমি তো নিরাপদ। তোমার হাত তোমার বগলে রাখ, এটা বের হয়ে আসবে শুভ্র সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করবার জন্য তোমার হাত দুটি নিজের দিকে চেপে ধর। এ দুটি তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের জন্য। ওরা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। (সূরা কাসাসঃ ২৯-৩২)

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মূসা (আ) পূর্ণতর মেয়াদ অর্থাৎ দশ বছর পূরণ করেছেন। মুজাহিদ (র) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রথম তিনি ১০ বছর পূরা করেন, পরে আরো দশ বছর। আয়াতে উল্লেখিত—এর অর্থ হচ্ছে, মূসা (আ) তাঁর শ্বশুরের নিকট থেকে সপরিবারে রওয়ানা হলেন। একাধিক মুফাসসির ও অন্যান্য উলামা বর্ণনা করেন যে, মূসা (আ) তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাকাতের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তাই তিনি গোপনে মিসরে গিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করতে মনস্থ করলেন। যখন তিনি সপরিবারে রওয়ানা হলেন তখন তাঁর সাথে ছিল ছেলে-মেয়ে ও বকরীর পাল। যা তিনি তার অবস্থানকালে অর্জন করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন, ঘটনাচক্রে তার যাত্রার রাতটি ছিল অন্ধকার ও ঠাণ্ডা। তারা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন, পরিচিত রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করেও তারা আগুন জ্বালাতে ব্যর্থ হন। অন্ধকার ও ঠাণ্ডা তীব্র আকার ধারণ করল। এ অবস্থায় হঠাৎ তিনি দূরে অগ্নিশিখা দেখতে পেলেন যা তূর পর্বতের এক অংশে প্রজ্বলিত ছিল। এটা ছিল তূর পর্বতের পশ্চিমাংশ যা ছিল তার ডান দিকে। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখতে পেয়েছি।’ আল্লাহই ভাল জানেন।

সম্ভবত এ আগুন শুধু তিনিই দেখেছেন অন্য কেউ দেখেননি; কেননা, এই আগুন প্রকৃত পক্ষে নূর ছিল, যা সকলের দৃষ্টিগোচর হয় না। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে বললেন, আমি হয়ত সেখান থেকে সঠিক রাস্তার সন্ধান পেতে পারব। কিংবা আগুনের কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে আসবো যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। সূরায়ে তা-হার আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। যেখানে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ ہَلۡ اَتٰىکَ حَدِیۡثُ مُوۡسٰی ۘ ﴿۹﴾ اِذۡ رَاٰ نَارًا فَقَالَ لِاَہۡلِہِ امۡکُثُوۡۤا اِنِّیۡۤ اٰنَسۡتُ نَارًا لَّعَلِّیۡۤ اٰتِیۡکُمۡ مِّنۡہَا بِقَبَسٍ اَوۡ اَجِدُ عَلَی النَّارِ ہُدًی ﴿۱۰﴾

অর্থাৎ–মূসার বৃত্তান্ত তোমার নিকট পৌঁছেছে কি? সে যখন আগুন দেখল তখন তার পরিবারবর্গকে বলল, তোমরা এখানে থাক, আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবত আমি তোমাদের জন্য তা হতে কিছু জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে আসতে পারব অথবা আমি তার নিকট কোন পথনির্দেশ পাব। (সূরা তা-হাঃ ৯-১০)

এতে প্রমাণিত হয় যে, সেখানে অন্ধকার ছিল এবং তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

اِذۡ قَالَ مُوۡسٰی لِاَہۡلِہٖۤ اِنِّیۡۤ اٰنَسۡتُ نَارًا ؕ سَاٰتِیۡکُمۡ مِّنۡہَا بِخَبَرٍ اَوۡ اٰتِیۡکُمۡ بِشِہَابٍ قَبَسٍ لَّعَلَّکُمۡ تَصۡطَلُوۡنَ ﴿۷﴾

অর্থাৎ–স্মরণ কর, সে সময়ের কথা যখন মূসা (আ) তার পরিবারবর্গকে বলেছিল- আমি আগুন দেখেছি, সত্বর আমি সেখান থেকে তোমাদের জন্য কোন খবর আনব অথবা তোমাদের জন্য আনব জ্বলন্ত অঙ্গার যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। (সূরা নামলঃ ৭)

বাস্তবিকই তিনি তাদের নিকট সেখান থেকে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন, সে কী সুসংবাদ। তিনি সেখানে উত্তম পথনির্দেশ পেয়েছিলেন, কী উত্তম পথনির্দেশ! তিনি সেখান থেকে নূর নিয়ে এসেছিলেন, কী চমৎকার সে নূর! অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَلَمَّاۤ اَتٰىہَا نُوۡدِیَ مِنۡ شَاطِیَٴ الۡوَادِ الۡاَیۡمَنِ فِی الۡبُقۡعَۃِ الۡمُبٰرَکَۃِ مِنَ الشَّجَرَۃِ اَنۡ یّٰمُوۡسٰۤی اِنِّیۡۤ اَنَا اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ ۳۰﴾

অর্থাৎ–যখন মূসা (আ) আগুনের নিকট পৌঁছল, তখন উপত্যকার দক্ষিণ পার্শ্বে পবিত্র ভূমিস্থিত এক বৃক্ষ হতে তাকে আহ্বান করে বলা হল, হে মূসা! আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক। (সূরা কাসাসঃ ৩০)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَلَمَّا جَآءَہَا نُوۡدِیَ اَنۡۢ بُوۡرِکَ مَنۡ فِی النَّارِ وَ مَنۡ حَوۡلَہَا ؕ وَ سُبۡحٰنَ اللّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۸﴾

অর্থাৎ–অতঃপর সে যখন তাঁর নিকট আসল তখন ঘোষিত হল, ধন্য যারা রয়েছে এ আলোর মধ্যে এবং যারা রয়েছে তার চতুষ্পার্শ্বে, জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ পবিত্র ও মহিমান্বিত। (সূরা নামলঃ ৮)

অর্থাৎ যিনি যা ইচ্ছা তা করেন এবং যা ইচ্ছা নির্দেশ করেন। এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন হে মূসা! আমি তো আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

সূরা তা-হায় আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَلَمَّاۤ اَتٰىہَا نُوۡدِیَ یٰمُوۡسٰی ﴿ؕ ۱۱﴾ اِنِّیۡۤ اَنَا رَبُّکَ فَاخۡلَعۡ نَعۡلَیۡکَ ۚ اِنَّکَ بِالۡوَادِ الۡمُقَدَّسِ طُوًی ﴿ؕ ۱۲﴾ وَ اَنَا اخۡتَرۡتُکَ فَاسۡتَمِعۡ لِمَا یُوۡحٰی ﴿۱۳﴾ اِنَّنِیۡۤ اَنَا اللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدۡنِیۡ ۙ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ لِذِکۡرِیۡ ﴿۱۴﴾ اِنَّ السَّاعَۃَ اٰتِیَۃٌ اَکَادُ اُخۡفِیۡہَا لِتُجۡزٰی کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا تَسۡعٰی ﴿۱۵﴾ فَلَا یَصُدَّنَّکَ عَنۡہَا مَنۡ لَّا یُؤۡمِنُ بِہَا وَ اتَّبَعَ ہَوٰىہُ فَتَرۡدٰی ﴿۱۶﴾

অতঃপর যখন সে আগুনের নিকট আসল তখন আহ্বান করে বলা হল, ‘হে মূসা! আমিই তোমার প্রতিপালক। অতএব তোমার পাদুকা খুলে ফেল, কারণ তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় রয়েছ। এবং আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব, যা ওহী প্রেরণ করা হচ্ছে তুমি তা মনোযোগের সাথে শুন! আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। অতএব, আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর। কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, আমি এটা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেকেই নিজ কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে। সুতরাং, যে ব্যক্তি কিয়ামতে বিশ্বাস করে না ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে এটাতে বিশ্বাস স্থাপনে নিবৃত্ত না করে, নিবৃত্ত হলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। (সূরা তা-হাঃ ১১-১৬)

প্রাচীন যুগের ও পরবর্তীকালের একাধিক মুফাসসির বলেন, মূসা (আ) যে আগুন দেখলেন তার কাছে পৌঁছতে তিনি মনস্থ করলেন। সেখানে পৌঁছে সবুজ কাটা গাছে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পেলেন। এ আগুনের মধ্যকার সবকিছু দাউ দাউ করে জ্বলছে অথচ গাছের শ্যামলিমা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। অবাক হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। আর এই গাছটি ছিল পশ্চিমদিকের পাহাড়ে তাঁর ডানদিকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ مَا کُنۡتَ بِجَانِبِ الۡغَرۡبِیِّ اِذۡ قَضَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسَی الۡاَمۡرَ وَ مَا کُنۡتَ مِنَ الشّٰہِدِیۡنَ ﴿ۙ ۴۴﴾

মূসাকে যখন আমি বিধান দিয়েছিলাম তখন তুমি পশ্চিম প্রান্তে উপস্থিত ছিলে না এবং তুমি প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলে না। (সূরা কাসাসঃ ৪৪)

মূসা (আ) যে উপত্যকায় ছিলেন তার নাম হচ্ছে তূওয়া। মূসা (আ) কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন। আর এই গাছটি ছিল পশ্চিম পার্শ্বে তাঁর ডানদিকে। সেখানে অবস্থিত তুওয়া নামক পবিত্র উপত্যকায় তার প্রতিপালক তাকে আহ্বান করলেন। প্রথমত তিনি তাকে ঐ পবিত্র স্থানটির সম্মানার্থে পাদুকা খুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন এবং বিশেষ করে ঐ পবিত্র রাতের সম্মানার্থে।

কিতাবীদের মতে, মূসা (আ) এই নূরের তীব্রতার কারণে দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়ার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নিজের চেহারার উপর হাত রাখলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে সম্বোধন করে বলেন, “নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালক।

ইরশাদ হচ্ছেঃ

اني انا الله لا إله إلا أنا فاغبانی . وأقم الصلوة لذكري .

অর্থাৎ–‘আমি জগতসমূহের প্রতিপালক, যিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। শুধু তাঁর জন্যেই ইবাদত ও সালাত নির্ধারিত, অন্য কেউ এর যোগ্য নয়। আর আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর। অতঃপর তিনি সংবাদ দেন যে, এই পৃথিবী স্থায়ী বাসস্থান নয় বরং স্থায়ী বাসস্থান হচ্ছে কিয়ামত দিবসের পরের বাসস্থান যার অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব অবশ্যম্ভাবী, যাতে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমল অনুসারে ভাল ও মন্দ কর্মফল ভোগ করতে পারে। এই আয়াতের মাধ্যমে উক্ত বাসস্থান লাভের জন্য আমল করার এবং মাওলার নাফরমান ও প্রবৃত্তির পূজারী এবং অবিশ্বাসী বান্দাদের থেকে দূরে থাকার জন্যে মূসা (আ)-কে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। অতঃপর তাকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি কোন বস্তুর সৃষ্টির পূর্বে নির্দেশ দেন হয়ে যাও তখন তা হয়ে যায়।

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ ইরশাদ করেনঃ

وَمَا تِلۡكَ بِیَمِینِكَ یَـٰمُوسَىٰ ۝ قَالَ هِیَ عَصَایَ أَتَوَكَّؤُا۟ عَلَیۡهَا وَأَهُشُّ بِهَا عَلَىٰ غَنَمِی وَلِیَ فِیهَا مَـَٔارِبُ أُخۡرَىٰ ۝ قَالَ أَلۡقِهَا یَـٰمُوسَىٰ ۝ فَأَلۡقَىٰهَا فَإِذَا هِیَ حَیَّة تَسۡعَىٰ [Surat Ta-Ha 17 - 20]

অর্থাৎ—“হে মূসা! তোমার ডান হাতে এটা কী? অর্থাৎ এটা কি তোমার লাঠি নয়, ‘তোমার কাছে আসার পর থেকে যা তোমার পরিচিত?’ তিনি বললেন, এটা আমার লাঠি যা আমি সম্যক চিনি, এটাতে আমি ভর দেই এবং এটা দ্বারা আঘাত করে আমি আমার মেষপালের জন্য গাছের পাতা ঝরিয়ে থাকি। আর এটা আমার অন্যান্য কাজেও লাগে। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, “হে মূসা! তুমি এটা নিক্ষেপ কর। অতঃপর তিনি এটা নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে এটা সাপ হয়ে ছুটতে লাগল।”

এটা একটি বিরাট অলৌকিক ব্যাপার এবং একটি অকাট্য প্রমাণ যে, যিনি মূসা (আ)-এর সাথে কথা বলেছেন, তিনি যখন কোন বস্তু সৃষ্টির পূর্বে বলেন كن (হয়ে যাও) তখন তা হয়ে যায়। তিনি তার ইচ্ছা মুতাবিক কাজ আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।

কিতাবীদের মতে, মিসরীয়দের মূসা (আ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার আশঙ্কা থাকায় তাঁর সত্যতা প্রমাণের জন্যে মূসা (আ) আপন প্রতিপালকের কাছে কোন প্রমাণ প্রার্থনা করেন। তখন মহান প্রতিপালক তাঁকে বললেন - তোমার হাতে এটা কী? তিনি বললেন, এটা আমার লাঠি। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, এটাকে ভূমিতে নিক্ষেপ কর। অতঃপর তিনি এটাকে নিক্ষেপ করলেন, সঙ্গে সঙ্গে এটা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল। মূসা (আ) এটার সম্মুখ থেকে পলায়ন করেন। তখন মহান প্রতিপালক তাকে হাত বাড়াতে এবং এটার লেজে ধরতে নির্দেশ দিলেন। যখন তিনি এটাকে মযবুত করে ধরলেন তার হাতে সেটা পূর্বের মত লাঠি হয়ে গেল।

সূরা কাসাসের (৩১) আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ اَنۡ اَلۡقِ عَصَاکَ ؕ فَلَمَّا رَاٰہَا تَہۡتَزُّ کَاَنَّہَا جَآنٌّ وَّلّٰی مُدۡبِرًا وَّ لَمۡ یُعَقِّبۡ ؕ یٰمُوۡسٰۤی اَقۡبِلۡ وَ لَا تَخَفۡ اِنَّکَ مِنَ الۡاٰمِنِیۡنَ ﴿۳۱﴾

অর্থাৎ–আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠিটি নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন সে এটাকে সাপের মত ছুটাছুটি করতে দেখল তখন সে পিছনের দিকে ছুটতে লাগল এবং ফিরে তাকাল না।’ অর্থাৎ লাঠিটি একটি বড় ভয়ংকর দাঁত বিশিষ্ট অজগরে পরিণত হল। আবার এটা সাপের মত দ্রুত ছুটাছুটি করতে লাগল, আয়াতে উল্লেখিত جان শব্দটি جنان রূপেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটা খুবই সূক্ষ্ম কিন্তু অতি চঞ্চল ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। কাজেই এটার মধ্যে স্থূলতা ও তীব্র গতি লক্ষ্য করে মূসা (আ) পিছনে ছুটতে লাগলেন। কেননা, মানবিক প্রকৃতিতে তিনি প্রকৃতস্থ এবং মানবিক প্রকৃতিও তা-ই চায়। তিনি আর কোন দিকে দেখলেন না। তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে আহ্বান করলেন, হে মূসা! সামনে অগ্রসর হও, তুমি ভয় করবে না, তুমি নিরাপদ। যখন মূসা (আ) ফিরে আসলেন, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সাপটি ধরার জন্যে নির্দেশ দিলেন। বললেন, এটাকে ধর, ভয় করো না, এটাকে আমি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব।’ কথিত আছে, মূসা (আ) অত্যন্ত ভয় পেয়েছিলেন তাই তিনি পশমের কাপড়ের আস্তিনে নিজের হাত রাখলেন। অতঃপর নিজের হাত সাপের মুখে রাখলেন। কিতাবীদের মতে, সাপের লেজে হাত রেখেছিলেন, যখন তিনি এটাকে মজবুত করে ধরলেন, তখন এটা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসল এবং দুই শাখাবিশিষ্ট পূর্বেকার লাঠিতে পরিণত হল। সুতরাং মহাশক্তিশালী এবং দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের নিয়ন্তা পাক পবিত্র। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হাত তার বগলে রাখার নির্দেশ দিলেন। এর পর তা বের করতে হুকুম দিলেন। অকস্মাৎ তা চাঁদের মত শুভ্র-সমুজ্জ্বল হয়ে চক্ চক্ করতে লাগল। অথচ এটা কোন রোগের কারণ নয়, এটা শ্বেত রোগের কারণে নয় বা অন্য কোন চর্মরোগের কারণেও নয়।

এজন্য আল্লাহ তা‘আলা এর পরের আয়াতে ইরশাদ করেনঃ

اُسۡلُکۡ یَدَکَ فِیۡ جَیۡبِکَ تَخۡرُجۡ بَیۡضَآءَ مِنۡ غَیۡرِ سُوۡٓءٍ ۫ وَّ اضۡمُمۡ اِلَیۡکَ جَنَاحَکَ مِنَ الرَّہۡبِ ﴿۳۲﴾

অর্থাৎ—তোমার হাত তোমার বগলে রাখ, এটা বের হয়ে আসবে শুভ্র-সমুজ্জ্বল নির্দোষ হয়ে। ভয় দূর করার জন্যে তোমার হাত দুটি নিজের দিকে চেপে ধর। (সূরা কাসাসঃ ৩২)

কেউ কেউ বলেন, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যখন তোমার ভয় করবে তোমার হাত তোমার হৃৎপিণ্ডের উপর রাখবে, তাহলে প্রশান্তি লাভ করবে। এ আমলটা যদিও বিশেষভাবে তার জন্যেই ছিল কিন্তু এটার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে তাতে যে বরকত হবে তা যথার্থ। কেননা, যে ব্যক্তি নবীদের অনুসরণের নিয়তে এটা আমল করবে সে উপকার পাবে।

আল্লাহ তা‘আলা সূরায়ে নামলে ইরশাদ করেনঃ

وَ اَدۡخِلۡ یَدَکَ فِیۡ جَیۡبِکَ تَخۡرُجۡ بَیۡضَآءَ مِنۡ غَیۡرِ سُوۡٓءٍ فِیۡ تِسۡعِ اٰیٰتٍ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ قَوۡمِہٖ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۱۲﴾

অর্থাৎ–এবং তোমার হাত তোমার বগলে রাখ। এটা বের হয়ে আসবে শুভ্র নির্মল অবস্থায়। এটা ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের নিকট আনীত নয়টি নিদর্শনের অন্তর্গত। তারা তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়। (সূরা নাম্‌লঃ ১২)

অন্য কথায় লাঠি ও হাত দুটো নিদর্শন যেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা সূরায়ে কাসাসে ইরশাদ করেনঃ

فَذٰنِکَ بُرۡہَانٰنِ مِنۡ رَّبِّکَ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمًا فٰسِقِیۡنَ ﴿۳۲﴾

অর্থাৎ—“এই দু’টি তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত প্রমাণ, ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের জন্যে। ওরা তো ছিল সত্যত্যাগী সম্প্রদায়।” (২৮ঃ ৩২) এ দু’টির সাথে রয়েছে আরো সাতটি। তাহলে মোট হবে নয়টি নিদর্শন।

সূরায়ে বনী ইসরাঈলের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسٰی تِسۡعَ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ فَسۡئَلۡ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اِذۡ جَآءَہُمۡ فَقَالَ لَہٗ فِرۡعَوۡنُ اِنِّیۡ لَاَظُنُّکَ یٰمُوۡسٰی مَسۡحُوۡرًا ﴿۱۰۱﴾ قَالَ لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَاۤ اَنۡزَلَ ہٰۤؤُلَآءِ اِلَّا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ بَصَآئِرَ ۚ وَ اِنِّیۡ لَاَظُنُّکَ یٰفِرۡعَوۡنُ مَثۡبُوۡرًا ﴿۱۰۲﴾

অর্থাৎ—তুমি বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, আমি মূসাকে নয়টি স্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলাম। যখন সে তাদের নিকট এসেছিল, ফিরআউন তাকে বলেছিল, হে মূসা! আমি মনে করি, তুমি তো জাদুগ্রস্ত। মূসা বলেছিল, “তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এই সমস্ত স্পষ্ট নিদর্শন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালকই অবতীর্ণ করেছেন প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ। হে ফিরআউন! আমি তো দেখছি তোমার ধ্বংস আসন্ন। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ১০১-১০২)

এই ঘটনা সূরায়ে আরাফের আয়াতে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ لَقَدۡ اَخَذۡنَاۤ اٰلَ فِرۡعَوۡنَ بِالسِّنِیۡنَ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّہُمۡ یَذَّکَّرُوۡنَ ﴿۱۳۰﴾ فَاِذَا جَآءَتۡہُمُ الۡحَسَنَۃُ قَالُوۡا لَنَا ہٰذِہٖ ۚ وَ اِنۡ تُصِبۡہُمۡ سَیِّئَۃٌ یَّطَّیَّرُوۡا بِمُوۡسٰی وَ مَنۡ مَّعَہٗ ؕ اَلَاۤ اِنَّمَا طٰٓئِرُہُمۡ عِنۡدَ اللّٰہِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۳۱﴾ وَ قَالُوۡا مَہۡمَا تَاۡتِنَا بِہٖ مِنۡ اٰیَۃٍ لِّتَسۡحَرَنَا بِہَا ۙ فَمَا نَحۡنُ لَکَ بِمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۳۲﴾ فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمُ الطُّوۡفَانَ وَ الۡجَرَادَ وَ الۡقُمَّلَ وَ الضَّفَادِعَ وَ الدَّمَ اٰیٰتٍ مُّفَصَّلٰتٍ فَاسۡتَکۡبَرُوۡا وَ کَانُوۡا قَوۡمًا مُّجۡرِمِیۡنَ ﴿۱۳۳﴾

অর্থাৎ– আমি তো ফিরআউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা আক্রান্ত করেছি যাতে তারা অনুধাবন করে। যখন তাদের কোন কল্যাণ হত তারা বলত, এটা আমাদের প্রাপ্য আর যখন তাদের কোন অকল্যাণ হত তখন তারা মূসা ও তার সঙ্গীদেরকে অলক্ষুণে গণ্য করত; শোন, তাদের অকল্যাণ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু তাদের অধিকাংশ এটা জানে না। তারা বলল, আমাদেরকে জাদু করবার জন্য তুমি যে কোন নিদর্শন আমাদের নিকট পেশ কর না কেন, আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না। অতঃপর আমি তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়।’ (সূরা আরাফঃ ১৩০-১৩৩)

এ সম্বন্ধে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এ নয়টি হল এমন নিদর্শন বা অন্য দশটি নিদর্শনের থেকে ভিন্ন। এ নয়টি নিদর্শন হল আল্লাহ তা‘আলার কুদরত সম্পর্কীয় আর অন্য দশটি নিদর্শন আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত বিষয়ক তাঁর বাণী সম্পর্কীয়। এ সম্বন্ধে এখানে এজন্য উল্লেখ করে দেয়া হল। কেননা, অনেক বর্ণনাকারীই এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। তারা ধারণা করে থাকেন যে, এ নয়টিই হয়ত উক্ত দশটির অন্তর্ভুক্ত। সূরায়ে বনী ইসরাঈলের শেষাংশের তাফসীরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা যখন মূসা (আ)-কে ফিরআউনের কাছে যাবার জন্যে নির্দেশ দিলেন।

যেমন সূরায়ে কাসাসের আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ

قَالَ رَبِّ اِنِّیۡ قَتَلۡتُ مِنۡہُمۡ نَفۡسًا فَاَخَافُ اَنۡ یَّقۡتُلُوۡنِ ﴿۳۳﴾ وَ اَخِیۡ ہٰرُوۡنُ ہُوَ اَفۡصَحُ مِنِّیۡ لِسَانًا فَاَرۡسِلۡہُ مَعِیَ رِدۡاً یُّصَدِّقُنِیۡۤ ۫ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اَنۡ یُّکَذِّبُوۡنِ ﴿۳۴﴾ قَالَ سَنَشُدُّ عَضُدَکَ بِاَخِیۡکَ وَ نَجۡعَلُ لَکُمَا سُلۡطٰنًا فَلَا یَصِلُوۡنَ اِلَیۡکُمَا ۚۛ بِاٰیٰتِنَاۤ ۚۛ اَنۡتُمَا وَ مَنِ اتَّبَعَکُمَا الۡغٰلِبُوۡنَ ﴿۳۵﴾

অর্থাৎ– “মূসা (আ) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো তাদের একজনকে হত্যা করেছি। ফলে আমি আশংকা করছি, তারা আমাকে হত্যা করবে। আমার ভাই হারুন আমার চাইতে অধিকতর বাগ্মী। অতএব, তাকে আমার সাহায্যকারীরূপে প্রেরণ কর, সে আমাকে সমর্থন করবে। আমি আশংকা করছি, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী ঠাওরাবে। আল্লাহ বললেন, আমি তোমার ভাইয়ের দ্বারা তোমার বাহু শক্তিশালী করব এবং তোমাদের উভয়কে প্রাধান্য দান করব। তারা তোমাদের নিকট পৌঁছতে পারবে না। তোমরা এবং তোমাদের অনুসারীরা আমার নিদর্শন বলে তাদের উপর প্রবল হবে।” (সূরা কাসাসঃ ৩৩-৩৫)

অন্য কথায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দা, রাসূল, প্রত্যক্ষ সম্বোধনকৃত মূসা (আ) সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মূসা (আ) আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের জুলুম ও অত্যাচার হতে পরিত্রাণ পাবার জন্যে মিসর ত্যাগ করেছিলেন। কেননা, তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুলক্রমে এক কিবতীকে হত্যা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন মূসা (আ)-কে ফিরআউনের কাছে যেতে হুকুম দিলেন—তখন মূসা (আ) উত্তরে বলেনঃ

قَالَ رَبِّ إِنِّی قَتَلۡتُ مِنۡهُمۡ نَفۡس ا فَأَخَافُ أَن یَقۡتُلُونِ ۝ وَأَخِی هَـٰرُونُ هُوَ أَفۡصَحُ مِنِّی لِسَان ا فَأَرۡسِلۡهُ مَعِیَ رِدۡء ا یُصَدِّقُنِیۤۖ إِنِّیۤ أَخَافُ أَن یُكَذِّبُونِ

[Surat Al-Qasas 33 – 34]

অর্থাৎ–“হে আল্লাহ! আমার ভাইকে আমার সাহায্যকারী, সমর্থনকারী ও উযীররূপে নিযুক্ত করুন যাতে সে আমাকে তোমার রিসালাত পরিপূর্ণভাবে তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারে; কেননা, সে আমার অপেক্ষা বাগ্মী এবং বর্ণনার ক্ষেত্রে আমার থেকে অধিকতর সমর্থ।

তার আবেদনের প্রতি উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

( سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِأَخِیكَ وَنَجۡعَلُ لَكُمَا سُلۡطَـٰن ا فَلَا یَصِلُونَ إِلَیۡكُمَا بِـَٔایَـٰتِنَاۤۚ أَنتُمَا وَمَنِ ٱتَّبَعَكُمَا ٱلۡغَـٰلِبُونَ )

[Surat Al-Qasas 35]

অর্থাৎ–“আমার নিদর্শনসমূহ তোমাদের নিকট থাকার দরুন তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেন, অর্থাৎ আমার নিদর্শনগুলোর বরকতে তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তোমরা এবং তোমাদের অনুসারিগণ আমার নিদর্শন বলে তাদের উপর প্রবল হবে।

সূরায়ে তা-হার আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ

اِذۡہَبۡ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿٪ ۲۴﴾ قَالَ رَبِّ اشۡرَحۡ لِیۡ صَدۡرِیۡ ﴿ۙ ۲۵﴾ وَ یَسِّرۡ لِیۡۤ اَمۡرِیۡ ﴿ۙ ۲۶﴾ وَ احۡلُلۡ عُقۡدَۃً مِّنۡ لِّسَانِیۡ ﴿ۙ ۲۷﴾ یَفۡقَہُوۡا قَوۡلِیۡ ﴿۪ ۲۸﴾

অর্থাৎ–“ফিরআউনের নিকট যাবে, সে সীমালংঘন করেছে। মূসা (আ) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কর্ম সহজ করে দাও। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দাও। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।” (সূরা তা-হাঃ ২৪-২৮)

কথিত আছে, মূসা (আ) বাল্যকালে ফিরআউনের দাড়ি ধরেছিলেন। তাই ফিরআউন তাঁকে হত্যা করতে মনস্থ করেছিল। এতে আসিয়া (রা) ভীত হয়ে পড়লেন এবং ফিরআউনকে বললেন, মূসা শিশুমাত্র। ফিরআউন মূসা (আ)-এর সামনে খেজুর ও কাঠের অঙ্গার রেখে মূসা (আ)-এর জ্ঞান-বুদ্ধি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। মূসা (আ) খেজুর ধরতে উদ্যত হন, তখন ফেরেশতা এসে তার হাত অঙ্গারের দিকে ফিরিয়ে দিলেন। তখন তিনি অঙ্গার মুখে পুরে দিলেন। অমনি তার জিহ্বার কিছু অংশ পুড়ে যায় ও তার জিহ্বায় জড়তার সৃষ্টি হয়। অতঃপর মূসা (আ) আল্লাহ তা‘আলার কাছে এতটুকু জড়তা দূর করতে আবেদন করলেন যাতে লোকজন তার কথা বুঝতে পারে; তিনি পুরোপুরি জড়তা দূর করার জন্যে দরখাস্ত করেননি।

হাসান বসরী (র) বলেন, ‘নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার দরবারে প্রয়োজন মাফিক দরখাস্ত করে থাকেন। এ জন্য তাঁর জিহ্বায় তার কিছুটা প্রভাব রয়েই যায়। এজন্যে ফিরআউন বলত যে, এটা মূসা (আ)-এর একটি বড় দোষ এবং এ জন্য মূসা (আ) নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে বলতে পারে না; তার মনের কথা উত্তমরূপে বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করতে পারে না।

অতঃপর মূসা (আ) বললেনঃ

وَ اجۡعَلۡ لِّیۡ وَزِیۡرًا مِّنۡ اَہۡلِیۡ ﴿ۙ ۲۹﴾ ہٰرُوۡنَ اَخِی ﴿ۙ ۳۰﴾ اشۡدُدۡ بِہٖۤ اَزۡرِیۡ ﴿ۙ ۳۱﴾ وَ اَشۡرِکۡہُ فِیۡۤ اَمۡرِیۡ ﴿ۙ ۳۲﴾ کَیۡ نُسَبِّحَکَ کَثِیۡرًا ﴿ۙ ۳۳﴾ وَّ نَذۡکُرَکَ کَثِیۡرًا ﴿ؕ ۳۴﴾ اِنَّکَ کُنۡتَ بِنَا بَصِیۡرًا ﴿۳۵﴾ قَالَ قَدۡ اُوۡتِیۡتَ سُؤۡلَکَ یٰمُوۡسٰی ﴿۳۶﴾

অর্থাৎ—“আমার জন্যে করে দাও একজন সাহায্যকারী আমার স্বজনবর্গের মধ্য থেকে; আমার ভাই হারূনকে; তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় কর ও তাকে আমার কার্যে অংশী কর। যাতে আমরা তোমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর এবং তোমাকে স্মরণ করতে পারি- অধিক। তুমি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা। তিনি বললেনঃ হে মূসা! তুমি যা চেয়েছ তোমাকে তা দেয়া হল।” (সূরা তা-হাঃ ২৯-৩৬)

অন্য কথায় তুমি যা কিছুর আবেদন করেছ, আমি তা মঞ্জুর করেছি এবং তুমি যা কিছু চেয়েছ তা তোমাকে দান করেছি। আর এটা হয়েছে আপন প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তার বিশিষ্ট মর্যাদার কারণে। তিনি তাঁর ভাইয়ের প্রতি ওহী প্রেরণের জন্যে সুপারিশ করায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণ করেন। এটা একটা বড় মর্যাদা।

যেমন সূরায়ে আহযাবে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ کَانَ عِنۡدَ اللّٰہِ وَجِیۡہًا ﴿ؕ ۶۹﴾

অর্থাৎ–“আল্লাহর নিকট সে মর্যাদাবান।” (সূরা আহযাবঃ ৬৯)

সূরা মারয়ামের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ وَہَبۡنَا لَہٗ مِنۡ رَّحۡمَتِنَاۤ اَخَاہُ ہٰرُوۡنَ نَبِیًّا ﴿۵۳﴾

অর্থাৎ– “আমি নিজ অনুগ্রহে তাকে দিলাম তার ভাই হারূনকে নবীরূপে।” (সূরা মারয়ামঃ ৫৩)

একদা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (রা) এক ব্যক্তিকে তার সম্প্রদায়ের লোকদের প্রশ্ন করা শুনতে পেলেন। আর তারা সকলে হজের জন্যে ভ্রমণরত ছিলেন। প্রশ্নটি হলো, কোন ভাই তার নিজের ভাইয়ের প্রতি সর্বাধিক ইহসান করেছেন? সম্প্রদায়ের লোকেরা নীরব রইল, তখন আয়েশা (রা) তাঁর হাওদার পাশের লোকদের বললেন, তিনি ছিলেন মূসা (আ) ইব্‌ন ইমরান। তিনি যখন আপন ভাইয়ের নবুওত প্রাপ্তির সুপারিশ করেন, তখন তা আল্লাহ তা‘আলার দরবারে মঞ্জুর হয় এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ওহী নাযিল করেন।

তাই আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَہَبۡنَا لَہٗ مِنۡ رَّحۡمَتِنَاۤ اَخَاہُ ہٰرُوۡنَ نَبِیًّاو

আবার আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা শু‘আরায় ইরশাদ করেনঃ

وَ اِذۡ نَادٰی رَبُّکَ مُوۡسٰۤی اَنِ ائۡتِ الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۙ ۱۰﴾ قَوۡمَ فِرۡعَوۡنَ ؕ اَلَا یَتَّقُوۡنَ ﴿۱۱﴾ قَالَ رَبِّ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اَنۡ یُّکَذِّبُوۡنِ ﴿ؕ ۱۲﴾ وَ یَضِیۡقُ صَدۡرِیۡ وَ لَا یَنۡطَلِقُ لِسَانِیۡ فَاَرۡسِلۡ اِلٰی ہٰرُوۡنَ ﴿۱۳﴾ وَ لَہُمۡ عَلَیَّ ذَنۡۢبٌ فَاَخَافُ اَنۡ یَّقۡتُلُوۡنِ ﴿ۚ ۱۴﴾ قَالَ کَلَّا ۚ فَاذۡہَبَا بِاٰیٰتِنَاۤ اِنَّا مَعَکُمۡ مُّسۡتَمِعُوۡنَ ﴿۱۵﴾ فَاۡتِیَا فِرۡعَوۡنَ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ ۱۶﴾ اَنۡ اَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ ۱۷﴾ قَالَ اَلَمۡ نُرَبِّکَ فِیۡنَا وَلِیۡدًا وَّ لَبِثۡتَ فِیۡنَا مِنۡ عُمُرِکَ سِنِیۡنَ ﴿ۙ ۱۸﴾ وَ فَعَلۡتَ فَعۡلَتَکَ الَّتِیۡ فَعَلۡتَ وَ اَنۡتَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۹﴾

অর্থাৎ– “স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক মূসাকে ডেকে বললেন, তুমি জালিম সম্প্রদায়ের নিকট যাও- ফিরআউন সম্প্রদায়ের নিকট; ওরা কি ভয় করে না? তখন সে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমি আশংকা করি যে, ওরা আমাকে অস্বীকার করবে এবং আমার হৃদয় সংকুচিত হয়ে পড়বে, আর জিহ্বা তো সচল নয়। সুতরাং হারূনের প্রতিও প্রত্যাদেশ পাঠান! আমার বিরুদ্ধে তো ওদের একটি অভিযোগ রয়েছে, আমি আশংকা করি তারা আমাকে হত্যা করবে। আল্লাহ বললেন, না, কখনই নয়; অতএব, তোমরা উভয়ে আমার নিদর্শনসহ যাও, আমি তো তোমাদের সাথে রয়েছি শ্রবণকারী। অতএব, তোমরা উভয়ে ফিরআউনের নিকট যাও এবং বল, আমরা তো জগতসমূহের প্রতিপালকের রাসূল, আর আমাদের সাথে যেতে দাও বনী ইসরাঈলকে। ফিরআউন বলল, আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদের মধ্যে লালন-পালন করিনি? তুমি তো তোমার জীবনের বহু বছর আমাদের মধ্যে কাটিয়েছ। তুমি তোমার কর্ম যা করবার তা করেছ; তুমি অকৃতজ্ঞ।” (সূরা শু‘আরাঃ ১০-১৯)

মোদ্দাকথা, তারা দুইজন ফিরআউনের নিকট গমন করলেন এবং তাকে উপরোক্ত কথা বললেন। আর তাদেরকে যা কিছু সহকারে প্রেরণ করা হয়েছিল তার কাছে তাঁরা তা পেশ করলেন। তারা তাকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান করলেন। তাঁরা তাকে বনী ইসরাঈলদের তার কর্তৃত্ব ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানান। যাতে তারা যেখানেই ইচ্ছে গিয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে, নিরংকুশভাবে আল্লাহ তা‘আলার একত্ব স্বীকার করতে, আল্লাহ তা‘আলাকে একাগ্রচিত্তে ডাকতে এবং আপন প্রতিপালকের কাছে অনুনয় বিনয় করে নিজেদের ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এতে ফিরআউন দাম্ভিকতার আশ্রয় নিল এবং জুলুম ও সীমালংঘন করল; সে মূসা (আ)-এর দিকে তাচ্ছিল্যের নজরে তাকাল এবং বলতে লাগল, তুমি কি আমাদের মাঝে বাল্যকালে লালিত-পালিত হওনি? আমরা কি তোমাকে আমাদের ঘরে পুত্রের মত লালন-পালন করিনি? তোমার প্রতি ইহসান করিনি? এবং একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার প্রতি অনুগ্রহ করিনি?’ ফিরআউনের এই কথার দ্বারা বোঝা যায়, যে ফিরআউনের কাছে মূসা (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং যে ফিরআউন থেকে মূসা (আ) পলায়ন করেছিলেন, সে অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু কিতাবীরা মনে করে, যে ফিরআউনের নিকট থেকে মূসা (আ) পলায়ন করেছিলেন তিনি মাদায়ানে অবস্থান কালেই সে মারা গিয়েছিল। আর যে ফিরআউনের কাছে মূসা (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করা হয়েছিল, সে ছিল অন্য লোক। আয়াতাংশ— ( وَفَعَلۡتَ فَعۡلَتَكَ ٱلَّتِی فَعَلۡتَ وَأَنتَ مِنَ ٱلۡكَـٰفِرِینَ )

[Surat Ash-Shu’ara 19]এর অর্থ হচ্ছে - তুমি কিবতী লোকটিকে হত্যা করেছ; আমাদের থেকে পলায়ন করেছ এবং আমাদের অনুগ্রহের প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছ।

মূসা (আ) প্রতি উত্তরে বলেনঃ

قَالَ فَعَلۡتُہَاۤ اِذًا وَّ اَنَا مِنَ الضَّآلِّیۡنَ ﴿ؕ ۲۰﴾ فَفَرَرۡتُ مِنۡکُمۡ لَمَّا خِفۡتُکُمۡ فَوَہَبَ لِیۡ رَبِّیۡ حُکۡمًا وَّ جَعَلَنِیۡ مِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۲۱﴾

অর্থাৎ– মূসা বললেন, আমি তো এটা করেছিলাম তখন যখন আমি ছিলাম অজ্ঞ।’ অন্য কথায়, আমার কাছে ওহী অবতীর্ণ হবার পূর্বে আমি এটা করেছিলাম। অতঃপর আমি যখন তোমাদের ভয়ে ভীত ছিলাম, তখন আমি তোমাদের নিকট হতে পলায়ন করলাম। তারপর আমার প্রতিপালক আমাকে জ্ঞানদান করেছেন এবং আমাকে রাসূলরূপে মনোনীত করেছেন। (২৬ঃ ১৯-২১) মূসা (আ)-এর প্রতি ফিরআউনের লালন-পালন ও অনুগ্রহ করার উল্লেখের জবাবে—মূসা (আ) বলেনঃ

وَ تِلۡکَ نِعۡمَۃٌ تَمُنُّہَا عَلَیَّ اَنۡ عَبَّدۡتَّ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ ۲۲﴾ قَالَ فِرۡعَوۡنُ وَ مَا رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ؕ ۲۳﴾ قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّوۡقِنِیۡنَ ﴿۲۴﴾ قَالَ لِمَنۡ حَوۡلَہٗۤ اَلَا تَسۡتَمِعُوۡنَ ﴿۲۵﴾ قَالَ رَبُّکُمۡ وَ رَبُّ اٰبَآئِکُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۲۶﴾ قَالَ اِنَّ رَسُوۡلَکُمُ الَّذِیۡۤ اُرۡسِلَ اِلَیۡکُمۡ لَمَجۡنُوۡنٌ ﴿۲۷﴾ قَالَ رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲۸﴾

অর্থাৎ– আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করছ তা তো এই যে, তুমি বনী ইসরাঈলকে দাসে পরিণত করেছ। তুমি যে উল্লেখ করেছ, তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছ অথচ আমি বনী ইসরাঈলের একজন; আর এর পরিবর্তে তুমি একটা গোটা সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে আপন কাজে নিযুক্ত রেখেছ এবং তাদেরকে তোমার খেদমত করার কাজে দাসে পরিণত করে রেখেছ। ফিরআউন বলল, “জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কী?’ মূসা বলল, ‘তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। ফিরআউন তার পারিষদবর্গকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা শুনছ তো?’ মূসা বলল, তিনি তোমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষগণেরও প্রতিপালক। ফিরআউন বলল, তোমাদের প্রতি প্রেরিত তোমাদের রাসূলটি তো নিশ্চয়ই পাগল। মূসা বলল, তিনি পূর্ব-পশ্চিমের এবং এদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক যদি তোমরা বুঝতে। (সূরা শু‘আরাঃ ২২-২৮)

ফিরআউন ও মূসা (আ)-এর মধ্যে যে সব কথোপকথন, যুক্তিতর্কের অবতারণা ও বাদ-প্রতিবাদ হয়েছিল এবং মূসা (আ) দুশ্চরিত্র ফিরআউনের বিরুদ্ধে যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৃষ্টিগ্রাহ্য যুক্তি-প্রমাণের অবতারণা করছিলেন; আল্লাহ তা‘আলা তার উল্লেখ করেছেন এভাবে যে, ফিরআউন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করেছিল এবং দাবি করেছিল যে, সে নিজেই মাবুদ ও উপাস্য। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَحَشَرَ فَنَادٰی ﴿۫ۖ ۲۳﴾ فَقَالَ اَنَا رَبُّکُمُ الۡاَعۡلٰی ﴿۫ۖ ۲۴﴾

অর্থাৎ–সে সকলকে সমবেত করল এবং উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক।’ (সূরা নাযিআতঃ ২৩-২৪)

অন্যত্র ইরশাদ করেছেনঃ

وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰۤاَیُّہَا الۡمَلَاُ مَا عَلِمۡتُ لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰہٍ غَیۡرِیۡ

অর্থাৎ–“ফিরআউন বলল, হে পারিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে আমি জানি না।” (সূরা কাসাসঃ ৩৮) উপরোক্ত বক্তব্য উচ্চারণকালে সে জেনে-শুনেই গোয়ার্তুমি করেছে, কেননা সে সম্যক জানতো যে, সে নেহাত একটি দাস, আর আল্লাহই হচ্ছেন সৃজনকর্তা, উদ্ভাবন কর্তা, রূপদাতা, প্রকৃত উপাস্য।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ جَحَدُوۡا بِہَا وَ اسۡتَیۡقَنَتۡہَاۤ اَنۡفُسُہُمۡ ظُلۡمًا وَّ عُلُوًّا ؕ فَانۡظُرۡ کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُفۡسِدِیۡنَ ﴿۱۴﴾

অর্থাৎ—“তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। দেখ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল?” (সূরা নাম্‌লঃ ১৪)

এজন্যেই সে মূসা (আ)-এর রিসালাতকে অস্বীকার করতে গিয়ে এবং একথা প্রকাশ করতে গিয়ে মূসা (আ)-কে যে রিসালাত প্রদানকারী কোন প্রতিপালকই নেই—সে বলেছিল, অর্থাৎ জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কে? কেননা, তাঁরা দু’জন [মূসা (আ) ও হারূন (আ)] তাকে বলেছিলেন, اِنَّا رَسُوۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡن অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমরা জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল।’ (সূরা শু‘আরাঃ ১৬) যেন তাদের দুজনকে বলছিল, তোমরা ধারণা করছ যে, জগতসমূহের প্রতিপালক তোমাদেরকে প্রেরণ করেছেন—এরূপ প্রতিপালক আবার কে? জবাবে মূসা (আ) বলেছিলেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনঃ

رب السموت والأرض وما بينهما إن كنتم موقنين -

অর্থাৎ—জগতসমূহের প্রতিপালক এসব দৃশ্যমান আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর এবং এগুলোর মধ্যে যেসব সৃষ্টি বিদ্যমান রয়েছে যেমন মেঘ, বাতাস, বৃষ্টি, তৃণলতা, জীব-জন্তু ইত্যাদির সৃজন কর্তা। প্রতিটি বিশ্বাসী লোক জানে যে, এগুলি নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি, এদের একজন সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছেন আর তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা; তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই; তিনিই জগতসমূহের প্রতিপালক। ফিরআউন তার আশে-পাশে উপবিষ্ট উজির-নাজির ও আমীর-উমারাকে মূসা (আ)-এর সুপ্রমাণিত রিসালাত অবমাননা এবং খোদ মূসা (আ)-কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার লক্ষ্যে বলল, তোমরা কি মূসার অযৌক্তিক কথাবার্তা শুনছ? মূসা (আ) তখন তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, অর্থাৎ তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের পূর্বে তোমাদের বাবা, দাদা ও অতীতের সমস্ত সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করেছেন; কেননা প্রত্যেকেই জানে যে, সে নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি; তার পিতামাতা কেউই নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি। অন্য কথায়, সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি এবং প্রত্যেককেই জগতসমূহের প্রতিপালক সৃষ্টি করেছেন। এই দুটি বিষয়েরই নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

سَنُرِیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُ الۡحَقُّ

অর্থাৎ–আমি ওদের জন্যে আমার নিদর্শনাবলী ব্যক্ত করব বিশ্বজগতে এবং ওদের নিজেদের মধ্যে; ফলে ওদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এটাই সত্য।’ (সূরা ফুসসিলাতঃ ৫৩) এসব নিদর্শন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা সত্ত্বেও ফিরাউন তার গাফিলতির নিদ্রা থেকে জাগ্রত হল না এবং নিজেকে পথভ্রষ্টতা থেকে বের করল না বরং সে তার স্বেচ্ছাচারিতা, অবাধ্যতা ও পথভ্রষ্টতায় অটল রইল। আর মন্তব্য করলঃ

اِنَّ رَسُوۡلَکُمُ الَّذِیۡۤ اُرۡسِلَ اِلَیۡکُمۡ لَمَجۡنُوۡن

অর্থাৎ—“নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে প্রেরিত রাসূলটি পাগল।

قَالَ رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲۸﴾

সে বলল, তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সব কিছুর প্রতিপালক যদি তোমরা বুঝতে। (সূরা শু‘আরাঃ ২৭-২৮)

তিনিই এসব উজ্জ্বল নক্ষত্রকে অনুগত করেছেন এবং ঘূর্ণায়মান কক্ষপথে এগুলোকে আবর্তিত করছেন। তিনিই অন্ধকার ও আলোর সৃষ্টিকর্তা, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, উপগ্রহ, চলমান ও স্থির তারকারাজির সৃজনকর্তা; রাতকে অন্ধকার সমেত এবং দিনকে আলো সমেত সৃষ্টিকারী; সবকিছু তাঁরই অধীনে, নিয়ন্ত্রণে ও ইখতিয়ারে চলমান এবং নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণরত। সব সময়ই একে অন্যকে অনুসরণ করছে এবং নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। সুতরাং তিনিই মহান সৃষ্টিকর্তা, মালিক, নিজ ইচ্ছেমাফিক আপন মাখলুকের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপকারী। যখন ফিরআউনের বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণাদি পেশ করা হল, তার সন্দেহ দূরীভূত হল এবং হঠকারিতা ছাড়া তার কোন যুক্তিই অবশিষ্ট রইল না। তখন সে জোর-জবরদস্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করল। যেমন আয়াতে উক্ত হয়েছেঃ

قَالَ لَئِنِ اتَّخَذۡتَ اِلٰـہًا غَیۡرِیۡ لَاَجۡعَلَنَّکَ مِنَ الۡمَسۡجُوۡنِیۡنَ ﴿۲۹﴾

অর্থাৎ—‘ফিরআউন বলল, তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করে রাখব।’ মূসা (আ) প্রতি উত্তরে বলেন, اَوَ لَوۡ جِئۡتُکَ بِشَیۡءٍ مُّبِیۡنٍ অর্থাৎ আমি তোমার নিকট স্পষ্ট কোন নিদর্শন নিয়ে আসলেও?’ ফিরআউন বলল, فَاۡتِ بِہٖۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡن অর্থাৎ তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে তা উপস্থিত কর।”

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَاَلۡقٰی عَصَاہُ فَاِذَا ہِیَ ثُعۡبَانٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۚۖ ۳۲﴾ وَّ نَزَعَ یَدَہٗ فَاِذَا ہِیَ بَیۡضَآءُ لِلنّٰظِرِیۡنَ ﴿٪ ۳۳﴾

অর্থাৎ–“অতঃপর মূসা তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হয়ে গেল এবং মূসা হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হল।” (সূরা শু‘আরাঃ ২৮-৩৩)

এ দুটো স্পষ্ট নিদর্শন যদ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলা মূসা (আ) ও হারূন (আ)-কে শক্তিশালী করেছিলেন। আর এ দুটো নিদর্শন হচ্ছে লাঠি ও হাত। এগুলো দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলা বিরাট অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শন করলেন যাতে সকল মানবীয় জ্ঞান ও দৃষ্টি মু‘জিযা দু’টোর কাছে হার মেনে গেল। যখন তিনি হাত থেকে লাঠি নিক্ষেপ করলেন, তখন এটা বিরাট আকারের অত্যাশ্চর্য মোটা ভয়ংকর ও বিস্ময়কর সাপে পরিণত হল। এমনকি কথিত আছে যে, ফিরআউন এটাকে দেখার পর এতই ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল যে, তৎক্ষণাৎ তার দাস্ত হতে লাগল; একদিনেই তার চল্লিশ বার দাস্ত হল অথচ এর পূর্বে সে চল্লিশ দিনে একবার পায়খানায় যেত। এখন অবস্থা বিপরীতে দাঁড়াল। অনুরূপভাবে যখন মূসা (আ) তাঁর নিজ হাত নিজ বগলে রাখলেন এবং বের করলেন তখন তা চাঁদের একটি টুকরার ন্যায় সমুজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসল। আর এমন আলো বিচ্ছুরিত করতে লাগল যা চোখকে একেবারে ঝলসিয়ে দেয়। পুনরায় যখন হাত বগলের মধ্যে স্থাপন করলেন, তখন তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসল। এসব নিদর্শন দেখার পরও ফিরআউন এর থেকে কোনভাবেই উপকৃত হলো না। বরং সে যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায়ই রয়ে গেল। সে প্রকাশ করতে লাগল যে, এসব জাদু ব্যতীত অন্য কিছু নয়। তাই সে জাদুকরদের দ্বারা মূসা (আ)-এর মুকাবিলা করতে ইচ্ছা পোষণ করল। সুতরাং সে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার সমস্ত জাদুকরের মাধ্যমে মূসা (আ)-কে মুকাবিলা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করল। অতঃপর সে লোক পাঠাল যারা সমগ্র রাজ্যের, তার প্রজাবর্গের, তার নিয়ন্ত্রণাধীন জাদুকরদের সমবেত করবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা নির্ধারিত জায়গায় পেশ করা হবে। এতে ফিরআউন, তার পারিষদবর্গ, আমীর-উমারা ও অনুসারীদের কাছে আল্লাহ্ তা‘আলার অসীম কুদরত, ক্ষমতা ও নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল।

আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা তা-হায় ইরশাদ করেনঃ

فَلَبِثۡتَ سِنِیۡنَ فِیۡۤ اَہۡلِ مَدۡیَنَ ۬ۙ ثُمَّ جِئۡتَ عَلٰی قَدَرٍ یّٰمُوۡسٰی ﴿۴۰﴾ وَ اصۡطَنَعۡتُکَ لِنَفۡسِیۡ ﴿ۚ ۴۱﴾ اِذۡہَبۡ اَنۡتَ وَ اَخُوۡکَ بِاٰیٰتِیۡ وَ لَا تَنِیَا فِیۡ ذِکۡرِیۡ ﴿ۚ ۴۲﴾ اِذۡہَبَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿ۚۖ ۴۳﴾ فَقُوۡلَا لَہٗ قَوۡلًا لَّیِّنًا لَّعَلَّہٗ یَتَذَکَّرُ اَوۡ یَخۡشٰی ﴿۴۴﴾ قَالَا رَبَّنَاۤ اِنَّنَا نَخَافُ اَنۡ یَّفۡرُطَ عَلَیۡنَاۤ اَوۡ اَنۡ یَّطۡغٰی ﴿۴۵﴾ قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِیۡ مَعَکُمَاۤ اَسۡمَعُ وَ اَرٰی ﴿۴۶﴾

অর্থাৎ–অতঃপর তুমি কয়েক বছর মাদায়ানবাসীদের মধ্যে ছিলে, হে মূসা! এর পরে তুমি নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলে এবং আমি তোমাকে আমার নিজের জন্য প্রস্তুত করিয়ে নিয়েছি। তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনসহ যাত্রা কর এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করবে না। তোমরা দুজন ফিরআউনের নিকট যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। তারা বলল, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আশঙ্কা করি সে আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে।” তিনি বললেন, “তোমরা ভয় করবে না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও আমি দেখি।” (সূরা তা-হাঃ ৪০-৪৬)

আল্লাহ্ তা‘আলা যে রাতে মূসা (আ)-এর প্রতি ওহী নাযিল করেন, তাকে নবুওত দান করেন, নিজের কাছে ডেকে নিয়ে তাঁর সাথে একান্তে কথা বলেন, সে রাতে মূসা (আ)-কে সম্বোধন করে বলেন, “আমি তোমাকে প্রত্যক্ষ করছিলাম যখন তুমি ফিরআউনের ঘরে ছিলে, তুমি আমার হিফাযতে ও যত্নে ছিলে। তারপর আমি তোমাকে মিসর ভূখণ্ড থেকে বের করে আমার ইচ্ছা, কুদরত ও কৌশল মাফিক তোমাকে মাদায়ানে নিয়ে আসলাম। সেখানে তুমি কয়েক বছর অবস্থান করলে। তারপর তুমি নবুওতের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলে অর্থাৎ আমার নির্ধারিত তাকদীর অনুযায়ী। তোমাকে আমার কালাম ও রিসালাতের জন্যে আমি মনোনীত করলাম। সুতরাং তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনসহ যাত্রা কর আর যখন তোমরা আমাকে স্মরণ করবে কিংবা তোমাদের আহ্বান করা হবে তোমরা আমার স্মরণে শৈথিল্য প্রদর্শন করবে না; কেননা, ফিরআউনেকে সম্বোধন করার সময়, তার প্রতি উত্তর প্রদানের সময়, তার প্রতি উপদেশ দানের সময় এবং তার সম্মুখে দলীল পেশ করার সময় আমার স্মরণ তোমাদের বিজয় দানে সাহায্য করবে। আবার কোন কোন হাদীসে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমার ঐ বান্দাই পরিপূর্ণ বান্দা যে তার প্রতিপক্ষের সাথে মুকাবিলার সময়ও আমাকে স্মরণ করে।

যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا لَقِیۡتُمۡ فِئَۃً فَاثۡبُتُوۡا وَ اذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿ۚ ۴۵﴾

অর্থাৎ—“হে মুমিনগণ! তোমরা যখন কোন দলের মুকাবিলা করবে তখন অবিচলিত থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা আনফালঃ ৪৫)

তারপর আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা দুইজনে ফিরআউনের কাছে যাত্রা কর সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।” (সূরা তা-হাঃ ৪৩)

ফিরআউনের কুফরী, জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারটি আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও তার সাথে নম্র কথা বলার নির্দেশ, মাখলুকের প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার পরম রহমত, বরকত, মেহেরবানী, নম্রতা ও ধৈর্যশীলতার পরিচায়ক। ফিরআউন ছিল তখনকার যুগে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকৃষ্টতম সৃষ্টি অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ যমানার শ্রেষ্ঠতম মনোনীত ব্যক্তিত্বকে তার হিদায়াতের জন্যে তার কাছে প্রেরণ করেন। এতদসত্ত্বেও তিনি মূসা (আ) ও হারূন (আ)-কে নম্র ভাষায় তাকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার জন্যে নির্দেশ দেন। আবার তাদের দুইজনকে তার সাথে এমন ব্যবহার করার জন্যে নির্দেশ দেন, যেমনটি যার উপদেশ গ্রহণ কিংবা ভয় করার সম্ভাবনা আছে তার সাথে করা হয়ে থাকে।

আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেনঃ

اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّکَ بِالۡحِکۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡہُمۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ رَبَّکَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ ضَلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ ﴿۱۲۵﴾

অর্থাৎ–‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহ্‌লঃ ১২৫)

আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ لَا تُجَادِلُوۡۤا اَہۡلَ الۡکِتٰبِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ٭ۖ اِلَّا الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡہُم

তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। (সূরা আনকাবুতঃ ৪৬)

হাসান বসরী (র) বলেনঃ আয়াতাংশের মাধ্যমে তার প্রতি রেয়াত প্রদর্শনার্থে বলা হয়েছে তোমরা দু’জনে তাকে বলবে, তোমার রয়েছেন একজন প্রতিপালক, তোমার জন্যে রয়েছে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান এবং তোমার সামনে রয়েছে বেহেশত-দোযখ। ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ্ (র) বলেছেন, এর অর্থ হচ্ছে তোমরা দু’জন তাকে বলে দাও, শাস্তি ও রোষের তুলনায় আমি আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার অধিকতর নিকটবর্তী। য়াযিদ আর রাক্কাশী (র) এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন, শত্রুর সাথে যিনি এরূপ বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের উপদেশ দিচ্ছেন বন্ধুর সাথে কিরূপ ব্যবহার এবং তাকে কিরূপ আহ্বানের উপদেশ দেবেন তা সহজেই অনুমেয়। আল্লাহর বাণীঃ

قَالَا رَبَّنَاۤ اِنَّنَا نَخَافُ اَنۡ یَّفۡرُطَ عَلَیۡنَاۤ اَوۡ اَنۡ یَّطۡغٰی ﴿۴۵﴾

তারা বললঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আশঙ্কা করি সে আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে।” (সূরা তা-হাঃ ৪৫)

এটা এজন্যে যে ফিরআউন ছিল অত্যাচারী, অনমনীয়, শয়তান ও সীমালঙ্ঘনকারী; মিসরে তার শক্তি ছিল দুর্দম, সে ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিরাট ক্ষমতা ও সৈন্য-সামন্তের অধিকর্তা। তাই মানবীয় চরিত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে তারা দুজনই তার ব্যাপারে ভীত হলেন এবং প্রকাশ্যত তাদের উপর সে হামলা করতে পারে এরূপ আশঙ্কা করছিলেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দৃঢ় থাকতে অনুপ্রাণিত করেন। তিনিই সুউচ্চ, সুমহান। তিনি বলেন, “তোমরা ভয় করবে না, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি; আমি শুনি ও আমি দেখি।” অন্য এক আয়াতেও বলেন, “আমি তোমাদের সাথে শ্রবণকারী।”

ইরশাদ হচ্ছেঃ

فَاۡتِیٰہُ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلَا رَبِّکَ فَاَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ وَ لَا تُعَذِّبۡہُمۡ ؕ قَدۡ جِئۡنٰکَ بِاٰیَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکَ ؕ وَ السَّلٰمُ عَلٰی مَنِ اتَّبَعَ الۡہُدٰی ﴿۴۷﴾ اِنَّا قَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡنَاۤ اَنَّ الۡعَذَابَ عَلٰی مَنۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿۴۸﴾

সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল, আমরা তোমার প্রতিপালকের রাসূল। সুতরাং আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে যেতে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিও না, আমরা তো তোমার নিকট এনেছি তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে নিদর্শন এবং শান্তি তাদের প্রতি যারা অনুসরণ করে সৎপথ। আমাদের প্রতি ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্যে যে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। (সূরা তা-হাঃ ৪৭-৪৮)

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি তাদের দু’জনকে নির্দেশ দিলেন যাতে তারা ফিরআউনের নিকট যায় এবং তাকে এক অদ্বিতীয় আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করেন। আর বনী ইসরাঈলকে যেন সে তার কয়েদ ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দেয়। এবং তাদেরকে যেন সে আর কষ্ট না দেয়। তাদের সাথে যেতে যেন অনুমতি দেয় এবং তাদেরকে তারা আরো বলেন, “আমরা তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের তরফ থেকে মহা নিদর্শন নিয়ে এসেছি। আর তা হচ্ছে লাঠি ও হাতের মু‘জিযা। শান্তি একমাত্র তাদেরই প্রতি যারা অনুসরণ করে সৎপথ।” সৎপথ অনুসারীদের সাথে শান্তিকে সম্পৃক্ত করার বর্ণনাটি খুবই চিত্তাকর্ষক ও তাৎপর্যপূর্ণ। তারপর তারা তাকে অস্বীকৃতির মন্দ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, আমাদের কাছে ওহী এসেছে যে, শাস্তি ঐ ব্যক্তির জন্যে যে সত্যকে অন্তর দিয়ে অবিশ্বাস করে এবং কার্যত তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সুদ্দী (র) প্রমুখ আলিম উল্লেখ করেছেন যে, মূসা (আ) যখন মাদায়ান থেকে প্রত্যাবর্তন করে আপন মাতা ও ভাই হারুনের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন তারা রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। খাবারের মধ্যে ছিল শালগম। তিনি তাঁদের সাথে তা খেলেন। তারপর তিনি বললেন, “হে হারূন! আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে ও তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমরা ফিরআউনকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের দিকে আহ্বান করি। সুতরাং তুমি আমার সাথে চল।” তখন তারা দু’জনেই ফিরআউনের মহলের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তাঁরা দরজা বন্ধ পেলেন। মূসা (আ) দারোয়ানদের বললেন, তোমরা ফিরআউনের কাছে সংবাদ নিয়ে যাও যে, আল্লাহর রাসূল তার দরজায় উপস্থিত। দারোয়ানরা মূসা (আ)-কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল।

কেউ কেউ বলেছেন, ‘ফিরআউন তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ পর প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছিল। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক (র) বলেন, ‘দু’বছর পর তাদেরকে ফিরআউন অনুমতি দিয়েছিল। কেননা, কেউ অনুমতি আনার জন্যে যেতে সাহস পায়নি।’ আল্লাহই সম্যক অবগত। এরূপও কথিত আছে যে, মূসা (আ) দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে লাঠি দ্বারা দরজায় আঘাত করেন। এতে ফিরআউন ভীষণ বিব্রত বোধ করল এবং তাদেরকে উপস্থিত করার জন্যে নির্দেশ দিল। তারা দু’জনেই তার সম্মুখে দাঁড়ালেন এবং তাকে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ মুতাবিক তার মহান সত্তার ইবাদতের প্রতি আহ্বান করলেন।

কিতাবীদের মতে, আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ)-কে বলেছিলেন, “লাওয়ী ইব্‌ন ইয়াকূব (আ) -এর বংশধর হারূন (আ) অতি শিগগির আত্মপ্রকাশ করবেন এবং তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তিনি নিজের সাথে বনী ইসরাঈলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নিয়ে ফিরআউনের কাছে যান এবং আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যা কিছু নিদর্শন প্রদান করেছেন ফিরআউনের কাছে তা যেন প্রকাশ করেন। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ)-কে বলেন, “শিগগিরই আমি তার অন্তর কঠিন করে দেব তাতে সে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়কে যেতে দেবে না। আমার অধিকাংশ নিদর্শন ও অত্যাশ্চর্য বস্তুসমূহ মিসরে অবস্থিত।” আল্লাহ তা‘আলা হারূন (আ)-এর প্রতি ওহী পাঠালেন তিনি যেন তার ভাইয়ের দিকে অগ্রসর হন এবং হোরাইব পর্বতের নিকটবর্তী প্রান্তরে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। যখন তিনি সাক্ষাৎ করেন তখন মূসা (আ) তাকে তার প্রতিপালকের নির্দেশের কথা অবহিত করলেন। যখন তারা দুজন মিসরে প্রবেশ করলেন, তখন তারা বনী ইসরাঈলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে সমবেত করলেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে ফিরআউনের কাছে গেলেন। ফিরআউনের কাছে আল্লাহ তা‘আলার রিসালতের বাণী পৌঁছালে ফিরআউন বলল, ‘আল্লাহ কে? আমি তাকে চিনি না এবং আমি বনী ইসরাঈলকে যেতে দেব না।’

আল্লাহ তা‘আলা ফিরআউন সম্পর্কে ইরশাদ করেনঃ

قَالَ فَمَنۡ رَّبُّکُمَا یٰمُوۡسٰی ﴿۴۹﴾ قَالَ رَبُّنَا الَّذِیۡۤ اَعۡطٰی کُلَّ شَیۡءٍ خَلۡقَہٗ ثُمَّ ہَدٰی ﴿۵۰﴾ قَالَ فَمَا بَالُ الۡقُرُوۡنِ الۡاُوۡلٰی ﴿۵۱﴾ قَالَ عِلۡمُہَا عِنۡدَ رَبِّیۡ فِیۡ کِتٰبٍ ۚ لَا یَضِلُّ رَبِّیۡ وَ لَا یَنۡسَی ﴿۫ ۵۲﴾ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ مَہۡدًا وَّ سَلَکَ لَکُمۡ فِیۡہَا سُبُلًا وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً ؕ فَاَخۡرَجۡنَا بِہٖۤ اَزۡوَاجًا مِّنۡ نَّبَاتٍ شَتّٰی ﴿۵۳﴾ کُلُوۡا وَ ارۡعَوۡا اَنۡعَامَکُمۡ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی النُّہٰی ﴿٪ ۵۴﴾ مِنۡہَا خَلَقۡنٰکُمۡ وَ فِیۡہَا نُعِیۡدُکُمۡ وَ مِنۡہَا نُخۡرِجُکُمۡ تَارَۃً اُخۡرٰی ﴿۵۵﴾

অর্থাৎ–ফিরআউন বলল, হে মূসা! কে তোমাদের প্রতিপালক? মূসা বলল, আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেছেন। ফিরআউন বলল, তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কী?’ মূসা বলল, এটার জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট কিতাবে রয়েছে; আমার প্রতিপালক ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না। যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বিছানা এবং এতে করে দিয়েছেন তোমাদের চলবার পথ, তিনি আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন এবং আমি তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। তোমরা আহার কর ও তোমাদের গবাদি পশু চরাও; অবশ্যই এতে নিদর্শন রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য। আমি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা থেকে আবার তোমাদেরকে বের করব।” (সূরা তা-হাঃ ৪৯-৫৫)

আল্লাহ তা‘আলা ফিরআউন সম্পর্কে সংবাদ দিচ্ছেন। ফিরআউন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বলে, “হে মূসা! তোমার প্রতিপালকটি কে?” মূসা (আ) প্রতিউত্তরে বলেন, আমাদের প্রতিপালক সমগ্র মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, তাদের আমল, রিযিক ও মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করেছেন। আর এগুলো তাঁর নিকট সংরক্ষিত কিতাবে বা লাওহে মাহফুযে লিখে রেখেছেন। অতঃপর প্রতিটি সৃষ্টিকে তার জন্যে নির্ধারিত বিষয় বস্তুর প্রতি পথনির্দেশ করেছেন। প্রত্যেক মাখলুকের আমল আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ইলম, কুদরত ও তকদীর অনুযায়ী ঘটে থাকে।

অন্য আয়াতে অনুরূপ ইরশাদ হচ্ছেঃ

سَبِّحِ اسۡمَ رَبِّکَ الۡاَعۡلَی ۙ ﴿۱﴾ الَّذِیۡ خَلَقَ فَسَوّٰی ۪ۙ ﴿۲﴾ وَ الَّذِیۡ قَدَّرَ فَہَدٰی ۪ۙ ﴿۳﴾

অর্থাৎ–তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। যিনি সৃষ্টি করেন ও সুঠাম করেন এবং যিনি পরিমিত বিকাশ সাধন করেন ও (মাখলুককে) সেদিকে পথনির্দেশ করেন। (সূরা আলাঃ ১-৩)

ফিরআউন মূসা (আ)-কে বলেছিল, “যদি তোমার প্রতিপালক সৃজনকর্তা, পরিমিত বিকাশকারী, মাখলুককে তাঁর নির্ধারিত পথে পথ-প্রদর্শনকারী হয়ে থাকেন এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য না হয়ে থাকেন, তবে পূর্বেকার যুগের লোকেরা কেন তাকে ছেড়ে অন্যদের ইবাদত করল? তুমি তো জান, পূর্বেকার যুগের লোকেরা তারকারাজি ও দেব-দেবীকে আল্লাহর সাথে শরীক করত, তাহলে পূর্বেকার গোত্রগুলোকে কেন তিনি তোমার উল্লিখিত সঠিক পথে পরিচালনা করলেন না?” মূসা (আ) বললেন, তারা যদিও আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা করেছে এটা তোমার পক্ষের বা আমার বিপক্ষের কোন দলীল হতে পারে না। কেননা, তারা তোমার ন্যায় মূর্খতার শিকার হয়ে যে সব অপকর্ম করেছে, কিতাবসমূহে তাদের ছোট বড় সব আমলের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এবং আমার মহান প্রতিপালক তাদের শাস্তিদান করবেন। এক অণুপরিমাণ কারো উপর তিনি জুলুম করবেন না। কেননা, বান্দাদের সব আমলই তার নিকট একটি লিপিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে, কিছুই বাদ পড়বে না এবং আমার প্রতিপালক কিছুই বিস্মৃত হবেন না। এরপর মূসা (আ) ফিরআউনের কাছে আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠত্ব, বস্তুসমূহ সৃষ্টির শক্তি, ভূমিকে বিছানারূপ, আকাশকে ছাদরূপে সৃষ্টি করার শক্তি রয়েছে—এর উল্লেখ করেন। বান্দা ও জীব-জানোয়ারের রিযিকের জন্যে বাদল ও বৃষ্টিকে যে তিনি নিয়ন্ত্রণাধীনে রেখেছেন এটাও তিনি উল্লেখ করেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ

كلو وارعوا انعامكم ان في ذلك لايت لاولي النهى

তোমরা আহার কর ও গবাদি পশু চারণ কর অবশ্যই তাতে নিদর্শন রয়েছে সহজ-সরল বিশুদ্ধ বিবেক ও সুস্থ প্রকৃতিসম্পন্ন লোকদের জন্যে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ও তোমাদের পূর্ব পুরুষদের সৃষ্টিকর্তা।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿ۙ ۲۱﴾ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِہٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰہِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲﴾

অর্থাৎ–“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার, যিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। সুতরাং তোমরা জেনেশুনে কাউকেও আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিয়ো না।” (সূরা বাকারাঃ ২১-২২)

এ আয়াতে বৃষ্টির মাধ্যমে ভূমিকে সজীব করা ও উদ্ভিদ জন্মানোর মাধ্যমে পৃথিবীকে সুশোভিত করা দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এই প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, “মাটি থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা হতে পুনর্বার তোমাদেরকে বের করব।”

অনুরূপ সূরায়ে আরাফের ২৯ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে کَمَا بَدَاَکُمۡ تَعُوۡدُوۡنَ অর্থাৎ—‘তিনি যেভাবে প্রথমে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমরা সেভাবে ফিরে আসবে।’

অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَ ہُوَ الَّذِیۡ یَبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُہٗ وَ ہُوَ اَہۡوَنُ عَلَیۡہِ ؕ وَ لَہُ الۡمَثَلُ الۡاَعۡلٰی فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿٪ ۲۷﴾

অর্থাৎ—তিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনয়ন করেন, তারপর তিনি এটাকে সৃষ্টি করবেন পুনর্বার; এটা তার জন্য অতি সহজ। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা তারই; এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা রূমঃ ২৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

وَ لَقَدۡ اَرَیۡنٰہُ اٰیٰتِنَا کُلَّہَا فَکَذَّبَ وَ اَبٰی ﴿۵۶﴾ قَالَ اَجِئۡتَنَا لِتُخۡرِجَنَا مِنۡ اَرۡضِنَا بِسِحۡرِکَ یٰمُوۡسٰی ﴿۵۷﴾ فَلَنَاۡتِیَنَّکَ بِسِحۡرٍ مِّثۡلِہٖ فَاجۡعَلۡ بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکَ مَوۡعِدًا لَّا نُخۡلِفُہٗ نَحۡنُ وَ لَاۤ اَنۡتَ مَکَانًا سُوًی ﴿۵۸﴾ قَالَ مَوۡعِدُکُمۡ یَوۡمُ الزِّیۡنَۃِ وَ اَنۡ یُّحۡشَرَ النَّاسُ ضُحًی ﴿۵۹﴾

আমি তো তাকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছিলাম কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ করেছে ও অমান্য করেছে। সে বলল, হে মূসা! তুমি কি আমাদের নিকট এসেছ তোমার জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ হতে বের করে দেবার জন্যে? আমরাও অবশ্যই তোমার নিকট উপস্থিত করব এটার অনুরূপ জাদু, সুতরাং আমাদের ও তোমার মধ্যে নির্ধারণ কর এক নির্দিষ্ট সময় ও এক মধ্যবর্তী স্থান, যার ব্যতিক্রম আমরাও করব না এবং তুমিও করবে না। মূসা বললেন, “তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেদিন পূর্বাহ্ণে জনগণকে সমবেত করা হবে।’ (সূরা- তা-হাঃ ৫৬-৫৯)

আল্লাহ্ তা‘আলা ফিরআউনের দুর্ভাগ্য এবং আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন ও অমান্য করে সে যে পাপিষ্ঠতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে এর উল্লেখ করছেন। ফিরআউন মূসা (আ)-কে বলেছিল যে, মূসা (আ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার সবটাই জাদু।

কাজেই সেও এরূপ জাদু দ্বারা মূসা (আ)-এর মুকাবিলা করবে। অতঃপর মুকাবিলার জন্যে মূসা (আ)-কে সে একটি নির্দিষ্ট সময় ও স্থান নির্ধারণ করতে বলল। আর মূসা (আ)-এরও উদ্দেশ্য ছিল যাতে তিনি জনতার সামনে আল্লাহ তা’আলার প্রদত্ত নিদর্শন, দলীল ও প্রমাণাদি প্রকাশ করতে পারেন। তাই তিনি বললেন, ‘তোমাদের নির্ধারিত সময় হচ্ছে তোমাদের উৎসবের দিন, যেদিন তারা সাধারণত সমবেত হতো।’ সেদিন দিনের প্রথমভাগে সূর্যের আলো প্রখর হবার সময় জনগণকে সমবেত করা হবে, যাতে সত্য সুস্পষ্টভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা যায়। এই মুকাবিলা রাতের বেলায় হবার জন্যে মূসা (আ) বলেননি, যাতে তাদের মধ্যে কোন সন্দেহ উদয় না হয় এবং তাদের জন্যে সত্য ও অসত্য বোঝা অসম্ভব না হয়ে পড়ে। বরং তিনি চেয়েছেন যাতে এই মুকাবিলা প্রকাশ্য দিবালোকে অনুষ্ঠিত হয়। কেননা, তিনি তাঁর প্রতিপালক প্রদত্ত অন্তদৃষ্টি দ্বারা সুনিশ্চিত ছিলেন যে, এই মুকাবিলায় আল্লাহ তা’আলা নিজের নিদর্শন ও দীনকে বিজয় মণ্ডিত করবেন—যদিও কিবতীরা তা কোনমতেই মেনে নিতে পারবে না।

আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেনঃ

فَتَوَلَّىٰ فِرۡعَوۡنُ فَجَمَعَ كَیۡدَهُۥ ثُمَّ أَتَىٰ ۝ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰ وَیۡلَكُمۡ لَا تَفۡتَرُوا۟ عَلَى ٱللَّهِ كَذِب ا فَیُسۡحِتَكُم بِعَذَاب ۖ وَقَدۡ خَابَ مَنِ ٱفۡتَرَىٰ ۝ فَتَنَـٰزَعُوۤا۟ أَمۡرَهُم بَیۡنَهُمۡ وَأَسَرُّوا۟ ٱلنَّجۡوَىٰ ۝ قَالُوۤا۟ إِنۡ هَـٰذَ  ٰ⁠ نِ لَسَـٰحِرَ  ٰ⁠ نِ یُرِیدَانِ أَن یُخۡرِجَاكُم مِّنۡ أَرۡضِكُم بِسِحۡرِهِمَا وَیَذۡهَبَا بِطَرِیقَتِكُمُ ٱلۡمُثۡلَىٰ ۝ فَأَجۡمِعُوا۟ كَیۡدَكُمۡ ثُمَّ ٱئۡتُوا۟ صَفّ اۚ وَقَدۡ أَفۡلَحَ ٱلۡیَوۡمَ مَنِ ٱسۡتَعۡلَىٰ [Surat Ta-Ha 60 – 64]

অর্থাৎ——“অতঃপর ফিরআউন উঠে গেল এবং পরে তার কৌশলসমূহ একত্র করল ও তারপর আসল। মূসা (আ) তাদেরকে বলল, ‘দুর্ভোগ তোমাদের। তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে না। করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন।’ যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সেই ব্যর্থ হয়েছে। ওরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের কর্ম সম্বন্ধে বিতর্ক করল এবং ওরা গোপনে পরামর্শ করল। ওরা বলল, ‘এ দু’জন অবশ্যই জাদুকর, তারা চায় তাদের জাদু দ্বারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বহিষ্কার করতে এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন ব্যবস্থা ধ্বংস করতে।’ অতএব, তোমরা তোমাদের জাদু ক্রিয়া সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধ হয়ে উপস্থিত হও এবং যে আজ জয়ী হবে সে সফল হবে। (সূরা তা-হাঃ ৬০-৬৪)

আল্লাহ তা’আলা ফিরআউনের সত্যের বিরুদ্ধে মুকাবিলা করার প্রস্তুতি সম্বন্ধে বলেন যে, ফিরআউন চলে গেল এবং তার রাজ্যের সমস্ত জাদুকরকে একত্র করল। ঐ সময় মিসর দেশটি জাদুকরে ভরপুর ছিল। আর এ জাদুকররা ছিল তাদের পেশায় খুবই পটু। প্রতিটি শহর ও প্রতিটি স্থান থেকে সংগ্রহ করে জাদুকরদেরকে সমবেত করা হল। বস্তুত তাদের একটি বিরাট দল সমবেত হল। কেউ কেউ বলেন, যথা মুহাম্মদ ইবন কা’ব (র) বলেন, “তারা ছিল সংখ্যায় আশি হাজার।” কাসিম ইবন আবু বুরদা (র) বলেন, “তারা ছিল সংখ্যায় সত্তর হাজার।” সুদ্দী (র) বলেন, “তাদের সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার থেকে চল্লিশ হাজারের মধ্যে।” আবু উমামা (র) বলেন, “তারা ছিল উনিশ হাজার।” মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (র) বলেন, “তারা ছিল পনের হাজার।” কা’ব আহবারের মতে, তারা ছিল বার হাজার। ইব্‌ন আবু হাতিম (র) আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “তারা ছিল সংখ্যায় সত্তরজন।” অন্য সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “তারা ছিল বনী ইসরাঈল বংশীয় চল্লিশজন ক্রীতদাস। এদেরকে ফিরআউন তাদের গণকদের কাছে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল এবং সেখানে জাদু শিক্ষা করার জন্যে হুকুম দিয়েছিল। এই জন্যই তারা আত্মসমর্পণের সময় বলেছিল, ‘তুমি আমাদেরকে জাদু শিখতে বাধ্য করেছিলে।‘ এই অভিমতটি সন্দেহযুক্ত।

ফিরআউন, তার আমীর-উমারা, পারিষদবর্গ, সরকারী কর্মচারীবৃন্দ এবং নির্বিশেষে দেশের সকলেই মাঠে হাযির হল। কেননা, ফিরআউন তাদের মধ্যে ঘোষণা করেছিল তারা সকলে যেন এই বিরাট মেলায় হাযির হয়। তারা বের হয়ে পড়ল এবং বলাবলি করতে লাগল, জাদুকররা যদি জিতে যায় তাহলে আমরা তাদেরই অনুসরণ করব। মূসা (আ) জাদুকরদের দিকে অগ্রসর হয়ে তাদেরকে উপদেশ দিলেন এবং আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন ও দলীলাদির বিরুদ্ধে ভ্রান্ত জাদু নিয়ে মুকাবিলায় অবতরণের জন্যে তাদেরকে তিরস্কারও করেন। তিনি তাদেরকে বললেন, “দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে না। করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করে দেবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সেই ব্যর্থ হয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে নিজেদের কর্ম সম্বন্ধে বিতর্ক করল।” কেউ কেউ বলেন, তাদের বিতর্কের অর্থ হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে, এটা নবীর কথা, জাদু নয়। আবার কেউ কেউ বলে, বরং সে-ই জাদুকর। আল্লাহ তাআলাই সম্যক জ্ঞাত।

এ বিষয়ে এবং অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে তারা গোপনে সলাপরামর্শ করল এবং বলতে লাগল, মূসা (আ) ও তাঁর ভাই হারূন (আ) দুজনই বিজ্ঞ ও দক্ষ জাদুকর; তারা তাদের জাদুবিদ্যায় অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে যেন লোকজন সমবেত হয়, তারা বাদশাহ ও তার পারিষদবর্গের উপর চড়াও হতে পারে, তোমাদের সামগ্রিকভাবে নির্মূল করে দিতে পারে। আর এ জাদুবিদ্যা দিয়ে যেন তারা তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। তারা বলতে লাগল, “তোমরা তোমাদের জাদু ক্রিয়া সংহত কর, অতঃপর সারিবদ্ধ হয়ে উপস্থিত হও এবং যে আজ জয়ী হবে সে সফল হবে। প্রথম কথাটি তারা এজন্য বলল, যাতে তারা তাদের কাছে প্রাপ্ত যাবতীয় ধরনের চেষ্টা, তদবীর, ছলচাতুরী, অন্যের প্রতি অপবাদ, জাদু ও ধোঁকাবাজির আশ্রয় নেয়। আফসোস, আল্লাহর কসম, তাদের সমস্ত ধ্যান-ধারণা ও যুক্তি-তর্ক ছিল মিথ্যা ও ভ্রান্ত। অপবাদ, জাদু ও ভিত্তিহীন যুক্তি-তর্ক কেমন করে এমন সব মু’জিযার মুকাবিলা করতে পারে, যেগুলো মহান আল্লাহ আপন বান্দা ও রাসূল মূসা (আ)-এর মাধ্যমে প্রদর্শন করেছেন। রাসূলকে এমন দলীল দ্বারা শক্তিশালী ও পুষ্ট করা হয়েছে, যার সামনে দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে যায় এবং লোক হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। ফিরআউন বলতে লাগল, “তোমাদের কাছে যা কিছু তদবীর জানা রয়েছে সব কিছু নিয়ে মাঠে নেমে পড় এবং একতাবদ্ধ হয়ে মুকাবিলা কর।’

অতঃপর তারা পরস্পরকে মুকাবিলার জন্যে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করতে লাগল। কেননা, ফিরআউন তাদেরকে পদমর্যাদা ও উপঢৌকনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অবশ্যই শয়তানের প্রতিশ্রুতি প্রতারণামূলক।

আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

قَالُوا۟ یَـٰمُوسَىٰۤ إِمَّاۤ أَن تُلۡقِیَ وَإِمَّاۤ أَن نَّكُونَ أَوَّلَ مَنۡ أَلۡقَىٰ ۝ قَالَ بَلۡ أَلۡقُوا۟ۖ فَإِذَا حِبَالُهُمۡ وَعِصِیُّهُمۡ یُخَیَّلُ إِلَیۡهِ مِن سِحۡرِهِمۡ أَنَّهَا تَسۡعَىٰ ۝ فَأَوۡجَسَ فِی نَفۡسِهِۦ خِیفَة مُّوسَىٰ ۝ قُلۡنَا لَا تَخَفۡ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡأَعۡلَىٰ ۝ وَأَلۡقِ مَا فِی یَمِینِكَ تَلۡقَفۡ مَا صَنَعُوۤا۟ۖ إِنَّمَا صَنَعُوا۟ كَیۡدُ سَـٰحِر ۖ وَلَا یُفۡلِحُ ٱلسَّاحِرُ حَیۡثُ أَتَىٰ

[Surat Ta-Ha 65 – 69]

অর্থাৎ—তারা বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি নিক্ষেপ কর অথবা প্রথমে আমরাই নিক্ষেপ করি।‘ মূসা (আ) বলল, “বরং তোমরাই নিক্ষেপ কর।‘ তাদের জাদু প্রভাবে অকস্মাৎ মূসা (আ)-এর মনে হল তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে। মূসা (আ) তার অন্তরে কিছু ভীতি অনুভব করল। আমি বললাম, ‘ভয় করবে না, তুমিই হচ্ছো প্রবল। তোমার ডান হাতে যা রয়েছে তা নিক্ষেপ কর; এটা ওরা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে। ওরা যা করেছে তা তো কেবল জাদুকরের কৌশল। জাদুকর যেখানেই আসুক, সফল হবে না।‘ (সূরা তা-হাঃ ৬৫-৬৯)

জাদুকররা যখন সারিবদ্ধ হল, মূসা (আ) তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারা তখন মূসা (আ)-কে বলল, হয় তুমি আমাদের আগে নিক্ষেপ কর, অথবা আমরা আগে নিক্ষেপ করি।‘ মূসা (আ) বললেন, ‘বরং তোমরাই প্রথম নিক্ষেপ কর।’ অতঃপর তারা দড়ি ও লাঠিগুলো নিক্ষেপ করার ঘোষণা দিল এবং পারদ ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এগুলোতে স্থাপন করল। আর এ জন্যে দড়ি ও লাঠিগুলো দর্শকের চোখে মনে হচ্ছিল যেন নিজ ইচ্ছে মাফিক ছুটাছুটি করছে অথচ এগুলো যন্ত্রের জন্যেই নড়াচড়া করছিল। এভাবে তারা মানুষের চোখকে জাদু করেছিল এবং তাদের মনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। তারা তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো নিক্ষেপ করার সময় বলেছিল, ‘ফিরআউনের মহা মর্যাদার শপথ! আমরা বিজয়ী হবই।’

আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

( قَالَ أَلۡقُوا۟ۖ فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ سَحَرُوۤا۟ أَعۡیُنَ ٱلنَّاسِ وَٱسۡتَرۡهَبُوهُمۡ وَجَاۤءُو بِسِحۡرٍ عَظِیم ࣲ)

[Surat Al-A’raf 116]

‘যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল, তাদেরকে আতংকিত করল এবং তারা এক বড় রকমের জাদু দেখাল।‘ মূসা (আ) জনগণের জন্যে একটু ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি আশংকা করতে লাগলেন যে, ওহী প্রাপ্তির পূর্বে তিনি তার হাতের লাঠি ছাড়তে পারছেন না, তাই লাঠি ছাড়ার পূর্বেই যদি জনগণ তাদের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে প্রতারিত হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা’আলা নির্দিষ্ট মুহূর্তে লাঠি নিক্ষেপ করার জন্যে মূসা (আ)-এর কাছে ওহী নাযিল করেন। মূসা (আ) তখন হাতের লাঠি নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন।

যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে ইরশাদ করেনঃ

فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئۡتُم بِهِ ٱلسِّحۡرُۖ إِنَّ ٱللَّهَ سَیُبۡطِلُهُۥۤ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُصۡلِحُ عَمَلَ ٱلۡمُفۡسِدِینَ ۝ وَیُحِقُّ ٱللَّهُ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُجۡرِمُونَ [Surat Yunus 81 – 82]

অর্থাৎ—“তোমরা যা এনেছ তা জাদু, আল্লাহ্ তা’আলা এটাকে শীঘ্রই অসার করে দেবেন। আল্লাহ্ তা’আলা অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না। অপরাধীরা অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ্ তা’আলা তার বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” (সূরা ইউনুসঃ ৮১-৮২)

আল্লাহু তা’আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ

وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَلۡقِ عَصَاكَۖ فَإِذَا هِیَ تَلۡقَفُ مَا یَأۡفِكُونَ ۝ فَوَقَعَ ٱلۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ۝ فَغُلِبُوا۟ هُنَالِكَ وَٱنقَلَبُوا۟ صَـٰغِرِینَ ۝ وَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سَـٰجِدِینَ ۝ قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ [Surat Al-A’raf 117 – 122]

অর্থাৎ-মূসার প্রতি আমি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর,’ সহসা এটা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তারা যা করছিল তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হল, সেখানে তারা পরাভূত হল ও লাঞ্ছিত হল এবং জাদুকররা সিজদাবনত হল। তারা বলল, আমরা ঈমান আনলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি যিনি মূসা ও হারূন এরও প্রতিপালক। (সূরা আরাফঃ ১১৭-১২২)

একাধিক পূর্বসূরি আলিম উল্লেখ করেন যে, মূসা (আ) যখন আপন লাঠি নিক্ষেপ করলেন, তখন তা পা, বড় গর্দান এবং ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ অবয়ববিশিষ্ট একটি বিরাট অজগরে পরিণত হল। জনতা এটাকে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত ও বিহ্বল হয়ে পড়ল এবং ছুটে পালাতে লাগল। জনতা অজগর দেখে যখন পিছনে সরে গেল, অজগর সম্মুখ পানে অগ্রসর হল এবং জাদুকরদের দড়ি ও লাঠি দিয়ে তৈরি অলীক সৃষ্টিগুলোকে একে একে অতি দ্রুত গ্রাস করতে লাগল। জনতা অজগরের প্রতি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অন্যদিকে জাদুকররা মূসা (আ)-এর লাঠির কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল এবং এমন একটি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করল যা তাদের ধারণার বাইরে ছিল, যা তাদের বিদ্যার ও পেশার আওতার বাইরে ছিল। এখন তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে ও জানতে পারল যে, মূসা (আ)-এর কর্মকাণ্ড ভিত্তিহীন জাদু নয়, অবাস্তব নয়, মায়া নয়, নিছক ধারণা নয়, মিথ্যা নয়, অপবাদ নয়, পথভ্রষ্টতাও নয় বরং এটাই সত্য বা যথার্থ। সত্য দ্বারা পুষ্ট রাসূল ব্যতীত অন্য কোন ধারক ও বাহকের এরূপ অত্যাশ্চর্য প্রদর্শন করা আর কারো পক্ষেই সম্ভব না। এভাবে আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তর থেকে অজ্ঞতার পর্দা দূর করে দিলেন এবং তাদের অন্তরকে হিদায়াতের নূর দ্বারা আলোকিত করে দিলেন। তাকে কাঠিন্য মুক্ত করে দিলেন। ফলে তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে ঝুঁকে পড়ল এবং তার সন্তুষ্টির জন্যই সিজদায় নত হল। তারা উপস্থিত জনতার পক্ষ থেকে কোন প্রকার শাস্তি বা নির্যাতনের আশংকা না করে প্রকাশ্যভাবে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলতে লাগল, “আমরা মূসা ও হারূন-এর প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম।”

আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

فَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سُجَّد ا قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ هَـٰرُونَ وَمُوسَىٰ ۝ قَالَ ءَامَنتُمۡ لَهُۥ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّهُۥ لَكَبِیرُكُمُ ٱلَّذِی عَلَّمَكُمُ ٱلسِّحۡرَۖ فَلَأُقَطِّعَنَّ أَیۡدِیَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَـٰف وَلَأُصَلِّبَنَّكُمۡ فِی جُذُوعِ ٱلنَّخۡلِ وَلَتَعۡلَمُنَّ أَیُّنَاۤ أَشَدُّ عَذَاب ا وَأَبۡقَىٰ ۝ قَالُوا۟ لَن نُّؤۡثِرَكَ عَلَىٰ مَا جَاۤءَنَا مِنَ ٱلۡبَیِّنَـٰتِ وَٱلَّذِی فَطَرَنَاۖ فَٱقۡضِ مَاۤ أَنتَ قَاضٍۖ إِنَّمَا تَقۡضِی هَـٰذِهِ ٱلۡحَیَوٰةَ ٱلدُّنۡیَاۤ ۝ إِنَّاۤ ءَامَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغۡفِرَ لَنَا خَطَـٰیَـٰنَا وَمَاۤ أَكۡرَهۡتَنَا عَلَیۡهِ مِنَ ٱلسِّحۡرِۗ وَٱللَّهُ خَیۡر وَأَبۡقَىٰۤ ۝ إِنَّهُۥ مَن یَأۡتِ رَبَّهُۥ مُجۡرِم ا فَإِنَّ لَهُۥ جَهَنَّمَ لَا یَمُوتُ فِیهَا وَلَا یَحۡیَىٰ ۝ وَمَن یَأۡتِهِۦ مُؤۡمِن ا قَدۡ عَمِلَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ لَهُمُ ٱلدَّرَجَـٰتُ ٱلۡعُلَىٰ ۝ جَنَّـٰتُ عَدۡن تَجۡرِی مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَـٰرُ خَـٰلِدِینَ فِیهَاۚ وَذَ  ٰ⁠ لِكَ جَزَاۤءُ مَن تَزَكَّىٰ [Surat Ta-Ha 70 – 76]

অর্থাৎ– “তারপর জাদুকররা সিজদাবনত হল ও বলল, “আমরা হারূন ও মূসার প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম।’ ফিরআউন বললঃ ‘কী, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা মূসাতে বিশ্বাস স্থাপন করলে! দেখছি, সে তো তোমাদের প্রধান, সে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। সুতরাং আমি অবশ্যই তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করবই এবং তোমরা অবশ্যই জানতে পারবে—আমাদের মধ্যে কার শাস্তি কঠোরতর ও অধিক স্থায়ী।’ তারা বলল, ‘আমাদের নিকট যে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে তার উপর এবং যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার উপর তোমাকে আমরা কিছুতেই প্রাধান্য দেব না; সুতরাং তুমি যা করতে চাও তা করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনের উপর কর্তৃত্ব করতে পার। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি ক্ষমা করেন আমাদের অপরাধ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ তাও।’ আর আল্লাহ শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী, যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো রয়েছে জাহান্নাম, সেথায় সে মরবেও না, বাঁচবেও না। যারা তাঁর নিকট উপস্থিত হবে মু’মিন অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের জন্যে রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা- স্থায়ী জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেথায় তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই, যারা পবিত্র। (সূরা তা-হাঃ ৭০-৭৬)

সাঈদ ইবন জুবাইর (রা), ইকরিমা, কাসিম ইবন আবু বুরদা, আওযায়ী (র) প্রমুখ বলেন, ‘যখন জাদুকররা মূসা (আ)-এর মুজিযা প্রত্যক্ষ করে সিজদায় অবনত হলেন তখন তারা জান্নাতে তাদের বসবাসের জন্য তৈরি ও তাদের অভ্যর্থনার জন্যে সুসজ্জিত ও দালানকোঠা অবলোকন করলেন আর এজন্যই তারা ফিরআউনের ভয়ভীতি, শাস্তি ও হুমকির প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র করলেন না। ফিরআউন যখন দেখতে পেল, জাদুকররা মুসলমান হয়ে গেছে এবং তারা মূসা (আ) ও হারূন (আ)-এর প্রচারিত বাণী লোকসমাজে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে, সে ভীত হয়ে পড়ল এবং ভবিষ্যত আশংকায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। এতে সে হতবিহ্বল হয়ে আপন অন্তদৃষ্টি ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলল। তার মধ্যে ছিল শঠতা, ধোঁকাবাজী, প্রতারণা, পথভ্রষ্টতা ও জনগণকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখার সুনিপুণ কৌশল। এজন্যই সে জনতার উপস্থিতিতে জাদুকরদের বলল, ‘কী আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা মূসাতে বিশ্বাস স্থাপন করলে!’ অর্থাৎ আমার প্রজাদের সামনে এরূপ জঘন্য কাজটি করার পূর্বে কেন আমার সাথে পরামর্শ করলে না। অতঃপর সে তাদেরকে ধমকি দিল, শাস্তির ভয় দেখাল এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলতে লাগল, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রধান; সে-ই তোমাদেরকে জাদুশিক্ষা দিয়েছে।

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ

قَالَ فِرۡعَوۡنُ ءَامَنتُم بِهِۦ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّ هَـٰذَا لَمَكۡر مَّكَرۡتُمُوهُ فِی ٱلۡمَدِینَةِ لِتُخۡرِجُوا۟ مِنۡهَاۤ أَهۡلَهَاۖ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ [Surat Al-A’raf 123]

অর্থাৎ—“ফিরআউন বলল, কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বে তোমরা এটাতে বিশ্বাস করলে? এ তো এক চক্রান্ত; তোমরা সজ্ঞানে এই চক্রান্ত করেছ নগরবাসীদেরকে এটা হতে বহিষ্কারের জন্যে। আচ্ছা, তোমরা শীঘ্রই এটার পরিণাম জানবে।” (সূরা আরাফঃ ১২৩)

ফিরআউনের এ উক্তিটি একটি ভিত্তিহীন অপবাদ ব্যতীত কিছু নয়। প্রত্যেকটি বোধ শক্তিসম্পন্ন লোকই জানে যে, এটা ফিরআউনের কুফরী, মিথ্যাচারিতা ও প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয় বরং এরূপ কথা ছেলেমেয়েদের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তার অমাত্যবর্গ ও অন্য সকলেরই জানা ছিল যে, মূসা (আ)-কে জাদুকররা কোনদিনও দেখেননি, তিনি কেমন করে তাদের প্রধান হতে পারেন? যিনি তাদেরকে জাদুশিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া তিনি তাদেরকে একত্র করেননি এবং তাদের একত্রিত হবার বিষয়টিও তার কাছে জানা ছিল না, বরং ফিরআউন তাদেরকে ডেকেছে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-নগর, মিসরের শহরতলি ও বিভিন্ন জায়গা থেকে বাছাই করে তাদেরকে সে মূসা (আ)-এর সামনে উপস্থাপন করেছে।

সূরা আ’রাফে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

ثُمَّ بَعَثۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِم مُّوسَىٰ بِـَٔایَـٰتِنَاۤ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِۦ فَظَلَمُوا۟ بِهَاۖ فَٱنظُرۡ كَیۡفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلۡمُفۡسِدِینَ ۝ وَقَالَ مُوسَىٰ یَـٰفِرۡعَوۡنُ إِنِّی رَسُول مِّن رَّبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ حَقِیقٌ عَلَىٰۤ أَن لَّاۤ أَقُولَ عَلَى ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡحَقَّۚ قَدۡ جِئۡتُكُم بِبَیِّنَة مِّن رَّبِّكُمۡ فَأَرۡسِلۡ مَعِیَ بَنِیۤ إِسۡرَ  ٰ⁠ ۤءِیلَ ۝ قَالَ إِن كُنتَ جِئۡتَ بِـَٔایَة فَأۡتِ بِهَاۤ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ ۝ فَأَلۡقَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِیَ ثُعۡبَان مُّبِین ۝ وَنَزَعَ یَدَهُۥ فَإِذَا هِیَ بَیۡضَاۤءُ لِلنَّـٰظِرِینَ ۝ قَالَ ٱلۡمَلَأُ مِن قَوۡمِ فِرۡعَوۡنَ إِنَّ هَـٰذَا لَسَـٰحِرٌ عَلِیم ۝ یُرِیدُ أَن یُخۡرِجَكُم مِّنۡ أَرۡضِكُمۡۖ فَمَاذَا تَأۡمُرُونَ ۝ قَالُوۤا۟ أَرۡجِهۡ وَأَخَاهُ وَأَرۡسِلۡ فِی ٱلۡمَدَاۤىِٕنِ حَـٰشِرِینَ ۝ یَأۡتُوكَ بِكُلِّ سَـٰحِرٍ عَلِیم ۝ وَجَاۤءَ ٱلسَّحَرَةُ فِرۡعَوۡنَ قَالُوۤا۟ إِنَّ لَنَا لَأَجۡرًا إِن كُنَّا نَحۡنُ ٱلۡغَـٰلِبِینَ ۝ قَالَ نَعَمۡ وَإِنَّكُمۡ لَمِنَ ٱلۡمُقَرَّبِینَ ۝ قَالُوا۟ یَـٰمُوسَىٰۤ إِمَّاۤ أَن تُلۡقِیَ وَإِمَّاۤ أَن نَّكُونَ نَحۡنُ ٱلۡمُلۡقِینَ ۝ قَالَ أَلۡقُوا۟ۖ فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ سَحَرُوۤا۟ أَعۡیُنَ ٱلنَّاسِ وَٱسۡتَرۡهَبُوهُمۡ وَجَاۤءُو بِسِحۡرٍ عَظِیم ۝ ۞ وَأَوۡحَیۡنَاۤ إِلَىٰ مُوسَىٰۤ أَنۡ أَلۡقِ عَصَاكَۖ فَإِذَا هِیَ تَلۡقَفُ مَا یَأۡفِكُونَ ۝ فَوَقَعَ ٱلۡحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا۟ یَعۡمَلُونَ ۝ فَغُلِبُوا۟ هُنَالِكَ وَٱنقَلَبُوا۟ صَـٰغِرِینَ ۝ وَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سَـٰجِدِینَ۝ ( قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ ۝ قَالَ فِرۡعَوۡنُ ءَامَنتُم بِهِۦ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّ هَـٰذَا لَمَكۡر مَّكَرۡتُمُوهُ فِی ٱلۡمَدِینَةِ لِتُخۡرِجُوا۟ مِنۡهَاۤ أَهۡلَهَاۖ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ ۝ لَأُقَطِّعَنَّ أَیۡدِیَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَـٰف ثُمَّ لَأُصَلِّبَنَّكُمۡ أَجۡمَعِینَ ۝ قَالُوۤا۟ إِنَّاۤ إِلَىٰ رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ ۝ وَمَا تَنقِمُ مِنَّاۤ إِلَّاۤ أَنۡ ءَامَنَّا بِـَٔایَـٰتِ رَبِّنَا لَمَّا جَاۤءَتۡنَاۚ رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡر ا وَتَوَفَّنَا مُسۡلِمِینَ [Surat Al-A’raf 103 – 126]

অর্থাৎ তাদের পর মূসাকে আমার নিদর্শনসহ ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট পাঠাই; কিন্তু তারা এটা অস্বীকার করে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল তা লক্ষ্য কর। মূসা বলল, ‘হে ফিরআউন! আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রেরিত। এটা স্থির নিশ্চিত যে, আমি আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলব না; তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণ আমি তোমাদের নিকট এনেছি সুতরাং বনী ইসরাঈলকে আমার সাথে যেতে দাও।’ ফিরআউন বলল, ‘যদি তুমি কোন নিদর্শন এনে থাক তবে তুমি সত্যবাদী হলে তা পেশ কর।’ তারপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল এবং তৎক্ষণাৎ এটা এক সাক্ষাৎ অজগর হল। সে তার হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ এটা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হল। ফিরআউন সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল, ‘এতো একজন সুদক্ষ জাদুকর, এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায়। এখন তোমরা কী পরামর্শ দাও?’

তারা বলল, ‘তাকে ও তার ভাইকে কিঞ্চিৎ অবকাশ দাও এবং নগরে নগরে সংগ্রাহকদেরকে পাঠাও, যেন তারা তোমার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ জাদুকরকে উপস্থিত করে।’ জাদুকররা ফিরআউনের নিকট এসে বলল, “আমরা যদি বিজয়ী হই তবে আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, এবং তোমরা আমার সান্নিধ্য প্রাপ্তদেরও অন্তর্ভুক্ত হবে।’ তারা বলল, “হে মূসা! তুমিই কি নিক্ষেপ করবে, না আমরাই নিক্ষেপ করব?’ সে বলল, তোমরাই নিক্ষেপ কর, যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল; তাদেরকে আতংকিত করল এবং তারা এক বড় রকমের জাদু দেখাল। আমি মূসার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমিও তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর, সহসা এটা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তারা যা করছিল তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হল। সেখানে তারা পরাভূত হল ও লাঞ্ছিত হল এবং জাদুকররা সিজদাবনত হল। তারা বলল, ‘আমরা ঈমান আনলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি – যিনি মূসা ও হারূন-এরও প্রতিপালক।’

ফিরআউন বলল, ‘কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বে তোমরা এটাতে বিশ্বাস করলে? এটা তো এক চক্রান্ত। তোমরা সজ্ঞানে এ চক্রান্ত করেছ নগরবাসীদের নগর থেকে বহিষ্কারের জন্যে। আচ্ছা, তোমরা শীঘ্রই এটার পরিণাম জানবে। আমি তো তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কর্তন করবই, তারপর তোমাদের সকলেরই শূলবিদ্ধও করব।’ তারা বলল আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাব। তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দান করছ শুধু এজন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে ঈমান এনেছি। যখন এটা আমাদের নিকট এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্যদান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদের মৃত্যু ঘটাও। (সূরা আ’রাফ ১০৩-১২৬)

আল্লাহ্ তা’আলা সূরা ইউনুসে ইরশাদ করেনঃ

ثُمَّ بَعَثۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِم مُّوسَىٰ وَهَـٰرُونَ إِلَىٰ فِرۡعَوۡنَ وَمَلَإِی۟هِۦ بِـَٔایَـٰتِنَا فَٱسۡتَكۡبَرُوا۟ وَكَانُوا۟ قَوۡم ا مُّجۡرِمِینَ ۝ فَلَمَّا جَاۤءَهُمُ ٱلۡحَقُّ مِنۡ عِندِنَا قَالُوۤا۟ إِنَّ هَـٰذَا لَسِحۡر مُّبِین ۝ قَالَ مُوسَىٰۤ أَتَقُولُونَ لِلۡحَقِّ لَمَّا جَاۤءَكُمۡۖ أَسِحۡرٌ هَـٰذَا وَلَا یُفۡلِحُ ٱلسَّـٰحِرُونَ ۝ قَالُوۤا۟ أَجِئۡتَنَا لِتَلۡفِتَنَا عَمَّا وَجَدۡنَا عَلَیۡهِ ءَابَاۤءَنَا وَتَكُونَ لَكُمَا ٱلۡكِبۡرِیَاۤءُ فِی ٱلۡأَرۡضِ وَمَا نَحۡنُ لَكُمَا بِمُؤۡمِنِینَ ۝ وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ ٱئۡتُونِی بِكُلِّ سَـٰحِرٍ عَلِیم ۝ فَلَمَّا جَاۤءَ ٱلسَّحَرَةُ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰۤ أَلۡقُوا۟ مَاۤ أَنتُم مُّلۡقُونَ ۝ فَلَمَّاۤ أَلۡقَوۡا۟ قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئۡتُم بِهِ ٱلسِّحۡرُۖ إِنَّ ٱللَّهَ سَیُبۡطِلُهُۥۤ إِنَّ ٱللَّهَ لَا یُصۡلِحُ عَمَلَ ٱلۡمُفۡسِدِینَ ۝ وَیُحِقُّ ٱللَّهُ ٱلۡحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُجۡرِمُونَ

[Surat Yunus 75 – 82]

অর্থাৎ- “পরে আমার নিদর্শনসহ মূসা ও হারূনকে ফিরআউন ও তার পারিষদবর্গের নিকট প্রেরণ করি। কিন্তু ওরা অহংকার করে এবং ওরা ছিল অপরাধী সম্প্রদায়। তারপর যখন ওদের কাছে আমার নিকট হতে সত্য এল তখন ওরা বলল, এটা তো নিশ্চয়ই স্পষ্ট জাদু।‘ মূসা বলল, ‘সত্য যখন তোমাদের নিকট আসল, তখন সে সম্পর্কে তোমরা এরূপ বলছ? এটা কি জাদু? জাদুকররা তো সফলকাম হয় না।’ ওরা বলল, “আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে যাতে পেয়েছি তুমি কি তা থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত করবার জন্যে আমাদের নিকট এসেছ এবং যাতে দেশে তোমাদের দুজনের প্রতিপত্তি হয় এজন্য? আমরা তোমাদের প্রতি বিশ্বাসী নই।

ফিরআউন বলল, ‘তোমরা আমার নিকট সকল সুদক্ষ জাদুকরকে নিয়ে এস। তারপর যখন জাদুকররা এল তখন তাদেরকে মূসা বলল, ‘তোমাদের যা নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর।’ যখন তারা নিক্ষেপ করল, তখন মূসা বলল, “তোমরা যা কিছু এনেছ তা জাদু, আল্লাহ জাদুকে অসার করে দেবেন। আল্লাহ অশান্তি সৃষ্টিকারীদের কর্ম সার্থক করেন না। অপরাধীরা অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বাণী অনুযায়ী সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। (সূরা ইউনূসঃ ৭৫-৮২)

আল্লাহ তা’আলা সূরা শূআরায় মূসা (আ) ও ফিরআউন সম্পর্কিত ঘটনা বর্ণনার্থে ইরশাদ করেনঃ

قَالَ لَىِٕنِ ٱتَّخَذۡتَ إِلَـٰهًا غَیۡرِی لَأَجۡعَلَنَّكَ مِنَ ٱلۡمَسۡجُونِینَ ۝ قَالَ أَوَلَوۡ جِئۡتُكَ بِشَیۡء مُّبِین ۝ قَالَ فَأۡتِ بِهِۦۤ إِن كُنتَ مِنَ ٱلصَّـٰدِقِینَ ۝ فَأَلۡقَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِیَ ثُعۡبَان مُّبِین ۝ وَنَزَعَ یَدَهُۥ فَإِذَا هِیَ بَیۡضَاۤءُ لِلنَّـٰظِرِینَ ۝ قَالَ لِلۡمَلَإِ حَوۡلَهُۥۤ إِنَّ هَـٰذَا لَسَـٰحِرٌ عَلِیم ۝ یُرِیدُ أَن یُخۡرِجَكُم مِّنۡ أَرۡضِكُم بِسِحۡرِهِۦ فَمَاذَا تَأۡمُرُونَ ۝ قَالُوۤا۟ أَرۡجِهۡ وَأَخَاهُ وَٱبۡعَثۡ فِی ٱلۡمَدَاۤىِٕنِ حَـٰشِرِینَ ۝ یَأۡتُوكَ بِكُلِّ سَحَّارٍ عَلِیم ۝ فَجُمِعَ ٱلسَّحَرَةُ لِمِیقَـٰتِ یَوۡم مَّعۡلُوم ۝ وَقِیلَ لِلنَّاسِ هَلۡ أَنتُم مُّجۡتَمِعُونَ ۝ لَعَلَّنَا نَتَّبِعُ ٱلسَّحَرَةَ إِن كَانُوا۟ هُمُ ٱلۡغَـٰلِبِینَ ۝ فَلَمَّا جَاۤءَ ٱلسَّحَرَةُ قَالُوا۟ لِفِرۡعَوۡنَ أَىِٕنَّ لَنَا لَأَجۡرًا إِن كُنَّا نَحۡنُ ٱلۡغَـٰلِبِینَ ۝ قَالَ نَعَمۡ وَإِنَّكُمۡ إِذ ا لَّمِنَ ٱلۡمُقَرَّبِینَ ۝ قَالَ لَهُم مُّوسَىٰۤ أَلۡقُوا۟ مَاۤ أَنتُم مُّلۡقُونَ ۝ فَأَلۡقَوۡا۟ حِبَالَهُمۡ وَعِصِیَّهُمۡ وَقَالُوا۟ بِعِزَّةِ فِرۡعَوۡنَ إِنَّا لَنَحۡنُ ٱلۡغَـٰلِبُونَ ۝ فَأَلۡقَىٰ مُوسَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِیَ تَلۡقَفُ مَا یَأۡفِكُونَ ۝ فَأُلۡقِیَ ٱلسَّحَرَةُ سَـٰجِدِینَ ۝ قَالُوۤا۟ ءَامَنَّا بِرَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَـٰرُونَ ۝ قَالَ ءَامَنتُمۡ لَهُۥ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّهُۥ لَكَبِیرُكُمُ ٱلَّذِی عَلَّمَكُمُ ٱلسِّحۡرَ فَلَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَۚ لَأُقَطِّعَنَّ أَیۡدِیَكُمۡ وَأَرۡجُلَكُم مِّنۡ خِلَـٰف وَلَأُصَلِّبَنَّكُمۡ أَجۡمَعِینَ ۝ قَالُوا۟ لَا ضَیۡرَۖ إِنَّاۤ إِلَىٰ رَبِّنَا مُنقَلِبُونَ ۝ إِنَّا نَطۡمَعُ أَن یَغۡفِرَ لَنَا رَبُّنَا خَطَـٰیَـٰنَاۤ أَن كُنَّاۤ أَوَّلَ ٱلۡمُؤۡمِنِینَ

[Surat Ash-Shu’ara 29 – 51]

অর্থাৎ- ফিরআউন বলল, ‘তুমি (হে মূসা) যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করব।’ মূসা বলল, ‘আমি তোমার নিকট স্পষ্ট কোন নিদর্শন আনয়ন করলেও?’ ফিরআউন বলল, ‘তুমি যদি সত্যবাদী হও, তবে তা উপস্থিত কর।‘ তারপর মূসা (আ) তার লাঠি নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগর হল এবং মূসা হাত বের করল আর তৎক্ষণাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র ও উজ্জ্বল প্রতিভাত হল। ফিরআউন তার পারিষদবর্গকে বলল, “এতো এক সুদক্ষ জাদুকর। এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে তার জাদুবলে বহিষ্কার করতে চায়। এখন তোমরা কি করতে বল?’ ওরা বলল, ‘তাকে ও তার ভাইকে কিছুটা অবকাশ দাও এবং নগরে নগরে সংগ্রাহকদেরকে পাঠাও যেন তারা তোমার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ জাদুকর উপস্থিত করে।’ তারপর এক নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট সময়ে জাদুকরদেরকে একত্র করা হল- এবং লোকদেরকে বলা হল,‘ তোমরাও সমবেত হচ্ছ কি?’ যেন আমরা জাদুকরদের অনুসরণ করতে পারি, যদি ওরা বিজয়ী হয়। তারপর জাদুকররা এসে ফিরআউনকে বলল, ‘আমরা যদি বিজয়ী হই আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?’ ফিরআউন বলল, ‘হ্যাঁ, তখন তোমরা অবশ্যই আমার ঘনিষ্ঠদের শামিল হবে।‘ মুসা তাদেরকে বলল, ‘তোমাদের যা নিক্ষেপ করার তা নিক্ষেপ কর। তারপর তারা তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল এবং ওরা বলল, ‘ফিরআউনের ইযযতের শপথ! আমরাই বিজয়ী হব।‘ তারপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল; সহসা এটা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল। তখন জাদুকররা সিজদাবনত হয়ে পড়ল এবং বলল, “আমরা ঈমান আনয়ন করলাম জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রতি; যিনি মূসা ও হারূন-এরও প্রতিপালক।‘ ফিরআউন বলল, “কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা এটাতে বিশ্বাস করলে? সে-ই তো তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। শীঘ্রই তোমরা এটার পরিণাম জানবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত এবং তোমাদের পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করব এবং তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করবই।‘ ওরা বলল, ‘কোন ক্ষতি নেই, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করব। আমরা আশা করি যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন; কারণ আমরা মু’মিনদের মধ্যে অগ্রণী।’ (সূরা শুআরাঃ ২৯-৫১)

মোদ্দাকথা হল এই যে, ফিরআউন নিশ্চয়ই জাদুকরদেরকে এ কথা বলে যে, মূসা (আ) ছিলেন তাদের প্রধান যিনি তাদের জাদু শিক্ষা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ফিরআউন মিথ্যা বলেছে, অপবাদ দিয়েছে এবং চরম পর্যায়ের কুফরী করেছে। ফিরআউনের মূসা (আ)-এর প্রতি অপবাদ সর্বজনবিদিত। নিম্নে বর্ণিত আয়াতাংশসমূহের মাধ্যমে বিজ্ঞমহলের নিকট ফিরআউনের ধৃষ্টতা ও মূর্খতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। যেমন আয়াতাংশ—

قَالَ فِرۡعَوۡنُ ءَامَنتُم بِهِۦ قَبۡلَ أَنۡ ءَاذَنَ لَكُمۡۖ إِنَّ هَـٰذَا لَمَكۡر مَّكَرۡتُمُوهُ فِی ٱلۡمَدِینَةِ لِتُخۡرِجُوا۟ مِنۡهَاۤ أَهۡلَهَاۖ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ [Surat Al-A’raf 123]

“এটা একটা চক্রান্ত, এই চক্রান্তের মাধ্যমে তোমরা নগরবাসীদেরকে তাদের ভিটামাটি থেকে উৎখাতের চেষ্টা করছ; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। এবং তার উক্তিঃ আমি তোমাদের ডান হাত ও বাম পা কিংবা বাম হাত ও ডান পা কর্তন করে দেব। আর তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করব যাতে তোমরা অন্যদের জন্যে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। রাজ্যের অন্য কোন ব্যক্তি ভবিষ্যতে এরূপ করার যেন আর সাহস না পায়। এ জন্যেই ফিরআউন বলেছিল, তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করব। কেননা তা সবচাইতে উঁচু এবং সবচাইতে বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য।’ সে আরও বলেছিল, “তোমরা বুঝতে পারবে যে, আমাদের মধ্যে দুনিয়াতে কে বেশি কঠোর স্থায়ী শাস্তিদাতা।’ মু’মিন জাদুকরগণ বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব নিদর্শন ও অকাট্য প্রমাণাদি এসেছে ও আমাদের অন্তরে স্থান নিয়েছে এগুলোকে ছেড়ে আমরা কোনদিনও তোমার আনুগত্য করব না।’

আয়াতাংশ والذي فطرنا -এর ‘ওয়াও’ সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন, এটা পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে সংযুক্তকারী অব্যয়। আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে এই অক্ষরটি ‘শপথ’ অর্থবোধক।

মুমিন জাদুকরগণ ফিরআউনকে আরো বললেন, ‘তুমি যা পার তা কর; তোমার আদেশ তো শুধুমাত্র এই পার্থিব জীবনেই চলতে পারে। তবে যখন আমরা এই নশ্বর জগত ছেড়ে আখিরাতে চলে যাব তখন ঐ সত্তার আদেশ বলবৎ থাকবে যার প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি এবং আমরা যার প্রেরিত রাসূলগণের অনুসরণ করছি।

তারা আরো বললেনঃ

( إِنَّاۤ ءَامَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغۡفِرَ لَنَا خَطَـٰیَـٰنَا وَمَاۤ أَكۡرَهۡتَنَا عَلَیۡهِ مِنَ ٱلسِّحۡرِۗ وَٱللَّهُ خَیۡر وَأَبۡقَىٰۤ )

[Surat Ta-Ha 73]

অর্থাৎ- ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি যাতে তিনি আমাদের যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ ও তুমি যে আমাদেরকে জোর-জবরদস্তি করে জাদু করতে বাধ্য করেছ সেই অন্যায় ক্ষমা করে দেন।’ কেননা, আল্লাহ তাআলা কল্যাণময় এবং তুমি আমাদেরকে সান্নিধ্য প্রদানের (পার্থিব জগতে) যে ওয়াদা অঙ্গীকার করেছ তার চেয়ে আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত সওয়াব অধিকতর কল্যাণকর ও অধিকতর স্থায়ী।‘ অন্য আয়াতাংশে বলা হয়েছেঃ মুমিন জাদুকরগণ বলেছিলেন, “আমাদের কোন ক্ষতি নেই, কেননা আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাব। আমরা আশা রাখি যে, আমাদের প্রতিপালক আমাদের কৃত পাপরাশি ও অনাচারসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আমরা কিবতীদের পূর্বেই মূসা (আ) ও হারূন (আ)-এর প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি বলে আমরা ঘোষিত হব।

তারা তাকে আরো বললেনঃ

( وَمَا تَنقِمُ مِنَّاۤ إِلَّاۤ أَنۡ ءَامَنَّا بِـَٔایَـٰتِ رَبِّنَا لَمَّا جَاۤءَتۡنَاۚ رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡر ا وَتَوَفَّنَا مُسۡلِمِینَ )

[Surat Al-A’raf 126]

অর্থাৎ—তুমি তো আমাদেরকে শাস্তিদান করছো শুধু এ জন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করেছি যখন এগুলো আমাদের কাছে এসেছে। এছাড়া আমাদের অন্য কোন অপরাধ নেই। হে আমাদের প্রতিপালক! পরাক্রমশালী অত্যাচারী হিংস্র শাসক, তাগূত ও শয়তান আমাদেরকে যে অসহনীয় শাস্তি প্রদান করছে তা সহ্য করার আমাদেরকে ধৈর্য দাও এবং আমাদেরকে আত্মসমর্পণকারীরূপে মৃত্যু দান কর।‘

অতঃপর তারা তাকে উপদেশস্বরূপ মহান প্রতিপালকের শাস্তির প্রতি ভীতি প্রদর্শন করে বললেনঃ

( إِنَّهُۥ مَن یَأۡتِ رَبَّهُۥ مُجۡرِم ا فَإِنَّ لَهُۥ جَهَنَّمَ لَا یَمُوتُ فِیهَا وَلَا یَحۡیَىٰ )

[Surat Ta-Ha 74]

অর্থাৎ—যে তার প্রতিপালকের নিকট অপরাধী হয়ে উপস্থিত হবে তার জন্য তো রয়েছে জাহান্নাম, সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না। তাঁরা বললেন, ‘সুতরাং সাবধান তুমি যেন এসব অপরাধীর অন্তর্ভুক্ত না হও।‘ কিন্তু ফিরআউন তাদের উপদেশ অমান্য করে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

তারা তাকে আরো বললেনঃ

وَمَن یَأۡتِهِۦ مُؤۡمِن ا قَدۡ عَمِلَ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فَأُو۟لَـٰۤىِٕكَ لَهُمُ ٱلدَّرَجَـٰتُ ٱلۡعُلَىٰ ۝ جَنَّـٰتُ عَدۡن تَجۡرِی مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَـٰرُ خَـٰلِدِینَ فِیهَاۚ وَذَ  ٰ⁠ لِكَ جَزَاۤءُ مَن تَزَكَّىٰ [Surat Ta-Ha 75 – 76]

অর্থাৎ- যারা তাঁর নিকট উপস্থিত হবে মু’মিন অবস্থায় সৎকর্ম সম্পাদন করে তাদের জন্যে রয়েছে সমুচ্চ মর্যাদা স্থায়ী জান্নাত যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এই পুরস্কার তাদেরই যারা পবিত্র।‘ (সূরা তা-হাঃ ৭৫-৭৬)

সুতরাং তুমি এ দলের অন্তর্ভুক্ত হও। কিন্তু ফিরআউন ও তার আমলের মধ্যে ভাগ্যলিপি অন্তরায় হল- যা ছিল অখণ্ডনীয় ও অপরিবর্তনীয়। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলা তার দুষ্কর্মের জন্য আদেশ দিলেন যে, “অভিশপ্ত ফিরআউন জাহান্নামী, সে মর্মন্তুদ শাস্তি ভোগ করবে, তার মাথার উপর গরম পানি ঢালা হবে এবং তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও তিরস্কৃত করার উদ্দেশ্যে বলা হবে -জাহান্নামের আযাব আস্বাদন কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত অভিজাত।” (সূরা দুখানঃ ৪৯)।

উপরোক্ত আয়াতসমূহের পূর্বাপর দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ফিরআউন মু’মিন জাদুকরদের শূলবিদ্ধ করেছিল ও তাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দিয়েছিল। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি প্রসন্ন হোন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস ও উবায়দ ইবন উমায়র (রা) বলেন, তারা দিনের প্রথম অংশে ছিলেন জাদুকর। আর দিনের শেষাংশে পুণ্যবান শহীদ হিসেবে পরিগণিত হলেন। উপরোক্ত উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে মুমিন জাদুকরদের নিম্নোক্ত মুনাজাতে।

( رَبَّنَاۤ أَفۡرِغۡ عَلَیۡنَا صَبۡر ا وَتَوَفَّنَا مُسۡلِمِینَ )

অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্যদান কর এবং মুসলিমরূপে আমাদের মৃত্যু ঘটাও!’

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন