hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১ম খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৬৫
ইউনুস (আ)-এর বর্ণনা
সূরা ইউনুসে আল্লাহ বলেনঃ

فَلَوۡ لَا کَانَتۡ قَرۡیَۃٌ اٰمَنَتۡ فَنَفَعَہَاۤ اِیۡمَانُہَاۤ اِلَّا قَوۡمَ یُوۡنُسَ ؕ لَمَّاۤ اٰمَنُوۡا کَشَفۡنَا عَنۡہُمۡ عَذَابَ الۡخِزۡیِ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ مَتَّعۡنٰہُمۡ اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۹۸﴾

অর্থাৎ—তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতীত কোন জনপদবাসী কেন এমন হল না যারা ঈমান আনত এবং তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসত? তারা যখন বিশ্বাস করল, তখন আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে হীনতাজনক শাস্তি হতে মুক্ত করলাম এবং কিছুকালের জন্যে জীবনোপভোগ করতে দিলাম। (সূরা ইউনুসঃ ৯৮)

সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ বলেনঃ

وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّہَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ ٭ۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۚۖ ۸۷﴾ فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ ۙ وَ نَجَّیۡنٰہُ مِنَ الۡغَمِّ ؕ وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸۸﴾

অর্থাৎ—এবং স্মরণ কর যুন-নূন-এর কথা, যখন সে ক্রোধভরে বের হয়ে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তার জন্যে শাস্তি নির্ধারণ করব না। অতঃপর সে অন্ধকার থেকে আহ্বান করেছিল, তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই; তুমি পবিত্র, মহান, আমি তো সীমালংঘনকারী। তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা হতে এবং এভাবেই আমি মু‘মিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। (সূরা আম্বিয়াঃ ৮৭-৮৮)

সূরা সাফ্‌ফাতে আল্লাহ বলেনঃ

وَ اِنَّ یُوۡنُسَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۳۹﴾ ؕ اِذۡ اَبَقَ اِلَی الۡفُلۡکِ الۡمَشۡحُوۡنِ ﴿۱۴۰﴾ ۙ فَسَاہَمَ فَکَانَ مِنَ الۡمُدۡحَضِیۡنَ ﴿۱۴۱﴾ ۚ فَالۡتَقَمَہُ الۡحُوۡتُ وَ ہُوَ مُلِیۡمٌ ﴿۱۴۲﴾ فَلَوۡ لَاۤ اَنَّہٗ کَانَ مِنَ الۡمُسَبِّحِیۡنَ ﴿۱۴۳﴾ ۙ لَلَبِثَ فِیۡ بَطۡنِہٖۤ اِلٰی یَوۡمِ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿۱۴۴﴾ ۚؒ فَنَبَذۡنٰہُ بِالۡعَرَآءِ وَ ہُوَ سَقِیۡمٌ ﴿۱۴۵﴾ ۚ وَ اَنۡۢبَتۡنَا عَلَیۡہِ شَجَرَۃً مِّنۡ یَّقۡطِیۡنٍ ﴿۱۴۶﴾ۚ

অর্থাৎ—ইউনুসও ছিল রাসূলগণের একজন। স্মরণ কর, যখন সে পলায়ন করে বোঝাই নৌযানে পৌঁছল। অতঃপর সে লটারীতে যোগদান করল এবং পরাভূত হল। পরে এক বৃহদাকার মৎস্য তাকে গিলে ফেলল, তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। সে যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত, তাহলে তাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত থাকতে হত এটার উদরে। অতঃপর ইউনুসকে আমি নিক্ষেপ করলাম এক তৃণহীন প্রান্তরে এবং সে ছিল রুগ্ন। পরে আমি তার উপর এক লাউ গাছ উদ্‌গত করলাম। (সাফ্‌ফাতঃ ১৩৯-১৪৬)

সূরায়ে সাফ্‌ফাতে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَ اَرۡسَلۡنٰہُ اِلٰی مِائَۃِ اَلۡفٍ اَوۡ یَزِیۡدُوۡنَ ﴿۱۴۷﴾ ۚ فَاٰمَنُوۡا فَمَتَّعۡنٰہُمۡ اِلٰی حِیۡنٍ ﴿۱۴۸﴾ؕ

অর্থাৎ–তাকে (ইউনুস) আমি এক লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম। ফলে তারা ঈমান এনেছিল। আর আমি তাদেরকে কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দিলাম। (সূরা সাফ্‌ফাতঃ ১৪৭-১৪৮)

সূরায়ে কলমে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ

فَاصۡبِرۡ لِحُکۡمِ رَبِّکَ وَ لَا تَکُنۡ کَصَاحِبِ الۡحُوۡتِ ۘ اِذۡ نَادٰی وَ ہُوَ مَکۡظُوۡمٌ ﴿ؕ ۴۸﴾ لَوۡ لَاۤ اَنۡ تَدٰرَکَہٗ نِعۡمَۃٌ مِّنۡ رَّبِّہٖ لَنُبِذَ بِالۡعَرَآءِ وَ ہُوَ مَذۡمُوۡمٌ ﴿۴۹﴾ فَاجۡتَبٰہُ رَبُّہٗ فَجَعَلَہٗ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۵۰﴾

অর্থাৎ–অতএব, তুমি ধৈর্যধারণ কর তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য সহচরের ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল। তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ তার নিকট না পৌঁছলে সে লাঞ্ছিত হয়ে নিক্ষিপ্ত হত উন্মুক্ত প্রান্তরে। পুনরায় তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করলেন। (সূরা কলমঃ ৪৮-৫০)

উল্লেখিত আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারগণ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তৎকালীন মাওসিল প্রদেশের নিনোভা নামক জায়গার অধিবাসীদের নিকট ইউনুস (আ)-কে প্রেরণ করেন। তিনি তাদেরকে মহান আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বান করেন। তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং তারা তাদের কুফরী ও অবাধ্যতায় নিমগ্ন থাকে। অতঃপর যখন নবীর বিরুদ্ধে তাদের অবাধ্যতা ও নাফরমানী দীর্ঘায়িত হয় তখন তিনি তাদের মধ্য হতে বের হয়ে পড়েন এবং তিন দিন পর তাদের প্রতি আযাব নাযিল হবে বলে সতর্ক করে দেন।

আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রা), মুজাহিদ, সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর, কাতাদা (র) প্রমুখ মনীষী বলেন, ইউনুস (আ) যখন তাঁর উম্মতদের মধ্য হতে চলে গেলেন এবং তাঁর সম্প্রদায় আল্লাহ তা‘আলার আযাব তাদের উপর অত্যাসন্ন বলে নিশ্চিত হল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে তাওবার অনুভূতি সৃষ্টি করেন এবং তারা তাদের নবীর প্রতি কৃত অপকর্মের জন্যে লজ্জিত হয়ে পড়ে। তারপর তারা দৈন্যের প্রতীক মোটা কাপড় পরে নিল এবং প্রত্যেকটি পশু শাবককে তাদের মা থেকে পৃথক করে দিল। অন্যদিকে নিজেরা আল্লাহ তা‘আলার দরবারে কাতর হয়ে প্রার্থনা করতে লাগল। করুণস্বরে তারা ফরিয়াদ করতে লাগল। অনুনয় বিনয় করতে লাগল। নিজেদেরকে প্রতিপালকের প্রতি সমর্পণ করে দিল। ছেলে-মেয়ে স্ত্রী-পুরুষ সকলেই আল্লাহ তা‘আলার দরবারে কান্নাকাটি করতে লাগল। প্রতিটি জীব-জন্তু জানোয়ার কাতরাতে লাগল।

উট ও তার বাচ্চাগুলো চিৎকার করতে লাগল। গাভী, গরু ও বাছুরগুলো হাম্বা হাম্বা রব ছাড়তে লাগল। ছাগল ও তার ছানাগুলো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে লাগল। এক প্রচণ্ড ও ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হল। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কুদরত, রহমত ও করুণাবশে তাদের উপর থেকে আযাব রহিত করে দিলেন। আল্লাহ তা‘আলার আযাব তাদের মাথার উপর এসে গিয়েছিল এবং রাতের তিমির রাশির ন্যায় মাথার উপর ঘুরছিল। এ ঘটনার দিকে ইংগিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

( فَلَوۡلَا كَانَتۡ قَرۡیَةٌ ءَامَنَتۡ فَنَفَعَهَاۤ إِیمَـٰنُهَاۤ إِلَّا قَوۡمَ یُونُسَ لَمَّاۤ )

[Surat Yunus 98]

অর্থাৎ– তবে ইউনুস (আ)-এর সম্প্রদায় ব্যতীত কোন জনপদবাসী কেন এমন হল না যারা ঈমান আনত এবং তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসত? অর্থাৎ কেন তুমি অতীতে বসবাসকারী এমন সম্প্রদায় পেলে না, যারা পরিপূর্ণভাবে ঈমান এনেছিল? এতে বোঝা যায় পরিপূর্ণরূপে কেউ ঈমান আনয়ন করেনি। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡ قَرۡیَۃٍ مِّنۡ نَّذِیۡرٍ اِلَّا قَالَ مُتۡرَفُوۡہَاۤ ۙ اِنَّا بِمَاۤ اُرۡسِلۡتُمۡ بِہٖ کٰفِرُوۡنَ ﴿۳۴﴾

অর্থাৎ–যখনই আমি কোন জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই এটার বিত্তশালী অধিবাসীরা বলেছে, তোমরা যা সহকারে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। (সূরা সাবাঃ ৩৪) পুনরায় আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ

( إِلَّا قَوۡمَ یُونُسَ لَمَّاۤ ءَامَنُوا۟ كَشَفۡنَا عَنۡهُمۡ عَذَابَ ٱلۡخِزۡیِ فِی ٱلۡحَیَوٰةِ ٱلدُّنۡیَا وَمَتَّعۡنَـٰهُمۡ إِلَىٰ حِین ࣲ)

[Surat Yunus 98]

অর্থাৎ–“তবে ইউনুস (আ)-এর সম্প্রদায় ব্যতীত, তারা যখন পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করল, তখন আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে হীনতাজনক শাস্তি থেকে মুক্ত করলাম এবং কিছু কালের জন্যে জীবনোপভোগ করতে দিলাম।” অর্থাৎ তারা পরিপূর্ণভাবে ঈমান এনেছিল।

তাফসীরকারদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে যে, এ ধরনের ঈমান কি আখিরাতেও তাদের কোন উপকারে আসবে এবং আখিরাতের আযাব থেকে তাদেরকে মুক্তি করবে? যেমন পার্থিব জীবনে এই ঈমান তাদেরকে পার্থিব শাস্তি থেকে রক্ষা করেছে? এ ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে, তবে বাক্যের বাচনভঙ্গিতে প্রকাশ্যতর মত হচ্ছে, হ্যাঁ, অর্থাৎ আখিরাতেও এই ঈমান উপকারে আসবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَمَّاۤ ءَامَنُوا۟ অর্থাৎ-যখন তারা ঈমান আনলো। আবার আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

( وَأَرۡسَلۡنَـٰهُ إِلَىٰ مِا۟ئَةِ أَلۡفٍ أَوۡ یَزِیدُونَ ۝ فَـَٔامَنُوا۟ فَمَتَّعۡنَـٰهُمۡ إِلَىٰ حِین ࣲ)

[Surat As-Saaffat 147 – 148]

অর্থাৎ—তাকে [ইউনুস (আ)] আমি লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম এবং তারা ঈমান এনেছিল। ফলে আমি তাদেরকে কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দিয়েছিলাম।

অর্থাৎ এ আয়াতে উল্লেখিত কিছু কালের জন্যে জীবনোপভোগ ও আখিরাতে আযাব রহিত হবার মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

যে সকল লোকের হিদায়াতের জন্যে ইউনুস (আ)-কে প্রেরণ করা হয়েছিল তাদের সংখ্যা সুনিশ্চিত এক লাখ ছিল। তবে তাফসীরকারগণের মধ্যে এক লাখের অতিরিক্ত সংখ্যা সম্বন্ধে মতানৈক্য রয়েছে। সাকহুল (র)-এর বর্ণনা মতে এ সংখ্যাটি ছিল দশ হাজার। তিরমিজী, ইব্‌ন জারীর তাবারী (র) ও ইব্‌ন আবূ হাতিম (র) প্রমুখ উবাই ইব্‌ন কা‘ব (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ)-কে

وأرسلناه إلى مائة الف او يزيدون

আয়াতাংশের তাফসীর সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, তারা এক লাখের ঊর্ধ্বে বিশ হাজার ছিল। আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “তারা ছিলেন ১ লাখ ৩০ হাজার।”

অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩০ হাজারের ঊর্ধ্বে। অন্য এক সূত্রে আবদুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে ১ লাখ ৪০ হাজারের উর্ধ্বে বলে বর্ণনা রয়েছে। সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর (রা) বলেন, “তারা সর্বসাকল্যে ১ লাখ ৭০ হাজার ছিল।”

এ সংখ্যা মাছ সংক্রান্ত ঘটনার পূর্বে ছিল, না কি পরে এ ব্যাপারেও তাফসীরকারগণের মতভেদ রয়েছে। এ লোকসংখ্যা একটি সম্প্রদায়ের নাকি পৃথক পৃথক দুইটি সম্প্রদায়ের এ নিয়েও মতভেদ আছে। এই তিনটি বিষয়ে তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, যখন ইউনুস (আ) আপন সম্প্রদায়ের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তার নিজ জনপদ ত্যাগ করে অন্যত্র রওয়ানা হলেন, তখন তিনি সাগর পার হবার জন্যে অন্যদের সাথে নৌকায় উঠলেন। নৌকাটি কিছুক্ষণ পর যাত্রীদের নিয়ে উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে পড়লো। নৌকাটি ঘুরপাক খেতে লাগলো এবং ডুবুডুবু অবস্থায় পতিত হলো। তাফসীরকারদের বর্ণনা মতে, তাদের সকলের ডুবে মরার উপক্রম হল। তাফসীরকারগণ বলেন, নাবিক ও যাত্রীরা মিলে পরামর্শ করল এবং লটারীর মাধ্যমে পলাতক অপরাধী সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তারা মনস্থ করল। তারা স্থির করল, লটারীতে যার নাম উঠবে অন্যদেরকে রক্ষা করার জন্যে তাকে নৌকা থেকে ফেলে দিতে হবে। লটারীতে আল্লাহর নবী ইউনুস (আ)-এর নাম উঠলো। এতে তারা তাঁকে নৌকা থেকে ফেলে দেবার সিদ্ধান্তে না পৌঁছে পুনরায় লটারী করে কিন্তু এবারও তার নাম উঠে। আল্লাহর নবী অন্যদেরকে রক্ষা করার জন্যে আপন কাপড় খুলে ঝাঁপ দেবার জন্যে তৈরি হলেন কিন্তু নাবিক ও যাত্রীরা তাঁকে বাধা দিল বরং তারা পুনরায় লটারী করলো এবং তৃতীয় বারেও আল্লাহ তা‘আলার কোন মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে তাঁরই নাম ওঠে। আল্লাহ তা‘আলা এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেনঃ

وَ اِنَّ یُوۡنُسَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۳۹﴾ ؕ اِذۡ اَبَقَ اِلَی الۡفُلۡکِ الۡمَشۡحُوۡنِ ﴿۱۴۰﴾ ۙ فَسَاہَمَ فَکَانَ مِنَ الۡمُدۡحَضِیۡنَ ﴿۱۴۱﴾ ۚ فَالۡتَقَمَہُ الۡحُوۡتُ وَ ہُوَ مُلِیۡمٌ ﴿۱۴۲﴾

অর্থাৎ–ইউনুস (আ)ও ছিল রাসূলদের একজন। স্মরণ কর, যখন সে পলায়ন করে বোঝাই নৌযানে পৌঁছল। তারপর সে লটারীতে যোগদান করল ও পরাভূত হল। পরে এক বিরাট মাছ তাকে গিলে ফেলল তখন সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। (৩৭ সাফ্‌ফাতঃ ১৩৯-১৪২)

লটারীতে ইউনুস (আ)-এর নাম উঠার ফলে তাকে নদীতে ফেলে দেয়া হল তখন আল্লাহ তা‘আলা তার জন্যে সবুজ সাগর থেকে একটি বিরাট মাছ প্রেরণ করেন যা তাকে গিলে ফেলে।

অন্যদিকে আল্লাহ তা‘আলা মাছকে হুকুম দেন যেন সে তার অস্থি মাংস কিছু না খায়, কেননা এটা রিযিক নয়। তারপর মাছটি তাকে ধরে নিয়ে সমস্ত সাগরময় ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ বলেন, এ মাছটিকে তার চাইতে বড় আকারের আরেকটি মাছ গিলে ফেলে। তাফসীরকারগণ বলেন, যখন তিনি মাছের পেটে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি নিজকে মৃত বলেই মনে করছিলেন। এবং তিনি নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়া দিয়ে এগুলো নড়ছে দেখে নিশ্চিত হন যে, তিনি জীবিত রয়েছেন। তিনি আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সিজদায় পড়লেন এবং বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমি এমন এক স্থানে আপনার দরবারে সিজদা করলাম, যেরূপ স্থানে এর আগে আর কেউই কোনদিন সিজদা করেনি।”

ইউনুস (আ)-এর মাছের পেটে অবস্থানের মেয়াদ নিয়ে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। মুজালিদ (র) আল্লামা শা’বী (র) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, দিনের প্রথম প্রহরে মাছ তাঁকে গিলেছিল আর শেষ প্রহরে বমি করে ডাঙ্গায় নিক্ষেপ করেছিল। কাতাদা (র) বলেন, তিনি মাছের পেটে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন।’ জাফর সাদিক (র) বলেন, সাত দিন তিনি মাছের পেটে অবস্থান করেছিলেন। কবি উমাইয়া ইব্‌ন আবূ সালত এই অভিমতের অনুকূলে বলেনঃ

وانت بفضل منك نجيت يونسا- وقد بات في اضعاف حوت لياليا

অর্থাৎ–হে আল্লাহ! তুমি অনুগ্রহ করে ইউনুস (আ)-কে মুক্তি দিয়েছিলে। অথচ তিনি মাছের পেটে কয়েক রাত কাল যাপন করেছিলেন।’ সাঈদ ইব্‌ন আবুল হাসান (র) ও আবু মালিক (র) বলেন, ইউনুস (আ) মাছের পেটে ৪০ দিন অবস্থান করেছিলেন। তবে আল্লাহ তা‘আলাই অধিক জানেন যে, কত সময় মাছের পেটে অবস্থান করেছিলেন। মোদ্দাকথা, যখন মাছটি তাকে নিয়ে সাগরের তলদেশে ভ্রমণ করছিল এবং উত্তাল তরঙ্গমালায় বিচরণ করছিল, তখন তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার উদ্দেশে নিবেদিত মৎস্যকুলের তাসবীহ শুনতে পেলেন এমনকি শস্য দানা ও আটির স্রষ্টা, সাত আসমান ও সাত যমীনের প্রতিপালক, এদের মধ্যে ও মাটির নিচে যা কিছু রয়েছে এদের প্রতিপালকের জন্যে নিবেদিত পাথরের তাসবীহও তিনি শুনতে পান। তখন তিনি মুখে ও তার অবস্থার দ্বারা যে আকৃতি জানান সে প্রসঙ্গে ইজ্জত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, গোপন কথা ও রহস্য সম্বন্ধে অবগত; অভাব-অনটন ও মুসীবত থেকে উদ্ধারকারী, ক্ষীণতম শব্দও শ্রবণকারী, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গোপন সম্পর্কেও অবগত, বড় থেকে বড় বিষয়েও সম্যক জ্ঞাত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আল-আমীন উপাধি লাভকারী রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ সুস্পষ্ট কিতাবে ইরশাদ করেন আর তিনিও তো সর্বাধিক সত্যভাষী বিশ্ব জগতের প্রতিপালকঃ

وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّہَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ ٭ۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۚۖ ۸۷﴾ فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ ۙ وَ نَجَّیۡنٰہُ مِنَ الۡغَمِّ ؕ وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸۸﴾

অর্থাৎ–এবং স্মরণ কর যূননূন তথা মাছের অধিকারী ইউনুস (আ)-এর কথা, যখন সে ক্ষুব্ধ মনে বের হয়ে গিয়েছিল এবং ভেবেছিল আমি তার জন্যে শাস্তি নির্ধারণ করব না। তারপর সে অন্ধকার থেকে আহ্বান করেছিল, “তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই; তুমি পবিত্র, মহান, আমি তো সীমালংঘনকারী।” তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা হতে এবং এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। (সূরা আম্বিয়াঃ ৮৭-৮৮)

আয়াতাংশ

فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ -এর অর্থ হচ্ছে, ইউনুস (আ) ভেবেছিলেন যে, আমি কখনও তার জন্যে শাস্তি নির্ধারণ করব না। আবার কেউ কেউ বলেন, نقدر শব্দটি تقدير থেকে নিষ্পন্ন। আর এই ব্যাখ্যাটি প্রসিদ্ধতর। একজন প্রসিদ্ধ কবি বলেনঃ

فلا فلا عائد ذالك الزمان الذي مضى تبارکت ما يقدر يكن تلك الامر

অর্থাৎ—যে যুগ চলে গেছে তা আর কোন দিনও ফিরে আসবে না। তুমি বরকতময় তোমার জন্য যা নির্ধারিত তা-ই ঘটে থাকে। হুকুম তো তোমারই।

আয়াতাংশ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ -এর তাফসীর প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসউদ (রা) ও সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র প্রমুখ মুফাস্‌সির বলেন, আয়াতে উল্লেখিত ظلمات দ্বারা মাছের পেটের অন্ধকার, সমুদ্রের অন্ধকার এবং রাতের অন্ধকারকে বুঝানো হয়েছে। সালিম ইবনে আবুল জাদ (র) বলেন, যে মাছটি ইউনুস (আ)-কে গিলে ফেলেছিল, অন্য একটি মাছ আবার ওটাকে গিলে ফেলে। তাই এই দুই ধরনের অন্ধকার যুক্ত হয়েছিল। তৃতীয় অন্ধকার অর্থাৎ সমুদ্রের অন্ধকারের সাথে। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

فَلَوۡ لَاۤ اَنَّہٗ کَانَ مِنَ الۡمُسَبِّحِیۡنَ ﴿۱۴۳﴾ ۙ لَلَبِثَ فِیۡ بَطۡنِہٖۤ اِلٰی یَوۡمِ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿۱۴۴﴾ ۚؒ

অর্থাৎ–সে যদি আল্লাহ্‌র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা না করত তাহলে তাকে পুনরুত্থিত দিবস পর্যন্ত তার পেটে থাকতে হত। (সূরা সাফ্‌ফাতঃ ১৪৩-১৪৪)

কেউ কেউ বলেন, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে—সে যদি সেখানে আল্লাহর পবিত্রতা ও তার মহিমা ঘোষণা না করত, অনুনয় বিনয় সহকারে আপন ত্রুটি স্বীকার না করত, কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত হয়ে আল্লাহর প্রতি ঝুঁকে না পড়ত তবে সে সেখানেই অর্থাৎ মাছের পেটে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত থাকত এবং মাছের পেট থেকেই তাকে পুনরুত্থিত করা হত। সাঈদ ইবনে জুবাইর (রা) হতে বর্ণিত দুইটি বর্ণনার একটি উপরোক্ত বর্ণনার মর্মার্থ প্রকাশ করে।

কেউ কেউ বলেন, আয়াতটির অর্থ হচ্ছে- মাছ তাঁকে গিলে ফেলার পূর্বে যদি তিনি আল্লাহ তা‘আলার অধিক স্মরণকারী, মুসল্লী ও আনুগত্য স্বীকারকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতেন। উপরোক্ত তাফসীরের সমর্থকদের মধ্যে আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন আব্বাস (রা), সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর (রা), যাহ্‌হাক, সুদ্দী, আতা ইব্‌ন সাঈর, হাসান বসরী (র) ও কাতাদা (র) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইব্‌ন জারীর (র)ও এই ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করেছেন। ইমাম আহমদ (র) ও কোন কোন সুনান গ্রন্থের সংকলক কর্তৃক আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতও এর প্রমাণ বহন করে। বর্ণনাটি হচ্ছে এই যে, ইব্‌ন আব্বাস (রা) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে সম্বোধন করে বলেন, হে বালক! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শেখাব। এগুলো তুমি সংরক্ষণ করবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমার হেফাজত করবেন। আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমের প্রতি লক্ষ্য রাখলে আল্লাহ্ তা‘আলাকে তোমার প্রতি সন্তুষ্ট পাবে। সচ্ছলতার সময় আল্লাহ্ তা‘আলাকে চিনলে তোমার সংকটকালে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাকে চিনবেন।

ইব্‌ন জারীর তাবারী (র) তার তাফসীর গ্রন্থে এবং বাযযার (র) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যখন আল্লাহ তা‘আলা মাছের পেটে ইউনুস (আ)-কে বন্দী করতে ইচ্ছে করলেন, তখন তিনি মাছকে নির্দেশ দিলেন যে, ইউনুস (আ)-কে ধর, তবে তার শরীর জখম করবে না এবং তার হাড়ও ভাঙবে না। মাছ যখন তাঁকে নিয়ে সাগরের তলদেশে চলে গেল ইউনুস (আ) তখন ছিলেন মাছের পেটে। আওয়াজ শুনতে পেলেন এবং মনে মনে বলতে লাগলেন, একি ব্যাপার? আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি এ মর্মে ওহী প্রেরণ করলেন যে, এগুলো হচ্ছে সাগরের প্রাণীদের তাসবীহ। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, মাছের পেটে অবস্থান কালেই তিনি তাসবীহ পড়তে লাগলেন। তখন ফেরেশতাগণ বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনমানবহীন স্থানে আমরা একটি আওয়াজ শুন্‌তে পাচ্ছি। জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বললেন, এ আমার বান্দা ইউনুস (আ)। সে আমার নাফরমানী করেছে তাই আমি তাকে সাগরের মাছের পেটে কয়েদ করেছি। ফেরেশতারা বললেন, “তিনি কি ঐ সৎবান্দা নন, যার নেক আমল প্রতি দিনই আপনার দরবারে পৌঁছত?” আল্লাহ্ তা‘আলা বললেনঃ “হ্যাঁ।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ তা‘আলার দরবারে তার জন্যে সুপারিশ করলেন। সুপারিশ মঞ্জুর করে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সাগরের কিনারে ফেলে দেবার জন্যে মাছকে নির্দেশ দিলেন। সেই মতে মাছ তাঁকে সাগরের কিনারায় ফেলে চলে গেল। এই অবস্থার কথাই আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, وهو سقيم অর্থাৎ সে ছিল রুগ্ন। (সূরা সাফ্‌ফাতঃ ১৪৩)

এটা হলো ইব্‌ন জারীর (র)-এর ভাষ্য। বাযযার (র) বলেন, এ সনদ ছাড়া আর কোন সনদে এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ইব্‌ন হাতীম (র) তাঁর তাফসীরে বলেন, আনাস ইব্‌নে মালিক (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, ইউনুস (আ) মাছের পেটে অবস্থানরত অবস্থায় নিম্ন বর্ণিত শব্দমালার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু’আ করেনঃ

أَن لَّاۤ إِلَـٰهَ إِلَّاۤ أَنتَ سُبۡحَـٰنَكَ إِنِّی كُنتُ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ )

[Surat Al-Anbiya’ 87]

অর্থাৎ–হে আল্লাহ! তুমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই; তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমালংঘনকারী। (সূরা আম্বিয়াঃ ৮৭)

এই দু’আর গুনগুন আওয়াজ আল্লাহ তা‘আলার আরশে পৌঁছলে ফেরেশতাগণ বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! জনমানবহীন ভূমি থেকে যে ক্ষীণ আওয়াজ আসছে তা যেন পরিচিত। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তোমরা কি এ শব্দ চেন না? তারা বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! তিনি কে? আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন, আমার বান্দা ইউনুস। তাঁরা বললেন, আপনার বান্দা সেই ইউনুস (আ) যাঁর আমল সব সময়ই গ্রহণীয়রূপে আপনার দরবারে উত্থিত হতো? তারা আরো বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের সময় যে আমল করতেন এর বিনিময়ে আপনি কি দুঃখের সময় তাঁর প্রতি সদয় হবেন না? এবং সংকট থেকে তাকে উদ্ধার করবেন না? আল্লাহ্ তা‘আলা বললেনঃ হ্যাঁ। তখন মাছকে তিনি নির্দেশ দিলেন। তখন মাছ তাকে এক তৃণহীন প্রান্তরে নিক্ষেপ করল। আবু হুরায়রা (রা) থেকে অতিরিক্ত বর্ণনায় রয়েছে, সেখানে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর জন্যে একটি লাউ গাছ জন্মালেন এবং তার জন্যে একটি পোকামাকড় ভোজী বন্য ছাগলের ব্যবস্থা করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, প্রাণীটি তার জন্যে গা এলিয়ে দিত এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁকে তৃপ্ত করে দুধ পান করাতো যাবৎ না সেখানে ঘাসপাতা গজিয়ে ওঠে। প্রসিদ্ধ কবি উমাইয়া ইব্‌ন আবু সালত এ সম্পর্কে একটি কবিতা বলেনঃ

فانبت يقطينا عليه بزحمة - من الله لولا الله اصبح ضاويا .

অর্থাৎ–আল্লাহ্ তা‘আলা দয়াপরবশ হয়ে তার জন্যে একটি লাউগাছ জন্মালেন; নচেৎ তিনি দুর্বলই থেকে যেতেন।

বর্ণনাটি গরীব পর্যায়ের। তবে পূর্বোক্ত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের দ্বারা এটি সমর্থিত। আল্লাহই সম্যক জ্ঞাত।

আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ

فَنَبَذۡنٰہُ بِالۡعَرَآءِ وَ ہُوَ سَقِیۡمٌ ﴿۱۴۵﴾ ۚ وَ اَنۡۢبَتۡنَا عَلَیۡہِ شَجَرَۃً مِّنۡ یَّقۡطِیۡنٍ ﴿۱۴۶﴾ۚ

অর্থাৎ–অতঃপর ইউনুস (আ)-কে আমি নিক্ষেপ করলাম এক তৃণহীন প্রান্তরে এবং সে ছিল রুগ্ন। পরে আমি তার উপর একটি লাউগাছ উদ্‌গত করলাম। (সূরা সাফ্‌ফাতঃ ১৪৫-১৪৬)

আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসউদ (রা) বলেন سقيم -এর অর্থ হচ্ছে দুর্বলদেহী যেন পাখির ছানা যার পালক গজায়নি। ইব্‌ন আব্বাস (রা), সুদ্দী এবং ইব্‌ন যায়েদ (র) سقيم -এর ব্যাখ্যায় বলেন- যেন সদ্য প্রসূত নেতিয়ে পড়ে থাকা গুঁই সাপের বাচ্চা।

আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসউদ (রা) ও ইব্‌ন আব্বাস (রা), ইকরিমা, মুজাহিদ (র) সাঈদ ইব্‌ন জুবায়ের (র) প্রমুখ মুফাস্‌সিরের মতে, يقطين -এর অর্থ লাউ গাছ।

উলামায়ে কিরামের কেউ কেউ বলেন, লাউগাছ উদগত করার মধ্যে প্রচুর হিকমত রয়েছে। যেমন লাউ গাছের পাতা খুবই কোমল, সংখ্যায় বেশি, ছায়াদার, মাছি তার নিকটে যায় না, তার ফল ধরার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তা খাওয়া যায়, কাঁচা ও রান্না করে খাওয়া যায়, বাকল ছাড়া ও বাকলসহ এবং বীচিও খাওয়া যায়। তার মধ্যে অনেক উপকারিতাও রয়েছে। এটা মস্তিষ্কের শক্তি বর্ধক এবং তাতে অন্য অনেক গুণাগুণ রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা)-এর বর্ণনা পূর্বেই বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জন্যে একটি বন্য ছাগলের ন্যায় প্রাণীকে নিয়োজিত রেখেছিলেন যা তাকে তার দুধ খাওয়াত, মাঠে চরত এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর কাছে আসত। এটা তাঁর প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত, নিয়ামত ও অনুগ্রহ রূপে গণ্য।

এজন্যেই আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ

فاستجبنا له ونجينا من الغم وكذلك ننجي المؤمنين

অর্থাৎ–“তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম এবং তাকে উদ্ধার করলাম দুশ্চিন্তা থেকে।” অর্থাৎ যে সংকটে তিনি পতিত হয়েছিলেন তা থেকে। এভাবেই আমি মুমিনদের উদ্ধার করে থাকি। অর্থাৎ যারা আমার কাছে ফরিয়াদ করে ও আশ্রয় প্রার্থনা করে তাদের প্রতি এ-ই আমার চিরাচরিত রীতি।

ইব্‌ন জারীর (র) আবু ওক্কাসের পৌত্র সাদ ইব্‌ন মালিক (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, “ইউনুস (আ) ইব্‌ন মাত্তার দু‘আয় ব্যবহৃত আল্লাহ্ তা‘আলার নাম নিয়ে দু’আ করা হলে তিনি তাতে সাড়া দেন এবং কিছু চাওয়া হলে তিনি তা দান করেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! এটা কি শুধু ইউনুস (আ)-এর জন্যে খাস ছিল, না কি সকল মুসলমানের জন্যেও?’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ এটা ইউনুস (আ)-এর জন্যে বিশেষভাবে এবং সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্যে- যদি তারা এ দু’আ করে। তুমি কি আল্লাহর বাণী লক্ষ্য করনি। যাতে তিনি বলেছেনঃ

فنادى في الظلمات أن لا إله الا انت سبحانك إني كنت من الظالمين فاستجبنا له ونجيناه من الغم وكذالك ننجي المو منين

কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দু‘আ করবে তার জন্যে শর্ত হচ্ছে ইউনুস (আ) যে দু’আ করেছেন সে দু‘আ করা। অন্য এক সূত্রে সাদ ইব্‌ন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ইউনুস (আ)-এর দু’আর শব্দ মালায় দু’আ করে তার দু’আ কবুল করা হয়। বর্ণনাকারী বলেন, এ হাদীসের দ্বারা وكذالك ننجى المؤ منين -এর দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইমাম মুহাম্মদ (র) হতে বর্ণিত। তিনি সাদ ইব্‌ন মালিক (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদিন আমি উসমান ইব্‌ন আফফান (রা)-এর সাথে মসজিদে দেখা করলাম এবং তাঁকে আমি সালাম দিলাম। তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট মনে হল কিন্তু তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন না। আমি উমর (রা)-এর নিকট গেলাম এবং বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! সালামের সম্বন্ধে কি কিছু ঘটে গেছে? তিনি বললেন ‘না’ তবে ব্যাপার কি? আমি বললাম কিছুই নয় তবে আমি উসমান (রা)-এর সাথে এই মাত্র মসজিদে দেখা করলাম, তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট মনে হল কিন্তু আমার সালামের উত্তর দেননি। বর্ণনাকারী বলেন, উমর (রা) উসমান (রা)-এর নিকট একজন লোক পাঠালেন এবং তাঁকে ডাকলেন, অতঃপর তিনি বললেন- তুমি আমার ভাইয়ের সালামের উত্তর কেন দিলে না? উসমান (রা) বললেন, না আমি এরূপ কাজ করিনি। সাদ (রা) বলেন, না তিনি এরূপ করেছেন। এতে দু’জনই শপথ করে নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করেন। বর্ণনাকারী বলেন, পরে যখন উসমান (রা)-এর স্মরণ হয় তখন তিনি বললেন- হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আল্লাহর কাছে আমি তওবা করছি। তুমি আমার সাথে এই মাত্র দেখা করেছিলে কিন্তু আমি মনে মনে এমন একটি কথা নিয়ে নিজে চিন্তামগ্ন ছিলাম যা আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) থেকে শুনেছি। আল্লাহর কসম! যখনই আমি এটা স্মরণ করি তখনই এটা যেন আমার চোখ, মুখ ও অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সাদ (রা) বললেন, আমি আপনাকে একটি হাদীস সম্পর্কে সংবাদ দিচ্ছি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন আমাদের সামনে উত্তম দু’আ সম্বন্ধে আলোচনা শুরু করেন এমন সময় এক বেদুঈন আসল এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে অন্যদিকে নিবিষ্ট করে ফেললো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উঠে দাঁড়ালেন, আমিও রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণ করলাম। যখন আমার আশঙ্কা হলো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমি পৌঁছে যাওয়ার পূর্বে, তিনি আপন ঘরে পৌঁছে যাবেন, তখন আমি মাটিতে জোরে পা দিয়ে আঘাত করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেন, কে হে? আবু ইসহাক নাকি? জবাবে আমি বললাম, হ্যাঁ, আমিই হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! তিনি বললেন, কি জন্য এই আওয়াজ? বললাম, মারাত্মক কিছুই না, আল্লাহর শপথ! আপনি আমাদের কাছে উত্তম দু‘আ সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন। ইতিমধ্যে বেদুঈনটি আসল ও আপনার কথায় ব্যাঘাত ঘটাল।

তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা হচ্ছে মৎস্য-সহচরের মাছের পেটে অবস্থানকালীন দু’আ। দু’আটি হচ্ছেঃ

لَّاۤ إِلَـٰهَ إِلَّاۤ أَنتَ سُبۡحَـٰنَكَ إِنِّی كُنتُ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ

যখনই কোন মুসলিম কোন বিষয়ে আপন প্রতিপালকের কাছে কখনও এই দু’আ করে তখনই তা কবুল করা হয়। এ হাদীসটি ইবরাহীম ইব্‌ন মুহাম্মদ ইব্‌ন সাদ সূত্রে তিরমিযী ও নাসাঈ (র) বর্ণনা করেছেন।

ইউনুস (আ)-এর মর্যাদা

সূরায়ে সাফ্‌ফাতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

اِنَّ یُوۡنُسَ لَمِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۱۳۹﴾ؕ

অর্থাৎ–নিশ্চয় ইউনুস ছিল রাসূলদের একজন (৩৭ সাফ্‌ফাতঃ ১৩৯)

অনুরূপভাবে সূরায়ে নিসা ও আনআমে তাঁকে আম্বিয়ায়ে কিরামের অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের উপর আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।

ইমাম আহমদ (র) আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন মাসউদ (রা) সূত্রে বর্ননা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

ولا نتقي لعيد أن يقول انا خير من يونس بن متی

অর্থাৎ—কারো একথা বলা উচিত নয় যে, আমি ইউনুস (আ) ইব্‌ন মাত্তা থেকে উত্তম।

ইমাম বুখারী (র) সুফিয়ান আছ ছাত্তরী (র) ও ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

وما ينبغي لعبد ان يقول اني خير من يونس بن متى ونسبه الى

অর্থাৎ—কারো একথা বলা উচিত নয় যে, আমি ইউনুস (আ) ইব্‌ন মাত্তা থেকে উত্তম। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) এ বাক্যে ইউনুস (আ)-কে তাঁর পিতার দিকে সম্পর্কিত করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) ও আবু দাউদ (র) অন্য এক সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেন।

ইমাম আহমদ (র) আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

وما ينبغي لعبد ان يقول انا خير من يونس بن متى

তাবারানীর বর্ণনায় عند الله শব্দটি অতিরিক্ত রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট উত্তম। বর্ণনাটির সনদ ত্রুটিমুক্ত।

ইমাম বুখারী (র) ও মুসলিম (র)... আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

لا ينبغي لعبد ان يقول انا خير من يونس بن متین

ইমাম বুখারী (র) ও মুসলিম (র) অন্য এক সূত্রে সারা জাহানের উপর মূসা (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করায় জনৈক ইহুদীর জনৈক মুসলমান কর্তৃক প্রহৃত হবার ঘটনা আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তবে ইমাম বুখারী (র) হাদীসের শেষাংশে বলেনঃ

ولا اقول ان احدا خير من يونس بن متی

অর্থাৎ–কেউ যেন ইউনুস (আ) থেকে নিজেকে উত্তম বলে মনে না করে। অন্য বর্ণনায় রয়েছেঃ

অর্থাৎ–আমাকে (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে) ইউনুস (আ) ইব্‌ন মাত্তা থেকে উত্তম মনে করা সমীচীন নয়।

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

لا تفضلوني على الانبياء ولا على يونس من متى

অর্থাৎ—‘আমাকে অন্যান্য নবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিও না, ইউনুস (আ)-এর উপরও নয়।

এটা অবশ্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিনয় প্রকাশের জন্যে বলেছেন। আল্লাহর রহমত ও শান্তি তাঁর প্রতি ও অন্যান্য নবী-রাসূলের প্রতি বর্ষিত হোক!

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন