মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
অর্থাৎ, সুতরাং আমি তাদেরকে শাস্তি দিয়েছি এবং তাদেরকে অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত করেছি। কারণ তারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার করত এবং এ সম্বন্ধে তারা ছিল গাফিল। যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হত তাদেরকে আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের অধিকারী করি; এবং বনী ইসরাঈল সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালকের শুভবাণী সত্যে পরিণত হল। যেহেতু তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল, আর ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের শিল্প এবং যে সব প্রাসাদ তারা নির্মাণ করেছিল তা ধ্বংস করেছি। আর আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে দেই; তারপর তারা প্রতিমাপূজায় রত এক সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হয়। তারা বলল, হে মূসা! তাদের দেবতার মত আমাদের জন্যও একটি দেবতা গড়ে দাও; সে বলল, তোমরা তো এক মূর্খ সম্প্রদায়। এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা তো বিধ্বস্ত হবে এবং তারা যা করছে তাও অমূলক। সে আবারো বলল, আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের জন্য আমি কি অন্য ইলাহ্ খুঁজব অথচ তিনি তোমাদেরকে বিশ্বজগতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন? স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে ফিরআউনের অনুসারীদের হাত হতে উদ্ধার করেছি, যারা তোমাদেরকে নিকৃষ্ট শাস্তি দিত। তারা তোমাদের পুত্র সন্তানকে হত্যা করত এবং তোমাদের নারীদেরকে জীবিত রাখত; এতে ছিল তোমাদের প্রতিপালকের এক মহাপরীক্ষা। (সূরা আ'রাফঃ ১৩৬-১৪১)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বর্ণনা দিচ্ছেন যে, কিভাবে তিনি ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং কিভাবে তাদের ইজ্জত-সম্মান ভূলুণ্ঠিত করেছিলেন। আর তাদের মাল-সম্পদ আল্লাহ্ তা’আলা কেমনভাবে ধ্বংস করে বনী ইসরাঈলকে তাদের সমস্ত ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী করে দিয়েছিলেন।
অর্থাৎ, যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হত তাদেরকে আমি আমার কল্যাণ প্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি এবং বনী ইসরাঈল সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালকের শুভ বাণী সত্যে পরিণত হল, যেহেতু তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল আর ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের শিল্প এবং যে সব প্রাসাদ তারা নির্মাণ করেছিল তা ধ্বংস করেছি। (সূরা আরাফঃ ১৩৭)
আল্লাহ্ তা’আলা ফিরআউন ও তার গোষ্ঠীর সকলকে ধ্বংস করে দিলেন। দুনিয়ায় বিরাজমান তাদের মহা সম্মান ঐতিহ্য তিনি বিনষ্ট করে দিলেন। তাদের রাজা, আমীর-উমারা ও সৈন্য-সামন্ত ধ্বংস হয়ে গেল। মিসর দেশে সাধারণ প্রজাবর্গ ব্যতীত আর কেউ অবশিষ্ট রইল না। ইবন আবদুল হাকাম ‘মিসরের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ঐদিন থেকে মিসরের স্ত্রী লোকেরা পুরুষদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছিল, কেননা আমীর-উমারাদের স্ত্রীরা তাদের চেয়ে নিম্ন শ্রেণীর সাধারণ লোকদেরকে বিয়ে করতে হয়েছিল। তাই তাদের স্বামীদের উপর স্বভাবতই তাদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠি হয়। এ প্রথা মিসরে আজ পর্যন্ত চলে আসছে।
কিতাবীদের মতে, বনী ইসরাঈলকে যে মাসে মিসর ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সে মাসকেই আল্লাহ্ তা’আলা তাদের বছরের প্রথম মাস বলে নির্ধারণ করে দেন। তাদেরকে হুকুম দেওয়া হয় যে, তাদের প্রতিটি পরিবার যেন একটি মেষশাবক যবেহ করে। যদি প্রতিটি পরিবার একটি করে মেষশাবক সংগ্রহ করতে না পারে তাহলে পড়শীর সাথে অংশীদার হয়ে তা করবে। যবেহ করার পর মেষশাবকের রক্ত তাদের ঘরের দরজার চৌকাটে ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে তাদের ঘরগুলো চিহ্নিত হয়ে থাকে। তারা এটাকে রান্না করে খেতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, মেষশাবকের মাথা, পায়া ও পেট ভুনা করে খেতে পারবে। তারা মেষশাবকের কিছুই অবশিষ্ট রাখবে না এবং ঘরের বাইরেও ফেলতে পারবে না, তারা সাতদিন রুটি দিয়ে নাশতা করবে। সাত দিনের শুরু হবে তাদের বছরের প্রথম মাসের ১৪ তারিখ হতে। আর এটা ছিল বসন্তকাল। যখন তারা খানা খাবে তাদের কোমর কোমরবন্দ দ্বারা বাঁধা থাকবে, পায়ে মুজা থাকবে, হাতে লাঠি থাকবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত খাবে, রাতের বেলায় খাবারের পর কিছু খাবার বাকি থাকলে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে; এটাই তাদের ও পরবর্তীদের জন্যে ঈদ বা পর্বের দিন রূপে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এই নিয়ম যতদিন বলবৎ ছিল তাওরাতের বিধান ততদিন পর্যন্ত বলবৎ ছিল। তাওরাতের বিধান যখন বাতিল হয়ে যায়, তখন এরূপ নিয়মও রহিত হয়ে যায়। আর পরবর্তীতে এরূপ নিয়ম প্রকৃত পক্ষে রহিত হয়ে গিয়েছিল।
কিতাবীরা আরো বলে থাকেন, ফিরআউনের ধ্বংসের পূর্ব রাতে আল্লাহ্ তা’আলা কিবতীদের সকল নবজাতক শিশু ও নবজাতক প্রাণীকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, যাতে তারা বনী ইসরাঈলের পিছু ধাওয়া থেকে বিরত থাকে। দুপুরের সময় বনী ইসরাঈল বের হয়ে পড়ল। মিসরের অধিবাসিগণ তখন তাদের নবজাতক সন্তান ও পশুপালের শোকে অভিভূত ছিল। এমন কোন পরিবার ছিল না, যারা এরূপ শোকে শোকাহত ছিল না। অন্যদিকে মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর প্রতি ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ আসার সাথে সাথে বনী ইসরাঈলরা অতি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে পড়ল। এমনকি তারা নিজেদের আটার খামিরও তৈরি করে সারেনি, তাদের পাথেয়াদি চাদরে জড়িয়ে এগুলো কাধে ঝুলিয়ে নিল। তারা মিসরবাসীদের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ধারস্বরূপ নিয়েছিল। তারা যখন মিসর থেকে বের হয়, তখন স্ত্রীলোক ব্যতীত তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ লাখ, তাদের সাথে ছিল তাদের পশুপাল। আর তাদের মিসরে অবস্থানের মেয়াদ ছিল চারশ ত্রিশ বছর। এটা তাদের কিতাবের কথা। ঐ বছরটিকে তারা নিষ্কৃতির বছর سنت الفسخ আর তাদের ঐ ঈদকে ‘নিষ্কৃতির ঈদ’ বলে অভিহিত করে। তাদের আরো দুটি ঈদ ছিল—ঈদুল ফাতির ও ঈদুল হামল। ঈদুল হামল ছিল বছরের প্রথম দিন। এই তিন ঈদ তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তাদের কিতাবে এগুলোর উল্লেখ ছিল।
তারা যখন মিসর থেকে বের হয়ে পড়ল তখন তারা তাদের সাথে নিয়েছিল ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর কফিন এবং তারা সূফ নদীর রাস্তা ধরে চলছিল। তারা দিনের বেলায় ভ্রমণ করত; মেঘ তাদের সামনে সামনে ভ্রমণ করত। মেঘের মধ্যে ছিল নূরের স্তম্ভ এবং রাতে তাদের সামনে ছিল আগুনের স্তম্ভ। এ পথ ধরে তারা সমুদ্রের উপকূলে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানে তারা পৌঁছতে না পৌঁছতেই ফিরআউন ও তার মিসরীয় সৈন্যদল তাদের নিকটে পৌঁছে গেল। বনী ইসরাঈলরা তখন সমুদ্রের কিনারায় অবতরণ করেছিল। তাদের অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়ল। এমনকি তাদের কেউ কেউ বলতে লাগল, এরূপ প্রান্তরে এসে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে মিসরের হীনতম জীবন যাপনই বরং উত্তম ছিল। তাদের উদ্দেশে মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, ভয় করো না। কেননা, ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনী এর পর আর তাদের শহরে ফিরে যেতে পারবে না। কিতাবীরা আরও বলেন, আল্লাহ তাআলা মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন সমুদ্রে নিজ লাঠি দ্বারা আঘাত করে সমুদ্র বিভক্ত করে দেন—যাতে তারা সমুদ্রে প্রবেশ করে ও শুকনো পথ পায়। দুই দিকে পানি সরে গিয়ে দুই পাহাড়ের আকার ধারণ করল; আর মাঝখানে শুকনো পথ বেরিয়ে আসে। কেননা, আল্লাহ তাআলা তখন গরম দক্ষিণা বায়ু প্রবাহিত করে দেন। তখন বনী ইসরাঈলরা সমুদ্র পার হয়ে গেল। আর ফিরআউন তার সেনাবাহিনীসহ বনী ইসরাঈলকে অনুসরণ করল। যখন সে সমুদ্রের মধ্যভাগে পৌঁছল, তখন আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন তাঁর লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত করেন। ফলে পানি পূর্বের আকার ধারণ করল। তবে কিতাবীদের মতে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল রাতের বেলায় এবং সমুদ্র তাদের উপর স্থির হয়েছিল সকাল বেলায়। এটা তাদের বোঝার ভুল এবং এটা অনুবাদ বিভ্রাটের কারণে হয়েছে। আল্লাহ তাআলাই অধিকতর জ্ঞাত। তারা আরো বলেন, যখন আল্লাহ্ তা’আলা ফিরআউন ও তার সেনাবাহিনীকে ডুবিয়ে মারলেন, তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) ও বনী ইসরাঈল প্রতিপালকের উদ্দেশে নিম্নরূপ তাসবীহ পাঠ করলেনঃ
يسبح الرب البهي الذى قهر الجنود
ونبذ فرسانها فى البحر المنيع المحمود
অর্থাৎ—‘সেই জ্যোতির্ময় প্রতিপালকের তাসবীহ পাঠ করছি, যিনি সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছেন এবং অশ্বারোহীদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছেন, যিনি উত্তম প্রতিরোধকারী ও প্রশংসিত।’ এটা ছিল একটি দীর্ঘ তাসবীহ। তারা আরো বলেন, হারূনের বোন নাবীয়াহ মারয়াম নিজ হাতে একটি দফ৮৫ (দফ এমন একটি বাদ্যযন্ত্র যার এক দিকে চামড়া লাগানো থাকে) ধারণ করেছিলেন এবং অন্যান্য স্ত্রীলোক তার অনুসরণ করেছিল, সকলেই দফ ও তবলা নিয়ে পথে বের হলো, মারয়াম তাদের জন্যে সুর করে গাইছিলেনঃ
فسبحان الرب القهار الذي قهر الخيول وركبانها القاء في البحر
“পরাক্রমশালী পবিত্র সেই প্রতিপালক যিনি ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে প্রতিহত করেছেন।” এরূপ বর্ণনা তাদের কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এরূপ বর্ণনা সম্ভবত, মুহাম্মদ ইবন কা’ব আল কুরাযী (র) থেকে নেয়া হয়েছে, যিনি কুরআনের আয়াত يا اخت هارون এর ব্যাখ্যায় বলতেন যে, ইমরানের কন্যা মারয়াম, ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মা হচ্ছেন মূসা (আলাইহিস সালাম) ও হারূন (আলাইহিস সালাম)-এর বোন। তার বর্ণনাটি যে অমূলক, তাফসীরে তা আমরা বর্ণনা করেছি। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। কেননা, কেউ এরূপ মত পোষণ করেননি বরং প্রত্যেক তাফসীরকার এটার বিরোধিতা করেছেন। যদি ধরে নেয়া হয় যে, এরূপ হতে পারে তাহলে তার ব্যাখ্যা হবে এরূপঃ মূসা (আলাইহিস সালাম) ও হারূন (আলাইহিস সালাম)-এর বোন মারয়াম কিন্ত ইমরান এবং ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর মা মারয়াম কিন্ত ইমরানের মধ্যে নাম, পিতার নাম ও ভাইয়ের নামের মধ্যে মিল রয়েছে। যেমন- একদা মুগীরা ইব্ন শুবা (রাযিআল্লাহু আনহু) সাহাবীকে নাজরানের অধিবাসীরা يا اخت هارون এ- আয়াতাংশের তাফসীর প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছিল। তিনি জানতেন না তাদেরকে কি বলবেন। তাই তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন, জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে বললেন, তুমি কি জান না তারা আম্বিয়ায়েকিরামের নামের সাথে মিল রেখে নামকরণ করতেন? ইমাম মুসলিম (র) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
মারয়ামকে তারা মাবিয়াহ বলত, যেমন রাজার পরিবারের স্ত্রীকে রানী বলা হয়ে থাকে। আমীরের স্ত্রীকে আমীরাহ বলা হয়ে থাকে, যদিও তাদের বাদশাহী কিংবা প্রশাসনে কোন হাত নেই। নবী পরিবারের সদস্যা হিসাবে তাঁকে নাবিয়াহ বলা হয়েছে। এটি রূপকভাবে বলা হয়েছে। সত্যি সত্যি তিনি নবী ছিলেন না এবং তার কাছে আল্লাহ তাআলার ওহী আসত না। আর মহা খুশির দিন ঈদে তাঁর দফ বাজানো হচ্ছে এ কথার প্রমাণ যে, ঈদে দফ বাজানো আমাদের পূর্বে তাদের শরীয়তেও বৈধ ছিল। এমনকি এটা আমাদের শরীয়তেও মেয়েদের জন্য ঈদের দিনে বৈধ। এ প্রসঙ্গে নিম্নে বর্ণিত হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য। মিনার দিনসমূহে তথা কুরবানীর ঈদের সময়ে দুটি বালিকা আয়েশা সিদ্দীকা (রাযিআল্লাহু আনহা)-এর কাছে দফ বাজাচ্ছিল এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে ছিলেন, হুযূরের চেহারা ছিল দেয়ালের দিকে। যখন আবু বকর (রাযিআল্লাহু আনহু) ঘরে ঢুকলেন তখন তাদেরকে ধমক দিলেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ঘরে শয়তানের বাদ্যযন্ত্র? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে আবু বকর! তাদেরকে এটা করতে দাও। কেননা, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যেই রয়েছে উৎসবের দিন এবং এটা আমাদের উৎসবের দিন। অনুরূপভাবে বিয়ে-শাদীর মজলিসে এবং প্রবাসীকে সংবর্ধনা জানানোর ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ধরনের দফ বাজাননা জায়েয আছে—যা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদিতে বর্ণিত রয়েছে।
কিতাবিগণ আরো বলেন যে, বনী ইসরাঈলরা যখন সমুদ্র অতিক্রম করল এবং সিরিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করল তখন তারা একটি স্থানে তিনদিন অবস্থান করে। সেখানে পানি ছিল না। তাদের মধ্য হতে কিছু সংখ্যক লোক এ নিয়ে নানারূপ সমালোচনা করে। তখন তারা লবণাক্ত বিস্বাদ পানি খুঁজে পেল, যা পান করার উপযোগী ছিল না। তখন আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে নির্দেশ দিলে তিনি একটি কাঠের টুকরো পানির উপর রেখে দিলেন। তখন তা মিঠা পানিতে পরিণত হল এবং পানকারীদের জন্যে উপাদেয় হয়ে গেল। তখন আল্লাহ তাআলা মুসা (আলাইহিস সালাম)-কে ফরজ, সুন্নাত ইত্যাদি শিক্ষা দান করলেন এবং প্রচুর নসীহত প্রদান করলেন।
মহাপরাক্রমশালী ও আপন কিতাবের রক্ষণাবেক্ষণকারী আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর কালামে ইরশাদ করেনঃ
অর্থাৎ, আর আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে দেই। তারপর তারা প্রতিমা পূজায় রত এক সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হয়। তারা বলল, “হে মূসা! তাদের দেবতার মত আমাদের জন্যেও একটি দেবতা গড়ে দাও।’ সে বলল, ‘তোমরা তো এক মূর্খ সম্প্রদায়; এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তাতে বিধ্বস্ত হবে এবং তারা যা করেছে তাও অমূলক।” (৭ আ’রাফঃ ১৩৮-১৩৯)
তারা এরূপ মূর্খতা ও পথভ্রষ্টতার কথা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর কাছে আরয করছিল অথচ তারা আল্লাহ্ তা’আলার নিদর্শনাদি ও কুদরত প্রত্যক্ষ করছিল যা প্রমাণ করে যে, মহাসম্মানিত ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ তা’আলার রাসূল যা কিছু নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা যথার্থ। তারা এমন একটি সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলো, যারা মূর্তি পূজায় রত ছিল। কেউ কেউ বলেন, এই মূর্তিগুলো ছিল গরুর আকৃতির। তারা তাদেরকে প্রশ্ন করেছিল যে, কেন তারা এগুলোর পূজা করে? তখন তারা বলেছিল যে, এগুলো তাদের উপকার ও অপকার সাধন করে থাকে এবং প্রয়োজনে তাদের কাছেই উপজীবিকা চাওয়া হয়। বনী ইসরাঈলের কিছু মূর্খ লোক তাদের কথায় বিশ্বাস করল। তখন এই মূর্খরা তাদের নবী মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর কাছে আরয করল যে, তিনি যেন তাদের জন্যেও দেব-দেবী গড়ে দেন যেমন ঐসব লোকের দেব-দেবী রয়েছে।
মূসা (আলাইহিস সালাম) তাদেরকে প্রতিউত্তরে বললেন, প্রতিমা পূজাকারিগণ নির্বোধ এবং তারা হিদায়াতের পথে পরিচালিত নয়। আর এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা তো বিধ্বস্ত হবে এবং তারা যা করেছে তাও অমূলক। তারপর মূসা (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামতরাজি এবং সমকালীন বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে তাদেরকে জ্ঞানে, শরীয়তের এবং তাদের মধ্য থেকে রাসূল প্রেরণের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব দানের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি তাদেরকে আরো স্মরণ করিয়ে দেন যে, মহাশক্তির অধিকারী ফিরআউনের কবল থেকে আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে উদ্ধার করেছেন এবং ফিরাউনকে তাদের সম্মুখেই ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাছাড়া ফিরআউন ও তার ঘনিষ্ঠ অনুচরগণ যেসব সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা নিজেদের জন্যে সঞ্চিত ও সংরক্ষিত করে রেখেছিল ও সুরম্য প্রাসাদ গড়েছিল, আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে সে সবের উত্তরাধিকারী করেছেন। তিনি তাদের কাছে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন যে, এক লা-শরীফ আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। কেননা তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও মহাপরাক্রমশালী। তবে বনী ইসরাঈলের সকলেই তাদের জন্যে দেব-দেবী গড়ে দেবার দরখাস্ত করেনি বরং কিছু সংখ্যক মূর্খ ও নির্বোধ লোক এরূপ করেছিল। তাই আয়াতাংশ وجاوزنا ببمي اسرائيل এ قوم বা সম্প্রদায় বলতে তাদের সকল লোককে নয়, কিছু সংখ্যককে বুঝানো হয়েছে। যেমন সূরায়ে কাহাফের আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
অর্থাৎ——“সেদিন তাদের সকলকে আমি একত্রকরণ এবং তাদের কাউকেও অব্যাহতি দেব না এবং তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত করা হবে সারিবদ্ধভাবে এবং বলা হবে, তোমাদেরকে প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করেছিলাম সেভাবেই তোমরা আমার নিকট উপস্থিত হবেই অথচ তোমরা মনে করতে, যে, তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত ক্ষণে আমি তোমাদেরকে উপস্থিত করব না।” (সূরা কাহাফঃ ৪৭-৪৮)
উক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘অথচ তোমরা মনে করতে’ দ্বারা তাদের সকলকে বুঝানো হয়নি বরং কতক সংখ্যককে বুঝানো হয়েছে। ইমাম আহমদ (র)এ প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, আবূ ওয়াকিদ লায়সী (রাযিআল্লাহু আনহু) বলেন, হুনাইন যুদ্ধের সময় আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে বের হলাম। যখন আমরা একটি কূল গাছের কাছে উপস্থিত হলাম তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। কাফিরদের যেরূপ তরবারি রাখার জায়গা রয়েছে, আমাদের সেরূপ তরবারি রাখার জায়গার ব্যবস্থা করে দিন। কাফিররা তাদের তরবারি কুল গাছে ঝুলিয়ে রাখে ও তার চারপাশে ঘিরে বসে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন (আশ্চর্যান্বিত হয়ে) বললেনঃ আল্লাহু আকবার! এবং বললেন এটা হচ্ছে ঠিক তেমনি, যেমনটি বনী ইসরাঈলরা মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে বলেছিল اجعل لنا الها كمالهم الهة অর্থাৎ “হে মূসা! তাদের দেবতাদের মত আমাদের জন্যেও একটি দেবতা গড়ে দাও।’ তোমরা তো তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতিই অনুসরণ করছ। ইমাম নাসাঈ (র) এবং তিরমিযী (র)ও ভিন্ন সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (র) হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলে অভিহিত করেছেন। ইন জারীর (র) আবূ ওয়াকিদ আল লাইসী (রাযিআল্লাহু আনহু)-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবায়ে কিরাম (রাযিআল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে খায়বারের উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। বর্ণনাকারী বলেন, কাফিরদের একটি কুলগাছ ছিল, তারা এটার কাছে অবস্থান করত এবং তাদের হাতিয়ার এটার সাথে ঝুলিয়ে রাখত। এ গাছটাকে বলা হত যাতু আনওয়াত। বর্ণনাকারী বলেন, একটি বড় সবুজ রংয়ের কুল গাছের কাছে পৌঁছে আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের জন্যেও একটি যাতু আনওয়াত-এর ব্যবস্থা করুন, যেমনটি কাফিরদের রয়েছে। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, তোমরা এরূপ কথা বললে, যেমন মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায় মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে বলেছিল, আমাদের জন্য এ সম্প্রদায়ের দেবতাদের মত একটি দেবতা গড়ে দাও। সে বলল, তোমরা তো এক মূর্খ সম্প্রদায়। এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে তা তো বিধ্বস্ত হবে এবং তারা যা করছে তাও অমূলক।” (সূরা আরাফঃ ১৩৮-১৩৯)
বস্তুত মূসা (আলাইহিস সালাম) যখন মিসর ত্যাগ করে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে সেখানে পৌঁছলেন, তখন সেখানে হায়সানী, ফাযারী ও কানআনী ইত্যাদি গোত্র সম্বলিত একটি দুর্দান্ত জাতিকে বসবাসরত দেখতে পান। মূসা (আলাইহিস সালাম) তখন বনী ইসরাঈলকে শহরে প্রবেশ করার এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বিতাড়িত করতে হুকুম দিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) কিংবা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে এই শহরটি বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তারা মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর নির্দেশ মানতে অস্বীকার করল এবং যুদ্ধ থেকে বিরত রইল। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে ভীতিগ্রস্ত করলেন এবং তীহ প্রান্তরে নিক্ষেপ করেন, যেখানে তারা সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবত উদ্ভান্তের মত ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকেন।
অর্থাৎ, স্মরণ কর, মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল— হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর; যখন তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবী করেছিলেন ও তোমাদেরকে রাজাধিপতি করেছিলেন এবং বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি দেননি তা তোমাদেরকে দিয়েছিলেন। হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন তাতে তোমরা প্রবেশ কর এবং পশ্চাদপসরণ করবে না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তারা বলল, হে মূসা! সেখানে এক দুর্দান্ত সম্প্রদায় রয়েছে এবং তারা সে স্থান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেখানে কিছুতেই প্রবেশ করব না; তারা সেই স্থান থেকে বের হয়ে গেলেই আমরা প্রবেশ করব। যারা ভয় করছিল তাদের মধ্যে দু’জন, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন তারা বলল, তোমরা তাদের মুকাবিলা করে দরজায় প্রবেশ করলেই তোমরা জয়ী হবে আর তোমরা মুমিন হলে আল্লাহর উপরই নির্ভর কর। তারা বলল, হে মূসা! তারা যতদিন সেখানে থাকবে, ততদিন আমরা সেখানে প্রবেশ করবই না। সুতরাং তুমি আর তোমার প্রতিপালক যাও এবং যুদ্ধ কর; আমরা এখানেই বসে থাকবো। সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার ও আমার ভাই ব্যতীত অপর কারও উপর আমার আধিপত্য নেই। সুতরাং তুমি আমাদের ও সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়সালা করে দাও। আল্লাহ্ বললেন, তবে এটা চল্লিশ বছর তাদের জন্য নিষিদ্ধ রইল, তারা পৃথিবীতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে, সুতরাং তুমি সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করবে না। (সূরা মায়িদাঃ ২০-২৬)
এখানে আল্লাহর নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরাঈলের উপর আল্লাহ তাআলা যে অনুগ্রহ করেছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নিয়ামতসমূহ দান করে অনুগ্রহ করেছিলেন। তাই আল্লাহর নবী তাদেরকে আল্লাহর রাহে আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্যে আদেশ দিচ্ছেন।
অর্থাৎ, হে আমার সম্প্রদায়! পবিত্র ভূমিতে তোমরা প্রবেশ কর আর এটা তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে না এবং দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হতে বিরত থাকবে না। যদি পশ্চাদপসরণ কর ও বিরত থাক। লাভের পর ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং পরিপূর্ণতা অর্জনের পর অপরিপূর্ণতার শিকার হবে।
প্রতিউত্তরে তারা বলল, ياموسي ان فيها قوما جبارين অর্থাৎ হে মূসা! সেখানে রয়েছে একটি দুর্ধর্ষ, দুর্দান্ত ও কাফির সম্প্রদায়। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে লাগল
অর্থাৎ যতক্ষণ না ঐ সম্প্রদায়টি সেখান থেকে বের হয়ে যায় আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। যখন তারা বের হয়ে যাবে আমরা সেখানে প্রবেশ করব, অথচ তারা ফিরআউনের ধ্বংস ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে। আর সে ছিল এদের তুলনায় অধিকতর দুর্দান্ত, অধিকতর যুদ্ধ-কুশলী এবং সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে প্রবলতর। এ থেকে বোঝা যায় যে, তারা তাদের এরূপ উক্তির ফলে ভৎসনার যোগ্য এবং খোদাদ্রোহী হতভাগ্য, দুর্দান্ত শত্রুদের মুকাবিলা থেকে বিরত থেকে লাঞ্ছনা ও নিন্দার যোগ্য।
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বহু তাফসীরকার বিভিন্ন ধরনের কল্প-কাহিনী ও বিবেকের কাছে অগ্রহণীয় এবং বিশুদ্ধ বর্ণনা বিবর্জিত তথ্যাদি পেশ করেছেন। যেমন কেউ কেউ বলেছেন, বনী ইসরাঈলের প্রতিপক্ষ দুর্দান্ত সম্প্রদায়ের লোকজন বিরাট দেহের অধিকারী ও ভীষণ আকৃতির ছিল। তারা এরূপও বর্ণনা করেছেন যে, বনী ইসরাঈলের দূতরা যখন তাদের কাছে পৌঁছল, তখন সে দুর্দান্ত সম্প্রদায়ের দূতদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি তাদের সাথে সাক্ষাত করল এবং তাদেরকে একজন একজন করে পাকড়াও করে আস্তিনের মধ্যে ও পায়জামার ফিতার সাথে জড়াতে লাগল, দূতরা সংখ্যায় ছিল বারজন। লোকটি তাদেরকে তাদের বাদশাহর সম্মুখে ফেলল। বাদশাহ বলল, এগুলো কি? তারা যে আদম সন্তান সে চিনতেই পারল না। অবশেষে তারা তার কাছে তাদের পরিচয় দিল।
এসব কল্প-কাহিনী ভিত্তিহীন। এ সম্পর্কে আরো বর্ণিত রয়েছে যে, বাদশাহ তাদের ফেরৎ যাওয়ার সময় তাদের সাথে কিছু আঙ্গুর দিয়েছিল। প্রতিটি আঙ্গুর একজন লোকের জন্যে যথেষ্ট ছিল। তাদের সাথে আরো কিছু ফলও সে দিয়েছিল, যাতে তারা তাদের দেহের আকার-আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা করতে পারে। এই বর্ণনাটিও বিশুদ্ধ নয়। এ প্রসঙ্গে তারা আরো বর্ণনা করেছেন যে, দুর্ধর্ষ ব্যক্তিদের মধ্য হতে উক্ত ইবন আনাক নামী এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলকে ধ্বংস করার জন্যে বনী ইসরাঈলের দিকে এগিয়ে আসল। তার উচ্চতা ছিল ৩৩৩৩ হাত। বাগাবী প্রমুখ তাফসীরকারগণ এরূপ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তা শুদ্ধ নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীসঃ
ان الله خلق ادم طوله ستون ذراعاثم لم يزل الخلق ينقص حتى الان
অর্থাৎ আল্লাহ আদমকে ষাট হাত উচ্চতা বিশিষ্ট করে সৃষ্টি করেন তারপর ক্রমে ক্রমে কমতে কমতে তা এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে- এর ব্যাখ্যা বর্ণনা প্রসঙ্গে তা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তারা আরো বলেন, উজ নামের উক্ত ব্যক্তিটি একটি পাহাড়ের চূড়ার প্রতি তাকাল ও তা উপড়িয়ে নিয়ে আসল এবং মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সৈন্য-সামন্তের উপর রেখে দেবার মনস্থ করল, এমন সময় একটি পাখি আসল ও পাথরের পাহাড়টিকে ঠোকর দিল এবং তা ছিদ্র করে ফেলল। ফলে উজের গলায় তা বেড়ীর মত বসে গেল। তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) তার দিকে অগ্রসর হয়ে লাফ দিয়ে ১০ হাত উপরে উঠলেন। তার উচ্চতা ছিল ১০ হাত। তখন মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে তাঁর লাঠিটি ছিল। আর লাঠিটির উচ্চতাও ছিল ১০ হাত। মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর লাঠি তাঁর পায়ের গিটের কাছে পৌঁছল এবং মূসা (আলাইহিস সালাম) তাকে লাঠি দ্বারা বধ করলেন। উক্ত বর্ণনাটি আওফ আল-বাকালী (র) থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইবন জারীর (র) আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে এটি বর্ণনা করেছেন তবে এ বর্ণনার সনদের বিশুদ্ধতায় মতবিরোধ রয়েছে। এ ছাড়াও এগুলো সবই হচ্ছে ইসরাঈলী বর্ণনা। এর সব বর্ণনা বনী ইসরাঈলের মূর্খদের রচিত। এসব মিথ্যা বর্ণনার সংখ্যা এত অধিক যে, এগুলোর মধ্যে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এগুলোকে সত্য বলে মেনে নিলে বনী ইসরাঈলকে যুদ্ধে যোগদান না করার কিংবা যুদ্ধ হতে বিরত থাকার ব্যাপারে ক্ষমার যোগ্য বলে বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে যুদ্ধ হতে বিরত থাকার জন্যে শাস্তি প্রদান করেছেন, জিহাদ না করার জন্যে এবং তাদের রাসূলের বিরোধিতা করার জন্যে তাদেরকে তীহের ময়দানে চল্লিশ বছর যাবত ভবঘুরে জীবন যাপন করার শাস্তি দিয়েছেন। দু’জন পুণ্যবান ব্যক্তি তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্যে অগ্রসর হতে এবং যুদ্ধ পরিহারের মনোভাব প্রত্যাহার করার জন্যে যে উপদেশ দান করেছিলেন, তা আল্লাহ্ তা’আলা উপরোক্ত আয়াতে ইংগিত করেছেন। কথিত আছে, উক্ত দু’জন ছিলেন ইউশা ইবুন নূন (আলাইহিস সালাম) ও কালিব ইবন ইউকান্না। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাযিআল্লাহু আনহু), মুজাহিদ (র), ইকরিমা (র), আতীয়্যা (র), সুদ্দী (র), রবী ইবন আনাস (র) ও আরো অনেকে এ মত ব্যক্ত করেছেন।
অর্থাৎ, যারা ভয় করে কিংবা যারা ভীত তাদের মধ্য হতে দুইজন যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও সাহস প্রদান করেছেন, তাঁরা বললেন, দরজা দিয়ে তাদের কাছে ঢুকে পড় এবং ঢুকে পড়লেই তোমরা জয়ী হয়ে যাবে। আর যদি তোমরা আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াকুল রাখ তার কাছেই সাহায্য চাও এবং তার কাছেই আশ্রয় চাও, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন এবং তোমাদেরকে বিজয়ী করবেন। তখন তারা বলল, 'হে মূসা! যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্দান্ত সম্প্রদায় উক্ত শহরে অবস্থান করবে, আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। তুমি ও তোমার প্রতিপালক তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, আমরা এখানেই বসে রইলাম।’ (সূরা মায়িদাঃ ২৩)
মোটকথা, বনী ইসরাঈলের সর্দাররা জিহাদ হতে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিল। এর ফলে বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেল। কথিত আছে, ইউশা (আলাইহিস সালাম) ও কালিব (আলাইহিস সালাম) যখন তাদের এরূপ উক্তি শুনতে পেলেন (তখনকার নিয়ম অনুযায়ী) তারা তাদের কাপড় ছিড়ে ফেলেন এবং মূসা (আলাইহিস সালাম) ও হারূন (আলাইহিস সালাম) এই অশ্রাব্য কথার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার গযব থেকে পরিত্রাণের জন্যে বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ্ তা’আলার রহমত কামনা করে সিজদায় পড়ে গেলেন।
অর্থাৎ, হে আমার প্রতিপালক! আমার ও আমার ভাই ছাড়া আর কারো উপর আমার আধিপত্য নেই। সুতরাং তুমি আমাদের ও সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়সালা করে দাও! (সূরা মায়িদাঃ ২৫)
উক্ত আয়াতে উল্লেখিত আয়াতাংশের অর্থ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাযিআল্লাহু আনহু) বলেন, এটার অর্থ হচ্ছে আমার ও তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দিন।
অর্থাৎ, জিহাদ হতে বিরত থাকার জন্য তাদেরকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছিল যে, তারা চল্লিশ বছর যাবত দিন-রাত সকাল-সন্ধ্যা তীহ ময়দানে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ভবঘুরে জীবন যাপন করবে। (সূরা মায়িদাঃ ২৬)
কথিত আছে, তাদের যারা তীহ ময়দানে প্রবেশ করেছিল তাদের কেউ বের হতে পারেনি বরং তাদের সকলে এই চল্লিশ বছরে সেখানে মৃত্যুবরণ করেছিল। কেবল তাদের ছেলে-মেয়েরা এবং ইউশা (আলাইহিস সালাম) ও কালিব (আলাইহিস সালাম) বেঁচে ছিলেন। বদরের দিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাহাবীগণ মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর সম্প্রদায়ের ন্যায় বলেননি। বরং তিনি যখন তাদের কাছে যুদ্ধে যাবার বিষয়ে পরামর্শ করলেন, তখন আবু বকর সিদ্দীক (রাযিআল্লাহু আনহু) এ ব্যাপারে কথা বললেন, আবু বকর (রাযিআল্লাহু আনহু) ও অন্যান্য মুহাজির সাহাবী এ ব্যাপারে উত্তম পরামর্শ দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘তোমরা আমাকে এ ব্যাপারে পরামর্শ প্রদান কর।’ শেষ পর্যন্ত সা’দ ইবন মুয়ায (রাযিআল্লাহু আনহু) বলেন, সম্ভবত আপনি আমাদের দিকেই ইঙ্গিত করছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে এ সমুদ্র পাড়ি দিতে চান অতঃপর আপনি এটাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। আমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তিই পিছু হটে থাকবে না। আগামীকালই যদি আমাদেরকে শত্রুর মুকাবিলা করতে হয় আমরা যুদ্ধে ধৈর্যের পরিচয় দেব এবং মুকাবিলার সময় দৃঢ় থাকব। হয়ত শীঘ্রই আল্লাহ তাআলা আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে এমন আচরণ প্রদর্শন করাবেন যাতে আপনার চোখ জুড়াবে। সুতরাং আপনি আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করে রওয়ানা হতে পারেন। তাঁর কথায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অত্যন্ত প্রীত হলেন।
ইমাম আহমদ (র) ইবন শিহাব (র) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সাহাবী হযরত মিকদাদ (রাযিআল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বদরের যুদ্ধের দিন বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে সেরূপ বলব না, যেরূপ বনী ইসরাঈল মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে বলেছিল-
অর্থাৎ তুমি ও তোমার প্রতিপালক যুদ্ধ কর আমরা এখানে বসে রইলাম, বরং আমরা বলব, আপনি ও আপনার প্রতিপালক যুদ্ধে যাত্রা করুন, আমরাও আপনাদের সাথে যুদ্ধে শরীক থাকবো।’
উল্লেখিত হাদীসের এ সনদটি উত্তম। অন্য অনেক সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমদ (র) আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাযিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “আমি মিকদাদ (রাযিআল্লাহু আনহু)-কে এমন একটি যুদ্ধে উপস্থিত হতে দেখেছি, যে যুদ্ধে তাঁর অবস্থান এতই গৌরবজনক ছিল যে, আমি যদি সে অবস্থানে থাকতাম তবে তা অন্য যে কোন কিছুর চাইতে আমার কাছে প্রিয়তর হতো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুশরিকদের বিরুদ্ধে বদদোয়ায় রত ছিলেন, এমন সময় মিকদাদ (রাযিআল্লাহু আনহু) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, “আল্লাহর শপথ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে এরূপ বলব না, যেরূপ বনী ইসরাঈলরা মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে বলেছিল ( فَٱذۡهَبۡ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَـٰتِلَاۤ إِنَّا هَـٰهُنَا ) বরং আমরা যুদ্ধ করব, আপনার ডানপাশে আপনার বামপাশে, আপনার সামনে ও পিছন থেকে আমরা প্রাণ দিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। এ কথা শুনার পর আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর চেহারা মুবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখতে পেলাম। তিনি এতে খুশী হয়েছিলেন।
ইমাম বুখারী (র) তাঁর গ্রন্থের তাফসীর এবং মাগাযী অধ্যায়ে এ বর্ণনা পেশ করেছেন। হাফিজ আবু বকর মারদোয়েহ্ (র) আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন বদরের দিকে রওয়ানা হলেন, তখন তিনি মুসলমানদের সাথে পরামর্শ করলেন। উমর (রাযিআল্লাহু আনহু) তাঁকে সুপরামর্শ দিলেন। তারপর হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আনসারগণের পরামর্শ চাইলেন। কিছু সংখ্যক আনসার অন্যান্য আনসারকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে আনসার সম্প্রদায়! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুদ্ধের ব্যাপারে তোমাদের পরামর্শ চাইছেন।’ তখন আনসারগণ বললেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে এরূপ বলব না যেরূপ বনী ইসরাঈল মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে বলেছিলঃ ‘যে সত্তা আপনাকে সত্যসহকারে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, আমাদেরকে যদি পৃথিবীর অতি দূরতম অংশেও মুকাবিলার জন্যে যেতে বলা হয়, নিশ্চয়ই আমরা আপনার আনুগত্য করব।’ ইমাম আহমদ (র) বিভিন্ন সূত্রে আনাস (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে অনুরূপ বর্ণনা পেশ করেছেন। ইবন হিব্বান (র) তার 'সহীহ’ গ্রন্থেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/488/69
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।