hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১ম খন্ড

লেখকঃ আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী (র)

৫৩
হযরত ইবরাহীম খলীল (আ)-এর প্রশংসায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ

( وَإِذِ ابْتَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ ۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا ۖ قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي ۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ ) [Surat Al-Baqarah 124]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীমকে তাঁর প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন এবং সেগুলো সে পূর্ণ করেছিল। আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করছি, সে বলল, আমার বংশধরগণের মধ্য হতেও? আল্লাহ বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি জালিমদের প্রতি প্রযোজ্য নয়। (সূরা বাকারাঃ ১২৪)

আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে যেসব কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন, তিনি সেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ্ তাঁকে মানব জাতির নেতৃত্ব দান করেন। যাতে তারা তাঁর অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারে। ইব্রাহীম (আ) এই নিয়ামত তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে অব্যাহত রাখার জন্যে আল্লাহর নিকট দু’আ করেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রার্থনা শুনেন এবং জানিয়ে দেন যে, তাকে যে নেতৃত্ব দেয়া হল তা জালিমরা লাভ করতে পারবে না, এটা কেবল তাঁর সন্তানদের মধ্যে আলিম ও সৎকর্মশীলদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ

( وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ وَآتَيْنَاهُ أَجْرَهُ فِي الدُّنْيَا ۖ وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ ) [Surat Al-Ankabut 27]

অর্থাৎ, আমি ইব্রাহীমকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকূব এবং তার বংশধরদের জন্যে স্থির করলাম নবুওত ও কিতাব, আমি তাকে দুনিয়ায় পুরস্কৃত করেছিলাম। আখিরাতেও সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম হবে। (২৯ আন-কাবূতঃ ২৭)

আল্লাহর বাণীঃ

( وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ ۚ كُلًّا هَدَيْنَا ۚ وَنُوحًا هَدَيْنَا مِنْ قَبْلُ ۖ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَىٰ وَهَارُونَ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ * وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَىٰ وَعِيسَىٰ وَإِلْيَاسَ ۖ كُلٌّ مِنَ الصَّالِحِينَ * وَإِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَيُونُسَ وَلُوطًا ۚ وَكُلًّا فَضَّلْنَا عَلَى الْعَالَمِينَ * وَمِنْ آبَائِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ وَإِخْوَانِهِمْ ۖ وَاجْتَبَيْنَاهُمْ وَهَدَيْنَاهُمْ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ )

[Surat Al-An'am 84 - 87]

অর্থাৎ, এবং তাকে দান করেছিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব ও ওদের প্রত্যেককে সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম, পূর্বে নূহকেও সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম এবং তার বংশধর দাঊদ, সুলায়মান, আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও; আর এভাবেই সকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করি এবং যাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম, এরা সকলে সজ্জনদের অন্তর্ভুক্ত। আরও সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম ইসমাঈল, আল-ইয়াসা’আ, ইউনুস ও লূতকে; এবং শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম বিশ্ব জগতের উপর প্রত্যেককে এবং এদের পিতৃ-পুরুষ, বংশধর এবং ভ্রাতৃবৃন্দের কতককে; তাদেরকে মনোনীত করেছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করেছিলাম। (সূরা আনআমঃ ৮৪-৮৭)

প্রসিদ্ধ মতে, ومن ذريته (তাঁর বংশধরদের) বলতে এখানে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে বুঝান হয়েছে। হযরত লূত (আ) যদিও হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর ভাতিজা তবুও অন্যদের প্রাধান্য হেতু তাঁকেও বংশধর হিসাবে বলা হয়েছে। অপর একদল আলিমের মতে, তাঁর বলতে হযরত নূহ (আ)-কে বুঝান হয়েছে। পূর্বে আমরা নূহ (আ)-এর আলোচনায় এ বিষয়ের উল্লেখ করেছি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। আল্লাহর বাণীঃ

( وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا وَإِبْرَاهِيمَ وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِمَا النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ ۖ فَمِنْهُمْ مُهْتَدٍ ۖ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ ) [Surat Al-Hadid 26]

অর্থাৎ, আমি নূহ এবং ইবরাহীমকে রাসূলরূপে প্রেরণ করেছিলাম এবং তাদের বংশধরগণের জন্যে স্থির করেছিলাম নবুওত ও কিতাব। (সূরা হাদীদঃ ২৬)

হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর পরে আসমান থেকে যত কিতাব যত নবীর উপর নাযিল হয়েছে, তারা সকলেই নিশ্চিতভাবে তাঁর বংশধরদের অন্তর্ভুক্ত। এটা এমন একটা সম্মান যার কোন তুলনা হয় না। এমন একটা সুমহান মর্যাদা যার তুল্য আর কিছুই নেই। কারণ, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ঔরসে দুই মহান পুত্র-সন্তানের জন্ম হয়। হাজেরার গর্ভে ইসমাঈল এবং সারাহর গর্ভে ইসহাক। ইসহাকের পুত্র ইয়াকূব তাঁর অপর নাম ছিল ইসরাঈল। পরবর্তী বংশধরগণ এই ইসরাঈলের নামেই বনী ইসরাঈল নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই ইসরাঈলী বংশে এতো বিপুল সংখ্যক নবীর আগমন ঘটে, যাদের সঠিক সংখ্যা তাদেরকে প্রেরণকারী আল্লাহ ব্যতীত আর কেউই জানেন না। অব্যাহতভাবে এই বংশেই নবী-রাসূলগণ আসতে থাকেন এবং হযরত ঈসা ইবন মারয়াম (আ) পর্যন্ত পৌঁছে সে ধারার সমাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ ঈসা ইবন মারয়াম (আ) ইসরাঈল বংশের শেষ নবী। অপরদিকে হযরত ইসমাঈল (আ)-এর সন্তানগণ আরবের বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে আরব ভূমিতেই বসবাস করতে থাকেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে সর্বশেষ নবী খাতামুল আম্বিয়া, বনী আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান, দুনিয়া ও আখিরাতের গৌরব রবি মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন হাশিম আল কুরায়শী আল-মক্কী ওয়াল মাদানী ব্যতীত অন্য কোন নবীর আগমন ঘটেনি। ইনিই হলেন সেই মহামানব যার দ্বারা সমগ্র মানব জাতি গৌরবান্বিত। আদি-অন্ত সকল মানুষের ঈর্ষার পাত্র।

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ

ساقوم مقامايرغب الى الخلق كلهم حتى ابر اهيم

অর্থাৎ—‘আমি এমন এক মর্যাদাপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হব যে, আমার কাছে পৌঁছার জন্যে প্রত্যেকেই লালায়িত হবে; এমনকি ইবরাহীম (আ)-ও।’ এই বাক্যের দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা) প্রকারান্তরে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর পরে অন্য সব মানুষের মধ্যে দুনিয়া ও আখিরাতে হযরত ইবরাহীম (আ)-ই শ্রেষ্ঠ মানুষ ও সম্মানিত পুরুষ।

ইমাম বুখারী (র) ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) হাসান (রা)-কে কোলে নিয়ে বলতেন, আমি তোমাদের দুই ভাইয়ের জন্যে সেরূপ আশ্রয় চাই, যেরূপ আশ্রয় চেয়েছিলেন তোমাদের আদি পিতা ইবরাহীম (আ) ইসমাঈল ও ইসহাকের জন্যে। আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর পরিপূর্ণ কালেমাহ্ দ্বারা প্রত্যেক শয়তান ও বিষাক্ত সরীসৃপ থেকে এবং প্রত্যেক ক্ষতিকর চোখের দৃষ্টি থেকে। সুনান হাদীসের গ্রন্থকারগণও মানসূর (র) সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ্ বলেনঃ

( وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَىٰ ۖ قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ ۖ قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي ۖ قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَىٰ كُلِّ جَبَلٍ مِنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا ۚ وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ) [Surat Al-Baqarah 260]

অর্থাৎ, যখন ইবরাহীম বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর আমাকে দেখাও।’ তিনি বললেন, ‘তবে কি তুমি বিশ্বাস করনি?’ সে বলল, ‘কেন করব না, তবে এটি কেবল আমার চিত্ত প্রশান্তির জন্যে।’ তিনি বললেন, ‘তবে চারটি পাখি লও এবং সেগুলোকে তোমার বশীভূত করে লও। তারপর তাদের এক এক অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন কর। তারপর তাদেরকে ডাক দাও ওরা দ্রুতগতিতে তোমার নিকট আসবে। জেনে রেখো, আল্লাহ্ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা বাকারাঃ ২৬০)

আল্লাহর নিকট হযরত ইবরাহীম (আ)-এর এই প্রশ্ন সম্পর্কে মুফাসসিরগণ বহু কথা লিখেছেন, আমরা তাফসীর গ্রন্থে সে সবের বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সারকথা এই যে, ইবরাহীম (আ)-এর প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ্ তাকে চার প্রকার পাখি সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন। এই চার প্রকার পাখি কি কি ছিল সে বিষয়ে মুফাসসিরগণের মতভেদ আছে। যাই হোক, উক্ত পাখিগুলোকে কেটে তাদের মাংস ও পাখা ইত্যাদি খণ্ড-বিখণ্ড করে সবগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে চারটি ভাগে বিভক্ত করে এবং এক এক ভাগ এক এক পাহাড়ে রাখতে বলেন। তারপর প্রত্যেকটি পাখির নাম ধরে আল্লাহর নামে ডাকতে বলেন। ইবরাহীম (আ) যখন একটি একটি করে পাখির নাম ধরে ডাকেন, তখন প্রত্যেক পাহাড় থেকে ঐ পাখির খণ্ডিত মাংস ও পাখা উড়ে এসে একত্রিত হতে থাকে এবং পূর্বে যেরূপ ছিল সেরূপ পূর্ণাঙ্গ পাখিতে পরিণত হতে থাকে। আর ইবরাহীম (আ) সেই মহান সত্তার কুদরত ও ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেন, যিনি কোন কিছুকে হও (কুন) বললে সাথে সাথেই তা হয়ে যায়। ইব্রাহীম (আ)-এর ডাকের সাথে ঐ পাখিগুলো তাঁর দিকে দৌড়িয়ে আসতে থাকে। উড়ে আসার চেয়ে দৌড়ে আসার মধ্যে আল্লাহর কুদরত অধিক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ইব্রাহীম (আ) পাখিগুলোর মাথা কেটে নিজের হাতে রেখে দিয়েছিলেন। বাকি অংশ পাহাড় থেকে উড়ে আসলে তিনি মাথা ফেলে দিতেন। ফলে মাথাগুলো সংশ্লিষ্ট পাখির দেহের সাথে গিয়ে লেগে যেত। অতএব, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। আল্লাহ মৃতকে জীবিত করতে পারেন এ ব্যাপারে ইব্রাহীম (আ)-এর ইলমে ইয়াকীন (দৃঢ় বিশ্বাস) ছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি তা খোলা চোখে দেখতে চেয়েছিলেন মাত্র। যাতে ‘ইলমে ইয়াকীন’ ‘আয়নুল ইয়াকীনে’ উন্নীত হয়। আল্লাহ্ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন ও আশা পূরণ করেন। আল্লাহর বাণীঃ

( يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تُحَاجُّونَ فِي إِبْرَاهِيمَ وَمَا أُنْزِلَتِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ إِلَّا مِنْ بَعْدِهِ ۚ أَفَلَا تَعْقِلُونَ * هَا أَنْتُمْ هَٰؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ ۚ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ * مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ * إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَٰذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا ۗ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ )

[Surat Aal-E-Imran 65 - 68]

অর্থাৎ, হে কিতাবিগণ! ইব্রাহীম সম্বন্ধে কেন তোমরা তর্ক কর, অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তার পরেই অবতীর্ণ হয়েছিল? তোমরা কি বুঝ না? দেখ, যে বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান আছে তোমরাই তো সে বিষয়ে তর্ক করেছ, তবে যে বিষয়ে তোমাদের কোনই জ্ঞান নেই সে বিষয়ে কেন তর্ক করছ? আল্লাহ জ্ঞাত আছেন এবং তোমরা জ্ঞাত নও। ইবরাহীম ইহুদীও ছিল না, খৃস্টানও ছিল না; সে ছিল একনিষ্ঠ, আত্মসমর্পণকারী এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যারা ইবরাহীমের অনুসরণ করেছিল তারা এবং এই নবী ও যারা ঈমান এনেছে মানুষের মধ্যে তারা ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতম। আল্লাহ্ মু’মিনদের অভিভাবক। (সূরা আল-ইমরানঃ ৬৫-৬৮)

ইয়াহুদ ও নাসারা প্রত্যেকেই দাবি করত যে, ইবরাহীম (আ) তাদেরই লোক। আল্লাহ্ তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইবরাহীম (আ)-কে তাদের দলভুক্ত হওয়ার অপবাদ থেকে মুক্ত করেন। তিনি তাদের চরম মূর্খতা ও জ্ঞানের স্বল্পতা এই বলে প্রকাশ করে দেন যে, তাওরাত ও ইনজীল তো তার যুগের পরেই নাযিল হয়েছে।

وما انزلت التورةوالانجيل الا من بعده

অর্থাৎ তিনি কিভাবে তোমাদের ধর্মের লোক হবেন, যখন দুনিয়া থেকে তার বিদায়ের বহু যুগ পরে তাওরাত ইনজীল নাযিল হয়েছে অর্থাৎ তোমাদের শরীয়ত এসেছে। এ কারণেই আল্লাহ বলেছেনঃ

افلا تعقلون

তোমরা কি এ সামান্য বিষয়টিও বুঝ না?

আল্লাহ আরও বলেনঃ

( مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ )

[Surat Aal-E-Imran 67]

অর্থাৎ, ইবরাহীম ইহুদীও ছিল না, নাসারাও ছিল না, বরং সে ছিল একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী। সে মুশরিকও ছিল না। আল্লাহ্ এখানে স্পষ্ট বলেছেন যে, ইবরাহীম ছিলেন দীনে হানীফের উপর প্রতিষ্ঠিত। দীনে হানীফ বলা হয় স্বেচ্ছায় বাতিলকে পরিত্যাগ করে হককে গ্রহণ করা এবং আন্তরিকভাবে তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। এই দীনে হানীফ ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরিকদের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আল্লাহ বলেনঃ

( وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ ۚ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا ۖ وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ * إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ ۖ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ * وَوَصَّىٰ بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ * أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَٰهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ * تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ ۖ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ ۖ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ * وَقَالُوا كُونُوا هُودًا أَوْ نَصَارَىٰ تَهْتَدُوا ۗ قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ * قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ * فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا ۖ وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ ۖ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ * صِبْغَةَ اللَّهِ ۖ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً ۖ وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ * قُلْ أَتُحَاجُّونَنَا فِي اللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ وَلَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُخْلِصُونَ * أَمْ تَقُولُونَ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطَ كَانُوا هُودًا أَوْ نَصَارَىٰ ۗ قُلْ أَأَنْتُمْ أَعْلَمُ أَمِ اللَّهُ ۗ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَتَمَ شَهَادَةً عِنْدَهُ مِنَ اللَّهِ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ ) [Surat Al-Baqarah 130 - 140]

অর্থাৎ, যে নিজেকে নির্বোধ করেছে সে ব্যতীত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ হতে আর কে বিমুখ হবে! পৃথিবীতে তাকে আমি মনোনীত করেছি; পরকালেও সে সৎ কর্মপরায়ণগণের অন্যতম। তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, ‘আত্মসমর্পণ কর’, সে বলেছিল, ‘জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।’ এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এ সম্বন্ধে তাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিল, ‘হে পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্যে এ দীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী না হয়ে তোমরা কখনও মৃত্যুবরণ করিও না।’ ইয়াকূবের নিকট যখন মৃত্যু এসেছিল তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? সে যখন পুত্রগণকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করবে?’ তারা তখন বলেছিল, আমরা আপনার ইলাহ্-এর ও আপনার পিতৃ-পুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এরই ইবাদত করব। তিনি একমাত্র ইলাহ্ এবং আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী।’ সেই উম্মত অতীত হয়েছে- ওরা যা অর্জন করেছে তা ওদের, তোমরা যা অর্জন কর তা তোমাদের। তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে কোন প্রশ্ন করা হবে না। তারা বলে, ইহুদী বা খৃস্টান হও, ঠিক পথ পাবে।’ বল, বরং একনিষ্ঠ হয়ে আমরা ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করব এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।’ তোমরা বল, আমরা আল্লাহতে ঈমান রাখি এবং যা আমাদের প্রতি এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীকে দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী। তোমরা যাতে ঈমান এনেছ তারা যদি সেরূপ ঈমান আনে তবে নিশ্চয় তারা সৎপথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধভাবাপন্ন। তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। আমরা গ্রহণ করলাম আল্লাহর রং, রঙে আল্লাহ অপেক্ষা কে অধিকতর সুন্দর? এবং আমরা তাঁরই ইবাদতকারী। বল, আল্লাহ্ সম্বন্ধে তোমরা কি আমাদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? যখন তিনি আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক! আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের এবং আমরা তাঁর প্রতি অকপট। তোমরা কি বল যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তার বংশধরগণ ইহুদী কিংবা খৃস্টান ছিল?

বল, তোমরা বেশি জান, না আল্লাহ্? আল্লাহর নিকট হতে তার কাছে যে প্রমাণ আছে তা যে গোপন করে তার অপেক্ষা অধিকতর জালিম আর কে হতে পারে? তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে অনবহিত নন। (২ঃ ১৩০-১৪০)

আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ)-কে ইহুদী বা খৃস্টান হওয়ার অপবাদ থেকে মুক্ত করে সুস্পষ্টভাবে বলে দেন যে, তিনি একনিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন এবং তিনি মুশরিকও ছিলেন না। এ কারণে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ

إن اولى الناس بابرهيم للذين أتبعوه .

‘মানুষের মধ্যে ইবরাহীম (আ)-এর ঘনিষ্ঠতম তারা, যারা তাকে অনুসরণ করে।’ তাঁর সময়ে যারা তাঁর অনুসারী ছিল এবং তার পরে যারা তাঁর দীন গ্রহণ করেছে।

وهذا النبى

(এবং এই নবী) অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (সা)। কেননা যেই দীনে-হানীফকে আল্লাহ ইবরাহীম (আ)-এর জন্যে মনোনীত করেছিলেন সেই দীনে-হানিফকেই তিনি মুহাম্মদ (সা)-এর জন্য মনোনীত করেছেন। তদুপরি মুহাম্মদ (সা)-এর দীনকে তিনি পূর্ণতা দান করেছেন এবং তাঁকে এমন সব নিয়ামত দান করেছেন যা অন্য কোন নবী বা রাসূলকে ইতিপূর্বে দান করেননি।

আল্লাহ বলেনঃ

( قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۚ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ * قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ * لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ ) [Surat Al-An'am 161 - 163]

অর্থাৎ, বল, আমার প্রতিপালক আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। এটাই সু-প্রতিষ্ঠিত দীন ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বল, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশে। তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি এরূপই আদিষ্ট হয়েছি এবং আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। (৬ঃ ১৬১-১৬৩)

আল্লাহ আরো বলেনঃ

( إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ * شَاكِرًا لِأَنْعُمِهِ ۚ اجْتَبَاهُ وَهَدَاهُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ * وَآتَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً ۖ وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ * ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۖ وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ) [Surat An-Nahl 120 - 123]

অর্থাৎ, ইবরাহীম ছিল এক উম্মত আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সে ছিল আল্লাহর অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছিলেন এবং তাকে সরল পথে পরিচালিত করেছিলেন। আমি তাকে দুনিয়ায় দিয়েছিলাম মঙ্গল এবং আখিরাতেও সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। এখন আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (১৬ঃ ১২০-১২৩)

ইমাম বুখারী (র) ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) কাবা ঘরের মধ্যে প্রাণীর ছবি দেখে তাতে প্রবেশ করেননি। অতঃপর তার হুকুমে সেগুলো মুছে ফেলা হয়। তিনি কাবাঘরে হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর মূর্তির হাতে জুয়ার তীর দেখতে পান। এ দেখে তিনি বলেন, যারা এরূপ বানিয়েছে তাদেরকে আল্লাহ নিপাত করুক। আল্লাহর কসম, তারা দু’জনের কেউই জুয়ার তীর বের করেন নি। আয়াতে উল্লিখিত উম্মতআ( امة ) অর্থ নেতা ও পথপ্রদর্শক। যিনি মঙ্গলের দিকে মানুষকে আহ্বান করেন এবং সে ব্যাপারে তাকে অনুসরণ করা হয়। قانتا لله এর অর্থ সর্বাবস্থায়—চলাফেরার প্রতি মূহূর্তে আল্লাহকে ভয় করে চলা حنيفا অর্থ অন্তদৃষ্টির সাথে আন্তরিক হওয়া।

( وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ * شَاكِرًا لِأَنْعُمِهِ )

[Surat An-Nahl 120 - 121]

অর্থ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে পালন কর্তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যথা অন্তর, জিহ্বা ও কর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে। اجتباه অর্থ-আল্লাহ তাঁকে নিজের জন্যে মনোনীত করেন। রিসালাতের দায়িত্ব দেয়ার জন্যে বাছাই করেন। নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ তাঁকে দান করেন।

আল্লাহর বাণীঃ

( وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا ۗ وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا ) [Surat An-Nisa' 125]

অর্থাৎ, দীনের ব্যাপারে সেই ব্যক্তি অপেক্ষা কে উত্তম, যে সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করে। আল্লাহ ইবরাহীমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। (৪ঃ ১২৫)

এখানে আল্লাহ হযরত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করার জন্যে উৎসাহিত করেছেন। কেননা, তিনি ছিলেন মজবুত দীন ও সরল পথের উপর সু-প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তাকে যা যা করার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি তার সব কিছুই যথাযথভাবে পালন করেছেন। আল্লাহ নিজেই তাঁর প্রশংসায় বলেছেন

( وَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّىٰ )

[Surat An-Najm 37]

(এবং ইবরাহীমের কিতাবে, সে পালন করেছিল তার দায়িত্ব (৫৩ঃ ৩৭)। এ কারণেই আল্লাহ তাঁকে খলীল রূপে গ্রহণ করেন। খলীল বলা হয় সেই বন্ধুকে যার প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা থাকে। যেমন কোন কবি বলেছেনঃ

قد تخلت مسلك الروح مني- وبذا سمي الخليل خليلا

অর্থাৎ—আমার অন্তরকে সে ভালবাসা দিয়ে জয় করে নিয়েছে আর এ কারণেই অন্তরঙ্গ বন্ধুকে খলীল বলা হয়। অনুরূপভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-ও আল্লাহর খলীল হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছিলেন। সহীহ বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থে জুনদুব আল-বাজালী, আবদুল্লাহ ইবন আমর ও ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত।

রাসূল (সা) বলেছেনঃ হে জনমণ্ডলী! জেনে রেখো আল্লাহ আমাকে তাঁর খলীলরূপে গ্রহণ করেছেন, যেভাবে তিনি ইবরাহীমকে খলীল রূপে গ্রহণ করেছিলেনঃ

ایها الناس ان الله اتخذني خليلا كما اتخذ ابرهيم خليلا .

জীবনের শেষ ভাষণে রাসূল (সা) বলেছিলেনঃ

ایها الناس لو كنت متخذا من اهل الارض خليلا لا تخذت أبا بكر

‘হে জনগণ! পৃথিবীর অধিবাসীদের মধ্যে কাউকে যদি আমি খলীল হিসাবে গ্রহণ করতাম, তবে অবশ্যই আবু বকর (রা)-কে আমার খলীল বানাতাম। কিন্তু তোমাদের এই সাথী আল্লাহর খলীল।’

এ হাদীস বুখারী ও মুসলিমে আবু সাঈদ খুদরী (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তা ছাড়া আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা), ইবন আব্বাস (রা) ও ইবন মাসউদ (রা) সূত্রে এ হাদীসখানা অন্যান্য কিতাবেও বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারীতে আমর ইবন মায়মূন (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত মু’আয (রা) ইয়ামানে গমন করেন। তখন সবাইকে নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করেন এবং কিরাআতে এ আয়াতে তিলাওয়াত করেনঃ

اتخذ الله ابرهيم خليلا

(আল্লাহ ইবরাহীমকে খলীলরূপে গ্রহণ করেন) তখন উপস্থিত একজন বললেন, ইবরাহীমের মায়ের চোখ কতই না শীতল হয়েছিল। ইবন মারদূয়েহ (র) .... ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, একদা রাসূল (সা)-এর কতিপয় সাহাবা তার জন্য অপেক্ষমাণ দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বের হয়ে আসেন। কাছাকাছি এলে তিনি শুনতে পান—এরা যেন কিছু একটা বলাবলি করছেন। তখন সেখানে থেমে গিয়ে তিনি তাদের থেকে শুনতে পান যে, কেউ একজন বলছেন, কী আশ্চর্য! আল্লাহ তাঁরই সৃষ্টি মানুষের মধ্য থেকে ‘খলীল’ বানিয়েছেন—ইবরাহীম তার খলীল। আর একজন বলছেন, কী আশ্চর্য! আল্লাহ মূসার সাথে কথাবার্তা বলেছেন। অপরজন বলছেন, ঈসা তো আল্লাহর রূহ্ ও কালিমাহ্। অন্য আর একজন বলছেন, আদম (আ)-কে আল্লাহ বাছাই করে নিয়েছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের সম্মুখে আসেন এবং বলেন, আমি তোমাদের কথাবার্তা ও বিস্মিত হওয়ার কথা শুনতে পেয়েছি। ইবরাহীম (আ) আল্লাহর খলীল, তিনি তা-ই ছিলেন, মূসা (আ) আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন তিনিও তা-ই ছিলেন, ঈসা (আ) আল্লাহর রূহ ও কালিমাহ্ তিনি ঠিক তা-ই ছিলেন। আদম (আ)-কে আল্লাহ বাছাই করেছিলেন, এবং তিনি তেমনই ছিলেন। জেনে রেখ, আমি আল্লাহর হাবীব (পরম বন্ধু) এতে আমার কোন অহংকার নেই। জেনে রেখ, আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশই প্রথম শোনা হবে, এতে আমার কোন অহংকার নেই। আমিই সে ব্যক্তি যে সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজার কড়া নাড়বে। অতঃপর তা খুলে আমাকে ভিতরে প্রবেশ করানো হবে। তখন আমার সাথে থাকবে দরিদ্র মুমিনগণ; কিয়ামতের দিন প্রাথমিক যুগের ও শেষ যুগের সকল মানুষের মধ্যে সবচাইতে সম্মানিত আমিই, এতে আমার কোন অহংকার নেই। এই সনদে হাদীসটি ‘গরীব’ পর্যায়ের বটে। তবে অন্যান্য সনদে এর সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

হাকিম (র) তাঁর ‘মুসতাদরাকে’ ইবন আব্বাস (রা)-এর উক্তি উল্লেখ করেছেন। ইবন আব্বাস (রা) বলেছেনঃ তোমরা কি অস্বীকার করতে পারবে যে, খলীল হওয়ার সৌভাগ্য হযরত ইবরাহীম (আ)-এর। আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হযরত মূসা (আ)-এর এবং আল্লাহর দীদার লাভের সৌভাগ্য মুহাম্মদ (সা)-এর। ইব্ন আবু হাতিম (র) ইসহাক ইবন বাশশার (র) সূত্রে বর্ণনা করেন, আল্লাহ যখন ইবরাহীম (আ)-কে খলীলরূপে বরণ করে নেন, তখন তার অন্তরের মধ্যে ভীতি গেড়ে বসে, এমনকি পাখি যেমন আকাশে ওড়ার সময় ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ হয় তেমনি তাঁর অন্তর থেকে উৎপন্ন ভীতির আওয়াজ দূর থেকে শোনা যেত। উবায়দ ইবন উমায়র (রা) বলেন, ইবরাহীম (আ) সর্বদাই অতিথি আপ্যায়ন করতেন। একদিন তিনি অতিথির সন্ধানে ঘর থেকে বের হলেন। কিন্তু কোন অতিথি পেলেন না। অবশেষে ঘরে ফিরে এসে দেখেন একজন মানুষ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওহে আল্লাহর বান্দা! আমার বিনা অনুমতিতে কে তোমাকে আমার ঘরে প্রবেশ করাল? লোকটি বলল, এ ঘরের মালিকের অনুমতিক্রমেই আমি এতে প্রবেশ করেছি। ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পরিচয় কী? সে বলল, আমি রূহ কবজকারী মালাকুল মওত। আমাকে আমার প্রতিপালক তার এক বান্দার নিকট এই সু-সংবাদ দিয়ে প্রেরণ করেছেন যে, তাঁকে আল্লাহ খলীল রূপে গ্রহণ করেছেন। ইবরাহীম (আ) বললেন, সেই বান্দাটি কে? আল্লাহর কসম, এ সংবাদটি যদি আমাকে দিতে! তিনি কোন দূরতম এলাকায় অবস্থান করলেও আমি তাঁর নিকট যেতাম এবং আমৃত্যু সেখানেই অবস্থান করতাম। মালাকুল মওত বললেন— আপনিই হচ্ছেন সেই বান্দা। ইবরাহীম (আ) বললেন, আমি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনিই। ইবরাহীম (আ) বললেন, আল্লাহ আমাকে কি কারণে তাঁর খলীলরূপে গ্রহণ করলেন? তিনি জবাব দিলেন, কারণ এই যে, আপনি মানুষকে দান করেন, তাদের কাছে কিছু চান না। ইবন আবু হাতিম (র) এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ্ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর এই গুণের কথা উল্লেখ করে কুরআনের বহু স্থানে তার প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, কুরআনের পঁয়ত্রিশ জায়গায় এর উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে কেবল সূরা বাকারায় পনের জায়গায় তার উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ) সেই পাঁচজন উলুল-আযম (দৃঢ় প্রতিজ্ঞ) নবীর অন্যতম, নবীগণের মধ্যে যাদের নাম আল্লাহ তা’আলা কুরআনের দুইটি সূরায় অর্থাৎ সূরা আহযাব ও সূরা শূরায় বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আয়াত দু’টি হলোঃ

( وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۖ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا ) [Surat Al-Ahzab 7]

অর্থাৎ, স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা এবং ঈসা ইবন মারয়ামের নিকট থেকে। আমি তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার। (সূরা আহযাবঃ ৭)

আল্লাহর বাণীঃ

( شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ ۖ أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ ) [Surat Ash-Shura 13]

অর্থ, আল্লাহ তোমাদের জন্যে বিধিবদ্ধ করেছেন সেই দীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে, আর যা ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি তোমার নিকট এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এ কথা বলে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ কর না। (সূরা শূরাঃ ১৩)

উক্ত পাঁচজন উলুল আযম নবীদের মধ্যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পরেই হযরত ইবরাহীম (আ)-এর স্থান। (মি’রাজ রজনীতে) তিনি হযরত ইবরাহীম (আ)-কে সপ্তম আকাশের উপরে বায়তুল মা’মূরে হেলান দেয়া অবস্থায় দেখেছিলেন। যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদত করার জন্যে প্রবেশ করেন এবং আর কখনও দ্বিতীয়বার সেখানে প্রবেশের সুযোগ তাদের আসে না। আর শূরায়ক ইবন আবু নুমায়র হযরত আনাস (রা) সূত্রে মি’রাজ সম্পর্কের হাদীসে যে বর্ণনা করেছেন, ইবরাহীম (আ) ষষ্ঠ আকাশে এবং মূসা (আ) সপ্তম আকাশে ছিলেন, উক্ত হাদীসে রাবী শূরায়ক-এর ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ সমালোচনা করেছেন। সুতরাং প্রথম হাদীসই সঠিক ও বিশুদ্ধ।

ইমাম আহমদ (র) আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

ان الكريم بن الكريم بن الكريم يوسف بن يعقوب بن اسحاق بن ابرهيم خليل

অর্থ, একজন সম্মানিত পুত্র যার পিতাও ছিল সম্মানিত। তার পিতাও ছিল সম্মানিত এবং তার পিতাও ছিল সম্মানিত। এরা হল ইউসুফ, তার পিতা ইয়াকূব। তার পিতা ইসহাক এবং তার পিতা ইবরাহীম খলীল (আ)। ইমাম আহমদ (র) এ হাদীসটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন।

হযরত মূসা (আ) থেকে হযরত ইবরাহীম (আ) যে শ্রেষ্ঠ এ বিষয়টি নিম্নোক্ত হাদীসের দ্বারা প্রতীয়মান হয়। যেখানে বলা হয়েছেঃ

واخرت الثالثة ليوم ير غب الى الخلق كلهم حتى ابراهيم

অর্থাৎ তৃতীয় যে বৈশিষ্ট্যটি আমাকে দান করা হয়েছে তা সেইদিন দেয়া হবে, যেই দিন সমস্ত মানুষ আমার প্রতি আকৃষ্ট হবে, এমনকি ইবরাহীমও।

এ হাদীস ইমাম মুসলিম উবাই ইবন কা’ব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আর তাহল ‘মাকামে মাহমূদ’। রাসূল (সা) পূর্বেই তা জানিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, ‘কিয়ামতের দিন আমি হব বনী আদমের সর্দার এবং এতে আমার অহংকার নেই।’ ঐ হাদীসে এর পর বলা হয়েছে যে, মানুষ সুপারিশ পাওয়ার জন্যে আদম (আ)-এর কাছে যাবে, তারপর নূহ, তারপরে ইব্রাহীম, তারপরে মূসা ও তারপরে ঈসা (আ)-এর কাছে যাবে। প্রত্যেকেই সুপারিশ করতে অস্বীকার করবেন। সবশেষে মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে যাবে। তখন তিনি বলবেন, ‘আমিই এর যোগ্য। এটা আমারই কাজ।’ বুখারী শরীফে বিভিন্ন জায়গায় এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ ইবন উমর আল আমরী সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী (র) আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অধিক সম্মানিত মানুষ কে? রসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ অধিকতর মুত্তাকী ব্যক্তি। তারা বললেনঃ আমরা আপনাকে এ কথা জিজ্ঞেস করি নাই। পরে তিনি বললেন, তা হলে ইউসুফ; যিনি আল্লাহর নবী, তাঁর পিতাও আল্লাহর নবী, তাঁর পিতাও আল্লাহর নবী এবং তার পিতা আল্লাহর খলীল। সাহাবাগণ বললেনঃ আমরা এটাও জিজ্ঞেস করিনি। তিনি বললেন, তা হলে কি তোমরা আরবদের উৎসসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ? তবে শোনঃ জাহিলী যুগে যারা উত্তম ছিল, ইসলামী যুগেও তারাই উত্তম, যদি তারা ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন হয়। বুখারী, নাসাঈ ও আহমদ (র) বিভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (র) ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ হাশরের ময়দানে মানুষকে নগ্ন পায়ে, উলঙ্গ ও খাৎনাবিহীন অবস্থায় উঠানো হবে। সর্বপ্রথম ইবরাহীম (আ)-কে কাপড় পরান হবে। এরপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করেনঃ

كما بدأنا اول خلق نعيده

‘যে অবস্থায় আমি প্রথমে সৃষ্টি করেছি ঐ অবস্থায়ই পুনরায় উঠাব।’ (২১ আম্বিয়াঃ ১০৪)

ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) উভয়েই এ হাদীসটি ভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর এই বিশেষ ফযীলত ও সম্মানের কারণে তিনি ‘মাকামে মাহমূদের অধিকারীর’ তুলনায় অধিক সম্মানিত হয়ে যাননি। যে মাকামে মাহমূদের জন্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই ঈর্ষান্বিত হবেন।

ইমাম আহমদ (র) আনাস ইবন মালিক (রা) সূত্রে বর্ণনা করেনঃ এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-কে সম্বোধন করে বলল, يا خير البرية (হে সৃষ্টিকুলের সেরা!) রাসূল (সা) বললেন, তিনি হলেন হযরত ইব্রাহীম (আ)। ইমাম মুসলিমও এ হাদীসটি বিভিন্ন মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী (র) একে সহীহ ও হাসান বলেছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) এ কথাটি আপন পিতৃ-পুরুষ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সম্মানার্থে বিনয় প্রকাশ স্বরূপ বলেছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ অন্য নবীদের উপরে তোমরা আমাকে প্রাধান্য দিও না ( لا تفضلو ني علي )তিনি আরও বলেছেন তোমরা আমাকে মূসার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করো না। কারণ, কিয়ামতের দিন সকল মানুষ বেহুশ হয়ে পড়ে থাকবে। অতঃপর সর্বপ্রথম আমার হুঁশ ফিরে আসবে। কিন্তু আমি উঠে দেখতে পাব মূসা (আ) আল্লাহর আরশের স্তম্ভ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি না, মূসা (আ) কি আমার পূর্বেই হুঁশপ্রাপ্ত হবেন, না কি তূর পাহাড়ে বেহুশ হওয়ার বদলাম্বরূপ এ রকম করা হবে। এই সব বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও মুহাম্মদ (সা)-এর কিয়ামতের দিন বনী আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও সর্দার হওয়াতে কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। কেননা, মুতাওয়াতির সূত্রে একথা প্রমাণিত যে, কিয়ামতের দিন তিনিই হবেন سبد واد ادم তথা মানবকুল শ্রেষ্ঠ।

অনুরূপভাবে মুসলিম শরীফে উবাই ইবন কাব সূত্রে বর্ণিত হাদীস—‘আমাকে যে তিনটি বিশেষত্ব দান করা হয়েছে তার তৃতীয়টি সেদিন দেয়া হবে, যেদিন সকল মানুষ আমার প্রতি আকৃষ্ট হবে। এমনকি ইবরাহীমও।’ এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণিত হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পরেই হযরত ইবরাহীম (আ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও উলুল-আযম রাসূল প্রমাণিত হবার কারণে সালাতের মধ্যে তাশাহহুদে ইবরাহীম (আ)-এর উল্লেখ করতে মুসল্লীদেরকে আদেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন বুখারী ও মুসলিমে কা’ব ইবন আজুরা (রা) প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে। কা’ব বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার প্রতি সালাম তো আমরা জানি, কিন্তু আপনার প্রতি সালাত কীভাবে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তোমরা বলবেঃ

اللهم صل على محمد وعلى آل محمد كما صليت على ابراهیم وعلی آل ابراهيم وبارك على محمد وعلى آل محمد کما بارکت علی ابراهیم و على ال ابراهيم إنك حميد مجيد .

অর্থাৎ, (হে আল্লাহ! মুহাম্মদের প্রতি ও তাঁর পরিবার বর্গের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন যেমনি আপনি ইবরাহীমের উপর ও তাঁর পরিবারবর্গের উপরে রহমত বর্ষণ করেছিলেন। আর মুহাম্মদের প্রতি এবং তার পরিবারবর্গের প্রতি বরকত দান করুন। যেমনি আপনি ইব্রাহীমের উপর ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি বরকত দান করেছিলেন। আপনি অত্যধিক প্রশংসিত ও সম্মানিত)।

আল্লাহর বাণীঃ

وابرهيم الذىوفى

‘আর ইব্রাহীম তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছিল।’ অর্থাৎ তাঁকে যত প্রকার হুকুম করা হয়েছিল তিনি তার সবগুলোই পালন করেছিলেন। ঈমানের সমস্ত গুণাগুণ ও সকল শাখা-প্রশাখা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। কোন বড় ও জটিল সমস্যাই তাকে কোন ছোট হুকুম পালনে বাধা দিতে পারেনি এবং বড় ধরনের হুকুম পালনের ক্লান্তি তাকে ছোট ধরনের হুকুম পালনে বিরত রাখেনি। আবদুর রাযযাক (র) ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে নিম্নের আয়াত

وإذ ابتلى إبراهيم ربه بكلمات فاتمهن .

(স্মরণ কর, ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা নিলে তিনি সবগুলোই পূরণ করেন)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ আল্লাহ্ ইবরাহীমকে মাথা সংক্রান্ত পাঁচ প্রকার, পবিত্রতা এবং দেহের অবশিষ্ট অংশ সংক্রান্ত পাঁচ প্রকার পবিত্রতার হুকুম দ্বারা পরীক্ষা করেছেন। মাথার পাঁচ প্রকার এইঃ (১) গোঁফ কাটা (2) কুলি করা (৩) মিস্ওয়াক করা (৪) পানি দ্বারা নাক পরিষ্কার করা। (৫) মাথার চুলের সিঁথি কাটা। অবশিষ্ট শরীরের পাঁচ প্রকার হল (১) নখ কাটা (২) নাভীর নীচের পশম মুণ্ডন (৩) খাৎনা করা (৪) বগলের পশম উঠান (৫) পেশাব-পায়খানার পর পানি দ্বারা শৌচ করা। ইবন আবূ হাতিম এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আবদুর রাযযাক বলেন, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, মুজাহিদ, শা’বী, নখঈ, আবূ সালিহ্ ও আবুল জালদও অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ মানুষের স্বভাবগত পরিচ্ছন্নত পাঁচটি (১) খানা করা (২) ক্ষৌর কর্ম করা (৩) গোঁফ কাটা (৪) নখ কাটা (৫) বগলের পশম উঠান। সহীহ মুসলিম ও সুনান গ্রন্থাদিতে আয়েশা (রা) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, স্বভাবগত পরিচ্ছন্নতা দশটি (১) গোঁফ ছাঁটা (২) দাড়ি লম্বা হতে দেয়া (৩) মিসওয়াক করা (৪) পানি দ্বারা নাক পরিষ্কার করা (৫) নখ কাটা (৬) দেহের গ্রন্থি পানি দ্বারা ধোয়া (৭) বগলের পশম উঠান (৮) নাভীর নীচের অংশে ক্ষৌর করা। (৯) পানি দ্বারা ইসতিনজা করা (১০) খাৎনা করা। খাৎনার সময়ে তাঁর (ইব্রাহীম (আ)-এর) বয়স সম্পর্কে আলোচনা পরে আসছে। যাই হোক নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও একাগ্রতার সাথে ইবাদত-বন্দেগী হযরত ইবরাহীম (আ)-কে শরীরের যত্ন নেয়া, প্রত্যেক অসঙ্গে-প্রত্যঙ্গের হক আদায় করা, সৌন্দর্য রক্ষা করা এবং যে জিনিসগুলো ক্ষতিকর ছিল যথাঃ অধিক পরিমাণ চুল, বড় নখ, দাঁতের ময়লা ও দাগ দূর করা থেকে অমনোযোগী করে রাখত না। সুতরাং এ বিষয়গুলোও আল্লাহ্ কর্তৃক ইবরাহীমের প্রশংসা (ইব্রাহীম তার কর্তব্য বাস্তবায়ন করেছে)-এর অন্তর্ভুক্ত।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন