মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
ইবরাহীম (আ)-এর নসবনামা নিম্নরূপঃ ইবরাহীম ই তারাখ (২৫০) ইবন লাহুর (১৪৮) ইবন সারূগ (২৩০) ইবন রাউ (২৩৯) ইবন ফালিগ (৪৩৯) ইবন আবির (৪৬৪) ইবন শালিহ্ (৪৩৩) ইবন আরফাখশাদ (৪৩৮) ইবন সাম (৬০০) ইবন নূহ (আ)। আহলে কিতাবদের গ্রন্থে এভাবেই হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নসবনামার উল্লেখ করা হয়েছে। উপরে বন্ধনীর মধ্যে বয়স দেখান হয়েছে। হযরত নূহ (আ)-এর বয়স ইতিপূর্বে তার আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, তাই এখানে পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। হাফিজ ইবন আসাকির (র) তার ইতিহাস গ্রন্থে ইসহাক ইবন বিশর কাহিলীর ‘আল মাবদা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর মায়ের নাম ছিল উমায়লা। এরপর তিনি ইবরাহীম (আ)-এর জন্মের এক দীর্ঘ কাহিনীও লিখেছেন। ফালবী লিখেছেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর মায়ের নাম বূনা বিত কারবানা ইবন কুরছী। ইনি ছিলেন আরফাখশাদ ইবন সাম ইবন নূহের বংশধর।
ইবন আসাকির ইকরামা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর কুনিয়াত বা উপনাম ছিল আবুয যায়ফান( ابو الضيفان )। বর্ণনাকারিগণ বলেছেন, তারাখের বয়স যখন পঁচাত্তর বছর তখন তার ঔরসে ইবরাহীম, নাহুর ও হারান-এর জন্ম হয়। হারানের পুত্রের নাম ছিল লুত (আ)। বর্ণনাকারীদের মতে, ইবরাহীম ছিলেন তিন পুত্রের মধ্যে মধ্যম। হারান পিতার জীবদ্দশায় নিজ জন্মস্থান কালদান অর্থাৎ বাবেলে (ব্যাবিলনে) মৃত্যুবরণ করেন। ঐতিহাসিক ও জীবনীকারদের নিকট এই মতই প্রসিদ্ধ ও যথার্থ। ইবন আসাকির ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ) গুতায়ে দামেশকের৭৮ (সিরিয়ার একটি এলাকার নাম - যেখানে প্রচুর পানি ও বৃক্ষ বিদ্যমান।) বুরযা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা কাসিয়ুন পর্বতের সন্নিকটে অবস্থিত। অতঃপর ইবন আসাকির বলেন, সঠিক মত এই যে, তিনি বাবেলে জন্মগ্রহণ করেন। তবে গুতায়ে দামেশকে জন্ম হওয়ার কথা এ কারণে বলা হয় যে, হযরত লুত (আ)-কে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে যখন তিনি এখানে আগমন করেছিলেন, তখন তিনি সেখানে সালাত আদায় করেছিলেন। ইবরাহীম (আ) বিবি সারাহকে এবং নাহূর আপন ভাই হারানের কন্যা মালিকাকে বিবাহ করেন। সারাহ ছিলেন বন্ধ্যা। তার কোন সন্তান হত না। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, তারা নিজ পুত্র ইবরাহীম, ইবরাহীমের স্ত্রী সারাহ্ ও হারানের পুত্র লূতকে নিয়ে কাশদানীদের এলাকা থেকে কানআনীদের এলাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন। হারান নামক স্থানে তারা অবতরণ করেন। এখানেই তারাখের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল দু’শ পঞ্চাশ বছর। এই বর্ণনা থেকে প্রমাণ মেলে যে, ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম হারানে হয়নি; বরং কাশদানী জাতির ভূখণ্ডই তার জন্মস্থান। এ স্থানটি হল বাবেল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা। এরপর তারা সেখান থেকে কানআনীদের আবাসভূমির উদ্দেশে যাত্রা করেন। এটা হলো বায়তুল মুকাদ্দাসের এলাকা। তারপর তারা হারানে বসবাস আরম্ভ করেন। হারান হলো সেকালের কাশদানী জাতির আবাসভূমি। জাসীরা এবং শামও-এর অন্তর্ভুক্ত। এখানকার অধিবাসীরা সাতটি নক্ষত্রের পূজা করত। সেই জাতির লোকেরা দামেশক শহর নির্মাণ করেছিল। তারা এই দীনের অনুসারী ছিল। তারা উত্তর মেরুর দিকে মুখ করে বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপ বা মন্ত্রের দ্বারা সাতটি তারকার পূজা করত। এই কারণেই প্রাচীন দামেশকের সাতটি প্রবেশ দ্বারের প্রতিটিতে উক্ত সাত তারকার এক একটি তারকার বিশাল মূর্তি স্থাপিত ছিল। এদের নামে তারা বিভিন্ন পর্ব ও উৎসব পালন করত। হারানের অধিবাসীরাও নক্ষত্র ও মূর্তি পূজা করত। মোটকথা, সে সময় ভূ-পৃষ্ঠের উপর যত লোক ছিল তাদের মধ্য থেকে শুধু ইবরাহীম খলীল (আ), তার স্ত্রী (সারা) ও ভাতিজা লূত (আ) ব্যতীত সবাই ছিল কাফির। আল্লাহ তা’আলা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দ্বারা সেসব দুষ্কৃতি ও ভ্রান্তি বিদূরিত করেন। কেননা, আল্লাহ তাঁকে বাল্যকালেই সঠিক পথের সন্ধান দেন। রাসূল হওয়ার গৌরব দান করেন এবং বৃদ্ধ বয়সে খলীল বা বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন। আল্লাহর বাণীঃ
অর্থাৎ, স্মরণ কর ইবরাহীমের কথা, সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর; তোমাদের জন্যে এটাই শ্রেয়, যদি তোমরা জানতে। তোমরা তো আল্লাহ ব্যতীত কেবল মূর্তি পূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ; তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের পূজা কর তারা তোমাদের জীবনোপকরণের মালিক নয়। সুতরাং তোমরা জীবনোপকরণ কামনা কর আল্লাহর নিকট এবং তারই ইবাদত কর ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তোমরা তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে। তোমরা যদি আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন কর তবে জেনে রেখ, তোমাদের পূর্ববর্তীগণও নবীগণকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করেছিল। বস্তুত সুস্পষ্টভাবে প্রচার করে দেয়া ব্যতীত রাসূলের আর কোন দায়িত্ব নেই। ওরা কি লক্ষ্য করে না, কিভাবে আল্লাহ সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করেন, তারপর তা পুনরায় সৃষ্টি করেন? এটা তো আল্লাহর জন্যে সহজ।
বল, পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং অনুধাবন কর, কিভাবে তিনি সৃষ্টি আরম্ভ করেছেন। তারপর আল্লাহ সৃষ্টি করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। তোমরা তারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে। তোমরা আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারবে না পৃথিবীতে অথবা আকাশে এবং আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই, সাহায্যকারীও নেই। যারা আল্লাহর নিদর্শন ও তাঁর সাক্ষাৎ অস্বীকার করে, তারাই আমার অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়, তাদের জন্যে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
উত্তরে ইবরাহীমের সম্প্রদায় শুধু এই বলল, তাকে হত্যা কর অথবা আগুনে পুড়িয়ে দাও। কিন্তু আল্লাহ তাকে অগ্নি থেকে রক্ষা করলেন। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য। ইবরাহীম বলল, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিগুলোকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করছ; পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের খাতিরে। পরে কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং পরস্পরকে অভিসম্পাত দিবে। তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। লূত তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করল। ইবরাহীম বলল, 'আমি আমার প্রতিপালকের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করছি। তিনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আমি ইবরাহীমকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকুব এবং তার বংশধরদের জন্যে স্থির করলাম নবুওত ও কিতাব এবং আমি তাকে দুনিয়ায় পুরস্কৃত করেছিলাম; আখিরাতেও সে নিশ্চয় সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম হবে। (সূরা আনকাবুতঃ ১৬-২৭)
তারপর আল্লাহ ইবরাহীম (আ)-এর সাথে তাঁর পিতার এবং সম্প্রদায়ের লোকদের বিতর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। পরে আমরা ইনশাআল্লাহ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। হযরত ইবরাহীম (আ) সর্ব প্রথম আপন পিতাকে ঈমানের দাওয়াত দেন। তার পিতা ছিল মূর্তিপূজারী। কাজেই কল্যাণের দিকে আহ্বান পাওয়ার অধিকার তারই সবচাইতে বেশি। আল্লাহ বলেনঃ
অর্থাৎ, স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহীমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ নবী। যখন সে তার পিতাকে বলল, হে পিতা! তুমি কেন তার ইবাদত কর যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজেই আসে না? হে আমার পিতা! আমার নিকট তো এসেছে জ্ঞান, যা তোমার নিকট আসেনি; সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাব। হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত কর না। শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি, তোমাকে দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করবে এবং তুমি শয়তানের বন্ধু হয়ে পড়বে।
পিতা বলল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হতে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণনাশ করবই। তুমি চিরদিনের জন্যে আমার নিকট হতে দূর হয়ে যাও!' ইবরাহীম বলল, তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করব, তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। আমি তোমাদের হতে ও তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত কর তাদের হতে পৃথক হচ্ছি। আমি আমার প্রতিপালককে আহ্বান করি, আশা করি আমার প্রতিপালককে আহ্বান করে আমি ব্যর্থকাম হব না। (সূরা মারইয়ামঃ ৪১-৪৮)
এখানে আল্লাহ ইবরাহীম (আ) ও তাঁর পিতার মধ্যে যে কথোপকথন ও বিতর্ক হয়েছিল তা উল্লেখ করেছেন। সত্যের দিকে পিতাকে যে কোমল ভাষায় ও উত্তম ভঙ্গিতে আহ্বান করেছেন তা এখানে সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে। তিনি পিতার মূর্তি পূজার অসারতা তুলে ধরেছেন এভাবে যে, এগুলো তাদের উপাসনাকারীদের ডাক শুনতে পায় না, তাদের অবস্থানও দেখতে পায় না; তা হলে কিভাবে এরা উপাসকদের উপকার করবে? কিভাবে তাদের খাদ্য ও সাহায্য দান করে, তাদের কল্যাণ করবে? তারপর আল্লাহ তাকে যে হিদায়াত ও উপকারী জ্ঞান দান করছেন তার ভিত্তিতে পিতাকে সতর্ক করে দেন, যদিও বয়সে তিনি পিতার চেয়ে ছোট।
অর্থাৎ, হে আমার পিতা! আমার কাছে জ্ঞান এসেছে যা তোমার নিকট আসেনি; সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাব। অর্থাৎ এমন পথ যা অতি সুদৃঢ়, সহজ ও সরল। যে পথ অবলম্বন করলে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাকে কল্যাণের পথে নিয়ে যাবে। ইবরাহীম (আ) যখন পিতার নিকট এই সত্য পথ ও উপদেশ পেশ করলেন, তখন পিতা তা গ্রহণ করল না, বরং উল্টো তাকে ধমকাল ও ভয় দেখাল। সে বললঃ
অর্থাৎ, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী থেকে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও, তবে আমি পাথরের আঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করবোই।' কেউ কেউ বলেন, মৌখিকভাবে আবার কেউ কেউ বলেন, বাস্তবেই পাথর মারব। واهجرني مليا (চিরতরের জন্যে দূর হয়ে যাও) অর্থাৎ আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দীর্ঘকালের জন্যে চলে যাও। ইবরাহীম (আ) তখন বলেছিলেনঃ سلام عليك (তোমার প্রতি সালাম) অর্থাৎ আমার পক্ষ থেকে কোন রকম কষ্টদায়ক ব্যবহার তুমি পাবে না। আমার তরফ থেকে তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। ইবরাহীম অতিরিক্ত আরও বললেনঃ
(আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল)। ইব্ন আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেছেনঃ حفيا অর্থ لطيفا অর্থাৎ দয়ালু। কেননা তিনি আমাকে সত্য পথের সন্ধান দিয়েছেন। একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করার তওফীক দিয়েছেন। একারণেই তিনি বললেনঃ
(আমি তোমাদেরকে পরিত্যাগ করছি এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের তোমরা পূজা করছ তাদেরও পরিত্যাগ করছি। আমি কেবল আমার পালনকর্তাকেই আহ্বান করি। আশা করি, আমার প্রতিপালককে আহ্বান করে আমি ব্যর্থকাম হব না। এই ওয়াদা অনুযায়ী ইবরাহীম পিতার জন্যে সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। পরে যখন জানলেন যে, তাঁর পিতা আল্লাহর দুশমন; তখন তিনি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
অর্থাৎ, ইবরাহীম তার পিতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, তাকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে; অতঃপর যখন এটা তার নিকট সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন ইবরাহীম তার সম্পর্ক ছিন্ন করল। ইবরাহীম তো কোমল হৃদয় ও সহনশীল। (সূরা তাওবাঃ ১১৪)
ইমাম বুখারী (র) আবূ হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আ)-এর সাথে তাঁর পিতা আযরের সাক্ষাৎ হবে। আযরের চেহারা মলিন ও কালিমালিপ্ত দেখে ইবরাহীম (আ) বলবেন, আমি কি আপনাকে দুনিয়ায় বলিনি যে, আমার অবাধ্য হবেন না? পিতা বলবে, আজ আর আমি তোমার অবাধ্য হব না। তখন ইবরাহীম (আ) বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, পুনরুত্থান দিবসে আমাকে লাঞ্ছিত করবেন না। কিন্তু আমার পিতা যেখানে আপনার দয়া ও ক্ষমা থেকে দূরে থাকছে, সেখানে এর চেয়ে অধিক লাঞ্ছনা আর কি হতে পারে? আল্লাহ বলবেন, আমি কাফিরদের উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। তারপর বলা হবেঃ হে ইবরাহীম! তোমার পায়ের নিচে কি? নিচের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখবেন, একটি জবাইকৃত পশু রক্তাপ্লুত অবস্থায় পড়ে আছে। তারপর পশুটির পাগুলি ধরে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
ইমাম বুখারী (র) কিতাবুত তাফসীরে ভিন্ন সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম নাসাঈও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বাযযার (র) এটা আবূ হুরায়রা (রা) ও আবূ সাঈদ (রা) থেকে বর্ণনা করছেন— এসব বর্ণনায় ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর বলে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ
অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেন? আমি আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি। (সূরা আনআমঃ ৭৪)
কুরআনের উক্ত আয়াত ও বর্ণিত হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম আযর। কিন্তু অধিকাংশ বংশবিদদের মতে—যাদের মধ্যে ইবন আব্বাস (রা)-ও আছেন, ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম তারাখ। আহলি কিতাবদের মতে, তারাখ একটি মূর্তির নাম। ইবরাহীম (আ)-এর পিতা এর পূজা করত এবং এরই নামানুসারে তাকে তারাখ উপাধি দেয়া হয়। কিন্তু প্রকৃত নাম আযর। ইবন জারীর লিখেছেনঃ সঠিক কথা এই যে, আযর তার প্রকৃত নাম; অথবা আযর ও তারাখ দুটোই তার আসল নাম; কিংবা যে কোন একটা উপাধি এবং অপরটা নাম। ইবনে জারীরের এ বক্তব্যটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আল্লাহই অধিকতর জ্ঞাত। আল্লাহর বাণীঃ
অর্থাৎ, এভাবে ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থা দেখাই, আর যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল, তখন সে নক্ষত্র দেখে বলল, ‘এই তো আমার প্রতিপালক,’ এরপর যখন উহা অস্তমিত হল তখন সে বলল, ‘যা অস্তমিত হয় তা আমি পছন্দ করি না।’ তারপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখল, তখন সে বলল, ‘এই তো আমার প্রতিপালক,’ যখন এটাও অস্তমিত হল তখন সে বলল, ‘আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ তারপর যখন সে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হতে দেখল তখন সে বলল, ‘এটাই আমার প্রতিপালক - এটিই সর্ববৃহৎ,’ যখন এটাও অস্তমিত হল তখন সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর তার সাথে আমার কোন সংশ্রব নেই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’
তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হল। সে বলল, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। আমার প্রতিপালক অন্যরূপ ইচ্ছা না করলে তোমরা যাকে তার শরীক কর তাকে আমি ভয় করি না, সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ত। তবে কি তোমরা অনুধাবন করবে না? তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর আমি তাকে কিরূপে ভয় করব? অথচ তোমরা আল্লাহর শরীক করতে ভয় কর না, যে বিষয়ে তিনি তোমাদেরকে কোন সনদ দেননি; সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল, দু’দলের মধ্যে কোন দল নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদের জন্যে, তারাই সৎপথ প্রাপ্ত। এবং এই হচ্ছে আমার যুক্তি-প্রমাণ যা ইবরাহীমকে দিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের মুকাবিলায়; যাকে ইচ্ছা মর্যাদায় আমি উন্নীত করি; তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানী। (সূরা আন'আমঃ ৭৫-৮৩)
এখানে ইবরাহীম (আ) ও তার সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্ট বিতর্কের কথা বলা হয়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এসব উজ্জ্বল নক্ষত্র মূলত জড় পদার্থ - যা কখনো উপাস্য হতে পারে না। আর আল্লাহর সাথে শরীক করে এগুলোর পূজাও করা যেতে পারে না। কেননা, এটা সৃষ্ট, প্রতিপালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এরা উদিত হয় ও অস্ত যায় এবং অদৃশ্যও হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, মহান প্রতিপালক আল্লাহ, যার থেকে কোন কিছুই অদৃশ্য হতে পারে না। কিছুই তার দৃষ্টি থেকে গোপন থাকতে পারে না। বরং তিনি সর্বদা, সর্বত্র বিদ্যমান। তার কোন ক্ষয় ও পতন নেই। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কোন প্রতিপালক নেই। এভাবে ইবরাহীম (আ) সর্বপ্রথম নক্ষত্রের ইলাহ হওয়ার অযোগ্যতা বর্ণনা করেন। কারো কারো মতে, এখানে নক্ষত্র বলতে যোহরা সেতারা তথা শুক্র গ্রহকে বুঝানো হয়েছে-যা অন্য সকল নক্ষত্রের চেয়ে অধিক উজ্জ্বল হয়। এ কারণেই পরবর্তীতে তিনি আরও অগ্রসর হয়ে চন্দ্রের উল্লেখ করেন—যা নক্ষত্রের চেয়ে অধিক উজ্জ্বল ও ঝলমলে। এর পর আরও উপরের দিকে লক্ষ্য করে সূর্যের উল্লেখ করেন, যার অবয়ব সর্ব বৃহৎ এবং যার উজ্জ্বলতা ও আলোক বিকিরণ তীব্রতর। এভাবে ইবরাহীম (আ) স্পষ্টভাবে বুঝালেন যে, সূর্যও নিয়ন্ত্রিত ও অধীনস্থ- অন্যের নির্দেশ পালনে বাধ্য। আল্লাহর বাণীঃ
অর্থাৎ, তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না; চন্দ্রকেও নয়, বরং সিজদা কর সেই আল্লাহকে—যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবল তার ইবাদত কর। (সূরা হা-মীম আসসাজদাঃ ৩৭)
অর্থাৎ, আমার প্রতিপালক অন্যরূপ ইচ্ছা না করলে তোমরা যাকে তাঁর শরীক কর তাকে আমি ভয় করি না অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদত তোমরা কর তাদের কোন পরোয়া আমি করি না। কেননা ওরা না পারে কোন উপকার করতে, না পারে কিছু শুনতে আর না পারে কিছু অনুধাবন করতে। বরং এরা হয় প্রতিপালিত ও নিয়ন্ত্রিত যেমন নক্ষত্র ইত্যাদি। না হয় নিজেদেরই হাতের তৈরি ও খোদাইকৃত।
নক্ষত্র সম্পর্কে ইবরাহীম (আ)-এর উপরোক্ত উপদেশ বাণী থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, এ সব কথা তিনি হারানের অধিবাসীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন। কেননা, তারা নক্ষত্রের পূজা করত। এর দ্বারা ইবন ইসহাক (র) প্রমুখ যাঁরা মনে করেন যে, ইবরাহীম (আ) এ কথা তখন বলেছিলেন; যখন তিনি বাল্যকালে গুহা থেকে বের হয়ে আসেন। এতে তাদের অভিমত খণ্ডন হয়ে যায়। এই মত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে নেয়া হয়েছে। যার কোন নির্ভরযোগ্যতা নেই। বিশেষ করে যখন তা সঠিক বর্ণনার পরিপন্থী হয়। অপরদিকে বাবেলবাসীরা ছিল মূর্তিপূজক। ইবরাহীম (আ) তাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হন। মূর্তি ভাঙ্গেন, অপদস্ত করেন এবং সেগুলোর অসারতা বর্ণনা করেন।
অর্থাৎ, ইবরাহীম বলল, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছো, পার্থিব জীবনে তোমাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের খাতিরে; পরে কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং পরস্পরকে অভিসম্পাত দিবে। তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। (সূরা আনকাবূতঃ ২৫)
অর্থাৎ, আমি তো এর পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত। যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলল, এই মূর্তিগুলো কী, যাদের পূজায় তোমরা রত রয়েছ? ওরা বলল, আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষগণকে এগুলোর পূজা করতে দেখেছি। সে বলল, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃ-পুরুষগণও রয়েছে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। ওরা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য এনেছ, নাকি তুমি কৌতুক করছ? সে বলল, না তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি ওদের সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী।
শপথ আল্লাহর, তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলো সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করব।’ তারপর সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল ওদের প্রধানটি ব্যতীত; যাতে তারা ওর দিকে ফিরে আসে। তারা বলল, আমাদের উপাস্যদের প্রতি এরূপ করল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী। কেউ কেউ বলল, এক যুবককে ওদের সমালোচনা করতে শুনেছি; তাকে বলা হয় ইবরাহীম। ওরা বলল, তাকে উপস্থিত কর লোকজনের সম্মুখে, যাতে তারা সাক্ষ্য দিতে পারে। তারা বলল, হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের প্রতি এরূপ করেছ? সে বলল, সে-ই তো এটা করেছে, এ-ই তো এগুলোর প্রধান। এ গুলোকে জিজ্ঞেস কর। যদি এগুলো কথা বলতে পারে। তখন ওরা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল, তোমরাই তো সীমালংঘনকারী?
অতপর ওদের মস্তক অবনত হয়ে গেল এবং ওরা বলল, তুমি তো জানই যে, এরা কথা বলে না। ইবরাহীম বলল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক্ তোমাদেরকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদেরকে। তবে কি তোমরা বুঝবে না? ওরা বলল, একে পুড়িয়ে দাও, সাহায্য কর তোমাদের দেবতাগুলোকে, তোমরা যদি কিছু করতে চাও। আমি বললাম, হে আগুন তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। ওরা তার ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু আমি তাদেরকে করে দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আম্বিয়াঃ ৫১-৭০)
অর্থাৎ, ওদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে যখন তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমরা কিসের ইবাদত কর? ওরা বলল, আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে ওদের পূজায় নিরত থাকব। সে বলল, তোমরা প্রার্থনা করলে ওরা কি শোনে?
অথবা ওরা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে? ওরা বলল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছি।
সে বলল, তোমরা কি তার সম্বন্ধে ভেবে দেখেছ যার পূজা করছ—তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃ-পুরুষরা? ওরা সকলেই আমার শত্রু, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয়। এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন; এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন, তারপর পুনর্জীবিত করবেন। এবং আশা করি, তিনি কিয়ামত দিবসে আমার অপরাধসমূহ মার্জনা করে দেবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞান দান কর এবং সকর্মপরায়ণদের শামিল কর। (সূরা শুআরাঃ ৬৯-৮৩)
অর্থাৎ, ইবরাহীম তো তার অনুগামীদের অন্তর্ভুক্ত। স্মরণ কর, সে তার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত হয়েছিল বিশুদ্ধচিত্তে। যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কেও জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা কিসের পূজা করছ? তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক ইলাহগুলোকে চাও? জগতসমূহের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কী? তারপর সে তারকারাজির দিকে একবার তাকাল এবং বলল, আমি অসুস্থ। অতঃপর ওরা তাকে পশ্চাতে রেখে চলে গেল। পরে সে সন্তর্পণে ওদের দেবতাগুলোর নিকট গেল। এবং বলল, তোমরা খাদ্য গ্রহণ করছ না কেন? তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা কথা বলনা? তখন সে তাদের উপর সবলে আঘাত হানল। তখন ঐ লোকগুলো তার দিকে ছুটে আসলো। সে বলল, তোমরা নিজেরা যাদেরকে খোদাই করে নির্মাণ কর, তোমরা কি তাদেরই পূজা কর? প্রকৃত পক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমরা যা তৈরি কর তাও। ওরা বলল, এর জন্যে এক ইমারত তৈরি কর, তারপর একে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ কর। ওরা তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের সংকল্প করেছিল; কিন্তু আমি ওদেরকে অতিশয় হেয় করে দিলাম। (সূরা সাফফাতঃ ৮৩-৯৮)
এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা জানিয়ে দেন যে, ইবরাহীম (আ) তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের মূর্তি পূজার সমালোচনা করেন এবং তাদের কাছে ওগুলোর অসারতা ও অক্ষমতার কথা তুলে ধরেন।
(এই মূর্তিগুলো কি? যাদের পূজায় তোমরা রত রয়েছ) অর্থাৎ এদের নিকট নিষ্ঠার সাথে বসে থাক ও কাতর হয়ে থাক। তারা উত্তর দিলঃ وخدنا اباءنا له عابدين (আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে এদের পূজারীরূপে পেয়েছি।) তাদের যুক্তি এই একটাই যে, তাদের বাপ-দাদারা এরূপ দেবদেবীর পূজা-অর্চনা করতো।
অর্থাৎ, যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা কিসের পূজা করছ? তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক ইলাহগুলোকে চাও? তা হলে জগতসমূহের প্রতিপালক সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি?
কাতাদা এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যখন তোমরা অন্যদের ইবাদত করছ, তখন যেদিন তার সাথে সাক্ষাৎ হবে সেদিন তিনি তোমাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করবেন বলে মনে কর?
অর্থাৎ, তোমরা প্রার্থনা করলে ওরা কি শুনে? অথবা ওরা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে? ওরা বলল, না তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপই করতে দেখেছি। (সূরা শু'আরাঃ ৭২-৭৪)
তারা স্বীকার করে নেয় যে, আহবানকারীর ডাক ওরা শোনে না, কারও কোন উপকারও করতে পারে না। অপকারও করতে পারে না। তারা এরূপ করছে কেবল তাদের মূর্খ পূর্ব-পুরুষদের অন্ধ আনুগত্য হিসেবে। এ জন্যেই তিনি তাদেরকে বলে দেন যেঃ
অর্থাৎ, তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ যাদের পূজা করে আসছ তোমরা ও তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃ-পুরুষেরা; কেননা রাব্বুল আলামীন ব্যতীত তারা সবাই আমার দুশমন। (সূরা শু'আরাঃ ৭৫-৭৭)
তারা মূর্তির উপাস্য হওয়ার যে দাবি করত তা যে বাতিল ও ভ্রান্ত, উল্লিখিত আয়াতসমূহে তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। কেননা, হযরত ইবরাহীম (আ) ওগুলোকে পরিত্যাগ করেন ও হেয়প্রতিপন্ন করেন। এতে যদি তাদের ক্ষমতা থাকত ক্ষতি করার তা হলে অবশ্যই তারা তাঁর ক্ষতি করত। অথবা যদি আদৌ কোন প্রভাবের অধিকারী হত, তবে অবশ্যই তার উপর সে ধরনের প্রভাব ফেলত।
(তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্যসহ আগমন করেছ, না কি তুমি কৌতুক করছ?) অর্থাৎ তারা বলেছে যে, হে ইবরাহীম! তুমি আমাদের নিকট যা কিছু বলছো, আমাদের উপাস্যদেরকে তিরস্কার করছ এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের সমালোচনা করছো এ সব কি তুমি সত্যি সত্যিই বলছ, নাকি কৌতুক করছ?
(সে বলল, না তোমাদের প্রতিপালক তো তিনি, যিনি আসমান ও যমীনের প্রতিপালক, যিনি এগুলো সৃজন করেছেন; এবং আমিই এর উপর অন্যতম সাক্ষী।) অর্থাৎ আমি তোমাদের নিকট যা কিছু বলছি, সবই সত্য ও যথার্থ বলছি। বস্তুত তোমাদের উপাস্য সেই একজনই, যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি তোমাদের প্রতিপালক এবং আসমান-যমীনেরও প্রতিপালক। পূর্ব-দৃষ্টান্ত ছাড়াই তিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ইবাদতের যোগ্য একমাত্র তিনিই, তার কোন শরীক নেই; এবং আমি নিজেই এর উপর সাক্ষী।
অর্থাৎ, আল্লাহর কসম, তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলো সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করব (সূরা আম্বিয়াঃ ৫৫-৫৭)। অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম (আ) এ মর্মে প্রতিজ্ঞা করেন যে, লোকজন মেলায় চলে যাওয়ার পর তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কারো কারো মতে, ইবরাহীম (আ) এ কথা মনে মনে বলেছিলেন। ইবন মাসউদ (রা) বলেছেন যে, তাদের মধ্যে কয়েকজন ইবরাহীম (আ)-এর এ কথাটি শুনে ফেলেছিল। ইবরাহীম (আ)-এর সম্প্রদায়ের লোকজন শহরের উপকণ্ঠে তাদের একটি নির্ধারিত বার্ষিক মেলায় মিলিত হতো। ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তাঁকে মেলায় যাওয়ার জন্যে আহ্বান জানালে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি পীড়িত’। আল্লাহ বলেনঃ
(সে নক্ষত্রের দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, আমি পীড়িত) তিনি কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললেন। যাতে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় আর তা হলো তাদের মূর্তিসমূহকে হেয়প্রতিপন্ন করা। মূর্তিপূজা খণ্ডনের ব্যাপারে আল্লাহর সত্য দীনের সাহায্য করা। আর ধ্বংস ও চরম লাঞ্ছনাই ছিল মূর্তিগুলোর যথার্থ পাওনা। এরপর সম্প্রদায়ের লোকজন যখন মেলায় চলে যায় এবং ইবরাহীম (আ) শহরেই থেকে যান তখন راغ الي الهتهم অর্থাৎ তিনি চুপিসারে দ্রুতপদে দেবতাদের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি দেখতে পান যে, মূর্তিগুলো একটি বিরাট প্রকোষ্ঠের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের সম্মুখে বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য নৈবেদ্যরূপে রাখা আছে। এ দেখে তিনি উপহাস ছলে বললেনঃ
لا تأكلون - مالكم لا تثطون . فراغ عليهم ضربا باليمين .
(তোমরা খাচ্ছ না কেন? কি হল তোমাদের, কথা বলছ না কেন? তারপর সে তাদের উপর তার ডান হাত দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানল।) কেননা, ডান হাতই অধিকতর শক্তিশালী ও দ্রুত ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। তাই তিনি নিজ হাতের কুঠারের প্রচণ্ড আঘাতে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন فجعلهم جذاذا (ইবরাহীম মূর্তিগুলোকে টুকরো টুকরো করে দিল) অর্থাৎ সবগুলোকে তিনি ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন ,
(তাদের মধ্যে বড়টা ব্যতীত, যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে।) কেউ কেউ বলেছেনঃ ইবরাহীম (আ) তাঁর কুঠারখানা বড় মূর্তির হাতে ঝুলিয়ে রেখে দেন। এতে এই ইঙ্গিত ছিল যে; তারা যেন মনে করে যে, তার সাথে ছোট মূর্তিগুলো পূজিত হওয়ার কারণে ওটাই ছোটগুলোর উপর ঈর্ষা বশত আক্রমণ করেছে। তারপর মেলা থেকে ফিরে এসে লোকজন তাদের উপাস্যদের এ অবস্থা যখন দেখলঃ
(তখন তারা বলল, আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ আচরণ কে করল? নিশ্চয়ই সে একজন সীমালংঘনকারী।) এ কথার মধ্যে তাদের জন্য সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল, যদি তারা বুঝতে চেষ্টা করত! কেননা, তারা যে সব দেব-দেবীর উপাসনা করে, তারা যদি সত্যি উপাস্য হত, তা হলে যে তাদেরকে আক্রমণ করেছে তাকে তারা প্রতিহত করত। কিন্তু নিজেদের মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা ও চরম পথভ্রষ্টতার কারণে তারা বললঃ
(আমাদের উপাস্যদের সাথে এ আচরণ করল কে? নিশ্চয়ই সে এক জালিম। তাদের কতিপয় লোক বলল, আমরা এক যুবককে এদের বিষয়ে আলোচনা করতে শুনেছি, তাকে ইবরাহীম বলা হয়।) অর্থাৎ সে এদের দোষ-ক্রটি বর্ণনা করত, এদের নিয়ে সমালোচনা করত। সুতরাং সে-ই এসে এদেরকে ভেঙ্গেছে। ইবন মাসউদ (রা) বলেছেন يذكرهم (সে এদের আলোচনা করত) দ্বারা ইবরাহীম (আ) ইতিপূর্বের কথা বলাই উদ্দেশ্য; অর্থাৎ -
(তারা বলল, তাকে জনসমক্ষে উপস্থিত কর, যাতে তারা দেখতে পারে) অর্থাৎ উপস্থিত জনতার মাঝে নেতৃবৃন্দের সম্মুখে তাকে হাযির কর; যাতে জনগণ তার বক্তব্য প্রদানকালে উপস্থিত থাকে এবং তার কথাবার্তা শুনতে পারে। এবং তাকে বদস্বরূপ যে শাস্তি দেওয়া হবে তা প্রত্যক্ষ করতে পারে। এটাই ছিল হযরত ইবরাহীম খলীলের প্রধানতম উদ্দেশ্য যে, সকল মানুষ উপস্থিত হলে তিনি সমস্ত মূর্তি পূজারীর সম্মুখে তাদের ধর্ম-কর্মের ভ্রান্তির প্রমাণ পেশ করবেন। যেমনটি মূসা (আ)-ও ফিরআউনকে বলেছিলেনঃ
তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেই দিন পূর্বাহ্ণে লোকজনকে সমবেত করা হবে। (সূরা তা-হাঃ ৫৯) তারপর যখন লোকজন জমায়েত হলো এবং ইবরাহীম (আ)-কে সেখানে হাযির করা হল, তখন তারা বললঃ
(হে ইবরাহীম! আমাদের দেব-দেবীর সাথে এই কাণ্ড কি তুমিই ঘটিয়েছ? সে বলল, এদের এই বড়টাই বরং এ কাজটি করেছে। কেউ কেউ এ আয়াতের অর্থ করেছেন এভাবে—এটি আমাকে এগুলো ভাঙ্গার ব্যাপারে উহুদ্ধ করেছে; অবশ্য কথাটাকে তিনি একটু ঘুরিয়ে বলেছেনঃ
( فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ )
[Surat Al-Anbiya' 63]
(ওদের কাছেই জিজ্ঞেস কর যদি ওরা কথা বলতে পারে) ইবরাহীম (আ) এ কথার দ্বারা এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, ওরা যেন দ্রুত এই কথা বলে যে, এরা তো কথা বলতে পারে না। ফলত তারা স্বীকার করে নিবে যে, অন্যান্য জড়বস্তুর ন্যায় এগুলোও নিছক জড়বস্তু।
(অতঃপর তারা মনে মনে চিন্তা করল এবং বলল; তোমরাই তো জালিম) অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে তিরস্কার ও ধিক্কার দিয়ে বলল, জালিম তো তোমরা নিজেরাই; এদেরকে তোমরা এমনিই ছেড়ে চলে গেলে, কোন পাহারাদার ও হিফাজতকারী রেখে গেলে না।
( ثُمَّ نُكِسُوا عَلَىٰ رُءُوسِهِمْ )
[Surat Al-Anbiya' 65]
(তারপর তারা মাথা নত করে ঝুঁকে গেল) সুদূদী (র)-এর অর্থ করেছেন, তারা ফিতনা ফ্যাসাদের দিকে ফিরে গেল। এ অর্থ অনুযায়ী উপরের ‘তোমরাই জালিম,
( إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّالِمُونَ )
[Surat Al-Anbiya' 64]
এর অর্থ তোমরা এদের ইবাদত করার কারণে জালিম পদবাচ্য। কাতাদা (র) বলেছেন, ইবরাহীম (আ)-এর কথায় তারা অত্যধিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। ফলে তাদের মাথা নত হয়ে যায়। তারপর তারা বললঃ
( لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَٰؤُلَاءِ يَنْطِقُونَ )
[Surat Al-Anbiya' 65]
(তুমি তো জানই যে, এগুলো কথা বলে না) অর্থাৎ হে ইবরাহীম! তোমার তো জানা আছে যে, এরা কথা বলে না। সুতরাং এদের নিকট জিজ্ঞেস করার জন্যে তুমি কেন বলছ? এ সময় ইবরাহীম খলীল তাদের উদ্দেশ করে বলেনঃ
(তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন সব বস্তুর পূজা কর, যা না তোমাদের কোন উপকার করতে পারে; না কোন ক্ষতি করতে পারে? ধিক তোমাদের জন্যে এবং তোমাদের উপাস্যদের জন্যে যাদেরকে তোমরা পূজা কর আল্লাহ ব্যতীত। তোমরা কি মোটেই জ্ঞান খাটাও না?)
( فَأَقْبَلُوا إِلَيْهِ يَزِفُّونَ )
[Surat As-Saaffat 94]
(তারপর তারা ইবরাহীমের দিকে তেড়ে আসলো।) মুজাহিদ বলেছেন, يزفون অর্থ يسرعون (দ্রুত ধেয়ে যাওয়া)।
( أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ )
[Surat As-Saaffat 95]
(তোমরা কি সেই সব দেবতাদের পূজা কর যেগুলো তোমরা নিজেরাই খোদাই করে তৈরি কর?) অর্থাৎ তোমরা কিভাবে এমন সব মূর্তির পূজা কর, যেগুলো তোমরা স্বহস্তে কাঠ অথবা পাথর খোদাই করে নির্মাণ করে থাকো এবং নিজেদের ইচ্ছামত আকৃতি দান কর।
( وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ )
[Surat As-Saaffat 96]
(অথচ আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন যাদেরকে তোমরা তৈরি করে থাক) ما অক্ষরটি مصدريه ও হতে পারে; আবার موصوله -ও হতে পারে। যেটাই হোক, এখানে যেকথা বলা উদ্দেশ্য তা হল এই যে, তোমরাও সৃষ্টি আর এই মূর্তিগুলোও সৃষ্টি। এখন একটি সৃষ্টি অপর একটি সৃষ্টির ইবাদত কিভাবে করতে পারে! কেননা, তোমরা তাদের উপাস্য না হয়ে তারা তোমাদের উপাস্য হবে এই অগ্রাধিকারের কোন ভিত্তি নেই। এটাও যেমন ভিত্তিহীন, তেমনি এর বিপরীতটা অর্থাৎ তোমার উপাস্য হওয়াও ভিত্তিহীন। কারণ, ইবাদত, উপাসনা পাওয়ার অধিকারী কেবল সৃষ্টিকর্তাই; এ ব্যাপারে কেউ তার শরীক নেই।
(তারা বলল, এর জন্যে এক ইমারত তৈরি কর। তারপর একে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ কর। তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে চক্রান্তের সংকল্প করেছিল, কিন্তু আমি তাদেরকে অতিশয় হেয় করে দিলাম।) ইবরাহীম (আ)-এর সাথে তারা যখন যুক্তি ও বিতর্কে এঁটে উঠতে পারলো না, তাদের পক্ষে পেশ করার মত কোনই দলীল-প্রমাণ থাকল না, তখন তারা বিতর্কের পথ এড়িয়ে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের পথ অবলম্বন করে—যাতে করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতা টিকিয়ে রাখতে পারে। সুতরাং আল্লাহ সুবহানুহ্ তা’আলাও তাদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেন। আল্লাহ বলেনঃ
অর্থাৎ, তারা বলল, ইবরাহীমকে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেবতাদেরকে সাহায্য কর যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের জন্যে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইবরাহীমের ক্ষতি সাধন করতে চেয়েছিল; কিন্তু আমি তাদেরকে করে দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আম্বিয়াঃ ৬৮-৭০)
তারা বিভিন্ন স্থান থেকে সম্ভাব্য চেষ্টার মাধ্যমে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে থাকে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা এ সংগ্রহের কাজে রত থাকে। তাদের মধ্যে কোন মহিলা পীড়িত হলে মানত করত যে, যদি সে আরোগ্য লাভ করে তবে ইবরাহীম (আ)-কে পোড়াবার লাকড়ি সংগ্রহ করে দেবে। এরপর তারা বিরাট এক গর্ত তৈরি করে তার মধ্যে লাকড়ি নিক্ষেপ করে অগ্নি সংযোগ করে। ফলে তীব্র দহনে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা এত উর্ধ্বে উঠতে থাকে, যার কোন তুলনা হয় না। তারপর ইবরাহীম (আ)-কে মিনজানীক নামক নিক্ষেপণ যন্ত্রে বসিয়ে দেয়। এই যন্ত্রটি কুর্দী সম্প্রদায়ের হাযান নামক এক ব্যক্তি তৈরি করে। মিনজানীক যন্ত্র সে-ই সর্ব প্রথম আবিষ্কার করে। আল্লাহ তাকে মাটির মধ্যে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকবে। তারপর তারা ইবরাহীম (আ)-কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তখন তিনি বলতে থাকেনঃ
لا إله إلا أنت سبحانك لك الحمد والله الملك لا شريك لك
(আপনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, আপনি মহা পবিত্র, বাদশাহীর মালিক কেবল আপনিই, আপনার কোন শরীক নেই।) ইবরাহীম (আ)-কে মিনজানীকের পাল্লায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রেখে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। তখন তিনি বলেনঃ
( حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ )
[Surat Aal-E-Imran 173]
(আমার জন্যে আল্লাহ-ই যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক)। যেমন বুখারী শরীফে ইবন আব্বাস (রা) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যেঃ ইবরাহীম (আ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেনঃ
( حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ )
[Surat Aal-E-Imran 173]
আর মুহাম্মদ (সা) তখন এ দু’আটি পড়েছিলেন। যখন তাঁকে বলা হয়েছিলঃ
অর্থাৎ, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এটা তাদের ঈমানকে আরও দৃঢ় করে দিয়েছিল। আর তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনি বড়ই উত্তম কর্ম-বিধায়ক। তারপর তারা আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল। কোনরূপ ক্ষতি তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৭৩-১৭৪)
আবু ইয়া'লা (র) ..... আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ইবরাহীম (আ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন তিনি এই দু’আটি পড়েনঃ হে আল্লাহ! আপনি আকাশ রাজ্যে একা আর এই যমীনে আমি একাই আপনার ইবাদত করছি।
পূর্ববর্তী যুগের কোন কোন আলিম বলেন, জিবরাঈল (আ) শূন্যে থেকে হযরত ইবরাহীম (আ)-কে বলেছিলেনঃ আপনার কোন সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে ইবরাহীম (আ) বলেছিলেন, ‘সাহায্যের প্রয়োজন আছে, তবে আপনার কাছে নয়।’ ইবন আব্বাস ও সাঈদ ইবন জুবায়র (রা) থেকে বর্ণিতঃ ঐ সময় বৃষ্টির ফেরেশতা (মীকাঈল) বলেছিলেন, আমাকে যখনই নির্দেশ দেওয়া হবে তখনই বৃষ্টি প্রেরণ করব। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ বাণী অধিক দ্রুত গতিতে পৌঁছে যায়,
অর্থাৎ—(আমি হুকুম করলাম, হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের উপর শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যাও)। হযরত আলী ইবন আবী তালিব (রা) سلاما -এর অর্থ করেছেন, তাকে কষ্ট দিও না। ইবন আব্বাস (রা) ও আবুল আলিয়া (র) বলেছেন, আল্লাহ যদি ( وَسَلَامًا عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ ) না বলতেন তাহলে ঠাণ্ডা ও শীতলতায় ইবরাহীম (আ)-এর কষ্ট হত। কা’বে আহবার বলেছেন, পৃথিবীর কোন লোকই ঐদিন আগুন থেকে কোনরূপ উপকৃত হতে পারেনি এবং ইবরাহীম (আ)-এর বন্ধনের রশি ছাড়া আর কিছুই জ্বলেনি। যাহহাক (র) বলেছেন, ঐ সময় হযরত জিবরাঈল (আ) ইবরাহীম (আ)-এর সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁর শরীর থেকে ঘাম মুছে দিচ্ছিলেন এবং ঘাম নির্গত হওয়া ছাড়া আগুনের আর কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায়নি। সুদূদী (র) বলেছেনঃ ইবরাহীম (আ)-এর সাথে ছায়া দানের ফেরেশতাও ছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) যখন প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যকার উক্ত গহবরে অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর চতুষ্পর্শে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করছিল অথচ তিনি ছিলেন শ্যামল উদ্যানে শান্তি ও নিরাপদে। লোকজন এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করছিল; কিন্তু না তারা ইবরাহীম (আ)-এর নিকট যেতে পারছিল, আর না ইবরাহীম (আ) বেরিয়ে তাদের কাছে আসতে পারছিলেন। আবু হুরায়রা (রা) বলেনঃ ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আপন পুত্রের এ অবস্থা দেখে একটি অতি উত্তম কথা বলেছিল, তা হলঃ نعم الرب ربك يا ابراهيم হে ইবরাহীম! তোমার প্রতিপালক কতই না উত্তম প্রতিপালক।
ইবন আসাকীর (র) ইকরিমা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেনঃ ইবরাহীম (আ)-এর মা পুত্রকে এ অবস্থায় দেখে ডেকে বলেছিলেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি তোমার নিকট আসতে চাই। তাই আল্লাহর কাছে একটু বল, যাতে তোমার চারপাশের আগুন থেকে আমাকে রক্ষা করেন। ইবরাহীম (আ) বললেন, হ্যাঁ, বলছি। তারপর মা পুত্রের নিকট চলে গেলেন। আগুন তাঁকে স্পর্শ করল না। কাছে গিয়ে মাতা আপন পুত্রকে আলিঙ্গন ও চুম্বন করলেন এবং পুনরায় অক্ষতভাবে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। মিনহাল ইবন আমর (রা) বর্ণনা করেছেনঃ হযরত ইবরাহীম (আ) আগুনের মধ্যে চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ দিন অবস্থান করেন। এই সময় সম্পর্কে হযরত ইবরাহীম (আ) বলেনঃ আগুনের মধ্যে আমি যতদিন ছিলাম ততদিন এমন শান্তি ও আরামে কাটিয়েছি যে, তার চেয়ে অধিক আরামের জীবন আমি কখনও উপভোগ করিনি। তিনি আরও বলেনঃ আমার গোটা জীবন যদি ঐরূপ অবস্থায় কাটত, তবে কতই না উত্তম হতো! এভাবে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সম্প্রদায় শত্রুতাবশত প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল; কিন্তু তারা ব্যর্থকাম হল। তারা গৌরব অর্জন করতে চেয়েছিল, কিন্তু লাঞ্ছিত হল। তারা বিজয়ী হতে চেয়েছিল, কিন্তু পরাজিত হল। আল্লাহর বাণীঃ
(তারা চক্রান্ত করে ক্ষতি করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তাদেরকে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত করে দেই।) অপর আয়াতে আছে।
فجعلنا هم الاسفلين
(আমি তাদেরকে হীনতম করে দেই) এরূপে দুনিয়ার জীবনে তারা ক্ষতি ও লাঞ্ছনাপ্রাপ্ত হয় আর আখিরাতের জীবনে তাদের উপর আগুন না শীতল হবে, না শান্তিদায়ক হবে বরং সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ
( إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا )
[Surat Al-Furqan 66]
অর্থাৎ, জাহান্নাম হল তাদের জন্যে নিকৃষ্ট আবাস ও ঠিকানা। (সূরা ফুরকানঃ ৬৬)
ইমাম বুখারী (র) উম্মু শারীক (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) গিরগিটি মারার আদেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন, ইবরাহীম (আ)-এর বিরুদ্ধে এটি আগুনে ফুক দিয়েছিল। ইমাম মুসলিম (র) ইবন জুরায়জ (র) সূত্রে এবং বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ ও ইবন মাজাহ্ (র) সুফিয়ান ইবন উয়ায়না (রা) সূত্রে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ (র) আয়েশা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা গিরগিটি হত্যা কর; কারণ সে ইবরাহীম (আ)-এর বিরুদ্ধে আগুনে ফুক দিয়েছিল— তাই হযরত আয়েশা (রা) গিরগিটি হত্যা করতেন। ইমাম আহমদ (র) নাফি (র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, জনৈক মহিলা হযরত আয়েশা (রা)-এর গৃহে প্রবেশ করে একটি বর্শা দেখে জিজ্ঞেস করল। এ বর্শা দ্বারা আপনি কি করেন? উত্তরে আয়েশা (রা) বললেন, এর দ্বারা আমি গিরগিটি নিধন করি। তারপর তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ইবরাহীম (আ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন সমস্ত জীব-জন্তু ও কীট-পতঙ্গ আগুন নিভাতে চেষ্টা করেছিল, কেবল এ গিরগিটি তা করেনি; বরং সে উল্টো আগুনে ফুক দিয়েছিল। উপরোক্ত হাদীস দু’টি ইমাম আহমদ (র) ভিন্ন আর কেউ বর্ণনা করেননি।
ইমাম আহমদ....ফাকিহ্ ইবনুল মুগীরার মুক্ত দাসী সুমামা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি একদা আয়েশা (রা)-এর গৃহে যাই। তখন সেখানে একটা বর্শা রাখা আছে দেখতে পাই। জিজ্ঞেস করলাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! এ বর্শা দিয়ে আপনি কী করেন? তিনি বললেন, এ দিয়ে আমি এসব গিরগিটি বধ করি। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে বলেছেনঃ ইবরাহীম (আ)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন যমীনের উপর এমন কোন জীব ছিল না যারা আগুন নেভাতে চেষ্টা করেনি, কেবল এই গিরগিটি ব্যতীত। সে ইবরাহীম (আ)-এর উপরে আগুনে ফুঁক দেয়। তাই রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে এগুলো হত্যা করতে আদেশ করেছেন। ইবন মাজাহ্ (র).... জারীর ইবন হাযিম (র) সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/488/45
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।