HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান

লেখকঃ ডা. জাকির নায়েক

কিতাবের নাম/ লেখক/ অনুবাদক/ সম্পাদক
কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানসুসংগত না অসংগত

ডা. জাকির নায়েক

অনুবাদমোঃ আব্দুল কুদ্‌দূস

পিস পাবলিকেশন

প্রকাশকের কথা
অনেকদিন থেকে মনের গভীরে দুটো ইচ্ছে পোষণ করে আসছিলাম; কিন্তু তা পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। একটি ইচ্ছে ছিল কলকাতার ২০০৮ বইমেলায় যাওয়া, আর দ্বিতীয় ইচ্ছে ছিল মুম্বাই গিয়ে ডা. জাকির নায়েকের সাথে সাক্ষাৎ করা। আল্লাহর মেহেরবাণীতে অবশেষে কলকাতা যাওয়ার একটা সুযোগ হলো; কিন্তু সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে দ্বিতীয় ইচ্ছেটি এ যাত্রায় পূরণ করা গেল না।

অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে ০৩-১২-২০০৮ তারিখে হজ্ব পালন অবস্থায় কাবা ঘরের চত্বরে জমজম টাওয়ারে ডা. জাকির নায়েকের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে দ্বিতীয় ইচ্ছেটি পূরণ হয়। অবশ্য পরবর্তীতে বোম্বে পিস টিভি কার্যালয়ে তার সাথে আবারো স্বাক্ষাত হলো ১০ জানুয়ারী ২০১০। আলহামদুলিল্লাহ।

কলকাতা বইমেলা– ২০০৮-এ আসতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে হলো। মনে হলো আরো আগেই মেলায় আসা উচিত ছিল। অনেক তারকাসমৃদ্ধ বইয়ের মাঝে ডা. জাকির নায়েকের বেশ ক’টি বইও দেখলাম জ্বলজ্বল করছে। তবে সব বই-ই ইংরেজি ভাষায়। ভাবলাম জাকির নায়েকের সাথে তো আর এ যাত্রায় দেখা করা সম্ভব হলো না। তার কিছু বই বাংলাদেশে নিয়ে যাই এবং সেগুলো বাংলায় ভাষান্তর করে আমাদের দেশের পাঠকদের হাতে পৌঁছিয়ে দেই। তার সম্পর্কে, তার মেধা ও যোগ্যতা এবং দ্বীনী দাওয়াতের কৌশল সম্পর্কে আমার দেশের জনগণকে অবহিত করতে পারলে এবং এতে করে যদি কিছুলোকও দ্বীনের পথে এগিয়ে আসে, তাহলে এটাই আমার নাজাতের উসিলা হয়ে যেতে পারে। ইনশাআল্লাহ।

বাংলা ভাষায় ডা. জাকির নায়েকের দু’চারটা বই বিক্ষিপ্তভাবে বের হয়েছে। আমাদের পিস পাবলিকেশন হতেও বিষয়ভিত্তিক ৩০ খানা বই বাজারে রয়েছে। তবে ব্যাপক পাঠক চাহিদার জন্য ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র নামক ১, ২, ৩ ও ৪ শিরোনামে চার খণ্ড পুস্তক ইতোমধ্যেই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছি। এতে ডা. জাকির নায়েক কর্তৃক রচিত অধিকাংশ বইয়ের সমাহার ঘটেছে। আশা করি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর পাঠক মহলের অন্তরের নানা প্রশ্ন ও তার সমাধান পাবে। পরিশেষে ডা. জাকির নায়েকের বইগুলোর ব্যাপক প্রচার আবশ্যক কামনা করি।

বর্তমানে পরিতাপের কথা হলো যে, কতিপয় মানুষ এমনকি কিছু সংখ্যক আলেমও না জেনে না বুঝে ডা. জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন। অনেকে তার টিভিতে প্রচারিত প্রোগ্রাম সরাসরি না দেখে তার বিরুদ্ধে গিবত করে যাচ্ছেন। তাদের দলিল হলো মুরুববিরা বলেছেন। অথচ তারা সূরা হুজরাতের ৬ নং আয়াতের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করে যাচ্ছেন।

তারপর যে কথাটি না বললেই নয়, পিস পাবলিকেশন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো নবীন। মানুষ ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। তদুপরি বিভিন্ন সংকট-সমস্যার কারণে কিছু ভুল-ভ্রান্তি থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। সম্মানিত পাঠকদের দৃষ্টিগোচর হলে আমাদেরকে অবহিত করলে ইনশাআল্লাহ আমরা এটাকে স্বাগত জানাব এবং পরবর্তী সংস্করণে তা শুধরে নেবো। পরিশেষে মহান আল্লাহর দরবারে দ্বীনী দাওয়াতের কাজের উত্তরোত্তর প্রবৃদ্ধি কামনা করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে নাজাতের আশা রেখে শেষ করছি।

১ জানুয়ারী ২০১৩

– প্রকাশক

ডা. জাকির আব্দুল করিম নায়েক-এর জীবনী
ডা. জাকির আব্দুল করিম নায়েক ১৯৬৫ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.বি.বি.এস ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে পেশায় একজন ডাক্তার হলেও ১৯৯১ সাল থেকে তিনি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারে একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশ করার ফলে চিকিৎসা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে বৈজ্ঞানিক, গঠনমূলক যুক্তি ও অন্যান্য প্রমাণাদির মাধ্যমে তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াসী হন। এ সময়ে ইসলামের দাওয়াতের পাশাপাশি অমুসলিম ও অসচেতন মুসলিম বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্য থেকে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা ও বিশ্বাস দূরীকরণার্থে ভারতের মুম্বাইয়ে তিনি ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আই.আর.এফ) নামক একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালু করেন।

উল্লেখ্য যে, ইসলাম ও তুলনামূলক অন্যান্য ধর্মের ওপরে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথ্যাবলি ইসলামিক রিচার্স ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে রয়েছে। পরবর্তীতে তারই উদ্যোগে আই.আর.এফ ‘এডুকেশনাল ট্রাস্ট’ ও ‘ইসলামিক ডিমেনসন’ নামক দুটি সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। এজন্য আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক (বিশেষত তাদের নিজস্ব টিভি নেটওয়ার্ক ‘Peace TV’) ইন্টারনেট এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের কাছে এটি ইসলামের প্রকৃত রূপকে উপস্থাপনে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গৌরবান্বিত আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের পাশাপাশি মানবীয় কারণ, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সাপেক্ষে এটি প্রকৃত সত্য সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের বোধগম্যতা ও ইসলামের শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করে।

ডা. জাকির মূলত ইসলামের দাঈ’র অনন্য দৃষ্টান্ত। ইসলামিক রিচার্স ফাউন্ডেশন গঠন ও তার পরিচালনার কঠিন সংগ্রামের পেছনে তিনিই প্রধান তদারককারী। আধুনিক ভাবধারার এই পণ্ডিতের ইসলাম ও তুলনামূলক অন্যান্য ধর্মের বিশ্লেষণে বিশ্ববিখ্যাত সুবক্তা ও বিশিষ্ট লেখক হিসেবেও জুড়ি নেই। তাঁর বক্তব্যের পক্ষে ব্যাপকভাবে অক্ষরে অক্ষরে গৌরবান্বিত আল-কুরআন, সহীহ হাদীস ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে তথ্য ও প্রমাণপঞ্জি পৃষ্ঠা নম্বর, খণ্ড ইত্যাদিসহ উল্লেখ করার কারণে যে কেউ তাঁর বক্তব্য বা প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করুক বা তার এ পর্ব শ্রবণ করুক না কেন, সে বিস্মিত ও অভিভূত না হয়ে পারে না। জনসমক্ষে আলোচনার সুতীক্ষ্ণ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য উত্তর প্রদানের জন্য তিনি সুপ্রসিদ্ধ।

অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনা (বিতর্ক) ও সংলাপের সময় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় আল্লাহর রহমতে তিনি সফলতার সাথে বিজয়ী হয়েছেন। ২০০০ সালের ১ এপ্রিল আমেরিকার শিকাগো শহরের আই.সি.এন.এ.ই কনফারেন্সে ‘বিজ্ঞানের আলোকে বাইবেল ও কুরআন’ বিষয়ে এক আমেরিকান চিকিৎসক ও খ্রিস্টানধর্ম প্রচারক ডা. উইলিয়াম ক্যাম্পবেল-এর সঙ্গে তার সবচেয়ে বিখ্যাত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ডা. উইলিয়াম ক্যাম্পবেল হচ্ছেন সেই লেখক যিনি তিন বছর ধরে গবেষণা করার পর ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোকে ‘কুরআন ও বাইবেল’ (১৯৯২ সালে ১ম সংস্করণ এবং ২০০০ সালে ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়) নামক দুটি গ্রন্থ লিখতে সমর্থ হন, যে বইটিকে তিনি ১৯৭৬ সালে ডা. মরিস বুকাইলির লেখা ‘বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান’ নামক বইটির উত্থাপিত অভিযোগগুলোর খণ্ডনকারী হিসেবে ধারণা করেন। শেখ আহমাদ দীদাত ১৯৯৪ সালে ডা. জাকির নায়েককে ইসলাম ও তুলনামূলক অন্যান্য ধর্ম বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত বক্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ২০০০ সালের মে মাসে দাওয়াহ্ ও তুলনামূলক অন্যান্য ধর্মের ওপর গবেষণার জন্য ‘হে তরুণ! তুমি যা চার বছরে করেছ, তা করতে আমার চল্লিশ বছর ব্যয় হয়েছে’– ‘আলহামদুলিল্লাহ’ খোদাই করা একটি স্মারক প্রদান করেন।

জনসমক্ষে আলোচনার জন্য ডা. জাকির পোপ বেনেডিক্টকে চ্যালেঞ্জ করেন, যা সারা বিশ্ব অবলোকন করেছে। বেনেডিক্ট নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে অসম্মানজনক ও বিতর্কিত মন্তব্য করায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ স্ফুলিঙ্গের মতো দাউদাউ করে জ্বলছিল। তাই মুসলিমদের এ উদ্বেগ নিবারণ করতে পোপ বিশটি ইসলামিক দেশ থেকে কূটনীতিকদেরকে রোমের দক্ষিণে তার গ্রীষ্মকালীন বাসভবনে আলোচনার জন্য আহ্বান জানায়। কিন্তু ডা. জাকির তাকে একটি প্রকাশ্য সংলাপের জন্য আহ্বান করে বলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে তার এই বিতর্কিত মন্তব্যের ফলে মুসলিম বিশ্বব্যাপী যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা শান্ত করতে এটি যৎসামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। মূলত ইসলাম সম্পর্কে পোপের এ মন্তব্য পূর্বপরিকল্পিত। পোপ জার্মানির রিজেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যা বলেছিলেন সে ব্যাপারে তিনি নিজেই ভালোভাবে অবগত।

তাই মুসলিমদের প্রতি পোপের এ দুঃখ প্রকাশ করাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ারই নামান্তর। পোপের উচিত ছিল গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি তার মন্তব্য তুলে নেয়া। দেখে মনে হয়, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের পদাঙ্কই পোপ বেনেডিক্ট অনুসরণ করে চলছেন। ডা. জাকির আরো বলেন, ‘পোপ যদি সত্যিই সঠিক সংলাপের মধ্যদিয়ে এ উত্তেজনা শান্ত করতে প্রয়াসী হন, তাহলে তার উচিত হবে জনসমক্ষে একটি প্রকাশ্য বিতর্ক অনুষ্ঠান করা। বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারের সুবিধা সম্বলিত আন্তর্জাতিক টিভি নেটওয়ার্কের ক্যামেরার সামনে পোপ বেনেডিক্ট-এর সঙ্গে আমি জনসমক্ষে প্রকাশ্য সংলাপ বা বিতর্কে অংশ নিতে দৃঢ়ভাবে ইচ্ছুক। এর ফলে সারা বিশ্বের ১শ কোটি ৩০ লাখ মুসলমান ও ২শ কোটি খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সেই বিতর্ক অনুষ্ঠান দেখতে ও শুনতে পারবে।

পোপের ইচ্ছেমতোই কুরআন ও বাইবেল-এর যেকোনো বিষয়ের ওপর সংলাপে বা বিতর্কে আমি রাজি। তাছাড়া এটা কেবল বিতর্ক অনুষ্ঠানই হবে না; বরং এখানে উপস্থিত ও অনুপস্থিত দর্শক-শ্রোতার জন্য প্রশ্নোত্তর পর্বও থাকতে হবে। আর এটা পোপের ইচ্ছেমতো কোনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক হবে না, যেমনটা তার পূর্বসূরি দ্বিতীয় পোপ জন পল দক্ষিণ আফ্রিকান ইসলামি পণ্ডিত আহমেদ দীদাতের খোলামেলা সংলাপের আহ্বানে চেয়েছিলেন। শেখ দীদাতকে পোপ জন পল তার নিজের কক্ষে এসে বিতর্ক করতে বলেছিলেন।

একটি আন্তঃবিশ্বাসগত সংলাপ কেন রুদ্ধদ্বারের মধ্যে সংঘটিত হবে? উপরন্তু আমার জন্য যদি একটি ইটালিয়ান ভিসা সংগ্রহ করা হয় তাহলে মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে পোপের সাথে বিতর্ক করতে আমি রোম বা ভ্যাটিক্যানে নিজের খরচায়ও যেতে পারি। তবে একথা সবার মনে রাখতে হবে যে, মুসলমানদের নিজস্ব মিডিয়াই হচ্ছে ইসলামের ওপরে আক্রমণের জবাবে প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানার উৎকৃষ্ট উপায়। দুর্ভাগ্যক্রমে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক মিডিয়া পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট। সুতরাং আমাদের যদি নিজস্ব মিডিয়া না থাকে তাহলে পশ্চিমারা সাদাকে কালো করে ফেলবে, দিনকে রাত করে ফেলবে, নায়ককে সন্ত্রাসী বানাবে আর সন্ত্রাসীকে বানাবে নায়ক।’

রিয়াদে অবস্থিত শ্রীলংকার দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত বহুসংখ্যক রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক ও শ্রীলংকার জনগণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ‘ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা সম্পর্কিত ২০টি সাধারণ প্রশ্ন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ডা. জাকির তাঁর বক্তব্যের শেষে এক ইন্টারনেট সাক্ষাৎকারে এ কথাগুলো বলেন।

ষোড়শ পোপ বেনেডিক্ট যদি খ্রিস্টানধর্ম ও বাইবেলের ওপর কোনো বিশ্বাস না রাখেন, তাহলে তার কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়; বরং জনসমক্ষে একটা বড় আকারের খোলামেলা বিতর্কের মাধ্যমে ডা. জাকিরের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা উচিত। কিন্তু পোপের যদি খ্রিস্টানধর্ম ও বাইবেলের ওপর আত্মবিশ্বাস না থাকে অথবা তিনি যদি খ্রিস্টানধর্ম ও বাইবেলকে ততটুকু পরিমাণে বিশ্বাস না করেন যাতে বড় রকমের কোনো বিতর্কে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়; তাহলে মুসলমানদের অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না এই পোপ বেনেডিক্ট তার জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসের পরিধি বাড়ানোর মাধ্যমে ডা. জাকিরের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে অথবা পদত্যাগ করার মাধ্যমে পরবর্তী পোপকে এ সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার নিশ্চয়তা দেন। অবশেষে যদি এ বিতর্ক পরিচালিত হয়, তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা ইসলাম সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বের মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে সক্ষম হব এবং সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে ইসলামের সত্যতা ও খ্রিস্টান ধর্মের মিথ্যাচারিতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে।

মুসলমানদের সাথে সংলাপ করার জন্য পোপ বেনেডিক্ট অবশ্য প্রথমাবস্থায় তার আন্তরিক ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু ডা. জাকিরের আহ্বানের পর থেকে এমন ভঙ্গিমা দেখাচ্ছেন যে, মনে হয় মুসলমানদের সাথে সংলাপের জন্য তিনি কখনো আহ্বানই জানান নি অথবা এ ধরনের কোনো কিছু সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। বিশ্বের অনেক মুসলমান পোপ বেনেডিক্ট-এর সাথে ডা. জাকির নায়েকের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে পশ্চিমা মিডিয়া যেমন বিভিন্ন জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে, পত্র-পত্রিকার অফিসে ই-মেইল করেছে; কিন্তু তারাও পোপের ভান করছে। তাই সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আজ একটাই প্রশ্ন, ডা. জাকির নায়েকের চ্যালেঞ্জে সমগ্র পশ্চিমা মিডিয়া বিশেষ করে পোপ নিজেই কেন এখন নিশ্চুপ?

ডা. জাকির সাধারণত লিখিত কোনো বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন না; বরং সর্বদা জনসমক্ষে বিতর্ক করেন। কারণ, এটা সবার জানা কথা যে, লিখিতভাবে কোনো বিতর্ক করলে তা কখনো শেষ হবার নয়; কিন্তু প্রকাশ্যে বিতর্ক করলে তা কার্যকরীভাবে একটা ফলাফল বয়ে আনে।

যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস বিমানবন্দরের একটি ঘটনায় তাঁর দক্ষতা সম্পর্কে একটি উদাহরণ দেয়া যাক :

১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে অনেক বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে অধিকাংশ মুসলিম বিভিন্ন প্রশ্নের যথোপযুক্ত উত্তর দিতে না পারার জন্য অযথা হয়রানির শিকার হন। কিন্তু ইসলাম ও মানবতার প্রতি অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইন্টারনেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃক দেয়া পুরস্কার গ্রহণ করতে ১২ অক্টোবর ডা. জাকির নায়েক যখন লসএঞ্জেলস বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তখন তার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে কি-না তা জানতে ইমিগ্রেশন অফিসারের আচরণ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার জন্য সেখানে কোনো সমস্যা ছিল না এবং তাদের সবার ব্যবহার ছিল মনোমুগ্ধকর।’ কয়েকটি সৌদী সংবাদপত্র ডা. জাকির নায়েকের এ সাক্ষাৎকার নেয়ার পরবর্তী অনুসন্ধানে জানতে পারে যে, লসএঞ্জেলস বিমানবন্দরে অবতরণের পর ডা. জাকিরও তার দাড়ি এবং মাথার টুপির জন্য কাস্টম অফিসারদের দৃষ্টির আড়াল হতে পারেন নি। তাই সাথে সাথে তাকেও প্রশ্ন করার জন্য অনুসন্ধান করা শুরু করে।

যেমন : ১১ সেপ্টেম্বরের আক্রমণ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়ে ‘জিহাদ’ শব্দটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তখন ডা. জাকির নায়েক বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণ, কুরআন, তালমুদ, তাওরাত (ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ), মহাভারত, ভগবত গীতাসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, জিহাদ শুধু ইসলামিক নয়; বরং বৈশ্বিক একটি বিষয়। এ কথা শুনে কাস্টম অফিসাররা উৎসাহী হয়ে আরো প্রশ্ন করেন। কিন্তু ওদিকে ডা. জাকির তার মেধা, জ্ঞান ও যুক্তি দ্বারা উত্তর দেয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। ইতোমধ্যে এক ঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়। অন্যদিকে যেহেতু প্রশ্ন করার কারণে দীর্ঘ লাইনে লোকজন অপেক্ষা করছিল তাই ডা. জাকিরকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। যখন তিনি উঠে দাঁড়ান ও কক্ষটি ত্যাগ করেন তখন প্রায় ৭০ জন কাস্টম অফিসার তাদের নিজেদের ধর্ম ও ইসলাম সম্পর্কে জানতে তাঁর পিছে পিছে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে কাস্টম অফিসারগণ বলেন যে, তারা বিস্মিত হয়েছেন এবং তারা জীবনে কখনো এতো জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি দেখেন নি।

আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, সাউথ আফ্রিকা, মৌরিতানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, ঘানা (দক্ষিণ আফ্রিকা) সহ আরো অনেক দেশে এ পর্যন্ত নয়শোরও বেশি বার জনসম্মুখে প্রকাশ্য আলোচনায় বিভিন্ন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মের ওপর তুলনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। উপরন্তু ভারতেও তিনি অসংখ্য বার বক্তব্য প্রদান করেছেন। যার অধিকাংশ অডিও এবং ভিডিও আকারে এবং ইদানিং বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থাকারে পাওয়া যায়। বিশ্বের একশোরও বেশি দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টিভি ও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে ডা. জাকিরকে প্রতিনিয়ত দেখা যায়। তিনি প্রায় প্রতিনিয়তই সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রিত হন।

ভারতের মিডিয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রয়েছে তার প্রভাব। ভারতীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা যেমন : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইনকিলাব, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, দ্য ডেইলি মিডডে, দ্য এশিয়ান এইজ ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকা তার অনেক বক্তব্য প্রকাশ করেছে। বাহরাইন ট্রিবিউন, রিয়াদ ডেইলি, গালফ টাইমস, কুয়েত টাইমসসহ আরো অন্যান্য সংবাদপত্রে ইংরেজি ছাড়াও বিভিন্ন ভাষায় ডা. জাকির নায়েক সম্পর্কে অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও তাঁর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি সাধারণত ইংরেজিতে বক্তব্য দেন। তাঁর দর্শক-শ্রোতার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত, আর্মি জেনারেল, রাজনৈতিক নেতা, নামকরা খেলোয়াড়, ধর্মীয় পণ্ডিত, শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ মানুষ। তার অধিকাংশ বক্তব্য ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নিজস্ব নেটওয়ার্ক ‘Peace TV’-এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়। তাঁর বক্তব্যগুলোতে খুবই সাধারণ ভূমিকা রয়েছে এবং একজন আন্তর্জাতিক বক্তা হিসেবে তিনি তার প্রায় সব বক্তব্যে কুরআন ও সহীহ হাদীসের বাণীগুলো বিজ্ঞান ও যুক্তির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেন। ফলে দর্শক ও শ্রোতারা সহজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। ধর্মগ্রন্থগুলো সম্পূর্ণভাবে মুখস্থ করার মতো অসাধারণ গুণটি তাঁর সম্পর্কে বিশেষভাবে লক্ষণীয় একটি বিষয়। মনে হয় কুরআন, বাইবেলের বিভিন্ন সংস্করণ, তালমুদ, তাওরাত (ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ), মহাভারত, ম্যানুসম্যারিটি, ভগবতগীতা ও বেদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের হাজার হাজার পৃষ্ঠা সম্পূর্ণভাবে তার মুখস্থ রয়েছে। তাছাড়াও বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক বিষয় এবং তত্ত্বেও রয়েছে তার পূর্ণ দখলদারিত্ব। কেননা তিনি কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করলে তার পৃষ্ঠা, অধ্যায় ও খণ্ডসহ উল্লেখ করেন।

ভূমিকা
بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ

এ গ্রহে মানুষ প্রথম যেদিন এসেছিল, সেদিন থেকেই সে সর্বদা প্রকৃতি, সৃষ্টি পরিক্রমায় তার অবস্থান এবং তার জীবনের একান্ত উদ্দেশ্যকে বুঝতে চেষ্টা করছে। সত্য অনুসন্ধানের এ পরিক্রমায় বহু শতাব্দী এবং ইতিহাস গতিপথকে বহুলাংশে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এরই ধারবাহিকতায় এসেছে বিভিন্ন ধর্ম। এসব ধর্মের মধ্যে কতিপয় ধর্ম বইভিত্তিক। আর এসব বইকে ঐসব ধর্মের অনুসারীরা ঐশী প্রত্যাদেশ বলে দাবি করেন। এছাড়া অন্য ধর্মগুলো মানবীয় অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে।

ইসলামি আক্বীদা বা ধর্ম বিশ্বাসের প্রধান উৎস হচ্ছে আল-কোরআন, মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, এটি সম্পূর্ণভাবে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ। মুসলমানরা আরও বিশ্বাস করেন যে, এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক। যেহেতু কোরআনের বাণীকে সকল যুগের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য বলে বিশ্বাস করা হয়, সেহেতু এটি সকল যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোরআন কি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ? এ ক্ষুদ্র পুস্তিকাটিতে আমি কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আলোকে, ঐশী উৎসের ভিত্তিতে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ দিতে চাই।

বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে একদা এমন সময় ছিল, যখন ‘অলৌকিকতা’ বা যা অলৌকিক হিসেবে বিবেচিত হত, তা মানবীয় ধারণা ও যুক্তির ওপর প্রাধান্য পেত। কিন্তু আমরা ‘অলৌকিকতা’ শব্দটিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? ‘অলৌকিকতা’র সাধারণ সংজ্ঞা হল, এটি এমন বিষয় যা জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের বাইরে সংঘটিত হয় এবং সেজন্য মানুষের কাছে এর কোন ব্যাখ্যা থাকে না। যাহোক, কোন কিছুকে ‘অলৌকিক’ হিসেবে গ্রহণ করার পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। মুম্বাই থেকে প্রকাশিত ‘The Times of India’-এর ১৯৯৩ সালের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছিল যে, ‘বাবা পাইলট’ নামে একজন সাধু একটানা তিন দিন তিন রাত ট্যাংকের ভেতরে পানির নিচে থাকার দাবি করে।

কিন্তু সংবাদিকরা যখন ঐ ট্যাংকটির তলদেশ পরীক্ষা করতে চাইল, যেখানে অবস্থান করে সে অলৌকিকত্ব দাবি করেছিল, সে তা তাদেরকে পরীক্ষা করতে দিতে অস্বীকৃতি জানাল। সে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যুক্তি দেখিয়েছে যে, যেই মা সন্তান প্রসব করে তার পেট পরীক্ষা করা যায় কীভাবে? ঐ ‘বাবা’ কোন কিছুকে লুকিয়েছিল? এটা ছিল নিজেকে জনপ্রিয় করার জন্য এক ধরনের প্রতারণা। সামান্যতম যৌক্তিক বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন কোন আধুনিক ব্যক্তি এ ধরনের অলৌকিকতাকে অবশ্যই গ্রহণ করবে না। এ ধরনের মিথ্যা অলৌকিকতা যদি ঐশী পরীক্ষা হয় তাহলে অতি সাধারণ যাদুকরী কৌশল ও মিথ্যাচারের রূপকার বিখ্যাত যাদুকর মিঃ পি. সি. সরকারকে সবচেয়ে আল্লাহভক্ত মানুষ হিসেবে আমাদের মানা উচিত নয় কি?

যদি কোন বইকে ঐশী বই বলে দাবি করা হয়, তাহলে অবশ্যই সেটা অলৌকিক বলেও দাবি করা যাবে। এ জাতীয় দাবি যে কোন যুগে সহজভাবে পরীক্ষাযোগ্য হওয়া উচিত। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত গ্রন্থ, যা সকল অলৌকিকতার অলৌকিকতা। সুতরাং আমাদের এ বিশ্বাসের নির্ভুলতা অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন।

১. কোরআনের চ্যালেঞ্জ
সকল সংস্কৃতিতে, সাহিত্য ও কবিতা মানুষের ভাবাবেগ এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্ব এমন একটি যুগ অবলোকন করেছে যখন সাহিত্য ও কবিতা গর্বের মর্যাদা লাভ করেছিল, যেমন বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অর্জন করেছে।

মুসলমানরা তো বটেই এমনকি অমুসলিমরা পর্যন্ত স্বীকার করেছে যে, কোরআন হচ্ছে চমৎকার এক আরবি সাহিত্য– ভূপৃষ্ঠে এটা সর্বোৎকৃষ্ট আরবি সাহিত্য। আল্লাহর নিকট থেকে কোরআন মানবজাতিকে নিম্নোক্ত আয়াতে অনুরূপ গ্রন্থ রচনায় চ্যালেঞ্জ দিয়েছে–

وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِہٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُہَدَآءَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ . فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُہَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ

অর্থ : আর আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তা সম্পর্কে তোমাদের যদি কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আস। এক আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাহায্যকরীদেরও সাথে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। আর যদি তা না পার– অবশ্য তা তোমরা কখনও পারবে না, তাহলে জাহান্নামের ঐ আগুনকে ভয় কর, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। (সূরা বাক্বারা : ২৩-২৪)

এখানে কোরআনের অন্তর্ভুক্ত সূরাগুলোর ন্যায় যেকোন একটি সূরা (অধ্যায়) রচনা করার জন্য কোরআন চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সৌন্দর্য, বাচনভঙ্গি, গভীরতা এবং মর্মার্থের দিক বিবেচনায়, কোরআনের সূরার সমপর্যায়ের হওয়ার মত অন্য একটি সূরা তৈরির চ্যালেঞ্জ অদ্যাবধি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে।

সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যিক ভাষায় পৃথিবীকে চ্যাপ্টা হিসেবে যে ধর্মগ্রন্থ বর্ণনা করে, তা বর্তমান যুগের আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কখনই গ্রহণ করবে না। কারণ, আমরা এমন এক যুগে বাস করি, যেখানে মানবিক কারণ, যুক্তি এবং বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কোরআনের অভূতপূর্ব চমৎকার ও সাবলীল ভাষার জন্য অনেকেই এটাকে আল্লাহর গ্রন্থ হিসেবে মেনে নিতে চাইবে না। আল্লাহর গ্রন্থ হবার দাবিদার কোন গ্রন্থকে অবশ্যই তার নিজস্ব কারণ এবং যুক্তির ওপর গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে, ‘ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ।’ সুতরাং আমাদেরকে কোরআন অধ্যয়ন করতে হবে এবং বিশ্লেষণ করতে হবে যে, কোরআন এবং আধুনিক বিজ্ঞান কি সুসঙ্গত না অসঙ্গত?

কোরআন বিজ্ঞানের কোন বই নয় বরং এটি হচ্ছে নিদর্শনের বই, যেমন ; আয়াত (যার অর্থ হচ্ছে– নিদর্শন) কোরআনে ছয় হাজারেরও বেশি নিদর্শন বা আয়াত রয়েছে যার মধ্যে থেকে এক হাজারেরও বেশি আয়াত বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোকপাত করেছে।

আমরা সকলেই জানি যে, বিজ্ঞান অধিকাংশ সময় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। এ বইতে আমি শুধু প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য নিয়ে আলোচনা করেছি, যা কল্পনা বা ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা কোন তত্ত্ব বা কল্পনা নয় এবং যা প্রমাণিত হয় নি এমন কোন বিষয়ও নয়।

২. জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশ্বের সৃষ্টি : বিগ ব্যাঙ (মহা বিস্ফোরণ)
বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে জ্যোতির্বিদগণ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যাটি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি বিষয়, যা ‘বিগ ব্যাঙ’ তত্ত্ব হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যুগ যুগ ধরে নভোচারী এবং জ্যোতির্বিদগণ কর্তৃক সংগৃহীত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষামূলক তথ্যের মাধ্যমে এ বিষয়টি সমর্থিত হয়েছে। ‘বিগ ব্যাঙ’ (মহা বিস্ফোরণ) তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্ব প্রাথমিক অবস্থায় একটি বিশাল নীহারিকা আকারে ছিল। এরপর সেখানে একটা মহা বিস্ফোরণ ঘটে (দ্বিতীয় পর্যায়ের বিচ্ছিন্নতা) ফলে ছায়াপর্ব তৈরি হয়।

পরবর্তীতে এগুলো তারকা, গ্রহ, সূর্য ও চন্দ্র ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়। বিশ্বের উৎপত্তি ছিল এক অনন্য ঘটনা এবং দৈবক্রমে এ ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শূন্য পর্যায়ে বা আদৌ নেই।

পবিত্র কোরআন মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে নিম্নের আয়াতে বলেছে,

اَوَ لَمۡ یَرَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنَّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ کَانَتَا رَتۡقًا فَفَتَقۡنٰہُمَا

অর্থ : কাফিররা কি ভেবে দেখে না যে, আসমানসমূহ ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল। (সৃষ্টির একটি অংশ হিসেবে) অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম। (সূরা আম্বিয়া : ৩০)

কোরআনের এ আয়াত এবং ‘বিগ ব্যাঙ’ তত্ত্বের মধ্যে বিস্ময়কর সাদৃশ্যতা কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়। ১৪০০ বছর পূর্বে আরবের মরুভূমিতে অবতীর্ণ হওয়া একটি গ্রন্থ কিভাবে এমন গভীর বৈজ্ঞানিক সত্যকে ধারণ করতে পারে?

ছায়াপথ সৃষ্টির পূর্বে প্রাথমিক গ্যাস পিণ্ড
বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, মহাবিশ্বে ছায়াপথ গঠিত হওয়ার পূর্বে, আকাশ সম্পর্কীয় পদার্থগুলো প্রাথমিকভাবে গ্যাস জাতীয় পদার্থের আকারে ছিল। সংক্ষেপে বলা যায়, ছায়াপথ তৈরির পূর্বে বিপুল পরিমাণ গ্যাস জাতীয় পদার্থ কিংবা মেঘ বিদ্যমান ছিল। আকাশ সম্পর্কিত প্রাথমিক পদার্থকে বর্ণনা করতে ‘ধোঁয়া’ শব্দটি গ্যাসের চেয়ে অধিকতর যথার্থ। কোরআনের নিচের আয়াতে ব্যবহৃত ‘দুখা-ন’ শব্দটি দ্বারা বিশ্বের এ অবস্থাটিকে বুঝায় যার অর্থ হচ্ছে ধোঁয়া।

ثُمَّ اسۡتَوٰۤی اِلَی السَّمَآءِ وَ ہِیَ دُخَانٌ فَقَالَ لَہَا وَ لِلۡاَرۡضِ ائۡتِیَا طَوۡعًا اَوۡ کَرۡہًا ؕ قَالَتَاۤ اَتَیۡنَا طَآئِعِیۡنَ

অর্থ : অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধূম্রকুঞ্জ, এরপর তিনি তাকে এবং পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বলল, স্বেচ্ছায় আসলাম। (সূরা ফুচ্ছিলাত :১১)

তাছাড়া এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, ‘বিগ ব্যাঙ’-এর স্বাভাবিক ফল হল এ ঘটনা এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্বে আরবের কারো কাছে এটি পরিচিত ছিল না। তাহলে, এ জ্ঞানের উৎস কি ছিল?

পৃথিবী গোলাকার
আদিকালে মানুষ বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীর আকার হচ্ছে চ্যাপ্টা বা স্ফীত। শত শত বছর ধরে মানুষ পৃথিবীর কিনারা থেকে ছিটকে পড়ে যাবার ভয়ে বেশি দূর পর্যন্ত ভ্রমণ করত না। ১৫৯৭ সালে স্যার ফ্রান্সিস ডেইকই প্রথম পৃথিবীর চারপাশে নৌভ্রমণের পর প্রমাণ করেছিলেন যে, পৃথিবী গোলাকার।

দিবারাত্রির বিবর্তন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের নিচের আয়াতটিকে বিবেচনা করা যাক–

اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ یُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّہَارِ وَ یُوۡلِجُ النَّہَارَ فِی الَّیۡلِ

অর্থ : আপনি কি দেখেন না যে, আল্লাহ রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান? (সূরা লোকমান - ২৯)

এখানে বলা হচ্ছে, রাত ধীরে ধীরে এবং ক্রমশ দিনে রূপান্তরিত হয়, অনুরূপভাবে দিনও ধীরে ধীরে এবং ক্রমশ রাতে রূপান্তরিত হয়। এ ঘটনা কেবল পৃথিবী গোলাকার হলেই ঘটতে পারে। যদি পৃথিবী চ্যাপ্টা হত, তাহলে রাত্রি থেকে দিনে এবং দিন থেকে রাত্রিতে একটা আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে যেত।

নিচের আয়াতটিও পৃথিবীর গোল আকৃতির ইঙ্গিত দেয়–

خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ ۚ یُکَوِّرُ الَّیۡلَ عَلَی النَّہَارِ

তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাতকে দিন দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন।’ (সূরা যুমার : ৫)

এ আয়াতে ব্যবহৃত আরবি শব্দটি হচ্ছে ( يکور ) যার অর্থ ‘আচ্ছাদিত করা’ বা কোন জিনিসকে প্যাঁচানো’– যেভাবে মাথার চতুর্দিকে পাগড়ি প্যাঁচানো হয়। দিন ও রাতের আচ্ছাদিত করা বা কুণ্ডলী পাকানো বিষয়টি শুধু তখনই সম্ভব যখন পৃথিবী গোলাকার হয়।

পৃথিবী বলের মত পুরোপুরি গোলাকার নয় বরং ভূ-গোলকের মত। উদাহরণস্বরূপ এটি মেরুদণ্ডের ন্যায় চ্যাপ্টা। নিচের আয়াতে পৃথিবীর আকারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে–

وَ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ ذٰلِکَ دَحٰىہَا

অর্থ : আর আল্লাহ পৃথিবীকে উহার পর ডিম্বাকৃতি করে তৈরি করেছেন। (সূরা আন-নাযি’আত :৩০)

এখানে ডিমের জন্য ব্যবহৃত আরবি শব্দ হচ্ছে ( دحاها ) (দাহাহা), যার অর্থ হচ্ছে একটি উট পাখির ডিম। একটি উট পাখির ডিমের আকৃতি হচ্ছে পৃথিবীর ভূ-গোলকীয় আকৃতির ন্যায়।

এভাবেই কোরআন পৃথিবীর আকৃতি সঠিকভাবে বর্ণনা করেছে, যদিও কোরআন নাযিল হওয়ার সময়ে পৃথিবী চ্যাপ্টা হবার ধারণাটাই ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।

চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো
পূর্বেকার সভ্যতাগুলো বিশ্বাস করতো যে, চাঁদ তার নিজস্ব আলো দেয় কিন্তু বিজ্ঞান এখন আমাদেরকে বলছে যে, চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। চাঁদের আলো হচ্ছে প্রতিফলিত আলো। যাহোক, কোরআন ১৪০০ বছর পূর্বে নিচের আয়াতের মাধ্যমে এ সত্যটি বলে দিয়েছিল।

تَبٰرَکَ الَّذِیۡ جَعَلَ فِی السَّمَآءِ بُرُوۡجًا وَّ جَعَلَ فِیۡہَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیۡرًا

অর্থ : কল্যাণময় তিনি, যিনি নভোমণ্ডলের রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে রেখেছেন সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্র। (সূরা ফুরকান-৬১)

কোরআনে সূর্যকে বুঝাতে (শামস) سمش শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আবার سراج (সিরাজ) শব্দটি দ্বারাও সূর্যকে বুঝানো হয়ে থাকে, যার অর্থ হলো বাতি বা মশাল। অন্যত্র সূর্যকে বুঝাতে وهاجا سراج উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, ‘প্রজ্বলিত বাতি’। আবার অন্য জায়গায়, একই অর্থ বুঝানোর জন্য ضياء শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘উজ্জ্বল জ্যোতি’। তিনটি বর্ণনার সবই সূর্যের জন্য উপযোগী। কারণ, সূর্য নিজ দহনক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচণ্ড তাপ ও আলো উৎপন্ন করে। চাঁদের আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে قمر কোরআন চাঁদকে বুঝাতে منير শব্দটি উল্লেখ করেছে, যার অর্থ হল ‘স্নিগ্ধ আলোদানকারী।’ তাছাড়া চাঁদ হচ্ছে একটি নিস্ক্রিয় জিনিস, যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে, চাঁদের এ প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের সাথে কোরআনের বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। কোরআনে একটি বারের জন্যও চাঁদকে سراج (সিরাজ) وهاجا (ওয়াহহাজ) বা ضياء (দিয়া) হিসেবে এবং সূর্যকে نور (নূর) বা منير (মুনীর) হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কোরআন সূর্যের আলো এবং চন্দ্রের আলোর পার্থক্যকে স্বীকার করে।

নিচের আয়াতগুলো সূর্য এবং চাঁদের আলোর প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন। যেমন :

ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ الشَّمۡسَ ضِیَآءً وَّ الۡقَمَرَ نُوۡرًا

অর্থ : তিনিই সেই সত্তা, যিনি সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময় এবং চাঁদকে স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করেছেন। (সূরা ইউনুস : ৫)

اَلَمۡ تَرَوۡا کَیۡفَ خَلَقَ اللّٰہُ سَبۡعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا . وَّ جَعَلَ الۡقَمَرَ فِیۡہِنَّ نُوۡرًا وَّ جَعَلَ الشَّمۡسَ سِرَاجًا

অর্থ : তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানে চাঁদকে রেখেছেন আলোরূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপরূপে? (সূরা নূহ : ১৫-১৬)

১০
সূর্য আবর্তিত হয়
দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করত যে, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থির হয়ে আছে এবং সূর্যসহ অন্য গ্রহগুলো এর চতুর্দিকে আবর্তন করছে। পাশ্চাত্যে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমির যুগ থেকে মহাবিশ্বের এ ভূকেন্দ্রিক ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত সত্য হিসেবে বিদ্যমান ছিল। ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাস কোপারনিকাস তার ‘সূর্যকেন্দ্রিক গ্রহসংক্রান্ত গতিতত্ত্ব’ দেন, যাতে বলা হয়– সূর্য তার চারদিকে ঘূর্ণায়মান গ্রহগুলোর কেন্দ্রে গতিহীন।

১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী ইউহান্নাস কেপলার ‘Astronamia Nova’ নামক বইটি প্রকাশ করেন। এতে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, গ্রহগুলো শুধু সূর্যের চারদিকে ডিম্বাকৃতির কক্ষপথেই পরিভ্রমণ করে না, বরং সেগুলো নিজ নিজ অক্ষের ওপর অসম গতিতে আবর্তিত হয়। এ জ্ঞানের ফলে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের পক্ষে দিন ও রাতের আবর্তনসহ সৌরজগতের বহু বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়েছিল।

এসব আবিষ্কারের পরেও বিশ্বাস করা হতো যে, সূর্য স্থির এবং পৃথিবীর মত স্বীয় অক্ষের ওপর আবর্তিত হয় না। আমি স্কুলে থাকাকালীন ভূগোলে এ ভুল ধারণাটি জেনেছি বলে মনে পড়ে।

পবিত্র কোরআনের নিচের আয়াতখানার প্রতি তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়–

وَ ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ الَّیۡلَ وَ النَّہَارَ وَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ

অর্থ : তিনিই সৃষ্টি করেছেন, রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। সবাই স্বীয় কক্ষপথে বিচরণ করে। (সূরা আম্বিয়া : ৩৩)

উপরে উল্লিখিত আয়াতে ব্যবহৃত আরবি শব্দ হচ্ছে یَّسۡبَحُوۡنَ (ইয়াছবাহুন)। শব্দটি سبحا (সাবাহা) শব্দ থেকে এসেছে। এ শব্দটি যেকোন প্রবাহমান বস্তু থেকে উদ্ভুত গতিকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শব্দটিকে যদি আপনি মাটির ওপরে কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন, তাহলে এর অর্থ এটা নয় যে, সে গড়াগড়ি দিচ্ছে বরং এর অর্থ হবে, সে হাঁটছে বা দৌড়াচ্ছে। আবার শব্দটিকে যদি আপনি পানিতে অবস্থানরত কোন ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করেন, তখন এর অর্থ হবে না যে, সে ভাসছে বরং এর অর্থ হবে, সে সাঁতার কাটছে।

একইভাবে, আপনি যদি یَّسۡبَحُوۡنَ (ইয়াছবাহুন) শব্দটি আকাশ সম্পর্কিত কোন জিনিস, যেমন– সূর্য সম্পর্কে ব্যবহার করেন, তাহলে এটা শুধু মহাশূন্যের মধ্যদিয়ে উড়াকেই বুঝাবে না, বরং এটি মহাশূন্যে আবর্তিত হয়– এমন অর্থকেও বুঝাবে। অধিকাংশ স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এ সত্যটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যে, সূর্য তার নিজের কক্ষপথে আবর্তন করে। সূর্যের নিজ কক্ষে আবর্তনকে বুঝার জন্য টেবিলের ওপরে সূর্যের প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা যেতে পারে না। আর কেউ বিচার বুদ্ধিহীন না হলে সূর্যের প্রতিকৃতিটি পরীক্ষা করতে পারে। দেখা গেছে যে, সূর্যের নিজস্ব অবস্থানস্থল আছে যা প্রতি ২৫ দিনে একটি বৃত্তাকার গতি আবর্তন করে, অর্থাৎ স্বীয় কক্ষপথে আবর্তন করতে সূর্যের প্রায় ২৫ দিন সময় প্রয়োজন হয়।

প্রকৃত প্রস্তাবে, সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ২৪০ কিলোমিটার গতিতে মহাশূন্যের মধ্যদিয়ে ভ্রমণ করে এবং আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রের চতুর্দিকে একটি পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর লাগে।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী নিম্নরূপ–

لَا الشَّمۡسُ یَنۡۢبَغِیۡ لَہَاۤ اَنۡ تُدۡرِکَ الۡقَمَرَ وَ لَا الَّیۡلُ سَابِقُ النَّہَارِ ؕ وَ کُلٌّ فِیۡ فَلَکٍ یَّسۡبَحُوۡنَ

অর্থ : সূর্য নাগাল পেতে পারে না চাঁদের এবং রাত আগে চলে না দিনের। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে। (সূরা ইয়াসিন : ৪০)

এ আয়াতটি আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র কর্তৃক আবিষ্কৃত কতিপয় বৈজ্ঞানিক সত্যকে উল্লেখ করেছে; যেমন– চাঁদ ও সূর্যের স্বতন্ত্র কক্ষপথের অস্তিত্ব এবং এগুলোর নিজস্ব গতিতে মহাশূন্যে ভ্রমণ।

সৌরজগৎকে নিয়ে সূর্য যে নির্দিষ্ট স্থানকে লক্ষ্য করে চলছে সে স্থানটি আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান দ্বারা যথার্থভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐ জায়গাটির নাম দেয়া হয়েছে– ‘সৌর শৃঙ্গ।’ প্রকৃতপক্ষে সৌরজগৎ মহাশূন্যে যে দিকে ধাবিত হয়, সে দিকটির অবস্থান বর্তমানে যথার্থ ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। আর সেটি হল বৃহদাকারের এক গ্রুপ তারকা (Alpha lyrae)।

পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে চাঁদের যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময়ে তা নিজ কক্ষপথে একবার আবর্তন করে। একবার পরিপূর্ণভাবে ঘুরে আসতে তার ২৯ ১/২ দিন সময়ের প্রয়োজন হয়।

কোরআনের আয়াতসমূহের বৈজ্ঞানিক নির্ভুল তথ্যে কেউ আশ্চর্য না হয়ে পারে না। আমাদের কি এ প্রশ্নটির ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত নয় যে, কোরআনের জ্ঞানের উৎস কি ছিল?

১১
নির্দিষ্ট সময় পরে সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে যাবে
গত ৫ বিলিয়ন বছর ধরে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সূর্যের পৃষ্ঠে তাপ উৎপন্ন হচ্ছে। অনাগতকালের কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে এর সমাপ্তি ঘটবে যখন সূর্য পৃথিবীর সকল প্রাণীর অস্তিত্বের বিলুপ্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। সূর্যের অস্তিত্বের অস্থায়িত্ব সম্পর্কে কোরআন বলে–

وَ الشَّمۡسُ تَجۡرِیۡ لِمُسۡتَقَرٍّ لَّہَا ؕ ذٰلِکَ تَقۡدِیۡرُ الۡعَزِیۡزِ الۡعَلِیۡمِ

অর্থ : সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। (সূরা ইয়াসীন : ৩৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন–

یُکَوِّرُ الَّیۡلَ عَلَی النَّہَارِ وَ یُکَوِّرُ النَّہَارَ عَلَی الَّیۡلِ وَ سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ یَّجۡرِیۡ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اَلَا ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفَّارُ

অর্থ : তিনি রাতকে দিবস দ্বারা এবং দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। আর তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করেছেন, প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত। জেনে রেখ, তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল। (সূরা যুমার : ৫)

এখানে ব্যবহৃত আরবি হচ্ছে مسيقر (মুসতাকার) : যার অর্থ, ‘একটি নির্দিষ্ট স্থান’ বা ‘একটি নির্দিষ্ট সময়’। এভাবে কোরআন বলছে যে, সূর্য একটি নির্ধারিত স্থানের দিকে আবর্তন করছে যা চলতে থাকবে পূর্ব নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। এর মর্মার্থ হল, একদিন সূর্যের অবসান ঘটবে। এ বিষয়টি অন্য আরেক জায়গায় আল্লাহ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেছেন–

اِذَا الشَّمۡسُ کُوِّرَتۡ

অর্থ : যখন সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। (সূরা তাকভীর :১)

১২
মহাশূন্যে বস্তুর অস্তিত্ব
প্রথম দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান পদ্ধতির সুসংগঠিত ধারার বাইরের স্থানকে শূন্য মনে করা হত। পরবর্তীতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ আন্তর্জাতিক মহাশূন্যে বস্তুর সেতু আবিষ্কার করেন। বস্তুর এ সেতুগুলোকে প্লাজমা বলা হয়, যা সমান সংখ্যক মুক্ত ইলেকট্রন ও ধনাত্মক আয়নবিশিষ্ট সম্পূর্ণ আয়নিত গ্যাস দ্বারা তৈরি। অধিকাংশ সময়ে প্লাজমাকে বস্তুর চতুর্থ অবস্থা বলা হয় (অন্য পরিচিত তিনটি অবস্থা হল– কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয়)। কোরআন নিচের আয়াতে মহাশূন্যে এ বস্তুর উপস্থিতি সম্পর্কে বলেছে–

ۣالَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا

অর্থ : তিনিই সেই সত্তা যিনি আসমান ও যমীন এবং এতদুভয়ের মাঝে অবস্থিত সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। (সূরা ফোরকান : ৫৯)

তারপরও যদি কেউ বলে যে, মহাশূন্যে ছায়াপথবর্তী বস্তুর উপস্থিতি ১৪০০ বছর পূর্বে জানা গিয়েছিল, তাহলে তা সবার জন্য হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া কিছুই হবে না।

১৩
সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব
আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ১৯২৫ সালে পর্যবেক্ষণমূলক সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেন যে, সকল ছায়াপথ একে অপর থেকে অপসৃত হচ্ছে– যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বর্তমানে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য। মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে কোরআনও ঐ একই কথা বলেছে–

وَ السَّمَآءَ بَنَیۡنٰہَا بِاَیۡىدٍ وَّ اِنَّا لَمُوۡسِعُوۡنَ

অর্থ : আমি স্বহস্তে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই এর সম্প্রসারণকারী। (সূরা যারিয়াত :৪৭)

আরবি শব্দ موصعون (মুছিউন)-এর যথার্থ অনুবাদ হল, ‘সম্প্রসারণকারী’ এবং এটা মহাবিশ্বের ব্যাপক সম্প্রসারণশীলতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

স্টিফেন হকিং তাঁর ‘A Brief History of Time’ (সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস) নামক গ্রন্থে বলেছেন, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে– এ আবিষ্কারটি বিংশ শতাব্দীর মহান বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের অন্যতম। কিন্তু কোরআন এমন সময় মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কথা বলেছে, যখন মানুষ সামান্য টেলিফোনও আবিষ্কার করতে পারে নি।

কেউ বলতে পারে যে, যেহেতু আরবরা জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রসর ছিল, সেহেতু কোরআনে জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত সত্যের উপস্থিতি আশ্চর্যের বিষয় নয়। জ্যোতির্বিদ্যায় আরবদের অগ্রসরতা স্বীকার করার ক্ষেত্রে তারা সঠিক। তথাপি তারা এ সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে, জ্যোতির্বিদ্যায় আরবদের অগ্রসরতার কয়েক শতাব্দী পূর্বেই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল।

তাছাড়া আরবরা তাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রসরতার সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করেও ‘বিগ ব্যাঙ’-এর কারণে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ছাড়াও ওপরে উল্লিখিত অনেক বৈজ্ঞানিক সত্য সম্পর্কে অবগত ছিল না। জ্যোতির্বিদ্যায় অগ্রগতির কারণে কোরআনে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক সত্যসমূহতে আরবদের কোন অবদান ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, বিপরীতটাই সত্য। আর তা হল, কোরআনে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানালোচনা বিদ্যমান রয়েছে বলেই আরবরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে অগ্রগতি অর্জন করেছিল।

১৪
৩. পদার্থবিজ্ঞান অতি পারমাণবিক কণিকার অস্তিত্ব
প্রাচীন যুগে ‘পরমাণুবাদ’ নামে একটি সুপরিচিত তত্ত্ব ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল। ২৩ শতাব্দীকাল পূর্বে, গ্রিকরা বিশেষত ডিমোক্রিটাস নামে এক গ্রিক দার্শনিক কর্তৃক এ তত্ত্বটি প্রস্তাবিত হয়েছিল। ডিমোক্রিটাস এবং তার পরবর্তী লোকেরা মনে করত যে, বস্তুর ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে পরমাণু। আরবরাও একই রকম বিশ্বাস করত। আরবি শব্দ ذرة (জাররাহ)-এর অতিসাধারণ অর্থ হচ্ছে পরমাণু। অতিসম্প্রতি বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে, পরমাণুকেও বিভক্ত করা যায়। পরমাণুকেও যে বিভক্ত করা যায় তা বিংশ শতাব্দীর আবিষ্কার। এমনকি আরবদের কারও ১৪ শতাব্দীকাল পূর্বে এ বিষয়টি জানা ছিল না। কারণ, ذرة (জাররাহ) ছিল একটি সীমা যা কেউ অতিক্রম করতে পারত না। তথাপি কোরআনের নিচের আয়াতটি ذرة শব্দের এ সীমা স্বীকার করে না–

وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَا تَاۡتِیۡنَا السَّاعَۃُ ؕ قُلۡ بَلٰی وَ رَبِّیۡ لَتَاۡتِیَنَّکُمۡ ۙ عٰلِمِ الۡغَیۡبِ ۚ لَا یَعۡزُبُ عَنۡہُ مِثۡقَالُ ذَرَّۃٍ فِی السَّمٰوٰتِ وَ لَا فِی الۡاَرۡضِ وَ لَاۤ اَصۡغَرُ مِنۡ ذٰلِکَ وَ لَاۤ اَکۡبَرُ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ

অর্থ : কাফিরগণ বলে, কিয়ামত আমাদের নিকট আসবে না। হে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি বলুন, না, আমার রবের শপথ! তোমাদের নিকট তা অবশ্য অবশ্যই আসবে। তিনি যাবতীয় অদৃশ্যের জ্ঞানী, তার থেকে আসমান ও যমীনে লুক্কায়িত নেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু; না তার থেকে ছোট আর না তার থেকে বড়। সবই আছে (লওহে মাহফুজ নামক) এক সুস্পষ্ট কিতাবে।’ (সূরা সাবা : ৩)

এ আয়াতে মহান আল্লাহর সর্বজ্ঞান, তার প্রকাশ্য ও গোপন সকল কিছুর জ্ঞানের দিকে ইঙ্গিত করে। তারপর এটি বলে যে, আল্লাহ পরমাণু অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর কিংবা বৃহত্তর সবকিছুর ব্যাপারেই সচেতন। এভাবে এ আয়াতটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্রতর কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। যে সত্যটি আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

১৫
৪. ভূগোল পানিচক্র
১৫০০ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড পলিসি সর্বপ্রথম পানিচক্রের বর্তমান ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন। তিনি সাগর থেকে পানির বাষ্পাকারে উড়ে যাওয়া এবং পরে তা ঠাণ্ডা হয়ে মেঘে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেন। মেঘমালা সাগর থেকে দূরবর্তী ভূ-খণ্ডের ওপর ঘনীভূত হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃষ্টি আকারে নিচে পতিত হয়। এ বৃষ্টির পানি খাল-বিল ও নদ-নদীতে জড়ো হয় এবং অব্যাহত নিয়মে পুনরায় সাগরে ফিরে আসে। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে মিলেটুসের থেলেস এ মতবাদ পোষণ করতেন যে, সমুদ্রের উপরিভাগের ছিটানো পানি কণাকে বাতাস ধারণ করে ওপরে তুলে নেয় এবং সমুদ্র দূরবর্তী স্থানে নিয়ে তা বৃষ্টি আকারে বর্ষণ করে।

আদিকালের লোকেরা ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস সম্পর্কে জানত না। তারা ভাবত যে, বাতাসের তাড়নায় সাগরের পানি সজোরে মহাদেশের অভ্যন্তরভাগে এসে পতিত হয়। তারা আরও বিশ্বাস করত যে, গোপন পথে কিংবা গভীর জলরাশি থেকে পানি পুনরায় ফিরে আসে যা সাগরের সাথে জড়িত। এটিকে প্লেটোর যুগে ‘টারটারুস’ বলা হত। এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত চিন্তাবিদ ডিসকার্টিজও এই একই মত পোষণ করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দিতে এরিস্টোটলের তত্ত্ব সর্বত্র বিদ্যমান ছিল। এ তত্ত্ব অনুসারে, পাহাড়ের ঠাণ্ডা গভীর গুহায় পানি ঘনীভূত হয় এবং মাটির নিচ দিয়ে প্রবাহিত হ্রদ ঝর্ণাগুলোকে পানি সরবরাহ করে। বর্তমানে, আমরা জানি যে, বৃষ্টির পানি মাটির ফাটল দিয়ে ভেতরে চুইয়ে পড়ার কারণে ঐ পানি পাওয়া যায়।

নিচের আয়াতসমূহের মাধ্যমে পানিচক্রের বর্ণনা দেয়া হয়েছে–

اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَسَلَکَہٗ یَنَابِیۡعَ فِی الۡاَرۡضِ ثُمَّ یُخۡرِجُ بِہٖ زَرۡعًا مُّخۡتَلِفًا اَلۡوَانُہٗ

অর্থ : তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর সে পানি যমীনের ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেছেন, এরপর তদ্বারা বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন। (সূরা যুমার : ২১)

وَّ یُنَزِّلُ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَیُحۡیٖ بِہِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِہَا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ

অর্থ : তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং এর দ্বারা মৃত্যুর পর ভূমিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নিশ্চয়ই এতে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে। (সূরা রূম : ২৪)

وَ اَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءًۢ بِقَدَرٍ فَاَسۡکَنّٰہُ فِی الۡاَرۡضِ ٭ۖ وَ اِنَّا عَلٰی ذَہَابٍۭ بِہٖ لَقٰدِرُوۡنَ

অর্থ : আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে থাকি পরিমাণ মত, তারপর তাকে যমীনে সংরক্ষণ করি এবং আমি তা অপসারণও করতে সক্ষম। (সূরা মুমিনুন :১৮)

১৪০০ বছর পূর্বে এমন অন্য কোন বই ছিল না যা পানিচক্রের এমন নির্ভুল বর্ণনা দেয়।

১৬
বাতাস মেঘকে পূর্ণ করে
وَ اَرۡسَلۡنَا الرِّیٰحَ لَوَاقِحَ فَاَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَسۡقَیۡنٰکُمُوۡہُ

অর্থ : আমি বৃষ্টিগর্ভ বাতাস পরিচালনা করি, অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, অতঃপর তোমাদেরকে তা পান করাই। (সূরা হিজর : ২২)

এখানে ব্যবহৃত আরবি শব্দটিও হচ্ছে لواقح (লাওয়াক্কিহ) যা لقح (নাকিহ) শব্দের বহুবচন এবং এর উৎপত্তি لقح (লাক্বাহ) শব্দ থেকে যার অর্থ পূর্ণ করা, গর্ভবতী করা বা উর্বর করা। এখানে পূর্ণ করার অর্থ হচ্ছে যে, বাতাস মেঘমালাকে একসাথে ধাক্কা দিয়ে ঘনীভূত করে। যার ফলে আকাশে বিজলী চমকায় এবং বৃষ্টি শুরু হয়। কোরআনে এ একই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়–

اَللّٰہُ الَّذِیۡ یُرۡسِلُ الرِّیٰحَ فَتُثِیۡرُ سَحَابًا فَیَبۡسُطُہٗ فِی السَّمَآءِ کَیۡفَ یَشَآءُ وَ یَجۡعَلُہٗ کِسَفًا فَتَرَی الۡوَدۡقَ یَخۡرُجُ مِنۡ خِلٰلِہٖ ۚ فَاِذَاۤ اَصَابَ بِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِہٖۤ اِذَا ہُمۡ یَسۡتَبۡشِرُوۡنَ

অর্থ : তিনি আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও যে, তার মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টিধারা। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছা পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়। (সূরা রূম : ৪৮)

اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ یُزۡجِیۡ سَحَابًا ثُمَّ یُؤَلِّفُ بَیۡنَہٗ ثُمَّ یَجۡعَلُہٗ رُکَامًا فَتَرَی الۡوَدۡقَ یَخۡرُجُ مِنۡ خِلٰلِہٖ ۚ وَ یُنَزِّلُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ جِبَالٍ فِیۡہَا مِنۡۢ بَرَدٍ فَیُصِیۡبُ بِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَصۡرِفُہٗ عَنۡ مَّنۡ یَّشَآءُ ؕ یَکَادُ سَنَا بَرۡقِہٖ یَذۡہَبُ بِالۡاَبۡصَارِ

অর্থ : তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন। তারপর তুমি দেখ যে, তার মধ্যে থেকে বারিধারা নির্গত হয় তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলা বর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টি শক্তিকে যেন বিলীন করে দিতে চায়। (সূরা নূর : ৪৩)

وَ ہُوَ الَّذِیۡ یُرۡسِلُ الرِّیٰحَ بُشۡرًۢا بَیۡنَ یَدَیۡ رَحۡمَتِہٖ ؕ حَتّٰۤی اِذَاۤ اَقَلَّتۡ سَحَابًا ثِقَالًا سُقۡنٰہُ لِبَلَدٍ مَّیِّتٍ فَاَنۡزَلۡنَا بِہِ الۡمَآءَ فَاَخۡرَجۡنَا بِہٖ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ ؕ کَذٰلِکَ نُخۡرِجُ الۡمَوۡتٰی لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ

অর্থ : তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহি বাতাস প্রেরণ করেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানিপূর্ণ মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত ভূ-খণ্ডের দিকে পাঠিয়ে দিই। অতঃপর এ মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সব রকমের ফল উৎপন্ন করি। এমনিভাবে মৃতদেরকে বের করব যাতে তোমরা চিন্তা কর। (সূরা আ’রাফ : ৫৭)

وَ السَّمَآءِ ذَاتِ الرَّجۡعِ

অর্থ : শপথ আসমানের যা ধারণ করে বৃষ্টি। (সূরা ত্বারিক : ১১)

পানিবিজ্ঞানের আধুনিক তত্ত্বের সাথে কোরআনের বর্ণনাগুলো নিশ্চিতভাবে নির্ভুল এবং যথার্থভাবে একমত। মহিমান্বিত কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে পানিচক্রের বর্ণনা রয়েছে। যেমন–

اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَسَالَتۡ اَوۡدِیَۃٌۢ بِقَدَرِہَا فَاحۡتَمَلَ السَّیۡلُ زَبَدًا رَّابِیًا ؕ وَ مِمَّا یُوۡقِدُوۡنَ عَلَیۡہِ فِی النَّارِ ابۡتِغَآءَ حِلۡیَۃٍ اَوۡ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِّثۡلُہٗ ؕ کَذٰلِکَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡحَقَّ وَ الۡبَاطِلَ ۬ؕ فَاَمَّا الزَّبَدُ فَیَذۡہَبُ جُفَآءً ۚ وَ اَمَّا مَا یَنۡفَعُ النَّاسَ فَیَمۡکُثُ فِی الۡاَرۡضِ ؕ کَذٰلِکَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ

অর্থ : তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর স্রোতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী। অতঃপর স্রোতধারা স্ফিত ফেনারাশি ওপরে নিয়ে আসে এইরূপে আবর্জনা উপরিভাগে আসে যখন অলংকার অথবা তৈজসপত্র নির্মাণ উদ্দেশ্যে কিছু অগ্নিতে উত্তপ্ত করা হয়, এইভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন। যা আবর্জনা তা ফেলে দেয়া হয় আর যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে থেকে যায়। এভাবে আল্লাহ উপমা দিয়ে থাকেন। (সূরা রা’দ :১৭)

وَ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ الرِّیٰحَ بُشۡرًۢا بَیۡنَ یَدَیۡ رَحۡمَتِہٖ ۚ وَ اَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً طَہُوۡرًا . لِّنُحۡیِۦَ بِہٖ بَلۡدَۃً مَّیۡتًا وَّ نُسۡقِیَہٗ مِمَّا خَلَقۡنَاۤ اَنۡعَامًا وَّ اَنَاسِیَّ کَثِیۡرًا

অর্থ : তিনিই রহমতের সময়ে বাতাসকে সুসংবাদবাহিরূপে প্রেরণ করেন। আর আকাশ থেকে আমি পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি বর্ষণ করি, তা দ্বারা মৃত ভূখণ্ডকে জীবিত করার জন্য এবং আমার সৃষ্ট জীবজন্তু ও মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে। (সূরা ফুরকান : ৪৮-৪৯)

وَ اللّٰہُ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ الرِّیٰحَ فَتُثِیۡرُ سَحَابًا فَسُقۡنٰہُ اِلٰی بَلَدٍ مَّیِّتٍ فَاَحۡیَیۡنَا بِہِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِہَا ؕ کَذٰلِکَ النُّشُوۡرُ

অর্থ : আর আল্লাহ হচ্ছেন সেই সত্তা যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, এরপর সে বায়ু মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর আমি উহাকে মৃত ভূখণ্ডের দিকে পরিচালিত করি। এরপর উহা দ্বারা সে ভূখণ্ডকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করি। একইভাবে হবে পুনরুত্থান। (সূরা ফাতির : ৯)

وَ جَعَلۡنَا فِیۡہَا جَنّٰتٍ مِّنۡ نَّخِیۡلٍ وَّ اَعۡنَابٍ وَّ فَجَّرۡنَا فِیۡہَا مِنَ الۡعُیُوۡنِ .....

অর্থ : উহাতে আমি সৃষ্টি করি খর্জুর ও আঙুরের উদ্যান এবং উহাতে উৎসারিত করি প্রস্রবণ....। (সূরা ইয়াসীন : ৩৪)

وَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ رِّزۡقٍ فَاَحۡیَا بِہِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِہَا وَ تَصۡرِیۡفِ الرِّیٰحِ اٰیٰتٌ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ

অর্থ : আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এরপর পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর জীবিত করেন উহাতে এবং বায়ুর পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে। (সূরা জাসিয়া : ৫)

وَ نَزَّلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً مُّبٰرَکًا فَاَنۡۢبَتۡنَا بِہٖ جَنّٰتٍ وَّ حَبَّ الۡحَصِیۡدِ . وَ النَّخۡلَ بٰسِقٰتٍ لَّہَا طَلۡعٌ نَّضِیۡدٌ . رِّزۡقًا لِّلۡعِبَادِ ۙ وَ اَحۡیَیۡنَا بِہٖ بَلۡدَۃً مَّیۡتًا ؕ کَذٰلِکَ الۡخُرُوۡجُ

অর্থ : আমি কল্যাণময় পানি বর্ষণ করি এবং উহার দ্বারা বাগান ও শস্য উৎপন্ন করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয় এবং দীর্ঘ খেজুর বৃক্ষ যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর, বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ এবং বৃষ্টি দ্বারা আমি মৃত্যু ভূ-খণ্ডকে জীবিত করি। আর এভাবেই পুনরুত্থান ঘটবে। (সূরা ক্বাফ : ৯-১১)

اَفَرَءَیۡتُمُ الۡمَآءَ الَّذِیۡ تَشۡرَبُوۡنَ . ءَاَنۡتُمۡ اَنۡزَلۡتُمُوۡہُ مِنَ الۡمُزۡنِ اَمۡ نَحۡنُ الۡمُنۡزِلُوۡنَ . لَوۡ نَشَآءُ جَعَلۡنٰہُ اُجَاجًا فَلَوۡ لَا تَشۡکُرُوۡنَ

অর্থ : তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষণ করি? ইচ্ছা করলে আমি উহাকে লোনা করে দিতে পারি। অতঃপর তোমরা কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর না? (সূরা ওয়াক্বিয়া : ৬৮-৭০)

১৭
৫. ভূ-তত্ব বিজ্ঞান পাহাড় পর্বতগুলো তাঁবুর পেরেক সদৃশ
ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানে, ‘ভাঁজ করার’ বিষয়টি একটি সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত সত্য। ভাঁজ করা বিষয়টি পাহাড়-পর্বতের বিন্যাসের জন্য দায়ী। পৃথিবীর যে কঠিন পৃষ্ঠের ওপর আমরা বাস করি, তা শক্ত খোসার ন্যায়, অথচ এর গভীরের স্তরগুলো উত্তপ্ত ও তরল, ফলে যে কোন প্রাণীর জন্য তা বসবাসের অনুপযোগী। এটাও জানা যায় যে, পাহাড়-পর্বতের স্থায়িত্ব ভাঁজ করার মত বিস্ময়কর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। কারণ অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে পাহাড়-পর্বতের ভিত্তি স্থাপন করাই ছিল এ ভাঁজগুলোর উদ্দেশ্য।

ভূ-তত্ত্ববিদরা আমাদের বলেন যে, পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় ৩৭৫০ মাইল এবং ভূপৃষ্ঠের শক্ত যে উপরিভাগে আমরা বাস করি তা অত্যন্ত পাতলা– এর বিস্তার ১ মাইল থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত। যেহেতু ভূ-পৃষ্ঠের শক্ত আবরণটি পাতলা সেহেতু এর আন্দোলিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। পাহাড়গুলো খুঁটি কিংবা তাঁবুর পেরেকের মত ভূ-পৃষ্ঠকে ধারণ করে এবং একে স্থিতি অবস্থা দান করে। কোরআন নিচের আয়াতে হুবহু এরূপ কথাই বলেছে–

اَلَمۡ نَجۡعَلِ الۡاَرۡضَ مِہٰدًا . وَّ الۡجِبَالَ اَوۡتَادًا

অর্থ : আমি কি জমিনকে বিছানা এবং পাহাড়কে পেরেক বানাইনি? (সূরা নাবা : ৬-৭)

এখানে ব্যবহৃত আরবি শব্দ اوتادا (অওতাদা)-এর অর্থ হচ্ছে পেরেক বা খুঁটি (যা তাঁবু স্থাপন করতে প্রয়োজন হয়)। এগুলো হলো ভূ-তাত্ত্বিক ভাঁজের ভিত্তি।

‘Earth’ নামক বইটি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূ-তত্ত্ব বিষয়ে প্রাথমিক ও মৌলিক রেফারেন্স বই হিসেবে বিবেচিত। এ বইয়ের অন্যতম লেখক হলেন ডঃ ফ্রাঙ্ক প্রেস, যিনি ১২ বছর ধরে আমেরিকার বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট এবং প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। এ বইতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, পাহাড়-পর্বত হচ্ছে পেরেকাকৃতি বিশিষ্ট এবং এগুলো অবিভক্ত বস্তুর এক ক্ষুদ্র অংশমাত্র, যার মূল মাটির গভীরে প্রোথিত। ডঃ প্রেসের মতে, ভূ-পৃষ্ঠের কঠিন আবরণকে স্থিতিশীল রাখতে পাহাড়-পর্বতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কোরআন পাহাড়-পর্বতের কার্যক্রম পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে বলেছে, তা পৃথিবীকে কম্পন থেকে রক্ষা করে।

وَ جَعَلۡنَا فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِہِمۡ

অর্থ : আমি পৃথিবীতে ভারী বোঝা রেখে দিয়েছি। যাতে তাদেরকে নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে। (সূরা আম্বিয়া : ৩১)

خَلَقَ السَّمٰوٰتِ بِغَیۡرِ عَمَدٍ تَرَوۡنَہَا وَ اَلۡقٰی فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِکُمۡ

অর্থ : তিনি আসমানকে খুঁটিবিহীন তৈরি করেছেন যা তোমরা দেখতে পাচ্ছ। আর পৃথিবীতে পাহাড় সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমাদেরকে নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে। (সূরা লুকমান : ১০)

وَ اَلۡقٰی فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِکُمۡ وَ اَنۡہٰرًا وَّ سُبُلًا لَّعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ

অর্থ : আর তিনি পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন যাতে উহা তোমাদেরকে নিয়ে ঝুঁকে না পড়ে এবং আরও সৃষ্টি করেছেন নদ-নদী ও পথ যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার। (সূরা নাহল : ১৫)

কোরআনের বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে আধুনিক ভূ-তাত্ত্বিক উপাত্তের সাথে সাদৃর্শ্বপূর্ণ।

১৮
পাহাড়-পর্বত দৃঢ়ভাবে প্রোথিত
ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ বহুসংখ্যক মজবুত প্লেটে বিভক্ত যেগুলোর ঘনত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। প্লেটগুলো আংশিক গলিত অঞ্চলে ভাসমান, যাকে Aestheno sphere (এসথেনাসফিয়ার) বলে।

পাহাড়-পর্বত গড়া শুরু হয় পাত বা প্লেটগুলোর প্রান্তসীমায়। পৃথিবীর কঠিন আবরণ সমুদ্রের ৫ কিলোমিটার নিচ পর্যন্ত বিস্তৃতপ্রায় ৩৫ কিলোমিটার মোটা সমতল মহাদেশীয় পৃষ্ঠগুলোর নিচ এবং প্রায় ৮০ কিলোমিটার মোটা বিশাল পর্বতমালার নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর পাহাড়-পর্বত দাঁড়িয়ে আছে। কোরআনও নিম্নের আয়াতে পাহাড়-পর্বতের শক্তিশালী ভিত্তির কথা বলে :

وَ الۡجِبَالَ اَرۡسٰہَا

অর্থ : আর তিনি পাহাড়-পর্বতকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। (সূরা নাযিয়াত :৩২)

وَ اِلَی الۡجِبَالِ کَیۡفَ نُصِبَتۡ

অর্থ : (তারা কি দেখে না) পাহাড়ের দিকে, তা কিভাবে স্থাপন করা হয়েছে। (সূরা গাশিয়াহ : ১৯)

وَ اَلۡقٰی فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِکُمۡ

অর্থ : তিনি পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, যাতে এটি তোমাদেরকে নিয়ে ঝুঁকে না পড়ে। (সূরা লুকমান : ১০)

وَ اَلۡقٰی فِی الۡاَرۡضِ رَوَاسِیَ اَنۡ تَمِیۡدَ بِکُمۡ

অর্থ : আর তিনি পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনও যেন তা তোমাদেরকে নিয়ে হেলেদুলে না পড়ে। (সূরা নাহল : ১৫)

১৯
৬. সমুদ্র বিজ্ঞান মিষ্টি ও লবণাক্ত পানির মধ্যেকার অন্তরায়
কোরআনের নিম্নলিখিত আয়াতটি লক্ষ্য করুন–

مَرَجَ الۡبَحۡرَیۡنِ یَلۡتَقِیٰنِ . بَیۡنَہُمَا بَرۡزَخٌ لَّا یَبۡغِیٰنِ

অর্থ : তিনি পাশাপাশি দুই প্রকার সাগর প্রবাহিত করেছেন, উভয়ের মাঝখানে রয়েছে অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। (সূরা আর-রাহমান :১৯-২০)

আরবি ভাষায় برزخ (বারযাখ) শব্দটির অর্থ হচ্ছে আড়াল বা অন্তরায়। এ অন্তরায় কোন শরীরিক বিভাজন নয়। আরবি শব্দ مرج (মরজা)-এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে। ‘তারা উভয়েই একত্রে মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রাথমিক যুগের মুফাসসিরগণ পানির দুটো ধারার দুটো বিপরীতমুখি অর্থের ব্যাখ্যা করতে অপারগ ছিলেন। অর্থাৎ, কিভাবে তারা মিশে একাকার হয়ে যায়, অথচ উভয়ের মধ্যে রয়েছে আড়াল। আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে, যেখানে দুটি ভিন্ন সমুদ্র এসে একত্রে মিলিত হয়, সেখানে উভয়ের মধ্যে একটি প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় থাকে। এ অন্তরায় দুটি সমুদ্রকে বিভক্ত করে, ফলে প্রত্যেক সমুদ্রের নিজস্ব তাপমাত্রা, লবণাক্ত এবং ঘনত্ব অক্ষুন্ন থাকে। সাগরবিদদের এ আয়াতের আরও উন্নততর ব্যাখ্যা দানের উত্তম সুযোগ রয়েছে। দুটি সাগরের মধ্যে প্রবাহমান ঢালু পানির অদৃশ্য আড়াল বা অন্তরায় আছে যার মধ্য দিয়ে এক সাগরের পানি অন্য সাগরে যায়।

কিন্তু যখন এক সমুদ্র থেকে পানি অন্য সমুদ্রে প্রবেশ করে তখন সে সমুদ্রটি তার নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে এবং অন্য সমুদ্রের পানির বৈশিষ্ট্যের সাথে একাকার হয়ে যায়। এভাবে দুই ধরনের পানির মধ্যে পরিবর্তনমূলক একীভূতকারী বন্ধন হিসেবে এ অন্তরায় কাজ করে।

কোরআনে উল্লিখিত এ বৈজ্ঞানিক ধারণাটি ডঃ উইলিয়াম হে, যিনি বহুল পরিচিত সমুদ্র বিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক, তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সমর্থন করেছেন।

কোরআনের নিচের আয়াতেও এ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে–

وَ جَعَلَ بَیۡنَ الۡبَحۡرَیۡنِ حَاجِزًا

অর্থ : তিনি দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। (সূরা নামল : ৬১)

এ অন্তরায় জিব্রাল্টার ভূমধ্যসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরের মিলনস্থলসহ আরও অনেক জায়গায় দেখা যায়।

কিন্তু কোরআন যখন মিষ্টি পানি ও লবণাক্ত পানির মধ্যে বিভক্তকারী অন্তরায় সম্পর্কে বলে, তখন ঐ অন্তরায়ের সাথে নিষেধকারী প্রতিবন্ধকতার কথাই বলে। যেমন, আল্লাহর কথা–

ہُوَ الَّذِیۡ مَرَجَ الۡبَحۡرَیۡنِ ہٰذَا عَذۡبٌ فُرَاتٌ وَّ ہٰذَا مِلۡحٌ اُجَاجٌ ۚ وَ جَعَلَ بَیۡنَہُمَا بَرۡزَخًا وَّ حِجۡرًا مَّحۡجُوۡرًا

অর্থ : তিনিই সমান্তরাল দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, একটি মিষ্ট, সুপেয় এবং অপরটি নিবারক ও এটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়; একটি দুর্ভেদ্য আড়াল। (সূরা ফুরকান : ৫৩)

‘আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে, নদীর মোহনায় যেখানে মিষ্টি পানি ও লবণাক্ত পানি মিলিত হয়, সেখানের অবস্থা ঐ স্থান থেকে ভিন্ন, যেখানে দু’লবণাক্ত পানি গিয়ে মিশে। নদীর মোহনায় লবণাক্ত ও মিষ্টি পানি মিলিত হলে যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়, তার কারণ হলো সেখানে দুটো স্তরকে পৃথককারী চিহ্নিত ঘনত্বের ধারাবাহিকতাবিহীন Pycnocline zone রয়েছে। এ বিভাজন স্থানে এক প্রকার লবণাক্ততা রয়েছে যা মিঠা ও লবণাক্ত উভয় থেকেই ভিন্ন।

মিসরের নীলনদ যেখানে ভূ-মধ্যসাগরে গিয়ে মিলিত হয় সে স্থানসহ আরও কয়েক জায়গায় এ ধরনের বিভাজনের দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

২০
সমুদ্রের গভীরে অন্ধকার
অধ্যাপক দুর্গা রাও একজন প্রখ্যাত সামুদ্রিক ভূ-তত্ত্ববিদ এবং জেদ্দার বাদশাহ আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাকে নিচের আয়াতের ওপর মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল :

اَوۡ کَظُلُمٰتٍ فِیۡ بَحۡرٍ لُّجِّیٍّ یَّغۡشٰہُ مَوۡجٌ مِّنۡ فَوۡقِہٖ مَوۡجٌ مِّنۡ فَوۡقِہٖ سَحَابٌ ؕ ظُلُمٰتٌۢ بَعۡضُہَا فَوۡقَ بَعۡضٍ ؕ اِذَاۤ اَخۡرَجَ یَدَہٗ لَمۡ یَکَدۡ یَرٰىہَا ؕ وَ مَنۡ لَّمۡ یَجۡعَلِ اللّٰہُ لَہٗ نُوۡرًا فَمَا لَہٗ مِنۡ نُّوۡرٍ

অর্থ : অথবা (তাদের কর্ম) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের ন্যায়, যাকে উদ্বেলিত করে তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ, যার ওপরে ঘন কালো মেঘমালা আছে। একের ওপর এক অন্ধকার। যখন সে তার হাত বের করে, তখন সে তাকে একেবারেই দেখতে পায় না। আল্লাহ যাকে আলো দেন না তার জন্য আর কোন আলো নেই। (সূরা নূর : ৪০)

অধ্যাপক রাও বলেন, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে সমুদ্রের গভীরের অন্ধকার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছে। কোন কিছুর সাহায্য ছাড়া মানুষ ২০-৩০ মিটারের অধিক পানির নিচে ডুব দিতে পারে না এবং মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহে ২০০ মিটারের অধিক পানির নিচে বাঁচতে পারে না। এ আয়াতটি সকল সমুদ্রের দিকে নির্দেশ করে না। কেননা, সকল সমুদ্রের নিচে অন্ধকারের স্তর নেই। আয়াতে শুধু গভীর সমুদ্র সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন, ‘এক বিশাল গভীর সমুদ্রের অন্ধকার।’ দুটি কারণে গভীর মহাসাগরে স্তরবিশিষ্ট অন্ধকার দেখতে পাওয়া যায় :

১. রংধনু সাতটি রংয়ের সমন্বয়ে গঠিত। এ সাতটি রং হলো– বেগুনি, নীল, আসমানি, হলুদ, কমলা, সবুজ ও লাল। আলোক রশ্মি পানিতে পড়লে তা ভেঙে যায়। পানির উপরিভাগের ১০ মিটার থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত পানি লাল রং শোষণ করে। সে কারণে কোন ডুবুরি পানির ২৫ মিটার নিচুতে আহত হলে সে তার রক্তের লাল রং দেখতে পাবে না, কেননা লাল রং ঐ গভীরতায় পৌঁছে না। এভাবে কমলা রং ৩০ মিটার থেকে ৫০ মিটারের মধ্যে, হলুদ রং ৫০ থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে, সবুজ রং ১০০ থেকে ২০০ মিটারের মধ্যে এবং সবশেষে নীল রং ২০০ মিটারের অধিক আসমানি ও বেগুনি ২০০ মিটারের অধিক দূরত্ব অতিক্রমের পর শোষিত হয়। বিভিন্ন স্তরে রংগুলোর এভাবে ক্রমাগত অদৃশ্য হবার পরে সমুদ্র অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় অর্থাৎ আলোর স্তর অন্ধকারে পরিণত হয়। পানির ১০০০ মিটার নিচে সম্পূর্ণ অন্ধকার।

২. মেঘ সূর্য রশ্মিকে ধারণ করে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। ফলে মেঘের নিচে অন্ধকারের একটি স্তর তৈরি হয়। এটাই অন্ধকারের প্রথম স্তর। সূর্যের আলো যখন সমুদ্রের উপরিভাগে পতিত হয় তখন তা পৃষ্ঠভাগের ঢেউয়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে এটিকে উজ্জ্বলিত করে। সেহেতু ঢেউগুলোই আলোকে প্রতিফলিত করে এবং অন্ধকারের সৃষ্টি করে। অপ্রতিফলিত আলো সমুদ্রের গভীরতায় প্রবেশ করে। তাই সমুদ্রের দুটি অংশ রয়েছে। উপরের অংশে রয়েছে আলো এবং উষ্ণতা এবং গভীরের অংশে রয়েছে অন্ধকার। ওপরের অংশটি ঢেউয়ের কারণে গভীর সমুদ্র থেকে ভিন্ন ধরনের।

অভ্যন্তরীণ ঢেউয়ের মধ্যে সাগর ও মহাসাগরের গভীর পানিও অন্তর্ভুক্ত আছে। কারণ, তখন ওপরের পানি অপেক্ষা নিচের পানির ঘনত্ব বেশি থাকে।

অভ্যন্তরীণ ঢেউয়ের নিচে অন্ধকার শুরু হয়। এমনকি সমুদ্রের নিচে মাছও দেখতে পায় না। তাদের আলোর একমাত্র উৎস হল, নিজেদের শরীরের আলো।

কোরআন এ বিষয়টি যথার্থভাবে বর্ণনা করেছে–

‘অথবা (তাদের কর্ম) প্রমত্ত সমুদ্রের বুকে গভীর অন্ধকারের ন্যায়, যাকে উদ্বেলিত করে তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ।’

অন্যভাবে বলা যায়, এ সকল ঢেউয়ের ওপর আরও বিভিন্ন প্রকারের ঢেউ আছে যা মহাসাগরের উপরিভাগে দেখতে পাওয়া যায়। কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে যার ওপরে ঘন কালো মেঘ আছে। একের ওপর এক ঘন অন্ধকার।

মেঘগুলো একের ওপর এক প্রতিবন্ধক যা পরবর্তীতে বিভিন্ন স্তরে রংয়ের শোষণের মাধ্যমে গভীর অন্ধকারের সৃষ্টি করে।

পরিশেষে, অধ্যাপক দুর্গা রাও এই বলে সমাপ্ত করেন যে, ‘১৪০০ বছর আগে একজন সাধারণ মানুষের দ্বারা এ বিষয়টি এত বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং এসব তথ্য অবশ্যই কোন অলৌকিক উৎস থেকে এসেছে।

২১
৭. জীববিজ্ঞান প্রতিটি জীবকে পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়
কোরআনের নিচের আয়াতটি বিবেচনা করা যায়–

اَوَ لَمۡ یَرَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنَّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ کَانَتَا رَتۡقًا فَفَتَقۡنٰہُمَا ؕ وَ جَعَلۡنَا مِنَ الۡمَآءِ کُلَّ شَیۡءٍ حَیٍّ ؕ اَفَلَا یُؤۡمِنُوۡنَ

অর্থ : কাফিররা কি দেখে না যে, আসমান ও জমিনের মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না? (সূরা আম্বিয়া : ৩০)

কেবল বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পরেই আমরা জানতে পেরেছি যে, জীব কোষের যে মৌলিক উপাদান, সাইটোপ্লাজম তা ৮০ ভাগ পানি দিয়ে তৈরি। আধুনিক গবেষণা আরও প্রকাশ করেছে যে, অধিকাংশ জীবেই শতকরা ৫০ ভাগ হতে শতকরা ৯০ ভাগ পানি আছে এবং প্রতিটি জীবন্ত সত্তারই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পানি অপরিহার্য।

প্রত্যেক প্রাণীকে যে পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা ১৪ শতাব্দি পূর্বে কোন মানুষের পক্ষে কি অনুমান করা সম্ভব ছিল। অধিকন্তু আরবের মরুভূমির কোলে মানুষের দ্বারা এ ধরনের অনুমান কি কল্পনাযোগ্য হতো, যেখানে সর্বদা পানির দুষ্প্রাপ্যতা ছিল।

নিচের আয়াতটি পানি দ্বারা প্রাণীর সৃষ্টি সম্পর্কে বর্ণনা করে–

وَ اللّٰہُ خَلَقَ کُلَّ دَآبَّۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ

অর্থ : আল্লাহ প্রত্যেক প্রাণীকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা নূর : ৪৫)

নিচের আয়াতটিও পানি দ্বারা মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে বলে–

وَ ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ مِنَ الۡمَآءِ بَشَرًا فَجَعَلَہٗ نَسَبًا وَّ صِہۡرًا ؕ وَ کَانَ رَبُّکَ قَدِیۡرًا

অর্থ : তিনিই মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাকে বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। তোমার প্রতিপালক সবকিছু করতে সক্ষম। (সূরা ফুরকান : ৫৪)

২২
৮. উদ্ভিদবিজ্ঞান উদ্ভিদ সৃষ্টি হয় জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও স্ত্রীরূপে
মানুষ আগে জানত না যে, উদ্ভিদেরও পুরুষ ও স্ত্রীলিঙ্গের পার্থক্য রয়েছে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বলে যে, প্রত্যেক উদ্ভিদের পুরুষ ও স্ত্রীলিঙ্গ আছে। এমনকি সমলিঙ্গ বিশিষ্ট গাছেরও পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ আছে–

وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً ؕ فَاَخۡرَجۡنَا بِہٖۤ اَزۡوَاجًا مِّنۡ نَّبَاتٍ شَتّٰی

অর্থ : আর আকাশ থেকে তিনি পানি বর্ষণ করেন, আর তা দিয়ে আমি বিভিন্ন লতাযুগল উদ্‌গত করি, যার প্রত্যেকটি অন্যটি থেকে আলাদা। (সূরা ত্ব-হা : ৫৩)

২৩
ফলের মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রীলিঙ্গ আছে
وَ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ جَعَلَ فِیۡہَا زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ

অর্থ : আর প্রত্যেক ফলের মধ্যে তিনি দু’প্রকার বা জোড়া সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রাদ :৩)

ফল হল উন্নত জাতের গাছের উৎপাদন। ফল উৎপন্ন হওয়ার পূর্বের স্তর হল ফুল। ফুলের আছে পুরুষ অঙ্গ (পুং কেশর) এবং স্ত্রী অঙ্গ (ডিম্বক)। পরাগ রেণু বাহিত হয়ে ফুলে এসে পড়লে তাতে ফল ধরে। পালাক্রমে পরিপক্ক হয় এবং তার বীজ মুক্ত করে। সুতরাং সকল ফলই পুরুষ ও স্ত্রী অঙ্গের অস্তিত্ব সূচিত করে। এ সত্যই বর্ণিত হয়েছে আল কোরআনে।

বিশেষ কিছু প্রজাতি রয়েছে যেগুলোর ফল অনিষিক্ত ফুল থেকে আসে। এগুলোকে পার্থেনোকর্পিক ফল বলা হয়। যেমন : কলা, বিশেষ ধরনের আনারস। ডুমুর, কমলা, আঙ্গুর ইত্যাদি এগুলোরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য।

২৪
সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছে
وَ مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ خَلَقۡنَا زَوۡجَیۡنِ

অর্থ : আর আমি প্রত্যেক জিনিসকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত : ৪৯)

এ আয়াতটি সকল কিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করেছে। মানুষ ছাড়াও প্রাণী, গাছপালা, ফল-ফলাদিতে এ জোড়া লক্ষণীয়। বিদ্যুতে যেমন আছে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ, সেরকম প্রত্যেক বস্তুর পরমাণুতে ঋণাত্মক (Negative) চার্জবাহী, ইলেকট্রন ও ঋণাত্মক (Positive) চার্জবাহী প্রোটন আছে।

سُبۡحٰنَ الَّذِیۡ خَلَقَ الۡاَزۡوَاجَ کُلَّہَا مِمَّا تُنۡۢبِتُ الۡاَرۡضُ وَ مِنۡ اَنۡفُسِہِمۡ وَ مِمَّا لَا یَعۡلَمُوۡنَ

অর্থ : পূত পবিত্র সেই সত্তা যিনি জমিন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদকে, মানুষকে এবং যা তারা জানে না তার প্রত্যেককে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। (সূরা ইয়াসিন :৩৬)

কোরআন এখানে বলেছে যে, বর্তমানে মানুষ যা জানে না এবং পরবর্তী সময়ে যা আবিষ্কৃত হতে পারে সেগুলোসহ সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করা হয়েছে।

২৫
৯. প্রাণীবিজ্ঞান জ্ঞানী ও পাখি দল যা সম্প্রদায় হিসেবে বাস করে
وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا طٰٓئِرٍ یَّطِیۡرُ بِجَنَاحَیۡہِ اِلَّاۤ اُمَمٌ اَمۡثَالُکُمۡ ؕ مَا فَرَّطۡنَا فِی الۡکِتٰبِ مِنۡ شَیۡءٍ ثُمَّ اِلٰی رَبِّہِمۡ یُحۡشَرُوۡنَ

অর্থ : আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখি দু’ ডানাযোগে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতই একেকটি সম্প্রদায় বা দল। (সূরা আনআম : ৩৮)

গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাণী ও পাখি দল যা সম্প্রদায় হিসেবে বাস করে। অর্থাৎ তারা সুসংগঠিত হয় এবং একত্রে বসবাস ও কাজ করে।

২৬
পাখির উড্ডয়ন
পাখির উড্ডয়ন সম্পর্কে কোরআন বলেছে :

اَلَمۡ یَرَوۡا اِلَی الطَّیۡرِ مُسَخَّرٰتٍ فِیۡ جَوِّ السَّمَآءِ ؕ مَا یُمۡسِکُہُنَّ اِلَّا اللّٰہُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡن

অর্থ : তারা কি উড়ন্ত পাখি দেখে না? এগুলো আকাশের অন্তরীক্ষে আজ্ঞাধীন রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া কেউ এগুলোকে আগলে রাখে না। নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে। (সূরা নাহল : ৭৯)

একই ধরনের বক্তব্য নিচের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে :

اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اِلَی الطَّیۡرِ فَوۡقَہُمۡ صٰٓفّٰتٍ وَّ یَقۡبِضۡنَ ؔۘؕ مَا یُمۡسِکُہُنَّ اِلَّا الرَّحۡمٰنُ ؕ اِنَّہٗ بِکُلِّ شَیۡءٍۭ بَصِیۡرٌ

অর্থ : তারা কি লক্ষ্য করে না, তাদের মাথার ওপর উড়ন্ত পাখিকুলের প্রতি পাখা বিস্তারকারী ও পাখা সংকোচনকারী? মেহেরবান আল্লাহই তাদেরকে স্থির রাখেন। তিনি সর্ব বিষয়ে লক্ষ্য রাখেন। (সূরা মূলক :১৯-২০)

আরবি শব্দ امسك (আমছাকা) এর শাব্দিক অর্থ, ‘কারো হাত ওপরে রাখা, পাকড়াও করা, ধরে রাখা, কাউকে পেছন থেকে ধরে রাখা, –এগুলো এ ধারণা প্রকাশ করে যে, আল্লাহ স্বীয় ক্ষমতায়নে পাখিকে আকাশে ধরে রাখে। এ আয়াতগুলো আল্লাহর নিয়ম মোতাবেক পাখির আচরণের চুড়ান্ত নির্ভরতার ওপর জোর দেয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, নির্দিষ্ট প্রজাতির এমন সব পাখি রয়েছে, যাদের চলাচলে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির উৎকর্ষের পরিচয় বর্তমান। শুধু পাখির gentic code (যে পদ্ধতি অনুসারে বংশানুগতির তথ্য বা সংকেতাবলি জীবকোষস্থিত Chromosome-এ রক্ষিত থাকে) এ রক্ষিত গমনাগমন সম্পর্কিত কর্মসূচির কারণেই এ ধরনের পাখির বাচ্চারা পর্যন্ত দীর্ঘ ও দুর্গম যাত্রাপথের উদ্দিষ্ট সফরে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম, যাদের ইতিপূর্বে দেশান্তরে গমনাগমনের কোন প্রকার অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি কোন পথ নির্দেশনাও অনুপস্থিত। এরা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে প্রস্থান স্থানে পুনরায় ফিরেও আসতে পারে।

অধ্যাপক হামবার্গার তার ‘Power and Fragility’ নামক বইতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বসবাসকারী Multon bird (মেষ পাখি) নামক এক প্রকার পাখির উদাহরণ দিয়েছেন, এ পাখিরা ইংরেজি সংখ্যা ৪ (আট)-এর আকৃতিতে ১৫,০০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে এবং ৬ মাসের বেশি সময় নিয়ে এরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে এবং প্রস্থান স্থানে ফিরে আসতে বড়জোড় এক সপ্তাহ লাগে। এরূপ একটি ভ্রমণের জন্য পাখিদের স্নায়ুকোষে খুবই জটিল নির্দেশিকা বিদ্যমান আছে। এ জটিল সফর ও প্রত্যাবর্তনের কর্মসূচি নিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত। আমাদের কি উচিত নয় সেই সুনির্ধারিত কর্মসূচির প্রণেতার স্বরূপ বা পরিচয় জানার চেষ্টা করা?

২৭
মৌমাছি
وَ اَوۡحٰی رَبُّکَ اِلَی النَّحۡلِ اَنِ اتَّخِذِیۡ مِنَ الۡجِبَالِ بُیُوۡتًا وَّ مِنَ الشَّجَرِ وَ مِمَّا یَعۡرِشُوۡنَ . ثُمَّ کُلِیۡ مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ فَاسۡلُکِیۡ سُبُلَ رَبِّکِ ذُلُلًا

অর্থ : আর তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে নির্দেশ দিলেন : পাহাড়ের গায়ে গাছে এবং উঁচু চালে ঘর তৈরি কর। অতঃপর প্রত্যেক ফল থেকে আহার কর, এবং তোমার প্রতিপালকের (শিখানো) সহজ পদ্ধতি অনুসরণ কর। (সূরা নাহল : ৬৮-৬৯)

১৯৭৩ সালে ভন-ফ্রিচ মৌমাছির আচরণ ও যোগাযোগের ওপর গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কোন নতুন বাগান বা ফুলের সন্ধান পাওয়ার পর একটি মৌমাছি আবার মৌচাকে ফিরে যায় এবং ‘মৌমাছি নৃত্য’ নামক আবরণের মাধ্যমে তার সহকর্মী মৌমাছিদেরকে সেখানে যাওয়ার সঠিক গতিপথ ও মানচিত্র বলে দেয়। অন্যান্য শ্রমিক মৌমাছিকে তথ্য দেয়ার লক্ষ্যে এ ধরনের আচরণ আলোকচিত্র ও অন্যান্য পদ্ধতির সাহায্যে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কোরআন উপরের আয়াতের সাহায্যে কিভাবে তার পালনকর্তার প্রশস্ত পথের সন্ধান পায় তা উল্লেখ করেছে।

শ্রমিক মৌমাছি বা সৈনিক মৌমাছি হচ্ছে স্ত্রী মৌমাছি। সূরা আন-নাহলের উপরিউক্ত ৬৮ ও ৬৯ নং আয়াতে উল্লিখিত ক্রিয়াপদে স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে ( کلى এবং فاسلکلى চল ও খাও)। এর দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, খাদ্যের অন্বেষণে বাসা ত্যাগকারী মৌমাছি হল স্ত্রী মৌমাছি। অন্য কথায়, সৈনিক কিংবা শ্রমিক মৌমাছি হচ্ছে স্ত্রীজাতীয় মৌমাছি।

বস্তুত শেক্সপিয়ারের ‘Henry the forth’ নাটকের কিছু সংলাপে মৌমাছি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মৌমাছিরা হল সৈনিক এবং তাদের একটি রাজা রয়েছে। শেক্সপিয়ারের যুগে মানুষ মৌমাছি সম্পর্কে এ রকমই ভাবত। তারা ভাবত যে, কর্মী মৌমাছিরা পুরুষ এবং ঘরে ফিরে তাদেরকে একটি রাজা মৌমাছির কাছে জবাবদিহি করতে হয়। যাহোক, এটা সত্য নয়। শ্রমিক মৌমাছিরা হল স্ত্রী এবং তারা রাজা মৌমাছির কাছে নয় বরং রানী মৌমাছির কাছে জবাবদিহি করে। কিন্তু এ বিষয়টি ৩০০ বছর পূর্বে আধুনিক অনুসন্ধানে আবিষ্কৃত হয়েছে (অথচ কোরআন তা ১৪০০ বছর পূর্বে বলেছে)।

২৮
মাকড়সার জাল বা বাসস্থান ক্ষণভঙ্গুর দুর্বল
কোরআন সূরা আনকাবুতের ৪১ নং আয়াতে বলেছে–

مَثَلُ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ اَوۡلِیَآءَ کَمَثَلِ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۖۚ اِتَّخَذَتۡ بَیۡتًا ؕ وَ اِنَّ اَوۡہَنَ الۡبُیُوۡتِ لَبَیۡتُ الۡعَنۡکَبُوۡتِ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ

অর্থ : যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অপরকে সাহায্যকারীরূপে গ্রহণ করে, তাদের উপমা মাকড়সার মত, যে নিজের জন্য একটি ঘর বানায়। নিশ্চয়ই সব ঘরের চেয়ে মাকড়সার ঘরই অধিক দুর্বল যদি তারা জানত। (সূরা আনকাবুত : ৪১)

কোরআন হালকা-পাতলা, সূক্ষ্ম, দুর্বলক্ষণভঙ্গুর হিসেবে মাকড়সার জালের বাহ্যিক বর্ণনা দেয়া ছাড়াও কোরআন মাকড়সার ঘরে আত্মীয়তার অসারতার ওপরেও জোর প্রদান করেছে। মাকড়সার ঘরেই স্ত্রী মাকড়সা কর্তৃক তার সহকর্মী পুরুষ মাকড়সাকে হত্যা করা হয়।

২৯
পিঁপড়ার জীবনধারা ও যোগাযোগ
কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি মনোযোগের সাথে ভাবা যাক–

وَ حُشِرَ لِسُلَیۡمٰنَ جُنُوۡدُہٗ مِنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ وَ الطَّیۡرِ فَہُمۡ یُوۡزَعُوۡنَ . حَتّٰۤی اِذَاۤ اَتَوۡا عَلٰی وَادِ النَّمۡلِ ۙ قَالَتۡ نَمۡلَۃٌ یّٰۤاَیُّہَا النَّمۡلُ ادۡخُلُوۡا مَسٰکِنَکُمۡ ۚ لَا یَحۡطِمَنَّکُمۡ سُلَیۡمٰنُ وَ جُنُوۡدُہٗ ۙ وَ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ

অর্থ : সোলায়মানের সামনে তার সেনাবাহিনীকে সমবেত করা হয়েছিল। জ্বীন, মানুষ এবং পাখিদের থেকে আর তাদের কুচকাওয়াজ করানো হলো। তারপর যখন তারা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল, তখন এক পিপীলিকা বলল, হে পিপীলিকার দল, তোমরা তোমাদের ঘরে প্রবেশ কর। অন্যথায় সোলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষে ফেলবে। (সূরা আন নামল :১৭-১৮)

অতীতে কেউ হয়তো এই বলে কোরআনের প্রতি উপহাস করে থাকতে পারে যে, কোরআন যাদুকরী বা রূপকথার কাহিনীর বই, যাতে পিঁপড়ার পরস্পরের কথা এবং উন্নত বার্তা বিনিময়ের বিষয়ে উল্লেখ আছে। সাম্প্রতিককালে গবেষণায় পিঁপড়ার জীবনধারা সম্পর্কে কিছু বাস্তবতা জানা গেছে, যেগুলো মানুষের পূর্বে জানা ছিল না।

গবেষণায় বলা হয়েছে মানুষের জীবনধারার সাথে যে সকল প্রাণী ও কীটপতঙ্গের অধিকতর মিল রয়েছে, তা হল পিঁপড়া। পিঁপড়া সম্পর্কে নিচের তথ্যগুলো থেকে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করা যায়।

ক. মানুষের মত পিঁপড়ারা তাদের মৃতদেহকে কবরস্থ করে।

খ. পিঁপড়াদের মধ্যে উন্নত পর্যায়ের শ্রম বিভাজন পদ্ধতি রয়েছে। পূর্ণমাত্রায় তাদের মধ্যে মহা ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক, সর্দার, শ্রমিক ইত্যাদি রয়েছে।

গ. মাঝে মাঝে তারা খোশগল্প করতে একত্রিত হয়।

ঘ. নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য তাদের রয়েছে উন্নত যোগাযোগ পদ্ধতি।

ঙ. দ্রব্য বিনিময়ের জন্য তারা নিয়মিত বাজার বানায়।

চ. শীতকালে দীর্ঘ সময়ের জন্য তারা খাদ্যশস্য জমা করে রাখে এবং খাদ্যশস্য যদি অঙ্কুরিত হয়, তাহলে তারা শিকড় কেটে দেয়; মনে হয়, তারা এটা বুঝতে পারে যে, খাদ্যশস্যকে অঙ্কুরিত অবস্থায় রেখে দিলে তা পচে যাবে। যদি তাদের মজুদকৃত শস্যদানা বৃষ্টিতে ভিজে যায়, তাহলে এগুলোকে রৌদ্রে শুকাতে বাইরে নিয়ে যায় এবং শুকানোর পর পুনরায় ভেতরে নিয়ে আসে। মনে হয় তারা এটাও জানে যে, আর্দ্রতার কারণে শস্যদানায় মুকুল বের হতে পারে, ফলে শস্যদানার পচন হতে পারে।

৩০
১০. চিকিৎসাবিজ্ঞান মধু মানুষের জন্য আরোগ্যকারী
মৌমাছিরা বিভিন্ন প্রকারের ফুল এবং ফলের রস শোষণ করে এবং নিজের শরীরের মধ্যে মধু তৈরির পর তা মোম কোষে জমা করে। মাত্র কয়েক শতাব্দী পূর্বে মানুষ জানতে পারে যে, মধু মৌমাছির পেট থেকে তৈরি হয়। অথচ বাস্তব সত্যটি ১৪০০ বছর আগে পবিত্র কোরআনের নিন্মোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘অতঃপর প্রত্যেক ফল থেকে আহার কর, এরপর তোমার প্রতিপালকের (শিখানো) সহজ পদ্ধতি অনুসরণ কর।

یَخۡرُجُ مِنۡۢ بُطُوۡنِہَا شَرَابٌ مُّخۡتَلِفٌ اَلۡوَانُہٗ فِیۡہِ شِفَآءٌ لِّلنَّاس

অর্থ : তাদের পেট থেকে বেরিয়ে আসে একটি পানীয়, বিচিত্র যার বর্ণ, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য রোগমুক্তি। (সূরা নাহল : ৬৯)

বর্তমানে আমরা জানি যে, মধুর রোগ নিরাময়ের বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এটা লঘু জীবাণুনাশক জাতীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ানরা তাদের ক্ষত শুকানোর জন্য মধু ব্যবহার করত। ক্ষতস্থানে আর্দ্রতা থাকলে সামান্য পরিমাণ ক্ষত স্থান নিরাময় হয়। মধুর ঘনত্বের কারণে ক্ষতস্থানে কোন ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে না।

যদি কোন ব্যক্তি কোন গাছের ফলের এলার্জি রোগে ভোগে, তাহলে তাকে ঐ গাছ থেকে আহরিত মধু পান করালে তার এলার্জি প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মধুতে ফল শর্করা বা ফ্রুকটোজ (Fructose) এবং ভিটামিন k (কে) রয়েছে।

মধুর উৎস বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত জ্ঞান, কোরআন নাযিলের কয়েক শতাব্দী পরে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন।

৩১
১১. শরীর তত্ত্ববিদ্যা রক্ত সঞ্চালন এবং দুধের উৎপাদন
মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে নাফীসের ৬০০ বছর পূর্বে এবং পশ্চিমা বিশ্বে উইলিয়াম হারওয়ে কর্তৃক রক্ত চলাচলের ধারণা দেয়ার ১০০০ বছর পূর্বে, কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। প্রায় ১৩০০ বছর পূর্বে এটা জানা ছিল যে, অন্ত্রে কি ঘটে এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান শোষিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পুষ্টি সাধন করে। কোরআনের একটি আয়াত দুধের উপাদানের উৎস সম্পর্কে বর্ণনা করে, যা এ মতবাদগুলোর সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ওপরের মতগুলোর ব্যাপারে কোরআনের আয়াত বুঝাতে হলে, এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে, অন্ত্রনালীতে কি কি রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটে এবং সেখান থেকে অর্থাৎ খাদ্যের নির্যাস কি করে একটি জটিল প্রক্রিয়ায় রক্তে প্রবাহিত হয়। কখনো কখনো তা রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে লিভারের মাধ্যমে রক্তে প্রবাহিত হয়। রক্ত সেগুলোকে শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সরবরাহ করে, যার মধ্যে দুধ উৎপাদনকারী লালাগ্রন্থিও অন্তর্ভুক্ত।

সহজ কথায়, অন্ত্রনালীর কিছু বিশেষ ধরনের নির্যাস অন্ত্রের আবরণের মধ্যদিয়ে বেরিয়ে আসে এবং এ নির্যাসগুলো রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছায়।

যদি আমরা কোরআনের নিম্নলিখিত আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে চাই, তাহলে উল্লেখিত ধারণাটির যথার্থ মূল্যায়ন করা যায়।

وَ اِنَّ لَکُمۡ فِی الۡاَنۡعَامِ لَعِبۡرَۃً ؕ نُسۡقِیۡکُمۡ مِّمَّا فِیۡ بُطُوۡنِہٖ مِنۡۢ بَیۡنِ فَرۡثٍ وَّ دَمٍ لَّبَنًا خَالِصًا سَآئِغًا لِّلشّٰرِبِیۡنَ

অর্থ : আর নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুসমূহের মধ্যে চিন্তা করার বিষয় রয়েছে। আমি তোমাদেরকে পান করাই তাদের উদরাস্থিত বস্তুসমূহের মধ্য থেকে গোবর ও রক্ত নিঃসৃত দুধ যা পানকারীদের জন্য উপকারী। (সূরা আন নাহল : ৬৬)

وَ اِنَّ لَکُمۡ فِی الۡاَنۡعَامِ لَعِبۡرَۃً ؕ نُسۡقِیۡکُمۡ مِّمَّا فِیۡ بُطُوۡنِہَا وَ لَکُمۡ فِیۡہَا مَنَافِعُ کَثِیۡرَۃٌ وَّ مِنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ

অর্থ : আর নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুসমূহের মধ্যে চিন্তা করার বিষয় রয়েছে। আমি তোমাদেরকে তাদের পেটে যা আছে (দুধ) তা থেকে পান করাই। আর তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে বহুবিধ উপকার। তোমরা তা থেকে খাও। (সূরা মুমিনুন : ২১)

গবাদি পশুর দুধ উৎপাদন সম্পর্কে কোরআনের বর্ণনা আর আধুনিক শরীর তত্ত্ববিদ্যা যা আবিষ্কার করেছে তা বিস্ময়করভাবে মিলে যায়।

৩২
১২. ভ্রূণতত্ত্ব বিদ্যা মানুষ ‘আলাক্ব’ - জোঁকের মত বস্তু হতে সৃষ্ট
কয়েক বছর আগে একদল আরব পণ্ডিত কোরআন হতে ভ্রূণ বিজ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। সেক্ষেত্রে তারা কোরআনের এ উপদেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রেখেছেন–

فَسۡـَٔلُوۡۤا اَہۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ

অর্থ : অতএব জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমাদের জানা না থাকে। (সূরা আম্বিয়া : ৭)

কোরআন থেকে ভ্রূণসংক্রান্ত সকল তথ্যকে একত্রিত করে ইংরেজিতে অনুবাদ করার পর কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রূণ অধ্যাপক এবং এনাটমি (জীবদেহের গঠনসংক্রান্ত বিজ্ঞান) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ কেইথ মূরের নিকট উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে তিনি ভ্রূণ তত্ত্ববিদ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের অন্যতম।

কোরআনে ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রদান করা হয়েছে সেই সম্পর্কে তার মতামত প্রদান করতে অনুরোধ করা হয়। তার নিকট উপস্থাপিত কোরআনের আয়াতের অনুবাদগুলো সতর্কতার সাথে যাচাই করার পর ডঃ মূর বলেন, যে ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কে কোরআনের উল্লেখিত অধিকাংশ তথ্য ভ্রূণ তত্ত্বের আধুনিক আবিষ্কারের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায় এবং কোনোক্রমেই এগুলোর মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয় না। তিনি আরও বলেন যে, কিছু আয়াত রয়েছে যার বৈজ্ঞানিক সত্যতা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করতে পারেন না। সেগুলো সত্য না মিথ্যা তাও তিনি বলতে পারেন নি, কারণ ঐ আয়াতগুলোতে বর্ণিত তথ্যসমূহ সম্পর্কে তিনি নিজেই জ্ঞাত নন। আধুনিক ভ্রূণ তত্ত্ব বিদ্যায় বা লেখায় সেগুলোর কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

ঐ ধরনের একটি আয়াত হল–

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ . خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ

অর্থ : পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। (সূরা আলাক্ব : ১-২)

আরবি শব্দ علق (আলাক্ব) এর অর্থ ‘জমাট রক্ত’। এর অন্য অর্থ হল– দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে এমন আঠালো জিনিস। যেমন, জোঁক কামড় দিয়ে আটকে থাকে।

ডঃ কেইথ মূর জানতেন না যে, প্রাথমিক পর্যায়ে একটি ভ্রূণকে জোঁকের মত দেখায় কিনা। একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ভ্রূণের প্রাথমিক অবস্থা যাচাই করতে গবেষণা শুরু করেন এবং প্রাথমিক দশায় ভ্রূণের আকৃতির সাথে একটি জোঁকের আকৃতিকে তুলনা করেন। তিনি এ দুটোর মধ্যে অদ্ভুত মিল দেখে অভিভূত হয়ে যান। একইভাবে ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কে তার অজানা অনেক জ্ঞান তিনি কোরআনের থেকে লাভ করেন।

ডঃ কেইথ মুর কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কিত আশিটির মত প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, ভ্রূণ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কারের সাথে সর্বশেষ আবিষ্কৃত তথ্যের পূর্ণ মিল রয়েছে। প্রফেসর মূর বলেন, ‘আমাকে যদি আজ থেকে ৩০ বছর পূর্বে এ সকল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হত, তাহলে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অভাবে আমি সেগুলোর অর্ধেকেরও উত্তর দিতে পারতাম না।’

ডঃ কেইথ মূর ইতিপূর্বে ‘The Dveloping Human’ নামক একটি বই লিখেছিলেন। কোরআন থেকে নতুন জ্ঞান অর্জনের পর তিনি ১৯৮২ সালে বইটির তৃতীয় সংস্করণ লিখেন। বইটি একক লেখকের সর্বোত্তম চিকিৎসা বই হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। বইটি বিশ্বের বড় বড় অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং প্রথম বর্ষের মেডিকেল কলেজের ভ্রূণতত্ত্বের পাঠ্য বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

১৯৮১ সালে সৌদি আরবের দাম্মামে সপ্তম মেডিকেল কনফারেন্সে ডা. মূর বলেছেন, “কোরআনে বর্ণিত মানুষের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে তথ্যাবলির ব্যাখ্যা প্রদানের সুযোগ পেয়ে আমি গভীরভাবে আনন্দিত। এটা আমার নিকট অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ সকল বর্ণনা অবশ্যই আল্লাহর নিকট হতেই এসেছিল। কারণ, এগুলোর প্রায় সকল জ্ঞানই পরবর্তী বহু শতাব্দী পরেও আবিষ্কৃত হয় নি। এটা আমার কাছে প্রমাণ করে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই আল্লাহর রাসূল।

যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে বেলর কলেজ অব মেডিসিনের ধাত্রীবিদ্যা ও স্ত্রীরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান ডঃ জো লিগ সিম্পসান ঘোষণা করেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণিত এসব হাদীস সপ্তম শতাব্দীতে বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে সংগৃহীত হয় নি। তাই পরবর্তীতে দেখা গেল যে, ধর্মের সাথে বংশগতিবিষয়ক বিজ্ঞান বা প্রজননশাস্ত্রের কোন পার্থক্য নেই; উপরন্তু প্রচলিত বৈজ্ঞানিক মতের সাথে ধর্ম তার বিস্ময়কর জ্ঞানকে যুক্ত করার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে পথ প্রদর্শন করতে পারে.... কোরআনের বর্ণিত বর্ণনাগুলো কয়েক শতাব্দী পরে যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে; যাতে বুঝা যায় যে, কোরআনের জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত।’

৩৩
মেরুদণ্ড ও পাজরের মধ্য থেকে নির্গত তরল পদার্থের ফোটা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে
فَلۡیَنۡظُرِ الۡاِنۡسَانُ مِمَّ خُلِقَ . خُلِقَ مِنۡ مَّآءٍ دَافِقٍ . یَّخۡرُجُ مِنۡۢ بَیۡنِ الصُّلۡبِ وَ التَّرَآئِبِ

অর্থ : সুতরাং মানুষের ভেবে দেখা উচিত কোন বস্তু হতে সে সৃজিত হয়েছে। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে বের হয়ে আসা পানি থেকে। তা বের হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষ পাঁজরের মাঝ থেকে। (সূরা তারিক : ৫-৭)

জন্মপূর্ব অবস্থায় বিকাশের স্তরে, পুরুষ ও স্ত্রীর জননেন্দ্রিয়গুলো যেমন, পুরুষের অণ্ডকোষ ও নারীর ডিম্বাশয়, কিডনীর কাছে মেরুদণ্ড স্তম্ভ এবং ১১শ ও ১২শ বক্ষ পাঁজরের হাড়ের মাঝে বিকশিত হওয়া শুরু করে। তারপর সেগুলো নিচে নেমে আসে। স্ত্রীর ডিম্বাশয় মেরুদণ্ডের নিচে ও নিতম্বের মধ্যেকার অস্থিকাঠামোর মধ্যে এসে থেমে যায়। কিন্তু জন্মের আগ পর্যন্ত পুরুষের অণ্ডকোষ উরুর গোড়ার নালী দিয়ে অণ্ডকোষের থলিতে নেমে আসার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। এমনকি বয়ঃপ্রাপ্ত অবস্থায় জননেন্দ্রিয় নিচে নেমে আসার পরেও মেরুদণ্ড ও বক্ষপাঁজরের মাঝে অবস্থিত উদরসংক্রান্ত বড় ধমনি থেকে এ অঙ্গগুলো উদ্দীপনা ও রক্ত সরবরাহ গ্রহণ করে। এমনকি রসজাতীয় পদার্থ বহনকারী নালী এবং শিরাগুলো একই এলাকায় গিয়ে মিলিত হয়।

৩৪
মানুষকে সৃষ্টি করা হয় নুতফাহ (অতি সামান্য পরিমাণ তরল) থেকে
মহিমান্বিত কোরআন কমপক্ষে এগার বার উল্লেখ করেছে যে, মানুষ নুতফাহ থেকে সৃষ্ট। ‘নুতফাহ’-এর অর্থ হল ‘নগণ্য পরিমাণ তরল’ বা ‘এক ফোটা তরল’ যা পেয়ালাশূন্য করার পর পড়ে থাকে। এ বিষয়টি কোরআনের নিম্নলিখিত স্থানে উল্লিখিত হয়েছে–

১৬:৪; ১৮:৩৭, ২২:৫; ২৩:১৩; ৩৫:১১; ৩৬:৭৭; ৪০:৬৭; ৫৩:৪৬; ৭৬:৩৭; ৭৬:২ এবং ৮০:১৯।

সম্প্রতি বিজ্ঞান দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছে যে, একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার জন্য গড়ে ৩০ লক্ষ শুক্রাণু হতে একটি মাত্র শুক্রাণুর প্রয়োজন অর্থাৎ, নিষিক্তকরণের জন্য শুধু নির্গত শুক্রকীটের ১/৩ মিলিয়ন ভাগ অথবা ০.০০০০৩% শুক্রাণুর প্রয়োজন।

৩৫
মানুষ সৃষ্টি হয় ছুলালাহ (তরল পদার্থের নির্যাস) থেকে
ثُمَّ جَعَلَ نَسۡلَہٗ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ مَّآءٍ مَّہِیۡنٍ

অর্থ : অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন, তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে। (সূরা সাজদাহ :৮)

আরবি শব্দ سللة (সুলালাহ) মানে তরল পদার্থের নির্যাস বা অবিভক্ত কোন বস্তুর সর্বোত্তম অংশ। আমরা এখন জানতে পেরেছি যে, পুরুষের দেহে তৈরি কয়েক মিলিয়ন শুক্রাণু থেকে ডিম্বাণুতে প্রবেশকারী একটি মাত্র শুক্রাণুই নিষেক ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য আবশ্যক। কয়েক মিলিয়নের মধ্য থেকে এই একটি মাত্র শুক্রাণুকীটকে কোরআন ‘সুলালাহ’ বলে উল্লেখ করেছে। বর্তমানে আমরা এটাও জেনেছি যে, স্ত্রী কর্তৃক উৎপাদিত হাজার হাজার ডিম্বাণুর মধ্য হতে মাত্র একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে থাকে। হাজার হাজার ডিম্বাণু থেকে কেবল একটি ডিম্বাণুকেও ‘সুলালাহ’ নামে কোরআন উল্লেখ করেছে।

তরল পদার্থ থেকে সুষমভাবে বের করে আনার অর্থেও ‘সুলালাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তরল পদার্থ দ্বারা জননকোষ ধারণকারী নারী ও পুরুষের ডিম্বাণু সংক্রান্ত তরল পদার্থকে বোঝায়। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উভয়কে নিষিক্তকরণের প্রক্রিয়ায় সুষমভাবে তাদের নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে বের করে আনা হয়।

৩৬
মানুষকে নুতফাতুন আমশা-জ (মিশ্রিত তরল পদার্থ) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে
নিচের আয়াতটির দিকে লক্ষ করা যাক–

اِنَّا خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاجٍ

অর্থ : আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে। (সূরা আদ-দাহর : ২)

আরবি শব্দ : نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاج (নুতফাতুন আমসা-জ)-এর অর্থ হচ্ছে, মিশ্রিত তরল পদার্থ। কোরআনের কতিপয় মুফাসসিরদের মতে, মিশ্রিত তরল পদার্থ বলতে পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ জাতীয় ধারক বা তরল পদার্থকে বুঝায়।

নারী ও পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিশ্রিত হওয়ার পরেও ভ্রূণ নুতফা আকারে অবস্থান করে। মিশ্রিত তরল পদার্থ শুক্রাণুজাতীয় তরল পদার্থকেও বুঝানো হতে পারে যা বিভিন্ন লালাগ্রন্থির নিঃসরিত রস থেকে তৈরি হয়।

সুতরাং نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاج (নুতফাতুন আমসা-জ)-এর অর্থ দাঁড়ায়, নারী ও পুরুষের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু এবং এগুলোর চতুর্পাশের তরল পদার্থের কিছু অংশ।

৩৭
লিঙ্গ নির্ধারণ
ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয় শুক্রাণুর প্রকৃতির দ্বারা ডিম্বাণুর প্রকৃতির দ্বারা নয়। একটি শিশু নারী বা নর তা নির্ভর করে ২৩তম ক্রোমোজোম (Chromosomes) যথাক্রমে XX না XY তার ওপর।

প্রধানত লিঙ্গ নির্ধারণ করার কাজটি হয়ে থাকে নিষিক্তকরণের সময় এবং এটা নির্ভর করে ডিম্বাণুকে শুক্রাণুর কোন প্রকার লিঙ্গ ক্রোমজোম নিষিক্ত করে তার ওপর। যদি এটা X বহনকারী শুক্রাণু হয় যা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, তাহলে ভ্রূণ হবে স্ত্রীলিঙ্গ এবং যদি এটা Y বহনকারী শুক্রাণু হয় তাহলে ভ্রূণ হবে পুংলিঙ্গ।

وَ اَنَّہٗ خَلَقَ الزَّوۡجَیۡنِ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰی . مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اِذَا تُمۡنٰی

অর্থ : তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী একবিন্দু থেকে যখন স্খলিত করা হয়। (সূরা আন-নাজম : ৪৫-৪৬)

আরবি শব্দ (নুতফা) نطفة অর্থ, সামান্য পরিমাণ তরল পদার্থ এবং تمنى (তুমনা) অর্থ স্খলিত বা নির্গত। সেহেতু নুতফা দ্বারা শুক্রাণুকেই বুঝানো হয়, কারণ শুক্রকীটই স্খলিত হয়।

কোরআন বলে–

اَلَمۡ یَکُ نُطۡفَۃً مِّنۡ مَّنِیٍّ یُّمۡنٰی . ثُمَّ کَانَ عَلَقَۃً فَخَلَقَ فَسَوّٰی . فَجَعَلَ مِنۡہُ الزَّوۡجَیۡنِ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰی

অর্থ : সে কি স্খলিত এক ফোটা শুক্রকীট ছিল না? অতঃপর সে পরিণত হয় এমন কিছুতে যা লেগে থাকে, এরপর আল্লাহ তাকে আকৃতি দান করলেন এবং যথার্থরূপে সুবিন্যস্ত করেন। তারপর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন যুগল নর ও নারী। (সূরা ক্বিয়ামাহ :৩৭-৩৯)

এখানে পুনরায় نطفةمن مني শব্দ দ্বারা ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য সাহায্যকারী হিসেবে পুরুষের নিকট থেকে আসা খুবই অল্প পরিমাণ শুক্রকীটকে বুঝানো হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশের শাশুরিরা প্রায়ই নাতী (ছেলে সন্তান) কামনা করে এবং যদি নাতনী (মেয়ে সন্তান) হয় তাহলে তারা পুত্র বধূকে দোষারোপ করেন। যদি তারা জানত যে, নারীর ডিম্বাণুর প্রকৃতি নয় বরং পুরুষের শুক্রকীটের প্রকৃতিই লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য দায়ী। তাই কন্যা সন্তান প্রসবের জন্য পুত্রবধূদের দোষারোপ করা উচিত নয়। গর্ভের সন্তান ছেলে শিশু না হয়ে মেয়ে শিশু হওয়ার জন্য একমাত্র পিতাই দায়ী। নারীর ডিম্বানুর ২৩ জোড়া ক্রোমোজমই নেগেটিভ কিন্তু পুরুষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে কিছু নেগেটিভ, কিছু পজেটিভ। এ কারণেই কোরআন ও বিজ্ঞান উভয়ই পুরুষের শুক্রকীটকেই একমাত্র লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য দায়ী হিসেবে উল্লেখ করে।

৩৮
অন্ধকারের তিনটি পর্দার দ্বারা ভ্রূণ সংরক্ষিত
یَخۡلُقُکُمۡ فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّہٰتِکُمۡ خَلۡقًا مِّنۡۢ بَعۡدِ خَلۡقٍ فِیۡ ظُلُمٰتٍ ثَلٰثٍ

অর্থ : তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে এক অবস্থার পর অন্য অবস্থায় তিন তিনটি অন্ধকার পর্দার ভেতরে। (সূরা যুমার : ৬)

অধ্যাপক ডঃ কেইথ মূরের মতানুসারে কোরআনের এ তিনটি স্তরের অন্ধকার বলতে বুঝায়–

১. মায়ের গর্ভের সম্মুখের প্রাচীর;

২. জরায়ুর প্রাচীর;

৩. সেই ঝিল্লি যা শিশুকে ঢেকে রাখে।

৩৯
ভ্রূণের পর্যায়সমূহ
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ طِیۡنٍ . ثُمَّ جَعَلۡنٰہُ نُطۡفَۃً فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ . ثُمَّ خَلَقۡنَا النُّطۡفَۃَ عَلَقَۃً فَخَلَقۡنَا الۡعَلَقَۃَ مُضۡغَۃً فَخَلَقۡنَا الۡمُضۡغَۃَ عِظٰمًا فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ٭ ثُمَّ اَنۡشَاۡنٰہُ خَلۡقًا اٰخَرَ ؕ فَتَبٰرَکَ اللّٰہُ اَحۡسَنُ الۡخٰلِقِیۡنَ

অর্থ : আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে তৈরি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্র বিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়।’ (সূরা মুমিনূন : ১২-১৪)

এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, قرار ملين (ক্বারাবীন কামীন) বা দৃঢ়ভাবে অটল এক বিশ্রামের স্থানে সুরক্ষিত অতি সামান্য পরিমাণ তরল পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। পিছনের মাংসপেশী যে মেরুদণ্ডটিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে সেই মেরুদণ্ডের দ্বারা জরায়ুর পশ্চাতে ভাগ হতে উত্তমরূপে সংরক্ষিত। তাছাড়াও গর্ভফুলের রস ধারণকৃত গর্ভস্থলী দ্বারা ভ্রূণ সংরক্ষিত। সুতরাং ভ্রূণের একটি সুরক্ষিত নিরাপদ বাসস্থান রয়েছে।

এ অল্প পরিমাণ তরল علق (আলাক্বে) এ পরিণত হয়। এর অর্থ হল, যা আটকে থাকে। এটার আরেক অর্থ হল, ‘জোঁক’ সদৃশ বস্তু। উভয় বর্ণনাই বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণীয়। কেননা, প্রাথমিক অবস্থায় ভ্রূণ দেয়ালের সাথে লেগে থাকে এবং এটাকে আবার জোঁকের আকৃতির মত দেখায়। তাছাড়া এটি জোঁকের (রক্তচোষক) মতই আচরণ করে। এটা মায়ের গর্ভফুলের মধ্যদিয়ে রক্ত সরবরাহ করে।

علق (আলাক্ব) শব্দের তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, ‘রক্তপিণ্ড।’ গর্ভের তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে রক্তপিণ্ডের স্তরে থাকাবস্থায় রক্তপিণ্ডটি তরল পদার্থ বেষ্টিত বন্ধ থলির মধ্যে অবস্থান করে। সুতরাং একই সময়ে রক্তের আকৃতির পাশাপাশি জোঁকের আকৃতিও ধারণ করে। নির্দ্বিধায় গ্রহণযোগ্য কোরআনের জ্ঞানকে মানুষের বৈজ্ঞানিক তথ্য অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টার সাথে তুলনা করুন।

১৬৭৭ সালে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী হাম এবং লিউন হুক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের শুক্রকোষ পর্যবেক্ষণ করেন। তারা ভেবেছিলেন যে, অতি ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষ জরায়ু কোষে থাকে যা জরায়ুতে বিকাশ লাভ করে নবজাতকরূপে গড়ে ওঠার জন্য। এটি ‘The perforation Theory’ বা ছিদ্রকরণ তত্ত্ব নামে পরিচিত ছিল। যখন বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন যে, শুক্রাণুর চেয়ে ডিম্বাণু বড়, তখন ডিগ্রাফের মত বিজ্ঞানীসহ অন্যান্য বিজ্ঞানী চিন্তা করলেন ডিম্বাণুর মধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতির ভ্রূণ বিকশিত হয়। পরবর্তীতে ১৮ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী মাওপারটুইস ‘মাতা-পিতার দ্বৈত’ উত্তরাধিকার তত্ত্ব ব্যাপকভাবে প্রচার করেন।

علقة (আলাক্বা) রূপান্তরিত হয় مضغة (মুদগাহ)-তে, যার অর্থ হচ্ছে, ‘যা চিবানো হয় (দাঁত দিয়ে)’ এবং এমন আঁঠালো এবং ছোট যা গামের মত মুখে দেয়া যেতে পারে। এ উভয় ব্যাখ্যাই বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। অধ্যাপক ডঃ কেইথ মুর একটি প্লাস্টার সিল নিয়ে এটিকে ভ্রূণের প্রাথমিক স্তরের মত তৈরি করে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে মুদগায় পরিণত করতে চেষ্টা করেন। তিনি এ প্রক্রিয়াকে ভ্রূণের প্রাথমিক স্তরের চিত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি দেখেন চিবানো প্লাস্টার সিলে দাঁতের দাগ Somites-এর মত সাদৃশ্যপূর্ণ আর এটাই হল মেরুদণ্ডের প্রাথমিক গঠন।

مضغة (মুদগাহ) পরিণত হয় عظام (ইযাম) বা হাড়ে। হাড়গুলোকে এক খণ্ড মাংস বা মাংসপেশি لحم (লাহুম) পরানো হয়। এরপর আল্লাহ একে তৈরি করেন ভিন্ন সৃষ্টিতে।

অধ্যাপক মার্শাল জনসন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় বিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার থমসন জেফারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দানিয়েল ইনস্টিটিউটের সম্মানিত পরিচালক ও জীবদেহের গঠন সংক্রান্ত বিজ্ঞান (Anatomy) বিভাগের প্রধান। তার নিকট ভ্রূণসংক্রান্ত কোরআনের আয়াতের ভ্রূণ তাত্তিক পর্যায়গুলো সম্পর্কে কোরআনের আয়াতগুলো সমকালীন কোন মত হতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, সম্ভবত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছিল। যখন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হল যে, কোরআন ১৪০০ বছর আগে অবতীর্ণ হয়েছে, আর অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বহু শতাব্দী পর। তখন তিনি হাসেন এবং স্বীকার করেন যে, প্রথম আবিষ্কৃত অণুবীক্ষণ যন্ত্র কোন ক্ষুদ্র জিনিসকে ১০ গুণের বেশি বড় করে দেখাতে পারত না। এবং পরিষ্কার ছবিও দেখাতে পারত না। তারপর তিনি বলেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোরআন পাঠ করেন, তখন তাঁর ওপর ঐশী বাণী নাযিল হওয়ার বিষয়ে কোন বিরোধ দেখি না।’

ডঃ কেইথ মূরের মতে, বিশ্বজুড়ে গৃহীত আধুনিক কালের ভ্রূণবিষয়ক উন্নয়ন স্তর সহজে বোধগম্য নয়। কারণ, এতে স্তরগুলোকে সংখ্যাগতভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, ১ম স্তর, ২য় স্তর ইত্যাদি। পক্ষান্তরে যে স্তরগুলো ভ্রূণ অতিক্রম করে তার শ্রেণীবিভাগ কোরআনের বর্ণনানুসারে পার্থক্যসূচক এবং সহজেই এগুলোর আকার-প্রকৃতি চিহ্নিত করা যায়। এগুলো জন্মপূর্ব বিভিন্ন স্তরের ওপর ভিত্তিশীল ও বোধগম্য এবং বাস্তব, বৈজ্ঞানিক ও সাবলীল বর্ণনার ধারণাকারী।

নিচের আয়াতগুলোতেও মানুষের ভ্রূণ বিকাশের স্তরগুলো বর্ণিত হয়েছে–

اَلَمۡ یَکُ نُطۡفَۃً مِّنۡ مَّنِیٍّ یُّمۡنٰی . ثُمَّ کَانَ عَلَقَۃً فَخَلَقَ فَسَوّٰی . فَجَعَلَ مِنۡہُ الزَّوۡجَیۡنِ الذَّکَرَ وَ الۡاُنۡثٰی

অর্থ : সে কি স্খলিত বীর্য ছিল না? এরপর সে ছিল রক্তপিণ্ড, তারপর আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সুবিন্যস্ত করেছেন। অতঃপর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন যুগল নর ও নারী। (সূরা ক্বিয়ামাহ : ৩৭-৩৯)

الَّذِیۡ خَلَقَکَ فَسَوّٰىکَ فَعَدَلَکَ . فِیۡۤ اَیِّ صُوۡرَۃٍ مَّا شَآءَ رَکَّبَکَ

অর্থ : যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন। তিনি তোমাকে তার ইচ্ছেমত আকৃতিতে গঠন করেছেন। (সূরা ইনফিতার : ৭-৮)

৪০
ভ্রূণ আংশিক গঠিত এবং আংশিক অগঠিত
مضغة (মুদগা) অবস্থায় যদি ভ্রূণকে ছেদন এবং এর অভ্যন্তরীণ কোন অঙ্গকে কর্তন করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এর অধিকাংশই গঠিত, কিন্তু অন্যান্য কিছু অংশ পুরোপুরি গঠিত হয় নি।

অধ্যাপক জনসনের মতে, ভ্রূণকে যদি আমরা একটি পূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে বর্ণনা করি, তাহলে আমরা ঐ অংশটিকে বর্ণনা করছি– যা ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর যদি আমরা একে অপূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে বর্ণনা করি, তাহলে যে অংশ এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি করা হয় নি ঐ অংশের বর্ণনা করছি। সুতরাং ভ্রূণ কি পূর্ণ সৃষ্টি না অপূর্ণ সৃষ্টি। এক্ষেত্রে কোরআনের বর্ণনা অপেক্ষা ভ্রূণের উৎপত্তির স্তর সম্পর্কে আর কোন উত্তম বর্ণনা নেই। যেমন, কোরআনের নিম্নের আয়াতে আংশিক গঠিত হয়েছে এবং ‘আংশিক গঠিত হয় নি’ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে।

خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ ثُمَّ مِنۡ مُّضۡغَۃٍ مُّخَلَّقَۃٍ وَّ غَیۡرِ مُخَلَّقَۃٍ لِّنُبَیِّنَ لَکُمۡ

অর্থ : আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিণ্ড থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্য। (সূরা হাজ্জ : ৫)

বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা জানি যে, বিকাশের প্রাথমিক স্তরে কিছু পার্থক্যমূলক কোষ এবং কিছু অপার্থক্যমূলক কোষ থাকে। অর্থাৎ কিছু অঙ্গ গঠিত এবং কিছু অঙ্গ এখনও গঠিত হয় নি।

৪১
শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অনুভূতি
বিকাশমান মানব ভ্রূণের সর্বপ্রথম শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের উদ্ভব ঘটে। ভ্রূণ ২৮তম সপ্তাহের পর হতে শব্দ শুনতে পায়। পরবর্তীতে দর্শন ইন্দ্রিয় বিকাশ লাভ করে এবং ২৮তম সপ্তাহ পরে রেটিনা বা অক্ষিপট আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়।

ভ্রূণে ইন্দ্রিয়ের বিকাশ সম্পর্কিত কোরআনের নিম্নের আয়াতটি লক্ষ করা যাক :

وَ جَعَلَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ

অর্থ : আর তোমাদেরকে কান, চোখ ও অন্তর প্রদান করেন। (সূরা সাজদাহ : ৯)

وَ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡشَاَ لَکُمُ السَّمۡعَ وَ الۡاَبۡصَارَ وَ الۡاَفۡـِٕدَۃَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَشۡکُرُوۡنَ

অর্থ : আর তিনিই তোমাদের কান, চোখ ও অন্তঃকরণ সৃষ্টি করেছেন। তোমরা অতি অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক। (সূরা মুমিনূন : ৭৮)

اِنَّا خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ اَمۡشَاجٍ ٭ۖ نَّبۡتَلِیۡہِ فَجَعَلۡنٰہُ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا

অর্থ : নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে তাকে পরীক্ষা করার জন্য। এজন্য তাকে করেছি শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। (সূরা আদদাহার :২)

এ সকল আয়াতে দৃষ্টিশক্তির পূর্বে শ্রবণশক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে আধুনিক ভ্রূণ বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে কোরআনের বর্ণনা পরিপূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৪২
১৩. সাধারণ বিজ্ঞান আঙ্গুলের ছাপ
اَیَحۡسَبُ الۡاِنۡسَانُ اَلَّنۡ نَّجۡمَعَ عِظَامَہٗ . بَلٰی قٰدِرِیۡنَ عَلٰۤی اَنۡ نُّسَوِّیَ بَنَانَہٗ

অর্থ : মানুষ কি মনে করে যে, আমি কখনো তার হাড়সমূহকে একত্রিত করব না? হ্যাঁ, সক্ষম, আমি তার আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত যথাযথভাবে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম। (সূরা কেয়ামাহ : ৩-৪)

অবিশ্বাসীরা প্রশ্ন করে যে, মানুষ মরে গেলে হাড়গুলো মাটির মধ্যে বিভিন্ন অংশে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও এগুলোর পুনরুত্থান এবং বিচারের দিন পৃথক পৃথক সকল মানুষকে কিভাবে চিহ্নিত করা হবে? সর্বশক্তিমান আল্লাহ জবাব প্রদান করে বলেন যে, তিনি শুষ্ক হাড়গুলোকে জমা করা নয় বরং আমাদের আঙ্গুলের ছাপও যথার্থভাবে পুনরায় তৈরি করতে সক্ষম।

ব্যক্তি পরিচয় নির্ধারণের ব্যাপারে কোরআন কেন আঙ্গুলের ছাপ সম্পর্কে কথা বলেছে? ১৮৮০ সালে স্যার ফ্রান্সিস গোল্ট-এর গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরিচয় নির্ধারণে আঙ্গুলের ছাপ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সমগ্র বিশ্বে এমন দুজন ব্যক্তিও নেই যাদের আঙ্গুলের ছাপ সম্পূর্ণ একই রকম। এ কারণে বিশ্বব্যাপী পুলিশ বাহিনী অপরাধীদের শনাক্ত করতে আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষা করে।

১৪০০ বছর পূর্বে প্রত্যেক ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপের অনন্যতা সম্পর্কে কে জানত? অবশ্যই স্বয়ং স্রষ্টা ব্যতীত আর কেউই জানত না।

৪৩
ত্বকে ব্যথা অনুভবকারী গ্রন্থির উপস্থিতি
একদা ধারণা করা হত যে, অনুভূতি ও ব্যথার উপলব্ধি মস্তিষ্কের ওপর নির্ভরশীল। সাম্প্রতিক আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে, ত্বকে ব্যথা উপলব্ধিকারী উপকরণ বিদ্যমান রয়েছে। ঐ উপাদান ছাড়া ব্যক্তি ব্যথা অনুভব করতে পারে না।

আগুনে পুড়ে যাওয়ার ফলে ক্ষত সৃষ্টি হলে ডাক্তার যখন তার চিকিৎসা করেন তখন একটি সরু পিন দ্বারা পোড়ার মাত্রা পরীক্ষা করেন। রোগী ব্যথা অনুভব করলে ডাক্তার খুশী হন। কেননা, এর দ্বারা উপলব্ধি করা যায় যে, পোড়ার ক্ষতটি অগভীর এবং ব্যথা উপলব্ধিকারী উপকরণ অক্ষত রয়েছে। পক্ষান্তরে রোগী ব্যথা অনুভব না করলে বুঝা যায় যে, পোড়ার ক্ষতটি গভীর এবং ব্যথা উপলব্ধিকারী কোষসমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে।

কোরআন নিম্নের আয়াতে ব্যথা উপলব্ধিকারী গ্রন্থি বা কোষের অস্তিত্বের স্থাপনই ইঙ্গিত প্রদান করে–

اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا سَوۡفَ نُصۡلِیۡہِمۡ نَارًا ؕ کُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُوۡدُہُمۡ بَدَّلۡنٰہُمۡ جُلُوۡدًا غَیۡرَہَا لِیَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَزِیۡزًا حَکِیۡمًا

অর্থ : যারা আমার আয়াতকে অস্বীকার করে নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করব। আর যখনই তাদের গায়ের চামড়া পুড়ে যাবে তখন আমি পাল্টে দেব, নতুন চামড়া দিয়ে, যাতে তারা (শাস্তির পর) শাস্তি ভোগ করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিসা : ৫৬)

থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি (জীবদেহের গঠনসংক্রান্ত বিজ্ঞান) বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাগাতাত তেজাসেন ব্যথা উপলব্ধিকারী উপকরণ তথা গ্রন্থি বা কোষের ওপর দীর্ঘকাল গবেষণা করেছেন। প্রথম দিকে তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, এ বৈজ্ঞানিক সত্যটি কোরআন ১৪০০ বছর পূর্বে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি কোরআনের এ বিশেষ আয়াতটির অনুবাদ পরীক্ষা করেন। অধ্যাপক তেজাসেন কোরআনের এ আয়াতটির বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতায় এতটা অভিভূত হয়ে পড়েন যে, রিয়াদে অনুষ্ঠিত ‘কোরআন ও সুন্নাহর বৈজ্ঞানিক দিকদর্শনাবলি’ বিষয়ের ওপর ৮ম সৌদি মেডিকেল কনফারেন্স প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন–

لااله الا الله محمد رسول الله

অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।

৪৪
১৪. উপসংহার
কোরআন বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোর উপস্থিতিকে সমকালে সংঘটিত কোন ঘটনা হিসেবে অভিহিত করা সাধারণ জ্ঞান ও সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে কোরআনের আয়াতসমূহের বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতাই কোরআনের উন্মুক্ত ঘোষণার নিশ্চয়তা প্রদান করেঃ

سَنُرِیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا فِی الۡاٰفَاقِ وَ فِیۡۤ اَنۡفُسِہِمۡ حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَہُمۡ اَنَّہُ الۡحَقُّ ؕ اَوَ لَمۡ یَکۡفِ بِرَبِّکَ اَنَّہٗ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَہِیۡدٌ

অর্থ : আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব দূর দিগন্তে (অর্থাৎ দূর পর্যন্ত ইসলামের আলো বিচ্ছুরিত হবে) আর তাদের নিজের মধ্যেও (অর্থাৎ কাফিররা নতজানু হয়ে ইসলাম কবুল করবে) যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ কুরআন সত্য। এটা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার প্রতিপালক সব কিছুরই সাক্ষী। (হামীম সিজদাহ : ৫৩)

নীচের আয়াতটির মাধ্যমে কুরআন সকল মানুষকে এ বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবতে আহ্বান করেঃ

اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی الۡاَلۡبَابِ

অর্থ : নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাতের আবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শন। (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)

কোরআনের বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য পরিষ্কার প্রমাণ করে যে, এটি আল্লাহর বাণী। ১৪০০ বছর পূর্বে কোন মানুষের দ্বারা এমন বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি সম্বলিত কোন বই লেখা সম্ভব ছিল না– যেসব সত্য মানুষের দ্বারা শতশত বছর পর আবিষ্কৃত হবে। যাহোক, কোরআন বিজ্ঞানের কোন গ্রন্থ নয় বরং নিদর্শন গ্রন্থ। এ নিদর্শনাবলি মানুষকে পৃথিবীতে তার অবস্থানের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে আহ্বান জানায়। কোরআন যথার্থভাবেই সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষক আল্লাহর পয়গাম বা বাণী। এতে আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম রয়েছে যার প্রতি সকল নবী-রাসূলগণ দাওয়াত দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আদম আলাইহিস সালাম, মুসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যতম।

‘কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান’ বিষয়ের ওপর বহু বৃহৎ গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং এ নিয়ে আরও অনেক গবেষণা চলছে। ইনশাআল্লাহ এ গবেষণা মানবজাতিকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর আরও নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ পুস্তিকায় কোরআনের অল্প কয়েকটি বৈজ্ঞানিক সত্যকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি বিষয়টির ওপর পূর্ণ ইনসাফ করতে পেরেছি বলে দাবি করছি না।

অধ্যাপক তেজাসেন কোরআনে উল্লিখিত একটি মাত্র বৈজ্ঞানিক নিদর্শনের শক্তির কারণে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কোরআন যে আসমানী গ্রন্থ তা নিশ্চিত হতে প্রমাণস্বরূপ কারো প্রয়োজন হতে পারে ১০টি নিদর্শন, আবার কেউ হয়তো ১০০টি নিদর্শনের প্রয়োজন অনুভব করতে পারে, আবার কেউ ১০০০টি নিদর্শন দেখেও সত্য (ইসলাম) গ্রহণ করবে না। কোরআনে নিচের আয়াতে এ ধরনের বন্ধ মানসিকতার নিন্দা করেছে–

صُمٌّۢ بُکۡمٌ عُمۡیٌ فَہُمۡ لَا یَرۡجِعُوۡنَ

অর্থ : এরা বধির, বোবা ও অন্ধ। সুতরাং এরা (সঠিক পথে) ফিরে আসবে না। (সূরা বাকারাহ : ১৮)

ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কোরআন একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। আলহামদুলিল্লাহ, (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য) মানব রচিত বিভিন্ন মতবাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত! স্রষ্টার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল পথনির্দেশ কে প্রদান করতে পারে?

আমি প্রার্থনা করি যে, আল্লাহ যেন এ সামান্য প্রচেষ্টাটুকু কবুল করেন। আমি তার ক্ষমা ও হেদায়াত কামনা করি।

সমাপ্ত

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন