HADITH.One
HADITH.One
Bangla
System
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন
ফিতনাতুত-তাকফীর
লেখকঃ শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ), শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ), শায়খ সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ), বিভিন্ন মুফাসসির ও মুহাদ্দিসদের (রহ) উদ্ধৃতি
نحمده ونصلى على رسوله الكريم اما بعد ـ
মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে লাখো, কোটি শুকরিয়া যে, কুরআন, সহীহ হাদীস ও সালাফে-সালেহীনদের বিশ্লেষণের আলোকে আমরা ‘‘তাফসীরু : হুক্মি বি-গয়রি মা-আনযালাল্লাহ’’ বইটি প্রকাশ করতে পেরেছি। এ গ্রন্থটি মূলত অনুবাদ ও সঙ্কলন। গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, যেসব মুসলিম শাসক নিজ নিজ দেশে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করছে না, তারা কি কেবল এ কারণেই সুস্পষ্টভাবে মুরতাদ-কাফির? নাকি তাদের এই কার্যক্রমের কারণে পরিস্থিতি বিশেষে তারা কবীরা গোনাহে লিপ্ত পাপী মুসলিম (সালাত ক্বায়েমের শর্তে)? আবার পরিস্থিতি বিশেষে (দ্বীনের ছোট বা বড় বিষয়কে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা বিরোধিতার কারণে) সুস্পষ্ট মুরতাদ-কাফির? এ পর্যায়ে মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের ব্যাপারে ঢালাওভাবে কোন কোন মহল সুস্পষ্ট কাফির ও তাদের রক্ত হালাল হওয়ার ফাতওয়া জারি করে ক্ষমতা দখল ও দেশবিরোধী নানাবিধ তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এ ফাতওয়া জারি হওয়ার মূলে রয়েছে, কুরআনের শাব্দিক অর্থকে ব্যবহার। [. শাব্দিক বিশ্লেষণ ও তার দাবি জানার জন্য পড়ুন এই বইয়ের ‘‘শাসক বা বিচারককে কখন কাফির গণ্য করা যাবে?’’- আলোচনাটি।] পক্ষান্তরে এর প্রয়োগিক অর্থ সাহাবীগণ (রা) এবং পরবর্তী ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ (রহ) (সালাফে-সালেহীন) কিভাবে নিয়েছিলেন তা থেকে দূরে থাকা। যারা কুরআন ও হাদীসের দাবি উপস্থাপনে এই পথ থেকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন, তাদেরকেই এখানে খারেজী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-কে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখি। আমরা তাঁর (রহ) দু’টি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ এখানে সংযুক্ত করেছি। যা এই বইটির প্রধান আকর্ষণ। প্রথমটি হল, তাঁর তাহক্বীক্বকৃত ‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসুস সহীহাহ’’-এর ষষ্ঠ খণ্ডের হাদীস নং ২৫৫২, ২৭০৪ এর উপস্থাপনা। দ্বিতীয়টি হল, তাঁরই ‘‘ফিতনাতুত তাকফীর’’ (শায়খ উসায়মীন (রহ)-এর টীকাসহ) পুস্তিকাটি। এর ফলে তিনি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন। তাঁর সমালোচনাকারীদের অন্যতম যুক্তি হল :
১.লেখকের স্বপক্ষের দলিলগুলো সমালোচনামুক্ত নয়।
২.কুরআনের সুস্পষ্ট দলিলের বিরোধী।
এ পর্যায়ে আমি লক্ষ করেছি- উভয় পক্ষই নিজ নিজ সমর্থনে কুরআনের আয়াত ও পছন্দমত সালাফদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এমনকি এ বিষয়ে উভয় পক্ষেরই পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যাপক পুস্তক/পুস্তিকাও রয়েছে। এই বিতর্কের প্রকৃত সমাধান রয়েছে নবী (স) ও সাহাবীগণ (রা) তৎকালীন প্রেক্ষাপটে কুরআনের আয়াতগুলোর বাস্তব দাবি কীভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তার উপর। যা আমি স্বতন্ত্রভাবে ‘‘আক্বীদাগত ও আমলগত কুফরের দৃষ্টান্ত’’ [.‘আক্বীদাগত ও আমলগত কুফরের দৃষ্টান্ত’ : এই অংশে (১) মুনাফিক্ব, (২) খারেজী, ও (৩) গোমরাহ শাসকদের প্রতি মুসলিমদের আচরণ, দায়িত্ব-কর্তব্য ও তার সীমারেখা কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীসের বিতর্কমুক্ত সূত্রের আলোকে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমাণ করা হয়েছে, তাদের ঈমান ও আমল আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূলের (স) কাছে অগ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যা মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-র উপস্থাপিত দলিলগুলোর দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করে (যদিও তিনি (রহ) নিজ প্রমাণের স্বপক্ষে সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা) এর তাফসীরটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যা তাঁর প্রতিপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি)। পক্ষান্তরে যারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন, তারা যে নবী (স) ও সাহাবীদের (রা) তৎকালীন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ না করে কেবল শাব্দিক তরজমা দ্বারা দলিল উপস্থাপন করেছেন তা সুস্পষ্ট।] ও ‘‘হাকিম ও হুকুম সম্পর্কিত আয়াতের বিশ্লেষণ’’ [.‘হাকিম ও হুকুম সম্পর্কিত আয়াতের বিশ্লেষণ’ : এই অংশে কুরআনে উল্লিখিত হাকিম ও হুকুম সংক্রান্ত আয়াতগুলো দ্বারা যে তাকফীরের ফিতনাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, ঐ আয়াতগুলো নবী (স)-এর ওপর নাযিল হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এ ধরনের কোন তৎপরতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আক্বীদাগতভাবে তাদের ঈমানহানির কথা কুরআন ঘোষণা করা সত্ত্বেও নবী (স) কর্তৃক ঐ সব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে কোন কঠিন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যার উদাহরণ পূর্বোক্ত টীকারই অনুরূপ।] অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। এছাড়া সাক্ষ্যমূলক প্রমাণ হিসাবে ‘‘আয়াতে তাহকীম ও প্রসিদ্ধ তাফসীর’’ [.‘আয়াতে তাহকীম ও প্রসিদ্ধ তাফসীর’ : এই অংশে পূর্ববর্তী প্রসিদ্ধ ও উপমহাদেশের সর্বমোট দশজন মুফাসসির থেকে আয়াতটির প্রকৃত তাফসীর উল্লেখ করা হয়েছে। যার ফলে সুস্পষ্ট হয়েছে, মুফাসসিরগণ উক্ত তাফসীরের ব্যাপারে একই পথের অনুসরণ করেছেন।], ‘‘আয়াতে তাহকীম ও সালাফে সালেহীন’’ [.‘আয়াতে তাহকীম ও সালাফে সালেহীন’ : এই অংশে সর্বজনস্বীকৃত ইমাম ও মুহাদ্দিসদের ‘আয়াতে তাহক্বীম’ সম্পর্কে মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অনেক আধুনিক ও পূর্ববর্তী শায়খ এবং ইমামদের অনেক স্ব-বিরোধী বক্তব্য থাকায়- বিরোধী পক্ষ বিতর্কটি স্থায়ী রাখার সুযোগ পেয়েছে। এর সমাধান হল, বিতর্ক দেখা দিলে আমরা কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাব (সূরা নিসা : ৫৯ আয়াত)। তবে বিরোধীপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালাফদের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনেনি।] প্রভৃতি শিরোনাম উল্লেখ করে এই বইয়ে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করেছি। তাছাড়া শায়খ ইবনু বায (রহ)-এর ‘‘ঈমান, কুফর, ইরজা‘ ও মুরজিয়া’’ [.এ প্রবন্ধটির মাধ্যমে ‘ঈমান, কুফর, ইরজা‘ ও মুরজিয়া’ সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ দূর হবে ইনশাআল্লাহ।], সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ) লিখিত ‘ইবাদত ও ইতাআত’ [.এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে শায়েখ সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রা) ‘ইবাদত ও ইতাআত’-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। যারা মনে করেন রাষ্ট্রের ইতাআত প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের ‘ইবাদত করা তথা শিরক- তাদের ভুলগুলো তিনি শুধরিয়ে দিয়েছেন।] প্রবন্ধটি অনুবাদ করে স্বতন্ত্র শিরোনামসহ এই পুস্তকে সংযোজন করেছি। সবশেষে সংযোজন করেছি ‘‘তাহক্বীক্বকৃত আমাদের হাকিম কেবলই একজন’’ [.‘‘তাহক্বীক্বকৃত আমাদের হাকিম কেবলই একজন’’ : এটি একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা। যা ‘‘জামআতুল মুসলিমীন’’ (পাকিস্তান)-এর ‘‘আমাদের হাকিম কেবলই একজন- আল্লাহ’’-এর তাহক্বীক্ব। এই বইটির উপস্থাপনাও কুরআনের শাব্দিক আয়াতের আলোকে করা হয়েছে। এই তাহক্বীক্বের মাধ্যমে সেগুলোর সংশোধন করা হয়েছে। যা পাঠ করলে সম্মানিত পাঠক ‘হাকিম ও হুকুম’ সংক্রান্ত প্রায় সবগুলো আয়াতের প্রকৃত দাবি বুঝতে পারবেন। তাছাড়া এর ভূমিকাতে সংযুক্ত হয়েছে খারেজীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।] -যা পাঠকদের এই বিতর্ক সমাধানে সহযোগিতা করবে, ইনশাআল্লাহ।
কেবল অনুবাদ নয়, যেন সাধারণ মানুষ সেগুলো বাংলায় অনূদিত হাদীস ও অন্যান্য গ্রন্থে সহজেই খুঁজে পান সেজন্য প্রয়োজনীয় সূত্রও উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। তবে সংগত কারণেই হাদীসের তাহক্বীক্বগুলো মূল আরবি গ্রন্থ থেকেই নিতে হয়েছে। আলোচনার স্বপক্ষে অন্যান্য দলিল থাকলে তা-ও আমার পক্ষ থেকে টীকাতে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। এ পর্যায়ে মানুষ হিসেবে ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যাওয়াটা অকপটে স্বীকার করছি। সম্মানিত পাঠক ও গবেষকদের সুচিন্তিত পরামর্শে পরবর্তী সময়ে সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার, সংশোধন ও সংযোজন করব, ইনঁশাআল্লাহ।
আল্লাহর কাছে এই দুআই করছি, তিনি যেন কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত ইলম অর্জন ও তার প্রচার-প্রসারের ব্যাপারে উন্মুক্ত চিন্তা দান করেন, সাথে সাথে সত্য গ্রহণ সব ধরনের মানসিক সংকীর্ণতা দূর করে দেন। আমিন!!
নিবেদক
কামাল আহমাদ
পুরাতন কসবা, কাজীপাড়া, যশোর-৭৪০০।
ই-মেইল : kahmed_islam05@yahoo.com
মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে লাখো, কোটি শুকরিয়া যে, কুরআন, সহীহ হাদীস ও সালাফে-সালেহীনদের বিশ্লেষণের আলোকে আমরা ‘‘তাফসীরু : হুক্মি বি-গয়রি মা-আনযালাল্লাহ’’ বইটি প্রকাশ করতে পেরেছি। এ গ্রন্থটি মূলত অনুবাদ ও সঙ্কলন। গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল, যেসব মুসলিম শাসক নিজ নিজ দেশে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করছে না, তারা কি কেবল এ কারণেই সুস্পষ্টভাবে মুরতাদ-কাফির? নাকি তাদের এই কার্যক্রমের কারণে পরিস্থিতি বিশেষে তারা কবীরা গোনাহে লিপ্ত পাপী মুসলিম (সালাত ক্বায়েমের শর্তে)? আবার পরিস্থিতি বিশেষে (দ্বীনের ছোট বা বড় বিষয়কে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা বিরোধিতার কারণে) সুস্পষ্ট মুরতাদ-কাফির? এ পর্যায়ে মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের ব্যাপারে ঢালাওভাবে কোন কোন মহল সুস্পষ্ট কাফির ও তাদের রক্ত হালাল হওয়ার ফাতওয়া জারি করে ক্ষমতা দখল ও দেশবিরোধী নানাবিধ তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এ ফাতওয়া জারি হওয়ার মূলে রয়েছে, কুরআনের শাব্দিক অর্থকে ব্যবহার। [. শাব্দিক বিশ্লেষণ ও তার দাবি জানার জন্য পড়ুন এই বইয়ের ‘‘শাসক বা বিচারককে কখন কাফির গণ্য করা যাবে?’’- আলোচনাটি।] পক্ষান্তরে এর প্রয়োগিক অর্থ সাহাবীগণ (রা) এবং পরবর্তী ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ (রহ) (সালাফে-সালেহীন) কিভাবে নিয়েছিলেন তা থেকে দূরে থাকা। যারা কুরআন ও হাদীসের দাবি উপস্থাপনে এই পথ থেকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন, তাদেরকেই এখানে খারেজী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-কে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখি। আমরা তাঁর (রহ) দু’টি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ এখানে সংযুক্ত করেছি। যা এই বইটির প্রধান আকর্ষণ। প্রথমটি হল, তাঁর তাহক্বীক্বকৃত ‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসুস সহীহাহ’’-এর ষষ্ঠ খণ্ডের হাদীস নং ২৫৫২, ২৭০৪ এর উপস্থাপনা। দ্বিতীয়টি হল, তাঁরই ‘‘ফিতনাতুত তাকফীর’’ (শায়খ উসায়মীন (রহ)-এর টীকাসহ) পুস্তিকাটি। এর ফলে তিনি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন। তাঁর সমালোচনাকারীদের অন্যতম যুক্তি হল :
১.লেখকের স্বপক্ষের দলিলগুলো সমালোচনামুক্ত নয়।
২.কুরআনের সুস্পষ্ট দলিলের বিরোধী।
এ পর্যায়ে আমি লক্ষ করেছি- উভয় পক্ষই নিজ নিজ সমর্থনে কুরআনের আয়াত ও পছন্দমত সালাফদের বক্তব্য তুলে ধরেন। এমনকি এ বিষয়ে উভয় পক্ষেরই পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যাপক পুস্তক/পুস্তিকাও রয়েছে। এই বিতর্কের প্রকৃত সমাধান রয়েছে নবী (স) ও সাহাবীগণ (রা) তৎকালীন প্রেক্ষাপটে কুরআনের আয়াতগুলোর বাস্তব দাবি কীভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তার উপর। যা আমি স্বতন্ত্রভাবে ‘‘আক্বীদাগত ও আমলগত কুফরের দৃষ্টান্ত’’ [.‘আক্বীদাগত ও আমলগত কুফরের দৃষ্টান্ত’ : এই অংশে (১) মুনাফিক্ব, (২) খারেজী, ও (৩) গোমরাহ শাসকদের প্রতি মুসলিমদের আচরণ, দায়িত্ব-কর্তব্য ও তার সীমারেখা কেবল কুরআন ও সহীহ হাদীসের বিতর্কমুক্ত সূত্রের আলোকে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমাণ করা হয়েছে, তাদের ঈমান ও আমল আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূলের (স) কাছে অগ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যা মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-র উপস্থাপিত দলিলগুলোর দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করে (যদিও তিনি (রহ) নিজ প্রমাণের স্বপক্ষে সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা) এর তাফসীরটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যা তাঁর প্রতিপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি)। পক্ষান্তরে যারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন, তারা যে নবী (স) ও সাহাবীদের (রা) তৎকালীন প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ না করে কেবল শাব্দিক তরজমা দ্বারা দলিল উপস্থাপন করেছেন তা সুস্পষ্ট।] ও ‘‘হাকিম ও হুকুম সম্পর্কিত আয়াতের বিশ্লেষণ’’ [.‘হাকিম ও হুকুম সম্পর্কিত আয়াতের বিশ্লেষণ’ : এই অংশে কুরআনে উল্লিখিত হাকিম ও হুকুম সংক্রান্ত আয়াতগুলো দ্বারা যে তাকফীরের ফিতনাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, ঐ আয়াতগুলো নবী (স)-এর ওপর নাযিল হওয়া সত্ত্বেও তাঁর এ ধরনের কোন তৎপরতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। আক্বীদাগতভাবে তাদের ঈমানহানির কথা কুরআন ঘোষণা করা সত্ত্বেও নবী (স) কর্তৃক ঐ সব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে কোন কঠিন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যার উদাহরণ পূর্বোক্ত টীকারই অনুরূপ।] অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি। এছাড়া সাক্ষ্যমূলক প্রমাণ হিসাবে ‘‘আয়াতে তাহকীম ও প্রসিদ্ধ তাফসীর’’ [.‘আয়াতে তাহকীম ও প্রসিদ্ধ তাফসীর’ : এই অংশে পূর্ববর্তী প্রসিদ্ধ ও উপমহাদেশের সর্বমোট দশজন মুফাসসির থেকে আয়াতটির প্রকৃত তাফসীর উল্লেখ করা হয়েছে। যার ফলে সুস্পষ্ট হয়েছে, মুফাসসিরগণ উক্ত তাফসীরের ব্যাপারে একই পথের অনুসরণ করেছেন।], ‘‘আয়াতে তাহকীম ও সালাফে সালেহীন’’ [.‘আয়াতে তাহকীম ও সালাফে সালেহীন’ : এই অংশে সর্বজনস্বীকৃত ইমাম ও মুহাদ্দিসদের ‘আয়াতে তাহক্বীম’ সম্পর্কে মতামত উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অনেক আধুনিক ও পূর্ববর্তী শায়খ এবং ইমামদের অনেক স্ব-বিরোধী বক্তব্য থাকায়- বিরোধী পক্ষ বিতর্কটি স্থায়ী রাখার সুযোগ পেয়েছে। এর সমাধান হল, বিতর্ক দেখা দিলে আমরা কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যাব (সূরা নিসা : ৫৯ আয়াত)। তবে বিরোধীপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালাফদের বক্তব্যের প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনেনি।] প্রভৃতি শিরোনাম উল্লেখ করে এই বইয়ে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজন করেছি। তাছাড়া শায়খ ইবনু বায (রহ)-এর ‘‘ঈমান, কুফর, ইরজা‘ ও মুরজিয়া’’ [.এ প্রবন্ধটির মাধ্যমে ‘ঈমান, কুফর, ইরজা‘ ও মুরজিয়া’ সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ দূর হবে ইনশাআল্লাহ।], সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ) লিখিত ‘ইবাদত ও ইতাআত’ [.এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে শায়েখ সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রা) ‘ইবাদত ও ইতাআত’-এর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। যারা মনে করেন রাষ্ট্রের ইতাআত প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের ‘ইবাদত করা তথা শিরক- তাদের ভুলগুলো তিনি শুধরিয়ে দিয়েছেন।] প্রবন্ধটি অনুবাদ করে স্বতন্ত্র শিরোনামসহ এই পুস্তকে সংযোজন করেছি। সবশেষে সংযোজন করেছি ‘‘তাহক্বীক্বকৃত আমাদের হাকিম কেবলই একজন’’ [.‘‘তাহক্বীক্বকৃত আমাদের হাকিম কেবলই একজন’’ : এটি একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা। যা ‘‘জামআতুল মুসলিমীন’’ (পাকিস্তান)-এর ‘‘আমাদের হাকিম কেবলই একজন- আল্লাহ’’-এর তাহক্বীক্ব। এই বইটির উপস্থাপনাও কুরআনের শাব্দিক আয়াতের আলোকে করা হয়েছে। এই তাহক্বীক্বের মাধ্যমে সেগুলোর সংশোধন করা হয়েছে। যা পাঠ করলে সম্মানিত পাঠক ‘হাকিম ও হুকুম’ সংক্রান্ত প্রায় সবগুলো আয়াতের প্রকৃত দাবি বুঝতে পারবেন। তাছাড়া এর ভূমিকাতে সংযুক্ত হয়েছে খারেজীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।] -যা পাঠকদের এই বিতর্ক সমাধানে সহযোগিতা করবে, ইনশাআল্লাহ।
কেবল অনুবাদ নয়, যেন সাধারণ মানুষ সেগুলো বাংলায় অনূদিত হাদীস ও অন্যান্য গ্রন্থে সহজেই খুঁজে পান সেজন্য প্রয়োজনীয় সূত্রও উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। তবে সংগত কারণেই হাদীসের তাহক্বীক্বগুলো মূল আরবি গ্রন্থ থেকেই নিতে হয়েছে। আলোচনার স্বপক্ষে অন্যান্য দলিল থাকলে তা-ও আমার পক্ষ থেকে টীকাতে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। এ পর্যায়ে মানুষ হিসেবে ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যাওয়াটা অকপটে স্বীকার করছি। সম্মানিত পাঠক ও গবেষকদের সুচিন্তিত পরামর্শে পরবর্তী সময়ে সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার, সংশোধন ও সংযোজন করব, ইনঁশাআল্লাহ।
আল্লাহর কাছে এই দুআই করছি, তিনি যেন কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত ইলম অর্জন ও তার প্রচার-প্রসারের ব্যাপারে উন্মুক্ত চিন্তা দান করেন, সাথে সাথে সত্য গ্রহণ সব ধরনের মানসিক সংকীর্ণতা দূর করে দেন। আমিন!!
নিবেদক
কামাল আহমাদ
পুরাতন কসবা, কাজীপাড়া, যশোর-৭৪০০।
ই-মেইল : kahmed_islam05@yahoo.com
-মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)
[সিলসিলাহ আহদীসুস সহীহাহ হা/২৫৫২ ও ২৭০৪]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ .... ُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ..... فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘আমি তাওরাত নাযিল করেছিলাম, তাতে হিদায়াত ও নূর ছিল। নবীগণ- যারা ছিলেন অনুগত (মুসলিম) তদনুযায়ী এই ইয়াহুদীদের বিধান দিত, আর রব্বানী (সূফী/দরবেশ) ও আহবার (পণ্ডিত/আলেম/চিন্তাবিদ)-রাও। কেননা তাদের আল্লাহর কিতাবের হেফযাতকারী করা হয়েছিল এবং তারা ছিল এর সাক্ষী। অতএব, তোমরা লোকদের ভয় করো না, আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতকে সামান্য ও নগণ্য বিনিময়ে বিক্রি করো না। যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম।..... তারাই ফাসিক্ব।’’
(সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭ আয়াত)
আয়াতের শানে নুযূল
ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : আল্লাহ তাআলা এই (সূরা মায়িদা, ৪৪-৪৭ নং) আয়াতগুলো ইয়াহুদীদের দু’টি গোত্র সম্পর্কে নাযিল হয়। একটি গোত্র ছিল বিজয়ী এবং অপরটি ছিল পরাজিত। তারা পরস্পর এ ব্যাপারে সন্ধি করে যে, বিজয়ী সম্মানিত গোত্রের কোন ব্যক্তি যদি পরাজিত অপমানিত গোত্রের কাউকে হত্যা করে, সেক্ষেত্রে পঞ্চাশ ওয়াসাক দিয়াত (রক্তমূল্য) দেবে। আর পরাজিত অপমানিত গোত্রের কেউ বিজয়ী গোত্রের কাউকে হত্যা করলে একশ’ ওয়াসাক দিয়াত দেবে। এই প্রথাই চলে আসছিল। যখন রসূলুল্লাহ (স) মদীনাতে আসলেন, তখন গোত্র দু’টি রসূলুল্লাহ (স) -এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেটা প্রকাশ করেনি, এমনকি সমাধানেরও চেষ্টা করেনি। এরপর এমন একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে পরাজিত ইয়াহুদীদের একজন বিজয়ী ইয়াহুদীদের কাউকে হত্যা করে। তখন এদের (বিজয়ীদের) পক্ষ থেকে একশ’ ওয়াসাক আদায়ের জন্য (পরাজিতদের কাছে) একজনকে পাঠান হল। পরাজিতপক্ষ তখন বলল, এটা সুস্পষ্ট বেইনসাফী। কেননা আমরা উভয়েই একই জাতি, একই দ্বীন, একই বংশ, একই শহরের অধিবাসী। তাহলে একপক্ষের দিয়াত কিভাবে অপরপক্ষের অর্ধেক হয়? আমরা যদিও এতকাল তোমাদের চাপের মুখে ছিলাম, এই বেইনসাফী আইন পরিবর্তন না করে তা লাঞ্ছিত অবস্থায় মেনে এসেছি। কিন্তু এখন মুহাম্মাদ (স) এখানে এসেছেন (যিনি ন্যায়বিচারক)। সুতরাং আমরা তোমাদের তা দিব না।
তাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধার উপক্রম হল। শেষাবধি তারা বলল, চল এই দ্বন্দের ফায়সালা মুহাম্মাদ (স) -ই করবেন। কিন্তু বিজয়ী গোত্রের লোকেরা যখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল তখন তারা বলল, দেখ আল্লাহ’র ক্বসম! মুহাম্মাদ (স) কখনই তোমরা যা (পরাজিতদের কাছ থেকে) পেতে, তাতে তোমাদের দ্বিগুণ দিবেন না। আর তিনি সত্য কথা বলেন। তারা কখনই আমাদের এটা দেবে না, যতক্ষন না এই বিচারের রায় আমাদের পক্ষে হয়- এই জন্যে যে আমরা তাদের উপর বিজয়ী। সুতরাং রসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে গোপনে লোক পাঠাও। সে এটা বুঝে আসুক তিনি (স) কি ফায়সালা করবেন। যদি তা আমাদের পক্ষে হয় তবে তো খুব ভাল- তখন আমরা তাঁর ফায়সালা মেনে নেব। আর যদি আমাদের বিপক্ষে যায় সেক্ষেত্রে দূরে থাকাই ভাল এবং তাঁর ফায়সালা মানব না। তখন মুনাফিক্বদের মধ্যে থেকে কাউকে গোয়েন্দা বানিয়ে নবী (স) -এর কাছে পাঠাল। সে যখন প্রথমে গেল তখন আল্লাহ তাআলা নিচের আয়াত নাযিল করে তাদের ষড়যন্ত্র নবী (স)-কে জানিয়ে দিলেন।
আয়াতগুলো হল :
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ لَا يَحْزُنْكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْكُفْرِ مِنَ الَّذِينَ قَالُوا آَمَنَّا بِأَفْوَاهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِنْ قُلُوبُهُمْ وَمِنَ الَّذِينَ هَادُوا سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ سَمَّاعُونَ لِقَوْمٍ آَخَرِينَ لَمْ يَأْتُوكَ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِنْ بَعْدِ مَوَاضِعِهِ يَقُولُونَ إِنْ أُوتِيتُمْ هَذَا فَخُذُوهُ وَإِنْ لَمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا وَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ -
‘‘হে রসূল! সেই সব লোক যেন আপনার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ না হয় যারা দ্রুতগতিতে কুফরীর পথে অগ্রসর হচ্ছে। তারা সেই লোক, যারা মুখে বলে- আমরা ঈমান এনেছি, কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান গ্রহণ করেনি এবং তারা সেই লোক যারা ইয়াহুদী হয়েছে, তাদের অবস্থা এই যে, মিথ্যা শোনার জন্য তারা কান পেতে থাকে এবং এমন এক শ্রেণীর লোকের থেকে তারা কথা টুকিয়ে (কুড়িয়ে) বেড়ায় যারা কখনো তোমার নিকট আসেনি। তারা আল্লাহর কিতাবের শব্দগুলোকে তার স্থান থেকে পরিবর্তন করে এবং বলে যে, তোমাদের এ আদেশ দেয়া হলে মানবে অন্যথায় মানবে না। বস্তুত আল্লাহই যাকে ফিতনায় নিক্ষেপ করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে উদ্ধার করার জন্য তুমি কিছু করতে পার না। এরা সেই লোক যাদের মন-হৃদয়কে আল্লাহ পবিত্র করতে চাননি। তাদের জন্যে রয়েছে দুনিয়ার লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি।’’ [সূরা মায়িদা : ৪১ আয়াত]
سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ فَإِنْ جَاءُوكَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ أَوْ أَعْرِضْ عَنْهُمْ وَإِنْ تُعْرِضْ عَنْهُمْ فَلَنْ يَضُرُّوكَ شَيْئًا وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ ( ٤٢ )
‘‘এরা মিথ্যা শ্রবণে ও হারাম মাল ভক্ষণে অভ্যস্ত। কাজেই এরা যদি তোমার নিকট (নিজেদের মোকদ্দমা নিয়ে) আসে তবে তোমার ইখতিয়ার রয়েছে, ইচ্ছা করলে তাদের বিচার কর, অন্যথায় অস্বীকার কর। অস্বীকার করলে এরা তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর বিচার ফায়সালা করলে ঠিক ইনসাফ মুতাবিকই করবে, কেননা আল্লাহ ইনসাফকারী লোকদের পছন্দ করেন।’’ [সূরা মায়িদা : ৪২ আয়াত]
وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِنْدَهُمُ التَّوْرَاةُ فِيهَا حُكْمُ اللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ ( ٤٣ ) إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ( ٤٤ ) وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ( ٤٥ ) وَقَفَّيْنَا عَلَى آَثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَآَتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ ( ٤٦ ) وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنْجِيلِ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ( ٤٧ )
‘‘এরা তোমাকে কিরূপে বিচারক মানে, যখন তাদের নিকট তাওরাত বর্তমান রয়েছে, তাতেই আল্লাহর আইন ও বিধান লিখিত আছে। কিন্তু এরা তা থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। আসল কথা এই যে, এরা ঈমানদার লোকই নয়। আমরা তাওরাত নাযিল করেছিলাম, তাতে হিদায়াত ও নূর ছিল। নবীগণ- যারা ছিলেন অনুগত (মুসলিম) তদনুযায়ী এই ইয়াহুদীদের বিধান দিত, আর রব্বানী (সূফী/দরবেশ) ও আহবার (পণ্ডিত/আলেম/চিন্তাবিদগণও)। কেননা তাদের আল্লাহর কিতাবের হিফযাতকারী করা হয়েছিল এবং তারা ছিল এর সাক্ষী। অতএব, তোমরা লোকদের ভয় করো না, আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতকে সামান্য ও নগণ্য বিনিময়ে বিক্রি করো না। যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির। তাওরাতে আমরা ইয়াহুদীদের প্রতি এ হুকুমই লিখে দিয়েছিলাম যে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং সব রকমের যখমের বদলা নির্দিষ্ট। অবশ্য কেউ ক্বিসাস সাদাক্বা করে দিলে তা তার জন্যে কাফফারা হয়ে যাবে। আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই যালিম। তাদের পরে ঈসা ইবনু মারইয়ামকে প্রেরণ করেছি। তাওরাতের যা-কিছু তার সম্মুখে ছিল, সে ছিল তারই সত্যতা প্রমাণকারী। আমরা তাঁকে ইঞ্জিল দান করেছি, যার মধ্যে ছিল হিদায়াত ও আলো এবং তা-ও তাওরাতের যা কিছু তার সম্মুখে ছিল তারই সত্যতা প্রমাণকারী এবং মুত্তাক্বীদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত ও নসীহত ছিল। আমাদের নির্দেশ ছিল যে, ইঞ্জিল বিশ্বাসীগণ তাতে আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করবে। আর যারাই আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করবে না তারাই ফাসিক্ব।’’ [সূরা মায়িদা : ৪১-৪৭ আয়াত]
আলবানী (রহ) বলেন : হাদীসটি আহমাদ ১/২৪৬, তাবারানী-মু‘জামুল কাবীর ৩/৯৫/১-এ আব্দুর রহমান বিন আবূ যিনাদ তাঁর পিতা থেকে, তিনি উবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উতবাহ বিন মাসউদ থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন। ইমাম সুয়ূতী (রহ) এটাকে সমর্থন করেছেন (আদ-দুররুল মানসুর ২/২৮১)। আবূ দাউদ, ইবনু জারীর, ইবনু মুনযির, আবূ শায়খ, ইবনু মারদুবিয়াহ-ও ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনু জারীর (রহ) নিজের তাফসীরে (১০/৩২৫/১২০৩৭) এভাবেই বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি ইবনু আব্বাসের (রা) নাম উল্লেখ করেননি। আবূ দাউদের বর্ণনাতে উক্ত ঘটনাটি সুনির্দিষ্টভাবে ইয়াহুদী গোত্র বনূ কুরায়যা ও বনূ নাযির গোত্র সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে। অথচ ইবনু কাসির (রহ) আহমাদ থেকে (পূর্বোক্ত) দীর্ঘ রেওয়ায়াতটি বর্ণনার পর লিখেছেন : ‘‘আবূ দাউদ আবূ যিনাদ তাঁর পিতা থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন’’ অথচ এখানে একটি সন্দেহের সৃষ্টি হয় (৬/১৬০)।
‘‘আর-রাওদুল বাসিম ফি আযযাহবিস সুন্নাহ আবীল ক্বাসিম’’ গ্রন্থের সম্মানিত লেখক ইমাম ইবনু কাসির (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন- তিনি এর সনদকে হাসান বলেছেন। আমি (নাসিরুদ্দীন আলবানী) ইমাম ইবনু কাসিরের ‘তাফসীরে’ এটা পাইনি। সম্ভবত তিনি তাঁর অন্য কোন কিতাবে তা উল্লেখ করেছেন।
উলূমুল হাদীসের আলোকে হাদীসটি অতি উত্তম। কেননা হাদীসটির ভিত্তি হল আবূ যিনাদ। তাঁর সম্পর্কে হাফিয (রহ) বলেছেন :
صدق ، تغير حفظه لَما قدم بغداد ، وكان فقيه
‘‘সত্যবাদী, কিন্তু বাগদাদে যাওয়ার পর তার স্মৃতিশক্তিতে বিভ্রম হয়। তিনি একজন ফক্বীহ ছিলেন।’’
হায়সামী (রহ) বলেছেন : (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/১৬ হা/১০৯৭৫)
رواه أحْمد والطبْراني بنحوه وفيه عبد الرحْمن بن أبِي الزناد وهو ضعيف وقد وثق وبقية رجال أحْمد ثقات
‘‘আহমাদ, তাবারানী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এতে আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদ যঈফ বর্ণনাকারী আছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তাকে সিক্বাহ গণ্য করা হয়। অন্যান্যরা আহমাদের সিক্বাহ বর্ণনাকারী।
আমি (আলবানী) বলছি : হায়সামী’র উক্তি : ضعيف وقد وثق ‘‘যঈফ, তবে তাকে সিক্বাহও গণ্য করা হয়’’ -সংগত নয়। কেননা তিনি তাঁকে যঈফ গণ্যকারীদের সিক্বাহ গণ্যকারীদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ প্রকৃত সত্য হল, তিনি মাঝামাঝি। অর্থাৎ তিনি ‘হাসান’ স্তরের, যদি না তাঁর থেকে অন্যদের (সিক্বাহ বর্ণনাকারীদের) বিপরীত কিছু পাওয়া যায়। [. শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদ (রহ)-কে হাসান স্তরের গণ্য করেছেন। আলী যাঈ (রহ) তাঁর সম্পর্কে সতেরজন ইমামের জারাহ ও বিশজন ইমামের তা‘দিল উল্লেখ করেছেন। অতঃপর (২১) ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) (২২) আল্লামা আয়নী (রহ) এবং (২৩) ‘আসারুস সুনানে’র সংকলক নিমাবী হানাফী’র পক্ষ থেকে আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদের গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর সমাপ্তি টেনেছেন নিম্নোক্তভাবে : خلاصہ التحقیق یہ ہے کہ عبد رحمان بن ابی زناد کی بیان کردہ حدیث حسن لذاتہ ہے اور سلیمان بن داود الہاشمی و اہل مدینہ کی ان سے روایت صحیح ہوتی ہے، اِلا یہ کہ کسی خاص روایت میں ان کا وہم یا اس روایت کو معلول ہونا محدثین کرام سے ثابت ہو جائے تو خاص کے عام پر مقدم ہونے کے اصول سے وہ روایت مستثنی ہوگی اور باقی تمامروایت پرحسن یا صحیح ولا اصول جاری رہے گا۔ ‘‘তাহক্বীক্বের সার-সংক্ষেপ : আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদের বর্ণিত হাদীস হাসান লিযাতিহি স্তরের। তার থেকে সুলায়মান বিন দাউদ হাশিমী ও মদীনাবাসীরা বর্ণনা সহীহ। তবে যদি কোন খাস (সুনির্দিষ্ট) বর্ণনাতে তার ব্যাপারে সংশয় বা বর্ণনাতে ত্রুটি থাকা মুহাদ্দিসগণের নিকট প্রমাণিত হয়, তবে ঐ খাস বর্ণনাকে ‘আম বর্ণনার উপর প্রাধান্য পাওয়ার উসূলের আলোকে ব্যতিক্রম (যঈফ) গণ্য হবে। অন্যান্য সবক্ষেত্রে হাসান বা সহীহ’র উসূল জারি থাকবে। আলহামদু লিল্লাহ। [শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ, তাহক্বীক্ব আওর ইলমি মাক্বালাত-৪ পৃ. ৩৭১-৩৭৭ (সংক্ষেপিত)।]-বাংলা অনুবাদক] কিন্তু পূর্বোক্ত (হায়সামীর) উক্তিটি এই মর্যাদা দেয় না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
[মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-বানী, সিলসিলাতুল আহাদীসুস সহীহাহ ৬/২৫৫২ নং হাদীস]
বিশেষ জ্ঞাতব্য : (অতঃপর ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) বলেন) যখন আপনি এটা বুঝতে পারলেন [‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম। ...... তারাই ফাসিক্ব।’’ (সূরা মায়িদার : ৪৪, ৪৫ ও ৪৭)] আয়াত তিনটি ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, আর তারা রসূলুল্লাহ (স)-এর হুকুম সম্পর্কে বলেছিল :
إن أعطاكم ما تريدون حكمتموه و إن لَم يعطكم حذرتُم فلم تُحكموه
‘‘যা তোমরা চাও যদি সে তা দেয় তবে তাঁকে হাকিম বানাও, আর যদি তোমাদের চাহিদা সে পূরণ না করে তবে তাঁকে হাকিম বানিয়ো না।’’ কুরআনুল কারীম তাদের এই বক্তব্যের দিকে লক্ষ করে নিম্নোক্ত বক্তব্যটি উপস্থাপন করে :
إِنْ أُوتِيتُمْ هَذَا فَخُذُوهُ وَإِنْ لَمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا يَقُولُونَ
‘‘তারা বলে : যদি তোমাদের এটা দেয়া হয় তাহলে মানবে, অন্যথায় মানবে না।’’ [সূরা মায়িদা : ৪১]
আপনি যখন এটা জানেনই যে, এই আয়াতগুলোর আলোকে ঐসব মুসলিম শাসককে কাফির বলা জায়েয নয়- যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আইনের পরিবর্তে দুনিয়াবী (মতবাদযুক্ত) আইন মোতাবেক বিচার ফায়সালা করে। কেননা সে এক দৃষ্টিতে ইয়াহুদীদের মতই অর্থাৎ (আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত) বিচারকার্যের ক্ষেত্রে। অন্য দৃষ্টিতে তাদের বিপরীত অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা-এর নাযিলকৃত বিধানের প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর সত্যতাকে মানা কাফির ইয়াহুদীদের বিপরীত। কেননা ইয়াহুদীরা নবী (স)-কে অস্বীকার করেছিল, যার স্বপক্ষে প্রথম (সূরা মায়িদা : ৪১ নং) আয়াতটি প্রমাণ বহন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা মুসলিমই ছিল না।
এর আলোকে যে বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট হয় তা হল কুফর দুই প্রকার। যথা :
১.ই‘তিক্বাদী বা আক্বীদাভিত্তিক,
২.আমালী বা আমলভিত্তিক।
ই‘তিক্বাদী হল, আন্তরিক স্বীকৃতি। পক্ষান্তরে আমালী হল, যা বাহ্যভাবে প্রকাশিত। যার কোন আমল শরীআতের বিরোধী হওয়ার কারণে কুফর হয় এবং যা তার অন্তরে আছে তাও প্রকাশ্য কুফর মোতাবেক হয়- সেক্ষেত্রে এই কুফরকে ই‘তিক্বাদী কুফর বলা হবে। এটা ঐ কুফর যা আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করেন না। আর এর পরিণাম হল, সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে। আর যদি তার অন্তরে যা আছে তা তার আমলের বিপরীত, অর্থাৎ সে নিজের রবের হুকুমের প্রতি ঈমান আনে, কিন্তু আমলের দিক থেকে তার বিপরীত করে- তবে তার কুফর কেবলই আমলী কুফর হবে, ই‘তিক্বাদী কুফর হবে না। আর সে আল্লাহ’র ইচ্ছার অধীন হবে- তিনি ইচ্ছা করলে তাকে আযাব দেবেন, কিংবা ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করবেন। আর ঐ সমস্ত হাদীস যেখানে অপরাধ বা গোনাহের কারণে মুসলিমের ব্যাপারে কুফর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সন্দেহযুক্ত কুফর হিসাবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণ নিচে প্রণিধানযোগ্য :
১.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : اثْنَتَان في النَّاسِ هُمَا بهم كُفْرٌ : الطَّعْنُ فِي النَّسَبِ، وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ ‘‘দু’টি বিষয় মানুষের মধ্যে রয়েছে, যা তাদের জন্য কুফর : ক. বংশ নিয়ে খোঁটা দেয়া, খ. মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা।’’ [. উক্ত হাদীসটি কেবল كفر শব্দ থেকে। অপর হাদীসে الكفر শব্দও এসেছে। যেমন- রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : ثلاثٌ مِن الكفرِ باللهِ : شَقُّ الجَيْبِ والنِّياحةُ والطَّعنُ في النَّسبِ ‘‘তিনটি হল আল্লাহর সাথে আল-কুফরের অন্তর্ভুক্ত : অন্তরে আঘাত দেয়া, নিয়াহাহ (মৃতের স্মরণে একত্রিত হওয়া), বংশের ব্যাপারে খোঁটা দেয়া।’’ [সহীহ ইবনু হিব্বান ১৪৬৫- শুআয়েব আরনাউত সহীহ বলেছেন] سُئِلَ ابنُ عباسٍ عن الذي يأتي امرأتَه في دُبُرِها ؟ فقال : هذا يَسْأَلُنِي عن الكُفْرِ ؟‘‘সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা)-কে কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর পশ্চাদদ্বারে সংগম করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল? তিনি (রা) বললেন : সে কি আমাকে আল-কুফর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে?’’ [নাসাঈ কুবরা ৮৯৫৫, আদাবুয যিফাফ পৃ. ১০৬, ৩০৪- আলবানী সনদ সহীহ]এ থেকে সুস্পষ্ট হল, ‘আল-কুফর’ থাকলেই চূড়ান্ত কুফর হয় না, বরং আমলী কুফরও হয়।- [বাংলা অনুবাদক]] [সহীহ মুসলিম, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব (ইফা) ৪/৩৫৬ পৃ.]
২.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : اَلْجِدَالُ فِي الْقُرْآنِ كُفْرٌ ‘‘কুরআন নিয়ে বিতর্ক করা কুফর।’’ [মুস্তাদরাকে হাকিম; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহুল জামেউস সগীর ওয়া যিয়াদাতাহু ১/৩১০৬ নং)]
৩.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه كُفْرٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪]
৪.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : كُفْرٌ بِاللهِ تَبَرُّؤَ مِنْ نَّسَبٍ وَ إِنْ دَقَّ ‘‘(সত্যিকারের) বংশকে অস্বীকার করাতে আল্লাহ’র সাথে কুফর করা হয়, যদিও বংশ খুবই নিচু হয়।’’ [বাযযার, দারেমী, তাবারানীর আওসাত; আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন (সহীহুল জামে‘ ২/৪৪৮৫ নং)]
৫.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : اَلتَّحَدُّثُ بِنِعْمَةِ اللهِ شُكْرٌ وَ تَرَكُهَا كُفْرٌ ‘‘আল্লাহ তাআলা-এর নিয়ামত বর্ণনা করা শোকর এবং তা তরক করা কুফর।’’ [বায়হাক্বী- শুআবুল ঈমান; আলবানী : হাসান বলেছেন (সহীহুল জামে‘ ১/৩০১৪ নং)]
৬.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَ تَرْجِعُنَّ بَعْدِيْ كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ ‘‘তোমরা আমার পরে পরস্পরের গর্দান উড়িয়ে কাফিরে পরিণত হয়ো না।’’ [সহীহ বুখারী ১২১, সহীহ মুসলিম ১২৬ (১১৮/৬৫), মিশকাত ৩৫৩৭]
এ ধরনের আরও অনেক হাদীস আছে, যার সবগুলোর বর্ণনা উল্লেখ করা এখানে নিষ্প্রয়োজন। সুতরাং মুসলিমদের মধ্যে কেউ এই জাতীয় অপরাধ করলে এই কুফর আমলী কুফর’ হিসাবে গণ্য হবে- অর্থাৎ সে কাফিরদের ন্যায় আমল করল। তবে সে যদি এ অপরাধ করাকে হালাল মনে করে এবং গোনাহ হিসাবে গণ্য না করে, তবে সেক্ষেত্রে সে (এমন) কাফির বলে গণ্য হবে, যার রক্ত (হত্যা করা) হালাল। কেননা তার কুফরী আক্বীদার ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে। আর حكم بغيْر ماانزل الله ‘‘আল্লাহ’র নাযিলকৃত হুকুম ছাড়া অন্য কোন হুকুম’’-এই নীতি থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সালাফদের থেকে এ ধরনের বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা একে শক্তিশালী করে। এই আয়াতের তাফসীরে তাদের বক্তব্য হল, كفر دون كفر ‘‘(মুরতাদ হওয়ার) কুফর থেকে কম কুফর’’। এই তাফসীর আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর তাঁর থেকে অনেক তাবেয়ী (রহ) বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে থেকে আমার সাধ্যমত কয়েকটি বর্ণনা জরুরি মনে করছি। আশাকরি, এর ফলে ইদানিং যারা এই মাসয়ালার ব্যাপারে চরমপন্থা গ্রহণে গোমরাহ হয়েছে তাদের সহীহ পথ দেখাবে এবং খারেজীদের পথ ছেড়ে দেবে, তারা মুসলিমদের গোনাহর কারণে তাকফির (সুস্পষ্ট কাফির সম্বোধন) করে- যদিও তারা সালাত আদায় করছে ও সিয়াম পালন করে।
১.ইবনু জারীর তাবারী (রহ) (১০/৩৫৫/১২০৫৩) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন-
و من لم يحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون قال : هي به كفر ، و ليس كفرا بالله و ملائكته و كتبه و رسله
‘‘(যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম শাসন করে না- তারাই কাফির) ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : এটা কুফর, কিন্তু এই ব্যক্তির কুফর এমন নয় যেভাবে কেউ আল্লাহ তাআলা, মালাইকা, কিতাবসমূহ ও রসূলগণের প্রতি কুফর করে।’’ [. এই সনদটি বিরোধী পক্ষের নিকটও সহীহ, কিন্তু তারা মতনটির ব্যাপারে আপত্তি করেছে। অথচ পরের বর্ণনাগুলো এই মতনটিকে সমর্থন করলেও তাদের দাবি হল, মতনগুলো পরস্পর বিরোধী বা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হওয়ায় একটি অপরটিকে সমর্থন করে না। যদিও প্রতিটি মতনের মূল দাবি হল, কুফর বলতে চূড়ান্ত কুফর সবসময় বুঝাবে না, বরং যে আল্লাহ, রসূল, আখিরাত প্রভৃতির উপর ঈমান রাখে তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কুফর থেকে কম কুফর প্রযোজ্য। তা ছাড়া সূরা মায়িদা’র ৪৪ নং আয়াতটি বলছে : ‘আল্লাহর বিধান’ হেফাযত না করে বিকৃত ও গোপন করার কারণে আল্লাহর বিধান জারি না হলে তারা কাফির। পক্ষান্তরে সূরা মায়িদা’র ৪৫ ও ৪৭ নং আয়াতের দাবি হল, কেবল আল্লাহর বিধান না জারিকারী জালিম ও ফাসিক্ব। কাজেই সূরা মায়িদা ৪৪-৪৭ আয়াতও ইবনু আব্বাস (রা)-এর হাদীসের মতনকে সমর্থন করছে। [বাংলা অনুবাদক]]
২.তিনি ইবনু আব্বাস (রা) থেকে অপর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন :
إنه ليس بالكفر الذي يذهبون إليه ، إنه ليس كفرا ينقل عن الملة، كفر دون كفر
‘‘এটা ঐ কুফর নয়, যার দিকে এরা (খারেজীরা) গিয়েছে। এটা ঐ কুফর নয়, যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে দেয়। বরং كفر دون كفر ‘‘(চূড়ান্ত) কুফরের থেকে কম কুফর’’। [. বিরোধী পক্ষ এই বর্ণনাটির সনদকে যঈফ বলেছেন। কেননা, এই বর্ণনাটির সনদে হিশাম বিন হুজায়রকে ইয়াহইয়া বিন ক্বত্তান (রহ), ইবনু মাঈন (রহ) ও ইমাম আহমাদ (রহ) বিভিন্ন শব্দে আপত্তি করেছেন। এর জবাব হল, হিশাম বিন হুজায়রকে যারা সিক্বাহ ও গ্রহণযোগ্য বলেছেন মুহাদ্দিসদের মধ্যে তারাই সংখ্যাধিক্য। ফলে সনদটি হাসান স্তরের। তার বর্ণনা রয়েছে সহীহ বুখারীতে (হা/৬৭২০), সহীহ মুসলিমে হা/২৯১১ (২০৯/১২৪৬)- হজ্জ অধ্যায়, হা/৪১৭৮ (২৩/১৬৫৪) - শপথ অধ্যায়। এ ছাড়া উক্ত ইমামদের পক্ষ থেকে হিশামের প্রতি আপত্তিগুলো চূড়ান্ত জারাহ’র শব্দ হিসেবে প্রমাণিত নয়। তাদের পক্ষ থেকে সমর্থনমূলক শব্দও আছে। বিস্তারিত : আবূ উসামা সুলায়ম বিন ঈদ হিলালী, কুর্রাতুল উয়ুন ফী তাসহীহ তাফসীর আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস পৃ. ৪৩-৭০। পূর্বের সহীহ সনদের বর্ণনাটিও মতনের দিক থেকে একে সমর্থন করে। সেক্ষেত্রে হিশাম একক হওয়ার আপত্তি দূর হয়। [বাংলা অনুবাদক]]
এটা ইমাম হাকিম (রহ) বর্ণনা করেছেন (২/৩১৩) এবং বলেছেন : ‘সহীহুল ইসনাদ’। আর ইমাম যাহাবী (রহ) চুপ থেকেছেন। আর তাদের দু’জনের সমন্বয়ে হক্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ তাদের উক্তি : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’ দ্বারা হাদীসটি উক্ত মর্যাদাই উন্নীত হয়। অতঃপর আমি এটাও দেখলাম যে, হাফিয ইবনু কাসির (রহ) তাঁর তাফসিরে (৬/১৬৩) হাকিম থেকে বর্ণনা করার পর বলেছেন : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’। সুতরাং সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুস্তাদরাকে হাকিমের কোন কোন সংস্করণে বাক্যটি বাদ পড়েছে। [. বর্ণনাটি রাবী হিশাম বিন জুহায়রকে যারা সিক্বাহ বা গ্রহণযোগ্য বলেছে : ইবনু শিবরামা (রহ) বলেন : ليس بمكة مثله (হিশামের সাথে তুলনীয় কেউ মক্কাতে ছিল না) [আহমাদ বিন হাম্বল, আল-জামিউ লিউলূমির রিজাল পৃ. ৩৪৩] ইবনু মাঈন (রহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে : তিনি সালিহ (নেককার) ছিলেন। ...ইমাম আবূ হাতিম (রহ) বলেন : তার হাদীস লেখা হয়। [আবূ হাতিম রাযী, আল-জারাহ ও তা‘দিল] যাহাবী (রহ) বলেন : ইমাম আহমাদ তাকে যঈফ বলেছেন আর অন্যরা তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [ইমাম যাহাবী, যাকারু আসমাউ মান তাকাল্লামা ফীহি ওয়া হুয়া মাওসুকুন ১/১৮৭ পৃ. ৩৫৫ নং] আজলী (রহ) তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [উক্বদুস সামিন ফী তারিখিল বালাদিল আমীন ৬/১৭৯-১৮০, ২৬৩৭ নং]- বাংলা অনুবাদক]]
৩.ইবনু জারীর তাবারী (রহ) অপর একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন যা আলী ইবনু আবী তালহা, ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (রা) বলেন :
من جحد ما أنزل الله فقد كفر ، و من أقر به و لَم يَحكم فهو ظالِم فاسق
‘‘যে আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিষয়াদি অস্বীকার করে সে কাফির, কিন্তু যে স্বীকার করে অথচ সে মোতাবেক ফায়সালা না করে তবে সে যালিম ও ফাসিক্ব।’’
আমি (আলবানী) বলছি : ইবনু আবী তালহা কর্তৃক ইবনু আব্বাস (রা) থেকে শোনার কথা প্রমাণিত নয়। এরপরও সাক্ষ্যমূলক হাদীস হিসেবে এটি খুবই উত্তম। [. বিরোধী পক্ষ বর্ণনাটির বাহ্যিক অবস্থা থেকে মুনক্বাতে‘ হওয়াতে যঈফ বলেছেন। তবে বর্ণনাটি উপরে সহীহ-মুত্তাসিল বর্ণনা দুটিকে সমর্থন করে। ফলে এক্ষেত্রে সিক্বাহ বর্ণনাকারী বর্ণনাকে সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা যায়। আবূ জা‘ফার নুহাস (রহ) তাঁর ‘নাসিখ ওয়াল মানসুখে’ (পৃ.৭৫) লিখেছেন : والذي يطعن في إسناده يقول : إبن أبي طلحة لم يسمع من ابن عباس، وإنما أخذ التفسير عن مجاهد وعكرمة ، وهذا القول لا يوجب طعنًا، لأنه أخذه رجلين ثقين، وهو في نفسه ثقة صدوق ‘‘যারা সনদটির প্রতি অভিযোগ করেন তারা বলেন : ইবনু আবী তালহা (রহ) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে শোনেননি। অথচ তিনি মুজাহিদ ও ইকরামা থেকে তাফসীরটি গ্রহণ করেছেন। ফলে উক্ত উক্তিটি অভিযোগটিকে গুরুত্ববহ করে না। কেননা তিনি দুইজন সিক্বাহ থেকে এটি নিয়েছেন। আর তিনি নিজেই সিক্বাহ ও সত্যবাদী। [বিস্তারিত : আবূ উসামা সুলায়ম বিন ঈদ হিলালী, কুর্রাতুল উয়ুন ফী তাসহীহ তাফসীর আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস পৃ. ৭২] -বাংলা অনুবাদক]
৪.অতঃপর ইবনু জারীর (রহ) (১২০৪৭-১২০৫১) আতা বিন আবী রিবাহ’র উক্তি উল্লেখ করেছেন : ‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম।.... তারাই ফাসিক্ব’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪, ৪৫ ও ৪৭) ‘‘তিনটি আয়াত উল্লেখ করে বলেছেন : كفر دون كفر ، و فسق دون فسق ، و ظلم دون ظلم (চূড়ান্ত) কুফর থেকে (কম) কুফর, (চূড়ান্ত) ফিস্ক্ব থেকে (কম) ফিস্ক্ব এবং (চূড়ান্ত) যুলুম থেকে (কম) যুলুম।’’ এর সনদ সহীহ। [. এই সনদটির প্রতি আপত্তি হল, এতে ইবনু জুরায়জ মুদাল্লিস এবং সে বর্ণনাটি ‘আন দ্বারা উল্লেখ করেছে। ফলে সনদটি যঈফ। এ পর্যায়ে অনুসন্ধানের বিষয় হল, ইবনু জুরায়জ (রহ) আতা (রহ) থেকে শুনেছেন কী না? সুলায়ম বিন ঈদ আল-হিলালী লিখেছেন : ابن جريج معروف بالتدليس مع جلالته وتقته، لكن استثنى أهل العلم روايته عن عطاء بخاصة ، فقد روى ابن أبي خيثمة بسند صحيح عن ابن جريج أنه قال : إذا قلت : قال عطاء فأنه سمعته منه وإن لم أقل : سمعت . ( تهذيب التهذيب ٦ \ ٤٠٦ ) ‘‘ইবনু জুরায়জ তার সম্মান ও বিশ্বস্ততাসহ তাদলীসকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। কিন্তু আহলে ইলম খাসভাবে আতা’র বর্ণনার ব্যাপারে তাকে ব্যতিক্রম গণ্য করেছেন। যেমনটি ইবনু আবী খায়সামা সহীহ সনদে ইবনু জুরায়জ থেকে উল্লেখ করেন, তিনি বলেছেন : যখন আমি বলি : আতা বলেছেন, তাহলে আমি তার থেকে শুনেছি। আর যদি আমি না বলি : তবে শুনেছি। (তাহযীবুত তাহযীব ৬/৪০৬) [কুর্রাতুল উয়ুন পৃ. ৭৮] শায়খ আলবানী (রহ) -ও উদ্ধৃতিটি দেয়ার পর বলেছেন : وهذه فائدة هامة جدا تدلنا على أن عنعنة ابن جريج عن عطاء في حكم السماع ‘‘উদ্ধতিটি খুব বেশি উপকারী, ইবনু জুরায়জ থেকে আতা সনদে আনআনা থাকাটা শোনার হুকুম হিসেবে আমাদের জন্য দলিল।’’ [ইরওয়াউল গালীল ৪/২৪৪ পৃ. হা/১০৫০-এর আলোচনা] -বাংলা অনুবাদক]
৫.অতঃপর (১২০৫২) ইবনু জারীর (রহ) সাঈদ আলমাক্কী থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘আয়াতটি উল্লেখ করার পর তিনি বলেছেন, ليس بكفر ينقل عن الْملة এটা ঐ কুফর নয় যা মিল্লাত থেকে বের করে দেয়।’’
এর সনদ সহীহ। এই সাঈদ হলেন, ইবনু যিয়াদ আশ-শায়বানী আলমাক্কী। যাঁকে ইবনু মুঈন, আল-ইজলী, ইবনু হিব্বান প্রমুখ সিক্বাহ বলেছেন এবং তার থেকে একটি জামাআত বর্ণনা করেছেন।
৬. অতঃপর ইবনু জারীর তাবারী (রহ) (১২০২৫-১২০২৬) দু’টি ভিন্নভাবে ইমরান বিন হাদীর থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘আবূ মিজলাযের কাছে বনী আমর বিন সাদুসের কিছু লোক এসে (অন্য বর্ণনায়, ইবাযিয়াহ’র একটি গোত্র) বলল :
أرأيت قول الله : ( و من لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ) أحق هو؟ قال : نعم . قالوا : ( و من لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الظالِمون ) أحق هو؟ قال : نعم . قالوا : ( و من لَم يَحكم بما أنزل الله فأولئك هم الفاسقون ) أحق هو ؟ قال : نعم . قال : فقالوا : يا أبا مُجلز فيحكم هؤلاء بما أنزل الله ؟ قال : هو دينهم الذي يدينون به ، و به يقولون و إليه يدعون - [ يعني الأمراء ] - فإن هم تركوا شيئا منه عرفوا أنّهم أصابوا ذنبا . فقالوا : لا والله ، و لكنك تفرق . قال : أنتم أولى بِهذا منَي ! لا أرى ، و إنكم أنتم ترون هذا و لا تَحرجون ، و لكنها أنزلت في اليهود و النصارى و أهل الشرك . أو نَحوا من هذا
‘‘আল্লাহ তাআলা’র এই নির্দেশের ব্যাপারে আপনি কি বলেন (‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’) এটা কি হক্ব (সঠিক)? তিনি জবাব দিলেন : হাঁ, অবশ্যই। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসা করল, (‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই যালিম।’’) এটা কি হক্ব (সঠিক)? তিনি জবাব দিলেন : হাঁ। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসা করল, (যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই ফাসিক।’’) এটা কি হক্ব (সঠিক)? তিনি জবাব দিলেন : হাঁ। তারা জিজ্ঞাসা করল, এই লোকেরা (হাকিম/বিচারক) কি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা করে? তিনি বললেন : এটা তাদের দ্বীন, যার উপর তারা চলছে। সে মোতাবেকই করে এবং সে দিকেই ডাকে। তারা এটা জানে যে, এর মধ্যে কোন কিছু থেকে বিচ্যুতি হলে সে গোনাহগার হবে। তারা বলল : এমনটা না, বরং আল্লাহর ক্বসম! আপনি তো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ পৃথক। তিনি বললেন : ‘‘(উম্মাতের বিভক্তির ক্ষেত্রে) তোমরাই আমার থেকে অগ্রগামী এবং এই অপবাদের অধিকারী। আমি তো এই রায় দিই না, অথচ তোমরা এমন দৃষ্টিভঙ্গিই রাখ এবং এ ব্যাপারে কোন ক্ষতির ভয় রাখ না। অথচ প্রকৃতপক্ষে আয়াতটি ইয়াহুদী, নাসারা, মুশরিকীন ও তাদের গোত্রগুলো সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।’’ -এর সনদ সহীহ।
আলেমদের ইখতিলাফ রয়েছে, প্রথম আয়াতটির ‘কাফির’ শব্দটির তাফসীর নিয়ে। এখানে পূর্বোক্ত পাঁচটি উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। যা ইবনু জারীর (রহ) তাঁর তাফসীরে নিজের সনদসহ উল্লেখ করেছেন (১০/৩৪৬-৩৫৭)। অতঃপর উপসংহারে (১০/৩৫৮) লিখেছেন :
و أولَى هذه الأقوال عندي بالصواب قول من قال : نزلت هذه الآيات في كفار أهل الكتاب ، لأن ما قبلها و ما بعدها من الآيات ففيهم نزلت ، و هم الْمعنيون بِها ، و هذه الآيات سياق الْخبْر عنهم ، فكونَها خبْرا عنهم أولَى . فإن قال قائل : فإن الله تعالى ذكره قد عم بالْخبْر بذلك عن جميع من لَم يَحكم بِما أنزل الله ، فكيف جعلته خاصا ؟ قيل : إن الله تعالَى عم بالْخبر بذلك عن قوم كانوا بِحكم الله الذي حكم به في كتابه جاحدين ، فأخبْر عنهم أنّهم بتركهم الْحكم - على سبيل ما تركوه - كافرون . و كذلك القول في كل من لَم يَحكم بِما أنزل الله جاحدا به هو بالله كافر ، كما قال ابن عباس ، لأنه بَجحوده حكم الله بعد علمه أنه أنزله في كتابه ، نظيْر جحوده نبوة نبيه بعد علمه أنه نبَي "
‘‘আয়াতে তাহকীমে’র তাফসীরে বর্ণিত উক্তিগুলোর মধ্যে আমার কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য উক্তি হল, যিনি বলেছেন : এই আয়াত আহলে কিতাবের কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কেননা, আয়াতটির পূর্বাপর সম্পর্ক আহলে কিতাবদের সাথে। এই কারণে তারাই এখানে উদ্দেশ্য। কেননা তাদের সম্পর্কে পূর্বেই খবর বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং তাদের সম্পর্কে পূর্বের বর্ণনাই এ সম্পর্কিত দলিল। যদি কেউ এটা বলে যে, আল্লাহ তাআলা এই খবরকে ‘আম রেখেছেন, যা সবার জন্যই প্রযোজ্য- যারা আল্লাহ তাআলা’র নাযিল করা শরীআত মোতাবেক ফায়সালা করে না। সুতরাং আপনি কিভাবে এগুলো খাস করছেন? তখন তাদের জবাব দেয়া হবে : নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এ খবরকে ‘আম রেখেছেন। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে যারা কিতাবুল্লাহ’র নাযিলকৃত আহকামকে অস্বীকার করে। সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে এ খবর দিচ্ছেন যে, তাদের হুকুমে ইলাহী তরক করার যে অভ্যাসগত আমল ছিল, সেই হুকুমে ইলাহী তরক করার ক্ষেত্রে ঐ (খাস) আমলের কারণেই তারা কাফির ছিল। আর এই হুকুম ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যারা আমলগতভাবেই অস্বীকৃতির করার কারণে হুকুমে ইলাহী মোতাবেক্ব ফায়সালা করে না। কেননা এ সমস্ত লোকেরা আল্লাহকেই অস্বীকার করে, যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন। কেননা হুকুমে ইলাহী অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বিষয়টি তাঁর কিতাবে নাযিল করেছেন জেনে নেয়ার পর, সেটা অস্বীকার করাটা তেমনি, যেমন নবীর নবুওয়াত অস্বীকার করা। অথচ তারা সুস্পষ্টভাবে তা জানে।’’
মোটকথা, এই আয়াত আল্লাহ তাআলা’র আয়াত অস্বীকারকারী ইয়াহুদের সম্পর্কে নাযিল হয়। এখন অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞার ক্ষেত্রে যে তাদের সাথে শরীক (মতো/সাদৃশ্য) হবে, সে কুফরের মধ্যকার ই‘তিক্বাদী (বিশ্বাসগত) কুফরের অধিকারী হবে। কিন্তু যে অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞার ক্ষেত্রে তাদের শরীক (মতো/সদৃশ) নয়, সে কুফরের মধ্যকার আমলী কুফরের অধিকারী হবে। কেননা সে ইয়াহুদীদের ন্যায় আমল করেছে। এ কারণে সে গোনাহগার ও সীমালঙ্ঘনকারী হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু এ কারণে সে মিল্লাতে ইসলামিয়া থেকে খারিজ (বহিষ্কৃত) হবে না। এ সম্পর্কে ইবনু আব্বাসের উক্তি ইতোপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইমাম হাফিয আবূ উবায়দ আল-ক্বাসিম বিন সালাম নিজ গ্রন্থ ‘কিতাবুল ঈমান’-এ উল্লেখ করেছেন। [ باب الْخروج من الإيْمان بالْمعاصي ( صـ ٨٤ - ٨٧ ) بتحقيقي )] সুতরাং যে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চায় সে যেন (আমার তাহক্বীক্বসহ) গ্রন্থটি পাঠ করে।
আমি (আলবানী) এগুলো লেখার পর আমার দৃষ্টি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ)’র ‘মাজমাউল ফাতাওয়া’র (৩/২৬৮) আয়াতে তাহকীমের দিকে নিবদ্ধ হয়। তিনি বলেছেন :
أي هو الْمستحل للحكم بغيْر ما أنزل الله .
‘‘এই হুকুম তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান ছাড়া অন্য বিধানকে হালাল মনে করে।’’
অতঃপর (৭/২০৪) বলেছেন : ইমাম আহমাদকে আলোচ্য কুফর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়।
তিনি (রহ) বললেন :
كفر لا ينقل عن الإيْمان ، مثل الإيْمان بعضه دون بعض ، فكذلك الكفر ، حتى يَجيء من ذلك أمر لا يَختلف فيه
‘‘এটা এমন কুফর যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না, যেভাবে ঈমান কারো থেকে কারো কম হয়। তেমনি কুফরও (কমবেশি হয়)। এভাবে ব্যক্তি ঐ কুফরেরও অধিকারী হয় যে ব্যাপারে কোন ইখতিলাফই (ভিন্নমত) নেই।’’
অতঃপর ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) (৭/৩১) বলেছেন।
সালাফদের উক্তি :
أن الإنسان يكون فيه إيْمان و نفاق
‘‘একজন মানুষের মধ্যে ঈমান ও নিফাক্ব একত্রিত হতে পারে।’’
তাঁদের অন্যতম অপর একটি উক্তি :
أنه يكون فيه إيْمان و كفر، و ليس هو الكفر الذي ينقل عن الْملة
‘‘একজন মানুষের মধ্যে ঈমান ও কুফর একত্রিত হতে পারে। তবে এ কুফর মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না।’’ যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) ও তাঁর সাথীরা আল্লাহ তাআলা’র বাণী : و من لَم يَحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون (সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত) সম্পর্কে বলেছেন।
তাঁরা বলেছেন :
كفر لا ينقل عن الْملة . و قد اتبعهم على ذلك أحْمد و غيْره من أئمة السنة
‘‘এটা এমন কুফরের অধিকারী যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও অন্যান্য সালাফগণ (রহ) এই উক্তির অনুসরণ করেছেন।’’ [সূত্র : মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬/২৫৫২ নং হাদীসের আলোচনা দ্রষ্টব্য]
উক্ত গ্রন্থের ৪৫৭ পৃষ্ঠায় (হা/২৭০৪) শায়খ আরও আলোচনা করেছেন :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ .... ُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ..... فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম। ...... তারাই ফাসিক্ব।’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭)
(রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :) ‘‘এই আয়াত কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়।’’
ইমাম আহমাদ (রহ) এটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি সনদ হল : ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন আ‘মাশ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন মার্রাহ থেকে, তিনি বারা বিন আযিব (রা) থেকে যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন ....।
আমি (আলবানী) বলছি : এর সনদ শায়খায়নের (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের) শর্তে সহীহ।
এই হাদীসটি সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে, আলোচ্য তিনটি (সূরা মায়িদা ৪৪-৪৭) আয়াতের প্রকৃত দাবি হল, ইয়াহুদী ও নাসারাদের কাফিরগণ এবং যেসব লোক ইসলামী শরীআত ও এর আহকামকে অস্বীকার করে। এভাবে তারাও এর মধ্যে শরীক, যাদের প্রতি হুকুমের সদৃশ পাওয়া যায়- যদিও সে নিজেকে মুসলিম হিসাবে প্রকাশ করে। কেননা, কোন একটি হুকুম অস্বীকার করলেও সেই প্রকৃত কাফির। কিন্তু যে ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত তা হল, যদি কেউ কোন ক্ষেত্রে এই ইসলামী বিধানকে অস্বীকার করা ছাড়াই (ইসলাম মোতাবেক) ফায়সালা না করে, তবে তার প্রতি কাফির হুকুম লাগানো জায়েয নয়। এমনকি সে এই মিল্লাত থেকে খারিজও নয়। কেননা সে মু’মিন। বেশির চেয়ে বেশি এটা বলা যাবে যে, তার কুফর আমলী কুফর। এটা এমনই গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা যে ব্যাপারে অধিকাংশ যুবকরাই ভুলের মধ্যে আছে। এ কারণে অধিকাংশ লোকেরা ঐ সমস্ত হাকিমদের (শাসক/বিচারক) ইসলাম থেকে খারিজ গণ্য করে যারা শরীআতের বিরোধি ফায়সালা দিচ্ছে। যার ফলে অনেক ফিতনার বিসত্মৃতি ঘটেছে। এমনকি যাদের তা প্রতিরোধের শক্তি ও ক্ষমতা নেই এমন অনেক নিষ্পাপ প্রাণ থেকে খুন ঝরছে।......
আমার মতে (এ মুহূর্তে) ওয়াজিব হল, ইসলামকে ঐ সব বিষয় থেকে পাক-পবিত্র করা যার উদ্যোগ তাদের মধ্যে নেই। তা হল- বাতিল আক্বীদা, নিরর্থক মাসলা-মাসায়েল (আহকাম), বিকৃত রায়ের মাধ্যমে সুন্নাতের বিরোধিতা। অতঃপর নতুন প্রজন্মকে এই পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ ইসলামের তারবিয়াত প্রদান। [সূত্র : মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬/২৭০৪ নং হাদীসের আলোচনা দ্রষ্টব্য]
العلماء الأعلام الذين صرحوا بصحة تفسير ابن عباس واحتجوا به
[সিলসিলাহ আহদীসুস সহীহাহ হা/২৫৫২ ও ২৭০৪]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ .... ُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ..... فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘আমি তাওরাত নাযিল করেছিলাম, তাতে হিদায়াত ও নূর ছিল। নবীগণ- যারা ছিলেন অনুগত (মুসলিম) তদনুযায়ী এই ইয়াহুদীদের বিধান দিত, আর রব্বানী (সূফী/দরবেশ) ও আহবার (পণ্ডিত/আলেম/চিন্তাবিদ)-রাও। কেননা তাদের আল্লাহর কিতাবের হেফযাতকারী করা হয়েছিল এবং তারা ছিল এর সাক্ষী। অতএব, তোমরা লোকদের ভয় করো না, আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতকে সামান্য ও নগণ্য বিনিময়ে বিক্রি করো না। যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম।..... তারাই ফাসিক্ব।’’
(সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭ আয়াত)
আয়াতের শানে নুযূল
ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : আল্লাহ তাআলা এই (সূরা মায়িদা, ৪৪-৪৭ নং) আয়াতগুলো ইয়াহুদীদের দু’টি গোত্র সম্পর্কে নাযিল হয়। একটি গোত্র ছিল বিজয়ী এবং অপরটি ছিল পরাজিত। তারা পরস্পর এ ব্যাপারে সন্ধি করে যে, বিজয়ী সম্মানিত গোত্রের কোন ব্যক্তি যদি পরাজিত অপমানিত গোত্রের কাউকে হত্যা করে, সেক্ষেত্রে পঞ্চাশ ওয়াসাক দিয়াত (রক্তমূল্য) দেবে। আর পরাজিত অপমানিত গোত্রের কেউ বিজয়ী গোত্রের কাউকে হত্যা করলে একশ’ ওয়াসাক দিয়াত দেবে। এই প্রথাই চলে আসছিল। যখন রসূলুল্লাহ (স) মদীনাতে আসলেন, তখন গোত্র দু’টি রসূলুল্লাহ (স) -এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেটা প্রকাশ করেনি, এমনকি সমাধানেরও চেষ্টা করেনি। এরপর এমন একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে পরাজিত ইয়াহুদীদের একজন বিজয়ী ইয়াহুদীদের কাউকে হত্যা করে। তখন এদের (বিজয়ীদের) পক্ষ থেকে একশ’ ওয়াসাক আদায়ের জন্য (পরাজিতদের কাছে) একজনকে পাঠান হল। পরাজিতপক্ষ তখন বলল, এটা সুস্পষ্ট বেইনসাফী। কেননা আমরা উভয়েই একই জাতি, একই দ্বীন, একই বংশ, একই শহরের অধিবাসী। তাহলে একপক্ষের দিয়াত কিভাবে অপরপক্ষের অর্ধেক হয়? আমরা যদিও এতকাল তোমাদের চাপের মুখে ছিলাম, এই বেইনসাফী আইন পরিবর্তন না করে তা লাঞ্ছিত অবস্থায় মেনে এসেছি। কিন্তু এখন মুহাম্মাদ (স) এখানে এসেছেন (যিনি ন্যায়বিচারক)। সুতরাং আমরা তোমাদের তা দিব না।
তাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধার উপক্রম হল। শেষাবধি তারা বলল, চল এই দ্বন্দের ফায়সালা মুহাম্মাদ (স) -ই করবেন। কিন্তু বিজয়ী গোত্রের লোকেরা যখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল তখন তারা বলল, দেখ আল্লাহ’র ক্বসম! মুহাম্মাদ (স) কখনই তোমরা যা (পরাজিতদের কাছ থেকে) পেতে, তাতে তোমাদের দ্বিগুণ দিবেন না। আর তিনি সত্য কথা বলেন। তারা কখনই আমাদের এটা দেবে না, যতক্ষন না এই বিচারের রায় আমাদের পক্ষে হয়- এই জন্যে যে আমরা তাদের উপর বিজয়ী। সুতরাং রসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে গোপনে লোক পাঠাও। সে এটা বুঝে আসুক তিনি (স) কি ফায়সালা করবেন। যদি তা আমাদের পক্ষে হয় তবে তো খুব ভাল- তখন আমরা তাঁর ফায়সালা মেনে নেব। আর যদি আমাদের বিপক্ষে যায় সেক্ষেত্রে দূরে থাকাই ভাল এবং তাঁর ফায়সালা মানব না। তখন মুনাফিক্বদের মধ্যে থেকে কাউকে গোয়েন্দা বানিয়ে নবী (স) -এর কাছে পাঠাল। সে যখন প্রথমে গেল তখন আল্লাহ তাআলা নিচের আয়াত নাযিল করে তাদের ষড়যন্ত্র নবী (স)-কে জানিয়ে দিলেন।
আয়াতগুলো হল :
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ لَا يَحْزُنْكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْكُفْرِ مِنَ الَّذِينَ قَالُوا آَمَنَّا بِأَفْوَاهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِنْ قُلُوبُهُمْ وَمِنَ الَّذِينَ هَادُوا سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ سَمَّاعُونَ لِقَوْمٍ آَخَرِينَ لَمْ يَأْتُوكَ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِنْ بَعْدِ مَوَاضِعِهِ يَقُولُونَ إِنْ أُوتِيتُمْ هَذَا فَخُذُوهُ وَإِنْ لَمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا وَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ -
‘‘হে রসূল! সেই সব লোক যেন আপনার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ না হয় যারা দ্রুতগতিতে কুফরীর পথে অগ্রসর হচ্ছে। তারা সেই লোক, যারা মুখে বলে- আমরা ঈমান এনেছি, কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান গ্রহণ করেনি এবং তারা সেই লোক যারা ইয়াহুদী হয়েছে, তাদের অবস্থা এই যে, মিথ্যা শোনার জন্য তারা কান পেতে থাকে এবং এমন এক শ্রেণীর লোকের থেকে তারা কথা টুকিয়ে (কুড়িয়ে) বেড়ায় যারা কখনো তোমার নিকট আসেনি। তারা আল্লাহর কিতাবের শব্দগুলোকে তার স্থান থেকে পরিবর্তন করে এবং বলে যে, তোমাদের এ আদেশ দেয়া হলে মানবে অন্যথায় মানবে না। বস্তুত আল্লাহই যাকে ফিতনায় নিক্ষেপ করতে ইচ্ছা করেছেন, তাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে উদ্ধার করার জন্য তুমি কিছু করতে পার না। এরা সেই লোক যাদের মন-হৃদয়কে আল্লাহ পবিত্র করতে চাননি। তাদের জন্যে রয়েছে দুনিয়ার লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি।’’ [সূরা মায়িদা : ৪১ আয়াত]
سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ فَإِنْ جَاءُوكَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ أَوْ أَعْرِضْ عَنْهُمْ وَإِنْ تُعْرِضْ عَنْهُمْ فَلَنْ يَضُرُّوكَ شَيْئًا وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ ( ٤٢ )
‘‘এরা মিথ্যা শ্রবণে ও হারাম মাল ভক্ষণে অভ্যস্ত। কাজেই এরা যদি তোমার নিকট (নিজেদের মোকদ্দমা নিয়ে) আসে তবে তোমার ইখতিয়ার রয়েছে, ইচ্ছা করলে তাদের বিচার কর, অন্যথায় অস্বীকার কর। অস্বীকার করলে এরা তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। আর বিচার ফায়সালা করলে ঠিক ইনসাফ মুতাবিকই করবে, কেননা আল্লাহ ইনসাফকারী লোকদের পছন্দ করেন।’’ [সূরা মায়িদা : ৪২ আয়াত]
وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِنْدَهُمُ التَّوْرَاةُ فِيهَا حُكْمُ اللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ ( ٤٣ ) إِنَّا أَنْزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ( ٤٤ ) وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ( ٤٥ ) وَقَفَّيْنَا عَلَى آَثَارِهِمْ بِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَآَتَيْنَاهُ الْإِنْجِيلَ فِيهِ هُدًى وَنُورٌ وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ التَّوْرَاةِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةً لِلْمُتَّقِينَ ( ٤٦ ) وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنْجِيلِ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فِيهِ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ( ٤٧ )
‘‘এরা তোমাকে কিরূপে বিচারক মানে, যখন তাদের নিকট তাওরাত বর্তমান রয়েছে, তাতেই আল্লাহর আইন ও বিধান লিখিত আছে। কিন্তু এরা তা থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। আসল কথা এই যে, এরা ঈমানদার লোকই নয়। আমরা তাওরাত নাযিল করেছিলাম, তাতে হিদায়াত ও নূর ছিল। নবীগণ- যারা ছিলেন অনুগত (মুসলিম) তদনুযায়ী এই ইয়াহুদীদের বিধান দিত, আর রব্বানী (সূফী/দরবেশ) ও আহবার (পণ্ডিত/আলেম/চিন্তাবিদগণও)। কেননা তাদের আল্লাহর কিতাবের হিফযাতকারী করা হয়েছিল এবং তারা ছিল এর সাক্ষী। অতএব, তোমরা লোকদের ভয় করো না, আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াতকে সামান্য ও নগণ্য বিনিময়ে বিক্রি করো না। যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির। তাওরাতে আমরা ইয়াহুদীদের প্রতি এ হুকুমই লিখে দিয়েছিলাম যে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং সব রকমের যখমের বদলা নির্দিষ্ট। অবশ্য কেউ ক্বিসাস সাদাক্বা করে দিলে তা তার জন্যে কাফফারা হয়ে যাবে। আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই যালিম। তাদের পরে ঈসা ইবনু মারইয়ামকে প্রেরণ করেছি। তাওরাতের যা-কিছু তার সম্মুখে ছিল, সে ছিল তারই সত্যতা প্রমাণকারী। আমরা তাঁকে ইঞ্জিল দান করেছি, যার মধ্যে ছিল হিদায়াত ও আলো এবং তা-ও তাওরাতের যা কিছু তার সম্মুখে ছিল তারই সত্যতা প্রমাণকারী এবং মুত্তাক্বীদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ হিদায়াত ও নসীহত ছিল। আমাদের নির্দেশ ছিল যে, ইঞ্জিল বিশ্বাসীগণ তাতে আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করবে। আর যারাই আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা করবে না তারাই ফাসিক্ব।’’ [সূরা মায়িদা : ৪১-৪৭ আয়াত]
আলবানী (রহ) বলেন : হাদীসটি আহমাদ ১/২৪৬, তাবারানী-মু‘জামুল কাবীর ৩/৯৫/১-এ আব্দুর রহমান বিন আবূ যিনাদ তাঁর পিতা থেকে, তিনি উবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উতবাহ বিন মাসউদ থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন। ইমাম সুয়ূতী (রহ) এটাকে সমর্থন করেছেন (আদ-দুররুল মানসুর ২/২৮১)। আবূ দাউদ, ইবনু জারীর, ইবনু মুনযির, আবূ শায়খ, ইবনু মারদুবিয়াহ-ও ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনু জারীর (রহ) নিজের তাফসীরে (১০/৩২৫/১২০৩৭) এভাবেই বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি ইবনু আব্বাসের (রা) নাম উল্লেখ করেননি। আবূ দাউদের বর্ণনাতে উক্ত ঘটনাটি সুনির্দিষ্টভাবে ইয়াহুদী গোত্র বনূ কুরায়যা ও বনূ নাযির গোত্র সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে। অথচ ইবনু কাসির (রহ) আহমাদ থেকে (পূর্বোক্ত) দীর্ঘ রেওয়ায়াতটি বর্ণনার পর লিখেছেন : ‘‘আবূ দাউদ আবূ যিনাদ তাঁর পিতা থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন’’ অথচ এখানে একটি সন্দেহের সৃষ্টি হয় (৬/১৬০)।
‘‘আর-রাওদুল বাসিম ফি আযযাহবিস সুন্নাহ আবীল ক্বাসিম’’ গ্রন্থের সম্মানিত লেখক ইমাম ইবনু কাসির (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন- তিনি এর সনদকে হাসান বলেছেন। আমি (নাসিরুদ্দীন আলবানী) ইমাম ইবনু কাসিরের ‘তাফসীরে’ এটা পাইনি। সম্ভবত তিনি তাঁর অন্য কোন কিতাবে তা উল্লেখ করেছেন।
উলূমুল হাদীসের আলোকে হাদীসটি অতি উত্তম। কেননা হাদীসটির ভিত্তি হল আবূ যিনাদ। তাঁর সম্পর্কে হাফিয (রহ) বলেছেন :
صدق ، تغير حفظه لَما قدم بغداد ، وكان فقيه
‘‘সত্যবাদী, কিন্তু বাগদাদে যাওয়ার পর তার স্মৃতিশক্তিতে বিভ্রম হয়। তিনি একজন ফক্বীহ ছিলেন।’’
হায়সামী (রহ) বলেছেন : (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/১৬ হা/১০৯৭৫)
رواه أحْمد والطبْراني بنحوه وفيه عبد الرحْمن بن أبِي الزناد وهو ضعيف وقد وثق وبقية رجال أحْمد ثقات
‘‘আহমাদ, তাবারানী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এতে আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদ যঈফ বর্ণনাকারী আছেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তাকে সিক্বাহ গণ্য করা হয়। অন্যান্যরা আহমাদের সিক্বাহ বর্ণনাকারী।
আমি (আলবানী) বলছি : হায়সামী’র উক্তি : ضعيف وقد وثق ‘‘যঈফ, তবে তাকে সিক্বাহও গণ্য করা হয়’’ -সংগত নয়। কেননা তিনি তাঁকে যঈফ গণ্যকারীদের সিক্বাহ গণ্যকারীদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ প্রকৃত সত্য হল, তিনি মাঝামাঝি। অর্থাৎ তিনি ‘হাসান’ স্তরের, যদি না তাঁর থেকে অন্যদের (সিক্বাহ বর্ণনাকারীদের) বিপরীত কিছু পাওয়া যায়। [. শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদ (রহ)-কে হাসান স্তরের গণ্য করেছেন। আলী যাঈ (রহ) তাঁর সম্পর্কে সতেরজন ইমামের জারাহ ও বিশজন ইমামের তা‘দিল উল্লেখ করেছেন। অতঃপর (২১) ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) (২২) আল্লামা আয়নী (রহ) এবং (২৩) ‘আসারুস সুনানে’র সংকলক নিমাবী হানাফী’র পক্ষ থেকে আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদের গ্রহণযোগ্যতা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর সমাপ্তি টেনেছেন নিম্নোক্তভাবে : خلاصہ التحقیق یہ ہے کہ عبد رحمان بن ابی زناد کی بیان کردہ حدیث حسن لذاتہ ہے اور سلیمان بن داود الہاشمی و اہل مدینہ کی ان سے روایت صحیح ہوتی ہے، اِلا یہ کہ کسی خاص روایت میں ان کا وہم یا اس روایت کو معلول ہونا محدثین کرام سے ثابت ہو جائے تو خاص کے عام پر مقدم ہونے کے اصول سے وہ روایت مستثنی ہوگی اور باقی تمامروایت پرحسن یا صحیح ولا اصول جاری رہے گا۔ ‘‘তাহক্বীক্বের সার-সংক্ষেপ : আব্দুর রহমান বিন আবী যিনাদের বর্ণিত হাদীস হাসান লিযাতিহি স্তরের। তার থেকে সুলায়মান বিন দাউদ হাশিমী ও মদীনাবাসীরা বর্ণনা সহীহ। তবে যদি কোন খাস (সুনির্দিষ্ট) বর্ণনাতে তার ব্যাপারে সংশয় বা বর্ণনাতে ত্রুটি থাকা মুহাদ্দিসগণের নিকট প্রমাণিত হয়, তবে ঐ খাস বর্ণনাকে ‘আম বর্ণনার উপর প্রাধান্য পাওয়ার উসূলের আলোকে ব্যতিক্রম (যঈফ) গণ্য হবে। অন্যান্য সবক্ষেত্রে হাসান বা সহীহ’র উসূল জারি থাকবে। আলহামদু লিল্লাহ। [শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ, তাহক্বীক্ব আওর ইলমি মাক্বালাত-৪ পৃ. ৩৭১-৩৭৭ (সংক্ষেপিত)।]-বাংলা অনুবাদক] কিন্তু পূর্বোক্ত (হায়সামীর) উক্তিটি এই মর্যাদা দেয় না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
[মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-বানী, সিলসিলাতুল আহাদীসুস সহীহাহ ৬/২৫৫২ নং হাদীস]
বিশেষ জ্ঞাতব্য : (অতঃপর ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) বলেন) যখন আপনি এটা বুঝতে পারলেন [‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম। ...... তারাই ফাসিক্ব।’’ (সূরা মায়িদার : ৪৪, ৪৫ ও ৪৭)] আয়াত তিনটি ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, আর তারা রসূলুল্লাহ (স)-এর হুকুম সম্পর্কে বলেছিল :
إن أعطاكم ما تريدون حكمتموه و إن لَم يعطكم حذرتُم فلم تُحكموه
‘‘যা তোমরা চাও যদি সে তা দেয় তবে তাঁকে হাকিম বানাও, আর যদি তোমাদের চাহিদা সে পূরণ না করে তবে তাঁকে হাকিম বানিয়ো না।’’ কুরআনুল কারীম তাদের এই বক্তব্যের দিকে লক্ষ করে নিম্নোক্ত বক্তব্যটি উপস্থাপন করে :
إِنْ أُوتِيتُمْ هَذَا فَخُذُوهُ وَإِنْ لَمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا يَقُولُونَ
‘‘তারা বলে : যদি তোমাদের এটা দেয়া হয় তাহলে মানবে, অন্যথায় মানবে না।’’ [সূরা মায়িদা : ৪১]
আপনি যখন এটা জানেনই যে, এই আয়াতগুলোর আলোকে ঐসব মুসলিম শাসককে কাফির বলা জায়েয নয়- যারা আল্লাহর নাযিলকৃত আইনের পরিবর্তে দুনিয়াবী (মতবাদযুক্ত) আইন মোতাবেক বিচার ফায়সালা করে। কেননা সে এক দৃষ্টিতে ইয়াহুদীদের মতই অর্থাৎ (আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত) বিচারকার্যের ক্ষেত্রে। অন্য দৃষ্টিতে তাদের বিপরীত অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা-এর নাযিলকৃত বিধানের প্রতি ঈমান আনা ও তাঁর সত্যতাকে মানা কাফির ইয়াহুদীদের বিপরীত। কেননা ইয়াহুদীরা নবী (স)-কে অস্বীকার করেছিল, যার স্বপক্ষে প্রথম (সূরা মায়িদা : ৪১ নং) আয়াতটি প্রমাণ বহন করে। প্রকৃতপক্ষে তারা মুসলিমই ছিল না।
এর আলোকে যে বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট হয় তা হল কুফর দুই প্রকার। যথা :
১.ই‘তিক্বাদী বা আক্বীদাভিত্তিক,
২.আমালী বা আমলভিত্তিক।
ই‘তিক্বাদী হল, আন্তরিক স্বীকৃতি। পক্ষান্তরে আমালী হল, যা বাহ্যভাবে প্রকাশিত। যার কোন আমল শরীআতের বিরোধী হওয়ার কারণে কুফর হয় এবং যা তার অন্তরে আছে তাও প্রকাশ্য কুফর মোতাবেক হয়- সেক্ষেত্রে এই কুফরকে ই‘তিক্বাদী কুফর বলা হবে। এটা ঐ কুফর যা আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করেন না। আর এর পরিণাম হল, সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে। আর যদি তার অন্তরে যা আছে তা তার আমলের বিপরীত, অর্থাৎ সে নিজের রবের হুকুমের প্রতি ঈমান আনে, কিন্তু আমলের দিক থেকে তার বিপরীত করে- তবে তার কুফর কেবলই আমলী কুফর হবে, ই‘তিক্বাদী কুফর হবে না। আর সে আল্লাহ’র ইচ্ছার অধীন হবে- তিনি ইচ্ছা করলে তাকে আযাব দেবেন, কিংবা ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করবেন। আর ঐ সমস্ত হাদীস যেখানে অপরাধ বা গোনাহের কারণে মুসলিমের ব্যাপারে কুফর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সন্দেহযুক্ত কুফর হিসাবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণ নিচে প্রণিধানযোগ্য :
১.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : اثْنَتَان في النَّاسِ هُمَا بهم كُفْرٌ : الطَّعْنُ فِي النَّسَبِ، وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ ‘‘দু’টি বিষয় মানুষের মধ্যে রয়েছে, যা তাদের জন্য কুফর : ক. বংশ নিয়ে খোঁটা দেয়া, খ. মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা।’’ [. উক্ত হাদীসটি কেবল كفر শব্দ থেকে। অপর হাদীসে الكفر শব্দও এসেছে। যেমন- রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : ثلاثٌ مِن الكفرِ باللهِ : شَقُّ الجَيْبِ والنِّياحةُ والطَّعنُ في النَّسبِ ‘‘তিনটি হল আল্লাহর সাথে আল-কুফরের অন্তর্ভুক্ত : অন্তরে আঘাত দেয়া, নিয়াহাহ (মৃতের স্মরণে একত্রিত হওয়া), বংশের ব্যাপারে খোঁটা দেয়া।’’ [সহীহ ইবনু হিব্বান ১৪৬৫- শুআয়েব আরনাউত সহীহ বলেছেন] سُئِلَ ابنُ عباسٍ عن الذي يأتي امرأتَه في دُبُرِها ؟ فقال : هذا يَسْأَلُنِي عن الكُفْرِ ؟‘‘সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা)-কে কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর পশ্চাদদ্বারে সংগম করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল? তিনি (রা) বললেন : সে কি আমাকে আল-কুফর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে?’’ [নাসাঈ কুবরা ৮৯৫৫, আদাবুয যিফাফ পৃ. ১০৬, ৩০৪- আলবানী সনদ সহীহ]এ থেকে সুস্পষ্ট হল, ‘আল-কুফর’ থাকলেই চূড়ান্ত কুফর হয় না, বরং আমলী কুফরও হয়।- [বাংলা অনুবাদক]] [সহীহ মুসলিম, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব (ইফা) ৪/৩৫৬ পৃ.]
২.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : اَلْجِدَالُ فِي الْقُرْآنِ كُفْرٌ ‘‘কুরআন নিয়ে বিতর্ক করা কুফর।’’ [মুস্তাদরাকে হাকিম; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহুল জামেউস সগীর ওয়া যিয়াদাতাহু ১/৩১০৬ নং)]
৩.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه كُفْرٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪]
৪.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : كُفْرٌ بِاللهِ تَبَرُّؤَ مِنْ نَّسَبٍ وَ إِنْ دَقَّ ‘‘(সত্যিকারের) বংশকে অস্বীকার করাতে আল্লাহ’র সাথে কুফর করা হয়, যদিও বংশ খুবই নিচু হয়।’’ [বাযযার, দারেমী, তাবারানীর আওসাত; আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন (সহীহুল জামে‘ ২/৪৪৮৫ নং)]
৫.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : اَلتَّحَدُّثُ بِنِعْمَةِ اللهِ شُكْرٌ وَ تَرَكُهَا كُفْرٌ ‘‘আল্লাহ তাআলা-এর নিয়ামত বর্ণনা করা শোকর এবং তা তরক করা কুফর।’’ [বায়হাক্বী- শুআবুল ঈমান; আলবানী : হাসান বলেছেন (সহীহুল জামে‘ ১/৩০১৪ নং)]
৬.রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَ تَرْجِعُنَّ بَعْدِيْ كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ ‘‘তোমরা আমার পরে পরস্পরের গর্দান উড়িয়ে কাফিরে পরিণত হয়ো না।’’ [সহীহ বুখারী ১২১, সহীহ মুসলিম ১২৬ (১১৮/৬৫), মিশকাত ৩৫৩৭]
এ ধরনের আরও অনেক হাদীস আছে, যার সবগুলোর বর্ণনা উল্লেখ করা এখানে নিষ্প্রয়োজন। সুতরাং মুসলিমদের মধ্যে কেউ এই জাতীয় অপরাধ করলে এই কুফর আমলী কুফর’ হিসাবে গণ্য হবে- অর্থাৎ সে কাফিরদের ন্যায় আমল করল। তবে সে যদি এ অপরাধ করাকে হালাল মনে করে এবং গোনাহ হিসাবে গণ্য না করে, তবে সেক্ষেত্রে সে (এমন) কাফির বলে গণ্য হবে, যার রক্ত (হত্যা করা) হালাল। কেননা তার কুফরী আক্বীদার ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে। আর حكم بغيْر ماانزل الله ‘‘আল্লাহ’র নাযিলকৃত হুকুম ছাড়া অন্য কোন হুকুম’’-এই নীতি থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সালাফদের থেকে এ ধরনের বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা একে শক্তিশালী করে। এই আয়াতের তাফসীরে তাদের বক্তব্য হল, كفر دون كفر ‘‘(মুরতাদ হওয়ার) কুফর থেকে কম কুফর’’। এই তাফসীর আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর তাঁর থেকে অনেক তাবেয়ী (রহ) বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে থেকে আমার সাধ্যমত কয়েকটি বর্ণনা জরুরি মনে করছি। আশাকরি, এর ফলে ইদানিং যারা এই মাসয়ালার ব্যাপারে চরমপন্থা গ্রহণে গোমরাহ হয়েছে তাদের সহীহ পথ দেখাবে এবং খারেজীদের পথ ছেড়ে দেবে, তারা মুসলিমদের গোনাহর কারণে তাকফির (সুস্পষ্ট কাফির সম্বোধন) করে- যদিও তারা সালাত আদায় করছে ও সিয়াম পালন করে।
১.ইবনু জারীর তাবারী (রহ) (১০/৩৫৫/১২০৫৩) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন-
و من لم يحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون قال : هي به كفر ، و ليس كفرا بالله و ملائكته و كتبه و رسله
‘‘(যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম শাসন করে না- তারাই কাফির) ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : এটা কুফর, কিন্তু এই ব্যক্তির কুফর এমন নয় যেভাবে কেউ আল্লাহ তাআলা, মালাইকা, কিতাবসমূহ ও রসূলগণের প্রতি কুফর করে।’’ [. এই সনদটি বিরোধী পক্ষের নিকটও সহীহ, কিন্তু তারা মতনটির ব্যাপারে আপত্তি করেছে। অথচ পরের বর্ণনাগুলো এই মতনটিকে সমর্থন করলেও তাদের দাবি হল, মতনগুলো পরস্পর বিরোধী বা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হওয়ায় একটি অপরটিকে সমর্থন করে না। যদিও প্রতিটি মতনের মূল দাবি হল, কুফর বলতে চূড়ান্ত কুফর সবসময় বুঝাবে না, বরং যে আল্লাহ, রসূল, আখিরাত প্রভৃতির উপর ঈমান রাখে তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কুফর থেকে কম কুফর প্রযোজ্য। তা ছাড়া সূরা মায়িদা’র ৪৪ নং আয়াতটি বলছে : ‘আল্লাহর বিধান’ হেফাযত না করে বিকৃত ও গোপন করার কারণে আল্লাহর বিধান জারি না হলে তারা কাফির। পক্ষান্তরে সূরা মায়িদা’র ৪৫ ও ৪৭ নং আয়াতের দাবি হল, কেবল আল্লাহর বিধান না জারিকারী জালিম ও ফাসিক্ব। কাজেই সূরা মায়িদা ৪৪-৪৭ আয়াতও ইবনু আব্বাস (রা)-এর হাদীসের মতনকে সমর্থন করছে। [বাংলা অনুবাদক]]
২.তিনি ইবনু আব্বাস (রা) থেকে অপর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন :
إنه ليس بالكفر الذي يذهبون إليه ، إنه ليس كفرا ينقل عن الملة، كفر دون كفر
‘‘এটা ঐ কুফর নয়, যার দিকে এরা (খারেজীরা) গিয়েছে। এটা ঐ কুফর নয়, যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে দেয়। বরং كفر دون كفر ‘‘(চূড়ান্ত) কুফরের থেকে কম কুফর’’। [. বিরোধী পক্ষ এই বর্ণনাটির সনদকে যঈফ বলেছেন। কেননা, এই বর্ণনাটির সনদে হিশাম বিন হুজায়রকে ইয়াহইয়া বিন ক্বত্তান (রহ), ইবনু মাঈন (রহ) ও ইমাম আহমাদ (রহ) বিভিন্ন শব্দে আপত্তি করেছেন। এর জবাব হল, হিশাম বিন হুজায়রকে যারা সিক্বাহ ও গ্রহণযোগ্য বলেছেন মুহাদ্দিসদের মধ্যে তারাই সংখ্যাধিক্য। ফলে সনদটি হাসান স্তরের। তার বর্ণনা রয়েছে সহীহ বুখারীতে (হা/৬৭২০), সহীহ মুসলিমে হা/২৯১১ (২০৯/১২৪৬)- হজ্জ অধ্যায়, হা/৪১৭৮ (২৩/১৬৫৪) - শপথ অধ্যায়। এ ছাড়া উক্ত ইমামদের পক্ষ থেকে হিশামের প্রতি আপত্তিগুলো চূড়ান্ত জারাহ’র শব্দ হিসেবে প্রমাণিত নয়। তাদের পক্ষ থেকে সমর্থনমূলক শব্দও আছে। বিস্তারিত : আবূ উসামা সুলায়ম বিন ঈদ হিলালী, কুর্রাতুল উয়ুন ফী তাসহীহ তাফসীর আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস পৃ. ৪৩-৭০। পূর্বের সহীহ সনদের বর্ণনাটিও মতনের দিক থেকে একে সমর্থন করে। সেক্ষেত্রে হিশাম একক হওয়ার আপত্তি দূর হয়। [বাংলা অনুবাদক]]
এটা ইমাম হাকিম (রহ) বর্ণনা করেছেন (২/৩১৩) এবং বলেছেন : ‘সহীহুল ইসনাদ’। আর ইমাম যাহাবী (রহ) চুপ থেকেছেন। আর তাদের দু’জনের সমন্বয়ে হক্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ তাদের উক্তি : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’ দ্বারা হাদীসটি উক্ত মর্যাদাই উন্নীত হয়। অতঃপর আমি এটাও দেখলাম যে, হাফিয ইবনু কাসির (রহ) তাঁর তাফসিরে (৬/১৬৩) হাকিম থেকে বর্ণনা করার পর বলেছেন : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’। সুতরাং সুস্পষ্টভাবে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুস্তাদরাকে হাকিমের কোন কোন সংস্করণে বাক্যটি বাদ পড়েছে। [. বর্ণনাটি রাবী হিশাম বিন জুহায়রকে যারা সিক্বাহ বা গ্রহণযোগ্য বলেছে : ইবনু শিবরামা (রহ) বলেন : ليس بمكة مثله (হিশামের সাথে তুলনীয় কেউ মক্কাতে ছিল না) [আহমাদ বিন হাম্বল, আল-জামিউ লিউলূমির রিজাল পৃ. ৩৪৩] ইবনু মাঈন (রহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে : তিনি সালিহ (নেককার) ছিলেন। ...ইমাম আবূ হাতিম (রহ) বলেন : তার হাদীস লেখা হয়। [আবূ হাতিম রাযী, আল-জারাহ ও তা‘দিল] যাহাবী (রহ) বলেন : ইমাম আহমাদ তাকে যঈফ বলেছেন আর অন্যরা তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [ইমাম যাহাবী, যাকারু আসমাউ মান তাকাল্লামা ফীহি ওয়া হুয়া মাওসুকুন ১/১৮৭ পৃ. ৩৫৫ নং] আজলী (রহ) তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [উক্বদুস সামিন ফী তারিখিল বালাদিল আমীন ৬/১৭৯-১৮০, ২৬৩৭ নং]- বাংলা অনুবাদক]]
৩.ইবনু জারীর তাবারী (রহ) অপর একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন যা আলী ইবনু আবী তালহা, ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (রা) বলেন :
من جحد ما أنزل الله فقد كفر ، و من أقر به و لَم يَحكم فهو ظالِم فاسق
‘‘যে আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিষয়াদি অস্বীকার করে সে কাফির, কিন্তু যে স্বীকার করে অথচ সে মোতাবেক ফায়সালা না করে তবে সে যালিম ও ফাসিক্ব।’’
আমি (আলবানী) বলছি : ইবনু আবী তালহা কর্তৃক ইবনু আব্বাস (রা) থেকে শোনার কথা প্রমাণিত নয়। এরপরও সাক্ষ্যমূলক হাদীস হিসেবে এটি খুবই উত্তম। [. বিরোধী পক্ষ বর্ণনাটির বাহ্যিক অবস্থা থেকে মুনক্বাতে‘ হওয়াতে যঈফ বলেছেন। তবে বর্ণনাটি উপরে সহীহ-মুত্তাসিল বর্ণনা দুটিকে সমর্থন করে। ফলে এক্ষেত্রে সিক্বাহ বর্ণনাকারী বর্ণনাকে সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা যায়। আবূ জা‘ফার নুহাস (রহ) তাঁর ‘নাসিখ ওয়াল মানসুখে’ (পৃ.৭৫) লিখেছেন : والذي يطعن في إسناده يقول : إبن أبي طلحة لم يسمع من ابن عباس، وإنما أخذ التفسير عن مجاهد وعكرمة ، وهذا القول لا يوجب طعنًا، لأنه أخذه رجلين ثقين، وهو في نفسه ثقة صدوق ‘‘যারা সনদটির প্রতি অভিযোগ করেন তারা বলেন : ইবনু আবী তালহা (রহ) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে শোনেননি। অথচ তিনি মুজাহিদ ও ইকরামা থেকে তাফসীরটি গ্রহণ করেছেন। ফলে উক্ত উক্তিটি অভিযোগটিকে গুরুত্ববহ করে না। কেননা তিনি দুইজন সিক্বাহ থেকে এটি নিয়েছেন। আর তিনি নিজেই সিক্বাহ ও সত্যবাদী। [বিস্তারিত : আবূ উসামা সুলায়ম বিন ঈদ হিলালী, কুর্রাতুল উয়ুন ফী তাসহীহ তাফসীর আব্দিল্লাহ বিন আব্বাস পৃ. ৭২] -বাংলা অনুবাদক]
৪.অতঃপর ইবনু জারীর (রহ) (১২০৪৭-১২০৫১) আতা বিন আবী রিবাহ’র উক্তি উল্লেখ করেছেন : ‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম।.... তারাই ফাসিক্ব’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪, ৪৫ ও ৪৭) ‘‘তিনটি আয়াত উল্লেখ করে বলেছেন : كفر دون كفر ، و فسق دون فسق ، و ظلم دون ظلم (চূড়ান্ত) কুফর থেকে (কম) কুফর, (চূড়ান্ত) ফিস্ক্ব থেকে (কম) ফিস্ক্ব এবং (চূড়ান্ত) যুলুম থেকে (কম) যুলুম।’’ এর সনদ সহীহ। [. এই সনদটির প্রতি আপত্তি হল, এতে ইবনু জুরায়জ মুদাল্লিস এবং সে বর্ণনাটি ‘আন দ্বারা উল্লেখ করেছে। ফলে সনদটি যঈফ। এ পর্যায়ে অনুসন্ধানের বিষয় হল, ইবনু জুরায়জ (রহ) আতা (রহ) থেকে শুনেছেন কী না? সুলায়ম বিন ঈদ আল-হিলালী লিখেছেন : ابن جريج معروف بالتدليس مع جلالته وتقته، لكن استثنى أهل العلم روايته عن عطاء بخاصة ، فقد روى ابن أبي خيثمة بسند صحيح عن ابن جريج أنه قال : إذا قلت : قال عطاء فأنه سمعته منه وإن لم أقل : سمعت . ( تهذيب التهذيب ٦ \ ٤٠٦ ) ‘‘ইবনু জুরায়জ তার সম্মান ও বিশ্বস্ততাসহ তাদলীসকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ। কিন্তু আহলে ইলম খাসভাবে আতা’র বর্ণনার ব্যাপারে তাকে ব্যতিক্রম গণ্য করেছেন। যেমনটি ইবনু আবী খায়সামা সহীহ সনদে ইবনু জুরায়জ থেকে উল্লেখ করেন, তিনি বলেছেন : যখন আমি বলি : আতা বলেছেন, তাহলে আমি তার থেকে শুনেছি। আর যদি আমি না বলি : তবে শুনেছি। (তাহযীবুত তাহযীব ৬/৪০৬) [কুর্রাতুল উয়ুন পৃ. ৭৮] শায়খ আলবানী (রহ) -ও উদ্ধৃতিটি দেয়ার পর বলেছেন : وهذه فائدة هامة جدا تدلنا على أن عنعنة ابن جريج عن عطاء في حكم السماع ‘‘উদ্ধতিটি খুব বেশি উপকারী, ইবনু জুরায়জ থেকে আতা সনদে আনআনা থাকাটা শোনার হুকুম হিসেবে আমাদের জন্য দলিল।’’ [ইরওয়াউল গালীল ৪/২৪৪ পৃ. হা/১০৫০-এর আলোচনা] -বাংলা অনুবাদক]
৫.অতঃপর (১২০৫২) ইবনু জারীর (রহ) সাঈদ আলমাক্কী থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘আয়াতটি উল্লেখ করার পর তিনি বলেছেন, ليس بكفر ينقل عن الْملة এটা ঐ কুফর নয় যা মিল্লাত থেকে বের করে দেয়।’’
এর সনদ সহীহ। এই সাঈদ হলেন, ইবনু যিয়াদ আশ-শায়বানী আলমাক্কী। যাঁকে ইবনু মুঈন, আল-ইজলী, ইবনু হিব্বান প্রমুখ সিক্বাহ বলেছেন এবং তার থেকে একটি জামাআত বর্ণনা করেছেন।
৬. অতঃপর ইবনু জারীর তাবারী (রহ) (১২০২৫-১২০২৬) দু’টি ভিন্নভাবে ইমরান বিন হাদীর থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘আবূ মিজলাযের কাছে বনী আমর বিন সাদুসের কিছু লোক এসে (অন্য বর্ণনায়, ইবাযিয়াহ’র একটি গোত্র) বলল :
أرأيت قول الله : ( و من لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ) أحق هو؟ قال : نعم . قالوا : ( و من لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الظالِمون ) أحق هو؟ قال : نعم . قالوا : ( و من لَم يَحكم بما أنزل الله فأولئك هم الفاسقون ) أحق هو ؟ قال : نعم . قال : فقالوا : يا أبا مُجلز فيحكم هؤلاء بما أنزل الله ؟ قال : هو دينهم الذي يدينون به ، و به يقولون و إليه يدعون - [ يعني الأمراء ] - فإن هم تركوا شيئا منه عرفوا أنّهم أصابوا ذنبا . فقالوا : لا والله ، و لكنك تفرق . قال : أنتم أولى بِهذا منَي ! لا أرى ، و إنكم أنتم ترون هذا و لا تَحرجون ، و لكنها أنزلت في اليهود و النصارى و أهل الشرك . أو نَحوا من هذا
‘‘আল্লাহ তাআলা’র এই নির্দেশের ব্যাপারে আপনি কি বলেন (‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’) এটা কি হক্ব (সঠিক)? তিনি জবাব দিলেন : হাঁ, অবশ্যই। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসা করল, (‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই যালিম।’’) এটা কি হক্ব (সঠিক)? তিনি জবাব দিলেন : হাঁ। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসা করল, (যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই ফাসিক।’’) এটা কি হক্ব (সঠিক)? তিনি জবাব দিলেন : হাঁ। তারা জিজ্ঞাসা করল, এই লোকেরা (হাকিম/বিচারক) কি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা করে? তিনি বললেন : এটা তাদের দ্বীন, যার উপর তারা চলছে। সে মোতাবেকই করে এবং সে দিকেই ডাকে। তারা এটা জানে যে, এর মধ্যে কোন কিছু থেকে বিচ্যুতি হলে সে গোনাহগার হবে। তারা বলল : এমনটা না, বরং আল্লাহর ক্বসম! আপনি তো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ পৃথক। তিনি বললেন : ‘‘(উম্মাতের বিভক্তির ক্ষেত্রে) তোমরাই আমার থেকে অগ্রগামী এবং এই অপবাদের অধিকারী। আমি তো এই রায় দিই না, অথচ তোমরা এমন দৃষ্টিভঙ্গিই রাখ এবং এ ব্যাপারে কোন ক্ষতির ভয় রাখ না। অথচ প্রকৃতপক্ষে আয়াতটি ইয়াহুদী, নাসারা, মুশরিকীন ও তাদের গোত্রগুলো সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।’’ -এর সনদ সহীহ।
আলেমদের ইখতিলাফ রয়েছে, প্রথম আয়াতটির ‘কাফির’ শব্দটির তাফসীর নিয়ে। এখানে পূর্বোক্ত পাঁচটি উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। যা ইবনু জারীর (রহ) তাঁর তাফসীরে নিজের সনদসহ উল্লেখ করেছেন (১০/৩৪৬-৩৫৭)। অতঃপর উপসংহারে (১০/৩৫৮) লিখেছেন :
و أولَى هذه الأقوال عندي بالصواب قول من قال : نزلت هذه الآيات في كفار أهل الكتاب ، لأن ما قبلها و ما بعدها من الآيات ففيهم نزلت ، و هم الْمعنيون بِها ، و هذه الآيات سياق الْخبْر عنهم ، فكونَها خبْرا عنهم أولَى . فإن قال قائل : فإن الله تعالى ذكره قد عم بالْخبْر بذلك عن جميع من لَم يَحكم بِما أنزل الله ، فكيف جعلته خاصا ؟ قيل : إن الله تعالَى عم بالْخبر بذلك عن قوم كانوا بِحكم الله الذي حكم به في كتابه جاحدين ، فأخبْر عنهم أنّهم بتركهم الْحكم - على سبيل ما تركوه - كافرون . و كذلك القول في كل من لَم يَحكم بِما أنزل الله جاحدا به هو بالله كافر ، كما قال ابن عباس ، لأنه بَجحوده حكم الله بعد علمه أنه أنزله في كتابه ، نظيْر جحوده نبوة نبيه بعد علمه أنه نبَي "
‘‘আয়াতে তাহকীমে’র তাফসীরে বর্ণিত উক্তিগুলোর মধ্যে আমার কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য উক্তি হল, যিনি বলেছেন : এই আয়াত আহলে কিতাবের কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কেননা, আয়াতটির পূর্বাপর সম্পর্ক আহলে কিতাবদের সাথে। এই কারণে তারাই এখানে উদ্দেশ্য। কেননা তাদের সম্পর্কে পূর্বেই খবর বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং তাদের সম্পর্কে পূর্বের বর্ণনাই এ সম্পর্কিত দলিল। যদি কেউ এটা বলে যে, আল্লাহ তাআলা এই খবরকে ‘আম রেখেছেন, যা সবার জন্যই প্রযোজ্য- যারা আল্লাহ তাআলা’র নাযিল করা শরীআত মোতাবেক ফায়সালা করে না। সুতরাং আপনি কিভাবে এগুলো খাস করছেন? তখন তাদের জবাব দেয়া হবে : নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এ খবরকে ‘আম রেখেছেন। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে যারা কিতাবুল্লাহ’র নাযিলকৃত আহকামকে অস্বীকার করে। সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে এ খবর দিচ্ছেন যে, তাদের হুকুমে ইলাহী তরক করার যে অভ্যাসগত আমল ছিল, সেই হুকুমে ইলাহী তরক করার ক্ষেত্রে ঐ (খাস) আমলের কারণেই তারা কাফির ছিল। আর এই হুকুম ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যারা আমলগতভাবেই অস্বীকৃতির করার কারণে হুকুমে ইলাহী মোতাবেক্ব ফায়সালা করে না। কেননা এ সমস্ত লোকেরা আল্লাহকেই অস্বীকার করে, যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন। কেননা হুকুমে ইলাহী অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বিষয়টি তাঁর কিতাবে নাযিল করেছেন জেনে নেয়ার পর, সেটা অস্বীকার করাটা তেমনি, যেমন নবীর নবুওয়াত অস্বীকার করা। অথচ তারা সুস্পষ্টভাবে তা জানে।’’
মোটকথা, এই আয়াত আল্লাহ তাআলা’র আয়াত অস্বীকারকারী ইয়াহুদের সম্পর্কে নাযিল হয়। এখন অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞার ক্ষেত্রে যে তাদের সাথে শরীক (মতো/সাদৃশ্য) হবে, সে কুফরের মধ্যকার ই‘তিক্বাদী (বিশ্বাসগত) কুফরের অধিকারী হবে। কিন্তু যে অস্বীকৃতি ও অবজ্ঞার ক্ষেত্রে তাদের শরীক (মতো/সদৃশ) নয়, সে কুফরের মধ্যকার আমলী কুফরের অধিকারী হবে। কেননা সে ইয়াহুদীদের ন্যায় আমল করেছে। এ কারণে সে গোনাহগার ও সীমালঙ্ঘনকারী হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু এ কারণে সে মিল্লাতে ইসলামিয়া থেকে খারিজ (বহিষ্কৃত) হবে না। এ সম্পর্কে ইবনু আব্বাসের উক্তি ইতোপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইমাম হাফিয আবূ উবায়দ আল-ক্বাসিম বিন সালাম নিজ গ্রন্থ ‘কিতাবুল ঈমান’-এ উল্লেখ করেছেন। [ باب الْخروج من الإيْمان بالْمعاصي ( صـ ٨٤ - ٨٧ ) بتحقيقي )] সুতরাং যে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চায় সে যেন (আমার তাহক্বীক্বসহ) গ্রন্থটি পাঠ করে।
আমি (আলবানী) এগুলো লেখার পর আমার দৃষ্টি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ)’র ‘মাজমাউল ফাতাওয়া’র (৩/২৬৮) আয়াতে তাহকীমের দিকে নিবদ্ধ হয়। তিনি বলেছেন :
أي هو الْمستحل للحكم بغيْر ما أنزل الله .
‘‘এই হুকুম তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান ছাড়া অন্য বিধানকে হালাল মনে করে।’’
অতঃপর (৭/২০৪) বলেছেন : ইমাম আহমাদকে আলোচ্য কুফর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়।
তিনি (রহ) বললেন :
كفر لا ينقل عن الإيْمان ، مثل الإيْمان بعضه دون بعض ، فكذلك الكفر ، حتى يَجيء من ذلك أمر لا يَختلف فيه
‘‘এটা এমন কুফর যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না, যেভাবে ঈমান কারো থেকে কারো কম হয়। তেমনি কুফরও (কমবেশি হয়)। এভাবে ব্যক্তি ঐ কুফরেরও অধিকারী হয় যে ব্যাপারে কোন ইখতিলাফই (ভিন্নমত) নেই।’’
অতঃপর ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) (৭/৩১) বলেছেন।
সালাফদের উক্তি :
أن الإنسان يكون فيه إيْمان و نفاق
‘‘একজন মানুষের মধ্যে ঈমান ও নিফাক্ব একত্রিত হতে পারে।’’
তাঁদের অন্যতম অপর একটি উক্তি :
أنه يكون فيه إيْمان و كفر، و ليس هو الكفر الذي ينقل عن الْملة
‘‘একজন মানুষের মধ্যে ঈমান ও কুফর একত্রিত হতে পারে। তবে এ কুফর মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না।’’ যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) ও তাঁর সাথীরা আল্লাহ তাআলা’র বাণী : و من لَم يَحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون (সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত) সম্পর্কে বলেছেন।
তাঁরা বলেছেন :
كفر لا ينقل عن الْملة . و قد اتبعهم على ذلك أحْمد و غيْره من أئمة السنة
‘‘এটা এমন কুফরের অধিকারী যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও অন্যান্য সালাফগণ (রহ) এই উক্তির অনুসরণ করেছেন।’’ [সূত্র : মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬/২৫৫২ নং হাদীসের আলোচনা দ্রষ্টব্য]
উক্ত গ্রন্থের ৪৫৭ পৃষ্ঠায় (হা/২৭০৪) শায়খ আরও আলোচনা করেছেন :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ .... ُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ..... فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।.... তারাই যালিম। ...... তারাই ফাসিক্ব।’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭)
(রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :) ‘‘এই আয়াত কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়।’’
ইমাম আহমাদ (রহ) এটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি সনদ হল : ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন আ‘মাশ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন মার্রাহ থেকে, তিনি বারা বিন আযিব (রা) থেকে যে, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন ....।
আমি (আলবানী) বলছি : এর সনদ শায়খায়নের (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের) শর্তে সহীহ।
এই হাদীসটি সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে, আলোচ্য তিনটি (সূরা মায়িদা ৪৪-৪৭) আয়াতের প্রকৃত দাবি হল, ইয়াহুদী ও নাসারাদের কাফিরগণ এবং যেসব লোক ইসলামী শরীআত ও এর আহকামকে অস্বীকার করে। এভাবে তারাও এর মধ্যে শরীক, যাদের প্রতি হুকুমের সদৃশ পাওয়া যায়- যদিও সে নিজেকে মুসলিম হিসাবে প্রকাশ করে। কেননা, কোন একটি হুকুম অস্বীকার করলেও সেই প্রকৃত কাফির। কিন্তু যে ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত তা হল, যদি কেউ কোন ক্ষেত্রে এই ইসলামী বিধানকে অস্বীকার করা ছাড়াই (ইসলাম মোতাবেক) ফায়সালা না করে, তবে তার প্রতি কাফির হুকুম লাগানো জায়েয নয়। এমনকি সে এই মিল্লাত থেকে খারিজও নয়। কেননা সে মু’মিন। বেশির চেয়ে বেশি এটা বলা যাবে যে, তার কুফর আমলী কুফর। এটা এমনই গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা যে ব্যাপারে অধিকাংশ যুবকরাই ভুলের মধ্যে আছে। এ কারণে অধিকাংশ লোকেরা ঐ সমস্ত হাকিমদের (শাসক/বিচারক) ইসলাম থেকে খারিজ গণ্য করে যারা শরীআতের বিরোধি ফায়সালা দিচ্ছে। যার ফলে অনেক ফিতনার বিসত্মৃতি ঘটেছে। এমনকি যাদের তা প্রতিরোধের শক্তি ও ক্ষমতা নেই এমন অনেক নিষ্পাপ প্রাণ থেকে খুন ঝরছে।......
আমার মতে (এ মুহূর্তে) ওয়াজিব হল, ইসলামকে ঐ সব বিষয় থেকে পাক-পবিত্র করা যার উদ্যোগ তাদের মধ্যে নেই। তা হল- বাতিল আক্বীদা, নিরর্থক মাসলা-মাসায়েল (আহকাম), বিকৃত রায়ের মাধ্যমে সুন্নাতের বিরোধিতা। অতঃপর নতুন প্রজন্মকে এই পাক-পবিত্র ও নিষ্কলুষ ইসলামের তারবিয়াত প্রদান। [সূত্র : মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬/২৭০৪ নং হাদীসের আলোচনা দ্রষ্টব্য]
العلماء الأعلام الذين صرحوا بصحة تفسير ابن عباس واحتجوا به
৪
ঐ সমস্ত আলেমদের সাক্ষ্য যারা ইবনু আব্বাস (রা) -এর
তাফসীরটিকে সহীহ বলেছেন এবং এর দ্বারা দলিল নিয়েছেন[প্রবন্ধটি www.AsliAhleSunnet.com থেকে প্রকাশিত فتنة التكفير او حكم بغير ما انزل الله (তাকফির বা কাফির ফাতাওয়া দেয়ার ফিতনা এবং আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধানের বিরোধি বিধান দেয়া) থেকে সঙ্কলিত। -অনুবাদ : কামাল আহমাদ]
الْحاكم فى الْمستدرك (٢/ ٣٩٣ ) ، ووافقه الذهبى، الْحافظ ابن كثير في تفسيره (٢/ ٦٤ ) قال : صحيح على شرط الشيخين، الإمام القدوة مُحمد بن نصر الْمروزي فى تعظيم قدر الصلاة (٢/ ٥٢٠ ) ، الإمام أبو بكر إبن العربى فى أحكام القرآن (٢/ ٦٢٤ ) ، الإمام القرطبي فى الْجامع لأحكام القرآن (٦/ ١٩٠ ) ، الإمام البقاعي في نظم الدرر (٢/ ٤٦٠ ) ، الإمام الواحدي فى الوسيط (٢/ ١٩١ ) ، العلامة صديق حسين خان فى نيل الْمرام (٢/ ٤٧٢ ) ، العلامة مُحمد الأمين الشنقيطي فى أضواء البيان (٢/ ١٠١ ) ، العلامة أبو عبيد القسم بن سلام فى الإيْمان ( صـ ٤٥ ) ، العلامة أبو حيان فى البحر الْمحيط (٣/ ٤٩١ ) ، الإمام ابن بطة فى الإبانة (٢/ ٧٢٣ ) ، الإمام ابن عبد البَر فى التمهيد (٤/ ٢٣٧ ) ، العلامة الْخازن فى تفسيره (١/ ٣١٠ ) ، العلامة السعدي فى تفسيره (٢/ ٢٩٦ ) ، شيخ الإسلام ابن تيمية في مُجموع الفتاوى (٧/ ٣١٢ ) ، العلامة ابن القيم الْجوزية في مدارج السالكين (١/ ٣٣٥ ) ، مُحدث العصر العلامة الألباني في ’’ الصحيحة ‘‘ (٤/ ١٠٩ )
এ যামানার শ্রেষ্ঠতম ফক্বীহ শায়খ সালেহ আল-উসায়মীন (রহ) তাঁর التجذير من فتنة التكفير গ্রন্থে (৬৮ পৃষ্ঠা) বলেছেন :
لكن لَما كان هذا الأثر لا يرضي هؤلاء الْمفتونين بالتكفيْر؛ صاروا يقولون : هذا الأثر غير مقبول ! ولا يصح عن ابن عباس ! فيقال لَهم : كيف لا يصحّ؟ وقد تلقاه من هو أكبر منكم، وأفضل، وأعلم بالْحديث؟ ! وتقولون : لا نقبل ..... فيكفينا أن علماء جهابذة؛ كشيخ الإسلام ابن تيمية، وابن القيم ـ وغيرهُما ـ كلهم تلقوه بالقبول ويتكلمون به، وينقلونه؛ فالأثر صحيح .
‘‘কিন্তু আসারটি (সাহাবা (রা)-এর উক্তি) তাকফীরের ফিতনাই জড়িত ব্যক্তিদের আকাঙ্ক্ষার বিরোধি হওয়ার তারা বলছে : ইবনু আব্বাস (রা)-এর আসারটি গ্রহণযোগ্য নয়(!) এবং ইবনু আব্বাস (রা) থেকে এটা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়(!)। আমি তাদের জবাবে বলছি : এটা কিভাবে সহীহ নয়? যখন উক্ত বড় বড় আলেম, যারা তোমাদের থেকে অনেক বড়, বেশি সম্মানিত ও হাদীসের ব্যাপারে অনেক বেশি বিজ্ঞ (তাঁরা সহীহ বলেছেন)! অথচ তোমরা বলছ : আমাদের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়.... তাহলে কি এই আলেমরা আমাদের থেকে বেশি যোগ্য নন? যেমন শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া, ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ) প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই এটাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ববুল করেছেন, এর উপর আলোচনা করেছেন এবং এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সুতরাং প্রমাণিত হল, আসারটি সহীহ।’’
الْحاكم فى الْمستدرك (٢/ ٣٩٣ ) ، ووافقه الذهبى، الْحافظ ابن كثير في تفسيره (٢/ ٦٤ ) قال : صحيح على شرط الشيخين، الإمام القدوة مُحمد بن نصر الْمروزي فى تعظيم قدر الصلاة (٢/ ٥٢٠ ) ، الإمام أبو بكر إبن العربى فى أحكام القرآن (٢/ ٦٢٤ ) ، الإمام القرطبي فى الْجامع لأحكام القرآن (٦/ ١٩٠ ) ، الإمام البقاعي في نظم الدرر (٢/ ٤٦٠ ) ، الإمام الواحدي فى الوسيط (٢/ ١٩١ ) ، العلامة صديق حسين خان فى نيل الْمرام (٢/ ٤٧٢ ) ، العلامة مُحمد الأمين الشنقيطي فى أضواء البيان (٢/ ١٠١ ) ، العلامة أبو عبيد القسم بن سلام فى الإيْمان ( صـ ٤٥ ) ، العلامة أبو حيان فى البحر الْمحيط (٣/ ٤٩١ ) ، الإمام ابن بطة فى الإبانة (٢/ ٧٢٣ ) ، الإمام ابن عبد البَر فى التمهيد (٤/ ٢٣٧ ) ، العلامة الْخازن فى تفسيره (١/ ٣١٠ ) ، العلامة السعدي فى تفسيره (٢/ ٢٩٦ ) ، شيخ الإسلام ابن تيمية في مُجموع الفتاوى (٧/ ٣١٢ ) ، العلامة ابن القيم الْجوزية في مدارج السالكين (١/ ٣٣٥ ) ، مُحدث العصر العلامة الألباني في ’’ الصحيحة ‘‘ (٤/ ١٠٩ )
এ যামানার শ্রেষ্ঠতম ফক্বীহ শায়খ সালেহ আল-উসায়মীন (রহ) তাঁর التجذير من فتنة التكفير গ্রন্থে (৬৮ পৃষ্ঠা) বলেছেন :
لكن لَما كان هذا الأثر لا يرضي هؤلاء الْمفتونين بالتكفيْر؛ صاروا يقولون : هذا الأثر غير مقبول ! ولا يصح عن ابن عباس ! فيقال لَهم : كيف لا يصحّ؟ وقد تلقاه من هو أكبر منكم، وأفضل، وأعلم بالْحديث؟ ! وتقولون : لا نقبل ..... فيكفينا أن علماء جهابذة؛ كشيخ الإسلام ابن تيمية، وابن القيم ـ وغيرهُما ـ كلهم تلقوه بالقبول ويتكلمون به، وينقلونه؛ فالأثر صحيح .
‘‘কিন্তু আসারটি (সাহাবা (রা)-এর উক্তি) তাকফীরের ফিতনাই জড়িত ব্যক্তিদের আকাঙ্ক্ষার বিরোধি হওয়ার তারা বলছে : ইবনু আব্বাস (রা)-এর আসারটি গ্রহণযোগ্য নয়(!) এবং ইবনু আব্বাস (রা) থেকে এটা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়(!)। আমি তাদের জবাবে বলছি : এটা কিভাবে সহীহ নয়? যখন উক্ত বড় বড় আলেম, যারা তোমাদের থেকে অনেক বড়, বেশি সম্মানিত ও হাদীসের ব্যাপারে অনেক বেশি বিজ্ঞ (তাঁরা সহীহ বলেছেন)! অথচ তোমরা বলছ : আমাদের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়.... তাহলে কি এই আলেমরা আমাদের থেকে বেশি যোগ্য নন? যেমন শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া, ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ) প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই এটাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ববুল করেছেন, এর উপর আলোচনা করেছেন এবং এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সুতরাং প্রমাণিত হল, আসারটি সহীহ।’’
-কামাল আহমাদ
মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-এর পূর্বোক্ত আলোচনায় আক্বীদাগত কুফর ও আমলগত কুফরের বর্ণনা এসেছে। আমরা এখন এ দু’টি বিষয়ে জড়িতদের সাথে নবী (স)-এর যামানাতে কী আচরণ ও নির্দেশ ছিল তা তুলে ধরার চেষ্টা করব। এর ফলে এ সম্পর্কে বাস্তবচিত্র আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হবে এবং মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-এর উপর মুরজিয়া হওয়ার অপবাদও খণ্ডিত হবে।
কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আক্বীদাগত কুফর ও আমলগত কুফরের দৃষ্টান্ত যাদের মধ্যে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হল :
১.মুনাফিক্ব
২.খারেজী
৩.গোমরাহ শাসক
৪.হত্যাকারী ও সুদখোরের চিরস্থায়ী (!?) জাহান্নামী হওয়া
৫.আল-ওয়ালা ওয়াল বারা (বন্ধুত্ব ও শত্রুতা)
কুরআন ও সহীহ হাদীসে এদের সাথে আচরণ ও হুকুমের আলোকে বর্তমান যামানায় যারা আক্বীদা বা আমলগত কিংবা উভয় কুফরের সাথে জড়িত তাদের প্রতি করণীয় বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাব, ইনঁশাআল্লাহ।
১.মুনাফিক্ব : এতে কোন মতপার্থক্য নেই যে, মুনাফিক্বরা আক্বীদাগত দিকে থেকে কুফরী আক্বীদা রাখলেও প্রকাশ্য আমলগতভাবে নিজেদের মুসলিম হিসাবেই প্রকাশ করত। কিন্তু আল্লাহ তাআলা’র কাছে তাদের আক্বীদা ও আমল উভয়টিই সুস্পষ্টভাবে কুফরীর দোষে দুষ্ট।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ ـ اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ـ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ ـ
‘‘যখন মুনাফিক্বরা আপনার নিকট আসে তখন তারা বলে : ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি- নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রসূল।’ আর আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই আপনি তাঁর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিক্বরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথসমূহকে ঢালরূপে ব্যবহার করে, আর তারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে। তারা যা করছে, তা কতই না মন্দ। এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে। ফলে, তাদের অন্তরের উপর মোহর মেরে দেয়া হয়েছে; পরিণামে তারা বুঝে না।’’ [.সূরা মুনাফিকুন : ১-৩ আয়াত।]
আলোচ্য আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হল, আল্লাহ তাআলা’র কাছে মুনাফিক্বদের আক্বীদা ও আমল উভয়টিই প্রত্যাখ্যাত। এরপরও আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ছাড় দিতে বলেছেন যতক্ষণ না তারা মুসলিম ও ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। এ সম্পর্কে সূরা নিসার ১২ নং রুকুর সম্পূর্ণ অংশটিতে তাদের ব্যাপারে নির্দেশ ও নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। উক্ত আয়াতগুলোর ধারাবাহিক বক্তব্যগুলো হল :
ক.মুনাফিক্বরা পথভ্রষ্ট, তারা কখনো পথ পাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِئَتَيْنِ وَاللَّهُ أَرْكَسَهُمْ بِمَا كَسَبُوا أَتُرِيدُونَ أَنْ تَهْدُوا مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا
‘‘আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা মুনাফিক্বদের ব্যাপারে দু’দল হয়ে গেলে? যখন আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও, যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন? আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্য কখনো কোন পথ পাবে না।’’ [সূরা নিসা : ৮৮ আয়াত]
খ.তারা মুসলিমদের কাফির বানাতে চায়। সবকিছু ছেড়ে মুসলিমদের কাছে হিজরত না করলে কাফিরদের ন্যায় তাদের হত্যা করতে হবে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا فَتَكُونُونَ سَوَاءً فَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ أَوْلِيَاءَ حَتَّى يُهَاجِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا
‘‘তারা চায় যে, তারা যেরূপ কাফির হয়েছে, তোমরাও সেরূপ কাফির হও, যাতে তোমরা তাদের সমান হয়ে যাও। সুতরাং তাদের মধ্যে হতে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের যেখানেই পাবে পাকড়াও করবে ও হত্যা করবে এবং তাদের মধ্যে হতে কাউকে বন্ধু ও সাহায্যকারীরূপে গ্রহণ করবে না।’’ [সূরা নিসা : ৮৯ আয়াত]
আলোচ্য আয়াতটিতে মুনাফিক্বদের কাফির বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
গ.যদি মুনাফিক্বরা মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধদের মাঝে থাকে, কিংবা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিজেদের দুর্বলতার কারণে তারা যুদ্ধ করতে ভয়ে দূরে থাকে এবং শান্তির প্রস্তাব দেয়, অথচ শক্তি থাকলে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো; এদের সাথেও যুদ্ধ নিষিদ্ধ।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِلَّا الَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ أَوْ جَاءُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ أَنْ يُقَاتِلُوكُمْ أَوْ يُقَاتِلُوا قَوْمَهُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَسَلَّطَهُمْ عَلَيْكُمْ فَلَقَاتَلُوكُمْ فَإِنِ اعْتَزَلُوكُمْ فَلَمْ يُقَاتِلُوكُمْ وَأَلْقَوْا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ فَمَا جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيلًا
‘‘কিন্তু তারা নয়, যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ। অথবা যারা তোমাদের নিকট এ অবস্থায় আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে অথবা তাদের সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করতে অনুৎসাহিত। আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তবে তাদের তোমাদের উপর ক্ষমতা দিতেন। ফলে তারা অবশ্যই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত। সুতরাং তারা যদি তোমাদের নিকট থেকে সরে দাঁড়ায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব করে, তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ রাখেননি।’’ [সূরা নিসা : ৮৯ আয়াত]
সুস্পষ্ট হল, মুনাফিক্বদের আক্বীদা কুফর হলেও যতক্ষণ তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না বা অন্য কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। অথচ আল্লাহ তাআলা’র কাছে তাদের আক্বীদা ও আমল কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং প্রমাণিত হল :
১.আল্লাহ তাআলা’র কাছে মুনাফিক্বদের ঈমান ও আমল গ্রহণযোগ্য নয়।
২.আল্লাহ তাআলা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাদের ছাড় দিচ্ছেন এবং তাদের ব্যাপারে যুদ্ধ করতে বা কঠোর হতে নিষেধ করছেন; যতক্ষণ না তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চরমপন্থা অবলম্বন করে।
ঘ.যখন মুনাফিক্বরা সমাজ ও রাষ্ট্রে ফিতনা সৃষ্টি করবে তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
سَتَجِدُونَ آَخَرِينَ يُرِيدُونَ أَنْ يَأْمَنُوكُمْ وَيَأْمَنُوا قَوْمَهُمْ كُلَّ مَا رُدُّوا إِلَى الْفِتْنَةِ أُرْكِسُوا فِيهَا فَإِنْ لَمْ يَعْتَزِلُوكُمْ وَيُلْقُوا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ وَيَكُفُّوا أَيْدِيَهُمْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأُولَئِكُمْ جَعَلْنَا لَكُمْ عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا مُبِينًا .
‘‘তোমরা আরো কতক লোক পাবে, যারা তোমাদের সাথে এবং তাদের সম্প্রদায়ের সাথে শান্তিতে থাকতে চায়। যখনই তাদের ফিতনার দিকে ডাকা হয়, তখনই তারা তাদের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবৃত্ত হয়। অতএব, তারা যদি তোমাদের নিকট হতে চলে না যায়, তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব না করে এবং তাদের হাত সংবরণ না করে, তবে তাদের যেখানেই পাবে গ্রেফতার করবে এবং হত্যা করবে। আমি তাদের উপর তোমাদের বিরুদ্ধাচারণের স্পষ্ট অধিকার দিয়েছি।’’ [সূরা নিসা : ৯১ আয়াত]
ঙ. তাগুতের কাছে বিচার উপস্থাপনকারী মুনাফিক্ব ও এ সম্পর্কিত বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ـ وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا ـ
‘‘আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে, তাতে তারা ঈমান আনে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদের ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়? তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রসূলের দিকে এসো, তখন মুনাফিক্বদের আপনি আপনার নিকট থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবেন।’’ [সূরা নিসা : ৬০-৬১ আয়াত]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
ياَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ
‘‘হে নবী! কাফির ও মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও।’’ [সূরা তাওবাহ : ৭৩ আয়াত]
এখন আমরা জানব, মুনাফিক্বদের সাথে কখন, কি পরিস্থিতিতে ও কিভাবে জিহাদ করতে হবে এবং কঠোর হতে হবে?
মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে জিহাদের ধরণ
ক.বিদ্রোহ করলে (হত্যা/ ক্বিতাল/ দেশান্তর) : এক্ষেত্রে বিদ্রোহ করার শাস্তি প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ ـ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ ـ
‘‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট শাস্তি হত্যা কিংবা শূলে চড়ান অথবা তাদের হাত ও পা বিপরীতভাবে কেটে ফেলা, কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা। এ লাঞ্ছনা ও অপমান হবে এ দুনিয়ায়; কিন্তু পরকালে তাদের জন্যে এটা অপেক্ষাও কঠিনতম আযাব নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু যারা তাওবা করবে, তাদের উপর তোমাদের আধিপত্য স্থাপিত হওয়ার পূর্বে। তোমাদের জেনে রাখা দরকার যে, আল্লাহই হচ্ছেন ক্ষমাকারী ও অনুগ্রহশীল।’’
[সূরা মায়িদা : ৩৩-৩৪ আয়াত]
সুস্পষ্ট হল মুনাফিক্ব/ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের উপর মুসলিমদের প্রভাব থাকলেও তারা মুসলিমদের সাথে বিদ্রোহমূলক আচরণ না করলে তাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-ই ছাড় দিয়েছেন। অথচ তাদের আক্বীদা ও আমল কোনটিই আল্লাহ তাআলা’র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
খ.সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি করলে (হত্যা) : আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَّرْضٌ وَالْمُرْجِفُوْنَ فِي الْمَدِيْنَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لاَيُجَاوِرُوْنَكَ فِيْهَا اِلاَّ قَلِيْلاً ـ مَّلْعُوْنِيْنَ ج اَيْنَمَا ثُقِفُوْا اُخِذُوْا وَقُتِّلُوْا تَقْتِيْلاً ـ
‘‘মুনাফিক্বরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা নগরে গুজব রটনা করে, তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে আপনাকে প্রবল করব। এরপর এ নগরীতে আপনার প্রতিবেশীরূপে তারা অল্প সময়ই থাকবে- অভিশপ্ত হয়ে। তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।’’ [সূরা আহযাব : ৬০-৬১ আয়াত]
গ.সমাজে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করলে (শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পাবে) : পূর্বোক্ত আয়াতে لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُوْنَ ‘‘মুনাফিক্বরা যদি বিরত না হয়’’ কথাটি রয়েছে। যা থেকে সুস্পষ্ট হয়, তারা অশান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকলে তাদের ব্যাপারে কঠিন হওয়া যাবে না। তাদের সংস্কারের ক্ষেত্রে ফাসেক/ বিদআতী প্রমুখের ন্যায় হাত/ মুখ/ অন্তরের জিহাদ পরিস্থিতি অনুযায়ী অব্যাহত থাকবে। ইবনু কাসির (রহ) মুনাফিক্বদের শাস্তির বিধান সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীর ভিন্ন ভিন্ন উদ্ধৃতি দেয়ার পর লিখেছেন :
انه لا منافاة بيْن هذه الأقوال، لأنه تارة يؤاخذهم بِهذا، وتارة بِهذا بِحسب الأحوال .
‘‘উপরোক্ত (বিভিন্ন) উদ্ধৃতির মধ্যে কোনরূপ বৈপরিত্য নেই। বস্তুত মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অবস্থায় পূর্বোক্ত বিভিন্ন পন্থায় জিহাদ করাই বিধেয়।’’
[তাফসীরে ইবনু কাসির, সূরা তাওবা : ৭৩-৭৪ নং আয়াতের তাফসীর দ্র:। এই আয়াতটির তাফসীরে মুনাফিক্বগণ কর্তৃক নবী (স)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র, বিদ্রূপ এবং পরবর্তীতে নবী (স)-এর সামনে তা অস্বীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে]
সুতরাং নবী (স)-এর উপস্থিতিতে যারা তাঁকে হত্যার ও ইসলামকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছে, নবী (স) -কে হাকিম/শাসক/বিচারক হিসাবে গ্রহণ করেনি- তাদের ব্যাপারে ইসলাম ক্ষমতাসীন থাকার মুহূর্তে যখন পূর্বোক্ত বিধানগুলো প্রযোজ্য। তখন মুসলিমদের দুর্বলতার সময় করণীয় বিষয়গুলো খুবই সুস্পষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে হাকিম/শাসকদের তাকফির করে হত্যা করা ঘোষণা দেয়ার চেয়ে তাসফিয়্যাহ ও তারবিয়্যাহ-ই যে সবচে জরুরি এতে কোন সন্দেহ নেই।
২.খারেজী : খারেজীদের সূত্রপাতও মুনাফিক্বদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنَّهُمْ لَمِنْكُمْ وَمَا هُمْ مِنْكُمْ وَلَكِنَّهُمْ قَوْمٌ يَفْرَقُونَ ـ لَوْ يَجِدُونَ مَلْجَأً أَوْ مَغَارَاتٍ أَوْ مُدَّخَلًا لَوَلَّوْا إِلَيْهِ وَهُمْ يَجْمَحُونَ ـ وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ ـ وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آَتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ سَيُؤْتِينَا اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللَّهِ رَاغِبُونَ ـ إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاِبْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘তারা আল্লাহ’র নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা ভয় করে থাকে। তারা কোন আশ্রয়স্থল, কোন গিরিগুহা অথবা কোন প্রবেশস্থল পেয়ে গেলে সে দিকে পলায়ন করবে ক্ষিপ্রগতিতে। তাদের মধ্যে এমনও লোক আছে, যে সাদাক্বা বণ্টনের ব্যাপারে আপনাকে দোষারোপ করে। অতঃপর তার কিছু তাদের দেয়া হলে পরিতুষ্ট হয় এবং তার কিছু না দেয়া হলে তখনই তারা বিক্ষুব্ধ হয়। ভাল হতো যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের যা দিয়েছেন তাতে রাযী হয়ে যেত এবং বলত আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট; আল্লাহ আমাদের দিবেন নিজ করুণা এবং তাঁর রসূলও। সাদাক্বা তো কেবল ফক্বীর, মিসকীন ও এর (জন্য নিয়োজিত) কর্মচারীদের জন্য এবং (অমুসলিম/দুর্বল মু’মিনদের) অন্তর আকৃষ্ট করার জন্য এবং দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য ও আল্লাহ’র পথে জিহাদরতদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহ’র বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’’ [সূরা তাওবা : ৫৮-৬০ আয়াত]
عن أبي سعيد رضي الله عنه قال : بعث إلي النبي ﷺ بشيء فقسمه بين أربعة وقال : أتألفهم . فقال رجل ما عدلت فقال : يَخرج من ضئضئ هذا قوم يِمرقون من الدين
‘‘আবূ সাঈদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী (স) -এর কাছে কিছু জিনিস প্রেরণ করা হল। এরপর তিনি সেগুলো চারজনের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। আর বললেন, তাদের (এর দ্বারা) আকৃষ্ট করছি। তখন এক ব্যক্তি বলল, আপনি সঠিকভাবে দান করেনি এতদশ্রবণে তিনি বললেন : এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন সব লোক জন্ম নেবে যারা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে।’’ [সহীহ বুখারী- কিতাবুত তাফসীর, সূরা নিসা : ৬০ নং আয়াতের তাফসীর দ্র :]
আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে : আলী (রা) ইয়ামান থেকে রসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে কিছু স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তিনি (স) সেগুলো চার জনের মধ্যে বণ্টন করেন। তখন সাহাবীদের একজন বললেন : ‘এ স্বর্ণের ব্যাপারে তাদের অপেক্ষা আমরাই অধিক হক্বদার ছিলাম।’ কথাটি শোনার পর নবী (স) বললেন : ‘তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না অথচ আমি আসমানবাসীদের আস্থাভাজন, সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে।..... তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল : ইয়া রসূলাল্লাহ! আল্লাহকে ভয় করুন। নবী (স) বললেন : তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি বেশি হক্বদার নই? লোকটি চলে গেলে খালিদ বিন ওয়ালিদ বললেন : ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? তিনি (স) বললেন : ( لا لعله أن يكون يصلي ) না, হয়ত সে সালাত আদায় করে। খালিদ বললেন : ( وكم من مصل يقول بلسانه ما ليس في قلبه ) অনেক মুসলস্নী আছে যারা মুখে এমন কথা উচ্চারণ করে যা অন্তরে নেই। রসূলুল্লাহ (স) বললেন : ( إنّي لَم أومر أن أنقب قلوب الناس ولا أشق بطونَهم ) আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেঁড়ে (ঈমান) দেখার জন্য বলা হয়নি .... তিনি (স) বললেন : এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে যারা শ্রুতিমধুর কন্ঠে আল্লাহ’র কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নিচে নামবে না। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে যেভাবে তীর বের হয়। যদি আমি তাদের পাই তাহলে অবশ্যই আমি তাদের সামুদ জাতির মত হত্যা করব।’’ [সহীহ বুখারী- কিতাবুল মাগাযী باب بعث على بن ابى طالب ; (সংক্ষেপিত)]
আলী (রা) -এর খিলাফতের যামানায় খারেজীদের উদ্ভব হয়।
[ফতহুল বারী, আলোচ্য অনুচ্ছেদ দ্র :, আরো বিস্তারিত : তাফসীরে মাযহারী সূরা নিসা : ৫৬-৫৯ আয়াতের তাফসীর]
আলী (রা) খারেজীদের বলেছিলেন : ‘‘যতদিন তোমাদের দায়িত্ব আমাদের উপরে ছিল ততদিন আমরা তোমাদের গনীমত দেয়া বন্ধ করিনি এবং আল্লাহর মাসজিদে সালাত আদায় করতে বাধা দেইনি এখন তোমাদের উপর আমরা আগেই হামলা করবো না। যদি তোমরা প্রথমে হামলা না করো।’’ এরপর তারা সবাই কূফা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাহরাওয়ান নামক স্থানে সমবেত হয়। [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ই.ফা.) ৭/৫১০ পৃষ্ঠা]
পূর্বোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হল, মুনাফিক্ব ও খারেজীরা একই সূত্রে গাঁথা। তাদের প্রতি একই ধরণের আচরণ প্রযোজ্য :
ক.তাদের ঈমান ও আমল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
খ.এরপরও রাষ্ট্রীয় আইন এক্ষেত্রে তাদের প্রতি অনেক সহনশীল ও যুক্তিসংগত আচরণ করেছে, যতক্ষণ তারা ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষতির কারণ না হয়। অথচ তখন ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েম ছিল। তাদের ঈমান ও আক্বীদা আল্লাহ তাআলা’র কাছে অগ্রহণযোগ্য হওয়াটাও সুস্পষ্ট ছিল। রসূল (স) -কেও হাকিম/শাসক/বিচারক হিসাবে স্বীকার করার ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহী ও সরাসরি ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নি, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আইনেই তাদের অবকাশ দেয়া হয়েছে।
৩.গোমরাহ শাসক : শাসকদের ব্যাপারে আমরা নবী (স) থেকে কয়েক ধরণের নিদের্শনা পায়। যথা :
ক.প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খিলাফত ও আইনসমূহ বিকৃতকারী শাসক : রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ গ্ধ ، قَالُوا : قُلْنَا : يَا رَسُولَ اللهِ، أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ عِنْدَ ذَلِكَ؟ قَالَ :র لَا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلَاةَ، لَا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلَاةَ، أَلَا مَنْ وَلِيَ عَلَيْهِ وَالٍ، فَرَآهُ يَأْتِي شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِي مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، وَلَا يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ .
‘‘তোমাদের শাসকদের মধ্যে সেই শাসকই উত্তম যাকে তোমরা ভালবাস, আর যারা তোমাদের ভালবাসে। আর তোমরা তাদের জন্য দুআ কর এবং তারাও তোমাদের জন্য দুআ করে। আর তোমাদের সেই শাসকই মন্দ যাদের তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। আর তাদের প্রতি তোমরা লানত কর এবং তারা তোমাদের প্রতি লানত করে। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমরা বললাম : ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! এমতাবস্থায় আমরা কি সেই সমস্ত শাসকদের অপসারণ করে তাদের সাথে কৃত বায়য়াত ভঙ্গ করে ফেলব না? তিনি (স) বললেন : না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম করে (আবার বললেন) না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে। সাবধান! যে ব্যক্তিকে তোমাদের উপর শাসক নিযুক্ত করা হয়, আর যদি তার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানীর কোন কিছু পরিলক্ষিত হয়, তখন তোমরা তার সেই আল্লাহর নাফরমানীর কাজটিকে ঘৃণার সাথে অপছন্দ কর, কিন্তু তার আনুগত্য হতে হাত গুটাতে পারবে না।’’
[সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫)]
হাদীসটিতে বায়য়াত ভঙ্গের প্রসঙ্গ দ্বারা সুস্পষ্ট হয়, উক্ত শাসকের শাসন ইসলামী হুকুমাতের অন্তর্ভূক্ত। অন্যত্র নবী (স) বলেন :
إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ " . قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ نُقَاتِلُهُمْ قَالَ " لاَ مَا صَلَّوْا " . أَىْ مَنْ كَرِهَ بِقَلْبِهِ وَأَنْكَرَ بِقَلْبِهِ .
‘‘তোমাদের উপর এরূপ কতিপয় আমীর নিযুক্ত করা হবে তোমরা তাদের চিনতে পারবে এবং অপছন্দ করবে। যে তাদের অপছন্দ করল সে মুক্তি পেল এবং যে প্রত্যাখ্যান করল সে নিরাপদ হল। কিন্তু যে (তাদের প্রতি) সন্তুষ্ট থাকল এবং অনুসরণ করল (সে ক্ষতিগ্রস্ত হল) লোকেরা জানতে চাইল, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায়কারী থাকবে। (অপছন্দ করল) অর্থাৎ, যে অন্তর থেকে তাদের অপছন্দ করল এবং অন্তর থেকে প্রত্যাখ্যান করল।’’ [.সহীহ : মুসলিম ৪৬৯৫ (৬৩/১৮৫৪), মিশকাত ৩৬৭১।]
অন্য বর্ণনায় আছে, لاَ مَا اَقَامُوْا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ ‘‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০। হাদীসটি বায়য়াত কোন পরিস্থিতিতে ভঙ্গ করা যায় সে সম্পর্কে প্রশ্ন-উত্তর সংশ্লিষ্ট ছিল।] অপর এক বর্ণনায় আছে, اِلاَّ اَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِّنَ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانَ ‘‘যতক্ষণ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫৬, সহীহ মুসলিম ৪৬৬৫ (৪২/১৭০৯), মিশকাত ৩৬৬৬। হাদীসটি নিযুক্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাদীসের শুরুর বাক্যগুলো থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।]
পূর্বোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায়, পূর্ব থেকেই বায়আত-খিলাফত ও সালাত ক্বায়েম ছিল, এমন শাসক যখন সালাত ক্বায়েম করবে না তখন তাকে হত্যা করা যাবে। তবে নিঃসন্দেহে উক্ত শাসককে অপসারণের বিষয়টি শক্তি-সামর্থ্যের সাথে জড়িত।
খ.সম্পূর্ণ গোমরাহ শাসক : হুযায়ফা (রা) বলেন :
قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّا كُنَّا بِشَرٍّ فَجَاءَ اللهُ بِخَيْرٍ فَنَحْنُ فِيْهِ فَهَلْ مِنْ وَّرَاءِ هَذَا الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ هَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الشَّرِّ خَيْرُ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ فَهَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ كَيْفَ قَالَ يَكُوْنَ بَعْدِيْ اَئِمَّةُ لاَيَهْتَدُوْنَ بِهُدَايَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِيْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالُ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِيْ جُثْمَانِ اِنْسٍ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ اَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنْ اَدْرَكْتُ ذَالِكَ قَالَ تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْاَمِيْرِ وَاِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَاُخِذَ مَالُكَ فَاسْمَعْ وَاطِعْ ـ
‘‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে তারপর আল্লাহ আমাদের জন্যে মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ অমঙ্গলের পরে কি আবার কোন মঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, তা কিভাবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে যারা আমার হিদায়েতে হিদায়েত প্রাপ্ত হবে না এবং আমার সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যাদের অন্তঃকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তঃকরণ; রাবী বলেন, আমি বললাম : তখন আমরা কী করবো, ইয়া রসূলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন : তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেয়া হয় তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৬৭৮ (৫১/১৮৪৭), মিশকাত ৫৩৮২]
যারা আল্লাহর বিধান দ্বারা হুকুমাত পরিচালনা করবে তারা কখনই হিদায়াত ও রসূলের সুন্নাত ত্যাগকারী শাসক নয়। তাদের যে বিষয়ে আনুগত্য করতে বলা হয়েছে তা আল্লাহর একক হক্ব তথা ইবাদাত সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। এমনকি ইসলামী কোন মৌলিক আক্বীদার বিরোধিতায়ও তাদেরকে মানতে বলা হয়নি। অথচ বান্দার অধিকার যেমন অন্যায়ভাবে বেত্রাঘাত করা অথবা ধন-সম্পদ প্রভৃতি তথা অধিকার কেড়ে নেয়া সত্ত্বেও তাদের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। যা সুস্পষ্টভাবে মুআমালাতের অন্তর্ভুক্ত। অথচ পূর্বের হাদীসগুলো শাসকের শেষ বাহ্যিক কুফর তথা সালাত আদায় পর্যন্ত আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, পরিস্থিতি বিশেষে যখন মুসলিমদের ঈমান ও বৈষয়িক শক্তি-সামর্থ্যের হ্রাস ঘটবে এবং গোমরাহ শাসকদের আবির্ভাব ঘটবে তখনকার করণীয় বিষয় সম্পর্কে হাদীসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন। আমিন!!
পূর্বোক্ত আলোচনাতে আক্বীদাভিত্তিক ও আমলভিত্তিক কুফরের বিষয়টি সুস্পষ্ট হল। কেননা রসূলুল্লাহ (স) যখন নিজেই হাকিম তখন তাঁর সাথে দুর্ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে যেখানে তার অবস্থান সুস্পষ্ট, অথচ তিনি তখন রাষ্ট্রীয় শক্তি-ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং যখন মুসলিমরা ঈমানী দুর্বলতায় জর্জরিত হবে, তখন শক্তিশালী গোমরাহ শাসকদের ব্যাপারে তাদের করণীয় সেটাই যা পূর্বোক্ত সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরকে পুনরায় নবী (স) -এর দেখানো পথেই সংস্কার করতে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন : একবার রসূলুল্লাহ (স) আমাদের বললেন : اِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ بَعْدِيْ اَثْرَةً وَاٌمٌوْرًا تُنْكِرُوْنَهَا ‘‘অচিরেই তোমরা আমার পরে স্বজনপ্রীতি এবং এমন সব কাজ দেখবে, যা তোমরা অপছন্দ করবে।’’ সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন : فَمَا تَأْمُرُنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ ‘‘ইয়া রসূলাল্লাহ! তখন আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (স) বললেন : اَدُّوْا اِلَيْهِمْ حَقَّهُمْ وَسَلُوْا اللهَ حَقَّكُمْ ‘‘তোমরা তাদের হক্ব তাদের পরিশোধ করে দেবে এবং তোমাদের হক্ব আল্লাহ’র কাছে চাবে।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫২, মিশকাত ৩৬৭২।]
রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
سَتَكُوْنُ أَحْدَاثٌ وَفِتْنَةٌ وَفُرْقَةٌ وَاِخْتِلاَفٌ ، فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُوْنَ الْمَقْتُوْلَ لاَ الْقَاتِلَ فَافْعَلْ
‘‘অচিরেই নিত্য নতুন বিষয়াদি (বিদআত), ফিতনা, ফিরক্বা (দলাদলি) ও ইখতিলাফ (মতবিরোধ) দেখা দেবে। তখন যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় তবে নিহত হও, হত্যাকারী হয়ো না, তবে তা-ই কর।’’ [.হাসান : মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাকে হাকিম। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহুল জামে‘ ১/৩৬১৬)। শুআয়েব আরনাউত হাদীসটির সমালোচনাসহ হাদীসটি হাসান লি-গয়রিহী বলে মন্তব্য করেছেন। (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ ৫/২২৫৫২)। পরবর্তী সহীহ হাদীসটি এই হাদীসটিকে সমর্থন করে।]
আবূ মূসা (রা) নবী (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (স) বলেন :
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وِيُمْسِيْ كَافِرًا وَيُمْسِيْ مُؤْمِنًا وَّيُصْبِحُ كَافِرًا اَلْقَاعِدُ فِيْهَا خَيْرٌ مِّنَ الْقَائِمِ وَالْمَاشِيْ فِيْهَا خَيْرٌ مِّنَ السَّاعِيْ فَكَسِّرُوْا فِيْهَا قِسِيَّكُمْ وَقَطِّعُوْا فِيْهَا أَوْتَارَكُمْ وَاضْرِبُوْا سُيُوْفَكُمْ بِالْحِجَارَةِ فَإِنْ دُخِلَ عَلى أَحَدٍ مِّنْكُمْ فَلْيَكُنْ كَخَيْرِ ابْنَيْ آدَمَ .
‘‘ক্বিয়ামত আসার পূর্বে ঘোর অন্ধকার রাত্রির একাংশের ন্যায় ফিতনা সংঘটিত হতে থাকবে, এতে কোন ব্যক্তি সকালে মু’মিন এবং বিকালে কাফির এবং বিকালে মু’মিন আর সকালে কাফিরে পরিণত হতে থাকবে। এতে বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হতে উত্তম হবে। আর চলমান ব্যক্তি দ্রুতগামী ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম হবে। তখন তোমরা তোমাদের ধনুকগুলো ভেঙ্গে ফেলবে এবং এর রশিগুলি কেটে ফেলবে। আর তোমাদের তলোয়ার পাথরে আঘাত করে এর ধার নষ্ট করে দেবে। এই সময় কেউ যদি আগ্রাসী হয়ে তোমাদের কাউকেও আক্রমণ করে, তখন সে যেন আদম (আ)-এর দুই ছেলের মধ্যে উত্তম ছেলের নীতি অবলম্বন করে।’’ [. সহীহ : আবূ দাউদ, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ৩/৫৩৯৯, তাহক্বীক্বকৃত আবূ দাউদ হা/৪২৫৯)।] আদম (আ)-এর উক্ত দুই পুত্র সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لأقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ
‘‘(আদম (আ)-এর এক পুত্র অপর পুত্রকে বলল) তুমি যদি আমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়াও, আমি তোমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়াব না। আমি রব্বুল আলামীনকে ভয় করি।’’ [সূরা মায়িদাহ : ২৮ আয়াত]
ইমাম ইবনু কাসীর (রহ) লিখেছেন :
قال أيوب السَّخْتَياني : إن أول من أخذ بهذه الآية من هذه الأمة : ﴿ لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لأقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ﴾ لَعُثْمان بن عفان رضي الله عنه . رواه ابن أبي حاتم .
‘‘আইয়ুব সাখতিয়ানী (রহ) বলেন : এই উম্মাতের মধ্যে সর্বপ্রথম এই আয়াতের ওপর যিনি আমল করেছিলেন তিনি হলেন উসমান (রা) । আবূ হাতিম এটা বর্ণনা করেছেন।’’
[তাফসীর ইবনু কাসীর, সূরা মায়িদাহ- ২৮ নং আয়াতের তাফসীর দ্র :]
লক্ষণীয় বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় ইসলামী রাষ্ট্র তখন শক্তিশালী ছিল। কিন্তু উসমান (রা) রাষ্ট্রীয় নীতির আলোকে তাদের মুসলিম গণ্য করায় তাদের রক্ত নেওয়ার চেয়ে নিজের শহীদ হওয়াটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-এর পূর্বোক্ত আলোচনায় আক্বীদাগত কুফর ও আমলগত কুফরের বর্ণনা এসেছে। আমরা এখন এ দু’টি বিষয়ে জড়িতদের সাথে নবী (স)-এর যামানাতে কী আচরণ ও নির্দেশ ছিল তা তুলে ধরার চেষ্টা করব। এর ফলে এ সম্পর্কে বাস্তবচিত্র আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হবে এবং মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-এর উপর মুরজিয়া হওয়ার অপবাদও খণ্ডিত হবে।
কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আক্বীদাগত কুফর ও আমলগত কুফরের দৃষ্টান্ত যাদের মধ্যে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম হল :
১.মুনাফিক্ব
২.খারেজী
৩.গোমরাহ শাসক
৪.হত্যাকারী ও সুদখোরের চিরস্থায়ী (!?) জাহান্নামী হওয়া
৫.আল-ওয়ালা ওয়াল বারা (বন্ধুত্ব ও শত্রুতা)
কুরআন ও সহীহ হাদীসে এদের সাথে আচরণ ও হুকুমের আলোকে বর্তমান যামানায় যারা আক্বীদা বা আমলগত কিংবা উভয় কুফরের সাথে জড়িত তাদের প্রতি করণীয় বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাব, ইনঁশাআল্লাহ।
১.মুনাফিক্ব : এতে কোন মতপার্থক্য নেই যে, মুনাফিক্বরা আক্বীদাগত দিকে থেকে কুফরী আক্বীদা রাখলেও প্রকাশ্য আমলগতভাবে নিজেদের মুসলিম হিসাবেই প্রকাশ করত। কিন্তু আল্লাহ তাআলা’র কাছে তাদের আক্বীদা ও আমল উভয়টিই সুস্পষ্টভাবে কুফরীর দোষে দুষ্ট।
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ ـ اتَّخَذُوا أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ـ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ آَمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ ـ
‘‘যখন মুনাফিক্বরা আপনার নিকট আসে তখন তারা বলে : ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি- নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রসূল।’ আর আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই আপনি তাঁর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিক্বরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথসমূহকে ঢালরূপে ব্যবহার করে, আর তারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত করে। তারা যা করছে, তা কতই না মন্দ। এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে। ফলে, তাদের অন্তরের উপর মোহর মেরে দেয়া হয়েছে; পরিণামে তারা বুঝে না।’’ [.সূরা মুনাফিকুন : ১-৩ আয়াত।]
আলোচ্য আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হল, আল্লাহ তাআলা’র কাছে মুনাফিক্বদের আক্বীদা ও আমল উভয়টিই প্রত্যাখ্যাত। এরপরও আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ছাড় দিতে বলেছেন যতক্ষণ না তারা মুসলিম ও ইসলামী রাষ্ট্রের বিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। এ সম্পর্কে সূরা নিসার ১২ নং রুকুর সম্পূর্ণ অংশটিতে তাদের ব্যাপারে নির্দেশ ও নীতিমালা বর্ণিত হয়েছে। উক্ত আয়াতগুলোর ধারাবাহিক বক্তব্যগুলো হল :
ক.মুনাফিক্বরা পথভ্রষ্ট, তারা কখনো পথ পাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِئَتَيْنِ وَاللَّهُ أَرْكَسَهُمْ بِمَا كَسَبُوا أَتُرِيدُونَ أَنْ تَهْدُوا مَنْ أَضَلَّ اللَّهُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ سَبِيلًا
‘‘আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা মুনাফিক্বদের ব্যাপারে দু’দল হয়ে গেলে? যখন আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। তোমরা কি তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও, যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন? আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্য কখনো কোন পথ পাবে না।’’ [সূরা নিসা : ৮৮ আয়াত]
খ.তারা মুসলিমদের কাফির বানাতে চায়। সবকিছু ছেড়ে মুসলিমদের কাছে হিজরত না করলে কাফিরদের ন্যায় তাদের হত্যা করতে হবে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَدُّوا لَوْ تَكْفُرُونَ كَمَا كَفَرُوا فَتَكُونُونَ سَوَاءً فَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ أَوْلِيَاءَ حَتَّى يُهَاجِرُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا
‘‘তারা চায় যে, তারা যেরূপ কাফির হয়েছে, তোমরাও সেরূপ কাফির হও, যাতে তোমরা তাদের সমান হয়ে যাও। সুতরাং তাদের মধ্যে হতে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের যেখানেই পাবে পাকড়াও করবে ও হত্যা করবে এবং তাদের মধ্যে হতে কাউকে বন্ধু ও সাহায্যকারীরূপে গ্রহণ করবে না।’’ [সূরা নিসা : ৮৯ আয়াত]
আলোচ্য আয়াতটিতে মুনাফিক্বদের কাফির বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
গ.যদি মুনাফিক্বরা মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধদের মাঝে থাকে, কিংবা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিজেদের দুর্বলতার কারণে তারা যুদ্ধ করতে ভয়ে দূরে থাকে এবং শান্তির প্রস্তাব দেয়, অথচ শক্তি থাকলে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো; এদের সাথেও যুদ্ধ নিষিদ্ধ।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِلَّا الَّذِينَ يَصِلُونَ إِلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ أَوْ جَاءُوكُمْ حَصِرَتْ صُدُورُهُمْ أَنْ يُقَاتِلُوكُمْ أَوْ يُقَاتِلُوا قَوْمَهُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَسَلَّطَهُمْ عَلَيْكُمْ فَلَقَاتَلُوكُمْ فَإِنِ اعْتَزَلُوكُمْ فَلَمْ يُقَاتِلُوكُمْ وَأَلْقَوْا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ فَمَا جَعَلَ اللَّهُ لَكُمْ عَلَيْهِمْ سَبِيلًا
‘‘কিন্তু তারা নয়, যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ। অথবা যারা তোমাদের নিকট এ অবস্থায় আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে অথবা তাদের সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করতে অনুৎসাহিত। আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তবে তাদের তোমাদের উপর ক্ষমতা দিতেন। ফলে তারা অবশ্যই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত। সুতরাং তারা যদি তোমাদের নিকট থেকে সরে দাঁড়ায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব করে, তবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ রাখেননি।’’ [সূরা নিসা : ৮৯ আয়াত]
সুস্পষ্ট হল, মুনাফিক্বদের আক্বীদা কুফর হলেও যতক্ষণ তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না বা অন্য কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। অথচ আল্লাহ তাআলা’র কাছে তাদের আক্বীদা ও আমল কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং প্রমাণিত হল :
১.আল্লাহ তাআলা’র কাছে মুনাফিক্বদের ঈমান ও আমল গ্রহণযোগ্য নয়।
২.আল্লাহ তাআলা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাদের ছাড় দিচ্ছেন এবং তাদের ব্যাপারে যুদ্ধ করতে বা কঠোর হতে নিষেধ করছেন; যতক্ষণ না তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চরমপন্থা অবলম্বন করে।
ঘ.যখন মুনাফিক্বরা সমাজ ও রাষ্ট্রে ফিতনা সৃষ্টি করবে তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
سَتَجِدُونَ آَخَرِينَ يُرِيدُونَ أَنْ يَأْمَنُوكُمْ وَيَأْمَنُوا قَوْمَهُمْ كُلَّ مَا رُدُّوا إِلَى الْفِتْنَةِ أُرْكِسُوا فِيهَا فَإِنْ لَمْ يَعْتَزِلُوكُمْ وَيُلْقُوا إِلَيْكُمُ السَّلَمَ وَيَكُفُّوا أَيْدِيَهُمْ فَخُذُوهُمْ وَاقْتُلُوهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوهُمْ وَأُولَئِكُمْ جَعَلْنَا لَكُمْ عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا مُبِينًا .
‘‘তোমরা আরো কতক লোক পাবে, যারা তোমাদের সাথে এবং তাদের সম্প্রদায়ের সাথে শান্তিতে থাকতে চায়। যখনই তাদের ফিতনার দিকে ডাকা হয়, তখনই তারা তাদের পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবৃত্ত হয়। অতএব, তারা যদি তোমাদের নিকট হতে চলে না যায়, তোমাদের নিকট শান্তির প্রস্তাব না করে এবং তাদের হাত সংবরণ না করে, তবে তাদের যেখানেই পাবে গ্রেফতার করবে এবং হত্যা করবে। আমি তাদের উপর তোমাদের বিরুদ্ধাচারণের স্পষ্ট অধিকার দিয়েছি।’’ [সূরা নিসা : ৯১ আয়াত]
ঙ. তাগুতের কাছে বিচার উপস্থাপনকারী মুনাফিক্ব ও এ সম্পর্কিত বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ـ وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا ـ
‘‘আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে, তাতে তারা ঈমান আনে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং শয়তান তাদের ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়? তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রসূলের দিকে এসো, তখন মুনাফিক্বদের আপনি আপনার নিকট থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখবেন।’’ [সূরা নিসা : ৬০-৬১ আয়াত]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
ياَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ
‘‘হে নবী! কাফির ও মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও।’’ [সূরা তাওবাহ : ৭৩ আয়াত]
এখন আমরা জানব, মুনাফিক্বদের সাথে কখন, কি পরিস্থিতিতে ও কিভাবে জিহাদ করতে হবে এবং কঠোর হতে হবে?
মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে জিহাদের ধরণ
ক.বিদ্রোহ করলে (হত্যা/ ক্বিতাল/ দেশান্তর) : এক্ষেত্রে বিদ্রোহ করার শাস্তি প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّمَا جَزَاءُ الَّذِينَ يُحَارِبُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا أَنْ يُقَتَّلُوا أَوْ يُصَلَّبُوا أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ مِنْ خِلَافٍ أَوْ يُنْفَوْا مِنَ الْأَرْضِ ذَلِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ ـ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَقْدِرُوا عَلَيْهِمْ فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ ـ
‘‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট শাস্তি হত্যা কিংবা শূলে চড়ান অথবা তাদের হাত ও পা বিপরীতভাবে কেটে ফেলা, কিংবা দেশ থেকে নির্বাসিত করা। এ লাঞ্ছনা ও অপমান হবে এ দুনিয়ায়; কিন্তু পরকালে তাদের জন্যে এটা অপেক্ষাও কঠিনতম আযাব নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু যারা তাওবা করবে, তাদের উপর তোমাদের আধিপত্য স্থাপিত হওয়ার পূর্বে। তোমাদের জেনে রাখা দরকার যে, আল্লাহই হচ্ছেন ক্ষমাকারী ও অনুগ্রহশীল।’’
[সূরা মায়িদা : ৩৩-৩৪ আয়াত]
সুস্পষ্ট হল মুনাফিক্ব/ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের উপর মুসলিমদের প্রভাব থাকলেও তারা মুসলিমদের সাথে বিদ্রোহমূলক আচরণ না করলে তাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-ই ছাড় দিয়েছেন। অথচ তাদের আক্বীদা ও আমল কোনটিই আল্লাহ তাআলা’র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
খ.সামাজিক অশান্তি সৃষ্টি করলে (হত্যা) : আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَّرْضٌ وَالْمُرْجِفُوْنَ فِي الْمَدِيْنَةِ لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لاَيُجَاوِرُوْنَكَ فِيْهَا اِلاَّ قَلِيْلاً ـ مَّلْعُوْنِيْنَ ج اَيْنَمَا ثُقِفُوْا اُخِذُوْا وَقُتِّلُوْا تَقْتِيْلاً ـ
‘‘মুনাফিক্বরা এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা নগরে গুজব রটনা করে, তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে আপনাকে প্রবল করব। এরপর এ নগরীতে আপনার প্রতিবেশীরূপে তারা অল্প সময়ই থাকবে- অভিশপ্ত হয়ে। তাদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।’’ [সূরা আহযাব : ৬০-৬১ আয়াত]
গ.সমাজে শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন করলে (শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পাবে) : পূর্বোক্ত আয়াতে لَئِنْ لَّمْ يَنْتَهِ الْمُنَافِقُوْنَ ‘‘মুনাফিক্বরা যদি বিরত না হয়’’ কথাটি রয়েছে। যা থেকে সুস্পষ্ট হয়, তারা অশান্তি সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকলে তাদের ব্যাপারে কঠিন হওয়া যাবে না। তাদের সংস্কারের ক্ষেত্রে ফাসেক/ বিদআতী প্রমুখের ন্যায় হাত/ মুখ/ অন্তরের জিহাদ পরিস্থিতি অনুযায়ী অব্যাহত থাকবে। ইবনু কাসির (রহ) মুনাফিক্বদের শাস্তির বিধান সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীর ভিন্ন ভিন্ন উদ্ধৃতি দেয়ার পর লিখেছেন :
انه لا منافاة بيْن هذه الأقوال، لأنه تارة يؤاخذهم بِهذا، وتارة بِهذا بِحسب الأحوال .
‘‘উপরোক্ত (বিভিন্ন) উদ্ধৃতির মধ্যে কোনরূপ বৈপরিত্য নেই। বস্তুত মুনাফিক্বদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অবস্থায় পূর্বোক্ত বিভিন্ন পন্থায় জিহাদ করাই বিধেয়।’’
[তাফসীরে ইবনু কাসির, সূরা তাওবা : ৭৩-৭৪ নং আয়াতের তাফসীর দ্র:। এই আয়াতটির তাফসীরে মুনাফিক্বগণ কর্তৃক নবী (স)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র, বিদ্রূপ এবং পরবর্তীতে নবী (স)-এর সামনে তা অস্বীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে]
সুতরাং নবী (স)-এর উপস্থিতিতে যারা তাঁকে হত্যার ও ইসলামকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছে, নবী (স) -কে হাকিম/শাসক/বিচারক হিসাবে গ্রহণ করেনি- তাদের ব্যাপারে ইসলাম ক্ষমতাসীন থাকার মুহূর্তে যখন পূর্বোক্ত বিধানগুলো প্রযোজ্য। তখন মুসলিমদের দুর্বলতার সময় করণীয় বিষয়গুলো খুবই সুস্পষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে হাকিম/শাসকদের তাকফির করে হত্যা করা ঘোষণা দেয়ার চেয়ে তাসফিয়্যাহ ও তারবিয়্যাহ-ই যে সবচে জরুরি এতে কোন সন্দেহ নেই।
২.খারেজী : খারেজীদের সূত্রপাতও মুনাফিক্বদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنَّهُمْ لَمِنْكُمْ وَمَا هُمْ مِنْكُمْ وَلَكِنَّهُمْ قَوْمٌ يَفْرَقُونَ ـ لَوْ يَجِدُونَ مَلْجَأً أَوْ مَغَارَاتٍ أَوْ مُدَّخَلًا لَوَلَّوْا إِلَيْهِ وَهُمْ يَجْمَحُونَ ـ وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ ـ وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آَتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ سَيُؤْتِينَا اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللَّهِ رَاغِبُونَ ـ إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَاِبْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘তারা আল্লাহ’র নামে শপথ করে যে, তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, বস্তুত তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা ভয় করে থাকে। তারা কোন আশ্রয়স্থল, কোন গিরিগুহা অথবা কোন প্রবেশস্থল পেয়ে গেলে সে দিকে পলায়ন করবে ক্ষিপ্রগতিতে। তাদের মধ্যে এমনও লোক আছে, যে সাদাক্বা বণ্টনের ব্যাপারে আপনাকে দোষারোপ করে। অতঃপর তার কিছু তাদের দেয়া হলে পরিতুষ্ট হয় এবং তার কিছু না দেয়া হলে তখনই তারা বিক্ষুব্ধ হয়। ভাল হতো যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের যা দিয়েছেন তাতে রাযী হয়ে যেত এবং বলত আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট; আল্লাহ আমাদের দিবেন নিজ করুণা এবং তাঁর রসূলও। সাদাক্বা তো কেবল ফক্বীর, মিসকীন ও এর (জন্য নিয়োজিত) কর্মচারীদের জন্য এবং (অমুসলিম/দুর্বল মু’মিনদের) অন্তর আকৃষ্ট করার জন্য এবং দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য ও আল্লাহ’র পথে জিহাদরতদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহ’র বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’’ [সূরা তাওবা : ৫৮-৬০ আয়াত]
عن أبي سعيد رضي الله عنه قال : بعث إلي النبي ﷺ بشيء فقسمه بين أربعة وقال : أتألفهم . فقال رجل ما عدلت فقال : يَخرج من ضئضئ هذا قوم يِمرقون من الدين
‘‘আবূ সাঈদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী (স) -এর কাছে কিছু জিনিস প্রেরণ করা হল। এরপর তিনি সেগুলো চারজনের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। আর বললেন, তাদের (এর দ্বারা) আকৃষ্ট করছি। তখন এক ব্যক্তি বলল, আপনি সঠিকভাবে দান করেনি এতদশ্রবণে তিনি বললেন : এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন সব লোক জন্ম নেবে যারা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে।’’ [সহীহ বুখারী- কিতাবুত তাফসীর, সূরা নিসা : ৬০ নং আয়াতের তাফসীর দ্র :]
আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে : আলী (রা) ইয়ামান থেকে রসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে কিছু স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তিনি (স) সেগুলো চার জনের মধ্যে বণ্টন করেন। তখন সাহাবীদের একজন বললেন : ‘এ স্বর্ণের ব্যাপারে তাদের অপেক্ষা আমরাই অধিক হক্বদার ছিলাম।’ কথাটি শোনার পর নবী (স) বললেন : ‘তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না অথচ আমি আসমানবাসীদের আস্থাভাজন, সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে।..... তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল : ইয়া রসূলাল্লাহ! আল্লাহকে ভয় করুন। নবী (স) বললেন : তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি বেশি হক্বদার নই? লোকটি চলে গেলে খালিদ বিন ওয়ালিদ বললেন : ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? তিনি (স) বললেন : ( لا لعله أن يكون يصلي ) না, হয়ত সে সালাত আদায় করে। খালিদ বললেন : ( وكم من مصل يقول بلسانه ما ليس في قلبه ) অনেক মুসলস্নী আছে যারা মুখে এমন কথা উচ্চারণ করে যা অন্তরে নেই। রসূলুল্লাহ (স) বললেন : ( إنّي لَم أومر أن أنقب قلوب الناس ولا أشق بطونَهم ) আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেঁড়ে (ঈমান) দেখার জন্য বলা হয়নি .... তিনি (স) বললেন : এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে যারা শ্রুতিমধুর কন্ঠে আল্লাহ’র কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের গলদেশের নিচে নামবে না। তারা দ্বীন থেকে এভাবে বেরিয়ে যাবে যেভাবে তীর বের হয়। যদি আমি তাদের পাই তাহলে অবশ্যই আমি তাদের সামুদ জাতির মত হত্যা করব।’’ [সহীহ বুখারী- কিতাবুল মাগাযী باب بعث على بن ابى طالب ; (সংক্ষেপিত)]
আলী (রা) -এর খিলাফতের যামানায় খারেজীদের উদ্ভব হয়।
[ফতহুল বারী, আলোচ্য অনুচ্ছেদ দ্র :, আরো বিস্তারিত : তাফসীরে মাযহারী সূরা নিসা : ৫৬-৫৯ আয়াতের তাফসীর]
আলী (রা) খারেজীদের বলেছিলেন : ‘‘যতদিন তোমাদের দায়িত্ব আমাদের উপরে ছিল ততদিন আমরা তোমাদের গনীমত দেয়া বন্ধ করিনি এবং আল্লাহর মাসজিদে সালাত আদায় করতে বাধা দেইনি এখন তোমাদের উপর আমরা আগেই হামলা করবো না। যদি তোমরা প্রথমে হামলা না করো।’’ এরপর তারা সবাই কূফা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাহরাওয়ান নামক স্থানে সমবেত হয়। [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ই.ফা.) ৭/৫১০ পৃষ্ঠা]
পূর্বোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হল, মুনাফিক্ব ও খারেজীরা একই সূত্রে গাঁথা। তাদের প্রতি একই ধরণের আচরণ প্রযোজ্য :
ক.তাদের ঈমান ও আমল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
খ.এরপরও রাষ্ট্রীয় আইন এক্ষেত্রে তাদের প্রতি অনেক সহনশীল ও যুক্তিসংগত আচরণ করেছে, যতক্ষণ তারা ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষতির কারণ না হয়। অথচ তখন ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েম ছিল। তাদের ঈমান ও আক্বীদা আল্লাহ তাআলা’র কাছে অগ্রহণযোগ্য হওয়াটাও সুস্পষ্ট ছিল। রসূল (স) -কেও হাকিম/শাসক/বিচারক হিসাবে স্বীকার করার ব্যাপারে তাদের আপত্তি ছিল। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহী ও সরাসরি ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নি, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী আইনেই তাদের অবকাশ দেয়া হয়েছে।
৩.গোমরাহ শাসক : শাসকদের ব্যাপারে আমরা নবী (স) থেকে কয়েক ধরণের নিদের্শনা পায়। যথা :
ক.প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খিলাফত ও আইনসমূহ বিকৃতকারী শাসক : রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ গ্ধ ، قَالُوا : قُلْنَا : يَا رَسُولَ اللهِ، أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ عِنْدَ ذَلِكَ؟ قَالَ :র لَا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلَاةَ، لَا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلَاةَ، أَلَا مَنْ وَلِيَ عَلَيْهِ وَالٍ، فَرَآهُ يَأْتِي شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِي مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ، وَلَا يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ .
‘‘তোমাদের শাসকদের মধ্যে সেই শাসকই উত্তম যাকে তোমরা ভালবাস, আর যারা তোমাদের ভালবাসে। আর তোমরা তাদের জন্য দুআ কর এবং তারাও তোমাদের জন্য দুআ করে। আর তোমাদের সেই শাসকই মন্দ যাদের তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। আর তাদের প্রতি তোমরা লানত কর এবং তারা তোমাদের প্রতি লানত করে। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমরা বললাম : ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! এমতাবস্থায় আমরা কি সেই সমস্ত শাসকদের অপসারণ করে তাদের সাথে কৃত বায়য়াত ভঙ্গ করে ফেলব না? তিনি (স) বললেন : না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম করে (আবার বললেন) না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে। সাবধান! যে ব্যক্তিকে তোমাদের উপর শাসক নিযুক্ত করা হয়, আর যদি তার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানীর কোন কিছু পরিলক্ষিত হয়, তখন তোমরা তার সেই আল্লাহর নাফরমানীর কাজটিকে ঘৃণার সাথে অপছন্দ কর, কিন্তু তার আনুগত্য হতে হাত গুটাতে পারবে না।’’
[সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫)]
হাদীসটিতে বায়য়াত ভঙ্গের প্রসঙ্গ দ্বারা সুস্পষ্ট হয়, উক্ত শাসকের শাসন ইসলামী হুকুমাতের অন্তর্ভূক্ত। অন্যত্র নবী (স) বলেন :
إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ " . قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ نُقَاتِلُهُمْ قَالَ " لاَ مَا صَلَّوْا " . أَىْ مَنْ كَرِهَ بِقَلْبِهِ وَأَنْكَرَ بِقَلْبِهِ .
‘‘তোমাদের উপর এরূপ কতিপয় আমীর নিযুক্ত করা হবে তোমরা তাদের চিনতে পারবে এবং অপছন্দ করবে। যে তাদের অপছন্দ করল সে মুক্তি পেল এবং যে প্রত্যাখ্যান করল সে নিরাপদ হল। কিন্তু যে (তাদের প্রতি) সন্তুষ্ট থাকল এবং অনুসরণ করল (সে ক্ষতিগ্রস্ত হল) লোকেরা জানতে চাইল, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায়কারী থাকবে। (অপছন্দ করল) অর্থাৎ, যে অন্তর থেকে তাদের অপছন্দ করল এবং অন্তর থেকে প্রত্যাখ্যান করল।’’ [.সহীহ : মুসলিম ৪৬৯৫ (৬৩/১৮৫৪), মিশকাত ৩৬৭১।]
অন্য বর্ণনায় আছে, لاَ مَا اَقَامُوْا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ ‘‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০। হাদীসটি বায়য়াত কোন পরিস্থিতিতে ভঙ্গ করা যায় সে সম্পর্কে প্রশ্ন-উত্তর সংশ্লিষ্ট ছিল।] অপর এক বর্ণনায় আছে, اِلاَّ اَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِّنَ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانَ ‘‘যতক্ষণ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫৬, সহীহ মুসলিম ৪৬৬৫ (৪২/১৭০৯), মিশকাত ৩৬৬৬। হাদীসটি নিযুক্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাদীসের শুরুর বাক্যগুলো থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।]
পূর্বোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায়, পূর্ব থেকেই বায়আত-খিলাফত ও সালাত ক্বায়েম ছিল, এমন শাসক যখন সালাত ক্বায়েম করবে না তখন তাকে হত্যা করা যাবে। তবে নিঃসন্দেহে উক্ত শাসককে অপসারণের বিষয়টি শক্তি-সামর্থ্যের সাথে জড়িত।
খ.সম্পূর্ণ গোমরাহ শাসক : হুযায়ফা (রা) বলেন :
قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّا كُنَّا بِشَرٍّ فَجَاءَ اللهُ بِخَيْرٍ فَنَحْنُ فِيْهِ فَهَلْ مِنْ وَّرَاءِ هَذَا الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ هَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الشَّرِّ خَيْرُ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ فَهَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ كَيْفَ قَالَ يَكُوْنَ بَعْدِيْ اَئِمَّةُ لاَيَهْتَدُوْنَ بِهُدَايَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِيْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالُ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِيْ جُثْمَانِ اِنْسٍ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ اَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنْ اَدْرَكْتُ ذَالِكَ قَالَ تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْاَمِيْرِ وَاِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَاُخِذَ مَالُكَ فَاسْمَعْ وَاطِعْ ـ
‘‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে তারপর আল্লাহ আমাদের জন্যে মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ অমঙ্গলের পরে কি আবার কোন মঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, তা কিভাবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে যারা আমার হিদায়েতে হিদায়েত প্রাপ্ত হবে না এবং আমার সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যাদের অন্তঃকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তঃকরণ; রাবী বলেন, আমি বললাম : তখন আমরা কী করবো, ইয়া রসূলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন : তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেয়া হয় তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৬৭৮ (৫১/১৮৪৭), মিশকাত ৫৩৮২]
যারা আল্লাহর বিধান দ্বারা হুকুমাত পরিচালনা করবে তারা কখনই হিদায়াত ও রসূলের সুন্নাত ত্যাগকারী শাসক নয়। তাদের যে বিষয়ে আনুগত্য করতে বলা হয়েছে তা আল্লাহর একক হক্ব তথা ইবাদাত সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়। এমনকি ইসলামী কোন মৌলিক আক্বীদার বিরোধিতায়ও তাদেরকে মানতে বলা হয়নি। অথচ বান্দার অধিকার যেমন অন্যায়ভাবে বেত্রাঘাত করা অথবা ধন-সম্পদ প্রভৃতি তথা অধিকার কেড়ে নেয়া সত্ত্বেও তাদের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। যা সুস্পষ্টভাবে মুআমালাতের অন্তর্ভুক্ত। অথচ পূর্বের হাদীসগুলো শাসকের শেষ বাহ্যিক কুফর তথা সালাত আদায় পর্যন্ত আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, পরিস্থিতি বিশেষে যখন মুসলিমদের ঈমান ও বৈষয়িক শক্তি-সামর্থ্যের হ্রাস ঘটবে এবং গোমরাহ শাসকদের আবির্ভাব ঘটবে তখনকার করণীয় বিষয় সম্পর্কে হাদীসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন। আমিন!!
পূর্বোক্ত আলোচনাতে আক্বীদাভিত্তিক ও আমলভিত্তিক কুফরের বিষয়টি সুস্পষ্ট হল। কেননা রসূলুল্লাহ (স) যখন নিজেই হাকিম তখন তাঁর সাথে দুর্ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে যেখানে তার অবস্থান সুস্পষ্ট, অথচ তিনি তখন রাষ্ট্রীয় শক্তি-ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং যখন মুসলিমরা ঈমানী দুর্বলতায় জর্জরিত হবে, তখন শক্তিশালী গোমরাহ শাসকদের ব্যাপারে তাদের করণীয় সেটাই যা পূর্বোক্ত সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদেরকে পুনরায় নবী (স) -এর দেখানো পথেই সংস্কার করতে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন : একবার রসূলুল্লাহ (স) আমাদের বললেন : اِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ بَعْدِيْ اَثْرَةً وَاٌمٌوْرًا تُنْكِرُوْنَهَا ‘‘অচিরেই তোমরা আমার পরে স্বজনপ্রীতি এবং এমন সব কাজ দেখবে, যা তোমরা অপছন্দ করবে।’’ সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন : فَمَا تَأْمُرُنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ ‘‘ইয়া রসূলাল্লাহ! তখন আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (স) বললেন : اَدُّوْا اِلَيْهِمْ حَقَّهُمْ وَسَلُوْا اللهَ حَقَّكُمْ ‘‘তোমরা তাদের হক্ব তাদের পরিশোধ করে দেবে এবং তোমাদের হক্ব আল্লাহ’র কাছে চাবে।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫২, মিশকাত ৩৬৭২।]
রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
سَتَكُوْنُ أَحْدَاثٌ وَفِتْنَةٌ وَفُرْقَةٌ وَاِخْتِلاَفٌ ، فَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ تَكُوْنَ الْمَقْتُوْلَ لاَ الْقَاتِلَ فَافْعَلْ
‘‘অচিরেই নিত্য নতুন বিষয়াদি (বিদআত), ফিতনা, ফিরক্বা (দলাদলি) ও ইখতিলাফ (মতবিরোধ) দেখা দেবে। তখন যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় তবে নিহত হও, হত্যাকারী হয়ো না, তবে তা-ই কর।’’ [.হাসান : মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাকে হাকিম। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহুল জামে‘ ১/৩৬১৬)। শুআয়েব আরনাউত হাদীসটির সমালোচনাসহ হাদীসটি হাসান লি-গয়রিহী বলে মন্তব্য করেছেন। (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ ৫/২২৫৫২)। পরবর্তী সহীহ হাদীসটি এই হাদীসটিকে সমর্থন করে।]
আবূ মূসা (রা) নবী (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (স) বলেন :
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وِيُمْسِيْ كَافِرًا وَيُمْسِيْ مُؤْمِنًا وَّيُصْبِحُ كَافِرًا اَلْقَاعِدُ فِيْهَا خَيْرٌ مِّنَ الْقَائِمِ وَالْمَاشِيْ فِيْهَا خَيْرٌ مِّنَ السَّاعِيْ فَكَسِّرُوْا فِيْهَا قِسِيَّكُمْ وَقَطِّعُوْا فِيْهَا أَوْتَارَكُمْ وَاضْرِبُوْا سُيُوْفَكُمْ بِالْحِجَارَةِ فَإِنْ دُخِلَ عَلى أَحَدٍ مِّنْكُمْ فَلْيَكُنْ كَخَيْرِ ابْنَيْ آدَمَ .
‘‘ক্বিয়ামত আসার পূর্বে ঘোর অন্ধকার রাত্রির একাংশের ন্যায় ফিতনা সংঘটিত হতে থাকবে, এতে কোন ব্যক্তি সকালে মু’মিন এবং বিকালে কাফির এবং বিকালে মু’মিন আর সকালে কাফিরে পরিণত হতে থাকবে। এতে বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি হতে উত্তম হবে। আর চলমান ব্যক্তি দ্রুতগামী ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম হবে। তখন তোমরা তোমাদের ধনুকগুলো ভেঙ্গে ফেলবে এবং এর রশিগুলি কেটে ফেলবে। আর তোমাদের তলোয়ার পাথরে আঘাত করে এর ধার নষ্ট করে দেবে। এই সময় কেউ যদি আগ্রাসী হয়ে তোমাদের কাউকেও আক্রমণ করে, তখন সে যেন আদম (আ)-এর দুই ছেলের মধ্যে উত্তম ছেলের নীতি অবলম্বন করে।’’ [. সহীহ : আবূ দাউদ, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ৩/৫৩৯৯, তাহক্বীক্বকৃত আবূ দাউদ হা/৪২৫৯)।] আদম (আ)-এর উক্ত দুই পুত্র সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لأقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ
‘‘(আদম (আ)-এর এক পুত্র অপর পুত্রকে বলল) তুমি যদি আমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়াও, আমি তোমাকে হত্যার জন্য হাত বাড়াব না। আমি রব্বুল আলামীনকে ভয় করি।’’ [সূরা মায়িদাহ : ২৮ আয়াত]
ইমাম ইবনু কাসীর (রহ) লিখেছেন :
قال أيوب السَّخْتَياني : إن أول من أخذ بهذه الآية من هذه الأمة : ﴿ لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لأقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ﴾ لَعُثْمان بن عفان رضي الله عنه . رواه ابن أبي حاتم .
‘‘আইয়ুব সাখতিয়ানী (রহ) বলেন : এই উম্মাতের মধ্যে সর্বপ্রথম এই আয়াতের ওপর যিনি আমল করেছিলেন তিনি হলেন উসমান (রা) । আবূ হাতিম এটা বর্ণনা করেছেন।’’
[তাফসীর ইবনু কাসীর, সূরা মায়িদাহ- ২৮ নং আয়াতের তাফসীর দ্র :]
লক্ষণীয় বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় ইসলামী রাষ্ট্র তখন শক্তিশালী ছিল। কিন্তু উসমান (রা) রাষ্ট্রীয় নীতির আলোকে তাদের মুসলিম গণ্য করায় তাদের রক্ত নেওয়ার চেয়ে নিজের শহীদ হওয়াটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
নবী (স) বলেছেন :
مَا مِنْ نَّبِىٍّ بَعْثَهُ اللهُ فِىْ اُمَّةٍ قَبْلِىْ اِلاَّ كَانَ لَه ও فِى اُمَّتِه حَوَارِيُّوْنَ وَاَصْحَابٌ يَّاخُذُوْنَ بِسُنَّتِه وَيَقْتَدُوْنَ بِاَمْرِه ثُمَّ اِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوْفٌ يَّقُوْلُوْنَ مَا لاَ يَفْعَلُوْنَ وَيَفْعُلَوْنَ مَا لاَ يُؤْمَرُوْنَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِه فَهُوَ مَؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِه فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَ هُمْ بِقَلْبِه فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذلِكَ مِنَ الْاِيْمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ ـ
‘‘আল্লাহ তাআলা আমার পূর্বে যে সব নবী (স)-কে তাঁর উম্মাতের জন্য পাঠিয়েছিলেন, ঐ উম্মাতের মধ্যে তাঁর জন্য সাহায্যকারী ও সাহাবীগণ ছিলেন। যারা তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করতেন ও তাঁর হুকুম মেনে চলতেন। তাদের পরে ঐ সমস্ত খারাপ লোকের উদ্ভব হতো যারা এমন কথা বলত যার উপর আমল করত না। আর তাদের যে বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়নি, তার উপর আমল করত। যে ব্যক্তি ঐ সমস্ত লোকদের সাথে হাত দ্বারা জিহাদ করে সে মু’মিন, যে যবান দ্বারা জিহাদ করে সেও মু’মিন, আর যে অন্তর দ্বারা জিহাদ করে সেও মু’মিন। অন্যথায় এর বাইরে তিল দানা পরিমাণ ঈমানের অস্তিত্বও নেই।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৮৩ (৮০/৫০), মিশকাত ১৫৭ ।]
এই শেষোক্ত হাদীসটিতেও ক্বলব তথা অন্তরের কার্যকারীতাকে স্বীকার করে তাকে সর্বশেষ ঈমানের অস্তিত্ব বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যা আহলে সুন্নাতের আক্বীদাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। পক্ষান্তরে খারেজীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
সংশয় : অনেকে এ ক্ষেত্রে বলতে পারেন, আলোচ্য হাদীসটিতো উপায়হীন অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যখন পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে তখন কেবল অন্তরের কার্যকারিতা গ্রহণযোগ্য নয়।
জবাব : হাদীসটিতে অন্তরের উক্ত কার্যকারিতাকে দুর্বল ঈমান বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ঈমানের সর্বশেষ অবস্থা। সুতরাং যখন শরীআত নিজেই তা স্বীকৃতি দেয় তখন তা অস্বীকার করা প্রকারান্তরে ‘‘আল্লাহর বিধানকেই অস্বীকার করা’’। যা কুফরে ই‘তিক্বাদী বা আক্বীদাগত কুফরের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া যারা ঈমানী দুর্বলতা ও অন্যান্য কারণে আমলগতভাবে চরম পাপী হিসাবে গণ্য হবে তাদের আখিরাতের পরিস্থিতি সম্পর্কেও হাদীসে সু্স্পষ্ট বর্ণনা আছে। যেমন- সমস্ত নবী-রসূলদের শাফায়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা বলবেন :
شُفِّعَتِ الْمَلَائِكَةُ وَشُفِّعَ النَّبِيُّونَ وَشُفِّعَ الْمُؤْمِنُونَ وَلَمْ يَبْقَ إِلَّا أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ فَيَقْبِضُ قَبْضَةً مِنَ النَّارِ فَيُخْرِجُ مِنْهَا قَوْمًا لَمْ يَعْمَلُوا خَيْرًا
‘‘মালাইকাগণ, নবীগণ ও মুমীনগণ সবাই শাফায়ত করেছেন, এখন এক আর-রহমানুর রহিমীন ছাড়া কেউ বাকি নেই। এই বলে তিনি মুষ্টিভরে এমন একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা কখনো কোন নেক কাজ করেনি’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৩৪৩ (৩০২/১৮৩), মিশকাত ৫৫৭৯।]
উপরিউক্ত হাদীসগুলো মুরজিয়া ও খারেজী উভয় ফিতনাকে খণ্ডন করে। কেননা-
১.মুরজিয়াদের দাবি হল, কেবল ঈমান থাকাই জান্নাতের যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথচ শেষোক্ত হাদীসটিতে কেবল ঈমান থাকলেও জাহান্নামী হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
২.খারেজীরা আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘনকারীকে কাফিরদের মতো চিরস্থায় জাহান্নামী মনে করে থাকে।
অথচ উক্ত হাদীসে নেক কাজহীন ব্যক্তিদের আল্লাহর অনুগ্রহে অবশেষে জান্নাতে যাওয়াটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। তাছাড়া আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদার পক্ষে নিচের সহীহ হাদীসটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উবাদা ইবনু সামিত (রা) বলেছেন :
كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِى مَجْلِسٍ فَقَالَ تُبَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَعُوقِبَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَسَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ فَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ .
‘‘আমরা কোন বৈঠকে রসূলুল্লাহ (স) এর সঙ্গে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন : তোমরা আমার কাছে এ বলে বায়য়াত গ্রহণ কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, যিনা করবে, চুরি করবে না এবং কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে (অর্থাৎ ক্বিসাসের কারণে)। অতএব, তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তা পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাবে। আর যদি কেউ উক্ত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে, তবে তাই তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যদি কোন ব্যক্তি উল্লিখিত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয় অতঃপর আল্লাহ তাআলা তা গোপন রাখেন, তবে বিষয়টি মহান আল্লাহ’র এখতিয়ারে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩৫৫ (৪৩/১৭০৯)- কিতাবুল হুদূদ باب الحدود كفارات لاهلها ]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- উবাদা (রা) বলেন : আমরা এ সকল কথার উপর তাঁর হাতে বায়আত করলাম।’’ [সহীহ বুখারী ১৮, সহীহ মুসলিম ৪৩৫৩ (৪১/১৭০৯), মিশকাত ১৮]
৪.হত্যাকারী ও সুদখোরো চিরস্থায়ী (!?) জাহান্নামী হওয়া
পূর্বের হাদীসটির বিপরিতে মু‘তাযিলা ও খারেজীদের দলিল হল :
ক. আল্লাহ তাআলা হত্যাকারী [. হত্যাকারীসম্পর্কিত আয়াত: আল্লাহ তাআলা বলেন : وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا .‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাক্রমে মু’মিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম- তাতে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে লা‘নত করেছেন এবং তার জন্যে রয়েছে ভয়ানক আযাব।’’ [সূরা নিসা : ৯৩ আয়াত]] এবং
খ. সুদখোরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলেছেন। [. সুদখোরসম্পর্কিত আয়াত : আল্লাহ তাআলা বলেন : وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُون ‘‘(সুদ হারাম ঘোষণার পর) যে পুনরায় করবে, সে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।’’ [সূরা বাক্বারাহ : ২৭৫]অতঃপর আল্লাহ তাআলা সুদের মধ্যে ফিরে যাওয়াকে কুফরির পাপ বলেছেন : يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ‘‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন ও দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ কোনো অধিক কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।’’ [সূরা বাক্বারাহ : ২৭৬]]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় এই দুটি কবীরা গুনাহকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং সে কাফির।
জবাব : পূর্বে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসটির মূলনীতির আলোকে বুঝা যায়, সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহকারীদের আল্লাহ ইচ্ছা করলে জাহান্নামে দিতে পারেন আবার ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন। তা ছাড়া হাদীসটির মতো কুরআনেও মু’মিনের পাপের কাফফারার কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنْثَى بِالْأُنْثَى فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَلِكَ تَخْفِيفٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ فَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘হে মু’মিনগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য ক্বিসাসের বিধান দেয়া হয়েছে, স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস এবং নারীর বদলে নারী; তবে যাকে তার ভাইদের পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, তখন যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও ইহসানের সাথে তা আদায় করা। এ বিধি তোমাদের রবের পক্ষ হতে সহজ ব্যবস্থা ও অনুগ্রহ। এরপরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব। ’’ [সূরা বাক্বারাহ : ১৭৮ আয়াত]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ
‘‘যে ব্যক্তি (ক্বিসাসের) শাস্তি সাদক্বা করে দেবে তা তার জন্য কাফফারায় পরিণত হবে।’’ (সূরা মায়িদা : ৪৫ আয়াত)
অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
مَنْ جُرِحَ فِي جَسَدِهِ جِرَاحَةً فَتَصَدَّقَ بِهَا كَفَّرَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَنْهُ بِمِثْلِ مَا تَصَدَّقَ بِهِ
‘‘যার শরীরে কোন আঘাত করা হয়েছে এবং সে তা সাদাক্বা (মাফ) করে দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা যে পর্যায়ের ক্ষমা হবে ঠিক একই পর্যায়ের গোনাহ মাফ করা হবে।’’ [মুসনাদে আহমাদ, শুআয়েব আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ ৫/২২৮৪৪ নং)।]
উক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে মানুষের অধিকার সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ তথা হত্যার ব্যাপারটিই মানুষ দ্বারাও যখন ক্ষমাযোগ্য। তখন অন্যান্য কবীরা গোনাহর ক্ষেত্রেও ঐ নীতিই প্রযোজ্য যা পূর্বে সহীহ মুসলিমের উবাদা ইবনু সামিত (রা) -এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী যথাযথ শাস্তি ভোগ বা মেয়াদের পর কেবল ঈমানের বদৌলতে জান্নাতী হওয়া সম্পর্কিত হাদীসগুলোও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ এক্ষেত্রে উক্ত আমলটি আমলী কুফর, আক্বীদাগত কুফর নয়।
চিরস্থায়ী জাহান্নামী ঘোষণার পরও কেবল মু’মিনদের জন্য
ব্যতিক্রম সিদ্ধান্তের ঘোষণা রয়েছে
হত্যা ও সুদের আয়াতে উক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চিরস্থায়ী জাহান্নামীদের সম্পর্কে ব্যতিক্রম ইচ্ছাও প্রকাশ করবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ ﴿۱ ٠٦﴾ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ﴿۱ ٠٧﴾ وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۖ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ .
‘‘অতএব যারা হতভাগ্য তারা থাকবে আগুনে (জাহান্নামে) এবং সেখানে তাদের জন্য থাকবে চিৎকার ও আর্তনাদ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে, যতদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, যদি না আপনার রব অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; আপনার রব যা চান তা-ই করেন। পক্ষান্তরে যারা ভাগ্যবান তারা থাকবে জান্নাতে, সেখানে তারা স্থায়ী হবে : যতদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, যদি না আপনার রব অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; এটা এক নিরবিচ্ছিন্ন পুরস্কার।’’ [সূরা হুদ : ১০৬-১০৮ আয়াত]
এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
لَيُصِيبَنَّ أَقْوَامًا سَفْعٌ مِنْ النَّارِ بِذُنُوبٍ أَصَابُوهَا عُقُوبَةً ثُمَّ يُدْخِلُهُمْ اللَّهُ الْجَنَّةَ بِفَضْلِ رَحْمَتِهِ يُقَالُ لَهُمْ الْجَهَنَّمِيُّونَ .
‘‘অনেকগুলো ক্বওমকে তাদের গুনাহর কারণে শাস্তি হিসেবে জাহান্নামের তাপে দগ্ধ করা হবে। অতঃপর আল্লাহ নিজ রহমতে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তাদেরকে জাহান্নামী বলে সম্বোধন করা হবে।’’ [সহীহ বুখারী হা/৭৪৫০, অনুরূপ হা/৬৫৫৯]
পূর্বোক্ত আয়াতে জাহান্নামবাসীদের সেখানে চিরস্থায়ী ঘোষণার পর আল্লাহ তাআলা’র বাণী : إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ‘‘যদি না আপনার রব অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; আপনার রব যা ইচ্ছা তা-ই করেন’’-এর তাফসীরে সালাহুদ্দিন ইউসুফ ‘তাফসীরে আহসানুল বায়ানে’ লিখেছেন :
‘‘এই ব্যতিক্রমের কয়েকটি অর্থ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহীহ অর্থ হল- এই ব্যতিক্রম ঐ সমস্ত গুনাহগারের জন্য, যার তাওহিদবাদী ও ঈমানদার হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতে উল্লিখিত شقى (হতভাগা) শব্দের দাবি ‘আম (ব্যাপকার্থক)। অর্থাৎ কাফির ও মু’মিন পাপী উভয়েই এর অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَۚ দ্বারা মু’মিন পাপী ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য। এখানে ما شاء এর ما এর অর্থ من (যে বা যারা)।’’ [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, তাফসীরে আহসানুল বয়ান (সৌদি আরব : শাহ ফাহদ কুরআনে কারীম প্রিন্টিং কমপেস্নক্স), আলোচ্য আয়াতের তাফসীর। আরও দ্র : : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার অনুবাদ ও তাফসীর (কুরআনুল কারীম : বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর, খাদেমুল হারামাইন আশ-শরীফাইন বাদশাহ সালমান ইবনু আব্দুল আজিজ আলে সউদ-এর পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ১৪৩৬ হিজরি- আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দ্র :)]]
কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ۚ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا .
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ করে।’’ [ সূরা নিসা : ৪৮ আয়াত]
মুত্তাক্বীদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো
যদি সূরা হুদের ১০৭ নং আয়াতটির শেষাংশের দাবি কাফিরদের সাথে হতো, অর্থাৎ ‘জাহান্নামে যাওয়ার পর পুনরায় জান্নাতে যাওয়া’, তা হলে عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذ ‘‘এটা এক নিবিচ্ছিন্ন পুরস্কার’’-বাক্যটি আসত না। কেননা মু’মিনদেরকেই কেবল জাহান্নাম থেকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَعِيمٍ (۱٧) فَاكِهِينَ بِمَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ وَوَقَاهُمْ رَبُّهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ .
‘‘নিশ্চয় মুত্তাক্বীগণ থাকবে জান্নাতে ও নিয়ামতের মধ্যে। তারা উপভোগ করবে যা তাদের রব তাদেরকে দেবেন এবং তিনি জাহান্নামের আযাব থেকে তাদের রক্ষা করবেন।’’ [সূরা তুর : ১৭-১৮ আয়াত]
অন্যত্র মু’মিনদের জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَا يَذُوقُونَ فِيهَا الْمَوْتَ إِلَّا الْمَوْتَةَ الْأُولَىٰ ۖ وَوَقَاهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ .
‘‘তারা সেখানে মৃত্যুর স্বাদ পাবে না, প্রথম মৃত্যু ব্যতীত এবং আপনার রব তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করবেন।’’ [সূরা দুখান : ৫৬ আয়াত]
এই দুটি আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয়, আল্লাহ তাআলা নিজের অনুগ্রহে মুত্তাক্বীদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন, যা খারেজী ও মু’তাযিলা আক্বীদার সম্পূর্ণ বিরোধী।
অপর একটি আয়াত ও হাদীসের সম্মিলিত দাবি থেকে জানা যায়। কাফিররা জাহান্নামী মু’মিনদের দেখে টিটকারী দিলে তখন আল্লাহ তাআলা মু’মিন জাহান্নামীদেরকে সেখান থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে নেবেন। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন :
رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ .
‘‘(যখন) সময় আসবে কাফিররা কামনা করবে যে যদি তারা মুসলিম হতো।’’ [সূরা হিজর : ২ আয়াত]
আয়াতটির ব্যাখ্যায় রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
يُخْرِجُ اللَّهُ أُنَاسًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ مِنَ النَّارِ بَعْدَمَا يَأْخُذُ نِقْمَتَهُ مِنْهُمْ، قَالَ : لَمَّا أَدْخَلَهُمُ اللَّهُ النَّارَ مَعَ الْمُشْرِكِينَ، قَالَ الْمُشْرِكُونَ : أَلَيْسَ كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ فِي الدُّنْيَا أَنَّكُمْ أَوْلِيَاءُ، فَمَا لَكُمْ مَعَنَا فِي النَّارِ؟ فَإِذَا سَمِعَ اللَّهُ ذَلِكَ مِنْهُمْ، أَذِنَ فِي الشَّفَاعَةِ، فَيَتَشَفَّعُ لَهُمُ الْمَلائِكَةُ وَالنَّبِيُّونَ حَتَّى يَخْرُجُوا بِإِذْنِ اللَّهِ، فَلَمَّا أُخْرِجُوا، قَالُوا : يَا لَيْتَنَا كُنَّا مَثَلَهُمْ، فَتُدْرِكُنَا الشَّفَاعَةُ، فَنُخْرَجُ مِنَ النَّارِ، فَذَلِكَ قَوْلُ اللَّهِ جَلَّ وَعَلا : ف رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمَيْنِق، قَالَ : فَيُسَمَّوْنَ فِي الْجَنَّةِ الْجَهَنَّمِيِّينَ مِنْ أَجْلِ سَوَادٍ فِي وُجُوهِهِمْ، فَيَقُولُونَ : رَبَّنَا أَذْهِبْ عَنَّا هَذَا الاسْمَ، قَالَ : فَيَأْمُرُهُمْ فَيَغْتَسِلُونَ فِي نَهْرِ الْجَنَّةِ، فَيَذْهَبُ ذَلِكَ مِنْهُمْ .
‘‘আল্লাহ তাআলা কিছু মু’মিনকে তাদের শাস্তি ভোগের পর জাহান্নাম থেকে বের করবেন। (এর পূর্বে) যখন মুশরিকদের সাথে তাদেরকে জাহান্নামে দাখিল করবেন, তখন মুশরিকরা তাদেরকে বলবে, তোমরা তো দুনিয়াতে দাবি করতে যে, তোমরা দুনিয়াতে আল্লাহর ওলী (প্রিয়ভাজন) ছিলে। এখন কী হলো, আমাদের সাথে জাহান্নামে যে? আল্লাহ তাআলা এ কথা শুনে শাফাআতের অনুমতি দিবেন। তখন মালাইকা, নবীগণ এবং মু’মিনগণ তাদের জন্য শাফাআত করবেন। ফলে আল্লাহ তাআলা’র নির্দেশে তাদেরকে বের করা হবে। মুশরিকরা এটা দেখে বলবে : যদি আমরা তাদের মতো হতাম, তবে আমরা তাদের সাথে বের হতে পারতাম। তিনি বলেন : رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ আয়াতটিতে একথাই বলা হয়েছে। অতঃপর তাদের মুখম-ল কালো হওয়ার কারণে তারা জান্নাতের মধ্যে জাহান্নামী নামে পরিচিত হবে। তখন তারা আল্লাহর দরবারে আবেদন করবে, ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদের এই নামের কলঙ্ক মুছে দিন। তখন আল্লাহ তাদের আবেদন মঞ্জুর করবেন। এরপর তারা জান্নাতের নহরে গোসল করবে ও তাদের ঐ নাম মুছে যাবে।’’ [.সহীহ ইবনু হিব্বান- শায়েখ আলবানী (রহ) হাদীসটিকে সহীহ লি-গয়রিহি বলেছেন (আত-তা‘লিকাতুল হিসান আলা সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৭৩৮৯), শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) লিখেছেন : এটি তাবারানি তাঁর ‘আল-মু‘জামুল আওসাতে’ (৮১০৬) উল্লেখ করেছেন। এর সনদ হাসান। (তাহক্বীক্ব তাফসীরে ইবনু কাসির উর্দু আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দ্র :) হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত। ফলে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হাদীসটি হাসান বা সহীহ লি-গয়রিহি। বিস্তারিত : তাফসীরে ইবনু কাসির, তাফসীরে মাযহারি, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার অনুবাদ ও তাফসীর (কুরআনুল কারীম : বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর, খাদেমুল হারামাইন আশ-শরীফাইন বাদশাহ সালমান ইবনু আব্দুল আজিজ আলে সউদ-এর পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ১৪৩৬ হিজরি- আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দ্র :)]]
পক্ষান্তরে জাহান্নামকে কেবল কাফির মিথ্যারোপকারীদের চিরস্থায়ী আবাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا - لِلطَّاغِينَ مَآبًا لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًالَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا جَزَاءً وِفَاقًا انَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا كِذَّابًا
‘‘নিশ্চয় জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে, সীমালঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থলরূপে। তারা সেখানে অনন্তকাল (হুকবা সময়কাল) থাকবে। সেখানে তারা কোনো শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না। কিন্তু ফুটন্ত পানি ও পূঁজ পাবে। পরিপূর্ণ প্রতিফল হিসেবে। নিশ্চয় তারা হিসাব-নিকাশ আশা করত না এবং আমার আয়াতসমূহের প্রতি মিথ্যারোপ করত।’’ [সূরা নাবা : ২১-২৮]
সম্মানিত পাঠক, কিছু পূর্বে বর্ণিত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয়েছে- মু’মিনদের আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। আর শেষোক্ত আয়াতে প্রমাণিত হলো, আখিরাত অস্বীকারকারী তথা কাফিরদের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটি ঘটবে না। সুতরাং সূরা হুদের ১০৬-১০৮ নং আয়াতের জান্নাতী ও জাহান্নামীদের বর্ণনার পরে إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ (তবে, তোমার রব যা ইচ্ছা করেন)-এর ব্যতিক্রম ইচ্ছার দাবিটি কেবলই মু’মিনদের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
আবার অনেক সময় মু’মিন ও কাফিরকে এই আয়াতে একইভাবে ভয় দেখান হলেও পূর্ববর্তী আয়াত ও হাদীসের ন্যায় সেগুলোর ব্যাখ্যা নিতে হবে। যেমন, সুদ সম্পর্কে আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহ) লিখেছেন :
قوله تعالى : ﴿ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا﴾ معناه عند جميع المتأولين في الكفار ، ولهم قيل : ﴿فَلَهُ مَا سَلَفَ﴾ ولا يقال ذلك لمؤمن عاص بل ينقض بيعه ويرد فعله وإن كان جاهلا ، فلذلك قال ﷺ : " من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد ". لكن قد يأخذ العصاة في الربا بطرف من وعيد هذه الآية .
‘‘আল্লাহর বাণী- ‘এটা (সুদখোর শয়তানের আছরে পাগলের মতো হবে) এ জন্যে যে, তারা বলে : নিশ্চয় ক্রয়-বিক্রয় হল সুদের মতো’- প্রথম যুগের সমস্ত ব্যাখ্যাকারী আয়াতটির দাবি কাফিরদের সাথে গণ্য করেছেন। তাদেরকে বলা হয়েছে فَلَهُ مَا سَلَفَ ‘তাদের মধ্যে যারা চলে গেছে তারা ব্যতিক্রম’। কেননা গুনাহগার মু’মিনকে এভাবে বলা হয় না। বরং তার ক্রয়-বিক্রয় ভঙ্গ হয় এবং তার আমলটি বাতিল করা হয় - যদি সে অবগত না থাকে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : ‘যে এমন কোনো আমল করল যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই- তা রদ বা বাতিল।’ পক্ষান্তরে সুদ গ্রহণ করে পাপে লিপ্ত ছিল তাদের ক্ষেত্রে আয়াতটির ধমকি প্রযোজ্য।’’ [তাফসিরে কুরতুবি, আলোচ্য আয়াতের তাফসির দ্র :]
বুঝা যাচ্ছে, সুদ ও হত্যার আয়াতটি সম্পর্কে খারেজীরা যে অর্থ নিয়েছেন সেটা কুরআন থেকে কুরআন, কুরআন থেকে হাদীস সালাফদের তাফসীর অনুযায়ী ভুল তাফসীর।
[বিস্তারিত জানতে দেখুন : (১) ‘‘কবীরা গুনাহাগার মু‘মিন কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী?’’ (২) ‘‘কবীরা গুনাহগার মু’মিনের নাজাত ও শাফাত’’ -কামাল আহমাদ; আতিফা পাবলিকেশন্স, ঢাকা]
খারেজী ও মু’তাযিলাদের পক্ষ থেকে আরও একটি যুক্তি দেয়া হয়েছে যে, সুদখোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। (সূরা বাক্বারাহ : ১৭৯)
এর জবাব হল, মু’মিনের সাথে মু’মিনের যুদ্ধ ঘটতে পারে। [সূরা হুজুরাত : ৯]
রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَ تَرْجِعُنَّ بَعْدِيْ كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ ‘‘তোমরা আমার পরে পরস্পরের গর্দান উড়িয়ে কাফিরে পরিণত হয়ো না।’’ [সহীহ বুখারী ১২১, সহীহ মুসলিম ১২৬ (১১৮/৬৫), মিশকাত ৩৫৩৭]
বুঝা যাচ্ছে, এইসব বড় বড় ক্ষেত্রেও আমলটি আক্বীদাগত নয় বরং আমলগত কুফর। শেষোক্ত আয়াত ও হাদীসটি পরস্পরের ব্যাখ্যা।
পক্ষান্তরে যদি সুদকে অস্বীকার করে তাহলে সে নিশ্চিত কাফির। তাদের বিরুদ্ধে মুরতাদ-কাফির হিসেবে যুদ্ধ করতে হবে। যেভাবে আবূ বকর (রা) তাঁর খেলাফতের শুরুতে যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কেননা, অস্বীকারের দ্বারা কুফরটি আক্বীদা ও আমল উভয় কুফরে পরিণত হয়।
৫) আল-ওয়াল ওয়াল বারা (বন্ধুত্ব ও শত্রুতা) :
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘হে মুমিণগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।’’ [সূরা মায়েদা : ৫১]
এই আয়াতের আলোকে বলা হয়, যেসব ব্যক্তি বা শাসক বা দেশ কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে তারা কাফির হয়ে যায়। অথচ পরবর্তী আয়াত বলছে, আয়াতটি তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা আক্বীদার দিক থেকে মুনাফিক্ব :
فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَن تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ ۚ فَعَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِّنْ عِندِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنفُسِهِمْ نَادِمِينَ
‘‘বস্তুত যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌঁড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলে : আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই। অতএব, সেদিন দূরে নয়, যেদিন আল্লাহ তাআলা বিজয় প্রকাশ করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেবেন-ফলে তারা স্বীয় গোপন মনোভাবের জন্যে অনুতপ্ত হবে।’’ [সূরা মায়েদা : ৫২]
পরবর্তী দুটি আয়াতেও আক্বীদাগত মুনাফিক্বদের সাথে মু’মিনদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا أَهَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ ۙ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ ۚ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ [٥ : ٥٣ ] يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ [٥ : ٥٤ ]
‘‘মু’মিনরা বলবে : এরাই কি সেসব লোক, যারা আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করত যে, আমরা তোমাদের সাথে আছি? তাদের কৃতকর্মসমূহ বিফল হয়ে গেছে, ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে। হে মু’মিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।’’ [সূরা মায়েদা : ৫৩-৫৪]
ইমাম তাবারী (রহ) লিখেছেন :
غير أنه لا شك أن الآية نـزلت في منافق كان يوالي يهودًا أو نصارى خوفًا على نفسه من دوائر الدهر، لأن الآية التي بعد هذه تدلّ على ذلك، وذلك قوله : فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ الآية .
‘‘এতে কোন সংশয় নেই যে, আয়াতটি মুনাফিক্বদের সম্পর্ক নাযিল হয়েছে, যারা আগত দিনগুলোতে নিজেদের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকায় ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে আন্তরিক বন্ধু বানিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌঁড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলে : আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই। (সূরা মায়েদা : ৫২)।’’ [তাফসীরে ইবনু জারীর তাবারী. সূরা মায়েদা ৫১-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর]
এ থেকে বুঝা যায়, যেসব শাসক বা ব্যক্তি ইসলামের থেকে ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বেশি হক্ব মনে করে তাদেরকে আন্তরিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তারা কাফির। নবী (স) -এর যামানাতে আক্বীদাগত মুনাফিক্বদের সম্পর্কে ওহীর মাধ্যমে এভাবে জানিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানের মুনাফিক্বদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। যেমন, সাহাবী হুযায়ফা (রা) হতে বর্ণিত :
إِنَّمَا كَانَ النِّفَاقُ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ ﷺ فَأَمَّا الْيَوْمَ فَإِنَّمَا هُوَ الْكُفْرُ بَعْدَ الإِيمَانِ .
‘‘নিফাক বস্তুত নবী (স) -এর যুগে ছিল। আর এখন হল তা ঈমান গ্রহণের পর কুফর।’’ [সহীহ বুখারী ৭১১৪, মিশকাত ৬২]
এ কারণে ইবনু তাইমিয়া (রহ) ও কয়েকজন ইমাম আক্বীদাগত নিফাক্ব কেবল নবী (স) -এর যামানার সাথে খাস করেছেন। ঐ যামানার পরবর্তীদের ক্ষেত্রে কেবল আমলগত নিফাক্ব প্রযোজ্য করেছেন। কেননা, নবী (স)-এর যামানাতে ওহীর মাধ্যমে আক্বীদাগত মুনাফিক্বদের জানা যেত। আমাদের যামানাতে যা অসম্ভব। তবে এ যামানাতে এভাবে আক্বীদাগত নিফাক্ব বা কুফর স্পষ্ট হতে পারে, যখন ঐ ব্যক্তি নিজেই সেটা দাবি করে : আমি আক্বীদাগতভাবে কাফির বা মুনাফিক্ব।
সুতরাং যখন কোন শাসক বা ব্যক্তিবিশেষ নিজেকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে - তখন তাকে আক্বীদাগত কাফির বলা যাবে না। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَتَبَيَّنُواْ وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلاَمَ لَسْتَ مُؤْمِنًا
‘‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হবে তখন যাচাই করবে এবং যে তোমাদেরকে সালাম দেবে দুনিয়ার জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলবে না যে, ‘তুমি মু’মিন নও’।’’ [সূরা নিসা : ৯৪]
আয়াতটির শানে-নুযূল বলছে, যখন কাফিরদের হয়ে কেউ যুদ্ধ করতে আসে অতঃপর সালাম দেয় নিজেকে ‘মু’মিন’ হিসেবে পরিচয় দিতে। তখন তাকে হত্যা করা যাবে না, এমনকি সে মু’মিন কি না, এ ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। ঐ কাফিরর পক্ষে যুদ্ধকারী ছলনা করুক বা সত্যিই এখন মু’মিন হতে চায় - যেটিই হোক তাকে মু’মিন হিসেবেই মেনে নিতে হবে। ইমাম আদিল হাম্বলী (রহ) লিখেছেন :
موالاة الكافر تنقسم ثلاثة أقسامٍ . الأول : أن يَرْضَى بكفره ، ويُصَوِّبَه ، ويواليَه لأجْلِه ، فهذا كافر ؛ لأنه راضٍ بالكفر ومُصَوِّبٌ له . الثاني : المعاشرةُ الجميلةُ بحَسَب الظاهر ، وذلك غير ممنوع منه . الثالث : الموالاة ، بمعنى الركون إليهم ، والمعونة ، والنُّصْرة ، إما بسبب القرابة ، وإما بسبب المحبة مع اعتقاد أن دينَه باطل - فهذا منهيٌّ عنه ، ولا يوجب الكفر .
‘‘কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব তিন প্রকারে বিভক্ত : প্রথমত, যে (মুসলিম) তাদের কুফরকে মেনে নেয় এবং সঠিক মনে করে আর এ কারণেই তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে, এরা কাফির। কেননা সে কুফরের ব্যাপারে খুশি এবং সেটাকে সত্যায়নকারী। দ্বিতীয়ত, দুনিয়াবী সুবিধা অর্জনে বাহ্যিক সুন্দর লেনদেনের সম্পর্ক, এটা নিষিদ্ধ নয়। তৃতীয়ত, এমন বন্ধুত্ব যার ফলে তাদের উপর নির্ভর করা হয়, সহায়ক শক্তি হয়, সহযোগিতা করা হয়- সেটা তাদের নৈকট্য হাসিলের কারণে হোক, অথবা এই আক্বীদাসহ মুহাব্বাতের ভিত্তিতে যে, তাদের দ্বীন বাতিল; সেক্ষেত্রে এটা নিষিদ্ধ কিন্তু ওয়াজিব কুফর নয়।’’ [আল-লুবাব ফী উলূমুল কিতাব ৫/১৪৩ পৃ. সূরা আলে-ইমরানের ২৮ নং আয়াতের তাফসীর]
ইমাম রাযী (রহ)-ও প্রায় কাছাকাছি অর্থে উক্ত তিনটি ভাগ উল্লেখ করেছেন। [তাফসীরে রাযী (মাফাতিহুল গায়ব) সূরা আলে-ইমরানের ২৮ নং আয়াতের তাফসীর]
অপর একটি দিক :
উপকারের ক্ষেত্রে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব : এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের শাসকদের অধিকাংশ ইয়াহুদী ও নাসারাদের সাথে বন্ধুত্বের কারণ হল, তারা তাদের ভয় করে। অর্থাৎ তাদের টেকনোলজির ভয়, আরাম-আয়েশের আকাঙ্ক্ষা, অলসতা ও উদ্যমহীনতা, মৃত্যুর ভয়, মাল-সম্পদের মুহাব্বাত প্রভৃতির কারণে আমাদের শাসকরা তাদের শত্রু ইয়াহুদী-নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করে। এসব ক্ষেত্রে শাসকরা ফাসেক্ব ও মুনাফিক্ব, কিন্তু এমন কাফির নয় যে, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে নিজের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দিক লক্ষ রেখে কাফিরদের সাথে বাহ্যিক বন্ধুত্বের সম্পর্কের অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً ۗ وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ ۗ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ .
‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।’’ [সূরা আলে ইমরান : ২৮]
শাসকদের অন্তরে কাফির এবং ইয়াহুদী ও নাসারাদের ব্যাপারে যে ভয়-ভীতি, সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে - সেটা হওয়া উচিত কি না ? অথচ উক্ত আয়াতটিতে আত্মরক্ষার ব্যতিক্রম অনুমতিটির প্রেক্ষাপটে শাসককে তাকফীর করার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে। আয়াতটিতে ব্যবহৃত تقاة দ্বারা সালাফগণ তাক্বীয়া ও ভয় উভয় অর্থ নেন। ইমাম শানকীতি মালিকী (রহ) বলেছেন : যদি শত্রুর ভয়ে কোন মুসলিম তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা জায়েয। তিনি সূরা মায়িদা’র ৫১ নং আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন :
وبين في موضع آخر : أن محل ذلك، فيما إذا لم تكن الموالاة بسبب خوف، وتقية، وإن كانت بسبب ذلك فصاحبها معذور، وهو قوله تعالى : ﴿لا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً﴾ ]٣/ ٢٨ ] ، فهذه الآية الكريمة فيها بيان لكل الآيات القاضية بمنع موالاة الكفار مطلقاً وإيضاح، لأن محل ذلك في حالة الاختيار، وأما عند الخوف والتقية، فيرخص في موالاتهم، بقدر المداراة التي يكتفي بها شرهم، .
‘‘অন্যত্র আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন যে, যদি (ইয়াহুদী ও নাসারাদের সাথে) বন্ধুত্বের নিষেধাজ্ঞা ভয় ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে না হলে প্রযোজ্য। আর যদি এ (ভয় ও বেঁচে থাকার) কারণে হয় তবে ব্যক্তি মা‘যুর। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।’ [সূরা আলে ইমরান : ২৮] এই আয়াতে কারিমাটি কাফিরদের সাথে উন্মুক্ত ও সুস্পষ্ট বন্ধুত্বের নিষেধাজ্ঞার ফায়াসালাকারী আয়াত হিসেবে সুস্পষ্ট করে। কেননা সেক্ষেত্রে বন্ধুত্বটি হবে উপায়হীন অবস্থাতে ভয় ও বেঁচে থাকার দাবিতে, ফলে সেক্ষেত্রে তাদের সাথে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ছাড় রয়েছে, সামর্থ্যানুযায়ী কোমল আচরণ দ্বারা যা তাদের ক্ষতি মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে।... ’’ [আযওয়াউল বায়ান সূরা মায়েদা’র ৫১ নং আয়াতের তাফসীর]
কাফিদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ হলেও দুনিয়াবী লেনদেন বৈধ : এ মর্মে আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে :
تُوُفِّيَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَدِرْعُهُ مَرْهُوْنَةٌ عِنْدَ يَهُوْدِيٍّ بِثَلَاثِيْنَ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ
‘‘নবী (স) -এর মৃত্যুর সময় তাঁর বর্মটি ত্রিশ সা’ যব-এর বিনিময়ে এক ইয়াহূদীর নিকট বন্ধক ছিল।’’ [সহীহ বুখারী ২৯১৬]
যুদ্ধ করে না এমন কাফিরদের সাথে সুন্দর ব্যবহার বৈধ :
لَا یَنۡهٰىکُمُ اللّٰهُ عَنِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یُقَاتِلُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ لَمۡ یُخۡرِجُوۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ اَنۡ تَبَرُّوۡهُمۡ وَ تُقۡسِطُوۡۤا اِلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ ﴿۸﴾
‘‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখাতে ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।’’ [সূরা মুমতাহিনা : ৮ আয়াত]
مَا مِنْ نَّبِىٍّ بَعْثَهُ اللهُ فِىْ اُمَّةٍ قَبْلِىْ اِلاَّ كَانَ لَه ও فِى اُمَّتِه حَوَارِيُّوْنَ وَاَصْحَابٌ يَّاخُذُوْنَ بِسُنَّتِه وَيَقْتَدُوْنَ بِاَمْرِه ثُمَّ اِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوْفٌ يَّقُوْلُوْنَ مَا لاَ يَفْعَلُوْنَ وَيَفْعُلَوْنَ مَا لاَ يُؤْمَرُوْنَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِه فَهُوَ مَؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِه فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَ هُمْ بِقَلْبِه فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذلِكَ مِنَ الْاِيْمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ ـ
‘‘আল্লাহ তাআলা আমার পূর্বে যে সব নবী (স)-কে তাঁর উম্মাতের জন্য পাঠিয়েছিলেন, ঐ উম্মাতের মধ্যে তাঁর জন্য সাহায্যকারী ও সাহাবীগণ ছিলেন। যারা তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করতেন ও তাঁর হুকুম মেনে চলতেন। তাদের পরে ঐ সমস্ত খারাপ লোকের উদ্ভব হতো যারা এমন কথা বলত যার উপর আমল করত না। আর তাদের যে বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়নি, তার উপর আমল করত। যে ব্যক্তি ঐ সমস্ত লোকদের সাথে হাত দ্বারা জিহাদ করে সে মু’মিন, যে যবান দ্বারা জিহাদ করে সেও মু’মিন, আর যে অন্তর দ্বারা জিহাদ করে সেও মু’মিন। অন্যথায় এর বাইরে তিল দানা পরিমাণ ঈমানের অস্তিত্বও নেই।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৮৩ (৮০/৫০), মিশকাত ১৫৭ ।]
এই শেষোক্ত হাদীসটিতেও ক্বলব তথা অন্তরের কার্যকারীতাকে স্বীকার করে তাকে সর্বশেষ ঈমানের অস্তিত্ব বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যা আহলে সুন্নাতের আক্বীদাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। পক্ষান্তরে খারেজীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
সংশয় : অনেকে এ ক্ষেত্রে বলতে পারেন, আলোচ্য হাদীসটিতো উপায়হীন অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যখন পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে তখন কেবল অন্তরের কার্যকারিতা গ্রহণযোগ্য নয়।
জবাব : হাদীসটিতে অন্তরের উক্ত কার্যকারিতাকে দুর্বল ঈমান বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ ঈমানের সর্বশেষ অবস্থা। সুতরাং যখন শরীআত নিজেই তা স্বীকৃতি দেয় তখন তা অস্বীকার করা প্রকারান্তরে ‘‘আল্লাহর বিধানকেই অস্বীকার করা’’। যা কুফরে ই‘তিক্বাদী বা আক্বীদাগত কুফরের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া যারা ঈমানী দুর্বলতা ও অন্যান্য কারণে আমলগতভাবে চরম পাপী হিসাবে গণ্য হবে তাদের আখিরাতের পরিস্থিতি সম্পর্কেও হাদীসে সু্স্পষ্ট বর্ণনা আছে। যেমন- সমস্ত নবী-রসূলদের শাফায়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা বলবেন :
شُفِّعَتِ الْمَلَائِكَةُ وَشُفِّعَ النَّبِيُّونَ وَشُفِّعَ الْمُؤْمِنُونَ وَلَمْ يَبْقَ إِلَّا أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ فَيَقْبِضُ قَبْضَةً مِنَ النَّارِ فَيُخْرِجُ مِنْهَا قَوْمًا لَمْ يَعْمَلُوا خَيْرًا
‘‘মালাইকাগণ, নবীগণ ও মুমীনগণ সবাই শাফায়ত করেছেন, এখন এক আর-রহমানুর রহিমীন ছাড়া কেউ বাকি নেই। এই বলে তিনি মুষ্টিভরে এমন একদল লোককে জাহান্নাম থেকে বের করবেন যারা কখনো কোন নেক কাজ করেনি’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৩৪৩ (৩০২/১৮৩), মিশকাত ৫৫৭৯।]
উপরিউক্ত হাদীসগুলো মুরজিয়া ও খারেজী উভয় ফিতনাকে খণ্ডন করে। কেননা-
১.মুরজিয়াদের দাবি হল, কেবল ঈমান থাকাই জান্নাতের যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। অথচ শেষোক্ত হাদীসটিতে কেবল ঈমান থাকলেও জাহান্নামী হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
২.খারেজীরা আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘনকারীকে কাফিরদের মতো চিরস্থায় জাহান্নামী মনে করে থাকে।
অথচ উক্ত হাদীসে নেক কাজহীন ব্যক্তিদের আল্লাহর অনুগ্রহে অবশেষে জান্নাতে যাওয়াটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। তাছাড়া আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদার পক্ষে নিচের সহীহ হাদীসটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উবাদা ইবনু সামিত (রা) বলেছেন :
كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِى مَجْلِسٍ فَقَالَ تُبَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَعُوقِبَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَسَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ فَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ .
‘‘আমরা কোন বৈঠকে রসূলুল্লাহ (স) এর সঙ্গে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন : তোমরা আমার কাছে এ বলে বায়য়াত গ্রহণ কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, যিনা করবে, চুরি করবে না এবং কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে (অর্থাৎ ক্বিসাসের কারণে)। অতএব, তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তা পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাবে। আর যদি কেউ উক্ত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে, তবে তাই তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যদি কোন ব্যক্তি উল্লিখিত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয় অতঃপর আল্লাহ তাআলা তা গোপন রাখেন, তবে বিষয়টি মহান আল্লাহ’র এখতিয়ারে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩৫৫ (৪৩/১৭০৯)- কিতাবুল হুদূদ باب الحدود كفارات لاهلها ]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- উবাদা (রা) বলেন : আমরা এ সকল কথার উপর তাঁর হাতে বায়আত করলাম।’’ [সহীহ বুখারী ১৮, সহীহ মুসলিম ৪৩৫৩ (৪১/১৭০৯), মিশকাত ১৮]
৪.হত্যাকারী ও সুদখোরো চিরস্থায়ী (!?) জাহান্নামী হওয়া
পূর্বের হাদীসটির বিপরিতে মু‘তাযিলা ও খারেজীদের দলিল হল :
ক. আল্লাহ তাআলা হত্যাকারী [. হত্যাকারীসম্পর্কিত আয়াত: আল্লাহ তাআলা বলেন : وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا .‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাক্রমে মু’মিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম- তাতে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে লা‘নত করেছেন এবং তার জন্যে রয়েছে ভয়ানক আযাব।’’ [সূরা নিসা : ৯৩ আয়াত]] এবং
খ. সুদখোরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলেছেন। [. সুদখোরসম্পর্কিত আয়াত : আল্লাহ তাআলা বলেন : وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُون ‘‘(সুদ হারাম ঘোষণার পর) যে পুনরায় করবে, সে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে সে চিরকাল থাকবে।’’ [সূরা বাক্বারাহ : ২৭৫]অতঃপর আল্লাহ তাআলা সুদের মধ্যে ফিরে যাওয়াকে কুফরির পাপ বলেছেন : يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ ‘‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন ও দানকে বর্ধিত করেন। আর আল্লাহ কোনো অধিক কুফরকারী পাপীকে ভালবাসেন না।’’ [সূরা বাক্বারাহ : ২৭৬]]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় এই দুটি কবীরা গুনাহকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং সে কাফির।
জবাব : পূর্বে সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসটির মূলনীতির আলোকে বুঝা যায়, সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহকারীদের আল্লাহ ইচ্ছা করলে জাহান্নামে দিতে পারেন আবার ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন। তা ছাড়া হাদীসটির মতো কুরআনেও মু’মিনের পাপের কাফফারার কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنْثَى بِالْأُنْثَى فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَلِكَ تَخْفِيفٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ فَمَنِ اعْتَدَى بَعْدَ ذَلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘হে মু’মিনগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য ক্বিসাসের বিধান দেয়া হয়েছে, স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস এবং নারীর বদলে নারী; তবে যাকে তার ভাইদের পক্ষ থেকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, তখন যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও ইহসানের সাথে তা আদায় করা। এ বিধি তোমাদের রবের পক্ষ হতে সহজ ব্যবস্থা ও অনুগ্রহ। এরপরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব। ’’ [সূরা বাক্বারাহ : ১৭৮ আয়াত]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ
‘‘যে ব্যক্তি (ক্বিসাসের) শাস্তি সাদক্বা করে দেবে তা তার জন্য কাফফারায় পরিণত হবে।’’ (সূরা মায়িদা : ৪৫ আয়াত)
অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
مَنْ جُرِحَ فِي جَسَدِهِ جِرَاحَةً فَتَصَدَّقَ بِهَا كَفَّرَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَنْهُ بِمِثْلِ مَا تَصَدَّقَ بِهِ
‘‘যার শরীরে কোন আঘাত করা হয়েছে এবং সে তা সাদাক্বা (মাফ) করে দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা যে পর্যায়ের ক্ষমা হবে ঠিক একই পর্যায়ের গোনাহ মাফ করা হবে।’’ [মুসনাদে আহমাদ, শুআয়েব আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ ৫/২২৮৪৪ নং)।]
উক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে মানুষের অধিকার সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ তথা হত্যার ব্যাপারটিই মানুষ দ্বারাও যখন ক্ষমাযোগ্য। তখন অন্যান্য কবীরা গোনাহর ক্ষেত্রেও ঐ নীতিই প্রযোজ্য যা পূর্বে সহীহ মুসলিমের উবাদা ইবনু সামিত (রা) -এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী যথাযথ শাস্তি ভোগ বা মেয়াদের পর কেবল ঈমানের বদৌলতে জান্নাতী হওয়া সম্পর্কিত হাদীসগুলোও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ এক্ষেত্রে উক্ত আমলটি আমলী কুফর, আক্বীদাগত কুফর নয়।
চিরস্থায়ী জাহান্নামী ঘোষণার পরও কেবল মু’মিনদের জন্য
ব্যতিক্রম সিদ্ধান্তের ঘোষণা রয়েছে
হত্যা ও সুদের আয়াতে উক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চিরস্থায়ী জাহান্নামীদের সম্পর্কে ব্যতিক্রম ইচ্ছাও প্রকাশ করবেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ ﴿۱ ٠٦﴾ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ﴿۱ ٠٧﴾ وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۖ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ .
‘‘অতএব যারা হতভাগ্য তারা থাকবে আগুনে (জাহান্নামে) এবং সেখানে তাদের জন্য থাকবে চিৎকার ও আর্তনাদ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে, যতদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, যদি না আপনার রব অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; আপনার রব যা চান তা-ই করেন। পক্ষান্তরে যারা ভাগ্যবান তারা থাকবে জান্নাতে, সেখানে তারা স্থায়ী হবে : যতদিন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, যদি না আপনার রব অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; এটা এক নিরবিচ্ছিন্ন পুরস্কার।’’ [সূরা হুদ : ১০৬-১০৮ আয়াত]
এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
لَيُصِيبَنَّ أَقْوَامًا سَفْعٌ مِنْ النَّارِ بِذُنُوبٍ أَصَابُوهَا عُقُوبَةً ثُمَّ يُدْخِلُهُمْ اللَّهُ الْجَنَّةَ بِفَضْلِ رَحْمَتِهِ يُقَالُ لَهُمْ الْجَهَنَّمِيُّونَ .
‘‘অনেকগুলো ক্বওমকে তাদের গুনাহর কারণে শাস্তি হিসেবে জাহান্নামের তাপে দগ্ধ করা হবে। অতঃপর আল্লাহ নিজ রহমতে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তাদেরকে জাহান্নামী বলে সম্বোধন করা হবে।’’ [সহীহ বুখারী হা/৭৪৫০, অনুরূপ হা/৬৫৫৯]
পূর্বোক্ত আয়াতে জাহান্নামবাসীদের সেখানে চিরস্থায়ী ঘোষণার পর আল্লাহ তাআলা’র বাণী : إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ‘‘যদি না আপনার রব অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; আপনার রব যা ইচ্ছা তা-ই করেন’’-এর তাফসীরে সালাহুদ্দিন ইউসুফ ‘তাফসীরে আহসানুল বায়ানে’ লিখেছেন :
‘‘এই ব্যতিক্রমের কয়েকটি অর্থ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহীহ অর্থ হল- এই ব্যতিক্রম ঐ সমস্ত গুনাহগারের জন্য, যার তাওহিদবাদী ও ঈমানদার হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতে উল্লিখিত شقى (হতভাগা) শব্দের দাবি ‘আম (ব্যাপকার্থক)। অর্থাৎ কাফির ও মু’মিন পাপী উভয়েই এর অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَۚ দ্বারা মু’মিন পাপী ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য। এখানে ما شاء এর ما এর অর্থ من (যে বা যারা)।’’ [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, তাফসীরে আহসানুল বয়ান (সৌদি আরব : শাহ ফাহদ কুরআনে কারীম প্রিন্টিং কমপেস্নক্স), আলোচ্য আয়াতের তাফসীর। আরও দ্র : : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার অনুবাদ ও তাফসীর (কুরআনুল কারীম : বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর, খাদেমুল হারামাইন আশ-শরীফাইন বাদশাহ সালমান ইবনু আব্দুল আজিজ আলে সউদ-এর পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ১৪৩৬ হিজরি- আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দ্র :)]]
কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ۚ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا .
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ করে।’’ [ সূরা নিসা : ৪৮ আয়াত]
মুত্তাক্বীদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো
যদি সূরা হুদের ১০৭ নং আয়াতটির শেষাংশের দাবি কাফিরদের সাথে হতো, অর্থাৎ ‘জাহান্নামে যাওয়ার পর পুনরায় জান্নাতে যাওয়া’, তা হলে عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذ ‘‘এটা এক নিবিচ্ছিন্ন পুরস্কার’’-বাক্যটি আসত না। কেননা মু’মিনদেরকেই কেবল জাহান্নাম থেকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَعِيمٍ (۱٧) فَاكِهِينَ بِمَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ وَوَقَاهُمْ رَبُّهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ .
‘‘নিশ্চয় মুত্তাক্বীগণ থাকবে জান্নাতে ও নিয়ামতের মধ্যে। তারা উপভোগ করবে যা তাদের রব তাদেরকে দেবেন এবং তিনি জাহান্নামের আযাব থেকে তাদের রক্ষা করবেন।’’ [সূরা তুর : ১৭-১৮ আয়াত]
অন্যত্র মু’মিনদের জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَا يَذُوقُونَ فِيهَا الْمَوْتَ إِلَّا الْمَوْتَةَ الْأُولَىٰ ۖ وَوَقَاهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ .
‘‘তারা সেখানে মৃত্যুর স্বাদ পাবে না, প্রথম মৃত্যু ব্যতীত এবং আপনার রব তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করবেন।’’ [সূরা দুখান : ৫৬ আয়াত]
এই দুটি আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয়, আল্লাহ তাআলা নিজের অনুগ্রহে মুত্তাক্বীদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন, যা খারেজী ও মু’তাযিলা আক্বীদার সম্পূর্ণ বিরোধী।
অপর একটি আয়াত ও হাদীসের সম্মিলিত দাবি থেকে জানা যায়। কাফিররা জাহান্নামী মু’মিনদের দেখে টিটকারী দিলে তখন আল্লাহ তাআলা মু’মিন জাহান্নামীদেরকে সেখান থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতে নেবেন। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন :
رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ .
‘‘(যখন) সময় আসবে কাফিররা কামনা করবে যে যদি তারা মুসলিম হতো।’’ [সূরা হিজর : ২ আয়াত]
আয়াতটির ব্যাখ্যায় রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
يُخْرِجُ اللَّهُ أُنَاسًا مِنَ الْمُؤْمِنِينَ مِنَ النَّارِ بَعْدَمَا يَأْخُذُ نِقْمَتَهُ مِنْهُمْ، قَالَ : لَمَّا أَدْخَلَهُمُ اللَّهُ النَّارَ مَعَ الْمُشْرِكِينَ، قَالَ الْمُشْرِكُونَ : أَلَيْسَ كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ فِي الدُّنْيَا أَنَّكُمْ أَوْلِيَاءُ، فَمَا لَكُمْ مَعَنَا فِي النَّارِ؟ فَإِذَا سَمِعَ اللَّهُ ذَلِكَ مِنْهُمْ، أَذِنَ فِي الشَّفَاعَةِ، فَيَتَشَفَّعُ لَهُمُ الْمَلائِكَةُ وَالنَّبِيُّونَ حَتَّى يَخْرُجُوا بِإِذْنِ اللَّهِ، فَلَمَّا أُخْرِجُوا، قَالُوا : يَا لَيْتَنَا كُنَّا مَثَلَهُمْ، فَتُدْرِكُنَا الشَّفَاعَةُ، فَنُخْرَجُ مِنَ النَّارِ، فَذَلِكَ قَوْلُ اللَّهِ جَلَّ وَعَلا : ف رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمَيْنِق، قَالَ : فَيُسَمَّوْنَ فِي الْجَنَّةِ الْجَهَنَّمِيِّينَ مِنْ أَجْلِ سَوَادٍ فِي وُجُوهِهِمْ، فَيَقُولُونَ : رَبَّنَا أَذْهِبْ عَنَّا هَذَا الاسْمَ، قَالَ : فَيَأْمُرُهُمْ فَيَغْتَسِلُونَ فِي نَهْرِ الْجَنَّةِ، فَيَذْهَبُ ذَلِكَ مِنْهُمْ .
‘‘আল্লাহ তাআলা কিছু মু’মিনকে তাদের শাস্তি ভোগের পর জাহান্নাম থেকে বের করবেন। (এর পূর্বে) যখন মুশরিকদের সাথে তাদেরকে জাহান্নামে দাখিল করবেন, তখন মুশরিকরা তাদেরকে বলবে, তোমরা তো দুনিয়াতে দাবি করতে যে, তোমরা দুনিয়াতে আল্লাহর ওলী (প্রিয়ভাজন) ছিলে। এখন কী হলো, আমাদের সাথে জাহান্নামে যে? আল্লাহ তাআলা এ কথা শুনে শাফাআতের অনুমতি দিবেন। তখন মালাইকা, নবীগণ এবং মু’মিনগণ তাদের জন্য শাফাআত করবেন। ফলে আল্লাহ তাআলা’র নির্দেশে তাদেরকে বের করা হবে। মুশরিকরা এটা দেখে বলবে : যদি আমরা তাদের মতো হতাম, তবে আমরা তাদের সাথে বের হতে পারতাম। তিনি বলেন : رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ كَانُوا مُسْلِمِينَ আয়াতটিতে একথাই বলা হয়েছে। অতঃপর তাদের মুখম-ল কালো হওয়ার কারণে তারা জান্নাতের মধ্যে জাহান্নামী নামে পরিচিত হবে। তখন তারা আল্লাহর দরবারে আবেদন করবে, ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদের এই নামের কলঙ্ক মুছে দিন। তখন আল্লাহ তাদের আবেদন মঞ্জুর করবেন। এরপর তারা জান্নাতের নহরে গোসল করবে ও তাদের ঐ নাম মুছে যাবে।’’ [.সহীহ ইবনু হিব্বান- শায়েখ আলবানী (রহ) হাদীসটিকে সহীহ লি-গয়রিহি বলেছেন (আত-তা‘লিকাতুল হিসান আলা সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৭৩৮৯), শায়খ যুবায়ের আলী যাঈ (রহ) লিখেছেন : এটি তাবারানি তাঁর ‘আল-মু‘জামুল আওসাতে’ (৮১০৬) উল্লেখ করেছেন। এর সনদ হাসান। (তাহক্বীক্ব তাফসীরে ইবনু কাসির উর্দু আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দ্র :) হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত। ফলে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হাদীসটি হাসান বা সহীহ লি-গয়রিহি। বিস্তারিত : তাফসীরে ইবনু কাসির, তাফসীরে মাযহারি, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার অনুবাদ ও তাফসীর (কুরআনুল কারীম : বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর, খাদেমুল হারামাইন আশ-শরীফাইন বাদশাহ সালমান ইবনু আব্দুল আজিজ আলে সউদ-এর পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ১৪৩৬ হিজরি- আলোচ্য আয়াতের তাফসীর দ্র :)]]
পক্ষান্তরে জাহান্নামকে কেবল কাফির মিথ্যারোপকারীদের চিরস্থায়ী আবাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا - لِلطَّاغِينَ مَآبًا لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًالَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا جَزَاءً وِفَاقًا انَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا كِذَّابًا
‘‘নিশ্চয় জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে, সীমালঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থলরূপে। তারা সেখানে অনন্তকাল (হুকবা সময়কাল) থাকবে। সেখানে তারা কোনো শীতল ও পানীয় আস্বাদন করবে না। কিন্তু ফুটন্ত পানি ও পূঁজ পাবে। পরিপূর্ণ প্রতিফল হিসেবে। নিশ্চয় তারা হিসাব-নিকাশ আশা করত না এবং আমার আয়াতসমূহের প্রতি মিথ্যারোপ করত।’’ [সূরা নাবা : ২১-২৮]
সম্মানিত পাঠক, কিছু পূর্বে বর্ণিত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয়েছে- মু’মিনদের আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন। আর শেষোক্ত আয়াতে প্রমাণিত হলো, আখিরাত অস্বীকারকারী তথা কাফিরদের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটি ঘটবে না। সুতরাং সূরা হুদের ১০৬-১০৮ নং আয়াতের জান্নাতী ও জাহান্নামীদের বর্ণনার পরে إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ (তবে, তোমার রব যা ইচ্ছা করেন)-এর ব্যতিক্রম ইচ্ছার দাবিটি কেবলই মু’মিনদের জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
আবার অনেক সময় মু’মিন ও কাফিরকে এই আয়াতে একইভাবে ভয় দেখান হলেও পূর্ববর্তী আয়াত ও হাদীসের ন্যায় সেগুলোর ব্যাখ্যা নিতে হবে। যেমন, সুদ সম্পর্কে আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহ) লিখেছেন :
قوله تعالى : ﴿ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبا﴾ معناه عند جميع المتأولين في الكفار ، ولهم قيل : ﴿فَلَهُ مَا سَلَفَ﴾ ولا يقال ذلك لمؤمن عاص بل ينقض بيعه ويرد فعله وإن كان جاهلا ، فلذلك قال ﷺ : " من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد ". لكن قد يأخذ العصاة في الربا بطرف من وعيد هذه الآية .
‘‘আল্লাহর বাণী- ‘এটা (সুদখোর শয়তানের আছরে পাগলের মতো হবে) এ জন্যে যে, তারা বলে : নিশ্চয় ক্রয়-বিক্রয় হল সুদের মতো’- প্রথম যুগের সমস্ত ব্যাখ্যাকারী আয়াতটির দাবি কাফিরদের সাথে গণ্য করেছেন। তাদেরকে বলা হয়েছে فَلَهُ مَا سَلَفَ ‘তাদের মধ্যে যারা চলে গেছে তারা ব্যতিক্রম’। কেননা গুনাহগার মু’মিনকে এভাবে বলা হয় না। বরং তার ক্রয়-বিক্রয় ভঙ্গ হয় এবং তার আমলটি বাতিল করা হয় - যদি সে অবগত না থাকে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : ‘যে এমন কোনো আমল করল যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই- তা রদ বা বাতিল।’ পক্ষান্তরে সুদ গ্রহণ করে পাপে লিপ্ত ছিল তাদের ক্ষেত্রে আয়াতটির ধমকি প্রযোজ্য।’’ [তাফসিরে কুরতুবি, আলোচ্য আয়াতের তাফসির দ্র :]
বুঝা যাচ্ছে, সুদ ও হত্যার আয়াতটি সম্পর্কে খারেজীরা যে অর্থ নিয়েছেন সেটা কুরআন থেকে কুরআন, কুরআন থেকে হাদীস সালাফদের তাফসীর অনুযায়ী ভুল তাফসীর।
[বিস্তারিত জানতে দেখুন : (১) ‘‘কবীরা গুনাহাগার মু‘মিন কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী?’’ (২) ‘‘কবীরা গুনাহগার মু’মিনের নাজাত ও শাফাত’’ -কামাল আহমাদ; আতিফা পাবলিকেশন্স, ঢাকা]
খারেজী ও মু’তাযিলাদের পক্ষ থেকে আরও একটি যুক্তি দেয়া হয়েছে যে, সুদখোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। (সূরা বাক্বারাহ : ১৭৯)
এর জবাব হল, মু’মিনের সাথে মু’মিনের যুদ্ধ ঘটতে পারে। [সূরা হুজুরাত : ৯]
রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَ تَرْجِعُنَّ بَعْدِيْ كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ ‘‘তোমরা আমার পরে পরস্পরের গর্দান উড়িয়ে কাফিরে পরিণত হয়ো না।’’ [সহীহ বুখারী ১২১, সহীহ মুসলিম ১২৬ (১১৮/৬৫), মিশকাত ৩৫৩৭]
বুঝা যাচ্ছে, এইসব বড় বড় ক্ষেত্রেও আমলটি আক্বীদাগত নয় বরং আমলগত কুফর। শেষোক্ত আয়াত ও হাদীসটি পরস্পরের ব্যাখ্যা।
পক্ষান্তরে যদি সুদকে অস্বীকার করে তাহলে সে নিশ্চিত কাফির। তাদের বিরুদ্ধে মুরতাদ-কাফির হিসেবে যুদ্ধ করতে হবে। যেভাবে আবূ বকর (রা) তাঁর খেলাফতের শুরুতে যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কেননা, অস্বীকারের দ্বারা কুফরটি আক্বীদা ও আমল উভয় কুফরে পরিণত হয়।
৫) আল-ওয়াল ওয়াল বারা (বন্ধুত্ব ও শত্রুতা) :
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘হে মুমিণগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।’’ [সূরা মায়েদা : ৫১]
এই আয়াতের আলোকে বলা হয়, যেসব ব্যক্তি বা শাসক বা দেশ কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে তারা কাফির হয়ে যায়। অথচ পরবর্তী আয়াত বলছে, আয়াতটি তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা আক্বীদার দিক থেকে মুনাফিক্ব :
فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَن تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ ۚ فَعَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِّنْ عِندِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنفُسِهِمْ نَادِمِينَ
‘‘বস্তুত যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌঁড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলে : আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই। অতএব, সেদিন দূরে নয়, যেদিন আল্লাহ তাআলা বিজয় প্রকাশ করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ দেবেন-ফলে তারা স্বীয় গোপন মনোভাবের জন্যে অনুতপ্ত হবে।’’ [সূরা মায়েদা : ৫২]
পরবর্তী দুটি আয়াতেও আক্বীদাগত মুনাফিক্বদের সাথে মু’মিনদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَيَقُولُ الَّذِينَ آمَنُوا أَهَٰؤُلَاءِ الَّذِينَ أَقْسَمُوا بِاللَّهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ ۙ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ ۚ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِينَ [٥ : ٥٣ ] يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ [٥ : ٥٤ ]
‘‘মু’মিনরা বলবে : এরাই কি সেসব লোক, যারা আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করত যে, আমরা তোমাদের সাথে আছি? তাদের কৃতকর্মসমূহ বিফল হয়ে গেছে, ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে। হে মু’মিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।’’ [সূরা মায়েদা : ৫৩-৫৪]
ইমাম তাবারী (রহ) লিখেছেন :
غير أنه لا شك أن الآية نـزلت في منافق كان يوالي يهودًا أو نصارى خوفًا على نفسه من دوائر الدهر، لأن الآية التي بعد هذه تدلّ على ذلك، وذلك قوله : فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ الآية .
‘‘এতে কোন সংশয় নেই যে, আয়াতটি মুনাফিক্বদের সম্পর্ক নাযিল হয়েছে, যারা আগত দিনগুলোতে নিজেদের ব্যাপারে শঙ্কিত থাকায় ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে আন্তরিক বন্ধু বানিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে, তাদেরকে আপনি দেখবেন, দৌঁড়ে গিয়ে তাদেরই মধ্যে প্রবেশ করে। তারা বলে : আমরা আশঙ্কা করি, পাছে না আমরা কোন দুর্ঘটনায় পতিত হই। (সূরা মায়েদা : ৫২)।’’ [তাফসীরে ইবনু জারীর তাবারী. সূরা মায়েদা ৫১-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর]
এ থেকে বুঝা যায়, যেসব শাসক বা ব্যক্তি ইসলামের থেকে ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বেশি হক্ব মনে করে তাদেরকে আন্তরিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তারা কাফির। নবী (স) -এর যামানাতে আক্বীদাগত মুনাফিক্বদের সম্পর্কে ওহীর মাধ্যমে এভাবে জানিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানের মুনাফিক্বদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। যেমন, সাহাবী হুযায়ফা (রা) হতে বর্ণিত :
إِنَّمَا كَانَ النِّفَاقُ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ ﷺ فَأَمَّا الْيَوْمَ فَإِنَّمَا هُوَ الْكُفْرُ بَعْدَ الإِيمَانِ .
‘‘নিফাক বস্তুত নবী (স) -এর যুগে ছিল। আর এখন হল তা ঈমান গ্রহণের পর কুফর।’’ [সহীহ বুখারী ৭১১৪, মিশকাত ৬২]
এ কারণে ইবনু তাইমিয়া (রহ) ও কয়েকজন ইমাম আক্বীদাগত নিফাক্ব কেবল নবী (স) -এর যামানার সাথে খাস করেছেন। ঐ যামানার পরবর্তীদের ক্ষেত্রে কেবল আমলগত নিফাক্ব প্রযোজ্য করেছেন। কেননা, নবী (স)-এর যামানাতে ওহীর মাধ্যমে আক্বীদাগত মুনাফিক্বদের জানা যেত। আমাদের যামানাতে যা অসম্ভব। তবে এ যামানাতে এভাবে আক্বীদাগত নিফাক্ব বা কুফর স্পষ্ট হতে পারে, যখন ঐ ব্যক্তি নিজেই সেটা দাবি করে : আমি আক্বীদাগতভাবে কাফির বা মুনাফিক্ব।
সুতরাং যখন কোন শাসক বা ব্যক্তিবিশেষ নিজেকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে - তখন তাকে আক্বীদাগত কাফির বলা যাবে না। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا ضَرَبْتُمْ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَتَبَيَّنُواْ وَلاَ تَقُولُواْ لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلاَمَ لَسْتَ مُؤْمِنًا
‘‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হবে তখন যাচাই করবে এবং যে তোমাদেরকে সালাম দেবে দুনিয়ার জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলবে না যে, ‘তুমি মু’মিন নও’।’’ [সূরা নিসা : ৯৪]
আয়াতটির শানে-নুযূল বলছে, যখন কাফিরদের হয়ে কেউ যুদ্ধ করতে আসে অতঃপর সালাম দেয় নিজেকে ‘মু’মিন’ হিসেবে পরিচয় দিতে। তখন তাকে হত্যা করা যাবে না, এমনকি সে মু’মিন কি না, এ ব্যাপারেও সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। ঐ কাফিরর পক্ষে যুদ্ধকারী ছলনা করুক বা সত্যিই এখন মু’মিন হতে চায় - যেটিই হোক তাকে মু’মিন হিসেবেই মেনে নিতে হবে। ইমাম আদিল হাম্বলী (রহ) লিখেছেন :
موالاة الكافر تنقسم ثلاثة أقسامٍ . الأول : أن يَرْضَى بكفره ، ويُصَوِّبَه ، ويواليَه لأجْلِه ، فهذا كافر ؛ لأنه راضٍ بالكفر ومُصَوِّبٌ له . الثاني : المعاشرةُ الجميلةُ بحَسَب الظاهر ، وذلك غير ممنوع منه . الثالث : الموالاة ، بمعنى الركون إليهم ، والمعونة ، والنُّصْرة ، إما بسبب القرابة ، وإما بسبب المحبة مع اعتقاد أن دينَه باطل - فهذا منهيٌّ عنه ، ولا يوجب الكفر .
‘‘কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব তিন প্রকারে বিভক্ত : প্রথমত, যে (মুসলিম) তাদের কুফরকে মেনে নেয় এবং সঠিক মনে করে আর এ কারণেই তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে, এরা কাফির। কেননা সে কুফরের ব্যাপারে খুশি এবং সেটাকে সত্যায়নকারী। দ্বিতীয়ত, দুনিয়াবী সুবিধা অর্জনে বাহ্যিক সুন্দর লেনদেনের সম্পর্ক, এটা নিষিদ্ধ নয়। তৃতীয়ত, এমন বন্ধুত্ব যার ফলে তাদের উপর নির্ভর করা হয়, সহায়ক শক্তি হয়, সহযোগিতা করা হয়- সেটা তাদের নৈকট্য হাসিলের কারণে হোক, অথবা এই আক্বীদাসহ মুহাব্বাতের ভিত্তিতে যে, তাদের দ্বীন বাতিল; সেক্ষেত্রে এটা নিষিদ্ধ কিন্তু ওয়াজিব কুফর নয়।’’ [আল-লুবাব ফী উলূমুল কিতাব ৫/১৪৩ পৃ. সূরা আলে-ইমরানের ২৮ নং আয়াতের তাফসীর]
ইমাম রাযী (রহ)-ও প্রায় কাছাকাছি অর্থে উক্ত তিনটি ভাগ উল্লেখ করেছেন। [তাফসীরে রাযী (মাফাতিহুল গায়ব) সূরা আলে-ইমরানের ২৮ নং আয়াতের তাফসীর]
অপর একটি দিক :
উপকারের ক্ষেত্রে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব : এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের শাসকদের অধিকাংশ ইয়াহুদী ও নাসারাদের সাথে বন্ধুত্বের কারণ হল, তারা তাদের ভয় করে। অর্থাৎ তাদের টেকনোলজির ভয়, আরাম-আয়েশের আকাঙ্ক্ষা, অলসতা ও উদ্যমহীনতা, মৃত্যুর ভয়, মাল-সম্পদের মুহাব্বাত প্রভৃতির কারণে আমাদের শাসকরা তাদের শত্রু ইয়াহুদী-নাসারাদের সাথে বন্ধুত্ব করে। এসব ক্ষেত্রে শাসকরা ফাসেক্ব ও মুনাফিক্ব, কিন্তু এমন কাফির নয় যে, ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা মুসলিমদেরকে নিজের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দিক লক্ষ রেখে কাফিরদের সাথে বাহ্যিক বন্ধুত্বের সম্পর্কের অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَّا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِن دُونِ الْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً ۗ وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ ۗ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ .
‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।’’ [সূরা আলে ইমরান : ২৮]
শাসকদের অন্তরে কাফির এবং ইয়াহুদী ও নাসারাদের ব্যাপারে যে ভয়-ভীতি, সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে - সেটা হওয়া উচিত কি না ? অথচ উক্ত আয়াতটিতে আত্মরক্ষার ব্যতিক্রম অনুমতিটির প্রেক্ষাপটে শাসককে তাকফীর করার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে। আয়াতটিতে ব্যবহৃত تقاة দ্বারা সালাফগণ তাক্বীয়া ও ভয় উভয় অর্থ নেন। ইমাম শানকীতি মালিকী (রহ) বলেছেন : যদি শত্রুর ভয়ে কোন মুসলিম তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা জায়েয। তিনি সূরা মায়িদা’র ৫১ নং আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন :
وبين في موضع آخر : أن محل ذلك، فيما إذا لم تكن الموالاة بسبب خوف، وتقية، وإن كانت بسبب ذلك فصاحبها معذور، وهو قوله تعالى : ﴿لا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً﴾ ]٣/ ٢٨ ] ، فهذه الآية الكريمة فيها بيان لكل الآيات القاضية بمنع موالاة الكفار مطلقاً وإيضاح، لأن محل ذلك في حالة الاختيار، وأما عند الخوف والتقية، فيرخص في موالاتهم، بقدر المداراة التي يكتفي بها شرهم، .
‘‘অন্যত্র আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন যে, যদি (ইয়াহুদী ও নাসারাদের সাথে) বন্ধুত্বের নিষেধাজ্ঞা ভয় ও বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে না হলে প্রযোজ্য। আর যদি এ (ভয় ও বেঁচে থাকার) কারণে হয় তবে ব্যক্তি মা‘যুর। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন।’ [সূরা আলে ইমরান : ২৮] এই আয়াতে কারিমাটি কাফিরদের সাথে উন্মুক্ত ও সুস্পষ্ট বন্ধুত্বের নিষেধাজ্ঞার ফায়াসালাকারী আয়াত হিসেবে সুস্পষ্ট করে। কেননা সেক্ষেত্রে বন্ধুত্বটি হবে উপায়হীন অবস্থাতে ভয় ও বেঁচে থাকার দাবিতে, ফলে সেক্ষেত্রে তাদের সাথে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে ছাড় রয়েছে, সামর্থ্যানুযায়ী কোমল আচরণ দ্বারা যা তাদের ক্ষতি মোকাবেলায় যথেষ্ট হবে।... ’’ [আযওয়াউল বায়ান সূরা মায়েদা’র ৫১ নং আয়াতের তাফসীর]
কাফিদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ হলেও দুনিয়াবী লেনদেন বৈধ : এ মর্মে আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে :
تُوُفِّيَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَدِرْعُهُ مَرْهُوْنَةٌ عِنْدَ يَهُوْدِيٍّ بِثَلَاثِيْنَ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ
‘‘নবী (স) -এর মৃত্যুর সময় তাঁর বর্মটি ত্রিশ সা’ যব-এর বিনিময়ে এক ইয়াহূদীর নিকট বন্ধক ছিল।’’ [সহীহ বুখারী ২৯১৬]
যুদ্ধ করে না এমন কাফিরদের সাথে সুন্দর ব্যবহার বৈধ :
لَا یَنۡهٰىکُمُ اللّٰهُ عَنِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یُقَاتِلُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ لَمۡ یُخۡرِجُوۡکُمۡ مِّنۡ دِیَارِکُمۡ اَنۡ تَبَرُّوۡهُمۡ وَ تُقۡسِطُوۡۤا اِلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ ﴿۸﴾
‘‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখাতে ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।’’ [সূরা মুমতাহিনা : ৮ আয়াত]
-কামাল আহমাদ
যারা ইসলাম অনুযায়ী শাসন পরিচালনা না করার জন্য শাসক বলতেই কাফির বলে ফতোয়া দিচ্ছে তাদের দলিল হল কুরআনের ঐ সমস্ত আয়াত, যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের ও তাঁর রসূলের হুকুম অমান্যকারীকে ‘মু’মিন নয়’ বলে সম্বোধন করেছেন। এ বিষয়টি পূর্বে আলোচিত মুনাফিক্ব ও খারেজীদের আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের ঈমান ও আক্বীদা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে অগ্রহণযোগ্য হলেও, ইসলামী রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না যতক্ষণ তাদের ইসলামবিরোধি আক্বীদাগুলো আমল হিসাবে বাস্তবরূপ লাভ করে। এখন এ সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতগুলো নবী (স) -এর যামানার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হল।
প্রথম আয়াত : আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘‘কিন্তু না, আপনার রবের ক্বসম! তারা মু’মিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিরোধে আপনাকে হাকিম না বানায়, এরপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে না নেয়।’’ [সূরা নিসা : ৬৫ আয়াত]
দৃষ্টান্ত : উরওয়া (রা) থেকে বর্ণিত; হাররা বা মদীনার কঙ্করময় ভূমিতে একটি পানির নালা নিয়ে যুবায়ের (রা) এর সাথে একজন আনসার ঝগড়া করেছিলেন। নবী (স) বললেন : ‘হে যুবায়ের! প্রথমত, তুমি তোমার জমিতে পানি দাও, তারপর তুমি প্রতিবেশীর জমিতে পানি ছেড়ে দেবে।’ আনসার বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! সে আপনার ফুফাত ভাই, তাই এই ফায়সালা দিলেন। এতে অসন্তুষ্টিবশত রসূল (স) এর চেহারা রক্তিম হয়ে গেল। তখন তিনি (স) বললেন : ‘হে যুবায়ের! তুমি পানি চালাবে তারপর আইল পর্যন্ত ফিরে না আসা পর্যন্ত তা আটকে রাখবে তারপর প্রতিবেশীর জমির দিকে ছাড়বে।’ আনসারী যখন রসূল (স)-কে রাগিয়ে তুললেন তখন তিনি তার হক পুরোপুরি যুবায়ের (রা) কে প্রদানের স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন। তাদেরকে প্রথমে নবী (স) এমন একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে উদারতা ছিল। যুবায়ের (রা) বলেন : فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ আয়াতটি এ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে বলে আমার ধারণা। [সহীহ বুখারী ২৩৫৯ কিতাবুত তাফসীর]
আলোচ্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হল, নবীকে বিচারক অমান্যকারী আক্বীদাগতভাবে কাফির। কিন্তু নবী (স) কর্তৃক এ ধরণের বিচার অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং পূর্বে মুনাফিক্ব ও খারেজীদের উদ্ভব সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, নবী (স) তাঁর বিচারের রায় অমান্যকারীকে لعله أن يكون يصلي ‘‘সম্ভবত সে সালাত আদায় করে’’ বাক্যের মাধ্যমে ছাড় দিয়েছেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ ফিতনার প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার দিকে সাহাবীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ আক্বীদাগত কুফর যতক্ষণ পর্যন্ত আমলী কুফরে পরিণত হয়ে প্রকাশিত না হয় এবং সমগ্র মুসলিম ও ইসলামের জন্য ফিতনাতে পরিণত না হচ্ছে- ততক্ষণ পর্যন্ত এমন লোকদের ছাড় দিতে নবী (স) নির্দেশ দিয়েছেন।
এই আয়াতটির শানে-নুযূল হিসাবে অপর একটি বর্ণনা হল, একজন ইয়াহুদী ও মুনাফিক্ব মুসলিমের সাথে সংঘটিত ঘটনা। যেখানে নবী (স) ইয়াহুদী ব্যক্তিটির পক্ষে রায় দিলে মুনাফিক্ব মুসলিমটি তা অমান্য করে, শেষাবধি উমার (রা) -এর কাছে বিচার পেশ করে। উমার (রা) নবী (স) এর ফায়সালা অমান্য করার কথা শুনে মুনাফিক্ব ব্যক্তিটিকে হত্যা করেন। কিন্তু এই হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম ইবনু কাসির (রহ) বলেছেন : হাদীসটি গরীব, মুরসাল (সূত্রছিন্ন), তাছাড়া এর অন্যতম রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু লিহইয়া (তাফসীরে ইবনু কাসির, সূরা নিসা : ৬৫ নং আয়াত দ্র :)। এছাড়া হাদীসটির শেষে বর্ণিত হয়েছে : অতঃপর নবী (স) উমার (রা) -কে উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করার দণ্ড হতে মুক্তি দিলেন। তবে পরবর্তীকালে এটা প্রথা হয়ে দাঁড়ানোকে আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করলেন এবং পরবর্তী (নিসা : ৬৬) আয়াতটি নাযিল হল।
তাছাড়া হাদীসটি পূর্বে বর্ণিত খারেজীদের উদ্ভব সংক্রান্ত সহীহ বুখারীর হাদীসটির বিরোধী। সেখানে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) রসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে তাঁর বিচার অমান্যকারীকে হত্যা করার অনুমতি চাইলে তিনি (স) তা নিষেধ করেন। সুতরাং হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ায় বাতিল। তাছাড়া নিচের সহীহ হাদীসটিও আমাদের বক্তব্যকে সমর্থন করে।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন : যখন নবী (স) হুনায়নের গনীমত বণ্টন করে দিলেন, তখন আনসারদের এক ব্যক্তি বলে ফেলল, এই বণ্টনের ব্যাপারে তিনি (স) আল্লাহ’র সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখেননি। কথাটি শুনে আমি নবী (স) -এর কাছে আসলাম এবং তাঁকে কথাটি জানিয়ে দিলাম। তখন তাঁর চেহারার রঙ পরিবর্তিত হয়ে গেল। এরপর তিনি (স) বললেন : رَحْمَةُ اللهِ عَلى مُوْسى لَقَدْ اُوْذِىَ بِاَكْثَرَ مِنْ هذَا فَصَبَرَ ‘‘আল্লাহ, মূসা (আ)-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। তাঁকে এর চেয়েও অধিক কষ্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সবর করেছিলেন।’’ [সহীহ বুখারী ৬২৯১]
সুতরাং সবক্ষেত্রে আমলগত কুফর ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোষিত চূড়ান্ত মুরতাদ হিসাবে গণ্য হবে না। বরং এখানে كفر دون كفر (চূড়ান্ত কুফরের চেয়ে কম কুফর) নীতি প্রযোজ্য। নবী (স)-এর নিজস্ব এই আমলটিই ইবনু আব্বাস (রা) -এর এই তাফসীরের প্রত্যক্ষ সমর্থক।
দ্বিতীয় আয়াতঃ আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘‘আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন বিষয়ের ফায়সালা দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।’’ [সূরা আহযাব : ৩৬ আয়াত]
আলোচ্য আয়াতটি যয়নাব বিনতে জাহাশের (রা) সঙ্গে যায়দ বিন হারিসের (রা) বিয়ে সম্পর্কে নাযিল হয়। প্রথমে যয়নাব (রা) এই বিয়েতে রাজী ছিলেন না। তখন আয়াতটি নাযিল হলে তিনি বিয়েতে রাজী হন।
(সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ অবলম্বনে)
عن قتادة قال : خطب النبي ﷺ زينب وهي بنت عمته وهو يريدها لزيد فظنت أنه يريدها لنفسه فلما علمت أنه يريدها لزيد أبت فأنزل الله تعالى : ﴿ وما كان لمؤمن ولا مؤمنة إذا قضى الله ورسوله أمرا أن يكون لهم الخيرة من أمرهم ﴾ فرضيت وسلمت رواه الطبراني بأسانيد ورجال بعضها رجال الصحيح . صـ ٢٠٩
(মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/২০৯ পৃ.)
এরপরেও তাদের বিয়ে টিকল না এবং শেষাবধি নবী (স) -এর সাথে যয়নাব বিনতে জাহাশের (রা) বিয়ে হয় এবং সে সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতটি নাযিল হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ فَلَمَّا قَضَى زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا
‘‘স্মরণ করুন! আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনি তাকে বলেছিলেন যে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ আপনি মনে মনে যা গোপন করেছেন আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। আপনি লোক ভয় করছিলেন অথচ আল্লাহকেই ভয় করা আপনার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত। এরপর যায়দ যখন তার স্ত্রী (যয়নাব)’র সাথে বিয়ে ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিয়ে দিলাম। যাতে মু’মিনদের পালকপুত্রদের নিজ স্ত্রীদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করলে সে সব নারীকে বিয়ে করায় মু’মিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।’’ [সূরা আহযাব : ৩৭ আয়াত]
মূলত আয়াতটির দাবি হল :
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ
‘‘নবী মু’মিনদের কাছে তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর।’’ [সূরা আহযাব : ৬ আয়াত]
অথচ মুনাফিক্বগণ কখনই এই দাবি পূরণ করে না। তারপরেও রাষ্ট্রে বা সমাজে ফিতনা বিস্তার না করা পর্যন্ত তাদেরকে ছাড় দেয়া হয়েছে। অনুরূপ খারেজীদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের বর্ণিত শানে-নুযূল আক্বীদাগত কুফরের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে পূর্ববর্তী আলোচনাতে প্রমাণিত হয়েছে, নবী (স) -এর যামানাতে কেবল সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ফিতনাবাজদের বিরুদ্ধেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ এসেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে রসূল (স) তাদের ব্যাপারে সবরের নীতি অবলম্বন করেছিলেন। আবূ বকরের (রা) যুগে যারা বিদ্রোহ করেছিল তা গোটা উম্মাতের বিরুদ্ধে ছিল। তা-ই তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। উসমান (রা) -এর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদেরকে তিনি (রা) গোটা উম্মাতের সাথে গণ্য না করে কেবল নিজের সাথেই সংশ্লিষ্ট করেন। ফলে তিনি (রা) আদম (আ)-এর নেককার পুত্র, মূসা (আ) ও নবী (স)-এর ন্যায় সবরের নীতি অনুসরণ করেন। তিনি (রা) মুসলিমদের মধ্যে রক্তপাত ঘটনোর পরিবর্তে নিজের মযলুম অবস্থায় শহীদ হওয়াকে বেছে নেন।
এ সম্পর্কে আরো যেসব আয়াত দলিল হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তার সবই ইবাদত ও আক্বীদাগত কুফরের সাথে সংশ্লিষ্ট। [.দ্রষ্টব্য : পরিশিষ্ট- ২।] যার জবাব পূর্বের ন্যায়। নবী (স) কর্তৃক তাঁর যামানার আমল ও উম্মাতের প্রতি তার নির্দেশ থেকে বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট।
যারা ইসলাম অনুযায়ী শাসন পরিচালনা না করার জন্য শাসক বলতেই কাফির বলে ফতোয়া দিচ্ছে তাদের দলিল হল কুরআনের ঐ সমস্ত আয়াত, যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের ও তাঁর রসূলের হুকুম অমান্যকারীকে ‘মু’মিন নয়’ বলে সম্বোধন করেছেন। এ বিষয়টি পূর্বে আলোচিত মুনাফিক্ব ও খারেজীদের আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের ঈমান ও আক্বীদা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কাছে অগ্রহণযোগ্য হলেও, ইসলামী রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না যতক্ষণ তাদের ইসলামবিরোধি আক্বীদাগুলো আমল হিসাবে বাস্তবরূপ লাভ করে। এখন এ সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াতগুলো নবী (স) -এর যামানার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হল।
প্রথম আয়াত : আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘‘কিন্তু না, আপনার রবের ক্বসম! তারা মু’মিন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিরোধে আপনাকে হাকিম না বানায়, এরপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে না নেয়।’’ [সূরা নিসা : ৬৫ আয়াত]
দৃষ্টান্ত : উরওয়া (রা) থেকে বর্ণিত; হাররা বা মদীনার কঙ্করময় ভূমিতে একটি পানির নালা নিয়ে যুবায়ের (রা) এর সাথে একজন আনসার ঝগড়া করেছিলেন। নবী (স) বললেন : ‘হে যুবায়ের! প্রথমত, তুমি তোমার জমিতে পানি দাও, তারপর তুমি প্রতিবেশীর জমিতে পানি ছেড়ে দেবে।’ আনসার বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! সে আপনার ফুফাত ভাই, তাই এই ফায়সালা দিলেন। এতে অসন্তুষ্টিবশত রসূল (স) এর চেহারা রক্তিম হয়ে গেল। তখন তিনি (স) বললেন : ‘হে যুবায়ের! তুমি পানি চালাবে তারপর আইল পর্যন্ত ফিরে না আসা পর্যন্ত তা আটকে রাখবে তারপর প্রতিবেশীর জমির দিকে ছাড়বে।’ আনসারী যখন রসূল (স)-কে রাগিয়ে তুললেন তখন তিনি তার হক পুরোপুরি যুবায়ের (রা) কে প্রদানের স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন। তাদেরকে প্রথমে নবী (স) এমন একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে উদারতা ছিল। যুবায়ের (রা) বলেন : فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ আয়াতটি এ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে বলে আমার ধারণা। [সহীহ বুখারী ২৩৫৯ কিতাবুত তাফসীর]
আলোচ্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হল, নবীকে বিচারক অমান্যকারী আক্বীদাগতভাবে কাফির। কিন্তু নবী (স) কর্তৃক এ ধরণের বিচার অমান্যকারীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং পূর্বে মুনাফিক্ব ও খারেজীদের উদ্ভব সংক্রান্ত ভবিষ্যদ্বাণীতে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, নবী (স) তাঁর বিচারের রায় অমান্যকারীকে لعله أن يكون يصلي ‘‘সম্ভবত সে সালাত আদায় করে’’ বাক্যের মাধ্যমে ছাড় দিয়েছেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ ফিতনার প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার দিকে সাহাবীদের নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ আক্বীদাগত কুফর যতক্ষণ পর্যন্ত আমলী কুফরে পরিণত হয়ে প্রকাশিত না হয় এবং সমগ্র মুসলিম ও ইসলামের জন্য ফিতনাতে পরিণত না হচ্ছে- ততক্ষণ পর্যন্ত এমন লোকদের ছাড় দিতে নবী (স) নির্দেশ দিয়েছেন।
এই আয়াতটির শানে-নুযূল হিসাবে অপর একটি বর্ণনা হল, একজন ইয়াহুদী ও মুনাফিক্ব মুসলিমের সাথে সংঘটিত ঘটনা। যেখানে নবী (স) ইয়াহুদী ব্যক্তিটির পক্ষে রায় দিলে মুনাফিক্ব মুসলিমটি তা অমান্য করে, শেষাবধি উমার (রা) -এর কাছে বিচার পেশ করে। উমার (রা) নবী (স) এর ফায়সালা অমান্য করার কথা শুনে মুনাফিক্ব ব্যক্তিটিকে হত্যা করেন। কিন্তু এই হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। ইমাম ইবনু কাসির (রহ) বলেছেন : হাদীসটি গরীব, মুরসাল (সূত্রছিন্ন), তাছাড়া এর অন্যতম রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু লিহইয়া (তাফসীরে ইবনু কাসির, সূরা নিসা : ৬৫ নং আয়াত দ্র :)। এছাড়া হাদীসটির শেষে বর্ণিত হয়েছে : অতঃপর নবী (স) উমার (রা) -কে উক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করার দণ্ড হতে মুক্তি দিলেন। তবে পরবর্তীকালে এটা প্রথা হয়ে দাঁড়ানোকে আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করলেন এবং পরবর্তী (নিসা : ৬৬) আয়াতটি নাযিল হল।
তাছাড়া হাদীসটি পূর্বে বর্ণিত খারেজীদের উদ্ভব সংক্রান্ত সহীহ বুখারীর হাদীসটির বিরোধী। সেখানে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) রসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে তাঁর বিচার অমান্যকারীকে হত্যা করার অনুমতি চাইলে তিনি (স) তা নিষেধ করেন। সুতরাং হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ায় বাতিল। তাছাড়া নিচের সহীহ হাদীসটিও আমাদের বক্তব্যকে সমর্থন করে।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন : যখন নবী (স) হুনায়নের গনীমত বণ্টন করে দিলেন, তখন আনসারদের এক ব্যক্তি বলে ফেলল, এই বণ্টনের ব্যাপারে তিনি (স) আল্লাহ’র সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখেননি। কথাটি শুনে আমি নবী (স) -এর কাছে আসলাম এবং তাঁকে কথাটি জানিয়ে দিলাম। তখন তাঁর চেহারার রঙ পরিবর্তিত হয়ে গেল। এরপর তিনি (স) বললেন : رَحْمَةُ اللهِ عَلى مُوْسى لَقَدْ اُوْذِىَ بِاَكْثَرَ مِنْ هذَا فَصَبَرَ ‘‘আল্লাহ, মূসা (আ)-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। তাঁকে এর চেয়েও অধিক কষ্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সবর করেছিলেন।’’ [সহীহ বুখারী ৬২৯১]
সুতরাং সবক্ষেত্রে আমলগত কুফর ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোষিত চূড়ান্ত মুরতাদ হিসাবে গণ্য হবে না। বরং এখানে كفر دون كفر (চূড়ান্ত কুফরের চেয়ে কম কুফর) নীতি প্রযোজ্য। নবী (স)-এর নিজস্ব এই আমলটিই ইবনু আব্বাস (রা) -এর এই তাফসীরের প্রত্যক্ষ সমর্থক।
দ্বিতীয় আয়াতঃ আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘‘আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন বিষয়ের ফায়সালা দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।’’ [সূরা আহযাব : ৩৬ আয়াত]
আলোচ্য আয়াতটি যয়নাব বিনতে জাহাশের (রা) সঙ্গে যায়দ বিন হারিসের (রা) বিয়ে সম্পর্কে নাযিল হয়। প্রথমে যয়নাব (রা) এই বিয়েতে রাজী ছিলেন না। তখন আয়াতটি নাযিল হলে তিনি বিয়েতে রাজী হন।
(সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াতের বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ অবলম্বনে)
عن قتادة قال : خطب النبي ﷺ زينب وهي بنت عمته وهو يريدها لزيد فظنت أنه يريدها لنفسه فلما علمت أنه يريدها لزيد أبت فأنزل الله تعالى : ﴿ وما كان لمؤمن ولا مؤمنة إذا قضى الله ورسوله أمرا أن يكون لهم الخيرة من أمرهم ﴾ فرضيت وسلمت رواه الطبراني بأسانيد ورجال بعضها رجال الصحيح . صـ ٢٠٩
(মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/২০৯ পৃ.)
এরপরেও তাদের বিয়ে টিকল না এবং শেষাবধি নবী (স) -এর সাথে যয়নাব বিনতে জাহাশের (রা) বিয়ে হয় এবং সে সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতটি নাযিল হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِي أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَاتَّقِ اللَّهَ وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ فَلَمَّا قَضَى زَيْدٌ مِنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ مَفْعُولًا
‘‘স্মরণ করুন! আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনি তাকে বলেছিলেন যে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ আপনি মনে মনে যা গোপন করেছেন আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। আপনি লোক ভয় করছিলেন অথচ আল্লাহকেই ভয় করা আপনার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত। এরপর যায়দ যখন তার স্ত্রী (যয়নাব)’র সাথে বিয়ে ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিয়ে দিলাম। যাতে মু’মিনদের পালকপুত্রদের নিজ স্ত্রীদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক ছিন্ন করলে সে সব নারীকে বিয়ে করায় মু’মিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।’’ [সূরা আহযাব : ৩৭ আয়াত]
মূলত আয়াতটির দাবি হল :
النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ
‘‘নবী মু’মিনদের কাছে তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর।’’ [সূরা আহযাব : ৬ আয়াত]
অথচ মুনাফিক্বগণ কখনই এই দাবি পূরণ করে না। তারপরেও রাষ্ট্রে বা সমাজে ফিতনা বিস্তার না করা পর্যন্ত তাদেরকে ছাড় দেয়া হয়েছে। অনুরূপ খারেজীদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের বর্ণিত শানে-নুযূল আক্বীদাগত কুফরের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে পূর্ববর্তী আলোচনাতে প্রমাণিত হয়েছে, নবী (স) -এর যামানাতে কেবল সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ফিতনাবাজদের বিরুদ্ধেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ এসেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে রসূল (স) তাদের ব্যাপারে সবরের নীতি অবলম্বন করেছিলেন। আবূ বকরের (রা) যুগে যারা বিদ্রোহ করেছিল তা গোটা উম্মাতের বিরুদ্ধে ছিল। তা-ই তিনি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। উসমান (রা) -এর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদেরকে তিনি (রা) গোটা উম্মাতের সাথে গণ্য না করে কেবল নিজের সাথেই সংশ্লিষ্ট করেন। ফলে তিনি (রা) আদম (আ)-এর নেককার পুত্র, মূসা (আ) ও নবী (স)-এর ন্যায় সবরের নীতি অনুসরণ করেন। তিনি (রা) মুসলিমদের মধ্যে রক্তপাত ঘটনোর পরিবর্তে নিজের মযলুম অবস্থায় শহীদ হওয়াকে বেছে নেন।
এ সম্পর্কে আরো যেসব আয়াত দলিল হিসাবে উল্লেখ করা হয়, তার সবই ইবাদত ও আক্বীদাগত কুফরের সাথে সংশ্লিষ্ট। [.দ্রষ্টব্য : পরিশিষ্ট- ২।] যার জবাব পূর্বের ন্যায়। নবী (স) কর্তৃক তাঁর যামানার আমল ও উম্মাতের প্রতি তার নির্দেশ থেকে বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট।
-সঙ্কলক : কামাল আহমাদ
[এই পুস্তকের শুরুতে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) কর্তৃক ইমাম ইবনু জারীর তাবারীর ‘তাফসীরে তাবারী' থেকে এ সম্পর্কিত বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এখন আলোচ্য আয়াতটির ব্যাপারে আরো কয়েকটি প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেয়া হল। যেন এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের মুফাসসিরদের আক্বীদাগত উপস্থাপনার ব্যাপারে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ না থাকে। - সঙ্কলক]
১.তাফসীরে কুরতুবী : ইমাম কুরতুবী (রহ) তাঁর বিখ্যাত ‘‘আল-জামেউ লি-আহকামিল কুরআন’’-এ আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন :
قوله تعالى : ﴿ومن لَم يَحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون﴾ و ﴿الظالِمون﴾ و ﴿الفاسقون﴾ نزلت كلها في الكفار ثبت ذلك في صحيح مسلم من حديث البراء وقد تقدم وعلى هذا الْمعظم فأما الْمسلم فلا يكفر وإن ارتكب كبيرة وقيل : فيه إضمار أي ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله ردا للقرآن وجحدا لقول الرسول عليه الصلاة والسلام فهو كافر قاله ابن عباس ومُجاهد فالآية عامة على هذا قال ابن مسعود والْحسن : هي عامة في كل من لَم يَحكم بِما أنزل الله من الْمسلمين واليهود والكفار أي معتقدا ذلك ومستحلا له فأما من فعل ذلك وهو معتقد أنه راكب مُحرم فهو من فساق الْمسلمين وأمره إلَى الله تعالَى إن شاء عذبه وإن شاء غفر له وقال ابن عباس في رواية : ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فقد فعل فعلا يضاهي أفعال الكفار وقيل : أي ومن لَم يَحكم بِجميع ما أنزل الله فهو كافر فأما من حكم بالتوحيد ولَم يَحكم ببعض الشرائع فلا يدخل في هذه الآية والصحيح الأول إلا أن الشعبي قال : هي في اليهود خاصة واختاره النحاس قال : ويدل على ذلك ثلاثة أشياء منها أن اليهود قد ذكروا قبل هذا في قوله ﴿للذين هادوا﴾ فعاد الضميْر عليهم ومنها أن سياق الكلام يدل على ذلك ألا ترى أن بعده ﴿وكتبنا عليهم﴾ فهذا الضميْر لليهود بإجْماع وأيضا فإن اليهود هم الذين أنكروا الرجم والقصاص فإن قال قائل : ﴿من﴾ إذا كانت للمجازاة فهي عامة إلا أن يقع دليل على تَخصيصها قيل له : ﴿من﴾ هنا بِمعنى الذي مع ما ذكرناه من الأدلة والتقدير : واليهود الذين لَم يَحكموا بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون فهذا من أحسن ما قيل في هذا ويروى أن حذيفة سئل عن هذه الآيات أهي في بني اسرائيل قال : نعم هي فيهم ولتسلكن سبيلهم حذو النعل بالنعل وقيل : ﴿الكافرون ﴾ للمسلمين و ﴿الظالِمون﴾ لليهود و ﴿الفاسقون﴾ للنصارى وهذا اختيار أبي بكر بن العربِي قال : لأنه ظاهر الآيات وهو اختيار بن عباس وجابر بن زيد وابن أبي زائدة وابن شبرمة والشعبِي أيضا قال طاوس وغيْره : ليس بكفر ينقل عن الْملة ولكنه كفر دون كفر وهذا يَختلف إن حكم بِما عنده على أنه من عند الله فهو تبديل له يوجب الكفر وإن حكم به هوى ومعصية فهو ذنب تدركه الْمغفرة على أصل أهل السنة في الغفران للمذنبين قال القشيري : ومذهب الْخوارج أن من ارتشى وحكم بغير حكم الله فهو كافر وعزي هذا إلَى الْحسن والسدي وقال الْحسن أيضا : أخذ الله عز وجل على الْحكام ثلاثة أشياء : ألا يتبعوا الْهوى وألا يَخشوا الناس ويَخشوه وألا يشتروا بأياته ثَمنا قليلا
‘‘আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা হুকুম করে না আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা, তারাই কাফির ... যালিম .... ফাসিক্ব’’। আয়াতগুলো সম্পূর্ণরূপে কাফিরদের ব্যাপারে নাযিল হয়, যা সহীহ মুসলিমের বারা বিন আযিব (রা) থেকে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, আর এটাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত। আর মুসলিমের ক্ষেত্রে কুফর হওয়া প্রযোজ্য নয়, আর যদি সে তা করে তবে কবীরা গোনাহগার হবে। বলা হয়, এখানে কিছু (বিষয়) ঊহ্য আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত কুরআনকে রদ (বাতিল গণ্য) করে, রসূলের (হাদীসের) বিরোধিতা করে- সে কাফির। ইবনু আব্বাস (রা) ও মুজাহিদ (রহ) আয়াতটির ‘আম দাবির ভিত্তিতে এমনটি বলেছেন। ইবনু মাসউদ (রা) ও হাসান (রহ) বলেছেন : ‘আমভাবে এটা তথা ‘‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম না করা’’ -মুসলিম, ইয়াহুদী, কাফির সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; অর্থাৎ যদি তারা আক্বীদাগতভাবে সেটিকে (বিধান জারি না করাকে) হালাল বা বৈধ গণ্য করে। আর যদি আমলগতভাবে তা করে অথচ আক্বীদা রাখে যে, হারাম কাজ করছে তবে সে মুসলিমদের মধ্যে ফাসিক্ব বলে গণ্য হবে। তার ব্যাপারটি আল্লাহ উপর ন্যস্ত। ইচ্ছা করলে তিনি আযাব দিবেন, ইচ্ছা করলে মাফ করবেন। ইবনু আব্বাস (রহ) বর্ণনা করেছেন : যদি কেউ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হুকুম না করে- তবে তা কাফিরদের আমলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আরও বলা হয় : যদি কেউ সামগ্রিকভাবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হুকুম না করে- তবে সে কাফির। আর যা তাওহীদের হুকুমের অন্তর্গত এবং শরীআতের কোন কোন হুকুমের ক্ষেত্রে হলে, তবে সেটা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে প্রথম উক্তিটিই সহীহ। অবশ্য শা‘বী (রহ) বলেছেন : এখানে ইয়াহুদীদের খাস (সুনির্দিষ্ট) করা হয়েছে। নুহাস এটি গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন : ‘‘এর দলিল হিসেবে তিনটি বিষয় রয়েছে। (প্রথমত :) এখানে ইয়াহুদীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেভাবে আল্লাহ তাআলা বলেছেন : " للذين هادوا ", যার যমীর (সর্বনাম) তাদের সাথে সম্পৃক্ত। এ সম্পর্কিত (পূর্বাপর) বর্ণনা প্রসঙ্গও এর দলিল হিসাবে সাব্যস্ত হয়। (দ্বিতীয়ত :) বিশেষভাবে লক্ষণীয় পরবর্তী শব্দ " للذين هادوا "-যার যমীর (সর্বনাম) ইয়াহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘ হয়েছে। (তৃতীয়ত :) অনুরূপভাবে ইয়াহুদীরা রজম ও ক্বিসাসকে অস্বীকার করেছিল।
যদি কেউ বলে : এখানে ‘ من ’ শব্দটি যখন ফলাফল হিসাবে আসে তখন এর দাবি ‘আম (ব্যাপক), তবে যদি কোন দলিল দ্বারা খাস করা যায়। তাদেরকে বলা যায় : এখানে ‘ من ’ শব্দটির অর্থ الذى যা দলিল দ্বারা সাব্যস্ত হয়। এটি ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট। এটিই সর্বোত্তম উক্তি। বর্ণিত আছে, হুযায়ফা (রা) কে আয়াতটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, এখানে কি বনী ইসরাঈল সম্পর্কে ওহি করা হয়েছে? তিনি বললেন : ‘‘হাঁ! এটা তাদেরই সম্পর্কে। তোমরা তাদের পথে রয়েছ, প্রতি পদে পদে।’’
অনেকে বলেছেন : মুসলিমদের ক্ষেত্রে " الكافرون ", ইয়াহুদীদের ক্ষেত্রে " الظالِمون ", নাসারাদের ক্ষেত্রে " الفاسقون " প্রযোজ্য। আবূ বকর ইবনুল আরাবী আয়াতের প্রকাশ্য ভাব দ্বারা এই অর্থ নিয়েছেন। এই মত ইবনু আব্বাস (রা), জাবির বিন যায়েদ, ইবনু আবী যায়েদাহ, ইবনু শিবরামাহ প্রমুখ গ্রহণ করেছেন। তাউস (রহ) ও অন্যান্যরা বলেছেন : ‘‘এটা এমন কুফর নয় যা মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে, বরং এটি কুফরের থেকে কম কুফর।’’
এ ব্যাপারে ইখতিলাফ আছে, যদি তারা হুকুম দেয় তাদের নিকট আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে বিকৃত করে, তবে সেক্ষেত্রে কুফর হওয়াটা নিশ্চিত। আর যদি হুকুম করে স্বেচ্ছাচারীতা ও অন্যায়ের মধ্যে দিয়ে তবে তা হবে ক্ষমাযোগ্য পাপ। যা আহলে সুন্নাতের ‘পাপীদের জন্য ক্ষমা’ নীতির অন্তর্ভুক্ত।
কুশায়রী (রহ) বলেন : খারেজী মাযহাব হল, যদি ঘুষ নেয় বা আল্লাহর বিধানের বিরোধী হুকুম দেয় তবে সে কাফির। হাসান ও সুদ্দীর মত এটাই। [.পূর্বে ইমাম কুরতুবী থেকে ইবনু মাস‘উদ ও হাসানের রেখাঙ্কিত উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণ হয়েছে, তারা খারেজীদের মত পোষণ করতেন না। বরং মুসলিমদের ক্ষেত্রে ‘আমালী কুফর গণ্য করতেন। সুতরাং খারেজীদের উদ্ধৃতি দেয়ার পর হাসান ও সুদ্দীর উদ্ধৃতির উল্লেখ স্ববিরোধী হয়। আমরা বলব, খারেজীদের বিশ্বাসের পরে হাসান ও সুদ্দীর বর্ণনার দাবি তাদের থেকে বর্ণিত অন্যান্য দলিল থেকে ব্যাখ্যা নিতে হবে। যা সামনে বর্ণিত হবে ইনঁশাআল্লাহ। -সঙ্কলক] আর এ ব্যাপারে হাসান আরও বলেছেন : আল্লাহ তাআলা তিন শ্রেণির হাকিমকে পাকড়াও করবেন- যারা নিজের স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ করেন, যারা লোকদের ভয় করে ও লোকেরা তাদের ভয় করে, যারা সামান্য বিনিময়ে আল্লাহর আয়াত বিক্রি করে।
[তাফসীরে কুরতুবী সূরা ৫ মায়িদাহ : ৪৪ আয়াত এর তাফসীর দ্র :]
২.তাফসীরে ইবনু কাসির : ইমাম ইবনু কাসির (রহ) তাঁর তাফসীরে আয়াতটি তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন :
وقوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال البراء بن عازب، وحذيفة بن اليمان، وابن عباس، وأبو مِجْلزٍ، وأبو رَجاء العُطارِدي، وعِكْرِمة، وعبيد الله بن عبد الله، والْحسن البصري، وغيرهم : نزلت في أهل الكتاب -زاد الْحسن البصري : وهي علينا واجبة . وقال عبد الرزاق عن سفيان الثوري، عن منصور، عن إبراهيم قال : نزلت هذه الآيات في بنِي إسرائيل، ورضي الله لِهذه الأمة بِها . رواه ابن جرير .
وقال ابن جرير أيضًا : حدثنا يعقوب، حدثنا هُشَيْم، أخبَرنا عبد الْملك بن أبي سليمان، عن سلمة بن كُهَيل، عن عَلْقَمَة ومسروق أنّهما سألا ابن مسعود عن الرشوة فقال : من السُّحْت : قال : فقالا وفي الْحكم؟ قال : ذاك الكفر ! ثُم تلا ﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾
وقال السُّدِّي : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ يقول : ومن لَم يَحكم بِما أنزلتُ فتركه عمدًا، أو جار وهو يعلم، فهو من الكافرين [ به ] وقال علي بن أبي طلحة، عن ابن عباس، قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : من جحد ما أنزل الله فقد كفر . ومن أقر به ولَم يَحكم فهو ظالِم فاسق . رواه ابن جرير . ثُم اختار أن الآية الْمراد بِها أهل الكتاب، أو من جحد حكم الله الْمنْزل في الكتاب .
وقال عبد الرزاق، عن الثوري، عن زكريا، عن الشعبي : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ ﴾ قال : للمسلميْن . وقال ابن جرير : حدثنا ابن الْمثنى، حدثنا عبد الصمد، حدثنا شعبة، عن ابن أبي السفر، عن الشعبي : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : هذا في الْمسلمين، ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ﴾ قال : هذا في اليهود، ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ﴾ قال : هذا في النصارى . وكذا رواه هُشَيْم والثوري، عن زكريا بن أبي زائدة، عن الشعبي .
وقال عبد الرزاق أيضًا : أخبْرنا مَعْمَر، عن ابن طاوس عن أبيه قال : سئل ابن عباس عن قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : هي به كفر -قال ابن طاوس : وليس كمن كفر بالله وملائكته وكتبه ورسله . وقال الثوري، عن ابن جُرَيْج عن عطاء أنه قال : كفر دون كفر، وظلم دون ظلم، وفسق دون فسق . رواه ابن جرير . وقال وَكِيع عن سفيان، عن سعيد الْمكي، عن طاوس : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : ليس بكفر ينقل عن الْملة .
وقال ابن أبي حاتِم : حدثنا مُحمد بن عبد الله بن يزيد الْمقري، حدثنا سفيان بن عيينة، عن هشام بن حُجَير، عن طاوس، عن ابن عباس في قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : ليس بالكفر الذي يذهبون إليه . ورواه الْحاكم في مستدركه، عن حديث سفيان بن عيينة، وقال : صحيح على شرط الشيخين ولَم يَخرجاه .
‘‘আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির।’’ বারা ইবনু আযিব, হুযাইফা ইবনু ইয়ামান, ইবনু আব্বাস, আবূ মাজলায, আবূ রিযা আল-উতারিদী, ইকরামা, উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ও হাসান বসরী প্রমুখ বলেছেন : এই আয়াতাংশটি আহলে কিতাবদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। হাসান বসরী বলেন : তবে এর হুকুম আমাদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। [.যখন ইয়াহুদীদের ন্যায় আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করবে। যেমন- তারা বলেছিল তাওরাতে রজমের হুকুমটি নেই। কোন মুসলিমও যদি কুরআন বা হাদীসে উল্লিখিত কোন বিধান সম্পর্কে বলে কুরআন ও রসূলের হাদীসে নেই- তবে ইয়াহুদীদের মতোই একই কুফরের হুকুম প্রযোজ্য। -সঙ্কলক।] আব্দুর রাজ্জাক (রহ) বলেন, তিনি সুফিয়ান সওরী, মানসুর থেকে বর্ণনা করেছেন, ইবরাহীম বলেন : এই আয়াতাংশটি বনী ইসরাঈলের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে বটে, কিন্তু এই উম্মাতের জন্যও এই হুকুম বলবৎ ও কার্যকর।
(ইবনু জারীর)
ইবনু জারীর বলেন : আমাদেরকে হাদীস বলেছেন ইয়াকুব, (তিনি বলেন) আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন হুশায়ম, (তিনি বলেন) আমাদেরকে খবর দিয়েছেন আব্দুল মালিক বিন আবূ সুলায়মান, তিনি সালামা বিন কুহাইল থেকে, তিনি আলক্বামাহ ও মাশরুক থেকে। তাঁরা উভয়ে ইবনু মাসউদকে (রা) ঘুষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : এটা অপবিত্র উপার্জন। তারা আবার জিজ্ঞাসা করেন : ঘুষ গ্রহণ করার ব্যাপারে হুকুম কী? তিনি বলেন, এটা কুফর। অতঃপর তিনি পাঠ করেন : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির।’’ [.ঘুষ গ্রহণ একটি হারাম কাজ। অর্থাৎ ইবনু মাসউদ (রা) আয়াতটি দ্বারা ‘আমালী কুফরের’ দলিল নিয়েছেন। অনেকে ইবনু মাস‘উদ (রা) -এর আলোচ্য উদ্ধৃতি থেকে ঘুষ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী ফায়সালাকে ইসলাম থেকে খারিজ তবে চূড়ান্ত কাফির বলে গণ্য করেছেন। অথচ ইবনু কাসির (রহ) আয়াতটির ব্যাখ্যা এখানেই শেষ করেননি। তার পরবর্তী উদ্ধৃতিগুলো কুফরকে আমালী ও আক্বীদা এই দু’ভাগের বিভক্তিকেই সমর্থন করে। -সঙ্কলক।]
সুদ্দী (রহ) এই আয়াতটি সম্পর্কে বলেন : ‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত অথবা জবরদস্তিমূলক আল্লাহর বিধানের বিপরীত হুকুম দেয়, অথচ সে আল্লাহর বিধানের সুফল সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত, সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।’’ আলী বিন আবী তালহা (রহ) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে এই আয়াতটি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে সে কাফির। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান স্বীকার করে বটে, কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুসারে হুকুম করে না, সে যালিম ও ফাসিক্ব -(ইবনু জারীর)। আরও বলা হয়েছে, এই আয়াতাংশের লক্ষ্য হল আহলে কিতাবরা এবং তারা যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অস্বীকার করে।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন : তিনি সাওরী থেকে, তিনি যাকারিয়া থেকে, তিনি শা‘বী (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রহ) বলেন : এই আয়াতটির সম্পর্ক মুসলিমদের সাথে।
ইবনু জারীর বলেন : আমাদেরকে ইবনু মাসনা হাদীস বর্ণনা করেছেন, (তিনি বলেন) আমাদেরকে আব্দুস সামাদ হাদীস বর্ণনা করেছেন, (তিনি বলেন) আমাদেরকে শু‘বাহ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনু আবূ সাফর থেকে, তিনি শু‘বা (রহ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (রহ) বলেছেন : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ -এই আয়াতটি মুসলিমদের জন্য। ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে যালিম’’ -এই আয়াতটি ইয়াহুদীদের উদ্দেশ্যে। ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে ফাসিক্ব’’ -এই আয়াতটি নাসারাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। অনুরূপ হুশাইম ও সাওরী থেকে, তাঁরা যাকারিয়া বিন আবী যায়েদাহ থেকে, তিনি শু‘বা থেকে বর্ণনা রয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন : আমাদের খবর দিয়েছেন মুআম্মার, তিনি ইবনু তাউস থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : ইবনু আব্বাস (রহ)-কে আল্লাহর বাণী- ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি (রা) বললেন : هي به كفر এটা কুফর। তাউস (রহ) বলেন : এটা আল্লাহ, মালাইকা, আসমানী কিতাব ও রসূলকে অস্বীকার করার মতো কুফর নয়। [.তাউস থেকে ইবনু আব্বাস (রা) ও তাউসের নিজের বর্ণনাটি মূলত একটি বর্ণনা। যা পরবর্তীতে ‘তাফসীরে খাযেন’-এর উদ্ধৃতিতে তাউসের সাথে ইবনু আব্বাস (রা)-এর প্রশ্নোত্তরে সুস্পষ্ট হবে। অনেকে উদ্ধৃতিগুলো ভিন্ন ভিন্ন মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, ভুল পথের দাও‘য়াত দিচ্ছেন। -সঙ্কলক] সাওরী বলেন : তিনি জুরাইজ থেকে, তিনি আতা (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রহ) বলেন : কুফরের মধ্যে কম-বেশি আছে, যুলুমের মধ্যে কম বেশি আছে, তেমনি ফিসক্বের মধ্যেও কম-বেশী আছে- (ইবনু জারীর)। তিনি বলেন, ওয়াকী সুফিয়ান থেকে, তিনি সাঈদ আল-মাক্কী থেকে, তিনি তাউস (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ আয়াতটি সম্পর্কে তিনি (রহ) বলেন : এ ধরনের কুফরের জন্য কেউ মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ হয় না।
আবূ হাতিম বলেন : আমাদের হাদীস বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন ইয়াযীদ মুকির্রী, (তিনি বলেন) আমাদের সুফিয়ান বিন উয়ায়না হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি হিশাম বিন হুজায়ের থেকে, তিনি তাউস থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (রা) আল্লাহর বাণী : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ সম্পর্কে বলেন : আয়াতটিতে সেই কুফরের কথা বলা হয়নি, যার দিকে এরা গিয়েছে। হাকিম তার মুস্তাদরাকে এটি বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী বলে, এটা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তে সহীহ, কিন্তু তারা উদ্ধৃত করেননি।
৩.তাফসীরে খাযেন : ইমাম আবূল হাসান (খাযেন) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর لباب التأويل في معاني التنْزيل এ বলেন :
﴿ ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ﴾ بِمعنَى : أن اليهود لَما أنكروا حكم الله تعالَى الْمنصوص عليه فى التوراة وقالوا إنه غير واجب عليهم ، فهم كافرون على الإطلاق بِموسى والتوراة وبِمحمد ﷺ والقرآن واختلف العلماء فيمن نزلت هذه الآيات الثلاث وهي قوله : ﴿ ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الظالِمون ، ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الفاسقون ﴾ فقال جَماعة من الْمفسرين : الآيات الثلاث نزلت فى الكفار ومن غير حكم الله من اليهود ، لأن الْمسلم وإن ارتكب كبيْرة ، لا يقال إنه كافر وهذا قول ابن عباس وقتادة والضحاك . ويدل على صحة هذا القول ما روي عن البَراء بن عازب قال أنزل الله تبارك وتعالى : ﴿ ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الظالِمون ، ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الفاسقون ﴾ فى الكفار لكلها أخرجه مسلم وعن ابن عباس قال ﴿ ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ﴾ إلَى قوله هم الفاسقون هذه الآيات الثلاث فى اليهود خاصة قريظة والنضير أخرجه أبو داود . وقال مُجاهد : فى هذه الآيات الثلاث من ترك الحكم بِما أنزل الله رداً لكتاب الله فهو كافر ظالِم فاسق .
وقال عكرمة ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله جاحداً به فقد كفر ومن أقر به ولّم يَحكم به فهو ظالِم فاسق وهذا قول ابن عباس أيضاً واختار الزجاج لأنه قال : من زعم أنّ حكماً من أحكام الله تعالى التّي أتانا بِها الأنبياء باطل فهو كافر . وقال طاوس : قلت لابن عباس أكافر من لّم يَحكم بِما أنزل الله؟ فقال : به كفر وليس بكفر ينقل عن الْملة كمن كفر بالله وملائكته ورسله واليوم الآخر ونَحو هذا روي عن عطاء . وقال : هو كفر دون الكفر . وقال ابن مسعود والْحسن والنخعي : هذه الآيات الثلاث عامة فى اليهود وفي هذه الأمة فكل من ارتشى وبدل الْحكم فحكم بغير حكم الله فقد كفر وظلم وفسق وإليه ذهب السدي لأنه ظاهر الْخطاب . وقيل : هذا فيمن علم نص حكم الله ثُم رده عياناً عمداً وحكم بغيره وأما من خفي عليه النص أو أخطأ فى التأويل فلا يدخل فى هذا الوعيد والله أعلم بِمراده .
‘‘ ومن لّم يَحكم ... আয়াতটির দাবি : নিশ্চয় ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা তাওরাতের মাধ্যমে তাদের উপর বিধিবদ্ধকৃত আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার করত এবং বলত এটা জারি করা আমাদের জন্য ওয়াজিব নয় (তাদের সাথে সম্পৃক্ত) তাদের কুফর হল, মূসা (আ) -এর তাওরাত এবং মুহাম্মাদ (স) -এর কুরআনকে বর্জন করা। আলেমদের মধ্যে (সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭) আয়াত তিনটির নাযিলের প্রেক্ষাপট নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একদল মুফাসসিরীন বলেছেন : আয়াত তিনটি ইয়াহুদীদের মধ্যকার কাফিরদের ব্যাপারে নাযিল হয় যারা আল্লাহর হুকুমের বিরোধী বিধান জারি করত। কেননা, মুসলিম (যে কুরআন ও মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি প্রকাশ্য ঈমান এনেছে, সে) যদি কাজটি করে তবে তা কবীরা গুনাহর অন্তর্ভূক্ত। তাকে কাফির সম্বোধন করা যাবে না- এটা ইবনু আব্বাস (রা), ক্বাতাদাহ ও যাহ্হাকের উক্তি। তাঁদের উক্তির বিশুদ্ধতার স্বপক্ষে বারা বিন আযিব এর বর্ণনা আছে। তিনি (রা) বলেন : ... কাফির ... যালিম.... ফাসিক্ব (আয়াত তিনটি) কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে -(সহীহ মুসলিম)। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : ‘‘... কাফির ... যালিম.... ফাসিক’’ আয়াত তিনটি ইয়াহুদী গোত্র কুরায়যা ও বনূ নাযীরের ক্ষেত্রে খাস- (আবূ দাউদ)। মুজাহিদ বলেছেন : যারা আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুমকে লঙ্ঘন করে আল্লাহর কিতাব হিসাবে রদ (খণ্ডন) করে- তারাই কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব।
ইকরামা (রহ) বলেন : যারা আল্লাহর হুকুম জারি না করার জন্য চেষ্টারত- তারা কাফির। আর যারা স্বীকার করে কিন্তু সে অনুযায়ী বিধান জারি করে না তারা যালেম ও ফাসেক্ব। ইবনু আব্বাস (রা)-এর মতও অনুরূপ। যাজ্জাজ এটা গ্রহণ করেছেন। কেননা তিনি বলেন : যে মনে করে বিধানের মধ্যে যেগুলো আল্লাহ তাআলা’র আহকাম, যা আম্বিয়া (আ)-গণ এনেছিলেন- সেগুলো বাতিল, তবে সে কাফির। তাউস বলেছেন : ইবনু আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি করে না সে কি বড় কাফির? তিনি বললেন : به كفر এটা কুফর, তবে এ কুফর দ্বারা মিল্লাত (দ্বীন) থেকে বহিষ্কার হয় না; যেভাবে আল্লাহ, তাঁর মালাইকা, তাঁর রসূল, আখিরাত প্রভৃতির কুফর (মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে)। [.আখবারুল কা‘যা গ্রন্থে (১/৪১ পৃষ্ঠা) ইবনু আব্বাসের উক্তিটি হল : كفى به كفره ‘‘কুফরের জন্য এটাই যথেষ্ট।’’ যা নিঃসন্দেহে তাউসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। পক্ষান্তরে তাউস কর্তৃক ‘তাফসীরে খাযেনের’ উল্লিখিত বর্ণনাটি পূর্ণাঙ্গ। এ পর্যায়ে বর্ণনাগুলো একটি অপরটির ব্যাখ্যা। তাছাড়া كفى به كفره দ্বারাও বড় এবং ছোট উভয় কুফর অর্থ হতে পারে। এ সম্পর্কে ‘‘আয়াতে তাহক্বীম ও সালফে সালেহীন’’ অধ্যায়ে হাফেয ইবনু ক্বাইয়েমের (রহ) উদ্ধৃতি আসবে ইনশাআল্লাহ। -সঙ্কলক] আতা থেকেও এমনটি বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘তিনি (ইবনু আব্বাস (রা)) এটাও বলেছেন : هو كفر دون الكفر ‘‘এটি কুফরের চেয়ে কম কুফর।’’ ইবনু মাসউদ, হাসান ও নাখাঈ বলেছেন : আয়াত তিনটি ‘আমভাবে ইয়াহুদী ও এই উম্মাতের জন্য। তাদের মধ্যে যারা ঘুষ নেয় এবং বিধান বদলে দেয়, ফলে তা আল্লাহর হুকুমের বিরোধী হলে তবে সে কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব। সুদ্দীও আয়াতের বাহ্যিক সম্বোধন দ্বারা এ দিকেই গিয়েছেন। [.এই উক্তির মাধ্যমে আমালী ও আক্বীদাগত কুফরের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয় না। যার কারণে উভয় পক্ষই এ ধরনের উদ্ধৃতি দ্বারা নিজেদের স্বপক্ষে দলিল গ্রহণ করে থাকে। তবে ঘুষ সম্পর্কিত আমলটি দ্বারা আমরা এভাবে সমন্বয় করতে পারি যে, যখন ঘুষ গ্রহণ কেবল আমলের দিক থেকে হয় তখন তা ‘আমালী কুফর’ এবং যখন এর সীমা আক্বীদা-বিশ্বাসের দিক থেকেও হয় তখনই কেবল চূড়ান্ত কুফর হয়। যা ইসলাম থেকে তাকে বহিষ্কার করে। -সঙ্কলক] (তবে) দুর্বল মত হল : যার আল্লাহর হুকুমের প্রমাণ জানা আছে, অতঃপর তা জেনে-বুঝে রদ করে এবং বিপরিত হুকুম দেয়; তেমনি যে আল্লাহর দলিল-প্রমাণ গোপন করে অথবা ব্যাখ্যা দ্বারা বিকৃত করে সে উক্ত হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লাহই এই হুকুমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞাত আছেন।
(তাফসীরে খাযেন, সূরা মায়িদার ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর)
৪.তাফসীরে বগভী : মুহিউস সুন্নাহ ইমাম বগভী (রহ) তাঁর তাফসীর ‘ معالِم التنْزيل ’-এ লিখেছেন :
قال قتادة والضحاك : نزلت هذه الآيات الثلاث في اليهود دون من أساء من هذه الأمة . رُوي عن البَراء بن عازب رضي الله عنه في قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ والظالِمون والفاسقون كلها في الكافرين، وقيل : هي على الناس كلهم . وقال ابن عباس وطاوس : ليس بكفر ينقل عن الْملة، بل إذا فعله فهو به [ كافر ] وليس كمن كفر بالله واليوم الآخر .
قال عطاء : هو كفر دون كفر، وظلم دون ظلم، وفسق دون فسق، وقال عكرمة معناه : ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله جاحدا به فقد كفر، ومن أقرّ به ولَم يَحكم به فهو ظالِم فاسق . وسئل عبد العزيز بن يَحيى الكناني عن هذه الآيات، فقال : إنّها تقع على جَميع ما أنزل الله لا على بعضه، فكل من لّم يَحكم بِجميع ما أنزل الله فهو كافر ظالِم فاسق، فأما من حكم بِما أنزل الله من التوحيد وترك الشرك، ثُم لَم يَحكم [ بِجميع ] ما أنزل الله من الشرائع لَم يستوجب حكم هذه الآيات .
‘‘ক্বাতাদাহ ও যাহ্হাক বলেছেন : এই তিনটি আয়াত ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, তেমনি এই উম্মাতের পাপীদের সম্পর্কেও। বারা বিন আযিব (রা) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর বাণী : ‘যারা হুকুম জারি করে না আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী, তারাই কাফির...... যালিম, ......ফাসিক্ব’’ -এর সবগুলোই কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত। বলা হয় : সমস্ত মানুষ এর অন্তর্ভূক্ত। ইবনু আব্বাস (রা) ও তাউস (রহ) বলেছেন : এই কুফর মিল্লাত (দ্বীন) থেকে বের করে দেয় না, বরং যখন কেউ আমলটি করে তখন সেটা (কুফর) হয়। তবে এটা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি কুফর করার মত নয়।
আতা (রহ) বলেছেন : এটা কুফরের চেয়ে কম কুফর, যুলুমের চেয়ে কম যুলম, ফিসক্বের চেয়ে কম ফিসক্ব। অনুরূপ অর্থে ইকরামাহ বলেছেন : যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি করে না, অস্বীকার করে সে কাফির। আর যে স্বীকৃতি দেয় কিন্তু বিধান জারি করে না সে যালিম ও ফাসিক্ব। আব্দুল আযীয বিন ইয়াহইয়া আল-কিনানীকে আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : এটি আল্লাহর নাযিলকৃত সমস্ত বিধানের ক্ষেত্রে সংঘটিত হলে প্রযোজ্য, বিশেষ কিছুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ যে সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না সে কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব। সুতরাং যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী তাওহীদের অন্তর্ভুক্ত ও শিরক ত্যাগকারী এবং (কিছু কিছু ক্ষেত্রে) আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী শরিআতী বিষয় জারি করে না, তবে তার প্রতি আলোচ্য আয়াতটির প্রয়োগ ওয়াজিব হয় না।
[তাফসীরে বগভী, সূরা মায়িদা : ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর]
৫.তাফসীরে কাবীর : ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর সুবিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ مفاتيح الغيب -এ আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
قال : ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله فَأُوْلَئِكَ هُمُ الكافرون ﴾ وفيه مسألتان : الْمسألة الأولَى : الْمقصود من هذا الكلام تَهديد اليهود في إقدامهم على تَحريف حكم الله تعالَى في حد الزانِي الْمحصن ، يعنِي أنّهم لَما أنكروا حكم الله الْمنصوص عليه في التوراة وقالوا : إنه غيْر واجب ، فهم كافرون على الاطلاق ، لا يستحقون اسم الإيْمان لا بِموسى والتوراة ولا بِمحمد والقرآن .
الْمسألة الثانية : قالت الْخوارج : كل من عصى الله فهو كافر . وقال جَمهور الأئمة : ليس الأمر كذلك ، أما الْخوارج فقد احتجوا بِهذه الآية وقالوا : إنّها نص في أن كل من حكم بغيْر ما أنزل الله فهو كافر ، وكل من أذنب فقد حكم بغيْر ما أنزل الله ، فوجب أن يكون كافراً . وذكر الْمتكلمون والْمفسرون أجوبة عن هذه الشبهة :
الأول : أن هذه الآية نزلت في اليهود فتكون مُختصة بِهم ، وهذا ضعيف لأن الاعتبار بعموم اللفظ لا بِخصوص السبب ، ومنهم من حاول دفع هذا السؤال فقال : الْمراد ومن لّم يَحكم من هؤلاء الذين سبق ذكرهم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، وهذا أيضاً ضعيف لأن قوله ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله ﴾ كلام أدخل فيه كلمة ﴿ مِنْ ﴾ في معرض الشرط ، فيكون للعموم . وقول من يقول : الْمراد ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله من الذين سبق ذكرهم فهو زيادة في النص وذلك غيْر جائز .
الثانِي : قال عطاء : هو كفر دون كفر . وقال طاوس : ليس بكفر ينقل عن الْملة كمن يكفر بالله واليوم الآخر ، فكأنّهم حَملوا الآية على كفر النعمة لا على كفر الدين ، وهو أيضاً ضعيف ، لأن لفظ الكفر إذا أطلق انصرف إلى الكفر في الدين .
والثالث : قال ابن الأنباري : يَجوز أن يكون الْمعنى : ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فقد فعل فعلاً يضاهي أفعال الكفار ، ويشبه من أجل ذلك الكافرين ، وهذا ضعيف أيضاً لأنه عدول عن الظاهر .
والرابع : قال عبد العزيز بن يَحيى الكنانِي : قوله ﴿ بِمَا أنزَلَ الله ﴾ صيغة عموم ، فقوله ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله ﴾ معناه من أتى بضد حكم الله تعالى في كل ما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، وهذا حق لأن الكافر هو الذي أتى بضد حكم الله تعالى في كل ما أنزل الله ، أما الفاسق فإنه لّم يأت بضد حكم الله إلاّ في القليل ، وهو العمل ، أما في الاعتقاد والاقرار فهو موافق ، وهذا أيضاً ضعيف لأنه لو كانت هذه الآية وعيداً مَخصوصاً بمن خالف حكم الله تعالى في كل ما أنزل الله تعالَى لّم يتناول هذا الوعيد اليهود بسبب مُخالفتهم حكم الله في الرجم ، وأجْمع الْمفسرون على أن هذا الوعيد يتناول اليهود بسبب مُخالفتهم حكم الله تعالى في واقعة الرجم ، فيدل على سقوط هذا الجواب ،
والْخامس : قال عكرمة : قوله ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله ﴾ إنّما يتناول من أنكر بقلبه وجحد بلسانه ، أما من عرف بقلبه كونه حكم الله وأقر بلسانه كونه حكم الله ، إلا أنه أتى بما يضاده فهو حاكم بما أنزل الله تعالى ، ولكنه تارك له ، فلا يلزم دخوله تَحت هذه الآية ، وهذا هو الْجواب الصحيح والله أعلم .
মহান আল্লাহ বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা হুকুম জারি করে না তারাই কাফির’’-এ আয়াতে দু’টি মাসআলা আছে :
প্রথম মাসআলা : আলোচ্য বাক্যের উদ্দেশ্য হল, ইয়াহুদীদের ভীতি প্রদর্শন করা, কেননা বিবাহিত যেনাকারীর হদের (শাস্তির) ব্যাপারে আল্লাহর দেওয়া বিধানকে তারা বিকৃত করে নিজেদের মধ্যে ক্বায়েম রেখেছিল। কেননা তাদের উপর বিধিবদ্ধকৃত তাওরাতের হুকুমকে তারা অস্বীকার করেছিল। তারা বলত : এটা জারি করা তাদের উপর ওয়াজিব নয়। এই নিকৃষ্ট কাজের জন্য তারা কাফির। তারা প্রকৃত ঈমানের দাবি পূরণ করত না, মূসার (আ)-এর তাওরাতের প্রতিও না এবং মুহাম্মাদ (স) ও কুরআনের প্রতিও ঈমান রাখত না।
দ্বিতীয় মাসআলা : খারেজীরা বলে : যে কোন ব্যাপারে আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী কাফির। কিন্তু অধিকাংশ ইমামগণ বলেছেন : এমনটি নয়। তবে খারেজীরা আয়াতটি দ্বারা নিজেদের পক্ষে দলিল গ্রহণ করে থাকে। তারা বলে : এ থেকে প্রমাণ পাওয়া গেল, যে কোন বিষয়েই কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী হুকুম দিলে সে কাফির। তেমনি যে ব্যক্তি এমন কোন পাপে জড়িত হয় যা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী (বা পাপ হিসাবে স্বীকৃত), তবে তার কাফির হওয়াটা ওয়াজিব (নিশ্চিত)। মুতাকাল্লিম ও মুফাস্সিরগণ এই সংশয়ের যে জবাব দিয়েছেন তা নিম্নরূপ:
প্রথমত : আয়াতটি ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়, এজন্য এর দাবি তাদের সাথে খাস (সুনির্দিষ্ট)। এ মতটি যঈফ, কেননা শব্দের ‘আম দাবির ভিত্তিতে এর সবব (কারণটি) সুনির্দিষ্ট হয় না। যারা আলোচ্য বিতর্কটি খণ্ডনের চেষ্টা করেন, তারা বলেন : আয়াতের উদ্দেশ্য হল, যারা হুকুম করে না যা তাদের প্রতি পূর্বে (তাওরাত/ইনজিলে) আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে- তারাই কাফির। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله বাক্যগুলোর মধ্যকার ‘‘ من ’’ শব্দটি মা‘রিযে শর্ত ( معرض الشرط ), যার দাবিই ‘আম (ব্যাপকার্থক) নেয়া। আর যারা বলে থাকেন : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله এর উদ্দেশ্য তারাই যাদের বর্ণনা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি উক্ত দলিলের মধ্যে অতিরিক্ত সংযোজন -যা জায়েয নয়।
দ্বিতীয়ত : আতা (রহ) বলেছেন, এটা كفر دون كفر (কুফরের চেয়ে কম কুফর)। তাউস বলেছেন : এটা এমন কুফর নয় যা মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে, যেভাবে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি কুফর (বহিষ্কার করে)। কেননা তাদের ব্যাপারে আয়াতটির সম্পৃক্ততা ‘কুফরুন নিয়ামাত’ (প্রদত্ত বিষয়াদির প্রতি কুফর) ছিল, ‘কুফরুদ দ্বীন’ (দ্বীনের মধ্যকার কুফর) ছিল না। এই মতটিও যঈফ। কেননা এখানে আল-কুফর শব্দটি দ্বীনের কুফরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।
তৃতীয়ত : ইবনুল আম্বাবারী (রহ) বলেন : আয়াতটির জায়েয অর্থ হল- আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করার আমলটি কারো দ্বারা বাস্তবায়িত হলে তা কাফিরদের আমলের মতো। অর্থাৎ কাফিরদের বাড়াবাড়ির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এটাও দুর্বল উপস্থাপনা। কেননা তাদের বিমুখতা সুস্পষ্ট।
চতুর্থত : আব্দুল আযীয বিন ইয়াহইয়া আল-কিনানী বলেন, আল্লাহর বাণী : بِما انزل الله সিগায়ে আম। সুতরাং আল্লাহর বাণী : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله -এর অর্থ হল, যদি কেউ আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত সমস্ত হুকুমের বিরোধিতা করে তবে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত। আর ফাসিক হল, যে ব্যক্তি আমলের ব্যাপারে অল্প কিছু ছাড়া আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে যায় না। আর যদি সে আক্বীদা ও স্বীকৃতির ব্যাপারে তেমনটি করে তবেও অনুরূপ (কাফির) হবে। এটাও একটি যঈফ উপস্থাপনা। কেননা যদি আয়াতটির ধমকি এমন ব্যক্তিদের জন্য সুনির্দিষ্ট হতো যারা সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধিতা করে, তবে আয়াতের ধমকীর সম্পৃক্ততা ইয়াহুদীদের সাথে হতো না- যারা (সুনির্দিষ্টভাবে) রজমের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করেছিল। মুফাসসিরগণের ইজমা‘ হল, আলোচ্য ধমকী ইয়াহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত- যারা রজম সম্পর্কিত ঘটনাতে আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করেছিল। সুতরাং এই দলিল দ্বারা পূর্বোক্ত জবাবটি খণ্ডিত হয়।
পঞ্চমত : ইকরামাহ (রহ) বলেছেন, আল্লাহর বাণী : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله -এর সম্পৃক্ততা তার সাথে, যে আন্তরিকভাবে অস্বীকার করে এবং মৌখিকভাবেও (বিরোধিতার) চেষ্টা করে। যদি কারো পরিচয় পাওয়া যায়, সে আন্তরিকভাবে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী কাজ করে এবং মৌখিকভাবেও আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী স্বীকৃতি দেয়- তবে যদি তাকে হাকিম হিসাবে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরিতে পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি কেবল (আমলগত আল্লাহর নির্দেশটি) তরককারী। তাকে এ আয়াতটির অন্তর্ভুক্ত করাটা ওয়াজিব হয় না। এটাই (পূর্ণাঙ্গ) সহীহ জবাব, আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
[সংযোজন : পূর্বোক্ত পাঁচটি বক্তব্যের মৌলিক দাবি এক হলেও, খারেজীদের জবাবে শেষোক্ত ইকরামাহ (রহ)-এর উদ্ধৃতিতে পূর্ণাঙ্গতা সুস্পষ্ট। মূলত এটাই ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ)-এর বক্তব্যের দাবি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। -সঙ্কলক]
এছাড়া ইমাম আলূসীর (রহ)-এর ‘‘তাফসীরে রুহুল মাআনী’’, ইমাম শওকানীর ‘‘তাফসীরে ফতহুল ক্বাদীর’’ প্রভৃতিতেও উপরোক্ত তাফসীরসমূহের ব্যাখ্যাই অনুসৃত হয়েছে। সুতরাং আমরা এটাই বলতে পারি আহলে সুন্নাতের স্বীকৃত মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ আলোচ্য সূরা মা‘য়িদার ৪৪-৪৭ নং আয়াতের যে তাফসীর করেছিলেন, এ শতাব্দীর মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক্ব মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-ও সেই পথই অনুসরণ করেছেন।
[এই পুস্তকের শুরুতে শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) কর্তৃক ইমাম ইবনু জারীর তাবারীর ‘তাফসীরে তাবারী' থেকে এ সম্পর্কিত বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এখন আলোচ্য আয়াতটির ব্যাপারে আরো কয়েকটি প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেয়া হল। যেন এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের মুফাসসিরদের আক্বীদাগত উপস্থাপনার ব্যাপারে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ না থাকে। - সঙ্কলক]
১.তাফসীরে কুরতুবী : ইমাম কুরতুবী (রহ) তাঁর বিখ্যাত ‘‘আল-জামেউ লি-আহকামিল কুরআন’’-এ আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন :
قوله تعالى : ﴿ومن لَم يَحكم بما أنزل الله فأولئك هم الكافرون﴾ و ﴿الظالِمون﴾ و ﴿الفاسقون﴾ نزلت كلها في الكفار ثبت ذلك في صحيح مسلم من حديث البراء وقد تقدم وعلى هذا الْمعظم فأما الْمسلم فلا يكفر وإن ارتكب كبيرة وقيل : فيه إضمار أي ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله ردا للقرآن وجحدا لقول الرسول عليه الصلاة والسلام فهو كافر قاله ابن عباس ومُجاهد فالآية عامة على هذا قال ابن مسعود والْحسن : هي عامة في كل من لَم يَحكم بِما أنزل الله من الْمسلمين واليهود والكفار أي معتقدا ذلك ومستحلا له فأما من فعل ذلك وهو معتقد أنه راكب مُحرم فهو من فساق الْمسلمين وأمره إلَى الله تعالَى إن شاء عذبه وإن شاء غفر له وقال ابن عباس في رواية : ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فقد فعل فعلا يضاهي أفعال الكفار وقيل : أي ومن لَم يَحكم بِجميع ما أنزل الله فهو كافر فأما من حكم بالتوحيد ولَم يَحكم ببعض الشرائع فلا يدخل في هذه الآية والصحيح الأول إلا أن الشعبي قال : هي في اليهود خاصة واختاره النحاس قال : ويدل على ذلك ثلاثة أشياء منها أن اليهود قد ذكروا قبل هذا في قوله ﴿للذين هادوا﴾ فعاد الضميْر عليهم ومنها أن سياق الكلام يدل على ذلك ألا ترى أن بعده ﴿وكتبنا عليهم﴾ فهذا الضميْر لليهود بإجْماع وأيضا فإن اليهود هم الذين أنكروا الرجم والقصاص فإن قال قائل : ﴿من﴾ إذا كانت للمجازاة فهي عامة إلا أن يقع دليل على تَخصيصها قيل له : ﴿من﴾ هنا بِمعنى الذي مع ما ذكرناه من الأدلة والتقدير : واليهود الذين لَم يَحكموا بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون فهذا من أحسن ما قيل في هذا ويروى أن حذيفة سئل عن هذه الآيات أهي في بني اسرائيل قال : نعم هي فيهم ولتسلكن سبيلهم حذو النعل بالنعل وقيل : ﴿الكافرون ﴾ للمسلمين و ﴿الظالِمون﴾ لليهود و ﴿الفاسقون﴾ للنصارى وهذا اختيار أبي بكر بن العربِي قال : لأنه ظاهر الآيات وهو اختيار بن عباس وجابر بن زيد وابن أبي زائدة وابن شبرمة والشعبِي أيضا قال طاوس وغيْره : ليس بكفر ينقل عن الْملة ولكنه كفر دون كفر وهذا يَختلف إن حكم بِما عنده على أنه من عند الله فهو تبديل له يوجب الكفر وإن حكم به هوى ومعصية فهو ذنب تدركه الْمغفرة على أصل أهل السنة في الغفران للمذنبين قال القشيري : ومذهب الْخوارج أن من ارتشى وحكم بغير حكم الله فهو كافر وعزي هذا إلَى الْحسن والسدي وقال الْحسن أيضا : أخذ الله عز وجل على الْحكام ثلاثة أشياء : ألا يتبعوا الْهوى وألا يَخشوا الناس ويَخشوه وألا يشتروا بأياته ثَمنا قليلا
‘‘আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা হুকুম করে না আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা, তারাই কাফির ... যালিম .... ফাসিক্ব’’। আয়াতগুলো সম্পূর্ণরূপে কাফিরদের ব্যাপারে নাযিল হয়, যা সহীহ মুসলিমের বারা বিন আযিব (রা) থেকে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, আর এটাই প্রাধান্যপ্রাপ্ত। আর মুসলিমের ক্ষেত্রে কুফর হওয়া প্রযোজ্য নয়, আর যদি সে তা করে তবে কবীরা গোনাহগার হবে। বলা হয়, এখানে কিছু (বিষয়) ঊহ্য আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত কুরআনকে রদ (বাতিল গণ্য) করে, রসূলের (হাদীসের) বিরোধিতা করে- সে কাফির। ইবনু আব্বাস (রা) ও মুজাহিদ (রহ) আয়াতটির ‘আম দাবির ভিত্তিতে এমনটি বলেছেন। ইবনু মাসউদ (রা) ও হাসান (রহ) বলেছেন : ‘আমভাবে এটা তথা ‘‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম না করা’’ -মুসলিম, ইয়াহুদী, কাফির সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; অর্থাৎ যদি তারা আক্বীদাগতভাবে সেটিকে (বিধান জারি না করাকে) হালাল বা বৈধ গণ্য করে। আর যদি আমলগতভাবে তা করে অথচ আক্বীদা রাখে যে, হারাম কাজ করছে তবে সে মুসলিমদের মধ্যে ফাসিক্ব বলে গণ্য হবে। তার ব্যাপারটি আল্লাহ উপর ন্যস্ত। ইচ্ছা করলে তিনি আযাব দিবেন, ইচ্ছা করলে মাফ করবেন। ইবনু আব্বাস (রহ) বর্ণনা করেছেন : যদি কেউ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হুকুম না করে- তবে তা কাফিরদের আমলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আরও বলা হয় : যদি কেউ সামগ্রিকভাবে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হুকুম না করে- তবে সে কাফির। আর যা তাওহীদের হুকুমের অন্তর্গত এবং শরীআতের কোন কোন হুকুমের ক্ষেত্রে হলে, তবে সেটা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে প্রথম উক্তিটিই সহীহ। অবশ্য শা‘বী (রহ) বলেছেন : এখানে ইয়াহুদীদের খাস (সুনির্দিষ্ট) করা হয়েছে। নুহাস এটি গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন : ‘‘এর দলিল হিসেবে তিনটি বিষয় রয়েছে। (প্রথমত :) এখানে ইয়াহুদীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেভাবে আল্লাহ তাআলা বলেছেন : " للذين هادوا ", যার যমীর (সর্বনাম) তাদের সাথে সম্পৃক্ত। এ সম্পর্কিত (পূর্বাপর) বর্ণনা প্রসঙ্গও এর দলিল হিসাবে সাব্যস্ত হয়। (দ্বিতীয়ত :) বিশেষভাবে লক্ষণীয় পরবর্তী শব্দ " للذين هادوا "-যার যমীর (সর্বনাম) ইয়াহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘ হয়েছে। (তৃতীয়ত :) অনুরূপভাবে ইয়াহুদীরা রজম ও ক্বিসাসকে অস্বীকার করেছিল।
যদি কেউ বলে : এখানে ‘ من ’ শব্দটি যখন ফলাফল হিসাবে আসে তখন এর দাবি ‘আম (ব্যাপক), তবে যদি কোন দলিল দ্বারা খাস করা যায়। তাদেরকে বলা যায় : এখানে ‘ من ’ শব্দটির অর্থ الذى যা দলিল দ্বারা সাব্যস্ত হয়। এটি ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট। এটিই সর্বোত্তম উক্তি। বর্ণিত আছে, হুযায়ফা (রা) কে আয়াতটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, এখানে কি বনী ইসরাঈল সম্পর্কে ওহি করা হয়েছে? তিনি বললেন : ‘‘হাঁ! এটা তাদেরই সম্পর্কে। তোমরা তাদের পথে রয়েছ, প্রতি পদে পদে।’’
অনেকে বলেছেন : মুসলিমদের ক্ষেত্রে " الكافرون ", ইয়াহুদীদের ক্ষেত্রে " الظالِمون ", নাসারাদের ক্ষেত্রে " الفاسقون " প্রযোজ্য। আবূ বকর ইবনুল আরাবী আয়াতের প্রকাশ্য ভাব দ্বারা এই অর্থ নিয়েছেন। এই মত ইবনু আব্বাস (রা), জাবির বিন যায়েদ, ইবনু আবী যায়েদাহ, ইবনু শিবরামাহ প্রমুখ গ্রহণ করেছেন। তাউস (রহ) ও অন্যান্যরা বলেছেন : ‘‘এটা এমন কুফর নয় যা মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে, বরং এটি কুফরের থেকে কম কুফর।’’
এ ব্যাপারে ইখতিলাফ আছে, যদি তারা হুকুম দেয় তাদের নিকট আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে বিকৃত করে, তবে সেক্ষেত্রে কুফর হওয়াটা নিশ্চিত। আর যদি হুকুম করে স্বেচ্ছাচারীতা ও অন্যায়ের মধ্যে দিয়ে তবে তা হবে ক্ষমাযোগ্য পাপ। যা আহলে সুন্নাতের ‘পাপীদের জন্য ক্ষমা’ নীতির অন্তর্ভুক্ত।
কুশায়রী (রহ) বলেন : খারেজী মাযহাব হল, যদি ঘুষ নেয় বা আল্লাহর বিধানের বিরোধী হুকুম দেয় তবে সে কাফির। হাসান ও সুদ্দীর মত এটাই। [.পূর্বে ইমাম কুরতুবী থেকে ইবনু মাস‘উদ ও হাসানের রেখাঙ্কিত উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণ হয়েছে, তারা খারেজীদের মত পোষণ করতেন না। বরং মুসলিমদের ক্ষেত্রে ‘আমালী কুফর গণ্য করতেন। সুতরাং খারেজীদের উদ্ধৃতি দেয়ার পর হাসান ও সুদ্দীর উদ্ধৃতির উল্লেখ স্ববিরোধী হয়। আমরা বলব, খারেজীদের বিশ্বাসের পরে হাসান ও সুদ্দীর বর্ণনার দাবি তাদের থেকে বর্ণিত অন্যান্য দলিল থেকে ব্যাখ্যা নিতে হবে। যা সামনে বর্ণিত হবে ইনঁশাআল্লাহ। -সঙ্কলক] আর এ ব্যাপারে হাসান আরও বলেছেন : আল্লাহ তাআলা তিন শ্রেণির হাকিমকে পাকড়াও করবেন- যারা নিজের স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ করেন, যারা লোকদের ভয় করে ও লোকেরা তাদের ভয় করে, যারা সামান্য বিনিময়ে আল্লাহর আয়াত বিক্রি করে।
[তাফসীরে কুরতুবী সূরা ৫ মায়িদাহ : ৪৪ আয়াত এর তাফসীর দ্র :]
২.তাফসীরে ইবনু কাসির : ইমাম ইবনু কাসির (রহ) তাঁর তাফসীরে আয়াতটি তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন :
وقوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال البراء بن عازب، وحذيفة بن اليمان، وابن عباس، وأبو مِجْلزٍ، وأبو رَجاء العُطارِدي، وعِكْرِمة، وعبيد الله بن عبد الله، والْحسن البصري، وغيرهم : نزلت في أهل الكتاب -زاد الْحسن البصري : وهي علينا واجبة . وقال عبد الرزاق عن سفيان الثوري، عن منصور، عن إبراهيم قال : نزلت هذه الآيات في بنِي إسرائيل، ورضي الله لِهذه الأمة بِها . رواه ابن جرير .
وقال ابن جرير أيضًا : حدثنا يعقوب، حدثنا هُشَيْم، أخبَرنا عبد الْملك بن أبي سليمان، عن سلمة بن كُهَيل، عن عَلْقَمَة ومسروق أنّهما سألا ابن مسعود عن الرشوة فقال : من السُّحْت : قال : فقالا وفي الْحكم؟ قال : ذاك الكفر ! ثُم تلا ﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾
وقال السُّدِّي : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ يقول : ومن لَم يَحكم بِما أنزلتُ فتركه عمدًا، أو جار وهو يعلم، فهو من الكافرين [ به ] وقال علي بن أبي طلحة، عن ابن عباس، قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : من جحد ما أنزل الله فقد كفر . ومن أقر به ولَم يَحكم فهو ظالِم فاسق . رواه ابن جرير . ثُم اختار أن الآية الْمراد بِها أهل الكتاب، أو من جحد حكم الله الْمنْزل في الكتاب .
وقال عبد الرزاق، عن الثوري، عن زكريا، عن الشعبي : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ ﴾ قال : للمسلميْن . وقال ابن جرير : حدثنا ابن الْمثنى، حدثنا عبد الصمد، حدثنا شعبة، عن ابن أبي السفر، عن الشعبي : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : هذا في الْمسلمين، ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ﴾ قال : هذا في اليهود، ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ﴾ قال : هذا في النصارى . وكذا رواه هُشَيْم والثوري، عن زكريا بن أبي زائدة، عن الشعبي .
وقال عبد الرزاق أيضًا : أخبْرنا مَعْمَر، عن ابن طاوس عن أبيه قال : سئل ابن عباس عن قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : هي به كفر -قال ابن طاوس : وليس كمن كفر بالله وملائكته وكتبه ورسله . وقال الثوري، عن ابن جُرَيْج عن عطاء أنه قال : كفر دون كفر، وظلم دون ظلم، وفسق دون فسق . رواه ابن جرير . وقال وَكِيع عن سفيان، عن سعيد الْمكي، عن طاوس : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : ليس بكفر ينقل عن الْملة .
وقال ابن أبي حاتِم : حدثنا مُحمد بن عبد الله بن يزيد الْمقري، حدثنا سفيان بن عيينة، عن هشام بن حُجَير، عن طاوس، عن ابن عباس في قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قال : ليس بالكفر الذي يذهبون إليه . ورواه الْحاكم في مستدركه، عن حديث سفيان بن عيينة، وقال : صحيح على شرط الشيخين ولَم يَخرجاه .
‘‘আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির।’’ বারা ইবনু আযিব, হুযাইফা ইবনু ইয়ামান, ইবনু আব্বাস, আবূ মাজলায, আবূ রিযা আল-উতারিদী, ইকরামা, উবাইদুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ও হাসান বসরী প্রমুখ বলেছেন : এই আয়াতাংশটি আহলে কিতাবদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। হাসান বসরী বলেন : তবে এর হুকুম আমাদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। [.যখন ইয়াহুদীদের ন্যায় আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করবে। যেমন- তারা বলেছিল তাওরাতে রজমের হুকুমটি নেই। কোন মুসলিমও যদি কুরআন বা হাদীসে উল্লিখিত কোন বিধান সম্পর্কে বলে কুরআন ও রসূলের হাদীসে নেই- তবে ইয়াহুদীদের মতোই একই কুফরের হুকুম প্রযোজ্য। -সঙ্কলক।] আব্দুর রাজ্জাক (রহ) বলেন, তিনি সুফিয়ান সওরী, মানসুর থেকে বর্ণনা করেছেন, ইবরাহীম বলেন : এই আয়াতাংশটি বনী ইসরাঈলের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে বটে, কিন্তু এই উম্মাতের জন্যও এই হুকুম বলবৎ ও কার্যকর।
(ইবনু জারীর)
ইবনু জারীর বলেন : আমাদেরকে হাদীস বলেছেন ইয়াকুব, (তিনি বলেন) আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন হুশায়ম, (তিনি বলেন) আমাদেরকে খবর দিয়েছেন আব্দুল মালিক বিন আবূ সুলায়মান, তিনি সালামা বিন কুহাইল থেকে, তিনি আলক্বামাহ ও মাশরুক থেকে। তাঁরা উভয়ে ইবনু মাসউদকে (রা) ঘুষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : এটা অপবিত্র উপার্জন। তারা আবার জিজ্ঞাসা করেন : ঘুষ গ্রহণ করার ব্যাপারে হুকুম কী? তিনি বলেন, এটা কুফর। অতঃপর তিনি পাঠ করেন : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির।’’ [.ঘুষ গ্রহণ একটি হারাম কাজ। অর্থাৎ ইবনু মাসউদ (রা) আয়াতটি দ্বারা ‘আমালী কুফরের’ দলিল নিয়েছেন। অনেকে ইবনু মাস‘উদ (রা) -এর আলোচ্য উদ্ধৃতি থেকে ঘুষ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী ফায়সালাকে ইসলাম থেকে খারিজ তবে চূড়ান্ত কাফির বলে গণ্য করেছেন। অথচ ইবনু কাসির (রহ) আয়াতটির ব্যাখ্যা এখানেই শেষ করেননি। তার পরবর্তী উদ্ধৃতিগুলো কুফরকে আমালী ও আক্বীদা এই দু’ভাগের বিভক্তিকেই সমর্থন করে। -সঙ্কলক।]
সুদ্দী (রহ) এই আয়াতটি সম্পর্কে বলেন : ‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত অথবা জবরদস্তিমূলক আল্লাহর বিধানের বিপরীত হুকুম দেয়, অথচ সে আল্লাহর বিধানের সুফল সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত, সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।’’ আলী বিন আবী তালহা (রহ) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে এই আয়াতটি সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে সে কাফির। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান স্বীকার করে বটে, কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুসারে হুকুম করে না, সে যালিম ও ফাসিক্ব -(ইবনু জারীর)। আরও বলা হয়েছে, এই আয়াতাংশের লক্ষ্য হল আহলে কিতাবরা এবং তারা যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অস্বীকার করে।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন : তিনি সাওরী থেকে, তিনি যাকারিয়া থেকে, তিনি শা‘বী (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রহ) বলেন : এই আয়াতটির সম্পর্ক মুসলিমদের সাথে।
ইবনু জারীর বলেন : আমাদেরকে ইবনু মাসনা হাদীস বর্ণনা করেছেন, (তিনি বলেন) আমাদেরকে আব্দুস সামাদ হাদীস বর্ণনা করেছেন, (তিনি বলেন) আমাদেরকে শু‘বাহ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবনু আবূ সাফর থেকে, তিনি শু‘বা (রহ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (রহ) বলেছেন : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ -এই আয়াতটি মুসলিমদের জন্য। ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে যালিম’’ -এই আয়াতটি ইয়াহুদীদের উদ্দেশ্যে। ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে ফাসিক্ব’’ -এই আয়াতটি নাসারাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। অনুরূপ হুশাইম ও সাওরী থেকে, তাঁরা যাকারিয়া বিন আবী যায়েদাহ থেকে, তিনি শু‘বা থেকে বর্ণনা রয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন : আমাদের খবর দিয়েছেন মুআম্মার, তিনি ইবনু তাউস থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : ইবনু আব্বাস (রহ)-কে আল্লাহর বাণী- ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি (রা) বললেন : هي به كفر এটা কুফর। তাউস (রহ) বলেন : এটা আল্লাহ, মালাইকা, আসমানী কিতাব ও রসূলকে অস্বীকার করার মতো কুফর নয়। [.তাউস থেকে ইবনু আব্বাস (রা) ও তাউসের নিজের বর্ণনাটি মূলত একটি বর্ণনা। যা পরবর্তীতে ‘তাফসীরে খাযেন’-এর উদ্ধৃতিতে তাউসের সাথে ইবনু আব্বাস (রা)-এর প্রশ্নোত্তরে সুস্পষ্ট হবে। অনেকে উদ্ধৃতিগুলো ভিন্ন ভিন্ন মনে করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, ভুল পথের দাও‘য়াত দিচ্ছেন। -সঙ্কলক] সাওরী বলেন : তিনি জুরাইজ থেকে, তিনি আতা (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রহ) বলেন : কুফরের মধ্যে কম-বেশি আছে, যুলুমের মধ্যে কম বেশি আছে, তেমনি ফিসক্বের মধ্যেও কম-বেশী আছে- (ইবনু জারীর)। তিনি বলেন, ওয়াকী সুফিয়ান থেকে, তিনি সাঈদ আল-মাক্কী থেকে, তিনি তাউস (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ আয়াতটি সম্পর্কে তিনি (রহ) বলেন : এ ধরনের কুফরের জন্য কেউ মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ হয় না।
আবূ হাতিম বলেন : আমাদের হাদীস বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন ইয়াযীদ মুকির্রী, (তিনি বলেন) আমাদের সুফিয়ান বিন উয়ায়না হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি হিশাম বিন হুজায়ের থেকে, তিনি তাউস থেকে, তিনি ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (রা) আল্লাহর বাণী : ‘‘যা আল্লাহ নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যে বিধান জারি করে না সে কাফির’’ সম্পর্কে বলেন : আয়াতটিতে সেই কুফরের কথা বলা হয়নি, যার দিকে এরা গিয়েছে। হাকিম তার মুস্তাদরাকে এটি বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী বলে, এটা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তে সহীহ, কিন্তু তারা উদ্ধৃত করেননি।
৩.তাফসীরে খাযেন : ইমাম আবূল হাসান (খাযেন) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর لباب التأويل في معاني التنْزيل এ বলেন :
﴿ ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ﴾ بِمعنَى : أن اليهود لَما أنكروا حكم الله تعالَى الْمنصوص عليه فى التوراة وقالوا إنه غير واجب عليهم ، فهم كافرون على الإطلاق بِموسى والتوراة وبِمحمد ﷺ والقرآن واختلف العلماء فيمن نزلت هذه الآيات الثلاث وهي قوله : ﴿ ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الظالِمون ، ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الفاسقون ﴾ فقال جَماعة من الْمفسرين : الآيات الثلاث نزلت فى الكفار ومن غير حكم الله من اليهود ، لأن الْمسلم وإن ارتكب كبيْرة ، لا يقال إنه كافر وهذا قول ابن عباس وقتادة والضحاك . ويدل على صحة هذا القول ما روي عن البَراء بن عازب قال أنزل الله تبارك وتعالى : ﴿ ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الظالِمون ، ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الفاسقون ﴾ فى الكفار لكلها أخرجه مسلم وعن ابن عباس قال ﴿ ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ﴾ إلَى قوله هم الفاسقون هذه الآيات الثلاث فى اليهود خاصة قريظة والنضير أخرجه أبو داود . وقال مُجاهد : فى هذه الآيات الثلاث من ترك الحكم بِما أنزل الله رداً لكتاب الله فهو كافر ظالِم فاسق .
وقال عكرمة ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله جاحداً به فقد كفر ومن أقر به ولّم يَحكم به فهو ظالِم فاسق وهذا قول ابن عباس أيضاً واختار الزجاج لأنه قال : من زعم أنّ حكماً من أحكام الله تعالى التّي أتانا بِها الأنبياء باطل فهو كافر . وقال طاوس : قلت لابن عباس أكافر من لّم يَحكم بِما أنزل الله؟ فقال : به كفر وليس بكفر ينقل عن الْملة كمن كفر بالله وملائكته ورسله واليوم الآخر ونَحو هذا روي عن عطاء . وقال : هو كفر دون الكفر . وقال ابن مسعود والْحسن والنخعي : هذه الآيات الثلاث عامة فى اليهود وفي هذه الأمة فكل من ارتشى وبدل الْحكم فحكم بغير حكم الله فقد كفر وظلم وفسق وإليه ذهب السدي لأنه ظاهر الْخطاب . وقيل : هذا فيمن علم نص حكم الله ثُم رده عياناً عمداً وحكم بغيره وأما من خفي عليه النص أو أخطأ فى التأويل فلا يدخل فى هذا الوعيد والله أعلم بِمراده .
‘‘ ومن لّم يَحكم ... আয়াতটির দাবি : নিশ্চয় ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা তাওরাতের মাধ্যমে তাদের উপর বিধিবদ্ধকৃত আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার করত এবং বলত এটা জারি করা আমাদের জন্য ওয়াজিব নয় (তাদের সাথে সম্পৃক্ত) তাদের কুফর হল, মূসা (আ) -এর তাওরাত এবং মুহাম্মাদ (স) -এর কুরআনকে বর্জন করা। আলেমদের মধ্যে (সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭) আয়াত তিনটির নাযিলের প্রেক্ষাপট নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একদল মুফাসসিরীন বলেছেন : আয়াত তিনটি ইয়াহুদীদের মধ্যকার কাফিরদের ব্যাপারে নাযিল হয় যারা আল্লাহর হুকুমের বিরোধী বিধান জারি করত। কেননা, মুসলিম (যে কুরআন ও মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি প্রকাশ্য ঈমান এনেছে, সে) যদি কাজটি করে তবে তা কবীরা গুনাহর অন্তর্ভূক্ত। তাকে কাফির সম্বোধন করা যাবে না- এটা ইবনু আব্বাস (রা), ক্বাতাদাহ ও যাহ্হাকের উক্তি। তাঁদের উক্তির বিশুদ্ধতার স্বপক্ষে বারা বিন আযিব এর বর্ণনা আছে। তিনি (রা) বলেন : ... কাফির ... যালিম.... ফাসিক্ব (আয়াত তিনটি) কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে -(সহীহ মুসলিম)। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : ‘‘... কাফির ... যালিম.... ফাসিক’’ আয়াত তিনটি ইয়াহুদী গোত্র কুরায়যা ও বনূ নাযীরের ক্ষেত্রে খাস- (আবূ দাউদ)। মুজাহিদ বলেছেন : যারা আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুমকে লঙ্ঘন করে আল্লাহর কিতাব হিসাবে রদ (খণ্ডন) করে- তারাই কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব।
ইকরামা (রহ) বলেন : যারা আল্লাহর হুকুম জারি না করার জন্য চেষ্টারত- তারা কাফির। আর যারা স্বীকার করে কিন্তু সে অনুযায়ী বিধান জারি করে না তারা যালেম ও ফাসেক্ব। ইবনু আব্বাস (রা)-এর মতও অনুরূপ। যাজ্জাজ এটা গ্রহণ করেছেন। কেননা তিনি বলেন : যে মনে করে বিধানের মধ্যে যেগুলো আল্লাহ তাআলা’র আহকাম, যা আম্বিয়া (আ)-গণ এনেছিলেন- সেগুলো বাতিল, তবে সে কাফির। তাউস বলেছেন : ইবনু আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি করে না সে কি বড় কাফির? তিনি বললেন : به كفر এটা কুফর, তবে এ কুফর দ্বারা মিল্লাত (দ্বীন) থেকে বহিষ্কার হয় না; যেভাবে আল্লাহ, তাঁর মালাইকা, তাঁর রসূল, আখিরাত প্রভৃতির কুফর (মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে)। [.আখবারুল কা‘যা গ্রন্থে (১/৪১ পৃষ্ঠা) ইবনু আব্বাসের উক্তিটি হল : كفى به كفره ‘‘কুফরের জন্য এটাই যথেষ্ট।’’ যা নিঃসন্দেহে তাউসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। পক্ষান্তরে তাউস কর্তৃক ‘তাফসীরে খাযেনের’ উল্লিখিত বর্ণনাটি পূর্ণাঙ্গ। এ পর্যায়ে বর্ণনাগুলো একটি অপরটির ব্যাখ্যা। তাছাড়া كفى به كفره দ্বারাও বড় এবং ছোট উভয় কুফর অর্থ হতে পারে। এ সম্পর্কে ‘‘আয়াতে তাহক্বীম ও সালফে সালেহীন’’ অধ্যায়ে হাফেয ইবনু ক্বাইয়েমের (রহ) উদ্ধৃতি আসবে ইনশাআল্লাহ। -সঙ্কলক] আতা থেকেও এমনটি বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘তিনি (ইবনু আব্বাস (রা)) এটাও বলেছেন : هو كفر دون الكفر ‘‘এটি কুফরের চেয়ে কম কুফর।’’ ইবনু মাসউদ, হাসান ও নাখাঈ বলেছেন : আয়াত তিনটি ‘আমভাবে ইয়াহুদী ও এই উম্মাতের জন্য। তাদের মধ্যে যারা ঘুষ নেয় এবং বিধান বদলে দেয়, ফলে তা আল্লাহর হুকুমের বিরোধী হলে তবে সে কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব। সুদ্দীও আয়াতের বাহ্যিক সম্বোধন দ্বারা এ দিকেই গিয়েছেন। [.এই উক্তির মাধ্যমে আমালী ও আক্বীদাগত কুফরের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয় না। যার কারণে উভয় পক্ষই এ ধরনের উদ্ধৃতি দ্বারা নিজেদের স্বপক্ষে দলিল গ্রহণ করে থাকে। তবে ঘুষ সম্পর্কিত আমলটি দ্বারা আমরা এভাবে সমন্বয় করতে পারি যে, যখন ঘুষ গ্রহণ কেবল আমলের দিক থেকে হয় তখন তা ‘আমালী কুফর’ এবং যখন এর সীমা আক্বীদা-বিশ্বাসের দিক থেকেও হয় তখনই কেবল চূড়ান্ত কুফর হয়। যা ইসলাম থেকে তাকে বহিষ্কার করে। -সঙ্কলক] (তবে) দুর্বল মত হল : যার আল্লাহর হুকুমের প্রমাণ জানা আছে, অতঃপর তা জেনে-বুঝে রদ করে এবং বিপরিত হুকুম দেয়; তেমনি যে আল্লাহর দলিল-প্রমাণ গোপন করে অথবা ব্যাখ্যা দ্বারা বিকৃত করে সে উক্ত হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়। আল্লাহই এই হুকুমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞাত আছেন।
(তাফসীরে খাযেন, সূরা মায়িদার ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর)
৪.তাফসীরে বগভী : মুহিউস সুন্নাহ ইমাম বগভী (রহ) তাঁর তাফসীর ‘ معالِم التنْزيل ’-এ লিখেছেন :
قال قتادة والضحاك : نزلت هذه الآيات الثلاث في اليهود دون من أساء من هذه الأمة . رُوي عن البَراء بن عازب رضي الله عنه في قوله : ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ والظالِمون والفاسقون كلها في الكافرين، وقيل : هي على الناس كلهم . وقال ابن عباس وطاوس : ليس بكفر ينقل عن الْملة، بل إذا فعله فهو به [ كافر ] وليس كمن كفر بالله واليوم الآخر .
قال عطاء : هو كفر دون كفر، وظلم دون ظلم، وفسق دون فسق، وقال عكرمة معناه : ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله جاحدا به فقد كفر، ومن أقرّ به ولَم يَحكم به فهو ظالِم فاسق . وسئل عبد العزيز بن يَحيى الكناني عن هذه الآيات، فقال : إنّها تقع على جَميع ما أنزل الله لا على بعضه، فكل من لّم يَحكم بِجميع ما أنزل الله فهو كافر ظالِم فاسق، فأما من حكم بِما أنزل الله من التوحيد وترك الشرك، ثُم لَم يَحكم [ بِجميع ] ما أنزل الله من الشرائع لَم يستوجب حكم هذه الآيات .
‘‘ক্বাতাদাহ ও যাহ্হাক বলেছেন : এই তিনটি আয়াত ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, তেমনি এই উম্মাতের পাপীদের সম্পর্কেও। বারা বিন আযিব (রা) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর বাণী : ‘যারা হুকুম জারি করে না আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী, তারাই কাফির...... যালিম, ......ফাসিক্ব’’ -এর সবগুলোই কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত। বলা হয় : সমস্ত মানুষ এর অন্তর্ভূক্ত। ইবনু আব্বাস (রা) ও তাউস (রহ) বলেছেন : এই কুফর মিল্লাত (দ্বীন) থেকে বের করে দেয় না, বরং যখন কেউ আমলটি করে তখন সেটা (কুফর) হয়। তবে এটা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি কুফর করার মত নয়।
আতা (রহ) বলেছেন : এটা কুফরের চেয়ে কম কুফর, যুলুমের চেয়ে কম যুলম, ফিসক্বের চেয়ে কম ফিসক্ব। অনুরূপ অর্থে ইকরামাহ বলেছেন : যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি করে না, অস্বীকার করে সে কাফির। আর যে স্বীকৃতি দেয় কিন্তু বিধান জারি করে না সে যালিম ও ফাসিক্ব। আব্দুল আযীয বিন ইয়াহইয়া আল-কিনানীকে আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : এটি আল্লাহর নাযিলকৃত সমস্ত বিধানের ক্ষেত্রে সংঘটিত হলে প্রযোজ্য, বিশেষ কিছুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ যে সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না সে কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব। সুতরাং যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী তাওহীদের অন্তর্ভুক্ত ও শিরক ত্যাগকারী এবং (কিছু কিছু ক্ষেত্রে) আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী শরিআতী বিষয় জারি করে না, তবে তার প্রতি আলোচ্য আয়াতটির প্রয়োগ ওয়াজিব হয় না।
[তাফসীরে বগভী, সূরা মায়িদা : ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর]
৫.তাফসীরে কাবীর : ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর সুবিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ مفاتيح الغيب -এ আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
قال : ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله فَأُوْلَئِكَ هُمُ الكافرون ﴾ وفيه مسألتان : الْمسألة الأولَى : الْمقصود من هذا الكلام تَهديد اليهود في إقدامهم على تَحريف حكم الله تعالَى في حد الزانِي الْمحصن ، يعنِي أنّهم لَما أنكروا حكم الله الْمنصوص عليه في التوراة وقالوا : إنه غيْر واجب ، فهم كافرون على الاطلاق ، لا يستحقون اسم الإيْمان لا بِموسى والتوراة ولا بِمحمد والقرآن .
الْمسألة الثانية : قالت الْخوارج : كل من عصى الله فهو كافر . وقال جَمهور الأئمة : ليس الأمر كذلك ، أما الْخوارج فقد احتجوا بِهذه الآية وقالوا : إنّها نص في أن كل من حكم بغيْر ما أنزل الله فهو كافر ، وكل من أذنب فقد حكم بغيْر ما أنزل الله ، فوجب أن يكون كافراً . وذكر الْمتكلمون والْمفسرون أجوبة عن هذه الشبهة :
الأول : أن هذه الآية نزلت في اليهود فتكون مُختصة بِهم ، وهذا ضعيف لأن الاعتبار بعموم اللفظ لا بِخصوص السبب ، ومنهم من حاول دفع هذا السؤال فقال : الْمراد ومن لّم يَحكم من هؤلاء الذين سبق ذكرهم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، وهذا أيضاً ضعيف لأن قوله ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله ﴾ كلام أدخل فيه كلمة ﴿ مِنْ ﴾ في معرض الشرط ، فيكون للعموم . وقول من يقول : الْمراد ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله من الذين سبق ذكرهم فهو زيادة في النص وذلك غيْر جائز .
الثانِي : قال عطاء : هو كفر دون كفر . وقال طاوس : ليس بكفر ينقل عن الْملة كمن يكفر بالله واليوم الآخر ، فكأنّهم حَملوا الآية على كفر النعمة لا على كفر الدين ، وهو أيضاً ضعيف ، لأن لفظ الكفر إذا أطلق انصرف إلى الكفر في الدين .
والثالث : قال ابن الأنباري : يَجوز أن يكون الْمعنى : ومن لّم يَحكم بِما أنزل الله فقد فعل فعلاً يضاهي أفعال الكفار ، ويشبه من أجل ذلك الكافرين ، وهذا ضعيف أيضاً لأنه عدول عن الظاهر .
والرابع : قال عبد العزيز بن يَحيى الكنانِي : قوله ﴿ بِمَا أنزَلَ الله ﴾ صيغة عموم ، فقوله ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله ﴾ معناه من أتى بضد حكم الله تعالى في كل ما أنزل الله فأولئك هم الكافرون ، وهذا حق لأن الكافر هو الذي أتى بضد حكم الله تعالى في كل ما أنزل الله ، أما الفاسق فإنه لّم يأت بضد حكم الله إلاّ في القليل ، وهو العمل ، أما في الاعتقاد والاقرار فهو موافق ، وهذا أيضاً ضعيف لأنه لو كانت هذه الآية وعيداً مَخصوصاً بمن خالف حكم الله تعالى في كل ما أنزل الله تعالَى لّم يتناول هذا الوعيد اليهود بسبب مُخالفتهم حكم الله في الرجم ، وأجْمع الْمفسرون على أن هذا الوعيد يتناول اليهود بسبب مُخالفتهم حكم الله تعالى في واقعة الرجم ، فيدل على سقوط هذا الجواب ،
والْخامس : قال عكرمة : قوله ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله ﴾ إنّما يتناول من أنكر بقلبه وجحد بلسانه ، أما من عرف بقلبه كونه حكم الله وأقر بلسانه كونه حكم الله ، إلا أنه أتى بما يضاده فهو حاكم بما أنزل الله تعالى ، ولكنه تارك له ، فلا يلزم دخوله تَحت هذه الآية ، وهذا هو الْجواب الصحيح والله أعلم .
মহান আল্লাহ বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা হুকুম জারি করে না তারাই কাফির’’-এ আয়াতে দু’টি মাসআলা আছে :
প্রথম মাসআলা : আলোচ্য বাক্যের উদ্দেশ্য হল, ইয়াহুদীদের ভীতি প্রদর্শন করা, কেননা বিবাহিত যেনাকারীর হদের (শাস্তির) ব্যাপারে আল্লাহর দেওয়া বিধানকে তারা বিকৃত করে নিজেদের মধ্যে ক্বায়েম রেখেছিল। কেননা তাদের উপর বিধিবদ্ধকৃত তাওরাতের হুকুমকে তারা অস্বীকার করেছিল। তারা বলত : এটা জারি করা তাদের উপর ওয়াজিব নয়। এই নিকৃষ্ট কাজের জন্য তারা কাফির। তারা প্রকৃত ঈমানের দাবি পূরণ করত না, মূসার (আ)-এর তাওরাতের প্রতিও না এবং মুহাম্মাদ (স) ও কুরআনের প্রতিও ঈমান রাখত না।
দ্বিতীয় মাসআলা : খারেজীরা বলে : যে কোন ব্যাপারে আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী কাফির। কিন্তু অধিকাংশ ইমামগণ বলেছেন : এমনটি নয়। তবে খারেজীরা আয়াতটি দ্বারা নিজেদের পক্ষে দলিল গ্রহণ করে থাকে। তারা বলে : এ থেকে প্রমাণ পাওয়া গেল, যে কোন বিষয়েই কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী হুকুম দিলে সে কাফির। তেমনি যে ব্যক্তি এমন কোন পাপে জড়িত হয় যা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী (বা পাপ হিসাবে স্বীকৃত), তবে তার কাফির হওয়াটা ওয়াজিব (নিশ্চিত)। মুতাকাল্লিম ও মুফাস্সিরগণ এই সংশয়ের যে জবাব দিয়েছেন তা নিম্নরূপ:
প্রথমত : আয়াতটি ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়, এজন্য এর দাবি তাদের সাথে খাস (সুনির্দিষ্ট)। এ মতটি যঈফ, কেননা শব্দের ‘আম দাবির ভিত্তিতে এর সবব (কারণটি) সুনির্দিষ্ট হয় না। যারা আলোচ্য বিতর্কটি খণ্ডনের চেষ্টা করেন, তারা বলেন : আয়াতের উদ্দেশ্য হল, যারা হুকুম করে না যা তাদের প্রতি পূর্বে (তাওরাত/ইনজিলে) আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে- তারাই কাফির। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله বাক্যগুলোর মধ্যকার ‘‘ من ’’ শব্দটি মা‘রিযে শর্ত ( معرض الشرط ), যার দাবিই ‘আম (ব্যাপকার্থক) নেয়া। আর যারা বলে থাকেন : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله এর উদ্দেশ্য তারাই যাদের বর্ণনা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি উক্ত দলিলের মধ্যে অতিরিক্ত সংযোজন -যা জায়েয নয়।
দ্বিতীয়ত : আতা (রহ) বলেছেন, এটা كفر دون كفر (কুফরের চেয়ে কম কুফর)। তাউস বলেছেন : এটা এমন কুফর নয় যা মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে, যেভাবে আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি কুফর (বহিষ্কার করে)। কেননা তাদের ব্যাপারে আয়াতটির সম্পৃক্ততা ‘কুফরুন নিয়ামাত’ (প্রদত্ত বিষয়াদির প্রতি কুফর) ছিল, ‘কুফরুদ দ্বীন’ (দ্বীনের মধ্যকার কুফর) ছিল না। এই মতটিও যঈফ। কেননা এখানে আল-কুফর শব্দটি দ্বীনের কুফরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।
তৃতীয়ত : ইবনুল আম্বাবারী (রহ) বলেন : আয়াতটির জায়েয অর্থ হল- আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করার আমলটি কারো দ্বারা বাস্তবায়িত হলে তা কাফিরদের আমলের মতো। অর্থাৎ কাফিরদের বাড়াবাড়ির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এটাও দুর্বল উপস্থাপনা। কেননা তাদের বিমুখতা সুস্পষ্ট।
চতুর্থত : আব্দুল আযীয বিন ইয়াহইয়া আল-কিনানী বলেন, আল্লাহর বাণী : بِما انزل الله সিগায়ে আম। সুতরাং আল্লাহর বাণী : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله -এর অর্থ হল, যদি কেউ আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত সমস্ত হুকুমের বিরোধিতা করে তবে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত। আর ফাসিক হল, যে ব্যক্তি আমলের ব্যাপারে অল্প কিছু ছাড়া আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে যায় না। আর যদি সে আক্বীদা ও স্বীকৃতির ব্যাপারে তেমনটি করে তবেও অনুরূপ (কাফির) হবে। এটাও একটি যঈফ উপস্থাপনা। কেননা যদি আয়াতটির ধমকি এমন ব্যক্তিদের জন্য সুনির্দিষ্ট হতো যারা সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধিতা করে, তবে আয়াতের ধমকীর সম্পৃক্ততা ইয়াহুদীদের সাথে হতো না- যারা (সুনির্দিষ্টভাবে) রজমের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করেছিল। মুফাসসিরগণের ইজমা‘ হল, আলোচ্য ধমকী ইয়াহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত- যারা রজম সম্পর্কিত ঘটনাতে আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করেছিল। সুতরাং এই দলিল দ্বারা পূর্বোক্ত জবাবটি খণ্ডিত হয়।
পঞ্চমত : ইকরামাহ (রহ) বলেছেন, আল্লাহর বাণী : وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله -এর সম্পৃক্ততা তার সাথে, যে আন্তরিকভাবে অস্বীকার করে এবং মৌখিকভাবেও (বিরোধিতার) চেষ্টা করে। যদি কারো পরিচয় পাওয়া যায়, সে আন্তরিকভাবে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী কাজ করে এবং মৌখিকভাবেও আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী স্বীকৃতি দেয়- তবে যদি তাকে হাকিম হিসাবে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরিতে পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি কেবল (আমলগত আল্লাহর নির্দেশটি) তরককারী। তাকে এ আয়াতটির অন্তর্ভুক্ত করাটা ওয়াজিব হয় না। এটাই (পূর্ণাঙ্গ) সহীহ জবাব, আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
[সংযোজন : পূর্বোক্ত পাঁচটি বক্তব্যের মৌলিক দাবি এক হলেও, খারেজীদের জবাবে শেষোক্ত ইকরামাহ (রহ)-এর উদ্ধৃতিতে পূর্ণাঙ্গতা সুস্পষ্ট। মূলত এটাই ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ)-এর বক্তব্যের দাবি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। -সঙ্কলক]
এছাড়া ইমাম আলূসীর (রহ)-এর ‘‘তাফসীরে রুহুল মাআনী’’, ইমাম শওকানীর ‘‘তাফসীরে ফতহুল ক্বাদীর’’ প্রভৃতিতেও উপরোক্ত তাফসীরসমূহের ব্যাখ্যাই অনুসৃত হয়েছে। সুতরাং আমরা এটাই বলতে পারি আহলে সুন্নাতের স্বীকৃত মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণ আলোচ্য সূরা মা‘য়িদার ৪৪-৪৭ নং আয়াতের যে তাফসীর করেছিলেন, এ শতাব্দীর মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক্ব মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)-ও সেই পথই অনুসরণ করেছেন।
এ পর্যায়ে আমরা এখন উপমহাদেশের কয়েকটি প্রসিদ্ধ তাফসীর থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
৬.তাফসীরে মাযহারী : কাযী মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ) তাঁর ‘‘তাফসীরে মাযহারী’’-তে সূরা মায়িদার ৪৪ নং আয়াতের শেষাংশ فاولئك هم الْكافرون এর তাফসীরে লিখেছেন : ‘‘যদি সে আল্লাহর বিধান তুচ্ছ জ্ঞান করে অন্যরূপ বিধান দেয়। কেউ বলেছেন, এখানে কাফির হওয়ার অর্থ ফাসিক্ব হওয়া। কুফরের অর্থ সত্য গোপন করা হতে পারে। ইবনু আব্বাস (রা) ও তাউস (রহ) বলেন, এটা এমন কুফরী কাজ নয়, যার দ্বারা মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যাবে, যেমন খারিজ হয়ে যায় আল্লাহ ও পরকালকে অস্বীকার করলে, বরং এরূপ করলে সে সত্যকেই গোপন করবে।’’ [.তাফসীরে মাযহারী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন,১৪০৫/১৯৮৮) ৩/৭০০-০১ পৃ.।] অতঃপর তিনি (রহ) فاولئك هم الظالِمون -এর তাফসীরে লিখেছেন : ‘‘আল্লাহর বিধান কার্যকরী না করার কারণে।’’ [.তাফসীরে মাযহারী ৩/৭০৭ পৃ.।] অতঃপর তিনি (রহ) فاولئك هم الفاسقون -এর তাফসীরে লিখেছেন : ‘‘এখানে ফাসিকুন এর দু’ রকম অর্থ হতে পারে-
ক.আল্লাহর বিধানের আনুগত্য থেকে তারা খারিজ;
খ.আল্লাহর বিধানকে তুচ্ছ জানার কারণে ঈমান থেকে খারিজ। [.তাফসীরে মাযহারী ৩/৭০৯ পৃ.।]
৭.তাফহীমুল কুরআন : সাইয়েদ আবূ আ‘লা মওদূদী (রহ) তাঁর ‘‘তাফহীমুল কুরআন’’-এ আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন :
‘‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এখানে তিনটি বিধান দিয়েছেন।
ক) তারা কাফের। খ) তারা যালেম। গ) তারা ফাসেক্ব।
এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম ও তাঁর নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফায়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল, কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত, তার এ কাজটি ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতির বিরোধী। কারণ, আল্লাহ যথার্থ ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করল তখন সে আসলে যুলুম করল। তৃতীয়ত, বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করল তখনই সে আসলে বন্দেগী ও আনুগত্যের গণ্ডীর বাইরে পা রাখল। [.সাইয়েদ আবূল আ‘লা মওদূদী (রহ) ইবাদত ও ইতাআতকে একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। এর ব্যাখ্যা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ) লিখিত ‘ইবাদত ও ইতাআত’ অনুচ্ছেদে আসবে ইনঁশাআল্লাহ।] আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসেক্বী। এ কুফরী, যুলুম ও ফাসেক্বী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিকে দিয়ে অনিবার্যভাবেই পুরোপুরি আল্লাহর হুকুম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। যেখানে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হবে সেখানে এ তিনটি বিষয় থাকবে না, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়ভেদ আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে ভুল এবং নিজের বা অন্য কোন মানুষের হুকুমকে সঠিক মনে করে আল্লাহর হুকুম বিরোধী ফায়সালা করে সে পুরোপুরি কাফির, যালেম ও ফাসেক্ব। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভুত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, যুলুম ও ফাসেক্বীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে সকল ব্যাপারেই কাফির, ফাসেক্ব ও যালেম। আর যে ব্যক্তি কিছু ব্যাপারে অনুগত এবং কিছু ব্যাপারে অবাধ্য তার জীবনে ঈমান ও ইসলাম এবং কুফরী, যুলুম ও ফাসেক্বীর মিশ্রণ ঠিক তেমনি হারে অবস্থান করছে যেহারে সে আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে এক সাথে মিশিয়ে রেখেছে। কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতগুলোকে আহলে কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই। হুযাইফা (রা) -এর বক্তব্যই এ ধরনের ব্যাখ্যার সঠিক ও সর্বোত্তম জবাব। তাঁকে একজন বলেছিল, এ আয়াত তিনটি তো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সে বুঝাতে চাচ্ছিল যে, ইহুদীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা হুকুমের বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে-ই কাফির, যালেম ও ফাসেক্ব। একথা শুনে হুযাইফা (রা) বলে ওঠেন :
نعم الإخوة لكم بنو إسرائيل، إن كانت لَهم كل مُرَّة، ولكم كل حلوة ! كلا والله، لتسلكن طريقَهم قِدَر الشراك
‘‘এ বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই, তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য। কখনো নয়, আল্লাহর ক্বসম তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে।’’ [.হুযায়ফা (রা) -এর উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করে অনেক খারেজী বলেন যে : যেভাবে বনী ইসরাঈলের জন্য আয়াতটি সরাসরি তথা চূড়ান্ত কুফর, সেটা ‘দুনা কুফর’ নয়। সেভাবে মুসলিমদের জন্যও আয়াতটি সরাসরি বা চূড়ান্ত কুফর, ‘দুনা কুফর’ নয়। অথচ আমরা তাফসীরকারকদের কাছ থেকে জেনেছি : যখন বনী ইসরাঈলের মতো কিতাব বিকৃতি, পরিবর্তন করা হবে এবং কুরআন ও মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াত অস্বীকার করা হবে, তখন উক্ত কুফর সরাসরি বা চূড়ান্ত কুফর হিসেবে প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে যখন কুরআন, মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াতকে মেনে নেয়, কুরআন-সুন্নাহতে বিকৃতি ও পরিবর্তন করে না, নিজের মনগড়া বিধানকে আল্লাহর বিধান, রসূলের সুন্নাহ বা ইসলামী বিধান বলে দাবি করেন না; তখন আল্লাহর বিধান না জারি অথবা না পালনের জন্য তার কুফরটি চূড়ান্ত কুফরের চেয়ে কম কুফর হিসেবে গণ্য হবে। অথচ খারেজীরা হুযায়ফা (রা) বক্তব্যকে তাদের পক্ষে দলিল বানাচ্ছে। যদিও সহীহ মুসলিমে সাহাবী বারা বিন আযিব (রা) থেকে দীর্ঘ হাদীসে সূরা মায়েদা’র ৪৪-৪৭ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে নবী (স)-এর উক্তিও এসেছে যে : فِي الْكُفَّارِ كُلُّهَا ‘‘এই সবগুলো আয়াত কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩৩২ (২৮/৭০০)] আর মুসলিমদের জন্য ঐভাবে প্রযোজ্য যেভাবে কিছু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।]
[তাফহীমুল কুরআন (ঢাকা, আধুনিক প্রকাশনী, ১৪২১/২০০০, আলোচ্য আয়াতের তাফসীর, টীকা ৭৭ দ্রষ্টব্য]
৮.তাফসীরে উসমানী : শিবিবর আহমাদ উসমানী (রহ) তাঁর ‘‘তাফসীরে উসমানী’-তে সূরা মায়িদা’র ৪৪ নং আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন :
’’ ما انزل الله ‘‘ کے موافق حکم نہ کرنے سے غالبا یہ مراد ہے کہ منصوص حکم کے وجود ہی سے انکار کردے اور اسکی جگہ دوسرے احکام اپنی راۓ اور خواہش سے تصنیف کرے۔ جیسا کہ یہود نے ’’ رجم ‘‘ کے متغلق کیا تھا۔ تو ایسے لوگوں کے کافر ہونے میں کیا شبہ ہو سکتا ہے اور اگر یہ ہو کہ ’’ ما انزل الله ‘‘ کو عقیدۃ ثابت مان کر پھر فیصلہ عملا اسکے خلاف کرے تو کافر سے مرادعملی کافر ہوگا۔ یعنی اسکی عملی حالت کافروں جیسی ہی
‘‘ ما انزل الله এর সম্পর্ক হল, ‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম না করা’-এর দ্বারা সম্ভাব্য অর্থ হবে, সুস্পষ্ট দলিলসমৃদ্ধ হুকুম থাকা সত্ত্বেও তা অস্বীকার করা এবং এর পরিবর্তে নিজের রায় ও খায়েশ দ্বারা ভিন্ন বিধান প্রবর্তন করা। যেভাবে ইয়াহুদীরা ‘রজমের’ হুকুমের ব্যাপারে করেছিল। এ ধরনের লোকেরা কাফির হওয়ার ব্যাপারে আর কি সংশয় থাকতে পারে? আর যদি ما انزل الله এর দাবি হয়, আক্বীদাগতভাবে স্বীকার করার পর আমলগত ফায়সালার ক্ষেত্রে এর বিপরীত করা- তবে সেক্ষেত্রে কাফিরের অর্থ আমলগত কুফর। অর্থাৎ তাদের আমলটি কাফিরদের মতো।’’ (তাফসীরে উসমানী, সূরা মায়িদা, ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর)
৯.তাফসীরে মাজেদী : আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী (রহ) তাঁর ‘‘তাফসীরে মাজেদী’’-তে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন :
‘‘ ومن لَم يَحكم بِما انزل الله -আর যারা বিধান দেয় না তদনুসারে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, বরং তারা শরীআত বিরোধী হুকুম-আহকামকে শরীআতসম্মত বলে মনে করে মানুষের তৈরী বিধানকে আল্লাহর বিধান বলে চালায়।
নেতৃস্থানীয় ইয়াহুদীদের সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং গুনাহ এই ছিল যে, তারা তাদের মনগড়া মতবাদকে আল্লাহর [.বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদে : ‘খোদায়ী কানুন’ শব্দ আছে। আমরা তা পরিবর্তন করে ‘আল্লাহর কানুন’ উল্লেখ করলাম।] কানুন বলে চালিয়ে দিত। ফাতওয়া নিজের ইচ্ছামত দিত এবং বলত : দ্বীনের হুকুম এরূপ। এ ধরনের দুঃসাহসী ব্যক্তিদের কুফরীর ব্যাপারে আর কি সন্দেহ হতে পারে? বিশিষ্ট তাবেঈদের থেকে আয়াতের তাফসীর এরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইবনু যায়েদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার নিজের হাতে লেখা কিতাবের মতানুযায়ী বিধান দেয় এবং আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করে এবং সে মনে করে যে তার কাছে যে কিতাব আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, সে কাফির হয়ে গেল- (ইবনু জারীর)। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমতও অনুরূপ।
ومن لَم يَحكم -এ আয়াতে من শব্দটি الذى শব্দের সমার্থজ্ঞাপক এবং আয়াতটি ইয়াহুদীদের শানে নাযিলকৃত। এখানে من শব্দটি الذى শব্দের সমার্থ জ্ঞাপক- (কুরতুবী)। অর্থ হল : ঐ সমস্ত ইয়াহুদী- যারা রজম, কিসাস ও অন্যান্য ইলাহী [.বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদে : ‘খোদায়ী বিধান’ শব্দ আছে। আমরা তা পরিবর্তন করে ‘ইলাহী বিধান’ উল্লেখ করলাম।] বিধান পরিবর্তন করে নিজেদের মনগড়া বিধান আল্লাহ সঙ্গে সম্পৃক্ত করতো, তারা কাফির। কাজেই এখানে এরূপ উক্তি উহ্য আছে : ইয়াহুদীগণ, যারা ফায়সালা করে না সে মতে, যে বিধান নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা কাফির। সুতরাং এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তন্মধ্যে এটাই উত্তম (কুরতুবী)। খারিজীরা এ আয়াত দিয়ে জোর দাবি করে যে, যে সমস্ত মুসলিম [.বাংলা অনুবাদে ‘মুসলমান’ আছে। আমরা ‘মুসলিম’ লিখলাম।] ফাসিক, তারাও কাফিরদের হুকুমের মধ্যে শামিল, যখন তারা গায়রুল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে; তখন তারা কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই দলিল (খারেজীদের অন্যান্য দলিলের ন্যায়) পরিত্যাজ্য। কেননা, যে ধরনের ফায়সালার কথা এখানে বলা হয়েছে। তার সম্পর্ক আমলের সাথে নয়, বরং তা আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। আর সে ব্যক্তি অবশ্যই কাফির হয়ে যায়। যে আক্বীদার দিক দিয়ে আল্লাহর কানুন বা বিধানকে ভুল বলে এবং নিজের মতবাদকে সঠিক মনে করে। এখানে অর্থ হল : ক্বলবের সাথে আমল করা এবং তা হল অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা যদি কেউ বিশ্বাস না করে, তবে তার কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ মতানৈক্য নেই- (রূহ)। আয়াতটি সাধারণ নয়, বরং কাফিরদের বিশেষকরে ইয়াহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত এবং এ ব্যাপারে তাবেঈদের মাঝে আবূ সালিহ, ইকরামা, যাহহাক, কাতাদা (রহ)-এর ও অন্যান্যরা ছাড়াও, সাহাবীদের মাঝে হুযায়ফা ও ইবনু আব্বাস (রা) একমত। বরং এতদসম্পর্কে নবী (স) পর্যন্ত সনদ মওজুদ আছে। যেমন- বারা বিন আযিব (রা) নবী (স) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা বাণী : আর যারা ফায়সালা দেয় না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা তো কাফির; আর যারা ফায়সালা করে না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা তো ফাসিক্ব। আয়াতগুলো ফাসিক্বদের শানে নাযিল হয়েছে (ইবনু জারীর)।
আবূ সালিহ (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : সূরা মায়িদার মধ্যে যে তিনটি আয়াত আছে : ‘‘আর যারা ফায়সালা দেয় না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা তো কাফির, যালিম এবং ফাসিক্ব’’ -আয়াতগুলি ইসলামের অনুসারীদের শানে নাযিল হয়নি, বরং তা কাফিরদের শানে নাযিল হয়েছে- (ইবনু জারীর)। যাহহাক (রহ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন : উপরোক্ত আয়াত ‘আহলে কিতাবদের’ শানে নাযিল হয়েছে (ইবনু জারীর)। ইকরামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : উপরোক্ত আয়াতগুলি ‘আহলে কিতাব’ এর শানে নাযিল হয়েছে (ইবনু জারীর)। উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আয়াতগুলো ইয়াহুদীদের শানে নাযিল হয়েছে আর তাদের গুণাবলি বর্ণনার আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছে (ইবনু জারীর)। ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করে- ‘‘যারা সে মত ফায়সালা করে না, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব; আয়াতত্রয় বিশেষভাবে ইয়াহুদীদের শানে নাযিল হয়েছে’’ (রূহ)।
বারা ইবনু আযিব, হুযায়ফা ইবনু ইয়ামান, ইবনু আব্বাস, আবূ মাজলায, আবূরাজা আতারদী, ইকরামা; উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ, হাসান বসরী প্রমুখ সুধীগণ বলেন : আয়াতগুলো ‘আহলে কিতাবদের’ শানে নাযিল হয়েছে। এ উম্মাতের অপরাধ বর্ণনার জন্য নয় (মাআলিম)।
ইমাম ইবনু জারীর তাবারী (রহ) স্বীয় স্বভাবসুলভ বর্ণনা ভঙ্গীতে বলেন যে, আয়াতের সম্পর্ক হল কাফির ও আহলে কিতাবদের সাথে; বর্ণনা ধারায় তাদের কথা উল্লেখ আছে এবং এর আগেও তাদের সম্বন্ধে আলোচনা রয়েছে। অন্যান্য বিশিষ্ট মুফাসসিরীনদের অভিমতও এরূপ। ইবনু জারীর বলেন : আমার নিকট এ অভিমতই অধিক যুক্তিযুক্ত যে, এসব আয়াত আহলে কিতাবের কাফিরদের শানে নাযিল হয়েছে। কেননা, এর পূর্বাপর আয়াতের আলোকে জানা যায় যে, তাদের সম্পর্কে এগুলো নাযিল হয়েছে এবং দোষারোপ তাদেরই করা হয়েছে (ইবনু জারীর)। ইমাম শা‘বী (রহ) বলেন : আয়াতগুলো বিশেষভাবে ইয়াহুদীদের শানে নাযিল হয়েছে এবং নাহহাসের অভিমতও এরূপ (কুরতুবী)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন ফায়সালাকে মানতে অস্বীকার করে, অথবা এমন ফায়সালা দেয়, যা আল্লাহর হুকুমের বিপরীত এবং বলে : নিশ্চয় এ হল আল্লাহর হুকুম, সে ব্যক্তি কাফির। যেমন বনূ ইসরাঈলরা কাফির হয়েছিল, যখন তারা এরূপ করেছিল। (জাসসাস)
আল্লাহবিরোধী কানুন মোতাবেক ফায়সালা করার কারণে যদি কোন মুসলিম অভিযুক্ত হয়; তবে তখন হবে, যখন সে জেনেশুনে সজ্ঞানে শরীআতের প্রকাশ্য ও স্পষ্ট বিধানের খিলাফ কিছু করবে এবং সে তখন অভিযুক্ত হবে না- যখন হুকুমটি গোপন কোন বিষয়ের ইঙ্গিতবহ হবে এবং না জেনে, না শুনে সে তার অপব্যাখ্যা করবে। এ সম্পর্কে উলামাদের অভিমত হল- যদি কেউ শরীআতের স্পষ্ট দলিলের খিলাফ কিছু করে বা বলে, তবে সে অভিযুক্ত হবে, পক্ষান্তরে শরীআতের গোপনতত্ত্ব যার কাছে স্পষ্ট নয়, সে যদি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভুল করে বসে, তবে সে অভিযুক্ত হবে না (মাআলিম)। তাবে‘য়ী ইকরামা (রহ), যার সঙ্গে ইমাম রাযী (রহ)-এর বক্তব্যের মিল আছে বলেন : যতক্ষণ কেউ কোন ইলাহী বিধানকে অন্তর দিয়ে মানবে এবং মুখে তা স্বীকার করবে, সে কিরূপে অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। যদি তার কাজ-কর্ম, বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তির খিলাফ হয়, তবে তাকে গুনাহগার এবং হুকুম তরককারী বলা যেতে পারে; তাকে অস্বীকারকারী বা কাফির ও বিদ্রোহী বলা যাবে না। ইকরামা (রহ) বলেন : আল্লাহর কথা- ‘‘যে ব্যক্তি ফায়সালা করে না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ- সে কাফির’’-এ অভিমত তার উপর প্রযোজ্য, যে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে এবং মুখে অস্বীকার করে এবং ‘আল্লাহর হুকুম’ হিসাবে যে মুখে তা স্বীকার করে, এরপর খিলাফ কিছু করে, তবে সে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার বিরোধিতাকারী নয়, বরং সে হবে তা তরককারী। সেজন্য এ আয়াতের আওতায় এনে তাকে অভিযুক্ত করা যাবে না। এটাই সহীহ জবাব (কাবীর)।
আমাদের যামানায় খারেজী মাযহাবের প্রচার ও প্রসার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। সুন্দর সুন্দর নাম ও উপাধীধারী ব্যক্তিরা এ কাজে নিয়োজিত। তারা এ আয়াত দ্বারা তাদের মতাদর্শ প্রচারে প্রয়াসে। সেজন্য জরুরি মনে করে আয়াতটির ব্যাখ্যা কিছু বিস্তারিতভাবে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের’ মাযহাব অনুযায়ী করা হল। [.আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী, তাফসীরে মাজেদী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জুন ১৯৯২) ২/৫৬৬-৬৮ পৃষ্ঠা।]
১০.বাদীউত তাফাসীর : ইমাম বাদীউদ্দীন শাহ আর-রাশেদী (রহ) তাঁর সিন্ধি ভাষায় লিখিত ‘বাদীউত তাফাসীরে’ আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তাফসীরে দুররে মানসুর ও তাফসীরে কুরতুবী থেকে পূর্বোক্ত তাফসীরগুলোর সমার্থক উদ্ধৃতিগুলো দেয়ার পর লিখেছেন :
‘‘সম্মানিত পাঠক! আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা জারি না করা কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। যেভাবে ইমাম যাহাবী তাঁর ‘আল-কাবায়ির’-এর ৩১ নং কবীরাহ গুনাহর বর্ণনাতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেবল কবীরা গুনাহর কারণে মুসলিম ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয় না, যতক্ষণ না সে নিজের কৃত আমলটিকে সহীহ বা হক্ব হওয়ার আক্বীদা রাখে। বরং যদি তা সে ভুল মনে করে, অথচ কোন বিশেষ (মাজবুরী) পরিস্থিতিতে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা না করে- তবে সে অবশ্যই যালিম ও ফাসিক্ব। কিন্তু তাকে কাফির বা ইসলাম থেকে খারিজ বলা যাবে না। এটাই আহলে সুন্নাতের ইজমা‘য়ী মাসআলা যা প্রথম থেকে চলে আসছে। কিন্তু খারেজীরা সব ধরনের কবীরা গোনাহকারীকে কাফির বলে থাকে।.... তারা এই আয়াতটি দ্বারা দলিল নিয়ে থাকে এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ থেকে নিজেদের চোখ বন্ধ রাখে। যেমনটি বিদআতীরা নিজেদের প্রমাণ উপস্থাপনে এমনটি করে থাকে।...’’
[বাদীউত তাফাসীর (১৯৯৮ ইং) ৭/২৩৮ পৃষ্ঠা]
উদ্ধৃত সমস্ত তাফসীরগুলো থেকে প্রমাণিত হল, আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে সুন্নী মুসলিমদের প্রকৃত আক্বীদা ও তাফসীর সেটাই যা শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) থেকে আমরা এই বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করেছি। উপরোক্ত সমস্ত মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে, কুফর দু’ধরনের হয়ে থাকে। যথা :
ক.কুফরে আমালী;
খ.কুফরে ইতিক্বাদী।
এই প্রকারভেদ শায়খ আলবানী (রহ) একাই করেননি। তাছাড়া আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি না করাতে কুফরের স্তর বিন্যাসেও তাদের উপস্থাপনায় কোন পার্থক্য নেই। যদি এই কারণে তাকে মুরজিয়া বলা হয়, তবে পূর্বোক্ত সমস্ত তাফসীরকারকগণও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। অথচ এক্ষেত্রে তাদের উপস্থাপনায় আমরা ঐকমত্য লক্ষ করি। সুতরাং এর বিপরীত মতই গোমরাহ পথ। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
৬.তাফসীরে মাযহারী : কাযী মুহাম্মাদ সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ) তাঁর ‘‘তাফসীরে মাযহারী’’-তে সূরা মায়িদার ৪৪ নং আয়াতের শেষাংশ فاولئك هم الْكافرون এর তাফসীরে লিখেছেন : ‘‘যদি সে আল্লাহর বিধান তুচ্ছ জ্ঞান করে অন্যরূপ বিধান দেয়। কেউ বলেছেন, এখানে কাফির হওয়ার অর্থ ফাসিক্ব হওয়া। কুফরের অর্থ সত্য গোপন করা হতে পারে। ইবনু আব্বাস (রা) ও তাউস (রহ) বলেন, এটা এমন কুফরী কাজ নয়, যার দ্বারা মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যাবে, যেমন খারিজ হয়ে যায় আল্লাহ ও পরকালকে অস্বীকার করলে, বরং এরূপ করলে সে সত্যকেই গোপন করবে।’’ [.তাফসীরে মাযহারী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন,১৪০৫/১৯৮৮) ৩/৭০০-০১ পৃ.।] অতঃপর তিনি (রহ) فاولئك هم الظالِمون -এর তাফসীরে লিখেছেন : ‘‘আল্লাহর বিধান কার্যকরী না করার কারণে।’’ [.তাফসীরে মাযহারী ৩/৭০৭ পৃ.।] অতঃপর তিনি (রহ) فاولئك هم الفاسقون -এর তাফসীরে লিখেছেন : ‘‘এখানে ফাসিকুন এর দু’ রকম অর্থ হতে পারে-
ক.আল্লাহর বিধানের আনুগত্য থেকে তারা খারিজ;
খ.আল্লাহর বিধানকে তুচ্ছ জানার কারণে ঈমান থেকে খারিজ। [.তাফসীরে মাযহারী ৩/৭০৯ পৃ.।]
৭.তাফহীমুল কুরআন : সাইয়েদ আবূ আ‘লা মওদূদী (রহ) তাঁর ‘‘তাফহীমুল কুরআন’’-এ আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন :
‘‘যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ এখানে তিনটি বিধান দিয়েছেন।
ক) তারা কাফের। খ) তারা যালেম। গ) তারা ফাসেক্ব।
এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম ও তাঁর নাযিল করা আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিতে ফায়সালা করে সে আসলে বড় ধরনের অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করার শামিল, কাজেই এটি কুফরী। দ্বিতীয়ত, তার এ কাজটি ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতির বিরোধী। কারণ, আল্লাহ যথার্থ ইনসাফ ও ভারসাম্যনীতি অনুযায়ীই হুকুম দিয়েছিলেন। কাজেই আল্লাহর হুকুম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করল তখন সে আসলে যুলুম করল। তৃতীয়ত, বান্দা হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করল তখনই সে আসলে বন্দেগী ও আনুগত্যের গণ্ডীর বাইরে পা রাখল। [.সাইয়েদ আবূল আ‘লা মওদূদী (রহ) ইবাদত ও ইতাআতকে একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। এর ব্যাখ্যা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ) লিখিত ‘ইবাদত ও ইতাআত’ অনুচ্ছেদে আসবে ইনঁশাআল্লাহ।] আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসেক্বী। এ কুফরী, যুলুম ও ফাসেক্বী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিকে দিয়ে অনিবার্যভাবেই পুরোপুরি আল্লাহর হুকুম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। যেখানে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হবে সেখানে এ তিনটি বিষয় থাকবে না, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে আল্লাহর হুকুম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়ভেদ আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে ভুল এবং নিজের বা অন্য কোন মানুষের হুকুমকে সঠিক মনে করে আল্লাহর হুকুম বিরোধী ফায়সালা করে সে পুরোপুরি কাফির, যালেম ও ফাসেক্ব। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে ইসলামী মিল্লাত বহির্ভুত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফুরী, যুলুম ও ফাসেক্বীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে সে সকল ব্যাপারেই কাফির, ফাসেক্ব ও যালেম। আর যে ব্যক্তি কিছু ব্যাপারে অনুগত এবং কিছু ব্যাপারে অবাধ্য তার জীবনে ঈমান ও ইসলাম এবং কুফরী, যুলুম ও ফাসেক্বীর মিশ্রণ ঠিক তেমনি হারে অবস্থান করছে যেহারে সে আনুগত্য ও অবাধ্যতাকে এক সাথে মিশিয়ে রেখেছে। কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতগুলোকে আহলে কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই। হুযাইফা (রা) -এর বক্তব্যই এ ধরনের ব্যাখ্যার সঠিক ও সর্বোত্তম জবাব। তাঁকে একজন বলেছিল, এ আয়াত তিনটি তো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সে বুঝাতে চাচ্ছিল যে, ইহুদীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা হুকুমের বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে-ই কাফির, যালেম ও ফাসেক্ব। একথা শুনে হুযাইফা (রা) বলে ওঠেন :
نعم الإخوة لكم بنو إسرائيل، إن كانت لَهم كل مُرَّة، ولكم كل حلوة ! كلا والله، لتسلكن طريقَهم قِدَر الشراك
‘‘এ বনী ইসরাঈল গোষ্ঠী তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই, তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য। কখনো নয়, আল্লাহর ক্বসম তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে।’’ [.হুযায়ফা (রা) -এর উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করে অনেক খারেজী বলেন যে : যেভাবে বনী ইসরাঈলের জন্য আয়াতটি সরাসরি তথা চূড়ান্ত কুফর, সেটা ‘দুনা কুফর’ নয়। সেভাবে মুসলিমদের জন্যও আয়াতটি সরাসরি বা চূড়ান্ত কুফর, ‘দুনা কুফর’ নয়। অথচ আমরা তাফসীরকারকদের কাছ থেকে জেনেছি : যখন বনী ইসরাঈলের মতো কিতাব বিকৃতি, পরিবর্তন করা হবে এবং কুরআন ও মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াত অস্বীকার করা হবে, তখন উক্ত কুফর সরাসরি বা চূড়ান্ত কুফর হিসেবে প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে যখন কুরআন, মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াতকে মেনে নেয়, কুরআন-সুন্নাহতে বিকৃতি ও পরিবর্তন করে না, নিজের মনগড়া বিধানকে আল্লাহর বিধান, রসূলের সুন্নাহ বা ইসলামী বিধান বলে দাবি করেন না; তখন আল্লাহর বিধান না জারি অথবা না পালনের জন্য তার কুফরটি চূড়ান্ত কুফরের চেয়ে কম কুফর হিসেবে গণ্য হবে। অথচ খারেজীরা হুযায়ফা (রা) বক্তব্যকে তাদের পক্ষে দলিল বানাচ্ছে। যদিও সহীহ মুসলিমে সাহাবী বারা বিন আযিব (রা) থেকে দীর্ঘ হাদীসে সূরা মায়েদা’র ৪৪-৪৭ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে নবী (স)-এর উক্তিও এসেছে যে : فِي الْكُفَّارِ كُلُّهَا ‘‘এই সবগুলো আয়াত কাফিরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩৩২ (২৮/৭০০)] আর মুসলিমদের জন্য ঐভাবে প্রযোজ্য যেভাবে কিছু পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।]
[তাফহীমুল কুরআন (ঢাকা, আধুনিক প্রকাশনী, ১৪২১/২০০০, আলোচ্য আয়াতের তাফসীর, টীকা ৭৭ দ্রষ্টব্য]
৮.তাফসীরে উসমানী : শিবিবর আহমাদ উসমানী (রহ) তাঁর ‘‘তাফসীরে উসমানী’-তে সূরা মায়িদা’র ৪৪ নং আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন :
’’ ما انزل الله ‘‘ کے موافق حکم نہ کرنے سے غالبا یہ مراد ہے کہ منصوص حکم کے وجود ہی سے انکار کردے اور اسکی جگہ دوسرے احکام اپنی راۓ اور خواہش سے تصنیف کرے۔ جیسا کہ یہود نے ’’ رجم ‘‘ کے متغلق کیا تھا۔ تو ایسے لوگوں کے کافر ہونے میں کیا شبہ ہو سکتا ہے اور اگر یہ ہو کہ ’’ ما انزل الله ‘‘ کو عقیدۃ ثابت مان کر پھر فیصلہ عملا اسکے خلاف کرے تو کافر سے مرادعملی کافر ہوگا۔ یعنی اسکی عملی حالت کافروں جیسی ہی
‘‘ ما انزل الله এর সম্পর্ক হল, ‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম না করা’-এর দ্বারা সম্ভাব্য অর্থ হবে, সুস্পষ্ট দলিলসমৃদ্ধ হুকুম থাকা সত্ত্বেও তা অস্বীকার করা এবং এর পরিবর্তে নিজের রায় ও খায়েশ দ্বারা ভিন্ন বিধান প্রবর্তন করা। যেভাবে ইয়াহুদীরা ‘রজমের’ হুকুমের ব্যাপারে করেছিল। এ ধরনের লোকেরা কাফির হওয়ার ব্যাপারে আর কি সংশয় থাকতে পারে? আর যদি ما انزل الله এর দাবি হয়, আক্বীদাগতভাবে স্বীকার করার পর আমলগত ফায়সালার ক্ষেত্রে এর বিপরীত করা- তবে সেক্ষেত্রে কাফিরের অর্থ আমলগত কুফর। অর্থাৎ তাদের আমলটি কাফিরদের মতো।’’ (তাফসীরে উসমানী, সূরা মায়িদা, ৪৪ নং আয়াতের তাফসীর)
৯.তাফসীরে মাজেদী : আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী (রহ) তাঁর ‘‘তাফসীরে মাজেদী’’-তে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন :
‘‘ ومن لَم يَحكم بِما انزل الله -আর যারা বিধান দেয় না তদনুসারে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, বরং তারা শরীআত বিরোধী হুকুম-আহকামকে শরীআতসম্মত বলে মনে করে মানুষের তৈরী বিধানকে আল্লাহর বিধান বলে চালায়।
নেতৃস্থানীয় ইয়াহুদীদের সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং গুনাহ এই ছিল যে, তারা তাদের মনগড়া মতবাদকে আল্লাহর [.বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদে : ‘খোদায়ী কানুন’ শব্দ আছে। আমরা তা পরিবর্তন করে ‘আল্লাহর কানুন’ উল্লেখ করলাম।] কানুন বলে চালিয়ে দিত। ফাতওয়া নিজের ইচ্ছামত দিত এবং বলত : দ্বীনের হুকুম এরূপ। এ ধরনের দুঃসাহসী ব্যক্তিদের কুফরীর ব্যাপারে আর কি সন্দেহ হতে পারে? বিশিষ্ট তাবেঈদের থেকে আয়াতের তাফসীর এরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইবনু যায়েদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি তার নিজের হাতে লেখা কিতাবের মতানুযায়ী বিধান দেয় এবং আল্লাহর কিতাবকে পরিত্যাগ করে এবং সে মনে করে যে তার কাছে যে কিতাব আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, সে কাফির হয়ে গেল- (ইবনু জারীর)। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমতও অনুরূপ।
ومن لَم يَحكم -এ আয়াতে من শব্দটি الذى শব্দের সমার্থজ্ঞাপক এবং আয়াতটি ইয়াহুদীদের শানে নাযিলকৃত। এখানে من শব্দটি الذى শব্দের সমার্থ জ্ঞাপক- (কুরতুবী)। অর্থ হল : ঐ সমস্ত ইয়াহুদী- যারা রজম, কিসাস ও অন্যান্য ইলাহী [.বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাংলা অনুবাদে : ‘খোদায়ী বিধান’ শব্দ আছে। আমরা তা পরিবর্তন করে ‘ইলাহী বিধান’ উল্লেখ করলাম।] বিধান পরিবর্তন করে নিজেদের মনগড়া বিধান আল্লাহ সঙ্গে সম্পৃক্ত করতো, তারা কাফির। কাজেই এখানে এরূপ উক্তি উহ্য আছে : ইয়াহুদীগণ, যারা ফায়সালা করে না সে মতে, যে বিধান নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা কাফির। সুতরাং এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তন্মধ্যে এটাই উত্তম (কুরতুবী)। খারিজীরা এ আয়াত দিয়ে জোর দাবি করে যে, যে সমস্ত মুসলিম [.বাংলা অনুবাদে ‘মুসলমান’ আছে। আমরা ‘মুসলিম’ লিখলাম।] ফাসিক, তারাও কাফিরদের হুকুমের মধ্যে শামিল, যখন তারা গায়রুল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে; তখন তারা কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই দলিল (খারেজীদের অন্যান্য দলিলের ন্যায়) পরিত্যাজ্য। কেননা, যে ধরনের ফায়সালার কথা এখানে বলা হয়েছে। তার সম্পর্ক আমলের সাথে নয়, বরং তা আক্বীদা-বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত। আর সে ব্যক্তি অবশ্যই কাফির হয়ে যায়। যে আক্বীদার দিক দিয়ে আল্লাহর কানুন বা বিধানকে ভুল বলে এবং নিজের মতবাদকে সঠিক মনে করে। এখানে অর্থ হল : ক্বলবের সাথে আমল করা এবং তা হল অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তা যদি কেউ বিশ্বাস না করে, তবে তার কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোনরূপ মতানৈক্য নেই- (রূহ)। আয়াতটি সাধারণ নয়, বরং কাফিরদের বিশেষকরে ইয়াহুদীদের সাথে সম্পৃক্ত এবং এ ব্যাপারে তাবেঈদের মাঝে আবূ সালিহ, ইকরামা, যাহহাক, কাতাদা (রহ)-এর ও অন্যান্যরা ছাড়াও, সাহাবীদের মাঝে হুযায়ফা ও ইবনু আব্বাস (রা) একমত। বরং এতদসম্পর্কে নবী (স) পর্যন্ত সনদ মওজুদ আছে। যেমন- বারা বিন আযিব (রা) নবী (স) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলা বাণী : আর যারা ফায়সালা দেয় না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা তো কাফির; আর যারা ফায়সালা করে না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা তো ফাসিক্ব। আয়াতগুলো ফাসিক্বদের শানে নাযিল হয়েছে (ইবনু জারীর)।
আবূ সালিহ (রহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : সূরা মায়িদার মধ্যে যে তিনটি আয়াত আছে : ‘‘আর যারা ফায়সালা দেয় না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা তো কাফির, যালিম এবং ফাসিক্ব’’ -আয়াতগুলি ইসলামের অনুসারীদের শানে নাযিল হয়নি, বরং তা কাফিরদের শানে নাযিল হয়েছে- (ইবনু জারীর)। যাহহাক (রহ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন : উপরোক্ত আয়াত ‘আহলে কিতাবদের’ শানে নাযিল হয়েছে (ইবনু জারীর)। ইকরামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : উপরোক্ত আয়াতগুলি ‘আহলে কিতাব’ এর শানে নাযিল হয়েছে (ইবনু জারীর)। উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আয়াতগুলো ইয়াহুদীদের শানে নাযিল হয়েছে আর তাদের গুণাবলি বর্ণনার আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছে (ইবনু জারীর)। ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করে- ‘‘যারা সে মত ফায়সালা করে না, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ, তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক্ব; আয়াতত্রয় বিশেষভাবে ইয়াহুদীদের শানে নাযিল হয়েছে’’ (রূহ)।
বারা ইবনু আযিব, হুযায়ফা ইবনু ইয়ামান, ইবনু আব্বাস, আবূ মাজলায, আবূরাজা আতারদী, ইকরামা; উবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দুল্লাহ, হাসান বসরী প্রমুখ সুধীগণ বলেন : আয়াতগুলো ‘আহলে কিতাবদের’ শানে নাযিল হয়েছে। এ উম্মাতের অপরাধ বর্ণনার জন্য নয় (মাআলিম)।
ইমাম ইবনু জারীর তাবারী (রহ) স্বীয় স্বভাবসুলভ বর্ণনা ভঙ্গীতে বলেন যে, আয়াতের সম্পর্ক হল কাফির ও আহলে কিতাবদের সাথে; বর্ণনা ধারায় তাদের কথা উল্লেখ আছে এবং এর আগেও তাদের সম্বন্ধে আলোচনা রয়েছে। অন্যান্য বিশিষ্ট মুফাসসিরীনদের অভিমতও এরূপ। ইবনু জারীর বলেন : আমার নিকট এ অভিমতই অধিক যুক্তিযুক্ত যে, এসব আয়াত আহলে কিতাবের কাফিরদের শানে নাযিল হয়েছে। কেননা, এর পূর্বাপর আয়াতের আলোকে জানা যায় যে, তাদের সম্পর্কে এগুলো নাযিল হয়েছে এবং দোষারোপ তাদেরই করা হয়েছে (ইবনু জারীর)। ইমাম শা‘বী (রহ) বলেন : আয়াতগুলো বিশেষভাবে ইয়াহুদীদের শানে নাযিল হয়েছে এবং নাহহাসের অভিমতও এরূপ (কুরতুবী)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন ফায়সালাকে মানতে অস্বীকার করে, অথবা এমন ফায়সালা দেয়, যা আল্লাহর হুকুমের বিপরীত এবং বলে : নিশ্চয় এ হল আল্লাহর হুকুম, সে ব্যক্তি কাফির। যেমন বনূ ইসরাঈলরা কাফির হয়েছিল, যখন তারা এরূপ করেছিল। (জাসসাস)
আল্লাহবিরোধী কানুন মোতাবেক ফায়সালা করার কারণে যদি কোন মুসলিম অভিযুক্ত হয়; তবে তখন হবে, যখন সে জেনেশুনে সজ্ঞানে শরীআতের প্রকাশ্য ও স্পষ্ট বিধানের খিলাফ কিছু করবে এবং সে তখন অভিযুক্ত হবে না- যখন হুকুমটি গোপন কোন বিষয়ের ইঙ্গিতবহ হবে এবং না জেনে, না শুনে সে তার অপব্যাখ্যা করবে। এ সম্পর্কে উলামাদের অভিমত হল- যদি কেউ শরীআতের স্পষ্ট দলিলের খিলাফ কিছু করে বা বলে, তবে সে অভিযুক্ত হবে, পক্ষান্তরে শরীআতের গোপনতত্ত্ব যার কাছে স্পষ্ট নয়, সে যদি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভুল করে বসে, তবে সে অভিযুক্ত হবে না (মাআলিম)। তাবে‘য়ী ইকরামা (রহ), যার সঙ্গে ইমাম রাযী (রহ)-এর বক্তব্যের মিল আছে বলেন : যতক্ষণ কেউ কোন ইলাহী বিধানকে অন্তর দিয়ে মানবে এবং মুখে তা স্বীকার করবে, সে কিরূপে অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। যদি তার কাজ-কর্ম, বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তির খিলাফ হয়, তবে তাকে গুনাহগার এবং হুকুম তরককারী বলা যেতে পারে; তাকে অস্বীকারকারী বা কাফির ও বিদ্রোহী বলা যাবে না। ইকরামা (রহ) বলেন : আল্লাহর কথা- ‘‘যে ব্যক্তি ফায়সালা করে না সে মতে, যা নাযিল করেছেন আল্লাহ- সে কাফির’’-এ অভিমত তার উপর প্রযোজ্য, যে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে এবং মুখে অস্বীকার করে এবং ‘আল্লাহর হুকুম’ হিসাবে যে মুখে তা স্বীকার করে, এরপর খিলাফ কিছু করে, তবে সে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার বিরোধিতাকারী নয়, বরং সে হবে তা তরককারী। সেজন্য এ আয়াতের আওতায় এনে তাকে অভিযুক্ত করা যাবে না। এটাই সহীহ জবাব (কাবীর)।
আমাদের যামানায় খারেজী মাযহাবের প্রচার ও প্রসার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। সুন্দর সুন্দর নাম ও উপাধীধারী ব্যক্তিরা এ কাজে নিয়োজিত। তারা এ আয়াত দ্বারা তাদের মতাদর্শ প্রচারে প্রয়াসে। সেজন্য জরুরি মনে করে আয়াতটির ব্যাখ্যা কিছু বিস্তারিতভাবে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের’ মাযহাব অনুযায়ী করা হল। [.আব্দুল মাজেদ দরিয়াবাদী, তাফসীরে মাজেদী (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জুন ১৯৯২) ২/৫৬৬-৬৮ পৃষ্ঠা।]
১০.বাদীউত তাফাসীর : ইমাম বাদীউদ্দীন শাহ আর-রাশেদী (রহ) তাঁর সিন্ধি ভাষায় লিখিত ‘বাদীউত তাফাসীরে’ আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তাফসীরে দুররে মানসুর ও তাফসীরে কুরতুবী থেকে পূর্বোক্ত তাফসীরগুলোর সমার্থক উদ্ধৃতিগুলো দেয়ার পর লিখেছেন :
‘‘সম্মানিত পাঠক! আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা জারি না করা কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। যেভাবে ইমাম যাহাবী তাঁর ‘আল-কাবায়ির’-এর ৩১ নং কবীরাহ গুনাহর বর্ণনাতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেবল কবীরা গুনাহর কারণে মুসলিম ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয় না, যতক্ষণ না সে নিজের কৃত আমলটিকে সহীহ বা হক্ব হওয়ার আক্বীদা রাখে। বরং যদি তা সে ভুল মনে করে, অথচ কোন বিশেষ (মাজবুরী) পরিস্থিতিতে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা না করে- তবে সে অবশ্যই যালিম ও ফাসিক্ব। কিন্তু তাকে কাফির বা ইসলাম থেকে খারিজ বলা যাবে না। এটাই আহলে সুন্নাতের ইজমা‘য়ী মাসআলা যা প্রথম থেকে চলে আসছে। কিন্তু খারেজীরা সব ধরনের কবীরা গোনাহকারীকে কাফির বলে থাকে।.... তারা এই আয়াতটি দ্বারা দলিল নিয়ে থাকে এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ থেকে নিজেদের চোখ বন্ধ রাখে। যেমনটি বিদআতীরা নিজেদের প্রমাণ উপস্থাপনে এমনটি করে থাকে।...’’
[বাদীউত তাফাসীর (১৯৯৮ ইং) ৭/২৩৮ পৃষ্ঠা]
উদ্ধৃত সমস্ত তাফসীরগুলো থেকে প্রমাণিত হল, আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে সুন্নী মুসলিমদের প্রকৃত আক্বীদা ও তাফসীর সেটাই যা শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) থেকে আমরা এই বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করেছি। উপরোক্ত সমস্ত মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে, কুফর দু’ধরনের হয়ে থাকে। যথা :
ক.কুফরে আমালী;
খ.কুফরে ইতিক্বাদী।
এই প্রকারভেদ শায়খ আলবানী (রহ) একাই করেননি। তাছাড়া আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি না করাতে কুফরের স্তর বিন্যাসেও তাদের উপস্থাপনায় কোন পার্থক্য নেই। যদি এই কারণে তাকে মুরজিয়া বলা হয়, তবে পূর্বোক্ত সমস্ত তাফসীরকারকগণও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। অথচ এক্ষেত্রে তাদের উপস্থাপনায় আমরা ঐকমত্য লক্ষ করি। সুতরাং এর বিপরীত মতই গোমরাহ পথ। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
-কামাল আহমাদ
১.আল্লাহর বিধানকে বিকৃতিকারী এবং মনগড়া (মাযহাবী ও তরীক্বার) বিধানকে আল্লাহর বিধান বলে প্রচারকারী কাফির :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘তোমরা আমার আয়াতকে সামান্য ও নগণ্য বিনিময়ে বিক্রি করো না। যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত)
আয়াতটির শানে-নুযূলে প্রমাণিত হয়েছে, ইয়াহুদীরা রজমের বিধানকে পরিবর্তন করে ভিন্ন বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলেছিল।
এমর্মে অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ
‘‘অতএব, তাদের জন্য আফসোস! যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, যেন এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে। অতএব তাদের জন্য ওয়েল (জাহান্নাম), তাদের কিতাব লেখার জন্য এবং তাদের জন্য ওয়েল (জাহান্নাম) তাদের উপার্জনের জন্য।’’ (সূরা বাক্বারাহ : ৭৯ আয়াত)
সুতরাং প্রমাণিত হল, যখন কোন আলেম বা হাকিম বা অন্য যে কেউ এমন কোন বিধান, মাসআলা বা ফাতওয়া দেয়- যা আল্লাহ নাযিল করেননি। অথচ জনগণের মাঝে তা আল্লাহর বিধান হিসাবে প্রচার করে। তখনই কেবল উক্ত আয়াতগুলোর হুকুম প্রযোজ্য। যা বিভিন্ন মাযহাবী ফিক্বাহ, ফাতওয়া ও সূফীদের তরীক্বাতে দেখা যায়। অথচ সেগুলোর পক্ষে আল্লাহ তাআলা কিছুই নাযিল করেননি। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, মুজাহিদ পরিচয় দানকারী বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলো কুরআন-হাদীস বিরোধী ও ভুলে ভরা মাযহাবী ফিক্বাহ ও ফাতওয়ার কিতাবকে বাতিল আখ্যায়িত করে না। অথচ উক্ত ফিক্বাহ ও ফাতওয়ার কিতাবগুলোর দাবি হল, সেগুলোতে উদ্ধৃত বিধানগুলো আল্লাহর বিধান বা ইসলামী বিধান। পক্ষান্তরে প্রচলিত মুসলিম শাসকেরা রাষ্ট্র যখন কোন আইন জারি করে সেটাকে আল্লাহর বিধান বা ইসলামী বিধান আখ্যায়িত না করে বলে- এটা সংসদ বা তোমাদের বর্তমান উলূল আমরের নির্দেশ - যে সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস নিরব। সেক্ষেত্রে ঐ আইনকে কীভাবে শিরক বা কুফর বলা যাবে!?
উল্লেখ্য উক্ত আয়াতের শুরুতে নবী ও আলেমদেরকে কিতাবের হেফাযতকারী গণ্য করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِن كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ
‘‘রব্বানী ও আহবারদেকে আল্লাহর কিতাবের হেফাযত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আর তারা ছিল এর (তাওরাতের) উপর সাক্ষী।’’ [সূরা মায়িদা : ৪৪]
সূরা মায়িদার ৪৪ নং আয়াতটির সাধারণ মর্ম থেকে বুঝা যায়, আলেমরা কিতাবের যে বিকৃতি ঘটিয়ে সেগুলোকে ‘আল্লাহর বিধান’ বলে প্রচার করে- তাদের ঐ কাজকে কুফর এবং তা জারি বাস্তবায়নকারীকে কাফির বলা হয়েছে।
কুরআন ইয়াহুদী আলেমদের আল্লাহর কিতাবের বিকৃতি ও ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে যত আলোচনা করেছে, ততটা শাসকদের নিয়ে আলোচনা করেনি। এ পর্যায়ে যেসব শাসক আল্লাহর বিধান বিকৃত, গোপন বা পরিবর্তন না করে কেবল হুকুমগুলো জারি করছে না, তাদের সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) সরাসরি আমাদের পথ-নির্দেশনা বা হেদায়াত দিয়েছেন। যেমন : নবী (স) বলেছেন :
ألا من ولي عليه وال فرآه يأتي شيئا من معصية الله فليكره ما يأتي من معصية الله ولا ينزعن يدا من طاعة .
‘‘সাবধান! যে ব্যক্তিকে তোমাদের উপর শাসক নিযুক্ত করা হয়, আর যদি তার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানীর কোন কিছু পরিলক্ষিত হয়, তখন তোমরা তার সেই আল্লাহর নাফরমানীর কাজটিকে ঘৃণার সাথে অপছন্দ কর, কিন্তু তার আনুগত্য হতে হাত গুটাতে পারবে না।’’[সহীহ মুসলিম ৪৬৯৮ (৬৫/১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০]
অন্যত্র রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
لاَطَاعَةَ فِيْ مَعْصِيَةٍ اِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ ‘‘নাফরমানীর ব্যাপারে ইতাআত নেই। ইতাআত কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৫৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৫৯ (৩৯/১৮৪০), মিশকাত ৩৬৬৫ নং।]
অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত না করে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে কিছু জারি করলে- সেটা কোন নিষিদ্ধ বিষয় না হলে - শাসকের আনুগত্য ফরয। আর নিষিদ্ধ বিষয় হলে - ঐ বিষয়ে শাসকের আনুগত্য ত্যাগ করা ফরয। পক্ষান্তরে যখন শাসকও কোন বিধানকে আল্লাহর বিধান হিসেবে চালায় বা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে - তখন সে উল্লিখিত আলেমদের মতো কাফির হয়। এ সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রা) বলেন :
كَانَتْ مُلُوكٌ بَعْدَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَامُ بَدَّلُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَكَانَ فِيهِمْ مُؤْمِنُونَ يَقْرَءُونَ التَّوْرَاةَ قِيلَ لِمُلُوكِهِمْ مَا نَجِدُ شَتْمًا أَشَدَّ مِنْ شَتْمٍ يَشْتِمُونَّا هَؤُلَاءِ إِنَّهُمْ يَقْرَءُونَ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ
‘‘ঈসা ইবন মারয়াম (আ)-এর পর এমন কয়েকজন বাদশাহ ছিলেন, যারা তাওরাত এবং ইঞ্জিলে পরিবর্তন সাধন করেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু ঈমানদার লোকও ছিলেন, যারা তাওরাত পাঠ করতেন। তখন তাদের বাদশাহদেরকে বলা হল, এ সকল লোক আমাদেরকে যে গালি দিচ্ছে, এর চেয়ে কঠিন গালি আর কী হতে পারে? তারা পাঠ করে : ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা মীমাংসা করে না, তারা কাফির’ ...।’’ [নাসাঈ (ইফা) ৫৩৯৯- মওকুফ সহীহ (আলবানী, তাহক্বীক্ব নাসাঈ ৫৪০০]
বুঝা গেল, সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা)-এর কাছে কাফির শব্দটি কিতাব বিকৃতিরকারীদের সাথে প্রযোজ্য। হোক সে শাসক বা আলিম।
২. আল্লাহর বিধান জারি না করলে ঐ আলেম বা শাসক জালিম ও ফাসিক :
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘তাওরাতে আমি ইহুদীদের জন্য এ বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং সব রকমের যখমের জন্য সমপর্যায়ের বদলা। তারপর যে ব্যক্তি ঐ শাস্তি সাদকা করে দেবে তা তার জন্য কাফ্ফারায় পরিণত হবে। আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই জালেম।’’ [সূরা মায়িদা : ৪৫]
পূর্বের ৪৪ নং আয়াতে কিতাবের হুকুম গোপন বা বিকৃতকারীদেরকে কাফির বলা হয়েছে। আর ৪৫ নং আয়াতে বিধান জারি না করলে - তাদেরকে জালিম বলা হয়েছে, কিন্তু কাফির বলা হয়নি। আবার ৪৭ নং আয়াতেও বিধান জারি না করলে ফাসিক বলা হয়েছে। যেমন : আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فِيهِ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন। তদানুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক্ব।’’ [সূরা মায়িদা : ৪৭]
বুঝা গেল :
সূরা মায়েদার ৪৪ নং আয়াতটি কিতাব বিকৃতি বা ভ্রান্ত ব্যাখ্যাকারীদেরকে কাফির বলা হয়েছে। যেমন- মুসলিমদের মাঝে প্রসিদ্ধ ও বহুল ব্যবহৃত কোন কোন ফিক্বহ ও ফাতওয়ার কিতাবের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। অথচ মুজাহিদ গ্রুপগুলো এ ব্যাপারে কোন সংস্কারমূলক কাজ করেন না। বরং উক্ত বিকৃতি বা ভুলকে মেনে নেয়। তারা নিজেদেরকে ক্ষমতার মসনদের একমাত্র যোগ্য মনে করায় এ ধরনের বিকৃত সংগঠনের প্রসার হচ্ছে। মুসলিমদের ফিক্বহী আইনের বিকৃতির কথা বললে, তারা আগে ক্ষমতা যাওয়ার কথা বলে পরে শূরা বা সংসদের সেগুলোর সংশোধন হওয়ার মুলা ঝুলিয়ে সমর্থক ও কর্মী সংগ্রহ করে। যার ফলাফল হল, তারা নিজেদেরকে কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক সংস্কারে পথ বন্ধ করে রাখে।
সূরা মায়েদা ৪৫ ও ৪৭ নং আয়াতে - যারা আল্লাহর বিধান জারি করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা সেটা জারি করে না - তাদেরকে জালিম ও ফাসিক বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে নবী (স) শাসকদের আনুগত্য অব্যাহত রাখতে বলেছেন।
৩.আল্লাহ তাআলা’র প্রতি মিথ্যারোপ এবং অস্বীকার করার কারণে : আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ
‘‘তার চেয়ে অধিক যালেম কে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলবে এবং তার কাছে সত্য আগমনের পর তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। কাফিরদের বাসস্থান কি জাহান্নাম নয়? (সূরা যুমার : ২৪ আয়াত)
এখানেও আল্লাহ তাআলা’র সাথে আক্বীদা, আমল বা বিধানকে সম্পর্কিত করার সাথে কাফির শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ নিমণরূপ :
ক) আক্বীদা : আল্লাহ তাআলা’র যাত ও সিফাত সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিষয়গুলো হুবহু গ্রহণ না করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতিহীন নিজস্ব বা দলীয় বা তরীক্বার বা মাযহাবী ব্যাখ্যা প্রদান করা।
খ) আমল : এমন সব বিদআতি আমলের সৃষ্টি করা যা আল্লাহ তাআলা হুকুম দেননি কিংবা তাঁর রসূল (স) -এর নির্দেশ ও আমলে পাওয়া যায়নি। কিন্তু নিজেরা শাব্দিক তরজমার মাধ্যমে আবিষ্কার করে - সেটা আল্লাহর বিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া। কিংবা এমনসব আমল যেগুলো আল্লাহ নাযিল না করা সত্ত্বেও সেগুলো ইসলামী আমল হিসেবে চালু আছে। যেমন- (১) অযুতে নিয়্যাত ফরয নয়, সুন্নাত বা মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে সলাতে নিয়্যাত করা ফরয়। (২) সলাতের প্রথম দুই রাকআত যে কোন ক্বিরআত করা ফরয, সূরা ফাতিহা পাঠ সুন্নাত। পরবর্তী শেষ এক/দুই রাকআতে- তিনবার সুবহানাল্লাহ পরিমান দাঁড়ান ফরয আর সূরা ফাতিহা বা যে কোন ক্বিরাআত করা সুন্নাত বা মুস্তাহাব। (৩) সলাতের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠের পর বায়ু ত্যাগ করলে - সলাত পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।- এগুলোর কোনটিই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়।
গ) বিধি-বিধান : যুগোপযোগী বিভিন্ন কারণে মানুষের প্রয়োজনে আইন রচনা করতে হয়। সেগুলোর ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে কোন ইশারা ইঙ্গিত না থাকার কারণে বিধি-বিধান জারি করার প্রয়োজন হয়। এ সমস্ত বিষয়কে আল্লাহ বা রসূলের সাথে সম্পর্কিত করলেও কাফির হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে এগুলো উলূল আমর, শূরা (সংসদ), খলীফা, আমীর বা শাসকের আনুগত্য বা অনুসরণ বললে - কাফির হবে না। অথচ সেই আইনগুলো কুরআন সুন্নাহর বিরোধী না হলে - মুসলিমরা মানতে বাধ্য।
৪.হারামকৃত বস্তুকে হালাল এবং হালালকৃত বস্তুকে হারাম ঘোষণা করার কারণে :
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَٰذَا حَلَالٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ
‘‘তোমাদের মুখ থেকে সাধারণভাবে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে, তেমনি করে আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করে বলো না যে, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ করে তারা সফল হবে না।’’ (সূরা নাহাল : ১১৬ আয়াত)
৫.বিচারক, আলেম-উলামা, পীর-দরবেশদেরকে হালাল ও হারাম করার হক্বদার গণ্য করার কারণে :
আল্লাহ তাআলা বলেন : اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
‘‘তারা তাদের আহবার (আলেম) ও রুহবান (সূফী)-দের আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসাবে গ্রহণ করেছে।’’ (সূরা তাওবা : ৩১ আয়াত)
নবী (স) আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন :
أَمَا إِنَّهُمْ لَمْ يَكُونُوا يَعْبُدُونَهُمْ وَلَكِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا أَحَلُّوا لَهُمْ شَيْئًا اسْتَحَلُّوهُ وَإِذَا حَرَّمُوا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوهُ
‘‘এমন নয় যে, তারা এদের ইবাদত করত। বরং এরা যদি তাদের জন্য কিছু হালাল করে দিত তখন তারা তা হালাল বলে গ্রহণ করত; এরা যখন কোন কিছু হারাম বলে স্থির করতো তখন তারাও তা হারাম বলে গ্রহণ করতো।’’ [.হাসান : তিরমিযী- তাফসীরুল কুরআন, সূরা তাওবা। আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত তিরমিযী হা/৩০৯৫]]
এখানে হালাল বা হারাম নির্ধারণ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা নাযিলকৃত বা ইলাহী হুকুম গণ্য করাকে চূড়ান্ত কুফর হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কাফির হওয়ার বিভিন্ন কারণ ও শর্ত রয়েছে। এখানে আমরা কেবল আল্লাহর বিধান জারি করা ও না করার ক্ষেত্রে কাফির হওয়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ উল্লেখ করলাম।
১.আল্লাহর বিধানকে বিকৃতিকারী এবং মনগড়া (মাযহাবী ও তরীক্বার) বিধানকে আল্লাহর বিধান বলে প্রচারকারী কাফির :
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَشْتَرُوا بِآَيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلًا وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘তোমরা আমার আয়াতকে সামান্য ও নগণ্য বিনিময়ে বিক্রি করো না। যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত)
আয়াতটির শানে-নুযূলে প্রমাণিত হয়েছে, ইয়াহুদীরা রজমের বিধানকে পরিবর্তন করে ভিন্ন বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বলেছিল।
এমর্মে অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ
‘‘অতএব, তাদের জন্য আফসোস! যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, যেন এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে। অতএব তাদের জন্য ওয়েল (জাহান্নাম), তাদের কিতাব লেখার জন্য এবং তাদের জন্য ওয়েল (জাহান্নাম) তাদের উপার্জনের জন্য।’’ (সূরা বাক্বারাহ : ৭৯ আয়াত)
সুতরাং প্রমাণিত হল, যখন কোন আলেম বা হাকিম বা অন্য যে কেউ এমন কোন বিধান, মাসআলা বা ফাতওয়া দেয়- যা আল্লাহ নাযিল করেননি। অথচ জনগণের মাঝে তা আল্লাহর বিধান হিসাবে প্রচার করে। তখনই কেবল উক্ত আয়াতগুলোর হুকুম প্রযোজ্য। যা বিভিন্ন মাযহাবী ফিক্বাহ, ফাতওয়া ও সূফীদের তরীক্বাতে দেখা যায়। অথচ সেগুলোর পক্ষে আল্লাহ তাআলা কিছুই নাযিল করেননি। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, মুজাহিদ পরিচয় দানকারী বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলো কুরআন-হাদীস বিরোধী ও ভুলে ভরা মাযহাবী ফিক্বাহ ও ফাতওয়ার কিতাবকে বাতিল আখ্যায়িত করে না। অথচ উক্ত ফিক্বাহ ও ফাতওয়ার কিতাবগুলোর দাবি হল, সেগুলোতে উদ্ধৃত বিধানগুলো আল্লাহর বিধান বা ইসলামী বিধান। পক্ষান্তরে প্রচলিত মুসলিম শাসকেরা রাষ্ট্র যখন কোন আইন জারি করে সেটাকে আল্লাহর বিধান বা ইসলামী বিধান আখ্যায়িত না করে বলে- এটা সংসদ বা তোমাদের বর্তমান উলূল আমরের নির্দেশ - যে সম্পর্কে কুরআন ও হাদীস নিরব। সেক্ষেত্রে ঐ আইনকে কীভাবে শিরক বা কুফর বলা যাবে!?
উল্লেখ্য উক্ত আয়াতের শুরুতে নবী ও আলেমদেরকে কিতাবের হেফাযতকারী গণ্য করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ بِمَا اسْتُحْفِظُوا مِن كِتَابِ اللَّهِ وَكَانُوا عَلَيْهِ شُهَدَاءَ
‘‘রব্বানী ও আহবারদেকে আল্লাহর কিতাবের হেফাযত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল আর তারা ছিল এর (তাওরাতের) উপর সাক্ষী।’’ [সূরা মায়িদা : ৪৪]
সূরা মায়িদার ৪৪ নং আয়াতটির সাধারণ মর্ম থেকে বুঝা যায়, আলেমরা কিতাবের যে বিকৃতি ঘটিয়ে সেগুলোকে ‘আল্লাহর বিধান’ বলে প্রচার করে- তাদের ঐ কাজকে কুফর এবং তা জারি বাস্তবায়নকারীকে কাফির বলা হয়েছে।
কুরআন ইয়াহুদী আলেমদের আল্লাহর কিতাবের বিকৃতি ও ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে যত আলোচনা করেছে, ততটা শাসকদের নিয়ে আলোচনা করেনি। এ পর্যায়ে যেসব শাসক আল্লাহর বিধান বিকৃত, গোপন বা পরিবর্তন না করে কেবল হুকুমগুলো জারি করছে না, তাদের সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) সরাসরি আমাদের পথ-নির্দেশনা বা হেদায়াত দিয়েছেন। যেমন : নবী (স) বলেছেন :
ألا من ولي عليه وال فرآه يأتي شيئا من معصية الله فليكره ما يأتي من معصية الله ولا ينزعن يدا من طاعة .
‘‘সাবধান! যে ব্যক্তিকে তোমাদের উপর শাসক নিযুক্ত করা হয়, আর যদি তার মধ্যে আল্লাহর নাফরমানীর কোন কিছু পরিলক্ষিত হয়, তখন তোমরা তার সেই আল্লাহর নাফরমানীর কাজটিকে ঘৃণার সাথে অপছন্দ কর, কিন্তু তার আনুগত্য হতে হাত গুটাতে পারবে না।’’[সহীহ মুসলিম ৪৬৯৮ (৬৫/১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০]
অন্যত্র রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
لاَطَاعَةَ فِيْ مَعْصِيَةٍ اِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ ‘‘নাফরমানীর ব্যাপারে ইতাআত নেই। ইতাআত কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৫৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৫৯ (৩৯/১৮৪০), মিশকাত ৩৬৬৫ নং।]
অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত না করে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে কিছু জারি করলে- সেটা কোন নিষিদ্ধ বিষয় না হলে - শাসকের আনুগত্য ফরয। আর নিষিদ্ধ বিষয় হলে - ঐ বিষয়ে শাসকের আনুগত্য ত্যাগ করা ফরয। পক্ষান্তরে যখন শাসকও কোন বিধানকে আল্লাহর বিধান হিসেবে চালায় বা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে - তখন সে উল্লিখিত আলেমদের মতো কাফির হয়। এ সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রা) বলেন :
كَانَتْ مُلُوكٌ بَعْدَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِ الصَّلَاة وَالسَّلَامُ بَدَّلُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَكَانَ فِيهِمْ مُؤْمِنُونَ يَقْرَءُونَ التَّوْرَاةَ قِيلَ لِمُلُوكِهِمْ مَا نَجِدُ شَتْمًا أَشَدَّ مِنْ شَتْمٍ يَشْتِمُونَّا هَؤُلَاءِ إِنَّهُمْ يَقْرَءُونَ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ
‘‘ঈসা ইবন মারয়াম (আ)-এর পর এমন কয়েকজন বাদশাহ ছিলেন, যারা তাওরাত এবং ইঞ্জিলে পরিবর্তন সাধন করেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু ঈমানদার লোকও ছিলেন, যারা তাওরাত পাঠ করতেন। তখন তাদের বাদশাহদেরকে বলা হল, এ সকল লোক আমাদেরকে যে গালি দিচ্ছে, এর চেয়ে কঠিন গালি আর কী হতে পারে? তারা পাঠ করে : ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা মীমাংসা করে না, তারা কাফির’ ...।’’ [নাসাঈ (ইফা) ৫৩৯৯- মওকুফ সহীহ (আলবানী, তাহক্বীক্ব নাসাঈ ৫৪০০]
বুঝা গেল, সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা)-এর কাছে কাফির শব্দটি কিতাব বিকৃতিরকারীদের সাথে প্রযোজ্য। হোক সে শাসক বা আলিম।
২. আল্লাহর বিধান জারি না করলে ঐ আলেম বা শাসক জালিম ও ফাসিক :
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘তাওরাতে আমি ইহুদীদের জন্য এ বিধান লিখে দিয়েছিলাম যে প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং সব রকমের যখমের জন্য সমপর্যায়ের বদলা। তারপর যে ব্যক্তি ঐ শাস্তি সাদকা করে দেবে তা তার জন্য কাফ্ফারায় পরিণত হবে। আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই জালেম।’’ [সূরা মায়িদা : ৪৫]
পূর্বের ৪৪ নং আয়াতে কিতাবের হুকুম গোপন বা বিকৃতকারীদেরকে কাফির বলা হয়েছে। আর ৪৫ নং আয়াতে বিধান জারি না করলে - তাদেরকে জালিম বলা হয়েছে, কিন্তু কাফির বলা হয়নি। আবার ৪৭ নং আয়াতেও বিধান জারি না করলে ফাসিক বলা হয়েছে। যেমন : আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الْإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فِيهِ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত, আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন। তদানুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক্ব।’’ [সূরা মায়িদা : ৪৭]
বুঝা গেল :
সূরা মায়েদার ৪৪ নং আয়াতটি কিতাব বিকৃতি বা ভ্রান্ত ব্যাখ্যাকারীদেরকে কাফির বলা হয়েছে। যেমন- মুসলিমদের মাঝে প্রসিদ্ধ ও বহুল ব্যবহৃত কোন কোন ফিক্বহ ও ফাতওয়ার কিতাবের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। অথচ মুজাহিদ গ্রুপগুলো এ ব্যাপারে কোন সংস্কারমূলক কাজ করেন না। বরং উক্ত বিকৃতি বা ভুলকে মেনে নেয়। তারা নিজেদেরকে ক্ষমতার মসনদের একমাত্র যোগ্য মনে করায় এ ধরনের বিকৃত সংগঠনের প্রসার হচ্ছে। মুসলিমদের ফিক্বহী আইনের বিকৃতির কথা বললে, তারা আগে ক্ষমতা যাওয়ার কথা বলে পরে শূরা বা সংসদের সেগুলোর সংশোধন হওয়ার মুলা ঝুলিয়ে সমর্থক ও কর্মী সংগ্রহ করে। যার ফলাফল হল, তারা নিজেদেরকে কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক সংস্কারে পথ বন্ধ করে রাখে।
সূরা মায়েদা ৪৫ ও ৪৭ নং আয়াতে - যারা আল্লাহর বিধান জারি করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা সেটা জারি করে না - তাদেরকে জালিম ও ফাসিক বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে নবী (স) শাসকদের আনুগত্য অব্যাহত রাখতে বলেছেন।
৩.আল্লাহ তাআলা’র প্রতি মিথ্যারোপ এবং অস্বীকার করার কারণে : আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللَّهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِلْكَافِرِينَ
‘‘তার চেয়ে অধিক যালেম কে আছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলবে এবং তার কাছে সত্য আগমনের পর তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে। কাফিরদের বাসস্থান কি জাহান্নাম নয়? (সূরা যুমার : ২৪ আয়াত)
এখানেও আল্লাহ তাআলা’র সাথে আক্বীদা, আমল বা বিধানকে সম্পর্কিত করার সাথে কাফির শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ নিমণরূপ :
ক) আক্বীদা : আল্লাহ তাআলা’র যাত ও সিফাত সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিষয়গুলো হুবহু গ্রহণ না করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতিহীন নিজস্ব বা দলীয় বা তরীক্বার বা মাযহাবী ব্যাখ্যা প্রদান করা।
খ) আমল : এমন সব বিদআতি আমলের সৃষ্টি করা যা আল্লাহ তাআলা হুকুম দেননি কিংবা তাঁর রসূল (স) -এর নির্দেশ ও আমলে পাওয়া যায়নি। কিন্তু নিজেরা শাব্দিক তরজমার মাধ্যমে আবিষ্কার করে - সেটা আল্লাহর বিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া। কিংবা এমনসব আমল যেগুলো আল্লাহ নাযিল না করা সত্ত্বেও সেগুলো ইসলামী আমল হিসেবে চালু আছে। যেমন- (১) অযুতে নিয়্যাত ফরয নয়, সুন্নাত বা মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে সলাতে নিয়্যাত করা ফরয়। (২) সলাতের প্রথম দুই রাকআত যে কোন ক্বিরআত করা ফরয, সূরা ফাতিহা পাঠ সুন্নাত। পরবর্তী শেষ এক/দুই রাকআতে- তিনবার সুবহানাল্লাহ পরিমান দাঁড়ান ফরয আর সূরা ফাতিহা বা যে কোন ক্বিরাআত করা সুন্নাত বা মুস্তাহাব। (৩) সলাতের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পাঠের পর বায়ু ত্যাগ করলে - সলাত পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।- এগুলোর কোনটিই আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়।
গ) বিধি-বিধান : যুগোপযোগী বিভিন্ন কারণে মানুষের প্রয়োজনে আইন রচনা করতে হয়। সেগুলোর ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসে কোন ইশারা ইঙ্গিত না থাকার কারণে বিধি-বিধান জারি করার প্রয়োজন হয়। এ সমস্ত বিষয়কে আল্লাহ বা রসূলের সাথে সম্পর্কিত করলেও কাফির হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে এগুলো উলূল আমর, শূরা (সংসদ), খলীফা, আমীর বা শাসকের আনুগত্য বা অনুসরণ বললে - কাফির হবে না। অথচ সেই আইনগুলো কুরআন সুন্নাহর বিরোধী না হলে - মুসলিমরা মানতে বাধ্য।
৪.হারামকৃত বস্তুকে হালাল এবং হালালকৃত বস্তুকে হারাম ঘোষণা করার কারণে :
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَٰذَا حَلَالٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ ۚ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ
‘‘তোমাদের মুখ থেকে সাধারণভাবে যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে, তেমনি করে আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করে বলো না যে, এটা হালাল এবং ওটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ করে তারা সফল হবে না।’’ (সূরা নাহাল : ১১৬ আয়াত)
৫.বিচারক, আলেম-উলামা, পীর-দরবেশদেরকে হালাল ও হারাম করার হক্বদার গণ্য করার কারণে :
আল্লাহ তাআলা বলেন : اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
‘‘তারা তাদের আহবার (আলেম) ও রুহবান (সূফী)-দের আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসাবে গ্রহণ করেছে।’’ (সূরা তাওবা : ৩১ আয়াত)
নবী (স) আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন :
أَمَا إِنَّهُمْ لَمْ يَكُونُوا يَعْبُدُونَهُمْ وَلَكِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا أَحَلُّوا لَهُمْ شَيْئًا اسْتَحَلُّوهُ وَإِذَا حَرَّمُوا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوهُ
‘‘এমন নয় যে, তারা এদের ইবাদত করত। বরং এরা যদি তাদের জন্য কিছু হালাল করে দিত তখন তারা তা হালাল বলে গ্রহণ করত; এরা যখন কোন কিছু হারাম বলে স্থির করতো তখন তারাও তা হারাম বলে গ্রহণ করতো।’’ [.হাসান : তিরমিযী- তাফসীরুল কুরআন, সূরা তাওবা। আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত তিরমিযী হা/৩০৯৫]]
এখানে হালাল বা হারাম নির্ধারণ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে তা নাযিলকৃত বা ইলাহী হুকুম গণ্য করাকে চূড়ান্ত কুফর হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কাফির হওয়ার বিভিন্ন কারণ ও শর্ত রয়েছে। এখানে আমরা কেবল আল্লাহর বিধান জারি করা ও না করার ক্ষেত্রে কাফির হওয়ার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ উল্লেখ করলাম।
قال اسْماعيل بن سعد فى ’’ سؤلات ابن هانى ‘‘ (২/১৯২) سألت احْمد : ﴿وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله فَأُوْلَئِكَ هُمُ الكافرون﴾ : فما هذا الكفر؟ قال : كفر لا يَخرج من الْملة
‘‘ইসামঈল বিন সা‘দ তাঁর ‘‘সুওয়ালাতে ইবনু হানী’’ (২/১৯২)-এ বলেন, ইমাম আহমাদ (রহ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির’’ (সূরা মায়িদাহ : ৪৪) আয়াতটিতে কুফরের উদ্দেশ্য কী? তিনি (রহ) বললেন : এই কুফর মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে না।’’
ولَما سئل ابو داؤد الْسجستانى فى ’’ سؤالاته ‘‘ ( صـ١١٤ ) عن هذه الاية، أجابه يقول طاوس و عطاء الْمتقدمين
‘‘যখন আবূ দাউদ সিজিস্তানীকে নিজের ‘সুওয়ালাত’-এ (পৃ. ১১৪) আলোচ্য আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি (রহ) জবাবে বললেন : ইমাম আহমাদ (রহ) তাউস ও আতা‘র (থেকে) পূর্বে উল্লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করেন।’’
وذكره شيخ الاسلام بن تيمية فى ’’ مُجمع الفتوى ‘‘ (٧/ ٢٥٤ ) وتلميذه ابن قيم حكم ’’ تارك الصلاة ‘‘ ( صـ ٥٩-٦٠ ) : ان الإمام اَحْمد رحمه الله سئل عن الكفر الْمذكور في آية الْحكم، فقال : ’’ كفر لا ينقل عن الْملة، مثل الإيْمان بعضه دون بعض، فكذلك الْكفر، حتى يَجزى، من ذلك أمر لا يَختلف فيه ‘‘ ـ
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) তাঁর ‘মাজমাউল ফাতাওয়া’’ (৭/২৫৪)-তে এবং তাঁর ছাত্র হাফিয ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) ‘তারকুস সালাতে’ (পৃ. ৫৯-৬০) বর্ণনা করেছেন : ইমাম আহমাদ (রহ)-কে আলোচ্য আয়াতে তাহক্বীম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন : ‘‘এটি এমন কুফর যা মিল্লাত থেকে খারিজ করে না। যেভাবে ঈমানের (শাখাগুলো) কোনটি কোনটির থেকে কমবেশি হয়। অনুরূপভাবে কুফরও যতক্ষণ না তা জায়েয মনে করে। এভাবে ঐ ব্যক্তি এমন কুফরের অধিকারী হয় যে ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ নেই।’’
‘‘ইসামঈল বিন সা‘দ তাঁর ‘‘সুওয়ালাতে ইবনু হানী’’ (২/১৯২)-এ বলেন, ইমাম আহমাদ (রহ)-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির’’ (সূরা মায়িদাহ : ৪৪) আয়াতটিতে কুফরের উদ্দেশ্য কী? তিনি (রহ) বললেন : এই কুফর মিল্লাত থেকে বহিষ্কার করে না।’’
ولَما سئل ابو داؤد الْسجستانى فى ’’ سؤالاته ‘‘ ( صـ١١٤ ) عن هذه الاية، أجابه يقول طاوس و عطاء الْمتقدمين
‘‘যখন আবূ দাউদ সিজিস্তানীকে নিজের ‘সুওয়ালাত’-এ (পৃ. ১১৪) আলোচ্য আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি (রহ) জবাবে বললেন : ইমাম আহমাদ (রহ) তাউস ও আতা‘র (থেকে) পূর্বে উল্লিখিত বক্তব্য উল্লেখ করেন।’’
وذكره شيخ الاسلام بن تيمية فى ’’ مُجمع الفتوى ‘‘ (٧/ ٢٥٤ ) وتلميذه ابن قيم حكم ’’ تارك الصلاة ‘‘ ( صـ ٥٩-٦٠ ) : ان الإمام اَحْمد رحمه الله سئل عن الكفر الْمذكور في آية الْحكم، فقال : ’’ كفر لا ينقل عن الْملة، مثل الإيْمان بعضه دون بعض، فكذلك الْكفر، حتى يَجزى، من ذلك أمر لا يَختلف فيه ‘‘ ـ
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) তাঁর ‘মাজমাউল ফাতাওয়া’’ (৭/২৫৪)-তে এবং তাঁর ছাত্র হাফিয ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) ‘তারকুস সালাতে’ (পৃ. ৫৯-৬০) বর্ণনা করেছেন : ইমাম আহমাদ (রহ)-কে আলোচ্য আয়াতে তাহক্বীম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন : ‘‘এটি এমন কুফর যা মিল্লাত থেকে খারিজ করে না। যেভাবে ঈমানের (শাখাগুলো) কোনটি কোনটির থেকে কমবেশি হয়। অনুরূপভাবে কুফরও যতক্ষণ না তা জায়েয মনে করে। এভাবে ঐ ব্যক্তি এমন কুফরের অধিকারী হয় যে ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ নেই।’’
ذكر فى ’’ الابانة ‘‘(٢/ ٧٢٣ ) : ’’ باب ذكر الذنوب التى تصير بصاحبها إلى كفر غَيْر خارج به من الْملة ‘‘. وذكر ضمن هذا الباب : الْحكم بغير ما أنزل الله، وأورد آثار الصحابة والتابعين على أنه كفر أصغر غيْر ناقل من الْملة
ইমাম ইবনুল বাত্তাহ (রহ) তাঁর ‘‘আল-ইবানাহ’’ (২/৭২৩)-এ একটি অনুচ্ছেদ এভাবে লিখেছেন : ‘‘ঐ সমস্ত গোনাহর বর্ণনা যা সংঘটিত হওয়ার দ্বারা ঐ কুফরের স্তরে নিয়ে যায়, যার দ্বারা মিল্লাত থেকে বহিষ্কার হয় না।’’ এই অনুচ্ছেদের অধীনস্থ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : (এই গুনাহর মধ্যে) ‘‘হুকুম বি গয়রি ম-আনযালাল্লাহ’’-ও অন্যতম। এ সম্পর্কে সাহাবী (রা) ও তাবেঈদের (রহ) আসার সংরক্ষিত আছে যে, এটা কুফরে আসগার- যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না।
ইমাম ইবনুল বাত্তাহ (রহ) তাঁর ‘‘আল-ইবানাহ’’ (২/৭২৩)-এ একটি অনুচ্ছেদ এভাবে লিখেছেন : ‘‘ঐ সমস্ত গোনাহর বর্ণনা যা সংঘটিত হওয়ার দ্বারা ঐ কুফরের স্তরে নিয়ে যায়, যার দ্বারা মিল্লাত থেকে বহিষ্কার হয় না।’’ এই অনুচ্ছেদের অধীনস্থ আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : (এই গুনাহর মধ্যে) ‘‘হুকুম বি গয়রি ম-আনযালাল্লাহ’’-ও অন্যতম। এ সম্পর্কে সাহাবী (রা) ও তাবেঈদের (রহ) আসার সংরক্ষিত আছে যে, এটা কুফরে আসগার- যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না।
قال فى ’’ التمهيد ‘‘ (٥/ ٧٤ ) : وأجمع العلماء على أن الْجور في الْحكم من الكبائر لِمن تعمد ذلك عالِما به رويت في ذلك آثار شديدة عن السلف وقال الله عز وجل : ﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ﴾ و ﴿الظَّالِمُونَ﴾ و﴿الْفَاسِقُونَ﴾ نزلت في أهل الكتاب قال حذيفة وابن عباس وهي عامة فينا قالوا ليس بكفر ينقل عن الْملة إذا فعل ذلك رجل من أهل هذه الأمة حتى يكفر بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر روي هذا المعنى عن جَماعة من العلماء بتأويل القرآن منهم ابن عباس وطاوس وعطاء
ইমাম ইবনু আব্দুল বার (রহ) তাঁর ‘আত-তামহীদ’ (৫/৭৪)-এ বলেন : ‘‘এ কথার উপর আলেমদের ইজমা‘ হয়েছে, ফায়সালা দেয়ার সময় স্বজ্ঞানে, জেনে-বুঝে, যুলুম-অন্যায় করা কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে সালাফদের থেকে জোরালো বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির, .... যালিম, .... ও ফাসিক্ব’’ সম্পর্কে হুযায়ফা ও ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : এই আয়াত আহলে কিতাবদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং আমাদের সাথেও এর দাবি ‘আম। তাঁরা বলেছেন. এটা এমন কুফর যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে বহিষ্কার করে না, যখন সে এই উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি হয়। যতক্ষণ কেউ আল্লাহ, মালাইকা, কিতাবসমূহ, রসূলগণ ও ক্বিয়ামাতের দিবসের প্রতি কুফর করে। আয়াতের তাফসীরটির এই অর্থ আলেমদের একটি বড় অংশের। যার মধ্যে ইবনু আব্বাস (রা), তাউস ও আতাও (রহ) আছেন।’’
ইমাম ইবনু আব্দুল বার (রহ) তাঁর ‘আত-তামহীদ’ (৫/৭৪)-এ বলেন : ‘‘এ কথার উপর আলেমদের ইজমা‘ হয়েছে, ফায়সালা দেয়ার সময় স্বজ্ঞানে, জেনে-বুঝে, যুলুম-অন্যায় করা কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। এ সম্পর্কে সালাফদের থেকে জোরালো বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির, .... যালিম, .... ও ফাসিক্ব’’ সম্পর্কে হুযায়ফা ও ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : এই আয়াত আহলে কিতাবদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে এবং আমাদের সাথেও এর দাবি ‘আম। তাঁরা বলেছেন. এটা এমন কুফর যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে বহিষ্কার করে না, যখন সে এই উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি হয়। যতক্ষণ কেউ আল্লাহ, মালাইকা, কিতাবসমূহ, রসূলগণ ও ক্বিয়ামাতের দিবসের প্রতি কুফর করে। আয়াতের তাফসীরটির এই অর্থ আলেমদের একটি বড় অংশের। যার মধ্যে ইবনু আব্বাস (রা), তাউস ও আতাও (রহ) আছেন।’’
قال فى ’’ زاد الْمسير في علم التفسير ‘‘ (٢/ ٣٦٦ ) : أن من لَم يَحكم بِما أنزل الله جاحدا له وهو يعلم أن الله أنزله كما فعلت اليهود فهو كافر ومن لَم يَحكم به ميلاً إلَى الْهوى من غيْر جحود فهو ظالِم وفاسق وقد روى علي بن أبي طلحة عن ابن عباس أنه قال من جحد ما أنزل الله فقد كفر ومن أقر به ولَم يَحكم به فهو فاسق وظالِم
ইমাম ইবুনল জাওযী (রহ) তাঁর ‘‘যাদুল মাসীর ফি ইলমুত তাফসীর’’ (২/৩৬৬)-এ বলেন : ‘‘যে আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী ফায়সালা অস্বীকৃতির সাথে করে, অথচ জানে যে এটা আল্লাহ নাযিল করেছেন- যেভাবে ইয়াহুদীরা করেছিল, তাহলে সে কাফির। আর যে ব্যক্তি নিজের নাফসের অপবিত্রতার জন্য আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, অথচ তার এ ব্যাপারটির অস্বীকৃতির পর্যায়েও নেই, তবে সে যালিম ও ফাসিক্ব। কেননা আলী বিন আবী তালহা (রহ) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন : যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান جحود (অস্বীকার) করে সে কাফির। পক্ষান্তরে যে তা স্বীকার করে কিন্তু সে অনুযায়ী ফায়সালা করে না, সে যালিম, ফাসিক্ব।’’
ইমাম ইবুনল জাওযী (রহ) তাঁর ‘‘যাদুল মাসীর ফি ইলমুত তাফসীর’’ (২/৩৬৬)-এ বলেন : ‘‘যে আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী ফায়সালা অস্বীকৃতির সাথে করে, অথচ জানে যে এটা আল্লাহ নাযিল করেছেন- যেভাবে ইয়াহুদীরা করেছিল, তাহলে সে কাফির। আর যে ব্যক্তি নিজের নাফসের অপবিত্রতার জন্য আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, অথচ তার এ ব্যাপারটির অস্বীকৃতির পর্যায়েও নেই, তবে সে যালিম ও ফাসিক্ব। কেননা আলী বিন আবী তালহা (রহ) ইবনু আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন : যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান جحود (অস্বীকার) করে সে কাফির। পক্ষান্তরে যে তা স্বীকার করে কিন্তু সে অনুযায়ী ফায়সালা করে না, সে যালিম, ফাসিক্ব।’’
وقال فى ’’ الْمفهم ‘‘(٥/ ١١٧ ) : وقوله : ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله فَأُوْلَئِكَ هُمُ الكافرون ﴾ يَحتج بظاهره من يكفر بالذنوب، وهم الْخوارج ! ، ولا حجة لَهم فيه، لأن هذه الآيات نزلت في اليهود الْمحرفين كلام الله تعالى، كما جاء فى الْحديث، وهم كفار، فيشاركهم فى حكمها من يشاركهم فى سبب النُزول .
وبيان هذا : أن الْمسلم إذا علم حكم الله تعالى في قضية قطعا ثُم لَم يَحكم به، فإن كان كافرًا، لا يَختلف في هذا، وإن كان لا عن جحد عاصيًا مرتكب كبيرة، لأنه مصدق بأصل ذلك الْحكم، وعالِم بوجوب تنقيذه عليه، لكنه عصى بترك العمل به، وهذا في كل ما يعلم من ضرورة الشرع حكمه، كالصلاة وغيرها من القواعد الْمعلومة، وهذا مذهب أهل السنة
ইমাম কুরতুবী (রহ) তাঁর ‘‘ الْمفهم ’’-এ (৫/১১৭) বলেন : ‘‘আল্লাহর তাআলা’র বাণী : ‘‘যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না, সে কাফির’’ -আয়াতটির বাক্যের বাহ্যিক দাবির ভিত্তিতে যারা গোনাহকারীদের কাফির বলে, তারা হল খারেজী। অথচ এই আয়াতে তাদের স্বপক্ষে দলিল নেই। কেননা এই আয়াতটি তো ঐ সমস্ত ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যারা আল্লাহর আহকামে তাহরীফ (বিকৃতি) করেছিল। যেভাবে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে তাদেরকে কাফির গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং ঐ ব্যক্তি কাফির হুকুমের মধ্যে তাদের সাথে শরীক হবে, যার ক্ষেত্রে আয়াতের শানে-নুযূলের প্রেক্ষাপটটি মিলে যাবে।
এর ব্যাখ্যা হল : যদি কোন মুসলিম কোন ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমের সুস্পষ্ট বিধান জানে, অতঃপর সে অনুযায়ী ফায়সালা করে না। এ পর্যায়ে যদি সে (আল্লাহর বিধানকে) অস্বীকার করে- তবে সে কাফির। এ ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ নেই। আর যদি সে অস্বীকার না করে, তবে তা গোনাহর মধ্যে কবীরা গোনাহর অন্তর্ভূক্ত। কেননা সে ঐ হুকুমকে প্রকৃতপক্ষে স্বীকার করে এবং নিজের ওপর তা প্রযোজ্য হওয়ার ইলমও রাখে। কিন্তু সে তার উপর আমল না করার কারণে পাপী হয়। শরীআতের সব ধরণের জরুরি হুকুমের ক্ষেত্রে এটাই প্রযোজ্য। যেমন- সালাত প্রভৃতিতে স্বীকৃত কানুন অনুযায়ী আহলে সুন্নাতের মাযহাব এটাই।’’
وبيان هذا : أن الْمسلم إذا علم حكم الله تعالى في قضية قطعا ثُم لَم يَحكم به، فإن كان كافرًا، لا يَختلف في هذا، وإن كان لا عن جحد عاصيًا مرتكب كبيرة، لأنه مصدق بأصل ذلك الْحكم، وعالِم بوجوب تنقيذه عليه، لكنه عصى بترك العمل به، وهذا في كل ما يعلم من ضرورة الشرع حكمه، كالصلاة وغيرها من القواعد الْمعلومة، وهذا مذهب أهل السنة
ইমাম কুরতুবী (রহ) তাঁর ‘‘ الْمفهم ’’-এ (৫/১১৭) বলেন : ‘‘আল্লাহর তাআলা’র বাণী : ‘‘যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না, সে কাফির’’ -আয়াতটির বাক্যের বাহ্যিক দাবির ভিত্তিতে যারা গোনাহকারীদের কাফির বলে, তারা হল খারেজী। অথচ এই আয়াতে তাদের স্বপক্ষে দলিল নেই। কেননা এই আয়াতটি তো ঐ সমস্ত ইয়াহুদীদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, যারা আল্লাহর আহকামে তাহরীফ (বিকৃতি) করেছিল। যেভাবে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে তাদেরকে কাফির গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং ঐ ব্যক্তি কাফির হুকুমের মধ্যে তাদের সাথে শরীক হবে, যার ক্ষেত্রে আয়াতের শানে-নুযূলের প্রেক্ষাপটটি মিলে যাবে।
এর ব্যাখ্যা হল : যদি কোন মুসলিম কোন ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমের সুস্পষ্ট বিধান জানে, অতঃপর সে অনুযায়ী ফায়সালা করে না। এ পর্যায়ে যদি সে (আল্লাহর বিধানকে) অস্বীকার করে- তবে সে কাফির। এ ব্যাপারে কোন ইখতিলাফ নেই। আর যদি সে অস্বীকার না করে, তবে তা গোনাহর মধ্যে কবীরা গোনাহর অন্তর্ভূক্ত। কেননা সে ঐ হুকুমকে প্রকৃতপক্ষে স্বীকার করে এবং নিজের ওপর তা প্রযোজ্য হওয়ার ইলমও রাখে। কিন্তু সে তার উপর আমল না করার কারণে পাপী হয়। শরীআতের সব ধরণের জরুরি হুকুমের ক্ষেত্রে এটাই প্রযোজ্য। যেমন- সালাত প্রভৃতিতে স্বীকৃত কানুন অনুযায়ী আহলে সুন্নাতের মাযহাব এটাই।’’
وقال في ’’ مُجموع الفتاوى ‘‘ (٣/ ٢٦٧ ) : وَالْإِنْسَانُ مَتَى حَلَّلَ الْحَرَامَ - الْمُجْمَعَ عَلَيْهِ - أَوْ حَرَّمَ الْحَلَالَ - الْمُجْمَعَ عَلَيْهِ - أَوْ بَدَّلَ الشَّرْعَ - الْمُجْمَعَ عَلَيْهِ - كَانَ كَافِرًا مُرْتَدًّا بِاتِّفَاقِ الْفُقَهَاءِ . وَفِي مِثْلِ هَذا نَزَلَ قَوْلُهُ عَلَى أَحَدِ الْقَوْلَيْنِ : ﴿ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ الله فَأُوْلَئِكَ هُمُ الكافرون ﴾ أَيْ هُوَ الْمُسْتَحِلُّ لِلْحُكْمِ بِغَيْرِ مَا أَنْزَلَ اللَّهَُ
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) তাঁর ‘মাজমাউল ফাতাওয়া’ (৩/২৬৭)-এ বলেন : ‘‘মানুষ যখন ঐ জিনিসকে হালাল গণ্য করে যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘ আছে, কিংবা ইজমাকৃত হারামকে হালাল করে, কিংবা ইজমা হওয়া শরীআতকে পরিবর্তন করে- এক্ষেত্রে ফুক্বাহাগণ ঐকমত্য যে সে কাফির, মুরতাদ। দু’টি উক্তির একটি উক্তির আলোকে ‘‘যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না সে কাফির’’ -আয়াতটি ঐ লক্ষ্যে নাযিল হয়েছে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান ছাড়াও অন্য হুকুমকে হালাল গণ্য করে।’’
وقال في ’’ منهاج السنة ‘‘ (٥/ ١٣٠ ) : قال تعالى : فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا [٤ : ٦٥ ] فمن لَم يلتزم تَحكيم الله ورسوله فيما شجر بينهم فقد أقسم الله بنفسه أنه لا يؤمن وأما من كان ملتزما لِحكم الله ورسوله باطنا وظاهرا لكن عصى واتبع هواه فهذا بِمنْزلة أمثاله من العصاة وهذه الآية مِما يَحتج بِها الْخوارج على تكفير ولاة الأمر الذين لا يَحكمون بِما أنزل الله ثُم يزعمون أن اعتقادهم هو حكم الله وقد تكلم الناس بِما يطول ذكره هنا وما ذكرته يدل عليه سياق الآية
তিনি (রহ) তার ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ (৫/১৩০)-এ বলেন, আল্লাহর বাণী : ‘‘আপনার রবের ক্বসম! তারা মু‘মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সমস্ত মোকদ্দমায় আপনাকে হাকিম না বানায়। অতঃপর আপনি যে ফায়সালা করেন সে ব্যাপারে মনে কোন সংকীর্ণতা রাখে না এবং হৃষ্টচিত্তে ক্ববুল করে নেবে।’’ (সূরা নিসা : ৬৫ আয়াত)। যারা নিজেদের পারস্পরিক ব্যাপারে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের হুকুমকে আবশ্যক গণ্য করে না, এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নিজের সত্তার ক্বসম খেয়ে বলেছেন- তারা মু‘মিন নয়। অবশ্য যে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূলের (স) হুকুমকে যাহেরী ও বাতেনীভাবে আবশ্যক গণ্য করে, কিন্তু নিজের নফসের আনুগত্যের জন্যে অবাধ্য হয় (গোনাহ করে বসে), তবে এর হুকুম অন্যান্য গোনাহর মত। এটাও একটি আয়াত যা দ্বারা খারেজীরা ঐ সমস্ত হাকিমকে তাকফির করে, যারা আল্লাহ তাআলা’র শরীআত অনুযায়ী ফায়সালা করে না। অতঃপর তারা এটাই ধারণা করে যে তাদের আক্বীদাটাই আল্লাহর হুকুম। এছাড়াও লোকেরা অনেক মন্তব্য করে থাকে, যার আলোচনা খুবই দীর্ঘ। এরপরেও আমি যতটুক বর্ণনা করেছি আলোচ্য আয়াত তারই দলিল।
وقال فى ’’ مُجموع الفتاوى ‘‘ (٧/ ٣١٢ ) وَإِذَا كَانَ مِنْ قَوْلِ السَّلَفِ : إنَّ الْإِنْسَانَ يَكُونُ فِيهِ إيْمَانٌ وَنِفَاقٌ فَكَذَلِكَ فِي قَوْلِهِمْ : إنَّهُ يَكُونُ فِيهِ إيْمَانٌ وَكُفْرٌ لَيْسَ هُوَ الْكُفْرُ الَّذِي يَنْقُلُ عَنْ الْمِلَّةِ ؛ كَمَا قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ وَأَصْحَابُهُ فِي قَوْله تَعَالَى ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قَالُوا : كَفَرُوا كُفْرًا لَا يَنْقُلُ عَنْ الْمِلَّةِ وَقَدْ اتَّبَعَهُمْ عَلَى ذَلِكَ أَحْمَد بْنُ حَنْبَلٍ وَغَيْرُهُ مِنْ أَئِمَّةِ السُّنَّةِ
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) তাঁর ‘‘মাজমাউ ফাতাওয়া’’ (৭/৩১২)-এ আরও বলেন : যেহেতু সালাফদের এই উক্তি আছে : ‘‘একজন মানুষের মধ্যে ঈমান ও কুফর একত্রে থাকতে পারে’’ অর্থাৎ ঐ কুফর যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না। যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) ও তাঁর সাথিরা আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত) সম্পর্কে বলেছেন : ‘‘এটা এমন কুফর যা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে না।’’ অনুরূপ উক্তি রয়েছে ইমাম আহমাদ (রহ)-এর এবং অন্যান্য সালাফগণও এর অনুসরণ করেছেন।’’
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) তাঁর ‘মাজমাউল ফাতাওয়া’ (৩/২৬৭)-এ বলেন : ‘‘মানুষ যখন ঐ জিনিসকে হালাল গণ্য করে যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে ইজমা‘ আছে, কিংবা ইজমাকৃত হারামকে হালাল করে, কিংবা ইজমা হওয়া শরীআতকে পরিবর্তন করে- এক্ষেত্রে ফুক্বাহাগণ ঐকমত্য যে সে কাফির, মুরতাদ। দু’টি উক্তির একটি উক্তির আলোকে ‘‘যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না সে কাফির’’ -আয়াতটি ঐ লক্ষ্যে নাযিল হয়েছে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান ছাড়াও অন্য হুকুমকে হালাল গণ্য করে।’’
وقال في ’’ منهاج السنة ‘‘ (٥/ ١٣٠ ) : قال تعالى : فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا [٤ : ٦٥ ] فمن لَم يلتزم تَحكيم الله ورسوله فيما شجر بينهم فقد أقسم الله بنفسه أنه لا يؤمن وأما من كان ملتزما لِحكم الله ورسوله باطنا وظاهرا لكن عصى واتبع هواه فهذا بِمنْزلة أمثاله من العصاة وهذه الآية مِما يَحتج بِها الْخوارج على تكفير ولاة الأمر الذين لا يَحكمون بِما أنزل الله ثُم يزعمون أن اعتقادهم هو حكم الله وقد تكلم الناس بِما يطول ذكره هنا وما ذكرته يدل عليه سياق الآية
তিনি (রহ) তার ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ (৫/১৩০)-এ বলেন, আল্লাহর বাণী : ‘‘আপনার রবের ক্বসম! তারা মু‘মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সমস্ত মোকদ্দমায় আপনাকে হাকিম না বানায়। অতঃপর আপনি যে ফায়সালা করেন সে ব্যাপারে মনে কোন সংকীর্ণতা রাখে না এবং হৃষ্টচিত্তে ক্ববুল করে নেবে।’’ (সূরা নিসা : ৬৫ আয়াত)। যারা নিজেদের পারস্পরিক ব্যাপারে আল্লাহর ও তাঁর রসূলের হুকুমকে আবশ্যক গণ্য করে না, এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নিজের সত্তার ক্বসম খেয়ে বলেছেন- তারা মু‘মিন নয়। অবশ্য যে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূলের (স) হুকুমকে যাহেরী ও বাতেনীভাবে আবশ্যক গণ্য করে, কিন্তু নিজের নফসের আনুগত্যের জন্যে অবাধ্য হয় (গোনাহ করে বসে), তবে এর হুকুম অন্যান্য গোনাহর মত। এটাও একটি আয়াত যা দ্বারা খারেজীরা ঐ সমস্ত হাকিমকে তাকফির করে, যারা আল্লাহ তাআলা’র শরীআত অনুযায়ী ফায়সালা করে না। অতঃপর তারা এটাই ধারণা করে যে তাদের আক্বীদাটাই আল্লাহর হুকুম। এছাড়াও লোকেরা অনেক মন্তব্য করে থাকে, যার আলোচনা খুবই দীর্ঘ। এরপরেও আমি যতটুক বর্ণনা করেছি আলোচ্য আয়াত তারই দলিল।
وقال فى ’’ مُجموع الفتاوى ‘‘ (٧/ ٣١٢ ) وَإِذَا كَانَ مِنْ قَوْلِ السَّلَفِ : إنَّ الْإِنْسَانَ يَكُونُ فِيهِ إيْمَانٌ وَنِفَاقٌ فَكَذَلِكَ فِي قَوْلِهِمْ : إنَّهُ يَكُونُ فِيهِ إيْمَانٌ وَكُفْرٌ لَيْسَ هُوَ الْكُفْرُ الَّذِي يَنْقُلُ عَنْ الْمِلَّةِ ؛ كَمَا قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ وَأَصْحَابُهُ فِي قَوْله تَعَالَى ﴿ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ﴾ قَالُوا : كَفَرُوا كُفْرًا لَا يَنْقُلُ عَنْ الْمِلَّةِ وَقَدْ اتَّبَعَهُمْ عَلَى ذَلِكَ أَحْمَد بْنُ حَنْبَلٍ وَغَيْرُهُ مِنْ أَئِمَّةِ السُّنَّةِ
ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) তাঁর ‘‘মাজমাউ ফাতাওয়া’’ (৭/৩১২)-এ আরও বলেন : যেহেতু সালাফদের এই উক্তি আছে : ‘‘একজন মানুষের মধ্যে ঈমান ও কুফর একত্রে থাকতে পারে’’ অর্থাৎ ঐ কুফর যা মিল্লাতে ইসলামিয়াহ থেকে খারিজ করে না। যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) ও তাঁর সাথিরা আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির’’ (সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত) সম্পর্কে বলেছেন : ‘‘এটা এমন কুফর যা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে না।’’ অনুরূপ উক্তি রয়েছে ইমাম আহমাদ (রহ)-এর এবং অন্যান্য সালাফগণও এর অনুসরণ করেছেন।’’
قال فى ’’ مدارج السالكين ‘‘ (١/ ٣٣٦ ) : والصحيح : أن الْحكم بغيْر ما أنزل الله يتناول الكفرين الأصغر والأكبَر بِحسب حال الْحاكم فإنه إن اعتقد وجوب الْحكم بِما أنزل الله في هذه الواقعة وعدل عنه عصيانا لأنه مع اعترافه بأنه مستحق للعقوبة فهذا كفر أصغر وإن اعتقد أنه غير واجب وأنه مُخير فيه مع تيقنه أنه حكم الله تعالى فهذا كفر أكبر وإن جهله وأخطأه : فهذا مُخطىء له حكم الْمخطئين
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) তাঁর ‘‘মাদারেজুস সালেকীন’’ (১/৩৩৬)-এ লিখেছেন : ‘‘সহীহ বক্তব্য হল : আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী ফায়সালা পরিস্থিতি বিশেষে উভয় কুফর গণ্য হবে, অর্থাৎ ‘কুফরে আসগার’ (ছোট কুফর) ও ‘কুফরে আকবার’ (বড় কুফর)। যদি সে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটিতে এই আক্বীদা রাখে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করা তার ওপর ওয়াজিব, অথচ তা থেকে বিরত থাকে তাহলে সেটা গুনাহ। কেননা সে এর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য মনে করে। এক্ষেত্রে পাপটি কুফরে আসগার। আর যদি হুকুমটি আল্লাহ তাআলা’র হওয়া সত্ত্বেও সে আক্বীদা রাখে যে, এটা তার উপর ওয়াজিব নয় বরং সম্পূর্ণ স্বাধীন, তাহলে এটা কুফরে আকবার। যদিও সে এ ব্যাপারে অজ্ঞ ও ভুলকারী, তাহলে সে ভুলকারক। এ পর্যায়ে তার জন্য অন্যান্য ত্রুটিকারীর হুকুম প্রযোজ্য।’’
و قال فى ’’ الصلاة وحكم تاركه ‘‘ ( صـ ٧٢ ) : وها هنا أصل آخر وهو أن الكفر نوعان كفر عمل وكفر جحود وعناد الْجحود أن يكفر بِما علم أن الرسول جاء به من عند الله جحودا وعنادا من اسْماء الرب وصفاته وأفعاله وأحكامه وهذا الكفر يضاد الإيْمان من كل وجه وأما كفر العمل فينقسم إلَى ما يضاد الإيْمان وإلَى ما لا يضاده فالسجود للضم والاستهانة بالْمصحف وقتل النبي وسبه يضاد الإيْمان وأما الْحكم بغيْر ما أنزل الله وترك الصلاة فهو من الكفر العملي قطعا
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) তাঁর ‘‘ الصلاة وحكم تاركه ’’ (পৃ. ৭২)-এ বলেন : ‘‘এ পর্যায়ে অপর একটি উসূল পাওয়া যায়, সেটা হল কুফর দুই ধরনের হয়ে থাকে। আমলী কুফর এবং জুহূদ (অস্বীকৃতির) বা ‘ঈনাদ (বিরোধিতার) কুফর। কুফরে জুহূদ হল, অস্বীকৃতির ভিত্তিতে ঐ কুফর যা সে জানে যে, এটা রসূল (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে এনেছেন। যেমন- আল্লাহর নাম ও তাঁর সিফাত, তাঁর বিভিন্ন আমল ও আহকামসমূহ। এ সমস্ত কুফর ঈমানের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে কুফরে আমালী দু’ভাগে বিভক্ত- যা ঈমান বিরোধী এবং যা ঈমান বিরোধী নয়। একটি হল, যা ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন : মূর্তিকে সিজদা করা, কুরআন মাজীদের অসম্মান করা, কোন নবী (স)-কে হত্যা করা বা গালি দেয়া ঈমান বিরোধি। [.আমাদের বিরোধী পক্ষ আমালী কুফরের এই অংশের মধ্যেই ‘হুকুম বি-গয়রি মা আনযালাল্লাহ’-কেও গণ্য করে থাকেন। অথচ সালাফগণ এই আমলটি ই‘তিক্বাদী হলে মুরতাদ কাফির গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহর বিধানকে স্বীকৃতি ও মেনে নেয়া সত্ত্বেও জারি না করাকে কেবল আমলী কুফর গণ্য করেছেন। -অনুবাদক] পক্ষান্তরে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি না করা, সালাত আদায় না করা নিশ্চিতভাবে কুফরে আমালী।’’ [.সালাত তরক করা কোন ধরনের কুফরী আমালী এ সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। হাফেয ইবনু ক্বাইয়েম (রহ) ও মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) সালাতের স্বীকৃতিদাতার সালাত তরককে ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন কুফরে আমালী গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আহমাদ (রহ), শায়েখ ইবনু বায (রহ) ও শায়েখ উসায়মীন (রহ) সালাত তরক করাকেই ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক কুফরী আমলী গণ্য করেছেন। এর বিরোধ নিরসণের জন্য স্বতন্ত্র পুস্তিকা লিখব, ইঁনশাআল্লাহ। -অনুবাদক]
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) তাঁর ‘‘মাদারেজুস সালেকীন’’ (১/৩৩৬)-এ লিখেছেন : ‘‘সহীহ বক্তব্য হল : আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী ফায়সালা পরিস্থিতি বিশেষে উভয় কুফর গণ্য হবে, অর্থাৎ ‘কুফরে আসগার’ (ছোট কুফর) ও ‘কুফরে আকবার’ (বড় কুফর)। যদি সে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটিতে এই আক্বীদা রাখে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করা তার ওপর ওয়াজিব, অথচ তা থেকে বিরত থাকে তাহলে সেটা গুনাহ। কেননা সে এর শাস্তি পাওয়ার যোগ্য মনে করে। এক্ষেত্রে পাপটি কুফরে আসগার। আর যদি হুকুমটি আল্লাহ তাআলা’র হওয়া সত্ত্বেও সে আক্বীদা রাখে যে, এটা তার উপর ওয়াজিব নয় বরং সম্পূর্ণ স্বাধীন, তাহলে এটা কুফরে আকবার। যদিও সে এ ব্যাপারে অজ্ঞ ও ভুলকারী, তাহলে সে ভুলকারক। এ পর্যায়ে তার জন্য অন্যান্য ত্রুটিকারীর হুকুম প্রযোজ্য।’’
و قال فى ’’ الصلاة وحكم تاركه ‘‘ ( صـ ٧٢ ) : وها هنا أصل آخر وهو أن الكفر نوعان كفر عمل وكفر جحود وعناد الْجحود أن يكفر بِما علم أن الرسول جاء به من عند الله جحودا وعنادا من اسْماء الرب وصفاته وأفعاله وأحكامه وهذا الكفر يضاد الإيْمان من كل وجه وأما كفر العمل فينقسم إلَى ما يضاد الإيْمان وإلَى ما لا يضاده فالسجود للضم والاستهانة بالْمصحف وقتل النبي وسبه يضاد الإيْمان وأما الْحكم بغيْر ما أنزل الله وترك الصلاة فهو من الكفر العملي قطعا
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) তাঁর ‘‘ الصلاة وحكم تاركه ’’ (পৃ. ৭২)-এ বলেন : ‘‘এ পর্যায়ে অপর একটি উসূল পাওয়া যায়, সেটা হল কুফর দুই ধরনের হয়ে থাকে। আমলী কুফর এবং জুহূদ (অস্বীকৃতির) বা ‘ঈনাদ (বিরোধিতার) কুফর। কুফরে জুহূদ হল, অস্বীকৃতির ভিত্তিতে ঐ কুফর যা সে জানে যে, এটা রসূল (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে এনেছেন। যেমন- আল্লাহর নাম ও তাঁর সিফাত, তাঁর বিভিন্ন আমল ও আহকামসমূহ। এ সমস্ত কুফর ঈমানের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। পক্ষান্তরে কুফরে আমালী দু’ভাগে বিভক্ত- যা ঈমান বিরোধী এবং যা ঈমান বিরোধী নয়। একটি হল, যা ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন : মূর্তিকে সিজদা করা, কুরআন মাজীদের অসম্মান করা, কোন নবী (স)-কে হত্যা করা বা গালি দেয়া ঈমান বিরোধি। [.আমাদের বিরোধী পক্ষ আমালী কুফরের এই অংশের মধ্যেই ‘হুকুম বি-গয়রি মা আনযালাল্লাহ’-কেও গণ্য করে থাকেন। অথচ সালাফগণ এই আমলটি ই‘তিক্বাদী হলে মুরতাদ কাফির গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহর বিধানকে স্বীকৃতি ও মেনে নেয়া সত্ত্বেও জারি না করাকে কেবল আমলী কুফর গণ্য করেছেন। -অনুবাদক] পক্ষান্তরে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান জারি না করা, সালাত আদায় না করা নিশ্চিতভাবে কুফরে আমালী।’’ [.সালাত তরক করা কোন ধরনের কুফরী আমালী এ সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। হাফেয ইবনু ক্বাইয়েম (রহ) ও মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ) সালাতের স্বীকৃতিদাতার সালাত তরককে ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন কুফরে আমালী গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আহমাদ (রহ), শায়েখ ইবনু বায (রহ) ও শায়েখ উসায়মীন (রহ) সালাত তরক করাকেই ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক কুফরী আমলী গণ্য করেছেন। এর বিরোধ নিরসণের জন্য স্বতন্ত্র পুস্তিকা লিখব, ইঁনশাআল্লাহ। -অনুবাদক]
قال في فتح البارى ( ١٣ / ١٢٠ ) : ان الآيات وان كان سببها أهل الكتاب لكن عمومها يتناول غيرهم لكن لَما تقرر من قواعد الشريعة ان مرتكب الْمعصية لا يسمى كافرا ولا يسمى أيضا ظالِما لأن الظلم قد فسر بالشرك بقيت الصفة الثالثة
ইবনু হাজার আস্কালানী (রহ) তাঁর ফতহুল বারীতে (১৩/১২০) বলেন : ‘‘এই আয়াতটির নাযিলের ভিত্তি যদিও আহলে কিতাব, কিন্তু ‘আম দাবির ভিত্তিতে অন্যান্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নির্ধারিত শরীআতের কায়েদার (নীতির) ভিত্তিতে পাপীকে কাফির বলা যাবে না। এমনকি অনুরূপভাবে যালিম বলাও যাবে না, কেননা যুলুমের তাফসীর হিসাবে কখনো শিরককে গণ্য করা হয়। সুতরাং তৃতীয় সিফাত (বৈশিষ্ট্য) বাকি থাকল (অর্থাৎ ফাসিক্ব শব্দটিই প্রযোজ্য)।"
ইবনু হাজার আস্কালানী (রহ) তাঁর ফতহুল বারীতে (১৩/১২০) বলেন : ‘‘এই আয়াতটির নাযিলের ভিত্তি যদিও আহলে কিতাব, কিন্তু ‘আম দাবির ভিত্তিতে অন্যান্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নির্ধারিত শরীআতের কায়েদার (নীতির) ভিত্তিতে পাপীকে কাফির বলা যাবে না। এমনকি অনুরূপভাবে যালিম বলাও যাবে না, কেননা যুলুমের তাফসীর হিসাবে কখনো শিরককে গণ্য করা হয়। সুতরাং তৃতীয় সিফাত (বৈশিষ্ট্য) বাকি থাকল (অর্থাৎ ফাসিক্ব শব্দটিই প্রযোজ্য)।"
قال فى تيسر الكريْم الرحْمن (٢/ ٢٩٦-٢٩٧ ) فالْحكم بغير ما أنزل الله من أعمال أهل الكفر، وقد يكون كفرا ينقل عن الْملة، وذلك إذا اعتقد حله وجوازه . وقد يكون كبيْرة من كبائر الذنوب، ومن أعمال الكفر قد استحق من فعله العذاب الشديد . .... قال ابن عباس : كفر دون كفر، وظلم دون ظلم، وفسق دون فسق، فهو ظلم أكبر، عند استحلاله، وعظيمة كبيرة عند فعله غير مستحل له .
শায়খ আব্দুর রহমান নাসির আস-সা‘দী (রহ) তাঁর ‘‘তায়সীরুল কারীমির রহমান’’ (২/২৯৬-৯৭)-এ বলেন : ‘‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করাটা কাফিরদের আমল। কখনো এই কুফর মিল্লাত (দ্বীন) থেকে বহিষ্কার করে, যখন আক্বীদার দিক থেকে তা হালাল হওয়া জায়েয করে। কখনো বড় পাপ যা ক্ববীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। এটা তখনই আমলী কুফর হয় যখন সে এর মাধ্যমে কঠিন আযাব হওয়ার যোগ্য মনে করে।....
ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : (কখনো এটা) কুফরের থেকে কম কুফর, (কখনো) যুলুমের থেকে কম যুলুম, আবার (কখনো) ফিসক্বের থেকে কম ফিসক্ব। হালাল গণ্য করাটা সর্বোচ্চ যুলুম (শিরক অর্থে)। পক্ষান্তরে হালাল গণ্য না করাটা কবীরা গোনাহর অন্তর্ভূক্ত।’’
পূর্বাপর আলোচনাতে প্রমাণিত হল, আহলে সুন্নাতের স্বীকৃত আলেমদের ‘হুকুম বি গয়রি মা-আনঝালাল্লাহ’-এর ব্যাখ্যার ব্যাপারে ইজমা‘ হয়েছে।
শায়খ আব্দুর রহমান নাসির আস-সা‘দী (রহ) তাঁর ‘‘তায়সীরুল কারীমির রহমান’’ (২/২৯৬-৯৭)-এ বলেন : ‘‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করাটা কাফিরদের আমল। কখনো এই কুফর মিল্লাত (দ্বীন) থেকে বহিষ্কার করে, যখন আক্বীদার দিক থেকে তা হালাল হওয়া জায়েয করে। কখনো বড় পাপ যা ক্ববীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। এটা তখনই আমলী কুফর হয় যখন সে এর মাধ্যমে কঠিন আযাব হওয়ার যোগ্য মনে করে।....
ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : (কখনো এটা) কুফরের থেকে কম কুফর, (কখনো) যুলুমের থেকে কম যুলুম, আবার (কখনো) ফিসক্বের থেকে কম ফিসক্ব। হালাল গণ্য করাটা সর্বোচ্চ যুলুম (শিরক অর্থে)। পক্ষান্তরে হালাল গণ্য না করাটা কবীরা গোনাহর অন্তর্ভূক্ত।’’
পূর্বাপর আলোচনাতে প্রমাণিত হল, আহলে সুন্নাতের স্বীকৃত আলেমদের ‘হুকুম বি গয়রি মা-আনঝালাল্লাহ’-এর ব্যাখ্যার ব্যাপারে ইজমা‘ হয়েছে।
-মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ)
[এই অংশটি www.AsliAhleSunnet.com থেকে সংগৃহীত। যা উর্দু ভাষায় অনূদিত ও সঙ্কলিত ‘ফিতনাতু তাকফীর আওর হুকুম বিগয়রি মা আনযালাল্লাহ’ ১৩৯-১৬২ পৃষ্ঠা থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হল। মূল (আরবি :) মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ),উর্দু অনুবাদ : তারিক্ব আলী বারভী (উর্দু অনুবাদক মূল আরবির ভাবানুবাদের দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন এবং শায়খ উসায়মীন (রহ) প্রদত্ত টিকা সংযোজন করেছেন ও শিরোনামগুলো সংযুক্ত করেছেন) -বাংলা অনুবাদ : কামাল আহমাদ]
إن الحمد لله نَحمده ونستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله أما بعد :
খারেজী : এই তাকফীরের মাসআলা কেবল হাকিমের (শাসকের/ বিচারকের) ক্ষেত্রেই নয়, বরং মাহকুমের (শাসিতের/সাধারণ জনগণের) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। [. অর্থাৎ কেবল শাসক-ই আল্লাহর আইন গোপন বা বিকৃত করলে সে কাফির হবে এমনটি নয়। বরং ব্যক্তিবিশেষ হোক, আলেম হোক বা বিচারকই হোক - যে কেউ আল্লাহর নামে কোন বিধান নতুনভাবে সৃষ্টি করলে, অথবা জেনে-বুঝে গোপন করলে, অথবা মাসআলা বা বিধান পরিবর্তন করলে - সে কাফির হয়। (সূরা মায়িদা : ৪৪) আর বিকৃত বা গোপন বা নতুন সংযোজন না করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করলে বা আমল না করলে জালিম (সূরা মায়িদা : ৪৫) ও ফাসিক্ব (সূরা মায়িদা : ৪৭) হয়। পক্ষান্তরে যারা প্রচলিত মুসলিম শাসক বলতেই কাফির বলেন, তারা বুঝেছেন : যারা শাসক বা বিচারকের আসনে রয়েছেন। তারা আল্লাহর আইন বিকৃত বা গোপন বা পরিবর্তনের দোষে দোষী না হয়েও কেবল আল্লাহর আইন জারি না করার কারণে কাফির।- (বাংলা অনুবাদক)] এটি একটি খুবই প্রাচীন ফিতনা, যা ইসলামের মধ্যকার একটি প্রাচীন ফিরক্বা হতে সৃষ্টি হয়েছিল। যারা ‘খারেজী’ নামে প্রসিদ্ধ। [.খারেজীদের সম্পর্কে ফিরক্বাগুলোর পরিচয় সম্পর্কিত কিতাবে লেখা হয়েছে। তাদের মধ্যকার একটি ফিরক্বার অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত রয়েছে- তবে ভিন্ন অপর একটি নামে তথা ‘‘আবাদ্বিয়াহ’’।এই ‘‘আবাদ্বিয়াহ’’ ফিরক্বা নিকটবর্তী অতীতকাল পর্যন্ত (ইসলামী) রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে পৃথক ছিল। তারা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যারা কোনরূপ দা‘ওয়াতী কাজের তৎপরতায় নিজেদেরকে জড়িত করেনি কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে তারা তাদের তৎপরতা শুরু করেছে। এ সম্পর্কে আমি কিছু পুস্তিকা ও আক্বীদা সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ ও প্রচার করেছি, যা মূলত প্রাচীন খারেজীদের আক্বীদা সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু তারা তাদের ঐসব বৈশিষ্ট্যকে শিয়াদের মত তাক্বীয়ার দ্বারা গোপন করার চেষ্টা করছে।তারা বলে আমরা খারেজী নই। যদিও আপনারা এটা জানেন যে, নাম পরিবর্তনে প্রকৃত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয় না। এরা কবীরা গোনাহকারীকে কাফির মনে করার ব্যাপারে খারেজীদের মতন। (টিকা : মূল আরবি ‘ফিতনাতুত তাকফীর’ (দারু ইবনু খুযায়মাহ, ১৪১৮ হি :) পৃ : ১৪। (বাংলা অনু :)]
[এই অংশটি www.AsliAhleSunnet.com থেকে সংগৃহীত। যা উর্দু ভাষায় অনূদিত ও সঙ্কলিত ‘ফিতনাতু তাকফীর আওর হুকুম বিগয়রি মা আনযালাল্লাহ’ ১৩৯-১৬২ পৃষ্ঠা থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হল। মূল (আরবি :) মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ),উর্দু অনুবাদ : তারিক্ব আলী বারভী (উর্দু অনুবাদক মূল আরবির ভাবানুবাদের দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন এবং শায়খ উসায়মীন (রহ) প্রদত্ত টিকা সংযোজন করেছেন ও শিরোনামগুলো সংযুক্ত করেছেন) -বাংলা অনুবাদ : কামাল আহমাদ]
إن الحمد لله نَحمده ونستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله أما بعد :
খারেজী : এই তাকফীরের মাসআলা কেবল হাকিমের (শাসকের/ বিচারকের) ক্ষেত্রেই নয়, বরং মাহকুমের (শাসিতের/সাধারণ জনগণের) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। [. অর্থাৎ কেবল শাসক-ই আল্লাহর আইন গোপন বা বিকৃত করলে সে কাফির হবে এমনটি নয়। বরং ব্যক্তিবিশেষ হোক, আলেম হোক বা বিচারকই হোক - যে কেউ আল্লাহর নামে কোন বিধান নতুনভাবে সৃষ্টি করলে, অথবা জেনে-বুঝে গোপন করলে, অথবা মাসআলা বা বিধান পরিবর্তন করলে - সে কাফির হয়। (সূরা মায়িদা : ৪৪) আর বিকৃত বা গোপন বা নতুন সংযোজন না করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করলে বা আমল না করলে জালিম (সূরা মায়িদা : ৪৫) ও ফাসিক্ব (সূরা মায়িদা : ৪৭) হয়। পক্ষান্তরে যারা প্রচলিত মুসলিম শাসক বলতেই কাফির বলেন, তারা বুঝেছেন : যারা শাসক বা বিচারকের আসনে রয়েছেন। তারা আল্লাহর আইন বিকৃত বা গোপন বা পরিবর্তনের দোষে দোষী না হয়েও কেবল আল্লাহর আইন জারি না করার কারণে কাফির।- (বাংলা অনুবাদক)] এটি একটি খুবই প্রাচীন ফিতনা, যা ইসলামের মধ্যকার একটি প্রাচীন ফিরক্বা হতে সৃষ্টি হয়েছিল। যারা ‘খারেজী’ নামে প্রসিদ্ধ। [.খারেজীদের সম্পর্কে ফিরক্বাগুলোর পরিচয় সম্পর্কিত কিতাবে লেখা হয়েছে। তাদের মধ্যকার একটি ফিরক্বার অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত রয়েছে- তবে ভিন্ন অপর একটি নামে তথা ‘‘আবাদ্বিয়াহ’’।এই ‘‘আবাদ্বিয়াহ’’ ফিরক্বা নিকটবর্তী অতীতকাল পর্যন্ত (ইসলামী) রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে পৃথক ছিল। তারা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যারা কোনরূপ দা‘ওয়াতী কাজের তৎপরতায় নিজেদেরকে জড়িত করেনি কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে তারা তাদের তৎপরতা শুরু করেছে। এ সম্পর্কে আমি কিছু পুস্তিকা ও আক্বীদা সম্পর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ ও প্রচার করেছি, যা মূলত প্রাচীন খারেজীদের আক্বীদা সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু তারা তাদের ঐসব বৈশিষ্ট্যকে শিয়াদের মত তাক্বীয়ার দ্বারা গোপন করার চেষ্টা করছে।তারা বলে আমরা খারেজী নই। যদিও আপনারা এটা জানেন যে, নাম পরিবর্তনে প্রকৃত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয় না। এরা কবীরা গোনাহকারীকে কাফির মনে করার ব্যাপারে খারেজীদের মতন। (টিকা : মূল আরবি ‘ফিতনাতুত তাকফীর’ (দারু ইবনু খুযায়মাহ, ১৪১৮ হি :) পৃ : ১৪। (বাংলা অনু :)]
বর্তমানে কিছু জামাআত কুরআন ও সুন্নাতের দা‘ওয়াতের ব্যাপারে হক্ব জামাআতের সাথে মিশে রয়েছে। কিন্তু হায় আফসোস! তারা কুরআন ও সুন্নাত থেকে বের হয়ে কুরআন ও সুন্নাতের নামে নতুন পথের সৃষ্টি করেছে। আমার বুঝ ও জ্ঞান মোতাবেক এর দু’টি কারণ রয়েছে :
প্রথমত : ইলমের ঘাটতি।
দ্বিতীয়ত : সবচে বড় দুর্বলতা হল, শরীআতের আইন-কানুনের ব্যাপারে তাদের গভীর জ্ঞান না থাকা। অথচ আকাঙ্ক্ষা হল সহীহ ইসলামী দা‘ওয়াতের। যার থেকে বিমুখ হওয়াকে রসূলুল্লাহ (স) তাঁর অসংখ্য হাদীসে নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত) জামাআত থেকে বহিষ্কৃত বলে চিহ্নিত করেছেন। বরং আরও একধাপ এগিয়ে বলা যায়, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা এই জামাআত থেকে বিচ্ছিন্নদের আল্লাহ ও রসূলের বিরুদ্ধাচারণকারী হিসাবে গণ্য করেছেন।
সালাফী মানহায : যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهَدى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نَوَلِّه مَا تَوَلّى وَنُصْلِه جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا ـ
‘‘আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা কত মন্দ আবাস।’’ [. সূরা নিসা : ১১৫ আয়াত।]
আলেমগণ এটা জানেন যে, আল্লাহ তাআলা কেবল এ কথা বলেই ক্ষান্ত হননি ‘‘যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর- তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব।’’ বরং রসূলের বিরুদ্ধাচারণের কথা উল্লেখ করার সাথে সাথে وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘এবং যে মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে’’ -বাক্যটিও উল্লেখ করেছেন।
‘‘মু’মিনদের পথ’’-এর অনুসরণ করা বা না করাটা, পক্ষ ও বিপক্ষ উভয় দৃষ্টিতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি ‘‘মু’মিনদের পথ’’-এর অনুসরণ করবে সে রব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ‘‘মু’মিনদের পথ’’-এর বিপরীতে চলবে তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট, আর তা কতই না মন্দ ঠিকানা।
এটাই সেই মূলকেন্দ্র যে ব্যাপারে প্রাচীন ও আধুনিক জামাআতগুলো হোঁচট খায়। তারা سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘মু‘মিনীনদের পথে’র অনুসরণ করে না। কুরআন ও সুন্নাতের তাফসীরের ব্যাপারে নিজেদের বিবেকের দারস্থ হয় এবং নিজেদের খাহেশের (প্রবৃত্তির) আনুগত্য করে। আর এ ভুলের কারণে তারা অত্যন্ত বিধ্বংসী কার্যকলাপে লিপ্ত। যার ফলাফল হল, তারা সালফে-সালেহীনের মানহায থেকে খারীজ (বহিষ্কৃত)।
আলোচ্য আয়াতের وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘এবং যে মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে’’ -অংশটির সঠিক ও সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা এবং প্রকৃত গুরুত্ব নবী (স)-এর বিভিন্ন সহীহ হাদীসে উল্লেখ করেছেন। যার কয়েকটি আমি বর্ণনা করব। ঐ সমস্ত হাদীস সাধারণ মুসলিমদেরও অজানা নয়। তবে এর মধ্যে তাদের অজানা হল, سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘মু‘মিনদের পথ’’-এর অনুসরণের ব্যাপারটি কিতাব ও সুন্নাহ’র দ্বারা ওয়াজিব হওয়ার দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও তার গুরুত্ব অনুধাবন করা। এটা (আক্বীদা বিষয়ক) এমন একটি মৌলিক দিক যা অনেক প্রসিদ্ধ গণ্যমান্য ব্যক্তিরও এর গুরুত্ব বুঝতে ভুল হয়েছে ও আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে উদাসীনতা কাজ করেছে। এরা তাকফীরকারী হিসাবে প্রসিদ্ধ। যাদের মধ্যে অনেক জামাআত রয়েছে- যারা নিজেদের জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের তাকফীর করাটাই খুব বড় ভুল।
এই লোকেরা মনে করছে, তারা নিজেদেরকে নেকী ও ইখলাসের মধ্যে নিয়োজিত রেখেছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা’র কাছে কারো নাজাত বা সফলতার অর্জনের জন্য কেবল নেকনীতি ও ইখলাসই যথেষ্ট নয়। তবে অবশ্যই একজন মুসলিমের উপর জরুরি হল, সে আল্লাহ তাআলা’র জন্য নিয়্যাতে ইখলাস রাখবে এবং রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত অনুযায়ী সর্বোত্তম আমল করবে।
মোটকথা একজন মুসলিম অবশ্যই ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে নিজে কুরআন ও সুন্নাত অনুযায়ী আমল করবে এবং সে দিকেই দা‘ওয়াত দিবে। তবে এর সাথে অপর একটি শর্তও জরুরি, তা হল- তাদের মানহায সঠিক ও দৃঢ়তা সম্পন্ন হওয়া। আর এটা কখনোই পূর্ণতা লাভ করে না, যতক্ষণ না সালফে-সালেহীনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়।
এর স্বপক্ষে কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল তিয়াত্তর ফিরক্বার হাদীস যার ইঙ্গিত আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
افْتَرَقَتِ الْيَهُودُ على إِحْدَى وَسَبْعِينَ فِرْقَةً فَوَاحِدَةٌ فى الْجنة وسبعين فى النار وافترقت النصارى على ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً فإحدى وسبعون فى النار وواحدة فى الجنة وَسَتَفْتَرِقَ أُمَّتِى على ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلَّهَا فِي النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةُ قَالُوْا مَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قال الْجَمَاعَة ـ وفي رواية : مَا أنَا عَلَيْهِ وَأَصَحَابِيْ
‘‘ইয়াহুদীরা একাত্তর ফিরক্বাতে বিভক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি জান্নাতে যাবে, অন্য সত্তরটি ফিরক্বা জাহান্নামী হবে। নাসারাগণ বাহাত্তর ফিরক্বাতে বিভক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি জান্নাতে যাবে এবং অন্য একাত্তরটি ফিরক্বা জাহান্নামে যাবে। আর আমার উম্মাত তিয়াত্তর ফিরক্বাতে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলোই জাহান্নামে যাবে। জিজ্ঞাসা করা হল : ইয়া রসূলাল্লাহ! তারা কারা? তিনি (স) বললেন : (তারা হল) ‘আল-জামাআত’। (অন্য বর্ণনায়) যার ওপর আমি ও আমার সাহাবীগণ আছি।’’ [. সহীহ : ইবনু মাজাহ, কিতাবুল ফিতান - باب افتراق الامم ; হা/৩৯৯২। মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী الجماعة ‘আল-জামাআত’ শব্দে বর্ণিত হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। অপর পক্ষে তিরমিযীতে আব্দুল্লাহ বিন ‘উমর থেকে বর্ণিত -ما انا عليه واصحابي -‘‘যার ওপর আমি এবং আমার সাহাবীরা আছি’’ -হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। [আল-বানীর তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ১ম খন্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪০৫হি :/১৯৯৫ ‘ঈসায়ী) পৃ. ৬১] অবশ্য উদ্দেশ্যের দিক থেকে হাদীসগুলো একই অর্থবোধকহওয়ায় ও অনেক সাক্ষ্য থাকায় তিনি অন্যত্র হাদীসটিকে হাসান লি-গয়রিহী বলেছেন (সলাতুল ঈদায়ীন ফিল মুসাল্লা পৃ. ৪৬)। আলবানী (রহ) হাদীসটি কিছুটা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। -বাংলা অনুবাদক]
নবী (স)-কে নাজী বা জান্নাতী ফিরক্বা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছিলেন আল্লাহ তাআলা’র উক্তি : وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘এবং যে মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে’’ -দ্বারা এটা পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং এই আয়াতটিতে যে মু’মিদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে- তারা হলেন নবী (স)-এর সাহাবীগণ। যা হাদীসে বর্ণিত : مَا أنَا عَلَيْهِ وَأَصَحَابِيْ ‘‘যার ওপর আমি ও আমার সাহাবীগণ আছি’’ উক্তিটিতে সুস্পষ্ট হয়েছে। নবী (স) কেবল এতটুকুই যথেষ্ট মনে করেননি বরং এটা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তাদের জন্য যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ জবাব ছিল- যারা ছিলেন কিতাব ও সুন্নাতের সুস্পষ্ট বুঝের অধিকারী। কিন্তু যদিও নবী (স) নিজে আল্লাহ তাআলা’র ঐ দাবির প্রতি আমল করেছিলেন যে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর (স) সম্পর্কে বলেছেন : بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيم ‘‘মু’মিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়।’’ [.সূরা তাওবা : ১২৮ আয়াত।]
সুতরাং নবী (স)-এর সমস্ত স্নেহ ও দয়ার দাবি হল, তিনি (স) তাঁর সাহাবী (রা) এবং সমস্ত অনুসারীদের জন্য ফিরক্বায়ে নাজীয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। যেন তারা সেগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে- যার প্রতি তিনি (স) ও পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহাবীগণ (রা) প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, মুসলিমদের জন্য জায়েয নয় কিতাব ও সুন্নাত বুঝার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ঐ সমস্ত জরুরি ইলমের উপর নির্ভর করবে যেমন- আরবি ভাষা, নাসিখ-মানসুখ এবং বিভিন্ন নিয়ম (উসূল) সম্পর্কিত জ্ঞান। বরং এই সমস্ত নিয়ম ছাড়াও ঐ পদ্ধতিরও অনুসরণ করা জরুরি যার ওপর সাহাবীগণ (রা)-ও ছিলেন। কেননা এটা সবার কাছে সুস্পষ্ট যে, তাদের বর্ণনা ও জীবন থেকে বুঝা যায়, সাহাবীগণ (রা) আল্লাহ তাআলা’র ইবাদাতের ব্যাপারে মুখলেস (নিষ্ঠাবান) ছিলেন। আর কুরআন ও সুন্নাতের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে আমাদের থেকে বেশি জ্ঞান রাখতেন। তাছাড়া তাদের এমন অনেক চারিত্রিক গুণ ছিল যে ব্যাপারে তারা নিজেরাই নিজেদের তুলনা।
আলোচ্য হাদীসটি পূর্বোক্ত আয়াতটির পরিপূর্ণতা দান করে। যখন রসূলুল্লাহ (স) একজন মুসলিমকে ফিরক্বায়ে নাজিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে এ দিকে ইঙ্গিত দিলেন যে, তারা ঐ মানহাযের ওপর থাকবে যার ওপর সাহাবীগণ (রা) ছিলেন। এই হাদীসটি ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ সম্পর্কিত হাদীসটির পরিপূরক যা সুনানগুলোতে ইরবায বিন সারিয়াহ (রা) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন :
وَعَظَنَا مَوْعِظَةً وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّهَا مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا قَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ تَأَمُّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ وَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ .
‘‘একবার রসূলুল্লাহ (স) আমাদের উদ্দেশ্যে এমনি মর্মস্পর্শী ওয়ায করলেন যে, তাতে অন্তরসমূহ ভীত ও চোখসমূহ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। আমরা বললাম : ইয়া রসূলাল্লাহ! মনে হচ্ছে এটা যেন বিদায়ী ভাষণ, তাই আপনি আমাদের উপদেশ দিন। তিনি বললেন : আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার এবং শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি যদিও কোন গোলাম তোমাদের আমীর নিযুক্ত হয়। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবে, অচিরেই তারা অসংখ্য ব্যাপারে মতভেদ দেখতে পাবে। কাজেই তোমাদের উচিত হবে আমার ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদার আদর্শকে মাড়ির মযবুত দাঁত দ্বারা আঁকড়ে ধরা। আর তোমরা বিদআত হতে অবশ্যই বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক বিদআত সুস্পষ্ট গোমরাহী।’’ [. সহীহ : আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ও ইবনু হিব্বান তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৩৭ নং)। মুহাম্মাদ তামিরও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (মিশর : দার ইবনু রজব) ১/৫৮ নং। আলবানী (রহ) হাদীসটি কিছুটা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। (বাংলা অনুবাদক)]
এই হাদীসটি পূর্বোক্ত হাদীসটির শাহেদ (সাক্ষ্য) যেখানে রসূলুল্লাহ (স) সাহাবা (রা) তথা নিজের উম্মাতকে কেবল তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকারই নসিহত করেননি বরং হিদায়াত অর্জনে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকেও আঁকড়ে ধরতে বলেন।
সুতরাং আমাদের ওপর জরুরি হল- আক্বীদা, ইবাদত, আখলাক, চাল-চলন প্রভৃতি সবক্ষেত্রেই সালফে-সালেহীনের প্রতি লক্ষ্য রাখা। ফলে একজন মুসলিম ফিরক্বায়ে নাজিয়ার অন্তর্ভূক্ত হিসাবে গণ্য হবে।
এটাই সেই গুরুত্বপূর্ণ দিক যার থেকে গাফেল ও বিমুখ হওয়ার কারণে সমস্ত নতুন ও পুরাতন ফিরক্বা ও জামাআত গোমরাহ হয়েছে। কেননা আলোচ্য (সূরা নিসা- ১১৫) আয়াত এবং ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনকে আঁকড়ে থাকার হাদীস যে মানহাযের (আদর্শিক পথের) দিকে পরিচালিত করে- তারা তা কবুল করেনি। যা ছিল উম্মাতের বিভেদের কারণ। সুতরাং তাদের মৌলিক ও যৌক্তিক বৈশিষ্ট্য হল- তারা কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে নববী (স) এবং সালফে সালেহীনদের থেকে বিমুখ হয়েছে, যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও বিমুখ হয়েছিল।
প্রথমত : ইলমের ঘাটতি।
দ্বিতীয়ত : সবচে বড় দুর্বলতা হল, শরীআতের আইন-কানুনের ব্যাপারে তাদের গভীর জ্ঞান না থাকা। অথচ আকাঙ্ক্ষা হল সহীহ ইসলামী দা‘ওয়াতের। যার থেকে বিমুখ হওয়াকে রসূলুল্লাহ (স) তাঁর অসংখ্য হাদীসে নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত) জামাআত থেকে বহিষ্কৃত বলে চিহ্নিত করেছেন। বরং আরও একধাপ এগিয়ে বলা যায়, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা এই জামাআত থেকে বিচ্ছিন্নদের আল্লাহ ও রসূলের বিরুদ্ধাচারণকারী হিসাবে গণ্য করেছেন।
সালাফী মানহায : যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهَدى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نَوَلِّه مَا تَوَلّى وَنُصْلِه جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا ـ
‘‘আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা কত মন্দ আবাস।’’ [. সূরা নিসা : ১১৫ আয়াত।]
আলেমগণ এটা জানেন যে, আল্লাহ তাআলা কেবল এ কথা বলেই ক্ষান্ত হননি ‘‘যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর- তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব।’’ বরং রসূলের বিরুদ্ধাচারণের কথা উল্লেখ করার সাথে সাথে وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘এবং যে মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে’’ -বাক্যটিও উল্লেখ করেছেন।
‘‘মু’মিনদের পথ’’-এর অনুসরণ করা বা না করাটা, পক্ষ ও বিপক্ষ উভয় দৃষ্টিতেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি ‘‘মু’মিনদের পথ’’-এর অনুসরণ করবে সে রব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ‘‘মু’মিনদের পথ’’-এর বিপরীতে চলবে তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট, আর তা কতই না মন্দ ঠিকানা।
এটাই সেই মূলকেন্দ্র যে ব্যাপারে প্রাচীন ও আধুনিক জামাআতগুলো হোঁচট খায়। তারা سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘মু‘মিনীনদের পথে’র অনুসরণ করে না। কুরআন ও সুন্নাতের তাফসীরের ব্যাপারে নিজেদের বিবেকের দারস্থ হয় এবং নিজেদের খাহেশের (প্রবৃত্তির) আনুগত্য করে। আর এ ভুলের কারণে তারা অত্যন্ত বিধ্বংসী কার্যকলাপে লিপ্ত। যার ফলাফল হল, তারা সালফে-সালেহীনের মানহায থেকে খারীজ (বহিষ্কৃত)।
আলোচ্য আয়াতের وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘এবং যে মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে’’ -অংশটির সঠিক ও সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা এবং প্রকৃত গুরুত্ব নবী (স)-এর বিভিন্ন সহীহ হাদীসে উল্লেখ করেছেন। যার কয়েকটি আমি বর্ণনা করব। ঐ সমস্ত হাদীস সাধারণ মুসলিমদেরও অজানা নয়। তবে এর মধ্যে তাদের অজানা হল, سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘মু‘মিনদের পথ’’-এর অনুসরণের ব্যাপারটি কিতাব ও সুন্নাহ’র দ্বারা ওয়াজিব হওয়ার দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও তার গুরুত্ব অনুধাবন করা। এটা (আক্বীদা বিষয়ক) এমন একটি মৌলিক দিক যা অনেক প্রসিদ্ধ গণ্যমান্য ব্যক্তিরও এর গুরুত্ব বুঝতে ভুল হয়েছে ও আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে উদাসীনতা কাজ করেছে। এরা তাকফীরকারী হিসাবে প্রসিদ্ধ। যাদের মধ্যে অনেক জামাআত রয়েছে- যারা নিজেদের জিহাদের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের তাকফীর করাটাই খুব বড় ভুল।
এই লোকেরা মনে করছে, তারা নিজেদেরকে নেকী ও ইখলাসের মধ্যে নিয়োজিত রেখেছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা’র কাছে কারো নাজাত বা সফলতার অর্জনের জন্য কেবল নেকনীতি ও ইখলাসই যথেষ্ট নয়। তবে অবশ্যই একজন মুসলিমের উপর জরুরি হল, সে আল্লাহ তাআলা’র জন্য নিয়্যাতে ইখলাস রাখবে এবং রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাত অনুযায়ী সর্বোত্তম আমল করবে।
মোটকথা একজন মুসলিম অবশ্যই ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে নিজে কুরআন ও সুন্নাত অনুযায়ী আমল করবে এবং সে দিকেই দা‘ওয়াত দিবে। তবে এর সাথে অপর একটি শর্তও জরুরি, তা হল- তাদের মানহায সঠিক ও দৃঢ়তা সম্পন্ন হওয়া। আর এটা কখনোই পূর্ণতা লাভ করে না, যতক্ষণ না সালফে-সালেহীনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়।
এর স্বপক্ষে কয়েকটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল তিয়াত্তর ফিরক্বার হাদীস যার ইঙ্গিত আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
افْتَرَقَتِ الْيَهُودُ على إِحْدَى وَسَبْعِينَ فِرْقَةً فَوَاحِدَةٌ فى الْجنة وسبعين فى النار وافترقت النصارى على ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً فإحدى وسبعون فى النار وواحدة فى الجنة وَسَتَفْتَرِقَ أُمَّتِى على ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلَّهَا فِي النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةُ قَالُوْا مَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قال الْجَمَاعَة ـ وفي رواية : مَا أنَا عَلَيْهِ وَأَصَحَابِيْ
‘‘ইয়াহুদীরা একাত্তর ফিরক্বাতে বিভক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি জান্নাতে যাবে, অন্য সত্তরটি ফিরক্বা জাহান্নামী হবে। নাসারাগণ বাহাত্তর ফিরক্বাতে বিভক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি জান্নাতে যাবে এবং অন্য একাত্তরটি ফিরক্বা জাহান্নামে যাবে। আর আমার উম্মাত তিয়াত্তর ফিরক্বাতে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলোই জাহান্নামে যাবে। জিজ্ঞাসা করা হল : ইয়া রসূলাল্লাহ! তারা কারা? তিনি (স) বললেন : (তারা হল) ‘আল-জামাআত’। (অন্য বর্ণনায়) যার ওপর আমি ও আমার সাহাবীগণ আছি।’’ [. সহীহ : ইবনু মাজাহ, কিতাবুল ফিতান - باب افتراق الامم ; হা/৩৯৯২। মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আলবানী الجماعة ‘আল-জামাআত’ শব্দে বর্ণিত হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। অপর পক্ষে তিরমিযীতে আব্দুল্লাহ বিন ‘উমর থেকে বর্ণিত -ما انا عليه واصحابي -‘‘যার ওপর আমি এবং আমার সাহাবীরা আছি’’ -হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। [আল-বানীর তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ১ম খন্ড (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪০৫হি :/১৯৯৫ ‘ঈসায়ী) পৃ. ৬১] অবশ্য উদ্দেশ্যের দিক থেকে হাদীসগুলো একই অর্থবোধকহওয়ায় ও অনেক সাক্ষ্য থাকায় তিনি অন্যত্র হাদীসটিকে হাসান লি-গয়রিহী বলেছেন (সলাতুল ঈদায়ীন ফিল মুসাল্লা পৃ. ৪৬)। আলবানী (রহ) হাদীসটি কিছুটা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। -বাংলা অনুবাদক]
নবী (স)-কে নাজী বা জান্নাতী ফিরক্বা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছিলেন আল্লাহ তাআলা’র উক্তি : وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘‘এবং যে মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে’’ -দ্বারা এটা পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং এই আয়াতটিতে যে মু’মিদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে- তারা হলেন নবী (স)-এর সাহাবীগণ। যা হাদীসে বর্ণিত : مَا أنَا عَلَيْهِ وَأَصَحَابِيْ ‘‘যার ওপর আমি ও আমার সাহাবীগণ আছি’’ উক্তিটিতে সুস্পষ্ট হয়েছে। নবী (স) কেবল এতটুকুই যথেষ্ট মনে করেননি বরং এটা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তাদের জন্য যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ জবাব ছিল- যারা ছিলেন কিতাব ও সুন্নাতের সুস্পষ্ট বুঝের অধিকারী। কিন্তু যদিও নবী (স) নিজে আল্লাহ তাআলা’র ঐ দাবির প্রতি আমল করেছিলেন যে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর (স) সম্পর্কে বলেছেন : بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيم ‘‘মু’মিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়।’’ [.সূরা তাওবা : ১২৮ আয়াত।]
সুতরাং নবী (স)-এর সমস্ত স্নেহ ও দয়ার দাবি হল, তিনি (স) তাঁর সাহাবী (রা) এবং সমস্ত অনুসারীদের জন্য ফিরক্বায়ে নাজীয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলের বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ সুস্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। যেন তারা সেগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে- যার প্রতি তিনি (স) ও পরবর্তী সময়ে তাঁর সাহাবীগণ (রা) প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, মুসলিমদের জন্য জায়েয নয় কিতাব ও সুন্নাত বুঝার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ঐ সমস্ত জরুরি ইলমের উপর নির্ভর করবে যেমন- আরবি ভাষা, নাসিখ-মানসুখ এবং বিভিন্ন নিয়ম (উসূল) সম্পর্কিত জ্ঞান। বরং এই সমস্ত নিয়ম ছাড়াও ঐ পদ্ধতিরও অনুসরণ করা জরুরি যার ওপর সাহাবীগণ (রা)-ও ছিলেন। কেননা এটা সবার কাছে সুস্পষ্ট যে, তাদের বর্ণনা ও জীবন থেকে বুঝা যায়, সাহাবীগণ (রা) আল্লাহ তাআলা’র ইবাদাতের ব্যাপারে মুখলেস (নিষ্ঠাবান) ছিলেন। আর কুরআন ও সুন্নাতের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে আমাদের থেকে বেশি জ্ঞান রাখতেন। তাছাড়া তাদের এমন অনেক চারিত্রিক গুণ ছিল যে ব্যাপারে তারা নিজেরাই নিজেদের তুলনা।
আলোচ্য হাদীসটি পূর্বোক্ত আয়াতটির পরিপূর্ণতা দান করে। যখন রসূলুল্লাহ (স) একজন মুসলিমকে ফিরক্বায়ে নাজিয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে এ দিকে ইঙ্গিত দিলেন যে, তারা ঐ মানহাযের ওপর থাকবে যার ওপর সাহাবীগণ (রা) ছিলেন। এই হাদীসটি ‘খুলাফায়ে রাশেদীন’ সম্পর্কিত হাদীসটির পরিপূরক যা সুনানগুলোতে ইরবায বিন সারিয়াহ (রা) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন :
وَعَظَنَا مَوْعِظَةً وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ وَذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّهَا مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا قَالَ : أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ تَأَمُّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ وَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ عَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ .
‘‘একবার রসূলুল্লাহ (স) আমাদের উদ্দেশ্যে এমনি মর্মস্পর্শী ওয়ায করলেন যে, তাতে অন্তরসমূহ ভীত ও চোখসমূহ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। আমরা বললাম : ইয়া রসূলাল্লাহ! মনে হচ্ছে এটা যেন বিদায়ী ভাষণ, তাই আপনি আমাদের উপদেশ দিন। তিনি বললেন : আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার এবং শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি যদিও কোন গোলাম তোমাদের আমীর নিযুক্ত হয়। কেননা তোমাদের মধ্যে যারা ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবে, অচিরেই তারা অসংখ্য ব্যাপারে মতভেদ দেখতে পাবে। কাজেই তোমাদের উচিত হবে আমার ও হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদার আদর্শকে মাড়ির মযবুত দাঁত দ্বারা আঁকড়ে ধরা। আর তোমরা বিদআত হতে অবশ্যই বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক বিদআত সুস্পষ্ট গোমরাহী।’’ [. সহীহ : আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ও ইবনু হিব্বান তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ১/৩৭ নং)। মুহাম্মাদ তামিরও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (মিশর : দার ইবনু রজব) ১/৫৮ নং। আলবানী (রহ) হাদীসটি কিছুটা সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। (বাংলা অনুবাদক)]
এই হাদীসটি পূর্বোক্ত হাদীসটির শাহেদ (সাক্ষ্য) যেখানে রসূলুল্লাহ (স) সাহাবা (রা) তথা নিজের উম্মাতকে কেবল তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে থাকারই নসিহত করেননি বরং হিদায়াত অর্জনে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকেও আঁকড়ে ধরতে বলেন।
সুতরাং আমাদের ওপর জরুরি হল- আক্বীদা, ইবাদত, আখলাক, চাল-চলন প্রভৃতি সবক্ষেত্রেই সালফে-সালেহীনের প্রতি লক্ষ্য রাখা। ফলে একজন মুসলিম ফিরক্বায়ে নাজিয়ার অন্তর্ভূক্ত হিসাবে গণ্য হবে।
এটাই সেই গুরুত্বপূর্ণ দিক যার থেকে গাফেল ও বিমুখ হওয়ার কারণে সমস্ত নতুন ও পুরাতন ফিরক্বা ও জামাআত গোমরাহ হয়েছে। কেননা আলোচ্য (সূরা নিসা- ১১৫) আয়াত এবং ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ ও খুলাফায়ে রাশেদীনকে আঁকড়ে থাকার হাদীস যে মানহাযের (আদর্শিক পথের) দিকে পরিচালিত করে- তারা তা কবুল করেনি। যা ছিল উম্মাতের বিভেদের কারণ। সুতরাং তাদের মৌলিক ও যৌক্তিক বৈশিষ্ট্য হল- তারা কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে নববী (স) এবং সালফে সালেহীনদের থেকে বিমুখ হয়েছে, যেভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও বিমুখ হয়েছিল।
ঐ সমস্ত গোমরাহ ফিরক্বার মধ্যে একাধারে প্রাচীন ও আধুনিক ফিরক্বা হল খারেজী। তাকফীরের আসল ভিত্তি যা ইদানীং চারদিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা হল কুরআনুল কারীমের নিম্নোক্ত আয়াত। যা এই লোকেরা সব সময় উপস্থাপন করে আসছে :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
আমরা সবাই জানি যে, এই আয়াতের সাথে সম্পর্কিত আয়াতগুলোতে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই যালিম।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৫ আয়াত।]
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই ফাসিক্ব।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৭ আয়াত।]
তারা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে উক্ত আয়াতগুলো থেকে প্রথম আয়াতটি দ্বারা দলিল গ্রহণ করছে। অর্থাৎ-
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
তাদের উচিত ছিল, কমপক্ষে যেসব দলিলে ‘কুফর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোকে কষ্ট করে হলেও একত্রিত করা। পক্ষান্তরে তারা এই একটি আয়াতে বর্ণিত ‘কুফর’ শব্দ দ্বারাই দ্বীন থেকে খারিজ ঘোষণা করছে। এরফলে, তাদের কাছে কোন মুসলিম যদি এই কুফরে লিপ্ত হয়, তবে ঐ মুসলিমের সাথে মুশরিক, ইয়াহুদী ও নাসারা প্রমুখদের কোন পার্থক্য নেই।
কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ’র অভিধানে ‘কুফর’ শব্দটির অর্থ একমাত্র এটাই নয়। অথচ তারা সেটাই দাবি করছে এবং এই ভুল বুঝ দ্বারা অনেক মুসলিমের উপর তাকফীর আরোপ করছে, অথচ তাদের প্রতি তা প্রযোজ্য নয়।
‘তাকফীর’ শব্দটি সবসময় একই অর্থ তথা দ্বীন থেকে খারিজ হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বরং এর সম্পর্ক পরের দু’টি আয়াতে ব্যবহৃত শব্দের ন্যায়ও হয়ে থাকে- অর্থাৎ ‘ফাসিক্ব’ ও ‘যালিম’। সুতরাং প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে যালিম বা ফাসিক্ব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে- তার জন্য কখনই এটা প্রযোজ্য নয় যে, সে মুরতাদ হয়ে গেছে। তেমনি যদি কারো ক্ষেত্রে বলা হয় যে, সে কুফর করেছে- তার অর্থ এটা নয় যে, সে মুরতাদ হয়ে গেছে।
এর একটি অর্থ আরবি অভিধানে ও আমাদের শরীআতে তথা আরবিতে নাযিলকৃত কুরআনুল কারীম দ্বারা প্রমাণিত। এ কারণে যে কেউ-ই আল্লাহ’র হুকুমের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়- সে হাকিম/শাসক হোক কিংবা সাধারণ প্রত্যেকেরই কিতাব, সুন্নাত এবং সালফে-সালেহীনের মানহায অনুযায়ী আহরিত ইলমের উপর ক্বায়েম থাকা ওয়াজিব।
আরবি ভাষার স্বকীয়তা সম্পর্কে জানা ছাড়া কুরআন এবং এর সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। আর এই নিয়মও প্রযোজ্য যে, যদি কোন ব্যক্তির আরবি ভাষার ব্যাপারে এতটা শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা অর্জিত না হয়, তবে সে নিজের পরিকল্পনানুযায়ী যা সে নিজের ভিতরে আকাঙ্ক্ষা করে- সেক্ষেত্রে সে ঐ সমস্ত আলেমদের দিকে নিজেকে সোপর্দ করবে যারা পূর্বে চলে গেছেন। বিশেষভাবে যাদের সাথে কুরুনে সালাসাহ (নেককারদের তিনটি যুগ)-এর সম্পর্ক রয়েছে। যাদের হিদায়াত, কামিয়াবী ও শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য স্বয়ং নবী (স) থেকে প্রমাণিত। তাদের দিকে নিজেকে সোপর্দ করার দাবি হল, তাদের মাধ্যমে পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করা। কেননা তাদের মধ্যে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সম্পৃক্তার নিদর্শন পাওয়া যায়।
আসুন আমরা পুনরায় আয়াতটির প্রসঙ্গে আসি। وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।] এই আয়াতটির فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ বাক্যটির উদ্দেশ্য কি-
১.সম্পূর্ণভাবে ইসলাম থেকে খারিজ (বহিষ্কার) হয়ে যাওয়া?
২.নাকি এর অর্থ- কখনো ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া, আবার কখনো ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া থেকে কিছু কম?
এ পর্যায়ে আয়াতটি কিছুক্ষণ গভীরভাবে লক্ষ করুন। কেননা আয়াতটির فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ বাক্যটির দ্বারা কখনো ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। আবার কখনো এর উদ্দেশ্য হল, আমলগত দিক থেকে কোন আহকামের ব্যাপারে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া। এর সহীহ তাফসীরের ব্যাপারে আমাদেরকে যা সহযোগিতা করবে তা হল, নবী (স)-এর ঘোষিত মুফাসসির সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা)-এর বিশ্লেষণ। কেননা, কিছু গোমরাহ ফিরক্বা ছাড়া সবাই একমত যে সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা) ছিলেন তাফসীরের ব্যাপারে ইমাম। আর এ কারণেই আমার জানা মতে সম্ভবত, সাহাবী ইবনু মাসউদ (রা) তাঁকে ‘তরজামানুল কুরআন’ উপাধি দিয়েছেন।
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
আমরা সবাই জানি যে, এই আয়াতের সাথে সম্পর্কিত আয়াতগুলোতে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই যালিম।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৫ আয়াত।]
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই ফাসিক্ব।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৭ আয়াত।]
তারা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে উক্ত আয়াতগুলো থেকে প্রথম আয়াতটি দ্বারা দলিল গ্রহণ করছে। অর্থাৎ-
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
তাদের উচিত ছিল, কমপক্ষে যেসব দলিলে ‘কুফর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোকে কষ্ট করে হলেও একত্রিত করা। পক্ষান্তরে তারা এই একটি আয়াতে বর্ণিত ‘কুফর’ শব্দ দ্বারাই দ্বীন থেকে খারিজ ঘোষণা করছে। এরফলে, তাদের কাছে কোন মুসলিম যদি এই কুফরে লিপ্ত হয়, তবে ঐ মুসলিমের সাথে মুশরিক, ইয়াহুদী ও নাসারা প্রমুখদের কোন পার্থক্য নেই।
কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহ’র অভিধানে ‘কুফর’ শব্দটির অর্থ একমাত্র এটাই নয়। অথচ তারা সেটাই দাবি করছে এবং এই ভুল বুঝ দ্বারা অনেক মুসলিমের উপর তাকফীর আরোপ করছে, অথচ তাদের প্রতি তা প্রযোজ্য নয়।
‘তাকফীর’ শব্দটি সবসময় একই অর্থ তথা দ্বীন থেকে খারিজ হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয় না। বরং এর সম্পর্ক পরের দু’টি আয়াতে ব্যবহৃত শব্দের ন্যায়ও হয়ে থাকে- অর্থাৎ ‘ফাসিক্ব’ ও ‘যালিম’। সুতরাং প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে যালিম বা ফাসিক্ব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে- তার জন্য কখনই এটা প্রযোজ্য নয় যে, সে মুরতাদ হয়ে গেছে। তেমনি যদি কারো ক্ষেত্রে বলা হয় যে, সে কুফর করেছে- তার অর্থ এটা নয় যে, সে মুরতাদ হয়ে গেছে।
এর একটি অর্থ আরবি অভিধানে ও আমাদের শরীআতে তথা আরবিতে নাযিলকৃত কুরআনুল কারীম দ্বারা প্রমাণিত। এ কারণে যে কেউ-ই আল্লাহ’র হুকুমের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়- সে হাকিম/শাসক হোক কিংবা সাধারণ প্রত্যেকেরই কিতাব, সুন্নাত এবং সালফে-সালেহীনের মানহায অনুযায়ী আহরিত ইলমের উপর ক্বায়েম থাকা ওয়াজিব।
আরবি ভাষার স্বকীয়তা সম্পর্কে জানা ছাড়া কুরআন এবং এর সম্পর্কিত গভীর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। আর এই নিয়মও প্রযোজ্য যে, যদি কোন ব্যক্তির আরবি ভাষার ব্যাপারে এতটা শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা অর্জিত না হয়, তবে সে নিজের পরিকল্পনানুযায়ী যা সে নিজের ভিতরে আকাঙ্ক্ষা করে- সেক্ষেত্রে সে ঐ সমস্ত আলেমদের দিকে নিজেকে সোপর্দ করবে যারা পূর্বে চলে গেছেন। বিশেষভাবে যাদের সাথে কুরুনে সালাসাহ (নেককারদের তিনটি যুগ)-এর সম্পর্ক রয়েছে। যাদের হিদায়াত, কামিয়াবী ও শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য স্বয়ং নবী (স) থেকে প্রমাণিত। তাদের দিকে নিজেকে সোপর্দ করার দাবি হল, তাদের মাধ্যমে পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করা। কেননা তাদের মধ্যে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সম্পৃক্তার নিদর্শন পাওয়া যায়।
আসুন আমরা পুনরায় আয়াতটির প্রসঙ্গে আসি। وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ ‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই কাফির।’’ [.সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।] এই আয়াতটির فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ বাক্যটির উদ্দেশ্য কি-
১.সম্পূর্ণভাবে ইসলাম থেকে খারিজ (বহিষ্কার) হয়ে যাওয়া?
২.নাকি এর অর্থ- কখনো ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া, আবার কখনো ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া থেকে কিছু কম?
এ পর্যায়ে আয়াতটি কিছুক্ষণ গভীরভাবে লক্ষ করুন। কেননা আয়াতটির فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ বাক্যটির দ্বারা কখনো ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। আবার কখনো এর উদ্দেশ্য হল, আমলগত দিক থেকে কোন আহকামের ব্যাপারে ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া। এর সহীহ তাফসীরের ব্যাপারে আমাদেরকে যা সহযোগিতা করবে তা হল, নবী (স)-এর ঘোষিত মুফাসসির সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা)-এর বিশ্লেষণ। কেননা, কিছু গোমরাহ ফিরক্বা ছাড়া সবাই একমত যে সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা) ছিলেন তাফসীরের ব্যাপারে ইমাম। আর এ কারণেই আমার জানা মতে সম্ভবত, সাহাবী ইবনু মাসউদ (রা) তাঁকে ‘তরজামানুল কুরআন’ উপাধি দিয়েছেন।
এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, এই তাফসীর সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রা) সে সময় এমন কোন কথা শুনেছিলেন- যা আজকাল আমরা শুনছি। অর্থাৎ তখন এমন কিছু লোক ছিল যারা আয়াতটির যাহেরী (প্রকাশ্য) অর্থ গ্রহণ করত। আর যে ব্যাখ্যার প্রতি আমি এখন ইঙ্গিত করছি তা তারা অস্বীকার করত। অর্থাৎ কখনোই এটা যাহেরী অর্থ (কাফির অর্থ- মুরতাদ হওয়া) হবে না, বরং কখনো কখনো এর থেকে কম স্তরের কুফরও উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এ জন্যে ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন :
ليس الكفر الذي تذهبون إليه وإنه ليس كفرا ينقل عن الْملة وهو كفر دون كفر
‘‘এটা ঐ কুফর নয়, যার দিকে এরা (খারেজীরা) গিয়েছে। এটা ঐ কুফর নয়, যা মিল্লাতে ইসলামিয়া থেকে খারিজ করে দেয়। বরং كفر دون كفر ‘‘(চূড়ান্ত) কুফরের থেকে কম কুফর’’। [.সহীহ : এটা ইমাম হাকিম (রহ) বর্ণনা করেছেন (২/৩১৩) এবং বলেছেন : ‘সহীহুল ইসনাদ’। আর ইমাম যাহাবী (রহ) চুপ থেকেছেন। আর তাদের দু’জনের সমন্বয়ে হক্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ তাদের উক্তি : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’ দ্বারা হাদীসটি উক্ত মর্যাদাই উন্নীত হয়। অতঃপর আমি এটাও দেখলাম যে, হাফিয ইবনু কাসির (রহ) তাঁর তাফসীরে (৬/১৬৩) হাকিম থেকে বর্ণনা করার পর বলেছেন : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’। [সিলসিলাতুল আহাদীসুস সাহীহাহ ৬/২৭০৪ নং হাদীস]বর্ণনাটির উপর আপত্তি হল, এর সনদে হিশাম বিন হুজায়র মাক্কী আছেন। যাকে ইয়াহইয়া বিন ক্বত্তান (রহ), ইবনু মাঈন (রহ) ও ইমাম আহমাদ (রহ) যঈফ বলেছেন।এর জবাব হল, হিশাম বিন হুজায়রকে যারা সিক্বাহ ও গ্রহণযোগ্য বলেছেন মুহাদ্দিসদের মধ্যে তারাই সংখ্যাধিক্য। ফলে সনদটি হাসান স্তরের। তাদের কয়েকজনের মন্তব্য : ইমাম বুখারী (রহ) তাঁর সহীহ বুখারীতে (হা/৬৭২০) হিশামের বর্ণনা ‘শপথের কাফফারা অধ্যায়ে’ এনেছেন। আর সহীহ বুখারী ‘সহীহ’র উপর অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণের ইজমা‘ রয়েছে। সুতরাং বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বিশেষ মুহাদ্দিসের তার প্রতি আপত্তি এক্ষেত্রে বাতিল হয়। সহীহ মুসলিমে হিশাম বিন হুজায়র (রহ)-এর একাধিক বর্ণনা রয়েছে। দ্র :মুক্বাদ্দামা : باب النَّهْىِ عَنِ الرِّوَايَةِ، عَنِ الضُّعَفَاءِ، وَالاِحْتِيَاطِ، فِي تَحَمُّلِهَا (পরিচ্ছেদ-৪ : যঈফ রাবীর হাদীস বর্ণনা করা নিষিদ্ধ এবং হাদীস সংগ্রহের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা)- এখানে হিশাম থেকে দুটি বর্ণনা রয়েছে।] তা ছাড়া আরও দুটি বর্ণনা রয়েছে : হা/২৯১১ (২০৯/১২৪৬)- হজ্জ অধ্যায়, হা/৪১৭৮ (২৩/১৬৫৪) - শপথ অধ্যায়] ইবনু শিবরামা (রহ) বলেন : ليس بمكة مثله (হিশামের সাথে তুলনীয় কেউ মক্কাতে ছিল না) [আহমাদ বিন হাম্বল, আল-জামিউ লিউলূমির রিজাল পৃ. ৩৪৩] ইবনু মাঈন (রহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে : তিনি সালিহ (নেককার) ছিলেন। ...ইমাম আবূ হাতিম (রহ) বলেন : তার হাদীস লেখা হয়। [আবূ হাতিম রাযী, আল-জারাহ ও তা‘দিল] যাহাবী (রহ) বলেন : ইমাম আহমাদ তাকে যঈফ বলেছেন আর অন্যরা তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন উসমান যাহাবী, যাকারু আসমাউ মান তাকাল্লামা ফীহি ওয়া হুয়া মাওসুকুন ১/১৮৭ পৃ. ৩৫৫ নং] আজলী (রহ) তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [উক্বদুস সামিন ফী তারিখিল বালাদিল আমীন ৬/১৭৯-১৮০, ২৬৩৭ নং]অর্থাৎ অল্প কয়েকজন হিশাম বিন হুজায়রের প্রতি আপত্তি করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাকে গ্রহণ করেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ। তা ছাড়া অন্য সনদে হিশাম ছাড়াও অন্য রাবী রয়েছে। ফলে হিশাম বর্ণনা এক্ষেত্রে একক নয়। [বাংলা অনুবাদক]]
এই আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে এটাই সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত জবাব। এছাড়া অন্যান্য দলিল যেখানে কুফর শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোও এই মর্মটি ছাড়া অনুধাবন করা সম্ভব নয়- যে ব্যাপারে আমি আমার আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। [.উর্দু অনুবাদকের টীকা : শায়েখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসায়মীন (রহ) ইমাম আলবানী (রহ)-এর আলোচ্য উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন : শায়েখ আলবানী (রহ) ইবনু আব্বাস (রা)-এর এই আসারটি দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন। এমনকি তিনি ছাড়াও অনেক আলেমে দ্বীনও এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে এর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। যদিও হাদীসের সনদটির ব্যাপারে কিছু অভিযোগ আছে, কিন্তু সমস্ত আলেম দলিলটির ব্যাপকতার ভিত্তিতে প্রকৃত মর্মের আলোকে এটির গ্রতি গুরুত্বারোপ করে গ্রহণ করেছেন। কেননা নবী (স) এর বাণী : سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه ও كُفْرٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪] এতদ্বসত্ত্বেও মুসলিমদের সাথে ক্বিতাল করা দ্বীন থেকে খারিজ করে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন : وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ‘‘মু’মিনদের দুই দল ক্বিতালে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেবে’’ (সূরা হুজুরাত : ৯ আয়াত)। এবং إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ‘‘মু‘মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তাদের ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো ’’ (সূরা হুজুরাত : ১০ আযাত)। এরপরেও তাকফীরের ফিতনায় নিমজ্জিত ব্যক্তিগণ এই বিষয়টির বিরোধিতা করেন। তারা বলেন : এই আসারটি গায়ের মাক্ববুল এবং ইবনু আব্বাস (রা) থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। আমি তাদের জবাবে বলছি : এটা কিভাবে সহীহ নয়? যখন উক্ত বড় বড় আলেম, যারা তোমাদের থেকে অনেক বড়, বেশি সম্মানিত ও হাদীসের ব্যাপারে অনেক বেশি বিজ্ঞ! তারা হাদীসটিকে গ্রহণ করেছেন, অথচ তোমরা বলছ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়!!আমাদের জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, শীর্ষস্থানীয় আলেম যেমন ইমাম ইবনু তাইমিয়া ও ইবনু ক্বাইয়েম (রহ) প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই এটাকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ক্ববুল করেছেন, এর উপর আলোচনা করেছেন ও এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সুতরাং প্রমাণিত হল, আসারটি সহীহ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, ইবনু আব্বাসের আসারটি সহীহ নয় তবুও আমাদের কাছে এমন অনেক সহীহ দলিল রয়েছে যা এর সমর্থন করে যে, কুফর কখনো এমনও হয় যা দ্বীন থেকে খারিজ করে না। যেভাবে পূর্বোক্ত আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। কিংবা রসূলুল্লাহ (স) -এর বাণী : اثْنَتَان في النَّاسِ هُمَا بهم كُفْرٌ : الطَّعْنُ فِي النَّسَبِ ، وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ ‘‘দু’টি বিষয় মানুষের মধ্যে রয়েছে, যা তাদের জন্য কুফর :১.বংশ নিয়ে খোঁটা দেওয়া,২.মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা। [সহীহ মুসলিম, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব (ইফা)৪/৩৫৬ পৃ.]নিঃসন্দেহে এই আমল মুসলিমকে ইসলাম থেকে খারিজ করে না। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে এবং সম্মানিত আলেমদের অনুসরণের বদলে অন্য পথের অনুসরণের মধ্যে দিয়ে তা ঘটে থাকে- যেভাবে আলবানী (রহ) শুরুতে উল্লেখ করেছেন।এখন আমি অপর একটি বিষয় সুস্পষ্ট করতে চাই। খারাপ নিয়্যাত খারাপ উপলব্ধির প্রতিক্রিয়া। কেননা যখন মানুষ কোন কিছুর নিয়্যাত করে তখন তার উপলব্ধি তার নিয়্যাতের দিকেই বাধ্যতামূলকভাবে ঝুঁকে পড়ে। আর এ কারণে তারা দলিল বিকৃতি করতেও কুন্ঠাবোধ করে না।কেননা আলেমদের প্রসিদ্ধ নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, তারা বলেছেন : استدل ثُم اعتقد ‘‘দলিল খোঁজ, অতঃপর সে মোতাবেক আক্বীদা বানাও।’’ অথচ তাদের মধ্যে এটা নেই। বরং তারা যেন এমন : ‘‘প্রথমে একটি আক্বীদা পোষণ কর অতঃপর দলিলকে সে দিকে লক্ষ্য করে উপস্থাপন কর। যার ফলাফল হল গোমরাহ হয়ে যাও।’’ এর কারণ তিনটি : (ক) ইলমের দৈন্যতা, (খ) শরীয়াতের ব্যাপক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে দুর্বল উপলব্ধি, ও (গ) খারাপ উপলব্ধি- যার ফলে খারাপ নিয়্যাত ও উদ্দেশ্যের রচনা হয়।]
‘কুফর’ শব্দটি অনেক দলিলেই উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কুফরে আকবার অর্থে আসেনি। কেননা যে সব আমলের ক্ষেত্রে ‘কুফর’ শব্দটি ঐ সব দলিলে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না। [.উর্দূ অনুবাদকের টিকা : শায়েখ উসামীন (রহ) একজন প্রশ্নকারীর উত্তরে বলেছিলেন : ‘‘খারাপ মর্ম উদ্ধারকারীদের মধ্যে এই কথারও প্রচার রয়েছে যে, তারা শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) এর কথা সম্পৃক্ত করে যে : اذا أطلق الكفر فإنّما يراد به كفر أكبر ‘‘যদি কুফর সম্পর্কে বর্ণনা করা হয় তবে তা দ্বারা কুফরে আকবারই উদ্দেশ্য হবে।’’ ফলে তারা এই উক্তির আলোকে বর্ণিত أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ আয়াত দ্বারা তাকফীরের দলিল নিয়ে থাকে। কিন্তু এই আয়াতটির পক্ষে এমন কোন দলিল দ্বারা এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, এর দাবি الكفر (প্রকৃত / বড় কুফর)।অথচ তাঁর থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত যে, তিনি الكفر শব্দে যে ال -ইসমে মা‘রিফাসহ এসেছে তাকে, كفر শব্দ যা ইসমে নাকিরাহ দ্বারা এসেছে তা থেকে পৃথক করেছেন।অথচ বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে আমাদের কাছে هؤلاء الكافرون এবং هؤلاء كافرون (তারা কাফির) উভয়ই সমান। যার দাবি হল, এ কুফরও হতে পারে যা দ্বারা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ হয় না। আসল বিষয় হল, ফে‘ল (কর্মের) বৈশিষ্ট্যের সাথে, ফা‘য়েল (কর্তার) বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য। এর আলোকে আলোচ্য আয়াতটির যে ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে - حكم بغير ما انزل الله ‘‘আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান ছাড়া হুকুম/শাসন করা’’ এমন কুফর নয় যা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। কিন্তু এই কুফরটি আমলী কুফর- যা দ্বারা এ ধরনের হুকুমদানকারী সহীহ পথ থেকে খারিজ হয়ে যায়।আর এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই যে, ঐ সমস্ত মানবরচিত আইন কারো কাছ থেকে গ্রহণ করে তা দ্বারা নিজের দেশে ফায়সালা করা, কিংবা স্বয়ং নিজেই তা আবিষ্কার করে ঐ মানবরচিত (মনগড়া) আইন প্রতিষ্ঠিত করা (উভয়টিই একই)। প্রকৃতপক্ষে যে বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল, সেটা কি আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত আসমানী বিধানের বিরোধী হয় কি না?] ঐ সমস্ত দলিলের মধ্যে উদাহরণ স্বরূপ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের একটি প্রসিদ্ধ হাদীস উপস্থাপন করা যায়, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, নবী (স) বলেছেন :
سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه كُفْرٌ
‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪।]
আমার কাছে قِتَالُه كُفْرٌ বাক্যটি আরবি ভাষার একটি সূক্ষ্ম তত্ত্বগত ব্যাপার। কেননা যদি কেউ বলে : سِبَابُ الْمُسْلِمِ وَ قِتَالُه فُسُوْقٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ও হত্যা করা ফাসেক্বী’’ -এটিও একটি সঠিক বাক্য। কেননা ফিস্কও আল্লাহ তাআলা’র নাফরমানী তথা তাঁর ইতাআত থেকে খারিজ হওয়া। কিন্তু যেহেতু রসূলুল্লাহ (স) আরবি ব্যাকরণের ফাসাহাত ও বালাগাতে সর্বোন্নত ছিলেন। তাই তিনি (স) বলেছেন:
سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه كُفْرٌ
‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪।]
লক্ষ করুন, আমরা হাদীসে বর্ণিত ‘ فسق ’ শব্দটিকে পূর্ববর্তী দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতের তাফসীর হিসাবে ‘ فسق ’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। অর্থাৎ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই ফাসিক্ব।’’ [.সূরা মায়িদাহ : ৪৭ আয়াত।] তাহলে এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াত وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ এবং হাদীস سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেক্বী’’ -এ ব্যবহৃত ‘ فسق ’ শব্দটির দাবি কি একই হবে?
প্রকৃতপক্ষে ‘ فسق ’ শব্দটি ‘ كفر ’ শব্দটির পরিপূরক। যার দাবি হল ‘ كفر ’ শব্দটি কখনো ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়, আবার কখনো ‘ كفر ’ শব্দটির দাবি হল যা ইসলাম থেকে খারিজ করে না। অর্থাৎ এর দাবি হল, যা পূর্বে তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে كفر دون كفر (মূল কুফরের থেকে কম কুফর)। আর হাদীসটিও সেই দাবি করছে যে, এর অর্থ কখনো কুফরও হয়ে থাকে।
কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বলেছেন :
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ
‘‘মু’মিনদের দুই দল ক্বিতালে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেবে। আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা ক্বিতাল করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’’ [.সূরা হুজুরাত : ৯ আয়াত।]
এই আয়াতটিতে আমাদের রব বিদ্রোহী ফিরক্বার বর্ণনা দিয়েছেন যারা ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ তথা প্রকৃত মু’মিন দলের সাথে ক্বিতাল করে। কিন্তু তাদের প্রতি কুফরের হুকুম দেননি। অথচ হাদীসে বলা হয়েছে ‘‘মুসলিমকে হত্যা করা কুফর।’’ সুতরাং প্রমাণিত হল, ক্বিতাল কুফর কিন্তু এটি دون كفر (ছোট কুফর) যা ইবনু আব্বাস (রা) -এর পূর্ববর্তী আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।
ليس الكفر الذي تذهبون إليه وإنه ليس كفرا ينقل عن الْملة وهو كفر دون كفر
‘‘এটা ঐ কুফর নয়, যার দিকে এরা (খারেজীরা) গিয়েছে। এটা ঐ কুফর নয়, যা মিল্লাতে ইসলামিয়া থেকে খারিজ করে দেয়। বরং كفر دون كفر ‘‘(চূড়ান্ত) কুফরের থেকে কম কুফর’’। [.সহীহ : এটা ইমাম হাকিম (রহ) বর্ণনা করেছেন (২/৩১৩) এবং বলেছেন : ‘সহীহুল ইসনাদ’। আর ইমাম যাহাবী (রহ) চুপ থেকেছেন। আর তাদের দু’জনের সমন্বয়ে হক্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ তাদের উক্তি : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’ দ্বারা হাদীসটি উক্ত মর্যাদাই উন্নীত হয়। অতঃপর আমি এটাও দেখলাম যে, হাফিয ইবনু কাসির (রহ) তাঁর তাফসীরে (৬/১৬৩) হাকিম থেকে বর্ণনা করার পর বলেছেন : على شرط الشيخين ‘‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী’’। [সিলসিলাতুল আহাদীসুস সাহীহাহ ৬/২৭০৪ নং হাদীস]বর্ণনাটির উপর আপত্তি হল, এর সনদে হিশাম বিন হুজায়র মাক্কী আছেন। যাকে ইয়াহইয়া বিন ক্বত্তান (রহ), ইবনু মাঈন (রহ) ও ইমাম আহমাদ (রহ) যঈফ বলেছেন।এর জবাব হল, হিশাম বিন হুজায়রকে যারা সিক্বাহ ও গ্রহণযোগ্য বলেছেন মুহাদ্দিসদের মধ্যে তারাই সংখ্যাধিক্য। ফলে সনদটি হাসান স্তরের। তাদের কয়েকজনের মন্তব্য : ইমাম বুখারী (রহ) তাঁর সহীহ বুখারীতে (হা/৬৭২০) হিশামের বর্ণনা ‘শপথের কাফফারা অধ্যায়ে’ এনেছেন। আর সহীহ বুখারী ‘সহীহ’র উপর অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণের ইজমা‘ রয়েছে। সুতরাং বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বিশেষ মুহাদ্দিসের তার প্রতি আপত্তি এক্ষেত্রে বাতিল হয়। সহীহ মুসলিমে হিশাম বিন হুজায়র (রহ)-এর একাধিক বর্ণনা রয়েছে। দ্র :মুক্বাদ্দামা : باب النَّهْىِ عَنِ الرِّوَايَةِ، عَنِ الضُّعَفَاءِ، وَالاِحْتِيَاطِ، فِي تَحَمُّلِهَا (পরিচ্ছেদ-৪ : যঈফ রাবীর হাদীস বর্ণনা করা নিষিদ্ধ এবং হাদীস সংগ্রহের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা)- এখানে হিশাম থেকে দুটি বর্ণনা রয়েছে।] তা ছাড়া আরও দুটি বর্ণনা রয়েছে : হা/২৯১১ (২০৯/১২৪৬)- হজ্জ অধ্যায়, হা/৪১৭৮ (২৩/১৬৫৪) - শপথ অধ্যায়] ইবনু শিবরামা (রহ) বলেন : ليس بمكة مثله (হিশামের সাথে তুলনীয় কেউ মক্কাতে ছিল না) [আহমাদ বিন হাম্বল, আল-জামিউ লিউলূমির রিজাল পৃ. ৩৪৩] ইবনু মাঈন (রহ) থেকে বর্ণিত হয়েছে : তিনি সালিহ (নেককার) ছিলেন। ...ইমাম আবূ হাতিম (রহ) বলেন : তার হাদীস লেখা হয়। [আবূ হাতিম রাযী, আল-জারাহ ও তা‘দিল] যাহাবী (রহ) বলেন : ইমাম আহমাদ তাকে যঈফ বলেছেন আর অন্যরা তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন উসমান যাহাবী, যাকারু আসমাউ মান তাকাল্লামা ফীহি ওয়া হুয়া মাওসুকুন ১/১৮৭ পৃ. ৩৫৫ নং] আজলী (রহ) তাকে সিক্বাহ বলেছেন। [উক্বদুস সামিন ফী তারিখিল বালাদিল আমীন ৬/১৭৯-১৮০, ২৬৩৭ নং]অর্থাৎ অল্প কয়েকজন হিশাম বিন হুজায়রের প্রতি আপত্তি করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস তাকে গ্রহণ করেছেন। ফালিল্লাহিল হামদ। তা ছাড়া অন্য সনদে হিশাম ছাড়াও অন্য রাবী রয়েছে। ফলে হিশাম বর্ণনা এক্ষেত্রে একক নয়। [বাংলা অনুবাদক]]
এই আয়াতটির তাফসীর প্রসঙ্গে এটাই সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত জবাব। এছাড়া অন্যান্য দলিল যেখানে কুফর শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোও এই মর্মটি ছাড়া অনুধাবন করা সম্ভব নয়- যে ব্যাপারে আমি আমার আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। [.উর্দু অনুবাদকের টীকা : শায়েখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসায়মীন (রহ) ইমাম আলবানী (রহ)-এর আলোচ্য উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন : শায়েখ আলবানী (রহ) ইবনু আব্বাস (রা)-এর এই আসারটি দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন। এমনকি তিনি ছাড়াও অনেক আলেমে দ্বীনও এর প্রতি গুরুত্বারোপ করে এর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। যদিও হাদীসের সনদটির ব্যাপারে কিছু অভিযোগ আছে, কিন্তু সমস্ত আলেম দলিলটির ব্যাপকতার ভিত্তিতে প্রকৃত মর্মের আলোকে এটির গ্রতি গুরুত্বারোপ করে গ্রহণ করেছেন। কেননা নবী (স) এর বাণী : سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه ও كُفْرٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪] এতদ্বসত্ত্বেও মুসলিমদের সাথে ক্বিতাল করা দ্বীন থেকে খারিজ করে না। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন : وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ‘‘মু’মিনদের দুই দল ক্বিতালে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেবে’’ (সূরা হুজুরাত : ৯ আয়াত)। এবং إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ‘‘মু‘মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তাদের ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো ’’ (সূরা হুজুরাত : ১০ আযাত)। এরপরেও তাকফীরের ফিতনায় নিমজ্জিত ব্যক্তিগণ এই বিষয়টির বিরোধিতা করেন। তারা বলেন : এই আসারটি গায়ের মাক্ববুল এবং ইবনু আব্বাস (রা) থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। আমি তাদের জবাবে বলছি : এটা কিভাবে সহীহ নয়? যখন উক্ত বড় বড় আলেম, যারা তোমাদের থেকে অনেক বড়, বেশি সম্মানিত ও হাদীসের ব্যাপারে অনেক বেশি বিজ্ঞ! তারা হাদীসটিকে গ্রহণ করেছেন, অথচ তোমরা বলছ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়!!আমাদের জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, শীর্ষস্থানীয় আলেম যেমন ইমাম ইবনু তাইমিয়া ও ইবনু ক্বাইয়েম (রহ) প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই এটাকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ক্ববুল করেছেন, এর উপর আলোচনা করেছেন ও এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সুতরাং প্রমাণিত হল, আসারটি সহীহ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, ইবনু আব্বাসের আসারটি সহীহ নয় তবুও আমাদের কাছে এমন অনেক সহীহ দলিল রয়েছে যা এর সমর্থন করে যে, কুফর কখনো এমনও হয় যা দ্বীন থেকে খারিজ করে না। যেভাবে পূর্বোক্ত আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। কিংবা রসূলুল্লাহ (স) -এর বাণী : اثْنَتَان في النَّاسِ هُمَا بهم كُفْرٌ : الطَّعْنُ فِي النَّسَبِ ، وَالنِّيَاحَةُ عَلَى الْمَيِّتِ ‘‘দু’টি বিষয় মানুষের মধ্যে রয়েছে, যা তাদের জন্য কুফর :১.বংশ নিয়ে খোঁটা দেওয়া,২.মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা। [সহীহ মুসলিম, আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব (ইফা)৪/৩৫৬ পৃ.]নিঃসন্দেহে এই আমল মুসলিমকে ইসলাম থেকে খারিজ করে না। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে এবং সম্মানিত আলেমদের অনুসরণের বদলে অন্য পথের অনুসরণের মধ্যে দিয়ে তা ঘটে থাকে- যেভাবে আলবানী (রহ) শুরুতে উল্লেখ করেছেন।এখন আমি অপর একটি বিষয় সুস্পষ্ট করতে চাই। খারাপ নিয়্যাত খারাপ উপলব্ধির প্রতিক্রিয়া। কেননা যখন মানুষ কোন কিছুর নিয়্যাত করে তখন তার উপলব্ধি তার নিয়্যাতের দিকেই বাধ্যতামূলকভাবে ঝুঁকে পড়ে। আর এ কারণে তারা দলিল বিকৃতি করতেও কুন্ঠাবোধ করে না।কেননা আলেমদের প্রসিদ্ধ নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, তারা বলেছেন : استدل ثُم اعتقد ‘‘দলিল খোঁজ, অতঃপর সে মোতাবেক আক্বীদা বানাও।’’ অথচ তাদের মধ্যে এটা নেই। বরং তারা যেন এমন : ‘‘প্রথমে একটি আক্বীদা পোষণ কর অতঃপর দলিলকে সে দিকে লক্ষ্য করে উপস্থাপন কর। যার ফলাফল হল গোমরাহ হয়ে যাও।’’ এর কারণ তিনটি : (ক) ইলমের দৈন্যতা, (খ) শরীয়াতের ব্যাপক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে দুর্বল উপলব্ধি, ও (গ) খারাপ উপলব্ধি- যার ফলে খারাপ নিয়্যাত ও উদ্দেশ্যের রচনা হয়।]
‘কুফর’ শব্দটি অনেক দলিলেই উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কুফরে আকবার অর্থে আসেনি। কেননা যে সব আমলের ক্ষেত্রে ‘কুফর’ শব্দটি ঐ সব দলিলে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না। [.উর্দূ অনুবাদকের টিকা : শায়েখ উসামীন (রহ) একজন প্রশ্নকারীর উত্তরে বলেছিলেন : ‘‘খারাপ মর্ম উদ্ধারকারীদের মধ্যে এই কথারও প্রচার রয়েছে যে, তারা শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) এর কথা সম্পৃক্ত করে যে : اذا أطلق الكفر فإنّما يراد به كفر أكبر ‘‘যদি কুফর সম্পর্কে বর্ণনা করা হয় তবে তা দ্বারা কুফরে আকবারই উদ্দেশ্য হবে।’’ ফলে তারা এই উক্তির আলোকে বর্ণিত أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ আয়াত দ্বারা তাকফীরের দলিল নিয়ে থাকে। কিন্তু এই আয়াতটির পক্ষে এমন কোন দলিল দ্বারা এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, এর দাবি الكفر (প্রকৃত / বড় কুফর)।অথচ তাঁর থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত যে, তিনি الكفر শব্দে যে ال -ইসমে মা‘রিফাসহ এসেছে তাকে, كفر শব্দ যা ইসমে নাকিরাহ দ্বারা এসেছে তা থেকে পৃথক করেছেন।অথচ বৈশিষ্ট্যের দিকে থেকে আমাদের কাছে هؤلاء الكافرون এবং هؤلاء كافرون (তারা কাফির) উভয়ই সমান। যার দাবি হল, এ কুফরও হতে পারে যা দ্বারা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ হয় না। আসল বিষয় হল, ফে‘ল (কর্মের) বৈশিষ্ট্যের সাথে, ফা‘য়েল (কর্তার) বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য। এর আলোকে আলোচ্য আয়াতটির যে ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে - حكم بغير ما انزل الله ‘‘আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান ছাড়া হুকুম/শাসন করা’’ এমন কুফর নয় যা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। কিন্তু এই কুফরটি আমলী কুফর- যা দ্বারা এ ধরনের হুকুমদানকারী সহীহ পথ থেকে খারিজ হয়ে যায়।আর এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই যে, ঐ সমস্ত মানবরচিত আইন কারো কাছ থেকে গ্রহণ করে তা দ্বারা নিজের দেশে ফায়সালা করা, কিংবা স্বয়ং নিজেই তা আবিষ্কার করে ঐ মানবরচিত (মনগড়া) আইন প্রতিষ্ঠিত করা (উভয়টিই একই)। প্রকৃতপক্ষে যে বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে তা হল, সেটা কি আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত আসমানী বিধানের বিরোধী হয় কি না?] ঐ সমস্ত দলিলের মধ্যে উদাহরণ স্বরূপ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের একটি প্রসিদ্ধ হাদীস উপস্থাপন করা যায়, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, নবী (স) বলেছেন :
سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه كُفْرٌ
‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪।]
আমার কাছে قِتَالُه كُفْرٌ বাক্যটি আরবি ভাষার একটি সূক্ষ্ম তত্ত্বগত ব্যাপার। কেননা যদি কেউ বলে : سِبَابُ الْمُسْلِمِ وَ قِتَالُه فُسُوْقٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ও হত্যা করা ফাসেক্বী’’ -এটিও একটি সঠিক বাক্য। কেননা ফিস্কও আল্লাহ তাআলা’র নাফরমানী তথা তাঁর ইতাআত থেকে খারিজ হওয়া। কিন্তু যেহেতু রসূলুল্লাহ (স) আরবি ব্যাকরণের ফাসাহাত ও বালাগাতে সর্বোন্নত ছিলেন। তাই তিনি (স) বলেছেন:
سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ وَ قِتَالُه كُفْرٌ
‘‘মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেক্বী, আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৪৮, সহীহ মুসলিম ১২৪ (১১৬/৬৪), তাহক্বীক্ব মিশকাত ৪৮১৪।]
লক্ষ করুন, আমরা হাদীসে বর্ণিত ‘ فسق ’ শব্দটিকে পূর্ববর্তী দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতের তাফসীর হিসাবে ‘ فسق ’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। অর্থাৎ وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন দ্বারা বিচার করে না, তারাই ফাসিক্ব।’’ [.সূরা মায়িদাহ : ৪৭ আয়াত।] তাহলে এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াত وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ এবং হাদীস سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ ‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেক্বী’’ -এ ব্যবহৃত ‘ فسق ’ শব্দটির দাবি কি একই হবে?
প্রকৃতপক্ষে ‘ فسق ’ শব্দটি ‘ كفر ’ শব্দটির পরিপূরক। যার দাবি হল ‘ كفر ’ শব্দটি কখনো ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়, আবার কখনো ‘ كفر ’ শব্দটির দাবি হল যা ইসলাম থেকে খারিজ করে না। অর্থাৎ এর দাবি হল, যা পূর্বে তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে كفر دون كفر (মূল কুফরের থেকে কম কুফর)। আর হাদীসটিও সেই দাবি করছে যে, এর অর্থ কখনো কুফরও হয়ে থাকে।
কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বলেছেন :
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ
‘‘মু’মিনদের দুই দল ক্বিতালে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেবে। আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা ক্বিতাল করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’’ [.সূরা হুজুরাত : ৯ আয়াত।]
এই আয়াতটিতে আমাদের রব বিদ্রোহী ফিরক্বার বর্ণনা দিয়েছেন যারা ফিরক্বায়ে নাজিয়াহ তথা প্রকৃত মু’মিন দলের সাথে ক্বিতাল করে। কিন্তু তাদের প্রতি কুফরের হুকুম দেননি। অথচ হাদীসে বলা হয়েছে ‘‘মুসলিমকে হত্যা করা কুফর।’’ সুতরাং প্রমাণিত হল, ক্বিতাল কুফর কিন্তু এটি دون كفر (ছোট কুফর) যা ইবনু আব্বাস (রা) -এর পূর্ববর্তী আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে।
মুসলিম কর্তৃক মুসলিমের সাথে ক্বিতাল করা বর্বরতা, চরমপন্থা, ফিসক্ব ও কুফর। কিন্তু এই ব্যাখ্যাসহ যে, কখনো তা কুফরে আমালী (আমলগত কুফর) আবার কখনো কুফরে ই‘তিক্বাদী (আক্বীদা/বিশ্বাসগত কুফর)। এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু উক্ত সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ দু’টির মধ্যেই রয়েছে। যার ব্যাখ্যা (ইবনু আব্বাস (রা) -এর পরে) সত্যিকারের ইমাম শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ) এবং তাঁর একনিষ্ঠ ছাত্র ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম আল-যাওজি (রহ) করেছেন। কেননা তারা কুরআনের অর্থে কুফরের এই দু’ ধরনের বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ ও তাঁর ছাত্র হাফেয ইবনু ক্বাইয়েম (রহ) তাঁদের আলোচনার মধ্যে সব সময় ‘কুফরী আমালী’ ও ‘কুফরে ইতি‘ক্বাদী’-এর বিবরণ দিয়েছেন। কেননা, যদি এই পার্থক্যের দিকে লক্ষ্য রাখা না হয়, তবে মুসলিমরা অজ্ঞতাবশত মুসলিম জামাআত থেকে খারিজ হয়ে ঐ ফিতনার মধ্যে নিমজ্জিত হবে যার মধ্যে প্রাচীন যামানাতে খারেজীরা পতিত হয়েছিল। অতঃপর বর্তমান যামানাতেও কিছু লোক এ ফিতনার মধ্যে পড়েছে।
সুতরাং প্রকৃতপক্ষে ‘ قتاله كفر ’ এর অর্থ দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া নয়। এ মর্মে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা একত্রিত করলে একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব হত। কিন্তু এটা তাদের কাছে দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না যারা আলোচ্য আয়াতের তাফসীরটি কেবল ‘কুফরে ই‘তিক্বাদী’ অর্থে গ্রহণ করে থাকে। অথচ প্রকৃত সত্য হল, এর স্বপক্ষে এত অধিক সংখ্যক দলিল রয়েছে যেখানে ‘ الكفر ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর দাবি কখনই এটা নয় যে, সম্পূর্ণ ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া। এই মুহূর্তে আমাদের এই দলিলটিই খণ্ডনের জন্য যথেষ্ট যে, এক মুসলিম অপর মুসলিমকে হত্যা করা ‘কুফরে আমালী’ এবং কখনই এটা ‘কুফরে ই‘তিক্বাদী’ (আক্বীদাগত কুফর) নয়। [.এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) থেকে সুস্পষ্ট হাদীসও আছে। উবাদা ইবনু সামিত (স) বলেছেন كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِى مَجْلِسٍ فَقَالَ تُبَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَعُوقِبَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَسَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ فَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ .‘‘আমরা কোন বৈঠকে রসূলুল্লাহ (স)-এর সঙ্গে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন : তোমরা আমার কাছে এ বলে বায়য়াত গ্রহণ কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেনা, যিনা করবে না, চুরি করবে না এবং কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে (অর্থাৎ ক্বিসাসের কারণে)। অতএব, তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তা পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাবে। আর যদি কেউ উক্ত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে, তবে তাই তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যদি কোন ব্যক্তি উল্লিখিত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয় অতঃপর আল্লাহ তাআলা তা গোপন রাখেন, তবে বিষয়টি মহান আল্লাহ’র এখতিয়ারে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩৫৫ (৪৩/১৭০৯)- কিতাবুল হুদূদ باب الحدود كفارات لاهلها ] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে : উবাদা (রা) বলেন : আমরা এ সকল কথার উপর তাঁর হাতে বায়য়াত করলাম।’’ [সহীহ বুখারী ১৮, সহীহ মুসলিম ৪৩৫৩ (৪১/১৭০৯), মিশকাত ১৮][-বাংলা অনুবাদক]]
এখন আমি জামাআতুত তাকফীর ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তথা শাসক, অধীনস্থ সাধারণ জনগণ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করব যারা ঐ হুকুমাতের অধীনে কাজ ও চাকরি করার কারণে তাকফীরের শিকার হচ্ছেন। [.সাহাবী আবূ সাঈদ ও আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন ليأتين عليكم أمراء يقربون شرار الناس ويؤخرون الصلاة عن مواقيتها فمن أدرك ذلك منكم فلا يكونن عريفا ولا شرطيا ولا جابيا ولا خازنا ‘‘অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই তোমাদের উপর এমন আমীর (শাসক) হবে, যারা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোকদের নিজের কাছে টেনে নেবে এবং তারা সালাতের ওয়াক্ত গড়িয়ে যাওয়ার পর তা আদায় করবে। এই সময় তোমাদের কেউ জীবিত থাকলে সে যেন তত্ত্বাবধায়ক, পুলিশ, যাকাতের সম্পদ আদায়কারী ও খাজাঞ্চী নিযুক্ত না হয়।’’ [সহীহ ইবনু হিব্বান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (ইফা) ১/৫৫৭ পৃ.; হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন - ইমাম হায়সামী (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৫/৯২২৫ নং), হুসাইন সালীম আসাদ (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আবী ইয়ালা ২/১১১৫ নং) ও মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (আস-সাহীহাহ ১/৩৬০ নং)। [বাংলা অনুবাদক]] অর্থাৎ তাদের অধীনতার পাপের কারণে কাফির বলা হচ্ছে। [.আমরা আল্লাহর কাছে (মুসলিমদেরকে তাকফির করার ব্যাপারে) ক্ষমা চাচ্ছি - শায়েখ উসায়মীন। [উর্দূ অনুবাদক]]
সুতরাং প্রকৃতপক্ষে ‘ قتاله كفر ’ এর অর্থ দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ হওয়া নয়। এ মর্মে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা একত্রিত করলে একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব হত। কিন্তু এটা তাদের কাছে দলিল হিসাবে গ্রহণযোগ্য হবে না যারা আলোচ্য আয়াতের তাফসীরটি কেবল ‘কুফরে ই‘তিক্বাদী’ অর্থে গ্রহণ করে থাকে। অথচ প্রকৃত সত্য হল, এর স্বপক্ষে এত অধিক সংখ্যক দলিল রয়েছে যেখানে ‘ الكفر ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এর দাবি কখনই এটা নয় যে, সম্পূর্ণ ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া। এই মুহূর্তে আমাদের এই দলিলটিই খণ্ডনের জন্য যথেষ্ট যে, এক মুসলিম অপর মুসলিমকে হত্যা করা ‘কুফরে আমালী’ এবং কখনই এটা ‘কুফরে ই‘তিক্বাদী’ (আক্বীদাগত কুফর) নয়। [.এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) থেকে সুস্পষ্ট হাদীসও আছে। উবাদা ইবনু সামিত (স) বলেছেন كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِى مَجْلِسٍ فَقَالَ تُبَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَعُوقِبَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ وَمَنْ أَصَابَ شَيْئًا مِنْ ذَلِكَ فَسَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ فَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَإِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ .‘‘আমরা কোন বৈঠকে রসূলুল্লাহ (স)-এর সঙ্গে বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন : তোমরা আমার কাছে এ বলে বায়য়াত গ্রহণ কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেনা, যিনা করবে না, চুরি করবে না এবং কাউকে হত্যা করবে না, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে (অর্থাৎ ক্বিসাসের কারণে)। অতএব, তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ তা পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাবে। আর যদি কেউ উক্ত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয়ে শাস্তি ভোগ করে, তবে তাই তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যদি কোন ব্যক্তি উল্লিখিত অপরাধের কোন একটিতে পতিত হয় অতঃপর আল্লাহ তাআলা তা গোপন রাখেন, তবে বিষয়টি মহান আল্লাহ’র এখতিয়ারে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন এবং ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩৫৫ (৪৩/১৭০৯)- কিতাবুল হুদূদ باب الحدود كفارات لاهلها ] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে : উবাদা (রা) বলেন : আমরা এ সকল কথার উপর তাঁর হাতে বায়য়াত করলাম।’’ [সহীহ বুখারী ১৮, সহীহ মুসলিম ৪৩৫৩ (৪১/১৭০৯), মিশকাত ১৮][-বাংলা অনুবাদক]]
এখন আমি জামাআতুত তাকফীর ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তথা শাসক, অধীনস্থ সাধারণ জনগণ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করব যারা ঐ হুকুমাতের অধীনে কাজ ও চাকরি করার কারণে তাকফীরের শিকার হচ্ছেন। [.সাহাবী আবূ সাঈদ ও আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন ليأتين عليكم أمراء يقربون شرار الناس ويؤخرون الصلاة عن مواقيتها فمن أدرك ذلك منكم فلا يكونن عريفا ولا شرطيا ولا جابيا ولا خازنا ‘‘অদূর ভবিষ্যতে অবশ্যই তোমাদের উপর এমন আমীর (শাসক) হবে, যারা সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট লোকদের নিজের কাছে টেনে নেবে এবং তারা সালাতের ওয়াক্ত গড়িয়ে যাওয়ার পর তা আদায় করবে। এই সময় তোমাদের কেউ জীবিত থাকলে সে যেন তত্ত্বাবধায়ক, পুলিশ, যাকাতের সম্পদ আদায়কারী ও খাজাঞ্চী নিযুক্ত না হয়।’’ [সহীহ ইবনু হিব্বান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (ইফা) ১/৫৫৭ পৃ.; হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন - ইমাম হায়সামী (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৫/৯২২৫ নং), হুসাইন সালীম আসাদ (তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আবী ইয়ালা ২/১১১৫ নং) ও মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (আস-সাহীহাহ ১/৩৬০ নং)। [বাংলা অনুবাদক]] অর্থাৎ তাদের অধীনতার পাপের কারণে কাফির বলা হচ্ছে। [.আমরা আল্লাহর কাছে (মুসলিমদেরকে তাকফির করার ব্যাপারে) ক্ষমা চাচ্ছি - শায়েখ উসায়মীন। [উর্দূ অনুবাদক]]
আমি আলোচ্য কথাগুলো আমার কাছে প্রশ্নকারী ভাইদের কাছ থেকে পেয়েছি যারা পূর্বে জামাআতুত তাকফীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল, অতঃপর আল্লাহ তাদের হিদায়াত দিয়েছেন। আমি তাদের কাছে জানতে চাই, আপনারা অনেক হাকিম (শাসক)-কে কাফির গণ্য করেন। কিন্তু আপনারা ইমাম, খতীব, মুয়াজ্জিন ও মাসজিদের খাদেমদেরকেও তাকফীর কেন করেন? এমনকি আপনারা ইলমে শরীআতের উস্তাদ যারা বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করছেন তাদের প্রতিও তাকফীর করেন!!
তারা উত্তরে এটাই বলেন যে, কেননা এই লোকেরা ঐ হাকিম (শাসক) ও তাদের শাসনতন্ত্রের প্রতি রাযী, অথচ তা আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত শরীআতের বিরোধী।
আমি তাদের বলি : যদি এই রাযী বা সন্তুষ্টি আন্তরিকভাবে হয়ে থাকে তবে তো এই আমালী কুফর প্রকৃতপক্ষে ই‘তিক্বাদী কুফরে পরিণত হয়। সুতরাং যদি কোন হাকিম (শাসক/বিচারক) আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা না করে এবং এটা মনে করে যে, এই হুকুম বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশি উপযোগী। পক্ষান্তরে কুরআন ও সুন্নাতের বিধি-বিধান বর্তমান যামানার জন্য উপযোগী নয়, তবে নিঃসন্দেহে তার এই কুফর- কুফরে ই‘তিক্বাদী এবং কখনই তা কুফরে আমালী নয়। আর কেউ যদি এই ধারণার প্রতি রাযী বা সন্তুষ্ট থাকে তবে সে কাফির। [.এই আক্বীদা রাখা সত্ত্বেও লোকেরা আমাকে ‘যামানার মুরজিয়া’ (মুরজিয়াতুল আসর) বলে তুহমাত (অপবাদ) দেয়া শুরু করেছে- শায়েখ আলবানী। (উর্দু অনুবাদক)]
কিন্তু আপনারা যে সমস্ত শাসক পশ্চিমা আইন দ্বারা কম বা বেশি বিধান জারি করছে- তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা কখনই এটা বলবে না যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আইন দ্বারা শাসন চালানো জরুরি এবং ইসলাম অনুযায়ী শাসন চালান জায়েয নয়। বরং তারা এভাবেও বলবে না যে, আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী শাসন চালানোর সম্ভব হচ্ছে না। কেননা এটা বললে তারা নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যাবে।
এখন আমি যদি শাসিত প্রজাসাধারণ- যার মধ্যে উলামা ও নেককার ব্যক্তিগণ রয়েছেন তাদের প্রসঙ্গে আসি, সেক্ষেত্রেও বলব যে, আপনারা কেন তাদের প্রতি তাকফির করছেন? সম্ভবত এই কারণে যে, তারা ঐ হুকুমাতের অধীনে জীবন-যাপন করছে। অথচ ঐ হুকুমাতের অধীনে জীবন-যাপনের ব্যাপারে আপনারাও (জামাআতুত তাকফীর) হুবহু তাদেরই মত। পার্থক্য এতুটুকু যে, আপনারা শাসকদের কাফির ঘোষণা করছেন। পক্ষান্তরে আলেমগণ এটা বলছেন না যে, তারা দ্বীন থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে। বরং তারা বলেন : আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত শরীআত দ্বারা শাসন চালান ওয়াজিব এবং আমলগত কারণে কোনটির বিরোধিতার জন্য এটা জরুরি নয় যে, সেই আলেম বা হাকিম/শাসক দ্বীন ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হবে।
সংশয় : একবার বা কয়েকবার আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করলে কাফির হয় না। কিন্তু বারবার বা সবসময় আল্লাহ তাআলা’র বিধানের বিরোধী হুকুম জারি করলে কাফির হয়ে যায়।
বিতর্ককারীদের মধ্যে যাদের গোমরাহী ও ভুল-ত্রুটিগুলো সুস্পষ্ট হয়েছে, আমি তাদের একটি পক্ষকে জিজ্ঞাসা করি : আমরা কখন একজন কালেমায়ে শাহাদাতের ( اشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله ) দাবিদার যারা সালাতও আদায় করে তাদের দ্বীন থেকে মুরতাদ হিসাবে গণ্য করব?
মূলতঃ এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি একটি দিকে থাকবে। আর তা হল – আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা না করাই দ্বীন থেকে মুরতাদ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যদিও এই তাকফীরকারীরা নিজের মুখ থেকে এই জবাব দিবে না- তবে মূলত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই।
এই প্রশ্ন তাদের সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয় এবং তাদের থেকে কোন জবাব পাওয়া যায় না। তখন আমি তাদের নিম্নোক্ত উদাহরণটি উপস্থাপন করি যা তাদের নির্বাক করে দেয়। যেমন আমি তাদের বলেছি- ‘‘একজন হাকিম (শাসক/বিচারক) তিনি শরীআত মোতাবেক ফায়সালা করবেন এবং এটাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কোন একটি ফায়সালাতে তিনি বিচ্যূত হয়ে শরীআত বিরোধী ফায়সালা দেন- অর্থাৎ কোন যালিমকে হক্ব দিয়ে দিলেন এবং মাযলুমকে বঞ্চিত করলেন। বলুন তো- এটা কি ‘হুকুম বিগয়রি মা-আনযালাল্লাহ’ নয়?
আপনারা কি বলবেন সে কুফর তথা মুরতাদ হওয়ার কুফর করেছে?’’
তারা জবাব দিল : না।
আমি বললাম : কেন না, সে তো আল্লাহ’র শরীআতের বিরোধিতা করেছে।
তারা জবাব দিল : এটা তো কেবল একবার সংঘটিত হয়েছে।
আমি বললাম : খুব ভাল। যদি এই হাকিম দ্বারা দ্বিতীয়বার শরীআতের বিরোধিতা হয়, কিংবা ভিন্ন কোন ব্যাপারে সংঘটিত হয় যা শরীআতের বিরোধি- তাহলে সে কি কাফির হবে?
আমি তিন-চার বার তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, কখন তাকে কাফির বলব? তারা এর কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে পারল না যে, কতবার শরীআতের খেলাফ হলে সে কাফির বলে গণ্য হবে।
যখন আমি উক্ত বক্তব্যটি ভিন্নভাবে বললাম : যদি আপনারা এটা মনে করেন যে, সে একটি শরীআত বিরোধী হুকুমকে উত্তম হিসাবে অব্যাহত রাখে এবং ইসলামী হুকুমের অবমাননা প্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে আপনারা তার প্রতি মুরতাদের হুকুম লাগাতে পারেন। যখন অন্যক্ষেত্রে আপনারা তাকে শরীআতের বিরোধী ফায়সালা করতে দেখবেন তখন জিজ্ঞাসা করবেন- হে শায়খ! আপনি কেন আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী ফায়সালা করছেন? সে তখন ক্বসম করে বলবে- ‘‘আমি ভয়ে এটা করেছি বা নিজের প্রাণের হুমকি ছিল, কিংবা আমি ঘুষ নিয়েছে প্রভৃতি।’’ শেষোক্ত অজুহাতটি পূর্বের দু’টি থেকেও নিকৃষ্ট। এরপরেও আপনারা এটা বলতে পারেন না যে, সে কাফির- যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজেই ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ নিজের অন্তরের গোপন কুফর প্রকাশ করে, তথা যখন আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত হুকুম মোতাবেক ফায়সালা করা জায়েয নয় বলে মানে- কেবল তখনই আপনারা বলতে পারেন সে মুরতাদ-কাফির।
তারা উত্তরে এটাই বলেন যে, কেননা এই লোকেরা ঐ হাকিম (শাসক) ও তাদের শাসনতন্ত্রের প্রতি রাযী, অথচ তা আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত শরীআতের বিরোধী।
আমি তাদের বলি : যদি এই রাযী বা সন্তুষ্টি আন্তরিকভাবে হয়ে থাকে তবে তো এই আমালী কুফর প্রকৃতপক্ষে ই‘তিক্বাদী কুফরে পরিণত হয়। সুতরাং যদি কোন হাকিম (শাসক/বিচারক) আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান মোতাবেক ফায়সালা না করে এবং এটা মনে করে যে, এই হুকুম বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশি উপযোগী। পক্ষান্তরে কুরআন ও সুন্নাতের বিধি-বিধান বর্তমান যামানার জন্য উপযোগী নয়, তবে নিঃসন্দেহে তার এই কুফর- কুফরে ই‘তিক্বাদী এবং কখনই তা কুফরে আমালী নয়। আর কেউ যদি এই ধারণার প্রতি রাযী বা সন্তুষ্ট থাকে তবে সে কাফির। [.এই আক্বীদা রাখা সত্ত্বেও লোকেরা আমাকে ‘যামানার মুরজিয়া’ (মুরজিয়াতুল আসর) বলে তুহমাত (অপবাদ) দেয়া শুরু করেছে- শায়েখ আলবানী। (উর্দু অনুবাদক)]
কিন্তু আপনারা যে সমস্ত শাসক পশ্চিমা আইন দ্বারা কম বা বেশি বিধান জারি করছে- তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা কখনই এটা বলবে না যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আইন দ্বারা শাসন চালানো জরুরি এবং ইসলাম অনুযায়ী শাসন চালান জায়েয নয়। বরং তারা এভাবেও বলবে না যে, আল্লাহ’র নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী শাসন চালানোর সম্ভব হচ্ছে না। কেননা এটা বললে তারা নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যাবে।
এখন আমি যদি শাসিত প্রজাসাধারণ- যার মধ্যে উলামা ও নেককার ব্যক্তিগণ রয়েছেন তাদের প্রসঙ্গে আসি, সেক্ষেত্রেও বলব যে, আপনারা কেন তাদের প্রতি তাকফির করছেন? সম্ভবত এই কারণে যে, তারা ঐ হুকুমাতের অধীনে জীবন-যাপন করছে। অথচ ঐ হুকুমাতের অধীনে জীবন-যাপনের ব্যাপারে আপনারাও (জামাআতুত তাকফীর) হুবহু তাদেরই মত। পার্থক্য এতুটুকু যে, আপনারা শাসকদের কাফির ঘোষণা করছেন। পক্ষান্তরে আলেমগণ এটা বলছেন না যে, তারা দ্বীন থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে। বরং তারা বলেন : আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত শরীআত দ্বারা শাসন চালান ওয়াজিব এবং আমলগত কারণে কোনটির বিরোধিতার জন্য এটা জরুরি নয় যে, সেই আলেম বা হাকিম/শাসক দ্বীন ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হবে।
সংশয় : একবার বা কয়েকবার আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি না করলে কাফির হয় না। কিন্তু বারবার বা সবসময় আল্লাহ তাআলা’র বিধানের বিরোধী হুকুম জারি করলে কাফির হয়ে যায়।
বিতর্ককারীদের মধ্যে যাদের গোমরাহী ও ভুল-ত্রুটিগুলো সুস্পষ্ট হয়েছে, আমি তাদের একটি পক্ষকে জিজ্ঞাসা করি : আমরা কখন একজন কালেমায়ে শাহাদাতের ( اشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله ) দাবিদার যারা সালাতও আদায় করে তাদের দ্বীন থেকে মুরতাদ হিসাবে গণ্য করব?
মূলতঃ এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি একটি দিকে থাকবে। আর তা হল – আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা না করাই দ্বীন থেকে মুরতাদ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যদিও এই তাকফীরকারীরা নিজের মুখ থেকে এই জবাব দিবে না- তবে মূলত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই।
এই প্রশ্ন তাদের সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয় এবং তাদের থেকে কোন জবাব পাওয়া যায় না। তখন আমি তাদের নিম্নোক্ত উদাহরণটি উপস্থাপন করি যা তাদের নির্বাক করে দেয়। যেমন আমি তাদের বলেছি- ‘‘একজন হাকিম (শাসক/বিচারক) তিনি শরীআত মোতাবেক ফায়সালা করবেন এবং এটাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কোন একটি ফায়সালাতে তিনি বিচ্যূত হয়ে শরীআত বিরোধী ফায়সালা দেন- অর্থাৎ কোন যালিমকে হক্ব দিয়ে দিলেন এবং মাযলুমকে বঞ্চিত করলেন। বলুন তো- এটা কি ‘হুকুম বিগয়রি মা-আনযালাল্লাহ’ নয়?
আপনারা কি বলবেন সে কুফর তথা মুরতাদ হওয়ার কুফর করেছে?’’
তারা জবাব দিল : না।
আমি বললাম : কেন না, সে তো আল্লাহ’র শরীআতের বিরোধিতা করেছে।
তারা জবাব দিল : এটা তো কেবল একবার সংঘটিত হয়েছে।
আমি বললাম : খুব ভাল। যদি এই হাকিম দ্বারা দ্বিতীয়বার শরীআতের বিরোধিতা হয়, কিংবা ভিন্ন কোন ব্যাপারে সংঘটিত হয় যা শরীআতের বিরোধি- তাহলে সে কি কাফির হবে?
আমি তিন-চার বার তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, কখন তাকে কাফির বলব? তারা এর কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে পারল না যে, কতবার শরীআতের খেলাফ হলে সে কাফির বলে গণ্য হবে।
যখন আমি উক্ত বক্তব্যটি ভিন্নভাবে বললাম : যদি আপনারা এটা মনে করেন যে, সে একটি শরীআত বিরোধী হুকুমকে উত্তম হিসাবে অব্যাহত রাখে এবং ইসলামী হুকুমের অবমাননা প্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে আপনারা তার প্রতি মুরতাদের হুকুম লাগাতে পারেন। যখন অন্যক্ষেত্রে আপনারা তাকে শরীআতের বিরোধী ফায়সালা করতে দেখবেন তখন জিজ্ঞাসা করবেন- হে শায়খ! আপনি কেন আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধানের বিরোধী ফায়সালা করছেন? সে তখন ক্বসম করে বলবে- ‘‘আমি ভয়ে এটা করেছি বা নিজের প্রাণের হুমকি ছিল, কিংবা আমি ঘুষ নিয়েছে প্রভৃতি।’’ শেষোক্ত অজুহাতটি পূর্বের দু’টি থেকেও নিকৃষ্ট। এরপরেও আপনারা এটা বলতে পারেন না যে, সে কাফির- যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজেই ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ নিজের অন্তরের গোপন কুফর প্রকাশ করে, তথা যখন আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত হুকুম মোতাবেক ফায়সালা করা জায়েয নয় বলে মানে- কেবল তখনই আপনারা বলতে পারেন সে মুরতাদ-কাফির।
যাহোক আসল বক্তব্য হল, এ ব্যাপারে স্পষ্টতা অত্যন্ত জরুরি যে, ফিসক্ব ও যুলুমের ন্যায় কুফরও দুই ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম থেকে বহিষ্কারকারী কুফর, ফিসক্ব ও যুলুম তখনই বিবেচ্য হবে যখন ইস্তিহলালে ক্বলবী (আন্তরিকভাবে হারামকে হালাল জানা) সংঘটিত হবে। পক্ষান্তরে দ্বীন ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে না এমন কুফর, ফিসক্ব ও যুলুম তখনই বিবেচ্য হবে যখন ইস্তিহলালে আমালী (হারাম কাজে লিপ্ত কিন্তু আন্তরিকভাবে কাজটি হারাম হিসাবে বিবেচনা করা) সংঘটিত হবে।
সুতরাং ঐ সমস্ত গোনাহ যেমন- ইস্তিহলালে আমালি রিবা (আমলগতভাবে সুদের হালালকরণ), যা এ যামানায় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে- এ সবই আমালী কুফরের উদাহরণ। সুতরাং ঐ গোনাহগারদের কেবল এই পাপ ও ইস্তিহলালে আমালী ’র জন্যে কাফির বলা আমাদের জন্য জায়েয নয়। কেননা যা কিছু তাদের অন্তরে লুকায়িত আছে তা আমাদের কাছে এভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে, তারা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূল (স) কর্তৃক হারামকৃত বিষয়কে আক্বীদাগত ভাবে হালাল মনে করে না। যদি আমরা জানতে পারি যে, তারা আন্তরিকভাবেই বিরোধিতা করে তখন আমরা তাদের উপর মুরতাদের হুকুম লাগাব। আর যদি তা জানতে না পারি তবে কখনই তাদের প্রতি কুফরের হুকুম লাগানোর হক্বদার নই। কারণ আমরা ভয় করি যে, দুর্ঘটনাক্রমে আমরা যদি নবী (স)-এর নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হই। তিনি (স) বলেছেন :
إذَا قَالَ الرَّجُلُ لأَخِيهِ : يَا كَافِرُ ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا ، فَإنْ كانَ كَمَا قَالَ وَإلاَّ رَجَعَتْ عَلَيْهِ
‘‘যখন কেউ তার ভাইকে বলে : ইয়া কাফির; তখন যেকোন একজনের উপর অবশ্যই কুফরী পতিত হবে। যাকে কাফির বলা হল যদি সে তা হয়, অন্যথায় এটা সম্বোধনকারীর প্রতিই প্রযোজ্য হয়।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৬১০৩, সহীহ মুসলিম ১১৯ (১১১/৬০), মিশকাত ৪৮১৫]
উক্ত মর্মে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এর পরিপূরক হিসাবে আমি ঐ সাহাবীর ঘটনা উল্লেখ করব, যিনি একটি মুশরিককে পাকড়াও করেন। এমনকি সে ঐ সাহাবীর তলোয়ারের নাগালের মধ্যে চলে আসে। তখন সে মুশরিক চট করে কালেমায়ে শাহাদাত ( أشهد أن لا إله إلا الله ) পাঠ করে। ঐ সাহাবী (রা) মুশরিকটির কালেমা পাঠের দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না এবং তাকে ক্বতল করে দিলেন। যখন ঘটনাটি নবী (স)’র কাছে পৌঁছলো তখন তিনি তাকে কতটা কঠিনভাবে তিরষ্কৃত করলেন তা সবারই জানা আছে। সাহাবী অজুহাত পেশ করলেন যে, সে কেবল প্রাণ বাঁচানোর জন্য কালেমা পড়েছিল। তখন নবী (স) বললেন : فهَلاَّ شقَقتَ عَن قلبه؟ ‘‘তুমি কি তার ক্বলব (অন্তর) চিরে দেখেছিল?’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ১৭৮ (১৫৮/৯৬), মিশকাত ৩৪৫০। উক্ত মুশরিকের তাৎক্ষণিক উক্ত শাহাদাত ছাড়া অন্য কোন আমল সাহাবীর জানা ছিল না। এরপরও কেবল ঈমানের স্বীকৃতিকেই কেন সাহাবী গ্রহণ করলেন না- এ কারণেই নবী (স) তাঁকে তিরস্কৃত করলেন। (বাংলা অনুবাদক)]
সুতরাং কুফরী ই‘তিক্বাদী বা আক্বীদাগত কুফরের ভিত্তি কেবল আমলের দ্বারা ঘটে না [. শায়েখ আলবানী (রহ) বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন : “কিছু আমল এমন আছে যা সংঘটিত হলে কুফরে ই‘তিক্বাদী’র হুকুম প্রযোজ্য। কেননা তার কুফরটি এতটা সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তার মৌখিক উপস্থাপনা বিষয়টিকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেমন- কুরআন মাজীদ পদদলিত হওয়ার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও এর অপমানের জন্য কাজটি সংঘটিত করা।’’ -উর্দু অনুবাদক] বরং এর সম্পর্ক অন্তরের সাথে। আর আমি এটা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারি না যে, আমরা জানি তারা আন্তরিকভাবেই ফাসেক্ব, ফাজির বা চোর, সুদখোর প্রভৃতি। যতক্ষণ না তার অন্তরে যা আছে তা মুখ দ্বারা প্রকাশ হয়। যাহোক এর সম্পর্ক আমলের সাথে- যা এটাই সুস্পষ্ট করে যে, সে শরীআতের আমলগত বিরোধিতা করছে। এ ক্ষেত্রে বলতে পারি, তুমি বিরোধিতা করছ, ফিস্ক-ফুজর করছ। কিন্তু এটা বলা যাবে না, তুমি কাফির হয়ে গেছ বা দ্বীন থেকে মুরতাদ হয়ে গেছ। কিন্তু তার মধ্যে যদি এমন কিছু আমাদের সামনে প্রকাশ পায় যা আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে কোন নিদর্শন- তখন মুরতাদের হুকুম প্রযোজ্য হবে। আর তার ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট হুকুম হল যা রসূলুল্লাহ (স)’র নিম্নোক্ত হাদীসটিতে এসেছে :
مَنْ بَدلَ دِينَهُ فاقتُلُوهُ
‘‘যে নিজের দ্বীনকে বদলে ফেলল তাকে হত্যা কর।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ৩০১৭, মিশকাত ৩৫৩৩]
সুতরাং ঐ সমস্ত গোনাহ যেমন- ইস্তিহলালে আমালি রিবা (আমলগতভাবে সুদের হালালকরণ), যা এ যামানায় ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে- এ সবই আমালী কুফরের উদাহরণ। সুতরাং ঐ গোনাহগারদের কেবল এই পাপ ও ইস্তিহলালে আমালী ’র জন্যে কাফির বলা আমাদের জন্য জায়েয নয়। কেননা যা কিছু তাদের অন্তরে লুকায়িত আছে তা আমাদের কাছে এভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে, তারা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূল (স) কর্তৃক হারামকৃত বিষয়কে আক্বীদাগত ভাবে হালাল মনে করে না। যদি আমরা জানতে পারি যে, তারা আন্তরিকভাবেই বিরোধিতা করে তখন আমরা তাদের উপর মুরতাদের হুকুম লাগাব। আর যদি তা জানতে না পারি তবে কখনই তাদের প্রতি কুফরের হুকুম লাগানোর হক্বদার নই। কারণ আমরা ভয় করি যে, দুর্ঘটনাক্রমে আমরা যদি নবী (স)-এর নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হই। তিনি (স) বলেছেন :
إذَا قَالَ الرَّجُلُ لأَخِيهِ : يَا كَافِرُ ، فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا ، فَإنْ كانَ كَمَا قَالَ وَإلاَّ رَجَعَتْ عَلَيْهِ
‘‘যখন কেউ তার ভাইকে বলে : ইয়া কাফির; তখন যেকোন একজনের উপর অবশ্যই কুফরী পতিত হবে। যাকে কাফির বলা হল যদি সে তা হয়, অন্যথায় এটা সম্বোধনকারীর প্রতিই প্রযোজ্য হয়।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৬১০৩, সহীহ মুসলিম ১১৯ (১১১/৬০), মিশকাত ৪৮১৫]
উক্ত মর্মে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এর পরিপূরক হিসাবে আমি ঐ সাহাবীর ঘটনা উল্লেখ করব, যিনি একটি মুশরিককে পাকড়াও করেন। এমনকি সে ঐ সাহাবীর তলোয়ারের নাগালের মধ্যে চলে আসে। তখন সে মুশরিক চট করে কালেমায়ে শাহাদাত ( أشهد أن لا إله إلا الله ) পাঠ করে। ঐ সাহাবী (রা) মুশরিকটির কালেমা পাঠের দিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না এবং তাকে ক্বতল করে দিলেন। যখন ঘটনাটি নবী (স)’র কাছে পৌঁছলো তখন তিনি তাকে কতটা কঠিনভাবে তিরষ্কৃত করলেন তা সবারই জানা আছে। সাহাবী অজুহাত পেশ করলেন যে, সে কেবল প্রাণ বাঁচানোর জন্য কালেমা পড়েছিল। তখন নবী (স) বললেন : فهَلاَّ شقَقتَ عَن قلبه؟ ‘‘তুমি কি তার ক্বলব (অন্তর) চিরে দেখেছিল?’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ১৭৮ (১৫৮/৯৬), মিশকাত ৩৪৫০। উক্ত মুশরিকের তাৎক্ষণিক উক্ত শাহাদাত ছাড়া অন্য কোন আমল সাহাবীর জানা ছিল না। এরপরও কেবল ঈমানের স্বীকৃতিকেই কেন সাহাবী গ্রহণ করলেন না- এ কারণেই নবী (স) তাঁকে তিরস্কৃত করলেন। (বাংলা অনুবাদক)]
সুতরাং কুফরী ই‘তিক্বাদী বা আক্বীদাগত কুফরের ভিত্তি কেবল আমলের দ্বারা ঘটে না [. শায়েখ আলবানী (রহ) বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন : “কিছু আমল এমন আছে যা সংঘটিত হলে কুফরে ই‘তিক্বাদী’র হুকুম প্রযোজ্য। কেননা তার কুফরটি এতটা সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তার মৌখিক উপস্থাপনা বিষয়টিকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেমন- কুরআন মাজীদ পদদলিত হওয়ার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও এর অপমানের জন্য কাজটি সংঘটিত করা।’’ -উর্দু অনুবাদক] বরং এর সম্পর্ক অন্তরের সাথে। আর আমি এটা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারি না যে, আমরা জানি তারা আন্তরিকভাবেই ফাসেক্ব, ফাজির বা চোর, সুদখোর প্রভৃতি। যতক্ষণ না তার অন্তরে যা আছে তা মুখ দ্বারা প্রকাশ হয়। যাহোক এর সম্পর্ক আমলের সাথে- যা এটাই সুস্পষ্ট করে যে, সে শরীআতের আমলগত বিরোধিতা করছে। এ ক্ষেত্রে বলতে পারি, তুমি বিরোধিতা করছ, ফিস্ক-ফুজর করছ। কিন্তু এটা বলা যাবে না, তুমি কাফির হয়ে গেছ বা দ্বীন থেকে মুরতাদ হয়ে গেছ। কিন্তু তার মধ্যে যদি এমন কিছু আমাদের সামনে প্রকাশ পায় যা আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে কোন নিদর্শন- তখন মুরতাদের হুকুম প্রযোজ্য হবে। আর তার ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট হুকুম হল যা রসূলুল্লাহ (স)’র নিম্নোক্ত হাদীসটিতে এসেছে :
مَنْ بَدلَ دِينَهُ فاقتُلُوهُ
‘‘যে নিজের দ্বীনকে বদলে ফেলল তাকে হত্যা কর।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ৩০১৭, মিশকাত ৩৫৩৩]
আমি হাকিম/শাসকদের কাফির সম্বোধনকারীদের বলছি, আপনাদের কথানুযায়ী যদি মেনে নিই যে, এই বিচারক/শাসকদের কুফর প্রকৃতপক্ষেই মুরতাদ হওয়ার কুফর। আর এদের উপর আরেকজন উর্ধ্বতন হাকিম/শাসক আছে যার প্রতি ওয়াজিব হল পূর্বোক্ত হাদীসের আলোকে হদ জারি করা। প্রশ্ন হল, আমলী দৃষ্টিতে যদি ধরে নেয়া হয় যে, সমস্ত হাকিম/শাসকরা কাফির মুরতাদ- সেক্ষেত্রে আপনাদের সফলতাটাই বা কি? আপনাদের পক্ষে কি এটা বাস্তবায়ন সম্ভব?
এই কাফিররাই (আপনাদের দাবিনুযায়ী) তো অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারী। আর এর চেয়ে বেশি আফসোসের বিষয় হল, আমাদের এখানে ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিন দখল করে আছে। প্রশ্ন হল, আপনারা বা আমি এর কি পরিবর্তন করতে পারছি? আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেসব শাসককে কাফির বলে গণ্য করছে- আপনারা কি তাদের বিরোধিতায় কোন কিছু করার সাহস রাখেন? [. শায়েখ উসায়মীন (রহ) বলেছেন : এটা শায়েখ আলবানীর খুব সুন্দর বক্তব্য। যে সমস্ত লোকেরা শাসকদের কাফির বলছে, তারা কি এর দ্বারা কোন সহযোগিতা করতে পারছে? তারা কি ঐ শাসকদের থেকে মুক্ত/পৃথক হতে পারছে? না, তারা সে ক্ষমতা রাখে না। কেননা ইয়াহুদীরা বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ফিলিস্তিন দখল করে আছে, অথচ সমস্ত উম্মাত- আরব কিংবা অনারব তাদের ঐ দখলদারিত্বের কোন অবসান ঘটাতে পারেনি। তাহলে আমরা কিভাবে ঐ সমস্ত শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলব যারা আমাদের উপর হুকুমাত চালাচ্ছে ? অথচ আমরা এটা জানি যে, তাদের আমরা উৎখাত করতে সক্ষম নই। তাছাড়া এটাই অনুমিত হয় যে, আমাদের চেয়ে এ ব্যাপারে যারা অগ্রগামী তারা কেবল খুন, ডাকাতি ও সর্বোচ্চ সুনাম-সম্ভ্রম লুট করা ছাড়া অন্য কোন কার্যকরী ফলাফল আশা করতে পারছে না। অনুরূপভাবে আমরা (এই সব শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে) এর চেয়ে আর ভাল কিছু করতে পারব না। সুতরাং এতে কি-ই-বা ফায়েদা আছে? অথচ যদি কোন মুসলিম আন্তরিকভাবে এ আক্বীদা রাখে যা তার ও তার রবের মধ্যকার বিষয়ে- ঐ শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ এমন যাদের কুফর প্রকৃতপক্ষেই দ্বীন ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এরপরও এটা ঘোষণা দিয়ে ও প্রচার করে, এর দ্বারা ফিতনার আগুনে হাওয়া দিয়ে- আর কি-ই-বা ফায়দা হতে পারে। এ কারণে শায়েখ আলবানী আলোচ্য উক্তি অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু তাঁর সাথে এ মাসআলায় মতপার্থক্যের অবকাশ আছে যে, তিনি (আলবানী) তাদের প্রতি কুফরের হুকুম লাগান না। তবে কেবলমাত্র তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করেন, যারা আন্তরিকভাবে এটা হালাল হবার আক্বীদা রাখে। এ মাসআলার ব্যাপারে আরো কিছু চিন্তা ও গবেষণার প্রয়োজন আছে। কেননা আমাদের এই বক্তব্য ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ’র হুকুম মোতাবেক ফায়সালা করে, কিন্তু সে এই আক্বীদা রাখে যে, গায়রুল্লাহ’র হুকুম বেশী উপযুক্ত তবে সে কাফির। যদিওবা সে আল্লাহ’র হুকুম মোতাবেক ফায়সালা করে। তার এ কুফর তো আক্বীদাগত (প্রকৃত) কুফর।’’শায়েখ আলবানী (রহ) উক্ত বক্তব্যের ব্যাপারে বলেছেন : আমি তাঁর (শায়েখ উসায়মীনের) বক্তব্যে কোনরূপ মতপার্থক্য দেখছি না। কেননা আমরা তো এটাই বলছি যে, যদি কোন ব্যক্তি বা হাকিম এটা মনে করে যে, অইসলামী আইন ইসলামী আইন থেকে উত্তম- যদিওবা সে আমলগতভাবে ইসলামী আইন অনুযায়ী ফায়সালা করুক না কেন, সে কাফির। সুতরাং প্রমাণিত হল, এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। কেননা আসল বিষয় তো যা মানুষের অন্তরে রয়েছে- সেটাই ধর্তব্য (যখন তা প্রকাশ পায়)। কিন্তু আমাদের আলোচনা তো আমল সম্পর্কিত। আর আমার ধারণা এটা অসম্ভব যে, কেউ অইসলামী আইন জারি করল যা দ্বারা আল্লাহ’র বান্দাদের মধ্যে সে ফায়সালা করে, তবে যদি সেটাকে ইস্তিহলাল (বৈধ) করে এবং এই আক্বীদা রাখে যে, এটা শরিয়াতী আইনের চেয়ে উত্তম। তবে সুস্পষ্ট কথা হল, সে কাফির। অন্যথা কোন্ জিনিস তাকে সে দিকে ধাবিত করল (যার ফলে সে শরিয়াত বিরোধী ফায়সালা করল)।অবশ্য এ দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভব যে, যে বিষয়টি তাকে সে দিকে ধাবিত করল তা হল- সে এমন কোন শক্তিকে ভয় করছে যে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। আর সে যদি উক্ত শরিয়াত বিরোধী ফায়সালা জারি না করে তবে তারা তার ব্যাপারে প্রভাব বিস্তারের বা চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করবে। এ পর্যায়ে আমি বলব, তার হুকুম অন্যান্য ঐ সব পাপের হুকুমের মত যেসব ব্যাপারে জবরদস্তি বা চাপের মুখে সংঘটিত আমলের হুকুম প্রযোজ্য। যে বিষয়টি আলোচ্য অনুচ্ছেদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ তা হল ‘মাসআলায়ে তাকফীর’। যা এই আমল তথা ঐ সমস্ত হাকিম/শাসকের বিরোধিতায় প্রয়োগ করা হচ্ছে- আর এটাই আসল সমস্যা। জি হাঁ, যদি মানুষের কাছে এতটা শক্তি সামর্থ্য থাকে যে, সে প্রত্যেক কাফির হাকিম/শাসককে নির্মূল করতে পারে। তবে আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। তবে শর্ত হল, তারা হাদীসে উল্লিখিত শর্ত মোতাবেক পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট কুফর দেখে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মাসআলাটি কোন নতুন নয় এবং এর বাস্তবায়নও সহজসাধ্য নয়- [শায়েখ আলবানী (রহ)]।-উর্দু অনুবাদক]
এ কারণে এটা কতই না ভাল হত, যদি এ বিষয়টি এক দিকে রেখে দেয়া হয় এবং ঐ সমস্ত ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালানো দরকার যার মাধ্যমে একটি সত্যিকারের ইসলামী হুকুমাত ক্বায়েম করা সম্ভব হয়। যা সম্পূর্ণরূপে নবী (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণে হবে, যার ব্যাপারে তিনি (স) তার সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং যার ভিত্তিতে রীতি ও নীতিমালা নির্ধারণ হয়।
এই কাফিররাই (আপনাদের দাবিনুযায়ী) তো অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনকর্তা ও ক্ষমতার অধিকারী। আর এর চেয়ে বেশি আফসোসের বিষয় হল, আমাদের এখানে ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিন দখল করে আছে। প্রশ্ন হল, আপনারা বা আমি এর কি পরিবর্তন করতে পারছি? আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেসব শাসককে কাফির বলে গণ্য করছে- আপনারা কি তাদের বিরোধিতায় কোন কিছু করার সাহস রাখেন? [. শায়েখ উসায়মীন (রহ) বলেছেন : এটা শায়েখ আলবানীর খুব সুন্দর বক্তব্য। যে সমস্ত লোকেরা শাসকদের কাফির বলছে, তারা কি এর দ্বারা কোন সহযোগিতা করতে পারছে? তারা কি ঐ শাসকদের থেকে মুক্ত/পৃথক হতে পারছে? না, তারা সে ক্ষমতা রাখে না। কেননা ইয়াহুদীরা বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ফিলিস্তিন দখল করে আছে, অথচ সমস্ত উম্মাত- আরব কিংবা অনারব তাদের ঐ দখলদারিত্বের কোন অবসান ঘটাতে পারেনি। তাহলে আমরা কিভাবে ঐ সমস্ত শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলব যারা আমাদের উপর হুকুমাত চালাচ্ছে ? অথচ আমরা এটা জানি যে, তাদের আমরা উৎখাত করতে সক্ষম নই। তাছাড়া এটাই অনুমিত হয় যে, আমাদের চেয়ে এ ব্যাপারে যারা অগ্রগামী তারা কেবল খুন, ডাকাতি ও সর্বোচ্চ সুনাম-সম্ভ্রম লুট করা ছাড়া অন্য কোন কার্যকরী ফলাফল আশা করতে পারছে না। অনুরূপভাবে আমরা (এই সব শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে) এর চেয়ে আর ভাল কিছু করতে পারব না। সুতরাং এতে কি-ই-বা ফায়েদা আছে? অথচ যদি কোন মুসলিম আন্তরিকভাবে এ আক্বীদা রাখে যা তার ও তার রবের মধ্যকার বিষয়ে- ঐ শাসকদের মধ্যে কেউ কেউ এমন যাদের কুফর প্রকৃতপক্ষেই দ্বীন ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এরপরও এটা ঘোষণা দিয়ে ও প্রচার করে, এর দ্বারা ফিতনার আগুনে হাওয়া দিয়ে- আর কি-ই-বা ফায়দা হতে পারে। এ কারণে শায়েখ আলবানী আলোচ্য উক্তি অত্যন্ত উপকারী। কিন্তু তাঁর সাথে এ মাসআলায় মতপার্থক্যের অবকাশ আছে যে, তিনি (আলবানী) তাদের প্রতি কুফরের হুকুম লাগান না। তবে কেবলমাত্র তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করেন, যারা আন্তরিকভাবে এটা হালাল হবার আক্বীদা রাখে। এ মাসআলার ব্যাপারে আরো কিছু চিন্তা ও গবেষণার প্রয়োজন আছে। কেননা আমাদের এই বক্তব্য ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ’র হুকুম মোতাবেক ফায়সালা করে, কিন্তু সে এই আক্বীদা রাখে যে, গায়রুল্লাহ’র হুকুম বেশী উপযুক্ত তবে সে কাফির। যদিওবা সে আল্লাহ’র হুকুম মোতাবেক ফায়সালা করে। তার এ কুফর তো আক্বীদাগত (প্রকৃত) কুফর।’’শায়েখ আলবানী (রহ) উক্ত বক্তব্যের ব্যাপারে বলেছেন : আমি তাঁর (শায়েখ উসায়মীনের) বক্তব্যে কোনরূপ মতপার্থক্য দেখছি না। কেননা আমরা তো এটাই বলছি যে, যদি কোন ব্যক্তি বা হাকিম এটা মনে করে যে, অইসলামী আইন ইসলামী আইন থেকে উত্তম- যদিওবা সে আমলগতভাবে ইসলামী আইন অনুযায়ী ফায়সালা করুক না কেন, সে কাফির। সুতরাং প্রমাণিত হল, এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। কেননা আসল বিষয় তো যা মানুষের অন্তরে রয়েছে- সেটাই ধর্তব্য (যখন তা প্রকাশ পায়)। কিন্তু আমাদের আলোচনা তো আমল সম্পর্কিত। আর আমার ধারণা এটা অসম্ভব যে, কেউ অইসলামী আইন জারি করল যা দ্বারা আল্লাহ’র বান্দাদের মধ্যে সে ফায়সালা করে, তবে যদি সেটাকে ইস্তিহলাল (বৈধ) করে এবং এই আক্বীদা রাখে যে, এটা শরিয়াতী আইনের চেয়ে উত্তম। তবে সুস্পষ্ট কথা হল, সে কাফির। অন্যথা কোন্ জিনিস তাকে সে দিকে ধাবিত করল (যার ফলে সে শরিয়াত বিরোধী ফায়সালা করল)।অবশ্য এ দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভব যে, যে বিষয়টি তাকে সে দিকে ধাবিত করল তা হল- সে এমন কোন শক্তিকে ভয় করছে যে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। আর সে যদি উক্ত শরিয়াত বিরোধী ফায়সালা জারি না করে তবে তারা তার ব্যাপারে প্রভাব বিস্তারের বা চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করবে। এ পর্যায়ে আমি বলব, তার হুকুম অন্যান্য ঐ সব পাপের হুকুমের মত যেসব ব্যাপারে জবরদস্তি বা চাপের মুখে সংঘটিত আমলের হুকুম প্রযোজ্য। যে বিষয়টি আলোচ্য অনুচ্ছেদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ তা হল ‘মাসআলায়ে তাকফীর’। যা এই আমল তথা ঐ সমস্ত হাকিম/শাসকের বিরোধিতায় প্রয়োগ করা হচ্ছে- আর এটাই আসল সমস্যা। জি হাঁ, যদি মানুষের কাছে এতটা শক্তি সামর্থ্য থাকে যে, সে প্রত্যেক কাফির হাকিম/শাসককে নির্মূল করতে পারে। তবে আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। তবে শর্ত হল, তারা হাদীসে উল্লিখিত শর্ত মোতাবেক পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট কুফর দেখে এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলিল থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই মাসআলাটি কোন নতুন নয় এবং এর বাস্তবায়নও সহজসাধ্য নয়- [শায়েখ আলবানী (রহ)]।-উর্দু অনুবাদক]
এ কারণে এটা কতই না ভাল হত, যদি এ বিষয়টি এক দিকে রেখে দেয়া হয় এবং ঐ সমস্ত ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালানো দরকার যার মাধ্যমে একটি সত্যিকারের ইসলামী হুকুমাত ক্বায়েম করা সম্ভব হয়। যা সম্পূর্ণরূপে নবী (স)-এর সুন্নাতের অনুসরণে হবে, যার ব্যাপারে তিনি (স) তার সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং যার ভিত্তিতে রীতি ও নীতিমালা নির্ধারণ হয়।
আমি এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি স্থানে এ ধরনের প্রত্যেকটি জামাআতের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য বিষয়ে আলোচনা করেছি। কেবল ইসলামী অঞ্চলগুলোতেই নয়, বরং দুনিয়াব্যাপী সর্বত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন :
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
‘‘তিনি রসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও দ্বীনে হক্ব সহকারে, যেন তা সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়- যদিও মুশরিকদের কাছে তা অপছন্দনীয়।’’ [.সূরা তাওবা : ৩৩ আয়াত।]
অনুরূপভাবে কিছু সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আগত দিনগুলোতে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। [.মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَ يَبْقى عَلى ظَهْرِ الْأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَّلاَ وَبَرٍ إِلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ كَلِمَةَ الْإِسْلاَمِ بِعِزِّ عَزِيْزٍ وَ ذُلِّ ذَلِيْلٍ إِمَّا يُعَزُّهُمُ اللهُ فَيَجْعَلُهُمْ مِّنْ أَهْلِهَا أَوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِيْنُوْنَ لَهَا قٌلْتُ فَيَكُوْنُ الدِّيْنُ كُلُّه ‘ ِللهِ ‘‘যমীনের ওপর কোন মাটির ঘর অথবা পশমের ঘর (তাঁবু) বাকী থাকবে না যাতে আল্লাহ তাআলা ইসলামের বাণী পৌঁছে দিবেন না- সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে এবং অপমানিতের ঘরে অপমানের সাথে। আল্লাহ যাদের সম্মানিত করবেন তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের উপযুক্ত করে দেবেন। পক্ষান্তরে যাদের অপমানিত করবেন, তারা ইসলামের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আমি (মিক্বদাদ (লা) তখন) বললাম : তখন তো গোটা দ্বীনই আল্লাহ’র হবে।’’ [আহমাদ, মিশকাত ৪২; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ১/৪২ নং] -(বাংলা অনুবাদক)]] এখন এই আয়াতের বাস্তবায়নের জন্যে কি মুসলিম হাকিম/শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার দ্বারাই এই আমলটির সূচনা করতে হবে? যাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা, এই কুফর ‘মুরতাদ হওয়ার কুফর’-এর চেয়ে কম না। যদিও এ ধারণাটি বাতিল, তবুও তারা কাফির সম্বোধন করার পরও কিছুই করতে পারছে না। [.শায়েখ উসায়মীন (রহ)-কে আলোচ্য সংশয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় :অনেক যুবকের মনে এ ব্যাপারে সংশয় রয়েছে এবং তারা এ আমলটির বিরোধিতায় খুবই তৎপর। তাদের সংশয় হল, যদি এই সমস্ত হাকিম/শাসক আল্লাহ’র নাযিলকৃত শরিয়াতের পরিবর্তে নিজ রচিত আইন প্রতিষ্ঠা করে- তবে তারা তাদের (শাসকদের) প্রতি মুরতাদ-কাফিরের হুকুম প্রয়োগ করে। এরই ভিত্তিতে তারা বলে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এর উপর ক্বায়েম থাকবে ততক্ষণ তাদের সাথে ক্বিতাল করা ওয়াজিব। এ পর্যায়ে বাড়াবাড়ি হল, এই যুবকেরা নিজেদের দুর্বলতার দিকে লক্ষ্য করে না। কেননা দুর্বলতার সময় যে সমস্ত খাস হুকুম নাযিল হয়েছিল, তারা আয়াতে সাইফ (সূরা তাওবা- ৫ আয়াত) দ্বারা তা মানসুখ হয়েছে বলে উল্লেখ করে। বর্তমান যামানায় মুসলিমদের দুর্বলতার ক্ষেত্রে এ আমলটি লুট করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যা তারা ইসলামের প্রাথমিক অবস্থাতে করেছিল। তিনি (উসায়মীন (রহ)) এই সংশয়টির যথাযথ জবাবে বলেন :‘‘প্রথমে আমাদের এটা জানা দরকার এই হাকিম/শাসকদের প্রতি মুরতাদের হুকুম প্রযোজ্য কি না? ’’এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম তাদের দলিলগুলোর অবস্থা জানা জরুরি। যারা বলে থাকে যে-১.তাদের কথা ও কাজে মুরতাদের হুকুম প্রযোজ্য;২.কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তা প্রযোজ্য করা, এবং৩.সর্বোপরি এ দিকে লক্ষ্য রাখা যে, তাদের এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ সংশয় আছে কি না?অর্থাৎ কোন দলিল দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায় যে, অমূক কথা বা কাজ কুফর। এর সাথে এমন কোন অর্থ যদি পাওয়া যায় যা উক্ত ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য কুফরের সাথে সম্পর্কিত কুফরের অর্থ প্রকাশক। কেননা, অর্থতো বিভিন্নভাবে প্রয়োগ হতে পারে। যেমন- ধারণা, অজ্ঞতা, ভুল বিষয়কে প্রাধান্যদান প্রভৃতি।যেমন- যদি কোন ব্যক্তি তার পরিবারকে বলে, ‘‘আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে পুড়িয়ে ফেলবে এবং আমার ছাই ও অবশিষ্টাংশ নদীতে/সমুদ্রে ফেলে দিবে। কেননা যদি আল্লাহ তাআলা যদি আমাকে পাকড়াও করেন তবে আমাকে এমন আযাব দেবেন, যা দুনিয়ার আর কাউকেই দেবেন না।’’ [সহীহ বুখারী ৭৫০৬, সহীহ মুসলিম ৬৮৭৩ (২৪/২৭৫৬), মিশকাত ২৩৬৯] হাদীসটির প্রকাশ্য অর্থ ব্যক্তিটির মধ্যে আল্লাহ’র পরিপূর্ণ কুদরতী ক্ষমতার ব্যাপারে কুফরযুক্ত সন্দেহের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর কুদরতী ক্ষমতায় তাকে সশরীরের জীবিত করে সম্বোধন করলেন, তখন সে ব্যক্তি বলল : من خشيتك يا رب ‘‘হে আমরা রব! আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছিলাম।’’ তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। যদিও তার আমলটি বিকৃত চিন্তার ফলাফল ছিল।অনুরূপ ঐ ব্যক্তির কাহিনীও উল্লেখযোগ্য, যে ব্যক্তি তার হারিয়ে যাওয়া উট পাওয়ার পর মাত্রাতিরিক্ত খুশিতে ভুল করে বলল : اللهم أنت عبدي وأنا ربك ‘‘হে আল্লাহ ! আপনি আমার বান্দা এবং আমি আপনার রব।’’ [সহীহ মুসলিম ৬৮৫৩ (৭/২৭৪৭), মিশকাত ২৩৩২] নিঃসন্দেহে এটি একটি সুস্পষ্ট আমলী কুফর। কিন্তু এর প্রতি কি চুড়ান্ত তাকফীরের হুকুম প্রযোজ্য ? সে তো নিজের বাঁধ ভাঙ্গা খুশিতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে এবং আবেগের মোহে সঠিক বাক্য উচ্চারণের পরিবর্তে ভুল উচ্চারণ করে ফেলে। অর্থাৎ সে তো এটাই বলতে চাচ্ছিল যে, ‘‘হে আল্লাহ ! আমি তোমার বান্দা এবং তুমি আমার রব।’’ কিন্তু তার মুখ থেকে ভুলক্রমে বের হল : ‘‘হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা এবং আমি আপনার প্রভু।’’অনুরূপ যে ব্যক্তিকে কুফরের ব্যাপারে বাধ্য করা হয়েছে এবং সে উক্ত জবরদস্তির কারণে কুফরী কালেমা বলে কিংবা কোন কুফরী আমল করে তবে কুরআনের (সূরা নাহাল- ১০৬ আয়াত) দলিলের আলোকে সে কাফির নয়। কেননা তার এ ব্যাপারে আন্তরিক স্বীকৃতি ছিল না। যাহোক এই সমস্ত হাকিম/শাসক ব্যক্তিগত বিষয় যেমন- বিয়ে, তালাক্ব, ওয়ারিসী সম্পত্তির ভাগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীস মোতাবেক নিজ নিজ মাযহাবের উপর ফায়সালা করে থাকে। কিন্তু লোকদের মধ্যকার বিভিন্ন লেনদেনের ব্যাপারে যখন ফায়সালা আসে তখন তারা এক্ষেত্রে বিপরীত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। কেননা তাদের উলামায়ে সূ‘ গণ এই বুঝ দিয়েছে যে, নবী (স) বলেছেন : أنتم أعلم بأمر دنياكم ‘‘তোমরা দুনিয়ার বিষয়ে বেশি জান।’’ [সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফাযায়েল باب وُجُوبِ امْتِثَالِ مَا قَالَهُ شَرْعًا دُونَ مَا ذَكَرَهُ -صلى الله عليه وسلم- مِنْ مَعَايِشِ الدُّنْيَا عَلَى سَبِيلِ الرَّأْىِ ; হা/৬২৭৭, আলবানীর সহীহুল জামে‘উস সগীর ওয়া যিয়াদাতাহু১/১৪৮৮ নং] আর এই হুকুমটি আম (ব্যাপক) দাবি সম্পন্ন। সুতরাং প্রত্যেক ঐ সমস্ত ব্যাপার যেখানে দুনিয়াবী কর্মকান্ড জড়িত সে ব্যাপারে আমরা স্বাধীন। কেননা নবী (স) স্বয়ং বলেছেন : أنتم أعلم بأمر دنياكم ‘‘তোমরা দুনিয়ার বিষয়ে বেশি জান।’’যদিও এটি একটি সংশয়ের সৃষ্টি করে কিন্তু আমরা দেখি তারা ঐ সমস্ত বিষয়ের বৈধতাকেও স্বীকৃতি দেয়। যেমন- হদ ক্বায়েম না করা, মদ পান প্রভৃতি বিষয়ে তারা ইসলামী শরিয়াতের বিপরীতে অবস্থান করে। এখন যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই তবে কিছু ব্যাপারে সংশয়ের বাস্তবতা সঠিক হলেও শেষোক্ত আইনগুলোর ব্যাপারে তাদের ব্যাপারে কোন সংশয় থাকে না। আলোচ্য অভিযোগের শেষাংশে বর্ণিত (দুর্বলতার সময় করণীয়) বিষয়ে বলা যায় : যখন আল্লাহ তাআলা জিহাদ ফরয হওয়ার পরে বললেন : يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَـ ‘‘হে নবী! আপনি মু’মিনদের ক্বিতালের প্রতি উদ্বুদ্ধ করুন। যদি তোমাদের মধ্যে বিশজন সবরকারী হয় তবে তারা দু’শ এর উপর বিজয়ী হবে। আর যদি তোমাদের মধ্যে একশ জন সবরকারী হয় তারা এক হাজার কাফিরের উপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা নির্বোধ লোক।’’ [সূরা আনফাল : ৬৫ আয়াত]আয়াতটিতে দশজন কাফিরের মোকাবেলায় একজন মু‘মিনকে ক্ববুল করা হয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন : الْآَنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَلْفٌ يَغْلِبُوا أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘‘এখন আল্লাহ তোমাদের থেকে বোঝা হালকা করে দিয়েছেন এবং তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে বলে জেনেছেন। অতএব যদি তোমাদের মধ্যে একশ জন সবরকারী হয় তবে তারা দু’শ জনের উপর জয় লাভ করবে আর এক হাজার হলে দু’ হাজারের উপর জয়লাভ করবে। আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।’’ [সূরা আনফাল : ৬৬ আয়াত]অনেক আলেম বলেন উক্ত অবস্থা পরিস্থিতি বিশেষে প্রযোজ্য। ......[সংযোজন : ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন : যখন ِ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ আয়াতটি নাযিল হল, তখন দশ জনের বিপরীতে একজনের পলায়নও নিষিদ্ধ করা হল, তখন এটা মুসলিমদের উপর দুঃসাধ্য মনে হলে পরে তা লাঘবের বিধান এলো الْآَنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : فَلَمَّا خَفَّفَ اللهُ عَنْهُمْ مِنَ الْعِدَّةِ نَقَصَ مِنَ الصَّبْرِ بِقَدْرِ مَا خَفَّفَ عَنْهُمْ ‘‘আল্লাহ তাদেরকে সংখ্যার দিকে থেকে যখন হাল্কা করে দিলেন তাদের সবরের ত্রুটির কারণে, সেই পরিমাণে তাদের সবরও হ্রাস পেল।’’ (সহীহ বুখারী- কিতাবুত তাফসীর, সূরা আনফাল)সাওবান (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : يُوْشِكُ الْاُمَمُ اَنْ تَدَاعي عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَي الْأكِلَةُ اِلي قَصْعَتِهَا، فَقَالَ قَائِلٌ : وَمِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ؟ قَالَ بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيْرٌ، وَلكِنَّكُمْ غُثَاءُ كَغُثَاءِ السَّيْلِ، وَلَيَنَزِعَنَّ اللهُ مِنْ صُدُوْرِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَاَبةَ مِنْكُمْ، وَلَيَقْذِفَنَّ فِيْ قُلُوْبِكُمُ الْوَهَنَ . قَاَل قَائِلٌ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ! وَمَا الْوَهْنُ؟ قَالَ : حُبُّ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَّةُ الْمَوْتِ ـ ‘‘অচিরেই বিশ্বের অন্যান্য জাতি তোমাদের ওপর হামলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন লোভী পেটুকেরা খাবার পাত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তখন জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এমনটি হবে? তিনি বললেন, না। বরং সে সময় তোমরা সংখ্যায় অধিক সংখ্যক হবে কিন্তু তোমাদের অবস্থা হবে খড়-কুটার মত।। আল্লাহ তোমাদের দুশমনের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দূর করে দিবেন এবং তোমাদের অন্তরে অলসতার সৃষ্টি হয়ে যাবে। তখন জনৈক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রসূল! অলসতার সৃষ্টি হবে কেন? তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি মহববত আর মৃত্যুকে অপছন্দ (ভয়) করার কারণে।’’ [আবূ দাউদ ৪২৯৭, মিশকাত ৫৩৬৯; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন- আলবানীর মিশকাত ৩/১৪৭৫ পৃ.] হাসান (রহ) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স)-এর একজন সাহাবী আয়েয ইবনু আমর (রা) একবার উবায়দুল্লাহ ইবনু যিয়াদের কাছে গেলেন। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন,বৎস! আমি রসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছি : إِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الْحُطَمَةُ ‘‘নিকৃষ্টতম রাখাল হচ্ছে অত্যাচারী শাসক।’’ সুতরাং তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া থেকে সাবধান থাকবে। তখন সে বলল : বসে পড়! তুমি হচ্ছ নবী (স)’র সাহাবীদের ভূষি স্বরূপ। জবাবে তিনি (রা) বললেন : وَهَلْ كَانَتْ لَهُمْ نُخَالَةٌ إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ وَفِى غَيْرِهِمْ ‘‘তাঁদের মধ্যেও কি ভূষি আছে? ভূষি তো তাদের পরবর্তীদের এবং অন্যান্যদের মধ্যে।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৬২৭ (২৩/১৮৩০)]মিরদাস আসলামী (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : يَذْهَبُ الصَّالِحُوْنَ الْأَوَّلُ فَالْأَوَّلُ وَتَبْقى حُفَالَةٌ كَحُفَالَةِ الشَّعِيْرِ أَوِ التَّمَرِ لاَ يُبَالِيْهِمُ اللهُ بَالَةً ‘‘ভাল ও নেককার লোকেরা (পর্যায়েক্রমে) একের পর এক চলে যাবে। অতঃপর অবশিষ্টরা যব অথবা খেজুরের নিকৃষ্ট চিটার ন্যায় থেকে যাবে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ করবেন না।’’ [সহীহ বুখারী ৬৪৩৪, মিশকাত ৫৩৬২]সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) থেকে বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছি : اِنَّ الْاِيْمَانَ بَدَا غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَمَا بَدَا فَطُوْبَى يَوْمَئِذٍ لِلْغُرَبَاءِ اِذَا فَسَدَ الزَّمَانُ وَالَّذِىْ نَفْسُ أَبِى الْقَاسِمُ بِيَدِه لَيَاُرِزَنَّ الْاِيْمَانُ بَيْنَ هَذَيْنِ الْمَسْجِدَيْنِ كَمَا تَازُ الْحَيَّةُ فِىْ جُحْرِهَا ‘‘নিশ্চয় ঈমান উৎপত্তি লাভ করেছে গরীব (পরবাসী/দুর্বল) অবস্থায় এবং তা অচিরেই প্রত্যাবর্তন করবে সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় উৎপত্তি লাভ করেছিল। সুতরাং মোবারকবাদ ঐ দিন সেইসব গরীবদের জন্য, যখন ফাসাদের যামানা হবে। যাঁর হাতে আবূল কাসিমের জীবন! সেই সত্তার ক্বসম! ঈমান এই দুই মাসজিদের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ করবে, সর্প যেমন তার গর্তে প্রবেশ করে থাকে।’’ [সহীহ মুসলিম ২৬৮ (২৩২/১৪৬), মুসনাদে আহমাদ (ইফা) ১/৯৯ নং] (বাংলা অনুবাদক)]তাছাড়া আমাদের কাছে এই দুর্বলতার সমর্থনে দলিল মজুদ রয়েছে যা এর সুস্পষ্টতা ও ব্যাপকতা ব্যক্ত করে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ‘‘আল্লাহ কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপান না’’ (সূরা বাক্বারাহ : ২৮৬ আয়াত)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন : فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘‘সুতরাং আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় কর’’ (সূরা তাগাবুন : ১৬ আয়াত)।যদি আমরা তর্কের খাতিরে মেনে নিই যে, আলেম-উলামাদের বর্ণিত শর্তের আলোকে এই সমস্ত হাকিম/শাসকদের উৎখাত করা ওয়াজিব। তবুও সেক্ষেত্রে এটা আমাদের প্রতি ওয়াজিব হয় না। কেননা তাদের পতন ঘটানোর মত শক্তি-সামর্থ্য আমাদের নেই। বিষয়টি যদিও সুস্পষ্ট, এরপরও মানুষ নাফসের অসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) যুক্ত’’ - শায়েখ উসায়মীন। [উর্দু অনুবাদক]]
সুতরাং কোন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে কুরআনের নিম্নোক্ত হক্ব পূর্ণাঙ্গরূপে আদায় করা যাবে :
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
‘‘তিনি রসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও দ্বীনে হক্ব সহকারে, যেন তা সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়- যদিও মুশরিকদের কাছে তা অপছন্দনীয়।’’ [.সূরা তাওবা : ৩৩ আয়াত।]
নিঃসন্দেহে এর একটিই পদ্ধতি- যা রসূলুল্লাহ (স) নিজের সাহাবীদের (রা) বলেছিলেন। তিনি নিজের প্রত্যেক খুতবাতেও বলতেন : وَخَيْرَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ ‘‘সর্বোত্তম হিদায়াত (পথ) হল মুহাম্মাদ (স)’র হিদায়াত।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ১৮৯০ (৪৩/৮৬৭), মিশকাত ১৪১।]
এ কারণে সমস্ত মুসলিম এবং কেবল মুসলিম রাষ্ট্রেই নয় বরং দুনিয়াব্যাপী ইসলামী হুকুম ক্বায়েমের সহযোগিতা করা ওয়াজিব। সর্বপ্রথম সেখানে দা‘ওয়াতকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করবে যেভাবে নবী (স) দা‘ওয়াত দেয়া শুরু করেছিলেন। যা সংক্ষেপে আমি দু’টি শব্দে উল্লেখ করে থাকি : التصفيه والتربيه [(ক) তাসফিয়্যাহ (পবিত্রতা/সংস্কার-সংশোধন) ও (খ) তারবিয়্যাহ (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ)।]
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
‘‘তিনি রসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও দ্বীনে হক্ব সহকারে, যেন তা সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়- যদিও মুশরিকদের কাছে তা অপছন্দনীয়।’’ [.সূরা তাওবা : ৩৩ আয়াত।]
অনুরূপভাবে কিছু সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আগত দিনগুলোতে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। [.মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَ يَبْقى عَلى ظَهْرِ الْأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَّلاَ وَبَرٍ إِلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ كَلِمَةَ الْإِسْلاَمِ بِعِزِّ عَزِيْزٍ وَ ذُلِّ ذَلِيْلٍ إِمَّا يُعَزُّهُمُ اللهُ فَيَجْعَلُهُمْ مِّنْ أَهْلِهَا أَوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِيْنُوْنَ لَهَا قٌلْتُ فَيَكُوْنُ الدِّيْنُ كُلُّه ‘ ِللهِ ‘‘যমীনের ওপর কোন মাটির ঘর অথবা পশমের ঘর (তাঁবু) বাকী থাকবে না যাতে আল্লাহ তাআলা ইসলামের বাণী পৌঁছে দিবেন না- সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে এবং অপমানিতের ঘরে অপমানের সাথে। আল্লাহ যাদের সম্মানিত করবেন তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের উপযুক্ত করে দেবেন। পক্ষান্তরে যাদের অপমানিত করবেন, তারা ইসলামের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আমি (মিক্বদাদ (লা) তখন) বললাম : তখন তো গোটা দ্বীনই আল্লাহ’র হবে।’’ [আহমাদ, মিশকাত ৪২; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ১/৪২ নং] -(বাংলা অনুবাদক)]] এখন এই আয়াতের বাস্তবায়নের জন্যে কি মুসলিম হাকিম/শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার দ্বারাই এই আমলটির সূচনা করতে হবে? যাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা, এই কুফর ‘মুরতাদ হওয়ার কুফর’-এর চেয়ে কম না। যদিও এ ধারণাটি বাতিল, তবুও তারা কাফির সম্বোধন করার পরও কিছুই করতে পারছে না। [.শায়েখ উসায়মীন (রহ)-কে আলোচ্য সংশয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় :অনেক যুবকের মনে এ ব্যাপারে সংশয় রয়েছে এবং তারা এ আমলটির বিরোধিতায় খুবই তৎপর। তাদের সংশয় হল, যদি এই সমস্ত হাকিম/শাসক আল্লাহ’র নাযিলকৃত শরিয়াতের পরিবর্তে নিজ রচিত আইন প্রতিষ্ঠা করে- তবে তারা তাদের (শাসকদের) প্রতি মুরতাদ-কাফিরের হুকুম প্রয়োগ করে। এরই ভিত্তিতে তারা বলে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এর উপর ক্বায়েম থাকবে ততক্ষণ তাদের সাথে ক্বিতাল করা ওয়াজিব। এ পর্যায়ে বাড়াবাড়ি হল, এই যুবকেরা নিজেদের দুর্বলতার দিকে লক্ষ্য করে না। কেননা দুর্বলতার সময় যে সমস্ত খাস হুকুম নাযিল হয়েছিল, তারা আয়াতে সাইফ (সূরা তাওবা- ৫ আয়াত) দ্বারা তা মানসুখ হয়েছে বলে উল্লেখ করে। বর্তমান যামানায় মুসলিমদের দুর্বলতার ক্ষেত্রে এ আমলটি লুট করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যা তারা ইসলামের প্রাথমিক অবস্থাতে করেছিল। তিনি (উসায়মীন (রহ)) এই সংশয়টির যথাযথ জবাবে বলেন :‘‘প্রথমে আমাদের এটা জানা দরকার এই হাকিম/শাসকদের প্রতি মুরতাদের হুকুম প্রযোজ্য কি না? ’’এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম তাদের দলিলগুলোর অবস্থা জানা জরুরি। যারা বলে থাকে যে-১.তাদের কথা ও কাজে মুরতাদের হুকুম প্রযোজ্য;২.কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তা প্রযোজ্য করা, এবং৩.সর্বোপরি এ দিকে লক্ষ্য রাখা যে, তাদের এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ সংশয় আছে কি না?অর্থাৎ কোন দলিল দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায় যে, অমূক কথা বা কাজ কুফর। এর সাথে এমন কোন অর্থ যদি পাওয়া যায় যা উক্ত ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য কুফরের সাথে সম্পর্কিত কুফরের অর্থ প্রকাশক। কেননা, অর্থতো বিভিন্নভাবে প্রয়োগ হতে পারে। যেমন- ধারণা, অজ্ঞতা, ভুল বিষয়কে প্রাধান্যদান প্রভৃতি।যেমন- যদি কোন ব্যক্তি তার পরিবারকে বলে, ‘‘আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে পুড়িয়ে ফেলবে এবং আমার ছাই ও অবশিষ্টাংশ নদীতে/সমুদ্রে ফেলে দিবে। কেননা যদি আল্লাহ তাআলা যদি আমাকে পাকড়াও করেন তবে আমাকে এমন আযাব দেবেন, যা দুনিয়ার আর কাউকেই দেবেন না।’’ [সহীহ বুখারী ৭৫০৬, সহীহ মুসলিম ৬৮৭৩ (২৪/২৭৫৬), মিশকাত ২৩৬৯] হাদীসটির প্রকাশ্য অর্থ ব্যক্তিটির মধ্যে আল্লাহ’র পরিপূর্ণ কুদরতী ক্ষমতার ব্যাপারে কুফরযুক্ত সন্দেহের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর কুদরতী ক্ষমতায় তাকে সশরীরের জীবিত করে সম্বোধন করলেন, তখন সে ব্যক্তি বলল : من خشيتك يا رب ‘‘হে আমরা রব! আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছিলাম।’’ তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। যদিও তার আমলটি বিকৃত চিন্তার ফলাফল ছিল।অনুরূপ ঐ ব্যক্তির কাহিনীও উল্লেখযোগ্য, যে ব্যক্তি তার হারিয়ে যাওয়া উট পাওয়ার পর মাত্রাতিরিক্ত খুশিতে ভুল করে বলল : اللهم أنت عبدي وأنا ربك ‘‘হে আল্লাহ ! আপনি আমার বান্দা এবং আমি আপনার রব।’’ [সহীহ মুসলিম ৬৮৫৩ (৭/২৭৪৭), মিশকাত ২৩৩২] নিঃসন্দেহে এটি একটি সুস্পষ্ট আমলী কুফর। কিন্তু এর প্রতি কি চুড়ান্ত তাকফীরের হুকুম প্রযোজ্য ? সে তো নিজের বাঁধ ভাঙ্গা খুশিতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছে এবং আবেগের মোহে সঠিক বাক্য উচ্চারণের পরিবর্তে ভুল উচ্চারণ করে ফেলে। অর্থাৎ সে তো এটাই বলতে চাচ্ছিল যে, ‘‘হে আল্লাহ ! আমি তোমার বান্দা এবং তুমি আমার রব।’’ কিন্তু তার মুখ থেকে ভুলক্রমে বের হল : ‘‘হে আল্লাহ! আপনি আমার বান্দা এবং আমি আপনার প্রভু।’’অনুরূপ যে ব্যক্তিকে কুফরের ব্যাপারে বাধ্য করা হয়েছে এবং সে উক্ত জবরদস্তির কারণে কুফরী কালেমা বলে কিংবা কোন কুফরী আমল করে তবে কুরআনের (সূরা নাহাল- ১০৬ আয়াত) দলিলের আলোকে সে কাফির নয়। কেননা তার এ ব্যাপারে আন্তরিক স্বীকৃতি ছিল না। যাহোক এই সমস্ত হাকিম/শাসক ব্যক্তিগত বিষয় যেমন- বিয়ে, তালাক্ব, ওয়ারিসী সম্পত্তির ভাগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীস মোতাবেক নিজ নিজ মাযহাবের উপর ফায়সালা করে থাকে। কিন্তু লোকদের মধ্যকার বিভিন্ন লেনদেনের ব্যাপারে যখন ফায়সালা আসে তখন তারা এক্ষেত্রে বিপরীত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। কেননা তাদের উলামায়ে সূ‘ গণ এই বুঝ দিয়েছে যে, নবী (স) বলেছেন : أنتم أعلم بأمر دنياكم ‘‘তোমরা দুনিয়ার বিষয়ে বেশি জান।’’ [সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফাযায়েল باب وُجُوبِ امْتِثَالِ مَا قَالَهُ شَرْعًا دُونَ مَا ذَكَرَهُ -صلى الله عليه وسلم- مِنْ مَعَايِشِ الدُّنْيَا عَلَى سَبِيلِ الرَّأْىِ ; হা/৬২৭৭, আলবানীর সহীহুল জামে‘উস সগীর ওয়া যিয়াদাতাহু১/১৪৮৮ নং] আর এই হুকুমটি আম (ব্যাপক) দাবি সম্পন্ন। সুতরাং প্রত্যেক ঐ সমস্ত ব্যাপার যেখানে দুনিয়াবী কর্মকান্ড জড়িত সে ব্যাপারে আমরা স্বাধীন। কেননা নবী (স) স্বয়ং বলেছেন : أنتم أعلم بأمر دنياكم ‘‘তোমরা দুনিয়ার বিষয়ে বেশি জান।’’যদিও এটি একটি সংশয়ের সৃষ্টি করে কিন্তু আমরা দেখি তারা ঐ সমস্ত বিষয়ের বৈধতাকেও স্বীকৃতি দেয়। যেমন- হদ ক্বায়েম না করা, মদ পান প্রভৃতি বিষয়ে তারা ইসলামী শরিয়াতের বিপরীতে অবস্থান করে। এখন যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই তবে কিছু ব্যাপারে সংশয়ের বাস্তবতা সঠিক হলেও শেষোক্ত আইনগুলোর ব্যাপারে তাদের ব্যাপারে কোন সংশয় থাকে না। আলোচ্য অভিযোগের শেষাংশে বর্ণিত (দুর্বলতার সময় করণীয়) বিষয়ে বলা যায় : যখন আল্লাহ তাআলা জিহাদ ফরয হওয়ার পরে বললেন : يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَـ ‘‘হে নবী! আপনি মু’মিনদের ক্বিতালের প্রতি উদ্বুদ্ধ করুন। যদি তোমাদের মধ্যে বিশজন সবরকারী হয় তবে তারা দু’শ এর উপর বিজয়ী হবে। আর যদি তোমাদের মধ্যে একশ জন সবরকারী হয় তারা এক হাজার কাফিরের উপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা নির্বোধ লোক।’’ [সূরা আনফাল : ৬৫ আয়াত]আয়াতটিতে দশজন কাফিরের মোকাবেলায় একজন মু‘মিনকে ক্ববুল করা হয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন : الْآَنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَلْفٌ يَغْلِبُوا أَلْفَيْنِ بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘‘এখন আল্লাহ তোমাদের থেকে বোঝা হালকা করে দিয়েছেন এবং তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে বলে জেনেছেন। অতএব যদি তোমাদের মধ্যে একশ জন সবরকারী হয় তবে তারা দু’শ জনের উপর জয় লাভ করবে আর এক হাজার হলে দু’ হাজারের উপর জয়লাভ করবে। আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।’’ [সূরা আনফাল : ৬৬ আয়াত]অনেক আলেম বলেন উক্ত অবস্থা পরিস্থিতি বিশেষে প্রযোজ্য। ......[সংযোজন : ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন : যখন ِ إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ আয়াতটি নাযিল হল, তখন দশ জনের বিপরীতে একজনের পলায়নও নিষিদ্ধ করা হল, তখন এটা মুসলিমদের উপর দুঃসাধ্য মনে হলে পরে তা লাঘবের বিধান এলো الْآَنَ خَفَّفَ اللَّهُ عَنْكُمْ وَعَلِمَ أَنَّ فِيكُمْ ضَعْفًا فَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِئَةٌ صَابِرَةٌ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ ইবনু আব্বাস (রা) বলেন : فَلَمَّا خَفَّفَ اللهُ عَنْهُمْ مِنَ الْعِدَّةِ نَقَصَ مِنَ الصَّبْرِ بِقَدْرِ مَا خَفَّفَ عَنْهُمْ ‘‘আল্লাহ তাদেরকে সংখ্যার দিকে থেকে যখন হাল্কা করে দিলেন তাদের সবরের ত্রুটির কারণে, সেই পরিমাণে তাদের সবরও হ্রাস পেল।’’ (সহীহ বুখারী- কিতাবুত তাফসীর, সূরা আনফাল)সাওবান (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : يُوْشِكُ الْاُمَمُ اَنْ تَدَاعي عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَي الْأكِلَةُ اِلي قَصْعَتِهَا، فَقَالَ قَائِلٌ : وَمِنْ قِلَّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ؟ قَالَ بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيْرٌ، وَلكِنَّكُمْ غُثَاءُ كَغُثَاءِ السَّيْلِ، وَلَيَنَزِعَنَّ اللهُ مِنْ صُدُوْرِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَاَبةَ مِنْكُمْ، وَلَيَقْذِفَنَّ فِيْ قُلُوْبِكُمُ الْوَهَنَ . قَاَل قَائِلٌ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ! وَمَا الْوَهْنُ؟ قَالَ : حُبُّ الدُّنْيَا وَكَرَاهِيَّةُ الْمَوْتِ ـ ‘‘অচিরেই বিশ্বের অন্যান্য জাতি তোমাদের ওপর হামলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন লোভী পেটুকেরা খাবার পাত্রে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তখন জনৈক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এমনটি হবে? তিনি বললেন, না। বরং সে সময় তোমরা সংখ্যায় অধিক সংখ্যক হবে কিন্তু তোমাদের অবস্থা হবে খড়-কুটার মত।। আল্লাহ তোমাদের দুশমনের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দূর করে দিবেন এবং তোমাদের অন্তরে অলসতার সৃষ্টি হয়ে যাবে। তখন জনৈক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রসূল! অলসতার সৃষ্টি হবে কেন? তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি মহববত আর মৃত্যুকে অপছন্দ (ভয়) করার কারণে।’’ [আবূ দাউদ ৪২৯৭, মিশকাত ৫৩৬৯; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন- আলবানীর মিশকাত ৩/১৪৭৫ পৃ.] হাসান (রহ) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (স)-এর একজন সাহাবী আয়েয ইবনু আমর (রা) একবার উবায়দুল্লাহ ইবনু যিয়াদের কাছে গেলেন। তখন তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন,বৎস! আমি রসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছি : إِنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الْحُطَمَةُ ‘‘নিকৃষ্টতম রাখাল হচ্ছে অত্যাচারী শাসক।’’ সুতরাং তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া থেকে সাবধান থাকবে। তখন সে বলল : বসে পড়! তুমি হচ্ছ নবী (স)’র সাহাবীদের ভূষি স্বরূপ। জবাবে তিনি (রা) বললেন : وَهَلْ كَانَتْ لَهُمْ نُخَالَةٌ إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ وَفِى غَيْرِهِمْ ‘‘তাঁদের মধ্যেও কি ভূষি আছে? ভূষি তো তাদের পরবর্তীদের এবং অন্যান্যদের মধ্যে।’’ [সহীহ মুসলিম ৪৬২৭ (২৩/১৮৩০)]মিরদাস আসলামী (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : يَذْهَبُ الصَّالِحُوْنَ الْأَوَّلُ فَالْأَوَّلُ وَتَبْقى حُفَالَةٌ كَحُفَالَةِ الشَّعِيْرِ أَوِ التَّمَرِ لاَ يُبَالِيْهِمُ اللهُ بَالَةً ‘‘ভাল ও নেককার লোকেরা (পর্যায়েক্রমে) একের পর এক চলে যাবে। অতঃপর অবশিষ্টরা যব অথবা খেজুরের নিকৃষ্ট চিটার ন্যায় থেকে যাবে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ করবেন না।’’ [সহীহ বুখারী ৬৪৩৪, মিশকাত ৫৩৬২]সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) থেকে বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছি : اِنَّ الْاِيْمَانَ بَدَا غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَمَا بَدَا فَطُوْبَى يَوْمَئِذٍ لِلْغُرَبَاءِ اِذَا فَسَدَ الزَّمَانُ وَالَّذِىْ نَفْسُ أَبِى الْقَاسِمُ بِيَدِه لَيَاُرِزَنَّ الْاِيْمَانُ بَيْنَ هَذَيْنِ الْمَسْجِدَيْنِ كَمَا تَازُ الْحَيَّةُ فِىْ جُحْرِهَا ‘‘নিশ্চয় ঈমান উৎপত্তি লাভ করেছে গরীব (পরবাসী/দুর্বল) অবস্থায় এবং তা অচিরেই প্রত্যাবর্তন করবে সেই অবস্থায়, যে অবস্থায় উৎপত্তি লাভ করেছিল। সুতরাং মোবারকবাদ ঐ দিন সেইসব গরীবদের জন্য, যখন ফাসাদের যামানা হবে। যাঁর হাতে আবূল কাসিমের জীবন! সেই সত্তার ক্বসম! ঈমান এই দুই মাসজিদের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ করবে, সর্প যেমন তার গর্তে প্রবেশ করে থাকে।’’ [সহীহ মুসলিম ২৬৮ (২৩২/১৪৬), মুসনাদে আহমাদ (ইফা) ১/৯৯ নং] (বাংলা অনুবাদক)]তাছাড়া আমাদের কাছে এই দুর্বলতার সমর্থনে দলিল মজুদ রয়েছে যা এর সুস্পষ্টতা ও ব্যাপকতা ব্যক্ত করে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ‘‘আল্লাহ কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে বোঝা চাপান না’’ (সূরা বাক্বারাহ : ২৮৬ আয়াত)। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন : فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ‘‘সুতরাং আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় কর’’ (সূরা তাগাবুন : ১৬ আয়াত)।যদি আমরা তর্কের খাতিরে মেনে নিই যে, আলেম-উলামাদের বর্ণিত শর্তের আলোকে এই সমস্ত হাকিম/শাসকদের উৎখাত করা ওয়াজিব। তবুও সেক্ষেত্রে এটা আমাদের প্রতি ওয়াজিব হয় না। কেননা তাদের পতন ঘটানোর মত শক্তি-সামর্থ্য আমাদের নেই। বিষয়টি যদিও সুস্পষ্ট, এরপরও মানুষ নাফসের অসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) যুক্ত’’ - শায়েখ উসায়মীন। [উর্দু অনুবাদক]]
সুতরাং কোন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে কুরআনের নিম্নোক্ত হক্ব পূর্ণাঙ্গরূপে আদায় করা যাবে :
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
‘‘তিনি রসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও দ্বীনে হক্ব সহকারে, যেন তা সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী হয়- যদিও মুশরিকদের কাছে তা অপছন্দনীয়।’’ [.সূরা তাওবা : ৩৩ আয়াত।]
নিঃসন্দেহে এর একটিই পদ্ধতি- যা রসূলুল্লাহ (স) নিজের সাহাবীদের (রা) বলেছিলেন। তিনি নিজের প্রত্যেক খুতবাতেও বলতেন : وَخَيْرَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ ‘‘সর্বোত্তম হিদায়াত (পথ) হল মুহাম্মাদ (স)’র হিদায়াত।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ১৮৯০ (৪৩/৮৬৭), মিশকাত ১৪১।]
এ কারণে সমস্ত মুসলিম এবং কেবল মুসলিম রাষ্ট্রেই নয় বরং দুনিয়াব্যাপী ইসলামী হুকুম ক্বায়েমের সহযোগিতা করা ওয়াজিব। সর্বপ্রথম সেখানে দা‘ওয়াতকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করবে যেভাবে নবী (স) দা‘ওয়াত দেয়া শুরু করেছিলেন। যা সংক্ষেপে আমি দু’টি শব্দে উল্লেখ করে থাকি : التصفيه والتربيه [(ক) তাসফিয়্যাহ (পবিত্রতা/সংস্কার-সংশোধন) ও (খ) তারবিয়্যাহ (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ)।]
আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহিত যার সাথে বিভ্রান্তি ও জ্ঞানের দৈনতা জড়িত। বরং বিভ্রান্ত বলাই বেশি পরিপূরক। কেননা তাদের জ্ঞান না থাকাটা অসম্ভব। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই তারা চরমপন্থাকে পছন্দ করে, যার ফলে হাকিম/শাসককে কাফির বলা ছাড়া আর অন্য কোন ব্যাপারে তাদের প্রতি বিভ্রান্ত হওয়ার বিষয়টি দেখা যায় না। ফলে তাদের অবস্থা তেমনই হয়েছে, যেমন তাদের পূর্বে আল্লাহ’র যমীনে ইক্বামাতে দ্বীন ও ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে দা‘ওয়াত দাতাদের অবস্থা হয়েছিল। তারা শাসকদেরকে কাফির ঘোষণা করে। অতঃপর তাদের তরফ থেকে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার ছাড়া আর কোন কিছুই পাওয়া যায়নি।
আমরা সবাই জানি, বিগত বেশ কয়েক বছরে উক্ত ফিতনার কারণে মক্কা থেকে শুরু করে মিশর পর্যন্ত নেতৃবৃন্দকে হত্যা এবং অসংখ্য নিরাপরাধ মুসলিমের রক্ত অন্যায়ভাবে ঝড়ানো হয়েছে। অবশেষে সিরিয়া ও আলজেরিয়াতেও অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা ঘটে...।
এ সবের ভিত্তি কেবলই একটি। তারা কিতাব ও সুন্নাতের দলিল-প্রমাণের বিরোধিতা করছে, বিশেষভাবে নিচের আয়াতটির। আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’’ [.সূরা আহযাব : ২১ আয়াত।]
তাহলে আমরা যখন যমীনে হুকুমে ইলাহী ক্বায়েম করতে চাইব, তখন কি হাকিম/শাসকদের সাথে ক্বিতাল করার মাধ্যমে করব? অথচ সেই সামর্থ্য আমাদের নেই। নাকি আমরা সেটাই করব যা নবী (স) করেছিলেন? নিঃসন্দেহে এর জবাব হল : لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘‘নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’’ [সূরা আহযাব- ২১]
এখন আমরা দেখব রসূলুল্লাহ (স) কিভাবে শুরু করেছিলেন :
আপনারা জানেন যে, রসূলুল্লাহ (স) সর্বপ্রথম তাদের দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন যাদের দা‘ওয়াত গ্রহণের মানসিক সম্ভাব্যতা ছিল। অতঃপর দা‘ওয়াতে লাব্বায়েক বলার মত ব্যক্তিরা লাব্বায়েক বলল। এটা নবী (স)-এর জীবন চরিত থেকে প্রমাণিত। অতঃপর দুর্বলতা ও বিরোধিতাকারীদের নির্যাতনের শিকার হলেন। শেষাবধি প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরতের হুকুম এবং তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহ... এমনকি আল্লাহ তাআলা মদীনাতে ইসলাম ক্বায়েম করলেন। অতঃপর কাফিরদের আক্রমণের ও ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হলেন।
এ কারণে আমি তা‘লিম (পাঠদান) সর্বোপ্রথম জরুরি মনে করি, যা নবী (স) করেছিলেন। কিন্তু আমি কেবল তা‘লিমই বলছি না, কিন্তু কেন? অর্থাৎ আমি তা‘লিম শব্দটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। উম্মাতের তা‘লিম তো দ্বীনি কাজ। অথচ উম্মাতের মধ্যে এমন অনেক বিষয় তা‘লিমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্কই নেই। বরং সেগুলো ইসলামকে কেবল বিকৃতই করে। এমনকি ঐ সমস্ত বিষয়কেও ধ্বংস করে যা সহীহ ইসলামের অধীনে অর্জিত হত।
সুতরাং ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দাতাগণের জন্য ওয়াজিব হল, ঐ বিষয়ের দ্বারা শুরু করা যা এখন আমি বলব অর্থাৎ-
১.তাসফিয়্যাহ (পবিত্রতা/সংস্কার-সংশোধন) : ঐ সমস্ত বিষয় থেকে ইসলামকে পবিত্র করা যা এর মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং তার পবিত্র-পরিচ্ছন্ন সত্তাকে কলুষিত করেছে। যার সম্পর্ক কেবল ফুরু‘য়ী (শাখা/প্রশাখাগত) ও ইখতিলাফী (মতপার্থক্য) মাসায়েলেই নয়, বরং তা আক্বীদাকেও বিপর্যস্ত করেছে।
২.তারবিয়্যাত (শিক্ষা-প্রশিক্ষণ) : পূর্বোক্ত তাসফিয়্যাহ’র (পবিত্রতা / সংস্কার-সংশোধনের) সাথে জড়িত অপর বিষয়টি হল তারবিয়্যাহ। অর্থাৎ যুবকদের ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান। [.শায়েখ উসায়মীন (রহ) বলেছেন : ‘‘শায়েখ আলবানী (রহ) সর্বপ্রথম ইসলামে তাসফিয়্যাহ (পবিত্রতা/সংস্কার) করতে চেয়েছেন। কেননা ইসলাম আজ অনেক শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। ১) আক্বীদাগত শাখা, ২) আখলাক্ব/চারিত্রিক শাখা, ৩) মুআমালাত/ লেনদেনগত শাখা, ৪) ইবাদতগত শাখা তথা উক্ত চারটি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। যেমন :ক. আক্বীদাগত শাখা- কেউ আশআরী, কেউ মু‘তাযিলা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখা। খ. ইবাদতগত শাখা- কেউ সূফী, কেউ ক্বাদেরী প্রভৃতি শাখা। গ. মুআমালাত/ লেনদেনগত শাখা : কেউ পুঁজিবাদী - সুদকে হালাল বলে, আবার কেউ বলে হারাম। কেউ লটারী, জুয়াকে হারাম গণ্য করে, আবার কেউ বলে হালাল।এমতাবস্থায় আমাদের সর্বপ্রথম জরুরি হল, ইসলামকে বর্তমানের এই সমস্ত শাখা ও বিভক্তি থেকে তাসফিয়্যাহ (পবিত্র/সংস্কার) করা। এ কারণে উলামা ও ছাত্রদের অনেক গুরুদায়িত্ব রয়েছে। অতঃপর আমরা যুবকদের এ সমস্ত শাখা-বিভক্তি থেকে পবিত্র করার তারবিয়্যাত (শিক্ষা-প্রশিক্ষণ) দেব। পরিশেষে যুবকরা কুরআন ও সুন্নাহ’র ভিত্তিতে সালফে সালেহীনদের উপলব্ধিতে সঠিক আক্বীদা, আদব ও উন্নত আখলাক্বের অধিকারী হবে। [উর্দু অনুবাদক]]
আমরা যখন বর্তমান যামানার ইসলামী আন্দোলনগুলোকে বিগত একশ’ বছরের পর্যালোচনার চোখে দেখি, তখন তাদের দ্বারা ফিতনা-ফাসাদের বিস্তার ছাড়া আর কোন ফায়দাই খুঁজে পায় না। কেউ কেউ নিরাপরাধ প্রাণগুলোর রক্তপাত করেছে, অথচ কোন ফায়দাই অর্জিত হয়নি পূর্বোক্ত কথাগুলোর সারাংশ হল, আমরা কিতাব ও সুন্নাতের বিরোধী আক্বীদা শ্রবণ করছি, যাদের দাবি হল- ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করছি। [.আমাদের বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বজুড়ে ইসলামের নামে যেসব সংগঠন/আন্দোলন রয়েছে এর অধিকাংশই কুরআন ও সহীহ হাদীসের দিকে সালফে-সালেহীনদের উপলব্ধির আলোকে দা‘ওয়াত দেয়ার পরিবর্তে নিজ নিজ মাযহাব, তরীক্বা ও উপলব্ধির দিকে দা‘ওয়াত দিয়ে থাকে। তাছাড়া ক্ষমতা, অর্থ ও জনপ্রিয়তার মোহে বিভিন্ন বিদআত (মিলাদুন্নবী/দুআর মাহফিল, বরকত/সওয়াবের নিয়তে বিভিন্ন স্থান সফর), শিরক (পীরবাদ, কবরপূজা), বিকৃত আক্বীদা (আল্লাহ’র নাম ও গুণাবলীতে বিকৃতি, আশআরী-মাতুরিদী-মুতাযিলা-শিয়া আক্বীদা, সাহাবীদের প্রতি রাজনৈতিক ও বিভ্রান্তির দোষারোপ) ও জাহেলিয়াতের সাথে আপোষকামীতা (গণতন্ত্র, সুদকে ইসলামী/আরবি পরিভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বৈধ করা), ইসলামের সবকিছুকেই রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন হওয়ার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত করা- প্রভৃতির মধ্যে লিপ্ত। এমনকি বিদআত ও জাহেলী অনেক কর্মকান্ডকে তারা ইসলাম ক্বায়েমের হিকমাত বলেও আখ্যায়িত করে। ফলে সাধারণ জনগণের পক্ষে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করা অত্যন্ত দূরূহ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। [উর্দু অনুবাদক নিজ পক্ষ থেকে বিভিন্ন দলের নাম উল্লেখ পূর্বক তাদের বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরেছেন। আমি (বাংলা অনুবাদক) সুনির্দিষ্টভাবে দলগুলোর নাম উল্লেখ না করে মূল কথাগুলো তুলে ধরেছি]]
এমন উদ্দেশ্যেই আমরা একটি বাক্য উল্লেখ করছি যা তাদেরই কোন দা‘ওয়াতদাতার উদ্ধৃতি। যে ব্যাপারে আমাদের আকাঙ্ক্ষা হল, তাদের অনুসারীরা এটাকেই বাধ্যতামূলক বানিয়ে নেবে এবং সেই লেবাসেই/ পরিচয়ে নিজেদের প্রকাশ করবে। বাক্যটি হল :
أقيموا دولة الإسلام في قلوبكم تقم لكم على أرضكم
‘‘নিজেদের ক্বলবে (অন্তরে) ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েম কর, যা তিনি (আল্লাহ তাআলা) তোমাদের জন্য তোমাদের যমীনের উপর তা ক্বায়েম করবেন।’’ [.শায়েখ উসায়মীন (রহ) বলেন : এটা খুবই উপকারী বাক্য। আল্লাহু মুস্তাআন (আল্লাহই সর্বোচ্চ সাহায্যকারী)। -উর্দু অনুবাদক]
কেননা যদি কোন মুসলিমের আক্বীদা কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে সহীহ হয়ে যায় তখন তার ইবাদত, আখলাক্ব, ব্যবহার প্রভৃতি নিজের পক্ষ থেকেই সংশোধিত হতে থাকে।
কিন্তু আমার দৃষ্টিতে ঐ সমস্ত লোক উক্ত বাক্যের দাবির উপর আমল করে না। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েমের পক্ষে আওয়াজ তুলে যাচ্ছে। তাদের প্রতি যেন কবির কবিতার এই অংশটি খুবই প্রযোজ্য :
ترجو النجاة ولم تسلك مسالكها إن السفينة لا تجري على اليبس
‘‘তুমি নাজাতের আকাঙ্ক্ষা কর অথচ তুমি সে পথ পাওনি।
জেনে রাখ! নৌকা কখনো শুকনা স্থানে চলে না।’’
আশাকরি প্রশ্নের উত্তরে এতটুকুই যথেষ্ট.....। আল্লাহু মুস্তাআন (আল্লাহই সর্বোচ্চ সাহায্যকারী)।
আমরা সবাই জানি, বিগত বেশ কয়েক বছরে উক্ত ফিতনার কারণে মক্কা থেকে শুরু করে মিশর পর্যন্ত নেতৃবৃন্দকে হত্যা এবং অসংখ্য নিরাপরাধ মুসলিমের রক্ত অন্যায়ভাবে ঝড়ানো হয়েছে। অবশেষে সিরিয়া ও আলজেরিয়াতেও অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা ঘটে...।
এ সবের ভিত্তি কেবলই একটি। তারা কিতাব ও সুন্নাতের দলিল-প্রমাণের বিরোধিতা করছে, বিশেষভাবে নিচের আয়াতটির। আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’’ [.সূরা আহযাব : ২১ আয়াত।]
তাহলে আমরা যখন যমীনে হুকুমে ইলাহী ক্বায়েম করতে চাইব, তখন কি হাকিম/শাসকদের সাথে ক্বিতাল করার মাধ্যমে করব? অথচ সেই সামর্থ্য আমাদের নেই। নাকি আমরা সেটাই করব যা নবী (স) করেছিলেন? নিঃসন্দেহে এর জবাব হল : لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ ‘‘নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’’ [সূরা আহযাব- ২১]
এখন আমরা দেখব রসূলুল্লাহ (স) কিভাবে শুরু করেছিলেন :
আপনারা জানেন যে, রসূলুল্লাহ (স) সর্বপ্রথম তাদের দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন যাদের দা‘ওয়াত গ্রহণের মানসিক সম্ভাব্যতা ছিল। অতঃপর দা‘ওয়াতে লাব্বায়েক বলার মত ব্যক্তিরা লাব্বায়েক বলল। এটা নবী (স)-এর জীবন চরিত থেকে প্রমাণিত। অতঃপর দুর্বলতা ও বিরোধিতাকারীদের নির্যাতনের শিকার হলেন। শেষাবধি প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরতের হুকুম এবং তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহ... এমনকি আল্লাহ তাআলা মদীনাতে ইসলাম ক্বায়েম করলেন। অতঃপর কাফিরদের আক্রমণের ও ইয়াহুদীদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হলেন।
এ কারণে আমি তা‘লিম (পাঠদান) সর্বোপ্রথম জরুরি মনে করি, যা নবী (স) করেছিলেন। কিন্তু আমি কেবল তা‘লিমই বলছি না, কিন্তু কেন? অর্থাৎ আমি তা‘লিম শব্দটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। উম্মাতের তা‘লিম তো দ্বীনি কাজ। অথচ উম্মাতের মধ্যে এমন অনেক বিষয় তা‘লিমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্কই নেই। বরং সেগুলো ইসলামকে কেবল বিকৃতই করে। এমনকি ঐ সমস্ত বিষয়কেও ধ্বংস করে যা সহীহ ইসলামের অধীনে অর্জিত হত।
সুতরাং ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দাতাগণের জন্য ওয়াজিব হল, ঐ বিষয়ের দ্বারা শুরু করা যা এখন আমি বলব অর্থাৎ-
১.তাসফিয়্যাহ (পবিত্রতা/সংস্কার-সংশোধন) : ঐ সমস্ত বিষয় থেকে ইসলামকে পবিত্র করা যা এর মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং তার পবিত্র-পরিচ্ছন্ন সত্তাকে কলুষিত করেছে। যার সম্পর্ক কেবল ফুরু‘য়ী (শাখা/প্রশাখাগত) ও ইখতিলাফী (মতপার্থক্য) মাসায়েলেই নয়, বরং তা আক্বীদাকেও বিপর্যস্ত করেছে।
২.তারবিয়্যাত (শিক্ষা-প্রশিক্ষণ) : পূর্বোক্ত তাসফিয়্যাহ’র (পবিত্রতা / সংস্কার-সংশোধনের) সাথে জড়িত অপর বিষয়টি হল তারবিয়্যাহ। অর্থাৎ যুবকদের ইসলামের সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান। [.শায়েখ উসায়মীন (রহ) বলেছেন : ‘‘শায়েখ আলবানী (রহ) সর্বপ্রথম ইসলামে তাসফিয়্যাহ (পবিত্রতা/সংস্কার) করতে চেয়েছেন। কেননা ইসলাম আজ অনেক শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। ১) আক্বীদাগত শাখা, ২) আখলাক্ব/চারিত্রিক শাখা, ৩) মুআমালাত/ লেনদেনগত শাখা, ৪) ইবাদতগত শাখা তথা উক্ত চারটি শাখাতে বিভক্ত হয়েছে। যেমন :ক. আক্বীদাগত শাখা- কেউ আশআরী, কেউ মু‘তাযিলা প্রভৃতি বিভিন্ন শাখা। খ. ইবাদতগত শাখা- কেউ সূফী, কেউ ক্বাদেরী প্রভৃতি শাখা। গ. মুআমালাত/ লেনদেনগত শাখা : কেউ পুঁজিবাদী - সুদকে হালাল বলে, আবার কেউ বলে হারাম। কেউ লটারী, জুয়াকে হারাম গণ্য করে, আবার কেউ বলে হালাল।এমতাবস্থায় আমাদের সর্বপ্রথম জরুরি হল, ইসলামকে বর্তমানের এই সমস্ত শাখা ও বিভক্তি থেকে তাসফিয়্যাহ (পবিত্র/সংস্কার) করা। এ কারণে উলামা ও ছাত্রদের অনেক গুরুদায়িত্ব রয়েছে। অতঃপর আমরা যুবকদের এ সমস্ত শাখা-বিভক্তি থেকে পবিত্র করার তারবিয়্যাত (শিক্ষা-প্রশিক্ষণ) দেব। পরিশেষে যুবকরা কুরআন ও সুন্নাহ’র ভিত্তিতে সালফে সালেহীনদের উপলব্ধিতে সঠিক আক্বীদা, আদব ও উন্নত আখলাক্বের অধিকারী হবে। [উর্দু অনুবাদক]]
আমরা যখন বর্তমান যামানার ইসলামী আন্দোলনগুলোকে বিগত একশ’ বছরের পর্যালোচনার চোখে দেখি, তখন তাদের দ্বারা ফিতনা-ফাসাদের বিস্তার ছাড়া আর কোন ফায়দাই খুঁজে পায় না। কেউ কেউ নিরাপরাধ প্রাণগুলোর রক্তপাত করেছে, অথচ কোন ফায়দাই অর্জিত হয়নি পূর্বোক্ত কথাগুলোর সারাংশ হল, আমরা কিতাব ও সুন্নাতের বিরোধী আক্বীদা শ্রবণ করছি, যাদের দাবি হল- ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করছি। [.আমাদের বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বজুড়ে ইসলামের নামে যেসব সংগঠন/আন্দোলন রয়েছে এর অধিকাংশই কুরআন ও সহীহ হাদীসের দিকে সালফে-সালেহীনদের উপলব্ধির আলোকে দা‘ওয়াত দেয়ার পরিবর্তে নিজ নিজ মাযহাব, তরীক্বা ও উপলব্ধির দিকে দা‘ওয়াত দিয়ে থাকে। তাছাড়া ক্ষমতা, অর্থ ও জনপ্রিয়তার মোহে বিভিন্ন বিদআত (মিলাদুন্নবী/দুআর মাহফিল, বরকত/সওয়াবের নিয়তে বিভিন্ন স্থান সফর), শিরক (পীরবাদ, কবরপূজা), বিকৃত আক্বীদা (আল্লাহ’র নাম ও গুণাবলীতে বিকৃতি, আশআরী-মাতুরিদী-মুতাযিলা-শিয়া আক্বীদা, সাহাবীদের প্রতি রাজনৈতিক ও বিভ্রান্তির দোষারোপ) ও জাহেলিয়াতের সাথে আপোষকামীতা (গণতন্ত্র, সুদকে ইসলামী/আরবি পরিভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে বৈধ করা), ইসলামের সবকিছুকেই রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন হওয়ার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত করা- প্রভৃতির মধ্যে লিপ্ত। এমনকি বিদআত ও জাহেলী অনেক কর্মকান্ডকে তারা ইসলাম ক্বায়েমের হিকমাত বলেও আখ্যায়িত করে। ফলে সাধারণ জনগণের পক্ষে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করা অত্যন্ত দূরূহ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। [উর্দু অনুবাদক নিজ পক্ষ থেকে বিভিন্ন দলের নাম উল্লেখ পূর্বক তাদের বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরেছেন। আমি (বাংলা অনুবাদক) সুনির্দিষ্টভাবে দলগুলোর নাম উল্লেখ না করে মূল কথাগুলো তুলে ধরেছি]]
এমন উদ্দেশ্যেই আমরা একটি বাক্য উল্লেখ করছি যা তাদেরই কোন দা‘ওয়াতদাতার উদ্ধৃতি। যে ব্যাপারে আমাদের আকাঙ্ক্ষা হল, তাদের অনুসারীরা এটাকেই বাধ্যতামূলক বানিয়ে নেবে এবং সেই লেবাসেই/ পরিচয়ে নিজেদের প্রকাশ করবে। বাক্যটি হল :
أقيموا دولة الإسلام في قلوبكم تقم لكم على أرضكم
‘‘নিজেদের ক্বলবে (অন্তরে) ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েম কর, যা তিনি (আল্লাহ তাআলা) তোমাদের জন্য তোমাদের যমীনের উপর তা ক্বায়েম করবেন।’’ [.শায়েখ উসায়মীন (রহ) বলেন : এটা খুবই উপকারী বাক্য। আল্লাহু মুস্তাআন (আল্লাহই সর্বোচ্চ সাহায্যকারী)। -উর্দু অনুবাদক]
কেননা যদি কোন মুসলিমের আক্বীদা কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে সহীহ হয়ে যায় তখন তার ইবাদত, আখলাক্ব, ব্যবহার প্রভৃতি নিজের পক্ষ থেকেই সংশোধিত হতে থাকে।
কিন্তু আমার দৃষ্টিতে ঐ সমস্ত লোক উক্ত বাক্যের দাবির উপর আমল করে না। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র ক্বায়েমের পক্ষে আওয়াজ তুলে যাচ্ছে। তাদের প্রতি যেন কবির কবিতার এই অংশটি খুবই প্রযোজ্য :
ترجو النجاة ولم تسلك مسالكها إن السفينة لا تجري على اليبس
‘‘তুমি নাজাতের আকাঙ্ক্ষা কর অথচ তুমি সে পথ পাওনি।
জেনে রাখ! নৌকা কখনো শুকনা স্থানে চলে না।’’
আশাকরি প্রশ্নের উত্তরে এতটুকুই যথেষ্ট.....। আল্লাহু মুস্তাআন (আল্লাহই সর্বোচ্চ সাহায্যকারী)।
-শায়খ ইবনু বায (রহ)
[শায়খ ইবনু বাযের এই প্রশ্নোত্তরটি নেওয়া হয়েছে, حوار حول مسائل التكفير (প্রকাশক : মাকতাবাহ আল-ইমাম যাহাবী, কুয়েত, ১৪২০ হি :/২০০০ ‘ঈসায়ী) থেকে। -অনুবাদক]
سـ ١ : هناك من يقول : إن هذا القول وهو قول السلف : إنا لا نكفر أحدا من أهل الملة بذنب ما لَم يستحله ، يقول هذا هو قول الْمرجئة ؟
প্রশ্ন-১: অনেকে বলেন : সালাফদের থেকে এই উক্তি রয়েছে যে, তারা বলেছেন : ‘‘আমরা এই মিল্লাতের (ইসলামের) কাউকেই তার পাপের জন্য কাফির ঘোষণা করতে পারব না, যদি না সে তা (পাপটি) হালাল মনে করে’’ -তারা বলেন, এটা হল মুরজিয়াদের উক্তি।
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا غلط ، هذا قول أهل السنة لا يكفر بذنب ما لَم يستحله ، الزاني لا يكفر ، وشارب الْخمر لا يكفر ، بل عاص ، إلا إذا استحل ذلك ، هذا قول أهل السنة خلافا للخوارج ،
الْخوارج هم الذين يكفرون بالذنوب ، أما أهل السنة فيقولون : عاص يُجب ضعيف الإيْمان ، خلافا للخوارج والْمعتزلة ، هذا قول أهل السنة والْجماعة ، أما إذا استحله ، قال : الزنا حلال يكفر ، أو قال : الْخمر حلال يكفر ، عند أهل السنة والْجماعة جَميعا ، أو قال : الربا حلال يكفر ، أو قال : عقوق الوالدين حلال يكفر ، لكن إذا فعله من غيْر اعتقاد ، وهو يعلم أنه حرام ، عق والديه يعلم أنه حرام ، زنا يعلم أنه حرام ، شرب الْخمر يعلم أنه حرام ، هذا عاص ، ناقص الإيْمان ، ضعيف الإيْمان عند أهل السنة ولا يكفر ، لكن يستحق أن يقام عليه حد الْخمر ، حد الزنا ، يؤدب عن العقوق ، يؤدب عن أكل الربا . لا بأس طيب .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এটা ভুল কথা। মূলত এটাই আহলে সুন্নাতেরই উক্তি (নীতি) : ‘‘কাউকে পাপের জন্য কাফির বলা যাবে না, যতক্ষণ সে তা হালাল গণ্য করে।’’ একজন যিনাকারী কাফির নয়, একজন মদপানকারী কাফির নয়- বরং সে অবাধ্য, যদি না সে তার কাজটি হালাল গণ্য করে। খারেজীদের মোকাবেলায় এটাই আহলে সুন্নাতের উক্তি।
খারেজীরা পাপের কারণে কাফির গণ্য করে থাকে। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত বলে থাকে : সে অবাধ্যদের একজন। তার ওপর হদ (শাস্তি) প্রয়োগ করা ওয়াজিব, তেমনি তার জন্য তাওবা করাও ওয়াজিব, কিন্তু সে কাফির নয়- যদি না পাপকে সে হালাল গণ্য করে। যদি সে যিনা করে, কিন্তু তাকে হালাল গণ্য না করে। তেমনি মদপান করে, কিন্তু তাকে হালাল গণ্য না করে। তেমনি অন্যান্য বিষয়েও। যেমন : সুদ খায় কিন্তু তা হালাল গণ্য করে না, তাহলে সে কাফির নয়। বরং সে পাপী- যা ঈমানের ত্রুটি, ঈমানের দুর্বলতা। এটা খারেজী ও মু‘তাযিলাদের বিপরীতে আহলে সুন্নাতের বক্তব্য। আর যদি হালাল গণ্য করে বলে : যিনা হালাল, তবে সে কাফির। কিংবা বলে : মদ হালাল, তবে সে কাফির- এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের সবাই একমত। কিংবা যদি কেউ বলে : সুদ হালাল, সে কাফির। কিংবা বলে : পিতামাতার অবাধ্যতা করা হালাল, তবে সে কাফির।
কিন্তু যদি তার আমলটি উক্ত আক্বীদা রাখা ব্যতিরেকে হয় এবং সে জ্ঞাত যে এটা হারাম। যেমন : পিতামাতার অবাধ্যতা করে, অথচ জানে তা হারাম। সে যিনা করে, কিন্তু জানে সেটা হারাম। মদপান করে, অথচ জানে সেটা হারাম। তবে এটা গোনাহ, ঈমানের ত্রুটি, ঈমানের দুর্বলতা। আহলে সুন্নাতের নিকট সে কাফির নয়। তার উপর যিনার হদ, মদপান করার হদ প্রযোজ্য। তেমনি পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য ও সুদ গ্রহণের জন্য তার ব্যাপারে সংশোধনমূলক (শাস্তির) ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। নিঃসন্দেহে এটা উত্তম।
سـ ٢ : هل العلماء الذين قالوا بعدم كفر من ترك أعمال الْجوارح ، مع تلفظه بالشهادتين ، ووجود أصل الإيْمان القلبي هل هم من الْمرجئة ؟
প্রশ্ন-২: যে সমস্ত আলেমরা বলেন, ‘‘তারা কাফির নয়- যারা সমস্ত আমলসমূহের শাখা-প্রশাখাগুলো ত্যাগ করে, সাথে সাথে দু’টি শাহাদাতের (কালেমায়ে শাহাদাতের) উচ্চারণ ঠিক রাখে এবং তাদের অন্তরে নীতিগতভাবে ঈমানের অস্তিত্ব রয়েছে’’ -তারা কি মুরজিয়া নন?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا من أهل السنة والْجماعة ، من قال بعدم كفر من ترك الصيام ، أو الزكاة ، أو الْحج ، هذا ليس بكافر ، لكنه أتى كبيْرة عظيمة ، وهو كافر عند بعض العلماء ، لكن على الصواب لا يكفر كفرا أكبر ، أما تارك الصلاة فالأرجح فيه أنه كفر أكبْر ، إذا تعمد تركها ، وأما ترك الزكاة ، والصيام ، والْحج ، فهو كفر دون كفر ، معصية وكبيرة من الكبائر ، والدليل على هذا أن النبي ﷺ قال في من منع الزكاة : «يؤتى به يوم القيامة يعذب بِماله»، كما دل عليه القرآن الكريْم : ﴿ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ ﴾، أخبْر النبي أنه يعذب بِماله ، بإبله ، وبقره ، وغنمه ، وذهبه ، وفضته ، ثُم يرى سبيله بعد هذا إلى الْجنة أو إلَى النار ، دل على أنه لَم يكفر ، كونه يرى سبيله إما إلَى الْجنة ، وإما إلَى النار ، دل على أنه متوعد ، قد يدخل النار ، وقد يكتفي بعذاب البَرزخ ، ولا يدخل النار ، بل يكون إلى الْجنة بعد العذاب الذي في البرزخ .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এই উক্তিটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত থেকেই এসেছে, যারা বলেছেন : কুফর সংঘটিত হয় না সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ তরক করার জন্যে। এ জন্যে সে কাফির নয়। কিন্তু সে ভয়ানক কবীরা গুনাহে লিপ্ত। কিছু আলেমের কাছে এরাও কাফির। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা কুফরে আকবার নয়। কিন্তু কেউ যদি সালাত তরক করে, সেক্ষেত্রে প্রাধান্যপ্রাপ্ত ( الراجح ) সিদ্ধান্ত হল, সেটা কুফরে আকবার- যখন সে স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করে। আর যদি সে সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ তরক করে, তবে সেটা كفر دون كفر (কুফরের থেকে কম কুফর), সেটা পাপ এবং কবীরা গুনাহগুলোর সর্বোচচ গুনাহর অন্তর্ভূক্ত। এর দলিল হল, নবী (স) যাকাত আদায় না করা সম্পর্কে বলেছেন : يؤتى به يوم القيامة يعذب بِماله ‘‘সে তার সম্পদসহ আসবে, তাকে তার মাল দ্বারাই আযাব দেয়া হবে।’’ [.‘‘যাকাত নাআদায়কারী’’ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর সার-সংক্ষেপ এটাই। বিস্তারিত হাদীসের কিতাবের ‘যাকাত’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য। (অনুবাদক)] তেমনিভাবে কুরআনে দলিল আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
‘‘সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা (যাকাতের সম্পদ) উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর (তার) যা তোমরা জমা রেখেছিলে।’’ [.সূরা তাওবা : ৩৫ আয়াত।]
নবী (স) জানিয়েছেন, তাদের আযাব দেয়া হবে তাদের মাল দ্বারা, উট দ্বারা, গরু দ্বারা, ভেড়া দ্বারা, সোনা ও রূপা দ্বারা। অতঃপর তাকে জান্নাত বা জাহান্নামের পথ দেখান হবে। [.যাকাত নাআদায়কারীর হাশরের ময়দানে তার সম্পদ, উট, গরু, ভেড়া দ্বারা শাস্তি লাভের বর্ণনার পর নবী (স) এর বাণী : فَيُرَى سَبِيلُهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّارِ ‘‘অতঃপর সে তার পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।’’ [সহীহ মুসলিম ২১৮০ (২৪/৯৮৭), মিশকাত ১৭৭৩। -অনুবাদক।] এটাই (হাদীসটি) প্রমাণ যে, সে কাফির নয়। (এরপর) হতে পারে সে দেখবে জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। এটা প্রমাণ করে, তাকে ভয়াবহভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করা হবে। তাকে হয়তো জাহান্নামে দাখিল করা হবে। কিংবা হয়তো কেবল বারযখে আযাব দেয়া হবে এবং জাহান্নামে দাখিল করা হবে না। কিংবা হতে পারে তাকে বারযাখে আযাব দেয়ার পর জান্নাতে দাখিল করা হবে।
سـ ٣ : شيخنا بالنسبة للإجابة على السؤال الأول فهم البعض من كلامك أن الإنسان إذا نطق بالشهادتين ولَم يعمل فإنه ناقص الإيْمان ، هل هذا الفهم صحيح ؟
প্রশ্ন-৩: (হে) আমাদের শায়খ! প্রথম প্রশ্নের জবাব প্রসঙ্গে বলছি, কিছু লোক আপনার বক্তব্যের মর্মটি থেকে বুঝেছে‘ যে, ‘‘যখন কেউ দু’টি শাহাদাতের (কালেমা শাহাদাতের) উচ্চারণ করে, কিন্তু আমল করে না, সেক্ষেত্রে তার ঈমানটি ত্রুটিযুক্ত’’ -এই বুঝটি কি সহীহ?
سَماحة الشيخ ابن باز : نعم . فمن وحدَّ اللهَ وأخلصَ له العبادةَ ، وصدّقَ رسول الله ﷺ ، لكنه ما أدى الزكاة ، أو ما صام رمضان ، أو ما حج مع الاستطاعة يكون عاصياً أتى كبيرة عظيمة ، ويُتوعدُ بالنارِ ، لكن لا يكفرُ على الصحيحِ ، أما من ترك الصلاةِ عمداً فإنه يكفرُ على الصحيحِ
শায়খ ইবনু বায (রহ) : হ্যাঁ, যে আল্লাহকে একক গণ্য করে এবং ইখলাসের সাথে তাঁর ইবাদত করে, আর রসূলুল্লাহ (স)-কে সত্যায়ন করে; যদিওবা সে যাকাত আদায় না করে, বা সিয়াম পালন না করে, কিংবা সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না- তাহলে সে গোনাহগার হবে, ফলে সে ভয়ানক কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়। তার জন্য জাহান্নামের ওয়াদা (ভয়ঙ্কর শাস্তি) রয়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও সহীহ কথা হল, সে কাফির নয়। তবে যদি স্বেচ্ছায় সালাত তরক করে, সেক্ষেত্রে তাকে কাফির গণ্য করাটাই সহীহ সিদ্ধান্ত।
سـ ٤ : أحسن الله إليك ، هل يَمكن صدورُ كفرِ عملي مُخرج من الْملة في الأحوال الطبيعية ؟
প্রশ্ন-৪: আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! এটা কি সম্ভব- কুফরে আমলী যা বিভিন্ন দেশে ( الأحوال الطبيعية -বৈশিষ্ট্যগতভাবে) প্রকাশ পেয়েছে, তাকি মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয়?
سَماحة الشيخ ابن باز : الكفر العملي يُخرج من الْملة مثل السجود لغيْر الله ، والذبح لغيْر الله كفر عملي يُخرج من الْملة فالذبح للأصنام ، أو للكواكبِ ، أو للجنِّ كفر عملي أكبر وهكذا لو صلى لَهم ، لو سجد لَهم يكفر كفراً عملياً أكبر - والعياذ بالله - ، هكذا لو سبّ الدينَ ، أو سب الرسولَ ، أو استهزأ بالله ، أو بالرسول . كفرٌ عملي أكبر عند جَميعِ أهل السنة والْجماعة .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : যে সমস্ত কুফর আমালী মিল্লাত (দ্বীন) থেকে খারিজ করে দেয় তার মেসাল (উদাহরণ) হল, গায়রুল্লাহকে সিজদা করা, গায়রুল্লাহর জন্যে যবেহ করা প্রভৃতি কুফরে আমালী মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয়। সুতরাং মূর্তির জন্য যবেহ করা, কিংবা তারকার জন্য বা জিনের জন্য প্রভৃতি কুফরে- আমালী-আকবার (আমলগত বড় কুফর)। এগুলোর মাধ্যমে যেন তাদের জন্য সালাত আদায় (ইবাদত) করা হয়, তাদেরকে সিজদা করা হয়। সে তখন কাফির হয়, বড় কুফরে আমালীর মাধ্যমে- এবং এর মাধ্যমে সে আল্লাহর থেকে বিতাড়িত। অনুরূপভাবে, যদি কেউ দ্বীন (ইসলাম)-কে গালাগালি দেয়, রসূলের (স) নিন্দা করে, আল্লাহ বা রসূলের (স) ব্যাপারে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে- তবে সেটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সবার নিকট বড় কুফরে আমালী। [.আমাদের বিরোধীপক্ষ ইমাম আলবানীর (রহ) ‘ফিতনাতুত তাকফীরের’’ বক্তব্য খণ্ডনে উপরোক্ত আমালী কুফরগুলোকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করে থাকেন। অথচ উক্ত আমলগুলো আক্বীদা, ইবাদত এবং আল্লাহ তাআলা ও রসূলের (স) হক্বের সাথে সম্পর্কিত, যা মুআমালাত বা লেনদেন তথা মানবীয় হক্বের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এ কারণে উক্ত আমলগুলো কেবল কুফরে আমালীই নয় বরং ‘ইবাদত ও আক্বীদাগত কুফর, যা দ্বীন থেকে খারিজ করে দেয় তথা বড় কুফর হিসাবে গণ্য। পক্ষান্তরে বিচার-লেনদেন তথা মুআমালাতের ক্ষেত্রে যতক্ষণ তা আক্বীদাকে নষ্ট করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন না করাটা ঐ সমস্ত আমালী কুফরের অন্তর্ভূক্ত যা ছোট কুফর ( كفر دون كفر )। কিন্তু এক্ষেত্রেও যদি হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল বলে, বা দ্বীন ইসলামের বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, গালি-গালাজ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে- তবে সেটা আক্বীদার বিরোধী হওয়ায় বড় কুফরের অন্তর্ভুক্ত হবে। যা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে। এ সম্পর্কিত ধারণা আমরা ‘ইবাদত ও ইতাআতের পার্থক্য’’ অনুচ্ছেদে আলোচনা করেছি। -অনুবাদক।]
سـ ٥ : سَماحة الشيخ : ما معنى الكفر العملي الذي يكون في الأحوال الطبيعية، والأصل القلبي لَم ينتقض ؟
প্রশ্ন-৫: মাননীয় শায়খ! ঐ সমস্ত কুফরে আমালীর অর্থ কী, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ( الأحوال الطبيعية -বৈশিষ্ট্যগতভাবে) রয়েছে, এর আন্তরিক অবস্থা কি (ঈমানের) ত্রুটি নয়?
سَماحة الشيخ ابن باز : مثل السجود لغير الله ، والذبح لغير الله كفر عمل ، مثل سبه لدين ، أو استهزأ بالدين كفر عملي - نسأل الله العافية - كفر أكبر .
শায়খ ইবনু বায (রহ): যেমন- গায়রুল্লাহকে সিজদা করা, গায়রুল্লাহর জন্য যবেহ করা কুফরে আমালী। আরো যেমন- দ্বীন (ইসলামকে) তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কিংবা দ্বীন নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করাটা কুফরে আমালী। আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি- এগুলো কুফরে আকবার।
سـ ٦ : السجود والذبح إذا كان جهلاً ، هل يفرق بين الْجهل والتعمد ؟
প্রশ্ন-৬: (গায়রুল্লাহর জন্য) সিজদা বা যবেহ করা যদি অজ্ঞতার জন্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছায় আমলটি সংঘটিত হওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا ما فيه جهلُ ... هذه من الأمور التِي لا تُجهلُ بين الْمسلمين ... يذبح لغيْر الله، لذلك يكفرُ وعليه التوبة، وإذا كان صادقاً عليه بالتوبة فمن تاب تاب الله عليه . الْمشركون تابوا وتاب الله عليهم يوم الفتح، وهم معروف كفرهم وضلالهم، ولَما فتح الله مكة ودخلوا في دينِ اللهِ قَبلَ اللهُ منهم .
শায়খ ইবনু বায (রহ): এর মধ্যে অজ্ঞতার কোন বিষয় নেই ...। এটা এমন একটা বিষয় যে ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যে কোন অজ্ঞতা নেই...। সে গায়রুল্লাহর জন্যে যবেহ করলে সেক্ষেত্রে কাফির হবে এবং তার উপর তাওবা করা জরুরি। যদি সে সত্যিকারভাবে তাওবা করে, তবে তার তাওবা আল্লাহ কবুল করবেন। মুশরিকরা তাওবা করেছিল, তারা মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর কাছে তাওবা করেছিল। তাদের কুফর ও গোমরাহীর বিষয় প্রসিদ্ধ ছিল। যখন মক্কা বিজয়ের দিনে তারা দ্বীনের মধ্যে দাখিল হল, আল্লাহ তাদের থেকে তাওবা ক্ববুল করেন।
سـ ٧ : لكن يا شيخ بِمجرد العمل ! كسجود معاذِ للنبي عليه الصلاة والسلام بِمجرد العمل هكذا ؟ !
প্রশ্ন-৭: তবে হে শায়খ, কেবল আমলের ক্ষেত্রে! যেমন মাআয (রা) কর্তৃক নবী (স)-কে সিজদা করা কি কেবল আমল হিসাবে গণ্য?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا متأولُ يِحسبُ أنه جاهلُ . بين له النبي ﷺ. استقرت الشريعةُ وعرف أن السجود لله ﴿فاسجدوا لله واعبدوا ﴾وانتهى الأمر . كان معاذ جاهلاً فعلمه النبيُّ ﷺ. الآن استقرت الشريعةُ ، وعلم أن السجود لله ﴿فاسجدوا لله واعبدوا ﴾ والذبح لله . ﴿ قل إن صلاتي ونسكي ومَحياي ومِماتي لله رب العالَمين لا شريك له ﴾ فالذي بين الْمسلمين [ من ] يسجد لغيْر الله يكون كافراً عليه التوبة .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এটা ছিল একটি মুতা’ওয়াল (ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাখ্যাকৃত সিদ্ধান্ত), যা তার অজ্ঞতা হিসাবে গণ্য। তাকে নবী (স) ব্যাখ্যা করেছিলেন। অতঃপর শরীআত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটাই বিধান হয়েছে যে, সিজদা কেবল আল্লাহ তাআলা-র জন্য। (ঘোষিত হয়েছে :) فاسجدوا لله واعبدوا ‘‘সুতরাং কেবল আল্লাহর সিজদা কর ও তাঁরই ইবাদত কর।’’ [. সূরা নাযম : ৬২ আয়াত।] এভাবে শরীআতী নির্দেশনা সমাপ্ত হয়েছে। মুআয (রা) ছিলেন এ ব্যাপারে অজ্ঞ, এ কারণে রসূলুল্লাহ (স) তাকে ইলম (শিক্ষা) দিয়েছিলেন। এখন শরীআত প্রতিষ্ঠিত। আর এটা জ্ঞাত যে, সিজদা করতে হবে কেবল আল্লাহ তাআলা’র। (কেননা আল্লাহর নির্দেশ :) فاسجدوا لله واعبدوا ‘‘সুতরাং কেবল আল্লাহর সিজদা কর ও তাঁরই ইবাদত কর।’’ [.সূরা নাযম : ৬২ আয়াত।] তেমনি যবেহ কেবলই আল্লাহর জন্যে। (ঘোষিত হয়েছে :) قل إن صلاتي ونسكي ومَحياي ومَماتي لله رب العالَمين لا شريك له ‘‘নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- সমস্ত কিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য, আর তাঁর কোন শরীক নেই।’’ [.সূরা আনয়াম : ১৬২-১৬৩ আয়াত।] সুতরাং মুসলিমদের মধ্যে যে গায়রুল্লাহকে সিজদা করে সে কাফির, তার ওপর তাওবা করা জরুরি।
سـ ٨ : هل تبديل القوانين يعتبْر كفراً مُخرجاً من الْملة ؟
প্রশ্ন-৮: তাহলে (ইসলামী) আইনের পরিবর্তন কি কুফর, যা মিল্লাত (ইসলাম) থেকে খারিজ করে দেয়?
سَماحة الشيخ ابن باز : إذا استباحه . إذا استباح حكم بقانون غير الشريعة يكون كافراً كفراً أكبر إذا استباح ذلك ، أما إذا فعل ذلك لأسباب خاصة عاصياً لله من أجل الرشوة ، أو من أجل إرضاء فلان أو فلان ، ويعلم أن مُحرم يكون كفراً دون كفر .
أما إذا فعله مستحلاً له يكون كفراً أكبر . كما قال ابن عباس في قوله تعالى : ﴿ ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون .... الظالِمون .... الفاسقون ﴾ . قال : ليس كمن كفر بالله ، ولكن كفر دون كفر .
أي إذا استحل الْحكم بقانون ، أو استحل الْحكم بكذا ، أو كذا غيْر الشريعة يكون كافراً ، أما إذا فعله لرشوة أو لإتاوة بينه وبين الْمحكوم عليه ، أو لأجل إرضاء بعض الشعب ، أو ما اشبه ذلك فهذا يكون كفراً دون كفر
শায়খ ইবনু বায (রহ) : যখন সে এটাকে বৈধ মনে করে। যদি সে ভিন্ন বিধান দ্বারা হুকুম জারি করাকে জায়েয মনে করে, তবে সে কাফির হবে। এটা কুফরে আকবার- যখন সে তা বৈধ মনে করে। আর যখন সে সুনির্দিষ্ট কারণে তা করে, তাহলে সেটা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ হবে। যেমন ঘুষের কারণে, বা ব্যক্তি বিশেষকে খুশি করার কারণে- কিন্তু সে জানে যে এটা হারাম। তখন এটা হবে كفر دون كفر (ছোট কুফর)।
আর যদি সে এটা হালাল গণ্য করে, তবে সেটা হবে কুফরে আকবার (বড় কুফর)। যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির, .... যালিম, ... ফাসিক্ব’’-(সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭ আয়াত) সম্পর্কে বলেছেন : এটি আল্লাহর প্রতি কুফর করার মত নয়, বরং كفر دون كفر (ছোট কুফর)।
অর্থাৎ যখন সে ঘোষণা করে তার জারিকৃত বিধানটি হালাল, কিংবা অনুরূপ অন্যান্য বিধানও (হালাল), কিংবা শরীআত বিরোধী বিধান (হালাল হিসাবে) জারি করে- তবে সে কাফির। আর যখন সে ঘুষের জন্য করে, বা তার ও বিচারপ্রার্থীর মধ্যকার শত্রুতার জন্য করে, কোন গোষ্ঠীর সন্তুষ্টির জন্য করে, বা এধরনের আরো কোন কারণে- তবে সেক্ষেত্রে কুফরটি হবে كفر دون كفر (ছোট কুফর)।
سـ ٩ : هل هناك فرق بين التبديل وبين الْحكم في قضية واحدة؟ ! يعني في فرق في هذا الْحكم بين التبديل ككل والْحكم في قضية واحدة؟ التبديل يا شيخ؟
প্রশ্ন-৯: হুকুমের তাবদীল (পরিবর্তন) ও কোন একটি বিচারের (বিকৃত) হুকুম জারির মধ্যে কি পার্থক্য আছে? অর্থাৎ কোন একটি (মূল) হুকুমের পরিবর্তন [.যেমন - হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করা। (অনুবাদক)] কি কোন একটি বিচারের হুকুম পরিবর্তনের মত- হে শায়খ?
سَماحة الشيخ ابن باز : إذا كان لَم يقصد بذلك الاستحلال ، وإنّما حكم بذلك لأجل أسباب أخرى يكون كفراً دون كفر ، أما إذا قال : لا حرج بالْحكم بغير ما أنزل الله ، وإن قال الشريعة أفضل ، لكن إذا قال ما في حرج مباح يكفّر بذلك كفراً أكبر سواءٌ قال إن الشريعة أفضل ، أو مساوية ، أو رأى أفضل من الشريعة كله كفر .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : যখন তার আন্তরিক ইচ্ছা এটা নয় যে, সে এটাকে বিচারের দ্বারা হালাল করছে, বরং হুকুমটি জারির পিছনে অন্য কোন (পূর্বোক্ত) কারণ আছে, তাহলে তখন এটি হবে كفر دون كفر (ছোট কুফর)। তবে যখন সে বলে : বিচারের ক্ষেত্রে আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুম বিরোধী বিধান জারি করলে কোন ক্ষতি নেই। কিংবা যদি সে বলে : শরীআতই উত্তম; কিন্তু সে যখন এটাও বলে : এতে কোন ক্ষতি নেই, মুবাহ (বৈধ) -তাহলে তা এমন কুফর যা কুফরে আকবার (বড় কুফর এর অন্তর্ভুক্ত)। অথচ সে বলে : শরীআতই উত্তম, কিংবা শরীআতেরই মত, কিংবা শরীআতের চেয়ে এটিই উত্তম- এর সবগুলো পর্যায়ই (বড়) কুফর।
سـ ١٠ : يعني هذا الْحكم يشمل التبديل وعدم التبديل يعني يشمل كل الأنواع ؟
প্রশ্ন-১০: অর্থাৎ (পূর্বে ব্যাখ্যাকৃত) এই হুকুম সামগ্রিকভাবে (শরীআতের) পরিবর্তন (তাবদীল) ও অপরিবর্তন (আদম তাবদীল) সম্পর্কিত, তথা এটা কি সমগ্র বিষয়টিকে ঘিরেই বর্ণিত হয়েছে?
سَماحة الشيخ ابن باز : جميع الصور في جَميع الصور . لكن يُجب أن يَمنع ، ويُجب منع ذلك ، وهو كفر دون كفر ولو قال ما قصدت ولو قال ما استحليته بينِي وبين فلان عداوة أو رشوة يُجب أن يّمنع ، فلا يَجوز لأحد أن يُحكم بغيْر ما أنزل الله مطلقاً ولو كان بينه وبين الْمحكوم عليه عداوة أو لأسباب أخرى يُجب الْمنع من ذلك يُجب على ولِي أمره أن يّمنعه من ذلك ، وأن يّحكم بشرع الله .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এটা সামগ্রিক শর্ত, যা সমভাবে সমস্ত শর্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে অবশ্যই তাকে নিষেধ করা ওয়াজিব, এ ব্যাপারে তাকে বাধা দেয়াও ওয়াজিব- আর এটা كفر دون كفر (ছোট কুফর)। আর যদি সে বলে : ‘‘আমার এটা করার ইচ্ছা ছিল না’’, কিংবা বলে : ‘‘আমি এটিকে হালাল করিনি আমার ও অমুকের মাঝে শত্রুতা ছিল, কিংবা এতে ঘুষ ছিল।’’ তবে অবশ্যই তার জন্য এর প্রতিকার করা ওয়াজিব। সর্বোপরি কারো জন্যই আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুমের বিরোধী বিধান জারি করা কোন ভাবেই জায়েয নয়। আর যদি সে এমন কারো বিচার করে যার সাথে তার শত্রুতা আছে, কিংবা অন্য কোন কারণ রয়েছে- সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিচারকার্যটি স্থগিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে উলূল আমরদের (দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের) প্রতি দায়িত্ব হল, এটা নির্মূল করা এবং শরীআত অনুযায়ী হুকুম জারি করা।
سـ ١١ : ما تقول فيمن يصف أهل السنة الذين لا يكفرون بالذنب بأنّهم مرجئة ؟
প্রশ্ন-১১: আপনি তার ব্যাপারে কি বলবেন, যারা আহলে সুন্নাতে অবস্থান করেন, কিন্তু পাপের কারণে কাউকে কাফির বলেন না, তারা কি মুরজিয়া নন?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا جهل مركب ويُجب أن يعلَّمَ ، هذا جاهل من الْجهلة ويجب أن يعلم ، الْمرجئة الذين يرون الأعمال أنّها تدخل في الإيْمان يرون من لّم يصل ولّم يزك ولّم يصم هذا من الإيْمان هذه هي الْمرجئة . أما أهل السنة والْجماعة يقولون : أن من ترك الزكاة عاص ناقص الإيْمان ، ومن لَم يصم ناقص الإيْمان ، ومن لّم يُحج وهو مستطيع ناقص الإيْمان ، ومن زنى ناقص الإيْمان ، ومن سرق ناقص الإيْمان ، لكن لا يكفر كما تقول الْخوارج ولا يكون مُخلداً في النار كما تقول الْمعتزلة لا . يكون معرض للوعيد وعلى خطر كبيْر ، ومنهم من يدخل النار بذنوبه ، ثُم يشفع فيه الشفعاء ولا يُخلد في النار إلا الكفرة الذين أشركوا بالله واستحلوا مُحارم الله أو سخطوا ما أوجب الله هم الْمخلدون في النار
أما الزانِي لا يَخلد لو مات على الزنا . لا يَخلد ولو دخل النار . وكذلك شارب الخمر لا يَخلد ، والعاق لوالديه إذا دخل النار لا يَخلد . آكل الربا وإن كان متوعداً دخول النار يبقى فيها ما شاء الله ثُم يَخرج بعد التطهيْر إلَى الْجنة كما جاءت به الأحاديث عن رسول الله ﷺ أحاديث الشفاعة .
ومن عنده شك يراجع أحاديث الآخرة ليعرف ما جاءت به السنة أن النبي ﷺ يشفع عدة شفاعات للعصاة ، ويُخرجهم الله من النار بشفاعته . ويشفع الْمؤمنون والأفراد والْملائكة والْمؤمنون ثُم بعد هذا يبقى بقية في النار من العصاة يُخرجهم الله من النار بغيْر شفاعة بعدما احترقوا ، ثم يلقون في نَهر الْحياة فينبتون كما تنبت الْحبة في حَميل السيل ، ثُم بعد هذا يأذن لَهم الله في دخول الْجنة ، ولا يبقى في النار إلا الكفرة هم الْمخلدون فيها أبد الآباد أما العصاة فلا يَخلدون . هذا قول أهل السنة ليس قول الْمرجئة .
الْمصيبة في الْجهل
ما يبلغ الأعداء من جاهل * ما يبلغ الْجاهل من نفسه
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এখানে অজ্ঞতার মিশ্রণ রয়েছে, তার জন্য ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। সে অজ্ঞতার অন্ধকারে রয়েছে, এজন্যে তার জন্য ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। মুরজিয়া হল তারা, যারা আমল যা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়- (যেমন) সালাত আদায় না করা, যাকাত আদায় না করা, সিয়াম পালন না করা প্রভৃতি সংঘটিত না হওয়ার পরও ঈমান (পূর্ণাঙ্গ) রয়েছে বলে দাবি করে, এরাই মুরজিয়া। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বক্তব্য হল : যদি কেউ যাকাত আদায় না করে তবে তা পাপ, ঈমানের ত্রুটি। যদি সিয়াম পালন না করে, তবে সেটাও ঈমানের ত্রুটি। যদি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ পালন না করে, তবে সেটাও ঈমানের ত্রুটি। তেমনি যিনাকারীর ঈমান ত্রুটিযুক্ত, চোরের ঈমান ত্রুটিযুক্ত- কিন্তু এজন্য তাকে কাফির বলে না, যেভাবে খারেজীরা বলে থাকে। এ জন্যে তারা স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে না- যেভাবে মু’তাযিলারা (স্থায়ী জাহান্নামের হওয়ার কথা) বলে থাকে। কিন্তু সে অত্যন্ত ভয়াবহ আযাব ও বিপদের সম্মুখীন। তাদের অনেকে পাপের জন্যে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর শাফায়াতের মাধ্যমে তাদের মুক্তি হবে। শেষাবধি কাফির যারা শিরক করেছে- তারা ছাড়া কেউই স্থায়ী ভাবে জাহান্নামে থাকবে না এবং তারাও যারা আল্লাহর নাযিলকৃত হারাম বিধানকে হালাল গণ্য করেছে। আর তারাও যারা আল্লাহর ওয়াজিবকৃত বিষয়গুলোর প্রতি ঘৃণা রাখে- তারাই স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে।
যিনাকারীও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, যদিও সে যিনারত অবস্থায় মারা যায়। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, যদিওবা সেখানে সে প্রবেশ করে। অনুরূপ মদপানকারীও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। পিতামাতার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী যদিওবা জাহান্নামী, কিন্তু সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না। সুদখোরের যদিওবা স্থায়ী জাহান্নামের ওয়াদা আছে, যেভাবে আল্লাহ চান। অতঃপর তাদেরকে পবিত্র করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে- যেভাবে শাফাআত সংক্রান্ত হাদীসে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন।
তাদের আখিরাতে (পাপীদের) মুক্তি পাওয়া সংক্রান্ত হাদীসটি সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। যা প্রসিদ্ধ সুন্নাত দ্বারা জানা যায়। সেটা হল, নবী (স) ব্যাপক সংখ্যক পাপীকে শাফাআত দ্বারা মুক্তি দেবেন। তাদের শাফাআতের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। অতঃপর মু’মিনগণ ও মালাইকাগণ শাফাআত করবে। শেষে অবশিষ্ট পাপীকে জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তাআলা মুক্তি দিবেন কারো শাফাআত ছাড়া- যাদের আগুনে দগ্ধ করা হয়েছে। তারপর তাদের ‘হায়াতের নদীতে’ ফেলা হবে। তখন তারা গাছের চারা গজানোর মত গজিয়ে উঠবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিবেন। শেষাবধি কাফির ছাড়া কেউই চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে না। পাপীরা সেখানে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না। এটা আহলে সুন্নাতের বক্তব্য, মুরজিয়াদের নয়।
সমস্যা হল অজ্ঞতা। অজ্ঞদের থেকে শত্রুরা তা পৌঁছায় না,
বরং অজ্ঞরা নিজের থেকেই তা পৌঁছায়।
سـ ١٢ : يا شيخ الذي يقول : أن هذا من قول الْمرجئة ماذا نقول فيه ؟
প্রশ্ন-১২: হে শায়খ! যারা বলে এটি মুরজিয়াদের মত, আমরা তাদের কি বলতে পারি?
سَماحة الشيخ ابن باز : قلنا جاهل مركب لا يعرف قول أهل السنة يراجع كلام أهل السنة يراجع كلام شيخ الإسلام ابن تيمية وكلام الأشعري في الْمقالات وغيرهم من أهل السنة وفتح الْمجيد للشيخ عبد الرحمن بن حسن وغيرهم ويراجع شرح الطحاوية لابن أبي العز ويراجع كتاب التوحيد لابن خزيْمة وأشباهه ، حتى يعرف كلام أهل السنة .
فإذا كان جاهلاً مركباً لا يُحكم على الناس بِجهله نسأل الله لنا وله الْهدايةا
শায়খ ইবনু বায (রহ) : আমরা অজ্ঞদের বলব, এরূপ উক্তি আহলে সুন্নাত থেকে শুনিনি। আমরা ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ), ইমাম আশআরী (রহ)-এর ‘আল-মাক্বালাত’ প্রভৃতি আহলে সুন্নাতের ইমামদের সূত্র উল্লেখ করব। তাছাড়া শায়খ আব্দুর রহমান বিন হাসানের (রহ) ‘‘ফতহুল মাজীদ’’, ইবনু আবীল ‘ঈযের ‘শরহে তাহাবিয়্যাহ’, ইবনু খুযায়মাহ ও অন্যান্যদের ‘কিতাবুত তাওহীদ’ প্রভৃতির সূত্র উল্লেখ করব। ফলে তারা আহলে সুন্নাতের বক্তব্য সম্পর্কে জ্ঞাত হবে। সুতরাং যারা অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন আমরা সে সমস্ত মানুষের প্রতি তাদের অজ্ঞতার জন্য হুকুম জারি করব না। আল্লাহর কাছে আমরা দুআ করব, তিনি যেন তাদের হিদায়াত দেন।
سـ ١٣ : أعمال الْجوارح تعتبِر شرط كمال في الإيْمان أم شرط صحة للإيْمان؟
প্রশ্ন-১৩: আমলের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা কি পূর্ণাঙ্গ ঈমানের শর্ত, নাকি সহীহ ঈমানের শর্ত?
سَماحة الشيخ ابن باز : أعمال الْجوارح منها ما هو كمال ، ومنها ما ينافي الإيْمان فالصوم يكمل الإيْمان والصدقة والزكاة من كمال الإيْمان وتركها نقص في الإيْمان وضعف في الإيْمان ومعصية ، أما الصلاة فالصواب أن تركها كفر- نسأل الله العافية - كفر أكبر ، وهكذا فالإنسان يأتِي بالأعمال الصالِحات ، فهذا من كمال الإيْمان أن يكثر من الصلاة ومن صوم التطوع ومن الصدقات . فهذا من كمال الإيْمان الذي يقوى به إيْمانه .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : আমলে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা (ঈমানের) পূর্ণতার জন্য। আর এ থেকে বিরত থাকা ঈমানের হ্রাস ঘটায়। সুতরাং সিয়াম ঈমানকে পূর্ণ করে, সাদাক্বা ও যাকাত ঈমানকে পূর্ণ করে। আর এগুলো থেকে বিরত থাকা ঈমানের ক্ষতি করে, ঈমানকে দুর্বল করে এবং এটা পাপ। পক্ষান্তরে সালাত তরককারী সহীহ মতে কাফির। এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি- যা কুফরে আকবার। এভাবে যখন মানুষ আমালে সালেহ করতে থাকে, তখন তা থেকে ঈমান পূর্ণ হয়। যেমন- বেশি করে নফল সালাত, সিয়াম ও সাদাক্বাত আদায় করা। এগুলোর দ্বারা ঈমান পূর্ণ হয় এবং এগুলো ঈমানকে শক্তিশালী করে।
سـ ١٤ : إذا كان من كلمة أو نصيحة أخيَرة ؟
প্রশ্ন-১৪: সর্বশেষ নসীহত হিসাবে কি আপনার কিছু বলার আছে?
سَماحة الشيخ ابن باز : وصيتِي للجميع التفقه في الدين ، والتدبر للقرآن . الإكثار من قراءة القرآن ، وتدبر معانيه ، والْمذاكرة فيما بينهم كما دل عليه القرآن والسنة ، والقراءة في كتب أهل السنة مثل شيخ الإسلام ابن تيمية وابن القيم ، ويقرؤون كتبهما فيها خير عظيم . كتب السلف مثل تفسير ابن جرير . وكتاب التوحيد لابن خزيْمة وشرح السنة للبغوي ومثل كتاب شرح الطحاوية لابن أبْي العز وأشباهه والْحموية ، التدمرية ، وكلها كتب عظيمة مفيدة
نسأل الله للجميع التوفيق والْهداية وصلاح النية والعمل .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : সবার প্রতি আমার নসিহত, দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করুন এবং কুরআনের মর্ম অনুধাবন করুন। বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করুন এবং অর্থ হৃদয়ঙ্গম করুন। পরস্পরকে উপদেশ দিতে থাকুন- কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎসারিত বিষয়ে। আহলে সুন্নাতের কিতাব পড়তে থাকুন, যেমন- ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ), ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) প্রমুখের কিতাবগুলোই সর্বোৎকৃষ্ট। সালাফদের তাফসীর যেমন- তাফসীরে ইবনু জারীর, ইমাম ইবনু খুযায়মাহ’র ‘কিতাবুত তাওহীদ’, ইমাম বগভীর ‘শরহে সুন্নাহ’, ইবনু আবীল ‘ঈযের ‘শরহে তাহাবিয়্যাহ’ প্রভৃতি খুবই উপকারী পুস্তক।
আল্লাহ তাআলা’র কাছে সবার জন্য তাওফিক্ব ও হিদায়াত এবং সহীহ নিয়্যাত ও আমলের জন্য দুআ চাইছি।
পরবর্তী দু’টি প্রশ্নোত্তর শায়খ ইবনু বাযের فتاوى نور على الدرب এর ৩৬-৪০ পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত।
سـ ١٥ : تسأل الأخت وتقول : هل الإيْمان بالقلب يكفي لأن يكون الإنسان مسلما بعيدا عن الصلاة والصوم والزكاة؟
প্রশ্ন-১৫: একজন বোনের প্রশ্ন, সে জিজ্ঞাসা করেছিল : ক্বলবের ঈমানই কি একজন মানুষের মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট, অথচ সে সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় থেকে দূরে থাকে?
سَماحة الشيخ ابن باز : الإيْمان بالقلب لا يكفي عن الصلاة وغيْرها، بل يُجب أن يؤمن بقلبه وأن الله واحد لا شريك له، وأنه ربه وخالقه، ويُجب أن يُخصه بالعبادة سبحانه وتعالَى، ويؤمن بالرسول مُحمد ﷺ ، وأنه رسول الله حقا إلى جَميع الثقلين، كل هذا لا بد منه، فهذا أصل الدين وأساسه كما يُجب على الْمكلف أن يؤمن بكل ما أخبَر الله به ورسوله فقد أدى ما عليه، وإن لّم يصل كفر، لأن ترك الصلاة كفر . أما الزكاة والصيام والْحج وبقية الأمور الواجبة إذا اعتقدها وأنّها واجبة، ولكن تساهل فلا يكفر بذلك، بل يكون عاصيا، ويكون إيْمانه ضعيفا ناقصا؛ لأن الإيْمان يزيد وينقص، يزيد الإيْمان بالطاعات والأعمال الصالِحات، وينقص بالْمعاصي عند أهل السنة والْجماعة . أما الصلاة وحدها خاصة فإن تركها كفر عند كثيْر من أهل العلم وإن لّم يِجحد وجوبِها، وهو أصح قولِي العلماء، بِخلاف بقية أمور العبادات، من الزكاة والصوم والْحج ونَحو ذلك، فإن تركها ليس بكفر أكبَر على الصحيح، ولكن نقص في الإيْمان، وضعف في الإيْمان، وكبيِرة عظيمة من كبائر الذنوب، فترك الزكاة كبيِرة عظيمة، وترك الصيام كبيِرة عظيمة، وترك الْحج مع الاستطاعة كبيِرة عظيمة، ولكن لا يكون كفرا أكبَر إذا كان مؤمنا بأن الزكاة حق، وأن الصيام حق، وأن الْحج لِمن استطاع إليه سبيلا حق، ما كذب بذلك ولا أنكر وجوب ذلك، ولكنه تساهل في الفعل، فلا يكون كافرا بذلك على الصحيح . أما الصلاة فإنه إذا تركها يكفر في أصح قولِي العلماء كفرا أكبَر والعياذ بالله وإن لّم يِجحد وجوبِها كما تقدم؛ لقول النبي ﷺ : « بين الرجل وبين الكفر والشرك ترك الصلاة » أخرجه مسلم في صحيحه ، وقوله ﷺ : « العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر » أخرجه الإمام أحْمد وأهل السنن الأربعة بإسناد صحيح ، والْمرأة مثل الرجل في ذلك . نسأل الله العافية والسلامة .
শায়খ ইবনু বায (রহ): ক্বলবের ঈমান যথেষ্ট নয় সালাত ও অনুরূপ অন্যান্য আমল ছাড়া। বরং ওয়াজিব হল, আন্তরিকভাবে একক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। নিশ্চয় তিনি তার রব ও সৃষ্টিকর্তা। তার জন্য এটাও ওয়াজিব যে, খাসভাবে আল্লাহ তাআলা’রই ইবাদত করবে। আর সে রসূলের (স) প্রতি ঈমান আনবে। নিশ্চয় তিনি সত্য রসূল হিসাবে উভয় জাতির (জিন ও মানুষের) কাছে এসেছিলেন। এর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই দ্বীনের মূলনীতি, যা মুকাল্লিফের (দ্বীনের অনুসারীদের) উপর বাধ্যতামূলক। তাদেরকে আল্লাহ ও রসূল (স) এর পক্ষ থেকে আগত খবর যেমন- জান্নাত, জাহান্নাম, পুলসিরাত, মিযান প্রভৃতি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান রাখতে হবে। সুতরাং এটা জরুরি যে, সাক্ষ্য দেবে ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রসূল।’’ তেমনিভাবে সালাত ও অন্যান্য আমলগুলোও জরুরি। সুতরাং যখন সে সালাত আদায় করে, তখন সে তার (ঈমানের) দাবি পূর্ণ করে। আর যদি সে সালাত না পড়ে তবে সে কাফির। যেহেতু সালাত তরক করা কুফর।
তাছাড়া যাকাত, সিয়াম, হজ্জ ও অন্যান্য ওয়াজিব আমলও তাকে পালন করতে হবে। যদি সে এগুলোর ব্যাপারে আক্বীদা রাখে যে তা ওয়াজিব, কিন্তু সে অলসতা ও অবহেলা করে- তাহলে সে কাফির নয়, বরং অবাধ্য (পাপাচারী)। এক্ষেত্রে তার ঈমান দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত। কেননা ঈমানের হ্রাস ও বৃদ্ধি হয়। ইতাআত (&আনুগত্য) ও আমলে সালেহ দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে অবাধ্যতা দ্বারা ঈমান হ্রাস পায়- আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে।
কেবল সালাত তরক করায় এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম (খাস), যা তরক করা অধিকাংশ আলেমের নিকট কুফর। যদিও-বা সে এর ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে না। এটাই আলেমদের সবচেয়ে সহীহ উক্তি। অবশিষ্টরা বলেন, সালাত তরক করা অন্যান্য ইবাদত যেমন- যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ তরক করার ন্যায়। কেননা সহীহ মতে এগুলো কেবল তরক করাটাই কুফরে আকবার নয়। বরং তা ঈমানের ত্রুটি, ঈমানের দুর্বলতা ও কবীরা গোনাহগুলোর সর্বোচ্চ গুনাহ। এ কারণে যাকাত তরক করা সর্বোচ্চ কবীরা গোনাহ। সিয়াম তরক করাও সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ। তেমনি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ আদায় না করা সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ। কিন্তু তাতে কুফরে আকবার সংঘটিত হয় না, যতক্ষণ একজন মু‘মিন যাকাতকে হক্ব মানে, সিয়ামকে হক্ব মানে, সামর্থ্যবানের জন্য হজ্জ আদায় করাকে হক্ব মানে। সে এগুলোকে মিথ্যা বলে না এবং এর ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকারও করে না। কিন্তু সে আমলের দিকে থেকে অলসতা করে। এ কারণে সহীহ মতে সে কাফির নয়।
তবে সালাত তরককারীর ব্যাপারে আলেমদের সহীহ উক্তি হল, সে কাফির, যা কুফরে আকবার। এ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই, যদিও সে সালাত ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে না- যেভাবে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। কেননা নবী (স) বলেছেন : ‘‘(মু‘মিন) ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হল সালাত তরক করা।’’ (সহীহ মুসলিম) তাছাড়া নবী (স) বলেছেন : ‘‘তাদের ও আমাদের মধ্যে চুক্তি হল সালাত। সুতরাং যে সালাত তরক করে সে কুফরী করে।’’ (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ) এক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের মতই। আল্লাহ কাছে ক্ষমা ও শান্তি চাচ্ছি। [.যারা এর বিপরীতে সালাতকে ওয়াজিব/ফরয হিসাবে স্বীকৃতিদাতার সালাত তরক করাকে আমলী কুফর বলেন তাদের দলিল নিম্নরূপ : ‘উবাদা ইবনু সামিত (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : خَمْسُ صَلَوَاتٍ كَتَبَهُنَّ اللَّهُ عَلَى الْعِبَادِ فَمَنْ جَاءَ بِهِنَّ لَمْ يُضَيِّعْ مِنْهُنَّ شَيْئًا اسْتِخْفَافًا بِحَقِّهِنَّ كَانَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَمْ يَأْتِ بِهِنَّ فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ ‘‘আমি রসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি : আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। কাজেই যে তা সংরক্ষণ করবে এবং তার হক্বের কোন অংশ কম করবে না, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর ব্যাপারে আল্লাহর অঙ্গীকার রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা করবে না, তার সাথে আল্লাহর কোন চুক্তি নেই। চাইলে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন নতুবা তিনি চাইলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’’ [মুয়াত্তা মালিক ২৬৭/১৪, আবু দাউদ ১৪২০, নাসাঈ ৪৬১, সহীহ ইবনু হিব্বান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (ইফা) ১/২৬৮ পৃ : হা/২৫; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহ আবূ দাউদ হা/১২৫৮)। আলবানী (রহ) বলেন : وقال أيضا : " من مات وهو يعلم أن لا إله إلا الله دخل الْجنة " إلَى غَيْر ذلك ولِهذا لَم يزل الْمسلمون يرثون تارك الصلاة ويورثونه ولو كان كافرا لَم يغفر له ولَم يرث ولَم يورث ‘‘অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে : যে ব্যক্তি এমন অবস্থাতে মারা যায় যে সে ‘ইলম রাখে- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩ (৪৩/২৬), মিশকাত ৩৭] অনুরূপ আরো বর্ণনা রয়েছে। এপ্রেক্ষিতে যদি মুসলিম (কালেমার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে) পদস্খলিত না হয়ে সালাত তরককারী হলে উপরোক্ত দাবির মধ্যে গণ্য হবে, আর যদি কাফির হয়, তবে তার জন্য ক্ষমা নেই, আর তার জন্য ওয়াদা নেই এবং সে উক্ত দাবির মধ্যেও গণ্য নয়।’’ [আলবানী, হুকমু তারিকুস সালাত ১৭-১৮ পৃ.] এই অনুবাদকের নিকট শেষোক্ত দলিলগুলো আখিরাতের আল্লাহর সিদ্ধান্তের সাথে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে শায়েখ ইবনু বায (রহ) -এর উল্লিখিত দলিলগুলো দুনিয়াতে মুসলিমের পরিচয় সম্পর্কিত। অর্থাৎ উভয় মতবিরোধের পক্ষের দলিলগুলো নিজ নিজ স্থানে প্রযোজ্য। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।]
سـ ١٦ : وتقول السائلة : إن هناك شيئا يتردد بين أوساط الناس حيث يقولون : إن الصلاة يشترط لَها الإسلام، والْحج يشترط له الإسلام، فالإنسان قد يكون مسلما ولو لَم يأت ببقية أركان الإسلام . فنريد تَجلية هذا الْموضوع . بارك الله فيكم؟
প্রশ্ন-১৬: প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করল : এ ব্যাপারে লোকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে যে যখন তারা বলে : সালাত ইসলামের ক্ষেত্রে শর্ত, হজ্জ ইসলামের জন্য শর্ত- তাহলেই একজন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারবে। যদিও-বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ইসলামের রোকনগুলো পালিত না হয়। এ কারণে বিষয়টি আরো বেশি সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন।
سَماحة الشيخ ابن باز : نعم . هو مسلم بالشهادتين، فمتى أقر بالشهادتين ووحد الله عز وجل وصدق رسول الله مُحمدا ﷺ دخل في الإسلام، ثم ينظر فإن صلى تُم إسلامه، وإن لّم يصل صار مرتدا، وهكذا لو أنكر الصلاة بعد ذلك صار مرتدا، أو أنكر صيام شهر رمضان صار مرتدا، أو قال الزكاة غيْر واجبة صار مرتدا، أو قال الْحج مع الاستطاعة غير واجب، صار مرتدا، أو استهزأ بالدين أو سب الله أو سب الرسول صار مرتدا .
فهذا الأمر ينبغي أن يكون واضحا، فإذا دخل في الإسلام بالشهادتين حكم له بالإسلام، ثُم ينظر بعد ذلك في بقية الأمور فإن استقام على الْحق تم إسلامه، وإذا وجد منه ما ينقض الإسلام؛ من سب الدين، أو من تكذيب الرسول ﷺ ، أو من جحد لَما أوجبه الله من صلاة وصوم، أو جحد لَما حرم الله كما لو قال : الزنا حلال، فإنه يرتد عن الإسلام بِهذا، ولو صلى وصام، ولو قال أشهد أن لا إله إلا الله، وأن مُحمدا رسول الله .
فلو قال : إن الزنا حلال، وهو يعلم الأدلة وقد أقيمت عليه الْحجة، يكون كافرا بالله كفرا أكبَر والعياذ بالله، أو قال : الْخمر حلال، وقد بينت له الأدلة ووضحت له الأدلة ثُم أصر يقول : إن الْخمر حلال، يكون ذلك كفرا أكبَر، وردة عن الإسلام والعياذ بالله، أو قال مثلا : إن العقوق حلال، يكون ردة عن الإسلام والعياذ بالله، أو قال إن شهادة الزور حلال، يكون هذا ردة عن الإسلام بعد أن تبين له الأدلة الشرعية .
كذلك إذا قال : الصلاة غيْر واجبة، أو الزكاة غيْر واجبة، أو صيام رمضان غيْر واجب، أو الْحج مع الاستطاعة غيْر واجب، كل هذه نواقض من نواقض الإسلام يكون بها كافرا والعياذ بالله .
إنّما الخلاف إذا قال : إن الصلاة واجبة، ولكن أنا أتساهل ولا أصلي، فجمهور الفقهاء يقولون : لا يكفر ويكون عاصيا يستتاب فإن تاب وإلا قتل حدا .
وذهب آخرون من أهل العلم وهو الْمنقول عن الصحابة رضي الله عنهم أنه يكفر بذلك كفرا أكبر، فيستتاب فإن تاب وإلا قتل كافرا؛ لقول الله جل وعلا : ﴿ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ ﴾ [ التوبة : 5] ، فدل ذلك على أن الذي لا يقيم الصلاة لا يَخلى سبيله ، بل يستتاب فإن تاب وإلا قتل، وقال سبحانه : ﴿ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ﴾ [ التوبة : ١١ ] ، فدل ذلك على أن الذي لا يقيم الصلاة ولا يصلي ليس بأخ في الدين .
শায়খ ইবনু বায (রহ): জি হ্যাঁ, দু’টি শাহাদাতের মাধ্যমে মুসলিম হয়। অর্থাৎ মনে প্রাণে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলা একক এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রসূল- তাহলে সে ইসলামে প্রবেশ করল। অতঃপর যদি তাকে সালাত আদায় করতে দেখা যায় তবে তার ইসলাম পূর্ণ হল। আর যদি সালাত আদায় করতে দেখা না যায় তবে সে মুরতাদ। অনুরূপ যদি সে সালাতকে অস্বীকার করে তবেও মুরতাদ হয়ে যায়। কিংবা সিয়ামকে অস্বীকার করলে মুরতাদ হয়। অথবা বলে যাকাত প্রভৃতি ওয়াজিব নয়, তবেও সে মুরতাদ। কিংবা বলে সামর্থ্য হলেও হজ্জ করা ওয়াজিব নয়, তবে সে মুরতাদ। কিংবা দ্বীন নিয়ে তামাশা করে, কিংবা রসূলকে গালি দেয়- তবেও সে মুরতাদ।
উক্ত সিদ্ধান্তের কারণ হল, এ বিষয়গুলো সুস্পষ্ট। সুতরাং যখন কেউ ইসলামে দু’টি শাহাদাত দ্বারা প্রবেশ করে তার উপর ইসলামী বিধি-বিধান আবশ্যক হয়। অতঃপর যদি তাকে অন্যান্য নির্দেশগুলোর উপর দেখা যায় এবং সে হক্বভাবে তাতে দৃঢ় হয়- তবে তার ইসলাম পূর্ণ হল। অতঃপর যদি তার মধ্যে ইসলামের কোন ত্রুটি দেখা যায়। যেমন : দ্বীন নিয়ে কটূক্তি করা, রসূলকে মিথ্যারোপ করা, আল্লাহর ওয়াজিবকৃত বিষয়গুলো যেমন- সালাত, সিয়ামের বিরোধিতা করা, কিংবা আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ের বিরোধিতা করা যেমন- যিনাকে হালাল গণ্য করা; তবে সে ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয়। যদিওবা সে সালাত, সিয়াম পালন করে এবং বলে : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই, এবং মুহাম্মাদ (স) তাঁর রসূল।
অনুরূপ যদি সে বলে : যিনা হালাল, অথচ সে এর দলিল সম্পর্কে জ্ঞাত- তখন প্রমাণ তার জন্য কার্যকরী হবে। সে আল্লাহর প্রতি কুফরী করেছে, যা কুফরে আকবার- সে আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত। কিংবা যদি সে বলে, মদ পান করা হালাল। অথচ তার কাছে দলীল-প্রমাণ পেশ করা হয় এবং সেটা তার কাছে সুস্পষ্টও হয়, তারপরেও সে বলে : মদ হালাল। তখন এটা কুফরে আকবার। ফলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত হয়। কিংবা সে বলে : পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ হালাল। সেক্ষেত্রে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত হয়। কিংবা বলে : মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া হালাল। সেও ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় যখন তার কাছে ইসলামী শরীআতের দলিলগুলো বর্ণনা করা হয়।
অনুরূপ যদি সে বলে : সালাত ওয়াজিব নয়, বা যাকাত ওয়াজিব নয়, রমাযানের সিয়াম ওয়াজিব নয়, সামর্থ্য হওয়ার পরেও হজ্জ ওয়াজিব নয়- এর সবগুলো ইসলাম থেকে বিচ্যুতির কারণগুলোর অন্যতম। ফলে সে কাফির হয় এবং আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত হয়।
তবে ব্যতিক্রম হল, যখন সে বলে : সালাত ওয়াজিব, আমার অলসতা আছে, আমি সালাত আদায় করি না। জমহুর ফক্বীহদের মতে : সে কাফির নয়, সে অবাধ্য ব্যক্তি, তাকে তাওবা করতে হবে। যদি সে তাওবা না করে তবে তাকে হত্যা করতে হবে।
পূর্বোক্ত বিষয়ে আহলে ইলমদের থেকে যাকিছু বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো সাহাবীদের (রা) থেকে এসেছে। তারা এ ব্যাপারটি কুফর গণ্য করতেন, যা কুফরে আকবার। সুতরাং সে তাওবা করবে, যদি তাওবা না করে তবে তাকে হত্যা করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘‘যদি তারা তাওবা করে, সালাত ক্বায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে- তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও।’’ (সূরা তাওবা- ৫ আয়াত) এ থেকে দলিল পাওয়া গেল, যদি সালাত আদায় না করে তবে তাদের পথ রোধ করতে হবে। বরং তাদের তাওবা করতে হবে। যদি তাওবা না করে তবে হত্যা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘‘যদি তাওবা করে, সালাত ক্বায়েম করে, যাকাত আদায় করে- তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।’’ (সূরা তাওবা- ১১ আয়াত) এ থেকে দলিল পাওয়া গেল, যারা সালাত আদায় করে না তারা দ্বীনি ভাই নয়।
[শায়খ ইবনু বাযের এই প্রশ্নোত্তরটি নেওয়া হয়েছে, حوار حول مسائل التكفير (প্রকাশক : মাকতাবাহ আল-ইমাম যাহাবী, কুয়েত, ১৪২০ হি :/২০০০ ‘ঈসায়ী) থেকে। -অনুবাদক]
سـ ١ : هناك من يقول : إن هذا القول وهو قول السلف : إنا لا نكفر أحدا من أهل الملة بذنب ما لَم يستحله ، يقول هذا هو قول الْمرجئة ؟
প্রশ্ন-১: অনেকে বলেন : সালাফদের থেকে এই উক্তি রয়েছে যে, তারা বলেছেন : ‘‘আমরা এই মিল্লাতের (ইসলামের) কাউকেই তার পাপের জন্য কাফির ঘোষণা করতে পারব না, যদি না সে তা (পাপটি) হালাল মনে করে’’ -তারা বলেন, এটা হল মুরজিয়াদের উক্তি।
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا غلط ، هذا قول أهل السنة لا يكفر بذنب ما لَم يستحله ، الزاني لا يكفر ، وشارب الْخمر لا يكفر ، بل عاص ، إلا إذا استحل ذلك ، هذا قول أهل السنة خلافا للخوارج ،
الْخوارج هم الذين يكفرون بالذنوب ، أما أهل السنة فيقولون : عاص يُجب ضعيف الإيْمان ، خلافا للخوارج والْمعتزلة ، هذا قول أهل السنة والْجماعة ، أما إذا استحله ، قال : الزنا حلال يكفر ، أو قال : الْخمر حلال يكفر ، عند أهل السنة والْجماعة جَميعا ، أو قال : الربا حلال يكفر ، أو قال : عقوق الوالدين حلال يكفر ، لكن إذا فعله من غيْر اعتقاد ، وهو يعلم أنه حرام ، عق والديه يعلم أنه حرام ، زنا يعلم أنه حرام ، شرب الْخمر يعلم أنه حرام ، هذا عاص ، ناقص الإيْمان ، ضعيف الإيْمان عند أهل السنة ولا يكفر ، لكن يستحق أن يقام عليه حد الْخمر ، حد الزنا ، يؤدب عن العقوق ، يؤدب عن أكل الربا . لا بأس طيب .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এটা ভুল কথা। মূলত এটাই আহলে সুন্নাতেরই উক্তি (নীতি) : ‘‘কাউকে পাপের জন্য কাফির বলা যাবে না, যতক্ষণ সে তা হালাল গণ্য করে।’’ একজন যিনাকারী কাফির নয়, একজন মদপানকারী কাফির নয়- বরং সে অবাধ্য, যদি না সে তার কাজটি হালাল গণ্য করে। খারেজীদের মোকাবেলায় এটাই আহলে সুন্নাতের উক্তি।
খারেজীরা পাপের কারণে কাফির গণ্য করে থাকে। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত বলে থাকে : সে অবাধ্যদের একজন। তার ওপর হদ (শাস্তি) প্রয়োগ করা ওয়াজিব, তেমনি তার জন্য তাওবা করাও ওয়াজিব, কিন্তু সে কাফির নয়- যদি না পাপকে সে হালাল গণ্য করে। যদি সে যিনা করে, কিন্তু তাকে হালাল গণ্য না করে। তেমনি মদপান করে, কিন্তু তাকে হালাল গণ্য না করে। তেমনি অন্যান্য বিষয়েও। যেমন : সুদ খায় কিন্তু তা হালাল গণ্য করে না, তাহলে সে কাফির নয়। বরং সে পাপী- যা ঈমানের ত্রুটি, ঈমানের দুর্বলতা। এটা খারেজী ও মু‘তাযিলাদের বিপরীতে আহলে সুন্নাতের বক্তব্য। আর যদি হালাল গণ্য করে বলে : যিনা হালাল, তবে সে কাফির। কিংবা বলে : মদ হালাল, তবে সে কাফির- এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের সবাই একমত। কিংবা যদি কেউ বলে : সুদ হালাল, সে কাফির। কিংবা বলে : পিতামাতার অবাধ্যতা করা হালাল, তবে সে কাফির।
কিন্তু যদি তার আমলটি উক্ত আক্বীদা রাখা ব্যতিরেকে হয় এবং সে জ্ঞাত যে এটা হারাম। যেমন : পিতামাতার অবাধ্যতা করে, অথচ জানে তা হারাম। সে যিনা করে, কিন্তু জানে সেটা হারাম। মদপান করে, অথচ জানে সেটা হারাম। তবে এটা গোনাহ, ঈমানের ত্রুটি, ঈমানের দুর্বলতা। আহলে সুন্নাতের নিকট সে কাফির নয়। তার উপর যিনার হদ, মদপান করার হদ প্রযোজ্য। তেমনি পিতামাতার অবাধ্যতার জন্য ও সুদ গ্রহণের জন্য তার ব্যাপারে সংশোধনমূলক (শাস্তির) ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে। নিঃসন্দেহে এটা উত্তম।
سـ ٢ : هل العلماء الذين قالوا بعدم كفر من ترك أعمال الْجوارح ، مع تلفظه بالشهادتين ، ووجود أصل الإيْمان القلبي هل هم من الْمرجئة ؟
প্রশ্ন-২: যে সমস্ত আলেমরা বলেন, ‘‘তারা কাফির নয়- যারা সমস্ত আমলসমূহের শাখা-প্রশাখাগুলো ত্যাগ করে, সাথে সাথে দু’টি শাহাদাতের (কালেমায়ে শাহাদাতের) উচ্চারণ ঠিক রাখে এবং তাদের অন্তরে নীতিগতভাবে ঈমানের অস্তিত্ব রয়েছে’’ -তারা কি মুরজিয়া নন?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا من أهل السنة والْجماعة ، من قال بعدم كفر من ترك الصيام ، أو الزكاة ، أو الْحج ، هذا ليس بكافر ، لكنه أتى كبيْرة عظيمة ، وهو كافر عند بعض العلماء ، لكن على الصواب لا يكفر كفرا أكبر ، أما تارك الصلاة فالأرجح فيه أنه كفر أكبْر ، إذا تعمد تركها ، وأما ترك الزكاة ، والصيام ، والْحج ، فهو كفر دون كفر ، معصية وكبيرة من الكبائر ، والدليل على هذا أن النبي ﷺ قال في من منع الزكاة : «يؤتى به يوم القيامة يعذب بِماله»، كما دل عليه القرآن الكريْم : ﴿ يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ ﴾، أخبْر النبي أنه يعذب بِماله ، بإبله ، وبقره ، وغنمه ، وذهبه ، وفضته ، ثُم يرى سبيله بعد هذا إلى الْجنة أو إلَى النار ، دل على أنه لَم يكفر ، كونه يرى سبيله إما إلَى الْجنة ، وإما إلَى النار ، دل على أنه متوعد ، قد يدخل النار ، وقد يكتفي بعذاب البَرزخ ، ولا يدخل النار ، بل يكون إلى الْجنة بعد العذاب الذي في البرزخ .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এই উক্তিটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত থেকেই এসেছে, যারা বলেছেন : কুফর সংঘটিত হয় না সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ তরক করার জন্যে। এ জন্যে সে কাফির নয়। কিন্তু সে ভয়ানক কবীরা গুনাহে লিপ্ত। কিছু আলেমের কাছে এরাও কাফির। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা কুফরে আকবার নয়। কিন্তু কেউ যদি সালাত তরক করে, সেক্ষেত্রে প্রাধান্যপ্রাপ্ত ( الراجح ) সিদ্ধান্ত হল, সেটা কুফরে আকবার- যখন সে স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করে। আর যদি সে সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ তরক করে, তবে সেটা كفر دون كفر (কুফরের থেকে কম কুফর), সেটা পাপ এবং কবীরা গুনাহগুলোর সর্বোচচ গুনাহর অন্তর্ভূক্ত। এর দলিল হল, নবী (স) যাকাত আদায় না করা সম্পর্কে বলেছেন : يؤتى به يوم القيامة يعذب بِماله ‘‘সে তার সম্পদসহ আসবে, তাকে তার মাল দ্বারাই আযাব দেয়া হবে।’’ [.‘‘যাকাত নাআদায়কারী’’ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর সার-সংক্ষেপ এটাই। বিস্তারিত হাদীসের কিতাবের ‘যাকাত’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য। (অনুবাদক)] তেমনিভাবে কুরআনে দলিল আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
‘‘সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা (যাকাতের সম্পদ) উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর (তার) যা তোমরা জমা রেখেছিলে।’’ [.সূরা তাওবা : ৩৫ আয়াত।]
নবী (স) জানিয়েছেন, তাদের আযাব দেয়া হবে তাদের মাল দ্বারা, উট দ্বারা, গরু দ্বারা, ভেড়া দ্বারা, সোনা ও রূপা দ্বারা। অতঃপর তাকে জান্নাত বা জাহান্নামের পথ দেখান হবে। [.যাকাত নাআদায়কারীর হাশরের ময়দানে তার সম্পদ, উট, গরু, ভেড়া দ্বারা শাস্তি লাভের বর্ণনার পর নবী (স) এর বাণী : فَيُرَى سَبِيلُهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِمَّا إِلَى النَّارِ ‘‘অতঃপর সে তার পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।’’ [সহীহ মুসলিম ২১৮০ (২৪/৯৮৭), মিশকাত ১৭৭৩। -অনুবাদক।] এটাই (হাদীসটি) প্রমাণ যে, সে কাফির নয়। (এরপর) হতে পারে সে দেখবে জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। এটা প্রমাণ করে, তাকে ভয়াবহভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করা হবে। তাকে হয়তো জাহান্নামে দাখিল করা হবে। কিংবা হয়তো কেবল বারযখে আযাব দেয়া হবে এবং জাহান্নামে দাখিল করা হবে না। কিংবা হতে পারে তাকে বারযাখে আযাব দেয়ার পর জান্নাতে দাখিল করা হবে।
سـ ٣ : شيخنا بالنسبة للإجابة على السؤال الأول فهم البعض من كلامك أن الإنسان إذا نطق بالشهادتين ولَم يعمل فإنه ناقص الإيْمان ، هل هذا الفهم صحيح ؟
প্রশ্ন-৩: (হে) আমাদের শায়খ! প্রথম প্রশ্নের জবাব প্রসঙ্গে বলছি, কিছু লোক আপনার বক্তব্যের মর্মটি থেকে বুঝেছে‘ যে, ‘‘যখন কেউ দু’টি শাহাদাতের (কালেমা শাহাদাতের) উচ্চারণ করে, কিন্তু আমল করে না, সেক্ষেত্রে তার ঈমানটি ত্রুটিযুক্ত’’ -এই বুঝটি কি সহীহ?
سَماحة الشيخ ابن باز : نعم . فمن وحدَّ اللهَ وأخلصَ له العبادةَ ، وصدّقَ رسول الله ﷺ ، لكنه ما أدى الزكاة ، أو ما صام رمضان ، أو ما حج مع الاستطاعة يكون عاصياً أتى كبيرة عظيمة ، ويُتوعدُ بالنارِ ، لكن لا يكفرُ على الصحيحِ ، أما من ترك الصلاةِ عمداً فإنه يكفرُ على الصحيحِ
শায়খ ইবনু বায (রহ) : হ্যাঁ, যে আল্লাহকে একক গণ্য করে এবং ইখলাসের সাথে তাঁর ইবাদত করে, আর রসূলুল্লাহ (স)-কে সত্যায়ন করে; যদিওবা সে যাকাত আদায় না করে, বা সিয়াম পালন না করে, কিংবা সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্জ করে না- তাহলে সে গোনাহগার হবে, ফলে সে ভয়ানক কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়। তার জন্য জাহান্নামের ওয়াদা (ভয়ঙ্কর শাস্তি) রয়েছে। এতদ্বসত্ত্বেও সহীহ কথা হল, সে কাফির নয়। তবে যদি স্বেচ্ছায় সালাত তরক করে, সেক্ষেত্রে তাকে কাফির গণ্য করাটাই সহীহ সিদ্ধান্ত।
سـ ٤ : أحسن الله إليك ، هل يَمكن صدورُ كفرِ عملي مُخرج من الْملة في الأحوال الطبيعية ؟
প্রশ্ন-৪: আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! এটা কি সম্ভব- কুফরে আমলী যা বিভিন্ন দেশে ( الأحوال الطبيعية -বৈশিষ্ট্যগতভাবে) প্রকাশ পেয়েছে, তাকি মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয়?
سَماحة الشيخ ابن باز : الكفر العملي يُخرج من الْملة مثل السجود لغيْر الله ، والذبح لغيْر الله كفر عملي يُخرج من الْملة فالذبح للأصنام ، أو للكواكبِ ، أو للجنِّ كفر عملي أكبر وهكذا لو صلى لَهم ، لو سجد لَهم يكفر كفراً عملياً أكبر - والعياذ بالله - ، هكذا لو سبّ الدينَ ، أو سب الرسولَ ، أو استهزأ بالله ، أو بالرسول . كفرٌ عملي أكبر عند جَميعِ أهل السنة والْجماعة .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : যে সমস্ত কুফর আমালী মিল্লাত (দ্বীন) থেকে খারিজ করে দেয় তার মেসাল (উদাহরণ) হল, গায়রুল্লাহকে সিজদা করা, গায়রুল্লাহর জন্যে যবেহ করা প্রভৃতি কুফরে আমালী মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয়। সুতরাং মূর্তির জন্য যবেহ করা, কিংবা তারকার জন্য বা জিনের জন্য প্রভৃতি কুফরে- আমালী-আকবার (আমলগত বড় কুফর)। এগুলোর মাধ্যমে যেন তাদের জন্য সালাত আদায় (ইবাদত) করা হয়, তাদেরকে সিজদা করা হয়। সে তখন কাফির হয়, বড় কুফরে আমালীর মাধ্যমে- এবং এর মাধ্যমে সে আল্লাহর থেকে বিতাড়িত। অনুরূপভাবে, যদি কেউ দ্বীন (ইসলাম)-কে গালাগালি দেয়, রসূলের (স) নিন্দা করে, আল্লাহ বা রসূলের (স) ব্যাপারে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে- তবে সেটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সবার নিকট বড় কুফরে আমালী। [.আমাদের বিরোধীপক্ষ ইমাম আলবানীর (রহ) ‘ফিতনাতুত তাকফীরের’’ বক্তব্য খণ্ডনে উপরোক্ত আমালী কুফরগুলোকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করে থাকেন। অথচ উক্ত আমলগুলো আক্বীদা, ইবাদত এবং আল্লাহ তাআলা ও রসূলের (স) হক্বের সাথে সম্পর্কিত, যা মুআমালাত বা লেনদেন তথা মানবীয় হক্বের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এ কারণে উক্ত আমলগুলো কেবল কুফরে আমালীই নয় বরং ‘ইবাদত ও আক্বীদাগত কুফর, যা দ্বীন থেকে খারিজ করে দেয় তথা বড় কুফর হিসাবে গণ্য। পক্ষান্তরে বিচার-লেনদেন তথা মুআমালাতের ক্ষেত্রে যতক্ষণ তা আক্বীদাকে নষ্ট করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন না করাটা ঐ সমস্ত আমালী কুফরের অন্তর্ভূক্ত যা ছোট কুফর ( كفر دون كفر )। কিন্তু এক্ষেত্রেও যদি হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল বলে, বা দ্বীন ইসলামের বিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, গালি-গালাজ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে- তবে সেটা আক্বীদার বিরোধী হওয়ায় বড় কুফরের অন্তর্ভুক্ত হবে। যা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ করে। এ সম্পর্কিত ধারণা আমরা ‘ইবাদত ও ইতাআতের পার্থক্য’’ অনুচ্ছেদে আলোচনা করেছি। -অনুবাদক।]
سـ ٥ : سَماحة الشيخ : ما معنى الكفر العملي الذي يكون في الأحوال الطبيعية، والأصل القلبي لَم ينتقض ؟
প্রশ্ন-৫: মাননীয় শায়খ! ঐ সমস্ত কুফরে আমালীর অর্থ কী, যা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ( الأحوال الطبيعية -বৈশিষ্ট্যগতভাবে) রয়েছে, এর আন্তরিক অবস্থা কি (ঈমানের) ত্রুটি নয়?
سَماحة الشيخ ابن باز : مثل السجود لغير الله ، والذبح لغير الله كفر عمل ، مثل سبه لدين ، أو استهزأ بالدين كفر عملي - نسأل الله العافية - كفر أكبر .
শায়খ ইবনু বায (রহ): যেমন- গায়রুল্লাহকে সিজদা করা, গায়রুল্লাহর জন্য যবেহ করা কুফরে আমালী। আরো যেমন- দ্বীন (ইসলামকে) তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কিংবা দ্বীন নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করাটা কুফরে আমালী। আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি- এগুলো কুফরে আকবার।
سـ ٦ : السجود والذبح إذا كان جهلاً ، هل يفرق بين الْجهل والتعمد ؟
প্রশ্ন-৬: (গায়রুল্লাহর জন্য) সিজদা বা যবেহ করা যদি অজ্ঞতার জন্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছায় আমলটি সংঘটিত হওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا ما فيه جهلُ ... هذه من الأمور التِي لا تُجهلُ بين الْمسلمين ... يذبح لغيْر الله، لذلك يكفرُ وعليه التوبة، وإذا كان صادقاً عليه بالتوبة فمن تاب تاب الله عليه . الْمشركون تابوا وتاب الله عليهم يوم الفتح، وهم معروف كفرهم وضلالهم، ولَما فتح الله مكة ودخلوا في دينِ اللهِ قَبلَ اللهُ منهم .
শায়খ ইবনু বায (রহ): এর মধ্যে অজ্ঞতার কোন বিষয় নেই ...। এটা এমন একটা বিষয় যে ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যে কোন অজ্ঞতা নেই...। সে গায়রুল্লাহর জন্যে যবেহ করলে সেক্ষেত্রে কাফির হবে এবং তার উপর তাওবা করা জরুরি। যদি সে সত্যিকারভাবে তাওবা করে, তবে তার তাওবা আল্লাহ কবুল করবেন। মুশরিকরা তাওবা করেছিল, তারা মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর কাছে তাওবা করেছিল। তাদের কুফর ও গোমরাহীর বিষয় প্রসিদ্ধ ছিল। যখন মক্কা বিজয়ের দিনে তারা দ্বীনের মধ্যে দাখিল হল, আল্লাহ তাদের থেকে তাওবা ক্ববুল করেন।
سـ ٧ : لكن يا شيخ بِمجرد العمل ! كسجود معاذِ للنبي عليه الصلاة والسلام بِمجرد العمل هكذا ؟ !
প্রশ্ন-৭: তবে হে শায়খ, কেবল আমলের ক্ষেত্রে! যেমন মাআয (রা) কর্তৃক নবী (স)-কে সিজদা করা কি কেবল আমল হিসাবে গণ্য?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا متأولُ يِحسبُ أنه جاهلُ . بين له النبي ﷺ. استقرت الشريعةُ وعرف أن السجود لله ﴿فاسجدوا لله واعبدوا ﴾وانتهى الأمر . كان معاذ جاهلاً فعلمه النبيُّ ﷺ. الآن استقرت الشريعةُ ، وعلم أن السجود لله ﴿فاسجدوا لله واعبدوا ﴾ والذبح لله . ﴿ قل إن صلاتي ونسكي ومَحياي ومِماتي لله رب العالَمين لا شريك له ﴾ فالذي بين الْمسلمين [ من ] يسجد لغيْر الله يكون كافراً عليه التوبة .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এটা ছিল একটি মুতা’ওয়াল (ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাখ্যাকৃত সিদ্ধান্ত), যা তার অজ্ঞতা হিসাবে গণ্য। তাকে নবী (স) ব্যাখ্যা করেছিলেন। অতঃপর শরীআত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটাই বিধান হয়েছে যে, সিজদা কেবল আল্লাহ তাআলা-র জন্য। (ঘোষিত হয়েছে :) فاسجدوا لله واعبدوا ‘‘সুতরাং কেবল আল্লাহর সিজদা কর ও তাঁরই ইবাদত কর।’’ [. সূরা নাযম : ৬২ আয়াত।] এভাবে শরীআতী নির্দেশনা সমাপ্ত হয়েছে। মুআয (রা) ছিলেন এ ব্যাপারে অজ্ঞ, এ কারণে রসূলুল্লাহ (স) তাকে ইলম (শিক্ষা) দিয়েছিলেন। এখন শরীআত প্রতিষ্ঠিত। আর এটা জ্ঞাত যে, সিজদা করতে হবে কেবল আল্লাহ তাআলা’র। (কেননা আল্লাহর নির্দেশ :) فاسجدوا لله واعبدوا ‘‘সুতরাং কেবল আল্লাহর সিজদা কর ও তাঁরই ইবাদত কর।’’ [.সূরা নাযম : ৬২ আয়াত।] তেমনি যবেহ কেবলই আল্লাহর জন্যে। (ঘোষিত হয়েছে :) قل إن صلاتي ونسكي ومَحياي ومَماتي لله رب العالَمين لا شريك له ‘‘নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- সমস্ত কিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্য, আর তাঁর কোন শরীক নেই।’’ [.সূরা আনয়াম : ১৬২-১৬৩ আয়াত।] সুতরাং মুসলিমদের মধ্যে যে গায়রুল্লাহকে সিজদা করে সে কাফির, তার ওপর তাওবা করা জরুরি।
سـ ٨ : هل تبديل القوانين يعتبْر كفراً مُخرجاً من الْملة ؟
প্রশ্ন-৮: তাহলে (ইসলামী) আইনের পরিবর্তন কি কুফর, যা মিল্লাত (ইসলাম) থেকে খারিজ করে দেয়?
سَماحة الشيخ ابن باز : إذا استباحه . إذا استباح حكم بقانون غير الشريعة يكون كافراً كفراً أكبر إذا استباح ذلك ، أما إذا فعل ذلك لأسباب خاصة عاصياً لله من أجل الرشوة ، أو من أجل إرضاء فلان أو فلان ، ويعلم أن مُحرم يكون كفراً دون كفر .
أما إذا فعله مستحلاً له يكون كفراً أكبر . كما قال ابن عباس في قوله تعالى : ﴿ ومن لَم يَحكم بِما أنزل الله فأولئك هم الكافرون .... الظالِمون .... الفاسقون ﴾ . قال : ليس كمن كفر بالله ، ولكن كفر دون كفر .
أي إذا استحل الْحكم بقانون ، أو استحل الْحكم بكذا ، أو كذا غيْر الشريعة يكون كافراً ، أما إذا فعله لرشوة أو لإتاوة بينه وبين الْمحكوم عليه ، أو لأجل إرضاء بعض الشعب ، أو ما اشبه ذلك فهذا يكون كفراً دون كفر
শায়খ ইবনু বায (রহ) : যখন সে এটাকে বৈধ মনে করে। যদি সে ভিন্ন বিধান দ্বারা হুকুম জারি করাকে জায়েয মনে করে, তবে সে কাফির হবে। এটা কুফরে আকবার- যখন সে তা বৈধ মনে করে। আর যখন সে সুনির্দিষ্ট কারণে তা করে, তাহলে সেটা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণ হবে। যেমন ঘুষের কারণে, বা ব্যক্তি বিশেষকে খুশি করার কারণে- কিন্তু সে জানে যে এটা হারাম। তখন এটা হবে كفر دون كفر (ছোট কুফর)।
আর যদি সে এটা হালাল গণ্য করে, তবে সেটা হবে কুফরে আকবার (বড় কুফর)। যেভাবে ইবনু আব্বাস (রা) আল্লাহ তাআলা’র বাণী : ‘‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী হুকুম জারি করে না তারা কাফির, .... যালিম, ... ফাসিক্ব’’-(সূরা মায়িদা : ৪৪-৪৭ আয়াত) সম্পর্কে বলেছেন : এটি আল্লাহর প্রতি কুফর করার মত নয়, বরং كفر دون كفر (ছোট কুফর)।
অর্থাৎ যখন সে ঘোষণা করে তার জারিকৃত বিধানটি হালাল, কিংবা অনুরূপ অন্যান্য বিধানও (হালাল), কিংবা শরীআত বিরোধী বিধান (হালাল হিসাবে) জারি করে- তবে সে কাফির। আর যখন সে ঘুষের জন্য করে, বা তার ও বিচারপ্রার্থীর মধ্যকার শত্রুতার জন্য করে, কোন গোষ্ঠীর সন্তুষ্টির জন্য করে, বা এধরনের আরো কোন কারণে- তবে সেক্ষেত্রে কুফরটি হবে كفر دون كفر (ছোট কুফর)।
سـ ٩ : هل هناك فرق بين التبديل وبين الْحكم في قضية واحدة؟ ! يعني في فرق في هذا الْحكم بين التبديل ككل والْحكم في قضية واحدة؟ التبديل يا شيخ؟
প্রশ্ন-৯: হুকুমের তাবদীল (পরিবর্তন) ও কোন একটি বিচারের (বিকৃত) হুকুম জারির মধ্যে কি পার্থক্য আছে? অর্থাৎ কোন একটি (মূল) হুকুমের পরিবর্তন [.যেমন - হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করা। (অনুবাদক)] কি কোন একটি বিচারের হুকুম পরিবর্তনের মত- হে শায়খ?
سَماحة الشيخ ابن باز : إذا كان لَم يقصد بذلك الاستحلال ، وإنّما حكم بذلك لأجل أسباب أخرى يكون كفراً دون كفر ، أما إذا قال : لا حرج بالْحكم بغير ما أنزل الله ، وإن قال الشريعة أفضل ، لكن إذا قال ما في حرج مباح يكفّر بذلك كفراً أكبر سواءٌ قال إن الشريعة أفضل ، أو مساوية ، أو رأى أفضل من الشريعة كله كفر .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : যখন তার আন্তরিক ইচ্ছা এটা নয় যে, সে এটাকে বিচারের দ্বারা হালাল করছে, বরং হুকুমটি জারির পিছনে অন্য কোন (পূর্বোক্ত) কারণ আছে, তাহলে তখন এটি হবে كفر دون كفر (ছোট কুফর)। তবে যখন সে বলে : বিচারের ক্ষেত্রে আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুম বিরোধী বিধান জারি করলে কোন ক্ষতি নেই। কিংবা যদি সে বলে : শরীআতই উত্তম; কিন্তু সে যখন এটাও বলে : এতে কোন ক্ষতি নেই, মুবাহ (বৈধ) -তাহলে তা এমন কুফর যা কুফরে আকবার (বড় কুফর এর অন্তর্ভুক্ত)। অথচ সে বলে : শরীআতই উত্তম, কিংবা শরীআতেরই মত, কিংবা শরীআতের চেয়ে এটিই উত্তম- এর সবগুলো পর্যায়ই (বড়) কুফর।
سـ ١٠ : يعني هذا الْحكم يشمل التبديل وعدم التبديل يعني يشمل كل الأنواع ؟
প্রশ্ন-১০: অর্থাৎ (পূর্বে ব্যাখ্যাকৃত) এই হুকুম সামগ্রিকভাবে (শরীআতের) পরিবর্তন (তাবদীল) ও অপরিবর্তন (আদম তাবদীল) সম্পর্কিত, তথা এটা কি সমগ্র বিষয়টিকে ঘিরেই বর্ণিত হয়েছে?
سَماحة الشيخ ابن باز : جميع الصور في جَميع الصور . لكن يُجب أن يَمنع ، ويُجب منع ذلك ، وهو كفر دون كفر ولو قال ما قصدت ولو قال ما استحليته بينِي وبين فلان عداوة أو رشوة يُجب أن يّمنع ، فلا يَجوز لأحد أن يُحكم بغيْر ما أنزل الله مطلقاً ولو كان بينه وبين الْمحكوم عليه عداوة أو لأسباب أخرى يُجب الْمنع من ذلك يُجب على ولِي أمره أن يّمنعه من ذلك ، وأن يّحكم بشرع الله .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এটা সামগ্রিক শর্ত, যা সমভাবে সমস্ত শর্তের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে অবশ্যই তাকে নিষেধ করা ওয়াজিব, এ ব্যাপারে তাকে বাধা দেয়াও ওয়াজিব- আর এটা كفر دون كفر (ছোট কুফর)। আর যদি সে বলে : ‘‘আমার এটা করার ইচ্ছা ছিল না’’, কিংবা বলে : ‘‘আমি এটিকে হালাল করিনি আমার ও অমুকের মাঝে শত্রুতা ছিল, কিংবা এতে ঘুষ ছিল।’’ তবে অবশ্যই তার জন্য এর প্রতিকার করা ওয়াজিব। সর্বোপরি কারো জন্যই আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুমের বিরোধী বিধান জারি করা কোন ভাবেই জায়েয নয়। আর যদি সে এমন কারো বিচার করে যার সাথে তার শত্রুতা আছে, কিংবা অন্য কোন কারণ রয়েছে- সেক্ষেত্রে অবশ্যই বিচারকার্যটি স্থগিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে উলূল আমরদের (দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের) প্রতি দায়িত্ব হল, এটা নির্মূল করা এবং শরীআত অনুযায়ী হুকুম জারি করা।
سـ ١١ : ما تقول فيمن يصف أهل السنة الذين لا يكفرون بالذنب بأنّهم مرجئة ؟
প্রশ্ন-১১: আপনি তার ব্যাপারে কি বলবেন, যারা আহলে সুন্নাতে অবস্থান করেন, কিন্তু পাপের কারণে কাউকে কাফির বলেন না, তারা কি মুরজিয়া নন?
سَماحة الشيخ ابن باز : هذا جهل مركب ويُجب أن يعلَّمَ ، هذا جاهل من الْجهلة ويجب أن يعلم ، الْمرجئة الذين يرون الأعمال أنّها تدخل في الإيْمان يرون من لّم يصل ولّم يزك ولّم يصم هذا من الإيْمان هذه هي الْمرجئة . أما أهل السنة والْجماعة يقولون : أن من ترك الزكاة عاص ناقص الإيْمان ، ومن لَم يصم ناقص الإيْمان ، ومن لّم يُحج وهو مستطيع ناقص الإيْمان ، ومن زنى ناقص الإيْمان ، ومن سرق ناقص الإيْمان ، لكن لا يكفر كما تقول الْخوارج ولا يكون مُخلداً في النار كما تقول الْمعتزلة لا . يكون معرض للوعيد وعلى خطر كبيْر ، ومنهم من يدخل النار بذنوبه ، ثُم يشفع فيه الشفعاء ولا يُخلد في النار إلا الكفرة الذين أشركوا بالله واستحلوا مُحارم الله أو سخطوا ما أوجب الله هم الْمخلدون في النار
أما الزانِي لا يَخلد لو مات على الزنا . لا يَخلد ولو دخل النار . وكذلك شارب الخمر لا يَخلد ، والعاق لوالديه إذا دخل النار لا يَخلد . آكل الربا وإن كان متوعداً دخول النار يبقى فيها ما شاء الله ثُم يَخرج بعد التطهيْر إلَى الْجنة كما جاءت به الأحاديث عن رسول الله ﷺ أحاديث الشفاعة .
ومن عنده شك يراجع أحاديث الآخرة ليعرف ما جاءت به السنة أن النبي ﷺ يشفع عدة شفاعات للعصاة ، ويُخرجهم الله من النار بشفاعته . ويشفع الْمؤمنون والأفراد والْملائكة والْمؤمنون ثُم بعد هذا يبقى بقية في النار من العصاة يُخرجهم الله من النار بغيْر شفاعة بعدما احترقوا ، ثم يلقون في نَهر الْحياة فينبتون كما تنبت الْحبة في حَميل السيل ، ثُم بعد هذا يأذن لَهم الله في دخول الْجنة ، ولا يبقى في النار إلا الكفرة هم الْمخلدون فيها أبد الآباد أما العصاة فلا يَخلدون . هذا قول أهل السنة ليس قول الْمرجئة .
الْمصيبة في الْجهل
ما يبلغ الأعداء من جاهل * ما يبلغ الْجاهل من نفسه
শায়খ ইবনু বায (রহ) : এখানে অজ্ঞতার মিশ্রণ রয়েছে, তার জন্য ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। সে অজ্ঞতার অন্ধকারে রয়েছে, এজন্যে তার জন্য ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। মুরজিয়া হল তারা, যারা আমল যা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়- (যেমন) সালাত আদায় না করা, যাকাত আদায় না করা, সিয়াম পালন না করা প্রভৃতি সংঘটিত না হওয়ার পরও ঈমান (পূর্ণাঙ্গ) রয়েছে বলে দাবি করে, এরাই মুরজিয়া। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বক্তব্য হল : যদি কেউ যাকাত আদায় না করে তবে তা পাপ, ঈমানের ত্রুটি। যদি সিয়াম পালন না করে, তবে সেটাও ঈমানের ত্রুটি। যদি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ পালন না করে, তবে সেটাও ঈমানের ত্রুটি। তেমনি যিনাকারীর ঈমান ত্রুটিযুক্ত, চোরের ঈমান ত্রুটিযুক্ত- কিন্তু এজন্য তাকে কাফির বলে না, যেভাবে খারেজীরা বলে থাকে। এ জন্যে তারা স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে না- যেভাবে মু’তাযিলারা (স্থায়ী জাহান্নামের হওয়ার কথা) বলে থাকে। কিন্তু সে অত্যন্ত ভয়াবহ আযাব ও বিপদের সম্মুখীন। তাদের অনেকে পাপের জন্যে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর শাফায়াতের মাধ্যমে তাদের মুক্তি হবে। শেষাবধি কাফির যারা শিরক করেছে- তারা ছাড়া কেউই স্থায়ী ভাবে জাহান্নামে থাকবে না এবং তারাও যারা আল্লাহর নাযিলকৃত হারাম বিধানকে হালাল গণ্য করেছে। আর তারাও যারা আল্লাহর ওয়াজিবকৃত বিষয়গুলোর প্রতি ঘৃণা রাখে- তারাই স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে।
যিনাকারীও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, যদিও সে যিনারত অবস্থায় মারা যায়। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়, যদিওবা সেখানে সে প্রবেশ করে। অনুরূপ মদপানকারীও চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। পিতামাতার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী যদিওবা জাহান্নামী, কিন্তু সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না। সুদখোরের যদিওবা স্থায়ী জাহান্নামের ওয়াদা আছে, যেভাবে আল্লাহ চান। অতঃপর তাদেরকে পবিত্র করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে- যেভাবে শাফাআত সংক্রান্ত হাদীসে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন।
তাদের আখিরাতে (পাপীদের) মুক্তি পাওয়া সংক্রান্ত হাদীসটি সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। যা প্রসিদ্ধ সুন্নাত দ্বারা জানা যায়। সেটা হল, নবী (স) ব্যাপক সংখ্যক পাপীকে শাফাআত দ্বারা মুক্তি দেবেন। তাদের শাফাআতের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। অতঃপর মু’মিনগণ ও মালাইকাগণ শাফাআত করবে। শেষে অবশিষ্ট পাপীকে জাহান্নাম থেকে আল্লাহ তাআলা মুক্তি দিবেন কারো শাফাআত ছাড়া- যাদের আগুনে দগ্ধ করা হয়েছে। তারপর তাদের ‘হায়াতের নদীতে’ ফেলা হবে। তখন তারা গাছের চারা গজানোর মত গজিয়ে উঠবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিবেন। শেষাবধি কাফির ছাড়া কেউই চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে না। পাপীরা সেখানে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না। এটা আহলে সুন্নাতের বক্তব্য, মুরজিয়াদের নয়।
সমস্যা হল অজ্ঞতা। অজ্ঞদের থেকে শত্রুরা তা পৌঁছায় না,
বরং অজ্ঞরা নিজের থেকেই তা পৌঁছায়।
سـ ١٢ : يا شيخ الذي يقول : أن هذا من قول الْمرجئة ماذا نقول فيه ؟
প্রশ্ন-১২: হে শায়খ! যারা বলে এটি মুরজিয়াদের মত, আমরা তাদের কি বলতে পারি?
سَماحة الشيخ ابن باز : قلنا جاهل مركب لا يعرف قول أهل السنة يراجع كلام أهل السنة يراجع كلام شيخ الإسلام ابن تيمية وكلام الأشعري في الْمقالات وغيرهم من أهل السنة وفتح الْمجيد للشيخ عبد الرحمن بن حسن وغيرهم ويراجع شرح الطحاوية لابن أبي العز ويراجع كتاب التوحيد لابن خزيْمة وأشباهه ، حتى يعرف كلام أهل السنة .
فإذا كان جاهلاً مركباً لا يُحكم على الناس بِجهله نسأل الله لنا وله الْهدايةا
শায়খ ইবনু বায (রহ) : আমরা অজ্ঞদের বলব, এরূপ উক্তি আহলে সুন্নাত থেকে শুনিনি। আমরা ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ), ইমাম আশআরী (রহ)-এর ‘আল-মাক্বালাত’ প্রভৃতি আহলে সুন্নাতের ইমামদের সূত্র উল্লেখ করব। তাছাড়া শায়খ আব্দুর রহমান বিন হাসানের (রহ) ‘‘ফতহুল মাজীদ’’, ইবনু আবীল ‘ঈযের ‘শরহে তাহাবিয়্যাহ’, ইবনু খুযায়মাহ ও অন্যান্যদের ‘কিতাবুত তাওহীদ’ প্রভৃতির সূত্র উল্লেখ করব। ফলে তারা আহলে সুন্নাতের বক্তব্য সম্পর্কে জ্ঞাত হবে। সুতরাং যারা অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন আমরা সে সমস্ত মানুষের প্রতি তাদের অজ্ঞতার জন্য হুকুম জারি করব না। আল্লাহর কাছে আমরা দুআ করব, তিনি যেন তাদের হিদায়াত দেন।
سـ ١٣ : أعمال الْجوارح تعتبِر شرط كمال في الإيْمان أم شرط صحة للإيْمان؟
প্রশ্ন-১৩: আমলের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা কি পূর্ণাঙ্গ ঈমানের শর্ত, নাকি সহীহ ঈমানের শর্ত?
سَماحة الشيخ ابن باز : أعمال الْجوارح منها ما هو كمال ، ومنها ما ينافي الإيْمان فالصوم يكمل الإيْمان والصدقة والزكاة من كمال الإيْمان وتركها نقص في الإيْمان وضعف في الإيْمان ومعصية ، أما الصلاة فالصواب أن تركها كفر- نسأل الله العافية - كفر أكبر ، وهكذا فالإنسان يأتِي بالأعمال الصالِحات ، فهذا من كمال الإيْمان أن يكثر من الصلاة ومن صوم التطوع ومن الصدقات . فهذا من كمال الإيْمان الذي يقوى به إيْمانه .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : আমলে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা (ঈমানের) পূর্ণতার জন্য। আর এ থেকে বিরত থাকা ঈমানের হ্রাস ঘটায়। সুতরাং সিয়াম ঈমানকে পূর্ণ করে, সাদাক্বা ও যাকাত ঈমানকে পূর্ণ করে। আর এগুলো থেকে বিরত থাকা ঈমানের ক্ষতি করে, ঈমানকে দুর্বল করে এবং এটা পাপ। পক্ষান্তরে সালাত তরককারী সহীহ মতে কাফির। এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি- যা কুফরে আকবার। এভাবে যখন মানুষ আমালে সালেহ করতে থাকে, তখন তা থেকে ঈমান পূর্ণ হয়। যেমন- বেশি করে নফল সালাত, সিয়াম ও সাদাক্বাত আদায় করা। এগুলোর দ্বারা ঈমান পূর্ণ হয় এবং এগুলো ঈমানকে শক্তিশালী করে।
سـ ١٤ : إذا كان من كلمة أو نصيحة أخيَرة ؟
প্রশ্ন-১৪: সর্বশেষ নসীহত হিসাবে কি আপনার কিছু বলার আছে?
سَماحة الشيخ ابن باز : وصيتِي للجميع التفقه في الدين ، والتدبر للقرآن . الإكثار من قراءة القرآن ، وتدبر معانيه ، والْمذاكرة فيما بينهم كما دل عليه القرآن والسنة ، والقراءة في كتب أهل السنة مثل شيخ الإسلام ابن تيمية وابن القيم ، ويقرؤون كتبهما فيها خير عظيم . كتب السلف مثل تفسير ابن جرير . وكتاب التوحيد لابن خزيْمة وشرح السنة للبغوي ومثل كتاب شرح الطحاوية لابن أبْي العز وأشباهه والْحموية ، التدمرية ، وكلها كتب عظيمة مفيدة
نسأل الله للجميع التوفيق والْهداية وصلاح النية والعمل .
শায়খ ইবনু বায (রহ) : সবার প্রতি আমার নসিহত, দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করুন এবং কুরআনের মর্ম অনুধাবন করুন। বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করুন এবং অর্থ হৃদয়ঙ্গম করুন। পরস্পরকে উপদেশ দিতে থাকুন- কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎসারিত বিষয়ে। আহলে সুন্নাতের কিতাব পড়তে থাকুন, যেমন- ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রহ), ইমাম ইবনুল ক্বাইয়েম (রহ) প্রমুখের কিতাবগুলোই সর্বোৎকৃষ্ট। সালাফদের তাফসীর যেমন- তাফসীরে ইবনু জারীর, ইমাম ইবনু খুযায়মাহ’র ‘কিতাবুত তাওহীদ’, ইমাম বগভীর ‘শরহে সুন্নাহ’, ইবনু আবীল ‘ঈযের ‘শরহে তাহাবিয়্যাহ’ প্রভৃতি খুবই উপকারী পুস্তক।
আল্লাহ তাআলা’র কাছে সবার জন্য তাওফিক্ব ও হিদায়াত এবং সহীহ নিয়্যাত ও আমলের জন্য দুআ চাইছি।
পরবর্তী দু’টি প্রশ্নোত্তর শায়খ ইবনু বাযের فتاوى نور على الدرب এর ৩৬-৪০ পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত।
سـ ١٥ : تسأل الأخت وتقول : هل الإيْمان بالقلب يكفي لأن يكون الإنسان مسلما بعيدا عن الصلاة والصوم والزكاة؟
প্রশ্ন-১৫: একজন বোনের প্রশ্ন, সে জিজ্ঞাসা করেছিল : ক্বলবের ঈমানই কি একজন মানুষের মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট, অথচ সে সালাত, সিয়াম ও যাকাত আদায় থেকে দূরে থাকে?
سَماحة الشيخ ابن باز : الإيْمان بالقلب لا يكفي عن الصلاة وغيْرها، بل يُجب أن يؤمن بقلبه وأن الله واحد لا شريك له، وأنه ربه وخالقه، ويُجب أن يُخصه بالعبادة سبحانه وتعالَى، ويؤمن بالرسول مُحمد ﷺ ، وأنه رسول الله حقا إلى جَميع الثقلين، كل هذا لا بد منه، فهذا أصل الدين وأساسه كما يُجب على الْمكلف أن يؤمن بكل ما أخبَر الله به ورسوله فقد أدى ما عليه، وإن لّم يصل كفر، لأن ترك الصلاة كفر . أما الزكاة والصيام والْحج وبقية الأمور الواجبة إذا اعتقدها وأنّها واجبة، ولكن تساهل فلا يكفر بذلك، بل يكون عاصيا، ويكون إيْمانه ضعيفا ناقصا؛ لأن الإيْمان يزيد وينقص، يزيد الإيْمان بالطاعات والأعمال الصالِحات، وينقص بالْمعاصي عند أهل السنة والْجماعة . أما الصلاة وحدها خاصة فإن تركها كفر عند كثيْر من أهل العلم وإن لّم يِجحد وجوبِها، وهو أصح قولِي العلماء، بِخلاف بقية أمور العبادات، من الزكاة والصوم والْحج ونَحو ذلك، فإن تركها ليس بكفر أكبَر على الصحيح، ولكن نقص في الإيْمان، وضعف في الإيْمان، وكبيِرة عظيمة من كبائر الذنوب، فترك الزكاة كبيِرة عظيمة، وترك الصيام كبيِرة عظيمة، وترك الْحج مع الاستطاعة كبيِرة عظيمة، ولكن لا يكون كفرا أكبَر إذا كان مؤمنا بأن الزكاة حق، وأن الصيام حق، وأن الْحج لِمن استطاع إليه سبيلا حق، ما كذب بذلك ولا أنكر وجوب ذلك، ولكنه تساهل في الفعل، فلا يكون كافرا بذلك على الصحيح . أما الصلاة فإنه إذا تركها يكفر في أصح قولِي العلماء كفرا أكبَر والعياذ بالله وإن لّم يِجحد وجوبِها كما تقدم؛ لقول النبي ﷺ : « بين الرجل وبين الكفر والشرك ترك الصلاة » أخرجه مسلم في صحيحه ، وقوله ﷺ : « العهد الذي بيننا وبينهم الصلاة فمن تركها فقد كفر » أخرجه الإمام أحْمد وأهل السنن الأربعة بإسناد صحيح ، والْمرأة مثل الرجل في ذلك . نسأل الله العافية والسلامة .
শায়খ ইবনু বায (রহ): ক্বলবের ঈমান যথেষ্ট নয় সালাত ও অনুরূপ অন্যান্য আমল ছাড়া। বরং ওয়াজিব হল, আন্তরিকভাবে একক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। নিশ্চয় তিনি তার রব ও সৃষ্টিকর্তা। তার জন্য এটাও ওয়াজিব যে, খাসভাবে আল্লাহ তাআলা’রই ইবাদত করবে। আর সে রসূলের (স) প্রতি ঈমান আনবে। নিশ্চয় তিনি সত্য রসূল হিসাবে উভয় জাতির (জিন ও মানুষের) কাছে এসেছিলেন। এর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। এটাই দ্বীনের মূলনীতি, যা মুকাল্লিফের (দ্বীনের অনুসারীদের) উপর বাধ্যতামূলক। তাদেরকে আল্লাহ ও রসূল (স) এর পক্ষ থেকে আগত খবর যেমন- জান্নাত, জাহান্নাম, পুলসিরাত, মিযান প্রভৃতি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান রাখতে হবে। সুতরাং এটা জরুরি যে, সাক্ষ্য দেবে ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রসূল।’’ তেমনিভাবে সালাত ও অন্যান্য আমলগুলোও জরুরি। সুতরাং যখন সে সালাত আদায় করে, তখন সে তার (ঈমানের) দাবি পূর্ণ করে। আর যদি সে সালাত না পড়ে তবে সে কাফির। যেহেতু সালাত তরক করা কুফর।
তাছাড়া যাকাত, সিয়াম, হজ্জ ও অন্যান্য ওয়াজিব আমলও তাকে পালন করতে হবে। যদি সে এগুলোর ব্যাপারে আক্বীদা রাখে যে তা ওয়াজিব, কিন্তু সে অলসতা ও অবহেলা করে- তাহলে সে কাফির নয়, বরং অবাধ্য (পাপাচারী)। এক্ষেত্রে তার ঈমান দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত। কেননা ঈমানের হ্রাস ও বৃদ্ধি হয়। ইতাআত (&আনুগত্য) ও আমলে সালেহ দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে অবাধ্যতা দ্বারা ঈমান হ্রাস পায়- আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে।
কেবল সালাত তরক করায় এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম (খাস), যা তরক করা অধিকাংশ আলেমের নিকট কুফর। যদিও-বা সে এর ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে না। এটাই আলেমদের সবচেয়ে সহীহ উক্তি। অবশিষ্টরা বলেন, সালাত তরক করা অন্যান্য ইবাদত যেমন- যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ তরক করার ন্যায়। কেননা সহীহ মতে এগুলো কেবল তরক করাটাই কুফরে আকবার নয়। বরং তা ঈমানের ত্রুটি, ঈমানের দুর্বলতা ও কবীরা গোনাহগুলোর সর্বোচ্চ গুনাহ। এ কারণে যাকাত তরক করা সর্বোচ্চ কবীরা গোনাহ। সিয়াম তরক করাও সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ। তেমনি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ্জ আদায় না করা সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহ। কিন্তু তাতে কুফরে আকবার সংঘটিত হয় না, যতক্ষণ একজন মু‘মিন যাকাতকে হক্ব মানে, সিয়ামকে হক্ব মানে, সামর্থ্যবানের জন্য হজ্জ আদায় করাকে হক্ব মানে। সে এগুলোকে মিথ্যা বলে না এবং এর ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকারও করে না। কিন্তু সে আমলের দিকে থেকে অলসতা করে। এ কারণে সহীহ মতে সে কাফির নয়।
তবে সালাত তরককারীর ব্যাপারে আলেমদের সহীহ উক্তি হল, সে কাফির, যা কুফরে আকবার। এ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই, যদিও সে সালাত ওয়াজিব হওয়াকে অস্বীকার করে না- যেভাবে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। কেননা নবী (স) বলেছেন : ‘‘(মু‘মিন) ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হল সালাত তরক করা।’’ (সহীহ মুসলিম) তাছাড়া নবী (স) বলেছেন : ‘‘তাদের ও আমাদের মধ্যে চুক্তি হল সালাত। সুতরাং যে সালাত তরক করে সে কুফরী করে।’’ (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ) এক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের মতই। আল্লাহ কাছে ক্ষমা ও শান্তি চাচ্ছি। [.যারা এর বিপরীতে সালাতকে ওয়াজিব/ফরয হিসাবে স্বীকৃতিদাতার সালাত তরক করাকে আমলী কুফর বলেন তাদের দলিল নিম্নরূপ : ‘উবাদা ইবনু সামিত (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : خَمْسُ صَلَوَاتٍ كَتَبَهُنَّ اللَّهُ عَلَى الْعِبَادِ فَمَنْ جَاءَ بِهِنَّ لَمْ يُضَيِّعْ مِنْهُنَّ شَيْئًا اسْتِخْفَافًا بِحَقِّهِنَّ كَانَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَمْ يَأْتِ بِهِنَّ فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ وَإِنْ شَاءَ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ ‘‘আমি রসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি : আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। কাজেই যে তা সংরক্ষণ করবে এবং তার হক্বের কোন অংশ কম করবে না, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর ব্যাপারে আল্লাহর অঙ্গীকার রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তা করবে না, তার সাথে আল্লাহর কোন চুক্তি নেই। চাইলে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন নতুবা তিনি চাইলে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’’ [মুয়াত্তা মালিক ২৬৭/১৪, আবু দাউদ ১৪২০, নাসাঈ ৪৬১, সহীহ ইবনু হিব্বান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (ইফা) ১/২৬৮ পৃ : হা/২৫; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন (সহীহ আবূ দাউদ হা/১২৫৮)। আলবানী (রহ) বলেন : وقال أيضا : " من مات وهو يعلم أن لا إله إلا الله دخل الْجنة " إلَى غَيْر ذلك ولِهذا لَم يزل الْمسلمون يرثون تارك الصلاة ويورثونه ولو كان كافرا لَم يغفر له ولَم يرث ولَم يورث ‘‘অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে : যে ব্যক্তি এমন অবস্থাতে মারা যায় যে সে ‘ইলম রাখে- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’ [সহীহ মুসলিম ৪৩ (৪৩/২৬), মিশকাত ৩৭] অনুরূপ আরো বর্ণনা রয়েছে। এপ্রেক্ষিতে যদি মুসলিম (কালেমার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে) পদস্খলিত না হয়ে সালাত তরককারী হলে উপরোক্ত দাবির মধ্যে গণ্য হবে, আর যদি কাফির হয়, তবে তার জন্য ক্ষমা নেই, আর তার জন্য ওয়াদা নেই এবং সে উক্ত দাবির মধ্যেও গণ্য নয়।’’ [আলবানী, হুকমু তারিকুস সালাত ১৭-১৮ পৃ.] এই অনুবাদকের নিকট শেষোক্ত দলিলগুলো আখিরাতের আল্লাহর সিদ্ধান্তের সাথে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে শায়েখ ইবনু বায (রহ) -এর উল্লিখিত দলিলগুলো দুনিয়াতে মুসলিমের পরিচয় সম্পর্কিত। অর্থাৎ উভয় মতবিরোধের পক্ষের দলিলগুলো নিজ নিজ স্থানে প্রযোজ্য। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।]
سـ ١٦ : وتقول السائلة : إن هناك شيئا يتردد بين أوساط الناس حيث يقولون : إن الصلاة يشترط لَها الإسلام، والْحج يشترط له الإسلام، فالإنسان قد يكون مسلما ولو لَم يأت ببقية أركان الإسلام . فنريد تَجلية هذا الْموضوع . بارك الله فيكم؟
প্রশ্ন-১৬: প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করল : এ ব্যাপারে লোকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে যে যখন তারা বলে : সালাত ইসলামের ক্ষেত্রে শর্ত, হজ্জ ইসলামের জন্য শর্ত- তাহলেই একজন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারবে। যদিও-বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ইসলামের রোকনগুলো পালিত না হয়। এ কারণে বিষয়টি আরো বেশি সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। আল্লাহ আপনাকে বরকত দান করুন।
سَماحة الشيخ ابن باز : نعم . هو مسلم بالشهادتين، فمتى أقر بالشهادتين ووحد الله عز وجل وصدق رسول الله مُحمدا ﷺ دخل في الإسلام، ثم ينظر فإن صلى تُم إسلامه، وإن لّم يصل صار مرتدا، وهكذا لو أنكر الصلاة بعد ذلك صار مرتدا، أو أنكر صيام شهر رمضان صار مرتدا، أو قال الزكاة غيْر واجبة صار مرتدا، أو قال الْحج مع الاستطاعة غير واجب، صار مرتدا، أو استهزأ بالدين أو سب الله أو سب الرسول صار مرتدا .
فهذا الأمر ينبغي أن يكون واضحا، فإذا دخل في الإسلام بالشهادتين حكم له بالإسلام، ثُم ينظر بعد ذلك في بقية الأمور فإن استقام على الْحق تم إسلامه، وإذا وجد منه ما ينقض الإسلام؛ من سب الدين، أو من تكذيب الرسول ﷺ ، أو من جحد لَما أوجبه الله من صلاة وصوم، أو جحد لَما حرم الله كما لو قال : الزنا حلال، فإنه يرتد عن الإسلام بِهذا، ولو صلى وصام، ولو قال أشهد أن لا إله إلا الله، وأن مُحمدا رسول الله .
فلو قال : إن الزنا حلال، وهو يعلم الأدلة وقد أقيمت عليه الْحجة، يكون كافرا بالله كفرا أكبَر والعياذ بالله، أو قال : الْخمر حلال، وقد بينت له الأدلة ووضحت له الأدلة ثُم أصر يقول : إن الْخمر حلال، يكون ذلك كفرا أكبَر، وردة عن الإسلام والعياذ بالله، أو قال مثلا : إن العقوق حلال، يكون ردة عن الإسلام والعياذ بالله، أو قال إن شهادة الزور حلال، يكون هذا ردة عن الإسلام بعد أن تبين له الأدلة الشرعية .
كذلك إذا قال : الصلاة غيْر واجبة، أو الزكاة غيْر واجبة، أو صيام رمضان غيْر واجب، أو الْحج مع الاستطاعة غيْر واجب، كل هذه نواقض من نواقض الإسلام يكون بها كافرا والعياذ بالله .
إنّما الخلاف إذا قال : إن الصلاة واجبة، ولكن أنا أتساهل ولا أصلي، فجمهور الفقهاء يقولون : لا يكفر ويكون عاصيا يستتاب فإن تاب وإلا قتل حدا .
وذهب آخرون من أهل العلم وهو الْمنقول عن الصحابة رضي الله عنهم أنه يكفر بذلك كفرا أكبر، فيستتاب فإن تاب وإلا قتل كافرا؛ لقول الله جل وعلا : ﴿ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ ﴾ [ التوبة : 5] ، فدل ذلك على أن الذي لا يقيم الصلاة لا يَخلى سبيله ، بل يستتاب فإن تاب وإلا قتل، وقال سبحانه : ﴿ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ ﴾ [ التوبة : ١١ ] ، فدل ذلك على أن الذي لا يقيم الصلاة ولا يصلي ليس بأخ في الدين .
শায়খ ইবনু বায (রহ): জি হ্যাঁ, দু’টি শাহাদাতের মাধ্যমে মুসলিম হয়। অর্থাৎ মনে প্রাণে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলা একক এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর রসূল- তাহলে সে ইসলামে প্রবেশ করল। অতঃপর যদি তাকে সালাত আদায় করতে দেখা যায় তবে তার ইসলাম পূর্ণ হল। আর যদি সালাত আদায় করতে দেখা না যায় তবে সে মুরতাদ। অনুরূপ যদি সে সালাতকে অস্বীকার করে তবেও মুরতাদ হয়ে যায়। কিংবা সিয়ামকে অস্বীকার করলে মুরতাদ হয়। অথবা বলে যাকাত প্রভৃতি ওয়াজিব নয়, তবেও সে মুরতাদ। কিংবা বলে সামর্থ্য হলেও হজ্জ করা ওয়াজিব নয়, তবে সে মুরতাদ। কিংবা দ্বীন নিয়ে তামাশা করে, কিংবা রসূলকে গালি দেয়- তবেও সে মুরতাদ।
উক্ত সিদ্ধান্তের কারণ হল, এ বিষয়গুলো সুস্পষ্ট। সুতরাং যখন কেউ ইসলামে দু’টি শাহাদাত দ্বারা প্রবেশ করে তার উপর ইসলামী বিধি-বিধান আবশ্যক হয়। অতঃপর যদি তাকে অন্যান্য নির্দেশগুলোর উপর দেখা যায় এবং সে হক্বভাবে তাতে দৃঢ় হয়- তবে তার ইসলাম পূর্ণ হল। অতঃপর যদি তার মধ্যে ইসলামের কোন ত্রুটি দেখা যায়। যেমন : দ্বীন নিয়ে কটূক্তি করা, রসূলকে মিথ্যারোপ করা, আল্লাহর ওয়াজিবকৃত বিষয়গুলো যেমন- সালাত, সিয়ামের বিরোধিতা করা, কিংবা আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ের বিরোধিতা করা যেমন- যিনাকে হালাল গণ্য করা; তবে সে ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয়। যদিওবা সে সালাত, সিয়াম পালন করে এবং বলে : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বুদ নেই, এবং মুহাম্মাদ (স) তাঁর রসূল।
অনুরূপ যদি সে বলে : যিনা হালাল, অথচ সে এর দলিল সম্পর্কে জ্ঞাত- তখন প্রমাণ তার জন্য কার্যকরী হবে। সে আল্লাহর প্রতি কুফরী করেছে, যা কুফরে আকবার- সে আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত। কিংবা যদি সে বলে, মদ পান করা হালাল। অথচ তার কাছে দলীল-প্রমাণ পেশ করা হয় এবং সেটা তার কাছে সুস্পষ্টও হয়, তারপরেও সে বলে : মদ হালাল। তখন এটা কুফরে আকবার। ফলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত হয়। কিংবা সে বলে : পিতামাতার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ হালাল। সেক্ষেত্রে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় এবং আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত হয়। কিংবা বলে : মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া হালাল। সেও ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় যখন তার কাছে ইসলামী শরীআতের দলিলগুলো বর্ণনা করা হয়।
অনুরূপ যদি সে বলে : সালাত ওয়াজিব নয়, বা যাকাত ওয়াজিব নয়, রমাযানের সিয়াম ওয়াজিব নয়, সামর্থ্য হওয়ার পরেও হজ্জ ওয়াজিব নয়- এর সবগুলো ইসলাম থেকে বিচ্যুতির কারণগুলোর অন্যতম। ফলে সে কাফির হয় এবং আল্লাহর থেকে বহিষ্কৃত হয়।
তবে ব্যতিক্রম হল, যখন সে বলে : সালাত ওয়াজিব, আমার অলসতা আছে, আমি সালাত আদায় করি না। জমহুর ফক্বীহদের মতে : সে কাফির নয়, সে অবাধ্য ব্যক্তি, তাকে তাওবা করতে হবে। যদি সে তাওবা না করে তবে তাকে হত্যা করতে হবে।
পূর্বোক্ত বিষয়ে আহলে ইলমদের থেকে যাকিছু বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো সাহাবীদের (রা) থেকে এসেছে। তারা এ ব্যাপারটি কুফর গণ্য করতেন, যা কুফরে আকবার। সুতরাং সে তাওবা করবে, যদি তাওবা না করে তবে তাকে হত্যা করতে হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘‘যদি তারা তাওবা করে, সালাত ক্বায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে- তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও।’’ (সূরা তাওবা- ৫ আয়াত) এ থেকে দলিল পাওয়া গেল, যদি সালাত আদায় না করে তবে তাদের পথ রোধ করতে হবে। বরং তাদের তাওবা করতে হবে। যদি তাওবা না করে তবে হত্যা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘‘যদি তাওবা করে, সালাত ক্বায়েম করে, যাকাত আদায় করে- তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।’’ (সূরা তাওবা- ১১ আয়াত) এ থেকে দলিল পাওয়া গেল, যারা সালাত আদায় করে না তারা দ্বীনি ভাই নয়।
-সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ)
[সফিউর রহমান মুবারকপুরী বিখ্যাত ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’-নামক সিরাতুন্নবী (স)-এর লেখক। তাছাড়া তাঁর অধীনে সম্পাদিত বোর্ডকর্তৃক তাফসীর ইবনু কাসিরের সংশোধিত সংস্করণটিও খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তিনি বর্তমান যামানার অন্যতম সালাফী আক্বীদার মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হিসাবে খ্যাত। এই প্রবন্ধটি www.AsliAhleSunnet.com থেকে যা উর্দু ভাষায় অনূদিত ও সঙ্কলিত ‘ফিতনাতুত তাকফীর আওর হুকুম বিগয়রি মা আনযালাল্লাহ’-এর ৮৪-৮৭ পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত। তাছাড়া মূল প্রবন্ধটির স্বতন্ত্র উর্দু শিরোনামেও مولانا مودودی کی نظرئہ حاکمیت کا رد (মওদুদী সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গির ‘তাওহীদে হাকিমিয়্যাত’ খণ্ডন) প্রকাশিত হয়েছে। -অনুবাদক : কামাল আহমাদ]
মওদুদী সাহেবের চিন্তা হল, যার প্রতি নিঃশর্ত ইতাআত করা হয় সেটাই প্রকারান্তরে তার ইবাদত করা। মুসলিমরা আল্লাহ তাআলা’র নিঃশর্ত ইতাআত করে। আর নবী (স)-এর ইতাআত এ জন্য করে যে, সেটা আল্লাহ তাআলা হুকুম দিয়েছেন। অর্থাৎ নবী (স)-এর ইতাআত হল, আল্লাহ তাআলা’র ইতাআতের অধীন। সুতরাং যখন তাঁর (স) ইতাআত করা হয়, তখন আল্লাহ তাআলা’রই ইতাআত করা হয়। যা ফলশ্রুতিতে আল্লাহ’র ইবাদতে পরিণত হয়। এর দ্বারা তিনি অপর একটি মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। আর তা হল, যদি কোন হুকুমাত আল্লাহ তাআলা’র কানুনের অধীনতা ছাড়াই হুকুমাত পরিচালনা করে, তবে সেই হুকুমাতের ইতাআত করাই- তার ইবাদত করা, যা প্রকারান্তরে শিরক। আর এভাবেই তিনি শিরক ফিল হাকিমিয়্যাহ’র দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। এটা অত্যন্ত জোরালোভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আপনাদের সামনে আমি এর স্বরূপ উপস্থাপন করব। অনেক সময় একশ’, দু’শ, চার’শ এমনকি আট’শ পৃষ্ঠার কিতাবে এ ধরনের মাসআলা লেখা হয়। মাসআলা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে, এবং অনেক লম্বা লম্বা আলোচনা বুঝার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। এ কারণে আমি আপনাদের সামনে কয়েকটি শব্দের ব্যাপারে দুই একটি আলোচনা উপস্থাপন করছি।
ইতাআত কি ইবাদত? নাকি ইবাদত এবং ইতাআত ভিন্ন ভিন্ন জিনিস? আমি এটা আপনাদের বুঝাব। এটা বুঝানোর জন্য আমি আপনাদের সামনে একটি বা দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।
একবার আমার কাছে জামায়াতে ইসলামী’র একজন যুবক আসল। সে আমার সাথে কথা বলতে লাগল, আমিও তার সাথে কথা বলতে থাকলাম। একপর্যায়ে সে তার দা‘ওয়াত দিল যে, আমাদের দা‘ওয়াত হল এটা....। আমি বললাম আমি জানি। সে এটাই আশা করছিল যে, আমি যেন তার দা‘ওয়াত কবুল করি।
আমি বললাম : দেখ, তোমাদের দা‘ওয়াত সহীহ নয়।
যুবক : কেন সহীহ নয়?
আমি : যদি এটাই তোমাদের সত্যিকার দা‘ওয়াত হয় যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন হুকুমাতের ইতাআত করে যা আল্লাহ তাআলা’র কানুনের অধীনস্থ নয়, তাহলে এই ইতাআত ইবাদতে পরিণত হবে। যদি এটাই তোমাদের দা‘ওয়াত হয়, তবে মেহেরবানি করে বাইরে যাও এবং যদি কোন মুসলিমকে বাম পাশে দেখ (ভারতের ট্রাফিক আইনে বাম পাশ থেকেই চলতে হয়), তখন যদি সে রাস্তায় বাম পাশ থেকে সাইকেল চালায় তবে তাকে বল, ভাই তুমি বাম পাশ থেকে চলো না, এই পাশ থেকে সাইকেল চালানো শিরক।
যুবক : (উচ্চৈঃস্বরে বলল) শায়খ এটা কি বলেন?
আমি : আমি তো তা-ই বলছি, যা তোমরা বলে থাক। তোমাদের বক্তব্যের মূল বিষয়ই আমি জানাচ্ছি।
যুবক : কিভাবে?
আমি : ভারতের হুকুমাত আল্লাহ তাআলা’র হুকুমাতের বিপরীত, নাকি আল্লাহ’র হুকুমাতের অধীন।
যুবক : না, আল্লাহ’র হুকুমাত গ্রহণ না করে এর বিপরীত পন্থায় চলে।
আমি : এখানে যে আইন আছে এর ইতাআত করাটি কি শিরক হবে, নাকি শিরক হবে না?
যুবক : কোনটা হবে?
আমি : এই আইনের অন্যতম একটি হল, সাইকেল রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলবে। যে ব্যক্তি বাম দিক দিয়ে সাইকেল চালাবে, সে এই হুকুমাতের ইতাআত করবে। আর এই ইতাআতকেই ‘জামায়াতে ইসলামী’ ইবাদত বলছে। আর গায়রুল্লাহ’র ইবাদতকে শিরক গণ্য করা হয়। সুতরাং এটা শিরক।
যুবক : (পেরেশানীর সাথে বলল) শায়খ আপনিই বলুন, কোনটা সহীহ আর কোনটা ভুল?
আমি : দেখ, ইতাআত ও ইবাদত ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। তবে কখনো কখনো একই আমল ইবাদত ও ইতাআত দু’টিই হতে পারে। তেমনই এমনটিও হতে পারে যে, কোন আমল ইতাআত হলেও তা ইবাদত নয়। আবার এটাও হতে পারে যে, কোন আমল ইবাদত কিন্তু ইতাআত নয়। এর সবগুলোই সম্ভব।
যুবক : কিভাবে?
আমি : বলছি, শোন। ইবরাহীম (আ) নিজের ক্বওমকে জিজ্ঞাসা করলেন :
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا تَعْبُدُونَ ( ٧٠ ) قَالُوا نَعْبُدُ أَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِينَ ( ٧١ ) قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُونَ ( ٧٢ ) أَوْ يَنْفَعُونَكُمْ أَوْ يَضُرُّونَ ( ٧٣ )
‘‘(ইবরাহীম আ.) যখন তার পিতা ও ক্বওমকে বললেন : তোমরা কিসের ইবাদত কর? তারা বলল : আমরা প্রতিমার ইবাদত করি এবং এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি। ইবরাহীম (আ) বললেন : তোমরা যখন আহবান কর, তখন কি তারা শোনে? অথবা তারা কি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে?’’(সূরা শূআরা : ৭০-৭৩ আয়াত)
বলতো, ইবরাহীম (আ)-এর ক্বওম যে মূর্তির ইবাদত করত, তারা কি তার ইতাআতও করত? মূর্তিতো কখনোই কোন হুকুম দেয়ার বা কোন কিছু বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং ঐ ক্বওমের কাজটি ইবাদত হলেও ইতাআত নয়।
যুবক : (তখন সে স্বীকার করল) হাঁ এটা ঠিক যে, ঐ ক্বওম ইতাআত নয় বরং মূর্তিদের ইবাদত করত।
আমি : তাহলে এবার আমরা আরেকটু সামনে যাব। ঈসায়ীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের কয়েকটি স্থানে বর্ণনা করেছেন। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করবেন :
وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ .
‘‘যখন আল্লাহ বলবেন : হে ঈসা ইবনু মারইয়াম! তুমি কি লোকদের বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহ সাব্যস্ত কর?’’.... (সূরা মায়িদা : ১১৬ আয়াত)।
তখন ঈসা (আ) এটা সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করবেন। বলবেন :
مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ
‘‘আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, তবে কেবল সে কথাই বলেছি যা আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাহল, আল্লাহ’র ইবাদত কর, যিনি আমার ও তোমাদের রব। আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্যদাতা যতদিন তাদের মাঝে ছিলাম।’’ (সূরা মায়িদা : ১১৭ আয়াত)
এভাবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করবেন। কুরআনের উল্লিখিত আয়াতের সম্পর্ক ঈসায়ীদের সাথে এবং ঈসা (আ) -এর ইবাদত করা সম্পর্কিত। কিন্তু ঐ লোকেরা যার ইবাদত করে সে না তাদের উপকার করতে পারে, আর না পারে তাদের ক্ষতি করতে। সুতরাং সুস্পষ্ট হল, তারা ঈসা (আ) -এর ইবাদত করত। আর ঈসা (আ) তাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারতেন না। এখন মাসআলা হল, তারা ঈসা (আ)-এর যে ইবাদত করত, সেটা কি তাঁর ইতাআতও ছিল?
(পুনরায় বললাম) ইবাদত করাতো প্রমাণিত হল, কেননা কুরআন এ কাজটিকে ঈসা (আ)-এর ইবাদত বলে উল্লেখ করেছে। সুতরাং ঈসায়ীদের মধ্যে যারা তাঁর ইবাদত করেছে ও করছে, তারা কি তাঁর ইতাআতও করছে? তারা কখনোই ইতাআত করছে না। ঈসা (আ) কখনই তাঁর ইবাদত করার হুকুম দেন নাই যে, আমার ইবাদত কর। বরং তিনি নিষেধ করেছেন। সুতরাং তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ইতাআতের বদলে নাফরমানী করেছে, আর সেটা ইবাদতই ছিল। সুতরাং ইবাদত করার জন্য এটা জরুরি নয় যে, যার ইবাদত করা হবে তাঁর ইতাআতও করতে হবে। ইতাআত ছাড়াও ইবাদত হয়, আর নাফরমানির মাধ্যমেও ইবাদত করা হয়। একে তাঁর পক্ষ থেকে অনুমোদিত ইবাদত বলা হবে না।
সুতরাং মাসআলাটি সুস্পষ্ট হল। এখন তুমি কী জানতে চাও? কারো কোন হুকুম মানা ও আনুগত্য করা তার ইতাআত। পক্ষান্তরে, কারো নৈকট্য অর্জনের জন্য তথা সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোন মাধ্যম ছাড়াই তার সন্তুষ্টি অর্জনের পদ্ধতিমূলক কাজই ইবাদত। ঐ লোকেরা ঈসা (আ)-এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ঐ আমল করত, এ কারণে তারা তাঁর ইবাদত করত। তারা তাঁর নির্দেশের আনুগত্য করেনি, সুতরাং তারা তাঁর ইতাআত করত না। আমরা সালাত আদায় করি- এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য কামনা করি। অর্থাৎ সালাত একটি ইবাদত। আর আল্লাহ যে হুকুম দিয়েছেন তা পালনও করি, এটাই হল তাঁর ইতাআত। ইতাআত ও ইবাদতের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন। সালাত একটি আমল যার মধ্যে দু’টি বিষয়ই রয়েছে অর্থাৎ ইবাদত ও ইতাআত।
অথচ মওদুদী সাহেব যেহেতু এই দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন যে, কারো নিঃশর্ত ইতাআত করাটাই তার ইবাদত করা। এ কারণে তিনি বলেছেন, বান্দা যদি আল্লাহ তাআলা’র ইতাআতে জীবন অতিবাহিত করে, তবে তার সমস্ত জীবনই ইবাদতে পরিণত হবে। সুতরাং তার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এগুলো (জীবন-যাপনের সব কিছুই) ইবাদত। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে জীবনের সবকিছুই ইবাদত নয়। বরং এর মধ্যে ইতাআতও রয়েছে। যদি সমস্ত যিন্দেগী আল্লাহ’র হুকুমে পালিত হয়, তবে সেই যিন্দেগীর পুরোটাই তাঁর ইতাআত। আর এটা সওয়াবের কাজ এবং এর মাধ্যমে সওয়াব অর্জিত হয়। কিন্তু এটা ইবাদত নয়। এটাই সহীহ অর্থ।
[সংযোজন : পূর্বেই আমরা দেখেছি স্বয়ং নবী (স) শাসককে ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড় দিতে বলেছেন যতক্ষণ তার থেকে স্পষ্ট কুফর প্রকাশ না পায়, কিংবা সালাত আদায় করে। পক্ষান্তরে যুলুম-অত্যাচার, স্বজনপ্রীতি, হক্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে জনগণকে শাসককে মেনে নিতে বলেছেন। কিন্তু দু’টিই আল্লাহর নির্দেশ। এর প্রথমোক্তটি আক্বীদা ও ইবাদত সংক্রান্ত। আর দ্বিতীয়টি ইতাআত বা মুআমালাত সম্পর্কিত। অথচ উভয়টির ব্যাপারেই সুস্পষ্ট নির্দেশাবলি আছে। -অনুবাদক]
[সফিউর রহমান মুবারকপুরী বিখ্যাত ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’-নামক সিরাতুন্নবী (স)-এর লেখক। তাছাড়া তাঁর অধীনে সম্পাদিত বোর্ডকর্তৃক তাফসীর ইবনু কাসিরের সংশোধিত সংস্করণটিও খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তিনি বর্তমান যামানার অন্যতম সালাফী আক্বীদার মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হিসাবে খ্যাত। এই প্রবন্ধটি www.AsliAhleSunnet.com থেকে যা উর্দু ভাষায় অনূদিত ও সঙ্কলিত ‘ফিতনাতুত তাকফীর আওর হুকুম বিগয়রি মা আনযালাল্লাহ’-এর ৮৪-৮৭ পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত। তাছাড়া মূল প্রবন্ধটির স্বতন্ত্র উর্দু শিরোনামেও مولانا مودودی کی نظرئہ حاکمیت کا رد (মওদুদী সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গির ‘তাওহীদে হাকিমিয়্যাত’ খণ্ডন) প্রকাশিত হয়েছে। -অনুবাদক : কামাল আহমাদ]
মওদুদী সাহেবের চিন্তা হল, যার প্রতি নিঃশর্ত ইতাআত করা হয় সেটাই প্রকারান্তরে তার ইবাদত করা। মুসলিমরা আল্লাহ তাআলা’র নিঃশর্ত ইতাআত করে। আর নবী (স)-এর ইতাআত এ জন্য করে যে, সেটা আল্লাহ তাআলা হুকুম দিয়েছেন। অর্থাৎ নবী (স)-এর ইতাআত হল, আল্লাহ তাআলা’র ইতাআতের অধীন। সুতরাং যখন তাঁর (স) ইতাআত করা হয়, তখন আল্লাহ তাআলা’রই ইতাআত করা হয়। যা ফলশ্রুতিতে আল্লাহ’র ইবাদতে পরিণত হয়। এর দ্বারা তিনি অপর একটি মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। আর তা হল, যদি কোন হুকুমাত আল্লাহ তাআলা’র কানুনের অধীনতা ছাড়াই হুকুমাত পরিচালনা করে, তবে সেই হুকুমাতের ইতাআত করাই- তার ইবাদত করা, যা প্রকারান্তরে শিরক। আর এভাবেই তিনি শিরক ফিল হাকিমিয়্যাহ’র দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। এটা অত্যন্ত জোরালোভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে অসংখ্য ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আপনাদের সামনে আমি এর স্বরূপ উপস্থাপন করব। অনেক সময় একশ’, দু’শ, চার’শ এমনকি আট’শ পৃষ্ঠার কিতাবে এ ধরনের মাসআলা লেখা হয়। মাসআলা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করে, এবং অনেক লম্বা লম্বা আলোচনা বুঝার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। এ কারণে আমি আপনাদের সামনে কয়েকটি শব্দের ব্যাপারে দুই একটি আলোচনা উপস্থাপন করছি।
ইতাআত কি ইবাদত? নাকি ইবাদত এবং ইতাআত ভিন্ন ভিন্ন জিনিস? আমি এটা আপনাদের বুঝাব। এটা বুঝানোর জন্য আমি আপনাদের সামনে একটি বা দু’টি উদাহরণ পেশ করছি।
একবার আমার কাছে জামায়াতে ইসলামী’র একজন যুবক আসল। সে আমার সাথে কথা বলতে লাগল, আমিও তার সাথে কথা বলতে থাকলাম। একপর্যায়ে সে তার দা‘ওয়াত দিল যে, আমাদের দা‘ওয়াত হল এটা....। আমি বললাম আমি জানি। সে এটাই আশা করছিল যে, আমি যেন তার দা‘ওয়াত কবুল করি।
আমি বললাম : দেখ, তোমাদের দা‘ওয়াত সহীহ নয়।
যুবক : কেন সহীহ নয়?
আমি : যদি এটাই তোমাদের সত্যিকার দা‘ওয়াত হয় যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন হুকুমাতের ইতাআত করে যা আল্লাহ তাআলা’র কানুনের অধীনস্থ নয়, তাহলে এই ইতাআত ইবাদতে পরিণত হবে। যদি এটাই তোমাদের দা‘ওয়াত হয়, তবে মেহেরবানি করে বাইরে যাও এবং যদি কোন মুসলিমকে বাম পাশে দেখ (ভারতের ট্রাফিক আইনে বাম পাশ থেকেই চলতে হয়), তখন যদি সে রাস্তায় বাম পাশ থেকে সাইকেল চালায় তবে তাকে বল, ভাই তুমি বাম পাশ থেকে চলো না, এই পাশ থেকে সাইকেল চালানো শিরক।
যুবক : (উচ্চৈঃস্বরে বলল) শায়খ এটা কি বলেন?
আমি : আমি তো তা-ই বলছি, যা তোমরা বলে থাক। তোমাদের বক্তব্যের মূল বিষয়ই আমি জানাচ্ছি।
যুবক : কিভাবে?
আমি : ভারতের হুকুমাত আল্লাহ তাআলা’র হুকুমাতের বিপরীত, নাকি আল্লাহ’র হুকুমাতের অধীন।
যুবক : না, আল্লাহ’র হুকুমাত গ্রহণ না করে এর বিপরীত পন্থায় চলে।
আমি : এখানে যে আইন আছে এর ইতাআত করাটি কি শিরক হবে, নাকি শিরক হবে না?
যুবক : কোনটা হবে?
আমি : এই আইনের অন্যতম একটি হল, সাইকেল রাস্তার বাম দিক দিয়ে চলবে। যে ব্যক্তি বাম দিক দিয়ে সাইকেল চালাবে, সে এই হুকুমাতের ইতাআত করবে। আর এই ইতাআতকেই ‘জামায়াতে ইসলামী’ ইবাদত বলছে। আর গায়রুল্লাহ’র ইবাদতকে শিরক গণ্য করা হয়। সুতরাং এটা শিরক।
যুবক : (পেরেশানীর সাথে বলল) শায়খ আপনিই বলুন, কোনটা সহীহ আর কোনটা ভুল?
আমি : দেখ, ইতাআত ও ইবাদত ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। তবে কখনো কখনো একই আমল ইবাদত ও ইতাআত দু’টিই হতে পারে। তেমনই এমনটিও হতে পারে যে, কোন আমল ইতাআত হলেও তা ইবাদত নয়। আবার এটাও হতে পারে যে, কোন আমল ইবাদত কিন্তু ইতাআত নয়। এর সবগুলোই সম্ভব।
যুবক : কিভাবে?
আমি : বলছি, শোন। ইবরাহীম (আ) নিজের ক্বওমকে জিজ্ঞাসা করলেন :
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا تَعْبُدُونَ ( ٧٠ ) قَالُوا نَعْبُدُ أَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عَاكِفِينَ ( ٧١ ) قَالَ هَلْ يَسْمَعُونَكُمْ إِذْ تَدْعُونَ ( ٧٢ ) أَوْ يَنْفَعُونَكُمْ أَوْ يَضُرُّونَ ( ٧٣ )
‘‘(ইবরাহীম আ.) যখন তার পিতা ও ক্বওমকে বললেন : তোমরা কিসের ইবাদত কর? তারা বলল : আমরা প্রতিমার ইবাদত করি এবং এদেরকেই নিষ্ঠার সাথে আঁকড়ে থাকি। ইবরাহীম (আ) বললেন : তোমরা যখন আহবান কর, তখন কি তারা শোনে? অথবা তারা কি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে?’’(সূরা শূআরা : ৭০-৭৩ আয়াত)
বলতো, ইবরাহীম (আ)-এর ক্বওম যে মূর্তির ইবাদত করত, তারা কি তার ইতাআতও করত? মূর্তিতো কখনোই কোন হুকুম দেয়ার বা কোন কিছু বাধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং ঐ ক্বওমের কাজটি ইবাদত হলেও ইতাআত নয়।
যুবক : (তখন সে স্বীকার করল) হাঁ এটা ঠিক যে, ঐ ক্বওম ইতাআত নয় বরং মূর্তিদের ইবাদত করত।
আমি : তাহলে এবার আমরা আরেকটু সামনে যাব। ঈসায়ীদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদের কয়েকটি স্থানে বর্ণনা করেছেন। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞাসা করবেন :
وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ .
‘‘যখন আল্লাহ বলবেন : হে ঈসা ইবনু মারইয়াম! তুমি কি লোকদের বলে দিয়েছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহ সাব্যস্ত কর?’’.... (সূরা মায়িদা : ১১৬ আয়াত)।
তখন ঈসা (আ) এটা সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করবেন। বলবেন :
مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ
‘‘আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, তবে কেবল সে কথাই বলেছি যা আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাহল, আল্লাহ’র ইবাদত কর, যিনি আমার ও তোমাদের রব। আমি তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্যদাতা যতদিন তাদের মাঝে ছিলাম।’’ (সূরা মায়িদা : ১১৭ আয়াত)
এভাবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করবেন। কুরআনের উল্লিখিত আয়াতের সম্পর্ক ঈসায়ীদের সাথে এবং ঈসা (আ) -এর ইবাদত করা সম্পর্কিত। কিন্তু ঐ লোকেরা যার ইবাদত করে সে না তাদের উপকার করতে পারে, আর না পারে তাদের ক্ষতি করতে। সুতরাং সুস্পষ্ট হল, তারা ঈসা (আ) -এর ইবাদত করত। আর ঈসা (আ) তাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারতেন না। এখন মাসআলা হল, তারা ঈসা (আ)-এর যে ইবাদত করত, সেটা কি তাঁর ইতাআতও ছিল?
(পুনরায় বললাম) ইবাদত করাতো প্রমাণিত হল, কেননা কুরআন এ কাজটিকে ঈসা (আ)-এর ইবাদত বলে উল্লেখ করেছে। সুতরাং ঈসায়ীদের মধ্যে যারা তাঁর ইবাদত করেছে ও করছে, তারা কি তাঁর ইতাআতও করছে? তারা কখনোই ইতাআত করছে না। ঈসা (আ) কখনই তাঁর ইবাদত করার হুকুম দেন নাই যে, আমার ইবাদত কর। বরং তিনি নিষেধ করেছেন। সুতরাং তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছে। ইতাআতের বদলে নাফরমানী করেছে, আর সেটা ইবাদতই ছিল। সুতরাং ইবাদত করার জন্য এটা জরুরি নয় যে, যার ইবাদত করা হবে তাঁর ইতাআতও করতে হবে। ইতাআত ছাড়াও ইবাদত হয়, আর নাফরমানির মাধ্যমেও ইবাদত করা হয়। একে তাঁর পক্ষ থেকে অনুমোদিত ইবাদত বলা হবে না।
সুতরাং মাসআলাটি সুস্পষ্ট হল। এখন তুমি কী জানতে চাও? কারো কোন হুকুম মানা ও আনুগত্য করা তার ইতাআত। পক্ষান্তরে, কারো নৈকট্য অর্জনের জন্য তথা সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোন মাধ্যম ছাড়াই তার সন্তুষ্টি অর্জনের পদ্ধতিমূলক কাজই ইবাদত। ঐ লোকেরা ঈসা (আ)-এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ঐ আমল করত, এ কারণে তারা তাঁর ইবাদত করত। তারা তাঁর নির্দেশের আনুগত্য করেনি, সুতরাং তারা তাঁর ইতাআত করত না। আমরা সালাত আদায় করি- এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা’র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য কামনা করি। অর্থাৎ সালাত একটি ইবাদত। আর আল্লাহ যে হুকুম দিয়েছেন তা পালনও করি, এটাই হল তাঁর ইতাআত। ইতাআত ও ইবাদতের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন। সালাত একটি আমল যার মধ্যে দু’টি বিষয়ই রয়েছে অর্থাৎ ইবাদত ও ইতাআত।
অথচ মওদুদী সাহেব যেহেতু এই দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন যে, কারো নিঃশর্ত ইতাআত করাটাই তার ইবাদত করা। এ কারণে তিনি বলেছেন, বান্দা যদি আল্লাহ তাআলা’র ইতাআতে জীবন অতিবাহিত করে, তবে তার সমস্ত জীবনই ইবাদতে পরিণত হবে। সুতরাং তার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এগুলো (জীবন-যাপনের সব কিছুই) ইবাদত। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে জীবনের সবকিছুই ইবাদত নয়। বরং এর মধ্যে ইতাআতও রয়েছে। যদি সমস্ত যিন্দেগী আল্লাহ’র হুকুমে পালিত হয়, তবে সেই যিন্দেগীর পুরোটাই তাঁর ইতাআত। আর এটা সওয়াবের কাজ এবং এর মাধ্যমে সওয়াব অর্জিত হয়। কিন্তু এটা ইবাদত নয়। এটাই সহীহ অর্থ।
[সংযোজন : পূর্বেই আমরা দেখেছি স্বয়ং নবী (স) শাসককে ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড় দিতে বলেছেন যতক্ষণ তার থেকে স্পষ্ট কুফর প্রকাশ না পায়, কিংবা সালাত আদায় করে। পক্ষান্তরে যুলুম-অত্যাচার, স্বজনপ্রীতি, হক্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে জনগণকে শাসককে মেনে নিতে বলেছেন। কিন্তু দু’টিই আল্লাহর নির্দেশ। এর প্রথমোক্তটি আক্বীদা ও ইবাদত সংক্রান্ত। আর দ্বিতীয়টি ইতাআত বা মুআমালাত সম্পর্কিত। অথচ উভয়টির ব্যাপারেই সুস্পষ্ট নির্দেশাবলি আছে। -অনুবাদক]
মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া যে, মুসলিম ভাইদের সংস্কারের স্বার্থে এই ‘‘তাহক্বীক্বকৃত আমাদের হাকিম কেবলই একজন- আল্লাহ তাআলা’’ লিখতে পেরেছি। আমরা এমন গুণীজন, সুধীজন, দল বা জামাআত ইদানীং লক্ষ্য করছি, যারা অনেকেই হক্বের দা‘ওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ সমস্ত জামাআতের মধ্যে সূক্ষ্ম ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। কখনো এটা আক্বীদার ক্ষেত্রে আবার কখনো বা আমলের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি জামাআতকে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় থাকতে দেখা যায়। এরকম অনেক হক্ব ও সংস্কারের অন্যতম বাহকদের একটি মূল শ্লোগান সমৃদ্ধ পুস্তিকা ‘‘আমাদের হাকিম কেবলই একজন- আল্লাহ তাআলা’’-এর সংস্কার জরুরি মনে করছি। মূলত ‘‘হাকিম একমাত্র আল্লাহ’’ এই শ্লোগানটি ছিল মুসলিমদের থেকে পৃথক প্রথম সৃষ্ট ফিরক্বা খারেজীদের। যাদের সংস্কারের উদ্দেশ্যে এই তাহক্বীক্ব বা বিশ্লেষণটি লেখা হয়েছে তাদেরও সেই ইতিহাস স্মরণ করানো দরকার মনে করছি।
এই ইতিহাসটি জানানোর ক্ষেত্রে আমরা যে গ্রন্থটিকে মূল সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি তা হল, ইমাম ইবনু কাসির (রহ)-এর ‘‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭ম খণ্ড (মিশর : মাকতাবাতুস সাফা পৃ : ২২৬-২৫৫, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭/৫০৩-৫৫৬)’’। গ্রন্থটি মূলত হাদীসের আলোকেই সঙ্কলিত। এরপরও আমরা সাধ্যমত এর সূত্রগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। যদি কেউ এর অনুল্লিখিত সূত্র সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন তবে পরবর্তী সংস্করণে এর প্রয়োজনীয় সংস্কার করার উদ্যোগ নেব এবং তার বা তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকব। অবশ্য আমরা এখানে কেবল সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় অংশগুলোই উল্লেখ করব।
এই ইতিহাসটি জানানোর ক্ষেত্রে আমরা যে গ্রন্থটিকে মূল সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি তা হল, ইমাম ইবনু কাসির (রহ)-এর ‘‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭ম খণ্ড (মিশর : মাকতাবাতুস সাফা পৃ : ২২৬-২৫৫, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭/৫০৩-৫৫৬)’’। গ্রন্থটি মূলত হাদীসের আলোকেই সঙ্কলিত। এরপরও আমরা সাধ্যমত এর সূত্রগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। যদি কেউ এর অনুল্লিখিত সূত্র সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন তবে পরবর্তী সংস্করণে এর প্রয়োজনীয় সংস্কার করার উদ্যোগ নেব এবং তার বা তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ থাকব। অবশ্য আমরা এখানে কেবল সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় অংশগুলোই উল্লেখ করব।
[সিফফীন যুদ্ধের পর আলী (রা) ও মুআবিয়া (রা)-এর] সালিসী চুক্তির পর আশআছ ইবনু কাইস তামীম গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছে চুক্তিনামাটি পড়ে শুনান। সেখানে ছিল রাবীআ ইবনু হানজালাহ বংশের সন্তান উরওয়াহ ইবনু উযায়না (উযায়না মাতার নাম, পিতার নাম জারীর)। সে আবূ বিলাল ইবনু মিরদাস ইবনু জারীর-এর ভাই। সে দাঁড়িয়ে বলল : أتَحكموك فى دين الله الرجال তোমরা কি আল্লাহ’র দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে হাকিম (বিচারক) নিয়োগ করছো? এ কথা বলেই সে আশআছ ইবনু কাইসের বাহনের পশ্চাৎভাগে তরবারি দিয়ে আঘাত হানলো। এতে আশআছ ও তার ক্বওমের লোকেরা অত্যন্ত রাগান্বিত হয়। ফলে আহনাফ ইবনু কাইস ও তাদের গোত্রের নেতৃস্থানীয় একটি দল এসে আশআছ ইবনু কাইসের কাছে এ ব্যাপারে ক্ষমা প্রার্থনা করে। খারিজী সম্প্রদায়ের ধারণা মতে যিনি সর্ব প্রথম তাদের নেতৃত্ব দেন তিনি হলেন আব্দুল্লাহ ইবনু ওহাব রাসিবী। গ্রন্থকারের মতে প্রথমটিই সঠিক। আলীর পক্ষের কিছুসংখ্যক লোক যারা কুররা নামে পরিচিত ছিল তারা ঐ ব্যক্তির মতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং ঘোষণা দেয় لا حكم الا الله (আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হুকুম নেই)। একারণে এ দলকে ‘মাহকামিয়্যা’ নামে অভিহিত করা হয়। তারপর লোকজন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে নিজ নিজ এলাকার দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। মুআবিয়া (রা) তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে দামেশকে যায়। আর আলী (রা) কূফার উদ্দেশ্যে ‘হীত’-এর পথ ধরে অগ্রসর হন। তিনি যখন কূফায় পৌঁছেন, তখন শুনতে পান এক ব্যক্তি বলছে, আলী গিয়েছিল কিন্তু শূন্য হাতে ফিরে এসেছে। এ কথা শুনে আলী (রা) বললেন, যাদের আমরা ছেড়ে এসেছি তারা অবশ্যই ওদের তুলনায় উত্তম।.....
এরপর আলী (রা) আল্লাহর স্মরণ করতে করতে কূফায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন কূফা নগরীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন, তখন তাঁর বাহিনীর প্রায় বার হাজার লোক তাঁর থেকে আলাদা হয়ে যায়। এরাই ইতিহাসে খারিজী নামে বিখ্যাত। তারা আলী (রা) -এর সাথে একই শহরে বসবাস করতে অস্বীকার করে এবং হারুরা নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করে। তাদের মতে আলী (রা) কয়েকটি অন্যায় কাজে জড়িত হয়ে পড়েছেন যার দরুন তারা আর তাঁকে মেনে নিতে পারছে না। আলী (রা) তাদের সাথে কথা বলার জন্যে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসকে প্রেরণ করেন। ইবনু আব্বাস (রা) তাদের কাছে গিয়ে তাদের অভিযোগ শোনেন ও জওয়াব দেন। ফলে তাদের অধিকাংশ লোক মত পরিবর্তন করে ফিরে আসে, আর অবশিষ্টরা আপন মতে অনড় থাকে। আলী (রা) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। [.আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫০৩-৫০৫ (সংক্ষেপিত)।]
অন্য বর্ণনানুযায়ী, আলী (রা) যখন মুআবিয়াকে চুক্তিপত্র লিখে দেন এবং সালিস নিযুক্ত করেন, তখন তাঁর দল থেকে আট হাজার ক্বারী বেরিয়ে যায় এবং কূফা নগরীর উপকণ্ঠে হারুরা নামক স্থানে গিয়ে সমবেত হয়। তারা আলীর উপরে দোষারোপ ও তাঁকে তিরস্কার করে বলতে থাকে :
انسلخت من قميص ألبسكه الله، واسم سَماك به الله ثم انطلقت فحكمت فى دين الله ولا حكم إلا الله
‘‘মহান আল্লাহ আপনাকে যে জামা (খিলাফত) পরিধান করিয়েছিলেন, আপনি সে জামা খুলে ফেলেছেন। যে উপাধিতে মহান আল্লাহ আপনাকে ভূষিত করেছিলেন আপনি সে উপাধি প্রত্যাহার করেছেন। এরপর আপনি আরো অগ্রসর হয়ে মহান আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে হাকিম নিযুক্ত করেছেন। অথচ মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কোন হাকিম নেই।’’
আলীর কাছে যখন তাদের এসব অভিযোগের কথা পৌঁছাল এবং তিনি জানতে পারলেন যে, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা তাঁর থেকে পৃথক হয়ে গেছে। তিনি এক ঘোষণাকারীর মাধ্যমে নির্দেশ জারি করলেন যে, আমীরুল মু‘মিনীনের দরবারে যেন কেবল ঐসব লোক প্রবেশ করে যারা পবিত্র কুরআন বহন করে (হাফিযে কুরআন)।
আমীরুল মু‘মিনীনের দরবার যখন ক্বারীদের সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি পবিত্র কুরআনের একটি কপি এনে সবার সম্মুখে রাখলেন। এরপর তিনি হাতের আংগুল দ্বারা পবিত্র কুরআনে উপর জোরে টোকা মেরে বললেন, ‘‘হে কুরআন! তুমি লোকদের তোমার কথা জানাও।’’ উপস্থিত লোকজন আলীকে বললো, ‘‘হে আমীরুল মু‘মিনীন। আপনি পবিত্র কুরআনের কপির কাছে এ কি জিজ্ঞেস করছেন? ও তো কাগজ আর কালি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা তো ওর মধ্যে যা দেখি তা নিয়ে কথা বলছি। তাহলে এরূপ করায় আপনার উদ্দেশ্য কী?’’ তিনি জওয়াবে বললেন : তোমাদের ঐসব সাথি যারা আমার থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান নিয়েছে, তাদের ও আমার মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে একজন পুরুষ (স্বামী) ও একজন নারীর (স্ত্রীর) ব্যাপারে বলেছেন :
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا
‘‘তাদের (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিরোধের আশংকা হলে, তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন ও তার (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন হাকিম নিযুক্ত করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।’’ [.সূরা নিসা : ৩৫ আয়াত।]
দ্বিতীয় অভিযোগের জবাবে আলী (রা) বললেন : তারা আমার উপর আরো অভিযোগ এনেছে যে, আমি মুআবিয়াকে যে চুক্তিপত্র লিখে দিয়েছি, তাতে (আমীরুল মু‘মিনীনের বদলে) আলী ইবনু আবূ তালিব লিখেছি। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল : হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহাইল ইবনু আমর আসলে রসূলুল্লাহ (স) যখন নিজ ক্বওমের সাথে সন্ধিপত্র লেখেন, তখন আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রসূলুল্লাহ (স) প্রথমে লিখলেন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’। সুহাইল আপত্তি জানিয়ে বলল : আমি ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ লিখতে রাজি নই। রসূলুল্লাহ (স) বললেন, তাহলে কিভাবে লিখব? সুহাইল বললেন : লিখব ‘বিইসমিকা আল্লাহুম্মা।’ রসূলুল্লাহ (স) বললেন, তা-ই লিখ। রসূলুল্লাহ (স) বললেন, এখন লিখ ‘এই সন্ধিপত্র, যা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স) সম্পাদন করলেন।’ সুহাইল বলল : আমি যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রসূল, তাহলে তো আপনার সাথে আমার কোন বিরোধই থাকত না। অবশেষে লেখা হল : এই সন্ধিপত্র যা আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ কুরাইশদের সাথে সম্পাদন করলেন। মহান আল্লাহ আপন কিতাবে বলেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে তাদের জন্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’’ [.সূরা আহযাব : ২১ আয়াত।]
এরপর আলী (রা) তাদের কাছে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা)-কে প্রেরণ করেন।..... আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস তিন দিন পর্যন্ত সেখানে তাদের সাথে আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। অবশেষে তাদের মধ্যে থেকে চার হাজার লোক তাওবা করে ফিরে আসে। ইবনুল কাওয়াও তাদের অন্তর্ভুক্ত। ইবনু আব্বাস (রা) এদের আলী (রা) -এর কাছে কূফায় নিয়ে আসেন। অবশিষ্ট লোকদের কাছে আলী (রা) বার্তা পাঠিয়ে জানান যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হোক। আর তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত থাকল যে, তোমরা অন্যায়ভাবে কারো রক্তপাত ঘটাবে না। ডাকাতি, রাহাজানি করবে না এবং যিম্মীদের উপর অত্যাচার চালাবে না। যদি এর কোনটিতে লিপ্ত হয়ে পড় তবে তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। (কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন :) إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ ‘‘আল্লাহ খিয়ানতকারীদের পছন্দ করেন না।’’ [.সূরা আনফাল : ৫৮ আয়াত।]
বর্ণনাকারী বলেন : আল্লাহর ক্বসম! ওদের বিরুদ্ধে আলী (রা) পক্ষ থেকে তখনই অভিযান পাঠানো হয়েছে, যখন ওরা ডাকাতি, রাহাজানি শুরু করেছে, খুন-খারাবী ছড়িয়ে দিয়েছে এবং যিম্মীদের উপর অত্যাচার করে তাদের সবকিছু নিজেদের জন্যে হালাল করে নিয়েছে।’’ [.ইবনু কাসীর (রহ) বলেছেন : আহমাদ এ হাদীস মুফরাদ বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদ সহীহ। যিয়া একে পছন্দ করেছেন। [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫০৬-৫০৯] তাছাড়া ইমাম হাকিম এ বর্ণনাটিকে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তাধীনে সহীহ বলেছেন, তবে উভয়ে তা বর্ণনা করেননি। [তাহক্বীক্বকৃত আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (মিশর) ৭/২২৯ পৃ.]]
অন্য বর্ণনায় আছে : আলী (রা) -কে তাদের সমালোচনার কারণ ছিল এই যে-
১.তিনি মানুষকে হাকিম (ফায়সালাকারী) নিযুক্ত করেছিলেন।
২.শাসকের পদবীকে মুছে দিয়েছিলেন।
৩.উষ্ট্রের যুদ্ধে তিনি অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করেছেন; অথচ শত্রুদের থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ও বন্দী সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করেননি।
প্রথম দু’টি অভিযোগের (হাকিম নির্ধারণ ও পদবী মুছে ফেলার) জওয়াবে তিনি যা বলেন, ইতোপূর্বে তা আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অভিযোগের জওয়াবে তিনি বলেন : ‘‘বন্দীদের মধ্যে উম্মুল মু‘মিনীনও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এখন যদি তোমরা দাবি করো যে, তোমাদের কোন উম্মুল মু‘মিনীন নেই, তবে তা হবে তোমাদের জন্য কুফরী কাজ। আবার যদি উম্মুল মু‘মিনীনকে বন্দী রাখা বৈধ মনে করো, তাও হবে কুফরী কাজ।’’ বর্ণনাকারী বলেন : এবার তাদের মধ্য থেকে দু’ হাজার লোক বেরিয়ে আসে বাকি সবাই বিদ্রোহ করে। এরপর তাদের সাথে যুদ্ধ হয়। [.আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫০৯ পৃ.।]
ইবনু জারীর (রহ) লিখেছেন : খারিজীদের অবশিষ্ট লোকদের কাছে আলী (রা) স্বয়ং গমন করেন। তিনি তাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত চালিয়ে যান। অবশেষে তারা সকলেই তাঁর সাথে কুফায় চলে আসে। সে দিনটি ছিল ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার দিন। এরপর তারা আলী (রা) -এর কথাবার্তায় বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। তাঁকে গালমন্দ করে এবং তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করতে থাকে।
ইমাম শাফেঈ (রহ) বলেন : আলী (রা) একদিন সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তাঁকে লক্ষ্য করে জনৈক খারিজী এ আয়াতটি পড়ে :
لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘‘তুমি আল্লাহ’র শরীক স্থির করলে তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্য তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’’ [. সূরা যুমার : ৬৫ আয়াত।] জওয়াবে আলী (রা) নিচের আয়াতটি পড়লেন :
فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلَا يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِينَ لَا يُوقِنُونَ
‘‘কাজেই, তুমি সবর কর। নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, তারা যেন তোমাকে বিচলিত করতে না পারে।’’ [. সূরা রূম : ৬০ আয়াত।]
ইবনু জারীর (রহ) বলেন : এ ঘটনা হয়েছিল তখন যখন আলী (রা) খুতবা পাঠ করছিলেন। ইবনু জারীর (রা) আরো একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তা হল :
‘‘আলী (রা) একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন। এ সময় এক খারিজী দাঁড়িয়ে বলল, হে আলী! আপনি মহান আল্লাহর দ্বীনে মানুষকে শরীক করেছেন (অর্থাৎ শির্ক করেছেন)। অথচ আল্লাহ ব্যতীত হুকুম দেয়ার অধিকার আর কারো নেই। এ সময় চারদিক থেকে একই আওয়াজ উঠলো - لا حكم الا الله ـ لا حكم الا الله ‘‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম নেই, আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম নেই।’’ তখন আলী (রা) বললেন : هذه كلمة حق يراد بِها باطل ‘‘কথাটি সত্য, কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ।’’ তারপর তিনি বললেন : ‘‘যতদিন তোমাদের দায়িত্ব আমাদের উপরে ছিল ততদিন আমরা তোমাদের গনীমত দেয়া বন্ধ করিনি এবং আল্লাহর মাসজিদে সালাত আদায় করতে বাধা দেইনি। এখন তোমাদের উপর আমরা আগেই হামলা করব না। যদি তোমরা প্রথমে হামলা না কর।’’ এরপর তারা সবাই কূফা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাহরাওয়ান নামক স্থানে সমবেত হয়। [. আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫১০ পৃ.।]
উপরোক্ত ঐতিহাসিক আলোচনাটি আরো সুস্পষ্ট হবে আমাদের পরবর্তী তাহক্বীক্বটি বিস্তারিতভাবে পাঠ করলে। এটাও সুস্পষ্ট হবে, খারিজী এবং বর্তমান যামানার বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী যারা একই ধরনের শ্লোগান ব্যবহার করছে এবং যত্রতত্র কুফরী ফাতওয়া প্রদান করে বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে- তাদের সংস্কার ও সংশোধন করা অতীব জরুরি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রকৃত হিদায়াত দান করুন। আমিন!!
এরপর আলী (রা) আল্লাহর স্মরণ করতে করতে কূফায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন কূফা নগরীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেন, তখন তাঁর বাহিনীর প্রায় বার হাজার লোক তাঁর থেকে আলাদা হয়ে যায়। এরাই ইতিহাসে খারিজী নামে বিখ্যাত। তারা আলী (রা) -এর সাথে একই শহরে বসবাস করতে অস্বীকার করে এবং হারুরা নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করে। তাদের মতে আলী (রা) কয়েকটি অন্যায় কাজে জড়িত হয়ে পড়েছেন যার দরুন তারা আর তাঁকে মেনে নিতে পারছে না। আলী (রা) তাদের সাথে কথা বলার জন্যে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসকে প্রেরণ করেন। ইবনু আব্বাস (রা) তাদের কাছে গিয়ে তাদের অভিযোগ শোনেন ও জওয়াব দেন। ফলে তাদের অধিকাংশ লোক মত পরিবর্তন করে ফিরে আসে, আর অবশিষ্টরা আপন মতে অনড় থাকে। আলী (রা) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। [.আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫০৩-৫০৫ (সংক্ষেপিত)।]
অন্য বর্ণনানুযায়ী, আলী (রা) যখন মুআবিয়াকে চুক্তিপত্র লিখে দেন এবং সালিস নিযুক্ত করেন, তখন তাঁর দল থেকে আট হাজার ক্বারী বেরিয়ে যায় এবং কূফা নগরীর উপকণ্ঠে হারুরা নামক স্থানে গিয়ে সমবেত হয়। তারা আলীর উপরে দোষারোপ ও তাঁকে তিরস্কার করে বলতে থাকে :
انسلخت من قميص ألبسكه الله، واسم سَماك به الله ثم انطلقت فحكمت فى دين الله ولا حكم إلا الله
‘‘মহান আল্লাহ আপনাকে যে জামা (খিলাফত) পরিধান করিয়েছিলেন, আপনি সে জামা খুলে ফেলেছেন। যে উপাধিতে মহান আল্লাহ আপনাকে ভূষিত করেছিলেন আপনি সে উপাধি প্রত্যাহার করেছেন। এরপর আপনি আরো অগ্রসর হয়ে মহান আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে হাকিম নিযুক্ত করেছেন। অথচ মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কোন হাকিম নেই।’’
আলীর কাছে যখন তাদের এসব অভিযোগের কথা পৌঁছাল এবং তিনি জানতে পারলেন যে, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা তাঁর থেকে পৃথক হয়ে গেছে। তিনি এক ঘোষণাকারীর মাধ্যমে নির্দেশ জারি করলেন যে, আমীরুল মু‘মিনীনের দরবারে যেন কেবল ঐসব লোক প্রবেশ করে যারা পবিত্র কুরআন বহন করে (হাফিযে কুরআন)।
আমীরুল মু‘মিনীনের দরবার যখন ক্বারীদের সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি পবিত্র কুরআনের একটি কপি এনে সবার সম্মুখে রাখলেন। এরপর তিনি হাতের আংগুল দ্বারা পবিত্র কুরআনে উপর জোরে টোকা মেরে বললেন, ‘‘হে কুরআন! তুমি লোকদের তোমার কথা জানাও।’’ উপস্থিত লোকজন আলীকে বললো, ‘‘হে আমীরুল মু‘মিনীন। আপনি পবিত্র কুরআনের কপির কাছে এ কি জিজ্ঞেস করছেন? ও তো কাগজ আর কালি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা তো ওর মধ্যে যা দেখি তা নিয়ে কথা বলছি। তাহলে এরূপ করায় আপনার উদ্দেশ্য কী?’’ তিনি জওয়াবে বললেন : তোমাদের ঐসব সাথি যারা আমার থেকে পৃথক হয়ে অবস্থান নিয়েছে, তাদের ও আমার মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব রয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে একজন পুরুষ (স্বামী) ও একজন নারীর (স্ত্রীর) ব্যাপারে বলেছেন :
وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا
‘‘তাদের (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিরোধের আশংকা হলে, তোমরা তার (স্বামীর) পরিবার হতে একজন ও তার (স্ত্রীর) পরিবার হতে একজন হাকিম নিযুক্ত করবে; তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।’’ [.সূরা নিসা : ৩৫ আয়াত।]
দ্বিতীয় অভিযোগের জবাবে আলী (রা) বললেন : তারা আমার উপর আরো অভিযোগ এনেছে যে, আমি মুআবিয়াকে যে চুক্তিপত্র লিখে দিয়েছি, তাতে (আমীরুল মু‘মিনীনের বদলে) আলী ইবনু আবূ তালিব লিখেছি। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল : হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহাইল ইবনু আমর আসলে রসূলুল্লাহ (স) যখন নিজ ক্বওমের সাথে সন্ধিপত্র লেখেন, তখন আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রসূলুল্লাহ (স) প্রথমে লিখলেন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’। সুহাইল আপত্তি জানিয়ে বলল : আমি ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ লিখতে রাজি নই। রসূলুল্লাহ (স) বললেন, তাহলে কিভাবে লিখব? সুহাইল বললেন : লিখব ‘বিইসমিকা আল্লাহুম্মা।’ রসূলুল্লাহ (স) বললেন, তা-ই লিখ। রসূলুল্লাহ (স) বললেন, এখন লিখ ‘এই সন্ধিপত্র, যা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (স) সম্পাদন করলেন।’ সুহাইল বলল : আমি যদি জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রসূল, তাহলে তো আপনার সাথে আমার কোন বিরোধই থাকত না। অবশেষে লেখা হল : এই সন্ধিপত্র যা আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ কুরাইশদের সাথে সম্পাদন করলেন। মহান আল্লাহ আপন কিতাবে বলেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে তাদের জন্যে রসূলুল্লাহ (স)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’’ [.সূরা আহযাব : ২১ আয়াত।]
এরপর আলী (রা) তাদের কাছে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা)-কে প্রেরণ করেন।..... আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস তিন দিন পর্যন্ত সেখানে তাদের সাথে আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। অবশেষে তাদের মধ্যে থেকে চার হাজার লোক তাওবা করে ফিরে আসে। ইবনুল কাওয়াও তাদের অন্তর্ভুক্ত। ইবনু আব্বাস (রা) এদের আলী (রা) -এর কাছে কূফায় নিয়ে আসেন। অবশিষ্ট লোকদের কাছে আলী (রা) বার্তা পাঠিয়ে জানান যে, উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হোক। আর তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত থাকল যে, তোমরা অন্যায়ভাবে কারো রক্তপাত ঘটাবে না। ডাকাতি, রাহাজানি করবে না এবং যিম্মীদের উপর অত্যাচার চালাবে না। যদি এর কোনটিতে লিপ্ত হয়ে পড় তবে তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। (কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন :) إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ ‘‘আল্লাহ খিয়ানতকারীদের পছন্দ করেন না।’’ [.সূরা আনফাল : ৫৮ আয়াত।]
বর্ণনাকারী বলেন : আল্লাহর ক্বসম! ওদের বিরুদ্ধে আলী (রা) পক্ষ থেকে তখনই অভিযান পাঠানো হয়েছে, যখন ওরা ডাকাতি, রাহাজানি শুরু করেছে, খুন-খারাবী ছড়িয়ে দিয়েছে এবং যিম্মীদের উপর অত্যাচার করে তাদের সবকিছু নিজেদের জন্যে হালাল করে নিয়েছে।’’ [.ইবনু কাসীর (রহ) বলেছেন : আহমাদ এ হাদীস মুফরাদ বর্ণনা করেছেন। তবে এর সনদ সহীহ। যিয়া একে পছন্দ করেছেন। [আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫০৬-৫০৯] তাছাড়া ইমাম হাকিম এ বর্ণনাটিকে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের শর্তাধীনে সহীহ বলেছেন, তবে উভয়ে তা বর্ণনা করেননি। [তাহক্বীক্বকৃত আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (মিশর) ৭/২২৯ পৃ.]]
অন্য বর্ণনায় আছে : আলী (রা) -কে তাদের সমালোচনার কারণ ছিল এই যে-
১.তিনি মানুষকে হাকিম (ফায়সালাকারী) নিযুক্ত করেছিলেন।
২.শাসকের পদবীকে মুছে দিয়েছিলেন।
৩.উষ্ট্রের যুদ্ধে তিনি অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করেছেন; অথচ শত্রুদের থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ও বন্দী সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করেননি।
প্রথম দু’টি অভিযোগের (হাকিম নির্ধারণ ও পদবী মুছে ফেলার) জওয়াবে তিনি যা বলেন, ইতোপূর্বে তা আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় অভিযোগের জওয়াবে তিনি বলেন : ‘‘বন্দীদের মধ্যে উম্মুল মু‘মিনীনও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এখন যদি তোমরা দাবি করো যে, তোমাদের কোন উম্মুল মু‘মিনীন নেই, তবে তা হবে তোমাদের জন্য কুফরী কাজ। আবার যদি উম্মুল মু‘মিনীনকে বন্দী রাখা বৈধ মনে করো, তাও হবে কুফরী কাজ।’’ বর্ণনাকারী বলেন : এবার তাদের মধ্য থেকে দু’ হাজার লোক বেরিয়ে আসে বাকি সবাই বিদ্রোহ করে। এরপর তাদের সাথে যুদ্ধ হয়। [.আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫০৯ পৃ.।]
ইবনু জারীর (রহ) লিখেছেন : খারিজীদের অবশিষ্ট লোকদের কাছে আলী (রা) স্বয়ং গমন করেন। তিনি তাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত চালিয়ে যান। অবশেষে তারা সকলেই তাঁর সাথে কুফায় চলে আসে। সে দিনটি ছিল ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার দিন। এরপর তারা আলী (রা) -এর কথাবার্তায় বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। তাঁকে গালমন্দ করে এবং তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করতে থাকে।
ইমাম শাফেঈ (রহ) বলেন : আলী (রা) একদিন সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় তাঁকে লক্ষ্য করে জনৈক খারিজী এ আয়াতটি পড়ে :
لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘‘তুমি আল্লাহ’র শরীক স্থির করলে তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে এবং অবশ্য তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’’ [. সূরা যুমার : ৬৫ আয়াত।] জওয়াবে আলী (রা) নিচের আয়াতটি পড়লেন :
فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلَا يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِينَ لَا يُوقِنُونَ
‘‘কাজেই, তুমি সবর কর। নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যারা দৃঢ় বিশ্বাসী নয়, তারা যেন তোমাকে বিচলিত করতে না পারে।’’ [. সূরা রূম : ৬০ আয়াত।]
ইবনু জারীর (রহ) বলেন : এ ঘটনা হয়েছিল তখন যখন আলী (রা) খুতবা পাঠ করছিলেন। ইবনু জারীর (রা) আরো একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তা হল :
‘‘আলী (রা) একদিন খুতবা দিচ্ছিলেন। এ সময় এক খারিজী দাঁড়িয়ে বলল, হে আলী! আপনি মহান আল্লাহর দ্বীনে মানুষকে শরীক করেছেন (অর্থাৎ শির্ক করেছেন)। অথচ আল্লাহ ব্যতীত হুকুম দেয়ার অধিকার আর কারো নেই। এ সময় চারদিক থেকে একই আওয়াজ উঠলো - لا حكم الا الله ـ لا حكم الا الله ‘‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম নেই, আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম নেই।’’ তখন আলী (রা) বললেন : هذه كلمة حق يراد بِها باطل ‘‘কথাটি সত্য, কিন্তু উদ্দেশ্য খারাপ।’’ তারপর তিনি বললেন : ‘‘যতদিন তোমাদের দায়িত্ব আমাদের উপরে ছিল ততদিন আমরা তোমাদের গনীমত দেয়া বন্ধ করিনি এবং আল্লাহর মাসজিদে সালাত আদায় করতে বাধা দেইনি। এখন তোমাদের উপর আমরা আগেই হামলা করব না। যদি তোমরা প্রথমে হামলা না কর।’’ এরপর তারা সবাই কূফা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাহরাওয়ান নামক স্থানে সমবেত হয়। [. আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইফা) ৭/৫১০ পৃ.।]
উপরোক্ত ঐতিহাসিক আলোচনাটি আরো সুস্পষ্ট হবে আমাদের পরবর্তী তাহক্বীক্বটি বিস্তারিতভাবে পাঠ করলে। এটাও সুস্পষ্ট হবে, খারিজী এবং বর্তমান যামানার বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী যারা একই ধরনের শ্লোগান ব্যবহার করছে এবং যত্রতত্র কুফরী ফাতওয়া প্রদান করে বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে- তাদের সংস্কার ও সংশোধন করা অতীব জরুরি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রকৃত হিদায়াত দান করুন। আমিন!!
৩৬
তাহক্বীক্বকৃত :
আমাদের হাকিম কেবলই একজন- আল্লাহ তাআলা
কয়েকটি পরিভাষা : ইবাদাত, ইতাআত, মুআমালাত ও ইস্তিআনাত[এই বইটির তাহক্বীক্ব বা বিশ্লেষণ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে গেলে উক্ত শব্দগুলোর সাথে পরিচয় থাকা জরুরি। অন্যথায় এক্ষেত্রে বিভ্রান্তি আসাটাই স্বাভাবিক। এ কারণে শুরুতে এ পরিভাষাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।]
আল্লাহ তাআলা বলেন :
اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ
অর্থ : আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদাত করি এবং কেবল আপনারই সাহায্য চাই। [সূরা ফাতিহা- ৪ আয়াত]
বিশ্লেষণ : اياك আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী কর্ম ( مفعول ) এবং এটার স্থান ক্রিয়া ( فعل ) ও কর্তার ( فاعل )পরে হলেও এখানে মর্যাদা এবং গুরুত্ব প্রকাশ ও حصر (সীমাবদ্ধতা)-এর অর্থ গ্রহণের জন্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। [. তাফসীরে মাযহারী [ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন] ১/১৫ পৃ :।] সাধারণভাবে বলা হয় যে, نَعْبُدُكَ وَنَسْتَعِيْنُكَ ‘‘আমরা তোমার ইবাদাত করি এবং তোমার সাহায্য চাই।’’ কিন্তু এখানে আল্লাহ তাআলা কর্মকে ( مفعول ) ক্রিয়ার ( فعل ) পূর্বে ব্যবহার করে বলেছেন : اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ -যা দ্বারা ইখতিসাস (সুনির্দিষ্টকরণ) করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদাত করি এবং কেবল আপনারই সাহায্য চাই।’’ [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দু তরজমা ও তাফসীর (মাদীনা মুনাওওয়ারা : বাদশাহ ফাহ্দ কুরআনে কারীম প্রিন্টিং কমপ্লেক্স) পৃ. ৪।]
অর্থাৎ ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যই বৈধ নয়। কুরআন ও সহীহ হাদীসে ইসলাম অনুমোদিত ইবাদাত শব্দটির পারিভাষিক প্রয়োগ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ইবাদাত এর অর্থ : কারো সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা, অক্ষমতা ও পূর্ণাঙ্গ বিনয় (খুশু) প্রকাশ করা। ইবনু কাসির (রহ)-এর মতে- ‘‘ইবাদাত হল শরীআতের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ মুহাব্বাত, বিনয় ও ভয়ের সমষ্টির নাম।’’ অর্থাৎ যে সত্তার সাথে মুহাব্বাত হয়েছে তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা এবং তাঁর কাছে গ্রেফতার হবার ভয় থাকা। [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দু তরজমা ও তাফসীর পৃ. ৪।]
[আভিধানিকভাবে ইবাদাত শব্দের ব্যবহার :
১. عَبَدَ ، يَعْبُدُ ، عِبَادَةٌ ، عُبُوْدِيَّةٌ : তাওহীদ (একক মানা), বন্দেগী করা, পূজা করা, খিদমাত করা, ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, ইতাআত বা আনুগত্য করা। [. মাসউদ আহমাদ, তাফসীরে কুরআনে আযীয [করাচী] পৃ. ৬০।]
২. عَبَدَ اللهَ ـ عِبَادَةً وَعُبُوْدِيَّةً : আল্লাহ আনুগত্য ও বন্দেগী করা, ইবাদাত করা, আদাবে বন্দেগী পালন করা, ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, কেবল আল্লাহকেই মালিক ও খালিক (সৃষ্টিকর্তা) এবং ওয়াজিবুল ইতাআত (তাঁর আনুগত্য অত্যাবশ্যক) মনে করা। [. আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদি [দেওবন্দ : কুতুবখানাহ হুসাইনিয়া, এপ্রিল-২০০৪] ২/১০৩৮ পৃ.।]
৩.ইবাদাত শব্দটি আরবি ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ক. পূজা ও উপাসনা করা, খ. আনুগত্য ও হুকুম মেনে চলা এবং গ. বন্দেগী ও দাসত্ব করা। এখানে (আলোচ্য আয়াতে) একই সাথে এই তিনটি অর্থই প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ আমরা তোমার পূজা-উপাসনা করি, তোমার আনুগত্য করি এবং তোমার বন্দেগী ও দাসত্বও করি। [. তাফহীমুল কুরআন, সূরা ফাতিহার ৬ নং টীকা।]]
ইবাদাত ও ইতাআত : ইবাদাত কেবল আল্লাহরই হয়। কিন্তু ইতাআত বা আনুগত্য আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টিজীবেরও হয়। যেমন- আল্লাহ তাআলা নিজের ও তাঁর রসূলের ইতাআত সম্পর্কে বলেছেন :
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اَطِيْعُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْا الرَّسُوْلَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ’র ইতাআত কর এবং রসূলের ইতাআত কর।’’ [. সুরা নিসা : ৫৯ আয়াত। অনুরূপ আরো দ্র : মায়িদাহ : ৯২, নূর : ৫৪, মুহাম্মাদ : ৩৩, তাগাবুন : ১২।]
অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ (স) আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ইতাআতের সাথে সাথে আমীরের ইতাআতের কথা উল্লেখ করে বলেছেন :
مَنْ اَطَاعَنِيْ فَقَدْ اَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ عَصَي اللهَ وَمَنْ يُّطِعِ الْاَمِيْرِ فَقَدْ اَطَاعَنِيْ وَمَنْ يَّعْصِ الْاَمِيْرِ فَقَدْ عَصَانِيْ
‘‘যে ব্যক্তি আমার ইতাআত করল, সে যেন আল্লাহ’র ইতাআত করল। আর যে ব্যক্তি আমার নাফমানি করল, বস্তুত সে আল্লাহ’র নাফরমানী করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের ইতাআত করল, সে যেন আমারই ইতাআত করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের নাফরমানী করল, সে যেন আমারই নাফরমানী করল।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭১৩৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৪১ (৩২/১৮৩৫), মিশকাত ৩৬৬১]
তবে আল্লাহ ও রসূলের ইতাআত বা আনুগত্য শর্তহীন। কিন্তু সৃষ্টিজীবের আনুগত্য শর্তযুক্ত। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَطَاعَةَ فِيْ مَعْصِيَةٍ اِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ ‘‘নাফরমানীর ব্যাপারে ইতাআত নেই। ইতাআত কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৫৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৫৯ (৩৯/১৮৪০), মিশকাত ৩৬৬৫] অন্যত্র তিনি (স) বলেন : لاَطَاعَةَ لِمَخْلُوْقْ فِيْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘‘সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর মধ্যে কোন সৃষ্টির ইতাআত নেই।’’ [. সহীহ : শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৬৯৬। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ২/১০৬২ পৃ :]]
উক্ত আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত কেবল আল্লাহরই করা যায়। ইবাদাতের অন্যতম অর্থ ইতাআত হলেও সব ইতাআত ইবাদাত নয়। কেননা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমীর, পিতা-মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বয়োজ্যেষ্ঠ, উর্ধ্বতন বা দায়িত্বশীল প্রমুখের ইতাআত করার প্রয়োজন হয়। তারা সেক্ষেত্রেই হুকুম করতে পারেন যেক্ষেত্রে আল্লাহ’র নাফরমানী হবে না, কিংবা যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা স্বাধীনতা দিয়েছেন। এ স্বাধীনতা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : دَعُوْنِيْ مَا تَرَكْتُكُمْ ‘‘আমি যেসব বিষয় বর্ণনা না করে তোমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, সেসব ব্যাপারে আমাকে ছেড়ে দাও।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৮৮; আর সহীহ মুসলিম ৩১৪৮ (৪১২/১৩৩৭), মিশকাত ২৫০৫-এ নিচের বাক্যে : ذَرُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فدَعُوه ‘‘আমাকে ছেড়ে দাও যেটুকু আমি তোমাদের জন্য রেখে যায়। কারণ তোমাদের পূর্বেকার লোকেরা তাদের অধিক প্রশ্নের কারণে এবং তাদের নবীদের বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতঃপর আমি তোমাদের যখন কোন কিছু করার নির্দেশ দেই, তোমরা তা যথাসাধ্য পালন কর এবং যখন তোমাদের কোন কিছু করতে নিষেধ করি, তখন তা পরিত্যাগ কর।’’]
তিনি (স) অন্যত্র বলেছেন :
اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ اِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِّنْ اَمْرِ دِيْنِكُمْ فَخُذُوْا بِه وَاِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ رَّائِيْ فَاِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ
‘‘আমি একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে কোন নির্দেশ দেই, তখন তা গ্রহণ করবে। আর আমি যখন (দ্বীন বহির্ভূত বিষয়ে) আমার রায় (ব্যক্তিগত মত) অনুসারে নির্দেশ প্রদান করি, তখন আমিও একজন মানুষ।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৬০২১ (১৪০/২৩৬২), মিশকাত ১৪৭।]
সুতরাং প্রমাণিত হল, জীবনের সবক্ষেত্রে আমলে সলেহ বা নেককাজ করা আল্লাহর হুকুম। কিন্তু কিছু হুকুম কেবলই আল্লাহর জন্য খাস (সুনির্দিষ্ট) এবং তাতে আর কেউই শরীক নয়- এটাই পারিভাষিক ইবাদাত। আর কিছু হুকুম স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মানুষের পারস্পরিক লেনদেন ও জীবন-যাপন পদ্ধতির জন্যে নির্দিষ্ট করেছেন। যা শাব্দিকভাবে ইবাদাতের মধ্যে গণ্য হলেও পারিভাষিকভাবে ইতাআত। কেননা এ হুকুমগুলো আল্লাহ তাআলা নিজের জন্যে খাস করেননি, বরং এর মধ্যে মাখলুককেও শরীক করেছেন। যেমন- আমীরের আনুগত্য, পিতা-মাতার আনুগত্য, স্বামীর আনুগত্য, আল্লাহর বান্দাদের (মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর) হক্ব প্রভৃতি। আর যে কাজের মধ্যে অন্যদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে তা নিষ্কলুষ ইবাদাত না, বরং তাকে ইতাআত বলাই বাঞ্ছনীয়। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-ও নিজের জন্য সুনির্দিষ্ট হক্ব তথা ইবাদাত এবং বান্দার হক্ব তথা সদাচারণকে স্বতন্ত্র শব্দে প্রকাশ করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
وَاعْبُدُوا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا وَّبِذِي الْقُرْبي وَالْيَتمي وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِي الْقُرْبي وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَاِبْنِ السَّبِيْلِ لا وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ
‘‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে ইহসান (সদাচরণ) কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও।’’ [. সূরা নিসা : ৩৬ আয়াত।]
ইবাদাত ও মুআমালাত : লক্ষণীয়, উক্ত আয়াতে আল্লাহ নিজের হক্বের ক্ষেত্রে ইবাদাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং তাতে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন। পক্ষান্তরে বান্দার হক্বের ক্ষেত্রে ইহসান বা সদাচারণ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এ পর্যায়ে প্রথমটি আল্লাহর ইবাদাত এবং দ্বিতীয়টি আল্লাহর ইতাআত। এ ধরনের ইতাআতকেই ফিক্বহী পারিভাষায় মুআমালাত (লেনদেন, আচার-ব্যবহার) বলা হয়। ইবাদাতের ক্ষেত্রে (নীতিমালা) হল, এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সহীহ দলিল-প্রমাণ না পাওয়া গেলে মনগড়া আমল করাটাই বিদআত।
এ সর্ম্পকে নবী (স) বলেছেন :
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই তবে তা বাতিল।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৩৮৫ (১৮/১৭১৮), রিয়াদুস সালেহীন [বি. আই. সি] ৪/১৬৪৭ নং।]
তিনি (স) অন্যত্র বলেন :
مَنْ اَحْدَثَ فِيْ اَمْرِنَا هذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীন সম্পর্কে কোন নতুন কথা সৃষ্টি করেছে যা এতে নেই, তবে তা রদ বা প্রত্যাখ্যাত।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম ৪৩৮৪ (১৪/১৭১৮), মিশকাত ১৪০।]
অন্যত্র বলেন :
وَشَرَّ الْاُمُوْرِ مُحْدَثُاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
‘‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে যা দ্বীন সম্পর্কে নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেক বিদআতই (নুতন সৃষ্টি) গোমরাহী।’’ [. সহীহ : মুসলিম ১৮৯০ (৪৩/৮৬৭), মিশকাত ১৪১।]
পক্ষান্তরে মুআমালাতের (লেনদেন, আচার-ব্যবহার) ক্ষেত্রে উসূল (নীতি) হল, হারাম বা নিষিদ্ধতার দলিল-প্রমাণ না পাওয়া গেলেই তা বৈধ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ لَكُمْ فِي الْاَرْضِ جَمِيْعًا
‘‘তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদেরই জন্য জমিনের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।’’ [.সূরা বাক্বারাহ : ২৯ আয়াত।]
এ আয়াতটি দ্বারা এই দলিল ও উসূল (নীতি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মানুষের জন্য আল্লাহর সৃষ্টি সব কিছুই তার আসল অবস্থাতেই হালাল। কোন জিনিস হারাম করতে হলে দলিল ( نص )দ্বারা প্রমাণ করতে হবে। [. শওকানীর ফতহুল ক্বাদীর সূত্রে : সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দু তরজমা ও তাফসীর পৃ : ১৬। কেননা, আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন : وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ ‘‘তোমাদের জন্য যেগুলো হারাম তা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।’’ [সূরা আনয়াম : ১১৯ আয়াত] সুতরাং কোন কিছু হারাম বললে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ জরুরী, অন্যথায় সবই হালাল। এই নীতিটি মুআমালাতের সাথে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে ইবাদাতের ব্যাপারে যার সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই তা পালন করাই বিদআত।]
এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
مَا اَحَلَّ اللهُ فِيْ كِتَابِه فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَتَهُ فَاِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا ثُمَّ تَلاَ هذِه الْايَةَ : وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا
‘‘আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তাই হালাল এবং যা হারাম করেছেন তাই হারাম এবং যা থেকে নীরব থেকেছেন তা মাফযোগ্য। সুতরাং যা মাফযোগ্য তা তোমরা আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে গ্রহণ কর। কেননা, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কিছু ভুলেন না।’’ অতঃপর তিলাওয়াত করলেন : ‘‘তোমাদের রব ভুলেন না। [সূরা মারইয়াম : ৬৪]’’ [. সহীহ : হাকিম- কিতাবুত তাফসীর باب سورة مريم । হাকিম এর সনদকে সহীহ বলেছেন। উক্ত মর্মে বাযযার সলেহ সনদে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। [ফতহুল বারী (মাকতাবা মিশর, ১৪২১/২০০১) ১৩/৩৭৮ পৃ.; নায়লুল আওতার (মিশর : দারুল হাদীস ১৪২১/২০০০)৮/৪২৮ পৃ.।]
অন্যত্র স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-ই তাঁর ইবাদাত ও দুনিয়াবী বস্তুসামগ্রী ও উপায়-উপকরণকে পৃথক করে বর্ণনা করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْاِنْسَ اِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ ـ مَا اُرِيْدُ مِنْهُمْ مِّنْ رِّزْقٍ وَّمَا اُرِيْدُ اَنْ يُّطْعِمُوْنِ ـ
‘‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদাতের জন্যে সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে রিযিক চাই না এবং তাদের কাছে খাদ্য-খাবারও চাই না।’’ [. সূরা যারিয়াত : ৫৬-৫৭ আয়াত।]
আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা ইবাদত থেকে রিযিক ও খাদ্য-খাবারকে পৃথক করে দেখিয়েছেন। অথচ দু’টির ক্ষেত্রেই মানুষকে আল্লাহর হুকুম স্বতন্ত্রভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু ইবাদত কেবল স্বয়ং আল্লাহর জন্যই করতে হয়, পক্ষান্তরে রুযী রোযগার, খাদ্য-খাবার প্রভৃতি দুনিয়াবী বিষয় মানুষ আল্লাহর হুকুমে নিজের প্রয়োজন ও শৃঙ্খলা আনার জন্য পালন করে থাকে। সুতরাং প্রমাণিত হল ইবাদাত ও মুআমালাত স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু উভয়টির মূল দাবি আল্লাহর হুকুম মেনে চলা, যা এক কথায় আল্লাহর হুকুম’ কিংবা আমলে সলেহ’ নামে আখ্যায়িত। মোটকথা শাব্দিকভাবে ইবাদাত ও ইতাআত পরিপূরক হলেও পারিভাষিক ও প্রায়োগিক অর্থে ভিন্নতা আছে।
সুতরাং যেহেতু ইবাদাতের ব্যাপারে সরাসরি শক্তিশালী দলিল-প্রমাণ ছাড়া নতুন কিছুর উপর আমল করা নিষিদ্ধ এ জন্য বিদআত শব্দটি এক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে মুআমালাত বা বৈষয়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে শরীআত থেকে নিষেধাজ্ঞা না পাওয়া পর্যন্ত তা সাধারণভাবে বৈধ। এ ক্ষেত্রে যুগোপযোগী ও নিত্যনতুন বিষয়াদির সংযোগ চলতে থাকবে। এ কারণে বৈষয়িক লেনদেনের ব্যাপারে বিদআত শব্দটি প্রযোজ্য নয়। বরং ‘‘যা নিষিদ্ধ নয় তা-ই বৈধ।’’
আল্লাহ তাআলা বলেন :
اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ
অর্থ : আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদাত করি এবং কেবল আপনারই সাহায্য চাই। [সূরা ফাতিহা- ৪ আয়াত]
বিশ্লেষণ : اياك আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী কর্ম ( مفعول ) এবং এটার স্থান ক্রিয়া ( فعل ) ও কর্তার ( فاعل )পরে হলেও এখানে মর্যাদা এবং গুরুত্ব প্রকাশ ও حصر (সীমাবদ্ধতা)-এর অর্থ গ্রহণের জন্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। [. তাফসীরে মাযহারী [ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন] ১/১৫ পৃ :।] সাধারণভাবে বলা হয় যে, نَعْبُدُكَ وَنَسْتَعِيْنُكَ ‘‘আমরা তোমার ইবাদাত করি এবং তোমার সাহায্য চাই।’’ কিন্তু এখানে আল্লাহ তাআলা কর্মকে ( مفعول ) ক্রিয়ার ( فعل ) পূর্বে ব্যবহার করে বলেছেন : اِيَّاكَ نَعْبُدُ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ -যা দ্বারা ইখতিসাস (সুনির্দিষ্টকরণ) করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদাত করি এবং কেবল আপনারই সাহায্য চাই।’’ [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দু তরজমা ও তাফসীর (মাদীনা মুনাওওয়ারা : বাদশাহ ফাহ্দ কুরআনে কারীম প্রিন্টিং কমপ্লেক্স) পৃ. ৪।]
অর্থাৎ ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্যই বৈধ নয়। কুরআন ও সহীহ হাদীসে ইসলাম অনুমোদিত ইবাদাত শব্দটির পারিভাষিক প্রয়োগ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ইবাদাত এর অর্থ : কারো সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা, অক্ষমতা ও পূর্ণাঙ্গ বিনয় (খুশু) প্রকাশ করা। ইবনু কাসির (রহ)-এর মতে- ‘‘ইবাদাত হল শরীআতের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ মুহাব্বাত, বিনয় ও ভয়ের সমষ্টির নাম।’’ অর্থাৎ যে সত্তার সাথে মুহাব্বাত হয়েছে তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা এবং তাঁর কাছে গ্রেফতার হবার ভয় থাকা। [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দু তরজমা ও তাফসীর পৃ. ৪।]
[আভিধানিকভাবে ইবাদাত শব্দের ব্যবহার :
১. عَبَدَ ، يَعْبُدُ ، عِبَادَةٌ ، عُبُوْدِيَّةٌ : তাওহীদ (একক মানা), বন্দেগী করা, পূজা করা, খিদমাত করা, ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, ইতাআত বা আনুগত্য করা। [. মাসউদ আহমাদ, তাফসীরে কুরআনে আযীয [করাচী] পৃ. ৬০।]
২. عَبَدَ اللهَ ـ عِبَادَةً وَعُبُوْدِيَّةً : আল্লাহ আনুগত্য ও বন্দেগী করা, ইবাদাত করা, আদাবে বন্দেগী পালন করা, ক্ষুদ্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা, কেবল আল্লাহকেই মালিক ও খালিক (সৃষ্টিকর্তা) এবং ওয়াজিবুল ইতাআত (তাঁর আনুগত্য অত্যাবশ্যক) মনে করা। [. আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদি [দেওবন্দ : কুতুবখানাহ হুসাইনিয়া, এপ্রিল-২০০৪] ২/১০৩৮ পৃ.।]
৩.ইবাদাত শব্দটি আরবি ভাষায় তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ক. পূজা ও উপাসনা করা, খ. আনুগত্য ও হুকুম মেনে চলা এবং গ. বন্দেগী ও দাসত্ব করা। এখানে (আলোচ্য আয়াতে) একই সাথে এই তিনটি অর্থই প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ আমরা তোমার পূজা-উপাসনা করি, তোমার আনুগত্য করি এবং তোমার বন্দেগী ও দাসত্বও করি। [. তাফহীমুল কুরআন, সূরা ফাতিহার ৬ নং টীকা।]]
ইবাদাত ও ইতাআত : ইবাদাত কেবল আল্লাহরই হয়। কিন্তু ইতাআত বা আনুগত্য আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টিজীবেরও হয়। যেমন- আল্লাহ তাআলা নিজের ও তাঁর রসূলের ইতাআত সম্পর্কে বলেছেন :
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اَطِيْعُوا اللهَ وَاَطِيْعُوْا الرَّسُوْلَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ’র ইতাআত কর এবং রসূলের ইতাআত কর।’’ [. সুরা নিসা : ৫৯ আয়াত। অনুরূপ আরো দ্র : মায়িদাহ : ৯২, নূর : ৫৪, মুহাম্মাদ : ৩৩, তাগাবুন : ১২।]
অনুরূপভাবে রসূলুল্লাহ (স) আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ইতাআতের সাথে সাথে আমীরের ইতাআতের কথা উল্লেখ করে বলেছেন :
مَنْ اَطَاعَنِيْ فَقَدْ اَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِيْ فَقَدْ عَصَي اللهَ وَمَنْ يُّطِعِ الْاَمِيْرِ فَقَدْ اَطَاعَنِيْ وَمَنْ يَّعْصِ الْاَمِيْرِ فَقَدْ عَصَانِيْ
‘‘যে ব্যক্তি আমার ইতাআত করল, সে যেন আল্লাহ’র ইতাআত করল। আর যে ব্যক্তি আমার নাফমানি করল, বস্তুত সে আল্লাহ’র নাফরমানী করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের ইতাআত করল, সে যেন আমারই ইতাআত করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের নাফরমানী করল, সে যেন আমারই নাফরমানী করল।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭১৩৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৪১ (৩২/১৮৩৫), মিশকাত ৩৬৬১]
তবে আল্লাহ ও রসূলের ইতাআত বা আনুগত্য শর্তহীন। কিন্তু সৃষ্টিজীবের আনুগত্য শর্তযুক্ত। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَطَاعَةَ فِيْ مَعْصِيَةٍ اِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ ‘‘নাফরমানীর ব্যাপারে ইতাআত নেই। ইতাআত কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৫৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৫৯ (৩৯/১৮৪০), মিশকাত ৩৬৬৫] অন্যত্র তিনি (স) বলেন : لاَطَاعَةَ لِمَخْلُوْقْ فِيْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘‘সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর মধ্যে কোন সৃষ্টির ইতাআত নেই।’’ [. সহীহ : শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৬৯৬। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ২/১০৬২ পৃ :]]
উক্ত আলোচনার মাধ্যমে সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত কেবল আল্লাহরই করা যায়। ইবাদাতের অন্যতম অর্থ ইতাআত হলেও সব ইতাআত ইবাদাত নয়। কেননা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমীর, পিতা-মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বয়োজ্যেষ্ঠ, উর্ধ্বতন বা দায়িত্বশীল প্রমুখের ইতাআত করার প্রয়োজন হয়। তারা সেক্ষেত্রেই হুকুম করতে পারেন যেক্ষেত্রে আল্লাহ’র নাফরমানী হবে না, কিংবা যেসব ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা স্বাধীনতা দিয়েছেন। এ স্বাধীনতা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : دَعُوْنِيْ مَا تَرَكْتُكُمْ ‘‘আমি যেসব বিষয় বর্ণনা না করে তোমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, সেসব ব্যাপারে আমাকে ছেড়ে দাও।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৮৮; আর সহীহ মুসলিম ৩১৪৮ (৪১২/১৩৩৭), মিশকাত ২৫০৫-এ নিচের বাক্যে : ذَرُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فدَعُوه ‘‘আমাকে ছেড়ে দাও যেটুকু আমি তোমাদের জন্য রেখে যায়। কারণ তোমাদের পূর্বেকার লোকেরা তাদের অধিক প্রশ্নের কারণে এবং তাদের নবীদের বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতঃপর আমি তোমাদের যখন কোন কিছু করার নির্দেশ দেই, তোমরা তা যথাসাধ্য পালন কর এবং যখন তোমাদের কোন কিছু করতে নিষেধ করি, তখন তা পরিত্যাগ কর।’’]
তিনি (স) অন্যত্র বলেছেন :
اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ اِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِّنْ اَمْرِ دِيْنِكُمْ فَخُذُوْا بِه وَاِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ رَّائِيْ فَاِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ
‘‘আমি একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে কোন নির্দেশ দেই, তখন তা গ্রহণ করবে। আর আমি যখন (দ্বীন বহির্ভূত বিষয়ে) আমার রায় (ব্যক্তিগত মত) অনুসারে নির্দেশ প্রদান করি, তখন আমিও একজন মানুষ।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৬০২১ (১৪০/২৩৬২), মিশকাত ১৪৭।]
সুতরাং প্রমাণিত হল, জীবনের সবক্ষেত্রে আমলে সলেহ বা নেককাজ করা আল্লাহর হুকুম। কিন্তু কিছু হুকুম কেবলই আল্লাহর জন্য খাস (সুনির্দিষ্ট) এবং তাতে আর কেউই শরীক নয়- এটাই পারিভাষিক ইবাদাত। আর কিছু হুকুম স্বয়ং আল্লাহ তাআলা মানুষের পারস্পরিক লেনদেন ও জীবন-যাপন পদ্ধতির জন্যে নির্দিষ্ট করেছেন। যা শাব্দিকভাবে ইবাদাতের মধ্যে গণ্য হলেও পারিভাষিকভাবে ইতাআত। কেননা এ হুকুমগুলো আল্লাহ তাআলা নিজের জন্যে খাস করেননি, বরং এর মধ্যে মাখলুককেও শরীক করেছেন। যেমন- আমীরের আনুগত্য, পিতা-মাতার আনুগত্য, স্বামীর আনুগত্য, আল্লাহর বান্দাদের (মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর) হক্ব প্রভৃতি। আর যে কাজের মধ্যে অন্যদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে তা নিষ্কলুষ ইবাদাত না, বরং তাকে ইতাআত বলাই বাঞ্ছনীয়। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-ও নিজের জন্য সুনির্দিষ্ট হক্ব তথা ইবাদাত এবং বান্দার হক্ব তথা সদাচারণকে স্বতন্ত্র শব্দে প্রকাশ করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
وَاعْبُدُوا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا وَّبِذِي الْقُرْبي وَالْيَتمي وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِي الْقُرْبي وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَاِبْنِ السَّبِيْلِ لا وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ
‘‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে ইহসান (সদাচরণ) কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও।’’ [. সূরা নিসা : ৩৬ আয়াত।]
ইবাদাত ও মুআমালাত : লক্ষণীয়, উক্ত আয়াতে আল্লাহ নিজের হক্বের ক্ষেত্রে ইবাদাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং তাতে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন। পক্ষান্তরে বান্দার হক্বের ক্ষেত্রে ইহসান বা সদাচারণ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এ পর্যায়ে প্রথমটি আল্লাহর ইবাদাত এবং দ্বিতীয়টি আল্লাহর ইতাআত। এ ধরনের ইতাআতকেই ফিক্বহী পারিভাষায় মুআমালাত (লেনদেন, আচার-ব্যবহার) বলা হয়। ইবাদাতের ক্ষেত্রে (নীতিমালা) হল, এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সহীহ দলিল-প্রমাণ না পাওয়া গেলে মনগড়া আমল করাটাই বিদআত।
এ সর্ম্পকে নবী (স) বলেছেন :
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই তবে তা বাতিল।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৩৮৫ (১৮/১৭১৮), রিয়াদুস সালেহীন [বি. আই. সি] ৪/১৬৪৭ নং।]
তিনি (স) অন্যত্র বলেন :
مَنْ اَحْدَثَ فِيْ اَمْرِنَا هذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীন সম্পর্কে কোন নতুন কথা সৃষ্টি করেছে যা এতে নেই, তবে তা রদ বা প্রত্যাখ্যাত।’’ [.সহীহ : সহীহ বুখারী ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম ৪৩৮৪ (১৪/১৭১৮), মিশকাত ১৪০।]
অন্যত্র বলেন :
وَشَرَّ الْاُمُوْرِ مُحْدَثُاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
‘‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে যা দ্বীন সম্পর্কে নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেক বিদআতই (নুতন সৃষ্টি) গোমরাহী।’’ [. সহীহ : মুসলিম ১৮৯০ (৪৩/৮৬৭), মিশকাত ১৪১।]
পক্ষান্তরে মুআমালাতের (লেনদেন, আচার-ব্যবহার) ক্ষেত্রে উসূল (নীতি) হল, হারাম বা নিষিদ্ধতার দলিল-প্রমাণ না পাওয়া গেলেই তা বৈধ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ لَكُمْ فِي الْاَرْضِ جَمِيْعًا
‘‘তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদেরই জন্য জমিনের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।’’ [.সূরা বাক্বারাহ : ২৯ আয়াত।]
এ আয়াতটি দ্বারা এই দলিল ও উসূল (নীতি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মানুষের জন্য আল্লাহর সৃষ্টি সব কিছুই তার আসল অবস্থাতেই হালাল। কোন জিনিস হারাম করতে হলে দলিল ( نص )দ্বারা প্রমাণ করতে হবে। [. শওকানীর ফতহুল ক্বাদীর সূত্রে : সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দু তরজমা ও তাফসীর পৃ : ১৬। কেননা, আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম তা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন : وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ ‘‘তোমাদের জন্য যেগুলো হারাম তা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।’’ [সূরা আনয়াম : ১১৯ আয়াত] সুতরাং কোন কিছু হারাম বললে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ জরুরী, অন্যথায় সবই হালাল। এই নীতিটি মুআমালাতের সাথে সম্পৃক্ত। পক্ষান্তরে ইবাদাতের ব্যাপারে যার সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই তা পালন করাই বিদআত।]
এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
مَا اَحَلَّ اللهُ فِيْ كِتَابِه فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَتَهُ فَاِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا ثُمَّ تَلاَ هذِه الْايَةَ : وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا
‘‘আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তাই হালাল এবং যা হারাম করেছেন তাই হারাম এবং যা থেকে নীরব থেকেছেন তা মাফযোগ্য। সুতরাং যা মাফযোগ্য তা তোমরা আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে গ্রহণ কর। কেননা, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কিছু ভুলেন না।’’ অতঃপর তিলাওয়াত করলেন : ‘‘তোমাদের রব ভুলেন না। [সূরা মারইয়াম : ৬৪]’’ [. সহীহ : হাকিম- কিতাবুত তাফসীর باب سورة مريم । হাকিম এর সনদকে সহীহ বলেছেন। উক্ত মর্মে বাযযার সলেহ সনদে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। [ফতহুল বারী (মাকতাবা মিশর, ১৪২১/২০০১) ১৩/৩৭৮ পৃ.; নায়লুল আওতার (মিশর : দারুল হাদীস ১৪২১/২০০০)৮/৪২৮ পৃ.।]
অন্যত্র স্বয়ং আল্লাহ তাআলা-ই তাঁর ইবাদাত ও দুনিয়াবী বস্তুসামগ্রী ও উপায়-উপকরণকে পৃথক করে বর্ণনা করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْاِنْسَ اِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ ـ مَا اُرِيْدُ مِنْهُمْ مِّنْ رِّزْقٍ وَّمَا اُرِيْدُ اَنْ يُّطْعِمُوْنِ ـ
‘‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল আমার ইবাদাতের জন্যে সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে রিযিক চাই না এবং তাদের কাছে খাদ্য-খাবারও চাই না।’’ [. সূরা যারিয়াত : ৫৬-৫৭ আয়াত।]
আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা ইবাদত থেকে রিযিক ও খাদ্য-খাবারকে পৃথক করে দেখিয়েছেন। অথচ দু’টির ক্ষেত্রেই মানুষকে আল্লাহর হুকুম স্বতন্ত্রভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু ইবাদত কেবল স্বয়ং আল্লাহর জন্যই করতে হয়, পক্ষান্তরে রুযী রোযগার, খাদ্য-খাবার প্রভৃতি দুনিয়াবী বিষয় মানুষ আল্লাহর হুকুমে নিজের প্রয়োজন ও শৃঙ্খলা আনার জন্য পালন করে থাকে। সুতরাং প্রমাণিত হল ইবাদাত ও মুআমালাত স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু উভয়টির মূল দাবি আল্লাহর হুকুম মেনে চলা, যা এক কথায় আল্লাহর হুকুম’ কিংবা আমলে সলেহ’ নামে আখ্যায়িত। মোটকথা শাব্দিকভাবে ইবাদাত ও ইতাআত পরিপূরক হলেও পারিভাষিক ও প্রায়োগিক অর্থে ভিন্নতা আছে।
সুতরাং যেহেতু ইবাদাতের ব্যাপারে সরাসরি শক্তিশালী দলিল-প্রমাণ ছাড়া নতুন কিছুর উপর আমল করা নিষিদ্ধ এ জন্য বিদআত শব্দটি এক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে মুআমালাত বা বৈষয়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে শরীআত থেকে নিষেধাজ্ঞা না পাওয়া পর্যন্ত তা সাধারণভাবে বৈধ। এ ক্ষেত্রে যুগোপযোগী ও নিত্যনতুন বিষয়াদির সংযোগ চলতে থাকবে। এ কারণে বৈষয়িক লেনদেনের ব্যাপারে বিদআত শব্দটি প্রযোজ্য নয়। বরং ‘‘যা নিষিদ্ধ নয় তা-ই বৈধ।’’
ইবাদাত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَاعْبُدُوْا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا
‘‘আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুরই শরীক করো না।’’ [. সূরা নিসা : ৩৬ আয়াত।]
তিনি অন্যত্র বলেন :
إِلَٰهُكُمْ اِلهٌ وَّاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْا لِقَاءِ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحًا وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّه اَحَدًا
‘‘তোমাদের ইলাহ, কেবলই এক ইলাহ। সুতরাং যে নিজের রবের সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন নেক আমল করে এবং নিজের রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে।’’ [. সূরা কাহাফ : ১১০ আয়াত।]
ইস্তিআনাত বা সাহায্য চাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন : وَاسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ ‘‘তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাও।’’ [. সূরা বাক্বারাহ : ৪৫ আয়াত। অনুরূপ দ্র : সূরা বাক্বারাহ : ১৫৩ আয়াত।]
অন্যত্র বলেন :
قَالَ مَوْسي لِقَوْمِهِ اسْتَعِيْنُوْا بِاللهِ وَاصْبِرُوْا
‘‘মূসা তাঁর ক্বওমকে বলল, আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং সবর কর।’’ [. সূরা আ‘রাফ : ১২৮ আয়াত।]
সুতরাং ইবাদাত ও ইস্তিআনাত (সাহায্য চাওয়া) উভয়টিই আল্লাহ ছাড়া অপর কারো জন্য আমল করা জায়েয নয়। প্রথমোক্ত আয়াতটি দ্বারা শিরকের দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যাদের অন্তরে শিরকের রোগ আছে তারা সাধারণ লোকদের মানুষের আয়ত্বাধীন ( ماتِحت الاسباب ) বস্তুর সাথে, মানুষের আয়ত্বাধীন নয় ( مافوق الاسباب ) এমন বস্তুর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সে ব্যাপারে বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। তারা বলে যে, ‘‘দেখ আমাদের রোগ হলে আমরা ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে থাকি, স্ত্রীর নিকট সহযোগিতা চাই, ড্রাইভার ও অন্যান্য লোকদের সাহায্য কামনা করি।’’ এভাবে তারা এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যদের নিকট সাহায্য চাওয়াও বৈধ। কিন্তু মানুষের আয়ত্বাধীন বস্তুর মাধ্যমে একে অপরের কাছে সাহায্য চাওয়া বৈধ এবং এটা শিরক নয়। এটাতো আল্লাহর সৃষ্ট ব্যবস্থাপনা মাত্র। যা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ্য বস্তুসমূহ দ্বারা সম্পন্ন করা হয়। এমনকি নবী (স)-গণও এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চেয়েছেন। [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দূ তরজমা ও তাফসীর পৃ. ৪।]
ঈসা (আ) বলেছিলেন : مَنْ اَنْصَارِىْ اِلَى اللهِ ‘‘আল্লাহ দ্বীনের জন্য কে আমাকে সাহায্য করবে?’’ [. সূরা সফ : ১৪ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা ঈমানদারগণকে সম্বোধন করে বলেছেন :
وَتَعَاوَنُوْا عَلَي الْبِرِّ وَالتَّقْوى
‘‘নেকি ও তাক্বওয়া অর্জনে একে অপরকে সাহায্য কর।’’ [. সূরা মায়িদা : ২ আয়াত।]
সুস্পষ্ট হল, একে অপরের সাহায্য করা ( تَعَاوُن ) নিষিদ্ধ বা শিরক নয়। বরং প্রয়োজনীয় ও প্রশংসার কাজ। এর সাথে পারিভাষিক শিরকের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। শিরক হল এমন কোন ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া যে প্রকাশ্য বস্তুজগতের নিয়মানুযায়ী সাহায্য করতে অক্ষম। যেমন- মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য তাকে ডাকা, তাকে ‘মুশকিল কুশা’ (সমস্যা দূরকারী) এবং ‘হাজত রুওয়া’ (উদ্দেশ্য পূরণকারী) মনে করা। তাকে উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতাসম্পন্ন জ্ঞান করা এবং দূরের ও কাছের সকল ফরিয়াদ শুনে তা সমাধান করার অধিকারী মনে করা। এরই নাম হল আয়ত্বাধীন নয় ( ما فوق الاسباب ) এমন বিষয়ে সাহায্য চাওয়া এবং তাকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা। আর এটাই শিরক- যা দুর্ভাগ্যবশত ‘মুহাব্বাতে আওলিয়া’ নামে মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে চালু আছে। [ اعاذنا الله منه ] [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দূ তরজমা ও তাফসীর পৃ. ৪।]
সুতরাং ইস্তিআনাত বা সাহায্য চাওয়ার দু’টি দিক রয়েছে-
১.যে সমস্ত বিষয়ের একক অধিকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এবং যেগুলো কোন বস্তুগত কর্তৃত্ব মানুষকে দেন নি সেক্ষেত্রে কোন মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া, প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন বা সুপারিশ করা- এ সবই শিরক। কেননা এগুলোর ক্ষেত্রে ইবাদাতের ন্যায় আল্লাহ কাউকে নিজের সাথে শরীক করেননি
২.পক্ষান্তরে যে সব ব্যাপারে মানুষকে শক্তি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সাহায্য চাওয়াটা বৈধ। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল, তা অবশ্যই আল্লাহ কর্তৃক নিষেধকৃত বিষয়ে হবে না। অর্থাৎ যেসব ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নেই সেসব ক্ষেত্রে এটা বৈধ। প্রথমোক্তটি ইবাদাতের এবং পরবর্তীটি মুআমালাতের অন্তর্ভুক্ত।
وَاعْبُدُوْا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا
‘‘আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুরই শরীক করো না।’’ [. সূরা নিসা : ৩৬ আয়াত।]
তিনি অন্যত্র বলেন :
إِلَٰهُكُمْ اِلهٌ وَّاحِدٌ فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْا لِقَاءِ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحًا وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّه اَحَدًا
‘‘তোমাদের ইলাহ, কেবলই এক ইলাহ। সুতরাং যে নিজের রবের সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন নেক আমল করে এবং নিজের রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে।’’ [. সূরা কাহাফ : ১১০ আয়াত।]
ইস্তিআনাত বা সাহায্য চাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন : وَاسْتَعِيْنُوْا بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ ‘‘তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাও।’’ [. সূরা বাক্বারাহ : ৪৫ আয়াত। অনুরূপ দ্র : সূরা বাক্বারাহ : ১৫৩ আয়াত।]
অন্যত্র বলেন :
قَالَ مَوْسي لِقَوْمِهِ اسْتَعِيْنُوْا بِاللهِ وَاصْبِرُوْا
‘‘মূসা তাঁর ক্বওমকে বলল, আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর এবং সবর কর।’’ [. সূরা আ‘রাফ : ১২৮ আয়াত।]
সুতরাং ইবাদাত ও ইস্তিআনাত (সাহায্য চাওয়া) উভয়টিই আল্লাহ ছাড়া অপর কারো জন্য আমল করা জায়েয নয়। প্রথমোক্ত আয়াতটি দ্বারা শিরকের দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যাদের অন্তরে শিরকের রোগ আছে তারা সাধারণ লোকদের মানুষের আয়ত্বাধীন ( ماتِحت الاسباب ) বস্তুর সাথে, মানুষের আয়ত্বাধীন নয় ( مافوق الاسباب ) এমন বস্তুর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সে ব্যাপারে বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। তারা বলে যে, ‘‘দেখ আমাদের রোগ হলে আমরা ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে থাকি, স্ত্রীর নিকট সহযোগিতা চাই, ড্রাইভার ও অন্যান্য লোকদের সাহায্য কামনা করি।’’ এভাবে তারা এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, আল্লাহ ছাড়া অন্যান্যদের নিকট সাহায্য চাওয়াও বৈধ। কিন্তু মানুষের আয়ত্বাধীন বস্তুর মাধ্যমে একে অপরের কাছে সাহায্য চাওয়া বৈধ এবং এটা শিরক নয়। এটাতো আল্লাহর সৃষ্ট ব্যবস্থাপনা মাত্র। যা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ্য বস্তুসমূহ দ্বারা সম্পন্ন করা হয়। এমনকি নবী (স)-গণও এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চেয়েছেন। [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দূ তরজমা ও তাফসীর পৃ. ৪।]
ঈসা (আ) বলেছিলেন : مَنْ اَنْصَارِىْ اِلَى اللهِ ‘‘আল্লাহ দ্বীনের জন্য কে আমাকে সাহায্য করবে?’’ [. সূরা সফ : ১৪ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা ঈমানদারগণকে সম্বোধন করে বলেছেন :
وَتَعَاوَنُوْا عَلَي الْبِرِّ وَالتَّقْوى
‘‘নেকি ও তাক্বওয়া অর্জনে একে অপরকে সাহায্য কর।’’ [. সূরা মায়িদা : ২ আয়াত।]
সুস্পষ্ট হল, একে অপরের সাহায্য করা ( تَعَاوُن ) নিষিদ্ধ বা শিরক নয়। বরং প্রয়োজনীয় ও প্রশংসার কাজ। এর সাথে পারিভাষিক শিরকের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। শিরক হল এমন কোন ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া যে প্রকাশ্য বস্তুজগতের নিয়মানুযায়ী সাহায্য করতে অক্ষম। যেমন- মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য তাকে ডাকা, তাকে ‘মুশকিল কুশা’ (সমস্যা দূরকারী) এবং ‘হাজত রুওয়া’ (উদ্দেশ্য পূরণকারী) মনে করা। তাকে উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতাসম্পন্ন জ্ঞান করা এবং দূরের ও কাছের সকল ফরিয়াদ শুনে তা সমাধান করার অধিকারী মনে করা। এরই নাম হল আয়ত্বাধীন নয় ( ما فوق الاسباب ) এমন বিষয়ে সাহায্য চাওয়া এবং তাকে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করা। আর এটাই শিরক- যা দুর্ভাগ্যবশত ‘মুহাব্বাতে আওলিয়া’ নামে মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে চালু আছে। [ اعاذنا الله منه ] [. সালাহুদ্দীন ইউসুফ, কুরআনে কারীম মাআ উর্দূ তরজমা ও তাফসীর পৃ. ৪।]
সুতরাং ইস্তিআনাত বা সাহায্য চাওয়ার দু’টি দিক রয়েছে-
১.যে সমস্ত বিষয়ের একক অধিকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এবং যেগুলো কোন বস্তুগত কর্তৃত্ব মানুষকে দেন নি সেক্ষেত্রে কোন মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়া, প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন বা সুপারিশ করা- এ সবই শিরক। কেননা এগুলোর ক্ষেত্রে ইবাদাতের ন্যায় আল্লাহ কাউকে নিজের সাথে শরীক করেননি
২.পক্ষান্তরে যে সব ব্যাপারে মানুষকে শক্তি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করেছেন, সেসব ক্ষেত্রে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সাহায্য চাওয়াটা বৈধ। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল, তা অবশ্যই আল্লাহ কর্তৃক নিষেধকৃত বিষয়ে হবে না। অর্থাৎ যেসব ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নেই সেসব ক্ষেত্রে এটা বৈধ। প্রথমোক্তটি ইবাদাতের এবং পরবর্তীটি মুআমালাতের অন্তর্ভুক্ত।
[আমাদের আলোচ্য বইটিতে পূর্বে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর সঠিক প্রয়োগ না থাকায় আমরা এখন বইটির তাহক্বীক্ব বা বিশ্লেষণ করব। এ পর্যায়ে প্রথমে আমরা লেখকের বক্তব্যের অনুবাদ প্রদান করব, যা পাঠক ‘‘মাসউদ আহমাদ’’ উদ্ধৃতির মধ্যে পাবেন এবং আমাদর বিশ্লেষণ পাবেন ‘‘তাহক্বীক্ব : ’’ উদ্ধৃতির মধ্যে]
১.মাসউদ আহমাদ : ‘‘হাকিম এর অর্থ- এমন হাকিম যাঁর হুকুমাত বা কর্তৃত্ব অনন্ত ও অসীম, যাঁর ইতাআত বা আনুগত্য সীমাহীন ও নিঃশর্ত। যিনি আইনদাতা, যাঁর আইন পূর্ণাঙ্গ এবং অপরিবর্তনশীল। যিনি ইতাআত বা আনুগত্যের একমাত্র দাবিদার (হক্বদার)।’’
তাহক্বীক্ব ১ : আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইলাহ বা মা‘বুদ শব্দটির বৈধ প্রয়োগ কেবল নিজের জন্যই সুনির্দিষ্ট করেছেন। এর বিপরীতে বাতিল ইলাহ’ বা মা‘বুদের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজেকে ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে বৈধ ‘ইলাহ’ বা মা‘বুদ হিসাবে এই শব্দগুলো ব্যবহার করেননি
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
‘‘হে নবী! এদের বলে দিন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি অহী আসে যে, একজনই মাত্র তোমাদের ইলাহ।’’ [. সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৬ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
‘‘তোমাদের ইলাহ তো একক ইলাহ, তিনি ছাড়া রহমান (পরম করুণাময়), রহীম (অসীম দয়ালু) কেউ নেই।’’ [. সূরা বাক্বারা : ১৬৩ আয়াত।]
وَاسْأَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ آَلِهَةً يُعْبَدُونَ
‘‘আপনার পূর্বে আমি যেসব রসূল প্রেরণ করেছি, তাদের জিজ্ঞেস করুন, রহমান (আল্লাহ) ছাড়া ইবাদতের জন্য আমি কি কোন ইলাহ নির্দিষ্ট করেছিলাম।’’ [. সূরা যুখরুফ : ৪৫ আয়াত।]
অর্থাৎ সত্যিকারের ইলাহ বা মা‘বুদ স্বয়ং আল্লাহই এবং তিনি এই শব্দ’টির প্রয়োগ অন্য কারো জন্য করেননি। বাতিল ইলাহ বা মা‘বুদের ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যবহার অন্য কোন ইলাহ থাকার প্রমাণ নয়, বরং তাতো বাতিল। উল্লেখ্য ইলাহ অর্থ মা‘বুদ- অর্থাৎ যার ইবাদত করা হয়।
পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা হাকিম শব্দটি কেবল নিজের জন্যই ব্যবহার করেননি। তিনি মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার বৈধ করেছেন। যেমন রসূলুল্লাহ (স) এর ক্ষেত্রে এই হাকিম শব্দটির প্রয়োগ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে আছে :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘‘অতএব আপনার রবের ক্বসম! তারা মু‘মিন হবে না, যতক্ষণ না তাদের সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে হাকিম বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা থাকবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে ক্ববূল করে নেবে।’’ [. সূরা নিসা : ৬৫ আয়াত।]
সহীহ হাদীসেও হাকিম শব্দটি বিচার-ফায়সালা বা সিদ্ধান্তদাতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ও আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
اِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ وَاَصَابَ فَلَه ও اَجْرَانِ وَاِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ وَاَخْطَأَ فَلَه ও اَجْرٌ وَّاحِدٌ
‘‘যখন কোন হাকিম ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে তখন তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার। পক্ষান্তরে যখন হাকিম ইজতিহাদ করার পরও ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে, তখন তার জন্য একটি পুরস্কার।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭৩৫২, সহীহ মুসলিম ৪৩৭৯ (১৫/১৭১৬), মিশকাত ৩৭৩২]
সুতরাং প্রমাণিত হল, আল্লাহ তাআলা ইলাহ হিসাবে একক দাবিদার। কিন্তু হাকিম শব্দটির প্রয়োগ ইলাহ শব্দটির থেকে আলাদা। তবে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ হাকিম আল্লাহ তাআলা। যেমন আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন :
أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ
‘‘আল্লাহ কি হাকিমদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর হাকিম নন।’’ [. সূরা তীন : ৮ আয়াত।]
সুস্পষ্ট হল, ইলাহ বা মা‘বুদ-এর মধ্যে বৈশিষ্ট্য বা গুণগতভাবে কেউই শরীক নয়। কিন্তু হাকিম শব্দটির ব্যবহার স্রষ্টার সাথে সাথে সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রয়োগযোগ্য। এ পর্যায়ে ইসলামের মূলনীতি হল, সৃষ্টি হাকিমের কোন ফায়সালা যদি স্রষ্টা আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ তাআলা’র বিপরীত হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَطَاعَةَ فِيْ مَعْصِيَةٍ اِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ ‘‘নাফরমানীর ব্যাপারে ইতাআত নেই। ইতাআত কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৫৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৫৯ (৩৯/১৮৪০), মিশকাত ৩৬৬৫] অন্যত্র তিনি (স) বলেন : لاَطَاعَةَ لِمَخْلُوْقْ فِيْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘‘সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর মধ্যে কোন সৃষ্টির ইতাআত নেই।’’ [. সহীহ : শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৬৯৬। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ২/১০৬২ পৃ.]]
কিন্তু ইলাহ বা মা‘বুদ শব্দটি এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই এ শব্দটির হক্বদার নয়। এক্ষেত্রেও প্রমাণিত হল, ইবাদাতের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহই হক্বদার, পক্ষান্তরে মুআমালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ নয় এমন বিষয়ে আমীর বা শাসক, পিতা-মাতা, শিক্ষক, বিচারক, স্বামী, অগ্রজ এদের মানা জায়েয, বরং ক্ষেত্রবিশেষ বাধ্যতামূলক। তবে এগুলো একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য ইবাদত নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশিত স্বতন্ত্র হুকুম পালন। যার মধ্যে আল্লাহর হক্ব ও বান্দার হক্ব উভয়ের সমন্বয় রয়েছে। আর ইবাদত তো কেবলই আল্লাহর হক্ব।
২.মাসউদ আহমাদ : ‘‘আল্লাহ তা্অলা জিন ও মানুষকে নিজের ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘‘আমি মানুষ ও জিনকে কেবলই আমার ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছি।’’ [. সূরা যারিয়াত : ৫৬ আয়াত।]
এখানে ইবাদত দ্বারা কেবল সালাত, সাওম, যিকির ও ওয়াযীফা এর অর্থ নেয়া হলে খুবই জটিলতা দেখা দেবে। কেননা, সেক্ষেত্রে এ আমলগুলো ছাড়া জীবনের অন্যান্য আমলগুলো আল্লাহ তাআলা’র সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য, খাওয়া-পান করা, বিয়ে-শাদী প্রভৃতির অস্তিত্ব থাকবে না। ফলে না দুনিয়াদারী হবে, না ইবাদাত বন্দেগী হবে। সর্বোপরি সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
তাহক্বীক্ব ২ : পাঠক গভীরভাবে আলোচ্য আয়াতটির সাথে এর পরবর্তী আয়াতটিও পাঠ করুন :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ . مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِّزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ
‘‘আমি মানুষ ও জিনকে কেবলই আমার ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে রিযিক চাই না ও খাদ্য-খাবারও চাই না।’’ [. সূরা যারিয়াত :৫৬-৫৭ আয়াত।]
আয়াত দু’টিতে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁর ইবাদত করা এবং মানুষের দুনিয়াবী লেনদেন, আয়-উপার্জনকে পৃথক করেছেন। যা থেকে সুস্পষ্ট হল, ইবাদত কেবল আল্লাহ তাআলা’র জন্য। কিন্তু দুনিয়াবী প্রয়োজনে মানুষকে প্রদত্ত রিযিক, আয়-উপার্জন এগুলো মানুষের জন্য, আর এগুলোতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। এই আয়াত থেকেই ইবাদাত ও মুআমালাতের দলিল পাওয়া গেল। আল্লাহ তাআলা ইবাদাত বন্দেগীর নির্দেশ প্রদানের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী লেনদেন, বিচারকাজ প্রভৃতিরও নির্দেশ প্রদান করেছেন। কিন্তু তিনি ইবাদাতের ব্যাপারে কোন মানবীয় সিদ্ধান্তকে বরদাশত করেননি নবী (স) দ্বীনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত রায় বা মতামত প্রদান সম্পর্কে বলেছেন :
مَنْ اُفْتِىَ بِفُتْيًا غَيْرَ ثَبَتٍ فَاِنَّمَا اِثْمُهُ عَلى مَنْ اَفْتَاهُ
‘‘দলিল-প্রমাণ ব্যতীত কাউকে ফতওয়া দেয়া হলে, তার গুনাহর ভার ফাতাওয়াদাতার উপর বর্তাবে।’’ [. হাসান : ইবনু মাজাহ - باب اتباع سنة رسول الله (ص) [ باب اجتناب الرأى والقياس ] ; আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত ইবনু মাজাহ (রিয়াদ) হা/৫৩]]
কেননা, দ্বীনের এই অংশটি পরিপূর্ণ এবং এর মধ্যে নতুন করে সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজন নেই। সুতরাং ‘‘সুস্পষ্ট দলিল নেই তো ফাতাওয়াও নেই।’’
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ
‘‘আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা।’’ [. সূরা নাহল : ৮৯ আয়াত।]
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ
‘‘আমি এ কিতাবের মধ্যে কোন কিছুরই বর্ণনা বাদ রাখিনি।’’ [. সূরা আনয়াম : ৩৮ আয়াত।]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ
‘‘আজ আমি তোমাদের জন্যে দ্বীনকে পূর্ণতা দান করছি।’’ [. সূরা আলে-ইমরান : ৩ আয়াত।]
দ্বীন পরিপূর্ণ তাই এর মধ্যে সংযোজন ও বিয়োজন নিষিদ্ধ। এ সর্ম্পকে নবী (স) বলেছেন :
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই তবে তা বাতিল।’’ [. সহীহ মুসলিম ৪৩৮৫ (১৮/১৭১৮), রিয়াদুস সালেহীন ৪/১৬৪৭ নং।]
তিনি (স) অন্যত্র বলেন :
مَنْ اَحْدَثَ فِيْ اَمْرِنَا هذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীন সম্পর্কে কোন নতুন কথা সৃষ্টি করেছে যা এতে নেই, তবে তা রদ বা প্রত্যাখ্যাত।’’ [. সহীহ বুখারী ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম ৪৩৮৪ (১৪/১৭১৮), মিশকাত ১৪০।]
অন্যত্র বলেন :
وَشَرَّ الْاُمُوْرِ مُحْدَثُاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
‘‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে যা দ্বীন সম্পর্কে নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেক বিদআতই (নুতন সৃষ্টি) গোমরাহী।’’ [. সহীহ : মুসলিম ১৮৯০ (৪৩/৮৬৭), মিশকাত ১৪১]
পক্ষান্তরে দুনিয়াবী লেনদেন, বিচারকাজ প্রভৃতির ক্ষেত্রে মানবীয় সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে নবী (স) বলেছেন :
اِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ وَاَصَابَ فَلَه اَجْرَانِ وَاِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ وَاَخْطَأَ فَلَه ও اَجْرٌ وَّاحِدٌ
‘‘যখন কোন হাকিম ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তখন তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার। পক্ষান্তরে যখন হাকিম ইজতিহাদ করার পরও ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তখন তার জন্য একটি পুরস্কার।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭৩৫২, সহীহ মুসলিম ৪৩৭৯ (১৫/১৭১৬), মিশকাত ৩৭৩২]
তবে শর্ত হল, তা আল্লাহর নির্দেশের বা সীমারেখার বিরোধী হতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
‘‘আর কাজকর্মে ( امر ) তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন।’’ [. সূরা আলে-ইমরান : ১৫৯ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
‘‘এবং তাদের কাজ-কর্ম ( امر ) পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে (সম্পন্ন হয়)।’’ [. সূরা শূরা : ৩৮ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ
‘‘তোমাদের জন্য যেগুলো হারাম তা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।’’ [. সূরা আনয়াম : ১১৯ আয়াত]
এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
مَا اَحَلَّ اللهُ فِيْ كِتَابِه فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَتَ فَاِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا ثُمَّ تَلاَ هذِه الْايَةَ : وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا
‘‘আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তাই হালাল এবং যা হারাম করেছেন তাই হারাম এবং যা থেকে নীরব থেকেছেন তা মাফযোগ্য। সুতরাং যা মাফযোগ্য তা তোমরা আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে গ্রহণ কর। কেননা, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কিছু ভুলেন না।’’ অতঃপর তিলাওয়াত করলেন : ‘‘তোমাদের রব ভুলেন না। [সূরা মারইয়াম : ৬৪]’’ [. সহীহ : হাকিম- কিতাবুত তাফসীর باب سورة مريم । হাকিম এর সনদকে সহীহ বলেছেন। উক্ত মর্মে বাযযার সলেহ সনদে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। [ফতহুল বারী (মাকতাবা মিশর, ১৪২১/২০০১) ১৩/৩৭৮ পৃ.; নায়লুল আওতার (মিশর : দারুল হাদীস ১৪২১/২০০০)৮/৪২৮ পৃ.।]
অন্যত্র নবী (স) বলেছেন :
اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ اِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَىْءٍ مِّنْ اَمْرِ دِيْنِكُمْ فَخُذُوْا بِه وَاِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَىْءٍ مِّنَ رَّائِىْ اَنَا بَشَرٌ
‘‘আমি একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে নির্দেশ দিই, তখন তা তোমরা গ্রহণ করবে, আর আমি যখন আমার রায় অনুসারে তোমাদের কোন বিষয়ে নির্দেশ ( امر ) দিই, তখন আমিও একজন মানুষ।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৬০২১ (১৪০/২৩৬২), মিশকাত ১৪৭।]
অন্যত্র নবী (স) বলেছেন :
دَعُوْنِيْ مَا تَرَكْتُكُمْ
‘‘আমি যেসব বিষয় বর্ণনা না করে তোমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, সেসব ব্যাপারে আমাকে ছেড়ে দাও।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৮৮; আর সহীহ মুসলিম ৩১৪৮ (৪১২/১৩৩৭), মিশকাত ২৫০৫-এ নিচের বাক্যে : ذَرُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فدَعُوه ‘‘আমাকে ছেড়ে দাও যেটুকু আমি তোমাদের জন্য রেখে যায়। কারণ তোমাদের পূর্বেকার লোকেরা তাদের অধিক প্রশেস্নন কারণে এবং তাদের নবীদের বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতঃপর আমি তোমাদের যখন কোন কিছু করার নির্দেশ দেই, তোমরা তা যথাসাধ্য পালন কর এবং যখন তোমাদের কোন কিছু করতে নিষেধ করি, তখন তা পরিত্যাগ কর।’’]
উপরোক্ত দলিল প্রমাণগুলো থেকে সুস্পষ্ট হল :
দ্বীন (ইবাদাত অর্থে)
১.সুস্পষ্টভাবে সবকিছু বর্ণিত হয়েছে, কোন অসম্পূর্ণতা, অপূর্ণতা নেই।
২.যা উল্লেখ্য করা হয়নি এবং নতুন সংযোজন এর সবই বিদআত ও গোমরাহী।
৩.নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রে أمر শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪.না জেনে ব্যক্তিগত রায় বা ফাতাওয়া প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ভুলের দায়-দায়িত্ব বর্তাবে।
৫.সম্পূর্ণরূপে মানবীয় মতামত মুক্ত।
দ্বীন (মুআমালাত অর্থে)
১.অনেক বিষয়ে বর্ণনা না করে স্বেচ্ছায় চুপ থেকেছেন বা ছাড় দেয়া হয়েছে।
২.হারাম নয় এমন সবকিছুই বৈধ। এটা ছাড় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কোন কিছু হারাম হবে দলিল দ্বারা।
৩.নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রে أمر শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪.সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ভুল হলেও ধর্তব্য নয়। (অনিচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষেত্রে)
৫.ছাড়কৃত বা অনুল্লিখিত স্থানে মতামত বৈধ।
অর্থাৎ সবকিছু আল্লাহর হুকুম হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত পন্থায় পার্থক্য করেছেন, যা বিভিন্ন দলিল প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত। উক্ত পৃথকীকরণের জন্যে আল্লাহ’র সৃষ্টির উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন সংঘাত বা সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় না।
পূর্বে বর্ণিত বিচারের ক্ষেত্রে হাকিমের ইজতিহাদ করার হাদীসটি সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইশতিয়াক (আমীর, জামাআতুল মুসলিমীন) লিখেছেন :
قارئین کرام مندرجہ بالا حدیث میں لفظ ’’ حاکم ‘‘ وارد ہوا ہے ۔ لفظ ’’ عالم ‘‘ نہیں ہے ۔ اس حدیث کا اطلاق حاکم یا بادشاہ وقت یا خلیفۃ المسلمین یا قاضی پر تو ہوتا ہے لکن اس حدیث کا اطلاق کسی عالم پر کر دینا صحیح نہ ہوگا ؛ رسول اللہ ﷺ نے حاکم یا قاضی یا خلیفۃ المسلمین یا امام امیر و غیرہ کو ایک قسم کی آسانی دی ہے ۔ کیونکہ اس کی حکومت یا امارت میں بعض مقدمات ایسے بھی آتے ہیں جو بالکل نئے ہوتے ہیے – ان مقدمۃ پر فیصلہ کرتے وقت اگر حاکم اجتہاد کرتا ہے خواہ فیصلہ صحیح ہو یا غلط تو حاکم کو ہر صورت میں اجر ملے گا یہ بات اس کی نیک نیتی کی وجہ سے کہی گئ ہے ۔
‘‘সম্মানিত পাঠক! উক্ত হাদীসে ‘হাকিম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, আলিম’ শব্দ নয়। হাদীসটির সম্পর্ক ক্ষমতাসীন বাদশাহ বা খলিফাতুল মুসলিমীন বা কাযীর সাথে। কোন আলিমের সাথে হাদীসটির সম্পৃক্ত করা সংগত নয়। রসূলুল্লাহ (স) কোন হাকিম বা কাযী বা খলিফাতুল মুসলিমীন বা ইমাম প্রমুখ দায়িত্বপ্রাপ্তদের এক ধরনের ছাড় দিয়েছেন। কেননা, তার হুকুমাত বা ইমারতে এমন অনেক মোকাদ্দামা আসে যা সম্পূর্ণ নতুন। এ ধরণের (নিত্য নতুন) মোকাদ্দামা ফায়সালার সময় যদি হাকিম ইজতিহাদ করে, আর যদিওবা তা সঠিক বা ভুল হয় উভয় ক্ষেত্রেই হাকিম সওয়াবের অধিকারী হবে। তার ন্যায়-নীতির কারণে এটি বলা হয়েছে।’’ [. মুহাম্মাদ ইশতিয়াক, তাহক্বীক্বে সালাত বাজাওয়াবে নামাযে মুদাল্লাল (করাচী : জামাআতুল মুসলিমীন, ১৪২২/২০০১) পৃ. ২৯।]
دوسری بات قابل غور يہ ہے کہ حاکم کا فیصلہ جو اس نے فريقين کے درميان کيا ہوگا وہ فیصلہ ہوگا قانون نہیں ہوگا ۔ اس فیصلہ کو شریعت کي حيثيت حاصل نہ ہوگي بلکہ وہ بطور فيصلہ بھي عارضي ہوگا اور ہنگامي طور پر اس کو تسليم کر لیا جاۓ گا ۔ پھر اس حاکم کے بعد دوسرا حاکم اس حکومت کا ولي ہوگا تو وہ اس بات کا مکلف نہیں ہوگا کہ جو فیصلے سابقہ حکومت ميں ہو چکے ہيں وہ ان کے مطابق ہی فیصلہ کرے بلکہ وہ آزاد ہوگا
‘‘অপর একটি দিক গভীরভাবে লক্ষ্য করুন- হাকিমের ফায়সালা, যা তিনি উভয়পক্ষের মধ্যে করে থাকেন সেটাতো কেবলই ফায়সালা, আইন নয়। এই ফায়সালা শরীআতের (আইনের) মর্যাদা অর্জন করে না। বরং এটা তো কেবল ফায়সালা যা তাৎক্ষণিক এবং এটা সুনির্দিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে। অতঃপর এই হাকিমের পরিবর্তে অন্য হাকিম হুকুমাতের অধিকারী হলে তখন সে পূর্বে হুকুমাতে সংঘটিত ফায়সালার অনুগামী হবেন না। বরং তিনি নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই ফায়সালা দিবেন এবং তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’’ [. ঐ পৃ. ২৯-৩০।]
তবে ক্ষেত্র বিশেষে দলিলের ব্যাপকতা বিদ্যমান থাকা সাপেক্ষে ইবাদাতের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন :
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضي الله عنه قَالَ قَالَ النَّبِيُّ ﷺ يَوْمَ الأَحْزَابِ " لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلاَّ فِي بَنِي قُرَيْظَةَ ". فَأَدْرَكَ بَعْضُهُمُ الْعَصْرَ فِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ نُصَلِّي حَتَّى نَأْتِيَهَا . وَقَالَ بَعْضُهُمْ بَلْ نُصَلِّي، لَمْ يُرِدْ مِنَّا ذَلِكَ، فَذُكِرَ ذَلِكَ ﷺ فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ .
ইবনু উমার (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী (স) আহযাব যুদ্ধের দিন (যুদ্ধ শেষে) বললেন : বনূ কুরায়যার মহল্লায় না পৌঁছে কেউ যেন আসরের সালাত আদায় না করে। পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেলে কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে পৌঁছার পূর্বে সালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা এখনই সালাত আদায় করব, কেননা নবী (স)-এর নিষেধাজ্ঞার অর্থ এই নয় যে, রাস্তায় সালাতের সময় হয়ে গেলেও তা আদায় করা যাবে না। বিষয়টি নবী (স)-এর কাছে উত্থাপন করা হলে তিনি তাদের কোন দলের প্রতিই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী- কিতাবুল মাগাযী - باب مرجع النبى صلى الله عليه و سلم من الاحزاب ; সহীহ মুসলিম- কিতাবুল জিহাদ باب جواز قتال من نقض العهد ।]
এই হাদীসটি সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইশতিয়াক (আমীর, জামাআতুল মুসলিমীন) লিখেছেন :
صحابہ کرام رضـ دونوں جماعتوں نے قرآن وحديث پر هي عمل كيا ، ايك جماعت نے آيت پر عمل كيا اور دوسري جماعت نے حديث پر عمل كيا يعني ايك جماعت نے حکم عام پر عمل كيا اور دوسری جماعت نے حکم خاص پر عمل كيا ۔ اللہ تعالي فرماتا ہے : إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتا يعني نماز مؤمنين پر اوقات مقررہ پر فرض كي گئ ہے ۔
‘‘সাহাবীদের (রা) উভয় জামাআতই কুরআন ও হাদীসের ওপর আমল করেছেন। একটি পক্ষ কুরআনের আয়াতের ওপর আমল করেছেন, অপর পক্ষ হাদীসের ওপর আমল করেছেন। অর্থাৎ একটি পক্ষ আম হুকুমের উপর আমল করেছেন এবং অপর পক্ষ খাস হুকুমের উপর আমল করেছেন।’’ (আম হুকুমটির স্বপক্ষে) আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন:
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا
‘‘নিশ্চয় মু’মিনদের জন্য নির্দিষ্ট ওয়াক্তে সালাত আদায় করা ফরয করা হয়েছে।’’ [সূরা নিসা : ১০৩ আয়াত] [. মুহাম্মাদ ইশতিয়াক, তাহক্বীক্বে সালাত বাজাওয়াবে নামাযে মুদাল্লাল (করাচী : জামাআতুল মুসলিমীন, ১৪২২/২০০১) পৃ. ২২-২৩।]
মাসউদ আহমাদ (রহ) লিখেছেন :
اس حدیث سے معلوم ہوا کہ جب حکم عام اور حکم خاص میں تضاد نظر آئے تو دونو میں سے کسی بھی حکم پر عمل کیا جا سکتا ہے ۔ اور عقیدہ بھی یہی رکھنا چاہۓ کہ دونو طرح جائز ہے کیونکہ رسول اللہ ﷺ نے کسی کو ناجائز نہیں بتایا ۔ یہ نہیں کہنا چاہۓ کہ فلاں عمل صحیح ہے اور فلاں غلط ، نہ یہ کہے کہ فلاں عمل راجح ہے اور فلاں عمل مرجوح ہے ، کیونکہ رسول اللہ ﷺ نے کسی کو راجح یہ مرجوح نہیں بتایا ۔ اس حدیث سے یہ بات بھی ثابت ہوئی کہ اگر کسی حدیث کا منشائ سمجھنے میں اختلاف ہو جائے تو یہ قابل معافی ہے ، لیکن ایک دوسرے کو برا نہ کہے کیونکہ رسول اللہ ﷺ نے کسی کو برا نہیں کہا ۔ البتہ اختلاف کی بنیاد پر فرقہ بنانا ، یا محض قیاس کی بنیاد پر حدیث کو نہ ماننا یا کسی غیر نبی کی رائے کو حدیث پر ترجیح دینا یہ سب چیزیں اسلام وایمان کے منافی اور شرک کی طرف لے جانے والی ہے ۔
‘‘এই হাদীসটি থেকে সুস্পষ্ট হল, যখন কোন হুকুমে আম ও হুকুমে খাসের মধ্যে কোন দ্বন্দ দেখা দেবে, তখন উভয়ের কোন একটি উপর আমল করা যেতে পারে। তখন এই আক্বীদাও রাখতে হবে যে, উভয়ই জায়েয। কেননা রসূলুল্লাহ (স) এর কোনটিকেই নাজায়েয বলেননি এটাও বলা যাবে না যে, এই আমলটি সহীহ এবং এটি ভুল। কিংবা এটা বলা যাবে না যে, অমুকটি গুরুত্ববহ, আর অমুকটি বেশি প্রাধান্য পাবে। কেননা নবী (স) কোনটিকে এভাবে গুরুত্ববহ বা বেশি প্রাধান্য দেননি এই হাদীসটি থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, কোন হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে যদি ইখতিলাফ হয়েই যায় তবে তা ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু পরস্পরকে খারাপ কিছু বলা যাবে না। কেননা, রসূলুল্লাহ (স) [পূর্বোক্ত হাদীসে] কোন পক্ষকেই খারাপ বলেননি অবশ্য ইখতিলাফের কারণে ফিরক্বা (দল, উপদল বা গোষ্ঠী) বানানো, কেবল ক্বিয়াসের ভিত্তিতে হাদীসকে না মানা। কিংবা কোন অ-নবী ব্যক্তির রায়কে হাদীসের উপর প্রাধান্য দেয়া- এ সমস্ত বিষয় ইসলাম ও ঈমানের দাবির ভিত্তিতে নিষিদ্ধ, যা শিরকের দিকে ধাবিত করে।’’ [. মাসউদ আহমাদ, সহীহ তারিখুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন (করাচী : জামাআতুল মুসলিমীন ১৯৯৫/১৪১৬) পৃ. ৩৩৪-৩৩৫। এই শর্তের আলোকে বিশ্বব্যাপী একই দিনে ঈদ, সিয়াম ও মুসলিমদের দিন, তারিখ ও মাস গণনা করা যায়। এর স্বপক্ষে ‘আম আয়াত নিম্নরূপ :১. আল্লাহ তাআলা বলেন : يَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ - قُلْ هِىَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجَّ ‘‘লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন : এটা মানুষ ও হজ্জের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নির্দেশক।’’[সূরা বাক্বারা : ১৮৯ আয়াত]আয়াতটি দ্বারা সুস্পষ্ট হয়, মানবজাতির জন্য চাঁদের হিসাবে দিন-তারিখ ও হজ্জের সময় নির্ধারণ একই হতে হবে। যেন তারা সবাই চন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী দিন, মাস ও বছর গণনা এবং হজ্জ, সিয়াম, ‘ঈদ প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো একই সাথে উদযাপন করতে পারে। ‘‘এটা মানুষ ও হজ্জের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নির্দেশক’’ বক্তব্যের দ্বারা কোন বিশৃঙ্খল দিন-তারিখের হিসাব সৃষ্টি করার মোটেই উদ্দেশ্য নেই, বরং সুশৃঙ্খল দিন-তারিখ ও সময় নির্ধারণই উদ্দেশ্য। সুতরাং আয়াতটির আলোকে এটা সম্পূর্ণ বিবেক ও বাস্তবতা বিরোধী যে, কেবল হজ্জ পালনের ক্ষেত্রেই মুসলিমদের তারিখ এক হবে এবং অন্যান্য ধর্মীয় নির্দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাঁদ দর্শনের আঞ্চলিকতাই প্রাধান্য পাবে।২. আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন : هُوَ الَّذِىْ جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُوْرًا وَّقَدَّرَه مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللهُ ذلِكَ اِلاَّ بِالْحَقِّ - يُفَضِّلُ الْآيتِ لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ ‘‘তিনিই (আল্লাহ তাআলা) সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’’ [সূরা ইউনুস : ৫ আয়াত]৩. আল্লাহ তাআলা তাআলা অন্যত্র বলেন : وَجَعَلْنَا الَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيَنِ فَمَحُوْنَا آيَةَ الَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُوْا فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَالْحِسَابِ ‘‘আমি রাত ও দিনকে করেছি দু’টি নিদর্শন; এরপর রাতের নিদর্শনটি করেছি নিষ্প্রভ আর দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বছরের সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার।’’ [সূরা বানী ইসরাঈল : ১২ আয়াত]তবে এর স্বপক্ষে খাস হাদীসও রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, অন্য এলাকার চাঁদ দেখার খবর বিশ্বস্ত সূত্রে পৌঁছালে সেই অনুযায়ী ঐ এলাকার সাথে ‘ঈদ প্রভৃতি উদযাপন করা যাবে। যেমন : عَنْ أَبِى عُمَيْرِ بِنْ أَنَسٍ عَنْ عُمُوْمَةٍ لَه مِنَ الصَّحَابَةِ اَنَّ رَكْبًا ( وفى رواية فَجَاءَ رَكِبٌ مِنْ آخِرِ النَّهَارِ ) فَشَهِدُوْا أَنَّهُمْ رَأَوُا الْهِلاَلَ بِالْأَمْسِ فَاَمَرَهُمُ النَّبِىُّ ﷺ أَنْ يُّفْطِرُوْا ، وَإِذَا أَصْبَحُوْا أَنْ يَّغْدُوْا إِلَى مَصَلاَّهُمْ ‘‘আবূ ‘উমাইর বিন আনাস (রা) তাঁর চাচাদের [সাহাবীদের (রা)] নিকট থেকে বর্ণনা করেন, একটি কাফেলা (অন্য বর্ণনায়, দিনের শেষভাগে) এসে সাক্ষ্য দিল যে, গতকাল সন্ধ্যায় তারা আকাশে চাঁদ দেখেছে। ফলে নবী (স) তাদের সিয়াম ভঙ্গ (ইফতার) করতে বললেন এবং পরদিন সকালে ‘ঈদের ময়দানে যেতে নির্দেশ দিলেন।’’ [আহমাদ, আবূ দাউদ, বুলূগুল মারাম; এর সনদ সহীহ (অনুবাদ : খলিলুর রহমান বিন ফজলুর রহমান) হা/৪৭৪। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বে আবূ দাউদ হা/১১৫৭]ইমাম শওকানী (রহ) এই মাসআলাটির বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন : واذا راه أهل بلد لزم سائر البلاد الْموافقة . أما كونه اذا راه أهل بلد لزم سائر البلاد الْموافقة فوجهه الاحاديث الْمصرحة بالصيام لرؤيته والافطار لرؤيته وهى خطاب لِجميع الامة فمن راه منهم فى أى مكان كان ذالك رؤية لِجميعهم .‘‘যখন কোন শহর বা দেশে চাঁদ দেখা যাবে তখন সমস্ত মুসলিম বিশ্ব এবং প্রত্যেকটি শহরবাসী এর অনুসরণ করবে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِه وَافْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ ‘‘চাঁদ দেখে সিয়াম রাখ এবং চাঁদ দেখে সিয়াম খোল।’’[সহীহ বুখারী ১৯০৯, সহীহ মুসলিম ২৩৮৯ (৪/১০৮০), মিশকাত ১৯৭০] এই হুকুম সমস্ত শহর ও প্রত্যেক দেশের জন্য ‘আম (ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য)। এই হাদীসে কোন শহর বা দেশকে খাস (সুনির্দিষ্ট) করা হয়নি এ কারণে কোন শহর বা দেশে চাঁদ দেখা সমস্ত মুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য।( الدرارى الْمضيئة ২/২০-২১ পৃ.)উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর মোকাবেলায় সহীহ মুসলিমে বর্ণিত সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা) এর সংশ্লিষ্ট বর্ণনাটির দাবিকে বিরোধী ভাবা যাবে না। যদি কোন এলাকার কাছে এতটা দীর্ঘ সময় পরে চাঁদ দেখার খবর পৌঁছে যেভাবে ইবনু আব্বাসের কাছে রমাযান মাসের শেষে পৌছেছিল। তাদের ক্ষেত্রে ইবনু আব্বাসের বর্ণনানুযায়ী নিজ এলাকার চাঁদ দেখার ভিত্তিতেই ‘ঈদ, সিয়াম প্রভৃতির আমল নির্ধারিত হবে। পক্ষান্তরে খবরটি যথা সময়ে পৌঁছলে পূর্বোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর ‘আম দাবি অনুযায়ী বিশ্বের যে কোন প্রামেত্মর বিশ্বস্ত খবর অনুযায়ীই ‘ঈদ, সিয়াম, হজ্জ প্রভৃতির উপর আমল করা যাবে। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন। [বিস্তারিত : আতাউল্লাহ ডায়রভী, ‘‘ইসলামের নতুন চাঁদের বিধান ও এ সম্পর্কিত বিতর্ক নিরসন’’, অনুবাদ : কামাল আহমাদ]]
৩.মাসউদ আহমাদ : ‘‘সালাত, সিয়াম প্রভৃতি ইবাদাত অবশ্যই জরুরি, কিন্তু সর্বাবস্থায় নয়। যেমন- মাগরিবে তিন রাকআতের বদলে যদি কেউ চার রাকআত পড়ে, তাহলে আভিধানিক অর্থে এটা ইবাদাত হবে কিন্তু শরীআতের পরিভাষায় এটা আল্লাহ তাআলা’র বিরুদ্ধাচরণ হবে। তার সালাত ইবাদাতের মোকাবেলায় অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। ফলে সৃষ্টির উদ্দেশ্যেরই অবসান হবে।
এভাবে যদি কেউ ফজরের সালাতের পরে সূর্যোদয়ের পূর্বে নফল সালাত পড়ে, তাহলে সে ইবাদাতকারী তো বটেই কিন্তু আল্লাহর কাছে সে বিদ্রোহী বা বিরুদ্ধাচারী।
এমনিভাবে যদি কেউ ‘ঈদের দিন সাওম রাখে, তাহলে তার সাওম ইবাদাত হবে না। এভাবে সিয়াম পালনকে সওয়াব বা ইবাদত হিসাবে গণ্যকারী কেবল গুনাহগারই নয়, বরং কাফিরে পরিণত হবে।’’
তাহক্বীক্ব ৩ : আমরা পূর্বে বলেছি, ইবাদাতের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বা হুবহু দলিল প্রমাণ ছাড়া তা বিদআত হিসাবে গণ্য হবে যা বাতিল ও গোমরাহীর নামান্তর। কিন্তু এর সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন, লেনদেন প্রভৃতির ক্ষেত্রে শরীআতের সীমারেখা মেনে চলাটাই হুকুম। অর্থাৎ ইবাদাতের ক্ষেত্রটি সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হবে। পক্ষান্তরে মুআমালাতের ক্ষেত্রে যা নিষিদ্ধ নয় তা-ই বৈধ। এর উদাহরণ ইবাদাতের মধ্যকার ফরয নির্দেশাবলি তরককারী বা মনগড়া আমলকারী ক্ষেত্র বিশেষে কাফির ও বিদআতী, কিন্তু মুআমালাতের মধ্যকার নির্দেশাবলি অমান্যকারী কাফির নয়। যেমন, আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী শাসকের ক্ষেত্রে নবী (স) বলেছেন :
يَكُوْنُ عَلَيْكُمْ اُمَرَاءُ تَعْرِفُوْنَ وَتُنْكِرُوْنَ فَمَنْ اَنْكَرَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ وَلكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ قَالُوْا اَفَلاَ نُقَاتِلُهُمْ قَالَ لاَ مَا صَلُّوْا ـ
‘‘অচিরেই তোমাদের ওপর এমন সব শাসক নিযুক্ত হবে, যারা ভাল মন্দ উভয় প্রকারের কাজ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের মন্দ কাজের প্রতিবাদ করল, সে ব্যক্তি দায়িত্ব হতে মুক্ত হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি মনে মনে উক্ত কাজটিকে খারাপ জানল, সে ব্যক্তিও নিরাপদ হল। কিন্তু যে ব্যক্তি তাদের কাজের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করল এবং উক্ত শাসকের সে (অন্যায়) কাজে আনুগত্য করল (সে গুনাহর মধ্যে নিমজ্জিত হল)। তখন সাহাবীগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করব না? তিনি (স) বললেন : না, যতক্ষণ তারা সালাত পড়ে।’’ [. সহীহ : মুসলিম ৪৬৯৫ (৬৩/১৮৫৪), মিশকাত ৩৬৭১] অন্য বর্ণনায় আছে, لاَ مَا اَقَامُوْا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ ‘‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০] অন্য বর্ণনা আছে, اِلاَّ اَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِّنَ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانَ ‘‘যতক্ষণ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫৬, সহীহ মুসলিম ৪৬৬৫ (৪২/১৭০৯), মিশকাত ৩৬৬৬। হাদীসটি নিযুক্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাদীসের শুরুর বাক্যগুলো থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।]
হুযায়ফা (রা) বলেন :
قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّا كُنَّا بِشَرٍّ فَجَاءَ اللهُ بِخَيْرٍ فَنَحْنُ فِيْهِ فَهَلْ مِنْ وَّرَاءِ هَذَا الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ هَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الشَّرِّ خَيْرُ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ فَهَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ كَيْفَ قَالَ يَكُوْنَ بَعْدِيْ اَئِمَّةُ لاَيَهْتَدُوْنَ بِهُدَايَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِيْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالُ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِيْ جُثْمَانِ اِنْسٍ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ اَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنْ اَدْرَكْتُ ذَالِكَ قَالَ تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْاَمِيْرِ وَاِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَاُخِذَمَالُكَ فَاسْمَعْ وَاطِعْ ـ
‘‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে তারপর আল্লাহ আমাদের জন্যে মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ অমঙ্গলের পরে কি আবার কোন মঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, তা কিভাবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে যারা আমার হিদায়েতে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে না এবং সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যাদের অন্তকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তকরণ; রাবী বলেন, আমি বললাম : তখন আমরা কি করবো, ইয়া রসূলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন : তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেওয়া হয় তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৭৮ (৫১/১৮৪৭), মিশকাত ৫৩৮২]
সুস্পষ্ট হল, সালাত তরককারী কাফির, কিন্তু মুআমালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী সালাতের ন্যায় ইবাদাত ত্যাগ না করলে জালিম হলেও কাফির নয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিষিদ্ধ এবং ভাল কাজে তাকে মানতে হবে।
৪.মাসউদ আহমাদ : ‘‘এভাবে শতশত উদাহরণ দেয়া যাবে। ভেবে দেখুন, কেন ইবাদাত বিরুদ্ধাচারণে পরিণত হচ্ছে? যদি আপনি স্বল্প পরিমাণ চিন্তাও করেন, তাহলে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন যে, এর কারণ হল, এ ইবাদাতগুলো আল্লাহ তাআলা’র নির্ধারিত সীমার আওতাভুক্ত ছিল না। এ জন্যেই এগুলো ইবাদাত নয়। এ সমস্ত ইবাদাতে আল্লাহ তাআলা’র বিরুদ্ধাচারণ করা হয়েছে, এর মাধ্যমে ইতাআত বা আনুগত্যের মোকাবেলায় অবাধ্যতা করা হয়েছে। সুতরাং শরীআতি পরিভাষায় এগুলোকে ইবাদাত বলা যায় না।’’
তাহক্বীক্ব ৪ : নিঃসন্দেহে ইবাদাত হতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত সুস্পষ্ট পন্থায়, অন্যথা এটা বিরুদ্ধাচারণে পরিণত হবে। শাব্দিক অর্থে সবকিছুই ইবাদাত ও ইতাআত। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে ইবাদাত ও ইতাআতের মধ্যে সু্স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে যার স্বপক্ষে আমরা পূর্বে প্রমাণ পেশ করেছি।
৫.মাসউদ আহমাদ : ‘‘পূর্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইবাদাত প্রকারান্তরে ইতাআত বা আনুগত্যেরই নাম। নিচের আয়াতটি এ দাবিই সমর্থন করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ
‘‘শয়তানের ইবাদাত করো না।’’ [. সূরা ইয়াসীন : ৬০ আয়াত।]
লক্ষণীয়, কেউ কি শয়তানকে সাজদা করে? তার নামে কুরবানী করে? তার নামে ওয়াযিফা পড়ে? তার নামে দান-খয়রাত করে? কখনোই না। তাহলে এখানে শয়তানের ইবাদাতের উদ্দেশ্যই বা কী? সুস্পষ্ট হল যে, শয়তানের ইবাদাত বলতে এখানে শয়তানের ইতাআত বা আনুগত্যকে বুঝানো হয়েছে। শয়তানের ইতাআত বা আনুগত্যের কারণেই লোকেরা কুফর ও শিরক, অন্যায় ও পাপাচার, গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে নিমজ্জিত হয় এবং সিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হয়। এ কারণে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَأَنِ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ
‘‘আমার ইবাদাত কর, এটাই সিরাতে মুস্তাক্বীম।’’ [. সূরা ইয়াসীন : ৬১ আয়াত।]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা শয়তানের ইবাদাতের মোকাবেলায় নিজের ইবাদাতের কথা উল্লেখ্য করেছেন। কেননা, শয়তানের ইবাদাত শয়তানের ইতাআত। সুতরাং আল্লাহ তাআলা’র ইবাদাত আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত।’’
তাহক্বীক্ব ৫ : শাব্দিক অর্থে ইবাদাত ও ইতাআত পরিপূরক হলেও, আভিধানিক অর্থে এদের মধ্যকার পার্থক্যও সুস্পষ্ট, যা পূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। শয়তানের ইবাদাত ও ইতাআত উভয়েরই প্রমাণ পাওয়া যায়। নিচের আয়াতটিতে মূর্তিপূজাকে শয়তানের ইবাদাত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে :
يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا ـ يَا أَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا ـ قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آَلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيمُ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا
‘‘ [ইবরাহীম (আ) বললেন:] হে আমার পিতা! আপনি শয়তানের ইবাদত করবেন না। শয়তান তো রহমানের (আল্লাহ’র) অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি, আপনাকে রহমানের আযাব স্পর্শ করবে এবং আপনি হবেন শয়তানের বন্ধু। [পিতা] বললো, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী থেকে বিমুখ? যদি বিরত না হও, তবে আমি প্রস্তরাঘাতে অবশ্যই তোমার প্রাণ নাশ করবো; তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট থেকে দূর হয়ে যাও।’’ [. সূরা মারইয়াম : ৪৪-৪৬ আয়াত।]
সুতরাং আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্যদের ইবাদত করাটাই প্রকারান্তরে শয়তানের ইবাদাত। এর মধ্যে সাজদা, রুকু, নযর-নেয়ায, দুআ বা আহবান করা, সমস্যা দূরকারী হিসাবে চিহ্নিত করা এ সবই অন্তর্ভুক্ত। তেমনি ইবাদাত ও মুআমালাত উভয় ক্ষেত্রেও শয়তানী আমল শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ
‘‘হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক তির নিকৃষ্ট শয়তানী আমল। তাই তোমরা তা বর্জন কর।’’ [. সূরা মায়িদা : ৯০ আয়াত।]
সুতরাং সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত ও ইতাআত শাব্দিক অর্থে এক হলেও পারিভাষিক দাবির ভিত্তিতে এদের মধ্যে স্বতন্ত্রতা আছে। যেমন- ইচ্ছাকৃত সালাত ত্যাগকারী দুনিয়াতে কাফির হিসাবে গণ্য হবে। এ সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন :
بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاَةِ
‘‘বান্দার ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হল সালাত তরক করা।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ১৪৮ (১৩৪/৮২), মিশকাত ৫৬৯।]
তিনি অন্যত্র বলেছেন :
بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ وَالْإِيْمَانِ الصَّلاَةِ ، فَإِذَا تَرَكَهَا فَقَدْ اَشْرَكَ
‘‘বান্দার এবং কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত বর্জন করা। কাজেই যখন সে সালাত বর্জন করল, সে শিরক করল।’’ [. সহীহ : হিবতুল্লাহ তাবারী সহীহ সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশান) ১/৩৭৩ পৃ., হা/৫]। মুহাম্মাদ তামির হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত আত-তারগীব (মিশর : দার ইবনু রজব) ১/৭৯৯ নং।]
পক্ষান্তরে ইচ্ছাকৃত কোন কবীরা গুনাহ করার কারণে ঐ কাজে ব্যস্ত থাকা পর্যন্ত সে ক্ষণিকের জন্য ঈমান হারা হলেও চূড়ান্তভাবে কাফির হিসাবে চিহ্নিত হয় না। এ সম্পর্কে আবূ যার গিফারী (রা) বর্ণনা করেন। আমি একদিন নবী (স) এর কাছে গেলাম, তিনি সাদা কাপড় পরিহিত অবস্থায় ঘুমিয়ে ছিলেন। অতঃপর আবার তাঁর কাছে গেলাম। সে সময় তিনি জেগেছেন। তখন তিনি (স) বললেন :
مَا مِنْ عَبْدٍ قَالَ لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ ثُمَّ مَاتَ عَلى ذَالِكَ اِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ قُلْتُ وَاِنْ زَنى وَاِنْ سَرَقَ قَالَ وَاِنْ زَنى وَاِنْ سَرَقَ
‘‘আল্লাহ’র যে বান্দা এ কথা বলবে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং এর উপর থেকে মারা যাবে সে জান্নাতে যাবে। আমি [আবূ যার (রা)] জিজ্ঞাসা করলাম : যদিও সে যিনা করে ও চুরি করে? নবী (স) বললেন : যদিও সে যিনা করে এবং চুরি করে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৫৮২৭, সহীহ মুসলিম ১৭১ (১৫২/৯৩), মিশকাত ২৬।]
তাছাড়া নবী (স) ঐসব কবীরা গুনাহকারীদের শাফায়াত করবেন যারা শিরক থেকে মুক্ত ছিল। আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
لِكُلِّ نَبِىٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِىٍّ دَعْوَتَه ও وَاِنِّى اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِىْ شَفَاعَةً لِّاُمَّتِىْ اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَهِىَ نَائِلَةٌ اِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَّاتَ مِنْ اُمَّتِىْ لاَيُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا
‘‘প্রত্যেক নবীকে একটি বিশেষ দুআর অধিকার দেয়া হয়েছে যা কবুল করা হয়। প্রত্যেক নবী শীঘ্র শীঘ্র দুনিয়াতেই তাঁর দুআ চেয়েছেন, আর আমি আমার দুআ ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুলতবী রেখেছি আমার উম্মাতের শাফায়াতরূপে। ইনশাআল্লাহ এটা আমার উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি পৌঁছবে, যে আল্লাহর সাথে কিছুকে শরীক না করে মারা গেছে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৩৭৬ (৩৩৫/১৯৮), মিশকাত ২২২৩।]
অন্যত্র নবী (স) বলেছেন :
شَفَاعَتِىْ لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِىْ
‘‘আমার শাফায়াত হবে আমার উম্মাতের কবীরা গুনাহগারদের জন্য।’’ [. সহীহ : আবূ দাউদ, বাযযার, তাবারানী, সহীহ ইবনু হিব্বান, বায়হাক্বী, আত-তারগীব (ইফা) ৪/৪৭১ পৃ :, হা/১১০। মুহাম্মাদ তামির হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত আত-তারগীব (মিশর) ৪/৫৩৩৯ নং, পৃ : ২২৫]]
সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত ও মুআমালাতের বিষয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনেই স্বতন্ত্রতা রয়েছে। কেননা পূর্বে বর্ণিত আয়াতে আমরা দেখেছি যে, দেবদেবীর পূজাকে শয়তানের ইবাদাত বলা হয়েছে। আর এতে লিপ্ত ব্যক্তি মুশরিক ও চিরদিনের জন্য জাহান্নামী। পক্ষান্তরে মদ, জুয়া, ব্যভিচার প্রভৃতি হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তি যদি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে তবে সে কেবল কবীরা গুনাহকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে এবং আখিরাতে আযাব ভোগের পর কিংবা নবী (স)-এর শাফায়াতে জান্নাতী হবে। সুতরাং শরীআতের উভয় দিকটির পার্থক্য সুস্পষ্ট। [. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মত প্রণীত- ‘‘কবীরা গুনাহগার মুমিন কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী?’’ -আতিফা পাবলিকেশন্স, ঢাকা।]
৬.মাসউদ আহমাদ : ‘‘উপরিউক্ত আয়াত ও পর্যালোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে ইতাআত বা আনুগত্যের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ইতাআত বা আনুগত্য কেবলই আল্লাহ তাআলা’র হক্ব। তিনি যতক্ষণ না অন্য কারো ইতাআত বা আনুগত্যের অনুমতি দিবেন, ততক্ষণ কারো ইতাআত জায়েয নয়। যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ইতাআত (আনুগত্য) করে তাহলে তা শিরক ফিল ইতাআত (আনুগত্যে শিরক) বলে গণ্য হবে। আর শিরকের চেয়ে বড় অন্য আর কোন শিরক নেই, যার দ্বারা জীবনের উদ্দেশ্যই পাল্টে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا
‘‘তোমাদের ইলাহ কেবলই একজন, সুতরাং কেবল তারই অনুগত থাক।’’ [. সূরা হাজ্জ : ৩৪ আয়াত।]
এই ইতাআত বা আনুগত্যের অপর নামই ইসলাম। ইসলাম অর্থ- আল্লাহ তাআলা’র নিকট সমর্পিত বা অনুগত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা’র আনুগত্য করে সেই মুসলিম। আর যে আল্লাহ’র ইতাআত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে অমুসলিম। সে জীবনের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে বেপরোয়া, সে নিজের স্রষ্টার বিরুদ্ধাচারী এবং তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পিত করতে বক্রতা অবলম্বনকারী।
তাহক্বীক্ব ৬ : নিঃসন্দেহে মুসলিম হিসাবে আল্লাহ’র সমস্ত নির্দেশই পালন করতে হবে। তা আল্লাহর হক্ব বা ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্টই হোক, কিংবা বান্দার হক্ব বা দুনিয়াবী মুআমালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ই হোক। উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর সুনির্দিষ্ট হুকুম ও সীমারেখা লংঘনকারী অমুসলিম। [. যেমন- ‘ইবাদাতে শিরককারী এবং মুআমালাতে হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম সাব্যস্তকারী অমুসলিম তথা কাফির।] এক্ষেত্রে পার্থক্য হল, ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজের সাথে কাউকেই শরীক করেননি পক্ষান্তরে ইতাআত শব্দটি আল্লাহ তাআলা বান্দার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করেছেন, যা নিঃসন্দেহে মুআমালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে পূর্বেই দলিল প্রমাণ উল্লেখ্য করেছি।
সম্মানিত লেখক লিখেছেন : ‘‘ইতাআত বা আনুগত্য কেবলই আল্লাহ তাআলা’র হক্ব। তিনি যতক্ষণ না অন্য কারো ইতাআত বা আনুগত্যের অনুমতি দিবেন, ততক্ষণ কারো ইতাআত জায়েয নয়। যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ইতাআত (আনুগত্য) করে তাহলে তা শিরক ফিল ইতাআত (আনুগত্যে শিরক) বলে গণ্য হবে।’’ -এ পর্যায়ে প্রশ্ন করা চলে, আল্লাহ তাআলা ইতাআতের ন্যায় ইবাদাতের ব্যাপারেও কি নিজেকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাতের অনুমতি দিয়েছেন? এর জবাব হল, না। সুতরাং ইবাদাত ও ইতাআত এক নয়, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন স্ব স্ব প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করাটাই ইসলাম। আল্লাহ তাআলা সত্য বুঝার তাওফিক দিন।
তাছাড়া আমরা পূর্বেই প্রমাণ পেয়েছি যে, ইবাদাতে শিরককারীর হুকুম ও দুনিয়াবী ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর বিধি-বিধানকে স্বীকৃতি দেয়া সাপেক্ষে তাঁরই আইন লঙ্ঘনকারীর হুকুম শরিআতের দৃষ্টিতেই এক নয়। এ কারণে ইতাআতের ক্ষেত্রে হুকুম লঙ্ঘনকারী ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে হুকুম লঙ্ঘনকারীরও হুকুম এক হয় না। অথচ সম্মানিত লেখক উভয়টিকেই এক দৃষ্টিতে দেখেছেন। আর এ দৃষ্টিভঙ্গী নিঃসন্দেহে শরীআতী দৃষ্টিভঙ্গী নয়।
৭.মাসউদ আহমাদ : ‘‘ইসলামই একমাত্র জীবন-বিধান যে বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপন করা উচিত। যদি জীবনের সমস্ত কাজকর্ম আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত অনুযায়ী হয়, তাহলে ঐ সমস্ত কাজকর্মও ইবাদাত। যদি সালাত আল্লাহ তাআলা’র হুকুম মোতাবেক আদায় করা হয়, তাহলে সালাতও ইবাদাত। যদি সাওম আল্লাহ তাআলা’র হুকুম মোতাবেক হয়, তাহলে সাওমও ইবাদাত। যদি ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহ তাআলা’র হুকুম মোতাবেক হয়, তাহলে এটাও আল্লাহর ইবাদাত। এভাবে জীবনের সমস্ত চলাফেরা, শোয়া-ঘুমানো, উঠা-বসা, খাওয়া-পড়া, বিয়ে-শাদী, লেনদেন, তালাক-মুক্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-শত্রুতা, বন্ধুত্ব-সহমর্মিতা প্রভৃতি যদি আল্লাহ তাআলা’র হুকুম-আহকাম মোতাবেক হয়ে থাকে; তাহলে এ সবই ইবাদাত। এভাবে সমস্ত জীবনের কাজকর্মই ইবাদাতে পরিণত হবে।
রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
اِنَّكَ لاَ تَنْفِقَ نَفْقَةً تَبْتَغِىْ بِهَا وَجْهَ اللهِ اِلاَّ اُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتّى مَا تَجْعَلُ فِىْ فَمِ امْرَاَتِك
‘‘তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা-ই খরচ কর না কেন, তোমাকে তার সওয়াব অবশ্যই দেয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে (খাদ্যের) লোকমা তুলে দাও, তাও।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী - কিতাবুল ঈমান باب ما جاء ان الاعمال بالنية والحسبة ।]
তাহক্বীক্ব ৭ : আল্লাহর নির্দেশ পালন মাত্রই সওয়াব রয়েছে। তা আল্লাহর হক্ব বা ইবাদাতের ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা বান্দার হক্ব বা দুনিয়াবী লেনদেনের ক্ষেত্রেই হোক। আর পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাব্দিক অর্থে ইবাদাত ও ইতাআত পরিপূরক হলেও পারিভাষিকভাবে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং পরিভাষার আলোকে ইবাদাত ও ইতাআত শব্দগুলোর নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকা উচিৎ। ইবাদাত ও ইতাআত উভয়টিই আল্লাহর হুকুম এবং অবশ্য পালনীয়।
৮.মাসউদ আহমাদ : ‘‘আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত (আনুগত্য) তাঁর বিধি-বিধান আমল করার মধ্যে নিহিত। এই বিধানদাতাও স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ
‘‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্যে দ্বীনি শরীআত (বিধান) দিয়েছেন।’’ [. সূরা শূরা : ১৩ আয়াত।]
আইন প্রদানের ক্ষেত্রে কেউই আল্লাহ তাআলা’র শরীক নয়। এ বিধান প্রদানের বিষয়টি কেবলই খালেস (নির্ভেজাল) ভাবে আল্লাহ তাআলা’র জন্য। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ
‘‘সাবধান! খালেস (নির্ভেজাল) দ্বীন কেবলই আল্লাহর জন্য।’’ [. সূরা যুমার : ৩ আয়াত।]
সুতরাং দ্বীনের মধ্যে অন্য কারো অংশ নেই। অন্য কাউকে বিধানদাতা মানা, তার তৈরীকৃত বিধান দ্বীনের মধ্যে সংযোজন, তার ইজতিহাদ-ক্বিয়াস ও ফাতাওয়াকে দ্বীনি বিষয় বিবেচনা করাটাই হল আল্লাহর সাথে শিরক করা। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে :
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ
‘‘তারা কি এমন কাউকে (আল্লাহ’র) শরীক স্থির করে, যে তাদের জন্য দ্বীনি বিধান তৈরী করে? অথচ আল্লাহ তাদেরকে এ ব্যাপারে অনুমতি দেননি’’ [. সূরা শূরা : ২১ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন :
وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
‘‘আল্লাহ তাআলা হুকুমে কাউকে শরীক করো না।’’ [. সূরা কাহাফ : ২৬ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা কারো অংশীদারীত্ব ছাড়া স্বয়ং একাকী-ই হুকুমদাতা। তাঁর হুকুম-আহকামে কেউ-ই শরীক নেই। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে :
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ
‘‘হুকুম কেবলই আল্লাহ তাআলা’র, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করো না।’’ [. সূরা ইউসূফ : ৪০ আয়াত।]
তাহক্বীক্ব ৮ : উম্মাতের মধ্যে উপরোক্ত আয়াতগুলো ইবাদাত ও মুআমালাত উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু আয়াতগুলোর পূর্বাপর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রমাণিত হবে যে, আয়াতগুলো দাবি ইবাদাতের ক্ষেত্রেই বেশী পরিপূরক। নিচে আমরা উপরোক্ত ক্রমানুসারেই এর বিবরণ উল্লেখ করলাম।
১.প্রথমে উল্লিখিত আয়াতটির পূর্ণ বর্ণনা হল :
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ
‘‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনি শরীআত দিয়েছেন। যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে, আর যা আমি অহী করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীনকে ক্বায়েম কর এবং তাতে ইখতিলাফ (মতভেদ) করো না। আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহবান করেছেন তা তাদের নিকট দুর্বল মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং তাঁর অভিমুখী, তাকে দ্বীনের দিকে পরিচালিত করেন।’’ [. সূরা শূরা : ১৩ আয়াত।]
‘‘আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহবান করেছেন’’ -আয়াতাংশটির ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত আয়াতটিতে রয়েছে। আর তা হল :
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুতকে বর্জন কর।’’ [. সূরা নাহল : ৩৬ আয়াত।]
সুতরাং সুস্পষ্ট হল, দ্বীন ক্বায়েমের দাবির মধ্যে সর্বাগ্রে যে দাবিটি প্রাধান্য পায়- তা হল, আল্লাহর ইবাদাত ও তাগুতকে বর্জন করা। তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা মুআমালাতের (রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক) ক্ষেত্রে যেসব আইন দিয়েছেন তাও দ্বীন ক্বায়েমের দাবির মধ্যে গণ্য। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন :
هُوَ الَّذِيْ اَرْسَلَ رَسُوْلَه ও بِالْهُدي وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَه عَلي الدِّيْنِ كُلِّه لا وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكِيْنَ
‘‘তিনিই তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও দ্বীনকে হক্বসহ প্রেরণ করেছেন। যেন সব দ্বীনের উপর তা প্রভাবশালী হয়। যদিও মুশরিকদের কাছে তা অপছন্দনীয়।’’ [. সূরা সফ : ৯ আয়াত।]
২.দ্বিতীয় আয়াতটির পূর্ণ বর্ণনা লক্ষ্য করুন :
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
‘‘সাবধান! খালেস (নির্ভেজাল) দ্বীন কেবলই আল্লাহ’র জন্য। যারা আল্লাহ’র পরিবর্তে অন্যকে অলীরূপে গ্রহণ করে, তারা তো বলে- আমরা তো এগুলোর ইবাদাত এজন্যে করি যে, এরা আমাদের আল্লাহ’র সান্নিধ্যে এনে দেবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে, আল্লাহ তার ফায়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’ [. সূরা যুমার : ৩ আয়াত।]
আয়াতটি যে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর হক্ব তথা ইবাদাতের জন্য এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে নিঃসন্দেহে আয়াতটির প্রথমাংশ ‘‘সাবধান! খালেস (নির্ভেজাল) দ্বীন কেবলই আল্লাহ’র জন্য’’ -এর দাবি আম বা ব্যাপকার্থক। যা ইবাদাত ও মুআমালাত উভয়টিকেই সম্পৃক্ত করে। কিন্তু এর মধ্যে ইবাদাতের দাবিই সর্বাগ্রে। কেননা ইবাদাত কেবলই আল্লাহর জন্যে হয় আর মুআমালাতের মাঝে আল্লাহ ও বান্দা উভয়েরই হক্ব রয়েছে।
৩.তৃতীয় আয়াতটি লক্ষ্য করুন :
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘তারা কি এমন কাউকে (আল্লাহ’র) শরীক স্থির করে, যে তাদের জন্য দ্বীনি বিধান তৈরি করে? অথচ আল্লাহ তাদেরকে এ ব্যাপারে অনুমতি দেননি ফায়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে তো সিদ্ধান্ত হয়েই যেত। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব।’’ [. সূরা শূরা : ২১ আয়াত।]
লক্ষণীয় যে, ইবাদাতের ক্ষেত্রেই আল্লাহ তাআলা নিজের সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
وَاعْبُدُوا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا وَّبِذِي الْقُرْبي وَالْيَتمي وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِي الْقُرْبي وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَاِبْنِ السَّبِيْلِ لا وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ
‘‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও।’’ [. সূরা নিসা : ৩৬ আয়াত।]
সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত কেবলই আল্লাহর জন্য। মানুষের প্রতি সদাচরণ, লেনদেন প্রভৃতি স্বতন্ত্র বিষয়। এটাও আল্লাহর হুকুম এবং এ ক্ষেত্রে ইতাআত ও মুআমালাত শব্দটি প্রযোজ্য। কেননা আল্লাহর অনুমতিক্রমে বান্দার ইতাআত বৈধ। কিন্তু ইবাদাত সম্পূর্ণরূপে এর বিপরীত। আল্লাহ তাআলা কোথাও বান্দার ইবাদাতের অনুমতি দেননি
৪.চতুর্থ আয়াতটির সম্পূর্ণ বর্ণনা লক্ষ করুন :
قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
‘‘বলুন! তারা (আসহাবে কাহফ) কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভাল জানেন। আসমান ও যমীনের গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে আছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন এবং শোনেন। তিনি ব্যতীত তাদের কোন অলী বা সাহায্যকারী নাই। তিনি কাউকে নিজের হুকুমে (কর্তৃত্বে) শরীক করেন না।’’ [. সূরা কাহফ : ২৬ আয়াত।]
এই আয়াতটির শুরুতে আল্লাহ তাআলা’র কয়েকটি সিফাত (গুণাবলি)-এর বর্ণনা এসেছে যা আক্বীদাগত ইবাদাত তথা তাওহীদের সাথে জড়িত। এ সমস্ত বিষয়ে কেউই আল্লাহ তাআলা’র কর্তৃত্বে শরীক নয়- এটাই আয়াতের দাবি। তবে মুআমালাতের ক্ষেত্রেও আল্লাহর হুকুমই প্রাধান্য প্রাপ্ত। কেননা আল্লাহ যা হালাল বা হারাম করেছেন, তাকে কেউ হারাম বা হালাল গণ্যকারী নিঃসন্দেহে কাফির ও মুশরিক। তবে আয়াতটির মূল দাবি প্রকৃতিতে আল্লাহ’র ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে প্রকাশ করা, যা তাওহীদ বা আক্বীদাগত ইবাদাতের সাথে সম্পৃক্ত।
৫.পঞ্চম আয়াতটির পূর্ণাঙ্গ অংশের দিকে লক্ষ্য করুন :
مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি হুকুম চলবে কেবল আল্লাহ’র। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করো না। এটাই দ্বীনুল ক্বাইয়েম। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’’ [. সূরা ইউসূফ : ৪০ আয়াত।]
আয়াতটির পূর্বাপর দাবি থেকে সুস্পষ্ট হয়, এটাও ইবাদাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কোন আমীর, এমন কি পিতা-মাতার বিরোধী হুকুমও কার্যকরী নয়। কেননা, ইবাদাত করা হয় কেবল আল্লাহর হুকুমে। পক্ষান্তরে ইতাআতও আল্লাহর হুকুমে করা হলেও ইবাদাত কেবল আল্লাহরই হক্ব। অপরপক্ষে ইতাআত আল্লাহ ও বান্দা উভয়েরই হক্ব, আল্লাহরই অনুমতিক্রমে।
সম্মানিত পাঠক! লক্ষ্য করুন, আয়াতগুলোর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা আয়াতগুলোর মূল শিক্ষা থেকে কি আমাদের বঞ্চিত করছে না? আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
সম্মানিত লেখকের পরবর্তী দলিল-প্রমাণ ও বক্তব্যগুলো মুআমালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর ইতাআত বা আনুগত্যের সুন্দর আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে।
৯.মাসউদ আহমাদ : ‘‘হালাল, হারাম করার এখতিয়ার কেবলই আল্লাহ তাআলা’র। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ
‘‘তোমাদের মুখ থেকে বেফাঁসভাবে মিথ্যারোপ করে বলো না যে, এটা হালাল, এটা হারাম। এটাতো আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ।’’ [. সূরা নাহল : ১১৬ আয়াত।]
সুতরাং উলামাদের ফাতাওয়াতে কোন কিছুই হালাল বা হারাম হয় না। কেননা হালাল কেবল ঐ জিনিস যা আল্লাহ তাআলা হালাল করেছেন। আর হারাম কেবল ঐ জিনিস যা আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন।
কাযী বা বিচারকের ফায়সালা দ্বারাও কোন কিছু হালাল বা হারাম হতে পারে না। কাযীর ফায়সালা কেবলই ফায়সালা, এটা কোন বিধান হতে পারে না। যদি তার ফায়সালা সহীহ হয় তবে তা উত্তম বিষয়, আর যদি সহীহ না হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত। যদি ভুলক্রমে তা জারি হয়ে যায়, তাহলে সেটা সাময়িকভাবে হবে। ঐ কাযীই অনুরূপ অন্য একটি বিচারে ভিন্ন ফায়সালা দিতে পারে। কাযীর ফায়সালা চিরস্থায়ী বিধানের মর্যাদা পাবে না। চিরস্থায়ী বিধান কেবল আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান। যে এ বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে সে মুসলিম, যে তার বিপরীত ফায়সালা করে সে অমুসলিম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই কাফির।’’ [. সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
তাহক্বীক্ব ৯ : আল্লাহ তাআলা’র হালালকৃত বিষয়কে হারাম এবং হারামকৃত বিষয়টি হালাল গণ্যকারী কাফির। কেননা সে আল্লাহ’র প্রদত্ত বিধানের বিকৃতি করেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ’র বিধান অনুযায়ী ফায়সালার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব, অবিচার প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তি জালিম ও ফাসিক্বে পরিণত হয়, তাকে কাফির বা অমুসলিম বলা যাবে না। যেমন- আল্লাহর বিধান ও রসূলের (স) সুন্নাত অমান্যকারী শাসকের ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
يَكُوْنَ بَعْدِيْ اَئِمَّةُ لاَيَهْتَدُوْنَ بِهُدَايَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِيْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالُ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِيْ جُثْمَانِ اِنْسٍ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ اَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنْ اَدْرَكْتُ ذَالِكَ قَالَ تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْاَمِيْرِ وَاِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَاُخِذَمَالُكَ فَاسْمَعْ وَاطِعْ
‘‘আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে যারা আমার হিদায়েতে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে না এবং সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যাদের অন্তঃকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তঃকরণ; রাবী বলেন, আমি বললাম : তখন আমরা কি করবো, ইয়া রসূলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন : তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেয়া হয় তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৭৮ (৫১/১৮৪৭), মিশকাত ৫৩৮২]
লক্ষণীয়, উক্ত মানবিক যুলুম ও হক্ব নষ্ট হওয়ার পরেও হিদায়াত ও সুন্নাত বিমুখ শাসকের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে ইবাদাতের ক্ষেত্রে হেরফেরকারী শাসকের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, নবী (স) বলেন :
سَيَلِي أُمُورَكُمْ بَعْدِي رِجَالٌ يُطْفِئُونَ السُّنَّةَ وَيَعْمَلُونَ بِالْبِدْعَةِ وَيُؤَخِّرُونَ الصَّلَاةَ عَنْ مَوَاقِيتِهَا فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنْ أَدْرَكْتُهُمْ كَيْفَ أَفْعَلُ قَالَ تَسْأَلُنِي يَا ابْنَ أُمِّ عَبْدٍ كَيْفَ تَفْعَلُ لَا طَاعَةَ لِمَنْ عَصَى اللَّهَ .
‘‘অচিরেই আমার পরে এমন সব লোক তোমাদের আমীর (নেতা) হবে, যারা সুন্নাতকে মিটিয়ে দেবে এবং বিদআতের অনুসরণ করবে এবং সালাত নির্দিষ্ট ওয়াক্ত থেকে পিছিয়ে দেবে। আমি তখন বললাম : ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! আমি যদি তাদের পাই, তবে কি করবো? তিনি বললেন : হে উম্মু আবদের পুত্র! তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছো যে, তুমি কি করবে? যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যচারণ করে, তার আনুগত্য করবে না।’’ [. সহীহ :ইবনু মাজাহ- কিতাবুল জিহাদ باب لا داعة فى معصية الله ; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৫]]
অর্থাৎ ইবাদাত বিকৃত হলে সেক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করা যাবে না। এ ধরনের শাসকদের ব্যাপারে নবী (স)-কে সাহাবীগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করব না? তিনি (স) বললেন : না, যতক্ষণ তারা সালাত পড়ে।’’ [. সহীহ : মুসলিম ৪৬৯৫ (৬৩/১৮৫৪), মিশকাত ৩৬৭১।] অন্য বর্ণনায় আছে, لاَ مَا اَقَامُوْا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ ‘‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০।] অন্য বর্ণনা আছে, اِلاَّ اَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِّنَ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانَ ‘‘যতক্ষণ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫৬, সহীহ মুসলিম ৪৬৬৫ (৪২/১৭০৯), মিশকাত ৩৬৬৬। হাদীসটি নিযুক্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাদীসের শুরুর বাক্যগুলো থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।]
এ পর্যায়ে লক্ষণীয় যে, কেবল কুরআনের আয়াতের আলোকে এ ধরনের শাসককে শাব্দিকভাবে কাফির হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। পক্ষান্তরে কুরআন ও সহীহ হাদীস উভয়টির সমন্বয়ে করলে এই সিদ্ধান্তই পাওয়া যায় যে, আল্লাহ’র তাওহীদ বা ইবাদাতে ত্রুটিকারী শাসক কাফির হলেও, মুআমালাতের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিষিদ্ধ বরং সব নেক কাজে তার ইতাআত ওয়াজিব। তবে মুআমালাতের ক্ষেত্রেও আল্লাহ’র হারামকৃত জিনিসকে হালাল বা হালালকৃত জিনিসকে হারাম গণ্যকারী বা ঘোষণাকারী শাসক কাফির। কেননা হালাল ও হারামের অধিকারী কেবলই আল্লাহ। ঐ সব শাসকরা যদি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন চালাতো তবে কি নবী (স) তাদেরকে নিকৃষ্ট শাসক হিসাবে চিহ্নিত করতেন? কক্ষণো না। পক্ষান্তরে তাদের সালাত তরক করা কিংবা প্রকাশ্য কুফরী পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ব্যবহারের অনুমতি প্রদান থেকে সুস্পষ্ট হয়- শরীআত এ পর্যায়ে আল্লাহর হক্ব (ইবাদাত) ও বান্দার হক্বের (মুআমালাতের) মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।
১০.মাসউদ আহমাদ : ‘‘কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান অনুসরণ করতে হবে। এটাই প্রকৃত তাওহীদ। অন্য কিছুর অনুসরণ করা হারাম। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন :
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ
‘‘ঐ বিধানের অনুসরণ কর যা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে, এছাড়া কোন আওলিয়াদের অনুসরণ করো না।’’ [. সূরা আ‘রাফ : ৩ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা’র বিধান সর্বদাই চূড়ান্ত। কারো ফাতাওয়া বা রায়কে চূড়ান্ত বিধানের মর্যাদা দেয়া শিরক। আহলে কিতাবরাও (ইয়াহুদী, নাসারাও) মুসলিমদের এ আক্বীদার সাথে ঐকমত্য ছিল। এ আক্বীদা থেকে বিচ্যুতির কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দিয়েছেন। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে :
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
‘‘বলুন, হে আহলে কিতাব! একটি বিষয়ের দিকে আস- যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করব না, তাঁর সাথে কোন শিরক করব না, এবং নিজেদের মধ্যকার একে অপরকে আল্লাহ’র পরিবর্তে রব হিসাবে গণ্য করব না।’’ [. সূরা আল-ইমরান : ৬৪ আয়াত।]
এ আক্বীদাতে একমত হওয়া সত্ত্বেও তারা আমলগত শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত হল। আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কাউকে নিজেদের রব হিসাবে না মানার আক্বীদা রাখা সত্ত্বেও, তারা নিজেদের উলামা ও দরবেশদের রব বানিয়ে রেখেছিল।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা নিজেদের আলেম ও দরবেশদের আল্লাহকে ছেড়ে রব বানিয়ে রেখেছে এবং ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও। অথচ তিনি তাদের এ হুকুম দিয়েছিলেন যে, ঐ একক সত্তার ইবাদাত (অর্থাৎ এক হাকিমের ইতাআত) কর। তিনি ছাড়া আর কোন হাকিম নেই। (কিন্তু তারা এর উপর দৃঢ় থাকে নি, তারা আলেম ও দরবেশদেরকে হাকিম বানিয়ে শিরক করে।) তিনি তাদের শিরক থেকে পবিত্র।’’ [. সূরা তাওবা : ৩১ আয়াত। এই আয়াতের অনুবাদে লেখক ইলাহ বা মা‘বুদ এবং হাকিমকে একই অর্থে গ্রহণ করেছেন। অথচ আল্লাহ তাআলা হাকিম শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলেও ইলাহ বা মা‘বুদ শব্দটির সহীহ প্রয়োগ হিসাবে এককভাবে নিজেকেই সম্পৃক্ত করেছেন। সুতরাং পারিভাষিকভাবে ইলাহ ও হাকিমের মধ্যে পার্থক্য থাকায় অনুবাদটি হবে নিম্নরূপ :‘‘তারা নিজেদের আলেম ও দরবেশদেরকে আল্লাহকে ছেড়ে রব বানিয়ে রেখেছে এবং ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও। অথচ তিনি তাদেরকে এ নির্দেশ ( امر ) দিয়েছিলেন যে, ঐ একক সত্তার ‘ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি তাদের শিরকে থেকে পবিত্র।’’]
সার-সংক্ষেপ : হাকিম কেবলই আল্লাহ তাআলা, ইতাআত (আনুগত্য) কেবলই আল্লাহ তাআলা’র হক্ব। চূড়ান্ত বিধান কেবল আল্লাহ তাআলা’র নির্দেশাবলি। অন্যান্যদের ইতাআতের হক্বদার মানা, তাদের রায় ও ফাতওয়াকে চূড়ান্ত বিধান গণ্য করাটাই আল্লাহ’র সাথে শিরক করা। এটাকে শিরক ফিল ইবাদাত (ইবাদাতে শিরক)-ও বলা হয়। তাছাড়া শিরক ফিল হুকুম (আদেশ পালনে শিরক) এবং শিরক ফিত্তাশরি‘য়ী (বিধি-বিধানে শিরক)-ও বলা হয়।
তাহক্বীক্ব ১০ : ইবাদাত বা মুআমালাত উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ’র প্রদত্ত বিধানের মোকাবেলায় যে কোন মানবীয় বিধানকে পরিপূরক বা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়াটাও শিরক। পার্থক্য এতটুকুই যে, ইবাদাত শব্দটির ক্ষেত্রে স্বয়ং আল্লাহ একক দাবিদার, আর অন্য কেউ-ই। পক্ষান্তরে মুআমালাতের ক্ষেত্রে ইতাআত শব্দটির প্রয়োগে আল্লাহ তাআলা তাঁর নির্দেশের বিরোধী না হলে অন্যদের যেমন- আমির, পিতামাতা, বয়োজৈষ্ঠ, স্বামী প্রমুখের ইতাআত করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তেমনি হাকিম শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইতাআত শব্দটি প্রযোজ্য। কিন্তু ইবাদাত শব্দটি শাব্দিক অর্থে একই হলেও পারিভাষিকভাবে এর দাবি কেবলই আল্লাহর। কোন আমির, পিতামাতা, বয়োজৈষ্ঠ, স্বামী কেউই এর হক্বদার নয়। যেমন নবী (স) বলেছেন :
لَوْ كُنْتَ آمُرُ اَحَدًا اَنْ يَّسْجُدَ لِاَحَد لَّاَمَرْتُ الْمَرْأَةَ اَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا
‘‘যদি আমি (আল্লাহ ছাড়া) কাউকে সাজদার করার নির্দেশ দিতাম, তবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সাজদা করার।’’ [. সহীহ : তিরমিযী ১১৫৯, মিশকাত ৩২৫৫। অনেক সাক্ষ্য থাকায় আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত (বৈরুত) ২/৯৭২ পৃ., হা/৩২৫৫]]
এই হাদীসটিতে সাজদার ন্যায় ইবাদাতের কাজটি যে স্বামীর ক্ষেত্রে হারাম তা সুস্পষ্ট হয়েছে। পক্ষান্তরে স্বামীর ক্ষেত্রে ইতাআত শব্দটি খুব প্রাঞ্জলভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
اَلْمَرْآةُ اِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَاَحْصَنَتْ فَرْجَهَا وَاَطَاعَتْ بَعْلَهَا فَلْتَدْخُلْ مِنْ اَىِّ اَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ ـ
‘‘স্ত্রীলোক যখন তার প্রতি নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে, রমাযান মাসের সিয়াম পালন করবে এবং নিজের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে ও স্বামীর ইতাআত করবে- তখন সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা চাইবে প্রবেশ করতে পারবে।’’ [. হাসান : আবূ নুআইম- হিলইয়া, মিশকাত ৩২৫৪। অনেক সাক্ষ্য থাকায় আলবানী হাদীসটিকে হাসান বা সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত (বৈরুত) ২/৯৭২ পৃ., হা/৩২৫৪]]
সুতরাং সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত ও ইতাআত শব্দ দু’টি আভিধানিক অর্থে পরিপূরক হলেও, পারিভাষিকভাবে এদের পার্থক্য সুস্পষ্ট। উভয়টির একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ। কিন্তু ইবাদাত কেবল তাঁরই জন্য এবং ইতাআত তাঁর অনুমতিতে ও সীমারেখার মধ্যে মানুষেরও করা জায়েয বরং ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্যতামূলক। পরবর্তী অংশে এই কথাই উল্লেখ হয়েছে।
১১.মাসউদ আহমাদ : ‘‘আল্লাহ তাআলা-ই প্রকৃত হাকিম (হুকুমদাতা)। আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত (আনুগত্য) চিরন্তন ও চিরস্থায়ী, নিঃশর্ত ও সীমাহীন। আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত ভাষা ও স্থানের মধ্যে সুনির্দিষ্ট নয়। আল্লাহ তাআলা’র ইতাআতেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
কেননা, আল্লাহ তাআলা-ই প্রকৃত ইতাআতের হক্বদার। সুতরাং অন্য কারো ইতাআত কেবল ঐসব ক্ষেত্রে অবশ্যই করতে হবে, যখন ঐ ইতাআতের হুকুম স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দেন। আল্লাহ তাআলা নিজের হুকুম-আহকাম যথাযথ পালনের সুবিধার্থে রসূলদের ইতাআতও ফরয করেছেন। সুতরাং আল্লাহর হুকুমে রসূলদের ইতাআতও ফরয।
জামাআতুল মুসলিমনের দা‘ওয়াত : আসুন আমরা সবাই মিলে আল্লাহকে হাকিম মেনে নিই। হাকিমিয়্যাত (সার্বভৌমত্ব) কেবল আল্লাহ তাআলা’র জন্যেই নির্ধারিত। কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান মেনে চলি। আল্লাহ তাআলা’র বিধান হিসাবে কেবল কুরআন ও হাদীসই সুরক্ষিত। কুরআন ও হাদীস আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। এ দু’টি জিনিসের মধ্যে আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। এই দু’টি জিনিসকেই আমরা অবশ্যপালনীয় মনে করি। দল বা ফিরক্বা ভিত্তিক মাযহাবকে ত্যাগ করি, ফিরক্বাবন্দীর অবসান করি। আল্লাহ তাআলা এক। তাঁকে একমাত্র হাকিম বা হুকুমদাতা মেনে নিয়ে এক হয়ে যাই।
জামাআতুল মুসলিমীনের দা‘ওয়াত ক্ববুল করুন এবং এর সহযোগী/সহযোদ্ধা হোন
তাহক্বীক্ব ১১ : উক্ত বক্তব্যের প্রয়োজনীয় সংস্কার আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। শেষাবধি আবারও লক্ষ্য করুন, এখানে রসূলের ইতাআতকে ফরয করা হয়েছে- আর নিঃসন্দেহে তা ফরয। কিন্তু কোনক্রমেই এটা কি বলা যাবে যে, রসূলের ইবাদাত করাও ফরয- কখনো না। অর্থাৎ ইবাদাত কেবল আল্লাহ‘রই হক্ব এবং এর মধ্যে আর কেউ-ই শরীক নয়। কিন্তু ইতাআত আল্লাহ‘র হুকুমে বা অনুমতিতে অন্যদেরও হক্ব। সুতরাং পারিভাষিকভাবে ইবাদাত ও ইতাআতের পার্থক্য সুস্পষ্ট। এই পৃথকীকরণের অস্পষ্টতার কারণে অধিকাংশ মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল ও দল ভেদে রূঢ় বা বিদ্রোহী আচরণের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। কেবল শাব্দিকভাবে কুরআনকে প্রাধান্য দান ও হাদীসের দাবিকে সেগুলোর সাথে মিলিয়ে সমন্বয় করার মাধ্যমে উক্ত ভারসাম্যহীন আচরণ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। অন্যথায় কেবল শাব্দিকভাবে কুরআন পাঠ ও এর সাধারণ বুঝ কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন দল, উপদল বা ফিরক্বার জন্ম নিচ্ছে, তেমনি সাধারণ জনগণ হচ্ছে বিভ্রান্ত। ইতোপূর্বে মুসলিমদের থেকে যেসব ফিরক্বার জন্ম হয়েছে তাদের প্রত্যেকের পৃথকীকরণের মূলেও ছিল এই একই কারণ। যার উদাহরণ আমাদের এই পুস্তিকার ভূমিকাতে উল্লেখ করেছি।
সুতরাং হক্বের দা‘ওয়াতের পূর্বে নিজেদের পূর্ববতী বিভিন্ন ফিরক্বার উৎস, তাদের ব্যাপারে সাহাবী (রা), মুহাদ্দিস তথা সালাফে-সালেহীনদের ভূমিকাকেওঅবশ্যই মূল্যায়নকরতেহবে।আমাদেরআলোচ্য পুস্তিকাটিতে যদি তাঁদের অবদানগুলোকে সামনে রেখে লেখা হত সেক্ষেত্রে এই শাব্দিক ভুল হবার সম্ভাবনা থাকতো না। নিঃসন্দেহে কুরআন হাদীসই তো মূল। কিন্তু এর প্রকৃত ব্যবহার মুহাদ্দিস ও সালাফে সালেহীনদের প্রদর্শিত পথেই হতে হবে। [. আল্লাহ তাআলা বলেন : وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهَدى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّه مَا تَوَلّى وَنُصْلِه جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا ـ ‘‘আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা কত মন্দ আবাস।’’ [সূরা নিসা : ১১৫ আয়াত]রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : خَيْرُ اُمِّتِىْ قَرْنِىْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ اِنَّ بَعْدَهُمْ قَوْمًا يَّشْهَدُوْنَ وَلاَيُسْتَشْهَدُوْنَ وَيَخُوْنُوْنَ وَلاَيُؤْتَمَنُوْنَ وَيَنْذُرُوْنَ وَلاَ يَفُوْنَ وَيَظْهَرُ فِيْهِمُ السِّمَنُ وفى رواية وَيَحْلِفُوْنَ وَلاَ يُسْتَحْلَفُوْنَ ـ ‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক হল আমার যুগের লোক। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক। তাঁদের পর এমন কিছু লোকের আবির্ভাব হবে, যারা সাক্ষ্য দিবে অথচ তাদের থেকে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। তারা খিয়ানত করবে, তাদের আমানতদারীর উপর বিশ্বাস করা যাবে না। তারা মান্নত করবে, কিন্তু তা পূরণ করবে না। (ভোগ-বিলাসের কারণে) তাদের মধ্যে স্থূলতা প্রকাশ পাবে।’’ অপর বর্ণনায় আছে- ‘‘তারা (অযথা) ক্বসম খাবে, অথচ তাদের থেকে ক্বসম চাওয়া হবে না।’’[সহীহ বুখারী ৩৬৫০, সহীহ মুসলিম ৬৩৬৪ (২১১/২৫৩৩), মিশকাত ৬০১০। হাফিয ইবনু হাজার (রহ) ‘আল-ইসাবা’তে (১/১২) এবং সুয়ূতী (রহ) ‘আল-মানায়ী’তে হাদীসটিকে মুতওয়াতির বলেছেন। আল-কিনানী (রহ) এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন।]] যেমন উসূলে হাদীস ছাড়া হাদীস মূল্যায়ন সম্ভব নয়- আর নিঃসন্দেহে তা মুহাদ্দিসদের প্রদর্শিত পথ। অনুরূপ উসূলে ফিক্বাহ’র বিষয়টিও। পূর্বোক্ত আলোচনায় সালফে সালেহীন প্রদর্শিত উসূলে ফিক্বাহ’র পরিভাষা ও প্রয়োগ থেকে দূরে থাকার কারণেই উক্ত বিচ্যুতি ঘটেছে। তবে নিঃসন্দেহে অনেক মাযহাবভিত্তিক উসূলে ফিক্বাহ সরাসরি কুরআন ও হাদীস বিরোধি। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে সাধারণ বিবেক বিরোধিও বটে। নিঃসন্দেহে এমন উসূলে ফিক্বাহ পরিত্যাজ্য।
সর্বোপরি এটাই উল্লেখ করতে হচেছ যে, সাহাবী (রা), তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও মুহাদ্দিসদের দেখানো পথেই আমাদের কুরআন ও হাদীসকে বুঝতে হবে। হঠাৎ করে কেবল কুরআনের শাব্দিক অনুবাদ বা হাদীসকে ঊহ্য রেখে কোন নতুন আভিভূত ব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য এই পথের অনুসরণ জরুরি। এর আলোকেই মুসলিমদের জন্য পূর্ণ কুরআন ও সহীহ হাদীসের সংকলন ও বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্য রচিত হতে হবে এবং সেগুলোই গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যথায় সালাফে সালেহীনের নির্দেশনাহীন নতুন কোন সাহিত্য বাতিল ফিরক্বার সৃষ্টি বলেই গণ্য হবে। এমনটি হলে সেগুলো থেকে দূরে থাকা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
‘‘আর যারা (মু’মিনরা) দুআতে বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর, যারা আমাদের জন্য চক্ষুশীতলকারী হয় এবং আমাদের মুত্তাক্বীদের জন্য ইমাম বা আদর্শ কর।’’ [. সূরা ফুরক্বান : ৭৪ আয়াত।]
ইমাম বুখারী (রহ) আয়াতটির শেষাংশ- ‘‘আমাদের মুত্তাক্বীদের জন্য ইমাম বা আদর্শ কর’’-এর ব্যাখ্যায় উদ্ধৃতি দিয়েছেন :
قَالَ اَيِمَّةً نَقْتَدِىْ بِمَنْ قَبْلَنَا ، وَيَقْتَدِىْ بِنَا مِنْ بَعْدِنَا
‘‘কেউ বলেছেন : এরূপ ইমাম যে আমরা আমাদের পূর্ববতীদের (হক্বের ব্যাপারে) অনুসরণ করব, আর আমরাদের পরবর্তীরা আমাদের (হক্বের ব্যাপারে) অনুসরণ করবে।’’ [. সহীহ বুখারী- কিতাবুল ই‘তিসাম বিল কিতাব ওয়া সুন্নাহ باب الاقتداء بسنن رسول الله ... হা/৭২৭৫-এর পূর্বে।]
যারা হাদীসের যাচায়-বাছাই পদ্ধতি বা উসূলে হাদীস মানেন তাদেরকে অবশ্যই উক্ত আয়াত ও তার দাবিকে মেনেই চলতে হয়। [. কেননা এটাই মু’মিনদের পথ (সূরা নিসা : ১১৫ আয়াত)] সুতরাং আসুন আমরা আল্লাহ তাআলা’র কাছে প্রার্থনা করি :
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ـ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ـ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
‘‘(হে আল্লাহ!) আপনি আমাদের সিরাতে মুস্তাক্বীমের পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথে যাদের আপনি নিয়ামত দিয়েছেন। তাদের পথে নয়, যারা আপনার গযবপ্রাপ্ত হয়েছে ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।’’ [. সূরা ফাতিহা : ৫-৭ আয়াত।]
১.মাসউদ আহমাদ : ‘‘হাকিম এর অর্থ- এমন হাকিম যাঁর হুকুমাত বা কর্তৃত্ব অনন্ত ও অসীম, যাঁর ইতাআত বা আনুগত্য সীমাহীন ও নিঃশর্ত। যিনি আইনদাতা, যাঁর আইন পূর্ণাঙ্গ এবং অপরিবর্তনশীল। যিনি ইতাআত বা আনুগত্যের একমাত্র দাবিদার (হক্বদার)।’’
তাহক্বীক্ব ১ : আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইলাহ বা মা‘বুদ শব্দটির বৈধ প্রয়োগ কেবল নিজের জন্যই সুনির্দিষ্ট করেছেন। এর বিপরীতে বাতিল ইলাহ’ বা মা‘বুদের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজেকে ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে বৈধ ‘ইলাহ’ বা মা‘বুদ হিসাবে এই শব্দগুলো ব্যবহার করেননি
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
‘‘হে নবী! এদের বলে দিন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার প্রতি অহী আসে যে, একজনই মাত্র তোমাদের ইলাহ।’’ [. সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৬ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
‘‘তোমাদের ইলাহ তো একক ইলাহ, তিনি ছাড়া রহমান (পরম করুণাময়), রহীম (অসীম দয়ালু) কেউ নেই।’’ [. সূরা বাক্বারা : ১৬৩ আয়াত।]
وَاسْأَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ آَلِهَةً يُعْبَدُونَ
‘‘আপনার পূর্বে আমি যেসব রসূল প্রেরণ করেছি, তাদের জিজ্ঞেস করুন, রহমান (আল্লাহ) ছাড়া ইবাদতের জন্য আমি কি কোন ইলাহ নির্দিষ্ট করেছিলাম।’’ [. সূরা যুখরুফ : ৪৫ আয়াত।]
অর্থাৎ সত্যিকারের ইলাহ বা মা‘বুদ স্বয়ং আল্লাহই এবং তিনি এই শব্দ’টির প্রয়োগ অন্য কারো জন্য করেননি। বাতিল ইলাহ বা মা‘বুদের ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যবহার অন্য কোন ইলাহ থাকার প্রমাণ নয়, বরং তাতো বাতিল। উল্লেখ্য ইলাহ অর্থ মা‘বুদ- অর্থাৎ যার ইবাদত করা হয়।
পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলা হাকিম শব্দটি কেবল নিজের জন্যই ব্যবহার করেননি। তিনি মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার বৈধ করেছেন। যেমন রসূলুল্লাহ (স) এর ক্ষেত্রে এই হাকিম শব্দটির প্রয়োগ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে আছে :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
‘‘অতএব আপনার রবের ক্বসম! তারা মু‘মিন হবে না, যতক্ষণ না তাদের সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে হাকিম বলে মনে না করে। অতঃপর আপনার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা থাকবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে ক্ববূল করে নেবে।’’ [. সূরা নিসা : ৬৫ আয়াত।]
সহীহ হাদীসেও হাকিম শব্দটি বিচার-ফায়সালা বা সিদ্ধান্তদাতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ও আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
اِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ وَاَصَابَ فَلَه ও اَجْرَانِ وَاِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ وَاَخْطَأَ فَلَه ও اَجْرٌ وَّاحِدٌ
‘‘যখন কোন হাকিম ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে তখন তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার। পক্ষান্তরে যখন হাকিম ইজতিহাদ করার পরও ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে, তখন তার জন্য একটি পুরস্কার।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭৩৫২, সহীহ মুসলিম ৪৩৭৯ (১৫/১৭১৬), মিশকাত ৩৭৩২]
সুতরাং প্রমাণিত হল, আল্লাহ তাআলা ইলাহ হিসাবে একক দাবিদার। কিন্তু হাকিম শব্দটির প্রয়োগ ইলাহ শব্দটির থেকে আলাদা। তবে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ হাকিম আল্লাহ তাআলা। যেমন আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন :
أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ
‘‘আল্লাহ কি হাকিমদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর হাকিম নন।’’ [. সূরা তীন : ৮ আয়াত।]
সুস্পষ্ট হল, ইলাহ বা মা‘বুদ-এর মধ্যে বৈশিষ্ট্য বা গুণগতভাবে কেউই শরীক নয়। কিন্তু হাকিম শব্দটির ব্যবহার স্রষ্টার সাথে সাথে সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রয়োগযোগ্য। এ পর্যায়ে ইসলামের মূলনীতি হল, সৃষ্টি হাকিমের কোন ফায়সালা যদি স্রষ্টা আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ তাআলা’র বিপরীত হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : لاَطَاعَةَ فِيْ مَعْصِيَةٍ اِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوْفِ ‘‘নাফরমানীর ব্যাপারে ইতাআত নেই। ইতাআত কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৫৭, সহীহ মুসলিম ৪৬৫৯ (৩৯/১৮৪০), মিশকাত ৩৬৬৫] অন্যত্র তিনি (স) বলেন : لاَطَاعَةَ لِمَخْلُوْقْ فِيْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘‘সৃষ্টিকর্তার নাফরমানীর মধ্যে কোন সৃষ্টির ইতাআত নেই।’’ [. সহীহ : শরহে সুন্নাহ, মিশকাত ৩৬৯৬। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত ২/১০৬২ পৃ.]]
কিন্তু ইলাহ বা মা‘বুদ শব্দটি এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই এ শব্দটির হক্বদার নয়। এক্ষেত্রেও প্রমাণিত হল, ইবাদাতের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহই হক্বদার, পক্ষান্তরে মুআমালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ নয় এমন বিষয়ে আমীর বা শাসক, পিতা-মাতা, শিক্ষক, বিচারক, স্বামী, অগ্রজ এদের মানা জায়েয, বরং ক্ষেত্রবিশেষ বাধ্যতামূলক। তবে এগুলো একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য ইবাদত নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশিত স্বতন্ত্র হুকুম পালন। যার মধ্যে আল্লাহর হক্ব ও বান্দার হক্ব উভয়ের সমন্বয় রয়েছে। আর ইবাদত তো কেবলই আল্লাহর হক্ব।
২.মাসউদ আহমাদ : ‘‘আল্লাহ তা্অলা জিন ও মানুষকে নিজের ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘‘আমি মানুষ ও জিনকে কেবলই আমার ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছি।’’ [. সূরা যারিয়াত : ৫৬ আয়াত।]
এখানে ইবাদত দ্বারা কেবল সালাত, সাওম, যিকির ও ওয়াযীফা এর অর্থ নেয়া হলে খুবই জটিলতা দেখা দেবে। কেননা, সেক্ষেত্রে এ আমলগুলো ছাড়া জীবনের অন্যান্য আমলগুলো আল্লাহ তাআলা’র সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য, খাওয়া-পান করা, বিয়ে-শাদী প্রভৃতির অস্তিত্ব থাকবে না। ফলে না দুনিয়াদারী হবে, না ইবাদাত বন্দেগী হবে। সর্বোপরি সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
তাহক্বীক্ব ২ : পাঠক গভীরভাবে আলোচ্য আয়াতটির সাথে এর পরবর্তী আয়াতটিও পাঠ করুন :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ . مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِّزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ
‘‘আমি মানুষ ও জিনকে কেবলই আমার ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে রিযিক চাই না ও খাদ্য-খাবারও চাই না।’’ [. সূরা যারিয়াত :৫৬-৫৭ আয়াত।]
আয়াত দু’টিতে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁর ইবাদত করা এবং মানুষের দুনিয়াবী লেনদেন, আয়-উপার্জনকে পৃথক করেছেন। যা থেকে সুস্পষ্ট হল, ইবাদত কেবল আল্লাহ তাআলা’র জন্য। কিন্তু দুনিয়াবী প্রয়োজনে মানুষকে প্রদত্ত রিযিক, আয়-উপার্জন এগুলো মানুষের জন্য, আর এগুলোতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। এই আয়াত থেকেই ইবাদাত ও মুআমালাতের দলিল পাওয়া গেল। আল্লাহ তাআলা ইবাদাত বন্দেগীর নির্দেশ প্রদানের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী লেনদেন, বিচারকাজ প্রভৃতিরও নির্দেশ প্রদান করেছেন। কিন্তু তিনি ইবাদাতের ব্যাপারে কোন মানবীয় সিদ্ধান্তকে বরদাশত করেননি নবী (স) দ্বীনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত রায় বা মতামত প্রদান সম্পর্কে বলেছেন :
مَنْ اُفْتِىَ بِفُتْيًا غَيْرَ ثَبَتٍ فَاِنَّمَا اِثْمُهُ عَلى مَنْ اَفْتَاهُ
‘‘দলিল-প্রমাণ ব্যতীত কাউকে ফতওয়া দেয়া হলে, তার গুনাহর ভার ফাতাওয়াদাতার উপর বর্তাবে।’’ [. হাসান : ইবনু মাজাহ - باب اتباع سنة رسول الله (ص) [ باب اجتناب الرأى والقياس ] ; আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত ইবনু মাজাহ (রিয়াদ) হা/৫৩]]
কেননা, দ্বীনের এই অংশটি পরিপূর্ণ এবং এর মধ্যে নতুন করে সংযোজন ও বিয়োজনের প্রয়োজন নেই। সুতরাং ‘‘সুস্পষ্ট দলিল নেই তো ফাতাওয়াও নেই।’’
যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ
‘‘আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা।’’ [. সূরা নাহল : ৮৯ আয়াত।]
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ
‘‘আমি এ কিতাবের মধ্যে কোন কিছুরই বর্ণনা বাদ রাখিনি।’’ [. সূরা আনয়াম : ৩৮ আয়াত।]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ
‘‘আজ আমি তোমাদের জন্যে দ্বীনকে পূর্ণতা দান করছি।’’ [. সূরা আলে-ইমরান : ৩ আয়াত।]
দ্বীন পরিপূর্ণ তাই এর মধ্যে সংযোজন ও বিয়োজন নিষিদ্ধ। এ সর্ম্পকে নবী (স) বলেছেন :
مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ নেই তবে তা বাতিল।’’ [. সহীহ মুসলিম ৪৩৮৫ (১৮/১৭১৮), রিয়াদুস সালেহীন ৪/১৬৪৭ নং।]
তিনি (স) অন্যত্র বলেন :
مَنْ اَحْدَثَ فِيْ اَمْرِنَا هذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
‘‘যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীন সম্পর্কে কোন নতুন কথা সৃষ্টি করেছে যা এতে নেই, তবে তা রদ বা প্রত্যাখ্যাত।’’ [. সহীহ বুখারী ২৬৯৭, সহীহ মুসলিম ৪৩৮৪ (১৪/১৭১৮), মিশকাত ১৪০।]
অন্যত্র বলেন :
وَشَرَّ الْاُمُوْرِ مُحْدَثُاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ
‘‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে যা দ্বীন সম্পর্কে নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেক বিদআতই (নুতন সৃষ্টি) গোমরাহী।’’ [. সহীহ : মুসলিম ১৮৯০ (৪৩/৮৬৭), মিশকাত ১৪১]
পক্ষান্তরে দুনিয়াবী লেনদেন, বিচারকাজ প্রভৃতির ক্ষেত্রে মানবীয় সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে নবী (স) বলেছেন :
اِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ وَاَصَابَ فَلَه اَجْرَانِ وَاِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ وَاَخْطَأَ فَلَه ও اَجْرٌ وَّاحِدٌ
‘‘যখন কোন হাকিম ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তখন তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার। পক্ষান্তরে যখন হাকিম ইজতিহাদ করার পরও ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তখন তার জন্য একটি পুরস্কার।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭৩৫২, সহীহ মুসলিম ৪৩৭৯ (১৫/১৭১৬), মিশকাত ৩৭৩২]
তবে শর্ত হল, তা আল্লাহর নির্দেশের বা সীমারেখার বিরোধী হতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
‘‘আর কাজকর্মে ( امر ) তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন।’’ [. সূরা আলে-ইমরান : ১৫৯ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
‘‘এবং তাদের কাজ-কর্ম ( امر ) পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে (সম্পন্ন হয়)।’’ [. সূরা শূরা : ৩৮ আয়াত]
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ
‘‘তোমাদের জন্য যেগুলো হারাম তা তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।’’ [. সূরা আনয়াম : ১১৯ আয়াত]
এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
مَا اَحَلَّ اللهُ فِيْ كِتَابِه فَهُوَ حَلاَلٌ وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَتَ فَاِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا ثُمَّ تَلاَ هذِه الْايَةَ : وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا
‘‘আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তাই হালাল এবং যা হারাম করেছেন তাই হারাম এবং যা থেকে নীরব থেকেছেন তা মাফযোগ্য। সুতরাং যা মাফযোগ্য তা তোমরা আল্লাহ তাআলা’র পক্ষ থেকে গ্রহণ কর। কেননা, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কিছু ভুলেন না।’’ অতঃপর তিলাওয়াত করলেন : ‘‘তোমাদের রব ভুলেন না। [সূরা মারইয়াম : ৬৪]’’ [. সহীহ : হাকিম- কিতাবুত তাফসীর باب سورة مريم । হাকিম এর সনদকে সহীহ বলেছেন। উক্ত মর্মে বাযযার সলেহ সনদে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। [ফতহুল বারী (মাকতাবা মিশর, ১৪২১/২০০১) ১৩/৩৭৮ পৃ.; নায়লুল আওতার (মিশর : দারুল হাদীস ১৪২১/২০০০)৮/৪২৮ পৃ.।]
অন্যত্র নবী (স) বলেছেন :
اِنَّمَا اَنَا بَشَرٌ اِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَىْءٍ مِّنْ اَمْرِ دِيْنِكُمْ فَخُذُوْا بِه وَاِذَا اَمَرْتُكُمْ بِشَىْءٍ مِّنَ رَّائِىْ اَنَا بَشَرٌ
‘‘আমি একজন মানুষ। আমি যখন তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে নির্দেশ দিই, তখন তা তোমরা গ্রহণ করবে, আর আমি যখন আমার রায় অনুসারে তোমাদের কোন বিষয়ে নির্দেশ ( امر ) দিই, তখন আমিও একজন মানুষ।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৬০২১ (১৪০/২৩৬২), মিশকাত ১৪৭।]
অন্যত্র নবী (স) বলেছেন :
دَعُوْنِيْ مَا تَرَكْتُكُمْ
‘‘আমি যেসব বিষয় বর্ণনা না করে তোমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি, সেসব ব্যাপারে আমাকে ছেড়ে দাও।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭২৮৮; আর সহীহ মুসলিম ৩১৪৮ (৪১২/১৩৩৭), মিশকাত ২৫০৫-এ নিচের বাক্যে : ذَرُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ فَإِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِكَثْرَةِ سُؤَالِهِمْ وَاخْتِلَافِهِمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فدَعُوه ‘‘আমাকে ছেড়ে দাও যেটুকু আমি তোমাদের জন্য রেখে যায়। কারণ তোমাদের পূর্বেকার লোকেরা তাদের অধিক প্রশেস্নন কারণে এবং তাদের নবীদের বিরোধিতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অতঃপর আমি তোমাদের যখন কোন কিছু করার নির্দেশ দেই, তোমরা তা যথাসাধ্য পালন কর এবং যখন তোমাদের কোন কিছু করতে নিষেধ করি, তখন তা পরিত্যাগ কর।’’]
উপরোক্ত দলিল প্রমাণগুলো থেকে সুস্পষ্ট হল :
দ্বীন (ইবাদাত অর্থে)
১.সুস্পষ্টভাবে সবকিছু বর্ণিত হয়েছে, কোন অসম্পূর্ণতা, অপূর্ণতা নেই।
২.যা উল্লেখ্য করা হয়নি এবং নতুন সংযোজন এর সবই বিদআত ও গোমরাহী।
৩.নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রে أمر শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪.না জেনে ব্যক্তিগত রায় বা ফাতাওয়া প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ভুলের দায়-দায়িত্ব বর্তাবে।
৫.সম্পূর্ণরূপে মানবীয় মতামত মুক্ত।
দ্বীন (মুআমালাত অর্থে)
১.অনেক বিষয়ে বর্ণনা না করে স্বেচ্ছায় চুপ থেকেছেন বা ছাড় দেয়া হয়েছে।
২.হারাম নয় এমন সবকিছুই বৈধ। এটা ছাড় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কোন কিছু হারাম হবে দলিল দ্বারা।
৩.নির্দেশ প্রদানের ক্ষেত্রে أمر শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
৪.সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ভুল হলেও ধর্তব্য নয়। (অনিচ্ছাকৃত ভুলের ক্ষেত্রে)
৫.ছাড়কৃত বা অনুল্লিখিত স্থানে মতামত বৈধ।
অর্থাৎ সবকিছু আল্লাহর হুকুম হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত পন্থায় পার্থক্য করেছেন, যা বিভিন্ন দলিল প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত। উক্ত পৃথকীকরণের জন্যে আল্লাহ’র সৃষ্টির উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন সংঘাত বা সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় না।
পূর্বে বর্ণিত বিচারের ক্ষেত্রে হাকিমের ইজতিহাদ করার হাদীসটি সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইশতিয়াক (আমীর, জামাআতুল মুসলিমীন) লিখেছেন :
قارئین کرام مندرجہ بالا حدیث میں لفظ ’’ حاکم ‘‘ وارد ہوا ہے ۔ لفظ ’’ عالم ‘‘ نہیں ہے ۔ اس حدیث کا اطلاق حاکم یا بادشاہ وقت یا خلیفۃ المسلمین یا قاضی پر تو ہوتا ہے لکن اس حدیث کا اطلاق کسی عالم پر کر دینا صحیح نہ ہوگا ؛ رسول اللہ ﷺ نے حاکم یا قاضی یا خلیفۃ المسلمین یا امام امیر و غیرہ کو ایک قسم کی آسانی دی ہے ۔ کیونکہ اس کی حکومت یا امارت میں بعض مقدمات ایسے بھی آتے ہیں جو بالکل نئے ہوتے ہیے – ان مقدمۃ پر فیصلہ کرتے وقت اگر حاکم اجتہاد کرتا ہے خواہ فیصلہ صحیح ہو یا غلط تو حاکم کو ہر صورت میں اجر ملے گا یہ بات اس کی نیک نیتی کی وجہ سے کہی گئ ہے ۔
‘‘সম্মানিত পাঠক! উক্ত হাদীসে ‘হাকিম’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, আলিম’ শব্দ নয়। হাদীসটির সম্পর্ক ক্ষমতাসীন বাদশাহ বা খলিফাতুল মুসলিমীন বা কাযীর সাথে। কোন আলিমের সাথে হাদীসটির সম্পৃক্ত করা সংগত নয়। রসূলুল্লাহ (স) কোন হাকিম বা কাযী বা খলিফাতুল মুসলিমীন বা ইমাম প্রমুখ দায়িত্বপ্রাপ্তদের এক ধরনের ছাড় দিয়েছেন। কেননা, তার হুকুমাত বা ইমারতে এমন অনেক মোকাদ্দামা আসে যা সম্পূর্ণ নতুন। এ ধরণের (নিত্য নতুন) মোকাদ্দামা ফায়সালার সময় যদি হাকিম ইজতিহাদ করে, আর যদিওবা তা সঠিক বা ভুল হয় উভয় ক্ষেত্রেই হাকিম সওয়াবের অধিকারী হবে। তার ন্যায়-নীতির কারণে এটি বলা হয়েছে।’’ [. মুহাম্মাদ ইশতিয়াক, তাহক্বীক্বে সালাত বাজাওয়াবে নামাযে মুদাল্লাল (করাচী : জামাআতুল মুসলিমীন, ১৪২২/২০০১) পৃ. ২৯।]
دوسری بات قابل غور يہ ہے کہ حاکم کا فیصلہ جو اس نے فريقين کے درميان کيا ہوگا وہ فیصلہ ہوگا قانون نہیں ہوگا ۔ اس فیصلہ کو شریعت کي حيثيت حاصل نہ ہوگي بلکہ وہ بطور فيصلہ بھي عارضي ہوگا اور ہنگامي طور پر اس کو تسليم کر لیا جاۓ گا ۔ پھر اس حاکم کے بعد دوسرا حاکم اس حکومت کا ولي ہوگا تو وہ اس بات کا مکلف نہیں ہوگا کہ جو فیصلے سابقہ حکومت ميں ہو چکے ہيں وہ ان کے مطابق ہی فیصلہ کرے بلکہ وہ آزاد ہوگا
‘‘অপর একটি দিক গভীরভাবে লক্ষ্য করুন- হাকিমের ফায়সালা, যা তিনি উভয়পক্ষের মধ্যে করে থাকেন সেটাতো কেবলই ফায়সালা, আইন নয়। এই ফায়সালা শরীআতের (আইনের) মর্যাদা অর্জন করে না। বরং এটা তো কেবল ফায়সালা যা তাৎক্ষণিক এবং এটা সুনির্দিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে। অতঃপর এই হাকিমের পরিবর্তে অন্য হাকিম হুকুমাতের অধিকারী হলে তখন সে পূর্বে হুকুমাতে সংঘটিত ফায়সালার অনুগামী হবেন না। বরং তিনি নিজের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই ফায়সালা দিবেন এবং তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’’ [. ঐ পৃ. ২৯-৩০।]
তবে ক্ষেত্র বিশেষে দলিলের ব্যাপকতা বিদ্যমান থাকা সাপেক্ষে ইবাদাতের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন :
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضي الله عنه قَالَ قَالَ النَّبِيُّ ﷺ يَوْمَ الأَحْزَابِ " لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلاَّ فِي بَنِي قُرَيْظَةَ ". فَأَدْرَكَ بَعْضُهُمُ الْعَصْرَ فِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لاَ نُصَلِّي حَتَّى نَأْتِيَهَا . وَقَالَ بَعْضُهُمْ بَلْ نُصَلِّي، لَمْ يُرِدْ مِنَّا ذَلِكَ، فَذُكِرَ ذَلِكَ ﷺ فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ .
ইবনু উমার (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : নবী (স) আহযাব যুদ্ধের দিন (যুদ্ধ শেষে) বললেন : বনূ কুরায়যার মহল্লায় না পৌঁছে কেউ যেন আসরের সালাত আদায় না করে। পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেলে কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে পৌঁছার পূর্বে সালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা এখনই সালাত আদায় করব, কেননা নবী (স)-এর নিষেধাজ্ঞার অর্থ এই নয় যে, রাস্তায় সালাতের সময় হয়ে গেলেও তা আদায় করা যাবে না। বিষয়টি নবী (স)-এর কাছে উত্থাপন করা হলে তিনি তাদের কোন দলের প্রতিই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী- কিতাবুল মাগাযী - باب مرجع النبى صلى الله عليه و سلم من الاحزاب ; সহীহ মুসলিম- কিতাবুল জিহাদ باب جواز قتال من نقض العهد ।]
এই হাদীসটি সম্পর্কে মুহাম্মাদ ইশতিয়াক (আমীর, জামাআতুল মুসলিমীন) লিখেছেন :
صحابہ کرام رضـ دونوں جماعتوں نے قرآن وحديث پر هي عمل كيا ، ايك جماعت نے آيت پر عمل كيا اور دوسري جماعت نے حديث پر عمل كيا يعني ايك جماعت نے حکم عام پر عمل كيا اور دوسری جماعت نے حکم خاص پر عمل كيا ۔ اللہ تعالي فرماتا ہے : إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتا يعني نماز مؤمنين پر اوقات مقررہ پر فرض كي گئ ہے ۔
‘‘সাহাবীদের (রা) উভয় জামাআতই কুরআন ও হাদীসের ওপর আমল করেছেন। একটি পক্ষ কুরআনের আয়াতের ওপর আমল করেছেন, অপর পক্ষ হাদীসের ওপর আমল করেছেন। অর্থাৎ একটি পক্ষ আম হুকুমের উপর আমল করেছেন এবং অপর পক্ষ খাস হুকুমের উপর আমল করেছেন।’’ (আম হুকুমটির স্বপক্ষে) আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন:
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا
‘‘নিশ্চয় মু’মিনদের জন্য নির্দিষ্ট ওয়াক্তে সালাত আদায় করা ফরয করা হয়েছে।’’ [সূরা নিসা : ১০৩ আয়াত] [. মুহাম্মাদ ইশতিয়াক, তাহক্বীক্বে সালাত বাজাওয়াবে নামাযে মুদাল্লাল (করাচী : জামাআতুল মুসলিমীন, ১৪২২/২০০১) পৃ. ২২-২৩।]
মাসউদ আহমাদ (রহ) লিখেছেন :
اس حدیث سے معلوم ہوا کہ جب حکم عام اور حکم خاص میں تضاد نظر آئے تو دونو میں سے کسی بھی حکم پر عمل کیا جا سکتا ہے ۔ اور عقیدہ بھی یہی رکھنا چاہۓ کہ دونو طرح جائز ہے کیونکہ رسول اللہ ﷺ نے کسی کو ناجائز نہیں بتایا ۔ یہ نہیں کہنا چاہۓ کہ فلاں عمل صحیح ہے اور فلاں غلط ، نہ یہ کہے کہ فلاں عمل راجح ہے اور فلاں عمل مرجوح ہے ، کیونکہ رسول اللہ ﷺ نے کسی کو راجح یہ مرجوح نہیں بتایا ۔ اس حدیث سے یہ بات بھی ثابت ہوئی کہ اگر کسی حدیث کا منشائ سمجھنے میں اختلاف ہو جائے تو یہ قابل معافی ہے ، لیکن ایک دوسرے کو برا نہ کہے کیونکہ رسول اللہ ﷺ نے کسی کو برا نہیں کہا ۔ البتہ اختلاف کی بنیاد پر فرقہ بنانا ، یا محض قیاس کی بنیاد پر حدیث کو نہ ماننا یا کسی غیر نبی کی رائے کو حدیث پر ترجیح دینا یہ سب چیزیں اسلام وایمان کے منافی اور شرک کی طرف لے جانے والی ہے ۔
‘‘এই হাদীসটি থেকে সুস্পষ্ট হল, যখন কোন হুকুমে আম ও হুকুমে খাসের মধ্যে কোন দ্বন্দ দেখা দেবে, তখন উভয়ের কোন একটি উপর আমল করা যেতে পারে। তখন এই আক্বীদাও রাখতে হবে যে, উভয়ই জায়েয। কেননা রসূলুল্লাহ (স) এর কোনটিকেই নাজায়েয বলেননি এটাও বলা যাবে না যে, এই আমলটি সহীহ এবং এটি ভুল। কিংবা এটা বলা যাবে না যে, অমুকটি গুরুত্ববহ, আর অমুকটি বেশি প্রাধান্য পাবে। কেননা নবী (স) কোনটিকে এভাবে গুরুত্ববহ বা বেশি প্রাধান্য দেননি এই হাদীসটি থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, কোন হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে যদি ইখতিলাফ হয়েই যায় তবে তা ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু পরস্পরকে খারাপ কিছু বলা যাবে না। কেননা, রসূলুল্লাহ (স) [পূর্বোক্ত হাদীসে] কোন পক্ষকেই খারাপ বলেননি অবশ্য ইখতিলাফের কারণে ফিরক্বা (দল, উপদল বা গোষ্ঠী) বানানো, কেবল ক্বিয়াসের ভিত্তিতে হাদীসকে না মানা। কিংবা কোন অ-নবী ব্যক্তির রায়কে হাদীসের উপর প্রাধান্য দেয়া- এ সমস্ত বিষয় ইসলাম ও ঈমানের দাবির ভিত্তিতে নিষিদ্ধ, যা শিরকের দিকে ধাবিত করে।’’ [. মাসউদ আহমাদ, সহীহ তারিখুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন (করাচী : জামাআতুল মুসলিমীন ১৯৯৫/১৪১৬) পৃ. ৩৩৪-৩৩৫। এই শর্তের আলোকে বিশ্বব্যাপী একই দিনে ঈদ, সিয়াম ও মুসলিমদের দিন, তারিখ ও মাস গণনা করা যায়। এর স্বপক্ষে ‘আম আয়াত নিম্নরূপ :১. আল্লাহ তাআলা বলেন : يَسْئَلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ - قُلْ هِىَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجَّ ‘‘লোকেরা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন : এটা মানুষ ও হজ্জের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নির্দেশক।’’[সূরা বাক্বারা : ১৮৯ আয়াত]আয়াতটি দ্বারা সুস্পষ্ট হয়, মানবজাতির জন্য চাঁদের হিসাবে দিন-তারিখ ও হজ্জের সময় নির্ধারণ একই হতে হবে। যেন তারা সবাই চন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী দিন, মাস ও বছর গণনা এবং হজ্জ, সিয়াম, ‘ঈদ প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো একই সাথে উদযাপন করতে পারে। ‘‘এটা মানুষ ও হজ্জের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় নির্দেশক’’ বক্তব্যের দ্বারা কোন বিশৃঙ্খল দিন-তারিখের হিসাব সৃষ্টি করার মোটেই উদ্দেশ্য নেই, বরং সুশৃঙ্খল দিন-তারিখ ও সময় নির্ধারণই উদ্দেশ্য। সুতরাং আয়াতটির আলোকে এটা সম্পূর্ণ বিবেক ও বাস্তবতা বিরোধী যে, কেবল হজ্জ পালনের ক্ষেত্রেই মুসলিমদের তারিখ এক হবে এবং অন্যান্য ধর্মীয় নির্দেশগুলোর ক্ষেত্রে চাঁদ দর্শনের আঞ্চলিকতাই প্রাধান্য পাবে।২. আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন : هُوَ الَّذِىْ جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُوْرًا وَّقَدَّرَه مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللهُ ذلِكَ اِلاَّ بِالْحَقِّ - يُفَضِّلُ الْآيتِ لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ ‘‘তিনিই (আল্লাহ তাআলা) সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’’ [সূরা ইউনুস : ৫ আয়াত]৩. আল্লাহ তাআলা তাআলা অন্যত্র বলেন : وَجَعَلْنَا الَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيَنِ فَمَحُوْنَا آيَةَ الَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِّتَبْتَغُوْا فَضْلاً مِّنْ رَّبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَالْحِسَابِ ‘‘আমি রাত ও দিনকে করেছি দু’টি নিদর্শন; এরপর রাতের নিদর্শনটি করেছি নিষ্প্রভ আর দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকময়, যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা বছরের সংখ্যা ও হিসাব স্থির করতে পার।’’ [সূরা বানী ইসরাঈল : ১২ আয়াত]তবে এর স্বপক্ষে খাস হাদীসও রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, অন্য এলাকার চাঁদ দেখার খবর বিশ্বস্ত সূত্রে পৌঁছালে সেই অনুযায়ী ঐ এলাকার সাথে ‘ঈদ প্রভৃতি উদযাপন করা যাবে। যেমন : عَنْ أَبِى عُمَيْرِ بِنْ أَنَسٍ عَنْ عُمُوْمَةٍ لَه مِنَ الصَّحَابَةِ اَنَّ رَكْبًا ( وفى رواية فَجَاءَ رَكِبٌ مِنْ آخِرِ النَّهَارِ ) فَشَهِدُوْا أَنَّهُمْ رَأَوُا الْهِلاَلَ بِالْأَمْسِ فَاَمَرَهُمُ النَّبِىُّ ﷺ أَنْ يُّفْطِرُوْا ، وَإِذَا أَصْبَحُوْا أَنْ يَّغْدُوْا إِلَى مَصَلاَّهُمْ ‘‘আবূ ‘উমাইর বিন আনাস (রা) তাঁর চাচাদের [সাহাবীদের (রা)] নিকট থেকে বর্ণনা করেন, একটি কাফেলা (অন্য বর্ণনায়, দিনের শেষভাগে) এসে সাক্ষ্য দিল যে, গতকাল সন্ধ্যায় তারা আকাশে চাঁদ দেখেছে। ফলে নবী (স) তাদের সিয়াম ভঙ্গ (ইফতার) করতে বললেন এবং পরদিন সকালে ‘ঈদের ময়দানে যেতে নির্দেশ দিলেন।’’ [আহমাদ, আবূ দাউদ, বুলূগুল মারাম; এর সনদ সহীহ (অনুবাদ : খলিলুর রহমান বিন ফজলুর রহমান) হা/৪৭৪। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন [তাহক্বীক্বে আবূ দাউদ হা/১১৫৭]ইমাম শওকানী (রহ) এই মাসআলাটির বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন : واذا راه أهل بلد لزم سائر البلاد الْموافقة . أما كونه اذا راه أهل بلد لزم سائر البلاد الْموافقة فوجهه الاحاديث الْمصرحة بالصيام لرؤيته والافطار لرؤيته وهى خطاب لِجميع الامة فمن راه منهم فى أى مكان كان ذالك رؤية لِجميعهم .‘‘যখন কোন শহর বা দেশে চাঁদ দেখা যাবে তখন সমস্ত মুসলিম বিশ্ব এবং প্রত্যেকটি শহরবাসী এর অনুসরণ করবে। কেননা রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : صُوْمُوْا لِرُؤْيَتِه وَافْطِرُوْا لِرُؤْيَتِهِ ‘‘চাঁদ দেখে সিয়াম রাখ এবং চাঁদ দেখে সিয়াম খোল।’’[সহীহ বুখারী ১৯০৯, সহীহ মুসলিম ২৩৮৯ (৪/১০৮০), মিশকাত ১৯৭০] এই হুকুম সমস্ত শহর ও প্রত্যেক দেশের জন্য ‘আম (ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য)। এই হাদীসে কোন শহর বা দেশকে খাস (সুনির্দিষ্ট) করা হয়নি এ কারণে কোন শহর বা দেশে চাঁদ দেখা সমস্ত মুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য।( الدرارى الْمضيئة ২/২০-২১ পৃ.)উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর মোকাবেলায় সহীহ মুসলিমে বর্ণিত সাহাবী ইবনু আব্বাস (রা) এর সংশ্লিষ্ট বর্ণনাটির দাবিকে বিরোধী ভাবা যাবে না। যদি কোন এলাকার কাছে এতটা দীর্ঘ সময় পরে চাঁদ দেখার খবর পৌঁছে যেভাবে ইবনু আব্বাসের কাছে রমাযান মাসের শেষে পৌছেছিল। তাদের ক্ষেত্রে ইবনু আব্বাসের বর্ণনানুযায়ী নিজ এলাকার চাঁদ দেখার ভিত্তিতেই ‘ঈদ, সিয়াম প্রভৃতির আমল নির্ধারিত হবে। পক্ষান্তরে খবরটি যথা সময়ে পৌঁছলে পূর্বোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোর ‘আম দাবি অনুযায়ী বিশ্বের যে কোন প্রামেত্মর বিশ্বস্ত খবর অনুযায়ীই ‘ঈদ, সিয়াম, হজ্জ প্রভৃতির উপর আমল করা যাবে। আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন। [বিস্তারিত : আতাউল্লাহ ডায়রভী, ‘‘ইসলামের নতুন চাঁদের বিধান ও এ সম্পর্কিত বিতর্ক নিরসন’’, অনুবাদ : কামাল আহমাদ]]
৩.মাসউদ আহমাদ : ‘‘সালাত, সিয়াম প্রভৃতি ইবাদাত অবশ্যই জরুরি, কিন্তু সর্বাবস্থায় নয়। যেমন- মাগরিবে তিন রাকআতের বদলে যদি কেউ চার রাকআত পড়ে, তাহলে আভিধানিক অর্থে এটা ইবাদাত হবে কিন্তু শরীআতের পরিভাষায় এটা আল্লাহ তাআলা’র বিরুদ্ধাচরণ হবে। তার সালাত ইবাদাতের মোকাবেলায় অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। ফলে সৃষ্টির উদ্দেশ্যেরই অবসান হবে।
এভাবে যদি কেউ ফজরের সালাতের পরে সূর্যোদয়ের পূর্বে নফল সালাত পড়ে, তাহলে সে ইবাদাতকারী তো বটেই কিন্তু আল্লাহর কাছে সে বিদ্রোহী বা বিরুদ্ধাচারী।
এমনিভাবে যদি কেউ ‘ঈদের দিন সাওম রাখে, তাহলে তার সাওম ইবাদাত হবে না। এভাবে সিয়াম পালনকে সওয়াব বা ইবাদত হিসাবে গণ্যকারী কেবল গুনাহগারই নয়, বরং কাফিরে পরিণত হবে।’’
তাহক্বীক্ব ৩ : আমরা পূর্বে বলেছি, ইবাদাতের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বা হুবহু দলিল প্রমাণ ছাড়া তা বিদআত হিসাবে গণ্য হবে যা বাতিল ও গোমরাহীর নামান্তর। কিন্তু এর সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন, লেনদেন প্রভৃতির ক্ষেত্রে শরীআতের সীমারেখা মেনে চলাটাই হুকুম। অর্থাৎ ইবাদাতের ক্ষেত্রটি সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে হতে হবে। পক্ষান্তরে মুআমালাতের ক্ষেত্রে যা নিষিদ্ধ নয় তা-ই বৈধ। এর উদাহরণ ইবাদাতের মধ্যকার ফরয নির্দেশাবলি তরককারী বা মনগড়া আমলকারী ক্ষেত্র বিশেষে কাফির ও বিদআতী, কিন্তু মুআমালাতের মধ্যকার নির্দেশাবলি অমান্যকারী কাফির নয়। যেমন, আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী শাসকের ক্ষেত্রে নবী (স) বলেছেন :
يَكُوْنُ عَلَيْكُمْ اُمَرَاءُ تَعْرِفُوْنَ وَتُنْكِرُوْنَ فَمَنْ اَنْكَرَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ وَلكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ قَالُوْا اَفَلاَ نُقَاتِلُهُمْ قَالَ لاَ مَا صَلُّوْا ـ
‘‘অচিরেই তোমাদের ওপর এমন সব শাসক নিযুক্ত হবে, যারা ভাল মন্দ উভয় প্রকারের কাজ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাদের মন্দ কাজের প্রতিবাদ করল, সে ব্যক্তি দায়িত্ব হতে মুক্ত হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি মনে মনে উক্ত কাজটিকে খারাপ জানল, সে ব্যক্তিও নিরাপদ হল। কিন্তু যে ব্যক্তি তাদের কাজের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করল এবং উক্ত শাসকের সে (অন্যায়) কাজে আনুগত্য করল (সে গুনাহর মধ্যে নিমজ্জিত হল)। তখন সাহাবীগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করব না? তিনি (স) বললেন : না, যতক্ষণ তারা সালাত পড়ে।’’ [. সহীহ : মুসলিম ৪৬৯৫ (৬৩/১৮৫৪), মিশকাত ৩৬৭১] অন্য বর্ণনায় আছে, لاَ مَا اَقَامُوْا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ ‘‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০] অন্য বর্ণনা আছে, اِلاَّ اَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِّنَ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانَ ‘‘যতক্ষণ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫৬, সহীহ মুসলিম ৪৬৬৫ (৪২/১৭০৯), মিশকাত ৩৬৬৬। হাদীসটি নিযুক্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাদীসের শুরুর বাক্যগুলো থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।]
হুযায়ফা (রা) বলেন :
قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنَّا كُنَّا بِشَرٍّ فَجَاءَ اللهُ بِخَيْرٍ فَنَحْنُ فِيْهِ فَهَلْ مِنْ وَّرَاءِ هَذَا الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ هَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الشَّرِّ خَيْرُ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ فَهَلْ وَرَاءَ ذَالِكَ الْخَيْرِ شَرُّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ كَيْفَ قَالَ يَكُوْنَ بَعْدِيْ اَئِمَّةُ لاَيَهْتَدُوْنَ بِهُدَايَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِيْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالُ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِيْ جُثْمَانِ اِنْسٍ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ اَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنْ اَدْرَكْتُ ذَالِكَ قَالَ تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْاَمِيْرِ وَاِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَاُخِذَمَالُكَ فَاسْمَعْ وَاطِعْ ـ
‘‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে তারপর আল্লাহ আমাদের জন্যে মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ অমঙ্গলের পরে কি আবার কোন মঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, এ মঙ্গলের পরে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেন : হাঁ। আমি বললাম, তা কিভাবে? তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে যারা আমার হিদায়েতে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে না এবং সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যাদের অন্তকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তকরণ; রাবী বলেন, আমি বললাম : তখন আমরা কি করবো, ইয়া রসূলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন : তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেওয়া হয় তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৭৮ (৫১/১৮৪৭), মিশকাত ৫৩৮২]
সুস্পষ্ট হল, সালাত তরককারী কাফির, কিন্তু মুআমালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী সালাতের ন্যায় ইবাদাত ত্যাগ না করলে জালিম হলেও কাফির নয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ নিষিদ্ধ এবং ভাল কাজে তাকে মানতে হবে।
৪.মাসউদ আহমাদ : ‘‘এভাবে শতশত উদাহরণ দেয়া যাবে। ভেবে দেখুন, কেন ইবাদাত বিরুদ্ধাচারণে পরিণত হচ্ছে? যদি আপনি স্বল্প পরিমাণ চিন্তাও করেন, তাহলে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন যে, এর কারণ হল, এ ইবাদাতগুলো আল্লাহ তাআলা’র নির্ধারিত সীমার আওতাভুক্ত ছিল না। এ জন্যেই এগুলো ইবাদাত নয়। এ সমস্ত ইবাদাতে আল্লাহ তাআলা’র বিরুদ্ধাচারণ করা হয়েছে, এর মাধ্যমে ইতাআত বা আনুগত্যের মোকাবেলায় অবাধ্যতা করা হয়েছে। সুতরাং শরীআতি পরিভাষায় এগুলোকে ইবাদাত বলা যায় না।’’
তাহক্বীক্ব ৪ : নিঃসন্দেহে ইবাদাত হতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত সুস্পষ্ট পন্থায়, অন্যথা এটা বিরুদ্ধাচারণে পরিণত হবে। শাব্দিক অর্থে সবকিছুই ইবাদাত ও ইতাআত। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে ইবাদাত ও ইতাআতের মধ্যে সু্স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে যার স্বপক্ষে আমরা পূর্বে প্রমাণ পেশ করেছি।
৫.মাসউদ আহমাদ : ‘‘পূর্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইবাদাত প্রকারান্তরে ইতাআত বা আনুগত্যেরই নাম। নিচের আয়াতটি এ দাবিই সমর্থন করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ
‘‘শয়তানের ইবাদাত করো না।’’ [. সূরা ইয়াসীন : ৬০ আয়াত।]
লক্ষণীয়, কেউ কি শয়তানকে সাজদা করে? তার নামে কুরবানী করে? তার নামে ওয়াযিফা পড়ে? তার নামে দান-খয়রাত করে? কখনোই না। তাহলে এখানে শয়তানের ইবাদাতের উদ্দেশ্যই বা কী? সুস্পষ্ট হল যে, শয়তানের ইবাদাত বলতে এখানে শয়তানের ইতাআত বা আনুগত্যকে বুঝানো হয়েছে। শয়তানের ইতাআত বা আনুগত্যের কারণেই লোকেরা কুফর ও শিরক, অন্যায় ও পাপাচার, গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে নিমজ্জিত হয় এবং সিরাতে মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হয়। এ কারণে পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَأَنِ اعْبُدُونِي هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ
‘‘আমার ইবাদাত কর, এটাই সিরাতে মুস্তাক্বীম।’’ [. সূরা ইয়াসীন : ৬১ আয়াত।]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা শয়তানের ইবাদাতের মোকাবেলায় নিজের ইবাদাতের কথা উল্লেখ্য করেছেন। কেননা, শয়তানের ইবাদাত শয়তানের ইতাআত। সুতরাং আল্লাহ তাআলা’র ইবাদাত আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত।’’
তাহক্বীক্ব ৫ : শাব্দিক অর্থে ইবাদাত ও ইতাআত পরিপূরক হলেও, আভিধানিক অর্থে এদের মধ্যকার পার্থক্যও সুস্পষ্ট, যা পূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। শয়তানের ইবাদাত ও ইতাআত উভয়েরই প্রমাণ পাওয়া যায়। নিচের আয়াতটিতে মূর্তিপূজাকে শয়তানের ইবাদাত হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে :
يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا ـ يَا أَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا ـ قَالَ أَرَاغِبٌ أَنْتَ عَنْ آَلِهَتِي يَا إِبْرَاهِيمُ لَئِنْ لَمْ تَنْتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا
‘‘ [ইবরাহীম (আ) বললেন:] হে আমার পিতা! আপনি শয়তানের ইবাদত করবেন না। শয়তান তো রহমানের (আল্লাহ’র) অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি, আপনাকে রহমানের আযাব স্পর্শ করবে এবং আপনি হবেন শয়তানের বন্ধু। [পিতা] বললো, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী থেকে বিমুখ? যদি বিরত না হও, তবে আমি প্রস্তরাঘাতে অবশ্যই তোমার প্রাণ নাশ করবো; তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট থেকে দূর হয়ে যাও।’’ [. সূরা মারইয়াম : ৪৪-৪৬ আয়াত।]
সুতরাং আল্লাহর ইবাদত ছাড়া অন্যদের ইবাদত করাটাই প্রকারান্তরে শয়তানের ইবাদাত। এর মধ্যে সাজদা, রুকু, নযর-নেয়ায, দুআ বা আহবান করা, সমস্যা দূরকারী হিসাবে চিহ্নিত করা এ সবই অন্তর্ভুক্ত। তেমনি ইবাদাত ও মুআমালাত উভয় ক্ষেত্রেও শয়তানী আমল শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ
‘‘হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক তির নিকৃষ্ট শয়তানী আমল। তাই তোমরা তা বর্জন কর।’’ [. সূরা মায়িদা : ৯০ আয়াত।]
সুতরাং সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত ও ইতাআত শাব্দিক অর্থে এক হলেও পারিভাষিক দাবির ভিত্তিতে এদের মধ্যে স্বতন্ত্রতা আছে। যেমন- ইচ্ছাকৃত সালাত ত্যাগকারী দুনিয়াতে কাফির হিসাবে গণ্য হবে। এ সম্পর্কে নবী (স) বলেছেন :
بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاَةِ
‘‘বান্দার ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হল সালাত তরক করা।’’ [.সহীহ : সহীহ মুসলিম ১৪৮ (১৩৪/৮২), মিশকাত ৫৬৯।]
তিনি অন্যত্র বলেছেন :
بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ وَالْإِيْمَانِ الصَّلاَةِ ، فَإِذَا تَرَكَهَا فَقَدْ اَشْرَكَ
‘‘বান্দার এবং কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত বর্জন করা। কাজেই যখন সে সালাত বর্জন করল, সে শিরক করল।’’ [. সহীহ : হিবতুল্লাহ তাবারী সহীহ সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন [আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশান) ১/৩৭৩ পৃ., হা/৫]। মুহাম্মাদ তামির হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত আত-তারগীব (মিশর : দার ইবনু রজব) ১/৭৯৯ নং।]
পক্ষান্তরে ইচ্ছাকৃত কোন কবীরা গুনাহ করার কারণে ঐ কাজে ব্যস্ত থাকা পর্যন্ত সে ক্ষণিকের জন্য ঈমান হারা হলেও চূড়ান্তভাবে কাফির হিসাবে চিহ্নিত হয় না। এ সম্পর্কে আবূ যার গিফারী (রা) বর্ণনা করেন। আমি একদিন নবী (স) এর কাছে গেলাম, তিনি সাদা কাপড় পরিহিত অবস্থায় ঘুমিয়ে ছিলেন। অতঃপর আবার তাঁর কাছে গেলাম। সে সময় তিনি জেগেছেন। তখন তিনি (স) বললেন :
مَا مِنْ عَبْدٍ قَالَ لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ ثُمَّ مَاتَ عَلى ذَالِكَ اِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ قُلْتُ وَاِنْ زَنى وَاِنْ سَرَقَ قَالَ وَاِنْ زَنى وَاِنْ سَرَقَ
‘‘আল্লাহ’র যে বান্দা এ কথা বলবে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং এর উপর থেকে মারা যাবে সে জান্নাতে যাবে। আমি [আবূ যার (রা)] জিজ্ঞাসা করলাম : যদিও সে যিনা করে ও চুরি করে? নবী (স) বললেন : যদিও সে যিনা করে এবং চুরি করে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৫৮২৭, সহীহ মুসলিম ১৭১ (১৫২/৯৩), মিশকাত ২৬।]
তাছাড়া নবী (স) ঐসব কবীরা গুনাহকারীদের শাফায়াত করবেন যারা শিরক থেকে মুক্ত ছিল। আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
لِكُلِّ نَبِىٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِىٍّ دَعْوَتَه ও وَاِنِّى اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِىْ شَفَاعَةً لِّاُمَّتِىْ اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَهِىَ نَائِلَةٌ اِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَّاتَ مِنْ اُمَّتِىْ لاَيُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا
‘‘প্রত্যেক নবীকে একটি বিশেষ দুআর অধিকার দেয়া হয়েছে যা কবুল করা হয়। প্রত্যেক নবী শীঘ্র শীঘ্র দুনিয়াতেই তাঁর দুআ চেয়েছেন, আর আমি আমার দুআ ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুলতবী রেখেছি আমার উম্মাতের শাফায়াতরূপে। ইনশাআল্লাহ এটা আমার উম্মাতের প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি পৌঁছবে, যে আল্লাহর সাথে কিছুকে শরীক না করে মারা গেছে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৩৭৬ (৩৩৫/১৯৮), মিশকাত ২২২৩।]
অন্যত্র নবী (স) বলেছেন :
شَفَاعَتِىْ لِأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْ أُمَّتِىْ
‘‘আমার শাফায়াত হবে আমার উম্মাতের কবীরা গুনাহগারদের জন্য।’’ [. সহীহ : আবূ দাউদ, বাযযার, তাবারানী, সহীহ ইবনু হিব্বান, বায়হাক্বী, আত-তারগীব (ইফা) ৪/৪৭১ পৃ :, হা/১১০। মুহাম্মাদ তামির হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত আত-তারগীব (মিশর) ৪/৫৩৩৯ নং, পৃ : ২২৫]]
সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত ও মুআমালাতের বিষয়ে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনেই স্বতন্ত্রতা রয়েছে। কেননা পূর্বে বর্ণিত আয়াতে আমরা দেখেছি যে, দেবদেবীর পূজাকে শয়তানের ইবাদাত বলা হয়েছে। আর এতে লিপ্ত ব্যক্তি মুশরিক ও চিরদিনের জন্য জাহান্নামী। পক্ষান্তরে মদ, জুয়া, ব্যভিচার প্রভৃতি হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তি যদি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে তবে সে কেবল কবীরা গুনাহকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে এবং আখিরাতে আযাব ভোগের পর কিংবা নবী (স)-এর শাফায়াতে জান্নাতী হবে। সুতরাং শরীআতের উভয় দিকটির পার্থক্য সুস্পষ্ট। [. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মত প্রণীত- ‘‘কবীরা গুনাহগার মুমিন কি চিরস্থায়ী জাহান্নামী?’’ -আতিফা পাবলিকেশন্স, ঢাকা।]
৬.মাসউদ আহমাদ : ‘‘উপরিউক্ত আয়াত ও পর্যালোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে ইতাআত বা আনুগত্যের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ইতাআত বা আনুগত্য কেবলই আল্লাহ তাআলা’র হক্ব। তিনি যতক্ষণ না অন্য কারো ইতাআত বা আনুগত্যের অনুমতি দিবেন, ততক্ষণ কারো ইতাআত জায়েয নয়। যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ইতাআত (আনুগত্য) করে তাহলে তা শিরক ফিল ইতাআত (আনুগত্যে শিরক) বলে গণ্য হবে। আর শিরকের চেয়ে বড় অন্য আর কোন শিরক নেই, যার দ্বারা জীবনের উদ্দেশ্যই পাল্টে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا
‘‘তোমাদের ইলাহ কেবলই একজন, সুতরাং কেবল তারই অনুগত থাক।’’ [. সূরা হাজ্জ : ৩৪ আয়াত।]
এই ইতাআত বা আনুগত্যের অপর নামই ইসলাম। ইসলাম অর্থ- আল্লাহ তাআলা’র নিকট সমর্পিত বা অনুগত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলা’র আনুগত্য করে সেই মুসলিম। আর যে আল্লাহ’র ইতাআত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে অমুসলিম। সে জীবনের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে বেপরোয়া, সে নিজের স্রষ্টার বিরুদ্ধাচারী এবং তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পিত করতে বক্রতা অবলম্বনকারী।
তাহক্বীক্ব ৬ : নিঃসন্দেহে মুসলিম হিসাবে আল্লাহ’র সমস্ত নির্দেশই পালন করতে হবে। তা আল্লাহর হক্ব বা ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্টই হোক, কিংবা বান্দার হক্ব বা দুনিয়াবী মুআমালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ই হোক। উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর সুনির্দিষ্ট হুকুম ও সীমারেখা লংঘনকারী অমুসলিম। [. যেমন- ‘ইবাদাতে শিরককারী এবং মুআমালাতে হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম সাব্যস্তকারী অমুসলিম তথা কাফির।] এক্ষেত্রে পার্থক্য হল, ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ নিজের সাথে কাউকেই শরীক করেননি পক্ষান্তরে ইতাআত শব্দটি আল্লাহ তাআলা বান্দার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করেছেন, যা নিঃসন্দেহে মুআমালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ সম্পর্কে পূর্বেই দলিল প্রমাণ উল্লেখ্য করেছি।
সম্মানিত লেখক লিখেছেন : ‘‘ইতাআত বা আনুগত্য কেবলই আল্লাহ তাআলা’র হক্ব। তিনি যতক্ষণ না অন্য কারো ইতাআত বা আনুগত্যের অনুমতি দিবেন, ততক্ষণ কারো ইতাআত জায়েয নয়। যদি তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো ইতাআত (আনুগত্য) করে তাহলে তা শিরক ফিল ইতাআত (আনুগত্যে শিরক) বলে গণ্য হবে।’’ -এ পর্যায়ে প্রশ্ন করা চলে, আল্লাহ তাআলা ইতাআতের ন্যায় ইবাদাতের ব্যাপারেও কি নিজেকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাতের অনুমতি দিয়েছেন? এর জবাব হল, না। সুতরাং ইবাদাত ও ইতাআত এক নয়, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন স্ব স্ব প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করাটাই ইসলাম। আল্লাহ তাআলা সত্য বুঝার তাওফিক দিন।
তাছাড়া আমরা পূর্বেই প্রমাণ পেয়েছি যে, ইবাদাতে শিরককারীর হুকুম ও দুনিয়াবী ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর বিধি-বিধানকে স্বীকৃতি দেয়া সাপেক্ষে তাঁরই আইন লঙ্ঘনকারীর হুকুম শরিআতের দৃষ্টিতেই এক নয়। এ কারণে ইতাআতের ক্ষেত্রে হুকুম লঙ্ঘনকারী ও ইবাদাতের ক্ষেত্রে হুকুম লঙ্ঘনকারীরও হুকুম এক হয় না। অথচ সম্মানিত লেখক উভয়টিকেই এক দৃষ্টিতে দেখেছেন। আর এ দৃষ্টিভঙ্গী নিঃসন্দেহে শরীআতী দৃষ্টিভঙ্গী নয়।
৭.মাসউদ আহমাদ : ‘‘ইসলামই একমাত্র জীবন-বিধান যে বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপন করা উচিত। যদি জীবনের সমস্ত কাজকর্ম আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত অনুযায়ী হয়, তাহলে ঐ সমস্ত কাজকর্মও ইবাদাত। যদি সালাত আল্লাহ তাআলা’র হুকুম মোতাবেক আদায় করা হয়, তাহলে সালাতও ইবাদাত। যদি সাওম আল্লাহ তাআলা’র হুকুম মোতাবেক হয়, তাহলে সাওমও ইবাদাত। যদি ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহ তাআলা’র হুকুম মোতাবেক হয়, তাহলে এটাও আল্লাহর ইবাদাত। এভাবে জীবনের সমস্ত চলাফেরা, শোয়া-ঘুমানো, উঠা-বসা, খাওয়া-পড়া, বিয়ে-শাদী, লেনদেন, তালাক-মুক্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হিংসা-শত্রুতা, বন্ধুত্ব-সহমর্মিতা প্রভৃতি যদি আল্লাহ তাআলা’র হুকুম-আহকাম মোতাবেক হয়ে থাকে; তাহলে এ সবই ইবাদাত। এভাবে সমস্ত জীবনের কাজকর্মই ইবাদাতে পরিণত হবে।
রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
اِنَّكَ لاَ تَنْفِقَ نَفْقَةً تَبْتَغِىْ بِهَا وَجْهَ اللهِ اِلاَّ اُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتّى مَا تَجْعَلُ فِىْ فَمِ امْرَاَتِك
‘‘তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা-ই খরচ কর না কেন, তোমাকে তার সওয়াব অবশ্যই দেয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে (খাদ্যের) লোকমা তুলে দাও, তাও।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী - কিতাবুল ঈমান باب ما جاء ان الاعمال بالنية والحسبة ।]
তাহক্বীক্ব ৭ : আল্লাহর নির্দেশ পালন মাত্রই সওয়াব রয়েছে। তা আল্লাহর হক্ব বা ইবাদাতের ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা বান্দার হক্ব বা দুনিয়াবী লেনদেনের ক্ষেত্রেই হোক। আর পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাব্দিক অর্থে ইবাদাত ও ইতাআত পরিপূরক হলেও পারিভাষিকভাবে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং পরিভাষার আলোকে ইবাদাত ও ইতাআত শব্দগুলোর নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার থাকা উচিৎ। ইবাদাত ও ইতাআত উভয়টিই আল্লাহর হুকুম এবং অবশ্য পালনীয়।
৮.মাসউদ আহমাদ : ‘‘আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত (আনুগত্য) তাঁর বিধি-বিধান আমল করার মধ্যে নিহিত। এই বিধানদাতাও স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ
‘‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্যে দ্বীনি শরীআত (বিধান) দিয়েছেন।’’ [. সূরা শূরা : ১৩ আয়াত।]
আইন প্রদানের ক্ষেত্রে কেউই আল্লাহ তাআলা’র শরীক নয়। এ বিধান প্রদানের বিষয়টি কেবলই খালেস (নির্ভেজাল) ভাবে আল্লাহ তাআলা’র জন্য। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ
‘‘সাবধান! খালেস (নির্ভেজাল) দ্বীন কেবলই আল্লাহর জন্য।’’ [. সূরা যুমার : ৩ আয়াত।]
সুতরাং দ্বীনের মধ্যে অন্য কারো অংশ নেই। অন্য কাউকে বিধানদাতা মানা, তার তৈরীকৃত বিধান দ্বীনের মধ্যে সংযোজন, তার ইজতিহাদ-ক্বিয়াস ও ফাতাওয়াকে দ্বীনি বিষয় বিবেচনা করাটাই হল আল্লাহর সাথে শিরক করা। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে :
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ
‘‘তারা কি এমন কাউকে (আল্লাহ’র) শরীক স্থির করে, যে তাদের জন্য দ্বীনি বিধান তৈরী করে? অথচ আল্লাহ তাদেরকে এ ব্যাপারে অনুমতি দেননি’’ [. সূরা শূরা : ২১ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন :
وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
‘‘আল্লাহ তাআলা হুকুমে কাউকে শরীক করো না।’’ [. সূরা কাহাফ : ২৬ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা কারো অংশীদারীত্ব ছাড়া স্বয়ং একাকী-ই হুকুমদাতা। তাঁর হুকুম-আহকামে কেউ-ই শরীক নেই। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে :
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ
‘‘হুকুম কেবলই আল্লাহ তাআলা’র, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করো না।’’ [. সূরা ইউসূফ : ৪০ আয়াত।]
তাহক্বীক্ব ৮ : উম্মাতের মধ্যে উপরোক্ত আয়াতগুলো ইবাদাত ও মুআমালাত উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু আয়াতগুলোর পূর্বাপর সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রমাণিত হবে যে, আয়াতগুলো দাবি ইবাদাতের ক্ষেত্রেই বেশী পরিপূরক। নিচে আমরা উপরোক্ত ক্রমানুসারেই এর বিবরণ উল্লেখ করলাম।
১.প্রথমে উল্লিখিত আয়াতটির পূর্ণ বর্ণনা হল :
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ
‘‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনি শরীআত দিয়েছেন। যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে, আর যা আমি অহী করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীনকে ক্বায়েম কর এবং তাতে ইখতিলাফ (মতভেদ) করো না। আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহবান করেছেন তা তাদের নিকট দুর্বল মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং তাঁর অভিমুখী, তাকে দ্বীনের দিকে পরিচালিত করেন।’’ [. সূরা শূরা : ১৩ আয়াত।]
‘‘আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহবান করেছেন’’ -আয়াতাংশটির ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত আয়াতটিতে রয়েছে। আর তা হল :
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুতকে বর্জন কর।’’ [. সূরা নাহল : ৩৬ আয়াত।]
সুতরাং সুস্পষ্ট হল, দ্বীন ক্বায়েমের দাবির মধ্যে সর্বাগ্রে যে দাবিটি প্রাধান্য পায়- তা হল, আল্লাহর ইবাদাত ও তাগুতকে বর্জন করা। তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা মুআমালাতের (রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক) ক্ষেত্রে যেসব আইন দিয়েছেন তাও দ্বীন ক্বায়েমের দাবির মধ্যে গণ্য। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন :
هُوَ الَّذِيْ اَرْسَلَ رَسُوْلَه ও بِالْهُدي وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَه عَلي الدِّيْنِ كُلِّه لا وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكِيْنَ
‘‘তিনিই তাঁর রসূলকে হিদায়াত ও দ্বীনকে হক্বসহ প্রেরণ করেছেন। যেন সব দ্বীনের উপর তা প্রভাবশালী হয়। যদিও মুশরিকদের কাছে তা অপছন্দনীয়।’’ [. সূরা সফ : ৯ আয়াত।]
২.দ্বিতীয় আয়াতটির পূর্ণ বর্ণনা লক্ষ্য করুন :
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
‘‘সাবধান! খালেস (নির্ভেজাল) দ্বীন কেবলই আল্লাহ’র জন্য। যারা আল্লাহ’র পরিবর্তে অন্যকে অলীরূপে গ্রহণ করে, তারা তো বলে- আমরা তো এগুলোর ইবাদাত এজন্যে করি যে, এরা আমাদের আল্লাহ’র সান্নিধ্যে এনে দেবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে ইখতিলাফ (মতভেদ) করছে, আল্লাহ তার ফায়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’ [. সূরা যুমার : ৩ আয়াত।]
আয়াতটি যে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর হক্ব তথা ইবাদাতের জন্য এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে নিঃসন্দেহে আয়াতটির প্রথমাংশ ‘‘সাবধান! খালেস (নির্ভেজাল) দ্বীন কেবলই আল্লাহ’র জন্য’’ -এর দাবি আম বা ব্যাপকার্থক। যা ইবাদাত ও মুআমালাত উভয়টিকেই সম্পৃক্ত করে। কিন্তু এর মধ্যে ইবাদাতের দাবিই সর্বাগ্রে। কেননা ইবাদাত কেবলই আল্লাহর জন্যে হয় আর মুআমালাতের মাঝে আল্লাহ ও বান্দা উভয়েরই হক্ব রয়েছে।
৩.তৃতীয় আয়াতটি লক্ষ্য করুন :
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘তারা কি এমন কাউকে (আল্লাহ’র) শরীক স্থির করে, যে তাদের জন্য দ্বীনি বিধান তৈরি করে? অথচ আল্লাহ তাদেরকে এ ব্যাপারে অনুমতি দেননি ফায়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে তো সিদ্ধান্ত হয়েই যেত। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব।’’ [. সূরা শূরা : ২১ আয়াত।]
লক্ষণীয় যে, ইবাদাতের ক্ষেত্রেই আল্লাহ তাআলা নিজের সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে :
وَاعْبُدُوا اللهَ وَلاَ تُشْرِكُوْا بِه شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا وَّبِذِي الْقُرْبي وَالْيَتمي وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِي الْقُرْبي وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَاِبْنِ السَّبِيْلِ لا وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ
‘‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, আর তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও।’’ [. সূরা নিসা : ৩৬ আয়াত।]
সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত কেবলই আল্লাহর জন্য। মানুষের প্রতি সদাচরণ, লেনদেন প্রভৃতি স্বতন্ত্র বিষয়। এটাও আল্লাহর হুকুম এবং এ ক্ষেত্রে ইতাআত ও মুআমালাত শব্দটি প্রযোজ্য। কেননা আল্লাহর অনুমতিক্রমে বান্দার ইতাআত বৈধ। কিন্তু ইবাদাত সম্পূর্ণরূপে এর বিপরীত। আল্লাহ তাআলা কোথাও বান্দার ইবাদাতের অনুমতি দেননি
৪.চতুর্থ আয়াতটির সম্পূর্ণ বর্ণনা লক্ষ করুন :
قُلِ اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثُوا لَهُ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَبْصِرْ بِهِ وَأَسْمِعْ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا
‘‘বলুন! তারা (আসহাবে কাহফ) কতকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভাল জানেন। আসমান ও যমীনের গায়েবী বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে আছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন এবং শোনেন। তিনি ব্যতীত তাদের কোন অলী বা সাহায্যকারী নাই। তিনি কাউকে নিজের হুকুমে (কর্তৃত্বে) শরীক করেন না।’’ [. সূরা কাহফ : ২৬ আয়াত।]
এই আয়াতটির শুরুতে আল্লাহ তাআলা’র কয়েকটি সিফাত (গুণাবলি)-এর বর্ণনা এসেছে যা আক্বীদাগত ইবাদাত তথা তাওহীদের সাথে জড়িত। এ সমস্ত বিষয়ে কেউই আল্লাহ তাআলা’র কর্তৃত্বে শরীক নয়- এটাই আয়াতের দাবি। তবে মুআমালাতের ক্ষেত্রেও আল্লাহর হুকুমই প্রাধান্য প্রাপ্ত। কেননা আল্লাহ যা হালাল বা হারাম করেছেন, তাকে কেউ হারাম বা হালাল গণ্যকারী নিঃসন্দেহে কাফির ও মুশরিক। তবে আয়াতটির মূল দাবি প্রকৃতিতে আল্লাহ’র ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে প্রকাশ করা, যা তাওহীদ বা আক্বীদাগত ইবাদাতের সাথে সম্পৃক্ত।
৫.পঞ্চম আয়াতটির পূর্ণাঙ্গ অংশের দিকে লক্ষ্য করুন :
مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি হুকুম চলবে কেবল আল্লাহ’র। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করো না। এটাই দ্বীনুল ক্বাইয়েম। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’’ [. সূরা ইউসূফ : ৪০ আয়াত।]
আয়াতটির পূর্বাপর দাবি থেকে সুস্পষ্ট হয়, এটাও ইবাদাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া কোন আমীর, এমন কি পিতা-মাতার বিরোধী হুকুমও কার্যকরী নয়। কেননা, ইবাদাত করা হয় কেবল আল্লাহর হুকুমে। পক্ষান্তরে ইতাআতও আল্লাহর হুকুমে করা হলেও ইবাদাত কেবল আল্লাহরই হক্ব। অপরপক্ষে ইতাআত আল্লাহ ও বান্দা উভয়েরই হক্ব, আল্লাহরই অনুমতিক্রমে।
সম্মানিত পাঠক! লক্ষ্য করুন, আয়াতগুলোর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা আয়াতগুলোর মূল শিক্ষা থেকে কি আমাদের বঞ্চিত করছে না? আল্লাহ সত্য বুঝার তাওফিক্ব দিন।
সম্মানিত লেখকের পরবর্তী দলিল-প্রমাণ ও বক্তব্যগুলো মুআমালাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর ইতাআত বা আনুগত্যের সুন্দর আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে।
৯.মাসউদ আহমাদ : ‘‘হালাল, হারাম করার এখতিয়ার কেবলই আল্লাহ তাআলা’র। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ
‘‘তোমাদের মুখ থেকে বেফাঁসভাবে মিথ্যারোপ করে বলো না যে, এটা হালাল, এটা হারাম। এটাতো আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ।’’ [. সূরা নাহল : ১১৬ আয়াত।]
সুতরাং উলামাদের ফাতাওয়াতে কোন কিছুই হালাল বা হারাম হয় না। কেননা হালাল কেবল ঐ জিনিস যা আল্লাহ তাআলা হালাল করেছেন। আর হারাম কেবল ঐ জিনিস যা আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন।
কাযী বা বিচারকের ফায়সালা দ্বারাও কোন কিছু হালাল বা হারাম হতে পারে না। কাযীর ফায়সালা কেবলই ফায়সালা, এটা কোন বিধান হতে পারে না। যদি তার ফায়সালা সহীহ হয় তবে তা উত্তম বিষয়, আর যদি সহীহ না হয় তবে তা প্রত্যাখ্যাত। যদি ভুলক্রমে তা জারি হয়ে যায়, তাহলে সেটা সাময়িকভাবে হবে। ঐ কাযীই অনুরূপ অন্য একটি বিচারে ভিন্ন ফায়সালা দিতে পারে। কাযীর ফায়সালা চিরস্থায়ী বিধানের মর্যাদা পাবে না। চিরস্থায়ী বিধান কেবল আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান। যে এ বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে সে মুসলিম, যে তার বিপরীত ফায়সালা করে সে অমুসলিম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘যারা আল্লাহ’র নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই কাফির।’’ [. সূরা মায়িদা : ৪৪ আয়াত।]
তাহক্বীক্ব ৯ : আল্লাহ তাআলা’র হালালকৃত বিষয়কে হারাম এবং হারামকৃত বিষয়টি হালাল গণ্যকারী কাফির। কেননা সে আল্লাহ’র প্রদত্ত বিধানের বিকৃতি করেছে। পক্ষান্তরে আল্লাহ’র বিধান অনুযায়ী ফায়সালার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব, অবিচার প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তি জালিম ও ফাসিক্বে পরিণত হয়, তাকে কাফির বা অমুসলিম বলা যাবে না। যেমন- আল্লাহর বিধান ও রসূলের (স) সুন্নাত অমান্যকারী শাসকের ক্ষেত্রে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
يَكُوْنَ بَعْدِيْ اَئِمَّةُ لاَيَهْتَدُوْنَ بِهُدَايَ وَلاَ يَسْتَنُّوْنَ بِسُنَّتِيْ وَسَيَقُوْمُ فِيْهِمْ رِجَالُ قُلُوْبُهُمْ قُلُوْبُ الشَّيَاطِيْنِ فِيْ جُثْمَانِ اِنْسٍ قَالَ قُلْتُ كَيْفَ اَصْنَعُ يَا رَسُوْلَ اللهِ اِنْ اَدْرَكْتُ ذَالِكَ قَالَ تَسْمَعُ وَتُطِيْعُ لِلْاَمِيْرِ وَاِنْ ضُرِبَ ظَهْرُكَ وَاُخِذَمَالُكَ فَاسْمَعْ وَاطِعْ
‘‘আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে যারা আমার হিদায়েতে হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে না এবং সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। অচিরেই তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে যাদের অন্তঃকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তঃকরণ; রাবী বলেন, আমি বললাম : তখন আমরা কি করবো, ইয়া রসূলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন হই? বললেন : তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সম্পদ কেড়েও নেয়া হয় তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৭৮ (৫১/১৮৪৭), মিশকাত ৫৩৮২]
লক্ষণীয়, উক্ত মানবিক যুলুম ও হক্ব নষ্ট হওয়ার পরেও হিদায়াত ও সুন্নাত বিমুখ শাসকের আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে ইবাদাতের ক্ষেত্রে হেরফেরকারী শাসকের আনুগত্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, নবী (স) বলেন :
سَيَلِي أُمُورَكُمْ بَعْدِي رِجَالٌ يُطْفِئُونَ السُّنَّةَ وَيَعْمَلُونَ بِالْبِدْعَةِ وَيُؤَخِّرُونَ الصَّلَاةَ عَنْ مَوَاقِيتِهَا فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنْ أَدْرَكْتُهُمْ كَيْفَ أَفْعَلُ قَالَ تَسْأَلُنِي يَا ابْنَ أُمِّ عَبْدٍ كَيْفَ تَفْعَلُ لَا طَاعَةَ لِمَنْ عَصَى اللَّهَ .
‘‘অচিরেই আমার পরে এমন সব লোক তোমাদের আমীর (নেতা) হবে, যারা সুন্নাতকে মিটিয়ে দেবে এবং বিদআতের অনুসরণ করবে এবং সালাত নির্দিষ্ট ওয়াক্ত থেকে পিছিয়ে দেবে। আমি তখন বললাম : ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! আমি যদি তাদের পাই, তবে কি করবো? তিনি বললেন : হে উম্মু আবদের পুত্র! তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছো যে, তুমি কি করবে? যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যচারণ করে, তার আনুগত্য করবে না।’’ [. সহীহ :ইবনু মাজাহ- কিতাবুল জিহাদ باب لا داعة فى معصية الله ; আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৫]]
অর্থাৎ ইবাদাত বিকৃত হলে সেক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করা যাবে না। এ ধরনের শাসকদের ব্যাপারে নবী (স)-কে সাহাবীগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (স)! এমতাবস্থায় আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করব না? তিনি (স) বললেন : না, যতক্ষণ তারা সালাত পড়ে।’’ [. সহীহ : মুসলিম ৪৬৯৫ (৬৩/১৮৫৪), মিশকাত ৩৬৭১।] অন্য বর্ণনায় আছে, لاَ مَا اَقَامُوْا فِيْكُمُ الصَّلاَةَ ‘‘না, যতক্ষণ তারা তোমাদের মধ্যে সালাত ক্বায়েম রাখে।’’ [. সহীহ : সহীহ মুসলিম ৪৬৯৯(৬৬/ ১৮৫৫), মিশকাত ৩৬৭০।] অন্য বর্ণনা আছে, اِلاَّ اَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِّنَ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانَ ‘‘যতক্ষণ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল থাকবে।’’ [. সহীহ : সহীহ বুখারী ৭০৫৬, সহীহ মুসলিম ৪৬৬৫ (৪২/১৭০৯), মিশকাত ৩৬৬৬। হাদীসটি নিযুক্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হাদীসের শুরুর বাক্যগুলো থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।]
এ পর্যায়ে লক্ষণীয় যে, কেবল কুরআনের আয়াতের আলোকে এ ধরনের শাসককে শাব্দিকভাবে কাফির হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। পক্ষান্তরে কুরআন ও সহীহ হাদীস উভয়টির সমন্বয়ে করলে এই সিদ্ধান্তই পাওয়া যায় যে, আল্লাহ’র তাওহীদ বা ইবাদাতে ত্রুটিকারী শাসক কাফির হলেও, মুআমালাতের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিষিদ্ধ বরং সব নেক কাজে তার ইতাআত ওয়াজিব। তবে মুআমালাতের ক্ষেত্রেও আল্লাহ’র হারামকৃত জিনিসকে হালাল বা হালালকৃত জিনিসকে হারাম গণ্যকারী বা ঘোষণাকারী শাসক কাফির। কেননা হালাল ও হারামের অধিকারী কেবলই আল্লাহ। ঐ সব শাসকরা যদি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন চালাতো তবে কি নবী (স) তাদেরকে নিকৃষ্ট শাসক হিসাবে চিহ্নিত করতেন? কক্ষণো না। পক্ষান্তরে তাদের সালাত তরক করা কিংবা প্রকাশ্য কুফরী পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ব্যবহারের অনুমতি প্রদান থেকে সুস্পষ্ট হয়- শরীআত এ পর্যায়ে আল্লাহর হক্ব (ইবাদাত) ও বান্দার হক্বের (মুআমালাতের) মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি করেছে।
১০.মাসউদ আহমাদ : ‘‘কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান অনুসরণ করতে হবে। এটাই প্রকৃত তাওহীদ। অন্য কিছুর অনুসরণ করা হারাম। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন :
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ
‘‘ঐ বিধানের অনুসরণ কর যা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে, এছাড়া কোন আওলিয়াদের অনুসরণ করো না।’’ [. সূরা আ‘রাফ : ৩ আয়াত।]
আল্লাহ তাআলা’র বিধান সর্বদাই চূড়ান্ত। কারো ফাতাওয়া বা রায়কে চূড়ান্ত বিধানের মর্যাদা দেয়া শিরক। আহলে কিতাবরাও (ইয়াহুদী, নাসারাও) মুসলিমদের এ আক্বীদার সাথে ঐকমত্য ছিল। এ আক্বীদা থেকে বিচ্যুতির কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দিয়েছেন। এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে :
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
‘‘বলুন, হে আহলে কিতাব! একটি বিষয়ের দিকে আস- যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করব না, তাঁর সাথে কোন শিরক করব না, এবং নিজেদের মধ্যকার একে অপরকে আল্লাহ’র পরিবর্তে রব হিসাবে গণ্য করব না।’’ [. সূরা আল-ইমরান : ৬৪ আয়াত।]
এ আক্বীদাতে একমত হওয়া সত্ত্বেও তারা আমলগত শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত হল। আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কাউকে নিজেদের রব হিসাবে না মানার আক্বীদা রাখা সত্ত্বেও, তারা নিজেদের উলামা ও দরবেশদের রব বানিয়ে রেখেছিল।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা নিজেদের আলেম ও দরবেশদের আল্লাহকে ছেড়ে রব বানিয়ে রেখেছে এবং ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও। অথচ তিনি তাদের এ হুকুম দিয়েছিলেন যে, ঐ একক সত্তার ইবাদাত (অর্থাৎ এক হাকিমের ইতাআত) কর। তিনি ছাড়া আর কোন হাকিম নেই। (কিন্তু তারা এর উপর দৃঢ় থাকে নি, তারা আলেম ও দরবেশদেরকে হাকিম বানিয়ে শিরক করে।) তিনি তাদের শিরক থেকে পবিত্র।’’ [. সূরা তাওবা : ৩১ আয়াত। এই আয়াতের অনুবাদে লেখক ইলাহ বা মা‘বুদ এবং হাকিমকে একই অর্থে গ্রহণ করেছেন। অথচ আল্লাহ তাআলা হাকিম শব্দটি মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলেও ইলাহ বা মা‘বুদ শব্দটির সহীহ প্রয়োগ হিসাবে এককভাবে নিজেকেই সম্পৃক্ত করেছেন। সুতরাং পারিভাষিকভাবে ইলাহ ও হাকিমের মধ্যে পার্থক্য থাকায় অনুবাদটি হবে নিম্নরূপ :‘‘তারা নিজেদের আলেম ও দরবেশদেরকে আল্লাহকে ছেড়ে রব বানিয়ে রেখেছে এবং ‘ঈসা ইবনু মারইয়ামকেও। অথচ তিনি তাদেরকে এ নির্দেশ ( امر ) দিয়েছিলেন যে, ঐ একক সত্তার ‘ইবাদাত কর। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি তাদের শিরকে থেকে পবিত্র।’’]
সার-সংক্ষেপ : হাকিম কেবলই আল্লাহ তাআলা, ইতাআত (আনুগত্য) কেবলই আল্লাহ তাআলা’র হক্ব। চূড়ান্ত বিধান কেবল আল্লাহ তাআলা’র নির্দেশাবলি। অন্যান্যদের ইতাআতের হক্বদার মানা, তাদের রায় ও ফাতওয়াকে চূড়ান্ত বিধান গণ্য করাটাই আল্লাহ’র সাথে শিরক করা। এটাকে শিরক ফিল ইবাদাত (ইবাদাতে শিরক)-ও বলা হয়। তাছাড়া শিরক ফিল হুকুম (আদেশ পালনে শিরক) এবং শিরক ফিত্তাশরি‘য়ী (বিধি-বিধানে শিরক)-ও বলা হয়।
তাহক্বীক্ব ১০ : ইবাদাত বা মুআমালাত উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ’র প্রদত্ত বিধানের মোকাবেলায় যে কোন মানবীয় বিধানকে পরিপূরক বা আন্তরিকভাবে মেনে নেয়াটাও শিরক। পার্থক্য এতটুকুই যে, ইবাদাত শব্দটির ক্ষেত্রে স্বয়ং আল্লাহ একক দাবিদার, আর অন্য কেউ-ই। পক্ষান্তরে মুআমালাতের ক্ষেত্রে ইতাআত শব্দটির প্রয়োগে আল্লাহ তাআলা তাঁর নির্দেশের বিরোধী না হলে অন্যদের যেমন- আমির, পিতামাতা, বয়োজৈষ্ঠ, স্বামী প্রমুখের ইতাআত করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। তেমনি হাকিম শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইতাআত শব্দটি প্রযোজ্য। কিন্তু ইবাদাত শব্দটি শাব্দিক অর্থে একই হলেও পারিভাষিকভাবে এর দাবি কেবলই আল্লাহর। কোন আমির, পিতামাতা, বয়োজৈষ্ঠ, স্বামী কেউই এর হক্বদার নয়। যেমন নবী (স) বলেছেন :
لَوْ كُنْتَ آمُرُ اَحَدًا اَنْ يَّسْجُدَ لِاَحَد لَّاَمَرْتُ الْمَرْأَةَ اَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا
‘‘যদি আমি (আল্লাহ ছাড়া) কাউকে সাজদার করার নির্দেশ দিতাম, তবে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সাজদা করার।’’ [. সহীহ : তিরমিযী ১১৫৯, মিশকাত ৩২৫৫। অনেক সাক্ষ্য থাকায় আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত (বৈরুত) ২/৯৭২ পৃ., হা/৩২৫৫]]
এই হাদীসটিতে সাজদার ন্যায় ইবাদাতের কাজটি যে স্বামীর ক্ষেত্রে হারাম তা সুস্পষ্ট হয়েছে। পক্ষান্তরে স্বামীর ক্ষেত্রে ইতাআত শব্দটি খুব প্রাঞ্জলভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন :
اَلْمَرْآةُ اِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا وَصَامَتْ شَهْرَهَا وَاَحْصَنَتْ فَرْجَهَا وَاَطَاعَتْ بَعْلَهَا فَلْتَدْخُلْ مِنْ اَىِّ اَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ ـ
‘‘স্ত্রীলোক যখন তার প্রতি নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্তের সালাত আদায় করবে, রমাযান মাসের সিয়াম পালন করবে এবং নিজের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে ও স্বামীর ইতাআত করবে- তখন সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা চাইবে প্রবেশ করতে পারবে।’’ [. হাসান : আবূ নুআইম- হিলইয়া, মিশকাত ৩২৫৪। অনেক সাক্ষ্য থাকায় আলবানী হাদীসটিকে হাসান বা সহীহ বলেছেন। [তাহক্বীক্বকৃত মিশকাত (বৈরুত) ২/৯৭২ পৃ., হা/৩২৫৪]]
সুতরাং সুস্পষ্ট হল, ইবাদাত ও ইতাআত শব্দ দু’টি আভিধানিক অর্থে পরিপূরক হলেও, পারিভাষিকভাবে এদের পার্থক্য সুস্পষ্ট। উভয়টির একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ। কিন্তু ইবাদাত কেবল তাঁরই জন্য এবং ইতাআত তাঁর অনুমতিতে ও সীমারেখার মধ্যে মানুষেরও করা জায়েয বরং ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্যতামূলক। পরবর্তী অংশে এই কথাই উল্লেখ হয়েছে।
১১.মাসউদ আহমাদ : ‘‘আল্লাহ তাআলা-ই প্রকৃত হাকিম (হুকুমদাতা)। আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত (আনুগত্য) চিরন্তন ও চিরস্থায়ী, নিঃশর্ত ও সীমাহীন। আল্লাহ তাআলা’র ইতাআত ভাষা ও স্থানের মধ্যে সুনির্দিষ্ট নয়। আল্লাহ তাআলা’র ইতাআতেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
কেননা, আল্লাহ তাআলা-ই প্রকৃত ইতাআতের হক্বদার। সুতরাং অন্য কারো ইতাআত কেবল ঐসব ক্ষেত্রে অবশ্যই করতে হবে, যখন ঐ ইতাআতের হুকুম স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দেন। আল্লাহ তাআলা নিজের হুকুম-আহকাম যথাযথ পালনের সুবিধার্থে রসূলদের ইতাআতও ফরয করেছেন। সুতরাং আল্লাহর হুকুমে রসূলদের ইতাআতও ফরয।
জামাআতুল মুসলিমনের দা‘ওয়াত : আসুন আমরা সবাই মিলে আল্লাহকে হাকিম মেনে নিই। হাকিমিয়্যাত (সার্বভৌমত্ব) কেবল আল্লাহ তাআলা’র জন্যেই নির্ধারিত। কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলা’র নাযিলকৃত বিধান মেনে চলি। আল্লাহ তাআলা’র বিধান হিসাবে কেবল কুরআন ও হাদীসই সুরক্ষিত। কুরআন ও হাদীস আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। এ দু’টি জিনিসের মধ্যে আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। এই দু’টি জিনিসকেই আমরা অবশ্যপালনীয় মনে করি। দল বা ফিরক্বা ভিত্তিক মাযহাবকে ত্যাগ করি, ফিরক্বাবন্দীর অবসান করি। আল্লাহ তাআলা এক। তাঁকে একমাত্র হাকিম বা হুকুমদাতা মেনে নিয়ে এক হয়ে যাই।
জামাআতুল মুসলিমীনের দা‘ওয়াত ক্ববুল করুন এবং এর সহযোগী/সহযোদ্ধা হোন
তাহক্বীক্ব ১১ : উক্ত বক্তব্যের প্রয়োজনীয় সংস্কার আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। শেষাবধি আবারও লক্ষ্য করুন, এখানে রসূলের ইতাআতকে ফরয করা হয়েছে- আর নিঃসন্দেহে তা ফরয। কিন্তু কোনক্রমেই এটা কি বলা যাবে যে, রসূলের ইবাদাত করাও ফরয- কখনো না। অর্থাৎ ইবাদাত কেবল আল্লাহ‘রই হক্ব এবং এর মধ্যে আর কেউ-ই শরীক নয়। কিন্তু ইতাআত আল্লাহ‘র হুকুমে বা অনুমতিতে অন্যদেরও হক্ব। সুতরাং পারিভাষিকভাবে ইবাদাত ও ইতাআতের পার্থক্য সুস্পষ্ট। এই পৃথকীকরণের অস্পষ্টতার কারণে অধিকাংশ মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চল ও দল ভেদে রূঢ় বা বিদ্রোহী আচরণের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। কেবল শাব্দিকভাবে কুরআনকে প্রাধান্য দান ও হাদীসের দাবিকে সেগুলোর সাথে মিলিয়ে সমন্বয় করার মাধ্যমে উক্ত ভারসাম্যহীন আচরণ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। অন্যথায় কেবল শাব্দিকভাবে কুরআন পাঠ ও এর সাধারণ বুঝ কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন দল, উপদল বা ফিরক্বার জন্ম নিচ্ছে, তেমনি সাধারণ জনগণ হচ্ছে বিভ্রান্ত। ইতোপূর্বে মুসলিমদের থেকে যেসব ফিরক্বার জন্ম হয়েছে তাদের প্রত্যেকের পৃথকীকরণের মূলেও ছিল এই একই কারণ। যার উদাহরণ আমাদের এই পুস্তিকার ভূমিকাতে উল্লেখ করেছি।
সুতরাং হক্বের দা‘ওয়াতের পূর্বে নিজেদের পূর্ববতী বিভিন্ন ফিরক্বার উৎস, তাদের ব্যাপারে সাহাবী (রা), মুহাদ্দিস তথা সালাফে-সালেহীনদের ভূমিকাকেওঅবশ্যই মূল্যায়নকরতেহবে।আমাদেরআলোচ্য পুস্তিকাটিতে যদি তাঁদের অবদানগুলোকে সামনে রেখে লেখা হত সেক্ষেত্রে এই শাব্দিক ভুল হবার সম্ভাবনা থাকতো না। নিঃসন্দেহে কুরআন হাদীসই তো মূল। কিন্তু এর প্রকৃত ব্যবহার মুহাদ্দিস ও সালাফে সালেহীনদের প্রদর্শিত পথেই হতে হবে। [. আল্লাহ তাআলা বলেন : وَمَنْ يُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهَدى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّه مَا تَوَلّى وَنُصْلِه جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا ـ ‘‘আর যে ব্যক্তি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাঁর নিকট হিদায়াত সুস্পষ্ট হওয়ার পর এবং মু’মিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে সে যেদিকে ফিরে যায়, সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা কত মন্দ আবাস।’’ [সূরা নিসা : ১১৫ আয়াত]রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন : خَيْرُ اُمِّتِىْ قَرْنِىْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ اِنَّ بَعْدَهُمْ قَوْمًا يَّشْهَدُوْنَ وَلاَيُسْتَشْهَدُوْنَ وَيَخُوْنُوْنَ وَلاَيُؤْتَمَنُوْنَ وَيَنْذُرُوْنَ وَلاَ يَفُوْنَ وَيَظْهَرُ فِيْهِمُ السِّمَنُ وفى رواية وَيَحْلِفُوْنَ وَلاَ يُسْتَحْلَفُوْنَ ـ ‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে সর্বোত্তম লোক হল আমার যুগের লোক। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক। তাঁদের পর এমন কিছু লোকের আবির্ভাব হবে, যারা সাক্ষ্য দিবে অথচ তাদের থেকে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না। তারা খিয়ানত করবে, তাদের আমানতদারীর উপর বিশ্বাস করা যাবে না। তারা মান্নত করবে, কিন্তু তা পূরণ করবে না। (ভোগ-বিলাসের কারণে) তাদের মধ্যে স্থূলতা প্রকাশ পাবে।’’ অপর বর্ণনায় আছে- ‘‘তারা (অযথা) ক্বসম খাবে, অথচ তাদের থেকে ক্বসম চাওয়া হবে না।’’[সহীহ বুখারী ৩৬৫০, সহীহ মুসলিম ৬৩৬৪ (২১১/২৫৩৩), মিশকাত ৬০১০। হাফিয ইবনু হাজার (রহ) ‘আল-ইসাবা’তে (১/১২) এবং সুয়ূতী (রহ) ‘আল-মানায়ী’তে হাদীসটিকে মুতওয়াতির বলেছেন। আল-কিনানী (রহ) এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন।]] যেমন উসূলে হাদীস ছাড়া হাদীস মূল্যায়ন সম্ভব নয়- আর নিঃসন্দেহে তা মুহাদ্দিসদের প্রদর্শিত পথ। অনুরূপ উসূলে ফিক্বাহ’র বিষয়টিও। পূর্বোক্ত আলোচনায় সালফে সালেহীন প্রদর্শিত উসূলে ফিক্বাহ’র পরিভাষা ও প্রয়োগ থেকে দূরে থাকার কারণেই উক্ত বিচ্যুতি ঘটেছে। তবে নিঃসন্দেহে অনেক মাযহাবভিত্তিক উসূলে ফিক্বাহ সরাসরি কুরআন ও হাদীস বিরোধি। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে সাধারণ বিবেক বিরোধিও বটে। নিঃসন্দেহে এমন উসূলে ফিক্বাহ পরিত্যাজ্য।
সর্বোপরি এটাই উল্লেখ করতে হচেছ যে, সাহাবী (রা), তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও মুহাদ্দিসদের দেখানো পথেই আমাদের কুরআন ও হাদীসকে বুঝতে হবে। হঠাৎ করে কেবল কুরআনের শাব্দিক অনুবাদ বা হাদীসকে ঊহ্য রেখে কোন নতুন আভিভূত ব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য এই পথের অনুসরণ জরুরি। এর আলোকেই মুসলিমদের জন্য পূর্ণ কুরআন ও সহীহ হাদীসের সংকলন ও বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্য রচিত হতে হবে এবং সেগুলোই গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যথায় সালাফে সালেহীনের নির্দেশনাহীন নতুন কোন সাহিত্য বাতিল ফিরক্বার সৃষ্টি বলেই গণ্য হবে। এমনটি হলে সেগুলো থেকে দূরে থাকা জরুরি। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
‘‘আর যারা (মু’মিনরা) দুআতে বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর, যারা আমাদের জন্য চক্ষুশীতলকারী হয় এবং আমাদের মুত্তাক্বীদের জন্য ইমাম বা আদর্শ কর।’’ [. সূরা ফুরক্বান : ৭৪ আয়াত।]
ইমাম বুখারী (রহ) আয়াতটির শেষাংশ- ‘‘আমাদের মুত্তাক্বীদের জন্য ইমাম বা আদর্শ কর’’-এর ব্যাখ্যায় উদ্ধৃতি দিয়েছেন :
قَالَ اَيِمَّةً نَقْتَدِىْ بِمَنْ قَبْلَنَا ، وَيَقْتَدِىْ بِنَا مِنْ بَعْدِنَا
‘‘কেউ বলেছেন : এরূপ ইমাম যে আমরা আমাদের পূর্ববতীদের (হক্বের ব্যাপারে) অনুসরণ করব, আর আমরাদের পরবর্তীরা আমাদের (হক্বের ব্যাপারে) অনুসরণ করবে।’’ [. সহীহ বুখারী- কিতাবুল ই‘তিসাম বিল কিতাব ওয়া সুন্নাহ باب الاقتداء بسنن رسول الله ... হা/৭২৭৫-এর পূর্বে।]
যারা হাদীসের যাচায়-বাছাই পদ্ধতি বা উসূলে হাদীস মানেন তাদেরকে অবশ্যই উক্ত আয়াত ও তার দাবিকে মেনেই চলতে হয়। [. কেননা এটাই মু’মিনদের পথ (সূরা নিসা : ১১৫ আয়াত)] সুতরাং আসুন আমরা আল্লাহ তাআলা’র কাছে প্রার্থনা করি :
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ـ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ـ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ
‘‘(হে আল্লাহ!) আপনি আমাদের সিরাতে মুস্তাক্বীমের পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথে যাদের আপনি নিয়ামত দিয়েছেন। তাদের পথে নয়, যারা আপনার গযবপ্রাপ্ত হয়েছে ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।’’ [. সূরা ফাতিহা : ৫-৭ আয়াত।]
রিডিং সেটিংস
Bangla
System
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
সাপোর্ট করুন