hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ

লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী

১০
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: অমুসলিমরা কি মুসলিমদের স্বীকৃতি দেয়?
উপরের অধ্যায়ে আলোচ্য সকল শ্রেণির অমুসলিমদের প্রতি রাসূলের স্বীকৃতি দান ও সদাচরণের এতগুলো দৃষ্টান্তের পর এবং সকল আকীদাগত মতপার্থক্য অতিক্রম করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাদেরকে বরণ ও গ্রহণ করে নেওয়ার ব্যাপক প্রমানাদি উপস্থাপনের পর এখন আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই যে, অমুসলিমরা কি রাসূল কিংবা মুসলিমদেরকে স্বীকার করে?!

মুসলিমদেরকে স্বীকৃতি প্রদানে ইয়াহূদীদের অবস্থান:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের অবস্থান কিরূপ ছিল এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁর আবির্ভাবের সুচনা লগ্ন থেকেই মিথ্যাচার, বিরুদ্ধাচরণ ও অস্বীকারই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইয়াহূদীদের মূল চেতনা। অথচ সকল প্রকার প্রামাণ্যচিত্র ও তথ্যাবলি এ কথারই দাবী রাখে যে, ইয়াহূদীরা রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর প্রচারিত দীন সম্পর্কে তাঁর মক্কী জীবনেই সম্যক অবগত ছিল।

ইয়াহূদীদের এ মানসিকতার পরিচ্ছন্ন ধারনা লাভের জন্য তাদের স্বজাতীয় গবেষক “ইসরাঈল ওয়ালফানসুন” এর সংকলনটি খুবই অগ্রগণ্য বিবেচনা করা হয়: (যদিও আমরা তার অনেক মতের সাথে সহমত পোষণ করি না তথাপি তার এ সংকলনটির শুদ্ধতায় কারো ভিন্নমতো নেই)

“ইসরাঈল ওয়ালফানসুন” [. “ইসরাঈল ওয়ালফানসুন” মিশরের ডক্টর ত্বহা হোসাইনের তত্থাবধানে ‘আরব বিশ্বে ইয়াহূদী’ বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনকারী একজন ইয়াহুদী আলোচক।] তার গবেষনায় উল্লেখ করেন “আমি এ ধারণা পোষণ করি যে, নিশ্চয় ইয়াহূদীরা ইসলামের উত্থান সম্পর্কে কখনই উদাসীন এবং অজ্ঞ ছিল না। কেননা এটি তাদের ঐক্য, বাণিজ্য এবং রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বিশেষতঃ রাসূলের মক্কী জীবনের শেষ দিনগুলোতে দাওয়াতে ইসলামীয়ার মহান ডাক মদীনা অভিমুখে ধেয়ে আসা, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বিদ্যমান এতো তীব্র বিদ্ধেষ- যে অত্র গোত্রের অপর দুই শাখা বুনু নাযীর ও বনু কুরাইজার দলপতিগণকে মুসলিমদের কর্মকাণ্ডের ওপর পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করা হলো- থাকা সত্যেও খাযরাজ গোত্রের নেতৃবৃন্দগণের রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা, মদীনায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গোপনীয়তা অবলম্বন না করা, (যেমন, মাস‘আব ইবন উমাইর [. মাস‘আব ইবনু উমাইর: তিনি বদর ও ওহুদ যদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মদীনায় দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলন।] সকলের গোত্রের মধ্যমণীত অবস্থান করেও প্রকাশ্যে লোকদরকে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি আহ্বান করতেন) এবং হজের মৌসুমে ইয়াহূদী বনীকগণের মুসলিমদের সাথে মিলিত হয়ে বাণিজ্য সম্পাদন করার পরও এ দাবী খুবই অযৌক্তিক যে, ইয়াহূদীরা মুসলিম সম্পদায় সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না।” [. ওয়ালফানসুন প্রণীত গ্রন্থ “জাহেলী যুগ ও ইসলামের আবির্ভাবকালীন আরব বিশ্বে ইয়াহুদীদের ইতিহাস” পৃষ্ঠা নং ১০৬-১০৮।]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কী জীবনে অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতেও ইয়াহূদী গবেষক ‘ওয়ালফানসুনের’ এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। কারণ, আয়াতে সুস্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, বনী ইসরাঈলের ‘আলেমগণ রাসূলের সত্যতা সম্পর্কে খুব ভালোরূপে অবগত ছিল। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে বলেন,

﴿أَوَ لَمۡ يَكُن لَّهُمۡ ءَايَةً أَن يَعۡلَمَهُۥ عُلَمَٰٓؤُاْ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ١٩٧﴾ [ الشعراء : ١٩٧ ]

“এটা কি তাদের জন্য একটা নিদর্শন নয় যে, বনী ইসরাঈলের পণ্ডিতগণ তা জানে?” [সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১৯৭]

কাজেই মক্কার মুশরিকদের জন্য এটি একটি নিদর্শন ছিল। কেননা তারা ইয়াহূদী ‘আলেমদের কাছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করে তার ব্যাপারে জানতে চাইলে ইয়াহূদী ‘আলেমগণ তাদের কিতাবে হুবহু বর্ণনাটিই খুঁজে পেল। অতএব, এ কথায় আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইয়াহূদীরা খুব ভালো করেই চিনতে পেরেছিল যে, এ সেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার ব্যাপারে নিজেদের কিতাবে পড়ে তার আগমনের জন্য অপেক্ষ্যমান ছিল।

বিখ্যাত তাবে‘ঈ ইবন ইসহাক [. আবু বকর মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক ইবন ইয়াসার, তিনি আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাক্ষাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বিখ্যাত তাবেয়ী, মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ আত্বা ইবন আবি রাব্বাহ ও ইবন শিহাব যুহরী রহ. থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। ১৫১ হিজরীতে মারা যান। অধিকতর জানতে দেখুন- ইমাম যাহাবী রচিত গ্রন্থ আল-কাশেফ: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৬।] এ ব্যাপারে যে বর্ণনাটি পেশ করেছেন তাতে বিষয়ের সত্যতা আরো তরান্বিত হয়। তিনি বর্ণনা করেন যে, কুরাইশরা নযর ইবন হারেছ এবং উকবাহ ইবন আবী মু‘ঈতকে মদীনার ইয়াহূদী পণ্ডিতদের কাছে প্রেরণ করল, যেন তারা নিজেদের (কুরাইশ) মধ্যে প্রেরিত এ ব্যক্তি (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জন্য কিছু প্রশ্ন জেনে যায়। তখন ইয়াহূদী পণ্ডিতগণ ঐ দু’জনকে তাওরাত কিতাবে বর্ণিত এমন কয়েকটি বিষয় শিখিয়ে দিলেন, যেগুলো কোনো নবী ছাড়া অন্য কেউ জানবে না। অতঃপর ঐ দুই কুরাইশী ব্যক্তি ইয়াহূদী পণ্ডিত থেকে শিখে আসা প্রশ্নসমূহ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উত্থাপন করল। তখন তিনি তাওরাত কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিলেন।

এ ঘটনাটিই ছিল সূরা কাহাফ অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট [. ইবন হিশাম রচিত গ্রন্থ আস-সীরাতুন্নববীয়্যাহ: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১০-২১১ ও আল্লামা ইবনু কাসীরের ‘তাফসীরুল কুরআনিল কারীম’ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৮।]। আর এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবী হওয়ার সত্যতাও সকলের সামনে পরিস্কার হয়ে যায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلۡأُمِّيَّ ٱلَّذِي يَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ﴾ [ الاعراف : ١٥٧ ]

“যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী; যার গুণাবলী তারা নিজেদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭]

উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবন কাসীর [. ইমাদুদ্দীন আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু উমার ইবনু কাসীর আল-করাইশী আদ-দামেশকী আল-শাফেঈ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ইমাম, হাফিজুল হাদীস ও বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। ৭০০ হিজরীতে দামেশকের আল মুজদিল এলাকায় জন্ম গ্রহন করেন। ‘তাফসীরুল কুরআনিল কারীম’, ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ তার রচিত অমর গ্রন্থ। অধিকতর জানতে দেখুন: ইবন তুগরী বুরদী রচিত আন-নুজুমুজ যাহেরাহ।] রহ. অনেকগুলো বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন, যেগুলোর দ্বারা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে, ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কী জীবনেই তাঁর সত্যতা সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল।

এ সকল প্রামাণিক বিষয়াদি এ কথারই গুরুত্বারোপ করে যে, ইয়াহূদীরা তাদের কিতাব তাওরাতের বিবরণ মতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে বিদ্যমান গুণাবলী সম্পর্কে মোটেও অনবহিত ছিল না; বরং তারা তো সেই যমানায় রাসুলের আবির্ভাবের অপেক্ষায় অপেক্ষমান ছিল। অতঃপর কালের আবর্তে দিনাতিপাত হলো এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করলেন। মদীনায় হিজরতের সূচনালগ্ন থেকেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাসাধ্য ইয়াহূদীদের নৈকট্য অর্জন বা নৈকট্যে আনয়নে সচেষ্ট ছিলেন। কারণ তারাও আসমানী কিতাবধারী। এ কারণে ইয়াহূদীদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়েও তিনি প্রত্যাশী ছিলেন।

আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ইয়াহূদীদের নৈকট্য কামনা শুধু জাগতিক প্রয়োজনের কিছু চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়; বরং এ নৈকট্য কামনা ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ শর‘ঈ বিধানের বাস্তায়ন চেষ্টা। বিশেষতঃ ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিধান ‘সালাত’ ও ‘সাওম’ পালনে মুসলিমদের সাথে তাদের সাদৃশ্যতা ছিল।

আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদানী জীবনের প্রাথমিক দিনগুলো পর্যন্ত মুসলিমদের কিবলা ছিল ফিলিস্তিনে অবস্থিত ‘বাতুল মুক্বাদ্দাস’ যা হিজরতের পর একটানা ১৬/১৭ মাস পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল অথচ পূর্ববর্তী সকল আম্বিয়াসহ ইয়াহূদীদেরও কিবলা ছিল এ ‘বাতুল মুক্বাদ্দাস’। আর ‘সিয়াম’ পালনে ইয়াহূদীদের সাথে সাদৃশ্য হওয়া বলতে আশুরা দিনের সাওম উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কারণ, এ দিনে ইয়াহূদী ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় সাওম পালন করে।

ইয়াহূদীরা এ বিষয়ে সম্যক অবগত ছিল যে, চলমান সময়ই হচ্ছে আখেরী যামানার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমনের পূর্ব ঘোষিত সময় এবং তারা এ কথাও খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিল যে, এ মুহাম্মাদই হচ্ছেন সেই শেষ রাসূল যার সম্পর্কে তারা তাওরাতে জানতে পেরেছিল। কেননা শেষ রাসূল সম্পর্কে তাদের কিতাবে বর্ণিত সকল নিদর্শন ও সু-সংবাদ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে সমন্বিত হয়েছিল। শুধু তাই নয় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে খুব বিনম্র ও হৃদয়গ্রাহী আচরণ করতেন। এতো কিছুর পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পর ইয়াহূদীরা তাঁকে প্রত্যাখ্যানের কী কারণ থাকতে পারে?!

বাস্তবিক অবস্থা ছিল ইয়াহূদীদের মধ্য থেকে মাত্র কিছু সংখ্যক লোক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীকার করেছিল। বাকী বৃহৎ অংশ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ ও তাঁকে অস্বীকার করার ব্যাপারে একেবারে লজ্জাস্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের এহেন হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ঘটনা হচ্ছে ইয়াহূদীদের পণ্ডিত আব্দুল্লাহ ইবন সালামের ইসলাম গ্রহণের সময় তাদের উদ্ভট আচরণ। যেমন,

ইয়াহূদী পণ্ডিত আব্দুল্লাহ ইবন সালাম [. আব্দুল্লাহ ইবন সালাম ইবন হারেস আল আনসারী। নবী ইউসুফ ইবন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর সন্তানদের একজন। তিনি আনসারগণের খুব ভালো মিত্র ছিলেন। জাহেলী যুগে তার নাম ছিল হুসাইন। অতঃপর তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নাম রাখলেন আব্দুল্লাহ। ৪৩ হিজরীতে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। অধিকতর জানতে দেখুন: আল্লামা ইবন হাজার আসকালানীর আল এসাবাহ (৪৭২৫), আবু আসীরের আসাদুল গাবাহ (৩/১৭৬), আল ইসতি‘আব: (২/৩৮২)] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সুদৃঢ় ধারনা লাভের জন্য তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল,

«إِنِّي سَائِلُكَ عَنْ ثَلاَثٍ لاَ يَعْلَمُهُنَّ إِلَّا نَبِيٌّ قَالَ : مَا أَوَّلُ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ؟ وَمَا أَوَّلُ طَعَامٍ يَأْكُلُهُ أَهْلُ الجَنَّةِ؟ وَمِنْ أَيِّ شَيْءٍ يَنْزِعُ الوَلَدُ إِلَى أَبِيهِ؟ وَمِنْ أَيِّ شَيْءٍ يَنْزِعُ إِلَى أَخْوَالِهِ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «خَبَّرَنِي بِهِنَّ آنِفًا جِبْرِيلُ» قَالَ : فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ ذَاكَ عَدُوُّ اليَهُودِ مِنَ المَلاَئِكَةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " أَمَّا أَوَّلُ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ فَنَارٌ تَحْشُرُ النَّاسَ مِنَ المَشْرِقِ إِلَى المَغْرِبِ، وَأَمَّا أَوَّلُ طَعَامٍ يَأْكُلُهُ أَهْلُ الجَنَّةِ فَزِيَادَةُ كَبِدِ حُوتٍ، وَأَمَّا الشَّبَهُ فِي الوَلَدِ : فَإِنَّ الرَّجُلَ إِذَا غَشِيَ المَرْأَةَ فَسَبَقَهَا مَاؤُهُ كَانَ الشَّبَهُ لَهُ، وَإِذَا سَبَقَ مَاؤُهَا كَانَ الشَّبَهُ لَهَا " قَالَ : أَشْهَدُ أَنَّكَ رَسُولُ اللَّهِ، ثُمَّ قَالَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ اليَهُودَ قَوْمٌ بُهُتٌ، إِنْ عَلِمُوا بِإِسْلاَمِي قَبْلَ أَنْ تَسْأَلَهُمْ بَهَتُونِي عِنْدَكَ، فَجَاءَتِ اليَهُودُ وَدَخَلَ عَبْدُ اللَّهِ البَيْتَ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «أَيُّ رَجُلٍ فِيكُمْ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَلاَمٍ» قَالُوا أَعْلَمُنَا، وَابْنُ أَعْلَمِنَا، وَأَخْيَرُنَا، وَابْنُ أَخْيَرِنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «أَفَرَأَيْتُمْ إِنْ أَسْلَمَ عَبْدُ اللَّهِ» قَالُوا : أَعَاذَهُ اللَّهُ مِنْ ذَلِكَ، فَخَرَجَ عَبْدُ اللَّهِ إِلَيْهِمْ فَقَالَ : أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، فَقَالُوا : شَرُّنَا، وَابْنُ شَرِّنَا، وَوَقَعُوا فِيهِ» .

“আমি আপনাকে এমন তিনটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাই যার উত্তর নবী ছাড়া আর কেউ অবগত নয়। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন কী? আর সর্বপ্রথম খাবার কী, যা জান্নাতবাসী খাবে? আর কী কারণে সন্তান তার পিতার সাদৃশ্য লাভ করে? আর কিসের কারণে (কোনো কোনো সময়) তার মামাদের সাদৃশ্য হয়? তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এইমাত্র জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। (বর্ণনাকারী বলেন) তখন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, সে তো ফিরিশতাগণের মধ্যে ইয়াহূদীদের শত্রু। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন হলো আগুন, যা মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে তাড়িয়ে নিয়ে একত্রিত করবে। আর প্রথম খাবার যা জান্নাতবাসীরা খাবেন তা হলো মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। আর সন্তান সদৃশ হওয়ার রহস্য হলো পুরুষ যখন তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্যের পূর্বে স্খলিত হয় তখন সন্তান তার সাদৃশ্যতা লাভ করে। তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি-নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রাসূল। এরপর তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইয়াহূদীরা অপবাদ ও কুৎসা রটনাকারী সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করার পূর্বে তারা যদি আমার ইসলাম গ্রহণের বিষয় জেনে ফেলে, তাহলে তারা আপনার কাছে আমার কুৎসা রটনা করবে। তারপর ইয়াহূদীরা এলো এবং আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ঘরে প্রবেশ করলেন (লুকিয়ে গেলেন)। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন সালাম কেমন লোক? তারা বলল, তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি এবং সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যাক্তির পুত্র। তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যাক্তি এবং সর্বোত্তম ব্যাক্তির পুত্র। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি আব্দুল্লাহ ইসলাম গ্রহণ করে, এতে তোমাদের অভিমত কী হবে? তারা বলল, এর থেকে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করুন। এমন সময় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাদের সামনে বের হয়ে আসলেন এবং বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তখন তারা বলতে লাগল, সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাক্তির সন্তান এবং তারা তাঁর গীবত ও কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয়ে গেল।” [সহীহ বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, হাদীস নং ৩১৫১ এবং কিতাবুল ফাযায়েল, হাদীস নং ৩৭২৩।]

মূলত ইয়াহূদীদের এ ধরনের উদ্ভট আচরণের আসল কারণ ছিল কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সরাসরি মহা সত্য থেকে প্রত্যাবর্তন করা। শুধুমাত্র মহা সত্যকে অস্বীকার করার জন্যই তাদের এ অস্বীকার।

প্রিয় পাঠক ইয়াহূদীদের এরূপ ঘটনার বিবরণ আমরা আরো দেখতে পাই যখন তাদের একটি দল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা ও জ্ঞানের গভীরতা যাচাই কার জন্য কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করল এবং জবাব শোনার পর এগুলো যুক্তিহীন, তুচ্ছ ও অবান্তর প্রমাণ বলে বাহানা করল যেন রাসূলের সত্যতাকে স্বীকার করে নিতে না হয়। যেমন,

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أَقْبَلَتْ يَهُودُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالُوا : يَا أَبَا الْقَاسِمِ إِنَّا نَسْأَلُكَ عَنْ خَمْسَةِ أَشْيَاءَ، فَإِنْ أَنْبَأْتَنَا بِهِنَّ، عَرَفْنَا أَنَّكَ نَبِيٌّ وَاتَّبَعْنَاكَ، فَأَخَذَ عَلَيْهِمْ مَا أَخَذَ إِسْرَائِيلُ عَلَى بَنِيهِ، إِذْ قَالُوا : اللَّهُ عَلَى مَا نَقُولُ وَكِيلٌ، قَالَ : «هَاتُوا» قَالُوا : أَخْبِرْنَا عَنْ عَلامَةِ النَّبِيِّ، قَالَ : «تَنَامُ عَيْنَاهُ، وَلا يَنَامُ قَلْبُهُ» قَالُوا : أَخْبِرْنَا كَيْفَ تُؤَنِّثُ الْمَرْأَةُ، وَكَيْفَ تُذْكِرُ؟ قَالَ : «يَلْتَقِي الْمَاءَانِ، فَإِذَا عَلَا مَاءُ الرَّجُلِ مَاءَ الْمَرْأَةِ أَذْكَرَتْ، وَإِذَا عَلَا مَاءُ الْمَرْأَةِ مَاءَ الرَّجُلِ آنَثَتْ» قَالُوا : أَخْبِرْنَا مَا حَرَّمَ إِسْرَائِيلُ عَلَى نَفْسِهِ؟ قَالَ : " كَانَ يَشْتَكِي عِرْقَ النَّسَا، فَلَمْ يَجِدْ شَيْئًا يُلائِمُهُ إِلا أَلْبَانَ كَذَا وَكَذَا - قَالَ أَبِي : " قَالَ بَعْضُهُمْ : يَعْنِي الْإِبِلَ «فَحَرَّمَ لُحُومَهَا»، قَالُوا : صَدَقْتَ، قَالُوا : أَخْبِرْنَا مَا هَذَا الرَّعْدُ؟ قَالَ : «مَلَكٌ مِنْ مَلائِكَةِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مُوَكَّلٌ بِالسَّحَابِ بِيَدِهِ - أَوْ فِي يَدِهِ - مِخْرَاقٌ مِنْ نَارٍ، يَزْجُرُ بِهِ السَّحَابَ، يَسُوقُهُ حَيْثُ أَمَرَ اللَّهُ» قَالُوا : فَمَا هَذَا الصَّوْتُ الَّذِي نَسْمَعُ؟ قَالَ : «صَوْتُهُ» قَالُوا : صَدَقْتَ، إِنَّمَا بَقِيَتْ وَاحِدَةٌ وَهِيَ الَّتِي نُبَايِعُكَ إِنْ أَخْبَرْتَنَا بِهَا، فَإِنَّهُ لَيْسَ مِنْ نَبِيٍّ إِلا لَهُ مَلَكٌ يَأْتِيهِ بِالْخَبَرِ، فَأَخْبِرْنَا مَنْ صَاحِبكَ؟ قَالَ : «جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلامُ» ، قَالُوا : جِبْرِيلُ ذَاكَ الَّذِي يَنْزِلُ بِالْحَرْبِ وَالْقِتَالِ وَالْعَذَابِ عَدُوُّنَا، لَوْ قُلْتَ : مِيكَائِيلَ الَّذِي يَنْزِلُ بِالرَّحْمَةِ وَالنَّبَاتِ وَالْقَطْرِ، لَكَانَ فَأَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ : ﴿مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ﴾ [ البقرة : ٩٧ ]».

“একবার কতক ইয়াহূদী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে বলল, হে আবুল কাসিম, আমরা আপনাকে পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করব। যদি আপনি সেসব বিষয়ে আমাদেরকে অবহিত করতে পারেন তাহলে আমরা বুঝে নিব যে, আপনি সত্য নবী এবং আমরা আপনার অনুসারী হয়ে যাব।

তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থেকে এমন অঙ্গীকার নিলেন যেমনটি নিয়ে ছিলেন ইসরাঈল (ইয়াকূব আলাইহিস সালাম) তার সন্তানদের থেকে। যখন বনী ইসরাঈল (ইয়াকূব পুত্রগণ) বলল: আমরা যা বলছি তার ওপর আল্লাহই সাক্ষী।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: প্রশ্ন করো।

তারা বলল: আমাদেরকে সত্য নবীর নিদর্শন সম্পর্কে বলুন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তার দু’চোখ ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।

তারা বলল: একজন মহিলা কীভাবে কন্যা ও পুত্র সন্তান জন্ম দেয়?

তিনি বললেন: স্বামী-স্ত্রীর পানি যখন এক সাথে মিলিত হয় আর যখন পুরুষের পানি স্ত্রীর পানির পূর্বে স্খলিত হয় তখন পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। আর যদি স্ত্রীর পানি পুরুষের পানির পূর্বে স্খলিত হয় তখন কন্য সন্তান জন্ম দেয়।

তারা বলল: আমাদেরকে বলুন যে, ইয়াকূব আলাইহিস সালাম নিজের জন্য কী হারাম করেছিলেন?

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তিনি عرق النسا (এক প্রকার বাথ) রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং এ জন্য তিনি অমুক প্রাণীর দুধ ছাড়া আর কিছুকে তিনি দোষতেন না। (আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ বলেন, আমার বাবা বলেছেন, তাদের অনেকে বলেন, অমুক বলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটকে বুঝিয়েছেন।) তাই তিনি উটের গোশত নিজের জন্য হারাম করেছিলেন।

তারা বলল: আপনি সত্য বলেছেন।

অতঃপর তারা বলল: আমাদেরকে বলুন যে, الرعد (বজ্রপাত) কী? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর একজন ফিরিশতা যিনি মেঘমালা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তার হাতে আগুনের একটি ছড়ি থাকে, যা দিয়ে তিনি আল্লাহর নির্দেশে মেঘমালোকে বিভিন্ন স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যান।

তারা বলল: যে শব্দটি শোনা যায় –তা কিসের শব্দ? তিনি বললেন সেই ছড়ির শব্দ।

তারা বলল: আপনি সত্য বলেছেন। আর একটি মাত্র প্রশ্ন বাকী আছে, এর উত্তর দিতে পারলেই আমরা আপনার হাতের বাই‘আত হব আর তা হচ্ছে প্রত্যেক নবীর কাছেই বার্তাবাহক একজন ফিরিশতা আসেন, আপনার কাছে কোন ফিরিশতা আসেন?

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: জিবরীল আলাইহিস সালাম।

তারা বলল: জিবরীল!!?? সে তো ঐ ফিরিশতা, যে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও শাস্তি নিয়ে আগমন করে। সে আমাদের শত্রু!! যদি আপনি বলতেন মিকাঈল যিনি রহমত, উদ্ভিদ ও বৃষ্টি অবতরণ করেন তাহলে ভালো হতো। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন:

﴿مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ﴾ [ البقرة : ٩٧ ]

“যে জিবরীলের শত্রু” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৯৭] [. মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২৪৮৩; আল্লামা হাইশামী “মাজমা‘আয যাওয়ায়েদ” গ্রন্থেও এ হাদীসটি বর্ণনা করছেন, হাদীস নং ১৩৯০২।]

ইয়াহুদ সম্প্রদায়ের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন পরিস্থিতির অবতারণার আরো একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন সাফওয়ান ইবন আসসাল [. সাফওয়ান ইবন আসসাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ১২টি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন।] রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। তিনি বলেন,

«قال يهودي لصاحبه اذهب بنا إلى هذا النبي فقال صاحبه لاتقل نبي إنه لو سمعك كان له أربعة أعين !!

فأتيا رسول الله صلى الله عليه و سلم فسألاه عن تسع آيات بينات فقال لهم لا تشركوا بالله شيئا ولا تسرقوا ولا تزنوا ولا تقتلوا النفس التي حرم الله إلا بالحق ولا تمشوا ببريء إلى ذي سلطان ليقتله ولا تسحروا ولا تأكلوا الربا ولا تقذفوا محصنة ولا تولوا الفرار يوم الزحف وعليكم خاصة اليهود أن لا تعتدوا في السبت .

قال : فقبلا يده ورجله، فقالا نشهد أنك نبي !!

قال : فما يمنعكم أن تتبعوني ؟

قالا : إن داود دعا ربه أن لا يزال في ذريته نبي، وإنا نخاف إن تبعناك أن تقتلنا اليهود» .

“এক ইয়াহূদী তার এক সঙ্গীকে বলল, আমাকে এ নবীর কাছে নিয়ে চল। সঙ্গীটি বলল: নবী বলবে না। তিনি যদি তা শুনতে পান তবে তো তার চক্ষু (খুশীতে) আটখানা হয়ে পড়বে। তারা উভয়েই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলো এবং তাঁকে নয়টি সুস্পষ্ট নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তিনি তাদের বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কিছুর শরীক করবে না। চুরি করবে না, যিনা করবে না, যে প্রাণ হত্যা করা অল্লাহ্ হারাম করেছেন কোনো হক ব্যতিরেকে সে প্রাণকে হত্যা করবে না, হত্যার উদ্দেশ্যে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে ক্ষতাসীনের কাছে নিয়ে যাবে না, যাদু টোনা করবে না, সুদ খাবে না, নিষ্পাপ মহিলাকে অপবাদ দিবে না, যুদ্ধের ময়দান থেকে পিঠ ফিরায়ে পলায়ন করবে না। আর হে ইয়াহূদীগণ! বিশেষ করে তোমাদের জন্য কথা হলো, তোমরা শনিবারের ক্ষেত্রে সীমালংঘন করবে না।

সাফওয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, তখন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’হাত ও দু’পায়ে চুম্বন করে বলল, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি সত্যই নবী। তিনি বললেন, তাহলে আমার অনুসরণ করতে তোমাদেরকে কিসে বাধা দিচ্ছে?

তারা বলল, নবী দাউদ আলাইহিস সালাম স্বীয় রবের কাছে প্রার্থনা করেছেন যে, যেন তার বংশধরদের মাঝে নবী আসতে থাকে। মূলত আমরা ভয় পাচ্ছি যদি আমরা আপনার অনুসরণ করি তাহলে ইয়াহূদী নেতৃবর্গ আমাদেরকে হত্যা করে ফেলবে।” [. তিরমিযী, হাদীস নং ২৭৩৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৭০৫।]

প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ঐ দুই ইয়াহূদী নিজেদের জীবননাশের ভয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ ও ইসলাম গ্রহণকে অস্বীকার করল। বস্তুত তখন সাধারণ ইয়াহূদীদের অবস্থাটা ছিল নিম্নরূপ:

কিছুসংখ্যক তীব্র বিদ্বেষের কারণে আর কথক নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য, বাকীরা স্বগোত্রীয় কর্তাদের দ্বারা নিজেদের প্রাণনাশের ভয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের প্রতি মিথ্যারোপ করতো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের সূচনা থেকে রাসূলের ব্যাপারে এমনটাই হলো ইয়াহূদীদের চিরাচরিত অবস্থান।

এ ক্ষেত্রে হুয়াই ইবন আখতাব কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণের ঘটনাটিকেও আমরা ভূলে যেতে পারি না। যার বিবরণ পেশ করতে গিয়ে সূফিয়া বিনতে হুয়াই রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “আমার পিতা ও চাচার সন্তানদের মাঝে তাদের নিকট আমার চেয়ে অধিক প্রিয়পাত্র আর কেউই ছিল না। আমার বাবা-চাচাদের সাথে যখনই আমার সাক্ষাত হত এবং এতে আমি হষোর্ৎফুল্ল হতাম তখনই তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাদ দিয়ে শুধু আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতো। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু আমর ইবন আউফ-এর মহল্লা কুবাতে আসলেন তখন তারা দু’জনও (আমার বাবা-চাচা, আবু ইয়াইসর ইবন হুয়াই) অন্ধকারে চুপিসারে সালূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হলো। আল্লাহর কসম! আমার বাপ-চাচারা কখনো সূর্য ডুবার আগে কখনো আমাদের কাছে আসতো না। সে দিনও তারা উদাসীন ও অলসভাবে ধীরপদে আমাদের কাছে আসল। আমি তাদের উপস্থিতি দেখে উৎফুল্ল হলাম যেমনটা আমি সব সময়ই হতাম। অতঃপর আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, তাদের দু’জনের কেহই আমাকে এখনো দেখে নি। এমন্থাবস্থায় আমি শুনতে পেলাম যে, আমার চাচা আবু ইয়াসির আমার পিতাকে বলছে, এ মুহাম্মাদই কি সেই ব্যক্তি?! (যার সম্পের্ক তাওরাতে বিবরণ রয়েছে)

পিতা জবাবে বললেন, আল্লাহর শপথ! এ মুহাম্মদই সেই ব্যক্তি!!

চাচা বললেন, আপনি কি তার গুণাবলী এবং নিদর্শনসমূহ দ্বারা তাকে চিনেছেন?

পিতা বললেন, আল্লাহর শপথ! হ্যাঁ!!

চাচা বললেন, তাঁর ব্যাপারে আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্ত কী?

পিতা বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তার শত্রুতা ও বিরোধিতাই আমার সিদ্ধান্ত।” [. আল্লামা ইবন কাসীর প্রণিত আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: (৩/২৩৭)]

এধরনের একরোখা ও বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতির বদলা নেওয়ার মানসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন?! নিজেকে স্বীকৃতি প্রদান বা স্বীয় দীনের ওপর ঈমান আনয়নের জন্য কি কারো ওপর জোড়জবরদস্তি বা বল প্রয়োগ করেছেন?

বরং বাস্তবচিত্র তো হলো ইসলাম এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিষয়সমূহ স্বচ্ছ ও নির্মলভাবে সকলের সামনে প্রকাশিত হওয়ার পরও, ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা ও বিশ্বস্থতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত -এ কথা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ও অপরাপর সকলে জানা সত্বেও তিনি তাদের কোনো একজনকেও নিজের ওপর ঈমান আনতে ও তাঁকে সত্যায়ণ করতে বাধ্য করেন নি। অথচ তাঁর বল-প্রয়োগ করার মতো যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় ছিল এবং মুসলিমদের তরবারীসমূহ তাঁর একটি ইশারার অপেক্ষায় ছিল।

বস্তুত রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো সেই মহান নীতির ওপর অটল ছিলেন, যে নীতির কোনো পরিবর্তন নেই। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন,

﴿لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ ﴾ [ البقرة : ٢٥٦ ]

“দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬]

ইয়াহূদী সম্প্রদায় শুধু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বীকার না করা বা মেনে না নেওয়াতেই কি সীমাবদ্ধ থেকেছে?! না, রবং বাস্তবিক প্রেক্ষাপট ছিল সম্পর্ণ তার ব্যতিক্রম। কেননা তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা ও শত্রুতামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত ও তাঁর ওপর অবতীর্ণ কুরআনের ওপর নানা রকম উদ্ভট সন্দেহমূলক মন্তব্য চড়াতে থাকে এবং সাধারণ মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর জন্যে বিভিন্ন রকম চক্রান্ত ও কটকৌশল শুরু করে।

শুধু তাই নয়, এর চেয়েও কৌতুহলোদ্দীপক কথা হচ্ছে এ যে, ইয়াহূদীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মদীনার অলিতে-গলিতে বিচরণ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে সাধারণ মানুষের মাঝে এ মর্মে সাবধান বাণী প্রচার করতে লাগল যে, এ ব্যক্তি সেই রাসূল নয়, যার বিবরণ তাদের তাওরাত গ্রন্থে রয়েছে। অথচ ইতোপূর্বে এরাই লোকদেরকে এ রাসূলের আগমনের সু-সংবাদ প্রদান করতো। এমনকি বিখ্যাত সাহাবী মা‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তো একবার ইয়াহূদীদের সম্বোধন করে বললেন, ‘হে ইয়াহূদী যুবকগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং ইসলাম গ্রহণ কর’ কেননা আমরা শির্ক-এ নিমজ্জিত থাকা অবস্থায় তোমরা যখন ইয়াহূদী পণ্ডিতগণকে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পের্ক জিজ্ঞাসা করতে তখন তারা আমাদেরকে এ মর্মে অবহিত করতো যে, তিনি অতিসত্বর প্রেরিত হবেন এবং আমাদের সামনে প্রেরিতব্য রাসূলের সেই নিদর্শন ও গুণাবলী উপস্থাপন করতো, যেগুলো এ (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাঝে বিদ্যমান রয়েছে!! তখন ইয়াহূদী পণ্ডিত সালাম ইবন মাশকাম তার জবাবে বললো, এ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদের কাছে কোনো কিছু নিয়ে প্রেরিত হয় নি, আমরা তাকে চিনি, মূলত সে ঐ রাসূলই নয়, যার ব্যাপারে আমরা তোমাদেরক অবহিত করতাম।

অতঃপর এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন, [. আল্লামা ইবন হিশামের আস-সীরাতুন্নববিয়্যাহ (২/৯১), তাফসীরে ইবন কাসীর (১/১৮৫), আল্লামা সুয়ুতী রহ.-এর আদ-দুররুল মানছুর (১/২১৭)।]

﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ كِتَٰبٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ وَكَانُواْ مِن قَبۡلُ يَسۡتَفۡتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُم مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِۦۚ فَلَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٨٩﴾ [ البقرة : ٨٩ ]

“আর যখন তাদের কাছে, তাদের সাথে যা আছে, আল্লাহরপক্ষ থেকে তার সত্যায়নকারী কিতাব এলো আর তারা (এর মাধ্যমে) পূর্বে কাফিরদের ওপর বিজয় কামনা করত। সুতরাং যখন তাদের নিকট এলো যা তারা চিনত, তখন তারা তা অস্বীকার করল। অতএব, কাফিরদের ওপর আল্লাহর লা‘নত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮৯]

অনুরূপভাবে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণের পথ হিসেবে আরো নানান প্রকার ঘৃন্যতম পরিকল্পনা গ্রহণ করল যেগুলোর নেতৃত্বে থাকতো আব্দুল্লাহ ইবন ছাঈফ, আদী ইবন যায়েদ ও হারিস ইবন আওফ-এর মতো শীর্ষ পর্যায়ের ইয়াহূদী ব্যক্তিবর্গ। তারা বলত, চল আমরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার ওপর সকালে ঈমান আনি অতঃপর সন্ধায় তা অস্বীকার করি, যাতে তাদের দীনের ওপর আমরা একটি আবরণী এঁকে দিতে পারি। তাহলে আশা করি (তাঁর ওপর যারা ঈমান এনেছে) তারাও বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের মতো কাজ করবে এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দীন থেকে ফিরে আসবে। তাদের এহেন অপকৌশলের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন, [. আল্লামা ইবন হিশামের আস-সীরাতুন্নববিয়্যাহ (২/৯১), তাফসীরে ইবন কাসীর (১/৪৯৬), আল্লামা কুরতুবী রহ.-এর ‘আল-জামেঈ লি আহকামিল কুরআন (৪/১১০)।]

﴿وَقَالَت طَّآئِفَةٞ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ ءَامِنُواْ بِٱلَّذِيٓ أُنزِلَ عَلَى ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَجۡهَ ٱلنَّهَارِ وَٱكۡفُرُوٓاْ ءَاخِرَهُۥ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٧٢ وَلَا تُؤۡمِنُوٓاْ إِلَّا لِمَن تَبِعَ دِينَكُمۡ قُلۡ إِنَّ ٱلۡهُدَىٰ هُدَى ٱللَّهِ أَن يُؤۡتَىٰٓ أَحَدٞ مِّثۡلَ مَآ أُوتِيتُمۡ أَوۡ يُحَآجُّوكُمۡ عِندَ رَبِّكُمۡۗ قُلۡ إِنَّ ٱلۡفَضۡلَ بِيَدِ ٱللَّهِ يُؤۡتِيهِ مَن يَشَآءُۗ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ٧٣﴾ [ ال عمران : ٧٢، ٧٣ ]

“আর কিতাবীদের একদল বলে, মুনিদের ওপর যা নাযিল করা হয়েছে, তোমরা তার প্রতি দিনের প্রথমভাগে ঈমান আন আর শেষ ভাগে তা অস্বীকার কর, যাতে তারা ফিরে আসে।

আর তোমরা কেবল তাদেরকে বিশ্বাস কর, যারা তোমাদের দীনের অনুসরণ করে। বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত। এটা এ জন্য যে, কোনো ব্যক্তিকে দেওয়া হবে যেরূপ তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। অথবা তারা তোমাদের রবের নিকট তোমাদের সাথে বিতর্ক করব’। বল, নিশ্চয় অনুগ্রহ আল্লাহর হাতে, তিনি যাকে চান, তা দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭২-৭৩]

ইয়াহূদীদের অপতৎপরতার আরেকটি উদারহরণ হচ্ছে মদীনায় আনসারদের মাঝে পরস্পরে কলহ-বিবাদ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে তারা বিভিন্ন চক্রান্তের অপচেষ্টা চালাত। কট্টর মুসলিম বিরোধী ইয়াহূদী শাশ ইবন কায়েস [শাশ ইবন কায়েস। সে ছিল হিংসুটে ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী এক ইয়াহুদী। সে মদীনার আনসার থেকে আওস ও খাযরাজ গোত্রে কলহ-বিবাদ সৃষ্টিতে সদা ব্যস্ত থাকত। এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেন, ﴿قُلۡ يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ لِمَ تَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ تَبۡغُونَهَا عِوَجٗا ﴾ [ ال عمران : ٩٩ ] “বল, ‘হে আহলে কিতাব, তোমরা কেন আল্লাহর পথ থেকে বাধা দিচ্ছ তাদেরকে, যারা ঈমান এনেছে? তোমরা তাতে বক্রতা অনুসন্ধান কর।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৯]] তো সদা আওস এবং খাযরাজ গোত্রের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছড়াতেই ব্যস্ত থাকত। এ ঘটনাটি আল্লামা ইবন হিশাম তার সীরাত গ্রন্থে ইবন ইসহাকেরসূত্রে বর্ণনা করেছেন। [. আল্লামা ইবন হিশামের ‘আস-সীরাতুন্নববিয়্যাহ’ (২/৯৫)।]

অতঃপর ইয়াহূদীরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে পূর্বোক্ত সকল অপকৌশলের সীমা অতিক্রম করে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার ওপর জঘন্য ও লজ্জাষ্কর মন্তব্যারোপ করা শুরু করল। তারা বলতে লাগল, ‘আল্লাহ হত-দরিদ্র অথচ আমরা ধনবান’। তাদের এহেন ঘৃন্য মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করে বললেন,

﴿لَّقَدۡ سَمِعَ ٱللَّهُ قَوۡلَ ٱلَّذِينَ قَالُوٓاْ إِنَّ ٱللَّهَ فَقِيرٞ وَنَحۡنُ أَغۡنِيَآءُۘ سَنَكۡتُبُ مَا قَالُواْ وَقَتۡلَهُمُ ٱلۡأَنۢبِيَآءَ بِغَيۡرِ حَقّٖ وَنَقُولُ ذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ ١٨١﴾ [ ال عمران : ١٨١ ]

“নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ দরিদ্র এবং আমরা ধনী’। অচিরেই আমি লিখে রাখব তারা যা বলেছে এবং নবীদেরকে তাদের অন্যায়ভাবে হত্যার বিষয়টিও এবং আমি বলব, ‘তোমরা উত্তপ্ত ‘আযাব আস্বাদন কর।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮১]

এর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আবু ইসহাকের সূত্রে ইবন হিশামের সীরাত গ্রন্থে [. আল্লামা ইবন হিশামের ‘আস-সীরাতুন্নববিয়্যাহ’ (২/৯৮)।] আলোচিত হয়েছে। অনুরূপ অন্য গ্রন্থেও [. যেমন, আল্লামা ইবন কাসীর রহ.-এর ‘তাফসীরুল কুরআনিল আযীম’ (১/৫৭৫)।] এর বিবরণ রয়েছে।

প্রিয় পাঠক! ইয়াহূদীদের জিজ্ঞাসা সুলভ মানসিকতার এখানেই শেষ নয়; বরং আরো একধাপ এগিয়ে (যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা-র ভিত্তিতে [. অনুবাদক।]) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকৃতি ও তাঁর ওপর মিথ্যারোপ করাকে আরো তরান্বিত করতে নবী সুলাইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের-এর নবুয়তকেও জোরপূর্বক মিথ্যারোপ করে বসল। (কারণ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নবী বলে মানেন) অথচ সুলইমান আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাদশাহী ও নবুওয়াতী একত্রে প্রাপ্ত হওয়ার কারণে ইয়াহূদীদের মতেও শ্রেষ্ঠতম নবী হিসেবে গণ্য হতেন। তারা দাবী করে বসল যে, সুলাইমান তো নবী নন; বরং একজন যাদুকর ছিল। যেমন কথক ইয়াহূদী পণ্ডিত বলে, “তোমরা কি মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঐ ধারনার ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ কর না যে, সে মনে করে সুলাইমান একজন নবী ছিল। আল্লাহর শপথ সুলাইমান তো যাদুকর বৈ কিছুই ছিল না।” [. আল্লামা ইবন হিশামের ‘আস-সীরাতুননববিয়্যাহ’ (৩/৮০)।]

তাদের এ জঘন্য মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,

﴿وَمَا كَفَرَ سُلَيۡمَٰنُ وَلَٰكِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ ٱلنَّاسَ ٱلسِّحۡرَ ﴾ [ البقرة : ١٠٢ ]

“আর সুলাইমান কুফুরী করে নি; বরং শয়তানরা কুফুরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১০২]

রাসূলের বিরোধিতায় এমন ধরনের নৃশংসতায়ও ইয়াহূদীদের মনের ঝাল মিঠে নি; বরং আরো ঘৃণ্যতম অপকর্মে তারা জড়িত হয়েছে। তারা মুশরিক এবং মূর্তিপূজকদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী মুসলিমগণের ওপর মর্যাদায় অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেছেন,

﴿أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ أُوتُواْ نَصِيبٗا مِّنَ ٱلۡكِتَٰبِ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡجِبۡتِ وَٱلطَّٰغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُواْ هَٰٓؤُلَآءِ أَهۡدَىٰ مِنَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ سَبِيلًا ٥١﴾ [ النساء : ٥١ ]

“তুমি কি তাদেরকে দেখ নি, যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছে? তারা জিবত [. জিবত ( الجبت ) অর্থ মূর্তি, প্রতিমা, যাদুকর, ভেলকিবাজ, যাদু, ভেলকি ইত্যাদি।] ও তাগুতের প্রতি ঈমান আনে এবং কাফিরদেরকে বলে, এরা মুমিনদের তুলনায় অধিক সঠিক পথপ্রাপ্ত।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫১]

ইয়াহূদীদের এতসব অপতৎপরতা ও চক্রান্ত বিস্তারের পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসকি হেসে তাদের সাথে সামাজিক আচার সম্পাদক করতেন। তাদের অস্থিত্বকেও তিনি অস্বীকার করতেন না। তারা আহলে কিতাব হওয়া এবং তাদের স্বীকৃতিতেও তিনি নেতিবাচক মানসিকতা পোষন করতেন না।

প্রিয় সূধী মহল! এমনটাই হলো অন্যদের ক্ষেত্রে মহান শাশ্বত ধর্ম ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামের ক্ষেত্রে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি। যাতে আপনার নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের মধ্যকার ফাঁকা সদৃশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে!!

মুসলিমদেরকে স্বীকৃতি প্রদানে খ্রিস্টানদের অবস্থান:

প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বীকৃতি প্রদান প্রশ্নে খ্রিস্টানদের মানসিকতায়ও ইয়াহূদীদের থেকে ভালো কোনো অবস্থান ছিল না। তবে হ্যাঁ! খৃস্টানদের বিরোদ্ধাচারণে ইয়াহূদীদের মতো এতো জঘন্য কোনো চক্রান্ত ছিল না। ইয়াহূদীদের থেকে যেমন ঘৃণ্যতম ঈর্ষা, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে খ্রিস্টানদের বেলায় তা এতো জটিল ছিল না। তথাপি সর্বোপরি হতাশাব্যাঞ্জক কথা একটাই যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে খ্রিস্টানদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তারা সেভাবে রাসূলকে মেনে নিতে বা স্বীকৃতি দিতে পারে নি।

ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখেত পেয়েছি যে, খ্রিস্টান রাজা রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে সে জ্ঞাত হলো এবং সে এমন সব বিষয়াদী অবহিত হলো যার দরুন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশই থাকে না। শুধু তাই নয় বরং হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পের্ক এক আশচর্যজনক মন্তব্য করল। আবু সুফিয়ান [. আবু সুফিয়ান সখর ইবন হারব ইবন উমাইয়াহ আল-কুরাইশী আল-উমওয়ী। তিন মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করনে। হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মালে গনিমত থেকে অংশ দিয়েছেন। তিনি তায়েফের যুদ্ধেও অংশগ্রহন করেছেন তখন তীরের আঘাতে তার এক চোখে হারান, তারপর ইয়ামুকের যুদ্ধেও অংশ করলে অপর চোখটিও হারান। অধিকতর জানতে দেখুন: ইবন আব্দুল বার-এর আল ইসতিয়াব (২/২৭০), ইবনুল আসীরের ‘আসাদুল গাবাহ’ (২/৪০৭), ইবন হাজারের ‘আল-ইসাবাহ’ (৪০৪৫)] রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে দীর্ঘ কথোপকথনের পর হিরাক্লিয়াস তাকে বলল, ‘তুমি ঐ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্বন্ধে যা বলছ তা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে অতি সত্বর সে আমার দু’পা রাখার স্থানটুকুরও মালিক হবে অথচ আমি জানতাম যে, শেষ নবী কুরাইশের বাইরে থেকে হবেন এবং আমি এ ধারনাও করতাম না যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে হবেন। যদি আমি এ কথা জানেত পারি যে, তাঁর কাছে গেলে মুক্তি পাব, তাহলে তাঁর সাক্ষাতপ্রাপ্ত হবার জন্য সকল কষ্ট সহ্য করে নিতাম এবং তার দর্শন পেলে আমি তার পা ধুয়ে দিতাম’। (উত্তম সেবা করতাম)

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবু্ওয়াতের ব্যাপারে এমন সু-উচ্চ ধারনা এবং মহান মর্যাদা দানের পরও হিরাক্লিয়াসের অবস্থান কী ছিল?! সে কি পেরেছিল ইসলামকে মেনে নিতে?!

বাস্তবতা হচ্ছে, এ রোম সম্রাটই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্ধশায় তাঁর বিরুদ্ধে ও পরবর্তীতে তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। মুতা ও তাবুকে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য রোমান সৈন্য প্রেরণ করেছে। আরব উপ-দ্বীপের খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর একটানা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে।

আরেক খ্রিস্টান -মিসরের কিবতী সম্প্রদায়ের নেতা মুক্বাওক্বিসের অবস্থানও হিরাক্লিয়াস থেকে খুব ভিন্নতর কিছু ছিল না। কেননা সে এমন এক ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে এমন সব কথা বলত, যাতে রাসূলকে সত্য নবী বলে মেনে নিয়েছে বলে অনুমিত হতো। শুধু তাই নয় বরং সে হাতিব ইবন আবী বালতা‌’আহ [. হাতিব ইবন আবী বালতা‌’আহ আল-লাখমী, বদর ও হুদায়বিয়ায় অংশ নিয়েছেন। মাত্র ৩০বছর বয়সে মদীনায় ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ কুরআনের আয়াত দ্বারা তার ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছেন, ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمۡ أَوۡلِيَآءَ﴾ [ الممتحنة : ١ ] “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করো না” হারান। অধিকতর জানতে দেখুন: ইবন্‌ আব্দুল বার এর আল ইসতিয়াব (১/৩৮৪), ইবনুল আসীরের ‘আসাদুল গাবাহ’ (১/৪৯১)।]এর মাধ্যেম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য উপঢৌকন প্রেরণ করেছে। এত কিছুর পরও যখন ইসলামী সৈন্য মিসরের সীমানায় প্রবেশ করল তখন সে রোমানদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলিমদেরকে প্রতিরোধ ও তাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য অবস্থান গ্রহণ করলো। অথচ এ মুক্বাওকিসই মিসরের দখলদারিত্ব থেকে রোমানদেরকে উৎখাত করেছে। যা পরবর্তী ছয়শত বছর পর্যন্ত কার্যকর ছিল!!

নাজরানের খ্রিস্টানদের অবস্থা তো সর্বজনবিধিত বরং; তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থানের সাক্ষী। কেননা তারা খুব ভালো করেই জানত যে, তিনিই প্রেরিত শেষ নবী। খ্রিস্টান দলপতিগণ যখন তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অভিসম্পাতের আহ্বান করত, তখন তারা এ ভয়ে তা করা থেকে বিরত থাকত যে, এমনটি করলে আল্লাহর ‘আযাব বর্ষিত হবে। তথাপী তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত ও তাঁর দীনকে মেনে নেয় নি!!

মুশিরকদের অবস্থান:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক স্বীকৃতি প্রদানে মুশরিকদের ভূমিকার ব্যাখ্যা বা বর্ণনায় মূলত নতুন করে বলার কিছু নেই। কেননা দীর্ঘসময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লামের চারপাশে নিরাপদ সহাবস্থানের পরও তারা তাঁকে স্বীকার করে নিতে পুরোপুরী অস্বীকার করেছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের প্রতি মুশরিকদের বিরূপ আচরণের প্রভাব নিয়ে শত-সহস্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এমনকি যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করলেন তখনো তিনি মদীনার মুশরিকদের সাথে অতীব বিনম্র আচরণ করেছেন। ইসলাম গ্রহণ করার জন্য কারো ওপর কোনো ধরনের বল-প্রয়োগ করেন নি; বরং তিনি বিনম্র ব্যবহার করে তাদরকে কাছে টানতে চাইতেন। অথচ মুশরিকরা সর্বদা তাঁর বিরোধিতা করে গিয়েছে।

এ বিষয়ের প্রামাণিকতার জন্যে আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ ঘটনার চেয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না যে ঘটনায় তিনি এমন একটি মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যাতে মুসলিম, মুশরিক, মূর্তিপূজক ও ইয়াহূদীরা সম্মিলিত হয়েছে.................ইমাম বুখারী উসামা ইবন যায়েদ [. উসামা ইবন যায়েদ ইবন হারেস, মাত্র আট বছর বয়সে মুসলিম সৈন্যদের সাথী হয়েছে। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাতে খুব আদর করতেন এমনকি কোনো বস্তু প্রদানে নিজের ছেলে আব্দুল্লাহ থেকেও উসামাকে প্রাধান্য দিতেন। খলীফা উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর হত্যার পর যখন ফেতনা ছড়িয়ে পরল তখন তিনি তা দমন করেন। ৫৮/৫৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। অধিকতর জানতে দেখুন: ইবন আব্দুল বার-এর ‘আল-ইসতিয়াব’ (১/১৭০), ইবনুল আসীরের ‘আসাদুল গাবাহ’ (১/৯১), ইবন হাজারের ‘আল-ইসাবাহ’ (৮৯)।]-এর সূত্রে বর্ণনা করেন,

«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَكِبَ حِمَارًا عَلَيْهِ إِكَافٌ تَحْتَهُ قَطِيفَةٌ فَدَكِيَّةٌ وَأَرْدَفَ وَرَاءَهُ أُسَامَةَ بْنَ زَيْدٍ وَهُوَ يَعُودُ سَعْدَ بْنَ عُبَادَةَ فِي بَنِي الْحَارِثِ بْنِ الْخَزْرَجِ وَذَلِكَ قَبْلَ وَقْعَةِ بَدْرٍ حَتَّى مَرَّ فِي مَجْلِسٍ فِيهِ أَخْلَاطٌ مِنْ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُشْرِكِينَ عَبَدَةِ الْأَوْثَانِ وَالْيَهُودِ وَفِيهِمْ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أُبَيٍّ ابْنُ سَلُولَ وَفِي الْمَجْلِسِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ فَلَمَّا غَشِيَتْ الْمَجْلِسَ عَجَاجَةُ الدَّابَّةِ خَمَّرَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أُبَيٍّ أَنْفَهُ بِرِدَائِهِ ثُمَّ قَالَ لَا تُغَبِّرُوا عَلَيْنَا فَسَلَّمَ عَلَيْهِمْ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ وَقَفَ فَنَزَلَ فَدَعَاهُمْ إِلَى اللَّهِ وَقَرَأَ عَلَيْهِمْ الْقُرْآنَ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ أُبَيٍّ ابْنُ سَلُولَ أَيُّهَا الْمَرْءُ لَا أَحْسَنَ مِنْ هَذَا إِنْ كَانَ مَا تَقُولُ حَقًّا فَلَا تُؤْذِنَا فِي مَجَالِسِنَا وَارْجِعْ إِلَى رَحْلِكَ فَمَنْ جَاءَكَ مِنَّا فَاقْصُصْ عَلَيْهِ قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ اغْشَنَا فِي مَجَالِسِنَا فَإِنَّا نُحِبُّ ذَلِكَ فَاسْتَبَّ الْمُسْلِمُونَ وَالْمُشْرِكُونَ وَالْيَهُودُ حَتَّى هَمُّوا أَنْ يَتَوَاثَبُوا فَلَمْ يَزَلْ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُخَفِّضُهُمْ ثُمَّ رَكِبَ دَابَّتَهُ حَتَّى دَخَلَ عَلَى سَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ فَقَالَ أَيْ سَعْدُ أَلَمْ تَسْمَعْ إِلَى مَا قَالَ أَبُو حُبَابٍ يُرِيدُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ أُبَيٍّ قَالَ كَذَا وَكَذَا قَالَ اعْفُ عَنْهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَاصْفَحْ فَوَاللَّهِ لَقَدْ أَعْطَاكَ اللَّهُ الَّذِي أَعْطَاكَ وَلَقَدْ اصْطَلَحَ أَهْلُ هَذِهِ الْبَحْرَةِ عَلَى أَنْ يُتَوِّجُوهُ فَيُعَصِّبُونَهُ بِالْعِصَابَةِ فَلَمَّا رَدَّ اللَّهُ ذَلِكَ بِالْحَقِّ الَّذِي أَعْطَاكَ شَرِقَ بِذَلِكَ فَذَلِكَ فَعَلَ بِهِ مَا رَأَيْتَ فَعَفَا عَنْهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ»

‍“একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি গাধার উপর সাওয়ার হলেন, যার জিনের নিচে ফাদাকের তৈরি একখানি চাদর ছিল। তিনি উসামা ইবন যায়দকে নিজের পেছনে বসিয়ে ছিলেন। তখন তিনি হারিস ইবন খাযরাজ গোত্রের সা‘দ ইবন উবাদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখাশোনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এটি ছিল বদর যুদ্ধের পূর্বের ঘটনা। তিনি এমন এক মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেখানে মুসলিম, মুশরিক, ইয়াহূদী ও প্রতিমাপূজক সবাই ছিল। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালুলও ছিল। আর এ মজলিসে আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও উপস্থিত ছিলেন। যখন সাওয়ারীর পদাঘাতে উড়ন্ত ধূলাবালী মজলিসকে ঢেকে ফেলছিল তখন আব্দুল্লাহ ইবন উবাই তার চাদর দিয়ে তার নাক ঢাকল। তারপর বলল, তোমরা আমাদের উপর ধুলাবালু উড়িওনা। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সালাম দিলেন। তারপর এখানে থামলেন ও সাওয়ারী থেকে নেমে তাদের আল্লাহর প্রতি আহ্বান করলেন এবং তাদের কাছে কুরআন পাঠ করলেন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সালুল বলল, হে আগত ব্যাক্তি! আপনার এ কথার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই? তবে আপনি যা বলছেন, যদিও তা সত্য, তবুও আপনি আমাদের মজলিসে এসব বলে আমাদের বিরক্ত করবেন না। আপনি আপনার নিজ ঠিকানায় ফিরে যান। এরপর আমাদের মধ্য থেকে কেউ আপনার নিকট গেলে তাকে এসব কথা বলবেন। তখন ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমাদের মজলিসে আসবেন, আমরা এসব কথা পছন্দ করি। তখন মুসলিম, মুশরিক ও ইয়াহূদীদের মধ্যে পরস্পর গালাগালি শুরু হলো। এমনকি তারা একে অন্যের ওপর আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামাতে লাগলেন। অবশেষে তিনি তার সাওয়ারীতে আরোহণ করে রওয়ানা হলেন এবং সা‘দ ইবন উবাদার কাছে পৌঁছলেন। তারপর তিনি বললেন হে সা‘দ! আবু তুরাব অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবন উবাই কি বলেছে, তা কি তুমি শুন নি? সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, সে এমন কথাবার্তা বলেছে। তিনি আরো বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনি তাকে মাফ করে দিন। আর তার কথা ছেড়ে দিন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে সব নি‘আমত দান করার ছিল তা সবই দান করেছেন। পক্ষান্তরে এ শহরের [. মদীনার অধিবাসিরা। ইবন হাজার আসকালানী রহ.-এর ‘ফাতহুল বারী’ (৮/২৩২)] অধিবাসীরা তো পরামর্শ করে সিধান্ত নিয়েছিল যে, তারা তাকে রাজ মুকুট পরাবে। আর তার মাথায় রাজকীয় পাগড়ী বেধে দিবে; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে দীনে হক দান করেছেন, তা দিয়ে তিনি তাদের সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে সে (ক্ষোভানলে) জ্বলছে এজন্যই সে আপনার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তা আপনি নিজেই প্রত্যাক্ষ করেছেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাফ করে দিলেন।” [. সহীহ বুখারী, (অনুমতি চাওয়া অধ্যায়, মুসলিম ও মুশরিকের যৌথ মজলিসে সালামের পরিচ্ছেদ), হাদীস নং ৫৮৯৯; সহীহ মুসলিম (ইতিহাস ও জিহাদ অধ্যায়, মুনাফিকদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্য ধারণ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দো‘আ পরিচ্ছেদ) হাদীস নং ১৭৯৮।]

পরিশেষে আমরা বলতে চাই যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ধরনের ইতিবাচক অবস্থান ও তার বিরোধীদের এতোসব নেতিবাচক অবস্থানের পরও কি কেহ এ কথা দাবী করেত পারে যে, মুসলিমরা অন্যদের সামাজিক স্বীকৃতি দেয় না?!

ভিন্ন সম্পদায়কে সামাজিক স্বীকৃতি ইসলামী মূলবোধের একটি মৌলিক বিষয়। ইসলাম কখনই কোনো অমুসলিমকে ধর্মান্তরিত করণে বল-প্রয়োগ করাকে বৈধতা দেয় না। সে জন্যেই বিশ্বময় আমাদের উদাত্ত আহ্বানের অন্যতম একিট হচ্ছে এ যে, এ শাশ্বত বিধানে কোনো অপবাদ দেওয়ার আগে ইসলামকে তার সঠিক ও বিশুদ্ধ উৎসমূল থেকে অধ্যয়ন করুন। তাহলেই আপনার মনের সকল কালিমা দূর হয়ে যাবে।

উপরের কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করার পর এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল ভিন্ন সম্প্রদায় ও তাঁর বিরোধীদেরকে শুধু সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন?! না, বরং তিনি এ সকল স্তর অতিক্রম করে আরো অনেক অনে-ক অনে-ক দূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছেন।

সামনের অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুসলিমদরেকে শুধু স্বীকৃতি দান নয়; বরং অমুসলিমদেরকে সম্মানপ্রদর্শন ও তাদেরকে যথোপযুক্ত মর্যাদার আসনে সমাসীনও করেছেন।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন