hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ

লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী

২১
পঞ্চম পরিচ্ছেদ: প্রমাণের ভিত্তিতে ফায়সালা
অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ন্যায়পরায়ণতার অসাধারণ দৃষ্টান্তের আরেকটি দিক হচ্ছে এ যে, তিনি কখনোই কোনো অমুসলিমের বিপক্ষে সুনির্ধারিত প্রমানাধি ছাড়া বিচারকার্য সঞ্চালন করতেন না।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ وَهُوَ فِيهَا فَاجِرٌ لِيَقْتَطِعَ بِهَا مَالَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَقِيَ اللَّهَ وَهُوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ قَالَ فَقَالَ الْأَشْعَثُ بْنُ قَيْسٍ فِيَّ وَاللَّهِ كَانَ ذَلِكَ كَانَ بَيْنِي وَبَيْنَ رَجُلٍ مِنْ الْيَهُودِ أَرْضٌ فَجَحَدَنِي فَقَدَّمْتُهُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلَكَ بَيِّنَةٌ قَالَ قُلْتُ لَا قَالَ فَقَالَ لِلْيَهُودِيِّ احْلِفْ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِذًا يَحْلِفَ وَيَذْهَبَ بِمَالِي قَالَ فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى { إِنَّ الَّذِينَ يَشْتَرُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَأَيْمَانِهِمْ ثَمَنًا قَلِيلًا } إِلَى آخِرِ الْآيَةِ»

“যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাযির হবে যে, আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন। আশ‘আস ইবন কায়েস [. আল-আশ‘আস ইবন কায়েস আল-কিন্দী। দশম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণের জন্য কিন্দা রাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে আসেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যাওয়ার পর মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর আবার ইসলামে ফিরে এসেছেন এবং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজ বোনকে তার সাথে বিবাহ দেন। তিনি কাদিসিয়্যাহ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সিফ্ফীনের যুদ্ধেও অংশ নেন। অতঃপর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত বরণের চল্লিশ দিন পর মারা যান। অধিক জানতে দেখুন: ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (১/৯৭), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (জীবনী নং ২০৫)] রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আল্লাহর কসম! এটা আমার সম্পর্কেই ছিল। আমার ও এক ইয়াহূদী ব্যক্তির সাথে যৌথ মালিকানায় এক খণ্ড জমি ছিল। সে আমার মালিকানার অংশ অস্বীকার করে বসল। আমি তাকে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমার কোনো সাক্ষী আছে কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি ইয়াহূদীকে বললেন, তুমি কসম কর। আমি তখন বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! সে তো কসম করবে এবং আমার সম্পত্তি নিয়ে নেবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা (এ আয়াত) নাযিল করেন,

﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَشۡتَرُونَ بِعَهۡدِ ٱللَّهِ وَأَيۡمَٰنِهِمۡ ثَمَنٗا قَلِيلًا﴾ [ ال عمران : ٧٧ ]

“যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে.....”। [সূরা আলে ইমরান: ৭৭] [. সহীহ বুখারী: ( كتاب الخصومات : باب كلام الخصوم بعضهم في بعض ) (হাদীস নং ২২৮৫; সহীহ মুসলিম: ( كتاب الإيمان : باب وعيد من اقتطع حق مسلم بيمين فاجرة بالنار ) হাদীস নং ১৩৮।]

নিশ্চয় এটি এক বিরল দৃষ্টান্ত..!!

এটি এমন দু’জনের মধ্যকার বিবাদ, যাদের একজন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী অন্যজন ইয়াহুদী। তারা পরস্পরের মধ্যে ফায়সালা করে দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসল। কাজেই রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দু’জনের মাঝে কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব ব্যতীত শরী‘আতের বিধান প্রয়োগ করা ছাড়া অন্য কোনো পন্থা অন্বেষণ করেন নি। আর এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরী‘আত বাদী আশ‘আস ইবন কায়েসকে এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করে যে, সে সাক্ষ্য ও প্রমাণ পেশ করবে। যদি সে প্রমাণ ও সাক্ষ্য উপস্থাপনে ব্যর্থ হয় তাহলে বিবাদীকে এ মর্মে শপথ করতে বলা যে, বাদী তার ওপর যে অভিযোগ উত্থাপন করেছে সে ঐ অভিযুগে অভিযুক্ত নয়। তখন বিবাদীর শপথকে সত্যায়ন করা হবে এবং সে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবে। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগত হাদীসের অর্থও তাই। তিনি বলেন,

« الْبَيِّنَةُ عَلى المُدَّعِي والْيَمِيْنُ عَلى مَنْ اَنْكَرَ»

“অভিযোগকারী প্রমাণ পেশ করবে। আর (প্রমাণ পেশ করতে না পারলে) যে অস্বীকার করে সে শপথ করবে”।

ইয়াহূদী যে মিথ্যার আশ্রয় নিতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধাবোধ করবে না রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে সম্যক জ্ঞাত ছিলেন। কারণ, তারা শুধু মানুষের সাথে কেন বরং স্বয়ং আল্লাহর ওপরই তো মিথ্যারোপ করে অভ্যস্থ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٥ ﴾ [ ال عمران : ٧٥ ]

“আর তারা জেনে-শুনে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা বলে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৫]

আর ইয়াহূদী যখন এ কথা জানলো যে সাহাবীর কাছে নিজ মালিকানার স্বপক্ষে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নেই তার শপথের ভিত্তিতেই বিষয়টি শুরাহা হবে। তখন তার মধ্যে আরো বেশি নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিল। অপরদিকে সাহাবীও এটি অনুভব করলেন যে, তার আশা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হতে যাচ্ছে। কারণ ইয়াহূদী তো বিনা দ্বিধায় মিথ্যা শপথ করে বসবে। কাজেই রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য কিছুই করতে পারবেন না এবং ইয়াহূদীকে সুযোগ দেওয়া ছাড়া রাসূলের সামনে আর কোনো পথই খোলা থাকবে না।

এটি কি সার্বজনিন ন্যায়পরায়ণতা নয় যার এতো সরল বাস্তবায়ন কোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারে না?!

এটাই ইসলাম... ।

এটাই সে আসমানী দীন, যা জমিনে মানব জীবন পরিচালনার জন্য এসেছে...।

ইনিই আমাদের মহান রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি সভ্যতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টিকূলের সেরা...।

কোনো ইয়াহূদীর বিপক্ষে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে মুসলিমের দাবী প্রত্যাখ্যাত হওয়ার মতো ঘটনা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে শুধু একবার নয়; বরং বারবার ঘটেছে। পৃথিবীতে আরো গুরুতর কলহেরও সৃষ্টি হয়েছে এবং পূর্বোক্ত ঘটনার চেয়ে কঠিনতর পরিস্থিতির অবতারণাও হয়েছে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিক্রিয়া ছিল একই রকম। কেননা তাঁর সকল চিন্তা-চেতনার উৎস তো একই। ধর্ম, চরিত্র ও ন্যায়পরায়ণতা তাঁর মতে এমন বিষয় যা কখনো বিভক্ত হয় না।

সাহল ইবন আবি হাসমাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন,

«أَنَّ نَفَرًا مِنْ قَوْمِهِ انْطَلَقُوا إِلَى خَيْبَرَ فَتَفَرَّقُوا فِيهَا وَوَجَدُوا أَحَدَهُمْ قَتِيلًا وَقَالُوا لِلَّذِي وُجِدَ فِيهِمْ قَدْ قَتَلْتُمْ صَاحِبَنَا قَالُوا مَا قَتَلْنَا وَلَا عَلِمْنَا قَاتِلًا فَانْطَلَقُوا إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ انْطَلَقْنَا إِلَى خَيْبَرَ فَوَجَدْنَا أَحَدَنَا قَتِيلًا فَقَالَ الْكُبْرَ الْكُبْرَ فَقَالَ لَهُمْ تَأْتُونَ بِالْبَيِّنَةِ عَلَى مَنْ قَتَلَهُ قَالُوا مَا لَنَا بَيِّنَةٌ قَالَ فَيَحْلِفُونَ قَالُوا لَا نَرْضَى بِأَيْمَانِ الْيَهُودِ فَكَرِهَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُبْطِلَ دَمَهُ فَوَدَاهُ مِائَةً مِنْ إِبِلِ الصَّدَقَةِ»

“তার (সাহল ইবন আবি হাসমাহ-এর) গোত্রের একদল লোক খায়বার গমন করল ও তথায় তারা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল। তারা তাদের একজনকে নিহত অবস্থায় পেল। (খায়বারে তখন ইয়াহূদীদের আবাস ছিল) যাদের কাছে তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল তাদেরকে তারা বলল, তোমরা আমাদের সাথীকে হত্যা করেছ। তারা বলল, আমরা না তাকে হত্যা করেছি, না তার রহত্যাকারী সম্পর্কে জানি। এরপর তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা খায়বার গিয়েছিলাম আর আমাদের একজনকে তথায় নিহত অবস্থায় পেলাম। তখন তিনি বললেন, বায়োবৃদ্ধকে বলতে দাও। বায়োবৃদ্ধকে বলতে দাও। [. তোমাদের মধ্যে যিনি সিনিয়র তাকে কথা বলতে দাও। অধিক জানতে দেখুন: ইবন হাজার আসকালানী: আল-ফাতহুল বারী (১২/২৩৩,২৩৪)] তারপর তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদেরকে তার হত্যাকারীর বিরুদ্ধে প্রমাণ পেশ করতে হবে। তারা বলল, আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তিনি বললেন, তাহলে ওরা কসম করে নেবে। তারা বলল, ইহুদীদের কসমে তো আমাদের কোনো আস্থা নেই। এ নিহতের রক্ত মূল্যহীন হয়ে যাক তা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করলেন না । তাই সদকার একশত উট প্রদান করে তার রক্তপণ আদায় করলেন।” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب الديات : باب القسامة ) হাদীস নং ৬৫০২; সহীহ মুসলিম: ( كتاب القسامة والمحاربين والقصاص والديات : باب القسامة ) হাদীস নং ১৬৬৯।]

আল্লাহু আকবার! এটি কতো বড় আশ্চর্যজনক ঘটনা!!

সহীহ মুসলিমের বর্ণনা মতে এ ঘটনাটি খায়বার উপত্যকায় ইয়াহূদীরা মুসিলমেদর সাথে পরাজিত হবার পর ইয়াহূদীরা মুসলিমদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে বসবাসের অনুমতি প্রাপ্ত হবার পরের ঘটনা। স্বভাবতই তখন ইয়াহূদীরা দুর্বল অবস্থায় এবং মুসলিমগণ শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। মুসলিমগণ চাইলে তাদের এ সামর্থ্য ছিল যে, নিজেদের কোনো মতকে জোরপূর্বক ইয়াহূদীদের ওপর চাপিয়ে দেবেন।

কিন্তু বাস্তবতা পৃথিবী দেখেছে..!

ইমাম মুসলিমের [. মুসলিম ইবন হাজ্জাজ, আল-ইমাম আল হাফেজ হুজ্জাতুল ইসলাম আবুল হাসান আন-নিসাবূরী। ২০৫ হিজরীতে তার জন্ম হয়। হাদীসের সেই সহীহ গ্রন্থের (সহীহ মুসলিম) প্রণেতা অধিকাংশ আলেমগণ যাকে সহীহ বুখারীর পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ বলেছেন। ২৬১ হিজরীতে নাইসাবুরে ইন্তেকাল করেন। অধিক জানতে দেখুন: ইবনুল আসীর: আলবিদায়া ওয়ান-নিহায়া: (১১/৩৩), ইমাম যাহাবী: তাযকিরাতুল হুফফায (২/৫৮৮)।] বর্ণনা মতে, ইয়াহূদী অধ্যুসিত এলাকায় আব্দুল্লাহ ইবন সাহল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নামীয় এক আনসার সাহাবীকে হত্যা করা হলো। সেই সাথে মুসলিম শিবিরে প্রকট সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি হলো যে, কোনো ইয়াহূদীই তাকে হত্যা করেছে। কিন্তু তাদের কাছে এ সন্দেহের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না। আর অভিযোগ উত্থাপনের ক্ষেত্রে সন্দেহ কখনোই সফল হতে পারে না। এজন্যই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ইয়াহূদীকে কোনো ধরণের শাস্তিই প্রদান করেন নি; বরং ইয়াহূদীদের প্রতি শুধুমাত্র এ আহ্বান করলেন যে, তোমরা শপথ করে বল যে, তোমরা এ কাজ কর নি।

এহেন পরিস্থিতিতে আনসারদের মধ্যে হাহাকার রব উঠল। কেননা তারা খুব ভালো করে জানতেন যে, ইয়াহূদীরা মিথ্যা শপথ করতে বিন্দু মাত্র পিছপা হবে না। এ কারণে আনসারদের মধ্যে এ ধারণাও তৈরি হতে চলল যে, তারা তাদের রক্তপণের অধিকার হারাতে বসেছেন। আর আনসারদের বিষণ্নতা ও প্রমাণহীন দাবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিচারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। তিনি ইয়াহুদীদেরকে জরিমানা করা বা তাদের কাউকে কিসাস হিসেবে হত্যা করা কিংবা কোনো প্রকারের শাস্তি প্রদানের আবেদন প্রত্যাখান করলেন। তখন আনসারদের মাঝে এ অনুভূতি জাগ্রত হলো যে, তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কারণ তাদের হত্যাকৃত ব্যক্তির রক্তের বিপরীতে তারা কিছুই পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন যা কোনো মানুষ কল্পনাও করতে পারে না...।

তিনি নিজ উদ্যোগে মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে ঐ আনসারীর রক্তপণ আদায় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। যেন আনসারদের মন শান্ত হয়ে যায় এবং ইয়াহূদীদের উপর প্রতিশোধ চিন্তা না করে। কাজেই ইয়াহূদীদের প্রতি শুধু সন্দেহের কারণে দণ্ডারোপ করা সম্ভব না হওয়া অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্র সেই রক্তপণের বোঝা বহন করে।

এ হাদীসের মন্তব্যে ইমাম নববী [. মহীউদ্দিন আবু যাকারিয়া আন-নববী আদ-দামেশক্বী আশ-শাফে‘ঈ (২৩১-২৭৬ হিজরী)। স্বীয় যমানায় বড় ফকীহগণের অন্যতম একজন। তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন তন্মধ্যে যেগুলো সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন তা থেকে ‘শরহে মুসলিম’ ও ‘আর-রাওজাহ’ অন্যতম। আর যে কিতাবগুলো তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি তা থেকে উল্লেখ্য শরহুল মুহাযযাব যা ‘আল-মাজমু‘ঊ’ নামে নামকরণ করা হয়। এটি তিনি ‘কিতাবুর-রিবা’ পর্যন্ত লিখতে পেরেছিলেন। দেখুন: ইবনুল আসীর: আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: (১৩/২৮৭)।] বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রক্তপণ এ জন্যে আদায় করলেন যেন সংঘাতের পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক সংশোধিত হয়। [. আন-নববী: আল-মিনহাজু শারহু সহীহ মুসলিম ইবন আল-হাজ্জাজ (১১/১৪৭)।] তিনি চেয়েছেন সংঘাতের পথ চিরতরে বন্ধ হোক। যেন আনসাররা রক্তপণ পেয়ে এ বিষয়টি ভুলে যায় আর ইয়াহূদীরাও প্রতিশোধের আতঙ্ক থেকে নিরাপত্তাবোধ করে।

প্রিয় পাঠক! দেখুন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ পদক্ষেপটি কতো মুগ্ধকর ও অভূতপূর্ব!!

নবম হিজরীতে বনু হানীফার প্রতিনিধি দলের সাথে মুসাইলামাহ আল-হানাফী (পরবর্তীতে মুসাইলামাতুল কাযযাব নামে পরিচিতি) যখন মদীনায় আসল তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে যে অবস্থান গ্রহণ করেন সেটি এ ঘটনার চেয়েও বেশি চমকপ্রদ। [. ইবন কাসীর: আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: (৫/৪৮)]

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন:

«قَدِمَ مُسَيْلِمَةُ الْكَذَّابُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَجَعَلَ يَقُولُ إِنْ جَعَلَ لِي مُحَمَّدٌ الْأَمْرَ مِنْ بَعْدِهِ تَبِعْتُهُ وَقَدِمَهَا فِي بَشَرٍ كَثِيرٍ مِنْ قَوْمِهِ فَأَقْبَلَ إِلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعَهُ ثَابِتُ بْنُ قَيْسِ بْنِ شَمَّاسٍ وَفِي يَدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قِطْعَةُ جَرِيدٍ حَتَّى وَقَفَ عَلَى مُسَيْلِمَةَ فِي أَصْحَابِهِ فَقَالَ : لَوْ سَأَلْتَنِي هَذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكَهَا وَلَنْ تَعْدُوَ أَمْرَ اللَّهِ فِيكَ وَلَئِنْ أَدْبَرْتَ لَيَعْقِرَنَّكَ اللَّهُ وَإِنِّي لَأَرَاكَ الَّذِي أُرِيتُ فِيهِ مَا رَأَيْتُ

فَأَخْبَرَنِي أَبُو هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَيْنَمَا أَنَا نَائِمٌ رَأَيْتُ فِي يَدَيَّ سِوَارَيْنِ مِنْ ذَهَبٍ فَأَهَمَّنِي شَأْنُهُمَا فَأُوحِيَ إِلَيَّ فِي الْمَنَامِ أَنْ انْفُخْهُمَا فَنَفَخْتُهُمَا فَطَارَا فَأَوَّلْتُهُمَا كَذَّابَيْنِ يَخْرُجَانِ بَعْدِي فَكَانَ أَحَدُهُمَا الْعَنْسِيَّ وَالْآخَرُ مُسَيْلِمَةَ الْكَذَّابَ صَاحِبَ الْيَمَامَةِ»

“(ভণ্ড নবী) মুসায়লামা কাযযাব রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে মদীনায় আসলো। এসে বলতে লাগলো, মুহাম্মাদ যদি তার (মৃত্যুর) পরে নেতৃত্ব আমাকে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন, তাহলে আমি তার অনুসরণ করব। সে তার কাওমের অনেক লোকজন নিয়ে মদীনায় আসলো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর সাথে ছিলেন সাবিত ইবন কায়স ইবন শাম্মাস রাদিয়াল্লাহু আনহু। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে ছিল খেজুর শাখার একটি টুকরা। অবশেষে তিনি সহচর বেষ্টিত মুসায়লামার সামনে গিয়ে থামলেন এবং কথাবার্তার এক পর্যায়ে বললেন তুমি যদি (আমার কাছে এ) নগণ্য খেজুর ডালের টুকরাটিও দাবি কর, তবু আমি তা তোমাকে দেব না এবং আমি কিছুতেই তোমার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করব না। আর যদি তুমি পাশ্চাতে ফিরে যাও (অবাধ্য হও), তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তোমাকে ঘায়েল করবেন। আর আমি অবশ্যই মনে করি যে, যা আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে, তা তোমার ব্যাপারেই দেখানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, আমি ঘুমন্ত ছিলাম, এমতাবস্থায় আমার কাছে পৃথিবীর ভাণ্ডারসমূহ নিয়ে আসা হলো। তখন আমার হাতে দু’টি সোনার কংকন রেখে দেওয়া হলে সে দু’টি আমার জন্য বড় ভারী মনে হলো এবং এগুলো আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলল। তখন আমার কাছে অহীর মাধ্যমে জানান হলো যে, আমি যেন সে দু’টির ওপরে ফুঁক দেই। তখন আমি ফুঁক দিলে সে দু’টি অন্তর্হিত হয়ে গেল। আমি সে দু’টির ব্যাখ্যা করলাম সে হলো মিথ্যুক (ভণ্ড নবী) যে দু’জনের মাঝে আমি রয়েছি (অর্থাৎ) সান‘আ অধিবাসী আসওয়াদ আল-আনসী এবং ইয়ামামা অধিবাসী মুসায়লামাতুল কাযযাব।” [. সহীহ বুখারী: ( كتاب المناقب : باب علامات النبوة في الإسلام ) হাদীস নং ৩৪২৪; সহীহ মুসলিম: ( كتاب الرؤيا : باب رؤيا النبي صلى الله عليه و سلم ) হাদীস নং ২২৭৩।]

আল্লাহু আকবার। কতো বড় বিষ্ময়কর ঘটনা!!

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন যে, এক লোক তার শর্ত না মানার কারণে ইসলামে দিক্ষীত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করছে। অথচ তার সম্প্রদায়ের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নিয়ে এক স্বপ্নও দেখেছেন। আর নবীদের স্বপ্ন তো সত্যই হয়ে থাকে। তিনি দেখলেন যে, ঐ ব্যক্তি তাঁর অবর্তমানে মিথ্যা নবুওয়াতের দাবী করবে। তার এ অপকর্মের ভয়াবহতা ও তার বিভ্রান্তিকর মতবাদের প্রচার প্রসার ও দাওয়াতের কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলতার বিষয়েও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্যক জ্ঞাত ছিলেন। মুসাইলামার এতো সব গুরুতর অপতৎপরতা, সেই সাথে সে সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমরা যথেষ্ট ক্ষমতাবান, অপরদিকে সে সময় বনু হানীফা ও আরবদের দৈন্যদশা থাকার পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এহেন পরিস্থিতিতেও তাকে শাস্তি প্রদান বা তাকে প্রতিরোধ প্রক্রিয়া গ্রহণ করেন নি। মদীনায় তার স্বাধীনতাবোধকেও হরণ করেন নি। তার অপচেষ্টার জন্য তাকে কোনো দণ্ডারোপও করেন নি।

আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরূপ করার কারণ হলো তিনি চান নি শুধুমাত্র স্বপ্নের ফলাফলের ভিত্তিতে তার ওপর কোনো আদেশ জারি করেন। সে কারণেই তার বিপক্ষে প্রকৃত সাক্ষ‍্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি। অথচ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেছিলেন এবং এ বিষয়ে তাঁর সুষ্পষ্ট ধারণা ও বিশ্বাস ছিল যে, মুসায়লামার দ্বারা অদূর ভবিষ্যতে কী অপকর্ম প্রকাশ পাবে? কিন্তু শুধুমাত্র উপস্থিত সময়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান না থাকার কারণে তিনি মুসায়লামাকে নিরাপদে ছেড়ে দিলেন।

এমনই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনন্য ন্যায়পরায়ণতা...।

ভূপৃষ্ঠে বিদ্যমান অপরাপর কোনো ধরণের ন্যায়-নিষ্ঠারই যার সাথে তুলনা হতে পারে না...।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন