hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ

লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী

৩০
এক. আবু সুফিয়ানের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সদাচরণ
আবু সুফিয়ান কুরাইশের একজন সাধারণ ব্যক্তি ছিল না। তাকে প্রজ্ঞা ও দক্ষ নেতৃত্বের জন্য প্রসিদ্ধির শীর্ষে থাকা কয়েকজনের মধ্যে গণ্য করা হতো এবং ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াত শুরু হওয়ার পরে সে নিরপেক্ষ ছিল না; বরং ইসলামের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়েছিল এবং ইসলামের ক্রমবৃদ্ধি ও অগ্রসরমানতাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। ইসলামকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার সাধনায় লিপ্তদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ছিল অন্যতম। ঐতিহাসিক আল্লামা তাবারী হিজরতের পূর্বে দারুন-নাদওয়াতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা পরিকল্পনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের নামও উল্লেখ করেছেন। [. তারীখুত-তাবারী: তারীখুল উমামি ওয়াল মুলূক (১/৫৬৬)।] মাদানী জীবনে উবায়দাহ ইবন হারেসের [. উবায়দাহ ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিব ইবন আবদি মানাফ আল-ক্বারাশী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেয়েও দশ বছর বেশি বয়সী ছিলেন। রাসূল দারুল আরকামে প্রবেশের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। নিজ দুই ভাইসহ মদীনায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তার আলাদা সম্মান ও মর্যাদা ছিল। অধিকতর জানতে- ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতি ‌‌‌‌‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ ‘আ‌ব (৩/১৪১), ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (৩/৪৪৮), ইবন হাজার: আল ইসাবাহ (৫৩৭৯)।] নেতৃত্বে ইসলামের প্রথম ‌‌‌ সারিয়্যায়’ [. সীরাতে ইবন হিসাম: (২/১৩৬)। ইবন ইসহাক বলেন, এটিই ইসলামের প্রথম সারিয়্যাহ। অন্যদের মতে প্রথম হচ্ছে, সারিয়্যায়ে হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব।] (যুদ্ধাভিযানে) মক্কার কাফিরেদর সেনাপ্রধান ছিল এ আবু সুফিয়ান। সে কাফির সৈন্যদেরকে ‘সানিয়্যাতুল মুররাহ’ [. মুররাহ বা মুরাহ উভয় উচ্চারণ সুদ্ধ। হিজরতের পথে একটি গলি ও একটি দুর্গন্ধময় পুকুরের মধ্যবর্তি প্রসিদ্ধ স্থান। সূত্র: মুহাম্মদ হাসান শুররাব: আল-মা‌আলিমুল আসীরাহ ফিস-সুন্নাতি ওয়াস-সীরাহ (২৫০)] নামক স্থানে একত্রিত করেছিল। যে বণিক কাফেলাকে কেন্দ্র করে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল -আবু সুফিয়ান ছিল সে কাফেলার প্রধান এবং সে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিল। বদর যুদ্ধে শীর্ষ ও নেতৃস্থানীয় কাফিরদের সত্তর জন নিহত হওয়ার সুবাদে কুরাইশের সকল শাখার একমাত্র নেতৃত্ব আবু সুফিয়ানের হাতে এসে যায়। মক্কার ইতিহাসে এটি একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা এবং এজন্যই আবু সুফিয়ান ইসলাম বিরোধী যুদ্ধে কুরাইশ ও আরবের অন্যান্য গোত্রসমূহের একমাত্র সংগঠক ও সমন্বয়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বদরের যুদ্ধে তার এক পুত্র (হানযালাহ) নিহত হয় এবং অপর পুত্র (আমর) মুসিলমদের হাতে বন্দি হয়। [. ইবনু সায়্যিদিন-নাস: উয়ূনুল আসার (১/৪৩২)] ফলে তার প্রতিহিংসার আগুন আরো জলে ওঠে এবং সে সব সময় এ চেষ্টায় থাকত যে, সে নিজ হাতে একজন বিখ্যাত সাহাবী সা‌‘দ ইবন নু‘মান ইবন আকাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বন্দি করে তার পুত্রকে বন্দি করার প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। সে এ মর্মে শপথ করেছে যে, মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে স্ত্রী-সঙ্গম করবে না। বাস্তবেও করেছে তাই। দুইশত অশ্বারোহীকে একত্র করে রাতের অন্ধকারে মদীনার ওপর অতর্কিত হামলা করে বসে। এতে দুইজন আনসারী সাহাবী শহীদ হন। [. একজন মা‘বাদ ইবন আমর আরেকজন তার সাথী যার নাম জানা যায় নি। ইবন ইসহাক পুরা ঘটনা উল্লেখ করেছেন তবে কারো নাম লিখেন নি।] ইতিহাসে এটিকে গাযওয়াতুস-সুয়াইক নামে নামকরণ করা হয়। [. ইবন কাসীর: আস-সীরাতুন-নাবাবিয়্যাহ (২/৫৪০)] উহুদের যুদ্ধে আবু সুফিয়ান মুসলিম সৈন্যদের বিরুদ্ধে তিন হাজার কাফির সৈন্যের নেতৃত্বে ময়দানে অবতীর্ণ হয়। উহুদ হচ্ছে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংকট ও মুসীবতের ইতিহাস। যুদ্ধের শুরুতে সাহায্য আসলেও শেষের দিকে তা আবার মুসীবতে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং কাফিরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। সেদিন সত্তরজন মুসলিম শহীদ হন। আবু সুফিয়ান সেদিন সালামা ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে [. সালামা ইবন সাবিত ইবন ওয়াকাশ আল-আনসারী আল-আশহালী। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। উহুদ যুদ্ধে তার ভাই আমর ইবন সাবিতসহ শহীদ হয়েছেন। তিনি নিহত হয়েছেন আবু সুফিয়ান ইবনুল হারাব এর হাতে। অধিকতর জানতে- ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতি‘আব (২/২০০), ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (২/২৯১), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (৩৩৬২)।] হত্যা করে। [. ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (১/৪৬৬)।] কেউ কেউ বলেন, গাসীলুল মালাইকাহ হানজালাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও [. হানজালাহ ইবন আবি আমের। বিয়ের রাতে যুদ্ধে গিয়েছেন। যুদ্ধের আহ্বান শুনেই বেরিয়ে পড়েছেন। ফরজ গোসলও করতে পারেননি। অতঃপর ফেরেস্তারা তাকে গোসল দিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তাকে আবু সুফিয়ান হত্যা করে নি; তাকে হত্যা করেছে শাদ্দাদ ইবন আসওয়াদ ইবন শু‘ঊব আল-লাইসী। অধিকতর জানতে:- ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতি‘আব (১/৪৩২), ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (১/৬২১), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (১৮৫৮)।] আবু সুফিয়ানই হত্যা করেছিল এবং বলেছিল যে,‌ ‘হানযালার বিনিময়ে হানযালাহ’। অর্থাৎ আমার পুত্র হানযালার প্রতিশোধে সাহাবী হানযালাহকে হত্যা করা হয়েছে। [. তারীখুত-তাবারী: তারীখুল উমামি ওয়াল মুলূক (২/৬৮)।] সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিলো আরবের যুদ্ধরীতিকে সম্পূর্ণ বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সেদিনের তার নির্লজ্জ উল্লাস প্রকাশের সে স্মৃতি। সেদিন উহুদ যুদ্ধের সমাপ্তি লগ্নে তার এবং মুসলিমদের মাঝে প্রত্যক্ষ কথোপকথন চলছিল। ইমাম বুখারী রহ. ও অন্যরা বর্ণনা করেছেন যে,“উহুদের দিন যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর আবূ সুফিয়ান একটি উঁচু স্থানে উঠে বলল, কাওমের মধ্যে মুহাম্মাদ জীবিত আছে কি? একথা সে তিনবার বলল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তার কোনো উত্তর দিও না। সে আবার বলল, কাওমের মধ্যে ইবন আবূ কুহাফা (আবূ বকর) বেঁচে আছে কি? একথাও সে তিনবার বলল। সে পুনরায় বলল, কওমের মধ্যে ইবনুল খাত্তাব কি জীবিত আছে? একথাও সে তিনবার বলল। তারপর সে তার সাথীদের দিকে ফিরে বলল, এরা সকলেই নিহত হয়েছে। বেঁচে থাকলে নিশ্চয় জবাব দিত। এ সময় উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজেকে সামলাতে না পেরে বললেন, ‘হে আল্লাহর দুশমন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। যে জিনিসে তোমাকে লাঞ্ছিত করবে আল্লাহ তা বাকি রেখেছেন’। পরিশেষে আবূ সুফিয়ান বলল, আজকের দিন বদর যুদ্ধের বিনিময়ের দিন, যুদ্ধ কূপ থেকে পানি উঠানোর পাত্রের মতো (অর্থাৎ একবার এক হাতে আরেকবার অন্য হাতে)। (যুদ্ধের ময়দানে) তোমরা নাক-কান কাটা কিছু লাশ দেখতে পাবে। আমি এরূপ করতে আদেশ করি নি। অবশ্য আমি এতে অসন্তুষ্টও নই। অতঃপর সে চিৎকার করতে লাগল, ‘হুবালের জয়, হুবালের জয়’। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে বললেন, তোমরা তার উত্তর দাও। তারা বললেন, আমরা কী বলব? তিনি বললেন, তোমরা বল ‘আল্লাহ সমুন্নত ও মহান’। আবূ সুফিয়ান বলল ‘আমাদের উযযা আছে, তোমাদের উযযা নেই’। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তার জবাব দাও। তারা বললেন, আমরা কী জবাব দেব? তিনি বললেন, বল ‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক, তোমাদের তো কোনো অভিভাবক নেই’। [. সহীহ বুখারী: ( كتاب المغازي، باب غزوة أحد ) হাদীস নং ৩৮১৭, আবু দাউদ: হাদীস নং ২৬৬২, নাসাঈ: হাদীস নং ৮৬৩৫]

এ কথোপকথনে আবু সুফিয়ান মুসলিম শহীদদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকৃতি, নাক-কান কাটা হওয়া ও পেট বিদীর্ণ হওয়ার প্রতি তার আনন্দ ও মনোতুষ্টি প্রকাশ করেছে। অথচ আরবরা জাহেলী যুগে কিংবা ইসলাম পরবর্তী যুগে কোনো কালেই এটি পছন্দ করতো না। এ সব কিছু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করা এবং তাদের ওপর ধ্বংসলীলা চালানোর প্রতি তার মনস্কামনা ও আগ্রহাতিশেয্যরই বহিঃপ্রকাশ।

যায়েদ ইবন দাসানাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু [. যায়েদ ইবন দাসানাহ ইবন বাইয়াযাহ আল-আনসারী আল-বাইয়াযী। বদর ও উহুদে অংশ নিয়েছেন। রজী‘ দিবসে খুবাইব ইবন ‘আদী এর সাথে বন্দি হয়েছেন। মক্কায় সফওয়ান ইবন উমাইয়্যার নিকট বিক্রি করে দেওয়া হলে সে তাকে মেরে ফেলে। এটি ছিল চতুর্থ হিজরীতে। অধিকতর জানতে- ইবনু আবদিল বার: আল-ইসতি‘আব (২/১২২), ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (২১/১৪৭), ইবন হাজার: আল-ইসাবাহ (২৯০০)]-এর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত হয়ে মুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে গাদ্দারী-নীতি অবলম্বনের স্পষ্ট স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে তার এ মানসিকতা আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। [. তারীখুত-তাবারী: তারীখুল উমামি ওয়াল মুলূক (২/৭৮)।] শুধু তাই নয়, আবু সুফিয়ানের এ মানসিকতার সর্ববৃহৎ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পঞ্চম হিজরীতে সম্মিলিত বাহিনী কর্তৃক মদীনা অবরোধের সময়। সে অবরোধের সময় দশ হাজার কাফির সৈন্যের নেতৃত্বে থাকা আবু সুফিয়ানসহ সকলে মিলে মদীনাকে সম্পূর্ণরূপে মুসলিম-শূন্য করে ফেলতে চেয়েছিল। শান্তি ও স্বস্তির শহর মদীনাকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করা এবং সেখানকার ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সকলকে ভীতি ও আতংকগ্রস্থ করে তোলার জন্য কাফিরদের সকল শাখা-উপশাখাকে সমবেত করা ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে আবু সুফিয়ানের এক ক্ষমার অযোগ্য মহা অপরাধ।

অষ্টম হিজরী পর্যন্ত আবু সুফিয়ান মক্কার অধিপতি ছিল। এর দু বছর পূর্বে হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হয়। সন্ধি-চুক্তিতে বনু বকর গোত্র মুশরিকদের এবং খযা‘আহ গোত্র মুসলিমদের পক্ষ অবলম্বন করে। অতঃপর বনু বকর কর্তৃক প্রসিদ্ধ সেই চুক্তিভঙ্গের বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটে এবং খোয‘আহ গোত্রের কয়েকজন লোক নিহত হয়। এ ক্ষেত্রে কুরাইশরা বনু বকরকে সহযোগিতা করেছিল। [. তারীখুত-তাবারী: তারীখুল উমামি ওয়াল মুলূক (২/১৫৪)] ফলে হুদায়বিয়ার সন্ধি রহিত হয়ে যায় এবং এখান থেকেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ হাজার সাহাবীদের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কা বিজয়ের অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঘটনা অনেক দীর্ঘ। বিস্তারিত বিবরণও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের লক্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে যে, ইসলাম বিরোধী যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের ভূমিকা ছিল অন্যান্য শত্রুনেতাদের তুলনায় অনেক বেশি এবং মুসলিম রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার ক্ষেত্রে তার অবস্থান ছিল সকলের শীর্ষে।

প্রিয় পাঠক! এ সকল জটিল প্রেক্ষাপটগুলোকে মনের পর্দায় মেলে ধরুন! অতঃপর মক্কা বিজয়ের দিন মক্কায় প্রবেশের প্রাক্কালে গ্রেফতারকৃত আবু সুফিয়ানকে হাতে পেয়ে তার সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীরূপ আচরণ করেছিলেন সেদিকে দৃষ্টিপাত করুন! এ বিষয়ে ইসলামের সুমহান দর্শন ও নবী চরিত্রের মাহাত্ম্য ভালোভাবে অনুধাবনের জন্য আমরা পুরো ঘটনাটি সবিস্তারে উল্লেখ করছি-

যুগ পাল্টে গেছে। সময় বদলেছে অনেক। আবু সুফিয়ান তার জীবনের অত্যন্ত সংকীর্ণ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। তার যাবতীয় কর্ম-তৎপরতা থেমে গেছে। সব ধরণের চিন্তা-ফিকির থেকেও সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। এটা ঐ সময়ের কথা যখন মক্কার মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে হঠাৎ করে মুসলিমদের বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়েছে এবং আবু সুফিয়ান ভালো করেই জানে যে, সে হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমদের প্রধান টার্গেট। ঐ সময় সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলিমদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জানতে মরিয়া হয়ে উঠলো এবং এক ধরণের ভীতি ও আতংক তাকে গ্রাস করে নিলো। ইতোমধ্যে সে তার এক পুরোনো দিনের বন্ধু -যিনি বর্তামানে মুসলিমদের দলভুক্ত- রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আব্বাস ইবন আব্দুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে সামনে পেয়ে গেল। তখন তার সাহায্য কামনা করে বলে উঠল, ‘আমার মাতা-পিতা আপনার ওপর কুরবান হোক, এখন উপায়?’

এরপরে মক্কার এ শত্রুনেতা ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে যা ঘটেছিল চলুন তা আমরা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর পুত্র আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর ভাষায় পাঠ করি-

সে দিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবু সুফিয়ানকে বললেন,

«واللَّهِ لئن ظفر بك ليضربن عنقك ..!!»

“আল্লাহর শপথ! তোমাকে গ্রেফতার করতে পারলে তো অবশ্যই তোমার গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হবে।”

এটি ছিলো আবু সুফিয়ানের ব্যাপারে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। শুধু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-ই নন, ইসলামের বিরুদ্ধে আবু সুফিয়ানের অবস্থানের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত যে কোনো ব্যক্তিই আবু সুফিয়ানের ব্যাপারে এ একই কথা বলবে। কিন্তু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবু সুফিয়ানের সাথে পূর্ব বন্ধুত্বের কারণে কিংবা কুরাইশদের প্রাণ রক্ষার প্রতি অত্যাধিক আগ্রহের কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবু সুফিয়ানের জন্য সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং বললেন, ‘তুমি আমার সাথে এ খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে চল। আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে যাব এবং তোমার জন্য নিরাপত্তা চেয়ে নেব’। তাই আবু সুফিয়ান আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-র সাথে সওয়ার হলো। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, অতঃপর আমি তাকে নিয়ে রওয়ানা করলাম। যখনি মুসলিমদের কোনো আগুনের/মশালের/চুলার পাশ দিয়ে যেতাম তখনই তারা বলতো, ‘কে এখানে?’ পরে যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চর এবং তাতে তাঁর চাচাকে দেখতে পেত তখন বলতো, ‘এটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চর এবং এতে রয়েছে তাঁরই চাচা। এক পর্যায়ে আমরা উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর আগুনের/মশালের/চুলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, ‘কে এখানে?’ এ কথা বলে আমার দিকে এগিয়ে এসে খচ্চরের পেছনে আবু সুফিয়ানকে দেখে চিনে ফেললেন এবং বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর শপথ! হে আল্লাহর দুশমন! সমস্ত প্রশংসা সে আল্লাহর যিনি তোকে পাইয়ে দিয়েছেন’। এ কথা বলেই তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাঁবুর দিকে দৌড়ে ছুটলেন। আমিও খচ্চরকে ছেড়ে দিলাম এবং ধীরগামী আরোহী ধীরগতির বাহনজন্তুকে যতটুকু পেছনে ফেলতে পারে ততটুকু খচ্চরকে পেছনে রেখে এগিয়ে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে প্রবেশ করলাম। ইতিঃমধ্যে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুও প্রবেশ করেছেন এবং বলছেন, ‘এ হলো আল্লাহর দুশমন আবু সুফিয়ান, কোনো প্রকার শান্তি/সন্ধি চুক্তিকালীন সময়ের বাইরে আল্লাহ তাকে আমাদের হাতে এনে দিয়েছেন। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই।’ তখন আমি (আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে বসলাম এবং তার মাথায় হাত রেখে বললাম, ‘আল্লাহর শপথ! আজ রাতে আমি ছাড়া তাঁর সাথে আর কেউ একান্ত আলাপ করতে পারবে না’। উমার যখন বারবার একই কথা বলছিলেন তখন আমি তাকে বললাম, চুপ কর, হে উমার! আল্লাহর শপথ! যদি এ লোকটি বনু আদী গোত্রের কেউ হতো তাহলে তুমি এরূপ বলতে না। কিন্তু এ লোকটি হচ্ছে বনু আবদে মানাফ গোত্রের’। এটা শুনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আপনি চুপ করুন, হে আব্বাস! আপনি এ ধরণের কথা বলবেন না। আল্লাহর শপথ! আপনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেছেন তখন আপনার ইসলাম গ্রহণ আমার কাছে আমার বাবা খাত্তাব যদি ইসলাম গ্রহণ করতেন তার ইসলাম গ্রহণের চেয়েও অধিক প্রিয় ছিল। আর এটা এ জন্য যে, আমি জানতাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আপনার ইসলাম গ্রহণ আমার বাবা খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে অধিক প্রিয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আব্বাস! তুমি তাকে তোমার তাবুতে নিয়ে যাও, সকালে আমার নিকট নিয়ে এসো’। অতঃপর আমি তাকে আমার তাবুতে নিয়ে গেলাম। সে আমার নিকট রাত্রি যাপন করল। পরদিন সকালে তাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিয়ে গেলে তিনি তাকে দেখেই বললেন,

«وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ، أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ؟»

“হে আবু সুফিয়ান! তোমার মঙ্গল হোক। তোমার কি এখনও এ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আসে নি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বুদ নেই?”

আবু সুফিয়ান বলল, আমার পিতা-মাতা আপনার ওপর কুরবান হোক! আপনি কতই না সম্মানিত, কতই না ধৈর্যশীল আর কতই না উত্তম সম্পর্ক স্থাপনকারী! এখন তো আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, যদি আল্লাহর সাথে কোনো মা‘বুদ শরীক থাকত তবে অবশ্যই আমার কোনো কাজে আসত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ، أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ؟»

“হে আবু সুফিয়ান! তোমার মঙ্গল হোক, এখনও কি তোমার সময় আসে নি যে, আমাকে আল্লাহর রাসূল বলে বিশ্বাস করবে?”

আবু সুফিয়ান বলল, ‘আমার পিতা-মাতা আপনার ওপর কুরবান হোক! আপনি কতই না সম্মানিত, কতই না ধৈর্যশীল আর কতই না আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী! এ ব্যাপারে এখনও মনে কিছুটা খটকা রয়েছে’। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘হে আবু সফিয়ান, তোমার নাশ হোক! তোমার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার আগেই মুসলিম হয়ে যাও এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মা‘বুদ নেই আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’।

এবার আবু সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে মুসলিম হয়ে গেলেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ আবু সুফিয়ান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কিছুটা সম্মানপ্রিয় মানুষ। সুতরাং তাকে বিশেষ একটা কিছু দান করুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ থাকবে, যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সে নিরাপদ থাকবে, (এবং যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থাকবে। [. এ কথাটি লেখকের মূল বইতে নেই; কিন্তু প্রায় সব বর্ণনায় রয়েছে বলে সংযুক্ত করে দেওয়া হলো- অনুবাদক।]) অতঃপর আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মক্কাবাসীকে এ সংবাদ দেওয়ার জন্য চলে যেতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

«يَا عَبَّاسُ، احْبِسْهُ بِمَضِيقِ الْوَادِي عِنْدَ حطْمِ الْخيلِ [. حطم শব্দটি ازدحام অর্থে। حطْم الْخيل অর্থ হচ্ছে, অশ্বারোহী বাহিনীর ভিড়। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে -خَطْم الْجَبَلِ خَطْمِ শব্দটি أنف অর্থে। خَطْم الْجَبَلِ এর অর্থ হচ্ছে, নাকের মতো পাহাড়ের বাড়তি অংশ।] ، حَتَّى تَمُرَّ بِهِ جُنُودُ اللَّهِ»

“হে আব্বাস! তাকে বাহিনীর ভিড়ের নিকট (অথবা নাকের মতো পাহাড়ের সেই বাড়তি অংশের ওপর) দাঁড় করাও যে দিকে পাহাড়ি সরুপথ গিয়েছে, যাতে সে আল্লাহর বাহিনীগুলো অতিক্রম করার দৃশ্য অবলোকন করতে পারে।” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মতে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে নিয়ে সেখানে দাড়ালেন। (আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন) প্রতিটি গোত্র নিজেদের বাহনজন্তুতে আরোহন করে অতিক্রম করছিল। যখনই কোনো গোত্র অতিক্রম করতো তখন তিনি বলতেন, এরা কারা? আমি বলতাম, বনু সালীম। তিনি বলতেন, বনু সালীমের সাথে আমার কী সম্পর্ক? অতঃপর অন্য গোত্র অতিক্রম করলে তিনি বলতেন, এরা কারা? আমি বলতাম, মুযাইনাহ। তিনি বলতেন, মুযাইনাহর সাথে আমার কী সম্পর্ক? তিনি এভাবেই বলছিলেন। এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহিনী অতিক্রম করল যা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্রের দরুন কালো বর্ণ দেখাতে লাগল। সেখানে আনসার এবং মুহাজিররা ছিলেন। লোহার বর্ম ও শিরস্ত্রাণের দরুন চক্ষু ছাড়া তাদের আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এরা কারা? আমি বললাম, মুহাজির ও আনসারদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বললেন, ‘কার ক্ষমতা আছে এদের মুকাবিলা করে? আল্লাহর শপথ! তোমার ভাতিজার রাজত্ব আজ অনেক বড় আকার ধারণ করেছে।’ আমি বললাম, হে আবু সুফিয়ান! এটি হলো নবুওয়াত। তিনি বললেন, তা ঠিক। আমি বললাম, ‘এবার দ্রুত আপনার কওমের নিকট যান’। এরপর তিনি চলে গেলেন এবং মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা করতে লাগলেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে গেছেন। তোমরা তাঁর মুকাবিলা করতে পারবে না। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাহ এ ঘোষণা শোনে এগিয়ে এলো এবং তার দাঁড়ি ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল,

اقْتُلُوا الدَّسَمَ الأَحْمَسَ [. دسم শব্দের অর্থ হচ্ছে, ময়লাযুক্ত। এখানে أسود তথা কুশ্রী অর্থে ব্যবহৃত। আর أحْمَس শব্দের অর্থ হচ্ছে, সাহসী ও উত্তেজিত। এখানে دني তথা ইতর অর্থে ব্যবহৃত। সূত্র: আল-মু‘জামুল ওয়াফী (৪৬৯ ও ৪৬-৪৭)।] ، فَبِئْسَ طَلِيعَة قَوْمٍ !

“তোমরা এ কুশ্রী ইতরকে হত্যা করে দাও। হায়! কতই না খারাপ লক্ষণ!”

আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘তোমাদের নাশ হোক! এ মহিলা যেন তোমাদেরকে জীবন রক্ষা করা থেকে ধোকায় না ফেলে। যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ’। লোকেরা বলল, ‘তোমার নাশ হোক, তোমার ঘরে আমাদের কী হবে?’ তিনি বললেন, ‘যে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে সেও নিরাপদ এবং যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ’। এটা শুনে লোকেরা নিজেদের ঘর ও মসজিদের দিকে বিভক্ত হয়ে ছুটতে লাগল। [. তাবারী, সহীহ বুখারী ( كتاب المغازي، باب أين ركز النبي صلى الله عليه وسلم الراية يوم الفتح ) উরওয়াহ এর মুরসাল সমূহের মধ্যে (৪০৩০), আল-মাতালিবুল আলিয়া (৪৩৬২), দালাইলুল বায়হাকী (৫/৩৩-৩৫), সীরাতে ইবন হিশাম (২/৩৯৯-৪০৫)]

এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য উদারতা ও মানবতার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এমনিভাবে এ ঘটনার মাঝে তাঁর একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত হওয়া এবং দাওয়াতের প্রতি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষারও অতুলনীয় নযীর স্থাপিত হয়েছে।

যেখানে নেতৃস্থানীয় সকলের মতে তরবারী-ই আবু সুফিয়ানের একমাত্র সমাধান সেখানে তিনি তার সাথে আন্তরিকতা পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতিতে দলীল-প্রমাণের বিশ্লেষণমূলক সংলাপ চালিয়ে গেলেন। আবার তাওহীদের প্রশ্নে আবু সুফিয়ানের উত্তরও যথেষ্ট এবং সন্তোষজনক ছিলো না। তবে এটা ঠিক যে, সে তাওহীদকে একেবারেই অস্বীকারও করে নি; কিন্তু রেসালাতের প্রশ্নে সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে, তার মনে এখনো খটকা বা সন্দেহ রয়েছে। এরপর যখন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে ভয় দেখালেন যে, তোমার হত্যা অত্যাসন্ন, ইসলাম ছাড়া তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল।

এখানে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দীন ইসলামে প্রবেশ করানোর ব্যাপারে বল প্রয়োগ করেন নি; বরং এতে তিনি শুধু আবু সুফিয়ানের প্রতিই নয় গোটা কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। কেননা ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে আবু সুফিয়ানের হত্যাকে কেউই খারাপ দৃষ্টিতে দেখতো না এবং আগে ও পরের পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রনায়কই এ ব্যাপারে সমালোচনা করার মতো কিছু পেত না; বরং বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতিতে এ ধরণের ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেওয়া তো রীতিমত যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ে। কারণ, এ আবু সুফিয়ানই মাত্র দু’বছর পূর্বে (পরীখার যুদ্ধে [. অনুবাদক।]) মদীনাবাসীকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল এবং এ ব্যক্তিই কয়েকদিন আগে মুসলিমদের সাথে কৃত সন্ধি-চুক্তি ভঙ্গ করেছিল যাতে (খোয ‌‌ ‘আহ গোত্রের [. অনুবাদক।]) অনেক নারী-পুরুষকে জীবন দিতে হয়েছিল।

ব্যাপারটি তো এমনও হতে পারতো যে, আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণকে আন্তিরকতা থেকে নয়, শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য হয়েছে বলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্দেহ করতে পারতেন এবং তা মেনে না নিতে পারতেন; কিন্তু তিনি আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণে কোনো প্রকার সন্দেহ পোষনণ না করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তা মেনে নিলেন এবং তার দৃঢ়তা ও আন্তরিকতার নিরিক্ষণও করলেন না; বরং মূহুর্তের মধ্যেই তাকে ক্ষমা করে দিলেন। এক সেকেন্ডেই তিনি আবু সুফিয়ানের সকল কষ্টদায়ক স্মৃতি এবং এমন সকল যন্ত্রনাদায়ক ক্ষত ও আঘাতের কথা ভুলে গেলেন যার ঘা এখনো শুকায়নি। তাঁর অন্তরে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা কিছুই স্থান পায় নি। ইবলিস-শয়তানের সকল কারসাযি-ই এখানে চরম ব্যর্থ।

এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতেই ক্ষমা ও উদারতার মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু, ঘটনা এখানেই শেষ নয়; এর পরে যা ঘটেছে তা পৃথিবীর সকল উত্তম আদর্শ ও মহৎ চরিত্রের সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর ব্যাখ্যা শুধু একটাই যে, তিনি ছিলেন একজন মহান নবী...।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানকে এমন একটি জিনিস দিলেন যা অনন্তকাল তার সম্মান ও মর্যাদার বাহক হয়ে থাকবে। তিনি শুধু আবু সুফিয়ানকেই নিরাপত্তা দিলেন না; বরং ঐ সকল ব্যক্তিদেরকেও নিরাপত্তা দিলেন যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে। ঘোষণা করলেন,

من دخل دار أبي سفيان فهو آمن

“যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হবে। ‍‍‍‍

কতোই না ভাগ্য! কতইনা সম্মান ও মর্যাদা আবু সুফিয়ানের...!!

আমরা এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাহাত্ম্যের সীমা ও পরিধি অনুমান করতে পারবো না যতক্ষণ না আমরা নিজেদেরকে এ ধরণের প্রেক্ষাপটে কল্পনা করতে পারবো।

সত্য ও বাস্তবকে সকলেরই স্বীকার করে নেওয়া উচিৎ। বিশ্ববাসীর নিকট আমরা বাস্তব-সত্যের স্বীকৃতি চাই এবং প্রশ্ন রাখতে চাই যে, মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো নিকট কি এমন আচরণ আশা করা যেতে পারে? এরপরেও কি কেউ এ দাবী করতে পারে যে, মুসলিমরা অন্যেদরকে স্বীকার করে না এবং অন্যদের সাথে সদাচরণ করে না? এখনো কি এমন কেউ আছেন যারা বলবেন যে, ইসলাম হচ্ছে সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের ধর্ম?

আমাদের অভাব শুধু জ্ঞানালোকের। নবী চরিত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা অতি সামান্য, শুধুমাত্র উপরের খোসা পর্যন্ত। আমরা যদি এর গভীরে প্রবেশ করতে পারি এবং জগতবাসীর সামনে তা তুলে ধরতে পারি তাহলে জ্ঞানদরিদ্র বিশাল জনগোষ্ঠির চোখের সামনের পর্দা সরে যাবে। তারা সত্যালোককে চিনতে ও গ্রহণ করতে পারবে।

আবু সুফিয়ানের সাথে যা ঘটেছে তা নবীচরিত্রের কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং একই ধরণের আচরণ আমরা দেখতে পাই ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচনাকারী ও ইসলাম বিরোধী আন্দোলনের অনেক সংগঠক নেতার সাথেও। ইকরামা ইবন আবু জাহালের সাথে তার এমনই আচরণ ছিল যা কখনো ভুলার মতো নয়।

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন