মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।
আসসালামু আলাইকুম, Hadith.one বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে! আমাদের সার্ভারের মেয়াদ ১১ অক্টোবর ২০২৫ এ শেষ হবে, এবং এবং ওয়েবসাইট টি চালানোর জন্য আমাদের কোনো ফান্ড নেই।
🌟 আপনার দান এই প্ল্যাটফর্মকে বাঁচাতে পারে এবং প্রতিটি হাদিস পড়ার মাধ্যমে সদকাহ জারিয়ার অংশীদার হতে পারেন!
🔗 অনুগ্রহ করে আপনার দানের মাধ্যমে আমাদের এই ওয়েবসাইটটি চালিয়ে নিতে সাহায্য করুন!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!
অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ
লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী
৭
প্রথম অধ্যায়: ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/400/7
সর্বপ্রথম আমাদের এটা জানা উচিৎ যে, একজন মানুষ হিসেবে তার প্রতি সাধারণ বিবেচনায় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী কী? তাহলে আমরা জানতে পারব অমুসলিমদের বিষয়গুলোকে ইসলাম কীভাবে গ্রহণ করে এবং তাদের সাথে ইসলামের আচরণবিধি কী?
নিশ্চই একজন মানুষ সাধারণ মানবিক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত এবং সাধারণভাবে এ সম্মানের বিষয়টি সকল মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। জাতি, ধর্ম ও বর্ণে নির্বিশেষে এতে কোনো তারতম্য নেই। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় গ্রন্থে ঘোষণা করেন:
“আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিযিক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে মর্যাদা দিয়েছি।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৭০]
আদম সন্তানের এ সম্মানের বিষয়টি ব্যাপক তথা সকল মানুষই এতে অর্ন্তভুক্ত। আল্লাহ নিজেই আপন অনুগ্রহের ছায়া মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্যই বিস্তৃত করেন। কাজেই সকল মানুষকেই তিনি জলে-স্থলে বাহন ও রিযিক দান করেন, সকল মানুষকেই আল্লাহর সৃষ্টি জগতের সব কিছুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
ইসলামের এ দৃষ্টিভঙ্গিটি সকল মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। ইসলামী শরী‘আতে সকল ক্ষেত্রেই মানবকুলের প্রতি এ সম্মান রয়েছে। শুধু তাই নয়, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল কথা এবং কাজেই এ দৃষ্টিভঙ্গিটির প্রতিফলন ঘটেছে। এটা আমাদের জন্য এক মহান ও অনন্য পন্থা ও পদ্ধতির সন্ধান দেয়, যে পন্থা ও পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় বিরুদ্ধাচারণকারী ও অস্বীকারকারীদের সাথে আচরণ করেছেন।
সকলের সাথেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ ছিল সম্মানসূচক। কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে অপদস্থ করা বা কারো প্রতি যুলুম করা কিংবা স্বীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং তার মর্যাদাহানী করা বৈধ নয়। এ বিষয়টি কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত থেকে স্পষ্টত ফুটে উঠে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“আর বৈধ কারণ ছাড়া সে প্রাণকে হত্যা করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৫১]
পবিত্র কুরআনের এ আদেশটি ব্যাপক অর্থবোধক। কাজেই মুসলিম এবং অমুসলিম সকল মানব প্রাণই এখানে উদ্দেশ্য। অতএব ইসলামের আদল তথা ইনসাফ ও ন্যায়ের বাস্তবায়নও সাধারণভাবে সকলের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। ধর্ম ও বর্ণ বিবেচনায় এখানে তারতম্য করা যাবে না।
ইমাম কুরতবী রহ. বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ কর্তৃক হারাম হওয়া প্রাণকে হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। চাই সেটি মু’মিনের প্রাণ হোক বা চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের। তবে যদি কারো দ্বারা এমন কোনো কাজ সংগঠিত হয়, যার দরুন তাকে হত্যা করা ওয়াজিব সেটা ভিন্ন ব্যাপার। [কুরতুবী ( الجامع لأحكام القرآن ) ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩২ (মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল আনসারী আল খাযরাজী আল মালেকী আল কুরতুবী, বিখ্যাত মুফাসসীর, ( الجامع لأحكام القرآن ) নামক গ্রন্থের প্রণেতা। মৃত্যু: ৬৭১ হিজরী। অধিকতর জানতে দেখুন- ( الزركلي الأعلام ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২২।] অতঃপর তিনি একাধিক হাদীস উল্লেখ করেছেন। যেমন,
আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধকে অন্যায়ভাবে কোনো কারণ ছাড়া হত্যা করেছে, আল্লাহ তার উপর জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন।” [আবু দাঊদ, হাদীস নং ২৭৬০। নাসায়ী, হাদীস নং ৪৭৪৭। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২০৩৯৩। দারেমী, হাদীস নং ২৫০৪।]
ইসলামী শরী‘আতে সকল শ্রেণির মানুষের প্রতি সর্বপ্রকার যুলুম নিষিদ্ধ। আর এ নিষিদ্ধকরণ অগণিত আয়াতে কারীমাহ ও হাদীসে নববী দ্বারা প্রমাণিত এবং এ বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত দিবসে বান্দার হিসাব-নিকাশের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
“আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মীযানসমূহ স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭]
এখানেও ন্যাবিচারের এ বিধানটি সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোনো শর্তযুক্ত হয় নি। কাজেই সেদিন কোনো মানবাত্মার প্রতিই যুলুম করা হবে না। চাই সেই মানবাত্মা আল্লাহতে বিশ্বাসী হোক বা কাফির হোক, মুসলিম বা নাসরানী, ইয়াহূদী কিংবা আরো যত একঘেয়ে বা ভিন্ন চিন্তাধারী হোক না কেন কারো প্রতিই যুলুম করা হবে না। নিশ্চই যুলুম খুবই জঘন্য কাজ, আল্লাহ তা‘আলা নিজ ও নিজ বান্দাদের জন্য যুলুম চিরতরে হারাম করে দিয়েছেন। আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীসে কুদসী বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে আমার বান্দারা আমার নিজের জন্য যুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মধ্যেও তা চিরতরে হারাম করেছি, কাজেই তোমরা পরস্পর একে অন্যের উপর যুলুম করো না” [. সহীহ মুসলিম ( كتاب البر والصلة والآداب : باب تحريم الظلم ); মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২১৪৮৫; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৯০ ( في الأدب المفرد ); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৬১৯; বায়হাকী, হাদীস নং ৭০৮৮ ( في شعب الإيمان ); সুনান কুবরা হাদীস নং ১১২৮৩।]
এটাই হচ্ছে মানুষের ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। এটা আত্ম-উপলব্ধি, সম্মান এবং মর্যাদাকর দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাপারে কতই না হৃদয়গ্রাহী ও মহৎতর পন্থা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যখন তার পাশ দিয়ে একজন ইয়াহূদীর শবদেহ অতিক্রম করছিল। ইমাম মুসলিম রহ. ইবন আবী লাইলার সূত্রে বর্ণনা করেন,
“কায়স ইবন সা’দ ও সাহল ইবন হুনায়িফ দু’জনই কাদেসিয়ায় অবস্থান করছিলেন। তাদের পাশ দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল। এতে তারা দু’জনই দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাদেরকে বলা হলো যে, এ জানাযাটি একজন কাদেসিয়াবাসীর। তাঁরা দু’জনই বললেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশ দিয়ে একটি জানাযা যাচ্ছিল, তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল জানাযাটি ইয়াহূদীর। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত এ পন্থা বা অবস্থানটি কি শ্রেষ্ঠতম নয়?
এটাই হচ্ছে শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি।
নিশ্চয়ই রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত অবস্থান বা আচরণের দ্বারা সকল শ্রেণির মানষের জন্য মুসলিমদের হৃদযন্ত্রে আত্ম-উপলব্ধি এবং সম্মানের বীজ বপন করেছেন এবং এরূপ সম্মানসূচক আচরণ তিনি সাধারণভাবেই করেছেন, তার (ঐ ইয়াহূদীর) আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্যের জন্যে নয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে করেছেন এবং অন্যদের এরূপ করার আদেশ দিয়েছেন -একথা জানার পরও যে, ঐ লোকটি একজন ইয়াহূদী ছিল।
তাহলে আমরা দেখতে পেলাম যে, ঐ সমস্ত ইয়াহূদী যারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে ছিল -তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্য রাসূল হওয়ার আয়াতসমূহ (নিদর্শানাবলী) দেখেছে এবং অখণ্ডনীয় দলীলাবলী ও উজ্জলতর সুষ্পষ্ট প্রমাণাদি শুনেছে। তার পরও তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইস সালাম-এর ওপর ঈমান আনে নি; বরং তারা নানানভাবে আক্রমণ করে তাঁকে হেনস্থা করেছে। ইয়াহূদীদের এতসব আপসহীনতা ও একগুয়েমির পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরই একজন অখ্যাত ব্যক্তির শবহেদের সম্মানে দাড়াঁলেন অথচ সে কোনো প্রসিদ্ধ লোক ছিল না, যদি হতো তাহলে তার ব্যপারে হাদীসের বাণীতে নাম ব্যতিরেকে শুধু “একজন ইয়াহূদী” বলা হতো না। সে কখনই মুসলিমদের পরিচিত ছিল না। এসব কিছুই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বোত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট বৈ কিছুই নয়। ঐ ইয়াহূদীর অপ্রসিদ্ধ হওয়ার এটাও একটা প্রমাণ যে, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তাকে চিহ্নিত করেছে তার ইয়াহুদিত্বের বৈশিষ্ট্য দিয়ে, তার নাম দিয়ে নয়। অতঃপর তাঁর দাঁড়ানোকে “সে কি একজন মানুষ নয়” কথা দ্বারা প্রত্যয়ন করেছেন, বৈধতা দিয়েছেন ও দৃঢ় করেছেন; কিন্তু তিনি ঐ ইয়াহূদীর কোনো বিশেষ শ্রেষ্ঠত্বের কথা উল্লেখ করেন নি।
এটাই হচ্ছে দীন ইসলামে একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রকৃত মূল্যায়ন। (এবং এটাই হচ্ছে ইসলামী শরী‘আতে মানব মূল্যায়নের মূল দৃষ্টিভঙ্গি।)
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক এ সম্মান সূচক দাঁড়ানো সামান্যতম সময়ের জন্য ছিল না; বরং শবদেহটি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত হয়েছিল।
জাবের ইবন আব্দুল্লাহ সূত্রে ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন,
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ এক ইয়াহূদীর শবদেহের সম্মানে শবদেহটি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিলেন।” [. সহীহ মুসলিম ( كتاب الجنائز : باب القيام للجنازة ) হাদীস নং ৯৬০; নাসায়ী হাদীস নং ১৯২৮; আহমদ হাদীস নং ১৯২৮, সুনানে বায়হাকী, হাদীস নং ৬৬৭০।]
আমার ধারণা মতে ইয়াহূদীর জানাযা অতিক্রম করা এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের শবদেহ দৃষ্টিগোচর হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকার মহৎ ও উদার মনোভাবটি সকল সাহাবায়ে কেরাম ও তৎপরবর্তী মুসলিমদের হৃদয়ে এ সুদৃঢ় চেতনা জাগ্রত করেছে যে, ইসলাম একজন মানুষকে শুধু মানুষ হওয়া হিসেবে তার যথাযোগ্য মর্যাদা দেয় এবং সম্মানের চোখে দেখে। পরবর্তীতে কায়েস ইবন সা‘দ [. কায়েস ইবন সা‘দ ইবন উবাদাহ, আরবের বিচক্ষণতম ব্যক্তিদের একজন। সমর কৌশলে পারদর্শী, অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বংশের লোক, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকেই পতাকাবাহী করেছিলেন। তিনি ৫৯ মতান্তরে ৬০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। অধিকতর জানতে দেখুন: ابن الأثير : أسد الغابة -٤ |262 ، و ابن حجر : الإصابة، الترجمة رقم (7176) ، وابن عبد البر : الاستيعاب – 3\350.] এবং সাহল ইবন হুনাইফ [. সাহাল ইবন হুনাইফ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সর্বক্ষণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকতেন এবং ওহুদের যুদ্ধেও সুদৃঢ় ছিলেন। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মদীনা ছেড়ে বসরায় যাওয়ার সময় তাঁকে মদীনায় প্রতিনিধি হিসেবে রেখে গেলেন। তিনি উষ্ট্রীর যুদ্ধে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাথে অংশ গ্রহণ করেন। সর্বশেষ আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে ফারস্যের গভর্ণর নিযুক্ত করেন। তিনি ৮৮ হিজরীতে কুফায় মৃত্যুবরণ করেন। অধিকতর জানতে দেখুন: ابن الأثير : أسد الغابة -2 |335 ، و ابن حجر : الإصابة، الترجمة رقم (5323) ، وابن عبد البر : الاستيعاب – 2\223.] রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক একজন (মজুসী) অগ্নিপূজকের শবদেহের সম্মানে দাঁড়ানোর মাধ্যমে ইসলাম কর্তৃক প্রদত্ত এ সম্মানের বিষয়টিই বাস্তবায়িত হয়েছে।
আর মাজুসী হলো যারা কোনো মৌলিক বা আসমানী কিতাবধারী নয় তারা দীন ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বিশ্বাসে বিশ্বাসী; বরং তারা ইসলাম বিরোধী যুদ্ধবাজ সম্প্রদায়। এতদসত্ত্বেও সাহাবীগণ ইসলামের মানব মূল্যায়নের ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন। কেননা তাঁরা ইয়াহূদীর শবদেহকে সম্মান দেখিয়েছেন এবং তার সম্মানে দাড়িয়েছেন। এটাই হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে আমাদের মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি। আর এটাই হচ্ছে সেই মহৎ মূলনীতি যা মুসলিমগণ অমুসলিমদের সাথে আচরণের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে পোষণ করে।
অতঃপর বিশ্বাসের জগতে যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরোদ্ধাচরণ করে ও ভিন্ন নীতি অবলম্বন করে তাদের ব্যাপারে ইসলামের আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এ যে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক, সম্ভাব্য বরং অনির্বায বিষয়। কেননা কখনোই এমন কোনো যামানা পাওয়া যায় নি যখন কোনো একটি ইস্যুতে সকল ‘আলেমগণ ঐকমত্য পোষণ করতেন। অতএব উলুহিয়্যাত (প্রভুত্ব) ও তাওহীদ (একত্ববাদ) এর মতো ইস্যুতে সমগ্র মানব জাতির ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হবে এটা কি করে সম্ভব? আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“যদি তোমার রব চাইতেন তবে সকল মানুষকে এক উম্মতে পরিণত করতেন। কিন্তু তারা পরস্পর মতোবিরোধকারী রয়ে গেছে।” [সূরা হূদ, আয়াত: ১১৮]
কাজেই মুসলিমগণ এ কথা খুব সহজেই মেনে নেন যে, আকীদাহগত দিক থেকে ভিন্ন মতাবলম্বী থাকতেই পারে এবং তারা একথাও জানে যে, এদের দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত করাও একদম অসম্ভব। এজন্যেই মুসলিমগণ বিরুদ্ধবাদীদের সাথে স্বাভাবিকভাবেই সহাবস্থান মেনে নেয় এবং এ জন্যেই ইসলামী শরী‘আত অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সর্বোত্তম, প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুষ্পষ্ট আচরণ পরিকাঠামো প্রদর্শন করে।
অতএব, এ পটভূমিগুলোতে লক্ষ্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম সম্প্রদায় এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, কিয়ামতের দিবসে হিসাবের ফয়সালা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই হাতে। কোনো ব্যক্তি যদি ঈমান বা কুফুরকে গ্রহণ করতে চায় সেটা তার ওপরই বর্তাবে এবং প্রতিদান দিবসে স্বীয় রবের নিকট তারই হিসাব দিতে হবে। মুসলিমদের চিন্তার জগতে যদি আপনি পরিভ্রমন করেন তাহলে এমন একজন মুসলিম দা‘ঈ তথা দীনের পথে আহ্বানকারী ব্যক্তিও পাবেন না, যিনি ভিন্ন মতাবলম্বীদের ইসলামের ছায়াতলে আসা বা তাদের দীন পরিবর্তন করার ব্যাপারে বল প্রয়োগের মানসিকতা পোষণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর যদি তোমার রব চাইতেন, তবে জমিনের সকলেই ঈমান আনত। তবে কি তুমি বাধ্য করবে, যাতে তারা মু’মিন হয়?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৯৯]
মুসলিমদের মধ্যে লক্ষ্য করার মতো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, তাঁরা খুব সহজেই অমুসলিমদের কাছে নিজেদের সুষ্পষ্টতম দীনের দাওয়াত নিয়ে পৌঁছে যেতে পারে। আর এমতাবস্থায় যদি অমুসলিমদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দীনি দাওয়াতকে বাধাগ্রস্তও করে তবুও কোনো দা‘ঈ কর্তৃক তারা জিজ্ঞাসিত হবে না বা কেউ তাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“আর তারা যদি তোমার সাথে বাকবিতণ্ডা করে, তাহলে বল, ‘তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ, আল্লাহ সে বিষয়ে কিয়ামতের দিন ফয়সালা করে দেবেন।” [সূরা আল-হজ: ৬৮-৬৯]
এ লজিক তথা যৌক্তিকতা এবং ইসলামী শরী‘আতে সকল মানবপ্রাণকে যথোপযুক্ত মূল্যায়ন বাস্তবতার কারণে এবং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সকল আদম সন্তানকে সৃষ্টির সেরা ঘোষনার কারণে ইসলামী শরী‘আতে মানব শ্রেষ্ঠত্য এবং মহত্ব বজায়ে অনেক শর‘ঈ বিধান বর্ণিত হয়েছে। বিশেষত আদল (ন্যায়পরায়নতা), রহমত (অনুগ্রহ), উলফত (অনুরাগ), তা‘আরুফ (পরিচিতি বা সামাজিক শিষ্টাচার) ইত্যাদি। এছাড়াও অনন্য ও উত্তম চরিত্রের অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এ সকল বিধি-বিধানগুলো সাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে, যা মুসলিম-অমুসলিম সকলকেই পরিবেষ্টন করে। কাজেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সাথেই চারিত্রিক মাহাত্ম্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
আর ইয়াহূদী সম্প্রদায় কর্তৃক তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতকে বিকৃত করে উত্তম আচরণকে শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধকরণ এবং অন্যদের ক্ষেত্রে সকল প্রকার ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞকে বৈধতা দানের মতো গর্হিত কাজ উম্মতে মুসলিমাতে কখনও সম্ভবপর হবে না।
আমাদের ইসলামী শরী‘আতে রহমত তথা দয়া ও অনুগ্রহের দৃষ্টান্তে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের রহমতস্বরূপ প্রেরিত হওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট নয়; বরং ধর্মীয় মতপার্থক্য ও ক্ষেত্র বিশেষ উগ্রতা থাকা সত্যেও সকল মানবগোষ্টিই এ রহমতের অন্তর্ভুক্ত।
আর তা‘আরুফ (পরস্পর পরিচিতি বা সামাজিক শিষ্টাচার) এর দৃষ্টান্তে আল্লাহ তা‘আলা বলেন
“হে মানুষ, আমরা তোমাদেরকে এক নারীও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
অত্র আয়াতের আঙ্গিকে এ কথাই প্রতিয়মান হয় যে, তা‘আরূফ তথা পরস্পরে সামাজিক শিষ্টাচার সুন্দর করার বিষয়টিও নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না; বরং চেষ্টা করতে হবে যাতে সকল জাতি ও গোষ্টিকে যেন পারস্পরিক পরিচিতি ও সু-সম্পর্ক স্থাপনের আওতায় আনা যায়। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তো স্বীয় অনুগ্রহে জমিনে অবস্থানরত সকল মানুষের রিযিকের নিশ্চয়তা দিয়েছেন ও জমিনের সকল কিছুকে নিজেদের প্রয়োজনে মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন এবং এতে তিনি মুমিন ও কাফির হওয়ায় কোনো তারতম্য রাখেন নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, জমিনে যা কিছু আছে এবং নৌযানগুলো, যা তাঁরই নির্দেশে সমুদ্রে বিচরণ করে সবই আল্লাহ তোমাদের জন্য অনুগত করে দিয়েছেন। আর তিনিই আসমানকে আটকে রেখেছেন, যাতে তাঁর অনুমতি ছাড়া তা জমিনের উপর পড়ে না যায়। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি বড়ই করুণাময়, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৬৫]
উক্ত আয়াতে নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল এবং জলরাশিকে অনুগত করে দেওয়ার বিষয়টি সকল মানুষের জন্যই অবধারিত। আর এ আয়াতের চূড়ান্ত মন্তব্যে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যই সাধারণভাবে সহানুভূতি ও অনুগ্রহ প্রযোজ্য। তাওরাতকে বিকৃতকারী ইয়াহূদীদের মতো স্ব-সম্প্রদায়ের সাথে উত্তম আচরণ আর ভিন্ন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক কাজের বৈধতা ইসলাম দেয় না।
“আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও জমিনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৪]
ক্ষমা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য আর উক্ত আয়াতে যে ক্ষমার কথা বলা হয়েছে সেটা শুধু মু’মিনদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং এখানে ক্ষমা শব্দটি ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে যা মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্য প্রযোজ্য।
আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ন্যায়পরায়নতার বিধান বর্ণনা করেছেন, তখন তিনি এটাকে শুধু মু’মিনদের জন্য বা মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের জন্যই নির্ধারণ বা সীমাবদ্ধ করেন নি; বরং তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন এ কথার যে, নগণ্যতম ব্যক্তির জন্যও ন্যায়নিষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ০৮]
অনুগ্রহ, অনুরাগ, ইনসাফ এবং সহনশীলতার এটাই হচ্ছে সেই প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুমহান চরিত্র মাধুর্য আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামী শরী‘আতের উল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করেছেন।
ইসলামের এ দৃষ্টিভঙ্গির সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক কথা হচ্ছে এ যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মহিমান্বিত চরিত্র মাধুর্য এমন এক সময়ে করে দেখিয়েছেন, যে সময়ের সভ্যতম রাজন্যবর্গ এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের থেকেও এটা দুষ্প্রাপ্য ছিল।
আর এ বিষয়ে আরো সুষ্পষ্ট ধারণা পেতে চাইলে পাঠকবৃন্দের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তারা সেই বিকৃত তাওরাত গ্রন্থ যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেও ছিল এখনও রয়েছে -তার কিছু বিধি-বিধান ও রীতি-নীতির প্রতি একটু দৃষ্টিপাত করবেন। তাহলে পাঠক সুষ্পষ্টতই শরী‘আতে ইসলামিয়াহ এবং মানব উদ্ভাবিত ভিত্তিহীন মতবাদ, যা মূল তাওরাত গ্রন্থে অনুপ্রবেশ করা হয়েছে -তার মধ্যে বিস্তর ফারাক উপলব্ধি করতে পারবেন।
যথা ( سفر يشوع ) [. উল্লেখ্য যে, سفر يشوع (জিহুশোর বই) এটি মূলত ইবরানী ভাষায় রচিত বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের এক ধর্মাযোদ্ধার দিকে সম্পর্কিত গ্রন্থ। যার নাম ছিল يشوع بن نون মূসা আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর তিনি তার ৮৪ বছর বয়সে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছিলেন এবং ১১০ বছর পযর্ন্ত জীবিত ছিলেন। এ পুরো সময়টুকুই সে বিকৃত বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় সম্প্রসারণ যুদ্ধে ও সেই লক্ষ্যে অতিবাহিত করেছেন। এটি ইসরাঈলীদের নিকট একটি পবিত্রতম গ্রন্থ। উইকিপিডিয়া আরবি ভার্সন। (গুগল অনুসন্ধান)] জিহুশো নামক গ্রন্থের কিছু অংশ তুলে ধরছি তাতেই ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের অন্যদের সাথে আচরণ পদ্ধতি কিরূপ ছিল তার একটি রূপরেখা প্রকাশ পাবে:
“জিহুশোয় এবং ইসরাঈলি সৈন্যরা নাখীশ থেকে উজলুনের দিকে রওয়ানা করে উজলুন নগরীটি অবরোধ করল। তার অধিবাসীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এ দিনই তাদের ওপর জিহুশোয় বাহিনী কর্তৃত্ব গ্রহণ করল এবং নগরবাসীকে ধ্বংসাত্মকভাবে দমন করল। প্রত্যেকে তরবারী দিয়ে দফারফার ফায়সালা গ্রহণ করল। যেমনটা করেছিল পূর্বে লাখীশ নগরীতে। অতঃপর জিহুশোয় তার বাহিনী নিয়ে উজলুন থেকে হিবরুনের দিকে ফিরল এবং সেখানে তার অধিবাসীদের ওপর আক্রমন করে তাদের ওপর কর্তৃত্ব গ্রহণ করল। হিবরুন ও তার আশেপাশের জনপদ ধ্বংস করার পাশাপাশি হিবরুনের শাসকসহ সকল জনগোষ্টিকে হত্যা করল। এমনকি উজলুনের মতো এখানেও অশ্বগুলোও তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পায় নি। অতঃপর জিহুশোয় দাবীর নগরীর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাদের ওপর আক্রমন করে কর্তৃত্ব গ্রহণ করে নিল এবং আশপাশের জনবসতিসহ পুরো এলাকা ধ্বংস করল ও তাদের শাসকসহ সকলকে হত্যা করল। এখানেও অশ্বসমূহও পরিত্রাণ পায় নি। মোটকথা: দাবীর নগরী ও তার শাসকের ওপর সে আচরণই করা হলো যেমনটি করেছিল লুবনা নগরী ও তার শাসকের সাথে। [. سفر يشوع কোনো সংস্করণে سفر يوشع লিখা হয়েছে: ১০ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৯।]
ইয়াহূদী-খ্রিস্টান কর্তৃক এ ধরণের ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপের উপমা যুগে যুগে অসংখ্য রয়েছে। এ সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে সেগুলোর পরিসংখ্যান টানা সম্ভব নয়। তবু সামান্যতম উপমা পেশ করলাম যাতে ইসলামী শরী‘আতের আযমত (মাহাত্ম্য), অনুগ্রহ, ন্যায়-নিষ্ঠা ও সহনশীলতার বিষয়টি পাঠকবৃন্দের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। কেননা আমরা জানি এ শরী‘আত এমন এক সময় আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে যখন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে এ ধরণের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং লজ্জাষ্কর পদক্ষেপের ঘনঘটা পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
অপরাপর ধর্মাবলী থেকে ইসলামের উদার নীতির তুলনামূলক পার্থক্য ও স্বাতন্ত্রিকতার অর্থ এ নয় যে, ইসলাম ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরকে নিজের প্রতি আহ্বান করতে আগ্রহী নয়; বরং মূল বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরম শত্রু যারা তাদের শত চক্রান্ত ও অপকর্মের পরও তিনি এটাই প্রার্থনা করতেন যে, তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে নিত! যার বিশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আবু জাহল এবং উমার ইবনুল খাত্তাব-এর জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দো‘আ। তারা ইসলাম ও মুসলিমদের ঘোর শত্রু। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য দো‘আ করলেন,
«اللهم أعز الإسلام بأحب هذين الرجلين إليك بأبي جهل أو بعمر بن الخطاب قال وكان أحبهما إليه عمر بن الخطاب» .
“হে আল্লাহ, উমার এবং আবু জাহল এ দু’জনের মধ্যে আপনার নিকট অধিকতর পছন্দনীয় ব্যক্তি দ্বারা আপনি ইসলামকে শক্তিশালী করুন। অতঃপর বর্ণনাকারী বলেন, যদিও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উমারই অধিকতর পছন্দনীয় ছিল।” [. তিরমিযী ( كتاب المناقب : باب في مناقب عمر بن الخطاب ) হাদীস নং ৩৮৬৩; আহমদ, হাদীস নং ৫৬৯৬; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস নং ৪৪৮৫; মিশকাত, হাদীস নং ৬০৩৬।]
বাস্তবতা হচ্ছে এ যে, অমুসলিমদের দীর্ঘকাল ধরে আল্লাহর রাস্তা থেকে বিমুখ হয়ে থাকা এবং দীন ইসলাম নিয়ে তাদের নানা বিভ্রান্তির পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ে কখনো প্রতিশোধের স্পৃহা জাগ্রত হয় নি এবং কখনও তিনি তাদের সাথে কোনো প্রকার অপব্যবহার বা কূটচালের বাসনাও পোষণ করেন নি। মূলতঃ তিনি সম্পূর্ণ এর বিপরীতমুখী চিন্তায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এদের মনোজগত অসুস্থ -এদের চিকিৎসা প্রয়োজন। এরা দিকভ্রান্ত -এদের সুষ্পষ্ট প্রমানাদিসহ সঠিক পথ দেখানো প্রয়োজন। কাজেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এহেন দাওয়াতী অভিযান এদের জন্য মুক্তি, সম্মান এবং সঠিক পথ প্রাপ্তির আলোকবর্তিকা রূপে উদিত হয়েছে।
এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, এটাই ছিল তাঁর পথ ও পদ্ধতি এবং মানুষের সাথে আচরণের পটভূমি ও হৃদয়গ্রাহী তথ্য।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল অমুসলিমের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর ব্যাপারে ছিলেন প্রবল আগ্রহী। সেজন্যেই তিনি সকল ইয়াহূদী-খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজকদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন। দাওয়াতের ব্যাপারে তিনি সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বনে সদা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যদি কখনো কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় ইসলামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করত -তখন তিনি প্রবল বিমূর্ষ হয়ে যেতেন। তাই তিনি যেন এহেন কারণে এতটা বিমূর্ষ ও মর্মপীড়িত না হন সে জন্য কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“অতএব, তাদের জন্য আফসোস করে নিজে ধ্বংস হয়ো না।” [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ০৮]
কোনো অমুসলিমের ইসলাম গ্রহণে এহেন তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকার পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম কবূল করার জন্য কারো ওপর বল প্রয়োগকে সমর্থন করেন নি; বরং
﴿لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِ﴾ [ البقرة : ٢٥٦ ]
“দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬]
এ আয়াতকে তিনি স্বীয় জীবনে কর্মপন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বস্তুত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে এ এক বিস্ময়কর ও অদ্ভুত ভারসাম্যতার বাস্তবায়ন ঘটেছে। তিনি যখন কাউকে স্বীয় রব থেকে নিয়ে আসা সত্যের দিকে আহ্বান করতেন তখন তিনি সর্বস্ব দিয়েই দাওয়াত দিতেন; কিন্তু কখনই কাউকে তিনি বল প্রয়োগ করে নিজের দিকে ধাবিত করতেন না।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগত বাণীটি কতইনা চিত্তাকর্ষক এবং এ বাণী দ্বারাই সাধারণত একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিভঙ্গিও ফুটে ওঠে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে,
“আমার ও লোকদের দৃষ্টান্ত এমন ব্যক্তির ন্যায়, যে আগুন জ্বালালো আর যখন তার চতুর্দিক আলোকিত হয়ে গেল, তখন পতঙ্গ ও ঐ সমস্ত প্রাণী যেগুলো আগুনে পড়ে, তারা তাতে পড়তে লাগলো। তখন সে সেগুলোকে আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য টানতে লাগলো; কিন্তু তারা আগুনে পুড়ে মরল। তদ্রূপ আমি তোমাদের কোমরে ধরে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করি অথচ তারা তাতেই প্রবেশ করবে।” [সহীহ বুখারী: ( كتاب الرقاق : باب الانتهاء عن المعاصي ) হাদীস নং ৬১১৮; সহীহ মুসলিম: ( كتاب الفضائل : باب شفقته صلى الله عليه وسلم على امته ) হাদীস নং ২২৮৪।]
এটাই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যত্নশীল এবং দয়াময় দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে কঠোরতা ও স্বেচ্ছাচারীতার লেশমাত্রও ছিল না।
পরিশেষে আমি পবিত্রতা বর্ণনা করছি সেই মহান সত্তার যিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ মহান চরিত্রমাধুর্য দ্বারা পরিপূর্ণ ও মহিমান্বিত করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাদিস শেয়ার করুন
Or Copy Link
https://hadith.one/bn/book/400/7
রিডিং সেটিংস
Bangla
English
Bangla
Indonesian
Urdu
System
System
Dark
Green
Teal
Purple
Brown
Sepia
আরবি ফন্ট নির্বাচন
Kfgq Hafs
Kfgq Hafs
Qalam
Scheherazade
Kaleel
Madani
Khayma
অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন
Kalpurush
Kalpurush
Rajdip
Bensen
Ekushe
Alinur Nakkhatra
Dhakaiya
Saboj Charulota
Niladri Nur
22
17
সাধারণ সেটিংস
আরবি দেখান
অনুবাদ দেখান
রেফারেন্স দেখান
হাদিস পাশাপাশি দেখান
এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন
মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।