hadith book logo

HADITH.One

HADITH.One

Bangla

Support
hadith book logo

HADITH.One

Bangla

System

এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন
hadith book logo

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ প্রসঙ্গ

লেখকঃ ড. রাগিব আস-সারজানী

১৫
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: অমুসলিমদের দূত ও প্রতিনিধিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নববী প্রোটোকল
এ বিষয়ে সবচেয়ে অবাক করা মতো ঘটনা হচ্ছে, ফারস্য সম্রাট কিসরার পক্ষ থেকে মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গ্রেফতার করার জন্য প্রেরিত দূতদ্বয়ের সাথে তাঁর আচরণ। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করতে লাগলেন তখন পারস্য সম্রাট কিসরা-এর নিকটও একটি পত্র পাঠান। পত্র পড়ে কিসরার মেজাজ বিগড়ে গেল, সে পত্রটাকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলল এবং ইয়ামানের গভর্ণর বাযানের কাছে পত্র লিখল যাতে সে তার বাহিনী প্রেরণ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গ্রেফতারপূর্বক তার সামনে হাযির করে। এ অস্বাভাবিক উত্তেজনাকর মুহুর্তেও অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিল তা জানতে হলে চলুন আমরা ঘটনাটি শুরু থেকে অধ্যয়ন করি।

ইয়াযীদ ইবন হাবীব [. প্রখ্যাত তাবে‘ঈ ইয়াযীদ ইবন হাবীব এ বর্ণনাটি উকবাহ ইবন আমের জুহানী থেকে বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মদ ইবন সাঈদ বলেন, ইয়াযীদ ইবন হাবীব অধিক হাদীস বর্ণনাকারী, নির্ভরযোগ্য। মৃত্যু ১২৮ হিজরীতে।] বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবন হুযাফা আস-সাহমীকে [. আব্দুল্লাহ ইবন হুযাফা ইবন কায়স আস-সাহমী আল-কারাশী। প্রথম যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং দ্বিতীয় দফা আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীদের মধ্যে ছিলেন। বদর যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর যুগে রোমীয়দের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারা তাকে ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করতে চেয়েছিল; কিন্তু পারে নি। অবশেষে আল্লাহ তাকে মুক্তি দিয়েছেন এবং তার উসিলায় অন্য বন্দিদেরকেও। অধিকতর জানতে দেখুন: ইবন হাজার: ‘আল-ইসাবাহ’ (৪৬২০); ইবন আব্দুল বার: ‘আল-ইসতি‘আব’ (২/২৬৭); ইবনুল আসীর: ‘উসদুল গাবাহ’ (৩/১০৬)।] পারস্য সম্রাট কিসরা (আবরুভেজ/খসরু পারভেজ ইবন হরমুজ)-এর নিকট পত্র দিয়ে প্রেরণ করেন। প্রেরিত পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

«بسم الله الرحمن الرحيم .. من محمد رسول الله إلى كسرى عظيم فارس، سلام على من اتبع الهدى، وآمن بالله ورسوله، وشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأن محمدًا عبدُه ورسوله، وأدعوك بدعاء الله، فإني أنا رسول الله إلى الناس كافة، لأنذر مَنْ كان حيًا، ويحقَّ القول على الكافرين، فأَسْلِمْ تَسْلَمْ، فإن أَبَيْتَ فإنَّ إثم المجوس عليك» “এ পত্র মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর পক্ষ থেকে পারস্যের মহান সম্রাট কিসরার প্রতি। যারা সত্য-কঠিন পথের অনুসরণ করেছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদের প্রতি সালাম। আমি আপনাকে মহান আল্লাহর আহ্বানের দ্বারাই আহ্বান জানাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি গোটা মানবজাতির প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসেবে এসেছি। যাতে, যারা জীবিত আছে তাদেরকে সতর্ক করতে পারি এবং কাফিরদের জন্য আল্লাহর বাণী সত্যে পরিণত হবে। আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তি ও নিরাপদে থাকুন। যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন তাহলে এ মাজুসীদের (অগ্নি উপাসক) সকল পাপ আপনার ওপর বর্তাবে।”

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পত্র পেয়ে কিসরা পত্রটি ছিড়ে ফেলে এবং বলে যে, ‘এ লোক আমার নিকট পত্র লেখে অথচ এ আমার অধীনস্ত!’ সাথে সাথে সে ইয়ামেনে তার প্রতিনিধি শাসক বাযানকে লিখল, ‘তুমি হিজাযের এ ব্যক্তির (মুহাম্মাদ) নিকট দু’জন এমন সাহসী লোক পাঠাও, যারা তাকে পাকড়াও করে আনতে পারে।’ কিসরার এ পত্রের প্রেক্ষিতে ‘বাযান’ রাসূলুল্লাহর নিকট একটি পত্রসহ দু’জন দূত পাঠায়। একজনের নাম বাবওয়াইহ, অন্যজন খারাখসারাহ। পত্রে সে বাহকদ্বয়ের সাথে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার নিকট উপস্থিত হবার নির্দেশ দেন এবং পত্রবাহকদ্বয়ের প্রধান বাবওয়াইহকে বলে দেয় যে, ‘এ লোকের শহরে যাও, তার সাথে কথা বল এবং আমাকে তার সংবাদ এনে দাও’। পত্রসহ বাহকদ্বয় তায়েফে উপস্থিত হয়। সেখানে তারা মক্কার কুরাইশ বংশের কিছু লোকের দেখা পায় এবং তাদের নিকট রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাস করে অবগত হয় যে, তিনি মদিনায়। কুরাইশ ব্যক্তিবর্গ লোক দু’টির পরিচয় ও উদ্দেশ্য অবগত হয়ে দারুণ উৎফুল্ল হয়। তাদের একজন আনন্দের আতিশয্যে এমনও বলে যে, তোমাদের জন্য সুসংবাদ! এবার শাহেনশাহ ইরান কিসরা তাকে দেখে নেবেন। লোকটির জন্য তিনিই উপযুক্ত। লোক দু’টি মদিনার পথে রওয়ানা হলো এবং এক সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজেদের পরিচয় দিল এবং বাবওয়াইহ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলল, কিসরা বাযানের কাছে পত্র লিখেছেন বাযান যেন আপনার কাছে এমন কাউকে পাঠায় যে আপনাকে কিসরার কাছে নিয়ে যাবে। বাযান আপনাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। যদি আপনি আমাদের সাথে যেতে রাজি হন তাহলে বাযান সম্রাট কিসরা –এর নিকট আপনার ব্যাপারে সুপারিশ করবেন। ফলে সম্রাট আপনার কোনো ক্ষতি করবেন না। আর যদি আপনি যেতে না চান তাহলে আপনি তো তাকে চেনেন, তিনি আপনাকে আপনার সম্প্রদায় ও দেশ সব কিছুকেই ধ্বংস করে দিতে পারেন। পত্রবাহক দুইজন দাঁড়ি মুণ্ডিত এবং দীর্ঘ গোঁফধারী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের চেহারার প্রতি তাকাতে বিরক্তিবোধ করলেন এবং বললেন, তোমাদের নাশ হোক! কে তোমাদের এরূপ (দাঁড়ি মণ্ডিত এবং গোঁফ লম্বা) করতে নির্দেশ দিয়েছে? তারা উত্তর করল, ‘আমাদের রব (কিসরা)’। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আর আমার রব আমাকে দাঁড়ি বড় করতে এবং গোঁফ ছাঁটতে নির্দেশ দিয়েছেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘এখন আপনারা যান, আগামীকাল আমার কাছে আসুন’। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসমান থেকে এ খবর এসে গেল যে, ‘আল্লাহ কিসরা আবরুভেজের ওপর তার পুত্র শিরাওয়ায়হিকে ক্ষমতাবান করেছেন। সে তার পিতাকে হত্যা করেছে’ এবং এ সংবাদও এসেছে যে, কোন শহরে কীভাবে ও কখন এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। পরের দিন লোক দু’টি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এলে তিনি তাদেরকে এ সংবাদটি জানালেন। তারা বললো, আমরা কি আপনার পক্ষ থেকে এ সংবাদ আমাদের রাজাকে জানাবো? বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমরা আমার পক্ষ থেকে তাকে এ সংবাদ অবহিত করো। তাকে এ কথাও বলো যে, আমার এ দীন, আমার এ রাষ্ট্র কিসরার সাম্রাজ্যের শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তাকে আরো বলবে, যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন তাহলে যেসব অঞ্চল ও জনগোষ্ঠী আপনার শাসনাধীনে আছে তা সবই ঠিক থাকবে।’ যাওয়ার সময় তিনি খারাখসারাহকে উপঢৌকন স্বরূপ স্বর্ণ-রৌপ্য খচিত একটি কমরবন্দ (বেল্ট) দিয়েছিলেন। লোক দু’টি ইয়ামেনে ফিরে গেল এবং বাযানের নিকট রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সব কথা খুলে বললো। বাযান সব কথা শুনে বললেন, আল্লাহর কসম! এ কোনো রাজা-বাদশাহর কথা নয়। তিনি যেমন বলেছেন, আমার মনে হয় তিনি একজন নবী। আমরা তাঁর কথার সত্য-মিথ্যা নিরূপণের জন্য অপেক্ষা করবো। যদি সত্য হয় তাহলে তিনি অবশ্যই একজন নবী। আর সত্য প্রমাণিত না হলে পরবর্তীতে তাঁর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এ কথা বলার অল্পক্ষণের মধ্যে তার হাতে ‘শিরাওয়ায়হি’-এর একখানা পত্র এসে পৌঁছে, অতঃপর এই যে, আমি কিসরাকে (আবরুভেজ) হত্যা করেছি। আমার এ পত্র আপনার নিকট পৌঁছার পর আপনি ও আপনার নিকট যারা আছে, আমার আনুগত্য মেনে নিবেন। আর ইতিঃপূর্বে কিসরা যে ব্যক্তির ব্যাপারে (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনাকে লিখেছিলেন, আমার পরবর্তী নির্দেশ না পৌঁছা পর্যন্ত তাঁকে কোনো রকম বিরক্ত করবেন না।

শিরাওয়ায়হির এ পত্র পাঠ শেষে বাযান বলে উঠেন, নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তিনি এবং তার সাথে ইয়ামেনের মাটিতে পারস্যের যত লোক ছিলেন সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। বাবওয়াইহ বাযানকে বলে, ‘আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর মতো প্রভাবশালী কোনো মানুষের সাথে কখনো কথা বলি নি’। বাযান জানতে চাইল, ‘কেন তার সাথে কি পুলিশ ছিল?’ সে বলল, ‘না, কোনো পুলিশ কিংবা বাহিনী ছিল না’। [. তারীখুত-তাবারী (৩/৯০), ইবন কাসীর, আস-সীরাতুন-নববিয়্যাহ (২/১৫৮-১৬১)।]

এ পয়েন্টে এসে আমরা বিরোধীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে নবী চরিত্রের এমন কিছু অবাক করার মতো বিষয় লক্ষ্য করলাম যা প্রকাশ করার সঠিক ভাষা আমাদের জানা নেই। দেখুন, কিসরার এ দূতদ্বয় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায়, রাসূলের ভূমিতে, রাসূলের বাড়িতে এসেছে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং তাদের আচরণও ছিল সম্রাট কিসরার ন্যায়ই মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতো ঔদ্ধত্যপূর্ণ!! এতকিছুর পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধীরতা, স্থীরতা ও স্বভাবসুলভ নম্রতার বিচ্যুতি ঘটে নি; বরং তিনি অত্যন্ত নির্ভরতা ও পরম নিশ্চয়তার সাথে তাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত আসমানী সংবাদ প্রদান করলেন এবং বললেন যে, ইয়ামেনের গভর্ণর বাযানকে আমার পক্ষ থেকে বলবে যে, ‘যদি আপনি ইসলাম গ্রহণ করেন তাহলে যেসব অঞ্চল ও জনগোষ্ঠী আপনার শাসনাধীনে আছে তা সবই ঠিক থাকবে’ এবং যাওয়ার সময় তিনি দূতদ্বয়ের একজন (খারাখসারাহ) কে মূল্যবান উপঢৌকনও দিয়েছিলেন, যা ছিল স্বর্ণ-রৌপ্য খচিত একটি কমরবন্দ (বেল্ট)।

ধর্ম-বিশ্বাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, স্বভাব-প্রকৃতি ও চিন্তা-চেতনা সবদিক থেকেই বিরোধী প্রতিপক্ষের কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের সাথে এ ধরণের উন্নত কুটনৈতিক আচরণ সত্যিই মনুষ্য-বিবেক স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো, যা চিন্তার জগৎকে ভাবিয়ে তোলে এবং মানবতাবোধকে জাগ্রত করে। এখানে এমন কোনো সাংবিধানিক বা প্রশাসনিক নিয়মনীতি ছিল না যা একজন সেনাপ্রধানকে তার প্রাণ-নাশের হুমকিদাতা ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনকারী কট্টরবিরোধী প্রতিপক্ষের সাথে এ ধরণের নম্র ব্যবহার করতে বাধ্য করেছিল; বরং এটা ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে সদা বিদ্যমান সেই প্রবণতা যা তার সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ ও শর‘ঈ বিধানের আওতায় পরিচালিত করে। আর এ বৈশিষ্ট্য-শ্রেষ্ঠত্ব শুধু ইসলামেই রয়েছে। কেননা, যে তার জীবনের প্রতিটি নড়া-চড়ায় আপন প্রতিপালককে অনুসরণ করে আর যে শুধুই কামনা তাড়িত হয়ে ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে উভয় কি সমান হতে পারে? এ তো আসমান জমিনের পার্থক্য।

অমুসলিমদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আচরণ গতানুগতিক ধারার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটা ছিল সকল অমুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে তার অবশ্য পালনীয় মূলনীতি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট প্রেরিত তাঁর পত্রাবলী থেকে এ কথাটি আরো স্পষ্ট উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল অমুসলিমদের সাথেই সর্বোত্তম কুটনৈতিক আচরণ করতেন। ইহুদী, খ্রিস্টান, মূর্তিপূজক, অগ্নিপূজক, আরব কিংবা অনারব সকল রাজন্যবর্গকেই তিনি সমান মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তৎকালীন পৃথিবীর সকল রাজা-বাদশাহদের প্রতি ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত অনেকগুলো পত্র প্রেরণ করেছেন। সকলকেই তিনি মহান, প্রধান, সম্রাট ইত্যাদি গুণবাচক বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন। কোনো একজন অমুসলিমকেও বিশেষায়িত করতে সংকীর্ণতা বোধ করেন নি।

রোম সম্রাটের প্রতি প্রেরিত চিঠির শুরুতে তিনি লিখেছেন,

«من محمد رسول الله إلى هرقل عظيم الروم ...»

“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রোমের মহান সম্রাট ‘হিরাক্লিয়াসের প্রতি।” [. সহীহ বুখারী ( كتاب بدء الوحي ،باب حديث لأبي سفيان عند هرقل ) হাদীস নং ৮, সহীহ মুসলিম كتاب الجهاد والسير ) ) হাদীস নং ১৭৭৩।]

ফারস্য সম্রাট কিসরার প্রতি প্রেরিত চিঠির শুরুতে তিনি লিখেছেন,

«من محمد رسول الله إلى كسرى عظيم فارس ...»

“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ হতে ফারস্যের মহান সম্রাট কিসরার প্রতি।” [. তারীখুত-তাবারী ( تاريخ الامم والملوك ) (৩/৯০,৯১); ইবন কাসীর: আস-সীরাতুন-নাবাবিয়্যাহ (৩/৫০৮-৫১০)।]

মিসরের অধিপতি মুকাওকিসের নিকট প্রেরিত চিঠিতে তিনি লিখেছেন,

«من محمد بن عبد الله إلى المقوقس عظيم القبط ...»

“মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহর পক্ষ থেকে কিবত’র মহান অধিপতি মুকাওকিস সমীপে।” [. আবু জা‘ফর ত্বাহাবী: মুশকিলুল আসার (১১/১৩৬)।]

হাবশা (আবিসিনিয়া)‘র প্রধানকে তিনি লিখেছেন,

«هذا كتاب من محمد النبي إلى النجاشي الاصحم ، عظيم الحبشة ...»

“নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে হাবশার মহান অধিপতি আসহাম নাজ্জাশী সমীপে।” [. মুসতাদরাকে হাকিম (২/৬৩৩); বায়হাকী: দালাইলুন-নবুওয়্যাহ (৩/৩০৮)।]

এমনই ছিল তাঁর প্রতিটি চিঠির ধরণ এবং অগ্রহণযোগ্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বার্তা নিয়ে আসা কিসরার দূতদ্বয়ের মতো মদীনায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগত সকল দূতের সাথেই তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই একই ধরণের আচরণ। যদিও দূতদের সাথে সাধারণত তাদের মর্যাদাগত অবস্থান অনুযায়ীই আচরণ করা হয়ে থাকে এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূতদের অভ্যর্থনা, থাকা-খাওয়া ও উপঢৌকন প্রদানসহ যাবতীয় আরাম-আয়েশের দিকে অত্যন্ত সযত্ন দৃষ্টি রাখতেন। তিনি দূতদেরকে স-সম্মানে অভ্যর্থনা জানাতেন, তাদের সম্মানে বনভোজনের আয়োজন করতেন, বারবার খোঁজ-খবর নিতেন এবং তাদের সামনে সুন্দর পোষাক পরে আসতেন [. ফারুক হাম্মাদাহ: العلافات الإسلامية النصرانية في العهد النبوي (৯৫)] এবং দূতদের অভ্যর্থনা ও বাসস্থানের জন্য নির্দিষ্ট ঘর প্রস্তুত করে রাখতেন। যেমন, সালমান [. হাবীব ইবন আমর সালামানী বর্ণনা করেন, আমরা সাতজন সালামান গোত্রের প্রতিনিধি হয়ে আগমন করলাম এবং আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মসজিদের বাইরে একটি জানাযার সামনে সাক্ষাৎ করলাম। আমরা সালাম দিলাম তিনি উত্তর দিয়ে জানতে চাইলেন, তোমরা কারা? বললাম, ‘আমরা সালামান গোত্র থেকে সকলের প্রতিনিধি হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছি’। তিনি স্বীয় গোলাম সাওবানকে ডেকে বললেন: “দূত ও প্রতিনিধিরা যেখানে থাকেন এদেরকে সেখানে নিয়ে যাও”। এরপর যোহরের সালাতের পর মিম্বর ও তাঁর ঘরের মাঝখানে আমরা তার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমরা তাকে সালাত ও ইসলামের অন্যান্য বিধি-বিধান এবং ঝাড়-ফুঁক সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলাম। তিনি আমাদের প্রত্যেককে পাঁচ আওকিয়া করে হাদিয়া দিলেন। অতঃপর আমরা আমাদের গোত্রে ফিরে এলাম। এটা ছিল দশম হিজরীর শাওয়াল মাসে। অধিকতর জানতে: ইবন সা‘দ: আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা (১/৩৩২)।] গোত্রের প্রতিনিধিরা আগমন করলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ গোলাম সাওবানকে বললেন,

«أنزل هؤلاء الوفد حيث ينزل الوفود»

“দূত ও প্রতিনিধিরা যেখানে থাকেন এদেরকে সেখানে নিয়ে যাও।” [. ইবন সা‘দ: আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা (১/৩৩২)।]

এ কথার দ্বারা বুঝা যায় যে, দূত ও প্রতিনিধিদের জন্য ঘর নির্ধারণ করা ছিল। কোনো কোনো বর্ণনাতে পাওয়া যায় যে, এটি ছিল রমলাহ বিনতে হারেস নাজ্জারীয়্যাহ [. রমলাহ বিনতে হারেস নাজ্জারীয়্যাহ আনসারী মহিলা ছিলেন। তার ঘরে দূত ও প্রতিনিধিরা অবস্থান করত। অধিকতর জানতে: ইবনুল আসীর: উসদুল গাবাহ (৬/১১৯)।]-এর ঘর। এমনিভাবে কিলাব, মাহারেব, আযরাহ, আবদে কায়েস, তাগলাব ও গাসসান ইত্যাদি গোত্রের প্রতিনিধিদেরকেও একই ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল [. ইবন সা‘দ: আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা (১/৩০০-৩৪৮)] এবং দূত ও প্রতিনিধিদেরকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল। অধিকাংশ সময় তা হতো রৌপ্য। [. প্রাগুক্তা] সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে- দূত ও প্রতিনিধিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগ্রহ ও আন্তরিকতা এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তিনি জীবনের অন্তীম মূহুর্তগুলোতেও সাহাবায়ে কেরামগণকে অসিয়ত করে বলেছেন যে,

«أجيزوا الوفد بنحو ماكنت أجيزهم»

“তোমরা দূত ও প্রতিনিধিদেরকে উপঢৌকন প্রদান করবে, যেমন আমি তাদেরকে উপঢৌকন প্রদান করতাম।” [. সহীহ বুখারী ( كتاب الجهاد والسير ) হাদীস নং ২৮৮৮।]

এ অধ্যায়ের সমাপ্তিলগ্নে আমরা উল্লেখ করতে চাই যে, অমুসলিমদের প্রতি সম্মান প্রদর্শানের ব্যাপারে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে, তিনি অমুসলিমদের জন্যে তাদের ধর্মগ্রন্থ সংরক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অথচ তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, এটি মূল আসমানী কিতাব নয়। এতে বিকৃতি সাধন করা হয়েছে এবং নবী-রাসূলগণের ব্যাপারে অযৌক্তিক ও মনগড়া অনেক কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও তিনি তাদের ধর্মীয় বই সংরক্ষনের দায়িত্ব পালন করেছেন। খায়বার দূর্গ বিজয়ের পর সেখানে কতগুলো ধর্মগ্রন্থ পাওয়া গিয়েছিল। তন্মধ্যে তাওরাতও ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবগুলোকে সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখলেন। ইয়াহূদীরা তাদের তাওরাত চাইতে আসলে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত তাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। [. আল-ওয়াকেদী: আল-মাগাযী (১/৬৮১)]

পৃথিবীর আদি থেকে এ পর্যন্ত মানব জাতির ইতিহাস রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত বিরোধীদের সাথে এ ধরণের উন্নত আচরণ-বিধি মেনে চলার মতো কোনো মহা মানবের সন্ধান দিতে পারে নি এবং কিয়ামত পর্যন্ত পারবেও না। যাচাই করতে চাইলে চলুন, ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টাই। দেখে আসি, স্পেন পতনের সময় খ্রিস্টানরা কী করেছিল এবং কী আচরণ করেছিল জেরুযালেম পতনের সময় রোমীয়রা? প্রতিটি বস্তুকে তার বিপরীত বস্তুর মুখোমুখি দাঁড় করালে স্পষ্ট ফুটে উঠে!!

রিডিং সেটিংস

Bangla

System

আরবি ফন্ট নির্বাচন

Kfgq Hafs

অনুবাদ ফন্ট নির্বাচন

Kalpurush

22
17

সাধারণ সেটিংস

আরবি দেখান

অনুবাদ দেখান

রেফারেন্স দেখান

হাদিস পাশাপাশি দেখান


এই সদাকা জারিয়ায় অংশীদার হোন

মুসলিম উম্মাহর জন্য বিজ্ঞাপনমুক্ত মডার্ন ইসলামিক এপ্লিকেশন উপহার দিতে আমাদের সাহায্য করুন। আপনার এই দান সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে আমল নামায় যুক্ত হবে ইন শা আল্লাহ।

সাপোর্ট করুন